Tuesday, July 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1407



তুমি কে পর্ব-০৫

0

#তুমি_কে?
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৫
রোহান অন্য সার্ভেন্টদের ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে তুবাকে দেখেছে কিনা৷ কিন্তু সবার উত্তর একটাই, না। রোহান ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। তুবা তাহলে কোথায় গেল! ও কি ওকে ছেড়ে চলে গেল? রোহানের খুব অস্থির লাগছে আর চিন্তা হচ্ছে। ওর মাথা একদম কাজ করছে না। হঠাৎই পিছন থেকে মানে রান্নাঘর থেকে পরিচিত সেই মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে আসে।

~ একি! আপনারা সবাই একসাথে? কি হয়েছে?

রোহানসহ সবাই পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে তুবা ট্রে’তে দুটো মগ নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। রোহান এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দ্রুত তুবার সামনে গিয়ে ওর হাতের বাহু দুটো ধরে অস্থির কণ্ঠে বলে,

— তুমি কোথায় গিয়েছিলে এভাবে না বলে? আমরা খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে গিয়েছি।

তুবা পুরো স্তব্ধ হয়ে যায় রোহানকে দেখে। কারণ ওর কথা আর ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছে, ও খুব ভয় পেয়েছে ওকে না পেয়ে। তুবা সেটা খুব বুঝতে পারছে। ও ইশারায় হাতের ট্রে টা দেখায়। রোহান বলে,

— কি?
~ আপনার জন্য কফি বানাচ্ছিলাম। এ বাসায় আসার পর থেকে শুধু খেয়েই যাচ্ছি। কোন কাজ কর্ম তো কিছুই করছি না। তাই ভাবলাম, আপনাকে আমার হাতের কফি বানিয়ে খাওয়াই।

রোহান নিলু আর অন্য সার্ভেন্টদের দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোমরা কেউ দেখো নি ওকে কিচেনে যেতে?

সবাই মাথা নাড়িয়ে না বলে। তুবা হেসে বলে,

~ কিভাবে দেখবে! আমি তো চুপিচুপি গিয়েছি। আর আমি জানি যে, নিলু ছাড়া কিচেনে কেউ যায় না৷ তাই আমাকে কেউ দেখেও নি।
— তুবা জানো তোমাকে তোমার রুমে না পেয়ে আমি কতটা ভয় পেয়েছি আর চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। উফফ! এরকম কেউ করে?
~ আচ্ছা সরি৷ আমি তো আপনার জন্য কফি বানাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দিব৷ কিন্তু… (অসহায় মুখ করে)

রোহান দ্রুত কফির মগটা নিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,

— আচ্ছা দেখি কেমন হয়েছে তোমার হাতের কফিটা।
~ এই না না। থামুন।
— ওমা! খাবো না? আমার জন্য না বানিয়েছো? (অবাক হয়ে)
~ না মানে আসলে…যদি কিছু মনে না করেন, আমি চাচ্ছিলাম আপনার বাগানটায় বসে আমরা একসাথে কফিটা খাবো।

রোহান হাসতে হাসতে বলে,

— হাহা। এই কথা, তাহলে দেরি কেন চলো বাগানের দিকে যাওয়া যাক।
~ সত্যিই? (খুব খুশি হয়ে)
— হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
~ আপুমনি ট্রে’টা আমাকে দিন৷
~ হুম নেও।

এরপর তুবা আর রোহান কফি হাতে বাগানের দিকে যাচ্ছে। রোহান সামনে আর তুবা পিছনে ছিল। ও রোহানের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে,

~ উনি আমাকে নিয়ে এত ভয় আর এত চিন্তা কেন করছিলেন? ওনার চোখে আমি স্পষ্ট আমাকে হারানোর ভয় দেখেছি। কিন্তু কেন? আমি কি ওনার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে গেলাম? নাকি উনি আমাকে…যাহ! এটা সম্ভবই না৷ আমি যে কিসব ভাবছি! ধুর..

ওরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে বাগানে চলে আসে। খুব সুন্দর একটা ফুলের বাগান। বাগানের মাঝে হাঁটার জন্য সুন্দর রাস্তা আছে। রোহান তুবাকে নিয়ে সেই রাস্তা ধরেই হাঁটছে। এদিকে তুবা তো মুগ্ধ হতে হতে হাপিয়ে যাচ্ছে। এত সুন্দর সুন্দর ফুলের সুবাসে ওর মন বারবার পুলকিত হয়ে যাচ্ছে। ওর যে কি ভালো লাগছে তা বোঝানো মুশকিল। এক সময় ও খেয়াল করে বাগানের ঠিক মাঝে অনেক সুন্দর একটা বসার জায়গা আছে। রোহান তুবাকে নিয়ে সেখানে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে। আর তারপর দ্রুত কফির মগে চুমুক দেয়৷ ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষায় ছিল তুবার হাতের কফিটা খাওয়ার জন্য। রোহান কফিতে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে তার স্বাদ নিচ্ছে। তুবাও চুমুক দিয়ে লজ্জাসিক্ত দৃষ্টিতে রোহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ও অপেক্ষায় আছে রোহান কি বলবে তা শোনার৷ রোহান আরও এক চুমুক কফি খেয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে তুবাকে বলে,

— আমার খাওয়া বেস্ট অ্যান্ড বেস্ট কফি ছিল এটা। ওয়াও! দাঁড়াও পুরোটা খেয়ে নি। নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে।

তুবা যেমন লজ্জা পাচ্ছে তেমনি ওর খুব ভালোও লাগছে। ও কফির মগে চুমুক দিয়ে মুচকি একটা হাসি দিয়ে আড় চোখে রোহানকে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে,

~ এই প্রথম কেউ আমার রান্নার প্রশংসা করলো। তাও আবার এতটা। সত্যিই উনি অনেক ভালো মনের একটা মানুষ। আমি যতক্ষণ ওনার কাছে কাছে থাকি নিজেকে কেন জানি খুব সেইফ আর হ্যাপি মনে হয়৷ কি এমন আছে ওনার মাঝে যে আমাকে এতটা আকৃষ্ট করছে তার দিকে। ওনাকে এখন একদম বাচ্চাদের মতো লাগছে৷ একদম কিউট কিউট। উফফ! মন চাচ্ছে ওনার গালটা টেনে দি। হিহি।

রোহানও কফি খেতে খেতে আড় চোখে তুবার দিকে তাকায়। ওদের আবার চোখাচোখি হয়। তুবা লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিলেও রোহান এবার সরায় না। ও তুবাকে দেখতে থাকে। প্রাণ ভরে দেখতে থাকে। সত্যি বলতে ও চায়, তুবা যতক্ষণ ওর কাছে আছে ঠিক ততক্ষণ প্রতিটি মুহূর্ত ও তুবাকে অনুভব করতে এবং ওর সাথে কাটাতে চায়। কারণ তুবার সঙ্গ ওকে অজানা একটা ভালো লাগা দেয়। যেটা রোহান আগে কখনো পায় নি। তুবা আসার আগে ওর নিজেকে খুব একা মনে হতো। একাকিত্বের চাদরে ও এতটাই ঢেকে গিয়েছিল যে ও হাসতেই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু এখন ও তুবার দিকে তাকালেই ও হাসে। মন থেকে হাসে, খুশি হয়ে হাসে, মেয়েটার পাগলামি দেখে হাসে। রোহান এসব ভাবতে ভাবতে ওর মনে হয় ও কিছু একটা ভুলে গিয়েছে। ওহ! হ্যাঁ তুবাকে তো ও ধন্যবাদই দিল না এত সুন্দর একটা কফি বানিয়েছে। রোহান কফিটা শেষ করে মগটা রেখে বলে,

— অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে এত সুন্দর কফি বানিয়ে খাওয়ানোর জন্য৷ সত্যিই আমি এত মজার কফি আগে খাইনি।
~ কি বলছেন আপনার এত ভালো লেগেছে?
— হ্যাঁ। শোনো, তুমি যতদিন এখানে থাকবে তোমার কাছে আমার একটা রিকোয়েস্ট আছে।
~ জি জি বলুন৷
— তুমি প্রতিদিন সকালে আমাকে এই কফিটা বানিয়ে খাওয়াবে৷ আমি চাই আমার দিনের শুরুটা তোমার মিষ্টি হাতের মিষ্টি কফি খেয়ে শুরু হোক।

তুবা খুব লজ্জা পেয়ে বলে,

~ আচ্ছা ঠিক আছে খাওয়াবো।

রোহান হাসি দিয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর লজ্জাসিক্ত মুখখানা দেখে রোহানের আরও বেশি ওকে ভালো লাগছে। ও মুগ্ধ হয়ে শুধু তুবাকে দেখছে। গোধূলি বিকেলে বাগানের মাঝে ঠান্ডা বাতাস আর মিষ্টি ফুলের সুবাস সাথে ওদের দুজনের নিস্তব্ধ আলাপন। বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি দিচ্ছে ওদের দুজনকে। ওরা দুজন দুজনকে আড় চোখে দেখছে। যেন চোখে চোখে অনেক কথা হচ্ছে ওদের। তবে এই পিন পত নিস্তব্ধতা তুবাকে বেশ লজ্জাসিক্ত করছিল। তাই ও আস্তে করে বলে উঠে,

~ কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?
— হ্যাঁ অবশ্যই।
~ আপনার পরিবারের কাউকে দেখছি না যে? তারা কোথায়?
— কেউই নেই। আমার মা, আমার যখন দশ বছর বয়স তখন তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারপর বাবাই আমাকে বড়ো করেন৷ তার এই বিশাল সম্পত্তি আর ব্যবসা বাণিজ্য সব আমার কাঁধে দিয়ে একদিন সেও মায়ের কাছে চলে যান৷ আমার বাবা আমার মাকে খুব ভালবাসতেন৷ বাবা কখনো জানতো না যে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তার কান্না দেখতাম। আমাকে ঘুম পারিয়ে বাবা মায়ের কথা মনে করে কান্না করতেন। এতটাই মাকে ভালবাসতেন যে কখনো দ্বিতীয় বিয়ে করার বিন্দুমাত্র চিন্তা করেন নি। বাবা মারা গিয়েছেন দু’বছর হলো। এরপর থেকে আমি একদম একা।

রোহান বাগানের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলছিল। কথা শেষে তুবার দিকে তাকালে দেখে ওর চোখে অশ্রু। রোহান অস্থির হয়ে বলে উঠে,

— আরে কাঁদছো কেন? একদিন না একদিন আমাদের সবাইকেই তো এই সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে যেতে হবে তাই না? তাহলে কষ্ট পেয়ে লাভ আছে বলো?
~ আপনি অনেক শক্ত মনের মানুষ। কিন্তু আমি না৷ জানেন, আমার বাবা একমাত্র আমাকে খুব ভালবাসতেন৷ তিনি যতদিন ছিলেন আমার একটুও কষ্ট হয় নি। কিন্তু আমার বয়স যখন পনেরো তখন একদিন রাতে বাবা হার্ট অ্যাটাক করেন৷ অনেক কিছু করেও তাকে আর বাঁচাতে পারে নি। এরপর আমার বড়ো ভাইয়া তার কাঁধে সব দায়িত্ব তুলে নেন৷ আর আমি হয়ে যাই তাদের কাছে বোঝা। তারা শুধু এটাই ভাবে, ও তো একটা মেয়ে। আমরা এত কষ্ট করে সব কিছু দেখে রাখবো আর ও এমনি এমনি সম্পত্তি নিয়ে চলে যাবে৷ এটা হবে না৷ আমরা অনেক ধনী হলেও আমাকে বাসার কাজের মেয়ের মতো রাখা হতো। আমি বুঝি না আমার মা একটা মেয়ে হয়েও কিভাবে তার আপন মেয়ের সাথে এরকম জুলুম করতে পারে! মেয়েরা কি আসলেই সমাজের বোঝা?

রোহান ওর হাতটা খুব শক্ত করে মুঠ করে আছে তুবার কথাগুলো শুনে। ওর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তুবার মা আর ভাইয়ের উপর। ও কেন জানি নিজেকে ধরে রাখতে পারে না তুবার চোখে অশ্রু দেখে৷ ও কোন কিছু না ভেবেই হঠাৎ করে তুবার চোখ দুটো মুছে দেয়। তুবা একদম অবাক হয়ে যায়। আজ পর্যন্ত কেউ ওর চোখের পানি মুছে দেয় নি। অনেক অনেক কেঁদেছে ও। ওর ভাই আর মা দেখেছে সেই কান্না। কিন্তু কখনো তারা মুছে দেয় নি। রোহানই প্রথম। রোহান তুবার চোখ মুছে দিয়ে বলে,

— মেয়েদের তারাই বোঝা ভাবে যাদের ভিতরটা পাষাণ আর যারা মনুষ্যত্বহীন৷ মেয়েরা হলো আল্লাহর সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি। অন্তত আমার মতে। মেয়েদের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ একটা সংসার বলো কিংবা একটা ছেলের জীবন কখনোই একটা মেয়েকে ছাড়া পরিপূর্ণতা পায় না। শূন্য শূন্য থাকে। একটা মেয়েই পারে স্বামী, সন্তান এবং তার সংসারকে দেখে রাখতে। কোন ছেলে সেটা সম্পূর্ণ ভাবে কখনোই পারে না। শুধু তাই না আজকাল মেয়েরাও জব করছে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বড়ো অবদান মেয়েদের। আর এই সবকিছুর থেকেও সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, একটা মেয়ে একজন মা। তাহলে সে কিভাবে সমাজের বোঝা হয় বলো?

তুবা স্তব্ধ হয়ে অবাক পানে রোহানের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের সমাজে খুব কম ছেলেই আছে যারা একটা মেয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে জানে। রোহান নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে একজন। যে সত্যিই জানে একটা মেয়ে সমাজের বোঝা না৷ আজ তুবার চোখে রোহানের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ও অজান্তেই হাসি দিয়ে বলে ফেলে,

~ আপনার মতো একজনকে সব মেয়েই তার লাইফ পার্টানার হিসেবে চায়।

কথাটা বলেই ও ভীষণ লজ্জা পায়। রোহানও হাসি দিয়ে বলে,

— তাই তো এখনো অপেক্ষায় আছি সেই মেয়েটার। কবে যে আসবে? নাকি এসেই পড়েছে কে জানে! হাহা।

তুবা রোহানের লাস্ট কথাটায় বেশ অবাক হয়। ও বুঝতে পারছে না রোহান কি বুঝাতে চেয়েছে ওকে। কিন্তু ও বেশি ভাবে না৷ রোহানের হাসির সাথে হাসি মিলিয়ে ও হাসে৷ সেদিনের গোধূলি বিকেলটা ওদের দুজনের মিষ্টি হাসি আর মিষ্টি অনুভূতি আদান প্রদান দিয়ে সমাপ্তি হয়৷

এরপর ওরা বাসার ভিতরে চলে আসে। নিলু ওদের জন্য অনেক মজার মজার নাস্তা বানায়। তুবা সেগুলো দেখে তো খুশিতে আটখানা। রোহান শুধু মুগ্ধ হয়ে ওকেই দেখছে। অনেক হাসি মজা করে সন্ধ্যার নাস্তা করে ওরা। হঠাৎ রোহানের অফিসিয়াল কল আসলে ও উপরে চলে যায়। তুবা নিলুর সাথে এটা ওটা নিয়ে গল্প করতে থাকে। ওদের ভালো একটা বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রোহান একদম রাতের খাবারের সময় নিচে আসে। তুবা ওকে দেখে ওর কাছে এসে দুষ্টামির স্বরে বলে,

~ কি গার্লফ্রেন্ড কল দিয়েছিল বুঝি? এতক্ষণ পর ছাড়লো? হুম?
— হাহা। তুমি আসলেই একটা পাগলি। আমার কোন গার্লফ্রেন্ড নেই। অফিসিয়াল কল এসেছিল। তারপর কিছু কাজও করতে হলো অফিসের৷ তাই লেইট হলো। কেন তুমি কি মিস করেছো নাকি আমাকে হুম?

তুবা থতমত খেয়ে যায়৷ কারণ রোহান হঠাৎ করেই সত্যিটা বলে ফেলেছে। তুবা কোন রকম নিজেকে সামলে বলে,

~ এহহ! আপনার মতো মানুষকে আমি করবো মিস? অসম্ভব। একটুও করি নি।
— তাই নাকি! তাহলে আমাকে দেখা মাত্রই আমার কাছে আসলে কেন? হুম?

এবার তুবা তো ধরা খেয়েছে। ও কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ও বিরক্তি নিয়ে ভ্রুকুচকে বলে,

~ বেশি বুঝেন আপনি। হুহ। খেতে আসেন তো।

বলেই ও হনহন করে চলে যায়। রোহান খুব খুশি হয়ে হাসতে হাসতে ওর পিছনে পিছনে খাবার টেবিলে গিয়ে বসে। তারপর ওরা খাওয়া দাওয়া করে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে হতে এগারোটার মতো বেজে যায়। এখন ঘুমানোর পালা। রোহান তুবাকে নিয়ে উপরে আসে। তুবাকে দেওয়া রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রোহান বলে,

— তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো সকালে কথা হবে কেমন? (হাস দিয়ে)
~ আচ্ছা।

এদিকে তুবার অবস্থা খারাপ। ও এত বড়ো বাসায় এত কম লোকজনের মাঝে কখনো থাকে নি। ওদের বাসায় অনেক লোকজন ছিল। আর ও থাকতো ওদের বাসার সার্ভেন্টদের সাথে। কিন্তু এখানে তো পুরোই একা। একদম নিস্তব্ধ পরিবেশ চারিদিকে। কেন জানি তুবার অনেক ভয় করছে। তাও ও সেই ভয়টা রোহানকে দেখায় না। ও খুব কষ্টে একটা হাসি দিয়ে বলে,

~ শুভ রাত্রি।
— শুভ রাত্রি। আর শোন কোন সমস্যা হলে আমাকে ডাক দিও। আমার রুমের দরজা খুলে রাখছি তোমার জন্য।
~ জি ধন্যবাদ। তবে আশা করি কোন সমস্যা হবে না। চাইলে লাগিয়ে ঘুমাতে পারেন।
— আচ্ছা।

এরপর রোহান ওর রুমে চলে যায় আর তুবা ওর রুমে। তুবা রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। এতটা নিস্তব্ধতা চারদিকে কি বলবো। ওর গা শিরশির করে উঠে ভয়ে। তার উপর রুমটাও অনেক বড়ো। সব মিলিয়ে বেশ ভালোই ভয় করছে ওর। তুবা আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু এত বড়ো রুমে একা একা ওর খুব ভয় করছে। তাই ঘুমও আসছিল না। কিন্তু ও অনেক চেষ্টা করছে ঘুমানোর। অন্যদিকে রোহান শোয়া মাত্রই গভীর ঘুমে হারিয়ে যায়।

রাত ১ঃ১২ মিনিট,

রোহান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু হঠাৎ ও ফিল করে ওর পিছনে ওর পিঠে কে যেন গুতো দিচ্ছে। প্রথম প্রথম ও স্বপ্ন ভাবে৷ কিন্তু একের পর এক গুতো খেয়ে রোহানও ভয় পায়। কোন সাড়া শব্দ নেই, শুধু গুতো দিচ্ছে। একি অবস্থা! কে হতে পারে এই রহস্যময় গুতো দেওয়া ব্যক্তি? রোহান সবসময় ওর বালিশের নিচে ওর পিস্তলটা রাখে। ও ঠিক করে যদি ভূত হয় তাহলে আজ তাকেও ও গুলি করবে৷ তাই দেরি না করে ও পিস্তলটা নিয়ে যেই ঘুরে আচমকা তাক করে আর সাথে সাথে তুবা চিৎকার দিয়ে উঠে।

~ আয়ায়ায়ায়ায়ায়া……

চলবে…?

তুমি কে পর্ব-০৪

0

#তুমি_কে?
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৪
তুবা চুপচাপ উঠে উপরে রোহানের রুমে ঢুকতেই হঠাৎ করে রোহান ওকে পিছন থেকে টান মেরে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। ওদের মাঝে বিন্দু পরিমাণ দূরত্ব নেই। দুজন একে অপরের সাথে একদম আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে৷ এদিকে তুবা ত পুরো আশ্চর্য হয়ে যায় রোহানের এই কান্ড দেখে। রোহান এসব কি করছে ওর সাথে? তুবা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

~ মানে কি এসব কি করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।
— তুমি রাগলে তোমাকে আরও অনেক বেশি সুন্দরী লাগে জানো?
~ আপনি আমাকে জড়িয়ে ধরে আছেন কেন? এটা কেমন অভদ্রতা? পাগল হয়েছেন নাকি?
— হ্যাঁ হয়েছি। তবে তোমাকে মারার জন্য৷ তুমি কি ভেবেছো আমি তোমার উদ্দেশ্য জানতে পারবো না? তুমি কেন এখানে এসেছো?
~ মানে! কি সব যাতা বলছেন আপনি? মাথা ঠিক আছে? আর আমি কেন এখানে এসেছি মানে কি? (ভীতু আর অস্থির কণ্ঠে)
— তুমি আমাকে খুন করতে এসেছো। আমি একটু আগে জানতে পেরেছি। আমার কোন এক শত্রু তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য, তাই না? তুমি খুব ভালো, অসহায় মেয়ে সাজার অভিনয় করছিলে। কি ভেবেছো আমি কিছুই বুঝতে পারবো না? এখন তোমাকে কে বাঁচাবে হ্যাঁ? (তুবাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে)

তুবা রোহানের কথা শুনে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুই বলছে না। রোহান ওকে চুপ দেখে আবার বলে,

— কি হলো চুপ কেন? ধরা খেয়েছো তাই?

