Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1405



একটি প্রেমাচ্ছন্ন বিকেল পর্ব-০২

0

#একটি_প্রেমাচ্ছন্ন_বিকেল
#পর্বঃ০২
#Arshi_Ayat

মৌ বারবার রাশেদের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ওর শক্তির সাথে পেরে উঠছে না।কিন্তু দুই তিন পা ফেলতেই থেমে যেতে হলো কারণ সামনে ওই ছেলেটা যে একটু আগে মৌ এর সাথে কথা বলছিলো।ছেলেটা পথ আগলে দাড়ালো।পথরোধ করায় রাশেদ চড়াও হয়ে বলল,’এই পথ আটকেছিস কেনো?পথ ছাড়।আর এখান থেকে যা নাহলে এখানেই তোকে পুঁতে রেখে দিবো।বাঁচতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলে যা।’

ছেলেটা একটু ভ্রু কুঁচকে মুখে গাম্ভীর্য ধারণ করে বলল,’আপনি ওনাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কেনো?’

‘এই তোরে কৈফিয়ত দিমু ক্যান?বাইরের পোলা হইয়া আমার লগে গলা চড়ায় কথা কস তোর তো সাহস কম না।’এটা বলেই রাশেদ ছেলেটাকে থাপ্পড় মারতে নিলেই ছেলেটা সিনেমা স্টাইলে থাপ্পড়টা আটকে ঘুরিয়ে চারটে চড় মারলো।চার নাম্বার চড়টা মেরে বলল,’এই যে তোর এলাকায় দাড়িয়ে তোকে চড়ও দিয়ে দিলাম।যা তোর বাপ দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠীকে ডাক।দেখি কে আমার কি বাল ফালায়।’
রাশেদ চারটা চড় খেয়ে রাগে অপমানে রক্তচক্ষু নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,’তুই দাড়া।তোরে আজকে কোপাইতে না পারলে আমার নাম রাশেদ না।’

রাশেদের কথা শুনে ছেলেটা কৌতুকে হেসে টিটকিরি দিয়ে বলল,’তাইলে তোর নাম কি দিবি?’
রাশেদ রাগটা হজম করে মৌ কে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে ছেলেটা নিজের একটা হাত দিয়ে মৌ এর হাত ধরে বলল,’ওনাকে না।তুই একা গিয়ে তোর চেলা পেলা চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে আয়।আমি এখানেই দাড়াইছি।’

রাশেদ মৌ এর হাত ছেড়ে দিয়ে একবার ছেললটার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো।আজকে এই ছেলের লাশ ফেলে দিতে না পারলে ও আজীবন মাথা ন্যাড়া করে রাখবে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো।এদিকে রাশেদ অনেকটা দূর চলে যাওয়ার পর ছেলেটা বাইকে বসে মৌ কে বলল,’হা করে কি দেখছেন?তাড়াতাড়ি বাইকে উঠুন।ওরা চলে এলে আর যাওয়া যাবে না।’

মৌ ইতস্তত করতে করতে বলল,’আমি আপনার সাথে যাবো কেনো?’
ছেলেটা বলল,’কারণ আমকে শিরিন ভাবি পাঠিয়েছে।বলেছে আপনাকে নিয়ে যেতে।’
মৌ বিশ্বাস করতে পারলো না।হতেও তো পারে লোকটা মেয়ে পাচারকারী!ওকে ধরে নিয়ে পাচার করে দিবে!এগুলো ভেবেই মৌ ইয়া বড়ো এক ঢোক গিললো।মৌ এর মুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছে সে ছেলেটাকে বিশ্বাস করছে না।নিজেকে বিশ্বাস করানোর জন্য ছেলেটা নিজের ফোন থেকে একটা ছবি বের করে দেখিয়ে বলল,’এই দেখুন আমি আর ভাবি।’
মৌ হাতে নিয়ে দেখলো আসলেই ছেলেটার সাথে শিরিন আপুর ছবি।আপু আগের থেকে একটু মোটা হয়েছে।মৌ ওনাকে আরো দুইবছর আগে দেখেছে।তখন চিকনই ছিলো।ছেলেটা মৌ এর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল,’এবার তো আসুন প্লিজ!ওরা আসলে চারটা চড়ের বদলে আমার চারশো টুকরা করবে।’ছেলেটা কথাটা কিছুটা অসহায় শোনা গেলো।মৌ এর হাসি পেলো।তখন তো কি বড় বড় গলায় বলেছিলো চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে আসতে আর এখন হাওয়া বের হচ্ছে।তবে হাসি আসলেও এই সিরিয়াস সময়ে মৌ হাসলো না।ছেলেটার পেছনে উঠে বসলো।কিন্তু বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগেই রাশেদ আর আরো কয়েকজনকে দেখ যাচ্ছে।হাতে লাঠিসোঁটা।ওদের দেখেই ছেলেটা কালবিলম্ব না করে বাইকে স্টার্ট দিয়ে দিলো।তারপর পিছনে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে ওদের একপলক দেখে সামনে তাকিয়ে হেঁড়ে গলায় গান ধরলো,’

আজ ম্যা উপার,আসমা নিচে।
আজ ম্যা আগে,জামানা হ্যায় পিছে।’

মৌ নিঃশব্দে হাসলো।স্টেশনে পৌঁছে বাইক থেকে নেমে ছেলেটা বলল,’আপনি একটু দাড়ান আমি এই বাইকটা দিয়ে আসছি।’

মৌ দাড়ালো।ছেলেটা বাইকটা দিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এলো।এই বাইকটা স্টেশনের একজনের থেকে ধার নিয়েছিলো মৌ কে আনার জন্য।দিতে চায় নি অবশ্য কিন্তু পাঁচশ টাকা দেওয়ার পর রাজি হয়েছে।

ছেলেটা ফিরে এসে মৌ এর থেকে ব্যাগটা চাইলো কিন্তু মৌ বলল,’না থাক।আমি পারবো।’
ছেলেটা আর কিছু বলল না।ট্রেন আসতে লেট হবে তাই ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসলো।রুমে মানুষ দিয়ে ঠাসা।কোনো মতে একটা সীট পেলো বসার।সেটায় মৌ বসল।আর ছেলেটা দাড়িয়ে রইলো।এখন সাড়ে ছয়টা।ট্রেন আসবে সোয়া সাতটায়।আরো পয়তাল্লিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।আশেপাশে কয়েকটা দোকান খোলা দেখলো আসার সময়।হোটেলও বোধহয় মাত্রই খুলেছে।ছেলেটা মৌ’কে বলল,’কি খাবেন আপনি?’
মৌ মাথা নেড়ে জানালো সে কিছু খাবে না।ছেলেটা একটু বিরক্ত চোখে তাকালো।ভাবলো কি নাকউঁচু বাপ রে!
নিজের জন্য পরোটা আর ভাজি এনে দাড়িয়ে দাড়িয়েই খেয়ে নিলো।

ট্রেন চলে এসেছে প্লাটফর্মে।মৌ কে নিয়ে ট্রেনে উঠলো ছেলেটা।একটা বগিতে উঠে দুজনেই মুখোমুখি বসলো।এভাবেই সীট কাটা হয়েছে।সীটে বসে ছেলেটা ফোন বের করতেই সেখানে কল এলো।রিসিভ করে বলল,’হ্যাঁ ভাবি বলো।’

ওপাশ থেকে শিরিন বলল,’তোরা কোথায় রে?’

‘এই তো ট্রেনে উঠেছে।’

‘সমস্যা হয় নি তো কোনো?’

‘হতে হতে বেঁচে গেছি।’

‘মৌ কোথায়?’

‘আমার সামনেই বসে আছে।’

‘ওকে একটু ফোনটা দে।’
ছেলেটা ফোনটা মৌ এর দিকে বাড়িয়ে দিলো।মৌ হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে কানি দিলো।ওপাশ থেকে শিরিন বলল,’ভয় পেয়ো না মৌ।ও আমার দেবর রুশান।আমি কাল পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছি তাই আসতে পারি নি।তাই ওকে পাঠিয়েছি।সংকোচ করো না কেমন!’

‘আচ্ছা আপু।’

‘নাস্তা করেছো?’

‘না আপু।’

‘কি!ওই বদমাশটা এখনো তোমায় না খাইয়ে রেখেছে।ওকে একটু ফোনটা দাও।’

মৌ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনের লাইন কেটে গেলো।তাই ফোনটা রুশানের কাছে দিয়ে দিলো।রুশান আবার ভাবিকে ফোন দিলো।ফোন রিসিভ করে শিরিন বলল,’এই বদমাশ।ওকে এখনো না খাইয়ে রাখলি কেনো?’

রুশান মুখ বাঁকা করে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বলল,’তোমার বোন যেই নাক উঁচু!আমি জিগ্যেস করেছিলাম কিছু খাবে কি না!কিন্তু সে না বলল।’

‘গাধা!ও এমনিই ভয় পেয়ে আছে তাই না করেছে।যা ওকে নাস্তা কিনে দে।’

‘আচ্ছা দিচ্ছি।এবার না খেলে আমি কিছু জানি না।’

‘খাবে,খাবে।’
ফোন রেখে রুশান ট্রেন থেকে নামলো নাস্তা কেনার জন্য।আর মাত্র পাঁচ মিনিট আছে ট্রেন ছাড়ার।রুশান দৌড়ে হোটেলে গেলো।কিন্তু এখানে সিরিয়াল কোনোমতে মানুষজনকে ঠেলেঠুলে নাস্তা কিনে আবার দৌড়ে ট্রেনে ফিরে এলো।ট্রেন আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে।রুশান বগিতে ফিরে এসে মৌ’কে নাস্তার প্যাকেট’টা দিলো।মৌ প্যাকেট হাতে নিলো কিন্তু সংকোচের জন্য খেতে পারলো না।রুশান ব্যাপারটা বুঝলো।তাই কানে হেডফোন গুজে চোখ বন্ধ করে রইলো।
খাওয়া শেষে মৌ মিনমিনে গলায় বলল,’পানি খাবো।’

কিন্তু রুশান শুনতে পেলো না।কানে হেডফোন থাকায়।এখন ওকে ডাকবে কিভাবে সেটাই ভাবছে মৌ!ভেবে না পেয়ে আর ডাকলোই না।এদিকে এতক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরই মৌ ডাকছে না দেখে রুশান নিজেই তাকালো।দেখলো মৌ চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।আশ্চর্য পানি খেতেও ডাকলো না এতো ভয়!এতো সংকোচ!রুশান একটু আগে কিনে আনা পানির বোতলটা মৌ এর দিকে বাড়িয়ে দিলো।মৌ হাত থেকে নিয়ে পানি পান করে রেখে দিলো নিজের কাছে।এরপর আর তেমন কোনো কথা হয় নি।মৌ ট্রেনের জানালা দিয়ে সাই-সাই করে ছুটেচলা প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত আর রুশান ঘুমাতে!সীটে হেলান দিয়ে সে ঘুমাচ্ছে।বাইরে থেকে মিষ্টি একটা বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর মুখমন্ডল।সামনে দিকের বড়চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে।ছেলেটা বোধহয় ঘুমাতে ঘুমাতেও হাসে।তাই তো শ্যামলা মুখশ্রীতে এক অপার্থিব হাসি লেগে আছে।

অনেক্ক্ষণ পর মৌ এর ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার পড়লো এবং আর্জেন্ট!কিন্তু কিভাবে যাবে?ওয়াশরুম কোথায়?এর আগে তো ট্রেনে ওঠে নি।আবার রুশানকে বলতেও লজ্জা লাগছে।তবে বলতে তো হবেই!কিন্তু কিভাবে বলবে।
‘এই যে আমি একটু টয়লেটে যাবো এভাবে?নাকি আমাকে একটু টয়লেটে নিয়ে যাবেন এভাবে?নাকি টয়লেট’টা কোন দিকে এভাবে!’

মনে মনে কিভাবে বলবে এগুলো এগুলোই ভাবতে থাকলো।হঠাৎ পাশের সীটের একটা বাচ্চা তার মা’কে বলল,’মা হাগু দিবো।’
বাচ্চাটা কি সুন্দর বলে দিলো আর মৌ এখনো মুখই খুলতে পারলো না।তবে মৌ’কে উশখুশ করতে দেখে রুশান বলল,’কিছু বলবেন?’

‘না মানে..!’

‘কি না মানে?’

মৌ হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেললো,’আমি হাগু দিতে যাবো।’

চলবে…
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

একটি প্রেমাচ্ছন্ন বিকেল পর্ব-০১

0

#একটি_প্রেমাচ্ছন্ন_বিকেল
#পর্বঃ০১
#Arshi_Ayat

পিঠ উন্মুক্ত করে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে মৌপ্রিয়া।রক্তে পিঠ লাল হয়ে আছে।ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছে ও।প্রচন্ড মারের চোটে শরীরের বেহাল দশা।ব্যাথায় দাত মুখ খিচিয়ে আসছে প্রায়।হঠাৎ পিছনে কেউ গরম কিছু একটা ছোয়াতেই মৌপ্রিয়া ব্যাথায় গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো।কান্নাকন্ঠে বলল,’আল্লাহ গো পুড়ে গেলো।উফফ!জ্বলে গেলো।’

মাহমুদা বেগম বাম হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন,’মৌ মা একটু ধৈর্য ধর তোর পিঠের রক্তগুলো পরিস্কার করে দেই।’

মৌপ্রিয়া দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।একটু আগে মাহমুদা বেগমের স্বামী বলতে গেলে মৌ এর সৎ বাবা লতিফ উদ্দিন প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছন।অপরাধ হলো ভুলবশত মৌ বসার ঘরে মেহমানদের সামনে চলে গিয়েছিলো।

মাহমুদ বেগম আস্তে আস্তে মেয়ের পিঠে স্যাভলন লাগাচ্ছেন।কাটা জায়গায় স্যাভলন লাগতেই জ্বলে যাচ্ছে।বুক ফেটে চিৎকার আসছে কিন্তু চিৎকার করলে আবার মার খেতে হবে।পুরো পিঠের রক্ত পরিস্কার করে মাহমুদা বেগম ব্যাথা নাশক ঔষধ লাগিয়ে দিলেন।কাঁদতে কাঁদতে মৌ ঘুমিয়ে গেছে।মাহমুদা বেগম মমতাভরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।এটা নিত্যকার কাহিনী।প্রতিদিনই ওকে মার খেতে হয়।আপন মা হয়েও মাহমুদা বেগম মেয়ের জন্য কিছু করতে পারে না।এতোটাই অসহায় তিনি!
মৌপ্রিয়ার যখন পাঁচবছর তখন ওর বাবা ক্যান্সারে মারা যায়।মাহমুদা বেগম চেয়েছিলেন আর বিয়ে করবেন না।একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবন পার করবেন।কিন্তু তার চাওয়া পূরণ হলো না।তিনমাসের মাথায় ভাইদের জোরাজোরি তে বিয়ে তে রাজি হতে হয়।যেহেতু বাবা মা নেই সেহেতু ভাইদের কথাই মানতে হয়।বিয়ের সময় কথা হয় মৌপ্রিয়াও মায়ের সাথে থাকবে।প্রথমে এই শর্ত শ্বশুর বাড়ির লোকেরা মেনে নিলেও পরে মৌপ্রিয়াকে সহ্য করতে পারতো না কেউ।ছোটোবেলা থেকেই মৌ অবহেলা,অপমান,মারধর এগুলোর সাথে খুব ভালো ভাবে পরিচিত।তিনবেলা খাবার না জুটলেও মারটা জুটে যেতো।তবে নিশুতিরাতে মা যখন বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখতো তখন সব কষ্ট ভুলে যেতো মৌ।কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারতো না মায়ের কোলজুড়ে।মৌ এর দমবন্ধ লাগে এইবাড়ির আবহাওয়া।দূরে কোথাও মা’কে নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে।মায়ের কষ্টও মৌ এর সহ্য হয় না।সারাদিন বাড়ির প্রত্যেকটা কাজ করে রাতে মদ্যপ স্বামীর খায়েশ পূরণ করতে হয় না পারলে তো চাবুকের আঘাত আছেই।মধ্যরাতে মারের আঘাতে মায়ের আত্মচিৎকার মৌ এর মরে যেতে ইচ্ছে করে।নিজের মায়ের অসহায়ত্ব দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো কিন্তু পরক্ষণেই মায়ের কথা চিন্তা করে মৌ আর সাহস পায় না মরার।

ঘুমের ঘোরেই পেটে কারো নোংরা স্পর্শে মৌ ধড়ফড়িয়ে উঠে যায়।সামনে থাকা লোকটাকে দেখেই ভয় পেয়ে যায়।এই লোকটা সম্পর্কে মৌয়ের সৎ চাচাতো ভাই রাশেদ।ও যখনই সুযোগ পায় মৌয়ের সাথে অসভ্যতা করতে ছাড়ে না।আর সবাইকে বলে বেড়ায় ও নাকি মৌ কে বিয়ে করবে।কিন্তু মৌ লোকটাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে।একে বিয়ে করার চেয়ে কলা গাছের সাথে ফাঁস নেওয়া ভালো।কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করছে আল্লাহ ভালো জানে।এলাকায় বেশ দাপট থাকায় কেউ কিছু বলে না এদের।

রাশেদ মৌ এর ভীত সন্ত্রস্ত মুখ দেখে বিচ্ছিরি এক হাসি দিয়ে বলল,’আমাকে ভয় পাস কেনো মৌ?তোকে তো আমি বিয়ে করবো।হবু স্বামীকে কি কেউ ভয় পায় নাকি?’
মৌ কিছু বলল না গুটিশুটি মেরে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।রাশেদ মৌয়ের হাত পায়ে মারের দাগ লক্ষ্য করে ন্যাকা আফসোসের স্বরে বলল,’চাচা আবার তোরে মারছে না?থাক কান্দিস না।তুই আমার বউ হলে কেউ তোরে মারতে পারবে না।’

এটা বলেই রাশেদ খপ করে মৌ এর এক হাত চেপে ধরে।আতংকে মৌ বারবার হাত ছাড়াতে চাচ্ছে কিন্তু রাশেদ খুব শক্ত করে হাত চেপে ধরে রেখেছে।এরইমধ্যে মাহমুদা বেগম চলে এলেন।রাশেদকে দেখে থমথমে গলায় বলল,’রাশেদ,এই ঘর থেকে যাও।মৌ এখন খাবে।’

রাশেদ একবার মাহমুদা বেগমের দিকে তাকিয়ে মৌ এর হাত ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।রাশেদ যেতেই মাহমুদা বেগম দরজা আটকে দিয়ে মৌ এর কাছে এসে বসলেন।তারপর কোমল গলায় বললেন,’মৌ তুই পালিয়ে যা।এখানে তুই ভালো থাকবি না।ওরা চাইছি রাশেদের সাথে তোর বিয়ে হোক কিন্তু আমি চাই না আমার মতো কষ্টে তুইও থাক।আমি আমার খালাতো বোন সিন্থিয়ার সাথে কথা বলেছি তুই আজকে ভোরে চলে যাবি।তোকে ওর মেয়ে শিরিন নিতে আসবে।’

মৌ আদ্র কন্ঠে বলল,’কিন্তু মা তুমি?’

মাহমুদা বেগম মলিন হেসে বলল,’তুই পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাড়াবি।তারপর আমায় নিয়ে যাবি এখান থেকে।ততদিন আমি তোর অপেক্ষা করবো।কিন্তু এখন তোকে যেতেই হবে।’

মৌ মা’কে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলো।এই পৃথিবীতে একমাত্র এই মানুষটা ছাড়া আর কেউ তাকে ভালোবাসে নি।

ভোর হওয়ার আর কিছুক্ষণ বাকি।উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে মৌ এর।আজ এবাড়ি থেকে বের হতেই হবে।অপেক্ষা করতে করতে একপর্যায়ে ভোরের আলো ফুটলো।মৌ কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে দরজা দিয়ে আস্তে আস্তে বের হলো।এখনো কেউ ওঠে নি।পা টিপে টিপে মেইন দরজার কাছাকাছি যেতেই ডানপাশ থেকে রাশেদের ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ হলো।মৌ দ্রুত সামনে থাকা টেবিলের নিচে লুকিয়ে গেলো।নিচ থেকেই দেখা যাচ্ছে রাশেদ আর ওর বন্ধুরা বের হয়েছে।রাশেদ ওর বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।ওরা সারারাত জুয়া খেলেছে আর মদ গিলেছে।প্রতিদিনই এমন করে।বাড়ির কেউ কিছু বলে না অবশ্য বলবেই বা কি!তারা তো নিজেরাই এমন।মদ গিলে বউ পেটানো এদের ধর্ম।তাহলে এদের ঘরের ছেলেরা আর কেমন হবে!যা দেখবে তাই তো শিখবে।
মৌ টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে দরজা সামনে এসে ধীরে ধীরে দরজা খুললো যেনো শব্দ না হয়।ঘর থেকে বেরিয়ে ওড়না দিয়ে ভালো করে মুখ ঢেকে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে আরম্ভ করলো।ভয়ে বারবার বুক কাঁপছে যদি একবার ধরা পড়ে যায় তাহলে আজকে বোধহয় জান যাবে।বাড়ির গেইটের সামনে আসতেই দো’তলা থেকে কে জানি চিল্লিয়ে বলল,’এই কে রে?’
মৌ না তাকিয়েও বুঝতে পারলো এটা রাশেদ।কারণ ওর ঘরের বারান্দা থেকে নিচটা পুরো দেখা যায়।
মৌ ভয়ে ওপরের দিকে তাকালো না।দ্রুত পায়ে গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেলো।পেছন থেকে রাশেদ কিছু বলেছিলো কি না শোনা যায় নি।আধো অন্ধকারে দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকে।গলির মোড়ের কাছে পৌঁছাতে হবে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে শিরিন।দ্রুত হাঁটতে হাঁটতেই পেছন থেকে শুনতে পেলো কেউ ওকে দাড়াতে বলছে।পিছনে তাকিয়ে দেখলো রাশেদ আর আরো কয়েকজন আসছে।মৌ ব্যাগটা শক্ত করে কাঁধে নিয়ে সর্বশক্তি নিয়ে দৌড় দিলো।মনে প্রাণে শুধু একটাই চাওয়া শুধু মুক্তি!
দৌড়াতে দৌড়াতে পেছনে তাকিয়ে দেখলো ওরাও দৌড়াচ্ছে।পিছনে তাকানোর ফলে সামনের একটা ইটের সাথে উষ্ঠা খেয়ে পড়ে গেলো।নখ ভেঙে গেছে।মৌ আবারও উঠে দাড়িয়ে দৌড়ানো শুরু করলো।দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে কিন্তু দৌড়াতে হবে।ওরা অনেকটাই কাছাকাছি।মৌ আর পিছনের দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দৌড়াতে লাগলো।পেছন থেকে রাশেদ অজস্র গালাগাল দিয়ে থামতে বলছে।কিন্তু মৌ থামছে না।মোড়ে এসে শিরিন আপুকে দেখতে পেলো না।হয়তো এখনো আসে নি।এখন কি করবে!ওরাও প্রায় কাছাকাছি।মৌ তাড়াতাড়ি ডানের পাশের রাস্তা ধরলো।একটু এগিয়ে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো।রাশেদসহ ওই লোকগুলোও এই রাস্তায় এলো কিন্তু মৌ কে পেলো না হঠাৎ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে হেলো।রাশেদ একজনকে বাম পাশের রাস্তায় আরেকজনকে ডান পাশের রাস্তায় পাঠালো আর নিজে গলির মোড়েই দাড়িয়ে রইলো।আর এদিকে মৌ থরথর করে কাপছে।মনে হচ্ছে কাঁপতে কাপতে পড়েই যাবে।অনেক্ক্ষণ খোজাখুজির পরও পেলো মা ওরা মৌ কে তাই হাতাশ হয়ে লোকগুলো চলে গেলেও রাশেদ ডানপাশের রাস্তা ধরে আবার খুঁজতে লাগলো।প্রায় বেশ খানিকক্ষণ পর মৌ ধীরে ধীরে বের হলো।এখনো শিরিন আপু আসে নি।মোড়ে তেমন কেউ নেই।শুধু একটা ছেলে ছাড়া।ওই ছেলেটা বাইকের সাথে হেলান দিয়ে ফোন চালাচ্ছে।মৌ ছেলেটার কাছাকাছি এসে দাড়াতেই ছেলেটা চোখ তুলে ওর দিকে চাইলো।তারপর বলল,’আপনি মৌপ্রিয়া না?’

