Tuesday, July 15, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1380



শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৯

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৯

সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গেই ঈশা দেখল ইভান বিছানায় নেই। উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে বসে পড়ল। এদিক সেদিক তাকাল কোথাও নেই ইভান। ওয়াশ রুম থেকে পানির আওয়াজ আসছে। বুঝতে পারলো ইভান ওয়াশ রুমে। সামনে ঘড়িটার দিকে তাকাল। কেবল সকাল হয়েছে। এতো সকালে ইভান কখনই উঠে না। কিন্তু গত দুই দিন ধরে নিজের রুটিন বদলে ফেলেছে। সকাল হতেই ঘুম থেকে উঠে বাইরে চলে যায়। আর আসে একদম মাঝ রাতে। ঈশা বেশ বুঝতে পারছে এসব নাটক। তার সাথে যাতে কথা বলতে না হয় সেই কারনে এসব নাটক শুরু করেছে। ঈশা দুই দিন ধরে তার নাটক শুধু দেখেই যাচ্ছে কিন্তু কোন কথা বলেনি। বলতেও চায় না। আর বলেও যে খুব একটা লাভ আছে তাও না। ইভান তার সাথে কথা বলবে না সেটা সে জানে। অজথা নিজে থেকে কথা বলতে গেলেই আরও ভাব ধরে বসে থাকবে। তাই ঈশাও এবার নিজেকে এমন ভাবে ব্যস্ত রেখেছে যাতে ইভান বুঝতে পারে তার সাথে কথা বলার সময় ঈশার নেই। ঈশার ভাবনার মাঝেই ইভান বের হয়ে গেলো ওয়াশ রুম থেকে। সোজা আলমারির সামনে দাড়িয়ে নিজের কাপড় বের করতে লাগলো। এমন আচরন করছে যেন সে ছাড়া এই ঘরে আর কেউ নেই। ঈশাও সেরকম ভাব দেখিয়ে উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখল ইভান প্রায় রেডি হয়েছে। ঈশা রান্না ঘরে চলে গেলো। এখনও কেউ উঠেনি ঘুম থেকে। ইভান নিজেকে ব্যস্ত প্রমান করতেই এতো সকালে বের হয়ে যায়। যাতে তাদের এই মান অভিমানের বিষয়টা বাসায় কেউ বুঝতে না পারে। ঈশা চা বানাচ্ছে আর ভাবছে ইভান কে কিভাবে জব্দ করা যায়। ইভান এসে টেবিলে বসলো। পানি ঢেলে মুখের সামনে ধরতেই তার ফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরে বেশ হেসে হেসে কথা বলছে সে। ইভান কে এমন হেসে হেসে কথা বলতে দেখে সকাল সকাল ঈশার মেজাজটা বিগড়ে গেলো। চা কাপে ঢেলে তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। হঠাৎ করেই মাথায় দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হল। বাকা হেসে ইভানের কাপে চিনির বদলে মরিচের গুড়া ঢেলে দিলো। যাতে বুঝতে না পারে তাই ভালো ভাবে মিশিয়ে দিলো। আর নিজের কাপটা আলাদা করে নিয়ে টেবিলে গেলো। ইভান ফোনেই কথা বলছে তখনও। ঈশা পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই নিজের কাপে চুমুক দিয়ে চা খাচ্ছে। এইদিকে ইভান ফোনে কথা বলতে বলতেই চায়ের কাপটা নিয়ে চুমুক দিলো। গলা পর্যন্ত যেতেই মুখ ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো। ভ্রু কুচকে একটু ভাবল। স্বাদটা কেমন অদ্ভুত। এরকম চা সে জিবনেও খায়নি। আবারো চুমুক দিলো। কিন্তু এবার মনে হল তার মুখ আর গলা জলে জাচ্ছে। ঈশার দিকে একবার তাকাল। সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের কাপে চুমুক দিয়ে খেয়েই যাচ্ছে। আর এক আঙ্গুলে ফোনে স্ক্রল করছে আর মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ইভান আর কথা বলতে পারলো না। ফোনটা কেটে দিলো। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মুখ লাল হয়ে গেছে। নাক চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অতিরিক্ত ঝালে মাথা ঘুরে যাচ্ছে। কোন কালেই ইভান এতো ঝাল খায়নি। ঈশা জানতো যে ইভান দুই এক চুমুক খাওয়ার পরে সাদের ভিন্নতার কারনে আর খাবে না। তাই সেই আন্দাজ করেই ঝাল দিয়েছিল যাতে দুই একবার খেলেই গলা জলে যায়। ঈশা মুচকি হেসে পাশ থেকে দুধের গ্লাসে কয়েক চামুচ চিনি মিশিয়ে রাখল। ইভান পানির গ্লাসটা হাতে ধরতেই ঈশা সেটা নিয়ে নিলো। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে তীক্ষ্ণ চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা এগিয়ে এসে দুই হাতে ইভানের শার্টের কলার চেপে ধরল। ইভান কিছু বুঝে উঠার আগেই তার ঠোটে ঠোট মিলিয়ে দিলো। কলার ছেড়ে এক হাত মাথার পিছনে দিলো। চুল মুঠো করে ধরল। বেশ অনেকটা সময় পর ছেড়ে দিলো। দুজনেই হাপাচ্ছে। ইভান তার ঝালের কারনে হাপাচ্ছে আর ঈশা শ্বাস আটকে যাওয়ার কারনে হাপাচ্ছে। ঈশা স্বাভাবিক ভাবে চিনি মেশানো দুধের গ্লাসটা ইভানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে উঠে চলে গেলো। ইভান মুহূর্তটাকে ঠিক ভাবে অনুভব করতে পারলো না ঠিকই কিন্তু সকাল বেলা এরকম একটা ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা ততক্ষনে উঠে রান্না ঘরে চলে গেছে।। আর সহ্য করতে না পেরে দুধটা পুরটা খেয়ে নিলো। ঝালটা একটু কমতেই বিষয়টা অনুভব করতে পারলো সে। চোখ বন্ধ করে তৃপ্ত শ্বাস ছেড়ে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। চোখে মুখে পানি দিয়ে কিছুক্ষন দাড়িয়ে ভাবল। সব তার মাথার উপর দিয়ে গেলো। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ভাবল এই প্রথমবার ঈশা সকাল বেলা উঠেই তার মেজাজ বিগড়ে দিলেও রাগ করার মতো কোন উপায় রাখল না। প্রথম ইভানের মনে হল তার ঠিক কি ধরনের রিয়াক্ট করা উচিৎ সেটা সে বুঝতে পারছে না।। ঘাড় ঘুরিয়ে একবার রান্না ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। ঈশা দরজার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

————
সব কাজ শেষ করে ঈশা ঘরে চলে গেলো। আলমারি থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো গোসল করতে। অনেকটা সময় নিয়ে গোসল শেষ করে বের হয়েই সামনে তাকাতেই চোখ কপালে উঠার উপক্রম ঈশার। ইভান বিছানায় বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ভর দুপুরে ইভান যে বাসায় আসবে সেটা ঈশা কল্পনাতেও আনেনি। কারন রাত ছাড়া সে তো বাসায় আসেনা। আর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তারপর। সকালের কথাটা মনে পড়তেই ঈশা ঠোট চেপে হাসল। ঠিক সেই সময় ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। হাসিটা চোখে পড়লেও তার মুখ ভঙ্গি একদম স্বাভাবিক। আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফোনের দিকে তাকাল। ঈশা দ্রুত পায়ে বারান্দায় চলে গেলো। ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে ঘরে চলে এলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াতে যাবে ঠিক তখনই মাথায় আবার দুষ্ট বুদ্ধি চেপে বসলো। ইভানের থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে চুল গুলো ঝাড়া দিলো। সব পানি ইভানের মুখে গিয়ে পড়ল। বিরক্তি নিয়ে ইভান চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। ঈশা আয়নায় সবটা দেখল। ঠোট চেপে হেসে আবার ঝাড়া দিলো। ইভান এবার চোখ খুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা এমন ভাব করলো যেন সে কিছুই বুঝতে পারলো না। ইভান বিরক্ত হয়ে উঠে আলমারির সামনে দাড়াতেই ঈশা অনিচ্ছাতেই ঘুরে গেলো। ইভানের সাথে ধাক্কা খেলো। পড়ে যেতে নিলেই ইভান ধরে ফেলল। ঈশা শক্ত করে ইভানের শার্ট চেপে ধরল। ইভান ঈশাকে সোজা করে দাড় করিয়ে ছেড়ে দিলো। ইভান আলমারি থেকে কাপড় বের করে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশা নিশব্দে হাসল। ভালো করে চুল মুছে নিচে গেলো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখতেই ইফতি এসে বসলো। একটা প্লেট বেশী দেখে বলল
–একটা প্লেট আজ বেশী কেন?

ঈশা প্লেট সাজাতে সাজাতেই বলল
–তোর ভাইয়া এসেছে।

ইফতি সামনে তাকিয়েই ইভান কে দেখে বলল
–আরে ভাইয়া তুমি এই সময় বাসায়?

ইভান এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–কেন আমার কি এই সময় বাসায় আসতে নিষেধ?

ইফতি হেসে বলল
–না না তা কেন হবে? কয়দিন ধরে তোমার তো দর্শন পাওয়া যাচ্ছিলো না। আজ হঠাৎ এমন কি ঘটনা ঘটল যে তোমার দর্শন মিলল। সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছিলাম।

ঈশা স্বাভাবিক ভাবেই গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল
–খাবার টা টেস্ট করে দেখ তো ইফতি ঝালটা কেমন? আজ কাল মনে হচ্ছে আমি খাবারে খুব বেশী ঝাল দিচ্ছি। রান্না বান্না কি ভুলে গেলাম নাকি বুঝতে পারছি না।

কথাটা কানে আসতেই ইভান আড় চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা খুব স্বাভাবিক। নিজের মতো সব খাবার নিয়ে বসে পড়ল। খাবার মুখে তুলেই ইভান ইফতিকে বলল
–বাবা মা কি বাসায় নাই?

ইফতি ছোট্ট করে বলল
–না। দুজনই গ্রামে গেছে। কাল আসবে।

ইভান ভ্রু কুচকে আনমনে বলল
–আমি জানিনা কেন?

ঈশা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল
–বাসার মানুষের খবর জানতে বাসায় থাকতে হয়। দিন রাত বাইরে থাকলে জানা যায়না।

ইফতি সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া তুমি কোন ভাবে রাতেও বাইরে থাক? আমি তো জানি তুমি রাতে বাসায় চলে আসো।

ইভান ধমক দিয়ে বলল
–তোকে এসব নিয়ে কেউ গবেষণা করতে বলেনি। চুপচাপ খা।

ইফতি খাবারে মনোযোগ দিলো। ইভান পানি খাওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই ঈশা গ্লাসটা নিয়ে নিলো। পানিতে চুমুক দিয়ে গ্লাসটা পাশে রাখল। ঈশার গ্লাসটাতে পানি ভর্তি তবুও সে সেখান থেকে পানি খেলো না। ইভান হাত বাড়িয়ে ঈশার গ্লাসটা নিতে গেলেই ঈশা সেটাকেও সরিয়ে একটু দূরে রাখল। ইভান শান্ত ভাবে দেখছে ঈশার সব কাজ কর্ম। কিছু বলছে না। ঈশা এতো কিছু করছে শুধু যাতে ইভান তার সাথে কথা বলে। কিন্তু ইভানও ঠিক করেছে এতো সহজে কথা বলবে না। সেও দেখতে চায় ঈশা আর কি কি করতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে পানি খাওয়ার জন্য জীবন বের হয়ে যাচ্ছে। তাই উপায় না পেয়ে ঐ গ্লাস থেকে পানি খেলো। ঈশা ঠোট চেপে হাসল। ইভান অতি বিরক্তি নিয়ে আড় চোখে ঈশার কাণ্ড দেখছে। খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে ঘরে গেলো সবাই। দুপুর বেলা আর কোন কাজ না থাকায় রেস্ট নিবে এখন। ইভান আগেই ঘরে চলে এসেছে। সে বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছে। ঈশা এসে অপর পাশে শুয়ে পড়ল। ইচ্ছা করেই খোলা চুল গুলো এমন ভাবে এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল যাতে ইভানের মুখে গিয়ে পড়ে। ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। কিছুক্ষন ওভাবে থেকে আলতো করে চুল গুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে ফেলে ঈশার দিকে তাকাল। সে উলটা ঘুরে শুয়ে আছে। কিছু বলল না। মুচকি হেসে চুল টেনে দিলো। ঈশা ‘আহ’ শব্দ উচ্চারণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবেই টিভি দেখছে। ঈশা বুঝতে পারলো ইভান তার চুল টেনেছে। কিন্তু কোনভাবেই সে স্বীকার করবে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ইভান ঠোট চেপে হাসল।

—————-
আলো অন্ধকারের খেলা। গোধূলি বিদায় নিয়ে সন্ধ্যা নামলো বলে। ইভান ঐ যে এসেছে তারপরে আর বাইরে যায়নি। দুপুরে শুয়ে থাকতে থাকতে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মাত্র ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে দেখল ঈশা কোথাও নেই। বুঝতে পারলো রান্না ঘরে আছে। বের হয়ে দেখে ইফতি টিভি ছেড়ে দিয়ে চা খাচ্ছে আর মনোযোগ দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইভান চোখ ফেরাতেই দেখল ঈশা রান্না ঘর থেকে বের হচ্ছে। শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুঁজার কারনে কোমরের অনেকটা দৃশ্যমান। ইফতির দিকে একবার তাকিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো ইভান। রান্না ঘরের দরজার সামনে দাড়াতেই ঈশার মুখোমুখি হল। ঈশা শান্ত চোখে ইভানের দিকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবে তখনই ইভান নিজের পা বাড়িয়ে দিলো। পায়ের সাথে পা লেগে পড়ে যেতে নিলেই ইভান ধরে ফেলল কোমর জড়িয়ে। ঈশা থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। সামনে তাকিয়েই ঈশার কোমর থেকে আঁচলটা খুলে দিলো সে। অনেক জোরে কোমরে চিমটি কাটতেই ঈশা চিৎকার করে উঠলো। ইফতি ঘাড় বেকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–কি হয়েছে? চিৎকার করলে কেন?

ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
-কিছু না। এমনিতেই।

ইফতি আর কথা বাড়াল না। টিভির দিকে মনোযোগ দিলো। ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ঠোটে জ্বালাময়ী হাসি দেখে ঈশার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। দ্রুত পা ফেলে ইফতির কাছে এসে ছুরি আর আপেল হাতে নিয়ে কাটতে গেলো। ইভান রান্না ঘরের দরজায় দাড়িয়ে দেখছে। রাগ করেই জোরে চাপ দিতেই ঈশার হাত কেটে গেলো। ইভান দৌড়ে এসে হাত ধরে ফেলল। রক্ত বের হচ্ছে। ইফতি সেদিকে তাকিয়ে বলল
–অনেকটা কেটে গেছে। আমি ডেটল আর তুলো আনছি।

বলেই চলে গেলো। ইভান চেপে ধরে আছে তবুও রক্ত বের হচ্ছে। ইভান রক্তিম চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা চোখ তুলে তাকাতেই ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে কাদ কাদ কণ্ঠে বলল
–আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি। বুঝতে পারিনি কিভাবে কেটে গেছে।

কথাটা শেষ করতেই ইভান ঈশার গালে একটা থাপ্পড় মারল। ঈশা হা করে তাকিয়ে আছে। থাপ্পড় টা এতটাই আস্তে ছিল যে ঈশা একটুও ব্যাথা পায়নি। সেটা নিয়েই সে ভাবছে যে থাপ্পড় মারল কিন্তু এতো আস্তে কেন। এর মাঝেই ইফতি এসে পড়ল। ইভান যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। ইফতির ফোন আসায় সে ঘরে চলে গেলো। ঈশা আবারো চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাতেই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ভয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান মুচকি হেসে যে গালে থাপ্পড় দিয়েছিল সেই গালে আলতো করে চুমু দিলো। ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ঠোটের কোনে মৃদু হাসি। ঈশাও একটু হেসে ইভানের বুকে মাথা রাখল। ইভান দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষন ওভাবেই থাকলো তারা। কিছুক্ষন পর ইভান শান্ত কণ্ঠে বলল
–ঈশা।

ঈশা ছোট্ট করে ‘হুম’ বলতেই ইভান আবার বলল
–তোমার সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা আছে।

ঈশা মাথা তুলে তাকাল। বলল
–আবার কথা?

ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–ভয় পাচ্ছ কেন? আবার কি করেছ?

