Monday, July 14, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1385



অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-১৩

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১৩।

প্রতিটি চাবুকের শব্দে কুঁকড়ে যাচ্ছে রুফাইদা।ভয়ে সিটিয়ে গুটি শুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষীণ আলোর ঘরটিতে। এটিকে বলা হয়, টর্চার রুম। কেউ নিয়ম ভাঙ্গলেই শাস্তি দিতে নিয়া আসা হয় গুহার মতো, দরজা জানলাবিহীন ঘরটিতে। রুফাইদার থরথর করে কাঁপচ্ছে। সামনেই বসা ভয়ংকর সুদর্শন যুবকটি মুহূর্তেই হিংস্র হয়ে উঠেছে। রুফাইদার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাশে দাঁড়ানো মুশফিকের উদ্দেশ্য বলল,

” নিয়ে আসো!”

এইখানের দেখাশোনা দায়িত্ব ছিলো খাদিজা। বয়সে ২৮ এর কোঠায়। ভয় ভয় মুখে এগিয়ে এলো মুশফিকের পায়ে পায়ে। রুমে তখন পিনপতন নিরবতা। সামনের সোফার উপর রাজা, মহারাজদের মতো ভাব করে বসে থাকা যুবকে দেখে বুঝতে বাকি নেই সে যা করছে তার শাস্তি আজ তাকে পেতেই হবে। খাদিজা আড় চোখে রুফাইদাকে দেখলো। মেয়েটির ফ্যাকাসে মুখ। বড্ড মায়া হলো। মেয়েটির জন্যই আজ বেঁচে আছে সে। সেদিন সময় মতো আগুনে পুড়ার হাত থেকে না বাঁচালে তার বুক সন্তান হারা হয়ে যেত।তাইতো রুফাইদাদের চিঠি পোষ্ট করার কথা না করতে পারেনি সে। খাদিজা ছোট শ্বাস ছাড়লো। মাথা নত করে বলল,

“আমি মানছি স্যার আমি দোষ করেছি। যা শাস্তি দিবেন মাথা পেতে নিবো। ”

যুবকটি হাসলো বিদ্রোপের হাসি। বরাবরই প্রেম প্রীতি তার অসহ্য লাগে। যুবক গা এলিয়ে দিলো সোফায়। হাত ইশরায় দুটি মেয়েকে ডেকে আনলো। ঘর ভর্তি মানুষের সামনে খাদিজার পরনের কাপড় কেঁড়ে নিয়া হলো।বন্ধ করা হলো রুফাইদাকে খাচায়। আর চাবুক নিয়ে উদম শরীরে বেদম পেটাতে লাগলো। নিস্তব্ধ খাদিজা টু শব্দটি করতে পাড়লো না। শুধু কেঁপে কেঁপে উঠলো। রুফাইদা আর্তনাদ করে উঠলো। চিৎকার করে বলল,

“দোস আমি করেছি আমাকে মারেন। উনাকে ছেঁড়ে দেন। দয়া করুন। আল্লাহকে ভয় করুন!”

কথা গুলো ঘরময় গুঞ্জন হতে লাগলো। তাতে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই যুবকটির মুখে, নেই ঘর ভিতরের মানুষ গুলোর মুখ। নির্বিকার চেয়ে রইলো যুবকটি খাঁচায় বন্দি রুফাইদার দিকে। মেয়েটি কাঁদছে। খাঁচা ভেঙ্গে উড়াল দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। যুবকটি ভালো লাগছে। মনে শান্তি লাগছে। সে গুন গুন করে গাইলো,

“হামে তুমসে পেয়ার কিতনা হে হাম নেহি জানতে,
মাগার জি নেহি সাকতে তোমহারি বিনা! ”

—————-

আজ অনেক দিন পর হাসপাতালে রাতে থাকছে জয়নব। সেদিনের ঘটনার পর বাড়ি থেকেই ক্লাস করে যেতে শুধু। কিন্তু আজ রাতে তার ডিউটি পড়েগেছে লেবার ওয়ার্ডে । আগত থাকতেই হচ্ছে। এখন রাত ১২ টা পায় ছুঁই ছুঁই৷ রোগীদের আনাগোনা কম এদিকটায়। সমানেই হচ্ছে বড় পার্কিং লট দেখা যাচ্ছে হাতে গোনা কজনকেই।

এর মাঝে একটি রোগী এলো। রোগীর সেন্স নেই। লোকটা মাথা ফেঁটে গেছে। সাথে এসেছে তার বউ আর দুবছরের বাচ্চা। লোকটির বউকে একনজর দেখলো জয়নব। বয়স কতটুকু হবে? ২০/২১ বছরে মেয়ে।চাপা গায়ের রঙে ঢেকে রেখেছে ফিনফিন শাড়ি।গোল গাল মুখ আর ছোট ছোট চোখ জোড়া ছলছল করছে! জয়নব বাহিরে ওয়েটিং রুমে বসে ছিলো। এখান থেকে টিকেক কাউন্টার দেখা যায়। মেয়েটি কাঁদছে। বাচ্চাটিও হাউমাউ করে কাঁদচ্ছে। জয়নবের বড্ড মায়া হলো। কৌতূহল ও হলো প্রচুর। সে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“আপু কি হয়েছে? তুমি কাঁদছো কেনো?”

মেয়েটি আঁচল টেনে মুখে চাঁপলো। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“আমার স্বামীর মাথা ফাইটা গেছে আফা। উনি রিকসা চালায়। উনার ভর্তি করার জন্য টাকা লাগবো আমার কাছে নাই। টাকা নাই বইলা তারা ভর্তি করতাছে না। আর দেখেন উনার মাথা থাইক্কাই রক্ত পইড়া ভাইসা যাইতেসে। আমি করি কন তো? আমার স্বামী ছাড়া কেউ নাই! কই জামু, কি করমু? বাচ্চাটার কি হইবো?”

মেয়েটি মাটিতে বসে কাঁদতে লাগলো। জয়নবের বড্ড কষ্ট হলো। তারও তো বাবা নেই। বাবা-মা ছাড়া ছন্নছাড়া জীবন কেমন তা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। জয়নব আজ টিউশনির বেতন পেয়েছে। কয়েক মাস যাবত নিজের খরচ নিচেই চালাচ্ছে । বেতনের অর্ধেক দিয়ে দিলো মেয়েটিকে। মেয়েটি খুশিতে আত্মহারা হয়ে জয়নবের পায়ে ধরে ফেললো। জয়নব পুরাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। নিজেকে সামলে মেয়েটিকে তুলে যাবতীয় সাহায্য করে দিলো । এক বার রোগীকেও দেখে নিলো।
তারপর আবার তার কাজে ফিরে এলো।

মাধ্য রাতে আবারো হাউমাউ করে কাঁদার শব্দ হকচকিয়ে উঠলো জয়নব। মাত্রই চোখ জোড়া লেগেছিলো তার। বাহিরে এসে সেই মেয়েটিকে দেখে মাটি গড়াগড়ি করে কাঁদছে। জয়নব হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই বুঝতে পাড়লো রোগীটি মারা গেছে। জয়নব থমকালো। লোকটির অবস্থা এতটাও ক্রিটিকেল ছিলো না যে মরে যাবে! আচ্ছা বাহে কিছু হলো নাতো আবার? জয়নব মেয়েটির হাতের রিপোর্ট ভালো করে পর্যবেক্ষন করলো। এখানে স্পষ্ট লিখা লোকটির দুটো কিডনি ডেমেজ হয়ে গেছে। জয়নবের মাথা আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চটজলদি ফোন করলো আয়ানকে। আয়ান তখন ল্যাবেই ছিলো। জয়নবের ফোন পেয়ে ছুটে এলো এক প্রকার। জয়নব হাতে রিপোর্ট দেখেই তার চোখ কঁপালে উঠে যায়। বিস্ফোরিত চোখ আর বিস্ময় বুঁদ হয়ে ঝুলে আসে মুখখানা৷ বলল,

” এটা.. এটা কিভাবে সম্ভব রোগীটিকে তো আমিই ব্যান্ডেজ করিয়ে ১০২ নং রুমে সীট নিতে বলেছিলাম। আর রিপোর্ট তো করাই হয় নি!”

জয়নবের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো। এই মুহূর্তে একটি প্রুফ পেয়ে ছুটে গেলো হাসপাতালের প্রধান অর্থাৎ ডা. সাহির আজওয়াজের কেবিনে। নক না করেই ডুকে পড়লো সে। ডা. সাহির মাঝ রাতে একটি সার্জারি ছিলো। সেটি শেষ করে মাত্রই রোলিং চেয়ারে গা এলিয়েছেন। আজ কাল তিনি শরীরে আগের মতো জোর পান না। বোঝা যাচ্ছে বাহির থেকে না হলেও ভিতর থেকে বার্ধ্যকের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। তিনি চোখ বুঝলেন। ঠিক তখনি একটি পুচকে মেয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে গেলো কেবিনে। সচিকতে তাকালেন তিনি।

” হাসপাতালে দিনে-দুপুরে বেআইনী কাজ চলছে আর আপনরা তার কিছুই জানেন না বলে গা ঝাড়া দিচ্ছেন বার বার? তাহলে এসব কি?”

ডা. সাহির ক্ষিপ্ত পুচকে মেয়েটিকে দেখলেন। ভ্রু কুচকে আছে তিনি। পঞ্চাশ বছর বয়সে এমন নাছোড় বান্দা মেয়ে দ্বিতীয়টি দেখেছেন বলে মনে হয় না। শ্যামবর্ণের গোলকার মুখে ছোট নাকে পাটা রাগে ফুলছিলো জয়নবে। পরনের ডিলা ডিলা এক পোশাকেও শুঁকনো জয়নবকে সুন্দর লাগছে। চোখ দুটি রাগে বড় বড় করে রেখেছে। অথচ এত কিছুর পরেও মুখের মায়া বিন্দু পরিমাণ কমেনি। তিনি তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাকিয়ে রইলেন।এমন দৃষ্টিতে অন্য সময় হলে ভয় পেতো জয়নব। কিন্তু এখন? ডরভয়ের সময় নেই। লোকটিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রাগ আরো বাড়লো। হাতে রিপোর্ট এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এসবের মানেটা কি বলবেন?”

ডা. সাহির ধারালো দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন,

“তোমার ভিতরে বড়-ছোট মান্যগণ্য বলে কি কিছু আছে?”

জয়নব থমকালো। কিন্তু কেন জানি এই লোকটিকে বিন্দু পরিমাণ সম্মান দিতে ইচ্ছে করে না জয়নবের। সবসময় মনে হয়। এই অভিজ্ঞ চোখ জোড়ার পিছনে রয়েছে কোনো ভয়ানক সত্য। যতটা দয়ালু সবাই ভাবে ততটা মোটেও নয়। জয়নব ছোট শ্বাস ফেলে। মাথানত করে বিনয়ের সুরে বলে,

“আমি দুঃখীত স্যার। এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। আমি হাইপার হয়ে গেছিলাম। এসন হলে মাথা ঠিক থাকে না! সরি স্যার!”

ডা. সাহির হাসলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি। তিনি জানেন। মেয়েটি তাকে কোনো কারণ ছাড়াই পছন্দ করেন না। আর সরি বলছে? মনে হচ্ছে বড্ড উপকার করলো যেন ডা. সাহিরের উপর। মাঝে মাঝে তার মনেই হয় মেয়েটিকে কসিয়ে দু চার থাপ্পড় মেরে দিতে। কিন্তু তিনি চাইলে এটি পাড়বেন না। ডা. সাহির এক পলক নজর বোলালো রিপোর্টস গুলোতে। বাম হাতটি থুতনিতে রেখে প্রতিটি পাতা পরখ করে দেখলেন। কিছু মুহূর্তে পর জয়নবের মুখের উপর ছুঁড়ে মারলেন রিপোর্ট, ধমকের সুরে বললেন,,

“ইউজলেস প্রুফ। এখানে স্পষ্ট লিখা লোকটির কিডনি ডেমেজ হয়েগেছে। সেখানে তুমি কিভাবে বলছো এই গুলো ফেইক?”

“রোগীকে আমি দেখেছিলাম স্যার যাষ্ট মাথায় প্রব ছিলো। কিন্তু কে যেন তার দুটো কিডনি বের করে নিলো। ”

লোকটি আবার হাসলো। টেবিলে উপর আঙ্গুল নাচিয়ে বলে উঠলো,

“হোয়ার’স দ্যা ডেড বডি? নিয়ে এসো যাও। আমি নিজেই চেক করবো!”

জয়নব সম্মতি দিল। দ্রুত বেড়িয়ে এসে বিনা ঝড়ে বাতাসে বাজ পড়লো। করিডোর যেখানে মেয়েটি আর তার বরকে রেখে গেছিলো তারা কেউ নেই।আয়ান ও নেই। জয়নব স্তম্বিত হল। পকেট থেকে ফোন বের করে লাগাতার ফোন করলো আয়ানকে রিং বাঁজতেছে কিন্তু কেউ তুলতেছে না। এই ভোর রাতে জয়নব পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো। না লাশ পেলো, না সেই মেয়েটিকে না তার বাচ্চাকে। দারওয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানা গেলো কোনো লাশ বের হয়নি গেট দিয়ে। তাহলে? কই গেলো তারা? আয়ানি বা কোথায় গেলো? তার সব প্ল্যান এভাবে মাঠে মারা গেলো? ভাবতেই কান্না চলে আসচ্ছে জয়নবের।

জয়নব হতাশ হয়ে বসে পড়লো ৩০৩ নাম্বার রুমের সামনে। ঠিক তখনি কানের মাঝে ভেসে এলো কিছু টুকরো কথা।

“মাইয়াটা খাসা মাল। স্যার কইছে দুদিন ফুর্তি কইরা বেইচা দিতে পাড়ায়।”

জয়নব কান খাড়া করে এগিয়ে এলো। ৩০৩ নং রুমের পাশের গলিটা অন্ধকার। সেখানে আগাগোড়া সাদা কাপড়ে দুটি লোক দাঁড়িয়ে কথা বলছে। পাশের জনের কথায় গদগদ হয়ে দ্বিতীয় লোকটি বলল,

“আমারে ভাগ দিবি না? আমি কত সাহাইয্য করলাম।”

“আরে দেবো দেবো।”

“কিন্তু বাচ্চাটিরে কি করবি?”

লোকটি পান খাচ্ছিলো। পানের ডাটা থেকে চুন জিবে লাগিয়ে বলল,

“কি আর করবো? ভিক্ষায় বসাবো।”

জয়নবের গায়ে রোমশ সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলো।মেয়েটিকে তারাই গুম করে ফেলেছে বুঝতে বাকি নেই এদের। রাগে দুঃখে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লো। সামনেই পড়ে থাকা স্যালাইনের স্টিক দ্বারা আঘাত করলো প্রথম লোকটিকে। চেঁচিয়ে বলল,

“পশুর বাচ্চা। কোথায় রেখেছিস তাদের?”

অাচমকা আঘাত আসতেই দুজনেই সামলাতে পাড়লো না। জয়নবকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যেতে লাগলো তারা। কিন্তু জয়নব থামার পাত্র নয়। স্টিকটি ওদের শরীরে নিক্ষেপ করতেই দুম করে পড়লো নিচে৷ জয়নব রাগে রণচণ্ডী । এগিয়ে এসে পরপর বাড়ি বসালো লোকগুলো শরীরে। লোক একটি লাথি মারলো জয়নবের পেটে। জয়নব কুঁকড়ে উঠলো। তবুও নিজেকে সামলে হাতের নখ ধারা খামচে ধরলো। বড় বড় নখ খুবলে নিতে লাগলো খারাপ লোক দুটির চামড়া। জয়নব ফোঁস ফোঁস করতে লাগলো। গুছোনো কোঁকড়াচুলো গুলো খুলে পড়লো পিঠময়। লোক দুটি নেতিয়ে পড়ছে। একটি মেয়ে এভাবে তাদের মেরে যাচ্ছে ভেবেই গা শিউরে উঠছে। যেন কোনো অশরীরী ভর করেছে তার শরীরে। ঠিক তখনি সেখানে থাকা একটি লোক হাত জোড় করে ভিক্ষা চাইলো। লোকটি হিন্দু বার বার দূর্গা দূর্গা বলছিলো। জয়নবের দিক তাকিয়ে তার মনে হলো যে মা কালি ভর করেছে।পান খাওয়া লোকটি প্রায় বেহুশ। লোকটি তা দেখে কাঁদতে লাগলো, জয়নবের পায়ে পড়ে বলল,

“মা ক্ষমা করো মা ক্ষমা করো!”

