Tuesday, July 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1381



শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৯

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৯

‘সন্দেহ’ দুনিয়ার সব থেকে ভয়ংকর একটা শব্দ। এর প্রলয়ঙ্করী ধ্বংসাত্মক রুপ যে কোন সম্পর্ককে মুহূর্তেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রচণ্ড ক্ষিপ্র গতিতে ঘরের এপাশ থেকে অপাশে পায়চারি করছে ঈশা। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করার বৃথা চেষ্টা। কোন লাভ হচ্ছে না এতে। বেহায়া মন আর চোখ দুটোই বারবার জানালার দিকে আর বারান্দার দরজার দিকে আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সব কিছুই বন্ধ। গত দুইদিন ধরেই বন্ধ। কিছুতেই খোলা হবে না। আর কোনদিন খোলা হবেনা। মস্তিষ্কে অগোছালো চিন্তা ভাবনা জটলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ভোতা অনুভুতি গুলো এলোমেলো হয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরে তাদের প্রচণ্ড আঘাতে চোখ ভরে আসছে। কিন্তু বারবার চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে আবার পায়চারি করছে। কি করছে না করছে নিজেই বুঝতে পারছে না। পুরো ঘর বস্তি বানিয়ে রেখেছে। গত দুইদিন ধরে অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। ঘড়ির কাটাও গতি হারিয়ে থেমে গেছে যেন। ভয়ংকর সব চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মাঝে মাঝে ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। আর কোন ভাবেই অপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। ভয়ংকর রকমের চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়েই করে ফেলল এক দুঃসাহসের কাজ। দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ইভানদের বাসায়। তীব্র গতিতে কলিং বেল চাপতে লাগলো। কারন সে জানে এখন বাসায় ইভান আর ইফতি ছাড়া কেউ নেই। কিছুক্ষন পরেই ইফতি এসে দরজা খুলে দিলো। ঈশাকে দেখে হেসে বলল
–আরে ভাবি আপু তুমি?

ঈশা ক্ষিপ্র গতিতে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে বলল
–তোর ভাইয়া কোথায়?

ইফতি একটু অবাক হয়ে বলল
–ঘরে। শুয়েছে মনে হয়।

ঈশা কোন কথা না বলে সোজা ইভানের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভর দুপুর বেলাও পুরো ঘর অন্ধকার। লাইট জালাতেই ইভান বিরক্তি নিয়ে চোখ মুখ খিচে তাকাল। ঈশাকে এভাবে দেখে অবাক হল। আবার নিজেকে সংযত করে নিয়ে বলল
–কি হয়েছে?

ঈশা এলোমেলো পায়ে ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো। ইভান ঈশার অস্বাভাবিক চেহারা দেখে উঠে দাড়িয়ে গেলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল
–কি হয়েছে পাখি? কোন সমস্যা?

–আমাকে বিয়ে করো না!

ঈশার নির্লিপ্ত কথা শুনে ইভান থমকে গেলো। সব কিছু যেন তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। মৃদু সরে বলল
–কি বললি আবার বল।

–আমাকে বিয়ে করো।

ইভান অস্পষ্ট সরে বলল
–বিয়ে?

–হুম।

–মানে?

–বউ করে তোমার ঘরে এনে রাখো। তোমার কাছে।

ঈশার কথা শুনে ইভান এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন জীবদ্দশায় এরকম অবাক কখনও হয়নি। সব থেকে বড় কথা ঈশার কাছ থেকে এরকম কথা যে শুনবে তা কোনদিনও ভাবেনি। অনুভুতি শুন্য দৃষ্টি নিয়ে দাড়িয়ে আছে ইভান। ঈশার কথা বুঝে উঠতে পারেনি এখনও। ঈশা আবারো বলল
–করবে বিয়ে?

ইভানের ঘোর কাটল। বুঝতে পারলো বাস্তব। কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বলল
–তুই তো আমার বউ।

–তাহলে তোমার কাছে এনে রাখো না কেন?

–এখনও সময় হয়নি তাই।

–যদি বলি আর সময় দিতে চাইনা?

–কিন্তু আমার যে সময় চাই। সব কিছু গুছিয়ে নিতেই একটু সময় চাই। ইনফ্যাক্ট আমাদের দুজনেরই এই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একটু সময় চাই।

–যদি না দেই?

ইভান কোন উত্তর দিতে পারলো না। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। সে ঈশাকে কাছে চায়। খুব করে কাছে চায়। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। তাকে একটু হলেও গুছিয়ে নিতে হবে। আর ঈশা এরকম পাগলামি করলে ইভান কিভাবে নিজেকে আটকাবে? একটু ভাবল। ঈশা পাগলামি করলেও সে তো আর আবেগে গা ভাসিয়ে দিতে পারেনা। তাই নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল
–আমি নিরুপায়। আমাকে সময় দিতেই হবে।

–আমি এখনি এই মুহূর্তে বিয়ে করতে চাই তোমাকে।

–তোর কি মাথা ঠিক আছে?

–আমি ঠিক আছি। তুমি হ্যা না কিছু একটা বল।

ইভান এগিয়ে এসে ঈশার দুই গালে হাত রেখে বলল
–পাগলামো করিস না। আমাদের দুজনেরই একটু সময় দরকার। তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কিন্তু যখন বুঝতে পারবি তখন মনে হবে সত্যিই আর একটু সময় দরকার ছিল। আবেগের বশে নেয়া ডিসিশন ভুল হয় ঈশা।

ঈশা হাত সরিয়ে দিলো। পিছিয়ে দরজার কাছে গেলো। বলল
–বিয়ে করেছ আর বউ হিসেবে রাখতেই যত প্রবলেম?

ঈশার কথার সুর অতি তাচ্ছিল্যে ভরা ছিল। ওভাবে বলায় ইভানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ভালো কথা এই মেয়েটা বুঝতে অনেক সময় নেয়। যখন সে বিয়ে করতে চেয়েছিল তখনও উলটা আচরন করেছে। কিন্তু তখন ইভানের প্রয়োজন ছিল ঈশাকে এটা বোঝানো যে সে চাইলেই তার জীবনের সাথে নিজের ইচ্ছা মতো কোন আচরন করতে পারেনা। ঈশার কাছ থেকে তার অধিকারটা কেড়ে নেয়া তখন জরুরি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন যদি ইভান আবার সেটার বিপরিত কিছু বলে তাহলে অবশ্যই সেটার কারন আছে। একে অপরকে ভালবাসে তারা ঠিকই। কিন্তু কাছাকাছি আসার জন্য এই সম্পর্কটাকে একটু সময় দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু ঈশা অযথাই জেদ করছে। তাই ইভান একটু ঝাঝাল সরে বলল
–স্টে ইন ইউর লিমিট ঈশা। আমি যখন বলেছি তখন অবশ্যই সেটার পিছনে কোন কারন আছে।

–আর আমি যখন বলেছি তখন কারো কথা শুনতে আমি রাজি না।

ইভান অতি বিস্ময় মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। গম্ভির গলায় বলল
–না বুঝেই জেদ করছিস। এতো জেদ ভালো না। ফলাফল কিন্তু খারাপ হয়।

–আমি এই মুহূর্তে আমার জেদের ফলাফল নিয়ে ভাবছি না। আমি যা জানতে চেয়েছি সেটার উত্তর দাও।

–আমার…

–জাস্ট সে ইয়েস ওর নো!

–নেভার!

ইভান একটুও না ভেবে জেদের বশে উত্তর দিয়ে দিলো। ঈশা কিছুক্ষন দাড়িয়ে থাকলো। শান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কিছুক্ষন পর স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–তোমার কাছে কোন অপশন নেই। বিয়ে করার জন্য রেডি হও।

ঈশা বের হয়ে গেলো। ইভান বিছানায় বসে পড়ল। মাথায় হাত দিয়ে চুল টেনে ধরল। এতক্ষন ঈশার আচরনে মনে হচ্ছে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রণা করছে প্রচণ্ড। ইভান শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে ভাবছে। ঈশা প্রচণ্ড রেগে চলে গেলো। রাগ করুক আর অভিমান করুক। এই মুহূর্তে ইভানের কিছুই করার নেই। কারন ঈশা এখন কোন কথাই শুনবে না। সন্ধ্যা বেলা ইভান ঠাণ্ডা মাথায় তাকে বোঝাবে। তখন একটু হলেও বুঝবে। একটু ভাবল। বাইরে কোথাও নিয়ে যাবে একা। ঈশাকে কখনও একা একা বাইরে নিয়ে যায়নি। যখনি গেছে সবাই মিলে গেছে। নিজেদের মতো সময় কাটানো হয়নি তাদের। আর এটাই হয়তো ঈশার মাথায় ঢুকেছে। তাই এভাবে জেদ করছে। ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল।

————–
দুই ঘণ্টা ধরে কান্নাকাটি করার ফলে চোখ মুখ সব কেমন ফোলা ফোলা লাগছে। এলোমেলো লাগছে নিজেকে। মনে হচ্ছে এক দমকা হওয়ায় সব কিছু হারিয়ে যাচ্ছে। আর সে চেয়েও কিছুই আটকাতে পারছে না। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। অনেক ভেবে আবারো নিজের সাহসের পরিচয় দিতে প্রস্তুত হয়ে গেলো। এ ছাড়া যে তার আর কোন রাস্তা খোলা নেই। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল বাবার ঘরের উদ্দেশ্যে। দরজার সামনে দাড়িয়ে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস টেনে ভিতরে ঢুকেই দেখল বাবা মা বসে কি যেন বিষয় নিয়ে কথা বলছে। ঈশাকে দেখে তারা থেমে গেলেন। তার চেহারার এরকম ভয়ংকর রুপ দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে ঈশার বাবা বললেন
–কি হয়েছে তোমার? এরকম অবস্থা করে রেখেছ কেন নিজের? তোমার কি শরীর খারাপ?

ঈশা সেসব কথার গুরুত্ব না দিয়েই বিছানায় বসে পড়ল। কঠিন গলায় বলল
–তোমাদের সাথে আমার কিছু কথা আছে।

ঈশার বাবা মনোযোগ দিলেন। বললেন
–বল।

ঈশা মাথা নামিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়ে বলল
–বাবা আমার বিয়ে হয়েছে। আমি এখন আমার শশুর বাড়িতে গিয়ে থাকতে চাই।

ঈশার বাবা মেয়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার উপক্রম হলেও ঈশার মায়ের মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হল না। তিনি শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। চোখ ফিরিয়ে পানের বাটা থেকে পান বের করে সাজাতে লাগলেন। ঈশার বাবা তার মায়ের দিকে তাকালেন। স্ত্রির এরকম স্বাভাবিক আচরন তিনি হজম করতে পারছেন না এই মুহূর্তে। ঈশার দিকে বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–আমি তো ভেবেছিলাম তোমার পড়া শেষ হলে আমরা অনুষ্ঠান করে তোমাকে আবার বিয়ে দেবো। এখনও তো অনেক দেরি আছে। সবে মাত্র তোমার অনার্স ফার্স্ট ইয়ার কমপ্লিট হল।

ঈশা চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
–কোন অনুষ্ঠানের দরকার নেই বাবা। আমি এখনি যেতে চাই ঐ বাড়িতে।

ঈশার বাবা এবার কি বলবেন সেটা বুঝতে পারলেন না। মুখে হাত দিয়ে একটু ভাবলেন। শান্ত কণ্ঠে বললেন
–তোমার বিয়ে হয়েছে ঠিক আছে। কিন্তু এখনও তো শারিয়াহ অনুযায়ী বিয়ে হওয়া বাকি মামনি। এভাবে তো তুমি ঐ বাড়িতে যেতে পারনা। সব কিছুর একটা নিয়ম আছে।

ঈশা অস্থির কণ্ঠে বলল
–তাহলে কি করতে হবে এখন?

ঈশার বাবা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সবাই মিলে কথা বলি। তোমার বড় বাবা বড় মা তাদের সাথে আলোচনা করি। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। ইভানের সাথেও কথা বলি।

ঈশা তীব্র প্রতিবাদী সরে বলে উঠলো
–এতো কিছুর সময় নেই বাবা। যা করার আজকেই করো। এখনি করো। এই মুহূর্তে। আমি আজই ঐ বাড়িতে যেতে চাই।

ঈশার বাবা এবার বিস্ময়কর দৃষ্টিতে নিজের স্ত্রির দিকে তাকালেন। ঈশার মা পান চিবুতে চিবুতে বললেন
–বিয়ে তো অর্ধেক হয়েই গেছে। শুধু কাজী ডেকে বাকি কাজটা সম্পন্ন করে দিলেই তো আর কোন ঝামেলা থাকে না। মেয়ে যখন বলছে তখন আর দেরি করে কি লাভ।

বলেই থামলেন তিনি। ঈশার বাবা বেশ অবাক হলেন। মা মেয়ের এমন কথা বলার পিছনে কি কারন থাকতে পারে? তিনি স্ত্রির দিকে তাকিয়ে বললেন
–ইভানের সাথে অন্তত কথা বলা প্রয়োজন। ইভানের এরকম কোন চিন্তা এখন নেই। আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ও আমাকে বলেছে এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে।

ঈশার মা বাধা দিয়ে বললেন
–আহা। ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে ভালো কথা। এমন তো না যে নিজের বউকে পালতে পারবে না। ইভান এখন যে পরিমান ইনকাম করে সেটা দিয়ে অনায়াসে ওদের সংসার চলে যাবে। ওর ব্যবসা তো ভালই চলছে। আর তাছাড়াও ওদের বিয়ে হয়েছে। জীবনের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সম্পূর্ণ ওদের। যা চায় করুক না। আমাদের এখন এসব নিয়ে কি কথা বলা সাজে। বিয়ের আগে পর্যন্ত মেয়ে আমাদের দায়িত্তে ছিল। এখন ইভানের দায়িত্তে। সেটা ওরা বুঝে নিবে। আমাদের কর্তব্য পালন করে দিলেই হল।

ঈশার বাবা ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা কঠিন গলায় বলল
–বিয়ে আজ সন্ধ্যায় হবে বাবা। তুমি অনুমতি দাও।

ঈশার বাবা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–মামনি একটা বিয়ে কি সহজ কথা? কত প্রস্তুতি আছে বল। আমি সবার সাথে কথা বলি। কাজী সাহেবের সাথে কথা বলে নেই। ওনার সময় আছে কিনা আসতে পারবে কিনা সেটাও তো দেখতে হবে তাই না? সব কিছু মিলে ঠিক করে কাল নাহয়……।

কথা শেষ হওয়ার আগেই ঈশা উঠে দাঁড়ালো। বলল
–সত্যিই বাবা এতো কিছুর সময় থাকলে আমি তোমাকে দিতাম। কিন্তু এখন আমার নিজেকে ভাবতে দেয়ার সময়টাই নেই। তাই আমিও ঠিক ভাবে ভাবতে পারছি না। তুমি শুধু অনুমতি দাও। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।

চলবে…………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৮ + বোনাস পর্ব

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৮

হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকে। কিছু কিছু মুহূর্ত বিশেষ হয়ে জীবনের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। সেসব ঘটনা এক সময় হয়ে যায় সুখময় স্মৃতি। দুইদিন যাবত ভ্যাপসা গরমে জন জীবন বিপর্যস্ত। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে তাল পাকা গরম। দিন ছোট হওয়ায় খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে। সেই বিশ্রী গরমে একদল তরুন তরুণী সন্ধ্যে বেলায় ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। নিজেদের মতো ব্যস্ত সময় কাটছে তাদের। কাজিনদের আড্ডার মাঝেই হঠাৎ করেই আকাশে বিজলির ঝলকানি চোখে পড়ল। গরম কেটে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করা হিম বাতাস বইতে লাগলো। উপরের দিকে তাকিয়ে ইফতি বলল
–বৃষ্টি হবে মনে হয়।

ইলু আর ইরিনা এক সাথে বলে উঠলো
–বৃষ্টি হলে ভিজব। কতদিন বৃষ্টিতে ভিজিনা।

সবাই সম্মতি দিলো। এমন কি ছোট্ট ইরা ইভানের কোলে বসে ছিল। গলা জড়িয়ে বলল
–ইভান ভাইয়া আমিও ভিজব।

ইভান গাল টেনে বলল
–ঠিক আছে। বৃষ্টি আসুক তখন ভিজব আমরা।

খানিকবাদেই অনেক জোরে মেঘ ডেকে উঠলো। ঈশান ঈশাকে বলল
–তুই এক পাশে গিয়ে দাড়া ঈশা। তোর মাথায় বৃষ্টির পানি পড়লে অসুবিধা হবে।

ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–বৃষ্টি আসুক আমি নিচে চলে যাব।

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। কোন কথা বলল না। কিছুক্ষন পরেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। সবাই খুশি হল। ঈশা নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাতে টান পড়ল। পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান তার হাত ধরে আছে। সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইভানের দিকে। ঈশা ততক্ষনে কাক ভেজা হয়ে গেছে। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–একটু ভিজলে তেমন কিছু হয়না।

হাত ছেড়ে দিয়ে সবার দিকে তাকাল। সবাই ইভানের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। কারন ঈশার বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে ইভানের সব থেকে আগে আপত্তি করা উচিৎ ছিল। কিন্তু সেই ভিজতে বলছে। ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজলে মন শরীর দুইটাই ভালো থাকে। তাছাড়াও সায়েন্টিফিক্যালি প্রুভড যে বৃষ্টির পানি ডিপ্রেশন কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু বেশী সময় নিয়ে ভিজলে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–জাস্ট ১০ মিনিট কিন্তু!

ঈশা মাথা নাড়ল। ঠোটের কোনে চাপা হাসি। সবাই নিরবতা ভেঙ্গে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো। ইরা ইভানের কোল থেকে নেমে গেলো। ইভান রেলিঙ্গে বসে ইরাকে বলল
–টুনটুনি জোরে দৌড়াস না। পড়ে যাবি।

ঈশা ইভানের পাশে গিয়ে বসলো। ইভান হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঠিক করছে। ঈশা ইভানের দিকে একবার তাকাল। তারপর তার ঘাড়ে মাথা রাখল। ইভান ঈশার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। মাথাটা ঈশার অনেকটা কাছে নিয়ে গেলো। ইভানের চুল বেয়ে ঈশার মুখে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। বেশ কিছুটা সময় ওভাবেই দুজনের নিরব অনুভুতির আদান প্রদান হল। কিছু সময় পরে ইভান মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল
–আর ভিজতে হবে না। নিচে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে নে। ঠাণ্ডা লাগবে পাখি।

ঈশা কোন কথা বলল না। উঠে ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে নিচে চলে গেলো। বাসায় ঢুকতেই ঈশার মা তাকে এভাবে ভিজতে দেখে চেচামেচি শুরু করে দিলো। কিন্তু সেসব কথা ঈশার কানেই গেলনা। তার কানে শুধু ইভানের কথাই বাজছে। সেই সময় ইভান ছাদ নেমে এলো ইরাকে নিয়ে। এভাবে সবাইকে অসময়ে ভিজতে দেখে ঈশার মা আরও রেগে গেলো। ইভান বিচক্ষণতার সাথে পুরো বিষয়টা সামলে নিলো। ঈশার মা আর কিছু বলল না। ইরাকে নিয়ে গেলো ভিতরে। ঈশা দরজার দিকে ঘুরতেই ইভান মৃদু সরে ডাকল।
–ঈশা।

ঈশা ঘুরে তাকাল। ইভান কাছে এসে দাঁড়ালো। আলতো করে কপালে লেপটে থাকা ভেজা চুলগুলো এক আঙ্গুলে সরিয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–এত সুন্দর একটা উপহারের জন্য ধন্যবাদ।

কথা শেষ করে ছেড়ে দিয়ে দূরে গেলো। ঈশা দাড়িয়ে থাকল। ইভান সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। কিছুদুর গিয়ে নামতে নামতেই বলল
–আমাকে দেখা হয়ে গেলে দয়া করে চেঞ্জ করে নেন ম্যাডাম।

ঈশা হেসে ভিতরে চলে গেলো। এটা সত্যিই জীবনের সুখময় স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। জীবনের ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখার মতো কিছু ভালবাসার মুহূর্ত।

————
বারান্দার গ্রিলের ফাক দিয়ে মাথা বের করে দেয়া হলুদ অল্কানন্দা ফুলটার গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি লেপটে আছে। কি সতেজ লাগছে। ঈশা চুল গুলো মুছতে মুছতে সেদিকেই তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির তেজটা কমে এসেছে। মেঘ জমে থাকলেও আগের মতো আর তেমন অন্ধকার নেই। তবে এখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি থাম বার নয়। একটু এগিয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখল ইভান কার সাথে যেন হেসে হেসে গল্প করছে। এখনও ভেজা কাপড়েই আছে। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। ঈশা সেই কখন চেঞ্জ করে বেরিয়েছে। এর মাঝে এক কাপ চাও খেয়েছে। চুলের পানি পড়ছিল তাই শুকনো তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইভান এখনও এখানে দাড়িয়ে কি করছে? আর কার সাথেই বা কথা বলছে? এতক্ষন ভেজা কাপড়ে থাকলে ঠাণ্ডা লাগবে জেনেও সে এখানে দাড়িয়ে গল্প করছে। ঈশা দাড়িয়েই দেখছে। জোরে কথা বলতেও পারবে না। নিষেধ আছে। তাই চুপচাপ দেখছে শুধু। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান কথা শেষ করে বাসার ভেতরে চলে গেলো। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়েই অপেক্ষা করছে। দৃষ্টি ইভানের বারান্দায় স্থির। ইভান তোয়ালে মেলে দিতে বারান্দায় আসল। ঈশার বারান্দার দিকে খেয়াল করেনি। ঈশা এগিয়ে গিয়ে ক্ষুব্ধ সরে বলল
–কার সাথে এতো গল্প করছিলে?

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভাবে বলল
–বন্ধুর সাথে কথা বলছিলাম। কেন?

ঈশা ঝাঝাল গলায় বলল
–এতক্ষন ধরে কি কথা বলছিলে?

ইভান বিস্ময়কর চোখে তাকাল। ঈশার এভাবে কথা বলার কারণটা বুঝতে পারলো না। নরম কণ্ঠে বলল
–এভাবে রিয়াক্ট করার কিছু নাই। ছেলে বন্ধু ছিল মেয়ে নয়। নাকি ছেলে বন্ধুর সাথেও কথা বলা যাবে না?