মৌ ভীত গলায় বলল,’জ্বী।’

তারপর ছেলেটা কিছু বলার আগেই একটা লোক এসে মৌ এর হাত ধরে বলল,’কার সাথে পালাচ্ছিলি?এটা তোর নাগর?তোর পালানো আমি বের করছি।আজকে তোকে বিয়ে করবে।’

এটা বলেই রাশেদ মৌ কে টেনে নিয়ে যেতে আরম্ভ করলো।

চলবে…

সে পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

1

#সে
#অন্তিম_পর্ব
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
কয়েক মাস পরের কথা। কলেজ থেকে ফেরার পর হঠাৎ-ই বৃষ্টি নামে। ছাতা মাথায় থাকলেও ব্যাগ আর মাথাই শুধু বৃষ্টির থেকে রেহাই পাচ্ছে। অন্যদিকে আমার সাদা ড্রেস বৃষ্টিতে একদম মাখামাখি। বৃষ্টি হলে তখন রিকশাওয়ালাদের দাম বেড়ে যায়। দ্বিগুণ ভাড়া দিলেও তারা যেতে নারাজ। অন্যদিকে বিকেল গড়িয়ে যাওয়ার পথে। বৃষ্টি থামারও কোনো নামগন্ধ দেখছিলাম না বিধায় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটা শুরু করেছি। আমার পাশাপাশি আরও কয়েকটা ছেলে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছিল। তারা আমায় দেখে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যও করছিল। কয়েক ঘা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সেই উপায় নেই কারণ রাস্তাঘাট প্রায় একদম ফাঁকা। অদূরে দু’একজন দাঁড়িয়ে থাকলেও তারা তাদের মতো ব্যস্ত। হঠাৎ তখন আমার সামনে এসে একজন বাইক থামায়। ছেলেগুলোকে ছেড়ে একটার কলার ধরে দু, চারটা থাপ্পড় দিতেই বাকিরাও লেজ গুটিয়ে পালায়। ওরা চলে যাওয়ার পর যখন সে হেলমেট খুলে তখন আবিষ্কার করি লোকটি শুভ্র। আমার বুকের বাঁ পাশটায় কেমন যেন চিনচিন করে ওঠে। রুদ্রর কথা মনে পড়ে যায় আমার। সেও একদিন ঠিক এভাবেই আমায় বাঁচিয়েছিল। সেফ করেছিল। সেই মানুষটা আজ নেই। ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে শুভ্র বলে,’রিকশা না নিয়ে এমন ভিজে ভিজে কেন যাচ্ছেন?’

‘রিকশা পাইনি।’ ধীরসুরে বললাম আমি।

সে বলল,’বাইকে উঠুন। আমি পৌঁছে দেই।’

আমি রাজি হয়ে গেলাম। রুদ্রর কথা মনে পড়ার পর থেকেই আমার হাত-পা অস্বাভাবিক রকমভাবে কাঁপছে। আমি আসলে বুঝতে পারছি না কেন এমন হচ্ছে। এই অবস্থায় হেঁটে বাড়ি পৌঁছানোও সম্ভব নয়। আমি শুভ্রর পেছনে উঠে বসি। সে বাইক চালাচ্ছে। এতটা সময়ের ব্যবধানে আমি নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছি। মনকে শক্ত করেছি। কিন্তু এখনও হঠাৎ হঠাৎ রুদ্রর প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। ওর কথা মনে পড়লে চাপা কষ্ট অনুভূত হয়। সবসময় কিন্তু এমনটা হয় না। কখনও কখনও মনে পড়লে ‘ধুর’ বলেও এড়িয়ে যেতে পারি আমি। কিন্তু এখনও কেন পুরোপুরিভাবে তাকে ভুলে থাকতে পারি না সেই উত্তরই আমার মিলে না।

বাড়ির সামনে এসে বাইক থেকে নামার পর শুভ্র বলল,’এখন থেকে বৃষ্টি হচ্ছে দেখলে আমায় ফোন করবেন। আমি আপনাকে নিয়ে আসব।’
আমি মৃদু হেসে বললাম,’আপনার কষ্ট করতে হবে না।’
‘যে যেচে কষ্ট পেতে চায় তাকে সেই কষ্ট পাওয়া থেকে কি বঞ্চিত করা ঠিক?’
‘কষ্ট পাওয়াটা সার্থক হতো যদি উদ্দেশ্যও সফল হতো।’
‘তার মানে?’
‘তার মানেটাও পরিষ্কার। আপনি তো আমায় পছন্দ করেন তাই না?’
‘না। স্রেফ পছন্দ নয়। ভালোওবাসি।’ এই কথাটা শুভ্র আমার চোখের দিকে তাকিয়েই বলল।

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম,’এজন্যই বলেছি কষ্ট পাওয়া তখনই সার্থক হয় যখন উদ্দেশ্য সফল হয়। আপনি আমায় ভালোবাসেন। কিন্তু আমি আপনাকে ভালোবাসি না।’
‘কেন? আপনি কি অন্য কাউকে ভালোবাসেন?’
‘হ্যাঁ বললে মিথ্যে বলা হবে, আবার না বললেও মিথ্যা বলা হবে। আমার আল্লাহ্ ভালো বলতে পারবেন।’
‘আমি বুঝিনি।’
‘যখন আমরা সিলেটে থাকতাম তখন একজনের সঙ্গে পরিচয় আমার। নাম রুদ্র। একটা সময়ে ভালোলাগা থেকে ভালোবাসাও তৈরি হয়। আমি তাকে বলিও। কিন্তু ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা নয় বরং অবহেলা পেয়েছি। যতবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলে তার কাছে ফিরে গিয়েছি ততবার সেও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে। তার থেকে দূরে থাকার, তাকে ভুলে থাকার জন্য কত কিছুই না করেছি। সফল হতে পারিনি। যতবার তার খোঁজ-খবর নিয়েছি আমি নিরাশ হয়েছি। তার ঐ রঙিন দুনিয়ায় নবনী বলতে কারো স্থান ছিল না। নেইও। তাকে তো ভুলতে পারিনি। তবে নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। এখন আমি নিয়মিত নামাজ পড়ি। একবারও কিন্তু আমি আল্লাহ্’র কাছে এটা বলি না যে আমি তাকে ভুলে যেতে চাই। বরং প্রতিবার আমি তার কাছে মানসিক শক্তি চাই। আল্লাহ্ আমায় নিরাশ করেনি। মনের জোর, মানসিক শক্তি নিয়েই এখন আমার পথচলা। সেখানে আমি আর পারব না অন্য কোনো সম্পর্কে জড়াতে।’

শুভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এতক্ষণ সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেও আমি তার দিকে তাকানোর সাথে সাথে সে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, সে কান্না অথবা কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করছে। আমার খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি নিরুপায়। আমি খুবই শান্তস্বরে বললাম,’আপনার হয়তো এখন খারাপ লাগছে। হতে পারে কষ্টও হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ভবিষ্যৎ-এ যেই কষ্টগুলো পেতেন সেগুলো এই কষ্টের কাছে কিছুই না। এখনও কিছুই হয়নি। আপনি মুভ অন করতে পারবেন।’

সে মুচকি হেসে বলল,’নবনী আপনি আল্লাহ্’র কাছে মানসিক শক্তি চেয়েছেন নামাজ পড়ে। আল্লাহ্ আপনাকে দিয়েছে। আমিও যদি নামাজ পড়ে আল্লাহ্’র কাছে আপনাকে চাই তাহলে কি উনি আপনাকে আমায় দেবে না?’
‘আমি যে রুদ্রকে চাইনি তাও কিন্তু নয়। প্রথমদিকটায় আমি রুদ্রকেই চেতাম। খুব করে! কিন্তু যতবার দেখতাম সে আমায় ছাড়া ভালো আছে, অন্য মেয়েদের মাঝে আমার কথা স্মরণ করার সময়ই তার নেই তখন থেকেই হয়ে উঠলাম আমি অন্য নবনী। আমার মাথায় একটা কথাই ঘুরতে লাগল, আমি তো ফেলনা নই, সস্তা নই। তাহলে বারবার কেন আমিই ছোটো হব? এটাকে ইগো ভাববেন না। সেল্ফরেসপেক্ট জেগে ওঠে আমার মধ্যে। তখনই থেকেই আমি আল্লাহ্’র কাছে মানসিক শক্তি আর মানসিক শান্তি ছাড়া অন্য কিছু চাইনি।’

‘রুদ্রর কাছে অন্য মেয়েদের প্রায়োরিটি আছে। কিন্তু আপনার কাছে অন্য ছেলেদের প্রায়োরিটি নেই। আপনার জগৎ অন্য রকম। আপনি ভুল মানুষকে মোনাজাতে চেয়েছেন বলেই হয়তো আল্লাহ্ আপনায় রুদ্রকে দেয়নি। হতেই পারে সে আপনার জন্য সঠিক মানুষ নন। এবার দেখি কার মোনাজাতে জোর বেশি। আল্লাহ্ আপনায় আমায় দেয় নাকি না দেয়!’
‘শুধু একজনের চাওয়ার ভিত্তিতেই কিন্তু পূর্ণতা পাওয়া যায় না। যখন দুটি মানুষই মোনাজাতে দুজনকে চায় তখনই কেবল সম্ভব হয়। হতে পারে আপনার মতো আরও অনেকেই নামাজ পড়ে আমায় চায়। হতে পারে অন্য অনেক মেয়েই নামাজ পড়ে আপনাকে চায়, অথচ আপনি চাচ্ছেন আমাকে। সেখানে কী করে পূর্ণতা পাওয়া সম্ভব?’

শুভ্র চুপ করে আছে। আমি বললাম,’শুনুন অনেকেই বলবে এক তরফা ভালোবাসায় শান্তি আছে। এখানে হারানোর ভয় নেই। যারা এ কথা বলে তারা কখনও কাউকে ভালোইবাসতে পারেনি। এক তরফা ভালোবাসায় সবচেয়ে কষ্ট বেশি। এখানে আপনি একজনকে সবটা দিয়ে ভালোবাসেন কিন্তু অপর পাশের মানুষটা আপনার এই ভালোবাসা বুঝতে নারাজ। সে আপনার ভালোবাসা বোঝে না বা বুঝতে চায় না। তখন ঠিক কী পরিমাণ কষ্ট হয় আপনি বুঝতেও পারবেন না। কতশত বার ইচ্ছে করবে একটাবার তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে। কিন্তু সেই ইচ্ছে অধরাই রয়ে যাবে। একদিকে আপনি কষ্টে কষ্টে মরলেও অন্যদিকের মানুষটা হ্যাপি থাকবে। আপনি এটা সহ্য করতে পারবেন না। সহ্য করার মতোও নয়। আমি এই সিচুয়েশনটা পার করে এসেছি। এখনও মাঝে মাঝে একই সিচুয়েশনে পড়তে হয়। কাজেই আমি চাই না একই কষ্ট অন্য কেউ পাক এবং সেটা আমারই জন্য!’

শুভ্র এবারও নিশ্চুপ। আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,’বাড়ি যান। অবশ্যই আল্লাহ্’র কাছে চান। তবে সেটা শান্তি! আমায় নয়। আমি চাই আপনি ভালো থাকুন।’
আমি চলে আসার মুহুর্তে সে পেছন থেকে বলে,’দেখাই যাক শেষটা কী হয়! যদি না পাই ধরে নেব, এরচেয়েও ভালো কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
আমি তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,’কথায় আছে কায়া(মুখ) দেখলে মায়া বাড়ে। রুদ্রর থেকে দূরে থাকার জন্যই কিন্তু আমি অনেকটা ভালো আছি। কারণ তার সঙ্গে এখন আমার দেখা হয় না। আমি চাই, আজ থেকে আপনার সঙ্গেও আমার দেখা না হোক।’
‘কাজটা আমার জন্য কষ্টকর। তবে চেষ্টা করতে তো আপত্তি নেই। আমি চেষ্টা করব।’

আমি বাড়ির ভেতর চলে আসি আর সেও চলে যায়। এরপর থেকেই তার সাথে আমার যোগাযোগ কমতে থাকে। ম্যাসেজ করলেও তেমন একটা রেসপন্স করি না। সে নিজেকেও গুটিয়ে নিচ্ছে। এদিকে আমিও তো ব্যস্ত আমার নিজের জীবন নিয়ে। প্রতিটা ভালোবাসার মানুষই ভালো থাকুক।

শুভ্রর সাথে আমার আর দেখা হয়নি। তবে ফায়াজের মাঝে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সে রিলেশনশিপে থাকার পরও আমার সাথে কথা বলেছে। যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছে। আমি যতটা পেরেছি এড়িয়ে গিয়েছি। তার সপ্তাহ্ দুয়েক পরই আবার তার মাঝে আমূল পরিবর্তন আসে। সে ঘনঘন আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। আমার কাছে এই ব্যাপারটা ভালো লাগেনি। আমি তাকে সরাসরিই বলে দিয়েছিলাম তার এই পাগলামি আমার পছন্দ নয়। এর মাঝে সেও চুপসে গেছে। কমিয়ে দিয়েছে তার পাগলামি।
.
.
প্রাইভেট থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর আদিবের কাছে জানতে পারলাম অজানা একটি কথা। আমার জন্য নাকি বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। বাবা-মা কেউই রাজি নয়। তবুও পাত্রপক্ষরা নাকি একবার দেখে যেতে চায় আমায়। আমি সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে আদিবকে জিজ্ঞেস করলাম,’তোকে এসব কে বলল?’
‘কেউ বলেনি। আব্বু-আম্মু আমার সামনেই বলছিল। তখন শুনেছি। আচ্ছা আপু তোমার কি বিয়ে হয়ে যাবে?’

আদিবের প্রশ্নে আমি হেসে ফেললাম। ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,’এখনই নয়। দেরি আছে।’
‘বিয়ে হলে কি তুমি আমায় ভুলে যাবে?’
‘কখনই না। তোকে সাথে করে নিয়ে যাব।’
‘সত্যি?’
‘৩ সত্যি।’
আমি ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বিয়ে নিয়ে কোনো মাথা-ব্যথা নেই আমার। আর এটাও জানি, বাবা-মা’ও এখন আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছে না। অন্তত আমার অমতে তো কখনই বিয়ে দেবে না। তাই বাড়তি দুশ্চিন্তা না নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ফ্যানের ভনভন শব্দ করে ঘোরা দেখছিলাম। আমার মাঝে মাঝে নিজেকে রোবট মনে হয়। একটা লিখিত রুটিনের মাধ্যমে চলছে আমার জীবনের গতিধারা। যতটুকু লেখা আছে ঠিক ততটুকুই কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। এর বেশি নয়। অথচ এমনটা আমার কাম্য ছিল না। আমারও ইচ্ছে করে আগের মতো হাসি-খুশি সময়টা ফিরে পেতে। আমি কি পাব কখনও?

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার দিকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের-ই পাইনি। চোখ মেলে দেখি মা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘুমটা হয়তো এজন্যই ভেঙেছে। মা মিষ্টি করে হেসে জিজ্ঞেস করে,’নামাজ পড়বি না?’
‘হুম।’ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললাম আমি।

চুলের মাঝে বিলি কাটতে কাটতে মা বলল,’রোবটের মতো জীবনযাপনে কোনো শান্তি নেই। হয়তো ব্যস্ততার মাঝে ক্ষণিক সময় কষ্ট ভুলে থাকা যায়; তবে সেটা চিরদিনের জন্য নয়।’

কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। মা আবার বলা শুরু করল,’তোর অনুমতি ছাড়াই তোর ডায়েরী পড়ে ফেলেছি। এজন্য দুঃখিত। একটা কঠিন সত্য কি জানিস নবনী? যার জন্য তুই নিজেকে পাল্টাবি সেই একদিন তোকে ভেঙে চলে যাবে। তাই যদি পাল্টাতেই হয়, তাহলে নিজের জন্য নিজে পাল্টাবি। অন্য কারো জন্য। এবার উঠে নামাজ পড়।’

মা চলে গেল। আমি সেভাবেই কিছু্ক্ষণ শুয়ে রইলাম। মায়ের প্রতিটা কথা বোঝার চেষ্টা করলাম। আসলেই এটা কি কখনও কোনো জীবন হতে পারে? যাকে ভুলে থাকার জন্য আমার এত ব্যস্ততা দিনশেষে তো তাকে একবার হলেও মনে পড়ে। কিছুটা হলেও খারাপ লাগে। তাহলে পুরোটা সময় ব্যস্ততায় রোবটের মতো কাটিয়ে লাভ কী? মনে যখন পড়বেই পড়ুক। বাকিটা সময় নিজেকে হাসি-খুশি এবং ভালো তো রাখতেই পারি আমি। শোয়া থেকে উঠে বসে দীর্ঘশ্বাস নিলাম। এরপর টেবিল থেকে ডায়েরীটা তুলে নিয়ে কিছু্ক্ষণ আনমনে হাত বুলিয়ে রান্নাঘরে চলে যাই। যেই যেই পাতায় রুদ্রকে নিয়ে লেখা ছিল সেইগুলো পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছিলাম। যেই মানুষটা সবার জন্য উন্মুক্ত সেই মানুষটা কখনও আমার ব্যক্তিগত সে হতে পারে না।

এরপর ডায়েরীটা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে অজু করার জন্য ওয়াশরুমে চলে যাই। নামাজ পড়ে ড্রয়িংরুমে আসার পর আদিব জানালো ফায়াজ এসেছিল বাসায়। বাইরে দেখা করতে বলেছে। আমি গেলাম। সে দরজার বাইরে পায়চারি করছিল। আমায় দেখে অস্থির হয়ে বলল,’তুমি কেমন আছো নবনী?’

আমি শান্তভঙ্গিতেই বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌ ভালো। আপনি?’
‘আমি ভালো নেই। তোমাকে ছাড়া আমি কোনোভাবেই ভালো থাকতে পারছি না।’
আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে নিচুস্বরে বলল,’কতদিন দেখা হয়নি আমাদের! এতটা কাছাকাছি থাকার পরও। তুমি কি আমায় একটুও মিস করোনি?’
‘না।’
‘না?’
কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললাম,’আপনাকে মিস করার মতো কি কোনো কারণ আছে? অথবা আপনি কি আমার এমন কেউ হোন যে মিস করতেই হবে?’
‘তুমি আমার ওপর রাগ করে আছো তাই না?’
‘মানে? আপনার ওপর আমি কেন রাগ করব?’
‘দেখো নবনী তিয়াশার সাথে আমি রিলেশনশিপে গিয়েছি তোমার ওপর রাগ করে। তোমায় কতবার করে বলেছি আমি ভালোবাসি তোমাকে। কিন্তু তুমি…তুমি বারবার আমায় নিরাশ করেছ। আমায় ফিরিয়ে দিয়েছ। তাই জেদ করে আমি রিলেশনে জড়াই তোমায় দেখানোর জন্য যে, আমার জন্যও অনেকেই পাগল। আমায়ও অনেকে ভালোবাসে। তবুও আমি শুধু তোমার পেছনেই ঘুরেছি।’

আমি হেসে ফেললাম ফায়াজের কথা শুনে। মুচকি হাসতে হাসতেই বললাম,’সরি আপনার কথা শুনে না হেসে পারলাম না। আচ্ছা আপনাকে তো আমি রুদ্রর কথা বলেছিলাম তাই না?’
‘হু।’
‘এটাও নিশ্চয়ই বলেছিলাম সে আমায় প্রতিবার কীভাবে অবহেলা করতো? অপ্রয়োজনে মিথ্যা বলতো। বলেছিলাম না?’
‘হু।’
‘আমি এই পর্যন্ত কতগুলো প্রপোজাল পেয়েছিলাম। এখনও পাই। আপনি তো সবই জানেন। জানেন না?’
‘হু।’
‘এরপরও কিন্তু আমার একবারও মনে হয়নি আমি কোনো রিলেশনশিপে যাই। রাগ,জেদ আমারও হতো। তবে এরকম নয় যে,রুদ্রকে দেখাই সে ছাড়াও আরও অনেক ছেলেই আমার দিওয়ানা।আরও অনেকেই আমায় চায়। ইভেন আমার ভাবনায়ও কখনও এসব আসেনি। রাগ, জেদ হতো এটা ভেবে আমার নিজেকে ভালো রাখতে হবে। তবে সেটা রিলেশনশিপে গিয়ে নয়। এখন আপনার আর আমার মধ্যকার পার্থক্যটা বুঝতে পেরেছেন?’

ফায়াজ অসহায়ের মতো বলল,’বুঝতে পেরেছি। আমি সরি সব কিছুর জন্য।আমি তিয়াশার সাথে ভালো ছিলাম না। বারবার শুধু তোমার কথা মনে পড়ত। তাই ব্রেকাপ করে ফেলেছিলাম। ব্রেকাপের পরও আমি ভালো নেই নবনী। আমার তোমাকে চাই।’
‘ওয়েট ওয়েট! রিলেশন থাকাকালীন আপনি ভালো ছিলেন না। ব্রেকাপ করার পরও আপনি ভালো নেই। ঠিক এজন্যই আপনি আমার কাছে ফিরে এসেছেন তাই না? হাহ্! তার মানে তো এটাই দাঁড়ায় আপনি যদি তিয়াশার সাথে ভালো থাকতেন অথবা ব্রেকাপের পরও ভালো থাকতেন তাহলে কখনই ফিরে আসতেন না। অর্থাৎ আমাকে আপনার প্রয়োজন ভালো থাকার জন্য। সরি টু সে, আমি কারো প্রয়োজনের প্রিয়জন হতে রাজি নই। আপনাকে আগেও আমি চাইনি আর এখন তো প্রশ্নই আসে না। মাফ করবেন।’

ফায়াজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি বাড়ির ভেতর চলে আসি। মায়ের বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে নিজেকে অন্য নবনী মনে হচ্ছে। অন্য রকম শান্তি আমার মধ্যে এখন বিরাজমান। এই নবনী কারও প্রয়োজন হবে না। এই নবনী কারও প্রয়োজনের প্রিয়জন হতেও রাজি নই। এই নবনীর কারো দয়ার প্রয়োজন নেই। সে নিজেই নিজের রাজ্যে মূল্যবান ব্যক্তি।
.
আমার সাথে বারবার ফায়াজের যোগাযোগ এবং কথা বলার চেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো তখন ফায়াজ নিজেও কিছুটা দমে গিয়েছে। একটা বড়ো পরীক্ষা রয়েছে আমার সামনে। আমি নিজেও বেশ উত্তেজিত এটা জানার জন্য যে আমি কতটা পেরেছি নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে। তবে হ্যাঁ, আগের মতো রোবটের ন্যায় জীবন আমি কাটাচ্ছি না। আগে যেমন কলেজে গিয়ে এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকতাম, কারো সাথে কথা বলতাম না এখন আর তেমনটা নেই আমি। এখন আমার একঝাক ফ্রেন্ডস রয়েছে। আমরা একসাথে কলেজে যাওয়া-আসা করি, একসাথে টিফিন খাই, আড্ডা দেই। মন চাইলেই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বাইরে ঘুরতে যেতে পারি। এখন আমার জীবনের আরও একটা মানে রয়েছে। জীবন মানেই শুধু কষ্ট নয়। জীবন মানে আনন্দও। সুখ এবং শান্তি। আপনি কীভাবে আপনার জীবনকে ভালো রাখবেন সেটা নির্ভর করে আপনার ওপর। নিজের ইচ্ছেশক্তির ওপর। যেটা আমি করতে পেরেছি।

আমার সামনের পরীক্ষাটা কি জানেন? রুদ্রর মুখোমুখি হওয়া। আমরা আজ সিলেট যাচ্ছি। রোজের বিয়ের দাওয়াতে।আমি যদি আগের নবনী থাকতাম তাহলে হয়তো কখনই রোজের বিয়েতে যেতাম না। তবে আগের আমি আর এখনকার আমির মধ্যে বিস্তর তফাৎ। ঠিক কতটুকু তফাৎ সেটাও একটু ঝালাই করে নিতে চাই আমি। আজ রোজের গায়ে হলুদ। আমরা আজই যাচ্ছি সিলেটে। আমাদের যেতে যেতে সম্ভবত গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাবে। বাবা কাজের জন্য যেতে পারেনি। মা, আমি আর আদিব যাচ্ছি। বাবা স্টেশনে এসে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে গেছে। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে হন্তদন্ত হয়ে একজন এসে আমার পাশে বসে। মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে সে হাঁপাচ্ছে। সে কিন্তু অন্য কেউ নয়। শুভ্র! মা আর আদিব দুজনই শুভ্রকে চিনতে পারে। ওদের মধ্যে কথাও হয়। আদিব বোধ হয় বেশি খুশি হয়েছে শুভ্রকে দেখে। মা যেহেতু জানে না আমাদের পরিচয় রয়েছে তাই শুভ্র আগ বাড়িয়ে আমার সাথে কোনো কথা বলল না।

