Monday, July 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1413



সে পর্ব-১২

2

#সে
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________________
সকালঃ ১০টা

বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে চুপচাপ চারিপাশ পর্যবেক্ষণ করছি। আর হয়তো কখনো এই জায়গায় আসা হবে না। আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট এখন অনুভূত হচ্ছে যে, এই স্কুল লাইফ আর ফিরে পাব না। তিথি,লিমাদের সাথে আর সামনা-সামনি দেখা হবে না। এই কথাগুলো আগে তেমনভাবে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারছি। বান্ধবীরা আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। এই মুহূর্তে আমার একদমই ইচ্ছে করছে না সিলেট থেকে চলে যেতে। এখন আর কিছু করারও নেই।

তিথি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,’নবনী তুই চলে যাস না প্লিজ! থেকে যা। আমাদের বাসায় থাকবি তুই।’

ওর আকুতিগুলো বাচ্চাদের মতো শোনালেও ভীষণ আবেগীয় ছিল। ওর অনুরোধ রাখার যে উপায় নেই আমার সেটাও মুখ ফুটে বলতে পারছি না। শুধু ওদের জড়িয়ে ধরে চুপচাপ কেঁদেই চলেছি। রোজকেও দেখলাম বার কয়েক ওড়নায় চোখ মুছল। একসঙ্গে অনেকটা সময় থাকলে এমনিতেই মায়া জন্মে যায়। যেমনটা ওদের প্রতি আমার মায়া জন্মেছে আর আমার প্রতি ওদের। শুধু একটা মানুষের মনেই আমি জায়গা করে নিতে পারিনি। বুকের ভেতর থেকে তীব্র দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

বাবা-মা গিয়ে রুদ্রদের সঙ্গে দেখা করে এসেছে। আমি যাইনি। যদিও রুদ্রর এখন বাসায় থাকার কথা নয়। বাবা এসে তাড়া দিয়ে বললেন,’চলো চলো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও সকলের সঙ্গে মায়ার বাঁধন ছিন্ন করে পাড়ি জমাতে হবে ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেই গাড়িতে আমাদের আসবাবপত্র যাচ্ছে বাবা ড্রাইভারের সঙ্গে সেই গাড়িতে যাবে। আমরা যাব ট্রেনে। আদিব বেশ কয়েকবার বাবার সাথে যাওয়ার জন্য বায়না করেছিল। কিন্তু কষ্ট হবে বিধায় বাবা আমাদের সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে।

সকলের থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। এখান থেকে মা, আমি আর আদিব যাব স্টেশনে। বাড়ির মেইনগেটের কাছে এসে আরও একবার পিছু ফিরে তাকালাম। উদ্দেশ্য কাঙ্ক্ষিত মানুষের মুখটি শেষবারের মতন দেখে যাওয়া। কিন্তু এবারও আমায় হতাশ হতে হলো। একবুক আক্ষেপ নিয়ে আমি গাড়ির সিটের সাথে মাথা এলিয়ে দিলাম। দু’চোখের কোণা বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ফোঁটা অশ্রুবিন্দু।

স্টেশনে গিয়ে টিকিট মিলিয়ে আমরা আমাদের সিটে বসে পড়ি। কিছু্ক্ষণ পর আদিব মাকে বলল, ওয়াশরুমে যাবে। ট্রেন ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। মা ওকে নিয়ে ওয়াশরুমে যাওয়ার পর কানে হেডফোন গুজে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম। অস্থরিতা, কষ্ট, অস্বস্তি সব একসাথে এসে হানা দিচ্ছে। যেই দহন নিরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিচ্ছুটি করার নেই আমার।

চোখ বন্ধ করা মাত্রই একটা ভারী পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,’ম্যাম এটা আমার সিট।’
আমি চোখ মেলে একবার তাকালাম মাত্র ছেলেটির দিকে। সৌজন্যমূলক হেসে বললাম,’দুঃখিত। সিট ফাঁকা ছিল তাই জানালার কাছে বসে পড়েছিলাম।’
‘ইট’স ওকে। আপনার যদি খুব দরকার হয় তাহলে জানালার পাশে বসতে পারেন।’
‘আপনার অসুবিধা হবে না?’
‘খুব একটা অসুবিধা হবে না। মানিয়ে নিতে পারব। আপনি বসুন।’
‘ধন্যবাদ।’

শুকনো একটা ধন্যবাদ দিয়ে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। ছেলেটি আমার পাশে বসল। কয়েকবার ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম রুদ্র কোনো ম্যাসেজ বা কল দিয়েছে নাকি। না! দেয়নি। ফেসবুকে লগিন করে আমার মেইন একাউন্ট ডিলিট করে দিলাম আমি। যেসব ফেইক একাউন্ট থেকে রুদ্রর আইডি চেক করতাম ঐগুলাতেও রুদ্রকে ব্লক করে আইডিগুলো ডিএক্টিভ করে রাখলাম। সর্বশেষ যেটা করলাম তা হলো সীম খুলে দু’টুকরো করে ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলাম। মনে হচ্ছিল একটু একটু হালকা হতে পারছিলাম আমি। কোন মুভিতে যেন একটা ডায়লগ শুনেছিলাম,’যখন মায়া বাড়িয়ে লাভ হয় না তখন মায়া কাটানো শিখতে হয়।’ ফেসবুকেও এই পোষ্টটি বেশ ভাইরাল। কথার সত্যতা এবং মর্মার্থ অনেক বেশি। সত্যিই তো মায়া বাড়িয়ে যদি লাভ-ই নয় হয় তাহলে মায়া কাটাতে তো হবেই। আর যতদিন আমি পিছুটানে পড়ে থাকব ততদিন মায়া কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

হোয়াটসঅ্যাপ আনইন্সটল করে গ্যালারিতে ঢুকলাম। রুদ্রর ছবি রাখার জন্য আলাদা একটা ফোল্ডার বানিয়েছিলাম। ওকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। কান্নাগুলো কেমন দলা পাঁকিয়ে আসছে। আশেপাশে তাকিয়ে চোখের পানি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করছি আমি। ঝাপসা চোখে দেখলাম পাশের ছেলেটি অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমার এহেন কর্মকাণ্ড-ই বোধ হয় তাকে আমায় নিয়ে ভাবাচ্ছে। ভাবুক। আমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। পিছুটান থেকে বের হতে হবে আমার। ঝাপসা দৃষ্টিতেই আমি পুরো ফোল্ডার ডিলিট করে দিলাম। রুদ্রর যতগুলো গাওয়া গান আমার ফোনে ছিল সেগুলো ডিলিট করে দিয়েছি। হাত কেঁপেছে, কষ্ট হয়েছে। তবুও আমায় পারতে হয়েছে। যার জীবনে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই তাকে কেন শুধু শুধু জীবনে আটকে রাখব। সবকিছু থেকেই সে মুক্তি পাক। সারাজীবনের জন্য!

ফোন ব্যাগে রেখে চুপ করে বসে রইলাম আমি। ছেলেটি এখনও আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়। মা এসে পড়ায় সে চুপসে যায়।
‘তোর চোখমুখ এমন ফুলে গেছে কেন?’ জিজ্ঞেস করল মা। মায়ের প্রশ্নে এবার আমার শব্দ করে কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে কোনো রকমভাবে বললাম,’কই? আমি ঠিক আছি।’
‘মিথ্যা বলবি না। কান্নাও করছিস। কেন? তিথিদের জন্য খারাপ লাগছে?’

আমি কিছু বললাম না।শুধু উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালাম। মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,’মন খারাপ করিস না মা। ওদের সাথে যোগাযোগ তো থাকবেই। ওরা ঢাকায় আসবে বেড়াতে। কখনও সম্ভব হলে আমরাও সিলেটে ঘুরতে আসব।’
‘আমি আর কখনও সিলেটে আসব না মা।’

মা এবার আমার পাশে বসে থাকা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বলল,’আচ্ছা আসতে হবে না। এবার কান্না থামা। সবাই কী বলবে বোকা মেয়ে?’
‘সবার কথায় আমার কী আসে যায়?’
আদিব তখন কথার মাঝে ফোঁড়ন কেঁটে বলল,’আপারে কাঁদলে সুন্দর দেখা যায়। সিনেমার নায়িকাদের মতো লাগে।’

মা ওকে ধমক দিতে গিয়ে হেসে ফেলে। হাসলো পাশে বসে থাকা ছেলেটিও। শুধু হাসি পেলো না আমার। আদিবের সঙ্গে তার বেশ ভাবও জমে গেছে ইতিমধ্যে। ওদের আলাপ শুনেই জানতে পারলাম ছেলেটির নাম শুভ্র। যাক তার কথা। আমার সবকিছু কেমন যেন বিরক্ত লাগছিল। আমি কোনোমতেই রুদ্রকে পুরোপুরি ভুলে থাকতে পারছি না। এটা আসলে সম্ভবও নয়। একদিনেই কি আর একটা মানুষকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া যায়? তবুও একদিনে কিছু সময়ের ব্যবধানেই যা যা করেছি সেটাই তো অনেকের পক্ষে দুঃসাধ্য প্রায়।
ব্যাগ থেকে খাতা আর কলম বের করে মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা কথাগুলো লিখতে শুরু করলাম,

‘আমি তোমায় এক আকাশ ভালোবাসা উপহার দিতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু দিনশেষে তুমি খুঁজে বেরিয়েছ এক সমুদ্র ভালোবাসা। আচ্ছা এটা বলো তো, সমুদ্র কি আকাশের চেয়েও বিশাল? নয়তো! তবে তুমি কেন আমার ভালোবাসা দেখলে না?

আমি তোমায় মুঠোভর্তি শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দিনশেষে তুমি খেঁটে চলেছ তোমার ক্যারিয়ার গঠনের পেছনে। একটাবারও তুমি ফিরে তাকাওনি মুঠ করে রাখা আমার ঐ হাতের দিকে। তুমি বুঝতেও পারলে না দূর-দূরান্তের সুখ কুড়িয়ে আনতে গিয়ে; চোখের সামনে থাকা প্রকৃত মানুষটিকেই তুমি ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছ।

আমায় ভালোবেসে নাম দিয়েছ মায়াবতী। অথচ আমার মায়ায় তুমি আটকাতে পারোনি। তবে কেন আমার এই নামকরণ বলতে পারো? বাকিদের মতো আমি চাইনি তোমায় অপশোনাল হিসেবে নিজের জীবনে রাখতে। আমি তোমায় ব্যবহার করতে চাইনি। একান্তই নিজের একটা মানুষ বানাতে চেয়েছিলাম। একদম পার্মানেন্টভাবে আমার করে চেয়েছিলাম। কিন্তু দিনশেষে তুমি তাদের কাছেই ফিরে গিয়েছ, যারা তোমায় অপশোনাল হিসেবেই চেয়েছে।

দিনশেষে তুমি নও, আমি এক পরাজিত ব্যক্তি, যে সত্যি ভালোবেসেও তোমায় বোঝাতে সক্ষম হইনি। আমি পারিনি! তবে আমি চাই, খুব করে চাই; একদিন, কোনোদিন দিনশেষে তোমার ঠোঁটে শান্তির হাসি ফুঁটে উঠুক।’

কী লিখলাম জানিনা। শুধু জানি প্রতিটা লাইন রুদ্রকেই উৎসর্গ করেছি। এটাও জানি, এই লেখা কখনও রুদ্র অব্দি পৌঁছাবে না। পৌঁছাতে পারবে না। সে যদি হাতের কাছেও পায় তাও বলবে না, একটাবার পড়ে দেখি কী লেখা আছে। তার এত সময়-ই বা কোথায়?

কোনো একদিন সে বুঝবে। আমায় খুঁজবে। হারিয়ে খুঁজবে। সবকিছু পেয়ে যাওয়ার পর যেদিন সে বিরক্ত হয়ে যাবে সেদিন-ই সে হন্যে হয়ে আমায় খুঁজবে। খুব করে মনে করবে। হয়তো সেদিন সে-ও আমার মতো কাব্য রচনা করে লিখবে,’একটা মেয়ে ছিল
ভীষণ জেদী। দু’চোখ ভর্তি তার রাগ।
কথায় কথায় ছিল অভিমান আর অভিযোগ।
সে মেয়েটা আজ কোথায়? সেই অভিমানি মেয়েটা কি এখনও রাগ দেখায়?
অন্য কাউকে?’

চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কাগজটি দু’টুকরো করে ফেললাম। এরপর আরও অসংখ্য টুকরো বানিয়ে বাতাসের সাথে দূরে উড়িয়ে দিলাম। যাদের গন্তব্য আমার মতোই ছিন্নভিন্ন।

‘লেখাগুলো অসাধারণ মনোমুগ্ধকর ছিল। পড়েই মনে হচ্ছিল, হৃদয়ের সুগভীর থেকে কারো জন্য লেখা। ছিঁড়ে ফেললেন কেন?’

শুভ্র নামক ছেলেটি কথাগুলো আমার উদ্দেশ্যেই বলল। তার মানে লেখাগুলো উনি পড়েছে। আমি মেকি হেসে বললাম,’লেখাগুলো যে দেখবে না কখনো।’
‘কে দেখবে না?’
‘সে।’

(প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
#সে গল্পের প্রথম পরিচ্ছদের সমাপ্তি এখানেই। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ আসবে কয়েকদিনের মধ্যেই।

গল্পটির থিম অতি সাধারণ একটা থিম। প্রায় মানুষের বাস্তবজীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর-ই মূলত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই গল্পে। এক তরফা ভালোবাসাকে আমি নবনীর মাধ্যমে বোঝাতে চাচ্ছি। যেহেতু নবনী নিজেই গল্পের বিবৃতি দিচ্ছে সেহেতু ওর অনুপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা জানা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। নবনী যতটুকু জানে, ওর সাথে যা হচ্ছে ততটুকুই সে বলতে পারছে। এমনিতেও গল্পটা খুব একটা বড়ো হবে না। কয়েকটা পর্ব হবে এবং প্রতি পর্বে পর্বে হয়তো টুইস্ট রাখতে পারব না। তবে অবশ্যই শেষে, আমি গল্পটির সম্পর্কে ম্যাসেজ দেবো। এখন আপনারা আপনাদের অতি মূল্যবান মন্তব্য করে গল্পটির প্রথম পরিচ্ছেদ সম্পর্কে কিছু জানান।]

সে পর্ব-১১

0

#সে
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
শীতের প্রায় শেষ সময়। গাছের পাতার মতো আমার মনে থাকা সকল সুখগুলোও ঝড়ে পড়েছে। সোনালী রোদের পিচঢালা পথ চিকচিক করছে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ দু’দিন হবে। রুদ্রকে ব্লক করার পর আর কথা হয়নি। এমন না যে, আমি কথা বলার অপশন রাখিনি। রেখেছি। হোয়াটসঅ্যাপে ব্লক করিনি। নাম্বারও ব্লক করিনি। সে চাইলেই পারতো যোগাযোগ করতে। কিন্তু না। সে করেনি। করিনি আমি নিজেও। মন অনেকবার করে বলেছিল একটা ফোন কিংবা ম্যাসেজ করার জন্য। আমার মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বেহায়া জিনিসটি হচ্ছে মন। শুধু মন নয়। মেয়ে মানুষের মন। এদিক থেকে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মন-ই সর্বাত্মক বেহায়া হয়।

কেন বলছি এ কথা? বলছি তার কারণ আছে। আমি কিন্তু রুদ্রর সব খবরই রাখি। সে দিব্যি আছে। আগে যেমন ছিল তেমনই। কোনো চেঞ্জ নেই। আমি এভাবে চলে আসায় তার জীবনে বিন্দুমাত্র কোনোরকম প্রভাব ফেলেনি। এর মানে কী দাঁড়ায়? তার জীবনে আমি আদৌ কিছু ছিলাম-ই না। যার জীবনে আমার কোনো প্রায়োরিটিই নেই, তার জন্য উতলা হওয়ার মাধ্যমকে বেহায়া বলব না?

এদিকে ঢাকায় যাওয়ার কার্যক্রম সম্পন্ন করে ফেলেছে বাবা। যতই ঢাকায় যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে ততই রুদ্রর সাথে কথা বলার জন্য মন ছটফট করছে। এতকিছুর পরও মনে হচ্ছে একটু কথা বলি। আমার মনের এই একটু চাওয়াকেও এখন আমি প্রাধান্য দিচ্ছি না। আসলে অপর মানুষটির অবহেলা সহ্য করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছি যে, এখন ভালোবাসার আগে ইগো নামের একটা শব্দ ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি চাইলেও পারছি না ইগোকে উপেক্ষা করে রুদ্রর কাছে যেতে। ইগোটা কি আসা প্রয়োজন ছিল না?

এরপর রুদ্রর সাথে আমার দেখা হয় রোজের জন্মদিনে। আমি জানতাম না সেখানে রুদ্রও উপস্থিত থাকবে। কারণ এতদিনে আপনারাও আমার সাথে এটা তো এটলিস্ট বুঝে গেছেন যে, সে ঠিক কতটা ব্যস্ত মানুষ! তাই এমন ছোটোখাটো জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সে আসবে এটা আমার ভাবনারও বাহিরে ছিল। আবার এমনও হতে পারে, আমি বাদে বাকি সবারই প্রায়োরিটি তার কাছে অল্প হলেও আছে। থাকতেই পারে। অস্বাভাবিক কিছু না। যতটা উৎফুল্লতা নিয়ে অনুষ্ঠানে জয়েন করেছিলাম ততটাই মিইয়ে গিয়েছিলাম রুদ্রকে দেখে। রুদ্রর সেই হাসি দেখে। আমার ধারণা ছিল, আমায় দেখার পর হয়তো সে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। কিন্তু সে এমনটা করেনি। বরং আমায় দেখে হাসি হাসি মুখটা আরও হাস্যজ্জ্বল হয়ে উঠল। অন্য কোনো সময় হলে আমি চলে আসতাম। কিন্তু আজ উপায় নেই। এর কারণ প্রধানত দুটো। এক. এটাই হয়তো রোজের জন্মদিনে আমার শেষ আসা। এবং দুই. রুদ্রকে দেখার লোভ।
সে আমার দিকে এগিয়ে এসে প্রথম যেই প্রশ্নটা করল,’তুমি কি আমায় ফেসবুকে ব্লক করেছ?’

আমার বুকচিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এরকম নাটক কেউ করে? এতদিন হয়ে গেছে আর সে আজ আমায় জিজ্ঞেস করছে আমি ব্লক করেছি কী-না। রাগকে কোনো রকম কন্ট্রোল করে বললাম,’দয়া করে এখানে আর কোনো নাটক করিয়েন না।’
‘আমি যা করি সব-ই নাটক হয়ে যায়? ব্লক কেন দিছ?’
‘ফেসবুকে গিয়ে লাস্ট ম্যাসেজগুলো পড়েন। তাহলেই বুঝবেন।’
‘তুমি মনে করাও।’
‘আমি পারব না।’
‘লিস্ট থেকে বের করার মতো তো কিছু হয়নি নবনী।’

আমি তার সাথে এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছিলাম না বিধায় সেখান থেকে সরে যাই। রুদ্রও কিছু বলল না। কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানে সে আমার দিকে তাকিয়েই রইল। সঙ্গে মুচকি মুচকি হাসি তো আছেই। এদিকে বারবার আমায় অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। এই মানুষটাকে আমি এখনও বুঝতে পারি না। এতটা রহস্য তার মাঝে। সে আসলে চায় কী? ছাড়তেও চায় না আবার শক্ত করে ধরেও না। ঝুলিয়ে রাখার মন-মানসিকতা কতটুকু যুক্তিসংগত? অনেকটা সময় তাকে চোখের সামনে দেখে আমি নিজেও গলে যাচ্ছিলাম। নিজেকে নিজের মাঝে আটকে রাখা দায় হয়ে পড়ছিল আমার জন্য।

অনুষ্ঠান শেষেরদিকে নিজের ফ্ল্যাটে আসার সময় রুদ্র পিছু ডাকে। জিজ্ঞেস করে,’একটু কথা বলা যাবে?’

আমি না করতে পারিনি। গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম,’হুম। বলেন।’
‘এখানে না। নিচে।’
‘আচ্ছা।’

নিচে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্র বলল,’নবনী তুমি রাগ আর জেদ একটু কমাও বুঝছো। বয়সের তুলনায় তোমার রাগ কিন্তু অনেক বেশি।’

‘তাই? আপনি শুধু রাগটাই দেখলেন। রাগের পেছনের কারণগুলা দেখেন না?’

‘কী কারণ?’
‘ওহ! আপনি জানেনই না?’
‘না। জানাও।’
‘প্রয়োজনই মনে করছি না। আমি আসলে আপনাকে সহ্যই করতে পারছি না। এত নাটক আপনি কীভাবে করেন?’
‘সবসময় শুধু ভুল বোঝো। আমি কী করেছি বলো?’
‘কিছু করেননি। যা করার আমি করেছি। ভুল করেছি।’
‘আচ্ছা বাদ দাও এসব। আমরা ভালো করে কথা বলি?’
‘আপনার কী বলার আছে আপনি বলেন।’
‘তোমার কিছু বলার নেই?’
‘কী বলার থাকবে?’
‘এই পিচ্চি এত রাগ করো কেন সবসময়? একটু হেসে কথা বলতে পারো না? হেসে কথা বলবা। হাসলে তো তোমায় অনেক সুন্দর লাগে।’

এত কিছুর পরও সে এত স্বাভাবিকভাবে কথা বলে যে, আমি কনফিউশনে পড়ে যাই। তাকে কী বলা যায়? সে কি মনে মনে ভালোবাসে আমায়? কোনো কারণে বলতে চাচ্ছে না?

‘চুপ করে আছো কেন?’ জিজ্ঞেস করল সে।
তার প্রশ্নে সচকিত হয়ে তাকিয়ে বললাম,’কিছু না। খুব তাড়াতাড়ি-ই আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে একটা সত্যি কথা জানতে চাই। আপনি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসেন না?’
রুদ্র বেশ শান্তস্বরে বলল,’না, নবনী। এর আগেও তো আমি তোমায় সবটা বুঝিয়েছি। আপাতত আমি ক্যারিয়ার ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে ভাবছি না।’

‘আপনি আমার থেকে অনেক কিছু লুকান। অপ্রয়োজনীয় মিথ্যা কথাও বলেন। কেন করেন এমন?’
‘আবার ভুল বুঝতেছ।’
‘আপনি নিজেও খুব ভালো করে জানেন আমি কোনো মিথ্যা বা ভুল বলছি না।’

রুদ্র নিশ্চুপ। ওর নিরবতায় আমার কান্না এসে পড়ছে। কেন জানি হঠাৎ করেই ভীষণ ইমোশোনাল হয়ে পড়ছি আমি। কোনোভাবেই কান্না আটকিয়ে রাখতে পারছি না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললাম,’কাল-ই আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি জানেন?’
রুদ্র ডান হাতের আঙুলী দ্বারা দু’ভ্রুর মাঝখানে চুলকে বলল,’না, জানতাম না। তুমি তো বলোনি। আচ্ছা সাবধানে যেও। ভালো থেকো।’

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কথা বলার ভাষাও লোভ পেয়েছে। কত সহজে কথাগুলো বলে ফেলল! তার মানে তো এটাই সে সত্যিই আমায় ভালোবাসে না!

আমি বিস্ময় নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
‘এত সহজে কথাগুলো বলে দিলেন?’
‘একটা সহজ কথা সহজভাবে না বলে কি কঠিনভাবে বলা উচিত ছিল নবনী?’
‘আপনি কি আমায় সত্যিই ভালোবাসেন না?’
‘না। সেটা তো আমি আগেই বলেছি। একদম শুরুর দিক থেকেই। কোনো রকম সম্পর্কে জড়ানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘অথচ আপনি আমার সাথে এমনভাবে মিশতেন যে মনে হবে আপনি আমায় ভালোবাসেন।’
‘একটা মিথ্যে মনগড়া ধারণাকে মনে পুষে বড়ো করলে সেটা তোমার ব্যর্থতা। আমার তো নয়।’
পেছনের সব রাগ, জেদ ভুলে গিয়ে আমি ওর হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললাম,’দেখেন আমি কিন্তু মজা করছি না। সত্যিই কাল আমরা ঢাকায় চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি আপনাকে ছাড়া কীভাবে থাকব?’
‘আমার সাথে দেখা হওয়ার আগে যেভাবে ছিলে সেভাবেই। দেখো নবনী, তুমি আমায় ভুল বুঝো না। তোমার বয়স কম। আবেগ বেশি। তাই এখন এসব ভেবে কান্নাকাটি করছ। আরও বড়ো হও। তখন এই আবেগটা আর থাকবে না। একটা সময়ে তোমার আজকের কথা মনে পড়লে হাসি পাবে।’

শেষ মুহুর্তে এসে তার এই কঠিন কঠিন কথাগুলোই আমায় বদলে দিতে যথেষ্ট ছিল। তার হাত ছেড়ে দিয়ে কিছু্ক্ষণ নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর মুখটা দেখছিলাম। হাতের উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছে বললাম,
‘আজ বুঝতে পারছেন না। এখন বুঝবেন না। আজ থেকে কয়েক বছর পর যখন অন্য কারো সাথে আমায় সুখে থাকতে দেখবেন, তখন বুঝবেন কষ্ট কাকে বলে।’

দু’হাতে চোখের পানি মুছেই আমি বাড়ির ভেতর চলে আসি। এইযে আমি ফিরে যাচ্ছি,আর পিছু ফিরে তাকাবো না আমি। আর ফিরে আসব না আমি। কখনো না। কখনো না।

চলবে…

সে পর্ব-১০

0

#সে
#পর্ব_১০
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
আমি প্রায় হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। সঙ্কিত মনে রুদ্রর মুখপানে তাকিয়ে থেকেও কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। তবে রুদ্রর চোখে-মুখে বিস্ময়। তবে কি সে আমার থেকে এ ধরণের কোনো কথা আশা করেনি? আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি। স্বাভাবিক থাকতে চেয়েও পারছি না। জোরপূর্বক ঠোঁটের কোণে মেকি হাসি এনে বললাম,’ভালোবাসার কথা শোনার পর কেউ ক্রেজি বলে?’

রুদ্র একবার আশেপাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে। পকেটে দু’হাত পুরে বলে,’দেখো নবনী তোমার ভালোবাসার কথা শুনে এই মুহূর্তে আমি অন্যকিছু আর বলতে পারলাম না। মানে! মানে কী এসব? তুমি কীভাবে বলে ফেললে ভালোবাসি? এক বছরও হয়নি আমাদের পরিচয়ের। এর মধ্যেই ভালোবাসা হয়ে গেল? কতটুকুই বা চেনো আমায়? কতটুকুই বা জানো আমার সম্পর্কে? এত অল্প সময়ে ভালোবাসা হয় না।’
‘একটা মানুষকে ভালোবাসার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়? এক ছাদের নিচে থেকেও তো একটা মানুষকে আগাগোড়া কখনো চেনা যায় না। সেখানে দীর্ঘ সময় নিলেও আমি আপনায় চিনে ফেলব?’

