বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1187



অনুরাগ (১ম অংশ)

0

অনুরাগ (১ম অংশ)
লেখিকাঃ #Israt_Jahan

ঘড়িতে রাত ১১ টা বেজে ১৫ মিনিট। বিছানার মাঝ বরাবর বধু বেশে বসে আছে শ্রুতি।কখন যে পুলক বাসায় ফিরবে আর কখন যে শ্রুতি কে দ্বিতীয়বারের মত বধু সাজে দেখে চমকে উঠবে সেই অপেক্ষাতে বসে প্রহর গুণছে মেয়েটা।আজ তাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী।বিয়ের আগে থেকেই শ্রুতি ভেবে রেখেছিল প্রতি বছর ঠিক এই দিনে নতুন বউ সেজে বাসরঘর সাজিয়ে পুলককে সে চমকে দেবে।আর পুলক মুগ্ধ নয়নে তার প্রেয়সীর মুখটা দেখবে।আর তারপর ঠিক প্রথম বাসররাতে পুলক ওকে যেভাবে কাছে টেনে নিয়ে খুব খুব ভালোবেসেছিল আজও ঠিক সেইভাবেই ওর কাছে আসবে।উফ! ভাবতেই শ্রুতি লজ্জায় কেঁপে উঠছে।বিছানা থেকে নেমে দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখছে।সেন্টমার্টিনে তোলা ছবিগুলো, যখন ওরা বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমাতে গিয়েছিল তখনকার ছবি। আরো কিছু ছবি রয়েছে যেগুলো ওদের ভার্সিটি পড়াকালীন দুজন চুটিয়ে প্রেম করত সেই সময়কার ছবি।একটা ছবিতে শ্রুতি ক্যাম্পাসের মাঠে বসে মনযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে আর পুলক পলকহীন ভাবে ওকে দেখছে।পাশ থেকে নিশাদ ফোন থেকে টুপ করে ছবিটা ক্লিক করে ফেলে।আজকে নতুন করে শ্রুতি ওদের সাজানো রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। সারা রুমে নীল দ্যুতি ছড়িয়ে একটা অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে।শ্রুতির খুব আনন্দ হচ্ছে।মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষটা ওই।সাদা চাদরের ওপর লাল গোলাপের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।ইচ্ছা করছে এখনই পুলকটাকে কান ধরে টেনে নিয়ে আসতে। আজ এত সময় নিচ্ছে কেন বাসায় ফিরতে কে জানে?তারউপর আজ চাঁদনিরাত।এমন রাতে আর কতক্ষণ একা বসে থাকা যায়?ছেলেটা যে কী পরিমাণ জ্বালায় আজ কাল!রুমে এলে প্রথমে জোড়ে দুটো ঘুষি দিবে পুলকের পেটে।
তারপর জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বলবে,
-‘ শুভ বিবাহবার্ষিকী পুলক সাহেব।শুভ হোক তোমার আর তোমার বউ এর বিবাহিত জীবন। ‘
এসব ভাবনার মাঝে দরজায় নক পড়ল। হঠাৎ দরজার নক শুনে শ্রুতি চমকে উঠল।হার্টবিট ওঠানামা করতে শুরু করেছে ওর।ধুকধুকানি শব্দটা নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছে মনে হচ্ছে।এত লজ্জা লাগছে কেন?সেই প্রথমবারের মত অনুভূতিটা।মৃদু ঘাম সৃষ্টি হয়েছে শ্রুতি’র নাকে আর কপালে।ধুত্! অনেক নাটক হয়েছে।গিয়ে তো দরজাটা খুলতে হবে। নতুন বউ সেজেছে বলে তো সে আর নতুন বউ নয়।তবু সে লজ্জাটাকে আড়াল করতেই পারছেনা।দ্রুত পায়ে হেঁটে ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি রেখে দরজাটা খুলল শ্রুতি।

ঈষাণঃ শুভ বিবাহবার্ষিকী ম্যাম।

হাসিমাখা মুখে ঈষাণ ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিল শ্রুতি’র দিকে।তোড়াটা হাত থেকে নিয়ে শ্রুতি বলল,
-‘ বাব্বাহ্ তাহলে আপনি শেষ পর্যন্ত এসেছেন এস.পি সাহেব? ‘
-‘ নাহ্ আসিনি তো।আমার ভূত এসেছে। ‘
-‘ আচ্ছা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বস আমি আসছি।তানিয়া,নিশাদ,রবিন,মেঘলা ওরা সবাই সোফাতেই ঘুমিয়েছে নাকি? ‘
-‘ না আড্ডা চলছে এখনো।আমি তো ভাবলাম পুলক বোধহয় রুমেই আছে। আর এতক্ষণে আপনাদের….। ‘
-‘ এই যাহ্ কিসব বলিস!যা আমি আসছি। ‘

ঈষাণ চলে যেতে গিয়েও থেমে গেল।
তারপর বলল,
-‘ একবার রুমে ঢুকতেও দিলিনা? ‘
-‘ ওহ্ স্যরি ভাই।আয় আয় ভেতরে আয়। ‘
-‘ মাই গড!এত চমৎকার করে সাজিয়েছিস রুমটা।ইচ্ছে তো করছে বাসরটা আমিই সেড়ে যাই। ‘
-‘ এই কী যে বলিস না তুই।তোর মুখে কিছুই আটকায়না।বদের হাড্ডি আছিস এখনো। ‘

ঘোর লাগানো চোখে তাকিয়ে আছে ঈষাণ শ্রুতি’র পানে।ধীর পায়ে হেঁটে এসে শ্রুতি’র সামনে দাঁড়াল।তারপর বলল,
-‘ খুব সুখে আছিস তাইনা? ‘
-‘ হ্যাঁ রে খুব।জানিসই তো পাগলটা কী পরিমাণ ভালোবাসে আমায়। ‘
-‘ বাই দ্যা ওয়ে।দানুণ লাগছে তোকে। ‘
-‘ থ্যাংক ইউ মহাশয়। ‘
-‘ আয়…ড্রয়িংরুমে আছি। ‘
————————
মেঘলাঃ কী ব্যাপার বল তো?রাত বারোটা বাজতে চলল প্রায়।আমরা কত প্ল্যান করেছিলাম পুলক কে সারপ্রাইজ দেওয়ার।ব্যাটার এখনো আসার নাম গন্ধ নেই?
শ্রুতিঃ বুঝতে পারছিনা।এমন তো কখনো করেনা ও।

পুলকের নাম্বার ডায়াল করছে শ্রুতি আর কথাগুলো বলছে।

ঈষাণঃ পেলি?
শ্রুতিঃ না।রিসিভ করছেনা তো ফোন।

নিশাদ গর্জনরত কন্ঠে শ্রুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘ ধ্যাত্তেরিকা।মেয়ে মানুষগুলো এমন ন্যাকা স্টাইলের কেন?টেনশানের ঝুড়ি খুলে বসেছিস একদম।প্রাইভেট কোম্পানির জব। কাজের চাঁপ বেশি থাকলে দেরী হতেই পারে।আর তাছাড়া ঢাকার রাস্তা তো আর তোর বেডরুমের ফ্লোর না। ‘

মেঘলা নিশাদের গায়ে চাপড় দিয়ে বলল,
-‘ এই বাজে বকিস না তো।টেনশান হওয়ারই বিষয় এটা।যেহেতু ও এমন লেট করে বাসায় কখনোই ফিরেনা।আর ওদিকে তানিয়া আর রবিনকে দ্যাখ।যেন প্রেম করার জন্য ডেকে আনা হয়েছে ওদের। দুজনে এক সাইডে বসে সেই তখন থেকে গুজুর গুজুর করে চলেছে। ‘

শ্রুতির কারো কথাই কানে ঢুকছেনা। এক নাগাড়ে কল করে যাচ্ছে পুলকের ফোনে।

ঈষাণঃ শ্রুতি?
শ্রুতিঃ হ্যাঁ বল।
ঈষাণঃ তাহলে আমি উঠি।আমার ডিউটি আছে বারোটার পর থেকে।পুলক আসলে বলিস আমার কথা।আর মন খারাপ করিস না হয়তো জরুরি কোনো কাজে আটকে পরেছে।চলে আসবে এক্ষণি।
মেঘলাঃ থেকে যা না আজ আমাদের সাথে।রাতে আমরা পাঁচজন আমাদের ঘরোয়া পার্টি ইনজয় করব।আর ওরা বাসরঘর।
শ্রুতিঃ হ্যাঁ।আজকে রাতে এখানেই থেকে যা।আর ডিনারও তো করলিনা।

শ্রুতি কথাটা কেবল বলার প্রয়োজন তাই বলল।ওর ধ্যান তো রয়েছে হাতের ফোনটার ভিতর।পুলকের জন্য বড্ড চিন্তা হচ্ছে ওর।ঈষাণ এক নজরে তাকিয়ে দেখছে শ্রুতি কে।কী মিষ্টিই না লাগছে মেয়েটা কে আজ।ঈষাণ নিজেই চোখ সরাতে পারছেনা।পুলক আজ তাহলে কী করবে?

মেঘলাঃ কীরে থাকবি তো?

মেঘলার ডাকে ঈষাণ স্তম্ভিত থেকে বেরিয়ে এল।বলল,
-‘ শ্রুতি যখন বলেছে।তখন তো থাকাই যায়। ‘
-‘ ওয়াও গ্রেট।আমরা আজ অন্নেক মজা করব সারারাত।তোকে তো ফ্রি পাওয়া বর্তমান সো টাফ। ‘

রাত ১ টা ২০ মিনিটে পুলক বাসায় ফিরল।ঈষাণ তখন ডাইনিং এ পানি খেতে এসেছে।পুলক ঈষাণকে দেখে থেমে গেল।

ঈষাণঃ কীরে এই তোর আসার সময় হলো?
পুলকঃ তুই?
ঈষাণঃ কেন?আসা কী অন্যায়?
পুলকঃ আরে না না।অন্যায় কেন হবে? হঠাৎ করে দেখলাম তো।কেমন আছিস বল?আর কী মনে করে এই গরীবের বাসায় পা রাখলি তাও আবার এত রাতে?

ঈষাণ পুলকের কাছে এগিয়ে এসে ঘড়ি দেখে বলল,
-‘ এক ঘন্টা বিশ মিনিট আগে তোর আর শ্রুতি’র প্রথম বিবাহ বার্ষিকী পার হলো।শুভ বিবাহবার্ষিকী। ‘
-‘ ওহ্ স্যরি দোস্ত।এক্সট্রিমলি স্যরি।আমার আসলে খেয়াল ছিলনা।রাতে খেয়েছিস তো?রবিন নিশাদ ওরা সবাই এসেছে না? ‘

ঈষাণ পুলকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল,
-‘ হুম।সবাই এসেছে। ‘
-‘ চল ওদের সাথে দেখা করে আসি।অনেক অপেক্ষা করতে হলো তোদের।স্যরি রে। ‘

পুলক সবার সাথে দেখা করার জন্য সামনে এগোতেই ঈষাণ পুলকের বাহু ধরে বাঁধ সাধল।তারপর ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘ এই মুহূর্তে আমাদের অপেক্ষার থেকে শ্রুতি’র অপেক্ষার দামটা বেশি।আর স্যরিটাও ওকেই আগে বলা উচিত।ওদের সাথে সকালে দেখা করলেও চলবে। ‘

পুলক শুধু মাথা নাড়াল।ঈষাণ আবার বলল,
-‘ তোকে কেমন যেন এলোমেলো লাগছে। তুই কী আজকাল স্মোক করছিস নাকি? ‘
-‘ স্মোক?কই না তো। ‘

ঈষাণ ওর কাঁধ হাত রেখে ঠোঁটের বাঁকা হাসিটা দিল।পুলক আজ কাল শুধু স্মোক না মাঝে মধ্যে কলিগদের সঙ্গে ড্রিংকস ও করে সেটা ঈষাণ ভালো করেই জানে। রুমে ঢুকে পুলক শ্রুতি কে দেখতে পেলোনা।নিশ্চই বেলকোনিতে বেতের চেয়ারটাতে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছে আর না হয় ঝিমুচ্ছে।পুলকের শরীরটা বড্ড ক্লান্ত।রুমে ঢুকে নীল আভা দেখে মনে হচ্ছে এখনি বিছানার ওপর ঠাস করে শুয়ে পড়তে।বাসরঘরের সাজসোজ্জার দিকে ওর একদমই কোনো মনযোগ নেই। কিন্তু শ্রুতি যে খুব আশা করে বসে আছে ওর ফেরার অপেক্ষাতে।একটু সময় না দিলে মেয়েটা খুব কষ্ট পাবে।ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শ্রুতি’র দেওয়া সাদা পাঞ্জাবী টা পরে বেলকোনিতে চলে গেল। চাঁদের আলোতে শ্রুতি কে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পুলক।বেতের চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে ঘাড়টা কাঁত করে ঘুমিয়ে আছে। বিয়ের শাড়িটা পড়েছে আজ।এই শাড়িটাতে শ্রুতি কে একদম হূরপরী লাগে পুলকের কাছে। সাদা জমিনে লাল পার আর লাল পারের ভিতর গোল্ডেন সুতার কাজ।পুরো শাড়িটার ভিতর গোল্ডেন সুতার হালকা কাজ।আর সেই সাথে শ্রুতি’র ব্রিডাল সাজটাও চোখ ধাঁধানোর মত।গলায় সাদা পাথরের একটি নেকলেস আর কানেও সাদা পাথরের বড়দুল। ডায়মোন্ডের মাঝারি নোসপিনটাও চিক চিক করছে হালকা আলোতে।চুলটা সুন্দর করে খোপা করা।ঠোঁটে লাল খয়েড়ি মিক্সড লিপস্টিকটাও খুব আকর্ষণীয়।পুরো সাজটাই অস্থির করা একদম।শ্রুতি’র লাল ঠোঁটদুটো যেন পুলকের শরীরের ক্লান্তি একদম দূর করে দিয়েছে। সেই সাথে চোখের ঘুমও কেড়ে নিয়েছে।পাশ থেকে বেতের অন্য একটি চেয়ার টেনে নিয়ে শ্রুতি’র কাছে গিয়ে বসল। খুঁটে খুঁটে বউটার সাজ দেখছে।সত্যিই খুব সারপ্রাইজড হয়েছে পুলক।বিয়ের পর থেকে শ্রুতি’র সৌন্দর্য যেন দিন দিন উপচে পড়ছে।ইশ!কত অপেক্ষাটা না করালো মেয়েটাকে আজ।আরো আগে আসা উচিত ছিল তার।মনে মনে নিজেকেই গালাগাল দিচ্ছে সে।ঠোঁটদুটোর দিকে নজর পরতেই ঠোঁটে ঠোঁটে কথা বলতে ইচ্ছা করল ওর।শ্রুতি’র ঠোঁটজোড়ার খুব কাছাকাছি পুলকের ঠোঁটজড়া।শ্রুতির থুতনিতে আর ঠোঁটের ওপর পুলকের ঘন ঘন নিঃশ্বাস পরছে।দুজনের ঠোঁট মিলিত হওয়ার আগেই শ্রুতি নড়েচড়ে বসল।লাল চোখে তাকিয়ে আছে পুলকের দিকে শ্রুতি।
একগাল হেসে পুলক বলল,
-‘ শুভ বিবাহবার্ষিকী আমার হূরপরী। ‘

ছোট্ট করে পুলকের নাক বরাবর ঘুষি লাগাল শ্রুতি।

পুলকঃ আআহ্….।এটাই কী ছিল আমার সারপ্রাইজ গিফ্ট?

শ্রুতি আরো একদফা রেগে গিয়ে বলল,
-‘ এতক্ষণেও তোর চোখে পড়েনি আমার সারপ্রাইজটা? ‘
-‘ এই এটা কী হচ্ছে?আবার তুই তুকারি করছো কেন? ‘
-‘ হ্যাঁ তুই তুই তুই।তোর বাপ দাদা চৌদ্দ গুষ্টিকে আমি তুই তুকারি করব। ‘
-‘ ছিঃ ছিঃ। আমাকে তুই তুকারি করো আমি মেনে নিব তাই বলে আমার বাপ দাদা কে না প্লিজ। ‘
-‘ হাজার বার করব।কোথায় ছিলি তুই এত রাত?তোর ওই নাবিলা ম্যামের কাছে?ওই মহিলা কী তোকে…..। ‘
-‘ এই একদম বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। তুমি সবসময় ঝগড়ার মাঝে আমার বাপ দাদা আমার অফিস কলিগ এদের কে টেনে আনতে পারোনা। ‘
-‘ কোনো কিছুই টেনে আনবোনা আর। যা দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। ‘
-‘ এমনভাবে বলতে পারলে?সত্যি চলে যাবো কিন্তু।”
-‘ আসার কী প্রয়োজন ছিল? ‘
-‘ আচ্ছা আজকে না হয় একটু লেট হয়েছে।অন্যান্য দিন তো আমি ১০ টা থেকে ১১ টার মাঝে চলে আসি,না? ‘
-‘ হ্যাঁ।বেছে বেছে আজকে রাতেই তোকে দেরী করে ফিরতে হল।বেশ করেছিস খুবই মহৎ কাজ করেছিস।এখন আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা।একদম সহ্য হচ্ছেনা তোকে আমার। ‘

পুলক গম্ভীরস্বরে বলল, ‘ একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? ‘

শ্রুতি আর কোনো জবাব না দিয়ে উঠে রুমে চলে গেল।তারপর খুব শব্দ করে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিল।মেজাজ খুব বিগড়ে গেছে আজ।কী এমন কাজ পরে গিয়েছিল যে নিজের বিবাহবার্ষিকীর কথা পর্যন্ত মনে ছিলনা ওর।রাগে সারা শরীর কাঁপছে শ্রুতি’র।পুলক বুঝতে পেরেছে শ্রুতি এখন ওয়াশরুমে বসে কান্না করছে।ডেকেও কোনো লাভ নেই।মেয়েটার মাঝে ভালোবাসার কমতি না থাকলেও রাগের পরিমাণটাও অসীম।পুলক রুম থেকে বেরিয়ে গেল।পনের মিনিট পর চোখ মুখ লাল করে শ্রুতি ওয়াশরুম থেকে বের হল।রুমে ঢুকে যখন দেখল পুলক নেই মেজাজ তখন আরো গরম হয়ে গেল। কোনো কিছু চেইঞ্জ না করেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।এপাশ ওপাশ করেই চলেছে।মাথা গরম থাকলে তো ঘুমও চোখে নামতে ভয় পায়।শ্রুতি ভাবছে এই বুঝি পুলক রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে মান ভাঙাবে।কিন্তু না ওর তো আসার কোনো খবরই নেই।বিছানা থেকে উঠে কড়া ডোজের একটু ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে দিল।কারণ যতক্ষণ অবদি ঘুম না আসবে ততক্ষন অবদি ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকবে।কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমের ভাবটা প্রায় চলে এসেছে।ঘুমে চোখের ঝাঁপি দুটো নেমে গেছে।ঠিক তখনই কেউ একজন শ্রুতি’র রুমে এসে দাঁড়াল।
শ্রুতি’র চোখের সামনে হাত নেড়ে দেখল ঘুমিয়ে পরেছে কিনা।

 

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২৫

1

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৫

লেখিকা: সুলতানা তমা

আয়নার সামনে বসে চুল আছড়াচ্ছি আর ভাবছি ঘুরতে না গেলেই ভালো হতো। যে আমাকে এতো সন্দেহ করে তার সাথে ঘুরতে যাবো কেন? কিন্তু উপায় নেই তোহার জন্য যেতেই হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে হয়ে চুলে খোঁপা করছিলাম হুট করে মেঘ এসে পিছনে দাঁড়ালো, দেখেও না দেখার ভাণ করে খোঁপা ঠিক করতে মন দিলাম। উঠতে চাইলাম তখনি মেঘ পিছন থেকে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো, বসতেই ও বেলী ফুলের মালা দুটু চুলের খোঁপায় পেঁচিয়ে দিলো। আয়নায় মেঘের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি, মেঘ মুচকি হেসে সরে গেল। আমি উঠে শাড়ি ঠিক করছি কুচিগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেছে, হুট করে মেঘ এসে আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো।
মেঘ: দাও আমি ঠিক করে দিচ্ছি। (কিছুনা বলে সরে আসলাম, মেঘ আবারো আমার কাছে আসলো)
মেঘ: সব গুলো কুচি এলোমেলো হয়ে গেছে দাও ঠিক করে দিচ্ছি।
আমি: লাগবে না আমি একাই পারবো।
মেঘ: কণা এবার কিন্তু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমিতো সব ভুলে রাতে তোমার রাগ ভাঙাতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি কি করলে? তোহা আর আমাকে রেখে সোফায় গিয়ে ঘুমালে।
আমি: বেশ করেছি সোফায় ঘুমিয়েছি বেশি কথা বললে ঘুরতে যাবো না।
মেঘ: কণা আর কতোবার সরি বলবো?
আমি: যে মনের মধ্যে সন্দেহ পুষে রেখে উপরে সরি বলে তার সাথে আমার কোনো কথা নেই সরো এখান থেকে।
মেঘ: এতো পাগলামি করো কেন? (চলে আসছিলাম মেঘ পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলো)
আমি: ছাড়ো তো!
মেঘ: ঘুরতে যাচ্ছি কোথায় হাসি মুখে থাকবে তা না প্যাচির মতো মুখ করে রেখেছ।
আমি: প্যাচিই ভালো, হয়েছে?
মেঘ: না হয়নি তোমাকে হাসি মুখে যেতে হবে। (আমাকে টেনে ওর কাছে নিয়ে গেল, আমার দুগালে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: তুমি বুঝনা কেন তোমাকে যেমন বারবার ফাঁসানো হয়েছিল আমাকেও সেভাবে ফাঁসানো হচ্ছে। আচ্ছা তুমি ভাবলে কিভাবে আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি তারপরও অন্য কারো সাথে.. ছিঃ এসব ভাবতেই তো রাগ হচ্ছে।
মেঘ: বললাম তো সরি।
আমি: লাগবে না। (মেঘ আমাকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো, ইচ্ছে হচ্ছে কান্না করি কিন্তু বেরুনোর সময় কাঁদলে মেঘ রেগে যাবে)
মেঘ: তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে। (মেঘ আমার নাকে গালে ঠোঁটে ওর ঠোঁট ঘষছে, চোখ দুটু বুজে ফেললাম। মেঘ আলতো করে ঠোঁট দুটু ওর ঠোঁটের ভিতরে নিয়ে গেল)
পপি: এএএ আমি কিছু দেখিনি। (পপির কন্ঠ শুনে মেঘ আমাকে ছেড়ে দূরে সরে গেল, ইসস কি লজ্জাটাই না পেলাম মেঘটা যে কি হুটহাট এসব শুরু করে)
রুহান: আমরা রেডি চলো। (রুহান শার্টের হাত ঠিক করতে করতে রুমে এসে ঢুকলো, আমার আর পপির দিকে তাকিয়ে আছে)
রুহান: কি ব্যাপার দুজনেই নীরব কেন?
পপি: সেদিনেরটা শোধ হয়ে গেছে।
রুহান: মানে?
আমি: দাঁড়াও ফাজি মেয়ে।
তোহা: আমি রেডি।
রুহান: তোহাকে তো আজ একদম পরীর মতো লাগছে।
তোহা: আমিতো পরীই আমার আব্বু আম্মুর পরী।
আমি: চলো মামুনি।
রুহান: ভাইয়া এসো।

ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি বাবা মা আর দাদী বসে গল্প করছেন।
মেঘ: আম্মু যাচ্ছি।
মা: সাবধানে..
আমি: আপনারা গেলে ভালো হতো।
পপি: হ্যাঁ আম্মু তোমরা না করলে কেন?
বাবা: বুড়ো বয়সে ঘুরাফেরা ভালো লাগেনা তোরা ঘুরে আয়।
রুহান: ঠিক আছে।
মেঘ আমি তোহা আর রুহান পপি সবাই বেরিয়ে পড়লাম, উদ্দেশ্য তোহাকে নিয়ে শিশু পার্কে যাওয়া।

রিক্সায় বসে আছি আর বারবার মেঘের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি, সন্দেহ করে আবার ভালোও বাসে। একহাতে তোহাকে ধরে আছে অন্যহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে, মনে হচ্ছে আমি তোহার মতো ছোট বাচ্চা যেকোনো সময় রিক্সা থেকে পড়ে যেতে পারি তাই ও এভাবে আগলে রেখেছে।
মেঘ: এভাবে বারবার দেখোনা তো নজর লেগে যাবে। (মেঘের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলাম, ও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে)
মেঘ: পপির কথামতো রিক্সায় করে না আসলে এতো সুন্দর মুহূর্তটা মিস করে ফেলতাম।
তোহা: হ্যাঁ ফুফিই তো আমাকে বলেছিল ঘুরতে যাওয়ার কথা তোমাদের বলার জন্য।
মেঘ: ওরে ফাজি মেয়ে এখন নাম বলা হচ্ছে?
তোহা: ফুফি নিষেধ করেছিল। (তোহা ওর ছোট ছোট কোমল হাত দুইটা মুখে চেপে ধরে হাসছে মনে হচ্ছে ও সব বুঝে, মুগ্ধ হয়ে ওর এই হাসি দেখছি আমি)
মেঘ: কণা সরি।
আমি: কেন?
মেঘ: আসলে এসব পিক দেখে মাথা ঠিক ছিল না…
আমি: এসব ওরা ইচ্ছে করেই করেছে আমাদের আলাদা করার জন্য।
মেঘ: হুহ বললেই হলো নাকি? আমাদের দুজনকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কণা ভালোবাসি তোমায়।
তোহা: আমি শুনে ফেলেছি। (কণা হাত তালি দিচ্ছে দেখে ওর দুহাত মুঠো করে ধরলাম)
আমি: মামুনি চুপ।
তোহা: হিহিহি..
আমি: মেঘ তুমিও না।
মেঘ: আমি কি করে জানবো এই পুঁচকে মেয়ে যে বুঝে ফেলবে।
তোহা: আমি সব বুঝি আমাকে ফুফি সব শিখিয়েছে।
মেঘ: আজ পপির খবর আছে এই মেয়েকে ফাজি পপিই বানাচ্ছে।
তোহা: ফুফিকে কিছু বললে তোমার কান মলে দিবো হুম।
আমি: মামুনি চুপ করো তোমার আব্বু রেগে গেলে কিন্তু ঘুরতে নিয়ে যাবে না।
তোহা: ওকে চুপ। (তোহা একটা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললো আসলেই ফাজি মেয়ে একটা)

পার্কে আসতেই তোহা ছুটাছুটি শুরু করে দিলো। পপি আর রুহান আলাদা গিয়ে বসলো, মেয়েকে এভাবে একা ছাড়া ঠিক হবে না তাই আমি তোহার কাছে চলে আসলাম।
তোহা: নতুন আম্মু চলো খেলবো। (তোহা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল)

তোহার সাথে আমিও ছুটাছুটি করছি, মনে হচ্ছে অনেক দিন পর একটু শান্তি পাচ্ছি। হঠাৎ মেঘের দিকে চোখ পড়লো একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। মেঘের দিকে এগিয়ে আসলাম।
আমি: থ্যাংকস!
মেঘ: কেন?
আমি: এইযে এমন একটা জায়গায় নিয়ে আসলে, মনে হচ্ছে সব বাচ্চাদের মতো আমিও বাচ্চা হয়ে যাই।
মেঘ: তুমি তো বাচ্চাই যেভাবে ছুটাছুটি করছিলে মনে হচ্ছিল কোনো বাচ্চা মেয়ে অনেকদিন পর তার স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছে। অবশ্য তুমি তো স্বাধীনতা পেয়েই বড় হয়েছ, শুধু বিয়ের পর আমি তোমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছি।
আমি: মানে কি?
মেঘ: এইযে তোমার কতো সুন্দর একটা জীবন ছিল, হুট করে আমাদের বিয়ে হলো তারপর একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে।
আমি: তাতে তো তোমার দোষ নেই এসব তো আমারই মামা করেছে।
মেঘ: হুম তবুও…
আমি: ঘুরতে এসেছ কি এসব শুনানোর জন্য?
মেঘ: এই রাগ করনা প্লিজ তোহার কাছে যাও আমি মা মেয়ে দুজনকে মুগ্ধ হয়ে দেখি। (মেঘের কথা শুনে মুচকি হেসে তোহার দিকে এগিয়ে গেলাম)

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসবে এবার যাওয়া প্রয়োজন। মেঘের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি: বিকেল হয়ে এসেছে বাসায় চলো।
মেঘ: রুহান আর পপিকে ডাক দাও আমি তোহাকে নিয়ে আসছি। (রুহানদের হাত দিয়ে ইশারা দিতেই ওরা উঠে চলে আসলো)
তোহা: আমি যাবো না আমি এখানে আরো কিছুক্ষণ থাকবো। (তোহা মেঘের কোল থেকে জোড় করে নেমে যাচ্ছে দেখে এগিয়ে গিয়ে ওকে আমার কোলে আনলাম)
আমি: মামুনি সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো আর এখানে থাকা যাবে না আমরা আর একদিন আসবো কেমন?
তোহা: সত্যি আসবে তো?
আমি: হ্যাঁ আসবো।
তোহা: তাহলে বাসায় চলো।

পার্ক থেকে বেরিয়ে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, রুহান রিক্সা ডাকতে গেল। পপির ফোন বাজছে ফোন নিয়ে পপি কিছুটা দূরে চলে গেল।
তোহা: আব্বু ওইযে বেলুন। (তোহা আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার অপর পাশে বেলুন দেখাচ্ছে)
মেঘ: তোমার আম্মুর কাছে দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।
তোহা: ঠিক আছে। (মেঘ চলে যেতেই তোহা আমার আঙ্গুল ধরে আমার দিকে তাকালো)
আমি: কি মামুনি?
তোহা: কিছুনা। (তোহা আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
তোহা: তোমার মতো আম্মু যেন সবার হয়। (তোহা মুচকি হাসলো আমিও হেসে তোহার নাক টেনে দিলাম)
–এইযে (পিছন থেকে কেউ ডাকছে শুনে পিছন ফিরে তাকালাম, তাকাতেই দেখি সেই লোকটা। আতকে উঠে মেঘের দিকে তাকালাম ও বেলুন কিনছে এদিকে তাকাচ্ছেই না)
আমি: আপনি?
তোহা: নতুন আম্মু এই পঁচা লোকটা কে? (তোহার কথা শুনে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম)
–বলেছিলাম তো আমি সবসময় তোমাকে ফলো করি। পিক দিয়ে কোনো কাজ হয়নি কিন্তু আজ হবে, আমি তোদের আলাদা করব আজ। (লোকটা জোড় করে আমার হাত দুটু চেপে ধরলো, তোহার হাত আমার হাত থেকে ছুটে গেল। তোহার দিকে তাকালাম ভয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না)
আমি: মেঘ.. (মেঘকে ডাক দিতে গিয়ে মাঝ রাস্তায় নজর পড়লো তোহা মাঝ রাস্তায় চলে গেছে, মেঘ আমার হাত লোকটার হাতের মুঠোয় দেখে দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: মেঘ তোহা..(মেঘ তো আমার ডাক শুনছেই না রাস্তার দিকেও তাকাচ্ছে না যে তোহাকে দেখবে)
আমি: পপি তোহা মাঝ রাস্তায় চলে গেছে। (পপি পিছন ফিরে তাকিয়েই তোহার দিকে দৌড় দিল, পপির দৌড়ানো দেখে মেঘও তোহার দিকে তাকালো। দুজনেই দৌড়ে আসছে কখন জানি গাড়ি চলে আসে)
আমি: ছাড় বলছি আমার মেয়ে…
–তোর মামার গাড়ি এসে তোর মেয়েকে পিষে ফেলবে তারপর ছাড়বো। (ওর কথা শুনে তোহার দিকে তাকালাম একটা প্রাইভেট কার একদম তোহার কাছে, চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিলো সব কেমন যেন নীরব লাগছে, চোখ খুলে তোহার দিকে তাকালাম রক্তে লাল হয়ে নিথর হয়ে পরে আছে তোহা। দৌড়ে তোহার দিকে এগিয়ে আসলাম)

মেঘ বোবার মতো বসে আছে রুহান কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসলো চারপাশে শুধু মানুষ, তোহার মাথাটা আমার কোলের উপর রাখলাম।
পপি: তোহা কথা বল মামুনি।
আমি: তোহা…(তোহা তো নিথর হয়ে পরে আছে চোখ খুলছে না)
রুহান: ছাড়ো ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। (রুহান আমার থেকে তোহাকে নিয়ে একটা গাড়িতে উঠে বসলো, সবকিছু কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। পপি আমার হাত ধরে টান দিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। গাড়ি হসপিটালের দিকে ছুটছে, এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু কেমন যেন উলটপালট হয়ে গেল)

তোহাকে নার্সরা অপারেশন থিয়েটারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমি দূরে দাঁড়িয়ে আছি। যতক্ষণ তোহাকে দেখা যায় তাকিয়ে রইলাম, হুট করে মাথাটা ঘুরে উঠলো দফ করে পড়ে গেলাম।

চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি হসপিটালের বেডে শুয়ে আছি পাশে আম্মু জোহা আর চাচ্চু। তোহার কথা মনে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠলাম।
আম্মু: উঠিস না তোর শরীর ভালো নেই।
আমি: আম্মু আমার তোহা..
আম্মু: ও ভালো হয়ে যাবে মা।
আমি: ছাড়ো আমি ওর কাছে যাবো।
জোহা: তোহা তো অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে কি করবে?
আমি: মেঘ কোথায়?
চাচ্চু: বাইরেই আছে। (জোহার হাত ছাড়িয়ে উঠে দৌড়ে বাইরে চলে আসলাম)

অপারেশন থিয়েটারের সামনে মেঘ আর ওদের পরিবারের সবাই বসে আছে। আস্তে আস্তে মেঘের দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমি: মেঘ..
পপি: এদিকে এসো। (পপি আমাকে একটু দূরে নিয়ে আসলো)
পপি: ভাইয়া তোমার উপর রেগে আছে এখন ভাইয়ার সাথে কথা বলতে যেও না। এখানে বসো তোমার শরীর ঠিক নেই। (চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লাম, চোখ থেকে অঝরে পানি পড়ছে। কি থেকে কি হয়ে গেল এক মুহূর্তের মধ্যে)
ভাবি: আমার মেয়েটাকে তোমরা আগলে রাখতে পারলে না? (ভাবির চিৎকার শুনে সামনে তাকালাম তোহাকে রক্ত দিয়ে এসেছে হয়তো। নার্স ভাবিকে এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো)
এখন তো সবাই আমাকে ভুল বুঝবে বলবে আমার মামা করেছে এসব, কি জবাব দিবো আমি মেঘকে? কি জবাব দিবো আমি ভাবিকে?

চারদিকে শুধু কান্নার আওয়াজ সবাই কাঁদছে তোহার জন্য, শুধু আমিই শব্দ করে কাঁদতে পারছি না। হঠাৎ অটি থেকে ডক্টর বেরিয়ে আসলো দৌড়ে ডক্টর এর কাছে গেলাম।
আমি: ডক্টর আমার মেয়ে…
ডক্টর: কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে কিন্তু ওর একটা পা ভেঙ্গে গেছে একটু বেশিই ভেঙ্গেছে, পা’টা ভালো হবে তবে অনেক দেরিতে।
আমি: তোহার কাছে যাবো আমি…
ডক্টর: কিছুক্ষণ পর আপনারা দেখা করতে পারবেন। (ডক্টর চলে গেল ফ্লোরেই বসে পড়লাম)
মা: বৌমা উঠো।
দাদী: তুই এভাবে ভেঙে পড়লে হবে? মেঘকে সামলাবে কে?
মেঘ: ওকে আমার প্রয়োজন নেই দাদী। (মেঘের কথা শুনে সবাই কান্না থামিয়ে ওর দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো)
বাবা: কি বলছিস এসব?
মেঘ: ঠিক কথা বলছি আব্বু, আমার জীবনে ওর আর কোনো প্রয়োজন নেই।
মা: মেঘ বুঝেশুনে কথা বল।
মেঘ: আমি সবদিক ভেবেই বলছি আম্মু।
আম্মু: হঠাৎ এই কথা কেন বলছ বাবা?
মেঘ: হঠাৎ নয় দুদিন ধরে ওর নষ্টামি আমি দেখছি ও বলেছিল এসব ওকে ফাঁসানোর জন্য করা হচ্ছে, বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম কিন্তু আজ তো ওর নষ্টামি নিজের চোখেই দেখেছি)
আমি: মেঘ এসব তুমি কি বলছ?
মেঘ: অস্বীকার করতে পারবে আজ তোমার জন্য তোহার এই অবস্থা হয়নি? তোমার কাছে তোহাকে রেখে বেলুন আনতে গিয়েছিলাম আর তুমি তোহার হাত ছেড়ে দিয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে নষ্টামি করছিলে, ভেবেছিলে আমি রাস্তার অন্যপাশ থেকে তোমার নষ্টামি দেখতে পাবো না।
চাচ্চু: মেঘ মুখ সামলে কথা বলো, তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়েকে এমন নোংরা কথা বলার?
মেঘ: আপনার মেয়ে নোংরামি করলে দোষ নেই আর আমি বললে দোষ?
বাবা: মেঘ..(বাবা এসে মেঘের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন)
বাবা: বাবার বয়সি লোকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় এইটাও শিখিসনি?
আমি: ওকে বকছ কেন তোমরা? বলতে দাও ওকে, ওর মাথা ঠিক নেই। তোহাকে খুব ভালোবাসে তো তা…
মেঘ: আমার মাথা ঠিক আছে কণা।
আমি: না ঠিক নেই তোমার মাথা, ঠিক থাকলে তুমি এসব বলতে পারতে না।
নার্স: আপনারা চাইলে বাচ্চাটির সাথে দেখা করতে পারেন। (নার্সের কথা শুনে কেবিনের দিকে পা বাড়ালাম কিন্তু মেঘ আমার হাত ধরে ফেললো)
মেঘ: কোথায় যাচ্ছ?
আমি: আমার মেয়ের কাছে।
মেঘ: তোহা তোমার মেয়ে নয়, যদি মেয়ে হতো তাহলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোহার হাত ছেড়ে অন্য পুরুষের হাত ধরতে না।
আমি: প্লিজ আমাকে তোহার কাছে যেতে দাও।
মেঘ: বললাম তো না। শায়লা তুমি যাও তোহার কাছে।
আমি: ছাড়ো আমাকে। (ঝটকা দিয়ে মেঘের থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে আনলাম)
আমি: দাদী, বাবা আপনারা মেঘকে বলুন না আমাকে একবার তোহার কাছে যেতে দিতে, আমি তোহাকে একনজর দেখবো শুধু।
বাবা: মেঘ…
মেঘ: আমি কারো কথা শুনতে চাই না।
আমি: মেঘ আমি তোমার পায়ে পড়ছি আমাকে একটাবার তোহার কাছে যেতে দাও।
মেঘ: বললাম তো না, আমার মেয়ের কাছে যাওয়ার ওকে স্পর্শ করার কোনো অধিকার নেই তোমার। (মেঘের পা থেকে আমার হাত সরিয়ে আমাকে তুলে ধাক্কা দিয়ে আম্মুর দিকে ফেলে দিলো। আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে মেঘকে রাগ দেখালেন)
আম্মু: মেঘ তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।
মেঘ: আজ থেকে কণার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মেয়ের ধারেকাছে যেন ওকে না দেখি, আমার চোখের সামনে যেন আর ওকে না দেখি।
মেঘের কথাগুলো শুনে ফ্লোরে বসে পড়লাম, কি বলছে মেঘ এসব? মেঘের কথা গুলো বারবার কানে বাজছে, বুঝতে পারছি আমি মেঘ আর তোহাকে হারিয়ে ফেলেছি চিরদিনের জন্য…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২৪

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৪

লেখিকা: সুলতানা তমা

ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাজে, চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছি মেঘ সোফায় বসে ল্যাপটপে কি যেন কাজ করছে। মেঘের দিকে বারবার তাকাচ্ছি সন্ধ্যার পর থেকে মেঘ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে আছে, আমার সাথে তেমন কথা বলছে না কি যেন শুধু ভাবে। সন্ধ্যায় কার আর কি মেসেজ এসেছিল জানিনা তবে এইটুকু বুঝতে পারছি এই মেসেজের কারণেই মেঘ এতো অন্যমনস্ক হয়ে আছে। মেঘের ফোন আমি অনেক সময় ঘাটাঘাটি করেছি কিন্তু মেসেজটা পাইনি, মেঘ হয়তো ডিলিট করে ফেলেছে। মেসেজটা কি ছিল আর কার ছিল জানতে পারলে ভালো হত।
মেঘ: ঘুমাচ্ছ না কেন? (মেঘের কথায় ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, পাশ ফিরে ওর দিকে তাকালাম)
আমি: তুমি ঘুমাবে না?
মেঘ: হু পরে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: রাগ করছ কেন ঘুমিয়ে পড়ো আমার কিছু কাজ আছে দেরি হবে।
কিছুনা বলে চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে রইলাম। মেঘ যখন লুকাতে চাইছে তাহলে আমি কেন জানতে চাইবো? যতো খুশি লুকিয়ে রাখুক।

মেঘ: কণা এই কণা উঠো। (মেঘের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো, চোখ খুলে আস্তে আস্তে ওর দিকে তাকালাম)
মেঘ: গুড মর্নিং।
আমি: হু!
মেঘ: অবাক হচ্ছ যে?
আমি: না দেখছি।
মেঘ: কি দেখছ? (অবাক হয়ে মেঘকে দেখছি রাতের মেঘ আর এখনের মেঘের মধ্যে এতো পার্থক্য। রাতে মুখ গোমরা করে ছিল অন্যমনস্ক ছিল আর এখন পুরো স্বাভাবিক)
মেঘ: কথা বলছ না কেন?
আমি: এখন তো তুমি স্বাভাবিক বলবে কাল কি হয়েছিল?
মেঘ: অফিসে যাবো মিটিং আছে পারলে সবকিছু একটু গুছিয়ে দাও।
আমি: এড়িয়ে যাচ্ছ?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: কিসের মিটিং?
মেঘ: তোমার চাচ্চু জানেন। (চুপচাপ উঠে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে চলে গেলাম)

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মেঘের দিকে তাকালাম, মেঘ আমার ফোন টিপছে আবার সেই কালকের চিন্তিত মুখ।
আমি: আমার ফোনে কি দেখছ?
মেঘ: কিছুনা তো।
আমি: দ্যাত সবসময় শুধু কথা লুকায়। (রাগে গজগজ করতে করতে ওর ঘড়ি ফাইল শার্ট প্যান্ট সবকিছু বিছানায় ছুড়ে দিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম)

বেশ বুঝতে পারছি মেঘ আমাকে এড়িয়ে চলছে, মেঘ এইটা কেন বুঝতে পারছে না এভাবে এড়িয়ে চললে আমাদের সম্পর্কে ভাঙ্গন ধরবে। আর আমিতো ওর বউ তাহলে আমার কাছে কোনো কিছু লুকিয়ে রাখবে কেন আমাকে এড়িয়ে চলবে কেন?
মেঘ: কাঁদছ কেন তুমি? (মেঘ এসে আমার পাশে দাঁড়ালো, কিছুনা বলে চোখের পানি মুছে নিলাম)
মেঘ: বলনা কাঁদছ কেন?
আমি: তাতে তোমার কি?
মেঘ: আমারই তো সবকিছু আমার পাগলী কাঁদবে কেন? (মেঘ আমার দুগালে ধরে আমার কপালে ওর কপাল ঠেকালো)
আমি: ইদানীং তুমি আমাকে এড়িয়ে চলছ।
মেঘ: কখন এড়িয়ে চললাম?
আমি: এইযে এখন নিজেই টাই বেঁধে নিলে।
মেঘ: তুমিই তো বলো রোজরোজ টাই বেঁধে দিতে পারবে না।
আমি: এসব তো এমনি বলি।
মেঘ: ওকে.. (মেঘ আমাকে ছেড়ে টাই খুলে নিলো)
মেঘ: নাও এবার বেঁধে দাও।
আমি: পারবো না। (একটানে আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেল, আমার ঠোঁটের একদম কাছে ওর ঠোঁট দুটু আনলো)
মেঘ: অফিসে যাবো প্লিজ মুখ গোমড়া করে থেকো না, একটা মিষ্টি হাসি দাও।
মৃদু হেসে ওর টাই বেঁধে দিলাম, আমার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে মেঘ বেরিয়ে গেল।

ফোনের কোনো কিছু বাকি রাখিনি মেসেজ, মেসেঞ্জার, হোয়াটএ্যাপস সবকিছু দেখলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না, আশ্চর্য মেঘ তাহলে সকালে আমার ফোনে কি দেখছিল? নাকি ও দেখে ডিলিট করে ফেলেছে?
রুহান: কণা আসবো? (রুহানের ডাকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, রুহান দরজায় দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: হ্যাঁ এসো। (রুহান এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো)
আমি: কিছু বলবে?
রুহান: আম্মুর ব্যাপারে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।
আমি: গতকাল থানায় গিয়েছিলাম চাঁচিকে দেখে এসেছি।
রুহান: আম্মু…
আমি: শুধরাননি উনি।
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: আমি কিন্তু ভেবে রেখেছিলাম উনি নিজেকে কিছুটা শুধরিয়ে নিলে আমি উনাকে ছাড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসবো কিন্তু…
রুহান: আমি আম্মুর সাথে একবার কথা বলতে চাই।
আমি: চাইলে বলতেই পারো কিন্তু আমার মনে হয় না কোনো লাভ হবে। কাল উনি আমার সাথে যেভাবে কথা বলেছেন তাতে বুঝতে পেরেছি উনি এতটুকুও নিজেকে বদলাননি আগের মতোই আছেন।
রুহান: একটু চেষ্টা করে দেখি।
আমি: হুম আজ থানায় চলে যাও।
রুহান: আমি আম্মুকে বুঝাতে পারলে তুমি…
আমি: হুম ছাড়িয়ে আনবো।
রুহান: ঠিক আছে আসছি।
রুহান বেরিয়ে যেতেই পিছু পিছু আমিও বেরিয়ে আসলাম।

পপি: ভাবি তুমি নাশতা করবে না?
মা: মেঘ তোমাকে জাগাতে মানা করলো তাই সবাই তোমাকে রেখেই নাশতা করে নিলাম।
আমি: এখন কিছু খাবো না মা পরে খেয়ে নিবো।
মা: খেয়ে নিও কিন্তু।
দাদী: এই এদিকে আয় তো। (দাদী আমার হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসালেন)
আমি: কি হয়েছে দাদী?
দাদী: তুই আর মেঘ কি বুঝেছিস বলতো?
আমি: মানে?
দাদী: বিয়ে হয়েছে এতোদিন হয়ে গেল অথচ কোনো খুশির সংবাদ শুনতে পাচ্ছি না কেন?
আমি: দাদী…
দাদী: আরে বাবা লজ্জা কিসের? তোহার একটা ভাই লাগবে না?
আমি: দ্যাত আপনি থাকুন আমি চলে যাচ্ছি।
দাদী: আমি কিন্তু মেঘকে বলবো খুব শীঘ্রই খুশির সংবাদ চাই। (দাদী জোরে জোরে কথাটা বললেন মা আর পপি হাসছে দেখে দৌড়ে উপরে চলে আসলাম)

তোহা: নতুন আম্মু চলনা আমার সাথে। (রুমের দিকে যাচ্ছিলাম হঠাৎ তোহা পিছন থেকে আচলে ধরলো)
আমি: কোথায় মামুনি?
তোহা: বাগানে যাবো।
আমি: কেন?
তোহা: চলই না।
তোহা আমার হাত ধরে টেনে বাগানের দিকে এগিয়ে গেল।

আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তোহা ফুল গাছের দিকে এগিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ের কান্ড দেখছি। তোহা একটা একটা করে বেলী ফুল গাছ থেকে নিচ্ছে দেখে আমিও এগিয়ে আসলাম।
আমি: ফুল দিয়ে কি করবে তোহা?
তোহা: উফফ মেয়েটা বড্ড বেশি কথা বলে, এতো কথা না বলে কিছু ফুল তুলে দাওতো। (মেয়ের কথা শুনে না হেসে পারলাম না)
তোহা: এই দেখো এখনো বসে আছে আরে কিছু ফুল তুলে দাও আমার অনেক ফুল লাগবে।
আমি: কিন্তু মামুনি গাছ থেকে ফুল ছেঁড়া তো ঠিক না গাছ কষ্ট পায়।
তোহা: আম্মু আব্বুর জন্য একটু ছেঁড়া যা… (তোহা জিহ্বায় কামর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
তোহা: এই যাহ্‌ বলে দিলাম।
আমি: গণ্ডগোল আছে মনে হচ্ছে? আমার আম্মুর মাথায় কি ঘুরপাক খাচ্ছে?
তোহা: বলা যাবে না।
আমি: খুব পেকে গেছ আম্মুর থেকে কথা লুকানো হচ্ছে?
তোহা: উঁহু আমি পঁচা মেয়ে নই কথা লুকাবো কেন?
আমি: তাহলে বলো ফুল দিয়ে কি করবে?
তোহা: পরে বলবো সারপ্রাইজ।
আমি: ওলে বাবা আমার আম্মু সারপ্রাইজ দিতে শিখে গেছে?
তোহা: হ্যাঁ ফুফি শিখিয়েছে। আর কথা নয় এখন ঝটপট ফুল তুলে দাওতো।
আমি: দিচ্ছি দিচ্ছি।
ঝুড়ি ভরে ফুল তুলে দিলাম। ফুলের ঝুড়িটা হাতে নিয়ে তোহা লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে গেল, মেয়েটাই জানে এতো বেলী ফুল দিয়ে কি করবে।

তোহা ফুল নিয়ে পপির রুমের দিকে চলে গেল, আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
রুমে আসতেই শুনতে পেলাম আমার ফোন বাজছে হাতে নিয়ে দেখি আম্মু।
আমি: হ্যালো আম্মু।
আম্মু: একটু বেরুতে পারবি?
আমি: কেন আম্মু?
আম্মু: একটু উকিলের কাছে যেতাম।
আমি: হঠাৎ উকিলের কাছে কেন?
আম্মু: ইকবালকে নিয়ে একটু কথা বলে দেখতাম। আসলে শায়লার মুখের দিকে তাকানো যায়না মেয়েটা শুধু কাঁদে।
আমি: ঠিক আছে তুমি আবার কেঁদো না তো।
আম্মু: ঠিক আছে চলে আসিস।
আমি: আচ্ছা।
ফোন রেখে ভাবছি মেঘকে ফোন করবো কিনা। মেঘকে তো বলে যাওয়া প্রয়োজন, কিন্তু মেঘ তো এখন মিটিং এ ফোন দিলে তো রেগে যাবে। থাকুক আম্মুর সাথেই তো যাচ্ছি এসে বলে দিবো।

রেডি হয়ে দাদী আর মা’কে বলে বেরিয়ে পড়লাম। উকিলের কাছে তো যাচ্ছি অযতা, কোনো লাভ হবে না। শুধু আম্মুর মনের অশান্তিটা দূর করার জন্য যাচ্ছি। পুলিশ আঙ্কেল তো বলেছেন তিন-চার বছরের আগে সম্ভব না কিন্তু এ কথা আম্মুকে বুঝাই কি করে?

