Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1408



প্রিয় তুমি পর্ব-১০

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১০

শেফা মনে মনে প্রচুর হাসলো। পূরব যে এতোদিন দেশেই ছিলোনা আর সেহেরের খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর সেহেরকে জানাতে ইচ্ছে করলোনা। থাকুক না ব্যাপারটা গোপন। সময় হলে হয়তো পূরবই বলবে। শেফা হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘তো তুই যে ওনাকে পছন্দ করিস সেটা বলছিস ওনাকে?’

সেহের হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি? ওনাকে পছন্দ করি? কবে, কখন এসব বললাম শেফা? এসব ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবিনা৷ যত্তসব…’

‘কেন?’

‘ওনারা কতো বড়লোক। আর আমি? ছিঃ! ওনাদের সাথে আমার তুলনা? কখনোই না। তাছাড়া ওনাকে আমার এমনিতেই অপছন্দ।’

‘এরকম ড্যাশিং একটা ছেলেকে এরকম বলতে পারলি?’

সেহের রেগে বলল, ‘ড্যাশিং হলে কী হবে? স্বভাব একদম ভালোনা…’

‘তুই কীভাবে জানলি ওনার স্বভাব ভালোনা?’

‘ভালো হলে কী এসব করতো? কোনো অপরিচিত মেয়ের বাসায় এসে ঢিল ছুঁড়তো? নাকি সারারাত দাঁড়িয়ে থাকতো? আর কথা শুনলে তো গা জ্বলে যায়। আর কেমন সন্ত্রাসী সন্ত্রাসী ভাব চেহারায় দেখলেই ভয় লাগে। মনে হয় এক্ষুনি গিলে খেতে আসবে।’

‘একবার বলিস চোর, এখন বলছিস সন্ত্রাসী? কিন্তু যা-ই বলিস না কেন ওনার ইউনিক লুকটা আমার বেশ পছন্দ। আহা ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে হ্যাট পরে, আর এটিটিউডের কথা কী বলবো, উফ..জাস্ট মাইন্ড ব্লোয়িং!’

‘তোর মাথা।’

‘আর কিছুসময়। তারপর ওনার বউ হলে সারাদিন চোর চোর বলিস৷ দেখব তখন এতো কিউট একটা ছেলেকে কেমনে তুই বাজে কথা বলিস!’

সেহের লজ্জা পেয়ে গেলো। ওর মনে যে পূরবের জন্য অনুভূতি নেই তা কিন্তু নয়৷ এতোদিনে পূরব ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন রাত্রে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ও শুধু সুন্দর লোকটাকেই দেখতো। মশার কামড় খেয়ে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো লোকটা? কিন্তু আজকাল আর আসেনা কেন? হয়তো রুচি বদলে গেছে তাই। লোকটা কি জানে ওর জন্য সেহের কতোরাত লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে? ভালোবাসে কিনা জানেনা, ভালো তো লাগে! কিন্তু ও তো একটা গরিব ঘরের এতিম মেয়ে। পূরবের স্ট্যাটাসের নয়। ওদের মিল হওয়াটা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। তবুও সেইরাতে যখন প্রথমবারের মতো প্রেমে পড়ার কথাটা সেহেরকে বলেছিলো পূরব, এক সমুদ্র ভালোলাগা হঠাৎ করেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলো লোকটার প্রতি! সেই থেকে অপেক্ষার শুরু!

শেফার কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ভান করে সেহের চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে তোর।’

‘এরকম বলতে পারলি? আমি কী বারোভাতারি মেয়ে? আমার একজন হলেই যথেষ্ট। আর সেটা পেয়েও গেছি।’

সেহের বলল, ‘জিসান ভাইকে মোটামুটি ভালোই মনে হয়। ওনার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?’

‘মা আর বোন। বোন তো মাকে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে।’

‘কেন?’

‘পড়াশোনা করে তো। হোস্টেলে থাকতে চায়না, তাই ওনার বোনের কাছে আম্মাকে পাঠিয়েছে।’

‘ওহহ। তাই বল। কোথায় পড়ে?’

‘চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে।’

‘অনেক দূর!’

‘হুম।’

সেহেরের সাথে সারারাত অনেক গল্পই হলো শেফার। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো৷ ওদিকে পূরব ওর বাবাকে সেহেরের কথা বলতে গিয়েও বলতে পারলোনা। কারণ ইরফান আহমেদের জরুরি একটা মিটিং পড়ে গিয়েছে হঠাৎ, তাই ল্যাপটপ নিয়ে ঘরে চলে গিয়েছেন৷ পূরব আর বাবাকে ডিস্টার্ব করতে চাইলোনা। জিসানকে সোফায় গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে পূরব এগিয়ে গেলো। দুই-পা ওপরে তুলে বসলো। হাতঘড়ির স্ট্রিপটা খুলতে খুলতে পূরব গম্ভীর গলায় বলল, ‘আব্বু চলে গেল?’

‘কী বলবি আমায় বল না?’

‘তুই আমাকে জন্ম দিছোস? আমার তো আব্বুর পারমিশন লাগবে, তোর না।’

জিসান হেসে বলল, ‘ভাবসাব দেখেতো মনে হচ্ছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবি।’

‘অবশ্যই ইম্পোর্টেন্ট কথা বলব। আমি ফালতু কথা বলিনা, ফালতু কাজও করিনা৷ যা করি সেটা নিজের বা অন্যের প্রয়োজনে করি। আর সেটা তুই খুব ভালো করেই জানিস। বাই দ্যা ওয়ে, তুই যে আমার সাথে ছলনা করিস সেটাতো আমি জানতাম না। নইলে এত ইম্পোর্টেন্ট একটা কথা তুই আমাকে একবারও জানালি না? এই তুই আমার জানের জিগার দোস্ত?’

জিসান অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘কোনটার কথা বলছিস? কি বলিনি আমি?’

পূরব ধমক দিয়ে বলল, ‘তোর সাথে শেফার সম্পর্ক আছে এটা জানাসনি কেন আমাকে?’

জিসান বোকার মতো তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘কে বলেছে তোকে?’

‘কেন? শেফা নিজে বলেছে!’

জিসান লজ্জা পেয়ে গেলো। তার জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কথাটা সে পূরবকে বলেনি শুধুমাত্র লজ্জার কারণে। এমনিতে সব বিষয় শেয়ার করে, কিন্তু এই ব্যাপারটা জানাতে গিয়ে বারবার ওর গলায় কথা আটকে গিয়েছে। শব্দ ভুলে গিয়েছে। পূরব ওকে আর কিছু বললোনা। ছোট্ট করে ‘কংগ্রাচুলেশনস’ জানালো। জিসানও হাসলো। পূরবকে কথাটা বলতে পারছিলোনা, ও যখন নিজেই জেনে গিয়েছে ভালোই হলো৷ প্রেম, ভালোবাসা বিষয়টা খুব সেন্সেটিভ মনে হয় জিসানের কাছে৷ এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করাটা ওর খুবই অপছন্দ। ভালোবাসা হলো দুটো মানুষ আর দুটো পরিবারের মিলন। দুনিয়া ভুলে সারাদিন ফোনে কথা বলা বা অন্যান্য পাগলামো করাটা নেহায়াতই বোকার কাজ। কেউ তোমার হবার হলে সে এমনিই তোমার হবে। ঠিক এমন সময় ফোন বেজে উঠলো জিসানের।

জিসান ওর মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে নিজের ঘরে চলে গেলো। পূরব বেশ ক্লান্ত ছিলো তাই নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। এসির টেম্পারেচার বাড়তি, তবুও কুলকুল করে ঘামছে ও। ইচ্ছে করছে এক ছুটে সেহেরের কাছে চলে যেতে। কিন্তু ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেরুনোটা ঠিক হবেনা৷ দু-রাত ঘুমাতে পারেনি। আজ ঘুমিয়ে শরীরটাকে ঠিক করে নিতে হবে। মাথাটা ভার হয়ে আছে। পেটে ক্ষিধেয় ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। কি আশ্চর্য! খেয়েই তো এলো। পূরব ওঠে নিচে চলে গেলো। ফ্রিজ থেকে নুডুলসের বাটিটা বের করলো। খুব ঠান্ডা। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও তা গরম করে ঘরে চলে গেলো। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লো। সারারাত ভেবে ভেবে একটা প্ল্যান বের করলো। ওই মাহিমকে একটা শাস্তি দিতে পারলে তবেই ওর শান্তি! যা হবার হবে, এর একটা বিহিত করতেই হবে। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমিয়ে পড়লো পূরব।

পরদিন সকালে ইরফান সাহেবকে ফ্রি পাওয়া গেলো। পূরব সরাসরি বলল, ‘এখন কথা বলতে পারবে?’

ইরফান সাহেব বললেন, ‘হুম।’

‘আব্বু আমি বিয়ে করতে চাই।’

ওনি অবাক হয়ে বললেন, ‘কাকে?’

‘তোমার খুব প্রিয় একটা মানুষকে।’

ইরফান আহমেদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার প্রিয়? কে সে?’

‘সেহের!’

‘সত্যি?’

‘হুম। এখন বলো তুমি কী চাও!’

‘ওকেই পছন্দ তোমার?’

‘হ্যাঁ।’

ইরফান সাহেব হেসে বললেন, ‘তাহলে আমার প্রবলেম নেই। আমি বরণ করতে রাজি!’

পূরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘থ্যাংকস আব্বু।’

ইরফান সাহেব যে রাজি হবেন সেটা জিসান, পূরব দুজনেই জানতো। সকালের নাস্তা সেরেই জিসানকে নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো পূরব। ও খুব ফুরফুরে মন নিয়ে অফিস করলো। আজকের দিনটা এতো সুন্দর কেন!! বারোটার দিকে অফিস শেষে সোজা চলে গেলো সেহেরের ভার্সিটিতে। এখন ওদের ক্লাস শেষ হবে। ও গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। তারপর জিসানকে ফোন লাগালো। কয়েকবার রিং হবার পর জিসানের কন্ঠ শোনা গেলো।

‘হ্যালো দোস্ত?’

‘হ্যাঁ তুই কোথায়?’

‘আমিতো অফিসে। তুই কই?’

‘আমি সেহেরের ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

‘কয়েকটা গুন্ডাপান্ডা ধরণের ছেলে জোগাড় করে দিতে পারবি?’

‘হঠাৎ গুন্ডাপান্ডা কেন?’

‘পারবি কিনা সেটা বল।’

‘পারবো। কিন্তু কেন সেটা তো বল?’

‘ফাহিম না কি যেন নাম ওই ছেলেটার? আরে তুই যার কথা বলেছিলি ওটাকে পিটাতে হবে।’

‘ফাহিম না মাহিম। কিন্তু মারবি কেন? তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে?’

পূরব রেগে বলল, ‘তুই জেনেও না জানার ভান করছিস? এই তুই আমার বন্ধু? ড্যামেট…’

জিসান বলল, ‘ওকে ওকে। আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করিসনা। শেষে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়।’

‘ডোন্ট ওরি!’

পূরব ফোন রেখে দিলো। মাথা থেকে হ্যাটটা খুলে স্টিয়ারিংয়ের ওপর রাখলো। কালো চুলগুলো হালকা বাতাসে দুলছে। এখন যদি কেউ জানতে পারে ইফরাজ পূরব এখানে এসেছে, তাহলে মুহূর্তেই হুলস্থুল কান্ড লেগে যাবে৷ সেজন্য বাইরে বেরুলে ও সবসময় সানগ্লাস আর হ্যাট পরিধান করে থাকে৷ যদিও এটা এখন ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর প্রিয় মানুষটার দেখা পাবে। যাকে সে কোনোভাবেই হারাতে চায়না। সেই অসাধারণ রমণীটিকে সারাজীবন প্রিয় তুমি করে রাখবে!

(বোনাস অংশ)

ক্লাস শেষে মাহিম যখন বেরিয়ে এলো তখন ফাঁকা জায়গা দেখে কয়েকটা ছেলে ওকে ঘিরে ধরলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেগুলো ওকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। প্রায় দশমিনিট এভাবে মারার পরে ওরা চলে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো, আমাদের ভাবির কাছ থেকে অলওয়েজ দশ হাত দূরত্ব বজায় রাখবি। নইলে পূরব ভাই তোকে দুনিয়া থেকে আউট করে দেবে। পূরব কে চিনছিস তো? ইফরাজ পূরব! আর তার হবু বউ সেহের। তার সাথে আজ থেকে তোর মেলামেশা যেন না দেখি। বলেই ছেলেগুলো চলে গেলো। মাহিম হতভম্ব। ও বুঝতে পারছেনা হঠাৎ করে কোথা থেকে কারা এসে ওকে মেরে চলে গেলো। তাও সামান্য এক কারণে। যেখানে ওর কোনো দোষই নেই। একপর্যায়ে ব্যথায় ও অজ্ঞান হয়ে গেলো। সেহের, শেফা, রিমা এই খবর শুনে দ্রুত ছুটে এলো। কমন রুমে নিয়ে ওকে পানি ছিঁটিয়ে জ্ঞান ফিরানো হলো। সবাই কি হয়েছে জানতে চাইলে মাহিম পুরো ঘটনা খুলে বললো। শেফা, রিমি হাসতে হাসতে বলল, ‘কী জেলাস রে পূরব ভাইয়া৷ মাই গড! সেহের তুই পাইছিস..’

‘কী পেয়েছি?’

‘বলছিলাম না পূরব ভাই তোকে পছন্দ করে?’

সেহের মাথা নিচু করে মাহিমকে বলল, ‘দুঃখিত আমি। আমার জন্য এসব হলো। আমি এটা চাইনি।’

মাহিম হাসতে হাসতে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘এরকম প্রেমিক তো জীবনে দেখিনি। প্রেমিকার সাথে কথা বললেও মাইর? ইউ আর ভেরি লাকি গার্ল সেহের। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কিছু মনে করিনি। তোমার অপ্রস্তুত হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা অলওয়েজ বেস্টফ্রেন্ড থাকবো। আমারও এবার থেকে কঠোর প্রেমিক হতে হবে, আমিও তো চাইনা আমার প্রিয় মানুষটা কারো সাথে কথা বলুক, আফটার অল আমিও জেলাস হই। হাহা।’

রিমি কড়া চোখে মাহিমের দিকে তাকালো। সেহের খুব লজ্জ্বা পেলো। মাহিমের কাছে স্যরি চেয়ে বাসায় ফিরে এলো। এসবের মানে কী? পূরব সেহেরকে ভালোবাসে? তাহলে সামনে এসে বলেনা কেন? আর এটাও বুঝি সম্ভব? আকাশ আর পাতালের কোনোদিনও বুঝি মিল হয়? কোথায় রাজপুত্র আর কোথায় ঝি’য়ের মেয়ে। হাস্যকর হলেও সেহেরের মনে একটু প্রশান্তির বাতাস বয়ে গেলো। সঙ্গে খুব রাগ আর অভিমান হলো। ওর জন্য শুধু শুধু মার খেলো মাহিম! আসুক না বিয়ের কথা বলতে, মজা দেখিয়ে দেবে সেহের! দুটো কড়া কথা যদি না শুনিয়েছে তাহলে ওর নামও সেহের নয়! সেহেরের মনে প্রিয়ের জায়গা করে নেওয়াটা এতোটাও সহজ নয় কিন্তু, এটাও জানা উচিৎ লোকটার। সবকিছুতে এতোটা সিনেমাটিক হলে চলে না। বাস্তব বলে কিছু তো আছে। কই, নিজে থেকে এসে তো বলেনি ভালোবাসি৷ রাস্তার মানুষকে পিটিয়ে ভালোবাসা জানান দেওয়াটা কেমনতর কাজ? সাহস থাকলে সামনে এসে বলুক, হুহ!

