Monday, July 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1412



এক ফালি চাঁদ পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_১০(অন্তিম পর্ব)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
ঘন কালো অন্ধকারে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। আনন্দ নেই, হাসি নেই কোথাও। চারদিকে শুধু থমথমে পরিবেশ। বাঁধনহারা হয়ে কাঁদছেন আমেনা বেগম এবং তিনু। খালেদ রহমান একটু পরপর শার্টের হাতায় চোখ মুছছেন। তাদের মেয়ের সাথেই কেন এমনটা হতে হলো! ডাক্তার জানিয়েছে অনুর গাল থেকে গলা পর্যন্ত একদম ঝলসে গেছে। ভেতরে কাউকে এলাউ করেনি। বাইরে থেকেই সকলে এক পলক দেখেছে শান্ত নির্জীব অনুকে! বুকের ভেতরটা একদম হু হু করে ওঠে। যেই কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না। আর না সবাই বোঝে!

যারা এসিড ছুড়েছিল ওদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওদের স্বীকারোক্তি দ্বারা জানা গিয়েছে অনুকে এসিড মারার উদ্দেশ্য ওদের ছিল না। বরং অন্য মেয়েটিকে এসিড ছুড়তে গিয়েই অনুর শরীরে পড়ে যায়। পুলিশ হাসপাতালে এসেছিল। কিন্তু অনু অথবা এসিড আক্রান্ত অন্য মেয়েটি অর্থাৎ আঁখি এখন কথা বলার মতো সিচুয়েশনে নেই। ডাক্তার জানিয়েছে এখনই তাদের কারো সাথে কথা বলতে দেওয়া যাবে না। পুলিশও ওদের দুজনের জবানবন্দি ছাড়া কিছু করতে পারবে না। তাই অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো গতি নেই।

করিডোরের একপাশে দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনল। বারবার চোখের সামনে অনুর ছটফট করা তখনকার দৃশ্য ভেসে উঠছে। কত কষ্ট ওকে পোহাতে হয়েছে! কী হবে সামনে? অনু এসব সহ্য করতে পারবে তো? ডাক্তার এসে জানায় ওরা এখন স্বাভাবিক সুস্থ। সবার আগে কথা বলার জন্য পুলিশই যায়। যদিও তারা উপস্থিত অনল এবং আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে উক্ত ঘটনাটি শুনেছিল তবুও একই প্রশ্ন তারা অনু এবং আঁখিকে করে। পুরো ঘটনা অনুর বলার প্রয়োজন হয়নি। শুধু এটাই জানিয়েছে সে তাদের কাউকে চিনে না। হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল তা বুঝতেও পারেনি। আঁখির জবানবন্দি এমন ছিল,
‘এসিড নিক্ষেপকারী একজন যার নাম পলাশ। পলাশ আমায় প্রেম প্রস্তাব দিয়েছিল কলেজে যাওয়ার সময়। সে ভালো ছেলে নয়। আমি না করে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে সে প্রায়ই আমায় বিরক্ত করত। রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করত। তারপরও যখন আমি রাজি হয়নি তখন ও হুমকি দিয়ে বলে,’তোর এই সুন্দর চেহারা নিয়ে এত বড়াই না? তোর এই চেহারাই আমি নষ্ট করে দেবো।’ সরাসরি ভয় না পেলেও মনে মনে আমি ঠিকই ভয় পেয়েছিলাম। কিছুদিন কলেজেও যাইনি। এরপর যখন আবার কলেজে যাওয়া শুরু করলাম তখন আর পলাশ আমায় বিরক্ত করত না। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, হয়তো আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই বলেছিল। কিন্তু ভুল ছিলাম আমি। সেদিন কোচিং করে ফেরার পথে…’

এইটুকু বলেই কান্নায় ভেঙে পড়ে আঁখি। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,’সেদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে পলাশ ও ওর সঙ্গীরা আমার দিকে এগিয়ে আসে। অদ্ভুতভাবে হাসে। আমি ভয় পেয়ে দৌঁড়ানো শুরু করি। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা খাই! আমার জন্য ঐ মেয়েটাকেও এসিডের শিকার হতে হয়!’

এবার আঁখির কান্নার দমক আরও বেড়ে যায়। ডাক্তাররা জানায় এই সময়ে ওদের উত্তেজিত করা ঠিক হবে না। পুলিশের যা জানার দরকার তা জেনে নিয়েছে। আর কোনো প্রশ্ন তারা করেনি। তবে এটা বলেছে যে এর প্রাপ্য শাস্তি পলাশ ও ওর বন্ধুরা পাবে। হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের দলবল। একদিনে একই সময়ে দুই মেয়ে এসিডের শিকার। এই খবর যেন মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। ডাক্তাররা তাদের হাসপাতালের ভেতর এলাউ করেনি। তারা উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে অনু এবং আঁখির সঙ্গে কথা বলার জন্য। এরমধ্যে যতটুকু জানা হয়েছে ততটুকুই টিভি, পত্রিকায় প্রচার করা হয়েছে। তাদের আগের ছবি এবং এসিডে ঝলসে যাওয়া ছবি দেখে সকলের মনেই আক্ষেপ। এত সুন্দর চেহারা! আজকাল সত্যিই এটাও মনে হয় যে, সুন্দর হওয়া’ও পাপ, অন্যায়!
.
অনু সুস্থ হওয়ার পর-ও কারো সঙ্গেই কথা বলতে চায়নি। এমনকি দেখা-ও করেনি। অনল ভেতরে যায়নি একবারও। আমেনা বেগম যাওয়ার পর হাত ধরে কান্না করে অনু। আকাশ-পাতাল কেঁপে উঠবে সেই কান্নার সুরে। আজ অনু এবং আঁখিকে আদালতে যেতে হবে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। দুজনকেই রেডি করা হয়। কিন্তু আয়না দেখতে দেওয়া হয় না কাউকেই। এমনকি ফোনও তাদের থেকে দূরে রাখে। এই ঝলসে যাওয়া মুখ দেখলে বেঁচে থাকার ইচ্ছে এখানেই মরে যাবে। গালে, গলায় হাত বুলিয়ে আৎকে ওঠে অনু। বুঝতে পারে নিজের করুণ পরিস্থিতি।
________________

ঘরের এক কোণায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে অনু। কিছু্ক্ষণ আগেই আদালত থেকে এসেছে। আসামীদের ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত অনু নিজেকে দেখেনি। আঁখির মুখ দেখতে পায়নি। ওড়না দিয়ে বড়ো ঘোমটা দেওয়া ছিল। তবে হাতটা দেখতে পেরেছিল। ডান হাতের ওপর ভাগ একদম ঝলসে পুড়ে গেছে। কী ভয়ংকর সেই দৃশ্য! হাতের যদি এই অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে মুখের অবস্থা কী রকম হয়েছে? বাড়ির সামনে আসার পর এলাকার মানুষদের করা বিকৃত মুখভঙ্গি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তাদের চোখে ভয় স্পষ্ট ছিল। তারা কি অনুকে ভয় পাচ্ছে?

ঘর থেকে সকল প্রকার আয়না জাতীয় সরঞ্জাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সে নিজেই তার মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। কেমন দেখাচ্ছে তাকে? খুব ভয়ংকর? খুব? ঠোঁট ভেঙে কান্না চলে আসে। ফ্লোরে গুটি গুটি পায়ে গলু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিতুস ওর কোলের কাছে এসে বসে আছে। খুব গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকালে মনে হবে তিতুসও বোধ হয় কাঁদছে। তবে সে অন্যান্যদের মতো ভয় পাচ্ছে না।

আমেনা বেগম প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসেন। তিনুর হাতে পানির গ্লাস। কাঁদতে কাঁদতে ওদের চোখমুখ ফুলে গেছে। নিজেকে কোনো রকম ভাবেই সামলে রাখতে পারছে না আমেনা বেগম। অনুর মুখের দিকে তাকালেই বুক ভেঙে কান্না চলে আসে। চোখ নামিয়ে ভাত মেখে মুখের সামনে ধরেন। অনু বিষাদিত সুরে বলে,’তুমিও কি আমার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছ মা?’
তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে অশ্রু ত্যাগ করেন। অনুর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলেন,’না মা, না। আমি কেন ভয় পাব? তুই আমার মেয়ে। আমার কলিজা। তুই আগে যেমন ছিলি, এখন তেমনই আছিস। আমার অনু সবসময় সুন্দর।’

‘না মা। আমি আগের মতো নেই। আমি নেই আগের মতো! মানুষ এখন ভয় পায় আমায় দেখলে।’ কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলে খাবারের প্লেট দূরে ছুড়ে মারে। ফ্লোরজুড়ে ছিটিয়ে পড়ে ভাতের দানা। শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গলু খাটের কোণায় লুকিয়ে পড়ে। আর তিতুস উড়ে চলে যায় অন্যত্র। অনুকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে। ঘরের সবকিছু এলোমেলো করতে করতে কাঁদছে। আহাজারি করে বলছে,’এই বিশ্রী মুখ নিয়ে আমি কী করে বাইরে যাব? কেন হলো আমার সাথে এমন?’

‘আপু প্লিজ তুমি একটু শান্ত হও। এভাবে ভেঙে পড়ো না।’ ফুঁপিয়ে বলে তিনু।
দু’হাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে নিজেকে মানানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় অনু। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে,’তোমরা চলে যাও। আমি একটু একা থাকতে চাই।’
ঐ মুহূর্তে ঘরে এসে উপস্থিত হয় অনল। ইশারায় আমেনা বেগম এবং তিনুকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে। তারা যাওয়ার পর অনলকে দেখে আরও রেগে যায় অনু। উল্টোপাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,’আপনি এখানে কেন এসেছেন? মজা নিতে? আনন্দ হচ্ছে না আপনার?’

অনল নিশ্চুপ। অনু বলল,’আপনি চলে যান। কারো দয়া, মায়া আমার লাগবে না। দূর থেকেই পরিহাস করেন।’
অনল এগিয়ে এসে অনুর হাত ধরে সামনে ঘুরিয়ে দাঁড় করায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে অনু। কাঁদতে কাঁদতে বলে,’চলে যান। প্লিজ! চলে যান আপনি।’
ঐভাবেই অনুকে জড়িয়ে ধরে অনল। সে কথা বলতে পারছে না। অনুকে বুঝতে দিতে চাচ্ছে না তার ক্রন্দনরত কণ্ঠস্বর। সে জানে না কীভাবে অনুকে স্বাভাবিক করবে, কীভাবে সামলাবে। শুধু জানে অনুকে তারই সামলাতে হবে। কিছু্ক্ষণ নিরবে কেঁদে অনলকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে নিজেও পিছিয়ে যায় অনু। চিৎকার করে বলে,’আপনি চলে যাচ্ছেন না কেন? চলে যান আপনি।’

‘অনু পাগলামি করিস না। এটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। তোর তো এখানে কোনো দোষ নেই। কেন এমন করছিস?’
‘কারণ দোষ না করেও আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। মানুষ ভয় পায় আমায় দেখলে।’
অনল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আহাজারি করে কাঁদতে কাঁদতে পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে অনু। নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অনল ঘর থেকে বেরিয়ে আবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই ফিরে আসে। অনুর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে একটা খোরগোশের বাচ্চা অনুর কোলের ওপর রাখে। অশ্রুশিক্ত নয়নে সে অনলের দিকে তাকায়। অনলের চোখের পানি চিকচিক করছে। এটাও বোঝা যাচ্ছে সে এখন কাঁদতে চাচ্ছে না। অনুর গালে আলতো করে হাত রেখে অনল বলে,’তোর পিলু! ওকে আমি ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলাম। কুকুর নেয়নি। ইচ্ছে ছিল, যেদিন তোকে বিয়ে করব সেদিন ফিরিয়ে দেবো। বিয়ে হওয়ার আগেই ফিরিয়ে দিলাম। তবে বিয়ে হবে আজ।’

‘আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? কীসব আবোল-তাবোল বকছেন!’
‘আবোল-তাবোল নয়। যা বলেছি ভেবেই বলেছি। আমি তোকে ভালোবাসি। তোকেই বিয়ে করব।’
‘অসম্ভব।’
‘কেন অসম্ভব অনু? তোর মুখ ঝলসে গেছে বলে কি আমার ভালোবাসায় ভাঁটা পড়েছে? কমে গেছে আমার ভালোবাসা?’
‘আপনার এখন আবেগের বয়স নেই। কোন আবেগের টানে আপনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমি জানি না। বাড়ি চলে যান।’

অনল এবার অনুর দু’গালে হাত রাখে। চোখে চোখ রেখে বলে,’আল্লাহ্’র কসম! তোকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত আমি আবেগের বশে নেইনি। আমি তোকে ভালোবাসি। আমার পরিবারের সবাই রাজি। আজই তোর বাবার সাথে কথা হবে।’
অনলের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে অনু বলে,’কেন এমন করছেন আপনি! কেন ভালোবাসেন!’
অনল কিছু বলল না। শুধু নিরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বাহুবন্ধনে শক্ত করে আবদ্ধ করে রাখল অনুকে।
.
.
খালেদ রহমান বাড়িতে ছিলেন না। একটু আগেই এসেছেন। চোখে-মুখে চিন্তার আভাস। চোখে-মুখ ফোলা।
‘চা দেবো?’ জিজ্ঞেস করেন আমেনা বেগম।
‘দাও।’
চা বানানোই ছিল। গরম করে কাপে ঢেলে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখে। পাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করে,’কোথায় গিয়েছিলে?’
‘বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে কথা বলতে।’
‘মানে?’
‘বাড়িটা বিক্রি করে দেবো আমেনা। মেয়ের চিকিৎসা করাবো। দেশের বাইরে পাঠাবো সার্জারি করার জন্য। কেউ আমার মেয়েকে কুৎসিত বলুক, বিশ্রী বলুক এটা আমি চাই না। সহ্য করতে পারব না আমি।’

কথার উত্তর দিতে পারলেন না আমেনা বেগম। কান্না ছাড়া তিনি আর কী-ই বা করতে পারবেন? তবে রাগী মানুষটার আড়ালে’ও যে অফুরান্ত ভালোবাসা রয়েছে সেটা তিনি আজ বুঝতে পারলেন। খালেদ রহমানের ব্যাপারে তার একটা ভ্রান্ত ধারণা ছিল। যা আজ তাসের ঘরের মতো ভেঙে গেছে। মানুষটার ভেতর অনেক ভালোবাসা রয়েছে যা রাগের আড়ালে খুঁজে বের করা মুশকিল। অনলের বাবা-মা এসে বিয়ের কথা বলেছেন। কিছু্ক্ষণ নিরব থেকে ভাবুক হয়ে খালেদ রহমান বলেছিলেন,’অনলকে আমার অপছন্দ নয়। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে, বিয়ে করতে চায় এতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আগে অনু পুরোপুরি ঠিক হবে তারপর বিয়ে। কেউ যেন আমার মেয়ের দিকে আঙুল তুলে এটা না বলতে পারে যে, অনল দয়া দেখিয়ে ওকে বিয়ে করেছে।’

সকলে অভিভূত হয়েছিল উনার কথা শুনে। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বারবার ওড়নায় চোখ মুছেছিল অনু। সে তার বাবার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছিল! অথচ বাবা কত ভালোবাসে। খালেদ রহমানের সিদ্ধান্তে সবাই রাজি হয়েছে। উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য টাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জেসি এবং শুভা বেশিরভাগ সময়টা এখন অনুদের বাসাতেই থাকে। লুডু খেলে, গান শোনে, চোর-পুলিশ খেলে। প্রকৃত বন্ধুরা কখনোই ভুলে যায় না। তারা পাশে থাকে যেকোনো মুহূর্তে। সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে শিখেছে অনুও।

দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে ঠিক করা হলো ওরা ছাদে যাবে। ছাদে বসে বসে লুডু খেলবে চারজন মিলে। জেসি আর শুভা সোফায় বসে আরাম করছে। কলিংবেল বাজে তখন। দরজা খুলে দেয় তিনু। এলাকার অনেকেই এসেছে এবং সেই ভিক্ষুক বৃদ্ধা মহিলাটিও। তাদের সকলকে ভেতরে নিয়ে আসে তিনু। ওড়না দিয়ে মুখের এক সাইড অনু ঢেকে রেখেছে। বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করেন,’ভালো আছো বইন? তোমার খবর আমি শুনছিলাম। আইছিলামও দেখতে। কিন্তু তুমি তহন কারো লগেই দেহা করো নাই।’

অনু কৃত্রিম হেসে বলল,’ভালো আছি দাদু।’
কথাবার্তার শব্দ পেয়ে খালেদ রহমান এবং আমেনা বেগমও ড্রয়িংরুমে আসেন। সকলের সঙ্গে আলাপবার্তা করেন। এরপর তারা সবাই টেবিলের ওপর টাকা রেখে বলেন,’বেশি টাকা-পয়সা দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের নাই ভাই। অনু জানে আমাদের অবস্থা। যা পারছি দিছি। আমরাও চাই আমাদের অনু আবার প্রাণ ফিরে পাক। হাসি-খুশি অনু ফিরে আসুক আমাদের মাঝে।’

আমেনা বেগম এবং খালেদ রহমানের চোখে পানি এসে পড়ে। এতগুলো মানুষ অনুকে ভালোবাসে! এমনি এমনি নয়, অনুও তাদের ভালোবাসে। কিছু মানুষ ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে না। যেটা করে তা হচ্ছে বেঈমানি। এই সহজ-সরল মানুষগুলো বেঈমানি বোঝে না। তাদের প্রত্যেককেই অনু কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করেছিল। তাদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিল। এখন অনুর বিপদেও তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী। ক’জন-ই বা থাকে বিপদের সময়ে পাশে? যদিও টাকার ব্যবস্থা সব হয়ে গিয়েছিল তবুও খালেদ রহমান তাদের ফিরিয়ে দিলেন না। অনুর প্রাণোচ্ছল জীবন ফিরে পাওয়ার পিছনে না হয় তাদেরও কিছুটা অবদান, ভালোবাসার স্পর্শ থাকুক। অনু কেঁদে ফেলে এত ভালোবাসা দেখে।

তিনু বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,’তুই-ই ঠিক ছিলি আপু। সেদিন তুই মিথ্যে বলিসনি। তারাও তোর বিপদে পাশে আছে।’
দুপুর থেকে বিকেল অব্দি তারা সবাই গল্প করলেন। অনুকে সময় দিলেন। অনু ভুলেই গেছে প্রায় তার কষ্ট। সবাই পাশে আছে কিন্তু অনল নেই। ওকে ছাড়া সবকিছু বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। অবশ্য সে গিয়েছে পাসপোর্ট আর ভিসার কিছু কাজ শেষ করতে। ওরা কাল’ই যাচ্ছে সুইজারল্যান্ডে সার্জারি করার জন্য। এখানে ইউসূফেরও হাত রয়েছে। সে সহযোগিতা করেছে বলেই চিকিৎসার ব্যবস্থা দ্রুত হয়েছে। ঐদেশের হাসপাতালেও বন্ধুদের দিয়ে কথা বলিয়ে রেখেছে। কাল সকালের ফ্লাইটেই সুইজারল্যান্ড যাবে।
.
সব কাজ শেষ করে রাতে বাড়িতে ফেরে অনল। রাতে অনুদের বাসাতেই খায়। ইশারায় তিনুকে জিজ্ঞেস করে,’অনু কোথায়?’
প্রত্যুত্তরে তিনুও চোখ দিয়ে ইশারা করে বলে,’ছাদে।’
খাওয়া শেষ করে অনল-ও ছাদে চলে যায়। উপস্থিতি জানান দিতে খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে।
‘এহেম, এহেম।’
অনু একবার পেছনে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। চাদরটা আরেকটু ভালো করে টেনে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। অনল এগিয়ে গিয়ে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’উফ! ঠান্ডা।’

অনু এবার তাকালোও না। অনল এবার অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,’একটু চাদরটা শেয়ার করবি অনু? খুব ঠান্ডা লাগছে।’
‘কেন? সাথীর কাছে গিয়ে চান।’ চেতে বলল অনু।
‘এখানে আবার সাথী আসলো কোথা থেকে?’
‘আকাশ থেকে! সেদিনের কথা মনে নেই?’
‘আছে। ঐদিন ওকে জ্যাকেট দিয়েছিলাম। তারপর যে একদিন আমাদের বাড়ির ছাদে তোকে জ্যাকেট দিলাম? এখন তুইও চাদর শেয়ার করবি। করতে বাধ্য তুই। দে।’
অনল চাদরে ধরে টান দিতে যাবে তার আগেই অনু দূরে সরে যায়।
‘দেবো না। সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি?’
‘কত কাজ আমার! রাত পোহালেই কাল চলে যাবি। আজ এমন করছিস কেন?’
‘কাল কে কে যাব?’
‘পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ যাবে তোর সাথে।’

ভ্রুঁ কুঁচকে মুখ কালো করে ফেলে অনু। অনল ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলে,’ঢং! কে কে যাবে! কেন রে তুই কি মহারাণী ভিক্টোরিয়া? রাজ্য জয় করতে যাবি যে, সবাই তোর সঙ্গে যাবে যুদ্ধ করতে! তা তো নয় তাই না? তুই যাবি চিকিৎসা করতে। যাদের যাওয়ার প্রয়োজন তারাই যাবে। আঙ্কেল যাবে, ইউসূফ ভাইয়া যাবে আর তুই।’
অনু দাঁত কিড়মিড় করে বিড়বিড় করে বলে,’গণ্ডার!’
অনল জিজ্ঞেস করে,’এই তুই কি বললি?’
‘কী বললাম?’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্ন করে অনু।
‘মাত্রই কী যেন বললি! কীসের ডার না কী জানি। কী বলছিলি বল?’
‘সেটাই তো কী বলছিলাম?’
‘একদম ঢং করবি না অনু। ভালোই ভালো বল কী বলছিস?’
অনু আমতা আমতা করে বলে,’আ…আন্ডার হ্যাঁ আন্ডার বলছিলাম।’
‘কীসের আন্ডার?’
‘কীসের আন্ডার! ঐতো ঐযে কবিতা বলছিলাম আমি। টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল স্টার, হাওয়াই আন্ডার হোয়াট ইউ আর…’ জোর পূর্বক ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুঁটিয়ে বলল অনু। অনল ওর মাথায় গাট্টা মেরে বলে,’গাধী! ঐটা আন্ডার না, ওয়ান্ডার হবে।’
এবারও বোকার মতো হেসে অনু বলল,’হ্যাঁ, ঐ একই।’
অনল আর কিছু না বলে চলে যায়। এদিকে বুকের ওপর হাত রেখে জোরে শ্বাস নেয় অনু। বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে আজ। ‘কিছু বলেও শান্তি নেই। সব শুনে ফেলে। গণ্ডার যেন কোথাকার!’ বিড়বিড় করে বলল সে। আবারও একা একা দাঁড়িয়ে থাকে। অদ্ভুত মানুষ! চলে গেল? কই একটু গল্প করবে তা নয়!