চলবে………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৮

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৮

মধ্য রজনীর নিস্তব্ধ প্রহর। দূরে কোথাও দুই একটা কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। থেমে থেমে রাস্তায় গাড়ি চলছে। উষ্ণ আবহাওয়াটা হঠাৎ করেই শীতল হয়ে গেলো। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। আর সেই বৃষ্টির শীতল হাওয়াই বয়ে আসছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোর কাছে কয়েক ঝাক পোকা থেমে থেমে উড়ছে। ঠিক তার পাশের বারান্দাতেই দুই জন মানুষ নিজের অনুভুতি প্রকাশে ব্যস্ত। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরে দুরু দুরু কাপন। মস্তিষ্কে এলোমেলো চিন্তা ধারা। ভয়ে হাত কাপছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে। ইভান এক হাতের মুঠোয় ঈশার দুই হাত ধরে রেখেছে। কাপতে দেখে দুই হাতে ঈশার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরে বলল
–ভয় পাচ্ছ কেন জান? রিলাক্স!

ইভানের কথা শুনে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও মস্তিষ্ক সায় দিলো না। গোলমেলে চিন্তা বেড়ে গেলো আরও। ইভান এক হাতে কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল
–আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় না?

ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–যায় তো। কেন যাবে না?

ইভান মৃদু হাসল। হাসিটা একেবারেই অন্য রকম। হাসির কারণটা না বুঝলেও অর্থটা বুঝতে অসুবিধা হল না ঈশার। এবার ভয়টা আরও গাড় হল। কি এমন বলবে ইভান যার কারনে এতো আয়োজন। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে তাকিয়ে বলল
–তাহলে এই নাটকের কারন কি?

ঈশার বুকের দুরু দুরু কাপন আরও বেড়ে গেলো। শুকনো ঢোক গিলে ফেলল। ইভান নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। ইভান চোখ তুলে ঈশার চোখে চোখ রাখল শান্ত ভাবে। শান্ত গলায় বলল
–কেন এতো কিছু?

ঈশা জোরে জোরে শ্বাস টেনে নিতে লাগলো। কাপা কাপা গলায় বলল
–ম…মানে?

ইভান ঈশার চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল
–মানেটা স্পষ্ট। আমি কারণটা জানতে চাই।

ঈশা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে বলল
–কি…কিসের কারন?

ইভান এবার নিজের রাগটাকে আর কন্ট্রোল করতে পারলো না। এক হাতে ঈশার গাল শক্ত করে চেপে ধরে বলল
–তোর এই বিয়ে নাটকের কারন। কেন এরকম একটা নাটক করলি? সবটা জানতে চাই। সত্যিটা বল।

ইভানের কথা শুনে ঈশার মাথায় বাজ পড়ার উপক্রম। ইভান এতো জোরে তার মুখ চেপে ধরেছে যে ঈশা ব্যথায় কথা বলতে পারছে না। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। ইভান চোখের পানি দেখে ছেড়ে দিলো। ঈশা চোখ নামাতেই ইভান থুতনিতে দুই আঙ্গুলে ধরে মুখ তুলে বলল
–আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। আর যা বলবি একদম সত্যি।

ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকাল। প্রচণ্ড রাগ তার চোখে। ঈশা ভয়ে আবার কেপে উঠতেই ইভান বলল
–চিঠির উপরে লেখাটা কার ছিল?

ঈশা চুপ করে থাকলো। এই মুহূর্তে ইভান কে কোন কথা সে বলতে চায় না। কারন ইভান এখন প্রচণ্ড রেগে আছে। ঠাণ্ডা মাথায় সবটা বলবে। বুঝিয়ে বলবে কারণটা। কিন্তু ঈশাকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে ইভানের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেলো। দাতে দাত চেপে বলল
–স্পিক আউট ঈশা।

ঈশা ভয়ে ভয়ে বলল
–এখন তুমি অনেক রেগে আছো। আমি তোমাকে পরে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলবো প্লিজ! আমার কথা শুনো।

ইভান প্রচণ্ড রেগে গেলো। উঠে দাড়িয়ে টুলটাতে একটা জোরে লাথি মেরে চিৎকার করে বলল
–অনেক অপেক্ষা করেছি। আর না। আমি এখনি শুনতে চাই। কি এমন হয়েছিলো যে এতো বড় একটা নাটক করতে হল তোকে। এর পেছনে যত ঘটনা আছে সবটা শুনতে চাই আমি। আর সেটা এখনই।

ইভানের জোরে বলা কথা গুলো মাঝরাতে হুঙ্কারের মতো শোনালো। ঈশা ভয়ে কেদে ফেলল। কাদতে কাদতে বলল
–বিয়ের আগে একদিন আমাদের সবার এক সাথে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। আমরা সবাই রেডি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তুমি প্রথমে আমাদের চলে যেতে বললে পরে যাবে বলে। কিন্তু আমরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই আবার ফোন করে বললে যাবে না। তোমার ভালো লাগছে না। আমরা সেদিন তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলাম। আমি বাসায় না গিয়ে ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে আসি। আবার অসুস্থ হলে কিনা একবার দেখে আসি। আমি বাড়িতে ঢুকার মুহূর্তেই ইফতিকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যেতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলে বলল যে স্নেহা আপু এসেছে তোমার সাথে দেখা করতে। আমি ভিতরে গেলাম। ঢুকে দেখলাম বাসায় কেউ নেই। একটু এগিয়ে যেতেই তোমার আর স্নেহা আপুর আওয়াজ পেলাম। তোমার ঘরের দরজায় গিয়ে দাড়াতেই স্নেহা আপুর কথা আমার কানে এলো। বলছিল সে তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। কান্নাকাটি করছিল। আর এটাও বলেছিল যে তোমাকে ছাড়া থাকার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারছে না। আমাদের বিয়ের কথা শুনে তার কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। আমি একটু এগিয়ে দরজার ফাক দিয়ে দেখতে গেলেই চোখে পড়ে তোমরা দুজন দুজন কে জড়িয়ে ধরে আছো। আমি প্রথমে খুব কষ্ট পেলেও পরে তোমার কথা শুনে বুঝতে পারি আসলে আমি যা ভেবেছিলাম বিষয়টা সেরকম কিছু ছিল না। মেঝেতে পানি ছিল আর তাতেই স্নেহা আপুর পা পিছলে যায়। কিন্তু মেঝেতে না পড়ে তোমার গায়ে পড়ে যায়। আর তুমি তাকে ধরে ফেল। ঠিক তখনই আমার চোখে পড়ে যায়।

ঈশা থেমে গেলো। ইভান সামনে তাকিয়ে শান্ত সরে বলল
–চিঠির উপরে লেখাটা কার?

ঈশা মাথা নামিয়ে কাদ কাদ সরে বলল
–ঈশান ভাইয়ার। আমি ঈশান ভাইয়া কে সবটা খুলে বলি। ভাইয়া আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে বলে। কিন্তু আমি আব্বুর কাছে শুনেছি তুমি এখনই বিয়ে করতে চাও না। তাই আর তোমার সাথে কথা বলতে চাইনি। নিজে নিজে সব প্ল্যান করে ভাইয়াকে জানাই। ভাইয়া প্রথমে না করলেও আমার জেদের কাছে হার মেনে রাজি হয়।

ঈশা মাথা নিচু করে ফেলল। চোখ বন্ধ করে বলল
–ভাইয়ার কোন দোষ নাই। পরেও আমাকে অনেকবার সবটা বলে দিতে বলেছিল। আমিই তোমাকে বলিনি।

ইভান গ্রিলের সাথে হেলানি দিয়ে দাঁড়ালো। শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। গম্ভীর গলায় বলল
–কাজটা কি ঠিক হয়েছে?

ঈশা উঠে দাড়িয়ে গেলো। ইভানের সামনে দাড়িয়ে বলল
–সরি। আমি আসলে না ভেবেই করে ফেলেছি।

ইভান নিজের রাগ সামলাতে না পেরে ঈশার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরল। দাতে দাত চেপে বলল
–যতটা অসহায় তুই সাজিস ততটাও নয়। বারবার না ভেবে কোন না কোন কাজ করেই ফেলিস। আর আমি যখন জানতে পারি তখন বলিস না ভেবেই করে ফেলেছিস। আমি প্রথমবারই বলেছি আমার কাছ থেকে তুই কোনদিনও কিছু লুকাতে পারবি না। আজ হোক কাল হোক আমি সব জেনে যাব। তখন কিন্তু আমি তোকে মাফ করবো না।

ঈশা কেদে ফেলল। ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। উলটা দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সামনে দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কি বুঝতে পারছিস ঠিক কি করেছিস?

থেমে তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলল
–আমার অনুভুতিকে অপমান করেছিস। আমাকে নিজের কাছে ছোট করেছিস। এমন একটা অপবাদ আমার উপরে দিয়েছিস যেটা আমি করা তো দুরের কথা ভেবেও দেখিনি কোনদিন। অদ্ভুত তুই ঈশা। অদ্ভুত তোর ভালবাসা। ঐ চিঠিতে যা লেখা ছিল সব কিছু তোকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ওগুলো শুধু লেখা না আমার মনের সব অপ্রকাশিত অনুভুতি। তুই জানিস আমি বরাবর আমার রাগ ভালবাসা সব কিছু প্রকাশ করতেই ব্যর্থ। এই জন্যই আমি কখনও তোকে আমার মনের কথা বলতে পারিনি। কিন্তু তোকে হারাতেও চাইনি। সব সময় আগলে রেখেছি। ভালো রাখার চেষ্টা করেছি। আমি চেয়েছি তুইও আমাকে ঠিক ততটাই ভালবাসতে বাধ্য হ যতটা আমি তোকে ভালবাসি। আমি তোর মনে জায়গা তৈরি করে নিতে চেয়েছি। আর আমি সেটা করতেও পেরেছি। কিন্তু তুই তোর জীবনের সব থেকে বড় সত্যিটা আমার কাছে থেকে লুকিয়ে আমাকে কষ্ট দিয়েছিস। আরও বেশী কষ্ট পেয়েছি যখন তুই নিজের জীবন শেষ করে দেয়ার চিন্তা করেছিস। কিন্তু আমি যে তোকে ছাড়া বাচব না। তাই সেই সময় তোর উপরে অধিকার পাওয়াটা আমার কাছে সব থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটার কারনেই আমি সেদিন প্রথমবার তোর ইচ্ছার বাইরে গিয়ে সাইন নিয়েছিলাম। কিন্তু পরের বার তুই যখন আমাকে বিয়ে করার বললি তখন আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আর এভাবে তোর জোর করার কারণটা আমার জানা ছিলনা তাই না করে দিয়েছিলাম। কারন আমি ভেবেছিলাম আমি না করে দিলেই তুই আমাকে সবটা খুলে বলবি। কিন্তু তুই কিছুই বলিস নি। আমিও শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তোর জেদের কারনে আমি আর কথা বাড়াই নি। ভেবেছিলাম পরে হয়তো তুই আমাকে বলবি। কিন্তু এতদিনেও যখন কিছুই বলিস নি। তখন নিজে নিজেই সবটা জানতে চেষ্টা করলাম। এটা আমার মাথায় খুব ভালভাবে ছিল যে আমার এসব জিনিস তুই ছাড়া আর কেউ খুজে পাবে না। আর পেলেও এরকম ঘটনা ঘটানোর সাহস পাবে না। তার থেকেও বেশী আমাকে ভাবিয়েছিল যে বিষয়টা সেটা হল তোর এতো সহজ ভাবে মেনে নেয়া। তোকে আমি খুব ভালো ভাবে চিনি। এসব বিষয় তুই এতো সহজে মেনে নেয়ার মতো মেয়েই না।

ইভান থেমে গেলো। ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি বুঝতে পারছি আমি কি করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকে হারানোর ভয়টা আমার অনেক তীব্র ছিল। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার তোমাকে সবটা বলে উচিৎ ছিল। আমি তোমাকে বলবো না আমাকে মাফ করে দাও। তোমার যা শাস্তি দিতে ইচ্ছা করে দাও। আমি মেনে নিবো।

ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–শাস্তি দেয়ার অধিকার কি আমার আছে? শাস্তি তো তুই আমাকে দিয়েছিস। তাও আবার এমন কিছুর যা আমি করিই নি। সেদিন স্নেহা বাসা থেকে চলে যাওয়ার পর আমি তোকে সব বলেছি। তবুও তুই আমাকে অবিশ্বাস করে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছিস যা আমি কল্পনাতেও আনিনি। এটা আমার জন্য খুব কষ্টের বিষয় ঈশা। নিজের উপরে করুনা হচ্ছে আজ খুব।

ঈশা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। বলল
–এভাবে বল না প্লিজ। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। যা করেছি তা অন্যায় ছিল কিন্তু তোমাকে হারাতে চাইনি।

ইভান কোন কথা বলল না। সামনেই তাকিয়ে থাকলো। ঈশা তার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। অনেকটা সময় পর মৃদু কণ্ঠে বলল
–শুয়ে পড় ঈশা। অনেক রাত হয়েছে।

ঈশা একবার চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকাল। আগের অবস্থাতেই দাড়িয়ে আছে। ঈশার নিজের মনেও অপরাধ বোধ তৈরি হয়েছে। সে বুঝতে পারছে ইভান কে চরম ভাবে অপমান করেছে। তার ছেলে মানুষী এবার ইভানের ভালবাসা অনুভুতিকে অপমান করেছে। কিন্তু সে যখন এরকম কিছু ভেবেছিল তখন তার মাথাতেই আসেনি যে বিষয়টা এরকম কিছু হতে পারে। বিয়ের পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেও ইভান কে বলার সাহস হয়ে উঠেনি। এখন মনে হচ্ছে সাহস করে বলে ফেললে হয়তো আজ ইভান তার অবস্থাটা বুঝতে পারতো। ভুল তো ভুলই! এই ভুলের কি কোন ক্ষমা হয় আদৌ?

চলবে…………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৭

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক – এ রহমান
পর্ব ২৭

জমজমাট আড্ডা আর এক রাশ উচ্ছাসের মাঝে হঠাৎ করেই ভাটা পড়লো তীব্র কলিং বেলের শব্দে। ঈশা এক গাল হেসে দৌড় দিল দরজা খুলতে। দরজা খুলেই ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অকৃত্রিম হাসিটা আরো প্রশস্ত হলো। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাতেই তার অমায়িক হাসিতে চোখ আটকে গেলো। এলোমেলো অনুভূতি গুছিয়ে উঠলো। সমস্ত ক্লান্তি, মন খারাপ দূরে চলে গেলো। অভিমান অভিযোগ সব কেমন ভালোবাসায় রূপ নিলো। মনটা ভরে উঠলো খুশীতে। ইভান কে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে ঈশা একটু দুষ্টুমি করে বলল
— শ্বশুর বাড়িতে ভিতরে আসতে লজ্জা পাচ্ছো বুঝি?

ইভান সরু চোখে তাকিয়ে বলল
— আমার লজ্জা বরাবরই কম সেটা তুমি ভালো করেই জানো। দেখাবো?

ইভান এর কথা বুঝতে পেরেও ঈশা তেমন গুরুত্ব দিলনা। কারণ তারা এই মুহূর্তে ঈশাদের বাড়ির দরজায় দাড়িয়ে আছে। আর এখানে যে ইভান সেরকম কিছুই করবে না সেটা নিয়ে ঈশা নিশ্চিন্ত। তাই সাহস নিয়ে বলল
— খুব সাহস তাই না? সাহস থাকলেই শুধু হয়না। যেখানে সেখানে দেখানোর ক্ষমতাও থাকতে হয়।

ঈশার কথাটা শেষ হতেই ইভান তার আচলটা ধরে ফেললো। হাতে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল
— চ্যালেঞ্জটা করে ভুল করে ফেলেছ। এখন এটা যে তোমার উপরে ভারী পড়ে যাবে।

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান সপূর্ণ আচল টা পেঁচিয়ে ঈশা কে টেনে আনলো নিজের কাছে। এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
— বাকিটা এবার দেখাই?

ঈশা পিছনে ঘুরে তাকাল। এই মুহূর্তে ডাইনিংয়ে কেউ নাই। কিন্তু যে কেনো সময় এসে যেতে পারে। ইভান কে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেষ্টা করে বলল
— এতো অসভ্য কেনো তুমি? এখন যদি কেউ চলে আসে তাহলে কি হবে?

ইভান আর একটু কাছে টেনে বলল
— আমার কোন দোষ নেই। তুমি দেখতে চেয়েছো। আর আমার সাহস নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আমি খুব উত্তেজিত হয়ে যাই। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনা ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না সাহস দেখাতে পারি।

ইভান এর কথা শেষ হওয়ার সাথেই ইরা দৌড়ে এলো। ইভান এর পায়ের কাছে দাড়িয়ে বলল
— ইভান ভাইয়া তুমি কখন এসেছ?

ইভান তাকে কোলে তুলে নিলো। পকেট থেকে দুই টা চকলেট বের করে একটা ইরার হাতে দিলো আর একটা ঈশার হাতে দিলো। ইরা চকলেট টা হতে নিয়ে বলল
— থ্যাংক ইউ।

বলেই ইভানের গালে একটা চুমু দিল। ইভান ও তার গালে একটা চুমু দিলো। ঈশা এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। ইরা ঈশার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল
— এই আপু ভাইয়া তোমাকে চকোলেট দিলো তুমি থ্যাংক ইউ দিলে না কেনো?

