এদিক ওদিক তাকিয়ে চারপাশ দেখে নেয় দিয়া। রাস্তার দু’পাশে বিদীর্ণ ফসলি জমি। দূর দূর পর্যন্ত জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। এই মুহূর্তে চিৎকার দিলে কেউ শুনবে না। কেউ বাঁচাতে আসবে না তাকে।
মাঝবয়েসি লোকটা বলে, ও-ম্যাডাম! কী এত ভাবছেন? থানায় নিয়ে যাবার কথা বলিনি। সামনেই আমার বাসা। আপনাকে বাসায় নিয়ে যাব। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেখানে খুশি চলে যাবেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।
কী করবে ভেবে পায় না দিয়া। লোকটা ধীরে ধীরে একদম কাছাকাছি চলে আসে। আর তখনই সাঁই করে ছুটে আসে কালো গাড়িটা। ব্রেক কষতেই রোদ বেরিয়ে আসে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, গাড়িতে বোস।
দিয়া বাধ্য মেয়ের মতো গাড়িতে গিয়ে বসে। রোদ মাঝবয়েসি কালো, মোটা লোকটার সঙ্গে অনেক্ষণ কথা বলে কিছু টাকা লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে বসে। সামান্য শব্দ তুলে চলতে শুরু করে গাড়িটা। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বলে না। ড্রাইভার এক মনে গাড়ি চালায়। রোদ চুপচাপ বসে থাকে। দিয়া অপেক্ষা করে। সে যে পালানোর চেষ্টা করেছিল, এর শাস্তি এখনও পাওয়া হয়নি। রোদ অত সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। একটা না একটা শাস্তি তো দেবেই। কিন্তু কীরকম শাস্তি দেবে? ভাবতেই দিয়ার গা কাঁটা দিয়ে উঠে। কান ধরে উঠবস করা কিংবা এ-জাতীয় কিছু হলে অনায়াসে মাথা পেতে নেওয়া যেত। কিন্তু রোদ অদ্ভুত সব শাস্তি আবিষ্কার করে। গতবারের কথাই ধরা যাক না! রোদ শাস্তি হিসেবে বলেছিল, কাপড় খোল!
অসভ্য! কথাটা অজান্তেই দিয়ার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়।
দিয়ার কখন ঘুম লেগেছিল খেয়াল নেই। তবে হঠাৎ চোখ খুলে আবিষ্কার করল, তার মাথাটা রোদের কাঁধের উপর ঝুঁকে আছে। অজানা এক অনুভূতিতে আপাদমস্তক কেঁপে উঠে তার। সে দ্রুত রোদের থেকে দূরে সরে গিয়ে বসে। পরক্ষণেই খেয়াল করে, রোদ ঝিমাচ্ছে। ঝিমাতে ঝিমাতে একসময় রোদের মাথাটা দিয়ার কাঁধের উপর ঝুঁকে পড়ে। অস্বস্তিতে দিয়ার পুরো দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে। কালো গাড়িটা দ্রুত গতিতে ছুটে চলে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ওঁরা?
সিলেট থেকে নারায়নগঞ্জ।
লম্বা সময় ছুটে চলার পর গাড়িটা মৃদু শব্দ করে থেমে যায়। ড্রাইভার হাই তুলে বলে, আইসা পড়ছি ভাবি। ভাইজানরে ডাইকা তুলেন।
রোদ তখন দিয়ার কাঁধে মাথা রেখে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। দিয়া রোদের গালে আলতো হাত রেখে ডাক দেয়, শুনছো? চলে এসেছি।
রোদ চোখ কচলে তাকিয়ে বলে, চলে আসছি?
ড্রাইভারকে বলে, নারায়নগঞ্জ চলে আসছি?
রোদ আর দিয়া গাড়ি থেকে নামতেই কালো গাড়িটা সবেগে ছুটে যায়। রোদ ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে, ক’টা বাজে রে?
দিয়া ঘড়ি দেখে বলে, একটা তেইশ।
অন্ধকারে বুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা বাড়িটার দোতলায় উঠে ডোরবেল চাপে রোদ। কিছুক্ষণ পর লুঙ্গি পরা মাঝবয়েসি একজন দরজা খুলে দেন। রোদকে দেখে বলেন, দূর মিয়া, এখন আইলা! দাওয়াত দিলাম মিয়া তিন দিন আগে। বিয়া দশটার মধ্যে শেষ হইছে। আর তুমি মিয়া রাইতের একটায় আইছো!
হঠাৎ দিয়ার দিকে চোখ পড়তেই বলেন, ভাবি নাকি?
রোদ মাথা নেড়ে জবাব দেয়, হ্যাঁ। আমার বউ।
দিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, দিয়া, ইনি আমার অফিসের প্রোপ্রাইটার। আজ উনার মেয়ের বিয়ে ছিল। আমরা লেট করে ফেলেছি।
ভদ্রলোক দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, আসেন ভাবি, আসেন। রোদ, তুমিও আসো।
তারা দু’জন যেহেতু স্বামী-স্ত্রী তাই তাদেরকে এক ঘরে থাকতে দেওয়া হয়। দিয়া আগ বাড়িয়ে বলে, আমি ফ্লোরে ঘুমাতে পারব। তুমি বিছানায় শুয়ে পড়ো।
দিয়া যখন উদাম টাইলসে কাঁচুমাচু হয়ে শুয়ে বেঘোরে ঘুমায়, তখন রোদ কী যেন ভেবে উঠে দাঁড়ায়। একটা মেয়ে তার সামনে এতটা কষ্ট করবে তা সে কোনোভাবেই চোখে দেখতে পারবে না।
রোদ যখন কোনোকিছু না বলেই ঘুমন্ত দিয়াকে কোলে তুলে নেয় তখন রোদের স্পর্শ দিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। তবে সেটা রোদকে বুঝতে দেয় না। চুপচাপ ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রাখে। রোদ দিয়াকে কোলে রেখেই বিড়বিড় করে বলে, পালাইছিলি না? তোর জন্য পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এর শাস্তি তুই পাবি।
দিয়া মনে মনে বলে, এখনই দাও! এখনই দাও! আজ যা শাস্তি দেবে, মাথা পেতে নেব।
রোদ আস্তে করে দিয়াকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর আপনমনে বিড়বিড় করে, মেয়ে মানুষের চুলের ঘ্রাণ এত মারাত্মক হয়! বাবারে বাবা, নেশা লেগে যায়। উফ্!
পরদিন তারা চলে আসার সময় রোদের অফিসের প্রোপ্রাইটার ভদ্রলোক বলেন, তুমি মিয়া মেজাজ খারাপ কইরা দিছো। আমার একমাত্র মাইয়্যার বিয়া। তোমারে তিনবার দাওয়াত দিছি। তা-ও তুমি সময়মতো আইলা না। ভাবিরে নিয়া আইছো বইলা কিছু কইলাম না।
এবার দিয়া বুঝতে পারে, কেন তাকে বউ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে রোদ। যাতে দেড়ি করায় বকা শুনতে না হয়।
বিকেল চারটা নাগাদ সিলেটে পৌঁছে তারা। রোদের চোখদু’টো টকটকে লাল। গতকাল শেষরাতে আর ঘুমায়নি সে। জেগে ছিল। দিয়ার চারপাশে ঘুরঘুর করছিল আর একটা দুইটা মশা দিয়ার গায়ে বসলে সেগুলোকে তাড়িয়ে দিচ্ছিল। ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকা দিয়া এই ভেবে অবাক হচ্ছিল যে, রোদ এতটা যত্নশীল! এতটা আগলে রাখতে জানে সে!
ছ’মাস পরের কথা।
শীতের সকালে প্রাতঃস্নান সেরে দোতলার বেলকনিতে দাঁড়িয়েছে দিয়া। তখনই লোহার গেট ঠেলে বাড়িতে প্রবেশ করে রোদ। দিয়া আপনমনে চুল শুকাতে শুকাতে নিজের ঘরে প্রবেশ করে। ইদানীং রোদকে দেখলেই কী যেন হয়ে যায় তার। আগে অতটা এমন হত না৷ আজকাল হয়। ওঁদের বিয়েটা বুঝি বেশি দেড়ি নেই। দুই পরিবার আড়ালে আড়ালে বিয়ের সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। সেদিন তো বাবা দিয়াকে ডেকে বললেন, তোরা যে হারে ঘুরে বেড়াস। রাত নেই দিন নেই যখন ইচ্ছে রোদের বাসায় চলে যাস। এটা কি দশজনে ভালো চোখে দেখে? একদিন তো নারায়নগঞ্জ থেকেও ঘুরে এসেছিস। এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না। একবার বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর যা খুশি করিস।
রোদ দিয়ার ঘরে প্রবেশ করেই চমকে উঠার ভান করে বলে, উরিব্বাস! সকাল আটটায় গোসল করছিস! এই শীতের সকালে গোসল! ব্যাপার কী রে, হুম? বল? বল?
দিয়া লাজুক ভঙ্গিতে বলে, গোসল করতে ব্যাপার লাগে নাকি?
রোদ দিয়ার একদম কাছে এসে চুলের ঘ্রাণ শুঁকে বলে, আহ্! কী ঘ্রাণ রে বাবা!
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রোদের হাতটা যখন শাড়ির ফাঁক দিয়ে দিয়ার পেট স্পর্শ করে, তখন দিয়া মৃদু কেঁপে একটু দূরে সরে যায়। রোদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চলে যাবার উদ্যোগ করে। তখন তার হাত ধরে ফেলে দিয়া। আস্তে করে টেনে তার পেটের কাছে রোদের হাত চেপে ধরে। যেখানে রোদ ভুল করে স্পর্শ করেছিল, সেখানেই। হঠাৎ দিয়ার কণ্ঠ কেমন যেন পাল্টে যায়৷ সে সম্পুর্ণ অন্যরকম গলায় বলে, ভালোবাসো?
রোদ প্রশ্ন এড়িয়ে বলে, পাগলামো করিস না দিয়া। হাত ছাড়।
ছাড়ব না। আগে বলো, ভালোবাসো কি না?
রোদ ছোটো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, হাত ছাড় দিয়া!
ছাড়ব না। ছাড়ব না। আগে জবাব দাও। ভালো যদি না-ই বাসো তবে বিয়ে করবে কেন? বলো?
রোদ ধমক দিয়ে বলে, এক চড় মারব! হাত ছাড়!
ধমক শুনে অবাক কান্ড করে বসে দিয়া। রাগে ফুঁসতে থাকা রোদের ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।
রোদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি তিন পর্যন্ত গুণব। এর মধ্যে যদি তুই আমার কথা না শুনিস, তা হলে কিন্তু খারাপ কিছু ঘটবে।
বলেই গুণতে শুরু করে রোদ। তিন পর্যন্ত গুণার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে পালায় দিয়া। তাড়াহুড়ো করে ছাদের এক কোণে নিজেকে আড়াল করে নেয়। তবে রোদের চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। রোদ ছাদে আসে ঠিকই, তবে বৃষ্টি পড়ছে দেখে আর এগোয় না। দূর থেকে বলে, পালাবি ভেবেছিলি? কই পালাবি? একবার না একবার তো আমার কাছে আসতেই হত। না কি? তখন দেখে নিতাম না?
বৃষ্টির জলে কাকভেজা দিয়া শেষমেশ নিজেকে রোদের কাছে সমর্পণ করে দেয়। রোদ মুখ বিকৃত করে বলে, মোড নষ্ট করে ফেলছিস। এখন তোকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। তুই বরং বৃষ্টিতে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাক। এটাই তোর শাস্তি।
দিয়া সত্যি সত্যি এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে। অন্য সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে। তবে রোদের সামনে ভালো লাগছিল না। অস্বস্তি হচ্ছিল। শীত লাগছিল খুব।
শাস্তি ভোগ করে রোদের কাপড় গায়ে দিয়ে চলে আসে দিয়া। মা-বাবা তাকে ছেলেমানুষের কাপড়ে দেখে অনেক প্রশ্ন করেন। দিয়া জবাব দেয় না। নিজের ঘরে গিয়ে ভেজা কাপড় গায়ে রেখেই শুয়ে পড়ে। রাতে গা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। দিয়া বিড়বিড় করে রোদের কাপড়ের সঙ্গে কথা বলে, কেন এমন করো তুমি? কেন এতটা কষ্ট দাও? তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না? না কি অন্য কেউ আছে তোমার জীবনে?
টানা তিন দিন জ্বরে ভোগছে দিয়া। গায়ে প্রচন্ড জ্বর। বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে গা ব্যথা হয়ে গেছে। বিকেলের পর একটু ঘুম লেগেছিল। হঠাৎ চোখ খুলতেই আৎকে উঠে দিয়া৷ তার সামনে রোদ দাঁড়িয়ে আছে। দিয়া দ্রুত উঠে বসে কাঁপা গলায় বলে, আ-আপনি!
রোদ দুম করে দিয়ার পাশে বসে পড়ে। দিয়ার হাতের উপর হাত রেখে বলে, একটা জায়গায় যেতে হবে। যাবি?
কোথায় যাবে, কেন যাবে এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে না দিয়া। সরাসরি বলে, হ্যাঁ, যাব।
এইতো, গুড। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। এক্ষুণি বেরোতে হবে।
এখনি? দিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, এখন। কোনো অসুবিধা? অসুবিধা থাকলে বল। আমি অন্য কাউকে ম্যানেজ করে নেব।
দিয়া মাথা নেড়ে বলে, কোনো অসুবিধা নেই। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
গুড। তাড়াতাড়ি কর। বলে বেরিয়ে যায় রোদ। দিয়া সোজা বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। হঠাৎ আবিষ্কার করে, তার গায়ে জ্বর নেই। বরং শরীরটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। তবে গোসল করতে করতে নানান প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। রোদ হঠাৎ তাকে কোথায় নিয়ে যাবার জন্য এসেছে? এত আর্জেন্ট কী কাজ থাকতে পারে? তা-ও রাতের বেলা!
সে-সব কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে দিয়া। একটা কালো শাড়ি পরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সাজগোজ খুব বেশি নয়, শুধু ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক ছুঁয়ে দেয়। তারপর রোদের সামানে গিয়ে দাঁড়ায়। রোদ খপ করে দিয়ার হাত ধরে বলে, তাড়াতাড়ি আয়। অনেক দেড়ি করে ফেলেছি।
বাসার গেটের সামনে গিয়ে বলে, কী রে, কাপড় আনিসনি?
দিয়া নিজের দিকে একবার তাকিয়ে জবাব দেয়, কাপড় পরেই তো এসেছি।
রোদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, গাধা! এক কাপড়ে হবে? আরো কাপড় লাগবে না?
দিয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, আরো কাপড় লাগবে? কোথায় যাচ্ছি আমরা? দূরে কোথাও?
বাসার গেটের সামনে একটা কালো গাড়ি দাঁড় করা ছিল। ড্রাইভার দাঁঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছিল। রোদকে দেখে সিগারেট হাত থেকে ফেলে গাড়ির দরজা খুলে দেয়। দিয়া গাড়িতে উঠে বসে। তার পাশাপাশি বসে রোদ। গাড়িটা সাঁই করে বেরিয়ে যায়। খানিক চুপচাপ থাকার পর রোদ প্রশ্ন করে, কী রে, পারফিউম মেরেছিস?
দিয়া মাথা নেড়ে বলে, না তো!
তাহলে এত গন্ধ কীসের?
ড্রাইভার পেছনের দিকে তাকিয়ে বলে, চুলের ঘ্রাণ, ভাইজান। ভাবি চুলে শ্যাম্পু করছে তো। সেই ঘ্রাণ। বলে গাড়ি চালাতে মনোযোগী হয়।
রোদ বিড়বিড় করে বলে, চুলের ঘ্রাণ এত মারাত্মক হয়! স্ট্রেইঞ্জ!
দিয়া চুপচাপ বসে থাকে। তার মাথায় কেবল একটি শব্দ ঘুরপাক খায়। সেই শব্দ হচ্ছে, “ভাবি”। ড্রাইভার তাকে ভাবি বলেছে। হয়তো ভেবেছে দিয়া আর রোদের বিয়ে হয়ে গেছে। কিংবা রোদ ড্রাইভারকে বলেছে, তারা স্বামী-স্ত্রী।
দিয়া হঠাৎ কী যেন ভেবে প্রশ্ন করে, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
রোদ সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, হানিমুনে যাচ্ছি।
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে চালাতে আরো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দু’জনকে দেখে নেয়। দিয়া প্রচন্ড অস্বস্তি মাথায় নিয়ে বসে থাকে। রোদের কথাটা দিয়ার একদম পছন্দ হয়নি। তারা এখনও বিয়ে করেনি। তা হলে কীসের হানিমুন? রোদকে বিশ্বাস করে ওঁর সঙ্গে চলে আসাটাই ভুল হয়েছে। এখন দিয়া চাইলেও পালাতে পারবে না। কিন্তু তবুও একেবারে হাল ছেড়ে দেয় না দিয়া। সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। সুযোগ পেলেই সে পালাবে।
প্রায় এক ঘন্টা চলার পর একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি দাঁড় করানো হয়। ড্রাইভার এবং রোদ দু’জনেই যখন নেমে যায়, তখন দিয়া অতি সাবধানে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। হাইওয়ে রোডের এক পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ বাঁ দিকের কাচা রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে দিয়া। একসময় পা দু’টো অবশ হয়ে আসে। দিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটুতে ভর করে থমকে দাঁড়ায়। আকস্মাৎ মাথা তুলে তাকাতেই দেখে কালো, মোটা, মাঝবয়েসি একটা লোক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। লোকটার পরনে পুলিশের পোশাক। বুকের বাঁ পাশে নাম ফলকে লেখা, “আওলাদ”।
লোকটা দিয়ার চোখ বরাবর টর্চ মেরে বলে, আজকাল ভদ্রলোকের মেয়েরাও এ-পেশায় নেমেছে! গুড, ভেরি গুড! তা ম্যাডাম, আপনাকে দেখে তো মনে হয় না আপনার টাকার অভাব। তা হলে এ-লাইনে কেন এসেছেন? ফিজিক্যালি নীডি বুঝি? বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নিলেই পারতেন।
জঘন্য কথাগুলো শুনেও দিয়া রেগে যায় না। নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রেখে বলে, খুব বিপদে পড়ে পালিয়ে এসেছি। আমাকে সাহায্য করুন।
লোকটা দাঁত বের করে হেসে বলে, এই দ্যাখেন, মিথ্যেটাও ঠিক করে বলতে পারেন না। রাতের অন্ধকারে এরকম সেজেগুজে কারা ঘুরে বেড়ায় তা সবাই জানে ম্যাডাম। নতুন কিছু বলুন। এমন মিথ্যে বলুন, যা বিশ্বাস করা যায়।
দিয়া আবার একই কথা বলে, সত্যি বলছি। বিপদে পড়ে পালিয়ে এসেছি। আমাকে সাহায্য করুন। নাহয় যেতে দিন।
লোকটা আবার দাঁত বের করে হেসে বলে, যেতে দিন বললেই তো যেতে দেওয়া যায় না ম্যাডাম! ধরা যখন পড়েছেন, আজকের রাতটা অন্তত আটকে রাখব। কাল সকালে যেখানে খুশি চলে যাবেন।
বিকৃত প্রস্তাব শুনে দিয়ার গা শিওরে উঠে। এরচে’ রোদের সঙ্গে যেখানে খুশি চলে যাওয়াই ভালো ছিল! তবে কি আরো কঠিন বিপদের মুখে পড়তে চলেছে সে? আরো খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে তার সঙ্গে?