ইভানের কথা শুনে ঈশা প্রচণ্ড রেগে গেলো। সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–ছেলে ছিল না মেয়ে সেটা কি আমি জানতে চেয়েছি? আমার চোখ নাই? আমি দেখিনি?

ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–তাহলে? সমস্যাটা কোথায়?

ঈশা ঝাঝাল গলায় একটু জোরেই বলল
–ভেজা কাপড়ে এতক্ষন বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে গল্প করার কি দরকার ছিল? বন্ধু কি হারিয়ে যাচ্ছিলো। পরে কথা বলা জেতনা? বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসতে। চেঞ্জ করে তারপর কথা বলতে।

ইভান কোন কথা বলল না। নিরব দৃষ্টিতে ঈশাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–এরকম ভেজা খোলা চুলে আবেদনময়ী রুপ নিয়ে বারান্দায় আসার কি দরকার ছিল? এরকম হুটহাট বারান্দায় আসা যাওয়া চলতে থাকলে কিন্তু একদিন বারান্দায় আসা বন্ধ করে দেবো। মাথায় থাকে যেন।

ইভানের এরকম ত্যাড়া কথায় চরম রাগ নিয়ে তাকাল ঈশা। সে যা বলতে চেয়েছিল সেটা তো শুনলই না উলটা তাকেই জব্দ করার চেষ্টা করছে। কারন ইভান ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ঈশা এখন অযথাই বিষয়টাকে অন্যদিকে নিয়ে যাবে আর ঝগড়া করবে। কিন্তু ইভানের এখন কোনভাবেই ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না। তাই যাতে আর কথা না বাড়ায় সেই জন্যই তাকে একটু রাগিয়ে দিলো। রাগে ফুসতে ফুসতে উলটা দিকে ঘুরে বলল
–অসহ্য একটা!

কথাটা স্পষ্ট রুপে ইভানের কান পর্যন্ত পৌছালো। মুচকি হেসে গলা তুলে বলল
–আমি অসহ্য হই বা অসভ্য! সবটা কিন্তু একজনের জন্যই। আর এই সব কিছু সহ্য করতে সে বাধ্য।

ঈশা থেমে ঘাড় ঘুরিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভানের ঠোটে সেই জ্বালাময়ী হাসি। রাগটা কমার বদলে বেড়ে আরো দিগুন হয়ে গেলো। দ্রুত পায়ে হেটে ঘরে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাগ কমানর জন্য যা যা করার দরকার সব করলো ঈশা। কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। এক সময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় বসে পড়ল। কোন এক গল্পের বইয়ে পড়েছিল যে রাগ হলে নাকি রবিন্দ্র সঙ্গীত শুনতে হয়। তাহলে রাগটা কমে যায়। তাই ফোনে রবিন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে দিলো। বসে বসে মনোযোগ দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করছে। রাগটা কতটুকু কমলো সেটা বোঝার আগেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। এতোটুকু ভালো করে বুঝতে পারলো গান শুনলে রাগ না কমলেও ঘুমটা বেশ হয়। উপায় না দেখে বালিশটা মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশা। কতক্ষন ঘুমিয়েছে সেটা বুঝতে পারলো না। কানের কাছে চাপা আওয়াজ শুনে চোখ খুলে ফেলল। ইলু ইরিনা আর ইফতিকে দেখে হুরমুরিয়ে উঠে বসলো। অবাক হল না মোটেই। কারন এরা কখন আসে আর কখন যায় সেটার কোন ঠিক নেই। ক্লান্ত সরে বলল
–তোমরা কখন এলে?

ইলু বলল
–অনেকক্ষণ এসেছি। তুই ঘুমাচ্ছিস তাই ডাকি নি।

ঈশা উঠে ওয়াশ রুমে গেলো। মুখে চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে বের হয়ে এলো। বিছানায় বসে বলল
–কয়টা বাজে?

ইফতি ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল
–৮.৩০ বাজে।

ঈশা চমকে উঠলো। সেই সন্ধ্যা বেলা ঘুমিয়েছে। এখন অব্দি ঘুমাচ্ছিল? আজ নির্ঘাত সারা রাত জেগে থাকতে হবে। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–চা খাবে তো? বানাবো?

ইরিনা বলল
–চা পরে খাবো। আগে ফুচকা, চটপটি এসব খাই।

ঈশা অবাক হয়ে বলল
–এসব কই পেলে?

এর মাঝেই ইলু সব কিছু প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে এলো। ঈশা খুব খুশি হল এসব দেখে। সবার সাথে মেঝেতে বসে পড়ল। নিজেদের মধ্যে গল্প করছে আর খাচ্ছে। খাওয়ার এক পর্যায়ে ঈশা বলল
–কে এনেছে এগুলা?

ইলু একটা ফুচকা মুখে পুরে অস্পষ্ট সরে বলল
–ইফতি এনেছে।

ঈশা ইফতিকে উদ্দেশ্য করে বলল
–অনেক ধন্যবাদ ভাই। খুব মিস করছিলাম। কতদিন খাইনা এসব।

ইফতি মুখের ফুচকাটা শেষ করে বলল
–আমি আনিনি তো। ইভান ভাইয়া এনেছে। আমাকে দিয়ে বলল এখানে নিয়ে আসতে। আর সাথে ইলু আপু আর ইরিনা আপুকেও ডাকতে। তাই আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসলাম।

ঈশা ফুচকা টা মুখে ঢুকাতে গিয়েও থেমে গেলো। একটু সময় ভাবল। তার মানে তখনের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য এই ব্যবস্থা। একটু হেসে বলল
–তোর ভাইয়া কোথায়?

ইফতি খেতে খেতে বলল
–জানিনা তো। আমাকে দিয়েই চলে গেলো।

ঈশা খাবারটা মুখে পুরে দিলো। ফোনটা হাতে নিয়ে ইভানকে একটা এস এম এস পাঠিয়ে দিলো।

“প্রিয় জিনিস গুলোর জন্য পছন্দের মানুষটাকে অনেক ধন্যবাদ। যদি এসব রাগ ভাঙ্গানোর জন্য হয়ে থাকে তাহলে ‘আই এম ইম্প্রেসড’ ! এখন আর রাগ নেই।”

মেসেজটা ডেলিভারড হতেই একটু হেসে আবার নিজের খাবারে মনোযোগ দিলো। খানিকবাদেই আবার ফোন বেজে উঠলো। ইভানের মেসেজ দেখেই মনটা খুশি হয়ে গেলো। ওপেন করে দেখল

“এতো প্রিয় জিনিস গুলোর জন্য শুধু শুকনো মুখে ধন্যবাদ? পছন্দের মানুষ আমাকে কোন উপহার দিলে আমি ধন্যবাদের সাথে যে আরও বিশেষ কিছু দেই। সেই বিশেষ কিছুর অপেক্ষায় থাকলাম। আর হ্যা কেউ দিতে না চাইলেও কোন সমস্যা নেই। আমার যা দরকার সেটা আমি সময় মতো নিজে থেকে নিয়ে নেই। সো! গেট রেডি টু গিভ সাম্থিং স্পেশাল।”

মেসেজটা পড়ে ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। সবাই তার দিকে তাকাল। ইফতি পানি এগিয়ে দিলো। পানি খেয়ে ঈশা বোতলটা চেপে ধরে ভাবতে লাগলো। ইভান ঠিক কি বোঝাতে চাইল?

চলবে…………।

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
বোনাস পর্ব

সকাল সকাল কারো চাপা গলায় নিজের নামটা উচ্চারণ করতে শুনে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে পড়ল ঈশা। কোথা থেকে এই আওয়াজ আসছে সেটাই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ করে গভির ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় এলোমেলো লাগছে সব কিছু। কিছুক্ষন বসে থেকে মস্তিষ্ককে ঠিক করে নিতেই আবার কানে এলো নিজের নামটা। ভ্রু কুচকে নিজে নিজে আওড়াল
–এটা তো বড় মার গলা।

পাশের বারান্দা থেকে ডাকছে। দরজা খুলে দেখল গ্রিল ধরে অস্থির ভঙ্গিতে ইভানের মা তার বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ঈশা তাকে এভাবে দেখে চিন্তিত হয়ে বলল
–কি হয়েছে বড় মা?

ইভানের মা এক প্রকার হাপাতে হাপাতে বলল
–তাড়াতাড়ি একটু বাসায় আয় না মা।

কথাটা শুনে ঈশার বুকের ভিতরে ছ্যত করে উঠলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বিপদের আভাষ জানিয়ে দিলো। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কোন সমস্যা হয়েছে? কারো কিছু হয়েছে?

ইভানের মা কাদ কাদ কণ্ঠে বললেন
–ইভানের খুব জ্বর। তুই একটু আয় না।

ঈশা থেমে গেলো। ভয় জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমি আসছি বড় মা। এখনি আসছি।

ইভানের মা ভিতরে চলে গেলো। ঈশা কোন রকমে ফ্রেশ হয়ে মাথায় ওড়না টেনে বাড়ি থেকে বের হতে গেলেই তার মা জিজ্ঞেস করলো
–এতো সকালে কই যাস?

ঈশা একটু ভাবল। তারপর চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–ইভান অসুস্থ মা। ঐ বাড়িতে যাচ্ছি।

ঈশার মাও আর দেরি না করে মেয়ের সাথে বেরিয়ে গেলেন। বাসায় ঢুকে দেখে সবাই ইভানের ঘরে। প্রচণ্ড জ্বরে কাতর ইভান। কোন হুশ নেই। চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। কাউকে এই মুহূর্তে চিনতে পারছে কিনা কে জানে। মুখ চোখ সব রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। কিছুক্ষন পরেই ডক্টর আসলো। ইভান কে দেখে বলল
–সারা রাত তীব্র জ্বর থাকায় নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আমি ইনজেকশন দিচ্ছি। ঘুমিয়ে পড়বে এখন। নিজে থেকে না উঠা পর্যন্ত ঘুম ভাঙ্গাবেন না। আর জ্বর জতক্ষন নামেনি ততক্ষণ পর্যন্ত মাথায় জলপটি দিতেই থাকবেন। আশা করা যায় কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্বর কমে যাবে।

প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে ডক্টর চলে গেলো। ইভানের মা মুখে আচল চেপে কাদছেন। ঈশার মা তাকে শান্তনা দিতে দিতে বলল
–রাত থেকে ছেলেটার এমন অবস্থা একবার ডাকবেন না ভাবি?

ইভানের মা মৃদু গলায় বলল
–আমিও তো জানতাম না। কখন জ্বর এসেছে কাউকে বলেনি। কিছুক্ষন আগেই আমি ঘরে এসে দেখি কাপছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখি প্রচণ্ড জ্বর।

ঈশার মা একটু রুষ্ট কণ্ঠে বলল
–হবেই না বা কেন? কাল অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজেছে সব কয়টা। বকতে গেলাম আমাকেই আরও উলটা বুঝিয়ে দিলো।

ইভানের মা কিছু বলল না। কাদতে লাগলো। ঈশার মা ইভানের মাকে বললেন
–কিছু খেয়েছেন আপনারা?

ইভানের মা না সুচক মাথা নাড়ল। ঈশার মা বলল
–আমি নাস্তা বানাই।

বলেই পা বাড়াতেই ইভানের মা ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–তুই এখানে থাক মা। আমি তোর মায়ের সাথে রান্না ঘরে যাই।

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–যাও। আমি আছি।

সবাই রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ঈশা ইভানের মাথার কাছে বসে জলপটি দিতে লাগলো। তীব্র জ্বরের ঘোরে ইভান ঈশার হাত শক্ত করে ধরে বিড়বিড় কি যেন বলল। ঈশার কানে আসলো না। কিন্তু বুঝতে পারলো ইভান খুব করে ঈশাকে কাছে চাইছে। ঈশা একটু ঝুকে মাথাটা বুকে নিয়ে আলতো করে বলল
–আমি তোমার কাছেই আছি। একদম কাছে। চোখ মেলেই আমাকে দেখতে পাবে।

ইভান ঠিক কতটা তার কথা বুঝল সেটা জানা সম্ভব হল না। কিন্তু ঈশার মনে হল তার কথা শোনার পরে ইভানের অস্থিরতা কমে গেলো। গভির ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। অনেক সময় পর ইভানের জ্বর নেমে গেলো। সে এখন গভির ঘুমে আচ্ছন্ন। ইভানের মা কয়েকবার এসে দেখে গেছে। এবার এসেছে ঈশার জন্য খাবার নিয়ে। ঈশাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো। ঈশা আলতো হাতে ইভানের মাথা টিপে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ করে তিনি মৃদু সরে বলল
–আমি চা এনে দিচ্ছি।

ঈশা ম্লান হেসে মাথা নাড়ল। ইভানের মা চলে গেলো।

————-
কপালে কচি হাতের নরম ছোঁয়ায় ইভানের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে। চোখ খুলতেই পারছে না কিছুতেই। এমন হওয়ার কারন বুঝতে না পেরে কষ্ট করে চোখ খুলে ফেলল। সাদা আলো এসে সোজা চোখের মনিতে আঘাত করতেই আবার বন্ধ করে ফেলল। চোখ খিচে বন্ধ করে কিছুক্ষন পর খুলে তাকাল। পাশেই ইরাকে বসে থাকতে দেখল। তার মাথায় হাত দিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–তুই কি করছিস টুনটুনি?

ইরা একটু চমকে গেলো। ইভান যে চোখ খুলেছে সে এতক্ষন বুঝতে পারেনি। চট করে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল
–তুমি উঠলে কেন? আবার ঘুমাও।

ইভান হাসল। উঠে পিছনে হেলানি দিয়ে বসে বলল
–আবার কেন ঘুমাব?

ইরা হাঁটুর উপরে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ইভানের কপালে হাত রেখে বলল
–তোমার যে জ্বর হয়েছে।

ইভানে ভ্রু কুচকে ফেলল। কাল রাতে শোয়ার সময় শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল। কিন্তু এখন এরকম টায়ার্ড লাগছে আর মাথা ব্যাথা করছে কেন সেটা ইরার কথায় বেশ ভালভাবে বুঝতে পারলো। ভাবনার মাঝেই ইরা আবার বলল
–মাথা ব্যাথা হইছে। দাও টিপে দেই।

ইভান হেসে ফেলল। ইরাকে কোলে বসিয়ে বলল
–কে বলেছে আমার মাথা ব্যাথা?

–আপু যে টিপছিল এতক্ষন।

ইভান ভ্রু কুচকে নিলো। একটু ভেবে অবাক সরে জিজ্ঞেস করলো
–তোর আপু কোথায়?

ইরা হাস্যজ্জল কণ্ঠে বলল
–ঐ যে।

ইরার কথা শুনে ইভান দরজার দিকে তাকাল। ঈশা অসহায়ের মতো ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান খেয়াল করলো ঈশার সেই অসহায় দৃষ্টি। ঈশা ইরার দিকে তাকিয়ে হতাশ সরে বলল
–বাইরে গিয়ে খেল ইরু। ভাইয়াকে রেস্ট নিতে দে।

ইরা উঠতে নিলেই ইভান থামিয়ে দিয়ে বলল
–থাক না। বিরক্ত করছে না তো।

ঈশা কোন কথা বলল না। বের হয়ে গেলো ইভানের জন্য খাবার আনতে। ইরা কোল থেকে নেমে পাশে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। কিছুক্ষন পরেই ঈশা খাবার নিয়ে আসলো। ইভান চোখ তুলে তাকাল। মুখটা কেমন বিস্বাদ হয়ে আছে। খাবারের গন্ধটাই অরুচি ধরিয়ে দিচ্ছে। বিরক্ত নিয়ে বলল
–খেতে ইচ্ছা করছে না। খাবো না।

ঈশা নরম সরে বলল
–কি খাবে? বল। বানিয়ে দিচ্ছি।

ইভান অবাক চোখে তাকাল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–থাক কিছু বানাতে হবে না। এগুলাই খাবো। কিন্তু অল্প।

ঈশা বসে পড়ল। ভাত মেখে মুখের সামনে ধরল। ইভান তাকিয়ে আছে। এসব কিছু এক সময় তার কাছে স্বপ্ন মনে হতো। কিন্তু এখন বাস্তবে হচ্ছে। ইভান মুখে খাবার নিলো। ঠোটে প্রশান্তির চাপা হাসি। কয়েকবার মুখে নিয়ে বলল
–আর খাবো না।

ঈশা জোর করলো না। পানি এগিয়ে দিলো। প্লেট রেখে হাত ধুয়ে এসে ইভানের হাতে ঔষধ ধরিয়ে দিলো। ইভান ঔষধ খেয়ে পানির গ্লাস ঈশাকে দিলো। সে গ্লাসটা নিয়ে টেবিলে রেখে ওখানেই দাড়িয়ে থাকল। ইভান ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–মুড অফ কেন?

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই সোজা সাপটা জিজ্ঞেস করলো
–তুমি সিগারেট খাও?

ঈশার মুখে এমন কথা শুনে ইভান চরম বিস্ময়ে তাকাল। তার এই অভ্যাসের কথা বন্ধু মহলের বাইরে কেউ জানে না। বন্ধুদের সাথে মাঝে মাঝেই সখের বসে খাওয়া হয়ে উঠে। কিন্তু ঈশা জানল কিভাবে? ভীষণ রকমের অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা কোনভাবেই প্রকাশ করতে চাইছে না সে। পিছনে মাথাটা ঠেকিয়ে নরম সরে বলল
–মাঝে মাঝে।

ঈশা আবারো কঠিন কণ্ঠে বলল
–আমি জতদুর জানি যারা সিগারেট খায় তাদের জীবনে ডিপ্রেশন থাকে। তোমার জীবনের ডিপ্রেশন কি? আমি?

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। বিরক্তিকর কণ্ঠে বলল
–এটা কি ধরনের প্রশ্ন ঈশা? সিগারেট খাওয়ার জন্য যে ডিপ্রেশন থাকতেই হবে এমন কোন কথা নাই। আর আমি বলেছি মাঝে মাঝে খাই। সখের বসে। আমি এডিক্টেড না।

ঈশা হাত গুজে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–আচ্ছা? সিগারেটের প্যাকেট পকেটে রাখার মানে মাঝে মাঝে খাওয়ার অভ্যাস বলে তো মনে হয়না।

ইভান হতবিহবল চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। ঈশা বিষয়টা কিভাবে জানল সেটা এখন স্পষ্ট তার কাছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঈশার মনের অবস্থা বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছুক্ষন পরে হাত বাড়িয়ে নরম কণ্ঠে বলল
–আসো।

ঈশা বিস্ময় মাখা দৃষ্টিতে তাকাল। একটা দুইটা নয় হাজারটা ময়ুর পেখম মেলে নেচে উঠলো মনের মাঝে। ভোতা অনুভুতি গুলো ধারালো ফলার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো উচ্চারিত এই একটা শব্দে। ইভান আবার বলল
–নিজে থেকেই আসবা নাকি আমি কাছে যাব। আমি গেলে কিন্তু……

কথা শেষ করার আগেই ঈশা এগিয়ে এসে ইভানের হাত ধরল। কারন ইভান এরপর কি বলবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে সে। ইভান আলতো করে পাশে বসিয়ে দিলো। এক হাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল
–মন খারাপের কারন কি শুধু এটাই?

ঈশা নিচে তাকিয়ে আছে। কোন উত্তর দিলো না। ইভান কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো উত্তরের জন্য। তারপর গম্ভির গলায় বলল
–ঠিক আছে। আর কখনও সিগারেট খাবো না। খুশি?

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–অন্য কারণটা বল এবার।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–কেন অত সময় বৃষ্টিতে ভিজলে? আমি বললাম সেটা কানেই নিলেনা। আবার রাতে জ্বর এসেছিলো সেটাও কাউকে জানাওনি।

ইভান অপরাধীর মতো বলল
–আমি যখন ঘুমাতে যাই তখন একটু খারাপ লাগছিল। কিন্তু সেটা যে জ্বরের কারনে বুঝতে পারিনি। পারলে ঔষধ খেয়েই ঘুমাতাম। পরে কি হয়েছে সেটা তো আর বলতে পারিনা।

ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল
–কি অবস্থা হয়েছে সেটা যদি বুঝতে তাহলে এরকম বলতে না।

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–আচ্ছা সরি।

ঈশা নিচেই তাকিয়ে থাকল। কোন কথা বলছে না দেখে ইভান ঈশাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটু কাছে টেনে বলল
–এভাবে সরি বলে লাভ না হলে আর কিভাবে বলতে হয় সেটা কিন্তু আমি জানি।

ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে ফিসফিস করে বলল
–কি করছ? ইরা আছে।

ইভান ঈশাকে ওভাবেই ধরে ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–টুনটুনি ইফতি ভাইয়ার কাছে গিয়ে বল ইভান ভাইয়া চকলেট দিতে বলেছে।

ইরা ইভানের কথা শুনে আর দেরি করলো না। এক দৌড়ে চলে গেলো। ইরা ঘর থেক বের হয়ে যেতেই ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বাকা হাসল। তারপর দুই হাতে ঈশাকে জড়িয়ে কাছে টেনে দুষ্টুমির সুরে বলল
–কোনটা দিয়ে শুরু করবো? আগে রাগ ভাঙ্গাব নাকি অভিমান।

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান হাতের বাধন আরও শক্ত করে বলল
–এতো সহজ না। তোমার উপরে সবটা ছেড়ে দিয়েছি। তাড়াতাড়ি ডিসাইড করো। যত দেরি করবা তোমার বিপদ তত বাড়বে ঈশা পাখি। আজ তো আমি কোন ভাবেই ছাড়বো না। এতো অভিযোগ আমি আর নিতে পারছি না।

চলবে………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৭

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৭

নিরিবিলি সকাল। মস্তিষ্কে অগোছালো ভাবনার বিচরণ। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে দিনের শুরু। কোন কাজ না পেয়ে শেষে টিভির সামনে বসে পড়ল। এলোমেলো ভাবে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে ঈশা। কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না তার। আজ একটু সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। তাই এখন আর সময় কাটছে না। আজ কাল টিভিতেও তেমন ভালো কিছুই হয় না। খুব বিখ্যাত একটা চ্যানেলে এসে থেমে গেলো সে। কোন এক সিরিয়ালে চরম রকমের ঝগড়া চলছে। বউ শাশুড়ির ঝগড়া। বউ নিজের যোগ্যতা প্রমান করতেই ব্যস্ত। আর শাশুড়ি বউকে একের পর এক টাস্ক দিয়েই যাচ্ছে। যাতে সে কোন ভাবেই যোগ্যতা প্রমান করে উঠতে না পারে। আর বেচারা নায়ক দু চোখ দিয়ে সব কিছু শুধু দেখেই যাচ্ছে অসহায়ের মতো। ঈশা ভলিউম টা একটু বাড়িয়ে দিলো। রিমোট হাতে ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। চমর সাসপেন্সের ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ এসে তার নাম ধরে প্রচণ্ড গতিতে কানের কাছে চিৎকার করে উঠল। ঈশা চমকে উঠল। হাত থেকে রিমোট পড়ে গেলো। অতি বিরক্ত নিয়ে পাশে ঘুরে তাকাল। ইভানের মা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রচণ্ড রেগে আছে সেটা দেখেই বোঝা সম্ভব। কিন্তু সকাল সকাল এরকম অগ্নি মূর্তি ধারন করার কারণটা বোধগম্য হল না তার। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে বড় মা?

বলেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিয়ে আবার বলল
–এরকম সেজে গুজে কোথাও যাচ্ছ? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছ?

ইভানের মা পাশে বসে পড়ল। ঝাঝাল গলায় বলল
–কখন থেকে ডাকছি। এমন ভাবে ঢুকে গিয়েছিস যে আশে পাশের কোন খেয়াল নেই।

ঈশা মিনমিনে গলায় বলল
–সিরিয়াল দেখছিলাম তো। তাই খেয়াল করিনি।

ইভানের মা ধমক দিয়ে বললেন
–এসব কি সিরিয়াল দেখিস? বউ শাশুড়ির ঝগড়া শিখছিস? আর আমার বাসায় গিয়ে এসব করার পরিকল্পনা করছিস? সংসারে আগুন লাগানোর পরিকল্পনা তাই না?

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশার মা হেসে ফেলল এসব কথা শুনে। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভানের মা আবার বলল
–ভালো জিনিস দেখবি। কিভাবে শশুর শাশুড়ির খেয়াল রাখতে হয় সেসব শিখবি আর সেবা করবি। আদর্শ বউ হবি বুঝলি?

ইভানের মা থামতেই ঈশা তাকে জোর করে জড়িয়ে ধরে বলল
–তুমি তো শাশুড়ি না। তুমি তো বড় মা। কেন শুধু শুধু শাশুড়ি সাজতে চাইছ। তোমাকে মোটেই মানাচ্ছে না।

ইভানের মা গম্ভির গলায় বলল
–এসব বলে কোন লাভ হবেনা। এখন ছাড় পাচ্ছ বলে যে পরেও ছাড় পাবে তা কিন্তু না। যাই হোক এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। আমরা একটু বাইরে যাব।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কই যাব?

–মার্কেটে। তোকে নিয়ে যাব। চল। রেডি হয়ে নে।

ঈশা আর কথা বাড়াল না। কারন আজ একটু বেশী গরম মনে হচ্ছে। সকাল সকাল না গেলে গরম আরও বেড়ে যাবে। উঠে নিজের ঘরে গেলো। বেছে বেছে আলমারি থেকে সাদা রঙের একটা কামিজ বের করলো। রেডি হয়ে বের হয়ে এলো। বাইরে এসে দেখে ইভানের মা আর ঈশার মা বসে গল্প করছে। ঈশা বের হয়েই বলল
–আমাকে কেমন লাগছে বড় মা?

মাথায় ওড়নাটা লম্বা করে টেনে দেয়া। আহামরি কোন সাজ নেই। ইভানের মা উঠে দাড়িয়ে বলল
–খুব সুন্দর লাগছে। একদম আমার বাড়ির বড় বউয়ের মতো।

ঈশা একটু লজ্জা পেল। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনি বের হয়ে গেলো।

—————
আবহাওয়াটা বেশ গরম। মার্কেটে মানুষের ভিড়ে আরও গরম লাগছে। ক্লান্ত শরীরে দুই হাত ভর্তি ব্যগ ধরে ঈশা আর ইভানের মা দাড়িয়ে আছে রিকশার জন্য। একটা রিকশা সামনে দেখতেই ঈশা হাত উচিয়ে ডাকল। পাশে ঘুরে দেখে ইভানের মা নেই। এদিক সেদিক তাকাতেই খেয়াল করলো তিনি পাশের দোকানে কি যেন কিনছেন। দোকানদার কে টাকা দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এসে বললেন
–রিকশা পেয়েছিস?

ঈশা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল
–কই গিয়েছিলে তুমি? উঠে পড়।

ইভানের মা উঠে বসলো রিকশায়। ড্রিংকসের বোতলটা ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–এটা আনতে গিয়েছিলাম।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কিন্তু এগুলা তো তোমার পছন্দ না। তাহলে কিনলে কেন?

ইভানের মা মৃদু হেসে বললেন
–তোর তো পছন্দ। তোর জন্য কিনেছি।

ঈশা গভির দৃষ্টিতে তাকাল। ছেলের মতো মাও তার পছন্দ অপছন্দের খেয়াল রাখে। মেয়ে নেই বলে ঈশাকে সে একদম নিজের মতো ভালবাসে। ঈশার মা ছোট বেলায় তাকে মারার জন্য ইভানের মায়ের কাছে কত যে বকা খেয়েছে তার হিসাব নেই। খুশি হয়ে একটু জড়িয়ে ধরে বলল
–থ্যাঙ্ক ইউ বড় মা।

দুজনে নিজেদের মতো গল্প করতে করতে পৌঁছে গেলো বাসায়। ঈশা রিকশা থেকে নেমে কিছু একটা ভেবে বলল
–বড় মা। আমি বাসায় যাই। গিয়ে গোসল করব।

ইভানের মা আপত্তি জানাল। বলল
–এখনি না। আগে আমার সাথে উপরে যাবি তারপর বাসায়।

কিন্তু এতে কোন লাভ হল না। ঈশা জোর করে বলল
–আমি একদম ঘেমে গেছি। এখনি গোসল করে ফ্রেশ না হলে ঠাণ্ডা লাগবে। পরে আবার আসব তো।

আর কিছু বলতে পারলো না। রাজি হয়ে গেলো। তিনি ‘আচ্ছা’ বলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অর্ধেক সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতেই ইভানের সাথে দেখা হল। ইভান বাইরে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে। মা তাকে দেখে বলল
–কোথাও যাচ্ছিস?

ইভান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–হুম। একটু কাজ আছে।

ইভানের মা আর কথা না বলে উপরে চলে গেলেন। ঈশা তাদের কথোপকথন শুনে মুচকি হাসল। আসলে সে নিচ থেকে ইভানের বারান্দায় দেখেছিলো তাকে রেডি হয়ে দরজা লাগাতে। বুঝে গিয়েছিলো ইভান এখন বাইরে যাবে। তাই বাসায় যাওয়ার বাহানা করে ইভানের জন্য অপেক্ষা করছে সিঁড়ির নিচে। ইভান শার্টের হাতা ভাজ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। হঠাৎ করেই সামনে চোখ পড়ল। ঈশাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থেমে গেলো। সাদা মাটা চেহারায় ঈশাকে অদ্ভুত লাগছে। শুভ্র রঙটা যেন তার চেহারার সৌন্দর্য হাজার গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। ইভানের মনেও ঠিক একি রকম অনুভুতি হচ্ছিল। এই মুহূর্তে ঈশাকে খুব মিস করছিল সে। মনে হচ্ছিল কোনভাবে এক পলক দেখা পেলে তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মন সতেজ হয়ে উঠবে। ইভান ধির পায়ে শেষ সিঁড়িটা অতিক্রম করতেই ঈশা সামনে এসে দাঁড়ালো। ছোট্ট একটা বক্স তার দিকে এগিয়ে দিলো। ইভান ভ্রু কুচকে বক্সটার দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে না পেরে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল। কিছুক্ষন পর হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিলো। কোন কথা বলার আগেই ইরিনা এসে মাঝখানে দাড়িয়ে বলল
–ওহো! এখানে দেখছি আদান প্রদান হচ্ছে। তো কি আদান প্রদান হচ্ছে শুনি?

ঈশা একটু বিরক্ত হল ইরিনার উপরে। এই সময়েই তাকে আসতে হল। একটু পরে আসলে কি ক্ষতি হতো। তেমন কিছু না হলেও ধন্যবাদটা বলতো সুন্দর করে। এখন হয়তো সেটাও আর বলবে না। মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার। একটা বিরক্তিকর শ্বাস ছাড়তেই ইভান বলল
–তুই একটু ভুল বলেছিস। সবে আদান হয়েছে। এখনও প্রদান বাকি।

ইরিনা আর ঈশা দুজনেই এমন অদ্ভুত কথা শুনে ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভানের কথার মানে যে কেউ বুঝতে পারেনি সেটা বুঝেই সে একটু হাসল। আর একটু এগিয়ে এসে ঈশার কাছাকাছি দাড়িয়ে ইরিনাকে বলল
–তাহলে এখন প্রদানের কাজটা সেরে ফেলি। কি বলিস?

ইরিনা না বুঝেই মাথা নাড়তেই ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে গেলো। ডান গালে আলতো করে একটা হাত রেখে বাম গালে গভির ভাবে একটা চুমু দিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। আচমকাই এমন কিছু হওয়াতে ঈশা হা হয়ে গেলো। কি থেকে কি হয়ে গেলো সেটাই বুঝতে পারলো না। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম। গরমে ঘেমে পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি শাওয়ার না নিলে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

দুই আঙ্গুলে আলতো করে গালে স্পর্শ করে বলল
–বি কেয়ার ফুল। ঠাণ্ডা যেন না লাগে।

বলেই চলে গেলো। ঈশা হা হয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। ইরিনা হেসে ফেলল। ঈশার দিকে তাকাতেই ঈশা বলল
–আমাকে একটা চিমটি কাটবে ইরিনা আপু? প্লিজ!

ইরিনা ঈশার কথা শুনে আরও জোরে হেসে ফেলল। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–পাগল হওয়ার কথা ছিল আমার আর পাগলামো করছ তুমি। আর আমি এখনও বুঝেই উঠতে পারলাম না বাস্তব না কল্পনা।

ইরিনা ঈশার হাতে জোরে চিমটি কাটতেই সে চিৎকার করে উঠল। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন ইরিনার দিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর বুঝে উঠতেই মুচকি হেসে তার গালে একটা চুমু দিলো। ইরিনা আবারো হেসে বলল
–তোর উপরে ইভান ভাইয়ার ভুতটা ভর করেছে।

ঈশা হেসে বলল
–এরকম জানলে আরও আগে ভুতকে নিমন্ত্রন জানাতাম। নিমন্ত্রন জানাতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।

দুজন মিলে অট্ট হাসিতে মেতে উঠল। খানিকবাদেই ঈশা বলল
–থাক আমি বাসায় যাই। তুমি কোথায় যাচ্ছিলে?

ইরিনা বলল
–বড় মার কাছে যাচ্ছিলাম।

ঈশা বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠছে আর কিছুক্ষন আগের কথা ভাবছে। ভেবেই ঠোট কামড়ে হাসল। বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজাতেই তার মা দরজা খুলে দিয়ে বলল
–কি রে এসেছিস? দেখি কি কি কিনলি?

ঈশা ব্যাগ গুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গালে একটা চুমু দিলো। ঈশার মা তার আচরনে বেশ অবাক হল। ভ্রু কুচকে বলল
–আজ হঠাৎ করে এতো ভালবাসা উতলে পড়ছে যে?

ঈশা ঘরের দিকে পা বাড়াতেই পিছনে ঘুরে মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
–ভালবাসা তো হঠাৎ করেই আসে মা।

বলেই ঘরে চলে গেলো। মেয়ের এরকম উদ্ভট আচরন দেখে তার মা বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো। ঈশা ঘরে গিয়ে কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমে চলে। অনেকটা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। এসেই টেবিলে রাখা ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিন অন হতেই চোখে পড়ল ইভানের মেসেজ।

“যাকে এক পলক দেখার মাঝে এক আকাশ সম তৃপ্তি! যার কাজল জড়ানো মায়াবি চোখে হৃদয় হরনের ক্ষমতা। যার মুচকি হাসিতে অনাবিল সুখ! সেই তুমিটা শুধুই যে আমার।”

চলবে…………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৬

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৬

মৃদু আওয়াজ কানে আসতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো ঈশার। চোখ খুলতে পারছে না। অনেক রাতে ঘুমানর ফলে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। কষ্ট করে চোখ খুলে ফেলল। অন্ধকার ঘর। কিন্তু সকাল হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। ফ্যানের বাতাসে জানালার পর্দাটা উড়ছে। সেটার ফাক দিয়ে মৃদু আলো আসছে। ঈশা উঠে বসলো। ফ্যানের শব্দটা কম মনে হচ্ছে। ফ্যানের স্পীড কমানো আছে। কিন্তু ঘুমানর আগে তো সে কমায়নি। তার মানে ঘুমানোর পরে ইভান এসেছিলো ঘরে। ঈশা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুনু ঝুনু আওয়াজ কানে আসতেই পায়ের দিকে খেয়াল করলো। সেই পায়েল। তার মানে ইভান এসে তাকে পরিয়ে দিয়ে গেছে। মনে মনে খুব খুশি হল। জানালার পর্দা সরিয়ে বারান্দার দরজা খুলে দিলো। সকালের স্নিগ্ধ বাতাসটা এসে লাগতেই মনটা ভরে গেলো। এবার ঘরের দরজা খুলতেই দেখল ইলু আর ইরিনা বাইরে দাড়িয়ে আছে। তারা যেন দরজা খোলার অপেক্ষাতেই ছিল। ঈশাকে দেখে দাত কেলিয়ে বলল
–গুড মর্নিং!

ঈশা হেসে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল
–গুড মর্নিং!

ঈশা পুরো দরজাটা খুলতেই ইলু আর ইরিনা দুজনেই ঘরে উকি ঝুকি দিলো। কাউকে দেখতে না পেয়ে ইরিনা ফিস ফিস করে বলল
–ভাইয়া কোথায়? ওয়াশ রুমে?

ঈশা ক্লান্ত সরে বলল
–ইফতির ঘরে।

কথাটা শুনে ইলু আর ইরিনা চোখ বড় বড় করে তাকাল। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঈশাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকল। ঈশা তাদের এরকম আচরনে বেশ অবাক হল। সেও ধির পায়ে গিয়ে বিছানার উপরে বসলো। ইরিনা ভ্রু কুচকে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া ইফতির ঘরে এতো সকাল সকাল কি করছে?

ঈশা ক্লান্ত সরে বলল
–ঘুমাচ্ছে।

দুজনি একসাথে চিৎকার করে বলল
–ঘুমাচ্ছে মানে?

ঈশা চমকে তাকাল তাদের দিকে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল
–এভাবে চিৎকার করার কি আছে? ইফতির ঘরে থাকা নিষেধ আছে নাকি?

ইলু একটু ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–নিষেধ মানে কি! মহাপাপ!

ঈশা বিরক্ত হল। কোন কথা বলল না। ইরিনা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া কি রাতে ওখানেই ঘুমিয়েছিল?

ঈশা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ইরিনা আবারো সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–তোরা কি ঝগড়া করেছিস নাকি?

ঈশা বিরক্তিকর শব্দ করে বলল
–কি আশ্চর্য! ঝগড়া কেন করতে যাব?

–তাহলে ইফতির ঘরে কেন ভাইয়া ঘুমিয়েছে?

ইলু প্রশ্ন শেষ করতেই ঈশা এবার তেতে উঠে বলল
–কি তখন থেকে ঘুরিয়ে পেচিয়ে একি কথা বলছ। সমস্যা কি? কেন ঘুমিয়েছে আমি কিভাবে জানব? তার মন চেয়েছে ঘুমিয়েছে। এটা নিয়ে এতো সিন ক্রিয়েট করার কি আছে?

থেমে আবার ক্লান্ত সরে বলল
–তাছাড়া ইফতির ঘরে ঘুমালে সমস্যা টা কি সেটাই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।

ইলু ঝাঝাল কণ্ঠে বলল
–অনেক সমস্যা। নতুন বউকে একা ঘরে রেখে রাতে অন্য ঘরে ঘুমানো অনেক সমস্যা। নতুন বর বউ আলাদা ঘুমায় সেটা বাইরে কেউ জানতে পারলে মান সম্মান থাকবে না।

এবার ঈশা ওদের কথা বুঝতে পারল। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। আবার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভানের গলা শুনে থেমে গেলো।
–এতো সকাল সকাল আড্ডা দিতে চলে এসেছিস। তোরা ঘুমাস না বলে কি আমার বউটাকেও ঘুমাতে দিবিনা।

ইরিনা গম্ভির গলায় বলল
–তোমার বউ নিজে নিজেই উঠে গেছে। আমরা বিরক্ত করিনি।

ইভান ঘরে ঢুকার আগেই ওদের কথা শুনেছে। ঈশা যে তাদের এসব কথার উত্তর দিতে পারবে না সেটাও বুঝে গেছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে ঈশার পাশে গিয়ে বসলো। নরম সরে জিজ্ঞেস করলো
–ঘুম হয়েছে রাতে?

ঈশা চোখ নামিয়েই মাথা নাড়াল। ইরিনা সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি বউকে একা রেখে ইফতির ঘরে কেন ঘুমিয়েছিলে?

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল দুজনের দিকে। এতক্ষন ঈশাকে প্রশ্ন করে মেরে ফেলছিল সেটা পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু তারা যে ইভান কেও এভাবে প্রশ্ন করবে সেটা সে ভাবেনি। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো
–আমার একটু কাজ ছিল। ঈশা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর আমার কাজ শেষ করতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই আর বিরক্ত করিনি। ওর ঘুম ভেঙ্গে যাবে বলে ইফতির ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।

ইভানের কথা যে তাদের বিশ্বাস হয়নি সেটা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ইভান সেটাকে পাত্তা না দিয়ে ঈশাকে বলল
–ব্রেক ফাস্ট করতে হবে না? ঔষধ খেতে হবে তো।

ঈশা মাথা নাড়িয়ে উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ইভান সস্তির নিশ্বাস ছেড়ে উঠে বাইরে গিয়ে সোফায় বসলো।

————-
ভর সন্ধ্যা বেলা। বারান্দায় দাড়িয়ে রাস্তার দিকে নিচে তাকিয়ে আছে ঈশা। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে মনে হয়। সেটারই ঠাণ্ডা হাওয়াটা গায়ে এসে লাগছে মাঝে মাঝে। খোলা চুল গুলো মুখে এসে পড়ছে। বেশ বিরক্ত লাগছে। হাত খোপা করে আবার নিচে তাকাতেই চোখে পড়ল ইফতি হেটে যাচ্ছে। ঈশা উপর থেকেই চেচিয়ে বলল
–ঐ ইফতি। কই যাস?

ইফতি ঈশার গলা শুনে উপরে তাকাল। সেও একটু গলা তুলে বলল
–এমনি হাটি। কোথাও যাই না।

ঈশা একটু ভাবল। তারও এখন হাটতে ইচ্ছে করছে। তাই আর কিছু না ভেবেই বলল
–আমিও যাব। দাড়া।

ইফতি ভালো করে দাড়িয়ে বলল
–আসো।

ইফতির কথা শেষ হতেই পাশের বারান্দা থেকে ইভান ধমক দিয়ে বলল
–এতো চেচামেচি করছিস কেন? কি হয়েছে?

ঈশা আচমকাই এরকম ধমক খেয়ে চমকে উঠল। ইফতি নিচ থেকে বলল
–ভাবি আপুকে নিয়ে হাটতে যাব।

ইভান ইফতির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ ভাবে তাকাল। ঈশা ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। ইভান কিছু বলার আগে ইফতি আবার বলল
–নিচে আসো।

ইভান এবার গলা তুলে ইফিতকে ধমক দিলো। বলল
–আবার যদি চিৎকার করেছিস তো তোর খবর আছে। ঈশা কোথাও যাবে না। তুই যা।

ইফতি গেলো না। কিছুক্ষন অপেক্ষা করলো। ইভান গম্ভির ভাবে বলল
–তুই যাবি না আমি আসব।

ইফতি বুঝতে পারল আর দাড়িয়ে থাকা সম্ভব না। তাই চলে গেলো একা একা। ঈশা অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে ইফতির দিকে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মুখ ভার করে ইভানের দিকে তাকাতেই ইভান বলল
–আসতে কথা বলতে বলেছিলাম। মনে নেই?

ঈশা মুখ ভার করেই বলল
–এখান থেকে আসতে কথা বললে কি নিচে শোনা যায়?

ইভান এবার রেগে গেলো। ধমক দিয়ে বলল
–এখান থেকে নিচে কথা বলার দরকার কি ছিল? না বললে কি দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত?

ঈশা কিছু বলতে গেলো কিন্তু আবার ইভান ধমক দিয়ে বলল
–চুপ। একদম চুপ। আর একটা কথাও যেন মুখ দিয়ে না বের হয়।

ঈশা কিছু বলল না। তার খুব মন খারাপ হল। মাথা নামিয়ে নিলো। এর মাঝেই ঈশান নিচে থেকে গলা তুলে বলল
–ইভান ভাইয়া।

ইভান নিচে তাকাল। ঈশানকে দেখে বলল
–কই যাস?