এদিকে তেমন মানুষ জন না থাকায় কেউ তাদের ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেল না। জয়নব চোখ বড় বড় করে খ্যাঁক করে বলে উঠে,

“বাচ্চা আর মেয়েটিকে কথায় রাখছোস? বল! নয়তো আজ এখানেই শেষ করে দিবো তোদের কাহিনি। ”

লোকটি ভয় সিটিয়ে আছে। মার খাওযার মত শক্তি আর নেই শরীরে। এবার মুখ খুললো সে,

“বেসমেন্ট..”

পুরোটি বলার আগেই জয়নবের মাথায় আঘাত করলো কেউ। ভয়ংকর বাঘিনী মুহূর্তে লুটি পড়লো মাটিতে। দেখতে পেলো সেই কালো পোশাকধারী লোক এগিয়ে আসচ্ছে তার দিকে। তারপর…. তারপর… চোখের সামনে সব অন্ধকার……..

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-১২

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১২।
নিঃস্পৃহ, নিস্তব্ধ আরেকটি দিন কেঁটে গেলো অভিনবের জীবন থেকে। ক্যারিয়ারের পাঁচটি বছর কেঁটে গেলো অগোচরে। ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার প্রতি ঝোঁক ছিল । বাবা ডাক্তার, মা ডাক্তার। ডাক্তারী পরিবেশেই বেড়ে উঠা। এক সময় শখ তার পর প্রফেশন। অনেকটা রবোটিক্সদের মতো, টাইম মাফিক চলছিলো সব। টাকা, পয়সা, পাওয়ার থাকা শর্তেও কি জানি ছিলো না তার জীবনে। বড্ড রুক্ষ সুক্ষ্ম জীবন। মনে হচ্ছিলো সে এক জন্তু যার হাত পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছে ভাড়ী বন্ধনে। গন্ডিতে টেনে দিয়া হয়েছে অদৃশ্য রেখা৷ রেখা পার কার শক্তিটুকু যেন কেউ কেড়ে নিয়েছে। ঠিক এই বাধ্যবাধকতার জীবনে ভাঁটা ফালিয়ে উদ্দীপ্ত হলো রুফাইদা নাওরিন। লাগামহীন জীবন, হাসোজ্জল মুখ, সরু নাক, পিঠে ঢেউ খেলানো কালো চুল। শুভ্র রং আর ঘন ভ্রু যুগলের নিচে কালো কুচকুচে চোখ জোড়া। কত মায়া, কত গম্ভীর সেই চোখ জোড়ায়। হাসলে মনে হতো তার চোখ জোড়াও হাসচ্ছে। মেয়েটি সব সময় তার থেকে পালিয়ে বেড়াতো। অভিনব এক পলক তার দিকে তাকাতেই সে যেন মুর্ছা যেত। লজ্জাবতী গাছে যেমন স্পর্শ করলেই লজ্জায় গুটিয়ে নেয়? ঠিক তেমনি ছিলো তার রুফাইদা। ডা. অভিনবের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। ঝংকার ময় কন্ঠ আজ গম্ভীর, আহত, ব্যাথাতুর, কন্ঠনালি বাক্যহীন।

ডা. অভিনব দাঁড়িয়ে আছে তার সুবিশাল প্রকন্ড বাড়ির, দোতালার গোল বারান্দায়৷ দক্ষিণা মুখ রুমটি। নিস্তব্ধ ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে দাড়িয়ে আছে বারান্দার কার্নিষ ঠেষ দিয়ে। পড়নে তার কালো টাউজার আর গায়ে ছাই রঙ্গা গেঞ্জি। উষ্কখুষ্ক চুল। হাতে তার একটি রুপোলী কারুকার্য সম্পন্ন ছবি ফ্রেম। রুমের মাঝে থেকে ভেসে আসা কম আলোয় ঝিলিক দিচ্ছে একটি তরুণীর খিল খিল কিশোরী হাসি। ডা. অভিনব আজওয়াদ এই ছবিটি ক্যাপচার করেছিলেন রুফাইদার অগোচরে। সব সময় গম্ভীর আর রোবট মানুষটিকে প্রাণ দিয়ে গেছিলো এই হাসিটি। চোরা চোখে পর্যবেক্ষন করে যেতে এই রমনীকে। বুঝতেই পারেনি কবে, কখন, কিভাবে এই রমণীর ভালোবাসায় হাবুডুবু খেতে শুরু করে দিয়েছিলেন। সেবার রুফাইদা সাতদিনের গায়েব হওয়াতে পাগল পাগল হয়ে গেছো অভিনব। অথচ আজ একটি বছর এ মেয়েটি নেই। কিভাবে দিন পারি দিচ্ছে অভিনব? তা শুধু সেই জানে?দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে মাস গড়িয়ে বছর পাড় হলো দুয়েক। আজকেই তো নাকি মেয়েটি প্রথম এ পৃথিবীতে প্রথম চোখ খুলে ছিলো? সেতো চাইতো? রুফাইদার প্রতিটি জম্মদিনে তার মুখে দেখেই হবে। সবার আগে জানাবে সে। কিন্তু হায়? চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? শুনেছে মরার পরে যাকে বেশি ভালোবাসে পৃথিবীতে সেই রূপ নিয়েই নাকি সাথী হয় কেউ? সত্যি এমন হলে, অভিনব দোয়া করে প্রতিটি নামাজের পর, রুফাইদাই যেন তার সঙ্গী হয়।

এক দমকা হামকা হাওয়ায় বারান্দায় থাকা উইনজারটি নাড়িয়ে দিলো টং টং করে বেঁজে সেটি। দোল খেলে গেলো তার ঝাঁকড়া চুল গুলো। নিস্তব্ধ ঘরটিতে তখন ঢং ঢং শব্দ রাজ্য করতে লাগলো ঘড়ির কাঁটা। ডা. অভিনবের সেদিকে কোনো খেয়াল, ধ্যান নেই। রুফাইদা তার থেকে সব সময় পালিয়ে বেড়াতো, আড়াল করতো নিজেকে। সত্যি সত্যি সে আড়াল করে ফেললো একে বারে। অশ্রুশিক্ত, নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে, ছবির ফ্রেমটিতে চুমু খায়। ছবিটিতে অতি আদরে ছুঁয়ে যায় তার হাত। অস্পষ্ট, ধরে আসা গলায় বলে উঠে,

“হেপি বার্থ ডে রূপ! মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দা ডে? সুখে থাকো তুমি। যেখানেই থাকো। মনে রেখো। আই লাভ ইউ। আই মিস ইউ!”

দু ফোঁটা গরম নোনা জল গড়িয়ে পড়ে ছবির ফ্রেমটিতে থাকা রুফাইদার হাস্যোজ্জ্বল মুখে।

——————

“হেপি বার্থ ডে বড়পু!”

সিক্ত চোখ আর ভাঙ্গা হৃদয় নিয়ে তাকিয়ে আছে জয়নব, তাদের বাসার বসার ঘড়টিতে খুব বড় করে টানানো রুফাইদা আর তার বাবা-মার ছবিটির দিকে। কত প্রাণবন্ত এই ছবিটি। ঘরময় যেন গুঞ্জন হচ্ছে খিল খিল করে রুফাইদার হাসি। এই ঘরের প্রতিটি ছবিতে তিন জন ব্যক্তি উপস্থিত। কোনো ছবিতে জয়নব নেই। কেনো নেই? এ প্রশ্নটি সে জানে। আগে না জানলে আজ জানা হয়েছে। আজ রুফাইদা জম্মদিন। নাজমা আজ নিজ থেকে ফোন করে ডেকে এনেছেন জয়নবকে। রুফাইদা মরে যাওয়ার পর তিনি কথা বলতেই যেন ভুলে গেছিলেন। ভুলেগেছিলেন স্বামীর কথাও। সাইফ মরে যাওয়ার পর যেন একে বারে নেতিয়ে গেছেন নাজমা। কিন্তু আজ এত বছর পর মায়ের কন্ঠ শুনে হল ছেড়ে এক প্রকার ছুটেই চলে আসে বাসায়। কিন্তু এখানেই যে তার পুরো দুনিয়া উল্টে যাবে জানা ছিলো না জয়নবের। নাজমার ছোট বাই ওয়াহিদ এসেছেন বিদেশ থেকে। নাজমাকে তার সাথে নিয়ে যাবে। নাজমা নিজেও সায় দিয়েছে। যেখানে মেয়ে আর স্বামী নেই? সেখানে একা পড়ে থেকে কি লাভ? জয়নব এসব শুনে থমকালো কিছুক্ষণ। মাথার নার্ভে নাড়া দিয়ে গেলো একটি প্রশ্ন,” আমি কে তাহলে? মা কি আমাকে ভুলে গেছে? ”

কথাটি কোনো মতেই হজম হলো না জয়নবের এক আকাশকুসুম বিস্ময় আর সঙ্কা নিয়ে জিগ্যেস করলো,

“মা আমি কি তোমার কেউ না? আমাকে একা করে কেন চলে যেতে চাইছো?”

“নাহ্ তুমি আমার সন্তান না। ”

আকাশের বুক ফেঁটে আচমকা এক বাজ যেন পড়ে গেরো জয়নবের মাথায়। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো। হাসার চেষ্টা করে বলল,

” মা.. মা তুমি আমার সাথে দুষ্টামি করছো তাই না? আমার ভালো মা প্লিজ এ…এমন দুষ্টামি করোনা। কেন মিছে মিছি এসব বলছো?”

নাজমার চোয়াল শক্ত। স্থীর তার দৃষ্টি। শ্যামকায় এই মেয়েটির উপর তাকালেই রাজ্যের ক্রোধ ভর করে তার মাঝে। ছোট বেলায় যখন সাইফ মেয়েটি এনে তার কোলে দিয়েছিলো? নাজমা তখন বড্ড অবাক। ভেবে ছিলো কুঁড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। কিন্তু পরক্ষণেই সাইফের কথা পুরো দুনিয়া উল্টে পাল্টে গেছে। ভেঙে গেছিলো তার মন, বিশ্বাস, সংসার। তবুও সামলে নিয়েছিলো নিজেকে সে। নাজায়েজ বাচ্চাটিকে যতবার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে দেখলে পিত্তি জ্বলে যেতে। কিন্তু কিছুই বলতেন না তিনি। কিন্তু আজ? আজ বলতে বাধ্য। এই মেয়েটির মা তার এককালের বান্ধবী ছিলেন ঘনিষ্ঠ। সাইফকে সেও নাকি চাইতো। কিন্তু সাইফ তার হৃদয় দিয়ে চেয়েছে নাজমাকে। কিন্তু জয়নবের মা ছলচাতুরী করে একরাতে সাইফকে ড্রাগ দিয়ে দেয়। এবং নিজের কার্য হাসিল করে ফেলে। যার ফল এই জয়নব। কিন্তু কখনো নাজমা বুঝতে দেয়নি এক মাত্র সাইফের জন্য। সে সব সময় এক কথাই জপে গেছে,

“দোষ না হয় ওর মা করেছে। কিন্তু ও তো আমারো সন্তান। সে যেভাবেই হোক!”

এই কথার পর মুখের রং পাল্টে যেত। রাগে গজগজ করতে করতে বিনা কারণে দু ঘা বসিয়েও দিতেন জয়নবের পিঠে। ছোট জয়নব ব্যথায় গোঙানির শব্দ নাজমা যেন পৈশাচিক সুখ পেতেন। এভাবেই দিন যেতে লাগলো। এক ঘঠনায় ধপ করে মনের আগুন নিভে গেছিলো নাজমার। রুফাইদাকে আগুনে পুড়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে মেয়েটি তার মনের কোনে এক শীতল স্পর্শ করেছিলো ঠিকি কিন্তু আজ সব পাল্টে গেলো এক উইলে। সাইফ তার সকল সহায় সম্পত্তি জয়নবের নাম করে দিয়েছে। ওয়াহিদ এটা জানার পর আরো কান পড়া দিয়েছে। সব শুনে নাজমা অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছে। তার সকল সহায় সম্পত্তি রুফাইদার নামে ছিলো, রুফাইদা নেই বলেই জয়নবের নাম হয় গেছে এটা তিনি হজম করতে পারছেন না। তার মন চাইছে সব বেঁচে অনাথালয় নয়ত মসজিদ মাদ্রাসায় বিলিয়ে নিঃস্ব করে দিতে মেয়েটিকে। কিন্তু তার হাতে কিছু নেই। সে না চাইতে মেয়েটিকে সহ্য করতে পাড়ছে না। মেয়েটি কেঁদে যাচ্ছে। লাল নাক মুখ। কিন্তু কি সুশ্রী মুখ মেয়েটির ঠিক তার মায়ের মতো যেন। নাজমার রাগ নিভু নিভু হয়েছিলো খানিকটা। জয়নবের মার কথা মনে আসতেই ধাক্কা মেরে জয়নবকে সরিয়ে দেয় তার থেকে। আর কোনো ভনিতা ছাড়াই বলে উঠে,

“না আমি তোমার মা আর না তুমি আমার মেয়ে। আমার মেয়ে একজন ছিলো যে মরে গেছে। আর তার সহায়সম্পদে ঘাপটি মেরে বসে আছো তুমি! আমি এসব কিছুই চাইনি। বাঁচতে চেয়েচিলাম আমার মেয়ে, স্বামী নিয়ে, যখন তারাই নেই তো এখানে আর থেকে কাজ নেই।”

নাজমা উঠে পড়লো। জয়নব হাউ মাউ করে কাঁদছে। এত এত সত্যের ভিতরে মরে যেতে চাইছে সে। বাঁচতে চায় না কোনো রকম। সে নাজমার পা জড়িয়ে ধরলো। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” ও মা। ওমা যেয়ো না। আমি মরে যাবো আমাকে একা রেখে যেয়ো মা প্লিজ যেয়ো না।”

নাজমা শুনলেন না। যেন কানের মাঝে তুলো গুঁজে আছেন। পা ছাড়িয়ে যখন পাচিল ছাঁড়াবে তখনি জয়নব চেচিয়ে উঠলো বললো,

“বড়পু বেঁচে আছে মা। আমার জন্য না হয়। বড়পুর জন্য থেকে যাও মা!”

নাজমা থমকালো। পা থেমে গেলো। কিছু মুহূর্ত সময় নিলো বোঝার বুঝতে পেড়েই চকিতে তাকালেন তিনি। উপলব্ধি করলেন তার গা কাঁপছে। তীব্র ব্যাথা অনুভব করছেন বুকে৷ হাহাকার জীবনে এক ফুঁটো সুখে ছোয়া খেলে গেলো নাজমার চোখে মুখে। নাজমা দৌঁড়ে এগিয়ে এলো। জয়নবের সামনে বসে পড়লো। টলমলে চোখে বলল,

“আমার মেয়ে কই জয়নব? কই আমার মেয়ে? নিয়ে আয় ওকে৷ নিয়ে আয়?”

জয়নব বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মায়ের মুখে চাইলো। আহ্ কত ব্যাকুলতা তার মায়ের নিজ সন্তানের জন্য। আর তার জন্য? এই মায়ের বুকে নেই ভালবাসা, নেই মায়া, নেই স্নেহ। আছে শুধু অঢেল ঘৃণা। জয়নব বেড়িয়া আসে দীর্ঘশ্বাস সপ্তপর্ণ গিলো নিলো। মায়ের চোখ জোরা মুছে দিয়ে আবেগী গলায় বলল,

“মা তোমার রূপ তোমার কোলে জলদি ফিরে আসবে। আর তার সহায়সম্পদ সব তারই থাকবে। চিন্তা করো না মা। আমি তোমার সন্তানকে তোমার বুকে ফিরিয়ে দিবো। খুব জলদি!”

