Thursday, July 10, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1400



মেঘসন্ধি পর্ব-০৭

0

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

হৃদয়ের প্রশ্নে মৌ বিস্ময়ভরা চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালো। হৃদয় যে এমন একটা প্রশ্ন করে বসবে তা সে কখনও চিন্তা করেনি। এদিকে আয়ান কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো হৃদয়ের এহেন প্রশ্নে। সে আনমনে ভাবছে, এ প্রশ্নটার উত্তর দুইজন মানুষের কাছে দুই ধরণের পাওয়া যাবে। তার কাছে এর জবাব হবে ‘না’ এবং মৌ এর কাছে এর জবাব হবে ‘হ্যাঁ’। সুতরাং মানুষভেদে একই প্রশ্নের জবাব সত্য মিথ্যা হতে পারে! এই ভেবে আয়ান মাথা নামিয়ে হালকা হেসে দিলো। বলা বাহুল্য, আয়ানের এ হাসি হৃদয়ের মনে সন্দেহের বাতিক জাগিয়ে তুললো। তবুও সে এ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে নিজের করা প্রশ্নের জন্য তৈরী হওয়া অস্বস্তিকর পরিবেশ কাটাতে বললো,
” কিছু মনে করবেন না ভাইয়া। আমি একটু খুঁতখুঁতে স্বভাবের তো, এজন্য এ বিষয়ে আজই সরাসরি জিজ্ঞাস করলাম। আমার অফিসের দুজন কলিগ এমন আছেন, যারা বিয়ের আগেই নিজেদের পছন্দের মানুষের সাথে রিলেশনে ছিলো। কিন্তু পরিবারের চাপে অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার পরও তারা এদিকে রিলেশন চালিয়ে যেতে থাকে। এখন আমার পক্ষ থেকে এমন কিছু হবে না। কিন্তু…….”

মৌ এতক্ষণ চুপচাপ সব সহ্য করলেও এখন মোটেও সে হৃদয়কে সহ্য করতে পারলো না৷ হৃদয়ের শেষের কথা যে তাকে ইঙ্গিত করেই বলা হয়েছে তা ধরে নিতে মৌ এর সময় লাগলো না। সে ক্ষুব্ধ গলায় তেড়ে গিয়ে বললো,
” আপনি আমার উপর সন্দেহ করছেন! আপনার সাহস তো কম নয়!”

মৌ এর তেজি কথাবার্তা শুনে হৃদয় ভয়ে চুপসে গেলো। তবুও ঠোঁটের কোনে ভদ্রতাজনক হাসি এঁটে বললো,
” আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন মৌ। আজকালের সময়ে এই রিলেশন থাকাটা অতি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্যই এমনটা জিজ্ঞাস করলাম আপনাকে।”

মৌ গরম চোখে একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” তাই বলে উনার সাথে!”

আয়ান মৌ এর রেগে যাওয়া এবং হৃদয়ের প্রশ্ন শুনে হেসেই কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে। তবে সবটাই নিজের ভিতরে। চাওয়া সত্ত্বেও এ হাসি সে বাইরে দেখাতে পারছে না।
এই প্রথম সে মৌ কে ক্রুদ্ধ হতে দেখেছে। পূর্বে সে মৌ কে নম্র অবস্থায় থাকতে দেখেছে। তবে আজ সম্পূর্ণ উল্টো। যেনো ভেজা বেড়াল আচমকা এক হিংস্র বাঘিনীতে রূপান্তরিত হয়েছে। আয়ান নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, ‘মৌ এর তাহলে দুই রূপ আছে? আগে তো কখনও দেখিনি!” উত্তরটা আর হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে হলো না তাকে। কারণ উত্তরদাতা স্বয়ং তার সামনে উপস্থিত।

হৃদয় কিছু বলতে যাবে এর আগেই আয়ান প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে হালকা হেসে বললো,
” আরে ভাই….এমন কিছুই নেই আমাদের মাঝে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। এমন কিছু হলে কি মৌ এর সাথে আপনার বিয়ে হতো নাকি? আমিই ওকে বিয়ে করে নিতাম। ” এই বলে সে পরক্ষণেই জিব কেটে বললো,
” আই মিন, আমাদের ফ্যামিলি আমাদের বিয়ে দিয়ে দিতো আরকি। কারণ, দুই ফ্যামিলির মধ্যকার সম্পর্কটা অনেক গাঢ়।”

আয়ানের কথাবার্তা শুনে হৃদয় বেশ আশ্বস্ত হলো। আয়ানের জবাব হ্যা হলে সে বেশ কষ্টই পেতো। কারণ সে মৌ এর ছবি দেখার সাথে সাথেই মৌ কে পছন্দ করে ফেলেছিলো। আর আজকে সরাসরি মৌ কে দেখে মৌ এর প্রেমে পরে গিয়েছে সে। এ মূহুর্তে যদি সে কোনোরকমে বুঝতে পারতো মৌ এবং আয়ানের মাঝে কিছু ছিলো বা আছে তাহলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেতো সে। অবশ্য মৌ এর ব্যবহারগুলো দেখে সে কিছুটা সন্দেহ করেছিলো। তবে আয়ানের কথাবার্তায় অদ্ভুতভাবে সে সন্দেহ দূর হয়ে যায়!

আয়ান কয়েক সেকেন্ড মৌ এর দিকে তাকিয়ে হৃদয়ের কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
” আচ্ছা, আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি। পরে দেখা হচ্ছে তাহলে?”

হৃদয় মৃদু হেসে বললো,
” জ্বি অবশ্যই। ”

আয়ান প্রত্যুত্তরে আর কিছুই বললো না। বরং দ্রুত পায়ে ব্যালকনি ত্যাগ করলো।

.

হৃদয় এবং তার পরিবার চলে যেতেই মৌ নিজের রুমে এসে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। হৃদয়ের প্রশ্নগুলো এখন অব্দিও তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কি করে হৃদয় এসব প্রশ্ন করতে পারলো! বিয়ের আগেই যদি সে এতো সন্দেহ করে তাহলে বিয়ের পরে কি করবে সে? যদিও মৌ জানে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন প্রশ্ন করা কিছুটা স্বাভাবিক। তবুও কোথায় যেনো একটা বাঁধা কাজ করছে বিয়েটা করতে।
মৌ চাইলেই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে পারতো। কিন্তু তার চোখের সামনে তার এবং হৃদয়ের বাবা একে অপরকে ওয়াদা করেছেন বিয়ের ব্যাপারে। এমন একটা পরিস্থিতিতে সে চাইলেও কিছু করতে পারেনি। এসব জানার পরও যেহেতু তাকে বিয়েটা করতে হচ্ছে সেহেতু তাকে ‘এডযাস্টমেন্ট’ নামক একটা ভারিক্কি ধরণের শব্দের সাথে পরিচিত হতে হবে। যে শব্দটা একজন মেয়ের জীবনে খুব বড় প্রভাব ফেলে।

মৌ এর শব্দ করে দরজা লাগানোর বিষয়টা অবন্তিকা ইসলাম এবং জহির ইসলাম মোটেও ভালো নজরে নিলেন না। মৌ কি আদৌ বিয়েতে রাজি কি না এ ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে তারা আলোচনা করলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই তারা মৌ এর রুমে গিয়ে মৌ এর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলে। মৌ তাদেরকে সম্পূর্ণ ঘটনা খুলে বললে জহির ইসলাম বলেন, ‘আমি এখন হৃদয়ের বাবার কাছে ওয়াদা বদ্ধ। চাইলেও এ বিয়ে ভাঙা সম্ভব না। তোকে এটা সহ্য করে নিতেই হবে। হৃদয়…..” জহির ইসলামের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অবন্তিকা ইসলাম বললেন, ‘যেহেতু সবদিক দিয়েই তুই আটকে পড়েছিস, সেহেতু এই বড় বিষয়টাকেও নিতান্তই ছোট হিসেবে ধরে নিতে হবে। এছাড়া আর উপায় নেই মৌ। আল্লাহ তোর কপালে কি লিখে রেখেছেন তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। ‘ এই বলে স্বামী স্ত্রী দুজনেই মৌ এর রুম থেকে চলে যায়। এদিকে মৌ দাঁতে দাঁত চেপে বিছানার চাদর খামচে ধরে কান্না করে দেয়। সামনের দিনগুলো তার জন্য কি নিয়ে আসছে তা সে জানে না। তবে মন বলছে, কিছু একটা খারাপ হবে। সেই সাথে ভালো কিছুও হবে, মন এমনটাই ইশারা করছে। এখন শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণা ছাড়া আর উপায় নেই তার কাছে।

.

এশার আজান দিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মৌ নামাজ পড়ে সকলের দৃষ্টির অগোচরে ছাদে এসে উপস্থিত হয়। এ মূহুর্তে একটু ঠাণ্ডা এবং সতেজ হাওয়া উপভোগ করে নিজের মধ্যকার অশান্তি, উৎকণ্ঠা, দম বন্ধ হয়ে আসার মতো পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাবে সে।
মৌ ক্লান্ত দৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে ছোট্ট করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো। মাঝেমাঝে এ নিঃশ্বাস নেওয়াও কেমন যেনো বোঝা মনে হয় তার কাছে। অবশ্য এমনটা গত তিনদিন যাবত মনে হচ্ছে। পূর্বে এমন কিছুই তার মনে হতো না। তখন তো দুনিয়াকেই অন্য রকম লাগতো তার কাছে। অথচ আজকে………
মৌ এক ধ্যানে রাতের নিকষ কালো আকাশের দিকে চেয়ে আছে। যদিও এ মূহুর্তে শহুরে আলোর জন্য রাতের আকাশের গাঢ় ভাব কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তবুও যেমন কালো আছে তা কি আদৌ কম! মোটেও না। কারোর জীবন এমন কালো রঙে ছেয়ে গেলে তা সমাপ্তি পর্যায়ে পৌঁছে যায় বললেই চলে। যদিওবা অনেকে ক্ষেত্রে এ কালো আকাশ ফুঁড়ে সকালের সূর্যের দেখা মিলে। তবে তা কি সবার ক্ষেত্রে? উত্তর হলো, না। মৌ এর মনে এ মূহুর্তে একটা প্রশ্নই জেগে উঠছে, তার জীবনের আকাশে এ নিকষ কালো আঁধার ভেদ করে কি আদৌ কখনো সকালের সূর্যের দেখা মিলবে? আদৌ কখন সে সুখী হতে পারবে? নাকি সারাজীবন এ কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে?

” মৌ? তুই সত্যিই হৃদয়কে বিয়ে করছিস?”

হঠাৎ আয়ানের কণ্ঠস্বরে শুনে মৌ চমকে উঠলো। তড়াক করে রেলিঙের উপর হতে হাত সরিয়ে পিছিয়ে এলো সে। কয়েক সেকেন্ড আয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে সে চলে যেতে নিলো। কিন্তু আয়ান পিছন হতে তার হাত চেপে ধরে বললো,
” এখন অন্তত কথা বল মৌ। আজ নিয়ে তিনদিন যাবত তোর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে চলছি। অথচ তুই আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিস না! ”

আয়ানের কোনো কথাই কানে তুললো না মৌ। সে আয়ানের হাত হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য তোরজোড় করতে লাগলো। কিন্তু আয়ানের শক্তির কাছে সে পেরে উঠলো না। আয়ান মৌ এর দিকে দু কদম এগিয়ে এসে কাতর গলায় বললো,
” মৌ, প্লিজ আমার সাথে কথা বল। আমি কখনই তোর সাথে অতোটা খারাপ বিহেইভ হয়তো করতাম না। কিন্তু সেদিন করে ফেলেছি। কারণ আমার মাথা প্রচণ্ড গরম ছিলো তখন। ভালোমন্দ বিচার করার সময় ছিলো না সেদিন। যা মুখে এসেছি বলে দিয়েছি। কিন্তু পরে ঠাণ্ডা মাথায় সেসব নিয়ে ভাবতেই বুঝলাম কত বড় ভুল করে ফেলেছি আমি। মৌ, আজ পর্যন্ত এমন হয়নি যে, আমি তোকে সরি বলেছি। কিন্তু আজ বলছি। এটা আমার প্রথম ভুল ভেবে ক্ষমা করে দে মৌ। ”

আয়ানকে অনেক কথাই বলতে মন চাইলো মৌ এর। কিন্তু মৌনব্রত নেওয়ার ব্যাপারটা মাথায় আসতেই সে নিজেকে সামলে নিলো। টু শব্দ করা ব্যতিতই সে সর্বশক্তি দিয়ে আয়ানকে ধাক্কা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছাদ হতে নেমে এলো। নিরুপায় আয়ান ক্ষুব্ধ হয়ে ছাদের রেলিঙে একটা ঘুষি মারলো।

.

আয়ান বাসায় এসে নিজের রুমের ব্যালকনিতে উপস্থিত হলো। এখান হতে মৌ এর রুম এবং ব্যালকনি স্পষ্টরুপে দেখা যায়। এ মূহুর্তে মৌ এর রুমে লাইট জ্বালানো রয়েছে। ব্যালকনির দরজা বন্ধ রয়েছে এবং রুমের যে জানালা ব্যালকনিতে বের হয় সে জানালার পর্দা অর্ধেক টাঙানো রয়েছে। সবটাই বেশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো আয়ান। কিছুক্ষণ বাদে নিজেই নিজের এ কাজে চমকে উঠলো সে। বিড়বিড় করে বললো,
” আয়ান…তুই এমন কাজ করবি এটা কখনও চিন্তা করিনি৷ শেষমেশ কি না মৌ এর রুমে উঁকিঝুঁকি!! ”

আয়ান কিছুক্ষণ মৌ এর রুমে সে জানালার দিকে চেয়ে রইলো। হঠাৎ মৌ এসে সেই জানালার পর্দা পুরোপুরি টাঙিয়ে দিয়ে গেলো। আয়ানকে কিছুটা ভড়কে উঠে নিজেকে প্রশ্ন করলো,
” এটা কি হলো!”

মৌ জানতো না আয়ান নিজেট রুম থেকে তার রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। সে স্বভাব বশতই নিজের রুমের জানালার পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে।

মৌ পর্দা টাঙিয়ে দিতেই আয়ান হতাশ ভঙ্গিতে রুমে এসে উপস্থিত হলো। সে নিজেও বুঝতে পারলো না, ঠিক কি কারণে সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মৌ এর রুমের দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিছুক্ষণ এ নিয়ে ভাবাভাবির পরও উত্তর না পেয়ে সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে আজকের সকল ঘটনা মনে মনে আওড়াতে লাগলো সে। হঠাৎ মৌ এর সৌন্দর্য নিয়ে হৃদয়ের মায়ের কথাগুলো তার কানে বাজতে লাগলো। কিছুটা অবহেলার সুরে সে বললো,
” মৌ এর মধ্যে এতো কিসের সৌন্দর্য আছে! আমি তো এতোদিনে কোনো সৌন্দর্য খুঁজে পায়নি।” এই বলে সে চিন্তা করতে লাগলো, মৌ এর ছবিগুলো দেখবে কি না। যেই ভাবা সেই কাজ৷

আয়ান দ্রুততার সহিত পকেট থেকে ফোন বের করে গ্যালারি ঘেঁটে মৌ এর ছবি বের করলো। মৌ এর হাতেগোনা কয়েকটা ছবি আছে তার ফোনে এবং সবগুলোই অহনা নাহয় মাহতাবের সাথে তোলা। সেসব ছবির মধ্যেই একটা ছবি সে বের করলো।
গত বছর শীতে আয়ানদের বাড়ির ছাদে দু পরিবার মিলে ছোটখাটো একটা বারবিকিউ পার্টির আয়োজন করেছিলো। সেখানেই মৌ হালকা মিষ্টি রঙয়ের একটা থ্রি পিছ পরে এসেছিলো। যদিও রাতের বেলায় ছাদে রাখা হলদে বাতির আলোয় সেই মিষ্টি রঙ আর মিষ্টি রঙ রইলো না। বরং হলদে মিষ্টি রঙয়ের মিশ্রণে অদ্ভুত এক রঙ তৈরী হলো।

ছবিতে অহনা এবং মৌ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান মৌ এর চেহারার দিকে জুম করে দেখতে লাগলো। মৌ এর চেহারার রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা৷ আয়ান তা জানে। তবে এ ছবিতে মৌ এট চোখেমুখে হালকা হলুদ রঙের ছটা পড়েছে। হরিণীর মতো টানাটানা চোখজোড়া আর মৌ এর ঠোঁটের কোনে লেপ্টে থাকা সেই মিষ্টি হাসিটা আয়ানকে জোরালোভাবে আকর্ষণ করছে। এর আগে সে কখনই মৌ এর চেহারা, হাসি এর দিকে দৃষ্টিপাত করেনি৷ অথচ আজ ফোনে সেই মৌ এর ছবিই ঘেঁটে দেখছে সে! অদ্ভুত ঠেকছে সবকিছু তার কাছে।
এ মূহুর্তে আশ্চর্যজনকভাবে মৌ এর রূপের বর্ণনা দিতে মন চাইছে আয়ানের। একদম গল্প উপন্যাসে একজন প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীর রূপের বর্ণনা যেভাবে দেয় সেভাবে! আয়ান নিজেই নিজের এ কাণ্ডে হতবাক হয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
” এক ‘সরি’ বলা আমাকে এতোটা চেঞ্জ করে দিলো! দিজ ইনসিডেন্ট গনা হন্ট মি ফর রেস্ট অফ মাই লাইফ।”

.

আগামী পরশুদিন মৌ এর হলুদ। হলদু এবং বিয়ে উপলক্ষে মৌ এর কাছের বান্ধবীদের এবং চেনা পরিচিত প্রায় সকল আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আজ সকাল হতেই এক এক করে মৌ এর খালা, মামা, চাচা, ফুফুরা আসতে শুরু করেছে। জহির ইসলামের পুরো বাড়ি এখন উৎসবমুখর পরিবেশে রূপান্তরিত হয়েছে।
বিয়ের পাত্রী হিসেবে আজকে মৌ এর উপস্থিত হওয়ার কথা থাকলেও ভার্সিটিতে জরুরী ক্লাস পরায় তাকে ভার্সিটিতে যেতে হয়েছে। অবশ্য অন্যান্য পাত্রীদের মতো তার বিয়ে নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তার বাবা জহির ইসলামের এ নিয়ে বেশ মাথাব্যথা। একমাত্র আদরের মেয়েকে বিয়ে দিবেন আর বড়সড় অনুষ্ঠান হবে না! এটা তো হতে দেওয়া যায় না। এজন্য জহির ইসলাম নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সকল সাজসরঞ্জাম করছেন।

মৌ এবং অহনা ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে এসে বসলো। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ তারা। মাথার উপরে ঘূর্ণনরত ফ্যানটার বাতাস তাদের কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। এজন্য অহনা ব্যাগ থেকে একটা শক্তপোক্ত খাতা বের করে হাতপাখার মতো বাতাস নিতে থাকে।
হঠাৎ অহনার পিছন থেকে তাদের ক্লাসের এক মেয়ে এসে কানে কানে ফিসফিস করে বললো,
” তোমাকে এখনই ফাহাদ ভাইয়া ডাকছে। ”

ফাহাদ এ ভার্সিটির শেষ বর্ষের ছাত্র। তবে একজন ছাত্রের চেয়ে নিজেকে নেতা হিসেবেই সবার কাছে পরিচিতি দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। অহনাকে সে প্রথম থেকেই পছন্দ করে। অর্থাৎ অহনা যখনযখন প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলো তখন থেকেই। অহনা অবশ্য ফাহাদকে তেমন একটা পছন্দ করে না। সে বেশিরভাগ সময়ই ভয়ে ভয়ে থাকে। কারণ একে তো ফাহাদ তার সিনিয়র এবং এ ভার্সিটির এক ভয়ংকর নেতা। সবাই ফাহাদকে দেখে ভয় পায়। সেখানে অহনার ভয় পাওয়াটাও স্বাভাবিক।

অহনা ফাহাদের কথা শুনে বেশ ভয় পেয়ে গেলো। শুকনো একটা ঢোক গিলে মেয়েটিকে জিজ্ঞাস করলো,
” কেনো ডাকছে?”

মেয়েটা নিচু স্বরে বললো,
” আমি জানি না। তুমি সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে।”

অহনা ভয়ার্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাস করলো,
” এখনই যেতে হবে?”

মেয়েটা হ্যাঁ বোধক জবাব দিলো। অহনা একবার মৌ এর দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা ঢোক দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো। সে এগিয়ে মৌ এর হাত ধরে তাকেও নিজের সাথে নিতে চাইলো। কিন্তু মেয়েটি তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
” মৌ কে নিতে নিষেধ করেছে। আমার সাথেই যেতে বললো তোমাকে।”

মেয়েটার এ কথা শুনে অহনা এবং মৌ ভয়ে চুপসে এলো। মৌ এর বুকের ভেতরটা ধুকপুক শব্দ করে চলছে। তার মন চাইছে অহনার সাথে যেতে। তবে সে নিরুপায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে অহনাকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত হতে বললো। অহনা অসহায় চাহনিতে মৌ এর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে মেয়েটার সাথে হাঁটা ধরলো। সে চলে যেতেই মৌ মনে মনে দোয়াদরুদ পড়া শুরু করলো।

পাঁচ মিনিট বাদে সেই মেয়েটিই মৌ কে ডাকতে এলো। মেয়েটি মৌ কে বললো, অহনা তাকে ডাকছে এখনই। মেয়েটার কথায় মৌ বেশ ভয় পেয়ে গেলো। অহনার বিপদের কথা চিন্তা করতেই কয়েক মূহুর্তের জন্য তার শ্বাস আটকে আসছিলো যেনো। এজন্য কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই সে মেয়েটির সাথে চলে এলো।
মেয়েটি মৌ কে একটা ক্লাসরুমের সামনে এসে দাঁড় করিয়ে বললো,
” এই রুমেই অহনা তোমাকে ডাকছে। ফাহাদ ভাইয়া এবং অহনা এখানেই আছে। তুমি যাও।”

মেয়েটির কথাবার্তা শুনে অজানা আশংকায় মৌ এর বুক কেঁপে উঠলো। সে তড়িৎগতিতে রুমে প্রবেশ করলো। তার কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটি তাকে ক্লাসরুমের দরজা আটকে সেখান থেকে চলে গেলো। ঘটনার আকস্মিকতায় মৌ থ বনে গেলো। সামনের দিকে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে সে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। তার বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করছে। সে বুঝতে পারছে, কোনো এক ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে সে৷
” দরজা ধাক্কিয়ে লাভ নেই মৌ।”

হঠাৎ পিছন থেকে আয়ানেট কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো মৌ। চট করে পিছনে ঘুরতেই আয়ানকে দেখতে পেলো সে। তার মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বেড়িয়ে এলো,
” আয়ান ভাইয়া, আপনি এখানে!”

