Sunday, July 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1416



দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৭

0

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৭
#Arshi_Ayat

আজ দু’দিন ধরে বেশ গরম পড়ছে।আবহাওয়া বার্তায় ঝড়বৃষ্টির পূর্ভাবাস থাকলেও এখনো হয় নি।তবে থমথমে পরিবেশ বিরাজমান সেই সাথে ভ্যাপসা গরম তো আছেই।তবে আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে।আকাশ গুড়গুড় করে ডাকছে।বাতাস হচ্ছে বাইরে।বিদ্যুৎ নেই।ঘর অন্ধকার হয়ে আছে।এখন আনুমানিক রাত সাড়ে বারোটা হবে।আধঘন্টা আগে অহর্নিশ এসেছিলো অহির ঘরে কিন্তু অহিকে ঘুমন্ত ভেবে হতাশ হয়ে চলে গিয়েছিলো।দুইদিন ধরে অহি ওকে এড়িয়ে চলছে।যেমন আগে সকালে উঠে কথা হতো কিন্তু এখন হয় না ও হয়তো রুমে থাকে না, নাহয় ঘুমিয়ে থাকে।আবার সারাদিনে ফোন দিলেও ধরে না।রাতে আসার আগেই ঘুমিয়ে যায়।অহর্নিশ বুঝতে পারছে খুব সুক্ষ্ম ভাবে অহি ওকে এড়িয়ে চলছে।ভেবেছিলো আজ একটু হলেও কথা বলবে কিন্তু আজও ঘুমিয়ে গেছে।এদিকে অহর্নিশ যাওয়ার পর অহি বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাড়িয়েছে।আজ বাইরের আবহাওয়া আর মনের আবহাওয়া একরকম।দুদিকেই ঝড় হচ্ছে।একটা ঝড় গোপনে,আরেকটা প্রকাশ্যে!

ঝড়বৃষ্টি বেশিক্ষণ হয় নি।কিছুক্ষণ পরপরই গর্জে উঠছে মেঘ।অহি ঘর থেকে বেরিয়ে জমে থাকা বৃষ্টির পানি ছোয়ার অভিপ্রায়ে ছাঁদে চলে গেলো।বৃষ্টির জমে থাকা ঠান্ডা পানিতে অহির পা ভিজলো।সে একটু একটু করে এগিয়ে গেলো রেলিঙ এর কাছে।ঠান্ডা মিহি একটা বাতাস ওর শরীর ছুয়ে মিলিয়ে গেলো।বাতাসে ঝড়ের স্বচ্ছ,স্নিগ্ধ একটা গন্ধ!রেলিঙ ঘেঁষে দাড়িয়ে সুবৃহৎ অন্তরীক্ষের পানে বৃথাই চেয়ে রইলো।অনেক্ক্ষণ!কতক্ষণ সেটা অহি জানে না।দৈবাৎ মনে হলো কেউ ওর পিছনে দাড়িয়ে আছে।কারো উপস্থিতি জানান দিচ্ছে খুব কাছ থেকে।অহি ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়ালো।অস্পষ্ট অনমিশায় সামনের সুবর্ণকেশী যুবকটিকে চিনতে তার বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না।তাকে রেলিঙের সাথে দু’হাতে আবদ্ধ করে দৃষ্টিতে নিবদ্ধ করে রেখেছে ছেলেটি।অন্ধকারে চাহনীর গভীরতা পরিমাপ করা না গেলেও সে যে দৃষ্টির তীক্ষ্ণ ফলা বিঁধিয়ে দিতে চাচ্ছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।ক্ষণিককাল কারো মুখেই বুলি ছিলো না।নিরবতা বিরাজ করছিলো শুধু!নিরবতার লাগাম টেনে অহর্নিশ ক্ষীণ অথচ আকুল কন্ঠে বলল,’আমাকে একটু ভালোবাসা যায় না?বেশি না এই একটু!বাসবে না অহি?

এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে অহি?যেখানে সে নিজেই ভালোবাসার সুবিশাল সমুদ্রের তীব্র
জোয়ারে প্রতিনিয়াত ভাসছে!ডুবছে!

নিশ্চুপ পরিবেশ সেই সাথে মেয়েটিও।ছেলেটি ব্যগ্রচিত্তে চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে আছে উত্তর শোনার জন্য।কিন্তু উত্তর তো মেলে না!ছেলেটি পূর্ববৎ ব্যাকুল স্বরে বলল,’বলো!বলো অহি!আমায় একটু ভালোবাসবে না?’

ধারালো ছুরির ফলার মতো ছেলেটির কন্ঠস্বর মেয়েটির বক্ষঃস্থল ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলছে!নয়নের আঙিনায় জলে ভরাট হয়ে গেছে।শির নিচু করে সেটা লুকানোর বৃথা চেষ্টা চলছে।কিন্তু হলো না।শুষ্ক কপল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনতা পানির রেখা।ছেলেটি মেয়েটির চিবুক স্পর্শ করে শির উঁচু করলো।অতিযত্নে গড়িয়ে পড়া পানিগুলো মুছে দিলো।এটাই হয়তো দরকার ছিলো।তাইতো মেয়েটি নিজেকে সর্বস্ব দিয়েও ধরে রাখতে পারলো না।দৈবাৎ হরিণীর বেগে ঝাপিয়ে পড়লো ছেলেটার বুকে।শীতল হলো বক্ষ!শান্তি মিললো প্রাণে।বাহুডোরে আবদ্ধ হলো মেয়েটি।কিছুক্ষণ!তারপর অনেক্ক্ষণ!

অহি এখনো কাঁদছে।অহর্নিশ বাঁধা দিচ্ছে না শুধু শক্ত করে আবদ্ধ করে রেখেছে ওকে যেনো নিভৃতে কাঁদতে পারে কেউ যাতে ওকে বিরক্ত না করে।অহর্নিশ শান্ত কন্ঠে বলল,’নিজের মধ্যে এতো কষ্ট লুকিয়ে রেখে তুমি আবার আমাকেই কষ্ট দিতে চাইছিলে?কেনো অহি?কেনো এই দূরত্ব?ভালোবেসে ও কেনো স্বীকার করছো না?কেনো ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছো?বলে দাও তুমি শুধু আমারই!’

অহি মাথা উঁচু করে অহর্নিশের আঁখিতে আঁখি মেললো।আর্দ্র কন্ঠে বলল,’আমাদের দেখা অসময় কেনো হতে হলো বলুন তো?কেনো এভাবেই আমাদের দেখা হতে হলো?কেনো কোনো একটা সোনালী রাঙা বিকেলে হঠাৎ করে আপনার আমার দেখা হলো না?কেনো স্বাভাবিক ভাবে আমি আপনাকে পেলাম না?’ বলতে বলতেই অহির কন্ঠরোধ হলো!কান্নার দমকে কথা বলতে পারলো না আবারও অহর্নিশের বুকে এলিয়ে পড়লো।কথাগুলোয় কতোট অসহায়ত্ব লুকিয়ে আছে তা কেবল ওরাই আচ করতে পারছে।পরিস্থিতি মানুষকে এতোটাই অসহায় বানিয়ে দেয় তখন চাইলেও কিছু করা যায় না।

পাশাপাশি দু’টো মানুষ বসে আছে।একটু আগেই অহি নিজেকে স্বাভাবিক করে অহর্নিশের পাশে বসেছে।আজ নিশ্চুপ অনুভূতিগুলো প্রকাশ পেয়েছে।এতোটা সময় কথা খুব অল্পই হয়েছে।অহি জমাট বাধা কান্নার জন্য কথা বলার নিমেষমাত্রও পায় নি।
——————-
কাল রাতে ঘুমাতে দেরি হওয়ায় আজ উঠতেও দেরি হয়েছে।তবে তাতে কিছু ক্ষতি নেই।কারণ আজ রবিবার!রবিবার মানেই আরাম আর আনন্দ!সপ্তাহের কর্মব্যস্ততার সব ক্লান্তির অবসান হয় মাত্র এই একটি দিনে।আজ সেই সাপ্তাহিক কাঙ্খিত দিন।আজ সকাল ১১ টা পর্যন্ত অহর্নিশ ঘুমিয়ে কাটিয়েছে আর এদিকে অহি দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে তবে অহর্নিশের মতো অতোও দেরি হয় নি সে সাড়ে আট’টায় উঠেছে।

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে অহিকে কল দিলো।একই বাড়িতে থেকেও ফোনে কথা বলতে হয়।কপাল বলে কথা আছে না!অহি প্রায় সাথে সাথেই রিসিভ করলো।

‘খেয়েছো?’

‘হ্যাঁ।আপনি?’

‘খাচ্ছি।আচ্ছা শোনো তুমি বিকেলের দিকে একটু বের হয়ো তো!’

‘কেনো?’

‘কোথাও একটা যাবো।’

‘কোথায়?’

‘সারপ্রাইজ!’

অহি মুখট বাকা করে বলল,’এই কি ফন্দি আটছেন বলুন তো?লক্ষ্মণ তো ভালো ঠেকছে না।আমাকে এভাবে ডাকছেন কেনো?কোথায় নিয়ে যাবেন?’

‘কাজি অফিসে।আর কয়দিন এভাবে সিঙ্গেল থাকবো বলো?একই বাসায় থেকেও ফোনে কথা বলবো!ডুয়েল খাটে সিঙ্গেল ঘুমাবো!জানো ক্ষণে ক্ষণে তোমার অভাববোধ করছি।’

অহি ঠাট্টা মেশানো কন্ঠে বলল,’তাই নাকি ডাক্তার সাহেব!’

‘হ্যাঁ তাই বেগম সাহেবা।’

অহি শব্দহীন হাসলেও ফোনের ওপাশ থেকে অহর্নিশ বুঝে ফেললো।অতঃপর আরো দু’একটা কথা বলে ফোন রেখে দিলো দু’জনই।

দুপুরের খাওয়া শেষে পূর্ব চৌধুরী রুমে গেলেন বিশ্রাম করতে আর মিসেস অনামিকা শপিংএ গেলেন।এটাই সুযোগ দুজনেই বেরিয়ে গেলো তবে আগে পরে!অহি আগে বের হলো তার দশমিনিট পর অহর্নিশ বের হলো।অহর্নিশ যাবার সময় পূর্ব চৌধুরীকে বলে গেলো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে কিন্তু অহি কাউকেই কিচ্ছু বলল না।এই বাড়িতে তাকে কৈফিয়ত দিতে হয় না।

অহি আর অহর্নিশ গ্রামের রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাটছে।কথা হচ্ছে না তবে একটু পর পরই একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।হাসির কারণটা অজানা!ওরা হাঁটতে হাঁটতে খালপাড়ে পৌঁছে গেলো।এই খালটা অনেক বড়ো।এর এইপাড় থেকে ওইপাড়ে যেতে একটা বাঁশের পোল দেওয়া হয়েছে।ওইপাড়ের জায়গাটা ভীষণ সুন্দর।অহর্নিশের ইচ্ছে অহিকে নিশে ওইপাড়ে ঘুরে আসবে।কিন্তু অহি বাশের পোলটা দেখেই ভীত চোখে অহর্নিশের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিললো।আর করুণ কন্ঠে বলল,’পার হওয়ার কি আর কোনো উপায় নেই?’

‘আছে তবে দেড়ঘন্টার মতো লাগবে।এটাই শর্টকার্ট।’

‘তাহলে ওইপাড়ে না যাই।এই জায়গাটাই অনেক সুন্দর।এখানে থেকে একটু ঘুরে চলে যাই।’

‘না অহি।আমরা ওইপাশে যাবে।এইপাশে থাকাটা রিস্ক।আমার অনেক পরিচিত আছে।দেখলে সমস্যা হবে।’

অহি দাঁত কটমট করে বলল,’আগে বললেই পারতেন আমাকে পানিতে চুবিয়ে মারার ইচ্ছে আপনার।’

অহর্নিশ দাঁত বের করে হেসে বলল,’আগে বললে তুমি আসতে না।আচ্ছা সমস্যা নেই আমরা নৌকা দিয়ে পার হবো।’

অহি খুশি হয়ে বলল,’আচ্ছা তাহলে চলুন।’

অহর্নিশ ঘাট থেকে একটা নৌকা ভাড়া করে সেখানে সাবধানে অহিকে নিয়ে উঠলো।অহি তো নৌকাতে উঠেই কাপাকাপি শুরু।বারবারই আতংকিত গলায় বলছে,’নৌকা ডুবে যাবে।আমরা পড়ে যাবো তো!’

অহর্নিশ অহির কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে ওকে নিশে নৌকায় বসলো প্রথমে নিজে বসলো তারপর ওকে নিজের সামনে বসিয়ে পিছন থেকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে কানেকানে ফিসফিস করে বলল,’এখন আর পড়বে না।আমি আছি তোমার কাছাকাছি।’

ভরসা পেলো অহি।এখন আর ভয় লাগছে না।অহি বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিলো।নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গের মতো লাগছে।একটা মুগ্ধতা কাজ করছে মনজুড়ে।অহি একহাত খালের পানিতে ছোয়াল।কি স্বচ্ছ!ঠান্ডা,নির্মল পানি।ছুঁতেই ভালো লাগার শিহরণ বয়ে যায়।

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৬

0

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৬
#Arshi_Ayat

আজকাল অহি আর অহর্নিশের মাঝে খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়েছে।তবে অহর্নিশের অনুভূতিগুলো বন্ধুত্বে আটকে নেই।এ অনুভূতিগুলোর সীমানা কোথায় অহর্নিশ নিজেও জানে না।তবে মাঝেমধ্যে মনে হয় এই বক্ষপিন্জিরাটা দখল হয়ে হয়ে গেছে।এইখানে খুব যতনে কেউ বাসা বেঁধেছে।এই সাতাশ বছরের জীবনে এমনটা প্রথমবার হচ্ছে অহর্নিশের সাথে।এমন নয় যে সে এর আগে কাউকে ভালোবাসে নি।কিন্তু তখনকার অনুভূতি আর এখনকার অনুভূতিগুলো আলাদা।ওই সময়ের অনুভূতিগুলে মনটাকে ব্যাকুল করে তুলতো কিন্তু এখন যে অনুভূতিগুলো সেগুলো ক্ষণে ক্ষণে ব্যাকুল করে তোলে অহর্নিশকে!

সময় রাত ১২ টা।অহর্নিশ ছাঁদের ওপর দোলনায় বসে কফি খাচ্ছে।আর চাদের দিকে চেয়ে আছে।আজ পূর্ণিমার দ্বিতীয় দিন।মানে কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয় রাত!কালকের চেয়ে আজকের চাঁদে আলো কম!তবুও আকাশটা ঝলমল করছে।কয়েকটা তারাও দেখা যাচ্ছে আশেপাশে।চাঁদ দেখতে দেখতেই অহর্নিশের মনে হলো দোলনাটা একটু দুলে উঠেছে।অহর্নিশ পাশে তাকাতেই অহিকে দেখলো।অহিও ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।ওদের দৃষ্টি আবদ্ধ!এভাবেই ক্ষণকাল কেটে গেলো পলকহীন!ভাষাহীন!স্থির হয়ে।কি এক সম্মোহনী শক্তি কাজ করছে দৃষ্টিতে যেনো বছরের পর বছর এভাবেই তাকিয়ে থাকা যাবে।

পাশের বাসার ছাঁদ থেকে বিড়ালের মিয়াঁও,মিয়াঁও শব্দ আসতেই অহি সচেতন হয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সামনে।ততক্ষণে অহর্নিশও সামনে তাকালো।নিশ্চুপতার অবসান ঘটিয়ে অহিই প্রথমে বলল,’আজ মন খারাপ মনে হচ্ছে!’

অহর্নিশ একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলল,’খারাপ ও না ভালোও না।মাঝামাঝি অবস্থায় আছি।’

‘মাঝামাঝি অবস্থায়!মানে নাতিশীতোষ্ণ?’

অহর্নিশ একটু জোরেই হেসে ফেললো।বলল,’হ্যাঁ,নাতিশীতোষ্ণ!’

‘আচ্ছা এই অবস্থায় অনুভূতি কেমন?মানে আমি কখনো এই অনুভূতির মুখোমুখি হই নি।’

‘এই অবস্থায় অনুভূতিগুলো খুব খারাপ।না তুমি হাসতে পারবে না কাঁদতে পারবে!একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা।’

অহির মাথার ওপর দিয়ে গেলেও অহি বুঝবার ভান করে দুই/তিনবার মাথা নাড়ালো।অহর্নিশ বুঝতে পেরেও কিছু বলল না।তারপর আবারও কিছুক্ষণ নিরব থেকে অহর্নিশ জিগ্যেস করলো,’আচ্ছা অহি তুমি কি চাও?এই জীবনটা?নাকি তোমার আগের জীবনটা?’

কিছু না ভেবেই অহি বলল,’আগের জীবনটাই চাই।হয়তো সেই জীবনে আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে!’

অহির শেষের বাক্যটা অহর্নিশের কলিজায় আঘাত করলো।আসলেই কি কেউ অপেক্ষা করে!তাহলে কি অনুভূতিগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে?কেনো ওর অতীতে কেউ থাকতে হবে?কেনো কেউ অপেক্ষা করবে!এইসব দুর্বোদ্ধ্য প্রশ্নগুলো মাথার ভেতর পোকার মতো কিলবিল করছে।অজান্তেই মনটা বারবার বলছে যেনো অহির স্মৃতি কখনোই না ফেরে!কখনো না।কিন্তু!কিন্তু আজ ডাক্তার আয়াজ যা বলল তাতে শংকাগুলো ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

আজকে যখন নিউরো বিভাগের ডাক্তার ইয়াসমিন বললেন অহির স্মৃতি শক্তি তাড়াতাড়িই ফিরবে কারণ ওর ডেড সেলগুলো আবার রিকোভার হয়ে যাচ্ছে।ওগুলো রিকোভার হলেই পুরোপুরি ওর স্মৃতি শক্তি ফিরে আসবে কিন্তু পুরোনো স্মৃতি ফিরে পাওয়ার পর বর্তমানের কিছু মনে থাকবে কি না এটা নিয়েই সমস্যা কারণ এইসব ক্ষেত্রে অনেককিছুই ঘটার সম্ভবনা থাকে যেমন হয়তো আগের স্মৃতি ফিরে পেলে বর্তমান ভুলে যাবে তা নাহলে স্মৃতি আর কখনো ফিরবেই না আবার কখনো কখনো এমনও হয় অতীত বর্তমান দুটোই মনে থাক তবে এ ক্ষেত্রে দু’টোই মনে থাকার সম্ভবনা খুব কম।আর বর্তমান ভুলে যাওয়ার সম্ভবনা খুব বেশি।

ডাক্তারের এই কথাগুলো শোনার পর থেকেই অহর্নিশ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে তবে অহি কাছে এটাই সবচেয়ে খুশীর সংবাদ আজকে।

সময়ের সাথে সাথে রাত ফুরচ্ছে দিন ঘনাচ্ছে!ঘনিয়ে আসছে বিষাদময় কিছু সময়!
ওরা প্রসঙ্গ পাল্টে কিছুক্ষণ কথা বলল তারপর নিচে চলে গেলো দুজনই।

আজ সকালে একটা ইমার্জেন্সি থাকায় অহর্নিশ খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলো হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।অহির সাথে শুধু দু’একটা কথা হয়েছে।অহর্নিশ না থাকলে অহি সারাদিন বই পড়ে,নাটক,মুভি দেখে সময় কাটে।বাড়ির কারো সাথেই কথা হয় না।অহির এই জীবনট ভালো লাগে না।মনে হয় সবার অবহেলা,উপেক্ষার পাত্রী হয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে।হয়তো ওর আগের জীবন খুব সুন্দর!হয়তো সেখানে মা বাবা সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করে অহির খুব ইচ্ছে করে স্মৃতিগুলো ফিরে পেতে কিন্তু এতকিছুর মাঝেও অহর্নিশকে বারংবার মনে পড়ে।ওর জন্যই মাত্র তিনমাসে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব হয়েছে।হাঁটাচলা সম্ভব হয়েছে।কিন্তু এছাড়াও অহর্নিশের প্রতি দিনদিন ছোটো-ছোটো অনুভূতিরা জন্ম নিচ্ছে।আস্তে আস্তে অনুভূতিগুলোর শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি পাচ্ছে।আচ্ছা অহর্নিশেও কি এমন হয়?ওর চোখ কি কথা বলে?অনুভূতিরা কি ডানা মেলে?ছুটতে চায় বহুদূর?নাকি এখনো ওর মনে বসন্তদূত আসে নি!
অহর্নিশ চলে যাওয়ার পর এগুলোই ভাবছিলো অহি।হঠাৎ অহর্নিশের মা দরজায় নক দিয়ে বললেন,’আসবো?’