সেদিনের মতো আজও মা ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুভ্র ওর ফোনটা আদিবকে গেম খেলতে দিয়ে বিস্ময় নিয়ে বলে,’মীরাক্কেল কীভাবে হয় দেখেছেন? আমি তো ভাবতেই পারিনি আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে। সবই আল্লাহ্’র ইচ্ছে বুঝলেন। তবে যাই বলেন, আমি কিন্তু ব্যাপক খুশি।’

আমি চুপচাপ তার কথা শুনে যাচ্ছি। আমার দৃষ্টি বাইরের দিকে। সে বলল,’কিন্তু…আপনি এমন নিশ্চল কেন? অবাক হননি একটুও? নাকি আমার উপস্থিতি আপনার মাঝে বিরক্তের সৃষ্টি করছে?’
আমি এবার তার দিকে তাকালাম। কিছু না বলে ফোন বের করে আমার আর তিথির ম্যাসেজ বক্স বের করে তার সামনে ধরলাম। সে ঢোক গিলে জিভ কাটল। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম,’শুধু শুধু নাটক করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি জেনেশুনেই এসেছেন।’
‘ধুর! তিথি সব বলে দিল।’
‘আপনি প্লিজ চুপচাপ বসে থাকেন।’
‘আচ্ছা চুপ থাকলাম।’

এরপর সত্যি সত্যি আর কোনো কথা বলেনি শুভ্র। শেষ কথা বলল ট্রেন থেকে নামার পর। প্রায় ফিসফিস করে কানের কাছে বলে গেল,’বিয়ে বাড়িতে দেখা হচ্ছে।’
আমি অবাক হলাম। রোজের বিয়েতে সে আসবে কেন? সে কি রোজেরও পরিচিত?
তাকে নিয়ে মাথা ঘামালাম না। অনেকটা সময় বাদে পরিচিত জায়গায় এসে পুরনো দিনের গন্ধ পাচ্ছিলাম যেন। আমাদের সিলেট পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেছে। গেটের কাছ থেকে এসে রোজের বাবা আমাদের রিসিভ করেছে। এক পা এক পা করে বাড়ির দিকে এগোচ্ছি আর আমার হৃদপিণ্ড যেন একটু একটু করে লাফাচ্ছিল। রোজের বাসায় প্রচুর মেহমান। তবুও আমাদের রেস্ট করার জন্য আলাদা একটা রুম ছেড়ে দেওয়া হলো। অনেকদিন বাদে রোজকে দেখে কান্না পেয়ে গেছে আমার। রোজ নিজেও কেঁদে ফেলে। সেই রাতে অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে বসে গল্প করেছি ওর সাথে। কাল বিয়ে। আজ সারা রাত জাগলে সকালে আবার উঠতে পারবে না তাই দুজনই ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে ঘুম ভাঙে রোজের মায়ের ধাক্কাধাক্কিতে। একবার আমায় ধাক্কাচ্ছে আরেকবার রোজকে। দুজনই রাতে সবার পরে ঘুমিয়েছি বলে এখন ঘুম কাটাতে কষ্ট হচ্ছে। সকালে নাস্তা খাওয়ার পর পার্লারে যাওয়ার জন্য রেডি হতে বলল। আমি ব্যাগ থেকে গাউন বের করছিলাম তখন মা একটা লাল জর্জেট শাড়ি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,’এটা পর।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’শাড়ি পরব? কিন্তু আমি তো গাউন নিয়ে এসেছি মা।’
‘আমি চাই তুই আজ শাড়ি পরবি।’
আমি হেসে ফেললাম। বললাম,’আচ্ছা যাও শাড়ি-ই পরব।’

যারা যারা পার্লারে যাব সবাই মিলে নিচে নামছিলাম। নিচে এসে আমি থমকে যাই। রুদ্র গাড়ি থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোজ বলে,’কী হলো? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন? চল।’
আমি মৃদুস্বরে বললাম,’উনিও কি যাবেন?’

আমার ইাশারা করা জায়গায় তাকিয়ে রোজ বলল,’রুদ্র ভাইয়ার কথা বলছিস? হ্যাঁ, সে-ই তো পার্লারে নিয়ে যাবে।’
সবাই গিয়ে গাড়িতে বসেছে। আমি আর রোজ-ই রয়েছি। রোজ তাড়া দিয়ে নিজেও এগিয়ে গেল। রুদ্ররও ফোনে কথা বলা শেষ। রোজের দিকে তাকানোর পর তার দৃষ্টি এসে আঁটকে যায় আমার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে যেন তার চোখেমুখেও বিস্ময় ভর করে। যেটা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি একটু একটু করে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,’নবনী! তুমি! তুমি কখন এসেছ? কেমন আছো?’
আমি ছোটো করে বললাম,’আলহামদুলিল্লাহ্‌।’

পাল্টা তাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করিনি সে কেমন আছে। সে নিজেই বলল,’আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না তো!’
‘আপনি সবসময় ভালো থাকেন আমি জানি। আপনার সব খোঁজ-খবর পাই তো।’
মুচকি হাসলো রুদ্র। আমি গিয়ে গাড়িতে বসলাম। রুদ্র আর ড্রাইভার বসলো সামনে। মেয়েরা রুদ্রর সাথে দুষ্টুমি করে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। রুদ্র নিজেও ওদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে। কেবল মাত্র আমিই ফোন ঘাটাঘাটি করছিলাম। তাদের সঙ্গ দেওয়া বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ করলাম না। তবে রুদ্র বেশ কয়েকবার আমায় খোঁচা মেরে কথা বলেছে। যার নমুনা এমন,’নবনী দেখি ঢাকায় গিয়ে আরও বড়োলোক হয়ে গেছ। কথাই বলো না এখন। আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছ। বয়ফ্রেন্ড বুঝি কথা বলতে বারণ করেছে?’

আমি তার প্রতিটা কথা উপেক্ষা করে তিথিকে কল দিয়ে ওর সাথে কথা বলেছি। ওরাও পার্লারে আসছে। রুদ্রর কিছুটা হলেও বোঝার কথা আমি তার সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্ট নই। পার্লারের সামনে গাড়ি থামতেই আমি সবার আগে নামি। তিথি আর লিমা আমাদের আগেই চলে এসেছে। তিনজন তিনজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না আটকাতে পারিনি।

এক এক করে সবাই আগে সাজছিল। আমি তিথি আর লিমা বসে বসে গল্প করছিলাম। চার-পাঁচজনের একত্রে সাজা শেষ হলে ওরা আগেই কমিউনিটি সেন্টারে চলে যায়। এরকম করে বেশির ভাগই চলে গেছে। এখন আছি শুধু আমি রোজ, তিথি, লিমা আর রোজের দুইটা বান্ধবী ও দুজন কাজিন। আমরা সবাই একসাথে বের হয়েছি। তার আগে বলে রাখি, সাজার পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে দেখে আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমি এর আগে কখনও চুল খোঁপা করিনি। আজ চুলের খোঁপায় গুঁজে দেওয়া হয়েছে তিনটে লাল টকটকে রক্ত গোলাপ। কানের দুলের এবং গলার মালার সাদা পাথরগুলো হীরের মতো চকচক করছে। লাইটের আলো পাথরের ওপর পড়ায় সেগুলো আমার মুখে, গলায় কিরণ ছড়াচ্ছিল। আমার ভেতরকার সে(আমি) যেন আমার প্রসংশা করছিল।

আমরা আটজন একসাথে কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে পৌঁছাই। কত মানুষজন সেখানে! যারা আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল কিছু সময়ের জন্য হলেও তাকিয়েই ছিল। হতে পারে রোজের জন্য। কারণ বউ সাজে আজ তাকে কতটা সুন্দর লাগছে সেটা আমি বলে প্রকাশ করতে পারব না। আমার দৃষ্টি কিন্তু একজনের দিকে আটকে গিয়েছিল। রুদ্রর পলকহীন চাহনী আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সে আমার দিকে এগিয়ে আসার আগেই মাঝখানে শুভ্র এসে দাঁড়ায়। ব্যস্তভঙ্গিতে বলে,’দাঁড়ান, দাঁড়ান। আগে আপনাকে নয়ন ভরে দেখি।’

এরপর আমার দিকে কিছু্ক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলে,’হায়ে! দিলে চোট লেগে গেছে। ইচ্ছে করছে লাল পরীকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। বুকের মাঝে আটকে রাখি।’

শুভ্র হাত দুটো প্রসারিত করে দাঁড়ায়। আমি তার বুকে কিল দিয়ে রোজের কাছে চলে যাই। রুদ্রকে দেখতে পাই ক্ষুব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সে। শুভ্র বিয়েতে এসেছে তিথির কাজিন সেজে। তাও শুধুমাত্র আমার জন্য। বিয়ে বাড়িতেও মেয়েরা রুদ্রকে জেঁকে ধরেছে। একসাথে ছবি তুলছে। আড্ডা দিচ্ছে। ওদের পছন্দের গান শোনাচ্ছে। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগছে না। বরং স্বাভাবিক-ই লাগছে। কারণ আমি অভ্যস্ত তার সম্পর্কে সব জানার পর।

বরযাত্রী আসার পর সবাই যখন বর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তখন রুদ্র আমায় টেনে একপাশে নিয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,’ইগনোর কেন করো? বয়ফ্রেন্ড শিখিয়ে দিয়েছে?’
‘আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। সরুন আমি যাব।’
‘দাঁড়াও।’ রুদ্র দু হাত দিয়ে বেরি দিয়ে বলল।
চোখ রাঙিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ঐ ছেলে কে? যার সাথে একটু আগে কথা বললে। সেই কি তোমার বয়ফ্রেন্ড?’
‘বললাম না আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই? তাহলে সে কী করে আমার বয়ফ্রেন্ড হবে?’

আমার রাগেও রুদ্র বিচলিত হলো না। বরং ওকে খুশি দেখাল। মৃদু হেসে বলল,’তাহলে কি ঐ ছেলে তোমায় ভালোবাসে?’
‘ভালোবাসতেই পারে। আপনি ভালোবাসতে পারেননি বলে কি আর কোনো ছেলে ভালোবাসতে পারবে না?’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’তোরে আমি মেরেই ফেলব। এখনও তোর রাগ কমেনি একটুও।’
‘কমবেও না। যারা আমার রাগ, জেদ মেনে নিতে পেরেছে তারা এখনও অব্দি আমার জীবনেই আছে। আপনি পারেননি বলেই আমরা আলাদা হয়েছি।’
‘যদি বলি আমিও ভালোবাসতাম?’
‘তাহলে সেটাই হবে আজকের দিনে সবচেয়ে বড়ো মিথ্যা কথা।’

রুদ্র এবার আমার দু’গাল চেপে ধরে বলে,’সুন্দর হওয়ার সাথে সাথে রাগও বেশি বেড়ে গেছে। তুই জানিস আজকে তোকে কতটা সুন্দর লাগছে? ইচ্ছে করতেছে তোর ঠোঁট দুটো খেয়ে ফেলি।’

আমি তার হাতে নখ ডাবিয়ে খামচি দিয়ে হাতটা সরিয়ে দিলাম। রাগী রাগী গলায় বললাম,’নিজের লিমিট ক্রস করবেন না একদম। আপনার আমার ওপর কোনো অধিকার নেই। তাই আমার সাথে কীভাবে কথা বলা উচিত সেটা আগে ভেবে নিবেন।’

আমি চলে আসার মুহূর্তে সে আমার হাত টেনে ধরে। আমি ধমক দিয়ে হাত ছাড়তে বলি। সে ছাড়ে না। এক হাতে আমার হাত ধরে রেখে অন্য হাতে মোবাইল বের করে। গ্যালারি থেকে একটা ছবি বের করে আমায় দেখায়। ছবিটা দেখিয়ে বলে,’মনে পড়ে কিছু?’
‘এটা তো…’
‘হ্যাঁ এটা রেস্টুরেন্টের ছবি। প্রথম যেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়। আমি লুকিয়ে সেদিন তোমার ছবি তুলেছিলাম। যদিও পরে জেনেছিলাম সেদিন তুমিও লুকিয়ে লুকিয়ে আমার অনেকগুলো ছবি তুলেছ।
তুমি সিলেট থেকে ঢাকায় যাওয়ার দিন আমি স্টেশনে গিয়েছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ফোন করেছিলাম তোমায়। কিন্তু ফোনও বন্ধ পাই। সোশ্যাল মিডিয়াতেও তোমার কোনো চিহ্ন ছিল না।
কমবেশি সময় কিন্তু আমি তোমাকে দিতাম। কিন্তু যখন তুমি নিজেই যোগাযোগ রাখতে চাইলে না তখন থেকে আমিও আর যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।’

আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতে বললাম,’একটু যে কিছু মিসিং করলেন। কিছু বলতে বোধ হয় ভুলে গেছেন। আচ্ছা সমস্যা নেই, আমিই বলে দিচ্ছি।
আপনি আসলে আমায় ভালোবাসতেন না। ভালো লাগতো আমায়। একটা মোহ কাজ করতো আমার প্রতি। অন্য সবার থেকে আলাদা একটা টান ছিল আমার প্রতি। কিন্তু যখন এবং যেদিন থেকে আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি আপনার ওপর দুর্বল সেদিন থেকেই একটু একটু করে আপনি আমায় অবহেলা করতে শুরু করেন। যেদিন থেকে বুঝতে পারলেন আপনাকে ছাড়া আমায় চলবেই না সেদিন থেকে পুরোদমে অবহেলা শুরু করলেন। বাকিদের মতো আমায়ও তখন থেকে অপশন বানিয়ে ফেললেন। আপনার ধারণা ছিল যতখুশি অবহেলা করেন না কেন আমি সব সহ্য করে থেকে যাব। আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, আপনি একটা মানুষকে দিনের পর দিন অবহেলা করে যাবেন আর অপর মানুষটিও অবহেলা সহ্য করে রয়ে যাবে? আপনি যদি অল্প একটুও ভালোবাসা দিতেন তবুও আমি থেকে যেতাম। কিন্তু আমি কী করেছেন? বারবার আমায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। আপনি আসলে চাননি একজনের জন্য আরও দশজনকে হারাতে। আমার সঙ্গে আপনার রিলেশন হলে আপনি একটা দায়িত্ববোধে আটকে যেতেন। বাকি মেয়েদের থেকে যেই পরিমাণ প্রায়োরিটি,দাম পান সেগুলো আর পেতেন না। কিন্তু এগুলো তো আর আপনি আমায় এক্সকিউজ হিসেবে দেখাতে পারেননি। আপনি তখন আরেক চাল চাললেন। আপনার ক্যারিয়ারকে আপনি ইস্যু করলেন। অথচ সেই সময়টা আপনি অন্যদের সঙ্গে যেই সময় ব্যয় করেন তার থেকে অল্প একটু সময় পেলেও আমি থেকে যেতাম। আমি চলে যাওয়ার পরও আপনার জীবনে বিন্দুমাত্র কোনোরকম প্রভাব পড়েনি। কেউ না কেউ এসে সেই জায়গা ভরাট করেছে। আর আজ যখন এতগুলো দিন বাদে আমায় দেখলেন, তখন আবারও আপনার মোহ কাজ করা শুরু করেছে। আপনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, স্বার্থের পাগল। আপনার কথা হচ্ছে, বাকি সবাইকে মেনে নিয়ে থাকতে পারলে আপনার কোনো সমস্যা নেই। আপনি মেয়েদের সাথে ইচ্ছামতো ফান করবেন সেগুলো মেনে নিয়ে থাকতে পারলে তবেই আপনার উত্তর হ্যাঁ হবে। কিন্তু কোনো ভালোবাসার মানুষ তো এটা মেনে নিতে পারবে না। আমি ঠিক বললাম তো সব?’

রুদ্র নিশ্চুপ। আমি একটু থেমে দম নিয়ে বললাম,’যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। অনেক কিছু শিখতে পেরেছি আমি। আপনি জীবনে এসেছিলেন বলেই মানুষ চিনতে পেরেছি। নিজেকে পরিবর্তন করতে পেরেছি। মনকে নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষমতা লাভ করেছি। আর সবশেষে সামনে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। পিছু ফিরে আর কখনই তাকাবো না। আপনার মিথ্যে ক্যারিয়ারের ইস্যু, বর্তমান জীবনযাত্রাও একটা মোহের মাঝে আটকে আছে। খুব বেশিদিন এগুলো ভালো লাগবে না। কোনো একদিন একটুখানি সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বুকের ভেতর হাহাকার করবে। সেদিনও হয়তো অনেক মেয়েই আসবে নিসঙ্গতা দূর করতে কিন্তু মন যাকে চায় তাকে পাবেন না। আপনার আগামী দিনের জন্য শুভকামনা রইল।’

রুদ্র আর একটা টু শব্দ পর্যন্তও করেনি। তবে তার নিরবতায় এটা তো স্পষ্ট এতদিন ধরে মনের মাঝে সুপ্ত যেই ধারণাগুলো আমার ছিল সব সত্যি।

আমি সেখান থেকে চলে আসার সময়ে হঠাৎ করে পা ফসকে যায়। আমি খেয়াল করলাম রুদ্র এগিয়ে এসেছে ধরার জন্য। সে আসার আগেই আমি নিজেকে সামলে নিই। তার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হেসে বললাম,’ভয় নেই। পড়ব না। এমন হোঁচট জীবনে অনেকবার আমি খেয়েছি। ক্ষতি হয়নি। কিছু না কিছু তো শিখেছিই।’

ফিরে আসার সময় আচমকা শাড়ির আঁচলে টান লাগে। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা ছেলের ঘড়ির সাথে আঁচল আটকে গেছে। পেছন ঘুরে তাকাতেই ছেলেটি অপরাধীর ন্যায় হাতটা দেখিয়ে মিষ্টি হেসে বলে,’আমি কিন্তু কিছু করিনি। এই দেখুন। তবে হ্যাঁ, পঁচিশটা বসন্ত অপেক্ষায় অপেক্ষায় কেটেছে। ভেবেছি কবে আসবে এই দিন। ফাইনালি কারো আঁচল ঘড়িতে আটকালো!’

আমি কিছু বললাম না। রুদ্র রাগী এবং জেলাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আমি আঁচলটা ছাড়িয়ে নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসি হেসে চলে আসি। পাঠকবৃন্দ নিশ্চয়ই আমার এই হাসির অর্থ বুঝতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার জীবনে স্ব-ভূমিকায় আমিই ‘সে’, যে নিজেকে নতুনরূপে গড়তে পেরেছি।

(সমাপ্ত।)
__________
গল্পটি সম্পর্কে কিছু ম্যাসেজঃ
অনেকের সঙ্গে এই গল্পের মিল রয়েছে। গল্পটির থিম বাস্তবতা থেকেই নেওয়া। প্রথমে ভেবে রেখেছিলাম কাল্পনিক ইন্ডিং দেবো। সেখানে হয়তো রুদ্রর সাথে নবনীর মিল হতো কিন্তু বাস্তব জীবনে যারা নবনীর মতোই অবহেলিত তারা কী করতো? তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা উন্মুখ হয়ে আছে শুধু শেষটা জানার জন্য। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাস্তবভিত্তিক একটা ইন্ডিং রাখব, যেখানে অল্প সংখ্যক মানুষ হলেও কিছু না কিছু শিখতে পারবে।

মানুষের ভালোলাগার শেষ নেই। চলার পথে চলতে চলতে কাউকে না কাউকে ভালো লাগতেই পারে। একটা বিষয় মনে রাখবেন, আপনি যেন কারো বিরক্তের কারণ না হোন। আপনাকে যেন কেউ অবহেলা করার সাহস না করতে পারে। যখন যেই মুহুর্তে আপনি বুঝতে পারবেন আপনি কোথাও, কারো কাছে অবহেলিত হচ্ছেন তখন সেই মুহূর্তেই সেখান থেকে চলে আসবেন। হয়তো প্রথম প্রথম কষ্ট হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, একটা সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে সেল্ফরেসপেক্ট হারিয়েন না।

ইন্ডিং কিন্তু সবটা আমি করিনি। পাঠকের ওপর-ও কিছু ছেড়ে দিয়েছি। গল্পে থাকা কোনো চরিত্রের সঙ্গেই আপনি কল্পনায় নবনীর মিল দিতে পারেন। যেভাবে আপনার মনঃপুত হয় আরকি! আমি শুধু দেখিয়েছি, বোঝাতে চেয়েছি, একটা মেয়ের সেল্ফরেসপেক্ট থাকা কতটা জরুরী। এখানে কিন্তু উল্টোও হতে পারে। যেমন নবনীর জায়গায় রুদ্র এবং রুদ্রর জায়গায় নবনী থাকতে পারতো। তখনও আমি বলতাম সেল্ফরেসপেক্টকে আগে সিলেক্ট করতে। মানুষ হিসেবে প্রত্যেক মানুষের সবকিছুর শীর্ষে থাকা উচিত এই আত্মসম্মানবোধ।
যেহেতু এখানে নবনীর মাধ্যমে সেল্ফরেসপেক্টের গুরুত্ব বুঝিয়েছি সেহেতু আমি বলব, প্রিয় মেয়েরা তোমার রাজ্যে তুমিই ‘সে’ হও যার প্রায়োরিটির সর্বোচ্চ চূড়ায় থাকবে আত্মসম্মানবোধ।
_________
গল্পটি যারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে থেকে পড়েছেন তাদের জন্য অফুরন্ত ভালোবাসা রইল। ভুল-ত্রুটি অবশ্যই থাকবে। সেগুলো নিজ দায়িত্বে বলে যাবেন। সাবধানে থাকবেন। ভালো থাকবেন। নতুন কোনো গল্প, উপন্যাস নিয়ে ফিরব খুব শীঘ্রই। আল্লাহ্ হাফেজ।

সে পর্ব-১৫

0

#সে
#পর্ব_১৫
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
শুভ্রর চোখে-মুখে হাসির বিস্তৃতি পরিলক্ষিত হচ্ছে স্পষ্টভাবে। ভাবটা এমন যেন, আমাদের দেখা যে হতোই সেই ব্যাপারে একদম শিওর সে। তবে আমার জন্য এতটাও স্বাভাবিক নয়। আমার ভ্রু কুঁচকানো দেখে সেও এবার ভ্রু কুঁচকে ফেলল। চিন্তিতভাবে বলল,’আপনি কি আমায় চিনতে পারেননি?’