ইরার কথা শুনে ঈশা হেসে ফেললো। হেসে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
— থ্যাংক ইউ!

বলেই চলে যাবার জন্য ঘুরতেই ইভান ইরাকে বলল
— তুই কি শুধু থ্যাংক ইউ বলেছিলি টুনটুনি?

ইরা মাথা নাড়িয়ে বলল
— না আদর করেছিলাম।

ইভান হেসে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— তাহলে তোর আপু যে শুধু থ্যাংক ইউ বলল?

ঈশা বড়ো বড় চোখে তাকাল। বুঝতে পারলো ইভান ঠিক কি বলতে চাইল। মৃদু সরে বলল
— কি হচ্ছে?

বলেই ঘরে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ইভান হাত ধরে ফেললো। ঈশা গোল গোল চোখে পিছনে ঘুরে তাকাল। ইরা আদেশ সূচক কণ্ঠে বলল
— ভাইয়াকে আদর করো আপু।

ঈশা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। ইভান হেসে ফেললো। ইরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। বলল
— ঘরে দেখতো টুনটুনি সবাই কি করছে?

ইরা ঘরের দিকে দৌড় দিলো। ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল
— তো?

ঈশা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল
— তো কি?

ইভান এক টানে কাছে এনে বলল
— বুঝেও অযথা নাটক করার কি মানে? সবার সামনে যদি এরকম পরিস্থিতির শিকার হতে হয় তাহলে কি সেটা ভালো হবে? অবশ্য এখন না শুনলে সেটাও হতে পারে। আমি গ্যারান্টি দিতে পারবো না।

ঈশা সরু চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। বুঝতে পারলো সে এখন পরিস্থিতির শিকার। নাহলে এখন যা বলল ইভান ঠিক তাই করবে। ইভান তাকে কাছে এনে বলল
— কি ভাবলে?

ঈশা কোন কথা বলল না। একটু এগিয়ে ইভানের গালে চুমু দিয়েই চলে যেতে নিলে ইভান আবার ধরে ফেলে। ভিতরে ঢুকে দরজা পা দিয়ে লাগিয়ে দিলো। ঈশা কে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলল
— নাউ ইটস মাইন্টার্ন! বলেছিলাম না আমাকে কিছু দিলে আমি তার অনেক গুণ ফেরত দিবো। এখন সেটার পালা।

ঈশা অসহায়ের মত করে বলল
— প্লিজ ছেড়ে দাও।

ঈশার কথা শেষ হতেই ইভান তার ঠোটে গভীর ভাবে চুমু খেল। তারপর ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। শান্ত ভাবে বলল
— যাও।

ঈশা চলে গেলো। ইভান বেসিনের সামনে গিয়ে দাড়ালো। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘরে গেলো। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। আজ ঈশাদের বাড়িতে সবার দাওয়াত। ইভান কাজে বাইরে গিয়েছিল। তাই আসতে দেরি করে ফেলেছে। তাকে দেখে সবাই খুশী হয়ে গেলো। ইভান এসে ঈশার পাশে বসে তার আচল দিয়ে মুখ মুছে নিলো। সবাই সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ইভান মুখ মুছে চোখ তুলে তাকাল। সবাইকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে বলল
— আমাকে কোন এলিয়েন মনে হচ্ছে? এভাবে তাকানোর মানে কি?

ইলু দাত কেলিয়ে বলল
— তুমি আসার পরে ঈশা কেমন লাল নীল হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখছিলাম।

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। তারপর ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বলল
— আমাকে দেখে কেউ যদি লাল নিল হয়ে যায় তাহলে সেটা আমার সমস্যা না তার সমস্যা। এভাবে আমার দিকে তাকানোর কোন মানে হয় না।

হাতা গুটিয়ে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— কই দেখি।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ভ্রু কুচকে তাকিয়েই আছে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল
— সত্যিই তো! কিন্তু এরকম হওয়ার কারণ কি? কোনভাবে কি তুমি লজ্জা পাচ্ছো? কিন্তু সেটা তো আমার পাওয়ার কথা ছিল। কারণ এই মহুর্তে আমি শ্বশুর বাড়িতে বসে আছি।

সবাই হেসে ফেললো। ঈশা আরো অসস্তিতে পড়ে গেলো। ইভান এর দিকে তাকাতেই ঠোটে সেই জ্বালাময়ী হাসি দেখে আরো রেগে গেলো। ইভান বুঝতে পেরে ঈশার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল
— বলেছিলাম না সাহসের চ্যালেঞ্জটা ভারী পড়বে। হয়েছে তো?

ঈশা বিস্ফোরিত চোখে তাকাল। উঠে বাইরে চলে গেলো। ইভান তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। অনেকদিন পর এরকম সবাই মিলে একসাথে সময় কাটাল তারা। ইভান এখন বেশ ব্যস্ত থাকায় সময় দিতে পারেনা। কিন্তু আজ সে সময় বের করে এসেছে সবার সাথে আড্ডা দিতে। সব কিছুর চাপে মোটামুটি হাপিয়ে উঠেছিলো। এখন অনেক টা ভালো লাগছে। রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে তারা। ইভান দের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে সবাই বিদায় দিয়ে চলে গেলো নিজ নিজ বাড়িতে। ঈশা আর ইভান বাড়ির ভিতরে ঢুকার মুহূর্তেই ইভানের ফোন বেজে উঠলো। ইভান ফোন বের করে নাম্বার দেখে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— তুমি যাও আমি কথা শেষ করে আসছি।

ঈশা কোন কথা না বলে উপরে চলে গেলো। ইভান তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশার ছায়ামূর্তি শেষ অবধি মিলিয়ে যাওয়ার পর ইভান ফোন ধরে বলল
— হ্যা বলো।

ওপাশ থেকে কিছু একটা বলতেই বলল
— আমি খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত জানাবো।

——————-

মধ্য রাত। আকাশে বিশাল একটা চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। তারাদের আলোর সমাহার বসেছে। কোথা থেকে এক উষ্ণ হাওয়া এসে শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে। ঈশার হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেলো। চোখ খুলেই দেখলো ইভান নেই। উঠে বসে চারিদিকে দেখলো। ওয়াশ রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। উঠে এলোমেলো পায়ে হেঁটে যেতেই দেখলো বারান্দায় ছায়ামূর্তি। সেদিকে গেলো। ইভান এক টুলের উপর বসে আর এক টুলে পা তুলে আছে। মাথাটা টুলের উপরে এলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশার উপস্থিতি বুঝতে পারেনি। কিছু একটা নিয়ে ভাবছে হয়তো। ঈশা একটু এগিয়ে মাথায় হাত দিতেই চমকে ঘুরে তাকাল। ঈশা কে কিছুক্ষণ দেখে নিয়ে বলল
— উঠে গেলে যে? ঘুম ভেংগে গেল কেনো?

ঈশা মৃদু সরে বলল
— এমনি।

ইভান হাসলো। সাভাবিক ভাবেই বলল
— আমাকে ছাড়া ঘুম আসেনা? আমার বুকে ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে তাই না।

ঈশা উত্তর দিলো না। ইভান ঈশার নিরবতা বুঝে আবারও হাসলো। ঈশা মৃদু সরে বলল
— তুমি ঘুমাওনি কেনো?

ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— ঘুম আসছে না।

ঈশা ভ্রু কুচকে বলল
— কেনো?
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— বসো।

ঈশা সামনের টুলে বসে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো উত্তরের অপেক্ষায়। ইভান একটু ঝুঁকে ঈশার হাত ধরে নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো। হাতে একটা চুমু দিয়ে এক হাত দিয়ে ঈশার এলোমেলো চুল গুলো গুছিয়ে দিয়ে বলল
— ঈশা আমি কিছু বলতে চাই।

ঈশার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ইভান এর গলার সর ভিন্ন। কেমন জানি খাপছাড়া শোনাচ্ছে। ঈশা জোরে জোরে শ্বাস টেনে বলল
— বলো।

ইভান ঈশার চোখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলল
— আমাকে ঠিক কতটা বিশ্বাস করো? মানে আমার উপরে কি চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়?

চলবে…….

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৬

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৬

ল্যাম্পোস্টে ভিজে আলোয় ইলেক্ট্রিক তারের ওপর সার বেঁধে জ্বলছে বৃষ্টির শিশির, জলের ফোঁটাগুলো একপলক পর পর নিচে ঝরে পড়ছে। বৃষ্টির অবিরাম ছন্দবদ্ধ সঙ্গীত। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির পানিতে মৃদু মন্দ কাঁপছে। বৃষ্টি পড়ার শব্দ। মাঝে মাঝে আকাশের এক কোণে হঠাৎ জ্বলে উঠে হারিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের চমক। স্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শ। দূর দিয়ে চলে যাওয়া কোন রিকশার অস্পষ্ট ঘন্টার শব্দ। মাঝে মাঝে বড় গাড়ি রাস্তায় জমে থাকা পানির মাঝে ছলাত ছলাত শব্দ করে জোরে ছুটে চলেছে। মাঝ রাতের বৃষ্টি বিলাস! কি যে এক অপার আনন্দ। ঈশা বারান্দায় দাড়িয়ে নিজের ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে ভালো করে মুছতে মুছতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি এখনও কমেনি। তুমুল বেগে পড়ছে। কিছুক্ষন আগেই দুজন ছাদ থেকে বৃষ্টিতে ভিজে নিচে নেমেছে। ঈশা নামতে চাচ্ছিল না। ইভান জোর করে নামিয়ে এনেছে। তাই সে রাগ করেছে। ভেজা কাপড় বদলে নিজের চুল মুছতেই ব্যস্ত সে। আর ইভান ওয়াশ রুমে কাপড় চেঞ্জ করছে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখল ঈশা বারান্দায় দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান পিছনে দাড়িয়ে জোরে ধমক দিয়ে বলল
–এখানে কি? ঘুম পায়নি?

ইভানের এমন গলার আওয়াজ শুনে ঈশা চমকে তাকাল। একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তোয়ালেটা মেলে দিয়ে ঘরের ভিতরে পা দিতেই ইভান আটকে দিলো। মৃদু সরে বলল
–একটু আগেই তো কত প্রেম ছিল। এখন কি হল? সব উধাও হয়ে গেলো কোথায়?

ঈশা মুখ ভার করে বলল
–আমার ঘুম পেয়েছে। ঘুমাবো।

ইভানের হাত সরিয়ে ঈশা ঘরের ভিতরে চলে গেলো। বিছানায় বসে পড়ল। ইভান তার কাছে গিয়ে পাশে বসলো। ঈশা পা তুলে ঘুরে শুতে যাবে তখনই ইভান ধরে ফেলল। নিজের কাছে টেনে এনে দুই হাত আলতো করে গালে রাখল। ঈশা বিরক্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলল
–ছেড়ে দাও। আমি ঘুমাব।

ইভান গালে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–যদি ঘুমাতে না দেই।

ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু অভিমানী সুরে বলল
–তোমার ইচ্ছাই তো সব। যা বলবে শুনতেই হবে।

ইভান ছেড়ে দিলো ঈশাকে। আলতো করে দুই আঙ্গুলে গালে স্লাইড করতে করতে বলল
–আমি কি এতো বড় অপরাধ করেছি যার শাস্তি স্বরূপ মাঝ রাতে এভাবে রাগ করে আমাকে কষ্ট দেয়া হচ্ছে?

ঈশার মনটা গলে গেলো। শান্ত চোখে তাকাল। ইভান আবার বলল
–আচ্ছা বাবা সরি। আর এভাবে জোর করবো না।

ঈশা তাকিয়েই থাকলো। ঈশা মনে মনে ভাবল এই মানুষটা এমন কেন? জোর করে কিন্তু অন্যায় করেনা। সব কিছুর পিছনে একটা সুনির্দিষ্ট কারন থাকে। সব ভাবনা কেমন গোছানো। ঈশার মতো এমন এলোমেলো একটা মেয়েকে প্রতি নিয়ত নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয় সে। ইভান চোখ নামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–এতো সময় ধরে বৃষ্টিতে ভিজলে ঠাণ্ডা লাগবে তাই………।

ইভান কথা শেষ করার আগেই ঈশা আদুরে কণ্ঠে বলল
–শুয়ে পড়। আমি মাথা টিপে দেই?

ইভান চোখ তুলে তাকাল। হেসে ফেলে বলল
–লাগবে না। শুয়ে পড়।

ঈশা বসেই থাকলো। ইভান লাইট অফ করে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়ে হাত বাড়িয়ে ঈশাকে বলল
–কাছে আসো।

ঈশা মৃদু হেসে ইভানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। ইয়াভন তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল।

—————-
কালো মেঘে ছেয়ে থাকা আকাশটা বিকেলের আলো গ্রাস করে ফেলেছে। এখনও বেলা থাকলেও মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমেছে। ইভান আজ সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হয়েছিলো। কি যেন জরুরী কাজ আছে দুপুরেও বাসায় আসেনি। ঈশা ঘরে বসে অপেক্ষা করছে তার জন্য। বলেছিল বিকেলের মধ্যে চলে আসবে। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল এখনও কোন খবর নেই। হঠাৎ করেই মেঘ ডেকে উঠলো প্রচণ্ড শব্দে। ভয় পেয়ে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল গুমোট মেঘ। প্রকৃতি তাণ্ডব শুরু করেছে। যেকোনো সময় মুশল ধারে বৃষ্টি নামবে। চিন্তিত হয়ে গেলো ঈশা। এমনিতেই গত রাতে অনেকটা সময় বৃষ্টিতে ভিজেছে। আবার এখন ভিজলে যদি অসুস্থ হয়ে যায়। বিছানার কাছে এসে ফোন হাতে নিয়ে ইভান কে ফোন দিলো। কিছুক্ষন রিং বাজতেই ইভান ফোন ধরে ফেলল
–হ্যালো।

ঈশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল
–কোথায় তুমি?

ইভান একটু থেমে গেলো। ঈশা আবারো বলল
–কি হল? কথা বলছ না কেন? কোথায় তুমি?

–একটু কাজে আছি। কেন?

ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–কেন আবার কি? তুমি কখন আসবে?

–বললাম তো কাজে আছি। আসতে দেরি হবে।

ঈশা তেতে উঠে ঝাঝাল গলায় বলল
–কেন দেরি হবে? সেই সকালে বের হয়ে গেছ। এখনও কাজ শেষ হয়নি। কি এমন কাজ করছ? বলেছিলে বিকেলের মধ্যেই চলে আসবে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তবুও খবর নেই। আকাশে মেঘ জমেছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসো।

ইভান একটু থেমে নরম গলায় বলল
–বললেই হল। কাজ না শেষ হওয়া পর্যন্ত তো আমি বাসায় আসতে পারবো না। বৃষ্টি হলেই বা আমার কি?

ঈশা রেগে গেলো। রাগ করে বলল
–তোমার কি মানে? এতো কথা কেন বলছ? আমি বলেছি আসবে মানে আসবে। আর কোন কথা বলবে না। ১০ মিনিটের মধ্যে বাসায় চলে আসবে। নাহলে……।

–নাহলে?

হঠাৎ করেই কানের কাছে আওয়াজ শুনতে পেয়ে ঈশা চমকে গেলো। ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো। পিছনে ঘুরতেই ইভানের সাথে ধাক্কা খেলো। এভাবে ইভান কে দেখে ঈশা কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। ইভান মুচকি হেসে বলল
–১০ মিনিটের আগেই চলে এসেছি। এখন?

ঈশা হেসে ফেলল। চোখে মুখে অবাধ খুশি। হাসি থামিয়ে বলল
–তুমি এখনি আসলে?

ঈশার খুশি দেখে ইভান মুচকি হেসে সামনের চুল গুলো যত্ন করে কানের পিছনে গুজে দিয়ে বলল
–আমার বউ আমাকে মিস করছে। আর আমি বাইরে থাকব। কিভাবে সম্ভব?

–আমি কি বলেছি মিস করছিলাম? বৃষ্টি হবে তাই আসতে বললাম। কাল রাতেও ভিজেছ। আজ আবার ভিজলে যদি জ্বর হয়।

ইভান ঈশার ঘাড়ে দুই হাত রেখে একটু ঝুকে বলল
–হলে হবে। সমস্যা কি?

ঈশা সরু চোখে তাকিয়ে বলল
–সমস্যা কি মানে? জ্বর হলে তো তোমার মাথায় কিছু থাকেনা। তুমি কিভাবে বুঝবে কি হয়?