আচমকা কারো গলায় শোনায় অহি ছিটকে পড়ে তার ভাবনার জগত থেকে।চলে আসতে হয় বর্তমানে।দরজায় অহর্নিশের মা’কে দেখে অনেকটাই অবাক হলো কারণ এই পর্য়ন্ত ওনার সাথে হাতেগোনা কয়েকবারই কথা হয়েছে।তাও দুই একটা!তবে উনি হঠাৎ এখানে আসছে কেনো?অহি ওর মাথার চিন্তাগুলোকে দমন করে সৌজন্য হেসে বলল,’জ্বি আন্টি আসুন।’

মিসেস অনামিকা আসলেন।অহির বেডের একপাশে বসলেন।তারপর ফর্মালিটি অনুযায়ী জিগ্যেস করলেন,’কেমন আছো?’

‘এইতো আন্টি ভালো আছি।আপনি আর আঙ্কেল কেমন আছেন?’

‘আমরাও ভালো আছি।শোনো তোমার সাথে কিছু প্রয়োজনীয় কথা আছে।’

‘জ্বি আন্টি,বলুন।’

‘অহর্নিশের বাবা আর আমার একটা পছন্দের মেয়ে আছে।বাংলাদেশে থাকে।নাম সেঁজুতি।ওর সাথে আমরা অহর্নিশের বিয়ে দিতে চাই।কিন্তু!’

অহির ভেতর ভেতর খুব কষ্ট হলেও জোর করেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো।তারপর বলল,’কিন্তু কি আন্টি?’

‘কিন্তু আমার মনে হয় তোমরা একটু বেশিই করছো।আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।দেখো আমার ছেলেকে কিছু বললে ও শোনে না।এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়।কিন্তু তুমি প্লিজ একটু বোঝো ওকেও বোঝাও!’

‘জ্বি,আন্টি।আমি বলবো।’

‘আর শোনো ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখো।চেকআপ করো!দেখো কি বলে!তোমারও তো জীবন আছে তাই না?সারাজীবন কি আর অন্যের বাড়ি পড়ে থাকলে হবে!’

‘জ্বি,আন্টি।আমি চলে যাবো কিছুদিনের মধ্যেই।’

‘আচ্ছা ঠিকাছে।আসি।ভালে থেকো।’

এটা বলেই মিসেস অনামিকা চলে গেলেন।উনি যেতেই অহি উঠে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে দরজার সাথেই বসে পড়লো।কি এক অসহনীয় অনলে দগ্ধ হচ্ছে বুকের ভেতরটা।কিন্তু আফসোস বাইরে থেকে পোড়াটা দেখা যায় না,পোড়ার গন্ধ আসে না।

আজ অহর্নিশের ফিরতে ১১ টা বাজলো।আজকে ৩ টা ইমার্জেন্সি ছিলো।সারাদিন প্রচুর ব্যস্ত ছিলো।একটা বারের জন্যও অহির সাথে কথা হয় নি।তবে আজ মনটা ফ্রেশ।আসার সময় দু’টো বেলিফুলের মালা এনেছে।অহিকে দিবে বলে।বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে অহির রুমে গিয়ে দেখলো অহি উদাস দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।বোধহয় মন খারাপ কিন্তু কেনো?সর্বপ্রথম এই প্রশ্নটাই মাথয় এলো অহর্নিশের।মৃদু স্বরে ডাকলো দিলে অহিকে?অহর্নিশের গলা পেয়ে অহি ফিরে তাকালো ওর দিকে।একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,’ওহ!কখন এলেন?’

‘এইতো একটু আগে।তোমার কি মন খারাপ?’

‘না তো!’খুব কষ্টে মিথ্যাটা বলল অহি।’

‘মনে হচ্ছে!আচ্ছা ছাঁদে চলো একটা সারপ্রাইজ দিবো।’

‘কি সারপ্রাইজ?’

‘আগে চলো তো!আর সারপ্রাইজ বলে দিলে কি আর সারপ্রাইজ থাকে নাকি!’

‘আমার না যেতে ইচ্ছে করছে না।’

‘অহি,আমার মনে হয় তোমার মন আজকে অনেক খারাপ।কি হয়েছে আমাকে বলো?আম্মু,আব্বু বা অন্য কেউ কিছু বলছে?’

‘নাহ!কেউ কিছু বলে নাই।এমনিই।চলুন ছাঁদে যাই।’

এই প্রশ্নবাণগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এটাই একমাত্র পথ ছিলো।ছাঁদে এসে অহর্নিশ অহির হাতে বেলির মালাগুলো বেধে দিয়ে বলল,’দেখো ঘ্রাণটা অসম্ভব সুন্দর।’

অহর্নিশের কথা মতো অহি ঘ্রাণটা নিলো।আসলেই অনেক সুন্দর।কিন্তু সকালের কথাগুলো আবারও মনে পড়তেই অহি একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।তারপর গম্ভীর স্বরে বলল,’আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।’

‘হ্যাঁ বলো।’

‘আপনার কি মনে হয় না।আমাদের সম্পর্কটা এখন আর বন্ধুত্বে আটকে নেই।সেটা ক্রমান্বয়ে শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি করছে?’

অহর্নিশ হাসলো।তারপর বলল,’তুমি এতো দেরিতে বুঝতে পারলে?এটা তো আমি কবেই টের পেয়েছি।শুধু তোমার জানার অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘কিন্তু আমার মনে হয় না এটা ঠিক।’

‘কেনো?ঠিক মনে হয় না কেনো?’

‘কারণ আমার অতীত!আমার অতীতে কিন্তু আপনি নেই আর দিনশেষে আমাকে সেখানেই ফিরতে হবে।তাই এটাই ভালো না আমাদের অনুভূতিগুলো আর বাড়তে না দোওয়া।’

‘অহি,কি বলছো তুমি এসব!ডাক্তার তো বলে নি তুমি পুরোপুরিই আমাকে ভুলে যাবে!’

‘ডাক্তার তো এটাও বলে নি আপনাকে মনে থাকবে আমার।পুরোটাই অনিশ্চয়তা।অনিশ্চয়তায় সম্পর্ক আগানো ঠিক না।আর আপনি আপনার বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ওনার আপনার কাছে অনেক কিছুই ডিজার্ভ করে।প্লিজ তাদের ইচ্ছাগুলোও মূল্য দিয়েন।’

অহর্নিশ রাগে মাথার পেছনের চুলগুলো টানছে।এতক্ষণ না বুঝলেও এবার বুঝেছে হয়তো ওর বাবা মা কেউ অহির ব্রেইনওয়াশ করেছে তা নাহলে আজ সকালে পর্যন্ত তো সব ঠিক ছিলো!

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৫

0

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৫
#Arshi_Ayat

অহর্নিশদের বাড়ি থেকে বের হতে কয়েকটা গলি পড়ে।গলিগুলোর অবস্থা তেমন ভালো না।দুর্বোদ্ধ চক্রগ্রহের মতো গলি,ক্ষয়ে যাওয়া,রংচটা সারি সারি একতলা দু’তলা বাড়ি।এই গলিগুলো পেরিয়েই সুন্দর একটা রাস্তা পাওয়া গেলো।মাটির রাস্তা,দুপাশে পুকুর আর গাছপালার বেশ চমৎকার লাগছে পরিবেশটা।গাছে গাছে দু’একটা শালিক,কাকাতুয়াও দেখা যাচ্ছে।একদম সকাল হওয়ায় মানুষজনও নেই।অহিকে সামলাতে অহর্নিশের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে।একটা মেয়েকে হাটাতে এতো কষ্ট!প্রায় অনেক কষ্টে বাড়ি থেকে কিছুটা দূর এনেছে অহিকে।তাতেই অহির অবস্থা কাহিল।বারবারই বসে পড়তে চায়।অহর্নিশ অহির কষ্ট হচ্ছে দেখে ওকে একটা গাছের গোড়ায় পা দুটো লম্বা করে বসিয়ে দিলো।তারপর বলল,’খুব কষ্ট হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।অনেক!’দাঁত মুখ খিচে।ডান হাত দিয়ে পায়ের ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল অহি।

‘আচ্ছা।একটু জোরে জোরে শ্বাস নাও।আর পানি খাও।’

অহর্নিশ পকেট থেকে একটা ছোটো বোতল বের করে দিলো।আসার সময় সে এটা পকেটেই নিয়ে এসেছিলো।অহর্নিশের কথা মতো একটু পানি খেয়ে আর একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল,’এবার বাসায় ফিরে যাই।আর এগুলে বোধহয় ফিরতে পারবো না।’

‘হ্যাঁ আমরা বাসায়ই ফিরবো।তুমি আরেকটু বসো।’

আরো কিছুক্ষণ বসার পর আবারো ওরা চলতে শুরু করলো কিন্তু একটু যেতেই অহি পড়ে যেতে নিলো।অহর্নিশ শক্ত করে ধরে ফেললো ওকে।অহি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আমি আর পারবো না।ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।’

অহর্নিশ উপায়ন্তর না পেয়ে ক্রাচ গুলো মাটিতে রেখে অহিকে কোলেই নিয়ে নিলো।অহর্নিশের এহেন কান্ডে অহি দুইমিনিট তব্দা মেরে রইলো।ওই দু’মিনিট অহর্নিশ চলতে শুরু করে দিয়েছে।আকষ্মিকতার রেশ কাটিয়ে অহি বলল,’একবারে কোলেই নিয়ে নিলেন?’

‘কি করবো বলুন?এছাড়া উপায়ও নেই।’

অহি এবার খানিকটা রসিকতা করে বলল,’আপনার বউ কিন্তু রাগ করবে।’

অহির কথা শুনে অহর্নিশ একবার অহির দিকে তাকালো।তারপর ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে বলল,’নাহ!রাগ করবে না।একটা অসুস্থ মানুষকে সাহায্য করছি।এতে রাগের কিছু নেই।আর এমনিতে তাকে তো প্রতিদিনই কোলে নিবো তারটা মিস হবে না।তাই সে রাগ করবে না।’

অহর্নিশের কথা শুনে অহি কিছুটা উচ্চ স্বরেই হাসলো।হাসির দমক কমে আসতেই বলল,’বাহ!আপনি তো দেখছি দারুণ রোমান্টিক।তা বিয়ে শাদী করবেন কবে?’

‘আপনি পাত্রী রেডি করতে পারলে আজকেই করবো।’

অহি আবার হাসলো।সারাটা পথ দু’জনে হাসি,ঠাট্টা করতে করতেই আসলো।কিন্তু বাড়ির সামনে আসতেই সতর্ক হয়ে গেলো দুজনেই কিন্তু বিপত্তি আরেক জায়গায় বসার ঘরে যদি এখন অহর্নিশের বাবা অথবা মা থাকে এবং তাদের সামনে দিয়েই অহিকে কোলে নিয়ে যেতে তাহলে প্রচুর লজ্জায় পড়তে হবে কিন্তু এছাড়া উপায় কি!
অহর্নিশ দরজার সামনে এসে দেখলো দরজা খোলা আর ভেতরে পূর্ব চৌধুরী আর মিসেস অনামিকা চা পান করছে আর কথা বলছে।অহর্নিশ পা দিয়ে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই বাবা মা দুজনই ওর দিকে এমন ভাবে চাইলো যেনো কোনো পাপা কর্ম সম্পাদন করে মাত্রই ঘরে ফিরেছে।কোনোমতে বাবা মায়ের চাহনী উপেক্ষা করে অহর্নিশ দ্রুত অহির ঘরে চলে গেলো।ঘরে এসে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,’আপনি থাকুন।আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

এটা বলেই ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো অহর্নিশ।অহি পা গুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে অপেক্ষা করতে লাগলো।অপেক্ষার প্রহর বেশি লম্বা হলো না অহর্নিশ তাড়াতাড়িই ফিরলো ওর হাতে অহির ক্রাচ দু’টো।এবার অহি বুঝলো অহর্নিশ কোথায় গিয়েছিলো।ক্রাচ দুটো দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রেখে অহর্নিশ বলল,’আমি মনিষার মা’কে বলে দিচ্ছি আপনাকে রেডি করে দিতে।আমরা আজকে হসপিটালে যাবো।’

‘কেনো?’

‘আপনাকে থেরাপি দিতে হবে।আমাকে কালকে ফিজিওথেরাপিস্টের সাথে কথা হয়েছে।তোমার হাত পায়ে দু’দিন অন্তর অন্তর থেরাপি দিতে হবে।সাথে ব্যায়ম আর প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটলে এক দেড় মাসেই পুরোপুরি সুস্থ হতে পারবে তবে এটার পরিশ্রম আর ধৈর্য থাকতে হবে।’

‘আচ্ছা আমি চেষ্টা করবো।’

‘গুড।আচ্ছা আমি রেডি হয়ে আসছি।’

বলেই অহর্নিশ চলে গেলো।অহর্নিশ যাওয়ার পাঁচমিনিট পরই মনিষার মা আসলো অহিকে রেডি করতে।

নিজের ঘরে চা খেতে খেতে ফোন দেখছিলো অহর্নিশ।পূর্ব চৌধুরী তখনই রুমে আসলেন।বাবাকে দেখে অহর্নিশ ফোনটা রেখে ওনার দিকে তাকয়।কারণ ভাবভঙ্গিই বলে দিচ্ছি সিরিয়াস কিছু বলতে এসেছে এবং সেটা যে অহিকে নিয়েই তা আর বলতে!কিন্তু না অহর্নিশের ধারণাকে চুরমার করে পূর্ব চৌধুরী বললেন,’অহর্নিশ মাস ছয়েক পর সেঁজুতি আর ওর মা বাবা আসবে বাংলাদেশ থেকে।’

‘কেনো?’

‘কেনো মানে?তোমাদের বিয়ের কথা বলতে।’

‘কিন্তু আমি তো সেঁজুতিকে বিয়ে করবো না।’অহর্নিশ কাটকাট গলায় বলল।

‘কেনো?কি সমস্যা?সেঁজুতি ভালো মেয়ে,বংশমর্যাদাও আমাদের সমপর্যায়ী।তোমার মায়ের,আমার দু’জনেরই সেঁজুতিকে পছন্দ।’

‘কিন্তু আমার তো পছন্দ না বাবা।’

‘তোমার কি কোনো পছন্দ আছে?’পূর্ব চৌধুরী সরাসরিই প্রশ্ন করলেন।

‘না।’সংক্ষিপ্ত এই জবাবটা দিয়েই অহর্নিশ উঠে দাড়ালো।পূর্ব চৌধুরী গম্ভীর স্বরে বললেন,’তাহলে আমাদের পছন্দে বিয়ে করতে সমস্যা কি?তোমার তো নিজের পছন্দও নেই।’

অহর্নিশ শেষের কথাগুলোর উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।

অহি রেডি হয়ে বিছানাতেই বসে ছিলো।অহর্নিশ ঘরে এসে বলল,’সব কাজ শেষ?’

‘হ্যাঁ শেষ।’
অহর্নিশ আর অহি হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হলো।

অহিকে থেরাপি দিয়ে নিজের চেম্বারে নিয়ে আসলে অহর্নিশ। নিজের গদিতে বসিয়ে পা দু’টো উচু একটা টুলে রাখলো।তারপর নিজেও একটা পেশেন্টের চেয়ারে বসলো।এরইমধ্যে চা চলে এলো।অহর্নিশ আসার সময় চায়ের কথা বলে এসেছিলো।একটা কাপ অহিকে দিয়ে বলল,’চা টা খেয়ে আমরা বের হবো।আপনাকে বাসায় দিয়ে আমি আবার চলো আসবো।’

অহি কিছুটা মন খারাপের গলায় বলল,’আমার জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে।’

‘এটা আমার দায়িত্ব আর এটাই পেশা।’

চা শেষ করে অহর্নিশ অহিকে বাসায় নিয়ে এলো।তারপর আবার হাসপাতালে চলে গেলো।

এভাবেই দিনগুলো কাটছে।আস্তে আস্তে অহি সুস্থ হয়ে উঠছে।এখন নিজে নিজেই হাঁটাচলা করতে পারে কিন্তু কষ্ট হয় অনেক!তবুও যে পারছে এটাই বেশি!সপ্তাহে তিনবার নিয়ম করে অহর্নিশ থেরাপি দিতে নিয়ে যায়।প্রতিদিন ব্যায়াম আর সকালে হাটাহাটি তো আছেই।তবে ব্যাপারগুলো ভালো লাগছে না অহর্নিশের বাবা মায়ের।ছেলে একটা নাম,পরিচয়হীন মেয়ের পিছনে ঘুরছে বিষয়টা ভালো লাগার মতোও নয়!

আজ রবিবার।বন্ধের দিন।সারা সপ্তাহের মধ্যে এই দিনটায় কেবল একটু আরাম আয়েশ করা যায় কিন্তু আজ তাও করা যাবে না।অহর্নিশের ছোট ফুপুর বাড়ি জলপাইগুড়ি।ওনারা আজ ওদের দাওয়াত দিয়েছে।খুব করে বলে দিয়েছে যেনো অহর্নিশও আসে।কিন্তু কাল রাত থেকে অহির জ্বর তাই অহর্নিশ যেতে নারাজ।তবে বাসায় থাকলে বাবা মায়ের জোরাজোরি তে যেতে বাধ্য!তাই চালাকি করে জরুরি কাজের কথা বলে সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লো সে।

ছেলেকে না পেয়ে হতাশ হয়ে ওনারা একাই চলে গেলেন।এদিকে বাবা মা যাওয়ার পর অহর্নিশ আবার বাসায় চলে এলো।অহির রুমে এসে দেখলো মেয়েটা ঘুমাচ্ছে।আজকে আর হাঁটতে যাওয়া হলো না।কপালে হাত দিয়ে দেখলো জ্বর আছে তবে এখন কম।অহর্নিশ আদুরে কন্ঠে ডাক দিলো,’অহি,উঠুন।সকাল হয়ে গেছে।আপনার ঔষধ খেতে হবে।’

অহি নড়াচড়া করে পিটপিট করে চোখ খুলে একবার অহর্নিশের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো।অহি কান্ড দেখে অহর্নিশ হেসে ফেললো।এবার অহির হাত ধরে বলল,’অহি,এবার উঠে পড়ুন।খেয়ে আবার ঘুমাবেন।’

হাই তুলতে তুলতে অহি উঠলো।তারপর ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেয়ে ঔষধ খেয়ে বিছানায় এসে বসলো।অহর্নিশও আসলো থার্মোমিটার নিয়ে।থার্মোমিটারে চেক করে দেখতে পেলো এখন জ্বর নেই।অহর্নিশ বলল,’আবার ঘুমাবেন?শরীর দুর্বল লাগছে?’

‘না ঘুম আসছে না।আপনি যান নি আপনার ফুপুর বাসায়?’