নাজমা কাঁদতেই লাগলেন। তার মেয়ে বেঁচে আছে এটিই যে বড় শান্তি।

——————

নাজমা ঘুমিয়ে আছেন। ওয়াহিদ অনেক কটু কথা বলে চলে গেছেন। বলে গেছেন সে আবার ফিরবে নিয়ে যাবে তার বোনকে। কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই জয়নবের। সে বসে আছে রুফাইদার রুমটিতে। হাতে তার একটি চিঠি। ঠিকানা হী। রুফাইদাকে আটকে রাখা হয়েছে। কে বা কারা করেছে কিছুই লিখেনি রুফাইদা।রুফাইদা গোটা গোটা অক্ষরের লিখা তার চেনা। হাতে চিঠিটি সে আবার খুললো। সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো যেন রুফাইদার শরীরের। জয়নব চিঠিতে নাম লাগিয়ে ঘ্রান নিলো৷ কান্নায় জড়জড়িত হয়ে আবারও পড়লো চিঠিটি,

প্রিয় বাবা,

তুমি হয়তো জানো আমি মারা গেছি। নেই অস্তিত্ব এই দুনিয়ায় আমার। কিন্তু বাবা আমি বেঁচে আছি মরার মতোই। নিত্যদিন মরছি। জানো বাবা? এখানে সবাই মরে প্রতিদিন রাতে। আমিও মরি। আমার গায়ের প্রতিটি আঘাত মরণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। আমি প্রতিদিন ভিক্ষা করি মরণের কিন্তু হয় না। আমাকে বাঁচাও বাবা। রক্ষে করো আমাকে। আমি আবারো তোমার কোলে মাথা রাখতে চাই বাবা। মায়ের হাতে রান্না কত দিন খাই না। যানো বাবা এখানে দু, তিন চলে যায় তারে খেতেও দেয় না।বাবা তোমাকে খুব মনে পড়ে। মাকেও মনে পড়ে। মনে পড়ে সেই ভয়ানক রাতের কথা। বিশ্বাস করো বাবা আমি জানতাম না তারা আমার সাথে ডাবল ক্রস করবে। ভাবিনি বাবা তারা আমাকে এমন এক পৃথিবীর সদস্য করে দিবে যেখানে আলো বাতাসের দেখাও মিলে না। বাবা আমাকে মুক্ত করো। আমি বাঁচতে চাইম মুক্তি চাই এই নরক যন্ত্রনা থেকে। মুক্তি চাই মানুষ খেকো মানুষদের থেকে। মুক্তি চাই!

ইতি,

তোমার রূপ

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-১১

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১১।
সেদিন আমি কেঁদে কুঁটে বাসায় চলে যাই। সাত দিন পর আবার ফিরে আসি মনের সাথে লড়াই করতে করতে। ঠিক সেই দিনেই ঘটলো অদ্ভুত ঘটনা…।আমি ক্লাসে যাচ্ছিলাম। দুতলার শেষের দিকটায় আমাদের ক্লাস। ডান পাশ পুড়োটাই খালি রুম গুলো পড়ে আছে। আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম। বর্ষাকালের স্ব স্ব হীম শীতল বাতাস বইছে। মিষ্টি বাতাস। ওরনা, জমা সব কিছুই এলো মেলো করে দিচ্ছিলো আমার। আমি ওরনা ঠিক করতে করতেই চোখে পড়ে গেল এক পরিচিত মুখ। উষ্কখুষ্ক চুল। কত দিনের অবহেলায় ভরাট দাড়ি-গোঁফ শক্ত চোয়াল জুড়ে। চোখের নিচে রাতের পর রাতে জেগে থাকার ক্লান্তির দাগ। ডা. অভিনবকে খানিকটা রোগা মনে হচ্ছিলো আমার কাছে। ললাটে চিন্তার ভাঁজ ফুঁটিয়ে খুঁজে যাচ্ছেন কিছু! তাকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো। আমি চাইনা তার সামনে পড়তে৷ দু হাত সমান পিলেরের পিছনে লুকিয়ে পড়লাম। বুকে ভিতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দকরে হৃদপিণ্ড বেড়িয়ে আসতে চাইলো। আমার মনে হলো, স্টুডেন্টদের গুঞ্জন থেকে আমার বুকে বা পাশের শব্দটাই বেশি হচ্ছে?

আমি শুকনো ঢুক গিললাম। এতক্ষণে চলে গেছেন হয়তো উনি! ভেবেই পা বাড়ালাম ক্লাসের দিক। ঠিক তখনি থমকে গেলো আমার পা, এক পুরুষলী শক্ত হাত আমার হাত চেপে ধরলো। ভয়, বিস্ময়, হতবাক হয়ে গেলাম আমি। কিছু বুঝার আগেই লোকটি টেনে নিয়ে গেল বদ্ধ একটি রুমে। ঠেসে ধরলো ধুলোমাখা দেয়ালে। অনেক দিন বন্ধ থাকায় শ্যাত শ্যাত ভাব রুমটিতে। এক পাশে ঠেলে রেখেছে বেঞ্চ। বেঞ্চ গুলো উপর ধুলোবালির স্তুপ। ভ্যাপসা এক গন্ধ ঠেলে ছড়িয়ে পড়লো সুগন্ধী। পরিচিত মানুষের শরীরের ঘ্রান ঘরময় ঘুরো ফিরা করতে লাগলো। আমি ভয়ে কাঠ। গলা শুকিয়ে গেছে। সাত দরিয়ার পানি খেলেও যেন তৃষ্ণা মিটবে না আমার। আমি পিট পিট করে তাকিয়ে দেখলাম ডা. অভিনব নিষ্প্রভ চাহনি মেলে এগিয়ে এসে মুখো মুখি দাঁড়ালো আমার। মনে হলো সেই মুহূর্তে আমার মাথা ফাঁকা, বুকে তীব্র চিন চিন ব্যথা, শিরশিরানি। উফ অসহ্য অনুভূতি।

ডা. অভিনব আমার মুখোমুখি দাঁড়ালো। পার্থক্য ইঞ্চি সমান। দুহাত দু দিকে দিয়ে আটকে ফেললো । লম্বা দেহখানি নিয়ে ঝুঁকলো। প্রতিটি নিশ্বাস আছড়ে পড়লো মুখ-মন্ডলে আমার। সময় যেন সেখানেই থেমে গেলো আমার। শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে আছি। কাঁপাচ্ছে আমার শরীর, হাত-পা, ঠোঁট। ডা. অভিনব আমার ঠোঁটের দিকে তার দৃষ্টি নিবন্ধ করলো। শীতল বরফ অথচ ধারলো কন্ঠে বলল,

“হোয়াই ডো ইউ ওয়ান্ট টু কিল মি?”

আমি চমকে তাকালাম। আগের থেকে শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বেগে দৌড়াতে লাগলো। কানের মাঝে চরকির মতো ঘুরতে লাগলো কথাটি। পরক্ষণেই উপলব্ধি করলাম আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসচ্ছে। তাকে আমি কেন মারতে চাইবো? কি বলছেন উনি?এই মুহূর্তে উনিই হয়তো মারতে চাইছেন আমাকে? আমি ভয়ে তোতলানো কন্ঠে বলে উঠলাম,

“কি ব-ল-ছে-ন?”

উনার ঠোঁটে এবার হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। থমথম মুখে মেদুর ছায়া দূরে ঠেলে সূর্যের মতো এক ফালি আলো দেখা গেলো। উনি আরো ঘেঁসে দাঁড়ালেন আমার সাথে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। কি হচ্ছে বুঝে উঠতে পারছি না এ মুহূর্তে।

ডা. অভিনব এবার আমার নত মুখ ডান হাতের দুই আঙুল থুতনি রেখে মুখটি উঁচু করলেন। না চাইতে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা জল। ডা. অভিনব শীতল দৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে, বলল,

“এবার পালালে! আই উইল কিল ইউ!”

আমি আরেকদফক চমকালাম। অসাড় হয়ে আসা শরীরটা সামলে ঠেলে সরিয়ে দিলাম ডা. অভিনবকে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস বের হবো তখনি শোনা গেলো আবার তার কন্ঠ। আমার পা সাথে সাথে থমকে গেলো।থমকে গেলো সময়, থমকে গেলো বাতাস। থমকে হেলো নিশ্বাস। অবাকতার শেষ চুড়ান্তে আমি। বন্ধঘর ময় বাড়ি খেয়ে যাচ্ছে এখনো সেই কথাটি,

“আই লাভ ইউ রূপ। আই লাভ ইউ। ”

~জয়নব পেইজ উল্টালো। এর পরের বেশ কিছু পেইজ পোড়া। জয়নব হতাশ হয়। কি উত্তর দিয়েছিলো তার বোন? জানা নেই। তবে লিখা গুলো পড়তে পড়তে সে হারিয়ে গেছিলো। নিজরকে রুফাইদার জায়গায় আর ডা. আদরকে ডা. অভিনবের জায়গায় অজান্তেই কল্পনা করে বসলো। লজ্জায় টুকটুকে লাল গাল গুলো আরোও লাল হয়ে গেলো। নিজের ভাবনাকে ঠেলে দিলো দূরে৷ কয়েকটি পেইজ উল্টাতেই চোখে পড়লো কিছু অদ্ভুত লিখা~

আমাদের মেডিকেল কলেজে ইললিগ্যাল কাজ চলছে। কে বা কারা করছে? এখনো জানা যায়নি। তবে আজ বিষয়টি আমার চোখে পড়েছে। আজ সকালে একজন রোগী আসে। লোকটি স্পট ডেড। মর্গে রাখা হয়েছিলো তাকে। আমি সেদিক দিয়ে আসার সময় দেখলা দুটো ওয়ার্ড বয় চুপি সারে লাশটি নিয়ে ঢুকছে পুরোতন ওটিতে। আমি কিছু বলতেই চাইছিলাম তখনি কেউ পিছন থেকে মুখ চেঁপে সাইডে নিয়ে আসে। আমি চমকে তাকাতেই দেখতে পাই পরিচত এক দেবীমূর্তি। যার চোখ গুলো ডাগর ডাগর প্রতিমার মতো। ঢেউ খেলানো চুল পিঠময় ছেড়ে রেখেছে। পড়নের সুতির জলপাই কুর্তি লতানো দেহে চেপে আছে। অামি অবাক চোখে তাকে দেখছিলাম, মুহূর্তেই রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে ভ্রু কুচকে বলে উঠলাম,

“পূজা তুই!”

পূজার চোখে ভয়, অস্থিরতা। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা দেখে চাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো,

“মরার শখ না থাকলে ওখানে যাইস না। ”

আমি হতবুদ্ধি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে বললাম,

“কি বলতে চাইছিস?”

পূজা স্বগতোক্তির মতো বলল,

“এখানে অনেক ইললিগাল কাজ চলছে। আমি আরো নোটিশ করেছি। ইনফ্যাক্ট ৩০৩ নাম্বার রুমটিই হচ্ছে সব নষ্টের মুল। কে বা কারা করছে? ধরতে পারছে না কেউ!”

আমি কিছুই বুঝলাম না। পূজা আমার বন্ধু। দেখকে প্রায় একই রকম আমরা। মাঝে মাঝে হোস্টেলের খালা মামারা আমাদের বোন ভেবেই ভুল করে বসে। আমি অবিশ্বাস্য গলায় বললাম,

“কি যা তা বলছিস?”

“যাতা নয়। এখানে ইললিগাল কাজ চলে, মৃত রোগীদের চোখ, হৃদপিণ্ড, কিডনি এমনকি শরীরের ইম্পর্টেন্ট পাটর্স কেউ বেআইনী ভাবে সেল করে যাচ্ছে।”

“তুই এত কিছু কিভাবে জানলি?”

“তুই ছিলিনা। দুদিন আগে পুলিশের একটি দল আসে হসপিটালে। এক রোগীর পরিবার কমপ্লেন করেছিল। রোগীর সার্টিফিকেটে ছিল নর্মাল ডেড। কিন্তু লোকটির শরীরে কাঁটা ছেঁড়া করা হয়েছে। যেখানে তার অপারেশন হইনি। তারা অন্য হাস্পাতালের ডাক্তারদের দিয়ে পরীক্ষা করেই জানতে পারে লোকটি শরীরে ইম্পরট্যান্ট পার্টস গুলো গায়েব।”

শিউরে উঠলাম আমি। থরথর করে কাঁপতে লাগলাম। কম্পিত কন্ঠে বললাম,

“এসব কিভাবে সম্ভব? ”

পূঁজা আসলো। পান মাতার মতো মুখ খানায় বিদ্রপের হাসি,

“টাকার জন্য আজ কাল সন্তানকে বেঁচে দিচ্ছে, আর এটা তো সামান্য ব্যাপার!”

স্পষ্ট দেখতে পেলাম পূজার চোখে, মুখে মেদুর ছায়া। সে আবার বলল,

“তুই এসব ঝামলেয় পরিস না এখান থেকে যা।”

“আমি কেন ঝামেলায় পড়ব? আর এসব হচ্ছে প্রন্সিপাল স্যার জানেন? বোর্ড এসবে কোনো পদক্ষেপ কেন নিচ্ছেন না?”

পূজা বলল,

” ইনভেস্টিগেশন চলছে। কারা করছে ধরতেই পারছে না। এই যে ৩০৩ নং রুম হাজার তল্লাশি করেও কিছুই পাওয়া যায় নি। কীংবা তুই এখন গেলেও কিছুই খুঁজে পাবি না। সব হাওয়া!”

আমরা মাথায় কিছুই ঢুকছিলো না। ৩০৩ নং রুমটি পুরোনো ওটি ছিলো। কোনো কারণবশত সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ইনফেক্ট কারো যাওয়া আসা নিষেধ। তাহলে কিভাবে কেউ হসপিটাল ভর্তি মানুষের অগোচরে ভয়ানক তান্ডব লিলা খেলা?এর জন্য পিছনে অবশ্যই বড় কোনো মহানায়ক আছে?

সেদিন আরো জানতে পারলাম পুলিশ পক্ষ আমাদের কলেজে সকলের অগোচরে গোয়ান্দাগিরির জন্য বেঁছে নিয়েছে কিছু লোাক। এবং তার মাঝে আমাদের গ্রুপের মাঝে আছে আয়ান, আঞ্জুমান, পূঁজা। আমি নিজেও তার সাথে যোগ দিলাম। এই ভয়ংকর কর্মকান্ড দূর করার জন্য। সেদিনের পর আরো কিছুদিন কেঁটে যায়। হাসপাতালে সব কিছু রোজকার মতোই চলছে। এর মাঝেই পূজা খবর আসে তার মাসিমা আর নেই। তাকে দ্রুত যেতে হবে তার শহরে। বাবা-মা মরে যাওয়ার পর এই মাসিটিই সব ছিলো তার। মাসি নেই শুনেই ভেঙে পড়ে সে। কলেজের ফর্মালিটি শেষ করে রওনা করে। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো তখন যখন পূজার যাওয়ার ১৫ দিন পার হয়ে গেছিলো তার কোনো খোঁজ ছিলো না। উপর থেকে ফেন বন্ধ আসচ্ছিলো। আমাদের সবার মাঝেই ছিলো চিন্তার ছাপ। ১৫ দিয়ে ২০ দিনের মাথায় একটি ফোন কলে শিউরে উঠে আমরা। পূজার মাসিমা ফোন করে আয়ানের কাছে।তখন আমরা মাঠের উপর বসে। একজন মৃত ব্যক্তি কিভাবে ফোন দিয়েছে? ভাবতেই সকলে ভয় পেয়ে গেলাম। পরবর্তীতে জানতে পারলাম পূজার মাসি মরে নি। আর পূজাকেও কেউ গুম করে দিয়ে ছিলো। এই খবর শোনার পর আতঙ্কে সাদা হয়ে গেলো সবার মুখ। পিছিয়ে গেলো মিশন থেকে আয়ান, আঞ্জুমান। রয়ে গেলাম আমি। ঠিক করে ফেললাম আমিই করবো সব।

জয়নব অস্তির হয়ে পড়লো। এর পরের পেইজ গুলো খালি। আর যা লিখা বেশির ভাগ পুড়ে ছাই।
জয়নব কি করবে এখন? তার মাথা ফাঁকা লাগছে। তবে এই হসপিটালের রহস্য কিছুটা সামনে এসেছে। ইলিগ্যাল কাজের জন্যই এত এত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে? জয়নব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে ঠিক করলো ৩০৩ নং রুমটিতে সে একবার টু মেরেই আসবে। কি আছে সেই রুমটিতে? কেনোই বা সেখানে ঢুকলেই সব হাওয়া হয়ে যাচ্ছে?