পরক্ষণেই তার মনে পরলো, সে তো আয়ানের সাথে মৌনব্রত পালন করছে! সাথে সাথেই সে দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরলো।আয়ান মৌ এর কাণ্ডকারখানা দেখে শব্দ করে হেসে বললো,
” এট লাস্ট তুই আমার সাথে কথা বললি। একবার যেহেতু কথা বলেই ফেলেছিস, এর মানে তোর মৌনব্রত ভেঙে গিয়েছে। এবার আমার সাথে ভালোমতো কথা বলে সবকিছু সলভ করবি।”

আয়ানের কথা শুনে মৌ এর মাথা যেনো দপ করে জ্বলে উঠলো। যেহেতু সে আয়ানের সামনে মুখ খুলেই ফেলেছে সেহেতু আজ সে আড়পার করেই দম নিবে। নিজের ভেতর জমিয়ে রাখা ক্রোধ আজ আয়ানের সামনে দেখিয়েই ছাড়বে। আয়ানের প্রতিটা কড়া কথার বদলে সেও তিক্ত কিছু কথা শুনিয়ে দিবে। এ সিদ্ধান্ত নিয়েই সে মুখ থেকে হাত সরিয়ে রাগত স্বরে বললো,
” কি সলভ করার কথা বলছেন আপনি? আমি যে সবার সামনে অপমানিত হয়েছি সেটা সলভ করবেন আপনি?”

মৌ এর উচ্চ এবং রাগত স্বর শুনে আয়ান থতমত খেয়ে গেলো। এমন প্রলয়ঙ্কারী রূপে মৌ কে সে কখনই দেখেনি। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো সে, ‘আমি কি আদৌ আজকে সবকিছু সলভ করতে পারবো?’

®সারা মেহেক

#চলবে

মেঘসন্ধি পর্ব-০৬

0

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

জহির ইসলামের বাসায় মেহমানদারীর তোড়জোড় চলছে। নানা পদের রান্নাবান্না করে ডাইনিং টেবিল প্রায় ভরিয়ে তুলেছেন অবন্তিকা ইসলাম। সকাল থেকেই তনিমা খান, অহনা এবং জান্নাত তাকে সাহায্য করছে। সকলের মধ্যেই ব্যাপক উৎসাহের দেখা মিলছে৷ এ বাড়ির মেয়েকে দেখতে আসবে বলে কথা!
মাহতাব আজ দুপুরের মধ্যেই অফিস থেকে ছুটি ফিরবে। সাথে আয়ানকেও নিয়ে আসবে সে। জহির ইসলাম অতি খুশিতে সকাল হতে এ পর্যন্ত তিন- চারবারেরও বেশি সময় ছেলেপক্ষকে ফোন করেছে। তারা কখন আসবে, কতদূর এসব নিয়েই প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পরেছেন তিনি। এতো ব্যতিব্যস্ত হওয়ার ফলে উনার প্রেশার স্বাভাবিক এর চেয়ে খানিকটা উপরে উঠেছে। এ নিয়ে পরে আফসার খান উনাকে শান্ত হতে বলেছেন। কিন্তু উনাকে কিছুতেই শান্ত করে বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না। মেয়ের বাবা বলে কথা!

.

জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকে বসে আছে মৌ। চেহারায় তার উদাসীনতার ভাব স্পষ্ট। তবে হৃদয়ে তৈরী হওয়া ক্ষতটা কাররো নিকটই স্পষ্ট নয়। এই ক্ষতটার বোঝা একমাত্র সে-ই বয়ে বেড়াচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সে কিভাবে সমাপ্ত হচ্ছে তার বর্ণনা সে কাউকে বলতে পারেনি৷ বরং মুখ বুজে সে সহ্য করে নিয়েছে। আজ দুদিন হলো আয়ানের সাথে কোনরূপ কথাবার্তা বলে না সে। এমনকি এই দুইদিন আয়ানের সম্মুখীনও হয়নি সে। কারণ সে এতোটাও সাহসী নয় যে, আয়ানের মুখোমুখি হয়ে প্রতিটা মূহুর্তে নিজেকে দূর্বল হতে দিবে সে। আয়ানকে সে ভালোবাসে তবে নিজের আত্মসম্মানের চেয়ে বেশি নয়। দুদিন আগে, আয়ান যেভাবে মৌ কে অপমান করেছিলো তাতে মৌ এর আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছিলো। তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, আয়ানকে চিরতরে নিজের মন থেকে উঠিয়ে দিবে। আয়ান নামক কোনো ব্যক্তিকেই সে মনে রাখবে না। সে মূহুর্তে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ মনে হলেও পরে এসে এ সিদ্ধান্তে অটল থাকা তার জন্য সহজ হয়ে উঠছে না।
রোজ রোজ আয়ানকে দেখা, নানা বাহানায় আয়ানের সাথে কথা বলা, মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই আয়ানের শাসন শোনা, এসব মৌ’য়ের নিত্যদিনের এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছিলো। অথচ নিয়তির খেলায় সে অভ্যাস এখনই, এ মূহুর্তেই ত্যাগ করতে হবে, এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী হয়ে গিয়েছে তার জন্য। কিন্তু এতো বছরের অভ্যাস কি দুই দিনেই মুছে ফেলা যায়? উত্তর হলো, না। এ ধরণের অভ্যাসগুলো মন-মস্তিষ্ক থেকে মুছে যেতে অনেক সময়ের প্রয়োজন৷ কিন্তু সেই সময়ই তো নেই মৌ’য়ের কাছে। এতোটা সময় নিয়ে ফেললে তো নিজের সমাপ্তি দেখতে পাবে সে!

চোখের কোল ঘেষে লেপ্টে থাকা নোনাজলের অংশবিশেষ মুছে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো মৌ। মাঝে মাঝে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় এ অক্সিজেনকেও ক্ষেত্রবিশেষে তার নিকট বোঝা মনে হচ্ছে। ছোট্ট একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বাসার সামনের রাস্তার দিকে তাকালো। আয়ান এবং মাহতাব একত্রে হেঁটে হেঁটে আসছ। দুজনের মাঝে চলছে জরুরি বিষয়ে কথাবার্তা। মৌ’র দৃষ্টিজোড়া আয়ানের উপর পড়তেই চট করে সে চোখ বন্ধ করে নেয়। তার মনোজগতে উঁকি দেয় কিছু প্রশ্ন, কিছু কথা…
কাউকে ভালোবাসা এতোটা কষ্ট দেয় কেনো? কেনো সারাজীবন সুখে রাখে না এ ভালোবাসা? এতোকিছু জানার পরও আমরা সেই ভালোবাসার পিছনেই কেনো ছুটে যাই? সবটা জানার পরও ক্ষণিকের সুখের আশায় ভালোবাসা নামক মরিচিকার পিছনে ছুটে যাই আমরা এবং সেখানে দেখা মেলে শুধু কষ্ট আর কষ্ট। কষ্ট ব্যতিত সুখকর অনুভূতি নেই বললেই চলে।

হঠাৎ দরজার ওপার হতে জান্নাতের কণ্ঠস্বর শুনে ভালোমতো চোখের আশেপাশে মুছে নিলো মৌ। ওড়না ঠিক করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরলো সে। অতি সন্তর্পণে দরজা খুলে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ভিতরে চলে এলো সে।
মৌ এর উদাস চেহারা জান্নাতের দৃষ্টিগোচর হতেই ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তার পিছুপিছু অহনাও মৌ এর রুমে এসে উপস্থিত হয়েছে। মৌ বিছানায় বসে পরার সাথে সাথেই অহনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে মৌ এর পাশে বসে পরলো। জান্নাতও মৌ এর অপর পাশে বসেছে।

অহনা মৌ এর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নরম সুরে জিজ্ঞাস করলো,
” কেমন লাগছে?”

মৌ মাথা তুলে হালকা হাসি দিলো। যে হাসিতে নেই কোনো আনন্দ, শুধু লুকিয়ে আছে কষ্ট। অহনার বুকটা কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠলো। ক্ষীণ স্বরে সে বললো,
” বিয়েতে রাজি হওয়া কি এতোটাই দরকার ছিলো?”

মৌ মাথা নিচু করে অহনার হাত হতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ছোট ছোট পা ফেলে জানালার কাছে এসে আকাশ পানে চেয়ে রইলো সে। কিছুক্ষণ বাদে উদাস গলায় বললো,
” আয়ান ভাইয়াকে ভুলে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়ের মধ্যে একটা এটা। ভাগ্য কিছুটা সহায়ক বলেই এমন সময়ে আমার জন্য বিয়ের প্রপোজালটা আসে। আর একদিন না একদিন তো বিয়ে করতেই হবে আমাকে। তো এখনই কেনো নয়?”

অহনা এবং জান্নাত দুজনেই বিছানা ছেড়ে উঠে এসে মৌ এর পাশে দাঁড়ালো। জান্নাত মৌ এর কাঁধে হাত রেখে বললো,
” জানি, তোমাকে একদিন না একদিন বিয়ে করতেই হবে। কিন্তু একটু সময় তো নিতে পারতে। দুইদিন আগেই এতোকিছু হয়ে গেলো…..নিজেকে সামলিয়ে নিতে একটু সময় তো নিবে।”

মৌ শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বললো,
” নিজেকে সামলিয়ে নেওয়ার কি আছে ভাবী? আমি এম ফাইন৷ শুধু একটুখানি কষ্ট হচ্ছে এই আরকি।”

অহনা কণ্ঠে চাপা রাগ দেখিয়ে বললো,
” একটু কষ্ট? আমাদের কি অবুঝ মনে হয় তোর? গত দুইদিন ধরে কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছিস আর আমাদের বলছিস একটু কষ্ট! ভাইয়ার প্রতি এমন রাগ কখনই হয়নি আমার। আমি মেনেই পারছি না……”

অহনাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মৌ শান্ত স্বরে বললো,
” পাস্ট ইজ পাস্ট। আমার মনে হয়, আজ হতে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। আমার খুশির জন্য অন্তত চুপ থাক অহো। ভাবী, তুমিও এ ব্যাপারে কিছুুই বলবে না আমাকে। আব্বু, আম্মু আর ভাইয়া ভেবেচিন্তেই হৃদয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি তাদের সিদ্ধান্তে খুশি আর বাবা মা তো কখনও সন্তানের খারাপ চাইবে না তাইনা? হৃদয়ের সাথে বিয়েতে আমার দ্বিমত নেই। যতদূর শুনেছি হৃদয় অনেক ভালো ছেলে। হ্যাঁ, তাকে আমি ভালোবাসি না। হয়তো কখনই ভালোবাসতে পারবো না। কারণ, একবার যে পথে গিয়ে কষ্ট পেয়েছি সে পথে ভুলেও দ্বিতীয়বার পা বাড়াবো না আমি। ভালোবাসা ছাড়াও তো সংসার করা যায়। আমি সেটাই করবো। এজন্য, প্লিজ তোমরা দুজনে এ বিষয়ে আমাকে আর কিছুই জিজ্ঞাস করবে না। ওকে?” এই বলেই মৌ দু হাতের আঙ্গুল দিয়ে বেশ জোর লাগিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো। জান্নাত এবং অহনা হালকা হেসে বললো,
” ওকে। আর কখনই বলবো না।”
তিনজনের ঠোঁটের কোনেই এবার দেখা মিললো মৃদু হাসির ছোঁয়া।
কিছুক্ষণ বাদে জান্নাত বললো,
” তোমাকে রেডি করিয়ে দিতে এসেছিলাম। আর কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো হৃদয় আর হৃদয়ের ফ্যামিলি চলে আসবে। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও।”

মৌ কোনোরূপ প্রত্যুত্তর না দিয়েই মৃদু হাসি বিনিময় করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

.

” মেয়ে তো মাশা-আল্লাহ অনেক সুন্দর। মেয়ের ছবি দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো আমার। এখন সামনাসামনি দেখে তো মন চাইছে আজই আমাদের বাড়ির বউ করে নিয়ে যাই৷ ” শায়লা বেগমের কথা শেষ হতেই ড্রইংরুমে ছোটখাটো একটা হাসির রোল পরে গেলো। অবন্তিকা ইসলাম বললেন,
” মেয়ে তো এখন থেকে আপনাদেরই। আগামী শুক্রবার কাগজে কলমে একদম আপনাদের বাড়ির বউ হয়ে যাবে সে।”
অবন্তিকা ইসলামের কথা শেষ হতেই হৃদয়ের বাবা হারুন সাহেব বললেন,
” বিয়ের তারিখ তো সব ঠিকঠাক। তবুও ছেলেমেয়ে যদি একটু একা কথা বলে……..”

জহির ইসলাম অতি উৎসাহের সহিত বললেন,
” জ্বি জ্বি কেনো নয়। জান্নাত, তুমি মৌ আর হৃদয়কে মৌ এর রুমে নিয়ে যাও। ওখানেই কথা বলুক ওরা।”

জান্নাত হালকা হেসে বললো,
” আচ্ছা আব্বু। আমি নিয়ে যাচ্ছি ওদের। “এই বলে সে মৌ কে উঠে আসতে ইশারা করলো। মৌ সোফা ছেড়ে উঠে আসতেই হৃদয়ও তার পিছুপিছু চলে এলো।

এদিকে আয়ান এতক্ষণ যাবত সম্পূর্ণ ঘটনা মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলো। মৌ’র হবু শাশুড়ীর মুখে মৌ’র এতো শত তারিফ শুনে সে মৌ এর দিকে ভ্রু কুটি করে তাকালো। জহুরি চোখে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করলো মৌ কে। আসলেই কি মৌ এতো সুন্দর নাকি এই ভদ্রমহিলাই সবকিছু বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন? এটার জবাব খুঁজতেই আয়ান সকলের চোখে ফাঁকি দিয়ে মৌ কে দেখে চলছিলো। তবে এর মধ্যে বাগড়া দিয়ে দিলেন হারুন সাহেব। এভাবে হুট করে ছেলেমেয়েকে একা কথা বলতে দেওয়ার মানে কি! আয়ান এটা ভেবে পেলো না।

মৌ এবং হৃদয় ড্রইংরুমে ছেড়ে চলে যেতেই জহির ইসলাম আফসার খান এবং আয়ানকে হৃদয়ের পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর পরই বিয়ের তারিখ এবং কতজন মেহমানকে দাওয়াত দিবেন সেসব নিয়ে আবারো আলোচনা শুরু করে দিলেন। আয়ানও এ আলোচনায় যোগ দিলো। তবে অফিস হতে একটা জরুরি ফোন আসায় সে আলোচনার মাঝেই উঠে চলে গেলো।
ডাইনিং এ টইটই করে হাঁটতে হাঁটতে সে ফোনে কথা বলছিলো। পাঁচ মিনিট বাদে কথা শেষ হতেই তার চোখ আটকে গেলো মৌ এর রুমের ব্যালকোনির দিকে। রুমে কেউই নেই। বরং ব্যালকনিতেই হৃদয় আর মৌ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছে।
রুমের বাইরে দাঁড়িয়েই মৌ এর রুমের ব্যালকনি স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এমনকি স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু জোরে কথা বললেই রুমের দরজা খোলা থাকলে বাইরে থেকে সব কথাই মোটামুটি শোনা যায়।

আয়ান বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেই ব্যালকনি হতে হৃদয়কে দেখতে পেলো। তবে মৌ কে দেখতে পেলো না। কারণ মৌ দেয়ালের ওপাশে রয়েছে। আয়ান কি মনে করে রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়া আবদ্ধ হলো হৃদয়ের উপর। ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার মধ্যে ভদ্রতার এক প্রতীকের দেখা মিলে। চেহারা দেখেই সকলে বলে দিতে পারবে হৃদয় নামের ছেলেটি বেশ ভদ্র। তবে আয়ান এ ভদ্রতার ট্যাগের সাথে আরেকটি ট্যাগ যুক্ত করতে চাইছে। সেই ট্যাগটা ‘হাবাগোবা’ নামের ট্যাগ। অন্য কারোর কি মনে হয় সেটা আয়ান জানে না। তবে হৃদয়কে দেখে তার প্রথমেই যা মনে পড়ে তা হলো, হৃদয় বেশ হাবাগোবা ধরণের ছেলে। এরপর এসে উপস্থিত হয় ভদ্রতার কথা।
হৃদয় এ মূহুর্তে দুহাত সামনের দিকে একত্র করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে অভ্যাসবশত গালের দাড়ি হালকা করে চুলকিয়ে নিচ্ছে সে। এ দেখে আয়ান হালকা হেসে স্বগোতক্তি করে বললো,
” আই থিংক, মৌ ডিজার্ভস আ বেটার গাই।”

আয়ান আরো কয়েক সেকেন্ড হৃদয়কে পর্যবেক্ষণ করলো। এরপর চলে যেতে নিলেই হৃদয় তাকে দেখে ফেলে। আরেকদফা ভদ্র হওয়ার চেষ্টা করার জন্যই আয়ানকে ব্যালকনি হতে ডাক দিলো হৃদয়,
” আরে ভাইয়া আপনি! ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? এদিকে আসুন। পরিচিত হই।”

আয়ান চাইলেই হৃদয়কে নিষেধ করে দিতে পারতো। তবে কোথায় একটা বাঁধা অনুভব করলো সে। ঠোঁটের কোনে ভদ্রতাজনক হাসি এঁটে নিয়ে সে রুম পেরিয়ে ব্যালকনিতে চলে এলো। ব্যালকনির প্রশস্ততা বেশ ভালো দেখেই সে হৃদয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। এক ঝলক মৌ কে দেখেই সে হালকা হেসে হৃদয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো করমর্দনের উদ্দেশ্য নিয়ে। হৃদয় হাত এগিয়ে করমর্দন করে নিজের পরিচয় দিয়ে আয়ানের সাথে পরিচিত হয়ে নিলো।
এদিকে মৌ তার দৃষ্টিজোড়া দিয়ে রেখেছে ব্যালকনির বাইরে। আয়ান হুট করে আসায় প্রচণ্ড বিরক্তি, রাগ এবং অস্বস্তি নিয়েও ভদ্রতার খাতিরে সে দাঁত রইলো। এ মূহুর্তে হৃদয়ের প্রতি তার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। কি দরকার আয়ানকে এখানে ডাকার! যে আয়ানকে সে এক মূহুর্তের জন্যও চোখের সামনে সহ্য করতে পারে না!

মৌ হাতের মুঠো শক্ত করে নিজের ভেতরকার সুপ্ত রাগ সংবরণের চেষ্টা করছে। এ বিষয়টা হৃদয়ের দৃষ্টির অগোচরে ঘটলেও আয়ানের দৃষ্টিগোচর ঠিকই হলো। সে জানে, মৌ এ মূহুর্তে তাকে এখানে সহ্য করতে পারছে না। এর কারণটাও তার অজানা নয়। সে এ কারণকে পুরোপুরি মিটিয়ে দিতে এ দুইদিনে অনেক চেষ্টা করেছে। তবে প্রতিবারই সে ব্যর্থ হয়েছে। মৌ এর সাথে নানাভাবে কথা বলার চেষ্টা করলেও মৌ সেসবের তোয়াক্কাও করেনি। উল্টো তাকে উপেক্ষা করেছে মৌ। এই দুইদিন যাবত আয়েশা খান এবং অহনাও তার সাথে কথা বলেনি বললেই চলে। যদিও অহনা দু একটা কথা শুনিয়েছে আয়ানকে। তবে আয়েশা খান এক শব্দও কথা বলেনি আয়ানের সাথে।
নিজের ভুলগুলোকে নিয়ে ভালোমতো ভাবনাচিন্তা করে প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগেছে আয়ান। আয়েশা খান, অহনা এবং মৌ, এই তিনজনের উপেক্ষা তাকে ভিতের ভিতরে কষ্টে শেষ করে দিচ্ছে। কিন্তু কাউকেই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না সে। কারণ তার মস্ত বড় ভুলের শাস্তি এটা। এ পর্যন্ত যতবার সে মৌ কে সরি বলার চেষ্টা করেছে, মৌ ততবারই তাকে না শোনার, না দেখার ভান করেছে। এজন্য তার প্রচণ্ড রাগও উঠেছিলো। তবে হাতের মুঠো শক্ত করে এবং জোরে জোর শ্বাস নিয়ে এ অবাধ্য রাগ সংবরণ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না তার কাছে। যে রাগের বশেই এতো বড় ভুল করা, সে রাগকেই আবারো নিজের উপর প্রশ্রয় দেওয়া বোকামি করা ছাড়া কিছুই না।
হঠাৎ হৃদয়ের করা এক প্রশ্নে আয়ানের ধ্যান ফিরে এলো। হৃদয় খানিকটা ইতস্ততভাবেই আয়ানকে জিজ্ঞাস করলো,
” ভাইয়া, একটা প্রশ্ন করবো, কিছু মনে করবেন না তো?”

আয়ান হালকা হেসে বললো,
” আরে না না…. কি প্রশ্ন করার করতে পারো।”

হৃদয় মাথা চুলকিয়ে বোকাসোকা এক হাসি দিয়ে বললো,
” বিয়ের আগেই এ প্রশ্নটা করে নেওয়া ভালো হবে আমার মনে হয়। এখনকার সময়ে এসব বেশ নরমাল বলেই এ প্রশ্নটা করছি আপনাকে। আপনি কি কখনও মৌ কে পছন্দ করতেন বা আপনাদের মাঝে কখনও কিছু ছিলো?”