‘না।আমি গেলে আপনার খেয়াল রাখবে কে?আপনাকে একা রেখে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে।’

‘তবুও আপনার বাবা মা কিন্তু রাগ করলো।যাওয়া উচিত ছিলো আপনার।’

‘সমস্যা নেই।কাল একবার গিয়ে আসবো।’

কিছুক্ষণ গল্প করে অহর্নিশ আর অহি হাঁটতে বের হলো।একটু কষ্ট হলেও অহি এখন নিজে নিজেই হাঁটতে পারে তবে আস্তে আস্তে হাঁটতে হয়।অহর্নিশও অহির সাথে আস্তে আস্তেই হাঁটে।

ঘন্টাখানেক হেঁটে ওরা বাসায় ফিরলো।আজ মনিষার মা আসে নি।বাবা মা ও বাসায় নেই।রান্নাবান্নাও হয় নি।তাই অহর্নিশ ঠিক করলো আজ ও রান্না করবে।অহিকে জিগ্যেস করলো,’কি খাবেন বলুন।আজ আমি রান্না করবো।’

অহি একটু হেসে বলল,’আপনি রান্না পারেন?’

‘হ্যাঁ।যখন হোস্টেলে বন্ধুদের সাথে থেকেছি তখন বুয়া সপ্তাহে ২ দিন আসতো না।আর ওদিকে বুয়া পাওয়াও যেতো না।তাই আমরা কয়েকমাস বুয়া রেখে পরে বাদ দিয়ে দেই।পাঁচ বন্ধু ছিলাম।ক্লাস শেষ করে এসে পাঁচজনেই রান্নার কাজ করতাম।দুজনে কাটতো,দুজনে রাঁধত,আর একজন মশলাপাতি, বাসনকোসন ধুয়ে দিতো।তো এভাবেই আমরা সবসময় রান্না করে খেয়েছি।ওই সময় থেকেই রান্না করতে পারি।’

‘বাহ!তাহলে তো খেতেই হয়।ডাক্তার যখন শেফ!’এটা বলেই অহি হাসলো।আর অহির হাসির সাথে অহর্নিশও যোগ দিলো।তারপর দুজনে মিলে ঠিক করলো আজ খিচুড়ি হবে।ভুনা খিচুড়ি!অহি কাজ না করলেও কিচেনে একটা চেয়ারে বসে অহর্নিশকে সঙ্গ দিয়েছে।কখনো কথা বলে বা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে আবার কখনো দুজনেই গলা ছেড়ে গান গেয়ে।গান গাইতে গিয়ে অহর্নিশ বুঝলো অহির গলা ভালো।গান ভালো গাইতে পারে।মোটামুটি রান্না শেষের দিকে।অহর্নিশ এক চামচ নিয়ে অহির সামনে ধরে বলল,’দেখুন তো কেমন হয়েছে?’

অহি খেয়ে মুগ্ধ নয়নে অহর্নিশের দিকে চেয়ে রইলো।অহর্নিশ কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল,’খারাপ হলো?’

‘আরে না!এত্তো ভালো হইছে!কি বলবো!আমার মনে হয় না এতো ভালো রান্না আমি কখনো খাইছি।’

অহর্নিশ একটু লজ্জা পেয়ে হেসে বলল,’ধন্যবাদ।’

‘আমার এখন হিংসা হচ্ছে খুব।’

‘কেনো?’অহর্নিশের গলায় কৌতুহল।

‘এই যে আপনি এতো সুন্দর রান্না পারেন।আপনার বউ তো সোনায় সোহাগা!ওর আর রান্না না পারলেও চলবে।যার স্বামী এতো ভালো রান্না পারে তার আর কি লাগে!’

অহর্নিশ হেসে বলল,’আমার বউ রান্না না পরলে সমস্যা নেই।শিখিয়ে দিবো।মাঝেমধ্যে আমিও রান্না করবো।প্রচলিত একটা রীতি না ছাই আছে যে পুরুষদের নাকি রান্না করা মানায় না।হেন!তেন!আরো কতোকিছু।কিন্তু আমার মনে হয় রান্না একটা আর্ট।যা সবাই পারে না।’

অহি অহর্নিশের কথায় আরো একবাট মুগ্ধ হলো।ওর বলতে ইচ্ছে হলো,’আপনার কথাগুলোও একটা আর্ট।এতো সুন্দর করে বলেন কি করে!’
কিন্তু মনের কথাগুলো মনেই রেখে দিলো।থাক অন্য একদিন বলা যাবে।

দুপুরে জমপেশ খাওয়া দাওয়া হলো।খাওয়া শেষে অহি বলল,’আপনাদের ছাঁদে যাওয়া যায় না?’

‘হ্যাঁ যায় তো!আপনি যাবেন?’

‘হ্যাঁ একটু দেখার ইচ্ছে ছিলো।’

‘আচ্ছা তবে চলুন।’
অহর্নিশ আর অহি ছাদে যাওয়ার জন্য সিড়িতে উঠতেই অহি ‘আহ!’ করে একটা মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠলো।অহর্নিশ চিন্তিত হয়ে বলল,’কি হয়েছে অহি?’

‘রগে টান পড়েছে।ব্যাথা করছে ভিষণ।’

অহর্নিশ দ্বিতীয়বারের মতো আবারও আচমকাই কোলে নিলো অহিকে আর অহিও দ্বিতীয়বারের মতোই চমকে গেলো।ছাঁদে এনে অহিকে দোলনায় বসিয়ে দিলো।তারপর ওর পায়ের কাছে বসে বলল,’এখনো ব্যাথা করছে?’

‘না এখন করছে না তেমন।’

‘হয়তো!উঁচুনিচু একটু সমস্যা হবে।সিড়িতে একটু দেখেশুনে হাটবেন।’

‘আচ্ছা।কিন্তু আমি বুঝলাম না আমি কি এতোই পাতলা যে আপনি আমাকে হুটহাট কলে নিয়ে ফেলেন।আপনার কষ্ট হয় না?’

অহির কথা শুনে অহর্নিশ একটু উচ্চ স্বরেই হাসলো।হাসির গতি কমতেই বলল,’আপনার ওজন কতো হবে বড়োজোর ৪৫ কেজি।এর বেশি হবে না।আর ৪০ কেজি একটা চালের বস্তা হয়।আগে যখন পড়াশোনা করতাম তখন বাসায় চালের বস্তা গলির মুখ থেকে আমাকেই আনতে হতো।কারণ গলিতে রিকশা আসতো না।৪০ কেজির বস্তা আনতে পারলে ৪৫ কেজির মেয়ে উঠানো কোনো ব্যাপারই না।’

এবার অহি খিলখিলিয়ে হাসলো।অহির হাসির সাথে অহর্নিশের হাসিও যোগ হলো।

অহর্নিশদের ছাঁদে বিভিন্ন জাতের গোলাপ আছে।এগুলে সব অহর্নিশের লাগানো।গোলাপ ছাড়াও রক্তজবা,বেলি,রজনী,করবী,ডালিয়াসহ বিভিন্ন জাতের ফুল আছে।অহি ফুলগুলো দেখতে দেখতেই একটা গোলাপ ফুলে চোখ আটকে পড়লো।অর্ধ পরিস্ফুটিত গোলাপটা যেনো অহির দিকেই চেয়ে আছে।অহি অহর্নিশকে ডেকে বলল,’আপনার গাছ থেকে একটা গোলাপ নিতে পারি?’

‘জ্বি অবশ্যই।কোনটা চাই আপনার?’

‘ওই যে ডান পশের কোণায় আধফোটা গোলাপটা।ওটাই লাগবে।’

অহর্নিশ গোলাপটা নিয়ে আসলো।কিন্তু অহির হাতে দিলো না।বলল,’এটা আপনার খোঁপায় সুন্দর লাগবে।’

‘কিন্তু আমি তো খোপা করতে পারি না।’

‘আমি পারি।মাঝেমধ্যেই আম্মুর খোপা করে দেই আমি।’

‘আচ্ছা তাহলে আপনি খোঁপা করে।খোপায় ফুলটা গুঁজে দিন।’

অহর্নিশ অনুমতি পেয়ে অহিকে খোঁপা করে দিয়ে।খোঁপা ফুলটা গুঁজে দিলো।সামনে থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে অহিকে।অহর্নিশ অহির কয়েকটা ছবি তুলে ফেললো।অহি নিজেও নিজের ছবিগুলো দেখে মুগ্ধ হলো আসলেই সুন্দর লাগছে।

সন্ধ্যার সময় আস্তে আস্তে অহর্নিশের হাত ধরে অহি ছাঁদ থেকে নামলো।এখন কোনো সমস্যা হয় নি।অহিকে নিজের রুমে দিয়ে এসে হোটেলে সন্ধ্যার নাস্তা অর্ডার করে দিলো।

নাস্তা আসতে আসতে অহর্নিশ অহিকে ব্যায়াম করাতে লাগলো।প্রায় দেড় ঘন্টা ব্যায়াম করার পর আজকের মতো সমাপ্ত হলো।এরফাকেই নাস্তা ডেলিভারি দিয়ে গেছে।নাস্তা করতে করতেই অহর্নিশের কল এলো।ওর এক বন্ধু ফোন দিয়েছে।জরুরি কথা আছে নাকি!এখনি দেখা করতে হবে।অহর্নিশ অহিকে বলে বাইরে চলে গেলো।ও বেরুনোর তিন/চার মিনিট পরই কলিং বেল বাজতেই অহি কষ্ট করে দরজা খুললো।অহর্নিশের বাবা মা এসেছে।মিসেস অনামিকা বাসায় এসেই অহিকে জিগ্যেস করলেন,’অহর্নিশ আসে নি এখনো?’

অহি পড়ে গেলো বিপাকে।কি বলবে?মিথ্যা বলবে নাকি সত্যি?এখন তো অহর্নিশও বাসায় নেই।অহি এগুলো ভাবতে ভাবতেই পূর্ব চৌধুরীর চোখ পড়লো পিৎজার প্যাকেটের দিকে।উনি ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলেন,’এটা অর্ডার দিয়েছে কে?’

অহি ভয় পেলো!একটা বড়সড় ঢোক গিলে কিছু বলতে নিলেই অহর্নিশ পেছন থেকে বলল,’আরে তোমরা চল আসছো!’

অহর্নিশকে দেখে অহি কিছুটা স্বস্তি পেলো।এখন ও ই সব সামলাবে।পূর্ব চৌধুরী অহর্নিশকে দেখে বললেন,’এতক্ষণ কোথায় ছিলে তুমি?’

‘বন্ধুদের সাথে।ওদের সাথে অনেকদিন পর দেখা হলো আজ।’

‘তোমার ফুপি খুব মন খারাপ করেছে।’মিসেস অনামিকা বললেন।

‘আচ্ছা মা আমি ফুপির সাথে কাল দেখা করে আসবো।’

এভাবে কথা বলতে বলতেই পিৎজার কথা ধামাচাপা পড়ে গেলো আর অহর্নিশও কৌশলে পিৎজার প্যাকেটগুলো সরিয়ে ফেললো।

চলবে….

দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৪

0

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৪
#Arshi_Ayat

কাঁচের স্বচ্ছ জানালা দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই কতোগুলো পাইন গাছ,দু’টো জোড়া রাধাচূড়া আর কয়েকটা নারকেল গাছ দেখা যাচ্ছে।সবচেয়ে কাছের নারকেল গাছটায় একটা কাকের বাসা দেখা যাচ্ছে।বাসাটা খালি।দৃষ্টিটা আরেকটু প্রখর করতেই অদূরে কয়েকটা পুরোনো বাড়িও লক্ষ্য করা যায়।এরমধ্যে একটা বাড়ি একতলা বাকিগুলো তিন,চার তলা সামনে কয়েকটা টিনের ঘরও দেখা যাচ্ছে।তবে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে না।দৃষ্টিটা ঘুরতে ঘুরতে আকাশে গিয়ে ঠেকলো।আজ আকাশ পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন।বৃষ্টির ‘ব’ ও নেই।একটি রৌদ্রময় দিন।সূর্য মাথার ওপর আজ চড়াও হয়ে উঠেছে।নিজের বিছানা থেকে অহি সামনের জানালা দিয়ে এতক্ষণ এগুলোই পর্যবেক্ষণ করছিলো।হঠাৎ তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে অহর্নিশ ঘরে এসে বলল,’অহি,আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।আপনার কিছু প্রয়োজন পড়লে আম্মুকে বা মনিষার মা কে বলবেন।’

অহর্নিশের কথাগুলো শুনলেও অহি অহর্নিশকেই লক্ষ্য করছিলো।দেখতে সুপুরুষই বটে,চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ।ফর্মাল পোশাকে আরো সুন্দর লাগছে।কিন্তু সে হাসপাতালে যাবে কেনো?অহির মনে কৌতুহল জাগলো।কৌতুহল চেপে রাখা বড় দায়!তাই অহি জিগ্যেস করেই ফেললো,’আচ্ছা আপনি হাসপাতালে যাচ্ছেন কেনো?’

অহর্নিশ ঠোঁট প্রশস্ত করে হেসে বলল,’আমি ডাক্তার।আর রবিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে আমার ডিউটি আছে তাই আমাকে এই সময়টায় রোজই আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়।’

‘ওহ!আবার আসবেন কয়টায়?’

‘সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই চলে আসবো।’

‘আচ্ছা।’

‘জ্বি,আর শুনুন আপনার বোধহয় বিরক্ত লাগতে পারে একা বসে থাকতে।তাই আমার ট্যাব টা দিয়ে গেলাম।যেকোনো মুভি,ড্রামা বা অন্যকিছু দেখতে পারেন।’

অহর্নিশ অহিকে নিজের ট্যাবটা দিয়ে দিলো।অহি ডানহাতে সেটা রাখলো।ডান হাত ছাড়া শরীরের আর কোনো অঙ্গই ও নাড়াতে পারে না।খুব অসহায় লাগে নিজেকে!

অহির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অহর্নিশ চলে গেলো।ও চলে যেতেই অহি আবারও বাইরের দিকে তাকালো তবে এবার আর বাইরের কিছুতেই ওর মনোযোগ নেই এবার ও ভাবছে নিজের কথা।কে ও?কোথা থেকে আসলো?আর এই ছেলেটাই বা এতো সেবা করছে কেনো ওর?এসব কিছুই ভাবছে অহি কিন্তু এসব ভাবনার কোনো আদি বা অন্ত নেই।

জৈষ্ঠ্যমাসের দুপুরের কড়া রোদে মানুষের প্রাণ জেরবার হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা।যেনো সূর্য মাথার এক হাত ওপরে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।এসির মধ্যেও গরম লাগছে অহর্নিশের।মাত্রই বায়ান্ন নাম্বার ওয়ার্ডের রোগীকে চেক-আপ করে নিজের কেবিনে ফিরলো।গদিতে আরাম করে বসে মা’কে ফোন দিলো।দু তিন বার ফোন হতেই মিসেস অনামিকা রিসিভ করলো।

‘হ্যালো মা,খেয়েছো তোমরা?’

‘হ্যাঁ তুই খেয়েছিস?’

‘না এখন খাবো।শোনো অহিকে খাবার দিয়েছো?’

‘অহিকে?’কিছুটা উৎসুক্য হয়ে বললেন মিসেস অনামিকা।

‘আরে ওই যে অচেনা মেয়েটা!ওর নাম অহি দিয়েছি।যেহেতু ওর কিছু মনে পড়ছে না সেহেতু এখন ডাকার জন্য আপাতত এই নামটাই রেখেছি।’

‘ওহ!হ্যাঁ তোমার অহিকে খাবার দেওয়া হয়েছে।’মিসেস অনামিকার গলায় তাচ্ছিল্যের ভাব স্পষ্ট।

অহর্নিশ সেটা বুঝেও কিছু বলল না।মিসেস অনামিকাই আবার বললেন,’শোনো অহর্নিশ এবার একটু অতি পরোপকারী ভাবটা বাদ দাও।দু’দিন বাদে তোমার বিয়ে দিবো আমরা।নিজেকে গোছাও।’

‘মা দয়া করে এখন বিয়ে বিয়ে করে মেজাজের হালুয়া করে দিও না।আমার যখন মনে হবে বিয়ে করা প্রয়োজন আমি তোমাদের বলবো।আর সবে মাত্র একবছর হলো জয়েন করেছি।এখনই এতো প্যারা দিও না।’

‘আচ্ছা যা ভালো বোঝো করো কিন্তু পরে যেনো আফসোস না হয়।আর জলদি খেয়ে নিও।’

‘আচ্ছা।’
বলেই অহর্নিশ ফোনটা রেখে দিলো।প্রতিদিন এসব কথা শুনতে শুনতে প্রায় বিরক্ত সে।তবুও ওর বিরক্তিটা কারো চোখেই পড়ে না সবাই নিজেরদের মতো প্যারা দিয়েই যাচ্ছে।অহর্নিশ বিড়বিড় করতে করতে খাওয়া শুরু করলো।

ডান পাশে কাত হয়ে অহি শুয়ে আছে না ঘুমিয়ে আছে একটু আগে দুপুরের খাবার খেয়েই ঘুমিয়েছে।খাবারটা মনিষার মা খাইয়ে দিয়েছে।যাবার সময় অবশ্য অহর্নিশ ওকে বলে গিয়েছিলো।অহর্নিশ যাবার পর একবার মনিষার মায়ের সাহায্যে ওয়াশরুমে গিয়েছিলো অহি।তারপর আবার ওনার সাহায্যেই বিছানায় এসেছে।এই বাড়িতে অহর্নিশ আর এই মনিষার মা’কেই দেখেছে অহি ও হ্যাঁ সকালে একবার অহর্নিশের মাও এসেছিলেন তবে এরপর আর তার ছায়াও পড়ে নি এ ঘরে।

অহি মনোযোগ সহকারে একটা উপন্যাস পড়ছিলো অহর্নিশের ট্যাব থেকে।ও এতোটাই মনোযোগী ছিলো যে কখনো অহর্নিশ এসে পাশে বসেছে সেদিকে খেয়াল নেই।হঠাৎ পড়তে পড়তেই খেয়াল হলো পাশে কারো উপস্থিতি।বই থেকে চেখ তুলে তাকাতেই দেখলো অহর্নিশ স্মিত হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওকে হাসতে দেখে অহি জিগ্যেস করলো,’হাসছেন কেনো?’

‘আপনার মনোযোগ দেখে।প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে আমি বসে আছি আর আপনার এখন খেয়াল হলো।’

অহর্নিশের কথা শুনে অহি একটা লজ্জা পেয়ে বলল,’আসলে উপন্যাসের ক্লাইমেক্সে ছিলাম তো তাই খেয়াল করি নি!’

‘তাই!আচ্ছা কোন উপন্যাস পড়ছেন।একটু নামটা বলুন।’

‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সোনালী দুঃখ।’

‘বাহ!তো এখন কাহিনির কোথায় আছেন?’

‘একটা ক্রিটিকাল জায়গায় আছি।ত্রিস্তানের অসুখ হয়েছে এখন কি রাজকুমারী সোনালী আসবে না ওর কাছে?জানেন আমার এই জায়গায় খুব খারাপ লাগছে।যদি রাজকুমারী সোনালী না যায়?

‘কি মনে হয় যাবে?’অহর্নিশ অহির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।

‘জানি না।ভালোবাসা সত্যি হলে যাবেই।’অহি দৃড়কন্ঠে বলল।

‘আর যদি না যায় তাহলে কি ভালোবাসা সত্যি না?’

অহি মরিয়া হয়ে বলল,’প্লিজ এভাবে বলবেন না।’

‘আচ্ছা বলবো না।পরে কি আমাকে জানাবেন কিন্তু!’

‘আচ্ছা।’
এরপরই কিছু একটা মনে হতেই অহি আবার জিগ্যেস করলো,’আপনি কখন এলেন?’

‘এইতো পনেরো মিনিট হয়েছে।’

‘ওহ!’

‘হ্যাঁ।আপনার জন্য একটা জিনিস এনেছি।’

‘কি?’

