#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১১
দরজায় করাঘাতের আঘাতে নিজেকে স্থির করে নিই। চোখ মুখ ভালো করে মুছে দরজা খুলে দেয়। দরজা খুলতেই প্রিয়ক ভিতরে এসে ডোর লক করে দেয়। তারপর আমাকে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে। তার হৃৎস্পন্দনের তীব্র আওয়াজ আমার হৃদয়েও ঝড় তুলছিল। বুঝতে বাকি নেই মানুষটার জন্য নিজের মনের মাঝেও সুপ্ত অনূভুতি সৃষ্টি হচ্ছে। কথায় আছে সৃষ্টিকর্তা বিয়ে নামক সম্পর্কে নিজে থেকেই বরকত ঢেলে দেন। দুটি মানুষকে অদৃশ্য এক মায়ায় বেঁধে দেন। ফলে না চাইতেও একে অপরের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। যা হয়তো আমাদের মাঝেও হচ্ছিল। কিন্তু এই মায়ার বাঁধন কি চিরস্থায়ী হবে?
কিছুসময় পার হতেই প্রিয়ক আমাকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে গিয়ে বলল,
“কেন করলি এমন, প্রিয়? কেন পিছিয়ে গেলি? কেন বিশ্বাস ঘাতকতা করলি আমার সাথে? ”
“কারন আমি আবিরকে ভালোবাসি৷ তোমাকে না।”
আমার কথায় থমকে যায় প্রিয়ক। হয়তো বিশ্বাস হয় না আমার কথা। সে বলল,
“মিথ্যা বলছিস তুই। এমন হলে কাল ওসব কি ছিল? ”
আমি প্রিয়ককে রাগি গলায় বললাম,
” ভুল ছিল। ভুল। আবেগ ছিল আমার। তোমার কথার মায়াজালে পড়ে আবেগে ভেসে গিয়েছিলাম। আর কিছু না। আর তুমি আমার সাথে যা করেছো তারপর ভাবলে কি করে তোমার সাথে থাকবো আমি?”
আমার উত্তরে আরো রেগে যায় প্রিয়ক। আমার সামনে এসে আমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে রেগে বলল,
“যদি নাই থাকবি তাহলে কাল কেন কাছে আসতে দিয়েছিলি? কেন গিয়েছিলি আমার সাথে? কেন বলেছিলি থাকবি আমার সাথে। কেন বলেছিলি ডিভোর্স চাস না তুই? বল কেন করলি?”
“বললাম তো আবেগ ছিল আমার৷ আর দুবছর আগে তুমি যেমন আমার বিশ্বাস ভেঙেছিলে আমিও তাই করেছি। আর কিছুনা।”
আমার কথায় প্রিয়ক স্তব্ধ হয়ে যায়। শব্দ যেন তার কণ্ঠনালীতে আটকে যায়। করুন কণ্ঠে বলল,
“প্রতিশোধ নিলি?”
“মনে করো তাই।”
আমার কথায় নিজের মাথা ধরে বেডে বসে পড়ে প্রিয়ক। আমি আগের মতোই দাঁড়িয়ে থাকি। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের রাগ সংবরণ করতে চাইল প্রিয়ক। তারপর কিছু একটা ভেবে হুট করে উঠে আমাকে ধরে বলে,
“মামী। মামী তোকে এসব বলতে বলেছে তাই না। এখানে আসার পর শুধু মামীই তোর সাথে কথা বলেছে। আর কেউ একা কথা বলেনি৷ তোকে মামী কিছু বলেছে। তাই না রে?”
আমি শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে আছি মানুষটার দিকে। এতকিছু বলার পরও মানুষটা কিভাবে এ কথা বলতে পারে? কিভাবে আমাকে বিশ্বাস করতে পারে? কেন তার মনে হচ্ছে আমাকে জোর করা হচ্ছে? ভালোবাসলে কি এমনটা হয়? কোনোটার উত্তর নেই আমার কাছে। তবে মনে হলো মন বলছে’ হ্যা হয়’।
আমি আগের মত করে বললাম,
“এত কিছু জানিনা। শুধু এতো টুকু জেনে রাখ আমি যেতে পারবো না তোমার সাথে।”
প্রিয়ক শুধু অবাক চোখে চেয়ে থাকে। হয়তো এই প্রিয়তা তার অচেনা। তার সেই ছোট পুতুলটা নয়। বরং অন্য কেউ। প্রিয়ক তখন আমার চোখে চোখ রেখে বলে,
“শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করছি প্রিয়তা। সত্যিই কী তুই ডিভোর্স চাস? চাস আমাদের সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে? আর হ্যা সত্যিটাই বলবি। মিথ্যা না। নয়তো এর পর যা হবে তার জন্য তুই দায়ী থাকবি।”
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। কথা যেন সব হারিয়ে ফেলেছি। কণ্ঠস্বর যেন বসে গিয়েছে। সে কোনোরূপ শব্দ করতে নারাজ। তাকে কিছু বলতে পারছিলাম না। নিরবে চোখ নামিয়ে নিই আমি। কয়েক ফোটা নোনা তরল গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। প্রিয়ক আমার জবাব না পেয়ে আমাকে তার বুকের মাঝে ভরে নেয়। মাথায় আলতো হাত রেখে বলে,
“থাক আর কিছু বলতে হবে না। আমি আমার উত্তর পেয়ে গিয়েছি। ”
আমি এবারও কিছু বলতে পারলাম না। প্রিয়ক একটু থেমে আবার বলল,
“তুই এখন আমার স্ত্রী। আমি না চাইলে তোকে আমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। কেউ না। তবে হ্যাঁ তোর এই মুখে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসিস এ কথাটা যেন আর উচ্চারিত না হয়। নয়তো জানে মেরে ফেলবো এবার। হয় তোকে না হয় নিজেকে। ”
প্রিয়কের এবারের কথায় ওকে শক্ত করে ধরে রাখলাম। কত সময় কেটে গিয়েছে তা জানা নেই আমার।
মা! পৃথিবীতে একটুকরো স্বর্গের নাম মা। মা তো সেই, যে দশমাস একটা প্রানকে নিজের অস্তিত্বে ধারন করে অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে পৃথিবীতে একটা নতুন জীবন নিয়ে আসে৷ কতগুলো মুখের হাসির কারন হয় একজন মা। সেই মা যখন কষ্ট পায় তখন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। যেমনটা এখন আমার মনে হচ্ছে৷ আমি আমার মাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসি। সেই মায়ের দেওয়া কসমের কাছে দায়বদ্ধ আমি। আম্মি প্রিয়কের মুখে আমাকে ওর সাথে যাওয়ার কথা শুনে রাগের সাথে কষ্ট ও পায়। তার বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রিয়ক যা বলেছে সত্যি বলেছে। আমি যেতে চেয়েছি তার সাথে। আর আম্মি যখন আমাকে নিতে রুমে আসে মায়ের চোখে কাঠিন্যতা দেখি আমি। যা এর আগে আমার প্রতি কখনই দেখি নি আমি। আম্মি এসেই আমার গালে খুব জোরে একটা চড় বসায়।
“এতটা বেহায়া কবে হলি তুই? আমাদের কাউকে কিছু না বলে প্রিয়কের সাথে ওর ফ্লাটে চলে গেলি। একটা রাত পার করে এলি ওখানে। এখন আবার একসাথে এসে বলছিস আমরা রাজি না হলে দেশ ছেড়ে চলে যাবি? কিছুদিন আগেও যার নামে নালিশের ঝুলি খুলে বসতিস, যাকে সবথেকে বেশি ঘৃণা করতিস। আজ তার জন্য আমাদের ছেড়ে চলে যেত চাস? ”
আমি আম্মিকে বিছানায় বসিয়ে বলি,
“আম্মি তুমি শান্ত হও প্লিজ। প্রিয়ক ওর ভুল বুঝতে পেরেছে। অনুতপ্ত ও। আমার কথায় সব সত্যি সবাইকে জানিয়েছে। তারপর ও কি করে ক্ষমা না করি? আর আমার কোনো ক্ষতি করবে না তা যেমন আমি জানি, তেমন তুমিও জানো আম্মি। প্লিজ ক্ষমা করে দাও প্রিয়ককে।”
“বাহ! এক রাতে এতটা উন্নতি! আমার মেয়ে এখন আমাকে বুঝাচ্ছে? তুই শুনে রাখ তোর বাবা কখনই মানবে না ওকে। তারপর ও যদি ওর সাথে যেতে চাস তাহলে আর কখনই তোর এই মাকে দেখবি না তুই। ”
“আম্মি এসব কি বলছো? ”
“যা বলছি ঠিক বলছি। আমি চাই না তুই প্রিয়কের কাছে যাস। ”
“তাহলে বিয়েটা কেন হতে দিয়েছিলে, আম্মি? সবটা তো তুমি জানতে। বিশ্বাস ও করেছিলে আমার কথা। তাহলে কেন সেদিন বাঁধা দেও নি?”
এবার আমার কথায় আম্মি চুপ হয়ে যায়। তবে তা কিছু সময়ের জন্য। তারপর আমার হাত তার মাথায় রেখে বলে,
“তোকে আমার কসম দিলাম। বাইরে যেয়ে সবাইকে এটাই বলবি তুই ডিভোর্স চাস। নয়তো আমার মরা মুখ দেখবি। ”
“আম্মি!”
“চিৎকার করবি না। আমি চাই না তুই নিজের অস্তিত্ব হারাস। নিজেকে সস্তা বানিয়ে ফেলিস। আজ তোর প্রিয়কের সাথে যাওয়ার মানে এটাই ওর সকল অন্যায় অবজ্ঞা করা। যা তুই করতে পারবি না। ওর তোকে পেতে হলে ঠিক ততটাই কষ্ট করতে হবে যতটা তুই পেয়েছিস। আর কষ্টটা তোদের ডিভোর্স থেকেই হবে।”
বলেই আম্মি আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে আসে। আমার আর কোনো কথা শোনে না। আসার আগে আবারও তার কসমের কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকি আমি। সবার সামনে প্রিয়কের সাথে ডিভোর্স চাই বলা ছাড়া আম্মি আমার কাছে আর কোনো উপায় রাখে নি। প্রিয়কের বুকের মাঝারে থেকেই ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি।
আজ আমার ছোট পুতুলটার জন্মদিন। পুতুলটা যে আজ কতটা আনন্দিত তা বলার বাহিরে। পাগলীটা অল্পতেই অনেক বেশি খুশি হয়৷ সামান্য কেক দেখে যে এতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তার জন্য আর কি চাই? পুতুলটা আজ আরো একবছর বড় হয়ে গেল। হেই প্রজাপতি, তুই কি উইস করেছিস আমার পুতুলটাকে? না করলে করে দে। রাগ করবে কিন্তু। আচ্ছা বাদ দে। তোর হয়ে না হয় আমিই করে দেবো। জানিস প্রজাপতি, মেয়েটা বড্ড অবুঝ। বুঝতেই চাইনা আমার ভালোবাসাটা। কবে বুঝবে বল তো। জানিস আজ পাগলীটা মিষ্টি রঙের গাউন পরেছিল। এই রঙটা ওকে এতটা মানাবে তা ভাবতেই পারিনি। আগে জানলে মিষ্টি রঙে মুড়িয়ে রাখতাম পাগলীটাকে। এতো মিষ্টি কেন মেয়েটা। দেখলেই মনে হয় টুপ করে খেয়ে ফেলি।”
আজ একমাস হলো প্রিয়ক বাংলাদেশে নেই। প্রিয়কের ডায়েরির একটি পাতার অংশ এটি। মানুষটার ভালোবাসা কতোটা ছিল তা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছি। প্রিয়ক বাইরে চলে যাওয়ার পূর্বে খুব সাবধানে তার ডায়েরিটা আমি রেখে দেয়। মূলত সে রাতেই রেখেছিলাম আমার কাছে যে রাতে তার বউ হয়ে গিয়েছিলাম তারই ফ্লাটে। তবে তা লুকিয়ে। আমাকে নিয়ে লেখা তার গল্পটা জানার ইচ্ছা ছিল খুব। হয়তো সে জানতেও পারেনি। যখনি মন খারাপ থাকে ডায়েরি পড়তে ভালো লাগে আমার। নিমিষেই মনটা ভালো হয়ে যায়। অনেক কিছুই জেনেছি আমার সম্পর্কে। যা আমি নিজেও জানি না। এতটা নিখুঁত ভাবে কি করে দেখত মানুষটা আমাকে?