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০৯

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯

ব্যবসায়িক কাজের সূত্র ধরে পূরবকে কিছুদিনের জন্য ইন্ডিয়া যেতে হয়েছিলো। সেই দিনগুলোতে সেহেরের উপর সর্বক্ষণ নজর রাখার মতো পূরব যখন আর কাউকেই পাচ্ছিলোনা তখন সেহেরের রুমমেট সুমা আর শিলাকে খুব করে অনুরোধ করলো ওর করা প্রতিটি কাজের খবর টাইম টু টাইম ওকে জানাতে। আর ভার্সিটিতে যা কিছু হবে সেগুলো জানতে জিসানকে দিয়ে শেফাকে রাজি করিয়েছে। শেফা আর রিমি রাজি হতে চাইছিলোনা সেহেরের অগোচরে। কিন্তু পূরবের অনুরোধ ওরা ফেলতে পারলোনা। পূরব শুধুমাত্র তার ধানিলংকাটার নিউজ জানতে চায়। সে কী করছে, কি খাচ্ছে, কোথায় গিয়েছে এভরিথিং! এতোদিনে পূরবের এসব অস্বাভাবিক আচরণ আর সেহেরের প্রতি অতিরিক্ত কেয়ারিং দেখানোর ফলে জিসান, রিমি, শেফা, সুমা, শিলা বুঝেই গিয়েছে সে সেহেরের প্রতি দুর্বল। অবশ্য ওরা মনে মনে খুশিই হলো। সেহের ওর মতোই কাউকে ডিজার্ভ করে। যাইহোক, পূরব ইন্ডিয়া যাওয়ার পরে সবাই ওর কথামতো সেহেরের খোঁজখবর দিতে থাকলো।

ভার্সিটির একটা ছেলের সাথে সেহেরের বন্ধুত্ব হলো। ছেলেটার নাম মাহিম। খুবই ভদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সেহেরেকে পড়াশোনায় যথেষ্ট সাহায্য করে, বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। দুজনে মিলে একদিন তো শিশুপার্কে ঘুরেও এসেছে। এই খবর জিসান ফোন করে পূরবকে জানালো। ও রেগে আগুন। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কয়েকদিনের মধ্যে দেশে ফিরলো। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা সেহেরের ভার্সিটি রওয়ানা দিলো। এবং সেখানে পৌঁছে দেখলো জিসানের কথাই ঠিক। ছেলেটা সারাক্ষণ ওর সাথে থাকে। ক্লাসে পাশাপাশি বসে, অফ টাইমে মাঠে বসে গল্প করে। গিটার বাজিয়ে গান গায় বন্ধুমহলে। হাবভাবে বোঝাতে চায় সেহেরকে সে পছন্দ করে। সেটা সেহের না বুঝলেও পূরব বুঝতে পারলো। তখনই ওর অস্থিরতা বেড়ে গেলো। মন কু ডাকতে লাগলো, সেহের বুঝি আর তার হলোনা। ভালোবাসার অনুভূতির মতো মারাত্মক অনুভূতি দ্বিতীয়টি নেই। সেহেরের ব্যক্তিত্ববোধে মুগ্ধ পূরব নিজেকে আর আটকাতে পারলোনা যখন দেখলো ওরই সামনে দিয়ে অন্য কোনো লোক সেহেরের সাথে মেলামেশা করছে। ঠিক মেলামেশা নয়, কিন্তু সেহেরের প্রতি খুবই কেয়ার দেখাচ্ছে যা পূরব কোনোভাবেই মানতে পারছেনা। রাগে ওর শরীর ফেটে গেলো৷

কোনোমতে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরলো। জিসান আর ইরফান সাহেব ড্রইংরুমে বসে কথা বলছিলেন। ওকে হঠাৎ দেখে দুজনেই অবাক। কাজের লোক আব্দুল মিয়া চা- নিয়ে এলো। পূরব সোজা বাবার কাছে গিয়ে বসলো। ছেলের গম্ভীর চেহারা দেখে ইরফান সাহেব কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলেন। হালকা কেশে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ ফিরবে জানালে না কেন?’

‘এমনি।’

জিসান জিজ্ঞেস করলো, ‘তুই ফিরবি বললে তো আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিতাম।’

‘ম্যানেজার সাহেব জানতো। ওনি অফিসের গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।’

ইরফান সাহেব গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে? এরকম করছো কেন?’

পূরব বাবার কথায় মুখ তুলে চাইলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। তারপর সরাসরি বলল, ‘আব্বু আমি আজ একটা জরুরি কথা বলতে চাই।’

ইরফান আহমেদে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘কী কথা?’

‘তুমি কিন্তু না করতে পারবেনা।’

‘রিল্যাক্স। তার আগে তুমি মাথা থেকে হ্যাট খুলো। এরকম ইংরেজ সেজে থাকতে কতোক্ষণ ভালোলাগে?’

‘মোটেও ইংরেজ বলবেনা। আমার ভালোলাগে তাই পরি।’

জিসান হেসে বললো, ‘ভাই এতো ডেস্পারেট হয়ে আছিস কেন? বিপি লো করবে তো!’

পূরব ফুঁসে ওঠে বলল, ‘বিপি লো হয়ে মরে যাক।’

‘কী যে বলিস তুই৷ রেগে আছিস বলে যা তা বলবি নাকি? অফ যা!’

ইরফান সাহেব এবার বলে উঠলেন, ‘ওকে ওকে। ফ্রেশ তো হয়ে আসো। তারপর আরাম করে তোমার কথা শুনবো।’

পূরব ছোট্ট করে বলল, ‘ওকে।’

ওদের সাথে কথা বলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পূরব ঘরে চলে এলো। সানগ্লাস, হ্যাট, ওয়ালেট বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে তোয়ালে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো৷ শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ওর উগ্র মস্তিষ্ক তখন ভাবনায় মত্ত! নাহ, সেহেরের সাথে ওই মাহিমের চলাফেরা একদম মানায় না। সেহেরকে শুধু ওর সাথেই মানায়৷ সাধে কি সেহেরের বলা চোর কথাটা মেনে নিয়েছে? ভালোবেসেছে বলেই মেনেছে। তাই বলে ওর সাত খুন মাফ করে দেবে তা কিন্তু নয়৷ পূরব যেমন ভালোবাসতে জানে, তেমনি কীভাবে ভালোবাসাকে আগলে রাখবে তাও ভালোভাবেই জানে। মেয়েটার কতোবড় স্পর্ধা, পূরবকে আজ ভার্সিটিতে দেখেও এমন একটা ভাব করলো যেন সে দেখেইনি। পনেরোদিন ছিলোনা দেশে, তাই বলে এতোটা পরিবর্তন হয়ে যাবে? অন্য লোকের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাবে, আইসক্রিম খেয়ে নাকের পানি মুছবে অন্য লোকের রুমালে? কেন? পূরবের কী রুমাল নেই? দরকার হলে ওর শার্টে মুছুক, ওর হাতে মুছুক, মানা করেছে নাকি ও?? দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে পূরব দেওয়ালে একটা ঘুসি মারলো। ব্যথায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার যোগাড় হলেও মুখ দিয়ে “টু” শব্দটি পর্যন্ত করলোনা।

ওদিকে জিসান আর ইরফান আহমেদ চিন্তিতমুখে বসে আছেন পূরবের কথা শোনার আশায়। কি বলবে ও? আর এতো রেগেই বা আছে কেন? হলোটা কী ওর? দেখাই যাক কি বলতে চায়!

শেফা, রিমি, সেহের আর মাহিম আজ পুরোটা দিন একসাথে কাটিয়েছে। তিনজনের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। পূরবকে ওরা কেউই দেখতে পায়নি। সারাদিন হৈ-হল্লা করে কাটিয়ে মাহিম বাড়ি ফিরে গেলো। রিমিও চলে গেলো। শেফা অনেক জোর করে সেহেরকে ওদের বাসায় নিয়ে গেল। রাতে ঘুমানোর সময় শেফা জিজ্ঞেস করলো, ‘মাহিম্মা আর রিমির রিলেশনটা মনে হয় হয়েই যাবে, কী বলস?’

সেহের বলল, ‘মনে তো তাই-ই হয়! মাহিমের ভাবসাব ভালো ঠেকছেনা। রিমিকে দেখলেই তার নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করে।’

‘এটা আমিও খেয়াল করছি। মাহিমের আম্মা আবার রিমিকে খুবই পছন্দ করে। সেবার আমরা ওর বাসায় গেলাম না? তখন তো ওনি কী আহ্লাদীপনা করলেন।’

সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘কবে গেলি? বললি না তো।’

‘আরে সেদিন তুই ভার্সিটি শেষে টিউশনে চলে গেলি আর মাহিম্মা জোর করে আমাদেরকে ওর বাসায় নিয়া গেলো। তোকে বলতে ভুইলা গেছি।’

‘ওহহ। ওদের কথা বাদ দে। ওই জিসান ভাইয়ের সাথে তোর এতো ফুটুরফাটুর কীসের রে? তলে তলে টেম্পু চালাস না তো আবার?’

শেফা থতমত খেয়ে বলল, ‘মানে?’

সেহের আড়চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোরা প্রেম করোস তাইনা? কি ভাবছিস আমার চোখকে ফাঁকি দিবি আর আমি কিছু জানতেও পারবোনা?’

শেফা আহত গলায় বলল, ‘মোটেও না।’

‘মিথ্যা বলবি না একদম। তোর মোবাইলে ওনার এতো ম্যাসেজ কেন তাহলে? সেদিন তো দেখলাম বাংলা সিনেমার হিরোদের মতো তোকে “আই লাভ ইউ” ও লিখেছে। তোর আম্মাকে বলতে হবে!’

শেফা ভয় পেয়ে বলল, ‘কী বলবি?’

‘বলবো আন্টি আপনার মেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সে সেলিব্রিটি চোরের বন্ধুর সাথে প্রেম করে।’

এই পর্যায়ে এসে শেফাকে স্বীকার করতেই হলো ওর আর জিসানের মধ্যে রিলেশন আছে। খুব বেশিদিনের নয়। জিসানই প্রথম ওকে প্রপোজ করেছে। সেহের হাসতে হাসতে বলল, ‘তুইও প্রেমে পড়লি ভাই, রিমিরও
মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাবে। আফসোস আমি আজীবন সিঙ্গেল থেকে গেলাম। কী দুঃখ, এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি! আমাকে কেউ সান্ত্বনা দে!’

শেফা ভাবুক গলায় বলল, ‘মাহিম আমাদের তিনজনের সাথে অনেক ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। পরশু জিসান ভাই জিজ্ঞেস করলো ওর সাথে তোর কোনো সম্পর্ক আছে নাকি? আমি মজা করে হ্যাঁ বললাম আর ওনি বিশ্বাস করে নিলো। ওনি তো আর জানেন না মাহিম অলরেডি বুকড! হা হা।’

সেহের শেফার হাসির সাথে তাল মেলালো। হঠাৎ শেফা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাই দ্যা ওয়ে, তোর ওই সেলিব্রেটি চোরের খবর কী?’

সেহের ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কে?’

‘আরে পূরব ভাই! ভুলে গেলি? তোর জানালার বাইরে যিনি দাঁড়ায় থাকতো?’

‘ওহ ওনি? তুই ওনার খোঁজ জানতে চাইছিস হঠাৎ? কেন?’

‘না অনেকদিন যাবৎ দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাই বললাম!’

সেহের গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘জানিনা। তিন সপ্তাহ আগে দেখেছিলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। এখন দাঁড়ায় না, হয়তো এখন মতি পাল্টেছে।’

শেফা মনে মনে হাসলো। পূরব যে এতোদিন দেশেই ছিলোনা আর সেহেরের খোঁজ প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছে সেই খবর সেহেরকে জানাতে ইচ্ছে করলোনা। থাকুক না ব্যাপারটা গোপন। সময় হলে পূরবই বলবে। শেফা হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘তো তুই যে ওনাকে পছন্দ করিস সেটা বলছিস ওনাকে?’

সেহের হতভম্ব হয়ে বলল, ‘আমি? ওনাকে পছন্দ করি? কবে, কখন এসব বললাম শেফা? এসব ফালতু কথা আমার সামনে একদম বলবিনা৷ যত্তসব…’

‘কেন?’

‘ওনারা কতো বড়লোক। আর আমি? ছিঃ! ওনাদের সাথে আমার তুলনা? কখনোই না। তাছাড়া ওনাকে আমার এমনিতেই অপছন্দ।’

‘এরকম ড্যাশিং একটা ছেলেকে এরকম বলতে পারলি?’

সেহের রেগে বলল, ‘ড্যাশিং হলে কী হবে? স্বভাব একদম ভালোনা…’

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০৮

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮

‘বাহ, খুবই ভালো। তাহলে তো এই ডান্ডার বারি খেয়ে যেতেই হয়৷ নাহয় হাত-পা একটু ভাঙলোই। নো প্রবলেম। প্রেমের স্বাদ বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই তাইনা? সো এলাকাবাসীদের কী তুমিই ডাকবে? নাকি আমি ডাকবো?’

সেহের অবাক হয়ে যাচ্ছে পূরবের কথাবার্তা শুনে। প্রেমের স্বাদ মানে কী? ও তো কারো সাথে প্রেম করছেনা। আর পূরবের বিহেভিয়ারও ভালো ঠেকছেনা। কেমন যেন অদ্ভুত! ওকে যা কিছুই বলছে তাতে কোনো পাত্তা দিচ্ছেনা। এলাকাবাসী ডাকার কথাটা তো ও এমনিই বলেছিলো, কী ঝামেলায় পড়া গেলো! মানুষজন ওকে এই রাতে এখানে দেখলে খারাপ ভাববে। তাছাড়া পূরবের সাথে আর কোনো কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছেনা, তাই সেহের বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরে আসে।

সুমা আর শিলা জানালা দিয়ে ওদেরকে দেখেছে এতোক্ষণ। তাই সেহের বাসায় ফিরলে ওকে ওরা ঝেঁকে ধরে কি বললো, কেন গিয়েছে, ওর সাথে পূরবের কী সম্পর্ক আছে? আরও নানা হ্যানত্যান করে ওকে জ্বালিয়ে মারলো। সেহের কোন কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনবোধ করলোনা। কারণ ও নিজেই পূরবের ব্যবহার সম্পর্কে অবগত নয়, কেন এরকম করছে সেটা সেহেরের চেয়ে পূরবই ভালো বলতে পারবে। সুমা, শিলা ভীষণ আপসেট হলো।

পূরব কিন্তু সেই রাতে আর বাড়ি যায়নি। সেহের চলে যাওয়ার পরেও সে গাড়িতে বসে ছিলো রাত তিনটে পর্যন্ত। কেন এখানে এসে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও নিজেই বুঝতে পারছেনা, শুধু জানে এখানে এসে সেহেরকে দেখলে ওর খানিকটা ভালো লাগে, অদ্ভুত সুখ অনুভূত হয়। মেয়েটার সম্পর্কে যতোই জানছে ততোই ওকে টানছে। সেহের একটা দারুণ মেয়ে, পূরবের বাবাও বলে। এতেই ও আরও আগ্রহবোধ করছে, কেমন ছেলেমানুষী ব্যাপার! মধ্যরাতে হঠাৎ জিসানের ফোন৷ বোধহয় ঘুমাচ্ছিলো। ওকে ঘুমে রেখেই গত চার-পাঁচদিন ধরে সেহেরের এলাকায় আসে পূরব। ওর বাবা বা জিসান কেউওই সেটা জানেনা। ও ঘুমুঘুমু গলায় বলে উঠে,

‘হ্যালো দোস্ত তুই কোথায়?’

পূরব গম্ভীর গলায় বলল, ‘আছি কোথাও।’

জিসান লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসলো। চোখ থেকে সাথে সাথেই ঘুম পালিয়ে গেলো৷ বলল, ‘মানে কী? তুই বাসায় না?’

পূরবের সহজ সীকারোক্তি, ‘না।’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘তাহলে কোথায়?’

‘বাইরে ঘুরাঘুরি করছি!’

‘এতো রাতে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পাগল হয়ে গেলি নাকি? এতো রাতে কেউ বাইরে ঘুরে?’

‘আমি ঘুরি!’

‘বিপদে পড়বি দোস্ত, বাসায় চলে আয়।’

‘কীসের বিপদ?’