অহর্নিশ অহিকে অপেক্ষা করতে বলে নিজের ঘরে গেলো।পাঁচ মিনিট পর একটা দু’টো ক্রাচ নিয়ে এসে বলল,’এখন থেকে এগুলো তে ভর দিয়ে অল্প অল্প করে হাটার চেষ্টা করতে হবে।প্রতিদিন হাঁটলেই আপনি আবার আগের মতো হাটতে পারবেন।’

‘কিন্তু আমি তো।হাত পা ই নাড়াতে পারি না।’

‘পারবেন।চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।’

অহর্নিশ ক্রাচগুলো দেয়াল সাথে দাড় করিয়ে রেখে অহির পাশে গিয়ে বসল।তারপর বলল,’এখন থেকে আমরা সন্ধ্যার ব্যায়াম করবো আর সকালে হাঁটতে বের হবো।’

‘আচ্ছা।’অহি সৌজন্য হেসে জবাব দিলে।

‘তাহলে এবার শুরু করা যাক।’
এটা বলেই অহর্নিশ অহির বাম হাত মুভ করানো শুরু করলো।হাতের কব্জিতে হালকা একটু চাপ দিলেই অহি ব্যাথায় চোখ মুখ খিঁচে ফেলে।অহর্নিশের খারাপ লাগে তবুও স্বাভাবিক হতে হলে এগুলো সহ্য করতেই হবে।ঘন্টাখানেক হাতের ব্যায়াম করে।রাতের খাবার খাইয়ে অহির ঔষুধগুলো খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেতে গেলো।খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে অহির লকেট’টা সাথে নিয়ে আবারো অহির ঘরে গেলো।অহি এখনো ঘুমায় নি চুপচাপ শুয়ে ছিলো অহর্নিশকে দেখে উঠতে নিলেই ও থামিয়ে দিয়ে বলল,’ওঠা লাগবে না।’
এটা বলেই অহির লকেট’টা ওর হাতে দিয়ে বলল,’দেখো তো কিছু মনে পড়ে কি না।’
অহি লকেট’টা হাতে দিয়ে দেখলো লকেটের একপাশে ওর ছবি আরেকপাশে একটা মহিলার ছবি।অহি চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু না আবদ্ধ চোখের নিচে সবই অন্ধকার।কিছুই দেখা যাচ্ছে না।অহি চোখ খুলে ফেললো।চিন্তিত মুখে বলল,’না আমার কিছুই মনে পড়ছে না।’

‘সমস্যা নেই।আস্তে আস্তে মনে পড়বে।এতো চাপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই।’

অহি কিছু বলল না।লকেট’টা অহর্নিশকে দিয়ে দিলো।ক্রমশ চিন্তারা দলা পাকিয়ে মেঘের মতো কুন্ডলী করে মাথার চারদিকে ঘুরছে।নিজেকে নিজেই চিনতে না পারাটা কতোটা যাতনার সেটা অহি বুঝতে পারছে।
অহি ঘুমিয়ে গেছে ভেবে অর্হনিশ লাইট বন্ধ করে চলে গেলো।অহর্নিশ চলে যেতেই অহি আবারও চোখ খুললো।অন্ধকারে চোখ মেলেই শুধুই অন্ধকার দেখলো।
—————-
ভোর ছয়টা বাজে।অহর্নিশ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো।তারপর জগিং স্যুট পরে অহির ঘরে আসতেই দেখলো অহি বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে।অহর্নিশ ঘরে এসেই বলল,’আরে!তুমি কখনো উঠলে?’

‘এই তো পাঁচ/সাত মিনিট হবে।’স্নিগ্ধ হেসে জবাব দিলো অহি।

‘আচ্ছা তাহলে ফ্রেশ হয়ে চলো আমরা বের হই।’

অহি মাথা নেড়ে সায় দিলো।অহর্নিশ ওকে উঠতে সাহায্য করলো।বলতে গেলে অহির শরীরের প্রায় সমস্ত ভরই অহর্নিশের হাতে।অহির ডান হাতে একটা স্কেচ দিয়ে বাম হাতটা অহর্নিশ নিজের কাধে নিয়ে একহাতে অহির কোমর চেপে ধরলো।

চলবে…..
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০৩

0

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০৩
#Arshi_Ayat

১৪২১ বঙ্গাব্দ,১লা জৈষ্ঠ্য,শিলিগুড়ি…

একটি নব্যদিনের সূচনা।এখন বেলা আট’টা।কাঁচের জানালা ভেদ করে সূর্যের একফালি রশ্মি মেয়েটির মুখে পড়ছে।সিঙ্গেল বিছানার মাঝখানে এভাবেই মেয়েটি একদম সটান হয়ে শুয়ে আছে বিগত তিনমাস ধরে।দুইপায়ের হাটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত ব্যান্ডেজ,বাম হাত পুরোটা ব্যান্ডেজ,মাথায়ও ব্যান্ডেজ,গালে তিনটা সেলাই ডান হাতে স্যালাইন লাগানো।গত তিনমাস তাকে এভাবেই বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তিনমাসে একবারও চোখ খোলে নি,কোথাও বলে নি একদম মূর্তির মতো শুয়ে ছিলো।
——————–
রাত ১০ টা।খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খাচ্ছে।এই বাড়ির একটা ধরাবাঁধা নিয়ম আছে তাহলে রাতে সবাই একসাথে খাবে।যতো ব্যস্তই হোক সবাইকে একসাথে খেতে হবে।আর এই নিয়মের হেরফের এখনো হয় নি।আজকে খাবার মেনু তে পাট শাক,মুসুরির ডাল,ডিম ভুনা,সালাদ,আর ভাত আছে।যে যার মতো খাচ্ছে।খেতে খেতেই পূর্ব চৌধুরী বললেন,’অর্হনিশ,মেয়েটির কি অবস্থা?এখনো কোনো ইম্প্রুভমেন্ট নেই?’

‘না বাবা।এখনো কোনো রেসপন্স নেই।’অহর্নিশ হতাশ গলায় বলল।

‘আর কতোদিন এভাবে ওকে রাখবে?হাসপাতালে দিয়ে আসো।ওরাই ওর টেক কেয়ার করবে।’গম্ভীর কন্ঠে বললেন পূর্ব চৌধুরী।

‘চেষ্টা তো কম করলে না অর্হনিশ।এখন তোমার বাবা যা বলে তাই করো।’মিসেস অনামিকাও স্বামীর সাথে সায় দিলেন।

‘জ্বি বাবা।’সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো অর্হনিশ।
হাত ধুয়ে অচেনা মেয়েটির রুমে পা বাড়ালো।ওর স্যালাইন পাল্টানোর সময় হয়ে গেছে।মেয়েটির ঘরে এসে লাইট জ্বালিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলো।তারপর ডানহাতটা ধরে বলল,’হ্যালো,আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’
প্রতিদিন যখনই অহর্নিশ এই ঘরে আসে তখনই মেয়েটার হাত ধরে কথা বলে যদি কোনো উত্তর অথবা সাড়া পাওয়া যায় সেই আশায় কিন্তু তিন মাস ধরে মেয়েটির কোনো উত্তর নেই তবুও অহর্নিশ তার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

এবারও কোনো উত্তর না পাওয়ায় অহর্নিশ হতাশ হয়ে স্যালাইন পাল্টে দিয়ে শেষ বারের মতো মেয়েটির হাত ধরে বলল,’হ্যালো,আপনি কি আমাকে শুনতে পাচ্ছেন?প্লিজ সাড়া দিন।’

হঠাৎই কি হলো কে জানে মেয়েটি আস্তে আস্তে চোখ খুললো।ওকে চোখ খুলতে দেখে অহর্নিশের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম।অনেক কষ্টে নিজেকে প্রতিহত করে উত্তেজিত গলায় বলল,’এই যে আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?’

মেয়েটা অহর্নিশের দিকে তাকালো।মুখ দিয়ে খুব ক্ষীণ স্বরে কিছু একটা বলল কিন্তু অক্সিজেন মাক্সের জন্য বোঝা গেলো না।অহর্নিশ মাক্সটা খুলে আবার বলল,’কিছু বলবেন?’

‘আমি কোথায় আছি?’খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলল মেয়েটি।

এতোদিন পর মেয়েটার কথা শুনতে পারায় অহর্নিশ খুশিতে আটখানা।এতোদিন কম চেষ্টা করে নি ও।তবে আজ আকস্মিক ভাবে যে চেষ্টার ফল মিলে যাবে সেটা অহর্নিশ ভাবতেও পারে নি।
ও মেয়েটার প্রশ্নের উত্তরে অভয় দিয়ে বলল,’চিন্তা করবেন না আপনি আমার বাসায় আছেন।’

‘আপনি কে?’মেয়েটা আবার দুর্বল গলায় বলল।

‘এক্সিডেন্টের পর আপনাকে আমারা উদ্ধার করেছি।’

‘আমার কি হয়েছিলো?’

মেয়েটার শেষ প্রশ্নে অর্হনিশ বুঝলো ওর কিছু মনে নেই।মেমোরি লস হয়েছে।অবশ্য ওর বাঁচারই চান্স ছিলো না তবুও যে কিভাবে বাচলো আল্লাহ জানে!
অহর্নিশ নতুন করে কিছু বলল না।এখন ব্রেইনে প্রেশার দেওয়া ঠিক হবে না।ওকে এক্সিডেন্টের কথা বললে ও এখন এগুলো ভাববে।এগুলো ভাবলে প্রেশার পড়বে ব্রেইনে।
অর্হনিশ উত্তর দিতে গিয়ে খেয়াল মেয়েটা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।ও স্মিত হেসে মেয়েটার হাত ধরে ভরসার গলায় বলল,’আপনি তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উঠবেন স্নো হোয়াইট!’

এটা বলেই অহর্নিশ মেয়েটার হাত ছেড়ে উঠে দাড়ালো।তারপর ওর ঘরের লাইট বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে এলো।ড্রেসিং টেবিলের ড্রায়ার থেকে একটা লকেট বের করে দেখলো একটা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের ছবি আর একজন মহিলার ছবি।বোঝাই যায় মা মেয়ে।চেহারায় মিল আছে।কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে অহর্নিশ লকেট’টা আবার রেখে দিলো।এই তিনমাসে একদিনও বাদ নেই যেদিন অহর্নিশ এই লকেট’টি দেখে নি।অহর্নিশ নিজেও জানে না ও কেনে এই লকেট’টা দেখে।তবে প্রতিদিন এটা না দেখলে ভালো লাগে না ওর।তবে ও অচেনা মেয়েটার একটা নাম দিয়েছে।মেয়েটার নাম স্নো হোয়াইট!

অহর্নিশ খুব খানদানি পরিবারের ছেলে।দাদার বাড়ি বাংলাদেশে তবে বাবার বাড়ি ভারতের শিলিগুড়িতে।নানার বাড়িও বাংলাদেশে।বাংলাদেশে বছরে দুই/তিন বার যাওয়া পড়েই।অহর্নিশ পেশায় ডাক্তার।গতবছর ইন্টার্নশিপ শেষ করে হাসপাতালে পার্মানেন্ট জয়েন হয়েছে।
—————–
খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই অহর্নিশ মেয়েটার ঘরে এলো।তারপর নিচে হাটু গেড়ে বসে মেয়েটার হাত ধরতেই মেয়েটা চোখ খুললো।ক্ষীণ কন্ঠে বলল,’আমি পানি খাবো।’

বেডসাইড থেকে খালি পানির গ্লাসটায় পানি ভরে আনলো অহর্নিশ তারপর মেয়েটার মাথাটা একহাত দিয়ে একটু তুলে ধরে আরেকহাত দিয়ে একটু পানি খাইয়ে দিলো।তারপর মুখটা মুছে দিলো।অহর্নিশ আস্তে আস্তে মেয়েটার স্যালাইন খুলে ফেললো।তারপর নিজের ঘরে গিয়ে সার্জিক্যাল ব্লেড,গরম পানি,তুলা,অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে আবার মেয়েটার ঘরে চলে এলো।দুইপায়ের ব্যান্ডেজ আর হাতের ব্যান্ডেজগুলো খুলে ফেললো।কাটাগুলো শুকিয়ে গেছে আর হাড়ও মোটামুটি জোড়া লেগে গেছে এখন শুধু ব্যায়াম করতে হবে আর নিয়ম মাফিক চলতে হবে তাহলেই আবার হাটাচলা করা সম্ভব।প্রথম প্রথম কষ্ট কিন্তু তবুও চেষ্টা করতে হবে।

হাত পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা শেষ হতেই অহর্নিশ চলে গেলো রান্না ঘরে একবাটি সবজি স্যুপ এনে মেয়েটার মুখের সামনে ধরে বলল,’এটা খেয়ে নিন।ভালো লাগবে।’

মেয়েটা অহর্নিশের দিকে চেয়ে বলল,’আচ্ছা আমার কি হয়েছিলো?আর আমি এখানে কেনো?আপনিই বা কে?আপনি কি আমাকে চেনেন?’

‘আচ্ছা সব বলবো কিন্তু আগে খেতে হবে।আপনি খেতে থাকুন আর আমি বলতে থাকি।’

অহর্নিশ মেয়েটাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলতে লাগলো,’আপনার কি হয়েছে আমি জানি না তবে সম্ভবত আপনি কোনো বাস অথবা রেল দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন।আমি যখন শিলিগুড়ির স্থানীয় হাসপাতালে জয়েন করি তার একমাস আগে থেকে আপনি সেখানে ছিলেন।তবে আপনার জ্ঞান ছিলো না।ডক্তার’রা হাল ছেড়ে দিয়েছিলো।তারপর থেকে আপনার অযত্ন হচ্ছিলো যেটা আমার ভালো লাগে নি তারপর আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসি।এখানে আপনি আরো দুইমাস অচেতন অবস্থায় ছিলেন।অতঃপর কাল রাতে আপনার জ্ঞান ফিরেছে।আমি এতটুকুই জানি।তবে এর আগে আপনার কি হয়েছিল,আপনি কে,কোথায় থাকেন কিছুই জানি না।’

অহর্নিশের কথা শুনে মেয়েটার কপালে চিন্তার ছাপ দেখা গেলো।মেয়েটাকে চিন্তিত দেখে অহর্নিশ বলল,’চিন্তা করবেন না।আপনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে যাবেন আর সবকিছু মনেও পড়ে যাবে।’

মেয়েটা উত্তরে কিছু বলল না।স্যুপ খাওয়ানো শেষ হতেই মিসেস অনামিকা ঘরে আসলেন।ওনাকে দেখে অহর্নিশ বলল,’আম্মু দেখো কাল রাতেমেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে।তোমাদের বলতাম কিন্তু তোমরা ঘুমিয়ে গিয়েছিলে।’

মিসেস অনামিকা মেয়েটার পাশে এসে বসলেন।বললেন,’এখন কেমন বোধ করছো?’

‘ভালো।’

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’
মিসেস অনামিকার এই প্রশ্ন শুনে মেয়েটা অহর্নিশের দিকে তাকালো।অহর্নিশ মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’মা ওনার আসলে কিছু মনে নেই।’

মিসেস অনামিকা আফসোসের স্বরে বললেন,’ওহ!’
তারপর আবার হাস্যমিশ্রিত কন্ঠে বললেন,’তুমি রেস্ট করো।আমি আসি।’

যাওয়ার সময় মিসেস অনামিকা অহর্নিশকে ইশারায় বাইরে আসতে বললেন।অহর্নিশ রুমের বাইরে আসতেই উনি বললেন,’মেয়েটার তো জ্ঞান ফিরলো কিন্তু এখন তো ওর কিছুই মনে নেই।বাড়ি ফিরবে কি করে?’

‘মা আপাতত এখানেই থাকুক।যখন মনে পড়বে তখন ফিরে যাবে।’

মিসেস অনামিকা শঙ্কাপূর্ণ গলায় বললেন,’পরে যদি না ফেরে?’

অহর্নিশ বিরক্তকন্ঠে বলল,’মা পরেরটা পরে দেখা যাবে।আগে ওনাকে শারীরিক ভাবে সুস্থ করে তোলা প্রয়োজন।আর ততদিনে হয়তো সবকিছু মনেও পড়ে যেতে পারে।’

‘হ্যাঁ তাই জেনো হয়।তবে বেশিদিন কিন্তু রাখা যাবে না।’এটা বলেই মিসেস অনামিকা চলে গেলেন।আর অহর্নিশ আবার মেয়েটাট ঘরে আসতেই দেখলো মেয়েটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।অহর্নিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বলল,’আচ্ছা আপনার নাম কি?’

‘অহর্নিশ চৌধুরী।’অহর্নিশ ঠোঁট হাসি রেখেই উত্তর দিলো।তারপর পাল্টা প্রশ্নে বলল,’আপনার নাম কি?’

‘জানি না।’মেয়েটার গলায় বিষন্নতা।

অহর্নিশ কিন্তু একটা ভেবে বলল,’আপনার নাম অহি।’

‘আপনার নামের সাথে মিলিয়ে রাখলেন মনে হচ্ছে।’মেয়েটা বলল।

‘হ্যাঁ,মিলিয়েই রেখেছি।কেনো সুন্দর হয় নি?’

‘হ্যাঁ সুন্দর তবে আমার নাম তো এটা নয়।’

‘যতোদিন না আপনার সব মনে পড়ছে ততদিন এটাই আপনার নাম।’

চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০২

0

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০২
#Arshi_Ayat

রাত দু’টোর ঘন্টা কবলেই বাজলো।প্রিয়তি বিছানায় শুয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সিলিংফ্যানে।মনে হচ্ছে চোখের সামনে মায়ের লাশটা ঝুলছে ফ্যানে।কি বিভৎস!
প্রিয়তি চোখ বন্ধ করে ফেললো।চোখের কোণা বেয়ে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।

মায়ের মৃত্যুর আজ পঞ্চম দিন।পাঁচটা দিন ধরে মা কবরে শুয়ে আছে।পাঁচদিন ধরে দেখা হয় না,কথা হয় না।ভেতরটা খা খা করে প্রিয়তির।মা থাকতে পৃথিবীটা কতো নিরাপদ ছিলো ওর জন্য কিন্তু মা চলে যেতেই পাঁচদিনের মাথায় নিষ্ঠুর পৃথিবী তার ঘৃণ্য আচরণ দেখিয়েই দিলো।পৃথিবীতে কেউই উটকো ঝামেলা চায় না।উটকো ঝামেলা মানেই সংসারে অশান্তি।আর কেউ যেচে তা আনবে না!তাই তো ফুপু কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি প্রিয়তিকে চলে যেতে বললেন কারণটা ওই যে উটকো ঝামেলা কেউই চায় না!

আজানের আগে চোখের পাতায় ঘুম একটুখানি ধরা দিয়েছিলো।কিন্তু তা বেশিক্ষণ টেকে নি।আজান হতেই ঘুম ছুটে গেলো।প্রিয়তি ওজু করে নামাজ আদায় করে ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।এখনো আলো তেমন ফোটেনি,তির তির হওয়া বইছে,পাখিরা কিচিরমিচির করছে,আকাশে সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।প্রিয়তি মেঘগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কি সুন্দর এরা ভেসে বেড়াচ্ছে বিশাল আকাশের বুকে।যেনো এদের চেয়ে স্বাধীন কেউই না।কিছুক্ষণ বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে আকাশের পানে চেয়েছিলো প্রিয়তি।হঠাৎই এক প্রবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে এলো।এখনো কেউ ওঠে নি।ঘড়িতে এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে।সবাই উঠতে উঠতে সাতটা বাজবে।প্রিয়তি একটা চাদর গায়ে দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লো।

রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই।যারা আছে তারা সবাই মর্নিওয়াক করতে বেরিয়েছে এদের মধ্যে বেশিরভাগই মধ্যবয়সী আর এদের বেশিরভাগেরই ডায়াবেটিস অথবা হাই ব্লাড প্রেশার আছে।আর এটা ডাক্তারের পরামর্শেই প্রতিদিন মর্নিওয়াকে বের হয়।বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কতো প্রচেষ্টা আর এদিকে প্রিয়তির এই জীবনটাকে বোঝা মনে হয়।যদি কাউকে জীবন দান করা যেতো তবে সে কোনো এক সুখী মানুষকে তার জীবনটা দিয়ে যেতো।কিন্তু আফসোস দু’টোর একটাও নেই!

রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয়তি গঙ্গাধারে এসে পৌঁছালো।নদীর উচ্ছল পানিতে সূর্যের আলো দোল খাচ্ছে।ঘাট থেকে মাত্রই একটা মালবাহী জাহাজ ছেড়েছে।এছাড়া ব্যস্ত নদীর বুকে ছোটো ছোটো নৌকা,স্টিমার তো চলছেই।প্রিয়তি কিছুক্ষণ নদীর পাড়েই ঘোরাঘুরি করলো।তারপর আবার উল্টোপথে বাড়ি ফিরলো।ফিরতে ফিরতে সাতটা বাজলো।প্রায় সবাই উঠে গেছে।প্রিয়তি বাসায় আসতেই ওর ফুপু উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করলো,’কোথায় গিয়েছিলি?’

‘এইতো একটু হাঁটতে।আমি একটু বের হবো ফুপু।’

‘না দুপুরে খেয়ে যাস।’গলায় জোর নেই।বলার জন্যই বলা।

‘না ফুপু যেতে হবে আমায়।আমি ব্যাগটা নিয়ে আসছি।’

প্রিয়তি ঘরে এসে কাল রাতে গোছানো ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে ওখান থেকে একটা স্কার্ফ বের করে বেঁধে নিলো।তারপর ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ডাইনিং রুমে চলে এলো।এখন টেবিলে বসে নাস্তা করছে।প্রিয়তির নাস্তা করতে ইচ্ছে করছে না তবুও সবার সাথে বসলো।কিন্তু বরাবর চোখ যেতেই দেখলো ফয়েজ ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।প্রিয়তি আর সেদিকে চাইলো না।নামমাত্র খেয়ে ফুপির থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

বাসায় এসে সজোরে কড়া নাড়লো প্রিয়তি।কয়েকবার নাড়ার পর ভেতর থেকে কেউ একজন দরজা খুললো।প্রিয়তি সামনে তাকাতেই দেখলো ওই মেয়েটা দাড়িয়ে আছে হাতে খুন্তি।বোধহয় রান্না করছিলো।প্রিয়তিকে দেখে দরজা থেকে চেপে দাড়ালো মেয়েটি।প্রিয়তি দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।ঘরে এসে সোজা শাওয়ার নিতে চলে গেলো।গোসল করে বেরুতেই দেখলো বোরহান সাহেব ওর খাটের ওপর বসে আছে।ওকে দেখেই তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,’তুমি না বললে এ বাড়িতে আর আসবে না।তাহলে এলে যে?নাকি অন্যকোথায় ঠাই মেলেনি বলে এসেছো।’

এমন জ্বালা ধরানো কথা শুনেও প্রিয়তি কিছু বলল না।যেনো সে কিছু শুনতেই পায় নি।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে অতি মনোযোগে মাথা মুচছে।
বোরহান সাহেব কিছুটা অপমানিত বোধ করে উঠে দাড়ালেন।তারপর বললেন,’শোনো এই বাড়িতে থাকতে হলে তোমার নতুন মায়ের কথা শুনে চলতে হবে।বেয়াদবি করলে বাড়ি থেকে বের করে দেবো।বুঝতে পেরেছো?’

‘না বুঝতে পারি নি।বাড়ির অর্ধেক আমার মায়ের নামে।বাকি অর্ধেক আপনার।আমার মা যেহেতু নেই সেহেতু অর্ধেকের মালিক আমি।এখন এই অর্ধেকে আমি যা ইচ্ছে করবো কারো হুকুমের ধার ধরবো না।বুঝতে পারলেন?’

রুঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো বোরহান সাহেব।সে বেরুতেই প্রিয়তি দরজায় খিল তুলে বিছানায় শুয়ে পড়লো।মাথাটা ভার হয়ে আছে।এখন ঘুমাতে পারলে শান্তি লাগতো।খাটে শুতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো।

প্রায় বিকেল হয়ে গেছে।পেটের ক্ষিধেই প্রিয়তিকে জাগিয়ে তুললো তা নাহলে কয়েকযুগ এভাবেই ঘুমিয়ে কাটাতে পারবে সে।আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলো।দুর্বল পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলতেই প্রথমে চোখ গেলো বসার ঘরের সোফায়!তার বাবা আর নতুন বউ মিলে টিভি দেখছে আর হাসছে।প্রিয়তি আর সেদিকে তাকালো না।রান্নাঘরে গিয়ে একগ্লাস পানি খেয়ে আবার ঘরে আসলো।পার্স থেকে টাকা বের করে সদর দরজা দিয়ে বের হলো মুদি দোকানে যাওয়ার জন্য।এক কেজি চাল আর একহালি ডিম কেনার জন্য।

বাড়ির পাশেই মুদি দোকানের অভাব নেই।প্রিয়তি সদাই কিনে আবার ফিরে এলো।তারপর ভাত রান্না করে আর ডিম ভেজে পেটে ক্ষিধে মিটিয়ে আবার ঘরে চলে আসলো।খাটের ওপর বসে ফোনটা চাল করলো।গত পাঁচদিন ধরে ফোনটা বন্ধ।ফোন অন করতেই দেখলো বন্ধু,বান্ধব আর দূরের আত্মীয় স্বজনের কল এসে ফোন জ্যাম হয়ে গেছে।সেখান থেকে বেছে বেছে দু চার জানের কথা বলে রেডি হয়ে নিলো টিউশনিতে যাওয়ার জন্য।আজ পাঁচদিন ধরে যাওয়া হয় না টিউশনিতে তারা অবশ্য প্রিয়তির মা মারা যাওয়ার ব্যাপারটা জানে।তাই এখনো কিছু বলছে না কিন্তু আর কামাই দেওয়া ঠিক হবে না।রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো প্রিয়তি।

সন্ধ্যা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত দু’টো ছেলেকে পড়িয়ে তারপর বাসায় আসবে সে।

এভাবেই পনেরোদিন গেলো।প্রাত্যহিক রুটিন মতো নিজের কাজ,পড়াশোনা করে ক্লান্ত চোখে রাতের আধারে মায়ের ছবিটা বুকে নিয়ে শুয়ে পড়ে প্রিয়তি।মাঝেমধ্যে মনে হয় মায়ের কাছে চলে যেতে কিন্তু সাহসে কুলোয় না।

আজও টিউশনি করিয়ে রাত নয়টার সময় বাড়ি ফিরলো প্রিয়তি।আজ বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়লো।ভিষণ ক্লান্ত লাগছে।পেটে ক্ষিধে থাকলেও চোখ খুলে রাখা বড়ো দায়।তাই ক্ষিধে নিয়েই শুয়ে পড়লো।কাল সকালে আবার বান্দরবানের বাস ধরতে হবে।বান্দরবান প্রিয়তির ছোটো খালার বাসা অনেকদিন ধরে যেতে বলছে ওকে খালা কিন্তু প্রিয়তি ইচ্ছে করেই যায় না।তবে গতকাল সকালে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলেছে বলেই কিছুদিনের জন্য সব ছেড়ে বান্দরবানে যেতে রাজি হয়েছে সে।হয়তো সেখানে গেলে ভালো লাগবে।

সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো।এখন সবে মাত্র পাঁচটা বাজে।নিজেও রেডি হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে একটা ডিম ভেজে খেয়ে নিলো।এখন রুটি বানানোট সময় নেই।একটা ডিম আর একগ্লাস পানি খেয়ে বেরিয়ে পড়লো।সাড়ে ছয়টায় বাস ছাড়বে।যেতে যেতেও একঘন্টার মতো লাগবে।

বাসে উঠে জানালার পাশের সীট’টায় বসলো প্রিয়তি।এমনিতে জানালার পাশের সীটেই বসতে হবে এমন কোনো ধরা বাঁধা নিয়ম নেই প্রিয়তির।কিন্তু আজ জানালার পাশেই বসতে ইচ্ছে করছে।তাই টিকিট’টাও সেভাবেই কেটেছে।

ভোর সাড়ে ছয়টা।বাস ছেড়ে দিয়েছে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে।প্রিয়তি কানে হেডফোন গুঁজে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।দুরের গাছপালা,দোকানপাট গুলো সাই সাই করে পিছনে চলে যাচ্ছে।সকালের মোলায়েম হাওয়া প্রিয়তির সারা শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে।এরমধ্যেই ফোন এলো ছোটো খালার।প্রিয়তি রিসিভ করতেই তিনি বললেম,’প্রিয়ু কোথায় তুই?’

‘এইতো আসছি।বাসে উঠেছি।’

‘সাবধানে আসিস মা।এসে আমাকে ফোন দিস।আমি আলভিকে পাঠাবো।’

আলভির কথা শুনে ঠোঁটের শেষ সীমানায় একটুখানি হাসি চিবুকের কাছে এসে হারিয়ে গেলো।আলভিকে প্রিয়তি পছন্দ করে অনেক আগে থেকেই।সেটা অবশ্য মা ছাড়া কেউ জানে না।আলভি আর সে সমবয়সী।মা বলেছিলো ওদের বিষয়ে কথা বলবে কিন্তু…একটা দীর্ঘশ্বাস আবারো ভেতরটা ভারী করে তুললো।ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে মায়ের ছবিগুলো দেখতে লাগলো।কখনো মা মেয়ে উচ্ছল হাসিতে মেতে উঠেছে তো কখনো দুজনে আকাশ দেখছে আবার কখনো কখনো ঘুড়ি উড়াচ্ছে।এসব দেখতে দেখতে কখন যে প্রিয়তির চোখ ভিজে উঠেছে সে খেয়াল নেই।হঠাৎ বাস ঝাঁকি খাওয়ায় হুস ফিরলে গ্যালারি থেকে বের হওয়ার সময় একটা ছবিতে চেখ পড়লো।ছবিটা আলভির!আলভি ফুচকা খাচ্ছে।এটা বছর দুয়েক আগের ছবি।সেদিন আলভি,সৈকত,সামির,মৌ আর ও একসাথে ঘুরতে বেরিয়ে ছিলো।সেদিন সবার অগোচরেই আলভির কয়েকটা ছবি তুলে নিয়েছিলো প্রিয়তি।মাঝেমধ্যেই ছবিগুলো দেখতে সে।আজ অনেকদিন পর ছবিগুলো দেখছে।আর কয়েকঘন্টা পর সামনাসামনিই দেখা হবে।ছবিগুলো উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎই দেখলো বাসের মানুষজন চিল্লাচ্ছে অস্বাভাবিক ভাবে।কেউ কেউ তো ড্রাইভারকে গালাগালও দিচ্ছে।প্রিয়তি ব্যাপাটা বোঝার জন্য সামনে তাকাতেই দেখলো…….
————
“বান্দাবান যাওয়ার পথে একযাত্রী বাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০ এর বেশি গুরুতর আহত হয়েছে ৩০।তাদের সবাইকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে।’

প্রত্যেকটা নিউজ চ্যানালে এই খবর দেখাচ্ছে।

চলবে…

দ্বিতীয় বসন্ত পর্ব-০১

1

#দ্বিতীয়_বসন্ত
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

একটু আগেই মা’কে কাফনের কাপড়ে ঢেকে দিয়ে এলো প্রিয়তি।পৃথিবীর বুকে এতিম হয়ে গেলো আজ সে।প্রিয়তির বাবা বোরহান সাহেব দ্বীতিয় স্ত্রীকে নিয়ে হানিমুনে গেছেন।কালই হুট করে প্রিয়তির বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসে প্রিয়তির বাবা।সেই কষ্ট’টা কিছুতেই সহ্য করতে না পেরে আজ সবার অগোচরে এই বিশালাকার নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।মা’কে খাটিয়ায় তোলা পর্যন্ত একটুও কাঁদেনি প্রিয়তি।সবার সাথে বরই পাতার গরম জলে গোসল করিয়ে আতর,গোলাপজলে সাজিয়ে কাফন পরিয়ে মা’কে বিদায় দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে।জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওরা মা’কে নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।মা আর ফিরবে না!কি একটা তীব্র কষ্ট বুকটা মুচড়ে ধরেছে।মনে হচ্ছে কষ্টের বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে।

কাল দুপুর বেলা প্রিয়তি মায়ের মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছিলো আর গল্প করছিলো।ছোটোবেলা থেকেই প্রিয়তি মায়ের খুব কাছের ছিলো।প্রায় প্রায়ই মা মেয়ে আড্ড দিতো।কালও তাই হচ্ছিলো।হঠাৎ দরজায় কলিং বেল বাজতেই প্রিয়তি উঠে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলেই দেখলো তার বাবার সাথে নিজের সমবয়সী একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে।পরনে লাল রঙের একটা সিল্ক শাড়ি।মাথায় ঘোমটা দেওয়া।প্রিয়তি কৌতুহলী হয়ে জিগ্যেস করলো,’উনি কে বাবা?’

এরমধ্যেই জোহরা বেগমও চলে এসেছেন এখানে।বোরহান সাহেব মেয়েটার পিঠে হাত দিয়ে বললেন,’ও নতুন বউ।ওকে আজকে আমি বিয়ে করেছি ও তোর নতুন মা।’

একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো দমটা আটকে এসেছে।ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।প্রিয়তি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বলল,’মানে কি বাবা?বিয়ে করেছো মানে?’

বোরহান সাহেব প্রিয়তিকে কে দরজা থেকে সরিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে ভেতরে এলো।প্রিয়তি হতভম্ব হয়ে শুধু কেবল তাদেরই দেখছে।এদিকে জোহরা বেগম বিয়ের কথাটা শুনেই আর কিছু শুনলেন না দৌড়ে প্রিয়তির ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।মায়ের খেয়াল হতেই প্রিয়তিও নিজের ঘরের দিকে ছুটলো কিন্তু ভেতর থেকে দরজা বন্ধ।প্রিয়তি বেশ কয়েকবার দরজা কড়া নেড়েছে কিন্তু ভেতর থেকে কোনো জাবাব আসে নি।ও ভেবেছিলো মা হয়তো কাঁদছে তাই দরজা খুলছে না।প্রিয়তি তখন আর ডাকলো না মা’কে।বসার ঘরে গিয়ে দেখলো তার বাবা মেয়েটার সাথে বসে রসের আলাপ করছে।এই দৃশ্যটা একদম সহ্য হলো না প্রিয়তি।নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সামনে টি-টেবিলের ওপর রাখা ফুলদানিটা এক আছাড়ে ভেঙে ফেললো।ঘটনার আকষ্মিকতায় বোরহান সাহেব প্রিয়তির দিকে চাইলেন সেই চাহনী রুঢ়!তিনি কাটাকাটা গলায় বললেন,’এসব কি প্রিয়তি?’

‘হ্যাঁ আমিও জানতে চাই এসব কি?কে এই মেয়ে।এখানে কি করে?’প্রিয়তিও গলায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল।

‘বলেছিতো ওকে আমি বিয়ে করেছি।এখন থেকে ও এই বাড়ির বউ।’

‘কি করে করতে পারো তুমি এটা?একটা মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে ছিঃ।’প্রিয়তির গলায় তাচ্ছিল্য।

‘বেশ করেছি।আমি আর ওই ফকিন্নির বাচ্চার সাথে সংসার করবো না।’বোরহান সাহেব কথা হলো উচ্চস্বরে বলে উঠলেন।

প্রিয়তি কিছু বলতে যেয়েও বলল না।সোজা চলো গেলো মেয়েটার কাছে।মেয়েটাকে কষে এক চড় দিয়ে বলল,’রাস্তার মেয়ে কোথাকার!আমার মায়ের সংসার ভাংতে এসেছিস কেনো?বেরিয়ে যা বাড়ি থেকে।এই বাড়িতে,এই সংসারে তুই থাকতে পারবি না।এটা আমার মায়ের সংসার।’

কথা শেষ করতে না করতেই বোরহান সাহেব প্রিয়তি আচমকা পরপর দু’টো চড় মেরে দিয়ে বলল,’কোন সাহসে তুই ওর গায়ে হাত দিস?মেরে হাত ভেঙে ফেলবো।ও এবাড়িতেই থাকবে।আমিও দেখি কি করিস তোরা।আর হ্যাঁ ওই ফকিন্নির বাচ্চাকে বলবি যেনো আমার বাড়ি থেকে চলে যায় আর তুইও যদি বেশি তেড়িবেড়ি করিস তাহলে দরজা খোলা আছে সোজা বেরিয়ে যাবি।’

এগুলো বলেই বোরহান সাহেব মেয়েটাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।ওরা যেতেই প্রিয়তি ধপ করে সোফায় বসে পড়লো।কখনো ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি প্রিয়তি এমনও হতে পারে।খুব কষ্ট হচ্ছে ওর!এমনিতেই আজ একুশটা বছর মায়ের চোখের পানি দেখেই বড়ো হয়েছে প্রিয়তি।কখনো স্বামীর কাছ থেকে ভালোবাসা পায় নি মানুষটা।তবুও একা হাতে তিল তিল করে এই সংসারটা জুড়েছে।এখন তারই সাজানো সংসারে অন্যকেউ রাজত্ব করবে এর চেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে!

প্রিয়তি সোফা থেকে উঠে আবারও দরজায় নক করলো কিন্তু কোনো সাড়া নেই।যেনো ভেতরে কেউই নেই।আরো অনেক্ক্ষণ দরজা ধাক্কানোর পর জোহরা বেগম দরজা খুললেন।মায়ের চেহারা দেখেই প্রিয়তির কান্না চলে আসছে।কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গেছে।মাথার পাশের রগটা দপদপ করছে।প্রিয়তি মা’কে জড়িয়ে ধরে বলল,’মা তুমি কষ্ট পেয়ো না তোমার সংসার তোমারই হবে আর কেউ আসতে পারবে না এখানে।’

জোহরা বেগম কিছু বললেন না।প্রিয়তিকে সরিয়ে রান্নাঘরে গেলেন।প্রিয়তিও মায়ের পিছনেই গেলো। প্লেটে ভাত বেড়ে প্রিয়তিকে দিয়ে বললেন,’নে খেয়ে নে।’

‘তুমি খাবে না?’

‘আমার ক্ষিধে নেই।তুই খেয়ে নে।আমার বড্ড ঘুম আসছে।মাথাব্যথা করছে।আমাকে ডাকিস না।আমি তোর রুমে ঘুমাবো।’

এই বলেই জোহরা বেগম চলে গেলো প্রিয়তির ঘরে।প্রিয়তি একটু খেয়ে ভাত ঢেকে চলে এলো।জোহরা বেগম প্রিয়তির রুমের দরজা বন্ধ করে রেখেছে।প্রিয়তি মা’কে আর না ডেকে ছাঁদে চলে গেলো।আজকে মায়ের মনের অবস্থা ভালো না।

সন্ধ্যার আজান পড়ে গেছে।প্রিয়তি একটা টিউশনি করিয়ে বাসায় এসেছে মাত্র।ফ্রেশ হয়ে মা’কে ডাকলো কিন্তু সে দরজা খুলছে না।অনেকবার ডাকার পরও খুলছে না।এবার প্রিয়তির ভয় লাগছে কারণ মা কখনোই এতো ঘুমায় না।আর আজকে সেই দুপুরে ঘুমিয়েছে এখনো কি ওঠেনি?

প্রিয়তি উপায়ন্তর না পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটের লোকদের ডাকলো।ওনারা এসে দরজা ভাঙতে সাহায্য করলো।কিন্তু দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতেই সবাই স্তব্ধ!

