জানালার শুভ্র রঙের পর্দাটা ভেদ করে শেষ বিকেলের রোদ গলে ভিতরে সোজা বিছানার উপরে পড়ছে। কি তেজ সেই রোদের। দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল ইভান। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। তাই হালকা তন্দ্রা ভাব এসেছিলো। শুয়ে পড়েছিল এই ভেবে যে একটু ঘুমিয়ে নিবে। কিন্তু সে আর হল না। রোদটা উত্তাপ ছড়িয়ে ঘুমটা নষ্ট করে দিলো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। একটু চা হলে ভালো হত। বিরক্তিকর একটা শ্বাস ছেড়ে উঠে বসলো। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থেকে উঠে জানালা বন্ধ করে দিলো। দরজা খুলে সামনে এগোতেই চেঁচামেচিতে সোফার দিকে তাকাল। সবাই মিলে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। কি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। ইভানের মাও ছোটদের সাথে যোগ দিয়েছে। তিনিও বেশ মজা নিয়ে হাসছেন। ইভান সোজা বেসিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিতে লাগল। ঈশা কি একটা কথা নিয়ে বেশ হাসছিল। সামনে বেসিনের আয়নায় চোখ পড়তেই মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে গেলো। চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে ইভানের। সামনের চুলগুলো ভিজে কপালে লেপটে আছে। ঈশা ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান মাথা তুলে আয়নায় তাকাতেই ঈশার দিকে চোখ পড়ল। আয়নায় চার চোখ এক হলেও ঈশা চোখ নামিয়ে নিলনা। তাকিয়েই থাকল। ইভান মুচকি হেসে এগিয়ে এসে মায়ের আচল দিয়ে মুখ ভালো করে মুছে নিলো। ইভান কে দেখে তার মা বলল
–কি রে তুই না ঘুমিয়েছিলি?
–ঘুম ভেঙ্গে গেছে। চা খাবো।
ইভান কথা শেষ করতেই তার মা উঠে দাড়িয়ে যায়। রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ইভান নিজের এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে ঈশার পাশে বসে পড়ে। ইভান কে ঈশার পাশে বসতে দেখে সবাই থেমে যায়। চারিদিকে হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা বিরাজ করায় সে ভ্রু কুচকে সামনে তাকায়। সবার দিকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে
–এভাবে দেখার কারণটা জানতে পারি?
ইরিনা দাত কেলিয়ে বলে
–ইভান ভাইয়া এটা তো তোমার ছাদে যাওয়ার সময় তাই না?
ইভান ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলে
–আমি কি আমার রুটিন মেইন্টেন করার দায়িত্বটা তোকে দিয়েছি? এতো হিসেব কিভাবে রাখিস?
ঈশান দাত কেলিয়ে বলল
–ওর তো হিসাব রেখে কাজ নাই। কিন্তু আশে পাশের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে হিসাব রাখতে হয়না। এমনি এমনি সব হিসাবের মধ্যে চলে আসে।
ইভান ভ্রু কুচকে তাকাতেই আবার বলল
–এলাকার মেয়েরা তোমার সাথে নিজের রুটিন সেট করে নেয়। তুমি কখন ছাদে উঠ। কখন ঘুমাও। কখন খাও। সব তাদের মুখস্ত।
ইভান সোফায় গা এলিয়ে দিলো। হাতটা ঈশার পিছনে প্রশস্ত করে আরেক হাতে ফোনটা নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–সো হোয়াট? সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আর কারো ব্যাক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার তো আর আমার নেই।
ঈশান আবারো বলল
–তোমার কারনে এলাকার ছেলেরাও কষ্টের মধ্যে আছে। তারা মাঝে মাঝেই আমার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।
ইভান ঠোটের কোনে ক্ষিন হাসি রেখে বলল
–ছেলে হয়ে যদি তারা কোন মেয়ে পটাতে না পারে তাহলে সেটার দায় কি আমার? ছেলে নামের কলঙ্ক সব কয়টা।
সবাই হেসে ফেলল। কিন্তু ঈশা চুপচাপ। কোন কথা বলছে না। ইলু হাসি থামিয়ে বলল
–আমার এক বন্ধুর গার্ল ফ্রেন্ড নাকি আমাদের এলাকার মেয়ে। তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। আবার সেটা নাকি বয় ফ্রেন্ডের সাথে আলোচনা করে।
কথা শেষ করে সবাই আবার হাসতে শুরু করলো। কিন্তু কলিং বেলের আওয়াজে হাসি থেমে গেলো। ইফতি বলল
–আমি দেখছি।
ইফতির কথার উত্তরে ছোট করে ‘ওহ’ বলতেই পাশে চোখ পড়ল। ইভান কে দেখে এক গাল হেসে বলল
–ইভান ভাইয়া কেমন আছেন?
ইভান এতক্ষন ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিজের নামটা কানে আসতেই চোখ তুলে তাকাল। একটু হেসে বলল
–ভালো আছি আপু। তুমি কেমন আছ?
ঈশা আড় চোখে একবার তাকাল। হঠাৎ করে মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো তার। নম্রতা বেশ কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থেকে রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভানের মায়ের সাথে কথা বলে আবার বেরিয়ে এলো। ইভানের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল
–আমি এখন আসি। আবার পরে আসব।
বলেই বের হয়ে চলে গেলো। ঈশা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান কারণটা বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। এর মাঝেই ইলু বলল
–যে ভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল এখনি গিলে ফেলবে।
সবাই তার কথা শুনে হেসে ফেলল। ঈশান বলল
–বেশী সুন্দর হওয়ার অপকারিতা কি জানো ইভান ভাইয়া? বউ তোমাকে অনাহারে রেখে চোখ দিয়ে নিজে গিলবে।
সারা ঘরময় হাসির শব্দ ঝমঝম করে উঠল। ইভান শান্ত ভাবে বলল
–অসুন্দর হওয়ারও অপকারিতা আছে। বউ তোকে না দেখে সুন্দর ছেলে দেখতে দেখতে বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
কথাটা কানে আসা মাত্রই ঈশার মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল। স্থির দৃষ্টি অগোছালো হয়ে গেল। পাশ ফিরে ইভানের দিকে তাকাতেই ঠোটে সেই জ্বালাময়ী হাসি দেখে রাগটাও চাড়া দিয়ে উঠল। সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। হাসি থামিয়ে ইলু বলল
–বারান্দায় আবার কোন বলদ ঘুমায়।
কথাটা কানে আসতেই ঈশা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। ইলু কথাটা বলেই আবার হাসতে শুরু করে দিলো। ইভান ঠোট টিপে হেসে চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাতেই সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ঠাট্টার সুরে বলল
–কি রে ঈশা তুই এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? কোন ভাবে তুইও আবার বারান্দায় ঘুমাস না তো?
ঈশা এবার প্রচণ্ড রেগে গেলো। উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো। কিছুক্ষন পরেই চা নিয়ে বের হয়ে আসলো। সবার হাতে হাতে কাপ দিলেও ইভানের হাতে দিলো না। সামনের টেবিলে কাপটা রেখে দিলো। ইভান কাপটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালো। ইভানের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলল
–তুই কোথায় যাচ্ছিস? চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তো।
ইভান তার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
–চা খাব না মা।
ঈশা পিছন ফিরে তাকাল। অভিমানী কণ্ঠের কথা শুনে অভিমানটা বুঝতে তার কষ্ট হল না। ইভানের মা অসহায়ের মতো বলল
–কি হল হঠাৎ করে? নিজেই তো খেতে চাইল।
ইভানের মা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। ঈশা দরজায় নক না করেই ঘরে ঢুকে গেলো। পুরো ঘর অন্ধকার। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় হালকা আলো আসছে ঘরে। সেটা দিয়েই আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। ইভান ঘরে কোথাও নেই। ঈশা আন্দাজ করে বারান্দায় গেলো। দরজা থেকে দেখল ইভান এক কোণায় বসে আছে। ঈশা চায়ের কাপটা পাশে রেখে নিশব্দে বসে পড়ল তার পাশে। ইভান ঘুরে তাকাল না। সামনে তাকিয়েই বলল
–আমার এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি বাইরে গিয়ে খাবো।
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–না খেলে বড় মা কষ্ট পাবে।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–বড় মা কষ্ট পাবে?
ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান সামনে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–আমার আম্মুকে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারি। সেটা তোর না ভাবলেও চলবে।
ঈশা আর কোন কথা বলল না। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ইভান রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–তোর কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই কেমন জানি একটা ভাললাগা ছুয়ে গেলো। তার মন খারাপের কারণটা অজানা থাকলেও ইভান যে মন খারাপটা বুঝতে পেরেছে সেটাতেই সে বেশ অবাক হচ্ছে। মুচকি হেসে নিজের অজান্তেই ইভানের ঘাড়ে মাথা রাখল। ইভান কিছু বলল না। ঈশা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলো
–ইভান ভাইয়া তুমি সেদিন আমার ঘরে গিয়েছিলে তাই না?
কিছুক্ষন আগের মান অভিমানের দেয়ালটা হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো। এখন বেশ ভালো লাগছে। ইভান খুব সাভাবিক ভাবেই বলল
–কেন বারবার একি কথা জানতে চাইছিস?
ঈশা অভিমানী কণ্ঠে বলল
–কেন? বললে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
ইভান মুচকি হেসে সামনে তাকিয়েই বলল
–লাভ ক্ষতির হিসাবটা বড়ই কঠিন ঈশা। এই হিসাবটা সবাই সঠিক ভাবে করতে পারেনা। আমার জীবনের এই প্রাপ্তিটা সবটাই আমার লাভ। কিন্তু আমি কোন ভুল করে সেটা ক্ষতিতে পরিণত করতে চাইনা।
একটু থেমে আবার বলল
–সব বিষয়ে এতো কৌতূহল থাকা ভালো না ম্যাডাম। এরকম থাকলে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবেন।
ঈশা মাথা তুলে বলল
–বিপদ কেন ডেকে আনবো? আমি তো ভুল কিছু বলিনি।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে পুরো মুখটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–আপনার কৌতূহল মেটাতে গিয়ে যদি আমি নিজেই কৌতূহলী হয়ে যাই। তখন কি হবে? আমার কৌতূহল কে মেটাবে?
ঈশা নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার দিকে দৃষ্টি স্থির রাখল কিছুক্ষন। ঈশার মনের অনুভূতিটা যে তার মতই গভির সেটা সে বুঝতে পারে। কিন্তু এখনও হয়ত সেভাবে অনুভুতি প্রকাশের সময়টা আসেনি। কিন্তু তার প্রেয়সী তো অভিমানী কিশোরী। সময় সুযোগ না বুঝেই হুট করে অভিমান করে বসে। বন্ধ থাকা আবেগের দরজায় কড়া নেড়ে সেটা খুলতে চায় বারবার।কিন্তু সেটা যে এখন কোনমতেই সম্ভব না। ঈশা উঠে দাঁড়ালো। নত দৃষ্টিতে বলল
–আমি বাইরে যাচ্ছি। সবাই বসে আছে।
ইভান নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল। মোহনীয় কণ্ঠে বলল
–সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অনুভুতি ততটাই প্রকাশ করা শ্রেয় যতটা পর্যন্ত নিজেকে সংযত রাখা সম্ভব। নিজেকে সংযত রাখতে চাওয়া যদি অভিমানের কারন হয় তাহলে সেটাই মেনে নিলাম।
ঠোটের কোনে তৃপ্তির হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল ঈশা। ইভান সামনেই তাকিয়ে আছে। ঈশার মনের সব কথা এভাবে না বলতেই বুঝে যাওয়াটা কি খুব সহজ কোন বিষয়? মোটেই না। এর পরেও ঈশার আর কিছুই জানার নাই। যেখানে নিরব অনুভুতির আদান প্রদান হয় সেখানে কি মুখের কথা আদৌ কোন মুখ্য ভুমিকা পালন করে?
টানা দুইদিন বর্ষণের পরে আজ আকাশ একদম পরিষ্কার। রোদ উঠেছে। ১ ঘণ্টা হল ইলেক্ট্রিসিটি নেই। গরমটাও বেশ অসহনীয়। গরমে গা চিটচিট করছে। ঈশা অস্থির হয়ে শেষ পর্যন্ত পাতলা একটা খাতা দিয়ে অনবরত বাতাস করেই চলেছে। জামাটা ঘেমে গায়ের সাথে লেপটে গেছে। বেশ অসস্তিতে পড়ে গেছে ঈশা। কি করবে সেটা ভাবতে গিয়েই মাথায় আসলো গোসল করে ফেললে অস্বস্তিটা হয়ত একটু কমবে। জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয়। ট্যাঙ্কি খালি হয়ে গেছে। যা পানি ছিল সবটা নানান কাজে ব্যবহার করে শেষ। এখন মহা যন্ত্রণা। ঈশা চেঁচাতে চেঁচাতে বাইরে গেলো। তার মা সোফায় বসে টিভি দেখছিল। ঘাড় বাকিয়ে একবার ঈশার দিকে তাকাল। এলোমেলো চুল। বারবার ঘাম মুছে ফেলায় মুখ লাল হয়ে গেছে। ঈশার মা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এভাবে চেচাচ্ছিস কেন?
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–আমি গোসল করব। পানি নেই।
–তো আমি কি করব? অপেক্ষা করতে হবে। ইলেক্ট্রিসিটি না আসা পর্যন্ত।
ঈশা বেশ বিরক্ত হল। ধপধপ শব্দে রুমের ভিতরে চলে গেলো। কিন্তু ভিতরে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। তাই সেই পাতলা খাতাটা নিয়ে বাতাস করতে করতে বারান্দায় গিয়ে বসলো। হালকা বাতাস আসছে। ঘরের থেকে এখানে একটু হলেও শান্তি আছে। মাথাটা সামনের দিকে বাড়াতেই দেখল তার একদম সামনের দোতলা ছাদ থেকে একটা ছেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই ছেলেটি অমায়িক হেসে উঠল। ঈশা বিরক্ত হয়ে সাথে সাথেই নিচে শুয়ে পড়ল। বারান্দার মেঝেতে শুয়ে থাকার ফলে তাকে আর বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। সেখানে শুয়েই বিড়বিড় করে বলল
–আজকাল কার ছেলেরাও হয়। সামনে একটা মেয়ে দেখলেই হল। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যেন মেয়ে জিবনেও দেখেনি। এদের জন্য নিজের বাড়িতেও ঘোরাফেরা করার আগে ১০ বার ভাবতে হয়। অসহ্য!
উপরের দিকে তাকিয়েই অনবরত হাত নাড়িয়ে বাতাস করছে। ঘামে ভেজা শরীরে মেঝের ঠাণ্ডা ভাবটা লাগতেই শরির ঝিমিয়ে আসলো। চোখের পাতা ভারি হয়ে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো ঈশা বুঝতেই পারল না। ইভান বারান্দার দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। সামনে গ্রিলে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আশে পাশে তাকাল। পাশের বারান্দায় একবার তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। ঈশা এরকম বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে কেন? তারপর মনে হল অনেক্ষন যাবত ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই হয়ত গরমে এখানে এসে বসে ছিল। একটা শ্বাস ছেড়ে ভিতরে চলে গেলো।
ঈশা ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছে বুঝতে পারল না। বাইরে থেকে বেশ আওয়াজ কানে আসায় ঘুমটা হালকা হয়ে গেলো। উঠে বসে এদিক সেদিক তাকাল। এখন কেউ নেই। ছেলেটা তাকে দেখতে না পেয়ে চলে গেছে মনে হয়। ঘুমু ঘুমু চোখে এলোমেলো পা ফেলে বাইরে বের হয়ে দেখল তার মা আর বড় চাচি দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছে। ঈশা হাই তুলে ঘুম জড়ান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–কোথাও গিয়েছিলে তোমরা?
ইভানের মা বলল
–আমরা আচার শুকাতে দিতে গিয়েছিলাম ছাদে। তুই কি করছিলি?
ঈশা অসহায় সরে বলল
–পানি নেই বড় মা। গোসল করতে পারছি না।
ঈশা কিছু বলতে চেয়েও পারল না। তাকে কোন কথা বলতে না দিয়েই ইভানের মা বলল
–কাপড় নিয়ে আমার সাথে চল।
ঈশা সম্মতি দিয়ে ঘরে চলে গেলো কাপড় নিতে। কাপড় হাতে নিয়েই ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। সামনের এলোমেলো চুলগুলো একটু ঠিক করে ওড়নাটা মাথায় টেনে দিলো। তখনই চোখ পড়ল ডান হাতে। বিস্ময় নিয়ে সেদিকে তাকাল। হাতের চুরিটা কিছুদিন আগে মার্কেটে দেখে এসেছিল সে। বেশ ভাল লেগেছিল তার। কিন্তু ইভানের তাড়াহুড়োতে কেনা হয়নি সেদিন। তাই একটু মন খারাপ হয়েছিল। পরে আবার ভুলেই গিয়েছিলো। কিন্তু সেই চুরি আবার তার হাতে আসলো কিভাবে। চুরিটা খুলে হাতে নিলো। অদ্ভুত ব্যাপার তো। সকালেও এটা ছিল না। তার মানে সে যখন বারান্দায় ঘুমাচ্ছিল কেউ এটা পরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কে? আর কেনই বা তার হাতে না দিয়ে এভাবে চুপি চুপি পরিয়ে দিলো? কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসল ঈশা। সব ঠিক করে কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেলো।
————–
অনেকটা সময় নিয়ে ঈশা গোসল করে বের হয়ে দেখে ঘরে ফ্যান চলছে। বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে চুল গুলো মুছে বিছানায় বসলো। তখনের ঘুমটা পুরন না হওয়ায় মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চোখ বন্ধ করে মাথাটা একটু ঠেকিয়ে আরাম করে বসলো সে।
–তুই আমার ঘরে?
গম্ভির আওয়াজে চোখ খুলে ফেলল। ইভান কে সামনে দেখে মোটেই অবাক হল না। কারন সে ইভানের ঘরে বসে আছে। সে জখন এসেছে তখন ইভান বাসায় ছিল না। তাই তার ওয়াশ রুমে ঢুকেছিল। ইভান বেশ কিছুক্ষন ভ্রু কুচকে দাড়িয়ে থেকে আবার বলল
–কি করছিস এখানে?
ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
–বাসায় পানি ছিলনা তাই এসেছিলাম গোসল করতে।
ইভান আর কিছু বলল না। বিছানার উপরে পা ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল। ফোনে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। ঈশা আবারো মাথা ঠেকিয়ে দিলো। কিন্তু চোখ বন্ধ করলো না। এবার দৃষ্টি স্থির করলো ইভানের উপরে। দুজনেই চুপচাপ। অনেকটা সময় পর ইভান ফোনের দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি কতটা সুন্দর সেটা জানি তো। তাই বলে এভাবে দেখার কিছু নেই।
কথা শেষ করে ফোনটা বুকের উপরে রেখে ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। একটু ঘুরে বসলো। ইভান এবার মনোযোগ দিয়েই ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা বুঝতে পেরেই ঈশার আরও বেশী অসস্তি হচ্ছে। ওভাবে শুয়েই বলল
–চুল ঠিক মতো মুছিস নি কেন? ঠাণ্ডা লাগবে না?
ঈশা উলটা দিকে ঘুরেই মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–লাগুক।
ইভান কঠিন সরে বলল
–কিছু বললি?
ইভান যে তার কথা শুনতে পেয়েছে সেটা গলার সর শুনেই ঈশা বুঝতে পারছে। তাই একটু ভয় পেয়ে বলল
–কিছু না।
বলেই উঠে গেলো। ঈশা দরজা পর্যন্ত যেয়েও আবার থেমে গেলো। ইভান ততক্ষনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ঈশা দরজার সাথে হেলানি দিয়ে হাত গুজে গম্ভির সরে বলল
–ইভান ভাইয়া।
ইভান চোখ খুলে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল
–কিছু বলবি?
ঈশা মুচকি হেসে বলল
–তুমি আমার ঘরে গিয়েছিলে?
ইভান চোখ খুলে ফেলল। কঠিন দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলল
–তুই কি সেটাই এক্সপেক্ট করিস?
ইভানের এমন প্রশ্নে ঈশার মেজাজ বিগড়ে গেলো। উত্তর তো দিলই না উলটা এমন একটা প্রশ্ন করে বসলো ঈশা এখন কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। ঈশাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে ইভান ধমক দিয়ে বলল
–কিছু বলতে চাইলে বল। নাহলে এখান থেকে চলে যা। মেজাজটা এমনিতেই খারাপ আছে। আরও খারাপ হয়ে গেলে কিন্তু তোর কপালে দুঃখ আছে।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–মেজাজ কেন খারাপ?