রোহানকে পুরো অবাক করে দিয়ে তুবা খুব ইন্টেন্স মুখ করে হঠাৎই ওর গলা চেপে ধরে বলে,

~ হ্যাঁ। আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনাকে মারতেই আমি এখানে এসেছি। অনেক বড়ো মাস্টার প্ল্যান করে এসেছিলাম। ভেবেছি আজ রাতে আপনি ঘুমালে আপনাকে খতম করে ফেলবো। কিন্তু ধরা খেয়ে গেলাম। এবার আপনাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তুমি শেষ চান্দু।

তুবার হঠাৎ এই পরিবর্তন দেখে রোহানের গলার পানি শুকিয়ে যায়। আরে ওতো একটা মুভি দেখে তুবার সাথে একটু মজা করছিল। কিন্তু সেই মজা যে এভাবে সত্যি হয়ে যাবে রোহান কল্পনাও করে নি। ও ভয়ে তুবাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। আর বলে,

— এসব কি বলছো তুমি? আমি তো মজা করছিলাম।

তুবা আবার রোহানের কাছে এসে ওকে ধরে বলে,

~ কিন্তু চান্দু আমি তো মজা করছি না। এখনি আপনাকে গুলি করবো। আমার কাছে একটা লুকানো পিস্তল আছে। এই যে… আপনি এবার শেষ। হাহা।

বলেই তুবা রোহানের পেটে আঙুল দিয়ে পিস্তলের মতো করে একটা গুতো দেয়। আর মুখ দিয়ে ডিস্কাও ডিস্কাও করতে থাকে। রোহান ভয়ে নায়ায়ায়া বলে চিৎকার দেয়৷ ও ভাবে তুবা ওকে সত্যি সত্যিই গুলি করেছে। কিন্তু পরক্ষণেই ও পেটে হাত দিয়ে দেখে ওর কিছুই হয় নি। ও অবাক হয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে দেখে, তুবা পাগলিটা অট্টো হাসতে হাসতে আঙুল দিয়ে ডিস্কাও ডিস্কাও করছে। রোহান এই দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামও চলে এসেছিল ভয়ে। আসলে ও পুরো অপ্রস্তুত ছিল। খুব তাড়াতাড়িই সব কিছু হয়েছে। তাই নিজেকে সামলাতেই পারে নি ও। আর এদিকে আমাদের তুবামনি তো হাসতে হাসতে কাহিল প্রায়। ও শুধু প্রাণ খুলে হাসছে আর আঙুল দিয়ে পিস্তলের মতো করে ডিস্কাও ডিস্কাও করছে রোহানের দিকে তাকিয়ে। রোহান খুব লজ্জা পায়৷ ও তুবার সাথে একটা মুভির মতো মজা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু ও নিজেই ভীষণ ভাবে বোকা হয়ে যায়। লজ্জায় ছেলেটার মাথাকাটা যাচ্ছে। তুবা হাসতে হাসতে বলে,

~ আমার সাথে মজা করেন হ্যাঁ? কেমন লাগলো আমার মজাটা? ডিস্কাও। হাহা।
— তবে রে দাঁড়াও, তোমার আজ খবর আছে। রোহানকে ভয় দেখানো না? দাঁড়াও একবার…

রোহান তুবাকে ধরার জন্য ওর পিছনে দৌড় দেয়। তুবা হাসতে হাসতে নিজেকে বাঁচাতে এদিক ওদিক ছুটতে থাকে যাতে রোহান ওকে ধরতে না পারে। কিন্তু একটা ছেলের সাথে কীভাবে তুবা পেরে উঠবে৷ তাই তুবা যখন বেডের উপর উঠতে যায় ওমনি রোহান ওকে খপ করে ধরে ফেলে। কিন্তু ধরতে গিয়ে একটা বিপত্তি হয়৷ রোহান তুবাকে ধরতে গিয়ে ওর উপর পড়ে যায়। এখন তুবার ঠিক উপরেই রোহান। দুজন একে অপরের সাথে আবার মিশে আছে। নেই একফোঁটাও দূরত্ব। রোহান তুবাকে ধরতে পেরে শয়তানি হাসি দিয়ে ওর হাত দুটো চেপে ধরে বলে,

— আমি চান্দু না? এখন তো ধরা পড়েই গেলে। এখন কই পালাবে? হুম?
~ ছাড়েন তো লাগছে।( লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে বলল)
— আমার সাথে এমন করলে কেন আগে সেটা বলো?

তুবা রোহানের দিকে তাকাতেই পারছে না৷ কারণ রোহানের গরম নিঃশ্বাস বারবার ওর মুখের উপর পড়ছিল। তুবার পুরো শরীরে অজানা এক অনুভূতি অনুভব হচ্ছে। ওর পুরো মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছে। ও আস্তে করে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ আপনি প্রথমে শুরু করেছেন। আমি না।
— তাহলে শেষটাও আমি করি।
~ মানে?

তুবা দেখে রোহান ওর মিষ্টি গোলাপি ঠোঁটটার দিকে খুব নেশালো একটা মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে৷ মনে হচ্ছে এই বুঝি রোহান ওর ঠোঁটটাকে নিজের করে নিবে৷ তুবার হৃদস্পন্দন এতই বেড়ে গিয়েছে যে ও স্পর্শ শুনতে পাচ্ছে ওর প্রতিটি হার্টবিট। শুধু ও না হয়তো রোহানও শুনতে পাচ্ছে। এদিকে রোহান তুবার নেশা লাগানো মিষ্টি ঠোঁটটার ঘোরে পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ। কেন জানি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না৷ রোহান অজান্তেই তুবার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুবাও কেন জানি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে৷ অজানা একটা অনুভূতির কারণে এর নয়ন জোড়া আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসে। তার মানে ও রোহানের পরম স্পর্শ চাচ্ছে। রোহান তুবার চোখ বন্ধ করা দেখে আরো নিজেকে হারিয়ে ফেলে। ও বুঝতেই পারছে না জেদের বসে ও কি করতে যাচ্ছে। ও যেই তুবার ঠোঁটটা নিজের করে নিতে যাবে ওমনি দরজায় কড়া পড়ে।

~ ও ভাইয়া…আপুর রাগ কি কমেছে? (নিলু)

সাথে সাথে তুবা চোখ মেলে তাকায়। আর রোহানের ঘোরও কেটে যায়। দুজনেই লজ্জায় মরে যাচ্ছে। রোহান এক লাফে উঠে বসে। আর তুবা উঠে সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়। যাওয়ার সময় একটা নতুন ড্রেস সাথে নিয়ে যায়। রোহান থতমত খেয়ে গিয়েছে। ও কি করতে যাচ্ছিলো একটু আগে! হায়! হায়! এদিলে নিলু বাইরে ডাকছে বলে ও কোন রকম নিজেকে সামলে দরজা খুলে হাসি মুখে বলে,

— হ্যাঁ বোন ভেঙেছে। ও ফ্রেশ হতে গিয়েছে।
~ ওহ! যাক তাহলে তো ভালো। আমি যাই তাহলে।
— আচ্ছা শোন, ধন্যবাদ তোকে।
~ কেন ভাইয়া? (অবাক হয়ে)
— এই যে বোনের মতো ভাইয়ের খেয়াল রাখছিস তাই।
~ হাহা তুমিও নক ভাইয়া। আমি আসি।

নিলু হাসতে হাসতে চলে গেলে রোহান ওর বুকে হাত দিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ও মাথায় হাত দিয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করতে করতে ভাবছে,

— হায় আল্লাহ! এ আমি কি করেছি। তুবা তো আমার সাথে আর কথাই বলবে না৷ ও নিশ্চিত আমাকে খারাপ একটা ছেলে ভাববে৷ ধুর! আমিও বা কি করবো, ওর মতো এরকম একটা নেশাকাতর মেয়ে কাছে থাকলে নিজেকে কন্ট্রোল করা যায় নাকি! তার উপর ওকে আবার ভালোও লাগে। নাহ! আমি ভুল করেছি। ও বের হলে আগে মাফ চাইবো। হ্যাঁ এটাই করতে হবে। লাগলে কান ধরে মাফ চাইবো।

রোহাম এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই তুবা ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। রোহান পিছনে ঘুরে ওর কাছে মাফ চাইবে বলে যেই ওর দিকে তাকায় ও পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। তুবা মিষ্টি কালারের একটা বাসার ড্রেস পরেছে। রোহান সব ভুলে আস্তে আস্তে করে হেঁটে ওর আশেপাশে ঘুরে ওকে দেখে বলে,

— ওয়াও তুবা, তোমাকে তো হুরের মতো লাগছে। একটা মেয়ে যে কখনো এতটা মায়াবী আর অপরূপা হতে পারে আমার জানাই ছিল না। মাশাল্লাহ।

বলেই যেই রোহান তুবার দিকে তাকায় ও সাথে সাথে ওর মুখ চেপে ধরে। ও আবার ভুল করেছে। ওর ত সরি বলার কথা। তুবা রোহানের কান্ড দেখে যেমন লজ্জা পাচ্ছে তেমন অস্বস্তি বোধও করছে। রোহান দ্রুত বলে উঠে,

— সরি।
~ সরি।

রোহানের সাথে সাথে তুবাও সরি বলে। রোহান অবাক হয়। ও আবার জিজ্ঞেস করে,

— তুমি সরি বলছো কেন?
~ আপনি সরি বলছেন কেন?

ওরা আবার দুজন একি সাথে সেইম প্রশ্ন করে। পরে দুজনেই হেসে দেয় এই অবস্থা দেখে। তুবা লজ্জায় লাল হয়ে আছে। রোহানও ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। ওরা কথা বাড়ায় না। রোহান আস্তে করে বলে,

— আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
~ জি।

বলেই রোহান আলমারি থেকে ওর পরনের বাসার ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকেই যাচ্ছিল। তুবা যেই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে ওমনি পিছন থেকে রোহান ওর কানের কাছে এসে আস্তে করে বলে,

— গোলাপ ফুল।

বলেই ও দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। তুবা রাগী ভাবে রোহানের দিকে তাকালেও ওর চলে যাওয়া দেখে খিলখিল করে হেসে দেয়। খুব হাসছে ও। বিগত এত বছরগুলোতে তুবার মুখে এরকম হাসি কখনো আসে নি। কখনো ওর এত ভালো লাগে নি। কখনো এই অজানা মিষ্টি অনুভূতি ওকে এত আনন্দ দেয় নি। কিন্তু রোহানের কাছে আসার পর থেকেই ওর শূন্য জীবনটা কেমন পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তুবা এসব ভাবতে ভাবতে হেঁটে জানালার কাছে যায়৷ জানালা দিয়ে রোহানের বাগানটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খুব সুন্দর একটা বাগান। তুবা ঠিক করে একবার বাগানে যাবে ও। তবে রোহান যদি ওর সাথে থাকে ওর ভালো লাগাটা হয়তো আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। তুবা গালে হাতে দিয়ে মুচকি একটা হাসি নিয়ে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো মনে করছে আর বেশ লজ্জা পাচ্ছে।

অন্যদিকে,

— এতগুলো সময় হয়ে গেল আর তোরা একটা মেয়েকে এখন পর্যন্ত খুঁজে বের করতে পারলি না? তাহলে তোদের টাকা দিয়ে পেলে লাভটা কি আমার হ্যাঁ? (খুব রাগী ভাবে)
— বস আরেকটু সময় দেন৷ আমরা অবশ্যই আপনার বোনরে খুঁজে বের করমু
— যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে খুঁজে বের কর। নাহলে তোদের খবর আছে।
— জি বস। ওই তোরা আয়।
— তুবা তুই কোথায় পলাবি? তোকে আমি খুঁজে বের করবোই। আমার সম্পত্তি ভোগ করা না? শুধু পেয়ে নি তোকে।

রোহানের বাসায়,

রোহান ফ্রেশ হয়ে আসলে তুবাকে নিয়ে লাঞ্চ করতে বসে ওরা। নিলু ওদের জন্য অনেক কিছু রান্না করেছে। তুবার কাছে নিলুর রান্না অসম্ভব ভালো লাগছে। ও একদম মন ভরে খায়৷ ওদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তুবা আর রোহান আবার ওদের রুমে চলে আসে। রোহান খুব ক্লান্ত থাকায় ওর বেডে এসে বসে পড়ে৷ কিন্তু তুবা চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রোহান বুঝতে পারে না তুবার আবার কি হলো। ও ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলে,

— কি হলো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কি হয়েছে?

তুবা রোহানের দিকে তাকিয়ে বলে,

~ আপনি জানেন না কি হয়েছে?
— না তো। কি হয়েছে বলো আমাকে?
~ আমার বিকালে ঘুমানোর অভ্যাস। আমি ঘুমাবো।
— ওও। এই কথা। তো ঘুমাও, না করেছে কে। এই যে বালি….(রোহান ওর বেডের বালিশটা ঠিক করতে করতে বলতে গিয়ে থেমে গেল)

রোহান বোকার মতো মুখে যা আসছে তা বলেই যাচ্ছিল। পরক্ষণেই ওর জ্ঞান হয় যে ও কি বলছে। ও আস্তে আস্তে শুষ্ক একটা হাসি দিয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে দেখে, ম্যাম রাগী ভাবে ভ্রুকুচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রোহান এবার বড়ো করে একটা হাসি দিয়ে উঠে তুবার কাছে গিয়ে বলে,

— তুমি কি শুনেছো আমি তোমাকে আমার বেডে ঘুমাতে বলেছি?

তুবা রাগী ভাব নিয়ে ইশারায় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে। রোহান হাসতে হাসতে বলে,

— হাহা। তুমি ভুল শুনেছো। আমি বলেছি পাশের রুমটা তোমার জন্য। এখন থেকে তুমি ওই রুমেই থাকবে। আসো আমার সাথে।
~ জি চলুন৷

রোহান তুবাকে পাশের রুমটা বুঝিয়ে দিয়ে ওর নিজের রুমে চলে এসে জিহবায় কামড় দিয়ে মনে মনে বলে,

— ছিঃ ছিঃ কি বললাম আমি ওকে। ও আমাকে মনে হয় এবার ঘৃণাই করবে৷ নাহ! আর ভালো লাগে না। আমিও একটু ঘুমাই।

এই বলে রোহানও ঘুম দেয়। এখন ঘড়িতে দুপুর তিনটা নাগাদ বাজে। রোহানের ঘুম ভাঙে বিকেল ৫ঃ১৬ মিনিটে৷ ও আস্তে আস্তে উঠে বসে আড়মোড়া দিচ্ছে। তার ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে বেশ ভালোই বিকেল হয়েছে। তাই ও ঠিক করে তুবাকে গিয়ে দেখে আসবে ও উঠেছে কিনা৷ আসলে রোহান তুবাকে দেখে না অনেকক্ষণ হয়েছে বলেই ও অস্থির হয়ে যাচ্ছে। রোহান পাশের রুমে গিয়ে নক দেয়। তিন চার বার নক দেয়। কিন্তু কোন সারা শব্দ নেই। রোহান বলে,

— কি হলো তুবা দরজা খুলো না কেন? নাহলে কিন্তু আমি চলে আসবো। এই তুবা…

কোন পাত্তা নেই৷ রোহান চিন্তায় পড়ে যায়৷ তাই ও আর দেরি না করে দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে দেখে পুরো রুম ফাঁকা। বেডটাও ঘুছানো। রুমে একটা পিঁপড়াও নেই। রোহানের হার্টবিট বেড়ে যায়। তুবা কই? ও দ্রুত নিচে চলে আসে। এসে দেখে নিলু হলরুমে টিভি দেখছে। ওর কাছে এসে রোহান অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— নিলু নিলু তুবা কই?
~আমি ত জানি না ভাইয়া। আপনার সাথে না উপরে ছিল।
— কি বলিস তুই জানিস না মানে! তুবাকে তো আমি আমার পাশের রুমে ঘুমাতে দিয়েছিলাম। এখন উঠে দেখি ও নাই৷
~ হায়! হায়! তাহলে আপুমনি কই গেল?

রোহান অন্য সার্ভেন্টদের ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করে তুবাকে দেখেছে কিনা৷ কিন্তু সবার উত্তর একটাই, না। রোহান ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। তুবা তাহলে কোথায় গেল! রোহানের খুব অস্থির আর চিন্তা হচ্ছে। ওর মাথা একদম কাজ করছে না। তুবা কই?

চলবে..?

তুমি কে পর্ব-০৩

0

#তুমি_কে?
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০৩
রোহান পিছন থেকে তুবাকে ধরে একটানে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। ও চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে রোহানের সুন্দর মুখখানার দিকে তাকিয়ে আছে। রোহান আস্তে আস্তে ওর একদম কাছে চলে যায়। ওদের দুজনের মাঝে মাত্র চার আঙুলের দূরত্ব। রোহানকে এত কাছে পেয়ে তুবার হার্টবিট অনেক বেড়ে যাচ্ছে৷ ও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তুবা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে যেই কিছু বলতে যাবে ওমনি রোহান ওর নরম মিষ্টি ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে ওকে থামিয়ে দেয়৷ আর তারপরই ও তুবার মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করা নয়ন জোড়ার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আমি তোমাকে এখানে কখন থাকতে বলেছি? তুমি একটা মেয়ে আর আমি একটা ছেলে। আমাদের একসাথে থাকাটা কখনোই ঠিক হবে না। তাহলে কিভাবে আমি তোমাকে থাকতে দিব? এরচেয়ে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসি। সেটাই ভালো হবে৷

তুবা খুব অস্থির হয়ে মাথা নাড়িয়ে ইশারায় না না করতে থাকে। রোহান তুবার ঠোঁটের ওপর থেকে আঙুল সরালে খুব অনুনয় স্বরে তুবা বলে উঠে,

~ আমাকে প্লিজ এখানে কদিন থাকতে দিন৷ আমি ওই বাসা থেকে কদিন দূরে থাকতে চাই। নাহলে আমি মরেই যাবো।

তুবার মুখে মরে যাবো কথাটা শোনা মাত্রই রোহান ওকে ছেড়ে এক কদম পিছনে চলে আসে। তুবা এই ফাঁকে নিজেকে সামলে নেয়। আর বলে,

~ আপনার এই বাসাটা তো অনেক বড়ো। আমাকে নাহয় আপনার সার্ভেন্টের মতোই রাখলেন। রোহান রাগী ভাবে তুবার দিকে তেড়ে এসে বলে,

— একদম চুপ। সেই কখন থেকে যা তা বলেই যাচ্ছো। আচ্ছা ঠিক আছে থাকো তুমি। তাও উলটা পালটা বলো না তো।
~ সত্যিই আমি এখানে থাকতে পারবো?
— তা ছাড়া আর কোন উপায় আছে? আচ্ছা তুবা..
~ এই এই কি বললেন?
— কি বললাম?
~ আপনি আমার নাম ধরে ডাকলেন?
— হ্যাঁ।
~ প্লিজ আবার ডাকেন তো।
— তুবা..
~ আবার।
— তুবা তুবা তুবায়ায়ায়া…
~ উফফফ! আপনার কাছে আমার নামটা শুনতে অনেক ভালো লাগছে। হিহি।
— তুমি সত্যিই একটা পাগলি। যাই হোক, তোমার পরিবারে কে কে আছে?
~ জেনে কি করবেন? থাক না ওসব।
— তুবা, সেই কাল থেকে তুমি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছো। আমার কিন্তু এবার রাগ হচ্ছে। (রাগী ভাবে কথা গুলো বলল রোহান)
~ আচ্ছা বলছি। সবই বলছি। আমার পরিবারে আমি, আমার বড়ো একটা ভাই আর মা আছে। আমার আব্বু নেই৷ সে মারা যাওয়ার পর থেকেই আমার জীবনটা নরক বানিয়ে ফেলেছে আমার মা আর ভাই। তারা আমাকে একটুও পছন্দ করে না। আমার ভাই আপনার মতো অনেক বড়ো বিজনেসম্যান। কিন্তু আমাকে সবসময় নিম্নমানের ড্রেস পড়ায়। মাঝে মাঝে খেতে দেয় না। আমার সাথে কথা বলে না৷ আমার ভাইয়া ভাবে তার সম্পত্তির দুই ভাগ আমি নিয়ে নিব তাই। আর আমার মাও চায় আমি যেন আর না বাঁচি মরে যাই। সে শুধু তার ছেলেকেই পছন্দ করে। আমাকে বোঝা ভাবে। আমার বাবার বিশাল সম্পত্তি আমার ভাই আর মা দখল করে বসে আছে। তবে আমার বাবা জানতো সে চলে গেলে আমার সাথে ওরা খুব অন্যায় করবে৷ তাই বাবা আগেই সব সম্পত্তি আমার নামে গোপনে লিখে দিয়ে গিয়েছেন। সেটা ওরা এত দিন জানতো না৷ জানলে মেরেই ফেলতো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আমার ভাই তা জেনে যায়৷ তাই ওখানে আর থাকতে পারছিলাম না৷ আমার ভাই খুব খারাপ। অনেক খারাপ। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি। সারাদিন রাস্তায় এদিক ওদিক শুধু হেঁটেছি। হাঁটতে হাঁটতে গতকাল অসুস্থই হয়ে পড়ি। বাকিটা তা আপনিই জানেন।

রোহান তুবার কথা শুনে ওর রুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়ে দু’হাত মাথায় দিয়ে। ও কল্পনাও করতে পারছে না মানুষ এতটা খারাপ হতে পারে। তাও আবার নিজের পরিবারের! এদিকে তুবাও অনেকটা ইমোশনাল হয়ে পড়ে। রোহান মাথা তুলে তুবার চোখে অশ্রু দেখে দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বলে,