ফ্যানের দড়িতে ঝুলছে জোহরা বেগম।জিহ্বাটা বেহ হয়ে আছে আর চেখ গুলো শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে প্রিয়তির দিকে।প্রিয়তি সাথে সাথে জ্ঞান হারালো।

যখন প্রিয়তির জ্ঞান ফিরলো তখন রাত আট’টা।চারপাশে মানুষ গিজগিজ করছে।সব চেনা পরিচিত মুখ।জ্ঞান ফিরতেই প্রিয়তির মনে পড়লো সব।কাউকে কিছু না বলে উঠে মায়ের কাছে চলে গেলো।জোহরা বেগমের লাশটা ঘরের বাইরে রাখা হয়েছে।প্রিয়তি চেয়েছিলো ঘরে রাখতে কিন্তু আত্মীয় স্বজনের কথায় আর রাখতে পারলো না কিন্তু নিজে ঠিকই বাইরে সারারাত মায়ের পাশে বসেছিলো।এই রাতটাই মা’কে মন ভরে দেখতে পাবে।এরপর আর কখনো না।

সকাল পর্যন্ত মায়ের লাশের পাশে বসেছিলো প্রিয়তি।সকালে কয়েকজন মহিলার সাথে মায়ের শেষ গোসল দিলো।তারপর নিজের হাতে আতর,গোলাপজল দিলো।কাফন পরিয়ে মায়ের কপালে শেষবারের মতো একটা চুমু দিলো।যখন ওরা মা’কে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন প্রিয়তি নিজের ঘরে ফিরে আসে।বিছানায় বসে ফ্যানের দিকে তাকায়।ফাঁসির দড়িটা এখনো ঝুলছে।প্রিয়তি মায়ের লেখা চিরকুট’টা খুললো।তাতে কাঁপাকাপা অক্ষরে লেখা

‘প্রিয়তি,
মা আমার।আমি মরার পর যেনো ওই লোকটা আমার মুখ দেখতে না পরে।এই শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে দিস মা।ভালো থাকিস না।’

চিরকুট’টা পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়লো প্রিয়তি।

এমনিতেও বোরহান সাহেব জোহরা বেগমের লাশ দেখতে পাবেন না কারণ সে এখন নতুন বউয়ের সাথে হানিমুনে তাকে জানানো হয়েছে সে নাকি আসছে!কিন্তু সে আসার আগেই জোহরা বেগমের দাফন হয়ে গেছে।

কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো প্রিয়তি।বিকেলের দিকে যখন ঘুম ভাঙলো তখন দেখলো ওর ঘরেও কয়েকজন মহিলা গল্পগুজব করছে।এরা ওর আত্নীয়ই।প্রিয়তি কাউকে কিছু না বলে ঘরে থেকে বের হতেই দেখলো বসার ঘরে ওর বাবা কয়েকজনের সাথে কথা বলছে।মুখটা দুঃখী দুঃখী করে রেখেছে।আর কেউ না জানুক প্রিয়তি জানে ওর মায়ের খুনী এই জানোয়ারটা।ও কখনো ওকে ক্ষমা করবে না।এখন ওকে দেখেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে প্রিয়তির মন চাচ্ছে খুন করে দিতে।প্রিয়তি আবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালো।তেড়ে গেলো বোরহান সাহেবের দিকে।ওনার কলার টেনে ধরে বলল,’তুই,হ্যাঁ তুই আমার মায়ের খুনী।তোকে কখনো মাফ করবো না আমি।’

প্রিয়তিকে ওর দুই ফুপু মিলে ছাড়িয়ে অন্যরুমে নিয়ে গিয়ে শান্ত করে।তারপর বড় ফুপু বলল,’প্রিয়তি তুই ক’টা দিন আমাদের বাসায় থাক।’

প্রিয়তি কিছু বলল না।বড় ফুপু ওর কয়েকটা জামা গুছিয়ে নিজের সাথে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন।প্রিয়তি আপত্তি করে নি কারণ এ বাড়িতে থাকলেই ওই খুনীটার চেহারা দেখতে হবে।আর ওকে খুন করতে মন চাইবে।

ওইদিন বড়ো ফুপুর সাথে প্রিয়তি চলে গেলো।তিনদিন পর খরচার দিন প্রিয়তি ওই বাড়িতে গেলো।তবে সেখানে থাকে নি।খরচা শেষ করে মায়ের জবর জিয়ারত করে আবার ফুপির বাসায় চলে এলো।এই তিনদিন কারো সাথে কথা বলে নি প্রিয়তি।সবাইকে বিরক্ত লাগছে তার।খাওয়া দাওয়াও তেমন করে না এখন।

আজ রাতেও কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।হঠাৎ মাঝরাতে শরীরে কারো হাতের ছোয়া পেতেই প্রিয়তি সজাগ হয়ে গেলো কিন্তু নড়াচড়া করলো না বুঝতে চেষ্টা করলো।কোনো একটা হাত প্রিয়তির পেটে চলাফেরা করছে।এবার এটা ধীরে ধীরে ওপর উঠতে নিলেই প্রিয়তি লাফিয়ে উঠে বসলো।সাথে সাথেই কেউ একজন উঠে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলো কিন্তু প্রিয়তি ওকে চেপে ধরে চিল্লাতে লাগলো।প্রিয়তির চিল্লনিতে ওর ফুপু আর ফুপাতো ভাইরা চলে এলো।তারপর রুমের লাইট জ্বালাতেই দেখলো প্রিয়তি যাকে চেপে ধরে রেখেছে সে ওর ফুপাতো ভাই ফয়েজ!সবাই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।সবচেয়ে বেশি অবাক প্রিয়তির ফুপু!

চলবে…

গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#গৃহযুদ্ধ -শেষ পর্ব
____________________________
জীবনটা অনেক অদ্ভুত৷ অন্তত রফিক সাহেবকে দেখে সেটাই মনে হচ্ছে। চরিত্র হারালে মানুষের সবকিছু হারিয়ে যায়৷ রফিক সাহেব সেটার জলজ্যান্ত উদাহরণ।রফিক নামের কোনো লোকের অস্তিত্ব কোনো কালে ছিলো কিনা সেটা মানুষ আস্তে আস্তে ভুলে যাবে, এমনকি রফিক নিজেও।অপরদিকে সুপ্তি! সুপ্তিকে সাক্ষাৎ মৃত্যুও ভোলাতে পারবেনা আমার মন থেকে। মানসিক অসুস্থতা একটা রোগ মাত্র। বাকি সবকিছুই সুপ্তির পৃথিবীতে আগের মত আছে৷ ভালোবাসাময় আছে।
ভালোবাসা এজন্যই সুন্দর। ভালোবাসা এজন্যই স্বর্গীয়।
অপরাধের কালো জগতে বিচরণ স্বল্প সময়ের জন্য মানুষকে লাভবান করে তুললেও, শেষ পরিনতি কখনোই ভালো হয়না। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ মিরাত।ভাড়াটে খুনী মিরাত নিজেরই কাছের এক ছোট ভাইয়ের হাতে নির্মমভাবে খুন হয়েছে।
বিনাদোষে যখন কাউকে খুন করা হয়,
তখন খুনীর একটু হলেও মন কাঁপে, হাত কাঁপে,মনের কোথাও একটা আফসোস হয়। কিন্তু অপরাধী লোকদের মারতে কারো হাত কাঁপে না,মায়া কাজ করে না।
আমি নিশ্চিত, মিরাতকে খুন করার সময় ওর খুনীর মনের কোথাও একটু আফসোস ছিলো না। ছিলো ঘৃণা ঘৃণা এবং ঘৃণা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে,শিক্ষা গ্রহণ জরুরি। রেশমি এবং রফিকের পুরো গেমটার দিকে তাকালে মনে হয়, উইনার একজন। সে হলো কাব্য। রফিক সাহেবের রেশমিকে খুন করার পরিকল্পনা যখন ব্যর্থ হয়, কাব্য রেশমির সাথে যোগাযোগ করে।ইনিয়ে বিনিয়ে রফিক সাহেবের কথা বলে বেশ মোটা অংকের টাকা নিয়ে যায় রেশমির কাছ থেকে। আর বেচারা রফিক সাহেবের অবস্থা!
রেশমির বিয়েতে সবাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও আমি মোটেও স্বাভাবিক ছিলাম না। রেশমি কারো সাথে ফোনে আমার ব্যপারে একটা কথা বলেছে ওটা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো বারবার।
আমি নিজে এমন কোন কাজ ই করিনি।
কিভাবে আমি মণিকা ভাবীর পেটের বাচ্চার বাবা হবো!
ধুর!
মনে কিছু একটা প্লান করতে করতে সুপ্তিকে বসে বসে সাজাচ্ছিলাম।
বিউটি ব্লেন্ডার দিয়ে যখন সুপ্তির মুখে প্রাইমার লাগিয়ে দিচ্ছিলাম ও বারবার নড়াচড়া করছিলো উঠে চলে যাচ্ছিলো।প্রাইমার লাগানো শেষে ওর মুখে ফাউন্ডেশন লাগিয়ে দিলাম,এরপর হালকা ফেস পাউডার দিয়ে বসলাম আই শ্যাডো নিয়ে।সুপ্তিকে যেহেতু নীল শাড়ি পড়াবো, তাই ঠিক করলাম ওর চোখের পাতার উপরে নীল রঙ এর শ্যাডো ব্যবহার করি।
নীল শ্যাডোর সাথে কম্বাইন্ড করে কালো আইলাইনার টেনে দিলাম ওর চোখে। সাজ শেষ না হতেই অদ্ভুত সুন্দর লাগছিলো সুপ্তিকে।
খেয়াল করে দেখলাম কোথাও যেন একটু কমতি লাগছে, পরে মনে পড়লো, ওহ মাশকারা লাগানো হয়নি। ওর বড় বড় পাঁপড়িতে সময় নিয়ে বসে বসে মাশকারা লাগালাম।
সব মায়াবি চোখের মেয়েরা নাকি কালো কাজল দিয়ে সাজে।
চোখের ওয়াটার লাইনে সুপ্তিকে আমি সাদা কাজল লাগিয়ে দিলাম।থাকনা কিছু বিষয় একটু আলাদা।
সাজানোর মূল কাজ শেষ, এরপর বাকি ছিলো কিছু টুকটাক কাজ,নাকের উপরে চিকন করে হাইলাইটার টেনে শেপ করে দেয়া,গালে হালকা করে ব্লাশ লাগানো ইত্যাদি ইত্যাদি।
লিপস্টিক চুজ করলো সুপ্তি নিজেই। গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক।
সবকিছু শেষে ওকে নিজ হাতেই শাড়ি পড়িয়ে দিলাম।
আমি নিজে পড়লাম একটা খয়েরী রঙের কাবলি, সাথে জিন্স এবং পায়ে স্নিকারস।
আয়নার সামনে দুজনে পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়ালাম। মনে হলো পৃথিবীর সবথেকে পরিপূর্ণ, সুন্দর, সুখী দম্পতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে।
সুপ্তি একটু আগেও কেমন ছটফট, বাচ্চামি করছিলো। শাড়ি পড়ার পরে সে হুট করেই একদম চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেলো।
” শাড়ি পোশাকটা জাদুকরী পোশাক।
একজন মেয়ে যত চঞ্চল,দুষ্টু কিংবা বেয়ারাই হোক না কেনো! শাড়ি পরলে তার মাঝে গাম্ভীর্যতা চলে আসবেই।”
দুজনে গায়ে বডি স্প্রে মেখে, একদম পরিপাটি হয়ে বের হলাম। ছাদে গান- বাজনা চলছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হই হুল্লোড় করছে। রান্না নিয়ে ব্যস্ত আছেন মণিকা ভাবীও। তার পুরোনো কিছু বান্ধবীরা এসেছে। বর ও বউ বসবে ছাদের বৃষ্টিবিলার নামক ছোট্ট কুটিরের বিছানায়৷
ছাদের খোলা জায়গায় সামিয়ানা টানানো হয়েছে।চেয়ার টেবিলেরও ব্যবস্থা হয়েছে। রেশমির যে ছেলের সাথে বিয়ে হবে, সে পেশায় একজন সাধারণ চাকুরিজীবী।খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ছেলেটা ভালোই।
ছাদে ওঠা মাত্রই ছোট বাচ্চা ছেলেমেয়েরা এসে সুপ্তিকে ঘিরে ধরলো। হাসতে হাসতে সুপ্তি আমাকে ছেড়ে ওদের মাঝে মিশে গেলো। আমি এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
দূর থেকে সুপ্তির চাঁদের মত হাসি দেখে আমি বহুবার ওর প্রেমে পড়লাম।
মৃদু স্বরে মুখে গান চলে আসলো,
তোমার হাসির শ্রাবণ ঢলে,
স্বপ্ন নিয়ে ভাসতে চাই……
মণিকা ভাবী দূর থেকে আমাকে ও সুপ্তিকে দেখতে লাগলেন।
রান্নার পাত্রে খুন্তি নিয়ে জোরাজুরি দেখে বুঝলাম ঝড়টা ওনার মনেও চলছে খুব জোড়ে৷
মণিকা ভাবী যখন আমার দিকে তাকালো,
ওনাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলাম।
সুপ্তি বাচ্চাদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠেছে।
ভাবীকে বললাম নিচে,ওনার বাসায় আসতে।
ভাবী রান্নার দায়িত্ব ওনার সহযোগীর হাতে দিয়ে আমার সাথে নিচে আসলো। ওনার বাসায়৷
বারান্দার টেবিলটায়, মুখোমুখি হয়ে বসা আমি এবং মনিকা ভাবী।
ওনাকে হাসিমুখে বললাম,
ভাবী, আপনি আমার নামে গুজব কেনো ছড়াচ্ছেন?
– কি গুজব রোহান?
– আপনি প্রেগন্যান্ট?
– কিসব প্রশ্ন করছো তুমি?
– সরি ভুল হয়েছে, প্রশ্ন করা ঠিক হয়নি।
নিশ্চিত হয়েই বলছি, আপনি প্রেগন্যান্ট।
আপনি গাইনী ডাক্তার শারমিন আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন। তার কাছ থেকেই নিশ্চিত হলাম।
কথাটা শুনেই লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন মণিকা ভাবী।
দাঁড়ানোর কারণও আছে যথেষ্ট। ডাঃ শারমিন আহমেদের কাছে গিয়ে ওনার স্বামীর নামের জায়গায় রোহান মাহমুদ লিখিয়েছেন তিনি।
মণিকা ভাবী আমাকে বললেন,
রোহান, এ বিষয়ে আমি আর কথা বলতে চাইনা।
– ব্যপারটি হাস্যকর ভাবী৷
– আমি জানি। আমি দুঃখিত, তোমার নাম ওখানে লেখানো উচিত হয়নি।
– রেশমিকেও আপনি আমার কথা বলেছেন? কিন্তু কেনো?
– এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করোনা রোহান। আমি কথা দিচ্ছি, আমি আর তোমাকে কখনো কোন কিছুতে জড়াবো না। কিন্তু তুমি যদি এ বিষয়ে আমাকে আর একটি প্রশ্ন করো, আমি সুইসাইড করবো।
এবং এটাই সত্যি।
মণিকা ভাবীর চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছিলোনা। তার বয়সের ছাপ নিজের চেহারায় ফুটে উঠেছে আজ। হুট করেই একটা তরতাজা গোলাপ যেনো কেউ আগুনে পুড়িয়ে ফেললো, মণীকা ভাবীর চেহারা ঠিক ঝলসানো গোলাপের মত হয়্র গেছে।
তিনি উঠে চলে গেলেন। যখন দরজা থেকে বের হবেন, ঠিক তখনই বললাম, রবীন!!
মণিকা ভাবী আবারো আমার দিকে তাকালেন। তার চোখদুটো বিষ্ফোরিতো অবস্থায় আছে।
ঠান্ডা গলায় বললাম, ভয় নেই ভাবী।
আমি কাউকে বলবো না। কাউকে জানাবো না।
মণিকা ভাবী বললো, কি জানো তুমি রোহান?
আমার পেটে রবিনের বাচ্চা এটাই তো বলতে চাচ্ছো?
– তা তো বটেই।
তবে আমি আরো ভয়ানক কিছু জানি।
মণিকা ভাবীর কপাল থেকে ঘাম বেয়ে পড়ছে। অস্পষ্ট গলায় বললো, কি জানো তুমি?
একটা সিগারেট ধরালাম। বললাম এক-কাপ চা বানিয়ে আনুন, আজ আপনার সাথে গল্প করবো।
.
.
.
.
বাসায় কেউ নেই।
রেশমি পার্লারে গিয়েছে ব্রাইডাল সাজের জন্য।বাকি সবাই ছাদে, সুপ্তির জন্য চিন্তা হচ্ছে মাথায়। বেচারি উল্টাপাল্টা কিছু না করে ফেলে আবার! বাড়ি ভরা মেহমানের সামনে সুপ্তি যদি উল্টাপাল্টা কিছু করেও ফেলে, তাতে আমার আফসোস নেই,বউকে নিয়ে বিন্দুমাত্রও অপমান বোধ হবেনা। মানসিক অসুস্থতা রোগ মাত্র, কোনো অপরাধ না।
মণিকা ভাবী চা আনলো দু-কাপ।
এক কাপ ওনার নিজের জন্য আরেক কাপ আমার জন্য।
উনি পুনরায় আমার সামনে বসলেন। মাত্রাতিরিক্ত ঘামছেন।
ওনাকে বললাম আমি গল্প শুরু করলে আপনার চা খাওয়া আর হয়ে উঠবে না। এজন্য এক কাপ আনতে বলেছিলাম।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
সিগারেটে টান দিয়ে পায়ের উপর পা উঠিয়ে বসলাম।
চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
আপনার চোখে কিছু একটা খেলা করছে। ভয় নাকি হিংস্রতা আমি বুঝছি না।
মণিকা ভাবী বললেন,
রোহান, তোমাকে যতটা বোকা আমি ভেবেছিলাম ততটা তুমি নও।
আমি হাসলাম।
“রবিনের লাশটা আধ-পচা অবস্থায় আমি কবর দিয়েছি ভাবি। আপনার বাসার পেছনেই, গর্ত করে৷ ”
মণিকা ভাবির মেরুদণ্ড বেয়ে যেনো শীতল একটা শিহরণ নিচে নেমে গেলো। তিনি এখন আর ঘামছেন না। ভয়ে জমে গেছেন।”
বলতে থাকলাম-
” আপনার এ পাঁচতলা বাড়িটিতে আপনি কেনো কোনো লোকজন ভাড়া দেন না, বিষয়টা নিয়ে আমার মাঝে বেশ কৌতূহল ছিলো। আমার মনে আরো কিছু প্রশ্ন আছে। আমি সেগুলো পরে আপনার কাছে উপস্থাপন করবো।
যাই হোক,
ফুলীর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আমি হাতে পেয়েছিলাম।
ওকে ধর্ষণ করা হয়নি। একটা মেয়েকে ধর্ষণ যদি না করা হয়, তবে তাকে উলঙ্গ করে খুন করার মানে হয়না। সুপ্তির যোনীতে একটা মদের বোতল ঢুকানো ছিলো।
হু…..
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম।
সিগারেট হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম বারান্দায়।
ভাবি?
– জ্বী!
– আপনি ছেলেদের মাঝে বিশেষ একটা কিছু দেখে তাদেরকে আপনার বাড়ি ভাড়া দেন। তাইনা?
মণিকা ভাবি চুপচাপ রইলেন।
– আমি আসলে খুঁজছিলাম, রবিন আর আমার মাঝে কি মিল আছে? এবং আমি পেয়েও গেছি। আমাদের দুজনেরই জোড় ভ্রু! মানে আমাদের দুই ভ্রুর মাঝে কোনো ফাঁকা নেই৷ লোম উঠে জোড়া লেগে গেছে৷
মণিকা ভাবি এক আকাশ কনফিউশন নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমি আমার কথা চালিয়ে যেতে লাগলাম,
রবিন বাসা ভাড়া নেয়ার পরে আমি আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন লোককে পাঠিয়েছি আপনার ফ্লাটে বাসা ভাড়া নেয়ার জন্য। অবশ্য আমি একটা বিষয় জানার জন্য এমনিতেই তাদের পাঠিয়েছিলাম।
কিন্তু আপনি তাদের বলেছেন রুম খালি নেই। অথচ খালি ছিলো।
আমি তখনই শিওর হই,যে আপনি আসলে নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে আপনার ফ্লাটে ভাড়া দেন সবাইকে না।
এরপর আমি আমার এবং রবিনের মাঝে মিল খুঁজতে শুরু করি। দেখতে পাই, আমার ও রবিনের একটা বিষয় কমন, সেটা হলো আমাদের দুজনেরই জোড় ভ্রু।
প্লান অনুযায়ী আমি জোড় ভ্রু আছে এমন একজন লোককে খুঁজে বের করি এবং আপনার কাছে বাসা ভাড়া নিতে পাঠাই।
আপনি তাকে বাসা ভাড়া দিতে রাজি হন। আমার ধারণা সত্য হয়৷
যাই হোক,
এবার আসি ফুলী প্রসংগে।
ফুলীর ব্যপারে বলতে গেলে, ঘটনার আরো একটু গভীরে যেতে হবে।
আমি যখন আপনার বাসার ছাদে বৃষ্টি বিলাসে ছিলাম, রেশমির সাথে কথা বলছিলাম, পুরো বিষয়টি আপনি আপনার ফোনে ভিডিও করেন। আমার অগোচরেই।
তখন রেশমি আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে। ওটাও রেকর্ড হয়। এবং আপনি সেই মুহূর্তের স্ক্রিনশট নিয়ে ফেক আইডি দিয়ে আমার স্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য কি ছিলো সেটা আমি বুঝেছি। আমার এবং আমার স্ত্রীর সম্পর্কের মাঝে ফাঁটল তৈরি করা। আপনি চেয়েছিলেন আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে।
আপনি হয়ত ভুলে গেছিলেন আপনি আমাকে আগেও টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছিলেন।
সুপ্তিকে ছবির সাথে যে লেখাগুলো পাঠিয়েছেন, সে লেখাগুলোর সাথে আমাকে মেসেজ পাঠানো লেখার টাইপিং স্টাইল হুবুহু মিলে যায়। এজন্য আমার বুঝতে কষ্ট হয়নি,কাজটা আপনার।
বারান্দায় থাকা একটা ক্যালাডিয়াম প্লান্ট এর চারা হাতে নিলাম।কাঁচের বোতলে শুধু পানিতেই বেড়ে উঠছে চারাটি। মাটির দরকার হচ্ছে না।
বোতলসহ চারা গাছটি এনে ভাবির সামনে রাখলাম।
মণিকা ভাবির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, ভাবি!
রবিনের সাথে নিজে টাকা খুইয়ে ঘুরেছেন,কেনাকাটা করেছেন, অবৈধ সম্পর্ক করেছেন,সেক্স করেছেন৷
তাহলে খুন কেনো?
ওকে খুন কেনো করলেন?
মণিকা ভাবি চিৎকার করে বলে,
“না আমি করিনি খুন ওকে। ”
-মিথ্যা বলে লাভ নেই ভাবি।
ক্যালাডিয়াম প্লান্ট এর চারা বোতল সহ হাতে তুলে নিলাম।
কাঁচের বোতলটির গায়ে লেখা- এবসুলুট ভদকা,
ফুলীর যোনীতে ঢুকানো ছিলো ঠিক এরকম ই একটি বোতল। এবসুলুট ভদকার বোতল মণিকা ভাবির বাসায় বেশ কয়েকটি দেখেছি আমি।
মণিকা ভাবিকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুরু করলাম,
রবিনকে যে আপনি খুন করেছেন, এ সন্দেহ জাগার পেছনে অনেক কারণ আছে।
প্রথমত – আপনার বক্তব্য ছিলো আপনি চার ঘন্টা যাবৎ ফুলীকে পাচ্ছেন না। একটা মানুষ যে আপনার বাসায় কাজ করে সারাক্ষন চোখে চোখে থাকে সে চার ঘন্টা যাবৎ নেই আর আপনি চার ঘন্টা পরে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে এসেছেন এ বিষয়টাই খটকা লেগেছিলো আমার। যখন ফুলীর লাশ দেখি, ওর নিম্নাংগে ঢুকানো বোতলটার মত একই রকম বোতল আমি শুধুমাত্র আপনার বাসাতেই দেখেছিলাম। যদিও এসবকিছুর উপর ভিত্তি করে আপনাকে সরাসরি খুনী বলা যায়না। তাই আমি সার্চ শুরু করি।
যদি আপনি রবিনকে খুন করেই থাকেন, তবে অবশ্যই বাসার এড়িয়ার মধ্যে কোথাও ওর লাশ রেখেছেন, এ চিন্তা থেকেই আমি সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করি।
এবং পেয়েও যাই।রবিনের লাশ পাই আমি বাসার পেছনের সেফটি ট্যাংকের ভেতরে।
ততদিনে লাশ পঁচে গেছে। গা ধরলে মাংস খসে পড়ে এমন। তবুও আমি যেভাবে পেরেছি উঠিয়েছি। উঠিয়ে কবরের ব্যবস্থা করেছি। ভাবতেও গা শিউরে উঠছে, শুধু রবিন নয়, আপনি খুন করেছেন ফুলীকেও।
পুলিশ যাতে আপনাকে কোনো ভাবেই সন্দেহ না করে তাই আপনি নিজে আপনার টাকা-পয়সা গহনা সরিয়ে এমন ভাব নিলেন যেনো রবিন সব চুরি করে নিয়ে গেছে।
সুন্দর মুখশ্রীর আদলে আপনার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জঘন্য পৈচাশিক সত্তা।
হয়ত, আপনার শিকার আমিও হয়ে যেতে পারতাম।
কিন্তু হইনি। এটা সুপ্তির ভালোবাসার জোড়।
ওর ভালোবাসার জোড়ে আমি বেঁচে আছি,বেঁচে গেছি।
এবার আপনার কাছে আমার প্রশ্ন, বলুন,রবিনকে কেনো হত্যা করেছেন?
মণিকা ভাবী বিমর্ষ দৃষ্টি নিয়ে বললো,
– রোহান, একাকিত্ব বিষয়টা খুব ভয়ানক। আমি একাকিত্বে ভুগি। খুব বেশি একাকিত্বে ভুগি।
আমার এমন কিছু কথা আছে, যা আমি কাউকে শেয়ার না করে পারিনা।
কিন্তু কেউ যদি জেনে যায় তারপর সেটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমি তাকে সরিয়ে দেই পৃথিবী থেকেই।তুমি সবকিছু কিভাবে বুঝে গেলে আমি তা জানিনা,
তুমি খুব চালাক।
আমার যে ডায়েরিটা তোমাকে পড়তে দিয়েছিলাম, ওটাতে আমার গোপন একটা কথা লেখা আছে।
রবিন ডায়েরীটা শেষ করার আগে ওর সাথে আমি মিশেছি, সবটা দিয়ে মিশেছি। ও যা চেয়েছে দিয়েছি, টাকা পয়সা,যৌনসুখ.. সব।
কিন্তু আমার ডায়েরি যেদিন ও পড়া শেষ করলো, সেদিন ই ওকে চায়ের সাথে হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই। এরপর শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলি৷ ফুলী পুরো ব্যাপারটা লুকিয়ে দেখে ফেলেছিলো। তাই ওকেও রেহাই দেইনি৷ আর সত্যি বলতে আমার এতে একটুও আফসোস নেই।
– আমাকেও কি রবিনের মত মেরে ফেলতেন?
– হ্যাঁ। তুমি ডায়েরীটার শেষ পাতা পডলেই তোমাকে মেরে ফেলতাম।
– কিন্তু আমি তো পড়ে ফেলেছি। আপনি হয়ত টের ও পাননি। লুকিয়ে লুকিয়েই আমি পড়েছি৷
মণিকা ভাবি আমার দিকে অশ্রুসজল নয়নে তাকিয়ে রইলেন। কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন,
এর মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকলো রেশমি। সাথে আরো কয়েকজন মহিলা। সবাই এসেই তোড়জোড় শুরু করে দিলো।রেশমি খুব খুশি। আজ তার বিয়ে খু্শি তো হবার ই কথা।
আমি বের হয়ে আসলাম।
সুপ্তির কাছে চলে এলাম। সে আমাকে দেখেই বাচ্চাদের মাঝ থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। বরযাত্রী আসলো আরো অনেক্ষন পরে।
কাজী আসলো, বিয়ে পড়ালো, হৈ হুল্লোড় হলো।
খাওয়াদাওয়া পর্বের সময় হঠাৎ মণিকা ভাবী নিঁখোজ।
রেশমির বিয়েতে কারো খাওয়াদাওয়া হয়নি। মণিকা ভাবীর যত্ন নিয়ে রান্না করা স্বাদযুক্ত খাবার অবহেলায় নষ্ট হয়ে গেলো৷ কেউ ছুঁয়ে দেখার সাহস ও পায়নি। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন আচমকাই শোনা গেলো বিকট এক আওয়াজ- চিৎকার, এরপরপিনপতন নিরবতা। মণিকা ভাবী ছাদ থেকে লাফ দিয়েছেন।
নিচে দেয়ালের উপরে লাগানো খাড়া খাড়া রডের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে ছিলো ভাবীর নিথর দেহটি। সুঁচালো রডের মাথা তার পেটে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। কি বীভৎস দৃশ্য।
সুপ্তিকে আমি কিছু দেখতে দেইনি।
ঘটনার পরে আমরা বাসা ছেড়ে দেই।
মণিকা ভাবির বিল্ডিং এ একটা পাপ চক্র শেষ হলো। শেষ হলো অনেক ধ্বংসের মাধ্যমে।
সব পাপচক্রই- শেষমেষ ধ্বংস কিংবা মৃত্যু দিয়ে শেষ হয়।
রেশমি দম্পতি নিজেরা একটা ফ্লাট কিনে উঠে পরে সেখানে। আমরা নতুন একটা জায়গায় বাসা ভাড়া নেই৷
সুপ্তি সুচিকিৎসায় আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠতে শুরু করে। তবে হাই পাওয়ারের ঔষধের প্রভাবে ওর রাগ বেড়ে যায়৷
বাসায় ভাংচুর, অযথা ঝগড়া,এমনকি আমার গায়ে হাত তোলাও চলে।
তবে একটা কথা কি!
ভালোবাসার মানুষটা যখন খুব ভদ্র ছিলো তখনো ওকে আমি প্রচন্ড ভালোবেসেছি।
যখন পাগল ছিলো তখনো প্রচন্ড ভালোবেসেছি।
আর এখন এই রগচটা বউটাকেও প্রচন্ড ভালোবাসবো৷ ভালোবাসা পরিবর্তন হয়না। বরং বাড়ে। দিনে দিনে বাড়ে।
.
.
.
রেশমির অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।
তার ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছিলো।
ফলশ্রুতিতে তার বুকের স্তন দুটোই কেটে বাদ দিতে হয়েছে। তবুও ক্যান্সার থেকে মুক্তি মেলায়, সে বহু খুশি।
এদিকে খুশি আমিও কারণ রেশমির ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়নি। ও সাধারণ বুকে ব্যাথার জন্য ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলো৷ পরে সেই ডাক্তারকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে রেশমির রিপোর্টে ব্রেস্ট ক্যান্সারের জটিল অবস্থা দেখানো হয়েছে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছে ওর স্তন কেটে ফেলার জন্য। রেশমি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিজের স্তন কেটে ফেলতে সম্মতি জানায়৷
সুপ্তির উলঙ্গ ছবি তোলার জন্য এই শাস্তিটুকু ওর প্রাপ্য ছিলো৷ এখন একটুখানি অপূর্ণতায় সারাজীবন ডুবে থাকো রেশমি।
.
.
.
আমাদের ফ্লাটের পাশের ফ্লাটেই নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভদ্রলোকের স্ত্রী আমাদের
বাসায় এসে সেধে সেধে কথা বলে। একদিন সুপ্তি ওয়াশরুমে ছিলো, ভাবী এসে আমাকে বললো,
ভাইয়া আপনার বউ তো গান গাইতে পারেনা। আমি গান গাইতে পারি। শুনবেন?আপনার নাম্বার টা দেন।
মুচকি হেসে উঠে গেলাম। ভাবলাম আবার আমার জীবনে হয়ত আসতে চলেছে নতুন এক গৃহযুদ্ধ।
হাসতে হাসতেই পৃষ্ঠা উল্টালাম,
মণিকা ভাবীর ডায়েরির শেষ পাতা।
শেষ পাতার লেখাগুলোর মাঝে অতিপ্রাকৃত কিছু আছে হয়ত। নইলে আমি এতবার পড়ছি কেনো!
শুধুমাত্র এ লেখাটুকুর জন্য প্রাণ গেছে অনেকের। ফুলী রবিন সহ অনেকেই হয়ত মণিকা ভাবীর শিকার হয়েছেন। আমার ধারণা ভাবীর নিজের স্বামীও খুন হয়েছেন তার হাতেই।
সবশেষে একটা বিষয় মনে হলো। পৃথিবীতে দু-ধরণের মানুষ পৃথিবীতে টিকে থাকে,
এক- যারা কাব্যের মত সুবিধাবাদী এবং ধূর্ত।
দুই- যারা আমার মত মুখোশের আড়ালে থাকে।
#সমাপ্ত