ইভান অসহায়ের মতো বলল
–আমার ক্ষমতা থাকলে তো আমি প্রতিদিন অসুস্থ হয়ে থাকতাম। অসুস্থ হলেই ভালো। বউ কত আদর করে। সেবা করে। খাইয়ে দেয়।

ঈশা একটু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিতেই দরজায় নক করার আওয়াজ হয়। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দেয়। বাইরে থেকে ইলু আর ইরিনার গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ইভান একটু রেগে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এই তোর জন্য ওরা আমার বেড রুম পর্যন্ত আসার সাহস পায়। নাহলে কেউ আমার ঘর অব্দি আসার সাহস এখনও পেতনা। বাড়িটা একদম বস্তি বানিয়ে রেখেছে। সারাদিন এখানেই ঘুরঘুর করে। বউয়ের সাথে যে একটু মন খুলে কথা বলবো সেটারও উপায় নেই আর রোমাঞ্চ তো দুরের কথা।

ইভানের রাগ দেখে ঈশা একটু ঘাবড়ে গেলো। নরম গলায় বলল
–তুমি দুপুরে খেয়েছ? খাবার দেই।

ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি খেয়েছি। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। যা দরজা খোল।

ঈশা আর কথা না বলে দরজা খুলে ফেলল। ওরা দুজনি হুরমুরিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে ঈশাকে নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিলো। ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে বলল
–কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?

ইলু ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–ভাইয়া আমরা ঈশাকে একটু নিয়ে গেলাম আমাদের বাসায়। তুমি ভেব না। আবার সময় মতো দিয়ে যাব তোমার বউকে।

ইভান দাত বের করে হেসে বলল
–কোন সমস্যা নেই। এক কাজ কর। তোরাই আমার বউকে নিজের কাছে রেখে দে। মাঝে মাঝে আমার যখন প্রয়োজন হবে তখন আমি চাইব দিয়ে যাস। তাহলেই হবে।

ইভানের কথা না বুঝেই ইরিনা বলল
–তোমার কখন দরকার হবে?

ইরিনার এমন প্রশ্নে সবাই থেমে গেলো। ইভান ঈশার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ঈশা বুঝতে পারলো ইভান অনেক রাগ করেছে। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকলো। সারাদিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীরে ইভান রাতে বাড়ি ফিরে ঈশার সাথে একটু সময় কাটাতে চায়। কারন ইভানের ব্যস্ততার কারনে রাতে ছাড়া ঈশার সাথে তার তেমন কোন কথা হয়না। কিন্তু সব দিকে এভাবে সামলাতে ঈশাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সবার মন রাখতে গিয়ে কি ইভান কে কষ্ট দিয়ে ফেলছে সে?

চলবে…………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৫

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক – এ রহমান
পর্ব ২৫

প্রচন্ড চিৎকার শুনে দিগ্বিদিক ভুলে ইভান এক প্রকার দৌড়ে চলে যায় রান্না ঘরে। দরজায় দাড়িয়ে ঈশা কে একবার দেখে নিল। সে পুরোপুরি ঠিক আছে। বিচলিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো
— কি হয়েছে জান?

ইভান এর গলার আওয়াজ শুনে ঈশা কোন কথা না বলে দৌড়ে এসে ইভান কে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। ইভান কিছু না বুঝেই সেও ঈশা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অদূরে কণ্ঠে বলল
— রিলাক্স! এই তো আমি। কি হয়েছে?

ঈশা এক প্রকার হাপাতে হাপাতে বলল
— তেলাপোকা!

ইভান চুপ হয়ে গেলো। সে কি ঠিক শুনলো। সামান্য তেলাপোকার জন্য এরকম সাংঘাতিক চিৎকার! কি ভয়াবহ ব্যাপার। কথাটা মাথায় ঢুকতেই ইভান হেসে ফেললো। হাসি থামিয়ে বলল
— এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওটা তোমাকে খেয়ে ফেলবে না।

ঈশা তবুও শান্ত হলো না। জোরে জোরে শ্বাস টেনে বলল
— ওটাকে সরাও।

ইভান হেসে ফেলে বলল
— ওটাকে সরানো যাবেনা তো।

ঈশা একটু বিরক্তির সরে বলল
— কেনো যাবেনা?

ইভান আদুরে কণ্ঠে বলল
— ওটাকে সরালে এটাও সরে যাবে যে।

ঈশা মাথা তুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল
–ফাইজলামি করো আমার সাথে?

ইভান সিরিয়াস ভাব এনে বলল
— একদম করছি না। আমি ভয়াবহ রকমের সিরিয়াস। আমি তো ভাবছি এই তেলাপোকাকে নিয়ে আমার ঘরে সাজিয়ে রাখবো।

ঈশা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই ইভান হেসে ফেলে ঈশা কে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
— তাহলে আমার বউ সারাদিন আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে থাকবে। একটুও নড়াচড়া করবে না।

ঈশা ইভান কে ধাক্কা দিয়ে একটু সরে যেতেই আবার তেলাপোকা উড়ে এসে ঈশার পাশের দেয়ালে বসলো। ঈশা আবারও চিৎকার দিয়ে ইভান কে জড়িয়ে ধরলো। ইভান ঈশা কে জড়িয়ে ধরে বলল
— চাইলেই কি দূরে যাওয়া যায় জান। কোনো না কোন ভাবে আমার কাছে আসতেই হবে।

ঈশা আবারও সরে দাড়ালো। কিন্তু তেলাপোকার দিকে তাকাতেই আবার ভয়ে ইভানের কাছে চলে এলো। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরে তেলাপোকাকে দেখছে। এর মাঝেই তাদের চেঁচামেচিতে ইভানের বাবা এসে দাড়ালো। চিন্তিত কণ্ঠে বলল
— কি হয়েছে? কোন সমস্যা?

ইভান ঈশা কে ছেড়ে দিলো। বাবার দিকে ঘুরে হাসতে হাসতে বলল
— কিছু না বাবা তেলাপোকা।

— তেলাপোকা?

উনি ভ্রু কুচকে একটু ভাবলো। কিছুক্ষণ পর বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই শব্দ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে ঘুরে চলে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। ইফতি এসে ওদের দুইজনকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলল
— কি হয়েছে? এভাবে চিৎকার করছো কেনো তোমরা?

ঈশা তেলাপোকার দিকে ইশারা করতেই ইফতি একটু এগিয়ে গেলো সেদিকে। ইফতি যেতেই তেলাপোকা আবার উড়তে শুরু করলো। ঈশা আবারও চিৎকার করে ইভানের কাছে এসে দাড়ালো। ইভান তাকে জড়িয়ে ধরতেই ইফতি বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল
— দেখো ভাইয়া আমার মনে হয় ওর ভাবী আপুকে ভীষন পছন্দ হয়েছে। শুধু উড়ে উড়ে সেদিকেই যাচ্ছে।

ইফতি তেলাপোকার কাছে আর একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
— কি ভাবী আপুকে পছন্দ হয়েছে?

ঈশা দুম করে ইফতির পিঠে একটা মেরে ঝাঁঝালো গলায় বলল
— কি ও ও করছিস? ও কি তোর গার্ল ফ্রেন্ড? এখনি ওটাকে সরা নাহলে তোকে ভর্তা বানাবো।

ইফতি হাত দিয়ে আলতো করে তেলাপোকা টা ধরতেই ঈশা ইভানের বুকে মুখ লুকালো। ইফতি ওটাকে নিয়ে বাইরে চলে গেলো। ইভান ঈশা কে দেখে হাসছে। ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
— হাসছো কেনো?

ইভান ঠোঁট চেপে হেসে বলল
— আমার বউ এতো সাহসী এসব বাইরে জানলে আমার মন সম্মান আর থাকবে না।

ঈশা রেগে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বলল
— আমি তেলাপোকা ভয় পাই। তার মানে এটা না যে আমি ভীতু। আমার সাহস আছে।

ইভান এগিয়ে গেলো ঈশার দিকে। দেয়ালের সাথে আটকে দিলো তাকে। এক আঙ্গুল দিয়ে পুরো মুখে স্লাইড করে গলা বেয়ে নামতেই ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
— কি..কি করছো?

ইভান শান্ত সরে বলল
— কত সাহস সেটা দেখছিলাম।

ঈশা কে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাড়ালো। ঈশা চোখ খুলে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ঠোঁট টিপে হাসছে। একটু কাছে এসে দুই হাতে কলার চেপে ধরে বলল
— তো কি দেখলে?

ইভান সরু চোখে তাকিয়ে বলল
— আমার তো মনে হলো না সাহস আছে।

ঈশা আর একটু কাছে এসে মৃদু সরে বলল
— আমি সাহস দেখালে আবার তুমি যাতে ভয় না পাও!

ইভান ঈশার কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে বলল
— আই অ্যাম ইগার্লি ওয়েটিং ফর দিস!

———————-

নিজের সব কাজ শেষ করে ঈশা ঘরে এসে দেখে ইভান বিছানায় শুয়ে টিভি দেখছে। ঘর একদম অন্ধকার। টিভির সাউন্ড অনেক বেশি। কান পাতানো যাচ্ছে না। ঘরটা সাউন্ড প্রুভ হওয়ায় বাইরে কোন আওয়াজ যাচ্ছে না। টিভির সাউন্ড শুনেই আন্দাজ করা সম্ভব সেখানে কোন মারাত্মক হরর মুভি চলছে। ইভান এর সমস্ত মনোযোগ সেদিকে। ঈশা ওয়াশ রুমে যাওয়ার আগে একটু জোরেই বলল
— সাউন্ড কমাও।

ইভান তার কথা শুনলো না। এমন ভাবে সামনে তাকিয়ে আছে যে তার আশে পাশে আর কিছু আছে সেটা মাথাতেই নেই। ঈশা সোজা ওয়াশ রুমে গেলো। হাত মুখ ধুয়ে বাইরে এসে দেখলো সব কিছু ওভাবেই আছে। কোন কিছুই পরিবর্তন হয়নি। ইভান এর সামনে এসে তুড়ি বাজিয়ে জোরে বলল
— সাউন্ড কমাও না।

ইভান তাকে সরে দিয়ে বলল
— বিরক্ত করোনা তো হরর মুভি দেখছি।

ঈশা বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। বুঝে গেলো কেনো লাভ হবে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিন্তু বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারলো না। কারণ ঈশা হরর মুভি প্রচন্ড ভয় পায়। আর এরকম হরর পরিবেশ মানেই আরো ভয়ংকর। উঠে বসলো। ভীষন আদুরে কণ্ঠে বলল
— এই শোন না!

এতো শব্দের মাঝেই ঈশার এমন আদুরে কথা ইভানের কানে পৌঁছাতেই সে ঘুরে তাকাল। চোখ মুখে অতি বিস্ময়! ঈশা আবারও আদুরে কণ্ঠে বলল
— সাউন্ড টা কমাও না।

ইভান ঈশার দিকে তাকিয়েই সামনে রিমোট দিয়ে সাউন্ড কমায় দিলো। আবারও প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলো। আরো কিছু বলবে কিনা তার অপেক্ষা। ঈশা এবার মৃদু কণ্ঠে বলল
— ওটা বন্ধ করোনা।

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামনে মুখ ফিরিয়ে বলল
— কেনো?

ঈশা অসহায় কণ্ঠে বলল
— আমার ভয় লাগছে। বন্ধ করো না প্লিজ!

ইভান সোজা সাপটা বলল
— বন্ধ হবে না। তোমার না অনেক সাহস।

ঈশা আবারও বলল
— আমি সত্যি ভয় পাচ্ছি।

ইভান তার দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে বলল
— কাছে আসো।

ঈশার রাগ হলো। ইভান জানে ঈশা ভয় পায়। তবুও সে এরকম কেনো করছে। তাই একটু দূরে সরে গেলো। ইভান সামনে তাকিয়েই বলল
— ভয় কমাতে হলে আমার কাছে আসা ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ ওটা বন্ধ হবে না। চয়েজ ইজ ইয়র্স!

ঈশা কোন কথা বলল না। গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকার চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। একটু আবার ভয়ংকর শব্দ হতেই উঠে ইভানের বুকের উপরে শুয়ে পড়লো। ইভান ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছে। এক হাতে ইভানের শার্ট খামচে ধরে আছে। ইভান ঈশা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
— এতো ভয় পাও কেনো আমাকে? আমি কি তোমাকে খেয়ে ফেলি?

ঈশা কোন কিছু না ভেবেই বলল
— যদি খেয়ে ফেলো?

ইভান একটু ভেবে বলল
— তাতে কি। খেয়ে ফেললে কি হবে? আমিই তো।

ঈশা হেসে ফেললো। মাথা উচিয়ে বলল
— তুমি বলে কি সব মাফ?

ইভান একটু চিন্তিত হয়ে বলল
— এমনি তো হওয়ার কথা ছিলো। তুমিই বলো।সব মাফ কিনা?

ঈশা হাসলো।কোন উত্তর দিল না। ইভান ঈশা কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আর এক হাত মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে আছে। কি মনে করে হুট করেই জানালার দিকে তাকাল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা একেবেকে জানালার কাঁচ বেয়ে নিচে পড়ছে। বৃষ্টির বেগ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। ইভান সেদিকে তাকিয়েই বলল
— বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাদে যাবা?

চলবে……..

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৪

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৪

মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে মাঝ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইভানের। চোখ বন্ধ করে পাশে হাত রাখতেই খেয়াল করলো ঈশা বিছনায় নেই। চোখ খুলে বোঝার চেষ্টা করলো। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখল ঈশা জানালার পাশে চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। উদাসিন চোখ আর সাথে খুব যত্ন করে দুই হাতে চেপে ধরা ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ। মাঝে মাঝে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। ইভান ঘুম কাটিয়ে উঠে বসলো। ঈশার দিকে তাকিয়ে ভাবল তখন একটু বেশিই খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেছে। এমনিতেই মেয়েটা কষ্টের মধ্যে আছে। তার উপর ইভান তাকে সময় দিতে পারছে না। নিজের মনের কথা গুলো কাউকে বলতেও পারছে না। কথাটা ভেবেই নিজের উপরে রাগ হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে গেলো ঈশার কাছে। ঈশা খেয়াল করেনি। কফিটা মুখের কাছে নিয়ে যেতেই ইভান হাত ধরে ফেলল। ঈশা ভয় পেয়ে চমকে তাকাল। ইভান কে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি? উঠলে কেন?

ইভান কোন উত্তর না দিয়ে কফির মগটা হাত থেকে নিয়ে চুমুক দিলো। ঈশা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান কফিতে চুমুক দিয়ে মুখ বেকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল
–মিষ্টিটা কম মনে হচ্ছে।

ঈশা চোখ পিটপিট করে তাকাল। ঈশার কাছে তো কম মনে হল না। সে তো নিজে হাতেই কফি বানাল। হুট করেই ইভান একটু ঝুকে ঈশার গালে এক হাত রাখল। মুখটা একটু উচু করে ঠোটে গাড় চুমু খেলো। একটু সরে গিয়ে জিভ দিয়ে নিজের ঠোট ভিজিয়ে বলল
–নাহ! ঠিক আছে। কফিটাই অনেক স্ট্রং। মাঝ রাতে এতো স্ট্রং কফি খাওয়ার কি দরকার?

বলেই কাপটা নিয়ে সোজা ওয়াশ রুমের দিকে গেলো। দরজা খুলে বেসিনে পুরো কাপটা উল্টে দিলো। ঈশা হা করে তাকিয়ে আছে। মাঝ রাতে হুট করে এমন অপ্রত্ত্যাশিত ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিল না সে। তাই বুঝতে একটু সময় লেগে গেলো। বসেই থা্কল চেয়ারে। ইভান বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ করেই বলল
–৩০ সেকেন্ডের মধ্যে বিছানায় না আসলে কিন্তু সারা রাত আর ঘুমাতে হবে না।

ঈশা আর কিছু ভাবতে পারলো না। এমন কড়া হুমকির মাঝে ভাবার সময়টাও পেলনা। উঠে বিছানায় যেতে যেতে ভাবল এটা আবার কোন সময় হল। ২ মিনিট দিতে পারত। একটু হাত মুখ ধুয়ে আসত। বিরক্তি নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরল। সোজা হয়ে ভাবছে। ইভান পাশ ফিরে ঈশার কাছাকাছি এসে এক হাতে কোমর জড়িয়ে ধরল। শীতল হাত শাড়ির ভাজ গলিয়ে স্পর্শ করতেই ঈশা কেপে উঠলো। গলায় মুখ ডুবাল ইভান। আদুরে কণ্ঠে বলল
–সরি। তখন ওভাবে বলতে চাইনি। রাগ হয়েছিলো। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিনি।

ইভানের এমন আদুরে কথা শুনে ঈশার মন হালকা হয়ে গেলো। ঈশা হেসে ইভানের মাথায় হাত রাখল। ইভান মুখটা তুলে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–মন ভালো হয়েছে নাকি আরও ভালো করে দিতে হবে?