আমি বললাম,’ট্রেনে আপনায় প্রথম দেখেছিলাম সেই হিসেবে চিনতে পেরেছি। কিন্তু স্টেশনে যে বলে গেলেন, আগেও আমাদের দেখা হয়েছিল সেটা আমি জানি না। আদৌ দেখা হয়েছিল কীনা সেটা যখন জানিনা তখন আপনাকে চেনার প্রশ্নই আসে না।’

সে মুচকি হাসলো। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে সীটের সাথে হেলান দিয়ে বসে বলে,’এটাও অবশ্য অস্বাভাবিক না। তো এখন কি আপনার জানতে ইচ্ছে করছে না কীভাবে চেনার কথা?’
‘আপনার বলার ইচ্ছে থাকলে শুনতে পারি।’
‘নিজ থেকে ইন্টারেস্ট নেই?’ শুভ্রর চোখেমুখে বিস্মিত ভাব। আমি শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললাম,’অতিরিক্ত আগ্রহ মানুষকে নিরাশ করে। জেনেশুনে বারবার একই পরিস্থিতিতে পড়তে চাচ্ছি না।’

এ কথা শুনে তার হাসিমুখে ব্যাঘাত ঘটল। কপালে পড়ল তিন, চারটে ভাঁজ। কিছু্ক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’বাচ্চা হলেও বেশ কঠিন কঠিন কথা বলতে শিখে গেছেন। আপনার খুব একটা আগ্রহ নেই সেটা অবশ্য বুঝতে পারছি।’
‘একেবারে যে নেই তাও নয়। বিষয়টা এমন যে, আপনি বললে আমিও শুনতে চাই। কিন্তু না বললেও আমার কোনো সমস্যা নেই।’
‘বুঝতে পেরেছি। আমি বলতে চাই। না জানলে আপনার কীরকম লাগবে জানিনা। তবে আমার মনটা সারাক্ষণই খুতখুত করবে।’

আমি হেসে ফেললাম। সে বলল,’সিলেটে সেই বিয়ের ঘটনা মনে আছে? আমি বরের বন্ধু ছিলাম।’

আমি চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে বলল,’আপনার সেই দুর্ঘটনার কথা অবশ্যই মনে থাকার কথা। আপনি যখন অস্থির হয়ে বলছিলেন আপনি বিপদে পড়েছেন তখন আমি ও আমার একটা বন্ধু ঐ ছেলের পেছনে দৌঁড়ে যাই। সবাই মিলে মারার পর ফিরে এসে আপনাকে অজ্ঞান অবস্থায় দেখতে পাই।ভয়ে আপনার আতঙ্কিত মুখটাও দেখতে মায়াবী লাগছিল। সেই যে চোখে আপনার মুখটা গেঁথে রয়েছে আর ভুলিনি। তাই তো ট্রেনে দেখেই আপনাকে চিনে ফেলেছিলাম।’

‘আই সী! এই তাহলে কাহিনী। আচ্ছা মা-ও কেন আপনাকে চিনল না?’
‘কী করে চিনবে? তার একমাত্র মেয়ের এমন অবস্থায় আশেপাশের কারো দিকে নজর দেওয়ার সময় আছে? কোনো বাবা-মা’ই পারবে না।’
‘হুম। সেদিনের জন্য ধন্যবাদ।’
‘তার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু একটু সাবধানে থাকবেন।’
‘থাকব।’

আমি আর কিছুই বললাম না। সেও আর কোনো কথা বাড়াল না। বাস থেকে নামার পূর্বে অনুনয়েরস্বরে বলল,’আপনার ফেসবুক আইডিটা পেতে পারি? প্লিজ!’
এমনভাবে বলল যে, মুখের ওপর না বলার উপায় নেই। আইডির নাম বলে আমি বাস থেকে নেমে যাই। সে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে,’রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। এক্সেপ্ট করে নিবেন। আর হ্যাঁ, সাবধানে যাবেন।’
উত্তরে আমি শুধু মাথা নাড়ালাম।

বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে-দেয়ে আবারও বই নিয়ে বসেছি। সত্যি বলতে আমি বইটির মাঝে পুরো ডুবে গিয়েছি। সময় কাটানোর জন্য বইয়ের নেশার চেয়ে ভালো কিছু হয় না। হতেই পারে না। আমি অন্তত এটাই মনে করি। কিন্তু সমস্যা বাঁধল ঘুম নিয়ে। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে খুব। পাঠ্যবই পড়তে গেলে ঘুম পেতো। কিন্তু এখন দেখছি গল্পের বই পড়লেও ঘুম পায়। বই বন্ধ করে কিছু্ক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম।

সময়গুলো কাটছিল আমার এভাবেই। এলোমেলো হয়ে রুটিনমাফিক বলা চলে। এরমাঝে একদিন দেখি রুদ্র একটা পোষ্ট করেছে। ছবি আপলোড করেছে আরকি। রোজও আছে সেখানে। ওকে ট্যাগ করেছিল বলে আমার নিউজফিডে এসেছে। অবাধ্য মন বারবার করে বলছে, ‘কমেন্ট কর। একটা কমেন্ট কর।’
আমিও বাধ্য মেয়ের মতো কমেন্ট করলাম,’ভালোই সময় কাটছে দেখি রোজ।’
প্রায় সাথে সাথে রুদ্র রিপ্লাই করে,’আরে! কে এটা? পিচ্চি ম্যাম?’
আমাকে সে কীভাবে চিনল আমি জানিনা। রিয়েল নামে আইডি তো খুলিনি। তবে প্রোফাইলে আমার নিজের একটা ছবি আছে। যদিও মুখ দেখা যায় না। তার কমেন্ট দেখে আমি আর কিছুই বললাম না। আমার মনে হচ্ছে, সে আগে থেকেই জানে এটা আমার আইডি। অথচ একবারও চেষ্টাও করেনি যোগাযোগ করার। বারবার তার ব্যবহার দেখে আমায় অবাক হতে হচ্ছে। অনলাইন থেকে বেরিয়ে ছাদে যাই আমি।

বাদলা দিন। তাই আকাশ মেঘলা করে বৃষ্টি নামতেও সময় লাগল না। আমি ছাদ থেকে না নেমে বৃষ্টিতে বেশ কিছু্ক্ষণ ভিজেছি। কখনও জ্বর আসেনি এর আগে। এবার এসেছে। রাতে শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে আমার। ফায়াজ আমার প্রচণ্ড কেয়ার করে। কিন্তু এবার যেন তা আরও বেশি বেড়েছে। তিনবেলা খাবার আর ওষুধ নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে করতে আমার মাথা খেয়ে ফেলছিল। একেবারে খারাপও লাগতো না। কেউ কেয়ার করলে ভালোই লাগে। তবে সেটা ভালো লাগা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।

এরপর আসে শুভ্রর কথা। তার কথা তো আর বলাই হয়নি। রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করার পর সবসময় ম্যাসেজ করতো। খোঁজ-খবর নিতো। আমার ফ্রেন্ডসদের সঙ্গেও এড হয়েছে দেখলাম। আমি কথা না বললে ওদের থেকে আমার খবর নেয়। ওরা এটা নিয়ে অনেক হাসি-ঠাট্টাও করে। শুভ্রর কথাবার্তাতেও মনে হয় সে আমায় পছন্দ করে। হতে পারে ভালোওবাসে। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকি। বান্ধবীদের সাথে যখন কথা হয় তখন ওরা ফায়াজ আর শুভ্রর টপিক তুলবেই। মাঝখানে আমি বলির পাঠা হয়ে ওদের হাস্যকর কথাবার্তা শুনি। ওরা এটাও বলে, কারো একজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যেন আমিও ভালো থাকি। আমার উত্তর বরাবরই এমন থাকে,’আমি এমনিতেও ভালো আছি।’

মানুষ দুটো ভীষণ ভালো। কিন্তু ভালোবাসতে পারব এমন কখনই মনে হয়নি আমার। সেদিনের কথা। রেজাল্ট দিয়েছে আমাদের। এরপর কলেজে ভর্তির ব্যাপারে কথা বলার জন্যই তিথি আমায় কল করেছিল। এই টপিকে কথা বলার পর কোত্থেকে থেকে তখন রুদ্রর কথাও চলে আসে মাঝে। তিথি বলে,’দোস্ত রুদ্র ভাইয়ার সাথে আর কথা হয়নি?’
‘না। কথা আর হবে বলে মনেও হয় না। সে তার জীবন নিয়ে দিব্যি ভালো আছে। ঐ জীবনে আমার কোনো ঠাই নেই।’
‘তার সমস্যাটা কী আমি আজও বুঝলাম না। মোট কথা আমি তো তারেই বুঝি না। পুরা রহস্যজনক একটা মানুষ। বারবার কনফিউশনে ফেলে দেয়।’
‘কনফিউশনের কী আছে? আমার কাছে তো সবটাই পরিষ্কার।’
‘মানে? কী পরিষ্কার? তুইও কি সব জানিস?’
‘আমিও সব জানি বলতে? বুঝলাম না।’
‘ভাইয়ার সঙ্গে একদিন কথা হয়েছিল আমার। তোর ব্যাপারে কথা বলার জন্যই নক করেছিলাম। আগেই সরি বলি, তোকে না জানিয়ে কাজটা করেছি বলে। আমি আসলে তার মনোভাব জানতে চেয়েছিলাম। সে কী চায় সেটা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার তো ব্যস্ততাই শেষ হয় না। শুধু একটা কথাই বলেছিল তোদের রিলেশন কখনও সম্ভব নয়। জিজ্ঞেস করলাম কারণ কী? ম্যাসেজ সীন করেই রেখে দিয়েছে।আর রিপ্লাই করেনি।’

আমি চুপ থেকে ওর কথাগুলো শুনলাম। রাগ হচ্ছে খুব। আসলে রাগটা ঠিক কার ওপর হচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,’কাজটা তোর একদম উচিত হয়নি তিথি। এতে আমি কতটা ছোটো হয়ে গেলাম তুই জানিস? সঙ্গে তোকেও ছোটো করেছে। মানুষ এতটা ব্যস্ত থাকে না যে একটা রিপ্লাই সে করতে পারবে না। যার ম্যাসেজ সীন করার সময় হয়, সে কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যয় করে ম্যাসেজের রিপ্লাইও দিতে পারে। তুই আর কখনও তাকে ম্যাসেজ করবি না। আমি বুঝে গেছি এবং জানিও সে কেমন এবং কী চায়!’

তিথি চুপ করে থাকে। আমি নিজেই বললাম,’সম্পর্কে জড়ালে সে অনেকটা আটকে থাকার মতো থাকবে। তখন তার আলাদা দায়িত্ব থাকবে। মেয়েদের সাথে যখন-তখন ঘুরতে যেতে পারবে না। রিপ্লাই করতে পারবে না। বিভিন্ন ধরণের রসিকতা মন্তব্যে করতে পারবে না। তার চারদিকে এখন অসংখ্য মেয়ের ছড়াছড়ি। অনেক মেয়ে তার ওপর ক্রাশিত। সে দেখতে সুন্দর, ভয়েস সুন্দর, ভালো গান করতে পারে। সুন্দর করে কথা বলতে পারে, মানুষ ইম্প্রেস করতে পারে। আর এই ধরণের মানুষেরা শুধু বাইরের চাকচিক্য দেখে। সত্যিকারের মানুষটিকে তাদের চোখে পড়ে না। মোহ অনেক খারাপ জিনিস। সে এখন মোহের ঘোরেই আছে। আমি জানিনা তার এই মোহ কখনও কাটবে নাকি, সে কখনও বুঝতে পারবে নাকি সে আসলে কী হারিয়েছে। তবে এতটুকু জানি, আমি তাকে চাই না। যেই মানুষটা এক আকাশ ভালোবাসা পেয়েও সমুদ্র সমান ভালোবাসা আর রূপকথার চাকচিক্যের মোহে মোহিত হয়, যার জন্য অনেক মেয়ে অপেক্ষারত, যার আমার জন্য এতটুকু সময় নেই সেই মানুষটা আর যাই হোক; আমার যোগ্য নয়। আমি তাকে চাই না।’

তিথি কেমন ভয়ে ভয়ে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল,’দোস্ত তুইও কিন্তু জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে পারিস। শুভ্র ভাইয়া, ফায়াজ ভাইয়া দু’জনই বেশ ভালো মানুষ। এর মধ্যে কাউকে না কাউকে তো সুযোগ দিতেই পারিস। বিশ্বাস করতে পারিস।’
‘এরকম কোনো ফিলিংস আর কারো প্রতি আমার আসে না। আমি তাদের পছন্দ করি। সম্মান করি। ব্যস এতটুকুই। বিশ্বাস শব্দটিতে যখন ঘুনে ধরে তখন আর কোনোভাবেই অখণ্ড জায়গাগুলো জোড়া লাগে না।’
‘কোনো মানুষ ব্যস্ততার মাঝে নিশ্চয়ই তোর এত কেয়ার করবে না। অবশ্যই তার অনুভূতি সত্যি।’
‘এখন কেউ ভালোবাসা দেখালে, কেয়ার করলেও আমার সন্দেহ লাগে। অবিশ্বাস হয়। নিশ্চয়ই পেছনে কোনো স্বার্থ লুকিয়ে আছে অথবা মাইন্ড গেইম খেলতে চাচ্ছে। এরকম ধারণাই রুদ্র আমার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’
‘আমি বুঝতে পারছি তোর দিকটা। তোর বলা সব কথাই সঠিক। কিন্তু তাই বলে তো সবাই এক নয়। কিছু তো ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।’
‘নিশ্চয়ই। আমিও এটা বিশ্বাস করি। তবে এই ব্যতিক্রমী মানুষগুলোকে পেতে ভাগ্য লাগে। কেউ কেউ আবার পেয়েও হারায়। অনেক তো উদাহরণ স্বচক্ষে দেখলাম। শেষে গিয়ে দেখা যায় সবাই এক।’

তিথি আর কিছু বলল না। ওপাশ থেকে ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। আমিও আর বেশি কিছু না বলে, ‘রাখছি রে।’ বলে ফোন রেখে দিলাম। মনের ভেতর চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। যত নিজেকে শক্ত করতে যাচ্ছি ততই কোনো না কোনোভাবে অতীতের ছায়া আমায় আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে। অথচ আমার চাই সুখ। একটু শান্তি।
.
.
আমি নিজেকে পুরোপুরিভাবে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম সবার থেকে। কারও সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। বাইরে যেতে ভালো লাগে না। সারাদিন রুমের ভেতরই থাকছি। বই পড়াতেও এখন মনোযোগ আসছে না। ফেসবুকে গেলে আরও বেশি খারাপ লাগে। রুদ্র কত ভালো আছে! অথচ আমি ভালো থাকতে পারছি না। নিজেকে ভীতু মনে হয়। অপারগ মনে হয়। আমি অতিষ্ঠ নিজের প্রতি।

ভেতরে ভেতরে গুমড়ে গুমড়ে মরছিলাম আমি। শুভ্র কিংবা ফায়াজ কারও সাথেই কথা হচ্ছিল না। ফায়াজ কয়েকবার বাসায় এসেছিল অবশ্য। আমি ঘর থেকে ওর গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। কিন্তু বের হইনি। দেখা হয়নি আর কথাও নয়। যেখানে আমি নিজেই ভালো নেই সেখানে অন্যকে ভালো রাখা আমার পক্ষে অসম্ভব প্রায়। উল্টে এখন কথা হলে রাগারাগি হবে। যা নয় তা বলে ফেলব। এজন্যই নিজেকে সময় দিচ্ছিলাম আমি।

একদিন শুক্রবারের কথা।আদিব জেদ ধরেছে ঘুরতে যাবে। বাবার শরীর ভালো নেই। তাই বিশ্রাম দরকার তার। এদিকে বাড়ির কাজ ফেলে মায়েরও সম্ভব নয় ওকে নিয়ে ঘুরে আসা।শুধু বাকি রইলাম আমি-ই। আদিবের সঙ্গে মা-ও জেদ ধরে বলল,’সারাদিন তো ঘরের মধ্যেই থাকিস। আদিবকে নিয়ে একটু ঘুরে আয়।’
আমি বারণ করা সত্ত্বেও মা শুনল না। আমায় বলল,’তুই রেডি হয়ে নে। আমি ফায়াজকেও বলে দিচ্ছি তোদের সাথে যেতে।’

মা চলে যাওয়ার পর আমিও বাধ্য হয়ে রেডি হতে চলে যাই। রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে আসার পর জানতে পারি ফায়াজ বাড়িতে নেই। একা ছাড়তেও মা সাহস পাচ্ছে না। আমি মাকে অভয় দিয়ে বললাম,’সমস্যা নেই মা। আমি যেই জায়গাগুলি চিনি ওখান থেকেই ঘুরে আসব। তুমি এতবেশি চিন্তা কোরো না।’
এরপর আদিব আর আমিই বেরিয়ে পড়ি ঢাকা-শহর ঘোরার জন্য।

ঢাকার রবীন্দ্র সরোবর জায়গাটা আমার বেশ লাগে। হাঁটাহাঁটি করার জন্য ভালো একটা জায়গা। আদিবকে নিয়ে আমি সেখানে যাব বলেই মনস্থির করলাম। মাঝরাস্তায় ওভারব্রিজ থেকে নামার সময় হঠাৎ-ই আদিব চিৎকার করে বলল,’আপু ঐ দেখো ফায়াজ ভাইয়া।’

আদিবের আঙুলি দ্বারা ইশারাকৃত স্থানটিতে আমিও তাকালাম। দেখতে পেলাম একটা ফুচকার স্টলে ফায়াজ বসে আছে। সঙ্গে একটি মেয়েও আছে। দুজনে বেশ হাসি-খুশিভাবে কথা বলছে। কখনও কখনও মেয়েটি উচ্চশব্দে হেসে ফায়াজের হাতে চাপড়ও দিচ্ছে।আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। বুঝতে পারছি না আমার ঠিক কী করা উচিত। আমি ওদের কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। তারপর ফায়াজকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’আপনি এখন কোথায় আছেন?’
‘বন্ধুর বাসায় আছি। কেন?’ ফায়াজের কণ্ঠস্বর গম্ভীর শোনালো। আমি হাসলাম। হেসেই বললাম,’হোয়াটসঅ্যাপ চেক করেন একটু।’

এই বলে আমি কল কেটে দিয়ে ফোনের ডাটা অন করি। এই মাত্র তোলা ছবিগুলো পাঠিয়ে দিয়ে আদিবকে নিয়ে আমি আড়াল হয়ে যাই। সীন করেছে ফায়াজ। ছবিগুলো দেখেই আশেপাশে তাকিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাকে। এর মাঝে আদিব আরেক কাণ্ড বাঁধিয়ে বসে। দৌঁড়ে চলে যায় ফায়াজের কাছে। এবার বাধ্য হয়ে আমায়ও সেখানে যেতে হলো। প্রথমে একটু অপ্রস্তুতবোধ করলেও এরপর ঈর্ষান্বিত পরিলক্ষিত হয় তার মুখমণ্ডলে। ঈর্ষার সহিত সে আমায় বলে,’আরে নবনী যে! বসুন।’

তুমি থেকে আপনি করে বলছে। স্ট্রেঞ্জ! কিন্তু আমি অবাক হইনি একটুও। তবে সে আমায় অবাক করতে চেয়েছে বলেই আমার মনে হচ্ছে। অন্তত তার চোখের ভাষা এমনটাই বলছে। সে আমার সঙ্গে পাশে বসে থাকা মেয়েটির পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েটির নাম তিয়াশা। আমি কিছুই বললাম না। ওরা আমাদের ওদের সাথে খাওয়ার জন্য অফার করল। কিন্তু আমি রাজি হইনি। বেঁকে বসে আদিব। ও ফায়াজের সঙ্গে থাকবে। প্রথম থেকেই আদিব ফায়াজের ভক্ত। অগত্যা না খেলেও আমায় বসতে হলো। ফায়াজ বলল,’জিজ্ঞেস করলেন না সে আমার কী হয়?’
আমি কিছু না বলে সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকালাম। সে হেসে বলল,’স্পেশাল একজন মানুষ। যে ভালো রাখতে জানে।’

আমি একটু উচ্চশব্দেই হাসলাম। আমার কিন্তু একটুও খারাপ লাগছে না। লাগার কথাও নয়। কারণ তার প্রতি আমার তেমন ফিলিংস কখনই তৈরি হয়নি। বরং যখন সে আমায় ডিরেক্ট প্রপোজ করেছিল তখনও তাকে আমি সরাসরি বারণ করে দিয়েছিলাম। আমি তাকে ঝু্লিয়েও রাখিনি। থেকে যেতেও বলিনি। সেখানে সে যদি নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ায় সেখানে আমার তো খারাপ লাগার কথা নয়। বরং আমি খুশি। হাসি পাচ্ছে ফায়াজের বাচ্চামো দেখে। সে আসলে চাচ্ছে আমি জেলাস ফিল করি। কষ্ট পাই। যেখানে তার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসাই ছিল না সেখানে কষ্ট পাব ভাবনাটা আকাশ-কুসুম।
তবে একটা কথা কিন্তু মানতেই হয়, ঘুরেফিরে প্রায় সবাই একদিকেই মোড় নেয়। শুধুমাত্র কোনো একজনকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। হয়তো এটা সম্ভবও নয়।

চলবে….

সে পর্ব-১৪

0

#সে
#পর্ব_১৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
বাবা একটা নতুন সীম কিনে দিয়েছে। নতুন আইডি খুলে পরিচিত সব ফ্রেন্ডসদের ফেসবুকে এড করেছি। এমনকি রোজকেও এড করেছি। আমাদের কথা হয় রেগুলার। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত হাতে অফুরন্ত সময় রয়েছে। কিন্তু সময় যে কাটাবো করার মতো কিছু নেই। নিজেকে পরিবর্তন করতে গেলেই বুঝা যায়,আপাত দৃষ্টিতে আমরা এটাকে যতটা সহজ মনে করি আসলে ততটা সহজ নয়। বড়ো বড়ো লেকচার অন্যকে দেওয়া যায়। যখন নিজে একই সিচুয়েশনে এসে উপস্থিত হয় তখন হারে হারে মানুষ বুঝতে পারে উপদেশ দেওয়া সহজ হলেও সেগুলো কাজে লাগানো অত সহজ নয়।

বাড়ির বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছি। আমার সাথে ফিহা আর আদিবও রয়েছে। বাচ্চাদের সঙ্গে থাকলে, খেললে নাকি মন ভালো হয়। সতেজ থাকে। কথাটি কিন্তু মিথ্যা নয়। যখন ওদের সঙ্গে আমি থাকি তখন অনেকটাই ভালো থাকি। তবে পুরোপুরি নয়! এছাড়া যখন আপনি নিজেও ধরে ফেলবেন যে, আপনি আসলে ভালো থাকার জন্যই বাচ্চাদের সঙ্গ দিচ্ছেন এবং নিচ্ছেন তখনই মন ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বেঁকে বসবে। কারণ এর আগেও বহুবার বলেছি, মন বড্ড বেহায়া। যার ভেতর থাকে, তার ভালো সহ্য হয় না।

আমি এক জায়গায় বসে পড়লাম। ফিহা দৌঁড়াচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। পেছন পেছন আদিব দৌঁড়াচ্ছে। অজান্তে আমি নিজেও হেসে ফেললাম। নিচ থেকে ঘাস তুলে অযথাই আঙুলে পেঁচাচ্ছি আর রুদ্রর কথা ভাবছি। তাকে না দেখে, কথা না বলে কত সময় পার হয়ে গেল! সে এখন কী করছে? আমি যেমন তার কথা ভাবছি,সেও কি ভাবছে? তারও কি আমার কথা মনে পড়ে? বোধ হয় না! সে তো ব্যস্ত মানুষ। অনেক মানুষের আনাগোনা রয়েছে তার চারপাশে। সেখানে আমার শূন্যতা পূরণ করার মানুষেরও অভাব নেই নিশ্চয়ই!