রুদ্র দুই ভ্রুঁ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অথচ তার নিরবতা আমার প্রাপ্য নয়। আমি চাই তার মুখ থেকে উত্তর শুনতে। বিচলিত হলেও তাকে বুঝতে দিলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি আমায় ভালোবাসেন না?’
‘না।’ রুদ্রর সোজাসাপ্টা উত্তর।
‘না? তাহলে এত কেয়ার, সময় দেওয়া, পাগলামি করা এসব কী ছিল?’
‘দেখো প্রথমত, তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয় এজন্যই ছায়ার মতো তোমার সাথে ছিলাম। তোমায় স্বাভাবিক করতে অতিরিক্ত সময় দিতাম। তুমি যাতে হ্যাপি থাকো এজন্য পাগলামি করতাম। কিন্তু এগুলো ভালোবাসা নয়। তুমি আমায় ফ্রেন্ড বানিয়েছ। বন্ধুত্বের জন্যই এতটুকু করেছি বলতে পারো।’
‘শুধুই বন্ধুত্ব? এগুলাই রিজন?’
‘হ্যাঁ।’
‘অন্য কাউকে ভালোবাসেন আপনি?’
‘না।’
‘তবে সমস্যা কী?’
‘সমস্যা আছে নবনী। অনেক সমস্যা রয়েছে। আমার সম্পূর্ণ ফোকাস এখন শুধু ক্যারিয়ারের দিকে। অন্য আর কোনোকিছুতে আমি ফোকাস করতে পারব না। এখন যদি আমি কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি তাহলে একটু হলেও আমার ফোকাস থেকে আমি সরে আসব। তাই রিলেশনে যাওয়া সম্ভব নয়। বাকি রইল বিয়ের কথা? সে তো আরও পরের কথা।’

রুদ্রর প্রত্যেকটা কথাই শুনলাম। মনোযোগসহকারে শুনলাম। হয়তো রুদ্র তার জায়গায় সঠিক। আমিই অপাত্রে ভালোবাসা প্রদান করেছি। রুদ্র আবার বলল,’আমি নিজে টাকা ইনকাম করব। নিজের বাড়ি হবে, গাড়ি হবে। আমি একটা লাক্সারি লাইফ লীড করতে চাই।’
‘আচ্ছা।’

ব্যাস এইটুকু বলেই আমি বাড়ির দিকে হাঁটা ধরি। এর বেশি কিছু আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। বলারও তো নেই। কী-বা বলা যায় বলুন তো? এরপর থেকেই আমার মাঝে নিরবতা ভর করে। না আমি কখনো রুদ্রর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি; না রুদ্র কখনো চেষ্টা করেছে। আমি নিজের মধ্যে গুমড়ে মরলেও রুদ্র আগের মতোই ছিল। নিয়ম করে তার আইডিতে ঘোরা বন্ধ করতাম না। তার আইডি দেখতাম। পোষ্ট দেখতাম। বন্ধু, কাজিনদের সাথে ঘুরতে গিয়ে আপলোড করা ছবি দেখতাম। আর সবশেষে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তাম।

পড়ার মাঝে ডুবে থাকার চেষ্টা করেও পারতাম না। এক লাইন পড়তে গেলেও বারবার রুদ্রর কথা মনে পড়ত। মনের মতো বেহায়া বোধ হয় আর কিছু নেই। নিজের সাথে যুদ্ধ করেও বারবার আমি পরাজিত হচ্ছিলাম। কেঁদেকেটে সময় কাটছিল আমার। মনের বিরুদ্ধে গিয়েই বই নিয়ে বসে থাকতাম। টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্টের পর এখন শুধু কোচিং হয়। আর প্রাইভেট পড়ি। এই দুটো নিয়ে পুরো দস্তুর ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু যখনই রুদ্রর আইডি চেক করি কষ্ট লাগে খুব। হতাশ হয়ে পড়ি। আমি ধুকেধুকে কষ্ট পেলেও ঐ মানুষ ভীষণ ভালো আছে।
মাঝে মাঝে মনে হতো ম্যাসেজ দেই। আবার ভাবতাম, না থাক! দেবো না। সে যদি আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে তবে আমি কেন পারব না? আমাকেও পারতে হবে।

এদিকে স্কুল লাইফটাও একদম শেষের দিকে। আজকে বিদায় অনুষ্ঠান। কী যেন হারিয়ে ফেলার কষ্ট অনুভব করছি। হয়তো স্কুল জীবনটাকেই। স্কুলে গিয়ে সারাটাদিন ফ্রেন্ডসদের সঙ্গেই ছিলাম। চোখের পানি বাঁধ মানেনি আজ কারো।
বিকেলের দিকে অনুষ্ঠান শেষ হয়। সবার সঙ্গে স্কুল থেকে বের হওয়ার পর রুদ্রকে দেখতে পাই। প্রথমে ভেবেছি হয়তো কোনো কাজে এসেছে। কিন্তু যখন সে আমার দিকেই এগিয়ে এলো তখন বুঝলাম আমার জন্যই এসেছে। তবুও শিওর করে বলা যায় না। এখনও পর্যন্ত আমি তো তাকে চিনতেই পারলাম না। সে আমার বাকি বান্ধবীদের সঙ্গেই আগে কথা বলল। ওরা বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার পর রুদ্র বলল,’চলো সামনে আগাই।’
আমি কিছু না বলেই হাঁটা শুরু করি। রুদ্র একটা রিকশা ডাকে। রিকশায় উঠার পর রুদ্র-ই কথা বলা শুরু করে। জিজ্ঞেস করে,’কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ । আপনি?’ বললাম আমি।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। মুখ এমন শুকিয়ে গেছে কেন? কান্না করেছ?’

তার এই প্রশ্নে আমি নিরুত্তর রইলাম। সে নিজেই বলল,’এতগুলো দিন কথা না বলে থাকতে পারলে?’
‘আপনিও তো বলেননি।’
‘মিস করেছি অনেক।’
‘কখনো একটা ম্যাসেজও তো দেননি।’
‘মিস করেছি এটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমি বলতে পারি না।’
‘অথচ আপনি আমায়ও বলেননি।’
‘রিলেশনশিপ না হলে কি বন্ধুত্বও রাখা যায় না?’
‘যেখানে অবহেলা থাকে, সেখানে আমি থাকতে পারি না।’
‘আমি অবহেলা করিনি নবনী। শুধু সত্যটা তোমায় জানিয়েছি।’
রিকশা বাড়ির সামনে চলে আসায় আর কিছুই বলিনি তাকে। তবে এরপর থেকে আবারও তার সাথে আমার যোগাযোগ শুরু হয়। কথা হয়। তবে আগের তুলনায় তেমন না। সে নিজে থেকে কিছু না বললে আমিও যেচে কিছু বলি না। এটাকে কেউ ইগো ভাববেন না। শুধুমাত্র রুদ্র যেন বিরক্ত না হয় এজন্যই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি।

ফাইনাল পরীক্ষা হলেও এবার মা ফোন নেয়নি। কারণ বিভিন্ন সাজেশন+ফ্রেন্ডের হেল্প ফোনের মাধ্যমেই নিতে হচ্ছে। আমি নিজেও এখন পড়া নিয়ে প্রচুর সিরিয়াস। প্রয়োজন ছাড়া ফোন হাতে নিই না। রাতে মা সঙ্গে ঘুমায় বলে বেশিক্ষণ ফোন চালানোরও সুযোগ নেই। রুদ্রর থেকে দূরে থাকার জন্য এটা আমার কাছে প্লাস পয়েন্ট। যদিও মন মানতে চাইত না। তবে মানিয়ে নিচ্ছি। এখনও অব্দি তো কম কিছুর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিইনি।

আমার নিরবতা রুদ্রর ওপর উল্টো প্রভাব ফেলল। সে আমার নিরবতা দেখেছে কিন্তু নিরব হয়ে যাওয়ার কারণ খোঁজেনি। এবার সেও আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিল। বন্ধ করে দিল বলতে সেও ম্যাসেজ করে না, আমিও করি না। প্রথম পরীক্ষা দিয়ে আসার পর ম্যাসেজ করে জিজ্ঞেস করেছিল,’পরীক্ষা কেমন হলো?’
আমি বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো হয়েছে।’
‘ভালোমতো পড়ো আর পরীক্ষা দাও।’

এরপর নরমাল কথাবার্তা হলো। আমি তার হাভভাব কিছুই বুঝি না। সে বলে আমায় ভালোবাসে না। আবার সে আমায় ছাড়তেও চায় না। আপনাদের একটা কথা শেয়ার করি। তাহলে বুঝতে পারবেন, আমার এমন কনফিউজড হওয়ার কারণ কী। পাঁচ নাম্বার পরীক্ষার পর তিনদিন গ্যাপ ছিল। ভালোই লম্বা একটা সময় হাতে। তাই পড়ার পাশাপাশি ফোনটাও অপ্রয়োজনে হাতে নেওয়া হতো। একদিন নিউজফিড ঘাঁটতে ঘাঁটতে রুদ্রর রিসেন্ট একটা পোষ্ট চোখের সামনে আসে। পোষ্ট অনেকটা এমন ছিল,’ভালোবাসার এক রাজ্যে যেতে চাই তোমায় নিয়ে। তুমি কি যাবে?’
কবিতার মতো করে ছিল। সবসময়ের মতো এবারও আমি তার এই পোষ্টের সব কমেন্টগুলো দেখছিলাম। সেখানে একটা মেয়ের কমেন্ট ছিল,’তুমি যাবে কী?’
রুদ্র কমেন্টে লাভ রিয়াক্ট দিয়ে রিপ্লাই করেছিল,’অবশ্যই।’ সঙ্গে লাভ ইমুজি দিয়েছিল। খটকা লাগার পাশাপাশি আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল। হিংসা’ও বলা যায়। আমি দুজনের কমেন্টেই লাভ রিয়াক্ট দিয়েছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র আমায় ম্যাসেজ দিয়ে বলে,’আরিয়া কিন্তু আমার ছোটো বোন হয়। উল্টাপাল্টা কিছু ভেবো না।’
ওহহো, ঐ মেয়েটির নামই তো আপনাদের বলিনি। হ্যাঁ, ঐ মেয়েটির নামই আরিয়া। রুদ্রর ম্যাসেজ সীন করেই আমি রেখে দিলাম। এবার সে আবার ম্যাসেজ দিল,’তার বয়ফ্রেন্ডও আছে। ঐদিন তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে কথাও হয়েছে দেখো।’

এটা বলে ওদের কথা বলার একটা স্ক্রিনশট পাঠায় আমায়। এবার আমি রিপ্লাই দিলাম,’এত কৈফিয়ত চেয়েছি আমি? নাকি প্রমাণ চেয়েছি? রিল্যাক্স থাকেন।’
‘আমায় বিশ্বাস করো। আমি সত্যি বলছি।’
এই ম্যাসেজটাও আমি সীন করে রেখে দিয়েছি। সে লিখেছে,’ম্যাসেজ সীন করো না! কথা বলো নবনী।’
এই ম্যাসেজও আমি সীন করে রেখে দিয়েছিলাম।

এখন আপনারাই বলুন, আপনাদের আসলে কী মনে হয়? সে কেন এমন করে? এত করে বলার পর কিন্তু আমার খুশি হওয়ার কথা। সে আমায় প্রমাণ দিচ্ছে, না চাইতেও কৈফিয়ত দিচ্ছে। কিন্তু আমি পারিনি খুশি হতে। উল্টো আমার মনের ভেতর আরও অনেক বেশি সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। কেন জানেন? কারণটা ছিল রুদ্রর পাঠানো ঐ স্ক্রিনশট। সেখানে আরিয়া এবং রুদ্র দুজনই দুজনকে আপনি করে বলছিল। এর মানে দাঁড়ায় রুদ্র যেই স্ক্রিনশট আমায় পাঠায় সেটা ছিল ওদের প্রথমদিককার কথা। কমেন্টের কথাটা কি আপনারা খেয়াল করেছেন? সেখানে কিন্তু আরিয়া তুমি করে বলেছিল। তার মানে ওদের দুজনের কথোপকথনই এখন তুমিতে এসেছে। সেখানে দুজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। আবার এমনও হতে পারে মেয়েটিই রুদ্রকে পছন্দ করে। চাইলেই প্রশ্নগুলো রুদ্রকে করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিরক্ত করতে চাই না। তার যা ইচ্ছে সে করুক।

সারাদিন আর কোনো কথা হয়নি আমাদের। রাতে আমি নিজেই ম্যাসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করি,’ডিনার?’
ওর রিপ্লাই ছিল,’হুম। আপনার?’
আমি অবাক হয়ে লিখলাম,’আপনি! ওয়েল। ফাইন। আপনি-ই ঠিক আছে।’
রুদ্র তখন মুখ ভেংচির একটা ইমুজি দিল আর আমি দিলাম লাইক। ব্যস এটাই ছিল আমাদের শেষ কথা। এরপর আবারও কথা বন্ধ। আমিও আর তাকে ঘাটাইনি। পুরো মনোযোগ ঢেলে দিয়েছি শুধু পড়ার দিকে। কিন্তু ঐযে বেহায়া মন! যতবার করে ভুলে থাকার চেষ্টা করেছি তত বেশিই মনে পড়েছে।

এদিকে পরীক্ষাও প্রায় শেষের দিকে। ওর সাথে কথা বলার ইচ্ছেও প্রবল হচ্ছিল। নিয়ম করে ওর আইডি ঘেটে ম্যাসেজ দিতে গিয়েও ফিরে আসতাম। অন্যদিন পরীক্ষা শেষ করে ওর আইডি চেক করতে গিয়ে দেখি ডে দিয়েছে। বলে রাখি, মাঝখানে আমাদের এক সপ্তাহের মতো কথা হয়নি। এর মাঝে একদিনও ওর ডে দেখিনি। ডে চেক করে দেখি তেরো ঘণ্টা আগে ডে দিয়েছিল। এরপর ছয় ঘণ্টা আগে একটা ডে। ঐটা ছিল কাজিনদের সাথে। অথচ ২০ মিনিট আগেও ওর আইডি আমি চেক করেছিলাম। কিন্তু তখন কোনো ডে দেখিনি। তার মানে রুদ্র আমার থেকে ডে হাইড করে রেখেছিল! রাগের পাশাপাশি কষ্টটাই আমার বেশি হচ্ছিল। এমন ইগনোর করার মানে কী? সিদ্ধান্ত নিলাম আজই এর একটা বিহিত করব। আর কত সহ্য করব? ডে তে রিপ্লাই করলাম,’আমার থেকে ডে হাইড করে রেখেছিলেন?’

রুদ্র একটিভ-ই ছিল। রিপ্লাই দিল দু’মিনিট পরে,’না।’
‘মিথ্যা কাকে বলেন আপনি?’
‘তোমাকে।’
আমি সেন্টি ইমুজি দিলাম। সে লিখল,’কেমন আছো?’
সে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চাইলেও আমি দিলাম না। ফের বললাম,’আমায় বিরক্ত লাগলে সেটা সরাসরি বলতে পারেন না? এভাবে ইগনোর করার মানে কী?’
‘আমি কি একবারও বলেছি যে তোমাকে আমার বিরক্ত লাগে? সবসময় দু’লাইন বেশি বোঝো। আর এত কীসের রাগ? রাগ, জেদ কমে না তোমার?’
‘আমি মোটেও রাগ-জেদ দেখাইনি। আমি শুধু জানতে চেয়েছি আমার থেকে ডে হাইড করার রিজন কী?’

রুদ্র এবার আর ম্যাসেজ সীন করল না। আমি একটু পরপর গিয়ে দেখি সীন করেছে কী-না! কিন্তু না। সীন-ই করেনি। আমি আবার ম্যাসেজ দিলাম,’ম্যাসেজ সীন করারও সময় নেই এখন?’
রুদ্র উত্তর দিল,’কাজে আছি। পরে কথা বলি।’
ম্যাসেজ সীন করে কিছু্ক্ষণ নিরুত্তর হয়ে বসে রইলাম আমি। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আমার। এমন সূক্ষ্মভাবে একটা মানুষ কী করে ইগনোর করতে পারে? আমি এখনও তাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। সে কেন এমন করে,কী চায় কোনো কিছুই আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু তার এই অবহেলাও আমি আর নিতে পারছিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে তিলে তিলে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একেবারেই কষ্টকে গ্রহণ করে নেবো।

ম্যাসেজ লিখলাম,’আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রুদ্র। আপনি আমার জীবনে না আসলে আরও অনেক কিছুই অজানা থাকতো।একটা ধাক্কা আমার খাওয়ার প্রয়োজন ছিল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। থ্যাংকস টু ইউ।’

আমার এই ম্যাসেজের রিপ্লাইও আসলো সেন্টি ইমুজি। আমি লিখলাম,’আহা! সেন্টি কেন? আজ কিছু শেষ কথা বলব শুনুন।’
‘শেষ কেন?’ রুদ্রর প্রশ্ন।
‘আমার ছোট্টো জীবনে মিথ্যাবাদীর কোনো জায়গা নেই। অন্যভাবে বলা যায়, আপনার জীবনে আমি বেমানান।’
এবার সে নিরুত্তর। নিজেই লিখে যাচ্ছিলাম,’মনে পড়ে সেই বিকেলে নৌকার কথা? আমায় বলা কথাগুলো? মনে থাকারও কথা না অবশ্য। সত্যি বলি, আসলেই চাইলে হাজারটা মানুষের সাথে কথা বলা যায়। কিন্তু ঐযে মন বলে একটা শব্দ আছে। সে সবার কথায় সায় দেয় না। কিন্তু কেন জানি আপনার কথায় সায় দিয়েছিল। সেদিন আপনাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছিল, নাহ্ এই মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায়। এই মানুষটাকে ভরসা করা যায়। এই মানুষটাকে মন খুলে সব কথা শেয়ার করা যায়।
কিন্তু আমি ভুল ছিলাম! এই মানুষটা আমার না, আমার না, আমার না!’
‘হুম।’

জি আমার বিশাল ম্যাসেজের উত্তর এসেছে তার ঐ ‘হুম।’ আমি অবশ্য অবাক হইনি। আমি তো জানি সে কেমন। আমি লিখলাম,’আপনি বলেছিলেন সবাই আপনাকে অপশোনাল হিসেবে ব্যবহার করে। সেদিন আমিও এটাই বিশ্বাস করেছিলাম। বাট এখন আমি এটা রিয়ালাইজ করতে পারছি, আসলে অপশোনাল আপনি নন বরং আপনার জীবনে অনেকগুলো অপশনের মধ্যে আমিও একটা অপশন ছিলাম।’
‘এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।’
‘প্লিজ! শেষবারের মতো আমায় অন্তত বোকা বানিয়েন না!
প্রত্যেকটা পদে পদে আপনি আমায় মিথ্যে সাজিয়ে বলেছেন, আপনাকে বিশ্বাস করতে শিখিয়েছেন। আমি বুঝেও চুপ থাকতাম। আপনার ব্যস্ততা,অবহেলা সব মেনে নিতাম।
কিন্তু ঐযে, মানুষের একটা দোষ আছে। এরা চাওয়ার চেয়ে বেশি কিছু পেয়ে গেলে সস্তা মনে করে। আপনার ক্ষেত্রেও সেম কাজটাই হয়েছে।’
‘দারুণ।’
‘তবে আপনি অনেক ভালো একটা মানুষ। মন ভালো করার মতো মানুষ। কিন্তু কারো সারাজীবনের সঙ্গী হওয়ার মতো অন্তত নন! সময়ের সাথে সাথে অবশ্য ঠিক হয়ে যাবে। আমার মতো, আমার চেয়েও বেটার আরও অনেকেই আসবে যাবে আপনার জীবনে। এসব কোনো ফ্যাক্ট না।’
‘ভেবেই রেখেছিলাম একদিন এসব শুনতে হবে। ভালোই বললে!’
‘আজ থেকে আমায় হাইড করে ডে দিতে হবে না। আজ থেকে আপনাকে কেউ বিরক্ত করবে না। এইটা করবেন না, ঐটা করবেন না, এটা করেন কেন? এসবও আর কেউ বলবে না। কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। কারো পাগলামি সহ্য করতে হবে না।’
ব্যস এইটুকু বলেই আমি রুদ্রকে ব্লক করে দিই। কষ্টের সমাপ্তি ঘটাই এখানেই।

চলবে…

সে পর্ব-০৯

0

#সে
#পর্ব_৯
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
রেষ্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি।আদিব বারবার বলছে,’আপু ভেতরে যাবে না? ভেতরে চলো।’
ওর কথা আমার কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। বুক কেমন ধুকপুক করছে। হার্টবিট খুব দ্রুত চলছে। আমি নিজেও জানি না, ভেতরে যাওয়ার পর কোন পরিস্থিতির সাথে আমায় নতুন করে পরিচিত হতে হবে।

বড়ো করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলাম। আদিবকে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে যেতেই সবার আগে লিমা আমায় দেখে। হাত নাড়িয়ে বলে,’নবনী এইযে আমি। আয়।’
লিমা আমায় ডাকার সাথে সাথে আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা কয়েকজন আমার দিকে তাকায়। তাদের সঙ্গে আরও একজোড়া হাস্যজ্জ্বল চক্ষু আমার দিকে নিবদ্ধ হয়। সম্ভবত আমার নামটি উচ্চারিত হয়েছে বলেই রুদ্র তাকিয়েছে। আমি ওর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে লিমা যেই টেবিলে বসেছে সেই টেবিলে গিয়ে বসলাম। রাগে আমার শরীর কাঁপছে। আমি কোনোভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। আদিবকে খাবার দিয়ে আমি রুদ্রর কাছে যাই। রুদ্র এতক্ষণ সবার সাথে হেসে হেসেই কথা বলছিল। আমায় দেখার পর হাসিটা আরও প্রশস্ত হয়। আমি অবাক হয়েছি এটা ভেবে যে, আমায় দেখে রুদ্রর কোনো ভাব পরিলক্ষিত হলো না। একটু অবাকও তাকে হতে দেখা গেল না। যেন আমার আসাটা খুব স্বাভাবিক।

রুদ্র হেসে বলল,’আরে নবনী! বসো। আমি এখনই তোমায় এই টেবিলে আসতে বলতাম।’
আমি কিছু না বলে শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রুদ্রর দুই পাশে দুই মেয়ে বসা। অন্য পাশে আরও একটি মেয়ে এবং একটা ছেলে। রুদ্র ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমায়। এখানে একজন শুধু স্বামী-স্ত্রী। বাকি দুইটা মেয়েকে কাজিন বলে পরিচয় দিল। যদিও সত্যিটা আমার জানা নেই। কাজিন না হয়ে বন্ধুও হতে পারে। তবে গার্লফ্রেন্ড মনে হলো না। আমি সরাসরি রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলাম,’এটাই কি আপনার ব্যস্ততা?’

আমার এই প্রশ্নে রুদ্রের সঙ্গে বাকিরাও যেন একটু ঘাবড়ে গেল। কারণ আমার কথায় কোনো ফর্মালিটি নেই। এমনকি আমি তাদের সাথেও হাসিমুখে দুটো বাক্যব্যয় করিনি। আসলে আমি পারিনি। এই মুহূর্তে আমার মাথায় অন্যকিছু আসছে না। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার দারুণ ক্ষমতা রুদ্রর রয়েছে বুঝতে পারলাম; যখন আমার কথার উত্তরে সে হেসে বলল,’আর বোলো না! সবগুলা মিলে জোর করে নিয়ে আসলো। তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো। বসে আড্ডা দিই।’
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’সরি। সময় নেই আমার। এসেছিলাম একটা বিশেষ কাজে। কাজ শেষ আমার। আজ যদি আপনার একটু সময় হয় তাহলে বাড়ি ফিরে দেখা কইরেন। আর যদি ব্যস্ত থাকেন, সময় না হয় তাহলে কোনো দরকার নেই।’

এরপর উপস্থিত বাকিদের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হেসে বললাম,’আসসালামু আলাইকুম আপুরা এবং ভাইয়া। অন্য একদিন আপনাদের সঙ্গে আড্ডা দেবো।’
উত্তরে তারা ঠোঁট প্রশস্ত করে হাসলো। নিজেদের টেবিলে ফিরে এসে লিমাকে বললাম,’বাড়িতে গিয়ে কল করব।’
আর খাবার পার্সেল করে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। বেচারা ছোটো ভাই আদিবের খাওয়ার হক তো আর তার জন্য নষ্ট করতে পারি না।

বাড়িতে এসেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছিলাম না। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এখানে এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে? রুদ্র তো আর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে যায়নি। হ্যাঁ, আপনাদের ধারণা ঠিক ধরে নিলাম। কিন্তু এই চিন্তা-ভাবনার আগে একবার আমার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে দেখুন তো! আপনি পারবেন এতো মিথ্যে সহ্য করতে? আমি জানিনা আপনি বা আপনারা পারবেন কী-না। তবে আমি পারছি না। সত্যি কথা বলতে তার কোথায় এত আপত্তি? আমি তো তাকে কখনো কোনো কিছুতে বাঁধা দেই না! তবে সমস্যাটা কোথায়?

যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। আমার অনুভূতি ভুল কোনো মানুষের প্রতি অনুভব হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নইলে কেন আমায় এমন কষ্ট পেতে হবে? মাথা ঠান্ডা করতে এবং রাগ কমাতে শাওয়ারের নিচে গিয়ে কতক্ষণ বসে রইলাম। অজানা কারণে কেঁদেও ফেললাম।
.
.
রাত পর্যন্ত আমায় অপেক্ষা করতে হয়নি। গোসল শেষ করে চুপচাপ শুয়েছিলাম। একটু আগে রুদ্র ফোন করে বলল নিচে যেতে। বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়ে মাথাটা কেমন জানি চক্কর দিয়ে উঠছে। ঝিমঝিমও করছে। অনেকক্ষণ শাওয়ারের নিচে ছিলাম বলেই হয়তো! বাড়িতে না বলেই নিচে নামলাম। প্লে-গ্রাউন্ডের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। রুদ্র অসহায় ভঙ্গিতে বলল,’তুমি কি কোনো কারণে আমার ওপর রেগে আছ নবনী?’

আমি অবাক হয়েছি। সত্যিই আমি অবাক হয়েছি তার এই প্রশ্নে। মানে সে জানেই না আমি রাগ করেছি কিংবা কোন কারণে রাগ করেছি সেটাও জানে না। তাচ্ছিল্য করে হেসে বললাম,’আপনি জানেন না?’
‘না বললে জানব কীভাবে? কেউ কি আমার নামে তোমায় কিছু বলেছে যেই কারণে তুমি আপসেট?’
‘আমি শোনা কথায় কান দিই না।’
‘তাহলে কী সমস্যা বলো? আমায় না বললে তো আমি বুঝব না।’
‘আপনি আমায় মিথ্যা কেন বলেন?’
‘কী মিথ্যা বলেছি?’
‘কী মিথ্যা বলেননি? শুরু থেকেই আপনার একটার পর একটা মিথ্যা শুনে যাচ্ছি আমি। সব বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে যাচ্ছি। আপনি যেভাবে বলছেন সেভাবেই চলছি। আপনি যাতে বিরক্ত না হোন এজন্য একটা কথা বলতে গেলে আগে দশবার ভাবি। আপনি সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। রাতে তো অল্প সময়ের জন্য হলেও ফ্রি থাকার কথা। এখন আপনি বলবেন আপনি ফ্রি থাকেন না? থাকেন! আপনি রাত জেগে গেম খেলেন, মুভি দেখেন। এসব কথা আমি আরও আগেই রিশানের কাছে জেনেছি। তবুও কোনোদিন অভিযোগ করে বলিনি, আমায় সময় না দিয়ে আপনি কেন গেম খেলেন, কেন মুভি দেখেন! আপনার পার্সোনাল একটা জীবন আছে। আমার কোনো অধিকার নেই আপনার পার্সোনাল জীবনে ইন্টারফেয়ার করার। ঠিক এ কারণেই আমি কোনো অভিযোগ করি না।

আপনি আমার সাথে কথা বলার জন্য আপনার ফ্রি সময়টা বেছে নেন। আর আমি? আমি আপনার জন্য ব্যস্ততাকে এক সাইডে সরিয়ে রাখি। আপনার কি ধারণা আমার ব্যস্ততা নেই? সারাদিন কত পড়ার চাপ থাকে আমার জানেন? তবুও ক্লাসে প্রতি ঘণ্টায় লুকিয়ে ফোন চেক করি আপনি একটা টেক্সট করেছেন কীনা! নিজে থেকে টেক্সট করা তো দূরের কথা, আমি যে ম্যাসেজ করতাম তারই তো রিপ্লাই দিতেন না। সীন করারই সময় হতো না আপনার হাহ্!’