ঈশা চোখ বন্ধ করে লাজুক হাসল। ইভান অন্ধকারেও ঈশার সেই লাজুক হাসির মায়ায় হারিয়ে গেলো। কোন ভাবেই এই মায়া থেকে নিস্তার পাওয়া সম্ভব না। আরও যেন গভির ভাবে জাপটে ধরল সেই মায়া। মনের গভিরে জমে থাকা অনুভুতি হুট করেই বাধন হারা হয়ে গেলো। সাথে হাতের স্পর্শও অবাধ্য হয়ে উঠলো নিমেষেই।

————–
ঈশা সকাল সকাল উঠে গেলেও ইভান এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। ঈশা বুঝে গেলো রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য এখনও ঘুম ভাংছে না। কিন্তু তার তো বাইরে কাজে যাওয়ার কথা। তাই ঈশা ঘরে গেলো ডাকতে। বিছানায় বসে ইভানকে দেখল কিছুক্ষন। ডাকবে কিনা বুঝতে পারছে না। একটু ভেবে আলতো হাত মাথায় রাখতেই ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা নরম সরে বলল
–এখনও উঠছ না যে? আজ কোন কাজ নেই?

ইভান পাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে ধরে বলল
–আজ কোথাও যাব না। ভালো লাগছে না।

ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–কেন শরীর খারাপ? কি হয়েছে?

ইভান চোখ বন্ধ করেই বলল
–কিছু না। এমনিতেই বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে না। বাসাতেই থাকব।

ঈশা মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ঘুমাতে চাইলে খেয়ে আবার ঘুমাও। এখন উঠ।

ইভান ঈশার দিকে তাকাল। মৃদু সরে বলল
–একটু পরে উঠি?

ঈশা মৃদু হেসে নাড়ল। উঠে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। দরজার কাছে যেতেই ইভান ডাকল।
–ঈশা।

থেমে গেলো। ইভান উঠে ঈশার সামনে এসে দাঁড়াল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে নিলো। গভির ভাবে তাকিয়ে চুলের খোপাটা খুলে দিলো আচমকা। এমন হওয়াতে ঈশা একটু বিরক্ত হল। এখন সে রান্না ঘরে কাজ করবে। আর খোলা চুল গুলো বিরক্ত করবে। কিন্তু ইভান সেটার তোয়াক্কা না করে বলল
–খোলাই থাক।

ঈশা বিরক্ত হলেও কোন কথা বলল না। মৃদু হাসল। ইভান একটু হেসে ওয়াশ রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। ঈশা রান্না ঘরে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে বাইরে চলে গেলো। গিয়েই দেখল ইলু ইরিনা আর ইফতি বসে আড্ডা দিচ্ছে। ইভান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–কি রে তোরা এতো সকাল সকাল?

ইলু বলল
–আমরা সকাল সকাল না। তুমি উঠতে লেইট করেছ।

ইভান বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল। ইভান কে খাবার দিয়ে ঈশা রান্না ঘরে চলে গেলো চা বানাতে। সবার জন্য চা বানাচ্ছে। ছেড়ে রাখা চুল গুলো প্রচণ্ড বিরক্ত করছিল। কাজের ফাকে ইভানের কথা ভুলে গিয়ে আনমনেই খোপা বেধে নিলো। চা বানানো শেষে কাপে ঢেলে এনে টেবিলে বসল। সবার হাতে কাপ দিয়ে নিজের কাপটা নিয়ে বসে পড়ল। ইভান নিজের মতো খেয়েই যাচ্ছে। ঈশা চায়ের কাপটা মুখের সামনে ধরতেই ইরিনা প্রশ্নবিদ্ধ কণ্ঠে বলল
–ঈশা তোর গলায় ওটা কিসের দাগ?

কথাটা কানে আসতেই ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঈশার দিকে না তাকিয়েও বুঝে গেলো সে আবার খোপা বেধেছে। চোখ খুলে স্বাভাবিক ভাবে খাবার মুখে দিলো ইভান। প্রচণ্ড অসস্তির মধ্যে পড়ে গেলো সে। এই অবস্থায় ঠিক কি করা বা বলা উচিৎ বুঝতে পারলো না। মাথা নামিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে খেয়ে যাচ্ছে। ঈশা কিছু না বুঝেই ভ্রু কুচকে সবার দিকে তাকাল। ইফতি মনোযোগ দিয়ে দেখে বলল
–ভাবি আপু তুমি কি কোনভাবে ব্যথা পেয়েছ গলায়?

কথাটা বোধগম্য হতেই ঈশাকে প্রচণ্ড অসস্তি ঘিরে ধরল। আড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান খুব স্বাভাবিক। এখানে কোন কথা হচ্ছে সেটাও সে শুনতে পাচ্ছে না এমন ভাব। ঈশা প্রচণ্ড লজ্জায় পড়ে গেলো। ইভানের উপরে খুব রাগ হল তার। ইরিনা এবার পুরো বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজের করা বোকামির জন্য লজ্জা পেলো। মুখ ফিরিয়ে ইলুর দিকে তাকাতেই দেখল ঠোট চেপে হাসছে। ইরিনাও নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলো না। ঈশা তাদেরকে এভাবে হাসতে দেখে লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে ইভানের ফোন বেজে উঠলে সে সস্তির নিশ্বাস ফেলে ফোনটা নিয়ে উঠে গেলো। কারন বুঝতেই পারছে এখানে এখন কি হবে। থাকা মানেই তার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে। অনেকক্ষণ পর কথা শেষ করে ইভান টেবিলে এসে বসলো। ঈশা একা বসে আছে। আশে পাশে এখন কেউ নেই। ইভান চেয়ারে বসে দেখল ঈশা প্রচণ্ড অসস্তি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। মুচকি হেসে বলল
–সবাই কই গেলো?

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান চোখ ফিরিয়ে খাবারের দিকে মনোযোগ দিলো। নিজের মুখে খাবার দিয়ে আবার খাবার তুলে ঈশার মুখের সামনে ধরল। ঈশা মুখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান হেসে বলল
–মান সম্মানের যা ফালুদা বানানোর ছিল বানানো শেষ। এখন খাবারের উপরে রাগ দেখিয়ে কি লাভ। খাবারের আর কি দোষ।

বলেই ঈশার মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল
–আমাকে রাগ দেখানোর কি আছে? আমার কি দোষ? আমি কি ইচ্ছা করে করেছি নাকি?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তার ঠোটের কোনে লেগে থাকা খাবার মুছে দিতে দিতে বলল
–আমার কি দোষ বল। চুল বাধতে নিষেধ করেছিলাম। আমার কথা না শুনলে এমনি হবে।

ঈশা ঝাঝাল গলায় বলল
–স্পষ্ট করে কথা বলতে পারনা? অর্ধেক কথা বল কেন সব সময়? ভালো করে বললে কি আমি চুল বাধতাম?

ইভান খাবারে মনোযোগ দিয়ে বলল
–পারি। কিন্তু বলতে ইচ্ছা করেনা।

ইভানের এমন হেয়ালিপূর্ণ কথা শুনে ঈশা রাগে গজগজ করতে করতে উঠে ঘরে চলে গেলো। ইভান হেসে ফেলল।

—————
সন্ধ্যার পরে ইভান একটু বাইরে গেছে। ছোট কি যেন কাজ আছে। যাওয়ার সময় বলে গেছে তাড়াতাড়ি আসবে। ঈশা শুয়েছিল একটু। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি। ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলো। কেমন এলোমেলো লাগছে। কাজল গুলো চোখের নিচে লেপটে গেছে। ওয়াশ রুমের দরজা খোলা রেখেই আঁচলের কোনা দিয়ে চোখের নিচে লেপটে থাকা কাজল ডলে ডলে মুছার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিক মতো উঠছে না। চোখের নিচেটা কালো হয়ে যাচ্ছে। ঘষে ঘষে চামড়া তুলে ফেলার মতো অবস্থা করে ফেলেছে। ইভান অনেক আগেই এসেছে বাসায়। চুপচাপ ঈশার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি করতে চাইছে। এক সময় এগিয়ে গিয়ে ঈশাকে নিজের দিকে ঘুরে ভ্রু কুচকে তাকাল। ঈশা চমকে উঠে বলল
–কি করছ?

ইভান নিজের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে নিলো। ঈশার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই ঈশা পিছিয়ে বেসিনের উপরে ঝুকে গেলো। ইভান কোমর জড়িয়ে ঈশাকে নিজের কাছে এনে টিস্যু ভিজিয়ে নিয়ে আলতো করে মুছে দিলো। ঈশা চুপচাপ তাকিয়ে আছে। ভেজা টিস্যু দিয়ে পুরো মুখটা মুছে দিয়ে বলল
–হয়েছে।

ঈশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে গেলো। আয়নায় ভালো করে দেখে নিয়ে বলল
–কিভাবে হল?

ইভান হেসে ফেলল। ঈশা আয়নায় ইভানের দিকে তাকাল। সেদিকে তাকিয়েই বলল
–হাসার কি হল? আমি কখন থেকে চেষ্টা করছিলাম মুছে ফেলতে। কিছুতেই পারছিলাম না।

ইভান বেসিনের উপরে দুই হাত রেখে ঈশাকে আটকে দিলো। ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল
–সব কিছু কি সবাইকে দিয়ে হয় ঈশা পাখি। কিছু কিছু বিষয়ে স্পেশাল কাউকে লাগে। তোমার সেই স্পেশাল মানুষটা আমি।

ঈশা হাসল। মৃদু সরে বলল
–সত্যিই তাই।

চোখ নামাতেই ইভানের ডান হাতে চোখ পড়ল। কেটে গেছে কোন ভাবে। রক্ত জমাট বেধে আছে। ঈশা হাত ধরে বিচলিত হয়ে বলল
–কিভাবে কাটল?

ইভান সেদিকে তাকাল। কিভাবে কাটল আসলে সেও খেয়াল করেনি। কোন ভাবে হয়তো কেটে গেছে। বলল
–জানিনা।

ঈশা ইভানের দিকে ঘুরে বলল
–জাননা মানে কি? কিভাবে কেটেছে সেটাও জাননা?

ইভান নিশ্বাস ছেড়ে বলল
–কেটেছে কোন ভাবে খেয়াল করিনি। তেমন কিছুই না।

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল
–তেমন কিছু না তাই না? কিভাবে কেটেছে সেটাও জাননা। কোথায় থাকে মন?

ইভান মুচকি হেসে ঈশাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে বলল
–এখানে থাকে।। বাকি কিছুর তো খেয়াল থাকে না।

ঈশা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে ডেটল নিয়ে ইভানের হাতে আলতো করে লাগিয়ে দিলো। ইভান ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভান কে ঠিক করে দিয়ে বলল
–ফ্রেশ হয়ে এস। খাবো।

বলেই পা বাড়াতেই ইভান হাত ধরে আটকে দিলো। যত্ন করে কপালে চুমু দিয়ে বলল
–আসছি। যাও।

ঈশা সোজা রান্না ঘরে চলে গেলো। ইভান ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই রান্না ঘর থেকে ঈশার চিৎকার কানে এলো। শুন্য মস্তিষ্কে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে সেদিকে দৌড় দিলো।

চলবে………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২৩

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২৩

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। অসময়ের বৃষ্টিতে প্যাচ প্যচে কাদাময় বাইরে। বেশ বিরক্তিকর একটা পরিবেশ। বাইরে বের হওয়ার কোন উপায় নেই। মনে হচ্ছে সারাদিন আজ বৃষ্টি থামবে না। ইভানও আজ সারাদিন বাসায়। এই বৃষ্টির দিনে ঘুম থেকে উঠেছে দেরি করে। কোন কাজ নেই তাই সামনে টিভি চালিয়ে দিয়ে গল্পের বই পড়ছে। আর এইদিকে বউ শাশুড়ি মিলে রান্না ঘরে ব্যস্ত। আজ খিচুড়ি আর ভাজি রান্না হবে। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি ভাজি বেশ মজাদার একটা খাবার। দুজনে মিলে রান্নায় মেতে উঠেছে। এমন সময় ইভানের মায়ের ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে তিনি ঈশাকে বললেন
–ভাজিটা একটু দেখ তো মা। আমি একটু কথা বলি।

ঈশা মাথা নেড়ে ভাজি নাড়তে শুরু করলো। ইভানের মা ফোনে কথা বলছেন। কার সাথে কথা বলছে ঈশা ঠিক বুঝতে পারছে না। আর বুঝতেও চাইছে না। সে তার কাজে ব্যস্ত। বেশ কিছুদিন পার হয়েছে বিয়ের। ঈশা নিজের মতো সংসারের দায়িত্ব গুছিয়ে নিয়েছে অনেকটা। আনমনে রান্না করছিল ঈশা। কিন্তু এর মাঝেই অস্পষ্ট কথা তার কানে আসলো। ইভানের মা বেশ উতফুল্যের সাথে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটাকে বলছেন
–সবে তো বিয়ে হল। কিছুদিন যাক। নিজেদেরকে একটু গুছিয়ে নিক। তারপর না হয় বাচ্চা নিয়ে ভাববে।

কথাটা কানে আসতেই ঈশার চাপা কষ্টটা আচমকাই নড়েচড়ে উঠলো। থমকে গেলো কেমন সব কিছু। চোখ ভরে এলো। ইভানের মা কথা শেষ করে রান্না ঘরে আসতেই ঈশা নিজের চোখের পানি লুকিয়ে ফেলল। ইভানের মা ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–যা মা গোসল করে নে। আমি এটা শেষ করে যাচ্ছি।

ঈশা কোন কথা বলল না। মাথা নেড়ে চলে গেলো উপরে। ছলছল চোখে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ঘরের দরজার সামনে এসে নিজের চোখের পানিটা লুকিয়ে ফেলল। দ্রুত ঘরে ঢুকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ওয়াশ রুমে গিয়ে নিজের ইচ্ছা মতো কাদল। এতদিনে ইভানের কাছে থাকতে থাকতে সে এই বিষয়টা ভুলেই গিয়েছিলো। ইভানের মায়ের কথা শুনে আবার কষ্টটা নতুন করে গাড় হয়ে উঠলো। এলোমেলো লাগছে সব কিছু। সবাই যখন জানতে পারবে তখন কি হবে। কিভাবে নিবে এসব ভাবতেই আবারো চোখের পানি ছেড়ে দিলো ঈশা। অনেকটা সময় পর ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এলো। বের হয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতেই ইভান কে বলল
–যাও তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো।

ইভান বই থেকে চোখ তুলে তাকাল ঈশার দিকে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। পিছন ফিরে আছে। ইভান সন্দিহান কণ্ঠে বলল
–কি হয়েছে?

ঈশা থেমে গেলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল
–কি হবে?

ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বইটা বন্ধ করে বলল
–সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।

ঈশা হেসে বলল
–কিছু হয়নি তো।

কাছে এসে ইভানের হাত ধরে ওয়াশ রুমের ভিতরে ঢুকে দিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি বের হবে কিন্তু। খুদা পাইছে।

ইভান কোন কথা বলল না। কিন্তু সবই বুঝল। ওয়াশ রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল।

—————
পশ্চিম আকাশে এলোমেলো ভাবে মেঘের বিচরণ। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির পরে গোধূলি বেলায় একটু ছাড় দিয়েছে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা হাওয়াটা গায়ে এসে লাগছে। বৃষ্টির ছোঁয়ায় প্রকৃতি কেমন প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে। ঈশা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শেষ বেলার সেই প্রকৃতির দর্শন করতে উঠেছে ছাদে। দৃষ্টি তার আকাশের দিকে স্থির। কিন্তু এসব কিছুই তার মন ছুঁতে পারছে না। এতদিনে বেমালুম ভুলে যাওয়া কষ্টটা আবার নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তার সাথেই কেন এমন হল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে যখন সবাই এসব নিয়ে কথা বলবে তখন ঠিক কি হবে? সবার মনে একটা অপ্রাপ্তি থেকে যাবে। সমাজে কতজন কত কথা বলবে। এসব ভাবতেই আবারো চোখ ভরে উঠলো।
–মন খারাপ?

রেলিঙ্গের উপরে পা তুলে বসতে বসতে বলল ইভান। গভির ভাবনায় ডুবে থাকলেও তার গলা শুনে ঈশা একটুও চমকাল না। যেন সে জানতো ইভান এখন আসবে। পিট পিট করে চোখের পানি লুকিয়ে সামনে তাকিয়েই বলল
–না তো। মন খারাপ হওয়ার কোন কারন আছে কি?

ইভান মুখে হাসির রেশ টেনে বলল
–আছে না কত কারন। হয়তো আমাকে মিস করছ।

ঈশা পাশ ফিরে সরু চোখে তাকাল। পুরোটা ঘুরে ইভানের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে বলল
–তুমি আজ সারাদিন বাসায় আছ। মিস করবো কেন? সামনে থাকলে কি কেউ মিস করে।

ইভান হাসল। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–তার মানে আমি জখন থাকিনা তখন মিস করো।

ঈশা কথা বলল না। আবার ঘুরে দাঁড়ালো। সামনে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। ইভান আবারো বলল
–কই বল না তো।

ঈশা সামনে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
–বললে কি হতো?

ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–বললে ছুটে চলে আসতাম তোমার কাছে।

ঈশা মৃদু হেসে কণ্ঠে হালকা অভিমান রেখে বলল
–তোমার তো কত কাজ। সেসব ফেলে কি আসতে?