বাসায় এসে কলিংবেল বাজাতেই ভাবি এসে দরজা খুলে দিলো।
আমি: ভালো আছ?
ভাবি: হ্যাঁ তুমি?
আমি: ভালো, আম্মু কোথায় রেডি হয়েছে?
ভাবি: হ্যাঁ।
আম্মু: কিরে চলে এসেছিস?
আমি: হ্যাঁ চলো।
আম্মু: ভিতরে এসে কিছু খেয়ে যা।
আমি: খিদে তো আছে কিন্তু সম্ভব না সন্ধ্যার আগে বাসায় পৌঁছাতে হবে।
আম্মু: ঠিক আছে চল।
আম্মুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

উকিল: দেখুন আপনারা যা যা বলেছেন সে অনুযায়ী মনে হচ্ছেনা কাজটা এতো সহজ হবে, চার- পাঁচবছর এর আগে তো কোনোভাবেই সম্ভব না। (উকিলের কথা শুনে আম্মু কেঁদে ফেললেন, আগেই বলেছিলাম কিন্তু আম্মু শুনেনি)
আম্মু: কোনো ভাবেই কি সম্ভব না?
আমি: আম্মু তুমি কথা বলো আমি একটু আসছি।
রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, আম্মুর কান্নাকাটি দেখতে ভালো লাগেনা। আমিও তো চেয়েছিলাম ভাইয়াকে ছাড়িয়ে নিতে কিন্তু পাপ যে বেশি করে ফেলেছে তাতে আমাদের কি করার আছে, পাপ করলে শাস্তি পেতে হবে এটাই স্বাভাবিক। আমিতো ভাবছি আমার শ্রদ্ধেয় মামা কবে এরেস্ট হবেন, উনি এরেস্ট হলেই আমি চিন্তা মুক্ত হবো। আচ্ছা পুলিশ আঙ্কেল কে একটা ফোন করবো? করেই দেখি কি বলে।

আঙ্কেল: হ্যাঁ কণা মা…
আমি: কিছু করতে পারলেন?
আঙ্কেল: না তবে ইকবাল একটা জায়গার নাম বলছিল যেখানে ওর বাবা সবসময় থাকে আগামীকাল আমরা সেখানেই যাবো।
আমি: যতো দ্রুত সম্ভব ওকে ধরার চেষ্টা করুন।
আঙ্কেল: ঠিক আছে।
আমি: রাখছি।
আম্মু: কণা চল। (ফোন রাখতেই আম্মু এসে পিছন থেকে ডাক দিলেন)
আমি: কথা বলা শেষ?
আম্মু: হুম।
আমি: হবে না বললো তো? আমিতো তোমাকে আগেই বলেছিলাম শুননি আমার কথা।
আম্মু: মেয়েটার কথা ভেবে এসেছিলাম কিযে হবে মেয়েটার।
আমি: কেন তোমার কাছে থাকবে।
আম্মু: তাতো থাকবেই চল বাসায় ফিরে যাই।
আমি: আম্মু আমার খুব খিদে লেগেছে কিছু না খেলে আমি আর থাকতে পারবো না।
আম্মু: ঠিক সময় না খেয়ে অসময়ে খাওয়ার অভ্যাসটা ছাড়িসনি দেখছি। চল রাস্তায় কোনো রেস্টুরেন্টে কিছু খেয়ে নিবি।
আমি: ঠিক আছে।

পাশের একটা রেস্টুরেন্টে খেতে আসলাম। যদিও আমি বাইরের খাবার অপছন্দ করি পেটের জন্য আসতে হলো, কেন যে সকালে কিছু খেলাম না, এখন তো দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে খিদে তো লাগবেই।
আম্মু: তুই খাবার অর্ডার কর আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।
আমি: ঠিক আছে। (পা নাচাচ্ছি আর খাবারের মেনু দেখছি হুট করে কে যেন আমার সামনে এসে বসলো। সামনে তাকিয়ে দেখি কালকের সেই লোকটা যে আমার হাত ধরেছিল। চোখ বড়বড় করে তাকালাম ওর দিকে)
আমি: কি ব্যাপার আপনি?
–চিনতে পেরেছ তাহলে?
আমি: চিনবো না কেন? কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন?
–আসলে আমি তোমাকে ফলো করছিলাম। দেখলাম তুমি রেস্টুরেন্টে ঢুকেছ তাও আবার তোমার আম্মু পাশে নেই তাই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে এখানে এসে বসলাম।
আমি: ফলো করছিলেন মানে? আপনি কি আমাকে চিনেন? তারমানে গতকাল ভুল করে নয় আপনি ইচ্ছে করেই আমার হাত ধরেছিলেন।
–বোকা মেয়ে এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছ?
আমি: কি চান আপনি?
–আসলে তোমাকে ফাঁসানো হচ্ছে আমিতো তোমাকে হেল্প করতে এসেছি। (লোকটা ফিসফিসিয়ে কথাটা বললো, আমি হা হয়ে তাকিয়ে আছি)
–জায়গাটা নিরাপদ নয় তাই এখানে সবকিছু বুঝিয়ে বলা সম্ভব না, এইযে চিঠিটা নাও এখানে সবকিছু লেখা আছে। (লোকটা আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো, ভাবছি নিবো কিনা)
–আরে নাও আমি বেশি সময় তোমার কাছে থাকতে পারবো না। (কাগজটা আনার জন্য হাত বাড়াতেই কাগজ দিতে দিতে লোকটা আমার হাত ধরে ফেললো)
আমি: একি করছেন হাত ছাড়ুন।
–না ছাড়লে?
আমি: না ছাড়লে? দাঁড়া দেখাচ্ছি। (আমি পায়ের জুতা খুলছি দেখে লোকটা আমার হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল)
আম্মু: কণা কি হয়েছে কাকে দৌড়াচ্ছিস?
ওয়েটার: মেডাম কোনো সমস্যা?
আমি: না। আম্মু চলো জায়গাটা আমাদের জন্য সেইফ না।
আম্মু: ঠিক আছে চল।

গাড়িতে বসে ভাবছি লোকটা কে ছিল আর কেনই বা এমন করছিল? লোকটা দুদিন আমার হাত ধরলো কিন্তু কেন? আচ্ছা এমন নয়তো মেঘকে যেভাবে বারবার ফাঁসানো হয়েছিল সেভাবে আমাকে এখন ফাঁসানো হচ্ছে? হয়তো লোকটা আমার হাত ধরার সময় আড়াল থেকে কেউ ছবি তুলেছিল আর সেটা গতকাল মেঘকে পাঠিয়েছিল যার কারণে মেঘ আমার সাথে এমন করেছে। যদি আমার ধারণা ঠিক হয় তাহলে তো আজও ছবি তুলেছে আর সে ছবি অবশ্যই মেঘকে দিবে। যে এই কাজ করছে তার আসল উদ্দ্যেশ্য মেঘ আর আমাকে আলাদা করে ফেলা। কিন্তু কে সে মামা নয়তো?
আম্মু: কণা কি ভাবছিস? আমরা তো চলে এসেছি নেমে আয়। (হঠাৎ আম্মুর ডাকে হকচকিয়ে উঠলাম, তাকিয়ে দেখি বাসার সামনে চলে এসেছি)
আমি: না আম্মু ভিতরে যাবো না বাসায় চলে যাবো। বিকেল হয়ে এসেছে তোহা আমাকে খুঁজবে।
আম্মু: ঠিক আছে সাবধানে যাস।
আমি: আচ্ছা।
আম্মুর থেকে বিদায় নিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।

দাদী: কিরে চলে এসেছিস? তোর মা কেমন আছে? (ড্রয়িংরুমে আসতেই দাদী বসা থেকে উঠে আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন)
আমি: ভালো দাদী।
দাদী: আচ্ছা তোর আর মেঘের মধ্যে কি ঝগড়া হয়েছে?
আমি: নাতো কেন?
দাদী: এই অসময়ে অফিস থেকে ফিরে আসলো মুখটা দেখলাম গম্ভীর।
আমি: কি মেঘ চলে এসেছে?
দাদী: হ্যাঁ এইমাত্র আসলো।
আমি: ঠিক আছে আমি আসছি।
দাদী: যা গিয়ে দেখ কি হয়েছে।
দৌড়ে রুমের দিকে আসলাম।

মেঘ দরজা খুলা রেখেই বেডে বসে আছে, মাথায় হাত দিয়ে মাথাটা নিচু করে রেখেছে।
আমি: মেঘ.. (আমার ডাকে মাথা তুলে সামনে তাকালো)
মেঘ: কোথায় গিয়েছিলে?
আমি: আম্মুর সাথে উকিলের কাছে।
মেঘ: সত্যি নাকি অন্য কোথাও গিয়েছিলে? আমাকে বলে যাওনি কেন? (আমার সন্দেহটাই ঠিক, মেঘকে আজকের ছবি দেওয়া হয়েছে আর মেঘ এসব দেখে বাসায় চলে এসেছে)
আমি: তুমি মিটিং এ ছিলে তাই ফোন করে বিরক্ত করিনি।
মেঘ: আমি যদি বলি তুমি অন্য কোথাও গিয়েছিলে?
আমি: আমাকে বিশ্বাস না করাটা তোমার ব্যর্থতা তবে আম্মুর থেকে জেনে নিতে পারো।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: আমাকে সন্দেহ করার আগে তোমার আমাকে একবার সবকিছু জানানোর প্রয়োজন ছিল, এসব সত্যি কিনা জানতে চাওয়া উচিত ছিল।
মেঘ: তারমানে তুমি…
আমি: জানিনা তবে আন্দাজ করে নিয়েছি।
মেঘ: আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না তবে এটাও সত্যি রোজ রোজ একি জিনিস দেখলে…
আমি: বউকে অবিশ্বাস করা যায় তাইতো?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: তুমি আমাকে কিছু জানাওনি তাই শুধু এইটুকু বলে রাখছি তোমাকে যেমন বারবার ফাঁসানো হয়েছিল ঠিক সেভাবে আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।
তোহা: এই তোমরা এতো দুষ্টু কেন সবসময় শুধু ঝগড়া করো। (মেঘ কিছু বলার জন্য আমার দিকে এগিয়ে আসছিল তোহা মাঝখানে চলে আসাতে মেঘ থেমে গেল)
আমি: তোমার হাত পিছনে কেন আম্মু হাতে কি আছে?
তোহা: বলেছিলাম না সারপ্রাইজ। (তোহা হাসতে হাসতে হাত দুটু সামনে নিয়ে আসলো, দু হাতে দুটু বেলী ফুলের মালা)
আমি: এই মালা কে বানিয়ে দিলো?
তোহা: ফুফি।
মেঘ: খুব সুন্দর হয়েছে মামুনি এবার তুমি খেলতে যাও।
তোহা: না আমিতো মালাগুলো তোমাদের দেওয়ার জন্য এসেছি। তোমরা মালা গুলো নিয়ে একে অপরকে পড়িয়ে দিবে আর বিনিময়ে আমাকে কিছু দিবে।
মেঘ: কি চাও তুমি?
তোহা: আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাবো।
মেঘ: কিন্তু..
আমি: থাকুক না মেয়েটা চাইছে যখন তখন নাহয় যাবো।
মেঘ: তোহা এসব তোমাকে কে শিখিয়ে দিয়েছে?
তোহা: নাম বলা যাবে না তুমি বলো যাবে কিনা?
মেঘ: ঠিক আছে আগামীকাল যাবো।
তোহা: এবার মালাটা নাও আর নতুন আম্মুকে পড়িয়ে দাও।
মেঘ: পরে পড়িয়ে দিবো তুমি যাও। (মেঘ তোহার থেকে মালা আনতেই তোহা দৌড়ে চলে গেল)
মেঘ: বয়েই গেছে তোমাকে মালা পড়াতে। এসব যদি সত্যি হয়…(মেঘ আঙ্গুল তুলে আমাকে শাসাচ্ছিল ওর আঙ্গুলটা নামিয়ে দিলাম)
আমি: ওইযে ওয়াশরুমটা ওইদিকে মাথায় পানি ঢেলে আসো তাহলে হয়তো মাথায় ঢুকবে যে এসব আমাকে ফাঁসানোর জন্য করা হচ্ছে।

মেঘ দাঁড়িয়ে আছে এখনো আমি বারান্দায় চলে এসেছি। যে বুঝেও না বুঝে তাকে কি বুঝানো যায়? আমাদের সাথে বারবার এমন হচ্ছে তাও মেঘ কিভাবে আমাকে সন্দেহ করতে পারলো? আমাকে সন্দেহ করার আগে তো ওর একবার ভাবা উচিত ছিল এসব পিক শুধু ওকে দেওয়া হয় কেন আর আমাকেও তো জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। এসব না ভেবে আমাকে জিজ্ঞেস না করে মেঘ নিজে নিজে ভেবে আমাকে সন্দেহ করে বসে আছে। থাকুক আমিও কোনো কিছু বুঝাতে বা বিশ্বাস করাতে যাবো না। সন্দেহ খুব খারাপ জিনিস যখন এই সন্দেহের কারণে আমাকে হারাবে তখন বুঝবে। আমি বুঝাতে যাবো কেন ও যদি আমাকে সন্দেহ করতে পারে তাহলে আমিও অভিমান করতে জানি…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২৩

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৩

লেখিকা: সুলতানা তমা

ভোরবেলা কলিংবেল এর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো, এতো ভোরে কে আসলো? উঠতে চাইলাম মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে, ওর হাত দুটু সরিয়ে দিতে চাইলাম কিন্তু ও আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
আমি: মেঘ হচ্ছে কি ছাড়ো কে যেন এসেছে।
মেঘ: হু..
আমি: দ্যাত কাকে কি বলছি ও তো পুরো ঘুমে।
মেঘ: ঘুমে না আমি তোমাকে যেতে হবে না অন্যকেউ ঠিক দরজা খুলে দিবে।
আমি: আর কারো ঘুম ভেঙ্গেছে কিনা কে জানে কলিংবেল তো সমানে বেজেই চলেছে।
মেঘ: ওইযে শুনো কলিংবেল বাজা বন্ধ হয়ে গেছে এবার শান্তু হয়ে ঘুমাও তো।
মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো, ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এই মায়া ভরা মুখটা যেন সারাজীবন দেখতে পারি মেঘ, কখনো যেন কোনো কিছু আমাদের আলাদা করতে না পারে। মেঘকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলাম।

আম্মু: সব তো শুনলে এখন বলো কণাকে এমন পরিস্থিতিতে একা রেখে আমি কিভাবে কানাডা থাকি। (ঘুম থেকে উঠে নিচে আসতেই দেখি আম্মু আর চাচ্চু ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছেন)
আমি: চাচ্চু কখন এলে?
চাচ্চু: এইতো ভোরবেলা। এসে যা শুনছি ইচ্ছে হচ্ছে তোকে আর তোর আম্মুকে আমার সাথে নিয়ে যাই। কিন্তু তোকে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব না।
আমি: কানাডা গিয়েও তো আম্মু নিরাপদে থাকতে পারছে না।
শায়লা: আর তো মাত্র কয়টা দিন বদমাইশ লোকটা এরেস্ট হয়ে গেলেই সবাই শান্তিতে থাকতে পারবে। (শায়লা চা নিয়ে এসে টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললো। সত্যি মেয়েটাকে যত দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি)
চাচ্চু: সামাদ এরেস্ট না হওয়া পর্যন্ত আমি আছি তোমাদের সাথে ভয় নেই।
আমি: কিন্তু চাচ্চু ওদিকে তোমার ব্যবসা…
চাচ্চু: ওসব তোর চাঁচি সামলে নিবে।
জোহা: আব্বু আমি কবে যাচ্ছি?
আমি: তুই কোথায় যাবি?
জোহা: কোথায় আবার কানাডা।
আম্মু: আপাতত তুই আমার কাছে থাক পরে যাবি। (শায়লার দিকে চোখ পড়লো সমানে কাজ করে যাচ্ছে। উঠে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম)
আমি: তুমি এতো কাজ করছ কেন কাজের লোক আছে তো।
শায়লা: একটু করি সমস্যা কোথায়?
আমি: না চলো আমাদের সাথে বসে গল্প করবে। (শায়লাকে টেনে এনে আম্মুর পাশে বসিয়ে দিলাম)
শায়লা: একটু কাজ করলে কি এমন হতো?
আম্মু: তুমি তো এ বাড়ির বউ তুমি কাজ করবে কেন? (শায়লা মুখ গোমরা করে ফেললো, হয়তো ভাইয়ার কথা মনে পড়ছে। সত্যি মেয়েটা ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসে)
আম্মু: কি হলো আবার মুখ গোমরা করলে কেন?
আমি: এই চলো তো তুমি আমার সাথে। (শায়লাকে নিয়ে বাগানের দিকে চলে আসলাম)

শায়লা বাগানে এসে দোলনায় বসে ঢুকরে কেঁদে উঠলো।
আমি: আরে কি হলো?
শায়লা: তোমরা কতো ভালো আর আমি তোমাদের সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করেছি।
আমি: আমিও তো তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি আর তুমি তো এসব পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে করেছ।
শায়লা: তুমি তো জানতে না আমি অভিনয় করছিলাম কিন্তু আমিতো জানতাম তোমরা খুব ভালো। তাছাড়া মেঘকে তো আমি ছিনতাম ওর সাথেও তো খারাপ ব্যবহার করেছি বারবার ওকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছি।
আমি: বাদ দাওনা এসব। (শায়লা সমানে কেঁদেই চলেছে কি যে করি)
আমি: আমার মিষ্টি ভাবির মুখে কান্না নয় মিষ্টি হাসি মানায়। (শায়লার গাল টেনে দিলাম ও ফিক করে হেসে দিলো)
আমি: হাসছ কেন?
শায়লা: শত্রু থেকে ভাবি?
আমি: হ্যাঁ আজ থেকে তুমি আমার ভাবি আর আমি তোমার ননদিনী। আজ থেকে কোনো শত্রুতা নয়। (বারবার ওকে শায়লা ডাকতে এখন নিজের মুখেই বাঁধছে, আগে যাই করে থাকুক এখন তো ও আমার ভাইয়ের স্ত্রী)
ভাবি: ঠিক আছে ননদিনী।
মেঘ: এইযে মেডাম ভাবির সাথে আড্ডা দিলে হবে রুমে যে নিজের স্বামীকে রেখে গেছ সে খেয়াল আছে? (মেঘের কথা শুনে ছাদের দিকে তাকালাম, ছাদে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে)
আমি: আসছি।
ভাবি: আমি এখানে একটু সময় বসি তুমি রুমে যাও।
আমি: আচ্ছা তুমি তো মেঘের সাথে দুবছর সংসার করেছ মেঘের পছন্দ অপছন্দ কি একটু বলবে আমাকে? (ভাবি আমার কথা শুনে মৃদু হাসলো)
আমি: হাসছ যে..
ভাবি: একজন কে ভালোবেসে অন্য জনের সাথে সংসার করার মতো কষ্ট যন্ত্রণা আর কিছুতে নেই অথচ এই কষ্টটাকেই পরিস্থিতির চাপে পরে আমাদের মেনে নিতে হয়। দুবছর অনেক সময় কিন্তু এতোটা সময়ের মধ্যেও মেঘের সাথে আমার তেমন কোনো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি, ওর পছন্দ অপছন্দ কখনো জানতে চাইনি। মেঘকে ইকবালের কথা বলতে পারিনি আর মেঘের মায়ের কথায় বেবি নিতে হয়েছিল। আসলে তো মেঘ আর আমার মধ্যে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কোনো কথাই হতো না। বুঝতাম মেঘ আমাকে ভালোবাসতো কিন্তু কিছু করার ছিল না কারণ আমি যে ইকবালকে ভালোবাসি।
আমি: (নিশ্চুপ)
ভাবি: জানো তো ভালোবাসা এমন এক জিনিস যার জন্য মানুষ সব করতে পারে যেমনটা আমি করেছি। ইকবাল আমাকে প্রথমেই তোমার কথা বলেছিল মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিয়েছিলাম আর বলেছিলাম আমি ওর ঘরের এক কোণে পরে থাকবো তোমাকে বিয়ে করার পরও, ইকবাল আমাকে ভালোবাসে তো তাই তোমাকে বিয়ে করতে চাইতো না কিন্তু ওর আব্বু সবসময় আমাদের আলাদা করে দেয়ার ভয় দেখাতো। ইকবালের বাবার অমতে আমরা বিয়ে করেছিলাম তাইতো উনি যা বলতেন তাই করতে হতো আমাকে। মেঘ আর তোমাকে আলাদা করার জন্য উনি ডিভোর্স পেপার মেঘের ফাইলের ভিতর রেখেছিলেন মেয়েটিকে দিয়ে, আর ফোনে সব কথা আমাকে দিয়ে বলিয়েছেন। তোমাদের আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি আ…
আমি: ইচ্ছে করে তো আর দাওনি বাদ দাও এসব। বিকেলে ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যাবো তোমাকে নিয়ে কেমন?
ভাবি: সত্যি?
ওর মুখে হাসির ছলক দেখে মৃদু হেসে চলে আসলাম।

মেঘ: এই আমাকে একা রেখে বাগানে কি করছিলে? (রুমে আসতেই মেঘ আমার দুগালে ধরে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো)
আমি: কি হয়েছে এমন করছ কেন?
মেঘ: তুমি জানোনা তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও একা থাকতে পারিনা। (মেঘের কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলাম)
মেঘ: হাসছ যে?
আমি: সত্যি আমাকে ছাড়া এক মুহূর্তও একা থাকতে পারোনা?
মেঘ: বললাম তো পারিনা।
আমি: যদি কখনো দুজন আলাদা হয়ে যাই তখন?
মেঘ: আলাদা হয়ে যাবো মানে?
আমি: না মানে যদি কখনো এমন কোনো পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় আমাদের যে দুজন আলাদা হয়ে যেতে হবে তখন কিভাবে থাকবে?
মেঘ: পারবো না আর এমন পরিস্থিতি আমি আমাদের জীবনে আসতে দিবো না। (মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো)
আমি: আরে পাগল কাঁদছ কেন আমিতো কথাটা এমনি বলেছি।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: আমি কিন্তু রুম থেকে বেরিয়ে যাবো।
মেঘ: আমি যেতে দিলে তো। (মেঘ আমাকে ছেড়ে দিয়ে আমার কপালে চুমু দিলো)
আমি: এতো ভালোবাস আমায় এতো সুখ সইবে তো আমার কপালে?
মেঘ: যতদিন আমি তোমার পাশে আছি ততদিন দুঃখ তোমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। (মৃদু হেসে মেঘের বুকে মাথা রাখলাম)
আমি: বিকেলে একবার থানায় যাবো ভাইয়া আর চাঁচির সাথে দেখা করবো।
মেঘ: বাসায় যাবে না?
আমি: হ্যাঁ যাবো থানা থেকে সোজা বাসায়।
মেঘ: আমাকে তো অফিসে যেতে হবে।
আমি: হুম যাও কাল থেকে চাচ্চু সবকিছুর দায়িত্ব নিবে তোমার আর এতো টেনশন করতে হবে না শুধু চাচ্চুর সাথে সাথে থাকলেই হবে।
মেঘ: ঠিক আছে।
আমি: রেডি হয়ে এসো আমি নাশতা দিচ্ছি।
মেঘ: ওকে মহারাণী।

মেঘকে অফিসে পাঠিয়ে জোহা আর ভাবির সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। আজ মনে হচ্ছে সত্যি সব ঠিক হয়ে গেছে। এতোদিন পর আবার সেই হাসি আড্ডা। এখন শুধু মামা এরেস্ট হবার অপেক্ষা, থানায় গিয়ে পুলিশ আঙ্গেলের থেকে জানতে হবে কবে এরেস্ট করতে পারবে ওরা মামাকে।
আম্মু: কণা তুই কি থানায় যাবি?
আমি: হ্যাঁ আম্মু।
আম্মু: একটু কথা বলে দেখিস তো ইকবালে…
আমি: আম্মু কেঁদো না আমি কথা বলে দেখবো।
আম্মু: ঠিক আছে একটু তাড়াতাড়ি চলে যা।
আমি: আচ্ছা।

জোহা আর আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছি ভাবি ভাইয়ার হাত ধরে পাগলের মতো কাঁদতেছে। ভালোই হয়েছে ভাবিকে নিয়ে থানায় এসেছি, অন্তত ওদের দুজনের দেখা তো হলো। ভাইয়াকে যে কবে বাসায় ফিরিয়ে নিতে পারবো, ভাবির কান্না সত্যি এখন অনেক কষ্ট দেয়।
আমি: জোহা তুই এখানে দাঁড়া আমি আসছি।
জোহা: ঠিক আছে।

আমি: আঙ্গেল কোনো ভাবেই কি সম্ভব না?
আঙ্গেল: না যদিও ইকবাল আত্মসমর্পণ করেছে তারপরও তিন-চার বছরের কমে সম্ভব না। আর ওর নিজের দেওয়া জবানবন্দীই তো সবচেয়ে বড় প্রমাণ। (আঙ্গেল এর কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল, তিন-চার বছরের কমে ভাইয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না এই কথা ভাবিকে বলবো কিভাবে? ভাবি তো এই কথা শুনে আরো ভেঙ্গে পড়বে)
আঙ্গেল: আর হ্যাঁ ইকবাল ওর বাবার সম্পর্কে সবকিছু বলেছে আমরা খুব তাড়াতাড়ি ওকে এরেস্ট করার চেষ্টা করবো।
আমি: ঠিক আছে আমি চাঁচির সাথে দেখা করতে চাই।
আঙ্গেল: কি করবে দেখা করে? এই বজ্জাত মহিলা এতটুকুও শুধরায়নি।
আমি: একবার দেখা করেই যাই এসেছি যখন।
আঙ্গেল: ঠিক আছে।

চাঁচির সামনে আসতেই উনি আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন।
চাঁচি: বজ্জাত মেয়ে এখানে কেন এসেছ?
আমি: দেখতে এসেছিলাম আপনি কিছুটা শুধরিয়েছেন কিনা। আসলে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না।
চাঁচি: এই মেয়ে মুখ সামলে কথা বল।
আমি: সামলেই তো বলতে এসেছিলাম আপনিই তো বজ্জাত মেয়ে বলে আমার মাথাটা গরম করে দিলেন।
চাঁচি: বজ্জাত মেয়েকে বজ্জাত বলবো নাতো কি বলবো?
আমি: যদি নিজেকে কিছুটা শুধরে নিতেন তাহলে এখান থেকে আপনাকে নিয়ে যেতাম কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনাকে এখানেই থাকাটা মানায়।
চাঁচি: চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।
আমি: রুহানের জন্য এসেছিলাম নাহলে.. দ্যাত আপনার সাথে কথা বলে শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট হচ্ছে।

ভাবির কাছে চলে আসলাম, মেয়েটা এখনো কেঁদেই যাচ্ছে।
আমি: অনেক কেঁদেছ এখন থামো তোমরা।
ভাইয়া: কণা ওকে বাসায় নিয়ে যা।
আমি: হুম নিয়ে যাচ্ছি আর তোমাকেও খুব তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে যাবো। (ভাইয়া মুচকি হাসলো তাহলে কি ভাইয়া জানে এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব না)
ভাইয়া: বাসায় যা।
আমি: হুম।

গাড়িতে সবাই চুপচাপ বসে আছি, বুঝতে পারছি না ভাবিকে কিভাবে সত্যিটা বলবো আর আম্মুকেই বা কি বলবো। ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে গেছে এখন দেখছি আমার জীবনের সবকিছু ঠিক করতে গিয়ে ভাইয়া আর ভাবির জীবনের সবকিছু উলটপালট হয়ে গেছে।
জোহা: আপু দেখো পুতুল গুলো কি সুন্দর। (জোহার কথা শুনে গাড়ির গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকালাম, দোকানে পুতুল রাখা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে)
আমি: গাড়িতে বস আমি আসছি।

জোহা আর তোহা দুজনের জন্য দুটু পুতুল কিনলাম।
আমি: আরে আপনি আমার হাত ধরেছেন কেন? (টাকা দিতে যাবো তখনি অচেনা একটি লোক আমার হাত ধরে ফেললো, লোকটার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছি)
–আসলে আমার স্ত্রী ঠিক এমনি একটা শাড়ি পড়েছে তাই ভুল করে আমার স্ত্রী মনে করে আপনার হাত ধরে ফেলেছি। (লোকটা চলে গেল আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি। লোকটার কথা কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না লোকটা মিথ্যে বললো নাকি সত্যি)
জোহা: আপু কি হয়েছে?
আমি: আর বলিস না লোকটা নাকি ভুল করে ওর স্ত্রী ভেবে আমার হাত ধরে ফেলেছে।
জোহা: ভুল করে…
আমি: ঠিক এমন শাড়িই নাকি ওর স্ত্রী পড়েছে তাই ভুল হয়ে গেছে নাকি।
জোহা: হতেই তো পারে।
আমি: আমার কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না লোকটার কথা।
জোহা: এতো ভেবো নাতো চলো।
আমি: হুম।

জোহা আর ভাবিকে আমাদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে আসলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে মেঘ হয়তো অফিস থেকে চলে এসেছে। কলিংবেল চাপতেই মা এসে দরজা খুলে দিলেন।
আমি: মা তোহা কোথায়?
মা: রুহানের কাছে দেখেছিলাম।
আমি: ঠিক আছে।
দাদী: এসেই মেয়ের দিকে ছুটছিস আমরা বুঝি কেউ না?
আমি: দুদিন হলো মেয়েটাকে দেখিনা পরে আসছি আপনাদের কাছে। (দৌড়ে রুহানের রুমে আসলাম, রুহান আর পপিকে রোমান্টিক অবস্থায় দেখে ফেললাম)
আমি: এই সরি সরি ভুল হয়ে গেছে।
রুহান: সমস্যা নেই।
আমি: দরজা খুলে রোমান্স মুটেও ঠিক না, আমার ননদিনী তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
পপি: ভাবি তুমি না..
আমি: চলে যাচ্ছি ডিস্টার্ব করবো না আমার মেয়ে কোথায়?
রুহান: ভাইয়া নিয়ে গেছে রুমেই হয়তো।
আমি: ঠিক আছে ছুটিয়ে রোমান্স করো হিহিহি।

রুমে এসে দেখি তোহা বেডে বসে বসে খেলছে আর মেঘ জুতো খুলছে। পুতুলটা মুখের সামনে ধরে তোহার দিকে এগিয়ে গেলাম।
তোহা: নতুন আম্মু এসেছে। (তোহা খুশিতে হাত তালি দিচ্ছে। মেয়ের কথা শুনে হা হয়ে তাকিয়ে আছি, পুতুলটা তো অনেক বড় মুখের সামনে ধরলে চেনার কথা না কে এসেছে অথচ তোহা কিভাবে যেন আমাকে ছিনে ফেললো)
মেঘ: তুমি তোহার আত্মার সাথে মিশে গেছ বুঝতে পেরেছ আর হা হয়ে তাকিয়ে থেকো না। (মেঘ হাসছে দেখে ওকে ভেংচি দিয়ে তোহাকে কোলে তুলে নিলাম)
তোহা: এতো বড় পুতুল আমার জন্য?
আমি: হ্যাঁ আমার মামুনিটার জন্য।
তোহা: কিন্তু আমার তো এত্তো বড় পুতুল চাই না আমার তো পুঁচকে পুতুল চাই।
মেঘ: তোহা কোন পুতুলের কথা বলছে বুঝতে পেরেছ?
আমি: এই হাসবা নাতো বাপ মেয়ে দুটু এক রকম। (মেঘ হাসতে হাসতে ওয়াশরুমের দিকে চলে যাচ্ছিল হঠাৎ ওর ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠতেই থেমে গেল)
মেঘ: কণা দেখো তো।
আমি: আমার মেয়েকে নিয়ে বিজি আছি দেখতে থাকো। (মেঘ নিজেই এসে ফোন হাতে নিলো। কিছুক্ষণ ফোন ঘাটাঘাটি করার পর আমার দিকে তাকালো)
আমি: কি হয়েছে?
মেঘ: কিছুনা।
আমি: চলে যাচ্ছ যে কি হয়েছে বলবে তো, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
মেঘ: বললাম তো কিছু হয়নি।
আমি: বলো প্লিজ কি হয়েছে। (মেঘের কাছে এসে ওর হাত ধরে ফেললাম। মেঘ আমার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে আমার দুগালে ধরলো)
মেঘ: এসব নিয়ে কথা বলে তোমাকে আমি হারাতে চাই না।
আমি: মানে?
মেঘ: তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।
মেঘ মৃদু হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেল, আমি হা হয়ে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। কি বলে গেল মেঘ এসব আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২২

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২২

লেখিকা: সুলতানা তমা

মামা এসে বাসায় ঢুকতেই পিছু পিছু শায়লা আর ইকবাল এসে ঢুকলো। আম্মু ভয়ে একটু দূরে সরে দাঁড়ালেন।
মামা: ভয় নেই বোন আমি এখানে খুন করতে আসিনি সবকিছু মিটমাট করতে এসেছি।
আমি: কিসের মিটমাট?
মামা: বোন তুই বল কণা মামুনিটা ক্লান্ত হয়ে গেছে এসব জামেলা পোহাতে গিয়ে।
আম্মু: আমিতো ভেবেছিলাম তুমি…
মামা: মারা গেছি? নারে মরিনি প্রতিশোধ না নিয়ে মরি কিভাবে বল।
আম্মু: কিসের প্রতিশোধ?
ইকবাল: আমার আম্মুকে খুন করার।
আম্মু: ভাবিকে খুন? আমাদের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছ কেন?
ইকবাল: কারণ তোমরা সবাই মিলে আম্মুকে খুন করেছিলে মা হারা করেছিলে আমাকে।
আম্মু: তোকে এসব এই লোকটা বলেছে তাই না? আরে এই লোক তোকে মিথ্যে বলেছে আমরা কেন ভাবিকে মারতে যাবো মেরেছে তো এই লোকটা নিজেই।
ইকবাল: কি?
মামা: ইকবাল ও তোকে ভুল বোঝাচ্ছে।
আম্মু: না বাবা আমি কেন তোকে ভুল বুঝাতে যাবো? যা সত্যি তাই বলছি।
আমি: সত্যিটা কি স্পষ্ট করে বলে দাও আম্মু।
আম্মু: সত্যি এটাই ভাইজান নিজে ভাবিকে খুন করেছিল আর সেজন্য আব্বু ওকে জেলে দিয়েছিল কিন্তু ও কয়েকমাস পরেই পালিয়ে যায়। (আমি এসব কথার কিছুই বুঝতে পারছি না, ইকবাল উঠে আম্মুর কাছে গেল)
ইকবাল: ফুফু সবকিছু খুলে বলো প্লিজ।
মামা: শারমিন ভালো হবে না আর একটাও মিথ্যে বললে কিন্তু…
আম্মু: এতো বছর পর যখন তুমি তোমার পাপ নিজেই টেনে সামনে এনেছ তাহলে আজ আমি বলবই।
ইকবাল: বল ফুফু প্লিজ!
আম্মু: তখন আমার বিয়ে হয়নি। হুট করে একদিন ভাইজান একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। মেয়েটি বড়লোক শুনেই আমরা বুঝে ফেলি ভাইজান ওকে ফাঁসিয়ে নিয়ে এসেছে কারণ উনার স্বভাবই এরকম। ছোট বেলা থেকেই যতো ধরনের খারাপ কাজ আছে সব ভাইজান করে, বাবা মা অনেক চেষ্টা করেছেন উনাকে সঠিক পথে আনার কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। সেদিন তোর আম্মুকে কেউ মেনে নেয়নি কিন্তু আমি মেনে নিয়েছিলাম, পরবর্তীতে সবাইকে বুঝিয়ে সবটা মানিয়ে নিয়েছিলাম।
ইকবাল: তাহলে আম্মু খুন হলো কিভাবে?
আম্মু: একটা বছর কেটে যায় এভাবেই। এই লোকটা বরাবরই সম্পত্তির লোভী ছিল তাই তোর আম্মুকে সবসময় বলতো সবকিছু উনার নামে লিখে দিতে কিন্তু ভাবির ভয় হতো সবকিছু দেওয়ার পর যদি ভাবিকে ভুলে যায়। এর মধ্যে ভাবির কোল আলো করে তুই আসলি, ভাবি সবকিছু তোর নামে করে দিলো। আর এই রাগে এই লোকটা ভাবিকে খুন করে পেলে। বাবা নিজের হাতে উনাকে পুলিশে তুলে দেন। তুই আমার কাছেই থাকতি কিন্তু কয়েকমাস পর উনি পুলিশের থেকে পালিয়ে যান তারপর বাড়িতে এসে জোড় করে তোকে নিয়ে যান। অনেক খুঁজেছি তোকে কিন্তু পাইনি। বাবা বলেছিলেন তোদের ভুলে যেতে কখনো যেন তোর জন্য না কাঁদি কিন্তু কয়েকমাস তোকে নিজে আগলে রেখেছি তো তাই লুকিয়ে কাঁদতাম। সময় সব গাঁ শুকিয়ে দেয় তেমনি তোর কষ্টটা ভুলে গেলাম যখন কণা আসলো আমার কোল জোড়ে। তোকে হারানোর কষ্টটা কখনো প্রকাশ করতাম না তাই কণা কখনো জানতে পারেনি ওর মামা আছে মামাতো ভাই আছে। (আম্মু ইকবাল দুজনেই কাঁদছে, কতো বছর পর ওদের দেখা হলো)
ইকবাল: ফুফু আমি সারাটা জীবন তোমাকে নানা নানুকে ঘৃণা করে এসেছি কারণ এই লোকটা বলেছিল তোমরা আম্মুকে খুন করিয়েছ। আর এজন্য আমি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এতোকিছু করেছি।
মামা: অনেক হয়েছে শারমিন মিথ্যে বলা আমি যে কারণে এসেছি তা আমাকে বুঝিয়ে দে আমি চলে যাচ্ছি।
আম্মু: কিসের জন্য এসেছ সম্পত্তি?
মামা: হ্যাঁ।
আম্মু: কিন্তু কোন সম্পত্তি? এখানে যা দেখছ সব কণার আব্বুর গড়ে তোলা।
মামা: আমার ভাগের সম্পত্তি কোথায়?
আম্মু: বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমি সবকিছু বৃদ্ধাশ্রম আর এতিমখানায় ডোনেট করে দিয়েছি।
মামা: এসব তো আমি বুঝবো না আমার সম্পত্তি চাই।
ইকবাক: সম্পত্তি চাই সম্পত্তি চাই সম্পত্তি চাই, ছোটবেলা থেকে এই একটা শব্দই শুনে এসেছি তোমার মুখ থেকে। এতো লোভ তোমার যে আমার আম্মুকে মেরে ফেললে?
মামা: ইকবাল শারমিন তোকে মিথ্যে বলেছে।
ইকবাল: কোনো মা মিথ্যে বলতে পারেনা আর ফুফুর কান্নাই বলে দিচ্ছে ফুফু মিথ্যে বলছে না। মিথ্যে তো তুমি বলেছ আমাকে সারাজীবন। তোমাকে আমি ছাড়বো না।
মামা: ইকবাল তুই কিন্তু ভুল করছিস।
ইকবাল: হ্যাঁ ভুল করছি কি করবে আমাকেও মেরে ফেলবে তাই তো? মেরে ফেলো তোমার মতো বাবার সন্তান হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
মামা: ইকবাল..
ইকবাল: একদম চিৎকার করো না, ভুলে যেওনা তোমার সব খারাপ কাজের সাক্ষী আমি।
মামা: কি করবি তুই?
ইকবাল: আম্মুর খুনের প্রতিশোধ নিবো।
আম্মু: ইকবাল থাম এই মানুষটার সাথে কথা বাড়াস না।
আমি: আম্মু কি হয়েছে তোমার।
মেঘ: আম্মু.. (আম্মু টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন, আম্মুকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে)
ইকবাল: ফুফু কি হয়েছে?
আমি: পানি দাও আম্মুকে।
শায়লা: এইযে পানি। (শায়লার হাত থেকে পানি এনে আম্মুকে খাওয়ালাম)
ইকবাল: সব হচ্ছে এই লোকটার জন্য… আব্বু কোথায়? (পিছনে তাকিয়ে দেখি মামা নেই তারমানে পালিয়ে গেছে)
ইকবাল: ভয়ে পালিয়ে গেল।
মেঘ: কণা আম্মুকে রুমে নিয়ে শুয়ে দাও।
আমি: ঠিক আছে।

আম্মুকে রুমে এনে শুয়ে দিতেই ইকবাল আম্মুর পায়ের কাছে বসে আম্মুর পা জড়িয়ে ধরলো।
ইকবাল: ফুফু আমাকে ক্ষমা করে দাও আমি এসব আব্বুর কথায় করেছি। লোকটা আমাকে সবসময় বলেছে আম্মুকে তোমরা মেনে নেওনি তোমরা খুন করিয়েছ তাই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমি এমন করেছি। তবে ফুফাকে আমি খুন করিনি আব্বু করিয়েছে আমি আর শায়লা তো আব্বুর কথামতো চলেছি শুধু।
আম্মু: পা ছেড়ে এদিকে আয়। (ইকবাল গিয়ে আম্মুর পাশে বসলো, আম্মু একটা হাত ওর মুখে বুলিয়ে দিলেন। কি করবো বুঝতে পারছি না ক্ষমা করে দিবো ওকে কিন্তু পরে যদি আবার কোনো ক্ষতি করে)
ইকবাল: বিশ্বাস করো ফুফু আব্বু সবসময় বলেছে তুমি আমাদের শত্রু, আগে যদি জানতাম আব্বু আম্মুকে খুন করেছে তাহলে আমি তোমার কাছেই থাকতাম অন্তত একজন মা তো পেতাম।
আম্মু: কাঁদিস না।
ইকবাল: আমি সত্যি একটা অপদার্থ, প্রতিটা মুহূর্তে আমি তোমাদের উপর নজর রেখেছি অথচ একবারের জন্য মনে হয়নি আমার ফুফু খারাপ কাজ করতে পারেনা।
আম্মু: এখন তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস তাতেই আমি খুশি।
ইকবাল: কিন্তু অনেক দেরি যে হয়ে গেছে ফুফু। খারাপ লোকটার কথায় আমি অনেক খারাপ কাজ করেছি এবার এসব প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
শায়লা: মানে কি করবে তুমি?
ইকবাল: আত্মসমর্পণ করবো আব্বুর সব খারাপ কাজের হিসেব দিবো আর আব্বুকে ধরিয়ে দিবো।
শায়লা: কি বলছ এসব? (শায়লা ইকবালের থেকে সরে আসতে আসতে ফ্লোরে এসে বসে পড়লো, পাগলের মতো কাঁদছে শায়লা। কি যে হচ্ছে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে)
ইকবাল: আমি আত্মসমর্পণ করবো তবে তোমরা আমার শায়লাকে কোনো শাস্তি দিওনা। মেয়েটা বড্ড ভালো শুধুমাত্র আমাকে হারানোর ভয়ে আব্বুর কথামতো সব করে গেছে, তবে ও শুধু কণাকে ফোনে ভয় দেখিয়েছে আর কোনো খারাপ কাজ করেনি। (ইকবাল কথাগুলো বলতে বলতে আমার দিকে তাকালো, উঠে আমার দিকে এসেই আমার পায়ের কাছে বসে পড়লো)
আমি: আরে কি করছ?
ইকবাল: ভাইকে ক্ষমা করে দে বোন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আত্মসমর্পণ করবো আর আব্বুকে ধরার জন্য পুলিশকে সব রকম সাহায্য করবো। (কি করবো বুঝতে পারছি না মেঘের দিকে তাকালাম ও বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইকবালের নজর মেঘের দিকে পড়তেই উঠে মেঘের কাছে গেল)
ইকবাল: শায়লা একটা অন্যায় করেছে শুধু আর সেটা তোমার আর তোহার সাথে। তবে জানো তো পাগলীটা রোজ রাতে তোহার জন্য কাঁদে আমি বলেছিলাম তোহাকে নিয়ে আসতে কিন্তু ও তোমার কথা ভেবে তোহাকে আনতে চায় না। তুমি তোহাকে ছাড়া থাকতে পারবে না তাই। এতোদিন ও যা যা করেছে সব অভিনয় ছিল। মেয়েটাকে উপর থেকে যতোটা খারাপ মনে হয় ভিতর থেকে ঠিক ততোটাই ভালো। কণা আর তোমাকে কষ্ট দিয়ে ও নিজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো। আব্বু সবসময় ওকে ভয় দেখাতো আব্বুর কথামতো না চললে ওর থেকে আমাকে আলাদা করে নিবে আর ও আমাকে হারানোর ভয়ে সব খারাপ কাজ মুখ বুজে করে যেতো কারণ পাগলীটা যে আমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। (ইকবাল শায়লা দুজনেই কাঁদছে, মেঘ এগিয়ে গেলো ইকবালের দিকে)
মেঘ: যদি তোমাকেই ভালোবাসতো তাহলে আমাকে বিয়ে করেছিল কেন?
ইকবাল: ওর পরিবারের জন্য। আমি তো খারাপ তাই ওর পরিবার মেনে নেয়নি, জোড় করে ওকে বিয়ে দিয়ে দেয়। তোমাকে কিছু বলতে পারতো না আবার আমাকে ভুলতে পারছিল না এভাবে দুবছর কেটে যায়। শায়লার বাবার মৃত্যুর পর ও আমার কাছে ফিরে আসতে চায়, আমিও খুব করে চাইছিলাম ও যেন আমার জীবনে ফিরে আসে। কি জানো তো যতোই খারাপ হই শায়লার প্রতি আমার ভালোবাসা সত্যি ছিল। আমি শায়লাকে বলেছিলাম তোহাকে নিয়ে আসতে আমি তোহাকে মেনে নিবো কিন্তু শায়লা বলেছিল তোহা মেঘের প্রাণ, তোহাকে নিয়ে আসলে মেঘ বেশি কষ্ট পাবে।
মেঘ: ভালোই হয়েছে শায়লা আমার জীবন থেকে না গেলে তো আমি কণাকে পেতাম না। শুধু আমার তোহা মা হারিয়েছে আ…
আমি: মেঘ তুমি আজো আমাকে তোহার মা ভাবতে পারনি?
মেঘ: সে কথা নয় কণা আ…
ইকবাল: আমি জানি কণা তুই তোহাকে খুব ভালোবাসিস তোর উপর নজর রাখতে গিয়ে বুঝেছি।
আম্মু: থামবি তোরা?
ইকবাল: ফুফু বলনা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ। আর শায়লা, ওকে কোনো শাস্তি দিওনা ও সত্যি খুব ভালো মেয়ে। আমাকে ভালোবাসে তো তাই হারানোর ভয়ে আব্বুর কথামতো কণাকে ফোন দিয়ে ভয় দেখাতো।
আম্মু: হুম বুঝতে পেরেছি।
শায়লা: তুমি আত্মসমর্পণ করলে আমার কি হবে?
আম্মু: তুমি আমার কাছে থাকবে বৌমা।
আমি: আম্মু কি বলছ…
আম্মু: তুই থাম। ইকবাল কম হউক বেশি হউক পাপ করেছে তাই ওর শাস্তি প্রয়োজন, তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি ওকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করবো।
আমি: আম্মু হুট করে সিদ্বান্ত নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে? আর পাপ তো শায়লাও করেছে।
আম্মু: মানুষ চিনতে আমি ভুল করিনা আর শায়লার পাপের শাস্তি তো ও পাচ্ছে তোহার জন্য কেঁদে।
আমি: আম্মু…
মেঘ: কণা আপাতত আম্মুর কথা শুনো আর ইকবাল আত্মসমর্পণ করে কিনা দেখো তাহলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে ওরা সত্যি ভালো হয়ে গেছে নাকি অভিনয় করছে। (মেঘ আস্তে আস্তে বললো, কি করবো সত্যি বুঝতে পারছি না)
ইকবাল: ফুফু আমি আসছি আমার শায়লাকে তুমি দেখে রেখো। আর কণা ভয় পাবি না একদম আব্বু তোদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না আমি খুব শীঘ্রই আব্বুকে এরেস্ট করাবো।
ইকবাল চলে গেল, শায়লা খুব কাঁদছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল। শায়লা কি সত্যি ভালো এতোদিন কি সত্যি মামার কথায় আমাদের সাথে অভিনয় করেছিল? হতেও পারে প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ে তো মানুষ সব করতে পারে।

রুমে এসে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম, বাইরে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি সত্যি কি সবকিছু ঠিক হয়ে গেল? এভাবে হুট করে সব পাল্টে যাবে আমিতো কল্পনাও করতে পারিনি। শুধুমাত্র একটা সত্যি সব পাল্টে দিলো। এতোদিন ইকবাল জানতো মামিকে আম্মুরা খুন করেছে আর আজ জানলো মামা নিজেই খুন করেছে আর এই একটামাত্র সত্যি সব পাল্টে দিলো।
মেঘ: কণা বাসায় কখন যাবো?
আমি: আজকে এখানে থাকি প্লিজ।
মেঘ: কিন্তু তোহা?
আমি: তুমি চলে যাও।
মেঘ: অসম্ভব আমি তোমাকে রেখে যাচ্ছি না, যেতে হয় দুজন একসাথে যাবো।
আমি: এমন করোনা প্লিজ আজ আম্মুর কাছে থাকি?
মেঘ: আমারো তো আমার বউয়ের কাছে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। আচ্ছা দাঁড়াও তোহাকে ফোন করি।
আমি: ঠিক আছে। (মেঘ আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পপির কাছে ফোন করলো)
পপি: হ্যাঁ ভাইয়া বলো।
মেঘ: আজ আসতে পারবো না তোহাকে রাখতে পারবি?
পপি: তোহা থাকলে আমি রাখতে পারবো না কেন?
মেঘ: তোহার কাছে ফোনটা দে।
পপি: দাঁড়াও।
তোহা: আব্বু…
মেঘ: মামুনি আমরা তো আজ আসতে পারবো না তুমি একা থাকতে পারবে?
তোহা: হ্যাঁ পারবো আমি ফুফির কাছে থাকবো। (ওদের কথার মাঝখানে পুলিশ আঙ্গেল এর কল এসে ঢুকলো)
আমি: মেঘ ফোনটা রাখো আঙ্গেল ফোন দিচ্ছেন। (মেঘ ফোন রাখতেই মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম)

আমি: হ্যাঁ আঙ্গেল..
আঙ্গেল: ইকবাল আত্মসমর্পণ করেছে।
আমি: কি? (আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছি না, তারমানে ওরা সত্যি ভালো হয়ে গেছে)
আঙ্গেল: শুধু তাই নয় ওর বাবার সমস্ত খারাপ কাজের প্রমাণ দিবে বলেছে যেন আমরা খুব তাড়াতাড়ি ওর বাবাকে এরেস্ট করতে পারি।
আমি: আমি ঠিক শুনছি তো?
আঙ্গেল: হ্যাঁ মা ইকবাল ওর সমস্ত অন্যায় স্বীকার করেছে।
আমি: ঠিক আছে ওর বাবাকে এরেস্ট করার ব্যবস্থা করুন খুব শীগ্রই।
আঙ্গেল: ঠিক আছে। (ফোন রেখে একটা সস্থির নিঃশ্বাস ফেললাম যাক এতোদিনে সব ঠিক হতে যাচ্ছে)
মেঘ: আমার মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে গেছে এখন তোমার মামা এরেস্ট হলেই তোমরা বিপদমুক্ত।
আমি: হুম।

রাতের আধারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আর দুপর থেকে এখন পর্যন্ত দেখা শায়লাকে নিয়ে ভাবছি। কেমন যেন দুটানায় পরে গেছি আমি। ইকবাল আত্মসমর্পণ করলো, সারাটা বিকেল শায়লার সাথে কাটালাম একবারের জন্যও মনে হয়নি মেয়েটা খারাপ অথচ ওরাই এতোদিন আমার বাঁচা অসম্ভব করে তুলেছিল। শায়লা নিজের হাতে রান্নাবান্না করেছে সবার সাথে ভালো ব্যবহার করছে একবারও আমার মনে হয়নি এই মেয়েটা এখন আমাদের সাথে অভিনয় করছে বরং মনে হচ্ছে শায়লা ভালো শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে খারাপ হওয়ার অভিনয় করেছিল।
মেঘ: অনেক রাত হয়েছে তো ঘুমাবে না?
আমি: শায়লার ব্যবহারে তোমার কি মনে হচ্ছে?
মেঘ: হয়তো তুমি রাগ করতে পারো তবে সত্যি এটাই শায়লা সবসময় এমন শান্তশিষ্ট ছিল। তোহা হবার পর থেকে ও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে তারপর তো ডিভোর্স দিয়ে চলে গেল। শায়লার আগের রূপ আমি আজ দেখতে পাচ্ছি কাজেই বলতে হচ্ছে শায়লা ভালো হয়ে গেছে। অবশ্য ও তো ভালোই ছিল শুধু ইকবালকে হারানোর ভয়ে খারাপ হবার অভিনয় করেছিল। আর আমার মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষ এই ভয় পায় যেমনটা আমি পাই তোমাকে হারানোর। (মেঘ আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো)
আমি: আচ্ছা শায়লা তোহাকে নিয়ে যাবে নাতো?
মেঘ: না কারণ শায়লা বুঝতে পেরেছে আমি তোহাকে কতোটা ভালোবাসি তাছাড়া এখন তো এইটাও জানে তুমি তোহার আরেক মা।
আমি: হুম।
মেঘ: অনেকদিন পর তোমাকে টেনশন মুক্ত লাগছে তাই…
আমি: তো?
মেঘ: কিছুই না।
আমি: কি করছ?
মেঘ: আমিতো কিছুই করছি না যা করার আমার হাত করছে। (মেঘ আমার শাড়ির নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পেটে হাত বুলাচ্ছিল জোড় করে ওর হাত সরিয়ে দিলাম)
মেঘ: এখন? (মেঘ আমাকে কোলে তোলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকিয়ে মুচকি হাসলো)
আমি: ছাড়ো না প্লিজ!