‘আরে এতো রাতে রাস্তায় চোর, ডাকাতের অভাব নাই। ওদের খপ্পরে পড়লে বুঝবি কি বিপদ। তোর কি কোনো কাজ আছে বাইরে? না থাকলে চলে আয়।’

‘শিট ম্যান। তোর ঘুমুঘুমু কন্ঠে শুনে মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আর এসব চোর-ডাকাতের ভয় আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই৷ আমি হচ্ছি রাতের আঁধারে বেড়ে ওঠা মানব।’

জিসান বলল, ‘তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে কোনো অশরীরী আত্মা কথা বলছে দোস্ত। আমিতো পানি খেতে উঠছি রাত দেড়টায়, পাশে তাকিয়ে দেখি তোর বেড খালি, ভাবলাম ওয়াশরুমে গিয়েছিস। এখন আবার ঘুম ভাঙলো দেখি তুই নাই৷ সন্দেহ হওয়ায় উঠে সারাবাড়ি খুঁজলাম। আঙ্কেলের ঘরেও চেক করলাম তুই নাই।’

‘আরে ইয়ার। নো টেনশান, জাস্ট চিল। আমি ঠিক আছি। একটু পরই বাসায় ফিরছি।’

‘গাড়ি নিয়েছিস?’

‘হুঁ!’

জিসান হাফ ছেড়ে বলল, ‘ওকে। তাড়াতাড়ি আয়।’

ফোন কাটার আগে পূরব জিসানকে থামালো। বলল, ‘আচ্ছা তোর কাছে প্রেম মানে কী? এটা মানে তুই কী বুঝিস?’

জিসান হঠাৎ এরকম প্রশ্ন শুনে অবাক। বেশকিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘উমম..প্রেম মানে রাস্তায় দাঁড়িয়ে লুতুপুতু করা।’

পূরব রেগে এক ধমক দিলো। তারপর বলল, ‘ফান করবিনা একদম। তোর এসব ফান মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।’

জিসান হেসে বলল, ‘প্রেম আবার স্বাস্থ্যেকর হয় নাকি? প্রেম মানেই অস্বাস্থ্যকর অনুভূতি… ‘

পূরব নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, ‘আমি জানতে চাইছি লাভ আই মিন ভালোবাসা কী?’

‘আমি জানিনা রে। কখনো প্রেম, ভালোবাসায় জড়াইনি তো তাই এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা কম। অবশ্য তুই চাইলে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের ইন্টারভিউ নিবো। জানতে চাইবো প্রেম কী, ভালোবাসা কী!! ওরা ওদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবে আর আমরা জানতে পারবো ভালোবাসার আসল সংজ্ঞা!’

‘ওফফ জিসান৷ আমি যা বলছি শোন।’

‘যথা আজ্ঞা বাদশাহ!’

‘শোন, একটা অসাধারণ মেয়ে, হুম? যে ছোট থেকেই স্ট্রাগল করে বড় হয়েছে, কারো সাহায্য ছাড়াই নিজের উৎসাহে। মানুষের বিপদেও যে সাহায্য করার চেষ্টা করে অথচ নিজেরই অনেক দুঃখ। তো একটা ছেলে আজকাল ওকে একনজর দেখার জন্য নানা ছেলেমানুষী আচরণ করে, মেয়েটাকে দেখতে, ওর হাঁটাচলা, কথাবার্তা, রাগ সবকিছুই ওর ভালো লাগে। মেয়েটার সামনে ওর বেহায় হতে ইচ্ছে করে, যা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি তা-ই ওর মনে উঁকি দেয় বারবার। মনে হয় সুখের মতো এক ব্যথা..তাহলে কি বলা যায়, ছেলেটা মেয়েটার প্রেমে পড়েছে? আর তারা দুজন স্রোতের বিপরীতে বয়ে চলা পানির মতোন..’

পূরব আর কিছু বলতে পারলোনা। তাঁর আগেই জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘মাথামুন্ডু বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। তবুও তোর কথা শুনে যা বুঝলাম ছেলেটা হয়তো মেয়েটার প্রেমে পড়েছে, আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে ধর, ছেলেটা মেয়েটার সারাজীবনের সব দুঃখকষ্টকে ভাগ করে নিলে, কষ্টগুলোকে নিবারণ করার সাহস করলে, একে অন্যের পাশে থাকার চিন্তা করলে তবেই বোধহয় ভালোবাসাটা হয়ে যাবে। তাইতো… ‘

পূরব আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিলো। তারপর সেহেরের বাসায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। কেন যে ছুটে আসে সেটা কিছুটা হলেও পূরব বুঝতে পারছে। ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা। সেহেরের ঘরের বাতি নেভানো, হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। পূরব গাড়ি স্টার্ট করলো। কিন্তু ও কী জানতো ওই অন্ধকার ঘরে জানালার পাশে বসে কেউ ওকে দেখছিলো? নির্ঘুম রাত পার করেছিলো? আর এর সাক্ষী হয়ে রয়েছিলো নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে একঝলক আলোয় মেতে ওঠা ওই শুক্লাদ্বাদশীর চাঁদটা!

সেহেরের আজকাল টিউশনের চাপটা বেড়েছে। পাঁচটা টিউশন করে সাথে সাথে সেলাই কাজও শিখেছে। তার উপর পড়াশোনার যথেষ্ট চাপ। সব মিলিয়ে খুব ব্যস্ত দিনকাল যাচ্ছিলো ওর। তবে টাকাপয়সার চিন্তা এখন আর নেই। যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছিলো, সেই টাকাও শোধ করা হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেলো ওর চাচা বেলায়েত আলীর সাথে। বাজার সেরে ফিরছিলেন তিনি। সেহেরকে দেখে এগিয়ে এলেন। সেহের কোনোরুপ অবান্তর বাক্যলাপ না করে চাচার সাথে যথেষ্ট মার্জিত ব্যবহার করলো। বেলায়েত আলী জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন আছিস?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন চাচা? আর চাচীমা? অনু, মিম, ইফতি ভাই ওরা কেমন আছে?’

‘সবাই ভালোই আছে। তোর চাচী তো গত মাসে স্ট্রোক করেছে৷ একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। পারভীনের অবস্থা খারাপই।’

সেহের কথাটা শুনে ঝটকা খেলো। ওই শক্ত-সামর্থ্য, রাগী মহিলাটা যার কথায় পুরো পরিবার উঠবস করতো সে আজ শয্যাশায়ী! হায় নিয়তি, সেহেরের সাথে কতোই না দুর্ব্যবহার করেছে, মারধর করে দিনের পর দিন ঘরে না খাইয়ে আটকে রেখেছে। সেই মানুষটার আজ এই অবস্থা! এটা কী সেহেরের সাথে তার করা পাপের ফল? একটা করুণ দীর্ঘশ্বাস বেরুলো সেহেরের বুক থেকে। ও আর কিছু ভাবতে চাচ্ছেনা। পারভীন বেগমকে দেখতে সে চাচার সাথে বাড়ি এলো। পারভীন বেগমকে এক কোণের একটা ঘরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঔষধপত্র টেবিলের উপর রাখা। ঘরটার ভেতর কেমন অসুস্থ ভাব। না চাইতেও সেহের চাচীর সাথে কথা বললো। পারভীন বেগম ওকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো। এই মেয়েটার উপর তিনি কতোই না অত্যাচার করেছেন একসময়। সেই কথা ভেবে সেহেরের হাত জড়িয়ে ধরে মাফ চাইলেন। অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে নিজের দুঃখের কথা বললেন। নিজের সন্তান-সন্ততি এখন ওনাকে দেখতে পারেনা, উঠতে বসতে কথা শোনায়৷ বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেয়। অথচ তাদের জন্যই সেহেরকে কতো না অত্যাচার করেছেন! সেহের বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরে এলো। তারপর শেফার ফোন। ওর সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ঘুম দিলো। সেই ঘুম ভাঙলো রাত দশটায়৷ এরপর হাত-মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসলো। বারোটার দিকে রান্নাঘরে চা বানাতে গিয়ে রাস্তার দিকে নজর যেতেই দেখলো আজও পূরব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই এতগুলো দিনে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে এটা৷ পলকহীন চোখে সেহের শুধু চেয়েই রইলো।

সেহের না জানলেও পূরব এতোদিনে পুরোপুরি শিওর হয়ে গিয়েছে যে সেহেরকে ওর চাই-ই চাই। এই কথাটা সে ইরফান আহমেদের সাথেও শেয়ার করেছে। তিনি তো পুত্রের প্রেমে পড়ার বিষয়টা নিয়ে খুবই উৎফুল্লতা প্রকাশ করেছেন। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা! এই অপেক্ষাও খুব মিষ্টি লাগে পূরবের৷ আহা, মেয়েটা যদি জানতে পারে পূরবের ওকে চায়, তাহলে নিশ্চয়ই ওকে কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেবে! ও মনে মনে বলল, এই চোরেরই বউ হতে হবে তোমায় সেহের। তুমি যে জানালা দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সেলিব্রিটি চোরকে দেখো সেটা খুব ভালো করেই সে জানে৷ বউ বানাতে শুধু সময়ের দরকার! বুঝলে চোরের বউ?’ হাসলো শুধু পূরব।

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০৭

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৭

সেহেরের কাছে এই প্রস্তাব রাখা হলে ও সোজাসুজি না করে দিলো। দরকার হলে না খেয়ে থাকবে তবু্ও ওই বজ্জাত সেলিব্রিটির কোনো দয়া সে নেবেনা। এখন কেন চাকরি দিতে চায়? যখন ওর প্রয়োজন ছিলো তখন তো দেয়নি, এখন তাঁর বাবাকে বাঁচিয়েছে সেজন্য কি মূল্য পরিশোধ করতে চায়? লোকটা কী জানে মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মূল্যবান কাজের কোনো পুরষ্কার হয়না! জিসান নিজে এই প্রস্তাব নিয়ে ওর বাসায় এসেছিলো৷ কিন্তু সেহের ওকে না করে দিয়েছে। সুমা, শিলা বেশ অবাক হলো। এতবড় সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে নাকি? ওরা হলে অফারটা কখনোই ফিরিয়ে দিতোনা৷ যতইহোক, ওরা বেশ বড় পজিশনের লোকজন! ওদের সাথে কাজ করতে পারলে আর কোনো চিন্তা করার দরকারই ছিলোনা। সেহের মেয়েটা কী বোকা, ইশ! তবে স্বীকার করতে হবে, সেহের মেয়েটা ভালো।

ভার্সিটি শেষে সারাদিনে পাঁচটা টিউশন সেরে বাসায় রওয়ানা দিলো সেহের। হেঁটে হেঁটে ফিরছে। এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। শেফার ফোন।

‘হ্যালো হ্যালো।’

‘হ্যাঁ বল শুনছি।’

‘তুই নাকি পূরব ভাইয়ের দেওয়া চাকরির অফার না করে দিয়েছিস? কেন না করলি?’

‘বুঝলি না? আমাকে দয়া দেখাতে আসছে। আমার ওসবের দরকার নেই। দরকার হলে না খেয়ে থাকবো তবুও ওই লোকের দয়া আমি নেব না।’

‘কিন্তু তোর তো একটা চাকরি পাওয়া ভীষণ জরুরি। এভাবে তো আর চলেনা সেহের। সুযোগ বারবার আসেনা রে।’

সেহের বলল, ‘শোন, ওনাকে আমি মনুষ্যত্বের খাতিরে বাঁচিয়েছি। বাঁচানোর আগ অবধি আমি জানতাম না ওনি ইরফান সাহেব। আমি কোনো আশা রাখিনি, সাধারণ মানুষ ভেবেই হেল্প করেছি কিন্তু এর বিনিময় আমি কি করে নেই? আমাকে জোর করিস না প্লিজ। এতোদিন তো কষ্ট করেছি, আরেকটু না হয় করি। তবুও নিজের যোগ্যতায় আমি একটা কাজ পেতে চাই।’

শেফা হতাশ গলায় বলল, ‘তুই না আসলে একটা বোকা মেয়ে..’

‘বোকা কিনা জানিনা। কিন্তু ওই পূরবের কিছুর সাথে আমি জড়াতে চাইনা।’

‘পূরব ভাই কিন্তু ততো খারাপও নয়।’

সেহের ধমকে বলল, ‘তোর ভাই লাগে? বারবার ভাই ভাই বলিস কেন?’

‘মুখ ফসকে চলে আসে। ওনার চেহারাটা দেখতে ভাই ভাই লাগে!’

সেহের হেসে ফেললো। আরও প্রয়োজনীয় কিছু কথাবার্তা সেরে রাতের রান্নাটা করে নিলো। সুমা, শিলাও এখন ওর সাথে খায়। যাইহোক, তিনজন মিলে রাতের খাবার শেষ করে স্টাডি টেবিলে বসে পড়লো। সেহের নিজের ঘরে বসে পড়ছে৷ ওর টেবিলটা জানালার সাথে লাগোয়া৷ ওখান থেকে রাস্তাঘাট দেখা যায়, চায়ের দোকান দেখা যায়৷ তারপরই আছে একটা খাল। মূলত ওটা বুড়িগঙ্গা নদীর একটা অংশ। এখান দিয়েই প্রবাহিত হয় নদীর পানি। রাতের আকাশে উঠা মস্ত বড় গোল চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে পানিতে। সেখান থেকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে পানিতে। দেখতে খুবই মোহনীয় লাগছে৷ বৃষ্টি হলে ভালো হতো৷ সেহের বইয়ে মনোযোগ দিলো। পড়তে পড়তে একসময় চোখটা লেগে এলো। মাথাটা হেলে পড়তেই গ্রিলে বারি লাগলো। সেহের চমকে উঠলো। জানালার বাইরে দৃষ্টি পড়তেই দেখলো পূরব সেদিনের মতো গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে কেউ নেই। মাথায় কালো হ্যাট। দু-হাত ভাঁজ করে সেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। সেহেরের বুক ধুকপুক করছে। এই লোকটা কী রাত-বিরেতে ওকে চমকে দিয়ে মেরে ফেলতে চায় নাকি? এখানে কীসের প্রয়োজন আর সেহেরকে জ্বালাচ্ছেই বা কেন? উফ…

দু-তিনদিন এভাবে কেটে যাওয়ার পরেও সেহের খেয়াল করলো পূরব প্রতিদিন রাতে এসে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। পুরো ব্যাপারটা সেহের শেফা আর রিমিকে জানালে ওরা হেসেই উড়িয়ে দিলো, কিন্তু শেফা জিসানকে জিজ্ঞেস করার পর এই ঘটনা বিশ্বাস কর‍তে বাধ্য হলো। ওর এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা সুমা আর শিলাও খেয়াল করলো। পূরবের মতো ম্যাচিউরড এবং স্বনামধন্য একজন ব্যবসায়ীর এরকম আচরণ এরকম হতে পারে তা কেউ মানতেও পারলোনা। এটাতো ষোলো বছর বয়সী কিশোরের আচরণ, প্রেমিকাকে একনজর দেখার জন্য রাত-বিরেতে এভাবে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, কাউকে তোয়াক্কা না করা!

এটা নিয়ে সুমা, শিলা ওরা যখন হাসাহাসি শুরু করে দিলো তখন সেহের ভীষণ রেগে গেলো। পেয়েছেটা কী ওই পূরব? যা খুশি তা-ই করে ওকে হ্যারেজ করবে? আজ আচ্ছামত একটা শিক্ষা দিয়ে আসবে! যাতে সেহেরের দশ মাইলের কাছাকাছি আসার সাহসও পায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই সেহের বাসা থেকে বেরুলো। অনেক হয়েছে আর নয়। এই বাসায় কোনো মালিক বা কেয়ারটেকার নেই। মাসের ভাড়া মাস শেষে এসে নিয়ে যান, ওনারা ধানমন্ডিতে থাকেন। তাই এসবের ঝামেলাও নেই। সেহের মাথায় ইয়া বড় এক ঘোমটা টেনে ধীরপায়ে রাস্তা পার হলো। পূরব ওকে দেখলো ঠিকই কিন্তু ভাবতেও পারেনি সেহের এভাবে নিচে নেমে আসবে! সেহের ওর দিকে এগিয়ে গেলো। পূরব ওকে দেখে আচমকা হতভম্ব। এই মেয়েকে তো একটু আগেই জানালার পাশে দেখেছিলো, নিচে নেমে এলো কখন? ওতো সেটা লক্ষ্য করেনি! ড্যামেট..

সেহের গলায় রাগী ভাব এনে বলল, ‘আপনি এখানে? এতো রাতে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?’

পূরব বোকা বনে গেলো। এখন কী বলা উচিৎ তাঁর? তবুও নিজেকে সামলে নিলো। ভাব নিয়ে বলল, ‘হাওয়া খেতে এসেছি।’

‘তো হাওয়া খেতে আমারই বাসার সামনে কেন? এটাতো আপনাদের মতো বড়লোকদের এলাকা নয়। এখানকার বাতাস দুর্গন্ধযুক্ত, আপনার ভালো লাগবেনা।’

‘সেটা আমার ব্যাপার!’