— শোনো তোমার আর কোন ভয় নেই।আর কোন চিন্তাও নেই। তুমি যতদিন খুশি এখানে থাকো। কেউ তোমাকে কিছু বলবে না৷ আর হ্যাঁ সার্ভেন্টের মতো নয় নিজের বাসা মনে করেই থেকো।

তুবা খুব খুশি হয়ে চোখ মুছে বলে উঠে,

~ সত্যি বলছেন আপনি?
— হুম।
~ আচ্ছা একটা আবদার করি আপনাকে?
— হ্যাঁ বলো।
~ আমাকে ছবি আঁকা শিখাবেন? আপনি খুব ভালো একজন আর্টিস্ট।

রোহান মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

— তোমার ছবি আঁকতে ভালো লাগে?
~ অনেক অনেক বেশি। (অসম্ভব মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে)
— ঠিক আছে আমি ফ্রী থাকলে অবশ্যই শিখাবো। এবার যাও ফ্রেশ হয়ে আসো। নাস্তা খাবে।
~ ঠিক আছে।

তুবা বাচ্চাদের মতো হাঁটতে হাঁটতে ফ্রেশ হতে চলে যায়। রোহানের কাছে তুবাকে খুব ভালোই লাগছে। সত্যি বলতে ও চাচ্ছিলো তুবা এখানেই থাকুক। কারণ তুবার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকেই রোহানে মুখে আবার হাসি ফিরে এসেছে। তুবার কথা ভাবতে ভাবতে রোহান বারান্দায় চলে যায়৷ ওর বারান্দাটা অনেক বড়ো। সামনে বিশাল বড়ো খোলা জায়গা। বেশ ভালোই লাগছে ওর। গতকাল এতগুলো টাকার যে লস হলো তা যেন ও ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎই ওর ফোনটা বেজে উঠে,

— হ্যালো…
— স্যার আসসালামু আলাইকুম। আপনি কি রওনা দিয়েছেন?
— অলাইকুম আসসালাম। না, আজকে আমি আসবো না। তুমি একটু দেখে রেখো সব।
— স্যার প্রজেক্টটার জন্য কি এখনো মন খারাপ করে আছেন?
— কোন প্রজেক্ট?
— হায় হায় স্যার! আপনি ভুলে গিয়েছেন? গতকাল আমাদের প্রজেক্টটা যে আহসান কোম্পানি নিয়ে নিল ওইটা।
— ওহ! সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা শোনো, আমরা হয়তো অনেক লাভ করতে পারতাম ওই প্রজেক্টটা দিয়ে। আবার ক্ষতিও হতে পারতো। সো হয়তো আমাদের কোম্পানির ভালোর জন্যই আমরা ওই প্রজেক্টটা পাই নি। তুমি আমাদের রানিং কাজ গুলোতে জোর দেও৷
— ওকে স্যার। সত্যিই আপনি অনেক ভালো। ইনশাআল্লাহ আমরা এর চেয়েও ভালো কাজ পাবো।
— হ্যাঁ অবশ্যই৷
— ওকে স্যার আসসালামু আলাইকুম।
— অলাইকুম আসসালাম।

রোহান ফোনটা রেখে দেয়৷ ওর মনটা এখন একদম ফ্রেশ। কারণ ওর মন জুড়ে এখন শুধু তুবার চিন্তা৷ এরপর তুবা ফ্রেশ হয়ে আসলে রোহান ওকে নিয়ে নিচে নাস্তা করতে যায়। নিলু তুবাকে দেখে দ্রুত ওর কাছে চলে আসে। রোহান খাবার টেবিলে বসে। নিলু তুবার কাছে গিয়ে বলে,

~ আপুমনি এখন কেমন আছেন আপনি? জ্বর আছে?
~ না না একদম সুস্থ এখন৷
~ সুস্থ তো হতেই হবে৷ ভাইয়া নিজে সারারাত আপনার সেবা করেছেন। আমাকেও করতে দেয় নি।

তুবা লজ্জা পায়। লজ্জায় ওর পুরো মুখ লাল হয়ে যায়। রোহান সেটা বুঝতে পেরে বলে,

— আহ! নিলু এগুলো বাদ দে। তুবা বসো নাস্তা খাবে।
~ ভাইয়া এমনিই, তার প্রশংসা করলে সে শুনতে চায় না। পরে আমরা আমরা করবো নি।
~ আচ্ছা আচ্ছা। (হাসি দিয়ে)
~ এখন বসেন আমি সবাইকে নাস্তা দিচ্ছি।

তুবা রোহানের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসে। আড় চোখে রোহানকে দেখছে ও৷ লোকটা অনেক ভালো। নাহলে ওকে কখনোই থাকতে দিত না৷ হঠাৎ রোহানও তুবাকে আড়চোখে দেখতে গিয়ে ওদের চোখাচোখি হয়ে যায়। রোহান থতমত খেয়ে গিয়ে জোরে বলে উঠে,

— কইরে নাস্তা কই। তাড়াতাড়ি নিয়ে আয়। তুবার নাকি অনেক ক্ষুধা লাগছে৷ আমাকেও নাকি খেয়ে ফেলতে পারে। হাহা।

তুবা হা করে রোহানের দিকে তাকিয়ে আছে ওর কথা শুনে৷ আর রোহান হাসতে হাসতে শেষ। তুবা ভ্রুকুচকে অভিমানী কণ্ঠে বলে,

~ এটা কি হলো?
— কই কি হলো?
~ আমি কখন বললাম আমার ক্ষুধা লেগেছে? আপনাকে খেয়ে ফেলবো?
— বলো নাই কিন্তু বলতে ত পারো। হাহা।
~ এএএ! আপনি অনেক পঁচা। আমি কিন্তু চলে যাবো।
— যাও। গেলে তোমারই ক্ষতি। আর ছবি আঁকা শেখা হবে না৷

রোহান হাসছে আর তুবা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। রোহান আবার বলে উঠে,

— আচ্ছা আচ্ছা বাবা সরি। একটু মজা করলাম তোমার সাথে। রাগ করো না।
~ কান ধরে বলেন৷ তাহলে মাফ করে দিব। নাহলে আর কথা নাই আপনার সাথে।
— যাহ! আমি কত বড়ো। আমি কিভাবে কান ধরবো?
~ তাহলে আর কি। আপনার সাথে আর কোন কথা নাই৷ হুহ।

রোহান তো মহা মুসিবতে পড়েছে। তুবা গাল ফুলিয়ে বসে আছে অভিমান করে। কি আর করবে, ভালো লাগার মানুষকে তো আর রাগ করিয়ে রাখা যায় না৷ রোহান অসহায় ভাবে মুখ করে বলে,

— আচ্ছা এই যে ধরছি…

তুবা তাকিয়ে দেখে রোহান ওর কান ধরতে নিচ্ছে। ও খুব হাসি দিয়ে দ্রুত বলে,

~ আরে আরে কি করছেন৷ কান ধরতে হবে না। আমিও মজা করছিলাম আপনার সাথে। হিহি।

রোহান মুগ্ধ হয়ে তুবার হাসি দেখছিল। কি মিষ্টি একটা হাসি। এরমাঝে নিলু শেষমেশ নাস্তা নিয়ে আসে। তারপর ওরা দুজন খুব মজা করে খায়। নিলুকে সবসময়ের মতো ওদের সাথে খেতে বললেও ও খায় না৷ খাওয়া দাওয়া শেষ হলে নিলু রোহানকে বলে উঠে,

~ ভাইয়া আপনি কিন্তু একটা জিনিস ভুলে গেছেন৷
— কি বোন?
~ আপুর তো কোন ড্রেসই নেই। সে এই একটা ড্রেস পরেই আছে গতকাল থেকে।
— সিট! আমার মাথায় তো এটা আসেই নি। তুবা তাহলে একটু রেস্ট নেও। আমরা শপিং এ যাবো।
~ আমার জন্য আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না? এখন আবার এত গুলো টাকা খরচ করবেন। তবে সমস্যা নেই। আপনার যে টাকা ৫০০০০/৬০০০০ হাজার টাকা আমার পিছনে খরচ করলে আপনার গায়েই লাগবে না। তাই না?

তুবার কথা শুনে রোহান হাসবে না কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অবশ্য ও ভুল বলে নি। রোহান হাসতে হাসতে বলে,

— মাত্র ৫০/৬০ হাজার টাকা! তোমাকে এর চেয়েও বেশি টাকার আজকে শপিং করে দিব চলো।
~ ইয়াহুউউউ। চলেন চলেন।

এরপর সারে এগারোটার দিকে রোহান আর তুবা শপিং এ বের হয়৷ এদিকে তুবা রোহানকে দেখে পুরো হা করে তাকিয়ে আছে। এত্তো হ্যান্ডসাম লাগছে ওকে। ব্ল্যাক কালারের জিন্স আর ফুল হাতার শার্ট পরেছে ও। হাতাটা আবার রোল করা। হাতে রোলেক্সের ঘড়ি। আর চোখে কালো দামী সানগ্লাস। পুরো হিরোদের মতো লাগছে। তুবাকে এমন দেখে রোহান বলে,

— কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
~ না মানে আসলে…(খুব লজ্জা পাচ্ছে ও)
— আহ! লজ্জা পাচ্ছো কেন? বলো?
~ আপনাকে অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে৷
— হাহা৷ আমার চেয়ে তোমাকে বেশি সুন্দর লাগছে বুঝলে। এবার চলো নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে৷
~ আচ্ছা। (খুশি হয়ে)
— পাগলি একটা।

রোহান তুবাকে নিয়ে ওর পরিচিত একটা ফ্রেন্ডের গার্লস আউটলেটে চলে যায়। ওরা ভিতরে ঢুকতেই রোহানের বন্ধু মানে রুমন এগিয়ে আসে। আর বলে,

— এসেছিস দোস্ত। আয় আয়। তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। এই তাহলে আমাদের ভাবী? ওয়াও দোস্ত! ভাবী তো মারাত্মক সুন্দরী। এত সুন্দরী ভাবীকে কোথায় পেলি?

তুবা রোহানের দিকে আর রোহান তুবার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। দুজনেই লজ্জায় শেষ। মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না৷ তুবা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। রোহান কিছু বলতে যাবে ওমনি তুবা ওর হাতটা ধরে বলে,

~ ভাইয়া একদিন বাসায় আসবেন তখন সব বলবেন উনি। এখন আমরা শপিং করি?
— হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্য। এই যা যা ভাবীর যা পছন্দ হয় সেটাই কিনে দিবি কিন্তু। তোদের জন্য স্পেশাল ছাড় আছে।
— আচ্ছা৷

রোহান তুবার পিছনে পিছনে ভয়ে যাচ্ছিল। তুবা ভিতরে গেলে রোহানের দিকে ঘুরে ভ্রুকুচকে রাগী ভাবে ওর দিকে তাকায় আর বলে,

~ আপনার বন্ধু তার ভাবীকে পেয়ে এত খুশি হচ্ছিল। আপনি তাকে কি বলতে যাচ্ছিলেন হ্যাঁ?
— কেন সত্যিটা।
~ আপনার কি মাথা ঠিক আছে? এটা একটা জায়গা এসব বলার? আর কেনই বা বলবেন? আমাকে ছোট করতে চান সবার কাছে?
— না মানে ও তো ভুল বুঝতে ছিল তাই না?
~ তো কি হয়েছে?
— না মানে আমি ভেবেছি তুমি রাগ করবে তাই আরকি..
~ আপনি সত্যিটা বললে রাগ করতাম। আর সে আমাকে আপনার গার্লফ্রেন্ড ভাবলেই কি আমি হয়ে গেলাম? আপনি তো আর ভাবেন না তাই না? তাহলে সমস্যা কোথায়?
— বললে ভাবতে পারি। ( খুব আস্তে করে বলল)
~ এই এই কি বললেন শুনিনি। আবার বলেন ত।
— বলেছি সরি। আর এমন হবে না৷ আজ থেকে তুমি সবার ভাবী। হাহা।
~ গুড বয়। আসুন এবার শপিং করি।
— হুম চলো।

এরপর তুবা বেশি না মাত্র দুটো ড্রেস কিনতে চেয়েছিল। ও বলে অযথা টাকা নষ্ট করবেন না আমার পিছনে। কিন্তু রোহান কোন কথা শুনে নি তুবার৷ অনেক গুলো দামী ড্রেস কিনে দেয় তুবাকে। তুবা রাগ করে মুখ ফুলিয়ে থাকে। আসলে ও মুখে বললেও সত্যি কারে চাচ্ছিলো না রোহানের এতগুলো টাকা নষ্ট করতে। শুধু দুইটা ড্রেসই কেনার ইচ্ছা ছিল ওর। তাও আবার কম দামী। কিন্তু রোহান তো সেই নাছরবান্দা। ও অনেক কিছু কিনে দেয় তুবাকে। এরপর বাসায় রওনা হয় ওরা। তুবা পুরো রাস্তা জুড়ে মুখ ফুলিয়ে থাকে৷ কেন ওর জন্য এতগুলো টাকা রোহান নষ্ট করলো! এরপর ওরা বাসায় আসলে তুবা হল রুমে চুপচাপ বসে থাকে। নিলু ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। রোহান ওকে ডাক দিয়ে বলে,

— ম্যাম মাত্র দুইটা ড্রেস কিনতে চেয়েছিল তাও আবার কম দামী। তাই আমি জোর করে অনেকগুলো দামী ড্রেস কিনে দেওয়ায় রাগ করেছে। দেখ কি কিউট টাই না লাগছে ওকে। হাহা।
~ ভাইয়া, আপু মনে হয় অনেক রাগ করছে। রাগটা ভাঙানো উচিত।
— হায় হায় বলিস কি।
~ হুম।

রোহান আস্তে আস্তে তুবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,

— আমার সাথে আসো। কথা আছে তোমার সাথে।

বলেই রোহান উপরে ওর রুমে চলে যায়। তুবা নিলুর দিকে তাকায়। নিলু দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বলে,

~ যান যান৷ দেখেন কি বলে ভাইয়া।

তুবা চুপচাপ উঠে উপরে রোহানের রুমে গেলেই হঠাৎ করে…

চলবে..?

তুমি কে পর্ব-০২

0

#তুমি_কে?
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০২
তুবা রোহানকে যা বলল তা শোনার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না। তুবা বলে,

~ আমি আসলে বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি। আমি আর এই নরকে যেতে চাই না। ওখানো কোন মানুষ বসবাস করে না। (বলতে বলতে কিছুটা কেঁদে দেয় ও)

রোহান সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যায়। আর অবাক কণ্ঠে বলে,

— কি বললে! তুমি পালিয়ে এসেছো?
~ জি। (রোহানের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে)
— তুমি কি পাগল নাকি? এভাবে কেউ পালিয়ে যায় নাকি নিজ বাসা থেকে? (চিন্তিত কণ্ঠে)
~ ওটা আমার বাসা না৷ ওখানে আমার কেউই থাকে না।
— মানে কি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না৷

নিলু রোহানের কাছে এসে বলে,

~ ভাইয়া শান্ত হন আপনি। মাথা ঠান্ডা করেন দয়া করে।
— তুই বুঝতে পারছিস? এই মেয়ে পালিয়ে এসেছে। এখন যদি ওকে খুঁজতে এসে আমার কাছে পায় তারা তো ভাববে আমি ওকে নিয়ে এসেছি। তখন আমার রেপুটেশনটার কি হবে একবার ভেবেছিস?
~ আমি কি আসতে চেয়েছিলাম নাকি। আপনিই তো জোর করে আনলেন। (নিচু স্বরে বলল)
— দেখ দেখ আবার কি বলছে? এই মেয়ে ক্ষুধা লাগছে এই কথা কে বলছিল তখন হ্যাঁ?
~ আমি আমি।

তুবা একদম বাচ্চাদের মতো হাত উঠিয়ে কথাটা বলল। ওর মায়াবী মুখখানা আর বাচ্চাপানা দেখে রোহানের রাগ কিছুটা পড়ে যায়। কিন্তু ও আবার জোর দিয়ে বলে,

— নাহ, এটা ঠিক না। বলো তোমার বাসা কোথায়? আমি এখনিই তোমাকে দিয়ে আসবো।
~ অসম্ভব। আমি মরে গেলেও আর ওখানে যাবো না৷
— আচ্ছা কেন যাবে না? কি হয়েছে ওখানে? আমাকে খুলে না বললে কিভাবে বুঝবো?
~ না আপনাকে কিছু জানতে হবে না। আমি আপনার বাসা থেকে চলে যাচ্ছি। শুধু শুধু আপনাদের কষ্ট দিতে চাই না৷ আমিই চলে যাচ্ছি। অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে খাবার দেওয়ার জন্য৷ আসি।

কথা শেষ করেই তুবা উঠে রওনা হয়। আর রোহান খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে। এই প্রথম রোহান কোন মেয়ের হাত ধরেছে। ভীষণ নরম আর গরম তুবার হাতটা। তুবা ভ্রুকুচকে রোহানের দিকে তাকাতেই রোহান ওকে ভীষণ অবাক করে দিয়ে ওকে টান মেরে কাছে এনে সোজা ওর কপালে হাত দেয়। তুবা আশ্চর্য হয়ে বলে,

~ এসব কি? আপনি আমাকে স্পর্শ করছেন কেন?

রোহান নিলুর দিকে তাকিয়ে বলে,

— দ্রুত জলপট্টির ব্যবস্থা কর। এই পাগল মেয়ের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।
~ জি ভাইয়া।

নিলু দ্রুত দৌড়ে যায়। রোহান এবার তুবার দিকে তাকায় আর রাগী ভাবে বলে,

— তোমার গায়ে যে এত জ্বর তুমি আমাকে আগে বলো নি কেন? এই জন্যই তোমার মুখ লাল হয়ে ছিল! আমি বুঝতেই পারিনি। (রোহান এখনো তুবার হাতটা ধরে ছিল)

তুবার সেটা ভালো লাগছিল না। তাই ও নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে,

~ আমাকে নিয়ে আপনার আর চিন্তা করতে হবে না। আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। ছাড়ুন আমাকে।
— একদম না। তুমি অনেক অসুস্থ।
~ আহ! বলেছি তো আমি ঠিক আছি। ছাড়ুন। আমি যাবো গা।

বলেই হ্যাচকা টান মেরে তুবা রোহানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,

~ আমি বলেছি আমি ঠিক আছি তারপ…..

হঠাৎই তুবা সব ঝাপসা দেখতে শুরু করে৷ আর মনে হতে থাকে ওর পুরো দুনিয়া ঘুরাচ্ছে অনেক জোরে। আর সাথে সাথে চোখটাও বন্ধ হয়ে আসছে। তুবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতে নিলে রোহান ওকে ধরে ফেলে। এর মধ্যে নিলুও এসে পড়ে। রোহান তুবাকে অজ্ঞান হতে দেখে অসম্ভব চিন্তিত হয়ে জোরে জোরে বলতে থাকে,

— তুবা…তুবা কি হয়েছে? অজ্ঞান হলে কেন? হায়! আল্লাহ এখন আমি কি করবো?
~ ভাইয়া শান্ত হন৷ আপুকে আপনার রুমে নিয়ে যান। জ্বরের কারণে মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। আমি ডাক্তার ভাইয়াকে কল দিচ্ছি।
— হ্যাঁ বোন দ্রুত সাদমানকে কল দে। বল ইমার্জেন্সি।
~ আচ্ছা আচ্ছা।

রোহান তুবাকে কোলে তুলে সোজা দোতলায় ওর বেড রুমে নিয়ে যায়। নিয়ে ওকে শুইয়ে দেয়। খুব অস্থির লাগছে রোহানের। একটু পরই নিলু জলপট্টি নিয়ে আসে। আর বলে,

~ ভাইয়া, সাদমান ভাইয়া বলছে বেশি বেশি জলপট্টি দিতে। দিন আমি দিয়ে দিচ্ছি। আপনি শান্ত হয়ে বসেন।
— না না আমি দিয়ে দিচ্ছি। তুই ছোট মানুষ। তুই আবার অসুস্থ হয়ে পড়লে আরেক ঝামেলায় পড়বো। তুই নিচে গিয়ে সাদমানের জন্য অপেক্ষা কর। ও আসলে সাথে সাথে ওকে উপরে নিয়ে আসবি।
~ ঠিক আছে ভাইয়া৷

নিলু চলে যায়। রোহান খুব যত্ন করে তুবার সেবা শুরু করে। ও কেন এমন একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য এতকিছু করছে তা ও নিজেও বুঝতে পারছে না৷ তবে ওর কাছে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তুবাকে সুস্থ করা। রোহান দেখে তুবার শরীর কাঁপছে। মানে ওর শীত করছে। রোহান দ্রুত ওর ব্লাংকেট’টা তুবার গায়ে দিয়ে দেয়৷ আর এদিকে জলপট্টি তো দিচ্ছেই৷ ও তুবার অসম্ভব সুন্দর মায়াবী মুখখানার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখের পলক, গোলাপি মিষ্টি ঠোঁটটা, খাড়া নাক সব মিলিয়ে ও একদম পার্ফেক্ট। রোহান কখনো একটা মেয়েকে এত কাছ থেকে দেখে নি। তবে এখন তুবার জন্য ওর অনেক খারাপ লাগছে। এত মিষ্টি মেয়েটা এভাবে অসুস্থ হয়ে যাবে ও ভাবতেই পারেনি। রোহান তুবার সেবা করতে করতে আর ওকে দেখতে দেখতে একসময় সাদমান চলে আসে। রোহান ওকে দেখে রীতিমতো অ্যাটাক করে। সাদমান বলে উঠে,

— ভাই ভাই শান্ত হ। আমি দেখছি পেসেন্টের কি হয়েছে।
— দেখ ভাই ভালো করে দেখ। হঠাৎ করেই অজ্ঞান হয়ে গেছে৷ সাথে জ্বর তো আছেই।