আচমকা তখন অনল ফিরে এসে চাদরটা টেনে নিয়ে নেয়। গায়ে জড়িয়ে পেছন থেকে অনুকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আমার অনুর চিকিৎসা হবে আর আমি থাকব না? কাল আমিও যাব। আমার পাগলীর পাশে আমি থাকব। একদম ঢাল হয়ে।’
অনুর ঠোঁটে হাসি ফুঁটে উঠে। অনলের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে। অনল বলে,
‘জানিস অনু তোর প্রতি আলাদা টান, ভালোবাসা সবসময়ই আমার কাজ করতো। কিন্তু ঝগড়া করতে করতে কেন জানি ভালোবাসাটা ধরতেই পারতাম না। সত্যি বলতে তোর পাশে অন্য কোনো ছেলেকে আমি সহ্যও করতে পারতাম না। তাসিনকেও না। আমার ভয় হতো তোকে হারিয়ে ফেলার। এরপর যখন তাসিনের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে জানলাম ওর ক্যারেক্টার ভালো না তখন অনেক খুশি হয়েছিলাম। বল তো কেন?’
‘কেন?’
‘কারণ আমি জানতাম প্রমাণ করতে পারলে তুই কোনোদিন ওর সাথে রিলেশন রাখবি না। আপদ বিদায় হবে।’

অনু হাসে। কিছু্ক্ষণ নিরব থেকে বলে,’আচ্ছা যদি এরকমটা হতো এসিড না লেগে রোড এক্সিডেন্টে মারা যেতাম। অথবা এই অবস্থার পর সুইসাইড করতাম তখন কী করতেন?’
সঙ্গে সঙ্গে অনুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনল। পারছে না শুধু বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে। অনু মৃদুস্বরে বলে,’ভর্তা হয়ে যাব তো!’
অনল এবার আলতো করে ধরে বলে,’এমন কথা কখনো মুখেও আনিস না অনু। তোর এই অবস্থাতেই আমি বেঁচেও জিন্দা লাশ হয়ে ছিলাম। তোর মুখে একটু হাসি দেখার জন্য ছটফট করতাম। আর তুই…! তোকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। তোর মুখ এমন থাকলেও আমার কিছু যায় আসে না। যেকোনো পরিস্থিতিতেই তুই আমার। সবভাবেই, সব সাজেই আমি তোকে ভালোবাসি।’

‘মুখের অপারেশন না করলে আমারও কোনো আফসোস থাকতো না সত্যি। আমি তো বুঝেই নিয়েছি, চিনেই নিয়েছি কারা আমার পাশে আছে আর থাকবে। বন্ধু তো অনেক আছে কিন্তু দিনশেষে শুধু জেসি আর শুভাকেই পেয়েছি। অনেকের বাবা-মা নাকি এ-ও বলেছে যে নিজের দোষে নাকি আজ আমার এই অবস্থা! তাদের ধারণামতে আমি চঞ্চল। হয়তো কোনো ছেলের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি তাই আমার এই হাল। তাদের মেয়ে আমার সাথে মিশলে যদি ওদেরও ক্ষতি হয়? কী অদ্ভুত মানুষের চিন্তা-ভাবনা তাই না? অথচ জেসি, শুভা সব বাঁধা উপেক্ষা করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে রেখেছে।
যেসব মানুষদের আমি সাহায্য করতাম তারাও আমার বিপদে আমার পাশে আছে। আমি শুধু তাদের প্রয়োজনই ছিলাম না বরং প্রিয়জনও ছিলাম এটা তো স্পষ্ট। যেই বাবাকে মনে মনে অপছন্দ করতাম, ভাবতাম আমায় সে ভালোবাসে না। অথচ সেই সবার চেয়ে বেশি অস্থির। কারো কাছ থেকে হাত পাতেনি। জমি-জমা সব বিক্রি করেছে। এমনকি নিজের শখের বাড়িটাও বিক্রি করতে দু’বার ভাবেনি।
আর… আর যাকে আমি ভালোবাসি সে এখনও আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার বাবা-মা, ভাই এসে তিনবেলা আমায় দেখে যাচ্ছে। সাহস যুগিয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদের বাড়ির বউ হওয়ার কথা। তারা অপেক্ষায় আছে। তাহলে এখন আপনিই বলেন, কেন আমি সামান্য এক্সিডেন্টের জন্য সবকিছু ছেড়ে দেবো? সত্যি বলতে অনেকবার ভেবেছিলামও সুইসাইডের কথা। কিন্তু সবার এত সাহস, ভরসা, সাপোর্ট সেটা হতে হয়নি। আমি বিশ্বাস করি, বেঁচে থাকার জন্য এসব আমার জন্য যথেষ্ট।’ অনলের বুকে মাথা রেখেই কথাগুলো বলল অনু।

অনুর কপালে চুমু খেল অনল। আরেকটু শকলত করে জড়িয়ে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,’আমার পাগলীটা অনেক বুঝদার হয়েছে। আকাশে আজ চাঁদ দেখতে পাচ্ছিস?’
অনু একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার অনলের বুকে মাথা রাখে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,’হুম।’

‘আকাশে কিন্তু আজ সম্পূর্ণ চাঁদ নেই। তবুও চারপাশ কত আলোকিত দেখেছিস? কুয়াশা কিন্তু চাঁদের সৌন্দর্য আড়াল করতে পারেনি। তেমনি সামান্য ঝলসে যাওয়া চামড়া-ও পারেনি তোর সৌন্দর্য কেড়ে নিতে। বরং তোর মনের সৌন্দর্য তোর চেহারার সৌন্দর্যকে আরও দ্বিগুণ করেছে। আর সম্পূর্ণ চাঁদ না পেলে আফসোসও থাকত না। আমার সম্পূর্ণ চাঁদ লাগবেও না রে। শুধু তুই থাকলেই হবে। তোর মুখের পোড়া অংশ কখনো তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কমাতে পারেনি। তুই যে আমার চাঁদ। আমার ভালোবাসার এক ফালি চাঁদ।’

(সমাপ্ত)

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৯

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
মাঝরাতে অনুর ঘুম ভাঙলে সে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে। বিছানার পাশে মোবাইল হাতড়েও মোবাইল পেল না। উঠে দাঁড়াতেও অলসতা লাগছে। শরীরে মনে হচ্ছে শক্তি নেই। কিছু্ক্ষণ ঝিম মেরে বিছানাতেই বসে থাকে। খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে বিছানা থেকে নামে। লাইট জ্বালিয়ে দেখে গলু ফ্লোরের এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রয়েছে। এই ঠান্ডার মধ্যে বেচারাকে কষ্ট দিচ্ছে ভেবে অনুর নিজেরই খারাপ লাগছে। গলুর জন্য ছোট্ট বাক্সে আলাদা বিছানা বানিয়েছিল অনু। ওকে তুলে নিয়ে সেই বাক্সের বিছানায় শুইয়ে দেয়। ওর জন্য বানানো ছোট্ট ল্যাপটা গায়ে জড়িয়ে দিল। গলু একবার চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। অনু ওর মাথা চুলকে দেয় কিছু্ক্ষণ। বারান্দায় গিয়ে দেখে তিতুস খাঁচার মধ্যে ঝিমুচ্ছে। ওর খাবার প্রায় শেষ। ঘর থেকে খাবার আর পানি দিয়ে যায়। তখন দৃষ্টি চলে যায় অনলের ঘরের দিকে। এখনও ওর ঘরে আলো জ্বলছে। অনুর মনে পড়ে যায় ছাদের ঘটনাটির কথা। অনলের নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতেই এক দলা ভারী মেঘ এসে জমা হয় চোখের কার্ণিশে। যার শেষ ফলাফল হিসেবে নেত্রপল্লব অশ্রুতে ভিজে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে অনু ঘরে ফিরে আসে। ওয়ারড্রব থেকে জামা-কাপড় বের করে শাড়িটা আগে খুলে ফেলে। তারপর ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

সকালে অনুর ঘুম ভাঙে আমেনা বেগমের ডাকে। চোখ না মেলেই অনু বলে,’বলো।’
‘ইউসূফ এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।’
‘এত সকালে?’
‘এত সকাল কোথায় পেলি? এগারোটা বাজতে চলল।’
অনু নিশ্চুপ। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে নির্ঘাৎ। তিনি কাঁধে ধাক্কিয়ে আবার ডাকেন,’উঠ রে অনু। ছেলেটা সেই কখন থেকে বসে আছে।’
‘উহ্! যাও। আসছি।’
‘তাড়াতাড়ি।’

আমেনা বেগম চলে যাওয়ার প্রায় পাঁচ মিনিট পরে অনু ওঠে। আরও পরে উঠত। যদি না তিনু এসে ডেকে যেত। অনু ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। ড্রয়িংরুমে কেউ নেই। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখে আমেনা বেগম রান্না করছেন। সম্ভবত দুপুরের রান্না করছেন। আয়োজন বেশ ভালোই।

‘উনি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করে অনু।
আমেনা বেগম পেছনে ফিরে বলেন,’তোর আক্কেল জ্ঞান কবে হবে বলতে পারিস? কখন থেকে এসে অপেক্ষা করছে।’
‘কোথায় সে?’
‘ছাদে।’
‘আচ্ছা।’
অনু চলে যাওয়ার সময় আমেনা বেগম পিছু ডেকে দুই মগ কফি এগিয়ে দিয়ে বলেন,’খালি মুখে কথা বলবি নাকি? কফি নিয়ে যা।’
অনু কোনো প্রত্যুত্তর করল না। শুধু নিরব হয়ে কফির মগদুটো হাতে নিয়ে ছাদে চলে যায়।

ছাদের রেলিং ধরে ধীরপায়ে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটছে ইউসূফ। কুয়াশা থাকলেও মৃদু রোদও রয়েছে। পরিবেশটা ওর বেশ ভালোই লাগছে।
‘আপনার কফি।’
অনুর কণ্ঠ শুনে পেছনে তাকায় ইউসূফ। হাত বাড়িয়ে কফির মগ নিয়ে বলে,’থ্যাঙ্কিউ।’
‘ওয়েলকাম।’
‘হুট করে চলে আসায় বিরক্ত হওনি তো?’
‘বিরক্ত হলে কি চলে যাবেন?’

ইউসূফ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অনু মেকি মৃদু হেসে বলে,’জাস্ট কিডিং। ডোন্ট বি সিরিয়াস।’
অনুর হাসিতে তাল মেলালেও ইউসূফের কেন জানি খটকা লাগছে। ঘাপলা অন্যকিছু মনে হচ্ছে।
‘কফিটা কেমন হয়েছে?’ প্রশ্ন করে অনু।
‘অসাধারণ। তুমি বানিয়েছ?’
‘না। মা বানিয়েছি। আমি এত ভালো কফি বানাতে পারি না।’

দুজনই নিশ্চুপ। অনুর দৃষ্টি মাঠের দিকে। এলাকার বাচ্চাদের সঙ্গে ফুটবল খেলছে অনল। বাচ্চাদের মতোই হাসছে। কত খুশি ছেলেটা! অনুর ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যকর হাসি ফুঁটে ওঠে।
‘অনু।’
‘হু?’
‘তুমি এই বিয়েতে রাজি তো?’
অনু এবার শব্দ করেই হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,’এই প্রশ্নটা কি আরও আগে আমাকে করা উচিত ছিল না?’
‘অনু তোমার সঙ্গে রিলেশন করার মতো কোনো ইন্টেনশন আমার ছিল না। আমার ইচ্ছে ছিল আমি তোমায় বিয়ে করে বউ করব। এজন্য বাবাকে দিয়ে ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’

‘সমস্যাটা এখানেই। আমার পরিবার আপনার পরিবারের মতো নয়। আপনার পরিবারে আপনার অনেক গুরুত্ব রয়েছে, ইচ্ছের দাম রয়েছে। যেটা আমার পরিবারে আমার নেই। এমনকি একটাবার আমায় জিজ্ঞেসও করা হয়নি আমি কী চাই? আমি বিয়েতে রাজি কী-না!’
‘তাহলে কি তুমি বিয়েতে রাজি নও?’
‘না হলেও বা আপত্তি কোথায়? বিয়ে তো হবেই। বাবা-মা’য়ের ইচ্ছে বলে কথা।’
‘বাবা-মা বললেই হবে নাকি? সংসার আমরা করব। আমাদের মতামত দরকার সবার আগে। তুমি আমায় ক্লিয়ার করে বলো তুমি এই বিয়েতে রাজি?’

অনু কিছু্ক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর চোখে চোখ রেখেই বলে,’না।’
ইউসূফ কী বলবে বুঝতে পারছে না। বাকশক্তি লোপ পাওয়ার জোগার। গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’তাহলে এই বিয়ে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করার মতো ছেলে আমি নই। আমি বাড়িতে গিয়ে বাবাকে বলব। যাচ্ছি এখন।’
‘দুপুরের খাবারটা খেয়ে যান। মা আপনার জন্য রান্না করছে।’
‘অন্য একদিন খাব অনু। আজ আসি।’

ইউসূফ সরাসরি নিজেদের বাড়ি চলে যায়। যাওয়ার আগে আমেনা বেগমের সঙ্গেও দেখা করে যায়নি। তাহলে এভাবে না খেয়ে কখনোই আসতে দিতেন না। অন্যদিকে অনুর এমন চটপটে স্বীকারোক্তি ওকে পীড়া দিচ্ছে। ভুলটা নিজেরই মনে হচ্ছে। সে যদি নিজেই একবার অনুকে জিজ্ঞেস করতো!

ইউসূফ চলে যাওয়ার পরও অনু কিছু্ক্ষণ ছাদে পায়চারি করে। লুকিয়ে লুকিয়ে অনলকেও দেখে। অনলের দৃষ্টি যে ছাদের দিকে নেই তা কিন্তু নয়! ও নিজেও খেলার ছলে একটু পরপর ছাদের দিকে তাকাচ্ছে। ইউসূফের সঙ্গে অনুকে দেখে কষ্ট হলেও সরে যেতে পারছিল না। অনু রাতে ঘুমিয়েছিল কী-না তার জানা নেই। কিন্তু তার চোখের পাতায় ঘুম সারারাতে একবারও আসেনি। অনু ইউসূফের বউ হবে এটা ভাবতেই যেন বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে। অজানা, অদৃশ্য কষ্টরা জেঁকে ধরে। অনুও ভালোবাসাটা আগে ফিল করতে পারেনি। হয়তো অনলও নয়। তবে এখন যেই অনুভূতি হচ্ছে তার নাম কী? ভালোবাসা?

অনু ছাদ থেকে নেমে আসে। আজ ভার্সিটিতে তো যাওয়া হলো না। তবে একটু হেঁটে আসা যায়। সেও কাউকে কিছু না বলে একাই হাঁটতে বের হয়। মাঠের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অনল দৌঁড়ে আসে। হাঁপাচ্ছে সে। অনু কিছু বলছে না। চুপচাপ হেঁটে চলেছে শুধু।
‘কেমন আছিস অনু?’

অনু নিরুত্তর। অনল প্রশ্ন করে,’কথা বলবি না?’
এবারও অনু কোনো উত্তর দিল না। একটা রিকশা ডেকে চুপচাপ উঠে পড়ল। এমনকি একটাবার অনলের দিকে ফিরেও তাকায়নি। অনুর এহেন ব্যবহারে বুকের ভেতর কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে অনলের। অসহায় লাগে। অনু তো এমন নয়!
______________
পুরো বাড়িতে পিনপতন নিরবতা চলছে। এমনকি ফ্যানের ভনভন করা শব্দটাকেও প্রকট মনে হচ্ছে এখন। অনুর সামনেই চোয়াল শক্ত করে ক্রুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে খালেদ রহমান। হাঁটতে যাওয়ার সময় মাঝরাস্তাতেই খালেদ রহমানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তার অগ্নিবর্ণ দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল ঠিক কতটা রেগে আছেন তিনি। কিন্তু রাস্তায় কিছুই বলেননি। অনুকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। এতক্ষণ ক্ষুব্ধ হয়ে চুপচাপ থাকলেও এবার তিনি কষে থাপ্পড় বসান অনুর গালে। টাল সামলাতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় অনু। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় গাল কয়েক ইঞ্চি ফুলে গেছে। এতটা ব্যথা হচ্ছে যে মনে হচ্ছে গাল ফেঁটে এখনই রক্ত বের হবে। গাল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে অনু। ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।

খালেদ রহমান বাজখাঁই গলায় বলেন,’তোমায় এত সাহস কে দিয়েছে বিয়ে ভাঙার? কোনদিক থেকে ইউসূফকে তোমার অপছন্দ বলো?’
নিরবে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে অনু। আমেনা বেগম কাছে আসার আগেই খালেদ রহমান চিৎকার করে বলেন,’খবরদার মাঝখানে আসবে না তুমি। এখানে আমি আর অনু কথা বলছি। আজ আমার সব প্রশ্নের উত্তর ওকে দিতে হবে।’

এবার তিনি অনুকে জিজ্ঞেস করলেন,’তুমি কেন বিয়ে ভেঙেছ? চুপ করে থাকবে না অনু। মাথায় রক্ত চেপে আছে এমনিতেই। ইউসূফকে তোমার কেন পছন্দ নয়?’
‘আমি এখনই বিয়ে করতে চাচ্ছি না আব্বু। সবাইকে ছেড়ে এতদূরে আমি থাকতেও পারব না।’ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল অনু। অনলের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। যেখানে অনল অনুকে ভালোবাসে না সেখানে বাবার সামনে এ কথা বলার বৃথা মানে হয় না। রাগে গিজগিজ করছেন খালেদ রহমান। চোয়াল শক্ত করে বলেন,’বড়ো হয়ে সাহস বেড়ে গেছে। নিজের ভালো বুঝতে শিখেছ। করো নিজের ভালো। তোমার কোনো ব্যাপারে আমি আর নেই।’

কথা শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে ধিরিম করে দরজা বন্ধ করে দেয় খালেদ রহমান। অনু আর এক সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তিনু, আমেনা বেগম অনেকবার ডাকলেও পিছু ফিরে দাঁড়ায়নি।
.
.
‘অনিক আমি কেন জানি অনুর বিয়ে নিয়ে খুশি হতে পারছি না।’ বলল অনল। অনিক কম্পিউটারে গেমস খেলছিল। অনলের এ কথা শুনে সচকিত হয়ে তাকিয়ে বলে,’কেন?’
‘এই কেন’র উত্তরই তো আমার কাছে নেই।’
‘তুমি কি অনুকে ভালোবাসো?’
‘কাল রাতে অনু ছাদে এসেছিল।’
‘কেন?’
‘আমার কাছে।’
‘কী বলেছে?’
‘অনু আমায় ভালোবাসে। বিয়ে ভেঙে দিতে বলেছে। কান্নাকাটি করেছে অনেক। আমার মনে হয় আ…’

অনলের পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই অনিকের ফোন বেজে ওঠে। তিনু ফোন করেছে। ‘একটু ওয়েট ভাইয়া।’ বলে অনিক ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে তিনু প্রায় কেঁদেই ফেলবে সেভাবে বলে,’অনিক!’
‘কী হয়েছে তিনু? আর ইউ ওকে?’
‘অনিক, আপু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।’
‘মানে? কেন?’
‘ইউসূফ ভাইয়াকে আপু বিয়ে করবে না বলেছে। বিয়ে ভেঙে দিয়েছে বলে আব্বু খুব রেগে গেছে। আপুকে মেরেছে আর বকেছেও অনেক।’
‘কখন বের হয়েছে?’
‘এই এখনই। তুমি আর অনল ভাইয়া একটু খুঁজে দেখো না।’
‘আচ্ছা তুমি চিন্তা কোরো না। আন্টিকে চিন্তা করতে বারণ করো। আমি দেখছি।’

অনিকের সব কথাই অনল শুনেছে। চিন্তিত হয়ে বলে,’কী হয়েছে রে?’
‘ভাইয়া অনু বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে।’
‘মানে কী! কেন?’
‘বিয়ে ভেঙে দিয়েছে অনু। এজন্য আঙ্কেল মেরেছিল।’
অনল কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলে,’আমি গিয়ে অনুকে খুঁজছি। তুই মাকে নিয়ে ওদের বাসায় যা। ওদেরকে চিন্তা করতে বারণ কর।’
‘ঠিকাছে।’
অনল বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে জেসি আর শুভাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে ওদের বাড়িতে গেছে নাকি। যখন শুনল সেখানে যায়নি তখন ওদের বলল যেন বাকি বান্ধবীদের ফোন করে আপডেট নিয়ে একটু জানায়। ওরা বলল জানাবে। এবার অনল রাজীব এবং এনামুলকে কল করে কিছু এড্রেস দিয়ে সেখানে অনু আছে নাকি খুঁজতে বলল।

অনু যেসব জায়গায় যেতে পারে সেসব জায়গাতেই খুঁজছে। এবং ভাগ্য ভালো থাকায় ধারণা সত্যি হয়। কতগুলো বাচ্চাদের মাঝে অনু উদাস হয়ে বসে আছে। বাচ্চারা অনুর রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। সবগুলো বাচ্চাকেই অনল চেনে। এরা এখানে ফুল, খাবার বিক্রি করে। অনেকবার অনুর সঙ্গেই এখানে আসা হয়েছিল। অবশেষে অনুকে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল। ঠোঁটের কোণে শান্তির হাসি। অনলও ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাঝখানে জায়গা করে বসে। অনলকে দেখে অনু ভ্রু কু্ঁচকে ফেলে।