®সারা মেহেক

#চলবে

মেঘসন্ধি পর্ব-০৫

0

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

বাসায় পৌঁছেই শাওয়ার নিতে চলে গেলো আয়ান। মাথায় একটু ঠাণ্ডা পানি ঢাললে তার রাগটা কমে যাবে, এই আশাতেই শাওয়ার নিতে চলে গেলো সে।
আয়ানের দাদি, আয়েশা খান আয়ানের রুমে এসে আয়ানকে না পেয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। তিনি আজ বেশ অবাক হয়েছেন এই দেখে যে, আয়ান অফিস থেকে ফিরে তার সাথে দেখা করেনি। অন্যান্য দিন আয়ান যত ক্লান্তই থাকুক না কেনো, সে অফিস থেকে ফিরে তার দাদির সাথে দেখা করবেই। এই একজনের সাথেই সে বন্ধুর মতো ফ্রি। অনেক ক্ষেত্রে সে বন্ধুর চেয়েও বেশি ফ্রি। সেই মানুষটির সাথেই আয়ান আজ দেখা করেনি, এটা তার দাদির নিকট বড্ড অদ্ভুত ঠেকছে।

শাওয়ারের পুরোটা সময় আয়ান মৌ কে নিয়ে ভেবেছে। যতই সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ততই তার রাগ কমে আসছে এবং ততই সে উপলব্ধি করতে পারছে মৌ এর সাথে অতোটা খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। এসব ভাবতে ভাবতেই ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এলো সে। রুমের চেয়ারে আয়েশা খান কে দেখতে পেয়ে ছোট্ট করে হাসি দিলো আয়ান। হালকা ভেজা তোয়ালেটা বিছানায় ছুঁড়ে মেরে সে তার দাদির সামনে দু পা ভাঁজ করে বসে পরলো। মৃদু হেসে জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার বিউটি কুইন? আজ এ সময় আমার রুমে? কি চিন্তা করে?”

আয়েশা খান আয়ানের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবে তার কপালের সামনে আসা চুলগুলোকে উল্টো হাতে পিছনে দিয়ে বললেন,
” আজকে তুই আমার সাথে দেখা করতে এলি না যে?”

আয়ান কিছু না বলে আয়েশা খানের পায়ের উপর মাথা দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
” মুডটা প্রচণ্ড খারাপ ছিলো। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে মাথাটা একটু বেশিই গরম হয়ে গিয়েছিলো।”

আয়েশা খান, আয়ানের ভেজা চুলগুলো আলতো হাতে নেড়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাস করলেন,
” কেনো? আজকে এতো কি হয়েছিলো?”

আয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,
” প্রথমেই বসের সাথে কথা কাটাকাটি। এরপর রিকশাওয়ালা আর তার প্যাসেঞ্জারের সাথে ঝগড়া। এরপর মৌ এর প্রপোজ করা…..” আয়ানকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়েই আয়েশা খান চকিত স্বরে জিজ্ঞাস করলেন,
” একদম শেষে কি বললি! ”

আয়ান মাথা তুলে তার দাদির দিকে তাকালো। সে জানতো, তার দাদি মৌ এর প্রপোজ করার বিষয়টা শুনে বেশ অবাক হবে এবং পুরো ঘটনা বলার পর যে তিনি আয়ানের উপর খুব রাগ দেখাবেন, সেটাও আয়ান জানে।
সে কয়েক সেকেন্ড তার দাদির দিকে তাকিয়ে রয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” মৌ আজকে আমাকে প্রপোজ করেছিলো। ”

মূহুর্তেই আয়েশা খানের চেহারায় চরম উত্তেজনার দেখা মিললো। তিনি অতি উৎফুল্লতার সহিত কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন,
“সত্যি বলছিস! ”

আয়ান নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
” হুম। ”

আয়েশা খান এবার কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাস করলেন,
” তুই কি জবাব দিয়েছিস?”

আয়ান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
” রিজেক্ট করে দিয়েছি।”

মূহুর্তেই আয়েশা খানের চেহারায় লেপ্টে থাকা সকল খুশি, কৌতুহল উবে গেলো। তিনি ক্ষীণ স্বরে বললেন,
” কি কি হয়েছে আজকে, সবটা আমাকে বল। আমি শুনতে চাই। ”

আয়ান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে আজকের পুরো ঘটনা বলে ফেললো। তার কথা শুনে আয়েশা খান স্তম্ভিত হয়ে পরলো। মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করতে পারছেন না তিনি। কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত চাহনিতে আয়ানের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি ঠাণ্ডা স্বরে বললেন,
” তোর মতো বেয়াদব ছেলে দুনিয়ায় হয়তো দ্বিতীয়টা নেই৷ তোকে নিজের নাতি বলে পরিচয় দিতেও বিবেকে বাঁধছে আমার। ”

এই বলে আয়েশা খান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আয়ান নিজের দাদির মুখে এমন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। শেষের কথাটি তার বুকে গিয়ে বাঁধলো। সে জানে, তার দাদি তাকে একটু বকাঝকা করবে। তবে এমন কিছু কড়া কথা বলবে তা সে জানতো না। সে উঠে গিয়ে অবিশ্বাসের চোখে তার দাদির দিকে তাকালো। আয়েশা খান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
” ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? ঠিকই বলেছি। এতোদিন তোকে নিয়ে গর্ব করলেও এখন তোর উপর ঘৃনা হচ্ছে আমার।”

আয়ান হতভম্ব হয়ে বললো,
” এমনটা বলতে পারলে দাদি!”

আয়েশা খান ক্ষুব্ধ গলায় বললেন,
” তুই মৌ কে সবার সামনে ওভাবে অপমান করতে পারলে আমি চার দেয়ালের মাঝে তোকে এমন বলতে পারবো না! অবশ্যই বলতে পারবো। তোর দ্বারা এমন কিছুই আশা করেনি আয়ান। আমার নাতি আমার গর্বের কারণ ছিলো। তবে একটা মেয়েকে এভাবে অপমান করায় সে এখন আমার কাছে লজ্জায় মুখ ঢাকার কারণ হয়ে গিয়েছে।”
এই বলে আয়েশা খান চলে যেতে নিলেন। কিন্তু আয়ান তার হাত ধরে পথ আটকে ফেললো। কাতর গলায় বললো,
” দাদি, তুমি আমার রাগ সম্পর্কে অবহিত। তারপরেও এ কথা বলছো?”

আয়েশা খান প্রচণ্ড রাগে আয়ানের হাত ঝামটা মেরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,
” তোর এই রাগই তোকে একদিন নিঃস্ব করে দিবে আয়ান। রাগ উঠেছে বলে তুই এভাবে কথা বলবি মৌ এর সাথে! নম্রতার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তা তুই জানিস না?”

দাদির কথা শুনে আয়ান মাথা নিচু করে ফেললো। আয়েশা খান আবারো বললেন,
” এতো রাগ ভালো না রে আয়ান৷ তোর এতো রাগ দেখলে মনে হয়, তুই রাগের বশে কারোর খুন করতেও পিছপা হবি না। ”

আয়ান অবিশ্বাসের চোখে তার দাদির দিকে তাকালো। আয়েশা সেদিকে তোয়াক্কা না করে ঠাণ্ডা স্বরে বললেন,
” মৌ এর কাছে আজকে এমনকি এখনই গিয়ে মাফ চাইবি। ও যদি মাফ করে তবেই আমার সামনে আসবি তুই। এর আগে না।” এই বলে আয়েশা খান আর এক মূহুর্তও আয়ানের রুমে দাঁড়িয়ে না থেকে চলে গেলেন। তিনি চলে যেতেই আয়ান অনেকটা নিঃশব্দে রুমের দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর ধপ করে বসে পরলো।
প্রচণ্ড অনুশোচনায় ভুগছে সে। মৌ এর সাথে অকারণে যে সে খুব খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে। তার ভেতরটা এ মূহুর্তে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। নিজের বিবেকের উপর সন্দেহ হচ্ছে। আসলেই কি সে বিবেকবান মানুষ? নাকি একজন রগচটা বিবেক বর্জিত মানুষ? আয়ান সবসময় সব মেয়েকে সম্মান করে এসেছে। হ্যাঁ, মৌ এবং অহনাকে সে ক্ষেত্র বিশেষে বেশ বকাঝকা করে। তবে সবার সামনে এমন অপমানিত কখনোই করেনি সে। এই প্রথম সে এতো জঘন্য একটা কাজ করে বসলো। এজন্য সে নিজেই দায়ী। নিজের এ অবাধ্য রাগের উপর কখনই সে নিয়ন্ত্রণ পায় না৷ এজন্য অনেক অঘটন ঘটিয়ে ফেলে সে। তবে এ নিয়ে প্রায়শ্চিত্তও করে সে। কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত করতে বড্ড দেরি করে ফেলে সে।
আয়ান ভাবছে, আদৌ কি এ রাগের উপর কখনও নিয়ন্ত্রণ পাবে সে? নাকি সারাজীবন তার রাগের দ্বারা মানুষগুলোকে কষ্ট দিয়ে চলবে? কবে তার এ ক্রোধ নেমে যাবে? কবে সে একজন বিবেকবান মানুষে পরিণত হবে? কবে?
আয়ান আর পারলো না৷ প্রচণ্ড রাগে বিছানার চাদর এক হাত দিয়ে উঠিয়ে পাশে ছুঁড়ে মারলো। নিজের উপর বাধাহীন রাগ হচ্ছে তার। এ মূহুর্তে তার মন চাইছে সবকিছু ভাঙচুর করতে। তবে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করতে চেষ্টা করলো সে। রাগের বশে আর কিছুই করবে না সে। নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা করবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করবে। তবে এসবের আগে সে সিদ্ধান্ত নিলো, মৌ এর কাছে মাফ চাইতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সে মৌ এর কাছে মাফ চাইবে না ততক্ষণ পর্যন্ত তার আত্মগ্লানি কমবে না এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তার দাদি তার সাথে কথা বলবে না। এটা সে কিছুতেই সহ্য করবে না যে, তার দাদি তার সাথে কথা বলছে না! যেভাবেই হোক, মৌ এর কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। কারণ ভুলটা মৌ এর নয়, ভুলটা আয়ানের। আয়ান পারতো শান্তভাবে মানা করে দিতে। কিন্তু ক্রোধ তার মস্তিষ্কে এঁটে বসেছিলো সে মূহুর্তে। এজন্য কি দিয়ে কি বলেছে তা নিয়ে তখন ভাবেনি সে। তবে এখন ভাবছে সে।

আয়ান লম্বা লম্বা কয়েকটা শ্বাস টেনে নিয়ে ব্যালকোনির দিকে পা বাড়ালো। এখান থেকে স্পষ্টরূপে মৌ এর রুম দেখা যায়। আফসার খান এবং জহির ইসলামের বাড়ি সামনাসামনি। রাস্তার এপাশ-ওপাশ। আফসার খানের বাড়িটি পুরোনো আমলের ছোটখাটো একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি। আয়ানের দাদার আমলে এ বাড়ি বানানো হয়েছিলো। সেখানেই আফসার খান এবং তার ছেলে আয়ান খানের ছোটবেলা কেটেছে৷
এদিকে জহির ইসলামের পিতৃ সূত্রে পাওয়া জমিতে নিজের পরিশ্রমের টাকায় বেশ সময় নিয়ে দো’তালা এক বাড়ি বানিয়েছেন৷ যার নিচ তলার দুটো ইউনিটে ভাড়াটে থাকে এবং দ্বিতীয় তলার দুটো ইউনিট মিলে এক ইউনিট বানানো বাসায় তিনি সপরিবারে বাস করেন। সামনাসামনি দুটো বাড়িতে থাকায় ক্লাস ফাইভ থেকেই আয়ান এবং মাহতাবের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। সে সূত্রে অহনা এবং মৌ এরও বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ব্যস, এভাবেই দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্কের চেয়েও অনেক গভীর সম্পর্ক হয়ে যায়।
জহির ইসলাম এবং আফসার খান যে এলাকায় থাকেন সে এলাকা আগে মোটামুটি ফাঁকা থাকলেও দিনকে দিন ঘিঞ্জি অঞ্চলে পরিণত হচ্ছে। এ সূত্র ধরেই অনুমান করা যায়, দেশের জনসংখ্যা কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে!

আয়ান চুপচাপ গিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে মৌ এর রুমের দিকে উঁকিঝুঁকি দিলো। নাহ, মৌ এ মূহুর্তে রুমে নেই। তাহলে কি সে ছাদে বা অন্য রুমে? ছাদে থাকতে পারে, এই ভেবে আয়ান দৌড়ে নিজেদের বাড়ির ছাদে উঠে পরলো। মৌ’দের ছাদের দিকে তাকাতেই চোখে পরলো, মৌ আর অহনা সামনাসামনি বসে গল্প করছে। এই দেখে আয়ান বেশ খুশি হলো। ছাদে বেশ আরামসে সকল সমস্যার সমাধান করা যাবে ভেবেই সে ছাদ হতে নেমে মৌ’দের বাসার দিকে ছুট দিলো।

অহনা এবং মৌ থেকে থেকে কথা বলছে। অন্যান্য সময়ের মতো উচ্ছ্বসিত ভাবটা এ মূহুর্তে কারোর মধ্যেই নেই। দুজনে আজকের ঘটনায় বেশ বড়সড় এক ধাক্কা খেয়েছে। এ ঘটনা যে কখনোই ভুলবার মতো নয় তা কারোরই অজানা নয়।
অহনা এই সেই নানাকিছু ভাবতে ভাবতে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হঠাৎ পিছনে কারোর উপস্থিতি টের পেতেই সে চকিতে পিছনে ফিরে তাকালো। আয়ানকে দেখতে পেয়ে মূহুর্তেই সে রেগে ফেটে পরলো। ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলো,
” ভাইয়া! তুমি এখানে কি করছো!”

অহনার কথায় চমকে উঠে হাঁটু থেকে মুখ তুলে সামনে তাকালো মৌ। আয়ানকে এখানে মোটেও আশা করেনি সে। আয়ানের দিকে একনজর তাকিয়ে সে দ্রুত উল্টো দিকে ফিরে বসে পরলো। সাথে সাথেই আয়ান কাতর স্বরে বললো,
” মৌ, তোর সাথে কথা আছে। আমার দিকে ফিরে বস। ”
মৌ আয়ানের কথা কানে তুললো না৷ বরং চুপচাপ পাথর হয়ে বসে রইলো। অহনা জানে, মৌ কোনো কথাই বলবে না আয়ানের সাথে। এজন্য সে নিজেই আগ বাড়িয়ে আয়ানকে বললো,
” তুমি এখান থেকে চলে যাও ভাইয়া। ”

অহনাকে পাত্তা না দিয়ে আয়ান মৌ এর উদ্দেশ্যে বললো,
” মৌ, তখনকার বিহেভিয়ার এর জন্য আই এম রিয়েলি সরি। আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। রাগের মাথায়…..” আয়ানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অহনা রাগত স্বরে বলে উঠলো,
” তুমি আজকে যা করেছো তা ভুলবার মতো ঘটনা না। এতোগুলো মানুষের সামনে মৌ কে এভাবে অপমান করতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না! কি করে পারলে এমনটা করতে?”

আয়ান এবার অহনার দিকে ফিরে বললো,
” আমার ভুল হয়ে গিয়েছে অহো। তখন প্রচণ্ড রাগে ছিলাম বলে কি দিয়ে কি বলে ফেলেছি তা এক মূহুর্তও ভাবিনি আমি। কিন্তু পরে এ নিয়ে প্রচণ্ড গিল্টি ফিল করেছি।”

অহনা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
” তোমার গিল্টি ফিলও হয় ভাইয়া? আমার তো জানা ছিলো না। আজকে জানলাম। ভালো লাগলো জেনে। তবে তোমার এ গিল্টি ফিলিংসের কোনো কাজ নেই এখানে। তুমি যেতে পারো।”

আয়ান আবারো কাতর গলায় বললো,
” অহো, তুই তো আমার রাগ সম্পর্কে অবহিত। তারপরও এমনট বলছিস কেনো? রাগের মাথায় বলা কথাগুলো মনে নিতে হয় না। ”

” সিরিয়াসলি ভাইয়া! এই রাগের মাথায় বলা কথাগুলো একজনকে পুরোপুরি ভেঙে দেওয়ার পরও বলছো, এসব মনে নিতে হয় না! মৌ তোমাকে ভালোবাসে…….” কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করার আগেই মৌ অহনার হাত ধরে ফেললো। যার অর্থ আয়ানকে এ ব্যাপারে কিছুই না বলতে। মৌ এর ইশারায় অহনা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আয়ানকে অনেক কথা শুনিয়ে দিতে মন চাইছে তার। কিন্তু মৌ তাকে চুপ থাকতে বলেছে। এজন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে চুপ থাকতে হবে। যদিও তার পুরো শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছে, আয়ানের সাথে ঝগড়া করতে তার গলা নিশপিশ করছে। তবুও সে এসবের কিছু করবে না।

আয়ান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো বললো,
” মৌ, আই এম রিয়েলি সরি। আমাকে মাফ করে দে প্লিজ। আমি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি। এমনটা…..” আয়ানকো মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মৌ নিজ অবস্থানে অটল থেকেই কাটা কাটা গলায় বললো,
” আমি আয়ান নামে কাউকে চিনি না। অর্থাৎ আয়ান নামের মানুষটা আমার কাছে অপরিচিত আর আমি অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলতে পছন্দ করি না৷ এদের সাথে মৌনব্রত পালন করতেই বেশি পছন্দ করি আমি। এ ছাদে আয়ান নামের কেউ থেকে থাকলে অতি সত্বর যেনো সে চলে যায়। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো লাভ নেই। কারণটা কিছুক্ষণ আগে জানানো হয়েছে।”

মৌ এর কথা শেষ হতেই অহনা আয়ানকে চলে যেতে ইশারা করলো। মৌ এর শক্ত গলায় বলা প্রতিটা কথা শুনে সে বুঝতে পারলো, এ মূহুর্ত এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোনো কাজ নেই৷ মৌ যে তার সাথে কথা বলবে না তা সে বেশ ভালোভাবেই জেনে গিয়েছে।
আয়ান নিরুপায় হয়ে দূর্বল পায়ে ছাদের দরজার দিকে পা বাড়ালো। ছাদ হতে নেমে দু সিঁড়ি এগুতেই সে মৌ এর ফোলা ফোলা রক্তবর্ণের চোখজোড়া দেখতে পেলো। মূহুর্তেই তার বুকের ভেতর কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো! অদ্ভুত তো!

®সারা মেহেক

#চলবে

মেঘসন্ধি পর্ব-০৪

0

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

মৌ আজ পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ গতকালই তার জ্বর নেমে গিয়েছিলো। এজন্য আজ পরীক্ষা দিতে আসবে বলে রাতেই পড়া শেষ করে সে।
আজকে ভার্সিটিতে পরীক্ষা থাকায় সে আর অহনা সকাল সকাল বেরিয়ে পরে। মাহতাব অফিসে যাওয়ার পথে তাদের দুজনকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দেয়। ক্লাসে ঢোকার আগে মৌ অহনাকে বললো,
” অহো….আমি ভাবছি, আজকে আয়ান ভাইয়াকে সবটা বলে দিবো।”
মৌ এর কথায় অহনা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
” উফ, আমার মৌটুসী পাখি! অবশেষে তুই ভাইয়াকে তোর মনের কথা বলবি৷ আমি তো গত পরশু ভেবে রেখেছিলাম যে, তোকে প্রপোজ করতে বলবো। বাট, তুই তো অসুস্থ হয়ে পরলি, এজন্য আর সম্ভব হলো না। কিন্তু আজকে তা সম্ভব হবে। ”

মৌ মুচকি হেসে বললো,
” আমি আজকে মনের দিক থেকে ফুল প্রিপারেশন নিয়ে এসেছি। যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে ক্লিয়ার হওয়া ভালো। কারণ, আয়ান ভাইয়ার জন্য গত দুইরাতের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিলো আমার, অসুস্থ থাকার পরও। তাহলে ভাব, কতোটা চিন্তায় আছি এ নিয়ে। ”

মৌ এর কথা শুনে অহনা টিপ্পনী কেটে বললো,
” ওহ-হো…… আমার ভাই তাহলে তোর রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। ”
অহনার কথার প্রত্যুত্তরে মৌ কিছু বললো না৷ শুধু লাজুক এক হাসি দিলো। অহনা আবারো বললো,
” ভাইয়াকে তাহলে ভার্সিটিতে আসতে বলি। এখানকার একটা খালি জায়গায় বসেই কথাবার্তা বলিস নাহয়। বাসায় তো এসব সম্ভব না। আর রেস্টুরেন্টে অনেক মানুষজন থাকবে, তো সেখানে তো আরোই সম্ভব না। এর চেয়ে ভালো ভার্সিটিতেই কথা হোক।”

অহনার প্রস্তাবে প্রথম প্রথম মৌ রাজি না হলেও পরে ঠিকই রাজি হয়ে গেলো। সবকিছু সম্পূর্ণ ভেবেচিন্তে তারা দুজন ক্লাস চলে গেলো।

.