রেলিঙ্গের উপরে রাখা ঈশার হাতটা ধরে সেটাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। ঈশা ফিরে তাকাল ইভানের দিকে। ইভান আবেগি কণ্ঠে বলল
–কিছু অনুভব করতে পারো?

ঈশা অবুঝের মতো চেয়ে থাকলো। ইভান আবারো বলল
–আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন এই তুমিটাকে ছাড়া আমি যে অপূর্ণ। বেচে থাকার জন্য আমার এই তুমিটাকে দরকার। তোমার মাঝেই আমার সব পূর্ণতা। তুমি থাকলে আমার আর কিছুই লাগবে না। আমার জীবনে যত কিছুই থাক তোমার থেকে কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখনি মিস করবে আমাকে ডাকবে আমি চলে আসব। প্রমিস।

ঈশা হেসে ফেলল। এতো মন খারাপের মাঝেও এভাবে তৃপ্তি নিয়ে হাসার কারণটা নিজের কাছেই বোধগম্য হলনা তার। হঠাৎ করেই মনের কাল মেঘটা সরে গিয়ে এক ফালি রোদ্দুর উকি দিলো মনে হচ্ছে। হাতটা আরও গভির ভাবে ইভানের বুকে স্পর্শ করে বলল
–মিস করি কিনা জানিনা। তবে আমি খুব বেশী বিরক্ত করতে পারি। যখন তখন ফোন করে আসতে বলবো। তখন কিন্তু বিরক্ত হওয়া যাবে না।

ইভান ঠোট চেপে হেসে বলল
–আমাকে আবার যে যত কিছু দেয় আমি তাকে তার অনেক গুন ফেরত দেই। আমাকে যত বিরক্ত করবে আমি তার কয়েক গুন ফেরত দিবো।
ঈশা বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। ইভান হেসে ফেলল।

—————
কয়দিন যাবত ইভান খুব ব্যস্ত। প্রতিদিন প্রায় সকাল বেলা বাসা থেকে বের হয় একদম রাতের বেলা আসে। ঈশাকেও ঠিক মতো সময় দিতে পারছে না। আজও কিছু জরুরী কাজ ছিল তার। সেগুলো সম্পন্ন করে সোজা হসপিটালে গেলো ইলহামের কাছে। ইলহাম নিজের কাজে ব্যস্ত তাই ইভান বসে অপেক্ষা করছে তার রুমে। কিছুক্ষনের মধ্যে হন্তদন্ত করে রুমে ঢুকেই ইভান কে বলল
–সরি রে। কাজ শেষ করতে একটু দেরি হয়ে গেলো। অনেক্ষন অপেক্ষা করেছিস।

ইভান একটু হেসে বলল
–অজথা কেন ফর্মালিটি করছ? আমি বেশিক্ষন অপেক্ষা করিনি।

ইলহাম চেয়ারে বসতে বসতে বলল
–বস। বল কি খাবি?

ইভান সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বলল
–চা খাবো।

–শুধু চা?

ইভান হেসে বলল
–আপাতত শুধুই চা।

–তারপর বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে?

ইলহামের প্রশ্ন শুনে ইভান হাসল। হাসি মুখে রেখেই বলল
–যেমন কাটার কথা ছিল। ঈশার মধ্যে এখনও বাচ্চামি ভাবটা আছেই। ম্যাচিউর হতে একটু সময় লাগবে।

ইভানের কথা শেষ হতেই ইলহাম বলল
–ইভান আমি ঈশার রিপোর্ট গুলো সবটা দেখেছি। ঈশার মেইন প্রবলেম হল ওর ইউট্রাসে অসংখ্য সিস্ট আছে। যার কারনেই ওর ইউট্রাস অনেক উইক। আর এই অবস্থায় কোন ভাবেই কন্সিভ করা পসিবল না।

ইভান মনোযোগ দিয়ে শুনল ইলহামের কথা। তারপর শান্ত গলায় বলল
–এর কি কোন ট্রিটমেন্ট নেই ভাইয়া?

ইলহাম একটু হতাশ গলায় বলল
–আছে। কিন্তু এটা বলা যায়না যে একদম সুস্থ হয়ে যাবে। সিস্ট গুলো এখনি তেমন কোন ক্ষতি না করলেও ছোট ছোট কিছু শারীরিক সমস্যা হবে। আর যত দিন যাবে ওগুলো তত বাড়তে থাকবে। তাই ট্রিটমেন্ট তো অবশ্যই শুরু করতে হবে। কিন্তু এই ট্রিটমেন্ট অনেক লম্বা সময় ধরে চলবে। সব থেকে বড় কথা হল ট্রিটমেন্ট করার পরে আমরা সিস্ট গুলো নিয়ন্ত্রনে আনতে পারলেও কন্সিভ করার ক্ষমতাটা ঈশার মধ্যে তৈরি হবে কিনা সেটা বলা সম্ভব না। চান্সও খুবই কম। বলতে গেলে নেই।

ইভান শান্ত ভাবে বলল
–আমার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। আসলে প্রবলেমটা ঈশার। কে কি ভাবল। কি বলল। এসবের কারনে ইদানিং খুব বেশী মেন্টালি স্ট্রেচড থাকে। ওর মেন্টাল স্ট্রেস কমানোর জন্যই আমি আসলে খুব তাড়াতাড়ি ট্রিটমেন্ট শুরু করতে চাই। পরে কি হবে সেটা পরের কথা। কিন্তু আপাতত মনের মধ্যে একটা শান্তি থাকবে যে ট্রিটমেন্ট চলছে। কিছু একটা রেজাল্ট আসবে তো।

ইলহাম সম্মতি জানালো। ইভান একটু ভেবে বলল
–আমি এখনি ঈশাকে কিছু বলতে চাচ্ছিনা ভাইয়া। তুমি সব কিছু ব্যবস্থা করো। তারপর জানাবো। আর হ্যা তুমি শুধু একটা বিষয় খেয়াল রেখো ঈশা এই ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে যা জানবে সবটাই যেন পজিটিভ হয়। আমি ঈশাকে কোন রকম ডিপ্রেশনের মধ্যে দেখতে চাই না।

ইলহাম মাথা নাড়ল। ইভান কথা শেষ করে বাসার উদ্দেশ্যে বের হল। সারা রাস্তা একটা বিষয় নিয়ে ভাবছে। নিজের কাজের কারনে মাঝে মাঝেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। ঠিক মতো সময় দিতে পারেনা ঈশাকে। আর ঈশাও একা একা শুধু এসব নিয়েই ভাবে। এরকম চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে যাবে। ঈশাকে এই ডিপ্রেশন থেকে বের করতেই হবে। ভাবতে ভাবতে বাসায় পৌঁছে গেলো।

ইভান বাইরে থেকে এসে সোজা ঘরে গেলো। সারা বাড়ি নিস্তব্ধ। সে আজ আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছে। ঈশা শুয়েছে কিনা সেটা ভেবেই ঘরের দরজাটা আসতে করে খুলল। কিন্তু ঈশাকে ঘরে কোথাও দেখতে পেলো না। একটু ভিতরে ঢুকে দেখল বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ঈশার এরকম আচরন ইভানের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। ঈশার কারনে সেও ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। শব্দ শুনে ঈশা ঘরে এসে ইভান কে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–এতো দেরি করলে যে?

ইভান পকেট থেকে ফোনটা বের করে সেটার দিকে তাকিয়ে মৃদু সরে বলল
–কাজ ছিল।

ঈশা একটু অভিমানী সুরে বলল
–এখন তো তুমি অনেক ব্যস্ত। সব সময় কাজে ব্যস্ত থাক। রাতেও দেরি করে আসো। এভাবে চলতে থাকলে দুইদিন পর তোমার সাথে কথা বলতেও এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখতে হবে।

ঈশার এমন কথা শুনে ইভানের মেজাজ আচমকাই খারাপ হয়ে গেলো। খুব কষ্টে নিজের রাগটা সংবরন করে হাতের ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলল
–ব্যস্ত মানুষের বউদের ধৈর্যটা একটু বেশী থাকতে হয়। এতো অল্পতেই অধৈর্য হয়ে পড়লে চলে না।

ঈশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–বউ আছে সেটা মনে আছে তাহলে।

ইভান এবার ঘুরে তাকাল। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–ভুলে যাওয়ার মতো কিছু হয়নি। সকালে বাইরে যাওয়ার সময় দেখি। রাতে বাইরে থেকে এসে দেখি। যখন বাসায় থাকি তখনও দেখি। নিজের মতো ভাই বোনদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মত্ত। বাড়ির সবার খেয়াল রাখায় ব্যস্ত। এতো বড় একটা সংসার সামলায়। সারা বাড়ির কাজে এদিক সেদিক ছুটে বেড়ায়। কখনও নিজের জন্য ব্যস্ত। কখনও সংসারের কাজে ব্যস্ত। এই তো। এতো কিছু চোখে পড়লে কি আর ভুলে যাওয়া সম্ভব।

ঈশা মনোযোগ দিয়ে শুনল কথা গুলো। কথার ধরনটা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। ঈশার কোথাও চরম ভাবে আঘাত করলো। ইভান কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ঘুরে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–এসব কথা বলার মানেটা কি জানতে পারি?

ইভান ওয়াশ রুমের দরজা ঠেলে খুলে বলল
–আমি এতো কঠিন কথা বলি জানতাম না তো। আমার তো এতদিন মনে হতো আমি খুব সহজ স্বাভাবিক একটা মানুষ। কিন্তু এখন দেখছি আমার মধ্যে অনেক জটিলতা আছে।

চলবে…………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২২

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২২

কোন এক তামিল সিনেমার মারামারির দৃশ্য চলছে টেলিভিশনে। সেদিকে না তাকিয়েও শব্দ শুনে বিষয়টা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ঈশা ইভানের দুই হাতের মাঝে আটকে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে তার চোখে মুখে ছড়িয়ে যাওয়া ইভানের উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করছে। এই উষ্ণতা সামলাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই উষ্ণতার তেজ তার ভিতরে পর্যন্ত পৌঁছে সবকিছু জালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। ইভান মাথার কাছ থেকে এক হাত সরিয়ে কোমরের কাছাকাছি আনতেই ঈশা চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। ইভান আলতো করে দরজার লকটা টিপে দিলো। ঈশা শব্দ শুনে চোখ খুলে সেদিকে তাকাল। আবার হাত উঠাতেই ঈশা আবারো চোখ বন্ধ করে ফেলল। এবার ইভান পাশের দেয়ালের সুইচ বোর্ডে হাত দিয়ে লাইটের সুইচটা অফ করে দিলো। ঈশা আবারো চোখ খুলে ফেলল। ইভান আর একটু কাছে আসতেই ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–আ…আমার ঘুম পাচ্ছে।

ইভান ভ্রু কুচকে ফেলল। গম্ভির সরে বলল
–পাইলেও কিছু করার নাই। ঘুমানো তো যাবে না।

ঈশা এদিক সেদিক অস্থির দৃষ্টি ফেলে অসহায় কণ্ঠে বলল
–কেন যাবেনা?

ইভান একটু সরে দাঁড়ালো। কিন্তু হাত সরাল না। স্বাভাবিক ভাবে বলল
–বাসর রাতে কেউ ঘুমায় না। তাই ঘুমানো যাবে না।

–মানে?

ঈশার সরল প্রশ্নের উত্তরে ইভান সোজা সাপটা বলল
–তুমি আমাকে যতটা ভদ্র ছেলে ভাব আমি আসলেই ততোটা ভদ্র না। এতদিন ভদ্রতা দেখাতে চেয়েছি তাই দেখেছ। কিন্তু এখন আর ভদ্রতা দেখায়ে কি হবে বল। নিজেরি ক্ষতি।

ঈশা ভয় পেয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইভান হাত উঠিয়ে ঈশার সামনের চুলগুলো কানের পিছনের গুজে দিয়ে বলল
–ভয় পাচ্ছ?

ঈশা হ্যা বলবে কি না সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না। কি একটু ভেবে অনুনয়ের সুরে বলল
–আমি কি একটু বিছানায় বসতে পারি? আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।

ইভান নিশব্দে হাসল। ঈশার অবস্থা সে বুঝতে পারছে। কিন্তু ঈশা তার হাসি দেখতে পেলো না। সে ঈশাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো বিছানায়। বসিয়ে দিয়ে পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। ঈশা সেটা হাতে নিয়ে সব পানি এক নিশ্বাসেই শেষ করে ফেলল। ইভান পাশে বসে আবার হেলানি দিলো বিছানায়। গম্ভির গলায় বলল
–শুয়ে পড়।

ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। আর দেরি না করে শুয়ে পড়ল। ঈশা ভালভাবে শুয়ে পড়তেই ইভান টিভির দিকে তাকিয়ে গম্ভির ভাবে বলল
–বলেছিলাম যে সম্পর্কটা এগিয়ে নিতে সময় প্রয়োজন। আমার কথা তখন মাথায় না ঢুকলেও এখন মাথায় ঢুকেছে নিশ্চয়?

ঈশা পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। ইভানের কথা শুনে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাল না। কেমন অসস্তি হচ্ছে। মনের আবেগটা তীব্র হলেও জড়তাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর উঠবেই বা কিভাবে সেরকম সুযোগ হয়নি তো। ইভান দেয় নি বা পায়নি সে যাই হোক। তাদের সম্পর্ক কোন কালেই স্বাভাবিক কোন প্রেমিক প্রেমিকার মতো ছিল না। তারা কখনই একে অপরের সাথে আলাদা ভাবে সময় কাটায় নি। নিজেদের মধ্যে অনুভুতির আদান প্রদান করেনি। সেরকম কোন কথা তাদের মধ্যে হয়ে উঠেনি। ঈশা মনে মনে ভাবল ‘ইভান ঠিকই বলেছিল। যখন বুঝতে পারবে তখন মনে হবে সত্যিই সময় প্রয়োজন ছিল।’ ইভান আবারো বলল
–কি ম্যাডাম? আমি কিছু বললাম। আমার কথা কি মাথায় ঢুকেছে?

ঈশা পাশ না ফিরেই কাপা কাপা গলায় বলল
–বি…বিয়ের পরেও তো সময় দেয়া যায়।

ইভান হেসে ফেলল। সে ঈশার কাছ থেকে এরকমি কিছু আশা করেছিলো। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা যে এমন কথা বলবে সেটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। এতো কিছু তো ছিল শুধু ঈশাকে বিষয়টা বোঝাতে। ইভান মৃদু হেসে বলল
–যায় তো।

ঈশা কোন কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষন ধরেই ঈশা নড়াচড়া করছে। তার ঘুম আসছে না। নতুন বিছানা। তার উপরে আবার পাশে ইভান শুয়ে আছে। সারা শরীর অসস্তিতে কাটা দিয়ে উঠছে। ঈশা ঘুমায়নি বুঝতে পেরে ইভান বলল
–অসুবিধা হচ্ছে? টিভি অফ করে দিবো?