এইটুকু বলে থামলাম আমি। তার দিকে তাকিয়ে দেখি নিষ্পলকভাবে সে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম,’ব্যস্ততা আমারও রয়েছে। এক্সাক্টলি সময় দেওয়াটা নির্ভর করে নিজের ওপর। ইচ্ছে থাকলে ব্যস্ততার মাঝেও একটুখানি সময় খুঁজে বের করা যায়। আর এই ইচ্ছেশক্তিটা আমার রয়েছে। আপনার নেই।’

‘আ’ম সরি নবনী। আর এমন হবে না। আমি তোমাকে এখন থেকে সময় দেওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা করব।’
‘প্লিজ! দরকার নেই কোনো। আমি কারো বিরক্তের কারণ হতে রাজি নই। আপনার কি ধারণা আমি ফেলনা? আমার কোনো দাম নেই? আপনাকে বেশি প্রায়োরিটি দেই বলে আমি ভেল্যুলেস?’
‘এমন কিছু নয় নবনী। আমি কখনো তোমায় এমন ভাবি না। অবশ্যই তোমার প্রায়োরিটি রয়েছে। ভেল্যু রয়েছে।’
‘হ্যাঁ, আছে। কিন্তু আপনার কাছে নেই। আপনার কাছে বিরক্তের আরেক নাম হলো নবনী। এজন্যই তো বিরক্ত দূরে রাখতে সবসময় কাজের বাহানা দেখান, ব্যস্ততা দেখান। ওকে ফাইন, আজ থেকে আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত। আর বিরক্ত করব না আপনাকে। আপনি আপনার মতো করে ভালো থাকেন। শান্তিতে থাকেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’

রুদ্র কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আগেই আমি বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করি। রুদ্র অনেকবার পিছু ডাকে। আমি দাঁড়াইনি। দৌঁড়ে ভেতরে চলে এসেছি। কথাগুলো বলা এতটা সহজ আমার জন্য ছিল না। কিন্তু কী করব বলুন? এতদিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট, অভিমানগুলো যে আর চাপিয়ে রাখতে পারিনি। আমাকে ছাড়া রুদ্রর কতটা কষ্ট হবে জানিনা। কিন্তু তাকে ছাড়া থাকতে, কথা না বলে আমি ভালো থাকতে পারব না। প্রয়োজন নেই ভালো থাকার। তবুও আর তার বিরক্তের কারণ হতে রাজি নই আমি।

বাড়িতে আসার পর রুদ্রর অনেকগুলো ম্যাসেজ এবং কল পাই। কল রিসিভ করিনি। ম্যাসেজের বেশিরভাগ এমন ছিল,’আর এমন হবে না। সরি। ফোন রিসিভ করো।’
আমি রেসপন্স করিনি। তিথি আর লিমাকে ফোন করে সব বললাম। তিথি বলল,’দেখ এবার কী করে। গুরুত্ব দিলে এবার থেকেই দেওয়া শুরু করবে। নয়তো সে আর ঠিক হবে না।’
আমিও চুপচাপ দেখতে লাগলাম সে কী করে। প্রতিদিন ক্লাস, কোচিং এর ফাঁকে এখনও ফোন চেক করার অভ্যাস রয়ে গেছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এখন আর আমায় নিরাশ হতে হয় না। রুদ্রর ম্যাসেজ পাই আমি। অবসর সময়ে প্রায়ই তার আইডি ঘাটাঘাটি করি। কমেন্ট চেক করি। কোনো মেয়ের কমেন্ট সন্দেহকর মনে হলে সেই মেয়ের আইডিও ঘুরি। নিজের মন খারাপের কারণ আমি নিজেই। নয়তো কেন খুঁটে খুঁটে সব বের করতে হবে আমার?

এর মাঝে আমার পরীক্ষা শুরু হয়। মা ফোন নিয়ে গেছে। ল্যাপটপও মায়ের কাছে। অতিরিক্ত স্বাধীনতা থাকলেও পরীক্ষার সময় মা ভীষণ কঠোর হয়ে যান। এটা অবশ্য আমার ভালোর জন্যই করে। তবুও রুদ্রর আইডি ঘুরাঘুরি করে যেই শান্তি পাই, তৃপ্তি পাই সেটা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছিলাম। এখনও মা পরীক্ষার সময় আমার স্কুলে গিয়ে বসে থাকে। সেই ছোটোবেলার মতো। পরীক্ষা শেষ হলে আবার সঙ্গে করে নিয়ে আসে। রাতে পড়ার সময় পাশে বসে থাকে। আমি রাত পর্যন্ত পড়ি। একসময় মা জেগে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েও যায়। একটু পরপর আবার হুট করে জেগে বলে,’পানি লাগবে তোর? চা খাবি? কফি বানিয়ে দেবো?’

মায়ের এত অস্থিরতা দেখে হাসি পায় আমার। মনে মনে ভীষণ খুশিও হই। মায়ের সঙ্গই মনটা অনেক হালকা করে আমার। অযথা চিন্তা-ভাবনা করার সময় হয় না। এর মাঝে কয়েকদিন স্কুলে যাওয়ার পথে রুদ্রর সঙ্গে দেখা হলেও কথা হয়নি। তার কথা হয়েছে মায়ের সাথে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে মাঝে মাঝে তাকে দেখতে পেতাম। যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ ছিল না। সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক হয়েছে রাগ-অভিমান। এবার সমঝোতা করা প্রয়োজন। কালই লাস্ট পরীক্ষা। এরপর তো মা ফোন দিয়ে দেবে। তখন সব অভিমান মিটিয়ে নেব। আর এবার মনের কথাও জানিয়ে দেবো।
__________
অপেক্ষা করতে করতে সকাল হয়। আমার আর তর সইছে না। মন কেমন যেন আকুপাকু করছে। কখন পরীক্ষা শুরু হবে, কখন শেষ হবে আর কখন ফোন হাতে পাব সেই অপেক্ষায় আছি এখন। সকালে কিছুক্ষণ পড়ার পর গোসল করে রেডি হয়ে নিলাম। তারপর নাস্তা করে মায়ের সঙ্গে স্কুলে চলে গেলাম।

সবগুলো পরীক্ষার চেয়ে শেষ পরীক্ষাই আমার বেশি ভালো হয়েছে। কথায় আছে শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। আজ আমারও সব ভালো হওয়ার সময়। তিথি আর লিমাকে কথাটি শেয়ার করার পর ওরাও বলল, এবার আর মনের কথা মনে যেন না রাখি। সরাসরি দেখা করে বলে দিই। আমিও এমনটাই ভেবে রেখেছি। বাড়ি ফেরার পর মা বলল খেয়ে একটা ঘুম দিতে। এই কয়দিনে বেশ রাত জাগা হয়েছে। ফোন চাইলে পাছে মা সন্দেহ করে তাই ভাবলাম একটু ঘুমিয়ে নিই তাহলে। এক ঘুম দিয়ে উঠলাম পাঁচটায়। হেলতে-দুলতে ফ্রেশ হয়ে এসে ফোন নিজের বিছানাতেই পেলাম।

সময় নষ্ট না করে গেলাম অনলাইনে। রুদ্রর ভয়েস ম্যাসেজ। ওপেন করার পর শুনতে পেলাম ওর কণ্ঠে গান।

‘তোমাকে আজ প্রয়োজন ভীষণ
ভেতর-বাহিরজুড়ে সত্য এটাই,
হারিয়ে ফেলেছি আমাকেই আমি;
মন যা চায়, তুমি ঠিক তাই!

যায় না ফেরানো নিজেকে
মন বলে থেকে যাও না আরও,
তোমারও কি বলো হচ্ছে এমন!
চোখের ভাষায় অভিমান হাজারও…
অভিমান হাজারও…!

রূপকথার গল্পরা খেলছে
তোমার চোখে,
তুমি আড়াল রাখছ কেন মন
পথভুলো মেঘেরা কী যেন কী ভেবে,
থেমে গেছে, দেখো অকারণ!
মন বলে থেকে যাও না আরও,
তোমারও কি বলো হচ্ছে এমন…’

পুরো গানটা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। একবার নয়, বেশ কয়েকবার শুনেছি। এই গানটা আগে কখনো আমি শুনিনি। কার গান তাও জানিনা। তবে রুদ্রর কণ্ঠে এই গান শুনে আমি মুগ্ধ। ভীষণ মুগ্ধ। মনে হচ্ছে, প্রতিটা লাইন রুদ্র শুধু আমাকেই উৎসর্গ করেছে। ম্যাসেজ দিলাম,’গান দ্বারা কী বুঝালেন?’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার রিপ্লাই আসে।
‘নবনী! এতদিন পর তুমি অনলাইনে আসলে। তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন?’
‘পরীক্ষার জন্য।’
‘পরীক্ষা শেষ?’
‘আজ শেষ হলো।’
‘কেমন হয়েছে?’
‘ভালো।’
‘নবনী।’
‘কী?’
‘এখনও রাগ করে আছো?’
‘মিস করেছেন?’
‘করেছি।’
‘সত্যিই? বিশ্বাস হয় না।’

রুদ্র এবার সেন্টি ইমুজি দেয়। হেসে ফেলি আমি। রুদ্রকে বললাম,’কোথায় আছেন এখন?’
‘কাজে।’
‘সাতটার দিকে একটু দেখা করতে পারবেন? নাকি ব্যস্ত বেশি।’
‘পারব। সমস্যা নেই। কোথায় আসব?’
‘মাঠে। এসে আমায় ফোন দিয়েন।’
‘আচ্ছা।’
যা বলার সরাসরি বলব বলে এই টপিকে আর কোনো কথা বলিনি। এমনিতেই দুজনের স্বাভাবিক কথাবার্তা হচ্ছিল।

সন্ধ্যায় নাস্তা করার জন্য ফোন রেখে ড্রয়িংরুমে যাই। আজ আমার অন্যরকম খুশি লাগছে। মনে মনে ভাবছি কী করে তাকে মনের কথা বলব। আমায় অন্যমনস্ক দেখে আদিব বলে,’কী ভাবো আপু?’
‘কিছু না। তুই খা।’
আদিবের চুলে হাত বুলিয়ে বললাম আমি। তখন দেখলাম বাবা রুম থেকে বের হচ্ছে। বিস্ময় নিয়ে বললাম,’আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছ?’
‘আসছি আরও আগেই। তুই তখন ঘুমিয়েছিলি। শরীরটা ভালো লাগছিল না। তাই চলে এসেছিলাম।’
‘এখন ঠিক আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। একদম চাঙ্গা।’

বাবা পাশের সোফায় বসলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,’একটা গুড নিউজ আছে।’
‘কার জন্য?’ জিজ্ঞেস করে আদিব। বাবা বললেন,’নবনীর জন্য।’
আমি আরও বিস্মিত হয়ে বললাম,’সত্যিই বাবা?’
‘হ্যাঁ, মা। তুই না ঢাকায় পড়তে চেয়েছিলি? সবসময় তো বলতি, এত জায়গায় ট্রান্সফার হয়; ঢাকায় হয় না কেন! এবার আমি নিজে থেকেই ঢাকায় ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছিলাম। আবেদন গ্রান্টেড। তোর এস.এস.সি শেষ হলেই আমরা ঢাকায় চলে যাব।’

আমি নিশ্চল হয়ে বসে রইলাম বাবার কথায়। এটা যে আমার জন্য গুড নিউজ নয় তা আমি কী করে বোঝাব বাবাকে? ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,’ঢাকায় পড়ার ইচ্ছে আগে ছিল। অনেক আগে বলেছিলাম তোমায়। রিসেন্ট তো আমি এমনকিছু বলিনি বাবা।’
‘জানি মা। ঐ ঘটনার পর তোর সিকিউরিটি নিয়ে আমায় খুব চিন্তায় থাকতে হয়। এজন্যই ট্রান্সফারের জন্য আবেদন করেছিলাম।’

আমি কী বলব, কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমার পরীক্ষার বাকি কয়েক মাস। যদি ঢাকায় চলে যাই তাহলে রুদ্রর সঙ্গে কী করে দেখা হবে? কীভাবে সব ঠিক রাখব! আমি থাকব কী করে। আর দেরি করা চলবে না। রুদ্রকে অতি দ্রুতই জানাতে হবে। নাস্তা করে বাবা ঘরে যাওয়ার পর আদিবকে নিয়ে আমি বের হই। মাকে বলেছি রোজের কাছে যাচ্ছি। ওর কাছে গিয়েছিও। আদিবকে ওর কাছে রেখে আমি নিচে এসেছি। মাঠে যাওয়ার পর দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি রুদ্র আসছে। দুশ্চিন্তায় আমার হাত-পা কাঁপছে।

গণেশ আরও বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলছিল। আমায় দেখে জিজ্ঞেস করে,’দিদি খেলবে?’
আমি মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ বললাম। রুদ্র প্রায় আমার কাছাকাছি চলে এসেছে। মুখ সম্পূর্ণ স্পষ্ট হতেই ওর স্বভাবসুলভ হাসিটা প্রদান করে। প্রচণ্ড চিন্তার মধ্যে থেকেও ওর হাসি দেখে আমার ওষ্ঠদ্বয়ও কিঞ্চিৎ প্রসারিত হয়। রুদ্র হেসে জিজ্ঞেস করে,’কী অবস্থা মহারাণী? হঠাৎ এত জরুরী তলব?’

আমি স্বাভাবিক থাকতে পারছি না। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়েছি। এক হাত দিয়ে আরেক হাতের নখ খোঁচাচ্ছি। কীভাবে কথা শুরু করব সেটাও বুঝতে পারছি না। রুদ্র সেদিনের মতো আজও আমার কপাল স্পর্শ করে,’সুস্থ আছো তুমি?’
আমি মাথা নাড়লাম। আমতা আমতা করেও কিছু বলতে পারছি না। রুদ্র নিজেই বলল,’এখনও কি রেগে আছো? আর রাগ করে থেকো না প্লিজ! নিজেদের মাঝে আর কোনো মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং রেখো না।’
‘আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।’
‘আমিও তো শুনতে চাই। বলো।’
রুদ্রর কণ্ঠে রসিকতা। এবারও আমি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে অন্য কথা বলে ফেললাম। বললাম,’বাবা বলেছে আমার এস.এস.সি শেষ হলে ঢাকায় চলে যাবে। একেবারে।’
‘কী! কেন?’ অবাক হয়ে বলল সে।
‘ঐযে রিমি আপুর বিয়েতে ঐ ঘটনার পর আব্বু খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। তাই নিজে থেকেই ট্রান্সফারের আবেদন করেছিল।’
‘এটা কোনো কথা? এ কারণে তোমরা কেন সিলেট থেকে চলে যাবে? প্রয়োজনে আমি নিজে তোমার সেফ্টির দায়িত্ব নিতাম। শোনো নবনী, তুমি আঙ্কেলকে বোঝাও।’

আমি চুপ করে রইলাম। আমায় চুপ থাকতে দেখে রুদ্র গলারস্বর চওড়া করে বলল,’কী হলো? চুপ করে আছো কেন তুমি? তোমার বাবাকে বলে বোঝাও।’
‘আই লাভ ইউ!’
রুদ্র অবাক হয়ে তাকায় আমার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড চুপ থেকে বলে,’কী?’
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,’আ…আমি আপনা…কে আমি আপনাকে ভালোবাসি!’
এরপর রুদ্র যেটা বলল আমি বুঝতে পারলাম না তার এই কথা বলার রিজন কী! এটা কেমন উত্তর হতে পারে? উত্তর তো নয়ই বরং প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন। সে আমায় বলল,’আর ইউ ক্রেজি নবনী?’
ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়ে যায় আমার। কপালে ভাঁজ পড়ে। হৃদস্পন্দন দ্রুত চলছে।তাহলে কি সে আমায় ভালোবাসে না?

চলবে…

সে পর্ব-০৭

0

#সে
#পর্ব_৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। আকাশের বোধ হয় মন খারাপ। কিন্তু পরিবেশ সুন্দর। মেঘলা আকাশ দেখতে মন্দ লাগে না। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যেতেই রাজ্যের যত আলসেমি লাগে। স্কুলে যাওয়াটা ভীষণ মিস করছি। এখন ক্লাসে পড়ার চেয়ে আড্ডা বেশি হতো। গান গাওয়া হতো। তাই স্কুলে থাকাকালীন বৃষ্টি হলে আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। আমার স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এখনও মন থেকে ভয়টা পুরোপুরি দূর করতে পারিনি। বাড়িতেই চলছে পড়াশোনা।

‘নবু আপা এই ছড়াটা শিখাইয়া দিবেন?’

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি বই হাতে রাজ্জাক দাঁড়িয়ে আছে। আপনাদের তো বলাই হয়নি, বাবা রাজ্জাককে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। আমি তো আগেই বলেছিলাম আপনাদের, এমনটাই হবে। মনে আছে? ঘরের কাজ মা একাই করে। যত বকাঝকাই করুক না কেন, কাজের বেলায় সে একদম ঠিকঠাক। সবার সব কাজ মায়ের পছন্দও হয় না।

আমি বারান্দায় ছিলাম এতক্ষণ। ঘরে এসে রাজ্জাককে নিয়ে বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করলাম,’আজ স্কুলে যাসনি কেন?’
‘মা বারণ করছে। কইছে বিষ্টির মইধ্যে ইস্কুলে যাওন লাগব না।’
‘তুই আমার মাকে মা বলিস নাকি?’
‘হ। ক্যান আপনি জানেন না?’
‘না। এখন জানলাম। তুই তাহলে আমার ভালোবাসায় ভাগ বসাতে চলে আসছিস?’
‘হেহেহে।’
‘দাঁত কেলিয়ে হাসবি না। শোন, তুই আমার ভাই হবি এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কারণ সবার মতো আমারও ইচ্ছে হয় যদি একটা ভাই-বোন থাকত আমার! কিন্তু শোন, খামু, যামু, বিষ্টি এভাবে কথা বলবি না। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবি।’
‘আমি তো পারি না।’
‘আমি শিখিয়ে দেবো।’
‘আইচ্ছা।’
‘আইচ্ছা না, বল আচ্ছা।’
‘আচ্ছা।’
‘আচ্ছা শোন, তোর ব্যাপারে তো তেমনকিছু জানিই না আমি। তোর বাবা-মা নেই?’
‘নানীর কাছে শুনছিলাম আমি হওনের পর নাকি আম্মায় মারা গেছে। পরে আব্বা আরেকটা বিয়া করছে।’
‘তুই কোথায় থাকতি?’
‘নানার বাসায়। নানা-নানী মরার পর মামা-মামির কাছে আছিলাম।’
‘উনারা তোকে স্কুলে পড়ায়নি?’
‘না। আমি তো ফেলাস্কে (ফ্লাস্কে) কইরা চা বেঁচতাম। পরে একদিন আপনার আব্বার লগে দেহা হয়। আমারে অনেক প্রশ্ন করে। পরে আমার লগে বাসায়ও যায়।’
‘তাহলে কি বাবা তোকে দত্তক এনেছে?’
‘দত্তক কী?’

রাজ্জাকের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হেসে ফেললাম। আহারে মাসুম বাচ্চা! ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,’তুই বুঝবি না। আমি যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। এখন পড়। কোনটা পারিস না দেখি?’
.
.
ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বাবার আসার অপেক্ষা করছিলাম। রাজ্জাককে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার আছে। বাবার বাড়ি ফিরতে প্রায় দশটা বেজে যায়। খাওয়ার সময় কথার প্রসঙ্গ তুলে বললাম,’স্কুলে রাজ্জাকের নাম কী দিয়েছ বাবা?’
বাবা ভাতের লোকমা মুখে তুলে বললেন,’ওর নামই। রাজ্জাক।’
‘স্কুলে গিয়ে ঠিক করিয়ে আসবে। আমি ওর নতুন নাম রেখেছি। তোমার নামের সঙ্গে মিলিয়ে আদিব। আকিকাও দিয়ে দিও।’
‘বলিস কী রে!’
‘যা শুনেছ তাই বলেছি। দত্তক আনতে পারবে আর নামের জন্য আকিকা দিতে পারবে না?’

বাবা এবার হোহো করে হেসে উঠলেন। সঙ্গে মা’ও মুচকি হাসলেন। বাবা হেসে হেসেই বলল,’ধরে ফেলেছিস তাহলে।’
‘জি আজ্ঞে।’
_______________
প্রাইভেট টিচার আজ এতগুলো হোমওয়ার্ক দিয়ে গেছে। এগুলো সব কাল বিকেলের মধ্যে কমপ্লিট করতে হবে। তাই ভাবলাম জেগেই যখন আছি তখন অর্ধেক এখন করে রাখি। বাকিটা সকালে করব। লিখতে লিখতেও আলসেমি লাগে। আমি একটা জিনিস কিছুতেই বুঝি না, পড়তে বসলেই কেন এত ঘুম আসবে? সারাদিন পড়ে রয়েছে, রাত পড়ে রয়েছে তখন তো ঘুম আসে না। শুধু পড়তে বসলেই ঘুমের যত বাহানা। বিরক্ত লাগে!

চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চুপ করে বসেছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য লেখা স্থগিত রেখেছি। হাত ব্যথা করছে। বইয়ের লাইনে চোখ বুলাচ্ছিলাম তখন নজর যায় জানালার দিকে। এক মুহূর্তের জন্য আমার চোখ যেন আটকে গেল! আমি সোজা হয়ে বসে জানালা দিয়ে তাকাই। না, ভুল তো দেখছি না। এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্পষ্ট আমি রুদ্রকে দেখতে পাচ্ছি। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অর্ধবৃত্ত চাঁদের মৃদু আলোতে আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি। কালো প্যান্টের দু’পকেটে হাত পুরে জানালার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। অনেকটা দূরে এবং উঁচু জায়গায় দাঁড়ানোর ফলে সে আমায় দেখতে পেয়েছিল। আমার শুষ্ক ঠোঁটের কোণে শিশিরবিন্দু হয়ে হাসি ফোঁটায় রুদ্রর এহেন উপস্থিতি। আমি হাত নাড়িয়ে ইশারা করে বললাম,’আমি আসব?’

রুদ্রও ইশারায় ঘাড় নাড়িয়ে বলল,’আসো।’
গলায় একটা ওড়না ঝুলিয়ে দ্রুত আমি নিচে নেমে পড়ি। অবশ্যই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে নামতে হয়েছে। বাড়ির নিচে এসে দেখি রুদ্র দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমায় দেখেই সেই ভুবনজয়ী হাসি হেসে বলে,’হাঁটবে?’
আমি কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। দুজনে চুপচাপ হাঁটছি। নাহ্, আমি চুপ থাকলেও রুদ্র চুপ নেই। কথা বলছে সে। আর আমি? আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনছি।

আমরা এখন যাচ্ছি টং দোকানে চা খেতে। রুদ্রর ভাষ্যমতে বাদলা দিনে চা পান করার অমৃত খাবার আর কোনোটাই নয়। অধিকাংশ মানুষের চা পছন্দ হলেও আমার কেন জানি ততটা ভালো লাগে না। কারো কারো কাছে চা এতটাই পছন্দের যে পারলে বালতি ভরে খেতে পারবে। আর আমার বিষয় হচ্ছে, মুডের ওপর ডিপেন্ড করে। আপনাদের অদ্ভুত এবং অবাক লাগতে পারে। কিন্তু সত্যি এটাই। এক সময় অবশ্য প্রচুর চা খেতাম। ছোটোবেলায় আরকি। যদিও এখনও আমি ছোটোই! কিন্তু আরও ছোটো থাকতে মোটামুটিভাবে গ্লাস ভর্তি করে চা খেতাম। একথা আমায় মা জানিয়েছে।

আজ যেখানে রুদ্র চা খাওয়ার অফার করেছে সেখানে না করার তো প্রশ্নই আসে না। এখন আমরা হাঁটছি কাদাভর্তি রাস্তায়। এখানে, ওখানে পানি জমে রয়েছে। অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে হাঁটার পরেও আমার পা কাদার মধ্যে পড়ে যায়। ছোটোবেলা থেকেই আমার শুচিবায়ু রয়েছে। গা ঘিনঘিন করছে এখন। আর এক কদমও আগাতে ইচ্ছে করছে না। রুদ্র তখন আমায় নিয়ে পাশে থাকা মুদি দোকানে যায়। পানির বোতল কিনে হাতে দিয়ে বলে,’পা ধুয়ে নাও।’
আপনারা হয়ত ভাবছেন, হাঁটার দরকার কী? রিকশা নিলেই তো হয়। আসলে আমরাও রিকশা খুঁজেছি। পাইনি। বৃষ্টির দিনে খালি রিকশা পাওয়া আর চাঁদ পাওয়া আমার কাছে সমানই মনে হয়। রুদ্র কাকে যেন ফোন করেছে। এই সুযোগে আমি ভালো করে পা ধুয়ে নিয়েছি।

‘হয়েছে?’ ফোনে কথা বলা শেষ করে জিজ্ঞেস করল রুদ্র। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,’হ্যাঁ।’
‘এখানেই একটু দাঁড়াও। পরিচিত এক রিকশাওয়ালা চাচাকে ফোন দিয়েছি। সে পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে পড়বে।’
‘তাকে কেন ডাকতে গেলেন?’
‘খেয়াল করলাম তুমি কাদাপানির মধ্যে হাঁটতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছ না।’
‘এজন্য রিকশা ডাকতে হবে?’
‘হবে।’

আমি হাসলাম। কিছু্ক্ষণ মৌন থেকে বললাম,’আপনার বউ যে হবে সে অনেক লাকি।’
কথাটা আমি খোঁচা মেরেই বললাম। আমি আসলে শুনতে চাচ্ছি, আমার এই কথায় সে কী বলে! কিন্তু অদ্ভুত! রুদ্র কিছু বলল না। শুধু হাসল। আমি জিজ্ঞেস করলাম,’হাসছেন যে?’
‘তোমার কথা শুনে হাসলাম।’
‘হাসির কী বললাম আমি? সত্যিই তো বললাম।’
‘আচ্ছা।’
‘আবার আচ্ছা কী?’
‘এত খুঁত ধরো কেন পিচ্চি?’
‘কথার উত্তর না দিলে জিজ্ঞেস করব না?’

আমার এই কথার জবাব দিল না রুদ্র। একটা ফাঁকা রিকশা সামনে এসে দাঁড়ানোর পর রুদ্র বলল,’রিকশায় উঠো।’

চাইলে রিকশায় বসেও আমি প্রশ্নটি আবার করতে পারতাম। কিন্তু এক প্রশ্ন বারবার করাটা কেমন যেন দেখায়! আমার নিজের কাছেও আনইজি লাগবে।
আঁকাবাঁকা রাস্তায় ছোটো ছোটো গর্তগুলো এখন পানি দ্বারা পূর্ণ। তাই হঠাৎ হঠাৎ রিকশায় ঝাঁকুনিও লাগছে।

‘সামলে বসো।’ বলল রুদ্র।
আমি রিকশা ধরেই বসে ছিলাম। রুদ্রর প্রতি বিয়েরদিন আমার প্রচুর রাগ থাকলেও এখন আর সেটা নেই। সময়ের সাথে সাথে রাগও কমে গেছে। আবার এমনও হতে পারে, প্রিয়মানুষের ভুল-ত্রুটি, দোষগুলো আমাদের চোখে পড়লেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বেমালুম ভুলে যাই আমরা। মাঝে মাঝে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কেন সে আমায় মিথ্যে বলেছিল। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারি না। কী করে জিজ্ঞেস করব? সেই অধিকার যে আমার নেই।
.
রিকশা এসে থামে টং দোকানের সামনে। রুদ্র রিকশাওয়ালা চাচাকে বলল,’চাচা আসেন চা খাই।’
‘না, বাবা। তুমরা খাও।’
‘আরে আসেন তো।’
দোকানদারও রুদ্রর পরিচিত। রুদ্রকে দেখেই এক গাল হেসে বললেন,’এতদিন পর এই চাচার কথা মনে হইল?’