আজকে বসের কাছে বেশ কয়েকটা খোঁটা শুনেছে আয়ান৷ এজন্য প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে আছে তার। ডেস্কে বসার সাথে সাথেই সে ভেবেছিলো যাওয়ার আগে বসের হাতে রেজিগনেশন লেটার ধরিয়ে দিয়ে আসবে। রাগের মাথায় পুরো লেটার লেখাও শেষ হয়েছিলো তার। এমনকি লেটার হাতে নিয়ে সে বসের কাছে যেতেও বসেছিলো কিন্তু পথিমধ্যে অহনার ফোনকল আসায় সে বসের রুমে যেতে পারেনি।
অহনা তাকে জরুরী ভিত্তিতে দুপুর দুটার দিকে ভার্সিটি আসতে বলেছে। প্রথম প্রথম সে অহনাকে কয়েকটা ধমক দিলেও অহনা সেসবে পাত্তা দিলো না৷ বরং সে, আফসার খান অর্থাৎ নিজেদের বাবার ভয় দেখিয়ে আয়ানকে আটকে ফেলে। ফলে উপায় না থাকায় দাঁতে দাঁত চেপে অহনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সে।

আয়ান ডেস্কে ফিরে এসে রেসিগনেশন লেটারটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে লক করে রাখে। আপাতত রেসিগনেশন লেটার দেওয়ার চিন্তা মাথা হতে নেমে গিয়েছে তার। কিন্তু তার ক্রোধ নামেনি। বরং সে অফিসের বসকে মনে মনে ইচ্ছামতো বেশ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিচ্ছে।
বসের উপর আয়ানের এ রাগ সময় সুযোগ বুঝে মাঝেমধ্যে হানা দেয়। তাছাড়া সাধারণত সে বসের উপর রেগে থাকে না বা তার বস তার উপর রেগে থাকে না। অবশ্য তাদের মধ্যে নতুন কোনো ডিল বা প্রমোশন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। আপাতত আয়ান বেশ কিছুদিন ধরে তার বসের উপর রেগে আছে। কারণ সে প্রমোশন প্রার্থী, তবে তার বস হাতে আসা নতুন প্রজেক্টের জন্য সকলের নিকট দোয়া প্রার্থী। আয়ান অবশ্য ইনিয়েবিনিয়ে বেশ ক’বার প্রমোশনের কথা বলেছে। তবে তার বস সম্পূর্ণ কথা বোঝার পরও না বোঝার ভান করে বসে থাকে। এজন্যই তার উপর আয়ানের রাগটা বেশি।

কোনোরকমে আজকের কাজ শেষ করে আয়ান দুপুর একটার দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে পরলো। আজ আপাতত কাজ একটু কম থাকায় সে দ্রুত বেড়িয়ে পরতে পেরেছে। তবে রাতে ল্যাপটপে বাকি কাজটুকু শেষ করতে হবে৷ এই লক্ষ্য নিয়েই সে বাইকে চড়ে বসলো।

কিছুটা ঠাণ্ডা মাথায় আয়ান বাইক চালাচ্ছে। তবে তার এ ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের স্থায়িত্ব খুব বেশি হলো না৷ ভার্সিটির কাছাকাছি এসে ইউ টার্ন নিতে গিয়ে তার বাইক এবং একটি রিকশার মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। যদিও তা ছোট পর্যায়ের তবে আয়ানের রাগের উপর এ ছোট্ট ঘটনা ঘি এর কাজ করলো। কিছুক্ষণের জন্য আটকে থাকা তার সুপ্ত রাগ এখন রিকশাওয়ালা এবং রিকশার সেই যাত্রীর উপর আগ্নেয়গিরির মতো বর্ষিত হওয়া শুরু হলো। অবশ্য রিকশাওয়ালা এবং তার যাত্রীও কোনো অংশে কম নয়। তারাও আয়ানের উপর রাহ দেখাতে শুরু করলো।
তিনজন একদম সমানতালে একে অপরের সাথে ঝগড়া করে চলছে। কারোরই থামার নাম নেই। বরং তিনজনই একে অপরের উপর দোষ চাপিয়ে দিতে ব্যস্ত। এক্ষেত্রে অবশ্য দোষ দুপক্ষেরই আছে৷ তবে তারা সেটা মানতে নারাজ। মিনিট পাঁচেকের ঝগড়া বিবাদের পর চতুর্থ পক্ষের হস্তক্ষেপে সেই ঝগড়ার সমাপ্তি ঘটে। অবশেষে আরেক দফা রাগের আগ্নেয়গিরি নিজের মধ্যে সমাহিত করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো আয়ান।

এদিকে আজ আয়ানকে প্রপোজ করবে বলে মৌ এর মধ্যে ভয় এবং উৎকণ্ঠার সীমা নেই৷ অবশ্য এর পাশাপাশি সে খানিকটা খুশিও বটে। কারণ, এতোদিন পর সে সরাসরি আয়ানকে নিজের মনের কথা বলবে। পাশাপাশি সে অবশ্য এটাও ভাবছে যে আয়ানও তাকে ভালোবাসে। তার প্রতি আয়ানের যত্নশীল নজর, বিপদ আপাদ থেকে রক্ষা করার প্রতিটা মূহুর্তেই সে ভেবেছে আয়ানের মনে সুপ্ত কিছু অনুভূতি রয়েছে। যদিও এ বিষয়ে সে কখনই নিশ্চিত হয়নি৷ অনেকটাই আন্দাজের উপর ভিত্তি করে সে মনে মনে এসব সাজিয়েছে সে। এতোদিনের অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে অবশেষে সে আজ আয়ানের মনের কথা জানতে চলেছে। আজ সে জানতে পারবে, আয়ান আদৌ তাকে ভালোবাসে কি না।

আয়ান, অহনার নির্ধারিত করা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মৌ এবং অহনা এখনও সেখানে পৌঁছায়নি। গাছের নিচে বসেও প্রচণ্ড গরমে তড়তড় করে ঘামছে আয়ান। চারপাশে বাতাসের আনাগোনা তেমন নেই বললেই চলে। এজন্য প্রচণ্ড গরমে আয়ানের মেজাজ ধীরেধীরে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে।

শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ভাজ করে হাত ঘড়ির দিকে এক নজর বুলালো সে। দুইটা বেজে দশ মিনিট হয়েছে। যেখানে অহনা বরাবর দুইটার সময় আয়ানকে ভার্সিটিতে এসে পৌঁছাতে বলেছে, সেখানে অহনা নিজেই পৌঁছায়নি। ব্যাপারটা মেজাজকে গরম বানিয়ে দিতে যথেষ্ট।

অবশেষে আরো পাঁচ মিনিট পর অহনা এবং মৌ হাসিমুখে আয়ানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। এই দুজনের ঠোঁটের কোনে এঁটে থাকা হাসিটা মোটেও সহ্য হচ্ছে না আয়ানের। গুনে গুনে পনেরো মিনিট তাকে অপেক্ষা করিয়েও কিভাবে দুজনের মেজাজ এতো ফুরফুরে থাকে ! কিভাবেই বা তাদের চোখেমুখে এতো খুশির ছটা থাকে! কিছুক্ষণ ভাবাভাবির পরও সে এর যথার্থ কারণ খুঁজে পেলো না। উপরন্তু তার রাগ আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
নিজের এ অবাধ্য রাগের উপর প্রচণ্ড বিরক্ত আয়ান। এজন্য মাঝেমাঝে সামনের মানুষটির উপর অহেতুক মেজাজ দেখিয়ে বসে সে। পরে অবশ্য এ নিয়ে আফসোসও প্রকাশ করে সে। নিজের রাগের এ অনুভূতিগুলোকে সে পুরোপুরি শেষ করে দিতে চায়। তবে সে বরাবরই এতে ব্যর্থ হয়।

অহনা এবং মৌ আয়ানের সামনে আসতেই আয়ান ঠাণ্ডা স্বরে জিজ্ঞাস করলো,
” একজন মানুষকে এই গরমে এতোক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখার অর্থ কি?”

অহনা এবং মৌ কোনো জবাব দিলো না৷ বরঞ্চ মৌ ভয়ে চুপসে গেলো। এতোক্ষণ ভিতরে ভিতরে জমিয়ে রাখা আত্মবিশ্বাসটা এবার পিছনের গেট দিয়ে পালিয়ে গেলো। শুকনো একটা ঢোক গিলে সে অহনার দিকে তাকালো। অহনা চোখের ইশারায় মৌ কে ভরসা দিলো। যার অর্থ, ‘কিছুই হবে না। তুই ভাইয়াকে মনের কথা বলে দে। ‘

অহনার চোখের ইশারায় মৌ কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলো। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে আয়ানের দিকে তাকালো সে। তার কিছু বলে উঠার আগেই আয়ান চোখ গরম করে বললো,
” কি হলো? চুপ করে আছিস কেনো দুইজন?” এই বলে কয়েক সেকেন্ড থামবার পর সে আবারো টেনে টেনে বললো,
” যে কাজে ডেকেছেন সে কাজটা কি, তা দয়া করে বলবেন আপনারা?”

আয়ানের প্রশ্ন শোনার সাথে সাথেই অহনা মৌ এর বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে নিজের কথা বলতে বললো। অহনার ইশারায় মৌ তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে চোখজোড়া খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। মুখস্থ বিদ্যার মতো হড়বড় করে বলতে লাগলো,
” আয়ান ভাইয়া, আমি আপনাকে ভালোবাসি। এটা ডেয়ার না। একদম সত্য কথা। আমি মন থেকে এটা বলছি। আমি আপনাকে অনেক দিন যাবত ভালোবাসি। অনেক ভাবনা চিন্তা করে আজ আপনাকে কথাগুলো বললাম। এবার আপনার যা সিদ্ধান্ত হবে তাই মাথা পেতে মেনে নিবো।” এই বলে দ্রুততার সহিত ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো মৌ। তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রচণ্ড তেজি গতিতে চলছে। যেনো এখনই তা বুকের খাঁচা হতে বেড়িয়ে যাবে।

এদিকে আয়ান স্তব্ধ হয়ে মৌ এর কথাগুলো শুনলো। নিজের কানকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না যে, মৌ এসব কথা বলছে তাকে। আয়ান পুরোপুরি নিশ্চিত হতে কিছুটা অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞাস করলো,
” এ মূহুর্তে আমাকে কি বললি মৌ? আরেকবার বল তো।”

মৌ আগের মতোই হড়বড় করে বলে দিলো,
” আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং এটা কোনো নাটক নয়। সম্পূর্ণ সত্য।”
মৌ এর কথা শেষ হতেই আয়ান দু হাত উঁচিয়ে সজোরে হাতে তালি দিতে লাগলো। গলার আওয়াজ উঁচিয়ে রাগত স্বরে বললো,
” বাহ বাহ….তো এই ছিলো তোদের সো কল্ড অতি জরুরি কাজ! আই এম শকড! কি চিন্তাভাবনা করে এসব বললি আমাকে মৌ? আগেপিছে কি কিছুই ভাবিস নি ? তুই কি ভেবেছিস, তুই আমাকে প্রপোজ করলে আমিও প্রত্যুত্তরে বলবো, আমি তোকে ভালোবাসি?”

আয়ানের এহেন কথাবার্তায় মৌ মাথা তুলে অবিশ্বাসের চোখে তাকালো তার দিকে। আয়ানের এই কয়েক লাইনের কথাবার্তাই প্রমাণ করে দিলো, আয়ানের মনে তার জন্য কোনো ধরণের অনুভূতি নেই। এ ব্যাপারে আগেই সে কিছুটা অনুমান করেছিলো। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো না সে। বরং এ কয়দিনে সে নিজের মনকে বুঝিয়েছে, আয়ানও তাকে ভালোবাসে। আগেকার সেই না বোধক ধারণাকে ইচ্ছা করেই পাশ কাটিয়ে হ্যাঁ বোধক সকল ধারণাকে নিজের মনে পুষে রেখেছিলো সে। কিন্তু তার এ সিদ্ধান্ত যে তাকে এভাবে ধাক্কা দিবে তা সে ভেবে উঠতে পারেনি।

মৌ কিছু না বলে স্থির দৃষ্টিতে আয়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো। আয়ান কিছুটা ধমকের সুরে বললো,
” তোর মাথা কি ঠিক আছে মৌ? তুই কি ভেবে আমাকে প্রপোজ করলি? আমি কি তোকে কখনও এমনটা ইশারা করেছি? বল আমাকে?”

মৌ কোনো জবাব দিলো না। বরং চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এদিকে মৌ এর এই নির্বিকার ভঙ্গি দেখে আয়ানের ক্রোধ ধীরেধীরে আকাশচুম্বী হচ্ছে। সে প্রচণ্ড আক্রোশে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
” তুই এতোটা বেহায়া সেটা জানতাম না আমি। এভাবে আমাকে প্রপোজ করতে চলে এলি! আমি কি কখনো তোকে আমার কাজের মাধ্যমে বলে বুঝিয়েছি যে আমি তোকে ভালোবাসি? আমার তো এমন কিছু মনে পড়ে না৷ তারপরও তুই আমাকে প্রপোজ করলি! তুই কি ভেবেছিলি আমিও তোকে নাচতে নাচতে বলবো, ‘মৌ, আমিও তোকে ভালোবাসি? ‘ নেভার এভার। কখনোই এমনটা বলবো না আমি৷ কজ আই যাস্ট ডোন্ট লাইক ইউ৷ সবসময় মুসিবতের গোডাউন নিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসিস তুই। আমার হাজার রাগ, হাজার বিরক্তির কারন তুই। আর সেই তোকেই কি না আমি ভালোবাসবো! হাসিয়ে ছাড়লি আমাকে। নিজেকে কি ভাবিস তুই হ্যাঁ? বিশ্ব সুন্দরী? এতো বছরেও যখন আমি তোকে ভালোবাসতে পারিনি, সেখানে এখন ভালোবাসা তো দূরের কথা, তোকে আমার চোখের সামনেই সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। আর তুই কি না ভাবনাচিন্তা ছাড়াই আমাকে প্রপোজ করে বসলি!” এই বলে সে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো। এরপর দু হাত মাথায় চেপে ধরে বললো,
“এ মূহুর্তে আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে আছে। মন চাইছে, এই এতোগুলো মানুষের সামনেই তোর দু গালে দুটো চড় বসিয়ে দেই। সকাল থেকেই বসের প্যানপ্যানানি, আবার রিকশাওয়ালার অশ্রাব্য ভাষার গালাগালি আর এখন তোর এই প্রপোজাল….. সব মিলিয়ে আমার রাগটা যে এখন কোন পর্যায়ে আছে তা আন্দাজও করতে পারবি না তুই। আর বেছে বেছে আজকের দিনেই তোর প্রপোজ করতে হলো। আমার রাগটাকে বাড়ানোর কি দরকার ছিলো? ফালতু একটা মেয়ে কোথাকার।” এই বলে আর এক মূহুর্তের জন্যও আয়ান সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো না। বরং বড় বড় পা ফেলে ভার্সিটির গেট থেকে বেড়িয়ে বাইক নিয়ে চলে গেলো সে।

আশেপাশে থাকা ভার্সিটির কয়েকজন ছেলেমেয়ে আয়ানের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সেই গাছের তলার চারপাশে ছোটখাটো একটা ভিড় জমালো। প্রথম প্রথম দু একজন ছেলেমেয়ে থাকলেও তাদেরকে এদিকে এগিয়ে আসতে দেখে তামাশা দেখার টানে অদূর হতেও কয়েকজন ছেলেমেয়ে চলে আসে। মৌ এর প্রপোজাল দেওয়া, আয়ানের রিজেকশন দিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করা, সবকিছু নিয়েই প্রত্যেকের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। অহনা এবং মৌ প্রতিটা কথা মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছে। অহনা প্রথমে কিছুতেই আয়ানের এমন ব্যবহার মেনে নিতে পারেনি। পুরোটা সময় সে হতভম্ব হয়ে আয়ানের কথাবার্তা শুনেছে। সে আয়ানের এ অতিরিক্ত রাগ সম্পর্কে জানে। তবে সেই রাগ যে আজকে এভাবে ভয়ংকর রূপ ধারণ করবে সেটা তার জানা ছিলো না।
অহনা এ মূহুর্তে মৌ কে নিয়ে চিন্তিত আছে। মৌ প্রতিটা কথা কিভাবে সহ্য করেছে তারই হিসাব কষছে সে মনে মনে। সে যতদূর জানে, এতগুলো মানুষের সামনে এভাবে অপমানিত হওয়ার পর মৌ কখনোই আয়ানের সাথে কথা বলবে না৷ অবশ্য কথা বলার চিন্তাভাবনা করা হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো অর্থাৎ অসম্ভব কিছু। মৌ যে ভুলেও আয়ানের সামনে যাবে না, অহনা তা স্পষ্টভাবেই জানে। কারণ মৌ প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ মেয়ে। এর আগে আয়ানের বকাঝকা তার উপর খুব একটা প্রভাব না ফেললেও, আজকে এতোগুলো মানুষের সামনে অপমানিত হওয়ার প্রভাব সামনের দিনগুলোতে খুব ভালোভাবেই পড়তে চলেছে। তবে এ মূহুর্ত মৌ এর মনে কি চলছে তা অহনা জানে না।

এদিকে মৌ নিরবে চোখের জল ফেলে মনে মনে কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো।

®সারা মেহেক

#চলবে

মেঘসন্ধি পর্ব-০৩

0

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

আয়ান দ্রুত মৌ এর সামনে বসে পরলো। ততক্ষণে ভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষার্থী আয়ান,মৌ এবং অহনাকে ঘিরে ধরলো। সকলেই বলাবলি করছে, ‘হুট করে মেয়েটা এভাবে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলো কেনো?’
এদিকে কারোর কোনোরূপ কথাবার্তাই অহনার কানে আসছে না। সে এ মূহুর্তে মৌ কে নিয়ে প্রচণ্ড ভীত-সন্ত্রস্ত। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘মৌ জ্বরের কারণে এভাবে মাথা ঘুরে পরে গেলো! তাহলে কত ভয়ানক জ্বর বাঁধিয়েছে সে!’

প্রচণ্ড চিন্তার মধ্যেও অহনা কাঁপা-কাঁপা গলায় আয়ানকে বললো,
” ভাইয়া…..জলদি একটা সিএনজি ডাক। ওর অবস্থা হয়তো ভালো না।”
এই বলে অহনা দ্রুততার সহিত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে মৌ এর চোখেমুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো। আয়ান ততক্ষণে সিএনজি আনতে চলে গিয়েছে।
পানির ছিটায় পিটপিট করে চোখের পাতা খুললো মৌ। মুখের উপর গুটিকয়েক মানুষজনকে ঝুঁকে থাকতে দেখে খানিকটা ভড়কে উঠে সে। দ্রুত উঠতে নিলেও শরীরে শক্তির স্বল্পতা অনুভব করে সে। অহনা তা দেখে মৌ কে বললো,
” ধীরে ধীরে উঠার চেষ্ট কর। ভাইয়া সিএনজি আনতে গিয়েছে। ”
অহনার কথা শেষ হতে না হতেই আয়ান এসে হাজির হলো। মৌ এর দিকে ভ্রুকুটি করে চেয়ে থেকে বললো,
” তাহলে ম্যাডাম উঠেছে। ভেবেছিলাম, মনে হয় হসপিটালেই নিয়ে যেতে হবে ওকে। শেষমেশ, সময় থাকতেই উঠে পরেছে। ভালো…..”

অহনা আর মৌ আয়ানের কথার গুরত্ব দিলো না। বরং অহনা আয়ানকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” ভাইয়া, মৌ কে গেট পর্যন্ত নিয়ে যাবো কিভাবে?ওর শরীর তো দূর্বল। বাহিরের গেট পর্যন্ত তো আমি একা হাতে কিভাবে নিয়ে যাবো?”

আয়ান একনজর আশেপাশে তাকিয়ে বললো,
” তোদের আর ফ্রেন্ড নেই আশেপাশে? ”

” আপাতত না। এই ভীড়ের মধ্যে থেকেই একজনকে বলো আমাকে সাহায্য করতে। ”
মৌ ততক্ষণে আস্তে আস্তে করে উঠার চেষ্টা করছে। অহনা যতটুকু পারছে তাকে সাহায্য করছে। আয়ান ভীড়ের মধ্যে থেকেই একটা মেয়েকে বললো, মৌ কে একটু সাহায্য করতে। মেয়েটাও বিনাবাক্যে মৌ এর কাছে চলে এলো।

সিএনজির কাছে এসে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিলো আয়ান। অহনা আর সেই মেয়েটি মৌ কে সিএনজির কাছে আনলে মৌ অহনার হাত ধরে কষ্টেসৃষ্টে সিএনজিতে উঠে বসে। তারা উঠার পরপরই সিএনজি স্টার্ট হয়ে গেলো। খানিকটা বিরক্ত আর অনিচ্ছা নিয়েই সে সিএনজির পিছু পিছু বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

.

” এই৷ মেয়েটার তো এক কথা কানে যায় না। এতো ঢিট! গতকাল বললাম,বৃষ্টিতে ভিজিস না। জ্বর বাঁধতে সময় লাগবে না। কিন্তু এ কি শোনার পাত্র! ”
প্রচণ্ড তেজে কথাগুলো বলে ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ছাড়লো আয়ান। অবন্তিকা ইসলাম, জহির ইসলাম, মাহতাব, জান্নাত এবং অহনা চুপচাপ বসে আয়ানের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে একনজর মৌ এর দিকে তাকাচ্ছে।
এ মূহুর্তে বালিশে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে মৌ। কান দিয়ে কথা শোনা ছাড়া আর কোনো কাজ না থাকায় হাতের আঙ্গুলগুলোর চামড়ার ভাঁজ দেখছে সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আয়ানের প্রতিটা ধমক মুখ বুজে সহ্য করে নিচ্ছে সে। প্রতিবার এমনটাই করে সে। কোনো ভুল করে থাকলে আয়ান আর মাহতাব তাকে ইচ্ছামতো ধমকাতে পিছপা হয়না। যেখানে ছোটখাটো ভুলেই সে ধমক শুনে, সেখানে রীতিমতো অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছে সে!

মৌ কে বাসায় আনা হলে পরিচিত এক ডক্টর দিয়ে তাকে দেখানো হয়। কিছু ওষুধপত্র লিখে ডক্টর চলে যেতেই মাহতাব আগুনের গোলার মতো বর্ষিত হতে থাকে মৌ এর উপর। পরে সে চুপ হয়ে বসে থাকলে আয়ান ধমকানো শুরু করে। এক্ষেত্রে মৌ এর মা অবন্তিকা ইসলাম এবং মৌ এর বাবা জহির ইসলাম নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। কারণ তারা জানেন মৌ এর ভুল হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানেই দ্বিতীয়বার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়া। যদিও মৌ কে দুজনেই খুব ভালোবাসেন।

কিছুক্ষণ থেমে থেকে আয়ান মৌ এর দিকে তাকিয়ে তেজি সুরে বলতে লাগলো,
” এখন মাথা নিচু করে বসে আছিস কেনো? বৃষ্টিতে ভেজার সময় তো ধেই ধেই করে নাচছিলি! আবারো বললি কি? ‘আমার জ্বরে আসবে না আয়ান ভাইয়া। গত দুইবার আসেনি, এবারও আসবে না।’ অথচ এখন কি হলো? জ্বর বাঁধিয়ো রীতিমতো অজ্ঞান হয়ে পরেছিলি! উফ,, মাথাটাই খারাপ করে দিলি তুই। তোর আর অহনার মত ত্যাড়া মেয়ে আমি এ জীবনেও দেখিনি।”

অহনা এবার তেড়ে গিয়ে বিস্ময় নিয়ে বললো,
” এর মধ্যে আবার আমি কি করলাম! শুধু শুধু আমাকে টানছো কেনো ভাইয়া? ”

” তোকেও টানা উচিত এর মধ্যে। দুটো আস্ত এক ঝামেলার গোডাউন। ঠিক বলেছি না মাহতাব?”