ঈশান দুষ্টুমির সুরে বলল
–তোমাদের কাছেই যাচ্ছিলাম। আম্মু নতুন বর বউকে বাসায় ডাকে। তাড়াতাড়ি আসো।

ইভান হাসল। ঈশা কিছু বলতে গিয়েও ইভানের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলো। ইভান গম্ভির গলায় বলল
–আর একটা কথাও যদি আমার কানে আসে তাহলে ধরে মাইর লাগাবো।

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান ঈশানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই যা আমরা আসছি।

ঈশান হেসে চলে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকাল। মন খারাপ করে দাড়িয়ে আছে। ইভান আদুরে কণ্ঠে বলল
–এখানে দাড়িয়ে থাকলে কিভাবে যাব? নিচে নামতে হবে তো।

ইভানের কথা শুনে ঈশার মন গলে গেলো। কিন্তু সে কিছুতেই ইভান কে বুঝতে দিবে না। তাই কোন কথা না বলে ভাব নিয়ে ঘরে চলে গেলো। ইভান মুচকি হেসে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। সে ঈশাদের বাড়ির নিচে অপেক্ষা করছে। এতক্ষন মেয়েটা কি করছে কে জানে। কিছুক্ষন পর ঈশাকে নামতে দেখল। সিঁড়ি বেয়ে নামছে কিন্তু চোখ ফোনের মাঝে। এতো মনোযোগ দিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে যে ইভান কেও সে দেখেনি। ইভান একটু বিরক্ত হল। কিন্তু মাথায় দুষ্টুমি খেলে গেলো। দুটো সিঁড়ি উপরে উঠল। একদম ঈশার বরাবর দাড়িয়ে গেলো। ঈশা খেয়াল করেনি। সে আনমনে ইভানের সামনে চলে আসলো। ইভান মুখে হাসি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঈশা আর একটা সিঁড়ি পা বাড়াতেই ইভানের সাথে ধাক্কা খেলো। পড়ে যেতে নিলে ইভান তাকে দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আচমকা এসব হওয়াতে ঈশা কিছুই বুঝতে পারল না। কিছুক্ষন পর সব মাথায় ঢুকতেই নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ইভান অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারল না। মাথা তুলতেই ইভানের অনেক কাছাকাছি এলো। ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান ঈশার মুখটা ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–যাকে দেখার দরকার তাকে ছেড়ে অন্য দিকে তাকালে এমনি হবে।

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাতেই ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা দুই টা সিঁড়ি উপরে উঠে দাঁড়ালো। ইভান কে দেখে নিয়ে বলল
–আমার ভুল না। তুমি ভুল জায়গায় দাড়িয়ে আছ। তুমি সামনে না দাঁড়ালে আমি ঠিক ঠাক নেমে যেতাম।

ইভান গম্ভির সরে বলল
–আমি যদি ভুল জায়গায় দাড়িয়ে থাকি আর সেটার জন্য যদি তোর কোন বিপদ আসে তাহলে আমিই সেটা সামলাবো।

ঈশা কঠিন কণ্ঠে বলল
–কিভাবে সামলাবে? লুকিয়ে? সামনে তো এরকম কিছুই করোনা। যা করো সব লুকিয়ে।

ঈশার কথা ইভান প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝতে পারল। আর কথাটা শুনে খুব রেগে গেলো। একটা সিঁড়ি উপরে উঠে শক্ত করে হাত ধরে ফেলল। দাতে দাত চেপে বলল
–সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আমার কোন কাজের জন্য কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে রাজি না।

হাত ছেড়ে দিয়ে সামনে পা বাড়াল ইভান। ঈশার মুখে হাসি ফুটে উঠল। কারন ইভান তার সাথে আবার আগের মতো ব্যবহার করছে। তার মানে অভিমানটা অনেকটা কমে গেছে। ঈশা মুচকি হেসে ইভানের পিছে পিছে পা বাড়াল। ঈশানদের বাড়ির সামনে এসে বলল
–পায়েলটা কখন পরিয়ে দিয়েছ?

ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সেই দৃষ্টির মানে স্পষ্ট যে সে কিছুই বলবে না। ঈশাও নাছোড়বান্দা। আবার বলল
–আমি যখন ঘুমাইছিলাম তখন তুমি ঘরে এসেছিলে?

ইভান থেমে গেলো। বিরক্ত হয়ে বলল
–বলেছি না সব বিষয়ে এতো কৌতূহল ভালো না।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
–কেন? আমার জানার অধিকার আছে। আমি জানতে চাই। তোমাকে বলতেই হবে।

ইভান ঈশার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। অভিমানী সুরে বলল
–জানার অধিকার থাকলেই কি সব কিছু জানা যায়? আমি কি জানতে পেরেছিলাম?

ইভানের তীব্র অভিমানী কণ্ঠটা ঈশার বুকে ধারালো ফলার মতো আঘাত করলো। মুহূর্তেই চোখে পানি জমে গেলো। কণ্ঠের অসহায়ত্ব সাথে এক রাশ অভিমান। সবটা যেন উছলে পড়ছে। চোখ নামিয়ে নিলো। চোখের পাতা পিট পিট করে পানি লুকাবার চেষ্টা করলো ঈশা। ইভান সবটা বুঝতে পারলো। কিন্তু তারই বা কি করার। যখনি মনে পড়ে যায় এতো বড় একটা ঘটনা ঈশা তার কাছ থেকে লুকিয়ে তাকে দিনের পর দিন অবহেলা করে গেছে তখনি মনের কষ্টটা বেড়ে যায়। সব কিছু না জেনেও সে তাকে সামলে নিতে পেরেছিল। তাহলে জানালে কি সামালতে পারত না? কেন ঈশা তাকে বিশ্বাস করতে পারলো না। শুধু তাই নয় সে ইভানের কথা একবারও ভাবল না। তার কিছু হয়ে গেলে ইভান কিভাবে বাঁচবে সেটাও ভাবল না।

ঈশা নিজের চোখের পানি আটকাতে ব্যর্থ হল। না চাইতেও গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ইভান দাড়িয়ে সবটা দেখছে। ঈশার চোখে পানি দেখে আন্দাজ করতে পারলো ভিতরের কষ্টটা। তার অভিমান এক জায়গায় আর ঈশার কষ্ট আরেক জায়গায়। ঈশা যে এতো বেশী কষ্ট পাচ্ছে সেটা ইভানের ধারনাও ছিল না। সে বুঝতে পারেনি খুব বেশী কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। নিজের মধ্যে অপরাধবধ তৈরি হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে ইফতি দৌড়ে এসে বলল
–তোমরা এসে গেছ? ইলু আপু ফোন করেছিল। সেজো মা নাকি ডাকছে।

ঈশা আড়ালে চোখের পানি মুছে ফেলল। ইভান কোন কথা বলল না। দ্রুত পায়ে হেটে ভিতরে চলে গেলো। ইফতি ঈশার কাছে এসে বলল
–ভাবি আপু কি হয়েছে? কোন সমস্যা? ভাইয়া মনে হল রাগ করেছে।

ঈশা সামনে তাকিয়েই বলল
–কত আর রাগ করে থাকবে? আমি ঠিক সামলে নিবো। তুই ভাবিস না। চল।

চলবে………

(রিচেক করার সময় হয়নি। একটু কষ্ট করে পড়ে নিবেন। ধন্যবাদ।)

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৫

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৫

শরতের নির্মল স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের আলো উপরের আকাশের মতো নিচেও দৃশ্যমান। শান্ত নদীর পানিতে যেন আকাশের মেঘ বালিকা নেমে এসেছে। নদীর পানিতে আকাশের মেঘের ভেলা সাথে এক ফালি চাঁদ আর তারার পসরা ভেসে বেড়ানোর প্রতিচ্ছবি দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেলো ঈশার। এলোমেলো হাওয়ায় অবাধ্য চুল গুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। দুই হাত ব্রিজের রেলিঙ্গে ভর দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। ঠোটে প্রশস্ত হাসি। তার থেকে একটু দূরে ইভান দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। বাসায় জানিয়ে দিচ্ছে যে তাদের আসতে দেরি হবে। প্রথমে একটু আপত্তি জানালেও পরে ইভান আর ঈশান থাকায় তেমন কোন অসুবিধা হবে না সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়ায় আর আপত্তি করেনি কেউ। সোডিয়াম বাতির হলদেটে আলোয় কি অপূর্ব লাগছে ইভান কে। ঈশা মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। ইভান পাশ ফিরতেই ঈশার দিকে চোখ পড়ল। ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে আবার নিচে তাকাল। ঠোটের হাসিটা একটুও কমেনি। ইভানের ভারাক্রান্ত মনটা ভালো হয়ে গেলো ঈশাকে হাসতে দেখে। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। এদিকটায় তেমন যানবাহন চলাচল এখনও শুরু হয়নি। শহর থেকে একটু দূরে নতুন তৈরি হয়েছে এই ব্রিজটা। আর এতো রাতে এমনিতেই রাস্তা ফাঁকাই থাকে। ওরা কয়েকজন ছাড়া কেউ নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ির দেখা মিলছে। উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে তীব্র গতিতে চলছে। একদিকে ইরিনা আর ইফতি ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আরেক দিকে ঈশানের হাত ধরে ইলু ব্রিজের রেলিঙ্গে উঠে বসেছে। মাঝে মাঝে পড়ে যাবার ভয়ে চিৎকার করছে। আর ঈশান তার বোনের উপরে খুব বিরক্ত হচ্ছে এটা ভেবে যে ভাইয়ের উপরে তার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই। ঈশা সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ইভান ঈশার দিকে তাকাল। হলদেটে আলোয় রুপবতির হাসি যেন ঝলমলিয়ে উঠছে। চোখ ধাধিয়ে গেলো তার। ইফতি ইভানের কাছে এসে বলল
–ভাইয়া তুমি ভাবি আপুর কাছে গিয়ে দাড়াও। তোমাদের ফটো তুলব।

ইভান কোন কথা না বলে ঈশার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশা নদীর পানি দেখতেই ব্যস্ত। ইফতি নিজের ক্যামেরা ঠিক করে নিতেই ইভান এক টানে ঈশাকে ঘুরিয়ে দিলো সামনে। হঠাৎ এমন টানে ঈশা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে ইভান তাকে দুই হাতে ধরে নেয়। ঈশা ইভানের বুকের শার্ট খামচে ধরে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইভান ঈশাকে দুই হাতে ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পরেই ইভান বিরক্তিকর গলায় বলল
–এতক্ষন লাগে? তাড়াতাড়ি কর বলদ।

ইফতি দাত বের করে হেসে বলল
–হয়ে গেছে।

বলেই এক দৌড়ে ইভানের কাছে আসতেই সে ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সে এখনও ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ছবিটা দেখে নরম গলায় বলল
–নাইচ। যত্ন করে রেখে দিস।

বলেই একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ইফতি ঈশার কাছে এসে বলল
–তুমি দেখ ভাবি আপু।

ঈশার ছবিটা দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। ইফতি ছবিটা দেখতে দেখতে বলল
–এটা বড় করে ভাইয়ার ঘরে টাঙ্গাব।

ইফতির কথা শুনে ঈশা আবারো হা হয়ে গেলো। নামানো গলায় বলল
–তোর ভাইয়া ঠিকই বলেছে। তুই আসলেই বলদ।

ইফতি ভ্রু কুচকে বলল
–কত রোমান্টিক একটা ছবি তুলে দিলাম। বিনিময়ে বলদ উপাধি পেলাম। হায় ভাগ্য।

ঈশা আশে পাশে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–ছবি তোলার আগে আমাকে বলতে পারিস নি? আমি নিজে নিজে ঠিক হয়ে যেতাম।

ইফতি মিন মিনে গলায় বলল
–বলেছিলাম তো। শোন নি?

ঈশা আর কথা বলল না। সে জানে ইফতির সাথে কথা বলে কোন লাভ নাই। ইভান দূর থেকে তাদের কথা শুনছিল। ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে একটু হাসল। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কিন্তু হাসিটা চোখে পড়ল না।

————–
সোজা রাস্তা ধরে সোডিয়াম বাতির আলোয় কয়েকজন যুবক যুবতী হেটে চলেছে নিজেদের গন্তব্যে। এলোমেলো ভাবে হাঁটছে। মাঝে মাঝে থেমে থেমে ব্রিজের উপরে উঠে চিৎকার করছে। আবার কখনও একজন আরেক জনের পিছনে দৌড়ে ধরার চেষ্টা করছে। অবাধ্য মনটার সকল আবদার আজ পুরন করতে ব্যস্ত তারা। ঈশা পিছনে ছিল। ইভান ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। হঠাৎ থেমে সামনে তাকিয়েই পিছনে হাত বাড়িয়ে দিলো। ঈশা একটু থেমে গেলো। হাত বাড়ানোর কারন বুঝতে পেরে মুচকি হেসে হাত ধরে ফেলল। ঈশা হাত ধরে তার পাশে দাড়াতেই ইভান হাটার গতি কমিয়ে দিলো। কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সামনে তাকিয়ে ঈশার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটছে। কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে দেখল রিক্সা দাড়িয়ে আছে। ইভান একটু গলা তুলে বলল
–চল রিক্সায় উঠি।

সবাই থেমে গেলো। আবার জোড়া ধরে রিক্সায় উঠল। চলতে লাগল বাড়ির দিকে। কিছুক্ষন থেমে ঈশা মৃদু কণ্ঠে বলল
–কয়টা বাজে?

ইভান যেন কথাটা শুনল না। খানিক্ষন পর মুখ ফিরিয়ে গম্ভির আওয়াজে বলল
–১.৩০।

ঈশা আঁতকে উঠল। এতো রাত পর্যন্ত বাইরে সে! ভাবতেই গায়ে কেমন কাটা দিয়ে উঠল। আচমকা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে আরও কাপন ধরিয়ে দিলো। ঈশা ওড়নাটা ঠিক করে মেলে পুরো গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইভান বুঝতে পারল তার ঠাণ্ডা লাগছে। হুডটা উঠিয়ে দিলো। ঈশা প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও পরে মনে মনে খুশি হল। কিছুদুর যেতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভয়ে ভয়ে ইভানের ঘাড়ে মাথা রাখল। কিন্তু ইভানের কোন প্রতিক্রিয়া হল না। এমন কি ঈশার দিকে ঘুরেও তাকাল না। ঈশা এতেই খুশি যে তাকে উঠিয়ে দেয় নি। সে আর একটু সুযোগ নিয়ে ইভানের হাত জড়িয়ে ধরল। এবার ইভান ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। খুব শান্ত দৃষ্টিতে। ঈশা ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু ইভানের দৃষ্টি দেখে সস্তি পেল। ইভান সামনে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল
–খারাপ লাগছে?

ঈশা কথাটা শুনে নিজের খুশিটা চেপে রাখতে পারল না। হাসি হাসি মুখেই বলল
–না ভালো লাগছে।

ইভান মুখ ফিরিয়ে মুচকি হাসল। ঈশা সারা রাস্তা ওভাবেই থাকল। রিক্সার ঝাকুনিতে আর ইভানের উষ্ণতায় হালকা তন্দ্রা ভাব এসে গেলো। রিক্সা এসে থামতেই ঈশার তন্দ্রা ঘোর কেটে গেলো। একে একে সব রিক্সা এসে থামল। ঈশা কি ভেবে নিজের ব্যাগে হাতড়াল অনেকটা সময়। কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটা না পেয়ে অসহায়ের মতো মুখ করে বলল
–ইলু আপু আম্মু এতক্ষনে ঘুমিয়ে গেছে। আমার চাবিটাও খুজে পাচ্ছি না। আমি তোমার সাথে যাব।

ইরিনা খুশি হয়ে ঈশার হাত ধরে বলল
–খুব ভালো হইছে। চল একসাথে থাকব সবাই।

ইলু ইরিনার হাত ঈশার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসি মুখে বলল
–তোর বর নেই। তোর দায়িত্ব আমি নিতে পারি। কিন্তু এই বিবাহিত মহিলার দায়িত্ব আমি কোনভাবেই নেব না।

মহিলা কথাটা শুনেই ঈশা রেগে গেলো। একটু ঝাঝাল গলায় বলল
–কি বলছ এসব? আমি মহিলা মানে?

ইভান উলটা দিকে ঘুরে দাড়িয়ে মানি ব্যাগ থেকে ইফিতকে বাড়ির চাবি বের করে দিচ্ছিল। ইফতি চাবি নিয়ে উপরে গেলো তালা খুলতে। আর ইভান ওভাবেই দাড়িয়ে থাকল। ইলু ইভানের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল
–তোর জলজ্যান্ত বর নিজে উপস্থিত আছে। আর শশুর বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছিস। সেখানে আমি কি করে তোর দায়িত্ত নেই বল।

ঈশা কথার মানে বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আপত্তি জানাতে প্রস্তুতি নিয়েও লাভ হল না। ইলু দাত কেলিয়ে বলল
–তুমি তোমার বরের সাথে শশুর বাড়িতে যাও। প্রথমবার বলে কথা। নতুন বউ। আমরা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে আসব। প্রমিস। একটুও মিস করার সুযোগ দেব না।

বলেই ইরিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–অল দা বেস্ট ভাইয়া।

ইভান পিছনে ঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। সে মাথা ঘুরিয়ে ইরিনা কে নিয়ে চলে গেলো। ইভান সামনে ঘুরে নিশব্দে হেসে ফেলল। ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে দৌড় দিয়ে বাসায় চলে যেতে। কিন্তু সেটারও উপায় নাই। ঈশাকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইভান ঘুরে বলল
–আপনার জন্য কি ইনভাইটেশন কার্ড ছাপাতে হবে?

ঈশা কোন কথা না বলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। ইভান একটু হেসে তার পিছনে পিছনে গেলো। ভিতরে ঢুকে দেখে সব অন্ধকার। ইফতি নিজের ঘরে চলে গেছে। ঈশা মাঝখানে দাড়িয়ে গেলো। এই বাড়িতে আগেও অনেকবার থেকেছে। কিন্তু এরকম অনুভুতি হয়নি। আর সব সময় ইভানের মায়ের সাথেই থেকেছে। কিন্তু আজ তো উনি ওনার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাহলে কোথায় থাকবে? তার ভাবনার মাঝেই ইভান নিজের দরজার সামনে দাড়িয়ে হেলানি দিয়ে বলল
–কি হল? ওখানে দাড়িয়েই কি রাত পার করে দেয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?

ঈশা চমকে উঠল। ঢোক গিলে একটা জোরে শ্বাস টেনে দ্রুত পায়ে ইভানের ঘরের দিকে গেলো। ইভানের পাশ কেটে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো রহস্যময় হাসি। সেই হাসিই যেন ঈশার এতক্ষনের সব তন্দ্রা ভাব কেটে দিলো। ঝরঝরে হয়ে গেলো মস্তিষ্ক। ইভান ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল পা ঝুলিয়ে। ঈশা ব্যাগটা টেবিলে রেখে এদিক সেদিক ঘুরে দেখছে। ইভান মাথাটা একটু তুলে বলল
–ছোট বেলা থেকেই এই ঘরে ঘোরাফেরা করার পরেও কি আজ অপরিচিত মনে হচ্ছে?

ঈশা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–না। টায়ার্ড লাগছে। আমি ফ্রেশ হব।

বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ইভান উঠে বসলো। ঠোট কামড়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে হাসল। আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করে নিয়ে আবার বিছানায় বসে পড়ল। কিছুক্ষন পর ঈশা ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এলো। ইভান ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে উঠে ওয়াশ রুমে গেলো। পানির আওয়াজ পেয়ে ঈশা ভাবল ইভান গোসল করছে। বের হতে দেরি হবে। তাই ওড়নাটা বিছানার উপরে রেখে চুল গুলো আঁচড়িয়ে বাধতে লাগল। কিন্তু চুল বাধা শেষ হওয়ার আগেই ইভান বের হল। দরজা খুলেই আগে চোখ পড়ল ঈশার দিকে। ঈশা তাড়াতাড়ি করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইভান চোখ নামিয়ে নিলো। এগিয়ে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলে তোয়ালে মেলে দিয়ে আবার লাগিয়ে দিলো। ঈশার দিকে তাকাল না। দরজার কাছে গিয়ে মৃদু সরে বলল
–অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমান উচিৎ।

ঈশা কিছু না বুঝেই ইভানের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
–তুমি কোথায় যাচ্ছ?

ঈশার কথা কানে আসতেই ইভানের এতক্ষনের বাধ্য চিন্তারা কেমন অবাধ্য হয়ে উঠল। গোছানো অনুভুতি বর্বর হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। তারপর নরম গলায় বলল
–বাসায় আব্বু আম্মু আছে। এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। আমি ইফতির ঘরে ঘুমাব।

ইভানের কথা বুঝতে পেরে ঈশা সোজা সাপটা উত্তর দিলো
–আমি সেটা বলিনি। কোথায় ঘুমাবে তাই জানতে চাচ্ছিলাম।

ইভান কোন উত্তর না দিয়ে লাইট অফ করে বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষন সোফায় বসে ফোন নিয়ে কাজ করলো। ঈশা শুয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান উঠে ইফতির ঘরে যাওয়ার আগে নিজের ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। ঈশাকে ঘুমাতে দেখে মুচকি হেসে পায়ের কাছে বসে পায়েলটা সাবধানে পরিয়ে দিলো। উঠে মাথার কাছে এসে কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে ফিস ফিস করে বলল
–তুমি নামক অভ্যাসটা বড়ই ভয়ংকর! একবার করে ফেললে এর থেকে যে আর কোনভাবেই আমার নিস্তার নেই। তাই গোছানো অনুভুতি গুলোকে এলোমেলো করতে চাইনা জান।

চলবে………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৪

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৪

শরৎ মানেই শুভ্র নীলের সমাহার। রোদ্রজ্জল ঝলমলে সকাল। এলোমেলো দখিনা হাওয়া। দোলনচাঁপা, শিউলি, বেলি আর কাশফুলের স্নিগ্ধতা। ঝকঝকে নীল আকাশে ঝাকে ঝাকে শুভ্র মেঘ। যেন কয়েক গুচ্ছ তুলোর পেঁজা। রোদ্র ছায়ার খেলার মাঝেই ছাদে ব্যস্ত ভাবে হাঁটছে ঈশা। গভির ভাবনায় নিমগ্ন। ভ্রু কুচকে নিচের দিকে তাকিয়েই হেটেই যাচ্ছে। অবাধ চিন্তা ধারা মস্তিষ্কে নানান রকম ভাবে হানা দিচ্ছে। এতো চেষ্টা করছে কিন্তু ইভান কে কিছুতেই মানাতে পারছে না। এতো কঠিন মানুষ হয়? এরকম অনেক কারনেই অনেক বার ইভান তার উপরে রাগ করেছে। সময়ের সাথে সেসব ঠিকও হয়ে গেছে। কিন্তু এবার তো পুরোটাই ভিন্ন। না সে ঈশার সামনে আসছে আর না তার সাথে কথা বলছে। কথা না বলুক। সামনে আসলে তাও তো মানানো যায়। সামনে আসছে কিন্তু সেই সময় কথা বলার মতো সুযোগ থাকছে না। কারন পুরো পরিবার তখন উপস্থিত থাকছে। আর সেটারই সুযোগ নিচ্ছে ইভান। অসহায় মুখ করে বিড়বিড় করে বলল
–সবার সামনে আদর্শ সামির দায়িত্ব পালন করছে কিন্তু পরে ঠিকই খারাপ ব্যবহার করছে। খারাপ আর কই ব্যবহারি তো করছে না।

–কিসব একা একা বিড়বিড় করছিস?