ক্লাস শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। হল রুমের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি মুনি, হাসি আর তন্নির জন্য। ওরা ক্যান্টিনে গিয়েছ খাবার খেতে। আমার ভালো না লাগায় যায়নি আমি। প্রায় ১৫মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পর ও ওদের না আসায় সামনে যেতে চাই আমি। কিন্তু তখনি সামনে এসে বাঁধা দেয় আবীর। আমার পথ আগলে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছিলে?”
“ক্যান্টিনের দিকে।”
“খাবা কিছু? চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
“আমি একাই যেতে পারবো। তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আর আমি কিছু খাবো না। ”
” তাহলে আমার সাথে চলো। তোমাকে একটা জিনিস দেখানোর আছে।”
আমি আবীরকে বাধা দিয়ে বলি,
“তুমি যাও। আমার ভালো লাগছে না আবীর। ”
তবুও আবীর আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল,
“আরে চলোতো। ”
“আবীর আমার হাত ছাড়ো।”
অনেকটা রেগে গিয়ে বলি আমি। এসব হাত ধরাধরি কোনো কালেই পছন্দ নয় আমার। তবে প্রিয়ক চলে যাওয়ার পর থেকে আবীর আজ কাল একটু বেশিই কাছে আসার চেষ্ঠা করে। বেশ কয়েকবার মানা করা সত্বেও শোনে নি। তবে ইদানিং আমার প্রতি আবীরের কেয়ার বেড়েছে। আমার সামান্য সমস্যার কথা শুনলেই হয়ছে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে যেন আমার পিছনেই পড়ে থাকে। বন্ধুদের সাথে আড্ডাও কমে এসেছে তার। আমাকে বেশি সময় দেওয়ার চেষ্ঠা করে। তবুও এসব অযথা মেলামেশা আমার পছন্দ নয়। আমার জোর আওয়াজে আশেপাশের বেশ কয়েকজন কিছু পলকের জন্য চেয়ে থাকে আমাদের দিকে। ততক্ষণে হাসি ওরাও চলে এসেছে। হাসি এসেছেই বলল,
“কি হয়েছে প্রিয়? রেগে আছিস কেন?’
ততক্ষণে আবীর আমার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
” আই ম সরি প্রিয়তা। প্লীজ রাগ করো না। ”
আমি রাগী কন্ঠে হাসিকে বললাম,
“কিছু হয়নি। চল তোরা ” বলেই ওদের নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পিছনে ফিরে তাকানোর ইচ্ছা ছিল না আমার। ক্যাম্পাস থেকে বাইরে আসার সময় হাসি ওর বিভিন্ন উদ্ভট কথায় আমাদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করলো। রিয়ন আজ আসে নি। দুদিন আগে খেলতে গিয়ে বাজে ভাবে ব্যথা পেয়েছে। যার ফলস্বরূপ বেড রেস্ট নিতে বলা হয়েছে ওকে। সবাই মিলে ঠিক করা হলো ওকে একবার দেখে তারপর যে যার বাড়ি ফিরব। বাইরে বেরিয়ে তন্নি বলল,
“আর কতদিন এভাবে থাকবি?”
“যতদিন না তাকে তার প্রাপ্য শাস্তি বুঝিয়ে দিতে পারি ততদিন।”
তন্নি আবারও বলল,
“ফোন রিসিভ করেছিল?”
আমি ক্লান্ত গলায় বললাম,
না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সবার ভিতর থেকে
প্রকৃতির এক অপরুপ সৌন্দর্যের নাম হলো সমুদ্র। সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জলরাশি যেন মুহূর্তেই মনকে আনন্দিত করে তোলে। সমুদ্রের এপাড় থেকে ওপারে তাকালে দেখা যায় ছবির মতো ছোট ছোট সুন্দর বাড়িঘর। যার প্রায়টাই তৈরী হয়েছে রঙিন টিন দ্বারা। যা দেখতে অপরুপ লাগে। আমাদের বাসা থেকে অনেকটা দূরেই এই সমুদ্র। দূরে হলেও একসময় সপ্তাহে এক দুবার আসাই হতো এখানে।প্রিয়কই নিয়ে আসত আমাকে আর রিক্তা আপুকে। অনেকটা সুখময় সময় কাটাতাম এখানে। সেই ঘটনার পর আর আসা হয়নি এখানে। আজ দুবছর পর আবারও এখানে এসে পুরনো স্মৃতিগুলো মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে। সবগুলোই মধুর স্মৃতি।
“আমি চলে যাচ্ছি, প্রিয়তা। ”
প্রিয়কের এ কথায় চমকে উঠে তাকাই আমি। মানুষটা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার ভাবনা জুরে তখন একটা কথায় ঘুরছিল কোথায় যাবে? প্রিয়ক হয়তো বুঝেছিল আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। সে আমার দিকে ফিরে আবারও বলল,
“বাইরে চলে যাচ্ছি। এবার আর হয়তো ফেরা হবে না। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আল্লাহ চাইলে কোন একসময় হয়তো আবাও দেখা হতে পারে।”
আমি প্রিয়কের দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ যেন আমার অন্তরে আঁচড়ে পড়ছিল। অদ্ভুত এক অনুভূতি শিরায় শিরায় বয়ে চলছিল। এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নই আমি। কষ্ট হচ্ছে খুব কষ্ট হচ্ছে। জানি না কেন? এর আগেও যখন গিয়েছে তখন তো বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনি। তাহলে এখন কেন? প্রিয়ক আমার অবস্থা বুঝতে পারছিল কিনা জানি না। তবে তাকে অনুভূতিশূন্য মনে হচ্ছিল। কিছু বলবো সেই ভাষা ও যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। ক্ষীন কন্ঠে বললাম,
“আমার জন্য? ”
“না তোর জন্য না। তোর জন্য তো এসেছিলাম।”
“তাহলে কেন যাচ্ছো?”
“এখানে থাকলে মরে যাব রে আমি। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় আমার। জানিস ওই দিনের পর থেকে মা আমার সাথে কথা বলেনি। যেই মা আমার সাথে একবেলা কথা না বলে থাকত পারতো না। সেই মা আমার সাথে এতদিন হলো কথা বলে না। সবার এত কঠিন রুপ আমি এর আগে দেখিনি রে প্রিয়। দমবন্ধ হয়ে আসে আমার। পারব না রে থাকতে এখানে। পারবো না।”
প্রিয়কের কথাগুলো যেন বিষের মতো আঘাত হানছিল আমার উপর। এত কষ্ট কি সত্যিই পাওয়ার যোগ্য মানুষটা? শাস্তি টা বেশিই হয়ে গেল না তার জন্য? কান্না পাচ্ছিল খুব। প্রিয়ক আবার বলল,
“তবে তুই চিন্তা করিস না। তোর শর্ত ঠিকই মানবো আমি। ”
প্রিয়কের এবারের কথায় স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। শর্ত মানবে মানে কী? কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললাম,
“মা..মানে?”
” আমাকে ক্ষমা করার শর্ত দিয়েছিলি।তা ভুলে গেলি? সেই শর্ত মেনে নিয়েছি তো আমি।”
এখন বুঝতে পারছি কেন সেদিন সবাই আমাদের ডিভোর্সের কথা বলার পরও চুপ ছিল প্রিয়ক। তার কারন যে আমিই। তাকে দেওয়া দুটি শর্তের একটি হলো সবাইকে সব সত্যিটা জানানো। আর অন্যটি হলো তারা যে শাস্তি দেবে তা মেনে নেওয়া। আর তাদের দেওয়া শাস্তি হলো আমাদের ডিভোর্স। তার মানে প্রিয়ক ডিভোর্স দিতে রাজি? ভীষণ কান্না পাচ্ছিল আমার। হুট করেই জরিয়ে ধরি প্রিয়ককে। খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরি। জানি না কেন করেছি এমন। তবে কিছুটা হলেও ভালো অনুভব করতে পারছিলাম। প্রিয়ক সেভাবেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। আমাকে জরিয়ে ধরলো ও না, আবার আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ও নিলো না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
“আমি ডিভোর্স চাই না। চাই না আমি।”
“পাগলামী করিস না, প্রিয়তা। এটা পাগলামীর সময় না। বুঝার চেষ্টা কর। সবাই আমাদের ডিভোর্স এর পক্ষে। তোকেও জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রাজি ছিলি না তুই। তোর তো খুশি হওয়ার কথা। তুই কেন কাঁদছিস? ”
“জানিনা আমি। কিচ্ছু জানিনা। বাট আমি খুশি হতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ”
“দুদিন পর সব ঠিক হয়ে যাবে। সব ভুলে যাবি।”
আমি প্রিয়ককে ছেড়ে ওর চোখে চোখ রেখে বললাম,
“তুমি চাও আমাদের ডিভোর্স হোক?”
“আমার চাওয়া না চাওয়াই কিছু হবে না। যা হওয়ার তা হবেই। সেটা আমরা চাইলেও হবে। না চাইলেও হবে।”
প্রিয়ক দেখাতে না চাইলেও ওর কষ্টগুলো যেন অনুভব করতে পারছিলাম আমি। কি করে এতোটা শান্ত থাকতে পারছে মানুষটা। সেই সাথে নিজের উপর রাগ হচ্ছিল খুব। কেন খারাপ লাগছে আমার? কেন কষ্ট পাচ্ছি আমি? সত্যিই তো। আমার তো খুশি হওয়ার কথা? তাহলে কেন হচ্ছি না আমি? যেই মানুষটার জন্য এতগুলো দিন মিথ্যা অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়ালাম সেই মানুষটার জন্য কেন কষ্ট হচ্ছে আমার? কেন কেন কেন?ভিতর থেকে চিৎকার করলেও তার আওয়াজ বাইরে এলো না। শুধু রেগে গিয়ে প্রিয়ককে বললাম,
“তুমি কি আমাকে এখানে এগুলো বলার জন্য নিয়ে এসেছো?”
“বলতে পারিস।”
“এখন তো বলা শেষ হয়েছে? দিয়ে আসো আমাকে।”
বলেই চলে যেতে নেয়। প্রিয়ক পিছন থেকে হাত ধরে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। এবার খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে আমাকে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবো আমি। প্রিয়কের হৃৎস্পন্দনের তীব্র আওয়াজ আমার হৃদয়েও যেন আঘাত হানছিল। নিজের হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ যেন নিজেই শুনতে পারছিলাম। যত সময় গড়াচ্ছে প্রিয়কের স্পন্দনের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মাঝে প্রিয়কের বলা কিছু কথা আমার হৃদয়ের ঝড় তুললো।
“তোকে ছাড়া থাকতে খুব কষ্ট হবে রে আমার। এভাবে বাঁচার থেকে মরে যাওয়াও বোধহয় ভালো। দোয়া করিস যেন আমার মৃত্যুটা তাড়াতাড়ি হয়। খুব তাড়াতাড়ি। ”
প্রিয়কের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। উল্টো দিকে ফিরে বললাম,
“আর তুমিও দোয়া করো যেন আমার মৃত্যুটা এখনি হয়। ”
“প্রিয়তা। চুপ। এসব কথা যেন আর কখনও না শুনি।”
“শোনার জন্য তুমি থাকছোই বা কোথায়? ”
প্রিয়ক আবার ও আমাকে জরিয়ে নেয়। এবার আর কিছু বলে না। আমিও আর কিছু বলি না। বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর প্রিয়ক বলে,
“এই পাগলী।”
“হু।”
“কাল সকালেই চলে যাচ্ছি আমি। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো কিছু চাইবো তোর কাছে। দিবি? ”
আমি প্রিয়কের বুক থেকে মাথা তুলে বলি,
“কী?”
“এখন থেকে কাল সকাল পর্যন্ত আমার হয়ে থাকবি? এসময়টা একান্তই আমার হবে। থাকবি আমার বউ হয়ে? শুধু কাল সকাল পর্যন্ত।”
কয়েক মুহুর্ত পার হয়ে যাওয়ার পর ও আমার তরফ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে প্রিয়ক আবারও বলল,
“থাক এতো ভাবতে হবে না। চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি।”
প্রিয়ক আমাকে নিয়ে যেত নিলেই আমি বলে উঠি,
“আ. আমি রাজি।”
“সবকিছু ভেবে বলছিস?”