ঈশা মৃদু সরে ‘না’ বলল। ইভান খানিকবাদেই টিভি অফ করে নিজেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু এভাবে কি আর ঘুমানো সম্ভব? ঈশার শরীরের ঘ্রান ইভানের সব কিছু কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে। কাঙ্খিত মানুষটার পাশে শুয়ে এভাবে ঘুমানো একেবারেই অসম্ভব। সুপ্ত অনুভুতি গুলো ধারালো হয়ে যাচ্ছে। তার মাঝেও অসস্তি কাজ করছে। কিছুক্ষন এপাশ অপাশ করে উঠে বসলো। একবার ঘাড় ফিরে দেখল। ঈশা ঘুমাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। উঠে সোফায় গিয়ে বসলো। সেখান থেকেই খোলা জানালা দিয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোয় ঈশাকে দেখল কিছুক্ষন। ঈশা উলটা দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। সেই দৃশ্য দেখেই ইভানের চোখ জুরিয়ে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেলো। এতো বছরের সেই অপেক্ষার অবশান হল। ঠোটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ঈশার দিকে তাকিয়েই সোফায় শুয়ে পড়ল। ঈশাকেই নিস্পলক দেখে যাচ্ছে সে। কি অদ্ভুত এক প্রশান্তি মনে। মুহূর্তেই কত কিছু বদলে গেলো। এভাবে নিজের প্রিয়তমাকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ল বুঝতে পারলো না।

———–
খোলা জানালার পর্দাটা সরানো। বেশ আলো ঢুকছে ঘরে। খুব একটা বেলা গড়ায় নি। তবুও যেন মনে হচ্ছে অনেক বেলা হয়েছে। আলোর দাপটে সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখ নিয়ে উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে কোথায় আছে সেটা বুঝতেই কিছুটা সময় পার হয়ে গেলো ঈশার। ঘাড়টা ব্যথা করছে। সারা রাত একদিকে শুয়ে ছিল তাই। হাই তুলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পাশ ফিরতেই দেখল ইভান নাই। এতো সকালে তো ইভানের উঠার কথা ছিল না। কই গেলো? একটু ভেবে নিচে নামলো। কুচকান শাড়ীটা টেনে ঠিক করে নিলো। আধ খোলা চুল গুলো ভালো করে বেধে নিলো। উপরের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ইভান সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ঈশা ভ্রু কুচকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর সত্যি সত্যি বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই একটু এগিয়ে গেলো সোফার দিকে। একটু ঝুকে ভালো করে ইভান কে দেখে নিলো। গভির ঘুমে আছে। কিন্তু ইভান তো বিছানায় শুয়েছিল রাতে। আর সেটা ভেবেই ঈশা একদম নড়াচড়া করেনি। ঈশার ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করার অভ্যেস আছে। চুপচাপ সে কিছুতেই ঘুমাতে পারেনা। কিন্তু একি বিছানায় শুয়ে এভাবে নড়াচড়া করলে ইভানের ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবেই সে নড়ার সাহস পায়নি। কিন্তু ইভান সোফায় আসলো কিভাবে? ঘুমের মধ্যে আবার হাটার অভ্যেস নাই তো? ঈশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বেশ বিরক্ত নিয়ে বিড়বিড় করে বলল
–সোফাতেই যদি ঘুমায় তাহলে আগেই ঘুমাত। আমিও একটু শান্তিতে নড়েচড়ে ঘুমাতে পারতাম। এক পাশে শুয়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।

বিরক্ত নিয়ে আলমারির সামনে দাঁড়ালো। ইরিনা আর ইলু মিলে কাল অল্প কিছু কাপড় এনে আলমারি গুছিয়ে দিয়েছে। চারিদিকে দেখল। কিন্তু কোনটা পরবে বুঝতে পারছে না। অনেক সময় নিয়ে ভেবে বের করলো সে এখন থেকে শুধু শাড়ি পরবে। বাড়ির বড় বউ বলে কথা। তার কাছে তেমন শাড়ি নেই। মায়ের সব শাড়ি নিয়ে আসবে। কিন্তু অন্য কিছু পরবে না। অল্প কয়টা শাড়ির মধ্যে থেকে একটা সবুজ সুতির শাড়ি খুজে বের করলো। সেটা নিয়েই ওয়াশ রুমে গেলো। বেশ লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে এলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছে। খুটখাট আওয়াজে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। প্রচণ্ড রকমের বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে ফেলল। খুব একটা গাড় ঘুম হয়নি তার। কাল রাতের সব কথাই মনে আছে। তাই এই শব্দের পিছনে যে ঈশাই দায়ী সেটা মাথায় রেখেই ভয়ংকর এক ধমক দিতে প্রস্তুত হল। মাথা তুলে সামনে তাকাতেই তার দুনিয়া অন্ধকার হওয়ার বদলে সবুজে ছেয়ে গেলো। সদ্য ঘুম ভাঙ্গা জড়ানো চোখ গুলোও বড় বড় হয়ে গেলো। ঈশার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ভেজা চুল গুলো ইচ্ছা মতো আছড়ে জাচ্ছে সে। সবুজে জড়ানো মায়াবতীকে কি স্নিগ্ধটাই না লাগছে। চোখ ফেরান দায় হয়ে গেছে। একটু ছুয়ে দিতে মন চাইছে। কিন্তু কিছু একটা ভেবে নিজেকে সংযত করে নিলো। চুল ঠিক করে ঈশা পুরো ঘরে এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে কি যেন কাজ করছে। ইভানের এবার ঈশার উপরে প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ লাগছে। অযথাই রাগটা ক্ষণে ক্ষণে চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু এমন কোন কারন নাই। তবুও ইভান নিজেকে কিছুতেই রাগ করা থেকে আটকাতে পারছে না। এর মাঝেই দরজায় জোরে জোরে ধাক্কানর আওয়াজে ঈশা পিছন ঘুরে একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান কে চোখ খুলে থাকতে দেখে নিরভয়ে দরজা খুলে দিলো। ইরা দৌড়ে এসে ঈশার পায়ের কাছে ধরে বলল
–আপু তুমি এখানে কেন ছিলে? বাসায় যাবে না।

সকাল সকাল ইরার এমন কথা শুনে ঈশা একবার ইভানের দিকে তাকাল। ইভান উঠে বসে পড়ল। ইফতি ঘরে ঢুকে বলল
–রাতে তোমাকে বাসায় দেখতে না পেয়ে প্রচণ্ড কান্না কাটি করেছে। সকাল থেকে জেদ আপুর কাছে যাবে। তাই নিয়ে এলাম সকাল সকাল।

ইভান মৃদু সরে বলল
–ভালো করেছিস।

ইরা আবারো ঈশার শাড়ি টেনে বলল
–ও আপু। বাসায় কখন যাবে?

ঈশা মৃদু হেসে বসে পড়ল। ইরার গাল টেনে বলল
–আমি এখন থেকে এখানেই থাকব ইরু মনি।

–কেন থাকবে? তোমার কি বাড়ি নেই?

ইরা ভ্রু কুকে বলতেই ঈশা হাসল। ইরা ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে ইভানের কাছে গিয়ে বলল
–ও ভাইয়া আপু কেন তোমার ঘরে থাকবে?

ইভান ইরার কথার কি উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না। চুপচাপ বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো। ইরা আবারো বলল
–আপু থাকলে কিন্তু আমিও তোমার ঘরে থাকব।

ঈশা ইরার কথা শুনে তার দিকে তাকাল। ইভান শান্ত ভাবে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলল
–একদম। আমি তো ভাবছি তোর বাপের বাড়িতে যত মেয়ে হবে আমি সবাইকে নিয়ে এসে আমার ঘরে রাখবো। আর আমি আমার ঘর বিছানা সব ছেড়ে বারান্দায় থাকব।

ঈশা বড় বড় চোখে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান ইরার দিকে আছে। ঈশা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–তুমি সোফায় শুয়েছিলে কেন?

ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু আবারো রাগটা চেড়ে উঠলো। কোন রকমে সেটাকে গিলে উঠে দাড়িয়ে বলল
–তোর মাথায় কখন কি চলে কে জানে। ঘুমানোর আগে মনে হয়েছে সময় দরকার আবার ঘুমানোর পরে যদি মনে হয় আর সময় দরকার নেই। যদি কোনভাবে আমার ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিস। তাই নিজেকে সেফ রাখতেই দূরত্ব বজায় রেখেছি।

চলবে……।

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২১

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২১

বিদঘুটে শব্দে ফোনটা নিচে পড়ে সব কিছু আলাদা হয়ে গেলো। ঈশার এতে কোন আক্ষেপ নেই। কারন সে ইচ্ছা করে করেছে। কারন সে চায়না ইভান ফোনটা ধরুক। আর ইভান অসহায়ের মতো ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
–‘এলোমেলো জীবনে গোছালো ভালবাসার উৎস’, ‘অন্ধকার সময়ের আলোর দিশারী’, ‘রংহীন জীবনের রঙ্গিন স্বপ্ন’!

কথা গুলো কানে আসতেই ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল ঈশার দিকে। ঈশা হাত গুজে দেয়ালে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে আছে। গাড় গোলাপি রঙের একটা সুতির শাড়ি গায়ে জড়ানো। হালকা সাজ এলোমেলো হয়ে গেছে। চোখে মুখে বউ বউ কোন ভাব নেই। একদম অগোছালো। মুখের ভাব দেখেই বোঝা সম্ভব যে তিক্ত মন নিয়ে বাসর রাতে অপেক্ষমাণ বউ। ইভানের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেলো আবারো ঈশার তিক্ত কথার সরে
–আরও শুনতে বাকি আছে নাকি তাই এতো রাতে ফোন করেছে?

ইভান কোন কথা বলল না। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকলো। ঈশা আবারো বলল
–কেন ফোন করেছে তোমাকে? কথা না বলে থাকতে পারছিল না?

ইভান দাতে দাত চেপে বলল
–একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছে না?

ঈশা এগিয়ে আসলো ইভানের কাছে। দুই হাতে শার্টের কলার চেপে ধরে বলল
–কোনটা বেশী? জোর করে বিয়ে করাটা নাকি ফোনটা ভেঙ্গে ফেলাটা।

ইভান কোন কথা বলল না। কলার থেকে ঈশার হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হনহন করে ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেলো। দুম করে ওয়াশ রুমের দরজা লাগাতেই ঈশা সস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। এতক্ষনের ভয়টা কেটে গেছে। ঈশা যে প্রচুর ভয় পাচ্ছিল সেটা ইভান বুঝতে পারেনি। আর ঈশাও সেটা লুকাতে চরম বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। এভাবে যে ইভানের সাথে কথা বলতে পারবে সেটা সে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। যাই হোক এতোটুকু বুঝতে পারলো যে ইভান কে জব্দ করতে হলে এভাবেই আচরন করতে হবে।

ওয়াশ রুমে ঢুকে ইভান আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছে। নতুন করে ঈশাকে দেখছে সে। এরকম আচরন মনে হয় স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। ইভান বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। ঈশার কথা শুনে এতক্ষনের এই বিয়ে নাটকের সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো ইভানের কাছে। স্নেহার বিষয়টাকে ঈশা যে এভাবে নিবে সেটা সে ভাবেইনি। যতটুকু বললে ভুল টাকে ঠিক মনে হবে না ইভান সেটাই তাকে বলেছে। সবটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছে। ইভানের কোন দোষ নেই সেটাও তাকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাহলে কি ঈশা তার কথা বিশ্বাস করেনি? একটা শ্বাস ছেড়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলো। এসেই দেখে ঈশা একদম নতুন বউয়ের মতো বিছানার মাঝখানে গোল হয়ে বসে আছে। এক পলক দেখে হাত মুখ মুছে বিছানায় বসে পড়ল। ঠিক তখনই ইফতি দরজায় নক করলো। ইভান উঠতেই ঈশা গলা তুলে বলল
–খোলা আছে।

ইভান ঈশার দিকে সরু চোখে ঘুরে তাকাল। ঠিক কি কারনে সেটা ঈশা বুঝতে না পারলেও এমন ভাব করলো যে সেটাকে পাত্তা দিচ্ছে না। ইফতি এসে বলল
–ভাবি আপু মা তোমাদেরকে খেতে ডাকছে।

ইভান হালকা সরে বলল
–যা আসছি।

ইফতি চলে যেতেই ইভান ঈশার দিকে ঘুরে বলল
–চল খাবি।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
–আমি খাবো না।

ইভান বিরক্ত নিয়ে বসে পড়ল ঈশার সামনে। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অসহায় কণ্ঠে বলল
–তুই ঠিক কি চাইছিস ঈশা? কেন এরকম করছিস?

ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–চল আগে খাবি। খেয়ে এসে তারপর নাটক করিস। সারা রাত পড়ে আছে।

ঈশা কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–আমার ইমোশন এখন তো তোমার কাছে নাটক মনে হবে।

ইভান অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল। আবার বসে পড়ল। ঈশার হাত ধরতে গেলেই সরিয়ে নিলো। ইভান অসহায়ের মতো বলল
–তুই আমাকে একটুও বিশ্বাস করিস না। কেন ঈশা? আমি এমন কি করেছি?

ঈশা ছলছল চোখে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল
–বিশ্বাস না করলে আজকে তোমার বউ হয়ে তোমার ঘরে থাকতাম না। বিশ্বাস করি বলেই এসব করেছি।

–তাহলে এই ব্যাবহারের মানে কি?

ইভান নিচের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল। ঈশা কেদে ফেলল। চোখের পানি মুছে বলল
–আজ পর্যন্ত কখনও আমাকে বলেছ ভালোবাসো? কেন বলনি? বিয়ে পর্যন্ত গড়াল অথচ ভালবাসি বলতে পারলে না।

ইভান অগোছালো দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা এসব কথা কেন বলছে সেটা বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করে নিলো। ঈশার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলো। নরম কণ্ঠে বলল
–সব সময় কি বলেই বোঝাতে হয়? আমার অনুভুতি গুলো তো তোর বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না। না বলে ভালবাসা যায়না?

ঈশা চোখের পানি ছেড়ে দিলো। ভাঙ্গা মন নিয়ে বলল
–আমি জানি তুমি ঐ চিঠি গুলো স্নেহা আপুকে লিখনি। কিন্তু আমি ওগুলো দেখার পর থেকে নিজেকে কোনভাবেই বোঝাতে পারছি না। খুব এলোমেলো লাগছে নিজেকে। কেমন অস্থিরতা কাজ করছে।

ইভান ঈশার হাত ছেড়ে দিলো। ঈশার অবস্থাটা সে ভালই বুঝতে পারছে। যত কিছুই হোক। ইভান কে তো সে ভালবাসে। আর ভালবাসার মানুষকে নিয়ে অন্য কারো সাথে ভাবার বিষয়টা ভয়ংকর কষ্টের। উঠে দাড়িয়ে বলল
–পুরো হাতের লেখা আমার হলেও শুরুতেই ‘প্রিয় স্নেহা’ লেখাটা কিন্তু অন্য কারো। অবশ্য প্রথম অবস্থায় যে কেউ দেখলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য যে আমি ঐ চিঠি গুলো স্নেহাকেই লিখেছি। আমি যদি তোকেই বিষয়টা ক্লিয়ার করে না দিতাম তাহলে তুই নিজেও বুঝতে পারতিস না। ভাগ্যিস নিজে নিজে বেশী না বুঝে আমার কাছে এনেছিলি। আমি হ্যান্ড রাইটিং ম্যাচ করে না দেখালে তুই কোনদিনও বিশ্বাস করতিস না আমাকে।

ঈশার দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বলল
–চিঠি গুলো তুই কই পেয়েছিলি?

ঈশা কাপা কাপা গলায় বলল
–তোমার আলমারিতে একটা খাম ছিল। ঐ খামের মধ্যে অনেক চিঠি আর আমার ছবি ছিল। আমি ওটা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম। সেগুলো দেখার জন্য। কিন্তু আমি পুরটা দেখার আগেই আম্মুর হাতে সেটা পড়ে যায়। আর আম্মুই ঐ চিঠি গুলো আমাকে দেয়।

ইভান বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। ঠোট কামড়ে কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো ঈশার দিকে। তারপর ধির কণ্ঠে বলল
–না জানি আমার শাশুড়ি মা কি ভেবে বসেছে? নিশ্চয় ভেবেছে জামাই আমার মেয়েকে রেখে বাইরে আর একটা প্রেম করছে। উফ! তুই কেন ওগুলো বাসায় নিয়ে গেলি ঈশা? আমার মান সম্মান বলে কিছু থাকলো না। আমার ঘরে বসে পড়তিস সব। তাহলেই এতো কিছু হতোনা।

ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বসলো
–কার জন্য লিখেছিলে ঐ চিঠি গুলো?

ইভান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–আমার জীবনে শুধু একজনই আছে। এটা সবাই জানে। আমার সব কিছু তাকে ঘিরেই। আমার অনুভুতি, আমার ভালবাসা, চাওয়া, পাওয়া সব কিছু তাকে নিয়েই। এটা নিয়ে এতো সন্দেহ প্রকাশের কিছু নেই। ঐ চিঠি গুলতে কোন নাম লেখা ছিল না। আমি ভেবেছিলাম বিয়ের দিন তোকে পুরো খামটা দিবো। কিন্তু দূর ভাগ্য আমার। আগেই তুই পেয়ে গেলি।

ঈশা আবারো বলল
–স্নেহা আপু তোমাকে পছন্দ করতো তুমি জানতে না?

–স্নেহা আমাকে পছন্দ করে কিনা আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এমন কি এসব নিয়ে কখনও মাথাও ঘামাইনি। আমাদের মধ্যে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক ছিল। আর বন্ধুদের মাঝে ফান হয়েই থাকে। সেদিন রেস্টুরেন্টে তোর সামনেও স্নেহা আর মিলা ফান করেছিলো এটা নিয়ে। আমি সেদিন রেস্টুরেন্টে ওদেরকে ডেকেছিলাম শুধু তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। যাতে সবাই এই বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যায় যে তুই আমার বউ।

এক নিশ্বাসে কঠিন গলায় কথা শেষ করে ইভান একটু চিন্তিত হয়ে গেলো। এবার নরম কণ্ঠে বলল
–আমি ভাবছি তোকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠি গুলো স্নেহা কোথায় পেলো? আর ঐ চিঠির শুরুতে কেই বা ওর নামটা লিখল?