চমকে পিছনে ঘুরতেই দেখল ইরিনা দাড়িয়ে আছে। নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–কিছু না। তুমি কখন এলে?

ঈশার কথার উত্তর দেয়ার আগেই পাশের ছাদে চোখ গেলো তার। ইফতি আর ঈশান কি নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছে। ইরিনার দৃষ্টি তাক করেই ঈশা সেদিকে তাকাল। তাদের কথার মাঝেই ইলু চায়ের কাপ নিয়ে ছাদে এলো। ঈশা একটু এগিয়ে গিয়ে গলা তুলে বলল
–তোমরা ওখানে কি করছ?

ঈশার কথা শেষ হতেই ইভান ছাদে এসে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। ঝাঝাল গলায় বলল
–আসতে কথা বলা যায়না?

ঈশা ভয় পেয়ে চুপ করে গেলো। কারন অপারেশন হওয়ার পর থেকে ঈশার জোরে কথা বলা শুনলেই ইভান রেগে যায়। আগেও কয়েকবার বলেছে। কিন্তু ঈশা ভুলে যায়। আর রাগ করার কি আছে সেটাই বুঝতে পারেনা। জোরে কথা বলতে তার তো কোন প্রব্লেম হয় না। তাহলে ইভানের সমস্যা কি। ইরিনা সিঁড়ির দিকে ঘুরে ঈশার উদ্দেশ্যে বলল
–চল। ঐ বাড়িতে যাই।

ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরিনার সাথে চলে গেলো। ছাদে উঠতেই ইলু বলল
–তোদের জন্য চা আনিনি। ঈশা তুই নিচে গিয়ে একটু কষ্ট করে চা নিয়ে আয় না।

ঈশা কোন কথা বলল না। সোজা নিচে চলে গেলো। ইভানের মা রান্না ঘরেই ছিল। পিছন থেকে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। তিনি একটু চমকে উঠে বলল
–আরে তুই কখন আসলি?

ঈশা ক্লান্ত গলায় বলল
–এই তো। উপরে চা নিয়ে যেতে বলল।

ইভানের মা আঙ্গুল তাক করে বলল
–ঐ যে গরম করে নে।

ঈশা চুপচাপ চা গরম করে কাপে ঢেলে নিলো। ইভানের মা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে? মন খারাপ নাকি তোর?

ঈশা একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–না বড় মা। এমনিতেই।

ইভানের মা আর কথা বাড়ালেন না। ঈশা চা নিয়ে চলে গেলো ছাদে। ছাদে গিয়ে দেখে সবার হাতে চায়ের কাপ শুধু ইভানের হাতে নেই। ঈশা এগিয়ে গিয়ে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। ইভান রেলিঙ্গের উপরে এক পা তুলে বসে আছে। তার মুখের এক পাশে রোদ পড়েছে। ঈশা ইভানের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে পিছনে এসে দাঁড়ালো। ইভান ঈশার দিকে তাকাল না। ঈশা পিছনে রেলিঙ্গে হেলানি দিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরিনা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি রে ঈশা তুই এরকম বিধবাদের মতো সাদা কামিজ পরেছিস কেন? মনে হচ্ছে তোর জামাই মরে টরে গেছে।

ইভান চায়ের মধ্যে বিস্কুট ডুবিয়ে কেবল মুখে দিয়েছে। ইরিনার কথা শুনেই গলায় আটকে গেলো। কাশতে লাগল। ঈশা ঈশানের হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে এগিয়ে দিলো ইভানের দিকে। ইভান সেটা নিয়ে পানি খেয়ে ইরিনার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ইরিনা বুঝতে পারল সে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। একটু হকচকিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুচকে একটু ভাবল। ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–আমি জলজ্যান্ত মানুষটা তোর সামনেই বসে আছি। আর তুই আমাকে মেরে ফেললি?

ইরিনা এবার বুঝতে পারল সে কি বলেছে। অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বলল
–না মানে ভুলে বলে ফেলেছি। ভুলে গিয়েছিলাম যে তুমিই ওর বর।

সবাই ঠোট চেপে হেসে ফেলল। ইভান তীক্ষ্ণ চোখে সবার দিকে একবার তাকাল। ইফতি এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলল
–ইভান ভাইয়া তুমি ব্যচেলর থেকে ম্যারিড হয়ে গেলে। সেই হিসেবে অন্তত একটা ট্রিট দেয়া উচিৎ ছিল। কি বল ভাবি আপু?

কথা বলে ঈশার দিকে তাকাতেই সে ভ্রু কুচকে বলল
–এটা কি ধরনের ডাক?

ইফতি দাত কেলিয়ে বলল
–ছোট বেলা থেকেই তোমাকে আপু বলে এসেছি। এখন বড় বেলায় ভাবি হয়ে গেলে। এখন আপু টা কিছুতেই ছাড়তে পারছিনা। তাই আর কি। আর বড় বেলায় যে ভাবি হয়ে যাবে সেটা তো বুঝতে পারিনি। তুমি ছোট বেলায় বলে দিলেই তখন থেকেই ভাবি বলে ডাকতাম। তাহলে আর আমার অসুবিধা হতনা।

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল। সবাই শব্দ করে হেসে ফেলল। ইভান ঠোট চেপে হাসল। কিন্তু ঈশা পিছনে থাকায় সেটা দেখতে পেলনা। ইফতির কথায় সে বেশ বিরক্ত হল। কিন্তু ঈশান তার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল
–একদম ঠিক। তুই এভাবেই ডাকবি। শুনতে ভালই লাগছে। আন কমন নাম।

ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোর এক মাত্র দেবর শখ করেছে। তুই বাধা দিস না।

বলে আবারো সবাই হাসতে লাগল। ঈশা সবার উপরে বেশ বিরক্ত হল। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতেই ইলু বলল
–তবে ইভান ভাইয়া ইফতি কিন্তু ভুল কিছু বলে নি। এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো। কি হল সবটা মাথার উপর দিয়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারলাম না। অন্তত বোঝার সুযোগটা তো দাও।

ইভান একটু চুপ থেকে বলল
–কোথায় যাবি? আজ রাতে চল।

সবাই খুশি হয়ে গেলো। জার জার পছন্দ মতো বলতে লাগল। সেটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষন ঝগড়া চলল। অবশেষে একটা রেস্টুরেন্ট ঠিক করলো সবাই মিলে। ইভান সম্মতি দিতেই ঈশা ভ্রু কুচকে একটু ভাবল। তারপর মুখ বাকিয়ে বলল
–আমি যাব না। তোমরা যাও।

ঈশার কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকাল। ঈশান বলল
–তুই যাবি না মানে?

ঈশা মলিন কণ্ঠে বলল
–আমি যাবনা এটার আবার কি মানে হয়?

ইরিনা বিরক্তিকর গলায় বলল
–ঈশা এমন করিস না।

ঈশা কিছুতেই রাজি হল না। সবাই ঈশার উপরে বেশ বিরক্ত হল। সহজেই ইভান রাজি হয়ে গেলো। আর ঈশার নাটক শুরু হল। এখন যদি কোনভাবেই ইভান প্ল্যান ক্যান্সেল করে দেয়? সবার কথার মাঝেই ইভান সামনে ঘুরে বলল
–ঈশা যেতে না চাইলে জোর করিস না। ও তো এখনও পুরপুরি সুস্থ না। রেস্ট নিক।

ইভানের কথা শুনে সবাই থেমে গেলেও ঈশার মনে হল কেউ তার গায়ে ফুটন্ত গরম তেল ঢেলে দিলো। কারন সে ভেবেছিল যেতে না চাইলে সবার সামনে হয়তো ইভান তাকে জোর করবে। কারন সে তো সবার সামনে ভালো সাজে। কিন্তু এখানে তো পুরই উলটা ব্যাপার ঘটে গেলো। এখন কি হবে? কিভাবে বলবে সে যাবে? বিরক্ত হয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। ঈশা নেমে যেতেই ইভান মুচকি হাসল। কারন সে বুঝতে পেরেছে ঈশার এমন নাটকের কারন। সবাই ঈশার এমন আচরন দেখে একটু অবাক হল। ইলু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বলল
–ঈশার কি কিছু হয়েছে?

ইভান শান্ত গলায় বলল
–তেমন কিছু না। মেডিসিনের কোর্স এখনও চলছে তো। পাওয়ার ফুল মেডিসিন নেয়ার ফলেই একটু মুড সুইং হচ্ছে।

————–
ভর সন্ধ্যা বেলা। রাস্তায় অনেক লোকজন। ল্যাম্পপোস্টের সাথে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে ইভান। ঈশান হাতের ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল
–মেয়েদেরকে নিয়ে কোন জায়গায় যাওয়া খুব প্রব্লেম। কখনই সময় মতো বের হতে পারেনা।

ইভান মুচকি হাসল। কোন কথা বলল না। ঈশান বিরক্তিকর শব্দ করে বলল
–ইফতি কোথায়?

ইভান ফোন থেকে মুখ তুলে ঈশার বারান্দার দিকে তাকিয়ে বলল
–ঈশাকে আনতে গেছে।

ঈশান ইভানের দিকে ঘুরে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল
–ঈশা নাকি যাবে না?

ইভান ঠোট কামড়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল
–যাবে।

ঈশান সামনে ফিরতেই ইভান হাসল। ঈশা ইভানের উপরে রাগ করে বাসায় চলে গিয়েছিলো। কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে যাবেই না। কিন্তু যখন জানতে পারল যে শুধু তার কাজিনরা না ইভানের দুই জন মেয়ে বন্ধুও আসছে তখন থেকেই ঈশার মাথা আরও গরম হয়ে গেলো। সে কিছুতেই আর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারল না। কারন ওর মধ্যে একজন মেয়ে ইভানের গায়ে পড়ে সেটা ঈশার জানা আছে। এভাবে নিজের জেদ আর আত্মসম্মান ধরে রাখতে গিয়ে নিজের বরকে বিসর্জন দেয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। তাই সব কিছু ভুলে রেডি হয়ে নিলো। ইভানও জানতো এটা শোনার পর ঈশা কিছুতেই আর বাসায় থাকতে পারবে না। তাই তো ইফতিকে সেভাবে বলেই পাঠিয়ে দিয়েছে। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ইফতি সিঁড়ি দিয়ে নামলো। আর তার পিছনে ঈশা নিজের চুল ঠিক করতে করতে আসছে। এপাশে ইরিনা আর ইলুও এসে পড়েছে। ঈশান সামনে দাড়িয়ে রিক্সা দেখছে। সে রিক্সা থামাল। ঈশান ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি তোমার বউকে নিয়ে যাও আমরা আসছি।

ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার দিকে তাকিয়ে রিক্সায় উঠতে ইশারা করলো চোখ দিয়ে। ঈশা কোন কথা না বলে উঠে বসলো। ইভান তার পাশে বসে পিছনে ঘুরে বলল
–তোরা আয়।

বলেই চলে গেলো। এলোমেলো হাওয়া বইছে শিরশির করে। ঈশার আধ খোলা চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে। ওড়না এক পাশে উড়ে চলে যাচ্ছে। যে কোন সময় চাকায় ঢুকে যেতে পারে। ঈশা খেয়াল করেনি। ইভান ঈশার দিকে একটু ঝুকে গেলো। হঠাৎ এমন হওয়ায় ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান সেদিকে না তাকিয়েই ওড়নাটা ধরে কোলে তুলে দিলো। ইটের টুকরোর উপরে রিক্সার চাকা উঠতেই ঈশার দিকে হেলে গেলো। ঈশা ভয় পেয়ে ইভানের হাত চেপে ধরল। ইভান আর এক হাতে ঈশাকে ধরল। তাকে ধরে নিয়েই নিজে সোজা হয়ে বসলো। রিক্সা ওয়ালা মামাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আসতে চালাও মামা।

রিক্সার গতি কমে গেলো। সাথে ঈশার হাত আলগা হল। ছেড়ে দিলো ইভানের ধরে থাকা হাত। কোলে রাখা ওড়নাটা চেপে ধরল। ইভানের হাত আলগা হল না। সে আগের মতো করেই ধরে রাখল। সারা রাস্তা কেউ কোন কথা বলল না। মান অভিমানের মাঝেই শেষ হয়ে গেলো পথ। চলে এলো গন্তব্য। রিক্সা থামতেই ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা নেমে গেলো। পর পর সব রিক্সা এসে থামল। ঈশা ইলুর কাছে এসে দাঁড়ালো। ইভানের বান্ধবীরাও এসে পড়েছে। দুইজনই ইভানের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। একজন বলল
–কিরে কতক্ষন থেকে ওয়েট করছি। এতো দেরি করলি যে?

ইভান কিছু বলার আগেই আর একজন বলে উঠল
–এখন আর ও কি আগের মতো সময়ে আসতে পারে? এখন তো অনেক কিছু মেইনটেইন করতে হয়। বিবাহিত বলে কথা।

বলেই দুজন হাসতে লাগল। হাসি থামিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল
–তোর বউ কই?

ইভান ঈশার দিকে তাকাতেই দুজনি সেদিকে এগিয়ে গেলো। একটু হেসে বলল
–তুমি ঈশা রাইট?

ঈশা হেসে মাথা নাড়াল। তাদের মধ্যে একজন বলল
–তোমার বর কিন্তু বিয়ের আগে আমার ক্রাশ ছিল।

কথাটা শুনেই ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছু বলল না। অপরজন বলল
–এখন এসব ভুলে যা। তোর ক্রাশ কিন্তু এখন বিবাহিত। এসব বলে ওদের সংসারে আগুন জালানর কোন মানেই হয়না।

ইভান পিছন থেকে বলল
–আমার বউ সেরকম না। অনেক ব্রড মাইন্ডের। আমি মেয়েদের নিয়ে ঘুরাফেরা করলেও কিছুই ভাববে না।

ইভানের কথা শেষ হতেই ঈশা তার দিকে তাকাল। ভীষণ অভিমান হল তার। চোখ ছলছল করে উঠল। ইভান বুঝতে পেরেও সেদিকে পাত্তা দিলো না। সামনে এগিয়ে গেলো। এবার লিফটে উঠার পালা। ঈশা সবার পিছনে দাড়িয়ে আছে। ইভান মেয়ে দুইটার সাথে লিফটের দরজার সামনে। ঈশা ভাবছে আগের বারের মতো ইভান তার ধরবে না। তাহলে উঠবে কিভাবে। এগিয়ে গিয়ে ইলুর পাশে দাঁড়ালো। লিফট এসে থামতেই ঈশার অসস্তি হল। ইলুর হাত চেপে ধরার আগেই ইভান বলল
–সবার এক সাথে লিফটে জায়গা হবে না। তোরা যা আমরা পরে আসছি।

সবাই এক এক করে লিফটে উঠে গেলো। শুধু ঈশা আর ইভান থেকে গেলো। লিফট চলে যেতেই ঈশা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করে নিলো। এখনও তার শারীরিক দুর্বলতাটা কেটে উঠেনি। একটু আগের ভয়ে মাথা ঘুরে উঠেছিল। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিলো। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে চোখ খুলে দেখল ইভান লিফটের দরজার সামনে দাড়িয়ে ভ্রু কুচকে ঠোট কামড়ে নিজের চুল ঠিক করছে হাত দিয়ে। ঈশা তাকিয়ে আছে তার দিকে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ছেলে মানুষ কি এতো সুন্দর হতে পারে? পারে তো! নাহলে তার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই মানুষটাকে দেখে সে বারবার এভাবে মুগ্ধ হতোনা। তার সৌন্দর্য দেখে লজ্জার শেষ সীমাটুকু অতিক্রম করে তাকিয়ে থাকত না। ঈশার ভাবনার মাঝেই টুং আওয়াজ করে লিফট নেমে এলো। তার ঘোর কেটে গেলো। একটু নড়েচড়ে ইভানের পাশে এসে দাঁড়ালো। লিফটের দরজা খুলতেই ইভান ভিতরে ঢুকে গেলো। ঈশা দাড়িয়ে থাকল। ঢোক গিলে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল ইভান অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাত ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিতেই সে হাত ধরে ফেলল। ঈশা ভিতরে ঢুকতেই ইভান হাত ছেড়ে দিলো। ঈশার হার্ট বিট বেড়ে গেলো। জোরে জোরে শ্বাস নিতেই দুর্বলতার কারনে মাথা ঘুরে গেলো। লিফটের দরজা বন্ধ হতেই খেয়াল করলো নিজের কোমরে হাতের স্পর্শ। কিছু বুঝে উঠার আগেই ইভান তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ইভানের চোখের দিকে তাকাতেই ঈশার পুরো শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। ইভানের হাত আরও গভির ভাবে কোমরে স্পর্শ করলো। ঈশা ঠোট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ইভান আরও কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ঈশাকে। ঈশা লিফটের কথা ভুলেই গেলো। সে এখন চরম অসস্তির মাঝে ডুবে আছে। ইভান ঈশার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে মুগ্ধ চোখে। আবারো টুং আওয়াজ হতেই লিফট থেমে গেলো। ঈশা চোখ খুলে ফেলল। দরজা খোলার আগেই ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। দরজা খুলতেই দেখল সবাই সামনে দাড়িয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশা লিফট থেকে নেমে শুকনো ঢোক গিলে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলো। এতক্ষন যা হল সবটা ঈশার মাথার উপর দিয়ে গেলো। তার অবস্থা দেখে যে কেউ ভাববে এতক্ষন দম বন্ধ হয়ে ছিল। গলায় জমে থাকা ঘাম ওড়নার মাথা দিয়ে মুছে ফেলল। ইরিনা এগিয়ে এসে বলল
—কি রে ঈশা তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?

ঈশা মাথা নাড়িয়ে না বলল। ইভান পাশে দাড়িয়ে বলল
–শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মাত্র ছাড়া পেল তো। ঘোর কাটতে একটু সময় লাগবে।

ইফতি এগিয়ে এসে ভ্রু কুচকে বলল
–মানে?

ইভান কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঈশা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল
–আমার লিফটে ফোবিয়া আছে তুই জানিস না?

ইফতি মাথা নাড়িয়ে বলল
–ওহ! হ্যা। জানতাম। ভুলে গেছিলাম।

ইভান ঠোট টিপে হাসল। ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। তারা রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকল। নিজেদের মতো পাশা পাশি দুইটা টেবিলে বসে পড়ল।

———-
পরিষ্কার আকাশে এক ফালি চাঁদ। তারা গুলো জ্বলজ্বল করছে। ঈশা মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ রাত হওয়ায় রাস্তায় তেমন ভিড় নেই। রিক্সা চলছে প্রচণ্ড গতিতে। মাঝে মাঝে টুং টাং আওয়াজ কানে আসছে। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল এতক্ষন। পাশ ফিরতেই ঈশাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও তাকাল। বেশ ভালো লাগছে। কি মনে করে হঠাৎ পিছনে ঘুরে দেখল। ইলু আর ইফতি এক রিক্সায়। তারা কি একটা কথা নিয়ে বেশ গম্ভির ভাবে আলোচনা করছে। যেন এই মুহূর্তে এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইভান একটু গলা তুলে বলল
–ঐ ইলু। নতুন ব্রিজের ঐ দিকটায় ঘুরতে যাবি?
ইভানের কথা কানে আসতেই ঈশার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মাথা নামিয়ে ইভানের দিকে ঘুরে তাকাল। সে ইলুর দিকে তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষা করছে। আর ইলু এমন ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেন ভুত দেখছে। ঈশা সাথে সাথেই মাথা বেকিয়ে ইলুর দিকে তাকিয়ে একটা চোখ টিপ দিতেই ইলু হেসে ফেলল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ইভান সামনে ঘুরে দেখল ঈশা পিছনে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পেরে মুচকি হাসল। ঈশা সামনে ঘুরে ভদ্র মেয়ের মতো ঠিক হয়ে বসলো। দুজনের ঠোটের কোনেই চাপা হাসি। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ঈশা হঠাৎ করেই পায়েলটা সামনে ধরল। ইভান সেটার দিকে একবার তাকাতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো এই ভেবে যে ঈশা পায়েলটা পরেনি। মুখ ফিরিয়ে নিলো আর একদিকে। ঈশা ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বলল
–নিজে হাতে পরিয়ে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো?

ইভান কোন কথা বলল না। ঈশার হাত থেকে পায়েলটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দিলো। আবার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ঈশার চোখে পানি টলমল করে উঠল। সে কি আবারো না বুঝে ইভান কে কষ্ট দিয়ে ফেলল?

চলবে……

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১৩

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৩

~ “এই মুহূর্তে ‘কেমন আছো’ এই প্রশ্ন করে তোমার মন আরও খারাপ করে দিতে চাচ্ছি না। তোমার হাতে ধরে থাকা রিপোর্টটা তোমাকে ঠিক কতটা ভেঙ্গে দিয়েছে সেটা আমার থেকে ভালো হয়তো তুমি নিজেও জাননা। আমি জানি তুমিও ঠিক আমার মতন এমন অজস্র তিক্ত মূহুর্ত কাটাচ্ছ। তোমার তিক্ততা বাস্তবতাকে ঘিরে। আর আমার তিক্ততা তোমার নিজের মনের বিরুদ্ধে এই জুদ্ধের কারনে। জীবনের প্রতি এই অনিহার কারনে। এতো অধিকার কেন তোমার নিজের উপরে? কে দিয়েছে? আমার মোটেই সহ্য হয়না তোমার উপরে কেউ অধিকার দেখাক। তাই তো এই অধিকার কেড়ে নিলাম।

যেখানে তোমার শরীরে সামান্য আঁচড়ের দাগও আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে যায় সেখানে এতো বড় কাটা ছেড়া! কিভাবে সহ্য করেছি বলতে পার? নিজের অজান্তেই কেমন করে যেন দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল আমার চোখ থেকেও। কিন্তু একটা কথা মাথায় ছিল পুরুষ মানুষের কাদতে নেই । তাই নিজেকে সামলে নিয়েছি। কিন্তু মনের মাঝে আজ বড্ড অভিমান। কি ভেবেছিলে? আমি কিছুই জানতে পারবো না? তোমার জিবনে আমার অজানা কোন ঘটনা কি কখনও ছিল আদৌ? তাহলে কেন এই লুকোচুরি?