‘তোমাদের আপামনি এভাবে গাল ফুলিয়ে আছে কেন বাচ্চারা?’ জিজ্ঞেস করল অনল। ওরা সমস্বরে বলল,’জানি না।’
সত্যি বলতে অনলকে এখন অনুট বিরক্ত লাগছে। অসহ্য লাগছে। সে বাচ্চাদের থেকে বিদায়ও নিল না। বসা থেকে উঠে হনহন করে হাঁটা শুরু করে। পিছু পিছু অনলও আসে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে,’কী সমস্যা অনু? আমার সঙ্গে কথা কেন বলিস না?’
‘কথা বলতে ভালো লাগে না তাই বলি না।’
‘কেন ভালো লাগে?’
‘কোনো কারণ নেই।’
‘অবশ্যই কারণ আছে। সব কিছুর পেছনেই কোনো না কোনো কারণ থাকে।’

অনু থেমে যায়। দু’হাত জড়ো করে বলে,’দয়া করে আমায় একটু একা থাকতে দিন। আমি একা থাকতে চাই।’
‘তুই নাকি বিয়ে ভেঙে দিয়েছিস?’
‘এজন্য মনে হচ্ছে আপনার খুব অসুবিধা হয়ে গেল? ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনাকে ভালোবাসার কথা কাউকে বলব না। আর আপনাকেও বিরক্ত করব না। কাল রাতের জন্য সরি।’
অনু কথা শেষ করে হাঁটা শুরু করে। এর মাঝেই নির্জনতা ছেড়ে দুজনে লোকালয়ে চলে এসেছে। চারপাশে লোকজনের সমাগম। অনল পেছন থেকে বলে,

‘সরি বললেই তো এখন আর কিছু হবে না অনু। আমি তোকে একা-ও থাকতে দেবো না। কারণ আমি তোকে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ!’
শেষের দুইটা লাইন কানে পৌঁছাতেই অনু থমকে দাঁড়ায়। চোখ দুটো ছলছল করে ওঠে। ভালোবাসা পাওয়ার যেই আনন্দ, সেই আনন্দের রেখা ঠোঁটের কোণে। অনলের দিকে এবার ঘুরে দাঁড়ায় অনু।

পাশ থেকে তখন দৌঁড়ে আসে কিছু লোক।তখনই একটা মেয়ে ধাক্কা দিয়ে যায় অনুকে। সম্ভবত দৌঁড়াতে গিয়েই অনুর সঙ্গে ধাক্কাটা খায়। ধাক্কাটা এত জোড়েই লেগেছে যে টাল সামলাতে পারেনি। অনু ঘুরে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে তরল জাতীয় কিছু ওর মুখ বরাবর এক সাইডে এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী চিৎকার করে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে অনু। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। গালের এক সাইড এবং গলার মাংস ঝলসে যেতে শুরু করে মুহূর্তেই। পুরো ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটল যে অনল বুঝে উঠতেই পারল না ঠিক কী হলো! দু’হাতে মুখ ঢেকে রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে কাঁদছে অনু। ছটফট করছে। যখন বুঝে উঠতে পারে অনুর শরীরে এসিড পরেছে ততক্ষণে অনল উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসে। কিছুদূর থেকে আরও একটা মেয়ের গগনবিদারী আর্তনাদ শোনা যায়। আশেপাশের লোকজন কয়েকটা ছেলেকে ধরে ফেলে। অনলের দম বন্ধ হয়ে আসছে!

চলবে..

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৮

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৮
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
‘একটা বিয়ে ভাঙতে হবে অনল ভাই। আমি কিছুতেই এখন বিয়ে করব না। এই বিয়ে করা আমার পক্ষে একদম অসম্ভব।’

হন্তদন্ত হয়ে হড়বড় করে বলল অনু। অনিকের ঘরে ইউসূফকে দেখেই একছুটে দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল অনু। মেইন দরজার কাছে এসে অনলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তখনই অনলের হাত ধরে ছাদে নিয়ে এসেছে অনু। বাইরে থেকে এসে অনল ক্লান্ত। অনুর হুট করে বলা বিয়ের কথাও অনলের মাথায় ঢুকছে না। তবে অনুর পেরেশানি মুখ দেখে মনে হচ্ছে ঘটনা সিরিয়াস কিছু। অনল গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে। শীতের মধ্যেও ওর এখন গরম লাগছে। জ্যাকেটটা অনুর দিকে ছুঁড়ে মেরে বলে,’তোর বিয়ে?’
‘তো এতক্ষণ কি আমি আপনার বিয়ের কথা বললাম নাকি?’
‘ত্যাড়াব্যাড়া কথা বলবি না অনু। মাত্র বাইরে থেকে এসেছি। ক্লান্ত আমি। তবুও যে তোর কথা শুনছি, এটা তো তোর ভাগ্য।’
‘আচ্ছা সরি। বিয়েটা ভেঙে দেন না প্লিজ!’
‘বিয়ে ভাঙলে আমায় কী দিবি?’
‘৫০ টাকা দেবো।’

অনল চোখ পাঁকিয়ে তাকায়। অনু তখন তাড়াহুড়ো করে বলে,’আচ্ছা একশো টাকা দেবো।’
‘পঞ্চাশ টাকা দিবি, একশো টাকা দিবি এসবের মানে কী? আমায় কি তোর ছোটো লোক মনে হয়?’
‘না, না। আমি তো সে কথা বলিনি।’
‘তাহলে তুই কী বলেছিস আমায় বোঝা।’
‘এখন এতকিছু বোঝানোর সময় নেই। প্লিজ এই সাহায্যটা করেন।’
‘হয়েছে থাম। ন্যাকা কান্না কাঁদবি না। মেরে ছেলেটার হাত-পা ভেঙে দেবো?’
‘না, না। এসবের কোনো দরকার নেই। পরে আপনারই সমস্যা হবে।’

অনল তাচ্ছিল্য করে হেসে বলে,’হাহ্! আমার সমস্যা হবে? আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কারো নেই।’
‘কিন্তু সে আপনার পরিচিত। আর কাছেরও অনেক।’
‘কে সে? এনামুল নাকি রাজীব?’
‘আরে ধুর না। তারা কেন বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে? ইউসূফ ভাইয়ার কথা বলছি।’
‘ইউসূফ ভাইয়া! মানে আমার মামাতো ভাই?’
‘হ্যাঁ।’
‘তুই মজা নিচ্ছিস না অনু?’
‘একদম না। আমি সত্যি বলছি।’
‘কিন্তু আমি বিশ্বাস করছি না। দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে তোর মতো গবেটমার্কা একটা মেয়েকে ভাইয়া বিয়ে করতে চাইবে? অসম্ভব!’

‘শুনেন কথায় কথায় এত গবেট গবেট বলবেন না। আমি মোটেও গবেট নই। আপনার চোখে আমার গুণ, সৌন্দর্য চোখে পড়েনি বলে যে আর কারো চোখে পড়বে না এমনটা তো নয়। আর আপনার যদি আমার কথা বিশ্বাস না হয় তাহলে নিচে গিয়ে আন্টিকে জিজ্ঞেস করেন।’
‘তার কোনো প্রয়োজন নেই। তোর এসব ঢপবাজিতে আমি গলছি না। তুই সাথীকে নিয়ে জেলাস হয়েছিস বলে এখন ভাইয়াকে নিয়ে আমায় জেলাস ফিল করাতে চাচ্ছিস আমি জানি।’ কথাগুলো বলে অনুর হাত থেকে জ্যাকেটটা নিয়ে অনল নিচে নেমে যায়। হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে অনুর। অনল তো বিশ্বাসই করল না!

অনল বাসায় গিয়ে ইউসূফকে দেখে রীতিমতো চমকে যায়। কুশল বিনিময় করে বলে,’ভাইয়া তুমি! কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভাই। তুই ভালো আছিস?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। কখন আসলে?’
‘সকালেই। তুই কি সারাদিন বাড়ির বাইরেই থাকিস নাকি?’
‘ঐতো একটু যাওয়া হয় ঘুরতে।’
শিমুল বেগম ইউসূফকে জিজ্ঞেস করেন,’অনু চলে গেল কেন রে?’
‘আর বোলো না ফুপি! আমায় দেখে লজ্জা পেয়েই দিল দৌঁড়।’ হাসতে হাসতে বলল ইউসূফ।

এবার অনলের টনক নড়ল। ছাদে বলা অনুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। তার মানে অনু মিথ্যে বলেনি? শিমুল বেগম অনলকে বললেন,’খবর কিছু শুনেছিস?’
অনল বোকার মতো তাকিয়ে রয়েছে। তিনি মুচকি হেসে বলেন,’আমাদের ইউসূফ ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে।’
‘বুঝিনি মা।’
‘ইউসূফ অনুকে বিয়ে করতে চায়। তোর বাবা কথাও বলেছে। অনুর বাবা তো রাজি।’

শীতকাল। বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবুও অনলের মনে হচ্ছে বাইরে বাজ পড়ছে। অথচ বৃষ্টি নেই। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে অনল। অনুর বিয়ে হলে ওর কী? এত অস্থির তো লাগার কথা না। শিমুল বেগমের লাস্ট কথা শুনে অস্থিরতা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। তিনি বললেন,’তোর মামা-মামি দোকানে গেছে। আংটি কিনতে। যেহেতু দুই পরিবার-ই রাজি তাই এঙ্গেজমেন্ট আজই হবে।’

সবকিছু অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। চোখের পলক পড়ার আগেই। কথাটি বলতে চেয়েও বলতে পারছে না অনল। অজানা কোনো শক্তি যেন গলা চেপে ধরে রেখেছে। সত্যিই কি অনুর বিয়ে হয়ে যাবে?
____________
আয়নার সামনে নির্জীব হয়ে বসে রয়েছে অনু। পরনে ওর নীল সুতী শাড়ি। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আর চোখে গাঢ় কাজল। এইটুকু সাজ তিনুই সাজিয়ে দিয়েছে। অনলের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর খালেদ রহমান যখন বললেন ইউসূফ ওর বাবা-মাকে নিয়ে আজ বাসায় আসবে এবং এঙ্গেজমেন্ট হবে তখন থেকেই একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে অনু। বাবার মুখের ওপর কথা বলার মতো সাহস অনুর নেই। তাছাড়া কী বলবে? বলার মতো কী-বা আছে? অনু কাউকে ভালোবাসে না। কোনো পছন্দও নেই। পড়াশোনা? সে তো ইউসূফ নিজেই পড়াবে বলেছে। তাহলে আপত্তিটা কোথায় দেখাবে? খালেদ রহমান কোনো সুযোগও দিলেন না অনুকে।

ইউসূফদের আসতে রাত একটু বেশিই হলো। এর মাঝেই আমেনা বেগম খাবারের বিশাল বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। যদিও এখন ডিনার করার সময় কিন্তু এসেই তো ডিনার করা যায় না। তাই হালকা-পাতলা নাস্তা দিলেন আগে। কিছুক্ষণ পর অনুকে নিয়ে এলো তিনু। মাথায় ঘোমটা টানা। ইউসূফের পাশে বসানো হয় অনুকে। ওদের মুখোমুখি সোফায় অনিকের পাশে অনল বসা। হুট করে অনুকে দেখে বুকটা কেমন যেন মোচর দিয়ে ওঠে অনলের। এরকম অনুভূতি ওর আগে কখনো হয়নি। অস্বস্তিতে ঘিরে আছে সে। সাবলীল বা স্থির কোনোটাই থাকতে পারছে না। ইউসূফের বাবা হেসে বলেন,’বেয়াই সাহেব মেয়ে কী দেখব বলেন? ছোটো মেয়েটা যে এত বড়ো হয়ে গেল টেরই পেলাম না। ইউসূফ হুট করে আবদার করে বসে অনুকে বউ করে আনবে। অনুকে তো আমাদের শুরু থেকেই পছন্দ। আপত্তি করার প্রশ্নই আসেনি। আমার ছেলের পছন্দ কিন্তু মানতে হবে মশাই।’

উত্তরে খালেদ রহমান হাসেন। তাড়া দিয়ে বলেন,’তা যা বলেছেন! আপনার ছেলেও কম নয়। একি! চা নিচ্ছেন না কেন? চা নিন।’
‘তা নিচ্ছি। আগে এঙ্গেজমেন্টটা হয়ে যাক? আচ্ছা এত ঘরোয়াভাবে সবকিছু হওয়াতে আপনাদের কোনো সমস্যা নেই তো?’
‘একদম না।’ বললেন খালেদ রহমান।
‘তাহলে তো ঝামেলা চুকেই গেল। বুঝলেন সবই ছেলের পাগলামি!’

ইউসূফ একটু লজ্জা পেল। এর মাঝে একবারও অনু মুখ তুলে তাকায়নি।
‘দেখি আংটিটা দাও তো ইউসূফের মা।’ বললেন ইউসূফের বাবা। তিনি আংটিটা ইউসূফকে দিয়ে বললেন,’নে আংটিটা পরিয়ে দে।’
ইউসূফ ডান হাতে আংটি নিয়ে বাম হাত বাড়িয়ে দেয় অনুর দিকে। অনু সরাসরি অনলের দিকে তাকায়। তার চক্ষু ভরে অশ্রু জমা হয় মুহূর্তেই। অনল দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে ফেলে মাথা নত করে। আমেনা বেগম ছুটে এসে অনুর মাথাটা বুকে চেপে ধরেন। মাকে কাছে পেয়ে আরও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে অনু। তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,’পাগলী মেয়ে! কাঁদছিস কেন? এখনই কি তোকে নিয়ে যাচ্ছে নাকি?’

জরুরী ফোন এসেছে বলে তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে অনল। অশ্রুশিক্ত নয়নে অনলের চলে যাওয়া দেখে অনু। সকলে মিলে কী কী বোঝাচ্ছে তার কোনো কথাই অনুর কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। আমেনা বেগম অনুর বাম হাতটা ধরে এগিয়ে দেওয়ার পর ইউসূফ ওকে আংটি পরিয়ে দেয়।

রাতে খাওয়া-দাওয়া করে ইউসূফরা ওদের বাড়িতে চলে যায়। তারা গাড়ি নিয়েই এসেছিলেন। ঘরের বারান্দায় গলুকে কোলে নিয়ে চুপ করে বসে আছে অনু। বাবা-মা আত্মীয়দের ফোন করে সু-খবর জানাচ্ছে। তিনু অনিকের সঙ্গে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত। বড়ো বোনের বিয়েতে কী পরবে, কীভাবে সাজবে কতশত জল্পনা-কল্পনা তার! এদিকে মনের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে অনু। মনে পড়ে যায় অনলের সাথে কাটানো মুহূর্তের কথাগুলো। একসাথে ঘোরাফেরা, ঝগড়া করা। এসবকিছুর আড়ালে কি ভালোবাসা নামক কোনো শব্দ ছিল?
.
.
আকাশে চাঁদ নেই। তারা নেই। নাকি আছে? হতে পারে মেঘে ঢেকে আছে। পুরো আকাশজুরে অন্ধকারের বিচরণ। ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে অনল। অনুদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকেই ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাড়িতে কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে। জানালা, ব্যলকোনি থেকে অনুর ঘর দেখলে কষ্টে মূর্ছা যেতে ইচ্ছে করে। অথচ এরকমটা কখনো হওয়ারই কথা ছিল না।

‘অনল!’
নিজের নাম কারো ক্রন্দনরত কণ্ঠে শুনে পেছনে ফিরে তাকায় অনল। সামনে দাঁড়িয়ে অনু। অন্ধকারে মুখ বোঝা না গেলেও চিনতে অসুবিধা হয়নি একটুও। শাড়ির আঁচল এলোমেলো। খোঁপা করা চুলগুলো খুলে যাওয়ার উপক্রম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।

‘কাঁদছিস কেন অনু?’ জিজ্ঞেস করে অনল।

অনু দৌঁড়ে এসে ঝড়ের বেগে আছড়ে পড়ে অনলের বুকে। জ্যাকেট খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,’প্লিজ বিয়েটা ভেঙে দেন! আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।’

অনলের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অনুকে সে বহুবার কাঁদতে দেখেছে। কিন্তু কখনো তার এরকম অনুভূতি অনুভূত হয়নি। আজ মনে হচ্ছে বুকের পাঁজর ভেঙে চূড়ে যাচ্ছে। অনু অনলের শার্টের কলার চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,’ভেঙে দিবেন তো এই বিয়ে?’
‘শুধু শুধু পাগলামী করছিস অনু। ইউসূফ ভাইয়া অনেক ভালো ছেলে। তোকে অনেক সুখে রাখবে। তবে তোকে খুব মিস করব রে। তোর সাথে আর ঝগড়া করা হবে না, তোর পেছনে লাগা হবে না। সুইজারল্যান্ড গিয়ে কি আমায় ভুলে যাবি অনু?’

অনু এবার আরও জোড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ঐভাবেই শক্ত করে শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,’আপনি বলেছিলেন না আমি বোকা? সত্যি ভালোবাসা কোনটা আবেগ কোনটা আমি বুঝি না? সত্যিই এতদিন আমি বুঝিনি। আমি বুঝিনি যেই মানুষটা সারাক্ষণ আমার সাথে ঝগড়া করে সেই মানুষটাকেই আমি ভালোবাসি। আমি বুঝিনি যে এই মানুষটাকে ছাড়া আমার চলবে না। হ্যাঁ,আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনার সাথেই সারাজীবন আমি ঝগড়া করতে চাই। আপনার সাথেই আমি সারাজীবন কাটাতে চাই।’

অনুর হাত ছাড়িয়ে নেয় অনল। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,’একদিন তোর বিয়ে হবে জানতাম। তোর বিয়েতে খুব নাচব, আনন্দ করব ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই দিনটা যে এত দ্রুত চলে আসবে সেটা ভাবিনি। মিস করব অনু। ভীষণ মিস করব!’

এরপর জ্যাকেটটা খুলে অনুর গায়ে দিয়ে বলে,’শীতের মধ্যে আর এখানে থাকিস না। বাড়ি চলে যা।’
অনু কান্না বাঁধ মানে না। অনলকে খাঁমচে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে,’আপনি কি বুঝতে চাচ্ছেন না? নাকি বুঝতে পারছেন না? এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন? এড়িয়ে যাবেন না প্লিজ! দয়া করে আমার মনের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন। আমার আপনাকে প্রয়োজন। শুধুই আপনাকে।’
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যায়। আস্তে আস্তে শরীরটাও নিস্তেজ হয়ে আসে। কথাগুলো কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। একসময় সেন্সলেস হয়ে অনলের ওপরেই পড়ে যায় অনু। দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সে অনুকে। বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,’সরি।’ দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে অনলের চোখ থেকে।

চলবে…

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৭

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
অনলকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মুক্ত হয়ে নিল অনু। ভেংচি কেটে বলল,’হুহ্! আসছে। ভালোবাসিস আমায়! ঢং যত্তসব।’
‘ঢং?’
‘তা নয়তো কী?’
‘আচ্ছা যদি ঢং-ই হয় তাহলে তুই সাথীর প্রতি জেলাস হচ্ছিস কেন?’
‘আমি মোটেও জেলাস হইনি। আপনি আমায় জ্যাকেট দেননি অথচ ওকে দিয়েছেন এজন্যই আমার রাগ হয়েছিল।’
‘নিকুচি করি তোর রাগের।’
‘আর আপনার রাগকে আমি নিমকুচি করি। সারাজীবন অনু সিঙ্গেল থাকবে দরকার হলে। তবুও তো আপনাকে ভালোবাসবে না, না, না! কখনো না।’

অনু চলে যায় ভেতরে। অনল হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছু্ক্ষণ। এই মেয়ে সাংঘাতিক লেভেলের হিংস্র! তবে টোপ দিলে গিলবে নির্ঘাৎ। পরেরদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার পর একদম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই সাথীর সাথে দেখা হয়ে যায়। পারতপক্ষে বলা যায় সাথী নিজ থেকে পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। মিষ্টি করে হেসেই সাথী জিজ্ঞেস করল,’ভালো আছেন?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। তুমি?’
‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ্‌।’
অনুকে তখন দেখা গেল জেসি আর শুভার সাথে এদিকে আসছে। আড়চোখে ওদের দিকেও তাকাচ্ছে। অনল বেশ মজা পাচ্ছে। সে ঠোঁটে চওড়া হাসি টেনে বলে,’কফি খাবে?’
‘হ্যাঁ, খাওয়া যায়।’ মাথা দুলিয়ে বলল সাথী।

ওদের দুজনের কথোপকথন শুনতে না পেলেও দুজনকে ক্যান্টিনের দিকে যেতে দেখা গেল। অনু নাকমুখ কুঁচকে ফেলে। শুভা বলে,’এদের কাহিনীটা কী রে?’
‘আমি কী করে বলব?’ অনুর কথায় ক্রোধ। শুভা বলল,’রাগ করছিস কেন? আমি তোকে জিজ্ঞেস করলাম নাকি?’
‘তুই চুপ করে থাক।’
‘কথায় না পারলেই চুপ করে থাক!’
অনু এবার দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’জেসি ওকে চুপ করতে বল। নয়তো একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে বলে দিলাম।’
‘সকাল সকাল এত চটে যাচ্ছিস কেন? শুভা এমন কী বলল?’
‘ওহ! এখন তুইও তাহলে শুভার দলে? ভালো। খুব ভালো।’
রাগ দেখিয়ে হনহন করে অনু ক্লাসে চলে যায়। পিছু পিছু জেসি আর শুভাও আসে। কলম কামড়াচ্ছে অনু। আর একটু পরপর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো সাথীর আসার জন্যই অপেক্ষা করছে। কিন্তু সেই যে ক্যান্টিনে গিয়ে ঘাপটি মেরে রইল! এখনও তো আসার কোনো নামই নেই। অদ্ভুত! কী রসের আলাপ দুজনে শুরু করেছে কে জানে!