মেঘ: ছেড়ে দিলাম।
আমি: কোমরটা বোধয় ভেঙ্গেই গেছে। (মেঘ আমাকে বিছানায় এনে দফ করে ছেড়ে দিয়েছে ইচ্ছে হচ্ছে ওকে..)
মেঘ: আমি আদর করে দিচ্ছি ব্যথা কমে যাবে।
আমি: দুষ্টুমি করবে না একদম।
মেঘ: আমিতো আজ দুষ্টুমি করবোই পারলে আটকিয়ে দেখাও।
মেঘ আমার উপরে শুয়ে আমার দুহাতের আঙ্গুলের ভাজেভাজে ওর আঙ্গুল গুলো আটকে দিলো। আমার চোখের দিকে শান্তভাবে তাকিয়ে আছে, আমি জানি ও কেন এভাবে তাকিয়ে আছে। মেঘ ভালো করে জানে আমি ওর চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারিনা আর ও এভাবে তাকিয়ে থাকলে ওকে আমি আটকাতেও পারিনা, তাইতো ও এভাবে তাকিয়ে আছে। চুপচাপ চোখ দুটু বন্ধ করে নিলাম, মেঘ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো “কি মেডাম আটকাবে না”
উত্তরে শুধু মৃদু হাসলাম। মেঘ আমার কপালে আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২১

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২১

লেখিকা: সুলতানা তমা

আম্মুকে সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আম্মু ফোন রিসিভই করছে না। শপিংমলে আছে নাকি বাসায় পৌঁছেছে কিছুই বুঝতে পারছি না। কিযে করবো এখন…
মেঘ: একটু স্থির হয়ে বসো প্লিজ।
আমি: আমার আম্মু মৃত্যুর মুখে আর তুমি…
মেঘ: না মানে অস্থিরতার সময়… (রাগি চোখে তাকালাম মেঘের দিকে, চুপ হয়ে গেল একদম)

ফোন হাতে নিয়ে রুমে পায়চারী করছি আর আম্মুর ফোনের অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম।
আমি: আম্মু কোথায় ছিলে?
আম্মু: কেন কি হয়েছে?
আমি: তুমি বাসায় আছ তো?
আম্মু: হ্যাঁ একটু শপিং এ গিয়েছিলাম বাসায় আসছি মাত্র।
আমি: যাক নিশ্চিন্ত হলাম।
আম্মু: হয়েছে কি বলবি তো?
আমি: সব বলবো আগে তুমি দেশে আসো।
আম্মু: দেশে?
আমি: হ্যাঁ আজ বিকেলের ফ্লাইটেই চলে আসো। কোনো প্রশ্ন করবা না, আমি এয়ারপোর্টে তোমাকে রিসিভ করার জন্য থাকবো।
আম্মু: তোর চাচ্চুকে জিজ্ঞেস করে নেই?
আমি: জিজ্ঞেস করতে হবে না শুধু বলো তুমি দেশে আসছ আমার কাছে।
আম্মু: কখন যে কি তোর মাথায় ঘুরপাক খায় কিছুই বুঝিনা।
আমি: তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে নাও।
আম্মু: ঠিক আছে রাখছি।

ফোনটা বিছানার উপর রেখে একটা সস্থীর নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় বসলাম। আম্মুকে কোনোভাবে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারলে শায়লা আর ইকবালকে ছাড়ে কে। একবার শুধু আম্মুকে এয়ারপোর্ট থেকে ভালোভাবে বাসায় নিয়ে আসি তারপর শায়লার শশুড়কে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো আমি।
মেঘ: আম্মু বিকেলের ফ্লাইটে আসলে তো রাত হয়ে যাবে।
আমি: হ্যাঁ এগারোটা বাজবে।
মেঘ: এয়ারপোর্ট থেকে এতো রাতে নিয়ে আসাটা রিস্ক হয়ে যাবে না?
আমি: তাইতো।
মেঘ: কি করবে?
আমি: সমস্যা নেই পুলিশ আঙ্গেলকে বলে সঙ্গে করে দুজন পুলিশ নিয়ে যাবো।
মেঘ: ঠিক আছে।

মা রান্না করছেন আমি হাতে হাতে সবকিছু এগিয়ে দিচ্ছি কিন্তু কোনো কাজে মন বসাতে পারছি না। আব্বুকে হারিয়েছি এখন যদি আম্মুর কিছু হয়ে যায় আমিতো শেষ হয়ে যাবো। আম্মুর কিছু হবার কথা ভাবতেই ভিতরে ছ্যাঁত করে উঠে।
মা: বৌমা তোমার কি হয়েছে বলতো তোমাকে এতো অস্থির অস্থির লাগছে কেন?
আমি: কিছু হয়নি তো মা।
মা: কিছু নিয়ে টেনশনে আছ?
আমি: আসলে আজ আম্মু আসছেন তাই একটু টেনশন হচ্ছে।
মা: তোমার মায়ের তো আর কোনো বিপদ হবে না শায়লা তো জেলে তাহলে এতো ভয় পাচ্ছ কেন?
আমি: ভয়টা তো শায়লার শশুড়কে নিয়ে মা কখন কি করে বসবে বুঝতেই পারছি না।
মা: কলিংবেল বাজছে দেখতো কে এসেছে।
আমি: দেখছি।

দরজা খুলে বাবাকে দেখে থমথম খেয়ে গেলাম, জানিনা বাবাকে বুঝিয়ে সবকিছু ঠিক করবো কিভাবে।
বাবা: কেমন আছ মা? বাসার সবাই কোথায় ডাকো সবাইকে, পাক্কা তিনদিন পর বাসায় আসলাম সবাইকে দেখি একটু।
আমি: ডাকছি বাবা।
বাবা: আমার তোহা দাদুভাই কোথায়?
তোহা: এইতো আমি। (পপির হাতের আঙ্গুল ধরে হাটছিল তোহা, বাবাকে দেখে দৌড়ে এসে কোলে উঠে বসলো। বাবার কন্ঠ শুনে সবাই একে একে ড্রয়িংরুমে আসতে শুরু করলো)
বাবা: পপি তোর হাতে কি হয়েছে?
পপি: আসলে বাবা…
বাবা: রুহান তোর আবার কি হলো মুখটা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন?
দাদী: আমি বলছি তোকে সবকিছু তবে আগে বল তুই টেনশন করবি না হুট করে রেগে যাবি না।
বাবা: ঠিক আছে বলো আগে কি হয়েছে।
দাদী বাবাকে প্রথম থেকে সবকিছু বলতে শুরু করলেন। জানিনা বাবা কেমন রিয়াক্ট করবেন, ভয় হচ্ছে আমিতো বাবাকে কথা দিয়েছিলাম। বাবার চোখের সামনে থেকে রান্নাঘরে চলে আসলাম মায়ের কাছে।

মা: মানুষটার আবার না কিছু হয়ে যায় এসব শুনে।
আমি: কিছু হবে না মা একটু ধৈর্য ধরুন।
বাবা: এতোগুলো বছর ধরে আমি কাকে ছোট বোনের মতো ভালোবাসলাম? হ্যাঁ সেদিন একটা এক্সিডেন্ট ঘটেছিল কিন্তু আমিতো ওদের আপন করে নিয়েছিলাম আর ও কিনা আমাকে শত্রু ভেবে এসেছে সবসময়? (বাবার কথা গুলো শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই তো যাকে এতো ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখলেন সে কিনা এমন করলো। আপন মানুষ গুলো আঘাত করলে সত্যি খুব কষ্ট হয়)
মেঘ: আব্বু এসব নিয়ে টেনশন করোনা তো রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নাও। (বাবার দিকে একবার তাকালাম মাথা নিচু করে রুমের দিকে চলে গেলেন)

আর কিছুক্ষণ পর আম্মুর ফ্লাইট এখন পর্যন্ত তো সব ভালোই চলছে বাকি সময়.. হুট করে ফোন বেজে উঠলো, কেঁপে উঠলাম ফোনের শব্দে। আগের সেই লোকটির নাম্বার দেখে ভয়ে ভয়ে রিসিভ করলাম।
–কণা মামুনি বয়সে তো একটা পিচ্ছি মেয়ে তুমি আমাকে টপকে যাওয়ার কথা ভাবছ কিভাবে?
আমি: মানে?
–ভেবেছিলে আমার ছেলে আর বৌমাকে না ছেড়েই তোমার আম্মুকে তোমার কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমিতো তোমার আম্মুর ঠিক পিছনের সিটে বসে আছি, আমাদের ফ্লাইট একসাথেই। (ভেবেছিলাম লোকটা জানতে পারবে না কিন্তু ও তো আম্মুকে ফলো করছে, এখন কি করবো)
–কি হলো মামুনি চুপ হয়ে আছ যে? দেখবে তোমার আম্মুকে ভিডিও করে পাঠাবো?
আম: কি চান আপনি?
–ওই এটাই আমার ছেলে আর বৌমাকে ছেড়ে দাও।
আমি: ওদের ছেড়ে দিলে পর যে আপনি আম্মুর ক্ষতি করবেন না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
–বললাম তো আপনজনদের মারতে আমার আবার একটু কষ্ট হয়।
আমি: কে আপনি? আমাদের কে হন?
–জানতে চাও তাহলে তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করো সামাদ কে?
আমি: সামাদ?
–হ্যাঁ আমি সামাদ বাকিটা তোমার আম্মুর থেকে জেনে নিও রাখছি এখন। তবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে যেন ইকবাল আমাকে ফোন করে নাহলে তোমার আম্মু…
আমি: না না আমি ফোন করে বলছি ছেড়ে দিতে।
–লক্ষী মামুনি।
লোকটা ফোন রেখে দিলো। পুলিশ আঙ্গেলকে ফোন দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে এতো কষ্টের পর ওদের ধরা গেল আর এখন কিনা ছেড়ে দিতে হবে।

ফোনটা সমানে বেজেই চলেছে ইচ্ছে করেই রিসিভ করছি না। মাত্র পাঁচ মিনিট আগে পুলিশ আঙ্গেলকে ফোন করে বলেছি ওদের ছেড়ে দিতে আর গুনে গুনে পাঁচ মিনিট পরেই শায়লা ফোন করলো। এখন ফোন রিসিভ করলেই শায়লা হাসবে আর আমার বোকা হয়ে থাকা ছাড়া কিছু করার থাকবে না।
মেঘ: কি হলো ফোন রিসিভ করছ না কেন?
আমি: থাকুক না শায়লার তাচ্ছিল্যের হাসিটা শুনতে চাই না।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: আমি হেরে গেছি মেঘ।
মেঘ: দূর পাগলী কাঁদছ কেন আর হেরে যাবে কেন? ওরা তো আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে না, তুমি আম্মুকে আগে তোমার কাছে নিয়ে এসো তারপর আবার ওদের শাস্তি দিবে।
আমি: সে সুযোগটা কি ওরা আমাকে দিবে?
মেঘ: দেখো সব কিছুর মূলে তোমাদের সম্পত্তি আর এই সম্পত্তি পাওয়ার জন্যই ওরা এতোকিছু করছে, ওরা এই সম্পত্তি না নিয়ে দেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। আবার ফিরে আসবে ওরা আর তখন আম্মুও তোমার কাছে থাকবে তখন ওদের আবার এরেস্ট করাতে পারবে।
আমি: পারবো তো নাকি ওরা এভাবে অন্যায় করেও খুলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াবে?
মেঘ: নিজের উপর ভরসা রাখো কণা, তুমি ঠিক পারবে।
আমি: হুম

এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছি আম্মুকে রিসিভ করার জন্য। সঙ্গে করে দুজন পুলিশ এনেছি ভয় হচ্ছে সামাদ এর লোকজন হয়তো আমাদের আশে পাশেই আছে।
মেঘ: ওইতো আম্মু। (মেঘের কথা শুনে সামনে তাকালাম, আম্মু আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। আমার দুচোখ সামাদ নামের লোকটাকে খুঁজছে কিন্তু সন্দেহজনক কাউকে তো দেখছি না। তবে কি সামাদ আমাকে বোকা বানালো? না না বোকা বানাবে কি করে ও তো বলেছিল এয়ারপোর্টে আম্মুর পিছনের সিটে বসা, যদি না আসবে তাহলে জানবে কিভাবে)
আম্মু: কণা কাকে খুঁজছিস আমিতো তোর সামনে।
আমি: কাউকে না আম্মু গাড়িতে চলো।
আম্মু: আচ্ছা তুই আমাকে এভাবে এতো তাড়াতাড়ি আসতে বললি কেন?
আমি: সব বলবো বাসায় চলো।
আম্মু: ঠিক আছে।

বাসায় আসতে আসতে রাত সাড়ে বারোটা বেজে গেল, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমি: আম্মু তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।
আম্মু: ঠিক আছে।
আমি: মেঘ তুমিও ফ্রেশ হয়ে এসো।
মেঘ: ওকে।

টেবিলে খাবার এনে সাজাচ্ছি আর ভাবছি ভালোয় ভালোয় তো আম্মুকে বাসায় নিয়ে আসলাম কিন্তু ওই লোকটা কি আমাদের পিছু ছাড়বে? সম্পত্তি চাইছে তারমানে সবকিছু নিজের নামে না নেয়া পর্যন্ত সে আমাদের পিছু ছাড়বে না। আব্বুর এতো কষ্টের সম্পত্তি ওই খারাপ লোকটাকে দিয়ে দিতে হবে নাকি? ফোনের স্কিনে চাচ্চুর নাম্বার ভেসে উঠলো, ফোনটা রিসিভ করলেই চাচ্চু নানা প্রশ্ন করবেন তাও রিসিভ করলাম।
আমি: চাচ্চু…
চাচ্চু: কি হয়েছে কণা তোর মা’কে এভাবে হুট করে দেশে যেতে বললি? ভাবি ঠিকমতো পৌঁছেছে তো?
আমি: হ্যাঁ চাচ্চু আম্মুকে নিয়ে বাসায় চলে এসেছি।
চাচ্চু: এখন বলতো কি হয়েছে তোর কন্ঠটাও আমার ঠিক লাগছে না। (কি করে বলি চাচ্চু আমার সন্দেহের তালিকায় তুমি ছিলে তাই তোমাকে কিছু জানাইনি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এসবের পিছনে তুমি নেই)
চাচ্চু: কি হলো বল।
আমি: আসলে চাচ্চু আব্বুকে যারা খুন করেছিল তারা আম্মুকেও মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল আমাকে তাই আমার কাছে নিয়ে এসেছি।
চাচ্চু: আমার কাছে কি তোর আম্মু সেইফ থাকতো না?
আমি: ছিল না চাচ্চু, ওখানে আম্মুকে ফলো করা হচ্ছিল তাইতো ভয় পেয়ে…
চাচ্চু: আমাকে একবার বলতে পারতি।
আমি: আসলে বলিনি…
চাচ্চু: আমি আগামীকাল আসছি।
আমি: চাচ্চু শুনো…
চাচ্চু তো রেগে গিয়ে ফোন রেখে দিলেন। আমাদের আপন কেউ বলাতে ভেবেছিলাম সবকিছু চাচ্চু করছেন কারণ চাচ্চু ছাড়া আমাদের আপন কেউ নেই। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে চাচ্চু এমন করতেই পারেনা। তাহলে কে করছে এসব আমাদের আপন আর কে আছে?

মেঘ: কণা তুমি খাবে না?
আমি: হুম তোমরা খাও আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।
আম্মু: এতো কিসের টেনশন করছিস?
আমি: কিছুনা আম্মু ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি।

রুমে এসে লোকটার নাম্বারে ফোন দিলাম, রিং হয়েই যাচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। কয়েকবার ফোন দেওয়ার পর রিসিভ করলো।
–মামুনি তোমার দেখছি বড্ড কৌতূহল।
আমি: কে আপনি পরিচয় দিন।
–এতো তাড়া কিসের আস্তে আস্তে পরিচয় দিবো…
আমি: কি চান আপনি?
–সবকিছু।
আমি: মানে?
–আসলও চাই শোধও চাই এক কথায় সবকিছু চাই।
আমি: আপনার কি মনে হয় আমার আব্বুর এতো কষ্ট করে গড়ে তোলা সবকিছু আপনাকে আমি দিয়ে দিবো?
–আগে বোকা ছিলাম তাই জোড় করিনি কিন্তু এখন জোড় করবো প্রয়োজন হলে তোমাকে আর তোমার আম্মুকে খুন করবো।
আমি: আগে মানে?
–বহু বছর আগে।
মেঘ: কণা কি হলো এতো দেরি হচ্ছে কেন? (দ্যাত মেঘ ডাকছে)
আমি: আসছি।
–এতো কৌতূহল ভালো না মামুনি। সময় হলে আমিই তোমার সামনে আসবো এয়ারপোর্টে দুচোখ দিয়ে আমাকে তোমার খুঁজে বেড়াতে হবে না। (তারমানে লোকটা আমাকে এয়ারপোর্টে দেখেছে কিন্তু আমিতো দেখিনি। অবশ্য দেখলে তো চেনারও কথা না, জন্মের পর ওকে দেখেছি বলেতো মনে হয় না)
–আচ্ছা মামুনি এক কাজ করলে কেমন হয় একসাথে বসে সবকিছু যদি মিটমাট করে নেই? দেখো আমাকে সবকিছু দিয়ে দিলে কিন্তু আমি আর তোমাদের জ্বালাবো না।
আমি: একটা কানাকড়িও দিবো না আমি আপনাকে।
ফোন কেটে দিলাম। লোকটা তো কোনো ভাবেই পরিচয় দিচ্ছে না, আম্মুকে কি জিজ্ঞেস করবো?

ফ্রেশ হয়ে নিচে আসতেই আম্মু আর মেঘ আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে রইলো।
আমি: কি হয়েছে?
আম্মু: ফ্রেশ হতে এতো সময় লাগে?
মেঘ: আমাদের খাওয়া তো শেষ।
আমি: সমস্যা নেই আমি একা খেতে পারবো।
আম্মু: হ্যাঁ সেটা আমিও জানি এবার বল কি বলবি।
আমি: আম্মু খেতে দাও সারাদিন খাওয়া হয়নি তাছাড়া আমি খুব ক্লান্ত ঘুম পাচ্ছে, এসব নিয়ে সকালে কথা বলবো। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
আম্মু: তোর মতিগতি বুঝার সাধ্য কারো নেই। (আম্মু রুমের দিকে চলে গেলেন)
মেঘ: কি হলো আম্মুকে এসব বললে না কেন?
আমি: লোকটার কথায় যা বুঝতে পেরেছি লোকটা আমাদের আপন কেউ আর আম্মু ওকে চিনেন। যেহেতু লোকটা এমন করছে তারমানে ও আমাদের শত্রু। আম্মু এতোটা জার্নি করে এসেছেন এখন এসব বলে আম্মুকে টেনশন দেওয়া ঠিক হবে না আম্মুর ঘুম প্রয়োজন।
মেঘ: ঘুম তো তোমারও প্রয়োজন কণা, একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছ এসব টেনশনে নিজের কি অবস্থা করেছ?
আমি: (মৃদু হাসলাম)

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই ফ্রেশ হয়ে আম্মুর রুমে আসলাম, এখন আম্মুকে জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন কে এই সামাদ। কিন্তু আম্মু আর জোহা সবকিছু গুছগাছ করছে কেন?
আমি: আম্মু কি করছ?
আম্মু: জোহার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছি।
আমি: কেন?
আম্মু: আমি দেশে চলে এসেছি জোহা আর এখানে থাকবে কেন?
আমি: তারমানে তোমরা বাসায় চলে যাচ্ছ?
আম্মু: হ্যাঁ, মেয়ের শশুড় বাড়িতে থাকা যায় নাকি? তুই ঘুমুচ্ছিলি তাই ডাকিনি সব গুছিয়ে নিয়ে তোকে ডাক দিতাম।
আমি: কিন্তু আম্মু তোমরা একা ওই বাসায়…
জোহা: আব্বু আসছেন তো আজ।
আম্মু: হ্যাঁ তোর চাচ্চু আসছে কিছুদিন আমাদের সাথে থাকবে।
আমি: ঠিক আছে চলো আমিও যাবো তোমাদের সাথে।
আমি: তুই?
আমি: বিকেলে চলে আসবো।
আমি: ঠিক আছে।

আম্মু আর জোহাকে নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসলাম সাথে মেঘও এসেছে। যদিও চাচ্চু আসছেন তারপরও খুব ভয় হচ্ছে আম্মুকে এই বাসায় রাখতে।
জোহা: আমি সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি।
আম্মু: ঠিক আছে।
আমি: আম্মু বসো এখানে তোমার সাথে আমার কথা আছে।
আম্মু: বল কি কথা? (সোফায় বসতে বসতে বললেন আম্মু, আমিও বসলাম)
আমি: আম্মু যারা আব্বুকে খুন করেছিল তাদের আমি জেলে দিয়েছিলাম কিন্তু তোমার জন্য ওদের আবার ছেড়ে দিতে হয়েছে।
আম্মু: আমার জন্য…
আমি: যে সবকিছু করছে সে তোমাকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিল আমাকে তাই ছাড়তে হয়েছে।
আম্মু: এজন্যই তুই আমাকে তোর কাছে নিয়ে আসলি? কিন্তু লোকটা কে?
আমি: তোমাকে চিনে আম্মু তুমিও হয়তো চিনো, লোকটা তো বলছে আমাদের আপন কেউ।
আম্মু: আপন…
আমি: সামাদ নামে কাউকে চিনো আম্মু?
আম্মু: সামাদ? (আম্মু চমকে গিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন)
আমি: চিনো তুমি? উনার ছেলের নাম ইকবাল।
আম্মু: সামাদ, ইকবাল? হ্যাঁ চিনি তো।
আমি: কে উনি?
আম্মু: তোর মামা। (এবার আমার চমকে যাওয়ার পালা, এতো বড় হয়েছি কখনো শুনিনি আমার কোনো মামা আছে। সবসময় শুনে এসেছি আম্মু একা, আর কয়েক বছর আগে তো নানা নানু দুজনই মারা গেছেন)
আমি: আম্মু কখনো তো বলনি আমার কোনো মামা আছে, সবসময় তো বলেছ তুমি একা তোমার কোনো ভাইবোন নেই।
আম্মু: বলবো কিভাবে সামাদ তো… (কলিংবেল বেজে উঠলো, এই সময় কে আসলো)
আম্মু: আমি দেখছি।

আম্মু দরজা খুলতে গেলেন, কে এসেছে দেখার জন্য আমিও দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আম্মু দরজা খুলে আচমকা পিছিয়ে আসলেন, একজন লোক এসেছে। আম্মু ভাইজান বলেই আচল দিয়ে মুখ চেপে ধরলেন। দাঁড়িয়ে পড়লাম, তারমানে এই লোকই সামাদ মানে আমার মামা? কিন্তু কেন এসেছে এই লোক? আম্মুর কোনো ক্ষতি করবে নাতো…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২০

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২০

লেখিকা: সুলতানা তমা

হসপিটালে কি ঘুম হয়? রাতে একদম ঘুম হয়নি। ইচ্ছেই হচ্ছে না অফিসে যেতে তাও যেতে হবে। ঝটপট একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম এখান থেকে অফিস তারপর রাতে সোজা বাসায়।
মেঘ: একা যাবে নাকি আমিও আসি।
রুহান: হ্যাঁ ভাইয়া আমি আছি এখানে তোমরা দুজন অফিসে চলে যাও। তাছাড়া বিকেলে তো পপিকে রিলিজ করে দিবে আমরা বাসায় চলে যাবো।
আমি: ঠিক আছে চলো।
মেঘকে নিয়ে অফিসের দিকে রওনা দিলাম।

মেঘ: তুমি তো সকালে নাশতা করনি আমি কিছু নিয়ে আসছি তুমি বসো। (অফিসে এসেই মেঘ খাবার আনতে চলে গেল)
আসিফ: মেডাম আসবো?
আমি: হ্যাঁ আসুন।
আসিফ: এখন থেকে রোজ আসবেন তো? অফিসের কিন্তু এই কয়দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে।
আমি: বসুন।
আসিফ: হুম।
আমি: আমার এইসব অফিস কাজকর্ম একদম ভালো লাগে না তাছাড়া এসব তো আমি তেমন বুঝিও না তাই ভাবছি সবকিছুর দায়িত্ব মেঘকে বুঝিয়ে দিবো।
আসিফ: এই বয়সে এসব সামলানো একটু কঠিন তবে আমার মনে হয় মেঘ স্যার এর চেয়ে আপনি ভালো পারবেন।
মেঘ: আমার বদনাম করা হচ্ছে? (মেঘ খাবার নিয়ে চলে আসলো)
আসিফ: একদম না স্যার, মেডামকে শুধু বলছিলাম…
মেঘ: আমি বোকা তাইতো?
আসিফ: মেডাম স্যার কিন্তু আমাকে ভুল বুঝছেন।
আমি: আরে না ও তো ফাজলামো করছে।
মেঘ: তবে আসিফ কিন্তু মিথ্যে বলেনি, আমার চেয়ে এই পিচ্ছি মেয়ের মাথায় কিন্তু অনেক বুদ্ধি। এই পিচ্ছি মেয়ে যেভাবে সব বিপদ কাটিয়ে সবকিছু সামলিয়ে নিচ্ছে আমার পক্ষে তো তা সম্ভবই হতো না।
আসিফ: আমিতো এটাই বলতে চাইছিলাম। কে না কে আপনাকে ফোন করে হুমকি দিলো আর আপনি ভয় পেয়ে মেডামকে কিছু জানালেন না আর মেডাম দেখুন এসেই মেয়েটিকে পুলিশে দিয়ে দিলেন। (মেঘ আর আসিফ কথা বলছে আমি ভাবছি মেয়েটিকে তো জেলে দিলাম কিন্তু মেঘকে ভয় দেখালো কে? আর আম্মুকে মেরে ফেলার ভয় দেখালো কেন আম্মু তো কানাডায়। তবে কি কেউ কানাডায় আম্মুকে ফলো করছে আমাকে জব্দ করার জন্য? যদি তাই হয় তাহলে তো এটা শায়লারই কাজ)
মেঘ: কি ভাবছ? (মেঘের কথায় ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো, তাকিয়ে দেখি আসিফ চলে গেছে আর মেঘ দরজা লাগিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে)
আমি: দরজা লাগালে কেন?
মেঘ: তোমার তো আবার লজ্জা বেশি যদি লজ্জা পাও।
আমি: লজ্জা পাবো মানে?
মেঘ: ভয় নেই খাইয়ে দেবো মাত্র। (ভেংচি দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম)
মেঘ: খেয়ে নাও।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
আমি: দেখছি কতোটা ভালোবাস।
মেঘ: একটা মাত্র বউ ভালো না বাসলে হবে? (মৃদু হেসে মেঘের হাত থেকে খাবার খেয়ে নিলাম)

মেঘ আমার কাধে মাথা রেখে বসে আছে আর আমি ল্যাপটপে কাজ করছি। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো, জোহা ফোন করেছে।
আমি: হ্যাঁ জোহা বল।
জোহা: তোমার মেয়ে কথা বলবে।
আমি: দেতো।
তোহা: নতুন আম্মু তুমি কবে আসবে?
আমি: আর কিছুক্ষণ মামুনি চলে আসবো।
তোহা: তুমি খুব পঁচা শুধু আমার থেকে দূরে দূরে থাকো।
আমি: এখনি আসছি মামুনি।
তোহা: সত্যি?
আমি: হ্যাঁ সত্যি। (ফোন রাখতেই দেখি মেঘ আমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি?
মেঘ: এখনি চলে যাবে?
আমি: সবকিছুর আগে আমার মেয়ে বুঝেছ? আমার মেয়ে বলেছে আমি নাকি পঁচা ওর থেকে সবসময় দূরে দূরে থাকি তাই চলে যাচ্ছি। আর হ্যাঁ শুনো এসবের দায়িত্ব এখন তুমি নাও আর পারবো না এতোদিক সামলাতে।
মেঘ: ওকে মহারাণী।
আমি: আসছি।
মেঘ: সাবধানে যেও।

বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই জোহা দরজা খুলে দিলো সাথে তোহা। আসার সময় চকলেট আর বেলুন নিয়ে এসেছিলাম তোহা এসব দেখেই হেসে দিলো, এই হাসিটা যেন সব কষ্ট মুছে দেয়।
তোহা: তুমি তোমার কথা রেখেছ উম্মম্মম্মম্মম্মম্মমাহ। (জোহার কোল থেকেই আমার গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিলো)
আমি: পাগলী মেয়ে।
মা: অন্যকারো মেয়েকে কেউ এতোটা আপন করে নিতে পারে আগে কখনো দেখিনি।
আমি: অন্যকারো মেয়ে মানে? কে অন্যকারো মেয়ে?
মা: সরি সরি ভুল হয়ে গেছে তোহা তো তোমারই মেয়ে।
আমি: আপনারা কেন আমাকে তোহার মা ভাবতে পারেন না?
মা: সেটা বলতে চাইনি এখন যা যুগ এমন ভালো কেউ বাসে না।
আমি: এই তোহার জন্যই তো আমি মেঘকে পেয়েছি আপনাদের সবাইকে পেয়েছি এমন একটা সুন্দর পরিবার পেয়েছি।
মা: সুন্দর পরিবার আর থাকলো কোথায়? তোমার শশুড় যখন গ্রাম থেকে ফিরে এসে এই অবস্থা দেখবে জানিনা মানুষটা এই আঘাত সহ্য করতে পারবে কিনা।।আমি: আমার কি করার ছিল মা, চাঁচি এতো অন্যায় করেছেন যে উনাকে শাস্তি না দিলে উনি প্রশ্রয় পেয়ে অন্যায় আরো বেশি করতেন।
দাদী: যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, এমন মানুষ বাড়িতে না জেলে থাকাই মানায়। কি কান্ডটাই না করল।
মা: বৌমা রুহান আর পপি কবে ফিরবে?
আমি: বিকেল তো হয়ে এলো কিছুক্ষণ পর চলে আসবে।
মা: ঠিক আছে।
জোহার থেকে তোহাকে এনে রুমে চলে আসলাম।

ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখি তোহা বিছানায় বসে বেলুন আর চকলেট নিয়ে খেলছে। খুব ক্লান্ত লাগছে তাই তোহার এক পাশে শুয়ে পড়লাম।

মেঘের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো, কবে যে চোখ দুটু বুজে এসেছিল বুঝতেই পারিনি। পাশ ফিরে তাকালাম তোহা এখানে নেই, মেঘ সোফায় বসে জুতো খুলছে।
মেঘ: তোহা আম্মুর কাছে, এই অসময়ে ঘুমাচ্ছ কেন?
আমি: বুঝতে পারিনি কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
মেঘ: তাই? (মেঘ টাই খুলতে খুলতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে)
মেঘ: এতো ঝর ভয়ে যাচ্ছে যে তোমাকে একটু ভালোবাসাও হয় না। (মেঘ আমার উপর শুয়ে আমার নাকে ওর নাক ঘষে দিলো)
আমি: কি করছ দরজা খুলা।
মেঘ: সবাই পপির কাছে কেউ আসবে না এখন।
আমি: সরো আমি ফ্রেশ হবো।
মেঘ: উঁহু! (মেঘ আমার কপালে চুমু খেলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেই আমার ঠোঁটে ওর ঠোঁট দুটু আলতো করে ছুয়ালো)
আমি: মেঘ কি করছ সরো বলছি। (কোনো কথা না বলে আমার গলায় ওর নাক ঘষে যাচ্ছে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম ওকে)
মেঘ: এইটা কি হলো?
আমি: সঠিক কাজ হয়েছে।
মেঘ: বুঝাবো পরে। (মেঘকে ভেংচি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম)

পপি: মা আর কেঁদো না আমি ঠিক আছি। (পপির রুমে সবাই ভীড় জমিয়েছে, মা পাশে বসে কাঁদছেন। বারান্দার দরজা খুলা দেখে ওদিকে চোখ পড়লো রুহান দাঁড়িয়ে আছে, ওর দিকে ওগিয়ে গেলাম)
আমি: রুহান।
রুহান: হুম।
আমি: কাঁদছ তুমি?
রুহান: নাতো। (রুহান চোখের পানি মুছে নিয়ে বাইরে রাতের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো। বুঝতে পারছি রুহান চাঁচির জন্য কাঁদছে। বাবা নেই ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে বড় হয়েছে এখন মা’কে ছাড়া থাকতে কষ্ট তো হবেই)
আমি: আমাকে ক্ষমা করে দিও এছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। তুমি চাইলে আগামীকাল চাঁচির সাথে দেখা করে আসতে পারো। কথা দিচ্ছি উনি যদি নিজেকে এতটুকু শোধরে নেন তাহলে আমি উনাকে ছাড়িয়ে আনবো।
রুহান: হুম। (এই মুহূর্তে রুহানকে শান্তনা না দেওয়াটাই ভালো একা থাকুক কিছুটা সময়। চলে আসলাম ওদের রুম থেকে)

যেভাবেই হউক ইকবালকে ধরতে হবে নাহলে কোনো কিছুই সম্ভব হবে না। একবার ইকবালকে ধরতে পারলে আমার সব শত্রু বেরিয়ে আসতো কিন্তু ইকবালকে পাবো কোথায়?
মেঘ: আরে এভাবে আনমনা হয়ে কেউ হাটে? এখনি পরে যেতে তো। (এসব ভাবলে মাথা ঠিক থাকে না, হুচট খেয়ে পরে যাচ্ছিলাম মেঘ ধরে ফেললো)
আমি: ধরার জন্য তুমি আছতো।
মেঘ: সবসময় কি আমি থাকবো মেডাম? (মেঘ আমার কোমরে ধরে টান দিয়ে আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেল)
আমি: আজ তোমার হয়েছে কি বলতো এতো রোমান্স আসছে কোথা থেকে?
মেঘ: রোমান্টিকতা প্রতিদিন থাকে শুধু রোমান্স করার মতো সুযোগ আর সময় হয় না।
দাদী: যেখানে সেখানে রোমান্স ভালো না বাসায় ছোটরা আছে। (দাদীর কথায় দুজন আলাদা হয়ে গেলাম, দাদী চোখে হাত দিয়ে হাসছেন)
মেঘ: বুড়ী তুমি বুঝি এভাবে প্রেম করনি? (মেঘ যে কি.. দৌড়ে রুমে চলে আসলাম।)

গভীর রাত মেঘ আর তোহা ঘুমাচ্ছে আমি রুমের মধ্যে পায়চারী করছি, ঘুম কিছুতেই আসছে না। শায়লাকে পুলিশে না দেওয়া পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না। যেভাবেই হউক ইকবালকে ধরে শায়লার কাছে পৌঁছতে হবে কিন্তু কিভাবে? আচ্ছা শায়লাকে এরেস্ট করালে কি ইকবালকে ধরা যাবে? হ্যাঁ হতেই তো পারে শায়লাকে এরেস্ট করলে ইকবাল বেরিয়ে আসবে। এইটা ছাড়া এখন আর কোনো উপায় নেই, যা করার আগামীকালই করতে হবে।
মেঘ: কণা তুমি ঘুমাওনি?
আমি: হু ঘুম আসছে না।
মেঘ: এদিকে এসো। (বিছানায় এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম, মেঘ আমার চুলে একটা হাত রাখলো)
মেঘ: কি হয়েছে এতো রাতে না ঘুমিয়ে পায়চারী করছিলে কেন?
আমি: আমার ভালো লাগছে না মেঘ, এতোদিন হয়ে গেল অথচ আব্বুর খুনিদের এরেস্ট করাতে পারলাম না।
মেঘ: কেঁদো না প্লিজ তুমি তো চেষ্টা করছ।
আমি: আর চেষ্টা করলে হবে না শায়লাকে আমি প্রমাণ ছাড়াই এরেস্ট করাবো তারপর পুলিশ ওর থেকে সব বের করবে।
আমি: শায়লাকে পুলিশ জিজ্ঞেস করলে হয়তো ইকবালের কথা বলে দিতে পারে।
আমি: হুম তাই করতে হবে।
মেঘ: সকালে ভেবো এখন ঘুমাও প্লিজ।
আমি: হুম।

আমি: আঙ্গেল আমি শায়লাকে জেলের অন্ধকার রুমে দেখতে চাই।
আঙ্গেল: কিন্তু কণা মা…
আমি: এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে বলে এরেস্ট করুন তারপর কয়েকটা দিলে সব সত্যি গড়গড় করে বলে দিবে।
আঙ্গেল: ঠিক আছে আমি দেখছি। (ফোন রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, এবার শায়লাকে ধরতে পারলে শান্তি পাবো।)
মেঘ: কণা কি শুরু করেছ সকাল হতে না হতেই…
আমি: প্রমাণ জোগাড় করার তো কম চেষ্টা করিনি এখন এটাই রাস্তা।
মেঘ: যা খুশি করো।
আমি: এতো রেগে যাচ্ছ কেন নাকি শায়লাকে অন্ধকার রুমে দেখতে হবে ভেবে খারাপ লাগছে তোমা…
মেঘ: এই শুনো আমি তোমাকে ভালোবাসি শায়লা মরলো না বাঁচলো আমি জানতে চাই না। (মেঘ দুহাতে জোড়ে আমার মাথা চেপে ধরলো)
আমি: তাহলে এতো রেগে যাচ্ছ কেন?
মেঘ: তোমাকে হারানোর ভয়ে বুঝেছ? এসবের মধ্যে যদি তোমার কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে আমি বাঁচতে পারবো না।
আমি: আমার কি হবে কিছু হ…
মেঘ: যদি হয়ে যায় তখন? (মেঘ আমাকে টেনে নিয়ে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো, কি বলবো এখন ওকে? ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয় পাওয়াটা যে স্বাভাবিক)
মেঘ: যা করো সাবধানে করো আমার কণার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। (মেঘ আচমকা আমাকে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল)

সবার সাথে বসে নাশতা করছি হঠাৎ রুম থেকে ফোনের রিংটোন ভেসে আসলো, পুলিশ আঙ্গেল ফোন দিয়েছেন মনে হয়। তাড়াতাড়ি উঠে রুমে চলে আসলাম।
আমি: আঙ্গেল…
আঙ্গেল: শায়লা ইকবাল দুজনই এরেস্ট হয়েছে।
আমি: সত্যি?
আঙ্গেল: হ্যাঁ চাইলে তুমি একবার আসতে পারো।
আমি: আসছি আমি। (ফোন রেখে পিছন ফিরতে দেখি মেঘ দাঁড়িয়ে আছে)
মেঘ: কোথায় যাচ্ছ?
আমি: পুলিশ ষ্টেশন।
মেঘ: একা?
আমি: হ্যাঁ তোমার তো অফিস আছে।
মেঘ: আমিও যাবো তোমার সাথে চলো।
আমি: অফিস…
মেঘ: তোমাকে একা ছাড়তে পারবো না আমি। (কবে যে তুমি আমাকে এতো ভালোবেসে ফেলেছ বুঝতেই পারিনি)
মেঘ: কি ভাবছ?
আমি: কিছুনা চলো।

শায়লাকে জেলের ভিতরে দেখে নিজের ভিতরে শান্তি লাগছে। আমাদের দেখেই শায়লা এগিয়ে আসলো।
শায়লা: খুব শান্তি লাগছে তাই না?
আমি: প্রচুর শান্তি।
শায়লা: আমাদের কেন এরেস্ট করালি?
আমি: মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানিস না?
শায়লা: প্রমান জোগাড় করেছিস এরেস্ট যে করালি?
আমি: ভেবেছিলাম প্রমাণ জোগাড় করে তারপর তোদের এরেস্ট করাবো কিন্তু তুই তো তার সুযোগ রাখলি না তাই এখন তোদের পিঠিয়ে স্বীকারোক্তি নিয়ে প্রমাণ জোগাড় করবো।
শায়লা: তোকে…
ইকবাল: শায়লা কেন ওদের সাথে বকবক করছ আর তো কিছুক্ষণ তারপর আমরা বাসায় চলে যাবো। (ইকবাল সামনে এসেই জোড়ে হেসে উঠলো)
মেঘ: মানে কি?
ইকবাল: বাসায় চলে যাও এতো খুশি হওয়ার কিছু হয়নি। (ওদের কথার কিছুই বুঝতে পারছি না এতোটা কনফিডেন্স নিয়ে কিভাবে ওরা বলছে বাসায় চলে যাবে)
ইকবাল: কণা তোমাকে বিয়ে করার অনেক প্ল্যান করে রেখেছিলাম কিন্তু আফসোস হুট করে মেঘের সাথে তোমার বিয়েটা হয়ে গেল।
মেঘ: কণা তুমি ওকে চিনতে?
আমি: নাতো এর আগে কখনো দেখিনি।
ইকবাল: কিন্তু আমি তোমাকে দেখেছি কারণ তুমি যে আমাদের আপন কেউ একজন।
আমি: মানে?
ইকবাল: এতো মানে খুঁজ না বাসায় চলে যাও আর কিছুক্ষণ পর ফোন করে তোমার পুলিশ আঙ্গেল কে বলো আমাদের ছেড়ে দিতে।
আমি: এতো কাঠখড় পুড়িয়ে এরেস্ট করিয়েছি কি ছেড়ে দেওয়ার জন্য।
ইকবাল: ছাড়বে ছাড়বে কণা সোনা এখন বাসায় চলে যাও।
মেঘ: কণা ওদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে চলো তো এখান থেকে।
আমি: হুম চলো।

ইকবাল আমাকে ওর আপন কেউ কেন বললো? আমি তো ওকে এর আগে কখনো দেখিনি অথচ ও আমাকে বিয়ে করার প্ল্যান করেছিল।
মেঘ: কণা ওই ইকবাল কিনা কি পাগলের মতো বকবক করলো আর তুমি এসব নিয়ে ভাবতে বসে গেলে। বাসায় এসে তো ফ্রেশও হওনি যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
আমি: ইকবাল আমার কে হয়? আমাকে আপন কেউ বললো কেন?
মেঘ: আরে ও হয়তো তোমাকে চিন্তায় ফালানোর জন্য মিথ্যে বলেছে।
আমি: না আমি এই নামটা আগে কোথায় যেন শুনেছি কিন্তু মনে করতে পারছি না।
মেঘ: দুনিয়ায় কি ইকবাল নামে শুধুমাত্র একটি মানুষই আছে আর কারো নাম ইকবাল হতে পারে না?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: ফ্রেশ হয়ে এসো।

মেঘ: কণা তাড়াতাড়ি এসো। (ফ্রেশ হতে এসেছিলাম মেঘের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলাম)
আমি: কি?
মেঘ: ভিডিওটা দেখো। (মেঘের হাত থেকে আমার ফোন এনে ভিডিও দেখতে শুরু করলাম। আম্মু আর চাঁচিআম্মা শপিংমলে, কে যেন আম্মুদের ফলো করছে আর সেটা ভিডিও করে আমার হোয়াটস এ্যাপে দিয়েছে)
আমি: এইটা কোথায় পেলে?
মেঘ: কে যেন ফোন করে বললো হোয়াটস এ্যাপ অন করতে তারপর অন করে দেখি এই ভিডিও। (মেঘ কথা শেষ করার সাথে সাথে ফোন বেজে উঠলো, অচেনা নাম্বার)
–কণা মামুনি ভিডিওটা দেখেছ?
আমি: আপনি…
–তুমি চিনবে না তবে তোমার আম্মু ভালো করেই চিনে।
আমি: আম্মু ক…
–বেশি কথা বলা পছন্দ করিনা আমার ছেলে আর বৌমাকে ছেড়ে দাও নাহলে তোমার আম্মু…
আমি: ওহ আপনি দুই বদমাইশ এর…
–বললাম তো এতো কথা ভালো লাগেনা। দেখো তোমার আম্মুকে মারতে আমার অনেক কষ্ট হবে আপনজনদের মারতে যেমনটা হয় আরকি কিন্তু আমার ছেলের জন্য তো এইটুকু কষ্ট সহ্য করতেই হবে। ভেবে দেখো কি করবে।

লোকটা ফোন রেখে দিলো দফ করে বিছানায় বসে পড়লাম। এবার কি করবো? আম্মুর জন্য ওদের ছেড়ে দিতে হবে? কিন্তু পরে যদি আর ওদের শাস্তি দিতে না পারি? কিন্তু আম্মুকেও তো বাঁচাতে হবে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৯

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৯

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘের বুকে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি ও আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। কতো ঝর বয়ে যাচ্ছে আমাদের উপর দিয়ে শান্তিতে থাকার কোনো উপায় নেই। শায়লাকে পুলিশে দিতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচতাম কিন্তু কোনো প্রমাণই তো পাচ্ছি না। প্রমাণ পাবোই বা কি করে শায়লা তো কোনো প্রমাণ রেখে কাজটা করেনি। এখন একমাত্র রাস্তা শায়লার হাজবেন্ডকে ধরে পুলিশে দিতে হবে আর ওর মুখ থেকেই সব সত্যি বের করতে হবে। মেঘের ফোন বেজে উঠলো, এতো রাতে ফোন আসাতে বেশ অবাক হলাম। কে ফোন দিলো? মেঘের বুকের উপর তুথুনি রেখে ওর দিকে তাকালাম, মেঘ ফোন রিসিভ করলো।
মেঘ: হ্যালো।
শায়লা: মেঘ কণা কোথায়? (শায়লা ফোন করেছে দেখে মেঘ সাউন্ড বাড়িয়ে দিলো)
শায়লা: কি হলো কথা বলছ না কেন? কণা কোথায়?
মেঘ: কণাকে কি প্রয়োজন?
শায়লা: ওর ফোনটা ওর বোনের কাছে হসপিটালে রেখে এসেছে ওর কাছে তোমার ফোনটা দাও আমি কথা বলবো।
মেঘ: কণা এখন ব্যস্ত আছে কথা বলতে পারবে না।
শায়লা: কণা কোথায় সেটা বলো।
মেঘ: কোথায় আবার আমার বুকে ঘুমুচ্ছে।
শায়লা: উউউউহহহহ।
মেঘ: চিৎকার করো না ফোন রাখো।
শায়লা: কণাকে বলে দিও ও আমার লোককে পুলিশে দিয়ে ভালো করেনি, এর ফল ওকে ভোগ করতেই হবে। (শায়লা ফোন রেখে দিতেই মেঘ আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো)
মেঘ: কাকে পুলিশে দিয়েছ?
আমি: আসিফ এর বদলে যে মেয়েটি জয়েন করার মিথ্যে অভিনয় করেছিল।
মেঘ: তুমি জানতে এই কথা?
কণা: উঁহু সেদিন জেনেছি। কিন্তু তুমি তো জানতে আমাকে বলনি কেন?
মেঘ: কণা আমরা সবাই শায়লার জালে আটকা পরে আছি।
আমি: মানে?
মেঘ: আমি এসব বুঝতে পেরে তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু কে যেন ফোন করে আমাকে বলে তোমাকে কিছু জানালে তোমার আম্মুকে মেরে ফেলবে…
আমি: কি?
মেঘ: হ্যাঁ আর আমি নিশ্চিত এই লোকের কথামতো শায়লা সব করছে।
আমি: শায়লার হাজবেন্ড নয়তো?
মেঘ: হতে পারে।
আমি: কিন্তু আম্মুকে মারবে কিভাবে আম্মু তো কানাডায়?
মেঘ: তাতো জানিনা তবে লোকটার কথায় আমি সত্যি ভয় পেয়েছিলাম। টাকা নিয়ে গেলেই কি আম্মু ভালো থাকলেই তো হলো তাই তোমাকে বলিনি।
আমি: আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না কিছুই বুঝতে পারছি না।
মেঘ: এসব নিয়ে পরে ভেবো এখন একটু ঘুমাও তো।
আমি: হুম।
মেঘের বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ ঘুমিয়ে রইলাম।

সকালে মেঘের ডাকেই ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি মেঘ ওর ঠোঁট দুটু আমার ঠোঁটের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে আসছে। একটা আঙ্গুল ওর ঠোঁটে রাখতেই যেন ওর ঘোর কেটে গেল।
আমি: কি হচ্ছে?
মেঘ: প্লিজ!
আমি: উঁহু চলো হসপিটালে যেতে হবে।
মেঘ: যাবো তো প্লিজ একবার মিষ্টি দুটু খেতে দাও।
আমি: মেঘ না প্লিজ! (মেঘ মুখ গোমড়া করে বারান্দায় চলে গেল। আমি উঠে ফ্রেশ হতে চলে আসলাম)

ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় আসলাম মেঘ রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর বাইরে তাকিয়ে আনমনা হয়ে কি যেন ভাবছে।
আমি: এতো কি ভাবছ? (মেঘকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে মাথা রাখলাম। মেঘ আমার দুহাতের উপর ওর দুহাত রাখলো)
মেঘ: ভাবছি তোমার সুন্দর জীবনটা আমি কিভাবে একটু একটু করে নষ্ট করে দিচ্ছি।
আমি: মানে? (মেঘকে ছেড়ে দিয়ে ওকে আমার দিকে ফিরালাম)
মেঘ: বিয়েটা হয়তো একটা এক্সিডেন্ট ছিল কিন্তু তারপর থেকে তো তোমার জীবনে একটার পর একটা ঝর বয়েই যাচ্ছে আর এইসব হচ্ছে আমার জন্য। শায়লা তোমা…
আমি: এসব শায়লা করছে মেঘ, এতে তোমার দোষ কোথায়?
মেঘ: শায়লা আমার আগের স্ত্রী বলেই তো এমন করছে নাহলে তো ও তোমাকে চিনতো না।
আমি: তাই বলে তোমার দোষ হয়ে গেল?
মেঘ: হ্যাঁ শায়লা…
আমি: এসব বলছ আমাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাই না?
মেঘ: আরে পাগলী কাঁদছ কেন আর আমি তোমাকে দূরে সরিয়ে দিবো কেন?
আমি: হসপিটালে যাচ্ছি। (হনহন করে চলে আসলাম ওর সামনে থেকে)

গাড়িতে উঠে বসতেই মেঘ দৌড়ে এসে গাড়িতে উঠলো। কিছুনা বলে চুপচাপ একপাশে এসে বসে পড়লাম।
মেঘ: আমার পাশে এসে বসো নাহলে গাড়ি চলবে না।
আমি: তোহা ঘুম থেকে জেগে আমাকে খুঁজবে তাড়াতাড়ি চলো।
মেঘ: বললাম তো আমার পাশে এসে না বসলে গাড়ি চলবে না।
আমি: লাগবে না তোমার যাওয়া সরো আমি ড্রাইভ করতে জানি। (মেঘকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলাম মেঘ আমাকে টেনে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো তারপর মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো)
মেঘ: সবসময় এতো রেগে যাও কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: আচ্ছা বাবা সরি আর কখনো এসব বলবো না।
আমি: মনে থাকে যেন।
মেঘ: থাকবে, এবার বলো শায়লার ব্যবস্থা কি করেছ? ওর জন্য তো আমরা শান্তিতে থাকতে পারছি না।
আমি: শায়লার হাজবেন্ডকে পুলিশে দিবো আর পুলিশ ওর মুখ থেকে সব সত্যি বের করবে তারপর শায়লাকে এরেস্ট করাবো।
মেঘ: শায়লার হাজবেন্ড?
আমি: হিহিহি..
মেঘ: হাসছ কেন?
আমি: হাসবো না শায়লা তো তোমাকে বলেছিল ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে আর তুমি সেটা বিশ্বাসও করে নিয়েছিলে।
মেঘ: আমি সত্যিই অনেক বোকা।
আমি: জ্বী এবার একটু তাড়াতাড়ি চলুন আমার মেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
মেঘ: ওকে।

তোহা: নতুন আম্মু কোথায় গিয়েছিলে তুমি? (দরজায় আসতেই তোহা প্রশ্ন করলো, এবার মেয়েকে কি বলে বুঝাবো)
আমি: বাসায় মামুনি।
তোহা: তুমি খুব পঁচা আমাকে একা রেখে চলে গিয়েছিলে।
আমি: এইতো চলে এসেছি।
জোহা: মামুনি তোমার আম্মু তো তোমার আব্বুর রাগ ভাঙাতে গিয়েছিল হিহিহি।
আমি: এই চুপ কর।
জোহা: সত্যি বলেছি চুপ করবো কেন?
আমি: রুহান তোমরা বাসায় চলে যাও আমি আর মেঘ আছি এখানে।
রুহান: ডক্টর বললো বিকেলে তোহাকে রিলিজ করে দিবে তখন নাহয় সবাই একসাথে বাসায় যাবো।
জোহা: হ্যাঁ এটাই ভালো হবে আর ততক্ষণে আপু তুমি তোমার কাজটা সেরে পেলো।
আমি: কি কাজ?
জোহা: শায়লার হাজবেন্ড এর ঠিকানা এখন আমাদের হাতে।
আমি: তাহলে তোমরা এখানে থাকো আমি আর মেঘ আসছি।
জোহা: ঠিক আছে।
রুহান: আমি আসবো?
মেঘ: না তুই এদিকে থাক।
রুহান: ঠিক আছে।

চাঁচির পাঠানো ঠিকানায় পুলিশ নিয়ে মেঘ আর আমি আসলাম কিন্তু বাসায় তো তালা দেওয়া।
মেঘ: কণা এই ঠিকানা ভুল নয়তো?
আমি: ভুল হবে কিভাবে? আচ্ছা তালাটা ভেঙে ফেলো ভিতরে গিয়ে দেখি। (পুলিশ তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকলো কিন্তু পুরো বাসা খালি। আশ্চর্য চাঁচি কি আমাকে ভুল ঠিকানা দিলো)
মেঘ: এইটা ভুল ঠিকানা আমি নিশ্চিত।
আমি: নিজের ছেলের এই অবস্থা দেখে ভুল ঠিকানা দেওয়ার সাহস চাঁচির হবে না। তুমি এখানে থাকো আমি আসছি।
মেঘ: উপরে যাচ্ছ কেন?