চলবে,

আশা করছি কিছুটা ক্লিয়ার হয়েছেন? 🙆‍♀️🙆‍♀️

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-১০

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
১০।
সন্ধ্যা ৭ টা বেজে কুঁড়ি মিনিট। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ, আরো না রঙ্গে রাঙ্গানো হয়েছে কলেজ। কলেজের ভিতরেই অডিটোরিয়াম রুমে বিশাল আয়েজন করা হয়েছে। সারি সারি স্টুডেন্ট বসে আছে তাদের আসনে। সবারই গায়ে লাল-সাদা শাড়ি আর ছেলেদের গায়ে লাল-,সাদা পাঞ্জাবি। একের পর এক পারফরম্যান্স হচ্ছে।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে ডা. আদর আর ডা. অভিনবকে। দুই রাজপুত্র সবার সামনে বসে আছেন। কি সুনরদর লাগচ্ছে তাদের। মনে হচ্ছে আধারের মাঝে, ঝিলিক মারা দুটি তারা পদর্পন করেছে অনুষ্ঠানে। তারা যদি পা না ফেলতো অনুষ্ঠান যেন ফিকে লাগতো। বোনের ডায়রি পরে ডা. অভিনবকে আরো বেশি পর্যবেক্ষন করছে ইদানীং জয়নব। এরই মাঝে উপস্থিত হয়েছে শহরের মেয়র জীবন তালুকদার। পরনে ফর্মাল ড্রেসস কোড। বয়সে ৪০/৪৫ এর কাছাকাছি। জীবন তালুকদারের বক্তৃতা শেষেই উপস্থিত হলেন কলেজের প্রিন্সিপাল সাহির আজওয়াদ। তিনি কিছু ঘন্টা আগেই আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। জীবন তালুকদার সাহির আজওয়াদকে দেখেই এগিয়ে এসে কুশলাদি বিনয় পর্ব শেষ করে বসে পড়লেন তাদের নির্দিষ্ট আসনে। জয়নবের কাছে সাহির আজওয়াদকে বড্ড চেনা মনে হচ্ছে। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। অভিনব স্যারের মুখখানার মতোই মুখের গঠন। কিন্তু চোখ জোড়া ডা. আদরের মতো। কিন্তু লোকটিকে কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে পরছে না জয়নবের।

“ওই বুইড়া বেটাগো দিকে চাইয়া কি দেখোস?”

কুয়াশার কথা জয়নবের ভাবনা ছেদ পড়ে, সে অবাক হয়ে বলে,,

“উল্টা পাল্টা বকস কেন? আমি তো ওই লোকটারে দেখতাছি। চেনা চেনা লাগতাছে বইলা!”

কুয়াশা জহুরির মত দেখলো একবার জয়নবকে। পরমুহূর্তেই হাতে তালি বাজাবার মতো করে বলল,

“বাহ্ বইন বাহ্ তুই আমার থেকে ২০০ কদম এগিয়ে গেলি!”

জয়নব ভ্রু কুচকে বলল,

“কি কইতাছোস! ”

কুয়াশা মুখ ভঙ্গি গম্ভীর করে ফেললো। জয়নবের দিক ঝুঁকতেই জয়নবও হালকা পিছনের দিক হেলে পড়লো। কুয়াশা ফিসফিস করে বলল,

“পোলারে পছন্দ হয় না তোমার, খাইশটা ডাকো। এখন বাপের উপর নজর দাড়ি করো। মাইনশে কি কইবো দোস্ত?”

কথাটি প্রথমে ধরতে পাড়লো না জয়নব। পরে বুঝতে পেরে কুয়াশার মাথা গাট্টা মেরে বলল,

“গাধী! আমি কইছি ওই ব্যাটরে পছন্দ করি? এত দুই লাইন বুঝোস কেন?”

“আমি ভাবছি..”

কথার মাঝেই কথা থামিয়ে দিলো জয়নব। দু হাত তুলে মাফ চাওয়ার মতো ভঙ্গিমা করে বলল,

“মাফ কর আম্মা। তুই আর ভাবিস না কিছু!”

কুয়াশার মুখ চুপসে যাওয়া আমের মতো হয়ে গেল।
অনুষ্ঠান বক্তৃতার পর্ব শেষ করে আবার শুরু হলো। কুয়াশা নিজেও ভালো ডান্স পারে। সেও একক ভাবে নাচবে। তার পালা আসতেই এক ছুট। জয়নব হেসে দিলো।

জয়নব হঠাৎ করেই প্রকৃতিক ডাকে ওয়াশরুম যাওয়ার প্রয়োজন পড়তেই বেড়িয়ে পড়লো। ওয়াশরুম এসে তার কাজ সেরে, শাড়ি ঠিক করতে লাগলো। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে এলো কারো আত্মচিৎকার। জয়নব হন্তদন্ত হয়ে বের হতেই দেখতে পায় আয়ান ভাইয়াকে সেই কালো কাপড় পরিহিত লোকটি ছুঁড়ি মারার চেষ্টা করছে। জয়নব দৌড়ে তাদের মাঝে এসে পড়লো। চিৎকার করে বলল,

“এই কি করছো? মারতে চাইছো কেন?”

আয়ান ভাইয়া ভয়ে আদমরা। কেঁদেই দিয়েছে। লোকটির সাথে পেরে উঠতে পারছে না। জয়নব নিজেই লোকটিকে ধাক্কা দিতে চাইলো। উল্টো কালো পোশাক পরিহিত লোকটি ওকেই ধাক্কা মেরে দিলো। জয়নব শরীরের ব্যালেন্স সামলাতে না পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নিচে। তবুও সে থেমে নেই। আবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে লোকের মুখের কাপড় খুলে নিতে চাইলো সে। ঠিক তখনি জয়নবের হাত পোঁচ মেরে লোকটি পালিয়ে যায়। জয়নবের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসে আর্তনাদ।

————-

“আমার জান বাঁচানোর জন্য থ্যাঙ্ক ইউ ছোট আপু!”

আয়ান জয়নবের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল কথাটুকু। জয়নব তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল,

“আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম ভাইয়া আপনি পাত্তা দেন নি আমার কথার!”

আয়ান গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,

“আমাকে কেন কেউ মারতে চাইবে বুঝতে পারছি না!”

“রুফাইদা আপু ও জানতো না তাকে মরতে হবে!”

এক প্রকার চমকে তাকালো আয়ান। রুফাইদা নামটি তার বুকে গিয়ে লাগলো। তোতলানো গলায় বলল,

“রু ফাই দা!”

“হ্যাঁ রুফাইদা, যাকে খুন করা হয়েছিলো নির্মম ভাবে!”

আয়ান বিস্মিত কন্ঠে বলল,

“তুমি তার..”

কথাটুকু কেড়ে নিয়ে জয়নব বলল,

“বোন!”

আয়ান আবেগে আপ্লূত হয়ে কেঁদে ফেললো। জয়নবকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“তুমি রূপের বোন আগে বলবা না? জানো ওকে কত মিস করি। ওকে কত ভালোবাসাতাম আমি। কিন্তু ও আমার কথাই শুনলো না। কতবার না করেছি ওকে ওই পথে পা বাড়াতে কিন্তু সে…”

আবারো কথার মাঝে ফোঁড়ন কাঁটলো কারো গগনবিদারী চিৎকার। জয়নব আর আয়ন তাকালো সদর দরজার দিকে। ডা. আদর দাঁড়িয়ে আছে। রক্তিম চোখে ভস্ম করে দিচ্ছে যেন তাদের। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলেন উনি। জয়নব ভয়ে সিটিয়ে গেছে। বার বার মন বলছে, “এখন কি হবে?”

ডা. আদরের ভয়ংকর সুন্দর চোখ দুটি মেলে তাকিয়ে আছে জয়নবের দিক। অত্যান্ত ঠান্ডা গলায় বললেন,

“এই জন্যই বুঝি পালিয়ে বেড়াচ্ছো আমার থেকে?”

জয়নব কিছু মূহুর্ত কথা খুঁজে পেলো না। আয়ান তখনি বলে উঠলো,

“স্যার আপনি ভুল ভাবছেন। ও আমার বোনের মতো!”

ডা. আদর এই মুহূর্তে কিছুই যেনো শুন্তে রাজি না। আয়ানকে সেখানে থেকে যেতে বলে, জয়নবের বাহু চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,

” আমি কম কিসে মেয়ে? আমাকে কেন ফিরিয়ে দিচ্ছো? কেন ইগনোর করছো?”

জয়নব ব্যথায় রাগে হিতাহিতজ্ঞান শূণ্য হয়ে পড়লো। আদরের চোখে চোখ রেখে বলল,

“আমি আপনাকে পছন্দ করি না। প্লিজনদয়া করে আর বিরক্ত করবেন না।”

কথাটি আদরের বুকে গিয়ে লাগে। জয়নবের হাত ছেঁড়ে দিয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে তাকায়। ম্লান গলায় বলে,

“ঠিক আছে। আমি তোমাকে আর বিরক্ত করবো না!”

আর দাঁড়ায় না আদর যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই ফিরে যায়। জয়নব সেখানেই বসে পরে ডুকরে কাঁদতে লাগে।

——–

বিষন্ন আরো একটি রাত কেঁটে যেতে লাগলো। নিশাচর নিশ্চুপ পাখিদের মতো চুপচাপ জয়নব নিজেও। বোনের ডায়রিটি আবারো খুলে বসলো সে।

~

আজ অনেক দিন পর ডা. অভিনব আমার দিকে তাকালেন। ভালোবাসা ছিলো না দৃষ্টিতে কিন্তু কিছু একটা ছিলো যেন আমার মনে ঘায়েল করার জন্য। আমি তার চাহনিতে স্থির হয়ে গেছিলাম। মনে হচ্ছিলো তিনি আমাকে কন্ট্রোল করতে চাইছেন। আমি হারিয়ে যেতে চাইছিলাম তার সেই চাহনিতে। কিন্তু তা বেশিক্ষণ রইলো না। পাশ থেকে একজন মেয়ের কথা শুনে সেদিন আমার স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেলো। ডা. অভিনবের নাকি গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তাউ তাদেরই ব্যাচমেট। কিন্তু কে? তা কেউ আজো জানতে পারেনি। এইটুকু কথা আমার মনে ঝড় তোলার মতো হয়েছিলো। সেদিন আমি কেঁদে কুঁটে বাসায় চলে যাই। ঠিক সাত দিন পর আবার ফিরে আসি মনের সাথে লড়াই করতে করতে। ঠিক সেই দিনেই ঘটলো ঠিক অদ্ভুত ঘটনা…

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৯

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৯।
রিসোর্টের কামড়ায় নিয়ন আলো জ্বলছে। মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে দখিনা জানালার পাশটি। খোলা জানালার বাহির দাম্ভিক পূর্ণ চন্দ্রটির আলেখ্য ভেষে আসচ্ছে। ঘরটির কোনোয় কোনোয় আলোকিত করে খেলা করছে দীপ্তি। আর তাতেই দেখা যাচ্ছে, বিছানার দুই প্রান্তে দুই মানব সটান করে শুয়ে আছে। মাঝে খানে দিয়ে রাখা হয়েছে বালিশের পাহাড়। কাজটি অবশ্যই জয়নবের। কামড়াটি বিশাল, মাঝামাঝি রাখা বিছনা, ঠিক তার উল্টোদিকে ড্রেসিংটেবিল। তার পাশেই রাখা কেবিনেট। জয়নব তাকিয়ে আছে খোলা জানালার দিকে। বাতাসে ফরফর করে উড়ছে সাদা লাল পর্দা। পিনপতন নিরবতা ঠেলে ভেসে আসচ্ছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। থেকে থেকে তাল মিলিয়ে ডাকছে হুতুম পেঁচা আর শিয়াল। এদের ডাকে কেঁপে উঠছিলো জয়নব। কিন্তু পাশে গুমরো মুখে বসে থাকা ডক্টরকে বুঝতে দিতে চায় না। লোকটিকে এমনিতেই তেতো মুখের করকরে কথা শুনিয়েছে সে। আদর মুখ গোঁজা করে রাখেছিলো বৈকি। কিন্তু লাল রক্তিম ঠিকি ফুটে উঠেছিলো চোখে,মুখ। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলে উঠেছিল,

“আমার থেকে দূরে থাকুন।”

আদর এর পর ওর দিকে তাকিয়েও দেখেনি। জয়নব ছোট শ্বাস ছাড়লো লোকটি ইগনোরনেস ভালো লাগচ্ছে না। চারদেয়ালের মাঝে মুখ বন্ধ করে বসে থাকতেও রাগ গা কেঁপে উঠছে। বীপ বীপ করে ভাইব্রেশন শব্দ হতে লাগলো বালিশের নবচে চাঁপা পড়া ফোনটি। ফোনটি হাতে নিয়ে এক প্রকার ছিটকে চলে এলো বারান্দায় জয়নব। তার যাওয়ার দিক ভ্রু কুচকে থমথমে মুখে চেয়ে আছে ডা. আদর। জয়নব ফোন তুলেই ফিসফিস করে বলল,

“দোস্ত বাঁচাইছোস তুই আমারে। ”

ওপাশ থেকে বলে উঠলো কুয়াশা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে,

“আমি না হয় তোরে বাঁচাইলাম আম্রে কে বাঁচাইবো। বাচ্চা গর কাউ কাউ আমারে পাগল কইরে দিতাছে দোস্ত। আমি মইরা জামু। আমার লিলায় তোর দাওয়াত।”

জয়নব হেসে ফেললো। আফসোস হওয়ার হচ্ছে এমন ভাব করে বলল,

“আহরে আমার বইনাটা কি খাটুনি করতাছে। ইশশ!”

কুয়াশা জয়নবের মজা ধরতে পেরে আরো খেপে গেলো। গাল ফুলিয়ে বলল,

“হইছে আর মজা লওয়া লাগবো না। ভুলিস না তোর জন্যই আমি ভুক্তভোগী। তা কিভাবে বাঁচাইলাম তা কয়!”

জয়নব বলল,

“আর কইছ না, আমি আর আদর স্যার এক লগে,এক রুমে, এক বিছানায়!”

কুয়াশা আকাশ থেকে পড়লো। এমন ভাব করে অার্তনাদ করে উঠলো,

“কি কস দোস্ত? তোগোর মাঝে কিছু হইছে? এবার কি হবে?”

জয়নব ধমকে উঠলো,

“বাজে কথা কম কয়। তার সাথে কিছুই হয় নাই। বেটা খাইশটার সাথে জীবনেও আমার কিছু হইতো না।”

“তাইলে?”

“আর কইছ না। হাসপাতালে পিয়নরে দিয়া এখানে একটা রেসর্টে বুকিং করাই ছিল দুইটা রুম। আইয়া শুনি একটা রুম বুকিং করছে। মাথায় আকাশ ভাইঙা পরছে দোস্ত। অবশ্য ডক্টর আদর, মি. বাঁদর চেষ্টা করছে অন্য রুম নিতে বাট হয়নি। আবার অন্য রেসোর্টে এ যাইতে চাইছিলো কিন্তু বাহিরের অবস্থা বেশি একটা ভালো না।”

হতাশ শুনালো এ পর্যায়ে জয়নবের কন্ঠ। সব শুনে কুয়াশা ওই প্রান্ত থেকে খ্যাঁক করে উঠে বলল,

” এইখানে এত টেনশন নিতাছোস কেন তুই? আদর স্যার রগচটা হলেও ভালো মানুষ কিছুই করবো না তরে। আর সে তো বাঘ, ভালুক না ভয় পাইতেছিস কেন!”

জয়নব অসহায় ভাবে বলল,

“জানি না দোস্ত কেমন জানি লাগতেছে খালি!”

কুয়াশা ওই প্রান্ত থেকে বুঝাবার মতো করে বলল,

“চিন্তা করিস না দোস্ত। এখন গিয়া সটান হইয়া চুপটি মাইরা শুয়া পর। আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়া!”

জয়নব সুপ্তপর্ণে শ্বাস টুকু গিলে বলল,

“আচ্ছা থাক তাহলে কাল দেখা হবে!”