দোকানের ভেতর থেকে একটা চেয়ার উনি আমাকে আগে দিলেন। বাকি দুইটা চেয়ার দিলেন ঐ চাচা আর রুদ্রকে। রুদ্র চেয়ারে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে বলে,’সময় পাই না চাচা। কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতে হয়।’
‘হ, বাজান বুঝি। তাও সময় কইরা একটু আইবা। আমার ভালো লাগব।’
‘আচ্ছা চাচা সময় পেলেই আসব। এইযে আজ সময় করে চলে এলাম।’

দোকানদার চাচা পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে হেসে বললেন,’এল্লিগা অনেক খুশি হইছি বাজান। চায়ের লগে কি বিস্কুট দিমু?’
‘আমি খাব না। নবনী বিস্কুট খাবে?’ রুদ্র জিজ্ঞেস করল।
আমি বারণ করলাম। গরম চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার সাহস নেই। গরম চা আমি খেতে পারি না। কিন্তু রুদ্র কী সুন্দর করে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে! সেই দৃশ্য আমি লিখে বর্ণনা করতে পারব না। গল্প হচ্ছে এখন তাদের তিনজনের মধ্যে। আমি নিরব শ্রোতা হয়ে তাদের কথা শুনছি। মাঝে মাঝে গভীর দৃষ্টিতে রুদ্রর হাসিমাখা মুখটি লক্ষ্য করছি। আমি ভীষণভাবে ফেঁসে গেছি। আটকে গেছি আমি রুদ্রর মায়ায়, রুদ্রর প্রেমে। এই ঘোর, এই ধ্যান আমার কাটবে না। আমার রুদ্রকে চাই। একান্ত আপন মানুষ হিসেবে। সে শুধু আমার হবে। অন্য কারো সঙ্গে আমি তাকে ভাগ করতে পারব না। করব না। সে হবে একান্তই আমার প্রিয় ব্যক্তিগত মানুষ।

‘এই পিচ্চি?’ চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল রুদ্র। ধ্যানে ফিরে আমি হকচকিয়ে উঠি। আশেপাশে তাকিয়ে একটু লজ্জাবোধও করি। রুদ্র হেসে বলে,’উঠি এবার?’
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,’হুম।’
ইশ! এতক্ষণ রুদ্রর দিকে তাকিয়ে কত কী ভাবলাম। রুদ্রও নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে। আমি চুপচাপ রিকশায় উঠে বসলাম। রুদ্র দোকানদার চাচাকে বলল,’চাচা সময় পেলে একদিন বাসায় আসিয়েন। আমিও সময় পেলে আসব।’
‘আইচ্ছা বাজান।’

হালকা বাতাস, ঠান্ডা ওয়েদার, পাশে প্রিয় মানুষ। ইচ্ছে করছে সময়টা এখানেই থেমে থাকুক। আজ একটা টাইম-মেশিনের খুব শখ হচ্ছে। থাকলে বেশ ভালোই হতো। ঘড়ির কাঁটা টুপ করে থামিয়ে দিতাম। থমকে যেত সময়। গল্প করতাম আমরা অহরহ। কিন্তু সময় ফুরাতো না। আফসোস…এটা কখনও হওয়ার নয়।

রুদ্র নিজের চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলল,’নবনী কাল থেকে তুমি স্কুলে যাবে।’
‘না।’
‘না কি আবার? সামনে তোমার এস.এস.সি পরীক্ষা। ভালো রেজাল্ট করতে হবে না?’
‘আমি তো বাসায় পড়ছি।’
‘বাসায় পড়া আর ক্লাস করা কি এক হলো? যদি একই হতো তাহলে কেউই আর স্কুলে যেত না। বাসায় পড়ে পড়ে বিদ্যাসাগর হয়ে যেত।’
‘আপনি আমার দিকটা বুঝতে পারছেন না।’
‘আমি সবই বুঝতে পারছি। সেদিনের ঘটনা এখনও মন থেকে পুরোপুরি দূর হয়নি তাই না?’
‘হু।’
‘বেশ! আচ্ছা তুমি যে আমার সাথে বের হয়েছ তোমার কি এখন ভয় লাগছে?’
‘না।’
‘তাহলে তো হয়েই গেল।’
‘কী হয়ে গেল?’
‘কাল থেকে অফিসে যাওয়ার পথে আমি তোমায় স্কুলে ড্রপ করে দেবো। খবরদার! এখন কোনো বাহানা করবে না। একটু আগে তুমি নিজেই বলেছ আমি সাথে থাকলে তোমার ভয় করে না।’

রুদ্রর কথার ধরণে আমি হেসে ফেললাম। আচ্ছা রুদ্রর মনেও কি আমার জন্য সেম ফিলিংস রয়েছে? যেমনটা ওর প্রতি আমার রয়েছে। নয়তো আপনারাই বলুন, সে কেন শুধু শুধু আমার জন্য এত ভাববে? আমায় এত সাহায্য করবে? আপনাদের কি মনে হয় না সেও আমায় ভালোবাসে?

চলবে…

সে পর্ব-০৬

0

#সে
#পর্ব_৬
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
__________________
ছেলেটির শক্ত হাতের কবল থেকে নিজেকে বাঁচানো আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। এই সিচুয়েশনে কোনো মেয়ের নিজেকে রক্ষা করার মতো বোধবুদ্ধি থাকবে না। মনেপ্রাণে আল্লাহ্কে ডেকে চলেছি। চিৎকার করছি। আমি জানি, আমার চিৎকার কারো কান পর্যন্ত পৌঁছাবে না। কিন্তু তবুও ব্যাকুল মন সম্ভ্রমহানির কবল থেকে বাঁচতে চাইছে। সুন্দর পৃথিবী, সুন্দর ভোরটা দেখতে চাইছে। পেছনের দরজার বামদিকে খুপরীর মতো একটা অন্ধকার রুমে আমায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে ছেলেটি। এখানে এসে শরীরের যত শক্তি আছে সব খাঁটিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। চিৎকার করছি। ছেলেটি আমার সাথে পেরে উঠছিল না। না পেরে আমার গালে থাপ্পড়ও বসিয়ে দেয়। হাত ধরে টানতে থাকে। তবুও দমে যাইনি। শক্তিতে যতটা কুলাচ্ছে আমি জোরজবরদস্তি করছি সঙ্গে চিৎকার করছি।

কথায় আছে রাখে আল্লাহ্ মারে কে! যেখানে স্বয়ং আল্লাহ্’ই রয়েছে রক্ষা করার জন্য তখন দুষ্টুলোক কী করে তার উদ্দেশ্য হাসিল করবে? আমি গেইটের দিকে কতগুলো ছেলেকে দেখতে পাই। চিৎকার করার মুহূর্তে এবার ছেলেটি আমার মুখ চেপে ধরে। এত শক্ত করে ধরেছে যে আমি শব্দ করতে পারছি না। তখন মাথায় এলো অন্য বুদ্ধি। ছেলেটির অণ্ডকোষ বরাবর হাঁটু দিয়ে মারতেই ছেলেটির হাত আলগা হয়ে যায়। ব্যথায় কুকিয়ে ওঠে। সেই সুযোগে আমি ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে দৌঁড় দিয়ে চিৎকার করি। হন্তদন্ত হয়ে তারাও আমার দিকে এগিয়ে আসে। কাঁদতে কাঁদতে আমার বেহাল অবস্থা। শুধু এতটুকুই বলতে পারি,’ঐ…ঐখানে একটা ছেলে আছে। তাকে ধরুন। আমাকে বাঁচান।’

তখন ঐ ছেলেটিকে দৌঁড়ে পালাতে দেখে এখানকার তিনজন ছেলেও দৌঁড় দেয় তার পেছনে। এবার মনের সব শক্তি, জোর শেষের পথে। সেন্সলেস হয়ে যাই আমি। এরপর আর কিছু মনে নেই আমার।

যখন জ্ঞান ফিরে তখন নিজেকে আবিষ্কার করি নিজের ঘরে। ঐ ঘটনার কথা মনে পড়তেই চিৎকার করে কেঁদে উঠি। পাশে মা বসেছিল। আমায় জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,’কাঁদিস না মা। কিছু হয়নি। শান্ত হ। শান্ত হ।’
আমি নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না। বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। আমার বারবার মনে হচ্ছে, ঐ ছেলেগুলো যদি না থাকত তাহলে আমার কী হতো? একথা মনে পড়তেই বাঁধভাঙা কান্নারা আমায় পেয়ে বসে। মা-বাবা অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়েও আমার কান্না থামাতে পারে না। কিন্তু কান্নার গতি কিছুটা কমে আসে। মা আমায় বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

সকালে ঘুম ভাঙার পর কিছু্ক্ষণ বিছানায়ই বসে থাকি। কিছুতেই কাল রাতের কথা মাথা থেকে বের করতে পারছি না। রাজ্জাক গিয়ে মাকে ডেকে আনে। মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’এখন কেমন লাগছে মা?’
আমি কিছু না বলে নিষ্পলকভাবে শুধু চেয়ে রইলাম। কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই রুদ্র ঘরে আসে। মাকে জিজ্ঞেস করে,’আপনারা রেডি হন নি এখনো?’
‘আমরা রেডি-ই। তোমার আঙ্কেলও ঘরেই।’ বললেন মা।

রুদ্র এবার আমাকে বলল,’নবনী চলো। তাড়াতাড়ি রেডি হও। ঐ কুত্তার বাচ্চারে জেলের ভাত খাওয়াব।’
আমি এবারও নিরব রইলাম। রুদ্রও আর কিছু বলল না আমায়। ও সোজা বাবার কাছে চলে যায়। আর মা আমায় রেডি করে দেয়। যতবার কাল রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাটা মাথায় আসছে ততবারই ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। কলিজার পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা, আমি এবং রুদ্র থানায় গিয়ে কেস করে আসি। স্কুলেও যাই না বেশ ক’দিন। ভয়ে কেমন জানি একদম গুমড়ে গিয়েছি। বান্ধবীরা আসে। সময় দেয়। সাহস জোগায়। শুধু নিজেই পারি না নিজেকে বোঝাতে। আমি জানিও না এই ভয় আমার মন থেকে কবে যাবে অথবা আদৌ যাবে কী-না!

বান্ধবীরা প্রায়ই প্রাইভেট, কোচিং মিস দিয়ে আমার বাসায় এসে পড়ে থাকে। কতবার আমায় স্কুলে নিয়ে যেতে চেয়েছে। আমি যাইনি। সাহস হয়নি আমার। বারবার মনে হয়, যদি আবার এমনকিছু হয়? বাবা-ও অনেকবার চেষ্টা করেছেন। যখন দেখলেন আমার মনের ভীতি একেবারেই কমছে না তখন সময় দিলেন আমায় স্বাভাবিক করতে। মাকে বলতে শুনেছি,’নয়না এখন থেকে নবনীকে সময় দিও। ওর সাথে গল্প করো। আগে মেয়ে স্বাভাবিক হোক। সুস্থ হোক। স্কুলে পড়ে যাওয়া যাবে। ওকে ঠিকমতো খাওয়াবে।’

আমায় স্বাভাবিক করতে চেষ্টার কমতি রাখছে না কেউ। কিন্তু ঐযে ভয় তো আমার মনে চেপে বসেছে। রোজের কাছে শুনেছিলাম সেদিন যেই ছেলেগুলো দেবদূত হয়ে এসেছিল ওরা ছিল বরপক্ষ। বরের বন্ধু এবং কাজিন। ওরা সেই ছেলেটিকে ধরে বেধরম পিটিয়েছে। বিয়ে বাড়ির অনেকের কানে এই ঘটনার কথা চলে গেছে। রুদ্র যখন এসে ওকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। এই ছেলেটির নাম তপন। রুদ্রর চরম শত্রু। রুদ্র এসে এমন মাইর শুরু করে যে ছেলেটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অতিরিক্ত মাইর খেয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছে। ময়মুরুব্বিরা না আটকালে রুদ্র হয়তো তপনকে সেখানেই মেরে ফেলত।
.
বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি। উড়ে যাওয়া পাখির সংখ্যা গোনার চেষ্টা করছি। কখনো পারি তো কখনো আবার গুলিয়ে ফেলছি। দু’সপ্তাহেরও বেশি হবে আমি বাইরে যাই না। বাবা প্রাইভেট টিউটরকে বাড়িতে এসে পড়াতে বললেন। কোচিং, ক্লাসের পড়া বান্ধবীরা বাসায় এসে বুঝিয়ে দিয়ে যেত। এভাবে আর কতদিন চলবে আমার জানা নেই। ইচ্ছে করে মুক্তি পেতে। কিন্তু আমি পারি না। ভয় হয় ভীষণ।

কোথা থেকে তখন রোজ দৌঁড়ে এসে আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চমকে গেলেও ওকে দেখে শান্ত হই। ওর পিছু পিছু দেখতে পাই তিথি, লিমা, শান্তা, মৌ, জেরিন, আর রাকাকে। বলে রাখি, আমার বন্দি জীবনে ওরা আমায় অনেকটা সময় দিচ্ছে। রোজের সঙ্গে ওদেরও অনেক ভালো একটা সম্পর্ক হয়ে গিয়েছে। মৃদু হাসলাম আমি। রোজ বলল,’ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আমরা সবাই ঘুরতে যাব।’
‘তোমরা যাও। আমি যাব না।’
‘ইশ! বললেই হলো যাব না? তোর জন্য আজ আমরা কেউ স্কুলে যাইনি। এই দেখ একদম রেডি হয়ে এসেছি। সবাই মিলে আজ প্রচুর ঘুরব। প্রচুর আনন্দ করব।’ বলল তিথি।

আমি হালকা হেসে বললাম,’তোরা ঘুরে আয়।’
রুদ্রকে তখন ঘরে আসতে দেখে অবাক হই। রুদ্রও যাবে নাকি? সে শার্টের হাতা গোছাতে গোছাতে বলে,’পিচ্চি তাড়াতাড়ি রেডি হও। তোমার কোনো বাহানা আমরা কেউ শুনব না।’
আমি এবারও না করলাম। মা এসে আমায় রাজি করায়। বিরাট একটা গ্যাং মিলে আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। রুদ্র, অন্তু, কাউসার, ইলিয়াস, রোজ, তিথি, লিমা, শান্তা, মৌ, জেরিন, রাকা, রাজ্জাক, রিশান আর আমি। এতগুলা মানুষ মিলে আমরা কোথায় যাব সেটা এখনও আমার অজানা। একটা মিনি বাস ভাড়া করা হয়েছে। আমি বসেছিলাম তিথির সাথে। রুদ্র তিথিকে বলল,’আপু কিছু মনে না করলে আমি নবনীর সাথে বসি?’

তিথি হেসে বলল,’না ভাইয়া, সমস্যা নেই। বসেন।’
রুদ্র আমার পাশে বসে ইচ্ছে করে কাঁশি দেয়। ‘এহেম, এহেম।’
আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। এতদিন পর বাইরে বের হয়ে একটু ভালো লাগছিল। ভালোমতো নিঃশ্বাস নিতে পারছি।
‘নবনী কী করো?’
রুদ্রর বোকা বোকা কথা শুনে আমি হাসব নাকি কিছু বলব বুঝতে পারছিলাম না। কথা বলার জন্যই হয়তো এসব বলছে।
‘কথা বলবে না পিচ্চি?’ জিজ্ঞেস করল রুদ্র। আমি বললাম,’বলেন। শুনছি।’
‘শুধু শুনলে তো হবে না। কথা বলতে হবে।’
‘আচ্ছা।’
‘কেমন আছো?’
‘ভালো। আপনি?’
‘কত ভালো?’
‘এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করছেন কেন?’
‘আমি তো সেই হাসি-খুশি পিচ্চিটাকে দেখতে চাচ্ছি। কিন্তু পিচ্চিটা হাসে না কেন? এমন মনমরা হয়ে রয়েছে কেন?’
‘ভালো লাগছে না।’

রুদ্র নিজেও এবার চুপ হয়ে গেল। বাকিরা গান গাওয়া শুরু করেছে। সমস্বরে গান গাচ্ছে সবাই। মনে হচ্ছে আমরা কোনো পিকনিকে যাচ্ছি। আমারও ইচ্ছে করছে ওদের সাথে যোগ হই। কিন্তু কোথায় যেন একটা দ্বিধা! অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বিশাল একটা নদীর সামনে গিয়ে পৌঁছাই। নদীর পাড়ে আসার কারণ কী বুঝলাম না। তবে হ্যাঁ, নদী জায়গাটা আমার পছন্দ। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে নৌকায় ঘুরতে। এজন্যই কি তাহলে এখানে আসা হয়েছে? সামনে এগিয়ে দেখলাম রুদ্র নাকি আগে থেকেই নৌকা ভাড়া করে রেখেছে। সবাই ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠলেও আমি আর রুদ্র উঠলাম ডিঙি নৌকায়। এই নৌকায় চড়তেই আমি পছন্দ করি। আমার পছন্দ অনুযায়ীই কি রুদ্র সব করছে?

কোনো প্রশ্ন করিনি কাউকে। চুপচাপ নৌকায় উঠে মাঝখানে বিছানো পাটির ওপর বসে পড়ি। নৌকার এক মাথায় মাঝি এবং অন্য মাথায় রুদ্র। মাঝি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বৈঠা চালাচ্ছে নদীর স্রোতে। একটু এদিক-সেদিক হেলতে-দুলতে নৌকা বিরামহীনভাবে চলছে। রুদ্র আমায় অবাক করে দিয়ে একটা গান ধরে।

‘Aasman ke parre ek jahaan hai kahin
Jhooth sach ka waha qyeda hi nahi
Roshni mein waha ki alag noor hai
Saaye jismon se aage jahaan jaate hai
Chal wahan jaate hain
Chal wahan jaate hain
Pyaar karne chalo
Hum wahan jaate hain..’

রুদ্রের গানের সুরে ঝলমলে করা রোদ মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। নীল আকাশে এখন উড়ো মেঘের ছড়াছড়ি। বৃষ্টির মাধ্যমেই কি আকাশ রুদ্রর গানকে সমভর্থ্যনা জানাচ্ছে? তাই, হবে হয়তো। মাঝি বলল,’বৃষ্টি হইব মনে হইতাছে। নৌকা কি পাড়ে নিমু?’
‘না। আপনি নৌকা চালান।’ বলল রুদ্র।
এবারে আর আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। ভয়ে ভয়ে বললাম,’বেশি বৃষ্টি হলে যদি নৌকা উল্টে যায়? যদি পড়ে যাই? আমি কিন্তু সাঁতার পারি না।’

রুদ্র হেসে ফেলে আমার কথায়। ওর জায়গা ছেড়ে আমার পাশে এসে বসে।
‘আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই।’
আমি সরাসরি রুদ্রর চোখের দিকে তাকাই। ও চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকার সাধ্যি নেই আমার। অন্যদিকে চোখ ফেরানোর সাথে সাথে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু করে। প্রথমে ছোটো ছোটো ফোঁটায় আর এখন বড়ো বড়ো ফোঁটায়। প্রবল বর্ষণ হচ্ছে। নদীতে পড়া প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা বিন্দু সৃষ্টি করছে। একটা, দুইটা করে অসংখ্য বিন্দুরেখা। একটা আরেকটার সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমরা তিনজনও ভিজছি। রুদ্র আমার হাত ধরে বলে,’ভয় নেই। আমি আছি।’

কিছু্ক্ষণ মৌন থেকে নিজেই বলল,’আমি রিলেশন করি না, কারো সাথে মিশি না এজন্যই। আমার অনেক শত্রু রয়েছে। এরা আমার ক্ষতি করতে না পারলেও চেষ্টা করে আমার কাছের মানুষদের ক্ষতি করার। তোমার সঙ্গে আমার ভালোই মেলামেশা হয়েছে। শত্রুরা ফলোও করেছে। তপনও এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে। আমি নিজে থেকে না বললে, যেই বলুক না কেন তাদের কথা বিশ্বাস করবে না। তোমায় ডাকার হলে আমি নিজেই ডাকব। নিজেই আসব। যখন শত্রুরা তোমায় টার্গেট করেই নিয়েছে তখন আর তোমায় আমি ছাড়ছি না। আমি ছাড়ব না তোমায়। তোমার সাথে আছি। তোমার পাশে আছি।’

রুদ্রর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নৌকা দুলে ওঠে। ভয়ে রুদ্রর হাত খাঁমচে ধরি আমি। চোখমুখ বন্ধ করে বলি,’পড়ে যাব, পড়ে যাব!’
রুদ্র হেসে ফেলে। আমার দু’হাত ধরে বলে,’আমি আছি তো!’
‘ভয় করছে।’
‘লিমা বলেছে নৌকায় উঠলে নাকি পানিতে পা ভেজাও? পা নামাও।’
‘না, না। অসম্ভব।’
‘বললাম তো কিছু হবে না।’
রুদ্র নিজেই আমার পা পানির মধ্যে নামিয়ে দেয়। এবার আমি রুদ্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে বলি,’একবার পড়ে গেলে মরেই যাব আমি!’
রুদ্র মুগ্ধ করা হাসি হেসে বলে,
‘Seenein se tum mere aake lagg jaao na
Darte ho kyun zara paas toh aao na..
Dhun meri dhadkano ki suno
Chal wahan jaate hain
Chal wahan jaate hain
Pyaar karne chalo
Hum wahan jaate hain..
Chal jaate hai..
Koi subha wahan raat se na mile
Ud ke waha chalo aao tum hum chale..
Chal jaate hai।’

চলবে…

সে পর্ব-৪+৫

0

#সে
#পর্ব_৪_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
পাশে পড়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে না চমকে পারলাম না। এই হতচ্ছাড়াটা কে! আমি দ্রুত উঠে জামা,হাতের ময়লা ঝাড়তে লাগলাম। বেচারা এখনো ফ্লোরেই পড়ে রয়েছে। বেশ বুঝতে পারছি আমার চেয়েও অনেক গুণ বেশি ব্যথা এই লোক পেয়েছে।

‘আপা আপনি ব্যাথা পাইছেন?’ জিজ্ঞেস করল রাজ্জাক। এটা কোনো কথা হলো বলেন তো? পড়ে গেলে ব্যথা পাব না তো কী আরাম পাব? রাজ্জাকের ওপর মেজাজ চটে গেলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখলাম। হাত বাড়িয়ে দিলাম সেই ছেলেটির দিকে। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে ছেলেটি একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তাকে টেনে তুললাম। নিচে একটা চশমাও পড়ে থাকতে দেখলাম। সম্ভবত এই লোকেরই হবে। চশমাটি তুলে দিয়ে বললাম,’এটা কি আপনার?’
‘জি।’ মৃদু স্বরে বলল ছেলেটি।

চশমা পরার পর তাকে কেন জানি আমার কাছে খুব ইনোসেন্ট, ভদ্র আর সহজ-সরল মনে হলো। একটু বোকা বোকা’ও অবশ্য লাগছে। এই ছেলেকে দেখে মেয়েরা ক্রাশ খেতে পারে কিন্তু সবাই ভয় পাবে কেন? একে নিয়ে তো পারলে মেয়েরা আরও মজা লুটবে। রিশান যে আমায় ঢপ মেরেছে আমি নিশ্চিত। মনে সংশয় রাখতে চাইলাম না বিধায় রিশানকে প্রশ্ন করলাম,’এটাই তোমার ভাই?’
‘না। ভাইয়ার বন্ধু। অন্তু ভাইয়া।’

আমি অন্তুর দিকে তাকিয়ে বললাম,’আ’ম সরি। আসলে কীভাবে যেন পড়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। তার মধ্যে আবার আপনি এসে উদয় হয়েছিলেন।’
‘না, না সমস্যা নেই। ইট’স ওকে।’ চশমাটি ঠিক করে বলল অন্তু। আমি আর কথা না বাড়িয়ে রাজ্জাককে নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে আসি। কোমরে বেশ খানিকটা ব্যথা পেয়েছি। আসার পথে রাজ্জাককে ভালো করে বুঝিয়ে বলেছি এই কথা যেন ভুলেও মায়ের কানে না যায়। নিজের ঘরে ফিরে চট করে জামা-কাপড় পাল্টে নিলাম আগে। নয়তো মায়ের চোখে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল।

সন্ধ্যার দিক দিয়ে পরিবেশটা অনেকবেশি মোহনীয় লাগছিল। এই পরিবেশে হাঁটতে পারলে মন রিফ্রেশ হতে বাধ্য। রাজ্জাককে নিলাম না সাথে। একাই হাঁটতে বের হয়েছি। বেশিদূর যাব না। বাড়ির ভেতরেই ফাঁকা জায়গায় হাঁটব। গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে হাঁটছিলাম তখন সামনে একটি মেয়ে এসে দাঁড়ায়। তার মুখটা ভীষণ হাসি হাসি। মিষ্টি করে হেসে আমায় বলল,’তুমি এই অ্যাপার্টমেন্টেে নতুন এসেছ তাই না?’

প্রত্যুত্তরে আমিও হেসে বললাম,’হ্যাঁ।’
‘জানি। তোমরা যেদিন এসেছ সেদিন ব্যলকোনি থেকে তোমাদের দেখেছিলাম। তোমার সাথে কথা বলার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল আমার। কিন্তু তোমার দেখাই তো পাওয়া যায় না।’
‘আসলে ক্লাশ, প্রাইভেট, কোচিং করে সময় তেমন পাওয়া যায় না।’
‘ও। কীসে পড়ো?’
‘টেনে। আপনি?’
‘আমি ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ি। তোমার থেকে খুব একটা তো বড়ো নই। আমায় তুমি করে বলো।’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,’আচ্ছা।’

‘এই তোমার নামটাই তো জানা হলো না।’
‘নবনী। তোমার?’
‘রোজ।’
‘নামটা অনেক সুন্দর।’
‘তোমার নামও সুন্দর।’
দুজনে হেঁটে হেঁটে গল্প করছিলাম। মেয়েটা আমার চেয়েও বেশি মিশুক। কয়েক মিনিটের পরিচয়েই গড়গড় করে সব গল্প বলছে আমায়।
‘জানো আমার না তেমন কোনো ফ্রেন্ডও নেই। বেষ্টফ্রেন্ড আছে শুধু। কিন্তু ও সবসময় ব্যস্ত থাকে। সময় দেয় না একদম।’
‘বেষ্টফ্রেন্ড কেন সময় দেবে না?’
‘জানিনা গো।’
‘থাক মন খারাপ কোরো না আপু। এখন থেকে তোমার জন্য আমি আছি।’
‘সব ঠিক আছে। আপু বলে তো মাঝখানে একটা দেয়াল টেনে দিলে।’
‘তাহলে?’
‘আপু বলবে না।’
‘আচ্ছা বলব না।’

দুজনে খেলার মাঠের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর সামনে যেতে চাইল না রোজ। তাই জিজ্ঞেস করলাম,’ওদিকে যাবে না কেন?’
রোজ আমায় হাত দিয়ে একটা ছেলেকে দেখিয়ে বলল,’ঐযে সাদা শার্ট পরা একটা ছেলেকে দেখতে পাচ্ছ? ফুটবল খেলছে বাচ্চাদের সাথে। দেখেছ?’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলেটিকে দেখলাম। এটা সেই ছেলে যার সাথে আমি ধাক্কা খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। যদিও আমি তার নাম জানতাম। কিন্তু রোজ তার পরিচয় দিয়ে বলল,’ঐ ছেলেটা আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। আমার রুম থেকে সরাসরি তার রুমের জানালা দিয়ে দেখা যায়।’
‘তোমায় পছন্দ করে?’
‘হ্যাঁ। অনেক বেশি।’
‘তুমি করো না?’
‘না।’
‘কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি তাকে পছন্দ করো। এমনকি ভালোও বাসো।’
‘এমন মনে হলো কেন?’
‘জানিনা। কিন্তু সত্যিটাই বলেছি তাই না?’

রোজ কিছু বলল না। কিন্তু ওর মুখ দেখেই আমি যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। ওকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি মাঠে গিয়ে বললাম,’এই চাশমিস ভাইয়া আমায় খেলায় নিবেন?’
অন্তু দাঁড়িয়ে জোরে বলল,’আপনি পারবেন না।’
কত বড়ো সাহস! আমি নাকি পারব না। আমি জোর নিয়ে বললাম,’পারব আমি।’

এরপর পিচ্চিটার থেকে বল নিয়ে এমন জোরে কিক দিলাম যে উড়ে গিয়ে লাগল রুদ্রর গায়ে। কিন্তু আমি টার্গেট করে মেরেছিলাম অন্তুকে। কে জানত এই সময়ে সে এসে হাজির হবে! ভয়ে এদিকে আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। অন্তু দৌঁড়ে যায় রুদ্রর কাছে। মাথা ডলতে ডলতে রুদ্র এগিয়ে এসে বলে,’কে মারল বল?’