ইভান এবার এমন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশা খুব ভালভাবেই বুঝে গেলো যে মেজাজ খারাপের কারন সে। কিন্তু সে কি এমন করলো যে ইভান এরকম রেগে গেলো। এরকম রেগে জাওয়ার তো কোন কারন নেই। তার ওয়াশ রুমে গোসল করার জন্য রাগ নাকি চুল না মুছার জন্য রাগ। আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই ইভান উঠে বসে বলল
–আমার মেজাজ খারাপের কারনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় তুই জানতে চাস। তাই কারণটা নিয়ে এতো গবেষণা না করে যা জানতে চাস সেটা জিজ্ঞেস করেই চলে যা।
ঈশা একটা শুকন ঢোক গিলে বলল
–তুমি কি আমার ঘরে এসেছিলে?
জিজ্ঞেস করতেই ইভান আবারো কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। তার দৃষ্টির মানে এমন যেন একি কথা আর একবার জিজ্ঞেস করলেই কথা বলাই বন্ধ করে দিবে। ঈশা নরম সরে আবার বলল
–না মানে আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি। আমার মনে হল আমার ঘরে কেউ গিয়েছিল তাই জিজ্ঞেস করলাম। অন্য কোন কারন নেই।
ইভান শান্ত সরে বলল
–আমিও সেরকম কিছু বলতে চাইনি। তোর কেন এরকম মনে হল যে আমিই গিয়েছিলাম? বাড়িতে এতো মানুষ থাকতেও আমার এই বাড়ি থেকে তোর ঘরে যাওয়ার কারণটা তোর কাছে স্পষ্ট হলেও আমার কাছে নয়। বিষয়টা কি একটু অদ্ভুত মনে হয়না?
ঈশা কোন কথা বলল না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রেগে গেলো। কারন সে ভাল করেই জানে ইভান তার ঘরে গিয়েছিলো। আর সেই তাকে এই চুরিটা পরে দিয়েছে। সে তখন ঘুমাচ্ছিল বলেই বুঝতে পারেনি। আর এখন তার কাছে কোন প্রমান নেই। এই চুরির কথা জিজ্ঞেস করলেও ইভান এখন কোন ভাবেই সিকার করবে না। কিন্তু কেন? এরকম করার তো কোন দরকার নেই। বলে দিলেই হয়। বললে তো আর ঈশা তাকে খেয়ে ফেলবে না। মানুষটা কেমন আজব। কিন্তু কিভাবে তার মুখ থেকে বের করবে। কেন যে এরকম একটা জটিল মনের মানুষের প্রেমে পড়েছিল। দুনিয়াতে কি সরল মনের মানুষের অভাব ছিল। জতসব! ভেবেই দরজার মধ্যে একটা লাথি দিলো। নিজের পায়ে নিজেই ব্যাথা পেল। কিন্তু প্রকাশ করলো না। ব্যাথার থেকে রাগটাই তার বেশী এখন। ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশা। ইভান তার পায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
–এভাবে লাথি দিলে রাগ তো কম্বেই না বরং পা ভাংবে। তখন বরের কোলে চরে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হবে। আমার অবশ্য কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তুই পারবি তো?
ঈশা আরও রেগে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার বর আর আমার ব্যাপার সেটা। আমরাই বুঝে নিব।
–বুঝলেই ভালো।
একটা জ্বালাময়ী হাসি দিয়ে ইভান ওয়াশ রুমের দরজা পর্যন্ত চলে গেলো। ঈশা রেগে বিড়বিড় করে বলল
–রুমে একটা সিসি ক্যামেরা লাগাব যাতে কে আসে কে যায় সবটা রেকর্ড হয়ে থাকে। তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। কাউকে আর প্রশ্ন করতে হবে না।
–খুব ভালো চিন্তা। আমিও ভাবছি জানিস এরকম কিছু করলে খারাপ হয়না। সারাদিন রুমে বসে সামনে মনিটরে দেখব।
ঈশা ভ্রু কুচকে ইভানের দিকে তাকাল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–সারাদিন ঘরে থাকলে আবার সিসি ক্যামেরা লাগানোর কি দরকার?
ইভান হাসল। দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
–আমি কখন বললাম আমার ঘরে লাগাবো। আমি তো তোর ঘরের কথা বলছিলাম।
ইভানের কথা শুনে ঈশার মুখ পুরাই হা হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকাল। ইভান চোখ টিপ দিয়ে মুচকি হেসে ওয়াশ রুমের সামনে গেলো। দরজা ঠেলতেই ঈশা এপাশ থেকে গলা তুলে বলল
–এই বিশেষ উপহারের জন্য অজানা মানুষটাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। এভাবে চুপিচুপি না দিলেও পারত। তবুও অনেক ধন্যবাদ।
ইভান সামনে তাকিয়েই মুচকি হেসে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশাও হেসে বাইরে চলে গেলো।
‘হঠাৎ বৃষ্টি’ কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেলো। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরের পরে হঠাৎ করেই মেঘ জমে গেলো আকাশে। চারিদিকে অন্ধকার করে গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজে কেপে উঠল সব কিছু। বিকেলে নেমে গেলো ঝুম বৃষ্টি। সবুজ হয়ে উঠল প্রকৃতি। গাছের পাতা গুলো সতেজ হয়ে উঠল। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়ে দুই হাতে গ্রিল চেপে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকৃতির মেজাজ আজ রুক্ষ। বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে। গভির মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে ঈশা। ইরা পিছনে এসে জামা টেনে বলল
–আপু।
ঈশা পিছনে ঘুরে বসে পড়ল। ইরাকে দুই হাতে ধরে বলল
–কি হয়েছে?
ইরা হাতে একটা খাতা আর একটা কলম নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মুখটা মলিন। ঈশা একটু হেসে বলল
–কি হয়েছে? ইরু মনির মন খারাপ কেন?
ইরা খাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলল
–লিখতে পারছি না।
ঈশা খাতাটা হাতে নিতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এসাইনমেন্টের খাতায় ইরা হাবিজাবি লিখে সব নষ্ট করে ফেলেছে। ঈশার মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেলো। শক্ত করে ইরার হাত চেপে ধরে বলল
–কি করেছিস এটা? কেন ধরেছিস আমার খাতা?
শক্ত করে ধরার ফলে ইরার হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা পাচ্ছিল। কিন্তু ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ইরা কেদে ফেলল। চিৎকার করে কাদতে শুরু করতেই ঈশা তার মুখ চেপে ধরল। গম্ভির সরে বলল
–একদম চুপ। শব্দ করবি না। নাহলে মারব কিন্তু।
ইরা ভয় পেয়ে শব্দ করে কান্না করা তো বন্ধ করলো কিন্তু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে লাগল। ঈশা তাকে ঘরে হাত ধরে টেনে আনল। বিছানায় নিজে বসে ইরাকে আবারো চাপা সরে ধমক দিলো
–আবার চোখের পানি ফেলছিস। থামতে বলছি না।
কথা শেষ করে দরজার দিকে তাকাতেই তার চোখ কপালে উঠে গেলো। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ভয় পেয়ে ইরাকে ছেড়ে দিলো। ইরা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছছে আর কাদছে। ইভান এসে ইরাকে কোলে নিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে টুনটুনি কাদছিস কেন?
ঈশা ধমকে উঠল। একটু জোরেই বলল
–এখন থেকেই মিথ্যা বলা শিখে গেছিস? আমি তোকে মেরেছি? কখন মারলাম?
ইরা ধমকে ভয় পেয়ে আবার কাদতে শুরু করলো। ইভান ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ইরার দিকে ঘুরে তাকে একটা চকলেট হাতে দিয়ে বলল
–কাদিস না টুনটুনি। তোকে আরও চকলেট দিবো। এখন থাম।
ইরা থেমে গেলো। ইভান ইরাকে কোল থেকে নেমে দিলো। ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। ইভানের দৃষ্টি দেখে ঈশা ভয় পেয়ে উঠে দাড়িয়ে দু কদম পিছিয়ে গেলো। ইভান এগিয়ে গেলো। ঈশা একদম পিছিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। ইভান বারান্দার দরজায় এসে হেলানি দিয়ে দাঁড়াল। দৃষ্টি তার ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ। ঈশা এবার বুঝতে পারল সে সব থেকে বড় বোকামিটা করে ফেলছে। বারান্দায় না এসে ঘর থেকে পালিয়ে জাওয়া উচিৎ ছিল। এখন না জানি কি শাস্তি দিবে। এই মানুষটার শাস্তিও বেশ অদ্ভুত রকমের হয়। শারীরিক আঘাতের চিহ্ন আর ব্যথা দুইটাই সাময়িক হয়। কিন্তু মানসিক আঘাত সেটা চিরকাল থেকে যায়। রীতিমত ইমোশনাল টর্চার করে। ইভান দুকদম এগিয়ে যেতেই ঈশা আবারো পিছিয়ে গেলো। গ্রিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। আর পেছানর কোন উপায় নেই। ইভান কে এগিয়ে আসতে দেখে তার মনে হচ্ছে গ্রিল ভেঙ্গে বের হয়ে যেতে পারলে ভাল হত। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। এর মাঝেই ইভান এগিয়ে এসে গ্রিলের দুই পাশে হাত রেখে ঈশাকে আটকে দিয়েছে। গম্ভির গলায় বলল
–আর পেছানোর সুজগ নেই।
ঈশা মাথা ঘুরাতেই চমকে গেলো। ইভান তার অনেক কাছে। দুজনের নাক প্রায় ছুঁইছুঁই। ঈশার খুব অসস্তি হচ্ছে। মিষ্টি একটা ঘ্রান নাকে এসে বাড়ি খাচ্ছে। মাথা ঘুরে উঠছে। ইভান গম্ভির গলায় জিজ্ঞেস করলো
–কেন মেরেছিস ওকে?
ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–মা…মারিনি তো।
–তাহলে কাদল কেন?
–এ…এমনি।
–এমনি কেউ কাদে?
ঈশার অস্বস্তিটা বেড়েই গেলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান বুঝতে পেরে সরে দাঁড়াল। এক পাশে দাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল
–কি করেছে ইরা?
ইভানের গলার আওয়াজ দূর থেকে আসায় ঈশা চোখ খুলে ফেলল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ইভান পাশেই সামনে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। চোখ ফিরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বলল
–আমার এসাইনমেন্টের খাতায় হাবিজাবি লিখে নষ্ট করে ফেলেছে। তাই বকেছি।
–এটা তাহলে তোর দোষ। বাসায় বাচ্চা আছে সেটা তোর ভাবা উচিৎ ছিল। ও ছোট মানুষ। এতো কিছু বুঝলে তো কাজ হয়েই যেত। তোর উচিৎ ছিল সব কিছু গুছিয়ে রাখা যাতে ইরার হাতে না পড়ে। ওর সাথে এভাবে খারাপ ব্যাবহার করার কোন মানে নেই।
ঈশা কথা বলল না। ইভানের কথা সব ঠিক। অপরাধির মতো চোখ নামিয়েই রাখল। ইভান ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–ঈশা। কোন সমস্যা?
ঈশা মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ঘুরে দাঁড়াল। ঈশা দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল। সেদিন ঈশা ইভান কে কিছু বলতে চেয়েও পারেনি। প্রথমত সাহসের অভাব। দ্বিতীয়ত কথার মাঝ পথেই ইরিনা এসে পড়ায় কথা শেষ করা সম্ভব হয়ে উঠে নি। ইভান বুঝতে পেরেছিল ঈশা হয়ত এমন কিছু তাকে বলতে চায় যা বলার জন্য তার নিজের কিছুটা সময় সাহস দুটোই প্রয়োজন। ইভান তাকে সময় তো দিতে পারে। কিন্তু সাহস কি আদৌ দিতে পারবে? সেটা তার জানা নেই। সে কি ঈশার জিবনে সেই জায়গাটা তৈরি করে নিতে পেরেছে যেখান থেকে ঈশা চোখ বন্ধ করে তার উপরে ভরসা করতে পারে। ঈশার মনে তার জন্য অনুভুতি তো তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস আর ভরসা কি এতই সহজ? পারবে কি ইভান ঈশার জীবনের এক মাত্র ভরসা হয়ে উঠতে? ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার মনে হয় তুই ভাল নেই। কারণটা আমার জানা নেই। চাইলেই জানাতে পারিস। না চাইলেও আপত্তি নেই। কারন জানতে চাওয়ার মতো অধিকার এখনও হয়নি। যখন হবে তখন কিন্তু আমি আমার অধিকার জোর করে আদায় করে নিব। তখন কিছুই লুকাতে পারবি না আমার কাছ থেকে।
ঈশা কিছু বলল না। ইভান আবারো বলল
–জীবন মানেই ছোট খাটো একটা জুদ্ধ ক্ষেত্র। আমরা যখন ছোট থাকি তখন বাচার অবলম্বন হয়ে উঠে অবচেতন মনের রঙ বেরঙ্গের স্বপ্ন। আর যখন বড় হই তখন সেই রঙ বেরঙ্গের কিছু স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। তখন শুরু হয় চরম বাস্তবতা। কাছের মানুষ গুলো হুট করেই কেমন অচেনা হয়ে উঠে। গোছানো জীবন অগোছালো হয়ে উঠে। হঠাৎ করেই এমন বাস্তবতার মাঝে পড়ে কেউ ঠিক থাকতে পারেনা। তখন প্রয়োজন হয় একটা ভরসার হাত। জার হাতে হাত রেখে কিছু সময়ের সস্তি পাওয়া যায়। জিবনে বেচে থাকার মানে খুজে পাওয়া যায়। জিবনের কষ্টের ভাগটা তার কাছে গুছিয়ে বলতে পারলে নিজেকে অনেক হালকা মনে হয়। আমি জানি তু………।
–জীবনটা কি সত্যিই এতো সুন্দর?
ঈশা ইভান কে থামিয়ে দিয়েই মাঝপথে প্রশ্ন করে বসে। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে
–কোন জীবনই সুন্দর হয়না। সুন্দর করে নিতে হয়। ভাল থাকা নিজের কাছে। সব থেকে কষ্টের মুহূর্তেও যে জীবনের সুন্দর মুহূর্ত থেকে ভাল থাকার মানে খুজে নেয় ভাল থাকার অধিকার তারই।
ঈশা আবারো প্রশ্ন করলো
–কষ্টের মাঝে ভাল থাকা যায়? কিভাবে?
ইভান মুচকি হেসে বলল
–ভাল থাকার জন্য জিবনে এমন একটা মানুষ থাকা দরকার জার কথা কষ্টের মুহূর্ত গুলতে মেডিসিনের মতো কাজ করবে। তার হাসি মুখটা দেখলেই সমস্ত কষ্ট ভুলে মনে হবে জীবনটা সত্যিই অনেক সুন্দর। দিন শেষে ক্লান্ত শরিরে আমি যখন ফিরব তখন তার মিষ্টি হাসি দেখেই সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। তার ঘুমন্ত চেহারা দেখে শত শত রাত না ঘুমিয়েই পার করে দেয়া যাবে।
ঈশা হেসে ফেলল। বলল
–না ঘুমালে তো অসুস্থ হয়ে যাবে। অসুস্থ শরির নিয়ে এতো কিছু ভাবার সময় হবে তখন?
ইভান হেসে বলল
–ঐ যে ভাল থাকার মেডিসিন। ওটা কাছে থাকলে তো আর কিছুই লাগবে না।
ঈশা আবারো হাসল। ইভান মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঈশার মন খারাপ ছিল সেটা ভাল ভাবেই বুঝতে পেরেছিল সে। কিন্তু কারণটা তার অজানা। তবুও নিজের মতো করেই চেষ্টা করছে তার মন ভাল করতে। একটু থেমে বলল
–যাহ! যেটা বলতে এসেছিলাম সেটাই ভুলে গেছি।
ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান মুচকি হেসে বলল
–বৃষ্টির দিনে আম্মু আজ নতুন রেসিপি রান্না করেছে। তোদেরকে ডাকতে এসেছিলাম।
ঈশা ইভানের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকল। অদ্ভুত মানুষটা। মুহূর্তেই কেমন পুরো পরিবেশটা পরিবর্তন করে দিলো। তার অল্প কিছু কথায় মন খারাপ গুলো ভাল লাগায় পরিনত হয়ে গেলো। ইভান সামনে তাকিয়ে বলল
–পুরাতন কষ্ট ভুলে নতুন করে ভাবার সুযোগটা সব সময় আসেনা। তাই সেটা আসলেও ফিরিয়ে দিতে নেই।
ঈশা উত্তর দিলনা। কি বোঝাতে চাইল ইভান সেটাও বুঝল কিনা কে জানে। ঈশা একটু ভেবে বলল
–চল।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান ইরাকে কোলে নিয়েছে আর তার পাশে হাঁটছে ঈশা। ঝুম বৃষ্টির ফলে রাস্তায় প্যাচ প্যাচে কাদা। ঈশা কাপড় তুলে হাঁটছে। কিছুদুর গিয়ে থেমে গেলো। সামনে অনেক কাদা। তার স্যান্ডেল গুলোও অনেক পিচ্ছিল। সাপোর্ট ছাড়া হাটা অসম্ভব। ইভান দাড়িয়ে পিছনে ঘুরে ঈশার কাণ্ড দেখছে। ঈশা ভ্রু কুচকে ভাবছে কিভাবে পার করবে। ইভান কোন কথা বলছে না। সে দেখতে চায় ঈশা কি করে। কিছুক্ষন ওভাবে দাড়িয়ে থেকে ঈশা বলল
–কিভাবে যাব? পুরো কাদা। পা দিলেই নির্ঘাত পড়ে যাব।
ইভান শান্ত কণ্ঠে বলল
–আমাকে ধরতে পারিস। আমি কিছু মনে করব না।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ঠোট চেপে হেসে দুষ্টুমির সুরে বলল
–তোর কাছে এটা ছাড়া আর কোন অপশন নেই। কারন আমি ধরলে তুই আর হাটতে পারবি না। ওখানেই দাড়িয়ে যেতে হবে।
ঈশা কটমট চোখে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে সামনে এগিয়ে গেলো। কিছুদুর যেতেই পা পিছলে পড়ে গেলো। ইভান এক হাতে কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরল। ইভানের এতো কাছে আসায় ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু উপায় নাই। একটু নড়াচড়া করলে একদম কাদায় পড়ে যাবে। তাই শক্ত করে ইভানের শার্ট চেপে ধরল। সামনে ঈশান ইরিনা আর ইলু ইভান দের বাড়িতে যাচ্ছিলো। ইলু আর ইরিনা খেয়াল না করেই ভিতরে ঢুকে গেলো। কিন্তু ঈশান তাদেরকে দেখে সেদিকে এগিয়ে এলো। এভাবে দেখে বলল
–কোন সমস্যা?
ইভান বলল
–না ঠিক আছে। তুই ইরাকে নিয়ে যা।
ঈশান ইরাকে কোলে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ঈশা কিছু বুঝে উঠার আগেই ইভান তাকে কোলে তুলে নিলো। কাদা পার করে একদম দরজার সামনে এনে নামিয়ে দিলো। ঈশার পুরো শরির অসাড় হয়ে গেছে। সে অসস্তিতে অস্থির হয়ে উঠেছে। ইভান কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল
–কথা না শুনলে এমনি হবে। তুই নিজেই তোর অপশন পছন্দ করেছিস। আমার কিছু করার নেই।
কথা বলেই সামনে তাকিয়ে দেখল ঈশান তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান তাকাতেই অমায়িক একটা হাসি দিলো। ঈশা আরও অসস্তিতে পড়ে গেলো। সে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো ভিতরে। ইভান ঈশানের দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই দাত কেলিয়ে বলল
–ঈশার জায়গায় আমি হলেও কি আমাকে যত্ন করে কাদা পার করে দিতে?
ইভান বিরক্ত হল। ঈশানের সামনে গিয়ে ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–তোর প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। তাই প্রশ্নই উঠে না। তুই পড়ে গেলেও আমার কোন যায় আসেনা।
বলেই সামনে পা বাড়াতেই ঈশান আবার বলল
–সবি বুঝি। কার প্রতি তোমার এতো ইন্টারেস্ট!
ইভান পিছনে ঘুরে বলল
–আমার ইন্টারেস্ট জেখানেই থাক সেটা নিয়ে তোর এতো ইন্টারেস্ট মোটেই ভাল কথা না।
ইভান আর ঈশান হেসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই দেখল ঈশা আর ইলু দাড়িয়ে আছে। ইভান একটু অপ্রস্তুত হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
–তোরা এখানে কি করছিস?