গেটের দিকে চোখ পড়তেই লক্ষ্য করলাম ফায়াজ আসছে। আমরা ঢাকায় এসেছি ছয় দিন হবে। এই ছয় দিনে তার সঙ্গে আমার বিশেষ দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি। বার দুয়েক ঘরের বারান্দা থেকে দেখেছিলাম। সেটাও সেরকম নয়। আজ তাকে বিশেষভাবে আমার নজরে পড়েছে। কারণটা যদিও আহামরি নয়। ফায়াজ একটা কালো রঙের শার্ট পরেছে। নীলের প্রতি বেশিরভাগ মানুষের ঝোঁক থাকলেও ছোটোবেলা থেকেই আমার পছন্দ কালো রং। কালো রং যে শুধু ছেলেরা পরলেই মুগ্ধ হই এমনটা নয়। কালো শাড়ি পরা কোনো মেয়ে দেখলেও আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি।

ফায়াজ বাড়ির দিকে না গিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসলো। তার হাতে একটা ফাইল। মিষ্টি করে হেসে বলল,’বসতে পারি?’
উত্তরে আমিও মৃদু হেসে বললাম,’শিওর।’
ফায়াজকে দেখেই ফিহা ‘মামা, মামা’ বলে দৌঁড়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে। ফায়াজও পরম আদরে ফিহাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। পকেট থেকে চকোলেট বের করে আদিব আর ফিহাকে দিয়ে বলে,’যাও তোমরা খেলো।’

ওরা চকোলেট নিয়ে দূরে গিয়ে আগের মতোই খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি ওদের ব্যস্ত হওয়া দেখছিলাম। পাশ থেকে সে খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে বলে,’ভালো আছেন ম্যাম?’
‘জি আলহামদুলিল্লাহ্‌। আপনি?’ উনার দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।
‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমিও ভালো আছি। বলতে পারেন অনেক ভালো আছি।’
‘তাই নাকি?’
‘জি। কারণটা শুনবেন না?’
‘বললে অবশ্যই শুনব।’
‘আমার চাকরী হয়েছে আজ।’
‘ওয়াও! সত্যিই? এটা তো খুশির খবর।’

ফায়াজের ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়। সে আমার দিকে দুটো ডেইরি মিল্ক চকোলেট এগিয়ে দিয়ে বলে,’আপনার জন্য।’
‘মিষ্টির বদলে চকোলেট কেন?’
‘বেতন পেয়েই মিষ্টি খাওয়াব নিজের টাকায়।’
‘থ্যাঙ্কিউ। আমি কিন্তু মজা করে বলেছি। আর চকোলেট দুটো ফিহাকে দিয়েন। আমি ডেইরি মিল্ক খাই না।’
‘কেন?’
‘পুরোটাই চকোলেট। অতিরিক্ত মিষ্টি লাগে। আমার ক্যাটবেরী পছন্দ।’
‘ও।’
‘মন খারাপ করবেন না প্লিজ!’
‘না, মন খারাপ করিনি। তারপর আপনার দিনকাল কেমন যায়?’
‘যাচ্ছে একটু বোরিং ভাবেই। এখানকার জায়গা তেমন চিনি না। কোনো বন্ধু-বান্ধবীও নেই যে তাদের সাথে ঘুরব কিংবা সময় কাটাবো।’
‘স্বাভাবিক। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখবেন তখন ফ্রেন্ডের অভাব হবে না। তবে আপনি চাইলে, আমি আপনাকে ঢাকার কোথাও ঘোরাতে পারি।’
‘আপনি? চাকরী বাদ দিয়ে?’
‘না, তা কেন হবে? শুক্রবার তো অফ ডে। আজ বুধবার। কালকের পরেরদিনই যেতে পারি।’
‘আচ্ছা আমি আপনাকে পরে জানাবো।’
‘পরে কেন? বিশ্বাস করতে পারছেন না আমাকে?’
‘এমনটা নয়। মাকে আগে বলতে হবে।’
‘ও। আচ্ছা সমস্যা নেই।’

আসল বিষয়টা কিন্তু মা নয়। মাকে বললে অবশ্যই মা রাজি হবে। কারণ ইতিমধ্যে ফায়াজ মায়ের অনেক পছন্দের একটা ছেলে। তাকে বিশ্বাসও করা যায়। শুধু আমার মন-ই টানে না। টানবেই বা কী করে? মন যে রুদ্রর কাছে পড়ে রয়েছে। তাকে হাসিমুখে বললাম,’আমি উঠব এখন। আপনি কি এখন যাবেন নাকি আরও পরে?’
‘আপনি ছিলেন বলেই বসেছি। আপনি না থাকলে তো বসে লাভ নেই। চলুন।’

যাওয়ার সময় আদিব আর ফিহাকেও ডেকে নিলাম। প্রথম প্রথম যতটা মুডি এবং গম্ভীর ফায়াজকে ভেবেছিলাম ততটা কিন্তু সে নয়। একটু চঞ্চল আছে বটে। আমাদের ফ্ল্যাট আগে পড়ে। বিদায় নিয়ে ভেতরে যাওয়ার সময় সে পিছু ডেকে বলে,’ম্যাম অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম।’
আমি পেছনে তাকিয়ে বললাম,’অনুমতি চাওয়ার কী আছে? বলুন।’
‘আপনি আমার জন্য লাকি পার্সন। আমার মন কেন যেন বলে, আপনি জীবনে এসেছেন বলেই চাকরীটা পেয়েছি। মুখে হাসি ফুঁটেছে। জীবনটা এখন আর রঙহীন লাগে না; বরং রঙিন মনে হয়।’

সে ফিহাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে আমি ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি কী করে তার জীবনে আসলাম? তাও কীনা লাকি পার্সন! আদিব তাড়া দিয়ে বলল,’ও আপু চলো।’
চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে আমি ভেতরে চলে যাই।
________________

অনেকদিন বাদে আজ রুদ্রর আইডি সার্চ করেছি। বুকটা কেমন ধকধক করছে। পুরো টাইমলাইন চেক করলাম। সুন্দর সুন্দর কিছু কবিতা রয়েছে। বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ছবি। নিজে গান গেয়ে আপলোড করেছে। সেখানে অসংখ্য মেয়েদের কমেন্টের সারি। মনে মনে হিংসা হচ্ছে খুব। আবার কষ্টও লাগে। কষ্টের চেয়ে অবাক বেশি লাগে এটা ভেবে, সে তো ভীষণ ভালো আছে। তার বিরহে আমি কেন এত পুড়ছি? তাকে দোষ দেওয়া যায় না। সেই অধিকার-ও আমার নেই। আর না কখনও ছিল! সে ভালো থাকুক, ভালো থাকবে এটাই আমি চাই। ডাটা অফ করে ফোনটা বিছানার ওপর ফেলে দিলাম। কী করব ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যেই পায়চারি করি। তখন মনে পড়ে যায় ডায়েরীর কথা। গত পরশু বাড়ির সামনের দোকান থেকে একটা ডায়েরী করেছি। ডায়েরীর রং নীল। কেমন যেন চিকমিক করে। রোদের মধ্যে আরও বেশি সুন্দর লাগে। এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, কিনে ফেলি। এখনও অব্দি কিছুই লিখিনি। আজ মনে হচ্ছে,কিছু লিখি।

মন খারাপের অসংখ্য গল্প লেখার জন্য সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম ডায়েরীকে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছি, ‘ব্যক্তিগত সে’।
হ্যাঁ, এখানেই আজ থেকে তাকে নিয়ে লিখব আমার অব্যক্ত কথাগুলি। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত ২টা বাজে। প্রথম পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লিখলাম,

‘সে আমার না হওয়া আক্ষেপ,
আমার না হওয়া এক আফসোসের নাম।
সে আমার মাঝরাতে ঘুম ভাঙার কারণ,
সে আমার অপেক্ষার ডাকনাম।

অপেক্ষার প্রহর ফুরাবে একদিন
শুধু ফুরাবে না তাঁর ব্যস্ততা।
মানিয়ে হয়তো নেব একদিন
শুধু রয়ে যাবে শূন্যতা।

আমার জায়গা দখল করে নেবে অন্য কেউ,
শুধু আমার-ই কাটবে না তাঁর শূন্যতা।
আমার কি ভালো থাকা হবে না?
হয়তো হ্যাঁ,আবার হয়তো না!’

হাত কাঁপছে। আর লিখতে পারছি না। ডায়েরী বন্ধ করে ঘরের লাইট অফ করে শুয়ে পড়ি। সত্যিই কি আমার কখনও ভালো থাকা হবে না? অন্য কেউ যদি রুদ্রর শূন্যতা দূর করতে পারে তাহলে আমার শূন্যতাকে কেন কেউ পূর্ণতা দান করতে পারবে না?

একটা কথা বলা হয়নি আপনাদের। চাকরীতে জয়েন করার পর থেকে ফায়াজ যথেষ্ট পরিমাণ সময় দিচ্ছে আমাকে। প্রতিবেলায় ফেসবুকে ম্যাসেজ করে খবর নিচ্ছে আমি খেয়েছি কী-না। ফায়াজ করে পরের চাকরী আর রুদ্রর নিজের বিজনেস। ফায়াজ সময় পায় আর রুদ্র সময় পায় না? সবকিছুর জন্যই রুদ্রর সময় হয়। শুধু আমিই ছিলাম না তার প্রায়োরিটির লিস্টে কোথাও। হয়তো আমারই এক্সপেকটেশন বেশি ছিল।

সেই শুক্রবার ফায়াজের সঙ্গে ঘুরতে যাইনি। ইচ্ছে হয়নি বলতে পারেন। সে টেক্সট করলে রিপ্লাই করার চেষ্টা করি। ভদ্রতার খাতিরেই বলা চলে। একটা জিনিস আমায় খুব ভাবায়, আমার ক্ষেত্রে যেমনটা হচ্ছে মানে আমি তো রুদ্রকে ভালোবাসি তাই অন্য কাউকে আমার পছন্দ হয় না। অন্য কারো সঙ্গ খুব একটা ভালোও লাগে না। হতে পারে রুদ্রও কাউকে ভালোবাসে। এজন্যই হয়তো তার আমার সঙ্গ ভালো লাগে না। সেও ভদ্রতার খাতিরে কথা বলে। এমনটা কি হতে পারে না? এরকম কতশত যুক্তি যে সামনে দাঁড় করাই! কিন্তু কোনোটাই মনঃপুত হয় না। রুদ্রকে আমার বেশ রহস্যজনক বলে মনে হয়। অন্যদিকে মনে হচ্ছে ফায়াজ বেশ পজেসিভ আমার ওপর। এতবেশি টেক কেয়ার করে! শুধু তাই নয় তার পাগলামিগুলোও ইদানীং চোখে পড়ছে। অনলাইনে না পেলেই ফোন করবে। যতক্ষণ না রিসিভ করব ফোন দিতেই থাকবে। যেদিন অনেক বেশি অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে সেদিন দিনে কথা হয় না। রাত ১১টা কি ১২টার দিকে কল দিয়ে অনুরোধ করে বলবে,’পাঁচ মিনিট কথা বলো প্লিজ!’ আমি ঘুমের অভিনয় করলেও সে হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ করে।

প্রথম মাসে বেতন পেয়ে কী করেছিল শুনুন। মিষ্টি তো এনেই ছিল কিন্তু আমার জন্য যেটা করেছিল তা ছিল ভাবনারও বাহিরে। সে’বার ফাতিমা আপু আবার এসেছিল। আমায় ফোন দিয়ে বলল,’একটু বাসায় আসো তো। খুব দরকার।’
সময়টা তখন বিকেল। আমি ঘরেই ছিলাম। এরকম জরুরী তলব আপু কখনও করেনি। দরকার হলে সে নিজেই বাড়িতে আসে। ভাবলাম কোনো সমস্যা হয়েছে কী-না আবার! একবার ভেবেছিলাম মাকেও নিয়ে যাই। ঘুমিয়েছিল বলে আর ডাকিনি। ভাগ্যিস মা ঘুমিয়ে ছিল! নয়তো কী যে ভাবতো! বাড়ি থেকে বের হয়ে মেইন দরজার সামনে একটা বেলীফুলের মালা, একটা কিটক্যাট আর একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। চিরকুটে লেখা ছিল,’নবনী তোমার জন্য সব।’

চকোলেট আর ফুল নিয়ে আরেকটু এগোতেই দেখি আরেকটা কিটক্যাট। এভাবে একটার পর একটা পেতেই থাকি। কী একটা অবস্থা! কিটক্যাটের লাইন শেষ হয় ফায়াজের ঘরে গিয়ে। সেখানে দেখি খাটের ওপর অনেকগুলো কিটক্যাট আর একটা টেডিবিয়ার। আমি স্তব্ধ! পেছন থেকে তখন ফায়াজ বলে,’পছন্দ হয়েছে?’

আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’এসব কী? এত চকোলেট দিয়ে আমি কী করব?’
‘খাবে। তুমিই তো বলেছিলে তুমি কিটক্যাট পছন্দ করো।’
‘এজন্য এতগুলো?’
‘তোমার হাতে ১০টা। আর বিছানার ওপর ১০০টা। মাত্র ১১০টা কিটক্যাট। এত হলো কীভাবে?’
আমি তখন কিছুই বলতে পারিনি। তবে এটা বুঝে গিয়েছিলাম, তার মনে আমার জন্য অন্যরকম অনুভূতি রয়েছে। হয়তো সেই অনুভূতির নাম ভালোবাসা! যা হোক, রাত অনেক হয়েছে। এখন আমার ঘুমানো দরকার।
.
.
পরেরদিন সকালে রেডি হয়ে বের হয়েছি। উদ্দেশ্য নীলক্ষেত যাব। সময় কাটানোর জন্য বই পড়া উপকারী। এটা আমার কথা নয়। তিথির কথা। তিথিও নাকি ইদানীং অনেক উপন্যাসের বই পড়ে সময় কাটাচ্ছে। একাডেমিক বইয়ের প্রতি ইন্টারেস্ট না থাকলেও, গল্প-উপন্যাসের বই অনেক ইন্টারেস্টিং হয়। এখন মোটামুটি ঢাকার রাস্তাঘাট চিনি। বন্ধের দিন বাবার সাথে ঘুরে ঘুরে চিনেছি। আমি রিকশা নিয়ে নিলাম। ঢাকা শহরে আর কিছু থাকুক না থাকুক জ্যামের শেষ নেই। ভুল বললাম, ঢাকায় তো সবই আছে। তবে জ্যামের জন্যই বের হতে মন চায় না। যারা ঢাকা-শহরে চাকরী করে তাদেরকে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বের হতে হয়। যদিও আমার কোনো তাড়া নেই তবুও জ্যাম আমার একদম পছন্দ না। গা গুলায়।

এখন জ্যাম কিছুটা কম থাকায় দ্রুতই পৌঁছে গিয়েছি। শুক্রবার বোঝা যায় জ্যাম কাকে বলে! নীলক্ষেত গিয়ে বই ঘাটছি। রুদ্রর প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ। ভাবলাম উনার বই-ই নিই। হুমায়ুন আহমেদের অসংখ্য বইয়ের মধ্যে বই সিলেক্ট করা কষ্টকর। তিথিকে কল করে ওর পড়া কিছু বইয়ের নাম জেনে নিলাম। খুঁজে খুঁজে বের করে ঐগুলাই কিনলাম। ফিরে আসার সময়ে একটা ফুটপাতে চোখ আটকে যায়। বেশ অনেকগুলো বই নিয়ে একজন বুড়ো দাদার বয়সী লোক বসে রয়েছে। আমার দৃষ্টি আটকিয়েছে হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘অপেক্ষা’ বইটির দিকে। বইটির বিষয়বস্তু কী আমি জানি না। তবে নামটা আমায় খুব টেনেছে। অপেক্ষা! এই বইটিও আমি নিয়ে নিলাম।

ফিরে আসার সময় রিকশা নিয়ে বিপত্তি বাঁধল। যেগুলো পাচ্ছিলাম ভাড়া বেশি চাচ্ছিল। এদিকে বই কিনে আমার হাতের অবস্থাও ফাঁকা। তাই বাধ্য হয়ে বাসেই উঠলাম। বই পড়তে পড়তে যাব, মন্দ হবে না। বাসে উঠে মাঝের সারিতে জানালার পাশের সিটটায় বসলাম। জানালার কাঁচ খুলে দেওয়ায় এখন কিছুটা বাতাস আসছে। অপেক্ষা বইটিই আগে পড়া শুরু করলাম। বাস চলছে বাসের মতো। আমার পাশে কে এসে বসেছে আমি দেখিনি। আমি ততক্ষণে পড়ায় ব্যস্ত। হেল্পার এসে যখন বলল,’আপা ভাড়া দ্যান।’

তখন বই পড়া থেকে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া দিয়ে তৎক্ষণাৎ বই পড়ায় মনোযোগ বসাই। এদিকে যে বৃষ্টি পড়াও আরম্ভ হয়েছে সেই খেয়ালও আমার নেই। পাশের লোকটি যখন বলল,’জানালা লাগান। বৃষ্টি আসতেছে।’ তখন আবারও আমার মনোযোগ নষ্ট হয়। এবার আমি বেশ বিরক্তও হই। কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করলাম না। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে বাঁধল আরেক বিপত্তি! এত শক্ত যে হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছিল তবুও জানালার কাঁচ লাগাতে পারছিলাম না। তখন পাশের ব্যক্তিটি বলল,’দেখি আমি লাগাচ্ছি।’

জানালা থেকে হাত সরিয়ে নিলাম আমি। উনি উঠে দাঁড়িয়ে জানালা লাগিয়ে দিল। আমার মতো তার এত কসরত করতে হয়নি। সব ঝামেলা শেষ। এবার পড়া যাক। পড়ার মাঝে ডুবে যাচ্ছিলাম প্রায় তখন সে পিঞ্চ মেরে বলল,’এত মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা পড়ছেন। কারো জন্য অপেক্ষা করছেন নাকি? আমার জন্য নয় তো?’
বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে তার দিকে তাকানোর পর সে হেসে ফেলল। সে যে হেসেছে সেটা আমি তার চোখ দেখে বুঝেছি; কারণ তার মুখে মাস্ক। সে এবার মাস্কটি খুলে বলল,’এবারও কি আমায় চেনেনি? আমি শুভ্র।’

চলবে…

সে পর্ব-১৩

0

#সে
#পর্ব_১৩
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)

মেঘলা আকাশের ঘন মেঘ কেটে গিয়ে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামছে এখন। এদিকে কমলাপুর স্টেশনে আমরা পৌঁছেও গেছি। মা আর আদিব ঘুমাচ্ছে। মায়ের এই সময়ে ঘুম আসাটা স্বাভাবিক নয়। রাত জেগে ঘরের সব জিনিসপত্র গুছিয়েছে। কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য আমি নিজেও বাবা-মায়ের অনিচ্ছায় রাত জেগে সাহায্য করেছি। সেই হিসেবে আমারও ঘুম আসার কথা। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না। মনের মধ্যে পাহাড়সম কষ্ট চেপে রাখলে কারোরই দু’চোখের পাতা এক হওয়ার কথা নয়। মাঝে মাঝে একটা জিনিস ভেবে অবাক হই আমি। আপনারা বিষয়টা খেয়াল করেছেন কীনা জানিনা। তবে খেয়াল হলে স্বল্প পরিমাণে আপনাদেরও অবাক হওয়ার কথা। একমাত্র সন্তান হওয়ায় হোক কিংবা তাদের সন্তান হওয়ায় যেটাই হোক না কেন আমি কিন্তু আমার বাবা-মায়ের ভীষণ আদরের মেয়ে। প্রত্যেকটা সন্তানই বাবা-মায়ের কাছে আদরের হয়। কিন্তু আমার মনে হয়, তাদের কাছে আমার আদর এবং ভালোবাসার পরিমাণ অনেক অনেক বেশি। কোনো কিছুর কমতি তারা রাখেন না। সবকিছু পেয়েও আমি এমন একজনের পিছু ঘুরেছি যার মনে আমার জন্য ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নেই। অদ্ভুত!

আদিব যেন কেমন ভুসভুস শব্দ করে ঘুমাচ্ছে। নাক ডাকছে না। শব্দটা কেমন যেন মুখ দিয়েই করছে বলে মনে হচ্ছে। এই ছেলেটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। একটু সময় আর সুযোগ পেলেই হলো; দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে যেভাবে হোক ঘুমাবে। ওর বয়সী থাকতে আমিও এমন ঘুমকাতুরে ছিলাম। তখন আলাদা কোনো চিন্তাই আমার ছিল না। এখন যেই চিন্তার জন্য আমার দিন-রাতের ঘুম, শান্তি সব উধাও হয়ে গেছে সেটাও কোনো কাজের চিন্তা নয়। একদম ফাউ একটা চিন্তা। সুখে থাকতে ভূতে যাদেরকে কিলায় তারাই ভালো সময়ে এই ফাউ চিন্তাকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে আসে। এখন আপনারা হয়তো ভাবছেন এই মেয়ে তো দেখি পল্টিবাজ! কিছু্ক্ষণ আগেও রুদ্রর জন্য হায় হুতাশ করছিল আর এখন কীনা বলছে ফাউ চিন্তা! আপনাদের এরকমটা ভাবাও অস্বাভাবিক নয়। তবে এটা বলে রাখি, অবশ্যই আমি পল্টিবাজ নই। মনের সুখশান্তির জন্য নিজেই নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম এসব আসলে ফাউ চিন্তা। এতে তো আর কারো ক্ষতি হচ্ছে না তাই না?

আরও একজনের কথা আপনাদের বলা হয়নি। আমি আসলে এই মহাশয়ের কথা স্কিপ করে যেতে চেয়েছিলাম। আবার ভাবলাম, এতটা পথ সেও সাথে ছিল তাই একেবারে তার কথা বেমালুম ভুলে যাওয়ার নাটক করাও বৃথা। মা আর আদিব ঘুমালেও শুভ্র নামক ছেলেটিও আমার মতো ঘুমায়নি। আলগা পিরিতও করেনি। কিংবা আগ বাড়িয়ে খেজুরে আলাপও তিনি আমার সাথে করতে আসেননি। যতক্ষণ আদিব জেগে ছিল ততক্ষণ ওর সাথেই গল্প করেছে। দুজনে ফোনে লুডু খেলেছে। আদিব ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সে কানে হেডফোন গুঁজে বসে থেকেছে। তার এই ভদ্র গুণগুলোর জন্যই তার কথাও আপনাদের জানালাম।

ট্রেন কমলাপুর পৌঁছে গেছে। মানুষজনও নামতে শুরু করেছে। শুধু আমিই গালে হাত ঠেকিয়ে বসে রয়েছি। আপনারা তো জানেনই কাদাপানিতে আমার শুচিবায়ু রয়েছে। একবার রুদ্রর প্রসঙ্গে তুলেছিলাম কথাটা। বৃষ্টি থামবে তো দূরের কথা; এখনও কমেওনি। মায়েরও ঘুম ভাঙেনি। ওদের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছেও করছে না।

‘একি গালে হাত দিয়ে বসে আছেন যে? নামবেন না?’
আমার বামদিকে শুভ্র নামক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আমি। প্রশ্নটি উনিই করেছেন। চকিতে তখন মায়েরও ঘুম ভেঙে যায়। হন্তদন্ত হয়ে বলে,’কোথায় কোথায়? কোথায় আছি আমরা? আসিনি এখনও?’

আমি মাকে শান্ত করব কী নিজেই হকচকিয়ে গিয়েছি। যদিও মায়ের এরকম স্বভাবে আমি অভ্যস্ত। দিনে ঘুমালেই মা হুট করে জেগে বলবে,’এখন কয়টা বাজে? আমি কোথায়? রাত হয়ে গেছে?’ আরও অনেক আবোল-তাবোল তো বকেই।

শুভ্র ছেলেটি মুচকি হেসে মাকে শান্ত করে বলল,’শান্ত হোন আন্টি। আমরা মাত্রই পৌঁছেছি। সবাই নামুক। তারপর আস্তেধীরে আমরাও নামব।’
মা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল উনার কথায়। তবুও আমায় মৃদু ধমক দিয়ে বলল,’তুই আমায় ডাকিসনি কেন?’