কেউ বলার আগেই আমি একটা গুলুমুলু মোটাসোটা বাচ্চা ছেলেকে দেখিয়ে বললাম,’এই পটলা মেরেছে।’
‘না, না রুদ্র দাদা। আমি মারিনি। মা কালীর দিব্যি করে বলছি।’ ভয়ে জড়সড় হয়ে রুদ্রকে কথাগুলি বলল বাচ্চাটি। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত-মুখ খিঁচে বলল,’এই দিদিভাই তুমি এত মিথ্যে বলো কেন? তুমি আমায় পটলাই বা বললে কেন? আমার নাম গণেশ।’
‘বাবা গণেশ! কে তোরে মুখ খুলতে বলেছে রে? দোষটা নিজের ঘাড়ে নিলে কী এমন ক্ষতি হতো? তুই ছোটো মানুষ। তোরে দুইটা থাপ্পড় দিলেও মানুষ কিছু বলবে না। কিন্তু আমি তো বড়ো। আমায় একটা থাপ্পড় দিলে মান-সম্মান কিছু থাকবে? কিচ্ছু থাকবে না। সব একদম ধুলোয় মিশে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।’ বিড়বিড় করে বললাম আমি।

রুদ্র এবার আমার কাছে এগিয়ে আসে। এখনই বোধ হয় দেবে গালে পাঁচ ইঞ্চির একটা থাপ্পড় বসিয়ে। কিন্তু সে আমায় এবং উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে বলল,’পিচ্চি হলে কী হবে; পায়ে তো বিশাল জোর! ফুটবল কি নিয়মিত খেলো? না খেললে এটাকে সিরিয়াসভাবে নেওয়া উচিৎ। তাহলে অনেকদূর আগাতে পারবে।’
রুদ্র চলে যাওয়ার পরেও আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় রয়েছে সকলের চোখেমুখে। কারণ ওর সম্পর্কে যা যা শুনেছি তার সারমর্ম হচ্ছে, সে খুব রাগী। বদমেজাজি স্বভাবের। অবশ্যই স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। ভুল পেলে কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। সে যেই হোক না কেন! মুরুব্বি হলেও নয়। এজন্য অনেকেই রুদ্রকে অপছন্দ করে, বেয়াদব বলে তাতেও রুদ্রর কিছু যায় আসে না। সে তার নিজের জায়গায় স্থির এবং অটল। কিন্তু আজকের ঘটনার পর সে আমায় না মারলে একটা ঝাড়ি যে অন্তত দেবে এটা সবারই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু না, সে তা করেনি। বরং কেয়ারিং দেখিয়েছে। আর এই সামান্য কথাটাই এবার ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। মনে মনে কিন্তু আমিও পুলকিত ছিলাম। আনন্দ লাগত আমার। অনেক মেয়েই আমায় হিংসা করা শুরু করে। যাদের প্রায় অধিকাংশকে আমি চিনিই না। যখনই রুদ্রর সাথে আমার দেখা হতো মিষ্টি করে হেসে বলত,’কী খবর পিচ্চি?’

আহা! তার ঠোঁটের হাসি আর মুখনিঃসৃত ডাক ‘পিচ্চি’ যতবারই শুনতাম আবেগে ভাসতাম। ভীষণ আপন আপন লাগত তাকে। একদিন তাকে আমি বললাম,’অ্যাপার্টমেন্টে যে একটা গুজব ছড়িয়েছে আপনি জানেন?’
তার হাতে কিছু বিয়ের কার্ড ছিল। বাইরে বসে বসে কার্ডে নাম লিখছিল। ওপর তলার এক আপুর বিয়ের কার্ড। তাদের সঙ্গে রুদ্র এবং ওর পরিবারের খুব ভাব। তাই বিয়ের অধিকাংশ কাজের দায়িত্বই রুদ্রর ওপর পড়েছে। কার্ড বিলি করতে যাওয়ার সময়েই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। কার্ডগুলোতে চোখ বুলিয়ে আমায় বলল,’কোন গুজব?’
‘আপনি কি সত্যিই জানেন না?’
‘শুনি তো কত কথাই। তুমি কোনটার কথা বলছ?’
‘কীভাবে বলব বুঝতেছি না।’
‘তবে থাক। আমি অনেক ব্যস্ত পিচ্চি। পরে কথা হবে।’

মন খারাপ হয়ে গেল আমার। তবুও তার ব্যস্ততাকে তো আর উপেক্ষা করার জো নেই। জোরপূর্বক হেসে বললাম,’আচ্ছা।’
সে দু’কদম এগিয়ে আবার ফিরে তাকিয়ে বলল,’প্রাইভেটে যাচ্ছ নাকি কোচিং-এ? তোমার স্কুলের সামনে দিয়েই যাব। গেলে সাথে আসতে পারো।’
আজ প্রাইভেট নেই আমার। কোচিং করে মাত্রই ফিরেছি। কাঁধে ব্যাগ দেখেই রুদ্র প্রশ্নটি করেছে। রুদ্রর সাথে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই বললাম,’হ্যাঁ চলুন।’

মেইন গেটের কাছে গিয়ে রুদ্র একটা রিকশা নেয়। আমায় আগে উঠতে বলে তারপর সে ওঠে। এই প্রথম আমরা একসাথে রিকশায় পাশাপাশি বসেছি। আমার যে কতটা খুশি লাগছে তা আমি আপনাদের বলে বুঝাতে পারব না। ওর পারফিউমের ঘ্রাণ আমায় মাতাল করে তুলছে। ওহ, আর একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। রুদ্র নীল কালারের একটা পাঞ্জাবি পরেছে। যেটা রুদ্রর গায়ে অনেকবেশি মানিয়েছে।
‘ওড়না সামলিয়ে নিও নবনী। রিকশার চাকায় যেন না লাগে!’

রুদ্রর কথায় আমার ঘোর কাটে। ওড়নাটা কোলের ওপর গুছিয়ে রেখে আড়চোখে আরেকবার তাকে দেখে নিলাম। ওর এই ছোট্ট কেয়ারিং’টাই ওর প্রতি ভালোবাসা, ভালোলাগার টান আমায় বাড়িয়ে দিয়েছে। রুদ্র তখন বলল,’হ্যাঁ তখন যেন কোন গুজবের কথা বলছিলে?’
‘ঐতো অ্যাপার্টমেন্টের সবাই ভাবছে আপনার সাথে আমার সম্পর্ক আছে। এজন্য অনেক মেয়ে আমায় হিংসা’ও করে।’

রুদ্র শব্দ করে হেসে বলে,’পাগলের সুখ মনে মনে।’
‘একথা বললেন কেন?’
‘ওদের কথা বললাম। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, সত্যটা তো আমরা জানি? আমরা তো জানি যে আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘হুম।’
‘তুমি ওদের কথায় মন খারাপ কোরো না। ওদের কথা গায়েও মাখবে না। মানুষের কথায় তো আর সত্যিটা বদলে যাবে না।’

এই ছেলেকে আমি কী করে বোঝাই; ওদের কথায় আমার মন খারাপ হয় না। বরং আমি খুশি হই। আর সম্পর্ক নেই তো কী হয়েছে? হতে কতক্ষণ? স্কুলের সামনের প্রায় এসে পড়েছি। সত্যিটা না বললে এখন রিকশা থেকে নামিয়ে দেবে বিধায় ভয় নিয়ে বললাম,’একটা সত্যি কথা বলি?’
‘বলো।’
‘আমার না মন ভীষণ খারাপ! তাই মিথ্যে বলে আপনার সাথে এসেছি। আপনার সঙ্গে কথা বললে আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমার প্রাইভেট, কোচিং কোনোটাই এখন নেই।’

রুদ্র কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে কী যেন ভাবল। তারপর বলল,’আচ্ছা সমস্যা নেই।’
রুদ্রর সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তার সবকিছুই এখন আমার মিথ্যে মনে হচ্ছে এই মানুষটা তো কখনো আমার সাথে রুড বিহেভ করে না। বাকিদের সাথেও করতে দেখিনি। তবে সেদিন ডেয়ার পূরণ করতে গিয়ে ঐ ছেলেটাকে মারতে দেখে বুঝেছি যে সে ভীষণ রাগী। এছাড়া আর কিছু নয়। আমি তার সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ইনভাইটেশন কার্ড বিলি করলাম। একবিন্দু পরিমাণ বিরক্তও আমার লাগেনি। তার সাথে সময় কাটাতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছিল। বাড়িতে মায়ের ফোনে ম্যাসেজ করে জানিয়ে দিয়েছি আসতে একটু লেট হবে। তিথিকেও ম্যাসেজ করে বলে দিয়েছি মা ফোন করলে যেন সেভাবেই কথা বলে। কার্ড বিলি করা শেষ হলে রুদ্র জিজ্ঞেস করে,’চা খাবে নাকি আইসক্রিম?’
‘গরমের মধ্যে চা খাব না এখন। আইসক্রিম খাওয়া যেতে পারে।’

রুদ্র দোকান থেকে একটা আইসক্রিম আর পানির বোতল নিয়ে আসে। আইসক্রিমটা আমার হাতে দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে একটা রিকশা ডাকে। আমরা দুজন রিকশায় উঠে বসি। রিকশা চলছে মন্থর গতিতে। বিন্দু বিন্দু বাতাসে রুদ্রর ঘামে লেপ্টে থাকা চুল কপালে এসে পড়ছে। সেই মুহূর্তে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে। পানির বোতলটা আমার হাতে দিয়ে সিগারেট ধরাল। আশ্চর্য! সে যে সিগারেট এনেছে আমি দেখিইনি। আমি নাকমুখ কুঁচকে ফেললাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। কারণ সিগারেটের গন্ধ আমি একদম সহ্য করতে পারি না। বিরক্ত লাগে। বাবা’ও খায়। কত চেষ্টা করেছি সিগারেট ছাড়ানোর জন্য! কিন্তু পারিনি। আর এখন কী-না রুদ্রও!

রুদ্র সিগারেটে টান দিয়ে অন্যপাশে রাখল। ধোঁয়াও উড়াল অন্যপাশে। যথাসম্ভব চেষ্টা করছে যেন আমার দিকে সিগারেটের ধোঁয়া না আসে। আমি আইসক্রিম হাতে বসে রয়েছি। গলে গলে জামার ওপর পড়ছে। তখন রুদ্র বলে,’খাচ্ছ না কেন? গলে যাচ্ছে তো।’
‘আপনি সিগারেট ফেলেন। আমার বমি পাচ্ছে।’
সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট ফেলে দিল রুদ্র। পানি দিয়ে কুলকুচি করে বলল,’এখন ঠিক আছো?’
‘হুম।’ ছোটো করেই বললাম আমি।

এরপর নিরবতা কাটিয়ে বললাম,’সিগারেট কেন খান?’
‘সবসময় খাই না। মাঝে মাঝে খাই। এখন একটু খেতে ইচ্ছে হলো।’
‘আমার সামনেই ইচ্ছে হলো?’
‘তুমি কি আমার ওপর রেগে গেছ? রাগ করলে বলতে পারো। সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া ভালো।’
‘এমন কিছু না। সিগারেট আমার পছন্দ না।’
‘স্বাভাবিক। অধিকাংশ মেয়েই সিগারেট পছন্দ করে না।’
‘তাহলে আপনি আমার সামনে কেন খেলেন?’
‘আমার সম্পর্কে তো প্রায় অনেক কিছুই শুনেছ। স্বচক্ষেও দেখা উচিৎ আমি কেমন!’

একথার পিঠে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে রইলাম। সূর্যে ডুবে গিয়ে অন্ধকার এখন রাজত্ব করছে। মাঝে মাঝে চাঁদটাও বড়াই করে চলেছে দখল নেওয়ার জন্য। কিন্তু দুষ্টু মেঘের জন্য পেরে উঠছে না। মেঘ চাঁদকে আড়াল করে রেখেছে। আমি সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে রুদ্র বিষণ্ণ গলায় বলল,’জানো নবনী কেন জানি আমি কখনোই কারো প্রিয় হয়ে উঠতে পারিনি। একান্ত প্রিয় মানুষ হতে পারিনি কারো। সবাই আমায় অপশন হিসেবেই ব্যবহার করে এসেছে। কেন জানি সবার জীবনে আমি অপশোনাল হিসেবেই থেকে যাই!’

রুদ্রর কথাগুলো আকাশে থাকা মেঘের আড়ালে চাঁদটির বিষণ্ণের চেয়েও আরও বেশি বিষণ্ণ শোনাল। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না কথাগুলো যে রুদ্রই বলেছে। এই মানুষটারও কি কোনো দুঃখ থাকতে পারে?

চলবে….
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। কিছু সমস্যাজনিত কারণে কয়েকদিন গল্প দিতে পারিনি এজন্য দুঃখিত।]

#সে
#পর্ব_৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
রুদ্র নিরব এবং নির্জীব হয়ে রয়েছে। কথা নেই আমার মুখেও। চারপাশ থেকে বারবার রিকশার টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। কতক কতক জায়গায়, চায়ের দোকানের সামনে লোকজনের কোলাহল এবং সমাগম। ফিরতি কোনো প্রশ্ন করব সেই সাহসও কেন জানি পাচ্ছি না। আচমকা পুরো প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে রুদ্র বলল,’এখান থেকে বাড়ি খুব কাছেই এখন। হেঁটে যাবে? হাঁটতে খুব ইচ্ছে করছে।’

তার এই প্রস্তাবে আমি খুশিই হলাম। কারণ রাতেরবেলায় রাস্তায় হাঁটার অন্যরকম আনন্দ রয়েছে। সাথে পাশে যদি থাকে প্রিয় মানুষ, তাহলে সেই সময়ের বর্ণনা করা কষ্টসাধ্য বটে। তাই বারণ করার প্রশ্নই আসলো না। আমি বিনাবাক্যেই রাজি হয়ে যাই। রিকশা থেকে নেমে দুজনে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা প্রশ্নটিও করে ফেললাম।

‘কেন সবাই আপনাকে অপশোনাল হিসেবে ব্যবহার করে?’
‘অপশোনালের চেয়েও সেকেন্ড চয়েজ বেশি হয়েছি। কেন হয়েছি সেসব না হয় আরেকদিন বলব। একদিনে সব জেনে ফেললে পরে আর কোনো আগ্রহ থাকবে না।’
আমি হেসে ফেললাম। সে তো আর এটা জানে না যে, তার প্রতি আমার আগ্রহ কোনোদিনই কমবে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে।

বাড়ির গেইটের কাছে আসার পর রুদ্রর কিছু মেয়ে কাজিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এদেরকে আমি ফেসবুকে দেখেছি রুদ্রর আইডিতে। যদিও তারা কাজিন কিন্তু আমার ভীষণ হিংসা হয়। কাঁধে হাত রেখে, হাসি হাসি মুখ করে তোলা যতগুলো ছবি আছে সবকয়টা আমার পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। আমি সহ্য করতে পারি না একদম। রুদ্রকে পেয়ে ওরা একদম জেঁকে ধরেছে। একজন বলছে,’তোর কাছেই যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো দেখা হয়ে গেছে। চল আড্ডা দেবো।’
‘আজ থাক। রিমির বিয়ের অনেক কাজের দায়িত্ব আমার ওপর।’ বলল রুদ্র।

আরেকটা মেয়ে তখন রুদ্রর গাল চেপে ধরে বলল,’তোর নাটক বন্ধ কর। বিয়ে তো আর আজই হচ্ছে না। কয়েক ঘণ্টা আমাদের সাথে আড্ডা দিলে কিচ্ছু হবে না। প্রয়োজনে পরে এসে আমরা সবাই তোকে কাজে হেল্প করব।’
রুদ্র তখন হেসে বলল,’তাহলে ঠিকাছে। চল।’

ওরা একদিকে খুনশুটিময় ঝগড়া করছে। আর আমি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ওদের কাণ্ড দেখছি। আপনাদের হয়তো আমার এমন কথা শুনে হাসি পাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। খারাপ লাগছে। আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি সুখ ও দুঃখ একে অপরের পরিপূরক। একটু আগেও যেই আমি সুখের সাগরে ভাসছিলাম সেই আমিই এখন তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছি। আমি বুঝতে পারি না কিছুতেই মেয়েগুলো এমন ছেচ্রা হয় কী করে? ছেচ্রা হবে ছেলেরা। মেয়েদের পেছনে ঘুরে ঘুরে ছেচ্রামি করবে। মানায় ওদের। কিন্তু মেয়েরা কেন এমন করে? আমি কিন্তু সব মেয়ের কথা বলছি না। এই টাইপ কিছু মেয়ের কথাই বলছি। ছেলে কাজিন আমারও আছে। কিন্তু আমরা ঘন ঘন আড্ডা দিই না। কোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গে হলেও সবাই মিলে গল্পগুজব করি না। এভাবে কেউ মিশতে পারি না। ছেলেরা ছেলেরা একসাথে এবং মেয়েরা মেয়েরা একসাথে আড্ডা দিই। তাহলে কি আমরাই ইমম্যাচিউর?

ওদের গল্পগুজব এবং কোথায় আড্ডা দেবে সব প্ল্যান শেষ হলে রুদ্রর নজর আমার দিকে পড়ে। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। উচিৎ ছিল অনেক আগেই বাড়িতে ফিরে আসা। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আমার পা সেখানেই স্থির ছিল। রুদ্র আমার কাছে এসে বলল,’নবনী তুমি বাসায় যাও। রাত না হলে তোমায়ও সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম।’
‘সমস্যা নেই। আপনি ওদের সঙ্গে যান। ইনজয় করুন।’
এইটুকু বলেই আমি ভেতরে চলে আসি। একবারও পেছনে তাকাইনি। ভেতর থেকে আসা দীর্ঘশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে চোখের কোণে পানিও নিয়ে এসেছে। বড্ড জেলাসি তো আমি!
.
.
বাড়িতে এসে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার সময় কাটছে না কিছুতেই। আমায় গম্ভীর থাকতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,’কী হয়েছে তোর?’
‘কই? কিছু না তো!’ আনমনেই বললাম আমি।
‘বললেই হলো? কিছু না হলে তুই তো এত চুপচাপ থাকার মেয়ে না।’
‘এগুলো কোনো কথা হলো মা? চুপচাপ আছি এমনিই। কোনো স্পেসিফিক রিজন নেই।’
‘তুই চুপ কর। মিথ্যা কার সঙ্গে বলিস তুই? তুই আমার পেটে হইছিস নাকি আমি তোর পেটে হইছি?’
‘তোমরা মায়েরা কি কমন ডায়লগগুলা দেওয়া এবার অফ করতে পারো না? ছোটোবেলা থেকে শুনে আসা সব ডায়লগই এখন আমার মুখস্থ।’
‘তুই অনেক বেয়াদব হয়ে গেছিস নবনী।’
‘সরি মা। তুমি এখন যাও। আমি একটু একা থাকব।’
‘আমার পেটের মেয়ে হয়েও তুই এমন করিস। তোর থেকে তো রাজ্জাকই ভালো।’
‘বেশ তো! ওর কাছেই যাও।’

মা কিছুক্ষণ আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রুম থেকে চলে গেলেন। আমি ঠায়ভাবে সেখানেই কিছু্ক্ষণ বসে থেকে বারান্দায় চলে আসি। মেইন গেটের দিকে তাকিয়ে দেখি রুদ্র আসছে কী-না! নাহ্। অনেকেই আসে। কিন্তু রুদ্র আসে না। ফেসবুকে লগিন দিয়ে রুদ্রর আইডিতে গেলাম। তাকে একটিভ দেখাচ্ছে। ডে’ও দিয়েছে দেখলাম। একঘণ্টা আগে দেওয়া। ছবিটা ওর মেয়ে কাজিনের সাথে। তার মানে যাওয়ার পর ছবি তুলে সাথে সাথেই ডে তে দিয়েছে। কী যে অসহ্য রকমেই পেইন হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারব না। বড়ো বড়ো শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে ওর পুরনো পোষ্ট, ছবিগুলো দেখছিলাম। হাত শুধু নিশপিশ করছিল নক দেওয়ার জন্য। মনের কথায় সায় দিলাম। নক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’বাড়ি ফিরেছেন?’

রিপ্লাই এলো ঠিক দু’মিনিট পর। লিখেছে,’না। আজ বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।’
‘ওহ। আড্ডা দিন। ভালো লাগবে।’
এই ম্যাসেজটা আর সীন হলো না। অনেকক্ষণ যাবৎ ফোনের স্ক্রিনে চাতকপাখির মতো তাকিয়েই রইলাম। ডাটা অফ করতে যাব তখন টুং করে ম্যাসেঞ্জারে একটা শব্দ হয়। রুদ্রর ম্যাসেজ। দ্রুত আমি ওর ইনবক্সে গেলাম। আসলে ম্যাসেজ নয় ছবি পাঠিয়েছে আর একটা ভিডিও। সবগুলো ছবি ওর ঐ কাজিনগুলোর সাথে। ভিডিওটা মনে হচ্ছে ছবি তুলতে গিয়ে ভুল করে করে ফেলছে। বুঝতে পারার পর রুদ্র হেসে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। ইশ! হাসিটা যেন সোজা বুকে এসে বিঁধেছে। শুধু চোখের কাঁটা লাগছিল ঐ আপুগুলোকেই। আমি ম্যাসেজ লিখলাম,’শুধু মেয়ে কাজিনরাই এসেছে? ছেলেরা আসেনি?’
রুদ্র যদিও লেট করে উত্তর দিচ্ছিল তবুও যে রিপ্লাই করছিল আমি এতেই খুশি ছিলাম। রুদ্র লিখল,’হ্যাঁ, ছেলেও আছে চারজন।’
‘তাহলে ওদের ছবি দেন।’
‘ওদের ছবি ওদের ফোনে।’
‘আশ্চর্য! একটা ছবিও আপনি ছেলেদের সাথে তোলেননি? একটা হলেও নিশ্চয়ই তুলেছেন। দিন দেখি।’

রুদ্র চোখ উল্টানো ইমুজি দিয়ে বলে,’ওদের ছবি দিয়ে কী করবে?’
‘কী আজব! আমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের ছবি দেখে কী করব? ছেলেদের ছবি দিন। চয়েজ করি। দেখি কাকে ভালো লাগে।’
মূলত রুদ্রকে একটু খোঁচা মারতেই আমি এই ম্যাসেজ লিখেছি। রুদ্র এবার সেন্টি ইমুজি পাঠালো। আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছিল। আমিও তো নাছোড়বান্দা। তাই আবার বললাম,’কী হলো? দিন?’

রুদ্র বলল,’পরে ওদের থেকে নিয়ে দিবনি।’
‘শিওর?’
‘হুম।’
ব্যস কনভারসেশনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ‘হুম’ বলে। এরপর তো আর নতুন করে কিছু বলা যায় না। আমি আর কিছু বললামও না। রাতে ডিনার করে আবার গেলাম ফেসবুকে। ওর আইডি ঘেটে দেখলাম মেয়ে কাজিনদের সাথে ছবি পোষ্ট করেছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এখানেও রুদ্র বাদে কোনো ছেলের ছবি নেই। একটা কথা আপনারাই বলুন তো, সবাই একসাথে আড্ডা দিতে গিয়েছে সেখানে সব মেয়েদের ছবি আছে অথচ ছেলেদের কারো ছবি নেই! এটা হতে পারে? আমার কেন জানি এবার মনে হচ্ছে রুদ্র আমায় মিথ্যে বলেছে।

এর পরের কয়েকদিন রুদ্রর বেশ ব্যস্ত সময় কাটল। মোটামুটিভাবে পড়াশোনা নিয়ে আমি নিজেও ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু এতটা ব্যস্তও থাকতে পারিনি যে রুদ্রর কথা মনে পড়বে না। সেদিনের পর থেকে আমি আবারও রুদ্রর সামনে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু দূর থেকেই দেখি। কারণ আমি ৯৯% শিওর রুদ্র আমায় মিথ্যে বলেছিল। তার ছেলে কাজিনরা কেউ ছিল না। ছবিও দেয়নি আমায়। আমার কথা হচ্ছে, মিথ্যে বলার কী দরকার? কোনো ফায়দা তো নেই। এই মিথ্যেটাই মূলত রুদ্রর প্রতি চাপা অভিমান তৈরি করেছে।

রিমি আপুর বিয়ে আজ। গতকাল গায়ে হলুদ গিয়েছে। হলুদে আমি যাইনি। রোজ অনেকবার জোর করেছিল আসার জন্য। কিন্তু মিথ্যে বাহানা দিয়ে যাইনি। সত্যি বলতে রুদ্রর মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। মায়ার টান আমি বাড়াতে চাচ্ছিলাম না কাছ থেকে। সে আমায় দেখে কিছু আন্দাজ করুক এটাও আমি চাইনি। হলুদে না গেলেও বিয়েতে না এসে পারলাম না। রিমি আপু সকালে ফোন করে বলেছে বিয়েতে না গেলে কান ধরে নিয়ে যাবে। বিয়ের কিছুদিন আগে থেকেই আমি রিমি আপুর সাথে পরিচিত হই। রোজ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আপু ভীষণ মিশুক। অল্প দিনের ব্যবধানেই আমায় একদম নিজের বোন বানিয়ে ফেলেছে। যে কারণে এত অধিকারবোধ তার কথায়। আমিও ভাবলাম, একটা মানুষের জন্য শুধু শুধু আরেকটা মানুষকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো মানে হয় না। রুদ্রর সামনে না গেলেই তো হয়। তাই রেডি হয়ে রোজের সঙ্গে আগে চলে আসলাম। আব্বু,আম্মু পরে আসবে। ওহ আপনাদের তো এতদিন একটা কথা বলাই হয়নি। রিশানের আপন ভাই হচ্ছে রুদ্র। রিশান সেদিন রুদ্রর কথাই বলেছিল। রাজ্জাকের সাথে রিশানের ভাব জমে গেছে বহু আগেই। ওরা ওদের বন্ধুত্বের নাম দিয়েছে আর টু(R2). এদিকে আমি তো আমার চারপাশে সবই আর(R) দেখি। এই যেমন, রুদ্র, রিশান, রাজ্জাক, রোজ, রিমি। শুধু আমার নামটাই বোধ হয় এন(N) দিয়ে হয়ে গেল। যাক সেসব। আমি ভাবছি এখন যদি রুদ্র সামনে পড়ে যায় তাহলে কী করব?

আমার ভাবনা তার জায়গামতো সীমাবদ্ধ থাকতে পারল না। রুদ্রর সাথে দেখা হয়ে গেল। রুদ্র এক গাল হেসে বলল,’কেমন আছো পিচ্চি?’
আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌। কালকে নাকি তুমি হলুদে আসোনি?’