ইলু হেসে বলল
–কিছু না। তোমরা উপরে যাও। আমরা আসছি।
ইভান আর ঈশান উপরে চলে যেতেই ইলু ঈশার ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–পড়ে জাওয়ার অভিনয়টা তাহলে সার্থক।
ঈশা হতাশ হয়ে বলল
–রাজ্যের কথা বলে কিন্তু যা শুনতে চাই সেটাই বলেনা। অসহ্য একটা। এভাবে কি প্রেম করা যায় বল? আমিও কম না। আমার কাছে তো মুখে বলতেই হবে। আমিও দেখতে চাই কতদিন সময় নেয়।
শুক্রবার মানেই ব্যস্ততম দিন। সবাই বাড়িতে থাকে আর অনেকটা সময় অব্দি ঘুমায়। সকালে নাস্তা খেতেও দেরি করে। তাই রান্না বান্নার দেরি হয়ে যায়। আর এই দিনে ইভানের মা একটু আয়োজন করে সবার পছন্দের রান্না করতে খুব ভালবাসেন। এক সাথে খেতেও। রান্নার হাতটা তার বরাবর খুব ভাল। এই কাজটা তিনি খুব ভালবাসেন বিধায় যত্ন সহকারে করেন। প্রতি বৃহস্পতি বার সন্ধ্যা থেকে ইউটিউব ঘেঁটে নতুন নতুন রেসিপি শিখে ফেলেন। আর শুক্রবার সেগুলো রান্না করেন। আজও তার ব্যতিক্রম না। তিনি বহু মনোযোগ দিয়ে আজ ভাপে ইলিশ রান্না করছেন। সকাল থেকে প্রস্তুতি চলছে তার। একজন সাহায্যকারী আছে তবুও তাকে একাই এসব কাজ করতে হয়। কারন তার কোন মেয়ে নেই। দুই ছেলে। ছেলেদের বিয়ে হলে তারপর বউ আসলে নাহয় এসবের দায়িত্ত নিবে। কিন্তু ততদিন তো তাকেই সামলাতে হবে। ইভান রান্না ঘরের দরজায় দাড়িয়ে কিছুক্ষন বুঝতে চেষ্টা করল কি চলছে। বুঝতে না পেরে অবশেষে জিজ্ঞেস করলো তার মাকে।
–কি রান্না হচ্ছে?
ইভানের মা এক গাল হেসে বললেন
–ভাপে ইলিশ। নতুন শিখেছি কাল।
ইভান ছোট্ট করে ‘ওহ’ বলেই আবার বলল
–ইফতি এখনও ঘুম থেকে উঠেনি? আজ তো শুক্রবার। নামাজে যাবেনা?
ইভানের মা হতাশ হয়ে বলল
–এই ছেলেটাকে নিয়ে আমি আর পারিনা। অতিস্ট হয়ে যাচ্ছি। আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় জানিস। এই ছেলেটাকে আমি জন্ম দিয়েছিলাম নাকি হসপিটালে আমি যখন অজ্ঞান অবস্থায় ছিলাম তখন তোর বাবা বাচ্চা পালটে এনেছিল।
ইভান হেসে ফেলল মায়ের কথা শুনে। ইভানের মা হতাশ শ্বাস ছাড়ল। এর মাঝেই ইফতি এসে ইভানের পিঠে নিজের মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করেই ঘুম জড়ান কণ্ঠে বলল
–মা এক কাপ স্ট্রং কফি দাওনা। ঘুমটাকে তাড়াই। কিছুতেই যাচ্ছে না জানো।
ইভান হালকা ঘুরে একটু জোরেই কান টেনে দিলো। ইফতি ‘আহ’ শব্দে কান চেপে ধরে বলল
–ঘুম থেকে উঠেই এভাবে কেন অত্যাচার করছ ভাইয়া। মায়া হয়না তোমার। অসহায় বাচ্চাটার উপর এভাবে অত্যাচার কর।
ইভান একটু ধমক দিয়ে বলল
–রাতে সেই কখন ঘুমিয়েছিস। এখনও তোর ঘুম ভাঙ্গেনা কেন? আজ শুক্রবার সেটা কি ভুলে গেছিস? নামাজে যেতে হবে না।
ইফতি পাশে চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে বলল
–হবে না আবার কেন? যেতে হবে যাব। এখনও তো আজান দেয়নি। দিক আগে।
ইভান একটু বিরক্ত হয়ে বলল
–তোমার ছেলে মানুষ হবে না মা।
বলেই সোফায় গিয়ে বসলো। পেপারটা হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। ইভানের মার সাহায্যকারী কলি নামের মেয়েটা এসে ইভানের সামনের টেবিলে চায়ের কাপ রাখল। সাথে কয়েকটা বিস্কিট। পেপারে মুখ ডুবিয়েই ইভান চায়ে একবার চুমুক দিয়ে আবার কাপটা সামনে রেখে দিলো।
–বড় মা।
পেপার থেকে মুখটা তুলে ইভান দরজার দিকে তাকাল। হালকা রঙের একটা কামিজ পরেছে ঈশা। ওড়নাটা মাথায় অরধেক টেনে দেয়া। সামনের ছোট চুলগুলো বের হয়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে। স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। ঈশা দরজায় দাড়িয়েই আছে। ইফতি ভ্রু কুচকে বলল
–কারো অনুমতির অপেক্ষা করছ ঈশা আপু?
ঈশা ভিতরে ঢুকে হাতের বাটিটা ইফতির সামনে রেখে বলল
–অনুমতির অপেক্ষা করছিলাম না। অনুমতি ছাড়াই আমি এই বাড়িতে আসতে পারি যখন তখন। আর আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।
ইফতি দাত বের করে বলল
–ওহ! তাহলে ওখানে দাড়িয়ে দেখছিলে বুঝি? তো কাকে দেখছিলে? তোমার ওখান থেকে তো…।
থেমে আবার বলল
–বুঝেছি। ভাইয়াকে দেখছিলে।
ঈশা থতমত খেয়ে দাড়িয়ে থাকল। ইভান পেপারে মুখ ডুবিয়েই হাসল। ইভানের মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে এসে বাটিটা দেখে বলল
–এটাতে কি রে?
–মিষ্টি বড় মা। আমি বানিয়েছি। তাই নিয়ে আসলাম।
ইভানের মা হেসে ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–তুই বস আমি রান্না শেষ করে আসি।
ঈশা মাথা দুলিয়ে ইফতির সামনে থেকে একটা বিস্কিট নিয়ে মুখে দিলো। ইভানের মা রান্না ঘরে গেলো। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে পেপার নিয়েই ব্যস্ত। ধির পায়ে সেদিকে গিয়ে তার পাশে বসে পড়ল। ইভান পেপারের দিকে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সেটা আবার সামনে রেখে দিলো। ঈশা আড় চোখে একবার ইভানের দিকে তাকাল। তারপর হুট করেই চায়ের কাপটা তুলে নিলো। তখনি রান্না ঘর থেকে ইভানের মায়ের আওয়াজ আসলো।
–ঈশা চা খাবি?
ইভান আড় চোখে ঈশার দিকেই তাকিয়ে আছে। বুঝতে চেষ্টা করছে তার মাথায় কি চলছে। ঈশা চায়ে পরপর দুই বার চুমুক দিয়ে কাপটা সামনে রেখে গলা তুলে অভিমানী কণ্ঠে বলল
–আমি বাসায় যাচ্ছি বড় মা। কাজ আছে। পরে আসব।
উঠে কিছুদুর যেতেই ইভানের মৃদু কণ্ঠ কানে এলো।
–মিষ্টিটা যে এতো কড়া হবে ধারনা ছিলনা। ধন্যবাদ ম্যাডাম। মিষ্টি মুখ করানোর জন্য।
–কিন্তু আমি তো চায়ে চিনি দিতেই ভুলে গেছি। তাহলে কড়া মিষ্টি হল কিভাবে?
ইভান ঈশা দুজনেই ঘুরে তাকাল। তার মা চিনির বয়াম হাতে দাড়িয়ে আছে। ইভান পেপারটা রেখে উঠে যেতে যেতে বলল
–মিষ্টি তো ঈশার কাছে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস কর।
কথা শেষ করে ইভান ঘরে চলে গেলো। ইভানের মা ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা আমতা আমতা করে মিষ্টির বাটির দিকে ইশারা করে বলল
–ঐ যে মিষ্টি। ওটাই অনেক কড়া। চিনি বেশী দিয়ে ফেলেছি মনে হয়।
ইভানের মা একটু হেসে রান্না ঘরে চলে গেলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলে ইভানের ঘরের দিকে একবার তাকাল। ইভান দরজায় হেলানি দিয়ে হাত গুজে মুখে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা কঠিন চোখে তাকিয়ে ঘুরে বের হতে যাবে তখনি ইফতি বলল
–কিন্তু ভাইয়া তো মিষ্টিই খেলনা। তাহলে বুঝল কিভাবে কড়া না হালকা?
ঈশা পিছনে ঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। এগিয়ে এসে ইফতির সামনে মাথা ঝুকে গাল টেনে বলল
–তোকে কি ইনভেস্টিগেশনের জন্য মেডেল দেয়া হবে?
ইফতি না সুচক মাথা নাড়ল। ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–তাহলে নিজের কাজে মনোযোগ দে। আশে পাশে এতো মনোযোগী হওয়ার দরকার নেই তো। নাহলে আমি তোর প্রতি মনোযোগী হয়ে গেলে কিন্তু দুঃখ আছে কপালে।
ইফতি কি বুঝল কে জানে। কিন্তু ভয় পেয়ে শুকন ঢোক গিলে ফেলল। ঈশা চোখ তুলে আবারো ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো।
—————
শেষ বিকেলে চায়ের সাথে মুড়ি মাখার সংমিশ্রণটা বেশ। ইরিনাদের বাড়ির ছাদে ঈশা আর ইরিনা ছোট একটা বাটিতে মুড়ি আর হাতে চায়ের কাপ নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। ইরিনাদের বাড়িটা একদম মাঝে। বাম পাশে ইভানদের বাড়ি আর ডান পাশে ইলুদের বাড়ি। ইরিনা একাই। তার কোন ভাই বোন নেই। ঈশার ছোট চাচার মেয়ে সে। সেজো চাচার দুই ছেলে মেয়ে হচ্ছে ঈশান আর ইলু। ইরিনা হতাশ হয়ে বলল
–কতদিন বিয়ে খাইনা। আমাদের বাড়িতে কেউ বিয়ে করেনা কেন? সেদিন একটা বিয়ে হইল তাও আবার খাওয়ার মতো না। কি যে হইল বুঝতেই পারলাম না।
ঈশা সামনে তাকিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–আসলেই। আমার মনে হয় সেজো মা সেজো বাবাকে বুঝিয়ে বললে তারা ঠিক রাজি হত। ইলু আপুর এভাবে বিয়ে করার প্রয়োজন ছিলনা। সায়ান ভাইয়া খুব ভাল একজন মানুষ। আর ইভান ভাইয়ার খুব ভাল বন্ধু হিসেবে বাসায় মোটামুটি সবাই জানে তার সম্পর্কে। কারো আপত্তি থাকার কথা না।
–ইভান ভাইয়ার বুদ্ধি ছিল সবটা। যদিও বা আমার ভাল লাগেনি কিন্তু ইভান ভাইয়া কিছু তো একটা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে যে কোন ভুল করতে পারেনা সেটা সবাই জানে ঈশা। কিছু তো ভেবেছে সে। আর সব কথাও যে সে সবাইকে বলবে তাও তো না। আমরা তো জানি ইভান ভাইয়া সবার কাছে তার মনের সব কথা প্রকাশ করতে পছন্দ করেনা। কেউ বুঝলে তবেই সেটা জানতে পারে।
ইরিনার কথা গুলো চুপচাপ শুনলেও ঈশার দৃষ্টি ইভানদের ছাদে স্থির। হালকা গোলাপি রঙের একটা পাঞ্জাবি পরেছে ইভান। ওটা পরেই হয়ত নামাজ পড়তে গিয়েছিলো। এখনও খুলেনি। ছাদে রেলিঙ্গে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। বেশ হাসি খুশি। ঈশা একটু হেসে ইভানের দিকে তাকিয়েই ইরিনাকে বলল
–তুমি ঠিক বলেছ আপু। মানুষটা একদম অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। জাকে বলে এক কথায় পারফেক্ট!
ইরিনা কিছু না বুঝেই মাথা নাড়াল। ঈশা একটু এগিয়ে গেলো ছাদের কিনারে। এপাশ থেকে গলা তুলে বলল
–ইভান ভাইয়া।
হঠাৎ এমন ডাকে ইভান চমকে পাশ ফিরে তাকাল। ঈশাকে হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনটা কানে ধরেই তার দিকে তাকিয়ে বলল
–পরে কথা বলছি।
ইভান ভ্রু কুচকে নিলো। কিছুক্ষন পর সাভাবিক ভাবেই বলল
–খেয়েছি। এখন খাবনা।
–আমি বানাই? তবুও খাবেনা?
ইভান এবার এগিয়ে আসলো। রেলিঙ্গে দুই হাত রেখে বলল
–আমার জন্য এতো কষ্ট আপনাকে করতে হবে না ম্যাডাম। আমার ইচ্ছা করলে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসব। এমনিতেও আমি এখন বাইরেই যাব।
–তা তো যাবেই। আমি কি তোমাকে আটকে রাখব নাকি? শুধু এক কাপ চা খাওয়াতে চেয়েছি। খুব বেশী কিছু না তো।
ইভান বেশ অবাক হল তার কথা শুনে। ঈশা পিছনে ঘুরে ইরিনাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–ইরিনা আপু আমি নিচে যাচ্ছি চা বানাতে। তুমি কি আরও এক কাপ খাবে?
–কিন্তু ইভান ভাইয়া তো খাবেনা। আর আমরা তো চা খেলাম। এখন থাক বানাতে হবে না। তুই বস। একটু পরেই সন্ধ্যা হবে। তখন নিচে গিয়ে আবার খাবো।
ঈশা প্রশস্ত হাসি হেসে মৃদু সরে বলল
–খাবে।
ইরিনা বধ হয় কোন রকমে শুনতে পেল। কিন্তু ঐ ছাদে ইভানের কান পর্যন্ত গেলই না। ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেলো। ঈশার এমন আচরনে ইভান বেশ অবাক হল।
বেশ কিছুক্ষন পর ঈশা চা বানিয়ে এনে দেখল ইভান ইরিনার সাথে বসে গল্প করছে। খুব সাভাবিক ভাবেই এগিয়ে গিয়ে একটা কাপ তুলে ইভানের দিকে এগিয়ে দিলো। যেন সে জানত ইভান আসবে। ইভান শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে কাপটা হাতে নিলো। ইরিনার ফোন বেজে উঠল। সে ফোন ধরতে চলে গেলো। ইভান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল
–কিছু বলবি?
ঈশা একটু ভেবে বলল
–কেন তোমার মনে হল আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই?
ইভান সোজা হয়ে বসলো। ঈশার দিকে তাকাল গভির ভাবে। বেশ কিছুক্ষন পর শান্ত সরে বলল
–আমি হয়ত তোকে খুব ভাল মতো চিনি। তুই যে শুধু চা খেতে আমাকে ডাকিস নি সেটাও জানি। যা বলতে চাস বলতে পারিস। একদম নিশ্চিন্তে।
ঈশা করুন দৃষ্টিতে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ঈশার দৃষ্টির মানে বুঝতে পারল না। কিন্তু এটা খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে কিছু একটা বলতে চায়। ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা ওভাবে তাকিয়েই বলল
–যদি কখনও চরম সত্যের মুখোমুখি হতে হয় তখন কি করবে?
আকাশ পরিষ্কার। নীলের মাঝে শুভ্র মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। সূর্যটাও আজ সকাল সকাল তেজ ছড়াতে শুরু করেছে। দোতলার জানালা দিয়ে বেশ ভাল রকমের বাতাস আসছে ঘরে। বাতাসের দাপটে শুভ্র রঙের পর্দাটা ঝাপটে ঝাপটে ক্লান্ত হয়ে এক সময় দমে যাচ্ছে। পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল ঈশা। গায়ে কারো স্পর্শ পেতেই পিছনে ঘুরে দেখল ইলু তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। একটু বিরক্ত হয়েই তাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে আশে পাশে তাকাল। ইরা নেই। বাইরে তার কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক আগেই উঠে পড়েছে মনে হয়। চোখটা বন্ধ করে বালিশে মাথাটা ঠেকাতেই বাইরে থেকে একটা মৃদু গলার আওয়াজ কানে আসতেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে গেলো ঈশার। চট করে উঠে বসলো। মায়ের গলার আওয়াজ পেয়ে মুহূর্তেই ঘুম ছুটে গেলো তার। আজ ঈশানের জন্মদিন উপলক্ষে ঈশানদের বাড়িতেই সবাই। কিন্তু এতো সকাল সকাল তার মা যে এসে পড়বে সেটা বুঝতে পারেনি। চোখ ডলে ভাল করে তাকাতেই সামনের দেয়ালে চোখ পড়ল। দেয়াল ঘড়ির কাটা ১১ টা ছুঁইছুঁই। আঁতকে উঠে জিভ কেটে ঢোক গিলে ফেলল ঈশা। তার মা যদি কোনভাবে জানতে পারে ঈশা এখন ঘুমাচ্ছে তাহলে আজ সারাদিনটাই মাটি হয়ে যাবে তার। চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলবে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে যেয়ে আরেক বিপদ বাধিয়ে ফেলল। না দেখেই নিচে পা দিতেই নিচে শুয়ে থাকা ইরিনার উপরে তার পা পড়ল। এক চিৎকার করে উঠে বসলো ইরিনা। ইলুও চমকে উঠে বসলো। ঈশা অপরাধীর মতো কাচুমাচু হয়ে আবার পা তুলে বসে পড়েছে। ইরিনা শক্ত চোখে তাকিয়ে বলল
–আমাকে কি পারা দিয়ে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছিস নাকি?
ঈশা দুই হাতে নিজের পা চেপে ধরে অসহায়ের মতো বলল
–সরি। আমি না দেখতে পাইনি।
–অত বড় চোখ গুলা কি আলমারিতে তুলে রেখেছিস যে দেখতে পাস নি। নিচে নামার সময় কি আকাশে দেখে ছিলি? বেয়াদব মেয়ে। এখনি আমার দম বন্ধ করে মেরে দিতিস।
ইলু এতক্ষন কিছুই বুঝতে না পেরে হাবার মতো তাকিয়ে ছিল তাদের দিকে। ইরিনার কথায় কি হয়েছে সেটা আন্দাজ করতে পেরেই অট্টহাসিতে ফেতে পড়ল। ইরিনা কঠিন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার কি মাথায় সমস্যা আছে? এভাবে হাসার কি হল?
ইলু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে বলল
–আমি এটা ভেবেই হাসছি যে তোর মতো হাতিকে ঈশার মতো পিঁপড়া কিভাবে পারা দিয়ে মেরে ফেলে। মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই।
বলেই আবার হাসতে লাগল। এবার ঈশাও তার সাথে জুক্ত হল। ইরিনা প্রচণ্ড রেগে গেলো। রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইলু আর ঈশা দুজনি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আবার মায়ের আওয়াজ কানে আসতেই ঈশা উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখল ঘরে কেউ নেই। বাইরে বের হল। বের হতেই সোজা সোফায় বসে থাকা সোনিয়ার উপরে চোখ পড়ল। হঠাৎ করেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু সবার সামনে সেটা প্রকাশ করতে চায়না বলেই নিজেকে সংযত করে এগিয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলের চেয়ার গুলোয় এলোমেলো ভাবে বড়রা বসে খোস গল্পে মশগুল। আর ছোটরা সোফায়। ইরা ইভানের ফোনে গেম খেলছে আর ইভান টিভি দেখছে। ঈশা সেদিকেই ধির পায়ে এগিয়ে গিয়ে সিঙ্গেল সোফায় বসলো। সোনিয়ার দিকে তাকাতেই দেখল সে এমন ভাবে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে যেন চোখ দিয়ে গিলে ফেলবে। ঈশার খুব রাগ হল। রাগের মাথায় অনিচ্ছাতেই আশ্চর্য একটা কাজ করে ফেলল। উঠে গিয়ে ইভানের পাশে বসে পড়ল। ইভান সাভাবিক ভাবেই পাশ ফিরে একবার ঈশার দিকে তাকাল। তারপর আবার টিভির দিকে মনোযোগ দিলো। ঈশা ইভান কে দেখে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল
–সোনিয়া আপু কেমন আছ?
সোনিয়া ইভানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বলল
–ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
–ভাল আছি।
উত্তর দিয়েই ঈশা ইভানের দিকে আর একটু চেপে গিয়ে তার অপর পাশে বসে থাকা ইরার ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–কি করছিস রে ইরু?