পুরো বাসা ঘুরে দেখতে দেখতে বেড রুমে এসে ঢুকলাম, যা খুঁজছি তা বেড রুমে পাওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।
মেঘ: কি খুঁজছ বলতো?
আমি: ছবি।
মেঘ: কার?
আমি: এইতো পেয়ে গেছি।
মেঘ: এইটা তো শায়লা…
আমি: হ্যাঁ পাশে এই লোক তারমানে এইটাই শায়লার হাজবেন্ড।
মেঘ: হুম।
আমি: চলো।

আমি: এই লোককে যেখানে পাবেন এরেস্ট করবেন।
পুলিশ: কিন্তু…
আমি: চাচ্চুকে ফোন করতে হবে নাকি?
পুলিশ: না না আমরা ওকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।
আমি: ঠিক আছে।

আবার হসপিটালে ফিরে আসলাম। এভাবে ব্যর্থ হবো ভাবতেও পারিনি। কিন্তু একটা জিনিস আমার মাথাতে ঢুকছে না রুহানের এই অবস্থা দেখেও চাঁচি ভুল ঠিকানা দিলো নাকি? যদি সঠিক ঠিকানা দিয়ে তাকে তবে কি শায়লা কোনো চালাকি করেছে? শায়লার কথা ভাবতে ভাবতেই শায়লা ফোন দিলো।
আমি: হ্যালো।
শায়লা: আমাদের ধরা এতো সহজ না।
আমি: মানে?
শায়লা: ইকবালকে এরেস্ট করাতে গিয়েছিলি পেরেছিস?
আমি: তারমানে আমার ধারণা ঠিক এইসব তোর চালাকি।
শায়লা: হ্যাঁ তুই বাসা থেকে বেরুনোর পর পরই আমি ইকবালকে ফোন করে ওই বাসা থেকে সরে যেতে বলি তা…
আমি: এসব খবর চাঁচি দিচ্ছে তাই না?
শায়লা: তুই খুব চালাক জানিস তো…
আমি: তোর পাখনা আমি ভাঙবো চাঁচিকে পুলিশে দিয়ে, অনেক বার সাবধান করেছি এই মহিলাকে আর নয়।
শায়লা: ইকবালকে খুঁজার চেষ্টা করিস না বার বার ব্যর্থ হবি সফল হতে পারবি না কখনো।
ফোনটা কেটে দিলাম, চাঁচিকে তো আজ আমি শাস্তি দিবো অনেক বেড়েছে এই মহিলা।

আমি: রুহান আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমার আম্মুকে পুলিশে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার কাছে। (তোহার পাশে বসতে বসতে কথাটা বললাম সবাই আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
পপি: ভাবি এসব তুমি কি বলছ? হ্যাঁ মানছি উনি ভুল করেছেন তাই বলে নিজের মানুষকে জেলে…
আমি: উনার ভুলটা এখন অপরাধে রূপ নিয়েছে পপি তাই উনার শাস্তি প্রয়োজন।
রুহান: নতুন করে আবার কিছু করেছেন?
আমি: হ্যাঁ আমি আর মেঘ বাসা থেকে বেরুনো মাত্রই উনি শায়লাকে ফোন করে সব বলে দিয়েছেন। আর শায়লা ওর হাজবেন্ডকে ওই বাসা থেকে সরিয়ে ফেলেছে নাহলে আজ নিশ্চিত ইকবালকে ধরা যেতো। শুধুমাত্র চাঁচির কারণে আমি আব্বুর খুনিদের শাস্তি দিতে পারছি না।
রুহান: যদিও ছেলে হয়ে কথাটা বলতে কষ্ট হচ্ছে তাও বলছি আম্মুকে তুমি পুলিশে দিয়ে দাও যদি নিজেকে একটু শুধরে নিতে পারেন তখন নাহয়…
আমি: তখন আমি নিজেই উনাকে সসম্মানে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসবো রুহান।
রুহান: (নিশ্চুপ)
জোহা: তোহাকে নিয়ে আগে বাসায় যাই তারপর চাঁচির ব্যবস্থা করো।
আমি: হুম।

বিকেলে তোহাকে রিলিজ করে দিলো, সবাই তোহাকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। আসার পথে পুলিশ আঙ্গেলকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেছি কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবেন।
মা: তোরা সবাই চলে এসেছিস?
পপি: মা চাঁচি কোথায়?
মা: রুমেই আছে কেন কিছু হয়েছে? (সবাই নিশ্চুপ হয়ে আছে। রুহান চুপচাপ সোফায় বসে পড়লো। পুলিশ আঙ্গেলকে ফোন দেওয়ার পর থেকে মেঘ চুপচাপ হয়ে গেছে কোনো কথা বলছে না আমার সাথে)
আমি: জোহা তোহাকে নিয়ে তুই রুমে যা।
জোহা: ঠিক আছে আপু।
মেঘ: কণা বলছিলাম…
চাঁচি: রুহান বাবা তুই ঠিক আছিস তো? (চাঁচি দৌড়ে এসে রুহানকে জড়িয়ে ধরলেন)
রুহান: ছাড়ো আমাকে।
চাঁচি: এই বদমাইশ মেয়ে তোকে আটকে রেখেছিল তোর কোনো ক্ষতি করেনি তো? তুই আসলি কিভাবে?
রুহান: আমার সাথে তো পপিকেও আটকে রেখেছিল আম্মু কই পপিকে তো কিছুই জিজ্ঞেস করলে না।
চাঁচি: আগে আমার ছেলে বুঝেছিস?
দাদী: কিরে কি হয়েছে কে কাকে আটকে রেখেছিল?
চাঁচি: কে আবার তোমার আদরের নাতবৌ আমার ছেলেকে আটকে রেখেছিল।
আমি: দাদী চাঁচিকে একবার জিজ্ঞেস করুন তো এসব আমি কেন করেছিলাম। (কলিংবেল বেজে উঠলো, দরজা খুলতে আমিই আসলাম)

দরজা খুলে পুলিশ আঙ্গেলকে দেখতে পেলাম। আঙ্গেল ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে চারদিকে চোখ বুলালেন।
আঙ্গেল: কণা মা কেমন আছ?
আমি: এইতো ভালো।
চাঁচি: বাসায় পুলিশ কেন? (ভয়ে আতকে উঠলেন চাঁচি)
রুহান: তোমার শাস্তি প্রয়োজন আম্মু অনেক পাপ করেছ।
চাঁচি: ওহ ওই বজ্জাত মেয়ের সাথে তুই যোগ হয়েছিস? তাহলে তো আমার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। (কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই চাঁচি টেবিল থেকে ফল কাটার চাকুটা হাতে নিয়ে পপির গলায় ধরে ফেললেন)
আমি: আরে চাঁচি কি করছেন?
মা: কি করছ পাগল হয়ে গেছ আমার মেয়েকে ছাড়ো।
চাঁচি: জেলে যখন যেতেই হবে আমার শত্রুর মেয়েকে শেষ করেই যাবো।
রুহান: আম্মু পপি শুধু তোমার শত্রুর মেয়ে না আমার স্ত্রী ছাড়ো বলছি ওকে।
চাঁচি: ছাড়বো আমাকে যেতে দাও তাহলে।
মেঘ: কণা আমি তোমার কাছে হাত জোড় করছি চাঁচিকে যেতে দাও আমার বোনকে বাঁচাও।
দাদী: অনেক্ষণ ধরে তোমার বদমাইশি দেখছি ছোট বৌমা ছাড়ো বলছি পপিকে।
চাঁচি: বললাম তো আমাকে যেতে দাও…
আঙ্গেল: আপনার মতো খারাপ মানুষকে সামলানোর জন্যই তো আমরা। (পুলিশ আঙ্গেল চাঁচির হাত ধরে ফেললেন, চাঁচি ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে পপির হাতে চাকু লাগিয়ে দিলেন। পপির হাতের শিরা কেটে গেছে হয়তো, ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে ওর হাত থেকে)
রুহান: পপি…
মেঘ: বলেছিলাম তোমাকে চাঁচিকে ছেড়ে দাও শুননি, আমার বোনের কিছু হলে কিন্তু… (মেঘ আমাকে শাসিয়ে পপির কাছে চলে গেল)
আঙ্গেল: আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি মেয়েটাকে হসপিটালে নিয়ে যাও ভয় নেই সব ঠিক হয়ে যাবে। (আঙ্গেল চলে যেতেই পপির কাছে আসলাম এখনো ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে)
মা: ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে চল।

পপিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে সবাই বাইরে অপেক্ষা করছি। আমার খুব ভয় হচ্ছে যদি পপির কিছু হয় আমাকে মেঘ কখনো ক্ষমা করবে না। কিন্তু আমারই বা কি করার ছিল চাঁচি এতো নিচে নেমে যাবে আমি তো ভাবতেই পারিনি।

সবাই কাঁদছে আমি একা একটা চেয়ারে চুপচাপ বসে আছি এমনটা হবে কল্পনাও করতে পারিনি।
রুহান: ডক্টর আমার পপি.. (হঠাৎ রুহানের কথা শুনে পিছনে তাকালাম ডক্টর বেরিয়ে এসেছে)
ডক্টর: চিন্তার কোনো কারণ নেই.. (ডক্টর এর কথা শেষ হবার আগেই রুহান দৌড়ে কেবিনের ভিতর ঢুকে গেল। মেঘ দরজা থেকে পপিকে এক নজর দেখে আমার দিকে এগিয়ে আসলো)
মেঘ: কণা সরি আসলে তখন মাথা ঠিক ছিল না তাই উল্টাপাল্টা কত কিছু বলে ফেলেছি তোমাকে।
আমি: এমন পরিস্থিতিতে কারো মাথা ঠিক থাকে না মেঘ। বিশ্বাস করো আমি ভাবতে পারিনি চাঁচি এতো নিচে নেমে যাবেন আর এমন জঘন্য কাজ করবেন।
মেঘ: চাঁচি আমাদের এতো ঘৃণা করেন আর আমরা কিনা বুঝতেই পারিনি।
আমি: মেঘ তুমি কিন্তু এখনো আমাকে বলনি তুমি চাঁচি আর রুহানের কাছে কিসের ঋণী।
মেঘ: ছোটবেলায় খেলতে খেলতে বাসার বাইরে রাস্তায় চলে গিয়েছিলাম। তখন তেমন কিছু বুঝতাম না কিন্তু সেদিনের সেই স্মৃতি আজো মনে পড়ে আমার। মাঝ রাস্তায় হাটছিলাম সামন দিক থেকে গাড়ি আর পিছনে চাচ্চু। চাচ্চু বারবার বলছিলেন সরে যেতে কিন্তু ছোট ছিলাম তো চাচ্চু বুঝতে পেরেছিলেন সরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আর তাই চাচ্চু দৌড়ে এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন আর নিজে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে যান… (মেঘ হাউমাউ করে কাঁদছে কি বলবো ওকে বুঝতে পারছি না)
মেঘ: এই দৃশ্য মাঝেমাঝে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে বিশ্বাস করো কণা তখন আমার গা শিউরে উঠে। সেদিন চাচ্চু মারা যান, রুহান তখন খুব ছোট। আব্বু রুহান আর চাঁচির দায়িত্ব নেন। আমরা সবসময় চাঁচি আর রুহানকে ভালোবেসেছি কিন্তু চাঁচি যে সেদিনের ঘটনার জন্য আমাকে দায়ী ভাবেন সেটা কখনো বুঝতে পারিনি।
আমি: হুম আর এজন্যই চাঁচি তোমাদের শত্রু ভাবেন আর তাই এতোকিছু করেছেন, বারবার তোমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন আর আজ তো পপিকে…
মেঘ: চলো পপির কাছে।

পপি শুয়ে আছে পাশের চেয়ারে রুহান বসে বসে কাঁদছে, একটু দূরে মা আর দাদী বসে আছেন।
আমি: রুহান যা হয় ভালোর জন্যই হয় তা আজ আবার প্রমাণ হয়ে গেল। (আমার কথা শুনে সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো)
রুহান: মানে?
আমি: পপির আজ এ অবস্থা হয়েছে বলেই তো পপির প্রতি তোমার ভালোবাসাটা প্রকাশ পেলো।
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: এভাবে মানুষ প্রিয়জনের জন্যই কাঁদে রুহান।
পপি: ভাবি…
আমি: পপি তুমি চুপ থাকো। রুহান এখন তো আর অস্বীকার করতে পারবে না যে তুমি পপিকে ভালোবাস না।
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: এখন কিন্তু আর নিশ্চুপ হয়ে থাকাটা মানায় না। (রুহান সবার দিকে তাকালো ও হয়তো মা’কে দেখে লজ্জা পাচ্ছে)
মা: চলুন মা আমরা ডক্টর এর সাথে কথা বলে আসি।

মা আর দাদী বেরিয়ে যেতেই রুহান পপির কপালে চুমু খেলো।
রুহান: ভালোবাসি। (পপি মৃদু হেসে রুহানের হাত ধরলো)
মেঘ: এইযে মেডাম আমিও কিন্তু আপনাকে ভালোবাসি।
মেঘ ওদের সামনেই আমার দুগালে ধরে কপালে আলতো করে চুমু খেলো, লজ্জায় মেঘের বুকেই মুখ লোকালাম…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৮

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৮

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘের চোখেমুখে পানির ছিটা দিতেই ওর জ্ঞান ফিরল, চোখ খুলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আমি: তোহার কি হয়েছে।
মেঘ: আমি তোমার তোহাকে আগলে রাখতে পারিনি। (মেঘ আমার হাত ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে কেঁদে দিলো)
আমি: মেঘ তোহার কি হয়েছে বল।
মেঘ: হসপিটালে চলো তোহা তোমাকে দেখতে চাইছে।
আমি: আমার তোহা…
মেঘ: ভয় পেয়ো না কিছু হবেনা তোহার, তুমি চলে আসার পর কিছু মুখে দেয়নি সারাক্ষণ তোমাকে ডেকে ডেকে কেঁদেছে। আজ সকালে হঠাৎ করে মাটিতে লুটিয়ে পরে তারপর হসপিটালে নিয়ে এসেছি। তোমাকে অনেক বার ফোন করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ।
জোহা: আপু দেরি করো না চলো।
আমি: হুম।

অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, বেডে নিথর হয়ে পরে আছে আমার তোহা। চুপচাপ ওর মাথার কাছে এসে বসলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তোহা চোখ মেলে তাকালো।
নার্স: আপনি বোধহয় বাচ্চাটির মা তাইতো আপনার ছোঁয়া পেতেই জ্ঞান ফিরে আসলো। এতোক্ষণ ধরে তো নতুন আম্মু নতুন আম্মু বলে ডেকেই যাচ্ছে আর বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে।
আমি: মামুনি…
ডক্টর: মাস্কটা খুলে দাও। (ডক্টর রুমে এসে বলতেই নার্স এসে তোহার অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিলো)
তোহা: নতুন আম্মু। (তোহা আমাকে জড়িয়ে ধরলো আমিও জড়িয়ে ধরলাম আমার সোনামণিটাকে)
ডক্টর: এই বয়সে এতো কষ্ট বাচ্চাটি নিতে পারেনি আর ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া না করা থেকেই এই অবস্থা হয়েছে। আপাতত আর কোনো সমস্যা হবে না তবে ভবিষ্যৎ এ যেন ও আর কখনো এমন পরিস্থিতির স্বীকার নাহয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
আমি: আর হবে না, তোহাকে এখন থেকে আমার বুকে আগলে রাখবো।
মা: বৌমা নিজেকে সামলাও এভাবে কেঁদো না।
আমি: আপনারা এতো গুলো মানুষ আমার ছোট মেয়েটাকে দেখে রাখতে পারলেন না?
পপি: ভাবি আমরা কি কম চেষ্টা করেছি, তোহা তো তোমাকে ছাড়া কিছুই বুঝছিল না।
মেঘ: কণা ওদের অজতা বকো না, তোহা তো তুমি খাইয়ে না দিলে খায় না এই দুদিন কিছুই মুখে দেয়নি সারাক্ষণ কেঁদেছে তাই এই অবস্থা হয়েছে।
চাঁচি: তোহা নাহয় বাচ্চা মেয়ে তাই মায়ের জন্য না খেয়ে নিজের এমন হাল করেছে কিন্তু তুই? তুই তো বুঝিস তাহলে তুই কেন দুদিন কিছু মুখে দেসনি সারাক্ষণ কেঁদেছিস? এতো আহ্লাদ ভা…
মেঘ: আমার যন্ত্রণা তুমি কি বুঝবে চাঁচি, তুমি তো…
চাঁচি: আমি কি বল।
আমি: থামবে তোমরা? (ওদের ধমক দিতে গিয়ে চাঁচির দিকে নজর পড়লো, আচ্ছা সেদিন রাতে চাঁচি কোথায় ছিলেন? জ্ঞান ফেরার পর তো চাঁচিকে দেখতে পাইনি)
চাঁচি: এই মেয়ে আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
আমি: বুঝার চেষ্টা করছি। (মৃদু হাসলাম, চাঁচি বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছেন)
মা: অনেক হয়েছে এবার সব ঠিকঠাক করো, বৌমা তুমি মেঘকে ক্ষমা করে দিয়ে বাসায় ফিরে এসো।
জোহা: মানুষ ভুল করলে ক্ষমা করা যায় খুন করার চেষ্টা করলে না। বাসায় গেলে পর যদি আবার আপুকে…
আমি: জোহা থাম তুই।
জোহা: আপু একদম ওকে ক্ষমা করবে না করেছ তো আমি তোমাকে জোর করে নিয়ে কানাডা চলে যাবো। (মেঘ মুখ গোমরা করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। যেভাবেই হউক চাঁচিকে দিয়েই সব সত্যি বের করতে হবে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সেদিন রাতের ঘটনার সাথে মেঘ নয় চাঁচি যুক্ত। তোহাকে রেখে দৌড়ে বেরিয়ে আসলাম, মেঘ চলে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম)
মেঘ: এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন পরে গিয়ে ব্যথা পাবে তো।
আমি: মেঘ এখনো সময় আছে প্লিজ সত্যিটা বলো।
মেঘ: আর কোন সত্যি জানতে চাও বলতো? সত্যি তো এটাই আমি তোমাকে খুন করতে চেয়েছিলাম।
আমি: তুমি আমাকে খুন করবে কেন তুমি তো আমাকে ভালোবাস। তুমি শুধু একটা কারণ দেখাও যে এই কারণে তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছি…
মেঘ: কারণ তো তুমিও জানো কণা। আমি শায়লার কথামতো তোমাকে খুন করতে চেয়েছিলাম, তুমি আমার আর শায়লার মাঝখানে বারবার আসছ তাই।
আমি: মিথ্যে কথা আমি বিশ্বাস করিনা। তুমি তো শায়লাকে নয় আমাকে ভালোবাস।
মেঘ: নাহ আমি শায়লাকেই ভালোবাসি।
আমি: একদম মিথ্যে বলবে না।
মেঘ: কণা সবাই দেখছে কলার ধরেছ কেন ছাড়ো।
আমি: ছাড়বো না তুমি বলো সব মিথ্যে তুমি এমনটা করনি।
মেঘ: ছাড়ো বলছি।
আমি: আহহ। (দুহাতে মেঘের শার্টের কলার চেপে ধরেছিলাম, মেঘ আমার হাত ছাড়াতে গিয়ে কাটা হাতে ব্যথা দিয়ে ফেললো)
মেঘ: কণা আমি দেখে দেইনি বিশ্বাস করো। খুব ব্যথা পেয়েছ তাই না? (মেঘ হাতের এপাশ উপাশ দেখছে আর আমি দেখছি ওকে)
আমি: ব্যান্ডেজ করা হাতে এভাবে কি দেখছ?
মেঘ: বিশ্বাস করো আমি দেখে দেইনি। (মেঘ ব্যান্ডেজ এর মধ্যে একটা চুমু খেলো, ওর দুচোখে পানি)
আমি: কাটা হাতে ব্যথা পেয়েছি বলে যে এতোটা উতলা হয় সে নাকি আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। (মেঘ কথাটা শুনে আমার হাত ছেড়ে দিলো, কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হনহন করে চলে গেল। মেঘ তো পালিয়ে গেল কিন্তু আমি সত্যিটা বের করে মেঘকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনবো আর সেটা খুব তাড়াতাড়ি)

এবার এমন প্ল্যান করবো চাঁচি সব সত্যি বলতে বাধ্য হবে। তার আগে সবাইকে বাসায় পাঠানো প্রয়োজন, সবাই এখানে থাকলে আমার প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা সম্ভব হবে না। রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম…
আমি: মা আপনি আর বাবা চাঁচিকে নিয়ে বাসায় চলে যান দাদী একা আছেন তো, এদিকে আমরা আছি।
মা: কিন্তু…
আমি: তোহার কিছু হবেনা মা আমি আছি তো।
মা: ঠিক আছে।

সবাই চলে গেল। আমি, জোহা, রুহান আর পপি তোহার পাশে বসে আছি, আর তোহা ঘুমিয়ে আছে।
আমি: রুহান আমাকে একটা হেল্প করবে?
রুহান: কি হেল্প বলো।
আমি: তোমার আর পপির একটু অভিনয় চাই আমি।
পপি: মানে?
আমি: আমি যা যা বলি তাই শুধু করে যাও সময় হলে ঠিক জানতে পারবে কেন করেছি এসব।
রুহান: এখন নাকি?
আমি: তোহাকে রেখে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব না তাই এখানেই করতে হবে আর সেটা রাতে।
রুহান: ঠিক আছে।
পপি: কিন্তু কি কাজ?
আমি: পরেই নাহয় বলবো।

আম্মু: তুই ওখানে বিপদে পড়েছিস আমি বেশ বুঝতে পারছি।
আমি: না আম্মু সবাই তো আছে আমার পাশে কেন অজতা টেনশন করছ বলতো।
আম্মু: আমি আগামীকাল দেশে আসছি।
আমি: আম্মু প্লিজ এই ভুল করো না। তুমি এখানে আসলে আমার টেনশন বাড়বে, আব্বুর মতো তোমার উপর শায়লা যেকোনো সময় হামলা করতে পারে।
আম্মু: শায়লা কে? (ভুলু মনে বলে দিলাম এখন তো আম্মু হাজারটা প্রশ্ন করবে)
আম্মু: বলছিস না কেন এই শায়লাটা কে?
আমি: আম্মু শায়লা-ই আব্বুকে খুন করিয়েছে।
আম্মু: কিন্তু কেন? কে এই শায়লা আমাদের ক্ষতি করে ওর কি লাভ?
আমি: এসব তোমায় পরে বলবো আম্মু, ওর বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই আমার হাতে তাই ওকে এরেস্ট করাতে পারছি না। আমি প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করছি তুমি প্লিজ এখানে এসো না।
আম্মু: এমন বিপদের মধ্যে তুই একা…
আমি: একা কোথায় জোহা আছে মেঘ আছে ওদের পরিবারের সবাই আছে আমার পাশে।
আম্মু: ঠিক আছে।
আমি: তুমি টেনশন করো না রাখছি।
আম্মু: হুম।
ফোন রেখে যেন হাফ ছেড়ে বাচঁলাম, সত্যি যদি আম্মু চলে আসতেন তাহলে আর একটা টেনশন আমার বেড়ে যেতো।

রুহান আর পপি দুজন দু চেয়ারে বসে আছে, ওদের হাত পা রশি দিয়ে বেঁধে দিয়েছি। রাত অনেক হয়েছে ডক্টর তোহাকে দেখে গেছে এখন আর আসবে না। রুহান আর পপির কাছে এসে ওদের দুজনের মুখ রুমাল দিয়ে বেঁধে দিলাম।
আমি: বাহ্ দারুণ লাগছে তোমাদের, মনে হচ্ছে তোমাদের দুজনকে আমি সত্যি সত্যি কিডন্যাপ করেছি।
জোহা: আপু রুহান ভাইয়ার আম্মুকে ভিডিও কল করবো?
আমি: হ্যাঁ তাড়াতাড়ি কর।
জোহা: আপু রিসিভ করছে নাতো।
আমি: শান্তিতে ঘুমুচ্ছে, কল দিয়ে যা একবার রিসিভ করুক শান্তির ঘুম হারাম হয়ে যাবে।

কয়েকবার কল করার পর চাঁচি ফোন রিসিভ করলেন, ফোন রিসিভ করা মাত্র রুহানের দিকে ফোনটা ধরলাম। ঘুম ভাঙ্গতেই ঘুম ঘুম চোখে নিজের ছেলেকে এই অবস্থায় দেখে উনি চিৎকার করে উঠলেন।
চাঁচি: আমার রুহান…
আমি: ভালো করে দেখে নিন আপনার ছেলে কি অবস্থায় আছে।
চাঁচি: আমার ছেলের সাথে এমন করছ কেন?
আমি: কারণ আপনি আমার সাথে করছেন তাই। আপনি বারবার আমার সাথে খেলবেন আর আমি একবারো খেলবো না তা কি করে হয় চাঁচি শাশুড়ি।
চাঁচি: রুহানের কোনো ক্ষতি করবে না তুমি বলে দিলাম।
আমি: জোহা চাকুটা রুহানের গলার কাছে ধরতো।
চাঁচি: এই চাকু সরাও আমার ছেলের লেগে যাবে।
আমি: সব সত্যি না বললে আপনার ছেলের গলাটা আলাদা করে ফেলবো।
চাঁচি: আমি সবাইকে ডাকছি তোমার কাজকর্ম সব দেখাবো।
আমি: খবরদার বাবা মা’কে ডাকতে যাবেন না, উল্টাপাল্টা করেছেন তো রুহানকে মেরে ফেলবো। আর আপনি ভালো করেই জানেন এমন দু একটা লাশ ঘোম করা আমার কাছে কোনো ব্যাপার না, তখন কিন্তু নিজের ছেলের লাশটাও শেষ বারের মতো দেখতে পারবেন না।
চাঁচি: আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও, তোমার কাছে তো পপি আছে ওকে মেরে ফেলো। (কথাটা শুনে রুহান আর পপির চোখ বড়বড় হয়ে গেল)
আমি: আপনি না আসলেই একটা খারাপ মানুষ আপনার শাস্তি প্রয়োজন, আর রুহানকে মেরে ফেললেই আপনার চরম শাস্তি হবে।
চাঁচি: দ্যাত আমি অজতা টেনশন করছি, রুহান তো তোমাকে ভালোবাসে তাই তুমি ওকে মারতেই পারো না।
আমি: ভুল ভাবছেন চাঁচি শাশুড়িআম্মা, রুহান আমাকে ভালোবাসে কিন্তু আমি না। এমনিতে রুহান আমাকে মেঘের সাথে সুখে ঘর করতে দিচ্ছে না তাই ওকে মেরে ফেললে আমার অনেক লাভ।
চাঁচি: এই না না তুমি বল কি জানতে চাও আমি সব বলবো।
আমি: সেদিন রাতে আমাকে খুন করতে চেয়েছিল কে? মেঘ নাকি আপনি?
চাঁচি: আআমমি আআর শাশায়লার লোক।
আমি: মেঘ’কে ফাঁসালেন কিভাবে? না তোতলিয়ে ভালোভাবে বলুন নাহলে কিন্তু রুহানকে…
চাঁচি: না না বলছি… আমি তোমাদের রুমে ঢুকা মাত্রই শায়লা মেঘের ফোনে মেসেজ করে যেন আমি খুন করার পর মেঘকে ফাঁসানো যায় কিন্তু মেসেজের শব্দে মেঘের ঘুম ভেঙে যায়। আমি আগেই তোমাদের রুমের লাইট অফ করে রেখেছিলাম, মেঘ মেসেজ দেখে উঠে লাইট জ্বালাতে চায় তখনি শায়লার লোক বারান্দা থেকে কিছু একটা ফেলে দিয়ে শব্দ করে তখন মেঘ লাইট না জ্বালিয়েই বারান্দার দিকে চলে যায়। ততক্ষণে তোমার ঘুম ভেঙে যায় আমি রুমে আছি এইটা বুঝতে পেরে তুমি চিৎকার দিতে পারো তাই তোমার মুখ চেপে ধরি। দুজনের লড়াইয়ের শব্দ শুনে মেঘ চলে আসে, আমার হাতে চাকু ছিল সেটা তোমার হাতে লেগে যায় তখনি মেঘ আমার হাত ধরে ফেলে। মেঘের হাতে চাকুটা ধরিয়ে দিয়ে আমি ফালিয়ে আসি, মেঘ আমার পিছু পিছু এসেছিল কিন্তু তোমাদের রুম থেকে বেরুতেই বাইরের আলোয় মেঘ আমাকে দেখে ফেলে ততক্ষণে তুমি রুমের লাইট জ্বালিয়ে মেঘকে চাকু হাতে নেওয়া অবস্থায় দেখে ফেলো। মেঘ আমাকে দেখে বোবা হয়ে গিয়েছিল তাই তখন কোনো কথা বলেনি। আমি ভেবেছিলাম মেঘ সবাইকে বলে দিবে তাই সে রাতে রুম থেকে আর বের হইনি কিন্তু মেঘ দোষটা নিজের কাধে নিলো। (চাঁচির কথাগুলো শুনে সবাই বোবার মতো হয়ে গেলাম, রুহানের দিকে তাকালাম ও নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছে)
আমি: আপনি তো মেঘের মায়ের মতো তাই আপনাকে বাঁচিয়ে মেঘ নিজে খুনি সেজেছে আর আপনি.. ছিঃ
চাঁচি: এবার আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও।
আমি: তার আগে বলুন শায়লাকে সাহায্য কে করছে? কে আছে শায়লার পিছনে?
চাঁচি: শায়লার স্বামী আছে, ও কোথায় আছে আমি জানিনা।
আমি: আপনি জানেন বলুন বলছি নাহলে…
চাঁচি: বলছি, শায়লার স্বামী পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে আছে আমি ওর ঠিকানা জানি, তোমাকে বলবো প্লিজ রুহানকে ছেড়ে দাও। রুহান ছাড়া যে আমার কেউ নেই, ওর কিছু হলে আমি বাঁচবো না।
আমি: আপনি তো এমনিতেও বাঁচবেন না অনেক পাপ করে ফেলেছেন এবার আপনাকে আমি পুলিশে দিবো। ঠিকানাটা এক্ষণি মেসেজ করুন।
চাঁচি: ঠিক আছে রুহানকে ছেড়ে দাও।

ফোন রেখে রুহান আর পপির বাঁধন খুলে দিলাম, রশি রুমাল সবকিছু সরিয়ে ফেললাম।
আমি: যাও তোমরা ফ্রেশ হয়ে এসো।
জোহা: আপু কি অভিনয়টাই না করলে তুমি মনে হচ্ছিল সত্যি ওদেরকে কিডন্যাপ করেছ।
আমি: এমনটা না করলে সত্যিটা চাঁচি কখনোই বলতো না।
পপি: রুহান কাঁদছ কেন? (পপির কথা শুনে রুহানের দিকে তাকালাম, নীরবে কেঁদে যাচ্ছে)
আমি: রুহান কি হলো কাঁদছ কেন?
রুহান: আমার আম্মু এতোটা খারাপ আর আমি কিনা বুঝতেও পারিনি।
আমি: উনি নিজের স্বার্থে সব করতে পারেন রুহান, ভয় পেয়ো না আমি উনাকে ভয় দেখাবো মাত্র পুলিশে দিবো না।
রুহান: না কণা আম্মু পাপ একটু বেশিই করে ফেলেছেন উনার এখন শাস্তি প্রয়োজন।
পপি: আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না ভাইয়ার উপর চাঁচির কিসের এতো রাগ।
আমি: চাঁচি তোমাদের শত্রু ভাবেন পপি।
পপি: কিন্তু কেন?
আমি: এই প্রশ্নের উত্তর আমারো জানা নেই, মেঘ হয়তো বলতে পারবে।
পপি: সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি আব্বু আমাদের যতটুকু ভালোবাসেন রুহানকেও ততটুকু ভালোবাসেন, রুহানকে কখনো বুঝতে দেননি ওর যে বাবা নেই। আর চাঁচি কিনা আমাদের শত্রু ভাবেন, আজ তুমি এমনটা না করলে তো জানতেই পারতাম না।
আমি: শান্ত হও পপি, সব ঠিক হয়ে যাবে। রুহানকে দেখো আমি আসছি।
জোহা: কোথায় যাবে এতো রাতে?
আমি: মেঘের কাছে।
পপি: ভাইয়া…
আমি: বাসায় আছে। তোমরা সবাই থেকো এখানে তোহাকে দেখো আসছি।
রুহান: কণা একা যেও না এতো রাতে।
আমি: যেতে পারবো।

বাসায় এসে কতক্ষণ ধরে কলিংবেল চাপতেই বাবা এসে দরজা খুলে দিলেন।
বাবা: একি বৌমা তুমি?
আমি: মেঘ কোথায় বাবা?
বাবা: রুমেই আছে।
দৌড়ে রুমের দিকে আসলাম।

মেঘ তো রুমে নেই, তাড়াতাড়ি বারান্দায় আসলাম কিন্তু মেঘ এখানেও নেই। এতো রাতে মেঘ কোথায় গেল, ছাদে যায়নি তো? ছাদের দিকে দৌড় দিলাম।

ছাদের কিনারায় মেঘ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে দৌড়ে গিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। মেঘ আমার দুহাত ধরে আমাকে ওর সামনে এনে দাঁড় করালো, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ও। কিছু না বলে জাপটে ধরলাম ওকে।
মেঘ: কণা কি হয়েছে?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কথা বলছ না কেন? এতো রাতে চলে আসলে যে তোহা কোথায়?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কণা আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
আমি: যতক্ষণ না আমাকে জড়িয়ে ধরছ আমি কোনো কথা বলব না।
মেঘ: এবার বলো। (মেঘ আমাকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো)
আমি: সব সত্যি আমি জেনে গেছি মেঘ, তুমি এই কাজ করনি চাঁচি করেছে।
মেঘ: মানে কিভাবে জেনেছ?
আমি: আগে বলো তুমি চাঁচিকে বাঁচাতে চেয়েছিলে কেন? নিজের উপর সব দোষ নিয়েছ কেন?
মেঘ: চাঁচি এমনিতে শায়লার সাথে জড়িয়ে আছেন তুমি একবার ক্ষমা করে দিয়েছ কিন্তু বারবার তো ক্ষমা করবে না। তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছেন জানতে পারলে তো তুমি চাঁচিকে পুলিশে দিতে।
আমি: হ্যাঁ দিতাম, যে বারবার অপরাধ করে তার শাস্তি হওয়া প্রয়োজন মেঘ।
মেঘ: কিন্তু আমি চাইনা চাঁচি কোনো শাস্তি পাক।
আমি: কিন্তু কেন?
মেঘ: কারণ আমি চাঁচি আর রুহানের কাছে ঋণী হয়ে আছি। (মেঘকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে তাকালাম)
আমি: কিসের ঋণ?
মেঘ: এইটা নাহয় পরে বলবো। (মেঘ আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেল, আমার কোমর জড়িয়ে ধরে ওর কপাল আমার কপালে ঠেকালো)
মেঘ: কষ্ট হয়নি এই দুদিন আমাকে ছাড়া থাকতে?
আমি: হয়েছে তো।
মেঘ: আমিতো আর একদিন এভাবে থাকলে মরেই যেতাম। না পারছিলাম খাবার খেতে না পারছিলাম ঘুমাতে আর না পারছিলাম নিশ্বাস নিতে। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি আমার কণা’কে হারিয়ে ফেলেছি, আর বুঝি ফিরে পাবো না।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কণা তোমাকে ছাড়া আমার নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় প্লিজ আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না আমি বাঁচতে পারবো না তোমাকে ছাড়া।
মেঘ ওর বুকের সাথে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, আমিও জড়িয়ে ধরলাম। মেঘ আমাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে পাগলের মতো কাঁদছে, বাঁধা দিচ্ছি না। কাঁদুক এই দুদিনের জমানো কষ্ট গুলো কেঁদে উড়িয়ে দিক…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৭

1

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৭

লেখিকা: সুলতানা তমা

চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছি ডক্টর হাতে ব্যান্ডেজ করছে, সবাই পাশে দাঁড়ানো মেঘ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অজ্ঞান হবার আগে দেখেছিলাম মেঘ ডক্টরকে ফোন করে কতোটা অনুরোধ করেছে, হাতে কি একটা যেন বেঁধে দিয়ে আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে সবাইকে পাগলের মতো ডাকছিল। চোখ বুজার আগে মেঘের কান্না শুনেছিলাম। আর এখন মেঘ শান্ত হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই শুধু ডক্টর যাওয়ার অপেক্ষা করছে। জানি সবাই কিছুক্ষণ পর নানা প্রশ্ন করবে জানিনা কি উত্তর দিবো।
ডক্টর: একটু সাবধানে থাকবেন হাতে যেন কোনো ছুট না লাগে।
আমি: ঠিক আছে।
ডক্টর: আর ওষুধ গুলো ঠিকমতো খাবেন।
আমি: হুম।
বাবা: রুহান ডক্টরকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়।
ডক্টর: লাগবে না আমি যেতে পারবো।
বাবা: এতো রাতে।
ডক্টর: সমস্যা নেই পারবো। (ডক্টর চলে গেল, দাদী এসে আমার পাশে বসলেন)
দাদী: কি করে হলো এসব?
আমি: (নিশ্চুপ)
মা: কথা বলছ না কেন বৌমা?
বাবা: মা বলো এসব কি করে হলো।
আমি: বলবো তার আগে আমি মেঘের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই। (আমার কথা শুনে একজন আরেকজনের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে)
রুহান: তুমি সুইসাইড করতে চেয়েছিলে তাই না? ভাইয়ার অবহেলা তোমাকে এই কাজ করতে বাধ্য করেছে ভাইয়াকে তো…
আমি: রুহান আমিতো বলেছি আমি আগে মেঘের সাথে আলাদা কথা বলতে চাই।
রুহান: ঠিক আছে।
সবাই একে একে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, মেঘ আস্তে আস্তে এসে আমার পাশে বসলো।

মেঘ নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না, ইচ্ছে করেই ও তাকাচ্ছে না।
আমি: সবসময় তো বলো আমি তোমাকে বলার বা আমাকে বুঝানোর মতো সুযোগ সময় কোনোটাই তোমাকে দেই না আজ দিচ্ছি শুধু একবার বলো এমনটা কেন করেছ?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: আমার দিকে তাকাও মেঘ প্লিজ বলো এমনটা কেন করেছ তুমি তো আমাকে ভালোবাস।
মেঘ: আসছি আমি।
আমি: তুমি এই রুমের বাইরে গেলে আমি হাতের ব্যান্ডেজ খুলে ফেলবো আর আমি ভালো করেই জানি তুমি এইটা চাও না।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: মেঘ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি আমাকে খুন করতে চেয়েছিলে, আমার শুধু মনে হচ্ছে কোথাও কোনো একটা ভুল আছে। প্লিজ তুমি একবার বলো তুমি এই কাজ কর…
মেঘ: আমিই করেছি কণা। তুমি তো আমার হাতে চাকু দেখেছ তাহলে বিশ্বাস করতে পারছ না কেন? তাছাড়া আমিতো এতোটা ভালো নই যে আমার দ্বারা খারাপ কাজ করা সম্ভব না।
আমি: মেঘ তুমি কি লোকানোর চেষ্টা করছ?
মেঘ: কি লুকাবো?
আমি: কিছু একটা তো লোকানোর চেষ্টা করছ তুমি, মেঘ প্লিজ বলো…
মেঘ: কতোবার বলবো আমিই করেছি।
আমি: কিন্তু কেন?
মেঘ: শায়লার কথামতো করেছি।
আমি: তাহলে একেবারে মেরে ফেললে না কেন? পাগলের মতো আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলে কেন? দিশেহারা হয়ে ডক্টরকে ফোন করে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলে কেন?
মেঘ: জানিনা।
আমি: মেঘ শুনো… (মেঘ আমার কথা না শুনে চলে গেল, কি লুকাচ্ছে মেঘ আমার থেকে)
জোহা: আপু ভাইয়া তো চলে গেল কি হয়েছে বলো আমাকে।
আমি: কিছু হয়নি চল বাসায় চলে যাবো।
জোহা: মানে এতো রাতে বাসায়…
আমি: এখানে আমি এক মুহূর্তও থাকতে চাই না।
বাবা: কেন মা কি হয়েছে?
আমি: আজ আমাকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছে ভবিষ্যৎ এ আবারো হয়তো হবে। আমি এখানে থাকবো না।
বাবা: খুন? কে করবে এই কাজ?
আমি: শায়লা করিয়েছে।
দাদী: তুই ওই বাসায় গেলে যে খুনি চেষ্টা করবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে?
আমি: করলে করেছে আমি এই বাসায় থাকবো না।
পপি: তোমরা কেন বুঝতে চাইছ না ভাবি ভাইয়ার উপর অভিমান করে চলে যেতে চাইছে।
আমি: (নিশ্চুপ)
পপি: ভাইয়াকে বলো ভাবিকে আটকাতে তাহ…
মেঘ: না পপি ও চলে গেলেই আমি খুশি হবো। (মেঘ দরজার বাইরে থেকে কথাটা বলতেই বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো, যার জন্য এতো কিছু করলাম সে কিনা আজ..)
মা: মেঘ কি বলছিস এসব?
মেঘ: ওকে চলে যেতে বলো আম্মু।
আমি: চলেই তো যাবো এক্ষণি চলে যাবো।
জোহা: আপু কি করছ হাতে ছুট লাগবে। সকাল হতে দাও আমরা সকালে চলে যাবো।
বাবা: কি হয়েছে খুলে বলো একটু আমাকে।
আমি: শায়লার কথা মতো মেঘ আমাকে খুন করতে চেয়েছিল। (চিৎকার করে বললাম, এই কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল)
রুহান: এতো বড় সাহস ওর। (রুহান দরজার বাইরে থেকে মেঘকে টেনে নিয়ে আসলো, সবাই ওর দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
রুহান: কণা যা বলছে তা কি সত্যি ভাইয়া? (মেঘ আমার দিকে তাকালো কোনো কথা বলছে না, আমি সবাইকে বলতে চাইনি সবার রাগারাগিতে মেঘ যদি সত্যিটা বলে দেয় এই আশায় বলেছি। আমি জানিতো মেঘ এমন কাজ করতেই পারেনা কোথাও কোনো একটা ভুল আছে)
বাবা: মেঘ কথা বলছিস না কেন? বৌমা যা বলছে তা কি সত্যি?
দাদী: তুই কণাকে খুন করতে চেয়েছিলি তাও শায়লার কথামতো?
মেঘ: হ্যাঁ আমিই করেছি এসব। (মেঘ চিৎকার করে উঠতেই মা গিয়ে মেঘকে অনেক গুলো থাপ্পড় দিলেন)
বাবা: এক্ষণি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবি নাহলে…
মেঘ: চলে যাচ্ছি।
পপি: ভাইয়া শুনো এতো রাতে কোথায় যাবে? (মেঘ চলে যাচ্ছে আমিতো জানি মেঘ এমন কোনো কাজ করতেই পারেনা, মেঘ এতো রাতে বাইরে গেলে যদি শায়লা মেঘের কোনো ক্ষতি করে)
আমি: মেঘ এখন বেরিয়ে গেলে আমিও এতো রাতে বেরিয়ে যাবো।
রুহান: মানে কি? যে তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করলো তার জন্য তু…
আমি: বললাম তো ও চলে গেলে আমিও চলে যাবো।
জোহা: আমরা সকালে চলে যাবো আপু আর শুধু এই বাসা থেকে নয় এই দেশ থেকে চলে যাবো, আমি আব্বুকে ফোন করে সবটা বলছি। কোনো খুনির সাথে তোমার সংসার করতে হবে না।
আমি: চাচ্চুকে কিছু বলার প্রয়োজন নেই জোহা, আম্মু টেনশন করবেন।
জোহা: তুমি এই খুনিদের মধ্যে থাকবে নাকি? ওরা তো যেকোনো সময় তোমাকে খুন করতে পারে। আমার তো এখন মনে হচ্ছে চাচ্চুকে মেঘ’ই খুন করেছে।
আমি: জোহা না জেনে কাউকে দোষ দেওয়া ঠিক না।
জোহা: না জেনে কোথায় দোষ দিলাম? যে রাতের অন্ধকারে নিজের স্ত্রীকে খুন করার চেষ্টা করতে পারে সে তো খুনিই। আপু আমি তোমাকে বলছি ওকে পুলিশে দাও নাহলে ও আবারো তোমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে।
মা: আমার ছেলেটাকে জেলে দিওনা অন্য যা শাস্তি দিতে হয় দাও।
আমি: ভয় নেই মা আমি এমন কিছু করবো না। (মা কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন, একে একে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মেঘ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে)
জোহা: আপু আমি এখানে আছি তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো, সকাল হলেই আমরা আমাদের বাসায় চলে যাবো।
আমি: হুম।

ঘুম ভাঙ্গতেই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জোহা আমার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে আছে দেখে ওকে ডেকে তুললাম। আমাকে এই বাসা থেকে চলে যেতে হবে তাহলে হয়তো মেঘ সত্যিটা বলবে। আর সত্যিই যদি মেঘ এমনটা করে থাকে তাহলে ওকে ডিভোর্স দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কানাডা চলে যাবো।
জোহা: আপু চলো। (ঘুমন্ত তোহার দিকে তাকিয়ে আছি, মেয়েটাকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে)
জোহা: আপু যদি সম্ভব হতো তোহাকে নিয়ে যেতাম, সম্ভব নাতো ওরা দিবে না তাছাড়া কোন অধিকারে নিয়ে যাবো।
আমি: একবার মেঘকে বলে দেখনা।
মেঘ: বলতে হবে না আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবে। (তোহার কপালে একটা চুমু দিয়ে মেঘের কাছে আসলাম, কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে আসলাম)

বাবা: আমাদের ক্ষমা করে দিস মা এমন হবে কখনো ভাবিনি। আমরা তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।
মা: মেঘ এমন হয়ে যাবে আমরা কেউ তা ভাবিনি আমাদের কারণেই তো তুমি বিয়েটা করতে রাজি হয়েছিলে।
জোহা: হ্যাঁ আর এটাই ছিল আপুর সবচেয়ে বড় ভুল। নিজেদের ছেলেকে একটু বুঝান, ভবিষ্যৎ এ আর কখনো এমন কিছু করার চেষ্টা করলে আমি কিন্তু আপুর কথা শুনবো না ওকে…
আমি: জোহা চুপ কর।
জোহা: কেন চুপ করবো? আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো ফিরে পেতাম তোমাকে?
আমি: আমার তোহাকে দেখে রেখো সবাই। (চোখের পানি মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলাম)

জোহা: আপু কিছু খেয়ে ওষুধ গুলো খেয়ে নাও। (বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেঘের কথা ভাবছিলাম, জোহা খাবার নিয়ে আসলো)
আমি: খাবার…
জোহা: দারোয়ানকে দিয়ে আনিয়েছি রান্না তো পারিনা।
আমি: আমাদের আগের কাজের খালাকে ফোন করে আসতে বলেছি টেনশন করিস না উনি চলে আসবেন।
জোহা: ঠিক আছে তুমি খাবারটা খেয়ে ওষুধ খেয়ে নাও।
আমি: হু। (জোহা খাবার রুমে রেখে চলে গেল, পিছু পিছু আমিও আসলাম)

খাবার মুখে দিতেই তোহার কথা মনে পরে গেল, রোজ তো আমিই তোহাকে খাইয়ে দেই আমি ছাড়া অন্যকারো হাতে মেয়েটা খেতে চায় না। ঘুম থেকে উঠে আমাকে দেখতে না পেয়ে মেয়েটা অনেক কেঁদেছে হয়তো, খাবার খেয়েছে কিনা কে জানে। হঠাৎ আমার ফোন বেজে উঠলো, মেঘ ফোন করেছে দেখে বেশ অবাক হলাম। বার বার ফোন বেজেই চলেছে বিরক্ত হয়ে কেটে দিয়ে ফোনটা অফ করে ফেললাম। মেঘ সত্যিটা না বলা পর্যন্ত কথা বলবো না ওর সাথে।

ছাদের এক কোণে বসে বসে ভাবছি শায়লা ছোট তোহাকে ছেড়ে কিভাবে থেকেছে আমার তো এই কয়েক ঘন্টায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। তোহার দুষ্টুমি গুলো খুব মনে পড়ছে, মন চাইছে একটাবার তোহার মুখে নতুন আম্মু ডাকটা শুনতে। হয়তো আবার কখনো তোহা আমাকে নতুন আম্মু বলে ডাকবে, হয়তোবা আর কখনো তোহা আর আমার দেখা হবে না নতুন আম্মু ডাকটাও শুনা হবে না।
বুয়া: মা কে জানি আসছে তোমার সাথে দেখা করার জন্য। (বুয়ার ডাকে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিয়ে পিছন ফিরে তাকালাম)
আমি: কে এসেছে খালা?
বুয়া: একজন ছেলে।
আমি: ঠিক আছে তুমি যাও আমি আসছি।

কে এসেছে ভাবতে ভাবতে নিচে আসলাম, ড্রয়িংরুমে সোফায় একটি ছেলে বসে আছে। আমাকে দেখেই ছেলেটি উঠে দাঁড়ালো।
আমি: আপনি…
–আমার নাম আসিফ আপনাদের ম্যানেজার।
আমি: আপনাকে তো সেদিন দেখিনি আমি তো সেদিন অফিসে গিয়েছিলাম।
আসিফ: আমি অসুস্থ ছিলাম আসলে অসুস্থ ছিলাম বললে ভুল হবে, আমাকে কারা যেন মেরেছিল। আমি ছিনিনি তাদের তবে এখন বুঝতে পারছি কেন আমাকে আহত করে হসপিটালে পাঠানো হয়েছিল।
আমি: কেন?
আসিফ: আমি আপনার সাথে অনেক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু হসপিটাল থেকে কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে পারিনি কারণ আপনার ফোন নাম্বার ছিল না আমার কাছে। এই বাসায় অনেক বার ফোন করেছিলাম কিন্তু কেউ রিসিভ করেনি। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমি এতোদিন অফিসে আসিনি কিন্তু কেউ কোনো খুঁজ নেয়নি। আজ আপনাকে খুঁজে এই বাসায় এসেছি আর পেয়েও গেলাম।
আমি: আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
আসিফ: গতকাল অফিসে এসে দেখি আমার চাকরি নাকি নেই আমার জায়গায় একটি মেয়ে বসে আছে। আমি জোর করে সবকিছুর হিসেব মিলাতে যাই আর গিয়ে দেখি সব গড়মিল তখন বুঝতে পারি আমাকে সরানো হয়েছিল এজন্যই।
আমি: এখন বুঝলাম আপনাকে সরিয়ে মেয়েটিকে আনা হয়েছিল টাকা…
আসিফ: দশ কোটি টাকা লস হয়েছে মেম আর সব টাকা একটা একাউন্টেই ট্রান্সফার করা হয়েছে।
আমি: নাম কি?
আসিফ: ইকবাল…
আমি: ইকবাল?
আসিফ: চমকে উঠলেন যে?
আমি: নামটা বেশ চেনাচেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছি না।
আসিফ: আমি একটা কথা ভেবে পাচ্ছি না, মেঘ স্যার তো আমাকে চিনেন তাহলে মেয়েটিকে কেন চাকরি দিলেন আর আমার কোনো খুঁজ নিলেন না কেন? এতোগুলো টাকা অন্য একটা একাউন্টে ট্রান্সফার হয়েছে অথচ মেঘ স্যার কিছুই বুঝতে পারেননি? ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত না মেডাম? (আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না মেঘ এতো গুলো টাকার গড়মিল দেখেও আমাকে কিছু জানালো না কেন)
আমি: আগামীকাল থেকে আমি অফিসে যাবো সবকিছু আমিই এখন থেকে দেখাশোনা করবো। আর হ্যাঁ কাল থেকে আপনিও আসবেন।
আসিফ: ঠিক আছে মেডাম।
আসিফ চলে গেল, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না মেঘ আমাকে কিছু জানায়নি কেন নাকি টাকার ব্যাপারটা মেঘ নিজেই জানতো না? মেঘকে তো এখন কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না কথাই তো হয়না আমাদের।