টানা এক ঘন্টা বৃষ্টিতে ভিজেছে দিয়া। এটা তার শাস্তি। রোদ দূরে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দিয়া ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কয়েকবার হাঁচি দিয়েছে। সেদিকে রোদের খেয়াল নেই। সে একবার শাস্তির কথা মুখে উচ্চারণ করেছে মানে শাস্তি ভোগ করতেই হবে। এবার যা কিছু হয়ে যাক।
এক ঘন্টা পার হবার পর রোদের মুখে কথা ফোটে। সে ঘড়ি দেখে বলে, টাইম আপ। আর ভিজতে হবে না।
ততক্ষণে দিয়ার চোখদু’টো টকটকে লাল হয়ে গেছে। তার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে বারবার। সে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপতে কাঁপতে নিচে নামতে থাকে। তার পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে রোদ। ঘরে এসেই তোয়ালে এগিয়ে দেয়। দিয়া রাগে, ক্ষোভে তোয়ালেটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেয়। রোদ দাঁত কটমট করে দিয়ার গলা চেপে ধরে। দিয়া পেছনে সরে যেতে যেতে একসময় দেয়ালে বাধা পায়। রোদ দিয়াকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে, খুব রাগ, না? খুব মেজাজি হইছিস? আমার সাথে মেজাজ দেখাস?
দিয়া জবাব দেয় না। ঝাপসা চোখে রোদের দিকে চেয়ে থাকে। চোখের জলে গাল ভেসে যায়। ঠোঁট কাপঁতে থাকে। রোদ তাচ্ছিল্য করে বলে, আহারে, ইমুশন্যাল ফুল! ভুল করছিস, ভুলের মাশুল দিতে হবে না?
এরপর নিজ হাতে দিয়ার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বলে, ভুল করছিস। ভুলের শাস্তিও পেয়েছিস। সমান সমান। এবার যা, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে নে। আর ভেজা কাপড়গুলো বদলে ফেল। না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে।
দিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, আমার ঠান্ডা লাগার কথা তুমি ভাবো তাহলে ভাইয়া?
রোদ কপাল কুঁচকে বলে, ভাবব না! শত হোক, দু’দিন পরে তুই আমার বউ হবি। ঠান্ডা লেগে মরে গেলে আমি বিধবা হয়ে যাব না? আমি আবার অল্প বয়সে বিধবা হতে চাই না। যা, কাপড় বদলা গিয়ে।
যাব না। বলে দাঁড়িয়ে থাকে দিয়া। তার চোখে মুখে অভিমান। দিয়ার ভেজা জবজবা কাপড় বেয়ে টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা জল ফ্লোর স্পর্শ করে। রোদ চোখ রাঙিয়ে বলে, যাবি না মানে!
দিয়া ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, এখানে দাঁড়িয়ে কাপড় বদলাব।
এখানে মানে! আমার সামনে!
দিয়া কথা বলে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রোদ ধমক দিয়ে বলে, মাইর খাবি। যা, ভাগ!
ধমক শুনে দিয়া তোয়ালে হাতে নিয়ে রোদের ঘরে চলে যায়। তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে ভেজা কাপড় খুলে রেখে দেয়। কিন্তু সে কি তোয়ালে পরেই থাকবে? রোদটা যা অসভ্য। কখন না এক টানে…
দিয়া দরজায় উঁকি দিয়ে বলে, আমি কি তোয়ালে পরেই থাকব?
আলমারিতে দ্যাখ। কাপড় আছে। রোদের কণ্ঠে বিরক্তি।
দিয়া পুরো আলমারি খুঁজে সালোয়ার-কামিজ কিংবা শাড়ি জাতীয় কিছু পায় না। শেষমেশ রোদের ফুলহাতা শার্ট আর জিন্স পরে বেরিয়ে আসে। তখনও তার চোখে জল। তখনও সে জড়োসড়ো হয়ে কাঁপছে। রোদ কড়া গলায় বলে, এক দৌড়ে বাসায় যাবি। আর কখনো আমার এখানে আসবি না।
দিয়া চুপচাপ কথা মেনে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে ছাতা নেই। দিয়া ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে পা চালায়।
রোদ দিয়ার চাচাতো ভাই। ছোটোবেলা থেকেই ওঁদের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। দিয়ার পড়াশোনা শেষ হয়ে গেলেই পারিবারিকভাবে বিয়েটা হয়ে যাবে। কিন্তু দিয়ার মনে হয় বিয়েটা শেষমেশ হবে না। রোদ কোনো না কোনো বাহানা করে বিয়ে ভেঙে দেবে।
রোদের পড়াশোনা শেষ। আপাতত একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। তার বাবার বিশাল ফ্ল্যাটে সে একা থাকে। আর তার বাবা মা গ্রামে থাকেন। দিয়া প্রায় প্রতিদিনই রোদের ফ্ল্যাটে যায়। রোদ তাকে অপমান করে, নানা ছুতো ধরে শাস্তি দেয়, দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। এমনকি গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধাবোধ করে না। তবুও দিয়া বেহায়ার মতো রোদের ফ্ল্যাটে উঁকি দেয়। রোদের ভালোমন্দ খোঁজ নেয়। অপমান, লাঞ্ছনা এসব গায়ে মাখে না। শত হোক, রোদকে সে মনেপ্রাণে ভালোবাসে। কিন্তু রোদ কাকে ভালোবাসে, তা সে জানে না। তবে রোদ যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে, তা হলে দিয়া বাঁচবে না। হয়তো হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবে। আর নাহয় আত্মহত্যা করবে।
আজ যখন দিয়া রোদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল, তখন রোদ নিজের ঘরে শরীরচর্চা করছিল। কাজের মেয়েটা দরজা খুলে দেওয়ার পরই দিয়া সরাসরি রোদের ঘরে চলে যায়। তখন রোদের পরনে শুধু নেভী-ব্লু জিন্স। গা খালি। দিয়াকে দেখে রোদ হুড়মুড় করে টি-শার্ট গায়ে দেয়। এবং তার পরই রাগে দাঁত কটমট করতে করতে বলে, হুট করে চলে এলি কেন? আসার আগে অনুমতি নিবি না?
দিয়া জবাব দিতে পারে না। নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। আর তখনই দিয়াকে অবাক করে দিয়ে রোদ বলে, তুই আমাকে কাপড় ছাড়া দেখেছিস। এবার আমি তোকে দেখব।
দিয়ার আপাদমস্তক কেঁপে উঠে। সহসা মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। এ-কেমন মানুষকে ভালোবেসেছে সে! এমন জঘন্য মানুষটাই ছিল তার কপালে! রোদ ধমক দিয়ে বলে, কথা কানে যায় না? আমি তোকে দেখব। কাপড় খোল।
কাজের মেয়েটা আড়ালে কান পেতে সব শুনছিল। হঠাৎ আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, এইডা ঠিক না ভাইজান। এমুন কাম করলে পাপ হইব।
পাপ পুণ্য তুই আমাকে শেখাবি? বলে সঙ্গে সঙ্গে কাজের মেয়ের চাকরি নট করে দেয় রোদ। দিয়া কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। সে জানে, রোদ এক কথার মানুষ। সে একবার যখন বলেছে তখন আর নিস্তার নেই। তবুও দিয়া কাঁদে আর মনে মনে প্রার্থনা করে, খোদা, রক্ষা করো!
রোদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি তিন পর্যন্ত গুণব। এর মধ্যে যদি তুই আমার কথা না শুনিস, তা হলে কিন্তু খারাপ কিছু ঘটবে।
বলেই গুণতে শুরু করে রোদ। তিন পর্যন্ত গুণার সঙ্গে সঙ্গে…
লোক দুটো মৌ এর দিকে এগিয়ে আসছে। মৌ হাত বাঁধা থাকা অবস্থাতেও হাতজোড় করে বাঁচার আকুতি করছে। কিন্তু লোক দুটোর উপর এর কোনো প্রভাবই পড়ছে না। তারা এগিয়ে মৌ এর উপর ঝুঁকে দাঁড়ালো। এরপর মৌ এর হিজাবটা ধীরধীরে খুলে ফেললো। এতে মৌ এর মুখমণ্ডল, চুল উন্মুক্ত হয়ে পরলো। তাদের মধ্যে একজন মৌ এর মুখ, গলা এবং ঠোঁটের কাছে বাজেভাবে স্পর্শ করে বললো,
” আজকে তো তোর সব শ্যাষ হয়ে যাইবো তাই না?” এই বলে লোকটি পৈশাচিক হাসি দিলো। অপর লোকটি মৌ এর বোরকা উঠিয়ে পায়ে বাজে স্পর্শ করে বললো,
” আজকে তুই এই গলি দিয়ে না গেলে আমাগোর দিনটাই খারাপ যাইতো।”
এদিকে মৌ আর সহ্য করতে পারছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। মস্তিষ্ক পুরোপুরি শূন্য অনুভূত হচ্ছে। তার মনে শুধু একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে, “আজ আমার ইজ্জত রক্ষা পাবে তো?”
সে মনেপ্রাণে আল্লাহকে ডাকছে। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছে। এদিকে লোক দুটো মৌ এর শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুব বাজেভাবে স্পর্শ করছে। চোখ বন্ধ করে, হাত দুটো শক্ত মুঠো করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবটা সহ্য করছে মৌ। আর পারছে না সে। মরণ যন্ত্রণার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে তার। আর কতো সহ্য করবে সে? কেউ তার শেষ রক্ষা করতে আসবে তো? আয়ান কোথায়? এখনো আসছে না কেনো? তার অফিস তো এই এলাকার কাছাকাছিই। তাহলে এতো দেরি হচ্ছে কেনো আসতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না মৌ। চোখের পাতা বন্ধ রেখে জল ফেলতে ফেলতে আল্লাহর কাছে বাঁচার আকুতি করছে সে।
হঠাৎ একজনের আর্তনাদের শব্দে মৌ চট করে চোখ মেলে তাকালো। চোখের সামনে মাহতাব আর আয়ানকে দেখতে পেয়ে সে যেনো প্রাণ ফিরে পেলো৷ হৃদয়ে বয়ে গেলো প্রশান্তির এক শীতল স্রোত৷
মাহতাব নিজের হাতে থাকা কাঠের তক্তা দ্বারা লোক দুটোর একজনকে ইচ্ছামতো মারছে। অপরজন তার সহযোগীকে রক্ষা করতে হাতের কাছে থাকা ইটের টুকরা মাহতাবের দিকে ছুঁড়ে দিলো। সেটা আঘাত হানলো মাহতাবের কাঁধ বরাবর৷ এতে সে সামান্য ব্যাথা পেলেও থমকালো না। বরং পূর্ণ উদ্যমে সামনে পরে থাকা লোকটাকে পেটাতে লাগলো। লোকটা এদিক ওদিক করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মাহতাবের হাতের মার থেকে সে কিছুতেই বাঁচতে পারছে না।
এদিকে আয়ান একনজর ক্রন্দনরত মৌ এর দিকে চেয়ে অপর লোকটিকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে মারতে লাগলো। যতটুকু সে পারছে ততটুকুই মারছে লোকটিকে। এক পর্যায়ে লোকটি দূর্বল হয়ে পরলে আয়ান তাকে ছেড়ে মৌ এর কাছে চলে আসে। মৌ এর হাতের এবং মুখের বাঁধন খুলে পাশে পরে থাকা হিজাব দিয়ে তাকে জড়িয়ে নিজের মধ্যে আগলে নিলো আয়ান। এতক্ষণ পর আয়ানকে পেয়ে মৌ তাকে জাপটে ধরে দ্বিগুণ গতিতে কান্না শুরু করে দিলো। আয়ান মৌ এর মাথায় হাত বুলিয়েও মৌ এর কান্না থামাতে পারছে না।
এদিকে মৌ এর এ অবস্থা দেখে মাহতাবের রাগ আগের চেয়েও বহুগুণে বেড়ে গেলো। সে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাঠের মোটা তক্তা দিয়ে লোক দুটোকে মেরে চলছে৷ সাথে পা দিয়ে লাথিও দিচ্ছে। একপর্যায়ে সে ক্লান্ত হয়ে পরলে মারা বন্ধ করে দেয়৷ লোক দুটোর অবস্থাও এতক্ষণে নাজেহাল হয়ে পরেছে। তাদের মধ্যে নূন্যতম শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই যাকে আশ্রয় করে তারা এ জায়গা হতে পালিয়ে যেতে পারে।
মৌ কাঁদতে কাঁদতে আয়ানের বুকে লুটিয়ে পরলো। মাহতাব কাঠের তক্তাটা ছুঁড়ে ফেলে মৌ এর দিকে এগিয়ে আসতেই আয়ান বললো,
” তুই তাড়াতাড়ি একটা এম্বুলেন্স বা সিএনজি ডাক।”
আয়ানের কথা শুনে মাহতাব তড়িঘড়ি করে পকেট থেকে ফোন বের করে এম্বুলেন্সের লোকদের ফোন দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু এম্বুলেন্স আসতে বেশ দেরি হবে বলে সে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে মেইন রোড হতে সিএনজি আনতে চলে গেলো। মাহতাব চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই পুলিশের জিপ এসে লোক দুটোকে এরেস্ট করলো। এখানে আসার আগেই মাহতাব তার বন্ধুকে কল করে, যে এ এরিয়ার অন্তর্ভুক্ত থানায় কর্মরত আছে। মাহতাবের কল পেয়ে তার বন্ধু অতিদ্রুত দুজন কনস্টেবল নিয়ে মাহতাবের পাঠানো ঠিকানায় চলে আসে৷
মাহতাবের বন্ধুকে দেখে আয়ান ক্লান্ত গলায় বললো,
” আমি পরে থানায় এসে রিপোর্ট লেখাবো। আপনি আপাতত ওদের নিয়ে যান।”
লোকটি কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না দিয়ে আসামীদের নিয়ে চলে গেলো। তারা চলে যেতেই আয়ান নিজের বুকের উপর থেকে মৌ কে সরিয়ে নিজের বাহুর উপর তার মাথা নামালো। মৌ এর চেহারা দেখে তার বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। সে কিছুতেই মৌ এর এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। সে কখন চিন্তাও করেনি মৌ এমন পরিস্থিতির শিকার হবে৷
আয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে মৌ এর দিকে তাকালো। কি মায়া এই ঘুমন্ত চেহারায়! কি নিদারুণ কষ্ট এই ঘুমন্ত চেহারায়! আজ সে সময়মতো না আসলে কি হতো তার সামনে থাকা এ মানুষটার! যদি কোনো অঘটন ঘটে যেতো তাহলে কি সে সহ্য করতে পারতো? পারতো না। ভালোবাসার মানুষকে এতো কষ্টে দেখে কেউই ভালো থাকে না৷ কেউই তার ভালোবাসার মানুষটার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আয়ানও সহ্য করতে পারতো না। সে যে মৌ কে ভালোবেসে ফেলেছে!
আয়ান আলতো হাতে মৌ এর শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দিলো। শুকিয়ে আসা পুরো মুখমণ্ডলে হাতের ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিলো। খানিক বাদে মৌ এর পুরো মুখমণ্ডল সে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
” তোকে ভালোবাসি মৌ। খুব ভালোবাসি।”
.
মৌ এর জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। দু বাড়ির সবাই তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মৌ মাথা নিচু করে নিরবে কেঁদে চলছে। জান্নাত এবং অহনা নিচু স্বরে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাতে তারা সফল হচ্ছে না। মৌ এর কান্না কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।
জহির ইসলাম নির্বাক বসে থেকে খানিক সময় মৌ কে পর্যবেক্ষণ করলেন। এরপর ঠাণ্ডা স্বরে জিজ্ঞাস করলেন,
” ঐ পথ দিয়ে আসা যাওয়া করো রোজ রোজ?”
মৌ কান্নার দমকে কিছু বলে উঠতে পারছিলো না। তবুও বেশ কষ্টেসৃষ্টে চেষ্টা করে সে বললো,
” না আব্বু। ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার পর অনেকক্ষণ যাবত রিকশার জন্য অপেক্ষা করেও রিকশা পাচ্ছিলাম না। এজন্য হাঁটা শুরু করি। মেইন রোডে হাঁটতে বিরক্ত লাগছিলো বলে গলি ধরে হাঁটা শুরু করি। অন্যান্য দিন ঐ গলি এতো সুনসান থাকে না। কিন্তু আজকে…..” এই বলে সে কান্নায় ভেঙে পরলো। আয়ান তার কান্না দেখে এগিয়ে এলে সে বসে থাকা অবস্থাতেই আয়ানকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দেয়। এবার নিরবে নয় বরং প্রবল শব্দে কান্না শুরু করে দেয়।
মৌ এর কান্না দেখে আয়ান সবাইকে ইশারায় চলে যেতে বললো। অহনা, মৌ এর কাছে থেকে যেতে চাইলেও আয়ান তাকেও চলে যেতে বলে। ফলে সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবার সাথে চলে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর মৌ এর কান্না থেমে এলে আয়ান তাকে ছেড়ে তার সামনে বসে পরলো। কাতর গলায় সে মৌ কে বললো,
” এতো কান্না করিস না মৌ। অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।”
মৌ প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর হঠাৎ ক্ষীণ গলায় বলে উঠলো,
” ওরা আমার শরীরের প্রতিটা অংশ ছুঁয়ে দেখেছে। ” এই বলে সে নিজের গলা, পেট, হাত, পায়ের দিকে ইশারা করে করে বলতে লাগলো,
” এই যে, এখানে ওরা ছুঁয়েছে আমাকে। এখানে এখানে…..” বলতে বলতে সে আবারো কান্নায় ভেঙে পরলো। বারবার তার চোখের সামনে আজকের ঘটনা ভেসে উঠছে।
মৌ কে এতো কাঁদতে দেখে আয়ান এগিয়ে তাকে নিজের বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তার এ কান্না দেখে আয়ানের বুক যে কষ্টে চিঁড়ে যাচ্ছে তা হয়তো মৌ বুঝতে পারছে না। বুঝবেই বা কি করে। সে তো এখনও সে দুঃসহ স্মৃতিকে ভুলে যেতে পারছে না।
আয়ান, মৌ এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
” এতো কান্না করছিস কেনো? আমি তো আছি তোর সাথে। আমি থাকতে ভয় কিসের?”
মৌ কোনো প্রকার জবাব দিলো। তার কান অব্দি আয়ানের কথা পোঁছাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তা কোনো কাজ করছে না৷ আয়ান আবারো বললো,
” কিছুই হয়নি তো তোর। আমি আর মাহতাব তো সময়মতো পৌঁছে গিয়েছিলাম তাইনা? ”
মৌ নিশ্চুপ। আয়ান কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ গলায় বললো,
” তোকে অনেক ভালোবাসি মৌ৷ প্লিজ আর কাঁদিস না৷ তোর কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না৷ কান্না থামাতে তুই যা করবি আমি তাই মেনে নিবো। কিন্তু দয়া করে কান্না থামা।”
আয়ানের কথাগুলো মৌ এর কানে এলেও তা ঠিকঠাক বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো তার। কিন্তু যখন সে আয়ানের বলা কথাগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে পারলো, তখন সে আয়ানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো এবং দ্বিগুণ স্বরে কান্না করতে করতে বললো,
” আমিও আপনাকে ভালোবাসি৷ অনেক অনেক ভালোবাসি আপনাকে।”
.
ঐ ঘটনার পর প্রায় দুই মাস কেটে গিয়েছে। এখন মৌ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মাঝেমাঝে অতীতের কালো ছায়ার মতো সেই ঘটনা তাকে হানা দেয়। সে-সব মনে পরলেই সে আয়ানকে জড়িয়ে ধরে থাকে। তবে আয়ান বাসায় না থাকলে সে অহনার রুমে গিয়ে অহনার সাথে কথাবার্তা বলে সেসব ভুলে যেতে চেষ্টা করে। সেদিনের পর থেকে প্রথম প্রথম আয়ানের স্পর্শতেও ভয়ে শিউরে উঠতো মৌ। কিন্তু দিন যেতে যেতে নিজেকে শক্ত করে সবটা সামলে নিয়েছে সে। তার এ কাজে আয়ান যতটুকু পেরেছে ততটুকু সাহায্য করেছে। তাদের একে অপরের প্রতি ভালোবাসা এ সময়গুলোতে আর গাঢ় এবং মজবুত হয়েছে।
সন্ধ্যার দিকে অফিস শেষে বাসায় ফিরেই মৌ এর হাসিমাখা মুখখানি দেখে আয়ানের সারাদিনের ক্লান্তি, কর্মব্যস্ততা সব যেনো নিমিষেই দূর হয়ে গেলো। সে মৌ এর দিকে তাকিয়ে ফিরতি হাসি দিয়ে কাপড়চোপড় আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
পাঁচ মিনিট পর আয়ান ফ্রেশ হয়ে এলে মৌ তাকে জিজ্ঞাস করলো,
” কফি খাবেন?”