তোমার অবহেলা যে আমাকে কষ্ট দিয়েছে প্রতি নিয়ত। তুমি বুঝতে চাওনি। কারন তুমি নিজের কষ্ট নিয়েই ব্যস্ত ছিলে। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। এভাবে অবহেলা না করে নিজের কষ্টটা তো বলতে পারতে একবার। পারতাম না কি তোমার হাতে হাত রেখে সব কষ্ট ভাগ করে নিতে?

বিধাতার খেলা বড়ই অদ্ভুত তাই না? ‘বিয়ে’ নামক ছোট্ট একটি পবিত্র শব্দ আমাদের দুজনকে কত কাছে টেনে এনেছে। কিন্তু আবার তোমার জীবনের চরম বাস্তবতাকে ঘিরে আজ তুমি এই অনুভুতি থেকে দূরে। প্রতিনিয়ত তোমাকে ভাবাচ্ছে কোন ভুল করনি তো? কেন ভুল করবে? বিশ্বাস নেই আমার উপরে? হয়তো নেই। তাই এমন ভাবনা তোমার। কিন্তু আমি তো জানি তুমি আমাকে ছাড়া কেমন থাকবে। এই প্রশ্নটা তোমাকে করা মানেই নিতান্ত বোকামি।

তুমি নিজেকে তুচ্ছ ভেবে অন্যায় করেছ। নিজের কাছে তুমি একজন সাধারন মানুষ হলেও আমার কাছে কিন্তু আমার জীবন। এটা কিভাবে ভুলে যাও? নিজের জীবনের সাথে এতো বড় অন্যায় আমি কিভাবে মেনে নেই?

মুখ ফুটে ভালবাসার কথা সবসময় হয়ত তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি। কখনো মুগ্ধতা, কখনো নীরবতা, কখনো অপলক দৃষ্টিতে শুধুই চেয়ে থাকা। এসব কি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ নয়?

এই যে আমি এতো অদ্ভুত। ভেতরে ভেঙে চুরে একাকার হয়ে যাই,কিন্তু প্রকাশ করার ক্ষমতা নাই। এটা নিয়ে তোমার অভিযোগের শেষ নেই। তবে কি ধরে নিব মুখে না বলায় তুমি ভালবাসা বুঝে নিতে ব্যর্থ? তবে কি জানো। আমার ভালবাসার মতো আমার অভিমানটাও তীব্র। নিজেকে কষ্ট দেয়া মানে আমাকে কষ্ট দেয়া। তুমি ভুল করেছ জান। এটার শাস্তি যে তোমাকে পেতেই হবে। আমি নিরুপায়। আমি সব অপরাধ ক্ষমা করতে পারলেও এই ভুলের অপরাধ ক্ষমা করতে পারিনা। দূরে যেতে চেয়েছিলে! তাহলে দূরত্বটাই থাক।“~

কম্পিত হাতে ধরা চিঠিটি দুরুদুরু বুকে নিশ্বাস বন্ধ করে প্রতিটি লাইন পড়েছে ঈশা। সেই ভালোবাসার শব্দমালা। সাথে এক রাশ গাড় অভিমান মেশানো। চিঠিটি পড়ে আবেগি হয়ে কেদে ফেলল সে। চোখ বন্ধ করে ফেলল। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ খুলে সেদিকে তাকাল। দরজার সামনে ইভান দাড়িয়ে হাতে থাকা চিঠিটির দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা নিস্পলক ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। যৌবনের হারান প্রেমিকের সাথে অনেকদিন পর হঠাৎ দেখা হলে মন যেমন আনন্দে নেচে উঠে ঠিক তেমন অনুভুতি হচ্ছে তার। দীর্ঘ ২০ দিন পর ইভানের সাথে তার দেখা। ১০ দিনের মতো হাসপাতালেই থেকেছে। শারীরিক দুর্বলতার কারনে তার সুস্থ হতে একটু বেশী সময় লেগেছে। আর বাকি সময়টা বাসায় এসে পুরো রেস্ট। বিছানা থেকে নামার সুযোগ হয়নি তার। এই ২০ দিনে ইভান যে তার কাছে যায়নি তা নয়। প্রতিদিনই গিয়েছিলো তাকে দেখতে। কিন্তু সে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন। তাই ইভানের সাথে তার দেখাও হয়নি কথাও হয়নি। ইভান অবশ্য ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে। কারন ঈশারও একটু বোঝা উচিৎ। প্রিয়জনের অবহেলা আর কষ্ট ঠিক কেমন লাগে। ইভান আগে ঈশার সাথে কখনও এমন করেনি তাই সে বুঝতেও পারেনি। কিন্তু এখন তাকে বুঝতে হবে।

ঈশাকে নিজের ঘরে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইভানের যেমন রিয়াক্ট করার কথা ছিল তেমনটা কিছুই করলো না। ঈশার কেন জানি মনে হল সে যে এখন এখানে আসবে সেটা ইভানের জানা ছিল। ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ঈশার দিকে একবার তাকাল না। ধির পায়ে হেটে আলমারির সামনে গেলো। আলমারি খুলে একটা বক্স বের করে পিছনে হাত বাড়িয়ে ঈশার দিকে এগিয়ে দিলো। কিন্তু পেছন ফিরে তাকাল না। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বক্সটা নিয়ে নিলো। ইভান এগিয়ে ওয়াশ রুমের দরজার সামনে যেতেই ঈশা নরম কণ্ঠে বলল
–তুমি সব জানতে?

ইভান থেমে গেলো। ছোট্ট করে ‘হুম’ বলতেই ঈশা আবারো কাপা কাপা গলায় বলল
–কবে জানতে পেরেছ? আমাকে বলনি কেন?

ইভান এবার ঘুরে দাঁড়ালো। ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
–এতো কিছু জেনে কি লাভ? জার জানানো উচিৎ ছিল সে তো জানায়নি কিছু। এমন তো হওয়ার কথা ছিলনা তাই না?

ঈশা চোখ নামিয়ে নিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–আমি বলতে চেয়েছিলাম অনেকবার। কিন্তু……।

ঈশা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ইভান বলল
–এসব লেইম এক্সকিউজ। বিশ্বাস ছিল না তাই বলা হয়ে উঠেনি। মনে হয়েছিলো আমি সবটা জানার পর ছেড়ে চলে যাব। নিজের জীবনের সাথে জড়াতে চাইব না। দায়িত্ব নিতে চাইব না।

ঈশা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল
–যাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশী ভালবাসি। জার জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। জার মুখে হাসি দেখার জন্য আমি গোটা পৃথিবী দিয়ে দিতে পারি সে আমাকে এক রত্তি পরিমান বিশ্বাস করেনা। অদ্ভুত!

ঈশা কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমি এরকম ভাবিনি। বিশ্বাস কর। আমি কখনই এরকম ভাবতে পারবো না। আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম। তোমার সাথে কোন রকম সম্পর্কে জড়ানোর আগে আমি তোমাকে সবটা জানাতে চেয়েছিলাম যে আমি কখনও কনসিভ করতে পারবো না। কিন্তু সেরকম সুযোগ হয়ে উঠেনি। সেদিন আমি তোমাকে বলতে এসেছিলাম কিন্তু তুমি বাসায় ছিলে না। তোমার ঘরে এসে ডাইরিটা চোখে পড়ল। সেটা খুলে পাতা উল্টাতেই তোমার লেখাটা পড়ে জানতে পারলাম তোমার বাচ্চা কত পছন্দ। কিন্তু আমি তো অক্ষম। তাই কিছু ভাবতে পারিনি। মাথায় ঐ সময় একটা কথাই ঘুরছিল তোমার জীবনের সাথে জড়ানো মানে আমি অন্যায় করে ফেলব তোমার সাথে। আমার মাথায় সত্যিই কিছু ছিল না। আমি বুঝতে পারিনি।

ঈশা কেদে ফেলল। ইভান কোন কথা বলল না। দাড়িয়েই থাকল একি ভাবে। ঈশা একটা শ্বাস টেনে আবারো বলল
–তারপর আবার বড় মা আমাকে বলছিল তোমার ছোট বেলার সব খেলনা তোমার বাচ্চার জন্য রেখে দিয়েছে। যখন জানতে পারবে তার এই ইচ্ছাটা অপূর্ণ থেকে যাবে তখন কি হবে? কত কষ্ট পাবে?

এবার ইভান শান্ত সরে বলল
–সবার অনুভুতির এতো খেয়াল! এতো চিন্তা! আমার টা কই? এই জিবনে আমার কি আদৌ কোন জায়গা আছে?

ঈশা কেদে ফেলল। ইভান আর কোন কথা না বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশা বুঝতে পারল সব কিছু নিয়ে তার ইভানের সাথে কথা বলা উচিৎ ছিল। তাকে বুঝিয়ে বলা উচিৎ ছিল। সে বড় অন্যায় করে ফেলেছে তার সাথে। ইভানের অভিমান তার দিক থেকে একদম ঠিক। সব দোষ তার নিজের। সে বেশী বুঝতে গিয়েই সবটা এলোমেলো করে ফেলেছে।

ঈশা এলোমেলো পা ফেলে ইভানের বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের বাড়িতে এলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। কাগজটা আবার খুলে চোখের সামনে ধরল। ঈশার সামনে এবার সবটা পরিষ্কার হল। ইভানের এভাবে হুট করে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা কোন ছেলে মানুষী ছিলনা। সবটা জেনে বুঝে সে এমনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভিতরে জমে থাকা কষ্টটা দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলো বদ্ধ ঘরে। চোখ বন্ধ করতেই পানি গড়িয়ে পড়ল।

ভাবতে লাগল সেদিনের কথা যেদিন সে প্রথম জানতে পেরেছিল কোনদিন মা হতে পারবে না। ঈশা যখন প্রথম তার এই অক্ষমতার কথা জানতে পেরেছিল তখন অনেক ভেঙ্গে পড়েছিল। চেয়েছিল ইভান কে সবটা জানাতে। সাহস সুযোগ কোনটাই হয়ে উঠেনি। কিন্তু ইভানের মতো একটা মানুষ কোন কিছু না জেনেই তাকে ঠিক সামলে নিয়েছিল তার অসীম ভালবাসা দিয়ে। আর ঈশাও তার এই ভালবাসা পাবার লোভে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। ইভান তাকে জীবনের নেতিবাচক দিক থেকে সরিয়ে এনে সৌন্দর্য টা দেখাতে চেষ্টা করে। আর এতে সে সফল হয়ে উঠে। ইভানের তীব্র ভালবাসার জোরেই ঈশা আবারো নিজেকে সামলে নেয়। কিন্তু ঈশার মতো সাধারন পরিবারের মেয়েরা সাধারন জীবন যাপনের স্বপ্ন দেখে। একজনকে ভালবেসে তার সাথে সাধারন ভাবে বাঁচতে চায়। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখি পরিবারের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এই শারীরিক অক্ষমতা ঈশার জিবনে অভিশাপের মতো মনে হয়েছে। সন্তান বিহীন দাম্পত্য জীবন ভয়ানক কষ্টের। ইভানের ডাইরি পড়ে সেদিন ঈশা বুঝতে পেরেছিল তার বাচ্চা কত পছন্দ। যদিও বা এসবের জন্য ঈশা কোনভাবেই দায়ী না। তবুও সেদিন নিজেকে অপরাধি মনে হয়েছিলো তার। মনে হয়েছিলো এই অপূর্ণতা তার একার। নিজের ভালবাসা আর অনুভুতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সে এতো গুলো মানুষের অনুভুতির সাথে অন্যায় করছে। তাই সেদিন থেকে ইচ্ছা করে ইভান কে ইগ্নর করতে শুরু করে। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিল যে ইভান কে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ। সে কোন ভাবেই বাঁচতে পারবে না। তাই নিজের বাচার ইচ্ছাটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।

ইভান যে এতো সহজভাবে নেবে বিষয়টা ঈশা সেটাই ভাবতে পারেনি। আবারো ইভানের ভালবাসার কাছে বাস্তবতা হেরে গেলো। ভাবনার মাঝেই হাতে থাকা বক্সটার দিকে চোখ গেলো। সেটা খুলতেই একটা চিরকুট বেরিয়ে এলো। মেলে ধরতেই দেখল শুভ্র রঙের একটা কাগজে নীল কালিতে লেখা

“ওয়েডিং নাইটে নাকি বউকে ওয়েডিং গিফট দিতে হয়। বিয়েটা যেভাবেই হোক বউ তো তুমি আমার। তাই সেই দায়িত্বটাই পালন করতে চেষ্টা করেছি। জানিনা তোমার ভালো লাগবে কি না। তবে আমার এই ছোট্ট গিফট নিজের সাথে পরম আলিঙ্গনে রাখলে আমার ভালো লাগবে। জানিনা তুমি এমন কিছু করবে কিনা। কারন আজ কাল আমার ভালো লাগার প্রতি তোমার বড্ড অনিহা! ”

চিঠিটা পড়ে এতক্ষনের কষ্টটা আচমকাই দূর হয়ে গেলো। আশ্চর্য জনক ভাবে হেসে ফেলল সে। ভালবাসার অনুভুতি গুলো বড়ই এলোমেলো। কখন কাদায় কখন হাসায় কেউ বলতে পারেনা। বক্সের ভিতরের প্যাকেটটা খুলতেই বেরিয়ে এলো অসম্ভব সুন্দর একটা পায়েল। তার মানে এটাই সেই ওয়েডিং গিফট! হাতে ধরে ঠোট টিপে হাসল সে। কোনভাবেই এটা পরবে না সে। ইভান জতক্ষন না নিজে হাতে তাকে পরিয়ে দিবে ততক্ষন সে কিছুতেই এটাকে নিজের সাথে জড়াবে না। কারন বিশেষ উপহার তো বিশেষ মানুষের হাতেই পরতে হয়। সেও দেখতে চায় ইভানের অভিমান টা ঠিক কতটা। ঈশা যে ভুল করেছে সেটা সে বুঝতে পেরেছে। নিজের বোকামির ফল যে ইভান কে এতো কষ্ট দিবে সেটা হয়তো আন্দাজ করাও তার পক্ষে সম্ভব হতনা যদি না ইভানের আবেগময় চিঠিটা পড়তো। এটা এখন তার কাছে স্পষ্ট যে ইভানের সাথে অন্যায় করেছে। তার উচিত ছিল ইভানের ভালবাসাটা বোঝা। কিন্তু সে সেটা না করে তার ভালবাসাকে অসম্মান করেছে। ঈশা ভেবেছিল সে ইভানের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। বাস্তবতা জতই কঠিন হোক না কেন যে তার জন্যই বাচে এমন প্রেমিক কে কি কষ্ট দেয়া সম্ভব? এটা যে বড় অন্যায় হবে।

চলবে………

(বিঃ দ্রঃ গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এটাকে বাস্তবতার সাথে মেলাতে জাবেন না। এই গল্পের উদ্দেশ্য দুজন ভালবাসার মানুষের জীবনের কিছু ভালো খারাপ মুহূর্ত আপনাদের সামনে তুলে ধরার। কেউ নিজের জীবনের সাথে সেটাকে মিলিয়ে ফেললে আমি কোন ভাবেই সেটার দায় ভার নিতে রাজি না। দয়া করে এমন কমেন্ট কেউ করবেন না যে মানুষের জিবনে এমন হয়না।)

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১২

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১২

ইভানের কথাটা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু ঈশা গম্ভির হয়ে গেলো। তার চোখে মুখে হতাশার ছাপ। সে ইভানের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে। ঈশার বাবা সস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–আমি তো না করিনি বাবা। আমি তোর হাতে তুলে দিলেই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। সময় হলেই আমি তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।

ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা ইভানের দৃষ্টি দেখে আঁতকে উঠল। ইভানের চোখ ছলছল করছে। হারানোর ভয়। সাথে ধরে রাখার আকুলতা। ঈশা করুন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান ছলছল চোখে ঈশার দিকে তাকিয়েই বলল
–আমি এখনি এই মুহূর্তে ঈশাকে বিয়ে করতে চাই।

পুরো ঘর নিরবতায় ভরে গেলো। ঈশার বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন
–এখনি?

ইভান ঈশার বাবার দিকে তাকাল। করুন সরে বলল
–তোমার মেয়েকে আমার হাতে তুলে দিয়ে যদি তুমি নিশ্চিন্তেই থাক তাহলে আজ হলে সমস্যা কোথায়? মানুষটা তো আমিই বাবা। তোমার সেই ভরসার মানুষ। আমি আজ এখন থেকেই ঈশার দায়িত্ব নিতে চাই। প্লিজ তুমি রাজি হয়ে জাও বাবা।

ঈশার বাবা কি বলবে বুঝতে পারছে না। একদিকে মেয়ের অসুস্থতা। অন্যদিকে ইভানের যুক্তি। তিনি একটু ভেবে বললেন
–ঈশা সুস্থ হওয়া পর্যন্ত না হয়……।

ইভান থামিয়ে দিলো। কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি তো তোমার মেয়েকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছি না। শুধু রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করবে। এটাই কি খুব বেশী চাওয়া? তোমার আর তোমার মেয়ের কাছে আমি এই মুহূর্তে এটাই চাই। আমি কোনদিন কিছুই চাইনি বাবা। আমাকে নিরাশ করোনা। আপাতত শুধু ঈশার সাইনটাই দরকার। বাকিটা নাহয় সুস্থ হলে দেখা যাবে।

ঈশার বাবা মাথা নিচু করে ভাবলেন কিছুক্ষন। চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাতেই দেখল সে ঈশার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তিনি ঈশার দিকে তাকালেন। ঈশা অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। চোখের পানি গড়ে পড়ছে। ঈশার বাবা তার কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিতেই ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন পর মুখ ঘুরিয়ে বাবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। চোখ দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিলো সে এই বিয়ে করতে চায় না। তার বাবা মেয়ের কথা বুঝলেও এটা বুঝতে পারলেন না যে এখনি বিয়ে করতে তার আপত্তি নাকি ইভান কে বিয়ে করতে আপত্তি। তিনি আরও কিছু বলার আগেই ইভান গম্ভির গলায় বলল
–আমি ঈশার সাথে কথা বলতে চাই। একা।

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই ইভান টুলে বসে পড়ল। সাদা পর্দায় মোড়ানো নিস্তব্ধ ঘরটার নিরবতা ভয়ংকর লাগছে ঈশার কাছে। এক হাতে স্যালাইন ঝুলছে। আর এক হাতে নিজের গায়ে জড়ান শুভ্র চাদরটা খামচে ধরে আছে। শ্বাস অনবরত চলছে। চোখে মুখে ভয়ের আভাষ। সামনের টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা হাত নিলো ইভান। ফাকা গ্লাস। পানি নেই। হাত ধরে ঈশার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নরম গলায় বলল
–তুই কি ভাবছিস আমি সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছি। আর কি বলতে চাইছিস সেটাও জানি। তুই কথা না বললেও তোকে বুঝতে আমার কষ্ট হয়না জান।

কথাটা ঈশার বুকের ভিতরে তোলপাড় শুরু করে দিলো। অবাক চোখে কিছুক্ষন ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকল। ইভান মৃদু হেসে বলল
–খুব অধিকার বোধ নিজের উপরে তাই না?

ঈশা চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান হাতের গ্লাসটা চাপ দিয়ে ভেঙ্গে দিলো। এতে কাচের টুকরো গুলো তার হাতে ঢুকে গেলো। রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ঈশা সেদিকে তাকাল। ইভানের হাতে রক্ত দেখে তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। এক হাত উঠিয়ে ইভানের দিকে বাড়াতেই সে হাত সরিয়ে নিলো। হালকা হেসে বলল
–এতো সহজ? আমার কষ্টের কোন দাম নেই না? এখন থেকে থাকবে। তুই এবার থেকে আমার সব কষ্টের দাম দিবি। আমি সব হিসাব তোর কাছ থেকে নিব।

দাতে দাত চেপে বলল
–তোর সব অধিকার আমি কেড়ে নিব। তোর উপরে এখন থেকে শুধু আমার অধিকার থাকবে। আমার এই অধিকার এতটাই কষ্টের হবে তোর জন্য যা তুই ভাবতেও পারবি না। আমি আর কোন ভাবেই কষ্ট পেতে রাজি না। কোন ভাবেই না।

রেজিস্ট্রি পেপারটা ঈশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–সাইন কর। আমি হেল্প করছি। দেরি করিস না।

ঈশা কি করবে বুঝতে পারছে না। ইভানের দিকে তাকিয়ে অনবরত চোখের পানি ফেলেই যাচ্ছে। ইভান এক হাতে ঈশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–তুই যত দেরি করবি আমার শরির থেকে ততই রক্ত ঝরবে। তাই তাড়াতাড়ি কর। হাতে বেশী সময় নেই।

ঈশা করুন চোখে তাকাল। ইভান তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলল
–আমি তোর উপরে জোর করতে চাইনা। আমাকে এসব করতে বাধ্য করিস না। এই মুহূর্তে নাহলে আমি যে কোন কিছু করতে দুই বার ভাবব না। আমাকে তো তুই চিনিস জান।

কথা শেষ করেই ইভান তার হাত থেকে কাচের টুকরো টান দিয়ে বের করলো। হাত থেকে গল গল করে রক্ত পড়তে লাগল। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো ভাবার সময় নাই তো। তোর কাছে কোন অপশন নাই।

ঈশা বুঝতে পারল ইভানের কথা শোনা ছাড়া তার কাছে কোন উপায় নাই। ইভান আর কিছুতেই কোন কথা শুনবেনা। তাই কিছু না ভেবেই কাপা কাপা হাতে সাইন করে দিলো। ইভান সস্তির নিশ্বাস ফেলে কাগজটা ঈশার হাত থেকে নিয়ে নিলো। ঈশার গালে আলতো করে হাত রেখে বলল
–সরি জান। তোর জন্য কোন অপশন রাখিনি। বাধ্য করার জন্য সরি। পারলে মাফ করে দিস।

ঈশার কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলো। ঈশা নিজের চোখের পানি আটকাতে পারল না। সে বুঝতে পারছে না তার জীবনের কাঙ্খিত প্রাপ্তিটাকে সে গ্রহন করবে নাকি বাস্তবতার কাছে হার মেনে দূরে ঠেলে দিবে। কিন্তু সে তো ইভান কে ভালবাসে। তাহলে কেন এতো বাধা।

ইভান কাগজ হাতে বাইরে বেরিয়ে এলো। ঈশার বাবার হাতে কাগজটা দিয়ে বলল
–ঈশা সাইন করে দিয়েছে মেজ বাবা। সব ঠিক আছে।

ঈশার বাবার চোখ থেকে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। এটা তার খুশির কান্না। সবাই এগিয়ে এলেন। তখনি ইফতি চিৎকার করে বলল
–ভাইয়া তোমার হাত কাটল কিভাবে?

ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কাচ লেগে। তেমন কিছু না।

ইলহাম কাছে এসে ইভান কে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। তার রুমে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে কাচ গুলো সাবধানে বের করতে করতে বলল
–ইচ্ছা করে করেছিস তাই না? ঈশা সাইন করতে রাজি হচ্ছিল না? কিন্তু কেন?

ইভান হাতের দিকে তাকিয়েই বলল
–ঈশার অসুস্থ হয়ে যাওয়াটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না সেটা তুমি জানো। যা করেছে সবটা ইচ্ছাকৃত। ওর মধ্যে বাচার কোন ইচ্ছাই নাই। কিন্তু আমি যে ঈশাকে ছাড়া বাচব না। আমার জন্য হলেও ওকে বাচতে হবে।

ইলহাম একটু চিন্তিত হয়ে বলল
–কিন্তু ঈশার এরকম আচরন করার মানে কি? কেন এমন করছে?

ইভান মৃদু হেসে বলল
–বাস্তবতা! বাস্তবতার কাছে হার মেনে ঈশা এরকমটা করছে। কিন্তু লাভ নেই। ও হয়তো ভুলে গেছে যে ওর জীবনে এমন কিছু নেই যা এই ইভান জানেনা। আমি এতো সহজে ঈশাকে হেরে যেতে দিবনা। কোনভাবেই না। আমি এই নাটকটা না করলে ঈশা কোনদিনও সাইন করত না। আপাতত ঈশাকে বেচে রাখতে এটাই যথেষ্ট। বাকিটা সুস্থ হলেই নাহয় ভাবা যাবে।

ইলহাম ইভানের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল
–তুই অনেক ভালো বুঝিস ইভান। আমি আশা করব তোদের মধ্যে সব ঠিক থাকবে।

ইভান হেসে বলল
–ভেবনা ভাইয়া। ঈশাকে আমি সামলাতে পারি। এখন শুধু ওর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা।

কথা শেষ করে ইভান বের হয়ে এলো। সবাই একসাথে দাড়িয়ে তাদের বিয়ে নিয়েই জল্পনা কল্পনা করছে। ভিতরে কি হয়েছে কেউ জানে না। কিন্তু বাইরে সবাই বেশ খুশি। ইভান কে এগিয়ে আসতে দেখে তার মা হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো
–কিভাবে কাটল?

ভিতরে কি হয়েছে। কিভাবে ঈশার কাছ থেকে সাইন নিয়েছে এসব কিছুই সে কাউকে জানতে দিতে চায়না। কারন সেসব নিয়ে কথা বলতে গেলে যে অনেক কিছুই সামনে আসবে। আর ইভান কোন ভাবেই সেসব নিয়ে কথা বলতে চায়না। তাই ইভান চায় তাদের সম্পর্ক দুনিয়ার সামনে স্বাভাবিক থাকবে। তাদের মাঝে কি হচ্ছে সেটা কেউ জানবে না। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–অসাবধানতায় গ্লাস ভেঙ্গে হাতে লেগে গেছে। তেমন কিছু না মা। সব ঠিক আছে।

ইভানের মা একটু হেসে বলল
–সব ঠিক থাকবে এখন।

ইভান একটু হেসে চোখ নামিয়ে নিলো। ঈশার মা এগিয়ে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। ইভান চোখ তুলে তার দিকে তাকালেই তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আজ ইভান না থাকলে তার মেয়ের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরে বলল
–এভাবে কান্না কাটি করার কি আছে? তোমার মেয়ে একদম ঠিক আছে। পুরপুরি সুস্থ হতে একটু তো সময় লাগবেই। সেই সময়টাও কি দিতে চাওনা?

ঈশার মা নিজের চোখ মুছে ফেললেন। ইভানের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–সারাদিন কোথায় ছিলি? ফোন কেন বন্ধ তোর?

ইভান নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল
–একটু কাজ ছিল। আর ফোনে চার্জ নেই তাই বন্ধ হয়ে গেছে।

ইলুর বাবা এগিয়ে এসে বললেন
–তুই কিভাবে ঈশার অসুস্থতার কথা জানলি?

–ঈশার ঘরে লাইট জালানো ছিল। আর এতো রাতে ঘরে লাইট জালিয়ে রাখা একটু অস্বাভাবিক। কারন ঈশা আলোর মধ্যে একদম ঘুমাতে পারেনা। তাই ভেবেই নিয়েছিলাম যে সে জেগে আছে। আমি ফোন দিয়েছিলাম জিজ্ঞেস করতে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। কিন্তু আমার সাথে কোন কথা হয়নি। ফোনটা রিসিভ করার কিছুক্ষন পরেই আমি কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পাই। তারপর কিছুক্ষন পর ঈশার রেসপন্স না পেয়ে মেজ বাবাকে ফোন করি। মেজ বাবাই ঈশার রুমে দেখে আমাকে ফোন করে সবটা জানায়।

ইভানের কথা শুনে সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ইভানের কারনে হয়তো আজ খারাপ কিছু হওয়া থেকে বেচে গেলো।

চলবে………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১১ + বোনাস পর্ব

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১১

ঘড়ির কাটা ১২ টা ছুঁইছুঁই। নিস্তব্ধতায় ঘেরা রাতটার সময় যেন কিছুতেই এগুচ্ছে না। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল ইভান। নিশব্দে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই এগিয়ে গেলো বেসিনের দিকে। নিকষ অন্ধকারের মাঝে ড্রইং রুমের জানালার পাশে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টটার সাদা আলোটা কাচ ভেদ করেই ঢুকে পড়েছে। তার বদৌলতেই অন্ধকার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পিছনে ঘুরতেই চমকে গেলো। তার মা ঠিক পিছনেই দাড়িয়ে আছে। শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু হকচকিয়ে গেলেও আবার নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–এখনও ঘুমাওনি তুমি?

ইভানের মা ছেলের কথার উত্তর না দিয়ে উলটা প্রশ্ন করে বসলো।
–তুই এতক্ষন কোথায় ছিলি?

ইভান নরম গলায় বলল
–আসিফের সাথে দেখা হয়েছিলো। কথা বলছিলাম। তাই দেরি হয়ে গেলো।

ইভানের মা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–এতো রাত পর্যন্ত তুই তো বাইরে থাকিস না। আজ কেন?

ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বললাম তো। বিশ্বাস হল না কেন তোমার?

ইভানের মা একটু নরম হল। হালকা গলায় বলল
–বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা নয় বাবু। তুই খুব জরুরি কাজ ছাড়া এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকিস না। আর থাকলেও বলেই যাস। আজ না বলেই এতো রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলি। আমি তো মা। চিন্তা হয় নাকি?

ইভান মায়ের হাত ধরল। অপরাধির সরে বলল
–বাড়ির নিচেই ছিলাম। একটু কথা বলতেই দেরি হয়েছে। আর হবে না।

ইভানের মা হালকা হেসে বলল
–খাবি চল। খাবার দেই।

ইভানের মা পা বাড়াতেই ইভান বলল
–ক্ষুধা পায়নি মা। তুমি ঘুমাও। পরে আমি নিজে নিয়ে খাবো।

ইভানের মা কথা বললেন না। ইভান দাঁড়ালো না। ভেজা মুখের পানি চুয়ে চুয়ে পড়ে টি শার্টটা ভিজে যাচ্ছে। সে ঘরের আলো জালিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে মুখ মুছে ফেলল। ফোনটা বের করে একবার দেখে নিলো। ইভানের মা পিছন থেকে মৃদু আওয়াজে বলল
–দুধটা খেয়ে নে।

ইভান পিছনে ঘুরে ভ্রু কুচকে বলল
–আমি দুধ খাই?

ইভানের মা বিছানায় বসে পড়লেন। ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন
–জানি খাস না। কিন্তু মাঝে মাঝে খেতে হয়। তুই যে পরে আর কিছু খাবিনা সেটা আমি জানি। তাই খালি পেটে ঘুমালে আমার যে শান্তিতে ঘুম হবে না। এই দুধ টুকু নিজে চোখে খেতে দেখলে তাও একটু শান্তি পাব।

মায়ের কথার বিপরিতে ইভান কিছু বলতে পারল না। আর কথা বাড়ান মানেই মাকে কষ্ট দেয়া। মুচকি হেসে বিছানায় মায়ের পাশে বসে দুধের গ্লাসটা হাতে নিলো। এক নিশ্বাসে সবটা শেষ করে মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
–এখন শান্তি?

ইভানের মা মৃদু হাসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন
–কি হয়েছে? কিছু নিয়ে কি খুব বেশী চিন্তা করছিস?

ইভান মায়ের দিকে তাকাল। মায়ের ভালবাসা এমনি হয়। না বলতেই বুঝে যায় সব কিছু। ইভানের মা আবারো জিজ্ঞেস করলো
–ঈশার জন্য চিন্তা হচ্ছে?

ইভান চোখ নামিয়ে নিলো। কোন কথা বলল না। তার মা ছেলের মনের কথা বুঝতে পেরে আবারো বলল
–চিন্তা করিস না। মেয়েটা ঠিক হয়ে যাবে। ছোট মানুষ উলটা পাল্টা কিছু খেয়েছে হয়তো। তাই ফুড পয়জনিং হয়েছে। সকালেই দেখবি ঠিক হয়ে যাবে।

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–তোমার কথাই যেন ঠিক হয়।

ইভানের মা আর কিছু বলল না। গ্লাসটা হাতে নিয়ে উঠে চলে গেলো। দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার দাড়িয়ে বলল
–সারা রাত এখন মেয়েটার চিন্তায় আবার জেগে বসে থাকিস না। মেয়েটা নিজেও ঘুমাচ্ছে। তুইও শুয়ে পড়। বেশী চিন্তা হলে ঘুম থেকে উঠে একবার দেখে আসিস।

মায়ের এমন খোলামেলা কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। একটু দুষ্টুমি করে বলল
–এতই যখন ছেলের ঘুম নিয়ে চিন্তা হচ্ছে তাহলে সেই চিন্তার কারণটাকেই এনে দাও। আমিও শান্তিতে ঘুমাই আর তুমিও ঘুমাও।

ইভানের মা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন
–আমি তোর মা। সেটা কি ভুলে যাচ্ছিস?

ইভান ঠোট চেপে হেসে বলল
–ভুলে যাইনি তো। তুমি মা বলেই তো তোমার টেনশনটা কমাতে চেষ্টা করছি। আমি ছেলে হিসেবে কর্তব্য আছে না?

ইভানের মা কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন। গম্ভির গলায় বললেন
–তুই দিন দিন লাগাম ছাড়া হয়ে যাচ্ছিস।

ইভান একটু হেসে বলল
–এখন তো সব আমার দোষ। তোমার টেনশন কমাতেই তো ভালো উপায় বলে দিলাম। সেটাও তোমার পছন্দ হলনা। এখন আর কি করার। তোমার বা আমার কারো যদি ঘুম না হয় তাহলে সে জন্য কিন্তু আমি কোনভাবেই দায়ি থাকব না।

ইভানের মা হালকা হেসে বের হয়ে গেলেন। ইভান দরজা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিছানায় বসে কিছুক্ষন ভাবল। এক রাশ চিন্তারা এলোমেলো ভাবে বিচরন করছে তার মস্তিষ্কে। আজ রাতে আর কোন ভাবেই ঘুম আসবে না। তার মা ছেলের মন ঠিকই বুঝেছেন। ইভানের কেন জানি মনে হচ্ছে ঈশা তার কাছ থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছে। ঈশার আচরন আজ বেশ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তার চোখের সেই অসহায় দৃষ্টি দেখেই ইভান বুঝতে পেরেছে ঈশা এমন কিছু লুকাচ্ছে যা সে কাউকেই জানতে দিতে চায় না। কিন্তু কেন? কি এমন গোপন বিষয় থাকতে পারে? কিছু জিজ্ঞেস করেও তো লাভ নেই। কোন ভাবেই বলবে না। নিজেকেই খুজে নিতে হবে। কিন্তু কিভাবে? বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে ভাবতে লাগল সে। কেন ঈশা তার উপরে ভরসা করতে পারেনা। সে নিজেও জানে ইভান তাকে কতটা ভালবাসে। কিন্তু সেই ভালবাসার মুল্য ঈশা কখনই দেয়না। ঈশা তার প্রতি অনেক অন্যায় করে। সেটা ভাবতেই ইভানের মনে অভিমান বাসা বাধল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঘুম না আসলেও চেষ্টা তো করতে পারে।

—————
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলো সাধারণত জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সুচনা করে। কখনও সেটা ভালো হয় আবার কখনও খারাপ। জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা গুলোকে কেউ আঁকড়ে ধরে বেচে থাকার অবলম্বন হিসেবে নেয়। আর কেউ সেগুলোর চাপে পিষ্ট হয়ে জীবন থেমে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

অনেকটা দিন কেটে গেছে। বর্ষার মাঝামাঝি সময়। কবি সাহিত্যিকের ভাষায় বর্ষাকাল নাকি প্রেমের ঋতু। বৃষ্টি নাকি মানব মনে প্রেমের জন্ম দেয়। কিন্তু এই প্রেমের ঋতুতেই ঈশার জিবনে ঘটে গেলো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। শুন্য মস্তিষ্কে কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। নিকষ কালো অন্ধকারে ঠিক কালো মেঘটা দেখা না গেলেও দূর আকাশের বিদ্যুতের ঝলকানি দেখে আন্দাজ করা সম্ভব। মাঝে মাঝেই আবার বেশ শব্দে কেপে উঠছে চারপাশ। কিন্তু ঈশার সেসবের কিছুই মনে ধরছে না। অনুভুতি শুন্য হয়ে পড়ে আছে মন। এলোমেলো ভাবনা। সব কিছুতেই বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে সে। আর সহ্য করতে পারছে না। এলোমেলো ভাবনার মাঝেই আচমকা কান ফাটানো আওয়াজে নামলো বৃষ্টির ধারা। কিন্তু সেই বৃষ্টি মনে আনন্দ দেয়ার বদলে জমে থাকা সমস্ত কষ্ট যেন বাধ ভেঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে সাহায্য করছে। এক রাশ অভিমান। কিন্তু কার প্রতি এই অভিমান? ভাগ্যের? সে কি ভাগ্যের চরম নির্মমতার স্বীকার? বাধ ভাঙ্গা কান্না থামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এক দৌড়ে চলে গেলো ওয়াশ রুমে। প্রকৃতির কান্না সে পৃথিবীর বুকে বিলিয়ে দিয়ে নিজেকে হালকা করতে পারে কিন্তু ঈশা তার কান্না কাউকে দেখাতে পারেনা। এই কষ্ট তার একান্ত। ঝর্নার নিচে বসে হাঁটু দুই হাতে ধরে অসহায়ের মতো কেদে চলেছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ করেই কান্নার বেগ বেড়ে যাচ্ছে। সাথে আর্তনাদও। সেটাকে আটকাতেই মুখে হাত চেপে ধরছে। মাঝ রাত হওয়ায় রুমে এখন কেউ আসবে না। তাই কোন চিন্তাও নেই। নিশ্চিন্তে ঝর্নার নিচে বসে কাদছে সে।

অনেকটা সময় পর বের হয়ে এলো ওয়াশ রুম থেকে। ঠিক কতটা সেটা হিসাব করে বলতে পারবে না সে। এতটা সময় ভেজার ফলে চোখ নাক লাল হয়ে গেছে। মাথাটাও ভারি হয়ে আসছে। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। ভেজা কাপড় পরেই সারা ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শুকনা কাপড় বের করে নিলো আলমারি থেকে। চেঞ্জ করার জন্য ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই টেবিলের উপরে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল। এতো রাতে কেউ ফোন দিবে ভেবে একটু অবাক হয়েই সেদিকে তাকাল। ইভানের নামটা দেখে চোখ ছলছল করে উঠল তার। পাতা জোড়া বন্ধ করতেই গাল বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। ফোনটা হাতে নিলো ঠিকই। কিন্তু রিসিভ করতে নয়। কেটে বন্ধ করে দিতে। কিছুদিন ধরেই ঈশা ইভান কে ইগনোর করছে। ইভান বিষয়টা বেশ বুঝতে পারছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলছে না। আবার হার মানতেও নারাজ সে। নিজের মতো করেই ঈশার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। কিন্তু ঈশা চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। ঈশা ফোনটা কেটে বন্ধ করতে চাইলেও সেটা সম্ভব হল না। কারন ঐ যে কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তেমনি কিছু ঘটে গেলো। প্রচণ্ড রকমের শ্বাস কষ্ট শুরু হতেই হাত পা কাপতে লাগল তার। কথায় আছে বিপদের সময় মানুষ নাকি তাকেই মনে করে যাকে সব থেকে আপন মনে হয়। ঈশার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হল না। প্রবল বাচার আকুতি নিয়ে মনের সাথে যুদ্ধ করে ফোনটা ধরে অস্পষ্ট সরে বলল
–আমার খারাপ লাগছে। খুব খারাপ লাগছে।

কথাটা ইভানের কান পর্যন্ত পৌছালো কিনা সেটা বোঝার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো ফোনটা। ওপাশের মানুষটা আদৌ কিছু শুনতে পেয়েছে কিনা বা বিপদটা ঠিক ঠাক আন্দাজ করতে পেরেছে কিনা সেটা বোঝা সম্ভব হল না।

চলবে………

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
বোনাস পর্ব

চারিদিকে থম্থমে নিস্তব্ধতা। ঠিক কয়টা বাজে কারো খেয়াল নেই। থেমে থেমে চাপা কান্নার আওয়াজ আসছে কোথাও থেকে। হয়তো খুব আপনজনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বুকের ভিতরে লুকিয়ে রাখা আর্তনাদ বাস্তবে রুপ নিচ্ছে। কিন্তু আবার পর মুহূর্তেই থেমে যাচ্ছে আশে পাশের পরিবেশের কথা ভেবে। এয়ারকন্ডিশনের বাতাসে ঠাণ্ডা ভাবটা জোরালো হয়ে উঠেছে। অনুভুতিশুন্য হয়ে সামনের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে ঈশার মা। অপারেশন থিয়েটারের সামনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাড়িয়ে আছে ঈশার বাবা। আশে পাশে চেয়ারে ইলু, ইরিনা, ঈশান বসে আছে। ইফতি গেছে তার মাকে আনতে। ভিতরে ঈশার অপারেশন হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ভেজার পরে ঈশার গলার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়। টনসিল বেড়ে যায়। শ্বাস কষ্ট শুরু হয়। ডক্টর আগেই বলে দিয়েছিল যে খুব সাবধানে থাকতে। ঠাণ্ডা লেগে যদি টনসিল কোনভাবে বেড়ে যায় তাহলে অপারেশন ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। ঈশার বোকামির কারনে আজ সে নিজেই এই পরিস্থিতির সম্মুখীন। খুব জটিল কোন অপারেশন না হলেও সেটা অপারেশন তো। আর তাছাড়াও ঈশার প্রচণ্ড শ্বাস কষ্ট শুরু হয়েছিলো। শ্বাস নিতে না পারায় সেন্স হারিয়ে ফেলেছিল। এতেই সবাই অনেক বেশী ভয় পায়। প্রায় ১ ঘণ্টা ধরে সবাই অপেক্ষা করছে অপারেশন থিয়েটারের সামনে। ডক্টর বলেছে খুব বেশী হলে ১ ঘণ্টাই লাগতে পারে। ঠিক তাই। সবার অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে অবশেষে ডক্টর বের হয়ে এলো। ঈশার বাবা বিচলিত হয়ে বললেন
–আমার মেয়ে কেমন আছেন ডক্টর?

ডক্টর মৃদু হেসে বললেন
–একদম ঠিক আছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তবে চিন্তার কোন কারন নেই। সন্ধ্যার মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।

বলেই ডক্টর এগিয়ে যেতেই ঈশার মা অসহায় কণ্ঠে বললেন
–আমার মেয়ে কথা বলতে পারবে তো?

ডক্টর মৃদু হাসলেন। ঈশার মায়ের সামনে দাড়িয়ে বললেন
–তিন দিন পর্যন্ত কথা বলতে একটু প্রব্লেম হবে। ব্যথা হবে। ধিরে ধিরে ঠিক হয়ে যাবে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আর জটিল কোন সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে।

সবাই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ঈশা ঠিক আছে এটাই এই মুহূর্তে সব থেকে বড় খবর। ইভানের মা এসে দাঁড়ালো। সবার দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা এখন কেমন আছে?