সেহের কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তো গত তিনদিনও আপনি এখানে হাওয়া খেতে এসেছিলেন? মিথ্যে বলার আর জায়গা পান না?’

‘ওফফ..তোমার এতো কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।’

‘মিথ্যাবাদী, ঠকবাজ লোক কোথাকার!’

পূরব রেগে বলল, ‘কী বললে তুমি? আবারও বেয়াদবি শুরু করেছো? সেদিনের কথা ভুলে গেলে?’

‘সেহেরের সঙ্গে মিথ্যা বলা? আবার আপনি আমাকেই চোখ রাঙাচ্ছেন? আসলে আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? কোনো মতলব টতলব আছে নাকি? আমি যে চাকরিটা ফিরিয়ে দিয়েছি সেটা কী আপনার ইগোতে লেগেছে? তাহলে আ’ম সো স্যরি মিস্টার পূরব। আমি কারোর দয়া নেই না!’

পূরব এবার বেজায় রেগে গেলো। মেয়েটা তখন থেকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। ও কী করে বুঝাবে এই ঠাস ঠাস করে কথা বলা মেয়েটিকে একনজর দেখার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে? কী করে বলবে? মেয়েটার ব্যবহার বারবার ওকে রাগিয়ে দিচ্ছে, তবুও নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে পূরব। রাগ মানুষের চরম শত্রু, তাই ও চাচ্ছে আগেরবারের মতোন এবারেও যাতে রাগ এসে সব নষ্ট না করে ফেলে। একই ভুল বারবার করা মানে নিজেকে বোকা প্রমাণ করা। পূরব ঠান্ডা মাথায়, খুব শান্তভাবে বলল, ‘আমি তোমাকে দয়া করিনি। আব্বু তোমাকে খুব পছন্দ করেছে কারণ তুমি তাঁকে বাঁচিয়েছো। জানি এর মূল্য শোধ করার নয়, কিন্তু তোমাকে হেল্প তো করতে পারে ওনার ছোট্ট একটা সাহায্য! বাট তুমি অফারটা এক্সেপ্ট করোনি, দ্যান ওই ব্যাপার ওখানেই শেষ। আর আমি কোথায় যাবো না যাবো সেটা আমার ইচ্ছে। তুমি এখানে কেন ইন্টারফেয়ার করছো ইডিয়ট?’

‘আমি কোনো ইন্টারফেয়ার করছিনা৷ দাঁড়াতে হলে অন্যকোথাও দাঁড়ান। আমার জানালার বরাবরই কেন? আপনি জানেন, আমার রুমমেটটা আপনাকে নিয়ে কতোটা হাসাহাসি করে?’

পূরব কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী বলে?’

‘আপনাকে কেন বলতে হবে?’

‘বিকজ আমার ফ্যানেরা আমাকে নিয়ে কী বলে তা জানার আমার খুব ইন্টারেস্ট৷ পৃথিবীতে বোধহয় তুমিই আমার প্রথম হেটার্স! যে এইরকম বাহাদুরি দেখাও আমার সাথে। অন্যান্য হেটার্সরা আড়ালে যা করার করে, কিন্তু আমার সামনে কখনো নয়।’

সেহের বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি এখানে আর দাঁড়াবেন না কখনো৷ এবার আসতে পারেন।’

পূরব ভাব নিয়ে বলল, ‘যাবোনা। আমার শুধু একজনের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে কারোর রেগে যাওয়া লাল নাকটাকে!’

সেহের অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে সে?’

পূরব হ্যাটটার ওপর হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে!’

সেহের হতভম্ব। এই দুইনাম্বারি লোকের কথা শুনে ওর গা জ্বলে গেলো। আবার ওর নামেই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। এতোটা বেহায়াও কোনো মানুষ হতে পারে?আবার ওকে ভালোবাসার কথাও বলছে! ওদের প্রেমে পড়া আর আগুনে ঝাঁপ দেওয়া একই কথা৷ ওরা ভালোবাসার কী বোঝে? যত্তসব মিথ্যুকের দল! সেহের কটমট করে বলল, ‘মিস্টার ইফরাজ পূরব, আপনি জানেন এই মুহূর্তে আমি আপনার কী অবস্থা করতে পারি?’

পূরবের চোখ হাসছে। সেহেরের রেগে যাওয়া মুখটা দেখে ওর ভীষণ হাসি পাচ্ছে। হাসি আটকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী করতে পারো শুনিতো?’

‘এলাকার লোক ডেকে আপনার হিরোগিরি ছুটিয়ে দিতে পারি৷ এদিকে সব খেটে খাওয়া, কর্মঠ লোকেরা
থাকে। আশা করি ওনাদের হাতের ডান্ডার বারি খেলে আপনার মাথা থেকে এসব প্রেম-ভালোবাসার কথামালার চিরসমাপ্তি ঘটবে।’

‘বাহ, খুবই ভালো। তাহলে তো এই ডান্ডার বারি খেয়ে যেতেই হয়৷ নাহয় হাত-পা একটু ভাঙলোই। নো প্রবলেম। প্রেমের স্বাদ বোঝার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই তাইনা? সো এলাকাবাসীদের কী তুমিই ডাকবে? নাকি আমি ডাকবো?’

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০৬

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৬

পূরব সবেমাত্র বাইরে থেকে ফিরেছে। ফ্রেশ হয়ে এসে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ডিভানের ওপর পা তুলে আরাম করে বসলো। জিসান ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চেয়ারে বসলো। পূরব স্যালাড চামচে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো, ‘কখন ফিরলি?’

‘এইতো আধঘন্টা হবে হয়তো।’

‘কাজ হয়েছে?’

‘হুম। ওখানকার ম্যানেজারকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। ওনার খুব ইচ্ছে তুই নিজে গিয়ে যাতে সবকিছু দেখে আসিস।’

‘সময় হলে যাওয়া যাবে! আপাতত শিডিউল.. ‘

‘তোকে একটা বিষয় জানাতে এলাম।’

পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী?’

‘তোর মনে আছে সেহেরের কথা? আরে যে মেয়েটা তোকে চোর বলেছিল?’

পূরব প্রায় সাথে সাথেই মনে কর‍তে পারলো। স্যালাডের বাটিটা রেখে বলল, ‘কী হয়েছে ওর?’

‘ওর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে এলাম।’

‘তা কী জানতে পারলি?’

‘খুবই করুণ ঘটনা।’

‘বল। এভাবে কথা প্যাঁচিয়ে বলবিনা, যা বলবি স্ট্রিক্ট বলে ফেল।’

‘আসলে সেহের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো।’

‘ছিলো মানে? এখন নেই?’

‘পুরো কথাটা তো শোন।’

‘হ্যাঁ শুনছি!’

‘তো ছোটবেলায়ই ওর বাবা-মা মারা যায়।’

পূরব ওকে থামিয়ে দিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘আই মিন ওর কেউ নেই?’

‘হুম।’

পূরব কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। এই কথাটা ও মানতে পারছেনা কিছুতেই। তবে কী সেহেরের সঙ্গে ও অন্যায়ই করেছে? চাকরিটা দেওয়া উচিৎ ছিল কী? ওফ..

জিসান বলতে লাগলো, ‘তারপর ওর জায়গা হয় চাচার বাড়িতে। সেখানে ওর চাচী সংসারের সব কাজ করাতো ওকে দিয়ে। খুব টর্চার করতো, তারপরও সেহের নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে। বৃত্তির টাকা দিয়ে নিজের কাজ চালিয়েছে। এমনিতে খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এই হিংসায় ওর চাচী ওর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে ওকে নিজের কাজের লোক বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলো। টাকার লোভে জোর করে এক বয়স্ক লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। ওকে রাজি করানোর জন্য দু’দিন ঘরে বন্দী করে অকথ্য নির্যাতনও চালিয়েছে৷ পরে ওর বান্ধবীরা খবর পেয়ে ওকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। চাচা-চাচীকে পুলিশের ভয় দেখায়। এরপর ওর চাচী সেহেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় এবং বলে দেয় যে, ওই সংসারে ওর কখনো জায়গা হবেনা। পারলে ফুটপাতে গিয়ে ঘুমাক, ডাস্টবিনের খাবার কুড়িয়ে খাক, তবু্ও ওর দায়িত্ব ওরা নিবেনা। আত্মসম্মানের জোরে সেহের এক কাপড়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। এখন টিউশনি করেই নিজের খরচ চালাচ্ছে। এজন্যই সেদিন তোর ওখানে কাজ খুঁজতে গিয়েছিলো, কিন্তু সেখানে তুচ্ছ একটা কারণে ওর চাকরিটা তুই দিসনি। এখন এভাবেই খুব কষ্টে ওর দিনকাল চলছে।’

পূরব সেহের সম্বন্ধে এসব শুনে হতভম্ব। এটাও হওয়ার ছিল? আজকালকার দিনে চাকরি করেও যেখানে সংসার চালানো যায়না, সেখানে টিউশনি করে খরচ চালানো? ও মাই গড! তাও আবার একটা ভার্সিটির! খানিক চুপ থেকে বলল, ‘তোকে এসব কে বললো?’

‘ওর বান্ধবী শেফার কাছ থেকে জেনেছি!’

‘ওহহ!’

ভার্সিটি শেষে বাড়ি ফিরছিলো সেহের। গাড়ি ভাড়ার জন্য পর্যাপ্ত টাকা হাতে না থাকায় ঠিক করলো হেঁটেই বাড়ি পৌঁছাবে। কাঠফাটা রোদ্দুরে ছেয়ে আছে রাস্তাঘাট। সূর্যদেবের তপ্ত নিঃশ্বাসে রুক্ষ হয়ে আছে সবকিছু। ঘামে ভেজা কপাল ওড়না দিয়ে মুছে ছাতা মাথায় দিয়ে হেঁটে হেঁটে হাইওয়ে পর্যন্ত পৌঁছে। সেখানে রাস্তা পার হওয়ার সময় দেখলো একটা লোক ওপাশ থেকে রাস্তা পেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, যেই না রাস্তার মাঝখানে পৌঁছেছে তখনই বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগামী একটি ট্রাক চলে এলো। লোকটি তা দেখতে পেলোনা। ঘটনাটি দেখে সেহেরের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। সাত-পাঁচ না ভেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লোকটিকে তড়িঘড়ি করে টেনে নিয়ে এলো ফুটপাতে। লোকটি নিজেকে সামলে নিলেও সেহের গিয়ে বারি খেলো গাছের সাথে। হাত-পা ছিলে, পা মচকে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো সেহের। লোকটি ওর কাছে গিয়ে মাটি থেকে ওকে তুললো। সেহের চোখে পানি নিয়ে অবাক হয়ে তাকালো লোকটির দিকে। এতো স্বয়ং ইরফান আহমেদ! এতোদিন শুধু টিভিতে দেখছে, আজ সরাসরি! নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না সেহের। পায়ের ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। ইরফান সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথাও লেগেছে তোমার মা? আমি খুবই দুঃখিত!’

সেহের একটু হাসলো। বলল, ‘না স্যার। আমি ঠিক আছি। আপনি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমি এটা বিশ্বাসই করতে পারছিনা!’

‘একথা বলে লজ্জা দিও না মা। আমার খামখেয়ালিপনার জন্য তোমার বড় কোনো ক্ষতি হতে পারতো।’

সেহের মনে মনে বলল, তাহলে তো ভালোই হতো। মরে গেলে আর টেনশন থাকতোনা। বাবা-মায়ের কাছে চলে যেতাম। কারোর বোঝা হতাম না। কেউ আমাকে ছোট নজরে দেখতো না। ভালো থাকতাম তাহলে! কিন্তু মুখে একটা কথাও বললোনা। ইরফান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথাও যাচ্ছিলে?’

‘জি। বাসায় ফিরছিলাম।’

‘পড়াশোনা করো?’

‘জি।’

‘কীসে পড়ো?’

‘সেকেন্ড ইয়ারে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট আমি।’

‘কোন ভার্সিটির স্টুডেন্ট?’

‘টিউলিপ ইউনিভার্সিটি।’

এভাবে আরও নানা কথাবার্তা হলো ইরফান আহমেদের সাথে। সেহেরের ব্যবহার এবং নমনীয়তা দেখে ইরফান সাহেবের খুব পছন্দ হলো। কত ভদ্র, ভালো একটা মেয়ে। আজ যদি মেয়েটা না থাকতো তাহলে হয়তো এতক্ষণে গাড়ির নিচে পিষ্ট হয়ে পড়ে থাকতো। আজই খুলনা থেকে কাজ সেরে ফিরেছেন তিনি। সাথে গাড়ি, ড্রাইভার আছে। কিন্তু একটা কাজে এখানে নামতে হয়েছিলো ওনাকে। কাজ শেষে রাস্তা
পার হতে গিয়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়তে চলেছিলো। ভাগ্যিস মেয়েটা এসেছিলো। সেহেরকে ওনি পানি খেতে দিলেন, মেয়েটাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। সেহের ইতস্তত করছিলো। কত বড় একজন মানুষ তিনি, আচার-ব্যবহাত খুবই ভালো। অথচ ওনার ছেলে, ওই পূরব না টূরব নাম! যেন আগুনের গোলা, কিছু বলাই অন্যায়! সেহের ওনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে হেলে ইরফাব সাহেব নিজে ওকে বাসায় পৌঁছে দেন। যদিও সেহের সেটা চাচ্ছিলো না। ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ইরফান সাহেব চলে গেলেন গাড়ি নিয়ে। লোকটাকে ভীষণ ভালো লেগেছে ওর।

বাড়ি পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের রান্না সেরে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো সেহের। বিকেলের দিকে ওর রুমমেট সুমা আর শিলা গ্রাম থেকে ফিরে এলো। শিলা এসেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমাকে নাকি আজ ব্যবসায়ী ইরফান আহমেদের সাথে দেখা গিয়েছে? বাহ! তুমিতো ভাইরাল হয়ে গিয়েছো!’

সেহের কথাটার মানে বুঝতে পারলোনা। সুমা আর শিলা ওকে একটা ভিডিও দেখালো। সেখানে ইরফান আহমেদেকে এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচানোর ক্লিপটা দেখা যাচ্ছে। সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এ আর নতুন কী? বড় বড় মানুষের সাথে এরকম ঘটনা ঘটবে তা তো স্বাভাবিকই। তবুও সেখানে নিজেকে একদমই মানাচ্ছেনা তার। সে তো ভাইরাল হতে চায়নি, একটা মানুষকে বাঁচিয়েছে সে। এটাতো ওর দায়িত্ব! যাইহোক, এ বিষয়টা নিয়ে সেহের আর ভাবলো না। সুমা আর শিলা ওর সাথে আজ খুবই ভালো ব্যবহার করলো। এমনকি রাতে নিজেদের খাবারের ভাগও দিলো। রাতে অনেক গল্প করলো৷ সেহের ভাবলো ওদের কী হয়েছে? হঠাৎ করেই এতো আদর-আপ্যায়ন, স্ট্রেঞ্জ! ওই ভিডিও দেখেই ওদের মন গলে গেলো? হা হা।

রাতের মেঘযুক্ত আকাশ! একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেহের। মনটা আজ বেশ উৎফুল্ল। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ও অনুভব করতে পারলো, এই বিশাল পৃথিবীতে কেউ একা নয় । কারো না কারোর সাথে মানুষের একটা যোগসূত্র থাকে। এই যে, আকাশের সাথে সেহেরের একটা যোগাযোগ আছে। ওর মনের সব অব্যক্ত কথামালা আকাশ জানে। এই বিশাল আকাশটাই ওকে ছুঁতে চাওয়ার প্রেরণা যোগায়, সবাইকে স্বপ্ন দেখতে শেখায়, আর তা বাস্তবে রূপায়িত করার অনুপ্রেরণা দেয়! ওর সুখ, দুঃখ সবই আকাশের ডাকবাক্সে জমা আছে। তাই আকাশ একাধারে মানুষের দুঃখের সঙ্গী এবং সুখেরও সাথী।

ইরফান সাহেব বাসায় ফেরায় পূরব আজ জমজমাট ডিনারের আয়োজন করেছে। তাঁর বাবার এক্সিডেন্টেত বিষয়টা পুরোটাই শুনেছে এবং ভিডিও দেখেছে। কোনো এক পথচারী হয়তো ঘটনাটা ফোনের ক্যামেরায় রেকর্ড করে নেটে ছড়িয়ে দেয়। সেহেরকে চিনতে ওর একটুও ভুল হয়নি। বরং অবাকই হয়েছে। পূরব ইরফান সাহেবের সাথে খেতে খেতে নানা দরকারি আলাপন সেরে নিলো৷ সেখানে জিসান প্রস্তাব দিলো ওদের কোনো একটা অফিসে বা রেস্টুরেন্টে যদি সেহেরকে চাকরি দেওয়া যায়! ইরফান সাহেব তখনোই রাজি হয়ে গেলেন। মেয়েটি তার জান বাঁচিয়েছে, কিছু একটা করে মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারলে ওনারও খুব ভালো লাগবে। ইতোমধ্যে জিসান সেহেরের সম্পর্কে যেসব তথ্য জানে তা জানালো ইরফান সাহেবকে। ওনি বেশ দুঃখই পেলেন। পূরব সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। এসব বিষয়ে বারবার আলোচনা ভালো লাগেনা, এসব বড্ড বিরক্তিকর! অসহ্য!