মাহতাব তীক্ষ্ণ চোখে একবার মৌ এর দিকে এবং একবার অহনার দিকে চেয়ে বললো,
” একদম ঠিক। ”

আয়ান এবার অবন্তিকা ইসলামকে বললো,
” আন্টী, মৌ কে একটু বকবেন। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে অথচ এখনও ওকে বকতে হয়! এতো বড় মেয়েকে বকা দেওয়া উচিত না। তবুও বকতে হয়। এই যে, এখন জ্বর বাঁধিয়ে ফেললো, এই সারতে সারতে দুই-তিনদিন পার হয়ে যাবে। জুলুম হয়ে যাবে আপনার আর জান্নাত ভাবীর।”
এই বলে আয়ান চুপ করে রইলো। অবন্তিকা ইসলাম শান্ত দৃষ্টিতে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
” সবসময় একটা না একটা ঝামেলা বাঁধিয়েই চলিস। তোদের ঝামেলায় কোনো না কোনোভাবে ছেলে দুটোকে টেনেই আনিস। কবে যে শুধরাবি! গতকাল আয়ানের কথা শুনে বৃষ্টিতে না ভিজলে এই জ্বর আসতো না। আর তোকে নিয়েও এতো টেনশন করতে হতো না। কিন্তু তুই শুনলে তো…..” এই বলে অবন্তিকা ইসলাম চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন। স্ত্রীর পিছুপিছু জহির ইসলামও ছুটে চললেন। তারা চলে যেতেই আয়ান মৌ এর সোজাসুজি বিছানায় বসে মিষ্টি স্বরে বললো,
” মৌ…..আর কি কোনো সমস্যা ক্রিয়েট করা বাকি আছে? বাকি থাকলে আজকের মধ্যেই করে ফেল।” এই বলে আয়ান কয়েক সেকেন্ড চুপ রইলো। পরমূহুর্তেই দ্বিগুণ তেজে বললো,
” আমার আর ধৈর্য নেই প্রবলেম সলভ করার। আমাকে আর মাহতাবকে কি সব প্রবলেম সলভ করার মেশিন মনে হয়? সেই ক্লাস ফাইভ থেকে তুই আর অহনা একসাথে আছিস। সেই থেকে যে তোদের প্রবলেম সলভ করা শুরু করলাম…..এই যাত্রা আর শেষই হচ্ছে না। একটা কথা বলে রাখি…..এখন থেকে তুই আর অহনা মিলে নিজেদের প্রবলেম সলভ করবি। খবরদার আমাদের ডিস্টার্ব করবি না।” এই বলে চট করে উঠে মৌ এর রুম থেকে বেরিয়ে গেলো আয়ান। তার পিছুপিছু মাহতাবও বেরিয়ে গেলো। রুমে রইলো মৌ, অহনা এবং জান্নাত।
আয়ান আর মাহতাবকে এতো রাগারাগি করতে দেখে জান্নাত পুরোটা সময় চুপ করে ছিলো। কারণ সে জানে, এর মধ্যে সে যদি কিছু বলে তাহলে মাহতাব তাকেও কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিবে। সুতরাং, চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয়।

অহনা মৌ এর সামনে বসে অসহায় সুরে বললো,
” দুজনে শুধু শুধু এতো বকলো কেনো আমাদের? আমরা আজকে কি প্রবলেম ক্রিয়েট করলাম, বুঝলাম না। তোর তো শুধু জ্বরই এসেছে। অথচ দেখ, কত কথা শুনিয়ে দিলো আমাদের।”

মৌ কিছু না বলে চুপচাপ বসে রইলো। জান্নাত এবার বললো,
” দুজনেই মৌ এর অসুস্থতার জন্য চিন্তায় আছে। মৌ আয়ানের কথা শুনেনি বলেই তো জ্বরটা বাঁধালো। আর বারবার ঝামেলা করার কথা বলতে আমার মনে হয়, সেদিনকার ঐ ছেলেটার কথা বলছিলো। কয়দিন আগেই ঐ ছেলেটার ঝামেলা শেষ হলো। হয়তো আগেকার ঝামেলার কথাগুলোই রাগের কারণে আজকের কথায় টেনে এনেছে।”
এই বলে জান্নাত একটু থামলো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবারো বলা শুরু করলো,
” সেদিন যদি তোমরা দুজনে ছেলেটা সাথে ভদ্রতার খাতিরে কথা না বলে মুখের উপর দু চারটা কথা শুনিয়ে দিতে, তাহলে পরবর্তীতে ছেলেটা তোমাদের ডিস্টার্ব করার সাহস পেতো না। এ ব্যাপারে কিন্তু আয়ান আগে থেকেই তোমাদের সতর্ক করেছিলো। তবুও তোমরা পাত্তা দাওনি। আবার গতকাল ওর নিষেধ করা সত্ত্বেও মৌ বৃষ্টিতে ভিজেছিলো। পরে ঠিকই জ্বর এলো। সো বুঝতেই পারছো, দোষটা তোমাদেরই।”

অহনা আর মৌ চুপচাপ বসে সবটা কথা শুনলো। নিজেদের ভুল নিয়ে তারা প্রতিবারই পস্তায়। মনে মনে ঠিক করে আয়ান আর মাহতাবের কথা মেনে চলবে তারা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তারা নিজেদের ঠিক করা ব্যাপারই বেমালুম ভুলে বসে। এজন্য পরে তারা সমস্যাতেও পরে আর প্রতিবারের মতো সেই সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে আয়ান নয়তো মাহতাবকেই ছুটে আসতে হয়।

.

®সারা মেহেক
#চলবে

মেঘসন্ধি পর্ব-০২

1

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক

মৌ মুচকি হেসে আয়ানের দিকে তাকালো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। তবুও মৌ এর ঠোঁটের কোনে আটকে থাকা সে মিষ্টি হাসি আয়ানের নজর এড়ালো না। তবে বরাবরের মতোই সেই হাসিটা অগ্রাহ্য করলো সে। আজও এ হাসিটা তার উপর কোনো প্রভাব ফেলেনি। যেমনটা এর আগেও হয়েছে।

আয়ান ছাতা নিয়ে মৌ এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৌ এর মাথার উপর ছাতা ধরতেই মৌ চোখমুখ কুঁচকে বলে উঠলো,
” এসব কি আয়ান ভাইয়া?”

আয়ান গরম চোখে তাকিয়ে নিজের দিকে ইশারা করে বললো,
” এটা আমি আর আমার হাতে থাকা এ জিনিসটা হলো ছাতা।”

আয়ানের খোঁচা দেওয়া কথাবার্তা শুনে মৌ সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
” সে আমি জানি। আমি বলছি, আমাকে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে বাঁধা দিচ্ছো কেনো?”

আয়ান শান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মৌ এর দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর হুট করে কোনো প্রকার কথাবার্তা ছাড়াই মৌ এর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো সে। মৌ বেশ বুঝে গিয়েছে, আয়ান তাকে এ মূহুর্তে বৃষ্টিতে ভিজতে দিবে না। কিন্তু সে-ও নাছোড়বান্দা। আর যাই হোক, আজ সে ভালোমতো বৃষ্টিতে ভিজে তবেই বাসায় যাবে। এজন্য ছাদের দরজার কাছে পৌঁছানোর আগেই সে আয়ানের হাত ঝামটা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
” আমি এখন বাসায় যাবো না। বৃষ্টিতে ভিজবো। অনেকদিন পর আজকে একটু বৃষ্টিতে ভিজার সুযোগ হলো। আর তুমি সেই সুযোগ কেড়ে নিবে! মোটেও না৷ তুমি চলে যাও। বৃষ্টি থেমে গেলে আমি চলে আসবো।”

আয়ান কিছুটা রাগত স্বরে বললো,
” দেখ মৌ…..বাচ্চাদের মতো জিদ করিস না। ভালোমতো বলছি, বাসায় ফিরে চল। শুধু শুধু বৃষ্টিতে ভিজে কি হবে? কোনো লাভ তো নেই বরং ক্ষতি আছে। এই যে এখন, বৃষ্টিতে ভিজছিস, রাতের মধ্যেই তোর জ্বর এসে যাবে৷ তখন পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবি আর আংকেল, আন্টী, মাহতাব, জান্নাতের রাতের ঘুম হারাম করে দিবি৷ এজন্য বলছি, চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মত আমার সাথে নিচে চল।”

আয়ানের যুক্তিপূর্ণ কথা শোনার পরও মৌ নিজের জায়গা থেকে এক পা নড়ে উঠলো না৷ বরং দৃঢ়চিত্তে বললো,
” এবার জ্বরও আসবে না৷ পুরো বাড়িও মাথায় তুলবো না। সুতরাং, আমি এখন বৃষ্টিতে ভিজবো। ”

” তুই তো শরীরের ভেতরকার সব খবর জানিস তাইনা? তোর যে এবার জ্বর আসবে না কে বললো?”

” গত বছরে দুইবার বৃষ্টিতে ভিজেছি। একবারও জ্বর আসেনি। তাই এবারও আসবে না। ”

” এতো ভবিষ্যতবাণী না করে বাসায় চল। নাহলে আজ পর্যন্ত মাহতাব যেটা করেনি, সেটা আজ করবো আমি। দু গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিবো। ”

আয়ানের এ ধমকও কাজ করলো না মৌ এর উপর। সে জানে, আয়ানের রাগ বেশ ভয়ংকর। তবুও সে এখন আয়ানের রাগ দেখে ভয় পাচ্ছে না। উল্টো হুট করে সে একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো সে।
কোনোরূপ কথাবার্তা ছাড়াই আয়ানের হাত থেকে ছাতা নিয়ে ছাদের অপর দিকে ছুট লাগালো সে। আচমকা এমন হওয়ায় আয়ান হতভম্ব হয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঘটনাটি বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো তার।
ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ বুঝে উঠার সাথে সাথেই আয়ান বড় বড় পা ফেলে মৌ এর দিকে এগিয়ে এলো। গরম চোখে মৌ এর তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
” আজ যদি তোর জ্বর এসেছে….তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। ” এই বলে আয়ান শক্ত হাতে মৌ এর হাত চেপে ধরে ছাদ হতে বাসায় নিয়ে আসলো।

বাসায় আসার সাথে সাথেই মৌ মুখ কালো করে রুমে চলে গেলো। মৌ কে বাসায় দিয়েই আয়ান চলে যেতে নিলো। কিন্তু মাহতাব আয়ানকে ভেজা অবস্থায় দেখে কিছুটা অবাক হলো। দরজার কাছে এসে সে আয়ানকে জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার আয়ান? তুই ভিজলি কি করে?”

মাথার ভেজা চুলগুলো হালকা নাড়াচাড়া করে আয়ান বললো,
” তোর ঢিটমার্কা বোনের জন্য। ”

” ও আবার কি করলো?”

” আর বলিস না….আমরা ছাদে থাকতে থাকতেই বৃষ্টি শুরু হয়। সবাই চলে আসতে চাইলেও মৌ আসতে চায় না। পরে জান্নাত ভাবী আমাকে বললো, একটা ছাতা নিয়ে মৌ কে ছাদ থেকে নিয়ে আসতে। আমিও বেশ আনতে গেলাম….কিন্তু সে কিছুতেই আসবে না। আমি যেনো ওকে না নিয়ে যেতে পারি, এজন্য আমার কাছ থেকে ছাতা নিয়ে এক ছুট দিলো। ” এই বলে আয়ান ছোট্ট এক নিঃশ্বাস ফেললো। মাহতাব কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো,
” এই মেয়েটার কিছু কিছু স্বভাব পুরোই বাচ্চাদের মতো। আবার কিছু কিছু জ্ঞানীগুণীদেরও হার মানায়। তুই বাসায় চলে যা। বৃষ্টি থামলে আমি অহনাকে দিয়ে আসবো।”

হঠাৎ অহনার কথা বলতেই আয়ান মাহতাবের কাঁধ ছাপিয়ে ড্রইংরুমে চোখ বুলালো। সেখানে অহনাকে দেখতে না পেয়ে সে জিজ্ঞাস করলো,
” অহনা কোথায়?”

” আমাদের রুমে। জান্নাতের সাথে গল্প করছে।”

” ওহ আচ্ছা। তো তুই বাসায় কখন এলি?”

” বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসি। ”

” আচ্ছা ভালো….. তাহলে আমি যাচ্ছি।”

” ওকে যা।” এই বলে আয়ান সিঁড়ি বেয়ে চলে গেলো।
আয়ান চলে যাওয়ার পর মাহতাব ড্রইংরুমে এসে টিভি ছেড়ে দিয়ে খবর দেখতে বসে পরলো।

.

ঘুমের মাঝে প্রচণ্ড শীত অনুভব করলো মৌ। একদম হাড় কাঁপানো শীত যাকে বলে। অথচ এখন বর্ষাকাল চলছে!
শীতের কামড়ে ঘুম থেকে উঠে পরলো মৌ। বোজা বোজা চোখ নিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারির কাছে গেলো। আলমারির দরজা খুলে একটা কাঁথা বের করেই বিছানায় এসে শুয়ে পরলো। এরপর আপাদমস্তক নিজেকে কাঁথায় ঢেকে নিলো।
কিছুক্ষণ পর সে অনুভব করলো তার শীত লাগা ভাবটা কমে আসছে। কিন্তু নিজের এক হাত দিয়ে অপর হাত স্পর্শ করতেই গরম ছোঁয়া অনুভব করলো সে। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, সে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। তবুও পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে আলতো হাতে কপাল চেপে ধরলো। প্রচণ্ড গরমে কপাল পুরে যাচ্ছে যেনো! এ মূহুর্তে একটা ‘নাপা’ না খেলেই নয়। এ মূহুর্তে মৌ এর শরীরে ওষুধ প্রবেশের প্রয়োজন রয়েছে। অথচ সে তা চাইছে না। ধীরেধীরে শরীর যেনো ভেঙে আসছে তার। মনমস্তিষ্ক কিছুতেই সায় দিচ্ছে না, এখন উঠে গিয়ে ওষুধ খেতে। যেখানে মনমস্তিষ্কই সাফ মানা করে দিয়েছে সেখানে মৌ এর সাধ্য নেই এ ভাঙা শরীরকে টেনে নিয়ে উঠে যেতে। বরং এখন কষ্ট করে ঘুমিয়ে পরলে সকালে উঠে জ্বর ঠিক হয়ে যাবে। এই বুঝ দিলো সে নিজেকে।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ আয়ানের কথা মনে আসতে মৌ ম্লান হেসে বিড়বিড় করে বললো,
” আমার ভবিষ্যতবাণী তো ঠিক হলো না আয়ান ভাইয়া। শেষমেশ জ্বরটা আমাকে জড়িয়েই ধরলো। ” এসব বিড়বিড় করে বলতে বলতেই মৌ ঘুমের দেশে তলিয়ে পরলো।

.

প্রচণ্ড জ্বরে মৌ এর দুচোখ জ্বলছে। চোখ খোলা রাখা দায় হয়ে পরেছে তার জন্য। কিন্তু ক্লাস তো করতেই হবে। আগামী পরশু এ ক্লাসের উপর পরীক্ষা আছে তার। বরাবরের মতো এবারও তাকে পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। এজন্য ক্লাসে মনযোগ দেওয়াটা খুব দরকার। অথচ এ দরকারী কাজটা সে করতে পারছে না।

সকালে ঘুম ভাঙার পর মৌ নিজের জ্বর পরীক্ষা করেছিলো। তখন মোটামুটি সুস্থই ছিলো সে। তবুও ভার্সিটিতে যেতে মন চাইলো না তার। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে আসার পরপরই আজকের ক্লাসের কথা মনে পরতেই ভার্সিটি আসার তাগিদ অনুভব করে সে। যথারীতি সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ করে অহনার সাথে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে সে। তখন থেকে একটু একটু করে আবারও অসুস্থতা অনুভব করে সে। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ক্লাস বাদ দেওয়া যাবেনা। ফলে শরীর আর মনের উপর এক প্রকার জোর খাটিয়ে সে ক্লাস করতে চলে আসে। অহনা তার সাথে থাকার পরও তার অবস্থা বুঝতে পারেনি। কারণ সে নিকাব পরে বাহিরে বের হয়।

যতো সময় পার হচ্ছে ততোই বেশি অসুস্থতা অনুভব করছে মৌ। তার পুরো শরীর জ্বরের তাপে পুড়ে যাচ্ছে যেনো। পরনের জামাকাপড়ও হয়তো এতক্ষণে গরম হয়ে পরেছে।চোখ খোলা রাখাও দায় হয়ে পরেছে তার জন্য। হঠাৎ করেই কোনো এক কারণে গলবিলের কাছে তেতো তেতো অনুভূত হচ্ছে। মৌ এর কারণট আপাতত জানে না। সে জানে জ্বর হলেই তার এসব লক্ষণ দেখা দেয়।
পুরো ক্লাসটা অতি কষ্টে শেষ করে উঠলো মৌ। অহনা এতক্ষণ তার পাশেই বসে ছিলো। কিন্তু মৌ এর অসুস্থতা সে খেয়াল করেনি। পুরো ক্লাস মনযোগ দিয়ে করেছে সে। কারন চলমান টপিকটা সে খুব একটা ভালোভাবে বুঝে না। এর উপর আবার পরশুদিন পরীক্ষা!
অহনা যে মৌ এর অসুস্থতা বুঝেনি তা নয়। সে প্রথম প্রথম কিছুটা আন্দাজ করেছিলো। মৌ কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসও করেছিলো। কিন্তু মৌ সাফ নাকচ করে দেয়। পরবর্তীতে ক্লাস শুরু হওয়ায় এ বিষয়ে অহনা আর ঘাটাঘাটি করেনি।

ক্লাস শেষে অত্যন্ত দূর্বল ভঙ্গিতে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মৌ। অহনা খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার মৌ? তুই এভাবে উঠলি কেনো? কোনো সমস্যা?”

মৌ ম্লান হেসে জবাব দিলো,
” একটু জ্বর এসেছে, এই তো…..”

অহনা এবার চিন্তিত হয়ে মৌ এর ডান হাত চেপে ধরলো। নিজের হাতে প্রচণ্ড গরম অনুভূত হলে সে বিস্ময় নিয়ে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বললো,
” মৌ!! তোর গায়ে তো প্রচণ্ড জ্বর! এতো জ্বর নিয়ে ক্লাস করলি কি করে এতক্ষণে? ”

মৌ জবাবে কিছুই বললো না। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ রাখার পর নিচু গলায় বললো,
” শরীরটা একদমই ভালো লাগছে না। বাসায় নিয়ে চল অহনা….”

মৌ এর কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার আগেই অহনা মৌ এর হাত ধরে বললো,
” চল। হাঁটতে কষ্ট হলে বলিস। আর তুই এতো জ্বর নিয়ে ক্লাস করলি কেনো?”

মৌ আবারও নিচু গলায় বহু কষ্টেসৃষ্টে বললো,
” পরশুদিন পরীক্ষা বলে আজ কষ্ট করে ক্লাসটা করলাম।”

অহনা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
” তোরও না….. পুরো মাথাই খারাপ। আমাকে বললে আমি সব ঠিকঠাক নোট করে তোকে দিয়ে দিতাম। শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেওয়া।”

মৌ প্রত্যুত্তরে কিছুই বললো না। কিছুদূর যাওয়ার পর সে আয়ানকে নিজের বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। দূর্বল কণ্ঠে অহনাকে জিজ্ঞাস করলো,
” আয়ান ভাইয়া এখানে কেনো?”

” কয়েকটা জিনিস কেনাকাটার জন্য ডেকেছি। কিন্তু আজকে তো আর যাওয়া সম্ভব না। দাঁড়া, আমি ভাইয়াকে বলি, একটা সিএনজি ঠিক করতে।”

মৌ আর কথা বাড়ালো না। অহনার সাথে ধীর পায়ে হেঁটে চললো। তার শরীরের সমস্ত শক্তি যেনো শেষ হয়ে আসছে একটু একটু করে। যেনো নিভে যাচ্ছে তার জীয়নকাঠি। ধীরে ধীরে পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। মাথাটা অল্পবিস্তর চক্কর দিচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই যেনো সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে।
মৌ এর এই ‘মনে হওয়া’টা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস্তবে পরিণত হয়। অহনাকে কিছু বলে উঠার আগেই মৌ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পরে যায়। তার সাথে অহনাও পরে যেতে নেয়। তবে তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নেয়।
ওদিকে আয়ান এতক্ষণ স্বাভাবিকভাবেই মৌ আর অহনার চলার পানে তাকিয়ে ছিলো। মৌ এর দূর্বল চলনে সে একটু সন্দিহান ছিলো। মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলো, ‘মৌ কি অসুস্থ?’।

অবশেষে কিছুক্ষণের মাঝেই মৌ অজ্ঞান হতেই তার সে সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়। মৌ কে পরে যেতে দেখে হাতে থাকা হেলমেটটা কোনোরকমে বাইকের উপর রেখে মৌ আর অহনার দিকে দৌড়ে আসে সে। মৌ কে এভাবে পরে থাকতে দেখে দুশ্চিন্তা এবং হতভম্বের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠে আয়ানের চোখেমুখে।

®সারা মেহেক
চলবে

মেঘসন্ধি পর্ব-০১

0

#মেঘসন্ধি
#লেখনীতে:সারা মেহেক
পর্ব-০১

” আয়ান ভাইয়া, আমি আপনাকে ভালোবাসি।” খানিকটা লজ্জা এবং সংকোচ নিয়ে বললো মৌ।

আয়ান এ প্রপোজালটা বেশ সহজ এবং স্বাভাবিকভাবেই নিলো৷ মৌ এর চেহারার লাজুক ভাব দেখে আয়ান এবার শব্দ করে হেসে উঠে বললো,
” এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেনো? তোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে সত্যিকারের প্রপোজ করছিস তুই।” এই বলে আয়ান আবারো হেসে দিলো। তৎক্ষনাৎ মৌ এর মনে পরলো যে, এটা শুধুমাত্র ডেয়ার ছিলো। ফলে তার ঠোঁটের কোনে বিদ্যমান সেই মিষ্টি হাসিটা মূহুর্তেই উবে গেলো। সে জানে, এটা ডেয়ার ছিলো। তবে এটাও সত্য যে, ডেয়ারটা সে মন থেকে করেছে। অর্থাৎ ডেয়ারের জন্য বলা প্রতিটা কথা সে মনের গভীর থেকে বলেছে। কারণ, সে আয়ানকে ভালোবাসে। অনেক আগে থেকেই তার মনে আয়ানের জন্য এ ভালোবাসা তৈরী হয়েছে। কিন্তু একপ্রকার জড়তা থাকায় সে কখনোই নিজ হতে স্বাভাবিকভাবে আয়ানকে এসব বলতে পারেনি৷ সে জানে না আয়ানের মনে তার জন্য আদৌ কোনো অনুভূতি আছে কি না৷ তবে সে জানে, আয়ানের জন্য তার হৃদয়ের অন্তস্থলে গভীর ভালোবাসা আছে।

আজ সন্ধ্যায় জান্নাত এই ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার আয়োজন করে। সে ইচ্ছাকৃতভাবেই এ খেলার আয়োজন করে। কারণ সে জানে, মৌ আয়ানকে ভালোবাসে এবং সে এটাও জানে, খানিকটা ভয় এবং লজ্জার জন্য মৌ আয়ানকে তার মনের কথা বলবে না। এজন্যই এ উপায় বের করেছে সে।
মৌ’দের বাসার ছাদে মাহতাব, জান্নাত, অহনা, আয়ান এবং মৌ একসাথে ট্রুথ এণ্ড ডেয়ার খেলায় অংশ নেয়। খেলার এক পর্যায়ে মাহতাবের এক কলিগ ফোন করে, কিছু অফিশিয়াল কাগজ নেওয়ার জন্য। সেই কাগজপত্র দেওয়ার জন্যই মাহতাব বাসার নিচে চলে যায়৷ এ সুযোগে জান্নাত বেশ কৌশলে মৌ কে ডেয়ার নেওয়ার কথা বলে। মৌ-ও তেমন কিছু চিন্তাভাবনা না করে ডেয়ার নিয়ে নেয়৷

পরে, জান্নাত আয়ানকে প্রপোজ করার ডেয়ার দিলে মৌ প্রথমেই তাতে আপত্তি জানায়। তবে অহনা এবং জান্নাতের জোরাজুরিতে শেষমেশ সে ডেয়ারটা করতে বাধ্য হয়। এদিকে, আয়ান এ সম্পূর্ণ বিষয়টাকে বেশ সহজ স্বাভাবিকভাবেই নেয়। কারণ, ডেয়ার হিসেবে এসব প্রপোজাল দেওয়া নেওয়ার বিষয়ে সে অভস্ত্য। এজন্য সে মৌ এর করা প্রপোজাল স্বাভাবিকভাবে নিলো। তবে মৌ এর চোখেমুখে সেই লাজুক ভাবটা দেখে খানিকক্ষণ পর সে জিজ্ঞাস করলো,
” মৌ? তুই এতো লজ্জা পাচ্ছিলি কেনো বল তো?”