মৌ হালকা হাসি দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো কফি বানাতে। প্রথমে সে তার শ্বশুর শাশুড়ীর জন্য দু কাপ চা বানিয়ে তাদের রুমে দিয়ে আসলো। পরে তিন মগ কফি বানিয়ে এক মগ অহনাকে দিয়ে এসে বাকি দু মগ নিজেদের জন্য নিয়ে রুমে চলে এলো সে।
আয়ান চুপচাপ ব্যালকনিতে বসে আছে। তার দৃষ্টিজোড়া সন্ধ্যার আকাশের দিকে। মৌ কখন এসে তার পাশে বসেছে, সে খেয়াল করেনি৷ মৌ যখন তার হাতে কফি দিলো তখন সে টের পেলো। তার এমন আনমনা ভাব দেখে মৌ হালকা হেসে বললো,
” কি দেখছিলেন?”
মৌও এবার আকাশের দিকে তাকালো। সন্ধ্যার আকাশ দেখতে বড্ড সুন্দর লাগছে! লাল, কমলা, নীল, কালোসহ আরো কয়েকটা রঙের মিশ্রণে সন্ধ্যার আকাশটা মোহময় রূপে পরিনত হয়েছে। এ দৃশ্য হাজারবার দেখলেও চোখজোড়া ক্লান্ত হবে না৷ বরং বারংবার নতুনভাবে এ আকাশের সৌন্দর্য চোখে এসে ধরা দিবে। প্রকৃতিপ্রেমীরা চাওয়া সত্ত্বেও এ দৃশ্য হতে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না৷
মৌ আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে৷ আয়ান নিজের হাত থেকে কফির মগটা পাশের ছোট্ট টেবিলে রেখে দিলো। এরপর অতি সন্তর্পণে মৌ এর হাত থেকেও কফির মগটা নিয়ে টেবিলে রেখে দিলো। কিছুক্ষণ থেমে একদম হুট করে সে মৌ এর অপর পাশের বাহু ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। মৌ আকাশের সৌন্দর্যে এতোটাই বিভোর হয়ে আছে যে কোন মূহুর্তে আয়ান তার হাত থেকে কফির মগ নিয়েছে তা সে টের পায়নি৷ আয়ানের স্পর্শ পেয়ে সে ধ্যান ফিরে পেয়ে বললো,
” কি হয়েছে?”
আয়ান হালকা হেসে বললো,
” কিছু হয়নি৷ তোকে এভাবে পাশে ধরে রাখতে মন চাইলো তাই এমনটা করলাম।”
মৌ প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না৷ বরং আয়ানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে দিলো। কিছুক্ষণ পর আয়ান আকাশের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,
” ঐ যে, দুটো মেঘের আবছায়া দেখা যাচ্ছে। দেখতে পারছিস?”
আয়ানের ইশারা মোতাবেক মৌ সামনে তাকাতেই সেই মেঘের আবছায়া দেখতে পেলো। বললো,
” হুম, দেখতে পাচ্ছি।”
আয়ান বিস্তৃত হেসে বললো,
” এই মেঘ দুটোর মধ্যে একটা তুই, আরেকটা আমি৷ দেখিস….আর কিছুক্ষণ পর মেঘ দুটোর সন্ধি ঘটবে। কোনো কথাবার্তা না বলে ঐ দিকেই তাকিয়ে থাক।”
মৌ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। এদিকে সন্ধ্যার আকাশ ধীরেধীরে নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে যাচ্ছে এবং অপরদিকে মেঘ দুটোর সন্ধি ঘটছে। আরো কিছুক্ষণ পর দুটো মেঘ যখন মিলে একাকার হয়ে গেলো তখন আয়ান ঝলমলে গলায় বললো,
” দেখেছিস? দুটো মেঘের সন্ধি ঘটেছে। যেমনটা আমাদের ঘটেছিলো…..”
মৌ হালকা হেসে আয়ানের কাঁধে মাথা রেখে বললো,
” হুম….আয়ান এবং মৌ এর মেঘসন্ধি ঘটেছে। রাগ, কষ্ট, মান-অভিমান শেষে তাদের মেঘসন্ধি ঘটেছে। ”
বউভাতের পরেরদিন আয়ান নিজের বাড়ি চলে গেলেও মৌ যায়নি। সে জেদি মেয়ের মতো নিজের বাসাতেই পরে রইলো। তার বাসায় থাকার কারণ আর কেউ না জানলেও আয়ান ঠিকই জানে৷ মৌ যে তার উপর মানঅভিমান করেই নিজের বাসা হতে আসতে চায়নি তা সে জানে। সে এ কথা, ও কথা বলে মৌ কে মানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু মৌ মানেনি৷ আয়ানের মন বলছে, মৌ এর মাথায় নিশ্চয়ই ভূতে ভর করেছে। এমনটা না হলে এতো শান্তশিষ্ট, চুপচাপ মেয়ে এমন হয়ে গেলো কি করে! গভীর ভাবনার ব্যাপার।
মৌ আয়ানের সাথে বাড়িতে আসেনি বলে আয়ান সবার কাছে এই বলেছে যে, বাবার বাড়ি খুব থাকতে মন চাইছিলো মৌ এর। এজন্য আয়ান তাকে রেখেই চলে এসেছে। তবে আজ বিকেল অথবা আগামীকাল সকালের মধ্যে সে মৌ কে নিয়ে বাসায় ফিরবে। এমনটা সে মুখে বললেও করতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে তার। তবে মৌ যেমন ঢিট, আয়ানও এখন তেমন ঢিট হতে প্রস্তুত। সে মনে মনে এঁটে নিয়েছে, আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সে আগেকার মতোই শান্ত এবং নরম হয়ে মৌ এর রাগ, অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করবে। এতে মৌ স্বাভাবিক হলে ভালো। এমনটা না হলে সে জোরজবরদস্তি করতেও রাজি আছে। কেননা তার পক্ষে এসব সহ্য করা আর সম্ভব হচ্ছে না। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে প্রায়। একজন মানুষ আর কতোটা সহ্য করবে!
বিকেলের দিকে আয়ান, মাহতাবসহ অফিস হতে ফিরে এলো। মৌ কে অপমান করার ঘটনায় সকলেই আয়ানকে ক্ষমা করে দিয়েছে। শুধুমাত্র মৌ বাদে। যেহেতু মৌ বাদে সকলেই আয়ানের দিকে আছে সেহেতু মৌ এর অভিমান ভাঙাতে আয়ানের পক্ষ সবাই নিবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আয়ান, মাহতাবকে বললো, মৌ এর রাগ ভাঙাতে তাকে সাহায্য করতে হবে। মাহতাব একবারেই রাজি হয়ে গেলো। তাদের দুজনের সাথে পরে আবার জান্নাত এবং অহনাও যোগ দিলো। চারজনে মিলে মৌ এর রাগ ভাঙানোর জন্য প্ল্যান বানালো। প্ল্যান মোতাবেক, জান্নাত মৌ কে তাদের ছাদে নিয়ে আসবে। মৌ কে দেখে আয়ানদের বাসার ছাদ হতে আয়ান ‘সরি’ লেখা বেলুন উড়াবে এবং ‘সরি’ বলবে। পরে মৌ এর বাসায় ‘সরি’ লেখাসহ একটি কেক পৌঁছে যাবে। এরপর জান্নাত মৌ কে মৌ এর রুমের ব্যালকনিতে নিয়ে এলে আয়ান একটি গান শুনাবে। এই এতো কিছুর পরও যদি মৌ এর মান-অভিমান না ভাঙে তাহলে আয়ান আরেক প্ল্যান করবে। অবশ্য ইতোমধ্যে প্ল্যানিং করে রেখেছে সে। এ প্ল্যানিং এর ব্যাপারে কাউকেই কিছু বলেনি সে। এটা একান্তই তার নিজের মধ্যকার প্ল্যানিং।
.
বিকেল পাঁচটার দিকে জান্নাত এ কথা সে কথা বলে মৌ কে ছাদে নিয়ে এলো। সে ছাদে আসবার পর পরই আয়ান, মাহতাব এবং অহনা তাদের বাসার ছাদ হতে একযোগে অনেকগুলো বেলুন আকাশে উড়িয়ে দিলো। গোলাপি রঙের বেলুনের উপর কালো রঙ দিয়ে ‘সরি’ লেখা ছিলো।
হঠাৎ এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়ে মৌ থ বনে যায়। আকাশসম বিস্ময় চোখে রেখে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত নয়নে প্রতিটা বেলুনের উর্ধ্বমুখী গতি পর্যবেক্ষণ করছে সে। সবটাই অবিশ্বাস্য লাগছে তার কাছে। বেশ কয়েকটা বেলুন নিচে আকাশে থাকতে থাকতেই আয়ান হাঁটু গেঁড়ে দু কান ধরে কিছুটা উচ্চস্বরে বললো,
” সরি মৌ….এবার তো আমাকে মাফ করে দে।”
আয়ানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মৌ চট করে সামনের দিকে তাকালো। এ ছাদ হতে ঐ ছাদ পর্যন্ত সে স্পষ্ট দেখতে পারছে আয়ানের অসহায় চেহারা। নিজের কাছে একটু খারাপ লাগছে তার। সে এক ধ্যানে আয়ানের দিকে চেয়ে আছে। এই মানুষটাকেই তো সে ভালোবাসে! আর আজ সেই মানুষটা তার স্বামী, অতি আপনজন! নিজের ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়া যাবে তার কাছে। সে তো এটাই চায়। তবে সময়ের পরিবর্তনে তার এ চাওয়া প্রায় মুছে গিয়েছিলো। অথচ আজ ভাগ্যের সে চাকা ঘুরে আবারো অতীতের চাওয়াকে সতেজ করে তুলেছে। একজন মেয়ে হয়ে মৌ কিভাবে সে চাওয়াকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে!
মৌ কখনও কল্পনা করেনি আয়ান তার কাছে এভাবে এতোবার ক্ষমা চাইবে। প্রথম প্রথম সে আয়ানের প্রতি কঠোর হয়েছিলো৷ কিন্তু দিন যেতে যেতে সে কঠোরতা কোমলতায় পরিণত হয়৷ আর আজ আয়ানের এমন সরি বলার ধরণে মৌ পুরোপুরি গলে যায়। তার সম্পূর্ণ রাগ যেনো গলে পানি হয়ে যায়।
মৌ বেশ কিছুক্ষণ যাবত নির্বাক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে আয়ানকে দেখে চলছিলো। জান্নাত, মাহতাব এবং অহনা বিষয়টা খেয়াল করে। তখনই হুট করে মাহতাব ঘড়িতে সময় দেখে জান্নাতকে ইশারায় বলে, মৌ কে নিয়ে নিচে যেতে। কেক ডেলিভারি দেওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।
মাহতাবের ইশারা মোতাবেক জান্নাত এগিয়ে গিয়ে মৌ এর কানে ফিসফিস করে বললো,
” একটু নিচে চলো। কেউ একজন এসেছে।”
মৌ এতে খানিকটা অবাক হয়। তবে স্বাভাবিক হয়ে কোনো কথাবার্তা না বলেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। জান্নাত পিছন থেকে বললো,
” এদিকের জবাবটা দিয়ে যাও মৌ।”
মৌ এর পা থমকে গেলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে একনজর আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান এখনও হাঁটু গেঁড়ে বসে আসে। অসহায় চাহনি নিয়ে অপেক্ষায় আছে মৌ এর ঠোঁটে হাসি দেখার জন্য৷ যা তাকে নিমিষেই বলে দিবে, মৌ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু মৌ এমন কিছুই করলো না৷ সে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আয়ানের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে জান্নাতের দিকে তাকালো। ফিসফিস করে জান্নাতের উদ্দেশ্যে সে কিছু বললো। তবে জান্নাত তা শুনতে পেলো না৷ মৌ কিছু বলার পর জান্নাতের প্রত্যুত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সে বাসায় ঢুকে যাওয়ার পর পরই ডেলিভারি ম্যান এলো। মৌ কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেই দরজা খুললো। তবে ডেলিভারি ম্যানের হাতে কেকের বক্সের মতো বক্স দেখে সে কিছুটা বিস্মিত হলো। তার বিস্ময়ের মাত্রা আরো বেড়ে গেলো যখন ডেলিভারি ম্যান তার দিকে কেকের বক্সসহ এক বুকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
” ম্যাম, আয়ান স্যার আপনার জন্য পাঠিয়েছে এটা।”
মৌ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ডেলিভারি ম্যানের ডাকে সে হুঁশ ফিরে পেলে কেক আর বুকেটা হাতে নিয়ে দরজা আটকে দিলো। নিজের রুমে এসে সে কেকের বক্সটা রেখে বুকে হতে চিরকুটটা নিলো। আয়ান সে চিরকুটে সুন্দর করে লিখেছে,
” এবারের মতো মাফ করে দে আমাকে। জীবনে কখনও এমনটা করবো না। কান ধরেছি আমি৷ লাইফের সবচেয়ে বড় ভুলে সবচেয়ে বড় সাজাটা পেয়েছি। আর সাজা দিস না আমাকে। আমি অসহায় পথিক রে মৌ৷ তোর হৃদয়ে কি এই পথিকের বসত গড়বার সুযোগটা আরেকবার দিবি? আমি জবাবটা কিন্তু চাই।
ইতি,
আয়ান।”
চিরকুটটা পড়ে মৌ মুচকি হেসে দিলো। তারপর চিরকুটটা বিছানায় রেখে কেকের বক্স খুললো। কেকের উপর যতটুকু জায়গাজুড়ে ‘সরি’ লেখা যায়, আয়ান ঠিক ততোটা জায়গা জুড়েই ‘সরি’ লেখিয়েছে। আয়ানের এমন ‘সরি’ লেখার ধরণে মৌ ফিক করে হেসে দিলো। বিড়বিড় করে সে বললো,
” পুরোই পাগল হয়ে গিয়েছে।” এই বলে সে বুকেটা হাতে নিয়ে সেখানকার প্রতিটা ফুল আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো।
” এই মৌ, বারান্দায় আয় একটু। ” এই বলে হাঁক ছাড়লো আয়ান।
আয়ানের ডাক শুনে মৌ চমকে উঠলো। তবে সাথে সাথে নিজেকে ধাতস্থ করে বিছানা ছেড়ে উঠে এসে তার রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়ালো। মৌ কে দেখতে পেয়ে আয়ান মুচকি হেসে দিলো। এরপর কয়েক সেকেন্ড মৌ এর দিকে চেয়ে থেকেই মাহতাবকে গিটার বাজাতে ইশারা করে সে গান শুরু করলো,
“Mere samne wali khidki mein
Ek chaand ka tukda rehta hai
Mere samne wali khidki mein
Ek chaand ka tukda rehta hai
Afsoos yeh hai ke woh humse
Kuch ukhda ukhda rehta hai
Mere samne wali khidki mein
Ek chaand ka tukda rehta hai”
গান শেষেই আয়ান আবারো দু কান ধরে অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
” সরি, সরি, সরি। তিন সরি। এবার তো ক্ষমা পাবো?”
আয়ানের এমন কাণ্ডে মৌ এর প্রচণ্ড হাসি পেলো। তবে সে হাসলো না। বেশ কষ্টে নিজের হাসি চাপিয়ে রাখলো। আয়ানের এমন কিউট কিউট কাজকর্ম দেখে মৌ এর মন পুরোপুরি গলে গেলো। বলেকয়ে নয়, মনে মনেই সে আয়ানকে ক্ষমা করে দিলো। তবে ঘটা করে বলেকয়ে সে তখনই আয়ানকে ক্ষমা করবে যখন আয়ানের কাছ থেকে কয়েকটা ওয়াদা করিয়ে নিবে সে। এই মতলব নিয়েই সে কোনো প্রকার জবাব না দিয়ে ব্যালকনির দরজা বন্ধ করে রুমে চলে গেলো।
মৌ এর এমন কাণ্ডে আয়ান প্রচণ্ড অধৈর্য হয়ে পরলো। ফলে রাগে তার মাথা দপ করে জ্বলে উঠলো। সে কান ছেড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। ”
এই বলে সে ব্যালকনি হতে রুমের দিকে পা বাড়ালো। এদিকে বোনের চিন্তায় চিন্তিত হয়ে পরা মাহতাব পিছন থেকে আয়ানের হাত ধরে মিনমিন করে বললো,
” ও আমার বোন লাগে দোস্ত। উল্টাপাল্টা কিছু করে বসিস না।”
আয়ান কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না দিয়ে মাহতাবের হাত ঝামটা মেরে সরিয়ে দিলো। এরপর বড় বড় পা ফেলে রুম হতে বেড়িয়ে এলো। এদিকে মাহতাব নিজের বোনের চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে পরলো। কারণ সে আয়ানের রাগ সম্পর্কে অবহিত। এ রাগের বশে আয়ান উল্টাপাল্টা কিছু করে বসবে না কি এ ভয়েই আছে সে।
প্রচণ্ড জোরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে চমকে উঠলো মৌ। ফলে কোনো প্রকার চিন্তাভাবনা ছাড়াই বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। সাথে সাথেই আয়ান রুমে ঢুকে মৌ কে হালকা ধাক্কা দিয়ে দরজা আটকে দিলো। দরজা আটকানোর আগে মৌ বাইরে তার বাবা-মা, ভাবী এবং অহনাকে দেখতে পেলো। প্রত্যেকের চোখমুখ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। সে এর কারণ খুঁজে পেলো না৷
আয়ান দরজা লাগিয়েই মৌ এর দিকে এক পা দু পা করে এগিয়ে যেতে লাগলো। আয়ানের আকস্মিক এমন কাজে মৌ খানিকটা ভড়কে গেলো। সে এক দু পা করে পিছিয়ে যেতে লাগলো।
আয়ানের রাগান্বিত চেহারা দেখে মৌ খানিকটা ঘাবড়ে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
” কি হয়েছে আপনার? এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?”
আয়ান, মৌ এর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” বড় বাড় বেড়েছে তোর তাই না? ”
মৌ শুকনো একটা ঢোক গিলে বললো,
” কি করলাম আমি?”