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০৫

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫

সেই মুহূর্তে লজ্জ্বায় সেহেরের গা- হাত-পা কাঁপছিলো। রাগ, জিদ আর লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো সেই সময়টাতে। পাতলা ফিনফিনে কাপড়ের আড়ালে ওর সুগঠিত দেহের অনেক কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। শেফা মাথা নিচু করে শুকনো ওড়না এনে সেহেরেকে ঢেকে দেয়। জিসান বন্ধুর করা এহেন আচরণে প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছে, পূরবের কাছ থেকে এমন কোনোকিছুই সে আশা করেনি। বারবার সেহেরকে স্যরি বলে পূরবকে একপ্রকার জোর করে টেনে নিয়ে আসে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আরেকটু পরেই আকাশখানি চাঁদের আলোয় গা ডুবিয়ে বসে থাকবে, গাঢ় আঁধারে ছেয়ে যাবে চারিপাশ।

পূরবের মাথা গরম হয়ে আছে। ওই মেয়েটার প্রতি জিসানের এতো আদিক্ষেতা দেখানোর কোনো মানে হয় নাকি? মেয়েটাকে আরও উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার দরকার ছিলো। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। আবার তারই বন্ধু ওর প্রতি সিমপ্যাথি দেখাচ্ছে। বিষয়টা ওর মোটেও পছন্দ হলোনা। কোনোমতে বাসায় ফিরলো। একটা হট শাওয়ার নিয়ে ডিনারটা সেরে ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো। খানিক বাদেই জিসান ফ্রেশ হয়ে বেরুলো ওয়াশরুম থেকে। পূরব কোনো কথা বললোনা। ঘুমানোর সময়ও এমন। জিসান বুঝতে পারলো পূরব তাকে ইগনোর করছে। তাই রাগ ভাঙাতে সে ডাকলো পূরবকে।

‘আমাদের রাজপুত্রের মনে কি কেউ আঘাত দিয়েছে? যার জন্য সে তার পরম বন্ধুর সঙ্গেও মত বিনিময় করছেনা?’

পূরব অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়লো জিসানের দিকে। ও মিনমিন করে নিচু স্বরে বলল,

‘এভাবে তাকাইস না ভাই, আমি ভয় পাই।’

‘তুই আমাকে ভয় পাস এটা আমার মানতে হবে?’

‘এভাবে বলিস না বন্ধু!’

‘তোর আজকের বিহেভিয়ার প্রুফ করে দিলো আমি তোর কেউ না।’

‘কী করলাম আমি?’

‘ভুলে গেলি এতো তাড়াতাড়ি?’

জিসান ওর কথার মানেটা বুঝতে পারলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলি, আছিস আর ফিউচারেও থাকবি। তোর সব কাজে আমি তোকে সাপোর্ট করে গেছি। তার মানে এই নয় যে, তুই কোনো ভুল করলে আমি তা ধরিয়ে দেবো না। আমি ওমন বিশ্বাসঘাতক বন্ধু নই৷ সবসময় মেয়েদের প্রতি তোর আলাদা একটা জায়গা দেখতে পেয়েছি। যেটা সম্মানের যোগ্য!’

‘তাতে কী কোনো সন্দেহ আছে?’

জিসান হেসে বললো, ‘একদমই না।’

‘তাহলে হঠাৎ এমন কথা বললি কেন?’

‘বলছি তার কারণ আছে। ওই সেহের নামক মেয়েটা না হয় ভুল করে তোকে দুটো কথা শুনিয়েই দিয়েছিলো, বা অসভ্যতামি ও করেছে। বাট ক্ষমা তো চেয়েছে তাইনা?’

‘এর মানে? তুই কী বলতে চাইছিস?’

‘বুঝেও না বোঝার ভান করিস না!’

‘তো ভনিতা না করে বলে ফেল না।’

‘তোর আজকের আচরণে আমি বেশ লজ্জিত হয়েছি।

পূরব অবাক হয়ে বলল, ‘লজ্জিত হয়েছিস? বাট কেন? এরকম কোনো কাজই আমি করিনি যার কারণে কাউকে লজ্জা পেতে হয়।’

‘বিষয়টা মেয়েলি এবং সেনসেটিভ। তুই ওরকমভাবে পানি ঢেলে একদম ঠিক করিসনি৷ তাছাড়া বেরুনোর সময় মেয়েটার বান্ধবীকে বলতে শুনলাম ওর নাকি অনেক প্রবলেম আছে।’

‘সো হোয়াট?’

জিসান অধৈর্য্য হয়ে বলল, ‘আচ্ছা তুই কী কিছুই বুঝতে পারছিস না? মেয়েটা যখন তোর কাছে মাফ চাইলো তোর উচিৎ ছিল ওকে ক্ষমা করে দেওয়া৷ তা না করে উলটো আরেক কান্ড ঘটালি। সেদিন রাতে জানালায় এভাবে ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি করাটাও ঠিক হয়নি। আর নিজের বিবেককেই একবার প্রশ্ন করে দেখ না। তোর মতো একজন মানুষের কী এই কাজগুলো করা মানায়? যেখানে সবার সাহায্যে নিজে থেকে এগিয়ে আসিস ; সেখানে তুই নিজেই অন্যের সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছিস!’

জিসানের বলা প্রতিটি সত্য কথা পূরবের মনে গভীর দাগ কাটলো। চিন্তায় ফেলে দিলো। পূরব নিজেও এবার নিজের প্রতি বিরক্ত হলো। ক্ষমা চেয়েছিলো যখন মাফ করে দেওয়াটাই উত্তম ছিলো। কতশত মানুষই তো ওকে কটুক্তি করে, মানবসেবার কাজ করার জন্য। কই ও তো এমন বাচ্চাদের মতো আচরণ করেনি৷ সেলিব্রেটিদের হেটার্স যেমন থাকে, লাভার্স ও তেমন থাকে। ধরে নেওয়া যাক সেহের তার হেটার্স, তাই বলে ওর সাথে ওরকম আচরণ করাটা ঠিক হয়নি। আজকাল ও বড্ড অসচেতন হয়ে গিয়েছে। রাগ জিনিসটা সর্বদাই ওর শত্রু! কেন যে এতো রাগ ওর বুঝতে পারেনা। বংশগত বৈশিষ্ট্য বোধহয় একেই বলে, কারণ ওর দাদা নাকি ভীষণ রাগী ছিলেন। গ্রামের লোকেরা ওনার ভয়ে কাঁপতো! যাইহোক, সামান্য বিষয়টাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আকাশসমান করে তুলছে। পূরব ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনাটাকে সাজালো, বোঝার চেষ্টা করলো। আচ্ছা পূরব তুমি কী মানসিকভাবে সিক?? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো। জিসানের কোনো কথার জবাব না দিয়ে বেডে শুয়ে পড়লো। আর তারপরই ওর মানসপটে ভেসে উঠলো সেহেরের কান্নারত মুখটা। মেয়েটা খুব বেশি ফর্সা নয়। গায়ের রঙ তামাটে, চুলগুলো কোমড় অবধি লম্বা, চোখগুলো ভীষণ সুন্দর, উচ্চতায় খুব বেশি লম্বাও নয়। এমনিতে পুতুল পুতুল চেহারা৷ তবে স্বভাবে বোঝা যায় মেয়েটা চঞ্চল ; কিন্তু কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে।

এসব ভেবে ও নিজেই অবাক হচ্ছে। এই প্রথম কোনো মেয়েকে নিয়ে এতো ভাবছে। মেয়েটার সাথে বিভিন্ন কারণে, ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কাকতালীয়ভাবে পাঁচবার দেখা হয়েছে মাত্র। এর আগে কতশত মেয়ে ওর সাথে কাজ করেছে, প্রপোজ করেছে আরও নানা কিছু করেছে কিন্তু ও অতোটা ভাবেনি তাঁদের নিয়ে, যতোটা এই সেহেরকে নিয়ে ভেবেছে। অতি নগন্য কারণগুলোকেই ও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। আর ফলাফলসরুপ ওকে এসব বিশ্রি ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।

রাতের বেশিরভাগ সময়ই কেটে গেলো সেহেরের কথা ভাবতে ভাবতে। একসময় চোখ লেগে এলো তার। ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠলো কয়েকবার। শান্তিতে ঘুমাতে পারলোনা একটুও। বারবার মনে হতে লাগলো ইফরাজ পূরবকে এসব আচরণে মানায় না, সে তো সবার বন্ধু! তার আলাদা একটা জায়গা আছে মানুষের হৃদয়ে। সে কী করে এমন করতে পারে! শিট…

সকালে ঘুম ভাঙার পরে পূরব জিসানকে সেহেরের সম্বন্ধে খোঁজ নিতে বললো। সব ইনফরমেশন জোগাড় করে ওকে জানাতে বললো। জিসান বেশ অবাক হলেও পূরবকে আর ঘাঁটালো না। পূরব ওর কালো রঙের ফেডোরা হ্যাটটি মাথায় চাপিয়ে জিসানকে নিয়ে রওয়ানা দিলো অফিসের উদ্দেশ্যে। এবার বেশ বড় একটা প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে ওরা। সেটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে ওর রেস্টুরেন্টের ব্যবসা জমজমাট হয়ে উঠবে! লভ্যাংশের টাকাটা দিয়ে একটা বৃদ্ধাশ্রম খুলবে ভাবছে। এ নিয়ে পূরবের বাবা ইরফান আহমেদের প্রাথমিক আলাপচারিতাও ইতোমধ্যে শেষ।

কাল ওরকম একটা ঘটনার পর রাতে সেহেরের বেশ জ্বর উঠেছিলো। শেফা আর রিমি না থাকলে মরেই পড়ে থাকতো বোধহয়, কেউ খোঁজ নিতে আসতোনা। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরে নিজেই সব নাস্তা তৈরি করলো। গমের রুটি আর ডালভাজি। শেফা আর রিমি ঘুম থেকে ওঠে ওর পাকনামি দেখে অনেকক্ষণ ধমকালো। অসুস্থ শরীর নিয়ে এসব করার মানে হয়? সেহেরের সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। যাইহোক, তিন বান্ধবী মিলে ব্রেকফাস্ট শেষে একসাথেই ভার্সিটিতে রওয়ানা দিলো। কালকের ঘটনাটা ভুলে থাকার জন্য সেহের আপ্রাণ চেষ্টা করলো। বাড়ি বয়ে এসে এমন কান্ড..ছিঃ! পূরবের প্রতি ওর ভীষণ ঘৃণা হলো।

এরপর অনেকদিন ওর সাথে পূরবের দেখা হলোনা। সেহেরও ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেলো। নিজের মতোই দিন কাটতে লাগলো। কয়েকটা টিউশন যোগাড় করে বাড়িভাড়া আর পড়াশোনার খরচ চালানোর ব্যবস্থা করলো। যদিও মাস শেষে হাত পুরো খালি হয়ে যায়, তখন গলির দোকান থেকে বাকিতে চাল-ডাল কিনতে হয়। কী করবে, ওর খরচ চালানোর মতো তো কেউ নেই এই ব্রহ্মান্ডে! বাবা-মা হারা এতিম মেয়েদের কারো সংসারে বুঝি জায়গা হতে নেই। তাইতো চাচার সংসারে ওর জায়গা হয়নি! কিন্তু আজকাল টের পায় কেউ ওকে ফলো করছে, ওকে দেখছে সারাক্ষণ! এই নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে সেহের!

এই এতোগুলো দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে পূরবের। সেহেরের কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলো। কিন্তু জিসান মনে করিয়ে দিলো ওর কথা। একটা কাজে সিলেট গিয়েছিলো জিসান। সেখান থেকে ফিরে সোজা চলে এলো পূরবদের বাড়ি। এই বাড়িটাতে পূরব আর ওর বাবা ছাড়া আর কেউ থাকেনা, জিসানও থাকে ওদের সাথে। ইরফান আহমেদ ব্যবসার কাজে এতোটাই ব্যস্ত যে বাড়িতে থাকার সুযোগই পান না। আর পূরবের মা এক বছর হলো পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। যাইহোক, জিসান লোক লাগিয়ে খোঁজ নিয়েছে সেহেরের। সে বিষয়ে কথা বলতেই এখন এসেছে পূরবের কাছে।

________

চলবে…ইনশাআল্লাহ

প্রিয় তুমি পর্ব-০৪

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪

রৌদ্রস্নাত বিকেল। মিষ্টি বাতাসে গাছাগাছালি দুলছে। আকাশ কিছুটা কালচে নীল। বৃষ্টি নামার আগে যখন আকাশটা বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে যায়, অনেকটা তেমন। রোদে ধুয়ে চকচক করছে সেহেরের সাবলেট বাসার বারান্দাটা। ওখানে বসে শেফা আর রিমির সাথে গল্প করছে সেহের। আজ বিশেষ নাস্তাও তৈরি করেছে সেহের। হাতখরচের টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে আজ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র ও কিনেছে। সেই টাকাটা ধার দিয়েছে শেফা। যদিও সেহের নিতে চায়নি, কিন্তু জোরজবরদস্তির চোটে নিতে বাধ্য হয়েছে। কেনাকাটা অবশ্য সেহের ওদের দুজনকে সাথে নিয়েই করেছে। রিমি, শেফা আজ রাতটা এখানে কাটাবে বলে ঠিক করলো। একা একা সেহেরে একদম ভালো লাগেনা। তাছাড়া ওর মনমেজাজও কিছুদিন ধরে ঠিক যাচ্ছেনা! এসব কারণেই মূলত শেফা, রিমি এসেছে। তিন’জন মিলে যখন গল্পে মগ্ন তখন দেখলো কালো রঙের একটা গাড়ি ঠিক রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ এবং এই গাড়িটা আর কারোর নয়, পূরবের! সেহের ভয়ে ভয়ে ঢোক গিললো! যখন থেকে পূরবের আসল পরিচয় জানতে পেরেছে তখন থেকেই ওর মধ্যে উৎকন্ঠা কাজ করছে, ভয় হচ্ছে। এই বুঝি হাজার খানেক ক্যামেরা নিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো মিডিয়ার লোকজন। আর নানা বিব্রতকর প্রশ্নে ওকে জর্জরিত করা হলো! আর পূরবকে চোর বলা আর পানি ঢালার শাস্তি হিসেবে ওকে বেড়ধক পিটানো হয়েছে। হাজার হোক সেলিব্রিটি বলে কথা। মানবসেবায় নিজেকে শামিল করে অল্পদিনের মধ্যেই নিজেকে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গিয়েছেন এই লোক। তাছাড়া রেস্টুরেন্টের ব্যবসা আর বাবা ইরফান আহমেদের ইম্পোর্ট এক্সপোর্টের ব্যবসা ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেও বেশ ভালোই পরিচিতি পেয়েছেন। আর তাঁর ইউনিক স্টাইলে চলাফেলা, আর গুড লুকের জন্য সর্বদা তাঁর নামের ছড়াছড়ি। এককথায় সিনেমায় অভিনয় না করেও বাস্তব জীবনে সে সেলিব্রিটি। অসংখ্য মানুষ তাঁকে ভালোবাসে! কিন্তু এই মানবদরদী মহাপুরুষের যে ভালো মানুষের আড়ালে কুৎসিত একটা রুপ আছে, সেটা সেহেরের থেকে ভালো আর কে জানে??