ঈশাও মনোযোগ দিয়ে সেদিকে দেখছে। কিন্তু তার আশে পাশে কি হচ্ছে সেটা সে বুঝতেই পারছে না। সে এমন ভাবে ঝুকে আছে তার মাথাটা ইভানের নাকের কাছাকাছি। তার চুলের ঘ্রান নাকে আসতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। মাতাল করা সেই ঘ্রানের নেশায় ইভান নিজেকে কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছে না। কিন্তু ঈশা কিছুতেই সরছে না। ইভানের এবার খুব অসস্তি হচ্ছে। হুট করেই বিস্ময়কর একটা কাজ করে বসলো। আলতো করে এক হাতে ঈশার কোমরে চেপে ধরল। ঈশা মুহূর্তেই কেপে উঠল। বুকের ভিতরে ঢিপঢিপ শব্দটা বেড়ে গেলো। ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে গেলো সে। উঠে তড়িৎ গতিতে সোজা তো হয়ে গেলো। কিন্তু সরতে পারল না। কারন ইভান অনেক জোরে চেপে ধরেছে। নড়াচড়া করা সম্ভব হল না। সামনে সোনিয়াকে বসে থাকতে দেখে ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়েই ধির কণ্ঠে বলল
–আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ।
ইভান কোন কথা বলল না। এমন কি ঘুরেও তাকাল না। এমন ভাব যে ঈশার কথা সে শুনতেই পায়নি। সোনিয়ার দৃষ্টি যদিও বা তখন টিভির দিকে তবুও ঈশা আবার বলল
–প্লিজ ছাড়ো।
এবার ইভান খুব স্বাভাবিকভাবেই তার দিকে তাকাল। শান্ত কণ্ঠে বলল
–কাপছ কেন? ঠাণ্ডা লাগছে? উষ্ণতা দরকার?
ঈশা কটমট চোখে ইভানের দিকে তাকালেও আবার দমে গেলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। ইভানের শরীরের উষ্ণতা এমনিতেই তাকে জালিয়ে দিচ্ছে। আরও উষ্ণতা বেড়ে গেলো তো পুড়েই ছাই হয়ে যাবে। ঈশার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেলো। ইলুকে তাদের দিকে আসতে দেখে ইভান ছেড়ে দিলো। ঈশা যেন সস্তি ফিরে পেল। মুহূর্তেই দুই হাত সরে গিয়ে বসলো। ইলু এসে ইরার পাশে বসে তার গাল টেনে দিয়ে বলল
–কি রে ইরু গেম খেলছিস?
ইরা বিরক্ত নিয়ে মাথা নাড়াল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একটু জোরেই বলল
–কি রে ঈশা তুই তো গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা। ওখানে বাতাস পাচ্ছিস না তো। কাছে এসে বস।
ঈশা কোন কথা বলল না। ইলু ভাল করে ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। তারপর বলল
–আমি তো এতদিনে জানতাম আমাদের বাড়িটাই সব থেকে ঠাণ্ডা। ঈশা তো তাই বলতো। ওদের বাড়িতে গরম বলে মাঝে মাঝে দুপুরে আমাদের বাড়িতে ঘুমাতে আসে। তাহলে আজ এভাবে ঘামছিস কেন?
–তোর শরির খারাপ লাগছে না তো? তুই ঠিক আছিস ঈশা?
ঈশান কথাটা বলতে বলতে সোনিয়ার পাশে বসলো। ঈশা নত দৃষ্টিতেই ওড়নার এক পাশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ফেলে বলল
–আমি ঠিক আছি। এমনিতেই গরমটা আজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে।
ইভান ঠোট চেপে হাসল। ঈশান বলল
–তুই ফ্যান থেকে দূরে বসেছিস তাই মনে হচ্ছে। ইভান ভাইয়ার কাছে বস। তাহলে গরম লাগবে না।
ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সামনে তাকিয়ে আছে। তার এসবে কোন যায় আসেনা। চেহারা অতিশয় সাভাবিক। ঈশা কিছুতেই সেখানে বসতে চায়না। কিন্তু সবার কথার জোরে বাধ্য হয়ে ইভানের কাছে এসে বসলো। ইলু উঠে যেতে যেতে বলল
–তুই তো কিছু খাস নি ঈশা। খেয়ে নে।
ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–আমি শুধু চা খাব আপু। এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না।
ইলু চলে গেলো। ঈশান সোনিয়ার সাথে গল্পে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ঈশান আর সোনিয়া দুজন এক সাথে পড়াশোনা করে। তাই তার জন্মদিন উপলক্ষে সোনিয়া এসেছে। ঈশা মাথা তুলে টিভির দিকে তাকাল। ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে ধির কণ্ঠে বলল
–সকাল থেকে কিছুই খাস নি। শুধু চা খেলে হবে?
ঈশা আড় চোখে একবার ইভানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। মিনমিন করে বলল
–এখন খেতে ইচ্ছা করছে না।
–ইচ্ছা অনিচ্ছা শুনতে চাইনি। আমার কথা শুনতে বলেছি।
ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–বললাম তো এখন খাব না।
ইভান একটু গম্ভির গলায় বলল
–আমার কথা না শুনলে কিন্তু কিভাবে শোনাতে হয় সেটা আমি জানি। তাই অজথা জেদ না করে চুপচাপ খেয়ে নে।
ঈশা কোন কথা বলল না। বসেই থাকল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এক কথা বারবার বলাটা আমার পছন্দ না। তুই কি আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিচ্ছিস? নিস না। ভুল করবি। আমি বিগড়ে গেলে তোর কপালে শনি নেমে আসবে।
ঈশা কোন কথা না বলে উঠে গেলো। রান্না ঘর থেকে খাবার নিয়ে এসে খেতে লাগল টেবিলে বসে। বড়রা সবাই ঘরে চলে গেছে। সাংসারিক আলচনায় মত্ত। ইলু চা নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বলল
–কে কে চা খাবে?
সবাই সম্মতি দিল। ইলু চায়ের কাপ নিয়ে সবার হাতে হাতে দিলো। ইভান কাপ নিয়ে উঠে গিয়ে ঈশার সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। ইরাও ইভানের পিছে পিছে এসে তার কোলে বসে পড়ল। ঈশা একবার চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে খেতে শুরু করল। হঠাৎ করেই ইভানের আদুরে কণ্ঠ কানে এলো
–এতো রাগ করে খাস না পাখি। গলায় আটকাবে।
ঈশা চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ইরার দিকে তাকিয়ে তার সাথে গেম খেলছে। তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছে দুজনে এখন দুনিয়ার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। কি মনে করে ঈশা হেসে দিলো। হঠাৎ মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হল। ইচ্ছা করে খানিকটা কাশতে লাগল। ইভান ভাবল ঈশার গলায় খাবার আটকে গিয়েছে। পানি এগিয়ে দিলো। বিচলিত হয়ে বলল
–বললাম না গলায় আটকাবে। কথা কানে যায়না না?
ঈশা পানি একটু মুখে দিয়ে গ্লাসটা পাশে রেখে দিলো। দুষ্টুমি করে বলল
–আমাকে বলেছিলে? কই শুনলাম না তো।
ইভান সবটা বুঝতে পেরে বাকা হেসে ইরাকে বলল
–ইলু আপুর কাছ থেকে বিস্কিট নিয়ে আয় তো টুনটুনি।
ইরা কোল থেকে নেমে এক দৌড় দিলো। ইভান উঠে ঈশার পাশের চেয়ারটা একটু টেনে কাছে নিয়ে বসলো। প্লেট থেকে খাবার তুলে ঈশার মুখে দিয়ে বলল
–এখন শুনতে পাবি নাকি আরও কাছে আসতে হবে? তুই চাইলেই আমি আসতে পারি। আমার কিন্তু কোন সমস্যা নেই।
এবার সত্যি সত্যি ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। ইভান পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে ঠোটে হাসি রেখেই বলল
–ততটুকুই টর্চার করা উচিৎ যতটা নিজের সহন ক্ষমতা। বেশী হয়ে গেলে কিন্তু সেটা নিজের উপরে ভারি পড়তে পারে। ভাবা উচিৎ ছিল।
‘ঈশার বয়ফ্রেন্ড’ কথাটা মধ্য রজনীর নিস্তব্ধ প্রহরে ঝমঝম করে বেজে উঠল। পুরো শহর যেখানে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে সেখানে কয়েকজন রাত পাখি নিজেদের সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে ব্যস্ত। মধ্য রাতে ছাদে মাদুর পেতে বসেছে এক ঝাক পাখি। গল্প আড্ডা খুনসুটিতে মেতে উঠেছে আশে পাশের পরিবেশ। তাদের এই মত্ত পরিবেশ দেখে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের প্রাণহীন পরিবেশটাও খিলখিল করে হেসে উঠছে। ঈশানের জন্মদিন উপলক্ষে সারপ্রাইজ পার্টির শেষে তাদের বাড়ির ছাদে চলছে মাঝরাত পর্যন্ত আনন্দ উৎসব।
“আমি তোমাকে অসংখ্যভাবে ভালবেসেছি, অসংখ্যবার ভালবেসেছি। এক জীবনের পর অন্য জীবনেও ভালবেসেছি। বছরের পর বছর, সর্বদা, সব সময়ে।“
কথাগুলো অতি বিস্ময়ে পড়া শেষ করে কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে ঈশার দিকে তাকাল ইলু। গম্ভির সরে বলল
–তোর বয়ফ্রেন্ড আছে?
ঈশা তখন মাথা তুলে মধ্য রাতের আকাশে তারা গুনতে ব্যস্ত। ইলুর কথা শুনে হকচকিয়ে গেল। তার দিকে তাকিয়ে মৃদু সরে বলল
–আমার আবার বয়ফ্রেন্ড কোথায়? আছে নাকি? জানতাম না তো।
ইলু হাতের কাগজটা উচু করে ধরে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–তাহলে এটা কি? তোর পড়ার টেবিল থেকে আবিষ্কৃত এই আবেগময় লেখাটা নিশ্চয় আমার না। আর এরকম ভাবে প্রেম করার মত কেউ এখানে উপস্থিত নেই। আর এটাও বলতে পারবি না যে তুই লিখেছিস। কারন তোর হ্যান্ড রাইটিং আমি চিনি।
ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো বেশ। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার দিকে একবার চোখ চালিয়ে কাগজটা নিতে হাত বাড়াল। তার আগেই ঈশান ছিনিয়ে নিলো সেটা। মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করছে কার লেখা। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর কিছুই বুঝতে না পেরে হার মেনে দমে গেলো। হতাশ হয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। এসব কি ঈশা?
ঈশা নড়েচড়ে বসলো। একটু ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–কি যা তা বলছ? এটা আমার না।
ইরিনা মাথাটা একটু এগিয়ে এনে বলল
–আচ্ছা মানলাম তোর না। আর তুই জানিসও না তোকে কে দিয়েছে? কিন্তু কেউ তো একজন তোকে দিয়েছে। সেই ব্যক্তিটা কে?
–আমি কিভাবে বলব কে? আমি তো কিছুই জানিনা। আর ইলু আপু যে এটা আমার টেবিলে পেয়েছে আমি সেটাও জানতাম না। তোমাদের মতো আমিও এখনি জানলাম।
সবার সন্দিহান দৃষ্টি পর্যবেক্ষণ করে ঈশা বুঝতে পারল তার এই যুক্তি কারো কাছেই গ্রহনযোগ্য হয়নি। অসহায় কণ্ঠে আবার বলল
–বিশ্বাস কর। আমি এসবের কিছুই জানিনা।
ঈশার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে সবাই আবার কাগজটার দিকে মনোযোগ দিলো। পিনপতন নিরবতার মাঝেই ইফতি হঠাৎ চেচিয়ে বলল
–আরে আমি জতদুর জানি এটা ইভান ভাইয়া লিখেছে। কারন হ্যান্ড রাইটিং একদম মিলে যাচ্ছে। এটা ইভান ভাইয়ারই লেখা।
–হোয়াট?
সবাই একসাথে চেচিয়ে উঠল। সব মাথা এক জায়গায় জমা হল। কথাটা সবার কাছে কেমন অবিশ্বাস্য। আবার পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠল। সবার থেকে বেশী অবাক হয়েছে ঈশা। ইফতির কথা অনুযায়ী যদি সত্যি সত্যি এটা ইভানের লেখা হয়ে থাকে তাহলে তার কি ধরনের রিয়াকশন দেয়া উচিৎ সেটা ভেবেই অকুল দরিয়ায় হাবুডুবু খেতে লাগল ঈশা। মাথা ভনভন করছে তার। বয়ফ্রেন্ড শব্দটা শোনার পরেও ততোটা শক খায়নি যতটা ইফতির কথা শুনে খেয়েছে। শুন্য মস্তিষ্ক নিয়ে পলকহীন চোখে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকল। গোছানো চিন্তা ভাবনা সব এলোমেলো লাগছে তার।
–ইভান ভাইয়া কোথায়?
–আমাদের বাসায় গেছে। আম্মু ফোন করেছিল ইরা ঘুম থেকে উঠে কান্নাকাটি করছে তাই তাকে আনতে গিয়েছে।
ইরিনার প্রশ্নের উত্তরে আনমনেই কথা গুলো বলে থামল ঈশা। ইরা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতে উঠে দেখে ঈশা বাসায় নেই। তখন কান্নাকাটি করে। ঈশার মা তাকে থামাতে না পেরে ইভান কে ফোন দেয় তাদের কাছে নিয়ে যেতে। আর তাকে নিতেই যায় ঈশাদের বাড়িতে। ইফতি এবার অবাকের রেশ টেনে বলল
–ঈশা আপুর বয়ফ্রেন্ড নাহলে তাহলে ইভান ভাইয়া কি তার গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য লিখেছে?
সবাই ইফতির দিকে তাকাল। আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেলো চারপাশ। এবারের বিষয়টা আরও অসম্ভব। এ জিবনেও ইভানের গার্ল ফ্রেন্ড আছে সেটা যে কেউ মানতে নারাজ। ঈশা মোটামুটি আহত হল। অতি বিস্ময়ের মাঝে এখন প্রচণ্ড মন খারাপ হানা দিলো। বিষয়টা মানা এতো সহজ না। আবার সোনিয়ার বিষয়টাও মাথায় ঢুকে গেলো। সব মিলে কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ভাবনার মাঝেই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পেয়ে সবাই বুঝে গেলো ইভান আসছে। সেদিকে সব দৃষ্টি স্থির করল। ইভান ইরাকে কোলে নিয়ে এসে মাদুরের উপরে বসে পড়ল। কারো দিকে তাকাল না। ইরার হাতে থাকা চকলেট টা খুলে হাতে ধরিয়ে দিলো। ইরা চকলেটটা নিয়ে দুই হাতে ইভানের গলা জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিলো। ইভান ইরার দিকে তাকিয়েই বলল
–একটা চকলেটের জন্য এতো ভালবাসা! মেয়ে মানুষ একটুতেই এমন গলে যায় ধারনা ছিলনা। আমি তো ভেবেছি আমার বউকে প্রতিদিন রাতে একটা করে চকলেট দিবো। না জানি কত আদর করবে।
ইভানের কথা শেষ হতেই চারিদিকে হাসির রোল পড়ে গেলো। কথা শেষ করেই ঈশার দিকে তাকাল ইভান। কিন্তু ঈশার কঠিন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুচকে নিলো। হাজার প্রশ্ন সেই দৃষ্টিতে। ইভান বুঝতে না পেরে পিছনে ঘুরে তাকাল। সবাই ততক্ষনে হাসি থামিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–কি হয়েছে? এভাবে কেন দেখছিস?
ইলু মুহূর্তেই ইভানের থেকে সরে বসলো। দূর থেকেই ঈশানের হাতের কাগজটার দিকে তাক করে নিচু কণ্ঠে বলল
–ঐটা তাহলে কার? কার জন্য লিখেছ।
ইভান ভ্রু কুচকে কাগজটার দিকে তাকাল। হাত বাড়াতেই ঈশান তার হাতে দিয়ে দিলো। সবাই ইভানের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। অপেক্ষা করছে উত্তরের। ইভান কাগজটার দিকে তাকিয়ে বলল
–কই পেয়েছিস এটা?
ইলু দূর থেকেই আমতা আমতা করে বলল
–ঈশার টেবিলে।
ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টির কোন পরিবর্তন হয়নি। ইফতি এগিয়ে এসে বলল
–এটা কার ইভান ভাইয়া? তোমার গার্ল ফ্রেন্ডের জন্য?
ইভান তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমার গার্ল ফ্রেন্ডকে দেখেছিস?
ইফতি না সুচক মাথা নাড়াল। ইভান ধমকে উঠল
–তাহলে বারবার একি কথা বলছিস কেন? যা নেই তা নিয়ে এতো মাথা ব্যাথার কারন কি?
–তাহলে কি ঈশার জন্য লেখা?
ইরিনা থেমে থেমে কথাটা বলতেই পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠল। ঈশা চমকে উঠে কঠিন দৃষ্টিতে ইরিনার দিকে তাকাল। সবাই এবার ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ভ্রু কুচকে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই আমার অগোচরে ঘরে এসে এসব চুরি করিস? কি আজব অবস্থা! ব্যক্তিগত কোন কিছুই সেফ না। এখন তো নিজেকে নিয়েই টেনশন হচ্ছে। রাতে ঘুমাব আর সকালে উঠে দেখব পাশের বাড়িতে! কখন আমার ঘর থেকে আমাকেই চুরি করে নিয়ে যাবে।
হো হো করে সবাই হেসে উঠল। কিন্তু ঈশার মেজাজ চরম খারাপ হল। কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেটা বুঝতে পেরেই তেতে উঠে বলল
–সিরিয়াসলি! এখন এসব চুরি করার অপবাদও ঘাড়ে নিতে হচ্ছে? এটা কোন চুরি করার জিনিস? এটা শোনার পর আমার মনে হচ্ছে উপর থেকে মই নামুক আর আমি উপরে উঠে যাই।
সবাই আরেক দফা হেসে উঠতেই ইভান বলল
–এটা চুরি করার মতো জিনিস। অবাক হওয়ার কিছুই নাই। চোখে না দেখা সব থেকে মুল্যবান জিনিসটা মনটাই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে আর এসব! খুব সাভাবিক ব্যপার। তোর দারাই সম্ভব।
ঈশা আরও বেশী রেগে বলল
–দেখ ইভান ভাইয়া। তোমার কোন কিছু চুরি করার ইচ্ছা আমার নাই। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে প্রয়োজন নাই। আমার যা লাগবে সেটা নিজের অধিকার বসত নিয়ে আসব। কেউ আটকাতে পারবে না।
সবাই হাসাহাসি নিয়ে ব্যস্ত ছিল বলে ঈশার কথা তেমন গুরুত্ত দিলো না। কিন্তু ইভান অমায়িক হেসে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা প্রথমে কিছু বুঝতে না পেরে পরে নিজের বোকা বোকা কথার প্রেক্ষিতে প্রচণ্ড লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে নিলো। এতক্ষন ইরা চুপচাপ চকলেট খাচ্ছিল। ইভানের হাতের কাগজটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বলল
–দেখি! দেখি!