” নিজেকে কি ভেবেছিস তুই? এক ঘটনার জন্য আর কত সরি বলবো আমি? একজন মানুষের ধৈর্য ক্ষমতা থাকে, বুঝছিস? সে ক্ষমতা পেরিয়ে গেলে সে চাইলেও নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। তুই-ই বল….দু সপ্তাহের মতো একজন মানুষ উঠতে বসতে তোকে সরি বলছে৷ কিন্তু তুই তাকে ক্ষমা করছিস না৷ তাহলে সে মানুষটার অবস্থা কেমন হয়েছে তা ভাবতে পারছিস? আবার আজকে তোর জন্য কান ধরলাম, বেলুন উড়ালাম, কেক আনলাম, গান গাইলাম। এতোকিছুর পরও তোর মন গললো না! আমার উপর কি মায়াদয়া হয় না তোর? ”
মৌ পিছিয়ে যেতে যেতে ব্যালকনির দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো। সেই ঘটনার পর থেকে সে আয়ানের রাগ দেখেনি বললেই চলে। কিন্তু আজ যখন সে মনে মনে সবটা ঠিক করার উদ্দেশ্য নিয়ে বসে ছিলো, তখন আয়ানের রাগ মোটেও আশা করেনি সে। সে শুকনো একটা ঢোক গিললো। আয়ানের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে এর আগেই আয়ান, মৌ এর দু’বাহু চেপে ধরে বললো,
” এখন ভয় পাচ্ছিস আমাকে দেখে? কেনো? এতোদিন ভয় লাগেনি? মনে পরেনি আমার রাগের কথা?” এই বলে সে মৌ এর চোখ বরাবর তাকিয়ে নিচু তবে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” আমি জীবনেও কোনো মেয়ের পিছনে এতোটা ঘুরিনি যতটা তোর পিছনে ঘুরেছি। তুই সেই মেয়ে যাকে আমি শাসন করতাম। অথচ একটা ঘটনা আমাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে যে তোকে এখন মাথায় তুলে রাখতে হয়৷ যে আমি দু -একবার হলেই সরি বলে হাল ছেড়ে দেই সে আমিই তোকে অগণিতবার সরি বলেছি। আর তুই আমাকে মাফ করার বদলে উল্টো দিনকে দিন তোর পিছনে ঘুরিয়েছিস! এতে তোর কি লাভ হলো? বল আমাকে। ”
মৌ নিশ্চুপ। কিছুই বলার মতো সাহস বা শক্তি সে পাচ্ছে না৷ বেশ কিছুক্ষণ যাবত আয়ানের চোখ বরাবর তাকিয়ে থেকে আর সহ্য করতে না পেরে সে চোখ নামিয়ে ফেলে। ভালোবাসার মানুষের সাথে এতোক্ষণ চোখে চোখ রাখা সম্ভব না কি! অন্যান্যদের দ্বারা হয়তো সম্ভব। তবে মৌ এর দ্বারা তা সম্ভব নয়।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও মৌ এর কাছে কোনো জবাব না পেয়ে আয়ান মৌ এর দিকে এগিয়ে এলো। মাথা নিচু করে মৌ এর ডান গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে ফেললো। আচমকা এমন হওয়ায় মৌ যেনো আকাশ থেকে পরলো। এমন কিছুর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না৷ হতবুদ্ধি হয়ে পরলো সে। ফলস্বরূপ তার চোখ দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে এলো। সে মুখ ফুটে কিছু বলতে যাবে কিন্তু এর আগেই আয়ান তার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
” কিন্তু আমার লাভ হয়েছে। ”
এই বলে সে মৌ কে ছেড়ে দিয়ে রুমের দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো। এদিকে মৌ এখনও পূর্বাবস্থায় বজায় থেকে বিড়বিড় করে বললো,
” এটা কি হলো!”
.
আয়ান এবং মৌ এর মধ্যে সবটাই মোটামুটি স্বাভাবিক। তবে সেদিনকার পর থেকে মৌ আয়ানের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলে৷ আচমকা আয়ানের অমন স্পর্শ পেয়ে মৌ যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো, তা হতে নিজেকে সামলে নিতে খানিকটা সময় লেগেছিলো তার৷ এরপর যখন আয়ান তার সামনে এসেছিলো তখন সে একপ্রকার দৃষ্টি চুরি করে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। কারণ আয়ানের সামনে যাওয়ার সাহস নেই তার৷
এরপর রাতে অবশ্য আয়ান কোনো এক কারণে মৌ এর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জিজ্ঞাস করেছিলো,
” আমাকে এখনও ক্ষমা করতে পারিসনি?”
মৌ তখন আয়ানকে এগিয়ে আসতে দেখে খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো। আয়ানের সে স্পর্শের কথা মনে পড়তেই সে আমতাআমতা করে বলেছিলো,
” না না….ক্ষমা করে দিয়েছি আপনাকে।”
মৌ এর এমন অবস্থা দেখে আয়ান নিশ্চুপে বেশ কিছুক্ষণ হেসেছিলো। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে নিজেকে বলেছিলো,
” এই টোটকাটা আগে জানা থাকলে এতো ঘুরতে হতো না আমাকে। ”
আজ মৌ একা একাই ভার্সিটি গিয়েছে। অহনার সাথে রোজ রোজ গেলেও আজ অহনার শরীর অসুস্থ থাকায় সে যেতে পারেনি। এজন্য মৌ কে একাই যেতে হয়েছে।
ভার্সিটি শেষে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে পরে রিকশা না পেয়ে মৌ হাঁটা শুরু করে দিলো। ভার্সিটি হতে তার বাসায় যেতে এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় প্রয়োজন হয়। মৌ এই উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলো যে, কিছুদূর যাবার পর রিকশা পেলে সে রিকশায় চড়ে বসবে। কিন্তু পনেরো বিশ মিনিট হাঁটার পরও সে কোনো রিকশা পেলো না৷ অতঃপর বিরক্ত হয়ে সে পুরো রাস্তা ধীরেধীরে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিলো। আজকের আকাশ মেঘলা বলেই সে নিশ্চিন্তে আরামসে হেঁটে যেতে পারবে।
আরো কিছুদূর যাওয়ার পর মৌ একটা গলি ধরে হাঁটা শুরু করলো। যানবাহনের কোলাহলে মেইন রোড দিয়ে হেঁটে যেতে প্রচণ্ড অস্বস্তিবোধ করছিলো সে। এজন্যই সামনের গলি ধরে হাঁটা শুরু করলো সে৷ কিছুদূর যাওয়ার পর সে লক্ষ্য করলো, এ গলিটা অন্যান্য দিনের চেয়ে আজ বেশি সুনসান দেখাচ্ছে। দুপুর বলে না কি? মৌ ভেবে পেলো না। তবে এ নিয়ে আর না ভেবে সে হাঁটতে লাগলো।
দু মিনিট হাঁটার পর সে লক্ষ্য করলো তার পিছন পিছন দুটো লোক আসছে। সে যে গতিতে হাঁটছে, লোক দুটোও সেই একই গতিতে হাঁটছে। আরো কিছুদূর যাওয়ার পরও লোক দুটো যখন তার সামনে না গিয়ে পিছনেই রইলো তখনই তার বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা এক আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে এলো। হাত দুটো ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে এলো। প্রচণ্ড ভয়ে সে যেনো হতবুদ্ধি হয়ে পরলো। তার পা দুটোও এ মূহুর্তে তার সাথে বেইমানি করে বসলো। কারণ খুব কষ্টেসৃষ্টে তাদের এগিয়ে নিতে হচ্ছে।
মৌ চোখ বুজে শুকনো একটা ঢোক গিলে দোয়াদরুদ পড়তে লাগলো। এ মূহুর্তে সে ঠিক কি করবে তা সে ভেবে পাচ্ছে না৷ দৌড়াবে? না… দৌড়ানো সম্ভব নয়৷ বোরকা পরে দুটো লোকের সাথে দৌড়ে পেরে উঠা সম্ভব নয়৷ তাহলে কি চিৎকার করবে সে? কিন্তু গলিটা তো জনবসতিপূর্ণ নয়৷ বেশ কিছুদূর পর পর দু একটা বাড়ি। সে এখন সে জায়গায় আছে তার এক পাশে দেয়াল এবং অপর পাশে জমির মতো জায়গা। তবে তা বড় বড় গাছগাছালি এবং আগাছায় তা পূর্ণ। কয়েক সেকেন্ড শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে হাঁটার পর হুট করে তার ফোনের কথা মনে পরলো। সে দেরি না করে তড়িঘড়ি নিজের ব্যাগ হতে ফোন বের করলো। এ মূহুর্তে আয়ানকে ফোন করা তার জন্য সুবিধা হবে। এজন্যই সে কন্ট্যাক্ট লিস্ট হতে আয়ানের নাম্ব খুঁজতে লাগলো। কিন্তু হায়, আয়ানের নাম্বার তো তার ফোনে নেই! প্রপোজের ঘটনার পর মৌ রাগের ফলে আয়ানের নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছিলো। এরপর আর আয়ানের নাম্বারের প্রয়োজন হয়নি, তাই সে আয়ানের নাম্বার আর সেভও করেনি। নিজের এ কাজের উপর তার নিজেরই প্রচণ্ড রাগ হলো। এখন একমাত্র মাহতাবই তাকে সাহায্য করতে পারবে। এজন্য সে কল লিস্ট হতে মাহতাবের নাম্বার বের করে কল করলো। একবার, দুইবার….এভাবে সে পাঁচবার কল করার পরও যখন মাহতাবকে পেলো না তখন ভয়ে তার দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। সে তো আর জানে না, মাহতাব এ মূহুর্তে জরুরি মিটিংয়ে ব্যস্ত আছে। এজন্য ফোন সাইলেন্ট রেখে দিয়েছে।
এখন কি করবে তা ভেবে পেলো না মৌ। এদিকে পথও যেনো শেষ হচ্ছে না৷ লোক দুটোও তার অনেকটা কাছে চলে এসেছে। এবার পর পর দুটো কাজ করবে সে৷ প্রথমত অহনাকে ম্যাসেজ করে তার লোকশন জানিয়ে দিয়ে বলবে আয়ানকে বলতে। দ্বিতীয়ত সে তার বাবাকে কল করতে থাকবে। প্ল্যান মোতাবেক সে অতিদ্রুত ম্যাসেজ টাইপ করে অহনাকে নিজের লোকেশন জানিয়ে দিয়ে বললো যে সে বিপদে পরেছে। যেভাবেই হোক, আয়ান যেনো অতিদ্রুতই চলে আসে। এ ম্যাসেজ দিয়ে সে জহির ইসলামকে কল করতে লাগলো। কিন্তু জহির ইসলামের ফোন বন্ধ!
‘বিপদ যখন আসে তখন চারপাশ থেকেই আসে’, এ প্রবাদবাক্যটা মৌ জানলেও আজ হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে সে। এই এতোকিছুর পরও তার যখন আর কিছুই করার রইলো না তখন ফোনটা ব্যাগে রেখে বড় বড় পা ফেলে দ্রুততার সহিত হাঁটতে লাগলো সে। তার পিছনের লোক দুটোও তার পিছুপিছু আরো জোরে হাঁটতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আর না পেরে মৌ দৌড়ানো শুরু করলো। কিন্তু এতেও তার শেষ রক্ষা হলো না৷ কিছুদূর যাওয়ার পরই লোক দুটো তাকে ধরে ফেললো। সে এতে চিৎকার করতে চাইলো। তবে এর আগেই তাদের মধ্যে একজন তার মুখ চেপে ধরলো। নিকাবের উপর মুখ চেপে ধরায় তার শ্বাস নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে যতটুকু পারছে নিজেকে তাদের থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার এ প্রচেষ্টা দেখে লোকটা আরো জোরে চেপে ধরলো তাকে। এতো বাঁধা পেয়েও সে চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ দেখে অপর লোকটা বিরক্ত হয়ে মৌ এর পা দুটো চেপে ধরে তাকে টেনেহিঁচড়ে কাছের একটা পরিত্যক্ত জায়গায় এনে ফেলে দিলো। পরার সাথে সাথেই কোমড়ে বেশ জোরেশোরে ব্যাথা পেলো সে। ফলে ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো সে।
মৌ এর মুখ থেকে আওয়াজ বের হওয়ার শব্দ শুনে একজন লোক নিজের হাতে প্যাচানো গামছা খুলে নিলো। একটানে মৌ এর নিকাব খুলে গামছা দিয়ে তার মুখ বেঁধে দিলো। এবার মৌ পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে পরে রইলো। সে জানে, এখন হাজার চিৎকার করেও লাভ হবে না৷ তবুও সে শেষ চেষ্টা স্বরূপ তার হাত পা চারটা ইচ্ছামতো ছুড়াছুড়ি করতে লাগলো সে। মৌ এর এমন বাঁচার প্রচেষ্টা দেখে লোক দুটো পৈশাচিক হাসি দিলো। তাদের মধ্যে একজন বললো,
” এই, তোর শার্টটা খুলে ওর হাত বাইন্ধা দে। সুবিধা হবো।”
অপর লোকটা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে বললো,
” ঠিক কইছোস। যেমন লাফাইতাছে এই মাইয়া…..”
এই বলে সে তার শার্টটা খুলে মৌ এর হাত বেঁধে দিলো। লোক দুটোর ঠোঁটের কোনে আবারও খেলা করলো পৈশাচিক হাসি। অপর লোকটা মৌ এর দিকে তাকিয়ে শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
” বহুত দিন পর একটা মাইয়া বাগে পায়ছি। ”
অপর লোকটা বললো,
” ঠিক কইছোস।”
লোক দুটোর চোখে এ মূহুর্তে খেলা করছে পশুত্ব আর মৌ এর চোখে খেলা করছে বাঁচার আকুতি। লোক দুটোর দিকে সে চেয়ে থেকে চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল ফেলছে। কিন্তু এতে তাদের মনে বিন্দুমাত্র মায়া হচ্ছে না৷ বরং নিজেদের ক্ষুধা মেটাতে তারা মৌ এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। এদিকে মৌ…….. চোখ খুলে, বন্ধ রেখে নিজের সতিত্ব হরণ, নিজের অন্ধকার ভবিষ্যত দেখতে পেলো।
” তোর তো নিজের কোনো পছন্দ নেই। তাহলে মৌ কে বিয়ে করতে দোষ কোথায়?” আফসার খানের গর্জে উঠা কণ্ঠে আয়ান খানিকটা ভড়কে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
” আমার নিজের পছন্দ নেই মানে এই না যে আমি মৌ কে বিয়ে করবো। ও এখনও সেদিনকার ঘটনা নিয়ে পরে আছে। আমাকে ক্ষমাই করতে পারেনি। সেখানে ওর সাথে সংসার করা কি করে সম্ভব? ”
” দোষ তো তোর। একটা মেয়েকে ওভাবে অপমান করলে সে কি কষ্ট পাবে না? তার গায়ে লাগবে না? তোকে অপমান করলে কেমন লাগতো?”
” তাই বলে এতোদিন এ নিয়ে পড়ে থাকবে?”
আফসার খান এবার চোখ গরম করে বললেন,
” উল্টো হাতে থাপ্পড় খাবি তুই। নিজের দোষ স্বীকার না করে গলা চওড়া করিস!”
আয়ান একটু দমে গেলো। অসহায় চেহারা বানিয়ে বললো,
” আমি কি নিজের দোষ স্বীকার করছি না? করছি তো। কিন্তু বলছি যে, অতীতের একটা ঘটনা নিয়ে এতো পড়ে থাকলে হয় নাকি!”
” এ বিষয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। শুধু বলে রাখলাম, আগামী শুক্রবার তোর আর মৌ এর বিয়ে। সেভাবে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখ।”
এই বলে আফসার খান চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে নিলেন। কিন্তু আয়ান তাঁর হাত ধরে আটকে নিলো। বাচ্চাদের মতো অসহায় সুরে বললো,
” কিন্তু আব্বু…..ওর প্রতি আমার তেমন কোনো ফিলিংস নেই। ”
আয়ানের এমন চেহারা দেখে আফসারের খানের ভারী মায়া হলো। ছেলের সাথে তাঁর সম্পর্ক খুব একটা গভীর না। বাবা ছেলে যেমনটা হাসিখুশি সময় কাটায়, তেমন সময় কাটাননি তিনি ছেলের সাথে। সবসময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকতেন৷ এজন্য আয়ানের সাথে তাঁর অদৃশ্য এক দূরত্ব তৈরী হয়ে যায়। অবশ্য সময় সুযোগ পেলে তিনি আয়ানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। আয়ানের মনের কথা জানার চেষ্টা করেন। ভালোমন্দ পরামর্শ দেন। আজ তিনি নিজ দায়িত্বে আয়ানের বিয়ে ঠিক করে এসেছেন। তিনি মনে করেন, ছেলের প্রতি তাঁর সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এটাই যে, তাকে একজন ভালো পাত্রী, ভালো সঙ্গী খুঁজে দেওয়া। তিনি এ নিয়ে একদম নিশ্চিত যে, আয়ানের জীবন সঙ্গিনী হিসেবে মৌ একদম উপযুক্ত মেয়ে।
আফসার খান আয়ানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে দিলেন। এরপর এমন একটি কাজ করে বসলেন, যা আয়ান কখনও চিন্তা করেননি।
আফসার খান হুট করে আয়ানের কাঁধে হাত রেখে নরম সুরে বললেন,
” ব্যালকনিতে চল। একটু কথা বলি। ”
আয়ান এখনও বিস্মিত হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সে হালকা মাথা দুলিয়ে বললো,
” আচ্ছা, চলো আব্বু। ”
আফসার খান এবং আয়ান এসে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পরলো। বাইরের আকাশ এখন রাতের অন্ধকারে ডুবে যেতে ব্যস্ত। তবে ব্যস্তময় শহরের প্রতিটি দালানকোঠায় বসবাসরত জনগণের ব্যবহৃত আলো নিকষ কালো আঁধারকে চিঁড়ে এক ঝলক উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। আফসার খান আয়ানের দিকে এক নজর তাকালেন। এরপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে চেয়ে বললেন,
” তোর আম্মু আর আমার বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়। আমি তখন শহরে চাকরি করি। একদিন আমার বাবা আমাকে জরুরি ভিত্তিতে গ্রামে ডেকে পাঠালেন। আমি গ্রামে যাওয়ার পর তিনি আমার হাতে তনিমার ছবি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখ তো মেয়েটাকে চিনিস নাকি? পছন্দ হয়? ওর সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি আমি।’ বাবার প্রথম দুটো কথা আমি স্বাভাবিকভাবে নিলেও শেষ কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। বাবাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে বাবা বললো, আমার ভালোর জন্যই সে তনিমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে৷ ওর ছবি ভালোমতো দেখে পছন্দ হলে যেনো উনাকে বলি। তাহলে বিয়ের কথা একদম পাকাপাকি করে দিবেন৷ এই বলে বাবা চলে গেলেন আমি তনিমার ছবি দেখি৷ কিছুক্ষণ ভালোভাবে ছবিটা দেখার পর চিনতে পারি যে, তনিমা আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি পরেই থাকে। আমি গ্রামে থাকতে ওর সাথে টুকটাক কথাবার্তা হতো। তখন আমার মনে ওর জন্য একটু আধটু অনুভূতি তৈরী হয়েছিলো। তবে সে অনুভূতি স্থায়ী হওয়ার আগেই আমি শহরে চলে আসি। এর কয়েক বছর পর ওর সাথে বিয়ে ঠিক হয় আমার। তখন ওর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি ছিলো না৷ কিন্তু তারপরও বাবার কথায় বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। আর এখন দেখ, বুড়ো বয়স পর্যন্তও ওকে সেই আগেকার মতো ভালোবাসি আমি।” এই বলে তিনি ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেলে আয়ানের দিকে তাকালেন। আয়ান তাঁর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তিনি এর অর্থ বুঝতে পেরে শব্দ করে হেসে বললেন,
” এসব বলার কারণ হলো, আমার আর তোর পরিস্থিতি অনেকটাই একরকম। আমার বাবা বিয়ে ঠিক করেছিলেন আমার পূর্বপরিচিত এক মেয়ের সাথে। তোর ক্ষেত্রেও এমন৷ অবশ্য ফিলিংসের একটু হের ফের আছে৷ সে যাই হোক, যেহেতু আমার আর তোর পরিস্থিতি কিছুটা একই ছিলো, সেহেতু এমনও তো হতে পারে যে, ভবিষ্যতের রূপরেখাও আমাদের দুজনের একই হতে পারে।”
” যদি এক না হয়?”