“হুম আল্লাহ হাফেজ! ”

ফোন কেঁটে গেলো। নিশাচর রাতের আধারে তাকিয়ে রইলো জয়নব কিছুক্ষণ। মনে মনে নিজেকে কটক্ষ রুমে প্রবেশ করতেই চোখ কঁপালে উঠে গেলো। ঘরময় কোথাও বিচরণ নেই ডা. আদরের। ভ্রু জোরা কুঁচকে গেলো। মাথায় চিন্তার দুখানা ভাজ-ও পরলো। পায়চারি করতে লাগলো ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। লোকটি গেলো কই? বলেও গেলো না! কি করবে জয়নব ঘুমিয়ে পড়বে কি?এসব চিন্তায় কেঁটে গেলো ঘন্টা খানেক। জয়নব ক্লান্ত হয়ে বিছানা পিঠ ছায়ালো। তন্দ্রা এসে যাচ্ছে তার। চোখের পাতা এক করতেই খটখট করে শব্দ হলো দরজায়। জয়নব ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। দরজার আওয়াজ আবার হতেই দৌড়ে দরজা খুলে দিলো।

ঢুলু ঢুলু শরীরে হেলেদুলে রুমে প্রবেশ করতেই হেলে পড়লো আদর জয়নবের দিকে। জয়নব বিস্ময়ে হতভম্ব। ডা. আদর সুরার ঢেলেছেন গলায়। তার মুখ থেকে তীব্র গন্ধ ধেয়ে আসচ্ছে। ভেসে আসচ্ছে আবার কিছু টুকরো কথা,

“আমাকে কেউ ভালোবাসা না..! মা না বাবা না। তুমিও না.. কেউ না। হোয়াই নো ওয়ান্স লাভ মি?হোয়াই?”

জয়নব কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। লোকটি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। অস্তিত্বে কাঠ হয়ে যাচ্ছে তার শরীর। কোনো রকম ডাকলো তোতলানো কন্ঠে,

“স্যার.. আর ইউ ওকে!”

অস্পষ্ট স্বরে ভেসে এলো,

“নো আম নট ওকে। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ সো মাচ! ডোন্ট গো। ডোন্ট!”

জয়নব কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মাথা কিছুই কাজ করছে না। ফাঁকা ফাঁকা লাগচ্ছে। কোনো এক নাবিককে মাঝ নদীতে কোনো সাহায্য ছাড়াই ছেঁড়ে দিলে যেভাবে হাবুডুবু খায়, ঠিক তেমন হাবুডুবু খাচ্ছে জয়নব। তার যৌবনে শুরুতেই তার লতনো শরীরের পেঁচিয়ে আছে কোন পরপুরুষ। মনের মাঝে জেগে উঠছে অবাধ্য কিছু অনুভূতি। আচ্ছা জয়নব কি ডা. আদরের মায়া পড়ে গেছে? এমন হলে কি করে হবে? তার এখন কত কাজ বাকি? সে কি গন্তব্য ভুলে যাচ্ছে? পরক্ষণেই আবার উঁকি মারে আদরের মুখখানা।বিছানায় শুয়ে দিলো জয়নব। অজান্তে হাসে দিলো কি সুন্দর বাচ্চাদের মতো মুখ করে শুয়ে আছে লোকটি।কত নিষ্পাপ, কত মায়া মায়া তার মুখ। নিজের অজান্তেই ডক্টর আদরের গালে স্পর্শ করে বসলো জয়নব।

——————–

সেদিনের পর কেঁটে গেছে দুদিন। চৈত্রের বিষন্ন দিন গুলোতে খা খা মাঠ, ঘাটের সাথে জয়নবের বুক খা খা করছে। দুটো দিন অকারণেই পালিয়ে বেড়িয়েছে জয়নব ডা. আদরের কাছ থেকে। এদিকে শ্যামার দিয়া ডায়রির কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে সে।

এখন টিফিন আওয়ার চলছে। কেন্টিনে চলছে হৈ-হুল্লোড়। আসড় জমেছে বন্ধু-বান্ধবদের। জয়নব আর কুয়াশা বসে আছে একটি টেবিলে কেন্টিনের এক পাশেই ৪২ ইঞ্চির টিবিতে চলছে বাংলা সিনেমা প্রেমের সমাধি চলছে। কেন্টেনের মামা খুব মগ্ন হয়ে সিনেমাটি দেখে যাচ্ছে। তা নিয়ে হাসা হাসি করছে সবাই।

দুদিন পর নবীন বরণ অনুষ্ঠান হবে। সে নিয়েও চলছে গুটুরপুটুর। কুয়াশা বলেই দিলো,

“আমিতো শাড়ি পরমু দোস্ত। সেই মাঞ্জা মারমু। দেখিস এবার বয়ফ্রেন্ড দুই তিনটা পকেটে ভরমু!”

জয়নব খিল খিল করে হেসে দিলো। দূর থেকে তার কিশোরী হাসি দেখে মুগ্ধ হলো কেউ বুঝতেই পারলো না জয়নব। জয়নব বলল,

“দোস্ত তোর কয়ডা বফ লাগরে? আগের দুইটা কি করছোস?”

কুয়াশা কাঁদো কাঁদো ভাবে বলল,

“বলিস না মামা কেডায় জানি পকেট কেটে নিয়া গেলো!”

এবার দুজনেই হেসে উঠলো। কুয়াশা বলল,

“বয়, আমি চা আর সিঙ্গারা নিয়া আসি। মামা যে ধ্যায়ানে পড়ছে আমা গো উপস থাকতে হইবো পরে!”

বলতে বলতে উঠে পরলো চেয়ার ছেড়ে কুয়াশা। আর জয়নব তাকালো টিভির স্ক্রিনে। নিউজ শুরু হয়েছে। জয়নব ছোট থেকেই নিউজের প্রতি ইন্টারেস্ট কম। সে চোখ ফিরিয়ে নিবে ঠিক সেই মুহূর্তেই ভেসে উঠলো হাস্যজ্জল চেনা পরিচিত মুখ। জয়নব অবাক হয়ে তাকালো। নিউজ বলা মেয়েটি গরগর করে বলে যাচ্ছে,

“আজ সকালে ট্রাকের সাথে সিএনজির সংঘর্ষনে নিহত হলে মেডিকেল স্টুডেন্ট সাজিয়া শ্যামা!”

জয়নব ভুত দেখার মতো তাকিয়ে রইলো। চোখ দুটি থেকে উপচে পরলো নোনাজল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌঁড় লাগালো জয়নব। পিছন থেকে কুয়াশার ডাক তার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। শ্যামাপু এভাবে মরতে পারে তার বিশ্বাস হচ্ছেই না। এটা হত্যাকান্ড কিন্তু সে কিভাবে প্রুভ করবে জানা নেই। জয়নব তার হোস্টেলের রুমটিতে এসে দরজা লাগিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। মরণফাঁদে আর কত মানুষ মরবে বুঝতে পারছে না সে। শ্যামাপু মুচকি আসি, আদর মাখা কন্ঠ, স্নেহময় ভালোবাসা সব একে একে মনে পড়তে লাগলো জয়নবের। মনে পরলো সেই প্যাকেটটির কথা। সময় ব্যয় না করে প্যাকেটটি হাতে নিলো জয়নব। প্যাকেটি খুলতেই দেখতে ফেলো একটি আধা পোড়া ডায়েরি। জয়নবের কঁপাল কুঁচকে গেলো৷ ডায়রিটি খুলতেই চকচক করে উঠলো গোটা গোটা অক্ষরের নামটি।

“রুফাইদা নাওরিন”

জয়নব এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। ছোট থেকেই রুফাইদার ডায়েরি লিখার অভ্যেস ছিলো। এটি যে তার বোনের ডায়েরি বুঝতে এক মুহূর্ত লাগলো না। জয়নব পরের পেইজ উল্টালো। অনেক লেখা মিটে গেছে। কোথাও কোথাও থেকে অক্ষর উঠে গেছে। জয়নব চোখের জলটুকু মুছে পড়তে লাগলো।

*রুফাইদা*

আজ আমার মেডিকেল কলেজের প্রথম দিন। ফুললেল শুভেচ্ছা দিয়ে বরণ করা হয়েছে। অনেক বন্ধু বান্ধব জুটেছে আমার। আয়ান, যুথি, মিফতা, মুশফিক, আঞ্জুমান, পূঁজা। আরো অনেকেই। এরা আমার ঘনিষ্ঠ তাই এদের নাম তুলে ধরলাম।

~জয়নব পেইজ উল্টালো~

আজ আমার মনে মাঝে নতুন অনুভূতি অনুভব করেছি। কিন্তু তা ভালো লাগা না মন্দ ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে ডা. অভিনবের ব্রাউনিশ চোখ জোরা ঘায়েল করার মতো। তার্কিশ হিরোদের যেন হার মানাবেন উনি। কলেজের সবাই নাকি তার উপর মরে মরে যায়। কিন্তু আমার তেমন হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ডা. অভিনবকে দেখলে শ্বাসকষ্ট হয় খুব।

~জয়নব অজান্তাতেই হাসলো। মনে হচ্ছে তার বোন তার সামনে বসেই কথা গুলো আওড়ায় যাচ্ছে। পাতা উল্টালো আবার।~

আজ আমাদের মর্গে মানবদেহের উপর ক্লাস চলছিলো। ডা. অভিনব স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। উনি খুব সুন্দর কথা বলেন। মন ছুঁয়ে যায়। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো তার ঠোঁট নাড়া দেখি। তার সাথে আমার কখনো কথা হয়নি। কিন্তু খুব ইচ্ছে করে ডা. অভিনব আজওয়াদকে বলতে,

“এই ডক্টর, আমাকে কি তোর চোখে পড়ে না। সবার দিকে তাকাস আমার দিকে তাকালে কি হয়? তোকে কি খেয়ে ফেলবো আমি?”

কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পাড়িনা। বুকে ভিতর ব্যথা হয়। রাতে ঘুমাতে পাড়িনা। খেতে পাড়িনা। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পাড়িনা। ডা. অভিনবকে নিয়ে অশ্লীল চিন্তা আসে। লজ্জায় তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে উফ…!

~জয়নব হতবিহ্বল। রুফাইদা ডা. অভিনবকে পছন্দ করতো? ভাবতেই অবাক লাগছে! তাহলে বিজয় ভূঁইয়াকে?~

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৮

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৮।
গাড়ির প্রচন্ড ঝাঁকুনীতে ঘুম ভেগে যায় জয়নবের। বিরক্তি নিয়ে আশে পাশে তাকাতেই মনে পড়ে, সে এখন ডা. আদরের পাশেই অবস্থান করছে। ডা. আদর নির্বিকার ভাবে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত। ফ্যাকাশে চোখ জোড়া আজ চশমা দিয়ে ঢাকা নয়। জয়নব নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো তার চোখের দিকে। কিছু মুহূর্ত অতিবাহিত হতেই ডা. আদর তাকালো তার দিকে। জয়নব সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ডা. আদর ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। জয়নব এই মুহূর্তে তাকালে দেখতে পারতো মনচোরা হাসিটি..।

“ঘুম কেমন হলো জান!”

চমকে তাকালো জয়নব। জান ডাকটি কতটা আদর মাখা, স্নেহের চাদরে মুড়ানো। আবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।

“কি ডাকলেন আমায়?”

ডা. আদর মনচোরা হাসিটি আবার হেসে ফেললো। জয়নব মুগ্ধ নয়নে দেখতে থাকলো। কথাটুকু এড়িয়ে জয়নবের গ্রীবাদেশে ইশারা করে বলল,

“গলার ক্ষতটা খুব বেশিই। মেডিসিন ইউস করেন নি?”

জয়নব এবার বিস্ময়ে আকাশ চূড়া। রাতের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে সে। ক্ষনিকের জন্য মনে পড়তেই ভেবেছিলো স্বপ্নে তারা করছে সেই লোকটি। সকালে ঘুম থেকে উঠতে লেইট হয়েছে বলে চুল গুলো হাত দিয়ে বেঁধে দৌড় করেছে সে। আয়না দেখার সময় টুকু পায়নি সে। কিন্তু হায়! সব সত্য ছিলো? জয়নব ওরনা দিয়ে গলা ঢাকার চেষ্টা করলো। তখনি শক্ত গলায় বলল ডা. আদর,

” বয়ফ্রেন্ডের দিয়া চিন্হ এভাবে ঢাকবে না। ”

বলেই গাড়ি সাইড করলো। জয়নব ঘাবড়ে গেলো। বাহিরে এক পলক দেখে নিলো। পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছিলো তারা। যেখানটায় গাড়ি থামিয়েছে আদর একদম জনশূন্য জায়গায়। জয়নব শুঁকনো ঢুক গিললো। ভয়ে তোতলানো শুরু করলো,

“এ..খানে, এখানে থামিয়েছেন কে..ন?”

আদর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো জয়নবের দিক। জয়নব চোখ ফিরিয়ে নিলো। ডা. আদর হালকা ঝুকে ফাস্টেড বক্স বের করলো। জয়নব নড়েচড়ে বসলো। ডা. আদর আরেকটু ঝুকে এলো। ঘাড় থেকে ওরনা নামিয়ে মেডিসিন লাগাতে লাগলো। এদিকে জয়নবের বুকের মাঝে দুরুদুরু করছে। হৃদপিণ্ড হাজারগুন স্প্রিডে ধুকপুক ধুকপুক শব্দ করছে। লোকটি শ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে তার ঘারে। আদর যতবার ঘাড়ে স্পর্শ করছে, জয়নবের শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটি বুঝে আছে। ঠোঁট দুটি কাঁপছে। এক অদ্ভুত অস্থিরতায় গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। মনের ভিতর শিরশিরানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। জয়নব যেন নিজের সত্তা ভুলতে বসেছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই লোকটির প্রশস্ত বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলতে। জয়নব আর পারছিলো না এই অদ্ভুত ভয়ংকর অনুভূতির সাথে। এবার সে খামচে ধরলো নিজের ওরনা। তখনি ডা. আদর স্বরে এলো। জয়নবের এবার প্রান ভরে শ্বাস নিলো। ডা. আদর জয়নবের এ অবস্থা দেখেই ভ্রু কুচকে ফেলে জিজ্ঞেস করলো,

“আর ইউ ওকে?এমন করছেন কেন আপনি? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?”

জয়নব ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। মাথা নাড়িয়ে বলল,

“ঠিক আছি!”

ডা. আদর ওকে বলে, আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো। জয়নব এবার স্বাভাবিক। বাহিরের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। গাড়িতে চলছে পিনপতন নিরবতা। কিছু সময় ব্যয় করে ডা. আদর আবার ডাকলেন,

“জান!”

জান ডাক শুনেই তরতর করে জয়নবের রাগ বেড়ে গেলো। কাঠ গলায় বলে উঠলো,

“আমাকে আপনি জান ডাকবেন না। জয়নব ঠিক আছে। জান শুধু আপনজনরাই ডাকে!”

আদর মুচকি হাসলো। বলল,

“আমি কি আপনার আপনজন নই জান?”

জয়নব বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। রাগ এবার মাথায় উঠে গেলো। কেন রাগ হচ্ছে বুঝলো না জয়নব। তবুও অনেক কষ্টে স্বাভাবিক রাখতে চেয়েও পারলো না। বলল,

“নাহ্ আপনি আমার শিক্ষক, আর আমি আপনার শিক্ষার্থী। এতটুকুই সম্পর্ক আপনার আর আমার!”

ডা. আদর মুখে হাসি উড়ে গেলো মুহূর্তেই। ফ্যাকাসে হয়ে গেলো দাম্ভিক মুখখানা। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“আই ইউল রিমেম্বার! ”

এর পর সব নিস্তব্ধতা। গাড়ির স্প্রীড চলতে শুরু করলো। ডা. আদরের মুখ ক্রোধে লাল হয়ে গেছে একদম। জয়নব বুঝতে পারলো না এই ক্রোধের কারণ কি?

——————-

অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে বসে হাঁপাচ্ছ জয়নব। মেডিকেল কলেজে নতুন সে। কাঁটা ছেঁড়া ছোট থেকেই ভয় পায়। আর তাদের এ বিষয়ে এখনো ক্লাস হয়নি। মানবদেহের চিড়ে ফেড়ে আবার জোরা লাগানো খুবই ভয়ংকর অনুভূতি। জয়নব ওটির ভিতরেই কাঁপা কাঁপা হাতে ডা. আদরের কথা অনুসরণ করে চলেছে। কঁপাল বয়ে ঘাম ঝরছিল তার। আশেপাশে অন্য ডক্টর গুলো একবার আদরকে বলেই বসল,

“অনভিজ্ঞ কাউকে না নিয়ে আসলেই পারতেন। দেখে মনে হচ্ছে মিস জয়নব নিজেই রোগী হয়ে যাচ্ছেন। পড়ে না উনার অপারেশনের ব্যবস্থা করতে হয়। ”

হাসির রোল পড়লো বন্ধ ঘরটিতে। জয়নব রাগে দুঃখ কান্না পেয়ে গেলো। এভাবে ডক্টর আদর তাকে অপমান না করলেই পারতো। জয়নব এবার যেন কেঁদে দিবে দিবে ভাব তখনি ডক্টর আদর বলে উঠলো,

“আপনি বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। সার্সার্জারি শেষ করে আসছি! ”

জয়নব দৌড়ে বেড়িয়ে এলো যেন সেখান থেকে।

“পানি!”