‘সরি।’ মৃদুসুরে বলল শুভা। অনু না তাকিয়েই বলল,’আমিও সরি। শুধু শুধু রাগ দেখিয়েছি।’
‘বাহ্। দুজনের তো মিল হয়েই গেল। চল ক্যান্টিনে যাই। কিছু খেয়ে আসি।’ প্রস্তাব করল জেসি। জেসির প্রস্তাবে সবচেয়ে বেশি খুশি অনুই হলো। সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ…বোধক ঘাড় নাড়িয়ে ক্যান্টিনে যাওয়ার জন্য ক্লাস থেকে বের হলো। ওরা ক্যান্টিনে ঢুকেছে, সাথী আর অনল ক্যান্টিন থেকে বের হয়েছে। অনুর মুখোমুখি হয়ে ফিচেল হাসে অনল। দাঁত কেলিয়ে বলে,’কিছু খাবি অনু? খেলে খা। বিল আমি দেবো।’

রাগে শরীর জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে অনলের কথা শুনে। অনু কটমট করে বলে,’আমার টাকা আছে। আপনার টাকা আমার লাগবে না।’
‘আরে এমন করিস কেন? তুই আমার ছোটো বোন। তোকে তো আমি খাওয়াতেই পারি।’
অনুর মাথা ভনভন করছে। শালা বললটা কী! অনুর চোখে-মুখে রাগ থাকলেও সাথী বেশ খুশি হলো। অনুকে জিজ্ঞেস করল,’তুমি আর অনল আপন ভাই-বোন?’
রাগের চোটে অনুর মুখ থেকে কথাই বের হচ্ছে না। অন্যদিকে অনল বেশ মজা নিচ্ছে। জেসি তখন কাঠকাঠ গলায় বলে,’না সাথী। অনল ভাইয়ার আম্মু আর অনুর আম্মু বেষ্টফ্রেন্ড। সেই সূত্রে ওদের পারিবারিক বন্ডিং আছে। অনু যেহেতু অনল ভাইয়ার থেকে বয়সে ছোটো সেহেতু অনু তো তাকে ভাইয়া বলেই সম্ভোধন করবে তাই না?’
‘ও।’ ছোটো উত্তর সাথীর।
সাথী সৌজন্যমূলক হাসলো। অনু, জেসি এবং শুভা আর কথা না বাড়িয়ে ক্যান্টিনের ভেতর চলে যায়। অনল বিড়বিড় করে বলে,’জ্বল জ্বল! আরো জ্বল। দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি।’
_______________

সূর্যের দেখা আজ প্রায় নেই বললেই চলে। ঘন শুভ্র কুয়াশার আড়ালে আচ্ছাদিত অবস্থায় আছে এখন সূর্য। ল্যাপের নিচে অনেকক্ষণ বসে থেকে এক মিনিটের জন্য বের হলেই আবারও শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই প্রয়োজন ব্যতীত আজ কেউই বাইরে যাচ্ছে না। তিনু কলেজ থেকে এসে সেই যে ল্যাপের ভেতর ঢুকেছে, আর বের হয়নি।
সন্ধ্যায় খালেদ রহমান বাড়ি ফিরেন। সচারচর বাড়ি ফিরতে তার দশটা বাজে।সেই তুলনায় আজ অনেক আগেই ফিরেছেন। চোখে-মুখে গাম্ভীর্যের সঙ্গে রয়েছে অন্য এক খুশির আভাস। আমেনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন,’এক কাপ চা নিয়ে ঘরে আসো তো।’

আমেনা বেগম চা নিয়ে ঘরে আসেন। খালেদ রহমান চায়ের কাপ নিয়ে বললেন,’বসো এখানে।’
আমেনা বেগম বিছানার এক পাশে বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খালেদ রহমান বলেন,’অনুর জন্য ভালো একটা পাত্র পেয়েছি। দেখতে-শুনতে সবদিক দিয়েই ভালো। পরিবার-ও মাশ আল্লাহ্।’
‘এত তাড়াতাড়ি অনুর বিয়ে দিতে চাচ্ছ যে?’
‘এত তাড়াতাড়ি কোথায় দেখলে? অনু এখন ভার্সিটিতে পড়ে। সেই ছোটোটি নেই এখন। আর মেয়েদের বেশি বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।’
‘অনুকে একবার বলা উচিত না?’
‘হ্যাঁ, বলবে। আমার মনে হয় না ছেলেকে কোনোদিক থেকে ওর বা তোমার অপছন্দ হবে। ছেলে কে সেটা জানলে তুমি অবাক হবে।’
‘আমি চিনি?’
‘হ্যাঁ। ইউসুফের কথা মনে আছে না? তোমার তো ভালো করে মনে থাকার কথা।’
‘অনিকের মামাতো ভাই?’
‘হ্যাঁ। দশ, পনের দিন হবে সুইজারল্যান্ড থেকে দেশে ফিরেছে। বেড়াতে এসেছে। আমাদের অনুকে দেখে পছন্দ করেছে। কী ভদ্র ছেলে! মেয়ে পছন্দ হয়েছে ডিরেক্ট ওর বাবাকে দিয়ে আমায় বলিয়েছে। এখনকার যুগে এমন ছেলে পাওয়া যায়? আজ এই বিষয়েই আমি, ইউসূফের বাবা আর অনলের বাবা কথা বললাম। ইউসূফকে তো আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তিন মাস থাকবে। এর মাঝেই বিয়ে করতে চায়। অনুকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডেই সেটেল হবে। বলো এবার আপত্তি আছে?’

আমেনা বেগম কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি একটা ঘোরের মাঝে আছেন। ইউসূফ অনলদের বাসায় এসে তার সাথেও দেখা করে গেছে। কিন্তু হাভভাবে এমন কিছুই মনে হয়নি। এমনকি কিছু বলেওনি। তিনি জড়তা রেখে বললেন,’অনু আমাদের ছেড়ে এত দূরে থাকবে! মানে বলছিলাম যে…’

এ কথা শুনে খালেদ রহমান কপালে ভাঁজ টেনে বলেন,’এইটা আবার কী কথা বললে? মানুষ কি বিদেশে থাকছে না? তোমার তো আরও খুশি হওয়ার কথা। ক’জন মেয়ে এমন ভাগ্য পায়?’
এমন কথার প্রত্যুত্তরে আমেনা বেগম আর কিছু বলতে পারলেন না। কাপের অবশিষ্ট চা’টুকু সম্পূর্ণ শেষ করে খালেদ রহমান বললেন,’যাও অনুকে গিয়ে খবরটা দাও।’

সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসা থেকে উঠলেন আমেনা বেগম। ধীর পায়ে অনুর রুমে এগিয়ে যান। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তখন ফেসবুকিং করছিল অনু। শান্ত মুখটা দেখে তার বড্ড মায়া হচ্ছে। যদি সত্যি সত্যিই অনুর ইউসূফের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়? তাহলে এই মুখটা প্রতিদিন কাছ থেকে দেখা হবে না। অনেক দূরে চলে যাবে। কত রাগই না তিনি অনুকে দেখান। সেসব স্মৃতি রোমন্থন করে দু’চোখের পাতা তার ভিজে উঠে। গলু ম্যাও ম্যাও শব্দ করলে তিনি চোখের পানি মুছে নেন। ফোন রেখে গলুকে পেটের ওপর বসিয়ে অনু বলে,’এমন চিল্লাচ্ছিস কেন বদ?’
এবারও উত্তরে গলু ম্যাও ম্যাও করছে। গলুর দৃষ্টি দরজার দিকে। অনুও দরজার দিকে তাকায়। আনমনে আমেনা বেগমকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,’মা তুমি! ওভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো।’

এই মুহূর্তে তার নিজেকে বড্ড ভারী মনে হচ্ছে। শরীর একদম চলতে চাচ্ছে না। তিনি এগিয়ে গিয়ে অনুর পাশে বসেন। চুলে হাত বুলিয়ে দেন। অনু মুচকি হেসে বলে,’কী ব্যাপার হু? হঠাৎ এত আদর কেন?’

অনুর ভ্রুঁ নাচানি আর দুষ্টু হাসি দেখে হেসে ফেলেন আমেনা বেগম। গালে হাত বুলিয়ে বলেন,’তুই কত বড়ো হয়ে গেছিস অনু।’
‘ওমা! তো বড়ো হব না?’
‘হবি তো! কিন্তু তাই বলে এত বড়ো? বউ হওয়ার মতো?’
‘বুঝলাম না মা। কীসের বউ? কার বউ?’
‘আমাদের ছোটো অনু চোখের পলকেই বড়ো হয়ে গেছে অথচ খেয়ালই হয়নি। এখনও মনে হয় তুই আমার ছোট্ট অনু।’

‘একটু ঝেড়ে কাঁশো মা। আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না।’ ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বলল অনু। তিনি বললেন,’ইউসূফের কথা মনে আছে? অনল, অনিকের মামাতো ভাই।’
‘একটু একটু! অনেক বছর আগে দেখেছিলাম। তো কী হয়েছে?’
‘তোকে পছন্দ করেছে ইউসূফ। বিয়ে করতে চায়।’
‘এসব তুমি কী বলছ মা? আমি তো এখন বিয়ে করব না।’
‘তোর আব্বুর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে রাজি। তাই তোকে বলতে বলল।’
‘কী আজব! আমার বিয়ে অথচ আমার মতামত নেবে না?’
‘অসুবিধা কী? ছেলে তো ভালো।’
‘হোক ভালো। আমিও তো খারাপ নই। কিন্তু আমি বিয়ে করব না। তুমি আব্বুকে বলে দাও।’
‘আমি কী বলব? তুই গিয়ে বল।’
‘কাউকেই বলতে হবে না। এই বিয়ে ভেঙে দেবো।’
আর কিছু না বলেই অনু বাড়ি থেকে বের হয় অনলের কাছে যাওয়ার জন্য। এর বিহিত একমাত্র অনলই করতে পারবে। ইউসূফকে জানালে অবশ্যই সে বিয়ে ভেঙে দেবে।

অনলদের বাড়ি যাওয়ার পর দরজা খুলে দেন শিমুল বেগম। অনল এবং অনিকের মা তিনি। অনুকে দেখেই এক গাল হেসে বলেন,’আরে অনু! তোর কথাই হচ্ছিল। আয় ভেতরে আয়।’
‘অনল ভাইয়া কোথায় আন্টি?’ ভেতরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল অনু।
‘সেই যে সকালে ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। আর আসেনি এখনও। কই কই যে থাকে ছেলেটা! বাদ দে ওর কথা। তুই বোস। তোর সঙ্গে কথা আছে।’

অস্বস্তি নিয়েই বসতে হলো অনুকে। ফোনটাও বাসায় রেখে এসেছে। নয়তো ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলা যেত। আচ্ছা অনিককে বললেই তো ফোন করার কথা। তখন শিমুল বেগম বললেন,’আমি চা নিয়ে আসি দাঁড়া।’
‘আচ্ছা। আন্টি অনিক কি বাসায়?’
‘হ্যাঁ, অনিক ওর ঘরেই আছে।’

শিমুল বেগম রান্নাঘরে যাওয়ার পর অনু অনিকের ঘরে আসে। ল্যাপ গায়ে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে অনিক। অনু ওকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ডাকে,’এই অনিক ভাইয়া। অনিক ভাইয়া? এই ভর সন্ধ্যায় ঘুমিয়েছেন নাকি? উঠুন।’

প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কিতে মনে হচ্ছিল ঝড় হচ্ছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে ল্যাপের ভেতর থেকে মাথা বের করে। সমস্ত ঘুমের নেশা তার কেটে যায়। এদিকে অনুও অপ্রস্তুত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।
‘অনিক ওয়াশরুমে। আমি ইউসূফ।’ মিষ্টি হেসে কথাটি বলল ইউসূফ।

চলবে…

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৬

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
তিনুকে নিয়ে আইসক্রিম খেতে বেরিয়েছে অনু। শীতের দিনে আইসক্রিম খাওয়ার আলাদা রকম মজা আছে। কিন্তু বাবা-মা একদম পছন্দ করে না। তাই দু’বোন লুকিয়ে বের হয়েছে। দোকানে যাওয়ার পর দেখা হয় এক পরিচিত ভিক্ষুকের সঙ্গে। অনু তাকে চেনে। বৃদ্ধা মহিলা। এই বয়সে কই আরাম-আয়েশ করে খাবে তা না; ভিক্ষা করতে হচ্ছে। ছেলেরা তাদের বউ নিয়ে আলাদা থাকে। একবার ভিক্ষা করা চালের ব্যাগ নিয়ে তাকে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বসে পড়ে সেখানেই। অনু কাছে গিয়ে দেখে বৃদ্ধার প্রচণ্ড জ্বর শরীরে। সেদিন তার থেকে ঠিকানা নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে রিকশা করে। বাড়ি না বলে বস্তি বলা যায়! বাড়ি যাওয়ার আগে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ আর কিছু খাবার কিনে দিয়েছিল। আবেগে বৃদ্ধা চোখের পানি ঝরঝর করে ছেড়ে দেন। সেই থেকেই বৃদ্ধা প্রায়ই এই এলাকায় আসতো।

‘দাদু এখানে কী করছেন?’
তিনি পিছু ফিরে অনুকে দেখে খুশি হন। ভাঙা ভাঙা গলায় বলেন,’দুধের প্যাকেট নিতে আইছিলাম বইন। কিন্তু আমার কাছে ১২ টেকা আছে শুধু।’
অনুর মায়া হলো তার কথা শুনে। সে নিজেই তাকে দুধের প্যাকেট কিনে দিল।
তিনি অনুর মাথায় হাত রেখে দোয়া দেন,’আল্লাহ্ তোরে বাঁচাইয়া রাখুক বইন। সারজীবন ভালো থাক, দোয়া করি।’
অনু মুচকি হাসে। তাকে একটা রিকশা ঠিক করে ভাড়াও দিয়ে দেয়। ছোটো বেলা থেকেই এমন পরোপকারীর স্বভাবটা অনুর মাঝে আছে। সাধ্যের মধ্যে সবসময়ই চেষ্টা করে আশেপাশের মানুষদের সাহায্য করতে।

আইসক্রিম খেতে খেতে দু’বোন রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। অনুর এমন পরোপকারী স্বভাব দেখে তিনু জিজ্ঞেস করে,’তুমি যে সবাইকে এত সাহায্য করো এতে কী লাভ হয় আপু?’
অনু হেসে বলে,’আজ ওদের বিপদে আমি সাহায্য করছি। একদিন ওরা আমার বিপদে সাহায্য করবে।’
‘ছাই করবে। তোমার মন অনেক নরম আপু। এরা স্বার্থের জন্যই তোমায় এত ভালোবাসা দেখায়। একদিন বিপদে পড়ে দেখো সবাই লেজ গুটিয়ে পালাবে। আসল চেহারা বের হবে তখন।’

তিনুর কথায় অনুকে বিচলিত হতে দেখা গেল না। বরঞ্চ মৃদু সহাস্যে বলল,’বেশ তো! তাতেই বা সমস্যা কী? আমার আল্লাহ্ আছে না? তিনিই আমার জন্য যথেষ্ট। আমার বিপদের সময় তার থেকেই আমি সাহায্য পাব আমার বিশ্বাস।’
‘আপু।’
‘বল।’
‘তুমি আমার অনুপ্রেরণা।’
অনু বোনের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,’পাগলী।’
বাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে যাওয়ার পর আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,’দুজনে মিলে কই গেছিলি?’
‘একটু নিচে গেছিলাম মা।’ বলল তিনু।
‘সারাক্ষণ শুধু টইটই করে ঘুরে বেড়ানো না? যা পড়তে বোস।’

তিনু অনিচ্ছা নিয়েই পড়তে বসলো। কিন্তু পড়াতে মন নেই। অনিকের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। এখন ফোন করাটা কী ঠিক হবে? না, থাক! দরজা লাগালেই মা খ্যাচখ্যাচ করবে। ইশ! আমার আর অনিকের সম্পর্কটা যদি আপু আর অনল ভাইয়ের মতো হতো তাহলেই ভালো হতো। যখন তখন ঝগড়া করতে অনিকও বাড়িতে চলে আসতো। উল্টাপাল্টা চিন্তা করে তিনু একাই আনমনে হাসে।
.
.
পা টিপে টিপে ঘরে আসে অনল। চুপচাপ অনুকে পর্যবেক্ষণ করছে। মেজাজ বোঝার চেষ্টা করছে। অনু বিড়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে আর হাসছে। অনলের আগমন টের পায়নি। দেখে তো মনে হচ্ছে মেজাজ ভালোই। খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে অনল, ‘এহেম! এহেম!’

অনু মাথা তুলে পেছনে তাকায়। অনলকে দেখেই হাসি উধাও হয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে। অনলকে সম্পূর্ণ ইগনোর করে বিড়ালের দিকে মনোযোগ দেয়।
‘কী করছিস অনু?’ মন গলানোর জন্য নরম স্বরে বলল অনল। অনু কিছুই বলল না। নিশ্চুপ রইল।
‘কথা বলবি না অনু? বোবা হয়ে গেছিস?’
মেজাজ খারাপ করে তাকায় অনু। অনল বলে,’তোকে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।’
‘তাড়াতাড়ি বলে বিদায় হন। অসহ্য!’
‘শোন গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হচ্ছে, তুই তো ঢং করে আবার পশু-পাখির নামও রাখিস। তাই আগেই বলে রাখি এই বিলাইর নাম ভু্লেও পিলু রাখবি না।’
‘কেন?’ অনলের কথায় ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলো অনু। অনল কোমরে হাত রেখে বলল,’এই বিলাই তো আর তোর সো কোল্ড বয়ফ্রেন্ড দেয়নি। আমি দিয়েছি।’
‘তো?’
‘তো ওর নাম রাখবি গলু। নামটা সুন্দর না? অবশ্য হতেই হবে। কে রেখেছে সেটাও তো দেখতে হবে!’
‘এত ভাব নেওয়ার কিছু নাই। আমার আপনাকে পছন্দ না। আপনার দেওয়া নামও পছন্দ হয়নি।’
‘তাইলে আমার বিলাই আমারে দে।’ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল অনল। অনু ঝড়ের গতিতে বিড়ালছানাটি সরিয়ে নিয়ে বলল,’এহ্! তা আর হচ্ছে না। এই বিড়াল এখন আমার।’
‘তুই বড্ড চালাক রে অনু।’
বিড়ালছানাটি দ্রুত সরাতে গিয়ে বিড়ালের নখের আঁচড় লাগে অনুর হাতে। অনু ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে।অনল দ্রুত বিড়ালটি কোলে নিয়ে বলে,’আহারে! দেখি দেখি কোথায় লাগল?’
হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে অনু বলে,’এখানে?’
অনল ধমক দিয়ে বলে,’তোকে জিজ্ঞেস করেছি নাকি? আমি তো বিলাইকে জিজ্ঞেস করেছি।’
‘আমি কী করে জানব আপনি মানুষ রেখে প্রাণীকে জিজ্ঞেস করবেন?’
‘ইশ! কী আমার মহারাণী আসছে গো।’
অনুর মুখের দিকে একটু ঝুঁকে গিয়ে বলে,’তুই কি ভেবেছিস তুই ব্যথা পেলে আমার টেনশন হবে? ভুল! আমার আনন্দ লাগে। খুশি হই আমি। হুহ!’
তারপর অনুর কপালে টোকা দিয়ে ঘর থেকে চলে আসে অনল। অনু কটমট করে তাকিয়ে থাকে ওর যাওয়ার পথে। বিড়বিড় করে বলে,’বজ্জাতের বজ্জাত অনইল্লাই!’

অনল চলে গিয়েও আবার ফিরে আসে। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকে,’অনু?’
‘আপনি এখনো যাননি?’
‘তোর কি মনে হয় তাসিন তোকে সত্যিই ভালোবাসে?’
‘অবশ্যই।’
‘বেশ। ওকে বিয়ের কথা বলতে বলছিলাম বলেছিলি?’
‘হ্যাঁ। ও বলছে চাকরী পেলে বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।’
‘আচ্ছা চল আমার সাথে।’
‘কোথায়?’
‘চল তো আগে।’

অনলের সাথে ঝামেলা করার ইচ্ছে নেই। সে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। খাইয়ে মন গলানোর চেষ্টা? তা হচ্ছে না।
‘এখানে নিয়ে আসলেন কেন?’ জিজ্ঞেস করল অনু।
‘আয়। চল।’
অনল এবার অনুকে দু’তলায় নিয়ে গেল। সামনে হাতের তর্জনী দ্বারা একটা টেবিল দেখিয়ে দিল। হাতের ইশারা অনুযায়ী অনুও সেখানে তাকায়। তাসিন একটা মেয়ের হাত ধরে বসে আছে। হাসাহাসি করছে। অনুর মুখটা হা হয়ে যায়। রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। অনলের দিকে তাকাতেই সে বলে,’এই হলো তোর সো কল্ড বয়ফ্রেন্ড। ও তোকে বিয়ে করবে মনে হয়? কক্ষনো না। টাইমপাস! সব টাইমপাস।’
অনু হনহন করে তাসিনের দিকে গেল। টেবিলের ওপর থাপ্পড় বসিয়ে দু’হাত রেখে তাসিনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায়। ভূত দেখার মতে চমকে যায় তাসিন। তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলে,’ত…তু..মি!’
অনু তাসিনের গলা টিপে ধরে বলল,’শালা তোতলা, গাধা, বলদ, হারামজাদা আমার সাথে প্রেম করে এখন আবার অন্য মেয়ে নিয়ে রেস্টুরেন্টে আসছিস। তোর কলিজা কত্ত বড়ো! আজ তোর কলিজা বের করে দেখব আমি। দাঁড়া!’
অনু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক খুঁজে টেবিলের ওপরই একটা ছোটো চাকু পায়। উপস্থিত সকলেই প্রায় হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়েছে। এমনকি তাসিনের নতুন গার্লফ্রেন্ডও! অনল দৌঁড়ে গিয়ে অনুকে আটকায়। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো অনু বলে,’ছাড়েন আমায়। আজ এই শালার কলিজা বের করবই আমি।’
‘থাম, থাম অনু। এমন করিস না।’

অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে শান্ত করে অনুকে। বড়ো বড়ো শ্বাস নিচ্ছে অনু। তাসিন সাহস করে বলে,’আমার কথা…’
অনু ঠাটিয়ে এক থাপ্পড় বসায় তাসিনের গালে। কাঁটাচামচ হাতে তুলে নিয়ে একদম তাসিনের মুখের সামনে ধরে বলে,’দেখছিস হাতে কী? নেক্সট টাইম আর যদি আমার সামনে আসিস তাহলে কাঁটাচামচ দিয়ে তোর চোখ আমি উপড়ে ফেলব। আজ থেকে তোর সাথে আমার ব্রেকাপ!’
কাঁটাচামচ রেখে একটা টিস্যু নিয়ে বেরিয়ে আসে অনু। তাসিন গালে হাত দিয়ে বসে আছে। থাপ্পড়টা খুব লেগেছে! অনল ওর নতুন গার্লফ্রেন্ডকে বলে,’আপু আপনি কিছু বলবেন না?’
মেয়েটি দাঁত কটমট করে তাসিনকে বলে,’লুচ্চা ছেম্রা কতগুলা মেয়ের লগে রিলেশন করস তুই? ভাগ্যিস শুরুতেই সব জানতে পারছিলাম। বেয়াদব! আমারও তোর সাথে ব্রেকাপ।’

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর অনল সেখানে বসে। কাঁটাচামচ টেবিলের ওপর ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,’প্রথমে যদি ভালো কথায় নিজেই অনুর জীবন থেকে সরে যেতে; তাহলে আজ সবার সামনে তোমায় অপমানিত হতে হতো না। আবার নতুন গার্লফ্রেন্ডও হাতছাড়া হতো না।’
তাসিন নির্বাক। অনল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’এতগুলো গার্লফ্রেন্ড পালতে শুধু চেহারা আর টাকা থাকলেই হবে না। বুদ্ধিও থাকা লাগবে। গবেট!’