আয়ানের প্রশ্ন শুনে মৌ চুপসে গেলো। আমতাআমতা করে বললো,
” এমনিই আয়ান ভাইয়া।”

” এমনিই আবার লজ্জা পায়……” আয়ানকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অহনা বললো,
” উফ, ভাইয়া….তুমিও না…..এটুকু কি বুঝো না যে ও মেয়ে? একজন মেয়ের পক্ষে প্রপোজ করা এমনিই একটু ডিফিকাল্ট। কারণ, মেয়েরা লাজুক স্বভাবের হয়। সেখানে দুই দুইটা মানুষের সামনে ও প্রপোজ করেছে। তো লজ্জা পাওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার তাই না?”

” বাট ইটস এ ডেয়ার। নট ইন রিয়েলিটি। ”

” আহহা, ভাইয়া। হোক ডেয়ার বা হোক রিয়েলিটি। প্রপোজ করা বহুত ডিফিকাল্ট ব্যাপার, এটাই মেনে নাও।”

অহনার কথাবার্তা শুনে আয়ান সন্দেহের সুরে জিজ্ঞাস করলো,
” তুই কিভাবে জানিস যে, প্রপোজ করাটা খুব ডিফিকাল্ট? হুম?”

অহনা এবার রাগান্বিত স্বরে বললো,
” তুমি এমন কেনো ভাইয়া? শুধু সন্দেহ, সন্দেহ আর সন্দেহ করা আমার উপর। এ ছাড়া আর কাজ নেই তোমার।”

আয়ান, অহনার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললো,
” অফিসের কাজগুলো তো তুই করে দিস, তাইনা?”

অহনা প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে যাবে, এর আগেই জান্নাত তাকে থামিয়ে বললো,
” এসব ঝগড়া বাদ দাও। আয়ান, তুমি মাহতাবকে ফোন করে বলো দোকান থেকে চিপস, চকলেট কিনে আনতে। কতদিন পর সবাই একসাথে বসে আড্ডা দিচ্ছি। একটু খাওয়াদাওয়া না হলে চলে নাকি!”

আয়ান হেসে বললো,
” তা ঠিক বলেছো ভাবী। আমি এখনই মাহতাবকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।” এই বলে আয়ান পকেট থেকে ফোন বের করে ছাদের এক কোনায় চলে গেলো।
আয়ান চলে যেতেই জান্নাত আর অহনা মিলে মৌ কে ঘিরে ধরলো। অহনা মৌ’র বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
” শেষমেশ আমার ভাইকে প্রপোজটা করেই ফেললি। উফ….এখন শুধু অপেক্ষা সেই দিনটার যেদিন তুই আমার ভাবী হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করবি। আহা…..” অহনার কণ্ঠে প্রকাশ পেলো দারুণ উচ্ছ্বাস। খুশিতে গদগদ হয়ে সে মৌ’কে জড়িয়ে ধরলো।
মৌ এর চোখেমুখে এ মূহুর্তে প্রকাশ পাচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু পাওয়ার পর আনন্দের ঝলক। সে জানে, আজ জান্নাত এমন ডেয়ার না দিলে সে কখনোই সাহস করে আয়ানকে এসব বলতে পারতো না। অবশ্য, আজকে আয়ানকে নিজের অনুভূতির কথা জানাতে পেরে সে কিছুটা হলেও সাহস অর্জন করেছে। এজন্য মনে মনে সে বেশ খুশি হয়েছে। মৌ’র চোখেমুখে এ হাসিখুশি ভাব দেখে জান্নাত মলিন মুখে বললো,
” এতো খুশি হচ্ছো কেনো মৌ? তুমি আয়ানকে বলেছো যে, তুমি তাকে ভালোবাসো। কিন্তু সে তো তোমাকে কিছু বলেনি। আবার তুমি যে ওকে ভালোবাসার কথা বলেছো, সেটা কেমন পরিস্থিতিতে বলেছো তা কি একবার ভেবে দেখেছো? আয়ান তো এখনও ভাবছে যে, তুমি শুধুমাত্র তোমার ডেয়ারটা সম্পূর্ণ করেছো।
তুমি শুধু নিজের মনের কথাটা ওর সামনে প্রকাশ করে একটু হালকা হয়েছো। ব্যস……”

জান্নাতের যুক্তিপূর্ণ কথাবার্তা শুনে মৌ এবং অহনার ঠোঁট থেকে হাসি উবে গেলো। মূহুর্তেই তাদের চোখেমুখে থমথমে এক ভাব দেখা গেলো। অহনা নিচু গলায় বললো,
” জান্নাত ভাবী ঠিক বলেছে মৌ। ভাইয়া তো এখনো ভাবছে যে, তুই তাকে প্রপোজ করে ডেয়ারটা কমপ্লিট করেছিস যাস্ট। তুই সরাসরি সত্যটা না বলা পর্যন্ত কোনো সলিউশনে আসা যাচ্ছে না।”

মৌ এবার চিন্তিত স্বরে বললো,
” তা অবশ্য ঠিক বলেছিস। কিন্তু আয়ান ভাইয়াকে সরাসরি মনের কথা বলার মত সাহস আর নেই আমার।”

অহনা বললো,
” তাহলে ভাইয়াকে ভুলে যা তুই। ”

মৌ এর চোখেমুখে এবার নেমে এলো বিষাদের ছায়া। সে মুখ কালো করে বলল,
” এ আমার দ্বারা সম্ভব না।”

অহনা হালকা ঝাঁঝালো গলায় বললো,
” এটাও তোর দ্বারা সম্ভব না। আবার ভাইয়াকে প্রপোজ করাও তোর পক্ষে সম্ভব না। তাহলে তোর দ্বারা সম্ভব কি বল তো?”

মৌ কোনো প্রকারের জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। জান্নাত ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে মৌ কে বললো,
” দেখো মৌ….. তুমি যদি সিরিয়াসলি আয়ানকে তোমার মনের কথা বলো তাহলে আয়ানের মনের কথাটাও তুমি জানতে পারবে। ”

জান্নাতকে পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে অহনা দৃঢ়চিত্তে বলে উঠলো,
” তুই এতোদিন ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিস। অর্থাৎ ভাইয়া আদৌ তোকে পছন্দ করে কি না সেটা জানতে চেয়েছিস, শুনতে চেয়েছিস। কিন্তু আলটিমেটলি তুই কিছুই জানতে পারিসনি।
এখন, ভাইয়ার মনের ভেতরকার খবর জানার জন্য তোর মনের কথা ওর সামনে তুলে ধরতে হবে। এতে ভাইয়াও তার মনের অবস্থা তোকে বলে দিবে। এ কাজটা করলে আমরা এটলিস্ট একটা কনক্লুশনে পৌঁছাতে পারবো। না হলে তুই আর কতদিন ভাইয়াকে এভাবে মনে মনে পছন্দ করে যাবি? ”
এই বলে অহনা থেমে মৌ এর দিকে তাকালো। মৌ তখন কিছু ভাবতে ব্যস্ত। অহনা আবারো বললো,
” ভাইয়াও যদি তোকে পছন্দ করে তাহলে তো দুই বাড়ির সবাইকে এ ব্যাপারে বলে বিয়ের আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু বাই এনি চান্স….ভাইয়ার জবাব না হলো। তখন কি হবে?”

অহনার এ প্রশ্নে মৌ এর মুখটা মলিন হয়ে এলো। সে মিনমিন করে বললো,
” এ ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখিনি আমি। ”

অহনা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
” আহহা…. এতোদিন ভাবিস নি। কিন্তু এখন ভাবতে হবে। ভাইয়ার জবাব না হলে তুই নিজের পথে চলে যাবি। পিছনে ফিরেও তাকাবি না। আমি চাই না তুই এসব নিয়ে সারাজীবন পরে থাক। তুই অবশ্যই একটা বেটার ফিউচার ডিজার্ভ করিস। বুঝতে পারছিস আমার কথা?”

মৌ হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো,
” হুম।”

” তাহলে ২/১ দিনের মধ্যেই এসব ব্যাপারে ক্লিয়ার হবি। ওকে?”

মৌ নিচু স্বরে বললো,
” ওকে।”

অহনা এবার জোর গলায় বললো,
” এভাবে ওকে বললে হবে না। সাহস সঞ্চয় কর। বুঝছিস?”

মৌ হালকা হেসে কিছুটা জোর গলায় বললো,
” ওকে।”

মৌ এর কথা শুনে জান্নাত আর অহনা মৃদু হাসি দিলো। ততক্ষণে আয়ান কথা বলা শেষে আবারো তাদের আড্ডায় যোগ দিয়েছে। এতক্ষণ পর আয়ানকে আসতে দেখে জান্নাত জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার আয়ান? এতক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলে?”

আয়ান হালকা হেসে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বললো,
” মাহতাবের সাথে কথা বলা শেষ হতেই অফিসের এক কলিগ ফোন দেয়। তার সাথেই কথা হচ্ছিলো এতক্ষণ। ”

জান্নাত প্রত্যুত্তরে আর কিছু বললো না। হঠাৎ মাঝারি ধরণের বজ্রপাতের শব্দে ছাদে উপস্থিত চারজন মানুষ অল্পবিস্তর কেঁপে উঠলো। আয়ান মৃদু হেসে বললো,
” বৃষ্টি হবে হয়তো। অনেকক্ষণ ধরেই বজ্রপাতের আওয়াজ শুনছি। আগেরগুলো আস্তে হলেও এবারেরটা একটু জোরেই হলো।”

আয়ানের কথা শেষ হতেই আবারো বজ্রপাতের আওয়াজ শুনতে পেলো সবাই। জান্নাত এবার খানিকটা ভীত হয়ে বললো,
” আমার মনে হয় আমাদের নিচে চলে যাওয়া উচিত। আজকালকার তো বজ্রপাত বেশ ভয়ংকর। ”

আয়ান জান্নাতের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
” এটাই ঠিক। চলো সবাই উঠি।”

এই বলে আয়ান, জান্নাত এবং অহনা উঠে পরলো। কিন্তু মৌ নিজের জায়গায় স্থির বসে রইলো। জান্নাত জিজ্ঞাস করলো,
” কি ব্যাপার মৌ? বসে আছো কেনো? বাসায় যাবে না?”

মৌ মিষ্টি হেসে বললো,
” না ভাবী। আজকে বৃষ্টিতে ভিজবো আমি। অনেকদিন যাবত বৃষ্টিতে ভেজা হয়না।”

আয়ান এবার একটা ধমক দিতে উদ্যত হতেই হুট করে ঝমাঝম বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ার ভয়ে তারা তিনজনে মৌ কে না নিয়েই দৌড়ে ছাদ থেকে বেরিয়ে গেলো। এদিকে মৌ দু চোখ বুজে আকাশের পানে মুখ দিয়ে বৃষ্টির টপটপ ফোঁটাগুলো নিজের মধ্যে সমাহিত করছে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা ছোঁয়ায় থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে। ওদিকে বজ্রপাতের কান ফাটানো আওয়াজে হৃদয়ে হালকা ভয়ের স্রোত জেগে উঠছে। তবে এসবই তার বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছাকে প্রতিহত করতে পারেনি। সে তো এখন মনের আনন্দে বৃষ্টিতে ভিজছে।
কিছুক্ষণ যেতেই সে পা দুটো একত্র করে হাত দুটো প্রসারিত করে ছাদে শুয়ে পরলো। এভাবে বৃষ্টিবিলাস করতে বেশ ভালো লাগছে তার। অন্য রকম এক ধরণের আনন্দ অনুভব হচ্ছে।
হঠাৎ মৌ খেয়াল করলো, তার চোখেমুখে বৃষ্টির ফোঁটা পরছে না। অথচ শরীরের নিচের অংশ দিব্যি বৃষ্টিতে ভিজছে। এমনটা হওয়ার কারণ বুঝতে না পেরে সে চোখ খুললো। সাথে সাথে নিজের মাথার উপর একটা ছাতা দেখলো সে। এতে সে চমকে উঠে শোয়া থেকে বসে পরে। মনে প্রশ্ন নিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে আয়ান রাগান্বিত চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এতে মৌ মোটেও ভয় পেলো না। উল্টো রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোলাগার এক উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করলো সে।

#চলবে?

Darkness Part-07 and Last Part

0

#Darkness
Writer: Abir Khan
Part: 07(last part)
তনু দেখে নেহাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোন কিছু বলছে না৷ তাই ও আস্তে আস্তে নেহালের দিকে তাকাতেই, হঠাৎই নেহাল কোন কিছু না বলেই ওকে সোজা কোলে তুলে নেয়৷ তনু পুরো অবাক হয়ে যায়। ও অবাক কণ্ঠে বলে উঠে,

~ একি! কোলে তুললেন যে?
— তোমার জন্য অনেক বড়ো একটা সারপ্রাইজ আছে। তবে সেটা এখানে না অনেক দূরে। তুমি চোখটা একটু বন্ধ করো। আমি বললেই তবে খুলবে৷
~ আবার সারপ্রাইজ! আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যা বলবেন।

তনু চোখ দুটো বন্ধ করে নেহালের গলা জড়িয়ে ধরে থাকে। নেহাল ওর পাওয়ার দিয়ে ব্ল্যাক হোল এনে ওরা ওদের কাঙ্ক্ষিত জায়গায় চলে আসে। তনু ফিল করে একটা ঠান্ডা বাতাস ওর পুরো শরীরে এসে লাগছে। সাথে পানির ঢেউয়ের শব্দ। নেহাল ওকে নিয়ে কোথায় আসলো? একটু হেঁটে নেহাল তনুকে নিচে নামিয়ে দিয়ে ওর পিছনে দাঁড়িয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

— এবার চোখ মেলে তাকাও।

তনু আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। ও পুরো স্তব্ধ হয়ে যায়। তনু দেখে, খোলা আকাশের নিচে সমুদ্রের ঠিক সামনে অনেক সুন্দর করে একটা বেড রাখা৷ বেডের উপর গোলাপের পাপড়ি। আশেপাশে রঙবেরঙের লাইট লাগানো। অনেক সুন্দর করে সাজানো পুরো জায়গাটা। তনু একদম অবাক হয়ে গিয়েছে। নেহাল পিছন থেকে ওর কানে কানে বলে,

— গভীর সমুদ্রের মাঝে এই দ্বীপটা আমি বানিয়েছি। শুধু তোমার আর আমার জন্য। এই দ্বীপের আশেপাশে ম্যাজিক্যাল বেড়িয়ার দেওয়া আছে৷ তাই কোন শত্রু আমাদের খুঁজেও পাবে না৷ এবং দেখতেও পারবেন না৷ আমাদের জীবনের বিশেষ মুহূর্তটাকে আরও বিশেষ করতে এই ছোট প্রচেষ্টা। তোমার পছন্দ হয়েছে তো?
~ অনেক অনেক বেশি পছন্দ হয়েছে। আমি কখনো ভাবতেও পারি নি, আমার এই ইচ্ছাটা আপনি না জেনেও বুঝে যাবেন৷ সত্যিই আমি অনেক অবাক হয়েছি।

নেহাল তনুকে নিয়ে আস্তে আস্তে বেডের কাছে গিয়ে ওকে বসিয়ে দেয়৷ তনু বঁধুর মতো চুপচাপ বসে আছে আর খুব খুব লজ্জা পাচ্ছে। নেহালও বেডে উঠে তনুর সামনে বসে। ওর হাত দুটো ধরে অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তনুর বাম গালে একটা ছোট্ট করে কালো তিল আছে। যেটা নেহালের সবচেয়ে বেশি পছন্দ। ও আস্তে করে তনুর গালে তিলের উপর ওর আঙুলের স্পর্শ বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,

— কখনো ভাবি নি আমার বিয়ে হবে৷ তাও একটা মানুষের সাথে। জীবনটা আসলেই অদ্ভুত তাই না?
~ হুম। (লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে)

নেহাল তনুর রিং ফিঙ্গারটা নিয়ে অনেক দামী ডায়মন্ডের একটা রিং পরিয়ে দেয়৷ তনু রিংটা দেখে পুরো অবাক। আলোতে চিকচিক করছিল ডায়মন্ডটা। ও খুব খুশি হয়ে বলে,

~ আপনি এগুলা কোথায় পান? এত সুন্দর।
— এটা ডার্কনেসের রিং৷ এই রিং এ কিন্তু ম্যাজিক্যাল পাওয়ার আছে। দেখবে?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ।
— রিংটায় চুমু দিয়ে তুমি যা চাইবে তাই চলে আসবে। তবে মৃত বা জীবিত কোন মানুষ বা এমন কোন কিছু আসবে না৷
~ ওহহ! তাহলে আমি একটা জিনিস চাইবো এটার কাছে। চাই?
— হ্যাঁ হ্যাঁ চাও।

তনু রিংটায় একটা চুমু দিয়ে মনে মনে একটা জিনিস চায়। নেহাল দেখে হঠাৎ করে চারদিক কেমন আলোতে ভরে যাচ্ছে। ও আকাশে তাকিয়ে দেখে অনেক বড়ো একটা চাঁদ উঠেছে। জ্যোৎস্নার আলোতে চারদিক ভরে গিয়েছে। পরিবেশটা আরও রোমান্টিক আর সুন্দর হয়ে গিয়েছে। তার মানে তনু চাঁদ দেখতে চেয়েছে। অবশ্য এই চাঁদটা নকল। নেহাল তা জানে। তবে তনুকে সেটা বলে না। তনু খুব খুশি হয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আবার নেহালের দিকে তাকিয়ে বলে,

~ এই চাঁদটা দেখতে গিয়েই আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম। তাই আজকের এই বিশেষ দিনে এই চাঁদটাকেও সাথে চাই।

নেহাল মুচকি একটা হাসি দিয়ে তনুর গালে হাত রাখে। ভরা জ্যোৎস্নার আলোতে তনুকে যেন আরও বেশি নেশাকাতর লাগছিল। নেহাল আস্তে আস্তে তনুর ঘোরে পড়ে যাচ্ছে। তনুর মিষ্টি গোলাপি ঠোঁটটা ওকে অনেক আকর্ষণ করছে। আর তনু নেহালের নেশাকাতর দৃষ্টি দেখে লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে যাচ্ছে। নেহাল তনুকে বলে,

— আজ তোমাকে অনেক অনেক বেশি সুন্দরী লাগছে৷ এই পুরো বিশ্বে তোমার চেয়ে বেশি সুন্দরী আর একটিও নেই৷ শুধু তুমি আর তুমি।

তনু মুচকি হেসে দেয়। মাথা নিচু করে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে ও বলে,

~ জি না। আমার থেকেও আপনাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে৷ একদম রাজার মতো।
— রাজা যখন তার রাণীকে কাছে পায় তখন সেও এমনিই অনেক সুন্দর হয়ে যায়৷ এবার রাজা তার রাণীটাকে একদম আপন করে নিতে চায়। তাকে ভ্যাম্পায়ার কুইন বানাতে চায়৷ সে কি প্রস্তুত?
~ ইসসস, জানি না৷ চুপ করুন তো আপনি। (লজ্জায় মেয়েটা শেষ)

নেহাল আর এক মুহূর্ত দেরি না করে তনুর মিষ্টি ঠোঁটটাকে একদম নিজের করে নেয়৷ নিস্তব্ধ মনোরম পরিবেশ যেন ওদের মাঝের ভালবাসাটাকে আরও গভীর করে দিচ্ছে। ওরা দুজন আস্তে আস্তে এক হয়ে যাচ্ছে। ওদের মন ওদের দেহ আর সবশেষে ওদের আত্না একদম এক হয়ে যায়। নেহাল দেখে হঠাৎ করেই তনুর পুরো শরীর থেকে অনেক পাওয়ারফুল আলোক রশ্মি বের হচ্ছে। নেহাল কোন ভাবে তাকাতেই পারছে না এই আলোর তাপে৷ আলোটা ওর শরীর থেকে বের হয়ে সোজা আকাশের বুকে উঠে যাচ্ছে। নেহাল তনুকে ছাড়ে না৷ ওর খুব ভয় হচ্ছিল। ও ফিল করে তনুর পুরো শরীর আস্তে আস্তে একদম বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। অস্বাভাবিক শক্তি অনুভব করছে নেহাল। নেহাল শুধু বলছে,