সাদমান পরীক্ষা নিরাক্ষা করে বলে,

— জ্বরের কারণে আর মানসিক চাপে এই অবস্থা হয়েছে। চিন্তা করিস না সকালে মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে৷ আমি ইনজেকশন দিয়ে দিচ্ছি।
~ ব্যথা পাবে না তো ও?
— এই ব্যাটা, ইনজেকশন এ কেউ ব্যথা পায় নাকি? ছোট বেলায় শুনিস নি পিঁপড়ার কামড়ের মতো ব্যথা লাগে। ওটা কোন ব্যথা?
— আচ্ছা আচ্ছা বুঝছি।

সাদমান হাসতে হাসতে তুবাকে ইনজেকশন দিয়ে দেয়৷ আর বলে,

— জ্বর যতক্ষণ না কমে জলপট্টি দিতে হবে৷ আর পারলে শরীরটাও মুছে দিতে হবে পেসেন্টের।
— আচ্ছা আচ্ছা।
— ওয়েট এ মিনিট! এই ব্যাটা আসল কথাই তো ধরা হইলো না। তুই এই রাতে এই মেয়েকে পেলি কই?
— তুবা নাম ওর।
— সে যাই হোক, তুই আসল কথা বল।
— আরে ম্যাডাম তার বাসা থেকে পালিয়ে এসেছেন। ভাগ্য ভালো আমি রাতে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। তখন তাকে পাইছি।
— বাহ! ব্যপারটা তো পুরাই সিনেমাটিক হয়ে গেল।
— হুম। কিন্তু সিনেমার গল্প তো আমাদের জীবন থেকেই লিখা তাই না দোস্ত?
— হ্যাঁ তাও ঠিক। যাই হোক এখন কি করবি কিছু ভেবেছিস? এরকম কুমারী সুন্দরী একটা মেয়েকে তোর বাসায় এভাবে রাখাটা কি ঠিক হবে?
— ওইইই…তুই এত বাড়িয়ে বলছিস কেন? আবার পছন্দ টছন্দ করেছিস নাকি ওকে? (একটু রাগি ভাবে)
— হাহা…চিল ভাই, তোর ভাবী আগেই ঠিক করা আছে। সো ভয় নাই। তোর যে তুবাকে ভালো লেগেছে সেটা এখানে আসার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারছি।
— হইছে এবার যা। অনেক রাত হইছে।
— হুম৷ এই ঔষধ গুলো সকালে এনে ওকে খাইয়ে দিস।
— আচ্ছা দোস্ত।
— আসি তাহলে। ওর খেয়াল রাখিস।
— হুম। তুই সাবধানে যাস। কষ্ট দিলাম।
— ধুর ব্যাপার না।

সাদমান চলে গেলে রোহান আবার তুবার পাশে গিয়ে বসে ওকে জলপট্টি দিতে থাকে। আর কিছুক্ষণ পর পর ওর মুখ আর হাত মুছে দেয়। কারণ পুরো শরীর ওর মুছে দেওয়া ঠিক হবে না তাই। এভাবে সকাল পাঁচটা পর্যন্ত রোহান তুবার সেবা করতে থাকে। তুবার জ্বর এখন অনেকটাই কমে আসে। রোহান মেপে দেখে জ্বর এখন আর নেই। ও এবার কিছুটা চিন্তা মুক্ত হয়৷ রুমের অল্প আলোতে তুবার মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রোহান। জ্বরটা কমে যাওয়ায় মুখের লালিমা এখন আর নেই। অনেকটা ফ্রেশ লাগছে ওকে। রোহান মুচকি একটা হাসি দিয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে আছে। ও ওর জীবনে অনেক মেয়ে দেখেছে। কিন্তু কাউকে কখনো মনে ধরে নি। কিন্তু এই পাগলিটাকে কেন জানি ভালোই লাগছে। রোহান ভাবছে, কেন এই পাগলিটা ওর বাসা থেকে পালিয়ে আসলো? আর ওর পরিবারেই বা কে কে আছে? এখনো অনেক কিছু জানা বাকি তুবার সম্পর্কে। রোহান তুবার দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি কে? বলেই আবার মুচকি হাসি দেয়। ওর কপালটায় একবার ছুঁয়ে দিয়ে নাকটায় একটা টোকা দিয়ে একসময় রোহান তুবার পাশেই ঘুমিয়ে পড়ে বসা অবস্থায়।

পরদিন সকালে,

দক্ষিণ জানালা দিয়ে স্নিগ্ধ সকালের মিষ্টি রোদ এসে প্রথমে তুবার চোখে মুখে পড়ে। রোদের হালকা তাপে ওর ঘুমটা আস্তে আস্তে ভেঙে যায়। চোখটা আস্তে আস্তে মেলে উপরে ঘুরন্ত ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে গতকাল রাতে কি কি হয়েছে তা মনে করার চেষ্টা করে ও। মনে করতে করতে ওর ফিল হয়, ওর নরম হাতটা কারো শক্ত উষ্ণ হাতের নিচে চাপা পড়ে আছে৷ মানে ওর হাতটা কেউ ধরে আছে। এই স্পর্শটা খুব পরিচিত মনে হলো তুবার৷ গতরাতে এই হাতের স্পর্শ ও পেয়েছে। আর দেরি না করে তুবা ডান পাশে তাকিয়ে দেখে রোহান ওর হাতটা ধরে মাথা পেতে ঘুমিয়ে আছে। পাশের ছোট টুলে জলপট্টি রাখা। তারমানে রোহান সারারাত ওর সেবা করেছে। তুবা ওর কপালে গায়ে হাত দিয়ে দেখে বিন্দু পরিমাণ জ্বর নেই ওর গায়ে। আর খুব ভালোও লাগছে ওর এখন। সবই রোহানের সেবার জন্য হয়েছে। তুবা তা ঠিকই বুঝতে পারে। ও মনে মনে খুব খুশি হয়। এই প্রথম ওর জন্য কেউ এত কিছু করলো। তুবা আস্তে আস্তে ওর হাতটা রোহানের কাছ থেকে সরাতেই রোহান শক্ত করে হাতটা ধরে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আর সাথে সাথে তুবার দিকে তাকায়। তুবা ভয়ে কোন কিছু না ভেবেই চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করতে থাকে। রোহান ভাবে তুবা এখনো ঘুমাচ্ছে। তাই ও তুবার কপালে গালে হাত দিয়ে চেক করছে ওর গায়ে আর জ্বর আছে কিনা৷ দেখে না পুরো গা ঠান্ডা। রোহান একদম চিন্তা মুক্ত হয়। কিন্তু এদিকে রোহানের এভাবে হাতের স্পর্শ পেয়ে তুবার পুরো শরীরে অন্যরকম একটা শিহরণ অনুভব হয়৷ ও মনে মনে আচ্ছা মতো রোহানকে বকা দিচ্ছে। খালি ওকে স্পর্শ করে রোহান। আরে একটা ছোট বাচ্চাকেও তো কেউ এত স্পর্শ করে না৷ তুবা মনে মনে বলে,

~ লুচ্চা, শয়তান, ফালতু লোক একটা। ইসস! কিভাবে আমাকে স্পর্শ করছে। উফফ!

তুবাকে এই প্রথম কোন ছেলে স্পর্শ করেছে। তাই ও এমন করছে। এদিকে রোহান তুবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে ওর হাতটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এরপর ও ফ্রেশ হতে চলে যায়। রোহান গেলে তুবা একটা চোখ মেলে তাকায়। দেখে রোহান কোথাও নেই। তারপর ও আস্তে আস্তে উঠে বসে। পুরো রুমটা ভালো করে দেখতে থাকে। এটা রোহানের রুম। বেশ সুন্দর আর অনেক বড়ো। অনেক দামী দামী আর্ট দেখা যাচ্ছে দেয়ালে। বরাবরই তুবা আর্টের প্রতি অনেক দুর্বল। ওর খারাপ সময় গুলো ও ছবি এঁকে এঁকে পাড় করতো। ও একলাফে উঠে আর্টগুলোর কাছে গিয়ে তা খুব মন দিয়ে দেখতে থাকে। তুবা আর্ট দেখতে দেখতে খেয়াল করে নিচে এক কোণায় ছোট্ট করে আর্টিস্ট এর নাম লিখা। তুবা যেই নামটা পড়ে ও পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। ও বাকি আর্ট গুলোও চেক করে দেখে একই নাম সব গুলোয়। আসলে এই আর্ট গুলো সব রোহানের আঁকা। তুবা ভাবতেও পারছে না রোহান এত ভালো একজন আর্টিস্ট। ও পুরো বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। হঠাৎই পিছন থেকে পরিচিত সেই কণ্ঠ বলে উঠে,

— এই ছবিটার নাম দিয়েছি আমি, পুড়ে যাওয়া স্মৃতি। কেমন হয়েছে ছবিটা? দীর্ঘ ২ মাস লেগেছে এটা আঁকতে আমার।

তুবা চমকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখে রোহান। ও কেন জানি একটু লজ্জা পায়৷ তাই চোখ নামিয়ে বলে,

~ আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দিব আমার জানা নেই। তাও অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে৷
— কেন? কেন? (ভীষণ অবাক হয়ে)
~ কারণ আপনি আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছেন তাই। আমি তো এখন থেকে এখানেই থাকবো। আপনি সত্যিই অনেক ভালো। (মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে)

কথাটা বলেই তুবা মিটমিট করে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু রোহান পিছন থেকে ওকে ধরে একটানে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। তুবা চোখ গুলো বড়ো বড়ো করে রোহানের সুন্দর মুখখানার দিকে তাকিয়ে আছে। রোহান আস্তে আস্তে তুবার একদম কাছে চলে যায়। ওদের দুজনের মাঝে মাত্র চার আঙুলের দূরত্ব। রোহানকে এত কাছে পেয়ে তুবার হার্টবিট অনেক বেড়ে যায়৷ ও জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তুবা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে যেই কিছু বলতে যাবে ওমনি রোহান ওর নরম মিষ্টি ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে ওকে থামিয়ে দেয়৷ আর তারপরই….

চলবে…?

তুমি কে পর্ব-০১

0

#তুমি_কে?
লেখকঃ আবির খান
পর্বঃ ০১

রাত প্রায় ২ টা নাগাদ বাজে। রোহান ওর নিজের ব্ল্যাক কালারের নিসান জিটি আর গাড়িটা নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছে। আজ ওর মনটা একদম খারাপ। অনেক বড়ো একটা প্রোজেক্ট হাত ছাড়া হয়েছে। খুব রাগ হচ্ছে নিজের উপর। ৩০০ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারতো ওর কোম্পানি যদি প্রোজেক্টটা ওরা পেত। কিন্তু ওর বিপক্ষদল আহসান কোম্পানি অফ ইন্ডাস্ট্রিজ প্রোজেক্টটা নিয়ে নেয় অসৎ ভাবে। রোহান আসলে বুঝতে পারছে না যে ওর কি হয়েছে। কেন ও পারলো না? খুব বিরক্ত লাগছিল ওর। তাই নিজেকে একটু ঠিক করতেই এই রাত্রি ভ্রমণ। রোহান সো করে গাড়ি টান দিতেই ওর মনে হলো রাস্তার পিছনে আইলাইনারের উপর কেউ একজন বসা ছিল। ও গাড়িটা একটু স্লো করে লুকিং গ্লাসে আবছা দেখে খুব সম্ভবত একটা মেয়ে। কিন্তু এত রাতে! এভাবে রাস্তায় বসে আছে কেন? রোহানের বিষয়টা খটকা লাগে। ও দ্রুত রিভার্স গিয়ারে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পিছনে এসে সাইড মিররে দেখে, হ্যাঁ সত্যিই একটা মেয়ে ফুটপাতে দু’গালে হাত দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। রোহান গাড়ি থেকে নামার আগে ভালো করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কোথাও কেউ আছে কিনা৷ বলা তো যায় না এটা কোন ট্রাপও হতে পারে। তাই রোহান ওর গাড়িতে রাখা সেল্ফ ডিফেন্স এর জন্য যে পিস্তলটা ছিল সেটা ওর পিছনে নিয়ে গাড়ি থেকে আস্তে আস্তে নেমে মেয়েটার কাছে যায়।

রোহান এখন মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মেয়েটার সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। রোহানের কাছে বিষয়টা অদ্ভুত লাগে। মেয়েটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাহলে এই রাতে রাস্তায় কেন? ওর মনের মধ্যে একের পর এক প্রশ্নের আবির্ভাব হচ্ছে তো হচ্ছেই। সেগুলোর উত্তর শুধু মেয়েটাই দিতে পারবে। তাই রোহান আর দেরি না করে বলে ওঠে,

— এই যে হ্যালো, এত রাতে আপনি এখানে এভাবে বসে আছেন কেন? কি হয়েছে?
~…….

কোন উত্তর নেই। মেয়েটা সেই আগের ন্যায় চুপচাপ বসেই আছে৷ রোহান এবার হাতে চুটকি বাজিয়ে জোর দিয়ে বলে,

— কি ব্যাপার আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন? নাকি পুলিশকে কল করবো?

এবার মেয়েটা দ্রুত মাথা তুলে রোহানের দিকে তাকায়। রোহান এই প্রথম মেয়েটাকে দেখলো। ও দেখে মেয়েটার অসম্ভব সুন্দর নয়নজোড়ায় অশ্রুতে ভরে আছে। মায়াবী মুখখানায় সেই অশ্রু গড়িয়ে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে। ও এই অপরূপার করুণ অবস্থা দেখে ব্যথিত হয় এবং সাথে সাথে জিজ্ঞেস করে,

— একি আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে প্লিজ বলুন তো?

মেয়েটা কান্নাসিক্ত কণ্ঠে এই প্রথম একটি বাক্য বলে,

~ আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।

রোহান মুহূর্তেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। এবং ওর মনটাও খারাপ হয়ে যায় মেয়েটার এভাবে বলা দেখে। মেয়েটার মুখটাও শুকনো মনে হচ্ছে। হয়তো অনেকক্ষণ না খাওয়া। রোহান বলে উঠে,

— তাহলে না খেয়ে এখানে বসে আছেন কেন?

মেয়েটা আবার আগের মতো মাথা নিচু করে কান্নাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ আমার কাছে কোন টাকা নেই। সেই সকাল থেকে না খাওয়া। শরীরে একটুও শক্তি পাচ্ছি না৷ (খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল)

মেয়েটার কথাগুলো রোহানের বুকে এসে তীরের মতো লাগলো। ও আর কিছু না ভেবে বলে,

— আচ্ছা বুঝেছি। আপনি আমার গাড়িতে উঠুন।

মেয়েটা মাথা তুলে রোহানের দিকে ভ্রুকুচকে তাকিয়ে বলে,

~ কেন?
— আপনাকে খাওয়াবো তাই।
~ সত্যি খাওয়াবেন নাকি আবার খারাপ কিছু করার চিন্তা করছেন? যদি করে থাকেন তাহলে আমি যাবো না। এখানেই চুপচাপ বসে থাকবো। আপনি চলে যান। আমি যাবো না।

মেয়েটার কথা শুনে রোহান অজান্তেই হেসে দেয়। দীর্ঘ একটি মাস পর ও আজ হাসি দিয়েছে। আর কদিন গেলে হয়তো ও হাসিই ভুলে যেত। রোহান মুচকি হেসে ভাবে, এত বড়ো মেয়ে তাও বাচ্চাদের মতো কথা বলছে। ও হাসতে হাসতে বলে,

— আচ্ছা আমাকে দেখে কি খারাপ ছেলেদের মতো মনে হচ্ছে?

মেয়েটা রোহানকে ভালো করে দেখে সাথে ওর গাড়িটাও দেখে আবার মাথা নিচু করে ইশারায় না না করে। রোহান হেসে বলে,

— তাহলে এই অপরিচিত ছেলেটাকে একটু বিশ্বাস করে আসুন আমার সাথে। ভয় নেই, আমি আপনার কোন ক্ষতি করবো না। শুধু আপনার ক্ষুধাটা নিবারন করতে চাই।

মেয়েটা রোহানের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে,

~ সত্যি বলছেন তো?
— জি সত্যি।
~ আচ্ছা চলুন।
— আসুন তবে।

রোহান মেয়েটাকে সামনে ওর পাশের সিটে বসিয়ে নিজেও এসে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ে। ও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে, মেয়েটা পেটে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে আছে মাথা নিচু করে। নিশ্চয়ই প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। রোহান গাড়ি স্টার্ট না নিয়ে ভাবছে, এত রাতে একে নিয়ে কোন রেস্টুরেন্টে গেলে নির্ঘাত সবাই ভুল বুঝবে৷ তার উপর ওর মতো বিজনেসম্যানের সাথে দেখলে তো আরও বিপদ। তাই রোহান শেষমেশ ঠিক করে ওর বাসায়ই নিয়ে যাবে এই মেয়েকে। যেই ভাবা সেই কাজ। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গুলশান মানে ওর বাসার দিকে রওনা হয় ওরা। গাড়ি চালাতে চালাতে রোহান আড় চোখে মেয়েটা দেখছিল। খুব সুন্দর পরিপাটি মেয়েটা। কিন্তু এরকম একটা মেয়ে বাসা রেখে রাস্তায় কেন আসলো? রোহান আরো ভাবে, এই মেয়েকে তো বাসায় নিচ্ছে। আবার কোন সমস্যায় পড়তে হবে নাতো ওকে? চিন্তায় ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আসে। এরপর আধা ঘণ্টার মধ্যে রোহান ওর বাসার সামনে চলে আসে। একটা হর্ণ দিতেই দারোয়ান দ্রুত দরজা খুলে দেয়। তারপর বাসার ভিতরে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে রোহান মেয়েটাকে আস্তে করে বলে,

— এই যে মিস আমরা চলে এসেছি। এবার মাথাটা তুলে একটু দেখুন।

মেয়েটা আস্তে আস্তে মাথা তুলে প্রথমে রোহানের দিকে এক নজর তাকিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে, বিশাল বড়ো একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। সামনে বাগান৷ অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা। একটা সার্ভেন্ট কখন থেকে ওর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে,সেদিকে মেয়েটার খেয়ালই নেই। খুব দুর্বল লাগছিল মেয়েটার। রোহান আবার বলে,

— গাড়ি থেকে নামবেন নাকি এখানেই খাওয়া দাওয়ার প্ল্যান করেছেন?

মেয়েটা লজ্জা পেয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি থেকে নামে। ততক্ষণে রোহানও নেমে মেয়েটার কাছে চলে আসে। মেয়েটা গাড়ি থেকে বের হলে রোহান বলে,

— আমার সাথে আসুন৷
~ জি।

এরপর রোহানের পিছু পিছু মেয়েটা যেতে থাকে। যেতে আশপাশটা ভালো করে দেখতে থাকে। তারপর বিশাল বড়ো একটা গেইটের সামনে আসতেই সেটা খুলে যায়। বেশ দামী কারুকার্য করা দরজাটা। রোহানের সাথে মেয়েটা বাসার ভিতরে ঢুকতেই মেয়েটা পুরো থ। এত সুন্দর আর এত বড়ো বাসা সে আগে কখনো দেখে নি। আধুনিক ডিজাইন আর দামী দামী আসবাবপত্র। রোহান যে কতটা ধনী ব্যক্তি মেয়েটা তা আচ করতে পারছে। রোহান মেয়েটাকে নিয়ে হল রুমে এসে একজনকে ডাক দেয়।

— নিলু..এই নিলু…
~ জি ভাইয়া বলেন।(দৌড়ে এসে)
— এই আপুর জন্য দ্রুত খাবার রেডি কর। দেরি হয় না যেন।

নিলু অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে আস্তে করে বলে,

~ জি ভাইয়া এখনি করছি।

নিলু হলো রোহানের বাসার রাঁধুনি। খুব মজা করে রান্না করে মেয়েটা। এবার রোহান মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলে,

— আসুন আমার সাথে।

মেয়েটাকে নিয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে একটা কমন ওয়াশরুম দেখিয়ে ও বলে,

— এতক্ষণ বাহিরে ছিলেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন৷
~ জি ধন্যবাদ।

মেয়েটা দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসে। তারপর রোহান ওকে খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে। আসলে ও রাতের খাবার এখনো খায় নি। নিলু একে একে অনেক খাবার নিয়ে আসে। এনে জিজ্ঞেস করে,

~ ভাইয়া আপনিও তো খান নি। আপনাকেও দি?
— হুম দেও।

তারপর নিলু ওদের দুজনকেই খাবার বেরে দেয়। মেয়েটা এত ক্ষুধার্ত ছিল যে নিলু খাবার দেওয়ার সাথে সাথেই সে খাওয়া শুরু করে। রোহান খাবার মুখে দিতে গিয়েও থেমে যায় মেয়েটার খাওয়া দেখে। নিলুও বেশ অবাক হয়ে দেখছিল। রোহানের দিকে তাকালে ও ইশারায় কিছু বলতে না করে। রোহান একটু খাবার মুখে দিয়ে খেতে খেতে বলে,

— যত ইচ্ছা খান৷ কোন সংকোচ করবেন না৷ একদম পেট মন সব ভরে খান।

মেয়েটা খেয়েই যাচ্ছে। রোহানের কথার কোন পাত্তাই দেয় নি। ও পুরো বোকা হয়ে যায়৷ নিলু মিটমিট করে হাসছে। মেয়েটা খেতে খেতে নিলুর দিকে তাকিয়ে বলে,

~ আরেকটা রোস্ট দিবে খুব মজা হয়েছে।

নিলু যেন মেয়েটার কথা আর মুখখানা দেখে আবেগি হয়ে যায়৷ ওর এত্তো এত্তো ভালো লাগে যে চোখে পানি চলে আসে। ও বলে উঠে,

~ আপুমনি একটা কেন দুটো নিন৷
~ না না একটা দিলেই হবে৷ খুব মজা হয়েছে সত্যিই।

মেয়েটা একদম গলা পর্যন্ত খায়৷ রোহান আর নিলু অবাক হয়ে তা দেখে। এক পর্যায় মেয়েটার খাওয়া শেষ হলে সে রোহানের দিকে তাকায়। রোহানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে খুব লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে,

~ সরি, আসলে খুব ক্ষুধা লেগেছিল। আর রান্নাটাও অসম্ভব মজা হয়েছে। তাই নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।
— আরে কি বলছেন! কোন সমস্যা নেই। আপনি লাগলে আরো খান। কেউ কিছু বলবে না।
~ না না আর খাওয়ার জায়গা নেই।
— হাহা আচ্ছা আচ্ছা।
~ ভাইয়া এবার আপনি তো খাওয়া শেষ করেন।
— হ্যাঁ করছি করছি।
~ আপুমনি আমার সাথে আসেন হাত ধুবেন।

নিলু মেয়েটাকে নিয়ে হাত ধুইয়ে দিতে নিয়ে যায়৷ আর রোহান মুচকি হাসতে থাকে খেতে খেতে। সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রোহান মেয়েটাকে নিয়ে হল রুমে বসে। মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। কিছু বলছে না। রোহানও ভাবছে কোথা থেকে শুরু করবে৷ মেয়েটা একবার আড় চোখে ওর দিকে তাকায়। ওদের চোখাচোখি হলে ওরা দুজনেই চোখ সরিয়ে ফেলে। রোহান আর সময় নষ্ট না করে জিজ্ঞেস করে,

— এবার বলুন তো আপনার নাম কি?