অনল রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে দেখে অনু কাঁদছে আর একটু পরপর টিস্যু দিয়ে নাক মুছছে। এজন্যই তাহলে টিস্যুটা নিয়ে এসেছিল। অনলকে দেখে অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে কেঁদে বলে,’ঐ বজ্জাতটা…’ এইটুকু বলে আবার নাক মুছে নিল। তারপর বলা শুরু করল,’কেমনে পারল!’
অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অনল বলে,’আহারে! থাক কাঁদিস না অনু। চল আজ তোকে ঘুরতে নিয়ে যাব।’
অনু রাজি হলো। এখন তার মন ফ্রেশ করা দরকার। সারা বিকেল ঘুরেফিরে সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে পৌঁছে দেয়। বাড়ির ভেতর যাওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়িয়ে অনু বলে,’তাসিনের আসল চেহারা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য থ্যাঙ্কস। আর সারা বিকেল আপনার সাথে ঘুরেছি বলে ভাববেন না, আপনার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। রাগ আছে। অনেক রাগ আছে।’
‘কেন? আমি আবার কী করলাম?’
‘নাটক করবেন না। আপনি অনেক স্বার্থপর একটা লোক। সকালে যে আমি জ্যাকেট চাইলাম তখন তো আমায় দিলেন না। অথচ সাথীকে ঠিকই দিলেন।’
‘সিচুয়েশনটা অন্যরকম ছিল অনু। তুই আমায় ভুল বুঝছিস।’
‘আমি কোনো ভুল বুঝছি না। আমি স্পষ্ট দেখেছি, সাথী কেমন করে যেন আপনার দিকে তাকাচ্ছিল। বিশ্বাস না হলে জেসি আর শুভাকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।’

অনল হ্যাঁচকা টানে অনুকে কাছে এনে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করায়। অনলের হাত দেয়ালে। অনু ওর দু’হাতের মাঝে বন্দি। বেশ অবাক এবং ভয়ও পায় এমন কাণ্ডে। এত কাছে অনল এর আগে কখনো আসেনি। অনলের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস অনুর মুখের ওপর পড়ছে। ধীরে ধীরে অনুর নিঃশ্বাসও কেমন জানি ভারী হয়ে আসে। মোহমীয় দৃষ্টিতে অনুর চোখে চোখ রেখে অনল জিজ্ঞেস করে,’ভালোবাসিস আমায়?’

চলবে….

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৫

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
খালেদ রহমান ভীষণ রাগী মানুষ। নিশ্চুপ এবং গম্ভীর স্বভাবের। সামনেই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনু। তিনি তিরিক্ষি মেজাজে বলেন,’সবসময় এত দৌঁড়াদৌঁড়ি কীসের? শান্তভাবে হাঁটা যায় না?’
‘সরি আব্বু।’ মাথা নত করেই বলল অনু। তিনি গললেন না। চেঁচিয়ে আমেনা বেগমকে ডাকেন। হন্তদন্ত হয়ে আমেনা বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। খালেদ রহমান বলেন,’মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষা কিছু দাওনি না? মেয়েরা মায়ের থেকে শিখবে না তো কার থেকে শিখবে?’

‘কী হয়েছে?’ নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম।
‘কী হয়েছে সেটা তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো। এমন দূরন্তপনা স্বভাব বাদ দিতে বলো। নম্রতা, ভদ্রতা কিছু শেখাও।’
তিনি অনলের দিকে একবার বিভাবসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলেন বাইরে। এতক্ষণ এক পাশে অনলও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি চলে যাওয়ার পর আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করেন,’কী করেছিলি তোরা দুটোয়?’
অনল নিরপরাধীর মতো বলল,’আমার কোনো দোষ নেই আন্টি। তোমার মেয়েই তো আমায় দৌঁড়ানি দিয়েছে।’
‘এসব সত্যি অনু?’ জিজ্ঞেস করলেন মা। অনু দাঁত কটমট করে বলে,’হ্যাঁ সত্যি। কেন দৌঁড়ানি দিয়েছি সেই কারণটাও তার থেকে শুনে নিও।’
এরপর গটগট করে সে চলে যায় নিজের রুমে। দুজনের ঝগড়াঝাঁটি সম্পর্কে তিনি বেশ ভালো করেই অবগত। তাই আর ঘাঁটালেন না এই বিষয়ে। অনু ভীষণ রেগে আছে বলে আর রাগালো না অনল। এই রাগ যে আবার কোনভাবে প্রয়োগ করবে কে জানে!

পাঁচবার ফোন দিয়েছিল তাসিন। ফোন সাইলেন্ট থাকায় শুনতে পায়নি অনু। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই দৃষ্টিতে পড়ে। কলব্যাক করে সে। কিন্তু তাসিন কেটে দিয়ে ব্যাক করে। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে অনলের করা থ্রেডের কথা অনুকে জানায়। অগ্নিশিখা দাউদাউ করে জ্বলছে অনুর দু’চোখে। তৎক্ষণাৎ ফোন রেখে অনু অনলকে খুঁজতে যায়। আজকে তো ওর খবর আছেই!
.
.
চায়ের দোকানে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে চা পান করছিল অনল এবং ওর বন্ধুরা। দূর থেকে অনুকে আসতে দেখে রাজীব বলল,’দোস্ত অনু আসতেছে। দেখে তো মনে হচ্ছে রেগে ফায়ার হয়ে আছে।’

রাজীবের কথায় ঘাড় বাঁকা করে পেছনে তাকায় অনল। ততক্ষণে অনু অনেকটা কাছে চলে এসেছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে অনলের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনল এবার ঘুরে অনুর মুখোমুখি বসে চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কোমরে হাত রেখে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে অনু। কাপের চা টুকু শেষ করে অনল অনুর উদ্দেশ্যে বলে,’সাপের মতো হিসহিস করছিস কেন অনু? তুই কি সাপের দেবী?’

এমনিতেই অনলের ওপর তার রাগের সীমা নেই। তার ওপর এখন উল্টাপাল্টা কথা বলছে। রাগের মাত্রা দ্বিগুণ থেকে চারগুণ হয়ে যায়। অনু কটমট করে তাকিয়ে থাকে অনলের দিকে। নাক ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,’আপনি তাসিনকে কী বলেছেন?’
‘তাসিন কে? ওহ মনে পড়েছে। তোর সো কোল্ড বয়ফ্রেন্ডের কথা বলছিস? কী বলব ঐ বলদটাকে। কিছুই বলিনি।’ ঠোঁট উল্টে ভ্রুঁ নাচিয়ে বলল অনল। অনু নিচের ঠোঁট কামড়ে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। চায়ের দোকানদার আর অনলের বন্ধুরা অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে বেশি কিছু বলা মানে সিনক্রিয়েট করা। এলাকার সবাই জানে অনু শান্তশিষ্ট, লক্ষী মেয়ে। এই খেতাবগুলো বজ্জাদ অনলের জন্য নষ্ট করতে চাচ্ছে না। তাছাড়া ওকে বলেও লাভ নেই। খাড়ার ওপর অস্বীকার করে বসে থাকে। যা বলার আন্টিকেই বলতে হবে। মনে মনে হিসাব কষিয়ে অনু চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। কয়েক কদম এগোনোর পর অনল অনুর নাম ধরে ডাকে। ডাক শুনে পিছু ফিরে অনু অনলের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তারপর হনহন করে আবারও হাঁটা শুরু করে। অনল দৌঁড়ে যায় অনুর কাছে। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলে,’এতদিন ভাবতাম ঐ বলদটাকে বলদ বললেও সত্যিকার অর্থে বলদ নয়। কিন্তু আজকে প্রমাণ হলো ঐ শালায় শুধু বলদই নয়; একটা রামছাগলও।’

অনু হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে থেমে যায়। সঙ্গে অনলও থেমে যায়। অনু দাঁতমুখ খিঁচে বলে,’আপনি কিন্তু বেশিরকম বাড়াবাড়ি করছেন।’
‘বাড়াবাড়ির কী দেখলি তুই? তোর ঐ সো কোল্ড বলদ বিএফকে যদি আর দেখেছি এই এলাকায় তাহলে ঠ্যাং ভেঙে রেখে দেবো। তারপর একটা ভাঙা থালা হাতে দিয়ে চার রাস্তার মোড়ে বসিয়ে দেবো ভিক্ষা করতে। পাশে তুইও থাকিস। দুজন মিলে ভিক্ষা করবি।’
‘আপনি একটা নিকৃষ্ট, অসহ্য, বিরক্তিকর লোক।’ অনলের দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল অনু। অনল মুচকি হেসে অনুর থেকে পিছিয়ে যায়। নিজের চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে অনুর দিকে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়ায়। চোখ দুটো ছোটো ছোটো করে বলে,’জানি।’
দু’হাতে ধাক্কা দিয়ে অনলকে সরিয়ে দিয়ে অনু বলে,’আপনাকে আর কিচ্ছু বলব না আমি। আমি তো এটাই বুঝি না আমাকে নিয়ে এত কীসের সমস্যা আপনার? থাকব না আর এই এলাকায়। মাকে বলে চলে যাব।’
‘তাই নাকি? চলে যাবি? আমিও দেখব তুই আন্টিকে কী করে রাজি করাস।’

রাগে চোখমুখ, গাল লাল হয়ে আছে অনুর। পারছে না শুধু অনলকে পানি ছাড়াই গিলে খেতে। অনল বেশ উপভোগ করছে অনুর এই রিয়াকশন। অনলকে মুচকি মুচকি হাসতে দেখে আরও বেশি রাগ হয় অনুর। জিদ্দে বলে,’অসভ্যের মতো হাসবেন না।’
‘কেন রে অনু? তুই পেঁচিমুখি বলে কি আমিও পেঁচা? আমি তো হাসতে পারি।’
অনু আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটা শুরু করে। অনল শব্দ করে হাসতে হাসতে বলে,’রাগলে তোকে লাল টমেটোর মতো লাগে অনু।’

অনু দাঁড়িয়ে যায়। অনলের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,’আপনি কি আমায় ভালোবাসেন অনল ভাই?’
অনলের হাসি থেমে যায়। চুপ করে তাকিয়ে থাকে অনুর দিকে। উত্তরের জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অনু। শান্ত শীতল বাতাস দুজনকেই ছুঁয়ে দিচ্ছে। হঠাৎই অনল ফিক করে হেসে বলে,’তোকে ভালোবাসতে যাব আমি? তোর চাইতে তো রাস্তার কোনো পাগলীকে ভালোবাসাও উত্তম।’
এবার মনে হচ্ছে রাগে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে অনুর। চারপাশে অনলকে মারার জন্য কিছু খুঁজছে। এদিকে পেটে হাত চেপে অনল হেসেই চলেছে। ইটের অর্ধেক টুকরো হাতে তুলে নিয়ে অনলের দিকে এগিয়ে আসে অনু। অনল পেছাতে পেছাতে বলে,’এটা দিয়ে মারিস না রে অনু। মাথা ফেঁটে যাবে। আর মাথা ফেঁটে গেলে রক্ত বের হবে। রক্ত বের হলে আমি মারা যাব। আর আমি মারা গেলে আমার হবু বউ বিধবা হবে। তুই এটা করতে পারিস না অনুউউউ।’

শেষের লাইনটা বলতে বলতেই অনু দৌঁড়ে আসতে শুরু করে। এবার অনলও দৌঁড় শুরু করে। জিদ্দে ইট ছুঁড়ে মেরে ক্ষান্ত হয় অনু। যদিও অনলের গায়ে লাগেনি। অনু হাঁপিয়ে উঠেছে। উরুতে দু’হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে নিতে স্বগতোক্তি করে বলে,’অসভ্য বানরের দল! জীবনটা তেজপাতা করে দিচ্ছে।’
______________________

এক সপ্তাহ্ প্রায় হয়ে গেছে ক্লাস শুরু হওয়ার। প্রথমদিনের পর থেকে কেউ আর কিছু বলেনি ওদের। কিন্তু ঐ ছেলেগুলোর সঙ্গে দেখা হলেই কেমন যেন আড়চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতো। কী লজ্জা! কী লজ্জা! স্টাইল করে আজ শুধু শাল পরে এসেছিল অনু। তাও পাতলা একটা শাল। তবুও যদি গায়ে থাকত! জেসি আর শুভা ভাগ করে গায়ে দিয়ে বসে আছে। সকালে হালকা রোদ দেখে ভেবেছিল আজ ঠান্ডা তেমন পরবে না। তাই ওরা জামার ওপর পাতলা সোয়েটার পরেছিল। ভার্সিটিতে আসার পর হলো তার উল্টা। একটু দেখা রোদের আলো ঘন কুয়াশার মাঝে তলিয়ে গেল। অনু অনলকে ওদের ক্লাসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় জানালা দিয়ে ডাক দেয়। তারপর দৌঁড়ে ক্লাস থেকে বের হয়।
‘কী বলবি তাড়াতাড়ি বল। সময় নেই হাতে।’ বলল অনল।
অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে একটু বিড়বিড় করল। তারপর বলল,’আপনার জ্যাকেটটা দেন না। ভেতরে তো সুয়েটার পরছেন।’

অনল ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’কোন দুঃখে? ভেতরে সুয়েটার পরি বা ল্যাপ,কম্বল সাথে করে নিয়ে আসি। তাতে তোর কী? তুই কেন আমার জ্যাকেটের দিকে নজর দিবি? স্টুপিড মেয়ে!’
‘দেন না! এমন করেন কেন? খুব শীত করছে।’
‘করুক শীত। শীত করাই উচিত। ঢং করে সুয়েটার পরিসনি কেন? এখন থাক। দেখ কেমন লাগে।’
অনল সত্যি সত্যিই জ্যাকেটটা দিল না। চলে গেল। নিষ্ঠুর লোক একটা!

অনুদের ক্লাসের কয়েকটা মেয়ে এবং ছেলে মিলে সাথীর চোখ চেপে ধরে ক্যান্টিনে নিয়ে যাচ্ছে। আজ সাথীর জন্মদিন। তাই ওরা সেলিব্রেট করবে। ওকে একটা চেয়ারের ওপর বসিয়ে তারপর চোখ ছাড়ে। সামনে চকোলেট কেক দেখে অবাক হয়ে যায় সাথী। সেই সাথে অনেক আনন্দিতও হয়। নতুন বন্ধুরা ওর বার্থডে সেলিব্রেট করবে এটা ভাবতেই পারেনি। ঐ সময়ে অনলও ক্যান্টিনেই ছিল। ওরা বার্থডে সেলিব্রেট করে চলে যায়। সাথী ওয়াশরুমে গিয়েছিল মুখ ধুতে। পুরো মুখে কেক দিয়ে মাখামাখি। ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার সময় কিছু ছেলেদের হাসাহাসি করে বলা কথা অনলের কানে আসে।
‘শালী এবার বুঝবে রিজেক্ট করার মজা! আমায় রিজেক্ট করে সাহস কত্ত বড়ো? ঐ শোন, সাথী আবার দেখেনি তো?’
তখন আরেকটি ছেলে বলল,’আরে না। মুন ওর চোখ ধরে নিয়ে আসছিল। ঐ সময়ে আমি চেয়ারে সস ঢেলে রাখছিলাম। দেখে নাই।’
‘গুড। এবার শুধু সবার সামনে দিয়ে ক্লাসে যাওয়ার পালা।’

ছেলেগুলোর কথোপকথন শুনে অনলের মাথায় রক্ত উঠে যায়। রিজেক্ট করেছে বলে প্রতিশোধ নিতে হবে? সে সামনে এসে দেখল তিনজন ছেলেকে। তিনটাকেই কষে থাপ্পড় দিল। ছেলেগুলো হকচকিয়ে যায়। অনল শাসিয়ে শাসিয়ে বলে,’কলেজে এগুলা করতে আসছিস? প্রপোজ করলেই মেয়েদের রাজি হতে হবে?’
ততক্ষণে মেয়েটাও ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে। রাগারাগির করতে দেখে এদিকেই এগিয়ে আসে। ওদেরকে জিজ্ঞেস করে,’কী হয়েছে রে?’
‘মাফ চা ওর কাছে।’ ধমক দিয়ে বলল অনল। ছেলেগুলো মাথা নত করে মাফ চাইল। সাথী কিছুই বুঝতে পারছে না। অনল বলল,’আর যদি কখনো দেখেছি নোংরামি করতে তাহলে প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে যাব। যা এখন।’

ওরা চলে যাওয়ার পর অনল মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে,’মানুষ চিনতে শেখো আগে। তারপর বন্ধুত্ব করবে। নিজের সিটটা গিয়ে আগে দেখে আসো।’
‘মানে?’
‘মানে তুমি যেখানে বসেছিলে সেই চেয়ারে ওরা সস রেখেছিল। ওদের কাউকে রিজেক্ট করেছিলে মেবি। এজন্য রিভেঞ্জ নিয়েছে।’
সাথী আৎকে উঠে পেছনে তাকায়। জামায় দেখতে পায় সসের দাগ। কান্না এসে যায় তার। ভালোমানুষীর পেছনেও কত জঘন্য রূপ থাকে! অনল সান্ত্বনা দিয়ে বলল,’কেঁদো না। এক্সট্রা কোনো ওড়না থাকলে কোমরে বেঁধে নাও।’
‘নেই। আর সুয়েটারের ওপর দিয়ে হিজাব পরা। গেঞ্জি সিস্টেম সুয়েটার হওয়ায় খুলতেও পারব না। আবার এই অবস্থায় কলেজের ভেতর যেতেও পারব না।’
উপায়ান্তর না পেয়ে অনল নিজেই ওর জ্যাকেট খুলে সাথীকে দেয়। ওর থেকে ক্লাস আর শাখা জেনে নিয়ে এনামুলকে দিয়ে সাথীর ব্যাগ আনায়।

তিন তলা থেকে সাথী আর অনলকে কথা বলতে দেখেছে অনু, জেসি আর শুভা। জ্যাকেট দেওয়ার দৃশ্যটিও অগোচর হলো না। জেসি ক্ষেপে বলে,’অসভ্যটা তোকে জ্যাকেট দিল না; অথচ সাথীকে ঠিকই দিল।’
অনু কিছু না বলে নির্জীব হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। হুট করে অনলেরও চোখও সেখানে যায়।দ্রুত অনু সেখান থেকে চলে যায়। এরকম করার মানে বুঝতে পেরে অনুর কাছে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সাথী বলল,’অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘ব্যাপার না।’
‘একটা রিকশা করে দিবেন প্লিজ?’

বিপদের সময় না করতে পারেনি অনল সাথীকে। তাই অনুর কাছে আর যাওয়া হলো না। মেয়েটিকে বলল,’আসো।’
কথা বলতে বলতে ওরা ভার্সিটির বাইরে যায়। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সাথী অনলের দিকে তাকায়। বোধ করি, খেয়াল করলে অন্য দৃষ্টিও নজরে আসবে ঐ দু’চোখে।

চলবে….