#গৃহযুদ্ধ – শেষ পর্ব
__________________

গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৭

0

#গৃহযুদ্ধ
পর্ব ১৭
_______________
গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সুপ্তির চড় দেয়ার কারণ এবং মণিকা ভাবীর কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
সুপ্তি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
মণিকা ভাবী আমাকে বললো! রোহান ফুলীকে পাচ্ছিনা।
জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে খুলে বলুন।
‘ আমি কিছুই জানিনা। বেশ কয়েকঘন্টা আগে ফুলী বারান্দার গাছগুলোয় পানি দিচ্ছিলো। আমি একটা গান ছেড়ে চা খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘন্টা দুয়েক পর ঘুম ভাংগে। উঠে দেখি ফুলী নেই৷ প্রায় দু ঘন্টা পার হতে চললো ওকে কোথাও খুঁজে পাইনি।
– ও কি বাইরে গেছিলো বা এমন কিছু?
– না বাইরে গেলে ও বাসার পোশাক পরে যায়না৷ ওর বাইরে যাওয়ার সব পোশাক ই গোছালো আছে। মনে হয়না এমন কিছু৷
– তাহলে আপনার কি মনে হয়?
বুঝতে পারছিনা।
– ছাদে খুঁজেছেন?
– হ্যাঁ। গিয়েছিলা।
ছাদে রেশমিকে দেখলাম বৃষ্টি বিলাসে ঘুমাচ্ছে। ফুলীকে পাইনি।
– রবিন তো আপনার বাসাতেই থাকে প্রায়শ। ও কোথায় আজ আপনার বাসায় যায়নি?
– না রবিন বাসায় যায়নি।
ওকে গিয়েও একটু জিজ্ঞেস করে দেখুন তো!
আমার ও মণিকা ভাবীর কথোপকথন শুনে সুপ্তি আবারো দরজার কাছে আসে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি চোখগুলোতে আগুন ঝরছে। মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে আমাকে মেরে ফেলবে।এমন পরিস্থিতি যেন মনে মনে ভাবছে মণিকা ভাবী সামনে থেকে একবার সরুক! তোর একদিন কি আমার একদিন।
গরম ভাত চুলো থেকে নামিয়ে রেখে দিলে যেমন আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায়, রাগের ব্যপারটাও তেমন।সময় আস্তে আস্তে কেটে গেলে তীব্র রাগও হালকা হয়ে আসে। সুপ্তির হাত থেকে বাঁচতে মণিকা ভাবীকে বললাম, চলুন ভাবী আপনার সাথে আমিও ফুলীকে একটু খুঁজি। রবিন ভাইয়ের কাছে এ বিষয়ে একটু খোঁজ খবর নেই চলুন। মণিকা ভাবী বললো- আচ্ছা চলো। সাথে সুপ্তিকেও ডাকলো।
সুপ্তি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাসা থেকে বের হলো।
রবিনের বাসার সামনে গিয়ে বেশ কয়েকবার কলিং বেল বাজালাম।
কেউ দরজা খুললো না।
মণিকা ভাবীর চোখে আতংক, উৎকন্ঠা।
সুপ্তির মাথায় রাগ জমে আছে। নিচে দিয়ে বেয়ে আসা রক্তের ফোয়ারা কেউ খেয়াল করলো না। কি মনে করে যেনো দরয়ার উপর হাত দিয়ে ধাক্কা দিলাম।
ক্যাচ-ক্যাচ শব্দ করে ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে গেলো৷
এরপরের দৃশ্যটা খুবই ভয়াবহ।
ফুলীর একটা কাটা হাত পড়ে আছে দরজার কাছে।
বাকি দেহটা বিছানার উপরে৷ গায়ে জামাকাপড় নেই। উদোম নাকমুখ সহ পুরো দেহে খামচির দাগ, গালের একপাশ থেকে মাংস উঠে দাঁত বের হয়ে গেছে।
সবথেকে বিভৎস দৃশ্য যেটা, ফুলীর নিম্নাংগে প্রবেশ করানো হয়েছে একটা মদের কাঁচের বোতল।
রবিন নেই কোথাও। ধপাস করে শব্দ হলো৷ পেছনে ফিরে দেখলাম সুপ্তি পড়ে গেছে। মনীকা ভাবী কান দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে একটা চিৎকার দিলেন। ভয়ানক চিৎকার। চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলো রেশমি।
এসে বাসার ভেতরে একপলক তাকিয়েই ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরলো সে। ফোন দিলো নিকটস্থ পুলিশ অফিসে।
.
.