ঈশা বিচক্ষনের মতো বলল
–স্নেহা আপুই যে লিখেছে সেটা তো নাও হতে পারে। অন্য কেউ তোমার ঘরে এসে সেগুলো দেখে তার নাম চিঠির মধ্যে লিখে দিতে পারে। তোমার বন্ধুদের মধ্যেই হয়তো কেউ এমন করেছে। আর সে হয়তো জানতো যে স্নেহা আপু তোমাকে পছন্দ করে।

ঈশার কথা ইভানের কানে গেলেও তার কাছে বিষয়টা সহজ মনে হল না। কারন তার ঘরে বাইরের কেউ সেরকম আসেনা। আর বন্ধুরা তো হাতে গোনা কয়বার এসেছিলো। ঐ চিঠি গুলো ঈশাকে উদ্দেশ্য করে কবে ইভান লিখেছিল সেটাই তার ঠিক মনে পড়ছে না। আর লিখলেও সব সময় সেগুলো ইভান অনেক যত্ন করে লুকিয়ে রাখত। কারন সে কখনই চায়নি এসব অনুভুতি অন্য কেউ জানুক। এভাবে তার আলমারি থেকে চিঠি খুজে বের করে তার লেখা নামহীন চিঠির শুরুতে অন্য কারো নাম লিখে রাখাটা সহজ কথা না। একটা জিনিস খুব ভালো হয়েছে যে চিঠির মুল লেখা গুলো পুরাতন হলেও স্নেহার নামটা খুব রিসেন্ট লেখা। যেটা কলমের কালির ধরন দেখেই বোঝা সম্ভব। আর হাতের লেখাটাও একদম আলাদা। ইভানের সাথে কোন ভাবেই মিলেনা। তাই তো ঈশাকে বিষয়টা বোঝাতে সক্ষম হয়েছে সে। নাহলে ঈশা বিষয়টা একদম অন্য দিকে নিয়ে যেত। এই ছোট একটা বিষয়েই জেদ করে বিয়ে করে ফেলল। তবে এটা ভেবেই ইভানের অসস্তি বোধ হচ্ছে যে ঈশার মা চিঠি গুলো আগে নিজে দেখে তারপর মেয়েকে দেখিয়েছে। এতদিন ওনার কাছে তৈরি হওয়া সমস্ত ইমেজ এক নিমেশেই মাটিতে মিশে গেলো। ইভানের ভাবনার মাঝেই তার মা আবার ডাকল। ঈশা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে দাড়িয়ে গেলো। ভাজ হওয়া শাড়ীটা ঠিক করে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান একটু দাড়িয়ে থেকে বের হয়ে গেলো। সোজা টেবিলে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। ঈশা দাড়িয়ে থাকলো। ইভানের মাও দাড়িয়ে আছে। ঈশা লাজুক সরে বলল
–বড় মা তুমি বস আমি বেড়ে দিচ্ছি।

ইভানের মা কঠিন গলায় বললেন
–তোমাকে এতো পাকনামি করতে হবে না। তুমি বস। আমি দিচ্ছি। সব কাজ তো তোমাকে দিয়েই করাবো। তবে আজই না। একটু সময় দেবো। সবে এসেছ। আগে একটু গুছিয়ে নাও।

ইভানের মায়ের এমন কথা ঈশার কাছে বিরক্তিকর মনে হল। শেষ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলে ফেলল
–তুমি এভাবে কেন কথা বলছ বড় মা? আগে তো এভাবে বলতে না? আর এরকম তুমি তুমি করে কি বলছ? তোমাকে এভাবে কথা বলে মোটেও মানাচ্ছে না।

সবাই হেসে ফেলল। ইভানের মা ভ্রু কুচকে বললেন
–এখন থেকে এরকমি চলবে। ভালো না লাগলেও সহ্য করতে হবে। শাশুড়ি হওয়ার প্রাকটিস করছি।

আরেকদফা হাসির পর সবাই একসাথে খেতে বসলো। খাওয়া শেষ করে সব গোছানোর সময় ঈশা সেখানে দাড়ালেই ইভানের মা ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়। তিনি নতুন বউকে আজ কোন কাজেই হাত দিতে দিবেন না। ঈশাও আর উপায় না দেখে ঘরে চলে এলো। এসে দেখে ইভান বিছানায় হেলানি দিয়ে টিভি দেখছে। ইভানের বেডের সামনের দেয়ালে বড় একটা টেলিভিশন রাখা আছে। ইভান সেদিকেই মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। ঈশা ঘরে ঢুকে দাড়িয়ে গেলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান চোখ ফিরিয়ে ঈশার দিকে তাকাল। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধির পায়ে ঈশার দিকে এগিয়ে গেলো। ঈশা শুকনো ঢোক গিলে পেছাতে লাগলো। দরজার সাথে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো। ইভান দু পাশে হাত রেখে একটু ঝুকে বলল
–বলেছিলাম আমি নিরুপায়, সময় প্রয়োজন। কিন্তু দাওনি। আমি এখনও নিরুপায়, কিন্তু এখন আর সময় প্রয়োজন নেই। তোমাকে প্রয়োজন।

চলবে………

শুভ্র নীলের প্রেমপ্রহর পর্ব-২০

0

#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ২০

–ইভান ভাইয়া।

ইভান মনোযোগ দিয়ে টিভি দেখছিল। ঈশানের চিৎকারে তার মনজগে ব্যাঘাত ঘটে গেলো। বেশ বিরক্ত হল। এমনিতেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। তার উপর এরকম চিৎকার। গম্ভির গলায় একবার ঘাড় ফিরিয়ে বলল
–প্লিজ ঈশান। আমার মন মেজাজ কোনটাই ভালো নাই। এখন বিরক্ত করিস না। পরে কথা বলবো।

ঈশান থেমে গেলো কপালে ভাজ ফেলে বলল
–এরপরের ঘটনা শুনলে মন মেজাজ আর কিছুই নিজের জায়গাতে থাকবে না।

ইভান টিভি অফ করে দিলো। ঈশানের দিকে ঘুরে বলল
–বল। কি বলতে এসেছিস।

ঈশান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–বিকেল থেকে ঈশা ঘরের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। দরজা ভেঙ্গে ফেলা বাকি শুধু। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাউন্ড আসছে না।

ইভান ঈশানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল। খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে আছে। ঈশান ইভান কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
–কিছু বল।

ইভান স্বাভাবিক ভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিলো। একটু ভেবে শান্ত কণ্ঠে বলল
–আমার এসব পাগলের পিছনে ওয়েস্ট করার মতো টাইম এনার্জি কোনটাই নাই। তুই গিয়ে তোর বোনকে উদ্ধার কর।

ইভানের এমন কথা শুনে ঈশান পুরই বোকা হয়ে গেলো। এতো শান্ত ভাবে ইভান যে এরকম কিছু বলবে সেটা ঈশানের ধারনার বাইরে ছিল। বিস্ময় মাখা কণ্ঠে বলল
–তুমি কিছুই বলবে না?

ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশান আবার বলল
–না মানে তোমার চিন্তা হচ্ছে না?

ইভান ওভাবে তাকিয়েই বলল
–ঈশার কপাল ভালো যে ও এখন আমার সামনে নাই। ঘর থেকে বের হলে ওকে বুঝিয়ে বলিস যে আমার সামনে যেন না আসে। নাহলে ধরে এমন মাইর দিবো সব পাগলামি ছুটে যাবে।

ঈশান বোকা বোকা চোখে তাকাল। ইভানের এমন আচরন বোধগম্য হল না তার। কোন কথা না বলে সেখান থেকে বের হয়ে এলো। সব কিছু কেমন তারও মাথার উপর দিয়ে গেলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। পকেট থেকে ফোন বের করে ঈশার নাম্বারে ফোন করলো। ঈশা ফোনটা ধুরতেই ঈশান বলল
–ইভান ভাইয়া মনে হয় অসুস্থ। উলটা পাল্টা কথা বলছে।

ঈশা একটু হেসে বলল
–তুমি চলে আসো। কিছুক্ষনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে।

ঈশান চলে গেলো ঈশাদের বাড়িতে। ঈশান বাড়িতে ঢুকে সোজা ঈশার রুমে গেলো। একবার ঈশার দিকে দেখে বিছানায় বসলো। ঈশা থম্থমে মুখে জিজ্ঞেস করলো
–আসেনি না?

ঈশান চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। অস্থির শ্বাস ছেড়ে বলল
–আচ্ছা তোদের সমস্যা টা কি? মনে হচ্ছে দুজন দুজনের বিরুদ্ধে কম্পিটিশনে নেমেছিস। একজন বিয়ে করতে অস্থির হয়ে গেছিস আর আরেকজন সমানে না বলে যাচ্ছে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

ঈশা হাসল। কোন উত্তর দিলো না। ঈশান আবার বলল
–আমার মনে হয় ইভান ভাইয়া সব নাটক বুঝতে পেরেছে। তাই আসতে চাইছে না। আর তাছাড়াও তার মধ্যে সেরকম কোন চিন্তা দেখলাম না। তোর কিছু হলে সেই আগে বিচলিত হয় কিন্তু আজ যা দেখলাম বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত।

ঈশা মুচকি হেসে বলল
–আসবে। তুমি বাইরে গিয়ে বস। অপেক্ষা করো। সময় হলেই চলে আসবে।

ঈশান ঈশার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর বাইরে গিয়ে বসলো। সত্যি সত্যি কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর ইভান চলে এলো। এসেই কারো দিকে না তাকিয়েই সোজা ঈশার ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–২ মিনিট সময়। দরজা না খুললে পরের এপিসোড পুরটাই তোর জানা।

আশ্চর্য জনক ভাবে ঈশা দরজা খুলে ফেলল। ইভান ঘরে ঢুকে শান্ত ভাবে ঈশাকে দেখে নিয়ে বলল
–এসব নাটকের কারন কি?

ঈশা চোখ নামিয়েই বলল
–বিয়ে!

ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলল। বিরক্তি কাটিয়ে ঈশার পাশে গিয়ে বসলো। মাথায় হাত দিয়ে বলল
–ঈশা পাখি। আমি রিকুয়েস্ট করছি। প্লিজ! আমরা এসব নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলবো। এখন পাগলামো করোনা।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান আবার বলল
–আমার সাথে এক জায়গায় যাবে? শুধু তুমি আর আমি। যাবে?

ঈশা এবার ইভানের দিকে তাকাল। তার চোখে পানি। কাপা কাপা গলায় বলল
–আমাকে বিশ্বাস করে আমার সাথে যাবে তুমি?

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। বলল
–কোথায়?

–কাজী অফিসে!

ইভান নিজের রাগটা সংবরণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। ঈশার মুখ চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বলল
–এনাফ ইজ এনাফ! আমার প্রতিটা কথার পিছনে অনেক কারন থাকে। আমার উপরে চোখ বন্ধ করে তোর বিশ্বাস করা উচিৎ। আমার সিদ্ধান্তের উপরে ভরসা করে আমার জন্য অপেক্ষা করা উচিৎ। এর থেকে বেশী কিছু আমি তোকে দিতে পারবো না। আমাকে খারাপ হতে বাধ্য করিস না।

ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ঘুরে বের হতে যাবে তখনি ঈশা বলল
–আমাকেও খারাপ কিছু করতে বাধ্য করোনা। বারবার আমার ভাগ্য ভালো হবে সেটা কিন্তু না।

ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশার কথার মানে স্পষ্ট। এলোমেলো লাগছে তার নিজেকে। ঈশা এবার কেদে ফেলল। দুই হাতে মুখ লুকিয়ে ডুকরে কেদে উঠলো। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল
–সেদিনের মতো তুমি আজকেও আমার কাছে কোন অপশন রাখছ না। আমি তোমার বাড়িতে থাকতে চাই। তোমার কাছে। সেদিন যদি কবুল বলে তোমার সাথে আমার বিয়ে হতো তাহলে আমি তোমাকে এতো কিছু করতেই বলতাম না। নিজে নিজেই চলে যেতাম। আমি এমন কঠিন কিছুই করতে বলিনি তোমাকে। কেন এতো আপত্তি করছ? কেন জোর করতে হচ্ছে?

শেষের কথাটা বেশ অসহায় শোনালো ঈশার মুখে। ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কোন কথা বলল না। এলোমেলো মন। বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুক্ষন ভাবল। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে আদুরে কণ্ঠে বলল
–কাদিওনা। থামো। তুমি যা চাও তাই হবে।

—————–
বাসর ঘরে বসে আছে ঈশা। সন্ধ্যার পরে তিন কবুল বলে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে তাদের। বিয়ের পুরো সময়টা ইভান মাথা নিচু করে বসে ছিল। একবারও ঈশার দিকে তাকায় নি। বড়দের সাথে ইভান বেয়াদবি করেনা জন্য চুপ করে বসে ছিল। নাহলে এতক্ষন থাপ্পড় দিয়ে ঈশার গাল ফাটিয়ে দিতো। ঈশাও সেটার সুযোগ নিয়েই এতো কিছু করে ফেলল। ইভান ধারনাও করেনি ঈশা এরকম কিছু করে বসবে। ঈশার উপরে তার প্রচণ্ড রাগ। কোন রকমে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে রেখেছে সে।

ঈশার বাবা মা মেয়েকে বিদায় দিতে কাদলেও ঈশার মধ্যে সেরকম কোন অনুভুতি প্রকাশ পায় নি। তাকে দেখে মনে হয়েছে সে খুব চিন্তিত আর ভীত। তার এরকম অদ্ভুত আচরন সবার দৃষ্টি গোচর হলেও কেউ কারণটা বুঝতে পারেনি। আর কেউ সেটা নিয়ে মাথাও ঘামায় নি। বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন তাদের ব্যপার তারা বুঝবে।

সাদা মাটা একটা শাড়ি পরেছে ঈশা। সাজ বলতে কিছুই নেই। চোখে কাজল টানা আর ঠোটে হালকা লিপস্টিক। বেশ রাত হয়েছে। আশে পাশে কাজিনদের বহর। নিজেদের মতো কথা বার্তায় ব্যস্ত তারা। সেসবের কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। তার বুক ধুকপুক করছে ভয়ে। ইভান আসার পর ঠিক কিভাবে রিয়াক্ট করবে সেটাই তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। বাসর রাতে আদরের পরিবর্তে ঠিক কয়টা থাপ্পড় খেতে হতে পারে সেটারও হিসাব কষা শেষ তার। দমবন্ধ কর একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সে। কিছুক্ষন পরেই ইভান এসে দরজা খুলল। সবাই দাড়িয়ে গেলো তাকে দেখে। ঈশা একবার চোখ তুলে তাকাল। মুখ দেখে বোঝার উপায় নাই রেগে আছে কিনা। সেটাই ভয়ের বড় কারন। রাগটা আন্দাজ করা গেলেও হয়তো কমানো সম্ভব হতো। কিন্তু বুঝতেই না পারলে কমাবে কিভাবে? ইভানের চোখে চোখ পড়তেই ঈশা নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। বেশ অবাক হল। এতো শান্ত থাকার তো কথা ছিল না। তাহলে এটা কি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস! ভয়ে চুপসে গেলো সে। ইলু একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–ইভান ভাইয়া। বিয়ে তো করেছ। আমাদের প্রতি তো কিছু দায়িত্ব থাকেই। সেটা এখন পালন কর।

ইভান শান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। কোন কথা বলল না। ঈশান ঢোক গিলে এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। সে ইভানের কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না। কারন কোনভাবে যদি ইভান জানতে পারে। সে ঈশার এই বিয়ের নাটকের সঙ্গি তাহলে তো তার নিস্তার নেই। ইভান ঈশানের দিকে তাকাল। চোখের ইশারায় কাছে আসতে বলল। ঈশান ভয় কাছে এসে দাত বের করে হেসে বলল
–কিছু বলবে ইভান ভাইয়া?

ইভান মৃদু হেসে ঈশানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–সব থেকে বড় উপহারটা তোর পাওয়া উচিৎ তাই না? তুই বড় উপকার করলি।

ঈশান ইভানের কথা আন্দাজ করতে পেরে হাসি থামিয়ে দিলো। ইভান পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ঈশানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল
— এবার বিরক্ত না করে সবাই বাইরে যা। আমি ভীষণ টায়ার্ড। মন মেজাজ এমনিতেই ভালো না। আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেলে কিন্তু সব কয়টার খবর আছে।

সবাই একটু কথা বলতে গেলেও ঈশান থামিয়ে দিলো। সবাইকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেলো। কারন সে ভালো করেই বুঝতে পেরেছে ইভান সবটা বুঝে গেছে। আর তার মেজাজ খুব খারাপ। সে কোন রকমে কন্ট্রোল করে রেখেছে নিজেকে। সবাই বাইরে চলে গেলো। ইভান দরজা লক করে দিলো। ঈশা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে বসে আছে। সে বুঝতেই পারছে তার কপালে শনি আছে। ইভান কোন কথা না বলে ফোনটা পকেট থেকে বের করে পাশের টেবিলে রাখল। ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই ফোন বেজে উঠলো। ইভান পিছন ফিরে ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বারটা একবার দেখে ঈশার দিকে তাকাল। চোখ ফিরিয়ে ফোনটা রিসিভ করতে যাবে সেই মুহূর্তেই ঈশা এসে ছো মেরে ফোনটা হাত থেকে নিয়ে নিলো। ইভান ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকাল। আশ্চর্য জনক ভাবে ঈশা একটুও ভয় পেল না। উলটা একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল।

চলবে…………