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৪

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
অতি শঙ্কা, আতঙ্ক নিয়ে ভার্সিটিতে উপস্থিত হয়েছে অনু। গেইটে দাঁড়ালেই কলেজ ক্যাম্পাস এবং মাঠটা সূক্ষভাবে দৃষ্টিবন্দি হয়। তীক্ষ্ণ চোখে অনু মাঠে খুঁজে বেড়াচ্ছে অনলকে। হতচ্ছাড়া তো বলেছিল ভার্সিটিতে আসলে কড়া র্যাগ দিবে। অনু নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,’এসব র্যাগট্যাগে আমি ভয় করি না। তবুও কেমন জানি লাগে! আচ্ছা এত ভয় কেন পাচ্ছি আমি ঐ ইডিয়টটাকে? একদম ভয় পাব না আমি। এমনিতেই তার ওপর আমার বেজায় মেজাজ খারাপ। আমার বয়ফ্রেন্ডকে হুমকি দেওয়া! শালা শুধু একবার যদি কাল রাতে তোকে বাসায় পেতাম তবে দেখতি হু! আমার ভয়ে লুকিয়ে কেন ছিল বল? বল, বল!’
আদতে অনল লুকিয়ে ছিল না। বরং বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়েছিল। তাসিনের কাছে হুমকির বিবৃতি শুনে তৎক্ষণাৎ ওর বাসায় গিয়েছিল অনু। সকালে পায়নি, বিকেলে পায়নি। এমনকি রাতেও নয়। ঐসময়ে অনলের ওপর রাগ ঝাড়তে না পেরে মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছে যে, অনুর ভয়েই অনল পালিয়েছে। আরে ভাই, মেজাজ ঠান্ডা তো করতে হবে? মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য ভক্করচক্কর বলে মনকে বোঝানো সঠিক কাজ। একদম সঠিক।

কলেজের গেইটের সামনে পায়চারি করতে করতে জেসি এবং শুভার জন্য অপেক্ষা করছে অনু। চাইলে আগেই সে ক্লাসে চলে যেতে পারে। কিন্তু সে খুব ভালো করেই জানে অনলের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্লাসে যাওয়া অত সহজ অনুর জন্য হবে না। বরং অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে তবেই সে ক্লাসে যেতে পারবে। সাহস অনুর অনেক আছে। কিন্তু সে দেখাতে চাচ্ছে না। শুধু জেসি আর শুভা আসলে মনের সাহস একটু জোর পায় এই আরকি! অনু কি ভয় পায় নাকি? নেহি, কাভি নেহি!
নিজের মনে সংলাপ বুনে যাচ্ছে অনু। অথচ এখনও গাধী দুইটা আসছে না। বিরক্ত হয়ে কল-ই করে। তখন দেখতে পায় ওদের রিকশা সামনে এসে থেমেছে। জেসি কল রিসিভ করে ফেলেছিল। রিকশা নজরে আসার পর কল কেটে দিয়ে অনু বলে,’আমায় দেখেও কল রিসিভ করলি কেন? টাকা কি তোর জামাই রিচার্জ করে দেয়?’

ভাড়া মিটিয়ে দুজনে এগিয়ে আসে। জেসি ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,’ম্যামের মেজাজ আজ চটে আছে কেন?’
‘ছাড় আমারে! আদিখ্যেতা দেখাবি না একদম। কতক্ষণ ধরে ওয়েট করতেছি?’
‘আমার কী দোষ? শুভারই তো রেডি হওয়া হয় না। ওর বাসায় গিয়ে এক ঘণ্টা ধরে বসে থাকা লাগছে।’
শুভা এ কথায় ফুঁসে উঠে বলে,’একদম মিথ্যা বলবি না ছেম্রি। তুই নিজেই লেট করে আসছিস। আমার রেডি হইতে দশ মিনিটও লাগে নাই।’

অনু চিৎকার করে বলে,’হইছে। থাম দুইটায়। তোরা দুইটায় যে কী পরিমাণ ঢিলা কোম্পানি সেটা আমি ভালো করেই জানি। ভালো সাজা লাগবে না কারো। এখন আর ঝগড়া না করে ভেতরে চল। এমনেই জান প্রায় যায় যায়!’
ধমক খেয়ে দুজনেই মেকি অভিমান করে চুপসে যায়। শেষের কথাটি শুনে শুভা জিজ্ঞেস করে,’জান যাবে কেন?’
‘এতকিছু জানা লাগবে না। চল।’
তিন বান্ধবী মিলে ভেতরে যায়। আল্লাহ্, আল্লাহ্ জপছে অনু। ক্যাম্পাসের কোথাও অনলকে চোখে পড়ল না। যাক বাবা! বাঁচা গেল। কলেজ ভবনে যাওয়ার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই পেছন থেকে ডাক আসে,’এই নিউ কামার। এদিকে আসো।’

তিনজনই পিছু ফিরে তাকায়। বিড়বিড় করে শুভা বলে,’বেদ্দপ তুই চামার!’
ওরা এগিয়ে যেতেই সামনের ছেলেগুলো জিজ্ঞেস করে,’ফার্স্ট ইয়ার না?’
‘হু।’ মাথা ঝাঁকালো তিনজনে।
‘গুড। ক্লাসে যাওয়ার আগে একটা কাজ করতে হবে।’
‘কী কাজ?’ জিজ্ঞেস করে জেসি।
‘বলছি। তার আগে তোমাদের নামগুলো বলো তো।’
জেসি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,’ওর নাম শুভা, ওর নাম অনু আর আমার নাম জেসি।’
‘তুমি আর শুভা এক সাইডে এসে দাঁড়াও।’

তিনজনই অবাক হয়ে তিনজনের দিকে তাকায়। বুঝতে পারছে না এরা ঠিক কী করতে চাচ্ছে! ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? যা বললাম চুপচাপ তাই করো।’ পূণরায় বলল ছেলেটি। জেসি এবং শুভা এক সাইডে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটি এবার আরাম করে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’অনু এবার একটা গান শোনাও তুমি।’

বাজ পড়ার মতো শব্দ হলো মনে হয় অনুর কানে। এখনই বাংলা সিনেমার মতো চারদিকে বজ্রপাত হবে, ধিম তানা, ধিম তানা শব্দ হবে। না! এ হতে পারে না। এত নিষ্ঠুরতম কাজ কেউ করতে পারে না। কিন্তু হায়! এরকম কিছু হলো না। ধুর! ফিলিংসের দফারফা। অনুর চোখে-মুখে বিস্ময় দেখে উপস্থিত ছেলেগুলো মুচকি মুচকি হাসছে। ভাবনার গহিন অতল থেকে বেরিয়ে এসে অনু প্রশ্ন করে,’গান গাইব কেন? তাছাড়া আমি গান গাইতে পারি না।’
‘গাইতে না পারলেও কিছু করার নেই। গাইতেই হবে। এটা তোমার র্যাগ।’
‘এত নতুন স্টুডেন্টসদের মধ্যে আমাকেই কেন র্যাগ দেওয়া হলো?’
‘কারণ তোমাকে আমাদের পছন্দ হয়েছে।লক্ষী একটা মেয়ে তুমি। এখন সময় নষ্ট না করে গান শুরু করো। একটু পরেই তোমাদের ক্লাস শুরু হবে। প্রথমদিনই দেরি করা ঠিক হবে না। তাহলেই স্যার নিকনেম দিয়ে দিবে লেট লতিফ। ক্লাস টিচার কিন্তু ভারী সাংঘাতিক!’ হাতঘড়িতে সময় দেখে কথাগুলো গড়গড় করে বলল পাশের ছেলেটি। কিন্তু অনু তো দমে যাওয়ার পাত্রী নয়। অনল র্যাগ দিলে ভিন্ন বিষয় ছিল। ঐ ছেলে ঘাড়ত্যাড়া! কথা না শুনে উপায় থাকতো না। কিন্তু এদেরকে ভয় দেখানো যাবে। অনলের কথা বললে ভয় পাবে নিশ্চয়ই! কারণ এই ভার্সিটিতে নাকি অনলের অনেক নামডাক আছে। সে শুনেছে।

গলাটা পরিষ্কার করে ভাব নিয়ে অনু বলল,’আপনারা কোন ইয়ারে পড়েন?’
‘অনার্স ফাইনাল ইয়ার।’
‘অনলকে চিনেন নিশ্চয়ই?’
‘চিনি। সিনিয়র ভাইয়া।’
‘গুড। জানেন সে আমার কে হয়?’ এবার ভাবটা বেড়ে গেল অনুর। উত্তরে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল,’কে হয়?’
‘আমার মায়ের বেষ্টফ্রেন্ডের ছেলে।’
‘অনল ভাইয়া তোমার নানুর মেয়ের বেষ্টফ্রেন্ডের ছোটো ছেলের বড়ো ভাই হোক তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। যা বললাম তাই করো।’
‘কচুটায় প্যাঁচাইয়া কী সম্পর্কের কথা বলল রে বাল!’ মাথা চুলকে বিড়বিড় করে বলল অনু। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে অনলকে ওরা ভয় পায় না। কচুর নামডাক কলেজে তার। ধুর!

ছেলেগুলো এবার তাড়া দিয়ে বলল,’অনেক সময় নষ্ট করেছ। র্যাগের শাস্তি বাড়িয়ে দেওয়া হলো। এবার আমাদের সিলেক্ট করা গান গাইতে হবে। তুমি মমতাজের ‘বন্ধু যখন বউ লইয়া’ গানটি গাইবে। এখনই। আর একটা কথাও বাড়াবে না।’
তৃষ্ণায় অনুর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এই বানরের দলগুলো দেখি অনলের চেয়েও ডেঞ্জারাস! জেসি আর শুভা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। অনু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,’আমি গান গাইতে পারি না।’
‘এসব কথা শুনব না খুঁকি। যেভাবে পারো সেভাবেই গাও। কোনো সমস্যা নেই।’
‘গাইতেই হবে?’
‘হ্যাঁ খুঁকি।’

অনুর ইচ্ছে করছে এখন হাত-পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে। যেমনটা ছোটোবেলায় করতো। কিন্তু এখন সে বড়ো হয়ে গেছে। ছোটোবেলায় কেউ না হাসলেও এখন সবাই হাসবে। প্রাণ খুলে হাসবে। বিনা টিকেটে ফ্রি-তে বিনোদন কেই বা না নিতে চায়? যেমনটা এখন চাচ্ছে বান্দরের দলগুলা। অনু মনে মনে ভাবছে, অনেকগুলা বানর পালবে সে। আর এই ছেলেগুলোর নামে বানরের নাম রাখবে। বদ, অসভ্য, নাইজেরিয়া!
আশেপাশে তাকিয়ে অনু প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেগুলো তাড়া দিয়েই চলেছে। গান না গাইলে যে রক্ষে নেই তা হারে হারে বুঝতে পারছে। অবশেষে মান-ইজ্জতের ফালুদা করে অনু গান গাইতে শুরু করে,’বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার চোখের সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাঁইটা যা,
ফাঁইটা যায়, বুকটা ফাঁইটা যায়!’

অনুর চোখ কাঁদো কাঁদো। দুঃখের কথা আর কী বলব, এই সিচুয়েশনে অনুর গান শুনে জেসি আর শুভারও হাসি পাচ্ছে। কিন্তু বান্ধবীর বিপদে হাসাটা অনুচিত। তাই আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে হাসি আটকানোর জন্য। ছেলেগুলো মিটিমিটি হাসছিল। বলল,’সুর হয়নি খুঁকি। আরেকবার গাও। এবার হবে।’
দ্বিতীয়বার গাওয়ার সময় জেসি আর শুভা নিজেদের হাসি আটকে রাখতে পারল না। ফিক করে দুজনে হেসে ফেলল। এবার ছেলেগুলোও শব্দ করে হাসা শুরু করে। আর অনুর ইচ্ছে করছে সবগুলারে মেরে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে। বান্ধবী দুইটা মীর জাফরের বংশধর বোঝা যাচ্ছে! ছেলেগুলো হাসি থামিয়ে ওদের দুজনের উদ্দেশ্যে বলে,’এই তোমরা হাসলে কেন? এখন ওর সঙ্গে তোমরাও গান গাইবে। শুরু করো। অনু খুঁকি আরেকবার গাও তো।’
রাগে গিজগিজ করছে অনু। কিন্তু জেসি আর শুভাকেও গাইতে বলেছে বলে খুশি হয়েছে। মীর জাফরের বংশধর এবার বুঝ মজা। তিনজনের বেসুরা কণ্ঠে গান শুনে ছেলেগুলো হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। অনু পারলে চোখের দৃষ্টিতে ওদের ভষ্ম করে দেয়। ক্লাস শুরুর ঘণ্টা পড়ার পর ওরা বলল,’অনেক সুন্দর গেয়েছ তোমরা। মাঝে মাঝে আমাদের একটু গান শুনিও কেমন খুঁকিরা? এখন ক্লাসে যাও। গুড লাক।’
‘গান শুনে মরলি না কেন বান্দরের দলগুলা! গানের সঙ্গে বিষ মেশানোর সুযোগ থাকলে সেই বিষ তোদের গিলাতাম অসভ্য! বেইজ্জতি করে এখন আবার বলে গুড লাক। ইশ! প্রথমদিনই বেইজ্জতি।’ কড়া দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কথাগুলো বলল অনু। তারপর তিন তলায় চলে গেল। হুট করে সিঁড়ির পাশের ক্লাস থেকে অনল বেরিয়ে আসে। অনুর পথ রোধ করে কানে কানে বলে,’র্যাগ কেমন লাগল অনু? ওদেরকে আজই একটা ট্রিট দেবো বুঝলি। একদম আমার শেখানো বুলি তোর ওপর ঝেড়েছে। আহা! আমি কত ভালো প্রশিক্ষণ দেই।’
অনু অবাক হয়ে বলে,’তার মানে আপনিই ওদেরকে এসব শিখিয়ে দিয়েছিলেন?’

অনল ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসতে হাসতে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকায়। রাগে অনু দৌঁড়ানি দেয়।অনলও দৌঁড় শুরু করে। তখন হাতে থাকা কলমটা ছুঁড়ে মারে অনলের দিকে। কিন্তু বিধি বাম! ভাগ্য খারাপ থাকায় অনলের গায়ে কলমটি লাগেনি। লেগেছে স্যারের গায়ে! স্যার কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনু, জেসি আর শুভা দৌঁড়ে ক্লাসে চলে যায়। আল্লাহ্ ভালো জানে মুখ দেখেছে নাকি!

স্যার ক্লাসে আসার আগেই মাঝখানের সারিতে ঘাপটি মেরে বসে ছিল তিনজনে। প্রিন্সিপালসহ সব টিচাররা এসে নিজেদের পরিচয় দিয়ে গেছে। তারা চলে যাওয়ার পর ক্লাস টিচার পরিচয়পর্ব শুরু করে। অনু, জেসি আর শুভা ভয়ে তটস্থ হয়ে রয়েছে। ওদের পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর হাফ ছেড়ে বাঁচে। কারণ স্যার ওদের দেখেনি। দেখলে নির্ঘাৎ এখানেও একটা বেইজ্জতির শিকার হতে হতো। ভার্সিটির প্রথম দিনটাই বাজে ভাবে শুরু হলো। ধ্যাৎ! সব হয়েছে ঐ বজ্জাত অনলের জন্য। শুভা তখন ফিসফিসি করে বলে,’অনল ভাইয়া এটা কীসের প্রতিশোধ নিলো রে?’
‘মরিচ সেদ্ধ শরবত খাওয়ানোর জন্য।’
‘কপাল। সবই কপাল। এসব আজগুবি রেসিপি কেন যে তোর মাথায় আসলো! এই আজগুবি রেসিপির জন্য মান-সম্মান সব শেষ হলো।’ আক্ষেপ করে বলল জেসি। অনু মৃদু ধমক দিয়ে বলে,’চুপ কর মীর জাফরের বংশধর। আমার চেয়ে বেশি বেইজ্জতি তো আর তোদের হয়নি। আর তোরা কেমনে পারলি ঐ সময়ে হাসতে?’
‘কী করব? হাসি পাচ্ছিল তো।’
‘সময় আসুক আমার। তখন বুঝাবো হাসি কাকে বলে, কত প্রকার এবং কী কী।’

তিনটা ক্লাস করার পর ছুটি হয়ে যায়। তাসিন অনুকে নিতে এসেছে। জেসি এবং শুভাকে বিদায় দিয়ে অনু তাসিনের বাইকে করে বাড়ি আসে। অনু বাড়ির ভেতর চলে যাওয়ার পর অনলের মুখোমুখি হয় তাসিন। ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে,’কী খবর ছোটো ভাই? তোমারে না বলছিলাম অনুর সাথে ব্রেকাপ করতে?’
‘আপনার কথায় ব্রেকাপ কেন করব ভাই? তাছাড়া আমি তো এটাই বুঝি না, আপনার সমস্যাটা কী? আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি। মাঝখানে আপনি কেন আসছেন?’

অনল অনিকের দিকে তাকিয়ে বলে,’দেখলি সাহস কত এই ছেলের?
এই, এতক্ষণ ভালো করে কথা বললাম ভালো লাগেনি? কীসের ভালোবাসা? অনু তো একটা বোকা, গাধী! ভালো লাগা, ভালোবাসার তফাৎ-ই বোঝে না। আমি ড্যাম শিওর, ভালোবাসা কী সেটা বুঝলে তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস একটা ছেলের সঙ্গে কখনোই রিলেশন করতো না। আদারওয়াইজ ও তো জানেও না, তোমার আরও কতগুলা মেয়ের সঙ্গে রিলেশন আছে। তুমি তো একা ওরে ভালোবাসো না। সময় থাকতে এখনও ভালো করে বলতেছি, অনুর পথ থেকে সরে দাঁড়াও।’
‘দেখেন ভাই, আমি আপনার সাথে ঝামেলা করতে আসি নাই। আমি আরও মেয়ের সাথে রিলেশন করি বা যাই করি আপনার তাতে কী? অনুর তো সমস্যা নাই। হুদাই আপনি ঝামেলা পাকাইয়েন না।’
‘বুঝছি। সোজা কথা শোনার মতো ছেলে তুমি না। ঘাড়ত্যাড়া আছো। তবে আমার চেয়ে বেশি না। লাস্ট ওয়ার্নিং দিতেছি, অনুর পথ থেকে না সরলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’
‘আপনি যা পারেন। কইরেন। আমি অনুকে ছাড়ব না। আর অনুও আমাকে ছাড়বে না।’
‘ওভার কনফিডেন্স হয়ে গেল না? তুমি অনুরে না ছাড়লেও অনু তোমায় ছাড়বে।’
‘পারলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। অনেক কষ্টে অনুর মন গলিয়েছি। আমার প্রতি ওর অগাধ বিশ্বাস আর ভালোবাসা আছে। তাছাড়া আপনাকে এমনিতেও অনু পছন্দ করে না। সহ্যও করতে পারে না। আপনার কথায় অনু আমায় ছাড়বে না।’
‘ছাড়বে, ছাড়বে! জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

তাসিন আর কিছু বলল না। বাইক নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। অনিক তখন বলে,’বাদ দাও না ভাই। কী দরকার অযথা ওদের মাঝে ঝামেলা করার?’
‘দরকার আছে অনিক। ছেলেটা ভালো হলে আমি এমন করতাম না। কিন্তু ছেলেটা প্লে-বয়, ক্যারেক্টারলেস। আরও অনেকগুলো মেয়ের সাথে ওর রিলেশন আছে।’
কিছু্ক্ষণ নিরব থেকে অনিক বলে,’ভাইয়া একটা কথা বলি?’
‘বল।’
‘তুমি কি অনুকে ভালোবাসো?’
অনিকের কথা শুনে অনল ফিক করে হেসে ফেলে। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলল,’হুঁশ! পাগল হলি নাকি তুই? আমি কেন অনুকে ভালোবাসতে যাব?’
‘তাহলে সারাক্ষণ তুমি ওর পেছনে লেগে থাকো কেন? ওর রিলেশনও ভাঙতে চাচ্ছ।’
‘পেছনে লাগি বলতে ওকে জ্বালাতে আমার ভালো লাগে। ও রাগলে আরও বেশি ভালো লাগে। বাকি রইল রিলেশনের কথা। ঐ মাথামোটা মেয়ে ভালো-খারাপ এখনও কিছুই বুঝে না। বড়ো হয়েছে শুধু হাতে-পায়ে। হ্যান্ডসাম হলে,আর কয়েকদিন পিছু পিছু ঘুরলেই ওর মন গলে যায়। ছেলে ভালো নাকি খারাপ সেটা তো মানুষ আগে খোঁজ-খবর করে! ওর ঐ বয়ফ্রেন্ড ভালো না।বললাম না, এক নাম্বারের ক্যারেক্টারলেস। এজন্যই আমি চাচ্ছি না তাসিনের সাথে ওর রিলেশন থাকুক।’

‘বুঝলাম। এখন কথা হচ্ছে ছেলে ক্যারেক্টারলেস হোক অথবা ভালো তাতে তোমার কী? মানে আমাদের কী? জীবন ওর। সিদ্ধান্তও ওর। যার সাথে ইচ্ছে রিলেশন করুক।’
‘এটা সিদ্ধান্ত নয় অনিক। আবেগ। অনু আবেগের বশে কোনো ভুল কাজ করুক কিংবা কারো দ্বারা ওর ক্ষতি হোক এটা আমি চাই না।’
এরপর হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে,’এখন যাই। এনামুল দেখা করতে বলেছে।’
‘আচ্ছা যাও।’
অনিক বাড়ির ভেতর যাওয়ার পর অনল আসে অনুদের বাসায়। তিনু দরজা খুলে দেয়। ‘অনু কী করে?’ জিজ্ঞেস করে অনল।
‘আপু ঘুমাচ্ছে। এসেই শুয়ে পড়েছে।’
‘অলসের অলস! বিড়ালটা কোথায়?’
‘আপুর ঘরেই।’
‘চলো তো যাই।’

তিনুকে নিয়ে অনল অনুর ঘরে আসে। ঘরে ফ্লোরে বসে আছে বিড়াল ছানাটি। বিড়ালটি হাতে নিয়ে অনল তিনুকে বলল,’ঐ কুম্ভকর্ণটাকে ডেকে তোলো।’
‘উঁহু। আপু বকবে। আপনি ডাকেন।’
‘আমারে ডাকা লাগবে না। তিনু ঐ অসভ্য লোকটাকে বল চলে যেতে।’ বলল অনু।

অনল বিড়ালটির মাথা চুলকে দিতে দিতে বলল,’তুই ঘুমাসনি? নাকি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাছ ধরিস?’
‘একদম বাজে কথা বলবেন না। বিরক্ত লাগতেছে আপনাকে। আপনি চলে যান।’
‘এত রেগে আছিস কেন? র্যাগ দেওয়ার জন্য?’
‘কথাই বলবেন না আপনি। যান বলছি।’ শোয়া থেকে উঠে বসলো অনু। যেন হাতের থাবাতেই অনলকে ঘায়েল করে ফেলবে।
‘উহ্! কী রাগ বাবা! আমার কী দোষ? আমি তো আর তোকে শাস্তি দেইনি।’
‘আপনি দেননি। কিন্তু আপনার কথামতোই তো ওরা কাজ করেছে তাই না?’
‘তা করেছে। আচ্ছা কাল যে তোর টুসটুস পাখিকে সব বললাম। তোকে সাবধান করেনি?’
‘ওর নাম টুসটুস না। তিতুস।’ রাগ দেখিয়ে বলল অনু।
‘ঐ একই হলো। তোর মতোই অদ্ভুত নাম তোর পশু-পাখির। মনে থাক না।’
‘আপনাকে মনে রাখতে বলেছে কে? এক্ষুণী আপনি আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাবেন।’
‘বের হব না।কী করবি?’
অনু বিছানা ছেড়ে তেড়ে আসে অনলের দিকে। অবস্থা বেগতিক থেকে অনল দৌঁড় দেয়। নয়তো হাতের সবগুলো নখ হাতে দাবিয়ে দেবে। পেছনে দৌঁড়াতে গিয়ে অনু ধাক্কা খেল বাবার সঙ্গে। অস্ফুটস্বরে তিনু বলল,’সর্বনাশ!’