“হুম।”
মাথা নুইয়ে ফেলি আমি। প্রিয়ক আমাকে জরিয়ে ধরে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তবে তার ঠোখের কোণে এক চিলতে হাসি আমার চোখ এড়ায় না। প্রিয়ক বলল,
“তাহলে কিন্তু তোকে আমার ফ্লাটে যেতে হবে। যাবি ওখানে?”
আমি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাতেই প্রিয়ক মৃদু হেসে আমার হাত ধরে নিয়ে যেয়ে গাড়িত বসায়। গাড়ি চলতে থাকে। গন্তব্য প্রিয়কের নিজস্ব ফ্লাট। এটা সেই ফ্লাট যেখান থেকে আমাদেট কাহিনী শুরু হয়েছিল। যেখান থেকে উলোট পালোট হয়ে গিয়েছিল আমার জীবন। আজ আবারও সেখানে যাচ্ছি। তবুও মনের মাঝে কোনোরুপ ভয় কাজ করছে না। বরং নিজেকে আরো বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছে। আজ না আছে মনে বাবা মা কি বলবে তার ভয়। না আছে ডিভোর্সের চিন্তা। আর না আছে কাল কি হবে তার চিম্তা। দুঘন্টা জার্নির পর আমরা সেখানে পৌছায়। গাড়ি থেকে নামার সময় একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। সবটা আগের মতোই আছে। ভিতরের পরিবেশটাও আগের মতোই আছে। সবটা আমার পছন্দের জিনিসে সাজানো। তিনটা বেড রুম একটা, ডাইনিং রুম, একটা ড্রয়িংরুম আছে ফ্লাটটিতে। ড্রয়িংরুমের ওয়ালে আমার আর প্রিয়কের একটা ছবি বড় করে ফ্রেমে বাঁধাই করা। ছবিটা আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন ওঠানো। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ। বাড়ির সব মেয়েরাই সেদিন লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়েছিল। আমিও পড়েছিলাম। প্রিয়ক ও আমাদের সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবি পড়েছিল। ছোট কাকার ছবি তোলার শখ ছিল। আমরা তখন একে অপরকে কোনো এক কারনে মারামারি করছিলাম। তখন ছোট কাকা ছবিটা তুলেছিল। ছবির ক্যামেরার ফোকাস লাইট আমাদের উপর পড়তেই দুজনে চমকে একে অপরের দিকপ তাকিয়ে ছিলাম। সেই সময়ের ছবিটাই প্রিয়ক বড় করে বাঁধিয়ে এনেছিল। যা সবসময় নিজের কাছে রাখত। হয়তো গত দুবছর ও সাথে ছিল তার।
“প্রিয়তা।”
হঠাৎ ডাকে চমকে উঠি আমি। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই সে হাসি মুখে বলল,
“রুমে যেয়ে ফ্রেস হয়ে নে। আমি খাবার রেডি করি। কিছু তো খাস ও নি।”
আমি সম্মতি জানিয়ে চলে আসতে নিলে থমকে যায়। কোন রুমে যাবো আমি? প্রিয়কের বেড রুমে। নাকি যে রুমে দুবছর আগে ছিলাম সেই রুমে। পিছনে ফিরে দেখলাম প্রিয়ক ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো প্রিয়ক ও দেখতে চাই আমি কি করি। আর কিছু না ভেবেই প্রিয়কের বেড রুমে চলে আসি আমি। কারন এখন আমি এখানে শুধু প্রিয়তা কিংবা প্রিয়কের মামাতো বোন হিসেবে আসি নি আমি। এসেছি প্রিয়কের স্ত্রী হিসেবে। তাই প্রিয়কের রুমটাই আমার হবে। রুমে ডুকে ডোর দিতে গিয়ে প্রিয়কের হাসি মাখা মুখটা দেখতে পেলাম।
সারাদিন নিজের উত্তাপ দেওয়ার পর নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে সূর্যটা। সেই সাথে প্রকৃতিতে নেমে এসেছে নতুন রঙ। চারদিক আলোকিত হয় রঙ বেরঙের রশ্নিতে। সেই আলোকরশ্মির মাঝে প্রিয়কের বেড রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বসে আছি আমরা দুজন। দুজনার হাতে প্রিয়কের বানানো কফি। তাতে একটু একটু চুমুক দিচ্ছি আর একে অপরের দিকে তাকাচ্ছি। প্রিয়কের কাছে মুহুর্তেটা কেমন লাগছে জানা নেই আমার। তবে আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে। এর মাঝে বাসা থেকে অনেকবার ফোন দেওয়া হয়েছে। তবে তা রিসিভ করিনি আমি। আম্মুর কাছে শুধু “আমি ঠিক আছি। ” লিখে ম্যাসেজ করে দিয়েছিলাম। তারপর পরই ফোন অফ করে রেখেছি। এভাবে পার হয়ে যায় সন্ধ্যার সময়টুকু। তবে সময় যত ঘনিয়ে আসছে মনের মাঝে অস্থিরতা যেন বেড়েই চলেছে। কাল কি হবে তা ভাবতে পারছি না।
ঘড়ির কাটা বলছে এখন রাত নয়টা। প্রিয়ক আমাকে একটা সপিং ব্যাগ হাতে দিয়ে বলে,
“এটা তোর জন্য। আজকের জন্য। ”
আমি ব্যাগটা নিয়ে রুমে চলে আসি। ব্যাগের ভিতর খুব সুন্দর একটা শাড়ি। বেগুনি রঙের একটা জর্জেটের শাড়ি। বুঝতে বাকি থাকেনা এটা আজ রাতের জন্য। তাই শাড়িটা পরে নেই। সেই সাথে শাড়ির সাথে থাকা ম্যাচিং ওরনামেন্টস গুলো পরে তৈরি হয়ে নেয়। সবটা শেষ হলে বারান্দায় প্রিয়কের সামনে যাই। প্রিয়ক এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেও আবার ফিরে তাকায়। কতক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে জানা নেই। হুট করেই কোলে তুলে নেয় আমাকে। প্রিয়ক আমাকে ওভাবেই কোলে করে ছাদে নিয়ে আসে। আসার পুরো সময়টা ছিলাম তার বুকে মুখ লুকিয়ে। ছাদে আসার পর চারপাশ দেখতেই থমকে যাই আমি। সবটা খুব সুন্দর করে সাজানো। চারপাশে বিভিন্ন রঙের লাইট, ফুল আর লাভ সেইপের বিভিন্ন রঙের বেলুন দিয়ে সাজানো। এর মাঝে ছোট একটা টেবিলে সাজানে হয়েছে বিভিন্ন রকম খাবার। যার সবটাই আমার পছন্দের। প্রিয়ক আমার হাত ধরে নিয়ে সেই টেবিলের সামনে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কেক রাখা।
হুট করেই কোথা থেকে সফট মিউজিক বেজে উঠে। প্রিয়ক তখন আমার সামনে হাটু গেড়ে বসে একটা রিং বের করে আমার সামনে এগিয়ে দেয়। আর বলল,
“আই লাভ ইউ, প্রিয়তা। আই লাভ ইউ সো মাচ। ঠিক কতটা ভালোবাসি তোকে তা বুঝাতে পারব না আমি। শুধু জানি ভালোবাসি তোকে। ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি। হবি আমার প্রেয়সী? তোর প্রিয়ক ভাইয়া না তোর জন্য শুধু প্রিয়ক হতে চাই আমি৷ দিবি আমাকে সে সুযোগ? বিশ্বাস কর আর একটুও কষ্ট পেতে দেবো না তোকে। ”
আমি কি বলবো সেসময় সত্যিই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমার কন্ঠনালি চেপে ধরে রেখেছে। যেন কোন শব্দই বের হচ্ছিল না। চোখ দিয়ে বয়ে চলছিল অবিরাম ধারায় কিছু নোনা তরল। নিজের শরীর যেন তখন বেইমানি করছিল আমার সাথে৷ চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়েও পারছিলাম না আমি। শুধু আস্তে করে নিজের হাতটা এগিয়ে দিয়ে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাই। প্রিয়ক আমার সম্মতি পেয়ে তার হাতের রিং আমার আঙুলে পরিয়ে দেয়। হাতের উপর তার উষ্ণ ছোয়া পড়ে। উঠে আমার কপালেও নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুইয়ে দেয়। সেই সাথে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে বলে,
“ওহে আমার প্রেয়সী, ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।”
নিজের হাতে খুব যত্ন করে খাইয়ে দেয় আমাকে। খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই প্রিয়ক আবারও আমাকে কোলে তুলে নেয়। তার ওষ্ঠদ্বয়ে ফুটে আছে মৃদু হাসি। আগত সময়ের কথা ভাবতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যায় আমি। মুখ লুকায় তার বুকে। সে আমার কপালে তার ওষ্ঠদ্বয়ের কোমল ছোয়া দিয়ে নিচে নেমে আসে। নিচে নেমে আমাকে প্রিয়কের বেড রুম কিংবা যে রুমে আমি ছিলাম তার কোনোটাতেই নিয়ে যায় না। বরং তৃতীয় রুমে নিয়ে আসে৷ রুমে ঢু্কতেই আরো বিস্মিত হই আমি৷ মোমবাতির মৃদু আলোয় সারা ঘর আলোকিত হয়ে আছে। ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে আছে বেলুন। চারপাশ ফুল দিয়ে সাজানো। বেডটাও খুব সুন্দর করে সাজানো৷ বেডের মাঝে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে লাভ সেইপ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এক রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এসব দেখে নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয় আমি৷ প্রিয়কের বুকের মাঝে নিজেকে লুকাতে ব্যস্ত হই আমি। প্রিয়ক মৃদু হেসে বলল,
“পছন্দ হয়েছে? সবটা তোর মনের মত করে সাজিয়েছি আমি। তোর পছন্দের ফুল দিয়ে। হয়েছে পছন্দ। ”
“জানি না আমি। ”
আমার উত্তরে প্রিয়কের হাসিটা আগের থেকেও চওড়া হয়। যা না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। আজ কেন যেন মানুষটাকে একটু বেশিই বুঝতে পারছিলাম আমি। প্রিয়ক আমাকে খুব সাবধানে বেডে শুইয়ে দেয়। সময় ত গড়াতে থাকে মনের মাঝের অস্থিরতা যেন বাড়তে থাকে। নিঃশ্বাসের গতি বাড়তে থাকে৷ সারা শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলে এক অদ্ভুত অনূভুতি। ভালোলাগা, অস্থিরতা আর এক সহনীয় সুখের রাজ্যের গভীরে তলিয়ে যেতে থাকি আমরা। খুব শক্ত করে জরিয়ে নেই মানুষটাকে। সময় কখন কেটে যায় কারোরই সেই খেয়াল থাকে না৷ শুধু মনে হয় থেমে যাক সময়, স্তব্ধ হয়ে যাক প্রকৃতি।
চলবে…??
(ক্ষমা করবেন। কথা দিয়েও রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি আমি। খুব চেষ্ঠা করি তাড়াতাড়ি দেওয়ার। তবুও হয়ে হঠে না। সব কিছুর জন্য দুঃখিত আমি।)
#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
মারিয়া মীম
পর্ব ১০
সকালের প্রকৃতি থাকে শান্ত নির্মল। কর্ম ব্যস্ত মানুষ ছুটে চলে তাদের কর্ম ক্ষেত্রে। বাড়ির গৃহিণী ব্যস্ত হয় সবার জন্য সকালের খাবার বানাতে। ব্যস্ত পায়ে হেটে চলা পথচারীদের দিকে দৃষ্টি আমার। প্রিয়ক পেছন থেকে আমাকে তার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ করে নেয়। আমার কাঁধে মাথা রেখে বাইরে দৃষ্টি রাখে। কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর প্রিয়ক বলল,
“রেডি হয়ে নে। বের হতে হবে আমাদের।”
“সত্যিই কি চলে যাবে? যাওয়াটা কি আসলেই জরুরী?”