ইরিনা তাকে বসাল চেয়ারে। শান্ত কণ্ঠে বলল
–ঠিক আছে বড় মা। জ্ঞান এখনও ফেরেনি। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরবে নাকি। বড় কোন ঝামেলা নেই।

ইভানের মা সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। ঈশার মায়ের ঘাড়ে হাত রাখতেই ডুকরে কেদে উঠলেন তিনি। আর যাই হোক সন্তানকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পাওয়া কোন মায়ের জন্য ভালো অনুভুতি হতে পারেনা। ইভানের মা তাকে যথেষ্ট শান্তনা দিলেন। তিনি বুঝে চুপ করে গেলেও মন তো অস্থির হয়েই আছে। এর মাঝেই ঈশাকে কেবিনে দেয়া হল। সবাই এক এক করে দেখে আসলো তাকে। সবার দেখা শেষ হতেই ইরিনা সবার উদ্দেশ্যে বলল
–ইভান ভাইয়া কোথায়? অনেক্ষন থেকেই দেখছি না।

সবাই বিচলিত হয়ে তাকাল। আসলেই তো। হসপিটালে ঈশাকে ভর্তি করানোর পর থেকেই ইভানের কোন খবর নেই। এতো টেনশনের মধ্যে কেউ তার খবর নিতেই ভুলে গেছে। অথচ সেই কাল রাতে ঈশার বাবাকে ফোন করে তার অসুস্থতার কথা জানায়। তারপর তাদের সাথেই ঈশাকে নিয়ে হসপিটালে চলে আসে। ঈশার অবস্থা তখন ভালো ছিল না। ধিরে ধিরে আরও খারাপের দিকে যায়। সবাই তখন ঈশাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তারপর থেকে ইভানকে কেউ দেখেনি। এমন কি ঈশার অপারেশন হল তবুও ইভানের কোন খবর নেই। বিষয়টা আসলেই অবাক করার মতো। ঈশান বলল
–আমি ফোন দিচ্ছি।

ফোন বের করে ইভানের নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু ফোনটা বন্ধ। ঈশান অসহায় ভঙ্গিতে ফোনটা কেটে দিয়ে নিচে তাকিয়েই বলল
–বন্ধ।

এবার সবার মাথায় একটু চিন্তা খেলে গেলো। ঈশাকে এই অবস্থায় দেখে ইভান ঠিক কতটুকু ঠিক রাখতে পারবে নিজেকে সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠল। কারন ইভানের মনে ঈশার জন্য যে অনুভুতি সেটা কাররি অজানা নয়। আর সেটা ঠিক কোন পর্যায়ে সেটাও সবাই ভালভাবেই বুঝতে পারে। তাই এখন ইভান কে নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে সবার। কি অবস্থায় আছে। আবার ফোনটাও বন্ধ। ঈশান বেশ কয়েক জায়গায় ফোন দিলো ইভানের খোজ নিতে। কিন্তু কারো কাছেই কোন খোজ পেল না। ব্যর্থ হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–ইভান ভাইয়া কি বাসায় যায়নি বড় মা?

ইভানের মা না সুচক মাথা নাড়ল। হতাশ হয়ে বলল
–আমি তো ভেবেছিলাম এখানেই আছে। তাই আর ফোন দেইনি।

ইলু বুঝতে পারল এখন পরিস্থিতি অনুকুলে নয়। তাই সব কিছু সামলাতে বলল
–এতো চিন্তার কিছু নেই। ইভান ভাইয়া চলে আসবে। হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছে।

তার কথাতেও কারো কোন ভাবান্তর হল না। তাই আশস্তের কণ্ঠে বলল
–ইভান ভাইয়া অনেক বোঝে। সে কোন ভুল করতে পারে সেটা আমি অন্তত মানি না। হয়তো এমন কোন পরিস্থিতি হয়েছে জার কারনে ফোনটা বন্ধ রেখেছে। কিন্তু ঠিক চলে আসবে। আমি জানি।

সবাই বেশ চুপচাপ। কেউ ইলুর কথার উত্তরে কোন কথা বলল না। সবার মনে এখন একটাই প্রশ্ন ইভান ঠিক আছে তো?

——————–
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। হসপিটালে কোলাহল বেড়ে গেলো হঠাৎ করেই। কোন সিরিয়াস কন্ডিশনের রোগী এসেছে মনে হচ্ছে। ডক্টর নার্স সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে। রোগীর আত্মীয় স্বজনরা বিচলিত হয়ে ঘুরছে। কেউ ঔষধ নিতে ছুটে চলেছে। আবার কেউ দরজায় দাড়িয়ে মুখে আচল চেপে কান্না আটকাতে ব্যস্ত। সেই দৃশ্যই চেয়ারে বসে দেখছে ঈশার মা। গত রাতে তার অবস্থাও এমন হয়েছিলো। মেয়ের অবস্থা দেখে তিনিও এভাবেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন মেয়ে ভালো আছে শুনে কিছুটা আশস্ত হলেও পুরটা হতে পারেনি। কারন এখনও ঈশার জ্ঞান ফেরেনি। বুক চিরে লুকান দীর্ঘশ্বাস টা বেরিয়ে এলো তার। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সামনে। এমন সময় ইভানের মা কোথা থেকে এসে বললেন
–ঈশার জ্ঞান ফিরেছে। তাড়াতাড়ি ভিতরে যাও।

ঈশার মায়ের খুশিটা চোখের পানির মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো। কয়েক ফোটা পানি ফেলে তারপর চোখ মুছে নিয়ে ছুটে গেলেন মেয়ের কাছে। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই দেখলেন ঈশার বাবা মেয়ের পাশে বসে আছেন। তার মা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
–এখন কেমন আছিস মা?

ঈশা অসহায় চোখে তাকাল। তিনি নিজের বোকামিটা বুঝতে পেরেই মন খারাপ হয়ে গেলো। ঈশা যে এখন কথা বলতে পারবে না সেটা তার মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। তবুও তিনি বোকার মতো তাকে প্রশ্ন করলেন। পরিস্থিতি সামলাতেই বলল
–ডক্টর বলেছে তুই রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবি। আর কোন সমস্যা নেই। একদম আগের মতো হয়ে যাবি।

ঈশার চোখ ছলছল করে উঠল। সাথে সাথেই ইলু, ইরিনা ঢুকে পড়ল ভিতরে। রীতিমত তারা সেখানে আড্ডায় মেতে উঠল। তাদের এরকম করতে দেখে নার্স এসে ধমক দিয়ে গম্ভির গলায় বললেন
–এভাবে বাচ্চাদের মতো আচরন করবেন না। পেশেন্ট কে রেস্ট নিতে দিন। সবাই বাইরে যান।

নার্সের কথা শেষ হতেই ইভান ভিতরে ঢুকল। নার্স তাকে দেখে খুব বিরক্ত হয়ে বললেন
–এতজন কেন একসাথে ভিতরে ঢুকেছেন। বাইরে যান। পেশেন্ট এখন রেস্ট নিবে।

ইভান কোন কথা বলল না। তার আগেই একজন ডক্টর ভিতরে ঢুকে বলল
–প্রব্লেম নেই সিস্টার। আমি দেখছি। আপনি বাইরে যান।

ডক্টরের কথা শুনে নার্স আর কোন কথা বলল না। বাইরে চলে গেলো। ডক্টর ইভানের পাশে এসে দাঁড়ালো। কাধে হাত রেখে বলল
–বেশী সময় নিবি না। ঈশার রেস্ট দরকার।

ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–হুম। রেস্টই নিবে। এখন থেকে ওর সব দায়িত্ব শেষ।

সবাই ইভানের দিকে তাকাল। তার কথার মানে কেউ বুঝতে পারল না। ঈশার বাবা এগিয়ে এসে ডক্টরের সামনে দাড়িয়ে বলল
–আরে ইলহাম তুই এখানে? এখানে কি করছিস?

ইলহাম হালকা হেসে বলল
–আমি এখন এই হসপিটালেই জয়েন করেছি মামা। কিছুদিন হল। তোমাদেরকে জানানোর সুযোগ হয়নি। নতুন জব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই। ভেবেছিলাম সময় করে যাব বাসায়। কিন্তু তার আগেই তো ঈশার এই অবস্থা।

ইলহাম এগিয়ে ঈশার কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলল
–এখন ভালো লাগছে?

ঈশা মাথা নাড়াল। ইলহাম একটু গম্ভির হয়ে বলল
–তুই কিন্তু কাজটা একদম ঠিক ক……।

ইভান মাঝ পথেই তাকে থামিয়ে দিলো। গম্ভির সরে বলল
–ভাইয়া এখন এসব থাক। আমি আমার কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি। ঈশার আবার রেস্ট দরকার।

ইলহাম আর কথা বাড়াল না। মুচকি হেসে ইভান কে সম্মতি দিলো। ইভান ঈশার বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মাথা নামিয়ে নরম সুরে বলল
–মেজ বাবা আমি ঈশাকে বিয়ে করতে চাই।

চলবে…………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-১০

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১০

পূর্ণিমার চাঁদটার আশে পাশে শুভ্র মেঘের বিচরন। চাঁদের আলোয় মেঘ গুলো বেশ লাগছে দেখতে। ঠিক যেন শিল্পীর রঙ তুলিতে আঁকা কোন পূর্ণিমার ছবি। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতে কিছু পোকা ঘুরে ঘুরে উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে নিজের মতো খেলায় ব্যস্ত তারা। ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে ইলু সায়ানের সাথে ফোনে কথা বলছে। কথা বলার মাঝেই নিচে এক পলক তাকাতেই ইভানকে দেখতে পেয়ে ডাকল।
–ইভান ভাইয়া।

ইভান বাইরে বেরিয়েছিল একটু হাঁটাহাঁটি করতে। পূর্ণিমা রাতে রাস্তায় অজানা উদ্দেশ্যে হাটতে বেশ লাগে। মাথা তুলে ইলুর দিকে তাকিয়ে গলা তুলে বলল
–কি হয়েছে?

ইলু কান থেকে ফোনটা হালকা সরিয়ে বলল
–কোথায় যাচ্ছ?

–কোথাও না। হাঁটছি। কিছু বলবি?

ইলু হাত উঠিয়ে বলল
–একটু দাড়াও। আমি আসছি।

ইভান বেশ বিরক্ত হল। সে একা একা হাটতে বেরিয়েছিল। এই সময় ইলুকে নিয়ে হাটতে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই তার। ঈশা হলে তাও একটা কথা ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদটা দেখেই মন ভরে গেলো। এর মাঝেই ইলু হাপাতে হাপাতে এলো। ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল তার দিকে। কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল
–ঈশাদের বাসায় যাব চল।

ইভান সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–আমি এখন ঐদিকে যাব না। সামনে যাব।

ইলু ইভানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–ঈশা অসুস্থ তুমি জাননা?

ইভানের ভ্রু কুচকে এলো। বিচলিত কণ্ঠে বলল
–অসুস্থ মানে? বিকেলেই না ছাদে দেখলাম।

–আরে বাবা বিকেলে ছাদে উঠলে যে এখন অসুস্থ হওয়া যাবে না তা তো না। সন্ধ্যা থেকে পেট ব্যাথা। কয়েকবার বমিও করেছে। সবাই ওখানেই আছে। আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম তাই এখনও যাইনি।

ইভান আর কথা বাড়াল না। ইলুর সাথে ঈশাদের বাড়ির দিকে হাটা দিলো। ইলু কিছুদুর যেতেই প্রশ্ন করলো
–তুমি কেন জাননা? তুমিও কি বাসায় ছিলে না?

ইভান চিন্তিত কণ্ঠে বলল
–হুম। আমি সন্ধ্যার আগেই বাইরে গিয়েছিলাম। একটু আগেই আসলাম। তাই আম্মুকে বাসায় দেখলাম না। জানলে তো এতক্ষন চলেই জেতাম।

ইলু সামনে তাকিয়েই বলল
–খুব চিন্তা হচ্ছে?

ইভান কঠিন দৃষ্টিতে ইলুর দিকে তাকাল। কিন্তু বেশ সাভাবিক ভাবেই মৃদু আওয়াজে বলল
–চিন্তা হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি? নাকি আমাকে তোর মানুষ মনে হয়না?

ইলু মুচকি হাসল। সামনে তাকিয়ে আবারো বলল
–ইভান ভাইয়া তুমিও জানো ঈশা তোমাকে পছন্দ করে। তাহলে কেন এই লুকোচুরি? বলে দিলে কি হয়?

ইভান হতাশ হয়ে বলল
–পছন্দ করা আর ভালবাসার মধ্যে পার্থক্য আছে। আমি ঈশাকে শুধু পছন্দ করিনা ভালবাসি। প্রচণ্ড ভালবাসি। আমার সব কিছু জুড়ে শুধুই ঈশা।

–এতো ভালবাস অথচ কিছুই বল না। কেন? তোমার ভয় করেনা। এই চুপ করে থাকার কারনে যদি ঈশা কোন ভাবে অন্য কোথাও ইনভল্ভ হয়ে যায়।

ইভান মুচকি হেসে বলল
–আজ পর্যন্ত ঈশার ধারের কাছেও কোন ছেলে ঘেষতে পারেনি। আমি দেইনি। একদম ছোটবেলা থেকে ওর চারিদিকে আমি আমার অনুভুতি বিছিয়ে রেখেছি। যাতে সেগুলো ছাড়া আর কিছুই তার চোখে না পড়ে। ওর সব কিছুর খবর আমার কাছে থাকে। এতো সহজ না। আমার ভাবনার মাঝে যেমন শুধু ঈশার বিচরন তেমনি ওর ভাবনার মাঝেও আমি আমার জায়গা করে রেখেছি।

ইলু কৌতূহলী হয়ে বলল
–সবই বুঝলাম। কিন্তু তুমি ওকে কিছু বল না কেন? আর বিয়ে কবে করবে? এভাবে আর কতদিন?

ইভান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইলুর দিকে। গম্ভির আওয়াজে বলল
–শুধু কি বিয়ে করলেই হয়ে যায়? বিয়ে মানে অনেক বড় দায়িত্ব। আমি নিজেই এখনও সেই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত না। আর ঈশার তো প্রশ্নই আসেনা। ওর মাঝে এখনও ছেলে মানুষী আছে। আর একটু সময় যাক তারপর ভাবা যাবে। তাছাড়াও আমি এখন নিজের ক্যারিয়ার গোছাতেই ব্যস্ত। এই সময় কি আর বিয়ে নিয়ে ভাবা যায়।

ইলু ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো কিছু কিভাবে ভাব তুমি? ভালবাস অথচ তাকে কাছে পাওয়ার কোন আকুলতা নাই তোমার মধ্যে। তাকে পাওয়ার চেয়েও তার জীবন নিয়ে ভাবনাটাই তোমার বেশী। কি অদ্ভুত তুমি আর তোমার ভালবাসা। এভাবেও কি ভালবাসা সম্ভব?

ইভান মুচকি হেসে বলল
–আমি কখনও ঈশাকে খারাপ রাখার কথা কল্পনাতেও আনিনি। আমি সব সময় চাই ঈশা আমার কাছে দুনিয়ায় সব থেকে ভালো থাকুক। কোন কিছুর অভাব না থাকুক। ঈশার জিবনে কোন আফসোস থাকলে আমি নিজেকে কখনও মাফ করতে পারব না। আমি ওকে জীবনের সব সুখ দিতে চাই।

ইলু অবাক হয়ে ইভানের কথা শুনছে। সেও সায়ান কে ভালোবাসে। কিন্তু ইভানের এই গভির ভালবাসার সাথে তাদের ভালবাসার কোন তুলনা হয়না। তারা হয়তো এভাবে ভাবতেও পারবে না কখনও। এভাবে কথা বলতে বলতেই তারা ঈশাদের বাড়িতে পৌঁছে গেলো। বাড়ির দরজা খোলা। সবাই ভিতরে বসে গল্প করছে। ইভান কে দেখে তার মা বলল
–আরে তুই কখন এলি?

ইভান ছোট্ট করে বলল
–একটু আগেই। ঈশা এখন কেমন আছে? কি হয়েছিলো?

ঈশার বাবা চিন্তিত সরে বলল
–হুট করেই পেট ব্যথা আর বমি শুরু হয়। আমি পরিচিত ডক্টরকে ফোন করি। এসে কিছু ঔষধ আর ইনজেকশন দিয়ে যায়। এখন রেস্ট নিচ্ছে।

ইভান সোফায় বসতে বসতে বলল
–এরকম হওয়ার কারন কি হতে পারে মেজ বাবা?

ঈশার বাবা গম্ভির আওয়াজে বললেন
–ডক্টরের ধারনা ফুড পয়জনিং। আপাতত মেডিসিন নিলেই কমে যাবে। যদি না কমে তাহলে টেস্ট করতে হবে।

একটু থেমে আবার বলল
–হয়ত সেরকম কিছুই। অন্য কিছু হলে তো এতক্ষন কমতো না।

ইভান একটা ছোট্ট শ্বাস ছাড়তেই তিনি ইভানের পিঠে হাত রেখে বললেন
–ঘরে যা। একবার দেখে আয়।

ইভান ম্লান হেসে উঠে গেলো। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই দেখল ঈশা চাদর মুড়ি দিয়ে গুটি সুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে। ইভান গিয়ে বিছানার উপরে বসে পড়ল। ঈশার দিকে ভালো করে দেখে নিলো। ভাবল হয়ত তার ঠাণ্ডা লাগছে। চাদরটা গলা পর্যন্ত ভালো করে টেনে দিতেই ঈশা চমকে উঠল। ইভান মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ভয় পাস না। আমি তো।

ইভানের গলার আওয়াজ শুনে ঈশা সস্তি পেল। উঠে বসতে চাইলে ইভান আবার জোর করে শুয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে
–এখন কেমন লাগছে?

ঈশা ক্লান্ত সরে বলে
–ভালো।

ইভান একটু কঠিন সরে জিজ্ঞেস করে
–কি খেয়েছিলি? এরকম হওয়ার কারন কি?

ঈশা কোন কথা বলল না। অসহায় চোখে তাকাল একবার। ঈশার অসহায় দৃষ্টি ইভানের চোখে পড়ল ঠিকই কিন্তু তার মানে বুঝতে পারল না সে। ঈশা মুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান মাথায় হাত বুলিয়ে আশস্তের সরে বলল
–টেনশনের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে। রেস্ট নে।

বলে উঠে দাড়াতেই ঈশা আবারো ‘আহ’ শব্দ উচ্চারন করলো। ইভান ঘুরে তাকাল। ঈশা পেট চেপে ধরে কোঁকড়া হয়ে শুয়ে আছে। চোখ খিচে বন্ধ করে রেখছে। ইভান বসে পড়ল। বিচলিত কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে জান? কষ্ট হচ্ছে? কেমন লাগছে আমাকে বল?

ঈশা এক হাতে ইভানের হাত চেপে ধরল শক্ত করে। ইভান ঈশার মাথায় হাত বুলিয়ে মৃদু সরে বলল
–কি হয়েছে?

ঈশা কোন কথা বলতে পারছে না। ইভান কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল
–হসপিটালে যেতে হবে। এভাবে হবে না।

ঈশা একবারেই উঠে বসলো। ইভানের হাত টেনে ধরে বলল
–আমি যাবনা। আমার কিছু হয়নি।

ইভান দাতে দাত চেপে বলল
–আমার সাথে জেদ করবি না একদম।

ঈশা এবার কাদতে শুরু করলো জোরে জোরে। তার কান্নার আওয়াজ শুনে সবাই ঘরে চলে এলো। ইভান একটু দূরে সরে বসলো। ঈশার মা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে? কাদছিস কেন?

ঈশা ফিকরে ফিকরে কাদতে কাদতে তার বাবাকে বলল
–বাবা দেখনা ইভান ভাইয়া আমাকে জোর করে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। আমি যাবনা।

ঈশার বাবা মেয়ের পাশে বসল। ইভান অসহায়ের মতো বসে আছে। ঈশার দিকেই তার দৃষ্টি স্থির। ঈশার বাবা বলল
–যদি সেরকম কিছু বলে থাকে তাহলে অবশ্যই সেরকম কিছু হয়েছে। কারন ইভান অকাজে কোন কিছু ভাবার মতো ছেলে না।

ইভান অভিমানের সুরে বলল
–তোমার মেয়ের ধারনা আমার মাথায় তো অকাজের ভাবনা ছাড়া আর কিছুই আসেনা। আমি সুস্থ মস্তিষ্কে ভাবতেই পারিনা।

ঈশা মাথা নামিয়ে অসহায় বলল
–আমি যাবনা হসপিটালে।

ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা বেশ সাহস করে মাথা তুলে তার দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের সরে বলল
–প্লিজ ইভান ভাইয়া। আমি যাবনা প্লিজ। হসপিটাল ডক্টর এসবে আমার ভয়ংকর রকমের ফোবিয়া আছে। তুমি বুঝতে চেষ্টা কর প্লিজ।

ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশার এভাবে কথা বলা তার এই মুহূর্তে মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। কারন এভাবে বললে সে কোন ভাবেই তার কথা ফেলতে পারবে না। একটা শ্বাস ছেড়ে ধমকের সুরে বলল
–একটা লাইনে এতো বার প্লিজ বলার কি আছে?

সবাই ঠোট চেপে হাসতে লাগল। ঈশা অসহায়ের মতো বসে থাকল। ঈশার বাবা বললেন
–টেস্ট করিয়ে আনলে বোধ হয় ভালই হতো।

ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–থাক মেজ বাবা। খুব বেশী প্রব্লেম হলে তো দেখাই যেত। মেডিসিন কাজ করতে একটু তো সময় নিবেই। রাতটা দেখ। তারপর ভাবা যাবে।

ঈশার বাবাও সম্মতি দিলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। সেটা দেখেই ইভান মুচকি হাসল। ঈশার বাবা ঈশাকে রেস্ট নিতে বলে বের হয়ে গেলেন। তার পিছনে পিছনে সবাই বের হয়ে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। ঈশা একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো। নিচু কণ্ঠে বলল
–আমি একটু ঘুমাব। তাহলেই ঠিক হয়ে যাব।

ইভান শান্ত ভাবে বলল
–আমাকে কি তোর বলদ মনে হয়? আমি কিছু বুঝি না তাই না?

ইভানের এমন কথা শুনে ঈশা শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। কারন তার যে এখনও পেট ব্যথা আছে সেটা ইভান ভালো করেই বুঝতে পারছে। অসহায় হয়ে বলল
–আমি সকালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাব। সত্যি। তবুও হসপিটালে যাব না।

ইভান গম্ভির আওয়াজে বলল
–মনে থাকে যেন। নাহলে সকাল বেলা কিন্তু হসপিটালে রেখে আসব।

বলেই উঠে দরজার কাছে গিয়ে লাইট অফ করে দিয়ে বলল
–ব্যথা খুব বেশী মনে হলে আমাকে ফোন দিবি। ঠিক আছে?

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। ঈশা চোখ বন্ধ করে মাথা বিছানায় ঠেকিয়ে দিলো। চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। বাস্তবতা অনেক কঠিন। ঈশা কি পারবে সেটা সামলে নিতে? নাকি কঠিন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে?

চলবে……।

(রিচেক করার সময় হয়নি। ভুল থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।)