সবাই তার দিকে তাকাল। মাত্র পড়ালেখা শিখছে সে। বানান করে পড়তে পারে অনেকটা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল
–এটা তো ইভান ভাইয়ার ঘরে ছিল। আমি পড়তে পারছিলাম না তাই নিয়ে এসেছি বাসায়। ঈশা আপুকে পড়তে দিবো। কিন্তু আপু ছিলনা বলে টেবিলে রেখেছিলাম।
ইরার কথা শুনে সস্তির নিশ্বাস ফেলল সবাই। কিন্তু পরক্ষনেই আবার থম্থমে পরিবেশে ইরিনা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল
–তাহলে কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা? এখন তো রহস্যের কিনারা হল না।
ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। গম্ভির গলায় বলল
–তোরা যে পড়ালেখা করিস না সেটার সত্যতা তোর কথায় প্রমান হল। এটা রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বিখ্যাত উক্তি। ভাল লেগেছিল তাই আমার ডাইরিতে লিখেছিলাম। ডাইরির পাতাটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। আর সেটাই ইরা নিয়ে যায় আমার ঘর থেকে।
সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। এতক্ষনে জটিল রহস্যের সমাধান হল। ইভান বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ইরাকে নিয়ে নিচে যেতে বলল
–ভাগ্যিস ইরা রহস্যের সমাধান করে দিলো। নাহলে আজ না জানি আমাকে কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হত। কার না কার সাথে আমাকে তোরা জুড়ে দিতিস। শেষে দেখা জেত তোদের জন্য আমাকে অগ্নি পরিক্ষা দিতে হচ্ছে।
কথা শেষ করে ইভান নিচে চলে গেলো। ঈশাও কিছুক্ষন বসে থেকে বলল
–আমার ঘুম পাচ্ছে।
ওর কথা শুনে সবাই সম্মতি দিলো। একে একে উঠে নিচে চলে এলো। নিচে এসে দেখে ইভান সোফায় বসে টিভি দেখছে। আর ইরা ওর কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঈশা একটুক্ষণ ইভান কে দেখে কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল
–ইভান ভাইয়া। ইরাকে আমার কোলে দাও। আমার পাশে শুয়ে দিবো।
ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। একটু ভেবে বলল
–চল। আমি দিয়ে আসি।
বলেই ইরাকে কোলে নিয়ে উঠে পড়ল। ঈশা আর কথা বাড়াল না। পাশে হাটতে হাটতে আচমকা ঈশা একটা অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন করে বসলো
–আচ্ছা তুমি তখন বললে কেন রাতে ঘুমালে সকালে পাশের বাড়িতে তোমাকে পাওয়া যাবে।
ইভান অতি বিস্ময় নিয়ে তাকাল। যে উদ্দেশ্যে কথাটা সে বলেছিল ঈশা যে সেটা ঠিক সেভাবেই ধরে ফেলেবে সেটা তার ধারনা ছিলনা। ভেবেছিল ঈশা হয়ত বুঝতে পারবে না। বুঝতে পেরেছে ভেবেই নিজের হাসিটা চেপে রেখে সাভাবিক ভাবেই বলল
–ঐ সময় যেহেতু তোর চুরি করার কথা হচ্ছিল। তাই আমাকে চুরি করে তো তোর বাড়িতেই নিয়ে যাবি। নিশ্চয় চুরি করে সোনিয়ার বাড়িতে রেখে আসবি না।
তেলে বেগুনে জলে উঠল ঈশা। কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সে। ইভান বুঝতে পেরে ঠোট চেপে হাসল। ঘরের ভিতরে ঢুকে ইভান ইরাকে বিছানায় শুয়ে দিলো। ঈশা পাশেই দাড়িয়ে আছে। ইভান বের হতে গিয়েও থেমে ঘুরে তাকাল। ঈশা অপেক্ষা করছে কিছু বলবে কিনা সেটা শোনার জন্য। ইভান পকেট থেকে চকলেট বের করে ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ঈশা এক পলক সেটার দিকে দেখে ইভানের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি দিয়ে নিয়ে নিলো। ইভান দাড়িয়েই ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ঠোটের কোনে চাপা হাসি নিয়ে বলল
–কিছু বলবে?
ইভানের কথা মাথায় ঢুকতেই ঈশার হাসি মিলিয়ে গেলো। স্থির দৃষ্টি অস্থির হয়ে উঠল। মাথা ভনভন করে ঘুরে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকাল। ইভান শব্দ করে হেসে বের হয়ে চলে গেলো।
‘রাতের শহর’ কথাটা বইতেই পড়েছে ঈশা। এসব সাহিত্যিক কথা বার্তা ঠিক কতো খানি সত্য সেটা সম্পর্কে সিকি খানিও ধারনা নেই তার। রক্ষণশীল পরিবারে সন্ধ্যার আগেই মেয়েদের বাড়িতে ফেরা কঠিন নিয়মের মধ্যেই পড়ে। সব মেনে নেয়া যায় কিন্তু সন্ধ্যার পরে মেয়েদের বাইরে থাকাটা যেন ঘোরতর অপরাধ। এটা কোন ভাবেই মাফ করা যায়না। তাই রাতে শহর দেখার ভাগ্যটা এতো বছরেও কখনও হয়নি ঈশার। দোতলার বারান্দায় বসে আলো আধারের খেলা দেখছে সে। রাস্তার হলদেটে নিয়ন বাতির আলোয় সারা শহর এক মহনীয়ও বর্ণ ধারন করেছে। দোতলা থেকে খুব একটা বেশী দূর পর্যন্ত দেখা না গেলেও যা দেখা যায় তাতেই ঈশা বেশ সন্তুষ্ট। কারন এটাই দেখার ভাগ্য হয় না তার। এখন নেহাত পড়ালেখা নেই তাই এতো সময়। নাহলে তার নিস্তার কই। মাথাটা আর একটু গ্রিলের দিকে বাড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল এক প্রেমিক যুগলের রিকশা ভ্রমন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা সাদা জামদানি শাড়ি পরেছে আর ছেলেটা নীল পাঞ্জাবী। তাদের এই শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর হলদেটে নিয়ন আলোয় সম্পূর্ণ বিপরীত বর্ণ ধারন করেছে। যার তুলনা কোনভাবেই করা সম্ভব না। সাদা শাড়ীটা ঈষৎ কালচে হলুদ লাগছে। আর নীল পাঞ্জাবী এক গাড় কালচে রঙ ধরেছে। সামনের শপিংমলের বিলবোর্ডের ছবির মেয়েটা মাঝে মাঝে উজ্জ্বল শুভ্র আলোয় হেসে উঠছে। সম্ভবত কোন ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপন হবে। গালে হাত দিয়ে সেদিকে কিছুক্ষন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকলো। রিকশাটা পার হয়ে যেতেই ঘোর কেটে গেলো তার। স্বাভাবিক জীবনের অভ্যাসেই ডাইরি আর কলমটা হাতে তুলে নিলো। কিছুক্ষন আগেই দেখা দৃশ্যের পটটাতে নিজেকে আর পাশে তার বিশেষ মানুষকে কল্পনা করে লিখে ফেলল কিছু কল্পনাময় প্রহর। নিজের মনের ইচ্ছাটার গতিবিধি ঠিক কতদুর। আদৌ সে গুটি গুটি পায়ে তার গন্তব্য মানে বাস্তবতায় পৌছাতে পারবে কিনা সেটা জানা নেই তার। তবুও ভাবতে তো মানা নেই। মন সে তো দিগ্বিদিক ভুলে ছুটে বেড়ায় এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। অসীম সাহস তার। আর সেটা যদি কিশোরী মন হয় তাহলে তো কথাই নেই। তার যে এক অন্য জগত আছে। সেই জগতের রানি শুধু সেই। নীল রঙের কালি দিয়ে শুভ্র রঙের পাতায় ফুটিয়ে তুলল নিজের কল্পনার কিছু প্রেমপ্রহর।
“এই যে শুনছো?
‘এই ঘনায়মান রাতের অন্ধকার রুপের অপার সৌন্দর্য দেখে যেখানে মন ভালো হওয়ার কথা ছিল সেখানে আমি আজ বড্ড উদাসীন। কারণটা আমার অজানা। কিন্তু জানো কোথাও একটা সুপ্ত আশা জমে আছে যেখানে বেহায়া মন চিৎকার করে বলছে,
তুমি আসবেই। আর এই রাতের শহরের মোহনীয় সৌন্দর্য, শরীরে হলদেটে আলোর ছোঁয়া, মাথার উপরের আকাশে হাজার তারার পসরা সাজিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। আমাকে ডাকবে। আর আমি কোনদিকে না তাকিয়েই ছুটে চলে যাবো। তোমার হাত ধরে খালি পায়ে হাঁটবো পিচ ঢালা রাস্তায়। সময়টা থমকে দাঁড়াবে। প্রেমিক যুগলের পাগলামো দেখে সময় নিজের গতি ভুলে মুগ্ধতায় ভরে উঠবে। আর সেই সুযোগে অনন্তকাল চলবে তোমার আমার এই প্রেমপ্রহর।’
ইতি
তোমার মায়াজালে আবদ্ধ এক কিশোরী ”
–এখানে এভাবে বসে কাকে দেখছিস?
পাশের বারান্দা থেকে ভারি গলার আওয়াজ পেয়েই চমকে উঠল ইশা। হাত থেকে ডাইরি কলম দুইটাই মেঝেতে পড়ে গেলো। চোখ তুলে পাশের বারান্দায় তাকাল। ইভান ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাত্র গোসল করেছে মনে হয়। ভেজা চুলগুলো খুব যত্ন করে গুছিয়ে রাখা। চিরুনি না করলেও হাত দিয়েই চুল গুছিয়ে রাখাতে ইভান বেশ পটু। আর মনে হয় তার চুল গুলাও এই হাত দিয়ে গোছানটা উপভোগ করে। অবশ্য ঈশাও কম উপভোগ করেনা।
–দেখা শেষ হলে আমার উত্তরটা দিয়ে ধন্য করুন ম্যাডাম।
আবারো ইভানের কথায় এবার ঘোর কাটল ঈশার। একটু ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–তোমার সব সময় কেন মনে হয় আমি কাউকে দেখি?
ইভান তোয়ালেটা মেলে দিল। দেয়ালে হেলানি দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল। সামনে তাকিয়েই বলল
–না দেখলে বারান্দায় বসার কি কোন কারন আছে? কাউকে না কাউকে তো অবশ্যই দেখিস। অবশ্য তোর……।
কথা শেষ করতে দিলনা ঈশা। মাঝেই থামিয়ে দিয়ে বলল
–তুমিও কি কাউকে দেখ?
ইভান বিস্ময় নিয়ে ঘুরে তাকাল ইশার দিকে। কিছুক্ষন শান্ত চাহুনিতে তাকিয়ে থেকে বলল
–দেখি তো। এত দেখি তবুও মন ভরেনা। দেখতেই ইচ্ছা হয় বারবার। একেক সময় একেক রুপ তার। ভীষণ মায়া তার মাঝে। ঐ এক সমুদ্র সম্মোহনী দৃষ্টির গভিরে হারিয়ে যাই আমি।
ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা সেই মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে আছে। ইভানের দৃষ্টির মানে হয়ত ঈশা দেখলেও বুঝতে পারত না। কঠিন দৃষ্টি হুট করেই অসহায় হয়ে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে শান্ত সরে বলল
–ঈশা।
ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভান কে সামনে তাকাতে দেখে ধরেই নিল সে সোনিয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই কোন কথা বলল না। ইভান সবটা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল
–ঘরে যা। শুয়ে পড়।
ঈশা দিরুক্তি করল না। উঠে চলে গেলো ঘরে। ইভান সামনেই তাকিয়ে আছে। পাশের বারান্দার দরজা লাগানোর আওয়াজে বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কিন্তু চোখ ফেরালনা। ইচ্ছা করছে না কিছুতেই। সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও মন যে অন্য জায়গায় আটকে আছে। আকাশের ঝলমলে তারা গুলর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। তারপর উঠে চলে গেলো একদম নিচে। একাকীত্ব কাটাতে কিছুক্ষন একা একা রাস্তায় হাঁটলে খারাপ লাগবে না। বাসা থেকে বের হয়ে একা একা সোজা রাস্তা ধরে হাঁটছে সে।
ঈশা এতক্ষন নিজের সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে জানালার পাশে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল। তারও মনটা বেশ খারাপ। জানালা দিয়ে নিচে তাকাতেই চোখ পড়ল ইভানের দিকে। বাসার সামনে দাড়িয়ে ফোনে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে ফোনের আলোটা ইভানের মুখে পড়ছে সরাসরি। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। ইভান সামনের দিকে চোখ তুলে তাকাল। সেই জানালায় বসে থাকা মেয়েটির দিকে চোখ পড়ল। মেয়েটি ইভান কে দেখেই মিষ্টি হাসি দিয়ে হাত উচিয়ে ইশারা করল। ইভান বেশ বিরক্ত হয়ে চোখ ফিরিয়ে বাসার ভিতরে চলে গেলো। সবটা দেখে ঈশা নিজের অজান্তেই হেসে ফেলল। জানালা বন্ধ করে ঘুমাতে গেলো।
ইরিনা চমকে ফিরে তাকাল। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুকে থুথু দিয়ে বলল
–আস্তে ডাকতে পারিস না। এতো জোরে চিল্লাস কেন? হায় আল্লাহ! এই মেয়ে শশুর বাড়িতে গিয়ে যে কিভাবে সংসার করবে?
ঈশা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। অবাক হয়ে বলল
–আমি আবার কখন জোরে কথা বললাম?
ইরিনা পানি দিতে দিতেই সাভাবিক ভঙ্গিতে বলল
–কি বলবি বল?
–কাল ইশান ভাইয়ার জন্মদিন।
ইরিনার হাত থেকে পাইপটা পড়ে গেলো। লাফ দিয়ে ঘুরে দারিয়ে ইশার কাধে হাত দিয়ে বলল
–একদম ভুলে গেছিলাম রে। ভাল কথা মনে করেছিস। আজ রাতে অন্তত একটা সারপ্রাইজ পার্টি এরেঞ্জ করা দরকার। ইভান ভাইয়াকে বলতে হবে এখন। চল তাড়াতাড়ি।
তখনি ইরিনার ডাক আসলো নিচ থেকে। ঈশা পিছনে ঘুরে সাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল
–তোমার কাছে।
ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। ইরিনা নিচে চলে গেলো। ইভান ধির পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে কঠিন ভাবে বলল
–বেলা শেষে আমার কাছেই তোকে আসতে হবে। এটাই তোর জিবনের বড় সত্য।
ঈশা ইভানের চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির করল। দুজনের দৃষ্টি দুজনের চোখে। অজানা এক নিরব অনুভুতির আদান প্রদান। মস্তিষ্ক সেই ভাষা না বুঝলেও মন অক্ষরে অক্ষরে বুঝে গেলো। ঝনঝন আওয়াজে দুজনেই চোখ নামিয়ে নিলো। ইরিনার হাত থেকে কাচের প্লেট পড়ে গিয়েছে। পুরো ছাদে বিছিয়ে পড়েছে কাচের টুকরো। সবাই সেদিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। ইরিনা ভিত দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়েই কাদকাদ সরে বলল
–মা জানলে আমাকে মেরে ফেলবে।
ঈশা হতাশ শ্বাস ছেড়ে বলল
–সেটা পরের কথা। আগে এগুলো তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে পায়ে লেগে যাবে।
–দাড়া আমি ঝাড়ু আনি।
ইভান একটু বিরক্ত হয়ে ধমকের সুরে বলল
–পুরো ছাদে যে বন্যা বয়ে ফেলেছিস সেটা কি মাথায় আছে? পানিটা আগে বন্ধ কর।
ইরিনা জিভ কেটে পার হয়ে আসতে নিলেই ঈশা হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে
–এদিকে আসিওনা। পায়ে কাচ লাগবে। তুমি ঝাড়ু আনো। আমি পানি বন্ধ করছি।
ঈশা পায়ের দিকে তাকিয়েই মৃদু কণ্ঠে বলল
–সিঁড়ির নিচে খুলে রেখেছি।
ইভান নিজের পায়ের স্যান্ডেল খুলে বলল
–এগুলা পরে যা। পায়ে কাচ ঢুকবে।
ঈশা মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–ঢুকবে না।
বলেই পা বাড়াতেই ইভান হাত টেনে ধরল। ঈশার পুরো শরিরে কাটা দিয়ে উঠল। পিছনে ঘুরে কিছু বলার আগেই ইভানের মুখ দেখে থেমে গেলো। রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। কঠিন গলায় বলল
–মতামত জানতে চাইনি। সিদ্ধান্ত জানায়ে দিছি।
ঈশা আর কিছু বলতে পারল না। কথা বললেই ইভান রেগে যাবে। তাই মাথা নামিয়ে জুতো জোড়া পায়ে ঢুকিয়ে এগিয়ে গিয়ে পানির ট্যাপ বন্ধ করে দিল। বড় জুতো পরায় হাটতে অসুবিধা হচ্ছে। আর পুরো ছাদ ভেজা তাই আরও বেশী অসুবিধা হচ্ছে। পা পিছলে যাচ্ছে। ঈশা সাবধানে পা টিপে টিপে হাঁটছে। কিন্তু একটা ছোট ইটের টুকরো জুতোর নিচে পড়তেই পা পিছলে গেলো। ঈশা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। কিন্তু খেয়াল করল কেউ একজন পরম জত্নে তাকে নিজের সাথে জরিয়ে রেখেছে। তার বুকের ঢিপঢিপ আওয়াজ মাদকতা ছড়াচ্ছে চারিদিকে। মিষ্টি ঘ্রাণটা ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছে মস্তিস্কে। কিছুক্ষন থাকার পরেই ঈশার অসস্তি হচ্ছে। সে একটু নড়েচড় উঠতেই ইভান তাকে ছেড়ে দিল। ঈশার দিকে তাকিয়ে বিচলিত কণ্ঠে বলল
–তুই ঠিক আছিস তো?
ঈশা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। এর মধ্যেই ইরা গুটি গুটি পায়ে এসে দরজা থেকে বলল
–ইভান ভাইয়া।
ইভান তার দিকে ঘুরেই চিৎকার করে বলল
–ওখানেই থাক টুনটুনি। এদিকে আসিস না পায়ে কাচ ঢুকবে। দাড়া আমি আসছি।
বলেই পা বাড়াতেই ঈশা হাত ধরে ফেলল। ইভান থেমে গেলো। বিস্ময়ে ঘুরে তাকাল। প্রথমে হাতের দিকে তারপর ঈশার দিকে। ঈশা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইভান বিশ্বাস করতে পারছে না ঈশা তার হাত ধরেছে।
–মাথায় কি কিছু নেই নাকি? তুমি খালি পায়ে যাচ্ছ কেন?
বলেই স্যান্ডেল খুলে সামনে দিল। ইভান মুচকি হাসল। ইরিনা ঝাড়ু নিয়ে অবশেষে বের হল। তার চুলে মাকড়শার জাল আটকে আছে। চেহারা দেখার মতো। দেখে মনে হচ্ছে বহু জুদ্ধের পর ঝাড়ু খুজে পেয়েছে। ঈশা তাকে দেখেই হেসে দিল। ইভান স্যান্ডেল পায়ে ইরার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আসলো। পাশে শুকনো জায়গায় দাড়ায়ে রাখল। ঈশা আর ইরিনা ততক্ষনে কাচ পরিস্কার করতে শুরু করেছে। ঈশার পায়ের কাছে একটা কাচ পড়ে আছে। ইভানের চোখে সেটা লাগতেই সে এগিয়ে কাচটা ধরতেই তার হাতে ফুটে যায়। ‘আহ’ শব্দ উচ্চারন করতেই ঈশা ঘুরে তাকায়। ইভানের হাত কেটে গেছে। ঈশা সব কিছু ফেলে ইভানের হাত ধরে ফেলে। পাশে সিমেন্টের বসার জায়গাটায় বসিয়ে দিয়ে হাতটা চেপে ধরে ধরে বলে
–ইশ! কেটে গেছে।
ইভান স্থির হয়ে দেখছে ঈশাকে। ঈশা বেশ বিচলিত হয়ে বলল
–রক্ত বের হচ্ছে।
সূর্যের প্রখরতা হঠাৎ করেই নরম হয়ে গেলো। রোদ্রজ্জল ঝলমলে দিন কেমন বিষাদময় হয়ে উঠলো। আকাশে এক পাশে কালো মেঘ জমেছে। আর এক পাশে শুভ্র মেঘের আনাগোনা। সেই শুভ্রর বুকে নীল মাথা গুঁজে লুকিয়ে আছে। আবছা দর্শন পাওয়া যাচ্ছে তার। এ যেন শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর চলছে। এতক্ষন তপ্ত গরমে ক্লান্তির রেশে অশান্তি লাগছিল ঈশার। এখন বাতাসের উত্তপ্ত ভাবটা কমে গিয়ে শিতলতা ছড়াচ্ছে কিছুটা। গরমে ঘেমে থাকা শরীরে হালকা বাতাস বেশ শীতল অনুভুতি দিচ্ছে। রিকশা থেকে নেমে দাড়িয়ে আছে সেই চিরচেনা রেস্টুরেন্টের সামনে। এখানে বেশ কয়েকবার এসেছে সে। ইভানের সাথেই এসেছে। কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। কিন্তু তার মনে হয়েছে ইভানের এই জায়গাটা খুব পছন্দ। ইভান দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে ফোনে কি যেন করছে। ঈশা এক পাশে দাড়িয়ে অপেক্ষমাণ দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে তার শাড়ির আচল আঙ্গুলে পেচিয়ে আবার খুলছে। বাকি সবার জন্য অপেক্ষা। একটু আগেই চলে এসেছে দুজন। ঈশা বিরক্ত হয়ে হাত থেকে আচলটা ছেড়ে দিতেই দেখল সবাই এক এক করে রাস্তা পার হয়ে আসছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। ব্যস্ত ইভান এবার নিজের কাজ ছেড়ে লিফটের সামনে দাড়িয়ে বাটন প্রেস করলো। কিন্তু ঠিক সেই সময় তার ফোনে একটা রিং বাজল। খানিক দূরে দাড়িয়ে সে ফোনটা রিসিভ করলো। লিফটের দরজা খুলতেই সবাই ধিরে ধিরে লিফটে উঠছে। কিন্তু ঈশা ঠায় দাড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়ছে তার। লিফটে মারাত্মক রকমের ফোবিয়া আছে তার। উঠলেই মাথা ঘুরে যায়। আর প্রচণ্ড রকমের ভয় পায়। কেউ হাত না ধরলে নিজে থেকে লিফটে উঠার সাহস সে কখনই পাবে না। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগেই সায়ান আরেকবার বাটন প্রেস করে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–চলে আসো ঈশা।
পা বাড়িয়েও আবার পিছিয়ে গেলো সে। চোখ বন্ধ করে শ্বাস ফুলিয়ে নিজেকে শক্ত করে নেয়ার চেষ্টা করে আবার পা বাড়ানোর আগেই একটা শক্ত পোক্ত হাত তার হাতের ভাজে স্পর্শ করলো। বন্ধ চোখেই গভির ভাবে অনুভব করলো সে। এ যেন এক ভরসার হাত। কোমলভাবে চোখ মেলে পাশে তাকাতেই দেখল ইভান খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে এক হাতে ফোন ধরে টাইপ করছে আর এক হাত ঈশার হাতের ভাজে। ঈশাকে এক প্রকার টেনে নিয়েই ভিতরে ঢুকল। একদম পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো দুজনে। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই ঈশা চোখ মুখ খিচে ইভানের বাহু দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরল। ইভান মুচকি হেসে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে ঈশাকে দেখছে। চোখ মুখ খিচে ভীত হরিণীর মতো তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। এই ভীত চেহারাটাই তাকে ভীষণ করে আকর্ষণ করে। এক অন্য রকম মায়া কাজ করে। লিফট এসে থামল। দরজা খুলতেই ঈশা ইভান কে ছেড়ে দিলো। সরে দাঁড়ালো। লিফট থেকে নেমে কয়েক কদম যেতেই রেস্টুরেন্ট। সবাই ভিতরে ঢুকে পাশাপাশি দুইটা টেবিলে বসে পড়ল। ঈশার বাম পাশে ইরিনা বসেছে কিন্তু ডান পাশের চেয়ারটা ফাকা। সামনে তাকিয়ে দেখল সেই সুন্দরি মেয়েটা সায়ানের পাশে বসেছে। ইরিনার দিকে চেপে গিয়ে মৃদু গলায় বলল
–ওই মেয়েটা কে?