মেয়েটা আস্তে করে বলে,

~ তুবা রহমান।
— বাহ! সুন্দর নাম। এবার আসল কথায় আসা যাক। আপনি এত রাতে রাস্তায় কি করছিলেন? আর আপনার বাসা কই?
~ আপনি আমার অনেক বড়ো। তাই তুমি করে বললেই ভালো হয়।
— ওহ! আচ্ছা। এই এই তুমি কথা ঘুরাচ্ছো। আমাকে উত্তর দেও আগে৷

তুবা চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। কোন কিছুই বলে না৷ রোহান আরো একবার জিজ্ঞেস করে। কিন্তু তুবা সেই মাথা নিচু করে বসে থাকে। নিলুও সেখানে ছিল। রোহান ইশারা করে ওকে। নিলু মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বলে তুবার কাছে গিয়ে বসে বলে,

~ আপুমনি ভয় নাই। আপনি বলেন। রোহান ভাইয়া অনেক ভালো। আপনাকে সাহায্য করবে৷

তুবা নিলুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে করে রোহানকে বলে,

~ আসলে আমি…

চলবে..?

প্রিয় তুমি পর্ব-১৫

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৫

সেহের চোখমুখ কুঁচকে বসে রইলো। পূরব সেহেরকে প্রতিনিয়ত লজ্জায় ফেলার জন্য বিভিন্ন কথা বলছে আর ড্রাইভ করছে। যাইহোক, একপর্যায়ে ওরা বাড়ি পৌঁছে গেলো। তখন গোধূলি শেষে সন্ধ্যা। গাড়ি বাড়ির সামনে থামতেই পূরবের কাজিনের দল হামলা চালালো। সেহেরকে গাড়ি থেকে নামালো৷ পূরব শক্ত করে ওর হাত ধরে আছে৷ ওদেরকে বরণ করলো পূরবের বড় খালা। তারপর বিভিন্ন নিয়মনীতি মেনে ওদেরকে বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেওয়া হলো৷

সেহের ভারী সাজগোজ নিয়ে অস্বস্তিতে কাদা হয়ে যাচ্ছে। কাকে বলবে সে এই কথা? পূরবও নেই। কিন্তু ওকে বলতে হলোনা। পূরবের খালা’রা এসে ওর হাতে একটা পার্পল রঙের শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে যেতে বললো৷ সেহের আনন্দে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পরে নিলো। এবার ভীষণ শান্তি লাগছে। এরপর সবার সামনে আড্ডা দেওয়া হলো। খালারা সবাই ভীষণ ভালো মানুষ। সেহেরকে খুব সহজেই আপন করে নিলো৷ ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্নই করলোনা ওরা।

সেহেরকে নিজ হাতে তুলে খাইয়ে দিলেন বড়খালা। এরপর সেহেরকে সাজাতে বসানো হলো। ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছিলো মিঠারঙা শাড়িটাতে। আজ ওর বাসর রাত। ভেবেই সারা শরীরে কাঁপন ছড়িয়ে পড়লো সেহেরের। একসময় পূরবের কাজিনরা ওকে পূরবের ঘরে এনে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলো। রাত তখন বারোটা। ক্লান্তিতে বুজে আসছিলো ওর চোখ। পূরব কোথায়? এলো মিনিট পাঁচেক পরেই। অবশেষে সেহের তার প্রিয় মানুষটাকে দেখে চোখ জুড়ালো। পূরব দরজা বন্ধ করে এসে সোজা হাতমুখ ধুয়ে এসে ওর পাশে বসলো। ব্যস্ত কন্ঠে বলল, ‘ওয়েট করছিলে?’

‘হুম। কোথায় ছিলেন আপনি?’

‘জিসানকে উচিৎ শিক্ষা দিয়ে এসেছি।’

‘কেন?’

‘আমার ফ্রেন্ডদের সাথে মিলে প্ল্যান করছিলো কীভাবে বাসর রাতে আমাকে জ্বালাবে। আমিও কম না, আগেই সব জানতে পেরে গেছি। বাকি বন্ধুদের টাকা দিয়ে হাত করে জিসানকে ওর ঘরে তালা মেরে, ওর ফোনটাও নিয়ে এসেছি। এবার প্ল্যান করার মজা বুঝুক!’

‘ওনাকে একা কেন? বাকিরাও তো প্ল্যান করেছিল?’

‘ওকে দিয়েছি কারণ, মাস্টার প্ল্যানটা ওর ছিল। তাই।’

সেহের হেসে বললো, ‘আপনি পারেনও বটে।’

‘তো পারতে হবেনা? জীবনের স্পেশাল রাত এটা। কি ভেবেছো তুমি? এমনি এমনিই ছেড়ে দিব? নো নো!’

সেহের লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেলো। পূরব বলল, ‘এই বাসর রাতের জন্য পঞ্চাশ হাজার জলে ফেলে দিলাম, আর তুমি লজ্জায় নুইয়ে যাচ্ছো? এটা কেমন কথা সেহের?’

‘পঞ্চাশ হাজার? এত? আমার ছয়মাসের থাকা-খাওয়া,বাসা ভাড়া, গাড়ি ভাড়া আর পড়ার খরচ হয়৷ আর আপনি সামান্য বাসর রাতের জন্য এত টাকা নষ্ট করলেন? ও মাই গড!’

পূরব সেহেরের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’এত আনরোমান্টিক তুমি? বাসর রাতে মাসের হিসাব নিয়ে বসেছ? ওফ নো!’

সেহের ভয় পেয়ে আমতাআমতা করে মিথ্যা কথা বলল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাব আমি৷’

পূরব রেগে ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে বলল, ‘কী বললে? ঘুমাবে? মিথ্যা বলার জায়গা পাও না? তুমি মিথ্যা ভালো বলতে পারোনা সেহের। যদি সত্যি বলতে তাহলে তুমি আজ ছাড়া পেতে, কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার অপরাধে এখন আমাকে কুড়িটা চুমু দিতে হবে। আর তাও যদি না চাও, কংগ্রাচুলেশনস মিসেস। আমি এর থেকে বেশিকিছু করার জন্য রেডি আছি। সো কোনটা চাও? অপশন “ওয়ান” অর “টু”?

সেহের কিছু বললো না। পূরবটা কি শুরু করেছে ভেবেই মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাচ্ছে। বিশটা চুমু? কখনো পারবেনা সেহের। ওর এই নীরবতা দেখে পূরব বাঁকা হেসে বলল, ‘কোনটা মিসেস?’

সেহের সিক্ত কন্ঠে জবাব দিল, ‘কোনোটাই না।’

‘তা বললে হবেনা। তাহলে অপশন “টু” –ই ঠিক আছে। কি বলো?’

সেহের বালিশে মুখ গুঁজে বলল,’আপনার লজ্জা নেই!’

‘বউয়ের সামনে কীসের লজ্জা?’

‘ছিঃ!’

‘ছিঃ বললে ডাবল হবে সবকিছু। ইউ নো, কুড়ির পরিবর্তে চল্লিশ, আই রিপিট চল্লিশ!!’

বলতে বলতে পূরব সেহেরের মুখটা উপরে তুললো। লজ্জারাঙা সেই মুখ দেখেই পূরব আবিষ্ট হয়ে গেলো। মাথার ভেতর সবকিছু গুলিয়ে এলো। সেহেরের ঠোঁটজোড়া অল্প কাঁপছে। মোহনীয় এক দৃশ্য! একটা চোখ মেরে সেহেরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতেই সেহেরের চোখদুটো বড়বড় হয়ে গেলো। হঠাৎই করেই আক্রমণ। সেহের লজ্জায় পূরবকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো। কিন্তু পারলোনা৷ ভালোবাসা জড়ানো সেই আদরে দুটি মন আবারও এক হয়ে গেলো৷ প্রিয়দের প্রিয় তুমিকে নিজের করে পেলো। সেহেরের সাধ্যি কী এই ভালোবাসাকে দূরে ঠেলবার? পারবেনা সে কখনো! অদ্ভুত সে এক ভালোবাসা। আদরে মোড়ানো, ভালোবাসায় জড়ানো! আবেশে পূর্ণ মায়াবী সেই রাত!

পরিশিষ্ট: এটা একটা ডায়েরি। সোনালি জড়ির মলাটে মুড়ানো মোটা ডায়েরি। এর মলাটে খোদাই করে লেখা “প্রিয়দের প্রিয় তুমি!” এবং এই ডায়েরিটা যখন শেষবার খোলা হয়েছিলো তখন ঊনত্রিশ মে’, ২০১২ সাল। গোটা গোটা অক্ষরে লিপিবদ্ধ করা একটা প্রেমকাহিনী। লিপিকারের নাম সেহের৷ তাঁর নামের আগে-পরে কোনো টাইটেল নেই। তিন শব্দের ছোট্ট নাম। এই ডায়েরিতে তাঁর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় দিনগুলোর কথা সে লিখে রেখেছে। একটা এতিম, অসহায় মেয়ের প্রেমের ঘটনা, দুঃখের জীবন। যত্ন করে সেটা রেখে দিয়েছে ইফরাজ পূরব নামক একজন ব্যক্তি। ডায়েরির শেষদিকের পৃষ্ঠাগুলোর লেখাগুলো ছিলো এরকম,

__________অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। সুমা,শিলা, রিমি-মাহিম,জিসান-শেফার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ওদের ঘরে একটা সন্তানও আছে। সব পাল্টে গিয়েছে। সংসারের যাঁতাকলে পড়ে এখন কারো সাথে দু-দন্ড কথা বলার সময়ই নেই কারোর। তবুও দিনশেষে সেই চঞ্চলা বিকেলের কথা মনে পড়ে তাঁদের। সোনালি দিনগুলোর হাজারো স্মৃতি চোখের কোণে পানি নিয়ে আসে। সেহেরের চাচীর মৃত্যু হয়েছে দুইবছর আগে, তার ছয়মাস পরে চাচারও মৃত্যু ঘটেছে। জিসান-শেফাকে নিয়ে লন্ডনে স্যাটেল। রিমি-মাহিম চট্টগ্রামে তাঁদের বাড়িতে। সংসার জীবনে অবশ্য সবাই-ই খুশি। আর রইলো বাকি সেহেরের কথা। সেহের মেয়েটা মূলত আমি৷ গল্পাকারে তুলে ধরছি আমি/সেহেরের কথা,

ছয় বছর পরের কথা। শরৎের একটি উষ্ণতম দিন। আকাশ গাঢ় নীল। বিশাল আকারের মেঘের দলেরা দল বেঁধে ভাসছে। মিষ্টি রোদ ঝিকমিক করে ছড়িয়ে পড়ছিলো গাছগাছালির পাতার উপর। হাওয়া সুন্দর, কোমল। শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি, সৌন্দর্য সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে। জ্যামে বসে বিরক্ত হচ্ছে ইফরাজ পূরব। একসময়ের জনপ্রিয় মডেল। বিয়ের পরপরই মডেলিংয়ের সাথে যুক্ত হয়েছিল পূরব। বেশ নামধামও করে ফেলেছিল সেহেরের ইচ্ছেয়। পরবর্তীতে কোনো এক কারণে স্বেচ্ছায় সেই পথ থেকে সরে আসে এবং ব্যবসায় মনোযোগ দেয়। হঠাৎ রাস্তায় পথচারী একটা মেয়েকে দেখতে পেয়ে চমকে তাকায় ও। বেশ খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে আনমনেই হেসে ওঠে। মাথায় সারাক্ষণ সেহেরের মুখটা বসবাস করে। যার দিকে তাকায় তাঁকেই সেহের মনে হয়। এতগুলো দিন পেরিয়ে গেলেও ওর এই স্বভাবটা গেলোনা। আর ওমন কিউট একটা বউ থাকলে পাগলামো স্বভাবগুলো যেতে চায় নাকি!! সেহেরের মতো একজন জীবনসঙ্গী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। পূরব বিগত দিনের ভাবনায় ডুবে গেল।

ওদের বর্তমানে সংসার সুখ,শান্তিতে পরিপূর্ণ হলেও অতীতে তা ছিলোনা৷ বিবাহ পরবর্তী দিনগুলো ভালো কাটলেও ধীরেধীরে আলো কেটে আঁধারে ডুবে যায় তাদের জীবন। সেই অন্ধকার কাটাতে কত প্রার্থনাই না করেছে সেহের-পূরব। টাকা-পয়সার অভাব না থাকলেও ওদের স্বস্তি ছিলোনা। কারণ বিয়ের এক বছরের মাথায় কনসিভ করে সেহের। পূরবের খুশি দেখে কে! কত স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল দুজন মিলে, কিন্তু মাস তিনেকের মাথায় আচমকাই মিসক্যারেজ হয়ে যায়। খুব ভেঙ্গে পড়ে সেহের। কিন্তু নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে আবারও একবার কনসিভ করে। সেটাও টেকেনি। কোনো এক অদ্ভুত কারণে সেটাও মিসক্যারেজ। তারপর একপ্রকার ট্রমাট্রাইজড হয়ে পড়ে সেহের। পাগলের মতো আচরণ আর কান্নাকাটি করতো। পূরব নিজের সাথে সাথে ওকেও সামলিয়েছে সেই কঠিন সময়টাতে। পৃথিবীতে সন্তান হারানোর মতো কষ্ট আর কোনোকিছুতে নেই। প্রতিবার সেহেরকে সামলানো ওর জন্য কষ্টকর হয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত সে পেরেছে। তৃতীয়বারের সময় আল্লাহ তায়ালা সহায় হলেন। পূরবের দিনরাত নামাজ পড়ে দোয়া, সেহেরের চোখের পানি সেবার বৃথা যায়নি। একটা ছোট্ট পরী যখন ওদের কোলজুড়ে এলো নিমিষেই সব কষ্ট, যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিলো। বিগত দিনগুলোর যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা ভুলার চেষ্টা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পথ খুঁজে পেলো ওরা। এখন তাঁদের পরিবারে আর কোনোকিছুরই কমতি নেই। ইরফান আহমেদ ব্যবসা থেকে একপ্রকার অবসর নিয়েছেন। তিনি সারাদিন নাতনিকে সঙ্গ দেন। তবে এতো ঝড়-ঝাপটার পরেও সেহের-পূরবের ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি পড়েনি। বরং দিনদিন তা বেড়েছে।

পূরব ভাবনার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চারদিকে আলো-আঁধারির খেলা, বোঝাই যাচ্ছে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে গেছে। রাস্তাঘাটের জ্যাম ততক্ষণে পাতলা হয়েছে। পেছন থেকে গাড়ির হর্ণ কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। বিরক্তির একটা শব্দ করে পূরব গাড়ি স্টার্ট করলো। মাথায় আজও সেই কালো হ্যাট, চোখে সানগ্লাস আর গায়ে ডেনিম শার্ট। সন্ধ্যাবেলার শহর। রাস্তার দু-পাশের গাছগাছালিকে পেছনে ফেলে বাড়ির পথে এগোলো সে।

সেহের মেয়েকে খাওয়ানোর জন্য সারা ঘরময় দৌঁড়াচ্ছে। চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে এত চঞ্চল হতে পারে, জানা নেই সেহেরের। জোর করে একটু খাবার মুখে তুলে দিতেই ‘পূর্বা’ হা করে সেটা ফ্লোরে ফেলে দেয়। সেহের রাগে মেয়েকে এমন ধমক দেয় যে পূর্বা ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো। ইরফান সাহেব সেহেরকে বললেন, ‘আহা, বকছো কেন এভাবে? কান্না করোনা পূর্বা। তুমিতো গুড গার্ল, ওদের কখনো কাঁদতে আছে নাকি বোকা মেয়ে?’

ইরফান সাহেব নাতনিকে কোলে তুলে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। পূর্বার হাতে ক্যাটবেরি ধরিয়ে দিয়ে কোলে নিয়ে উপরে চলে গেলেন। ইশারায় সেহেরকে জানালেন আধঘন্টা পরে খাবার নিয়ে আসতে। মেয়ের গায়ে হাত তোলার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা ও। এতো কষ্টের সন্তান ওর, কখনো উচ্চস্বরে কথা-ই বলেনি আর আজ সোজা ধমক দিলো ভেবেই ওর খারাপ লাগছে। চোখ জলে টলমল করছে ওর। মুখ গম্ভীর করে রান্নাঘরে চলে গেলো। একটু পরেই কলিংবেলের শব্দ হলো। সেহের দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো পূরব দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখে পূরব গম্ভীর হয়ে বলল, ‘চোখে পানি কেন? তুমি নাকি পূর্বাকে ধমক দিয়েছ আবার নিজেই কাঁদছো? আব্বু ফোন করে জানালো।’

সেহের মাথা নিচু করে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘আমি স্যরি।’

‘ইট’স ওকে। নিজেই বকা দিয়ে নিজেই কষ্ট পাও।কী লাভ এভাবে বকাঝকা করার! বাচ্চাদের ধমকিয়ে খাওয়ানো ঠিকনা, বুঝলে আমার বউ? ওরা পরে জেদি হয়ে যায়। আদর করে, ধৈর্য ধরে, বুঝিয়ে খাওয়াবে দেখবে আর এরকম করবেনা। ঠিক আছে? বুঝতে পেরেছো আমার কথা?’

সেহের মাথা নাড়ালো। পূরব ওর চোখ মুছে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তো আমার কফি? সেটা কই?’

‘ছাড়ুন বানাচ্ছি।’

‘ওকে আমি ঘরে যাচ্ছি৷ তুমি নিয়ে আসো আবার হাতটাত পুড়িয়ে ফেলোনা, রহিমা খালাকে বলো।’

‘আচ্ছা।’

পূরব উপরে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। সেহের রান্নাঘরের সব কাজ গুছিয়ে রাখলো। রহিমা খালা কফি তৈরি করে দিলে সেহের কফি নিয়ে উপরে এলো। ততক্ষণে পূরবের শাওয়ার নেওয়া শেষ। খালি গায়ে টাওয়াল পরিধান করে ফোনে কথা বলছিল জিসানের সাথে। সেহের ওর এ অবস্থা দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। পূরব আড়চোখে ওকে দেখে জিসানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘লন্ডন থেকে কবে ফিরছিস তোরা?’

জিসান বলল, ‘ভাবছি ডিসেম্বরে আসব। আসলে শেফা এখন একটু অসুস্থ।’

‘ওহ।’

‘তোরা আয় না, কতদিন দেখা হয়না…’

পূরব বলল, ‘গিয়েছিলি কেন? দেশে কী পিএইচডি করতে পারতিস না? কী আমার প্রফেসর রে? আমাকে দেখে শেখ, পিএইচডি করেও দেশে আছি, হুহ!’

জিসান আর্তনাদ করে বলল, ‘মনে হয় ভুলই করেছি। কতদিন আম্মুদের দেখিনা!!’

‘এবার চলে আয়।’

‘হুম। তোর মনে আছে আমার বাসর কীভাবে ভেস্তে দিয়েছিলি? এবার দেশে ফিরে আমি সেই শোধ নেব?’

পূরব হু হা করে হেসে বলল, ‘আমার বউয়ের সাথে প্রতিটা মুহূর্তই আমার বাসর মুহূর্ত। তুই আর কী নষ্ট করবি শালা!!’

জিসান কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ‘নির্দয় লোক একটা।’

‘আচ্ছা রাখি। ইট’স রোমান্স টাইম!’

তারপর জিসানও কিছু একটা বলে ফোন রেখে দিলো। পূরব পেছনে ঘুরে দেখলো সেহের রাগী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এখনই পূরবকে ভস্ম করে দেবে। পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী?’

‘আপনি এখনো এতটা নির্লজ্জ? ছিঃ। কীসব কথাবার্তার ছিরি!!’

পূরব বলল, ‘এখানে নির্লজ্জের কী আছে? বউ আমার, রোমান্স আমার, সবাইকে বলে বেড়াবো আমি, তোমার তো কোনো প্রবলেম হয়নি মিসেস ইফরাজ!’