আসিফ: মেডাম এই মেয়েটিই আমার পরিবর্তে আছে আর হ্যাঁ গতকাল রাতে আরো পাঁচলক্ষ টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছে আগের একাউন্টেই। (অফিসে এসে এইসব দেখতে হবে ভাবিনি, আর মেয়েটি তো সেই মেয়ে যে আমাকে শায়লা আর মেঘের কথা বলেছিল)
আমি: কে তুমি?
–আআমি…
আমি: কে পাঠিয়েছে তোমাকে?
–শাশায়লা মেমেডাম।
আমি: তোতলাচ্ছ কেন ভালো ভাবে বলো তোমাকে এখানে কে এনেছে আর এইসব কেন করেছ কার কথায় করেছ?
–শায়লা মেডাম এনেছে আর এইসব উনার কথাতেই করেছি।
আমি: যার একাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করা হয় সে কে?
–শায়লা মেডাম জানে আমি কিছুই জানিনা।
আমি: মেঘ জানতো?
–হ্যাঁ তবে স্যার আপনাকে বলতে চেয়েছিল কিন্তু ওই লোকটা স্যারকে ফোন করে কাকে যেন মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল তাই স্যার আপনাকে কিছু বলেনি।
আমি: সেদিন তুমি শায়লার কথা মতো আমাকে মেঘের বিরুদ্ধে এসব বলেছিলে তাই না?
–হ্যাঁ।
আমি: আসিফ পুলিশ এনে ওকে দিয়ে দাও।
–আমি কিছু করিনি মেডাম।
মেয়েটির কথায় পাত্তা না দিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম। মেঘকে আজ ফোন করে সব জিজ্ঞেস করবো কেন ও এমন করছে কিসের ভয়ে এমন করছে।

বাসায় এসে মেঘকে অনেক বার ফোন করলাম কিন্তু ও ফোন রিসিভ করছে না হয়তো আমি গতকাল রিসিভ করিনি এই রাগে। ফোনটা আবার অফ করে রেখে দিলাম যা জিজ্ঞেস করার মেঘকে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করবো, যদি কখনো ওর সাথে দেখা হয়। জানিনা আর কখনো ওর সাথে আমার দেখা হবে কিনা।

আজ ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গেল, তাড়াহুড়ো করে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছি। জোহা আমার পিছন পিছন খাবার নিয়ে হাটছে, দুদিন পেরিয়ে গেল এই বাসায় এসেছি এই জোহাটাই আমাকে দেখে রাখছে। জোহা আছে বলেই হয়তো আমি এখনো ভেঙে পড়িনি।
জোহা: তুমি কি খাবে নাকি আমি আব্বুকে ফোন করে সব বলে দিবো?
আমি: সবসময় চাচ্চুর ভয় দেখাস কেন?
জোহা: কারণ তুমি ভালো করেই জানো আব্বু এসব জানলে তোমাকে কানাডা নিয়ে যাবে।
আমি: হু।
জোহা: খেয়ে নাও কলিংবেল বাজছে আমি দেখি কে এসেছে।
আমি: ঠিক আছে।

জোহা: কেন এসেছ এখানে আমার বোনকে খুন করতে? আজ কি নিয়ে এসেছ চাকু নাকি অন্যকিছু? (জোহার চেঁচামেচি শুনে তাড়াতাড়ি নিচে আসলাম। ড্রয়িংরুমে মেঘকে দেখে বেশ অবাক হলাম)
জোহা: আপু একদম ওর কাছে যাবে না বলে দিলাম।
আমি: তুমি এখানে? আর তোমার এই অবস্থা কেন? (মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুদিনে কেমন যেন রোগা হয়ে গেছে ও, চুলগুলো সব উসকোখুসকো)
জোহা: বেরিয়ে যাও বলছি। (আচমকা মেঘ দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো, বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি)
মেঘ: কণা আমাদের তোহা…
আমি: কি হয়েছে তোহার?
মেঘ: তোহা তোহা হসপিটালে।
মেঘ অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো, দফ করে মেঘের মাথার কাছে বসে পড়লাম। কি হয়েছে আমার তোহার মেঘ এমনভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়লো কেন? তাহলে কি তোহা…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৬

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৬

লেখিকা: সুলতানা তমা

রুহান: তোহা কোথায়? ভাইয়া তোহাকে নিয়ে ফিরেছে তো? (আনমনা হয়ে রান্নাঘরে কাজ করছিলাম হুট করে রুহান এসে পিছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো)
আমি: হু!
রুহান: কি হয়েছে?
আমি: কোথায় কি?
রুহান: তুমি কাঁদছ কেন? তোহার জন্য নাকি? আরে তোহাকে তো ভাইয়া নিয়ে এসেছে।
আমি: কোথায় আমি কাঁদছি নাতো। (রুহান কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল)

মেঘকে তো খুব ভালোবাসি হয়তো প্রকাশ করি না, ওকে আজ থাপ্পড় দিয়ে নিজেই কষ্ট পাচ্ছি তাইতো নীরবে কেঁদে যাচ্ছি। আমি কখনো এমনটা চাইনি কিন্তু কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে…
রুহান: রুমে চলো। (রুহান আবার ফিরে এসেছে আর আমার হাত ধরে টানছে)
আমি: মানে?
রুহান: ভয় পেয়ো না আমার রুমে নয় তোমাদের রুমে চলো।
আমি: আরে কি করছ? (রুহান আমাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে আসলো)

মেঘ মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে, রুহান আমাকে এনে মেঘের পাশে ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিলো।
রুহান: তুমি কি ভেবেছ কণা নিজেও সুখে থাকবে না আমাকেও সুখী হতে দিবে না?
আমি: মানে?
রুহান: পপি আর আমার বিয়ে দিয়েছ হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারছি না কিন্তু তোমাকেও তো আর ডিস্টার্ব করছি না তাহলে তুমি কেন সুখে থাকবে না? সবসময় তোমাদের দুজনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হয় কেন?
মেঘ: রুহান এসব বাদ দে।
রুহান: না আমি বাদ দিবো না। আমি সুখে থাকি বা না থাকি কণা কে তো সুখে থাকতেই হবে।
আমি: আগে নিজের বউকে সুখী করো তারপর অন্যের বউকে সুখী করতে এসো।
রুহান: (নিশ্চুপ)
মেঘ: রুহান যাতো এসব নিয়ে অজতা মাথা ঘামাস না।
রুহান: তোমাদের এই ভুল বুঝাবুঝি ভালো লাগে না। তোমরা তো ছোট বাচ্চা না যে একজন আরেকজন কে বুঝাতে পারো না। তুমি কোথায় যাচ্ছ কি করছ সবকিছু কণাকে বলে গেলেই তো হয়।
মেঘ: আজ তো বলেছিলাম কিন্তু রাস্তায় শায়লার ফোন এসেছিল ও কি কি বলেছিল তুই তো সব শুনেছিস। শায়লা আমাকে বারবার ফাঁসাচ্ছে আর আমি বারবার বোকার মতো শায়লার ফাদে ফেঁসে যাচ্ছি কিন্তু এই কথাটা আমি কণাকে কিছুতেই বুঝাতে পারছি না। বুঝাবো কি করে কণা তো আমাকে কিছু বলার বা ওকে বুঝানোর মতো সুযোগ সময় কোনোটাই দিচ্ছে না।
রুহান: কণা আজ কিন্তু ভাইয়া আর আমি বিয়েতেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে শায়লা ফোন করে বলে ও তোহাকে কিডন্যাপ করে নিয়েছে। তুমি তোহাকে খুঁজে না পেলে কষ্ট পাবে তাই ভাইয়া তোহাকে আনতে চলে যায় কিন্তু শায়লা ভাইয়াকে ফাঁসিয়ে দিয়েছে, তোমার সামনে বলেছে ওদের বিয়ে আজ তাই ভাইয়া ওখানে গিয়েছে। তুমি শায়লার চালাকি বুঝতে পারোনি ভাইয়াকে ভুল বুঝেছ। (রুহানের কথা শুনে মাথা নিচু করে রাখলাম, চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। কি করলাম আমি এইটা? না বুঝে মেঘকে এভাবে আঘাত করলাম। শায়লার ছাল বুঝতে না পেরে মেঘকে এতো কষ্ট দিলাম আমি)
রুহান: প্লিজ আর ভুল বুঝাবুঝি নয় আসছি।
রুহান চলে যেতেই মেঘের দিকে তাকালাম নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে, আমার দিকে তাকাচ্ছে না। মেঘের গালে আমার আঙ্গুলের দাগ বসে আছে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে, জানিনা কিভাবে ক্ষমা চাইবো এখন মেঘের কাছে। ক্ষমা চাইলে মেঘ আমাকে ক্ষমা করবে তো?
মেঘের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে উঠে দাঁড়ালাম দুহাতে মেঘের মুখ উপরে তুলে ওর গালে চুমু বসিয়ে দিলাম, মেঘ হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, মুচকি হেসে তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

সন্ধ্যার আকাশ চারদিক একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে, মৃদু বাতাসের মধ্যে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না মেঘের কাছে কিভাবে ক্ষমা চাইবো, মেঘ আমাকে আদৌ ক্ষমা করবে কিনা তাও জানিনা আমি। আস্তে আস্তে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মেঘ: কণা…(হঠাৎ মেঘের কন্ঠ শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম, ও আমার দিকে এগিয়ে আসছে)
মেঘ: এই সময় ছাদে দাঁড়িয়ে আছ যে।
আমি: এমনি।
মেঘ: এখনো রেগে আছ? (অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, কি বলছে এসব ও? আমি কেন রাগ করে থাকবো রাগ তো করার কথা ওর)
আমি: তুমি সব ভুলে গেলে?
মেঘ: সবকিছু মনে রাখতে নেই।
আমি: তাই বলে থাপ্পড়ের কথাটাও ভুলে গেলে। (কথাটা বলে মাথা নিচু করে ফেললাম। মেঘ আমার কাছে এসে দুহাত দিয়ে আমার মুখ তুলে ধরলো, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি)
মেঘ: তুমি তো না বুঝে থাপ্পড়টা দিয়েছ আর এমন পরিস্থিতিতে তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই কাজটাই করতো। তাছাড়া তুমি তো তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ অনুতপ্ত হয়েছ আর সেটা তোমার দুচোখে ফুটে উঠেছে। কেউ তার নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত হলে তার উপর কি আর রাগ করে থাকা মানায়?
আমি: তুমি আমাকে এতো তাড়াতাড়ি ক্ষমা করে দিলে?
মেঘ: ভালোবাসি তো পাগলী। (মেঘ আমাকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো, নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছি এতোটা ভুল আমি কি করে করতে পারলাম)
মেঘ: এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমি চলে যাবো।
আমি: কোথায় কাঁদছি নাতো। (মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম)
মেঘ: রুমে চলো।
আমি: না এখানেই ভালো লাগছে।
মেঘ: ছাদে ভালো লাগছে নাকি আমার বুকে এভাবে থাকতে ভালো লাগছে? (মেঘ হাসছে নিশ্চুপ হয়ে ওর বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছি)

মেঘ আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আর আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলা করছে। চুপচাপ ওর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে এবার রুমে যাওয়া দরকার।
আমি: মেঘ নিচে চলো তোহা কোথায় দেখতে হবে।
মেঘ: পপির কাছে আছে টেনশন করো না।
আমি: ঠিক আছে রুমে তো চলো।
মেঘ: কেন আমার কাছে থাকতে ভালো লাগছে না তোমার?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: হয়তো এখনো মনে রাগ পুষে রেখেছ বিশ্বাস করো আমি কোনো ভুল করিনি শায়লা আমাকে ফাঁসাচ্ছে। আমিতো তোহাকে আনার জন্যই গিয়েছিলাম কিন্তু শায়লা দিচ্ছিল না হঠাৎ করে ওর আড়চোখে দরজার দিকে তাকানো দেখে আমি পিছন ফিরে তাকাই আর তোমাকে দেখতে পাই। আর তখনি শায়লা সুযোগ বুঝে বিয়ের কথা বলে যেন তুমি আমাকে ভুল বুঝে আমার থেকে দূরে চলে যাও আর তুমি করেছও সেটা।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: সেদিন অফিস থেকে খাবার আনার জন্য আমি রেস্টুরেন্টে যাইনি তোমাকে ফলো করতে করতে গিয়েছিলাম কারণ তুমি বলেছিলে শায়লার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে যাচ্ছ। শায়লা কতোটা ভয়ংকর আমি তো জানি তাই তোমার কোনো বিপদ হতে পারে ভেবে তোমাকে ফলো করেছিলাম কিন্তু কথাটা তোমাকে বলতে পারিনি কারণ তুমি না বুঝে রেগে যেতে।
আমি: সত্যি আমি একটা বোকা মানুষ।
মেঘ: শায়লা তোমার সামনে যা ঘটাচ্ছে তুমি তাই দেখছ আর আমাকে ভুল বুঝছ একবারো ভাবছ না আমিতো তোমাকে ভালোবাসি তাহলে শায়লার কথামতো এসব করবো কেন? ডিভোর্স পেপার নিয়ে ঝগড়া করেছ অথচ আমি জানতামই না শায়লা কখন ডিভোর্স এর ব্যবস্থা করেছে আর আমার ফাইলের ভিতর ডিভোর্স পেপারটা দিয়ে দিয়েছে।
আমি: ডিভোর্স পেপার দেখলে কারো মাথা ঠিক থাকে নাকি কিছু ভাবার মতো?
মেঘ: উঁহু ঠিক থাকবে কিভাবে তুমি যে আমায় ভালোবাস।
আমি: বাসি না।
মেঘ: সেটা তো আস্তে আস্তে বুঝেই যাচ্ছি।
আমি: হু!
মেঘ: কোনো প্রমাণ পেয়েছ?
আমি: না।
মেঘ: শায়লা অনেক চালাক কোনো প্রমাণ রেখে ও কাজ করে না। দেখেছ তো স্যার কে খুন করার সময় ইচ্ছে করে ফোনে আমার নাম্বার রেখে ফোনটা তোমাদের বাসায় ফেলে এসেছিল আমাকে ফাঁসানোর জন্য, এইটা থেকেই বুঝে নাও শায়লা কতোটা চালাক।
আমি: কিন্তু যে করেই হউক প্রমাণ তো আমাকে জোগাড় করতেই হবে।
মেঘ: চাঁচি ছাড়া অপশন নেই কিন্তু চাঁচিকে পুলিশ নিয়ে গেলে আব্বু আবারো স্ট্রোক করবেন।
আমি: চাঁচি যে জড়িত তুমি জানো কিভাবে আমি তো তোমাকে বলিনি।
মেঘ: রুহান বলেছে সবকিছু আর তুমি এইটা নিয়ে রুহানকে ব্ল্যাকমেইল করে ওদের বিয়ে দিয়েছ এইটাও বলেছে।
আমি: কি করবো বল পপির কষ্ট সহ্য করতে পারছিলাম না তাই বাধ্য হয়ে এই কাজ করতে হলো।
মেঘ: চাঁচির সাথে কথা বলে দেখো উনাকে বুঝিয়ে বলো যদি অন্য কোনো প্রমাণের কথা বলেন। (তোমাকে কি করে বুঝাই মেঘ চাঁচি কিছুতেই আমাকে প্রমাণ দিবে না কারণ চাঁচি তোমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে চাঁচি যে তোমাদের শত্রু ভাবে সেটা তো তোমরা জানো না)
মেঘ: কি হলো চুপ হয়ে আছ কেন?
আমি: এমনি রুমে চলো।
মেঘ: চলো।

রুমে এসে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি আম্মুর অনেক গুলো ফোন, তাড়াতাড়ি আম্মুকে ফোন দিলাম।
আম্মু: খুব অস্থির লাগছেরে মা।
আমি: কেন আম্মু কি হয়েছে?
আম্মু: এতো দিন হয়ে গেল অথচ তোর আব্বুর খুনি কে জানতে পারলাম না।
আমি: তুমি টেনশন করো নাতো আমি ঠিক জেনে যাবো আর খুনিকে খুব কঠিন শাস্তিও দিবো।
আম্মু: কখন খুঁজে পাবো কেঁদে কেঁদে আমার চোখ অন্ধ হয়ে গেলে পর?
আমি: রাগ করোনা আম্মু আমি ঠিক খুঁজে বের করবো খুনিকে।
আম্মু: ভালো লাগছে না রাখছি। (আম্মু ফোন কেটে দিলেন বিছানায় দফ করে বসে পড়লাম, আর ভালো লাগছে না কিযে করি আমি)

চাঁচি: তোমাকে এভাবে ভেঙে পড়ে যেতে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। (দরজায় তাকিয়ে দেখি চাঁচি হাসছেন, বিছানায় বসে বসে কাঁদছিলাম তাই উনি এতো খুশি হয়েছেন। ভাগ্যিস মেঘ রুমে নেই)
চাঁচি: আমি শায়লার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করবো ওকে জেলে দিবো! কোথায় গেল তোমার এসব বড়বড় কথা?
আমি: একটি মেয়ে তার বাবার খুনিকে শাস্তি দিতে পারছে না ভেবে কাঁদছে আর আপনি এই নিয়ে ঠাট্টা করছেন? অবশ্য করবেনই না বা কেন আপনি নিজেই তো এই কাজে জড়িত।
চাঁচি: আমি জড়িত এইটার কোনো প্রমাণ তো নেই তোমার কাছে।
আমি: পুলিশ যখন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞেস করবে তখন গড়গড় করে পেট থেকে সব কথা বের হয়ে আসবে আফসোস আমি আপনাকে পুলিশে দিতে পারছি না শুধুমাত্র বাবার কথা ভেবে এই খান পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে। তবে হ্যাঁ শায়লার পিছনে কে আছে এইটা আমি খুব তাড়াতাড়ি জেনে যাবো আর শায়লাকে পুলিশে দিয়ে ওর পেট থেকে সব কথা বের করবো।
চাঁচি: আমি তো তোমাকে একটা সাহায্য করেছি, শায়লার পিছনে মেঘ আছে ও সব আড়াল থেকে করছে বলে দিয়েছি তো তোমাকে।
আমি: মিথ্যে কথা মেঘ আর আমাকে আলাদা করার জন্য আপনি এসব করছেন আমি সব বুঝে গেছি। আপনি মেঘদের শত্রু ভাবেন তো তাই চাইছেন মেঘকে কোনোভাবে জেলে দি…
চাঁচি: বোকা মেয়ে তো তুমি তাই মেঘ তোমাকে বুঝিয়ে ফেলেছে। একদিন খুব বাজে ভাবে ঠকে যাবে তখন বুঝবে মেঘকে বিশ্বাস করে কতো বড় ভুল করেছ আর সেই দিনটা খুব বেশি দূরে নয়। (চাঁচি মিটিমিটি হাসতে হাসতে চলে গেলেন। না পারছি উনাকে কিছু বলতে না পারছি শায়লাকে ধরতে, প্রমাণ ছাড়া শায়লাকে এরেস্ট করাবো কিভাবে)

তোহা: আচ্ছা নতুন আম্মু এইরকম মানুষ পুতুল হয় না? (বিছানা ঠিক করছিলাম তোহার কথা শুনে ওর দিকে তাকালাম, তোহা একটা ছোট পুতুল আমার দিকে ধরে রেখেছে)
মেঘ: হয়তো মামুনি। (মেঘের কথা শুনে চোখ বড়বড় করে তাকালাম ওর দিকে)
তোহা: আমাকে এনে দাওনা।
মেঘ: তোমার আম্মুকে বলো ও চাইলেই আমি তোমাকে পুঁচকে একটা মানুষ পুতুল এনে দিতে পারি। (মেঘের কথার মানে বুঝে ওর দিকে বালিশ ছুড়ে মারলাম ও দিব্বি হাসছে)
তোহা: ওওও নতুন আম্মু এনে দাওনা আমাকে একটা মানুষ পুতুল।
আমি: দিবো মামুনি এখন খাবে চলো অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে হবে তো।
মেঘ: কণা তোমার ফোন বাজছে।
ফোন হাতে নিয়ে দেখি উকিল, তাড়াতাড়ি বারান্দায় চলে আসলাম।

আমি: হ্যালো।
উকিল: হ্যাঁ মা তোমার নতুন উইল রেডি।
আমি: যেভাবে বলেছিলাম ঠিক তেমন তো?
উকিল: হ্যাঁ একদম তোমার কথামতো করেছি।
আমি: ঠিক আছে আপনার কাছে রেখে দিন সময় হলে আমি নিয়ে আসবো।
উকিল: ঠিক আছে।

ফোন রেখে রুমে আসতেই দেখি মেঘ আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি: কি?
মেঘ: কে এমন ফোন করলো যে আমার সামনে কথা বলতে পারোনি?
আমি: তোমার সামনে কথা বলতে পারবো না কেন উকিল চাচ্চু ফোন করেছিলেন।
মেঘ: কেন?
আমি: নতুন উইল তৈরি করতে বলেছিলাম করেছেন তাই জানানোর জন্য ফোন করে…
মেঘ: নতুন উইল?
আমি: হ্যাঁ চমকে উঠলে কেন?
মেঘ: কেমন উইল তৈরি করেছ?
আমি: এইতো তোহার নামে আপাতত কিছু নেই আমার অবর্তমানে সবকিছু তোহার নামে হবে, মানে আমি মারা গেলে তোহা সব পা..(মেঘের চিন্তিত মুখ দেখে আমার কথা আটকে গেল, আশ্চর্য মেঘ এতো কি চিন্তা করছে)
তোহা: নতুন আম্মু খাবো।
আমি: হ্যাঁ মামুনি চলো।
তোহাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বেরুতেই মনে হলো কেউ একজন দরজার পাশ থেকে দৌড়ে চলে গেল। চারদিকে চোখ বোলালাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না আশ্চর্য কে আমাদের কথা শুনছিল লুকিয়ে লুকিয়ে? নাকি আমার চোখের ভুল এইটা? আচ্ছা চাঁচি নয়তো?

চাঁচি: ঘরে দুই দুইটা বউ রেখে আমাকে কাজ করতে হয় ভালো লাগেনা।
মা: তোমাকে তো করতে বলছি না কাজের লোক আছে ওরা করছে তুমি শুধু শুধু করো কেন? (চাঁচি কি সত্যিই রান্নাঘরে ছিল নাকি আমাকে আসতে দেখে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে এসব বলছে)
চাঁচি: আচ্ছা বউরা তো খাবারটা টেবিলে নিতে পারে তাইনা?
পপি: আমিতো নিতে আসছিলাম তুমিই তো রুহান ডাকছে বলে আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিলে অথচ রুহান রুমেই নেই।
চাঁচি: কেকেকেন রুরুহান ডাকলো তো…(চাঁচির দিকে আমার তাকানো দেখে উনি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন)
আমি: মা একটু শুনোন তো। (মা’কে টেনে একটু দূরে নিয়ে আসলাম)
মা: কি হয়েছে বৌমা?
আমি: মা চাঁচি কি এতোক্ষণ আপনার সাথে এখানেই ছিলেন নাকি কোথাও…
মা: না কোথাও যায়নি ও তো আমার সাথেই আছে এতোক্ষণ ধরে, কেন বলতো?
আমি: এমনি।
তোহা: নতুন আম্মু আসো না।
আমি: আসছি মামুনি।

তোহাকে ঘুম পারাচ্ছি আর মেঘকে দেখছি, এখনো আগের মতো চিন্তিত হয়ে বসে আছে। খাবার খেলো কারো সাথে কোনো কথা বলেনি কিসের যেন চিন্তা ওকে ঘিরে রেখেছে।
আমি: ঘুমুবে না?
মেঘ: হ্যাঁ আসছি। (মেঘ এসে চুপচাপ শুয়ে পড়লো)

মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, পুরো রুম অন্ধকার দেখে বেশ অবাক হলাম ডিম লাইট তো জ্বালানো ছিল। ফোন খুঁজতে গিয়ে দেখলাম মেঘ বিছানায় নেই আশ্চর্য মেঘ কোথায়? বাথরুমে যায়নি তো? আমার ফোন খুঁজে পাচ্ছি না দেখে মেঘের বালিশের কাছে হাত দিলাম, ওর ফোন পেয়ে টর্চ জ্বালাতে যাবো তখন ফোনের স্কিনে মেসেজ চোখে পড়লো “মেঘ কাজ শেষ তো” মেসেজ পড়ে কিছু বুঝতে না পেরে মেসেজ লিস্টে ঢুকলাম “মেয়েটা বড্ড জ্বালাচ্ছে ওকে আজ রাতেই শেষ করে দাও মেঘ” শায়লার এই মেসেজ দেখে ভয়ে আতকে উঠলাম ফোনটা আমার হাত থেকে ফ্লোরে পরে গেল। উঠে বসে পড়লাম সারা শরীর ঘামছে আমার, মেঘ আর শায়লা আমাকে খুন করার প্ল্যান করছে? এখন কি করবো আমি চলে যাবো? কিন্তু তোহা, মেয়েটাকে রেখে যাওয়া তো সম্ভব না। আস্তে আস্তে উঠে ফ্লোরে মেঘের ফোনটা খুঁজলাম কিন্তু পেলাম না, ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয়ে আমার হাত পা কাঁপছে। কোন দিকে দরজা কোন দিকে সুইচ কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন রুমে হাটছে চিৎকার দিতে যাবো তখনি আমার মুখ চেপে ধরলো। ধস্তাধস্তিতে দেয়ালে এসে আটকে গেলাম। হাতে কিসের যেন টান লাগলো হয়তো চাকু রক্ত ঝরছে হাত থেকে বেশ বুঝতে পারছি। হঠাৎ দরজা কিছুটা খুলে গেল বাইরের আসা আধো আলোতে কোনোভাবে আন্দাজ করে সুইচ এর কাছে এসে বাতি জ্বালালাম। মেঘে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে ওর হাতে চাকু, ফ্লোরে বসে পড়লাম মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। চিৎকার দিবো কিংবা মেঘকে কোনো প্রশ্ন করবো এই শক্তিটুকু আমার নেই, হাতের দিকে তাকালাম রক্তে ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। আচমকা মেঘের হাত থেকে চাকুটা পরে গেল, মেঘ হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। মেঘ মাথা নিচু করে রেখেছে দেখে আস্তে আস্তে ওর কাছে গেলাম, কাটা হাতে ওর মুখটা তুলে আমার দিকে করলাম, মেঘ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে পানি টলমল করছে ওর দুচোখে। চিৎকার করে উঠলাম “মেঘ কেন করলে এমন আমিতো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, দিনের পর দিন তুমি আমার সাথে প্রতারণা করে গেছ তারপরও আমি কিছু বলিনি নীরবে ভালোবেসে গেছি তোমাকে আর তুমি এই প্রতিদান দিলে”

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৫

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৫

লেখিকা: সুলতানা তমা

সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই মেঘকে দেখে বেশ অবাক হলাম, রাতে ড্রিংক করে মাতাল হয়ে যাওয়া ছেলেটা কতো সুন্দর করে আয়না দেখে হেলেদুলে চুল আছড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ শুয়ে শুয়ে ওর হেলেদুলে চুল আছড়ানো দেখলাম, এবার ওর মিটিমিটি হাসি দেখে আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না।
আমি: ভাব দেখে তো মনে হচ্ছে বিয়ে করতে যাচ্ছ। (আমার কথা শুনে একনজর আমার দিকে তাকালো তারপর আবার আয়নার দিকে নজর দিলো)
আমি: কোথায় যাচ্ছ তুমি?
মেঘ: আন্দাজ করে নিয়েছ তো বিয়ে করতে যাচ্ছি, এখন আমি যা বলি না কেন তোমার বিশ্বাস হবে না কারণ তুমি আমাকে এক ফোটাও বিশ্বাস করো না।
আমি: সোজা উত্তর দাও কোথায় যাচ্ছ?
মেঘ: উত্তর না দিলে কি করবে শুনি।
আমি: তোমার ভাগ্য ভালো তোহা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে নাহলে…
মেঘ: মেয়েটা বাবার কষ্ট একটু বুঝে। (ও হাসছে আর হাতের ঘড়িটা ঠিক করছে)
আমি: তারমানে শায়লা ঠিকি বলেছিল আজ তোমাদের বিয়ে।
মেঘ: হু তুমি যাবে নিমন্ত্রণ খেতে?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: এখন আর মুখ গোমড়া করে রেখে লাভ নেই। (কিছু বলতে পারলাম না চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ছে। তোহাকে আস্তে করে সরিয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম, মেঘের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বারান্দায় চলে আসলাম)

সত্যিই তো এখন আর মুখ গোমড়া করে বা কেঁদে কি হবে আগেই তো বুঝা উচিত ছিল এভাবে হুট করে বিয়ে করা ঠিক হবে না। বিয়ে তো সারাজীবন এর বন্ধন এই বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগে হাজার বার ভাবা উচিত, আব্বু আর আমিতো ভাবিনি। অবশ্য আমাদের দোষ কোথায় আমি তো তোহার মা হওয়ার জন্য বিয়েটা করেছি আর আব্বু তো বুঝতে পারননি মেঘ এতোটা…
মেঘ: কি ভেবেছ আমি সত্যি শায়লাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি? (পাগলের মতো কাঁদছিলাম আর বারবার চোখের পানি মুছার বৃথা চেষ্টা করছিলাম হুট করে মেঘ এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ওকে ছাড়িয়ে দিয়ে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম)
মেঘ: তুমি সব দিকে চালাক শুধু আমার ভালোবাসা বুঝার সময় বোকা। (মেঘের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম, মেঘ একদম আমার কাছে এসে দাঁড়ালো)
মেঘ: তোমাকে রাগানোর জন্য বলেছি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বুঝনা কেন যে ছেলে ডিভোর্স পেপার ছিঁড়ে টুকরোটুকরো করে ফেলেছে সে ছেলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে কিভাবে?
আমি: শায়লা যে বললো…
মেঘ: পাগলী বুঝার চেষ্টা করো ও আমাকে তোমার থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করছে। তোমার কি মনে হয় আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করেছিলাম? না কণা আমি সাইন করিনি, শায়লা আমার সাইন নকল করেছিল। (আমার দুচোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে ওর বুকে টেনে নিলো)
মেঘ: তুমি আমাকে যতোই ভুল বুঝ সত্যি তো এটাই আমি তোমাকে ভালোবাসি আর সারাজীবন বাসবো।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: রুহান আর আমাকে আব্বু পাঠাচ্ছেন আব্বুর বন্ধুর বাসায় বিয়েতে, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে তাই তোমাকে রাগানোর জন্য এমন হেলেদুলে চুল আছড়াচ্ছিলাম।
আমি: হু!
মেঘ: আর কেঁদো না আসছি। (মেঘ আমার কপালে চুমু খেয়ে চলে গেল। মেঘকে সত্যি বুঝা বড় কঠিন এই ভালো তো এই খারাপ)
মেঘ: এইযে!
আমি: আবার কেন এসেছ?
মেঘ: এভাবে শান্ত হয়ে আমার সব কথা শুনতে পারো না? তাহলেই তো আর ভুল বুঝাবুঝি হতো না। কাউকে ভুল বুঝার আগে তাকে কথা বলার সুযোগ দিতে হয় তুমি তো আমাকে কখনো বুঝিয়ে বলার সুযোগটা দাও না।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: আসছি আর হ্যাঁ রাতের জন্য সরি আর কখনো ড্রিংক করবো না।
মেঘ চলে গেল, ওর বলা শেষ কথা গুলো ভাবছি। সত্যিই তো আমি মেঘকে কখনো কিছু বলার সুযোগ দেইনা সবসময় নিজের মতো করে ধরে নেই আর দুজনের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আজকের মতো যদি ওকে সবসময় বলার সুযোগ দিতাম তাহলে হয়তো এতোটা দূরত্ব আমাদের মাঝে তৈরি হতো না।
জোহা: আপু আপু…
আমি: হুম আয়।
জোহা: একটা কথা ছিল।
আমি: বল।
জোহা: আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না আমি কানাডা চলে যাই প্লিজ।
আমি: আমাকে একা রেখে চলে যাবি?
জোহা: এই বাসায় তো শুধু জামেলা আর ভালো লাগেনা।
আমি: একটু মানিয়ে নে প্লিজ আর কয়েকটা দিন।
জোহা: হুম। (এসব অশান্তি আমারই ভালো লাগছে না জোহার তো মন খারাপ হবেই)

চাঁচি: শুধু নবাবজাদির মতো খেলে হবে কাজ করতে হবে না? (খাবার মুখে দিচ্ছিলাম চাঁচির কথা শুনে খাবার রেখে মা আর বাবার দিকে তাকালাম)
মা: তুমি কিন্তু আজকাল বেশি কথা বলছ আমার বৌমাকে দিয়ে আমি কাজ করাবো কিনা সেটা আমার ব্যাপার।
চাঁচি: ঠিক আছে তাহলে আমিই আমার বৌমাকে দিয়ে কাজ করাবো তখন কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারবে না। (চাঁচির কথা শুনে সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে। এই মহিলা তো খুব চালাক, এই কথাটা বলেছেন যেন মা রেগে গিয়ে নিজের বৌমা বলেন আর উনি উত্তরে পপিকে দিয়ে কাজ করানোর কথা বলতে পারেন। আচ্ছা তাহলে তুমি এভাবে পপির প্রতি প্রতিশোধ নিতে চাইছ)
আব্বু: একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
চাঁচি: কোনো বাড়াবাড়ি হয়নি বউদের রেখে আমরা কাজ করবো কেন বৌমারা কিসের জন্য?
আমি: আপনাকে তো কেউ কাজ করতে বলে না বাসায় কাজের লোক আছে ওরা করে প্রয়োজন হলে আরো কাজের লোক আনবো।
চাঁচি: কাজের লোক কাজ করবে কেন…
আমি: আপনারা চুপ থাকুন উনাকে আমি দেখছি। (চাঁচির হাত ধরে টেনে উনার রুমের দিকে নিয়ে আসলাম)

চাঁচি: এসব হচ্ছে কি হাত ছাড়ো আমার। (উনার হাত ছেড়ে দিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম)
চাঁচি: কি করছ এসব?
আমি: আপনি যা চাইছেন তার উল্টোটা। খুব সখ পপিকে দিয়ে কাজ করানোর তাই না? প্রতিশোধ নিতে চান…
চাঁচি: হ্যাঁ আমি প্রতিশোধ নিতে চাই পপিকে আমি তিলে তিলে শেষ করে দিবো।
আমি: আপনার এই আশা কখনো পূরণ হবে না।
চাঁচি: হবে প্রয়োজন হলে অন্য বাসায় চলে যাবো।
আমি: তার আগেই যদি আপনাকে আমি জেলে পুরে দেই। (চমকে উঠলেন উনি)
আমি: চাইলে এখনি আমি আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি।
চাঁচি: আমি যে তোমার আব্বুর খুনের সাথে জড়িত তার কি প্রমাণ আছে তোমার কাছে?
আমি: সেদিন আপনি শায়লার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন তখন আমি সব রেকর্ড করেছি, রেকর্ডে স্পষ্ট শুনা যায় শায়লা আব্বুকে খুন করিয়েছে আর আপনি এর সাথে যুক্ত আছেন। (উনি ভয়ে আতকে উঠলেন কথা বলতে পারছেন না শুধু ঘামছেন)
আমি: আমি যা যা বলি তাই করুন নাহলে কিন্তু…
চাঁচি: কি করতে হবে?
আমি: শায়লার সাথে কে কে যুক্ত আছে?
চাঁচি: মেঘ আর শায়লা এসব করছে।
আমি: মিথ্যে কথা মেঘকে তোমরা ফাঁসাচ্ছ।
চাঁচি: তুমি এমনিতে খুব চালাক শুধু মেঘকে বুঝার সময় বোকা।
আমি: মানে?
চাঁচি: মেঘ করছে এসব সবকিছু ওদের নামে করে নিয়ে তোমাকে লাথি মেরে ছুড়ে ফেলে দিবে।
আমি: মেঘ যে এসব করছে তার প্রমাণ কি?
চাঁচি: মেঘ আর শায়লার বিয়ে হচ্ছে আজ শায়লার অন্য একটি বাসায় চাইলে দেখে আসতে পারো। (উনার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো, তাহলে কি মেঘ আমাকে মিথ্যে বললো)
চাঁচি: তোহাকে ঘুমে রেখে নাশতা করতে এসেছিলে তো…
আমি: তোহা?
চাঁচি: হুম তোহা, গিয়ে দেখো তোহা রুমে নেই।
আমি: মানে তোহা কোথায়?
চাঁচি: শায়লার লোক এসেছিল তুলে দিয়েছি ওদের হাতে। দেখো এবার মেঘ তোহাকে নিয়ে ফিরে আসে কিনা।
আমি: আমার তোহা কোথায়?
চাঁচি: আরে ছাড়ো লাগছে।
আমি: তোহার জন্য না আমি খুন করতে দুবার ভাববো না। (উনার গলা চেপে ধরলাম, আমার হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন)
আমি: শায়লা তোহাকে নিয়ে কোন বাসায় আছে বলে দিন নাহলে আপনাকে আমি এখানেই খুন করবো। (উনি জুড় করে আমার হাত ছাড়িয়ে নিলেন তারপর হাপাতে হাপাতে বললেন..)
চাঁচি: বলার সুযোগ না দিলে বলবো কিভাবে আর একটু হলেই তো মারা যেতাম।
আমি: আপনার মতো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার চেয়ে মেরে ফেলাটাই ভালো।
চাঁচি: আমি গিয়ে এক্ষণি সবাইকে বলবো তুমি আমার গলা চেপে ধরেছিলে।
আমি: একটু শুনে যান..(উনি চলে যাচ্ছিলেন আমার কথা শুনে পিছন ফিরে তাকালেন)
আমি: এখান থেকে আর এক পা নড়লে এখনি পুলিশে ফোন করবো আর বলবো আপনি আমার তোহাকে কিডন্যাপ করেছেন।
চাঁচি: তুমি এতো…
আমি: খারাপ মেয়ে তাইতো? জানেন তো সন্তানের জন্য প্রত্যেক মা’ই খারাপ হতে দুবার ভাবে না।
চাঁচি: হুহ!
আমি: আপনি যে আব্বুর খুনের সাথে জড়িত এইটা বাবা জানেন আর উনার সম্মানের কথা ভেবেই আপনাকে পুলিশে দিচ্ছি না। এখন যদি বাবাকে গিয়ে বলি আপনি আমাদের তোহাকে কিডন্যাপ করেছেন তাহলে কেমন হবে?
চাঁচি: এমনটা করো না।
আমি: তাহলে চুপচাপ বলে দিন তোহা কোথায়।
চাঁচি: বলছি। (চাঁচির থেকে ঠিকানা নিয়ে চলে আসছিলাম আবার পিছন ফিরে তাকালাম)
আমি: আবার খারাপ কাজ করার আগে রেকর্ড এর কথাটা মাথায় রাখবেন কেমন?
হাসতে হাসতে চলে আসলাম। ভালোই বোকা বানিয়েছি উনাকে, আসলে তো আমার কাছে কোনো রেকর্ডই নেই।

শায়লা: মেঘ আমি ভাবছি তোহাকে তো আমার কাছে রাখবোই তোমাকেও আমার কাছে রেখে দিবো, বিয়ের পর তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
মেঘ: মানে? (মেঘ হুট করে পিছনে তাকালো, আমাকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমি চুপচাপ দরজাতেই দাঁড়িয়ে আছি, মেঘকে এখানে দেখতে হবে এইটা ভাবিনি। মেঘ আমার কপালে চুমু খেয়ে বলে এসেছিল আব্বু পাঠিয়েছেন বিয়েতে আর ও নিজেই এখানে বিয়ে করতে এসেছে)
মেঘ: কণা…
আমি: আজকেও কি তোমাকে কিছু বলার সুযোগ দিতে হবে?
মেঘ: আমার কথা তো শুনো…
আমি: সব তো নিজের চোখেই দেখছি আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তোহা কোথায় আমার তোহাকে দিয়ে দাও আমি চলে যাচ্ছি।
শায়লা: তোহাকে তুমি কোন অধিকারে নিতে এসেছ?
আমি: বিয়ের দিন আমাকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল সে অধিকারে।
শায়লা: এসব ভুলে যাও।
আমি: চুপ কর কেমন মা তুই? নিজের মেয়েকে কিডন্যাপ করে আনতে হয়…
শায়লা: একদম বাজে কথা বলবে না।
আমি: এখানে দাঁড়িয়ে তোদের নাটক দেখতে আমার ইচ্ছে হচ্ছে না তোহাকে ফিরিয়ে দে আমি চলে যাচ্ছি।
মেঘ: কণা শায়লা তোহাকে…
আমি: তোমার কাছে তো কিছু জানতে চাইনি কেন কথা বলছ? তোমার ডিভোর্স চাই তো দিয়ে দিবো তবে তোহাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে।
মেঘ: আমি তো তোহাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই এসেছি।
শায়লা: কেন মিথ্যে বলছ মেঘ? তুমি তো একটু আগে বললে আমরা আবার এক হবো আ…
মেঘ: শায়লা প্লিজ অনেক নাটক করেছ আর করো না, বারবার তুমি আমাকে ফাঁসাচ্ছ আর কণা আমাকে ভুল বুঝে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে।
শায়লা: আমি তোমাকে ফাঁসাতে যাবো কেন আজ আমাদের বিয়ে এইটা তো আমাদের দুজনের ইচ্ছেতেই হচ্ছে।
মেঘ: কিসের বিয়ে? তুমি আমাকে ফোন করে বলেছ তোহাকে কিডন্যাপ করেছ আমি আসলে দিয়ে দিবে, কণা শোনার আগেই আমি তোহাকে নিয়ে বাসায় ফিরতে চেয়েছিলাম কিন্তু তুমি…
শায়লা: মেঘ কেন মিথ্যে বলছ এই মেয়েটার ভয়ে?
মেঘ: চুপ করো আর পারছি না…
আমি: চুপ করবে তোমরা দুজন? তোমাদের যা নাটক করতে হয় আমি চলে গেলে পর করো আমার তোহাকে ফিরিয়ে দাও।
শায়লা: তোহা আমার মেয়ে দিবো না আমি।
আমি: যদি তোহার বিনিময়ে সবকিছু তোকে দিয়ে দেই?
শায়লা: ভেবে দেখতে পারি।
আমি: পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভাব।
তোহা: নতুন আম্মু। (তোহা হুট করে কোথা থেকে যেন আসলো, আমাকে দেখেই দৌড়ে আসতে চাইলো কিন্তু শায়লা ওকে কোলে তুলে নিলো)
আমি: বলেছি তো সবকিছু দিয়ে দিবো।
মেঘ: শায়লা তোহাকে ছেড়ে দাও।
শায়লা: তোমরা দুজন এমন ভাবে বলছ মনে হচ্ছে আমি তোহাকে কিডন্যাপ করে আটকে রেখেছি আরে ও তো আমার মেয়ে।
আমি: তুমি ওকে ছাড়বে নাকি আমি পুলিশ নিয়ে আসবো?
শায়লা: পুলিশ আনলে ভালো হয়। পুলিশই নাহয় বলে দিবে তোহা কার কাছে থাকবে, ওর আসল আম্মুর কাছে নাকি নকল আম্মুর কাছে। (চুপচাপ সোফায় বসে পড়লাম এখন কি করবো? পুলিশ আনা যাবে না তাহলে তোহাকে শায়লার কাছেই থাকতে হবে। আমি এখ..)
মেঘ: কণা প্লিজ ভেঙে পড়ো না। (মেঘ আমার পাশে এসে বসতেই ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম)
শায়লা: তোহাকে দিতে পারি এক শর্তে তুমি মেঘকে এক্ষণি ডিভোর্স দিবে আর এখানে বসে আমাদের দুজনের বিয়ের সাক্ষী হবে।
মেঘ: শায়লা বেশি বাড়াবাড়ি করছ কিন্তু।
শায়লা: তাহলে তোহা আমার কাছেই থাকবে।
তোহা: আমি থাকবো না তোমার কাছে। (তোহা শায়লার হাতে কামর বসিয়ে দিলো, শায়লা ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে তোহাকে ছেড়ে দিতেই ও দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলো)
তোহা: নতুন আম্মু চলো।
আমি: আসছি ডিভোর্স পেপারটা আজ তোমার মুখে ছুড়ে মারবো। (মেঘকে কথাটা বলে বেরিয়ে আসলাম তোহাকে কোলে নিয়ে, পিছু পিছু মেঘও বেরিয়ে আসলো)

গাড়িতে এসে বসতেই মেঘও গাড়িতে উঠতে চাইলো, ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম।
মেঘ: কণা আমার কথা শুনো…
মেঘের ডাকে পিছু না চেয়ে চলে আসলাম।

বাসায় ঢুকতেই দেখি সবাই ড্রয়িংরুমে চিন্তিত হয়ে বসে আছে। আমাদের দেখেই মা তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসলেন।
মা: কোথায় ছিলে তোমরা? তোহাকে না দেখতে পেয়ে তো আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেছিলাম।
আমি: তোহাকে শায়লা নিয়ে গেছিল।
বাবা: কিন্তু কিভাবে?
আমি: হয়তো এ বাড়িরই কেউ শায়লাকে সাহায্য করেছে। (চাঁচির দিকে তাকিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালাম)
বাবা: মেঘ তুই ফিরে আসলি যে বিয়েতে যাসনি? (বাবার কথা শুনে পিছনে তাকালাম মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে)
দাদী: কথা বলছিস না কেন? (মেঘ কারো কথার জবাব না দিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো, আমিও রুমে চলে আসলাম)

মেঘ: কণা আমার কথা শুনো প্লিজ। (তোহাকে বিছানায় দাঁড় করিয়ে পিছন ফিরতেই মেঘের সাথে ধাক্কা খেলাম, ও আমার একটা হাত ধরে ফেললো)
মেঘ: আমাকে বলার সুযোগ দাও প্লিজ।
আমি: আমার হাত ছাড়ো
মেঘ: তুমি কিন্তু আবারো ভুল করছ কণা। (ঠাস করে মেঘের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম, ও গালে হাত দিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: এই থাপ্পড়টা তোমাকে আমার অনেক আগেই দেওয়া উচিত ছিল, দুমুখো সাপ একটা।
মেঘের দু চোখ থেকে পানি ঝরছে দেখেও আর দাঁড়ালাম না চলে আসলাম ওর সামনে থেকে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৪

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৪

লেখিকা: সুলতানা তমা

পরন্ত বিকেল, ছাদের এক কোণে বসে আছি ডিভোর্স পেপারটা হাতে নিয়ে। এখন আমার কি করা উচিত ভেবে পাচ্ছি না, আমি একটু একটু করে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি। কলিংবেল বাজছে ইচ্ছে হচ্ছে না নিচে গিয়ে দরজা খুলার তাই চুপচাপ বসেই রইলাম।
সেই কখন থেকে কলিংবেল বেজেই চলেছে কিন্তু মেঘ দরজা খুলছে না, জানিনা কি করছে। নিচে নেমে আসলাম দরজা খুলার জন্য।

দরজা খুলে দেখি সবাই চলে এসেছে, সবাইকে দেখে কষ্ট করে একটা শুকনো হাসি দিলাম।
তোহা: নতুন আম্মু। (তোহা হাত বাড়িয়ে আমার কোলে আসলো, ওকে নিয়ে সোফায় এসে বসলাম)
পপি: একি ভাবি টেবিলের উপর খাবারের প্যাকেট তোমরা এখনো দুপুরের খাবার খাওনি?
দাদি: হেরে মেঘ কোথায়?
আমি: রুমেই আছে হয়তো।
মা: রান্না করে খাওনি তাই না?
আমি: রান্না তো পারিনা যা রান্না করি মুখে দেওয়ার মতো না। (আমার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো)
আমি: জোহা আর বাবাকে দেখছি না কোথায় ওরা?
জোহা: এইতো চলে এসেছি। (জোহার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম, জোহা চলে এসেছে যখন ওকে নিয়ে এ বাসা থেকে চলে যাবো। আর এখানে থাকতে চাই না)
মা: আমি তাড়াতাড়ি রান্না করে নিচ্ছি এসব বাইরের খাবার আর খেতে হবে না।
তোহা: নতুন আম্মু আব্বু কোথায়? আব্বু জানেনা আমি যে এসেছি?
আমি: না মামুনি জানলে তো তোমার কাছে আসতো। তুমি রুমে চলে যাও ওখানে তোমার আব্বু আছে।
তোহা: তুমিও চলো।
আমি: তুমি একা চলে যাও।
দাদি: মেয়েটা বলছে যখন যা না। (কিভাবে তোমাদের বুঝাই আমি মেঘের সামনে যেতে চাই না, ওকে দেখলে রাগ আরো বেড়ে যাবে আমার)
তোহা: চলো নতুন আম্মু। (তোহা আমার হাতের একটা আঙ্গুল ধরে টানছে তাই বাধ্য হয়ে ওর সাথে রুমের দিকে পা বাড়ালাম)

রুমের দরজা খুলার শব্দ পেয়ে মেঘ আমাদের দিকে তাকালো, বিছানায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে। তোহাকে দেখে হাত বাড়িয়ে দিলো মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে মেঘের কোলে উঠে বসলো।
মেঘ আর তোহা হাসছে মজা করছে একবারো মেঘ আমার দিকে তাকাচ্ছে না, চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে আসলাম।

আনমনা হয়ে বাগানে হাটছিলাম হঠাৎ বাগানের দোলনায় রুহানকে বসে থাকতে দেখলাম। এগিয়ে আসলাম রুহানের দিকে। আমাকে দেখে মিথ্যে হাসার অভিনয় করলো রুহান।
রুহান: তোমার মন খারাপ?
আমি: নাতো।
রুহান: বেশ বুঝা যাচ্ছে তোমার মন খারাপ।
আমি: (নিশ্চুপ)
রুহান: বাস্তবতা আমাদের এমন এক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে যে না পারছি এই জায়গা থেকে সরে আসতে আর না পারছি…
আমি: আমরা সবাই একটা গোলকধাঁধায় পরে আছি তাই না?
রুহান: হুম।
আমি: পপি ভালোবাসে তোমাকে, তুমি ভালোবাস আমাকে, আমি ভালোবাসি মেঘকে আর মেঘ ভালোবাসে শায়লাকে। হাহাহা কতো সুন্দর…
রুহান: ভাইয়া হয়তো তোমাকে ভালোবাসে না কিন্তু শায়লাকেও ভালোবাসে না।
আমি: বাসে রুহান তোমরা তো জানো না মেঘ আর শায়লা দুদিন পর বিয়ে করছে।
রুহান: মানে কি? এসব তুমি কি বলছ?
আমি: ঠিকি বলছি রুহান, মেঘ আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছে।
রুহান: কি?
আমি: হ্যাঁ ডিভোর্স পেপারটা আমার হাতেই আছে।
রুহান: আমি এক্ষণি গিয়ে বাসার সবাইকে বলবো, ভাইয়া পেয়েছে কি এভাবে তোমাকে নিয়ে খেলবে আ…
আমি: অনেক দায়িত্ববান হয়ে গেছ।
রুহান: তুমিই তো আমার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিলে। না পারছি এই দায়িত্ব থেকে সরে আসতে না পারছি আঁকড়ে ধরতে।
আমি: মেঘ আমাকে মেনে নিচ্ছে না আমি একটু একটু করে কষ্ট অবহেলা পেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি এইটা দেখে তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
রুহান: কষ্ট তো হচ্ছে কিন্তু আমার তো কিছু করার নে…
আমি: ঠিক এভাবে পপিও একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে রুহান। (আমার কথা শুনে রুহান চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো)
আমি: আমাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারছ না অথচ নিজেই অন্য একটি মেয়েকে কষ্ট দিচ্ছ যে কিনা তোমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।
রুহান: পপি আমাকে ভালোবাসে রোজ রাতে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আমি বুঝতে পারি কিন্তু আমার কি করার আছে আমি তো তোমা…
আমি: ভুলে যাওনা আমাকে, একবার পপির ভালোবাসার উপর ভরসা রেখে নিজেকে সপে দাও ওর কাছে দেখবে সব কেমন ঠিক হয়ে যায়।
রুহান: তোমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া তোমাকে ভালোবাসে না অথচ তুমি অন্য একটি মেয়ের কথা ভেবে ওর সংসার টিকাতে সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছ এইটা বোধহয় তোমার মতো পাগলী মেয়ের দ্বারাই সম্ভব।
আমি: (মৃদু হাসলাম)
রুহান: আসছি।
আমি: আমার কথাটা শুনে একবার পপিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করো দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। (রুহান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল। রুহান পপিকে মেনে নিলে খুব খুশি হতাম, আমার মতো একি আগুনে পুড়ে আর কোনো মেয়ে ছাই হউক সেটা আমি চাই না)

চাঁচি: বাহ্ কি আছে তোমার মধ্যে বলতো আমাকে? (বাসার ভিতর ঢুকতে গিয়ে চাঁচির সাথে ধাক্কা খেলাম, উনার এমন প্রশ্ন শুনে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম)
আমি: মানে?
চাঁচি: এইযে মেঘকে নাচাচ্ছ আবার রুহান আর পপির বিয়ের মিথ্যে নাটক করে রুহানকেও সমানে নাচিয়ে যাচ্ছ।
আমি: ভদ্র ভাবে কথা বলুন শাশুড়ি শাশুড়ির জায়গায় থাকুন নাহলে…
চাঁচি: নাহলে কি করবে হ্যাঁ? বউ হয়ে শাশুড়িকে…
আমি: আরে আজব আপনি এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন?
চাঁচি: আমার ছেলের জন্য তোমাকে বউ করে আনতে চেয়েছিলাম তুমি নিজে তো বউ হলেই না উল্টো আমার শত্রুর মেয়েকে আমার ছেলের বউ করিয়ে দিলে। তুমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট করে ফেলেছ তোমাকে তো আমি ছাড়বো না…
মা: কি হয়েছে তোমরা এমন চেঁচামেচি করছ কেন?
চাঁচি: দেখনা…
আমি: এমনি মা আমি তো চাঁচির সাথে মজা করছিলাম।
মা: ওহ! (মা চলে যেতেই চাঁচি আমার দিকে এগিয়ে আসলেন)
আমি: নিজের জায়গাতেই থাকুন আপনাকে থামানোর ওষুধ আমার কাছে আছে।
চাঁচি: মানে?
আমি: ভুলে যাবেন না আব্বুর খুনের সাথে আপনি জড়িত আছেন।
চাঁচি: এ্যাঁ!
আমি: এ্যাঁ না হ্যাঁ। (চাঁচির কানের কাছে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে চলে আসলাম, আসার আগে পিছন ফিরে একবার উনার দিকে তাকালাম উনি ভয়ে চুপসে গেছেন)

এখন চাঁচিকে আটকে রাখার একমাত্র রাস্তা ভয় দেখানো। কিন্তু আমার মাথায় একটা কথা কিছুতেই ঢুকছে না, চাঁচি শত্রুর মেয়ে বললেন কেন? মেঘ আর রুহানদের মধ্যে কি কোনো শত্রুতা আছে? কিন্তু ওদের দেখে তো তা মনে হয় না।
মেঘ: ওহ তুমি এসেছ তোহাকে দেখো আমি একটু আসছি। (রুমে ঢুকতেই মেঘ বসা থেকে উঠতে উঠতে কথাটা বললো)
আমি: কোথায় যাচ্ছ?
মেঘ: তুমি তো আমাকে বিশ্বাস করোনা এখন যাই বলি বিশ্বাস করবে না তাই না বলাটাই ভালো। (আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেঘ হনহন করে বেরিয়ে গেল)
তোহা: নতুন আম্মু তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: কই নাতো মামুনি।
তোহা: আমি বুঝিতো আমাকে নিয়েই যতো ঝামেলা।
আমি: হ্যাঁ আমার মাম্মা বড় হয়ে গেছে তাই সব বুঝে।
তোহা: হ্যাঁ আমি যদি আকাশের তারা হয়ে যেতাম তাহলে আব্বু আর তোমাকে কাঁদাতে পারতো না।
আমি: এসব কি কথা তোহা? কে শিখিয়েছে এসব? আর কখনো যেন এসব কথা না শুনি।
তোহা: নিজের আম্মু না থাকলে সবাই বকা দেয়। (মেয়েটা মাথা নিচু করে কাঁদছে তাড়াতাড়ি ওকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম)
আমি: আমি বুঝি তোর আম্মু না?
তোহা: তুমি আমার আম্মু বলেই তো আব্বু তোমাকে এতো কষ্ট দেয়। (হায় আল্লাহ্‌ এই ছোট বাচ্চাটাও বুঝে কিন্তু মেঘ বুঝে নাহ। আজ মেঘ আর শায়লার কাজকর্মের জন্য তোহা কষ্ট পেয়ে আকাশের তারা হয়ে যেতে চাইছে ওদের তো আমি ছাড়বো না, আমার কাছে সবার আগে তোহা তারপর অন্য সবকিছু)

তোহাকে খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো, শায়লার নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম না। কিন্তু ও বারবার ফোন দিয়েই যাচ্ছে বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলাম।
আমি: কি হয়েছে?
শায়লা: মেঘ কোথায়?
আমি: বাসায় নেই।
শায়লা: ও তারমানে চলে এসেছে।
আমি: চলে এসেছে মানে?
শায়লা: সবকিছু জানতে হবে কেন তোমাকে?
আমি: বলো বলছি নাহলে…
শায়লা: মেঘ আমার সাথে দেখা করতে আসছে বুঝতে পেরেছ? ঘুমিয়ে পড়ো ওর জন্য অপেক্ষা করো না কারণ আজ মেঘ আমার কাছে থাকবে। আর হ্যাঁ আগামীকাল প্রস্তুত থেকো তোহাকে গিয়ে নিয়ে আসবো।
আমি: তোহাকে আমি দিবো না।
শায়লা: তোহা আমার মেয়ে তাই চাইলেই আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারি অবশ্য তুমি চাইলে তোমাকে দিয়ে দিতে পারি তবে বিনিময়ে তোমার সবকিছু আমার নামে করে দিতে হবে।
আমি: আর যদি না দেই?
শায়লা: তোহাকে নিয়ে আসবো।
আমি: তোহা তোমার মেয়ে তুমি নিতেই পারো কিন্তু এতে তোমার লাভ কি?
শায়লা: তোমার সবকিছু তো এখন তোহার নামেই আছে।
আমি: তোমার কি মনে হয় তুমি একাই চালাকি করতে পারো?
শায়লা: মানে?
আমি: আমি উইল পাল্টে ফেলেছি তোহার নামে আপাতত কোনো সম্পত্তি নেই তাই ওকে নিয়ে তোমার কোনো লাভ নেই বরং ওকে আমার কাছে রাখলে তোমার লাভ হবে, হয়তো বিনিময়ে তোমাকে কিছু দিবো যেহেতু তুমি তোহার আসল মা।
শায়লা: তোকে তো আমি খুন করবো।
আমি: রাখছি তোমার সাথে কথা বলে আমার সময় নষ্ট হচ্ছে।
ফোন রেখে ভাবছি মেঘ কি সত্যি শায়লার সাথে দেখা করতে গেছে? কিন্তু এতো রাতে দেখা করতে যাবে কেন?