–সায়ান ভাইয়ার বোন।
ইরিনা ফিসফিস করে বলতেই ঈশা খেয়াল করলো সবাই আছে কিন্তু ইভান নেই। সায়ান সবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলো
–কি খাবে অর্ডার করো।
সবাই নিজ নিজ পছন্দের খাবারের অর্ডার করলো। কিন্তু ঈশা এখনো বসে আছে। সায়ান শান্ত কণ্ঠে বলল
–ঈশা তুমি কি খাবে?
ঈশা একটু নড়েচড়ে বসে বলল
–আমি আইস্ক্রিম খাব।
ঈশার জন্য তার পছন্দের আইস্ক্রিম অর্ডার করা হল। কিন্তু ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আর কি। খাওয়া কপালে না থাকলে চাইলেই কি আর পাওয়া যায়। আইস্ক্রিমের চামুচটা মুখে তুলতেই কেউ একজন পাশ থেকে হাত ধরে ফেলল। ঈশা মুখ হা করে তার হাতের আইস্ক্রিমের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি সবার দৃষ্টি সেই মানুষটার দিকে স্থির। ইভান মাথাটা ঝুকিয়ে ঈশার হাতে ধরা চামুচটা নিজের মুখে ঢুকিয়ে দিলো। তারপর হাত থেকে চামুচটা নিয়ে পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। আইস্ক্রিমের বাটিটা নিজের সামনে নিয়ে খেতে শুরু করে দিলো আনমনে। ইভানের এমন আচরনে সবাই স্বাভাবিক থাকলেও সায়ান খুব বিরক্ত হল। মুখে বিরক্তিকর ভঙ্গি রেখেই বলল
–এটা কি ইভান? ওটা ঈশার জন্য ছিল। তুই খেতে চাইলে তোর জন্য আলাদা অর্ডার করতে পারতিস। অযথা মেয়েটার আইস্ক্রিম নিয়ে নিলি। দেখ মন খারাপ করে বসে আছে।
ইভান কোন উত্তর দিলো না। এক হাতে আইস্ক্রিম খেয়েই যাচ্ছে আর আরেক হাতে ফোনে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মনে হচ্ছে কারও কথা তার কানেই যাচ্ছে না। সায়ান ইভানের আচরন সম্পর্কে বেশ অবগত। তার যদি মনে হয় যে উত্তর দিবে না তাহলে সেটার উত্তর আশা করা বোকামি। তাই আর কথা না বাড়িয়ে ঈশার দিকে তাকাল। আশস্তের সুরে বলল
–তোমার জন্য আমি আবার আইস্ক্রিম দিতে বলছি ঈশা। মন খারাপ করনা।
–ঈশা আইস্ক্রিম খাবে না।
ইভানের কথা শুনে সায়ান বিরক্ত হয়ে আবারো বলল
–কেন খাবে না? ঈশা নিজেই আইস্ক্রিম খেতে চেয়েছে। আমি আবার দিতে বলছি।
ইভান এবার সায়ানের দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ভাবে বলল
–ঈশার টনসিলের ইনফেকশন আছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলেই গলায় প্রবলেম হয়। ও তো কোন কিছু না ভেবেই সামনে যা পায় মুখে ঢুকিয়ে দেয়। কিন্তু আমিও তো আর ওর মতো নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতে পারিনা। মেজ মা তার মেয়েকে ভরসা করে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। আমি সেই ভরসা নষ্ট করে তাকে কিভাবে অসুস্থ বানায়ে বাসায় নিয়ে যাই?
ইভানের কথা শেষ হতেই সবাই আবারো ইভানের দিকে তাকাল। ইভান কঠিন চোখে একবার তাকাতেই সবাই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। এমন ভাব যেন এখানে কিছুই হয়নি। মুখ কালো করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে ঈশা। মাঝে মাঝে আড় চোখে ইভানের দিকে তাকাচ্ছে। সে কোনদিকে না তাকিয়ে খেয়েই যাচ্ছে। ঈশার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল তার উপরে। এক রাশ অভিমান চোখে মুখে নিয়ে নত দৃষ্টিতে বসে আছে সে। খানিকবাদে ওয়েটার স্যন্ডুইচ এনে ঈশার সামনে দিয়ে গেলো। কিন্তু অভিমানি ঈশা সেদিকে ফিরেও তাকাল না। সে যে আইসক্রিমই খাবে। জেদ! সায়ান স্যান্ডুইচের দিকে তাকিয়ে ইভানের উদ্দেশ্যে শান্ত ভাবে বলল
–আইস্ক্রিম ছাড়া আর কি খাবে সেটা জানতে চাইলিনা একবারও? ঈশা কি এটা খাবে?
–খাবে।
ইভানের আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে সায়ান বেশ অবাক হল। সোজা হয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো শেষটা দেখার জন্য। ঈশা আদৌ এই জিনিসটা খাবে কিনা। সবাই নিজ নিজ খাওয়ায় ব্যস্ত। কেউ আর ঈশার দিকে তাকাবেনা। কারন ঈশার নখরা সম্পর্কে সবার জানা। বেশী সাধলে অযথা চোখের পানি ছেড়ে ভাসিয়ে দিতেও দুই মিনিট ভাববে না। ওকে একমাত্র ইভানই ঠিক ঠাক চালাতে পারে। তা ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব না। ফোনটা পাশে রেখে ঈশার দিকে মনোযোগ দিলো ইভান। প্লেটটা ঈশার দিকে এগিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল
–এটা তো তোর অনেক পছন্দ। তবুও খাবি না?
ঈশার কোন উত্তর আসলো না। ইভান আশাও করেনি। সে জানে ঈশা কোন কথাই বলবে না। ইভান এবার আইস্ক্রিম খেতে খেতে বলল
–খাস না। এভাবেই বসে থাক। কিন্তু এভাবে অভিমান করে থাকলে যখন নিজের পছন্দের জিনিস গুলা অন্য কেউ নিয়ে নিবে। অন্য কেউ যখন অধিকার দেখাবে তখন মানতে পারবি তো?
ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ইভান তার দিকে তাকাতেই দাতে দাত চেপে বলল
–সবাই তো আর তোমার মতো না। পছন্দের জিনিস গুলা কেড়ে নেয়।
ইভানের হাতে ধরে রাখা আইস্ক্রিমের চামুচ টার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো বলল
–তুমি দুনিয়ার সব থেকে নিষ্ঠুর মানুষ ইভান ভাইয়া। মানুষের পছন্দের জিনিস কেড়ে নিয়ে কষ্ট দাও। তোমার একটুও মায়া হয়না?
ইভান সাভাবিকভাবেই বলল
–আমার মতো কেউ না হলেই ভালো। আমার মতো হোক সেটা আমি চাইনা। আর মনের মধ্যে এতো মায়া রাখলেই সমস্যা। সবার প্রতি মায়া দেখাতে গেলে তখন আবার আরেক প্রবলেম। কাছের মানুষটার কম পড়ে যাবে। তার কষ্ট হবে। সেটা আবার আমি সহ্য করতে পারব না।
বলেই হাতের চামুচটা ঈশার মুখের সামনে ধরে আদুরে কণ্ঠে বলল
–আর কেড়ে নিলেও সেটা তো আমিই তাই না? যতটা কেড়ে নিবো তার থেকে অনেক গুন ফেরত দিবো। ভরসা করতে পারিস।
এমন কথা ঈশার হৃদয় ছুয়ে গেলো। পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। ইভান ঈশাকে একটু লজ্জায় ফেলতেই মৃদু হেসে বলল
–রাস্তার মেয়েরা আমাকে কেন হা করে দেখে সেটার কারণটা নাহয় বুঝলাম। অনেকদিন পর দেখে তাই মন ভরে দেখে নেয়। কিন্তু তুই তো নিয়ম করে আমাকে দুই বেলা দেখিস। তবুও জখন দেখিস মনে হয় প্রথমবার দেখছিস।
লজ্জার চেয়ে রাগটাই বেশী প্রাধান্য পেলো। মুখে রক্তিম আভা নিয়ে অভিমানি কন্যা নাক ফুলিয়ে বসে থাকলো। এখন সে কিছুতেই খাবে না আর। সবার সামনে এভাবে বলার কোন মানেই হয়না। বারবার এই একটা বিষয়ে লজ্জায় ফেলতে সব সময় প্রস্তুত থাকে ইভান। ঈশাও কেমন নির্লজ্জ। এভাবে তাকানোর কোন প্রয়োজন আছে কি? ঠিকই তো বলেছে নিয়ম করে তাদের প্রায় দুইবেলা দেখা হয়। আবার বাসায় যখন ছোট খাট আড্ডা হয় তখন তো কথাই নাই। ঈশার ভাবনার মাঝেই ইভান আবার তার মুখের সামনে আইসক্রিমটা ধরল। ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিতেই ইভান বলল
–আদর করে দিচ্ছি। নিবিনা আদর?
ঈশা আবারো অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কি ভেবে মুখে নিয়ে নিলো। বুঝতে পারছে ইভান তাকিয়ে আছে। তারও একবার ইচ্ছা করছে ইভানের দিকে তাকাতে। কিন্তু আবার যদি সেরকম কিছু বলে সেটা ভেবেই আর তাকাল না। চোখ ফিরিয়ে একবার ফোনটা হাতে নিয়ে আবার সেটা রেখে দুই হাতে নিজের চুল ঠিক করতে করতে সামনে তাকাল ইভান। সায়ানের দৃষ্টি ভঙ্গি দেখে আটকে গেলো। সায়ান ঠোঁটে বাকা হাসি নিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো। ইভান প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও পরে বুঝল এতক্ষন সবাই নিজের মতো ব্যস্ত থাকলেও সায়ান তাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ইভান চোখ নামিয়ে হালকা হাসল। সায়ান নিজের হাসিটা প্রশস্ত করে নিয়ে খাবারের দিকে মন দিলো। ইভানের মৃদু হাসি যেন তার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে।
—————-
গোধূলি বেলার আকাশটা নানান রঙ্গে ছেয়ে গেছে। মাথার উপরে কোথাও সাদা কোথাও নীল। আবার সেই দূর দিগন্তে লালচে আভা। সাথে লাল সূর্যটা হেলে পড়েছে দিগন্তের শেষ প্রান্তে ছোট ছোট গাছের পিছনে নিজেকে বিলিন করার উদ্দেশ্যে। রিকশা থামতেই ঈশা হকচকিয়ে নেমে গেলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। সুন্দর মুহূর্ত গুলো এতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায় কেন? মন যে সৌন্দর্যের কাঙ্গাল! সবাই রিকশা থেকে নেমে এক জায়গায় দাড়িয়ে গেলো। পরপর চার ভাইয়ের চারটা বাড়ি দাড়িয়ে আছে। সবগুলো একই ডিজাইনে বানানো। আগে সবাই একসাথে একই বাড়িতে থাকতো। কিন্তু পরিবার বড় হয়ে জাওয়ায় সেই বাড়ি ছোট হয়ে যায়। তাই আলাদা করে নিজেদের বাড়ি করে সবাই। প্রথম বাড়িটা ঈশাদের। তার বাবা মেজ। পরেরটা ইভানদের। তার বাবা সবার থেকে বড়। বাকি দুটো বাড়ি পর পর সেজ আর ছোটর। কিন্তু একসাথে থাকার ফলে একান্নবর্তী পরিবারের রেশটা তাদের মধ্যে থেকেই গেছে। আলাদা বাড়িতে থাকলেও সারাদিনে একবার হলেও একসাথে হয় তারা। বড়রা ছোটরা আড্ডা খুনসুটিতে মেতে উঠে নিজেদের মতো। মনেই হয়না যে তারা আলাদা পরিবার। সবাই বিদায় নিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে চলে গেলো। ইভান শুধু দাড়িয়ে থাকলো। সে ঈশাকে বাসায় দিয়ে তারপর যাবে। সিঁড়ি বেয়ে দুজন দোতলায় উঠলো। কলিং বেল চাপতেই ঈশার মা দরজা খুলে ইভান কে দেখে এক গাল হেসে বলল
–তোরা এসেছিস?
ইভান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–এই নাও তোমার মেয়েকে দিয়ে গেলাম। আমার আর দায় ভার নাই।
ঈশার মা ভ্রু কুচকে বললেন
–দিয়ে গেলাম কি রে ভিতরে আয়।
–না মেজ মা। একটু কাজ আছে। বাসায় যাবো।
ঈশার মা আর কথা বললেন না। বলেও লাভ নাই। ইভান এখন কোনভাবেই শুনবে না। তাই তিনি ভিতরে চলে গেলেন। ইভান যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই ঈশা নিচু গলায় ডাকল
–ইভান ভাইয়া।
বিষয়টাতে ইভান একটু আশ্চর্য হলেও নিজেকে সামলে নিয়ে পুরোটা ঘুরে দাড়িয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল
–বিশেষ কিছু উপহার পেলে ধন্যবাদ হিসেবেও বিশেষ কিছু জিনিস দিতে হয় যে।
–কি বিশেষ জিনিস?
কৌতূহলী কণ্ঠে ঈশা প্রশ্ন করতেই ইভান হেসে ফেলল। ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল
–আজ না! বিশেষ জিনিসটা বিশেষ কোন মুহূর্তের জন্য তোলা থাকলো। তখন বিশেষ মানুষটার কাছ থেকে বিশেষ ভাবে বিশেষ দিনে নিয়ে নিবো।
‘বিশেষ! বিশেষ! বিশেষ!’ এতো বিশেষের মাঝে ঈশার গোছানো চিন্তা ধারা এলোমেলো হয়ে গেলো। তার বোকা বোকা চাহুনির মানে বুঝতে পেরে ইভান শব্দ করে হেসে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। ঈশা দরজায় হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখছে। হঠাৎ সজাগ মস্তিষ্ক অচেতন মনকে প্রশ্ন করে বসলো ‘এই কি তাহলে জীবনের সেই বিশেষ মানুষ?’
–কাজী অফিস।
গম্ভীর আওয়াজে ইভানের সোজা সাপটা উত্তরে গোল গোল চোখে তার দিকে তাকাল ঈশা। কাঠ ফাটা তপ্ত গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। শরীর ঝলসে যাওয়ার উপক্রম। এই অবস্থায় এমন মজা করা কি আদৌ সাজে। বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো ঈশা। ইভান পাঞ্জাবির ডান হাতটা গুটাতে ব্যস্ত। ঈশা সেদিকে এক নজর ফিরতেই চোখ আটকে গেলো। মিনিটে ১০ বার ক্রাশ খাওয়ার মতো চেহারা তার। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবীটা ঘামে পিঠের দিকে লেপটে আছে। ভিজে একাকার অবস্থা। বাম হাতাটা গুছিয়ে সেটা দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে নিলো। ঘামের সাথে লেপটে থাকা চুল গুলো এদিক সেদিক সরে এলোমেলো হয়ে গেলো। ঘর্মাক্ত চেহারাটাও কি অদ্ভুত আকর্ষণীয়।
–এই মামা যাবা?
ইভান হাত উচিয়ে রিকশা ডাকতেই ঈশার ঘোর কেটে গেলো। খুব শান্ত ভাবে পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল
–আমরা যাচ্ছি। তোরা আয়।
বলেই রিকশায় উঠে বসে গেলো। ঈশা ঘোর থেকে বের হলেও ইভানের উপর থেকে চোখ সরাতে তখনও ব্যর্থ। ইভান তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল। মুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে ঈশার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলল
—-দাড়িয়ে থেকে এভাবে না দেখে কাছে এসে বস। কাছে থেকে দেখ। মন ভরে দেখতে পারবি। কেউ ডিস্টার্ব করবে না। কেউ কিছুই বলবে না। আমিও মোটেই বিরক্ত হবো না। প্রমিস!
তার কথা কানে আসতেই চোখ নামিয়ে নিলো। পাশ থেকে ঈশানের চাপা হাসির আওয়াজ কানে আসলো। সেদিকে একবার শক্ত চোখে তাকালেও সে দমে গেলো বলে মনে হল না। মুখে হাত চেপে হাসতে লাগলো। ঈশা আর দেরি করলো না। লজ্জা নিয়েই রিকশায় উঠে বসলো। ইভান পাঞ্জাবির হাতায় ঘাম মুছে সামনে তাকিয়েই বলল
–মামা কাজী অফিস চল।
রিকশাওয়ালা আর ঈশা দুজনই গোল গোল চোখে ইভানের দিকে তাকাল। সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। সে ঘাড় বেকিয়ে পিছনের রিকশা গুলকে দেখছে। সবাই একে একে রিকশায় উঠে বসলো। কিন্তু ঈশার মাথায় আরও জটিল ভাবে তাল গোল পেকে গেলো। কাজী অফিস কেন যাচ্ছে? রিকশাওয়ালা ইভানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। পিছনের রিকশা গুলো এগিয়ে যেতেই ইভান সামনে ঘুরল। রিকশাওয়ালা তাদেরকে এগিয়ে যেতে দেখে অন্য রকম একটা হাসি দিয়ে রিকশা চালাতে শুরু করলো। অনেক্ষন চুপ করে থাকার ফলে ঈশার মস্তিষ্কে এলোমেলো চিন্তা ভিড় করছে। নাহ! আর চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। ইভানের দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভাবছে সেটা নিশ্চিত। কিন্তু ঈশার প্রশ্নের উত্তর তো তার চাই। তাই নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করলো
–ইভান ভাইয়া আমরা কাজী অফিসে কেন যাচ্ছি?
ঈশার প্রশ্ন শুনে এমন ভাবে তাকাল যেন সে কোন ভয়ানক রকমের কোন বাজে কথা বলে ফেলেছে। এখনি তাকে ফাসির শাস্তি দিলেও খুব একটা ভুল হবে না। সেভাবে তাকিয়েই শান্ত সরে বলল
–কাজী অফিসে কি করে?
–বিয়ে করে।
ঈশা নিজের উত্তরে নিজেই থেমে গেলো। একটু ভেবে বিস্ময়কর ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো
–কিন্তু কার বিয়ে?