একজন অপরিচিত একটি মেয়েলি কন্ঠ শুনে চোখ মেলে তাকালো জয়নব।লাল, খয়েরী জামা গায়ে নাদুসনুদুস গরনের হালকা লম্বাটে মুখে মেয়েটিও তাকে দেখে মুচকি হেসে যাচ্ছে।হাসি টুকু মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো৷ চোখ জোরায় মায়ায় ভর্তি। জয়নবের তখন খেয়াল হতেই ঝাঁপটে ধরে মেয়েটিকে। মেয়েটি পরম যত্ন মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠে,

“কেমন আছিস জান?”

“ভালো আছি শ্যামাপু তুমি কেমন আছো?বড়পু যাওয়ার পর আর তোমাকেও পেলাম না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল শ্যামা,

“আমি ভালো আছি।রুফাইদা চলে যাওয়ার পর আমিও থাকিনি সেই হাসপাতালে ট্রানস্ফার নিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি । তা তুই এখানে কেন?”

জয়নব সব খুলে বলল। শ্যামার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠলো। বলল,

“বোন তুই কেন এসব করছিস? এসব খুব ভয়ংকর। তোর উচিত হয়নি এসব করা!”

“আমি কি করতাম শ্যামাপু বলো? যেখানে আমার বোনের এভাবে খুন হয়ে গেলে, কেন হলো, কি করে হলো? তাদের কেন শাস্তি দিতে পারলো না পুলিশ আমি জানতে চাই। তুমি কিছু জেনে থাকলে প্লিজ সাহায্য করো! আমি যেখানেই হাত দিচ্ছি সব ধোঁয়াশা। আমি চাই আমার বোনের খুনিদের নিজ হাতে শাস্তি দিতে।”

শ্যাম কিছুক্ষণ চুপ মেরে রইলো। রুফাইদার মতোই হয়েছে জয়নব। দুবোনের কত মিল। কিন্তু রুফাইদাকে যারা মেরেছে, তাদের শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না ঠিকি। কিন্তু জয়নবকে সে সাহায্য করতেই পারে। এসব ভেবেই কিছু বলবে তার আগেই অপারেশন থিয়েটারের বাতি নিভে গেল। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে শ্যামা হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে গেল সেখান থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেলো। তার কথা কাউকে না বলতে, আর আধঘন্টার মাঝে ওয়াশরুমে দেখা করতে। জয়নব মাথা নাড়লো। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পাড়লো না, এভাবে চলে করন গেলো তার শ্যামপু?

—————-

চট্টগ্রামের কাজ শেষ ফিরে যাবার পালা। ঠিক সেই মুহূর্তে জানা গেলো, শহরে মারামারি লেগেছে রাজনৈতিক দুই দল। সেদিকে যে গাড়িই যাচ্ছে আগুন ধরিয়ে দিয়া হচ্ছে। এসব শোনার পর হাসপাতালের দায়িত্বরত ডাক্তার হাশেম বললেন আজ রাত রাত বাসাতেই থেকে যেতে। কিন্তু ডক্টর আদর রাজি হলেন না। তারা কোনো গেস্ট হাউজেই উঠতে চায়। ডক্টর হাশেম মাথা নাড়লেন। পাশেই একটি বাংলো বাড়ির মতো রেসর্টে বুকিং করে দিলেন রুম। ডা. আদর আর জয়নব বের হওয়ার আগেই জয়নব বলল,

“আপনি চলুন আমি আসছি। ”

ডক্টর আদর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেসা দৃষ্টিতে তাকাতেই জয়নব বলল,

“ওয়াশরুমে যাবো।”

“রেসর্ট তো কাছেই। সেখানে গিয়েই না হয়…”

মাঝ পথেই কথা থামিয়ে বলল জয়নব,

“ইটস আর্জেন্ট! প্লিজ!”

কাঁধ বাকিয়ে ডা. আদর বলল,

“ওকে!”

জয়নব হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশরুমে দিক ছুটলো। সেখাই পায়চারি করছে শ্যামা। চোখে মুখে আতঙ্ক। জয়নবকে দেখেই এগিয়ে এলো সে। কাগজে মোড়ানো একটি প্যাকেট এগিয়ে দিল তার দিকে। যেতে যেতে বলে গেলো,

” ওই হসপিটালের কাউকে বিশ্বাস করবে না। কাউকে মিনস কাউকে না..! কে কখন কোন দিক দিয়ে বিশ্বাস ঘাতকতা করে বসবে জানা নেই। আর হে আমার সাথেও কোনো যোগাযোগ করা চেষ্টা করো না! ভালো থেকো জান!”

জয়নবের ললাটে চুম্বন করে বেড়িয়ে গেল শ্যামা। তার চোখে ছলছল করছে পানি। কত বছরের আত্মগোপনে থাকতে পারবে জানা নেই তার। মন থেকে শুধু চায়। এসব ক্রাইম শেষ হোক। আর কোনো মানুষ না মারা যাক। জয়নব তাকিয়ে রইলো শ্যামার যাওয়ার দিক। ঠিক তখনি ভেসে এলো ডা. আদরের কন্ঠ। চট জলদি প্যাকেটটি ভরে নিলো ব্যাগে। আর বেড়িয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে। ডক্টর আদর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলল,

“চলুন এবার?”

জয়নব চাপা হাসার চেষ্টা করে বলল,

“হে চলুন।

—————–

সবুজে সবুজে চারিপাশ ঘেরা রেসর্টের। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, নিরিবিলি সময় কাঁটাবার জন্য পার্ফেক্ট। চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো জয়নব।চারিদিকে যেন চোখ ধাঁধানো সুন্দর। জয়নব হা করে দেখছে সব। সময়টা শেষ বিকেল হওয়াতে মনোরম পরিবেশ আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছে যুগলদের। জয়নব চোখ ফিরালো আদরের কন্ঠ পেয়ে। তার ভিতরে ঢুকতেই আকাশ ভেঙ্গে পড়লো জয়নবের মাথা। অস্পষ্ট স্বরে বলল শুধু,

” অসম্ভব! ”

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৭

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৭।
হতাশ হয়ে চাইলে এবার কুয়াশার দিকে। কুয়ার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। নিরাশ হয়ে তারা ফিরে এলো হলে। কিন্তু হলে পা রাখতেই যা দেখলো, চোখ ছানাবড়া….।

সবাই জড় হয়েছে এক সাথে। ঠিক তাদের মধ্যমনি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডা.আদর। হাত নাড়িয়ে খুব সুন্দর ভঙ্গিমায় কিছু বলছেন। দূর থেকে তেমন কিছু শুনতে পাচ্ছে না বলে এগিয়ে এলো ওরা। জয়নব এই প্রথম ডা. আদরকে মাস্ক ছাড়া দেখলো। লাল সাদা রং এর শরীর আর চশমার আড়ালে ফ্যাকাশে চোখের মালিক প্রচন্ড সুদর্শন। শরীরে তার যেন আভিজাত্য চুয়ে চুয়ে পড়ছে। শক্ত চোয়াল জুড়ে সুন্দর করে কাঁটা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। গায়ে ঝুলছে নেভি ক্যাজুয়াল শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট। সাদা চামড়ার হাতে উপর চুপটি করে বসে আছে ব্ল্যাক ওয়াচ। হালকা বাদামি চুল গুলো ঠেলে পিছনে রেখেছেন। অহংকারের সাথে যেন মাথা উঁচু করে আছে ছোট ছোট দুটো তীল গ্রীবাদেশে। জয়নব যেন ঘোরে চলে যেতে লাগলো। শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিটির উপর তার মন যেন ধীরে ধীরে গলে পড়তে লাগলো।

” সামনের শুক্রবার নবীন বরণ হতে চলেছে। প্রতিবারের মতো আপনাদেরকেও বরণ করে নিয়া হবে। তবে আপনারা চাইলে কবিতা, নাচ, গান, মডেলিং আরো অনেক কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তার জন্য দায়িত্বতে আপনাদের সিনিয়র ভাই আয়ান আর যুথি। ”

কানের মাঝে ঝনঝন করে উঠলো আয়ান নামটি। চকিতে মুখ তুললো জয়নব। চোখ দুটিতে চমকের ছাফ। আয়ান যখন এসে দাঁড়ালো ডা. আদরের পাশে, জয়নব যেন ১৮০ বোল্ডের শক্ড খেলো। শুকনো ঢুক গিলে কুয়াশার দিক তাকালো। কুয়াশা ভ্রু কুচকে আছে আয়ানকে দেখে। জয়নবের দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনে তাকালো আবার। এর মাঝে ডা.আদরের ঘোষণা সবাই হাততালি দিতেই জয়নব অসহায় ভাবে তাকালো কুয়াশার দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে ডা. আদর তাকালো অসহায় মুখশ্রী জয়নবের দিকে। ঠোঁটে তার বাঁকা হাসি। জয়নবের পাশ ঘেষে এবার চলে গিয়ে আবার দু পা পিছিয়ে এলেন তিনি। জয়নব তখন তাকিয়ে কুয়াশার দিকে। কুয়াশাও তাকিয়ে জয়নবের দিকে। যেন চোখে চোখে হাজার কথা চলছে তাদের মাঝে!

ডা. আদর সব কিছু লক্ষ করলেন। দুজনের সামনে এক চুটকি বাজিয়ে বললেন,

“কোথায় হারিয়ে গেলেন মিস?”

জয়নব চমকে তাকালো। বুকের মাঝে থুতু দিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। বলল,

“কোথাও না স্যার!”

সন্ধিহান দৃষ্টিতে থাকিয়ে রইলো ডা. আদর। জয়নবের আগাগোড়া দেখে নিলো। কচুঁ পাতা রঙ্গের জামা পড়া, উষ্কখুষ্ক চুল, ক্লান্ত মুখ আর চোখ। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ তাদের। ডা. আদর ঠান্ডা আর থমথমে কন্ঠে বললেন,

“ইউ বোথ কাম তোমায় কেবিন! কুইক লি? ”

জয়নবের ভয়ে মুখ সাদা হয়ে গেলো। কেন জানি লোকটিকে দেখলে তার ভয় লাগে। লোকটি ফ্যাকেশে ধারালো চোখ যেন তাকে আরো শিথিল হয়ে পরে…।আবার ডাকচ্ছে তাদের??

এদিকে কুয়াশা টুপ করে মাটটিতে বসে পড়লো।

“বইন আমি জামু না। তুই যা। এই বেটটা অভিনব স্যারের থেকে বেশি রাগী। ”

জয়নব তার পাশে বসলো। ফিসফিস করে বলল,

“তুই না গেলে আমিও জামু না। তার আগে আয়ান ভাইয়ার কাছে যাই চল!”

কুয়াশা এবার খেপে গেলো,

“তুই যা। মাফ কর আমায়। আয়ান মইরা, মইরা গেছে কইয়া মাথায় তুলছোস? ব্যাটা সমনে হাজির তোর সাথে নেই আমি যা ভাগ!”

জয়নব বাচ্চাদের মকো মুখ করে মানাতে চাইলো,

“প্লীজ!”

কুয়াশা রাগ করেও থেকেও পারলো। খিল খিল করে হেসে দিলো। তারপর পা বাড়ালো দুজন আয়ানের কাছে।

———-

“আর ইউ ম্যাড জয়নব?”

“আমি সত্যি বলছি ভাইয়া, আমি সেদিন আপনাতে দেখেছি। ”

একে একে সব খুলে বলল জয়নব! আয়ান হো হো করে হেসে উঠলো। বুকে হাত দিয়ে হাসি থামাবার চেষ্টা করলো। করিডোরের এক পাশে বসার জন্য চেয়ার দিয়া। সেখা বসে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,

“আই থিঙ্ক তোমার একটা ভালো সাইক্রেটিস্ট এর কাছে যাওয়া দরকার। ”

জয়নব আর কিছু বলতে পারলো না। এদিকে কুয়াশাো একটি কথা বারবার ঘ্যানঘ্যান করে চলছে। জয়নব রাগে চেঁচিয়ে উঠলো এবার,

” তোর আমার কথা বিশ্বাস না হলে আসিস না আমার সাথে।আমি অসুস্থ নেই। সেদিন যা দেখেছি ভুল দেখিনি। আমার কাজো আর তোর হেল্প করতে হবে না। যা করার আমি করবো। ”

কুয়াশা হতাশ হলো।জয়নবকে বোঝানো তার কাম্য নয়।এরেই মাঝে একজন ওয়ার্ড বয় এসে হাজির। লোকটি এসেই ধমকের মতো বলল,

“তোমাদের আদর স্যার ডাছেন!”

লোকটি কথায় দুজনেই কেমন সিটিয়ে গেলো। মিন মিন করে বলল,

“যাচ্ছি ভাইয়া!”

——————–

“আপনার কোথায় গিয়েছিলেন? আপনার কি জানেন না? ক্লাস চলা কালীন সময় গুলোতে কোথাও যাওয়া নিষেধ আপনারা কি জানেন না?”

মাথা নত করেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন। ডা. আদরের শক্ত কথাতেই যে কেঁপে উঠলো তারা। দুজনেই একসাথে বলে উঠলো,

“সরি স্যার।”

ডা. আদর এবার দুজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,

“নিয়ম যখন ভেঙেছেন শাস্তিতো পেতেই হবে!”

দুজনেই চোখ তুলে তাকালো। মুখখানা এমন যেন এখনেই মেরে বালি চাপা দিয়ে দিবে যেন ডাক্তার আদর। চুপসে গেছে একেবারে। আদরের তা দেখেই হেসে ফেলতে চাইলো হো হো বাট চেপে গেলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

“মিস কুয়াশা আজ আপনি ডিউটি করবেন শিশু ওযার্ডে। আপনি যেতে পারেন এখন।”

কুয়াশা কাঁদো কাঁদো মুখ করে চলে গেলো। বাচ্চাদের ওয়া ওয়া শুনতে মোটেও তার ইচ্ছে করছিলো না। সারা দিন জার্নি করে এই প্যারা নিয়ার কোনো মানেই হয় না।

কুয়াশা যেতেই জয়নবের পানে তাকালো আদর। জয়নবের মনে হলো, তার ধারালো দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে। জয়নব বার বার ঢুক গিলতে লাগলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো তার হাত পা। ডা. আদর টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখে যেন অদ্ভুত কিছু তার। কিন্তু কি? বুঝতে পারছে না জয়নব। ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখে সুক্ষ্ম ভাবে মুখস্থ করতে ব্যস্ত জয়নবের লতানো শরীরের দিক।জয়নবের অস্বস্তি লাগছে খুব। সে বলল,

“স্যার আ..মি কি করবো??”

ডা. অাদর অকপটে বলল,

“ভালোবাসো!”

জয়নব সাথে সাথে চোখ মেলে তাকাতেই আদর বলে উঠলো,

“কাল সকালেই আমি চিটাগং যাচ্ছি সেখানে একটি সার্জারি আছে, আমি আমাকে অ্যাসিস্ট করবেন। সো রেডি থাকবেন সকাল সাতটায় বের হবো আমরা!”

জয়নব আর মাথা ঘামালো না মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে গেলো সে। তার মাথা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে আয়ানের ব্যাপারটা….।

———-

রাত প্রায় দুটো বাজে, চোখে ঘুম নেই জয়নবের। নিশাচর পাখিদের মতো সেও বেড়িয়ে পড়লো হোস্টেল থেকে। ঠিক একই জায়গায় এসে দাঁড়ালো জয়নব। সেদিন রাতের কথা প্রতি স্পষ্ট মনে আছে এখন, তাহলে? কেন আয়ান অস্বীকার করছে সব? এসব ভেবেই সে আকাশের দিকে তাকালো। তারা ভরা আকাশ। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা লুব্ধকের দিকে তাকিয়ে চোখ বুঝলো। ভাঙ্গা কন্ঠে বলল,

“বড়পু! আমি তোমার জন্য কিছুই কি করতে পারবো না? যেখানেই হাত দিচ্ছি? সব ধোয়াশা লাগচ্ছে কি করবো আমি বলতো!”