রাত বারোটা বাজে ড্রয়িংরুমে বসে আছি মেঘ আসার নাম নেই, আমার ফোনটাও রিসিভ করছে না। তাহলে কি সত্যি মেঘ আজ শায়লার কাছে থাকবে?
দাদী: এখনো এখানে বসে আছিস?
আমি: হু!
দাদী: ঘুমাবি না রাতের খাবারও তো খেলি না।
আমি: মেঘ আসুক।
দাদী: বারোটার উপরে বাজে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবি।
আমি: আর একটু অপেক্ষা করে দেখিনা।
দাদী: দাদুভাইটা বুঝলনা তোকে। (দাদী চলে যেতে চাইলেন একটা হাত ধরে বসার জন্য বললাম)
দাদী: কিছু বলবি?
আমি: একটা কথা জানতে চাই।
দাদী: বল কি…
আমি: মেঘ আর রুহানদের মধ্যে কি কোনো শত্রুতা আছে?
দাদী: হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আমি: কারণ আছে দাদী।
দাদী: নাতো কি শত্রুতা থাকবে? আমার দুই ছেলে সবসময় মিলেমিশে থেকেছে।
আমি: রুহানের আব্বু কিভাবে মারা গেছেন?
দাদী: (নিশ্চুপ)
আমি: বলুন দাদী প্লিজ।
দাদী: একটা এক্সিডেন্টে…
আমি: সত্যি কি এক্সিডেন্ট ছিল নাকি অন্যকিছু?
দাদী: এক্সিডেন্ট ছিল কিন্তু তুই এসব জিজ্ঞেস করছিস কেন?
আমি: এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।
দাদী: তোর মাথায় যে কি ঘুরে বুঝিনা।
দাদী চলে গেলেন চুপচাপ বসে রইলাম। আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো এতোকিছু ভাবতে ভাবতে। চাঁচি পপিকে শত্রুর মেয়ে বললেন অথচ ওদের মধ্যে কোনো শত্রুতাই নেই। হয়তো এমন কোনো ঘটনা আছে যা মেঘরা ভুলে গেলেও চাঁচি ভুলে যাননি উল্টো এই নিয়ে চাঁচি মেঘদের শত্রু ভাবেন কিন্তু কি ঘটনা ছিল সেটা জানবো কিভাবে?

হঠাৎ কোনোকিছু ভেঙে যাওয়ার শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল, মেঘের জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ড্রয়িংরুমে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি। আবারো কিছু ভাঙার শব্দ ভেসে আসলো, আওয়াজ তো আমাদের রুম থেকে আসছে কে ভাঙছে জিনিসপত্র? দৌড়ে উপরের দিকে আসলাম।

মেঘ: সব ভেঙে ফেলবো আমাকে অবিশ্বাস করে সবকিছুতে। (মেঘ রুমের সব জিনিসপত্র ছুড়ে মারছে, ও কখন রুমে আসলো বুঝতেই পারিনি)
আমি: মেঘ কি করছ এসব?
মেঘ: একদম চুপ আমার সাথে কথা বলবে না তুমি।
আমি: পাগল হয়ে গেছ নাকি জিনিসপত্র এভাবে ভাঙছ কেন?
মেঘ: সব ভেঙে ফেলবো।
আমি: মেঘ তোহা কিন্তু ঘুমে ও যদি ভয় পায় বা ওর উপরে কোনো কিছু উড়ে গিয়ে পড়ে তাহলে কিন্তু…
মেঘ: এইতো পেয়েছি। (ওয়ারড্রব এর উপরে ডিভোর্স পেপার রাখা ছিল মেঘ পেপারটা এনে ছিঁড়ে টুকরোটুকরো করে ফেললো)
আমি: মেঘ হচ্ছে কি এসব?
মেঘ: আমি যা খুশি করবো তুমি বাঁধা দিবে না।
আমি: তুমি ড্রিংক করেছ?
মেঘ: তুমি আমাকে অবিশ্বাস করতে পারবে আর আমি যন্ত্রণা ভুলার জন্য ড্রিংক করতে পারবো না? বাহ্ অসাধারণ তোমার…
আমি: চুপ করো, বেরিয়ে যাও রুম থেকে।
মেঘ: যাবো না এইটা আমার রুম আমি এই রুমে বসে ড্রিংক করবো।

মেঘ ফ্লোরে বসে ড্রিংক করে যাচ্ছে আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখছি, ইচ্ছে হচ্ছে ওকে…
মেঘ: কণা খাবে? (হাসছে আর আমাকে মদের গ্লাস দেখাচ্ছে)
আমি: তুমি না পুরো মাতাল হয়ে গেছ।
মেঘ: কি করবো বল আমার বউ তো আমাকে অবিশ্বাস করে।
আমি: অবিশ্বাস করার মতো কাজ করো কেন? একটু আগে কোথায় ছিলে তুমি?
মেঘ: কোথায় কোথায়…
আমি: শায়লার কাছে ছিলে তাইতো। (বত্রিশটা দাত বের করে হাসি দিলো, ও তো পুরো মাতাল হয়ে গেছে)
মেঘ: তুমি আমাকে আবার অবিশ্বাস করছ আমি তো শায়লার কাছে ছিলাম না আমি ছিলাম… (মেঘ ঢলে পরে যাচ্ছে দেখে দৌড়ে গিয়ে ধরলাম)
আমি: বিছানায় চলো।

মেঘকে এনে বিছানায় শুয়ে দিলাম, জুতো খুলে শার্ট খুলতে গেলাম মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে ফেললো।
আমি: ছাড়ো তোমার শার্ট খুলতে হবে শার্টে মদ…
মেঘ: শোননা কণা আমি তোমাকে সত্যি ভালোবাসি। আমি শায়লার কাছে যাইনি।
আমি: ছিঃ এতো বাজে গন্ধ…
মেঘ: আমি তো এসব ছেড়ে দিয়েছিলাম তোমাকে পেয়ে কিন্তু তুমিই তো এখন আমাকে আবার এই নষ্ট পথে ঠেলে দিচ্ছ।
আমি: তুমি যা করছ এতে তোমাকে সন্দেহ করাটা অস্বাভাবিক কিছু না।
মেঘ: আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে ডিভোর্স দিতে চাইনা। শায়লা আমার সাইন নকল করে ডিভোর্স পেপারে সাইন বসিয়েছে আমাকে ফাঁসাচ্ছে…
মেঘ আস্তে আস্তে চোখ বুজে ফেললো, শার্টটা খুলে দিয়ে ওর গায়ে বিছানা টেনে দিলাম তারপর জানালার কাছে চলে আসলাম।

কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে, আব্বু আম্মু আর পড়াশুনা নিয়ে কতো ভালো ছিলাম। আর এখন এতো এতো ঝামেলা এসে জুটেছে আমার ঘাড়ে। কোথায় এখন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবো তা না আমাকে নিজের স্বামী সংসারের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। আর পারছি না আমি সত্যি পাগল হয়ে যাবো। মেঘের দিকে তাকালাম নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে আছে, দেখে বুঝাই যায় না এই মানুষটা আমাকে এতো কষ্ট দেয়। আস্তে আস্তে মেঘের দিকে এগিয়ে আসলাম, ওর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আমি সত্যি বুঝতে পারছি না মেঘকে বিশ্বাস করবো নাকি অবিশ্বাস…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১৩

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১৩

লেখিকা: সুলতানা তমা

চোখেমুখে রোদের আলো পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। মেঘ জানালার পর্দা সরিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
আমি: হাসছ কেন? (মেঘ আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমার পাশে বসতে বসতে আবারো হাসলো, এবার বেশ জোড়েই হেসে উঠলো)
আমি: আরে আজব এমন পাগলের মতো হাসছ কেন?
মেঘ: আমি তো পাগলই তোমার প্রেমে পাগল আর তাই পাগলের মতো হাসছি।
আমি: ফাজলামি রেখে বলতো। (মেঘ আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো..)
মেঘ: তোমাকে এই অবস্থায় রোদের আলোতে দেখতে বেশ লাগছে ইচ্ছে হচ্ছে আবারো… (মেঘের কথা শুনে নিজের দিকে একবার চোখ বোলালাম ও এখনো হাসছে দেখে লজ্জায় মেঘের বুকে মুখ লুকালাম)
মেঘ: এতো লজ্জা? রাতে এই পরীটার লজ্জা কোথায় ছিল? (মেঘকে ছেড়ে দিয়ে রাতের কথা ভাবতে লাগলাম, মেঘ আমাকে টেনে বুকে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো)
মেঘ: রাতের কথা ভাবতে যেওনা তাহলে আরো বেশি লজ্জা পাবে আর লজ্জায় আরো বেশি লাল হয়ে উঠবে তখন কিন্তু আর নিজেকে আটকে রাখতে পারবো না।
আমি: দ্যাত ফাজিল একটা।
মেঘ: উঠে ফ্রেশ হয়ে এসো আমাকে অফিসে যেতে হবে।
আমি: ওকে।

গোসল করে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রুমে এসে ঢুকলাম, মেঘ দুহাতে দুই মগ কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে কফির মগ দুটু টেবিলে রেখে আমার কাছে এসে তোয়ালেটা কেড়ে নিয়ে গেল।
আমি: এইটা কি হলো?
মেঘ: আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হচ্ছে সকালবেলা বউয়ের চুল থেকে টুপটুপ করে পানি ঝরে পরার দৃশ্য, আর তুমি আমাকে এই সুন্দর দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করতে চাইছ?
আমি: পাগল একটা…
মেঘ: কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নাও আমি নিজে বানিয়েছি যদিও এতোটা ভালো হবে না তাও রাতের খাবারের চেয়ে ভালোই হবে।
কথাটা বলেই মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো, রাতের খাবারের কথা ভেবে আমিও হেসে দিলাম।

আজ একটু অফিসে যাওয়া প্রয়োজন যদিও মেঘ সব সামলাচ্ছে তাও একবার তো ঘুরে আসা দরকার। তাছাড়া শায়লার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে হলে তো আমাকে বেরুতে হবেই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম, মোবাইলটা হাতে নিয়ে পিছন ফিরতেই মেঘের সাথে ধাক্কা খেলাম। মেঘ ইশারায় টাই বাঁধতে বলে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো।
আমি: কতোবার বলবো আমি রোজ টাই বেঁধে দিতে পারবো না তু…
মেঘ: ওকে সমস্যা নেই রোজ আমার টাই বেঁধে দেওয়ার জন্য তোমার একটা সতিন নিয়ে আসবো কেমন?
আমি: সরো যাও বিয়ে করো গিয়ে। (মেঘকে ধাক্কা দিলাম ও আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো)
মেঘ: এতো ভালোবাস কেন?
আমি: চলো তো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মেঘ: কণা তুমি কি শুধু অফিসে ঘুরতে যাচ্ছ নাকি অন্য কোনো কাজে…
আমি: হু আর একটা কাজ আছে।
মেঘ: কি কাজ?
আমি: তোমার শায়লার বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।
মেঘ: আবার আমার শায়লা বলেছ তো…
আমি: উফফ মেঘ লাগছে হাত ছাড়ো আমি তো ফাজলামো করেছি।
মেঘ: বলো কিসের প্রমাণ।
আমি: মেঘ আসলে শায়লাই আব্বুকে খুন করিয়েছে।
মেঘ: কি?
আমি: এটাই সত্যি আর আমার মনে হয় এই কাজে শায়লার স্বামী যুক্ত আছে। সেদিন আব্বুকে মেরে ফেলার পর সন্ত্রাসীরা ফোনে একটা কথা বলেছিল “স্যার কাজ শেষ”
একবার ভেবে দেখো মেঘ ওরা স্যার ডাকবে কাকে? শায়লা তো অবশ্যই না তাহলে ওর সাথে অন্য কেউ যুক্ত আছে। আমি যদি ভুল না ভেবে থাকি শায়লার স্বামী আর ও দুজন মিলেই সব করছে।
মেঘ: কিন্তু শায়লা যে বললো ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আমি: উফফ মেঘ তুমি এতো বোকা কেন? শায়লা বলেছে বলে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে? এমনো তো হতে পারে শায়লা আমাদের সামনে এসে সব করছে আর ওর স্বামী আড়ালে থেকে সব করছে।
মেঘ: হুম হতে পারে কিন্তু ওরা এসব করবে কেন?
আমি: সম্পত্তির জন্য মেঘ এইটা বুঝ না কেন? ওরা চাইছে তোহাকে নিয়ে যেতে কারণ তোহাকে নিয়ে গেলে সম্পত্তি শায়লা পাবে আর আমরা যদি তোহাকে না দেই তাহলে ওরা তোহার বিনিময়ে সম্পত্তি চাইবে।
মেঘ: তোহাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।
আমি: চিন্তা করোনা আমি সব সামলে নিবো তুমি শুধু আমার পাশে থেকো।
মেঘ: আমি তো সবসময় তোমার পাশে আছি। (মৃদু হাসলাম, মেঘ আর তোহা আমার জীবনে থাকলে আমি যেকোনো বিপদের মোকাবিলা করতে পারবো)
মেঘ: চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি: হুম চলো।

শায়লা: মেঘ এতো দেরি করে আসলে যে আজ তো আমাদের শপিং…(মেঘ রুমে ঢুকতেই শায়লা বলতে শুরু করেছিল, মেঘের পিছনে আমাকে দেখতে পেয়ে থেমে গেল)
আমি: কি যেন বলছিলে কি শপিং…
শায়লা: ককই কিকিছু নাতো।
আমি: মেঘ ও তোমার রুমে কি করছে?
মেঘ: আসল…
আমি: ওকে আমি চাকরি দিয়েছি তোমার পাশে বসে থাকার অনুমতি দেইনি।
শায়লা: আসলে আমি একটা ফাইল নিয়ে এসেছিলাম মেঘ ছিল না তাই অপেক্ষা করছিলাম তুমি আসবে ভাবিন…
আমি: মেঘ নয় স্যার আর আমি কে হই ভুলে গেছ?
শায়লা: সরি মেম।
আমি: আজ তোমাকে কাজ করতে হবে না বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও আমি সারাদিন মেঘের সাথে থাকবো।
শায়লা: কি?
আমি: অবাক হওয়ার কি আছে যাও।
শায়লা: ঠিক আছে।
মেঘ: কণা কি করতে চাইছ তুমি শায়লাকে চলে যেতে বললে কেন?
আমি: শান্তিতে কাজ করো আসছি আমি।
মেঘকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে আসলাম।

শায়লাকে তো বিদায় করেছি ওকে ফলো করার জন্য, ও কোথায় যায় কি করে সব আমাকে জানতে হবে।
–মেম আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। (হনহন করে চলে আসছিলাম পিছন থেকে কেউ কথাটা বলে উঠলো, পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন কর্মচারী মেয়ে)
আমি: হ্যাঁ বলুন।
–আপনার সাথে আমি অনেক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আপনার ফোন নাম্বার বা শশুড় বাড়ির ঠিকানা কিছুই নেই আমার কাছে।
আমি: কি হয়েছে বলুন।
–মেম কাদের আপনি কোম্পানির দায়িত্ব দিয়েছেন? শায়লা মেম সারা দিন স্যার এর রুমে থাকে আর…
আমি: আর কি?
–আমি বলতে পারবো না। (মেয়েটা মাথা নিচু করে ফেলেছে তবে কি..)
–স্যার আমাকে মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তাই আপনার ভালোর জন্য কথাটা বললাম। কোনো কাজে মেঘ স্যার এর রুমে গেলে শায়লা মেম বকাঝকা করে বলে এতো কাজ করতে হবে না ওই রুমে যেন না যাই।
আমি: হু ঠিক আছে।
–আর মেম ওরা বোধহয় বিয়ের প্ল্যান করছে, গতকাল শুনেছি ওরা বিয়ের শপিং করতে যাবে বলছিল। আর স্যার অফিস রেখে বার বার বাইরে যায়, আমাদের অন্য একজন কর্মচারী দেখেছে স্যার কোনো এক উকিলের কাছে যায় সম্ভবত মেম ডিভো…
আমি: থাক আর বলতে হবে না আসছি আমি।
বেরিয়ে আসলাম সবকিছু কেমন যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে, মেয়েটি এসব কি বললো? তবে কি মেঘ আমার সাথে অভিনয় করছে?

শায়লাকে হারিয়ে ফেলেছি আমি বেরুনোর আগেই হয়তো চলে গেছে এখন কি করবো? শায়লার ঠিকানা প্রয়োজন আবার ফিরে গেলাম মেঘের কাছে।

মেঘ: ফিরে আসলে যে?
আমি: ইচ্ছে হয়েছে তাই।
মেঘ: রেগে আছ কেন?
আমি: ভাবছি হানিমোনে যাবো।
মেঘ: কি?
আমি: এতে চমকে যাওয়ার কি আছে মনে হচ্ছে হানিমোন শব্দটা এই প্রথম শুনলে।
মেঘ: তা না অনেক কাজ…
আমি: বাইরে কোথাও যাবো এক মাসের জন্য।
মেঘ: এক মাস?
আমি: হ্যাঁ অবাক হচ্ছ কেন?
মেঘ: হানিমোনের ভূত মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো আমি যাচ্ছি না। (তুমি যাবে কি মেঘ, আমিই তো যাবো না। হানিমোনের কথা বলে আমি তো তোমায় পরীক্ষা করছি দেখি তুমি শায়লার সাথে বিয়ের প্ল্যান করেছ কিনা)
মেঘ: কথা বলছ না কেন? (মেঘের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সোফায় এসে বসে পড়লাম। চুপচাপ ভাবছি মেঘ কি সত্যি শায়লাকে বিয়ে করার প্ল্যান করেছে? তাহলে আমার সাথে অভিনয় করছে নাকি?)
মেঘ: কি হয়েছে কি এতো ভাবছ। (মেঘ আমার পাশে বসে আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিলো তারপর হাতে চুমু খেলো, তাকিয়ে আছি ওর দিকে সত্যি কি ও আমার সাথে অভিনয় করছে)
মেঘ: বলোনা কি হয়েছে তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?
আমি: কিছু হয়নি। (মেঘের কাধে মাথা রাখলাম। যদি মেয়েটির কথা সত্যি হয় তাহলে মেঘকে আর কিছু বলা ঠিক হবে না এমনিতে বলে দিয়েছি শায়লা যে আব্বুর খুনি সেটা আমি জানি)
মেঘ: বাসায় চলে যাও কেমন?
আমি: হুম।
মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে মেঘের চোখের আড়ালে আবার সেই মেয়েটির কাছে আসলাম।

–মেম কিছু বলবেন?
আমি: শায়লার বাসার ঠিকানা আমার প্রয়োজন দিতে পারবেন?
–ও কখন কোন বাসায় থাকে ঠিক নেই তবে অফিসে যে ঠিকানা দেওয়া আছে সেটা দিতে পারবো।
আমি: ঠিক আছে দিন।
ঠিকানা নিয়ে শায়লার বাসার দিকে রওনা দিলাম।

শায়লা: কতো বড় সাহস আমাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে ও নাকি মেঘের কাছে থাকবে যত্তোসব। মেঘ তোর কি হয় যে ওর কাছে সারাদিন থাকবি? মেঘ তো দুদিন পর আবারো আমার হয়ে যাবে তখন কি করবি? নেহাত সম্পত্তিটা হাত ছাড়া করতে চাই না তাই সব মুখ বুজে সহ্য করছি নাহলে কণার বাচ্চা কণাকে খুন করে ফেলতাম। (শায়লা জিনিসপত্র ড্রয়িংরুমের চারদিকে ছুড়ে মারছে আর আমাকে বকাবকি করছে। জানালা দিয়ে এসব দেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। শায়লার এসব কথায় আমি মোটেও অবাক হচ্ছি না, অবাক তো হচ্ছি শায়লার বাসা বিয়ে বাড়ির মতো সাজানো দেখে। তবে কি সত্যি ওরা বিয়ে করছে? কিন্তু মেঘের স্ত্রী তো আমি, আমাকে ডিভোর্স না দিয়ে কিভাবে সম্ভব?)
শায়লা: এতো গুলো সম্পত্তি কোন পাগলে হাত ছাড়া করতে চায়? আমি তো মেঘকে নিয়ে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারবো। ভাগ্যিস কণা তোহাকে মেয়ে ভেবে সব তোহার নামে করে দিয়েছে এবার তোহাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারলেই হয় অবশ্য তোহাকে কণা না দিতে চাইলে আমার কোনো সমস্যা নেই, তোহার বিনিময়ে সব সম্পত্তি দিয়ে দিলেই হবে। (শায়লার কথা শুনে ওকে ঘৃণা করতেও আমার রুচিতে বাধছে, নিজের সন্তানের বিনিময়ে সম্পত্তি চায় ছিঃ এতো খারাপ মানুষ হয়? শায়লার ফোন বেজে উঠলো..)
শায়লা: কোথায় দেখা করবে? (অপর পাশ থেকে কে কথা বলছে কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না)
শায়লা: আসছি। (শায়লা আসছে দেখে সরে গেলাম। মনে হয় না এভাবে কোনো প্রমাণ পাবো একমাত্র রাস্তা এখন রুহানের আম্মু কিন্তু উনাকে তো পুলিশে দিতে পারবো না কি করবো এখন?)

শায়লার পিছন পিছন আবারো আসলাম ও একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকছে দেখে আমিও ঢুকতে গেলাম তখনি পিছন থেকে কে যেন আমার হাত ধরে ফেললো, পিছনে তাকিয়ে মেঘকে দেখে বেশ অবাক হলাম। মেঘ অফিস রেখে এখানে কি করছে তবে কি শায়লা মেঘের সাথেই দেখা করতে আসছে?
মেঘ: বাসায় চলে যাবে বলে এখানে কি করছ?
আমি: অফিস রেখে তুমি এখানে কি করছ?
মেঘ: আআমমি তো…
আমি: তোতলাচ্ছ কেন?
মেঘ: তুমি বাসায় একা তাই অফিসে মন বসছে না আর দুপুর তো হয়ে আসছে তাই খাবার নিতে রেস্টুরেন্টে…
আমি: অফিসের কাছে রেস্টুরেন্ট নেই নাকি যে এতো দূর খাবার নিতে আসতে হলো?
মেঘ: চলো তো বাসায় খালি প্রশ্ন করো।
কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে এসে বসলাম।

মেঘ: কণা রেগে আছ কেন?
আমি: নাতো।
মেঘ: তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছ?
আমি: সন্দেহ করার মতো কাজ করেছ নাকি?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: এবার আমাকে সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে।
মেঘ: মানে কি করবে?
আমি: শায়লাকে আর ওর সাথে যারা জড়িত আছে সবাইকে জেলে দিবো। (মেঘ কথাটা শুনেই হুট করে গাড়ি থামালো, তাল সামলাতে না পেরে গাড়ির সাথে আমার মাথা লাগলো)
আমি: মেঘ হয়েছে কি এভাবে কেউ গাড়ি থামায়?
মেঘ: সরি, বেশি ব্যথা পেয়েছ?
আমি: কথাটা শুনে এভাবে চমকে উঠলে কেন?
মেঘ: শায়লার সাথে তো চাঁচি জড়িয়ে আছেন আর চাঁচিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে তো বুঝই আমাদের মান সম্মান সব যাবে আর আব্বু…
আমি: ভয় নেই বাবার কোনো ক্ষতি হবে এমন কিছু আমি করবো না।
মেঘ: হু।
মেঘ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছি সত্যি কি ও চাঁচিকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে নাকি অন্য কিছু…

এভাবে প্রমাণ জোগাড় করা সম্ভব না এখন একমাত্র রাস্তা চাঁচি। কিন্তু চাঁচিকে তো পুলিশে দিতে পারবো না এইটার বিনিময়ে তো রুহান আর পপির বিয়ে দিয়েছি তাছাড়া বাবাকে কথা দিয়েছি। চাঁচিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে এই খান পরিবারের সম্মান যাবে এই পরিবারের সাথে তো এখন আমারো সম্মান মিশে আছে, উফফফ কিযে করি।
মেঘ: একা একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছ? (বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম মেঘ এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো)
মেঘ: কথা বলছ না কেন?
আমি: এমনি।
মেঘ: খিদে লেগেছে তো।
আমি: ফ্রেশ হয়ে এসো আমি খাবার দিচ্ছি।

মেঘ ফ্রেশ হতে চলে গেল আমি রুম থেকে বেরুতে যাবো তখনি মেঘের ফোন থেকে মেসেজটোন বেজে উঠলো। একবার ওর ফোনটা দেখা প্রয়োজন, মেয়েটির কথা কতটুকু সত্যি সেটা অন্তত জানা যাবে। ফোন হাতে নিয়ে দেখি শায়লার মেসেজ।
“বিয়ের কথা যেন কণা জানতে না পারে জানলে কিন্তু ও জামেলা করবে। আর তুমি তো বলেছ একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সবাই মেনে নিবে। ডিভোর্স পেপারে কোনো ভাবে ওকে দিয়ে সাইনটা করিয়ে নিও আমি অপেক্ষায় আছি”
মেসেজ পড়ে বোবার মতো দাঁড়িয়ে আছি। তারমানে মেয়েটির কথাই সত্যি মেঘ আর শায়লা বিয়ের প্ল্যান করছে এমনকি আমাদের ডিভোর্স এর ব্যবস্থাও ওরা করে ফেলেছে।
মেঘ: কি হলো এখনো দাঁড়িয়ে আছ? (মেঘের কথার উত্তর না দিয়ে ফোনটা রেখে মেঘের কাগজপত্র খুঁজতে শুরু করলাম)
মেঘ: আরে এভাবে কি খুঁজছ?
আমি: যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেছি। (ফাইলের ভিতর ডিভোর্স পেপার পেয়ে মেঘের সামনে ধরলাম ও হা হয়ে তাকিয়ে আছে)
মেঘ: এইটা…
আমি: এইটা কি মেঘ? তুমি আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য…
মেঘ: অসম্ভব এইটা আমি আনিনি।
আমি: ওহ আমি এনেছি তাহলে।
মেঘ: তুমি আনতে যাবে কেন তুমি তো আমাকে ভালোবাস।
আমি: মেঘ নাটকটা একটু কম করো।
মেঘ: বিশ্বাস করো আমি এই ডিভোর্স পেপার এর ব্যাপারে কিছুই জানিনা, এই পেপার ফাইলের ভিতর আসলো কিভাবে আমি সত্যি জানিনা।
আমি: অনেক হয়েছে মেঘ, আমাকে বললেই পারতে তুমি শায়লাকে বিয়ে করতে চাইছ আমিই নাহয় সব ব্যবস্থা করে দিতাম।
মেঘ: কণা তুমি বিশ্বাস করো এইসব কিছুই আমি জানিনা, শায়লা আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।
আমি: পেপারটা আমি নিয়ে গেলাম কাজে লাগতে পারে।
মেঘ: প্লিজ কণা এইটা ছিঁড়ে ফেলো আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মেঘ ফ্লোরে বসে কাঁদছে চুপচাপ পেপারটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।

ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আর ডিভোর্স পেপারটার দিকে তাকিয়ে দেখছি মেঘ কতো সুন্দর সাইন করে দিয়েছে। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি পড়ে পেপারটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। মেঘ’কে তো আমি ভালোবাসি তাহলে ও আমার সাথে এমন কেন করছে? আচ্ছা মেঘও তো আমায় ভালোবাসে তাহলে ও এমনটা করতে যাবে কেন? তবে কি আমি যা দেখছি তা ভুল? মেঘ এসব সত্যি করছে নাকি শায়লা মেঘকে বারবার ফাঁসাচ্ছে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১২

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১২

লেখিকা: সুলতানা তমা

চোখ খুলে তাকালাম সবকিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছে, দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। সারা শরীর অবশ হয়ে আছে আস্তে আস্তে হাতটা নাড়ালাম। এখন সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমি বিছানায় শুয়ে আছি পাশে মেঘ আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। আবারো মেঘের দিকে তাকালাম ওর চোখেমুখে ক্লান্তির চাপ সারা রাত ঘুমায়নি মনে হয়। রাতের কথা মনে পড়লো আমি তো বাথরুমে ছিলাম এখানে কিভাবে… মাথাটা একটু তুলে বাথরুমের দিকে তাকালাম, বাথরুমের দরজা ভাঙ্গা তারমানে…
মেঘ: তোমার ঘুম ভেঙ্গেছে? কিছু খাবে সুপ করে আনবো? (মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলাম এক দৃষ্টিতে এই মানুষটাই রাতে আমার সাথে ঝগড়া করেছে আমাকে থাপ্পড় মেরেছে আর এখন এই মানুষটাই আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করছে)
মেঘ: আর রেগে থেকো না প্লিজ কথা দিচ্ছি আর কখনো তোমার উপর হাত তুলবো না। (মেঘ আমার দুগালে আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো)
আমি: রাগ করিনি।
মেঘ: একটু অপেক্ষা করো আমি আসছি।

মেঘ কিছুক্ষণ পর হাতে সুপ নিয়ে রুমে ঢুকলো, ওর চোখ দুটু লাল হয়ে আছে।
মেঘ: এইটা খেয়ে নাও। (ও নিজেই এসে আমাকে আধশোয়া করে শুয়ে দিলো)
আমি: তুমি কান্না করেছ?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি।
মেঘ: হু খেয়ে নাও।
আমি: খাবো না বলো কাঁদছ কেন?
মেঘ: কাঁদবো নাতো কি করবো? কিছু মনে আছে তোমার রাতে কি করেছ? তুমি বাথরুমে ঢুকে যতোক্ষণ কেঁদেছ ততক্ষণ আমিও দরজার পাশে বসে কেঁদেছি। হঠাৎ করে তোমার কান্না বন্ধ হয়ে যায় তোমাকে অনেক ডেকেছি কিন্তু কোনো সাড়া দাওনি, কতোটা ভয় পেয়েছিলাম আমি জানো তুমি ধারণা করতে পারছ? আমার কান্না শুনে বাসার সবাই চলে এসেছিল তারপর দরজা ভেঙ্গে বাথরুমে ঢুকে দেখি তুমি অজ্ঞান হয়ে পরে আছ। তোমাকে বাথরুমে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে আমার কেমন লেগেছিল বুঝতে পারছ তুমি? ডক্টর এসেছিল তোমার গায়ে প্রচুর জ্বর ছিল জ্ঞান ফিরছিল না, প্রায় এক ঘন্টা পর তোমার জ্ঞান ফিরে তারপর ডক্টর তোমাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখে যায়। সারারাত তো ঘুমিয়েছ দেখেছ আমি কতোটা চটপট করেছি? এই কিছুক্ষণ আগে দুচোখের পাতা এক করেছিলাম। (মেঘের কথাগুলো শুনে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি বোবার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে)
মেঘ: অবশ্য দোষটা আমারই এতো গুলো থাপ্পড় দেওয়া উচিত হয়নি, আমি কি করবো বলো সবকিছুতে শায়ালাকে টেনে আনো তুমি ভালো লাগে বুঝি। (মেঘ আমার মুখের সামনে সুপ এনে ধরলো চুপচাপ খেয়ে নিলাম)

মেঘ সুপের বাটী টেবিলে রেখে জানালার পর্দাটা একটু সরিয়ে দিল তারপর আমার পাশে এসে আধশোয়া হয়ে শুয়ে রইলো। পাশ ফিরে আমার দিকে একবার তাকালো তারপর একটা হাত বাড়িয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে টেনে নিয়ে ওর বুকে শুয়ে দিলো, চুপচাপ শুয়ে রইলাম ওর বুকে।
মেঘ: এখনো রেগে আছ?
আমি: নাতো।
মেঘ: রাতে কতোটা ভয় পেয়েছিলাম জানো তুমি? সবাই আমাকে খুব বকেছে তোমার গাল লাল দেখে। আমারো অনেক কষ্ট হয়েছে এখনো হচ্ছে এভাবে মারতে চাইনি কিন্তু তুমি…
আমি: বাদ দাওনা এসব। (মেঘকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ও আমার মাথায় চুমু খেলো)
মেঘ: একটু ছাদে যাবে?
আমি: কেন?
মেঘ: চলনা। (মেঘ উঠে আমাকে কোলে তুলে নিলো, দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে রইলাম ওর চোখের দিকে)

মেঘ আমাকে কোলে করে এনে ছাদে নামিয়ে দিলো, ছাদ সাজানো দেখে বেশ অবাক হলাম। মেঘের দিকে তাকাতেই ও আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
মেঘ: বলেছিলাম তো সারপ্রাইজ আছে। আজ আমার বার্থডে আর রাতে এজন্যই তোমাকে শাড়িটা পড়তে বলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল এই খোলা আকাশের নিচে তোমার কোলে শুয়ে সারারাত কাটিয়ে দিবো কিন্তু তুমি…
আমি: শায়লাকে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি তাছাড়া ও বলেছিল উকিল নাকি বলেছে ও চাইলেই তোহাকে নিয়ে যেতে পারবে। তুমি তো জানো তোহাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না তাই মাথা ঠিক ছিল না। আমি বুঝতে পারিনি আজ তোমার বার্থডে জানলে আ…
মেঘ: এখন তো জানো…
আমি: হ্যাপি বার্থডে তোহার আব্বু।
মেঘ: পাকনা বুড়ি হয়ে গেছ তোহার আব্বু ডাকা হচ্ছে।
আমি: হ্যাঁ আমাকে তোহার আম্মু ডাকবে বুঝেছ?
মেঘ: ভাবছি তোহার একটা পুঁচকে ভাই অথবা বোন হলে কেমন হয়। (মেঘ আমার পেটে দুহাত দিয়ে খেলা করছে, ওর কথা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম)
মেঘ: লজ্জা পেয়েছ কথা বলছ না যে।
আমি: জানিনা। (ঘুরে গিয়ে মেঘের বুকে মুখ লোকালাম। মেঘ সত্যি আমাকে ভালোবাসে শুধু শায়লাকে এখন আমাদের মাঝখান থেকে সরাতে হবে)
মেঘ: বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: তোহাকে হারানোর ভয়েই আমি শায়লার সাথে কথা বলি, ও চাইলেই তোহাকে নিয়ে যেতে পারে তাই ভয় হয়।
আমি: তোমার সাথে আমার কথা ছিল।
মেঘ: তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন কষ্ট হচ্ছে তোমার?
আমি: নাতো। (সকালের মৃদু বাতাসে শরীর কাঁপছে সত্যি কষ্ট হচ্ছে কিন্তু মেঘকে বুঝতে দিলে হবে না এমনি সারারাত চটপট করেছে)
মেঘ: তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি রুমে চলো।

মেঘ আমাকে নিয়ে রুমে আসলো তারপর বিছানায় শুয়ে দিলো। এবার মেঘকে সবকিছু বলা প্রয়োজন।
আমি: তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।
মেঘ: ভালোবাসি বলবে তো…
আমি: না আসলে আব্বু…
জোহা: আপু আসবো?
আমি: আয়। (জোহা এসে তোহাকে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল)
তোহা: নতুন আম্মুকে ছাড়া আমি আর কখনো ঘুমাবো না।
আমি: কেন আম্মু?
তোহা: কেন আবার আমার ঘুম আসেনা তাই।
শায়লা: তোকে ছাড়া যে আমারো ঘুম আসেনা মা। (দরজায় শায়লাকে দেখে চমকে উঠলাম আবার এসেছে ও)
শায়লা: ভাবছি তোহাকে নিয়ে চলে যাবো।
আমি: না ওকে নিয়ো না। (তোহাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম শায়লা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে)
মেঘ: শায়লা ওখানেই দাঁড়াও, তোমাকে তো বলেছি তুমি যা চাইবে তাই দিবো তাহলে কেন করছ এরকম?
শায়লা: বাহ্ মেঘ বড়লোক বউ পাশে থাকাতে রাতের সব কথা ভুলে গেলে?
মেঘ: মানে?
শায়লা: তুমিই তো রাতে বললে কণাকে ডিভোর্স দিয়ে আমাকে আবার বিয়ে করবে তারপর তোহাকে নিয়ে আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করবো।
আমি: মেঘ ও এসব কি বলছে?
মেঘ: সব মিথ্যে বলছে সারারাত তো আমি তোমার পাশেই বসে ছিলাম আর ওকে আমি এসব বলতে যাবো কেন?
আমি: শায়লা তুমি কিন্তু শর্ত ভুলে যাচ্ছ।
শায়লা: অনেক ভেবে দেখলাম শর্ত গুলো ভুলে যাওয়াই ভালো কারণ আমি যা চাইছি তা আমি এমনিতেই পাবো।
আমি: কি চাইছ তুমি?
শায়লা: সব কথা বলে দিতে নেই। (শায়লা ফিসফিস করে কথাটা বলেই হাসতে হাসতে চলে গেল। কোথায় পাবো প্রমাণ কবে শায়লাকে জেলে পাঠাবো আর ভালো লাগছে না)
মেঘ: কণা তুমি চিন্তা করো না তোহা তোমার কাছেই থাকবে।
আমি: হুম।

তোহার পাশে শুয়ে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, মেয়েটা চারহাত পা দিয়ে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ ওকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাবে। আমারো বড্ড ভয় হচ্ছে শায়লা যদি সত্যি তোহাকে নিয়ে যায় তখন আমি কি করবো। না না এর আগেই শায়লাকে জেলে দিতে হবে।
মা: বৌমা তোমার শরীর এখন কেমন।
আমি: এইতো মা এখন একটু ভালো।
মা: মেঘ তো জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চেয়েছিল কিন্তু হলো না তাই বলছিলাম কি আজ সন্ধ্যায় একটা পার্টি…
মেঘ: না আম্মু কণা অসুস্থ এ অবস্থায় এসবের প্রয়োজন নেই। (মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে আছে দেখে হাত দিয়ে রুমে আসতে বললাম)
মেঘ: কিছু বলবে?
আমি: মা যখন চাইছেন তখন…
মেঘ: বললাম তো এসব কিছু হবে না আগে তুমি সুস্থ হয়ে উঠো আমার আর কিছু চাই না।
আমি: তাই বলে জন্মদিন…
মা: থাক বৌমা ও যখন চাইছে না তাহলে এসব না করাই ভালো। (মা চলে গেলেন মেঘ এসে আমার পাশে বসলো)
আমি: তুমি তো চেয়েছিলে সেলিব্রেট করতে তাহলে মা বলাতে না করলে কেন?
মেঘ: তুমি তো অসুস্থ বাদ দাও।
আমি: তাই বলে…
মেঘ: তুমি সুস্থ হলে পর নাহয় আমার গিফট চেয়ে নিবো। (মেঘের মুখে দুষ্টু হাসি দেখে চোখ বড় বড় করে তাকালাম)
মেঘ: তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো প্লিজ। (মেঘ চোখ টিপ দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, ওর কথার কিছুই বুঝলাম না)

অসুস্থতার মধ্যে দুটু দিন কেটে গেল, এখন পুরোপুরি সুস্থ আছি। আজ যেভাবেই হউক একবার বাইরে যেতে হবে। শায়লার সম্পর্কে সবকিছু জানতে হবে আমাকে। সেদিনের পর শায়লা আর এ বাসায় আসেনি, কোথায় আছে কি প্ল্যান করছে সব জানতে হবে আমাকে। কিন্তু কিভাবে বাইরে যাবো? আব্বুকে বলে যাবো? মেঘকে বললে তো আমাকে একা বের হতে দিবে না তাছাড়া শায়লা যে আব্বুর খুনি একথাটা মেঘকে এখনো বলা হয়নি যখনি বলতে চাই কোনো একটা বাঁধা পড়ে যায়। আজ মেঘকে সবকিছু বলবো তারপর বাসার বাইরে যাবো।
মেঘ: কণা টাই’টা বেঁধে দাওনা… (মেঘ হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ওর টাই বেঁধে দিতে দিতে বললাম..)
আমি: রোজ রোজ আমি টাই বেঁধে দিতে পারবো না এখন থেকে সকালে তাড়াতাড়ি উঠবে বুঝেছ?
মেঘ: এখন থেকে তো সকালে উঠতে আরো বেশি দেরি হবে।
আমি: তুমি আবার দুষ্টু হাসি হাসছ?
মেঘ: আজ তোমার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ আছে।
আমি: আবার সারপ্রাইজ?
মেঘ: হ্যাঁ, আসছি।
আমি: আরে কিসের সারপ্রাইজ বলে তো যাও।
মেঘ: অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। (দ্যাত চলে গেল, এই মেঘকে আমি একদম বুঝতে পারিনা)

ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি সবাই রেডি হচ্ছে কোথায় যাবে সবাই?
আমি: মা সবাই মিলে কোথায় যাচ্ছেন?
মা: গ্রামের বাড়ি যাবো।
আমি: সবাই?
দাদী: তুই আর মেঘ থাকবি শুধু।
জোহা: আমি রেডি।
আমি: জোহা তুইও…
জোহা: গ্রাম দেখার লোভ আমি সামলাতে পারছি না আপু।
মা: আসুক না সবাই মিলে ঘুরে আসবো।
দাদী: ওইতো পপি আর রুহান চলে এসেছে। (সিঁড়ির দিকে তাকালাম দুজন একসাথেই নেমে আসছে, রুহানের রাগ কিছুটা কমলেও পপিকে ওর মন মেনে নিতে পারছে না। পপি এতটুকুও ভেঙে পরেনি বরং সবসময় হাসিখুশি থাকে সত্যি মেয়েটা পারেও)
রুহান: দাদী বলছিলাম আমি না গেলে হয় না?
দাদী: নতুন বিয়ে করেছিস বউ নিয়ে ঘুরার সুযোগ পাচ্ছিস আর এখন এসব কথা বলছিস।
চাঁচি: হুহ নতুন বিয়ে নতুন বউ।
আমি: হ্যাঁ ঘুরে এসো সবার সাথে দুজনেরই ভালো লাগবে।
মা: তোহাকে নিয়ে যাবো?
আমি: না না ও আমার কাছেই থাকবে।
তোহা: আমি যাবো দাদুর সাথে।
আব্বু: নিয়ে যাই সবাই তো আছি আমরা সমস্যা হবে না তোমার মেয়ের।
মা: আজ একটু কষ্ট করে রান্না করে নিও মা আসছি আমরা।
সবাই চলে গেল সাথে আমার মেয়েটাকেও নিয়ে গেল, আমি একা হয়ে গেলাম মেঘও অফিসে।

সারাদিন একা একা কাটালাম আর ভালো লাগছে না মেঘও আসছে না এতো রাত হয়ে গেল। রান্নাঘরে রান্না করছিলাম হঠাৎ মনে হলো বাসায় কেউ ঢুকেছে, ভয়ে ভয়ে ড্রয়িংরুমে আসলাম মেঘ চোরের মতো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে।
আমি: এই তুমি চোরের মতো রুমে যাচ্ছ কেন?
মেঘ: তুমি রান্না করছ ভেবে ডিস্টার্ব করলাম না আমার হাতে চাবি ছিল তা…
আমি: তুমি কিছু লুকাচ্ছ আমার থেকে?
মেঘ: নাতো কি লুকাবো?
আমি: হু ফ্রেশ হয়ে খেতে এসো।

মেঘকে খেতে দিয়ে আমিও খেতে বসলাম তখনি আমার ফোন বেজে উঠলো।
মেঘ: আমি যাচ্ছি।
আমি: না তুমি খাওয়া শুরু করো আমি আসছি।

ফোন হাতে নিয়ে দেখি শায়লা এই মেয়ে তো আমাকে জ্বালিয়ে মারছে।
আমি: কি হয়েছে ফোন করেছ কেন?
শায়লা: অনেক ভেবে দেখলাম আমার মেয়ে প্রয়োজন নেই সম্পত্তি প্রয়োজন তাই মেয়েটা তোমাকে দিয়ে সম্পত্তির জন্য ফোন দিলাম।
আমি: তুমি চাইবে আর আমি দিয়ে দিবো এতোই সস্তা? খুব ভালো করে শুনে রাখো তুমি যে আব্বুর খুনি সেটা আমি জেনে গেছি এখন শুধু…
শায়লা: প্রমাণের অপেক্ষা? কিন্তু প্রমাণ তো তুমি পাবে না কারণ আমি প্রমাণ রেখে কোনো কাজ করিনা।
আমি: আমিতো প্রমাণ খুঁজে বের করবোই।
শায়লা: তার আগেই যদি তোহাকে আমি নিয়ে আসি তাহলে তো সব সম্পত্তি আমার।
আমি: হিহিহি তুমি এতো বোকা জানতাম নাতো।
শায়লা: মানে?
আমি: সব কথা বলে দিতে নেই। (ফোনটা কেটে দিলাম। শায়লা আশা নিয়ে বসে আছে ও তো জানেই না নতুন উইল আমি কিভাবে তৈরি করেছি, তোহাকে নিয়ে গেলেও সম্পত্তি ও পাবে না)

মেঘ খাওয়া শেষ করে চুপচাপ বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমি: এতো তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ?
মেঘ: হুম তোমার খেতে হবে না রুমে চলো।
আমি: আমার খিদে আছে তো তুমি বললেই হলো নাকি?
মেঘ: তুমি আগে কখনোই কি রান্না করনি?
আমি: কেন রান্না খারাপ হয়েছে?
মেঘ: নাতো অনেক ভালো হয়েছে তুমি নিজেই দেখো আমি কতোটা খেয়েছি। (মেঘ তো সব রান্নাই খেয়েছে সত্যি কিন্তু ওর কথায় কিছুটা খটকা লাগলো। ওর দিকে তাকিয়ে খাবার মুখে দিলাম)
আমি: ওয়াক থুঃ…
মেঘ: আরে কি হলো নাও পানি খাও।
আমি: এসব রান্না তুমি খেয়েছ কিভাবে?
মেঘ: লবণ একটু বেশি হয়েছে কিন্তু রান্নাটা দারুণ…
আমি: চুপ করো এজন্যই আমাকে খেতে নিষেধ করেছিলে? এতো লবণ তুমি খেয়েছ কিভাবে?
মেঘ: আমার বউটা কষ্ট করে রান্না করেছে আমি না খেলে তো কষ্ট পেতো। (চুপচাপ তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে এতো ভালোবাসে আমায়। মেঘ মুচকি হেসে আমার সামনে থেকে প্লেট নিয়ে গেল)
মেঘ: আর খেতে হবে না চলো।
আমি: আরে কি করছ?
মেঘ: বলেছিলাম না জন্মদিনের গিফট ঠিক চেয়ে নিবো। (মেঘ আমাকে কোলে তুলে নিলো কি চাইছে ও কিছুই বুঝতে পারছি না)