আমি এবার অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে। সে আমায় জিজ্ঞেস করছে শিওর হওয়ার জন্য আমি এসেছিলাম নাকি! তার মানে সে জানেই না। খেয়ালও করেনি। এমনকি একবার আমার কথা মনেও হয়নি। অবশ্য আগ বাড়িয়ে এতকিছু ভাবা, এত এক্সপেকটেশন রাখা আমার উচিৎ হয়নি। তার সাথে আমার পরিচয়ই বা কয়দিনের? সে কেন আমায় নিয়ে এত মাথা ঘামাবে? শুধু শুধু আমি নিজেই এতসব ভেবে চলেছি। আমায় চুপ থাকতে দেখে রুদ্র বলল,’চুপ হয়ে গেলে যে?’
আমি মৃদু মেকি হেসে বললাম,’হুম আসিনি। আজ সকালে একটা পরীক্ষা ছিল তাই।’
‘এখন আবার কীসের পরীক্ষা? যাই হোক, আজকে কিন্তু তোমায় অনেক সুন্দর লাগছে। মাশ আল্লাহ্! মনে হচ্ছে আজ রাতের বুকে সুন্দর একটা চাঁদ জ্যোৎস্না ছড়াচ্ছে।’
‘আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারেন।’

রুদ্র হাসলো। তারপর চলে গেল অন্যদিকে। আমি রিমি আপুর কাছে গিয়ে কয়েকটা ছবি তুললাম। আমার ভীষণ অস্থির অস্থির লাগছিল। অস্থিরতা আরও বেশি বেড়ে যায় যখন দেখলাম রুদ্রর সেই মেয়ে কাজিনগুলা এসেছে। ওর বন্ধু-বান্ধবরাও এসেছে। একটা জিনিস আমায় খুব ভাবায়। মেয়ে বান্ধবীদের গায়ে পড়া স্বভাব রুদ্র পছন্দ করে না অথচ মেয়ে কাজিনগুলোকে কিছু বলে না। যদিও রুদ্র বলেছিল কাজিনগুলো ম্যারিড। কিন্তু আমি ওদের আইডি ঘেঁটে দেখেছি রিলেশনশিপ সিঙ্গেল দেওয়া। একের পর এক রুদ্রর এসব মিথ্যা আমার মাথায় চাড়া দিয়ে ওঠে। আমার মনে হচ্ছে আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে পারব না। তাই রোজকে বললাম,’আমার ক্ষুধা লেগেছে। চলো খেয়ে আসি।’

রোজ রাজি হলো। খাওয়ার সময় তখন হাজির হলো অন্তু। এমনিতেই খাবার গলা দিয়ে নামছিল না। ভেবেছিলাম রোজের সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে পারব। প্রয়োজনে রুদ্রর বিষয়টাও ওকে শেয়ার করব। এতে লাভ কী হবে জানিনা তবে মন হালকা হবে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। অন্তু খেজুরে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। রোজ-ও লজ্জায় লাল, নীল বর্ণ ধারণ করছে। এই মু্হূর্তে আমার গ্যাং-টাকে খুব মিস করছি। ওরা থাকলে কখনোই আমার এমন একা একা ফিলিংস হতো না। যতই জ্বালাক না কেন, দিনশেষে বিপদে-আপদে খারাপ সময়ে ওরা পাশে থাকলে তখন আর কিছু লাগে না। ভেতর থেকে আমার তখন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। এই খাবার আর আমার গলা দিয়ে নামবে না। আপনারা বিশ্বাস করবেন কীনা আমি জানিনা, তবে আমার খুব খুব একাবোধ হচ্ছে। আমি টেবিল ছেড়ে উঠে বললাম,’আমার খাওয়া শেষ। আপনারা খান।’
রোজ বলল,’বসো। আমারও প্রায় শেষ।’
‘আমি রিমি আপুর কাছে যাই। অন্তু ভাইয়া তো এখানে আছেই। খাওয়া শেষ করে চলে এসো।’

মিথ্যে বলেই আসলাম। রিমি আপুর কাছেও যাব না। কারণ সেখানে রুদ্র ও তার গ্যাং রয়েছে। ওদেরকে আমার সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে সবার মাঝখান থেকে রুদ্রর পাঞ্জাবির কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসি। এরপর সামনে বসিয়ে গান শুনি। রুদ্রর গানের গলা অসম্ভব রকমের সুন্দর! না, সে আমায় গান শোনায়নি। তার নিজের ডে ও টাইমলাইনে পোষ্ট করা গানগুলো শুনেই বলছি। কমিউনিটি সেন্টার থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালাম। এখান থেকে গান-বাজনার আওয়াজ তেমন তীব্রভাবে শোনা যাচ্ছে না। ফোনে কথা বলার জন্য খুব একটা ডিস্টার্ব করবে না এই সাউন্ড। তিথিকে কল লাগালাম। রিং হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তিথি কল রিসিভ করে বলল,’কীরে বিয়ে বাড়িতে কেমন ইনজয় করতেছিস? আমি তো ভাবছি দুই দিন তোর খোঁজই পাব না।’

‘ধুর! ফাউল কথা বলিস না তো। ভালো লাগছে না।’
‘কী হয়েছে? মুড অফ নাকি তোর?’
‘লাইনে থাক। বাকিদের কলে আনি।’
‘শোন তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে সমস্যা বিশাল। সবাই একসঙ্গে লাইনে আসলে টাকা শেষ হয়ে যাবে কিন্তু কথা শেষ হবে না। তার চেয়ে ভালো আমাদের ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আয়। সবাই একসঙ্গে কলে আসি। একটিভই আছে সবাই।’
‘আচ্ছা। আমি তাহলে এম্বি কিনে আসতেছি।’
‘আয়।’

কল কেটে দিয়ে ফোনে এম্বির অফার দেখছিলাম। বাড়িতে ওয়াইফাই থাকায় এম্বি নেওয়ার তেমন প্রয়োজন হয় না বলে নিইও না। কিন্তু এখন আমার মন সাংঘাতিক লেভেলের খারাপ। ওদের সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন। এম্বি কিনে ডাটা অন করব তখন মনে হলো পেছনে কেউ আছে। আমি সাথে সাথে পেছনে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি একটা ছেলে। ছেলেটি ভয় পেয়ে দু’হাত ওপরে তুলে বলে,’রিল্যাক্স! রিল্যাক্স ভয় পাবেন না।’

ভয় পাবেন না বললেই কি আর হয়? ভয় তো অলরেডি পেয়ে বসে আছি আমি। বুকে থুথু দিয়ে তার দিকে তাকালাম। সাদা শার্টের ওপর কালো স্যুট পরা ছেলেটি।
‘কে আপনি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমি রুদ্রর বন্ধু। আমি যদি ভুল না হই তাহলে আপনি নবনী।’
‘জি আপনি সঠিক।’
‘যাক! যেটা বলতে এসেছিলাম। রুদ্র আপনাকে ডাকছে। পেছনের গেইটের দিকে আছে।’
আমি সেদিকে তাকিয়ে বললাম,’আমি তো চিনি না। তাকে আসতে বলুন।’
‘ও আপনাকেই যেতে বলল।’

বললাম,’ঠিকাছে।’
যাওয়ার পথে সে বলল,’সরি। আমি কিন্তু আপনাকে ভয় দেখাতে চাইনি।’
‘ইট’স ওকে। সমস্যা নেই।’
এখান থেকে গান-বাজনার শব্দ অনেক জোড়ে জোড়ে আসছে। রুদ্র যে কেন আমায় ঐদিকে ডাকল আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। ক্রমে ক্রমে পথ নির্জনতার দিকে যাচ্ছিল। এবার আমার ভয় হতে লাগল। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি তাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছি। এখান থেকে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ আমার গলার আওয়াজ শুনতে পাবে না। ভয়ে হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ছেলেটির সরলভাবে বলে যাওয়া কথাগুলো শুনে সন্দেহ করাও কষ্টকর। কিন্তু এবার আমি সন্দেহ নয় বরং শিওর হয়ে গেলাম যে রুদ্র আমায় ডাকেনি বরং এটা এই ছেলের একটা ফাঁদ। আর আমিও বিশ্বাস করে সেই ফাঁদেই পা দিয়ে ফেলেছি। কারণ বক্স থেকে রুদ্রর গান শুনতে পাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, এটা রুদ্ররই গলা। রুদ্র যদি ভেতরে গান গেয়ে থাকে তাহলে একই সময়ে সে অন্য জায়গায় আমায় ডাকবে এটা অসম্ভব। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার সঙ্গে এবার ছেলেটিও দাঁড়িয়ে পড়ে। মাটির সাথে আমার পা আঁকড়ে আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমায় পালাতে হবে। আমি যদি নিজে নিজেকে না বাঁচাতে পারি তাহলে অন্য কেউ পারবে না। অন্য কেউ তো জানতেই পারবে না! আমি দৌঁড় দেওয়ার আগেই ছেলেটি আমার হাত চেপে ধরে বলে,’কী হলো? চলেন।’

আমরা দুজন দুজনের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম,’আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? হাত ছাড়েন।আপনি আমায় মিথ্যেও বলেছেন। রুদ্র আমায় ডাকেনি।’
ভয়ে আমার কণ্ঠস্বর থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। এই কথাগুলো বলতেই আমার নিজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এবার ছেলেটির চোখে-মুখে লোভ-লালসার কুৎসিত হাসি দেখতে পাই আমি। মনের সাহস আমি হারিয়ে ফেলছিলাম। আমার বোধ হয় আর কিছু করার নেই। ছেলেটি আমার হাত ছাড়ল না বরং আরও শক্ত করে ধরল। ছেলেটির হাতে সাহস করে কামড় বসিয়ে দেওয়ার পর তার হাত আলগা হয়। সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড় দেই আমি। কিন্তু হায়! দৌঁড়ানোর মতো শক্তি আমার একেবারেই ক্ষীণ। ছেলেটি ধরে ফেলে আমায়। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আমায় টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে নির্জনতা থেকে আরও নির্জনতার দিকে। দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল আমার। বারবার বাবা-মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আমার পরিণতির সমাপ্তি আজ এখানেই। এরপর আর এই সুন্দর ধরণী হয়তো দেখার সৌভাগ্য আমার হবে না। আমার আর্তচিৎকার রুদ্রর গাওয়া গানের আড়ালে তলিয়ে যাচ্ছে। কারো কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। পৌঁছাবে না!

চলবে…

সে পর্ব-২+৩

0

#সে
#পর্ব_২_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
বন-জঙ্গলের বিটপীর ন্যায় আমিও সেই জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। মাঝে মাঝে ঝড়ো হাওয়া-বাতাসে কিংবা মৃদু বাতাসে পাতাগুলো যেমন নড়েচড়ে তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় আমার অবস্থাও এখন তেমনই। শুধু পার্থক্য এইটুকুই যে পাতারা মনের আনন্দে নড়ে আর আমি নড়ছি ভয়ে। নড়ছি না বলে কাঁপছি বলাটাই মানানসই। হ্যাঁ, রুদ্রের ভয়েই আমি কাঁপছি। কিন্তু তার দিকে ঘুরে দাঁড়ানোর মতো সাহস কিছুতেই সঞ্চয় করতে পারছি না। আমি জানি, আপনারা এখন আমায় ভীতু ভাবছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি মোটেও ভীতু নই; উপরন্তু বড্ড সাহসী। সেটা অবশ্য আস্তে আস্তে আপনারাও জেনে যাবেন। কিন্তু কথা হচ্ছে এখন যে আমার কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতেই পারছি না। তবে এতটুকু শিওর যে, আমায় দেখতে এখন চুপসে যাওয়া বেলুনের মতোই দেখাচ্ছে।

আমি তো আমার জায়গা থেকে নড়লাম না ঠিক আছে; কিন্তু রুদ্র নিজেই এসে আমার সামনে দাঁড়াল। এবার আমার হাত-পায়ের সাথে সাথে দাঁত, ঠোঁটও কাঁপতে শুরু করেছে। যে কেউ দেখলেই ভাববে গরমের মধ্যে মাঘ মাসের শীত বোধ হয় আমার উপরেই হামলে পড়েছে।

‘ডাকলাম যে শুনতে পাওনি?’ রুদ্রের গলায় বিরক্তের আভাস। আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না। তবে এটাই বুঝতে পারছি না উনি আজ আমায় তুমি করে বলছে কেন? সেদিন তো আপনি করে বলেছিল! মাস্ক পরার কারণে উনি আমার পুরো মুখ দেখতে না পারলেও চোখ দেখে নার্ভাসনেস ঠিক বুঝে ফেলল। এবার তার কুঁচকে যাওয়া কপালখানা আগের ন্যায় বিস্তৃত হলো। আমায় অবাক করে দিয়েই সে আমার কপালে হাত রাখল। এবার আর আমায় কেউ আটকাতে পারবে না। আমি শেষ! আপনারা কি ভাবছেন আমি মরে যাওয়ার কথা বলছি? একদম নয়। আমি বরফ হওয়ার কথা বলছি।’

‘শরীরের তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।’ কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল সে।

আমায় চুপ থাকতে দেখে আবার বলল,’কথা বলছ না কেন? তুমি কি বোবা?’
এই লোকটার সমস্যা কী আমি বুঝি না। প্রথমদিন আমায় কাজের বুয়া বানিয়ে দিল আর আজ বোবা! আমি বড়ো করে শ্বাস নিতে গিয়েও ব্যর্থ হলাম। তবুও মাস্ক খুললাম না। আমায় কথা বলতেই হবে এখন।

‘না, আমি বোবা নই। অসুস্থও নই।’ বললাম আমি।
‘তাহলে এতক্ষণ চুপ করে ছিলে কেন? যাই হোক, তোমার হাতের পানির বোতলটা দাও। পানি ভালো তো?’

নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। স্কুল থেকে ফেরার পথে পানির বোতল বের করে যে পানি খেয়েছিলাম এখনও হাতেই রয়েছে। তার মানে উনি তখন পানির জন্যই আমায় ডেকেছিল? হায়রে নবনী! আর কত কী-ই না তুই ভেবে নিলি।
সব ভয় কাটিয়ে আমি পানির বোতলটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। সে ঢকঢক করে এক চুমুকে পুরো বোতল ফাঁকা করে ফেলল। আমি পলকহীনভাবে শুধু চেয়েই রইলাম। বোতলটা আমার দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল,’থ্যাঙ্কিউ পিচ্চি।’
এরপর সে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করল। আমি আহাম্মক সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কী বলে গেল আমায়? পিচ্চি!

রুদ্র চলে যাওয়ার পর তিথিরা আমার কাছে আসে।
‘কাহিনী কী হলো বল তো?’ জিজ্ঞেস করল তিথী। এখন আমি কী করে বলি আমি যে ভয়ে কাবু হয়ে গেছি? পুরো ঘটনা না শুনে আমায় ছাড়বে বলেও মনে হচ্ছে না। সংক্ষেপেই আমি বিবৃতি দিলাম। সব শুনে ওরা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আগেই বলেছিলাম একেকটা কী পরিমাণ বজ্জাতের হাড্ডি! আমায় মনমরা থাকতে দেখে তিথি বলল,’আহারে! থাক মন খারাপ করিস না। ডেয়ারে যখন জিততে পারিসনি তখন কালকের ট্রিট যেন মিস না যায়। আর হ্যাঁ, পিচ্চি বলেছে বলে এত ভাউ খাইস না। স্কুল ড্রেস পরা থাকলে বাচ্চাই তো মনে হবে। তোর ভাগ্য ভালো যে আপু না ডেকে পিচ্চি ডেকেছে।’

তিথির শেষ কথা শুনে একটু স্বস্তি পেলাম। যাক বান্ধবীগুলা হারামি হলেও সান্ত্বনা তো দিতে পারে! ট্রিট দেবো বলে ফাইনাল করে ফেললাম ডিসিশন। এরজন্য অবশ্য এখন আমায় বাবার পকেট কাটতে হবে।
.
বাবার বাড়ি ফিরতে রাত নয়টার মতো বাজবে। এখন বাজে আটটা পঁয়তাল্লিশ। এখনো আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে টম এন্ড জেরী কার্টুন দেখছিলাম। টিভি আছে আমাদের। ড্রয়িংরুমে সেটা। এখন টিভি মায়ের দখলে। সন্ধ্যে হলেই তিনি সিরিয়াল দেখতে বসেন। এমনকি এড আসলেও একই চ্যানেলে রেখে দেন। চ্যানেল পাল্টে দিলে যদি নাটকের কোনো সীন মিস হয়ে যায়? তাই অযথা টাইম ওয়েস্ট করে আমিও যাই না টিভি দেখতে। তাছাড়া নেট থাকতে সবকিছুই যখন হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় তখন টিভির আর কী দরকার?

শুয়ে বসে কার্টুন দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম গলাটা কেমন যেন খুসখুস করছে। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে পানি বের করে পান করলাম। তাতেও কোনো কাজ হলো না। মায়ের হাতে এখন লেবু চা খেলেই ম্যাজিকের মতো গলা খুসখুস করা সেরে যাবে। আমি তো ভয় পাচ্ছি এটা ভেবে, সিরিয়াল দেখার সময় ডাকার ফল আবার ভয়ানক না হয়! যা হয় হবে। একটু বকলে বকতে পারে। কিন্তু বারণ করবে না।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে মাকে বললাম,’মা এক কাপ লেবু চা করে দাও তো। গলাটা ভীষণ খুসখুস করছে।’
মা এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত নিয়ে বলল,’একটু পরই এড দিবে। যা বলার তখন বলবি।’

বুঝলাম সিরিয়ালে হয়তো টান টান উত্তেজনা চলছে। কী আর করার? এড আসার আশায় সোফায় বসে রইলাম। মায়ের একটু পর শেষ হয়েছে পাক্কা ছয় মিনিট পর। অর্থাৎ ঠিকঠাক ছয় মিনিট পর এড এসেছে। এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কী করে বললাম সেটাই তো ভাবছেন? আমার গায়েবি কোনো গুণ নেই। দেয়াল ঘড়িতে বসে বসে সময় গুণেছি। এড আসার পর মা বলল,’বল এখন কী বলবি।’
‘বলছিলাম যে গলাটা কেমন জানি খুসখুস করছে। এক কাপ লেবু চা বানিয়ে দাও।’
‘আমি সিরিয়াল দেখতে বসলেই তোর গলা খুসখুস করে, মাথা ব্যথা করে, পেট ব্যথা করে। কাহিনী কী বলতো?’
‘এখানে কাহিনীর কী হলো মা? আমি কি ইচ্ছে করে সমস্যাগুলো আননি?’
‘এক্সাক্টলি! আমার মনে হয় তুই ইচ্ছে করেই সমস্যাগুলি আনিস। নয়তো মিথ্যে বাহানা করিস।’
‘শুধু শুধু এতগুলো কথা শোনাচ্ছ মা। বিরক্ত লাগলে রেসিপি বলে দাও। আমিই বানিয়ে নিচ্ছি।’
‘তার আর কোনো প্রয়োজন নেই! রান্নার তো ‘র’-ও জানিস না। পরে হাত-পা পুড়িয়ে তোর বাবার বকুনি খাওয়াবি।’ কথাগুলো বলতে বলতে মা রান্নাঘরের দিকে গেল। আমিও পিছু যেতে যেতে বললাম,
‘বাবাকে দোষ দিচ্ছ কেন? রান্না শেখানোর দায়িত্ব সবসময় মায়েদের হয়। বাবার নয়। তুমি রান্না শেখাওনি, এমনকি এখনও শেখাচ্ছ না। বাবার সাথে সাথে তুমিও আমায় বেশি আহ্লাদ দিয়ে ফেলছ।’

মা তখন খুন্তি হাতে নিয়ে বলল,’বেশি বকবক করবি না নবনী। যা এখান থেকে।’
আমি রান্নাঘরের দরজার বাইরেই ছিলাম। কথা বাড়ালাম না আর। ফিরে আসার পথে কলিংবেলের আওয়াজ শুনলাম। বাবা এসেছে। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম আমি। আমায় দেখে বাবা মিষ্টি করে হাসল। একটা প্যাকেট আমার হাতে দিল। মুখ আলগা করে দেখলাম কচকচে পেয়ারা। বাবা জুতা খুলতে খুলতে বলল,’তোর মা কোথায়?’
‘চা বানাচ্ছে।’

পেয়ারাগুলো টেবিলের ওপর রেখে আমি সোফায় বসে পড়লাম। বাবা ঘরে যাওয়ার আগে শব্দ করে মাকে বলল,’আমার জন্য এক কাপ চা বানিও তো।’
টুং করে জোড়ে একটা শব্দ এলো রান্নাঘর থেকে। এরপর ঝনঝন করা শব্দ শুনতে পেলাম। মা রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এসে বলল,’বাপ-মেয়ে মিলে একটার পর একটা বায়না করেই যাচ্ছ। তোমাদের জন্য একটু শান্তিতে টিভিও দেখতে পারি না। পেয়েছ তো কলুদ বলদ। যেভাবে পারছ খাটাচ্ছ!’

মা রাগে ফোঁসফোঁস করছে। বুঝলাম রান্নাঘরে থালা-বাসনগুলো মা ইচ্ছে করেই ফেলেছে। বাবা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল,’মাত্র একটা আবদারই তো করলাম নয়না। এজন্য তুমি এতগুলো কথা শোনালে?’
বাবার এভাবে কথা বলায় আমার ভীষণ হাসি পেল। হাসলামও মুখ চেপে। কারণ মা দেখতে পেলে একদম রক্ষে নেই। মা কিন্তু হাসল না। সে আবার রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল,’এই বয়সেও তার ঢং-এর শেষ নেই।’

বাবা এবার বিচার দেওয়ার ভঙ্গিতে মাকে শুনিয়ে শুনিয়ে আমায় বলল,’নবনী তুই-ই বলতো আমার এমন কী আর বয়স হয়েছে? তোর মা কথায় কথায় আমায় বুড়ো বলে। এটা কি ঠিক?’
‘না। একদম না। এটা তো ঘোর অন্যায়।’ জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব ধরে বললাম আমি।

মা দুটো চায়ের কাপ নিয়ে এল। আমার দিকে একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,’বাপের চামচ একদম বাপের মতোই হয়েছে।’
‘মা ওটা চামচি হবে।’
‘তুই চুপ কর।’
‘করলাম।’
বাবা তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,’আহ্! চা তো নয় যেন অমৃত। নয়না তুমি আর রাগ করে থেকো না। কাল শুক্রবার। কালই আমি একটা কাজের লোক নিয়ে আসব। সে সব কাজে তোমায় সাহায্য করবে।’
‘দেখব নে। এখন চুপ করে থাকো। সিরিয়াল শুরু হয়েছে।’

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে নিজের ঘরে চলে গেল। এখন সে গোসল করবে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম বাবার গোসল শেষ হওয়ার। বাবা-মায়ের ঘরেই বসে রইলাম। গোসল শেষ করে আমায় দেখে বলল,’কী ব্যাপার? কিছু বলবি?’
‘বলব তো।’
‘তাহলে বলে ফেল।’
‘আমার কিছু টাকা লাগবে।’
‘নিবি। বারণ করল কে?’
‘তাহলে দাও।’
‘কত দেবো?’
‘এক হাজার হলেই হবে। কাল বান্ধবীদের ট্রিট দেবো।’
‘কীসের ট্রিট? পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে নাকি প্রেম-ট্রেম কিছু করিস?’
‘উফফ! বাবা। কোনোটাই না। একটা ডেয়ার নিয়েছিলাম। কিন্তু হেরে গিয়েছি। তাই ওদের ট্রিট দিতে হবে।’
‘তুই আমার মেয়ে হয়ে হেরে গেলি? ছিঃ, ছিঃ! ভেরি ব্যাড।’
‘তুমি আর কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা দিও না তো বাবা।’
‘আচ্ছা যা দেবো না। টাকা কাল সকালে নিয়ে যাস।’
‘পাক্কা তো?’
‘একদম পাক্কা।’
আমি বাবার গালে চুমু খেয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। আপনারা হয়তো বাবার সাথে আমার এমন কথোপকথন শুনে অবাক হয়েছেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাবা আমার প্রথম বেষ্টফ্রেন্ড। আমি প্রায় সব কথাই বাবাকে শেয়ার করি; যে কথা হয়তো মাকে বলতেও ভয় পাই।
ঘরে এসে আমি শুয়ে পড়লাম। রাত আটটার মধ্যেই আমি রাতের খাবার খেয়ে ফেলি। বাবা অফিস থেকে আসলে মা আর বাবা একসঙ্গে খায়।
___________
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুম থেকে হৈচৈ শুনতে পেলাম। হাই তুলতে তুলতে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি ১০/১১ বছরের এক ছেলের সাথে বাবা কথা বলছে। তার মানে সত্যি সত্যি বাবা সকাল হতে না হতেই কাজের জন্য এই ছেলেকে ধরে এনেছে।

বাবা ছেলেটিকে প্রশ্ন করছে,’বল তো ওয়াই(Y) এর আগের অক্ষর কী?’
ছেলেটি বলল,’জানিনা।’
বাবা আবার প্রশ্ন করলেন,’তাহলে বল তো ৫০ এর আগের সংখ্যা কত?’
ছেলেটি এবারও বলল,’জানিনা।’
বাবা হতাশ হয়ে বলল,’তুই তো দেখি কিছুই পারিস না। ওকে, নো প্রবলেম! আমি তোকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবো।’

আমি এবার এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলাম,’এই ছেলে কে বাবা?’
‘ভালো হয়েছে তুই এসেছিস। আয় তোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। ওর নাম হচ্ছে রাজ্জাক।
আর রাজ্জাক, এইযে সামনে দাঁড়ানো পরীর মতো সুন্দরী মেয়েটিকে দেখতে পাচ্ছিস ও হচ্ছে আমার একমাত্র রাজকন্যা। ওর নাম নবনী। তুই ওকে আপা বলে ডাকবি।’
‘আচ্ছা।’ মাথা নাড়িয়ে বলল রাজ্জাক।
আমি বেশ ভালো করেই জানি, বাবা এই ছেলেকে কাজ করার জন্য আনলেও কাজ করাবে না। বাবা ওর সম্পর্কে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়া দিয়ে বললাম,’সময় নেই বাবা। গোসল করে রেডি হতে হবে। বাহির থেকে ফিরে এসে তোমার গরীবের রাজ্জাকের সম্পর্কে সব শুনব।’
‘গরীবের রাজ্জাক! বেশ ইন্টারেস্টিং নাম তো!’ বিড়বিড় করে বলল বাবা।

ঘরে যাওয়ার আগে শুনতে পেলাম বাবা আবারও রাজ্জাককে প্রশ্ন করছে,’আচ্ছা এইটা বলতো ‘ঋ’ এর পরের অক্ষরটি কী?’
রাজ্জাক কী উত্তর দিয়েছে শুনতে পাইনি। তার আগেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছি। আমার ধারণা এবারও রাজ্জাক বলবে,’জানিনা।’
.
গোসল সেরে একদম রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। বাবা তখন টেবিলে রাজ্জাককে নিয়ে নাস্তা খাচ্ছিলও। মা-ও সেখানে উপস্থিত। আমায় রেডি দেখে মা বলল,’এত সকালে কোথায় যাস?’
‘রেস্টুরেন্টে যাই মা। বান্ধবীদের ট্রিট দেবো।’ বললাম আমি।
‘দুইদিন একদিন পরপর শুধু ট্রিট। টাকা কি গাছে ধরে?’
বাবা কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলল,’সেকি নয়না! তুমি জানো না? আমার একটা টাকার গাছ আছে। গোপন গাছ। ঐখান থেকেই তো আমি টাকা পাই।’
মা কটমট করে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। বাবা সেদিকে লক্ষ্য না করে আমায় বলল,’আমার ঘরে বালিশের নিচে দেখ পনেরো’শ টাকা আছে। সব টাকা আবার ভাঙিস না। আসার সময় নবরত্ন তেলের বোতল কিনে আনবি তোর মায়ের জন্য। নবরত্ন তেল মাথা ঠান্ডা করার জন্য বেশ উপকারী। আর বাকি সব টাকা তোর।’

মা টেবিলের ওপর জোরে থাপ্পড় দিয়ে বলল,’সবকিছুতেই তোমার বাড়াবাড়ি।’
আমার বাবা ভীষণ রসিক মানুষ। বাড়িতে থাকলে তার প্রথম এবং প্রধান কাজই হচ্ছে মাকে রাগানো। মানতেই হবে বাবা এই কাজটা খুব ভালো পারে। মা রেগে গেলেও প্রতিবার বাবার রসিকতায় আমি হেসে কুটিকুটি হয়ে যাই। মা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে তাকায়। কিন্তু হাসি থামে না কী করব বলুন! টাকা নিয়ে আমি দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বের হলাম। বলা যায় না কখন আবার মা হুংকার দিয়ে বলে বসে,’নবনী তুই এখন বাড়ি থেকে বের হবি না। খবরদার! আর এক পা-ও আগাবি না।’

মেইনগেটের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আশেপাশে চোখ বুলালাম। আশ্চর্য! একটা ফাঁকা রিকশা-ও নেই। এদিকে একটু পরপর তিথি ফোন করছে। ওরা রেস্টুরেন্টে এসে কখন থেকে নাকি বসে আছে। রাক্ষসের দল পেটুক একেকটা! কিছু্ক্ষণ অপেক্ষা করেও রিকশা পেলাম না। তাই এগিয়ে গিয়ে ভাবলাম সিএনজি নিয়েই যাই। টাকা তো আছেই। ভাগ্য ভালো থাকায় একটা সিএনজি পেয়েও গেলাম। ভেতরে ঢুকতে যাব তখনই ওপাশ থেকে আরেকটি ছেলে আমার সঙ্গে সিএনজিতে বসল। ছেলেটি অন্য কেউ নয়। রুদ্র! কালো জিন্সের সাথে সাদা একটা টি-শার্ট পরেছে। চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। অটোমেটিক আমার হাত বুকের বামপাশে চলে গেল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। আমায় অবাক করে দিয়ে রুদ্র হেসে ফেলল। মিষ্টি কণ্ঠে বলল,’সরি। আপনি যান।’

আমি তড়িঘড়ি করে বললাম,’শুনুন, শুনুন। সমস্যা নেই। আমি সামনেই নামব। আপনি আসতে পারেন।’
‘আমিও সামনেই নামব। আমি সাথে গেলে সমস্যা হবে না তো?’
‘একদম না।’
‘থ্যাঙ্কিউ।’
রুদ্র আমার পাশে এসে বসল। মাঝখানে যথেষ্ট পরিমাণ দূরত্ব। রুদ্র আপনমনে ফোন চাপছে। সিএনজি চলা শুরু করেছে। আমি চোরের মতো আড়চোখে বারবার রুদ্রকে দেখছি। কেমন ছেলেরে বাবা! কথা বলা তো দূরে থাক; ফিরেও তাকাচ্ছে না! না তাকাক! দুজনে যে একসঙ্গে একই সিএনজিতে যাচ্ছি এটা মনে করেই তো আমি মহাখুশি। কিন্তু অবাধ্য মনটা এরচেয়েও বেশি কিছু আবদার করছে। রুদ্রের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। আমি নিজেই নিজেকে বিদ্রুপ করে মনে মনে বললাম,’কাল তো খুব ভয় পেলি। আর আজ কথা বলার জন্য এত উতলা হয়ে পড়েছিস কেন?’