আফসার খান হালকা হেসে দিলেন। বললেন,
“এটার সম্ভাবনা খুবই কম। ” এই বলে তিনি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। এরপর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
” তোর মনে যে মৌ এর জন্য বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই এটা আমি বিশ্বাস করি না। অবশ্যই কোনো না কোনো অনুভূতি আছে। তবে তুই হয় সেটা উপলব্ধি করতে পারিসনি, নাহয় তুই সেটাকে উপলব্ধি করেও হেলাফেলা করেছিস। এতোটা বছর ধরে তুই মৌ কে চিনিস। কখনও কি মৌ এর জন্য সামান্য ভালোলাগার অনুভূতি তৈরী হয়নি তোর মনে? হ্যাঁ, আমি জানি, সবসময় ওর প্রতি তোর একটা দায়িত্ববোধের সম্পর্ক হয়ে এসেছে। কখনও হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়নি যে পরিস্থিতিতে তুই ওকে পছন্দ বা ভালোবাসতে পারিস৷ কিন্তু বিয়ের পর এটা সম্ভব এবং এর সম্ভাবনা অনেক বেশি। এ সম্ভাবনাকে শতভাগের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে তোর প্রতি মৌ এর ভালোবাসা। ও তোকে ভালোবাসে এবং বিয়ের পর স্বামী হিসেবে ওর প্রতি তোরও ভালোবাসা তৈরী হবে। এটা আমি নিশ্চিত। ”
আয়ান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। আপাতত বলার মতো কিছুই পাচ্ছে না সে। আফসার খান তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
” আজ রাতটা তুই সময় নে৷ মৌ কে নিয়ে ভাব। ওর প্রতি তোর কোনো অনুভূতি আছে কি না বা তৈরী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না সেটা আমাকে জানাবি। তাহলে আমি খুশিমনে তোর বিয়েটা দিতে পারবো। আর হ্যাঁ, এটা একটু মনে রাখিস, এতোদিন যে মেয়েটাকে তুই দেখেশুনে রেখেছিস তার প্রতি সবচেয়ে বড় দায়িত্বটা এখন তোকে পালন করতে হবে। মেয়েটার মান সম্মান রক্ষার্থে তোকেই মাঠে নামতে হবে। ” এই বলে আফসার খান ব্যালকনি হতে বেড়িয়ে চলে গেলেন। আয়ান তখনও সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ যাবত সে আকাশ পানে তাকিয়ে থেকে নিজের বাবার বলা কথাগুলো ভাবতে লাগলো। তার মনে কি আসলেই মৌ এর প্রতি কোনো অনুভূতি আছে? যদি এমনটাই হয় তাহলে সে এ ব্যাপারে জানে না কেনো? নাকি জেনেশুনেও সে তার অবচেতন মনের কথাগুলোকে প্রাধান্য দেয়নি?
আয়ান জানে, মৌ এর দিকে সে সবসময় দায়িত্ববোধের নজরে তাকিয়েছে। কখনও কোনো মেয়ের প্রতি তার তেমন কোনো টান অনুভব হয়নি। তবে মৌ এর প্রতি সবসময় সে একটা টান অনুভব করেছে। মৌ কোনো বিপদের পরলে সে ছুটে চলে গিয়েছে। সাধ্যমত মৌ এর পাশে দাঁড়িয়েছে। মৌ ভুল করলে তাকে ধমকে-ধমকে সঠিক পথে এনেছে। মৌ এর প্রতি সে সবসময় প্রতিরক্ষামূলক আচরণ করেছে। মৌ কে দেখে কোনো অনুভূতির আভাস পেলে সাথে সাথে সে তা পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। এজন্য সময় যেতে যেতে মৌ এর হাসি, মৌ এর সৌন্দর্য তার উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। কারণ সে এসবকে উপেক্ষা করতে পারদর্শী হয়ে গিয়েছিলো। কেননা আজ সে পারদর্শিতাকে পিছে ফেলে দেওয়া হোক? আচ্ছা? তা কি আদৌ সম্ভব? নিজের ভেতর থেকে সেই অনুভূতিশীল আয়ানকে বের করা কি আদৌ সম্ভব? চেষ্টা করা উচিত কি?
এ নিয়ে আয়ান খানিক সময় ভাবলো। তারপর মনের তীব্র মিছিল প্রতিবাদে সে অসহায় হয়ে নিজের ফোন হতে মৌ এর ছবি বের করে নিজের সামনে ধরলো। গভীর মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে সে ছবিটা দেখলো। এরপর ছবিতে মিষ্টি হাসি হেসে দাঁড়িয়ে থাকা মৌ এর উদ্দেশ্যে সে জিজ্ঞেস করলো,
” মৌ? তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিস? আমার মনে হয় তুই রাজি হবি না। তুই যেমন ঢিট মেয়ে…..অবশ্য আংকেলকে তুই তো অনেক ভালোবাসিস। উনার কথা ভেবে হয়তো রাজি হয়ে যাবি। আচ্ছা? তাহলে আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক কি জোরজবরদস্তিমূলক সম্পর্ক হবে? মানে, তুইও আংকেলের কথা ভেবে রাজি হয়ে যাচ্ছিস আর আমিও আব্বুর কথা মেনে রাজি হয়ে যাচ্ছি৷ অদ্ভুত! আমাদের নিজেদের মতামতের কোনো প্রাধান্য নেই! অবশ্য পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো আমাদের নিজেদের মতামতের প্রাধান্য থাকতো। কিন্তু পরিস্থিতি তো বেগতিক। এ বিয়েটা এখন মান সম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটা মানুষই মানসম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে চায়। কেউই মাথা নিচু করে বাঁচতে চায় না। এখন এ বিয়েটা না করায় যদি সমাজে মাথা নিচু করে বাঁচতে জোর করে তাহলে তো বিয়েটা করেই নেওয়া উচিত। ঠিক না মৌ? অবশ্য আমি আমার অনুভূতিকেও প্রাধান্য দিচ্ছি। আমার অনুভূতি কি বলে জানিস? আমার অনুভূতি বলে…….উমম….একটু ভাবতে হবে। রাতে ঘুমানোর আগে বলবো তোকে। আমার অনুভূতিগুলো তো একটু উপলব্ধি করতে হবে তাইনা? সো পরে কথা বলি। ” এই বলে আয়ান মুচকি হেসে ফোনটা পকেটে পুরে মৌ এর ব্যালকনির দিকে তাকালো। মৌ এর রুমের আলো জ্বলছে। ব্যালকনির দরজাও খোলা। পর্দা দেওয়া আছে। আয়ান কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনটা মৌ কে এক ঝলক দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু মৌ এর দেখা মিলছে না…….
বেশ কিছুক্ষণ যাবত অপেক্ষা করার পর আয়ান রুমে চলে যাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মনে মনে। তখনই হঠাৎ ব্যালকনিতে মৌ এর আগমন ঘটলো। মৌ কে দেখে আয়ান বেশ স্বস্তি অনুভব করলো। সে হাত নাড়িয়ে মৌ কে নিজের উপস্থিতির প্রমাণ দিলো। কিন্তু মৌ তা দেখেও না দেখার ভান করে মেকি হাই তুললো। কিছুক্ষণ ভ্রুকুটি করে সে আয়ানকে পর্যবেক্ষণ করলো। আয়ানের এমন নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার ঘটনা এই প্রথম। মৌ এ বিষয়টা খেয়াল করেছে। কিন্তু উপর উপর দিয়ে সে এটাকে পাত্তা দিচ্ছে না।
মৌ এখনও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান মৌ কে কিছু বলবে কি না এই ভাবতে ভাবতে সে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বিস্তৃত এক হাসি দিলো। মৌ তা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে রুমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। তবে রুমে যাওয়ার আগে আয়ানের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা ভেঙচি কাটলো সে। আয়ান এতে থতমত খেয়ে গেলো। মৌ এর কাছে এমনটা মোটেও আশা করেনি সে। মৌ কখনও তার সাথে উঁচু গলায় কথা বলেনি। চোখ গরম করেনি এবং ভেঙচিও কাটেনি। কিন্তু তার অপমান পাওয়ার পর থেকে এর সবটাই করছে সে। অদ্ভুত তো!
.
রাতের শোবার পর আয়ান আবারো মৌ এর ছবির সাথে কথা বলা শুরু করলো,
” আচ্ছা? তোকে আমার বউ হিসেবে কেমন দেখাবে? সুন্দর নাকি খারাপ? উমম…..অবশ্যই সুন্দর দেখাবে। কারণ সবার মুখে শুনেছি তুই দেখতে অনেক সুন্দর। ” এই বলে সে শব্দ করে হেসে ফেললো। আবারো বললো,
” আমি নিজেও উপলব্ধি করেছি তোর ছবিগুলো দেখে। এতো সুন্দর একটা পরী আমাকে ভালোবাসে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তুই হয়তো ভাবতে পারিস, আমি তোর সাথে এতো ভালো ব্যবহার কিভাবে করছি, এতো নরম দেখাচ্ছি কেনো? সো….তোর অবগতির জন্য জানিয়ে দিচ্ছি, আমি সবটা ভেবেচিন্তে আব্বুকে বিয়েতে রাজি হওয়ার কথা বলে এসেছি। আর নরম হওয়ার কথা বললে বলবো, আমি সবসময়ই নরম। তবে রাগ উঠলে আমি গরম হয়ে যাই। আর এ রাগটা ক্ষেত্র বিশেষে আসতে সময় নেয়, আবার ক্ষেত্র বিশেষে হুটহাট চলে আসে। সে যাই হোক, যেহেতু পরিস্থিতির শিকার হয়ে তোকে বিয়ে করতেই হচ্ছে সেহেতু তোর প্রতি নরম হতেই হবে। অবশ্য এ কয়দিন তোর পিছনে আমাকে যা ঘুরিয়েছিস! তাতে তো আমার নরম মনের পরিচয় পেয়েই গিয়েছিস৷ এখন……তোর আর আমার বিয়ে হবে। সো, তোর প্রতি আমার অনুভূতিগুলোকে বুঝতে হবে। প্রাধান্য দিতে হবে। উফ….. যেখানে তোকে শাসন করল নিজের নিচে রাখতাম সেখানে তোকে এখন আমার বরাবরে রাখতে হবে। হয়তো তোর কথায় উঠবস করতে হবে। কি এক সম্পর্ক হয়ে যাবে আমাদের! বন্ধুর বোন হতে সোজা বউ! যাই হোক, অনেক কিছু মানিয়ে চলতে হবে আমাকে। অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। তবে এটফার্স্ট, তোর কাছ থেকে ক্ষমাটা চেয়ে নিতে হবে। এখনও, আমি এটা ভুলিনি যে তুই আমাকে ক্ষমা করতে পারিসনি। তো, আজকে এ পর্যন্তই কথা বলা। তোর সামনাসামনি হয়ে অনেক কথাই বলবার আছে। দেখা যাক, সুযোগ পাই কি না।” এই বলে আয়ান হালকা হেসে ফোনটা রেখে দিলো। কিছুক্ষণের মাঝেই পাড়ি দিলো ঘুমের রাজ্যে।
.
সকল রীতিনীতি মেনে মৌ কে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেলো অহনা। অহনা প্রথম প্রথম এ বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করলেও পরে সবটা হাসিমুখে মেনে নেয় এই বিশ্বাস করে যে, আজ নয়তো কাল আয়ান এবং মৌ এর মধ্যকার ঝগড়ার মিমাংসা হবেই হবে৷ সেদিনকার পরের দিন আয়ান, মৌ এর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো। সে কথা তো বলতে পেরেছিলো তবে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সে বলতে পারেনি। এর পরের দিন যখন দু বাড়ির হলুদের আয়োজন একসাথে করা হলো, তখন আয়ান মৌ কে জিজ্ঞাস করেছিলো, “তাহলে ক্ষমা করেছিস আমাকে?” তখন মৌ মুখ ঝামটা মেরে জবাব দিয়েছিলো, “বিয়ে করছি এর মানে এই না যে আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।” এই বলে সে আর কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েছিলো। আয়ান পরবর্তীতে আর কিছু বলতে পারেনি।
আয়ান আর মৌ এর বিয়ে নিয়ে পরিচিত কয়েকজন সন্দেহ প্রকাশ করেছিলো। তবে তাদের সন্দেহকে নানারকম মিথ্যা কথা বলে দূর করে দেওয়া হয়। সবদিয়ে বিয়েটা তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই হয়ে যায়।
অহনা, মৌ কে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে চলে আসার পর পরই আয়ান রুমে ঢুকে যায়। আয়ানের রুমে প্রবেশের আগে অহনা আয়ানকে হাসিমুখে বেস্ট অফ লাক জানিয়েছে। কারণ সে আয়ানকে ক্ষমা করে দিয়েছে। এখন মৌ এর পালা। এ নিয়ে অহনা একটু সন্দেহ প্রকাশ করলেও সে জানে, মৌ অতি শীঘ্রই আয়ানকে ক্ষমা করে দিবে। তবে সে মৌ এর মনের কথা তো জানে না। মৌ বিয়েতে রাজি হওয়ার পরপরই মনে এঁটে নিয়েছিলো, আয়ানকে আরো নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে সে। প্রতিটা কষ্টের হিসাব নিবে সে।
আয়ান রুমে এসেই দেখলো মৌ এক এক করে বিয়ের গহনা খুলছে। সে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মৌ কে বললো,
” অনেক ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিস তাই না? তোর সাথে কিছু কথা বলার ছিলো। কিন্তু আজকে আর তা বলা হলো না৷ কালকে বলবো। আপাতত আমি ঘুম দেই।” এই বলে সে কাত হয়ে শুয়ে পরলো। মৌ গহনা খুলতে খুলতে আয়ানের দিকে ফিরে নরম সুরে বললো,
” আগে শেরওয়ানি খুলে নিতেন৷ নষ্ট হয়ে যাবে তো। আর আপনার ঘুমাতেও অসুবিধা হবে। ”
মৌ এর কথায় আয়ানের টনক নড়লো। সে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে বললো,
” হুম। তা ঠিক বলেছিস। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো তো, তাই অমনিই শুয়ে পরেছিলাম। ” এই বলে সে আলমারি হতে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। দশ মিনিট বাদে সে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো। মৌ তখন মেকাপ উঠাতে ব্যস্ত। আয়ান এক নজর মৌ এর দিকে তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো।
কিছুক্ষণ বাদে, মৌ আয়ানের কাছে এসে নরম সুরে বললো,
” বিছানা থেকে উঠুন৷ আপনার জন্য ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে শোবার ব্যবস্থা করেছি। ”
আয়ান মাত্রই ঘুমের জগতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলো। তবে মৌ এর কথায় সে কাঁচা ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
” কি বলছিস তুই?”
মৌ জোরপূর্বক মেকি হাসি দিয়ে বললো,
” যা বলেছি ঠিক বলেছি। আপনার বিছানা ফ্লোরে হবে। ”
আয়ান এবার খানিকটা রেগে গেলো। এভাবে কারোর কাঁচা ঘুম ভাঙানো হলে সে অবশ্যই রেগে যাবে। আয়ানও এর ব্যতিক্রম নয়। খানিকটা রাগত স্বরে সে বললো,
” এসবের মানে কি?”
মৌ এবার যেনো নিজের আসল রূপে ফিরে এলো। চোখ গরম করে, গাল দুটো শক্ত করে সে বললো,
” এসবের মানে হলো, আপনি নিচে ঘুমাবেন।”
আয়ান বিস্মিত হয়ে বললো,
” আমি নিচে ঘুমাতে যাবো কোন দুঃখে! তোর মাথা ঠিক আছে?”
” অবশ্যই ঠিক আছে। আমি আপনার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবো না বলেই আপনার বিছানা ফ্লোরে বিছিয়ে দিয়েছি।”
আয়ান এবার তড়াক করে উঠে বসলো। চোখ কপালে তুলে বললো,
” বিয়ে হয়েছে, তো এক বিছানায় ঘুমাতে কি প্রবলেম! ”
মৌ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” আমার অনেক প্রবলেম। আপনি বিছানা থেকে না নামলে খারাপ হবে বলে দিলাম। ”
আয়ান তেড়ে গিয়ে বললো,
” কি খারাপ হবে শুনি?”
মৌ ভ্রু নাচিয়ে বললো,
” আপনাকে এখনও ক্ষমা করেনি, মনে আছে আপনার? আমার ক্ষমা না পেলে বলে আপনি নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে থাকবেন।”
আয়ান কথার মোড় ধরতে না পেরে বললো,
” হুম, মনে আছে। তুই হঠাৎ এ কথা আনছিস কেনো?”
” আপনি আমার কথা না শুনলে আপনাকে কখনই ক্ষমা করবো না আমি।”
মৌ এর কথা শুনে আয়ান যেনো আকাশ থেকে পরলো। সে তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে মৌ এর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে পরলো। কণ্ঠে আকাশ সমান বিস্ময় নিয়ে বললো,
” তুই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছিস!”
মৌ দু হাত বুকে গুঁজে ভাব নিয়ে বললো,
“যা ভাববার ভাবুন। আপনি আজ নিচে না ঘুমালে আমার কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার আশা ছেড়ে দিন। আর সারাজীবন গিল্ট নিয়েই বাঁচুন।”
আয়ান এবার খানিকটা রেগে গেলো। বললো,
” সেদিনকার ঘটনা নিয়ে আর কতদিন পরে থাকবি তুই? দু সপ্তাহ হয়ে গেলো প্রায়। এখনও তুই ঐ ছোট্ট ঘটনাকে ভুলতে পারছিস না কেনো? এক প্রপোজের…….”
মৌ মেজাজ এবার দপ করে জ্বলে উঠলো। প্রচণ্ড রাগ নিয়ে সে বললো,
” আপনার জন্য ছোট্ট ঘটনা হতে পারে। কিন্তু আমার জন্য না৷ আপনাকে প্রপোজ করেছিলাম বলে আপনি ওভাবে সবার সামনে আমাকে অপমান করেছিলেন৷ এ ঘটনা আমার ক্লাসমেটদের কানে পৌঁছানোর পর তারা আমাকে নিয়ে কত কথা বানিয়েছে জানেন? আমাকে নিয়ে সবার সাথে হাসাহাসি করেছে। এসব কিভাবে সহ্য করেছি আমিই জানি৷ আর আপনি বলছেন, ছোট্ট একটা ঘটনা! এরপর থেকে নিজের উপর প্রচণ্ড রাগ হতো আমার। শুধু নিজেকে দোষারোপ করতাম আমি। কেনো সেদিন আপনাকে প্রপোজ করেছিলাম! কেনো আপনাকে আগে ভালোবেসে ছিলাম৷ আপনাকে ভালো না বাসলে আজ এ দিন দেখতে হতো না আমাকে।” এই বলে মৌ চোখের কোলে জমে থাকা নোনাজল মুছে ফেললো। কথা বলতে বলতে সে কান্না করছিলো। আয়ানের এ দেখে ভারী মায়া হলো। সে মৌ এর দিকে এগিয়ে নরম সুরে বললো,
” সরি মৌ। আমি আসলে ওভাবে বলতে চাইনি। ”
মৌ মুখ ঝামটা মেরে বললো,
” আপনার সরি শুনতে চাইনি আমি। চুপচাপ নিচে শুয়ে পরুন৷ আমি বেশ টায়ার্ড আজকে। এখন চেঞ্জ করে এসে ঘুমিয়ে পরবো। ”
এই বলে সে চেয়ারের উপর থেকে থ্রিপিছ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। এদিকে আয়ান অসহায় দৃষ্টিতে একবার ফ্লোরের দিকে তাকালো এবং আরেকবার খাটের দিকে তাকালো। নিজেকে বড্ড নিরুপায় লাগছে নিজের কাছে। প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে দাঁতে দাঁত চেপে ফ্লোরে শুয়ে পরলো আর মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে উদ্ধার করে ফেললো। (নোট: কেউ নিচের নোট দেখে না বলে বাধ্য হয়ে এখানে লিখতে হচ্ছে। আমি সেই ৪নং পার্টেই বলে দিয়েছিলাম, বর্ষার অংশ আমি ডিলিট করে দিয়েছি। বর্ষা নামের কেউ নেই গল্পে। এরপরও সবাই বলে, আয়ানের তো গার্লফ্রেন্ড আছে!🤦♀️🤦♀️ তাদের আর কি বলবো….🤦♀️)
জহির ইসলাম নির্বাক বসে রইলেন। আফসার খান খানিক সময় পর বললেন,
” আমি ভেবেচিন্তেই প্রস্তাবটা দিলাম জহির ভাই। যেহেতু আয়ান আর মৌ কে নিয়ে বদনাম ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা আছে। সেহেতু বিয়ের মাধ্যমেই একে আটকানো সম্ভব৷ আর মুখে বলে কয়জনের মুখ বন্ধ করা যায় বলুন? আমরা হাজার সাফাই গাইলেও তারা কোনো না কোনো খুঁত ধরবে। এমন পরিবেশে একজন মেয়ে হিসেবে বেঁচে থাকা খুব কষ্ট। আমরা যত যা-ই বলি না কেনো, যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় সেই হাড়ে হাড়ে টের পায়। ”
এই বলে আফসার খান কিছুক্ষণ থামলেন। হালকা হেসে বললেন,
” মৌ কে ছোট থেকেই চিনি। ওর মতো নম্র, ভদ্র মেয়েকে যে কেউ নিজের বাড়ির বউ করতে চাইবে। যেখানে আমি ওর সম্পর্কে সবটা জানি সেখানে এ বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াটা ঠিক বলেই মনে করে আমি৷ মৌ এর বিয়ে যদি হৃদয়ের সাথে ঠিক না হতো তবে কোনো না কোনো একদিন আমি আয়ানের জন্য মৌ এর হাত চাইতে আসতাম। এই দুজনার মধ্যকার প্লাস পয়েন্ট হলো, এরা একে অপরকে চিনে-জানে। এক্ষেত্রে দুজনের বিয়ে হওয়াটা লাভজনক। বুঝতে পারছেন ভাই?”