মেঘ আমাকে কোলে করে অন্য একটি রুমে নিয়ে আসলো। রুমের অবস্থা দেখে আমি পুরো থ হয়ে গেলাম। ঠিক আমাদের বাসর ঘরের মতো সাজানো দেখে আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম। একদম সেই সাজ পুরো রুম জোরে নীল সাদা অর্কিড ফুলের ছড়াছড়ি, সাথে জ্বলছে অনেক গুলো ক্যান্ডেল লাইট।
মেঘ: সারপ্রাইজটা কেমন হলো?
আমি: খুব সুন্দর কিন্তু কখন সাজালে এসব?
মেঘ: তুমি রান্না করছিলে সন্ধ্যার সময় এসে সাজিয়েছি বুঝতেও পারনি তুমি।
আমি: কিন্তু এসব কেন?
মেঘ: আজ আমরা আমাদের জীবন নতুন করে শুরু করবো।
আমি: মামাননে?
মেঘ: সব ভুলের অবসান ঘটাবো আজ।
মেঘ আমাকে খাটের উপর শুয়ে দিলো, ওর কাজকর্ম দেখে অবাক হচ্ছি শুধু।
মেঘ: তুমি কখনো আমার মনে এতোটা জায়গা করে নিবে আমি ভাবতেও পারিনি। সব ভুলের জন্য সরি, চলো আজ সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করি।
মেঘ আমার নাকের সাথে ওর নাক ঘষছে। আমার হাত বিছানায় চেপে ধরে আঙ্গুলের বাজে বাজে ওর হাতের আঙ্গুল গুলো আটকে দিলো। মেঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম ও আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কেমন যেন নেশা মিশানো ওর চোখ দুটুতে, এই চোখের গভীরতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে পারছি না ওর চোখ দুটুর দিকে, আস্তে আস্তে চোখ বুঝে ফেললাম। মেঘ আমার আরো কাছে চলে আসলো, দুজনের নিঃশ্বাস ভারী খাচ্ছে চোখ খুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। মেঘ আস্তে আস্তে আমার আরো কাছে এসে ওর ঠোঁট দুটু ডুবিয়ে দিলো আমার ঠোঁটের গভীরে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১১

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১১

লেখিকা: সুলতানা তমা

চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি সবাই একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো আবার পপির দিকে তাকাচ্ছে। মেঘ হুট করে এসে আমার হাত চেপে ধরলো।
মেঘ: এসব কি হ্যাঁ কি করেছ এইটা? বলছ না কেন? (মেঘের ধমকে ভয়ে চুপসে গেলাম, বাবা এসে মেঘের হাত সরিয়ে দিয়ে আমাকে উনার কাছে নিয়ে আসলেন)
বাবা: বৌমা তুমি হঠাৎ…
আমি: বাবা পপি রুহানকে ছোট থেকে ভালোবাসে তাই আ…
চাঁচি: তাই উনি ওদের বিয়ে দিয়ে মহৎ কাজ করেছেন।
বাবা: তুমি চুপ করতো।
চাঁচি: কেন চুপ করবো বিয়েটা কি ছেলেখেলা? বড়লোকের মেয়ে বলে আমাদের বাড়ির ছেলে মেয়ের জীবন নিয়ে খেলবে নাকি?
বাবা: কণা মা…
আমি: বাবা প্লিজ আপনি বিশ্বাস করুন পপি রুহানকে ভালোবাসে। হ্যাঁ রুহান এখন পাগলামি করছে কিন্তু দেখবেন কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
বাবা: পপি তুই রুহানকে ভালোবাসিস?
পপি: (নিশ্চুপ)
আমি: পপি বলে দাও ভালোবাসার কথা লুকিয়ে রাখতে নেই।
মেঘ: কিন্তু রুহান তো পপিকে ভালোবাসে না পপি কি সুখী হবে?
দাদি: নিজের বোনের সুখ খুঁজছিস অথচ নিজেই নিজের বউকে সুখী করছিস না কি অদ্ভুত। (দাদির কথায় মেঘ কেমন করে যেন তাকালো আমার দিকে)
পপি: আমি ঠিক রুহানের ভালোবাসা জয় করে নিবো দেখো তোমরা।
মা: এভাবে সুখী হওয়া যায়না মা।
বাবা: যা হবার হয়েছে এখন শুধু ওদের জন্য দোয়া কর সুখী হয় যেন।
চাঁচি: তুমি মেনে নিলে?
বাবা: হ্যাঁ, না মানার কি আছে ওরা তো ভুল কিছু করেনি ভালোবাসে তাই বিয়ে করেছে।
পপি: আব্বু…(পপি গিয়ে আব্বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো, যাক বাবা সবাই তো মেনে নিলো)
চাঁচি: আমি এই বিয়ে মানি না।
মা: কেন মানবে না আমার মেয়ে কম কিসে?
চাঁচি: সে কথা নয় আসলে..(এই মহিলাকে থামাতে হবে নাহলে জামেলা বাড়বে। উনার পাশে এসে আস্তে আস্তে বললাম..)
আমি: চুপচাপ মেনে নিন নাহলে দাদিকে বলে দিবো আপনি আমার আর মেঘের ডিভোর্স করানোর জন্য চক্রান্ত করছেন। একবার বলে দিলে কিন্তু দাদি আপনাকে আর রুহানকে ঘাড় ধাক্কা…(উনার রাগি চাহনি দেখে থেমে গেলাম কিন্তু এখন উনি মানতে বাধ্য)
দাদি: এই তোরা কি ফিসফিস করছিস?
আমি: ওই তো দাদী চাঁচিকে বলছিলাম আমাকে একটু হেল্প করতে ওদের বাসরঘর সাজাতে হবে না?
চাঁচি: না আমি…(আবার কথা বলছেন এখন কিন্তু বলেই দিবো। চাঁচি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছেন আর বেলুনের মতো ফুলছেন হিহিহি)
দাদি: হ্যাঁ বাসরঘর সাজাতে হবে তো, কিন্তু মেঘের পছন্দ আমি জানতাম বলে কিভাবে কিভাবে সাজাতে হবে বলে দিয়েছিলাম রুহানের পছন্দ তো জানিনা। (তারমানে সেদিন বাসরঘর মেঘের পছন্দ অনুযায়ী দাদি সাজিয়েছিলেন, মেঘ আর আমার পছন্দে এতো মিল। মেঘের দিকে তাকালাম ও আমার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে যেন কোনো কিছুর জন্য মেঘ অনুশোচনায় ভোগছে)
দাদি: আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে নিচ্ছি তোরা যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে আর পপিকে জোহার রুমে নিয়ে যা এখন।
জোহা: ঠিক আছে দাদি। (জোহা পপিকে নিয়ে ওর রুমের দিকে চলে গেল, আমিও রুমের দিকে পা বাড়ালাম)

ফ্রেশ হয়ে এসে ফোনটা হাতে নিলাম সন্ধ্যা হয়ে আসছে অনেক কাজ বাকি তার আগে আম্মুকে ফোন করা প্রয়োজন। আম্মুকে ফোন দিতেই রিসিভ করলেন।
আম্মু: আমাকে ভুলে গেলি।
আমি: না আম্মু একটু বিজি ছিলাম তাই…
আম্মু: হয়েছে হয়েছে বড় হয়ে গেছ তো বিজি তো থাকবাই। পড়াশুনা চলছে নাকি শশুড় বাড়িতে লক্ষী বৌমা সেজে বসে আছ? (সত্যি তো পড়াশোনার প্রতি তো একদম সময় দিচ্ছি না)
আম্মু: পরীক্ষা কিন্তু সামনে আমি মনে করিয়ে দিলাম।
আমি: তুমি টেনশন করোনা তো আমি ঠিক সামলে নিবো।
আম্মু: আমার ছোট মেয়েটা এখন বড় হয়ে গেছে এখন সবার সাহস জোগাতে পারে। (হ্যাঁ আম্মু আমি সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছি, আব্বুকে হারানোর যন্ত্রণায় রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনা, মেঘের অবহেলায় আমি একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছি কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনা আমি সত্যি অনেক বড় হয়ে গেছি আম্মু। আমি আর তোমার সেই ছোট্ট কণা নেই)
আম্মু: কণা কথা বলছিস না কেন?
আমি: বলতেছি তো আম্মু।
আম্মু: খুনির কোনো খুঁজ পেলি?
আমি: না তবে চিন্তা করোনা খুব তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো।
আম্মু: ওহ! (বেশ বুঝতে পারছি আম্মু কাঁদছেন, চুপচাপ ফোনটা কেটে দিলাম)

আম্মুকে ইচ্ছে করেই বলিনি আমি যে খুনী কে জানতে পেরেছি। বললে আম্মু দেশে আসতে চাইতেন তাই…
মেঘ: কণা তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছ..(বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম মেঘ আসাতে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম)
মেঘ: তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: নাতো।
মেঘ: মিথ্যে বলোনা কণা প্লিজ।
আমি: আব্বুর কথা মনে পড়ছে তাই।
মেঘ: শুধু কি তাই? (মেঘের চোখের দিকে তাকালাম কিভাবে বুঝাই ওকে, ওর অবহেলা গুলো যে আর নিতে পারছি না আমি)
মেঘ: বলো আমাকে কি হয়েছে? (মেঘ দুহাত দিয়ে আমার দুগালে ধরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: তোমাকে বলে কি হবে তুমি তো আমাকে বুঝই না। ছাড়ো আমাকে আ…
মেঘ: ছাড়বো না। (মেঘ আমাকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো, আমিও তো চাই ওর এই বুকে মাথা রেখে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে কিন্তু মেঘ.. একবার আমাকে চায় তো একবার শায়লাকে চায়)
আমি: ছাড়ো বলছি।
মেঘ: চেষ্টা করোনা কারণ আমি না ছাড়লে তুমি কখনো যেতে পারবে না।
আমি: কেন করো আমার সাথে এরকম। (মেঘকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম, ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো)
কতোক্ষণ মেঘ আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল বলতে পারবো না, চোখ বন্ধ করে ওর বুকের সাথে মিশে ছিলাম। আচমকা মেঘ আমাকে ছেড়ে দিলো।
মেঘ: আজ তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।
আমি: কি সারপ্রাইজ?
মেঘ: পাগলী সারপ্রাইজ আগে থেকে বলে দেয় নাকি। (মেঘ হনহন করে চলে গেল কিছুই বুঝতে পারলাম না কিসের সারপ্রাইজ দিবে)

পপি আর রুহানের বিয়ের খুশিতে মা আজ রাতের জন্য অনেক খাবার রান্না করছেন সাথে আমি মাকে হেল্প করছি।
মা: বৌমা তোমার আর রান্না করতে হবে না শরীরের যা অবস্থা করেছ যাও গোসল করে নাও।
আমি: আগে কখনো রান্না করিনি তো তাই একটু সমস্যা হচ্ছে।
মা: হ্যাঁ গলায় গালে ময়দা লাগানো হাতের কি অবস্থা করেছ পাগলী মেয়ে যাও গোসল করে নাও, মেঘ যদি দেখে ওর বউকে দিয়ে আমি রান্না করিয়ে বউয়ের এই হাল করেছি তাহলে তো রেগে যাবে।
আমি: কেন আমি কি বসে বসে খাওয়ার জন্য এসেছি নাকি? বউরা রান্না করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে খাবে এটাই তো নিয়ম। (মা আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন)
আমি: কি হলো মা?
মা: একদম লক্ষী বৌমার মতো কথা গুলো বলেছ। একদিন ঠিক এভাবেই মেহমান এসেছিল রান্না করতে রাত হয়ে গিয়েছিল, তোমার মতোই শায়লা টুকটাক কাজ করেছিল। পরে রুমে গিয়ে মেঘের সামনে কান্নাকাটি করে বলেছে বাবার বাড়িতে এর আগে কখনো এতো কাজ করেনি আর আমার ছেলেটা রেগে গিয়ে বাড়ির সবাইকে বকেছিল।
আমি: ভয় নেই মা মেঘ আমাকে এতোটা ভালোবাসে না তাছাড়া আমি এমন কোনো কাজ করবো না যেন আমার জন্য এই পরিবারের কেউ ছোট হয় আর আপনি তো মা।
মা: হয়েছে পাকনা বুড়ি এবার থেকে পড়াশুনোয় মন দাও কাজ করতে হবে না। তোমার মা ফোন করে বলেছেন তোমাকে শাসন করতে।
আমি: আম্মু কখন ফোন করেছিলেন?
মা: সকালবেলায়।
জোহা: আপু নাও তোমার মেয়েকে উফফ এতো দুষ্টু।
তোহা: আমি যাবো না পঁচা মেয়ের কাছে। (তোহার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম আমার মেয়ে আমার কাছে আসতে চাইছে না উল্টো জোহার গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে)
আমি: কেন আমি কি করেছি মামুনি?
তোহা: তুমি আজ একবারো আমাকে কোলে নাওনি। (সত্যি তো এতো জামেলার মধ্যে মেয়েটাকে একটু আদরও করা হয়নি)
আমি: আম্মু ফ্রেশ হয়ে এসেই তোমাকে কোলে নিবো। (রুমের দিকে পা বাড়াতেই কলিংবেল বেজে উঠলো আমিই দরজা খুলতে আসলাম)

দরজা খুলে আগে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম রাত সাড়ে আটটা বাজে আর এখন শায়লা এসেছে এই বাসায়।
আমি: এতো রাতে তুমি?
শায়লা: তোহাকে দেখতে এসেছি মেয়েটার জন্য মন কেমন করছিল।
আমি: তোমার আবার মনও আছে নাকি আর শর্তের কথা ভুলে গিয়েছ নাকি?
শায়লা: ভুলিনি শুধু একবার ওকে দেখে চলে যাবো। (শায়লা আমাকে ঠেলে ভিতরে চলে আসলো)
আমি: শুধু দেখবে কোলে নিতে পারবে না।
জোহা: আপু আমি আছি তো তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
আমি: না আগে ও এ বাসা থেকে বের হবে তারপর আমি রুমে যাবো।
শায়লা: এতো রাতে আমি ফিরে যেতে পারবো না।
মা: মানে তুমি এই বাসায় থাকবে নাকি? (শায়লা কিছু না বলে চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসে রইলো। এই মেয়ে তোহাকে দেখতে এসেছে এই কথা তো একফোঁটাও সত্য না তাহলে কেন এসেছে ও কি মতলব ওর)
আমি: শায়লা তুমি এক্ষণি বের হও।
শায়লা: উকিলের কাছে গিয়েছিলাম উকিল বলেছে আমি চাইলেই তোহাকে আমার কাছে নিয়ে যেতে পারবো। (ফল কাটার চাকুটা হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছে আর নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে শুরু করলো কি বলছে এসব ও? সত্যি কি উকিল এই কথা বলেছে)
শায়লা: কিন্তু আমি তোহাকে নিবো না কারণ তোহা তোমার কাছেই ভালো থাকবে তবে হ্যাঁ তার বিনিময়ে আমাকে কিছু দিতে হবে।
আমি: কি চাও তুমি?
শায়লা: সেটা নাহয় হিসেব করে পরে বলবো। ভয় নেই আমি এখানেই আছি তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো আর হ্যাঁ মেঘকে বলো আমি এসেছি। (মা আমাকে ইশারা দিয়ে রুমে চলে যেতে বললেন চুপচাপ রুমের দিকে চলে আসলাম)

রুমে ঢুকতেই দেখি মেঘ আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে ওর হাসি দেখে রাগ আরো বেড়ে গেল।
মেঘ: বাব্বাহ্ পরী আজ এতো রেগে আছে কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: তুমি বোধহয় আর কখনো রান্নাঘরের ধারেকাছে যাওনি।
আমি: এতো বকবক করো নাতো তোমার শায়লা এসেছে ওর কাছে যাও।
মেঘ: শায়লা এই সময়? (ওর কথার উত্তর না দিয়ে গোসল করার জন্য বাতরুমে চলে আসলাম)

গোসল করে রুমে আসতেই বিছানায় চোখ পড়লো বেগুনী রঙের একটা শাড়ি রাখা সাথে ছোট একটা চিরকুট। “শাড়িটা পড়ে নিও” চিরকুট সহ শাড়িটা ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দিলাম। এতো নাটক করে কিভাবে ও ভাবতেই পারছি না।

নিচে আসতেই মেঘ আমার দিকে রাগি চোখে তাকালো। বাহ্ মেঘ আর শায়লা পাশাপাশি বসে আছে কোথায় আমি রাগ দেখাবো উল্টো ও রেগে আছে। মেঘের দিকে আর তাকালাম না মায়ের কাছে রান্নাঘরে চলে গেলাম।
মা: পপি আর রুহান এসেছে?
আমি: হ্যাঁ সবাই আছে ড্রয়িংরুমে।
মা: খাবার গুলো টেবিলে নিয়ে যাও।
আমি: হুম।
মা: বৌমা কি হয়েছে?
আমি: কিছু নাতো।
মা: শায়লা এসেছে বলে মন খারাপ করে রেখেছ?
আমি: মেঘ শায়লাকে ভালোবাসে তাছাড়া এ বাড়িতে ওদের মেয়ে আছে শায়লা তো আসবেই। আমি কে রাগ করার?
মা: জানিতো মেঘের উপর অভিমান করে আছ। (মায়ের কথার কোনো জবাব দিলাম না, অভিমান কার উপর করবো যে আমাকে ভালোই বাসে না)

খাওয়া দাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে গেল, আমি পপিকে নিয়ে রুহানের রুমে আসলাম। পুরো রুম খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। দাদী বুড়ো হলেও পছন্দ আছে বলতে হয়। পপিকে খাটে বসিয়ে দিয়ে রুহানের পাশে এসে দাঁড়ালাম রুহান চুপচাপ সোফায় বসে আছে।
আমি: রুহান…
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: ক্ষমা করে দিও আমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইনি কিন্তু এছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পপি তোমাকে ভালোবেসে দিনের পর দিন কষ্ট পাচ্ছে তাছাড়া তুমি যা চাইছ তা সম্ভব না তাই এই কাজ করতে হলো। আজ হয়তো পপিকে মেনে নিবে না কিন্তু একদিন ঠিক মেনে নিবে। আর তুমি তো আমাকে ভালোবাসতে এবার থেকে নাহয় সবটুকু ভালোবাসা পপিকে দেওয়ার চেষ্টা করো।
রুহান: তোমার কথা শেষ হলে আসতে পারো।
পপি: ভাবি কাকে কি বুঝাচ্ছ ও তোমার কথার কিছুই বুঝবে না উল্টো অপমান করবে।
আমি: সমস্যা নেই একটু অপমানিত হলাম নাহয়।
রুহান: আমার মাথা ঠিক নেই তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না প্লিজ তুমি চলে যাও।
আমি: হ্যাঁ চলে যাচ্ছি তোমার কাছে শুধু একটা অনুরোধ আমি যে কষ্টের আগুনে পুড়ছি সে আগুনে পপিকে পুড়তে দিওনা।
চোখের পানি মুছতে মুছতে চলে আসলাম ওদের রুম থেকে। স্বামী অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবাসে এইটা নিজ চোখে দেখতে হয় এইটা বোধহয় একটি মেয়ের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট। আমি আর পপি দুজনই এই একি কষ্টে ভুগছি।

রুমে এসে দেখি মেঘ শাড়িটা হাতে নিয়ে বসে আছে তোহা তো বিছানায় নেই।
আমি: তোহা কোথায়?
মেঘ: জোহা নিয়ে গেল বললো ওর কাছেই থাকবে।
আমি: ওহ।
মেঘ: কোথায় যাচ্ছ?
আমি: তোহার কাছে।
মেঘ: দাঁড়াও বলছি। (মেঘ এসে আমার হাত ধরে ফেললো)
আমি: কি হচ্ছে এসব?
মেঘ: জোহা নিয়ে গেছে এখন তুমি নিয়ে আসতে গেলে জোহা কি ভাববে?
আমি: ঠিক আছে যাবো না হাত ছাড়ো।
মেঘ: খাবে না? তখন তো তোহাকে খাইয়ে দিয়েছ তুমি খাওনি।
আমি: খিদে নেই।
মেঘ: শাড়িটা পড়লে না?
আমি: শায়লা তো পাশের রুমেই আছে ওকে গিয়ে দিয়ে এসো পড়ে দেখাবে তোমাকে। (মেঘ আমার গালে ঠাস করে থাপ্পড় মারলো, গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম)
মেঘ: নিজে গিয়ে তোমার জন্য শাড়ি এনেছি আর তুমি শায়লাকে দিতে বলছ?
আমি: হ্যাঁ বলছি একদম চিৎকার করবা না বলে দিলাম।
মেঘ: কণা তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।
আমি: সীমা তো ছাড়িয়ে যাচ্ছ তুমি, ঘরে এক স্ত্রী থাকা অবস্থায় প্রাক্তন স্ত্রীকে বাসায় আসতে দিচ্ছ থাকতে দিচ্ছ আমার সাথেও সময় কাটাচ্ছ শায়লার সাথেও সময় কাটাচ্ছ। পেয়েছ কি তুমি আমাকে যা খুশি করবে আর আমি মেনে নিবো।
মেঘ: আমি শায়লাকে আসতে বলিনি।
আমি: তাহলে ওকে বাসা থেকে বের করে দাওনি কেন নাকি রাতে ওর কাছে…
মেঘ: কণা…(মেঘ আমার দুগালে অনেক গুলো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো)
আমি: মেরে ফেলো আমাকে আর পারছি না এসব সহ্য করতে। নিজের স্বামীকে অন্য মেয়ের সাথে দেখার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
মেঘ: চলো আমার সাথে।
আমি: আমার হাত ছাড়ো কোথাও যাবো না আমি। (মেঘকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। বাতরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম)
মেঘ: কণা প্লিজ দরজা খুলো উল্টাপাল্টা কিছু করো না। বিশ্বাস করো আমি শায়লাকে ভালোবাসি না আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।

মেঘ এখনো ডাকছে আর দরজায় ধাক্কাচ্ছে ওর ডাকে সাড়া না দিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে ভিজতে থাকলাম। এই শাওয়ারের পানিই নাহয় আমার চোখের পানি গুলোকে ধুয়ে দিয়ে যাক। আর পারছি না খুব কষ্ট হচ্ছে আস্তে আস্তে শাওয়ারের নিচে বসে পড়লাম, পাগলের মতো কাঁদছি হয়তো এই কান্না আমার কষ্ট গুলোকে কিছুটা হলেও হালকা করে দিবে…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ১০

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ১০

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ কপালে হাত দিয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, করতে চাইলাম কি আর হলো কি। তাড়াতাড়ি মেঘ’কে ধরে বিছানায় বসালাম।
আমি: সরি আমি এমনটা চাইনি।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: দেখি হাতটা সরাও।
মেঘ: লাগবে না ব্যান্ডেজ করা।
আমি: লাগবে না নাকি আমি করে দিচ্ছি বলে… (মেঘ আমার হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো)
আমি: দিবো না ব্যান্ডেজ করে যাও তোমার শায়লাকে গিয়ে বলো ব্যান্ডেজ করে দিতে।
মেঘ: আবার বলছ।
আমি: একশ একবার বলবো।
মেঘ ব্যান্ডেজ না করেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল আমিও বারান্দায় চলে আসলাম। সত্যি আমি এমনটা চাইনি খুব কষ্ট হচ্ছে এখন। মেঘ তাল সামলাতে না পেরে এভাবে পরে গিয়ে এতোটা আঘাত পাবে আমি ভাবতেও পারিনি।
পপি: ভাবি তোহা… একি তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: কোথায় নাতো। (মেঘকে কষ্ট দিয়ে আমিও যে কখন নিজের অজান্তে কেঁদে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি, পপি আসাতে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম)
পপি: ভাইয়ার কপালে কি হয়েছে?
আমি: (নিশ্চুপ)
পপি: তোমরা কি ঝগড়া করেছ?
আমি: হু।
পপি: আরে মন খারাপ করো না এসব দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়া কিছু করতে হয়।
আমি: তোমারও তো মন খারাপ।
পপি: এসব বাদ দাও। (হেসে উঠলো পপি, কষ্ট লুকিয়ে রেখে হাসাটা সত্যি খুব যন্ত্রণার। রুহান যে কবে পপির ভালোবাসা বুঝবে)
পপি: আসছি আমি। (পপি তোহাকে রেখে চলে গেল। তোহা রুম থেকে কিছু খেলনা নিয়ে এসে বারান্দায় খেলতে বসে পড়লো)
কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না শায়লা কিভাবে জানলো তোহার নামে সবকিছু দিয়েছি। সেদিন তো আব্বু আর আমি ছাড়া আব্বুর রুমে অন্য কেউ ছিল না যে শুনবে। নাকি রুমের বাইরে থেকে কেউ শুনেছে? মেঘ শুনেনি তো? সেদিন একমাত্র মেঘই তখন আব্বুর রুমের দিকে গিয়েছিল কিন্তু মেঘ শুনলে শায়লাকে বলতে যাবে কেন? তবে কি মেঘ শায়লা দুজন মিলে আমাকে নিয়ে খেলছে? সম্পত্তি পেয়ে গেলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে শায়লাকে মেঘ আবারো বিয়ে করবে এটাই কি ওদের প্ল্যান? উফফফ সবকিছু কেমন যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে।
তোহা: নতুন আম্মু তোমার ফোন। (তোহার ডাকে ভাবনায় ছ্যাদ পড়লো ও ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ফোনের রিংটোন বাজছিল শুনতেই পাইনি। ফোন হাতে নিয়ে দেখি অচেনা নাম্বার)
আমি: হ্যালো।
–শায়লা বলছি তুমি মেঘকে এভাবে…
আমি: মেঘ কোথায়?
শায়লা: আমার কাছেই আছে।
আমি: আমি ওর মাথায় আঘাত করেছি এবার তুমি ব্যান্ডেজ করে দাও যত্তোসব।
শায়লা: হ্যাঁ দিবো তো, তুমি আর কখনো এমন করবে না বুঝেছ?
আমি: ফোনটা মেঘ’কে দাও। (শায়লা রাগে গজগজ করতে করতে ফোনটা মেঘের হাতে দিলো)
মেঘ: হ্যালো ক…
আমি: এক্ষণি বাসায় এসো।
মেঘ: কণা আমি অফিসে।
কণা: অফিস তোমার নাকি আমার? যা হবে তা আমি বুঝবো তুমি এক্ষণি এসো।
মেঘ: হুম।
মেঘ ফোন রেখে দিলো। সাহস কতো বড় আমি ব্যান্ডেজ করে দিতে চেয়েছি করেনি চলে গেছে শায়লার কাছে। আগে তো শুধু কপাল কেটেছে এখন ওর পুরো মাথা ফাটাবো।

রুহান: আম্মু তুমি এসব কি বলছ আমি কণাকে সত্যি ভালোবাসি। (রুহানের রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ রুহানের কথা শুনে থমকে দাঁড়ালাম)
চাঁচি: হ্যাঁ সেটা আমিও জানি তাইতো বলছি তু…
রুহান: তুমি যা করছ তা ঠিক না আম্মু।
চাঁচি: তুই কি কণাকে তোর করে চাস না?
রুহান: হ্যাঁ চাই কিন্তু তাই বলে এভাবে?
চাঁচি: ভালোবাসায় একটু জোড় খাটাতে হয় বুঝেছিস গাধা।
রুহান: কিন্তু…
চাঁচি: তুই একটু পাগলামি কর দেখবি সবাই মেনে নিবে তাছাড়া মেঘ তো কণাকে মেনে নেয়নি তুই চাইলেই মেঘ কণাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।
রুহান: তাতো বুঝলাম কিন্তু তুমি কণাকে আমার বউ বানানোর জন্য এতো…
চাঁচি: এসব তোর এই গোবরের মাথায় ঢুকবে না। যা বলেছি তাই কর। (চাঁচি এদিকেই আসছেন বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি সরে গেলাম, চাঁচি রুহানকে কি করতে বললেন কিছুই তো বুঝতে পারলাম না। আর আমাকে রুহানের বউ বানিয়ে চাঁচির কি লাভ)
মেঘ: ওহ তুমি এখানে? এতো তাড়াতাড়ি আসতে বললে যে? (এমনিতেই টেনশনে আছি তার উপর মেঘ এর কপালে সুন্দর করে ব্যান্ডেজ করা দেখে রাগ মাথায় ছড়ে বসলো। ওর শার্টের কলার চেপে ধরে ওকে টেনে রুমে নিয়ে আসলাম)

মেঘ’কে খাটে বসিয়ে টেনে হিছড়ে ওর কপালের ব্যান্ডেজ খুলে ফেললাম।
আমি: শায়লাকে দিয়ে ব্যান্ডেজ করানো হয়েছে আমার হাতে ব্যান্ডেজ ভালো লাগে না… (মেঘ আমাকে টান দিয়ে শুয়ে দিলো বিছানায়, আমার উপর শুয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দুচোখের দিকে। মেঘের এমন চাহনি দেখে খুব অসস্থি হচ্ছে)
মেঘ: আল্লাহ্‌ যেন প্রত্যেকটা ছেলের জীবনে এমন গুন্ডি বউ দেন। (মেঘ মিটিমিটি হাসছে ওর কথার অর্থ বুঝতে একটু সময় লাগলেও বুঝে ফেলেছি একটু আগে ওর শার্টের কলার এভাবে ধরাতে এই কথা বলছে, লজ্জা পেয়ে ওর দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেললাম)
মেঘ: মেঘের কণা লজ্জা পেলে যে এতোটা সুন্দর লাগে আগে তো দেখিনি… (মেঘ আমার নাক টেনে দিলো, ও আমার এতোটা কাছে আছে ভাবতেই মনে অন্যরকম এক শিহরণ জেগে উঠলো। আবারো ওর চোখের দিকে তাকালাম)

কতক্ষণ মেঘের চোখের গভীরতায় ডুবে ছিলাম ঠিক বলতে পারবো না, মেঘের এক আঙ্গুল আমার গলায় খেলা করছে বুঝতে পেরে ওকে তাড়াতাড়ি ঠেলে সরিয়ে দিলাম।
মেঘ: এইটা কি হলো?
আমি: শায়লা তোমার কপালে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে কথাটা ভুলে যাইনি। (উঠে চলে আসতে চাইলাম মেঘ আমার কোমরে ধরে টান দিয়ে বসিয়ে দিলো। আমার পিছনে বসে চুলে নাক ঘষতে শুরু করলো)
মেঘ: ব্যান্ডেজটা অফিসে যাওয়ার সময় ফার্মেসি থেকে করিয়েছি, শায়লা আমাকে এতটুকুও স্পর্শ করেনি।
আমি: কথাটা কতটুকু সত্যি?
মেঘ: যতটুকু সত্যি তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা।
আমি: তাহলে তো বিন্দু পরিমাণও সত্যি না কারণ তুমি আমাকে ভালোবাস না।
মেঘ: তাই?
আমি: আরে কি করছ?
মেঘ: কণা আমি তোমাকে আমার করে পেতে চাই। (মেঘ আমার পেটে ওর হাত দিয়ে খেলা করছিল, ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে আমি দূরে এসে বসলাম)
আমি: শায়লাকে যদি চিরতরে তোমার জীবন থেকে সরাতে পারো তবেই আমাকে পাবে নাহলে ভাববো তুমি আমাকে নিয়ে খেলা করছ। (মেঘ চুপচাপ বসে আছে দেখে রুম থেকে বেরুনোর জন্য পা বাড়ালাম পরক্ষণেই মেঘকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, ফিরে আসলাম ওর কাছে)
আমি: আচ্ছা মেঘ শায়লা যে তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইছে ওর স্বামী কোথায়? তুমি তো বলেছিলে শায়লা ওর প্রেমিকের কাছে ফিরে গেছে তাহলে এখন আবার তাকে রেখে তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইছে কেন?
মেঘ: শায়লা তো বললো ওদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।
আমি: কেন হলো?
মেঘ: বললো তো সামান্য ঝগড়াঝাঁটি নিয়ে।
আমি: শায়লা বললো আর তুমি বিশ্বাস করে ফেললে? ভেবে দেখেছ ছয় মাসের ছোট বাচ্চাকে ফেলে যে শায়লা চলে গিয়েছিল তার প্রেমিকের কাছে তাদের কেন সামান্য ঝগড়াঝাঁটি থেকে ডিভোর্স হবে? আচ্ছা আদৌ কি ওদের ডিভোর্স হয়েছে নাকি ওরা তোমাকে কোনো কারণে বোকা বানাচ্ছে? (মেঘ চিন্তিত হয়ে বসে আছে, ভাবো মেঘ শায়লা সত্যি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইছে কিনা। আমার তো মনে হচ্ছে শায়লা কোনো চালাকি করছে। শায়লাকে পরে দেখছি আগে জানতে হবে চাঁচি রুহানকে কি শিখিয়ে দিয়েছে)

ড্রয়িংরুমে এসে দেখি দাদি আর রুহানের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে, দাদি রেগে গিয়ে রুহানকে একটা থাপ্পড় মারলেন। রুহান গালে হাত দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
দাদি: আগেই বলেছিলাম কণাকে ভুলে যা ওকে শান্তিতে সংসার করতে দে।
রুহান: ভাইয়া তো কণাকে ভালোবাসে না তাহলে ডিভোর্স দিতে সমস্যা কোথায়? আমি তো বলেছি কণাকে আমি বিয়ে করার পরও কণা তোহার মা হয়েই থাকবে আমি কিছু বলবো না তাছাড়া তোহা তো আমার মেয়ের মতোই।
দাদি: আবার তুই ডিভোর্স এর কথা বলছিস? তোকে তো আমি এই বাসা থেকেই বের করে দিবো।
রুহান: বাসা থেকে বের করতে হবে না আমি এই পৃথিবী ছেড়েই চলে যাবো আমি সুইসাইড করবো।
আমি: রুহান দাঁড়াও।
দূর রুহান রাগ করে রুমে চলে গেল। তারমানে বেশি বেশি পাগলামি করার কথা চাঁচি রুহানকে বলে দিয়েছে। কিন্তু এতে চাঁচির লাভ কি? চাঁচির প্ল্যান কি?

চাঁচি: তোমাকে আমি বলেছিলাম এই মেয়ের জীবন থেকে মেঘ’কে সরানোর জন্য যা যা করতে হয় তাই করো কিন্তু তুমি কি করছ… (চাঁচির সাথে কথা বলার জন্য উনার রুমের দিকে এসেছিলাম কিন্তু উনি ফোনে কথা বলছেন শুনে রুমের বাইরে থমকে দাঁড়ালাম। ফোনের অপর পাশ থেকে কে কথা বলছে বা কি কথা বলছে কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না তাহলে বুঝবো কিভাবে)
চাঁচি: আমি খুব তাড়াতাড়ি ওদের ডিভোর্স চাই বুঝেছ? তোমার যা করতে হয় করো শুধু মেঘ কণাকে আমি আলাদা দেখতে চাই। (দেখাচ্ছি তোমাকে মেঘ কণা কতোটা আলাদা, আমাকে চিনো নাই তোমার সব প্ল্যানে আমি জল ঢেলে দিবো)
চাঁচি: আচ্ছা তুমি আমাকে একটা কথা বলতো শায়লা, কণার বাবা সবকিছু তোহার নামে উইল করে দিয়েছে এই কথাটা তোমাকে জানিয়ে আমার কি লাভ হলো? তুমি কণার বাবাকে খুন করালে কিন্তু মেঘ’কে তো ফাঁসাতে পারলে না, মেঘ আর কণা তো এখনো একসাথেই আছে। (চাঁচির মুখে কথাগুলো শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, তারমানে আমার ধারণাই ঠিক শায়লা করছে এসব। কিন্তু চাঁচি কিভাবে শায়লাকে হেল্প করছে এতোটা খারাপ উনি আর চাঁচি আব্বু আর আমার কথা শুনলো কিভাবে? তাহলে কি সেদিন রুমের বাইরে চাঁচি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল? উফফ সবকিছু কেমন উলটপালট হয়ে যাচ্ছে)

রুমে এসে চুপচাপ বসে রইলাম, কি করবো এখন আমি চাঁচিকে পুলিশে দিবো?কিন্তু এতে তো এই পরিবারের সম্মান যাবে আর এই পরিবারের সম্মান যাওয়া মানে বাবা আবারো আঘাত পাবেন স্টোকও করতে পারেন। আব্বুকে হারিয়েছি এখন বাবার মতো শশুড়কে হারাতে পারবো না। তাড়াতাড়ি বাবার রুমের দিকে দৌড় দিলাম।

বাবাকে সবকিছু খুলে বললাম, উনি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলেন।
আমি: এখন কি করবো বাবা?
বাবা: আর যাই করো মা ওকে পুলিশে দিওনা আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে।
আমি: হুম আমি উনাকে ক্ষমা করতে পারি একটা শর্তে।
বাবা: কি শর্ত?
আমি: শায়লা যে আব্বুকে খুন করিয়েছে এই সাক্ষী উনাকে দিতে হবে।
বাবা: অপরাধী কি কখনো নিজের অপরাধ স্বীকার করে তাছাড়া শায়লা তো রুহানের মাকেও মেরে ফেলতে পারে।
আমি: আপাতত কোনো সাক্ষী দিতে হবে না আমি প্রমাণ জোগাড় করি তারপর নাহয়…
বাবা: আমি ভাবছি রুহান এসব শুনলে ছেলেটা কতোটা কষ্ট পাবে। নিজের মায়ের সম্পর্কে এমন কথা কোনো সন্তানই শুনতে চায় না। (ওর মায়ের এই একটা ভুলই তো আমি কাজে লাগাবো বাবা, এই ভুলটাই হবে রুহান আর পপিকে এক করার অস্ত্র)
আমি: শায়লার ব্যাপার আমি পরে দেখছি আগে আপনি আমাকে একটা কথা বলুন তো।
বাবা: কি কথা মা?
আমি: যদি কখনো অনেক বড় অন্যায় করে ফেলি আমি তখন কি আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন? (বাবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলেন)
বাবা: রায়হান কখনো কোনো অন্যায় কাজ করেনি যাই করেছে কারো না কারো ভালোর জন্যই করেছে তাই তোমার উপরেও আমার বিশ্বাস আছে মা, রায়হানের মেয়েও কোনো অন্যায় করবে না যা করবে কারো ভালোর জন্যই করবে। (মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম। বাবার শেষ কথাটায় অনেক ভরসা পেলাম। এবার আমি আমার কাজ শুরু করতে পারবো)

রুহানের রুমে আসলাম ও জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে আছে, ওর পাশে এসে দাঁড়ালাম।
আমি: রুহান জানো তো মানুষ সবসময় যা চায় তা কিন্তু পায় না। তবে এইটাও সত্যি যা চেয়েও পাওনি তারচেয়ে ভালো কিছু একদিন ঠিক পাবে। তেমনি তুমি যেমন আমাকে পাওনি বলে কষ্ট পাচ্ছ একদিন ঠিক এমন কেউ তোমার জীবনে আসবে যে আমাকে ভুলিয়ে দিবে তোমার মন থেকে। তার ভালোবাসায় তখন তোমার মনে হবে…
রুহান: আমি তোমার কাছে জ্ঞান চেয়েছি?
আমি: জ্ঞান দিতে আসিনি আমি, এসেছি একটা সত্য কথা জানাতে।
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: কথাটা শুনার পর হয়তো তুমি আমার সব কথা শুনবে।
রুহান: মানে?
আমি: তোমার আম্মু আমার আব্বুর খুনের সাথে জড়িত আছেন এখন তুমি ভাবো নিজের মাকে কিভাবে বাঁচাবে।
রুহান: কি বলছ এসব?
আমি: বিশ্বাস নাহলে তোমার আম্মুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো অবশ্য উনি স্বীকার নাও করতে পারেন, অপরাধী তো নিজের অন্যায় নিজে স্বীকার করে না যতোক্ষণ না পর্যন্ত পুলিশ…
রুহান: আম্মু এতোটা নিচে নামতে পারেন আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
আমি: এটাই সত্যি রুহান, এখন তুমি বলো উনাকে পুলিশে দিবো নাকি…
রুহান: কণা প্লিজ আম্মুকে মাফ করে দাও।
আমি: হুম কিন্তু শর্ত আছে।
রুহান: আমি তোমার সব শর্তে রাজি শুধু আম্মুকে পুলিশে দিওনা। আম্মু জেলে গেলে এই পরিবারের সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে তাছাড়া চাচ্চু আবারো স্টোক…
আমি: বাবার কথা ভেবেই আমি উনাকে মাফ করবো ভেবেছি নাহলে তো…
রুহান: প্লিজ তুমি রেগে যেও না। তুমি যা বলবে তাই আমি শুনবো।
আমি: তাহলে চলো আমার সাথে।
রুহান: কোথায়?
আমি: প্রশ্ন না করলেই ভালো হবে।

রুহান চুপচাপ আমার সাথে আসলো। পপি আর জোহা একটু বাইরে গিয়েছে, ওদের মেসেজ করে কাজী অফিসে আসতে বললাম।
রুহান: ড্রাইভার এদিকে কোথায় যাচ্ছ?
আমি: শপিংমলে।
রুহান: কিন্তু কেন?
আমি: উফফ রুহান তুমি না বড্ড বেশি কথা বলো। (রুহান চুপচাপ বসে রইলো)

একটা বেনারসি আর একটা পাঞ্জাবী আর কিছু গয়নাগাটি কিনলাম।
রুহান: এসব কিসের জন্য?
আমি: আবার কথা বলছ?
রুহান: (নিশ্চুপ)
আমি: চলো।

রুহানকে নিয়ে কাজী অফিসে আসলাম, জোহা আর পপি দাঁড়িয়ে আছে। জোহার হাতে বেনারসি আর গয়না গুলো দিলাম।
আমি: পপিকে সাজিয়ে নিয়ে আয়।
পপি: মামামানে?
আমি: যাও আর রুহান এই পাঞ্জাবীটা পড়ে এসো। (এতোক্ষণে রুহান বুঝতে পেরেছে আমি কি করতে চলেছি)
রুহান: কণা কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
আমি: শর্তের কথা ভুলে গেছ?
রুহান: না তবে পপি কখনো আমার ভালোবাসা পাবে না কথাটা মনে রেখো।
আমি: এইটা পপির উপর ছেড়ে দাও ওর ভালোবাসার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, একদিন ঠিক ও তোমার ভালোবাসা জয় করে নিবে। রুহান রাগে গজগজ করতে করতে পাঞ্জাবীটা হাতে নিয়ে চলে গেল।

রুহান আর পপির বিয়েটা দিয়ে দিলাম, জানিনা কতোটা ঠিক কাজ করেছি তবে মনে হচ্ছে একটি মেয়ের এতো বছরের ভালোবাসা আজ সার্থক হয়েছে।
জোহা: আপু বিয়ে তো হয়ে গেল কিন্তু বাসায় গিয়ে কি বলবে?
আমি: আগে বাসায় তো চল।
জোহা: চলো।
সারা রাস্তা রুহান কারো সাথে কোনো কথা বললো না আর পপি তো ভয়ে আছে বাসার সবাই মানবে কিনা তাছাড়া রুহান ওকে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দিবে কিনা।

বাসায় এসে কলিংবেল চাপতেই মা এসে দরজা খুলে দিলেন, রুহানকে বর সাজে আর পপিকে কনে সাজে দেখে উনি হা হয়ে তাকিয়ে আছেন।
আমি: মা নতুন বর বউকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন নাকি?
মা: এসব তুমি কি বলছ?
আমি: ভিতরে এসে বলি? (মা সরে গেলেন ভিতরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম সবাই)
মা: এসব কি বৌমা?
আমি: পপি রুহানকে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসে তাই ওদের বিয়ে দিলাম।
চাঁচি: বিয়েটা কি তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হয়? (চাঁচি উপর থেকে নেমে আসতে আসতে চিৎকার করে বললেন, উনার চেঁচামেচিতে সবাই ড্রয়িংরুমে আসতে শুরু করলো)
রুহান: চুপ করো মা, শুধুমাত্র তোমার একটা ভুলের জন্য আজ আমায় এই রাস্তা বেছে নিতে হলো।
রুহান মাথার পাগড়ী ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুমে চলে গেল। আমায় মাফ করে দিও রুহান, পপির ভালোবাসার জন্য তোমাকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করতে হলো তবে হ্যাঁ আমার বিশ্বাস একদিন তুমি আমাকে এই কাজের জন্য ধন্যবাদ দিবে। চাঁচি রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে উনার পাশে এসে দাঁড়ালাম। সবার চোখের আড়ালে উনার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম “কেমন দিলাম চাঁচি শাশুড়ি? মেঘ আর আমাকে আলাদা করে নিজের ছেলের বউ করতে চেয়েছিলেন, দিলাম তো আপনার প্ল্যানে জল ঢেলে”

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৯

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৯

লেখিকা: সুলতানা তমা

তোহা: ছাড়ো আমাকে।
শায়লা: না মা তুমি আমার…
তোহা: ছাড়ো বলছি। (তোহা শায়লার বুকে কিল দিতে শুরু করলো, শায়লা ওকে ছেড়ে দিলো। তোহা দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলো, আমার পাশে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিলো)
তোহা: আর কেঁদো না।
আমি: মামুনি। (তোহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম)
শায়লা: এসব কি হচ্ছে?
পপি: আমরা তোহাকে ভাবির হাতে তুলে দিয়েছি এখন ভাবিই তোহার মা বুঝেছ?
শায়লা: তাহলে আমি কে? তোমাদের কি মনে হয় আমি এসব মেনে নিবো। (শায়লা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে তোহাকে কোলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম)
শায়লা: এই মেয়ে শুনো একদম আমার মেয়ের দিকে নজর দিবা না।
তোহা: তুমি পঁচা দূরে যাও বলছি।
শায়লা: তোমার কারণে আমার মেয়ে আমাকে পঁচা বলেছে। তোমাকে… (শায়লা আমাকে থাপ্পড় দিতে আসছিল পিছন থেকে কে যেন ওর হাত ধরে ফেলেছে, পিছনে তাকিয়ে দেখি রুহান। হসপিটাল থেকে সবাই চলে এসেছে)
রুহান: কণার গায়ে হাত দিতে চাইলে হাত ভেঙ্গে ফেলবো। তোমার সাহস হয় কি করে এই বাসায় ঢুকার?
শায়লা: এইটা আমার স্বামীর বাসা।
রুহান: আসছে স্বামীর বাসা বলতে। ডিভোর্স দেওয়ার সময় মনে ছিল না এখন স্বামী বলো কেন লজ্জা করেনা?
শায়লা: না করেনা কারণ আমি মেঘ’কে ভালোবাসি, ফিরে আসতে চাই ওর কাছে।
মা: তুমি বললেই হবে নাকি?
বাবা: শায়লা তোমাকে তো ফোনে আমি বলেছি তুমি তোহাকে ছাড়া যা চাইবে তাই দিবো তার পরও তুমি জামেলা কেন করছ বলতো?
শায়লা: আমি তো আপনাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছি আমার মেঘ কণা দুজনকেই চাই। (এখন বুঝেছি আব্বু কেন তোহাকে নিয়ে এতো টেনশন করছেন। শায়লা আব্বুকে ভয় দেখিয়েছে। ওদের জামেলা আর ভালো লাগছে না, ওদের ঝগড়াঝাঁটির মাঝেই শায়লার চোখের আড়ালে তোহাকে নিয়ে রুমে চলে আসলাম)

মেঘ এখনো মাতালের মতো ঘুমুচ্ছে ইচ্ছে হচ্ছে ওকে…
আমি: মেঘ উঠনা প্লিজ। (মেঘের চোখেমুখে পানির ছিটা দিলাম কিন্তু ও উঠার নাম নেই। আর ও উঠেই বা কি হবে ভালোবাসে তো শায়লাকে)
নিচ থেকে শায়লার চেঁচামেচি শুনা যাচ্ছে আমি রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম, করুক ওরা ঝগড়া তোহা আমার কাছে থাকলেই হবে। কিছুক্ষণ পর নিচ থেকে আর কোনো শব্দ ভেসে আসলো না মনে হয় শায়লা চলে গেছে। এবারের মতো তো বাচঁলাম কিন্তু পরে যদি তোহাকে নিয়ে যায় আমি কিভাবে আটকাবো?