কোনো প্রশ্নের উত্তর ফিরে এলো না। এলো শুধু প্রবল বেগে স্ব স্ব বাতাস। জয়নব চোখ খুলো। বিজে যাওয়া ছল ছল চোখে ভেসে উঠলো সেই কালো আবরণের মানবের প্রতিছবি। জয়নব স্তম্বিত হলো। লোকটি তার খুব কাছে, বিন্দু পরিমাণ ফাঁকা নেই যেন। জয়নব যখন পিছিয়ে যেতে নিলো। তখনি লোকটির বলিষ্ঠ হাত জোরা চেপে ধরলো জয়নবের বাহু। জয়নবের কথা যেন গলার মাঝ বরাবর আটকে গেছে। কালো কুচকুচে চোখের মনির লোকটি তার হাত দুটি একবারে পিছনে নিয়ে পিঠের সাথে চেঁপে ধরলো। হিসহিস করে বলল,

“মেয়ে রাতবিরাতে হচ্ছে পশুদের রাজ কি করছো এই রাজ্যে প্রানের ভয় আছে তো?”

জয়নব চোখ বড় বড় করে চাইলো। অস্পষ্ট ভাবে বলল,

“প..শু”

লোকটি আরো ঘনিষ্ঠ হলো। জয়নবে শরীরের ঘান শুকে নিয়ে বলল,

“হে, পশু মানুষ খেকো পশু। ডোবা তেলে ভেজে খেতে খুব টেষ্ট। সব থেকে সুস্বাদু হয় মেয়েদের দেহের কিছু অংশ!”

জয়নবের পিলে চমকে উঠলো। লোকটির কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রবল চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। এদিকে সে চিৎকার করতে-ও পারছে না যেন গলার মাঝে কেউ কিছু একটা চাপা মেরে দিয়েছে।

“শোনো মেয়ে, প্রকৃতির মাঝে অনেক কিছু ঘটে যার উত্তর খুঁজতে হয় না। আজ ছেঁড়ে দিচ্ছি ভবিষ্যতে আর দয়া ময়া নাও হতে পারে আমার। হতেও পারে আমার পেটে গিয়ে তুমি হজম হয়ে আছো!”

লোকটির হাসির শব্দ পেলে জয়নব। লোকটি কথা হীম হয়ে যাচ্ছে শরীর। জয়নবের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। লোকটি এবার অপ্রতাশিত কাজ করে বসলো। প্রথম দিনের মতো দাঁতের দাগ বসিয়ে দিলো জয়নবের গ্রীবাদেশে। জয়নব ব্যথায় কুকিয়ে উঠলো একেবারে। ক্ষত স্থান থেকে বেড়িয়ে আশা রক্ততে জিব্বা বসলো। শরীরের শিড়া উপশিরায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো যেন। ধীরে ধীরে জয়নব নেতিয়ে পড়তে লাগলো। লোকটি এবার কোলে তুলে নিয়ে পা বাড়লোন হোস্টেলের দিকে। জয়নব তখন তাকিয়ে। লোকটি বিছানায় শুয়ে দিলো জয়নবকে। আধো খোলা চোখ জোড়ায় হাত বুলিয়ে চুম্বন করলো ললাটে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো সে,

” ঘুমিয়ে পরো আমার রাজ্যের রাণী। ”

চলবে,

আজকে আমার প্রচুর বানান ভুল হয়েছে তার জন্য দুঃখীত। ফোনটি আমার ভেঙ্গে গেছে। যার জন্য লিখতে একটি বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সরি😔

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৬

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৬।

পিটপিট করে চোখ খুললো জয়নব। খোলা আকাশের নিচে নিস্তেজ ভাবে ঘাসের উপর শুয়ে আছে। পাখি গুলো কিচিরমিচির করে উড়ে যাচ্ছে। ভোরে নিয়ন আলো সরে সোনালী আলো চোখে পড়ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে দৌড়ে এলো কুয়াশা পড়নে জগিং এর কাপড়। মাত্র বের হয়েছে সে দৌড়াতে। কোনো এক অকারণেই শরীরের ওজন কমাতে চায় সে। জয়নবকে এভাবে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে চিন্তার ভাজ পড়ে মাথায়। দৌড়ে কাছে এসে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,,

“জান? তুই এবাবে কেন পড়ে আছিস?? আর ইউ ওকে? জান? ”

জয়নব ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকালো। সূর্যে এক ফালি আলো চোখের কোনের জলটুকু ঝিলমিল করে উঠলো। অসহায় ভাবে বলল,

“বাঁচাতে পারলাম নারে আমি! তাকে.. বাঁচাতে পারলাম না!”

স্তম্ভিত হলো জয়নব। চোখ কাঁপালে উঠে গেলো। আতঙ্ক নিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“কার কথা বলছিস দোস্ত?”

“আয়ান ভাই!”

“কি বলছিস?”

“সত্যি বলছি। নীজের চোখে দেখেছি গত রাতে তাকে বস্তায় ভরে নিয়ে গেছে কেউ!”

কুয়াশা হতবিহ্বল। কি বলবে সে? কি করবে? এ মুহূর্তে কি রিয়েকশন দিয়া উচিত তার??

জয়নব আবার বলল,

“আমি কিছু করতে পারলাম না আরেকটা খুন হবে। আমি কেন পারলাম না!”

ফুপিয়ে উঠলো জয়নব। কুয়াশার যেন সব মাথার উপর যাচ্ছে। সে জয়নব কে সালাতে চাইলো। জয়নবের বাহু ধরে টেনে তুলে বলল,

“জান ডোন্ট বি স্যাড! এমন হতে পারে তুই ভুল দেখেছিস?”

জয়নব চেঁচিয়ে উঠলো,

“আমি নিজের চোখে দেখেছি। বিশ্বাস কর।”

“আচ্ছা আচ্ছা! তুই শান্ত হও। আমরা কোনো না কোনো পথ বের করবো উঠ এবার!”

———

“আই হেইট ইউ! যাষ্ট হেইট দ্যা গার্ল!”

অন্ধকারে মৃদুমন্দ আলোয় এক সুঠামো দেহী লোক বসে রয়েছে রোলিং চেয়ারে। হাতে তার পেপারওয়েট। বাহিরের দিকে তাকিয়ে বার বার ঘুরাচ্ছে আর একই কথা বলে যাচ্ছে সে।এবার সশব্দে আছড়ে মাড়লো মাটিতে পেপারওয়েটটি। ঘরের মাঝে বিকট শব্দ হযে উঠলো। কেঁপে উঠলো পাশে তাকিয়ে থাকা মুশফিক। কাচুমাচু হয়ে আছে। মুখ ভর্তি করে ফুটে আছে হাজারো প্রশ্ন,

“জয়নব মেয়েটিকে নিয়ে স্যার কেন এত ভাবছেন? এতই যখন অপছন্দ মেয়েটিকে সরিয়ে কেন দিচ্ছেন না এখনো?”

কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না কিছুই যদি বন্দুক তুলেই শাই করে চালিয়ে দেয়? শুকনো ঢুক গিললো সে। তখনি আবার ভেসে উঠলো ক্রোধান্বিত কণ্ঠ,

“আই হেইট ইউ। দু বোন একই রকম। কাঁঠালের আঠার মতো। একজনকে সরিয়েছি, তো আরেকজন হাজির! মেয়ে তুমি খুব বুদ্ধিসম্পন্ন,তেজী, সাহসী। তোমার সাহস ভাঙ্গতে আমার মজাই লাগবে!”

ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো সে। অন্ধকারে ভেসে আসা হাসির মালিকটি যেমন সুদর্শন তেমনি হিংস্র। ভেবেই ঘাম ছুটতে লাগলো মুশফিকের।

———

লাইব্রেরিতে বসে বাহিরে তাকিয়ে আছে জয়নব। জানালার বাধাই করা গ্রীল উপক্ষা করে ফেললো সে। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নীল শাড়ি পরিহিতা আকাশের দিকে। কি সুন্দর সাজ সেজেছে সে। খিল খিল করে হেসে যাচ্ছে কিশোরীদের মতো। জয়নব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আয়না ভাইকে নিয়ে তার ভাব চিন্তা নিত্যন্তই হ্যালোসিনেশন? কিন্তু না সে তো স্বচোখে দেখেছে। তাহলে? কেন কেউ বিশ্বাস করছে না তাকে! কেন? আর তারে ঘারের সেই দাগ? কামড়ের দাগ? যা দেখে সবাই তাকে কটু কথা শোনালো? উল্টো হেসে উড়িয়ে, তাকেই দোষারোপ করলো। কেউ কেউ মুখের উপরই বলে দিলো,

“গলার মাঝে লাভ বাইট নিয়ে চিরনি অভিযান করছো আয়ান ভাইকে নিযে? ব্যাপার কি? আয়ান ভাই আবার তোমার ফাইদা লুটে পালিয়ে টালিয়ে যায়নি তো? কে জানে? বোনের মতো তারো আবার শখ হয়ে প্লে গার্ল হওয়ার। ”

কান ঝাঝড়া হয়ে যাওয়ার মতো কথা বার্তা ভেসে আসতেই ফুপিয়ে উঠেছিলো জয়নব। কুয়াশা তখন বলে উঠে,

“আমি বিশ্বাস করি জান। তুই সত্যি বলছিস। এক কাজ করলে কেমন হয়? আয়ান ভাই যেহেতু হোস্টেলে নেই। বসায় গিয়েছে বলছে সবাই। তখন তার বাসায় টু মেরে আসি, দুধ কা দুধ ওর পানি কা পানি হয়ে যাবে!”

জয়নব তখন স্থীর নিশ্বাস ফেলে। কেউ তো তার সাথে আছে। যা ভাবা তাই করা। ক্লাস শেষে বেড়িয়ে পড়লো তারা। তিন ঘন্টা জার্নি করে পৌঁছে গেলো আয়ানের বাড়িতে। গেট খুলে বেড়িয়ে এলো একজন বৃদ্ধ। আয়ান ভাইয়ার কথা জিগ্যেস করতেই তিনি বলে উঠলেন,

“আয়ান তো কলেজে আম্মাজান, হে তো আরো দুইদিনবাদে আইবো।”

হতাশ হয়ে চাইলে এবার কুয়াশার দিকে। কুয়ার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। নিরাশ হয়ে তারা ফিরে এলো হলে। কিন্তু হলে পা রাখতেই যা দেখলো, চোখ ছানাবড়া….!

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৫

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৫।
চারিদিকে নিঃশব্দ, নিঝুম রাত। তলিয়ে আছে ঘুমের শহরের পুরো রাজ্য। ঘুম নেই জয়নবের আখিতে। তার কঁপালে সুক্ষ্ম ভাজ। এই ঘরটিতে চারটি সিট আছে। পাশের দুজন আজ বাড়িতে চলে গেছে। একজন গভীর ঘুমে মগ্ন। জয়নব এবার চোখ ফিরালো আশে-পাশে। কিছুক্ষন আগেই তার তন্দ্রা লেগে ছিলো। রাতে নিস্তব্ধতা তাদের ঘরটিতে যেন কিছু মানুষের হাটা চলার আভাস পেলো। মনে হচ্ছিলো খুব সপ্তপর্ণে কেউ ঘরটিতে প্রবেশ করেছে।জয়নবের সিক্স সেন্স ভালো। তার মনে হয়েছিলো এই ঘরটিতে সত্যি কারো বিরাজমান আছে। জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। এ যেন নতুন নয় আজ কদিন জাবত তার সাথে এমন হচ্ছে। যেখানেই যাচ্ছে? মনে হচ্ছে কেউ তাকে ফোলো করছে। কিন্তু কেন? কেন কথাটির উত্তর নেই । জয়নব ঘরের স্তিমিত আলোর মাঝে ঘরটি ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো। অথচ সে আলোটি এমনি যে টচ মেরেই খুঁজতে হবে আলোটি। জয়নব বুক ভরে শ্বাস টানলো। একদিনে অনেক তথ্য জোগাড় করেছে সে তার বোন সম্পর্কে। রুফাইদার ব্যাচের কিছু আপু রুফাইদা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই কথাটা এড়িয়ে গিয়েছে। তো কেউ বলেছে,

“মেয়েটি হেল্পফুল ছিলো। আমাদের সহায়তা করতো। হোস্টেলে কারো অসুখ পড়লেই তাকাই পাশে পাওয়া যেত।”

আবার কেউ কেউ নাক ছিটকে বলেছে,

“বখে যাওয়া মেয়ে। ছেলেদের সাথে নাকি খুব খোলামেলা সম্পর্ক ছিলো তার। বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ছিলো সে। রাতের আধারে একবার নাকি ছাদে ধরা পড়েছিলো হোস্টেল সুপারের কাছে। তা নিয়ে পুরো হোস্টেল যেন গুঞ্জন। ”

জয়নব যেন মাঝ দরদিয়তে পড়ে। বোনের সম্পর্কে এমন বিদঘুটে কথা হজম হয় না তার ক্রোদ নিয়ে ঠান্ডা মাথায় বলে,

“আমার বোন খুব ভালো। সি ইজ দা বেস্ট সিস্টার ইন দা ওয়ার্ল্ড! তোমাদের কথা বিশ্বাস করি না আমি!”

কিন্তু তবু-ও বয়ফ্রেন্ড ছিলো? এটি কেমন খটকা লাগলো যেন তার। কারণ তার বোন ছুটির দিন গুলো যখন তার পাশে থাকতো কখনোই প্রেমলাপ করেনি ফোনে বা বাবা-মা বিয়ের কথা তুললেও রুফাইদা লজ্জা মাখা মুখে বলতো,

“তোমরা যা ভালো বুঝো!”

জয়নব হতাশ হয়ে গেলো। না চাইতেও বয়ফ্রেন্ড উরপ বিজয় ভূঁইয়া নামক লোকটির ঠিকানা জোগাড় করে রুফাইদা। তার দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ায়। তখন যে এত বড় থাক্কা তার জন্য অপেক্ষা করছে? সে জানতোই না।
লোকটি দরজা খুলে খড়খড়ে গলায় বলল,

“কি চাই!”

অতি বিনয়ের সুরে যখন জিগ্যেস করে,

“আপনি কি বিজয়?”

“হে আমি বিজয়। কি কাজ?”

“আপনি রুফাইদাকে চিনেন?”

বিজয়ের কঁপলা চিন্তার ভাজ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে জিগ্যেস করে উল্টো,

“তুমি কে?”

চকিতে উত্তর দেয়,

“আমি ওর ছোট বোন?”

বিজয় ভূঁইয়া বললেন,

“তো আমার কাছে কি চাই?”

“আপুর সাথে আপনার রিলেশন ছিলো?”

বিজয় ভিতর দিক উঁকি দিয়ে বেড়িয়ে এলো বাহিরে। দরজাটা চাঁপিয়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,

“প্রাক্তন সে আমার। তার উপর মরে টরে গেছে সে। এখন কি চাই তোমাদের?”

জয়নব স্তম্বিত, হতবিহ্বল। আমতা আমতা করে বলল,

“আপুর সাথে আপনার কত দিনের সম্পর্ক ছিলো?”

“৬ মাস!”

কন্ঠস্বর এবার কেঁপে উঠলো যেন খানিটা,

“ব্রে..ক আপ কে করেছিলো?”

“কে আবার? আমি করেছি! করবোই বা না কেন? ওর বেড পারফরম্যান্স একদম বিচ্ছিরী ছিলো!”

কান গরম হয়ে গেলো জয়নব। চেঁচিয়ে উঠে গালি দিয়ে বলল,

“কুত্তা! তোরা সব মিথ্যা বলছিস! মেরে দিবো তোদের। ”

বলে গলা টিপে ধরলো বিজয়ের। বিজয় হঠাৎ হামলায় নিজেকে রক্ষে করতে পারলো না। এদিকে জয়নবের সাথে আসা কুয়াশা তাকা সামলে বলল,

“কি করছিস বইন ছাঁড়। পুলিশ কেস হয়ে গেলে আমাদের ডাক্তারীগিরি ছুটে যাবে। ছাড় এরে!”