ইভান বিরক্তিকর ভঙ্গিতে তাকাল। ঈশা বুঝে গেলো এবার আর কোন প্রশ্ন করে লাভ হবে না। এরকম দৃষ্টিতে তাকান মানে কথার ঝুলি ফুরিয়ে এসেছে। সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করলেও কোন কথা বেরবে না। তবে গালে থাপ্পড় পড়তে পারে। তাই আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলো। মস্তিষ্ক নিজের গতি মতো বিভিন্ন অসনি সঙ্কেত দিতে লাগলো। সব কটি ঘাবড়ে জাবার মতো। কিন্তু আসলেই কি ঘাবড়াবার মতো কোন কারন আছে কিনা ঈশার জানা নেই। তবে বিশ্বাসও করতে পারছে না। খুব টেনশন হচ্ছে তার। এতক্ষন গরমেও সে দমে যায়নি। কিন্তু টেনশনে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। শাড়ির আচল তুলে কপালে মুখে জমে থাকা ঘাম মুছে ফেলল। তার কাজিন সম্প্রদায়ের উপরে বিশ্বাস করা বিপদের থেকে কম কিছু না। তারা যে কোন মুহূর্তে যে কোন অসম্ভব ঘটনা কে সম্ভব করতে পারে। ইভানের ফোন উচ্চ শব্দে বেজে উঠলো। শব্দে ঈশার ঘোর কেটে গেলো। হাতেই ধরে ছিল সে ফোনটা। তাই একবার সেদিকে তাকিয়ে ধরে ফেলল। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই ইভান শান্ত সরে বলল
–বল।
ওপাশের ব্যক্তিটা কি বলল সেটা ঈশার কানে আসলো না। কিন্তু কিছুক্ষন চুপ থেকে ইভান বলল
–কাজী অফিসে যাচ্ছি।
আবার একটু হেসে বলল
–বউ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। যেখানে স্বয়ং আমি আছি সেখানে বউকে নিয়ে এতো ভাবার কিছু নাই।
ঈশা বড়বড় চোখে তাকাল ইভানের দিকে। কে বউ? শুকনো ঢোক গিলল। ইভান এবার শব্দ করে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল
–এতো কথা এখনি বলতে পারব না। এতো কৌতূহল থাকলে কাজী অফিসে চলে আয়। বিয়েটা নিজে চোখেই দেখবি। নাহলে আবার পরে বলবি বন্ধু হয়েও তোরা কিছুই জানলি না। আফসোস করার সুযোগ দিতে চাইছি না। চলে আয়। আমি অর্ধেক রাস্তায়। পৌছার আগেই চলে আয়। নাহলে কিন্তু বিয়েটা আর দেখা হবে না। বরের আবার ধৈর্য কম। জানিস তো।
বলেই হেসে উঠলো। ফোনটা কেটে দিয়েও হাসছে সে। হাসি মুখেই ঈশার দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে ঠোট কামড়ে ভালো করে দেখে নিলো। অবাক চোখে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
–তুই শাড়ি পরেছিস?
ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান আবার বিস্ময়ের ভঙ্গিতে বলল
–নীল শাড়ি কেন? অন্য রঙ ছিল না?
ঈশা কি বলবে বুঝতে পারলো না। চোখ নামিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–কার বিয়ে ইভান ভাইয়া?
ইভান ঈশার দিকে ভ্রু কুচকেই তাকিয়ে থাকলো। অনেক্ষন দেখে নিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। বলল
–আমার।
ঈশার বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। ইভানের দিকে তাকাল। সে সামনে তাকিয়ে আছে। ঠোটের হাসিটা এখন বেশ স্পষ্ট। হঠাৎ করেই অতি প্রিয় রিকশা ভ্রমণটা বিরক্তিকর হয়ে উঠলো। বাতাসটাও কেমন গরমে তেতে উঠেছে। নিঃশ্বাস নিতে ভীষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে। একটু দুরেই রিকশা থেমে গেলো। ঈশা মাথা তুলে পাশে তাকাল। বড়বড় করে লেখা ‘কাজী অফিস’। রিকশা থেকে নেমে এক পাশে দাঁড়ালো সে। ইভান ভাড়া মিটিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ালো। বাকি কাজিনরাও এসে একে একে তাদের পাশে দাঁড়ালো। ঈশা কারও দিকে তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করেই দাড়িয়ে আছে।
–কেমন আছো ঈশা?
কিঞ্চিত পরিচিত গলা শুনে ঈশা মাথা তুলে তাকাল। ইভানের বন্ধু সায়ান। সে অনেকবার এই ছেলেটাকে তাদের বাসায় আসতে দেখেছে। জোর করে হেসে বলল
–ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?
–ভালো আছি।
ঈশান এগিয়ে এসে সবাইকে উদেশ্য করে বলল
–এখন ভিতরে চল। সব রেডি।
ঈশা এবার মাথা তুলল। চারিদিকে ভালো করে তাকাল। সবাই তার কাজিন। শুধু ইভানের কয়েকজন বন্ধু এসেছে। ঈশা খুব শান্ত সরে বলল
–বউ কোথায়?
ঈশার এমন বোকা বোকা প্রশ্ন শুনে সায়ান তার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাল। কিন্তু বাকি সবার চেহারায় বেশ স্বাভাবিকতা। ইভান নরম কণ্ঠে বলল
–আসলে ওকে কিছু বলা হয়নি এখনও। কিছুক্ষন পরে সবটা তো দেখতেই পাবে।
ঈশা আবার চোখ নামিয়ে নিলো। পরিবেশটা বিষাক্ত লাগছে। এখানে আর থাকতে ইচ্ছা করছে না তার। সবাই একে একে কাজী অফিসের ভিতরে ঢুকল। ঈশা ভিতরে ঢুকে এক পাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো। সবাই বিভিন্ন খোশ গল্পে মত্ত। চাপা গল্পে মাঝে মাঝে খিলখিল করে হেসে উঠছে সবাই। ঈশার মুখে কালো মেঘের ছায়া। সে এক হাতে শাড়ির আচলটা পেঁচাচ্ছে আবার খুলছে। একটু পরে ইভান বাইরে থেকে এসে সবার উদ্দেশ্যে বলল
–তাহলে বিয়েটা শেষ করা যাক।
ঈশা সেদিকে তাকাল। একটা সুন্দরি মেয়ে তার পাশে দাড়িয়ে। মিষ্টি হাসি মুখে। মেয়েটা বেশ সুন্দর। কিন্তু এই মুহূর্তে ঈশার তাকে খুব বিরক্ত লাগছে। একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান হাসি মুখে নিয়ে মেয়েটার সাথে কথা বলছে। ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো আবার। ইভান চোখ দিয়ে ইশারা করতেই সবাই এগিয়ে গেলো। ইলু আর সায়ান কাজী সাহেবের সামনে বসতেই ঈশা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। ওরা দুজন কেন বসেছে ওখানে? ঈশার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। এগিয়ে গেলো বিষয়টা বুঝতে। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। ঈশার কপালে ভাঁজ পড়ল। সব কিছু তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ইলুর সাথে সায়ানের বিয়ে কেন? আর শুধু তারাই কেন? বড়রা কেউ নেই। এভাবে কাজী অফিসে এসে বিয়ে করার মানে কি? নানান প্রশ্নের মাঝে ঈশার মস্তিষ্ক ভনভন করছে। ইভান ঈশার সামনে দাড়িয়ে ছিল। পিছনে ঘুরতেই ঈশাকে তাদের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
–এতক্ষনের টেনশনটা কি একটু কমলো?
ঈশা আর একটু সামনে এসে দাতে দাত চেপে ফিস ফিসিয়ে বলল
–আমাকে এসব আগে বললে কি হতো? আর তুমি মিথ্যা বললে কেন?
ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–কি মিথ্যা বললাম?
–ওই যে তোমার বিয়ে। এখানে তো পুরো ঘটনাই অন্য রকম।
ইভান বাকা হেসে পুরোটাই ঈশার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে হাত গুঁজে গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–চাইলেই বিয়েটা আমার হতে পারতো। কিন্তু…।
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
–চেয়ে ফেল। তোমাকে তো কেউ আটকে রাখেনি। কাজী অফিস পর্যন্ত তো চলেই এসেছ। তাহলে বিয়েটাও করে ফেল।
ঈশা ঝাঝাল কণ্ঠে বলল। ইভান হেসে বলল
–সে কি চায়? সে চাইলেই আমি রাজি। আমি একা চাইলে তো আর সব হয়না।
ইভানের কথা শুনে ঈশা বোকার মতো জিজ্ঞেস করলো
–সে টা কে? তোমার গার্ল ফ্রেন্ড?
ইভান না সুচক মাথা নাড়াল। ধির স্থির কণ্ঠে বলল
–আমার সব। অস্তিত্ব, নিঃশ্বাস, যাকে এক কথায় বলে জীবন। আমার জান পাখি।
ঈশা সন্দিহান চোখে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–আগে তো কখনও শুনিনি এমন কথা? কে তোমার সেই পাখি?
ইভান মুচকি হেসে বলল
–আগে তো কখনও এভাবে সামনে আসেনি তাই বলার প্রয়োজনও হয়নি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে বিশেষ মানুষটাকে বলতে ইচ্ছা করছে অনেক কিছু। মনে জমিয়ে রাখা সেসব কথা যা বলা হয়নি।
–বলে ফেল। তোমাকে তো কেউ নিষেধ করেনি।
ঈশা চোখ নামিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলতেই ইভান হেসে ফেলল। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই বিয়ে পড়া শেষ হল। সবাই মোনাজাত করতে হাত তুলল। ঈশা মাথায় কাপড় টেনে হাত তুলে দোয়া করছে। ইভান হাত তুলে আছে ঠিকই কিন্তু তার সমস্ত ধ্যান এখন ঈশার দিকে। অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। নীল শাড়ীতে মেয়েটাকে অদ্ভুত লাগছে।
কাজী অফিসের সব পর্ব শেষ করে বের হয়ে এলো সবাই। ঈশা সবার উপরে রাগ করেছে। তাকে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি তাই। কিছুক্ষন কথা বার্তা শেষ করে আবার সবাই রিকশায় উঠলো। এবার গন্তব্য রেস্টুরেন্ট। সায়ান আজ ট্রিট দিবে। ঈশা রিকশায় উঠে গোমড়া মুখে বসে আছে। অভিমানি কিশোরী মন। হুটহাট কখন তীব্র অভিমান করে বসে তার কোন সময় নেই। ইভান সামনে তাকিয়েই বলল
–ওরা দুজন দুজনকে অনেক দিন থেকেই ভালোবাসে। সায়ান বিদেশে যাচ্ছে পড়ালেখা করতে। তাই বিয়েটা করে রেখে দিতে চায়। কিন্তু সেজ মা আর সেজ বাবা ইলুর এখনি বিয়ে দিবে না। তাই আমিই ওদের বুদ্ধি দেই এভাবে বিয়ে করে রাখতে। সায়ানের পড়া শেষ হলে বাসায় জানিয়ে আবার বিয়ে করবে। এখন আপাতত কয়েক বছরের জন্য সেফ।
ঈশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–ভালবাসার মানুষকে কে হারাতে চায়? ভালবাসার মানুষের হারানোর কথাটা মাথায় আসলে ন্যায় অন্যায় বোধটা না থাকেনা। তখন সেই মানুষটাকে নিজের কাছে ধরে রাখাটাই মুখ্য হয়ে উঠে। আর সেই মানুষটারও মনে যদি একই রকম অনুভুতি থাকে তাহলে তো কথাই নাই। সারা দুনিয়ার সাথে যুদ্ধ করে হলেও তাকে নিজের কাছে আগলে রাখতে চেষ্টা করে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত।
ঈশা এবার শান্ত হল। অভিমানি কণ্ঠে বলল
–আগে বলা জেতনা?
–আগে বললে কি তোর মধ্যে এই ভয়টা দেখতে পেতাম?
ইভানের কথার মানে বুঝতে না পেরে ঈশা আবারো বোকার মতো প্রশ্ন করলো
–কোন ভয়?
–বিশেষ কাউকে হারানোর ভয়। আকাশ সম ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়। পাশে বসে থাকা মানুষটার কাছ থেকে সময় অসময়ে অপ্রত্যাশিত কিছু প্রাপ্তির অপ্রাপ্ত থাকার ভয়।
থেমে আবার ঈশার দিকে তাকাল। মৃদু হেসে আদুরে কণ্ঠে বলল
–ভয় থাকবে তাহলেই তো ভালবাসা দৃঢ় হবে। তবে লজ্জাবতীর এই লাজুকতায় মাখা মুখটায় ভীত হরিণীর মতো ভয়টা অসম্ভব লাগে। চোখ দুটো জুরিয়ে যায় একদম। ভেরি ইম্প্রেসিভ!
ঈশা বড় বড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই আবার চোখ নামিয়ে নিলো সে। ইভান খুব যত্ন করে পড়ে যাওয়া ঘোমটাটা তুলে দিলো। সামনে তাকিয়েই বলল
–এই মনে আকাশ হয়ে রয়েছো তুমি। যেই আকাশ শুধুই আমার। আমি যে ভালবাসি এই নীল রঙ। ভালবাসি নীলে জড়ানো এই লজ্জাবতী।
#কোনো_একদিন
#পর্ব_৯ + ১০ (শেষ পর্ব)
#কলমে_অপরাজিতা_ইসলাম
“কবুল কবুল কবুল”
সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলো।
কাঁপা কাঁপা গলায় মেহেক কবুল বলার পর একদম নিশ্চুপ হয়ে গেলো।আজ থেকে মাসফি আর মেহেক একসাথে থাকবে ভাবতেই একটা জড়তা কাজ করছে মেহেকের মনে।আজ ১৫ই আগস্ট।গত কয়েকদিন প্রচুর ধকল গিয়েছে সবার উপর দিয়ে।অবশেষে মাসফি আর মেহেকের বিয়ে সম্পন্ন হলো।
মাসফি মেহেকের দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি হাসলো।
অন্যদিকে সিয়াম মাসফির পাশেই বসে ছিল।কিন্তু মেহেক কবুল বলার সময় উঠে চলে যায় অন্য এক দিকে।
“ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই।আজও যে ছেলেটা শত-শত মেয়ের হার্টবিট থামিয়ে দেয়,সেই ছেলেটা কাউকে ভালোবেসে কাঁদছে।আসলেই সিয়াম তোমার মতো করে সবাই ভালোবাসতে পারে না।কিন্তু কি বলো তো,আমাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসাটা ভুল মানুষের সাথেই হয়।একটাবার কি আমাকে সুযোগ দেওয়া যাবে তোমার মনের রাণী হওয়ার জন্য?কথা দিচ্ছি আমিই তোমার জীবনের শেষ ভালোবাসা হয়ে দেখাবো।”
পেছন থেকে কারোর এমন কথা শুনে সিয়াম চমকে তাকালো।সামনে তুলিকে অশ্রুশিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিয়াম অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
“তুলি তুমি এখানে?”
“হুমম আমি।”
“তুমি কি বলছো এসব?”
“যা সত্যি সেটাই বলছি।”
“তুমি কি করে জানলে আমার আর মেহেকের ব্যাপারে?”
“ভালোবাসার মানুষের সব কিছুই তো জানতে হয় তাইনা?”
“একটু আগেই তুমি বললে না যে আমাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসা ভুল মানুষের সাথে হয়।সেই একই ভুল তো তুমিও করেছো।কারণ আমি আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না।আর না কাউকে আমার জীবনে ঠাঁই দিতে পারবো।”
“তুমি যদি আমাকে সত্যি ভালোবেসে থাকো তাহলে আজ এখানেই তুমি তুলিকে বিয়ে করবে।ধরে নাও এটা তোমার ভালোবাসার মানুষের শেষ ইচ্ছে।”
“কারণ আমার সমস্ত ভালোবাসা আমি একজনকেই উৎসর্গ করেছি।”
“সিয়াম, তুমি তো জানো মন ভাঙ্গার ক্ষত কতটা গভীর।সেই একই কষ্ট কি তুমি তুলিকেও দিতে চাও?”
মেহেকের কথা সিয়াম কি বলবে ভেবে পেল না।সত্যিই তো তুলির এখানে কোন দোষ নেই।তাহলে ওও কেন কষ্ট পাবে।
“আর একটা কথা,আমি এখন তোমার ভাইয়ের বউ।তাই তুমি চাইলেও আর কখনোই আমাকে পাবে না।কিন্তু তোমার এই কষ্ট আমি আর দেখতে পারছি না।নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।আমিও যে ভালো নেই সিয়াম।প্রতিনিয়ত তোমার বিষন্ন মুখটা দেখে আমাকে আমার অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।তাই প্লিজ তুমি তুলিকে বিয়ে করে নাও।প্লিজ সিয়াম প্লিজজজজজ।”
মেহেকের কথায় বেশ অনেক্ক্ষণ চুপ করে থেকে সিয়াম ‘ঠিক আছে’ বলে হনহন করে স্টেজের সামনে গিয়ে দাড়ালো।মেহেক হালকে হেসে তুলির চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে সব সময় আগলে রাখিস।”
তুলি কোনোকিছু না বলে মেহেককে জড়িয়ে ধরলো।মেহেকও আলতো করে তুলিকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুক্ষণ পর মেহেক আর তুলিও গিয়ে স্টেজের সামনে দাড়ালো।
“আজ এখানে সিয়াম আর তুলির ও বিয়ে হবে।”
মেহেকের কথায় সব বেশ অবাক হলো।সিয়ামের মা মিসেস সাবিহা চৌধুরী বললেন,
“কিন্তু আজকেই কিভাবে?আর হুট করেই এই সিদ্ধান্ত কেন নিলে তোমরা?”
“আসলে আন্টি আমি আর তুলি চাই আমাদের বিয়েটা যেন একসাথেই হয়।আর এখানে তো সবাই উপস্থিত আছে।তুলির বাবা-মা ও আছে।আশা করি এতে কারো আপত্তি হওয়ার কথা না।”
মেহেকের কথায় সবাই সাই দিলে একই মঞ্চে মেহেক-মাসফি আর সিয়াম-তুলির বিয়ে সম্পন্ন হয়।মাসফিদের রুম আগেই সাজানো ছিল।কিন্তু সিয়ামদের জন্য সবাই দ্রুত আরো একটা রুম সাজিয়ে ফেলল।সবাই খাবার খাওয়া শেষ করে মেহেক আর তুলিকে নিয়ে ওদের দুজনের রুমে গিয়ে রেখে আসে।আজকে আর কারোর মজা করার কোনো ইচ্ছে নেই।কারণ সবাই অনেক বেশি ক্লান্ত।তাই রাত ১২টার আশেপাশেই সবাই ঘুমাতে চলে গেল।
মেহেক ঘোমটা দিয়ে বসে আছে।দরজা বন্ধ করার আওয়াজে মেহেক কেঁপে উঠল।মাসফি ধীরে ধীরে মেহেকের কাছে এসে বসলো।ঘোমটা তুলে মেহেকের দিকে তাকিয়ে বললো,
“মাই লাভ”
মাসফির কথা শুনে মেহেক লজ্জামাখা একটা হাসি দিয়ে মুখ নিচু করে নিলো।
“আমার লজ্জাবতীকে লজ্জা পেলে আরো বেশি সুন্দর লাগে।”
এটা বলেই মাসফি মেহেকের কপালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিলো।এরপর বলল,
“এগুলো খুলে ফ্রেশ হয়ে অযু করে আসো।নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি চলো।”
মাসফির কথায় মেহেক মাথা নেড়ে একটা সুতির নীল রংয়ের জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।কিছুক্ষণ পর অযু করে এসে দেখলো মাসফি অন্য ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে অযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে দাড়িয়ে আছে।মেহেক ও পাশের জায়নামাজে গিয়ে দাড়ালো।নামাজ পড়ে মাসফি আর মেহেক বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো।
মেহেক মাসফির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা মাসফি তোমার কাছে ভালোবাসা কী?কিভাবে দেখো তুমি ভালোবাসা নামক এই শব্দটিকে?ভালোবাসা বলতে তুমি কি বোঝো?”