জহির ইসলাম চিন্তিত মুখে বললেন,
” বুঝতে পেরেছি৷ মৌ এর মামা, খালু আর চাচাকে ডাকি এখানে। ওদের সাথেও এ বিষয়ে সলাপরামর্শ করা দরকার।”
” হুম। ঠিক বলেছেন। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে কথাবার্তা বলে একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। আপনি উনাদের ডাকুন।”
জহির ইসলাম জান্নাতকে নিজের রুমে ডেকে বললেন, মৌ এর মামা, খালু, চাচাকে যেনো এ রুমে আসতে বলে সে। শ্বশুরের আদেশ পেয়ে জান্নাত তৎক্ষনাৎ রুম থেকে বেড়িয়ে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনলো। সবাই রুমে এলে প্রায় আধ ঘণ্টার আলাপ-আলোচনা শেষে সকলেই আফসার খানের প্রস্তাবের সাথে মত প্রকাশ করলেন। এরপর আয়ান এবং মৌ এর বিয়ের ব্যাপারে কিছু প্রস্তুতিমূলক কথাবার্তা বলেই আফসার খান উঠে পড়েন৷
আফসার খান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর জহির ইসলাম বাসার বাকি সদস্যদের নিজের রুমে ডেকে পাঠালেন। আয়ান এবং মৌ এর বিয়ের কথা বলতেই মৌ স্তব্ধ চাহনিতে জহির ইসলামের দিকে তাকালো। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” সবকিছু জানার পরও আয়ান ভাইয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলে কি ভেবে আব্বু?”
জহির ইসলাম ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন,
” সবকিছু জেনেই তো এ সিদ্ধান্ত নিলাম। আর আয়ান তোকে সেদিন অপমান করেছিলো ঠিকই৷ পরে তো সেই অপমানের জন্য তোর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। তুই ওকে ক্ষমা করে এ বিয়েতে রাজি হয়ে যা।”
মৌ কিছু না বলে মুখ ঝামটা মেরে নিজের রুমে চলে এলো। রুমে এসেই সে দরজা বন্ধ করতে নিলো। তবে তার আগেই জান্নাত, মাহতাব, অবন্তিকা ইসলাম এবং মৌ এর খালা ও চাচি এসে উপস্থিত হলেন তার রুমে। তাদেরকে রুমে দেখেই মৌ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
” তোমাদের কোনো কথাই শুনতে চাই না আমি। আমাকে একটু একা একা থাকতে দাও।”
অবন্তিকা ইসলাম নরম স্বরে বললেন,
” আমাদের কথাবার্তা শোনার পর যা মন চায় তাই করিস। ”
মৌ কিছু বলতে যাবে তার আগেই মাহতাব বললো,
” আমাদের মতামত আগে শুনে নে। ”
মৌ ধপ করে বিছানায় বসে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” যা বলার দ্রুত বলো। আমার কিছুই ভালো লাগছে না৷ ”
মৌ এ কথার প্রেক্ষিতে মাহতাব কিছু কথা শুনিয়ে দিতে চেয়েছিলো তাকে। তবে পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো নেই বলে সে মূল কথায় চলে এলো। বললো,
” আয়ানকে বিয়ে করতে তোর সমস্যা কোথায়?”
মৌ ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,
” সমস্যা কি জানো না? আমি আমার মনে কথা আয়ানকে ভাইয়াকে বলেছিলাম বলে উনি আমাকে সবার সামনে ওভাবে অপমান করে দিলেন। ভাইয়া, তুমি জানো, এভাবে অকারণে কারোর অপমান আমি সহ্য করি না। ”
” সে তো নিজের কাজের জন্য গিল্টি ফিল করেছে। তোর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। ”
” এতো সহজে আমি উনাকে ক্ষমা করে দিবো ভাবলে কি করে! আমি কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে চলছি তা আমিই জানি। ছোট থেকেই উনাকে একটু একটু করে পছন্দ করতে করতে একপর্যায়ে উনাকে ভালোবেসে ফেললাম। এটা যে শুরু থেকে বুঝতাম তা নয়৷ ধীরেধীরে এটা উপলব্ধি করেছি। যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি আমি উনাকে ভালোবাসি, তখন থেকেই উনার প্রতি ভালোবাসা তীব্র হতে থাকে, গাঢ় হতে থাকে। এর মাঝে উনি আমাকে এভাবে অপমান করে বসে! আমি যে এখনও উনাকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছি তা নয়। উনাকে এখনও ভালোবাসি আমি। কিন্তু আমার নিজের সেল্ফ রেসপেক্ট আছে। যে আমাকে অপমান করেছে তার সাথে আমি সারাজীবন কিভাবে কাটাতে পারি? ভরসা নেই, ভবিষ্যতেও পরিস্থিতির শিকার হয়ে উনি রেগে আমাকে অপমান করে বসলেন৷ তখন কি কষ্টের হবে আমার ভাবতে পেরেছো?” এই বলে মৌ নিঃশব্দে দুফোঁটা চোখের জল ফেললো। মাহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম সুরে বললো,
” স্বাভাবিক সময় হলে এ বিয়েতে আমিই সবচেয়ে খুশি হতাম। একজন ভাই কি চাইবে না তার বোন সারাজীবন সুখী থাকুক? সে কি চাইবে না তার অনুপস্থিতিতে কেউ একজন তার বোনকে সবসময় বিপদ হতে আগলে রাখুক? আয়ান এর সবটা করতে পারবে। ওর কাছে তোকে দিয়ে আমরা সবাই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। এতোটা বছর ওর সাথে থেকেছি। ওকে কি আমি চিনি না?”
মৌ কিছু বলতে চাইলো। তবে মাহতাব তার দিকে হাত উঁচিয়ে চুপ থাকতে বললো। খানিক বাদে সে বললো,
” তুই নিজেই চিন্তা কর, আয়ান তোর খেয়াল রাখেনি? যখন আমি শহরের বাইরে থাকতাম তখন তোর প্রতিটা প্রয়োজন নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী পূরণ করেছে ও। তোর ভুলের জন্য সুযোগ বুঝে তোকে শাসনও করেছে আবার তোর খেয়ালও রেখেছে। হ্যাঁ, মানছি ওর রাগটা বেশি। রাগের মাথায় সে অনেক কিছু বলে ফেলে। তবে সময়মতো নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমাও তো চায় সে…….. তাহলে তোর এতো সমস্যা কোথায়?”
মাহতাবের কথা শেষ হতে না হতেই অবন্তিকা ইসলাম কাতর গলায় বললেন,
” মৌ? তোর বাবার অবস্থা দেখেছিস? আল্লাহর রহমতে আজকে হার্ট এটাক হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন উনি৷ এরপর আল্লাহ না করুক যদি উনার কিছু হয়ে যায় তখন?”
বাবার কথা চিন্তা করতেই ভয়ে মৌ এর বুক ধক করে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নেওয়াও ভুলে গেলো সে। বাবা মা’র মধ্যে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে নিজের বাবাকে। বাবার কিছু হয়ে গেলে সে কি করে টিকে থাকবে!
অবন্তিকা ইসলাম আবারো বললেন,
” এই ঘরের মধ্যেই হৃদয়ের বাবা মায়ের কথার তীর উনার বুকে কিভাবে বিঁধেছে খেয়াল করেছিস? তাহলে আগামী শুক্রবার তোর ঠিক হওয়া বিয়ে না হলে মানুষজনের কটু কথা উনি কিভাবে সইবেন? তুই জানিস, মানুষজন উনাকে কথা শোনাবেন, এমনটা উনি কিছুতেই চান না। যেখানে উনার কোনো দোষ নেই তারপরও তুই আমাদের মেয়ে হওয়ার খাতিরে উনাকে কথা শুনতে হবে। বুঝতে পারছিস পরিস্থিতিটা?”
মৌ নির্বাক বসে রইলো। তার কিছু বলার নেই। অবন্তিকা ইসলামের প্রতিটা কথা যে সত্য তা সে জানে৷ তাহলে এখন কি করবে সে?
অবন্তিকা ইসলাম মৌ এর দিকে তাকিয়ে আবারো বললেন,
” এ ঘটনার পর থেকে অন্য কোনো ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেওয়াটা খুবই কঠিন কাজ হয়ে পড়বে আমাদের জন্য। এমনও হতে পারে যে, তোর বিয়ের বয়স ফুরিয়ে আসছে, অথচ তোর বিয়েই হচ্ছে না৷ তখন আমরা কি করে সহ্য করবো এটা? সব বাবা মা-ই চায় তার মেয়ে ভালো পরিবারের বিয়ে করে সুখী হোক। সেখানে তোকে আমরা একা দেখবো কি করে?”
অবন্তিকা ইসলামের কথা শেষ হতেই জান্নাত বললো,
” এ বিয়ের ক্ষেত্রে তোমাকে কোনো ধরণের এডজাস্টমেন্ট করতে হবে না৷ কারণ আয়ানের পরিবার তোমার সকল পরিস্থিতি সম্পর্কে জানবে। আর ভালোবাসার কথা বললে বলবো, এ বিয়ের ক্ষেত্রে তোমার সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তুমি আয়ান ভাইয়াকে ভালোবাসো। হ্যাঁ, এখন পরিস্থিতির সাপেক্ষে সে ভালোবাসায় হয়তো ক্ষণস্থায়ী কিছু ধুলোময়লা এসে পড়েছে৷ এর মানে এই নয় যে সারাজীবন এমনটা থাকবে। কোনো না কোনো একদিন এ মান অভিমান ঘুচবেই। আর এমনটা হতেও সময় লাগবে না যে, আয়ান ভাইয়াও তোমাকে ভালোবেসে ফেলবেন!”
মৌ মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। মৌ এর খালা অবন্তিকা ইসলামের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
” আপা, মৌ কে কিছু সময় দেওয়া উচিত। এতক্ষণ সবাই যা যা বললো, সবটাই তো ও শুনেছে। এবার ওকে একটু ভাবনাচিন্তা করার জন্য সময় দেওয়া হোক।”
বোনের কথায় অবন্তিকা ইসলাম উঠে এলেন। বাকি সবাইকে চোখের ইশারায় উঠে আসতে বললেন। রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় অবন্তিকা ইসলাম মৌ এর উদ্দেশ্যে বললেন,
” একটা মেয়ের সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় বিয়ে সমাজের সামনে তার বাবা মায়ের মাথা তুলে দিতে পারে। আবার একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙা, ডিভোর্সি হওয়া সমাজের সামনে তার বাবা মায়ের মাথা একদম নিচু করে দিতে পারে। আমাদের মেয়ে হিসেবে তোর যেটা ভালো মনে হয় সেটা করিস।”
কিছুক্ষণ আগে ডক্টর এসে জহির ইসলামকে দেখে গিয়েছেন। উপরি পরীক্ষায় তিনি যতটুকু জানতে পেরেছেন, জহির ইসলামের অ্যানজাইনা এটাক হয়েছিলো। আর কিছুক্ষণ সময় এমন থাকলে তিনি নিশ্চিত হার্ট এটাক করতেন। সময়মতো বিশ্রাম এবং ওষুধ খাওয়ায় তিনি হার্ট এটাক হতে বেঁচে গিয়েছেন।
জহির ইসলামকে বিশ্রামে রেখে একে একে সকলে ড্রইংরুমে এসে বসলো৷ সকলের চোখেমুখে এ মূহুর্তে দুশ্চিন্তা এসে ভর করেছে। তাদের দুশ্চিন্তার কারণ আপাতত দু’টো। প্রথমত, জহির ইসলামের শারীরিক অবস্থা। দ্বিতীয়ত, মৌ এর বিয়ে। আশেপাশের একটু কাছের পরিচিত মানুষেরা জানে, মৌ এর বিয়ে আগামী শুক্রবার। আর এলাকার পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে যাদের সাথে সম্পর্ক ‘কেমন আছেন’ পর্যন্ত তাদের আজকাল মিলে দাওয়াত দেওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু মৌ এর বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না৷ আপাতত সবাই এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে, সবাইকে মৌ এর বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে কি বলা হবে। একটা মেয়ের বিয়ে ভাঙা মোটেও কম কথা নয়। যারা কোনোদিন কথা বলেনি, এ সুযোগে তারাও মেয়েকে এবং মেয়ের পরিবারের সদস্যদের কথা শুনিয়ে দিতে পিছপা হয় না৷ সমাজটাই এমন!
থমথমে নিস্তব্ধ পরিবেশের বুক চিড়ে হঠাৎ মাহতাব ঠাণ্ডা গলায় মৌ এর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
” তুই আয়ানকে ভালোবাসিস?”
মাহতাবের প্রশ্নে সকলে নড়েচড়ে বসলো। রুমে উপস্থিত প্রতি জোড়া চোখ মৌ এর উপর আবদ্ধ হলো। না চাইতেও ভয়ে চুপসে গেলো মৌ। ফলস্বরূপ কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো সে৷ তার নিশ্চুপ ভঙ্গি দেখে মাহতাব আগের মতোই একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো তার দিকে৷ এবারও মৌ কিছু বললো না৷ হঠাৎ করে সে কেমন যেনো মাহতাবকে ভয় পাচ্ছে। হয়তো তার-ই এই ভয়কে সত্য প্রমাণিত করতে মাহতাব গর্জে উঠলো। ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” কথা বলা কি ভুলে গিয়েছিস তুই? দুইবার একই প্রশ্ন করলাম। অথচ এর জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে আছিস! ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করতে ভয় করছে? হুম? ওকে ভালোবাসার আগে তোর এ ভয়টা হয়নি? বল আমাকে।”
মাহতাবের প্রতিটা কথা কাঁটার মতো মৌ এর শরীরে বিঁধলো যেনো। সে বসে থাকা অবস্থাতেই শিউরে উঠলো। জান্নাত মৌ এর অবস্থা দেখে গরম চোখে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
” এতোগুলো মানুষের সামনে বোনের উপর এভাবে চেঁচাচ্ছো কেনো? শান্ত হয়ে কথা বলো। ”
মাহতাব, জান্নাতের কথা কানে তুললো না৷ উল্টো সোফা ছেড়ে উঠে তেড়েমেরে মৌ এর গায়ে হাত তুলতে নিলো৷ তবে তার আগেই তার মামা মাহতাবকে শক্ত করে ধরে ফেললেন। রাগত স্বরে তিনি মাহতাবকে বললেন,
” তোর এতো রাগ কোথা থেকে আসলো? শান্ত হয়ে কথা বলা যাচ্ছে না? এতো বড় মেয়ের গায়ে তুই হাত তুলতে যাচ্ছিলি কোন সাহসে?”
মাহতাব তার মামার কথার তোয়াক্কা করলো। সমস্ত শক্তি দিয়ে মৌ এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। তার এ অবস্থা দেখে আয়ান দ্রুত নিজের জায়গা হতে এগিয়ে এলো। মাহতাবকে ধরে সে বললো,
” পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে কথা বল মাহতাব। আংকেলের অবস্থা ভালো না। আবার মৌ এর…..”
আয়ানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মাহতাব গর্জে উঠে বললো,
” তুই চুপ থাক। তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর আর মৌ এর জন্যই আজ আব্বুর এ অবস্থা। ”
আয়ান বিস্মিত হয়ে বললো,
” আমার জন্য কি হলো!”
” তোর জন্য কি হলো, এটা আবার জিজ্ঞাস করছিস!! মৌ কে ওভাবে ক্লাসরুমে না নিয়ে গেলে আজ এতো কাহিনি হতো না। শুধু শুধু ওরা মৌ কে সন্দেহ করলো!”
” সিরিয়াসলি মাহতাব! তুই এখনো ঐ হৃদয়কে সাপোর্ট করছিস? ওর তো সন্দেহ বাতিক আছে। যেদিন মৌ কে দেখতে আসে, সেদিন আমাকে জিজ্ঞাস করেছিলো, আমার আর মৌ এর মধ্যে কিছু আছে কি না৷ তাহলে বল, সেদিনই যদি সন্দেহ করে তাহলে বাকি জীবন তো মৌ এর প্রতি সন্দেহ করতে করতেই তার সময় কাটবে।”
” আমি হৃদয়ের পক্ষ নিচ্ছি না৷ তোর আর মৌ এর ভেতরকার সম্পর্কের কথা জানতে চাচ্ছি। ” এই বলে সে মৌ এর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” আর একবার জিজ্ঞাস করবো শুধু। জবাব দিলে ভালো। না হলে……..
তুই আয়ানকে ভালোবাসিস? ”
মৌ এবার মাথা তুলে চোখজোড়া অবনত রেখে বললো,
” ভালোবাসতাম। এখন ভালোবাসি না।”
মৌ এর কথা শুনে আয়ানের বুক ধক করে উঠলো। সে নিষ্পলক মৌ এর তাকিয়ে রইলো। সে অনুভব করছে, কোথাও এক সুক্ষ্ম ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে তার। এদিকে মৌ মুখে এমনটা স্বীকার করলেও সে জানে, এখনও সে আয়ানকে ভালোবাসে। আয়ানকে পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পারছে না সে। আয়ানের প্রতি নিজের ভালোবাসাকে ঘুচিয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে না৷
মাহতাব বললো,
” এ কথাটা আমাকে আগে বলা যেতো না? তাহলে হৃদয়……”
মাহতাবকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জান্নাত বললো,
” এসব কথা ভাইকে বলা যায় নাকি?”
” তো কাউকে তো বলবে……”
” বলেছে তো। আমি আর অহনা জানতাম। ”
মাহতাব বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” তুমি জানতে! ”
” হ্যাঁ, এসব বিষয়ে মানুষ ফ্রেন্ড, কাজিন, ভাবীর সাথেই শেয়ার করে। ভাইয়ের সাথে শেয়ার করে না।”
মাহতাব আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই অবন্তিকা ইসলাম কাতর গলায় বললেন,
” দোহাই লাগে, তোরা চুপ হো। তোদের বাবা যে ঐ রুমে শুয়ে আছে, এটা তোদের মাথায় নেই? কখন থেকে চেঁচিয়ে যাচ্ছে! আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি। ”
অবন্তিকা ইসলামের কথা শুনে মাহতাব একদম চুপ হয়ে গেলো, আর মৌ মাথা নিচু করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর আফসার খান সোফা ছেড়ে উঠে বললেন,
” আমরা এখন আসি তাহলে। বিকেলের দিকে জহির ভাইকে দেখতে আসবো আমি।”
এই বলে তিনি দরজার দিকে পা বাড়ালেন। তাকে অনুসরণ করে আয়েশা খান, তনিমা খান, আয়ান এবং অহনা বেড়িয়ে গেলো।
.