চলবে…

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০৩

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
বারুদের আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে অনুর মেজাজ। অনলকে ভর্তা বানাতে পারলে ওর শান্তি হতো। সবসময় প্যারা তো দেয়ই! এখন আবার কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তা-ভাবনা করছে। নাম অনীতা হোক বা গণিতা তাতে ওর কী? শালা বদ! রাগে হিঁসহিঁস করতে করতে নিজের ঘরে আসে অনু। বারান্দা থেকে ফিসফিসানির শব্দ আসছে। অনু বারান্দায় গিয়ে দেখতে পায় তিনুকে। হুট করে অনু আসায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তিনু।
‘তুই এখানে কী করছিস?’ ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ বাঁকা করে প্রশ্ন করে অনু।

অনুর ঘরের বারান্দা থেকে অনিকের ঘরের বারান্দা স্পষ্ট দেখা যায়। তাই তিনু অনুর ঘরে এসেছিল। দুজন দুজনকে দেখে ফোনে কথা বলছিল। আগে অবশ্য অনু এবং তিনু এই রুমেই থাকতো। কিন্তু পশুপাখিতে ভয় পায় তিনু। সারাক্ষণই পাখি ঘরে উড়াউড়ি করে। ভয় পায় তিনু। যদি কামড়ে দেয় বা খামচে দেয়? তিনুকে চুপ থাকতে দেখে ধমক দিয়ে অনু বলে,’এখন আবার চুপ করে আছিস কেন?’
‘ইয়ে..আসলে আপু তোমার পাখিকে দেখতে আসছিলাম। খাঁচায় রাখা তো তাই ভয় পাইনি।’

অনু কেমন করে যেন একবার তাকিয়ে বলল,’ঠিকাছে। এখন নিজের ঘরে যা। তিতুসকে খাঁচা থেকে বের করব।’
‘আচ্ছা।’
কোনো রকম পালিয়ে বাঁচে তিনু। একবার যদি ধরা খেয়ে যেত তাহলে বাসায় তৃতীয় যুদ্ধ বেঁধে যেত এতক্ষণে।

রাতঃ ১০টা ২০ মিনিট।
জেসি আর শুভা অনুদের বাসায় এসেছে। প্রতি শুক্রবারে সবাই একসঙ্গে বসে ভূতের মুভি দেখে। ওরা দু’জন অনুর স্কুল এবং কলেজ ফ্রেন্ড। তাই তিনজনের পরিবারেই তিনজন বেশ সুপরিচিত। জেসি উত্তেজিত হয়ে বলে,’ইশ! দোস্ত আজকে যেই মুভিটা দেখা হবে ঐটা কিন্তু অনেক ভয়ংকর।’
‘আজকে কোন মুভি দেখা হবে?’ জিজ্ঞেস করে শুভা।
‘Evil Dead. অনল ভাইয়া বলেছে।’
‘আজকে তোরা মুভি দেখিস। আমি দেখব না।’ বলল অনু।
‘কেন? তোর আবার কী হলো?’ জিজ্ঞেস করে জেসি। রাগে ফুঁসে উঠে অনু বলে,’ঐ বজ্জাত অনলকে আমার পছন্দ না। একদম পছন্দ না। তোদের তো একটুও পঁচায় না। কিন্তু আমি একটু ভয় পেলেই হলো! পারে না শুধু তখন এলাকায় মাইকিং করতে।’
‘আরে বাদ দে তো। এসব ব্যাপার না।’
‘তোর কাছে কোনো ব্যাপার না হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু। মান-সম্মান বলে কথা!’
‘প্লিজ! প্লিজ এমন করিস না। তুই না দেখলে আমরা কীভাবে দেখব?’ আকুতি করে বলল শুভা। শুভার সঙ্গে জেসিও অনুকে বোঝাতে লাগল। অবশেষে দুজনের অফুরান্ত অনুরোধের কারণে অনুকে রাজি হতে হয়।

১০:২৫-এই অনিক এবং অনল এসে হাজির হয়। এসে বসতে না বসতেই অনুকে ফরমায়েশ করে বলে,’অনু আমার জন্য এক গ্লাস শরবত নিয়ে আয় তো।’

‘শরবত? শীতের সময়ে কেউ শরবত খায়?’
‘আমি খাই। আর তুই বানাবি। যা।’
‘পারব না। ফ্লাক্সে চা বানিয়ে রেখেছে মা। চা খান।’
‘আন্টি বানিয়ে রেখেছে বলেই চা খাব না। তুই আমার জন্য শরবত বানাবি; গুড়ের শরবত এবং সেটা এখনই। হারি আপ!’
মেজাজ দেখিয়ে অনু রান্নাঘরে চলে আসে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’তোরে আমি শরবতের মধ্যে ডুবামু অসভ্য ব্যাডা!’

রাগে গিজগিজ করতে করতে কিছু্ক্ষণ রান্নাঘরে পায়চারি করে অনু। হঠাৎ করে বুদ্ধি উদয় হয় মাথায়।এক গ্লাস পানি চুলায় বসিয়ে দেয়। ১০টার মতো কাঁচামরিচ দুই টুকরা করে ঐ পানিতে ছেড়ে দেয়। পানি বলগ আসার পর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে অর্ধেক পানি গ্লাসে নেয়। তারপর ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে গ্লাসের গরম পানির সঙ্গে মিক্সড করে। এক চামচ ঝোলা গুড় আর পাঁচ চামচ লবণ মিশিয়ে তৈরি করে স্পেশাল শরবত। গ্লাস হাতে নিয়ে বাঁকা হাসি দিয়ে স্বগতোক্তি করে বলে,’এবার তোমার শরবত খাওয়ার শখ মিটবে চান্দু।’

শরবত নিয়ে ড্রয়িংরুমে যায় অনু। মুভি অলরেডি শুরু হয়েছে। গ্লাস নিয়ে অনল বলে,’এত লেট লতিফ হলে চলে?’
অনু কিছু বলল না। অপেক্ষায় রইল অনলের শরবত পান করা দেখার। আরাম করে বসে অনল শরবতে চুমুক দেয়। এক ঠোক গিলতেই প্রায় চেঁচাতে গিয়েও নিজ হাত দ্বারা মুখ বন্ধ করে রাখে। রক্তবর্ণ চক্ষু দ্বারা সে তাকিয়ে রয়েছে অনুর দিকে। ওর মুচকি হাসি যেন অনলের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। মুভি না দেখে, কাউকে কিছু না বলেই অনল বাসায় চলে যায়। অনু ভেবেছিল এখন হয়তো বকা দেবে। কিন্তু এমন কিছু হলোই না! উপস্থিত সকলেই অবাক হয় এমন কাণ্ডে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে অনুর দিকে তাকাতেই অনু বলে,’স্পেশাল মরিচ সেদ্ধ শরবত! আজকে আরাম করে ছবি দেখতে পারব।’

সকলে অবাক হয়। আবার এটা ভেবে মনকে সান্ত্বনা দেয় যে, এমন সব কুটনৈতিক কাজ অনুর পক্ষেই সম্ভব। অনিক হতাশ হয়ে বলে,’কবে যে তোমাদের ঝগড়াঝাঁটি মিটবে! যাই গিয়ে ভাইয়ের রাগ কমাই। তোমরা মুভি দেখো আজ।’
অনিক চলে যাওয়ার পর মন খারাপ করে বসে থাকে তিনু। আজ মুভি দেখে সে একটুও মজা পাবে না। তাই নিজের রুমে চলে গেল ঘুমাতে। জেসি বিরক্ত হয়ে বলে,’ধুর! মাত্র তিনজনে ভূতের ছবি দেখে কোনো মজা আছে? তিনুও চলে গেল! আমিও যাই ঘুমাব।’
‘আমিও যাব।’ বলল শুভা।
তারপর দুজনে মিলে চলে গেল অনুর রুমে। অনুর সোফার ওপর ভাব নিয়ে বসে বলল,’হুহ যা। আমি একাই দেখব।’

সাহস নিয়ে একা মুভি দেখার আশা করলেও সেই আশা বেশিদূর এগোলো না। ভূতের সীন আসার আগে ভয়ংকর শব্দ শুনেই অনু কুপোকাত। দ্রুত টিভি বন্ধ করে ঘরে চলে যায়। জেসি আর শুভার মাঝখানে ঘাপটি মেরে শুয়ে পড়ে। ভূতের ছবি একা দেখা অনুর কাম্য নয়!
________________

সকালের দিকে এলোপাথাড়ি ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙে অনুর।চোখ কচলে বিছানায় বসতেই দৃষ্টি যায় তিনুর দিকে। বিরক্তিসূচক ‘চ’ এর মতো শব্দ করে অনু বলে,’এভাবে ডাকলি কেন?’
‘আরে আগে ড্রয়িংরুমে আসো তাড়াতাড়ি।’ তিনু এক প্রকার টেনেই নিয়ে গেল অনুকে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে চমকে যায় অনু। অনলের কোলে পিলুকে দেখে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। ছো মেরে অনলের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে। আনন্দিত হয়ে অনলকে জিজ্ঞেস করে,’কোথায় পেলেন ওকে? আপনি যে বললেন কুকুর নিয়ে গেছে।’
‘ও তো পিলু নয়।’
‘তাহলে?’
‘তোর চোখের মাথা গেছে রে অনু। চোখ কচলে ভালো করে দেখ এটা খোরগোশ না। ওর মতো দেখতেই একটা ছোটো বিড়ালছানা।’
অনু এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখল আসলেই! খোরগোশের মতোই ধবধবে সাদা বিড়ালছানাটি। একদম ছোটো বাচ্চা! কী কিউট! অনুকে চুপ থাকতে দেখে অনল বলল,
‘পিলুর মতো দেখতেই দোকান থেকে একটা বিড়াল কিনে আনলাম। যেভাবে কান্নাকাটি শুরু করেছিলি!’
‘তাতে আপনার কী? তাসিনকে বললেই তাসিন কিনে দিত।’
‘কই তাসিন আর কই আমি! আমার লগে কি তাসিনের যায়?’
‘তাসিন আমার বয়ফ্রেন্ড কিন্তু আপনি কে? আমার পড়শি শুধু।’
‘উঁহু, শুধু পড়শি না। আন্টির বেষ্টফ্রেন্ডের ছেলেও আমি ভুলে যাস না। যেই সেই লোক না আমি। আমি হলাম অনল।’
‘আপনি একটা কচুর নল।’
‘রেসপেক্ট দিয়ে কথা বল অনু। তুই জানিস তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?’
‘জানি। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার জামাইয়ের বাড়ির দারোয়ানের বাড়ির কাজের লোকের সাথে।’
‘তুই আমায় অপমান করলি অনু অপমান!’
‘যার মান নাই তার আবার কীসের অপমান?’
‘একেই উপকারের ঘাড়ে লাথি। তুই হলি তার বড়ো প্রমাণ।’
‘বাজে কথা! আচ্ছা বলেন তো আসল কাহিনী কী? কালকে মরিচ শরবত খাওয়ানোর পরও আজ বিড়াল গিফ্ট করলেন। আমি তো ভেবেছিলাম নির্ঘাৎ কোনো শাস্তি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।’

অনল মাথা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলে,’চোরের মন পুলিশ পুলিশ। তবে তোর ধারণা ভুল নয়। শাস্তি তো তুই পাবি-ই। কাল থেকে তোর ভার্সিটিতে ক্লাস না? আয় শুধু কলেজে। র্যাগ কাকে বলে টের পাবি।’
‘কী করবেন আপনি?’
‘সেটা কলেজে আসলেই বুঝবি। এখন তো বলব না। হাতে বেশি সময় নেই তোর সাথে প্যাঁচাল পারার। আমি এখন যাই।’

অনল চলে গেল। ল্যাম্পপোস্টের মতো নির্জীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনু। আল্লাহ্ ভালো জানে, কাল যে কী পরিমাণ নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে ব্যাটা হতচ্ছাড়া!
চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে বাড়ি থেকে বের হয় অনল। বেশ হ্যান্ডসাম এক ছেলেকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে যায়। ছেলেটির দৃষ্টি লক্ষ করে তাকিয়ে দেখে, অনুর ব্যলকোনির দিকে তাকিয়ে আছে সে। অনল ছেলেটির দিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,’ঐদিকে কী দেখো?’
ছেলেটি প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নেয়। হাসি হাসি মুখ করে বলে, ‘ইয়ে! কিছু না।পাখি দেখছিলাম।।’
‘কিছু না আবার পাখি দেখছিলে! নাম কী তোমার?’
‘জি তাসিন।’
‘তাসিন…ওহ! মনে পড়েছে। তুমিই অনুর বয়ফ্রেন্ড?’

ছেলেটি এবার ইতস্তত করতে থাকে। একটু ভয়ও লাগছে। কে না কে! উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে অনল। কিছু না বলে চলেও যেতে পারছে না তাসিন। অন্যদিকে অনল মনে মনে বলছে,’শালা পড়ছিস আজকে মাইন্যা চিপায়! তোর প্রেম করার শখ আমি মিটাচ্ছি। ক্যারেক্টারলেস ছেলে কখনো অনুর বয়ফ্রেন্ড হতে পারে না, পারে না, পারে না!’

‘ভাই আপনি অনুর কে হন?’ প্রশ্ন করল তাসিন। অনল তখন বলল,’আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন করা হচ্ছে এখন? আমি যেই হই না কেন, আমি অধিকার তোমার চেয়ে অনেক বেশি। আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি অনুর বয়ফ্রেন্ড। তোমার সব খোঁজ-খবরও আমি নিয়েছি। শুধু সামনা-সামনি দেখলামই আজ। অনু ছাড়াও যে তোমার আরও কতগুলা জিএফ আছে সেই খবর কিন্তু আমার আছে। অনুকে গাপ্পি মাছ ভেবে জালে আটকে ফেলবা আর আমি তা হতে দেবো এটা ভুলেও ভেবো না। সো, সময় থাকতে আউট হয়।’
‘আপনার পরিচয়টাই এখনো জানলাম না। আর আপনি হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন?’
‘আমার পরিচয় জানার দরকার নেই। অনুর সাথে ব্রেকাপ করার সময় জাস্ট জিজ্ঞেস করবা, অনল কে? তাহলেই তোমার উত্তর পেয়ে যাবে।’ শেষের কথাটা এক্সট্রা ভাব নিয়েই বলল অনল।

তাসিন এবার হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,’ওহহো! আপনিই তাহলে অনল ভাই। অনু আমাকে আপনার কথা বলেছিল।’
এ কথা শুনে অনলের অবস্থা এখন আকাশে উড়ার মতো। একটু ভাবসাব নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,’কী বলেছিল?’
‘অসভ্য, বেয়াদব,ইতর, কুত্তা হতচ্ছাড়া অনল নামে একটা ছেলে আছে। সম্পর্কে ভাই-ই ডাকি। আম্মুর বেষ্টফ্রেন্ডের ছেলে। এরকম কথাই বলেছিল। আসলে আপনার কথা যতবার বলেছে ততবার গালিগুলো ব্যবহার করেছে তাই আমারও মুখস্থ হয়ে গেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না।’

সব ভাবসাব ধুলার সঙ্গে একদম ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। শেষমেশ অনু এইগুলো বলেছে? তাও কী-না ওর সো কোল্ড ক্যারেক্টারলেস বয়ফ্রেন্ডের কাছে! নাহ্, এই অপমান কিছুতেই সহ্য করা যায় না। একদম না। ঐ অনুকে তো একটা উচিত শিক্ষা দিতেই হবে। তার আগে এই ব্যাটাকে এখান থেকে দূর করতে হবে। অনল পকেট থেকে ফোন বের করে এনামুলকে কল করে বলে,’দোস্ত রাজীব আর চ্যালাপ্যালা পোলাপাইন যতগুলা আছে সবগুলারে নিয়ে বাড়ির সামনে আয় তো। অনুর বয়ফ্রেন্ডরে পাইছি।’

ওপাশ থেকে কী বলল তা শুনতে না পেলেও তাসিনের হার্টবিট কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেছে। সে কোনোরকমে বলে,’ভাই বেয়াদবি মাফ করবেন। আমি চলে যাচ্ছি।’ এ বলেই তাসিন দ্রুত হাঁটা ধরে। অনল বাঁকা হাসে এই কাণ্ডে। অনুর ঘরের ব্যলকোনির দিকে তাকিয়ে দেখে তিতুসকে খাঁচায় রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে অনলের দিকেই পাখিটি তাকিয়ে আছে। পাখির উদ্দেশ্যেই অনল বলে,’ঐ পাখি তোর নাম যেন কী? টুসটুস না? যাই হোক, টিসটিস বা টুসটুস একটা তো হবেই। শোন টুসটুস, তোর অনুর কপালে দুঃখ আছে। কাল শুধু ভার্সিটিতে আসতে দে।’

চলবে…

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০২

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#পর্ব_২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
অনল ছাদে এসে হাত মুচড়ে ধরে অনুর। ব্যথায় টু শব্দ করতেই যেন অনু ভুলে বসেছে। যেই ভয়ে ট্যাঙ্কির পেছনে লুকিয়েছিল; অথচ লাভ কিছুই হলো না। ঠিক ঠিক খুঁজে বের করেছে! শালা ডাফার! মনে মনে গালি দিয়েও অনু ক্ষান্ত হয় না। অনল এবার আরও জোড়ে হাত মুচড়িয়ে বলে,’আমার সাথে বিটলামি করার সাহস কোথায় পেলি তুই?’

‘আমি কোনো বিটলামি করিনি। সত্যি বলছি।’ আর্তনাদ করে বলল অনু। অনল দাঁতমুখ খিঁচে বলে,’কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা আমি জানি। তুই যদি ডালে ডালে চলিস, তাহলে আমি চলি পাতায় পাতায়। বুঝছিস?’
‘আমায় বিশ্বাস করেন।’
‘মরে গেলেও না। তোকে এখন আমি ট্যাঙ্কির পানিতে চুবাবো চল।’
‘না, না, না! ট্যাঙ্কির পানি অনেক ঠান্ডা। জমে বরফ হয়ে যাব আমি।’
‘আমি তো সেটাই চাই। আমার সাথে বিটলামি করার আগে এটা মাথায় ছিল না?’