সেহের তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘তাহলে সবাইকে কোলে বসিয়ে রোমান্স করুন। এই সেহেরের পাশে ঘেঁষবেন না। ছিঃ!’

‘এখানে ছিঃ ছিঃ করার কী হল? ঠিকই তো আড়চোখে আমার জিম করা বডি দেখছিলে, তখন নিজেকে নির্লজ্জ মনে হয়নি? আমি বলাতেই নির্লজ্জ? বাহ সেহের বাহ!!’

সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কখন আপনার বডি দেখছিলাম? নিজে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা খেয়াল নেই? শুধু একটা টাওয়াল পরে, এখন যদি এটা খুলে যায় তাহলে… ছিঃ!’

সেহের নাক সিঁটকালো। পূরব বাঁকা হাসি দিয়ে একটান দিয়ে ওকে কাছে নিয়ে এলো। কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আসো বউ আদর করি।’

‘আপনার আদরের গুষ্ঠি কিলাই৷ তিন সন্তানের বাপ হয়েছেন তাও লুচুগিরি কমেনা। কী লোকরে বাবা!!’

ঠিক এসময় পূর্বা ঘরে ঢুকলো ছোট্ট পায়ে। বাবা-মাকে এ অবস্থায় দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আমাতে তোলে নাও পাপ্পা!’

পূরব মেয়েকে দেখে হুট করে সেহেরকে ছেড়ে দিলো। মাথা চুলকে বোকার মতো হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই!’

পূর্বা বাবার কোলে ওঠে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,’তুমি মাম্মিতে আদল তরচিলে?’

পূরব সেহেরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু তোমার মাম্মি একটা দুষ্টু। সে আমার আদর নেয়না। আমি নাকি পঁচা।’

পূর্বা ওর গাল টেনে ধরে বলল, ‘তুমি বালো। আমি আদল দিব।’

বলেই ওর সারা মুখে চুমুতে ভরিয়ে দিল। পূরব মেয়েকে বলল, ‘তুমি নাকি খাওনি? মাম্মিকে এত জ্বালায় কেউ? মাম্মি তো কাঁদছিল!!’

পূর্বা মাথা নুইয়ে সেহেরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ মাম্মি স্যলি। তোমাকে জ্বালাব না। আমি খাব।’

সেহের মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘চলো। আসুন আপনি খাবার দিচ্ছি। কফি তো খেলেন না।’

পূরব বলল, ‘থাক। চলো।’

এরপর ওরা তিনজন নিচে নেমে এলো। রহিমা খালা ডাইনিংয়ে সব খাবার সাজিয়ে দিয়েছে। ইরফান সাহেব, পূর্বা, পূরব, সেহের একসাথে রাতের খাবার সেরে যার যার ঘরে চলে গেলো। রাত এগারোটা। পূর্বা পূরবের সাথে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেহেরকে জড়িয়ে ধরে পূরব ঘুমঘুম কন্ঠে বলল, ‘একসাথে কতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। এখনো সবকিছু নতুন মনে হয়, আমাদের নতুন সংসার। তাইনা?’

সেহের হেসে বলল, ‘হুম। প্রতিনিয়ত নতুন করে আপনার প্রেমে পড়ছি।’

পূরব মুচকি হেসে সেহেরের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, ‘তাই নাকি? এখন তো শাস্তি পেতে হবে!’

সেহের অবাক হয়ে বলল, ‘কীসের শাস্তি?’

‘আমার প্রেমের হাবুডুবু খাওয়ার অপরাধে। ইউ নো হোয়াট সেহের? আমি আজকাল চারপাশে শুধু তোমাকেই দেখতে পাই। আমি বোধহয় ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে যাওয়া এক প্রেমিক, যে শুরু আমার প্রিয় মানুষটাকেই খুঁজে ফিরি। তোমাকে দেখার সাধ আমার যেমন মেটেনা, তেমন শুধু মনে হয় আমি তোমাকে হয়তো সেভাবে সুখীও রাখতে পারিনি। অথচ আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তোমাকে ভালোবাসি। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত প্রিয় কোনোকিছুর একটা আমার পরিবার, আর অন্য প্রিয়টা শুধুই তুমি। খুব ভালোবাসি তোমাকে।’

সেহের ওর বুকে মাথা রেখে গভীর কন্ঠে বলল, ‘ভালোবাসি।’

‘জানি আমি।’

‘আচ্ছা ঘুমান এবার।’

পূরব সেহেরের কপালে চুমু খেলো। পূর্বাকে অন্যহাতে জড়িয়ে ধরে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে আকাশপানে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর ঘুমিয়ে পড়লো। সেহের তখনো ঘুমায়নি। ঘুমন্ত পূরবের নিষ্পাপ মুখখানা দেখবার লোভ সে কখনো সামলাতে পারেনা৷ আজ ছয়টা বছর পরেও সেহেরের এই অভ্যাসটা রয়ে গিয়েছে৷ পূর্বার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে ওকে ঠিক করে শুইয়ে দিলো। বাবা-মেয়ের ভালোবাসা দেখে মুচকি হাসলো ও। এভাবেই সে তার পরিবারের মানুষদের সুখী দেখতে চায়। ওর নিজের তো বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর সৌভাগ্য কোনোদিনও হয়নি। নিজের সন্তানকে ও সর্বোচ্চটা দিয়ে আগলে রাখতে চায়। প্রিয় তুমি’দের সাথেই বাকিজীবন কাটাতে চায়। সেদিন ছিলো শরৎের এক পূর্ণিমারাত। শিউলিমালার মাতাল করা সুবাস আর হাওয়ার বেপরোয়া ছুটে চলা। এলোমেলো হয়ে যায় মনটা, প্রিয় একটা গানের সুর কোথা থেকে যেন ভেসে আসে। উফ..প্রিয়’রা এতো মুগ্ধ হয় কেন? পৃথিবী এত সুন্দর কেন!! ভাবনার প্রতিফলনেই পাশ থেকে কে যেন ঘুমের মাঝেই অস্ফুটস্বরে সেহেরের কানে কানে বলল উঠে, ‘আমার প্রিয় তুমি!’

সমাপ্ত।

প্রিয় তুমি পর্ব-১৪

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৪

হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হলো বেশ রাতে। পূরব অনুষ্ঠান শেষে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে ফ্রেশ হতে গেলো। বিয়ে করায় যে কত প্যারা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সবার সাথে রোবটের মতো আচরণ কর‍তে ওর বিরক্ত লাগছে, পুতুলের মতো সবার কথা শুনে শুনে চলতে হচ্ছে। তার উপর মিডিয়ার উটকো ঝামেলা। গায়ে হলুদে এসেও তাদের একটাই প্রশ্ন পূরব কবে মডেলিংয়ে যোগ দিচ্ছে। ও কোনোমতে ওদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছে। দীর্ঘক্ষণ ধরে শাওয়ার নিয়ে পূরব বেরিয়ে এলো। গায়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার চাপিয়ে জিসানকে ফোন করে ঘরে খাবার দিয়ে যেতে বললো। খানিক পরেই দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে খুললো। দেখলো জিসান প্লেটে করে ওর প্রিয় বিরিয়ানি আর কোল্ড ড্রিংকস নিয়ে এসেছে। ক্ষিধের চোটে পূরব তাড়াহুড়ো করে খেতে বসলো। জিসানকে জিজ্ঞেস করলো, ‘খেয়েছিস? নাকি কামলা খেটে মরছিস?’

জিসান বন্ধুর কথা শুনে হু হা করে হেসে বললো, ‘বন্ধুর বিয়েতে কামলা খাটতেই হয়। আমার বিয়ের সময় তুই কামলা খাটবি। শোধবোধ হয়ে গেলো না!!’

‘হুহ। বিয়ে করছি কি তোর বিয়েতে কামলা খাটার জন্য নাকি? আমার এত ঠ্যাকা পড়ে নাই। তবে একটা কাজ করে দিতেই পারি, নো প্রবলেম।’

জিসান উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন কাজ?’

পূরব আয়েশ করে বলল, ‘তোর বাসর রাত মাটি করার কাজ। অবশ্য এই কাজটা তুই চাইবিনা জানি, তবে আমি তো করবোই।’

জিসান বড়বড় চোখ করে বলল, ‘মীরজাফর গিরি করবি? তাও আমার সাথে? তোর খারাপ লাগবেনা?’

‘এখানে খারাপ লাগার কী আছে? বাসর হবে আর তা ইফরাজ পূরব পন্ড করবেনা তা কী করে হয়?’

জিসান কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল, ‘তোর সাথে এরকম করার কোনো চিন্তাই করিনি আর তুই??’

‘তুই চিন্তা কর বা হাজারো, লক্ষ্য, কোটি প্ল্যান বের করতে পারিস। তাতে আমার বাসর কিছুতেই মাটি হবেনা।’

জিসান বলল, ‘জীবনে কোনোদিন প্রেমট্রেম করিনাই শুধু এই বাসর রাতটার জন্য। আর তুই আমার সাতাশ বছর ধরে দেখা স্বপ্নটার মধ্যে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য বসে আছিস? এমন তুই?’

‘প্রেম করার সাথে এর কী সম্পর্ক? আর সাতাশ বছর ধরে বাসর করার স্বপ্ন দেখছিস মানে? ও মাই গড জিসান, তুই কী জন্ম নেওয়ার সাথে সাথেই এডাল্ট বিষয়গুলো বুঝে গিয়েছিলি? পেন্ডাকালীন বয়সেও তুই বাসরের স্বপ্ন দেখতিস? ছিহ! ইউ নো হোয়াট জিসান? তুইতো একটা বিরল প্রজাতির প্রাণী, তোকে তো ফ্রান্সের জাদুঘরে রেখে আসা উচিৎ!’

জিসান অবাক হয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই? মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি আবার?’

পূরব বাঁকা হেসে বলল, ‘কাল বিয়ে। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে, তুইও শুয়ে পড়। আর দিন গুণতে থাক, কীভাবে তোর বাসর পন্ড করি। গুড নাইট মাই সুইট এন্ড ইয়াং বয়।’

জিসান বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। পূরব খাওয়া শেষে মোবাইল স্ক্রল করতে কর‍তে শুয়ে পড়লো। জিসানও ওর ঘরে চলে গেলো। তারপর ফোন লাগালো শেফাকে। কয়েকবার ট্রাই করার পরেও কেউ ধরলোই না। তাই জিসানও আর চেষ্টা না করে ঘুমিয়ে পড়লো।

ওদিকে হলুদের আয়োজন শেষ করে ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো সেহের। সুমা, শেফা ওরাও গোসল সেরে ঘুমে মগ্ন। ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসতেই সেহেরের ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো পূরবের কল। সেহেরের ঘুম পাচ্ছে, তাই কোনোমতে কলটা রিসিভ করে মিনিট পাঁচেক কথা বললো৷ কথা বলার অবস্থায়ই সেহের ঘুমিয়ে পড়লো। পূরব অবাক হলো। পরক্ষণেই হেসে খুন। কী এক মেয়েরে পাল্লায় পড়েছে সে,হবু বরের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। পূরব ফোন কলের ওপাড় থেকে সেহেরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো। পৃথিবীর আর কেউ কী জানতো, ওদের এই মিষ্টি ভালোবাসার কথা? বোধহয় জানতোনা। শুধু এই অন্ধকার রাত আর সময়ই সাক্ষী হয়ে রয়েছিল এই মুহূর্তটার৷

আজ বিয়ের দিন। সকাল থেকেই সব আয়োজন শুরু। বরের বাড়ি থেকে বিশাল অঙ্কের গেস্টরা আসবে, সব হাই প্রোফাইলের লোকজন। সকাল থেকেই বাড়ির পেছনের উঠোনে বাবুর্চিরা কয়েক পদ রান্নার আয়োজন শুরু করেছে। এ কাজে তাঁদেরকে সাহায্য করছে সেহেরের চাচা। ওর চাচী ভেতরের ঘরে মেহমানদের জন্য নাস্তা তৈরি করছেন৷ সেহেরকে সকাল সকাল ঘুম থেকে তুলে তিনি খাইয়ে দিয়েছেন। তারপর আবার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন।

বেলা গড়াতেই সেহেরকে সাজাতে বসলো শেফারা। লাল রঙের ওয়েডিং লেহেঙ্গা, ভারী গয়না আর মেকআপে ওর শ্যামরঙা চেহারাটা দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। জীবনে কোনোদিন এভাবে সাজেনি সেহের। সাজতে ইচ্ছে হতো একটা সময়ে, কিন্তু চাচীর অত্যাচারে কোনদিন যে সেই ইচ্ছেটা মরে গিয়েছিল বুঝতেই পারেনি। সেজন্য এত সেজেও ওর কোনো অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছেনা। আজ নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই চিনতে পারছেনা সেহের। এতো আটা-ময়দা মাখানোর কী প্রয়োজন ছিল? সবার সামনে যেতে, বিশেষ করে পূরবের সামনে এভাবে যেতে তো লজ্জায় মরেই যাবে। ওদিকে ওর অবস্থা দেখে রিমি আরও লজ্জা দিতে শুরু করেছে। বললো, ‘তোকে দেখেতো ভাই চিনতেই পারবেনা। তোকে এই সাজে যা লাগছেনা দোস্ত…সসসসস পূরব ভাইয়া না হার্ট অ্যাটাক করে!!’

সেহের ধমকে বলল, ‘চুপ কর।’

‘উফ কী লাগছে রে তোকে। খেয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে আমারই, পূরব ভাইয়ের না জানি কী ইচ্ছা হয়। আয় তোর সাথে ছবি নিই।’

‘আমি ছবি তুলব না।’

‘বললেই হলো? একমাত্র বিয়ে আর তুই ছবি নিবিনা? পাগলের মতো কথা বলিস না তো।’ সুমা বললো।

ছবিটবি তোলা শেষ হতেই সেহেরের চাচাতো বোন অনু এসে জানালো বরপক্ষ এসে গেছে৷ শুনেই সেহেরের হাত-পা কাঁপতে লাগলো। পূরবের কাজিনরা সবাই ওকে দেখতে এলো। ভাবি ভাবি করে জান বের করে ফেলার জোগাড়। সেহের লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিলো। ওর প্রতিবেশীরা কানাঘুষা করে বলতে লাগলো, ‘এতিম মাইয়াটা রাজকপাল লইয়া দুনিয়ায় আইছে। কী ভাগ্য দেখছো? কত বড়লোকের পোলা রাজি হইছে ওরে বিয়ে করতে।’

এসব শুনতে পেলোনা সেহের৷ পূরবের কাজিনদের সাথে কথা বলে ওর ভালোই লাগলো। সবাই বেশ ফ্রি-লি কথা বলছে। আর পূরবের অবস্থা বেশ শোচনীয়। বেচারা ওয়েডিং শেরওয়ানি পরে স্বস্তি পাচ্ছেনা। গরমে ঘেমে মুখচোখ লাল হয়ে গিয়েছে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল এটাই শেষ, আর কোনোদিন ফ্যামিলি গেদারিং করবেনা। এমন কোনো অনুষ্ঠানে ও যোগ দিবেনা৷ এত গরম?? মনে হচ্ছে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মাংসপেশি। আর এতক্ষণ লাগছে কেন? বিয়ে করতে এসেছে বিয়ে করে ও ওর বউ নিয়ে চলে যাবে, সেখানে এত লোককে দেখাতেই বা হবে কেন? উফ শিট..

যখন ওর সামনে আস্ত একটা খাসির ডিশ সাজিয়ে ওকে খেতে বলা হলো তখন পূরবের চরম রাগ উঠলো। কিন্তু বাবার দিকে চেয়ে রাগ সামলে সবার সাথে একসঙ্গে খাওয়া শুরু করলো। বিয়ের সময় যে নিজেকে পুতুল হয়ে থাকতেহয় তা আরো একবার প্রুফ হলো। যাইহোক, সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রোল করা রেজিষ্ট্রেশন খাতায় নিজের সাইন আর তিনবার “আলহামদুলিল্লাহ কবুল” বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

সেহের নিজেও জানেনা হঠাৎ ওর এতো কান্না কেন পাচ্ছে। গলা শুকিয়ে আসছে৷ অথচ শত কষ্টেও ওর চোখে পানি আসেনা। আজ সামান্য একটা সাইন করার সময় ওর হাত কাঁপছে, কবুল বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছে। এটাই বোধহয় মেয়েদের জন্য সবচেয়ে কষ্টের সময়। একসময় নির্বিঘ্নে বিয়ের পর্ব শেষ হলো। অতঃপর বিদায়ের পালা৷ পূরব হাফ ছেড়ে বাঁচলো। এবার কোনোমতে নিজের বৌকে নিয়ে বাড়ি ফির‍তে পারলেই হয়।

বিদায়ের সময় সুমা, শেফা, রিমি, শিলা সবার চোখে জল। তাদের বেস্ট ফ্রেন্ড আজ অন্য কারোর বউ হয়ে গিয়েছে। চাচা-চাচী আড়ালে চোখ মুছলেন৷ সবার মুখ থমথমে। এই বিষন্ন সময়টাতে সেহেরের মন খারাপ হয়ে এলো। তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আশ্চর্যের বিষয় গাড়িতে কোনো ড্রাইভার নেই। ড্রাইভ করছে স্বয়ং পূরব। ও আজ তার প্রিয়তমার দিক থেকে চোখই সরাতে পারছেনা। এই মেয়ে এত সেজেছে কেন? ওকে পাগল করে দিচ্ছে একেবারে! শক্ত করে সেহেরের হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে অন্য হাতে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘আমিতো আছি। একদম কাঁদবেনা।’

সেহের বলল , ‘কাঁদছিনা তো।’

‘মিথ্যা বলবেনা। তাহলে এখমই চুমু খেয়ে ফেলব।’

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-১৩

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

পূরব, সেহেরের বিয়ের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেওয়া শুরু করেছে ওর বাবা ইরফান আহমেদ। একমাত্র ছেলের বিয়েতে তিনি কোনো ত্রুটি রাখতে চান না। ডেকোরেশনের কাজ, গেস্টদের ইনভাইটেশন পাঠানো সব কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। সাথে গরিব-দুঃখীদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। ওটা মূলত পূরবের ইচ্ছে।
পূরবের বিয়ের জন্য কোনো কনভেনশন সেন্টার বুক করেননি ইরফান সাহেব। তাঁদের বাড়ির সামনের জায়গাটাতেই বিয়ের সব আয়োজন চলছে। এসব কাজে ইরফান সাহেবকে হেল্প করছে জিসান। পূরবের বিয়েটা মিটে গেলে মাসখানিক পরে ওর আর শেফার বিয়ের ডেট ঠিক করা হবে। আপাতত এখন এসব কিছু নিয়ে ভাবছেনা ও!

ওদিকে সেহেরের কোনো অভিভাবক না থাকায় ইরফান আহমেদের সাথে কথা বলে ওর চাচাই সব দায়িত্ব নিলেন। সেহের মোটেও তা চায়নি। কিন্তু অনেক জোরাজুরির পর ওকে রাজি করানো গেলো। ওর চাচী ফোন করলেন৷ সবসময় তিনি সেহেরের খারাপ চেয়েছেন, এবার খুব ইচ্ছে অন্তত মেয়েটার বিয়ে তাদের বাড়ি থেকে হোক। নিজের হাতে সেহেরের বিয়ের কাজ করবেন। যদিও খুব অসুস্থ সেহেরের চাচী। ওনার এক কথা, সারাজীবন তো আর কিছু করতে পারেননি সেহেরের জন্য, শুধু অত্যাচারই করেছেন। এখন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। সেজন্য বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে নিজের চাচার বাড়িতে উঠেছে সেহের। বিয়ে উপলক্ষে সুমা আর শিলাও ওর সঙ্গে এসেছে। শেফা আর রিমি আসবে একদিন পরে। সন্ধ্যাবেলায় আলমিরাতে বিয়ের জন্য শপিং করে আনা কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখছিলো সেহের। ওকে সাহায্য করছে শিলা। আচমকাই পূরবের ফোন। কাজের মধ্যেও এই লোকের ফোন, দিনের মধ্যে নিয়ম করে তিনবার কথা না হলে পূরবের নাকি শান্তি লাগেনা। শিলাকে হাতের কাপড়টা ভাঁজ করতে দিয়ে সেহের ফোন রিসিভ করলো। পূরব ওর কথা শোনার আগেই কথা বলে উঠলো। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

‘ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কী করছো?’

এটা জানার জন্য ফোন করেছে? কী জ্বালা। ভালোবাসার লোকগুলো কী এভাবেই জ্বালাতে ভালোবাসে নাকি? সময়ে-অসময়ে তাঁদের জানতে ইচ্ছে করে প্রিয় মানুষটি এই মুহূর্তে কী করছে? সেহেরের নাম না জানা এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিলো মুচকি হাসির রেখা। দোলনায় ঠেস দিয়ে বসলো। গাছের পাতায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে উঠলো, ‘ঠিক এই মুহূর্তে আমি সেহের ভীষণ ইম্পোর্টেন্ট কাজে ব্যস্ত আছি। আমিতো আর আপনার মতো অকর্মা মানুষ নই। সব কাজ একাই সামলাতে হয়।’

‘ওয়েট ওয়েট। আই মিন তুমি বলতে চাইছো আমি কোনো কাজ করিনা? যা করো সব তুমি? মানে পুরো পৃথিবীতে একমাত্র কর্মঠ লোক, আর তোমার কর্মের দ্বারা পুরো পৃথিবীর মানুষ খেয়েপড়ে বেঁচে আছে? ওহ নো সেহের..তোমার এই লজিকটা আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি, তাঁরা মানবোনা।’

‘আপনার মানা না মানায় কিছু যায় আসেনা।।সব কাজ আমি একাই করতে পারি।’

পূরব বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঠিক আছে মানলাম। তুমি অসুস্থ হলে তো নিজের সেবা নিজেই কর‍তে পারো তাইনা? সারারাত জেগে থাকা থেকে শুরু করে হসপিটালে যাওয়াটা তো তুমি একাই করো। আর মাঝেমধ্যে হুটহাট চুমু তো তুমিই দাও তাইনা? এই অসম্ভব কাজগুলো তুমি পারো ভাবতেই আমার প্রাউড ফিল হচ্ছে। তোমার মতো কর্মঠ বউ পেয়ে সত্যিই আমি ধন্য।’

সেহের অভিমানী গলায় দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আপনি কী এমনই বেহায়া? আগেও এমন ছিলেন? আচ্ছা, কতজনের সঙ্গে আপনার আগে রিলেশন ছিল? ক’টা মেয়ে আপনাকে চুমু দিয়েছে?’