পূরবের গাড়িটা ওরা তিন বান্ধবীই লক্ষ্য করেছে। শেফা মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এটা তো পূর.. পূরব ভাইয়ের গাড়ি!’

সেহের মিনমিন করে বলল, ‘ভাই? তোর ভাই লাগে?’

‘আরে ধুর…ভয়ের চোটে গলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।’

রিমি গালে হাত দিয়ে ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘সেহের? এখন কী হবে রে?’

সেহের চুপ করে বাইরে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। টেনশন হচ্ছে খুব। ইশ..একবার যদি জানতো এই লোক এমন কিছু করতে পারে তাহলে অভদ্র ব্যবহার করতোনা। কিন্তু এখন কী হবে? তাছাড়া পূরবকে ও দেখা যাচ্ছেনা! তবে কিছুক্ষণ পরই গাড়ি থেকে পূরব আর জিসানকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো। মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে এই লোক। সেহের ভয় পেয়ে রুমে চলে এলো, পেছন পেছন রিমি আর শেফাও এলো। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বড়লোকদের সাথে লাগতে গেলে এমনই হবে রে সেহের। এবার লাত্থি-ঘুসি খা। মনে মনে কথাগুলো বলে বিছানার এক কোণে চুপটি করে বসে রইলো সেহের!

মিনিটখানেক পরই দরজায় ঠকঠক ঠকঠক শব্দ হলো। ওরা তিন বান্ধবীই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।

রিমি সেহেরের কাঁধ খামচে ধরে ঢোক গিলে বলল, ‘এখন নিশ্চয়ই তোকে ধরতে এসেছে, কি বলে ডাকবো আর ভাই ছাড়া। ভাইটাই ডেকে যদি কিছু একটা করতে পারি..’

শেফা দাঁত কটমট করে বলল, ‘চুপ থাক রিমি! টেনশনেই বাঁচিনা এখন তোর উল্টাপাল্টা কথা শোনার মুড নেই একদম। এই সেহের, দরজা খুলবো?’

‘ওনারা এসেছেন তাইনা?’

‘মনে তো হচ্ছে, আচ্ছা জিজ্ঞেস করে দেখি!’

সেহেরের সাথে যে মেয়েগুলো ফ্ল্যাট শেয়ার করে তারা আজ বাসায় নেই, গ্রামে গিয়েছে। তাই কোনোরকম চিন্তাভাবনা নেই। শেফা মেইন দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। গলা খাকারি দিয়ে সাহসী গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কে?’

ওপাশ থেকে উত্তর এলোনা। শেফা আবারও ডাকলো কিন্তু কেউওই সাড়া দিলোনা। তাই ও ভাবলো বোধ হয় কেউ নেই আর পূরবরা এসে থাকলেও চলে গিয়েছে। নইলে তো সাড়া দিতোই। যাইহোক, কনফার্ম হওয়ার জন্য দরজাটা অল্প একটু খুলতেই ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। পূরব রাগী চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে তার বেস্ট ফ্রেন্ড জিসান। চিনতে পারলো শেফা। তারপর ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগাতে নিলেই দরজা ঠেলে একেবারে ঘরে এসে পড়ে পূরব। সেহের আর রিমি তো ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। এতো সরাসরি বাসায় ঢুকে পড়েছে। এখন যদি ওকে মেরে ফেলা হতো তাহলে কেউ জানতেও পারবেনা, ভাগ্যিস শেফা, রিমি আছে!

ঘরে ঢুকেই পূরব প্রথমে যে কাজটা করলো সেটা হলো চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। নাকে হাত দিয়ে এমন একটা ভাব করলো যেন সে কোনো ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। জিসান পূরবের এই কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো। কারণ সে যতোই হাই ক্লাস ফ্যামিলিতে বড় হোক বা স্টাইলিশভাবে চলাফেরা করুক এইধরনের কান্ড কস্মিনকালেও করেনি। বরংচ নিজ হাতে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করেছে। ডাস্টবিন পড়ে থাকা সদ্য জন্মানো শিশুকে বুকে তুলে নিয়েছে। কিন্তু আজ একটা মেয়ের বাসায় এসে কোনো কারণ ছাড়াই যে উদ্বত্যভাব দেখাচ্ছে তা জিসানকে প্রচন্ড ভাবিয়ে তুলেছে! ওর ঘোর কাটলো পূরবের হুংকারে।

‘সেহের কে সেহের? আই মিন ওই বেয়াদব মেয়েটা,কোথায় সে?’

পেছনে ঘুরেই দেখলো কাঁচুমাচু হয়ে বিছানার সাথে লেপ্টে বসে থাকা সেহেরকে। মেয়েটার অসহায় মুখটা দেখে ও চরম মজা পাচ্ছে। চিল্লিয়ে বলে উঠলো, ‘এই বেয়াদব মেয়ে, নামো বলছি বিছানা থেকে ফার্স্ট… ‘

সেহেরের আত্না প্রায় বেরিয়ে এলো। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পূরবের সামনে দাঁড়ালো। শেফা আর রিমি পূরবের পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো। পূরবের মাথায় হ্যাট, চোখে সানগ্লাস। কিন্তু সেহেরের সাথে কথা বলতে বলতে চোখ থেকে নীল রঙা সানগ্লাসটা খুলে ফেললো। ভয়ংকর রাগী, কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর চোখজোড়ার দিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্য মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে থাকলো সেহের। এই প্রথম পূরবকে এভাবে দেখেছে। সানগ্লাস ছাড়া এই লোকটাকে দেখতে অন্যরকম লাগছে। যাইহোক, সেহের মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আমি সেহের। কীজন্য এসেছেন এখানে?’

‘তুমি আমায় কী কী বলে এসেছিলে সেগুলো আবার রিপিট করো। নাও লেটস স্টার্ট..’

সেহের ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পাগল নাকি এই লোকটা? বাড়ি বয়ে এখানে এসেছে সিনেমাটিক ডায়লগ শুনতে?আর ও কী না কী ভেবে এতোক্ষণ বিড়ালের মতো মিঁউ মিঁউ করছিলো।

‘শুনুন, আপনার সাথে আমার ওরকম বিহেভ করা উচিৎ হয়নি। তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত! আসলে জানতাম না আপনি কে!’

‘কেন? জানলে কী করতে?’

‘জানলে আমি আপনাকে চোর বলতাম না। আর না আপনার মাথায় পানি ঢালতাম।’

পূরব কথাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘ওহহ তারপর?’

সেহের বিরক্ত চোখে তাকালো। বলল, ‘তারপর কিছুনা। স্যরিটা আপনার পাওনা ছিলো, মিটিয়ে দিলাম। এবার প্লিজ আমাকে ফলো করা বন্ধ করুন।’

পূরব রেগে বলল, ‘ফলো করি মানে?’

সেহের থতমত খেয়ে বলল, ‘করেনই তো। আমি যেখানে যাই সেখানেই আপনি হাজির, তাছাড়া সেদিন রাতে এসে আমার জানালায় ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি করেছেন, দাঁড়িয়ে ছিলেন, আবার রেস্টুরেন্টেও দেখা, ক্যান্টিনেও আপনি। মানে আমি যেখানে আপনি সেখানে টাইপ!’

পূরব ‘ফলো করা’ কথাটি শুনে রেগেমেগে একাকার। আজ পর্যন্ত ওর কাউকে ফলো করা তো দূর, বরং অন্যরা ওকে ফলো করে। আর সেখানে এই মেয়েটা এসব কি বলছে? সেহের ওর কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘আর একটা কথা, আপনি আমার বাসার ঠিকানা জানলেন কী করে?’

‘জিসানননন….’

‘বল দোস্ত।’

‘একে বল চুপ থাকতে, নইলে ওর কী হাল করবো সেটা কিন্তু নিজেও বুঝতে পারছেনা!’

জিসান ওর কথার মানে বুঝতে পেরে সেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপুমণি তুমি ওর সাথে বেয়াদবের মতো আচরণ করোনা।’

‘আমিতো বেয়াদবি করছিনা, জাস্ট জানতে চাচ্ছি আমার বাসার ঠি..’

পূরব সেহেরের গাল চেপে ধরলো। জিসান, শেফা আর রিমি ভয় পেয়ে গেলো। সেহের অবাক হয়ে গেলো। পূরব হুংকার দেওয়া কন্ঠে বলল, ‘আমার কাছে কৈফিয়ত চাও? এতো সাহস? দেখি তোমার কত দম আছে আমার সাথে লাগার! আমি ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ!’

এটুকু বলে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। তারপর আশপাশ খুঁজে একটা কলস দেখতে পেয়ে ওটা তুলে নিয়ে এলো। তারপর কলসের পুরো পানিটা সেহেরের উপর ঢেলে দিয়ে ওকে ভিজিয়ে দিলো। অবাক হয়ে গেলো বাকিরা। জিসান ওকে টেনে একপাশে নিয়ে এলো। ধমক দেওয়া গলায় বলল, ‘তুই এরকম অদ্ভুত আচরণ কেন করছিস? ও একটা মেয়ে, এভাবে পানি ঢালাটা ঠিক হলোনা।’

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০৩

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

এই লোক ওর বাসার ঠিকানা পেলো কীভাবে? হাউ? সেহের কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো জানালার ধারে। বসে বসে ওদের কর্মকান্ড দেখছে আর দুঃসাহস দেখে অবাক হচ্ছে। কতটা বেয়াদব হলে একটা ছেলে তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে নিরীহ একটা মেয়ের সাথে এরকম আচরণ করতে পারে! তাও আবার এতো রাতে? সেহেরের আজ পড়তে ইচ্ছে করছেনা। ঘুমও পাচ্ছেনা। রান্নাঘরে থালাবাসনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর সাথের মেয়ে গুলো কিছু একটা করছে। সেহেরের ভীষণ ইচ্ছে করলো ওদের সাথে গিয়ে কথা বলার, কিন্তু ও যাবার আগেই ওরা নিজেদের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। ওর ভীষণ খারাপ লাগলো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার নিজের ঘরটাতেই ফিরে এলো।

সাথে থাকা ছেলেগুলোকে কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে ওদেরকে বিদায় করে দিলো জিসান। পূরব গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই আধঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়েই আছে। কোনো কথা বলছেনা। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? জিসান বেশ বিরক্তবোধ করছে। শেষমেশ না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে আর কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবি? যা করতে এসেছিলি তা তো করেছিসই, এবার চল।’

পূরব কোল্ড ড্রিংকসের ক্যানটাতে চুমুক দিতে দিতে বলল, ‘তোর চলে যাবার ইচ্ছে হচ্ছে? ওকে যেতে পারিস তুই!’

‘তোকে একা ফেলে যাবো নাকি? মাথা খারাপ হয়নি আমার।’

‘তাহলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।’

‘হুয়াই ম্যান হুয়াই? রাস্তায় দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাওয়ার এতো শখ জাগলো কেন তোর? মেয়েটার বাসার জানালা তো ভেঙ্গে দিলি, আর কী বাকি আছে?’

পূরবের চেহারা থমথমে হয়ে আছে। শক্ত গলায় বলে উঠলো, ‘ওকে স্যরি বলতে হবে। নয়তো আজ এখান থেকে এক পা-ও নড়বোনা।’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে স্যরি বলবে? ও কি এখানে আসবে নাকি?’

‘আসতে হবে।’

‘পাগল হলি তুই? মানুষ দেখলে কী ভাববে?’

‘তোর এতো চিন্তা কর‍তে হবেনা।’

জিসান চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু মেয়েটা জানবে কীভাবে যে তোকে স্যরি বলতে হবে? না জানলে তো এখানে আসবেনা আর স্যরিও বলবেনা।’

পূরব গম্ভীর গলায় কিছু একটা ভেবে বলল, ‘চল।’

জিসান থতমত খেয়ে বলল,’কোথায়?’

‘বাসায়। বড্ড টায়ার্ড লাগছে।’

‘এক্ষুনি না বললি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। যতক্ষণ না মেয়েটি এসে স্যরি বলে ততক্ষণ যাবিনা৷ এখন আবার কী হলো?’

‘কিছুনা। গাড়িতে বস।’

জিসান গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল, ‘তোর যে মাঝেমাঝে কি হয়, বুঝিনা বাপু।’

পূরব অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। রহস্যময় সে হাসি। যখন ওর মনে কোনো কুটিল চিন্তাভাবনা আসে তখন এভাবে হাসা ওর স্বভাব। ফেল্টের কাউবয় হ্যাটটা মাথা থেকে খুলে এসির টেম্পারেচার নরমালে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। রাতের জাঁকজমকপূর্ণ ঢাকা শহর। সুউচ্চ বিল্ডিংগুলো তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক ভুতুড়ে নীরবতায় ছেয়ে আছে। রাস্তার দু’ধারের গাছগুলো শত বছর পার করার সাক্ষী হয়ে কেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পিচঢালা পথে একটা মানুষও নেই। মহানগরী এখন ঘুমন্তপুরীতে রুপান্তর হয়েছে! বাতাস এসে ঝাপটা খাচ্ছে পূরবের চোখেমুখে। লো ভলিউমে গান বেজে চলেছে! জিসান ফোন স্ক্রোল করায় ব্যস্ত, তবু্ও কি ভয়ানক নিস্তব্ধতা চারপাশে ভর করেছে ভাবতেই ওর গা কাঁটা দিয়ে উঠলো!

রাতের আঁধারে ছুটে চলা গাড়িটির দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সেহের। লোকগুলো চলে গিয়েছে এতেই ওর শান্তি৷ কেউ টের পেলে একটা জঘন্য ব্যাপার হতো৷ এই চিন্তাটা মাথা থেকে উবে যেতেই ওর ভীষণ ঘুম পেলো৷ পেটে ক্ষিধে নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো সেহের!

ভার্সিটির একপাশে ‘ভি’ আকৃতির লেকটার পাড়ে বসে আছে সেহের, রিমি আর শেফা। তারা তিনজনই বেস্ট ফ্রেন্ড এবং একই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করে। একে অন্যের সব খবর ওরা জানে, সব কথা শেয়ার করে। ঘাসের উপর বসে তিনজন গল্পে মশগুল। হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত! কথাবার্তার এক পর্যায়ে এসে সেহের শেফাকে একটা ছোটখাটো কাজ যোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ জানালো। শেফা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, ‘টিউশনি করাবি?’

সেহের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘টিউশন? সেতো করছিই! এতে আর কতো পাওয়া যায়, ছোটখাটো জব পেলেও চলে যেতো আমার।’

‘তা ও তো বটে!’

রিমি হঠাৎ বলল, ‘চাকরি করবি? গার্মেন্টসে?’

সেহের চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘গার্মেন্টসে? কীসের চাকরি?’

‘এই সবাই যেমন করে, নরমালি সেলাইয়ের কাজটাজ।’

শেফা আপত্তি জানালো। বলল, ‘ওখানে কাজ করা অনেক টাফ। তাছাড়া ওর পড়াশোনা আছে, গার্মেন্টসে কাজ করতে গেলে সেই সাতসকালে বেরিয়ে বিকেলে বাসায় ফির‍তে হয়, তাও বেতন সামান্য! কয়টা টাকা বেশি পাওয়ার জন্য ওভারটাইম করতে হয়, আর তা করতে গিয়ে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে! তখন পড়াশোনার সময় কই পাবে?’

‘এছাড়া তো আর অপশন নাই। আজকাল জব পাওয়া মুখের কথা নয়!’

সেহেরের মন খারাপ হয়ে গেলো। মাথা নিচু করে বসে ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ফুটে ওঠা ছোট ছোট জংলি ফুলগুলোয় হাত বুলালো অনেকক্ষণ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, ‘রেস্টুরেন্টের কাজটা হতে হতেও হয়নি ওই এক সেলিব্রেটির জন্য। এসব বড়লোকেরা নিজেদের যে কী ভাবে আল্লাহ জানে। সামান্য চোর বলায় আমাকে কাজটা দেয়নি! ভাবতে পারিস?’

রিমি ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ করিসনা দোস্ত!’