মনকে বকেও বলে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম। কাল রুদ্র রেগে ছিল। কিন্তু আজ তো রেগে নেই। চোখের সামনে বারবার মিষ্টি হাসিটা ভেসে উঠছে। বলি কথা! গলাটা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন?’

রুদ্র এবার ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকাল। যাক বাবা! তাও তো তাকাল। তারপর আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল,’না তো! তবে একটু একটু চেনা মনে হচ্ছে। মানে চোখদুটো আরকী!’
আমি হেসে ফেললাম। প্রথমদিনের কথা তার মনে নেই তাহলে।
‘কাল যে আমার থেকে পানি খেলেন। মনে নেই?’ বললাম আমি। রুদ্র মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল,’ওহ আচ্ছা! আচ্ছা! মনে পড়েছে এবার। স্কুল ড্রেস ছাড়া কিন্তু তোমায় বেশ বড়ো মনে হয়।’
‘এজন্যই বোধ হয় প্রথমদিন আমায় কাজের বুয়া ভেবেছিলেন?’

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে ফেলল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। হয়তো সেদিনের কথাটাই! রুদ্র নিজেই এবার শব্দ করে হেসে বলল,’আল্লাহ্!
তার মানে ঐ মেয়ে তুমি? সেদিনের জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত। আমি একদম বুঝতে পারিনি। আর সরি বলার সুযোগও দাওনি।’
‘ইট’স ওকে। ব্যাপার না। আমার লুকটাই তখন ওমন ছিল।’
‘তুমি রাগ করোনি তো?’
‘প্রথমে রাগ হয়েছিল। এরপর আয়নার সামনে গিয়ে ভালো করে নিজেকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম আপনার দোষ নেই।’
রুদ্র এবারও হাসল। এই ছেলে হেসেই আমায় মেরে ফেলবে নাকি বুঝি না!
‘সেদিনের পর তো তোমায় আর দেখলাম না। বাই দ্যা ওয়ে, তোমার নাম কী?’
‘কিন্তু আমি আপনাকে প্রতিদিনই দেখতাম। আমার নাম নবনী।’
‘সুন্দর নাম। কোন ক্লাসে পড়ো?’
‘টেনে।’
‘গুড।’

সিএনজি এসে রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। আমার সঙ্গে রুদ্রও নামে। আমি অবাক হয়ে বললাম,’আপনি এখানে নামলেন যে?’
‘আমিও তো রেস্টুরেন্টেই যাব।’
কত মিল আমাদের! মনে মনে ময়ূর পেখম তুলে নাচছে। রুদ্র জোর করেই আমার ভাড়া-ও দিয়ে দিল। দুজনে রেস্টুরেন্টের গেটের সামনে যাওয়ার পর একটা মেয়ে হাওয়ার বেগে উড়ে এসে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে। এই দৃশ্য দেখে আমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ইশরে! কেউ মনে হয় বুকের বাম পাশটায় তীর ঢুকিয়ে দিল। এই মেয়েটা আবার কে? রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড? এই মেয়ে যদি রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে সত্যি বলছি এখানে বসেই হাত-পা ছড়িয়ে আমি কাঁদব। আমার সান্ত্বনা দেওয়ার বাক্সগুলা যে কোথায়! প্লিজ রুদ্র প্লিজ এই মেয়েকে এক ধাক্কায় পঁচা নর্দমায় ফেলে দাও। আচ্ছা ঐ মেয়ে যদি সত্যিই রুদ্রর গার্লফ্রেন্ড হয় তাহলে আমার এখন কী করা উচিত?

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। অবশ্যই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। আপনাদের রেসপন্সের ওপরেই নির্ভর করে গল্পটা প্রতিদিন দেবো কী-না।]

#সে
#পর্ব_৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
রুদ্র আমার মনের কথা বুঝেছিল কী-না জানিনা তবে ঠিক ঠিক মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আমার ধারণা পাশে যদি কোনো নর্দমা থাকত তাহলে মেয়েটির জায়গা এখন সেই নর্দমাতেই হতো। রুদ্র রাগী রাগী গলায় মেয়েটিকে বলল,’তোর এই স্বভাব আমি বাদ দিতে বলেছি না? দেখলেই একদম বান্দরের মতো গলায় ঝুলে পড়িস। বিরক্তিকর! গায়ে পড়া স্বভাব আমার একদম ভাল্লাগে না শিরিন। নেক্সট টাইম তোর এমন ব্যবহার দেখলে থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো।’

এই প্রথম রুদ্রের রাগ দেখে ভয় পাওয়ার বদলে আমার খুশি খুশি লাগছে। বেশ হয়েছে একদম! হতচ্ছাড়ি আরও ধর জড়িয়ে। রুদ্র ওর বাকি বন্ধুদের নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর চলে যায়। শিরিন মেয়েটি কাচুমুচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত মানুষের সামনে এভাবে অপমান করবে রুদ্র এটা হয়তো একদম প্রত্যাশার বাহিরে ছিল মেয়েটির। সবাই চলে গেলেও একটি মেয়ে রয়ে গেছে। সে শিরিনের কাঁধে হাত রেখে বলল,’মন খারাপ করিস না। ভেতরে চল।’

‘রুদ্র সবসময় আমার সাথে এমন করে কেন?’ জিজ্ঞেস করল শিরিন। পাশের মেয়েটি বলল,’জানিসই তো রুদ্র কেমন। তবুও ওর সাথে আঠার মতো লাগতে যাস কেন?’
‘বিকজ আই লাভ হিম।’
‘তোর এই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে কবে জানি বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে যায়। এর আগে কতগুলারে ভালোবাসছিস? কতগুলা রিলেশনও করছিস। রুদ্র সব জানেও। তাছাড়া তোর প্রতি রুদ্রের রিলেশন করার মতো কোনো ইন্টেনশন নাই। এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবি ততই তোর জন্য ভালো।’
কথার শেষে শিরিনের মাথায় গাট্টা মেরে মেয়েটিও ভেতরে চলে গেল। বিরক্ত নিয়ে সঙ্গে গেল শিরিনও। এতক্ষণ আমি ফোন টেপার ভং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। নয়তো ওদের কথোপকথনগুলো তো আর শুনতে পারতাম না। এই শাঁকচুন্নি তাহলে রুদ্রের বান্ধবী। এমন খাইস্টা মাইয়া ওর মতো ছেলের বান্ধবী হয় কেমনে আমি তো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। থাক বাবা, আমার অত ভাবাভাবির কাজ নাই। এইটুকু তো শিওর হলাম যে, রুদ্র শিরিনকে পাত্তা দেয় না। দেওয়া উচিতও নয়। একদম নয়। হুহ!

রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে দেখলাম আমার বান্ধবীগুলা খাবার খাচ্ছে। মানে বুঝলাম না। আমি আসার আগেই ওরা খাবার অর্ডার দিয়ে ফেলেছে? আমি এক সাইডে বসে জিজ্ঞেস করলাম,’আমি আসার আগেই তোরা খাবার অর্ডার দিয়ে ফেললি? আবার আমায় রেখেই খাচ্ছিস।’

লিমা খাওয়ার ফাঁকে একটু ব্রেক নিয়ে বলল,’তোর জন্য আর কতক্ষণ ওয়েট করে থাকব? ট্রিট দিবি বলে সকালে আমরা কেউ নাস্তা করিনি।’
‘বাহ্! বাহ্! আমি যদি না আসতাম? বিল কে দিতি?’
‘তুই যে আসবি আমরা সেটা জানি। ফাজিল হলেও কথা দিয়ে কথা রাখিস তুই।’ বলল তিথি।

আমি উদাস হব নাকি ওদের চিবিয়ে খাব বুঝতে পারছিলাম না। আমার ভালো মানুষীর সুযোগ নিচ্ছে ওরা। এজন্য তথাকথিত একটা কথা আছে, ‘আজকাল ভালো মানুষের দাম নেই।’
মনের দুঃখে বড়ো শ্বাস নিয়ে ওয়েটারকে ডাকতে যাব তখন আমাদের অপজিটে এক টেবিল এগিয়ে বসা রুদ্র ও ওর বন্ধুদের দেখতে পেলাম। আমার এখান থেকে রুদ্রকে সরাসরি দেখা যাচ্ছে। কী সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে ছেলেটা! তিথি আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে,’ঐ সিটে আগে আমি বসা ছিলাম। দেখলাম ঐখান থেকে রুদ্র ভাইয়াকে দেখা যায়। তাই তোর জন্য ঐ সিট রেখে এখানে এসে বসেছি।’

তিথির এ কথায় আমি খুশি হয়ে গেলাম। ওর গাল ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বললাম,’ওলে আমাল লাল গুড্ডু গুড্ডু বান্ধবী!’
‘হুস যা! ঢং করা লাগবে না আর। আমার জন্য আরেকটা বার্গার অর্ডার দে।’
‘দিচ্ছি।’
তিথির জন্য বার্গার অর্ডার দিয়ে আমি চুপি চুপি রুদ্রকে দেখছিলাম। লুকিয়ে কয়েকটা ছবিও তুলে নিয়েছি। এত্ত সুন্দর করে হাসে ছেলেটা!

আমি আসার আগেই অর্ধেক খাওয়া হয়ে গেছিল ওদের। বাকি অর্ধেকও শেষ। আমি ট্রিট দিলাম অথচ একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস ছাড়া আমি আর কিছুই খাইনি। খাব কী করে? আমার পেট তো ভরে আছে খুশিতে। সব জায়গায় রুদ্রকে পাই। ওকে দেখলেই আমার খুশি খুশি লাগে। আর পেট ভরে যায়। কী অদ্ভুত কথা না?
তিথিরা ঢেকুর তুলে বলে,

‘নবনী বিলটা তাড়াতাড়ি দিয়ে বাড়ি চল। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’
‘আরে রুদ্র তো এখনও আছে।’ নাকমুখ কুঁচকে বললাম আমি। লিমা আমার হাতে চিমটি কেটে বলল,’সে কখন যাবে তার কোনো ঠিক আছে? তার আশায় বসে থাকলে বৃষ্টির কবলে পড়তে হবে। থাকিস তো পাশাপাশি এপার্টমেন্টে। মন চাইবে চলে যাবি।’
‘ধুর!’

রুদ্রকে রেখে যেতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আর বেশিক্ষণ থাকাও যাবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে বাড়িতে মা কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেবে। আকাশের অবস্থাও ভালো না। একবার বৃষ্টি শুরু হলে কখন থামবে তারও কোনো নিশ্চয়ত্তা নেই। তাই রুদ্রকে রেখেই বিল দিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এলাম।
.
আমি বাদে বাকিদের বাড়ি অপজিটে। অর্থাৎ আমায় একাই এখন বাড়ি ফিরতে হবে। ওরা একটা সিএনজি নিয়ে চলে যায়। আর আমি রিকশায় উঠে বসি। ভাগ্য এত খারাপ হবে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ ঝুমবৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। এমনিতেও যা ওজন আমার! সবাই বলে আমি নাকি বাতাসের আগে আগে চলি।

‘আপা! রিকশা তো চলে না। হাওয়া শ্যাষ।’
রিকশাওয়ালার কথা শুনে মনে হচ্ছে বিশাল আকাশ এখন আমায় মাথায় পড়ে ভেঙে খান খান হয়ে যাবে। আমি অসহায় ভঙ্গিতে বললাম,’মামা ট্রাই করে দেখেন আবার।’
‘টেরাই কইরা লাভ হইব না আপা। আমার ভাড়া লাগব না। আপনে তাড়াতাড়ি কইরা বাড়িতে যানগা।’

আমার অবস্থা এখন ‘চিৎকার করিয়া কাঁদিতে চাহিয়াও আমি করিতে পারিনি চিৎকার।’ বেচারা রিকশাওয়ালার-ই বা দোষ কী! ভাগ্যে ছিল এমন বিপদে পড়ব। পড়েছি। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই আমি হাঁটতে শুরু করি। বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশিক্ষণ হয়নি; অথচ এতেই প্রায় রাস্তা ডুবে যাওয়ার মতো অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে চায়ের টং দোকান যখন পাস করে গেলাম পেছন থেকে কতগুলো ছেলের উস্কানিমূলক কথা শুনতে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলাম চারজন ছেলেকে। বাজে বাজে কথা বলে যাচ্ছে আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে। ভয়ের চেয়ে রাগ বেশি হচ্ছিল আমার। যদি পারতাম এখনই সবকয়টাকে পিটিয়ে মাটিতে পুঁতে দিতাম। একা পেয়ে যা নয় তাই বলে যাচ্ছে! আশেপাশে কোথাও যে দাঁড়াব তারও কোনো উপায় নেই। আর একটা রিকশা-ও চোখে পড়ল না।

একটা রিকশা অবশ্য এলো। কিন্তু ফাঁকা নয়। রিকশাটি আমার সামনেই থামল। আরও বেশি অবাক হলাম রুদ্রকে দেখে। সেদিনের সেই রণমূর্তির আবির্ভাব ওর চোখেমুখে। সঙ্গে আরেকজন ছেলে ছিল। দু’জন মিলে ঐ ছেলেগুলোর দিকে এগিয়ে গিয়ে দিল গালে থাপ্পড়। বাকি দুইটা ভয়েই দৌঁড়। রুদ্র একটার কলার চেপে ধরে বলল,’আবার এই এলাকায় মেয়েদের বিরক্ত করা শুরু করছিস?’
‘মাফ চাই ভাই। আর হইব না।’
আরেকটি থাপ্পড় দিয়ে তবেই রুদ্র ছেলেটিকে ছাড়ল। বিষয়টা আমার কাছে সিনেমাটকই লাগল। না, না মীরাক্কেল বলা যায়!

রুদ্র কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,’বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছ কেন? একটা রিকশা তো নিতে পারতে।’
‘নিয়েছিলাম। মাঝরাস্তায় চাকার হাওয়া ফুঁশ!’ মাথা নত করে বললাম আমি। তখন রুদ্রর হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। হয়তো আমার শেষ কথাটি শুনেই হেসেছে। ওর হাসি দেখে আমিও মুচকি হাসলাম। রুদ্র হাসতে হাসতে বলল,’আচ্ছা যাও রিকশায় উঠো।’

খুশির উত্তেজনায় ইচ্ছে করছিল এখানেই নাচানাচি শুরু করি। রুদ্র আর আমি এক রিকশায়! ওর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে অবশ্য একটুখানি খুশি কমে গেল। থাক ব্যাপার না। আমাদের মাঝে সে দুধভাত। আমি আগে আগে গিয়ে রিকশায় বসলাম। রুদ্রও এগিয়ে এসে রিকশাওয়াকে বলল,’মামা একদম বাড়ির সামনে নামিয়ে দিবেন।’
‘আইচ্ছা।’ বলল রিকশাওয়ালা।

রুদ্র এটা কী বলল? আমি যে খুশিতে মনে মনে নাচলাম এগুলো সব বৃথা গেল?
‘আপনারা যাবেন না?’ সাহস করে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। রুদ্র বলল,
‘হ্যাঁ। আমরা হেঁটেই যেতে পারব। তুমি সাবধানে যাও।’
রিকশা চলা শুরু করে। এদিকে রাগে গজগজ করি আমি। বৃষ্টিও মনে হয় মাথার আগুন নেভাতে পারবে না। স্বগতোক্তি করে বলে ফেললাম,’ধ্যাত!’

পুরো কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফেরার দরুণ ইচ্ছেমতো মায়ের বকুনি খেলাম কতক্ষণ। ব্যাপার না। বকবে তিনি আদরও করবে তিনি। আমি জামা-কাপড় পাল্টে ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। বাবা আর রাজ্জাকও ড্রয়িংরুমেই বসে ছিল। মা এখন রান্নাঘরে। আমি শিওর সে আমার জন্য এখন গরম দুধ নিয়ে আসবে। এই খাদ্যটা অপছন্দ হওয়া সত্বেও শুধুমাত্র বকা খাওয়ার ভয়ে গিলতে হবে। দুধের গ্লাসটা আমার সামনে রেখে বলল,’কোনোরকম বাহানা না করে দুধটুখু খেয়ে নাপা-এক্সট্রা খেয়ে নিবি। তারপর একটা ঘুম দিবি।’

আমি কিছু বললাম না। বাবা বললেন,’তোকে যে নবরত্ন তেল আনতে বলেছিলাম। আনিসনি?’
‘না। মনে ছিল না।’
‘ভুল করে ফেললি রে। এখন তোর মায়ের মাথা ঠান্ডা করব কী করে বল তো?’
‘তুমি চুপ করে থাকো। সবসময় শুধু রসিকতা।’ ধমক দিয়ে বলল মা। বাবা ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে বলল,’এইযে আমি চুপ হলাম।’
দুধটুকু খেয়ে ওষুধ মুখে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসি। জানালা দিয়ে ওষুধটা ফেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আসলেই এখন প্রচুর ঘুম আসছে।
___________
ঘুম ভেঙেছে ঠিক তিনটায়। আকাশ এখনও থম মেরে রয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। ভাবলাম যাই গিয়ে একটু ছাদ থেকে হেঁটে আসি। ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম রাজ্জাক চুপচাপ বসে আছে। আমি বললাম,’এই রাজ্জাক ছাদে যাবি?’
‘যামু।’
‘চল তাহলে।’

রাজ্জাককে নিয়ে ছাদে এসে দেখলাম পরিবেশটা অনেক বেশি সুন্দর। ছাদের একেক কোনায় পানি জমে রয়েছে। জুতা খুলে পানির ওপর পা রেখে হাঁটছিলাম। ভালো লাগছিল খুব। ছাদে অনেকগুলো।গাছ লাগানো রাখা। কারা লাগিয়েছে জানিনা। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাওয়া গাছগুলোকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। গাছের পাতায় লেগে থাকা বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দিলাম আমি। পেছনে ঘুরে রাজ্জাককে ডাকতে গিয়ে দেখলাম আমাদের থেকে কিছুটা দূরে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন গিলে খেয়ে ফেলবে। ছেলেটা রাজ্জাকের বয়সীই হবে।

কোমরে হাত রেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,’কী পিচ্চি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?’
ছেলেটা আমার দিকে এগিয়ে এসে নিজের চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে বলে,’মোটেও আমি কোনো পিচ্চি নই। তুমি যেই গাছের পাতা ধরলে ঐটা আমার গাছ।’
‘হ্যাঁ, তো?’
‘আমার গাছ কেউ ধরুক এইটা আমি পছন্দ করি না।’

এইটুকু ছেলের কথা শুনেছেন আপনারা? বাপ্রে বাপ! কী এটিটিউড! এই বয়সে আমরা মায়ের আঁচল ধরে ঘুরতাম। খেলনাপাতি খেলতাম। বড়োদের সঙ্গে কথা বলা তো দূরে থাক; ঠিকমতো চোখের দিকেও তাকাতাম না ভয়ে। ছেলেটি মুচকি হেসে বলে,’আমি রিশান। তোমার নাম কী?’
‘নবনী।’
‘ওয়াও! অনেক সুন্দর নাম তো। আমাদের ক্লাসে একটা মেয়ে আছে। ব্যাপক সুন্দরী। ওর নাম হলো অবনী। তোমার নামের সঙ্গে কিন্তু মিল আছে।’
এই ছেলের কথাবার্তার স্টাইল শুনে মনে চাচ্ছিল ঠাস করে গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই। বেয়াদব ছেলে! মনে মনে বকলেও মুখে কিছু বললাম না। ছেলেটা গুলুমুলু আছে। গাল দুইটা চটকায় দিতে মনে চাচ্ছে। আমি হেসে বললাম,’এই বয়সে এত যে ঢং তোমার বাড়ির কেউ কিছু বলে না?’
‘কী বলবে? কারো সাহস আছে নাকি আমায় কিছু বলার?’
‘ও বাবা! রংবাজ নাকি তুমি?’
‘আমি না। তবে আমার ভাইয়া। সবাই ভাইয়াকে অনেক ভয় পায়। তুমি কি আমার ভাইয়াকে চেনো?’
‘জি না। আমি কী করে চিনব? আমরা এই বাসায় নতুন এসেছি।’
‘ও। সমস্যা নাই চিনে যাবা। এই এপার্টমেন্টের সবাই আমার ভাইয়াকে চিনে। বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েরা। আমার ভাইয়া কিন্তু কাউকে পাত্তা দেয় না।’
‘ও তাই? শুনো তোমার ভাইয়াকে এক কিকে দূরে ফেলে দেবে এমন একজনকে আমি চিনি।’
‘ছিঃ! এমন কথা মুখেও এনো না। আমার ভাইয়া একবার শুনলে তোমার খবর আছে।’
‘হুস! নবনী কাউকে ভয় পায় না।’
‘আচ্ছা বেশ! যার কথা বলছ সে তোমার কে হয়?’

পড়লাম তো এবার বিপাকে! আমি তো বলছিলাম রুদ্রর কথা। এখন কী করে বলি সে আমার কী হয়? এখন যদি বানিয়ে কোনো কথা বলি আর সেটা যদি রুদ্রর কানে যায় তাহলে থাপ্রিয়ে আমার গাল লাল করে ফেলবে শিওর। তাই মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে বললাম,’এই রে! কত সময় পার হয়ে গেল। যাই এখন। পরে তার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দেবো।’

এরপর রাজ্জাককে নিয়ে হাঁটা ধরলাম। সিঁড়িঘরের সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ে আচমকা প্লাজুতে পাড়া লেগে যায়। টাল সামলাতে না পেরে আমিও একদম উপুর হয়ে পড়ি। তখন কোন বেচারা যে উপরে আসছিল আমি জানিনা। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে সঙ্গে কষ্ট পোহাতে হলো সেই বেচারাকেও! একদম সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নিচে ফ্লোরে এসে ঠেকলাম। বিশ্বাস করেন, যেই ব্যক্তি একবার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়েছে সেই ব্যক্তি কখনো মুভিতে এই সীন দেখলে সেটাকে রোমান্টিক সীন বলবে না। ভাববেন না যে নায়ক-নায়িকার মতো একসাথে গড়িয়ে পড়েছি। শুধু এতটুকুই বুঝতে পেরেছি আমার জন্য আরেকজনকেও পড়তে হয়েছে। হাড়-হাড্ডি বোধ হয় সব এক হয়ে গেল আমার! সিঁড়ি দিয়ে দপাদপ কারোর নামার শব্দ পেলাম। হয়তো সেটা রাজ্জাক হবে। আর একটু দূর থেকে রিশানের কণ্ঠ শুনলাম,’ভাইয়া রে!’
ওর ভাইয়াটা কে এটা দেখার জন্যই সকল ব্যথা ভুলে গিয়ে চোখ মেলে তাকালাম… এই ছেলে আবার কে!

চলবে…

সে পর্ব-০১

0

#সে
#সূচনা_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া

ক্রাশকে চুমু অথবা থাপ্পড় দেওয়ার মতো সাংঘাতিক লেভেলের ডেয়ার দেওয়া হয়েছে আমাকে। বিশ্বাস করেন, ক্রাশকে পছন্দ করি। কিন্তু চুমু খাওয়ার মতো দুঃসাহস আমার এই ছোট্ট মনে নেই। কথায় আছে ঘর শত্রু বিভীষণ। কিন্তু আমার হচ্ছে ক্লাস শত্রু, কোচিং শত্রু এবং প্রাইভেট শত্রু। এই শত্রু কারা বোঝেননি? আমার বান্ধবীরা! সুযোগ পেয়ে এমন ধোলাই যে দেবে তা আমি কল্পনাতেও আনিনি। যাকগে বন্ধুমহলে আমি বেশ সাহসী মেয়ে। ভয়ে নেতিয়ে যাওয়ার বিষয়টা হাসি-ঠাট্টার মধ্যে পড়ে যাবে। কারো হাসির পাত্রী তো আমি হতে পারব না। দেখাই যাক এই ডেয়ারটাতে আমি জয়ী হতে পারি নাকি। যেহেতু চুমু খাওয়া সম্ভব নয় তাই থাপ্পড় দেবো বলেই ঠিক করলাম। ভাবতেই কষ্ট লাগছে!

ক্রাশ আর আমি এক এপার্টমেন্টেই থাকি। এবং পাশাপাশি ফ্ল্যাটে। আমার বাবা সরকারী চাকুরীজীবী। তার বদলির জন্যই আমাদের বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই ঘুরে বেড়াতে হয়। ছোটো পরিবার হওয়ায় খুব বেশি সমস্যাও হয় না। কিন্তু মা ভীষণ রাগ করেন। বারবার ঘর গোছানোর কাজ তার বিরক্ত লাগে। শুধু কি তাই? কাজের লোক খুঁজে পাওয়া’ও দায়! ক্লাস নাইনে উঠার পর কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে এলাম সিলেটে। পুরনো বন্ধু-বান্ধবীদের ছেড়ে আসতে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু কিছু করার নেই। ছোটোবেলা থেকেই তো এভাবে ঘুরছি। এক বছর যাবৎ অন্য এলাকায় ছিলাম। কিছুদিন ধরে নতুন এপার্টমেন্টে এসেছি। দ্বিতীয় দিনই ক্রাশের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আর সেদিনই তাকে প্রথম দেখে আমি শেষ! যাকে রোমিও ভাষায় বলে ফিদা। বয়স কম বিধায় আবেগে ভেসে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। আমাদের প্রথম দেখা কোনো সিনেমাটিকভাবে হয়নি।

শুনুন কী হয়েছিল সেদিন। এখানে নতুন আসায় কাজের লোক পাইনি আমরা। তাই ঘরের কাজ মাকে একাই করতে হতো। বাড়ির একমাত্র মেয়ে এবং একমাত্র সন্তান হওয়ায় আকাশসম ভালোবাসার সঙ্গে আমার রয়েছে বাড়াবাড়ি রকমের স্বাধীনতা। কখনো কোনো কাজে আমার হাত রাখতে হয় না। পুরো দু’দিন লেগেছিল আমাদের ঘর গুছাতে। ময়লা অনেক জমে গিয়েছিল। এত ময়লা ঘরে রাখা সম্ভব নয়। এপার্টমেন্টের নিচে ডাস্টবিন রয়েছে। আমি ভাবলাম এত কাজ করে মা তো ক্লান্ত; আমি গিয়ে বরং ময়লাগুলো ফেলে আসি। মা প্রথমে রাজি হতে চাইলেন না। কিন্তু আমিও তো হাল ছাড়ার পাত্রী নই। সত্যি বলতে সেদিন হাল ছেড়ে দেওয়াটাই আমার জন্য উত্তম ছিল। তাহলে এত লজ্জাকর পরিস্থিতিতে আমায় পড়তে হতো না। আমরা থাকি তিন তলায়। দু’হাত ভর্তি ময়লা নিয়ে লিফ্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু হাত আটকে থাকায় বাটন প্রেস করতে পারছিলাম না। বিরক্ত হয়ে নিচু হয়ে ময়লার পলিগুলো রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াবো অমন সময়ে কারো থুঁতনির সঙ্গে আমার মাথায় বাড়ি লাগে। ইশ! হুট করে যেন ঝড় বয়ে গেল। আমিই এত ব্যথা পেয়েছি, না জানি ঐ লোকের থোতার কী অবস্থা! চোখমুখ কুঁচকে ফেলেছিলাম। মাথা ডলতে ডলতে সামনে তাকাতেই একজন পুরুষের গলা দৃশ্যমান হলো। কী আজব! লোকটা এত লম্বা নাকি? লোকটা অত লম্বা হবে কী-না জানিনা। তবে আমি একটু বেঁটে। আবার ততটাও নই। ঠিক ঠিক ফাঁচ ফুট। আমি এবার তার মুখের দিকে তাকাতেই ব্যথায় বিকৃত করা আমার মুখ ‘হা’ হয়ে যায়। এত সুন্দরও কোনো মানুষ হয়? সরি, এখানে হবে এত সুন্দরও কোনো ছেলে মানুষ হয়? ছেলেরা সুন্দর হলে আমার কেন জানি হিংসা লাগে। ছেলেরা কেন সুন্দর হবে? সুন্দর হবে শুধু মেয়েরা। আর ছেলেরা ভালোবেসে তখন নাম দেবে মায়াবতী অথবা মায়াবিনী।

উহ্! ভাববেন না উনি সেই মাত্রায় সুন্দর। অথবা ফর্সা। আমি উনার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিচ্ছি শুনুন, উনার গায়ের রং শ্যাম। উচ্চতায় পাঁচ ফুট ছয় কিংবা সাত হবে। বড়োজোর আট-ও হতে পারে। নট শিওর! কিন্তু নাকের পাশে ছোট্ট একটা তিল আছে। হায়ে! ঘায়েল আমি। আরও একবার ঘায়েল হলাম তার কণ্ঠস্বর শুনে। তিনি বললেন,’সরি। আপনি ব্যথা পাননি তো?’
আমার মনের ভেতর তখন দ্রিমদ্রিম আওয়াজে কালবৈশাখীর প্রবল ঝড় বইছে। ঝড়ে গাছপালা নুইয়ে যাওয়ার মতো স্বপ্নের জগতে আমিও বোধ হয় এদিক-সেদিক দুলছিলাম। তার প্রশ্নে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে বললাম,’হুম।’

তারপর সে আগে লিফ্টে উঠল। আমি লিফ্টে উঠব তখন মনে পড়ে গেল আমার ময়লার কথা। ইশ! এই ময়লা নিয়ে এখন লিফ্টে উঠব? তাও ক্রাশের সাথে? ধুর ছাই বলে লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে ময়লা নিয়েই লিফ্টে উঠলাম। তিনি লিফ্টের এক মাথায় আর আমি লিফ্টের অন্য মাথায়। মাঝখানে ময়লা। সত্যি বলতে ময়লাগুলোকে ভিলেনই মনে হচ্ছিল আমার। একটু পরপর তাকে আড়চোখে আমি দেখছিলাম। প্রথম ভালোলাগা বলে কথা! সে কী অনুভূতি! আমি খেয়াল করলাম, উনি কেমন যেন আনইজি ফিল করছে। আরও অবাক করার বিষয় হলো, উনার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল উনি কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। তাহলে কি উনিও? ইশ… ভাবতেই তো কেমন জানি আনন্দ আনন্দ লাগছে। মনে মনে গানও গেয়েছিলাম সেদিন,

‘শোনো গো দখিনা হওয়া
প্রেমে পড়েছি আমি’

পুরো গান শেষ হওয়ার আগেই লিফ্ট খুলে গেল। ক্রাশের আগে আমিই ময়লা নিয়ে বের হলাম। একেবারে ছেচ্রা সাজাটা তো বেহায়াপনা মনে হবে তাই না? ক্রাশ এলো আমার পিছু পিছু। ডাস্টবিনে ময়লাগুলো ফেলেই আবার ফিরে আসছিলাম তখন উনার মুখোমুখি হয়ে গেলাম। অনিচ্ছা নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসার সময় উনি পিছু ডেকে বললেন,’শুনুন?’