সন্ধ্যার দিকে আফসার খান এসে জহির ইসলামের পাশে বসে পরলেন। জহির ইসলামের শরীর আগের তুলনায় কিছুটা ভালো। মোটামুটি সুস্থতা বোধ করছেন তিনি। রুমে আপাতত আফসার খান এবং জহির ইসলাম আছেন। দুজন দুজনার হালচাল জিজ্ঞাস করার পর হঠাৎ জহির ইসলাম বলে উঠলেন,
” আফসার ভাই? মেয়ের বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে কি বাইরের মানুষজনের কাছে খবর চলে গিয়েছে?”
আফসার খান চিন্তিত মুখে বললেন,
” এখনো খবর ছড়ায়নি। কিন্তু ছড়াতে কতক্ষণ? আজ না হোক, কাল না হোক, পরশু তরশু ঠিকই জেনে যাবে সবাই।”
জহির ইসলাম তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
” তা ঠিক বলেছেন। পরশুদিন হলুদের আয়োজনের সাজসজ্জা এবং বিয়ের সাজসজ্জা না দেখলে সবার সন্দেহ এমনিতেই হবে।”
এই বলে তিনি কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বললেন,
” হৃদয় ছেলেটা এমন জানলে কখনও বিয়ে ঠিক করতাম না। প্রথমদিনই আমার মেয়েকে নিয়ে সে সন্দেহজনক প্রশ্ন করে। এ নিয়ে অবশ্য আজ বিকেলে আমি আর অবন্তিকা কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই…..” এই বলে তিনি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আফসার খান তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
” আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। যা হওয়ার তা তো হয়ে গিয়েছে। এখন ওসব নিয়ে চিন্তা না করে সামনের দিনগুলোতে কি করবেন তা নিয়ে ভাবুন।”
” সেটা নিয়েই ভাবছি৷ এলাকার সবার সামনে আমার মানসম্মান তো শেষ হয়ে যাবে একেবারে। আমাকে দেখলেই হয়তো সবাই বলাবলি শুরু করে দিবে, উনার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে না? শুনলাম উনার মেয়ের চরিত্র নিয়ে……”
এই বলতে বলতেই জহির ইসলাম কান্নায় ভেঙে পরলেন। আফসার খান কাতর গলায় বললেন,
” ভাই…কান্না করবেন না। আপনি শক্ত না থাকলে বাসার বাকি সবার অবস্থা কি হবে? এমনিতেই তারা আপনার শরীর নিয়ে চিন্তায় আছে। ”
আফসার খান নিশ্চুপ ভঙ্গিতে বসে রইলেন। এদিকে জহির ইসলাম নিঃশব্দে কাঁদছেন বেশ কিছুক্ষণ ধরেই৷ তাঁর কান্না কিছুটা কমে এলে তিনি নিচু গলায় বললেন,
” আমার মেয়ে এমন কিছু করবে তা কখনও চিন্তা করিনি আমি৷ ”
আফসার খান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
” মেয়ের কোনো দোষ নেই ভাই। তার একজনকে পছন্দ হতেই পারে। দোষ তো আমার ছেলের। সে ভালোমতো মৌ কে না বুঝিয়ে অপমান করে গিয়েছে। পরে অবশ্য এর জন্য সে মৌ এর কাছে ক্ষমাও চেয়েছে। যদিও মৌ ওকে এখনও অব্দি ক্ষমা করেনি। ”
” দোষ দুপক্ষেরই আছে। তবে আমরা যা-ই বলি না কেনো, হৃদয়ের পরিবার আজ যেমন অপমানিত হয়ে গিয়েছে এর রেশ ধরে তারা আমার মেয়ে আর আয়ানকে নিয়ে নানা মিথ্যা কথা রটিয়ে দিতে পারে। এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ এজন্য আমি চিন্তায় আছি, মৌ এর বিয়ে নিয়ে। আগামী শুক্রবার ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে এভাবে ভেঙে যাওয়ার কথা শুনে আমার মুখে সবাই যেমন থু থু দিবে। তেমন মৌ কেও ছাড় দিবে না তারা। এরপর ওর জন্য ছেলে দেখতে নিলে, বিয়ে দেওয়াতে নিলেও আজকের এ কলঙ্কের জন্য সব শেষ হয়ে যাবে। আমার মেয়ের আর বিয়ে হবে না৷ কে করবে এমন কলঙ্কিত মেয়েকে বিয়ে? সবাই তো ওর অতীত নিয়ে ওকে কথা শুনাবে। ” এই বলে জহির ইসলাম মাথায় হাত রাখলেন।
আফসার এ মূহুর্তে গভীর চিন্তায় ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকবার পর তিনি হুট করে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন,
” মৌ কে আমাদের বাড়ির বউ করতে চাই৷ আপনার আপত্তি না থাকলে…….”
হারুন সাহেবের প্রশ্ন শুনে আয়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। তাঁর এমন প্রশ্নের কোনো আগামাথা না পেয়ে আয়ান চোখমুখ কুঁচকে জিজ্ঞাস করলো,
” কি বলছেন আংকেল? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। পরিষ্কারভাবে বলুন।”
আয়ানের অবুঝ রূপ দেখে শায়েলা বেগম উঠে এলেন৷ মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
” এতোদিন তুমি আর মৌ প্রেমলীলা চালিয়ে এখন আমার ছেলের ঘাড়ে মৌ কে চাপিয়ে দিতে চাইছো?”
শায়েলা বেগমের কথা এহেন কথায় ড্রইংরুমে ছোটখাটো একটা বোম ফাটলো যেনো। মূহুর্তেই সবার কানাকানি বন্ধ হয়ে গেলো। হৃদয় এবং তার বাবা মা বাদে সকলেই স্তব্ধ চাহনিতে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। মৌ নিজের কান’কে বিশ্বাস করাতে পারছে না৷ তার দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে সে মাটিতে লুটিয়ে পরবে। এদিকে জহির ইসলাম, হারুন সাহেবের মুখে এমন নিচু কথা শুনতে পাবে, তা তিনি কখন চিন্তাও করেননি। তাঁর বুকে ব্যাথা ক্রমশ বাড়ছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নিজের ব্যাথা কমানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
শায়েলা বেগমের কথায় মাহতাব প্রচণ্ড রেগে এগিয়ে যেতে চাইলে আয়ান তাকে আটকে ফেললো। চোখের ইশারায় মাহতাবকে শান্ত হতে বলে সে নরম গলায় বললো,
” আন্টী, আপনি যা বলছেন একটু ভেবেচিন্তে বলছেন তো?”
শায়েলা বেগম গলা উঁচিয়ে বললেন,
” তো? তোমার কি মনে হয় আমি ভিত্তিহীন কথা বলছি? ”
আয়ান বিস্তৃত হেসে বললো,
” অবশ্যই। আপনার কথাবার্তা শুনে এমনটাই মনে হচ্ছে। ”
শায়েলা বেগম কিছু বলতে যাবে, এর আগেই হারুন সাহেব প্রচণ্ড রেগে জহির ইসলামের উদ্দেশ্যে বললেন,
” ভাই, আপনার থেকে এমনটা আশা করেছিলাম না। এমন একটা চরিত্রহীন মেয়েকে আপনি আমার ছেলের ঘাড়ে তুলে দিতে বসেছিলেন?”
জহির ইসলামের বুকে ব্যাথা আগের মতোই রয়ে গেলো। তবে তাঁর মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে এলো। হারুন সাহেবকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলার মতো পরিস্থিতি তার নেই। তবে জহির ইসলামের কাজটা মাহতাব করে দিলো। সে আয়ানের বাঁধা উপেক্ষা করে হারুন সাহেবের দিকে এগিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বললো,
” খবরদার…আর একটা আজেবাজে কথা বলেছেন তো আপনার নামে মানহানির কেস করবো আমি।”
মাহতাবের কথা হেসেই উড়িয়ে দিলেন হারুন সাহেব। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
” এতোটাও সহজ না এসব করা। আগে তোমার বোনকে সামলাও তারপর কথা বলতে এসো। নিজের বোনকে সামলানোর যোগ্যতা নেই, আবার বড় বড় কথা বলতে আসছে।”
হারুন সাহেবের এমন তীর্যক কথাবার্তা শুনে মৌ, জহির ইসলাম এবং অবন্তিকা ইসলামের অবস্থা ধীরেধীরে খারাপ হতে লাগলো। মৌ যেনো শ্বাস নিতেই ভুলে গিয়েছে। হাত পা, কিছুই চলছে না তার। মস্তিষ্ক পুরোপুরি শূন্য হয়ে গিয়েছে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বেয়ে পড়ছে নোনা জলের একেকটা কণা। সে বেশ কষ্টে অহনার সাহায্যে ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আছে। অবন্তিকা ইসলাম জান্নাত এবং আয়ানের মা’র সাহায্যে বসে আছেন। জহির ইসলাম সাহায্য নিয়েছেন আফসার খানের।
আয়ান এতক্ষণ শান্ত থাকলেও এখন কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না সে। ধীরেধীরে নিজের উপর হতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে সে। তবুও হারুন সাহেবের বয়স দেখে সম্মান করতে গিয়ে সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শান্ত করার প্রচেষ্টা নিয়ে বললো,
” সেই কখন থেকে কিছু আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছেন, আমি কিছু বলছি না। কিন্তু আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবেন না আংকেল। এখানে কারোর অবস্থাই ভালো নেই আপনার কথাবার্তার ধরণ শুনে। দয়া করে, ভালোভাবে বুঝিয়ে বলুন। কি কারণে আমার আর মৌ এর উপর এমন অভিযোগ তুলছেন আপনি। ”
হারুন সাহেব ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন,
” তুমি আর মৌ যে একে অপরকে ভালোবাসো, এটা আমরা জেনে গিয়েছি।”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাস করলো,
” এসব আপনাকে কে বলেছে? ”
” আমার ভাইয়ের মেয়ে বলেছে। ও মৌ’দের ভার্সিটিতেই পড়ে। এমনকি মৌ আর অহনার ব্যাচেই পড়ে। সেই আমাকে বলেছে, মৌ আর তোমাকে আজ ফাঁকা একটা ক্লাসরুমে একসাথে দেখেছে।”
হারুন সাহেবের কথা শেষ হওয়া মাত্রই ড্রইংরুমে উপস্থিত সবকটা মানুষের দৃষ্টি আয়ান এবং মৌ এর উপর নিবদ্ধ হলো। প্রতি জোড়া চোখেই দেখা মিলছে তীব্র অবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। আয়ান হতভম্ব হয়ে ঘাড় ফিরিয়ে মৌ কে একনজর দেখে নিলো। মৌ এর চোখজোড়া টকটকে লাল হয়ে আছে। কান্না করার ফলে নাকটাও লালচে রঙ ধারণ করেছে। আয়ান মৌ এর চোখে এ মূহুর্তে নিজের জন্য একরাশ ঘৃণা এবং রাগ দেখতে পেলো।
আয়ান ঘাড় ফিরিয়ে কিছু বলতে যাবে। তবে তার আগেই মাহতাব চেঁচিয়ে উঠে বললো,
” মুখ সামলে কথা বলুন আংকেল৷ আর একটা মিথ্যা কথা বললে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো যে, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়।”
মাহতাবের কথা শুনে হৃদয় তেড়েমেড়ে গিয়ে বললো,
” আমার বাবা ঠিক কথাই বলছেন। আপনার বোন আর আপনার বন্ধু আজ ফাঁকা একটা ক্লাস রুমে একসাথে ছিলো।”
মাহতাব প্রচণ্ড রাগে হৃদয়ের শার্টের কলার চেপে ধরো বললো,
” কোনো প্রমাণ আছে?”
হৃদয় খানিকটা ভয় পেলেও বেশ সাহস নিয়ে বললো,
” অবশ্যই। প্রমান ছাড়া এতো বড় কথা বলতে এখানে আসিনি আমরা।”
হৃদয়ের কাছে প্রমাণ আছে শুনে মাহতাব এবার থমকে গেলো। এতোক্ষণ সে ভেবেছিলো, হৃদয় এবং তার পরিবার কোনো এক কারণে মৌ এবং আয়ানের উপর মিথ্যা অভিযোগ এনে কোনো স্বার্থ সিদ্ধি করতে চাইছে। কিন্তু যখন সে প্রমাণের কথা শুনলো, তখন সে বুঝতে পারলো, হৃদয় এবং তার পরিবার মিথ্যা কথা বলছে না৷ সে নিজেকে সামলে নিয়ে হৃদয়ের শার্টের কলার ছেড়ে দিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান সাথে সাথে ঘাড় পাশে ফিরিয়ে নজর লুকিয়ে নিলো। মূহুর্তেই মাহতাবের চোখেমুখে তীব্র অবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবির দেখা মিললো। সে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে কাঁপা-কাঁপা গলায় বললো,
” কি প্রমাণ আছে দেখাও। ”
মাহতাবের অনুমতি পেয়ে হৃদয় নিজের পকেট হতে ফোন বের করে আয়ান এবং মৌ’য়ের তখনকার কথাবার্তার রেকর্ডিং চালু করলো। তাদের কথাবার্তা শুরু হওয়ার কয়েক মিনিট পর থেকে রেকর্ড করা হয়েছে। আয়ান এবং মৌ এর প্রতিটা কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পেলো সকলে। কেউই বিশ্বাস করতে চাইছিলো না, ওপাশের দুটো ব্যক্তি আয়ান এবং মৌ।
আয়ান হাতের মুঠো শক্ত করে পুরো রেকর্ডিং শুনলো, আর মৌ ঠোঁট কামড়ে নিজের প্রতিটা কথা শুনলো। দীর্ঘ বারো মিনিটের রেকর্ডিং শেষ হতেই মাহতাব অবিশ্বাসের সুরে মৌ কে জিজ্ঞাস করলো,
” মৌ? তুই আয়ানকে ভালোবাসতি!”
মৌ কোনোরূপ জবাব না দিয়ে ধীরেধীরে মাথা নামিয়ে ফেললো। তার চোখ উপচে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। কয়েক সেকেন্ড বাদে অবন্তিকা ইসলাম কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞাস করলেন,
” এসব কি সত্য?”
মৌ এবারও কোনো জবাব দিলো না। সে জবাব দেওয়ার মতো কিছু পাচ্ছে না। নিজের প্রতি এবং আয়ানের প্রতি সে এ মূহুর্তে তীব্র ঘৃণা অনুভব করছে। তার মন চাইছে এখনই নিজেকে শেষ করে দিতে। এসব আর সইতে পারছে না সে। বুকের ভেতর কষ্টগুলোও ধীরেধীরে মোচড় দিচ্ছে। কি করবে এখন সে? আর কতো সহ্য করবে?
এদিকে আয়ান প্রচণ্ড রাগে হৃদয়ের ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
” এখানে কি কোথাও এমনটা শোনা যাচ্ছে, আমি আর মৌ একে অপরকে ভালোবাসি?”
হৃদয় কোনো জবাব দিতে পারলো না। জবাব দিতে পারলেন না হারুন সাহেব এবং শায়েলা বেগমও। আয়ান কোনো জবাব না পেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হৃদয়ের উদ্দেশ্যে বললো,
” এই রেকর্ডিং থেকে যদি এটা বের করতে না পারিস যে, আমি আর মৌ একে অপরকে ভালোবাসি, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউই হবে না। এ বাসা থেকে তখন তোর হাড়গুলো বের হবে শুধু। ”
এই বলে সে ফ্লোর থেকে ফোনটা নিয়ে হৃদয়ের হাতে গুঁজে দিলো। বললো,
” সোফায় বসে আরামসে পুরো রেকর্ডিংটা মনযোগ দিয়ে শুনবি। কোথায় কোথায় আমার আর মৌ এর একে অপরকে ভালোবাসার কথা বলা আছে তা বের করবি। বাই এনি চান্স, এমনটা না বের করতে পারলে তোর একদিন কি আমার একদিন। ”
এই বলে সে হৃদয়কে সোফার দিকে ধাক্কা দিলো। হৃদয় এবং তার বাবা মা এ মূহুর্তে প্রচণ্ড ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছেন। কারোর মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। এদিকেই মৌ এবং আয়ানের পরিবারের সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব তামাশা দেখে চলছে। এ মূহুর্তে তাদের বলার কিছুই নেই। জহির ইসলাম খুব কষ্টে নিজের ব্যাথা লুকিয়ে রেখে সবটা দেখে চলছেন। কোনো একটা বিহিত দেখেই তিনি এখান থেকে উঠবেন। এর আগে নয়।
আবারো বারো মিনিট সময় নিয়ে হৃদয় এবং তার বাবা মা রেকর্ডিং শুনলো। অত্যন্ত মনযোগ দিয়ে রেকর্ডিং শুনে তারা উপলব্ধি করলো, এখানে কোথাও আয়ান এবং মৌ একে অপরকে ভালোবাসে তা বলেনি। বরং মৌ ভালোবাসার কথা বললেও তা অতীত হিসেবে বলেছে। অর্থাৎ সে আয়ানকে ভালোবাসতো, বর্তমানে ভালোবাসে না।
রেকর্ডিং শেষ হতেই হৃদয় শুকনো মুখে আয়ানের দিকে তাকালো। ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছে সে৷ হৃদয়ের চেহারার এ অবস্থা দেখে আয়ান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” পেয়েছিস কোথাও? ”
হৃদয় কিছু বললো না৷ চুপচাপ বসে রইলো। আয়ান এবার গর্জে উঠে বললো,
” শালা….তুই যেমন ঠসা তেমন তোর মাথাটাও পুরো গোবরে ঠাসা। ভালোমতো সবটা না শুনে লাফাতে লাফাতে একটা মেয়ের দোষ ধরতে চলে এসেছিস। আগেপিছে ভাবনা চিন্তা করার ক্ষমতা কি তোর নাই? পারিস তো শুধু সন্দেহ করতে। একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে ক্লাসের ফাঁকা রুমে একসাথে আছে, এর মানে মহা বড় পাপ হয়ে গিয়েছে তাইনা? তুই এক মাথামোটা আর এ রেকর্ডিং যে করেছে সেও হয়তো কোনো এক মাথা মোটা মানুষ। বাই দা ওয়ে, রেকর্ডিং করলো কে?”
হৃদয় মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললো,
” আমার চাচাতো বোনকে যখন মৌ এর ছবি দেখাই তখন সে বললো, মৌ তাদের ব্যাচেই পড়ে। আর সে আপনাকে একদিন প্রপোজ করেছিলো। এটা শুনে আমি ওকে মৌ এর উপর নজর রাখতে বলেছিলাম। এজন্য এ কয়দিন ও মৌ এর নজর রেখেছিলো। আজ যখন সে মৌ কে একটা ফাঁকা ক্লাস রুমে ঢুকে যেতে দেখে তখন তার একটু সন্দেহ হয়৷ আবার যখন বাইরে থেকে আরেকটা মেয়ে দরজা আটকে দেয় তখন তার সন্দেহ জোরালো হয়। এজন্যই মেয়েটা সেখান থেকে চলে যেতেই সে ক্লাস রুমের বাইরে উঁকিঝুঁকি দিতেই আপনাকে আর মৌ কে কথাবার্তা বলতে দেখে।আর আমাদের কাছে এসব দেখানোর জন্যই তখন ফোনে সে কথাবার্তার রেকর্ডিং করে ফেলে।”
হৃদয়ের কথা শেষ হতেই আয়ান হাত তুলে জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে বললো,
” তোদের ফ্যামিলিকে তো গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করা দরকার ছিলো। তোরা এখানে কেনো? ছোট্ট একটা কথার রেশ ধরে কিভাবে সন্দেহ করা যায় তা তোদের দ্বারাই শিখতে হবে দেখছি। এই যে, এতোগুলা মানুষের সামনে আমাকে আর মৌ কে নিয়ে বাজে কথা বললি সেগুলোর ক্ষতিপূরণ কে দিবে?”