তোহাকে আমার পাশে বসিয়ে রাখলাম পুতুল নিয়ে খেলছে ও আর আমি ভাবছি শায়লা হঠাৎ ফিরে আসলো কেন। যে ছয় মাসের ছোট বাচ্চা ফেলে চলে গিয়েছিল আর এতো বছরে তোহাকে নিতে আসেনি সে কি হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়া ফিরে এসেছে নাকি কোনো কারণ আছে? কোনো কারণ থাকলে কি সে কারণ?
অনেক ভেবে একটাই কারণ ফেলাম শায়লা হয়তো কোনো ভাবে জানতে পেরেছে তোহার নামে সবকিছু দিয়ে দিয়েছি। উফফফ আগে জানলে এই ভুল করতাম না, তোহাকে কতোটা ভালোবাসি মেঘ’কে এইটা বুঝাতে গিয়ে তোহার জন্য বিপদ ডেকে এনেছি সাথে নিজেরও। আমার তো মনে হচ্ছে এই সম্পত্তির জন্যই আব্বুকে খুন করা হয়েছে, কিন্তু খুন করালো কে?
জোহা: আপু আসবো?
আমি: হুম আয়।
জোহা: ভাইয়া এখনো ঘুমুচ্ছে?
আমি: ড্রিংক করলে যা হয়।
জোহা: আপু আমার এসব জামেলা আর ভালো লাগছে না।
আমি: আমার কি ভালো লাগছে? ভুল তো সব আমি করেছি এখন হারে হারে টের পাচ্ছি।
জোহা: তুমি কি ভুল করলে?
আমি: প্রথম ভুল মেঘ’কে বিয়ে করা দ্বিতীয় ভুল তোহার নামে সবকিছুর উইল করা। আমার তো এখন মনে হচ্ছে আমার ভুলের কারণে আব্বুকে জীবন দিতে হয়েছে।
জোহা: চাচ্চুকে খুন করে খুনির কি লাভ হলো?
আমি: তোহার আঠারো বছর হবার আগে পর্যন্ত সবকিছু আব্বু দেখাশুনা করবেন এটাই উইলে লেখা ছিল, যে খুন করেছে তার লাভ তোহার আঠারো বছর হওয়া পর্যন্ত সবকিছু সে লুটপাট করে খেতে পারবে আর পরে তোহার থেকে সব কেড়ে নিবে।
জোহা: এই লাভ কার হতে পারে এইটা খুঁজো তাহলেই তো খুনি কে জানতে পারবে।
আমি: লাভ এখানে তিনজনের, মেঘ, শায়লা আর রুহান। কিন্তু আমার মনে হয় না মেঘ আর রুহান এমন কাজ করবে।
জোহা: তাহলে শায়লা, এই মহিলা যা খারাপ ওর পক্ষে খুন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আমি: কিন্তু আমি ভাবছি শায়লা আব্বুকে খুন করাবে কেন? সম্পত্তির জন্য? উইল এর কথা তো আমি আর আব্বু ছাড়া কেউ জানতো না তাহলে শায়লা জানলো কিভাবে?
জোহা: জেনেছে আপু কোনোভাবে নাহলে হুট করে মেয়ের জন্য এতো ভালোবাসা দেখাতো না।
আমি: ভুল যেহেতু আমি করেছি শুধরেও নাহয় আমিই নিবো। খুব তাড়াতাড়ি আমি নতুন উইল করবো আর এই উইল এমনভাবে তৈরি করবো না তোহার জন্য বিপদ আসবে না আমার জন্য।
জোহা: তোহার জন্য তুমি এতোকিছু করছ কিন্তু ভাইয়া তো তোমাকে ভালোই বাসে না।
আমি: ও আমাকে কখনো ভালোবাসবে এই কথা তো বিয়ের সময় ছিল না, তোহা আমার কাছে থাকলেই হবে।
জোহা: শুধু তোহাকে নিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিবে? ভাইয়া তো শায়লাকে এখনো ভালোবাসে।
আমি: (মৃদু হাসলাম)
জোহা: আপু তুমি হাসছ?
আমি: এছাড়া কি করার আছে?
জোহা: আপু তুমি নিজেকে শক্ত করো প্লিজ।
আমি: হুম।
জোহা কিছুক্ষণ মন খারাপ করে বসে থেকে রুমে চলে গেল। সত্যি এখন আমাকে শক্ত হতে হবে তোহাকে তো আমার কাছে রাখবো সাথে আব্বুর খুনি কে খুঁজে বের করবো।

তোহাকে কোলে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মেঘ সারাদিন ঘুমিয়েই কাটালো জানিনা কতোটুক ছাইপাঁশ খেয়েছিল। এমন একজন কে বিয়ে করলাম যার সব ধরণের বাজে অভ্যাস আছে আর শায়লার মতো খারাপ মেয়েকে ভালোও বাসে আবার।
মেঘ: কণা, তোহা কোথায় তোমরা?
আমি: এখানে। (উঠেছে আজ তো ওর সাথে আমি ভালো ভাবেই বুঝাপড়া করবো)
তোহা: নতুন আম্মু আব্বু এতো পঁচা কেন?
আমি: ছিঃ আম্মু এসব বলতে নেই।
তোহা: তাহলে তোমাকে কাঁদায় কেন?
আমি: কোথায় আম্মু কাঁদি নাতো আর কেন কাঁদবো তুমি তো আমার কাছেই আছ।
তোহা: যদি দুষ্টু মেয়েটা আমাকে নিয়ে যায়।
আমি: নিতে দিবো নাতো। (তোহা দুহাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো, ছোট মেয়েটাও ভয় পায় এখন)
মেঘ: কণা?
আমি: কি?
মেঘ: (চুপচাপ আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। তোহার গালে হাত দিয়ে আদর করতে চাইলো তোহা হাত সরিয়ে দিলো)
তোহা: তোমরা সব পঁচা তোমরা খুব দুষ্টু।
মেঘ: আমার মামুনি এতো রেগে আছে কেন?
আমি: চোখের সামনে বাবার খারাপ অভ্যাস গুলো দেখছে তো তাই।
মেঘ: মানে?
আমি: ড্রিংক করে মাতালের মতো বাসায় ফিরেছ, শায়লা এসে তোহাকে নিয়ে টানাটানি করে গেছে, সবকিছু তো মেয়েটার চোখের সামনেই ঘটছে। তোমার কি মনে হয় এসবের প্রভাব ছোট মেয়েটার উপর পরছে না?
মেঘ: শায়লা এসেছিল?
আমি: অবাক হওয়ার তো কিছু নেই তুমি শায়লাকে ভালোবাস তাই সে অধিকার ফলাতে এসেছিল। শুনো মেঘ যদি আর কখনো ড্রিংক করে বাসায় এসেছ আর তোহা এসব দেখেছে তাহলে কিন্তু আমি তোহাকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে চলে যাবো।
মেঘ: শায়লা চলে গেছে?
আমি: নাহ তোমার জন্য বাসর সাজিয়ে বসে অপেক্ষা করছে যাও ওর কাছে।
মেঘ: এভাবে কথা বলছ কেন?
আমি: তোমার মতো মানুষের সাথে এরচেয়ে ভালোভাবে কথা বলা যায়না।
মেঘ: কি করেছি?
আমি: কিছুনা তুমি তো ধোয়া তুলসী পাতা। এই শুনো তুমি শায়লাকে ফিরিয়ে আনো বা যা খুশি করো তোহাকে যদি আমার থেকে দূরে নেওয়ার চেষ্টাও করেছ তাহলে কিন্তু আমি তোমাদের সবাইকে জেলে দিবো, ভুলে যেওনা বিয়েটা তোহার জন্যই হয়েছে আর সেটা সেদিন যারা উপস্থিত ছিল সবাই জানে।
মেঘ: কণা আ…
আমি: তোমার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার যাওনা যাও তোমার শায়লার কাছে যাও। (মেঘ চুপচাপ রুমে চলে গেল, ওকে এভাবেই শাস্তি দিতে হবে)
মেঘ চলে যেতেই উকিল চাচ্চুকে ফোন দিলাম, সবকিছু ঠিকঠাক করে মেঘ আর শায়লাকে বুঝাবো।
চাচ্চু: হ্যালো কণা।
আমি: হ্যাঁ চাচ্চু কেমন আছ?
চাচ্চু: ভালো তুমি ভালো আছ তো মা।
আমি: হ্যাঁ, চাচ্চু নতুন করে একটা উইল করতে হবে।
চাচ্চু: কদিন আগেই তো তোমার বাবা করলেন।
আমি: আবার নতুন করে করতে হবে।
চাচ্চু: কিন্তু কিছুদিন সময় লাগবে।
আমি: যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি করে দাও আমি তোমার কাছে আসতে পারবো না সবকিছু মেসেজে বলে দিচ্ছি।
চাচ্চু: ঠিক আছে আমি তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করছি।

ফোন রেখে রুমে এসে দেখি মেঘ সোফায় মাথা নুয়ে বসে আছে।
আমি: তোমার শায়লাকে কাল একবার বাসায় আসতে বলো। (মেঘকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তোহাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলাম)

তোহাকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছি বাবা এসে আমার পাশের চেয়ারটা টান দিয়ে বসলেন, কিছু বলতে চাইছেন মনে হয়।
আমি: বাবা কিছু বলবেন?
বাবা: অপদার্থটা কোথায়?
আমি: (নিশ্চুপ)
বাবা: কতোবার বিয়ের কথা বললাম করলো না, ও নাকি দুনিয়ার সব মেয়েকে ঘৃণা করে। আর এখন নিজের ঘরে এমন ভালো একটা বউ রেখে আবারো সেই ডাইনীর পিছনে ছুটছে।
আমি: বাদ দিন না বাবা এসব।
বাবা: রায়হানের এমন মৃত্যু আমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছে জানিনা সামনে আর কি কি হবে।
আমি: কিছু হবে না বাবা আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।
বাবা: একটা কথা বলবো মা শায়লার হঠাৎ ফিরে আসাটা আমার ভালো লাগছে না।
আমি: কারণটা আমি খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করবো বাবা আপনি শুধু সকালের অপেক্ষা করুন।
বাবা: সকালে কি করবে?
আমি: যা হয় তাতো দেখতেই পারবেন।

তোহাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছি ঘুম আসছে না চটপট করছি শুধু, ওদিকে মেঘও চটপট করছে। মেঘ তোহাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো আমার হাতের উপর ওর হাত পড়তেই হাত সরিয়ে নিলো। পাশ ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মেঘ, ডিম লাইটের আলোতে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছি সেটা।
মেঘ: কণা..
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কথা বলবে না?
আমি: সকালে বলবো শায়লা যখন সামনে থাকবে।
মেঘ: সবকিছুতে শায়লাকে টানছ কেন?
আমি: কারণ তুমি শায়লাকে ভালোবাস।
মেঘ: আমি শায়লাকে ভালোবাসি না।
আমি: নেশার ঘোরে মানুষ সত্যি কথাই বলে।
মেঘ: মানে?
আমি: ড্রিংক করে এসে তুমি বলেছ তুমি শায়লাকে ভালোবাস এদিকে আমি থাকায় তুমি দুটানায় পরে গেছ।
মেঘ: এসব কখন বললাম এসব মিথ্যে।
আমি: হয়েছে আর একটা কথাও নয়। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা করো।
মেঘ: হুম।
মেঘ চুপ হয়ে গেল, চিন্তা করোনা মেঘ তোমাকে আমি এখন থেকে এতো অবহেলা করবো যে তুমি মাতাল অবস্থায় নয় নিজের মুখে সজ্ঞানে স্বীকার করবে কাকে ভালোবাস আমাকে নাকি শায়লাকে।

আজ সকালটা অন্যরকম লাগছে কারণ সবাই একসাথে বসে নাশতা করছে অন্যান্য দিন বাবা থাকেন না কখনো কখনো মেঘ আর রুহানও থাকে না। কলিংবেল এর শব্দ শুনেই সবাই দরজার দিকে তাকালো।
বাবা: নাশতা খাওয়ার বারোটা বেজে গেছে।
দাদি: এই সকালবেলা কে আসলো।
আমি: মেঘ যাও তোমার শায়লা এসেছে ভিতরে নিয়ে এসো।
মেঘ: আমার শায়লা মানে…
মা: এই বজ্জাত মেয়ে আবার আসলো কেন? (মেঘ আমার দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে দরজা খুলতে গেল)
আমি: পপি তোমার আর তোহার নাশতা নিয়ে রুমে চলে যাও তোহাকেও খাইয়ে দিও।
পপি: ঠিক আছে ভাবি।
শায়লা: আমার তোহা কোথায়?
আমি: আরাম করে সোফাটায় বসো আর আমাদেরও শান্তিতে নাশতা করতে দাও।

নাশতা শেষে সবকিছু গুছাতে গুছাতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললাম…
আমি: বাবা আমি আব্বুর খুনি কে তা জানতে পেরেছি। (আড়চোখে শায়লার দিকে তাকালাম ও চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
জোহা: কি বলছ আপু তাহলে পুলিশে দিচ্ছ না কেন?
আমি: আমার হাতে কিছু প্রমাণ আছে আরো কিছু প্রমাণ ফেলেই পুলিশে ধরিয়ে দিবো। (সত্যি বলতে তো আমার হাতে শায়লার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই যদি থাকতো তাহলে তো ওকে আমি ফাঁসিতে ঝোলাতাম)
বাবা: কণা মা…
আমি: যে কথা বলতে আমি সবাইকে এখানে ডেকেছি তা হলো তোহা আমার কাছে থাকবে ওকে আমার থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলে আমি সবাইকে পুলিশে দিবো।
মা: কি?
আমি: অবাক হওয়ার কিছু নেই আপনারাই তোহার জন্য আমাকে বিয়েতে জোর করেছিলেন এখন ওকে কেড়ে নিবেন আমি চুপচাপ বসে থাকবো এতোটা ভালো মেয়ে আমি নই।
দাদি: একদম ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই।
আমি: মেঘ যেহেতু আব্বুর বিশ্বস্ত লোক ছিল সবকিছুর দেখাশুনা ও করবে।
শায়লা: সত্যি? তাহলে আমিও মেঘের সাথে তোমার অফিসে কাজ করবো। (শায়লার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক দেখে সবাই খুব অবাক হলো। আমাকে তো চিনো না শায়লা তোমার সব মতলব আমি ধরে ফেলেছি)
আমি: করতেই পারো তবে প্রতিমাসে আমাকে সবকিছুর হিসেব দিতে হবে আর যদি হিসেবে কোনো গড়মিল থাকে তাহলে মেঘ আর তোমাকে আমি জেলে দিতে দ্বিধা করবো না।
শায়লা: কোনো গড়মিল হবে না। (শায়লা হয়তো ভাবছে অফিস সামলানোর কথা বলে সবকিছু নিয়ে নিবে ও তো আর জানেনা নতুন উইল আমি কিভাবে তৈরি করছি)
আমি: সম্পত্তি তো আর কম না যথেষ্ট সম্পত্তি তাই সবকিছু মেঘ’কে দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে আমি তোহার দায়িত্ব নিচ্ছি। আর মেঘ যেহেতু শায়লাকে এখনো ভালোবাসে তাই ও কখনো আমার আর তোহার ধারেকাছে আসতে পারবে না।
মেঘ: মানে?
আমি: আশা করি আবার বুঝাতে হবে না।
মা: তোমার কথা আমরা সবাই শুনবো কেন?
আমি: জেলে যেতে না চাইলে শুনতে হবে।
বাবা: আমি কণার কথায় রাজি। (বাবা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলেন তারমানে বাবা সব বুঝে ফেলেছেন)
আমি: শায়লা এবার তুমি আসতে পারো।
শায়লা: আমি কাল থেকে তোমার অফিসে জয়েন করছি তো?
আমি: হ্যাঁ।

একে একে সবাই ড্রয়িংরুম থেকে চলে গেল আমিও চলে আসতে চাইলাম তখনি বাবা পিছন থেকে ডাক দিলেন।
বাবা: বুদ্ধিটা কিন্তু দারুণ।
আমি: (মুচকি হাসলাম)
বাবা: শায়লা সম্পত্তির লোভে তোমার অফিসে কাজ করবে আর ততদিনে তুমি প্রমাণ জোগাড় করে ফেলবে অন্যদিকে তোহার থেকে শায়লাকে দূরে রাখা হবে। মেঘ’কে অবহেলা করছ যেন খুব তাড়াতাড়ি ও বুঝতে পারে কাকে ও ভালোবাসে শায়লাকে নাকি তোমাকে? তাছাড়া মেঘ’কে দিয়েই সম্পত্তি দেখাশোনা করাবে কারণ তোমার সবকিছু তো মেঘেরই। আমার বিশ্বাস মা মেঘ ঠিক তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারবে।
আমি: আমার কাজটা শুধু আপনিই বুঝতে পারলেন মা তো রেগে গেলেন।
বাবা: ওসব ঠিক হয়ে যাবে সবাই একদিন তোমাকে বুঝবে।
মৃদু হেসে রুমে চলে আসলাম।

আমি রুমে আসা মাত্রই মেঘ আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।
আমি: কি হচ্ছে এসব?
মেঘ: আগে তুমি বলো তুমি কি করছ এসব কেন করছ?
আমি: কি করেছি?
মেঘ: সবকিছুর দেখাশোনা নাহয় আমিই করবো কিন্তু তোমার আর তোহার থেকে দূরে থাকবো কেন?
আমি: কারণ তুমি শায়লাকে ভালোবাস। অন্য কাউকে ভালোবাস তারপরও…
মেঘ: কতোবার বলবো আমি শায়লাকে ভালোবাসি না।
আমি: কাকে ভালোবাস?
মেঘ: তোম…
আমি: থেমে গেলে কেন?
মেঘ: আমি তোমাকে ভালোবাসি শুনেছ তুমি।
আমি: বিশ্বাস করি না তাছাড়া আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না।
মেঘ: ভালোবাস না?
আমি: মেঘ লাগছে আমার হাতে।
মেঘ: লাগুক বলো ভালোবাস কিনা।
আমি: আমার মুখ থেকে পরে শুনো আগে নিজেকে প্রশ্ন করো কাকে ভালোবাসে তোমার মন। একবার আমাকে ভালোবাস বলবে আবার শায়লাকে ভালোবাস বলবে আমি তো এসব মেনে নিবো না। তাছাড়া আমি…
মেঘ: চুপ আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
আমি: একবার আমি একবার শায়লা এসব কি মেঘ?
আমি: বললাম তো আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি।
মেঘ আমার কপালে ওর কপাল ঠেকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের এমন দুরকম রূপ সত্যি আর নিতে পারছি না, ওকে অবহেলা করা প্রয়োজন। অবহেলা থেকেই ও সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝতে পারবে, জোড়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম ওকে তাল সামলাতে না পেরে মেঘ টেবিলের উপর গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। মাথা তুলে মেঘ আমার দিকে তাকাতেই দেখি কপাল কেটে প্রচুর রক্ত পড়ছে।

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৮

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৮

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ আমার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। আমার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
মেঘ: দেখতো কণা আমাকে দেখে কি খুনি মনে হয়?
আমি: খুনি কি কখনো গায়ে লিখে বেড়ায় যে আমি খুনি আমি খুনি?
মেঘ: তুমি অযতা আমাকে সন্দেহ করছ যখন সত্যিটা জানতে পারবে তখন নিজেই অনুশোচনায় ভুগবে।
আমি: তোমাকে পুলিশে দেওয়া উচিত তাহলেই সব সত্যি বেরিয়ে আসবে।
মেঘ: কাকে ফোন করছ?
আমি: পুলিশকে।
মেঘ: ফোন দাও বলছি। (মেঘ আমার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো)
মেঘ: রাগের মাথায় কোনো কাজ করতে নেই কণা পরে পস্তাতে হয়।
কণা: আমি তো ভুল কিছু করছি না।
মেঘ: তুমি ভুলই করছ। চোখের সামনে প্রমাণ দেখেই আমাকে সন্দেহ করছ একবার ভেবে দেখেছ এসবের আড়ালেও কোনো সত্যি থাকতে পারে।
আমি: মানে?
মেঘ: মানে খুব সহজ, এই ফোন থেকে আমার ফোনে কখনো কল আসেনি আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। (মেঘের কথা শুনে ফোনে থাকা মেঘের নাম্বারটা ভালো করে দেখলাম। শুধু ডায়াল লিস্টেই নাম্বারটা আছে তাছাড়া এই নাম্বারে ফোন দিয়ে কখনো কথা বলেনি কল দিয়েই কেটে দিয়েছে কিন্তু এমন ভাবে রেখেছে যেন দেখেই মনে হয় এই ফোন দিয়ে মেঘকে বারবার কল করা হয়েছে। তারমানে যে আসল খুনি সে মেঘকে ফাঁসানোর জন্য ইচ্ছে করেই মেঘের নাম্বারটা ডায়াল লিস্টে রেখে দিয়েছে আর ফোনটাও আমাদের বাসায় ইচ্ছে করেই ফেলে গেছে যেন আমি মেঘকে সন্দেহ করি)
মেঘ: কি হলো কণা?
আমি: তোমাকে ফাঁসানোর জন্যই কেউ এমনটা করেছে।
মেঘ: তাতো আমিও বুঝতে পারছি কিন্তু কে করবে এই কাজ।
আমি: রুহান হবে হয়তো।
মেঘ: মানে? কণা ও আমার ভাই হয়।
আমি: ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে মেঘ, তোমাকে আমার জীবন থেকে সরানোর জন্যই হয়তো রুহান এমন করেছে।
মেঘ: আমি বিশ্বাস করিনা আমার ভাই আর যাই করুক কাউকে খুন করার মতো জঘন্য কাজ করতে পারে না।
আমি: সেটা তো আস্তে আস্তে প্রমাণ হয়েই যাবে।
মেঘ: হ্যাঁ করো প্রমাণ। (মেঘ রাগ দেখিয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লো)
যতোই রাগ দেখাও মেঘ সত্যিটা তো আমি খুঁজে বের করবোই আর খুনি যদি হয় রুহান তাহলে তো ওকে আমি বুঝিয়ে দিবো ভালোবাসা কি।

দুদিন পর…

আজ আম্মুরা কানাডা চলে যাবে এয়ারপোর্ট এসেছি আম্মুদের সাথে। মধ্যে যে কিভাবে দুটু দিন কেটে গেল। আম্মুকে নিয়ে ভয় হচ্ছে যদি আম্মুকেও আব্বুর মতো… না না আম্মু কানাডা চলে যাওয়াই ভালো। কষ্ট তো হচ্ছে একটাই আব্বুর খুনি কে তা এখনো জানতে পারলাম না।
আম্মু: কণা তোর কোনো অসুবিধা হবে নাতো?
আমি: না আম্মু তুমি নিশ্চিন্তে যাও আর জোহা তো আমার কাছে আছেই।
চাচ্চু: একা বাসায় থাকবি না কিন্তু এখান থেকে সোজা তোর শশুড় বাড়ি চলে যাবি। ভয় হচ্ছে তোকে রেখে যেতে সম্ভব হলে তোকেও নিয়ে যেতাম কিন্তু তোর তো এখন বিয়ে…
আমি: আমাকে নিয়ে টেনশন করো না আম্মুকে দেখে রেখো।
চাঁচিআম্মু: তোর আম্মুর চিন্তা করিস না আমরা আছি তো।
চাচ্চু: আসছি মা।
আম্মু পিছন ফিরে বারবার আমাকে দেখছেন আর চোখের পানি মুচ্ছেন। নিয়তি আমাদের এমন জায়গায় এনে দাঁড় করাবে কখনো ভাবিনি, সত্যি নিয়তি খুব কঠিন।

জোহাকে নিয়ে মেঘদের বাসায় চলে আসলাম, বাসার দরজা খুলা কিন্তু কাউকে তো দেখতে পারছি না।
মেঘ: আশ্চর্য সবাই কোথায়?
আমি: দরজা খুলা অথচ কেউ…
পপি: ও তোমরা চলে এসেছ।
মেঘ: বাসার সবাই কোথায়রে পপি?
পপি: আব্বু অসুস্থ সবাই হসপিটালে আছে।
মেঘ: মানে কি হয়েছে আব্বুর? আমাকে জানালি না কেন?
পপি: আজ সকালে আব্বু হঠাৎ করেই স্ট্রোক করেন, তোমাদের অনেক বার ফোন করেছি কিন্তু দুজনের মোবাইলই বন্ধ। (তাড়াতাড়ি আমার মোবাইল দেখলাম সত্যি বন্ধ হয়ে আছে চার্জ নেই মনে হয়)
মেঘ: সকালে আব্বু স্ট্রোক করেছেন আর আমি এই সন্ধ্যাবেলায় জানতে পারলাম।
আমি: মেঘ কথা না বাড়িয়ে হসপিটালে চলো।
মেঘ: হ্যাঁ চলো।
আমি: জোহা তুই বাসায় থাক পপি আছে আর তোহাকে রেখে দাও পপি।
তোহা: আমি যাবো।
আমি: না মামুনি আম্মু চলে আসবো কিছুক্ষণ পর।
তোহাকে রেখে মেঘ আর আমি বেরিয়ে পড়লাম।

হসপিটালে বাবার কাছে বসে আছি, বাবা ঘুমিয়ে আছেন। সবাই এখানে কিন্তু মেঘ বারবার কেবিনের বাইরে যাচ্ছে আবার ভিতরে আসছে, চটপট করছে শুধু।
মা: কিরে মেঘ কি হয়েছে এমন চটপট করছিস কেন?
মেঘ: কিছুনা আম্মু আসছি একটু। (মেঘ বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি কোথায় গেল এভাবে)
আমি: মা হঠাৎ করে বাবার স্ট্রোক হলো কিভাবে?
মা: বুঝতে পারছি নারে মা।
দাদি: এইতো আহসানুল এর ঘুম ভেঙ্গেছে।
বাবা: কণা তুমি কখন আসলে?
আমি: এইতো কিছুক্ষণ আগে। আপনার কি হয়েছে হঠা…
বাবা: তোমাকে আমি বলতে পারবো না শুধু এইটুকু অনুরোধ তোহাকে তুমি আগলে রেখো।
আমি: তোহা তো আমার কাছেই আছে বাবা ওকে নিয়ে টেনশন করছেন কেন?
বাবা: কারণ আছে মা। (কি এমন হলো হঠাৎ বাবা তোহাকে নিয়ে টেনশন করছেন যার ফলে উনি স্ট্রোক পর্যন্ত করলেন)
দাদি: কণা তোরা বাসায় চলে যা রাতে থাকার প্রয়োজন নেই।
আমি: ঠিক আছে।
মা: মেঘ কোথায় দেখো তো।
আমি: আছে হয়তো বাইরে আমরা আসছি।
মা: ঠিক আছে।

কেবিনের বাইরে তো মেঘ’কে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না গেল কোথায়? হঠাৎ একটু দূরে বারান্দায় চোখ পড়লো, মেঘ একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে। কথা বলছে বললে ভুল হবে মনে তো হচ্ছে কথা কাটাকাটি করছে। কে এই মেয়ে? ওদের কাছে যাবো কিনা ভাবতে ভাবতেই মেঘ আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
মেঘ: চলো।
আমি: হুম।

মেঘ ড্রাইভ করছে বারবার ওকে আড়চোখে দেখছি, খুব টেনশনে আছে মনে হচ্ছে।
আমি: কি হয়েছে?
মেঘ: কিছু নাতো।
আমি: মেয়েটি কে ছিল?
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
মেঘ চুপ হয়ে আছে তাই আর কথা বাড়ালাম না।

রাতের খাবার খেয়ে রুমে আসলাম মেঘকে দেখতে পারছি না, রাতের খাবারো খেলো না। বারান্দার দরজা খুলা দেখে বারান্দার দিকে আসলাম। মেঘ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে সিগারেট ছিল আমাকে দেখেই ফেলে দিলো। ওর পাশে এসে দাঁড়াতেই আচমকা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি।
মেঘ: কণা আমি কখনো তোমার জীবনে যদি না থাকি আমার তোহাকে তুমি দেখে রেখো।
আমি: মানে?
মেঘ: কিছুনা। (মেঘ আমার চুল গুলো মুঠো করে ধরে কপালে চুমু খেলো, ওর এমন আচরণে খুব অবাক হলাম)
মেঘ: তুমি আমাকে ভালোবাস কিন্তু বুঝতে দাওনা কেন?
আমি: কে বললো ভালোবাসি?
মেঘ: বাসো তো আমি জানি কিন্ত আমি…
আমি: আরে কাঁদছ কেন?
মেঘ: একটু চুপ হয়ে আমার বুকের সাথে মিশে থাকো প্লিজ। (মেঘ আবারো আমাকে জড়িয়ে ধরলো, বুঝতেই পারছি না কি হলো ওর। বাবা আর মেঘ দুজনই তোহাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে কেন সেটাও বুঝতে পারছি না)
অনেক্ষণ পর মেঘ আমাকে ছেড়ে দিলো তারপর কোলে তুলে নিলো।
আমি: কি করছ?
মেঘ: আর কখনো তোমাকে এভাবে ভালোবাসতে পারবো না আজকে একটু ভালোবাসতে দাও।

মেঘ আমাকে এনে বিছানায় শুয়ে দিলো হা হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে, এসব পাগলামি কেন করছে ও?
মেঘ: তোহাকে পপির কাছে দিয়ে আসি…
আমি: এই খবরদার আমার মেয়েকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করোনা।
মেঘ: এতো ভালোবাস কেন তোহাকে?
আমি: প্রত্যেক মা’ই তার সন্তানকে এভাবে ভালোবাসে।
মেঘ: হুহ।
আমি: কি করছ?
মেঘ: বলেছি তো চুপ হয়ে থাকো আজ তোমাকে অনেক ভালোবাসবো।
আমি: কি হয়েছে তোমার হঠা… (মেঘ আমার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে কথা বলতে নিষেধ করলো। বুঝতে পারছি না ও কি হুশে আছে নাকি নেশাটেশা করেছে)
মেঘ মাতালের মতো আমার ঠোঁট চুষছে ছাড়াতে চাইলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরছে। সত্যি আমি বুঝতে পারছি না মেঘ হঠাৎ করে এমন কেন করছে।

আচমকা মেঘ আমাকে ছেড়ে দিলো তারপর আমার কপালে আলতো করে একটা চুমু খেলো।
মেঘ: ঘুমিয়ে পড়ো আসছি আমি। (মেঘ মুচকি হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেল)
আমি: আরে এতো রাতে কোথায় যাচ্ছ? (মেঘের পিছু পিছু বাসার বাইরে আসলাম, ওর কাছে আসার আগেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। কোথায় গেল এতো রাতে কিছুই বুঝতে পারছি না)

সকাল দশটা বাজে মেঘ এখনো বাসায় ফেরেনি। সারারাত চটপট করেছি ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে।
পপি: ভাবি আর কতক্ষণ এভাবে বসে বসে অপেক্ষা করবে?
আমি: কি করবো বলতে পারো?
জোহা: ভাইয়ার কোনো বন্ধুর বাসায় যায়নি তো?
পপি: আমি তো সবাইকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া কোথাও নেই। আম্মুকে ফোন করে বলি।
আমি: পাগল হয়েছ আব্বুকে নিয়েই তো সবাই টেনশনে আছে এখন আবার… (কলিংবেল বেজে উঠলো দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললাম। মেঘ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ দুটু লাল হয়ে আছে)
আমি: কোথায় ছিলে তুমি?
মেঘ: সরো। (মেঘ ভিতরে আসতে চাইলো কিন্তু হাটতে পারছে না, মুখ থেকে গন্ধ আসছে তারমানে মেঘ ড্রিংক করেছে)
আমি: তুমি ড্রিংক করেছ?
পপি: ভাইয়া তো এসব ছেড়ে দিয়েছিল। এখন আবা…
আমি: আগে ড্রিংক করতো মেঘ?
পপি: হ্যাঁ শায়লা ভাবি চলে যাওয়ার পর অনেকদিন এসব ছাইপাঁশ খেয়েছে কিন্তু এখন কেন খেলো বুঝতে পারছি না।
আমি: রুমে চলো।
মেঘকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে আসলাম বেশিই ড্রিংক করেছে হাটতেই পারছে না।

খাটে এনে বসাতেই মেঘ ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো সাথে আমাকেও টান দিয়ে ওর বুকে শুয়ে দিলো।
আমি: ছাড়ো আমাকে কি গন্ধ ছিঃ মেঘ এসব মানুষে খায়? দূর কাকে কি বলছি ও তো নেশার ঘোরে আছে। (মেঘের হাত আমার কোমর থেকে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসলাম। ওর শার্ট জুতো খুলে দিয়ে ভালোভাবে শুয়ে দিলাম, বিঘোরে ঘুমুচ্ছে ও। উঠে চলে আসতে চাইলাম মেঘ আমার এক হাত ধরে রেখেছে দেখে আবার ওর পাশে বসলাম। কি মায়াবী লাগছে ওর মুখটা, মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব কষ্ট এসে ভর করেছে ওর চোখেমুখে। মদের গন্ধের তোয়াক্কা না করে মেঘের একদম কাছে চলে আসলাম, ওর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিলাম। আমার ফোন বেজে উঠেছে দেখে ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম)

আমি: হ্যালো আম্মু।
আম্মু: কেমন আছিস মা?
আমি: এইতো তুমি ভালো আছ তো?
আম্মু: হ্যাঁ আমাকে নিয়ে তুই টেনশন করিস না। পুলিশ কি কিছু জানিয়েছে?
আমি: নাতো।
আম্মু: কিছু বুঝতে পারছি নারে মা কে আমাদের এতো বড় শত্রু তোর আব্বুকে…
আমি: কেঁদো না আম্মু সব ঠিক হয়ে যাবে আর পুলিশ তো তদন্ত করছে। (রুম থেকে মেঘের কন্ঠ ভেসে আসছে কি যেন আবোলতাবোল বলছে)
আমি: আম্মু আমি তোমাকে পরে ফোন করছি।
আম্মু: ঠিক আছে।

আম্মুর ফোন রেখে রুমে আসলাম। মেঘ চোখ বন্ধ রেখেই নেশার ঘোরে আবোলতাবোল বকছে।
মেঘ: আমি আর পারছি না দুটানায় পরে গেছি আমি। (কি বলছে মেঘ এসব কিসের দুটানা?)
আমি: মেঘ কি হয়েছে তোমার? (মেঘের পাশে বসে ওকে ধাক্কা দিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে বুকে শুয়ে দিলো)
মেঘ: আমি শায়লাকে এখনো ভালোবাসি এদিকে কণার প্রতি কেমন যেন অনুভূতি হয় আমার, মেয়েটা খুব লক্ষী মায়া জন্মে গেছে কণার প্রতি। শায়লা ফিরে আসতে চাইছে এখন আমি কি করবো আমি যে দুটানায় পরে গেছি।
মেঘের কথা শুনে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। শায়লা ফিরে আসতে চাইছে তারমানে মেঘ তোহা দুজনই আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে, তাহলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে। মেঘ এখনো আবোলতাবোল কি যেন বলে যাচ্ছে ওকে ছেড়ে দিয়ে দূরে এসে দাঁড়ালাম। কি করবো এখন আমি? কাকে নিয়ে বাঁচবো? মেঘ তো এখনো শায়লাকে ভালোবাসে তারমানে মেঘ শায়লাকেই বেছে নিবে, তাহলে আমার কি হবে? হ্যাঁ মেঘ আমার হবে না জেনেও ওকে বিয়ে করেছি কিন্তু তোহা? তোহার জন্যই তো এই বিয়ে, যদি তোহা না থাকে আমার কি হবে? উফফফ আর ভাবতে পারছি না মাথা প্রচুর ঘুরছে, আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসলাম।

টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি নিয়ে এক গ্লাস পানি ডগডগ করে খেলাম। কলিংবেল বাজছে চারপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে নিজেই এলোমেলো পায়ে দরজা খুলতে আসলাম। দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে আছি একটি মেয়ে এসেছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে খুব চেনা লাগছে মেয়েটিকে। ওহ এইটা তো সেই মেয়ে হসপিটালে মেঘ যে মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি করছিল কিন্তু এই মেয়ে বাসায় এসেছে কেন?
আমি: কাকে চাই?
–মেঘ আর তোহাকে।
আমি: আপনি কে?
–শায়লা হায়দার। (নামটা শুনে যেন আমার নিঃশ্বাস আটকে গেল, এতো তাড়াতাড়ি শায়লা ফিরে আসলো)
শায়লা: মেঘ কোথায় ওকে ডাকো আর তুমি কে? নিশ্চয় কণা।
আমি: হ্যাঁ আমি কণা।
শায়লা: তোমাকে দেখার খুব সখ ছিল। মানুষ এতো বেহায়া হয় জানতাম নাতো।
আমি: মানে?
শায়লা: এইযে মেঘের বউ বাচ্চা আছে জেনেও নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করেছ।
আমি: শুধু বাচ্চা ছিল বউ না। আর তোমাকেও আমার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল।
শায়লা: কেন?
আমি: যে ছয় মাসের একটি ফুটফুটে বাচ্চা ফেলে অন্য ছেলের হাত ধরে চলে যায় তাকে দেখার ইচ্ছে হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি?
শায়লা: একদম বাজে কথা বলবে না।
আমি: সত্যি কথা গুলোই তো বললাম।
পপি: ভাবি এভাবে কে বাইরে চিৎকার কর… (পপি শায়লাকে দেখে ভয়ে আতকে উঠলো, পপির কোলে তোহাকে দেখে শায়লা আমাকে ধাক্কা দিয়ে হাসতে হাসতে বাসার ভিতরে ঢুকে গেল)
শায়লা: তোহা মা।
পপি: তোহাকে ছুবে না তুমি বলে দিলাম।
শায়লা: আমার মেয়ে আমি যা খুশি করবো।
পপি: তখন মনে ছিল না এখন কেন ফিরে এসেছ?
শায়লা: কারণ মেঘ আমাকে এখনো ভালোবাসে।
শায়লা তোহাকে পপির কোল থেকে কেড়ে নিজের কাছে নিয়ে গেল। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে চুপ হয়ে এসব দেখছি। কি করবো এখন আমি? তোহা যে শায়লারই মেয়ে আমি জোড় করবো কিভাবে তাছাড়া মেঘ সত্যিই তো শায়লাকে এখনো ভালোবাসে। আমি কোন অধিকারে তোহাকে আমার মেয়ে বলে দাবী করবো? আমি যে তোহাকে ছাড়া সত্যি থাকতে পারবো না। শায়লা তোহাকে কোলে নিয়ে আদর করছে চুমু খাচ্ছে দেখে বুকে ব্যথা অনুভব হলো, দরজার কাছেই ফ্লোরে বসে পড়লাম। চোখ দিয়ে বৃষ্টির মতো পানি ঝরছে, আমি বোধহয় মেঘ তোহা দুজনকেই হারিয়ে ফেললাম…

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৭

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৭

লেখিকা: সুলতানা তমা

মেঘ: কণা তুমি এসব কি বলছ?
আমি: ঠিকি বলছি তুমিই আব্বুকে খুন করেছ।
মেঘ: আমি কেন স্যারকে খুন করতে যাবো?
আমি: কারণ তুমি এখনি সম্পত্তি নিজের দখলে নিতে চাইছ।
মেঘ: কিসের সম্পত্তি কি বলছ এসব।
আমি: তোহার নামে দিয়েছি সেটা তুমি জানতে পেরেছ আর তাই…
মেঘ: তোহার নামে মানে?
আমি: এখন না জানার ভাণ করছ কেন?
মেঘ: তোমার মাথা ঠিক নেই তাই ভুলভাল বকছ। আমি তোমার আব্বুকে খুন করবো কেন আমি কি এতোটাই খারাপ?
আমি: হ্যাঁ তুমি খারাপ।
মেঘ: কণা কোথায় যাচ্ছ একা যেও না।
দৌড়ে নিচে চলে আসলাম।

গাড়িতে উঠতেই মেঘ পিছু পিছু এসে গাড়িতে উঠলো।
মেঘ: আমি ড্রাইভ করছি সরো।
কণা: আমি একাই যেতে পারবো।
মেঘ: তোমার মাথা ঠিক নেই এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।
আমি: হলে হউক তাতে তোমার কি?
মেঘ: এক থাপ্পড় দিবো চুপ করে বস এখানে।
মেঘের ধমকে চুপচাপ বসে রইলাম, ও আমার হাত ধরে টান দিয়ে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো অন্য হাত দিয়ে ড্রাইভ করছে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে, আস্তে আস্তে চোখ দুটু বুজে আসলো।

চোখেমুখে পানির ছিটা পড়তেই আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম।
মেঘ: কণা আমরা চলে এসেছি ভিতরে চলো।
মেঘ: কণা আস্তে যাও পরে যাবে।
মেঘের কথার পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে ভিতরে চলে আসলাম।

সাদা কাপড়ে মোড়ানো আব্বুর নিথর দেহটা পরে আছে ড্রয়িংরুমে। আব্বুর পায়ের কাছে দফ করে বসে পড়লাম, সাদা কাপড়টায় এখানে সেখানে রক্তের ছাপ লেগে আছে। চারপাশে শুধু কান্নার আওয়াজ, উপরের রুম থেকে আম্মুর চিৎকার ভেসে আসছে। আমার চোখ দিয়ে কান্না আসছে না কেন, আমি পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি কিভাবে?
পুলিশ আঙ্গেল: কণা তুমি ভেঙে পড়ো না মা তুমি এমন করলে আমরা তদন্ত করবো কিভাবে খুনিকে ধরবো কিভাবে?
আমি: আঙ্গেল এই কাজ কে করলো?
পুলিশ: জানিনা মা তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো? (মেঘের দিকে তাকালাম আমি ওর নাম বলে দিতে পারি এই ভয় না পেয়ে উল্টো ও আমার কাছে এসে এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। ওর কাধে মাথা রেখে বসে রইলাম)
কণা: না চাচ্চু আপনারা খুঁজে দেখুন।
পুলিশ আঙ্গেল: ঠিক আছে মা। (পুলিশ চলে যেতেই মেঘ আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিলো)
মেঘ: তুমি যে আমাকে সন্দেহ করছ সেটা পুলিশকে বলনি কেন?
কণা: শুধু সন্দেহের বশে আমি তোমার গায়ে কলঙ্গের দাগ লাগাতে চাই না। পুলিশ তদন্ত করুক তখনি তো সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মেঘ: কণা আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি তাই বলে আমি এতোটা খারাপ না যে কোনো মানুষ খুন করবো।
আমি: আগে তো বলেছ প্রয়োজন হলে তুমিও খুন করতে পারো।
মেঘ: রুহান বলেছে তাই বলেছি তোমাকে হারানোর ভয়ে বলেছি। বলেছি বলে আমি স্যারকে খুন করবো ভাবছ কিভাবে? (মেঘের ফোন বেজে উঠলো ও ফোন নিয়ে দূরে চলে গেল। সত্যি বুঝতে পারছি না কাকে আমি সন্দেহ করবো)

আব্বুর থেকে একটু দূরে সোফাটায় বসে আছি আর আব্বুর নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে আছি।
চাচ্চু: কণা মা। (হঠাৎ চাচ্চুর কন্ঠ শুনে দরজার দিকে তাকালাম চাচ্চু চাঁচিআম্মা আর জোহাকে দেখে দৌড়ে ওদের কাছে গেলাম)
আমি: চাচ্চু তোমরা? (ভাই মারা গেছেন আমরা কানাডায় বসে থাকি কিভাবে বল)
জোহা: আপু। (আর বোধহয় কান্না চেপে রাখা সম্ভব না সবার কান্না দেখে জোহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম)
চাঁচিআম্মা: কণা তোর মায়ের কাছে চল।
চাচ্চু: দাড়া কণা।
আমি: বলো চাচ্চু।
চাচ্চু: তোর কি কাউকে সন্দেহ হচ্ছে।
আমি: নাতো কাকে সন্দেহ করবো? আমার মাথায় কিছুই আসছে না।
চাচ্চু: আমি দেখছি তুই ভেঙ্গে পড়িস না তোর মায়ের কাছে যা।
আমি: হুম।

সকাল হয়ে গেছে একটু পর আব্বুকে দাফন করা হবে।সারাটা রাত জোহার কোলে শুয়ে কেঁদে কেঁদেই কাটিয়ে দিয়েছি আর আম্মু তো অজ্ঞান হয়ে পরে আছেন। আমাদের এতো বড় ক্ষতি কে করলো বুঝতেই পারছি না।
রুহান: কণা… (চাঁচিআম্মার কাধে মাথা রেখে বসে ছিলাম, রুহানের ডাকে সামনে তাকালাম)
রুহান: রাতে এভাবে চলে এসেছ বাসার কাউকে কিছু না বলে…
আমি: আমার তোহা কোথায়?
রুহান: আসছে চাঁচির সাথে।
আমি: হুম।
রুহান: কণা প্লিজ তুমি ভেঙ্গে পড়ো না আমরা সবাই তো আছি।
আমি: (নিশ্চুপ)
রুহান: কণা কে করতে পারে এই কাজ কাউকে সন্দেহ হচ্ছে তোমাদের?
আমি: সবাই শুধু এই একি প্রশ্ন করছ আমি জানলে কি এখানে বসে থাকতাম? খুনিকে ধরে এনে নিজের হাতেই তো শাস্তি দিতাম। (আমার চিৎকার শুনে চাচ্চু আর মেঘ দৌড়ে আসলো)
চাচ্চু: মা কি হয়েছে?
আমি: যে আব্বুকে এতো কষ্ট দিয়ে মেরেছে তাকে ধরে এনে দাওনা চাচ্চু, আমি ওকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চাই।
চাচ্চু: এভাবে কাঁদিস না তোর কি একা কষ্ট হচ্ছে, আমার হচ্ছে না? আমারো তো ভাই। (চাচ্চু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন, মেঘ এসে আমার পাশে বসলো। আমি যতোটা কাঁদছি মেঘও কাঁদছে, নাহ মেঘ খুনি হতে পারে না আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি মেঘ আব্বুকে কতোটা ভালোবাসতো)
মেঘ: কণা এভাবে কেঁদো না প্লিজ তোমার কান্না আর সহ্য করতে পারছি না।
তোহা: নতুন আম্মু… (তোহার ডাক শুনে চমকে উঠলাম মেয়েটা দাদুর কোল থেকে নেমেই দৌড়ে আমার কাছে চলে আসলো)
আমি: মামুনি কাঁদে না এভাবে।
তোহা: তুমি কাঁদলে আমিও কাঁদবো। (তোহার আধোআধো কন্ঠে এই কথা শুনে উপস্থিত সবাই কেঁদে দিলো, বাচ্চা মেয়ে অথচ এতোটা ভালোবাসে আমাকে। মেঘ কখনো তোহাকে আমার থেকে কেড়ে নিলে আমি হয়তো মরেই যাবো)

নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি বিছানায়, পাশে জোহা, পপি, মা আর চাঁচি বসে আছেন। আব্বুর নিথর দেহটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না কাকে সন্দেহ করবো। মেঘকে সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু মেঘ কেন… আচ্ছা রুহান করেনি তো? হতেই তো পারে মেঘ’কে আমি ভালোবাসি বলে এমনটা করেছে। মেঘ’কে ফাঁসিয়ে দিয়ে আমার জীবন থেকে ওকে সরিয়ে দিলো। উফফ ভেবে পাচ্ছি না কিছু কাকে রেখে কাকে সন্দেহ করবো সত্যি ভেবে পাচ্ছি না। রুহানের কথা ভাবতে ভাবতেই রুহান আমার রুমে আসলো। আব্বুর দাফন কাজ হয়তো শেষ। একবার রুহানের সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
আমি: সবাই একটু বাইরে যাও রুহানের সাথে আমার কথা আছে। (রুহানের মা আর পপি কিছুটা অবাক হলেও বের হয়ে গেল)
রুহান: কি হয়েছে কণা?
আমি: রুহান তুমি কিছু করনি তো।
রুহান: মানে?
আমি: মেঘকে আমার জীবন থেকে সরান…
রুহান: মেঘ আমার ভাই হয় কণা তাছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসি আর ভালোবাসা কখনো খুন করা শিখায় না। হ্যাঁ আমি তোমাকে রাগের মাথায় বলেছিলাম প্রয়োজন হলে খুন করবো তাই বলে সত্যি…
আমি: ভালোবাসার জন্য মানুষ সব করতে পারে রুহান।
রুহান: কণা তোমার মাথা ঠিক নেই তাই যাকে সামনে দেখছ তাকেই সন্দেহ করছ।
আমি: বাবার নিথর হয়ে পরে থাকা লাশ দেখা মেয়েটার পক্ষে তো এটাই স্বাভাবিক।
মেঘ: কণা আসবো? (মেঘকে দেখে রুহান বেরিয়ে গেল)
মেঘ: কণা এখন…
আমি: আব্বুকে একা রেখে চলে এসেছ তাই না?
মেঘ: কেঁদো না প্লিজ এটাই তো নিয়ম।
আমি: এখন আমি কাকে আব্বু ডাকবো?
মেঘ: সব ঠিক হয়ে যাবে আর কেঁদো না।
আমি: হ্যাঁ ঠিক হবে কিন্তু আব্বু তো আর ফিরে আসবে না।
মেঘ: হুম। (মেঘ আমার পাশে শুয়ে ওর বাহুডোরে জড়িয়ে নিলো আমাকে। বাচ্চা মেয়ের মতো ওর বুকের সাথে মিশে চুপচাপ শুয়ে রইলাম)

পপি: ভাবি উঠো তোহা কাঁদছে। (পপির ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো, মেঘ কখন উঠে চলে গেছে বুঝতে পারিনি। রাত বোধহয় অনেক হয়েছে, অনেক সময় ঘুমিয়েছি)
পপি: তোমাকে ডাকতাম না ভাবি কিন্তু তোহা কাঁদছে খুব তোমার কাছে আসার জন্য।
আমি: হুম দাও ওকে। (তোহাকে এনে আমার বুকের উপর শুয়ে দিলাম, মেয়েটা নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে)
পপি: ভাবি কিছু খেয়ে নাও।
আমি: উঁহু খিদে নেই। (পপি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে গেল। পপি যেতেই তোহা উঠে ওর কোমল হাতে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে)
আমি: কি হয়েছে মামুনি?
তোহা: তুমি কাঁদছ কেন?
আমি: আমার আব্বু মারা গেছেন তো তাই।
তোহা: মারা যাওয়া কি?
আমি: আকাশের তারা হয়ে গেছেন।
তোহা: আর আসবে না?
আমি: না মামুনি আকাশে চলে গেলে আর ফিরে আসা যায় না।
তোহা: ওওও। (কিছুক্ষণ থেমে থেকে তোহা আবার প্রশ্ম করলো)
তোহা: আমিও যদি তারা হয়ে যাই তুমি কি কাঁদবে? (তোহার প্রশ্নে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো, কি বলছে এসব তোহা)
আমি: এসব বলতে নেই মা তুই আমার কাছে না থাকলে আমি মরেই যাবো।
মেঘ: ওকে তোমার থেকে কেউ দূরে সরিয়ে নিবে না। (তোহাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলাম হঠাৎ মেঘ আসলো)
আমি: কোনো একদিন হয়তো এমন পরিস্থিতি আসবে যে তুমি নিজেই ওকে আমার থেকে কেড়ে নিবে।
মেঘ: কথা দিচ্ছি যাই হয়ে যাক তোহাকে তোমার থেকে আলাদা করবো না।
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: নিচে যেতে পারবে তোমার চাচ্চু ডাকছেন?
আমি: হুম তোহাকে ঘুম পারিয়ে আসছি।

তোহাকে ঘুম পারিয়ে নিচে আসতেই দেখি মেঘ’দের বাড়ির সবাই চলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছে।
দাদি: কণা তোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আমরা চলে যাচ্ছি।
আমি: এতো রাতে যাওয়ার কি প্রয়োজন সকালে…
মা: না মা আমরা যাই, তোমার যখন ভালো লাগবে যেও ততদিন মেঘ এখানেই থাকবে। তুমি মন খারাপ করে থেকো না।
আমি: হুম।

একে একে সবাই চলে গেল বাসাটা কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। থাকবেই তো বাসার প্রাণ যে আব্বু, আব্বুই তো নেই।
চাচ্চু: কণা আমাদের তো চলে যেতে হবে। দুদিনের বেশি থাকা সম্ভব না বুঝিসই তো ওদিকে…
আমি: আমরা কার কাছে থাকবো?
চাচ্চু: আমি চাইছিলাম ভাবিকে আমাদের সাথে কানাডা নিয়ে যাই, তুই চাইলে তুইও…
আমি: আমি কিভাবে যাবো?
চাচ্চু: ভাবি বাসায় একা থাকবে কিভাবে আমাদের সাথে নিয়ে যাই, তুই যখন বলবি তখনই আবার নিয়ে আসবো।
আমি: তাহলে আমি একা থাকবো কিভাবে?
মেঘ: একা কোথায় কণা আমরা সবাই তো তোমার পাশে আছি।
জোহা: আব্বু আমি আপুর কাছে থাকি?
চাচ্চু: ঠিক আছে।

নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছি পাশে মেঘ আর তোহা ঘুমুচ্ছে। আমার ঘুম আসছে না বারবার আব্বুর চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি আব্বু আমাকে কণা মা বলে ডাক দিবেন। ছোটবেলা থেকে আব্বুই আমার প্রথম বন্ধু ছিলেন, সবকিছুতে আব্বু আমাকে সাপোর্ট করেছেন আর আজ আব্বু আমাকে একা করে দিয়ে এভাবে চলে গেলেন। চোখের সামনে বাবার লাশ দেখার মতো নির্মম দৃশ্য আছে কিনা জানিনা খুব কষ্ট হচ্ছে, ভাবতেই পারছি না আর কেউ আমাকে কণা মা বলে ডাক দিবে না। কে এই কাজ করেছে এইটা জানতে পারলে হয়তো কষ্টটা কিছুটা হলেও কম হতো।
আম্মু: কণা জেগে আছিস? (এতো রাতে আম্মুর ডাক শুনে বেশ অবাক হলাম। তাড়াতাড়ি উঠে এসে দরজা খুললাম)
আমি: আম্মু তুমি?
আম্মু: তোকে একটা জিনিস দিতে ভুলে গেছি আমার রুমে চল।
আমি: চলো।

আম্মুর পিছু পিছু আম্মুর রুমে আসলাম। আম্মু ড্রয়ার থেকে একটা ফোন বের করে আনলেন।
আমি: আম্মু কার ফোন এইটা?
আম্মু: সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর ফোনটা আমি ফ্লোরে পেয়েছি, ওদের মধ্যে কারো হবে, হয়তো পকেট থেকে পরে গেছে। (তাড়াতাড়ি আম্মুর থেকে ফোনটা আনলাম অফ হয়ে আছে চার্জ নেই হয়তো)
আমি: আম্মু আমি দেখছি তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।
আম্মু: ঘুম আসছে নারে মা কি থেকে কি হয়ে গেল।
আমি: এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো হবে না আম্মু। জোহা আম্মুকে বিছানায় নিয়ে যাতো।
জোহা: ঠিক আছে।
জোহা আর চাঁচিআম্মা আম্মুর কাছে আছে তাই নিশ্চিন্তে ফোনটা নিয়ে রুমে চলে আসলাম।

ফোনটা চার্জে দিয়ে অপেক্ষা করছি, হয়তো এই ফোন থেকে কিছু পাবো। ফোনটা চার্জে রেখে বিছানায় এসে বসলাম, দেয়ালে রাখা আব্বু আর আমার ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই দুচোখ ভিজে উঠলো। এভাবে আব্বুকে হারিয়ে ফেলতে হবে কখনো ভাবিনি।

রাত প্রায় তিনটা বাজে সোফায় বসে ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি। কল লিস্টে একটি নাম্বার ছাড়া সারা ফোনে আর কিছুই নেই। এই নাম্বারে ফোন দিবো কিনা ভাবতে ভাবতে ফোন দিয়ে দিলাম। আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে মেঘের ফোন বেজে উঠলো। অবাক হয়ে মেঘের ফোনটা হাতে নিলাম, এইটা মেঘের নাম্বার কিন্তু সন্ত্রাসীদের কাছে কেন? তবে কি আমার সন্দেহ ঠিক? কিন্তু মেঘের আচরণে তো কিছু বুঝা যায়নি। ফোনের রিংটোনে মেঘের ঘুম ভেঙে গেল, ঘুম ঘুম চোখে ও আমার দিকে তাকালো।
মেঘ: কণা তুমি ঘুমাওনি?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: কণা কি হয়েছে আর আমাকে এতো রাতে কে ফোন করেছে?
আমি: নিজেই দেখে নাও। (মেঘের হাতে ফোন দিয়ে আমি আবারো কল করলাম, মেঘ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে)
মেঘ: কি ব্যাপার ওই ফোন থেকে আমাকে ফোন দিচ্ছ কেন আর এই ফোন কার?
আমি: সত্যি তুমি জাননা এই ফোন কার? নাম্বারটা তো তোমার চেনার কথা তাই না?
মেঘ: আশ্চর্য আমি কিভাবে জানবো এই নাম্বার কার।
আমি: মেঘ ন্যাকামো করো না তুমি ভালো করেই জানো এই নাম্বার কার।
মেঘ: কণা তুমি কি বলছ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমি: এই ফোন আব্বুকে মারার সময় একজন ভুলে ফেলে গেছে মেঘ আর এই ফোনে শুধু তোমার নাম্বার।
আমার চিৎকার শুনে মেঘ উঠে দাঁড়িয়ে গেল, ও অবাক হয়ে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ফোনটার দিকে তাকাচ্ছে।

চলবে?