— তনু তুমি কি ঠিক আছো? তনু…

কিন্তু তনু কোন কথা বলছে না৷ আস্তে আস্তে এই পাওয়ারফুল আলো আবার তনুর মাঝে ঢুকে যায়৷ নেহাল তাকিয়ে দেখে তনু একদম পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ওর পুরো শরীর অনেক ফরসা হয়ে গিয়েছে। ওর চুল গুলো অনেক বড়ো বড়ো হয়ে গিয়েছে। চোখের পাপড়ি বড়ো হয়েছে। শরীরের গঠন আরও আকর্ষণীয় হয়ে গিয়েছে। মোট কথা তনুকে পুরো অপ্সরাদের মতো লাগছিল। তনু আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায়। নেহাল অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— ঠিক আছো তুমি?
~ হ্যাঁ। তবে আমি না আমার মাঝে অনেক অস্বাভাবিক শক্তি অনুভব করছি। আচ্ছা আকাশে এই নীল গোলকের মতো এটা কি?
— কি তুমি দেখতে পাচ্ছো আমার বেরিয়ারটা? ওয়াও তনু তুমি তো তাহলে আমার থেকেও পাওয়ারফুল ভ্যাম্পায়ার হয়ে গিয়েছো। এই বেড়িয়ার একমাত্র আমি ছাড়া আর কারো দেখার ক্ষমতা ছিল না৷ কিন্তু তুমি তো দেখতে পাচ্ছো। তারমানে তুমি আমার চেয়েও শক্তিশালী হয়ে গিয়েছো।
~ কি বলছেন? সত্যিই?
— হ্যাঁ তনু৷ আর তুমি আগের থেকেও অনেক সুন্দরী হয়ে গিয়েছো। আমার জানা মতে তোমার ভয়ংকর কোন রূপ ধারণ করার কথা ছিল। কিন্তু তুমি অনেক সুন্দরী রূপ পেয়েছো। দেখবে তোমার ভ্যাম্পায়ার রূপ?
~ হ্যাঁ।
— আসো।

নেহাল একটা বড়ো আয়না নিয়ে এসে তনুকে সেই আয়নার সামনে দাঁড় করায়। আর বলে,

— দেখো।

তনু নিজেকে দেখে চিনতেই পারছে না। ও অবাক পানে নিজেকে দেখছে৷ তনু দেখে ওরও নেহালের মতো সামনের দুটো দাঁত বড়ো বড়ো। তনু বলে উঠে,

~ আমি কি আমার পাওয়ার এর পরীক্ষা করতে পারি? আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে আমার শক্তি দেখতে৷
— হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই আমিও দেখতে চাই। এক কাজ করো সমুদ্রের দিকে তোমার ডান হাতটা তাক করে মনে মনে আগুনের কথা ভেবে ফায়ার করো। একদম তোমার সব শক্তি দিয়ে ফায়ার করবে।
~ ঠিক আছে৷

নেহালের কথা মতো তনু যেই ওর সব শক্তি দিয়ে সমুদ্রের দিকে আগুন মারে, ওরা দেখে বিশাল বড়ো মানে দশ তলা বিল্ডিংয়ের এর চেয়েও বেশি আগুনের প্রস্থ আর লম্বা ত চোখেই দেখা যায়। নেহাল দ্রুত ওকে থামায়৷ ও রীতিমতো ভয় পেয়ে যায়৷ তনু নিজেও অবাক। নেহাল বলে উঠে,

— তনু তুমি তো মুহূর্তেই পুরো একটা গোটা দেশ শেষ করে দিতে পারো। তোমার পাওয়ারের কোন লিমিট নেই৷ তুমি কখনো তোমার সব শক্তি ব্যবহার করবে না। নাহলে অনেক সমস্যা হবে।
~ ঠিক আছে৷ আচ্ছা এখন আমি চাইলে কি আপনার পাশে থেকে শত্রুদের সাথে ফাইট করতে পারবো?
— হ্যাঁ পারবে৷ তুমি একাই একশো জানো? মারসুকে এবার আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।
~ হুম। আমার স্বামীর শত্রু মানে ও আমারও শত্রু। ওকে আমিও ছাড়বো না।

নেহাল দেখে তনু একদম পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। অনেক সাহসী হয়ে গিয়েছে আগের থেকে। এটাই চাচ্ছিল ও। ও তনুর কাছে এসে ওর কানে কানে বলে,

— মিস ভ্যাম্পায়ার কুইন এবার আমরা আমাদের বাকি সময়টা কাজে লাগাই? কি বলেন?

তনু লজ্জায় নেহালকে আস্তে করে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, খালি লজ্জা দেয় আমাকে৷ কিন্তু নেহাল তনুর ধাক্কায় অনেক দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে। তনু ভয় পেয়ে যায়। নেহাল হাসতে হাসতে আবার ওর কাছে এসে ওর ঠোঁটটা নিজের করে নেয়। যাতে ওর শক্তটা নেহালের উপর কোন কাজ না করে। সেদিন রাতের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল তনুর কাছে নতুন নতুন এক্সপেরিয়ান্স। আর ভালবাসার আদান প্রদান তো আছেই৷

পরদিন সকালে ওরা আবার তনুর বাসায় চলে আসে। তনু ফ্রেশ হয়ে নেহালের দেওয়া নতুন ড্রেসটা পরে নেয়। কারণ ও ভ্যাম্পায়ারদের কুইন হয়ে ডার্কনেসে যাবে প্রথম বারের মতো। নেহালও ওরানতিশের মতো মানে ভ্যাম্পায়ার কিং এর পোশাক পরে নেয়। আজ অনেক দিন পর ও ওর প্রাসাদে যাবে৷ নেহাল তনুর হাতটা ধরে বলে,

— কি রেডি তো? ডার্কনেসে তোমাকে দেখার জন্য হাজার হাজার ভ্যাম্পায়ার অপেক্ষা করছে।
~ হ্যাঁ।
— তাহলে চলো।

নেহাল আর তনু একে অপরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নেহাল ওর বিশেষ পাওয়ার ব্যবহার করে তনুকে নিয়ে ডার্কনেসে টেলিপ্যাথ হয়ে যায়৷ ওরা এখান নেহালের রুমে আছে৷ তনু দেখে শুধু নেহালের রুমটাই মনে হয় ওদের বাড়িটার সমান৷ এত্তো বড়ো। তনু অবাক হয়ে বলে,

~ এত বড়ো রুমে থাকেন আপনি?
— হুম৷ রাজা বলে কথা। এই রুমে আগে আমার বাবা-মা থাকতো। তারা এখন কেউই বেঁচে নেই।
~ ওহ! আপনার কোন ভাই বোন নেই?
— নাহ! সবাইকে মেরে ফেলছে মারসু।
~ আপনি কোন চিন্তা করবেন না ওকে আমি শেষ করবো।
— আচ্ছা আচ্ছা। এখন চলো সবাই অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
~ চলুন।

নেহাল আর তনু ওদের রুম থেকে বের হতেই দেখে রাইগার দাঁড়িয়ে আছে। ওদের স্বাগত জানায়৷ পুরো পথ জুড়ে ফুল বিছানো। ফুলের উপর দিয়ে ওরা হেঁটে যাচ্ছে। তনু নেহালের হাত ধরে আশেপাশে দেখতে দেখতে যাচ্ছে। নেহালের প্রাসাদ বিশাল বড়ো। ওর প্রাসাদে কাজ করা মেয়ে ভ্যাম্পায়ার গুলো তনুকে দেখে খুব খুশি হচ্ছে। এত সুন্দরী মেয়ে ভ্যাম্পায়ার ওরা আগে কখনো দেখে নি৷ সবাই খুব খুশি। কিছু পথ হাঁটতেই ওরা দুজন সবার সামনে চলে আসে। তনু দেখে হাজার হাজার ভ্যাম্পায়ার জড়ো হয়েছে। ওর খুব নার্ভাস লাগছিল। নেহাল তনুর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে ওকে অভয় দেয়। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে জোর কণ্ঠে বলে উঠে,

— আমার ডার্কনেসবাসী আমি যেমনটা আপনাদের কাছে ওয়াদা করে ছিলাম যে আমি আমার রাণীকে যেভাবে হোক নিয়ে আসবো। এবং আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিব৷ এই হলো আপনাদের ডার্কনেসের নতুন রাণী, লিরা ফিরুন্দিস। তনু আজ থেকে তোমার নাম লিরা ফিরুন্দিস৷
~ অনেক সুন্দর নাম।
— এবার তুমি কিছু বলো।
~ জি। আমি লিরা ফিরুন্দিস, আপনাদের রাজার একমাত্র এবং শেষ রাণী৷ আমি ওয়াদা করছি আমি আপনাদের সবাইকে সকল ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা করবো। আপনারা কি আমাদের সাথে থাকবেন?
— হ্যাঁ…. (সবাই)

নেহাল পুরো অবাক হয়ে যায়। তনু সত্যিই একজন রাণীর মতো ভাষণ দিচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করে বিকট বিকট শব্দ হয়। সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মারসু রাইবেদান তার বিশাল আর্মি নিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। সাধারণ ভ্যাম্পায়ারদের উপর অ্যাটাক করছে। নেহাল কিছু বলার আগেই তনু খুব ক্ষিপ্ত হয়ে নেহালের সামনে এসে মারসুদের দিকে ওর সর্বোচ্চ পাওয়ার দিয়ে পালটা অ্যাটাক করে৷ মুহূর্তেই মারসু এবং ওর শয়তান সাথীরা নিঃশেষ হয়ে যায়। হাজার হাজার ভ্যাম্পায়ার তনুর ক্ষমতা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। এরকম শক্তি তারা আগে কখনো দেখেনি। তনু এবার নেহালের দিকে ঘুরে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

~ আমি থাকতে আপনার কাছে কেউ আসতে পারবে না৷

নেহাল খুব খুশি হয়ে তনুকে ধরে বলে,

— তুমি একটু আগে কাকে মেরেছো জানো?
~ কাকে?
— আমাদের সবার বড়ো শত্রু মারসু রাইবেদানকে। ও আমার চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। তুমি তো মুহূর্তেই ওকে শেষ করে দিলে।
~ বলেন কি! তাহলে আর কোন বিপদ নেই?
— না৷ আজ থেকে তুমি, আমি এবং আমরা সবাই শান্তিতে এখানে থাকতে পারবো। যতদিন নতুন কোন শত্রুর আগমন না হয়।
~ তাহলে তো খুব ভালো।
— হ্যাঁ।

হঠাৎ ওরা দুজন দেখে, যত ভ্যাম্পায়ার ছিল তারা সবাই মাথা নত করে বলছে, রাজা ওরানতিশের জয়, রাণী লিরা ফিরুন্দিসের জয়৷ আমরা সবাই আজ থেকে আমাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের আনুগত্য আপনাদের পায়ের কাছে দিলাম। নেহাল তনুর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে সবার উদ্দেশ্য বলে,

— আমি চাই আপনার সবাই সুখে শান্তিতে থাকুন৷ আপনাদের আনুগত্য আমি ওরানতিশ গ্রহণ করলাম। আজ সবার জন্য আনন্দের একটা দিন৷ আজ পুরো ডার্কনেস আনন্দে ভেসে যাক। সবার জন্য সব কিছু ফ্রী। সবাই আনন্দ করুন৷

নেহালের কথা শুনে সবাই আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠে। নেহাল আর তনু মানে ওরানতিশ আর লিরা ফিরুন্দিস একসাথে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ওদের ডার্কনেসের জনগণকে দেখছে আর খুশিতে হাসছে। আজ থেকে ওদের জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু হবে৷

— সমাপ্ত।

Darkness Part-06

0

#Darkness
Writer: Abir Khan
Part: 06
ওরা একে অপরের দিকে মায়ায় ভরা ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তনুর ঠোঁট জোড়া কাঁপছিল। নেহাল কেন জানি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না৷ ও তনুকে একদম অবাক করে দিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তনুর মিষ্টি ঠোঁটদ্বয়কে একদম নিজের করে নেয়। অজানা অনুভূতিতে দুজন হারিয়ে যায় অতলে। বেশ কিছুক্ষণ পর বাধ্য হয়ে ওরা একে অপরকে ছেড়ে দেয়৷ তনু এবার খুব লজ্জা পাচ্ছে। তবে আবার একটা অন্যরকম ভালো লাগাও কাজ করছে। মনের মানুষটাকে এভাবে কাছে পেলে কারই বা না ভালো লাগে! তনুরও লাগছে। নেহাল তনুর লজ্জাসিক্ত মুখখানা ওর দিকে করে কিছু মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

— তুমি যদি রাজি থাকো আমরা কালই বিয়েটা করে ফেলবো। কারণ হাতে সময় খুব কম। আমাদের খুব দ্রুত ডার্কনেসে যেতে হবে।

তনু কিছুক্ষণ ভেবে আস্তে করে লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে বলে,

~ আমি রাজি। আমার সব কিছু আপনার হাতে তুলে দিয়েছি। আপনি যা বলবেন তাই হবে। কিন্তু বাবা তো কিছুই জানে না৷ আমি যদি হঠাৎ করে এভাবে হারিয়ে যাই,তাহলে উনি কি ভাববেন?
— সে তো তোমার কোন খোঁজই নেয় না। তবে চিন্তা নেই আমি তাকে দেখে আসবো নি, যাতে সে তোমার কথা আর না ভাবে।
~ ঠিক আছে। আচ্ছা বিয়ে করতে তো দু’পক্ষেরই সাক্ষী লাগবে৷ সেটার কি হবে?
— উমমম, তুমি নীলাকে আসতে বলো আর আমি আমার একজনকে আনবো নি। তাহলেই তো হবে?
~ হ্যাঁ হ্যাঁ বেশ হবে৷ জানেন, আমার না খুব খুশি খুশি লাগছে। আমি কখনো ভাবতেও পারি নি আমি আপনার বউ হবো।
— শুধু বউ না, বলো ভ্যাম্পায়ার কিংয়ের একমাত্র ভ্যাম্পায়ার বউ। তোমাকে আপন করে নেওয়া মাত্রই তুমি ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবে৷ এটা হলো আমাদের রিচুয়াল।
~ যাহ! খালি লজ্জা দেয় আমাকে। চুপ করেন তো। (লজ্জায় একদম লাল টুকটুকে হয়ে)
— হাহা৷ তোমাকে একদম কাছে পাওয়ার জন্য বেকুল হয়ে আছি বুঝলে। আর তার চেয়েও বেশি অস্থির হয়ে আছি তোমার ভ্যাম্পায়ার রূপটা দেখে। জানি না কি হবে৷
~ আপনারা অনেক পঁচা। এরকম একটা রিচুয়াল কেউ বানায় নাকি! (নেহালের বুকে মুখ লুকিয়ে)
— পাগলি, এই রিচুয়াল না হলে অনেক মানুষই খুব সহজে ভ্যাম্পায়ার হয়ে যেত আর অন্য মানুষের ক্ষতি করতো। তাই হইতো এই রিচুয়াল বানিয়েছে।
~ হয়েছে চুপ করেন এবার। একটুও লজ্জা নাই আপনার।

তনু খুব লজ্জা পাচ্ছে। আর নেহালও ওর লজ্জাসিক্ত মুখখানা দেখে খুব মজা পাচ্ছে। একজন মানুষ ঠিক তখনই ভ্যাম্পায়ার হতে পারবে যখন সে আরেকটা ভ্যাম্পায়ার এর সাথে একদম আপন হয়ে যাবে। তাদের মন, দেহ এবং আত্না এই তিনটি জিনিস যখন এক হয়ে যাবে ঠিক তখনই সে ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবে। এটাই ভ্যাম্পায়ার হওয়ার রিচুয়াল। সেদিন রাতে নেহাল তনুকে এটাই বলেছিল। কিন্তু তনু চেয়েছে এই রিচুয়ালটা ওরা স্বামী স্ত্রী হয়ে পূর্ণ করবে৷ তাহলে ওদের কোন সম্পর্কটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। ওরা সারাজীবন স্বামী স্ত্রী হয়ে থাকতে পারবে৷ নেহাল তনুর কথায় সেদিন রাজি হয়৷ এবং কালকে ওরা সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিয়ে করতে যাচ্ছে। তনু আর নেহাল সেদিন রাতটা এভাবে খুনসুটি করেই কাটিয়ে দেয়৷ তবে নেহালের মনের গভীরে তনুকে নিয়ে একটা অজানা ভয় কাজ করছিল। তবে সেটা ও তনুকে বুঝতে দেয় নি।

পরদিন সকালে,

আজকের দিনটা অনেক স্পেশাল। তনু আর নেহাল একসাথে ঘুমিয়ে আছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। হঠাৎই দরজায় নক। আজিম আঙ্কেল তনুকে ডাকছে।

— মামনি… এই যে মামনি… উঠুন। নাস্তা করবেন না? নিচে আসুন।

তনু একলাফে উঠে বসে। দেখে নেহাল ওর পাশে ঘুমাচ্ছে। তনু উত্তরে বলে উঠে,

~ আঙ্কেল আপনি যান আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
— আচ্ছা মামনি।

আজিম আঙ্কেল চলে গেলে তনু আস্তে আস্তে নেহালকে ডাক দেয়।

~ এই যে মিস্টার উঠুন। সকাল হয়ে গিয়েছে। এই যে…
— আরেকটু ঘুমাতে দেও না।
~ আজিম আঙ্কেল ডাকছে আমাকে। নিচে যেতে হবে।
— আচ্ছা যাও। আমাকে কেউ দেখবে না সমস্যা নেই।
~ আরে আমি নিচে গেলে ঘর পরিষ্কার করতে আসবে তো।
— ওহ! তাহলে আমি অন্য কোথাও যাই। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে আসো।
~ ঠিক আছে। আর শুনুন..
— হুম বলো..
~ না মানে আমার রক্ত খাবেন না? (লজ্জাসিক্ত কণ্ঠে)

নেহাল তনুর দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। আর তনু খুব লজ্জা পাচ্ছে। হঠাৎই নেহাল তনুকে কাছে টেনে ওর ঘাড়ে আলতো করে একটা পরশ বুলিয়ে দিয়ে দাঁত বসিয়ে দেয়৷ কিছুক্ষণ ওর রক্ত খেয়ে তনুকে ছেড়ে দিয়ে ও বেড থেকে নেমে বলে,

— আহ! নিজেকে অনেক পাওয়ারফুল মনে হচ্ছে। যাই ট্রেনিং করে আসি কতক্ষণ।
~ আচ্ছা যান। (মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে)

নেহাল তনুর কাছে এসে ওর কপালে আলতো করে পরশ বুলিয়ে দিয়ে চোখের পলকে নাই হয়ে যায়৷ তনু চোখ বন্ধ করে মুচকি হেসে নেহালের ভালবাসার স্পর্শটা গ্রহণ করে। তারপর ও ফ্রেশ হতে চলে যায়৷ ফ্রেশ হয়ে এসে নিচে নাস্তা করতে চলে যায়। নাস্তা করে এসে নীলাকে সবার আগে ফোন দেয়৷

~ হায় দোস্ত কেমন আছিস? (তনু)
~ আলহামদুলিল্লাহ। তুই? আর গতকালকে আসিস নি কেন?(নীলা)
~ আমিও অনেক ভালো আছি। আসলে দোস্ত একটা জিনিস হয়ে গিয়েছে। তোর একটা হেল্পও লাগবে৷
~ বলিস কি! কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। আমার তো চিন্তা হচ্ছে।
~ আরে শান্ত হ। খুশির খবর আছে একটা।
~ তো কার অপেক্ষায় আছিস বল না৷
~ আসলে দোস্ত তুই তো জানিসই আমি কতটা একা। সারাদিন একাকিত্ব আর বিষন্নতায় ভুগি। কিন্তু হঠাৎ করে নেহাল আসায় ওর আর আমার মধ্যে কিছু একটা হয়ে গিয়েছে৷
~ কি হয়েছে!
~ উমমম, মানে…ভালবাসা দোস্ত। (খুব লজ্জা পেয়ে)
~ ওমা তাই নাকি? ওয়াও! আমিও ভেবেছিলাম তোদের মাঝে কিছু একটা হতে পারে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে তা ভাবি নি। কংগ্রেস দোস্ত।
~ থ্যাংকস।
~ আরে থ্যাংকস পরে, এখন বল আমার কি হেল্প লাগবে? আঙ্কেলকে বলতে হবে? আচ্ছা নাম্বার দে।
~ আরে না না৷ আসলে আজকে বিকেলে আমরা বিয়ে করবো তুই আমার সাক্ষী হবি প্লিজ? আব্বুকে নেহাল দেখে নিবে বলেছে।
~ কিহহ! তোরা আজকে বিয়ে করবি? হাউ! মানে কেমনে কি?
~ আরে আমরা অনেক সিরিয়াস। প্লিজ তুই একটু হেল্প কর।
~ আরে এত রিকোয়েস্ট করছিস কেন! অবশ্যই করবো। আমাকে এড্রেস পাঠিয়ে দিস আমি সময় মতো চলে আসবো।
~ সত্যি দোস্ত?
~ হ্যাঁ বাবা হ্যাঁ। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোর পাশে না থাকলে কার পাশে থাকবো বল? তোকে এতটা বছর পর আমি এত হ্যাপি দেখছি। আমিও যদি এই আনন্দের ভাগিদার হতে পারি খারাপ কি।
~ সত্যিরে তুই অনেক অনেক ভালো।
~ হয়েছে এবার যা সব গুছিয়ে নে৷
~ আচ্ছা৷

তনুর কথা শেষ হলে ও পিছনে তাকিয়ে দেখে নেহাল বেডের উপর বসে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। তনু নেহালকে দেখে অবাক হয়ে বলে,

~ আপনি কখন আসলেন?
— কিছুক্ষণ আগেই।
~ ও৷ যাক ভালোই হলো। নীলা রাজি ও সময় মতো চলে আসবে৷ বলেছে কাজী অফিসের এড্রেসটা দিতে শুধু।
— ওকে তোমার বাসায় আসতে বইলো তাহলেই হবে৷
~ বলেন কি! এখানে তো সবাই আছে। সবার সামনে কিভাবে কি?
— পাগলি আমি ভ্যাম্পায়ার ভুলে যাও কেন বারবার? সবার সম্মতিতেই আমাদের বিয়েটা হবে।
~ সত্যি!
— হ্যাঁ।
— এটা তোমার জন্য৷(একটা শপিং ব্যাগ দিয়ে)
~ এটা কি?
— খুলে তো দেখো।

তনু ব্যাগটা খুলে দেখে অসম্ভব সুন্দর ডিজাইনের একটা দামী কাজ করা নীল রঙের শাড়ি। ও পুরো অবাক আর অনেক খুশি। এত সুন্দর শাড়ি ও আগে কখনো দেখে নি। নেহাল তনুকে এত খুশি হতে দেখে বলে,

— শাড়িটা পাকিস্তান থেকে এনেছি। পছন্দ হয়েছে?
~ অনেক অনেক বেশি। আমি এখনিই এটা পড়বো।
— আরে এখন না৷ তোমাকে সাজাতে মেয়েরা আসবে৷ তারা সুন্দর করে পরিয়ে দিবে৷
~ ঠিক আছে। আপনি যা বলবেন তাই হবে।
— আমি তাহলে সব রেডি করে আসি।
~ আচ্ছা।