পুলিশদের আমার বরাবর বিরক্ত লাগে।
সুপ্তির জ্ঞান ফেরেনি। ওকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে। আমাকে অনেক প্রশ্ন করলো তারা। মণিকা ভাবীর কাছে রবিনের ডকুমেন্টস চাইলো। বাসা ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়ার ডকুমেন্টস রাখা খুব জরুরি। মণিকা ভাবী ডকুমেন্টস দিলো। পুলিশ সেগুলো নিয়ে চলে গেলো৷ ফুলীর লাশও নেয়া হলো পুলিশি হেফাজতে, ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করতে।
পুলিশ যাওয়ার কয়েকঘন্টা পরে মণিকা ভাবী টের পেলো তার আলমারিতে রাখা সোনা গহনা নগদ অর্থ যা ছিলো, একদম কিছুই নেই। সব শূন্য।
যদিও বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ করেন নি তিনি। টাকাপয়সা অনেক আছে তার। রেশমি ছাড়া আমরা কেউ ই এখন আর স্বাভাবিক মন মানসিকতায় নেই। ফুলী মেয়েটার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। এমন ফুটফুটে একটা মেয়ে চোখের সামনে শুভ্র খরগোশের মত আনন্দে লাফালাফি করতো! তার কি অবস্থা দেখতে হলো নিজের চোখে৷
ফুলীকে আমি কখনো কান্না করতে বা মন খারাপ করতে দেখিনি। সবসময় হাসিখুশি দেখেছি!ওকে যখন অত্যাচার করা হয়েছিলো তখন ওর কান্না মাখা মুখটা কেমন ছিলো তাও কল্পনা করতে পারছিনা।
কিছুই ভালো লাগছেনা। মণিকা ভাবীর পুরো বিল্ডিং জুড়ে বিষন্নতা। সোফায় আমার পাশে বসে আছে রেশমি। ডিম লাইটের আলোয় রেশমি লাইটার খুঁজে সিগারেট ধরালো।। আহ, কি বিষাক্ত জীবন!
সুপ্তির চড় মারার কারণ বুঝে উঠতে পারলাম না।
ওর ফোন ধরে ঘাটাঘাটি করতে করতে মেসেঞ্জারে ঢুকলাম৷ সর্বশেষ যে মেসেজটি এসেছে, তা একটা ফেক একাউন্ট থেকে।
রেশমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে এমন একটি ছবি ওকে পাঠানো হয়েছে।
বৃষ্টির সাথে ছবিটার ক্যাপচার দেখে খুব রোমান্টিক কাপল বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু ওই এটা তো একটা এক্সিডেন্ট ছিলো।
কে করলো এই কাজ! রবিন? নাকি মণিকা ভাবি? এ দুজন ছাড়া ছাদে যাওয়ার তো কথা না কারো।
এ ছবিটা দেখেই হয়ত রাগে ফুলে ছিলো সুপ্তি।
জীবনটা আর সহজ নেই। বিষময় হয়ে উঠেছে। এ বাসায় আর থাকা যাবেনা। সিদ্ধান্ত নিলাম বাসা ছেড়ে দিব। রেশমিকে বলবো,নিজের ঠিকানা খুঁজে নিতে।
.
.
.
সুপ্তির জ্ঞান ফিরেছে।
তবে ও ভালো নেই। ওকে সুস্থ বলা যাচ্ছে না। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই ও প্রলাপ বকছে। গালি দিচ্ছে। মাঝে মাঝে একা একাই হাসছে। আমি ওর কাছে গেলে ও কিছুক্ষনের জন্য চুপ থাকে৷ এরপর কান্না করে৷ পরক্ষনেই আবার হাসে। রেশমি এবং মণিকা ভাবীর ভাষায় সুপ্তি পাগল হয়ে গেছে।
ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে। মণিকা ভাবী তার পরিচিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করেছেন।
ব্যয়বহুল চিকিৎসা, তবে খরচ নিয়ে আমাকে ভাবতে হবেনা। মণিকা ভাবী বলেছেন খরচ উনি দিবেন। ভাবী বাসায় একা থাকতে ভয় পায়। রেশমিকে তিনি সাথে রাখেন। আমার বাসায় থাকি আমি আর সুপ্তি। সুপ্তির থালা বাসন ছুড়ে ফেলা,আমাকে মারধর করা খামচি দেয়া, মাঝ রাতে দরজা খুলে হঠাৎ বাইরে বের হয়ে যাওয়া, এসবে আমার মোটেও বিরক্ত লাগেনা। কিন্তু খুব কষ্ট হয়। মেয়েটার কাছে এই পৃথিবীটা এখন কেমন? ভাবতে খারাপ লাগে।
আচ্ছা পাগলদের কাছে পৃথিবীটা কেমন হয়?
তারা হাসে, আবার পরক্ষনেই কাঁদে কেনো!
তাদের অনুভূতি গুলো এত মিশ্র কেনো!
সুপ্তি দিনশেষে ঘুমায়।
আমার কোলের ভেতরে ঢুকে বিড়ালের মত কাচুমাচু করে ঘুমায়। নিজেকে খুব পরিপূর্ণ লাগে তখন।
বেশ অনেকদিন,
সুপ্তির সাথে আমার কোন প্রকারের শারিরীক সম্পর্ক নেই। অথচ এ বিষয়টি আমার চিন্তায় ও আসে না। বরং অবুঝ সুপ্তির কপালে চুমু এঁকে দিতে আমার খুব ভালো লাগে। কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সুপ্তির রান্না করতে হয়না। রান্না করে মণিকা ভাবী। সুপ্তিকে মাঝে মাঝে নিজ হাতেও খাইয়ে দেয়। আমাদের দুজনার জন্য উনি নিজ হাতে রান্না করেন।মণিকা ভাবী একদিন সুপ্তিকে খাইয়ে দেয়ার সময় বললেন, রোহান, আসো তোমাকেও দু লোকমা খাইয়ে দেই। বলে তিনি নিজেই খাবার নিয়ে আমার কাছে আসলেন। আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলেন। এরপর সুপ্তিকে যখন আবার খাওয়াতে গেলেন সুপ্তি মনিকা ভাবীর হাত থেকে খাবারের প্লেট ছুড়ে ফেলে দিলো। তারপর বাচ্চাদের মত হাসতে লাগলো।
পাগলদের কি নির্দিষ্ট কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মে?
.
.
.
মণিকা ভাবী এবং রেশমির খুব বেশি ভাব হয়ে যায়। তারা একে অপরের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকে সব সময়। রেশমি এর মাঝে আরেকটি ছেলের সাথে রিলেশনে জড়ায় এবং সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করে নিবে। মণিকা ভাবী নিজের বাসার ছাদে বিয়ের আয়োজন করে।
আমি মণিকা ভাবীকে আগেই জানিয়ে রাখি,
এলাকার ছোট খাটো সব ছেলেমেয়েদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি রাজি হন। সিদ্ধান্ত নেই সুপ্তিকে একটা আসমানী রঙ এর শাড়ি পড়িয়ে ছাদে নিয়ে যাবো৷
অবশেষে রেশমির কাঙ্ক্ষিত দিন আসে। ছোট ছোট পথশিশুরা আগেই এসে হই হুল্লোড় শুরু করছে। সেই সাথে এসেছে মাথায় লম্বা চুল গায়ে ছেডা জামা ও প্যান্ট পড়া একটা মধ্যবয়সী পাগল।
দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরে বুঝলাম, পাগল লোকটি রেশমির প্রাক্তন হাজবেন্ড রফিক সাহেব।
পুরো বাড়িতে কেমন একটা আনন্দ আনন্দ ভাব। রেশমি ফোনে কথা বলছে।আমি কখন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি তা খেয়াল করেনি রেশমি। ফোনের ওপাশের মানুষটার কাছে বলতে শুনলাম,
” মণিকা ভাবী! উনি তো অন্তঃসত্ত্বা। আমার মনে হয় রোহান কিছু করেছে। মণিকা ভাবী আমাকে সেটাই বললো। ”
রেশমির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম আমি।
.
.
চলবে…
লেখকঃ Hasibul Islam Fahad

গৃহযুদ্ধ পর্ব-১৬

0

#গৃহযুদ্ধ পর্ব ১৬
____________
__________________

রেশমিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে সুপ্তি। আমার কাছে বেশ কয়েকবার প্রশ্ন করেছে, আচ্ছা! ও চলে যাবে কবে!
আমি কোনো উত্তর দেইনি। যাদের ভালোবাসা নির্ভেজাল থাকে, তারা বিশ্বাসঘাতক কোনো ব্যক্তিকে একদম ই সহ্য করতে পারেনা।আমি ওকে বুঝাই, এখন রেশমি এখানে আছে, সেফ আছে। বাইরে কোথাও গেলে ওর জন্য ঘোর বিপদ। বেচারির জীবনটাই হয়ত চলে যাবে।
সুপ্তি আমার সাথে রেশমিকে নিয়ে আর কথা বাড়ায় না।
কিছুক্ষন পরে আমাদের সেভিংস এর রাখা স্বল্প কিছু টাকার পুরোটাই সে রেশমির হাতে তুলে দেয় এবং বলে, আমার জন্য যা করেছিস, সেটার ঋন আমি কখনোই শোধ করতে পারবো না। কিন্তু ঋণের বোঝা একটু হলেও হালকা করতে চাই৷
রেশমি উত্তরে কোন কথা বলে না। সুপ্তি রেশমির ব্যাগে টাকাগুলো রেখে দেয়।
এরপর থেকে সুপ্তি ওকে একেবারেই এড়িয়ে চলে। কারণ ব্যতীত ওর সামনে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। রেশমিও বাসায় খুব কম থাকে। সে অধিকাংশ সময় কাটায় বাড়ির ছাদে পায়চারী করে।
.
.
.
কাজের প্রতি ডেডিকেটেড এবং পরিশ্রমী হওয়ার সুবাদে সুপ্তিকে ওর পূর্বের অফিস থেকে বেশ কয়েকবার কল করে ডাকা হয়। আমার সাথে আলাপ আলোচনা করেই সুপ্তি তার পূর্বের অফিসে পুনরায় চাকরি করা শুরু করে।
খাওয়াদাওয়া নিয়ে এখন কষ্ট অনেকটাই কম হয়। সকাল ও দুপুরে রান্নার কাজটা সামলায় রেশমি।
এদিকে আমি মণিকা ভাবীর রান্নার স্বাদ কিছুতেই ভুলতে পারছিনা। শালা রবিন এসে আমার কপালটা পুড়িয়ে দিলো। পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে শিওর হয়েছি রবিন পুরো দিনের অধিকাংশ সময়ই মণিকা ভাবীর সাথে কাটায়। দু’দিন একসাথে শপিং এও গেলো।
মনে মনে একটু অপমানিত বোধ করলাম! রবিন আমার থেকে কোন দিক দিয়ে বেটার!মানলাম রবিনের চেহারা সুন্দর। কিন্তু ছেলেদের এত বেশি সুন্দর মানায় নাকি!
নাহ, নিজের প্রতি আমার একদম ই খেয়াল নেয়া হয়না। আমাকে আরেকটু স্মার্ট হতে হবে।
.
.
বাসার পাশের সাজিদ চাচার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছি,
হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হলো রবিন।
এসে একটা সিগারেট নিলো। আমার পাশে পায়ের উপর পা উঠিয়ে বসে বললো,
কি অবস্থা ভাই, আপনি আমাদের বিল্ডিং এ থাকেন না?
– আপনাদের বিল্ডিং মানে?
– ঐতো, মণিকার বিল্ডিং এ আপনাকে দেখেছিলাম একদিন।
মনে মনে বললাম,
“শালা সারাদিন মণিকা ভাবীর বাসায় সময় কাটালে আমাকে দেখবি কিভাবে! আমি তো ঠিক ই তোকে দেখি।”
মনের কথা মনে চেপে রবিনকে বললাম,
হ্যাঁ ভাই।আমাদের বাসস্থান একই বিল্ডিং এ।
– বেশ, বেশ। রবিন,সাজিদ চাচার দিকে তাকিয়ে বললো, ভাইয়ের কতটাকা বিল হয়েছে?বলুন। আমি দিয়ে দেই।
বাঁধা দিলাম রবিন কে।
বললাম,
কেনো? আপনি আমার বিল কেনো দিতে যাবেন?😅
আপনি কি অনেক টাকা বেতনের চাকরী করেন?
– নাহ, ব্যপারটা আসলে তেমন না। তবে হ্যাঁ চাকরী আগে করতাম একটা। তবে এ বিল্ডিং এ আসার পরে আমার ভাগ্য খুলে গেছে। মণিকা বললো, চাকরী টাকরি না করতে।
আমি এখন মণিকাকে সময় দিচ্ছি। আর টাকাপয়সা যা লাগে মণিকা আমাকে দিচ্ছ।
ওর কথা শুনে হালকা হাসলাম, বললাম বাহ, আপনার ই তো কপাল তাহলে।
পকেট থেকে পাঁচটাকার কয়েন বের করে সাজিদ চাচাকে দিয়ে আসলাম। সাজিদ চাচার কাছে দুইকাপ চায়ের দাম আমি পাঁচ টাকা দেই। এটা নিয়ে চাচা কখনো কোন অভিযোগ করেনি। বরং খুশি হয়েছে।দুই কাপ চা খেয়ে এক কাপের টাকা দিয়ে ” জিতে গেছি” এই আনন্দটা কখনোই রবিন উপলব্ধি করতে পারবে না। যাদের হাতে অনেক টাকা থাকে, তারা অনেক প্রকার নির্মল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়।
সাজিদ চাচার সাথে পরিচয় বেশিদিন হয়নি। রবিন এন্ট্রি মারার পর থেকে বাইরেই চা খেতে হয়।
.
.
.
ছোট খাটো কিছু হাতের কাজ, যা ছিলো সেরে বাসায় পৌঁছালাম।বেশ কিছুক্ষন কাজ করলাম অনলাইনে। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মাথাটা একেবারে ধরে গেলো।
এবার একটু ব্রেক দরকার। হুট করে মনে পড়লো আমি এ পর্যন্ত এ বাড়ির ছাদে উঠিনি, আজ গিয়ে দেখে আসি,ছাদটা কেমন!
যেই ভাবা সেই কাজ। আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম।
গিয়েই আমি পুরো থ, পুরো ছাদটা পরিপাটি, সারি সারি গাছপালা, চারদিকে ওয়াল দিয়ে বানানো আছে ছোট পুকুর। তাতে খেলা করছে সোনালী লেজের লাল টুকটুকে গোল্ড ফিশ। পানিতে আরো আছে শ্রিম্প এবং পদ্ম। সবথেকে নজরকাড়া ফুল সাদা জলগোলাপ আরো সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে।
চারপাশে ওয়াল এবং উপরে টিন শেড দিয়ে ছাদের এক কোনায় বানানো আছে ছোট্ট একটি কুটির। এ কুটিরের নাম আবার বৃষ্টি বিলাস। রেশমিকে দেখলাম ওখানে পেতে রাখা বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা উপন্যাসের বই পড়ছে।
এতদিনে বুঝলাম রেশমি কেনো ছাদে সময় কাটায়, কিভাবে সময় কাটায়।
ছাদে উঠে চারদিকে পায়চারী করলাম। অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ফ্রেশ হয়ে গেলো। ফুরফুরে হয়ে গেলো।
একটু পরে রেশমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। আমাকে বললো, কি ব্যপার রোহান ভাই?
আপনি হুট করে ছাদে কি করছেন?
উত্তর দিলাম, মন ভালো করতে আসলাম।
রেশমি বললো,
আমার মন যতই খারাপ থাকুক এখানে আসলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এজন্যই আসলে এখানে আসা হয়। এখানে সময় কাটানো হয়।
” তোমার মন খারাপ থাকে? হাহা, কেনো?
– আপনি হয়ত সুপ্তির কাছে শুনেছেন পুরোটায় ই৷স্মরনের এবং আমার এফেয়ারের ব্যপারে ও আমাকে বলে নি?
– হুম। বলেছে।
– ঐ বিষয় নিয়েই।
– আচ্ছা।
যাই হোক রেশমী, আমার একটা অভ্যেস আমি মানুষের গল্প জানতে পছন্দ করি। তুমি বলোতো, একদম সত্যি করেই বলবে,
রফিক সাহেবকে ছেড়ে তোমার স্মরনের দিকে আকর্ষণ কেনো গেলো!
রেশমী বললো,
সত্যি জানতে চান?
জবাব দিলাম,
হুম বলো।
আচ্ছা তবে বৃষ্টি বিলাসে বসুন। আমি বলছি।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ছোট্ট কুটিরের দিকে।
একপাশে বসলো রেশমি। একপাশে আমি।
রেশমি বলতে শুরু করলো,
রফিককে আমি কিন্তু কম ভালোবাসিনি। ইভেব আমি ওকে এতটাই ভালোবেসেছিলাম যে ও পুরোটাই আমার ভেতরে ডুবে ছিলো। আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না।আমার প্রতি ওর বিশ্বাসের মাত্রাটা অনেক বেশি থাকায় এবং ওর সম্পত্তির দিকে অন্যান্য লোভী মানুষের লোভ থাকায়, আমার নামে এ টু যেড সবকিছু লিখে দেয়। এরপর কেটে যায় বেশ অনেক বছর, আমার শরীরে মেদ জমে। একটু মোটা হই, এতেই আমার প্রতি আকর্ষণ কমতে শুরু করে রফিকের। এটাও জেনেছিলাম যে ও ওর অফিসে জব করা মেয়েদের সাথে ফিজিকালি এটাচড ছিলো। প্রথম এসব নিয়ে অনেক ডিপ্রেশনে থাকতাম। একা একা কান্না করতাম। কিন্তু একটা সময়ে আমিও ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি। ভাবি ও যদি সবকিছু করতে পারে, আমি কেন পারবো না। এছাড়াও সিগারেট খেয়ে খেয়ে রফিক ফিজিকালি ও উইক হয়ে পড়েছিলো। এজন্যই আমাকে অন্যদিকে পা বাড়াতে হয়েছে।
ওর কথার একটু সংশোধন করে দিলাম,
অন্য পথ না বলো ভুল পথ।
আকাশ মেঘলা হয়ে আসে খুব। হুট করেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। টিনের চালের ওপর বৃষ্টির কনা ঝুমুর ঝুমুর গান সৃষ্টি করে। গুরুগম্ভীর কন্ঠে ডেকে ওঠে মেঘ। মেঘ ডাকার শব্দে মেয়েরা ভয় পায়। রেশমিও পেলো। হুট করে ভীষন জোড়ে বাজ পড়ায় ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বিরক্ত লাগলো খুব ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে আমি কুটির থেকে বাইরে চলে আসলাম ভারী বর্ষণে ভিজে জুবুথুবু হয়ে গেলাম। অনড় হয়ে ছাদের মাঝে দু হাত দু দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়েছি। মস্তিষ্ক সুপ্তির একটা অবয়ব তৈরি করলো। সুপ্তি যেনো আমার পেছনে কয়েকফুট দূরে দাঁড়িয়ে ভিজছে। অপূর্ব লাগছে তাকে। হঠাৎ ও ছুটে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
ওর দেহের উষ্ণ অনুভূতি আমার প্রতি শিরায় উপশিরায় ভালোবাসার তুফান তুলে দিলো…
চোখ মেললাম কল্পনা দূরীভূত হয়ে গেলো। শরীর থেকে সুপ্তির কাল্পনিক অস্তিত্ব মিইয়ে গেলো আস্তে আস্তে যেটা থেকে গেলো সেটা- ভালোবাসা ভালোবাসা মিষ্টি অনুভূতি, পবিত্র অনুভূতি । বেশি ভিজলে চলবে না। আমাকে সুস্থ থাকতে হবে সুস্থ থাকাটা খুব জরুরী।
.
.
.
সিঁড়ি দিয়ে হেটে নিঁচে নামছি। রেশমি হয়ত আছে এখনও বৃষ্টি বিলাস কুটিরে।
আমার পবিত্র ভালোবাসার কল্পনায় যেমন সুপ্তি স্থান পেলো, রেশমির মত মেয়েরা এভাবে কখনোই কারো কল্পনায় স্থান পায়না। এসব ভাবতে ভাবতে যখন নিচে নামছিলাম, রবিনের বাসার সামনে এসে হুট করে চোখ গেলো ওর ফ্লাটের দরজার নিচের দিকটায়। লাল কিছু তরল দরজার ফাঁকা দিয়ে বাইরে গড়িয়ে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামালাম না।
বাসায় এসে শাওয়ারে গোসল দিতে দিতে ভাবলাম বৃষ্টি থামলে ছাদ থেকে কিছু তরতাজা ফুল নিয়ে চলে যাবো সুপ্তির কাছে।
গোসল করে বের হলাম,
বৃষ্টি থামার নাম নেই।
এর ভেতরে কলিং বেল বাজলো।
দরজা খুলে ভীষন অবাক হলাম, সুপ্তি এসেছে।
ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে সুপ্তিও। দরজা খুলে কিছু বলার আগেই সুপ্তি আমাকে সজোরে একটা চড় মেরে বসলো।
এর ভেতরেই সেখানে উপস্থিত হলেন মনিকা ভাবী।
সুপ্তি আমার গালে চড় মেরেছে সেটা দেখে তিনি অবাক হলেন একটু। তবে তার ভেতর উৎকন্ঠাও ছিলো।। সুপ্তি এবং আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, চার ঘন্টা যাবৎ ফুলী নিঁখোজ। ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা৷

লেখক; Hasibul Islam Fahad

চলবে…