পূরব ওর অভিমান স্পষ্ট বুঝতে পেরে মজা করে বলল, ‘তা জেনে তোমার কী হবে? আমি সেলিব্রিটি মানুষ, কত মেয়ের চুমু খেয়েছি তা তো গুণে রাখিনি। তবে এদের মধ্যে বেস্ট ছিল একজনই। ওকে আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবোনা।’

সেহেরের চোখে জল টলমল করছে। শুধু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষা বাকি। রাগ করে ফোন কেটে দিলো। পূরব একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছে তাহলে সেহেরকে কেন বিয়ে করতে চায়? নাহ, ও যখন ওই মেয়েকে কোনোদিন ভুলতেই পারবেনা তাহলে সেহেরের ওকে বিয়ে করা উচিৎ হবেনা। অন্য কাউকে ভালোবাসবে আর সংসার করবে ওর সাথে তা কি করে হয়! সেহেরের দোলনায় মাথা এলিয়ে বসে রইলো। মৃদু হাওয়ায় ওড়না উড়ছে। ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এবার কেঁদেই ফেললো সে। কান্না শুনে সুমা, শিলা ছুটে এলো ওর কাছে। কারণ জিজ্ঞেস কর‍তেই সেহের কান্নারত কন্ঠে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ‘আমি ওনাকে বিয়ে করবোনা৷ বিয়ে ক্যান্সেল করে দে সুমা।’

ওরা দুজন হতভম্ব। সুমা সেহেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পূরবকে ফোন করে বললো সেহের ওকে বিয়ে করবেনা। যা যা ঘটেছে তার সব বলতেই ও হু হা করে হেসে উঠলো। সুমা অবাক হয়ে বলল, ‘ভাইয়া আপনি হাসছেন? তার মানে আপনিও বিয়ে করতে চাননা?’

পূরব হেসে বললো, ‘তোমার গাধী বান্ধবীকে ফোনটা পাস করো।’

‘ও আপনার সাথে কথা বলতে চাইছেনা।’

‘ওকে বলো আমার সেই প্রিয় মানুষটা সেহের নিজেই।’

সুমা বুঝতে না পেরে বলল, ‘কীসের মেয়ে?’

‘কিছুনা। সেহেরের কাছে ফোন দিয়ে তোমরা চলে যাও। আমি বুঝিয়ে বলছি।’

অগত্যা সুমা সেহেরের হাতে জোর করে ফোনটা ধরিয়ে শিলাকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। সেহের পূরবের ফোন বারবার কাটতে লাগলো। একসময় বাধ্য হয়ে ধরলো। পূরব সবটা ওকে বুঝিয়ে বলতেই নিজের কাছে নিজেই বোকা প্রমাণিত হলো সে। রেগে বলল, ‘আমার সাথে এধরণের মজা একদম করবেন না চোরমশাই।’

পূরব বলল, ‘আমার প্রিয় বলতে তুমিই আছো। অনেক ভালোবাসি আমার প্রিয় তুমিটাকে।’

সেহের চোখ মুছে গভীর কন্ঠে বলল, ‘কখনো ভুলে যাবেন না তো? সেলিব্রেটিরা নাকি বিয়ের পর সব ভুলে যায়? এমন হলে আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাব!’

পূরব বলল, ‘মৃত্যু ছাড়া আর কোনোকিছু তোমাকে ভুলাতে পারবেনা আমার মন থেকে। এছাড়া আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন।’

সেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওর কথায় সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম।’

সারারাত এভাবে কথা বলতে বলতে কেটে গেলো। সম্পর্ক হওয়ার পরে আজ প্রথম সারারাত কথা হলো দু’জনের মধ্যে। ভোররাতের দিকে ঘুমাতে গেল দুজন। ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠে পড়লো সেহের। চাচা বাজারে যাবেন, সব লিস্ট ওর চাচী নিজের হাতে করে দিলেন। সেহেরের চাচাতো দুই ভাই বউ নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছেন। এক মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ে খেতে এসেছে। তাছাড়া প্রতিবেশী আর কাছের আত্মীয়রা মিলে পঞ্চাশজনের মতো মেহমান হলো ওদের বাড়িতে।
মেহমানদের মধ্যে কেউ কেউ সেহের খুব প্রশংসা করলো আবার কেউ কেউ কটু কথা শোনাতেও পিছপা হলোনা। এত বড় মাপের একটা ছেলে কী দেখে এই এতিম মেয়েকে পছন্দ করেছে খোদা জানেন। তবে এসব কথা সেহেরের কর্ণগোচর হলোনা, আর হলেও সেহের পাত্তা দিতোনা। বিগত দিনগুলোতে ও একাই যুদ্ধ করে এতদূর এসেছে, আজ তাঁদের কথায় কেন ও পাত্তা দিবে? ওদের কথা শুনলে কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবেনা, তাই সেসব না শোনাই ভালো।

সারা বাড়িতে বিয়ের আমেজ। শেফা, রিমি ওরা এসে হাজির হলো বিকেলের দিকে। সেহের ভীষণ খুশি। এর মধ্যে পূরব দু-বার ফোন করে খোঁজখবর নিলো। ওর গায়ে-হলুদের আয়োজন করা হচ্ছে। সারা বাড়ি গেস্টে ভর্তি। মিনিট খানিক কথা বলে ফোন রেখে দিলো
সেহের। একটু পরে ওকে নিয়ে যাওয়া হলো। হলুদ দিয়ে গোসল করানো হলো। তারপর সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হলো। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মানুষ কম থাকলেও জমকালো আয়োজন বলা চলে। দু-হাত ভরে মেহেদি, কাঁচা ফুলের গয়না আর হলদে-সোনালি শাড়িতে সেহেরকে অপূর্ব দেখাচ্ছিলো। ওর সাথে কালার কম্বিনেশন করে পূরবের পাঞ্জাবিটা কেনা হয়েছে। সুমা, শিলা, রিমি, শেফা সবাইকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। ওরা সবাই মিলে এক বাটি হলুদ সেহেরের মুখে মেখে দিলো। সেহের রেগে গেল। পুরো ভূত বানিয়ে দিয়েছে ওকে। আচ্ছামত ধমক দিলো ওদেরকে। শেফা ওর চেহারা দেখে হাসতে হাসতে অনেকগুলো ছবি তুলে পাঠিয়ে দিলো পূরবকে।

পূরব এত এত মানুষের মাঝখানে দম ফেলার জো পাচ্ছেনা। তার নানা বাড়ি, দাদা বাড়ির লোকজন, বাবার বন্ধুরা, ওর বন্ধুরা, তাছাড়া পরিচিত সব ব্যবসায়ী, ডিলারসহ ব্যবসার খাতিরে তৈরি হওয়া সব লোকজন এসেছে। হঠাৎই ফোনে সেহেরের মিষ্টি ছবিটা দেখে ওর খুব ভালো লাগলো। গালে হলুদ ভর্তি। চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা ওর থেকে। আরও একবার নতুন করে ওর মায়ায় ডুবে গেলো পূরব, নতুন করে আবার ভালোবেসে ফেললো প্রিয় তুমিটাকে। আর একটা দিন, তারপর সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ওর জীবনে পদার্পণ করবে এই মেয়েটি। কত ভালোবাসে সেহেরকে, তা যদি সেহেরকে বোঝাতে পারতো! আর কয়েকটা ঘন্টা, তারপর সারা জীবনের জন্য বাঁধা পড়বে একে-অপরের সাথে।

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-১২

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১২

সেদিনের পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। কয়েকদিন পর সেহেরের রেজাল্ট পাবলিশড হলো। দেখা গেলো রেজাল্ট মোটামুটি ভালো কিন্তু সেহের খুশি হতে পারলোনা। ও যেটা আশা করেছিল তার থেকে বেশ কিছু নাম্বার কম। যেটা ওর কাম্য নয়। শেফা, রিমি ওরাও ভালোই করেছে। এই খুশিতে ওরা সেহেরের আপসেট হওয়ার বিষয়টা মানতে পারলোনা। শেফা সেহেরের মুড ঠিক করার জন্য জোর করে একটা কফিশপে নিয়ে গেলো ওকে। কোল্ড কফি, বার্গার অর্ডার করলো শেফা। হাতমুখ ধুতে ওয়াশরুমে গেলো৷ ফোন আর পার্স পড়ে রইলো টেবিলের উপর। হঠাৎ শেফার ফোন বাজলো। ওরা কেউ অতোটা পাত্তা দিল না। কিন্তু বারবার ফোন আসতে থাকার সেহের বলল, ‘কীরে রিমি? কোথায় গেল শেফা? ফোন আসছে মনে হচ্ছে!’

রিমি বলল, ‘শেফা তো ওয়াশরুমে।’

‘বারবার কল আসছে। দরকারী নাকি?’

‘কী জানি।’

‘ধর ফোন।’

‘আমি?’

‘তুই ছাড়া যেহেতু এখানে কেউ নেই তাই তুই ধরবি।’

‘আরেকজনের ফোন ধরব?’

‘দরকারি হতে পারে!’

রিমি বিষন্ন স্বরে বলল, ‘আচ্ছা ধরছি।’

রিমি ফোনটা হতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। রিসিভ করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে বলছেন?’

ওপাশ থেকে বয়স্ক মহিলার গলা শোনা গেলো। সালামের উত্তর দিয়ে বলল, ‘তুমি শেফা মা? আমি জিসানের আম্মু। চিনতে পারছো?’

রিমি কথাটা শুনেই ফোনের স্পিকার চেপে ধরে সেহেরকে নিচু স্বরে বলল, ‘জিসান ভাইয়ের আম্মা। কী কমু?’

‘তোর যা ইচ্ছে!’

‘বইলা দিই আপনার হবু বৌমা টয়লেটে গিয়েছে?’

সেহের কটমট করে বলল, ‘ফাজলামো করবিনা। সুন্দর করে কথা বল। হয়তো জরুরি কোনো কথা।’

রিমি মুখটা কালো করে ফোনটা কানে ধরলো। জিসানের মাকে বলল, ‘আসলে আন্টি আমি শেফার ফ্রেন্ড রিমি বলছি। শেফা একটু ওয়াশরুমে গিয়েছে।’

ওপাশ থেকে জিসানের মা বলল, ‘ওহ আচ্ছা।’

‘কেমন আছেন আন্টি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমিতো শেফার বান্ধবী তাইনা?’

‘জি।’

‘তবে তোমাকেই জিজ্ঞেস করি, তুমিতো শেফাকে কাছ থেকে দেখেছ? তাইনা?’

রিমি বিব্রতবোধ করছে। ফোনটা সেহেরের কাছে জোর করে দিয়ে দিল। নিচু গলায় বলল, ‘প্লিজ দোস্ত। তুই কথা বলে ম্যানেজ কর। আমি কী বলতে কী বলে ফেলব আল্লাহই জানে। নার্ভাস লাগছে।’

সেহের বিরক্ত হলো। ফোনটা নিয়ে সালাম দিয়ে কথা শুরু করলো এবং শেফার বিষয়ে প্রায় সবকিছুই শেয়ার করলো। ওর পছন্দ-অপছন্দ, ক্যারেক্টার কেমন তাও জেনে নিলো জিসানের আম্মা। আর পূরবের হবু বউ সেহের, জানতে পেরে অগ্রিম শুভেচ্ছা জানালেন। ছোটবেলা থেকেই পূরবকে চেনেন তিনি। আধুনিকতার ছোঁয়া থাকলেও ছেলেটা ভালো। টাকাপয়সা হতদরিদ্রদের দান করে, তাও খুব নিভৃতে। জিসানকে কতবার সাহায্য করেছে। বন্যা দুর্গত মানুষদের বাঁচাতে গিয়ে কয়েকবছর আগে তো নিজেই মরতে বসেছিল পূরব। পাঁচদিন আই-সি-ইউতেও রাখা হয়েছে। অবশেষে সুস্থ হয়েছে। এরকম অনেক কথা তিনি সেহেরকে বললেন। অথচ সেহের এ বিষয়ে কিছুই জানতোনা। কথা বলার মাঝপথেই শেফা ফিরে এলো। দেখলো ওর ফোনে সেহের কারো সাথে কথা বলছে। রিমি ওর কানে কানে ফিসফিস করে সব কথা উগলে দিল। শেফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। জিসানের আম্মার সাথে কথা বলতে ও জীবনেও পারতোনা। যাক সেহের সামলে নিয়েছে। কিন্তু ওর বিশ্বাসে পানি ঢেলে দিয়ে সেহের ওকে ফোন ধরিয়ে দিল। জিসানের আম্মা শেফার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন। কীভাবে ওদের পরিচয়, কখন বিয়ে করতে চায় সবকিছু। শেফা লজ্জ্বামিশ্রিত কন্ঠে ওনার ওপর সবকিছু ছেড়ে দিল। জিসানের মা পুত্রবধূকে ঘরে নিতে দেরি করতে চান না। তাই তিনি আশ্বাস দিলেন খুব দ্রুতই শেফার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হবে। শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল শেফা।

কথা বলা শেষ করে ফোন রাখলো শেফা। তারপর সেহেরকে থ্যাংকস জানালো। ওর চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। সেহের,রিমি ওকে নিয়ে বেশ মজাও করলো খানিকক্ষণ। ওয়েটার কফি, বার্গার দিয়ে গেছে সেই কখন! রিমি খাওয়া শুরু করলো। অর্ডারকৃত কফি পান করে, বিল মিটিয়ে মার্কেটে গেলো। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনলো শেফা, রিমি ওর বোনের জন্য একটা জামা নিলো। সেহের একটা ঘড়ি কিনলো। ওর হাতঘড়িটা মাস তিনেক আগে পানিতে পড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে ওরা যার যার বাসায় ফিরে গেলো, সেহের টিউশনে চলে এলো। পাঁচটা টিউশনের তিনটে কামাই দিয়ে দুটো পড়িয়ে বাসায় চলে এলো। গোসল সেরে, খাওয়াদাওয়া করে ঘুম দিলো। এর মধ্যে সুমা আর শিলা ফ্রেন্ডের বাসা থেকে ফিরে এলো। বাসায় ফিরে দেখে সেহেরের প্রচন্ড জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে কয়েকবার বমিও করলো। সুমা ওকে ঔষধ খাইয়ে দিল, শিলা মাথায় পানি দিতে লাগলো। সুমা সেহেরের জ্বর দেখে কী করবে বুঝে উঠতে পারলোনা।

রাত সাড়ে তিনটা। শিলা ক্লান্ত হয়ে সেহেরের পিছনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। সুমার চোখ ঢুলছে, মাথাটা ভীষণ ভারে নুইয়ে পড়তে চাইছে। সেহেরের কপালে হাত দিয়ে চেক করে দেখলো জ্বর খানিকটা কমেছে। সেহেরের ফোনটা ড্রয়ারে ছিলো। ভ্রাইবেট করছিলো। সুমা হাতে নিয়ে দেখলো পূরব অসংখ্য ম্যাসেজ করে রেখেছে, ফোন করেছে। কিন্তু সেহের রিসিভ করেনি। করবে কীভাবে তখন তো জ্বরে অজ্ঞানের মতো পড়ে ছিল। সেহেরের শরীর ভালোনা সেটাতো ওকে জানানো দরকার। আফটার অল পূরব ওদেরকে বলে রেখেছে সেহেরের অসুবিধা হলে সেটা যেন ওকে জানায়। কিন্তু এতো রাতে পূরবকে ফোন করা ঠিক হবে কিনা? যা হয় হোক, সামান্য ঘুম ভাঙলে কোনো ক্ষতি হবেনা ভেবে ডায়াল করলো পূরবের নাম্বারে।

পূরবের চোখটা সবেমাত্র লেগেছে। প্রজেক্টের কাজ দেখতে দেখতে কখন যে রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেলো খেয়ালই হয়নি। সেহেরকে অনেকবার ফোন, ম্যাসেজ করেও খোঁজ পাওয়া যায়নি। মেয়েটার সাথে আজ সারাদিন একবারের জন্যও কথা হয়নি ভেবেই মন খারাপ লাগছিলো। কিন্তু এত রাতে ফোন কলের শব্দে ওর বিরক্তি চরম আকার ধারণ করল। অফিস থেকে ফোন আসার সম্ভাবনা নেই, সেহের তো আরো করবেনা এত রাতে। তাহলে কে? খুব জরুরি না হলে তো কেউ ফোন করেনা৷ এই ভেবে নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করলো পূরব। কে ফোন করেছে জিজ্ঞেস করতেই সুমার কন্ঠ শোনা গেলো।

‘হ্যালো ভাইয়া? আ আমি সুমা বলছি। সেহেরের রুমমেট।’

পূরব তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘এত রাতে? সেহেরের কিছু হয়েছে? ঠিক আছে ও?’

‘না ভাইয়া। ওর তো সন্ধ্যা থেকে জ্বর। অনেক জ্বর। জ্বরের ঘোরে একপ্রকার বেহুঁশের মতো পড়ে আছে।’

ওদিকে কথাটা শুনেই পূরবের গলা শুকিয়ে এলো। ভীষণ টেনশন শুরু হলো। পূরব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘আমাকে আগে জানালে না কেন?’

‘আসলে আপনার কথাটা মাথায় ছিল না।’

পূরব বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, ‘ওয়েট, আমি আসছি৷ ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।’

কথাটা শুনে সুমা অনুরোধের স্বরে বলল, ‘আপনার আসতে হবেনা ভাইয়া। আর এখন জ্বর কিছুটা কমেছে। আমি ঔষধ খাইয়ে দিয়েছি। ঘুমাচ্ছে এখন। আপনি আসলে প্রবলেম হবে।’

পূরব ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কীসের প্রবলেম?’

‘এত রাতে মেয়েদের বাসায় আসবেন লোকে জানলে কত কথা রটাবে ভেবেছেন? কেউ তো আর সত্যটা জানতে আসবেনা, উলটো আমাদেরই সমস্যা হবে। খারাপ ভাববে। আর আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা আছি তো।’

পূরব ভেবে দেখলো কথাটা আসলেই ঠিক। হতাশ হয়ে বলল, ‘আচ্ছা৷ বাট কাল সকালে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে ওকে। আমি কথা বলে রাখবো। আর ওর এতো পরিশ্রম করার মানে হয়? ঠিকমতো খায়না, নিজের প্রতি নূন্যতম খেয়াল রাখেনা অসুস্থ তো হবেই। বেয়াদব মেয়ে একটা।’

সুমা হেসে ফেললো। পূরব ফোন রেখে দিলো আরও কিছু উপদেশ দিয়ে। সেহেরের দুইগালে থাপ্পড় দেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে। পরদিন সকালে জ্বর কমলে সুমা ওকে জোর করে একপ্রকার হুমকি দিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। হসপিটালে গিয়ে দেখলো সেখানে পূরবও ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। সুমার প্রতি রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সেহের। পূরবকে জানানোর কী দরকার ছিল? যত্তসব! এখন ওর উপর খবরদারি শুরু করবে এই লোক। সেহের চুপচাপ হয়ে রইলো। পূরব ডাক্তারের চেম্বারে ওকে নিয়েই গেলো। কথাবার্তায় বোঝা গেলো ডাক্তার পূরবের পূর্ব পরিচিত। তিনি সেহেরকে পরিশ্রম কম করতে উপদেশ দিলেন। কিছু ঔষধপত্র লিস্ট করে দিলেন। ওখান থেকে বেরিয়ে পূরব সেহেরের সাথে রাগারাগি করলো খুব। আজ থেকে টিউশন বন্ধ। সেহের কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আমি নিজের খেয়াল রাখবো। কিন্তু টিউশন বন্ধ করবোনা।’

‘ত্যাড়ামি যাবেনা এই মেয়ের। যত্তসব পাগলের পাল্লায় পড়েছি।’

সেহের চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘তাহলে পাগলের জন্য এত দরদ দেখাবেন না। যাচ্ছি আমি।’

পূরব পেছন থেকে ওর হাতটা টেনে ধরে বলল, ‘বিয়েটা এই সপ্তাহেই করছি। তারপর দেখবে কীভাবে ত্যাড়ামি ছুটাই তোমার। বেয়াদব কোথাকার।’

‘আমি আপনাকে বিয়ে করব না।’

‘তোমার মতামত জানতে চাইনি।’

সেহের মুখ ভেঙিয়ে বলল, ‘চোর চোরই থাকে। কখনো ভালো হয়না।’

পূরব রেগে ওর হাত চেপে ধরে বলল, ‘কী বললে? এত সাহস? এখন তো শাস্তি দিতেই হবে..’