“হুম, জরুরী। ”
“যদি বাবা মা না মানে?”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দে। শুধু তুই পিছিয়ে যাইস না। তাহলেই হবে। পারবি তো। ”
মৃদু হেসে তার হাতের উপর দুহাত রেখে বললাম “পারব।” প্রিয়ক আর কিছু না বলে শক্ত করে জরিয়ে রাখল।
দুবছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আবারও। যেখান থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের গল্প সেখান থেকেই আবার নতুন করে শুরু হবে সবটা। তবে আসলেই শুরু হবে নাকি শেষ তা জানিনা আমি। গাড়ি ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে। আমি প্রিয়কের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রয়েছি। চোখের পাতায় ভেসে উঠে গতরাতের চিত্রটি। পরিনয়ের গভীরে প্রবেশ করার পূর্বেই থেমে যায় প্রিয়ক। সবটা ভুল মনে হয় ওর। মোমের মৃদু আলোয় প্রিয়কের চোখে স্পষ্টই অনুশোচনা দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। প্রিয়ক নিজেকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে আমার পায়ের কাছে। তাকে এমন করতে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসি আমি।
“এসব কি করছো তুমি? উঠো বলছি।”
“বিশ্বাস কর, প্রিয়তা। আমার এরকম করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। আমি এখানে শুধু শেষ সময়টুকু তোর সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। তোকে কলঙ্কিত করে যেতে চাইনি। আবার ও সেই একই ভুল করতে যাচ্ছিলাম আমি। আমাকে মাফ করে দে প্রিয়তা। না না মাফ করিস না। শাস্তি দে। যে শাস্তি দিতে ইচ্ছা হয় দে।”
“প্লিজ আগে শান্ত হও তুমি। তারপর বলছি।”
প্রিয়কের স্থির হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। প্রিয়ক শান্ত হলেও নিজের অনুশোচনা থেকে বের হতে পারে না। কেমন জানি পাগলের মত করতে থাকে মানুষটা। আর কোন উপায় না পেয়ে তার বুকের মাঝে নিজেকে গুটিয়ে নিই। ধীরে ধীরে শান্ত হয় প্রিয়ক।
“এই পাগলী।”
প্রিয়কের ডাকে মাথা তুলে তাকায় তার দিকে। প্রিয়ক আমার চোখে চোখ রেখে বলে,
“বিয়ে করবি আমাকে? ”
প্রিয়কের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই আমি। আমাদের বিয়ে তো হয়ে গেছে। তাহলে আবার কিসের বিয়ে! সেভাবেই বললাম,
“আমাদের বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে। তাহলে কিসের বিয়ে?”
“হুম হয়েছে। কিন্তু তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে। জোর করে হয়েছিল আমার বিয়েটা। এবারের বিয়েটা তোর সম্মতিতে হবে। আমাদের বিয়ে ভালোবেসে না হলেও ঘৃণা করে হবে না। ”
“কিন্তু তুমিতো বললে সকালেই চলে যাবে তুমি। ”
“হুম যাবো। তবে তোকে ফেলে নয়, তোকে সাথে নিয়ে। যাবি তো আমার সাথে?”
“বাবা মা, চাচ্চুরা..”
“ওনাদের চিন্তা করতে হবে না। শুধু তোর কাছে জানতে চাই কি চাস তুই? তুই কি চাস আমাদের ডিভোর্সটা হোক?”
“না।”
“তাহলে থাকবি আমার সাথে? তোর দেওয়া শর্ত মানতে সেদিন কিছুই বলিনি আমি। কিন্তু তুই যখন নিজেই এই ডিভোর্স চাস না, তখন এই শাস্তি মেনে নেবো না। শাস্তিটা বরং তুই নিজে দিস। ”
প্রিয়কের কথায় মৃদু হেসে সম্মতি দেয়। জানিনা তাকে ভালোবাসি কিনা৷ তবে এই সম্পর্ক ভাঙতে চাই না। সবশেষে ঠিক হলো সকালে আমরা বাসায় ফিরবো। সবাইকে বোঝাবো। তারা যদি না মানে তাহলে শুধু প্রিয়ক নয়, প্রিয়কের সাথে আমিও পাড়ি জমাবো দূর দেশে। সবকিছু আগেই রেডি করে রেখেছে প্রিয়ক। বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্লানিং ছিল প্রিয়কের। তার জন্য আগেই আমার পাসপোর্ট আর ভিসা তৈরি করে রেখেছিল। আর কোনো কথা হয়নি আমাদের মাঝে। প্রিয়কের বুকের মাঝে গুটিশুটি হয়ে থাকতে থাকতেই ডুব দেয় ঘুমের রাজ্যে।
“এই প্রিয়তা।
হঠাৎ ডাকে চমকে উঠি আমি। চোখ মেলে তাকাতেই প্রিয়ক বলল,
“ওঠ। চলে এসেছি আমরা।”
প্রিয়কের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ছিলাম আমি। এর মাঝে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম! প্রিয়ক মৃদু হেসে আমার কপালে উষ্ণ পরশ দিয়ে বলল,
“এত ঘুম কাতুরে কবে হলি তুই? নেমে আয়। এসে পড়েছি তো।”
প্রিয়কের কথা শেষ হলে আমাকে গাড়ি নামায়। আমাদেরই বাড়ি এটা। ভিতর দিকে যাওয়ার সময় কেমন একটা ভয় ভয় হচ্ছিল আমার। ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারি গাড়ির আওয়াজে বাসার অনেকেই বাইরে চলে এসেছে। আমাকে প্রিয়কের সাথে দেখে সবাই রেগে যায়। আম্মি এসেই আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
“কোথায় ছিলি সারারাত? ”
“প্রিয়ক ভাইয়ার সাথে ছিলাম।”
দুবছর আগেও এই পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম আমি। তখন ও যা বলেছিলাম এখন তাই বলি। আমার কথা শুনে আম্মি আমার গালে আরেকটা থাপ্পর দিয়ে বলল,
“এ জন্য তোকে এত ভালোবেসে বড় করেছিলাম। আমাদের মুখে কালি দেওয়ার জন্য। ”
আম্মির কথা শেষ হতেই বাবা গম্ভীর কণ্ঠে আম্মিকে বলল,
“আয়রা, তুমি ওকে ভিতরে নিয়ে যাও। ”
আম্মি বাবার কথার উপর কখনই কোনো কথা বলেনি৷ এমনকি বাবার কোনো কথার অবাধ্য হয়নি। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার সময় হাতে টান পড়ে। পিছনে ফিরে দেখি মানুষটা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার হাতের মুঠোয় আমার হাত। আম্মি তা দেখে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। বাবা চাচ্চুরাও সবাই ভিতরে চলে আসে। বাইরে কোন সিনক্রিয়েট করে মানুষকে কথা বলার সুযোগ দিতে রাজি নয় কেউই। আমরা আসার কিছুক্ষণ পরই মামনি আর ফুফাও চলে আসে সেখানে। প্রিয়ক গাড়িতে থাকাকালীন ফোন দিয়ে মামনি আর ফুফাকে আসতে বলেছিল। আবারও বসে বিচার সভা। তবে তা কোনো কোর্টে নয়। আমাদেরই রুমের বারান্দায়। আমি বাদে সেখানে সবাই আছে। কারন আম্মি আমাকে রুমে বন্দি করে রেখে গেছে। তবুও বাইরের সব কথা শুনতে পারছিলাম আমি। বাবা নিজের কন্ঠে গভীরতা বজায় রেখে প্রিয়ককে বলল,
“কি চাস তুই? কেন নিয়ে গিয়েছিলি প্রিয়কে? ”
প্রিয়ক দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি বা প্রিয়তা কেউই এই বিয়ে ভাঙতে চাই না, মেজমামা। দুজনের কেউই ডিভোর্স চাই না।”
প্রিয়কের কথায় বড় চাচ্চু প্রিয়কের গালে থাপ্পর বসিয়ে দেয়। থাপ্পরটা জোরেই লেগেছিল। তা বুঝতে অসুবিধা হলো না। আরেকটা থাপ্পর দিতে গেলেই বাবা বলল,
“থাম ভাই। ওকে মেরে কিছুই হবে না। ওমানুষ হয়ে গিয়েছে ও। ”
তারপর প্রিয়ককে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তুই ভাবলি কি করে এত কিছু হওয়ার পরও তোদের একসাথে রাখবো? আমার মেয়ে কোন খেলনা নয়, যে ওকে নিয়ে খেলবি তুই। আর রইলো ওর ডিভোর্স না দেওয়ার কথা৷ প্রিয় যদি তোকে ডিভোর্স না দিতে চাইতো তাহলে তোর সত্যিটা আমাদের সামনে আনতো না। আমার মেয়েটা তোর জন্য এতগুলো দিন কষ্ট পেয়েছে। এই বিয়ে না ভাঙলে বাকি দিনগুলো ও কষ্টে কাটবে আমার মেয়েটার। সেটা হতে দিবো না। ”
প্রিয়ক তখন আমার বাবার পায়ের কাছে বসে পড়ে। অনুরোধের সূরে বলল,
“এমনটা হবে না, মামা। বিশ্বাস করো প্রিয়তাকে আর কোনো কষ্ট পেতে দেবো আমি। যা হয়ে গিয়েছে তা বদলাতে না পারলেও ভবিষ্যতে ওর চোখে একফোটা জল আসতে দিবো না আমি। মামা যদি এমনটা হয় তাহলে তখন তোমরা যে শাস্তি দেবে মেনে নেবো। বাট আমাদেরকে আলাদা করো না। ”
বাবা সেভাবেই বলল,
“এখন আর এসব বলে কোনো লাভ হবে না প্রিয়ক। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।”
“মামা তোমরা না মানলে আমি আর প্রিয়তা এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। ”
প্রিয়কের কথায় সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ছোট চাচ্চু বলল,
“কি বলতে চাইছিস তুই?”
“ঠিকই বলেছি, মামা। তোমরা না মানলে এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে।”
“প্রিয়তা তোকে বলেছে ও তোর সাথে যাবে?”
বাবা প্রিয়ককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“প্রিয়তাকে নিয়ে আসো আয়রা। আমি জানতে চাই আমার মেয়েটা কি চাই?”