আমি একবার শুভ্র নামক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলাম। বারবার ‘শুভ্র নামক ছেলেটি’ বলে উনাকে সম্বোধন করছি বলে আপনারা বিরক্ত হচ্ছেন না তো? আসলে অচেনা একজন মানুষকে আপনাদের সামনেও নাম ধরে ডাকতে আমার আনইজি ফিল হচ্ছে।

মা এবার তাড়া দিয়ে বলল,’চল আস্তেধীরে নামি। ঐ ছেলে বোধ হয় এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে।’
‘কোন ছেলের কথা বলছ মা?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘তুই চিনবি না। আমিও চিনি না। কেয়ারটেকারের ছেলে এইটুকুই জানি শুধু। কী যেন একটা নাম বলল তোর বাবা!’
‘থাক নাম মনে করতে হবে না এখন। চলো নামি।’
‘ছাতা এনেছিস?’
‘না। সকালে তো আকাশ একদম পরিষ্কার ছিল।’

‘আপনাদের সমস্যা না হলে আমার ছাতা নিতে পারেন।’ এই প্রস্তাবটিও শুভ্র নামক ঐ ছেলেটিই করল। মা এক গাল হেসে তড়িঘড়ি করে বলল,’না, না বাবা। লাগবে না। তুমি বলেছ আমরা এতেই খুশি।’
‘সমস্যা নেই আন্টি। নিন।’

আদিবের বৃষ্টিভীতি রয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসবে। তাই অগত্যা মা রাজি হয়ে যায়। মা কিন্তু রাগী হলেও আমার সঙ্গে সঙ্গে আদিবকেও ভীষণ ভালোবাসে। ছাতাটি নিয়ে মা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’তুই আদিব ছাতা নিয়ে যা। আমি আসছি।’
আমি ছাতাটি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম,’তুমি আদিবকে নিয়ে যাও। তোমার তো নিজেরও বৃষ্টিভীতি রয়েছে। ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসবে আবার। আমার কিছু হবে না।’

আমার জোড়াজুড়িতে মা আদিবকে নিয়ে আগে ট্রেন থেকে নামল। তারপর নামল শুভ্র নামের ছেলেটি। আমি নামার সময় উনি একটি অবাক করা কাণ্ড করে বসলেন। আমার মাথার ওপর উনার দু’হাত রেখে বৃষ্টির পানি থেকে আমায় আড়াল করার চেষ্টা করলেন। আমার চোখেমুখে বিস্ময়। পেছন থেকে যাত্রীরা নামার জন্য তাড়া দিচ্ছে। তাদের কথা আমি শুনতে পাচ্ছি না। উনি আমায় তাড়া দেওয়ার পর হুঁশ ফিরল। বললেন,’আরে আসুন। পেছনের যাত্রীরাও তো নামবে।’

উনার দিকে তাকিয়েই ট্রেন থেকে নামলাম আমি। দু’পা আগানোর পর কেউ একজন ছাতা ধরল আমার মাথার ওপর। আমি এবং শুভ্র নামক ছেলেটি দুজনই দাঁড়িয়ে পড়লাম। সেই মানুষটির দিকে তাকালামও দুজন। সামনের আগন্তুকটি একজন ছেলে। ঘন আঁখিপল্লব তার। গাম্ভীর্য বজায় রেখে আমার উদ্দেশ্যে বলল,’আসুন।’

আমি কিছু বলতে যাব তার আগেই পেছন থেকে মা বলল,’তাড়াতাড়ি আয় নবনী।’
এবার ছাতা ধরে রাখা ছেলেটি বলল,’চলুন।’
আমি তখনও বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমি আসলে বুঝতে পারছি না এটাই সেই ছেলে নাকি যার কথা একটু আগে মা আমায় বলেছিল। মাকে দেখলাম একটা গাড়িতে গিয়ে বসতে। ছেলেটি শুভ্রর দিকে আরেকটি ছাতা এগিয়ে দিয়ে বলল,’এই ছাতাটি সম্ভবত আপনার।’

শুভ্র নামক ছেলেটিও এতক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিল। এবার বাড়িয়ে রাখা ছাতাটি হাতে নিয়ে সে বলল,’জি আমার।’
আমি আর চুপ থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম,’আপনাকে কি বাবা পাঠিয়েছে?’
‘জি।’ ছেলেটির উত্তর।
‘ও।’
আমি এবার শুভ্রর নামক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে বললাম,’ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আপনাকেও স্বাগতম। তবে আমার ধারণা ছিল আপনি আমায় চিনবেন।’
‘সরি? আপনাকে কি আমার চেনার কথা ছিল?’
‘ছিল হয়তো! চিনেননি যখন তখন থাক। অন্য কোনোদিন দেখা হলে আমি-ই না হয় বলে দেবো।’

আমাকে দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে রেখে সে ছাতা ফুঁটিয়ে চলে যাচ্ছে। এদিকে গাড়ি থেকে ক্রমাগত মা তাড়া দিচ্ছে। আমি তখনও শুভ্র নামের ঐ ছেলেটির যাওয়ার পথে তাকিয়ে রয়েছি। উনাকে আমি কী করে চিনব? সারা পথ পাড়ি দেওয়ার পর তীরে এসে তরী ডোবার মতো ঘটনা ঘটে গেল। সামনের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আমি আরও অবাক হলাম। এই ছেলে কি বোকা নাকি কে জানে! ছাতা শুধু আমার মাথার ওপর ধরে রেখেছে। আর নিজে এতক্ষণ ধরে ভিজছে। আমি ছাতাটি তার দিকেও সামান্য এগিয়ে দিতেই সে সরিয়ে দিয়ে বলল,’আমি বৃষ্টিতে ভিজলে সমস্যা হবে না। আপনি আসুন প্লিজ!’

আমার মনে হচ্ছে, আমি ঢাকা-শহরে নয় বরং বোকার শহরে প্রবেশ করেছি। একজন বোকা বানিয়ে যাচ্ছে আরেকজন বোকা হয়ে সঙ সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার যা ইচ্ছে করুক। এক টেনশন নিয়েই সিলেট থেকে ঢাকায় আসতে হয়েছে। আরও বাড়তি টেনশন নিয়ে এবার বাংলাদেশ ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। ছেলেটি যখন ঠিক করেছে ভিজেই যাবে তাই ছাতাটি আমিই হাতে নিলাম। গাড়িতে গিয়ে বসার পর শুরু হলো মায়ের বকুনি।
‘এতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী গল্প করছিলি? দেখ তো ছেলেটার ভিজে কী অবস্থা হয়েছে!’

ঐ ছেলেটি সামনে বসে ড্রাইভ করছে। আমি মা আর আদিব বসেছি পেছনে। এই গাড়ি কার সেটাও আমার জানা নেই। সম্ভবত বাবার অফিস থেকেই আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছে। আমি একবার ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম,’উনাকে তো কেউ ভিজতে বলেনি মা। উনার শখ হয়েছে তাই বৃষ্টিতে ভিজেছে।’
‘এগুলো আবার কোন ধরণের কথা নবনী? ঢাকায় এসে আদব-কায়দা সব ভুলে বসেছিস নাকি?’
‘জি না। আমি তাকে বলেছিলাম ছাতা শেয়ার করতে। উনি রাজি হননি। আমার সাথে ছাতা শেয়ার করলে কি উনার জাত চলে যেত নাকি জিজ্ঞেস করো তো!’

মা আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে ঐ ছেলেকে মিষ্টিসুরে বলল,’তুমি ওর কথায় কিছু মনে কোরো না।’
এতক্ষণ সে চুপ করেই ছিল। এবার মুখ খুলে বলল,’না আন্টি। আমি কিছু মনে করিনি।’
আমি গাড়ির সিটের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসিয়ে রইলাম। ভাবতেই অবাক লাগছে রুদ্রকে ছেড়ে আমি কতদূরে চলে এসেছি।

‘তোমার নাম কী?’ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল মা। ছেলেটি গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই বলল,’ফায়াজ।’
‘মাশ-আল্লাহ্। কী করছো এখন? মানে পড়াশোনা করো নাকি চাকরী করো?’
‘অনার্স শেষ করেছি আন্টি। চাকরীর জন্য ঘুরছি। এখনও হয়নি। তাই বেকারই বলা চলে।’
‘মাস্টার্স করছো না কেন? বসে যখন আছো মাস্টার্স করে ফেলো।’
‘কী হবে এত পড়ে? টাকা ছাড়া শুধু রেজাল্ট দিয়ে চাকরী হয় না আন্টি।’
‘মন্দ বলোনি!’ বেশ আক্ষেপের স্বরেই কথাটি বলল মা। এরপর সবাই চুপ হয়ে গেছে। ভালো হয়েছে চুপ করেছে। খেজুরে আলাপ শুনতে ভালো লাগছিল না। লং জার্নি করে মাথা ধরে গেছে আমার।

অল্প সময়ের ব্যবধানেই আমরা একটা বাড়িতে পৌঁছালাম। বাড়ি নয়। এটা কোয়ার্টার। তবে জায়গাটা পার্কের মতো। একদম নিরিবিলি জায়গা। বৃষ্টি ততক্ষণে কিছুটা কমে এসেছে। আমরা পৌঁছানোর পর দু’জন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক এগিয়ে আসে। ফায়াজ নামের ছেলেটিকে বলেন,’সাবধানে এনেছিস তো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?’
সে ছোটো করে উত্তর দিল,’না, সমস্যা হয়নি।’
হাভভাবে মনে হচ্ছে ইনারা এই ছেলের বাবা-মা।

আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে না উঠে পাশেই থাকা হাফ বিল্ডিংটায় উঠলাম। এখানে ফায়াজরা থাকে। বারবার শুভ্র নামক ছেলেটি এখন আবার ফায়াজ নামক ছেলেটি বলে ডাকতে বিরক্ত লাগছে। আনইজিকে গোল্লায় পাঠিয়ে নাম ধরেই ডাকা শুরু করলাম। সে না জানলেই হলো। আমাদের যেই রুমটায় বসতে দেওয়া হলো পুরো রুমটা একদম পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো। আমি চুপচাপ একটা সোফা দখল করে বসে রইলাম। এই মুহূর্তে আমার বিশ্রাম নেওয়া দরকার। তার আগে দরকার অল্পকিছু খাবার। কিন্তু মুখ ফুঁটে বলার উপায় নেই।

একটা বাচ্চা মেয়েকে বারবার দেখছি দরজার পর্দা ধরে উঁকি দিচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই লুকিয়ে পড়ছে। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালোই লাগছে। চোর-পুলিশ খেলার মতো। তখন ফায়াজ পেছন থেকে এসে বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে,’চোরের মতো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছ কেন মামনী?’

বাচ্চাটি খিলখিল করে হাসছে। বাবা ফোন দিয়েছিল বলে বাইরে গিয়েছিল মা। ফিরে এসে দরজার কাছে ওদের দেখে জিজ্ঞেস করল,’কে হয় তোমার?’
‘আমার ছোটো বোনের মেয়ে।’ বলল ফায়াজ।
মা বাচ্চাটির গাল টেনে দিয়ে আদুরেস্বরে বলল,’নাম কী তোমার?’
বাচ্চাটি মুখে এক আঙুল পুরে লজ্জার ভঙ্গিতে বলল,’ফিহা।’

প্রথম প্রথম বাচ্চামো ভালো লাগলেও এখন বেশ বিরক্ত লাগছে আমার। পেটে ক্ষুধা থাকলে দুনিয়ার সব সুন্দর জিনিসই বিচ্ছিরি লাগে। তখন পাশের রুম থেকে আরেকটি মেয়ে এসে আমায় বলল,’চলো হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নিবে।’

এতক্ষণে যেন শান্তি পেলাম আমি। বিনাবাক্যে মেয়েটির সঙ্গে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে পড়লাম। আমার পিছু পিছু মা আর আদিবও আসলো। আমরা খেতে বসলেও তারা কেউ খেতে বসেনি। মা অবশ্য বেশ কয়েকবার তাদের জোর করেছিল। খাওয়ার ফাঁকে জেনে নিলাম যেই মেয়েটি খেতে ডেকেছে সে ফিহার আম্মু ফাতিমা। সপ্তাহ্ খানেক হবে বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। খাওয়ার আইটেম অনেক। ভর্তা থেকে শুরু করে গরুর গোশত, মুরগীর গোশত আর মাছ ভাজা। মন আছে বলতে হবে তাদের। খাওয়ার পর শুরু হলো আমার ঝিমানি। প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুমের জন্য টিকতে না পেরে মাকে ফিসফিস করে বললাম,’আমি একটু ঘুমাব মা।’

মা তখন ফায়াজের মায়ের সঙ্গে গল্প করছিল। উনি ফাতিমা আপুকে ডেকে বললেন,’ফায়াজ কি ঘরে? ঘরে থাকলে বল ওরে বের হতে। নবনী একটু ঘুমাবে।’
‘না,না এত ব্যস্ত হতে হবে না। উনি ঘরে থাকলে থাকুক। আমি সোফায় ঘুমাতে পারব।’ বললাম আমি।

ফায়াজের আম্মু আমার বারণ শুনলেন না। ফাতিমা আপু একটুপর এসে আমায় ডেকে নিয়ে গেলেন। ছেলে মানুষের ঘর হিসেবে এই ঘরটাও বেশ গোছালো। আমায় রেখে যাওয়ার আগে আপু বলে গেলেন,’কিছু লাগলে আমায় ডাক দিও। আমি পাশের ঘরেই আছি।’
উত্তরে আমি শুধু মৃদু হাসলাম। এরপর চিৎপটাং হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটু আয়েশ করে কাৎ হয়ে শুতেই মনে পড়ে গেল রুদ্রর কথা। আরামে থাকব আর রুদ্রর কথা মনে পড়বে না তা কি হয়? বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠল। নিমিষেই আরাম-আয়েশ মন খারাপের কাছে পরাজয় গ্রহণ করে নিল। এরপর এপাশ-ওপাশ করতেই কেটে গেল অনেকটা সময়। ঘুম আসার নাম নেই। অথচ একটু আগেই ঘুমের জন্য দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছিল আমার। চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে ছিলাম তখন আদিব এসে বলল,’আপু ঘুমিয়েছ?’

‘না। কিছু বলবি?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘আমিও ঘুমাব।’
‘ট্রেনে না ঘুমালি? আবারও ঘুম পেয়েছে?’
আদিব হাসলো। তারপর ওকে জড়িয়ে ধরেই কিছু্ক্ষণের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
.
.
ঘুমের মাঝেই উচ্চশব্দে কারো হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। কিছু্ক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি। চোখ মেলার পর বুঝতে পারলাম স্বপ্ন নয় বরং সত্যি। হাসির শব্দ আসছে পাশের ঘর থেকে। এই রুম এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। বালিশের নিচে হাতরিয়েও আমার ফোন পেলাম না। পরমুহূর্তে মনে পড়ল ফোন তো আমি ব্যাগ থেকে বের-ই করিনি। অন্ধকার রুমে কোথায় কী আছে কে জানে! বিছানায় বসেই ফাতিমা আপুকে কয়েকবার ডাকলাম। আপু আসেনি। এসেছে ফায়াজ। আর তার কোলে ফিহা। লাইট জ্বালিয়ে বলল,’ফাতিমা আর আম্মু গেছে আপনাদের ফ্ল্যাটে।’
‘এখন কয়টা বাজে?’
সে একবার পেছনে তাকিয়ে বলল,’পৌনে এগারোটা।’
‘রাত হয়ে গেছে?’
‘হুম।’
‘আব্বু আসেনি এখনও?’
‘এসেছে আরও আগেই। আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

প্রথমবার ওয়াশরুমে যাওয়ার কারণে আমি জানি ওয়াশরুমটা কোথায়। তাই চটজলদি গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে আসলাম। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ফায়াজকে জিজ্ঞেস করলাম,’আদিবও গেছে?’
‘জি।’

ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম সবকিছু গোছানো শেষ। এখন শুধু কাপড়, কাঁচের জিনিসপত্র গুছাচ্ছে মা। মাকে সাহায্য করছে আন্টি আর ফাতিমা আপু। আন্টি আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন,’একি! ঘুম ভেঙে গেছে? খেয়েছ? ফায়াজ ওকে খেতে দিসনি?’
আমি বললাম,’পেট ভরা আছে আন্টি। এজন্য আমিই খাইনি।’
‘ঘুম থেকে উঠলে পেট খালি হয় জানো না?’

আমি কিছু বললাম না। মানুষগুলোকে দেখে অবাক হচ্ছি। কত উদার মনের তারা! মাকে জিজ্ঞেস করলাম,’বাবা কোথায়?’
কাজ করতে করতেই মা উত্তর দিল,’পাশের রুমে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন আজ কত খাটনি গেল মানুষটার ওপর।’

একটু চুপ হয়ে আবার বলল,’ভালো কথা। তোর ফোন বন্ধ কেন? তোর বাবাও কয়েকবার ফোন দিয়ে বন্ধ পেয়েছিল। তিথিও কিছু্ক্ষণ আগে ফোন দিয়েছিল। বলল তোর ফোন বন্ধ।’

তিথির কথা উঠতেই একরাশ মন খারাপ এসে ভর করল আমার ওপর। ও ফোন করেছে শুনে খুশির চেয়ে কষ্টই বেশি হচ্ছে। কত্ত দূরে আমরা! মায়ের ফোন নিয়ে আমি বারান্দায় চলে যাই। তিথিকে কল করার পর ওপাশ থেকে যখন ওর কণ্ঠস্বর শুনি তখন আমি কেঁদে ফেলি। অনুভব করি তিথিও কাঁদছে। বেশ অনেকটা সময় নিয়েই দুজনে কথা বলি। কথার শেষপ্রান্তে এসে জিজ্ঞেস করলাম,’রুদ্রর সাথে কি কথা হয়েছে তিথি?’
‘না রে। আমাদের কারো সাথেই তার কথা হয়নি।’
‘ও।’
‘দেখ নবনী, তুই তার জন্য একদম মন খারাপ করবি না। তার জন্য একদম ভাববিও না তুই। যে তোর কথা ভাবে না, তুইও তার কথা ভাববি না।’

চুপ করে আমি তিথির কথাগুলো শুনলাম। আসলেই কিন্তু আমার এরকমটা করা উচিত। সে কিন্তু তিথি আর লিমার সাথে ফেসবুকে এড আছে। চাইলেই অন্তত একটা খবর নিতে পারতো। কিন্তু নেবে না। তার যে বড্ড ইগো! নিরব দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,’মন খারাপ করছি না। আচ্ছা শোন, কাল আব্বুকে দিয়ে একটা নতুন সীম কিনব। এরপর নতুন আইডি খুলে তোদের এড দেবো। রুদ্র যেন কোনোভাবে জানতে না পারে। যদিও সে কখনো জানার চেষ্টাই করবে না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘এখন তাহলে রাখছি। খেয়ে নিস।’
‘তুইও। আর হ্যাঁ, নিজের খেয়াল রাখিস।’

কল কেটে কিছু্ক্ষণ বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। অস্ফুটস্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,’হায়রে মানুষ!’

চলবে…

বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১০ ( অন্তিম পর্ব)
.
.
সকাল ৯ টা। আরিফুল অফিসে বসে অন্যকেসের ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি করছিল। সামনের চেয়ার টেবিল থেকে নীরব এসে বলল,
” স্যার, চা খাবেন?”
” চা দিবে, দাও। শরীরটা এমনিতে মেজমেজ করছিল দেখি চা খেয়ে খানিকটা চাঙা করতে পারি কি-না! ”
নীরব হাবিলদারকে দুটো চা আনতে পাঠিয়ে আরিফুলের সম্মুখ চেয়ারে বসল। এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আচ্ছা স্যার, রাকিবের কীরকম শাস্তি হতে পারে কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?”
কাজের ফাঁকে আরিফুল ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
” তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে নতুন জয়েন করেছ এই লাইনে? কিছুই বুঝো না। পুলিশ লাইনে জয়েন করেছ কমদিন তো হয়নি। এর আগে কি দেখোনি এরকম অপরাধের শাস্তি কী হয় বা কী হতে পারে?”
” আসলে স্যার আমি যতদূর দেখেছি একই অপরাধের শাস্তি একেকবার একেকজনকে একেকরকম দেয়া হয়। কাউকে মৃত্যুদন্ড তো কাউকে আবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। কেউ তো আবার বেলও পেয়ে যায়। তাই আর কি জিজ্ঞেস করলাম এই কেসের ক্ষেত্রে ঠিক কী হতে পারে।”
” বেশিরভাগ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা বেল হয় যাদের উপরে হাত আছে তাদের। কিন্তু সাধারণ জনগণের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। সেই হিসেবে রাকিবের ফাঁসি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ”
” ওহ্!”
” হঠাৎ তোমার মাথায় এ ধরনের কথা এলো যে?কোনো সমস্যা?”
” না স্যার, আসলে সামান্য আগ্রহের বসেই জিজ্ঞেস করা। এর বাইরে তেমন কিছুই না।”
“ও….তো সকালের দিকে ওকে দেখতে গিয়েছিলে কি?”
” জি স্যার, ঘন্টা দেড়েক আগেই ওই পাশটা ঘুরে এসেছি। ”
” কী করছে সে?”
” তেমন কিছু না, উল্টো দিক মুখ করে বসে ছিল। আর ছোট একটা ইটের চারা দিয়ে দেয়ালে ঘঁষছিল।”
” ইটের চারা! ও লকাপের ভেতর ইটের চারা কোথায় পেল?কে দিয়েছে ওকে ইটের চারা?”
” না স্যার কেউ দেয়নি। ওটা আগে থেকেই ওখানে ছিল। শুধু ওই একটি চারাই না, আরও বেশ কয়েকটি চারা ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ডান পাশের যেই দেয়ালটি রয়েছে সেটির আস্তর খসে পড়েছে স্যার। আর সেখান থেকেই সিমেন্ট আর ইট মিশ্রিত কিছু চারা মেঝেতে পড়ে আছে। হয়তো সেখান থেকেই ও তুলে নিয়েছে। ”
“ও…… ”
হাবিলদার দু কাপ চা টেবিলে রেখে যেতেই আরিফুল তার হাতে থাকা ফাইলটি বন্ধ করে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিল। গরম কাপে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে ছোট্ট করে চুমুক দিতেই নীরব বলে উঠল,
” স্যার, ওকে কোটে চালানের জন্য থানা থেকে ছাড়বেন কখন? সাড়ে ন’টা তো প্রায় বেজে যাচ্ছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে না? যেতেও তো সময় লাগবে।”
” পাঠাবো, সাড়ে দশটা নাগাদই পাঠিয়ে দিব। ও নিয়ে তুমি ভেবো না।”
” জি স্যার। ”
আরিফুল ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আমার না এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না রাকিব এ কাজ করেছে। যদিও ওর জবানবন্দি সমেত সকল প্রমাণ আমাদের হাতে আছে কিন্তু তারপরও কেন যেন মনে হয় ও এ কাজ করতে পারে না। কোনো একটা ঘোরে আছি আমরা।”
” আপনার ভাবনায় কোনো ভুল নেই স্যার। তবে এটাও ঠিক যে আমরা কোনো ঘোরে নেই। আসলে কাজটা নিজের প্রিয় ভাই করেছে তো তাই আর-কি আপনার বিশ্বাস করতে সমস্যা হচ্ছে। বাইরের কেউ কাজটা করলে হয়তো আপনার এরকম লাগত না। কিন্তু কথায় আছে না স্যার, ঘরের শত্রু বিভীষণ! সেরকমটাই ঘটেছে এ ক্ষেত্রে। ”
” কীভাবে পারল এরকম একটি জঘন্য কাজ করতে? আমার ভাবতেই কেমন লাগছে। আর সে নিজের হাতে করেছে। ভাবতেই তো গা শিউরে উঠছে।”
” স্যার, রাকিবের কর্মকাণ্ড ভেবে আমার কিন্তু গা শিউরে উঠার মতো সেরকম কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। কেননা রাকিব তো ছিল মহিউদ্দিন সাহেবের চাচাতো ভাই আর মারিয়া, মাহফুজের দূরসম্পর্কের চাচা। বর্তমান যুগে দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের দ্বারা এরকম কাজ কোনো ব্যাপারই না। আমার তো অবাক লাগছে মহিউদ্দিন সাহেবের স্ত্রীর কথা ভেবে। দশ মাস দশদিনের মতো অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে যে প্রাণ দুটোকে এ ভুবনে আনার জন্য প্রসবের মতো মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করেছে সেই দুটো প্রাণ নিজ হাতেই কেড়ে নিল! পরকীয়ার টানে নিজের সন্তানকে মেরে ফেলল! একটুও তার হাত কাঁপল না? চোখ জুড়ে নোনাজলের ধারা তো দূরের কথা, সামান্য জলের ছিঁটেফোঁটাও এলো না? তাহলে রাকিবের করতে সমস্যা কী? ওর তো এ সমস্ত কাজ নির্দ্বিধায় করার কথা। যেটা ও করেছেও। যে মা পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে সেই মা যদি নিজ সন্তানের কথা না ভাবে, চাচা কেন ভাবতে যাবে স্যার? তাও যদি হয় দূরসম্পর্কের চাচা!”
” যদিও তোমার কথা ঠিক… যদি কেন, শতভাগ তোমার কথা ঠিক। কিন্তু তারপরও মনের ভেতর কেমন যেন হাসফাস লেগেই আছে। ”
“বিশ্বাস করবেন কি-না জানি না স্যার। রাকিবকে কিন্তু আমার প্রথম থেকেই ভীষণ সন্দেহ হচ্ছিল। ওকে যখন প্রথম আমরা ঘটনাস্থলে নিয়ে গেলাম ওর হাবভাব আপনি লক্ষ্য করেছিলেন কি-না জানি না, তবে আমি কিন্তু ওর আপাদমস্তক লক্ষ্য করেছি। কেমন যেন একটা চোর চোর ভাব ছিল ওর মাঝে। ওর চাহনিতেও কেমন যেন রহস্যের খেলা ছিল। কিন্তু তারপরও মনের সুপ্ত স্থানে ভরসা রেখেছিলাম যে, হয়তো আমার ভাবনা ভুল। তাই ওকে জেরা করার বিষয়টা মাথায় আনিনি। কিন্তু ফলাফল কী বের হলো, ওই রাকিবই সর্বদোষের দোষী।”
” হ্যাঁ, সেটাই তো দেখছি।”
আরিফুল ও নীরব দু’জনই গুমোট মুখ করে ফেলল। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। কেবল একের পর এক চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে।চায়ের কাপে শেষ চুমুক টুকু দিয়েই আরিফুল বলল,
” আচ্ছা নীরব,তোমাদের এলাকার যে মেয়েটিকে কিছুদিন আগে ধর্ষণ করা হলো ওই ধর্ষণের মামলার কী অবস্থা? কোন খবর টবর নিয়েছ?”
” হ্যাঁ স্যার নিয়েছি তো। মামলা এখন টোটালি ক্লোজ হয়ে গিয়েছে। যেটা আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম। আসলে মেজিস্ট্রেটের ছেলে এ মামলার আসামি তো তাই আর কি কোটে বেশিদিন গড়াতে পারেনি কেসটা। টাকা, সবই টাকার খেলা স্যার।”
” এরই নাম বাংলাদেশ। বুঝলে নীরব? টাকা আছে তো ক্ষমতা আছে। আর ক্ষমতা আছে তো সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করতেই হবে। এরকম খবর শুনলে মাঝে মাঝে তো ইচ্ছে করে এরকম বাপ ছেলেকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে সমানে ব্রাশফায়ার করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেই। যত্তসব ফালতু লোকজন! ”
বলেই চেয়ারে গা এলিয়ে বসল আরিফুল। মিনিট দুয়েক পেরোতেই টেবিল উপর হাত চেপে উঠে দাঁড়ালো আরিফুল। বলল,
” চলো নীরব রাকিবকে দেখে আসি আর চালানের ব্যবস্থাও করে আসি।”
” ওকে স্যার।”
আরিফুল সামনে আর নীরব পেছনে। বড় বড় পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে রাকিবের লকাপ রুমটির দিকে। তালা খুলে মাথা নিচু করে লকাপের ভেতর যেতেই আরিফুল ও নীরব দু’জনেই ‘থ’ মেরে গেল।
লকাপের ভেতরের একেবারে পেছনের দেয়ালের উপরিভাগে যে ছোট জানালাটি রয়েছে তাতে দড়ি দিয়ে গিট বেঁধে ফাঁস দিয়ে ঝুলে আছে রাকিব। মেঝে থেকে পা সামান্য উপরে। সর্বোচ্চ ৫ ইঞ্চি। হাত পা ছেড়ে একেবারে শক্ত হয়ে আছে। গলা থেকে মাথা অবধি ইতিমধ্যে ফুলে ভার হয়ে গিয়েছে।আরিফুল একবার সামনের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার নীরবের দিকে। নীরবেরও একই হাল।
আরিফুল ও নীরব দু’জন সমান তালে দু’পা সামনে এগিয়ে রাকিবের ঝুকে থাকা দেহকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। নীরব ভ্রু কুচকে বলল,
” স্যার, এভাবে জানালায় ফাঁস দিয়ে কি মানুষ আদৌ মারা যায়? তারউপর পা তো প্রায় মেঝে ছুঁই ছুঁই। তাহলে কীভাবে কী?”
আরিফুল কোমরে দু-হাত চেপে রাকিবকে দেখতে দেখতে বলল,
” আত্মহত্যা করার জন্য প্রয়োজন নেই যে ফ্যান কিংবা গাছেই ঝুলতে হবে। মেডিকেল সাইন্স বলে, গলায় ফাঁস বসে থেকেও দেয়া যায়। আর তা কার্যকরীও হয়। তাই এই ফাঁসে কোনো সন্দেহ নেই।”
বলেই আরিফুল রাকিবের কাছে গিয়ে গলার উপর মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে ধরল। লাল দাগ হয়ে গিয়েছে পুরো গলা জুড়ে। জায়গায় জায়গায় রক্ত জমাটও বেঁধে গিয়েছে। চোখ দুটো আধখোলা। জিহবা প্রায় চার আঙুল সমান বেড়িয়ে বা পাশে বেঁকে আছে।
রাকিবকে ঘুরে ঘুরে দেখার মাঝে নীরব আরিফুলকে ডাক দিল,
” স্যার!”
” হুম, বলো।”
” একটু এদিকটায় আসুন।”
আরিফুল চার কদম এগিয়ে নীরবের কাছে যেতেই নীরব আঙুল দিয়ে সামনে ইশারা করল। আরিফুল তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে তাকাতেই লাল ইট ঘঁষে লেখা বড় বড় অক্ষরের কয়েকটি শব্দ দেখতে পেল, ‘ পাপ যখন করেছি শাস্তি তো পেতে হবেই। হোক সে শাস্তি নিজ হাতেই!”
নীরব বলল,
” স্যার আমি যখন ওকে দেখতে এসেছিলাম ও এখানে বসেই ইটের চারা ঘঁষছিল। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পারিনি যে ও শুধু ঘঁষছিলই না, সাথে কিছু লিখছিলও।”
” লক্ষ্য করার দরকার ছিল নীরব। তাহলে হয়তো থানায় এরকম একটা ঘটনা ঘটত না।”
” সরি স্যার!”
আরিফুল আর কিছু বলল না। কেবল একবার ডানপাশ, একবার বামপাশ দিয়ে ঘুরেফিরে রাকিবের ঝুলন্ত দেহ দেখতে লাগল।
এরই মাঝে নীরব বলে উঠল,
” যে হাতে পাপ করলি সেই হাতেই আবার মাশুল দিলি। লাভ কী হলো এতকিছু করে?”
” পাপ কখনো বাপকেও ছাড়ে না। দুনিয়ার পাপের ফল দুনিয়াতেই ভোগ করে যেতে হয়। যা জন্ম লগ্ন থেকেই ঘটে আসছে। আর পরবর্তীতেও এর ব্যাতিক্রম ঘটবে না।”
বলেই আরিফুল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লকাপ থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
” CSU দের খবর পাঠাও। নতুন করে ইনভেস্টিগেশন শুরু করতে হবে যে!”
.
.
(সমাপ্তি)

বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৯

0

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৯
.
.
উচ্চস্বরে কথাগুলো বলে উঠল হাফসা। আমি স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,
” তুমি এতটা উত্তেজিত হচ্ছো কেন হাফসা? আমরা তো কথাগুলো ঠান্ডা মাথায় স্বাভাবিক ভাবেও বলতে পারি তাই না?”
” কিসের ঠান্ডা মাথা? কিসের স্বাভাবিক কথা? ঠান্ডা মাথায় কথা বলার রাস্তা রেখেছ তুমি? একের পর এক সময় দিয়ে যাচ্ছো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সেই আমাকে এই চার দেয়ালের মাঝেই গুমরে গুমরে মরতে হচ্ছে। তাহলে কেন তুমি? কেন তোমার সাথে এই সম্পর্ক? সেইবার যখন প্রেগন্যান্ট হলাম মিষ্টি মুখ করে বললে, আর পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে। আমি তখনি জানতাম সেটাও ছিল তোমার জাস্ট মুখের কথা। কিন্তু তারপরও কিচ্ছুটি বলিনি শেষবারের মত তোমাকে বিশ্বাস করে অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু রেজাল্ট কি হলো? পাঁচ মাস গিয়ে ছ’মাসে পড়ে গিয়েছে কিন্তু তোমার জবের ‘জ’ ও হয় নি। এরপরও বলছ ঠান্ডা মাথায় কথা বলতে?”
এতক্ষণ হাফসা অন্যদিক মুখ করে কথাগুলো বলছিল। তাই আমি বিছানায় একপা উঠিয়ে বসে হাফসাকে আমার দিক ঘুরে বসালাম। বললাম,
” রাগ হয়েছে? ”
হাফসা চুপ করেই বসে রইলো। আমি আরও বেশ ককয়েকবার নানান কথা বলে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতেই হাফসা বলে উঠল,
” এসব কথায় আমি আর ভুলছি না বাবলু। হয়তো তুমি আমাকে নেয়ার একটা ব্যবস্থা করবে। নয়তো আমার জীবন থেকে একেবারে সরে যাবে। এরকম দোটানার জীবন আমি আর নিতে পারছি না। ”
” তুমি আমার সাথে সংসার করতে চাও? ”
” একবার না হাজারবার চাই। কিন্তু তুমিই তো দিচ্ছ না। ”
” দিব অবশ্যই দিব। কিন্তু……”
” কিন্তু কী?”
” তোমাকে যে আমার কথামতো কাজ করতে হবে। ”
” মানে? কিসের কাজ? কোন কাজের কথা বলছ তুমি?”
” দাঁড়াও।” বলেই আমি দরজাটা ভেতর থেকে লক করে বিছানায় এসে বসলাম।বললাম,
” এই মুহুর্তে আমার জব নেই। আর জীবনো হবে কি-না তাও শিউর না। কেননা জব করার মনমানসিকতা আমার মাঝে কখনো ছিল না আর হবেও না। তাই আমি বলছিলাম…”
হাফসা ভ্রু কুচকে বলল,
” কী বলছিলে?”
” না মানে ভাইয়ার অবর্তমানে যা কিছু আছে সব তো বাচ্চাদের। আর বাচ্চাদের অবর্তমানে সবকিছু আমার। অর্থাৎ ভাইয়ার তো আর ভাই বোন নাই যে,ভাইয়া বা তার বাচ্চারা না থাকলে তার সবকিছু মালিক তার ভাইবোন হবে। সে তো একা। সেই হিসেবে আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী ভাইয়া ও তার ওয়ারিশ না থাকলে তার যা সম্পত্তি আছে সবই চাচাতো ভাইদের হবে। বিশেষ করে আমার হবে। যেহেতু ভাইয়ার খুব কাছের মানুষ আমি। আর তাছাড়াও ভাইয়ার কোথায় কী আছে সবই তো আমার জানা। তাই আমিই হব ভাইয়ার সবকিছুর মালিক।মোটামুটি একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে পায়ের উপর পা তুলে জীবন চলে যাবে দু’জনের। তবে হ্যাঁ, যদি তুমি চাও।”
” বাবলু! তুমি এসব কী বলছ? তুমি তোমার ভাইকে মারার কথা বলছ? সেই সাথে ওই দুটি শিশুকেও? মাথা ঠিকাছে তোমার? যা হয়েছে আমাদের হয়েছে শুধু শুধু ওদের জীবন কেন এর মাঝে এনে দাঁড় করাচ্ছো? সম্পর্কের শুরুতে তো বলোনি এসব কথা! তাহলে আজ কেন নতুন সুরে গান গাইছ?”
” বরের জন্য এতো প্রেম থাকলে আমার কাছে ধরা দিয়েছিলে কেন? শোয়ার সময় হুশ ছিল না? জোর করেছিলাম না-কি শুতে?”
” বাবলু! কেমন ভাষায় কথা বলছ তুমি?”
” গলা নামিয়ে কথা বলো হাফসা। সবসময় যে তোমার চড়া গলা মেনে নেব তা কিন্তু নয়। গলার জোর আমারও আছে। অতএব সাবধান। ”
” তুমি আমাকে ধোঁকা দিচ্ছ?”
” না, মোটেও না। আমি তোমাকে নিয়ে সুখের ঘর বাঁধতে চেয়েছি। আমাদের একটা সংসার বাঁধতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি তো…..”
এবার হাফসা নরম সুরে বলল,
” এসব করার কী দরকার বাবলু? চলো আমরা অনেক দূরে চলে যাই। ওরা ওদের মত থাকুক আর আমরা আমাদের মত করে। এর মাঝে এসব খুন খারাপির কী দরকার বলো! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি তোমার কাছে বাড়ি, গাড়ি, ভালো কাপড়, ভালো খাবার এসব কিচ্ছু চাইব না। তুমি যেভাবে রাখবে, যা খেতে দিবে সেগুলোই হাসি মুখে গ্রহণ করে নিব। এসব ঝামেলায় যেয়েও না প্লিজ।”
” ঐশ্বর্যের প্রয়োজন তোমার না থাকলেও আমার আছে হাফসা। একবার যখন বলেছি আমার সবকিছু চাই মানে চাই। এখন তুমি সাথে থাকো বা না থাকো। তবে হ্যাঁ, এটা মাথায় রেখো ভাইয়া কিন্তু আর আগের মতো তোমায় ভালোবাসবে না। আর না তুমি তাকে ভালোবাসতে পারবে। তুমি তো এখন ভাইয়াকে চোখের দেখাও দেখতে পারো না। তাহলে থাকবে কী করে তুমি?”
” তোমার ভাইয়ার কথা এখানে আসছে কেন? আমি তো তার সাথে না, আমি তো তোমার সাথে আছি। সে ভালোবাসল কি না বাসল তাতে তো আমার কিছু যায় আসে না। ”
” যায় হাফসা আসে যায়। যখন আমি থাকব না তখন তুমি তার ভালোবাসা পেতেই মরিয়া হয়ে উঠবে। মানুষ যে ভালোবাসার কাঙ্গাল। আর এটাই যে মানব জাতির বিশেষত্ব। ”
” তুমি থাকবে না মানে? কী বলছ এগুলো? ”
” হুম থাকব না-ই তো… কেননা তুমি যদি আমার সঙ্গ না দাও আমি তো আর তোমার সাথে সম্পর্ক রাখব না। আর না তোমার ছায়া হয়ে থাকব। তখন বাদ্ধ হয়েই তোমাকে ভাইয়ার শরণাপন্ন হতে হবে। আর ভাইয়া যেই মানুষ সে একবার যার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় দ্বিতীয় বার সেদিক ঝুঁকে না। হ্যাঁ সন্তানের খাতিরে এখন যেরকম লোক দেখানো সম্পর্ক আছে সেরকম হয়তো থাকবে কিন্তু মনের দিক থেকে নয়। তখন তুমি কী করবে?”
” তোমার সঙ্গ না দিলে তুমি আমাকে ছেড়ে দিবে? এ কথা তুমি বলতে পারলে বাবলু? ”
” অস্বাভাবিক কিছু বলেছি? এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভালোবেসে তুমি যদি আমার জন্য কিছু করতে না পারো, আমি কেন সেই ভালোবাসায় জড়িয়ে থাকব বলতে পারো? এমন তো না যে এইসব কিছু আমি আমার একার জন্য করছি। যা করছি সবই তো দু’জনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করছি। তো সেই কাজে তুমি যদি আমার ছায়া না হও আমি কেন তোমার জীবন ছায়া হবো বলো।”
” তুমি কিসের সাথে কী মেলাচ্ছ বাবলু? ভালোবাসা একটা আর কোন ক্রাইমকে সাপোর্ট দেয়াই আরেকটা। তুমি এটা বাদে অন্য যেকোনো কথা বলো দেখো আমি মানি কি-না! কিন্তু এসব কী করে সম্ভব? ”
” আমার সাথে থাকতে হলে এই অসম্ভবকেই তোমার সম্ভব করতে হবে হাফসা। আর নয়তো আমার কথা ভুলে যাও।আমি আমার রাস্তা মেপে নেব তুমি তোমারটা মাপো। ”
” এটাই তোমার শেষ কথা?”
” হুম এটাই শেষ কথা।”
হাফসা দুই হাঁটু উঁচিয়ে তাতে মাথায় গুঁজে বেশ খানিকটা সময় বসে রইলো। আমিও উল্টো দিক মুখিয়ে বসে রইলাম। কারো মুখে কোন কথা নেই। দু’জন দু’জনের মত নীরবে সময় কাটাতে লাগলাম। একপর্যায়ে প্রায় মিনিট দশেক পড়ে হাফসা ভারী কন্ঠে বলে উঠল,
” কীভাবে কী করতে হবে বলো।”
হাফসার কথা শুনে আমার মুখে পূর্ণ হাসির রেখা ফুটে উঠল।বুকে টেনে বললাম,
” এই তো ভালো মেয়ে। আমি তো জানতাম তুমি রাজি হবে। রাজি না হয়ে উপায় আছে না-কি! আমাকে যে তুমি বড্ড ভালোবাসো তাই না!”
” হুম, বলো কীভাবে কী করবে?”
” আমি একটা বুদ্ধি বের করেছি বুঝলে? আমার মনে হয় আমার ভাবনা অনুযায়ী সামনে এগোলে সহজেই সবকিছু সামাল দেয়া যাবে।”
” কী বুদ্ধি?”
” কিছুদিন পর অর্থাৎ এই বৃহস্পতিবারের পরের বৃহস্পতিবার আমি বন্ধুদের সাথে ৫ দিনের ট্যুরে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবো। তবে যেদিন যাবো তারপরের দিন অর্থাৎ শুক্রবারই আবার রাতে ফিরে আসব। কিন্তু সেটা ভাইয়া জানবে না, জানবে শুধু তুমি। আমি ঘুমের ঠিক আগ মুহুর্তে আসব। তুমি দরজা খুলে দিলে আমি লুকিয়ে যাবো। ভাইয়া কিছু জিজ্ঞেস করলে পাশের বাসার ভাবি বলে চালিয়ে দিবে। ব্যস হয়ে গেল। মাঝরাতে ভাইয়া যখন ঘুমে বিভোর থাকবে তখনই আমরা আমাদের কার্য সম্পন্ন করব। কোনোরকম ঝামেলাই হবে না। ”
” এসবে কিন্তু অনেক রিস্ক বাবলু। ধরা পড়লে ফাঁসি হওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। তুমি আরেকবার ভেবে নাও প্লিজ।”
” ভাবাভাবির কিছু নেই। সব কাজেই রিস্ক থাকে। আর এই রিস্ক নিয়েই আমাদের চলতে হয়। তাই ওসব নিয়ে না ভাবাই ভালো। ”
” আমার ভীষণ ভয় লাগছে বাবলু। ”
” আহা! ভয়ের কী আছে? আমি আছি না? তুমি তো জাস্ট আমার সঙ্গ দিবে বাকি কাজ তো আমারই। তোমাকে তো আর খুনটুন করতে বলছি না।”
” কিন্তু…”
” কোন কিন্তু না, যা বলেছি যেভাবে বলেছি সেভাবেই হবে। বুঝতে পেরেছ?”
রাকিবের কথার মাঝেই আরিফুল বলে উঠল,
” যা বলেছিস, যেভাবে বলেছিস সেভাবেই সবকিছু হলো তাই তো?”
রাকিব চুপ হয়ে গেল। নীরব বলল,
” এখন তুই চুপ করেই থাক। তোকে আর আমাদের প্রয়োজন নেই। যা জানার সব জেনে গিয়েছি। বাকি কাজ আদালতে।”
আরিফুল বলল,
” এই যে একে একে চারটে খুন করলি পারলি বাঁচতে? যে ঐশ্বর্যের জন্য এতকিছু করলি পারলি সেই ঐশ্বর্য ভোগ করতে? সেই তো চার দেয়ালের মাঝে আসতে হলো। তাহলে লাভ কি হলো এই শান্তির জীবনে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়কে স্বাগতম জানিয়ে? তুই কি জানিস তোর এতো বড় অপরাধের শাস্তি কী হতে পারে? মৃত্যু…. মৃত্যুদন্ড হচ্ছে একমাত্র শাস্তি তোর এই জঘন্য অপরাধের। এর ব্যাতিত কোনো শাস্তি তুই পাওয়ার যোগ্য নস আর না তোকে দেবে। মৃত্যুই হচ্ছে তোর শেষ পরিণতি। ”
বলেই ফাইলপত্র হাতে নিয়ে রিমান্ড ঘর ছেড়ে বেড়োতে লাগল আরিফুল। দরজার কাছে গিয়ে বলল,
” সকালেই ওকে চালান করতে হবে সব কাগজপত্র রেডি করো নীরব। আর হ্যাঁ, আজ রাতটা কোনার যে খালি ঘরটা আছে সেখানেই তালাবদ্ধ করে রাখো।”
” ওকে স্যার।”
আরিফুল বেড়িয়ে যেতেই নীরব রাকিবকে নিয়ে রিমান্ড ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল।
.
.
চলবে…

বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৮

0

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৮
________________
নীরব আরিফুলকে থামিয়ে চেয়ারে বসালো। বলল,
” স্যার এভাবে উত্তেজিত হবেন না, আমাদের আগে ঠান্ডা মাথায় পুরো ঘটনা জানা দরকার।”
আরিফুল চোখ বুজে দাঁত কিড়মিড়িয়ে রাকিবের দিকে হিংস্রাত্মক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
” বল……”
এদিকে ব্যাথায় রাকিব কাত হয়ে আছে। ব্যাথায় পিঠ যেন নাড়াতেই পারছে না। সারা শরীর সমানে কাঁপছে। গলা দিয়ে নূন্যতম শব্দ বের হচ্ছে না। সেই শক্তিই নেই তার। কিন্তু তারপরও মারের ভয়ে অস্পষ্ট স্বরে সে বলতে লাগল,
” লুকোচুরির মাঝ দিয়েই আমাদের সম্পর্কের ডানা দিন দিন মেলছিল। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হাফসা আর আমার মাঝের শারীরিক সম্পর্ক চলছিল। প্রথম দিকে শারীরিক চাহিদার জন্যে হাফসা আমার কাছে এলেও পরবর্তীতে সেটা হাফসার দিক থেকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। সম্পর্কের ৮ মাস হওয়ার কিছুদিন পর অর্থাৎ এই চলতি বছর ২০২০ এর জানুয়ারির একদুপুরে হঠাৎ করেই হাফসা আমার রুমে এসে বলে….
” আমি প্রেগন্যান্ট বাবলু!”
” কী! কী বলছ এসব? মাথা ঠিকাছে তোমার?”
হাফসা ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক করে বলল,
” আমাকে তুমি শীঘ্রই এখানে থেকে নিয়ে চলো। আমি আর এখানে থাকতে পারব না। এখানে থাকা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ”
” কী আবল তাবল বলছ তুমি? এখানে থাকা অসম্ভব মানে কী?”
” আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা বাবলু। আর ক’দিন গেলে আমার শারীরিক পরিবর্তন ঘটে সবকিছু ফুটে উঠবে। বুঝে যাবে সবাই সবকিছু। তখন কী হবে ভাবতে পারছ? তার থেকে ভালো চলো আমরা এখন… আজকেই যাই। মহিউদ্দিনও বাসায় নেই, বাচ্চা রাও ঘুমাচ্ছে। এখন বেড়োতে একেবারেই সহজ হবে।”
” মাথা ঠিকাছে তোমার? এই অবস্থায় তোমায় নিয়ে আমি কোথায় যাবো? তারউপর জবও তো নেই আমার। থাকব কোথায়? খাবো কী? তাছাড়া আমার যদি নিজের টাকায় থাকার সামর্থ্যই থাকত তাহলে কী আমি এখানে দিনের পর দিন পড়ে থাকতাম?”
” তাহলে এখন? এখন আমি কী করব? আর এভাবেই বা কতদিন থাকব? কবে নিবে তুমি জব? এভাবে তো দিন যেতে পারে না? সংসার করব একজনের আর প্রহর গুনব আরেকজনের! এটা কী জীবন বাবলু? সম্পর্কের শুরুতে তো খুব বড় মুখ করে বলেছিলে খুব দ্রুতই এখান থেকে মুক্তি দেবে। এখানে তুমি থাকবে না। এই তোমার দ্রুত? যে হাল ধরে বসে আছো এভাবে তো বছর কেন যুগ পেরোলেও তোমার জব হবে না। যেখানে তোমারই কোন আশা নেই, সেখানে আমি কোন আশায় দিনের পর দিন এভাবে বসে থাকব?”
” এমন তো না যে আমি জব খুঁজছি না। আমি তো জব খুঁজছি। এখন ভালো একটা জব না পেলে আমার দোষটা কী বলোতো?”
” দোষ তোমার না, দোষ আমার কপালের। কেন যে এ ঝামেলায় জড়াতে গিয়েছিলাম! ”
” কী?”
” কিছু না।”
” ও….আচ্ছা শোনো একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়।”
” কিসের বুদ্ধি!”
” বলছি তো……আগে তুমি বিছানায় শান্ত হয়ে বসো। তারপর আমি সবটা খুলে বলছি তোমায়।”
হাফসা বিছানায় বসতেই আমি তার পাশে বসলাম। বললাম,
” রাতে ভাইয়া ফিরলে তুমি একটু নমনীয় ভাষায় ভাইয়ার সাথে কথা বলবে। আজকাল যা বাজে ব্যবহার করো! ”
” যাকে ভালো লাগে না তার সাথে মুখ নাড়তেও ভালো লাগে না, ভালো ব্যবহার তো দূরের কথা! ”
” কিন্তু সবসময় তো মনের ভালোমন্দ বিবেচনা করলে চলবে না বাবু। মাঝেমধ্যে নিজের লাভক্ষতির জন্য হলেও মনের বিরুদ্ধে যেতে হয়।”
” মানে?”
” ভাইয়া আসার আগেই একটু ভালো করে সাজুগুজু করে নেবে। তারপর ভাইয়ার আসলে হাসিমুখে কথা বলবে। একটু কাছাকাছি গিয়ে মনমাতাবে। তারপর একপর্যায় গিয়ে বলে দেবে তুমি প্রেগন্যান্ট। মানে ভাইয়ার সাথে এরকম ভাবে কথা বলবে যেন এ বাচ্চাটা তারই…”
কথা শেষ না হতেই হাফসা দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্থিরতা ঘেরানো গলায় বলল,
” এটা অসম্ভব বাবলু। তুমি খুব ভালো করেই জানো লাস্ট সাড়ে তিন মাসের উপর হবে মহিউদ্দিনের সাথে আমার সেরকম কোনো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। ও কাছে আসতে চাইলেও আমি নানা অজুহাতে বারংবার পিছিয়ে গিয়েছি। তাহলে যেখানে ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্কই হয়ে উঠেনি সেখানে আজ হঠাৎ করেই বা কী করে বলব আমি ওর সন্তানের মা হতে যাচ্ছি? এটা কীভাবে সম্ভব? আর ও এরকম ধরনের কথা কেনই বা বিশ্বাস করবে? ও কি শিশু বাচ্চা? কিচ্ছু বুঝে না ও?”
” হুম তাও কথা! কিন্তু আমার পক্ষে তো এখন কোত্থাও যাওয়া সম্ভব না হাফসা। কম করে হলেও আরও মাস পাঁচেক সময় চাই আমার। চাকরির কথা আর টাকার কথা মুখে বললেই তো হয় না, ব্যবস্থা করতে হয়।”
” তাহলে কী এই পাঁচ মাস আমি এভাবেই থাকব? পাঁচ মাস পর আমার কী অবস্থা হবে তোমার ধারণা আছে? ”
” আহা….তোমাকে এভাবে থাকতে কে বলেছে? আমি বলেছি? বলিনি তো, তাহলে এত ভাবছ কেন?”
” মানে?”
” শোনো হাফসা, অন্তঃসত্ত্বা হয়েছ বলেই যে মা হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বছর চারেক আগেই তোমার দ্বিতীয় সন্তান মারিয়া এসেছে। তোমার শরীর তো বলতে গেলে এখনো কাচা। অন্তত নিজের শারীরিক সুস্থতার কথা ভেবে হলেও এই মুহুর্তে বাচ্চা নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ”
” কী বলছ তুমি এসব? মাথা ঠিকাছে তোমার? আমার গর্ভে যে আছে সে আমাদের প্রথম সন্তান বাবলু। তুমি কী করে পারলে এরকম একটি কথা বলতে?”
” তুমি যেরকম করছ মনে তো হচ্ছে এই প্রথম মা হচ্ছো তুমি!”
” বাবলু!”
হাফসার অবাক চাহনি বুঝতে পেরেই আমি গলারস্বর পরিবর্তন করে নরম গলায় বললাম,
” তুমি একটু বুঝার চেষ্টা করো হাফসা। আমরা এখন সময়ের কাছে বাঁধা। আমাদের অনুভূতি গুলো এই মুহূর্তে সময়ের কাছে বেওয়ারিশ অনুভূতি। চাইলেও এগুলোকে নাম দেয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তুমি কি মনে করো এই বাচ্চাকে নিয়ে অনুভূতি শুধু তোমারই? আমার নেই? আরে তুমি তো মা আগেই হয়েছ।এ অনুভূতির সাথে পূর্ব থেকেই তোমার পরিচিতি। কিন্তু আমি….আমি তো এ অনুভূতির আষ্টেপৃষ্টে নতুন করে জড়িয়েছি। আমার ভেতরটা কেমন লাগছে জানো? ছেলেরা যখন শুনে সে বাবা হবে তখন তাদের মনের অবস্থা কেমন হয় তুমি ধারণাও করতে পারবে না হাফসা। সেদিক দিয়ে আজ এই মুহূর্তের পর থেকে এ অনুভূতির কাঙ্গাল আমি। এ বাচ্চাকে ঘিরে অনুভূতি তোমার থেকে শতগুণ বেশি আমার হাফসা। ”
বলেই কান্না করে দিলাম। হাফসা তখন বেমালুম হয়ে নিজের কথা ভুলে আমাকে সামাল দিতে বলল,
” আমি আর কিচ্ছু বলব না,তাও তুমি এভাবে কেঁদো না প্লিজ। তুমি যেভাবে যা বলবে তাই হবে আমি কোনো আরগুমেন্ট করব না। প্লিজ বাবলু কেঁদো না।”
হাফসা আমার চোখ মুছে দিতেই আমি বললাম,
” ভুল বুঝো না আমাকে। আমি যা করছি আমাদের ভালোর জন্যই করছি। আর ভবিষ্যতেও যা করব আমাদের ভালোর জন্যজ করব। ভরসা রেখো আমার উপর।”
” হুম।”
” টাকা হাতে কিছু আছে? ”
” হুম আছে তো।”
” তাহলে আজ এক্ষুনি চলো হসপিটালে চলে যাই। কাজটা যত তাড়াতাড়ি সাড়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিন্তামুক্ত হওয়া যাবে।”
” এক্ষুনি যাবে? কাল গেলে হয় না? বাচ্চারা তো ঘুমাচ্ছে এই সময় যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
” ঘুমাচ্ছে বলেই তো এখন যাবো। সজাগ থাকলে কী যেতে পারব না-কি? আর হসপিটালও তো কাছেই কাজ সেড়ে আসতে যেতে সময় লাগবে না তেমন। ”
” কিন্তু…..”
” কোনো কিন্তু না, যাও দ্রুত রেডি হয়ে নাও। আমিও রেডি হচ্ছি। আর শোনো টাকা কিন্তু একটু বেশি করেই নিও। কত লাগে বলা তো যায় না। ”
” আচ্ছা।”
সেদিনই হসপিটাল গিয়ে বাচ্চাটার কাহিনী শেষ করে এলাম। যার ফলে হাফসার শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে ধাবিত হলেও দিন দশেক যেতেই আবার উন্নতিও হচ্ছিল। ভাইয়া সেইবার অনেক করে হাফসাকে জিজ্ঞেস করলেও হাফসা কিছু বলেনি। এটা সেটা বলে বারংবার বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভাইয়া হয়তো কিছু আঁচ করতে পেরেছিল। ভাইয়া কেন যেন আমার সাথে আগের মত কথা বলত না, আড্ডা দিত না। হাফসার কাছেও ভিড়তো না। নিজের মত নিজে থাকত আর বাচ্চাদের ঘিরে থাকত আর তাদের সঙ্গ দিত। অবশ্য এতে যে আমার আর হাফসার আহামরি কোনো সমস্যা হচ্ছিল তা না। আমরা আমাদের মতই চলছিলাম। দিনের পর দিন মাসের পর মাস এভাবেই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। যার দরুণ আমাদের বন্ডিং টাও বেশ মজবুত হয়ে গিয়েছিল।
তো দিন দশেক আগের কথা। শেষ বিকেলে মারিয়াকে কোলে নিয়ে মারিয়ার পছন্দের কার্টুন শিনচেন দেখছিলাম। মাহফুজ অন্যরুম থেকে এসে বলল,
” চাচ্চু চাচ্চু, আম্মু তোমাকে আম্মুর ঘরে ডাকছে।”
বলেই ও সোফায় বসে পড়ল। আমি মারিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে মাহফুজের পাশে বসিয়ে হাফসার রুমে যেতেই হাফসা বিছানায় বসতে বলল। আর আমিও কোনো প্রশ্ন না করে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ বাদে হাফসা এটাসেটা হাতের কাজ করার ফাঁকে বলল,
” তোমার মতলব কী?”
” মতলব! কী আজেবাজে বলছ? মতলবের কথা আসছে কোথা থেকে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
” কিছুই বুঝতে পারছ না? ”
” বুঝলে অবশ্যই জিজ্ঞেস করতাম না।”
” বেশ তাহলে তোমাকে বুঝিয়েই বলছি। এই যে তোমার আমার সম্পর্ক এর ভবিষ্যৎ কী? কিসের আশায় এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে আছো? কী চাইছ কী তুমি? দিনের পর দিন তুমি এভাবে আমার সাথে মজা লুটে যাবে আর আমি চুপটি করে থাকব? দায়ভার যখন নিতেই পারবে না, কেন এ খেলা জুড়েছ?”

.
.
চলবে……

বর্ষাস্নাত রাত পর্ব-০৭

0

#বর্ষাস্নাত_রাত
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ৭
________________
হরদম মার খেয়ে ক্লান্ত মুখ নিয়ে চেয়ারে গা ছেড়ে বসে আছে রাকিব। শরীরে মিলছে না একটুখানি শক্তি। হাত পা যেন পুরো অবস হয়ে আছে। তবে এই ক্লান্ত শরীরেও পানির তৃষ্ণা যেন তার মিটছেই না। মার খাওয়ার পর গুনে গুনে ৫ টি পানির গ্লাস শেষ করেছে সে।
মাথার প্রতিটি চুলের আগা বেয়ে টপ টপ করে ঝড়ছে লবণাক্ত জলরাশি। এ যেন বর্ষা মৌসুমের ঝিম ঝিমানো বৃষ্টি।
আরিফুল চোখের দৃষ্টিতে ভয়ানক ভাব এনে রাকিবের সামনে থাকা মাইকের মাথাটি উঁচু করে বলল,
” ভিডিও ফুটেজে দেখা গেল মহিউদ্দিন সাহেবের স্ত্রী তোকে বাবলু বলে ডাকছে। কিন্তু তোর আর বাকি সবার ভাষ্যমতে তোর নাম রাকিব। তাহলে উনি কেন তোকে বাবলু নামে ডেকেছিল?”
” বাবলু আমার ডাক নাম স্যার। বাড়ির মানুষ আমাকে বাবলু বলেই ডাকে। আর বাহিরের মানুষ রাকিব বলে।”
“ও…. এবার বল, কী বলবি।”
রাকিব মাইকের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে মুখ চুপসে ফেলল। আরিফুল ধমকের সুরে বলল,
” কী হলো? চুপ কেন? বল…..”
আরিফুলের এক ধমকে রাকিবের বন্ধ থাকা দুই ঠোঁটের ভাজ খুলে গেল……
” ২০১৭ সাল। অনার্স পাশ করে ঢাকায় এসেছিলাম চাকরির খোঁজে। একে তো বেকার তারউপর হাতেও তেমন টাকা পয়সা ছিল না যে, বাড়িভাড়া কিংবা মেসে থাকব। তখন বাধ্য হয়েই মহিউদ্দিন ভাইয়ার কাছে আসি কিছুদিনের জন্য মাথা গোঁজবার ঠাই চাইতে। ভাইয়ার সাথে আমার অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক থাকার সুবাদে ভাইয়াও না করেনি। বরং বলেছিল, ” তুই কি পর কেউ? আমার মায়ের পেটের ভাইয়ের সমতূল্য তুই। তোর কোত্থাও যেতে হবে না, চাকরি পেলেও এখানেই থাকবি। আমার সাথেই থাকবি। এক্সট্রা রুম তো আমার আছেই।”
ভাইয়ার সেদিনকার কথাগুলো ছিল আমার কাছে ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত আনন্দ। কতবড় বোঝা যে মাথার উপর থেকে নেমেছিল সে কেবল আমিই জানি। হাসিখুশিতেই যাচ্ছিল দিনগুলো। ভাইয়ার ঘরকে ধীরে ধীরে যেন আমি নিজের ঘরই ভাবতে শুরু করলাম। যখন যা ইচ্ছে হতো তাই করতাম। বাঁধা নিষেধ করার মত কেউই ছিল না। আরাম আয়েশে দিন কাটাতে কাটাতে জবের কথা যেন আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। ভাইয়া মাঝেমধ্যে জবের কথা জিজ্ঞেস করলেও নানান বাহানা দেখিয়ে এড়িয়ে যেতাম। ভাইয়া অবশ্য বুঝতো কিন্তু কখনোই তেমন শক্ত করে কিছু বলেনি।
দিন যেতে লাগল আর আমি যেন ভাইয়ার আরও ঘনিষ্ঠ হতে লাগলাম। ভাইয়ার যা কিছু ছিল সবকিছুই ভাইয়া আমার সাথে শেয়ার করতো। কোন একাউন্টে কত টাকা, কোথায় কতটুকু জমি সবই বলতো ভাইয়া। আর আমি শুধু অবাক হয়ে শুনতাম। কারণ ছোট থেকেই বাবার ঘরে অভাবে বড় হয়েছি। আর বর্তমান জীবনেও অভাবের দাস ছিলাম। আর অপরদিকে ভাইয়া ছোট থেকেই ঐশ্বর্যের ভেতর বড় হয়েছে আর নিজের জীবনেও সে ওই ধারা বজায় রেখেছে।
যার দরুণ একপ্রকার লোভ আর আক্রোশ জন্মে গিয়েছিল ভাইয়ার সবকিছুর উপর। কারণ আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী সম্পত্তির মালিকের কোনো ছেলেমেয়ে না থাকলে ওই সম্পত্তির মালিক ভাইস্তারা হয়। তাই সবসময় আমার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেত। ভাইয়া ও তার বংশ না থাকলে ভাইয়ার ক্লোজ যেহেতু আমি, তারউপর চাচাতো ভাই, সেহেতু ভাইয়ার ভাগের পৈত্রিক সম্পত্তি ও তার নিজের সমস্ত সম্পত্তি সবই আমার হবে। জীবনে কোনকিছু করার প্রয়োজন পড়বে না। পায়ের উপর পা তুলে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারব।
বলতে গেলে সারাদিনই এই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে ভাবতাম কিন্তু কীভাবে কী হবে বা কীভাবে কী করব তার কোনো সুরাহা খুঁজে পেতাম না। একদিন হঠাৎই মাথায় এলো হাফসা ভাবীর কথা। অর্থাৎ তাকে তুরুপের তাশ বানানোর কথা। কেননা কথায় আছে, প্রেমে পড়লে সবাই অন্ধ হয়ে যায়!”
বলেই থামল রাকিব। আরিফুল আর নীরব একে অপরের দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,
” তারপর! ”
” এক গ্লাস পানি দেয়া যাবে?”
রাকিবের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে আরিফুল চোখের ইশারা দিতেই পানি ভর্তি গ্লাস হাজির হয়ে গেল। রাকিব ঝড়ের বেগে পানির গ্লাস ফাঁকা করতেই আরিফুল বলল,
” তারপরের অংশ বল…”
রাকিব মাথা নাড়িয়ে বলতে আরম্ভ করল…..
” ২০১৯ সালের মে মাসের কথা! ভাইয়ার অফিসের একটা কাজে ভাইয়াকে ১০ দিনের জন্য দিল্লি যেতে হয়েছিল। যদিও ভাইয়া যেতে চাইছিল না কিন্তু চাকরির খাতিরে যেতে হয়েছিল। আর সেই সুযোগটাই নিয়েছিলাম আমি…..
ভাইয়ার যাওয়ার পরেরদিন……
দুপুর ৩ টা। মাহফুজ আর মারিয়াকে ঘুম পারিয়ে খাবার টেবিলে খাবার বেড়ে ডাক দিয়েছিল ভাবি। আমি চেয়ার টেনে টেবিলে বসতেই ভাবি খাবারের প্লেট সামনে দিয়ে দিল। আর সে বসল আমার থেকে দুটো চেয়ার পরে। সেসময় আমাদের মাঝে বাড়তি কথা তেমন হয়নি। তবে সে বাড়তি কথাটা হয়েছে খাবারের পর ড্রয়িং রুমে টিভি দেখার অজুহাতে। টিভি চলছিল…. ভাবি একপাশের সোফায় আর আমি অন্যপাশের। টিভি দেখার মাঝেই আমি বললাম,
” ভাই নেই খারাপ লাগছে না ভাবি? বিয়ের পর তো এই প্রথমই মনে হয় এতদিনের জন্য ভাইয়া এতদূর গেল তাই না? ”
” হ্যাঁ, এই প্রথম। তাই তো বেশি খারাপ লাগছে।”
ভাবির এই কথাটির মাঝে কেমন যেন এক ধরনের ইশারা এবং সাহস দুটোই খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। বললাম,
” একটা কথা বলব ভাবি?”
” হ্যাঁ বলো। ”
” আপনাকে দেখলে কিন্তু কেউ বলবে না আপনি দুই বাচ্চার মা। আপনার ফিগার এখনো মাশাল্লাহ সেই বিয়ের আগের মত। মনে হয় কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। এক্ষুনি প্রেম করে ফেলি। ”
” কী যে বলো না!”
” আমি যে মিথ্যে বলি না সেটা কিন্তু আপনি ভালো করেই জানেন। তাছাড়া আপনি এরকম সত্যি একটা কথা শুনে অবাক হচ্ছেন কেন? এর আগে এরকম কথা ভাইয়া কি কখনো বলেনি বুঝি?”
” তোমার ভাইয়ার এসব বলার সময় সুযোগ আছে না-কি! তার কথানুযায়ী আমি এখন দুই বাচ্চার মা। বয়স হয়েছে আমার। অতিরিক্ত আদর আহ্লাদ আমায় মানায় না। ” কথাগুলো একটু মুখ বাঁকিয়েই বলেছিল ভাবি। যা আমাকে আরও গভীর সাহস জোগাতে সহযোগিতা করে। তাই আমি ভাবির পাশের সিটে বসে বললাম,
” এটা কেমন কথা? স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসার আবার বয়স, ছেলেমেয়ে এসব আছে না-কি? এ ভালোবাসা তো সর্বকালের জন্য। হোক সে দু সন্তানের মা কিংবা পাক চুল ওয়ালী বুড়ি।”
” তোমার ভাইয়া যদি তোমার মত বুঝত তাহলে তো হতোই।”
” ভাইয়া না বুঝুক…. আমি তো বুঝি ভাবি। ”
” মানে!”
আমি ভাবির হাত ধরে ফেললাম। বললাম,
” আমি আপনাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছি ভাবি। তাছাড়া ভাইয়ার সাথে আপনার বয়সও ম্যাচ হয় না, আর বয়স ম্যাচ না হওয়ার জন্যে শারীরিক, মানসিক কোনো চাহিদাই হয়তো ম্যাচ হয় না। হয়তো কেন অবশ্যই ম্যাচ হয় না। যেটা আপনার মুখ দেখলেই স্পষ্ট বুঝা যায় আপনি আপনার প্রাপ্য ভালোবাসা, চাহিদা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। ”
” তুমি কি বলতে চাচ্ছো বাবলু?”
” আমি আপনার সঙ্গ চাই ভাবি। আমি আপনাকে ভালোবাসতে চাই। আমি আপনাকে আপনার প্রাপ্য সুখের সাগরে ভাসাতে চাই। প্লিজ ভাবি আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। কথা দিচ্ছি আমি আপনাকে আমার জীবন থাকতে কষ্ট পেতে দেব না। আপনার সমস্ত কষ্ট আমি হাসিমুখে বুক পেতে নিব।”
” এটা হয় না বাবলু। তোমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। তুমি চাইলে আরও সুন্দর মেয়ে পেতে পারো। শুধু শুধু নিজের জীবনে ঝামেলা ডেকে এনো না। ”
” আমার অন্য কাউকে না, তোমাকে চাই হাফসা। আমি তোমার ভালোবাসায় বিভোর হয়ে গিয়েছি। আমার মনের অলিতেগলিতে কেবল তোমারই বিচরণ। একটা সুযোগ দাও প্লিজ…… একটা সুযোগ! ”
” তুমি বুঝার চেষ্টা করো বাবলু……তোমার ভাই জেনে গেলে কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে। ”
” আমি আর তুমি যদি না জানাই ভাই জানবে কীভাবে? পাড়াপড়শি তো আর ঘরের খবর জানবে না যে ভাইয়াকে বলবে। তুমি শুধু আমাকে একটা সুযোগ দাও। যদি আমি তোমার মনমতো হতে না পারি আমার সাথে কোনো সম্পর্ক রেখো না। আমিও তোমাকে ফোর্স করব না। আর যদি আমি তোমাকে পূর্ণ সুখী করতে পারি তাহলে তুমি ভাইয়ার সংসার ছেড়ে আমার হাত ধরবে। আমাদের সংসার সাজানোর স্বপ্নে বিভোর হবে।প্লিজ হাফসা আমি তোমার পায়ে পড়ি আমার ভালোবাসার একটা পরীক্ষা নাও তুমি।”
” কিন্তু……”
” কোনো কিন্তু না, আমি একটা সুযোগ তোমার কাছে ভিক্ষে চাই হাফসা। একটা সুযোগ মাত্র।”
ভাবির মুখের আভায় সম্মতির লক্ষণ দেখতে পেতেই ভাবিকে আরও কাতর করতে আমি ভাবিকে জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলাম। আর ভাবিও তা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ভাবেই নিতে লাগল।
এভাবেই কেটে গেল বাকি দিনগুলো। ভাইয়া আসতে আর বেশি দেরি ছিল না। মাঝের রাত টাই শুধু হাতে ছিল। দিনের আলো ফুটলেই ভাইয়া আগের ন্যায় আবার হাজির হয়ে যাবে আমাদের মাঝে। অবশ্য এতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ আমার যা করার ছিল আমি করে ফেলেছিলাম। হাফসা তখন আমাতে বিভোর ছিল। আর সেই বিভোরতাই ছিল আমার কার্য সম্পাদনের প্রথম ধাপ।
রাত ২ টা। কাপড় বিহীন দেহ মেলে হাফসা আমার উপর শুয়ে। চোখমুখে বিষাদের ছায়া। কন্ঠস্বরে আবেগময় শব্দভাণ্ডার। কালো মুখে বলল,
” আবার আমরা কবে এক হবো বাবলু? তোমার ভাই তো চলে আসবে। এইভাবে খোলামেলা তো আমরা আর থাকতে পারব না। সারাদিনের খুনসুটি আর করা হবে না। রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে তোমার জড়িয়ে ধরা অনুভূতি আর পাওয়া হবে না। কীভাবে থাকব আমি? কেমন করে দিন পার করব? সাদামাটা জীবন যে আমার আর ভালো লাগবে না।”
” এতো ভাবছ কেন পাগলী? ভাইয়া আসছে তাতে কী হয়েছে? আমি তো আর চলে যাচ্ছি না। তাছাড়া ভাইয়া তো সারাদিন অফিসেই থাকবে কেবল রাতটাই ঘরে। আর আমি তো সারাদিন ঘরেই থাকব। রাতে না হোক পুরোদিনটা তো আমাকে ঘিরেই থাকবে। ”
” আমার যে রাতেও চাই তোমায়। তোমার ভাই তো অফিস থেকে এলে আর হুশ থাকে না কখন ঘুম দেবে। আমি যে পাশে আছি খবরই থাকে না। আর তুমি আমার কত খেয়াল রাখো। আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন সব তুমি আমার মতো করে বুঝো। গল্প করে আমাকে হাসাও, আবার রাগ করলে সেই রাগ সযত্নে ভাঙাও। এগুলিই তো আমিই চাই। এর থেকে বেশি কিছু তো আমার চাওয়া নেই। না না, আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না বাবলু। ”
” এবার বুঝলে তো আমার ভালোবাসা তোমার জন্য ঠিক কতটা খাঁটি? ”
” সে কী আর বলতে?” বলেই আমার খোলা বুকে চুমু খেল।
আমি তার খোলা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে বললাম,
” আমি দ্রুতই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে দূরে চলে যাবো। ততদিন ভাইয়ার সাথে আর তেমন মেলামেশা করো না। যেহেতু এখনো তার বউ হিসেবে এই ঘরে থাকতে হবে তাই যতটুকু না করলেই নয় ততটুকুই করবে। আর হ্যাঁ, যত দেরি করে মেলামেশা করবে ততই ভালো। আমার কিন্তু এসব সহ্য হবে না। ”
” তোমার কী আমারই তো ভালো লাগবে না। আমার সবকিছুর জন্যে তো তুমি আছোই। ”
বলেই আমার ঠোঁটে চুমু খেতেই আমি তার খোলা পিঠে চেপে ধরে কাত করে বিছানার উপর ফেলে দিলাম। আর আমার সমস্ত শরীরের ভর ছেড়ে দিলাম তারউপর।”
আরিফুল দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
” যার বিড়াল তাকে বলিস মিয়াঁও? যার টাকায় খাচ্ছিস, দাচ্ছিস তার বউয়ের সাথে নষ্টামি করে আবার তাকে তার পরিবার সহ মারার প্ল্যান করছিলি? আবার শোয়াশুইয়ের কথা ব্যাখ্যাও করছিস! তুই তো ভয়ানক বড় ও উদার মনের মানুষ! ”
বলেই আরিফুল নিজেকে কন্ট্রোল না করতে পেরে বসা থেকে উঠে সজোরে বেতের বারি বসালো রাকিবের পিঠ জুড়ে।
.
.
চলবে……