নেহাল আবার চলে যায়। এরপর দেখতে দেখতে বিকেল চলে আসে। এর মাঝে নেহাল কাজীকে ঠিক করে, তনুর বাসায় যারা আছে তাদের সবাইকে ওর পাওয়ার দিয়ে বশ করে ফেলে। যেন তারা নেহালকে অনেক বছর যাবৎ চিনে৷ আজিম আঙ্কেল পুরো বাসা সুন্দর করে সাজায়। এছাড়া নেহাল নিজ হাতে ওদের জন্য স্পেশাল বাসর রেডি করে৷ তবে সেটা তনুর বাসায় না অনেক দূরে কোথাও। যেটা তনু জানে না৷ নেহাল চায় ওদের জীবনের এই বিশেষ মুহূর্তটা যেন স্মরণীয় হয়ে থাকে তনু আর ওর মাঝে। সব কিছু গুছিয়ে নেহাল অসম্ভব সুন্দর একটা কুর্তা পরে নিচে হল রুমে বসে আছে। নীলা আগেই এসে তনুকে সাজাচ্ছে। আর নেহালের সেই বিশ্বস্ত বন্ধু মানে রাইগারও এসেছে। বেচারা এত মানুষ দেখে অনেক কষ্টে নিজের লোভকে সামলে আছে। শুধু মাত্র নেহালের ভয়ে। মাগরিবের ঠিক পর পরই তনুকে নিয়ে নীলা নিচে আসে। নেহাল সহ সবাই তনুকে দেখে পুরো অবাক৷ তনুকে একদম রাণীর মতো লাগছে। অসম্ভব থেকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছে ওকে। নেহাল যেন ওর চোখই সরাতে পারছে না। তনু লজ্জাসিক্ত মুখখানা নিয়ে নেহালের পাশে এসে বসে। নীলা বলে উঠে,

~ কি জিজু আপনার রাণীকে কেমন লাগছে? কেমন সাজালাম আমরা?
— অসম্ভব সুন্দর৷ যেন চাঁদের টুকরো বসে আছে আমার পাশে।
~ বাব্বাহ! আমাদের জিজু তো ভালোই রোমান্টিক। হাহা৷

সবাই হেসে দেয়৷ এদিকে তনু লজ্জায় শেষ। নেহাল সেটা বুঝতে পেরে ওর হাতে হাত রাখে৷ আর কাজীকে বলে,

— জি এবার শুরু করুন। সবাই এসেছে।

কাজী ওদের বিয়ে পড়ানো শুরু করে৷ রাইগার আর নীলা সাক্ষী হয়েছে আর আজিম আঙ্কেল হয়েছেন উকিল বাবা৷ ওরা দুজন কবুল বলা মাত্রই কাজী সাহেব মোনাজাত ধরেন৷ মোনাজাত শেষে তিনি বলেন,

— আজ থেকে আপনারা স্বামী আর স্ত্রী হিসেবে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হলেন৷ আমিন৷
— আমিন।(সবাই)

এরপর মিষ্টি সহ আরও অনেক খাওয়া দাওয়া হয়৷ সবাই অনেক হাসাহাসি করে। নীলা নেহালকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে। নেহাল বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলে। আস্তে আস্তে সবাই বিদায় নিয়ে চলে যায়। নীলা তনুকে ওর রুমে রেখে এসেছে। যাওয়ার সময় ও নেহালকে বলে,

~ তনুকে আপনার হাতে দিয়ে গেলাম। ওর খেয়াল রাখবেন কিন্তু মিস্টার জিজু।
— অবশ্যই। (হাসি দিয়ে)
~ আসি তাহলে।
— আচ্ছা।

নীলা গেলে আজিম আঙ্কেল এসে বলেন,

— বাবা তাহলে তুমি উপরে তনু মামনির কাছে যাও আমি এদিকটা দেখছি।
— জি আঙ্কেল।

নেহাল এবার তনুর কাছে যাচ্ছে। তনু ওর বেডে অনেক বেশি উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে৷ আজ ও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাবে৷ যখন নেহাল ওকে একদম আপন করে। এসব ভেবেই ওর মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। লজ্জায় বারবার লাল হয়ে যাচ্ছে ও। এদিকে তনু আবার জানে না নেহাল কত বড়ো একটা সারপ্রাইজ ওর জন্য রেডি করে রেখেছে। তনু নেহালের অপেক্ষায় আর নেহাল তনুকে সেই সারপ্রাইজটা দেওয়ার অপেক্ষায়। নেহাল দরজায় নক করে তনুর রুমে প্রবেশ করে। তনু নেহালকে আসতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসে। নেহাল দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে ওর কাছে এসে দাঁড়ায়। তনু আড় চোখে একবার নেহালের দিকে তাকায়। আবার লজ্জায় চোখ সরিয়ে ফেলে। তনু দেখে নেহাল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোন কিছু বলছে না৷ তাই ও আস্তে আস্তে নেহালের দিকে তাকাতেই, হঠাৎই নেহাল কোন কিছু না বলে তনুকে সোজা….

চলবে…?

Darkness Part-05

0

#Darkness
Writer: Abir Khan
Part: 05
নেহাল তনুর ঘাড়ে কামড় দিয়ে ওর রক্ত খায়। কিছুক্ষণ পর ওকে ছেড়ে দিয়ে বলে,

— ঠিক আছো?
~ হ্যাঁ।
— প্লিজ ভয় পেয়েও না আমার আসল রূপ দেখে৷ চেয়েছিলাম কোন দিন যেন আমার আসল রূপ তুমি না দেখো কিন্তু মনে হচ্ছে তা আর সম্ভব না। আমাকে যেভাবে হোক তোমাকে বাঁচাতেই হবে৷

বলেই নেহাল মুহূর্তেই মধ্যে ওর আসল রূপ ধারণ করে। তনু দেখে নেহালের শরীর আস্তে আস্তে অনেক বড়ো হয়ে যায়। ওর পুরো শরীর মানুষ থেকে একটা হিংস্র পশুর মতো হয়ে যায়। ওর শরীর এত বড়ো হয়ে গিয়েছে যে তনু নেহালের পায়ের নিচে পড়লেই মারা যাবে৷ নেহালের পুরো শরীরে কেমন কাটা কাটা আর রক্ত প্রবাহ হচ্ছে। শুধু তাই না পুরো শরীরের বাইরে থেকে আগুনের শিখা বের হচ্ছে। আর নেহালের মাথাটা কঙ্কালের মতো। ওর চোখ পুরো লাল। যেন রক্ত ঝরছে। এই বিভৎস দৃশ্য দেখে তনুর অবস্থা খুব খারাপ। নেহালের আসল রূপ যে এতটা ভয়ংকর হতে পারে তনু কল্পনাও করেনি। ও একটা পাথরের পিছনে লুকিয়ে ছিল। তনু দেখে একের পর এক ভ্যাম্পায়ার ওর দিকে তেড়ে আসছে। কিন্তু নেহাল কাউকেই তনুর কাছে আসতে দিচ্ছে না। ও বিকট গর্জন দিয়ে উঠছে। ওর পুরো শরীরের অনেক ভ্যাম্পায়ার উঠে ওকে আঘাত করছে। নেহাল আর কোন উপায় না পেয়ে এবার ওর সত্যিকারের পাওয়ার ব্যবহার করে৷ ও একের পর এক ভ্যাম্পায়ারগুলোকে মারতে থাকে। ও অনেক ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছে। নিজের উপর ওর আর কোন কন্ট্রোল নেই। তনু চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে নেহালের হিংস্রতা দেখে যাচ্ছে। এতটা ভয়াবহ ভাবে নেহাল ওই ভ্যাম্পায়ার গুলোকে মারছিল যে, কারো মাথা ছিড়ে যাচ্ছে, কারো শরীর দুভাগ হয়ে যাচ্ছে, কেউ ওর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। আবার কাউকে ও চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে। এভাবে টানা এক ঘণ্টা নেহাল লড়াই করে। ওর আলটিমেট শক্তি প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। এখনো অনেক ভ্যাম্পায়ার বাকি। তাই ও আর কোন উপায় না পেয়ে নিজের সব শক্তি ব্যবহার করে মুহূর্তেই সব ভ্যাম্পায়ারকে মেরে ফেলে। আর সাথে সাথে ও আগের মতো হয়ে ঠাস করে বালির ওপর পড়ে যায়। তনু কাঁদতে কাঁদতে নেহালের কাছে দৌড়ে চলে আসে। এসে দেখে ওর পুরো শরীরের অনেক জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে, অনেক বড়ো বড়ো ক্ষত হয়েছে। তনু যেন এসব মানতেই পারছে না। ও কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার দিয়ে বলে,

~ এইই যে….আপনার কি হয়েছে? চোখ খুলুন, কথা বলুন। নেহাল….

নেহাল কোন কথা বলে না৷ একটু নড়াচড়াও করছে না। ইভেন কোন নিঃশ্বাসও নিচ্ছে না। তনু নেহালের এই অবস্থা দেখে অসম্ভব ভয় পেয়ে যায়৷ ওর অস্থিরতা বেড়ে আকাশচুম্বী। ও ঠিক কি করবে বুঝতে পারছে না। আশেপাশে এতশত লাশ পড়া তাও এত বিভৎস ভাবে যে ও খুব ভয়ও পাচ্ছে। তনু নেহালের রক্তাক্ত মুখখানার দিকে তাকিয়ে শুধু অঝোরে কাঁদছে। নেহাল কি আর নেই? ওকে বাঁচানোর জন্য এতকিছু করেছে নেহাল। কারণ তনু দেখেছে অর্ধেকের বেশি ভ্যাম্পায়ার শুধু ওকে মারার জন্যই ওর কাছে আসছিল কিন্তু নেহাল তার আগেই তাদেরকে মেরে ফেলে সব আঘাত নিজের গায়ে নিয়ে। বাকি ভ্যাম্পায়াররা তো নেহালের উপর অ্যাটাক করতেছিলোই। প্রতিটি ভ্যাম্পায়ারই অনেক শক্তিশালী ছিল। নেহাল যদি তনুর রক্ত না খেতো তাহলে কখনোই এতগুলো ভ্যাম্পায়ারকে মারা ওর পক্ষে সম্ভব হতো না৷ তনু এসব ভেবে হঠাৎ করে ওর মাথায় আসে, হ্যাঁ রক্ত। ওর রক্তই তো নেহালের সবচেয়ে বড়ো শক্তি। কিন্তু নেহাল তো এখন অচেতন। তাহলে কিভাবে ওর রক্ত খাবে! তনুর নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। যে লোকটা ওকে বাঁচাতে নিজের জীবন বাজি রাখলো এখন তাকে বাঁচাতে ও কি কিছুই করতে পারবে না? তনু ওর হাত দুটো সামনে এনে তাকায়। হঠাৎই ও একটা বুদ্ধি পেয়ে যায়। তবে এই কাজটা করলে ও অনেক ব্যথা পাবে। তাতে কি যদি নেহাল আবার আগের মতো হয়ে যায়। তনু ওর একটা আঙুলের মাথা অনেক কেটে ফেলে। সাথে সাথে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। তনু দেরি না করে নেহালের মুখে ওর আঙুল দিয়ে দেয়। এবার সব রক্ত নেহালের মুখের ভিতর যাচ্ছে। কিন্তু কোন কিছু হচ্ছে না৷ তনুর খুব ভয় করছে। তাহলে কি আজ ওর রক্তও আর কাজে দিবে না। নেহাল চিরতরে হারিয়ে যাবে৷ ওর একমাত্র আপনজনটাও শেষমেশ এভাবে হারিয়ে যাবে! তনুর খুব চিন্তা আর ভয় হচ্ছিল। নেহালের মাঝে কোন পরিবর্তন নেই। অলরেডি অনেক রক্ত গিয়েছে। তাও কিছুই হচ্ছে না৷ কিন্তু হঠাৎই তনু অবাক হয়ে দেখে, নেহালের ক্ষত গুলো আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাচ্ছে। ওর শরীর থেকে রক্ত পড়াও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরও পাঁচ মিনিটের মধ্যে নেহালের পুরো শরীর একদম ভালো হয়ে যায়। আর তার ঠিক একটু পরই নেহাল আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকিয়ে তনুর আঙুলে হালকা একটা কামড় দিয়ে ফেলে। তনু ব্যথায় গোঙ্গানি দিয়ে উঠে। নেহাল সাথে সাথে এক লাফে উঠে বসে তনুর দিকে তাকায়। ওর আঙুলটা মুখ থেকে বের করতেই নেহাল সব বুঝে যায়। তনু নেহালকে একদম সুস্থ হতে দেখে ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নেহালকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

~ আপনি বেঁচে আছেন! আল্লাহ তোমার কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া। আপনি ঠিক আছেন তো?

নেহালও তনুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

— আমার তনু আমার পাশে থাকতে আমার কিছু হতে পারে বলো? তুমি যদি রক্তটুকু আমাকে না দিতে আমি হয়তো আর কখনো তোমার এই মায়াবী মুখখানা, তোমার এই উষ্ণ স্পর্শ আর তোমার সীমাহীন ভালবাসাটা আর পেতাম না৷
~ চুপ করুন। আপনার কিচ্ছু হতে দিব না আমি। অনেক ভালবাসি আপনাকে। জানেন খুব ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছি আমার একমাত্র আপনজনটাও হারিয়ে যাবে৷
— তোমার ভালবাসা আমাকে আবার বাচিঁয়ে দিয়েছে। দেখি তোমার আঙুল টা।

নেহাল তনুর কাটা আঙুলটা নিয়ে একটা চুমু দেয়। সাথে সাথে ওর কাটা জায়গাটা আবার ভালো হয়ে যায়। নেহাল এবার মাথা নিচু করে আছে৷ তনু ওর গাল দুটো ধরে চিন্তিত স্বরে বলে,

~ কি হলো? মন খারাপ করলেন কেন?
— তুমি কি এখন আমাকে দেখে ভয় পাবে? কারণ আমার আসল রূপ দেখে ফেলেছো তুমি।
~ আমি তো রূপের পূজারি না। আপনার মনটা আমার ভালো লেগেছে, আপনার সঙ্গ আমার ভালো লেগেছে, আপনার রহস্যময় হাসিটা আমার ভালো লেগেছে। আর কি চাই বলুন তো।
— তুমি সত্যিই আমার জন্য৷
~ আর আপনিও আমার জন্য৷ তবে হ্যাঁ আপনি যে এতটা ভয়াবহ হতে পারেন আমার জানা ছিল না।
— আসলে বারবার মনে হচ্ছিল আমি যদি একবার হাল ছেড়ে দি ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে৷ আর তুমি একবার চলে গেলে আর কোন দিন আমি তোমাকে ফিরে পাবো না। তাই আমার ভিতরে যে হিংস্র পশুটা ছিল আমি আমাকে তার কাছে তুলে দিয়েছিলাম তোমাকে বাঁচাতে৷
~ প্লিজ আমার জন্য আর এভাবে নিজের জীবনকে বাজি রাখবেন না৷
— সে দেখা যাবে৷ এবার বাসায় চলো। তোমাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে।
~ হুম চলুন৷

নেহাল তনুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আশেপাশে এতগুলো ভ্যাম্পায়ারের লাশ দেখে ও একটা হাত উপরে উঠিয়ে চুটকি বাজায়। আর সাথে সাথে সবগুলো লাশে আগুন ধরে ছাই হয়ে যায়। তারপর ওরা আবার তনুর বাসায় চলে আসে। নেহাল তনুকে বলে,

— তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি বারান্দায় আছি।
~ যদি কেউ দেখে ফেলে?
— ভয় নেই তুমি ছাড়া এখন আমাকে আর কেউ দেখতে পারবে না৷ এতগুলো ভ্যাম্পায়ারকে মারার ফলে আমার মধ্যে নতুন নতুন অনেক পাওয়ার এসেছে।
~ ওহ! আচ্ছা যাচ্ছি তাহলে।

তনু একটা ড্রেস নিয়ে চলে যায়। নেহাল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে,

— সামনে আয়।

নেহালের বন্ধু ওর সামনে চলে আসে। এসে বলে,

— তাহলে তুই বেঁচে গেলি? কিন্তু কিভাবে? এতগুলো ভ্যাম্পায়ারকে মারার ক্ষমতা তোর মাঝে আছে?
— কেন এসেছিস সেটা বল।
— একটা ভালো খবর আছে আর একটা খারাপ।
— বল শুনি।
— মারসু রাইবেদানের সাথীরা তোর ভয়ে ওর পিছু ছেড়ে তোর কাছে আত্নসমর্পণ করেছে। ওরা বলেছে আর কোনদিন তোর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।
— হাহা। ওরা বললেই আমি বিশ্বাস করবো? তবে খবরটা ভালো। আর খারাপ খবরটা কি?
— মারসু খুব খারাপ কিছু করতে যাচ্ছে। ও নাকি রেড ট্রি পাইনে গিয়েছে। নতুন করে ওর আর্মি বানাতে। তার মানে বুঝছিস?
— ও কি ভেবেছে শয়তানের শক্তি নিয়ে আমাকে মারতে পারবে? কখনো না। ওর থেকেও বেশি শক্তি আছে আমার কাছে। শোন খুব তাড়াতাড়ি আমরা ডার্কনেসে আসছি। রেডি থাকিস আমাদের আর্মি নিয়ে।
— তুই কি সত্যিই ওকে ভ্যাম্পায়ার বানাবি?
— হ্যাঁ। এছাড়া ওকে বাঁচানোর আর কোন উপায় নেই। আর তারচেয়ে বড়ো কথা ওকে আমি ভালবাসি। ডার্কনেসের একমাত্র কুইন ওই হবে৷
— ওরানতিশ(নেহালের ভ্যাম্পায়ার নাম) তুই জন্ম থেকে ভ্যাম্পায়ার আর তনু তো মানুষ। ও যদি এই পরিবর্তন না নিতে পারে?
— রাইগার(নেহালের বন্ধুর নাম) আমি ওরানতিশ, আমার চেয়ে ভালো কে জানবে বল? আমার তনুর পাওয়ার সম্পর্কে তোর ধারণা নেই।
— ঠিক আছে তুই যা ভালো ভাবিস। আমি আসি।
— যাহ! খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে ডার্কনেসে।
— হুম।

রাইগার চলে গেলে নেহাল চোখ বন্ধ করে চাঁদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চাঁদের আলোতে ওর শরীর অনেক শক্তি উৎপন্ন করে। এদিকে তনু ফ্রেশ হয়ে বারান্দার দিকে আসে। এসে দেখে নেহাল দাঁড়িয়ে আছে। তনু কিছু না ভেবেই নেহালকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আর বলে,

~ কি ভাবছেন?
— খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
~ ইসস! মাথায় খালি দুষ্টামি ঘুরে তাই না?

নেহাল তনুর দিকে ঘুরে ওর কোমড়টা জড়িয়ে ধরে ওর দিকে মুচকি একটা হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। চাঁদের আলোতে তনুকে অসম্ভব সুন্দরী লাগছিল। নেহাল আস্তে করে ওর গাল দুটো ধরে আর বলে,

— সামনে আরও বড়ো বাঁধা আসছে। এ যাত্রায় আমি একা লড়াই করেছি। কিন্তু তখন আর তা সম্ভব না। তোমাকে নিয়ে ডার্কনেসে যেতে হবে৷
~ ডার্কনেস? এটা আবার কি?
— ওহ! তোমাকে তো বলিই নি। আমি ডার্কনেসে থাকি। আমি বলতে আমরা যারা ভ্যাম্পায়ার তারা সবাই ওখানে থাকে। ডার্কনেস হলো ভ্যাম্পায়ারদের দুনিয়া৷ ওখানে সব ভ্যাম্পায়াররা থাকে। একটা আলাদা দুনিয়া সেটা। সেখানে অনেক ধরনের ভ্যাম্পায়ার থাকে। আর তাদের সবার রাজা একমাত্র আমি, ওরানতিশ।
~ ওরানতিশ, আপনার আসল নাম?
— হ্যাঁ। আর নেহাল নামটা এই দুনিয়ার জন্য৷
~ ওও। ডার্কনেস কি অনেক সুন্দর? নাকি ভয়ংকর?
— তোমাদের পৃথিবীর মতোই। তবে কিছুটা আলাদা। ওখানে সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে সব কিছুতে। ওখানে কোন সাধারণ মানুষ যেতেই পারবে না৷ তাহলে সে সাথে সাথে মারা যাবে। তাই তোমাকেও খুব তাড়াতাড়ি ভ্যাম্পায়ার হতে হবে তনু। খুব তাড়াতাড়ি।

তনু খুব লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জার ওর মুখখানা লাল হয়ে গিয়েছে। নেহাল ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,

— আমার কি মনে হয় জানো, তুমি যদি ভ্যাম্পায়ার হও আমার থেকেও অনেক শক্তিশালী হবে তুমি।
~ আমিও আপনার মতো ফাইট করতে পারবো তখন?
— হ্যাঁ পারবে৷ আমি তোমাকে অনেক কিছু শিখাবো। তুমি তো ডার্কনেসের রাণী হবে৷ তোমাকে সব জানতে হবে৷ আমরা দুজন মিলে হাজার হাজার বছর রাজত্ব করবো। না না আমাদের ছেলে মেয়ে করবে৷ তুমি আর আমি শুধু প্রেম ভালবাসা করবো।
~ যাহ! কেউ হাজার বছর বাঁচে নাকি?
— হাহা৷ তুমি ভ্যাম্পায়ার হলে হাজার বছর বাঁচবে৷
~ কি সত্যিইইই? আমি হাজার বছর আপনাকে আমার কাছে পাবো?
— হ্যাঁ পাগলিটা।

তনু নেহালের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর নেহাল তনুর দিকে। হঠাৎই নেহাল খেয়াল করে তনুর চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। নেহাল তনুর চোখ দুটো মুছে দিতে দিতে বলে,

— একি! কাঁদছো কেন?
~ আপনাকে হারানোর ভয় করছে খুব। কিছুক্ষণ আগেও আমরা জীবন মরণ পরিস্থিতিতে ছিলাম। আবার যদি সেই মুহূর্ত চলে আসে।
— এবার আর তা হবে না৷ কারণ এই শেষ যুদ্ধে তুমিও আমার পাশে থাকবে। আমরা একসাথে বিজয় আনবো। তারপর সুন্দর একটা জীবন পাড় করবো।
~ সত্যি?
— হ্যাঁ।

ওরা একে অপরের দিকে মায়ায় ভরা ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তনুর ঠোঁট জোড়া কাঁপছিল। নেহাল কেন জানি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না৷ ও তনুকে একদম অবাক করে দিয়ে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তনুর মিষ্টি ঠোঁটদ্বয়কে….

চলবে..?