উনার ডাক শুনে মনে হচ্ছিল আমি আকাশে-বাতাসে উড়ছিলাম। লজ্জামিশ্রিতভাবে হেসে আমি বললাম,’জি?’
উনি তখনও আনইজি ফিল করছিলেন। এরপর জড়তা কাটিয়ে বলল,’আসলে কথাটা বলা ঠিক হবে কী-না বুঝতে পারছি না।’

‘কী যে বলো তুমি! তুমি বলো না কী বলবে? আমার নাম জানতে চাও? নাকি নাম্বার চাও? কোনটা চাও বলো, বলো!’ মনে মনে পুলকিত হয়ে বললাম আমি।

ক্রাশ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল,’আপনি যেই ফ্লোরে কাজ করেন আমরা’ও ঐ ফ্লোরেই থাকি। আপনি যদি আপনার বর্তমান কাজের পাশাপাশি আমাদের কিছু ছুটা কাজ করে দিতেন তাহলে খুব উপকার হতো। আমাদের ছুটা কাজের মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। তাই কাজটা ছেড়ে দিয়েছে। এখনকার সময়ে কাজের লোক পাওয়া খুব ভার। তাই আপনাকেই বললাম। সবাই যেরকম বেতন দেয় আমি তার থেকে একটু বেশিই দেবো। করবেন?’

বিশ্বাস করেন, ঐ মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছিল…. ইচ্ছে করছিল কোনো কচু গাছ দেখে সেখানেই ঝুলে পড়ি। শেষমেশ ক্রাশ আমাকে কাজের মেয়ে বানিয়ে দিল? মাবুদ! এই দিন দেখার আগে রাত হলো না কেন? তাহলে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম, এই দিনও আমায় দেখতে হতো না। ভেতরে ভেতরে আমি খুব কাঁদছিলাম। মন কাঁদছিল আর-কী! আমায় চুপ থাকতে দেখে উনি বললেন,’চুপ করে আছেন যে?’

কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম বাচ্চাদের মতো আমার ঠোঁট উল্টে যাচ্ছে। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে রয়েছে। কথা কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। এত নরম হলে তো চলবে না। তাই বিষাদিতভাবে কাঠ কাঠ গলায় বললাম,’আমি কোনো কাজের মেয়ে না। আমরা এই বাড়িতে নতুন এসেছি।’
এরপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে ফ্ল্যাটে চলে গেলাম। ক্রাশের কী অবস্থা হয়েছিল সেটা আর আমি জানি না। নিজের রুমে এসে বারবার আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম। আসলেই নিজেকে ফকিন্নির মতো লাগছিল। তার মধ্যে হাতে ছিল ময়লা! ক্রাশেরই বা দোষ কী? রাগ কমে গেল আমার। এরপর থেকে প্রায়ই তাকে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম।

এই হচ্ছে ক্রাশের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। ক্রাশের বিষয়ে এতকিছু বললাম অথচ এখনও তার নামটাই বললাম না! উনার নাম রুদ্র। নামটা সুন্দর না? হতেই হবে। যেখানে মানুষটা সুন্দর, মন সুন্দর, ব্যবহার সুন্দর সেখানে নাম তো সুন্দর হবেই। আর আমি? আমি নবনী।

‘হ্যাঁ রে, নবনী। আর কত দাঁড়িয়ে থাকবি? চল এবার।’ বাজখাঁই গলায় কথাটি বলল আমার পরম বন্ধু নামক শত্রু তিথি। শত্রু বললাম তার কারণ হচ্ছে এই সাংঘাতিক লেভেলের বিশ্রী ডেয়ারটা তিথিই আমায় দিয়েছে। আগেরবার ওকে যেই ডেয়ার দিয়েছিলাম সেটারই শোধ আজকে তুলছে। অসভ্য! ওকে কী ডেয়ার দিয়েছিলাম সেই গল্প অন্যদিন করব। আমি ভাবছি আজকের কথা। এই কাজটা আমি কীভাবে করব? কত আশা নিয়ে ছিলাম, ক্রাশ আমায় নিজে প্রপোজ করবে। প্রেম হবে, বিয়ে হবে, সংসার হবে। তা বোধ হয় আর হবে না!

‘এত কী ভাবছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? যতই ভাবিস লাভ হবে না কিছু। ডেয়ার পূরণ করতেই হবে।’ বলল তিথি। তিথির সঙ্গে তাল মেলাল আমার বাকি বন্ধু নামক শত্রুরাও।

আমি কটমট করে বললাম,’করব, করব। আমি কি এত ভীতু নাকি? তবে মনে রাখিস, আমার না হওয়া প্রেমটা ভেঙে যাওয়ার জন্য দায়ী তোরাই থাকবি। কোনোদিন ভালো হবে না তোদের।’

‘তোর মতো বান্ধবী থাকলে এমনেও জীবনে ভালো কিছু আশা করা যায় না। বেশি দেরি করলে কিন্তু আজ আর তার সাথে দেখা হবে না।’

কেমন বান্ধবী দেখলেন আপনারা? আমায় কাঁদায় ফেলে এমন ভাব করছে যেন, ওদের পায়ে কাঁদা লেগেছে। যাগকে সেসব। এখন ক্রাশকে কীভাবে থাপ্পড় দেবো বলুন তো? থাপ্পড় দিলে প্রেম হওয়ার সম্ভাবনা একদমই থাকবে না। তাছাড়া এভাবে হুট করে থাপ্পড় দেওয়ার মানে হয় বলেন? আচ্ছা থাপ্পড় না দিয়ে যদি চুমু দেই তাহলে কেমন হয়? হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলাম গিয়ে বলব,’একটা চুমু খাই আপনাকে?’ ইয়াক ছিঃ! কী রকম সস্তা আবদার। ইংরেজিতে বলব,’আই ওয়ান্না কিস ইউ?’ উহ্ না! খুবই বেহায়াপনা মনে হচ্ছে। উনি আমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে এটা ভেবেই খারাপ লাগছে। ডেয়ার বরং বাদ দিই। এবার না হয় হার মেনে নিলাম। কী বলেন?

আমার হার মানার কথা বলার আগেই তিথি আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,’ঐযে রুদ্র ভাইয়া আসছে।যা তাড়াতাড়ি।’
‘ইয়ে..মানে একটা কথা ছিল তিথি।’
‘কথা পরে শুনব। আগে ডেয়ার পূরণ কর। যা।’
এক প্রকার ঠেলেঠুলেই আমায় পাঠিয়ে দিয়ে ওরা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। এদিকে ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। শরীরে জ্বরও মনে হয় চলে এসেছে। রুদ্র পার্কিংলটের বিপরীতে থাকা একটা বেঞ্চিতে বসল। বেঞ্চের সাথে লাগানো একটা রঙ্গন ফুলগাছ। পুরো গাছটিতে থোকা থোকা লাল রঙ্গন ফুল ফুঁটে রয়েছে। মুখের মাস্কটা ঠিকঠাকমতো লাগিয়ে ধীরপায়ে আগানো শুরু করলাম। ঐদিনের পর রুদ্রর সঙ্গে সরাসরি আর দেখা হয়নি। আমিই তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। একবার দেখাতেই চেহারা মনে থাকার কথা নয়। তবুও রিস্ক নিতে চাই না বলে মাস্ক পরে নিয়েছি। যতই তার দিকে এগোচ্ছি ততই হৃদস্পন্দনের শব্দ প্রবলভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম। তখন দেখলাম কয়েকজন ছেলে রুদ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হ্যাংলা-পাতলা রোগা করে তালগাছের মতন লম্বা এক ছেলে অন্য একটি ছেলের শার্টের কলার ধরে রেখেছে।

আমি আর না এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাদের দূরত্বও এখন বেশি নয়। এখান থেকেই ওদের কথোপকথন আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। তালগাছের মতো লম্বা ছেলেটি বলল,’রুদ্র পাইছি শালারে। সেদিন কী বলছিল মনে নাই?’

রুদ্র আনমনে ফোন টিপছিল। হুট করে ফোনটা অফ করেই ঝড়ের বেগে থাপ্পড় বসিয়ে দিল মাঝখানের ছেলেটিকে। ছেলেটা কাচুমুচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেঁদে ফেলবে ফেলবে ভাব। রুদ্র বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,’শালা! সেদিন খুব তো পাওয়ার দেখিয়েছিলি। আমায় নাকি মারবি? মার দেখি আমায়। দেখি তোর গায়ে কত জোর!’

কথা শেষ করেই নাক বরবার দিল আরেক ঘুষি। খেয়াল করলাম আমার হাত-পা কাঁপছে। মানে সিরিয়াসলি? এই ছেলেকে আমি থাপ্পড় মারতে এসেছিলাম? তাও বিনা দোষে! রুদ্রর বাঘের থাবার মতো একটা থাপ্পড় যদি আমার গালে পড়ে তাহলে তো আমি এখানেই কাইৎ! আল্লাহ্ বাঁচিয়েছে যে এই ঘটনাটা আগেই ঘটেছে। নয়তো নবনী তুই আজকে মরতি। ছেলেগুলো চলে গেল। রুদ্র ঘুরেফিরে তাকাতেই আমি সঙ্গে সঙ্গে উল্টো পথে হাঁটা শুরু করি। তখনই পেছন থেকে ওর ডাক শুনতে পাই,

‘এই মেয়ে এই? হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। এদিকে এসো তো।’
আমার হাঁটু হিড়হিড় করে কাঁপছে! নবনী রে তুই বোধ হয় আজ শেষ! কেন ডাকছে সে?

চলবে….

মধুরেণ সমাপয়েৎ পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#মধুরেণ_সমাপয়েৎ
#১২তম_পর্ব

কাজী সাহেব তার কাছে বিয়ের সব কথা বলে জিজ্ঞেস করে,
– আপনি কি এই বিয়েতে রাজী, রাজী থাকলে বলুন কবুল

তখন প্রণয় কানে কানে এসে কিছু একটা বলে সাফওয়ানকে। প্রণয়ের কথাটা শুনেই সাফওয়ান বলে উঠে,
– সত্যি?
– হু, মাত্র সুহানা বললো

কাজী সাহেব পুনরায় একই কথাই বললেন,
– আপনি কি এই বিয়েতে রাজী, রাজী থাকলে বলুন কবুল

মুচকি হেসে সাফওয়ান বলে উঠে,
– কবুল

সবাই একসাথে “আলহামদুলিল্লাহ” বলে উঠে। ইফাদ এক কোনায় দাঁড়িয়ে ম্লান হাসি হেসে বেরিয়ে যায়। রাতের একা আকাশে আজ তাকে একাই হাটতে হবে। নিজের সামান্য দায়িত্বহীনতার জন্য সবচেয়ে দামী জিনিস যে হারিয়ে ফেলেছে সে। আয়াতের প্রতি তার ভালোবাসাতে বুঝি অনেক বড় ফাঁক থেকে গেছে, তাইতো আজ সে অন্য কারোর হয়ে গেছে। সেদিন তাই স্পষ্ট তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো আয়াত।

সেদিন,
– জানো তো কতোটা ভালোবাসি তোমায়, সাফওয়ান যদিও আমাকে সব বলেছে তবুও তোমাদের বিয়ের কথাটা শুনে পাগল পাগল লাগছিলো। সরি বাবু, আর হবে না সরি।

নিজের থেকে ইফাদকে সরিয়ে একটু দূরে দাঁড়ায়, ইফাদের চোখে চোখ রেখে বলে,
– সেদিন যখন আমার তোমাকে সব থেকে বেশি দরকার ছিলো তুমি তখন আমার পাশে ছিলে না ইফাদ, ফোন হারিয়েছিলো কিন্তু পৃথিবীর উপর থেকে ফোন তো শেষ হয়ে যায় নি। অথচ তুমি আমাকে একটা বার জানাও নি। আমি পাগলের মতো তোমায় খুজেছি। আমি তোমাকে দোষ দিবো না ইফাদ। তোমার সাথে সেই মূহুর্তে যেটা জরুরি মনে হয়েছে তুমি করেছো। কিন্তু আমি তোমায় আর ভালোবাসি না ইফাদ। এতোদিন আমি কনফিউশানে ভুগেছি কেনো আমি বারবার সাফওয়ান ভাই এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছি। আজ আমার কাছে সেটা পানির মতো পরিষ্কার। আমি তাকে ভালোবাসি, প্রচুর ভালোবাসি। থ্যাংক উ আমার সামনে আবার আসার জন্য। নয়তো আমি নিজের মনকে বুঝতেই পারতাম না। ভাবতাম, ভুল করছি; কনফিউজড থাকতাম। কিন্তু আজ আমার কনফিউশান ক্লিয়ার হয়ে গেছে। থ্যাংক উ। তুমি অনেক ভালো একটা মানুষ; আজ যদি তোমার সাথে আবার জড়িয়ে পড়তাম তবে সেটা তোমার বা আমার কারোর জন্যই ভালো হতো না। কারণ আমি তোমার স্বচ্ছ থাকতাম না। আমার মনে তো এখন অন্য কারোর রাজত্ব। আমাকে ক্ষমা করে দিও ইফাদ। আই এম সরি। আই এম সরি। কিন্তু আমি সাফওয়ান ভাইকে ভালোবাসি। প্রচুর ভালোবাসি, সরি।

বর্তমান,
ইফাদের চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছে। সে যে আজ নিঃস্ব, তবে একটাই সান্তনা আয়াত তাকে ঠকায় নি। তার কাছে নিজেকে স্বচ্ছ রেখেছে। এখন মন তো কখন কাকে নিজের সিংহাসনে বসিয়ে দেয় কেউ জানে না!

রাত ১২টা,
খুব তোড়জোড় করে শেষমেশ বাসর ঘরে ঢুকার সুযোগ পেলো সাফওয়ান। ঘরে ঢুকে দেখলো, মোমের আলোয় ঘরটাকে নতুন বউ এর নেয় সাজানো হয়েছে। খাটটা পুরো সাদা আর লাল গোলাপের মোড়া, এর মাঝে লাল শাড়ি পড়ে ঘোমটা দিয়ে এক রূপবতী বসা। চাদের আলো জানালার ফাক দিকে ঘরে ভেতর উপসে পড়ছে। রুপবতীটি যে সাফওয়ানের মায়াবতী। যার নেশায় আজকাল সে মত্ত থাকে। ধীর পায়ে আয়াতের পাশে গিয়ে বসে। সাফওয়ানের উপস্থিতি আয়াতের হার্টবিট বাড়িয়ে তুলছে। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তার। আলতো করে তার হাতে নিজের হাত রেখে মজার ছলে সাফওয়ান বলে,
– ইফাদ, চলে গিয়েছে। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো ওর সাথেই চলে যাবে। সমস্যা নেই আমি একটা লয়ারের সাথে কথা বলে ছ মাস পর আমাদের ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করে ফেলবো
-………

আয়াতকে চুপ থাকতে দেখে আলতো হাতে ঘুমটা সরায় সাফওয়ান। দু হাতে আয়াতের মুখ আলতো করে ধরে উচু করে সে। আয়াতের চোখে পানি চিকচিক করছে। আয়াতের চোখে চোখ রেখে শান্ত কন্ঠে বলে উঠে,
– তুমি তো এটাই চেয়েছিলে, তবে আজ চোখে পানি যে?
– আপনি কি সত্যি বুঝেন না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করেন?

কাঁপা কাঁপা গলায় আয়াত বলে উঠে।
– কি বুঝবো? তুমি যদি বুঝিয়ে না বলো বুঝবো কিভাবে?
– সব কিছু বলে বুঝাতে হয়।
– হয় বই কি! কিছু জিনিস বলে করে বুঝাতে হয়। এতোদিন তো তুমি যা বলেছো আমি তাই বুঝেছি। দেখো না বিয়ে ভাঙ্গার কথা বলেছো, আমি সেটার চেষ্টা করেছি। ঢাকা যেয়েই উকিলের সাথে….

কথাটা শেষ না হতেই সাফওয়ানের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো নিজ ঠোঁট জোড়া দিয়ে। ঘটনার আকর্ষিকতায় সাফওয়ানের মাথা পুরো ফাঁকা হয়ে গেছে। আয়াতের পক্ষে এমন একটা সাংঘাতিক কাজ করা সম্ভব এ যেনো ধারণার বাহিরে ছিলো সাফওয়ানের। বেশকিছুক্ষণ পর সাফওয়ানের ঠোঁট জোড়াকে মুক্তি দেয় আয়াত। শাড়ির আঁচলটা মাজায় বেধে সাফওয়ানের কলার চেপে ধরে রাগী গলায় বলে,
– আরেকবার যদি ডিভোর্সের কথা শুনেছি তো দেখবেন আমি করি। ফাজলামি পাইছেন? এতো যখন আমাকে অপছন্দ তাহলে সেই রাতে কেনো আমাকে বলেছিলেন ভালোবাসি? ইফাদের সাথে চলে গেলে খুশি হতেন বুঝি। আপনি কি ভেবেছেন এতো সহজে আপনাকে মুক্তি দিবো। সারাজীবন এভাবেই আমাকে সহ্য করতে হবে। আর মরে গেলে ভুত হয়ে আপনার ঘাড়ে চেপে বসবো কিন্তু আমার থেকে আপনার নিস্তার নেই।

বলতে বলতেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে আয়াতের। প্রচুর কান্না পাচ্ছে তার। লোকটা এমন কেনো? যদি দূরে ঠেলে দেবার ইচ্ছা ছিলো তবে কেনো কাছে টেনে নিয়েছে। সাফওয়ান মুচকি হেসে হ্যাচকা টানে তাকে বুকে আগলে ধরলো; কানে মুখ লাগিয়ে বললো,
– এবার নিজ ইচ্ছায় আমার কাছে এসেছো। এবার যদি তুমি চাইলেও আমি তোমাকে ছাড়বো না। এইভাবে শক্ত করে নিজের কাছে রেখে দিবো।
– সত্যি? তাহলে এতোক্ষণ যে
– ওইটা একটা ছোট্ট শাস্তি ছিলো, আমাকে এই তিনদিন কষ্ট দেওয়ার জন্য। আমি তো সত্যি সত্যি বিয়েটা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম; কিন্তু আজ যখন প্রণয় কানে কানে বললো, তুমি নিজ থেকে ইফাদকে ফিরিয়ে দেবার কথা সুহানাকে জানিয়েছো আমার ওশান্ত মন শান্ত হয়ে গিয়েছিলো। তাই দেরি না করে কবুলটা বলে দিয়েছি।
– আপনি খুব খারাপ।
– এখনো তো কিছুই দেখাই নাই এখনই খারাপ হয়ে গেলাম?
– আমি কিচ্ছু দেখবো না
– তা বললে তো হবে না এখন সে অনেককিছু দেখার বাকি রয়েছে
– কি?
– আসো আমার সাথে।

বলেই কোলে তুলে নিলো আয়াতকে। সাফওয়ানের রুমের ভেতরে একটি ছোট স্টোর রুমের মতো জায়গা রয়েছে যেখানে সাফওয়ান বাসায় থাকতে ড্রয়িং করতো; যাকে সে তার কল্পনারাজ্য বলে। তার সকল সৃষ্ট সকল শিল্প সেখানে মজুত। আয়াতকে কোলে করে তার কল্পনারাজ্যে নিয়ে যায় সে। একটি চেয়ারে তাকে বসিয়ে সামনে থাকা সকল ড্রয়িং বোর্ডের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেয়। আয়াতের চোখ যেন বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। সব গুলো ক্যানভাসে তার পোর্ট্রেইট। রংতুলির আচড়ে আকা এক একটি জীবন্ত আয়াত তার সামনে। অজান্তেই নোনা জলের ভিড় জমেছে চোখে তার। এখনই চোখগুলো তাদের মুক্তি দিবে যেনো। ধরা গলায় বলে উঠে,
– আপনি তো বলেছিলেন আমার চেহারা ক্যানভাসে তুলার যোগ্য নয়।
– নয় ই তো, তাই তো শুধু ক্যানভাসেই থাকবে এই চিত্র।
– তাই বুঝি?
– হু, তাই তো। এই সারপ্রাইজটা তোমাকে দেওয়ার ছিলো

বলে আয়াতের কপালে উষ্ণ ঠোঁটের পরশ দেয়।
– আজ রাতে তোমাকে ভালোবাসার অধিকার দিবে আয়াত?
– আমি তো মানা করি নি।
– তবে একটু বেহায়া হতে দোষ নেই বলো।

বলেই পুনরায় কোলে তুলে নেয় আয়াতকে। আয়াতকে বিছানায় শুইয়ে রুমের মোম গুলি নিভিয়ে দেয় সে। রাতের নীরবতা, চাদের কালো সাক্ষ্ণী হলো তাদের মধুর মিলনের। কিছু আর্তনাদ, কিছু উষ্ণ নিঃশ্বাসের মধ্য দিয়ে সুখ কুড়াতে ব্যস্ত তারা। আজ তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেলো।

তিন বছর পর,
হাসপাতালের ওপারেশন থিয়েটারের বাহিরে পায়চারি করছে সাফওয়ান। টেনশনে শ্বাস আটকে যাচ্ছে তার। আয়াত এবং তার পরিবারের সবাই সেখানে উপস্থিত। বারবার সান্তনা দিচ্ছেন রামিম সাহেব। কিন্তু কিছুতেই সাফওয়ানকে শান্ত করতে পারছেন না তিনি। আজ যে আয়াতের ডেলিভারি, এক ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো কোনো খবর নেই। এমনিতেই আয়াতের অবস্থা সিরিয়াস ছিলো, আর্লি লেবার পেইন উঠেছে মাত্র সাত মাস চলছে প্রেগ্ন্যাসির। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে সাফওয়ানের। থিয়েটারে ঢুকার আগে আয়াত বলেছিলো,
– যদি এবার ফিরে না আসি, তবে জেনে রেখো খুব ভালোবাসি তোমায়।

কথাটা মনে করতেই চোখ ভিজে আসছে সাফওয়ানের। ঠিক তখনই ডক্টরের আগমণ ঘটে, ছুটে গিয়ে কাছে যেতেই প্রথম প্রশ্ন ছিলো,
– আয়াত কেমন আছে ডক্টর?
– কংগ্রেচুলেশন, আপনার জমজ মেয়ে হয়েছে।
– আচ্ছা, আয়াত কেমন আছে?
– নার্স মেয়েদের নিয়ে আসছেন, আপনার মেয়েরা প্রিম্যাচ্যুর কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।আপনি কি খুশি নন মি. সাফওয়ান?
– আরেহহ ধুর, আমার ওয়াইফ কেমন আছে সেটা বলেন? দম আটকে যাচ্ছে আমার।
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন, একটু উইক। এক সপ্তাহ রেস্ট করতে হবে।

ভয়ে ভয়ে ডাক্তার বলে কথাগুলো। আয়াত ঠিক আছে শুনতেই সাফওয়ান খেয়াল করলো, ডাক্তার বলেছিলো তার মেয়ে হয়েছে তাও জমজ। খুশিতে পাগল প্রায় হয়ে গেছে সে। নার্স যখন মেয়েদের নিয়ে এসেছে, সাফওয়ানের কাছে মনে হয়েছে ছোট দুইটো আয়াত তার কাছে নিয়ে এসে নার্স। দুজনকে একসাথে কোলে নিয়ে নিলো সে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সুখী ব্যক্তি সে।

তিন ঘন্টা পর,
আয়াতের জ্ঞান ফিরলে দেখে সবাই ঝুকে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সবার মাঝে সে তার সাফওয়ানকেই খুজে যাচ্ছিলো। ধীর কন্ঠে শারমিন বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
– সা…সাফ…ওয়ান
– ওইযে আসছে।

সবার পেছন থেকে সাফওয়ান বেরিয়ে এলো, নার্সরা একে একে দুই মেয়ে আয়াতের পাশে রাখে। আয়াতের চোখে পানি চিকচিক করছে। ভেবেছিলো হয়তো এই খুশি তার দেখা হবে না। সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলে সাফওয়ান আলতো হাতে আয়াতকে উঠে বসিয়েছে। বাচ্চাগুলোর একজনকে আয়াতের কোলে দিয়ে আরেকজনকে নিজের কোলে নেয় সে। আয়াতের পাশে বসলে আয়াত ধীরে তার মাথাটা সাফওয়ানের কাধে এলিয়ে দেয় আর বলে,
– কার মতো হয়েছে বলো তো?
– তোমার মতো, থ্যাংক ইউ ফিরে আসার জন্য।
– আল্লাহ চেয়েছেন তাই ফিরে আসতে পেরেছি, তুমি খুশি তো।
– খুব খুব খুশি। তবে আমরা আর এই বাচ্চা নেওয়ার কথা ভাববো না।
– কেনো?
– আমার দম বন্ধ লাগছিলো তোমাকে ছাড়া। যদি কিছু হয়ে যেতো? আমি কি করতাম তখন? পাগল হয়ে যেতাম সত্যি বলছি।
– তুমি সত্যি পাগল।
– ওদের নাম কি রাখবে?
– ভাবি নি
– আমি বলি আল্পনা এবং কল্পনা
– ধুর এই আধ্যাত্মিক নাম আমি রাখবো না।
– কেনো সুন্দর তো
– না বলেছি, মানে না
– আমি ওদের বাবা
– তো?
– মানে কি!!

এভাবেই আবার খুনসুটিতে মেতে উঠলো আয়াত এবং সাফওয়ান। তাদের জীবনে এই অধ্যায়ের মধুরেন সমাপয়েৎ ঘটেছে। তাদের ভালোবাসার মধুরেন সমাপয়েৎ ঘটেছে। থাকুক তারা তাদের মতো সুখে আজীবন

||সমাপ্ত||

মুশফিকা রহমান মৈথি