সেহের কোলের উপর ব্যাগটা রেখে গম্ভীর মুখে বসে রইলো। সামনের দিনগুলোর কথা মনে করে ওর ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। সামান্য টাকায় কীভাবে সব সামাল দিবে? আল্লাহ ভালো জানেন। তাছাড়া সেমিস্টার ফি’ চলে আসছে! শেফা ওর মলিন চেহারা দেখে ওকে হাসানোর জন্য দু’ হাত ওপরে তুলে বলল, ‘ওই সেলিব্রিটির বউ যাতে কড়া আর রাগী হয়, যেন সারাদিন তাঁকে চোর বলে ক্ষেপায়। তখন তো বউকে আর ফেলে দিতে পারবেনা, একে সহ্য করতে হবেই। যা আমি দোয়া করে দিলাম। বেচারা অসহায় সেলিব্রিটি! এই শেফার দোয়া কখনো বিফলে যাবেনা দেখে নিস!’

শেফার কথা শুনে রিমি আর সেহের হেসে ফেললো। শেফাকে জিজ্ঞেস করলো, এটা দোয়া না অভিশাপ ছিল?’

রিমি হাসতে হাসতে শেফার পিঠে কিল মেরে বসলো। ওর এই এক অভ্যাস৷ হাসি আটকাতে পারেনা, সিরিয়াস মোমেন্টে হাসতে হাসতে থাপ্পড় খাওয়ার অনেক রেকর্ড আছে। কিন্তু তাও ওর শিক্ষা হয়না। পিঠে কিলটা একটু জোরেই লাগলো শেফার। চোখমুখ কুঁচকে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে ওঠে রিমির চুল টেনে ধরলো। ক্ষিপ্ত গলায় বলল,

‘কি খাস তুই? দেখতে তো শুটকি আর শক্তি হাতির মতো! অসহ্য, আমার পিঠটাই বাঁকা করে দিলি!’

‘স্যরি রে দোস্ত। তোর কথা শুনে হাসি আর কিল কোনোটাই কন্ট্রোল করতে পারিনি।’

শেফা বিরক্ত গলায় বলল, ‘হাসার মতো কিছু বলিনি যে দাঁত কেলিয়ে হাসবি!’

সেহের পরিস্থিতি সহজ করার জন্য বলে উঠলো, ‘আচ্ছা বাদ দে। ওই সেলিব্রেটির কথা আমার সামনে আর বলবিনা। এ নিশ্চয়ই টিকটক সেলিব্রিটি, নইলে আমরা চিনিনা কেন?’

শেফা আর রিমি ওর কথায় সায় জানিয়ে মাথা দোলালো। বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বলল, ‘হতেও পারে!’

‘এই সেলিব্রিটি হ্যাটের কথা বাদ দে। চেহারা দেখলেই গা জ্বলে যায়! কোথাকার পাগলেরা যে এর জন্য এতো পাগল আমি বুঝিনা! শালা আবাল…’

রিমি উৎসাহী কন্ঠে বলল, ‘আচ্ছা চল, ফুচকা খেয়ে আসি! চিল কর সেহের…জাস্ট চিল। কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে!’

‘আমি খাবোনা। তোরা যা।’

‘আরে দোস্ত চল..’

রিমি আর শেফা একপ্রকার জোর করেই সেহেরকে নিয়ে ফুচকা খেতে গেলো। ভার্সিটি গেইটের কাছে বিশাল এক হিজল গাছের নিচে ফুচকাওয়ালা চপলের দোকান। কোনো মানুষের নাম আদৌ ‘চপল’ হতে পারে জানা নেই সেহেরের। বেশি করে ঝাল দিয়ে ফুচকা নিলো তিনজনই। খাওয়ার একপর্যায়ে সেহেরের মাথায় ঝাল উঠে গেলো। পানি বোতল নিয়ে কাউন্টার থেকে ফেরার সময় দেখলো হ্যাট পরা লোকটা পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। ওর দিকে চেয়ে আছে। যেন চিবিয়ে খেতে পারলে তাঁর শান্তি! সেহের ভয় পেয়ে ঢোক গিললো। এই লোক কি ওকে ফলো করছে নাকি? কাল রাতের ঘটনা মনে করতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসলো। কোনোক্রমে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই লোকটা তার পা বাড়িয়ে দিলো সেহেরের যাওয়ার পথে। ফলস্বরূপ সেহের পায়ে পা বেঁধে একদম ফ্লোরে পড়ে গেলো আর ওর হাতে থাকা পানির বোতলের পানি ছিঁটকে পড়লো পূরবের গায়ে! ভীষণ রেগে গেলো পূরব।

‘ড্যাম ইট। এটা কী করলে তুমি?’

‘আমি দেখতে পাইনি। দুঃখিত!’

সেহের পড়ে গিয়ে কোমড়ে বেশ ব্যথা পেয়েছে। তবুও উঠে দাঁড়ালো। ক্ষীণ কন্ঠে বলল, ‘আপনার পায়ে বেঁধেই তো আমি পড়েছি। এখানে আমার কিছুই করার নেই।’

‘তাই বলে আমার গায়ের উপর পানি ফেলবে? তুমি জানো আমি কে? কার সাথে কথা বলছো জানক তুমি? ইডিয়ট কোথাকার.. ‘

সেহের বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। এই লোকের বড় বড় কথা ওর আর সহ্য হচ্ছেনা। এমনিতেই মাথার ঠিক নেই হাজারো টেনশনে, আবার ওকে চোখ রাঙানো হচ্ছে! আর এখানে তো ওর দোষ ছিল না, এই হ্যাটওয়ালা নিজেই তো পা বাড়িয়ে দিয়েছিল! আবার ঘাড়ত্যাড়ামি করছে! এবার গলা উঁচু করে বলেই ফেললো, ‘কে আপনি? আর আমার পিছু এভাবে লেগে আছেন কেন? যেখানে যাচ্ছি সেখানেই আপনি আপনার ভিলেনমার্কা চেহারা নিয়ে হাজির! আপনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আমি? যেদিন থেকে দেখা হয়েছে সেদিন থেকেই একটা না একটা কান্ড ঘটিয়েই চলেছেন আপনি! আপনি নাকি মহান মানুষ? তাহলে এসব কী অসভ্য আচরণ আপনার? রাতবিরেতে মেয়েদের বাসায় ঢিল ছুঁড়াছুঁড়ি এসব ছাড়া কি আপনার আর কাজ নেই? নিজের দোষ না দেখে হুদাই আমার উপর চেঁচাচ্ছেন! যত্তসব…’

এটুকু বলে বোতলের বাকি পানিটা ওর মাথায় ঢেলে দিয়ে ক্যান্টিন থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে গেলো সেহের! রিমি আর শেফা এতোক্ষণ ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে কান্ডকারখানা দেখছিলো! সেহের বেরিয়ে যেতেই ওর পিছু দৌড় লাগালো দুজন। চপল মিয়া ওদের ডাকছে, ফুচকার বিল না দিয়েই ওরা চলে গিয়েছে। এদিকে পূরব স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুহুর্তেই কি থেকে কি হয়ে গেলো সেটা বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছে। রাগে কিলবিল করছে শরীর!


শেফা আর রিমি সেহেরকে নিয়ে একটা পার্কে বসে আছে। সেহের কাঁদছে। কেঁদেটেদে অবস্থা ভীষণ করুণ। ওর আজ ভীষণ কান্না পাচ্ছে, কোনো কারণ ছাড়াই ওর চোখের পানিতে গাল ভেসে যাচ্ছে। এতো এতো টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরলে মেজাজ তো তিরিক্ষি হবারই কথা! শেফা ওর পিঠে হাত রাখলো। তারপরে বলল, ‘যাকে এতোগুলো কথা শুনিয়েছিস, তুই চিনিস তাকে? সে কে?’

‘আমার তাকে চেনার কোনো প্রয়োজন নেই। নিশ্চয়ই কোনো বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া সন্তান হবে..’

শেফা অবাক হয়ে বলল, ‘আরে না দোস্ত। এ তো ইরফান আহমেদের বড় পুত্র ইরফাজ পূরব! তুই নেটে ছবি দেখস নাই? হায় আল্লাহ!’

সেহেরের চোখগুলো বড়বড় হয়ে গেলো এই কথা শুনে। ইরফান আহমেদের পুত্র? এই বেয়াদব লোকটা? ও আল্লাহ! এতো ভালো একটা মানুষের পুত্র এতো নিচু মানসিকতা নিয়ে ঘোরাফেরা করে? ছিঃ…

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০২

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২

পেটের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সেহের দাঁড়িয়ে আছে হ্যাট পরা লোকটির সামনে। ওর চোখে পানি টলমল করছে। কেননা রেস্টুরেন্টে ওর কাজটা গ্রান্টেড হয়নি। ওরা অন্য কাজের লোক রেখে দিয়েছে। দুদিন পর এসে এই কথাটি জানার পরে সেহেরের শেষ আশাটুকুও এক নিমিষেই নিভে গেলো। মুখে নেমে এলো বিষাদের ছায়া! ওর গায়ে হলুদ রঙের মলিন একটা কামিজ, পায়ে কমদামী স্যান্ডেল। এলোমেলো ভাবে চুলগুলো বেণী করা। হাতব্যাগটারও যাচ্ছেতাই অবস্থা। তার উপর পিরিয়ডের অসহনীয় ব্যথা আর চাকরি না পাওয়ার কষ্ট। সব মিলিয়ে ওর চেহারা বিধবস্ত দেখাচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো সেদিনের হ্যাট পরিহিত লোকটা অট্টহাসি দিয়ে সেহেরকে বলল, ‘এটা তোমার পানিশমেন্ট ছিলো পেঁচিমুখী। আমাকে কামড় দেওয়া ও চোর বলার শাস্তি।’

লোকটার হাসি দেখে সেহেরের গা জ্বলে উঠলো। চোখের পানিটুকু মুছে ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘আপনার রেস্টুরেন্ট নয় এটা, আপনি যা ইচ্ছে তাই করতে পারেননা। আমি এখন বুঝতে পারছি আমাকে কাজ না দেওয়ার পেছনে আপনার হাত আছে! আমি এখানকার মালিকের সঙ্গে কথা বলবো। আমি জিজ্ঞেস.. ‘

লোকটি ডিভানের উপর বসতে বসতে ভাব নিয়ে বলল, ‘হাত থাকবে কী? এটাতো আমারই রেস্টুরেন্ট। আমিই এটার মালিক। এখানে আমার অর্ডারেই সব হবে! কাকে কাজ দেবো না দেবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।’

সেহের অবাক চোখে চেয়ে আছে। ওর মুখ চুপসে গিয়েছে। এই তাহলে এখানকার মালিক। আর সেদিন ও একে চোর বলেছে? ও মাই গড! সেহের কথাটা ঠিক হজম করতে পারলোনা। ওর মাথা ঘুরে এলো, কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা। এর জন্যই সেদিন এতো এতো লোক ভিড় জমিয়েছে এখানে? এই সেই সেলিব্রিটি? সেহের যখন এসব ভাবনায় মত্ত তখন ওর চোখ পড়লো লোকটার উপর। লোকটার গা জ্বালানো চাহনি আর দাম্ভিক হাসি নজরে পড়তেই মন বিষিয়ে উঠলো। সেহেরকে বোকা বানিয়েছে সেদিন! রাগে হাত-পা কাঁপতে লাগলো ওর।এখন মনে হচ্ছে, এখানে কাজ পেলে হয়তো এর মুখোমুখি হতে হতো, তার চেয়ে কাজ পায়নি সেটাই ভালো। অন্তত হ্যাট পরা লোকটার হিরোদের মতো শয়তানি চেহারা আর এই অহংকারী হাসিটা দেখতে হবেনা।

‘তার মানে আপনিই সেই সেলিব্রেটি? যাকে দেখতে এতো এতো লোক ভিড় করেছিলো?’

‘ইয়েস পেঁচিমুখী।’

‘একদম পেঁচিমুখী বলবেন না।’

‘তো? কী বলবো? তোমাকে দেখতে ঠিক পেঁচার মতোই লাগছে। তোমাকে ডাকার জন্য এরচেয়ে ভালো কোনো নাম আমি খুঁজে পাইনি!’

সেহের কটমট করে বলল, ‘আমার খুব ভালো একটা নাম আছে বুঝলেন ভাই? সেহের! আমার নাম সেহের।’

‘হোয়াট দ্যা ভাই? কে তোমার ভাই? আর তুমি কী ভেবেছো তোমার নাম আছে আর আমার নেই? কোথা থেকে যে এরা আসে…’

‘আপনার নাম শোনার আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আর এখানে কাজ পাওয়ারও ইন্টারেস্ট নেই।’

সেহের রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে নিলে লোকটা ওকে ডেকে বলল, ‘এক কাপ কফি খেয়ে যেতে পারো। আমাদের সার্ভিস ভালো।’

কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে দেওয়া হচ্ছে! সেহের রেগে বলল, ‘আপনার কফিতে আর আপনার এই আলিশান রেস্টুরেন্টে থু থু মারি!’

লোকটার মুখ রক্তিম হয়ে উঠলো। সানগ্লাসটা চোখ থেকে সরাতেই রেগে যাওয়া লাল চোখদুটো দেখে ওর গলা শুকিয়ে এলো। বুঝতে পারলো এই কথাটা বলা ওর ঠিক হয়নি। লোকটা চিৎকার করে বলল, ‘আমার সাথে? এই ইফরাজ পূরবের সাথে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস দেখালে? তুমি জানোনা তুমি কত বড় ভুল করলে, এর জন্য ভুগতে হবে তোমায়। সেদিনের বেয়াদবির জন্য তোমাকে কাজ দেওয়া হয়নি, তারপরও তোমার শিক্ষা হয়নি? ওকে, আমি দেখে নেবো তোমায়! রাইট নাও, গো টু হেল ড্যামেট…’

সেহের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। ভালোয় ভালোয় জান নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে এটাই ভালো। খোলা হাওয়ায় প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়েও ওর শান্তি লাগছেনা। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছুর উপর বিরক্ত সে। ওর ভাগ্যই ওর সাথে বেঈমানি করলো! কেন ওর সাথে সবসময় খারাপ হয়? কই ভেবেছিলো কাজটা হয়ে গেলে আর চিন্তা নেই। বাড়িভাড়া, খাওয়ার খরচ, পড়াশোনার খরচ চালাতে পারবে। কিন্তু তা আর হলো কই? বড়লোকরা বুঝি এমনই হয়! গরিবদের উপরই ওদের যত অত্যাচার।

পথেঘাট রোদের আলোয় চিকচিক করছে। বাতাস বন্য। সেহের হাতব্যাগ খুঁজে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পেলোনা ও। এই টাকাটা দিয়ে বাসা পর্যন্ত যেতে হবে। কিন্তু এখন বাসায় যাওয়া যাবেনা, কারণ এখন ভার্সিটির সময় হয়ে গিয়েছে। ক্লাস মিস করা যাবেনা, আবার ভার্সিটি গেলে বাসায় আসার টাকা পাবেনা। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। অবশেষে বাড়ির পথেই রওয়ানা হলো। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসটা মিস হয়ে যাওয়ায় ওর খুব খারাপও লাগলো। কিন্তু কিছু করার নেই। একদিন হলো কয়েকজন অচেনা মেয়ের সাথে সাবলেটে বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। তাছাড়া জিনিসপত্র গোছানো হয়নি, এখন গিয়ে সেই কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে! তাহলে রাতজেগে পড়াশোনা করতে সুবিধা হবে।


পেঁচিমুখী মেয়েটার স্পর্ধা দেখে পূরব এখনো রাগে কাঁপছে। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। সামান্য একটা মেয়ে বলে কিনা ‘থু থু’ মারি? এতো সাহস? সেদিনের ঘটনায় মেয়েটাকে কিছু করেনি বলে আস্কারা পেয়ে গিয়েছে। ওর সাথে গলা উঁচু করে কথা বলে! একে একটা উচিৎ শিক্ষা দিতেই হবে। পূরব বাঁকা হেসে মনে মনে বলল, ‘যার যতো টাকা, তার ততো ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতার বলেই পৃথিবী জয় করা যায়। আর সেখানে তোমার মতো বেয়াদব মেয়েকে সোজা করা এই পূরবের বাঁ হাতের খেল!’

এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে জিসান নামটা। পূরব ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিসান বলে উঠলো, ‘মাথায় কাউবয় হ্যাট পরে, ঘোড়ার পিঠে বসে, ঘোড়াকে চাবুক মারতে মারতে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতে ইচ্ছা করছে। তা আসবে নাকি আমাদের রাজকুমার ইফরাজ পূরব?’