বলেই আচমকা সেহেরের গালে চুমু খেলো। সেহের কাঠ হয়ে গেল। আশেপাশের লোকজন দেখেছে কিনা আল্লাহ মাবুদ জানে। পূরবের বুকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলো। পূরব বাঁকা হেসে বলল, ‘আসো আরেকটা দিই। চলো!’

‘শয়তান কোথাকার, দূরে যান বলছি৷ নির্লজ্জ লোক।’

পূরব ওর দিকে এগোতে লাগলো। হঠাৎ সুমা চলে আসায় পূরব ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে পড়লো। ওদেরকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে সেহেরকে চোখ টিপে ওর কানে কানে বলল, ‘রেডি থেকো বউ। বিয়েটা এই সপ্তাহেই হচ্ছে।আমাকে চোর বলার সাধ সুদে-আসলে মিটিয়ে দেব।’

ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি। সাজানো গোছানো একদম ভালো হয়নি!
চলবে..ইনশাআল্লাহ!

প্রিয় তুমি পর্ব-১১

0

#প্রিয়_তুমি
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১১

এরপর কিছুদিন কেটে গেলো। পূরব ভাবতে লাগলো কীভাবে সেহেরকে সবটা বলবে। কীভাবে জানালে সেহের বুঝতে পারবে যে পূরব ওকে ভালোবাসে? আর যদি সেহের না করে দেয়? তাহলে? পূরব কিছুতেই সেটা মানতে পারবেনা। খুব কষ্ট হবে৷ এতসব ভাবনায় এলোমেলো মস্তিষ্কটাকে সান্ত্বনা দিতে পূরব ঠিক করলো আগামীকালই সেহেরকে সবকিছু জানাবে। এর মধ্যে একটা নামীদামী পোশাক কোম্পানির ব্র‍্যান্ড এম্বাসেডর হিসেবে কাজ করতে ওকে অফার করা হলো। পূরব ওদেরকে হ্যাঁ না কিছুই বললোনা৷ এসবে ওর ইন্টারেস্ট না থাকলেও ইরফান আহমেদের প্রচুর ইন্টারেস্ট আছে। তিনি এটাও চান ছেলে মডেলিং করে যাতে ভালো একটা পজিশনে যেতে পারে। কিন্তু পূরবের মনে হয় এসব করা ওর কর্ম নয়, যেমন পজিশনে আছে তেমনই ভালো। এমনিতেই লোকচক্ষুর সামনে পড়লে ওর আর রক্ষা নেই, সেখানে মডেল হওয়া তো আরো রিস্কের৷ যখন তখন লোকজনের সামনে যাওয়া যাবেনা ইচ্ছে থাকলেও, মেয়েরা তো জেঁকে ধরবে একদম। তাই ও আর এই বিষয়ে ফাইনাল কোনো সিদ্ধান্ত নিলোনা। আপাতত পেন্ডিংয়ে রাখা হলো। এখন ওর কাজটা আগে শেষ করতে হবে৷

সেহেরের এক্সাম শেষ হয়েছে সপ্তাহ খানিক হলো। খুব একটা খারাপ হয়নি। তবে সিজিপিএ নিয়ে ওর খুব টেনশন হচ্ছে। টিউশন শেষে বাসায় ফিরে ও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লো। গোসল সেরে ভেজা চুল নিয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘুমে দুচোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। রাত নয়টার দিকে সুমা এসে ওকে ডেকে তুললো। সেহের ঘুমের মধ্যেই খুব বিরক্ত হলো, তবুও উঠলোনা। সুমা এবার কপট রাগ নিয়ে বলল, ‘এই সেহের, সেহের উঠ না?’

‘ডি ডিস্টার্ব করিসস ন না।’

‘ডিস্টার্ব কই করলাম। কত রাত হয়েছে খেয়াল আছে? খেতে উঠ।’

‘খাব ব ন না।’

‘আরে আমি নিজের হাতে রান্না করেছি। উঠ বলছি।’

‘বললাম তো খাবোনা।’

এভাবে অনেকক্ষণ জোরাজোরি করার পরেও সেহের উঠতে চাইলোনা অথচ পেটে ক্ষিধেয় ছুঁচো দৌঁড়াচ্ছে। কাঁথা টেনে মুখ ঢেকে ফেললো যার অর্থ সে খেতে উঠবেনা। সুমা ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়লোনা। হঠাৎই ওর মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেলো। বিছানায় বসে গলার স্বরটা উঁচু করে শিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই শিলা দেখে যা কি কান্ড ঘটছে!’

শিলা রান্নাঘরে আলুভাজতে ব্যস্ত। সুমার কথা শুনে বলল, ‘কী হইসে?’

‘পূরব ভাইকে চিনস না? আরে আমাদের বাসার নিচে আইসা যে দাঁড়িয়ে থাকতো?’

শিলা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘লম্বা করে যে ওনি? আরে হ্যাট পরা মানব?’

‘হুম।’

‘কী হয়েছে ওনার?’

শিলা জিজ্ঞেস করতেই সুমা ওকে চোখ টিপে দিলো। যার অর্থ একটুখানি এক্টিংয়ে ওর সাথে তাল মেলাতে হবে, যাতে করে সেহেরকে এই ঘুম থেকে উঠাতে পারে। শিলা মুখ টিপে হেসে সুমার সাথে সায় জানালো। সুমা ভ্রু কুঁচকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রল করার ভঙ্গি করে নাক টেনে বলল, ‘আরে ওনার মতো বড়মাপের একজন লোক আমাকে ম্যাসেজ করেছে তুই ভাবতে পারোস?’

শিলা আকাশ থেকে পড়ার মতো ভান করে বলল, ‘কী বলস? ও আল্লাহ!’

‘হুম সত্যি। পূরব ভাই আমাকে ম্যাসেজ দিয়েছে।’

ঘুমের মধ্যে থাকলেও সেহেরের কান ওর মস্তিষ্কে এই নামটা পৌঁছালো। কাঁথার ভেতর চোখ খুলে চাইলো। অবাক হয়ে সুমার কথা শুনতে লাগলো। পূরব সুমাকে ম্যাসেজ করেছে? সত্যিই?

শিলা বলল, ‘কী লিখেছে?’

সুমা ভাব নিয়ে বলল, ‘কথাটা তো আমাদের নিয়ে লেখেনি। লিখেছে সেহেরকে নিয়ে। আল্লাহ শিলা, আমরা যা ভাবতাম তাই রে। ওনি এজন্যই রাত-বিরেতে আমাদের এখানে এসে এতিমের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো।’

শিলা উৎসুক কন্ঠে বলল, ‘সেহেরকে নিয়া লিখছে? কি লিখছে রে?’

‘খুবই গোপনীয় কথা। এটা শুধু ওকে বলতেই বলছে।’

সেহের ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ক কী লিখেছে?’

সুমা হেসে বললো, ‘জানতে চাস? এতো ইন্টারেস্ট কেন তোর? তাছাড়া এখন তো তুই ঘুমাবি, সো ঘুমিয়েই থাক।’

সেহের বলল, ‘প্লিজ বল না।’

‘বলব এক শর্তে।’

সেহেরের খুব জানতে ইচ্ছে করছে পূরবের ম্যাসেজের ব্যাপারটা। কী ওমন লিখেছে ওকে নিয়ে? ভ্রু কুঁচকে সুমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী শর্ত?’

‘খাবি আগে।’

সেহের হতাশ হয়ে বলল, ‘খেতেই হবে?’

‘হুম হবে।’

‘তোরা আবার আমাকে ধোঁকা দিচ্ছিসনা তো?’

সুমা ভাব নিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস না করতে পারলে না-ই করতে পারিস৷ সম্পূর্ণটা তোর উপর।’

‘আচ্ছা। খাবো।’

সেহের ফ্রেশ হয়ে এসে সুমাদের সাথে বসে খেয়ে নিল। খাওয়াদাওয়া সেরে সবকিছু গুছিয়ে সেহের সুমার জন্য ওয়েট কর‍তে লাগলো। ওর ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। কিন্তু ওকে পুরো অবাক করে দিয়ে সুমা আর শিলা নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তার মানে ওকে খাওয়ানোর জন্য ওরা মিথ্যা বলেছে? আর সেহেরও সেটা বিশ্বাস করেছে। না জানি সুমা, শিলা পূরবের প্রতি ওর এতো ইন্টারেস্ট দেখে কি ভাবছে। ইশ কী লজ্জা!

সেহের টিউশন শেষে বাসায় ফিরছিল। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। গলির মুখে কিছু ছেলেদের দেখা যাচ্ছে। তাদের চেহারা দেখেই যে কেউ চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারবে ওরা বখাটেপনা করে বেড়ায়৷ সেহের দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে গেলো, ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে গল্প করায় মগ্ন৷ ওকে দেখতে পেল না। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে সেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। উফ বাঁচা গেল। সামনে পা বাড়ালো আবার। হঠাৎই লক্ষ্য করলো ওর পিছু কেউ আসছে৷ সেহের ওর ব্যাগ চেপে ধরলো। পা চালালো দ্রুত। নিশ্চয়ই ওই লোক গুলোর মধ্যে কেউ! ভয়ে একপর্যায়ে দৌড় শুরু করল। বড় একটা গাছের নিচে পৌঁছাতেই কেউ ওকে ডাকলো। না চাইতেও সেহের পেছনে ফিরে দেখলো হ্যাট পরা একটা লোক, মুখ দেখা যাচ্ছেনা। সেই মুহূর্তে হ্যাট পরা কোনো লোকের কথা ওর মাথায় এলোনা। ভয়ের চোটে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমি কিছু করিনি। আমাকে যেতে দিন প্লিজ।’

পূরব অবাক হয়ে বলল, ‘হোয়াট??’

সেহের চোখ বন্ধ করে বলল, ‘প্লিজ আমায় যেতে দিন। আমার ক্ষতি করবেন না।’

পূরব আরেকটু এগিয়ে গেলো ওর দিকে। বুঝতে পারলো কোনো এক কারণে ও ভয় পাচ্ছে। পূরব বলল, ‘আমিতো ক্ষতি করতে আসিনি তোমার। নিয়ে যেতে এসেছি।’

সেহের ভয়ের চোটে এবার চোখ খুলল। সামনে পূরবকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। অস্ফুটস্বরে বলল, ‘আ আ আপনি?’

পূরব মুচকি হেসে বললো, ‘হুম আমি। কিন্তু তুমি এভাবে রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলে কেন? আর এত ভয়ই বা কেন পাচ্ছো? আমি তো তোমার কোনো ক্ষতি কর‍তে আসিনি৷ সেরকম কোনো ইন্টেনশন আমার নেই।’

সেহের রেগে বলল, ‘তার মানে আপনি এতক্ষণ আমার পিছু নিচ্ছিলেন?’

পূরব বলল, ‘একদমই না৷ আমিতো তোমার বাসার দিকেই যাচ্ছিলাম৷ হঠাৎ দেখলাম তুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছো। আমি গাড়ি থেকে নেমে তোমাকে ডাকলাম৷ তুমি হয়তো শুনোনি। আমি তোমার পিছনে পিছনে আসছিলাম, আচমকাই তুমি দৌড় শুরু করলে। বাই দ্যা ওয়ে, এরকম করার কারণ?’

সেহের নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই বকলো। পূরবের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহারই করার চেষ্টা করলো। কিন্তু ও এখানে কেন? তারপর বলল, ‘এমনিই। ভাবলাম কেউ হয়তো আমায় ভয় দেখাতে এরকম করছে।’

‘ওহহ। এত রাতে কোথা থেকে ফিরছ?’

‘টিউশন থেকে।’

পূরব বলল, ‘শুনো তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম৷ তোমার সাথে দরকার আছে!’

‘কীসের দরকার? তাও আবার আমার সাথে?’

‘হুম! রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলতে চাইনা। কোথাও বসার জায়গা আছে?’

‘এখানেই বলুন।’

‘আমার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পেশাল কথাগুলো আমি এভাবে বলতে চাচ্ছিনা। কোথাও বসে বললেই বেটার।’

সেহের চোখ গরম করে বলল, ‘আসুন তবে। সামনে একটা টঙ দোকানের পাশে পার্ক আছে। যাবেন?’

পূরব কিছুক্ষণ গাইগুই করে রাজি হলো। তারপর ওরা সেখানে গেল। দোকানী একজন বয়স্ক লোক। কম করে
হলেও আশি বছর বয়স তো হবেই। সেটার অদূরে একটা পার্ক। তার পাশে খোলা মতোন একটা জায়গা, ঘাসে ভরপুর। কাঠের তৈরি একটা বসার জায়গা দেখে সেহের আর পূরব সেখানে বসলো। সেহের বলল, ‘বলুন আপনার ইম্পোর্টেন্ট কথা।’

পূরব হালকা কেশে বলে উঠলো, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই এবং করবো।’

সেহের অবাক হলেও তা প্রকাশ করল না। মৃদু হেসে বলল, ‘কেন?’

‘কারণ তোমাকে ভালোবাসি।’

সেহের থমকে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুতে চাইছেনা। তাও খুব কষ্টে বলল, ‘এটা কতটুকু সত্যি?’

‘যতটুকু সত্য ভালোবাসা নামক কথাটায়।’

‘এটা বিশ্বাস করব কী করে? আজকালকার দিনে ভালোবাসা হয়না, যা হয় পুরোটাই মোহ। আপনারও ঠিক সেটাই হয়েছে। মোহ কেটে গেলে আমার প্রতি আপনার ইন্টারেস্ট উঠে যাবে। তাই প্লিজ বিয়েটিয়ের কথা বলবেন না।’

পূরব গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘প্লিজ আমার ভালোবাসাকে মোহ বলে চালানোর চেষ্টা করবেনা। আমি বাচ্চা নই। সাতাশ বছরের জীবনে কোনটা মোহ, কোনটা ভালোবাসা সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে শিখেছি। তাই আমার ভালোবাসাকে নিয়ে মজা বা অপমান কোনোটাই করার রাইট তোমার নেই।’

‘হঠাৎ করে আমার প্রতি ভালোবাসা উদয় হওয়ার কারণ? আপনার পাশে কোনো অপ্সরা মানায়। আমি কিন্তু দেখতে অপ্সরা নই।’

পূরব গভীর গলায় বলল, ‘আমি অপ্সরাকে ভালোবাসিনি, সেহেরকে ভালোবেসেছি।’

‘তবুও বলছি, আপনার পাশে অপ্সরা মানায়।’

পূরবের ভীষণ রাগ হচ্ছিলো। কাঠ কাঠ গলায় সে বলল, ‘মানিয়ে নেওয়াটা আমার ব্যাপার। তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে।’

‘কিন্তু জীবনটা তো আমার!’

‘উফ..বড্ড বেশি কথা বলো তুমি।’

‘তা আমাকে বেছে নেওয়ার কারণটা ঠিক কী?’

পূরব স্বপ্নালু চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে। প্রথম যেদিন তোমার সাথে দেখা তখন থেকেই একটা ইন্টারেস্ট তৈরি হয় তোমার প্রতি। তোমাকে হেনস্থা করার জন্য যতটুকু টাইম ওয়েস্ট করেছি, ততটুকু টাইম আমি অন্য কোনো মেয়েকেও দিইনি। অথচ আমার আশেপাশে মেয়েদের অভাব ছিলনা কখনো। কিন্তু তুমি আলাদা। সেই থেকে ভালোলাগা। তারপর আব্বুকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে যখন বাঁচালে আব্বুও তোমাকে নিয়ে প্রশংসা করত। আমি তখন আরো তোমাতে মগ্ন হয়ে যাই। রাতেরবেলা একপলক দেখার জন্য ছুটে আসতাম, দাঁড়িয়ে থাকতাম পাগলের মতো। আব্বুর দেওয়া চাকরিটা ফিরিয়ে দিয়ে নিজের আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখেছিলে তাতে আমি তোমার ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়ে যাই। একসময় বুঝতে পারি তোমাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।’

সেহের শুনলো সবটা। তারপর বলল, ‘আপনি আমার ব্যাপারে সব জানেন না। কিন্তু আপনার জানা দরকার আমি একটা এতিম মেয়ে। খুব সাধারণ একটা ফ্যামিলি থেকে বিলং করি। চাচীর সংসারে লাথি-ঝাটা খেয়ে দিনাতিপাত করেছি। একমুঠো খাবারের জন্য কত কি-না করেছি। ছেঁড়া জামাকাপড় পরেছি। স্কুলে যাওয়ার ইউনিফর্ম ছিলনা বলে ক্লাসে আউটড্রেস পরে যেতাম, সেজন্য কত মার খেয়েছি। কাজের লোকের মতো সারাদিন কাজ করেছি, বিনিময়ে নুন-পান্তা জুটেছে কপালে। শুধুমাত্র পড়াশোনা জানা ছিল বলে আজ আমি এতদূর এসেছি। এই তিনকূলে এক চাচা ছাড়া আমার আর কেউ নেই৷ তাও সেই চাচার সংসারে আমার কোনো জায়গা নেই। আপনার জানা উচিৎ, আমার সাথে আপনার স্ট্যাটাস মিলেনা। আপনার সাথে বড়লোক ঘরের মেয়েকেই খাটে, আমাকে নয়।’

পূরবের বুক কেঁপে উঠলো। সেহেরের হাতটা নিজের মুঠোতে নিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠলো, ‘তবুও ভালোবাসি।’

সেহের অস্বস্তিভরা গলায় বলল, ‘ছাড়ুন হাত। প্লিজ। আপনার সাথে আমার যায়না। লোকে হাসবে। আমায় লোভী ভাববে।’

পূরব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কিন্তু তুমি তা নও। তোমার সেল্ফ-রেস্পেক্ট তোমাকে সেটা ভাবতে বলেনা। তাছাড়া কোন সোসাইটির কথা ভাবছো, যেখানে তোমার শৈশব-কৈশোর এতো খারাপ কেটেছে! কই তখন তো কেউ এসে তোমাকে সাহায্য করেনি। কেউ তো দু-মুঠো অন্ন জোগাড় করে দেয়নি। সবাই নিজেদের নিয়ে যেখানে ব্যস্ত ছিলো, সেখানে তুমি নিজের যোগ্যতায় এতদূর এসেছো। আর আজ তুমি ভালো থাকার চেষ্টা করলে সবাই কটুক্তি করবে, তা তুমি মেনে নিচ্ছো? তাদের কথা ভাবছো? ঘুরেফিরে সেই সমাজের কাছেই বাক্সবন্দি হয়ে থাকতে চাইছ! এটা কেমনতর কথা হলো?’

সেহের অবাক হয়ে পূরবের দিকে তাকালো। ওর পুরো কথাটাই তো ঠিক। কিন্তু… একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। সেহেরকে চিন্তায় মগ্ন দেখে পূরব বলল, ‘আজগুবি চিন্তা বন্ধ করো৷ কোনো ভয়-লজ্জা পাবার কারণ নেই। ইউ নো হোয়াট, তুমি নিজেও আমাকে ভালোবাসো, সেটা তোমার চোখগুলোই আমাকে জানান দিচ্ছে।

সেহের কপট রাগ নিয়ে বলল,’ইশ চুপ করুন। আপনি কিছুই জানেন না!’

পূরব ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী জানিনা? সব জানি আমি। কীভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে তুমি আমাকে দেখতে। ফ্রেন্ডসদের সাথে আমাকে নিয়ে আলোচনা করতে। ফার্স্ট টু লাস্ট অলওয়েজ তুমি আমাকে, আর আমি তোমাকে ভালোবাসবো। গট ইট… এবার সত্য কথাটা বলে ফেলো, এই রাতে আমি কথাটা শোনার জন্যই তোমার কাছে এসেছি!’

‘কোন কথা?’

‘ভালোবাসি বলাটা।’

সেহের ভীষণ লজ্জায় মুখ নুইয়ে ফেলল। এতেই পূরব বুঝতে পারলো প্রিয় মানুষটার ও ওর প্রতি বিশেষ অনুভূতি আছে। ওর লজ্জায় লাল হওয়া গালটাকে আরও রাঙিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। আলতো করে গাল ছুঁইয়ে দিলো। হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় সেহের ওকে চুপ করিয়ে রেগে বলল, ‘আপনিই তাইনা? সেদিন মাহিমকে লোক দিয়ে পিটিয়েছিলেন? আর আমাকে নিজের হবু বউ পরিচয় দিয়েছিলেন? কি মিথ্যুক আপনি? এমন কেন করেছিলেন?’

পূরব রেগে বলল, ‘অভিয়েসলি আমি করেছি। তোমার আশেপাশে আবার দেখলে এবার জানে মেরে দিব। তুমি যেভাবে ওর সাথে কথা বলতে আমার রাগ উঠতো। তাই ধোলাই দিয়েছি। এবার যদি শিক্ষা হয়!”

সেহের গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল, ‘ও আমার ফ্রেন্ড রিমির ফিয়ন্সে।’

পূরব অবাক হয়ে গেলো। থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। সেহের হাসতে লাগলো। পূরব মুগ্ধ করা সেই হাসি অবলোকন করে নিজেও মুচকি হাসলো৷ প্রশান্তির উষ্ণ নিঃশ্বাস জানান দিলো ভালোবাসার মানুষটির মনের সুপ্ত কথা। পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে পূরব হঠাৎ জোরালো গলায় বলে উঠলো, ‘ভালোবাসি। খুব বেশিই ভালোবাসি লাজুক হাসিতে মুগ্ধ করা সেই মেয়েটিকে, যে আমার বুকের বাঁ-পাশটা জুড়ে আছে।’

সেহের ওকে এরকম করতে দেখে নিঃশব্দে হাসছে। ঘন পাপড়িযুক্ত চোখ মেলে দেখছে তার হ্যাট পরা সেলিব্রেটি চোরটাকে। আহা তাঁর ভালোবাসাটা!

চলবে