আম্মি আমাকে নিয়ে আসলে সবার আগে আমার দৃষ্টি যায় প্রিয়কের দিকে। প্রিয়ক ও তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। প্রিয়কের দৃষ্টিতে বন্দি হই আমি। মলিন তার সেই দৃষ্টি। আমি আসার পর কোমল কন্ঠে বাবা বলল,
“এদিকে আয় মা। বস এখানে। ”
বাবার পাশে যেয়ে বসতেই বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আগের মতোই কোমল কন্ঠে বলল,
“দেখ মা। আমরা কেউই তোর খারাপ চাই না। দুবছর আগে যা হয়েছিল তাতে যে শুধু তোর বিয়ে ভেঙে ছিল, তা কিন্তু না। আমার এতবছরের পুরোনো বন্ধুর সাথেও সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। রায়ান তোকে পছন্দ করেছিল বলেই ওর বাবা আমার কাছে প্রস্তাব রাখে। আমিও রাজি হয়ে যায়। বাসার সবাইও সম্মতি দেয়। আমার বিশ্বাস ছিল আমার বন্ধু তোকে নিজের মেয়ে করেই রাখত। ভালো থাকতি ওখানে। কিন্তু সবটা শেষ হয়ে যায়। আর যার জন্য হয় সে প্রিয়ক। সেটা যদি তোদের বিয়ের আগে জানতে পারতাম তাহলে কখনই তোদের বিয়ে হতে দিতাম না আমরা। প্রিয়ককে ছোট থেকে বড় করেছি। চোখের সামনে ছেলেটাকে হেসে খেলে বড় হতে দেখেছি। দেখেছি তোর প্রতি ওর ভালোবাসা। তাই আর তোদের বিয়েতে অমত করিনি। কিন্তু এখন সবটা জানার পর আমরা কেউই চাই না তোদের একসাথে রাখতে। এমন না যে তোর খারাপ চাই। তাই আমাদের ইচ্ছা তোর উপর চাপিয়ে দেবো না। তুই কি চাস সেটা জানতে চাই। তুই যেটা চাইবি সেটাই হবে। তবে কিছু চাওয়ার আগে সব ভেবে দেখবি। প্রিয়ক বলল তুই ও নাকি বিয়েটা ভাঙতে চাস না। এমনকি আমরা রাজি না হলে নাকি আমাদের ছেড়ে, এই দেশ ছেড়ে ওর সাথে চলে যাবি? এটা কতটা সত্যি তা জানিনা আমি। তবে আমার বিশ্বাস প্রিয়ক তোর জীবনে এতটাও জায়গা করে নিতে পারেনি, যার জন্য তুই আমাদের সবাইকে ছেড়ে ওর সাথে চলে যাবি? হ্যাঁ সেদিন ও বলেছিলি ডিভোর্স চাস না। কিন্তু এতোদিনে আশা করি সবকিছু নিয়ে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিবি। থাকতে চাস ওর সাথে যে তোর সাথে হওয়া এতকিছুর জন্য দায়ী? ”
আজকে আমার বাবার মাঝে অন্য এক বাবাকে আবিষ্কার করলাম আমি। এ বাবার মাঝে নেই কোনো কঠোরতা। এই বাবাও আর দশটা বাবার মতো তার আদরের মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত। বাবার সব কথা শোনার পর বলার মতো ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। আসলেই তো। শুধু মাত্র প্রিয়কের জন্য সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছিলাম আমি। প্রিয়কের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর চোখে একরাশ আকুতি। হয়তো সে দৃষ্টি বলতে চাইছে ‘আমার হাত ছাড়িস না প্রিয়তা’। আম্মির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমাকে কথা বলার জন্য ইশারা করছে। বাড়ির সবাই আমার উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি মাথা নিচু করে বাবাকে বললাম,
“আমি ডিভোর্স চাই, আব্বু। আমি ডিভোর্স চাই। ”
“আমি জানতাম। আমার মেয়েটা ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না। ”
বাবা মাথায় হাত রেখে বলল কথাটা৷ নিজের চোখের কোণে জমা জলটুকু গড়িয়ে পড়ার আগেই মুছে নিলাম আমি। প্রিয়কের দিকে তাকানোর সাহস হলো না আমার। তবে ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
“আমি রুমে যাচ্ছি, আব্বু।”
বলেই একছুটে আমার রুমে চলে আসি। দরজা বন্ধ করে দেই। বাইরে তখন অনেকবেশি কথার আওয়াজ পেতে থাকি। হয়তো প্রিয়ক সবাইকে বোঝাচ্ছে। কিন্তু এখন যে আর কিছুই করার নেই প্রিয়কের৷ বাবা চাচ্চুরা কেউই আর মানবে না ওর কথা৷ সে পথ যে আমিই বন্ধ করে দিয়ে এসেছি।
#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব-৮
.
সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে রাতটুকুই থাকে একটু শান্তির জন্য। একটু আরামের জন্য ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। অথচ আজ! ঘুম নেই কারো চোখে। প্রতিটি মানুষ রাত জেগে বসে আছে। এর মাঝে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ক। বাবা চাচ্চুরা অনেক বেশিই রেগে আছে প্রিয়কের উপর। মামনি আর ফুফাকেও ডাকা হয়েছে। এখানের সবাই নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করছে। প্রিয়ক একবার দৃষ্টি তুলে আমার দিকে চাইতেই তার চোখের কোনে জল জমা দেখতে পেলাম। আমি মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছি৷ এর মাঝে হঠাৎ কান্নায় চমকে উঠে সকলে। নিরবতা ভেঙে কান্নার আওয়াজ আসতেই রিক্তা আপু সেদিকে চলে যায়। চাচ্চু তখন বলেন,
“সবাই যে যার ঘরে যাও। চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো সকলে। বাকি কথা কাল হবে। ”
বড়চাচ্চুর এ কথার পর কারও কথা বলার সাহস হবে না। তাই সবাই চুপচাপ সে জায়গা প্রস্থান করে। সেই সাথে আমিও। আসার আগে আরো একবার প্রিয়কের দিকে তাকালাম। মানুষটা কি রাত এখানেই কাটাবে? ভাবতেই কষ্ট লগছে। আম্মু আমাকে রুমে দিয়ে নিজেও নিজের রুমে চলে যায়। বিছানায় শুয়ে থাকলেও ঘুম নামে না দুচোখে। বড্ড অস্থির লাগছে। হঠাৎ করেই খুব কান্না পেয়ে গেল। বার বার প্রিয়কের গালে পড়া বড় চাচ্চুর চড়ের আওয়াজ কানের মাঝে বাজছে। সবটা শুনার পরপরই বড় চাচ্চু খুব জোরে আঘাত করে প্রিয়ককে। যে ভাগ্নের গায়ে সামান্য ফুলের টোকা লাগতে দেয়নি কখনও। সেই ভাগ্নের গায়ে এমন আঘাত সবার জন্যই অকল্পনীয়। ভেবেছিলাম সবাই রাগ করবে প্রিয়কের উপর। কিন্তু সব এলোমেলো হয়ে গেল।
গেইট খোলার আওয়াজে চুপ করে রইলাম। ঘুমের ভ্যান করে থাকি৷ একটুপরই বুঝত পারি প্রিয়ক এসে শুয়েছে আমার পাশে। একসময় আমাকে তার বুকের মাঝে টেনে নিয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরে। কেন জানি আজ নিজেকে ছাড়ানোর কোনো ইচ্চাই হলে না। চুপচাপ সেভাবেই রইলাম। প্রিয়ককে বলতে শুনলাম,
“এতো অবুঝ কেন রে তুই? কেন বুঝতে পারলি না? এখনতো ছোট না তুই। তবুও কেন বুঝছিস না।”
প্রিয়ক কাঁদছে। না দেখেও বুঝতে পারছিলাম। জানিনা কাল কি সিদ্ধান্ত নেবে সবাই মিলে। তবুও ভয় হচ্ছে। প্রিয়ক আবারও বলল,
“এত চিন্তা করিস না। যা হবে ভালোই হবে। যত যাই হোক অন্যায় তো করেছি আমি। শাস্তি তো পেতেই হবে। তাই এসব না ভেবে ঘুমিয়ে পড়।”
বলা শেষ হতেই আমার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল। আর আমি ভাবছি প্রিয়ক বুঝলো কি করে আমি ঘুমাই নি? ভাবছিলাম আমি? এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ি আমি। তবে আমার মন বলছিল সারারাতে দুচোখের পাতা এক করেনি প্রিয়ক।
পরদিন সকাল বেলা। হালকা পাতলা নাস্তা করেই সবাই বসেছে আমাদের ঘরের বারান্দায়। ফুফা আর মামনি ও এসে গিয়েছে ততক্ষণে। সবটা শুনে মামনি প্রিয়কের গালে এলোপাতাড়ি কতগুলো চড় বসালেন। প্রিয়ক একটু টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। প্রায় ঘন্টাখানেক চলল সেই বিচার। যেবিচারে ভিক্টিম হলাম আমি আর অপরাধী প্রিয়ক। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আমাদের বিয়ে ভেঙে ফেলে হবে৷ অর্থাৎ ডিভোর্স। বাবা যখন এ কথা বলছিল তখন প্রিয়ক বাবার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে ছিল। হয়তো শাস্তি চেয়েছিল তবে এরকম নয়। তার সেই করুন দৃষ্টি একবার আমার দিকেও পড়েছিল। হুট করেই আমার কি হলো জানি না। সবার মাঝে বলে বসলাম,
“আমি ডিভোর্স চাই না। ”
আমার কথায় প্রিয়কের ঠোটের কোণে একচিলতে হাসি দেখেছিলাম। কিন্তু বাব আমার কথা শুনে রেগে গেলেন। রাগী গলায় আম্মিকে বললেন,
“আয়রা, তোমার মেয়েকে সামলাও। বেশি বুঝতে যেন না যায়। আমরা যা বলবো তাই করতে হবে ওকে।”
মামনি হয়তো আমার কথায় একটু ভরসা পেয়েছিল। মামনি বলল,
“দেখ ভাই, যা হয়েছে হয়েছে। মানছি ছেলেটা অনেক বড় ভুল করেছে। কিন্তু তাই বলে ডিভোর্স! ভাই একটা সম্পর্ক ভাঙা যত সহজ, গড়া কিন্তু তার থেকেও কঠিন। আর একবার ভেবে দেখ। আমি জানি আমার ছেলে কেমন। প্রিয়তার কোনো ক্ষতি হবে তা কখনই চাইবে না ও। প্রিয়তা ভালো থাকবে ওর কাছে। বিশ্বাস কর। ”
“তোর উপর বিশ্বাস আছে আমার। যেখানে তুই আছিস সেখানে প্রিয়তাকে নিয়ে একটুও চিন্তিত নয় আমি। প্রিয়ককে নিয়েও ছিলাম না। অথচ ওই আমাদের সবচেয়ে বড় আঘাতটা দিলো। সমাজের কাছে বদনাম হলাম আমরা। তারপর কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। ”
বাবার কথা শেষ হতেই মামনিও চুপ করে রইলো। হয়তো আর কোন কথা খুজে পেল না। তবে এই পুরো সময়টা প্রিয়ক নিবর ছিল৷ যেন একজন জীবন্ত লাশ দাঁড়িয়ে আছে এখানে। সবসময়ের চঞ্চল আর নিজের শক্ত অবস্থান ধরে রাখা মানুষটার এমন নিস্তেজ হয়ে পড়া যেন মেনে নিতে পারছিলাম না। একছুটে নিজের রুমে চলে আসি আমি। ফোন হাতে নিয়ে তন্নিকে ফোন দেয়। তন্নি ফোন রিসিভ করতেই ওকে সবটা খুলে বলি। সব শুনে ও বলে,
“আগে নিজে শান্ত হ, প্রিয়। এরকম হুট করেই কোনো ডিসিশন নিবি না। এখন সবাই রেগে আছে প্রিয়ক ভাইয়ার উপর। এই মুহূর্তে তোর কোনো কথায় তাদের কাছে ঠিক মনে হবে না। তাই দুইটা দিন সময় দে সবাইকে সবটা বুঝে নিতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন তুই তোর ডিসিশন জানাবি। বিয়ে কোনো পুতুল খেলা নয় রে প্রিয়। যে এই জুরলাম ভালো লাগলো না, ভেঙে ফেললাম। আর আমার মনে হয় তোর আগে এই ব্যাপারে প্রিয়ক ভাইয়ার সাথে কথা বলা উচিত। উনি কি চায় সেটা জানতে হবে তোকে। তারপর দুজনে মিলে ঠিক করবি কি করবি? সারাটা জীবন একসাথে থাকবি নাকি ডিভোর্স নিবি। আর আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি?”