মেহেকের কথায় মাসফি বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে বলল,
“ভালোবাসা শব্দটা যতটা ছোট এর ব্যাখ্যা ঠিক ততটাই বিশাল।ভালোবাসা মানে আবেগ,অনুভূতি,মায়া,মোহ,ভালোলাগা,মান,অভিমান,এই সবকিছুর সংমিশ্রণ।একেক জনের কাছে ভালোবাসার ব্যাখ্যা একেক রকম।তবে আমার কাছে ভালোবাসা মানে সবসময় ভালো থাকা,প্রিয় মানুষটিকে ভালো রাখা।ভালোবাসার মানুষটিকে সব সময় আগলে রাখা।এমনভাবে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখা যেন আমার ভালোবাসার মানুষটা কখনো আমাকে ছেড়ে না যেতে পারে।আমি হয়তো তোমাকে ১০০% ই ভালো রাখতে পারবো না।কারণ,সব সম্পর্কেই যেমন ভালোবাসা থাকে তেমনি মান-অভিমান ও থাকে।কিন্তু আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো যেন তোমাকে ভালো রাখতে পারি।তোমার মুখ থেকে যেন কখনোই মিষ্টি হাসিটা হারিয়ে না যায় সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার।তুমি হয়তো আমাকে অনেক কারণেই ভুল বুঝেছো,হয়তো ভবিষ্যতেও ভুল বুঝবে।সেটা আমাকে বলবে।আমার থেকে কৈফিয়ত চাইবে যে কেন আমি এমনটা করেছি।কিন্তু প্লিজ কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না।আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি।তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।আর তুমিই আমার জীবনের শেষ ভালেবাসা।আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত শুধু এবং শুধুমাত্র তোমাকেই ভালোবাসবো।তোমাকে কখনো ঠকাবো না কথা দিলাম।”
এটা বলেই মাসফি পেছন থেকে মেহেককে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিল।মেহেক মাসফির ছোঁয়া পেলে চোখ বন্ধ করে ফেলল।হঠাৎই মাসফি মেহেককে ঘুড়িয়ে এক হাত চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে অন্য হাতে কোমড় পেচিয়ে ধরল।আর তারপর মেহেকের কাঁপতে থাকা ওষ্ঠদ্বয় নিজের অধীনে নিয়ে নিল।মেহেক পরম আবেশে মাসফির টিশার্ট খামচে ধরলো।বেশ কিছুক্ষণ পর মাসফি মেহেককে ছেড়ে দিয়ে দু’জনেই হাঁপাতে লাগলো।মাসফি আবারো মেহেকের কাছে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলে মেহেকের ডক্টর হৃদির কথাগুলো মনে পড়ে যায়।মেহেক মাসফির দিকে তাকিয়ে বলল,
“মাসফি হৃদি আপুর কথাগুলো মনে আছে তো?”
মেহেকের কথায় মাসফির মুখটা কালো হয়ে হেল।মাসফি মাথা নেড়ে কোনোকিছু না বলেই বাইরে বেরিয়ে গেল হনহন করে।মেহেক কিছু না বলে অপলক দৃষ্টিতে মাসফির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিকভাবে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল মেহেক।
_____________________________
সিয়াম আর তুলি নফল নামাজ পড়ে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে।কারো মুখেই কোনো কথা নেই।বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা কাটিয়ে সিয়াম বলল,
“দেখো তুলি তুমি সবটাই জানো।সবটা জানার পরেই আমাকে বিয়ে করেছো।কিন্তু আমি এখনো শুধু মেহেককেই ভালোবাসি।ওকে ভুলে যাওয়া আমার জন্য এতটাও সহজ না।কারণ মেহেক আমার প্রথম ভালোবাসা।আমি জানিনা কখনো তোমাকে ভালোবাসতে পারবো কিনা।তবে একটা কথা দিতে পারি।যদি তোমার কথা অনুযায়ী সত্যি আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা বলতে কিছু আসে তাহলে সেদিন আমি তোমাকে নিজে থেকে কাছে টেনে নিব।ততদিন অবধি তুমি আর আমি সাধারণ কাপলদের মতোই থাকবো।কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো শারীরিক সম্পর্ক হবে না।আশা করি তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো।”
তুলি একধ্যানে সিয়ামের কথাগুলো শুনছিল।
“সিয়াম তুমি যেদিন ফার্মহাউসে মেহেককে ‘ভালোবাসার সজ্ঞা’ বলছিলে তখনি আমি গিয়ে সেখানে উপস্থিত হই।সেদিনই আমি জানতে পারি তুমি মেহেককে ভালোবাসো।বিশ্বাস করো,সেদিন যেন আমার পুরো পৃথিবী উল্টে গিয়েছিল।কারণ আমি তোমাকে আজ থেকে নয় বরং আরো দুই বছর আগে থেকেই ভালোবাসি।এতদিন বলিনি ভয়ের জন্য।যদি তুমি আমাকে না করে দাও আর আমার সাথে বন্ধুত্বটাও নষ্ট করে দাও এই জন্য।কিন্তু সেদিন যখন তেমার কথাগুলো শুনলাম তখন বুঝতে পারলাম তোমার জীবনে আমাকে আসতেই হবে।আর কিছু নাই বা পারলাম।অন্তত আমার ভালেবাসা দিয়ে তোমার অগোছালো জীবনটাকে গোছালো করে দিতে তো পারবো।এতেই হবে আমার।তোমার জীবন সঙ্গিনী হতে পেরেছি।তাতেই আমি খুশি।আমার আর কিচ্ছু চাই না।তোমার যতদিন সময় লাগে তুমি নাও।কিন্তু দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না প্লিজ।আমি তোমাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।একটা কথা কি জানো,না পাওয়ার থেকে পেয়ে হারানোর কষ্ট অত্যাধিক।সেই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।তাই প্লিজ আর কিছু না পারো,শুধু আমার পাশে থেকো প্লিজ।”
তুলির এমন কান্না জড়িত কথা শুনে খুব মায়া হচ্ছে সিয়ামের।এখন ওর মনে হচ্ছে,কেন মেহেককে না ভালোবেসে প্রথমেই তুলিকে ভালোবাসলো না!
“সিয়াম তোমার বুকে আমাকে একটু জায়গা দিবে?”
তুলির এমন আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে একটানে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো তুলিকে।তারপর তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমাকে একটু সময় দাও।যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে আমি তোমার প্রাপ্য সম্মান এবং ভালোবাসা দিয়ে নিজের করে নিব।শুধু আমাকে একটু সময় দাও।”
তুলি সিয়ামকে আলতো হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তোমার যত সময় লাগে তুমি নাও।আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য আমি মৃত্যুর আগ অবধি অপেক্ষা করতে রাজি আছি।ততদিন পর্যন্ত শুধু এমন করেই আমাকে বুকে আগলে রেখো তাহলেই হবে।”
সিয়াম মুচকি হেসে আরো শক্ত করে তুলিকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।তুলিও পরম আবেশে নিজের প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত মনে চোখ বন্ধ করে নিল।
চলবে?
বিঃদ্রঃ এত বড় পর্ব মনে হয় আজকেই প্রথম দিলাম।আর হ্যা গল্পটা আর মাত্র তিন/চার পর্বেই শেষ করে দিব।
দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছে চারটি মাস।এই চার মাসে অনেক কিছুই হয়েছে।রাজ আর তাহার এনগেজমেন্ট হয়েছে গত মাসে।সানভি আর মিহি এখনো চুটিয়ে প্রেম করছে।খুব শীঘ্রই বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে তারা।তাহার সেই বিষাক্ত অতীত জেনেও রাজ তাহাকে সাদরে গ্রহন করেছে।
তাহা গ্রামের মেয়ে ছিল।মা ছিল না ওর।বাবা দ্বিতীয় বার বিয়ে করার পর সৎ মা মোটেও ওকে সহ্য করতে পারতো না।একদিন তাহা কোচিং করে বাড়ি ফিরছিল।তখনই কয়েকটা বখাটে মিলে তাহাকে নিয়ে যায় তাদের আস্তানায়।তাহা চিৎকার করেও ওদেরকে থামাতে পারেনি।কিন্তু ঠিক সেই সময় সেখানে রাজ গিয়ে হাজির হয়।সেদিন রাজ ওর বন্ধুর বাসায় ঘুরতে গিয়েছিল।তখনই একটা মেয়ের আওয়াজ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।এরপর তাহা সব কথা রাজকে বলতে না পারলেও রাজের জোরাজুরিতে বাধ্য হয় ওর অবস্থা বলতে।সেদিন রাতেই তাহাকে নিয়ে রাজ ওদের বাসায় আসে।রাজের পরিবার তাহাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা করেনি।এরপর থেকেই রাজ ধীরে ধীরে তাহা নামক এই মিষ্টি মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় রাজ।এই ছিল তাহা আর রাজের কাহিনী।
অন্যদিকে সিয়াম আর তুলির সম্পর্কটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও মেহেক-মাসফির জীবনে নেমে এসেছে ঘোর অমাবস্যা।কিছুদিন আগে মাসফির সাথে মেহেক যে মেয়েটাকে সেদিন দেখেছিল সেটার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।তখন থেকেই মাসফির থেকে মেহেককে আলাদা করে নিয়েছে মেহেকের পরিবার।মেহেক সেদিন কোনো প্রতিবাদ করেনি।বরং একটা রোবটের মতো হয়ে ছিল।মাসফির দিক থেকে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।মাসফি মেহেককে ছাড়া যেন প্রাণহীন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে এক প্রকার।অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি।এক প্রকার নিজেকে ঘর বন্দি করে নিয়েছে।
বিকেল তিনটার দিকে দরজায় কারো আওয়াজের শব্দে মাসফির ঘুম ভেঙ্গে যায়।ওও উঠে গিয়ে দেখলো তুলি হাতে একটা খাম নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
“কি হলো?এখানে কি করছিস তুই তাহা?”
“তোর সাথে আমি এখানে গল্প করতো আসিনি।এসেছি এই খামটা দিতে।আজ একজন কুরিয়ার ম্যান এসে এটা দিয়ে গিয়েছে।”
গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিল তাুলি।মাসফি হতাশ হয়ে তুলির হাত থেকে খামটা নিয়ে বলল,
“কে পাঠিয়েছে?”
“সেটা নিজেই দেখে নে।”
এটা বলেই তুলি চলে গেল।এরপর মাসফি দরজা লাগিয়ে দিয়ে খামটা খুলল।তিন টা আলাদা আলাদা কাগজ।প্রথম কাগজটা খুলে মাসফির মাথায় যেন বাজ পড়লো।কারণ সেখানে ডিভোর্স পেপার।কিন্তু কারোর সই নেই।ওও তারাতাড়ি করে দ্বিতীয় কাগজটা খুলল।সেখানে লেখা আছে,
“ডিয়ার মাসফি,আজ তুমি আমার পরিচয় পাবে।
প্রথমেই বলে রাখি সেদিনের ভিডিও ক্লিপটা আমিই ভাইরাল করেছি আর সেটা যে ফেক ছিল তা তো তুমিও জানো আর আমি তো জানিই।কারণ সবটাই তো আমার প্ল্যান ছিল।সেদিন লিফটে মেয়েটা তোমাকে বলে ওর চোখে কিছু পড়েছে তাই একটু দেখতে।তুমিও সরল মনে সেটাই করলে।আর তখনই মেহেকের আগমন ঘটলো।আসলে সেখানে সিসি টিভি ও লাগানো ছিল।বেচারা তুমি এসব কিছু না জেনেই ফেসে গেলে।এটা তো শুধু সমাজের চোখে তোমাকে ছোট করার একটা ট্রেইলার মাত্র।
এরপর আসি মেহেক আর তোমার ফিজিক্যালি ইনভল্ভ হওয়ার ব্যাপারে।সেটাও আমার পূর্ব পরিকল্পিত ছিল যাতে তুমি মেহেকের কাছে আসতে না পারো।ডক্টর হৃদি আমাকে সাহায্য করেছে।কারণ সে জানতো আমি ভুল কিছু করবো না।
এখন তো আসল ধামাকার কথাটা তোমাকে জানাবো।ফাইরুজ খান ফায়াজ আমার একমাত্র বড় বোনের বর ছিল।তাহলে চলো তোমাকে আসল ঘটনা টুকু খুলেই বলি,
২০১৭ সালে আমার বড় আপু জানায় সে ফায়াজ ভাইয়াকে ভালোভাসে।তারা দু’জন বিয়ে করতে চায়।ফায়াজ ভাইয়া অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে।তাই আমার বাবা-মাও আর না করেনি।তাদের ভাইয়াকে দেখে মায়া হয়েছিল।তবুও আমি ভাইয়ার সম্পর্কে সবকিছুর খোঁজ-খবর নেই।তখনো আমরা কেউ জানতাম না যে ভাইয়া একজন মাফিয়া কিং।তো বিয়ের বেশ কয়েক মাস পর আপু এই কথাটা জানতে পারে।তখন আপু আমাকেও এটা জানায় যে ভাইয়া একজন মাফিয়া।সেদিন আপু আর আমি দু’জনই ভাইয়ার সাথে কথা বলি।আসলে কি বলো তো,আমরা চোখের সামনে যা দেখি সেটা কখনো কখনো ভুল প্রমানিত হয়।ফায়াজ ভাইয়াকে এই জগতে তোমার প্রাণ প্রিয় বন্ধু আয়ান এনেছিল।ফায়াজ ভাইয়া,আয়ান আর তুমি ছিলে বেস্ট ফ্রেন্ড।কিন্তু আয়ান ছিল একটা কালসাপ।তুমি যে ফাইলটার জন্য নিজের বন্ধুকে মারলে,আসলে সেটা আয়ানের পরিকল্পিত প্ল্যান ছিল যাতে করে তুমি ফায়াজকে মারো।আর পরবর্তীতে আয়ান তোমার বিশ্বাস যুগিয়ে ঐ ফাইলটা নিয়ে তোমাকে মারতে পারে।ভাবতে পারছো?তুমি কত বড় গোলক ধাঁধায় আটকে আছো।তুমি এতো বুদ্ধিমান হওয়া সত্বেও বোকার উপাধি পেলে আজ।আর কি বলো তো,তুমি যেদিন ভাইয়াকে মেরে ফেললে সেদিন আপুর কোল জুড়ে ওদের ভালোবাসার একমাত্র সন্তান ‘ইমিরা ইরজা’এই পৃথিবীতে আসে।আপু যখন ভাইয়ার মৃতদেহটা দেখলো তখন পাথর হয়ে গিয়েছিল।আমি তখন লেখাপড়ার জন্য সিংগাপুরে ছিলাম।আপু মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়ে।কারণ ভাইয়া আর আপু একে-অপরকে নিজের থেকে বেশি ভালেবাসত।আমি এই ঘটনার পর আপু আর ইরজাকে সিংগাপুরে নিয়ে যায় নিজের কাছে।কিন্তু আপু ভালো নেই আজও।প্রতিনিয়ত ভাইয়ার জন্য ছটফট করে।আমি শুধু দেখেছি কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।কারণ আপুর মুখের হাসিটা একমাত্র ভাইয়া নিজে ফিরিয়ে দিতে পারতো।কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়।তোমার একটা ভুলের জন্য আমার বোনের মুখের হাসি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।আমার চোখের মণি ইরজা জন্মের পরপরই নিজের বাবার মৃতদেহ দেখেছে।বাবার ভালোবাসা পায়নি।আচ্ছা তোমাদের শত্রুতার জন্য আমার বোন আর তার মেয়ে কেন ভালোবাসাহীন নিষ্প্রাণ হয়ে দিন কাটাচ্ছ?জানি কোনো উত্তর নেই তোমার কাছে।মেহেককে ছাড়া তুমি যেমন ভালো নেই,প্রতি মুহূর্তে গুমরে মরছো তেমনি আমার বোনটাও ভালো নেই।তার জন্য আজ আমিও ভালো নেই।এই এত এত পাপের ফল তো তোমাকে পেতেই হবে তাইনা?এখন প্রতিটা প্রহরে তুমি উপলব্ধি করতে পারবে যে ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে একা একা জীবন কাটানো কতটা কষ্টের।আমিও তোমাকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখতে চাই।কারণ আমার বোনটাও যে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
শেষ ধামাকার জন্য তৃতীয় চিঠিটা খোলো।”
ইতি,
‘ব্ল্যাক রোজ’
মাসফির মাথা কাজ করছে না।একদিনে এত এত ধামাকা ওর মাথা মেনে নিতে পারছেনা।তবুও শেষ চিঠিটা খুলল।
“প্রেগন্যান্সির পজিটিভ রিপোর্ট”
নিচে মেহেকের নাম লেখা।তার নিচে কিছু লেখা দেখতে পেল মাসফি,
“তেমার জন্য বড় চমক হলো তুমি বাবা হবে অথচ তার অনুভূতি কষ্টদায়ক হবে।কারণ তোমার সন্তানকে তুমি কখনোই কাছে পাবে না।ভাবছো তো এটা কিভাবে সম্ভব?আসলে একদিন তুমি ড্রিংক করার ফলে নিজের মধ্যে ছিলে না।আর সেদিন আমিও তেমাকে আমার কাছে আসতে বাঁধা দিতে পারিনি।কারণ ভালো তো আমিও কোনো একটা সময় বেসে ফেলেছি।তোমাকে ভালেবাসতে চাইনি।আমি তো প্রতিশোধের জন্য তোমার কাছে গিয়েছিলাম।কিন্তু কখন যে ভালবেসে ফেললাম নিজেও বুঝতে পারিনি।যখন বুঝতে পারলাম তখন আর কিছু করার ছিল না।আশা করি এতোক্ষণে বুঝে গিয়েছো এই এতকিছুর পেছনে আসল ব্যক্তি টা কে? হ্যা ঠিকই ধরেছো,আমিই সেই ‘ব্ল্যাক রোজ’।এখন শুধু তুমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু আমার বা আমাদের সন্তানের দেখা কখনোই পাবে না।আমার কাছে অন্যায়ের কোনো ক্ষমা নেই।তোমার জন্য আমি আমার আপুকে কষ্ট পেতে দেখেছি।তাই তোমাকে মাফ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।আমি আমার অনাগত সন্তান এবং আপু আর ইরজাকে নিয়ে তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে এসেছি।তাই আর খুঁজেও লাভ হবে না।আমি আমার কথা রেখেছি।আজ ইরজার জন্মদিন।এই দিনেই ফায়াজ ভাইয়া আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার চলে গিয়েছে।আর আজকের এই দিনেই তুমিও নিজের ভালোবাসাকে হারিয়ে একা হয়ে গেলে চিরদিনের মতো।
পরিশেষে একটা কথায় বলবো,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই তোমার সব অন্যায় মেনে নিব না।ভালো তো দূর থেকেও বাসা যায়।আজ আমি হয়তো তেমার সাথে নেই।কিন্তু তোমার আর আমার ভালোবাসার একমাত্র প্রতীক আমার সাথে আছে।হ্যা,আমাদের একটা ফুটফুটে মেয়ে হবে।তাকে নিয়েই আমি বাকিটা জীবন কাটাতে পারবো আপুর মতো।কিন্তু তুমি এক অদৃশ্য আগুনের জলন্ত লাভায় জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।আমি চাইলেই আর পাঁচটা মেয়ের মতো তোমাকে মেনে নিতে পারতাম।কিন্তু আমার কাছে যে অন্যায়কারীদের কোনো মাফ নেই।আমার কাছে ‘ভালোবাসার সজ্ঞা’ মানে বহুদূরে থেকেও ভালোবেসে একে-অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও জীবনে বাঁচা যায়।বাঁচতে শিখতে হয়।আমিও নাহয় আপুর মতো করে তোমার স্মৃতি আর আমাদের মেয়েকে নিয়েই বাকিটা জীবন বাঁচব।
আর হ্যা ডিভোর্স পেপারে আমি সিগনেচার করিনি।কারণ তোমাকে নতুন করে জীবন শুরু করতে দিবো না আমি।তুমি ডিভোর্স পেপার নিয়ে শুধু দেখবে এটাই চাই আমি।কারণ আমি যে তোমাকে অন্য আর কারোর হতে দিতে পারবো না।তোমাকে যে শাস্তি-ই দেই না কেন,দিনশেষে তুমি শুধু আমার এবং আমারই!”
চিঠিটা পড়েই মাসফি ধপ করে মাটিতে বসে পরলো।দুই চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরছে।আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।কি থেকে কি হয়ে গেল সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না ওও।শুধু এটুকু বুঝতে পারছে,মেহেক আসলেই অনন্য।মাসফি আপাতত কিছু ভাবার অবস্থায় নেই।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওও হঠাৎ পড়ে গেল মাটিতে।
দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা পর মাসফি চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে।হাতে ক্যানোলা লাগানো।চারপাশে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।সবার চোখেই পানি।
মাসফিকে বিকালে সিয়াম ডাকতে গিয়ে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে বারবার ডাকতে লাগে।তাতেও কোনো কাজ না হওয়ায় দরজার ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ঢুকে মাসফিকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে সিয়াম চিৎকার করে সবাইকে ডাক দেয়।তখনই ওকে হসপিটালে আনা হয়।তারপর ওর পাশে পড়ে থাকা চিঠিটা পড়ে আর কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে আসলে কি হয়েছে।
মাসফি কোনোকিছু না বলে চুপ করে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।আর মনে মনে একটা কথায় আওরাতে লাগে,
“ভালোবাসি বলেই ভুলতে পারি না।”
অপর পাশে মেহেকও নিজের পেটে হাত দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,