হৃদয় এবং তার বাবা মায়ের মুখখানা এবার ভয়ে চুপসে এলো। এতোকিছুর পরও হারুন সাহেব দমে রইলেন না৷ বরং গলা উঁচিয়ে বললেন,
” এখন ঐ মেয়ে তোমাকে ভালোবাসে না। কিন্তু ভালোবাসতো তো? বলা তো যায় না, বিয়ের পর ওর মনে পুরোনো ভালোবাসা জেগে উঠলো। তখন আমার ছেলেকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসলো।”
আয়ান মেকি হাসি দেখিয়ে বললো,
” আংকেল, বুড়ো বয়সে ব্রেইনটা একটু কম ব্যবহার করলে ভালো হয়। কারণ শেষ বয়সে এসে কিন্তু ব্রেইন ক্ষয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা হওয়ার না, তা নিয়ে এতো আন্দাজে ঢিল মারতে আসেন কেনো? মৌ এর চরিত্র…….”
আয়ানের কথা শেষ হতে না হতেই শায়েলা বেগম মেকি সাহস দেখিয়ে বললেন,
” তোমার আর মৌ এর মধ্যে এমন কি হয়েছিলো যে তুমি ওর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠেছিলে?”
আয়ান শত চেষ্টার পরও নিজের রাগ সংবরণ করতে পারলো না। এজন্যই হাতের পাশে থাকা কাঠের শো পিছটা এক টানে ফেলে দিয়ে বললো,
” দুনিয়ার প্রশ্নের ঝুড়ি খুলে বসছে এই বেকুব ফ্যামিলি। মৌ আমাকে প্রপোজ করেছিলো। তখন রাগের মাথায় সবার সামনে ওর প্রপোজাল রিজেক্ট করে ওকে অপমান করেছিলাম। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওর কাছে সরি বলেছিলাম? হ্যাপি নাও?”
আয়ানের এ কথা বলার পর হৃদয় এবং তার বাবা মায়ের কিছু বলার রইলো না৷ তাদের প্রত্যেকের মুখখানা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে রইলো।
খানিক বাদে মাহতাব ঠাণ্ডা গলায় বললো,
” আশা করি সব ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে আপনাদের সামনে। এবার আপনারা যেতে পারেন৷ ”
হারুন সাহেব কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু মাহতাব হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
” কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই চলে গেলে ভালো হবে আপনাদের জন্য৷ আর হ্যাঁ, ভুলেও এ বাড়ির আশেপাশে আসার চেষ্টা করবেন না। এমনটা দেখলে আপনাদের নামে মানহানির কেসসহ আরো মিথ্যা কয়েকটা কেস ছুঁড়ে দিবো।”
মাহতাবের কথা শেষ হতে না হতেই হৃদয় এবং তার বাবা মা গুটি গুটি পায়ে বাসা হতে বেড়িয়ে গেলেন। তারা চলে যেতেই আয়ান বিড়বিড় করে বললো,
” শালা আস্ত বেকুব আর মাথা মোটা ফ্যামিলি। ”
এই বলে সে পিছন ফিরে ডাইনিং এর দিকে তাকিয়ে দেখলো জহির ইসলাম বুকের বামপাশে এক হাত চেপে চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে আছেন। তাঁর এমন অবস্থা দেখেই আয়ান দৌড়ে জহির ইসলামের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
” আমার মনে হয় আংকেলের হার্ট এটাক হয়েছে।”
আয়ানের কথা অবন্তিকা ইসলাম, মাহতাব, জান্নাত এবং মৌ এর কানে যেতেই তারা হুড়োহুড়ি করে জহির ইসলামের কাছে চলে এলো। আফসার খান এতক্ষণ জহির ইসলামের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও স্তব্ধ হয়ে সবটা দেখছিলেন বলে জহির ইসলামের বুকে ব্যাথা বুঝতে পারেননি। আয়ানের কথা হুট করে তার কানে ভেসে আসতেই তিনি পিছন হতে জহির ইসলামকে ধরে ফেললেন৷ এদিকে অবন্তিকা ইসলামের মুখ ভয়ে পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। তিনি অস্ফুটস্বরে বললেন,
” মাহতাব, দ্রুত ডাক্তার ডাক। ”
জহির ইসলামের বুকে ব্যাথা আগের তুলনায় ক্রমশ বাড়ছে। পুরো শরীর একেবারে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে এসেছে। প্রচণ্ড অস্থির অনুভব করছেন তিনি। জান্নাত এবং অহনা ভয়ে এবং উৎকণ্ঠার মধ্যে তাঁর হাত পা মালিশ করে দিচ্ছেন। আয়েশা খানসহ বাসায় উপস্থিত কিছু আত্মীয়স্বজন দোয়াদরুদ পড়ছেন এবং কিছু আত্মীয়স্বজন প্রচণ্ড অস্থিরতা দেখাচ্ছেন।
এদিকে বাবা’র এমন অবস্থা দেখে রান্নাঘর থেকে কিছুক্ষণ আগে পানি নেওয়ার জন্য ছুটে যাওয়া মৌ মাত্রই ফিরে এলো। জহির ইসলামের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে কান্নারত কণ্ঠে বললো,
” আব্বু, পানি খাও প্লিজ। আর শক্ত থাকার চেষ্টা করো।”
®সারা মেহেক
#চলবে
(টাইপিং মিস্টেকগুলো কষ্ট করে শুধরে পড়ে নিবেন।)
আয়ানের নির্বিকার ভঙ্গি দেখে মৌ অস্থির হয়ে আবারো দরজা খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু বাইরে থেকে দরজা বন্ধ থাকায় প্রথমবারে মতো এবারও সে ব্যর্থ হয়। আয়ান মৌ এর দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো,
” ব্যর্থ চেষ্টা করে লাভ নেই মৌ। আমার কথাটা শোন।”
মৌ রাগত স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” ব্যর্থ চেষ্টা আমি না, আপনি করছেন। হাজার চেঁচালেও আমি আপনাকে মাফ করছি না৷ ”
আয়ান কাতর গলায় বললো,
” আমি কি খুব বড় পাপ করে ফেলেছি?”
” এটা আবার আমার কাছে জিজ্ঞাস করছেন! আপনার বিবেক কি বলছে না আপনি কি করেছেন?”
আয়ান মাথা নিচু করে ফেললো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে চট করে মাথা তুলে বললো,
” আমি জানি, আমার দ্বারা অনেক বড় ভুল হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কি আমাকে মাফ করা যায় না? এটা আমার প্রথম এবং শেষ ভুল ভেবে মাফ করে দে মৌ। তুই জানিস না, এই ক’টা দিন আমার কেমন কেটেছে। যতটা সময় বাসায় থাকতাম শুধু সুযোগ খুঁজতাম, কখন তোর সাথে কথা বলবো। কখন তোর কাছে মাফ চাইবো। কিন্তু সুযোগ পেলেও তুই আমার সাথে কথা বলিস না। আজকে যখন কথা বলছিস, তখন প্লিজ আমাকে মাফ করে দে মৌ।”
মৌ আয়ানকে ঠেলে দিয়ে কাছের বেঞ্চে এসে বসে পরলো। কিছুক্ষণ আয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাণ্ডা গলায় বললো,
” একটা মেয়েকে সবার সামনে অপমান করে কোন মুখে মাফ চাইতে আসছেন আপনি? আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি কখনও মাফ করতে পারতেন? জবাব হলো, ‘না’। কারণ একজন আত্মসম্মান সম্পন্ন মানুষের কাছে তার আত্মসম্মানটাই সব। সেখানে, আপনি আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছেন। এতো দ্রুত আপনাকে মাফ করে দিবো ভাবলেন কি করে? ”
এই বলে মৌ কিছুক্ষণ থামলো। এর ফাঁকে আয়ান কিছু বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু মৌ আরেকদফায় কথা শুরু করায় সে আর কিছু বলতে পারেনি।
মৌ এখন কিছুটা শান্ত। তবে কথা বলতে গিয়ে তার গলা ধরে এসেছিলো। চোখে জমে উঠেছিলো নোনা জলের অশ্রু। সে নোনা জল চোখ গড়িয়ে পরার আগেই সে অতি সন্তর্পণে তা মুছে নিলো। ভেজা গলায় বললো,
” নিজের মনের কথা ভালোবাসার মানুষকে বলার পর এমন অপমানিত খুব কম মানুষই হয়েছে হয়তো। আপনি ঠাণ্ডা মাথায় রিজেকশন দিতে পারতেন। সেটা মুখ বুজে মেনে নিতাম আমি। তবে এমন অপমান করে রিজেকশন দিয়েছেন যে এখন নিজের উপর প্রচণ্ড ঘৃণা হয় আমার। সে সময়টাকে কুফা মনে হয় যে সময়ে আমি আপনার প্রেমে পরেছিলাম। আপনাকে নিজের মনে জায়গা দিয়েছিলাম। কিন্তু জানেন? আপনি সে জায়গা পাওয়ার যোগ্য না। আপনি বরং আমার ঘৃণা পাওয়ার যোগ্য।
আপনার মতো মানুষকে ভালোবেসে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করেছিলাম আমি। তবে এখন আপনাকে ভুলিয়ে সে ভুলটা শুধরে নেওয়ার প্রচেষ্টায় আছি এবং সে প্রচেষ্টায় আমি সফলও হচ্ছি। ”
এই বলে মৌ মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে লাগলো। আয়ান নামক ব্যক্তির সামনে নিজের চোখের জল সে দেখাতে চাইছে না৷ যদি আবারো এ নিয়ে তাকে অপমান করে বসে!
মৌ এর কথাগুলো আয়ানের হৃদয়ে খুব গভীরভাবে দাগ কাটতে সক্ষম হলো। এই প্রথম মৌ এর লুকিয়ে রাখা চোখের জল দেখে তার বুক কেঁপে উঠলো। সে কিছুক্ষণ মৌ এর তাকিয়ে রয়ে ধীর পায়ে হেঁটে হাঁটু গেঁড়ে মৌ এর সামনে বসে পরলো। মৌ এর থুতনি ধরে মাথা তুলে কাতর গলায় বললো,
” এভাবে বলিস না মৌ। শুনতে কষ্ট হচ্ছে। ”
মৌ আয়ানের হাত ঝামটা মেরে সরিয়ে গরম চোখে তাকিয়ে বললো,
” আপনি তো আমাকে পছন্দ করেন না৷ আপনার জন্য তো আমি আস্ত মুসিবতের গোডাউন। তো, আমার ক্ষমা নিয়ে আপনার এতো মাতামাতি কেনো? আপনি আপনার মতো জীবন কাটান৷ আর আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।”
আয়ান মাথা নিচু করে বললো,
” আমি নিজের কাছে নিজে আর কতোদিন ছোট হয়ে থাকবো?”
” যতদিন আমার কষ্ট পুরোপুরি ঘুচবে না ততদিন।”
” এমনটা বলিস না মৌ। আমি কোনোদিনও কারোর কাছে এতোটা অসহায় অনুভব করেনি যতটা তোর কাছে করছি। তোর ক্ষমা পাওয়ার জন্য আমাকে কি করতে হবে বল, আমি সবটাই করবো। ”
” কিছুই করতে হবে না আপনাকে। যা কিছু করেন না কেনো, আমার ক্ষমা কোনোদিনও পাবেন না। কারণ আপনার দেওয়া এ কষ্ট জীবনেও ভুলতে পারবো না আমি৷ তবে, যেদিন আপনার প্রতি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারবেন সেদিন আমার এ কষ্টটা বুঝবেন। বুঝবেন, আমি কেনো আপনাকে ক্ষমা করতে পারছি না।”
এই বলে মৌ উঠে যেতে চায়। তবে সামনে আয়ান থাকায় এ কাজে ব্যর্থ হয় সে। নিচু গলায় সে আয়ানের উদ্দেশ্যে বললো,
” আমার পথ ছাড়ুন। আমি বাসায় যাবো। সামনে আমার বিয়ে। এজন্য কোনো ধরণের তামাশা ফেস করতে চাইছি না আমি। ”
এতো চেষ্টার পরও মৌ এর মন গলাতে না পেরে নিরুপায় হয়ে আয়ান মৌ এর পথ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মৌ বড় বড় পা ফেলে দরজার কাছে এসে দরজা ধাক্কাতে থাকে। তার দরজা ধাক্কানোর ফলে কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সে মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিয়ে পাশ করে দাঁড়িয়ে পড়ে। মৌ সেদিকে খেয়াল না করে দ্রুততার সহিত সে স্থান ত্যাগ করে ভার্সিটির গেটে এসে দাঁড়িয়ে পরে।
.
অবন্তিকা ইসলাম এবং জহির ইসলাম হৃদয়ের ব্যাপারে হৃদয়ের বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাইছেন। হৃদয়ের মনে এমন সন্দেহ বাতিক সবক্ষেত্রেই নাকি বিয়ের আগে সবটা জানার জন্য মৌ এর ক্ষেত্রেই অমনটা হয়েছে তা নিশ্চিত হতে চাইছেন তারা। আজ বিকেলের দিকে জহির ইসলাম হৃদয়ের বাবা মা’কে একটা রেস্টুরেন্টে ডেকেছেন এ ব্যাপারে কথা বলতে।
মৌ কে হৃদয় এবং তার বাবা মা দেখে গিয়েছেন গত পরশু। সেদিন মৌ এর কথাবার্তা শুনে অবন্তিকা ইসলাম ওমন কথা বললেও তার মন কিছুতেই বিয়েতে সায় দিচ্ছিলো না। এ নিয়ে তিনি তার স্বামী জহির ইসলামের সাথে কথাও বলেছেন। কিন্তু জহির ইসলাম প্রথম দিকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও অবন্তিকা ইসলামের কথায় তার মনে একরাশ চিন্তার মেঘ দলা পাকাতে শুরু করে। এজন্যই তিনি এ বিষয়ে হৃদয়ের বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চান৷ গতকাল নানা ব্যস্ততায় কথা বলা হয়ে উঠেনি বলে আজ তারা কথা বলতে চাইছেন।
জহির ইসলাম অবশ্য খানিকটা ভয়েই আছেন। কারণ মৌ এর বিয়ের ব্যাপারে আশেপাশের পরিচিত সবাইকে বলা হয়ে গিয়েছে। আত্মীয়স্বজনকেও বলা হয়ে গিয়েছে। এ মূহুর্তে যদি রেস্টুরেন্টে গিয়ে উঁচুনিচু কোনো ঘটনা ঘটে যায় তাহলে সমাজে তিনি মুখ দেখাবেন কি করে সে দুশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছেন তিনি৷ হ্যাঁ, মৌ এর সুখী জীবনটাই তার কাছে সবচেয়ে বড়। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ সমাজে তাকে বাঁচতে তো হবে। ততদিন কি মাথা নিচু করে বাঁচবেন তিনি? এ নিয়ে চিন্তা করতেই হালকা বুকে ব্যাথা অনুভব করেন তিনি। বছর দুয়েক আগে আকস্মিক মাইনর হার্ট অ্যাটাকের কারণে তিনি ভেবেচিন্তে জীবনযাত্রা করেন। এর মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটে গেলে কি তিনি আদৌ বেঁচে থাকতে পারবেন? এ নিয়ে অবশ্য জহির ইসলামের চেয়ে অবন্তিকা ইসলামের চিন্তা সবচেয়ে বেশি।
হৃদয়ের ব্যাপারটা নিয়ে তারা মাহতাব, জান্নাত এবং মৌ এর সাথে কোনরূপ আলোচনা করেননি৷ নিজেদের মধ্যেই সব কথাবার্তা বলতে চাইছেন তারা। তাদের মন এ ব্যাপারে অশনিসংকেত দিলেও আল্লাহর কাছে বারংবার তারা দোয়া করে চলছেন।
.
দুপুরের দিকে খাওয়াদাওয়া শেষ করে সবাই মিলে হলুদের আয়োজন নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন। হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ শুনতেই জান্নাত কাজ ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিলো। দরজার বাইরে হৃদয় এবং তার বাবা মা’কে দেখে চমকে উঠলো সে৷ আজ এ মূহুর্তে তাদেরকে মোটেও আশা করেনি সে।
জান্নাত দরজার কাছ থেকে সরে এসে হতবাক হয়ে বললো,
” আপনারা এখানে!”
জান্নাতের বিস্ময়ভাবকে পাশ কাটিয়ে হৃদয় এবং তার বাবা মা বড় বড় পা ফেলে ড্রইংরুমে চলে এলেন। হৃদয়ের বাবা হারুন সাহেব ক্রুদ্ধ গলায় চেঁচিয়ে উঠিয়ে বললেন,
” জহির সাহেব, আপনার বউ বাচ্চাদের নিয়ে এখনই ড্রইংরুমে চলে আসুন। ”
হারুন সাহেবের এমন আচরণে বাসায় থাকা সকল আত্মীয়স্বজন হতবাক হয়ে যায়। একে একে তারা সকল ড্রইংরুমে ছোটখাটো একটা ভিড় জমাতে শুরু করেন। হৃদয় এবং হৃদয়ের মা শায়েলা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বেশ কষ্টে রাগ সংবরণ করতে থাকেন। তারা অপেক্ষায় আছে কখন মৌ এর পরিবারের সবাই তাদের সামনে আসবেন আর কখন নিজেদের কথা রাখতে পারবেন তিনি।
হারুন সাহেবের উঁচু গলার আওয়াজ শুনে মৌ, অবন্তিকা ইসলাম এবং জহির ইসলাম তড়িঘড়ি করে ড্রইংরুমে ছুটে এলেন। হারুন সাহেবকে এ মূহুর্তে এখানে দেখে জহির ইসলাম বেশ অবাক হলেন। বিস্মিত গলায় বললেন,
” আপনারা এখানে! বিকেলে তো দেখা হবেই। এভাবে হুট করে আসার মানে কি?”
হারুন সাহেব হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
” আপনার ছেলে কোথায়? ওকে ডাকুন। সাথে আপনার বন্ধু আর তার পরিবারকেও ডাকুন। ”
জহির ইসলাম কিছুই না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাস করলেন,
” ওদের কেনো ডাকবো? আর আপনাদের আসার কারণটা বলবেন দয়া করে?”
” আগে যা করতে বলেছি তাই করুন। পরে সব কথা হবে। আজকে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ছাড়বো। আপনি কথা না বাড়িয়ে ওদেরকে ডাকুন। যেখানেই আছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা যেনো এখানে উপস্থিত হয়।”
হারুন সাহেবের কথা শুনে অবন্তিকা ইসলামের বুক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় জহির ইসলামকে তাগাদা দিয়ে বললেন,
” এই, তুমি তাড়াতাড়ি ফোন করো ওদের। আমার খুব ভয় করছে। উনাদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”
স্ত্রী তাগাদা পেয়ে জহির ইসলাম আড়ালে এসে মাহতাব, আয়ান এবং আফসার খান কে কল করে দ্রুত চলে আসতে বললেন। এদিকে মৌ এর চাচা খালাসহ সবার মাঝে কানে কানে ফিসফিস করে কথাবার্তা চলছে। জান্নাত এবং মৌ একে অপরের হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা ভয়ে ঢিপঢিপ আওয়াজ তুলে চলছে।
এমন থমথমে মহলের পরিবেশে নানা ধরণের অশুভ চিন্তায় অবন্তিকা ইসলামের বিপি হাই হয়ে যাচ্ছে। জহির ইসলাম প্রচণ্ড চিন্তায় বুকে মৃদু ব্যাথা অনুভব করছেন। কিন্তু কাউকেই কিছু বলতে পারছেন না৷
হৃদয় এবং তার বাবা মা চুপচাপ সবটা দেখে চলছেন আর নিজেদের ভেতরে রাগে ফুঁসছেন। তারা অপেক্ষায় আছে কখন জহির ইসলাম এবং তার পরিবারকে হাজারটা কটু কথা শোনাতে পারবেন।
প্রায় আধঘণ্টা পর সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আয়ান এবং মাহতাব অফিস থেকে ফিরে এলো। আফসার খান এবং তার পরিবার আরো আগে চলে এসেছিলেন।
হারুন সাহেব আয়ানকে দেখেই তেড়ে উঠে গেলেন। আয়ানের উপর অকপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
” নিজের ব্যবহার করা জিনিস আমার ছেলেকে দিতে চলেছিলে কোন সাহসে?”
( বর্ষার অংশ ডিলিট করছি)