“প্রিয়ক ভাইয়া তোকে ভালোবাসে। একটু বেশিই ভালোবাসে তোকে। ”
“এরকম কিছুই না। ”
“আমার মনে হওয়াটা তোকে বললাম। বাকিটা তুই বুঝে নিস।”
সূর্যের উত্তাপ কিছুটা কমে আসতেই প্রিয়ক চলে যায় এ বাড়ি থেকে। চলে যায় বললে ভুল হবে। অনেকটা বের করে দেওয়া হয়েছে। চলে যাওয়ার আগে অবশ্য একবার এসেছিল আমার কাছে। তবে কিছু বলে নি। নিরব চাহনিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল বারবার। মনে হচ্ছিল সবাইকে সত্যিটা জানালেও পারতাম। কিন্তু নিজের উপর এই মিথ্যা অপবাদ যে আর সহ্য হচ্ছিল না। এক দিকে এই মিথ্যা অপবাদ থেকে মুক্তি অপট দিকে প্রিয়কের এমন অবস্থা। কিচ্ছু ভালো লাগছিল না। আব্বু আর চাচ্চুরা আমাকে প্রিয়কের সাথে যেতে দেয় নি। শুধু যে তা তাও ও নয়। আব্বু এই প্রথম আমার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিল। আব্বুর এই নত মাথা ও ছিল আমাকে অপরাধী করার আরেক কারন। সবকিছু বিরক্ত লাগছিল আমার কাছে। মামনি যাওয়ার সময় আমাকে বুকে জরিয়ে ধরে বলল,
“মারে মাফ করে দিস তোর মামনিকে। তোর এই মা টা তোর খেয়াল রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। প্রিয়ককে তুই মাফ করবি কি না সেটা তোর ইচ্ছা। তবে ওকে মাফ করতে পারব না আমি। আজ ওর জন্য ভাইয়াদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলো।
তোর এত বড় ক্ষতিটা হলো। ওর জন্য এতদিন এক মিথ্যা বদনাম বয়ে বেরিয়েছিস তুই। এখন আবার আরেক বদনাম জুড়বে তোর নামের সাথে। সেটাও ওরই জন্য। কখনই ক্ষমা করতে পারব না। যে জন্যই করুক না কেন এই কাজ।কাজটা ঠিক করে নি ও। আমার সাথে কথা বলতে পারত একবার। তাও করে নি। আজ ওর জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। এতকিছু হওয়ার পর কোনোভাবেই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। সেই সাথে প্রিয়ক তোরও যোগ্য নয়।”
কথায় আছে সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সে নিজের মত বয়ে চলে। ঠিক তেমনি আমাদের সময়ও বয়ে চলেছে নিরন্তর। প্রায় ২সপ্তাহ হতে চলল সেই ঘটনার। আমি এখন আমাদের বাড়িতেই আছি। ওবাড়িতে যাওয়া হয় নি আমার। হয়নি বলতে যেতে দেওয়া হয়নি আমাকে। কলেজে নিয়মিতই যাচ্ছি আমি। তন্নি, মুনি, হাসি, রিমন ওদেরও সাথেও দেখা হচ্ছে প্রতিটা দিন। আমাকে খুশি রাখতে ব্যস্ত থাকে ওরা। সবকিছু থাকলেও কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করতে থাকি আমি। প্রিয়কের সাথে এর মাঝে আর দেখা হয়নি আমার। জানিনা মানুষটা কেমন আছে? সবার কাঠিন্যরুপ ঠিক কতটা সহনীয় তার জন্য জানতে ইচ্ছা হয় খুব। তবুও কোথাও থাকা একটা কিন্তু সবকিছু আটকে দেয়। আবিরের সাথে মাঝে মাঝে কথা হলেও তেমন একটা ভালোলাগা কাজ করে না। আগে যেমানুষটার মাঝে নিজের জন্য সবসময় ভালোবাসা দেখতাম সেই মানুষটার সবকিছু সেরকম থাকলেও মনে হয় কিছুই নেই। হয়তো তন্নির কথায় ঠিক। তবে এর মাঝে আবিরের পাগলামি আগের থেকেও বেড়ে গেছে। যেদিন শুনেছে বাসার সবাই আমাদের ডিভোর্সের কথা ভাবছে সেদিন থেকে আবিরও উঠে পড়ে লেগেছে আমি যেন ডিভোর্স দেয়। ওভালোবাসে আমাকে। আমিও জানি তা৷ তবুও কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।
আজ ক্লাস শেষ করে বাইরে আসতেই অনাকাঙ্ক্ষিত একটি মানুষকে দেখতে পেলাম। গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই দৃষ্টিতে কাউকে এক পলক দেখার তৃষ্ণা যেন। তার দৃষ্টি আমাতে পড়তেই এক পলকের জন্য তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ে আমার। সে এগিয়ে আসে আমার দিকে। যত কাছে আসছে বুকের মাঝে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে আমার। সে কাছে আসতেই হাসি, মুনি ওরা তাকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। সেই মলিন হাসি দিয়ে তার জবাব দেয়। তন্নি আমাকে কিছু কথা বলে বিদায় নেয়। ওরা চলে যেতেই মানুষটা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমার সাথে একটু আসতে পারবি? কিছু কথা ছিল। ”
আমি নিরবে সম্মতি দিতেই সে আমার হাত ধরে সাবধানে রোড ক্রস করে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে নিজেও উঠে পড়ে। গাড়ি চলতে থাকলে তার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাই আমি। চোখ দুটো ফুলে আছে তার। চোখের নিচে কালি জমেছে। সেই সাথে চেহারাটাও মলিন। নিজের যত্ন নেওয়ার কথা হয়তো ভুলেই গেছে মানুষটা। সব সময় পরিপাটি থাকা পুরুষটা আজ একদম এলোমেলো।
“এভাবে দেখার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”
হঠাৎ আওয়াজে চমকে উঠি আমি। তার দিকে তাকিয়ে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে নেই। কিছুটা রাগী গলায় বলি,
“দেখতেই পারছি কতটা ঠিক আছো?”
আমার কথায় হালকা হাসি ফুটে ওঠে মানুষটার গালে৷ সেই হাসি বজায় রেখেই বলল,
“বউয়ের মতো অধিকার দেখিয়ে কথা বলছিস। ভালোই লাগছে।”
বউ! আসলেই কি তাই! মানুষটার বউ আমি। আমাদের বিয়ে হয়েছে ২সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে কখনই এমন ভাবে কথা বলা হয়নি। আজ তার মুখে বউ ডাকটা শুনতেই লজ্জায় লজ্জাবতী গাছের মত মিইয়ে গেলাম। আর কোন প্রতিত্তোর না করে বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
.
.
চলবে..??
“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”
তার পরের পেইজে লেখা.
আজ একটা মিষ্টি মেয়ের গল্প বলবো তোকে। মেয়েটার প্রজাপতি খুব পছন্দের। তাই তোর নাম দিলাম প্রজাপতি। জানিস প্রজাপতি, আজ থেকে ১৩বছর পূর্বে একটি ছোট পুতুল এসেছিল এই ধরনীতে। তার ছোট ছোট কোমল হাত, তুলতুলে গাল, তুলার মতো নরম শরীর। তাকে একটি ছুলেই রক্তজবার মতো লাল হয়ে যেত। মনে হত শরীর থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। অথচ ওই ছোট পুতুলটা ছিল আমার খেলার সঙ্গিনী।
এতটুকু পড়ে থমকে যাই আমি। এটা আমাকে নিয়ে লেখা। প্রজাপতি খুবই প্রিয় আমার। আর সেই প্রজাপতি নামই রেখেছে ডায়েরির। একপলক প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও পড়ায় মন দেয়।
“পুতুলটার যখন দুমাস। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করতো সে। যা কেউ বুঝত কিনা জানিনা আমি। কিন্তু আমি আমার মত করে বুঝে নিতাম। ওর একটু কান্না সহ্য হতো না আমার। খাবারের জন্য কান্না করলে পুতুলটার মাকে বারবার বিরক্ত করতাম। তার মা বলতো পুতুলটা এমনিই কান্না করছে। এরকমটা নাকি সবাই করে। তবুও স্থির থাকতে পারতাম না আমি।”
আর পড়তে পারি না আমি। ডায়েরীটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখি। বুকের মাঝটা কেমন যেন ভার ভার লাগে। যে আমাকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারে সে কখনই আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে না। কিছুতেই না। কিছুটা ধাতস্থ হতেই আবারও পড়া শুরু করি। কিন্তু পরের পেইজ পড়তে নিলেই তীব্র আলোক রশ্মি চোখে পড়ে। হকচকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি আমার হাতে যেতেই ডায়েরিটা নিয়ে নেই। কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“এসব কি প্রিয়তা? তুই কবে থেকে অন্যের জিনিসে না বলে হাত দিতে শুরু করলি?”
প্রিয়কের এই কথায় কিছুটা নয়, অনেকটা অবাক হই আমি। তার কোনো জিনিসে হাত দিতে হলে আমাকে অনুমতি নিতে হবে তা ভাবতেই কেমন জানি লাগছে। কেন জানি চোখের কোণে জমা হয় কিছু নোনা তরল। আর তা প্রিয়কের দৃষ্টিতে ধরা দিল কিনা জানা নেই আমার। তবে সে ওই সময় আমার দিকে আর একবারও না তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। আর আমি! সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবতে থাকি এরকমটা করার কারন কী? কিন্তু কোনো উত্তর পায় না। এমনিতেও এভাবে আর কতদিন! যত সময় যাচ্ছে প্রশ্নেরা তাদের ডালপালা মেলে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এত এত প্রশ্নের ভীরে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। তাই বাধ্য হয়েই আমিও বের হয়ে আসি। চারপাশ নিরবতায় ছেয়ে আছে। এর মাঝে সামান্য নিঃশ্বাসের আওয়াজ ও যেন কম্পন তুলছে৷ আশপাশে দেখে বুঝতে পারলাম প্রিয়ক ছাদে গিয়েছে। আমিও উঠে যায় সেদিকে। ছাদের সিঁড়ি ঘরে প্রবেশ করতেই কিছুটা আওয়াজ করেই একটা শব্দ হলো। তাড়াতাড়ি সেদিকে যেতেই দেখলাম প্রিয়ক তার হাত মুঠো করে অনবরত দেয়ালে আঘাত করছে। ছুটে গিয়ে ভাইয়ার হাত ধরতেই আমার হাত থেকে এক ঝটকায় নিজের হাত সরিয়ে নেয়। দুহাতে আমার কাঁধ ধরে ঝাকিয়ে রাগী কন্ঠে বলে,
“এখানে কেন এসেছিস? হ্যা কেন এসেছিস?”
বলেই ছুড়ে ফেলে আমাকে। কিছুটা হেলে পড়ি আমি৷ ততক্ষণে প্রিয়ক নিজের মাথা নিজেই চেপে ধরে রেখেছে। হুট করেই অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,
“আমার কাছে তোর অনেক প্রশ্ন আছে, তাই না? জানতে চাস কেন করেছি আমি? ”
“হুম জানতে চাই। কেন করেছিলে সেদিন ওই করম? কেন ভাইয়া? কেন কলঙ্কিত করেছিলে আমাকে? তুমি তো জানতে আমি তোমার সাথেই ছিলাম। তাহলে মিথ্যা কেন বললে? ”
“জানিস প্রিয়তা। তোর যখন বিয়ে ঠিক হয় আমি জানতাম ও না। অথচ এই বাড়ির সব কিছুতে আমাকে রাখা হতো। ছোট বড় সবকিছুতে আমার মতামতের গুরুত্ব ছিল। অথচ সবচেয়ে বড় ব্যাপারটাই কেউ আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ পর্যন্ত করলো না। মানে তোর বিয়ের কথা হচ্ছে। এমনকি তা ফাইনাল পর্যন্ত হয়ে গেছে তবুও আমি জানতাম না। কবে জেনেছিলাম জানিস? তোর দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন। সেদিন এখানে আসি সবাইকে আমার জবের খবর দিতে। যখন জবের কথা বললাম তখন বড় মামা কি বলেছিল জানিস? ”
আমি শুধু চুপ করে শুনে যাচ্ছি ভাইয়ার কথা। আমার কিছু বলার আগেই আবারও একটু থেমে ভাইয়া আবারও বলতে লাগল।
“বলেছিল ” এটা তো খুবই ভালো খবর। একসাথে দুই দুইটা ভালোখবর এলো তাহলে। ”
আমি অবাক হয়ে মামা কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘আরেকটা কি মামা? ‘ মামা হাসতে হাসতে বলেছিল আরে সামনেই তো প্রিয়র বিয়ে। কেন তুই জানিস না?’ বিশ্বাস কর। এ কথাটা বারবার বুকের মাঝে আঘাত করছিল। আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোর বিয়ে! আমার প্রিয়তার বিয়ে! যে পুতুলটাকে নিজ হাতে বড় করলাম, সবসময় যাকে সামলে রাখলাম সেই পুতুলটার নাকি বিয়ে! ভাবতে পারছিস তোকে ছাড়া থাকতাম কিভাবে আমি? তুই যে আমার কাছে কি? তা আর কেউ জানুক বা না জানুক আমি তো জানি। পারতাম নারে তোকে ছাড়া থাকতে। কারন আমি যে তোকে..”