মনে মনে বারবার আল্লাহ্কে ডাকছে অনু। অনলকে সে ভালো করেই চিনে। ট্যাঙ্কির পানিতে চুবানোর সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েছে তখন একটা হলেও নাকানিচুবানি খাওয়াবেই! অনুর মনের ডাক আল্লাহ্ শুনেছে। ঐ সময়ে ছাদে এসে উপস্থিত হয় অনিক। অনলের ছোটো ভাই। সে ছাদে এসে বলে,’ভাইয়া তুমি ছাদে! আর আমি তোমায় কত জায়গায় না খুঁজলাম।’
‘কেন কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করে অনল।
‘মা তোমায় খুঁজছে। কিন্তু তোমরা এখানে কী করছ?’
অনল চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’এই বজ্জাত মেয়ে আমার গায়ে ঠান্ডা পানি ঠেলে দিয়েছে।’

অনলের হাতটা কিঞ্চিৎ আলগা হওয়ায় দ্রুত নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় অনু। অসহায়ের মতো মুখ করে বলে,’বিশ্বাস করো অনিক ভাইয়া, আমি ইচ্ছে করে কাজটা করতে চাইনি। আমি তো ভেবেছি উনার….’
‘চুপ! একদম চুপ। মিথ্যাবাদী!’ রাম ধমক দিয়ে অনুকে থামিয়ে দেয় অনল। ধমকে কিছুটা চমকেও যায় অনু। ওদের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসে অনিক। ছোটো থেকেই দুজনের সাপে-নেউলে সম্পর্ক দেখে আসছে। সুযোগ একবার পেলেই হচ্ছে। কেউ কাউকে জব্দ করতে সেই সুযোগ এক তিল পরিমাণ পর্যন্ত ছাড়বে না। তবে এর একটা বিহিত এখন করতেই হবে। নয়তো দুজনের ঝগড়া চলতে চলতে রাত হয়ে যাবে; তবুও ঝগড়া থামবে না। অনিক পণ্ডিতের মতো অঙ্গভঙ্গি করে বলে,’আচ্ছা আচ্ছা ঝগড়া অনেক হয়েছে। এখন অনু ঘরে যাও। আর ভাইয়া আমার সঙ্গে বাসায় চলো।’
‘কীসের বাসায় যাব? আগে এই পাজি মেয়েটাকে আমি শায়েস্তা করব।’ অনুর দিকে তাকিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল অনল।

‘আপু গাছে পানি দেওয়া শেষ হয়নি?’ ছাদের দরজার সামনে এসে বলল তিনু। সঙ্গে অনল এবং অনিককে দেখে একটু চমকিতই হলো যেন। আসলে চমকায়নি। অবাক হওয়ার অভিনয় করেছে মাত্র। অনিক আসার আগে তিনুকে বলেই এসেছে। ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বলে,’আরে অনিক এবং অনল ভাইয়াও তো দেখি এখানে।’
উত্তরে অনিকও হেসে বলল,’হ্যাঁ, ছাদটা একটু ঘুরতে আসলাম। ভালো আছো?’
‘জি। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌।’
আরও কিছু কথা অনিক এবং তিনু চোখে চোখে বলে নিল। এখান থেকে পালানোর জন্য অনু তাড়া দিয়ে বলল,’মা আমায় ডাকছে তাই না? হ্যাঁ তাড়াতাড়ি ভেতরে চল।’

অন্য দিকে তাকিয়ে আছে অনল। অনু তিনুর হাত ধরে হাঁটা ধরে। অনল এবং অনুর দৃষ্টির অগোচরে তিনুকে চোখ মারে অনিক। লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় তখন তিনু। বড়ো দুজনের সম্পর্ক সাপে-নেউলে হলেও ছোটো দুজনের ভাব গলায় গলায়। তিনু যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন থেকেই দুজনের সম্পর্ক হয়। এখন তিনু ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। অনল পড়ছে মাস্টার্সে। অনিক অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। একই ভার্সিটিতে। অনু অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া নিয়েও কত কাহিনী করতে হয়েছে। কিছুতেই অনলের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে চায়নি। কিন্তু ওর চাওয়াতেই বা কী? বাবা-মায়ের কথাই শেষ কথা। আর তাদের পিছনে কলকাঠি নাড়ছে বজ্জাত অনল হুহ!
.
আমেনা বেগম রান্না করছিলেন। পিলুর জন্য মনটা ভালো নেই অনুর। খাওয়ার প্রতি রুচি মরে গেছে। একটু ঝাল ঝাল করে চিংড়ী দিয়ে নুডলস্ খেতে ইচ্ছে করছে। অনু রান্নাঘরের দিকে এগোয়। মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,’আম্মা।’
‘কী?’
‘নুডলস্ খাব।’
‘এই সময়ে?’
‘হু। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘আচ্ছা রান্না শেষ হোক।’
কলিংবেলের শব্দ শুনে তিনি আবার বললেন,’ময়লাওয়ালা আসছে মনে হয়। যা তো ময়লাগুলো দিয়ে আয়।’
‘আমি রান্নাঘরে তোমার ময়লা নিতে আসছি?’
‘বেশি কথা না বলে যা বলছি তাই কর। যা।’
‘হুহ।’
প্রচণ্ড অনীহা নিয়ে ময়লার ঝুড়ি হাতে তুলে নেয় অনু। রাগে গজগজ করতে করতে দরজা খুলে ময়লাগুলো সামনে ধরে বলে,’ময়লা নিয়ে বিদায় হন।’

সামনের লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইতস্তত করে ক্ষীণস্বরে বলে,’আমাকে দেখে কি আপনার ময়লাওয়ালা মনে হচ্ছে?’
এবার অনু ভালো করে খেয়াল করে ময়লার ঝুড়ি নামিয়ে রাখল। লোকটিকে দেখে তো ময়লাওয়ালা মনে হচ্ছে না। ফর্মাল ড্রেস, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। দেখতে ভদ্রলোক লাগে। অনু জিজ্ঞেস করল,’কে আপনি?’
‘জি আমি অয়ন।’ চোখের চশমা ঠিক করে বলল ছেলেটি।
‘অয়ন না কয়েন সেটা জানতে চাইনি। এখানে কেন এসেছেন? কাকে চান?’
‘জি আমি একজন ডাক্তার। ডা. কামাল স্যার আমায় পাঠিয়েছেন।’
অনু এবার উচ্ছসিত হয়ে বলল,’ডাক্তার! আপনি কি পাখির ডাক্তার?’

অয়ন বিব্রতবোধ করতে লাগল এই প্রশ্নে। পূণরায় চশমার ফ্রেম ঠিক করে বলল,’জি না।’
‘তো আপনি কি গরু ডাক্তার? কিন্তু আমরা তো গরু পালি না।’
‘জি না। আমি গরুর ডাক্তারও না। আমি মানুষের ডাক্তার।’
‘ওহ। আমরা তো কেউ অসুস্থ না। আমার তিতুস একটু অসুস্থ। তাই মানুষের ডাক্তার প্রয়োজন নেই। তাহলে কামাল আঙ্কেল আপনায় কেন পাঠিয়েছেন?’
‘তিতুস কে?’
‘আমার টিয়া পাখি।’
‘ওহ! জি আসলে উনার বন্ধুর প্রেশার মাপার জন্য।’
‘মানে বাবার?’
‘উনার নাম খালেদ রহমান।’
‘হু। উনি আমার বাবা হন। আসুন ভেতরে আসুন। আর কিছু মনে করবেন না। আমি ভেবেছিলাম, ময়লাওয়ালা এসেছে।’
‘সমস্যা নেই।’
ডাক্তারকে বাবার রুমে রেখে অনু নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে খাঁচা থেকে তিতুসকে বের করে হাতের ওপর রাখে। মাথা চুলকে দেয়। কথা বলে।

আমেনা বেগম রুমে এসে বলেন,’আবার পশু-পাখি নিয়ে বসছিস!’
‘উহ্! মা। কতবার বলছি ওদের পশু-পাখি বলবে না। সুন্দর সুন্দর নাম রেখেছি আমি। আর এই টিয়ার নাম তিতুস। ওকে তিতুস ডাকবে।’
‘তোর মতো এত রং ঢং তো আমি করতে পারব না। সারাজীবন কুকুরকে কুত্তা আর বিড়ালকে বিলাই বলে এখন উনি পশু-পাখির নাম রাখা শুরু করেছে। তাও আজগুবি সব নাম! টেবিলের ওপর বিরিয়ানির বাটি রাখা। অনিকদের বাসায় দিয়ে আয়।’
‘আমি কেন? তিনুকে পাঠাও।’
‘তুই কিন্তু সব কথায় ঘাড়ত্যাড়ামি করিস অনু। তিনুকে পাঠানোর হলে তোকে বলতাম? তিনু কাজ করতেছে।’
আমেনা বেগম চলে যাওয়ার পর অনু বিড়বিড় করে বলে,’সুযোগ পেলেই শুধু আমাকে খাটাতে চায় হুহ!’
__________________

অনলদের বাড়ির বাগানে একটা দোলনা আছে। এখানে বসলে ফুলের ঘ্রাণে মন মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। দোলনায় বসে অনল দোল খাচ্ছিল আর গুণগুণ করে গান গাইছিল। বাড়ির গেটে এসে অনলকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় অনুর। আরও সামনে এগিয়ে গিয়ে অনলকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ভাবে। তখন অনলের ডাক পড়ে,’চোরের মতো পালাচ্ছিস কেন? এদিকে আয়।’
‘কই পালাচ্ছি? আমি তো ভেতরেই যাচ্ছি।’
সামনে এসে বলল অনু। হাতের বাটি নিজের হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলল অনল। চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিয়ে বলে,’আহ্! বিরিয়ানি! ঘ্রাণ শুনেই পেট অর্ধেক ভরে যায়।’
‘তাহলে ফিরিয়ে দেন। বাসায় নিয়ে যাই। আপনার পেট তো ভরেই গেছে।’
অনল ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’তুই ভীষণ কিপ্টা অনু। যাকগে, ওসব বাদ দে। একটু আগে তোদের বাসায় একটা ছেলেকে যেতে দেখলাম। কে রে?’
‘ডাক্তার। আব্বুর প্রেশার মাপতে এসেছে।’
‘আগে না কামাল আঙ্কেল আসতো?’
‘উনিই পাঠিয়েছেন।’
‘সত্যি বলছিস নাকি কাহিনী অন্যকিছু?’
‘অন্য কি কাহিনী হবে?’
‘তোকে দিয়ে বিশ্বাস কী? যাই হোক, ডাক্তারদের থেকে দূরে থাকবি। মোট কথা ছেলেদের থেকে দূরে থাকবি।’
‘ঢং যত্তসব! আপনার এত মাথাব্যথা করা লাগবে না। ঐ ডাক্তার বিবাহিত, দুইটা বাচ্চাও আছে।’
‘এর মধ্যে খোঁজ নেওয়া’ও শেষ?’
‘খোঁজ নেব কেন? আন্দাজ করে বলেছি।’
‘তোর যেই গবেট মার্কা আন্দাজ!’
‘আচ্ছা আমি এখন যাই? আপনি বাটি বাসায় নিয়ে যাইয়েন।’
‘আরে দাঁড়া। এত তাড়া দেখাস কেন? তোর সঙ্গে একটা ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে।’
‘ইম্পোর্ট্যান্ট কথা? তাও আমার সাথে? ইন্টারেস্টিং! আচ্ছা শুনি কী কথা?’

বাটির ঢাকনা লাগিয়ে অনুর ওড়নায় হাত মুছে নিল অনল। রাগে মুখ বিকৃত করে ফেলে অনু। কিন্তু মুখে কিছু বলে না। ঢেকুর তুলে অনল বলে,
‘তোর পুরো নামটা যেন কী? অনীতা না? কী একটা নাম! ছ্যাহ্! মনে হচ্ছে গণিত এর সঙ্গে একটা আকার যোগ করে গণিতা বানানো হয়েছে; আর সেখান থেকে অনীতা। তোর বাচ্চাকাচ্চা যখন হবে তখন তাদেরকে তোর জামাই গল্প শুনাবে, ‘শোনো আমার গুলুমুলু কুলুকুলু আন্ডাবাচ্চারা। তোমরা কি জানো তোমাদের মায়ের আদি নাম কী ছিল? গণিতা ছিল। গণিতা থেকে অনীতা। এরপর আরও শর্ট করে রাখা হয়েছে অনু। তোমরা তোমাদের মাকে এখন থেকে ডাকবে গণু। নাহ্! নাহ্! মাকে তো নাম ধরে ডাকা যায় না। ডাকবে গণু মাম্মাম! মনে থাকবে? দেখো যেন আবার গণু ডাকতে গিয়ে গরু ডেকে ফেলো না। তোমাদের মা যেই দজ্জাল! কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে বাড়িতে।’ এই হবে তোর ভবিষ্যৎ।’

অনলের কথা শুনে দাঁত কিড়মিড় করে অনু। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’প্রথমত আমার নাম আমি নিজে রাখি নাই। আব্বা-মা আকিকা দিয়ে রাখছে। দ্বিতীয়ত, আমার জামাই আপনার মতো বদ, অসভ্য, ইতর হবে না যে এসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা বা কল্পনা তার মাথায় আসবে। বুঝছেন?’

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]

এক ফালি চাঁদ পর্ব-০১

0

#এক_ফালি_চাঁদ
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

‘চোর আমি অনেক রকম দেখেছি অনু! কিন্তু কচু চুরি করতে তোকেই প্রথম দেখলাম।’
মশকরাসূচক তীরের ফলার মতো বলা কথাগুলো ভেসে এসেছে পুরুষালী ভারী কণ্ঠস্বর থেকে। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরে অনু দেখতে পেল অনলকে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। বিরক্তিতে আর সহ্যের সীমা রইল না অনুর। রাগান্বিতস্বরে বলল,’কচু চুরি করছি মানে? দেখেন অনল ভাই, উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি।’
‘যাহ্ বাব্বাহ্! উল্টাপাল্টা কথা বললাম নাকি আমি? তুই-ই দেখ তুই এখন কোথায়? তুই কচুর বাগানে কী করিস বল?’
‘নাগিন ডান্স দেই। আপনার কোনো সমস্যা?’
‘না, না। আমার কেন সমস্যা হবে? তবে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে।’
অনুর কপালে এবার ভাঁজ পড়ে। এই লোকটি সুযোগ পেলে অনুকে হেনস্তা করতে ছাড়ে না সে নাকি আবার অনুরই জন্য চিন্তা করছে! ‘তা কী চিন্তা হচ্ছে শুনি?’ দু’হাত বগলদাবা করে জানতে চাইলো অনু।

অনল ঠোঁটের হাসিটা চওড়া করে বলল,’তুই তো এমনিতেই চুলকানি মানুষ। আবার নাকি কচু ক্ষেতে নাগিন ডান্স করছিস! চুলকাতে চুলকাতেই তো পটল তুলবি।’
রাগে দাঁত কিড়মিড় করছে অনু। রাগের চোটে বলার মতো কোনো কথাও খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু থেমে থাকার মেয়ে অনু নয়। শাসিয়ে শাসিয়ে সে বলল,’আপনার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে তারপর আমার সামনে আসবেন বলে দিচ্ছি অসভ্য লোক।’
‘একি রে! তোর ভালোর জন্যই তো বললাম।’
‘রাখেন আপনার ভালো! অযথা বিরক্ত না করে এখান থেকে চলে যান।’
‘দেখ অনু, তুই কিন্তু সবসময় আমার সাথে বাজে ব্যবহার করিস।’
‘আপনি লোকটাই যে অমন।’
‘কেন রে, তোর কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি আমি? তুই কচু চুরি করছিস কর। আমি মাকে বলব না।’
‘আমি মোটেও কচু চুরি করছি না অনল ভাই। আমি তো…’
অনুকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই অনল বলে উঠল,’ওহ আচ্ছা বুঝেছি। তুই কচুর লতি চুরি করছিলি? আচ্ছা কর। সমস্যা নেই। এটাও আমি মাকে বলব না। তবে শর্ত একটাই। চিংড়ী মাছ দিয়ে সুন্দর করে লতি রান্না করে এক বাটি আমাদের বাসায়ও দিয়ে যাবি। একটা লেবু কেটে দিস তরকারিতে। তাহলে আর গলা চুলকাবে না।’

রাগে মনে হয় মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগার অনুর। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,’হয়েছে? বলা শেষ আপনার? একবার বলতে শুরু করলে আপনার আর থামাথামির কোনো নাম নাই। আশ্চর্য লোক আপনি! ভাই কেমনে পারেন আপনি? আমি একবারও বলেছি কচুর লতি চুরি করতে আসছি আমি?’
‘ওহ! কচুর লতিও না? তাহলে কি কচুমুখী?’
এবার ক্ষেপে অনেকটা কাছে এগিয়ে যায় অনু। অনলের দিকে একটু ঝুঁকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’আপনাকে খুন করে ফেলব আমি!’
রাগের চোটে কচু তুলে নিয়েছিল অনু। কাচুমুচু ভঙ্গিতে অনল বলল,’এই কচুতে আমি মরব না রে অনু। কিন্তু চুলকাবে খুব। সরা প্লিজ!’
‘ধ্যাত!’ বলে অনু সরে যায়। আবারও গাছ-গাছালির ভেতর খুঁজে বেড়ায় পিলুকে। সকাল থেকেই পিলুকে পাচ্ছে না। ছোটো বোন তিনু বলল অনল ভাইয়ের বাড়ির বাগানে নাকি পিলুকে দেখেছিল। অনল সম্পর্কে ওদের প্রতিবেশী। তবে আরও একটা পরিচয়ও রয়েছে। সে অনুর মায়ের বেষ্টফ্রেন্ডের ছেলে। অন্যদিকে পিলু হচ্ছে অনুর খোরগোশ। দু’দিন হবে অনুর বয়ফ্রেন্ড তাসিন গিফ্ট করেছে। অনল গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,’অনু তুই যে রেগে গেলে দাঁতে দাঁত পিষিস তখন এক কাজ করবি। কয়েক টুকরা আদা, রসুন দাঁতের নিচে দিয়ে রাখবি। তাহলে তোর রাগও কমবে আবার আদা-রসুন বাটা-ও হয়ে যাবে।’

অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে একবার অনলের দিকে তাকিয়ে আবারও পিলুকে খুঁজতে শুরু করে। কোনো প্রতিউত্তর না পেয়ে অনল জিজ্ঞেস করে,’তুই কি কিছু খুঁজছিস?’
‘হু।’ ছোটো করেই বলল অনু।
‘কী খুঁজিস?’
‘পিলুকে।’
‘ওহহো! তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি অনু। তোর পিলুকে তো আমাদের বাগানে দেখেছিলাম। পরে আমার রুমের বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম একটা কুকুর মুখে করে তোর পিলুকে নিয়ে যাচ্ছে। আহারে কী খারাপটা যে লেগেছে আমার!’

মুহূর্তেই চোখ ফেঁটে অশ্রু নির্গত হয় অনুর। সে পিলুকে ভীষণ ভালোবাসে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলল,’আর আপনি চুপচাপ দেখলেন? নিচে এসে কেন আটকালেন না?’
‘এসেছিলাম তো! তার আগেই চলে গেছে।’
অনু আর কিছু বলল না। বাচ্চাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের বাসায় চলে যায়।
বাড়িতে ফিরে এসে ঘরে বসে কাঁদছে সে। তখন ওর মা আমেনা বেগম ঘরে প্রবেশ করেন।
কীরে তুই কাঁদছিস কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন আমেনা বেগম। মায়ের প্রশ্ন শুনে ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে অনুর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,’আমার পিলুকে কুকুর নিয়ে গেছে। তোমার বান্ধবীর ছেলে দেখেও পিলুকে বাঁচায়নি।’
‘বেশ হয়েছে! পশুপাখি দিয়ে ঘোরদোর একদম ভরে ফেলেছিস। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় পশুপাখি আমাদের বাড়িতে থাকে নাকি আমরা ওদের বাড়ি থাকি।’
‘তুমি এভাবে কেন বলছো মা?’
‘তাহলে আর কীভাবে বলব বল? এত পশুপাখি কেউ শহরের বাড়িতে পালে? এটা কি গ্রাম পেয়েছিস?’
‘শখ করি পালি মা। আমার ভালো লাগে।’
‘তাহলে গরু-ছাগলও কিনে দিই? এগুলো কেন বাকি থাকবে? ঘরের মধ্যে গরু-ছাগলও পালা শুরু করে দে।’

কথাগুলো বলে রাগে গজগজ করতে ঘর থেকে বের হয়ে যান তিনি। অসহায় দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে অনু। একটু মায়া-দয়াও বুঝি তার অনুর জন্য হয় না! হবেই বা কী করে? সব ভালোবাসা, মায়া তো তার বান্ধবীর ছেলের জন্য। ওই বজ্জাত অনলের জন্য! অনলের কথা মনে পড়তেই রাগে দাঁতমুখ খিঁচে বিড়বিড় করে অনু।
.
ভগ্ন হৃদয় এবং বিষাদিত চক্ষুযুগল মেলে আকাশমুখী হয়ে সোফায় শুয়ে আছে অনু। বারবার পিলুর শোকে সে মূর্ছা যাচ্ছে। এই শোকে দুপুরে খাওয়াও হয়নি। এ নিয়ে আমেনা বেগমের রাগের শেষ নেই। খোরগোশ তো নয় যেন ওর বাচ্চা চুরি করে নিয়ে গেছে কেউ। তিনু পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে অনু ডাকে। তিনু পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে পড়ে।
‘কোথায় যাচ্ছিস?’ জিজ্ঞেস করল অনু। হাতের বালতির দিকে দেখিয়ে তিনু বলল,’ছাদে যাই গাছে পানি দিতে।’
‘আমায় দে। আমি যাচ্ছি।’
‘সমস্যা নেই আপু। আমি পারব।’
‘আমি জানি তুই পারবি। মন ভালো নেই। প্রকৃতির সঙ্গে কিছু সময় কাটালে ভালো লাগবে।’
‘তবে যাও।’

পানিভর্তি বালতি নিয়ে হেলতে-দুলতে ছাদে যায় অনু। ছাদের উঠোনজুড়ে মিষ্টি রোদ। শীতের সময়টায় এই মিষ্টি রোদ অমৃতের মতো লাগে। কিন্তু অনুর এখন কোনো অনুভূতিই হচ্ছে না। সে গাছে পানি দিচ্ছে আনমনে। হঠাৎ করে চোখ যায় নিচে। অনল খালি গায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্রোধে ফুঁসে ওঠে অনু। মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,’অসভ্য, ইতর লোক! তুই ইচ্ছে করে আমার পিলুকে বাঁচাসনি। আজ দেখ আমি কী করি!’
বালতিতে থাকা অবশিষ্ট সবটুকু পানি সে অনলের গায়ে ঢেলে দেয়। দু’তলা ছাদ থেকে পানি ফেলার সুবাদে একদম ঠিকঠিক সব পানি অনলের গায়ে পড়েছে। একই তো শীতের দিন; তারওপর ঠান্ডা পানি। অনলের বিস্ময়ের শেষ নেই। উপরে তাকিয়ে অনুকে দেখতে পেয়ে রাগান্বিতস্বরে জিজ্ঞেস করে,’এটা কী করলি তুই?’

অনলকে রাগতে দেখে পেট ফেঁটে হাসি পাচ্ছে অনুর। কিন্তু সে কোনো রকমে ঠোঁট টিপে হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করে বলে,’কী হলো অনল ভাই?’
অনুর চোখে মুখে স্পষ্ট দুষ্টুমির ছাপ। অনলের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জেনে বুঝে ইচ্ছে করেই অনু কাজটা করেছে। সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’কী হলো আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করছিস? পানি ফেললি কেন?’
‘ওহহো! আপনি খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমি ভাবলাম আপনার বোধ হয় গরম লাগছে। তাই তো পানি ফেললাম। ঐগুলো ভালো পানিই ছিল। আপনার গায়ে কি আর আমি নোংরা পানি ফেলতে পারি?’
‘কষে মারব এক থাপ্পড় ফাজিল মেয়ে! শীতের দিনে কারো গরম লাগে? মাত্রই গোসল করে এসে আমি রোদে দাঁড়িয়েছিলাম। আর তুই গায়ে পানি ঢেলে দিলি?’
‘হুহ! এতে আমার কী দোষ? আমি কি জেনে বুঝে দিয়েছি নাকি? ছাদে রোদ থাকতে আপনি উদোম গায়ে নিচে দাঁড়িয়ে যে রোদ পোহাচ্ছেন আমি বুঝব কী করে?’
‘আমার সঙ্গে তুই চালাকি করিস না। আমি বেশ ভালো করেই জানি যে, তুই ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছিস।’
‘একদমই না। সত্যি বলছি।’
‘অনুর বাচ্চা! তুই ঐখানেই দাঁড়া! আজ তোকে আমি মজা দেখাচ্ছি।’
এই বলেই অনল বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে ছাদে যাওয়ার জন্য। এদিকে ভয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে অনুর। না জানি, ছাদে এসে কোন কাণ্ড করে বসে!

চলবে…