পুরো বাঘীনির মতো গলা চিপে ধরেছে জয়নব। এই মুহূর্তে কুয়াশার কাছে মনে হচ্ছে জয়নব কোনো রণচন্ডী। কুয়াশা ঢোক গিললো। মেয়েটি বিজয়কে না ছাড়লে লোকটি পটল তুলবে যেন।কুয়াশা অনেক কষ্ট ছাঁড়িয়ে ফেললো। লোকটি ঘাবড়ে গেছে খুব।মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে বেচারা। জয়নব রাগের ঠেলায় তার গোপন অঙ্গ পিশে দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

” এবার তুই দেখাস বেড পারফরমান্স কুব ভালো করে জংলি কোথাকার!”

কুয়াশার হো হো করে হাসি পেলে চেঁপে গিয়ে টেনে নিয়ে বের হলো তারা। বিজয় মাটিতে পড়ে কাঁটা মুরগীর ধাপা ধাপি করছে। কুয়াশা সেদিকে এক পলক তাকিয়ে জয়নবের কাঁধ চাপরে বলল,

“সাব্বাস মেরে শেরনি। যে খেল দেখালি। লোকটি সত্যি আর শুতে তো দূর মূত্র বিয়োগ ও করতে পারবে না।”

হেসে উঠলো দুজনেই। কিন্তু মনের মাঝে আরো সন্দেহ বীজ বপন করতে লাগলো।

জয়নব এবার অন্ধকার ঘরটি থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় এলো। চারতলা বিল্ডিং এর শেষ দিকটায় তার ঘর। বারান্দায় মৃদুমন্দ আলো জলচ্ছে। বারান্দায় একটু কার্নিশ ঘেসে দাঁড়িয়ে দূরেন আকাশ আর লাল-নীল গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে তাদের হাসপাতালটাও সুন্দর দেখাচ্ছে। এত রাতে মানুষ জনের আনাগোনা চলছে। তার পাশেই হচ্ছে বয়েজ হোস্টেল। আর ঠিক তার পাশেই ঘেষে চলে গেছে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে ছোট থেকেই পছন্দ জয়নবের। হাসপাতাল টা খানিকা পাহাড়ি এলাকায় পড়াতে সেই সুযোগ পেলো সে। ঠিক সেই মুহূর্তে জয়নবের চোখে পড়লো আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা দুটি লোক দেয়াল টপকে তাদের বিল্ডিং এ প্রবেশ করল। জয়নবের পিলারের আড়ালে লুকিয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ। রাতের আধারে এ লোক গুলো কি করতে চায়? দেখতে লাগলো সে।

লোক দুটো দুজনের মাঝে কিছু কথা বার্তা বলে টুপ করে চলে গেলো বয়েজ হোস্টেলে। কিছুক্ষণের মাঝেই একটি বস্তা টানতে টানতে বের হলো একজন। এদিক সেদিক তাকিয়ে বস্তা নিয়ে বের হতে লাগলো। আলোর কাছে আসতেই জয়নব দেখতে পেলো একটি হাত। আর দাঁড়ালো না সে। এক ছুঁটে নেমে এলো চারতলা থেকে। মাঠের কাছে আসতেই চেঁচিয়ে বলল,

“তোমরা কারা? কাকে নিয়ে যাচ্ছ? কি করেছো ওর সাথে?”

লোক দুটি ঘাবড়ে গিয়ে দুজনের দিকে তাকালো। জয়নবকে দেখেই বস্তা কাঁদে নিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। জয়নব-ও পিছু ছুটছে। জয়নব কিছুতেই বুঝতে পারলো না তাদের গেট ম্যান কেন আসচ্ছে না তার চিৎকার শুনার পরেও? হয়তো তারাও মিলে আছে এদের সাথে? সেদিকে আর ভাবলো না জয়নব। পাশেই একটি গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখে ছুঁড়ে মারলো তাদের গায়ে লোক গুলো হুড়মুড় করে পড়ে গেলো নিচে। পড়ে গেলো বস্তাটাও আর বেড়িয়ে এলো মাথা টা। জয়নব স্পষ্ট দেখলো সিনিয়র আয়ান ভাই। চোখ দুটি বড় বড় করে উচ্চারণ ও করলো সে। কিন্তু ততক্ষণে আর আওয়াজ বের করতে পারলো না মুখ দিয়ে। কেউ অতি আদরের সহিত কোমরে এক হাত চেঁপে ধরেছে। কাঁধের মাঝে তার উষ্ণ আর্দ্র তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে। অন্য সাইডে গলার মাঝে সূক্ষ্মভাবে ইনজেকশন পুশ করে দিল। জয়নব সেখানেই স্তব্ধ। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলো লোক দুটি আয়নকে তুলে নিয়ে যেতে লাগলো। জয়নব হাত দিয়ে ইশরা করতে চাইলো, মুখ দিয়ে কথা বলতে চাইলো। কিছুই পারলো। শুধু বুঝতে পারলো, পরম মমতায় কেও কোলে তুলে নিলো তাকে। আলো আধারে মাঝে এক জোড়া কালো কুচকুচে নয়ন জোড়া মালিক। তারপর..তারপর আর কিছু মনে নেই জয়নবের।

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় পর্ব-০৪

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#লিখনীতে_সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
৪।
নির্জন করিডোর ধরে পা টিপে টিপে ভিরু পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো জয়নব। এই হাসপাতালে করিডোর দিনের বেলা হাজার বার হেটে ক্লাস করতে যায়। কিন্তু এখন অবস্থা ভিন্ন রাতের আধারে লুকিয়ে, চুরিয়ে যাচ্ছে মর্গের দিকে। পর পর আর দুটি লাশ পাওয়ার খবর শুনে মনের সন্দেহ দূর করতে চায় সে। ভয়ে থরথর করে কেঁপে যাচ্ছে জয়নব। বিন্দু বিন্দু ঘামে বেয়ে পরছে কঁপাল চুয়ে গলা ঘারে।

“উম..উম..উম!”

নিস্তব্ধ অন্ধকার করিডর থেকে মেয়েলী গোঙ্গানি আর ধস্তাধস্তির আওয়াজ কানে আসতেই পিলে চমকে উঠে জয়নবের। শ্বাসরূদ্ধ কর অবস্থা যেন তার। জয়নব ভয় টুকু টুপ করে গিলে নিলো। মর্গের ভিতর থেকেই আসচ্ছে এই শব্দ। জয়নব দ্রুত পা চালিয়ে দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে থম মেরে গেলো। একটু মেয়েকে হাত পা বেঁধে মাটিতে ফেলে রেখেছে। মেয়েটির উপর আরেকটি লোক ঝুঁকে আছে। কি যেন করছে। ধর্ষন নয় তো? ভেবেই গা কেঁপে উঠলো জয়নবের। এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনেই পড়ে থাকা বালতি দিয়ে বাড়ি দিতে লাগলো জয়নব । লোকটি কুকিয়ে উঠলো৷ এক ধাক্কা দূরে সরিয়ে দিলো জয়নব। মেয়েটির কাছে আসতেই চক্ষু চড়কগাছ। সিনিয়র যুথী আপু । যে কি না খাবার টেবিলে তার সাথে রুড ব্যবহার করে ছিলো। জয়নব এক পলক তাকিয়ে হাত পা খুলে দিতে লাগলো। খুলা শেষে কোনো কথা না শুনেই আবার মারতে লাগলো নিচে পড়ে থাকা লোকটিকে। এদিকে যুথীও চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে,

” আরে আরে করছে কি তাকে মারছো কেন? ছাড়ো ছাড়ো?”

জয়নবের কানে কোনো কথাই ঢুকলো। চোখের সামনে বোনের মুখটি ভেসে উঠতেই মাথায় চরচর করে রাগ বেরে গেলো। থাম থুম মারা শুরু। লোকটি যেন পেরে উঠছেই না তার সাথে। ধাক্কা দিতে চেষ্টা করেই যাচ্ছে। পিছন থেকে যুথিও টেনে উঠাতে পারছে না। বার বার বলছে,

” জয়নব কি করছো? ছাড়ো উনাকে, ছাড়ো। এই মেয়ে কি করছো।”

মর্গে তখন-ও আধো আলো। লোকটি মাস্ক পড়া। চেহারা এখনো আবছায়া। জয়নব লোকটির উপর চড়ে বসেছে। এলোপাতাড়ি থাপড় মেরেই যাচ্ছে।লোকটি এবার জয়নবকে উল্টে ফেললো। তার উপর চড়ে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলো। তখন পাশের বালতি দিয়ে দাপাস করে মাথায় এক বাড়ি বসিয়ে দিতে লোকটি “আহ্” বলে কুকিয়ে উঠলো। আর্তনাদ শোনা গেলো যুথির মুখে থেকে-ও,

“আদর স্যার!”

আদর নামটা কানে যেতেই হীম হয়ে গেল শরীর। ভয়ে ভয়ে তার উপর ঝুকেঁ থাকা লোকটি দিকে চাইলো মুখে এখনো মাস্ক। রক্তিম ফ্যাকাসে চোখ দুটি ভাঙ্গা চশমার আড়ালে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। চোখ দিয়ে গিলে ফেলবো টাইপ। মাথা এক হাত দিয়ে চেঁপে ধরে উঠে বসলো আদর। রক্ত বের হচ্ছে কঁপাল ফেঁটে। যুথী কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে। জয়নব অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। যুথি ব্যস্ত হয়ে পড়লো,

“স্যার আপনি ঠিক আছেন? আম সরি, আমাকে বাঁচতে এসেই আপনি ইনজুরি হয়ে গেলেন।”

জয়নবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। ডাঃ আদরকে এখনো সে চোখে দেখেনি। আর এই অবস্থা যে কেউ ভাববে যুথীকে কেউ রেপ করার চেষ্টা করেছে। জয়নব উঠে বসলো। জড়সড় ভাবে বলল,

“আমি ভেবেছিলাম আপু কেউ তোমাকে রেপ করতে চাইছে! তাই…!”

যুথী কিড়মিড় করে উঠলো,

“তাই না বুঝে এসেই স্যারের উপর হামলে পড়েছো। দেখো রক্ত পড়ছে মাথা ফেটে। সরি স্যার প্লিজ কিচু মনে করবেন না। আসুন আমি ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছি!”

আদর রক্তিমা ফ্যাকাসে চোখ দুটি এক পলক দেখে বেড়িয়ে গেলো। টু শব্দটি করলো। এ দিকে জয়নব অবাক। যার জন্য করলো চুরি সেই বলে চোর? বাহ্।

—————

সকালের মিষ্টি রোদ খেলা করছে হাসপাতালের রুম গুলোর দিকে। চারিদিকে ছুটছে মানুষের দল বল। কেউ দৌড়চ্ছে ঔষধের জন্য? কেউ ডাক্তার দেখাবার জন্য, কেউ বা ভর্তি হতে, আবার কেউ বা স্বজন প্রীতির হারাবার টানে। জয়নব ছোট শ্বাস ছাড়লো হাসপাতালের রুটিন মাফিক কাজের সাথে এসব ও যেন জড়িয়ে গেছে নিত্যাদিনের জীবনে। জীবনটা বড্ড বিচিত্র। ছোট বেলায় বাবা-মার সাথে হাসপাতালে এলে মনে হতো এদের কত মজা। দিন রাত ডাক্তারের পোষাক করে এদিক ওদিক ছোটা, মানুষকে নিয়ে এদের খেলা খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো। বস থেকে বেশি রুফাইদার। তাই তো সেদিন চট করে বলে ফেলেছিল,

“বাবা, আমি বড় হয় ডাক্তার হবো! ”

সাইফ তখন খুশিতে আত্মহারা। সে চাইতো তার মেয়ে ডাক্তার হোক। স্বপ্ন পূরণের কয়কে কদম আগেই মেয়েটি হারিয়ে গেলো। ভেঙ্গে চুরমার হলো তার স্বপ্ন, তার পরিবার। ছোট শ্বাস সুপ্তপূর্নে টুপ করে গিলে নিয়ে পা বাড়ালো ডাঃ আদরের কেবিনে। বুকের মাঝে চিন চিন ব্যথা করছে জয়নবের। লোকটি কেন তাকে ডাকে পাঠালো? মাথায় খেলছে না। কি চায় সে? কাল রাতের জন্য তাকে কলেজ থেকে বের করে দিবে না তো? তেমন হলে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে। তাহলে? সত্যি এমন হলে কি করবে জয়নব? ডাঃ আদরের হাত জোর করবে? দরকার পড়লে পা পড়ে যাবে। বন্ধ ঘরেই বা কে দেখতে আসচ্ছে তাকে? জয়নব সাহস সঞ্চয় করছে ভুড়ি ভুড়ি। কিন্তু আর বেশিক্ষণ রইলো না। কেবিনে ডুকতেই বেলুনের মতো চুপসে গেলো যেন।
নাতিশীতোষ্ণ ঘরটির কোনে ভনভন করে এসির শব্দ হচ্ছে। এত ঠান্ডার মাঝেও মাথার পাশটায় ঘামের বিন্দু। জয়নব দাঁড়িয়েই রইলো মাথা বুকের সাথে লাগিয়ে।

হালকা লেমন কালারের একটি ফুল হাতা শার্ট। মুখে সবুজ মাস্কের উপর ওয়ানটাইম মাস্ক। মাথা ঝাকড়া চুল।মাথার এক পাশে ব্যান্ডেজ করা। সুদর্শন, দীর্ঘাকায় এক যুবক জয়নবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যুবকটির চোখ রীতিমতো খেলা করছে কিশরীর উপর। কিশোরী গায়ের রং চাপা। জিড়ো ফিগার, ঘন ভ্রু যুগেলের চোখ গুলো পিট পিক করে। করমচার মতো ঠোঁট গুলো কাঁপছে। যুবকটি যেন নিজের আনমনেই বলে ফেললো,

“মা শা আল্লাহ! ”

কথাটি কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই চোখ দুটি তুলে তাকায় জয়নব,

“এক্সকিউজ মি! স্যার কিছু বললেন? ”

ডাঃ আদর কেশে উঠলেন। চেয়ারটা পিছনের দিক ঠেলে আরম করে হেলে বসলেন। হাতের কলম ঘুরাতে ঘুরাকে কথা ঘুরিয়ে বললেন,

“তো আপনি মিস, রুবাইদা জয়নব?”

জয়নব এবার লোকটিকে দেখলো। ফ্যাকাসে চোখের শ্বেতাঙ্গ যুবকটি তার দিকেই শান্ত অথচ যেন ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জয়নব তাকিয়ে রইলো তার চোখের দিকে। মাথা নাড়িয়ে বলল,

“জি স্যার! ”

“তো রাতে আধারে মর্গের সামনে কি করতে গেছিলেন??যতটুকু জানি আপনার হোস্টেল তো তার উল্টো দিকে?”

চমকে তাকালো জয়নব। যেন চোর ধরা পড়ে গেছে টাইপ। শুকনো ঢুক গিলে তোতলাতে তোতলাতে বলল,

” আ..মি, আ..মি ফোনে কথা বলতে বলতে ওখান কিভাবে যেন চলে গেছিলাম!”

“এত রাতে ফোন কথা বলছিলেন? কার সাথে?”

প্রশ্নটি এমন ভাবে ছুঁড়ে দিলো ডাঃ আদর যেন স্পষ্ট অধিকারবোধ। জয়নব এবার সরাসরি তাকালো ডাঃ আদরের ফ্যাকাসে চোখ দুটোর দিক।শান্ত, স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাঃ আদর।

“ইটস পার্সোনাল স্যার!”

চোয়াল কিছুটা শক্ত হয়ে এলো। গভীর শ্বাস টেনে উঠে এসে দাঁড়ালো জয়নবের মুখোমুখি। জয়নব কিছুটা ঘাবড়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। ডাঃ আদর মিষ্টি করে হাসলো। জয়নবের কানের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বলল,

“বয়ফ্রেন্ড জনিত রোগে ভুগছেন বুঝতে পারছি!”

স্তম্বিত হলো জয়নব। রাতের মতোই হীম হয়ে গেলো শরীর। শির শির করতে লাগলো পায়ের পাতা। এ কেমন অনুভূতি? ডাঃ আদর মিটিমিটি হেসে দরজা খুলে বের হতে নিলো। ঠিক তখনি ভেসে আসা জয়নবের রিনঝিনে কন্ঠে থেমে গেলো। ভ্রু কুচকে সন্দেহ দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো জয়নব,

“এতে রাতে আপনি কি করছিলেন মর্গের এখানে..স্যার??”

চলবে,