এতটুকু বলে প্রিয়ক থেমে যায়। ততক্ষণে প্রিয়কের গলা ধরে আসে। কণ্ঠস্বর আগের থেকেও ক্ষীণ হয়ে যায়। কান্না চেপে রেখেছে সেটাও বুঝতে পারছি। কেন জানি সেই মুহুর্তে প্রিয়কের উপর যত রাগ অভিমান ছিল সব হাওয়ায় মিশে যাচ্ছিল। প্রিয়ক জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্থির করে আবারও বলতে শুরু করলো,
“তবুও নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম জানিস। বুঝিয়েছিলাম আমিও তো বাইরে যাচ্ছি ২বছরের জন্য। এমনিতেও তোকে ছাড়া থাকতে হবে সেখানে। তাই সবকিছু মেনে নিয়ে তোর বিয়ের যাবতীয় কাজে সাহায্য করছিলাম। এরই মাঝে একদিন জানালো জবের জন্য তিনদিনের মধ্যে যেতে হবে। তখন মনে হলো সব ঠিক আছে কিন্তু ছেলেটার ব্যাপারে তো খোজ খবর নিলাম না। ১দিনের মধ্যে সব খোজ নিলাম। আর তারপরই জানতে পারি ছেলেটা ভালোছিল না রে। আমার প্রিয়তার যোগ্য সে ছিল না। সে তোর যোগ্য ছিল না রে প্রিয়তা। ছিল না। তারপর অনেক চেষ্ঠা করেছি বাট বিয়ে ভাঙতে পারিনি। মামাদেরকেও বলেছিলাম কেউ শোনেনি আমার কথা। আর দুদিন পরই আমার ফ্লাইট ছিল। কিছু ভাবতে পারছিলাম না। তোকে আমার যাওয়ার কথা আমিই জামাতে মানা করেছিলাম। তুই ভেঙে পড়তিস তাতে। তাই বাধ্য হয়েছিলাম ওই রকম করতে। বিশ্বাস কর আমি শুধু বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছিলাম। তোকে কলঙ্কিত করতে নয়। ”
“তাই বলে এভাবে? একটা বিয়ে ভাঙতে গিয়ে তুমি আমার জীবনটাই শেষ করে দিয়েছো ভাইয়া। আমি আর তুমি সত্যিটা জানলেও এই সমাজ প্রতিনিয়ত মিথ্যের আড়ালে থেকে আমাকে আঘাত করে গেছে। বারবার নিজের মৃত্যু কামনা করেছি আমি। ”
“চুপ কর প্রিয়তা। তোর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়। তোকে হারালে বাঁচতে পারবো না আমি। তাই নিজের মৃত্যুর সাথে আমার মৃত্যুর জন্য ও দোয়া করিস।”
বলার মতো আর কিছু খুজে পেলাম না আমি৷ তবে বুঝতে পারলাম না আমার মনে কি চলছে? প্রিয়ক আবারও বলল,
“আবীরকে বড্ড ভালোবাসিস, তাই না?”
প্রিয়কের এই কথায় তার দিকে তাকাই আমি। সে করুন চাহনীতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি সেসময় কিছুই বলতে পারলাম না। তন্নির বলা কথাগুলো মাথায় আসে হুট করেই। এলোমেলো হয়ে যায় এতো দিনের ভালোবাসি ভেবে আসাটা। চুপ হয়ে যাই আমি। প্রিয়ক আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
“পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস প্রিয়তা।”
“ক্ষমা করতে পারি এক শর্তে। যদি আমার ২টা কথা মেনে নাও। ”
“রাজি আমি। বল কি করতে হবে? ”
“বাড়ির সবাইকে সব সত্যিটা জানাবে তুমি। ”
আমার এই কথায় প্রিয়ক আমার দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে হাসলো। সেটা কষ্টের হাসি নাকি সুখের বুঝতে পারলাম না।
“এই প্রিয়তা, এভাবে ভিজছিস কেন? জ্বর আসবে তোর। ”
কারো ভাবী কন্ঠের আওয়াজে ঘোর ভাঙে আমার। সামনে তাকিয়ে দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভিজছি কেন জিজ্ঞাসা করলেও নিজেও যে ভিজে যাচ্ছে তা হয়তো বুঝতে পারছে না। অনেকক্ষণ ভেজার কারনে মাথা ভার ভার লাগে। একসময় ঢলে পড়ি আমি প্রিয়কের বুকে। প্রিয়ক আমাকে ধরে পাগলের মত করছে তাও বুঝতে পারছিলাম। পুরোপুরি জ্ঞান না হারালেও দূর্বল ছিলাম আমি। প্রিয়ক আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে নিয়ে আসে। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মাকে ডাকতে গেলে আমি হাত ধরে নেই প্রিয়কের। তার অদ্ভুত চাহনিকে অগ্রাহ্য করে তাকে বিছানায় ফেলে তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকি আমি। নিজের শরীরের উষ্ণতা কখন যে প্রিয়কের মাঝেও ছড়িয়ে গেল তা আর বোঝা হলো না আমাদের কারোরই।
পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে চোখ মেলে তাকাই আমি৷ সকাল হয়ে গিয়েছে। উঠে বসতে নিলেই বুঝতে পারলাম কারো শক্ত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ আমি। তার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে বসতে নিলেই নিজের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠি আমি। কাল সন্ধ্যার পরের মুহুর্তটা ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ে। এমনটা হওয়ার কি খুব দরকার ছিল। এমনটা তো না হলেও পারত। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে কিছু নোনা তরল। ততক্ষণে প্রিয়ক ও উঠে যায়। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে বলে,
“এই প্রিয়, কাঁদছিস কেন? খারাপ লাগছে? কি হয়েছে বল না?”
আমি বিস্মিত হয়ে চেয়ে থাকি তার পানে। এতবড় ঘটনা হওয়ার পরও কিভাবে এ কথা বলছে মানুষটা। আবারও ঘৃণা জন্ম নিতে শুরু করে। প্রিয়ক ও হয়তো ততক্ষণে বুঝে গিয়েছে কেন কাঁদছি আমি। প্রিয়ক আমাকে ওর বুকের মাঝে নিয়ে বলল, এই পাগলি, কাদছিস কেন? তুই যেরকমটা ভাবছিস সেরকম কিছুই হয়নি। প্লিজ কান্না করিস না। ”
আমি সেভাবেই ফুফিয়ে বললাম,
“তাহলে এসব কি?”
“মামি চেঞ্জ করে দিয়ে গেছে। ভেজা থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়তি। এমনিতেই কাল জ্বর ছিল। তাই মামিকে ডেকেছিলাম। আমি কিচ্ছু করিনি। শান্ত হ। ”
কিছুটা শান্ত হতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম তার বাহুডোর থেকে। তবে এবার খুব লজ্জা লাগছিল। কি ভাবছিলাম আমি! তাড়াতাড়ি নেমে বাইরে চলে আসি আমি। পিছন থেকে প্রিয়কের মৃদু হাসির আওয়াজ হৃদমাঝারে আঘাত হানে।
সকালের নাশতার পর্ব একটু আগেই শেষ হয়েছে। এখন আয়োজন চলছে আর এক অতিথিদের আপ্যায়নের। আমার বড় চাচ্চুর মেয়ে রিক্তা আপু আর তার স্বামী তুহিন ভাইয়া আসছে তাদের ছোট পরী রিহিকে নিয়ে। আমরা এসেছি শুনেই তাদের আগমন। তাদের।জন্য চলছে আয়োজন। দুপুর না হতেই আগমন ঘটে তাদের। রিক্তা আপু আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে। সেই সাথে প্রিয়ককেও। রিক্তা আপু আমার ২বছরের বড়। এক বছর আগেই বিয়ে হয়েছে আপুর। প্রিয়ক ও আপুকে ভীষণ ভালোবাসে। কোনোরুপ বিপদ আমাদের ছুতে দেয় নি। তাদের ছোট পরীটা ও হাসছে। কোনো কিছু না বুঝলেও হাসিতে মেতে থাকে। তুহিন ভাইয়া আর প্রিয়ক যেন এক নতুন সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে। আর সেটা আমার সাথে প্রিয়কের বিয়ের কারনেই হয়েছে। কিন্তু এতো সব আনন্দ যেন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই যেমন প্রকৃতি কালো আঁধারে ঢাকা পড়তে থাকে ঠিক তেমনি কালো আঁধারে ঢেকে গেল সবকিছু। আর সবকিছুর মূলে অপরাধী একজন। সে হলো প্রিয়ক!
.
.
চলবে…???
#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ৬
বিকালের মৃদু রোদ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমি, প্রিয়ক আর আমাদের ছোট বার্ডটা। পুনম আশপাশ দেখছে আর হৈ-হুল্লোড় করছে। আমার কোলেই বসেছে ও। কতবার পিছনে বসতে বললেও শোনে নি। তাই বাধ্য হয়েই বসেছি৷ আমাদের আর মামনিদের বাড়ি খুব বেশি দূরে নয়। মামনিদের বাড়ি শহরের ভিতর পড়লেও আমাদের বাড়ি পুরো গ্রামীন পরিবেশে পড়েছে। আর দূরত্বটা মাত্র ১ঘন্টার৷ প্রযুক্তির ছোয়ায় আর আধুনিক বাংলাদেশ তৈরীর কল্যানে আমাদের গ্রামের মেঠো পথ আর এখন নেই। কাঁচা পাকা মেঠো পথের পরিবর্তে তৈরী হয়েছে কনক্রিটের পাকা রাস্তা। তবুও বছর বা ঘুরতেই রুপ নিয়েছে এবড়োখেবড়ো রোডে। আশপাশে মোটামুটি ভালো আকারেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকানপাট৷ ক্রেতা বিক্রেতার জমে উঠেছে সেই পরিবেশ। হুট করেই গাড়িতে ব্রেক কষতেই সামনের দিকে হেলে পড়ি৷ আঘাত পাওয়ার আগেই প্রিয়ক তার হাত দিয়ে আমাদের দুজনকে ঠেকিয়ে নেয়। নয়তো ভালোই আঘাত লাগত আমাদের। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ দৃষ্টির মানে বুঝতে ব্যর্থ আমি। শুধু এখন নয়, কলেজ থেকে আশার পর থেকেই তার দৃষ্টি আমার অচেনা লাগছে৷
“নেমে এসো, প্রিয়তা।”
হঠাৎ ডাকে ঘোর কাটে আমার। প্রিয়কের কথায় আশে পাশে তাকালাম। না এখনও তো আসিনি আমরা। তাহলে এখানে কেন নামবো? প্রিয়ক আবারও নামতে বললে নেমে আসি আমি আর পুনম। প্রিয়ক পুনমকে একটা চকলেট আইসক্রিম কিনে দিয়ে হাঁটতে থাকে। একটা দোকানের সামনে এসে থামতেই সামনে তাকাই আমি। একটা ফোনের দোকান। আমাকে নিয়ে ভিতরে যেতে চাইলে বাঁধা দিয়ে গাড়িতে চলে আসি আমি। প্রিয়ক আমার দিকে নিরব দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভিতরে ঢুকে যায়। সেই সাথে পুনম ও। প্রায় ১৫মিনিট পর এসে আমার হাতে ফোন দিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠে বসে। আর পুনমকেও বসায়। গাড়ি চলতে শুরু করে।
“প্রিয়তা’স ড্রিম” লেখা বাড়িটার সামনে নামতেই মনটা কেমন করে উঠল। মনে হচ্ছে বহুবছর পর এসেছি আমি এখানে। অথচ মাত্র আড়াই দিন হয়েছে আমার এখান থেকে যাওয়ার। তাও সেখানে যেখানে আমার রোজ আশা যাওয়া হয়। তবুও মনে হচ্ছে একটা শূন্যতা যেন পূরন হচ্ছে খুব গোপনীয় ভাবে। মা, চাচী আম্মু, ছোট চাচ্চু আর বড় চাচ্চু এগিয়ে আসে আমাদের দিকে৷ মাকে দেখেই তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ি। যেন কতদিনের অভুক্ত আমি৷ চোখ দিয়ে নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়ে কিছু তরল পদার্থ। মা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। একসময় চাচি আম্মুও আমাকে বোঝালেন। মা বললেন,
“পাগল মেয়ে আমার, এভাবে কাঁদে নাকি কেউ?”