পূরব রেগে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে ঘুসি দিয়ে বলল, ‘ফ্লাট করবিনা একদম। আমার মনমেজাজ ভালো নেই, কিছু একটা বলে ফেললে তোরই খারাপ লাগবে। তাই কাজের কথা বল..’

জিসান বলল, ‘ওকে ওকে..তুই কী আসছিস? আজ একটা পার্টি আছে!’

‘আমি কোনো পার্টিতে যাবোনা। বাসায় যাচ্ছি.. তুই চলে আয়!’

‘তুই না গেলে আমিও যাবোনা। আচ্ছা আমি আসছি।’

পূরব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ওকে।’

জিসান এবার ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে ভাই? এতো রেগে আছিস কেন?’

পূরব ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার সাথে একজন বেয়াদবি করেছে। ভাবতে পারছিস?’

জিসান বড্ড অবাক হলো। তার এই রাগী বন্ধুটির সাথে কেউ বেয়াদবি করেছে এটাও কোনোদিন ওকে শুনতে হবে তা কখনোই ভাবতে পারেনি। ব্যবসায়ী ইরফান আহমেদের ছেলে, হাজারো মেয়েদের ক্রাশ ইফরাজ পূরবের সাথে কথা বলতে গেলে যেখানে দু’বার ভাবতে হয়, সেখানে কে এই দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো? কিন্তু ভাবনার প্রহরকে সাইডে রেখে জিসান গলা উঁচু করে বলল, ‘একবার বল ভাই কে তোকে কি বলেছে। তোর সাথে কেউ বেয়াদবি করবে আর আমি বন্ধু হয়ে সেটা মেনে নেবো তা কখনোই হবেনা। দরকার হলে গাজা দিয়ে মশাল বানিয়ে তার মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে পুরো ঢাকা শহরে আন্দোলন করবো৷ তবুও বল কে সে? কোন অধম বান্দা তোকে রাগিয়েছে! একবার বল ভাই, তার অবস্থা আমি খারাপ করে দেবো!’

‘একটা মেয়ে। আর কোন মেয়ে জানিস? যাকে কাজ না দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আজ রেস্টুরেন্টে এসেছি!’

বলেই ফোনটা কেটে দিলো পূরব। জিসান বাক্যহারা হয়ে গেলো। একটা মেয়ে ওর বন্ধুকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে? হা হা। এই দিনও দেখতে হচ্ছে ওকে! মেয়েটাকে দেখার প্রচন্ড ইচ্ছে হচ্ছে ওর। কে সেই রমণী? ভাবতে ভাবতে বন্ধুদের আড্ডামহল থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো জিসান। তারপর রওনা দিলো পূরবের বাসার উদ্দেশ্যে!


সেহের বাসায় পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সবকাজ করে ফেললো। কাপড়চোপড় ট্রাঙ্কে রেখে, বইখাতা সেলফে সাজিয়ে নিলো। তারপর বিছানা করে ঘর ঝাড়ু দিয়ে মুছলো। এসব করতে করতেই রাত নয়টা বেজে গেলো। অতঃপর রান্না চাপালো। ভাত আর ডিমের তরকারি। অন্যান্য রুমমেটরা নিজেদের ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে আছে। কারো রুমে ঢোকার পার্মিশন নেই সেহেরের। তাই ও আর সেদিকে যায়না। গোসল সেরে খাবার নিয়ে বসলো জানালার ধারের পড়ার টেবিলটায়। পেট ক্ষিধেয় চোঁ চোঁ করছে। কষ্ট করে রান্না করা ভাতের লোকমাটা মুখে তুলতে গেলেই বাইরে থেকে কিছু একটা এসে জানালা ভেঙে সোজা ওর থালায় পড়ে। হাত ফসকে থালাটা সোজা মেঝেতে পড়ে ভাতগুলো সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। ঘটনাটা এতো দ্রুত ঘটে গেলো যে সেহের কিছু বুঝে উঠতে পারলোনা। ভাতগুলো মেঝেতে দেখে ওর চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। বাইরে থেকে কেউ পাথর নিক্ষেপ করেছে। সেহের জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো কয়েকটা ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে হাসছে। পাশেই বিকেলের হ্যাট পরা লোকটি আর সাথে চেক শার্ট পরিহিত অন্য একটা যুবক। সবাই হাসছে যেন খুব মজার ঘটনা ঘটেছে। কাচের জানালাটা ভেঙ্গেছে। মূলত ওদের উদ্দেশ্য ছিলো জানালা ভাঙ্গা, কিন্তু তারা তো আর জানেনা এই কাজে একটা মেয়েকে সারারাত না খেয়ে কাটাতে হবে! বড়মাপের সেলিব্রিটি টাইপের, একজন লোক রাতবিরেতে এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে পারে ভেবেই গা গুলিয়ে উঠলো সেহেরের। ছিঃ এতো নিচু মানসিকতা…কিন্তু, কিন্তু এই লোক ওর বাসার ঠিকানা পেলো কীভাবে? হুয়াই?

চলবে…ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-০১

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১

দরজার পেছনে একটা লোকের সাথে লেপ্টে আছে সেহের। ওর কোমড় ধরে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। যে-কেউ দেখলে খারাপ ধারণা করবে। কিন্তু লোকটার এতে কোনো হেলদোল নেই। তার গরম নিঃশ্বাস সেহেরের চোখেমুখে পড়ছে, হাতদুটো অবাধ বিচরণ করছে ওর কোমড়ে। সেহেরের ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। বাধ্য হয়ে লোকটার পায়ে পাড়া দিয়ে সরে দাঁড়াতে গেলেই লোকটা আবার তার কোমড় চেপে ধরে বুকের সাথে লেপ্টে ধরে। ধমকের সুরে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকো। একদম নড়াচড়া করার চেষ্টা করবেনা।’

সেহের ধমক শুনে ঢোক গিললো। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকো মানে কী? ও কী লোকটার নিজস্ব সম্পত্তি? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপর নিজের নির্দেশ চাপিয়ে দিতে চাইছে। লোকটা তো মহা বেয়াদব! সেহের প্রচন্ড রাগ নিয়ে এবার বলে উঠলো, ‘আমাকে এভাবে ধরে রাখার মানেটা কী? আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড বা বউ নই। ছাড়ুন আমায়।’

লোকটার মাথায় একটা কালো রঙের বড় হ্যাট। সেটা একচোখ আড়াল করে কোনাকুনি উঠে যাওয়ায় দেখতে অদ্ভুত লাগছে। চোখে দামী সানগ্লাস। পোশাক-পরিচ্ছদও পরিপাটি। নিশ্চয়ই কোনো বড়লোক ঘরের ছেলে হবে! সেহেরের কথা শুনে রাগে তার নাক লাল টকটকে হয়ে গেছে। গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘এতবেশি কথা না বলে মুখটা বন্ধ রাখো।’

‘আপনি ছাড়ুন আমায়। আমি কিন্তু এবার চিৎকার করবো…’

‘চিৎকার করে দেখো তোমার কী অবস্থা করি।’

সেহের খানিকটা ভয় নিয়েই জিজ্ঞেস করলো, ‘কে আপনি? আর আমার সঙ্গে এমন অসভ্যের মতো আচরণ করছেন কেন?’

‘আমি কে সেটা তোমার না জানলেও চলবে।’

‘তাহলে আমাকে ছেড়ে দিন, আমার প্রচুর কাজ আছে।’

লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার কাজ পরে করে নিও।’

‘পারবোনা। আমার ইমিডিয়েটলি যেতে হবে। তাছাড়া বাইরে কিছুক্ষণ পরই বৃষ্টি নামবে।’

‘উফ…শিট! একটু আস্তে কথা বলো।’

সেহের চুপ হয়ে গেলো। অনেক মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। এটা একটা রেস্টুরেন্ট। এরকম হতেই পারে, কিন্তু এতো লোকের গলা শোনা যাচ্ছে যেন কোনো নামীদামী লোক এখানে এসেছে আর তার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য মিডিয়ার লোকেরা ভিড় জমিয়েছে। যেমনটা কোনো সেলিব্রেটি এলে হয়! কিন্তু কোথাও তো এরকম গণমান্য ব্যক্তিবর্গ দেখা যাচ্ছেনা। তাহলে? যাইহোক, এই লোকের সমস্যাটা কী? সেহেরকে কেন এখানে আটকে রেখেছে, তাও কেমন চোরের মতো! সেহের কিছু একটা চিন্তা করে এবার তীক্ষ্ণ কন্ঠে হ্যাট পরা লোকটার দিকে তাকালো। লোকটা ভ্রু দুটো নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হয়েছে?’

‘আপনি কী চোর?’

নিচু গলায় চিৎকার করে লোকটা বলল,

‘হোয়াট?’

‘আপনি চোরের মতো লুকিয়ে আছেন কেন? আর আপনি চোর-ডাকাত যা-ই হোন না কেন আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন? বিলিভ মি, আমি ভদ্র পোশাক পরে কখনো কাউকে চুরিটুরি করতে দেখিনি।’

লোকটা কপট রাগ নিয়ে বলল, ‘আমাকে দেখে চোর মনে হচ্ছে?’

‘হতেই পারে। বাইরে দেখছেন না কত লোকজন জড়ো হয়েছে? বাংলাদেশে এতো মানুষ কখন জমা হয় জানেন? যখন কোনো চোর-ডাকাত ধরা পড়ে তখন!’

লোকটা সেহেরকে ছেড়ে দিয়ে ঠিক করে দাঁড়ালো। সেহের এতোক্ষণ পর ছাড়া পেয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলো। ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে দরজার পেছন থেকে বেরুতে গেলে একটা শক্ত-সামর্থ্য হাত ওকে টেনে ধরে। সেহের বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, ‘সমস্যা কী চোরমশাই? মেয়েদের গায়ে হাত দিতে বুঝি অনেক ভালো লাগে?’

লোকটা ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘এখন যাওয়ার পার্মিশন তো আমি দিইনি!’

‘আপনার পার্মিশনে আমাকে চলতে হবে? ও মাই গড! কে আপনি ভাই? কোন মন্ত্রীর ছেলে?’

‘সেটা না হয় পরে জেনে নিও। আপাতত এখান থেকে বেরুনোর কথা ভুলে যাও।’

সেহেরের ইচ্ছে করছে এই ছেলের কানের মাঝে দুটো থাপ্পড় দিয়ে সিঁধে করে দিতে। একে তো চুরি, তার উপর সিনাজুড়ি! আবার ওর উপর আদেশ জারি করছে! এই রাতে কোন কুক্ষণে যে রেস্টুরেন্টে কাজের খোঁজে এসেছিলো তা ভেবেই নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কাজের কাজ কিছুই তো হলোনা বরং আরো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো। মনটা এমনিতেই বেশ খারাপ হয়ে আছে। হাজারো টেনশনের মধ্যে এখন আবার এই উটকো ঝামেলা। চোখেমুখে রাজ্যের ক্লান্তি। দাঁতে দাঁত চেপে এবার বলে উঠলো, ‘আপনি আমাকে এখান থেকে যেতে দিন। নইলে আমি এক্ষুনি বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে দিচ্ছি চোর এখানে লুকিয়েছে আর আমার সাথে অসভ্যতামি করেছে! তখন মজা টের পাবেন মিস্টার চোরমশাই।’

‘স্টপ ইট..’

বলেই সেহেরের মুখ চেপে ধরলো লোকটা। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। ঘটনাটি বুঝতে ওর বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। যখন মাথায় এলো তখন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য লোকটার হাতে কামড় দিয়ে বসলো। রক্তচক্ষু নিয়ে হ্যাট পরা লোকটা ওর দিকে তাকাতেই ভয়ে চুপসে গেলো। কিন্তু লোকটা নিজের হাত সরালোনা। মিনিট খানেক পর লোকটা বাঁ হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করলো।

‘হেই জিসান, ওরা চলে গিয়েছে?’

ওপাশ থেকে জিসান নামক কেউ একজন বলল, ‘অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বের করেছি। তুই এখন বেরিয়ে আসতে পারিস।’

‘ওকে। থ্যাংকস তোকে সবটা হ্যান্ডেল করার জন্য।’

‘এসব ফর্মালিটি করার কোনো প্রয়োজন নেই। তুই কোথায়?’

‘এসে বলছি। তুই সেকেন্ড ফ্লোরে ওয়েট কর।’

‘ওকে আয়।’

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে হ্যাট পরা লোকটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সেহেরকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ‘আমার সাথে যে বাজে বিহেভিয়ারটা তুমি করলে এটার জন্য এখন তোমাকে কিছু বললাম না, তাই বলে ভেবোনা আমি এই ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি। আবার কখনো দেখা হলে এর শোধ আমি নিয়েই ছাড়বো।’

সেহেরও এবার রেগে গেলো। ওর সাথে বাজে ব্যবহার করে আবার ওকেই কথা শোনানো হচ্ছে? ও বিগলিত কন্ঠে বলল, চোরের মায়ের বড় গলা!’

‘স্টুপিড! কে, কে চোর?’

‘এই যে আমার সামনে ভদ্র পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা অভদ্র একটা মানবসন্তান। যার নূন্যতম বিবেকবুদ্ধি নেই!’

‘আমার বিবেকবুদ্ধি নেই কী আছে সেটা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেব সময়মতো! বাট একটা থ্যাংকস তোমার প্রাপ্য।’

সেহের আচমকা অবাক হয়ে হ্যাট পরা লোকটির দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘থ্যাংকস কেন?’

‘তোমার জন্য আজ বেঁচে গেলাম।’

সেহের ভাব নিয়ে বলল, ‘থাক থাক। একটা চোরকে বাঁচিয়ে আমি কোনো নেকী লাভ করিনি। লোকগুলোর হাতে তুলে দিলেই ভালো ছিলো। একেবারে পিটিয়ে পিঠের ছালচামড়া তুলে দিতো। আর কোনো মেয়ের সাথে এরকম চিপকে দাঁড়িয়ে থাকার সাধ সুদে-আসলে মিটিয়ে দিতো।’

লোকটা নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের রাগ সামাল দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘বাই দ্যা ওয়ে, তুমি এতো রাতে রেস্টুরেন্টে কীজন্য এসেছিলে?’

‘আপনাকে বলবো কেন?’

‘না শোনার ইচ্ছে হলো আরকি!’

‘কাজ খুঁজছিলাম। এটা তো নতুন খুলেছে তাই ভাবলাম ছোটখাটো একটা কাজ পেলেও পেতে পারি। কিন্তু আজ নাকি ইন্টারভিউ নেওয়া হবেনা, সময় শেষ। তাই পরশু আসতে বললো।’

লোকটা মুচকি হেসে বলল, ‘ওহ তাই বলো।’

‘তো চোরমশাই আমি এবার আসছি।’

লোকটা উত্তর দিলোনা। সেহের বেরিয়ে এলো করিডোরের বাঁ দিকের দরজার আড়াল থেকে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে হ্যাট পরা লোকটা সেহেরের চলে যাওয়া দেখলো। অতঃপর নিজেও বেরিয়ে এলো। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে বাগানের কাছে চলে এলো। সেলফোন বের করে ফোন লাগালো জিসান নামক কাউকে।

রাত সাড়ে আটটা। সেহের আলিশান রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভাবছে। রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের সাথে ইন্টারভিউয়ের বিষয়ে কথা বলে তিনতলার রিসেপশন থেকে নামার সময়ই মানুষের শোরগোল শুনতে পায়। সামনে এগুনোর জন্য পা বাড়াতেই কোথা থেকে আসা হ্যাট পরা লোকটার সাথে ওর ধাক্কা লাগে। শব্দ শুনে এদিকে লোকজন এগিয়ে আসতে নিলেই ওকে নিয়ে একপ্রকার জোর করে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পরে লোকটা। কিন্তু এরকম করার মানে কী? গার্ড থেকে জানতে পারলো রেস্টুরেন্টে কোনো চুরিটুরি হয়নি। কোনো একজন সেলিব্রিটি আসায় মিডিয়ার লোকেরা হামলে পড়েছিলো। গার্ডরাও জানেনা সে কে? নিশ্চয়ই বড় কেউ হবে, নইলে কি এতো লোক ভিড় জমাতো!

চলবে।