“ওদেরকে ভিতরে নিয়ে বসতে দাও।”
পিছন থেকে ভারী গলার আওয়াজ শুনেই বুঝতে পারলাম আব্বু এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে ছেড়ে সেদিকে ফিরতেই দেখলাম আব্বু আমাদের দিকেই আসছে। আব্বু কাছে এসে প্রিয়ককে জরিয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি আমি৷ আমাকে যেমন ওই বাসার সবাই খুব ভালোবাসে প্রিয়ককেও তেমন এবাসার সবাই খুব ভালোবাসে৷ প্রিয়ক এর মাঝেই সবার খোঁজ খবর নিয়ে নিয়েছে। আমাদের দুজনকে আমারই রুমে পাঠিয়ে ফ্রেস হয়ে নিতে বলে। আমারই রুম! যা একসময় আমার সকল ক্লান্তি মেটানোর উৎস ছিল। কত কত স্মৃতি যে জরিয়ে আছে তা বলার বাহিরে। কত নির্ঘুম রাতের নিরব কান্নার সাক্ষী যে এই ঘর, ঘরের প্রতিটি বস্তু। ওরা যদি কথা বলতে পারত তাহলে এই মুহুর্তে প্রিয়ককে নিজেদের মাঝে আসতে দিত না। চিৎকার করে জানাতো সবাইকে। বাট আফসোস।
নিষুতি রাত। কিছু রাত জাগা পাখি ব্যতীত আর কোনো কিছুর আওয়াজ নেই। এর মাঝে খুব দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু করুন সূর। মনে হচ্ছে কান্না করছে কেউ। সেই আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। পাশ ফিরতেই দৃষ্টি যায় প্রিয়কের ঘুমন্ত মুখের দিকে। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। আজও তার বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ আমি। খুব সন্তর্পণে নিজেকে তার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে উঠে বসি আমি। তৃষ্ণা মেটাতে টেবিলের উপর থাকা বোতল থেকে পানি খেয়ে নেয়৷ বোতলটা রাখার সময় চোখ যায় টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে একটি ডায়রী। প্রিয়কের ডাইরী। এর সাথেও জরিয়ে আছে একটি মধুর স্মৃতি। যা ভেসে উঠল চোখের পাতায়।
ডিসেম্বর মাস। ইংরেজি মাসের শেষমাস হলেও বাংলা মাসের নবম মাস। পৌষ মাস। জে এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছিল। খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। তার পুরো ক্রেডিট না গেলেও অর্ধেকের বেশি ক্রেডিট ছিল ভাইয়ার। আমাকে একস্ট্রা ভাবে এত সুন্দর আর সহজ করে সব পড়া বুঝাতো যা সহজেই বুঝতাম আমি। আর মনেও থাকতো। তাই ঠিক করেছিলাম ভাইয়াকে একটা গিফট দিবো। যেই ভাবা সেই কাজ। বাট কী দিবো? তখনই মাথায় এলো ডায়রীর কথা। ফ্রেন্ডের সাথে গিয়ে কিনেছিলাম এটা দোকানটার পাশেই ছিল ঘড়ির দোকান। একটা ঘড়ি ও কিনেছিলাম সেদিন। ভাইয়াকে তা দিতেই এতটা খুশি হয়েছিল তা বলার বাহিরে। কেঁদে ফেলেছিল ভাইয়া। সেদিনই প্রথম ভাইয়াকে কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। আমাকে সেদিন খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরেছিল ভাইয়া।
ডায়রীটা হাতে নিয়ে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলাম আমি। খুব যত্ন করে রেখেছে ডায়রীটা। একটুখানি দাগ পড়তে দেয়নি তাতে। হুট করেই মাথায় এলো ভাইয়ার আমার সাথে করা অন্যায় গুলোর কারন লেখা নেয় তো এখানে! জানতে হবে আমাকে। যা ভাবা তাই কাজ।
বাইরের অতিরিক্ত শব্দে চোখ মেলে তাকালাম আমি। মাথাটা ভার ভার লাগছে আমার। তবুও উঠে বসলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম বেলা অনেক হয়েছে। পাশে প্রিয়ক নেই। তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেস হয়ে নিলাম। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম বাড়ির সবাই ভীষণ ব্যস্ত। মা চাচীরা রান্নাঘরে হরেক রকম খাবারের আয়োজন করায় ব্যস্ত। বাড়ির নতুন জামাই বলে কথা! জামাই! হাসি পেয়ে গেল কথাটা ভাবতেই। আমাকে একা একা হাসতে দেখে এগিয়ে এলো আমার দাদীমা। এসেই বলল,
“কিলো নাতিন, এত হাসছ ক্যান?নাতজামাইয়ের সোহাগের কতা মনে পরল নি?”
“তোমার মতন না গো বুড়ি আমি। ”
“হ্যারে বু। তোগো মদ্যে সব ঠিক আছে লো? পিয়ক কিছু কইছে নি লো?”
দাদীর আদর মাখা কন্ঠশুনেই বুঝতে পারলাম আার জন্য কতটা চিন্তিত ছিল। দাদীর কথায় এক পলকের জন্য দৃষ্টি প্রিয়কের দিকে চলে যায়। মামাদের সাথে কাজে ব্যস্ত সে। সেই সাথে ছোট বাচ্চাদের সাথে চলছে দুষ্টামি। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দাদীকে বললাম,
“সব ঠিক আছে গো, দাদীমা। তুমি এত চিন্তা কইরো না। শরীর খারাপ করবো তোমার। ”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। ”
সকাল পেরিয়ে দুপুর ঘনিয়ে আসে। প্রকৃতি তীব্র রোদের তাপে গরম হতে থাকে। এসময় একটু শীতল বৃষ্টির ছোয়া পেতে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে প্রকৃতির কোণে কোণে থাকা ক্লান্ত শরীর। সেই ছোয়া দিতেই যেন নেমে আসে বৃষ্টির ধারা। বৃষ্টির কণা মাটিতে স্পর্শ করার আগে স্পর্শ করছে আমাকে। বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জলের ধারা। এমনও দিন দেখতে হবে তা জানা ছিল না আমার। কষ্টটা যে এত পরিমানে হতে পারে তা কখনই ভাবতে পারিনি। চোখের নোনা জল যেমন বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে যাচ্ছে তেমন যদি কষ্ট গুলোকেও ধুতে পারতাম! বাট আফসোস!
কাল রাতের কথা মনে পড়ল। ডায়রীর প্রথম পৃষ্টায় খুব সুন্দর করে লেখা
“তুই আমার কাছে ভীষণ প্রিয়। কারন তোকে দেওয়া মানুষটা যে আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। তাই তোকেও ঠিক ততটাই যত্নে রাখবো যতটা আমার সেই মেয়েটিকে রাখা যায়।”
আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না। খুব ভালোবাসি যে তোমাকে।”
আবির আমার দুহাত ওর হাতের মাঝে নিয়ে বলল। আবিরের শেষ কথা শুনে হালকা হাসলাম আমি। সত্যি পাগল ছেলেটা। আবির আমাকে হাসতে দেখে বলল,
“হাসছো যে। হাসির কি বললাম?”
“কিছু না। এমনিতেই হাসি পেলো।”
” বাট এভাবে হেসো না গো প্রিয়। তোমার হাসিটা যে বুকে আঘাত করে। মাতোয়ারা হয়ে যাই আমি।”
আমি হালকা লজ্জা পেলাম আবিরের কথায়৷
“এতো কেন ভালোবাসো আমাকে? ”
” কোনো কারনে তো ভালোবাসি নি। ভালোবাসাটা হয়ে গিয়েছিল৷ আর সারাজীবন ভালোবেসে যেতে চাই তোমায়, প্রিয়।”
আবিরের কথায় হৃদয়মাঝে একটু কষ্ট অনূভুতি হলো। আদো কোনো ভবিষ্যত আছে কি আমাদের? হুট করেই তখন প্রিয়কের কথা মনে এলো৷ কেন করলো আমার সাথে এমন? কেনই বা আবার বিয়ে নামক সম্পর্কে জড়ালো আমাকে? এত এত কেন? অথচ উত্তর দেওয়ার মানুষটা নিশ্চুপ। কিন্তু কতদিন! আমাকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে আবির হাতের তুবড়ি বাজিয়ে নিজের দিকে মনোযোগ নিয়ে এলো।
“কী, কোথায় হারালে?”
“ভাবছিলাম, আবির।”
“কী ভাবছ?”
“আগে কি হবে?
” এত চিন্তা করো না। যা হবে ভালোই হবে।”
“হুম। ”
“চলো তোমাকে ড্রপ করে দিয়ে আসি৷ ”
“তার দরকার নেই। হাসি, মুনি ওরা হয়তো অপেক্ষা করছে। ”
“ঠিক আছে সাবধানে যেও। আর নিজের খেয়াল রেখো। ভেঙে পড়ো না। বি স্ট্রং।”
আবিরের কথার বিনিময়ে হালকাভাবে হাসলাম শুধু। তারপর ওখান থেকে এসে আবার ক্যাম্পাসের সামনে আসলাম। যা ভেবেছিলাম তাই। হাসি, মুনি, রিয়ন আর তন্নি অপেক্ষা করছে। আমাকে দেখেই ওরা দৌড়ে আসল আমার কাছে। হাসি মুনি আর তন্নি আমাকে জরিয়ে ধরে। রিয়ন ওদের ধমকে বলে,
“আরে ছাড় ওরে। যেমনে ধরছিস এখনি না অক্কা পায়।”
রিয়নের কথায় ওরা আমাকে ছেড়ে রিয়নকে মারতে থাকে। পাঁচ বন্ধু আমরা। আমি, মুনিয়া, হাসি, তন্নি আর রিয়ন৷ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল মুনিয়া। সবকিছুতেই ওর চঞ্চলতা বিরাজমান। নিজের নাম হাসি সে কারনেই কি জানি না, সবাইকে হাসিতে মাতিয়ে রাখে যে মেয়েটি, সে হলো হাসি। কষ্টের মাঝেও এমন কিছু বলে বসবে যা অন্যদের হাসতে বাধ্য করে। তন্নি আবার এসবের বিপরীত। সবকিছুতেই গভীর ভাবনা ওর। কোনো কিছু শুনলে বা হুট করে কিছু ঘটে গেলে তৎক্ষনাৎ কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া দেখায় না মেয়েটা। আগে সবকিছু নিয়ে ভাববে তারপর বুঝে শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাবে। তবে ওর এই স্বভাবের জন্য বেশ কয়েকবার আমরা বাকিরা অনেক সমস্যা সহজেই সমাধান করতে পেরেছি। আর রিয়ন! আমাদের কাছে ও হলো সংগীত শিল্পী। আমাদের রকস্টার। যার গান আমরা ব্যতীত আর একটা মেয়ে শুনেছে। মেয়েটির নাম নয়না। ভারী মিষ্টি মেয়ে। মনে মনে রিয়ন নয়নাকে পছন্দ করলেও নয়না করে কিনা জানা নেই আমাদের কারোরই।
“এই প্রিয় কই হারালি?”
মুনির কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় আমি৷ মাথা নাড়িয়ে কোথাও না বুঝাতেই তন্নি বলল,
“হ্যারে প্রিয়, তার মানে সত্যি সত্যিই কি প্রিয়ক ভাইয়া আর তোর বিয়ে হয়ে গিয়েছে?”
“হুম।”
“বাট কিভাবে?”
ওদেরকে সবটা খুলে বলতেই মুনি মলিন মুখে বলল,
“তাহলে আবির ভাইয়ার কি হবে? ”
“কিছু ভাবতে পারছি না আমি। কি করবো তোরাই বল।”
“আবিরকে ভুলে যা, প্রিয়।”
তন্নির কথায় আমরা সবাই ওর দিকে তাকালাম। ও নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছে। আমাদের এভাবে তাকাতে দেখে বলল,
“কী এভাবে কী দেখছিস? ভুল কি বলেছি আমি?”
হাসি বলল,
“দেখ তন্নি, আমরা সবাই জানি প্রিয়ক ভাইয়া কী করেছে প্রিয়র সাথে। তারপর কিভাবে প্রিয়ক ভাইয়াকে মেনে নেবে বলতো? তার থেকে বড় কথা, প্রিয় আবিরকে ভালোবাসে। আর আবির ও।”
“সবটাই জানি আমি। কিন্তু এখন কি কিছু করার আছে? বিয়ে না হলে হয়তো কিছু করা যেত। কিন্তু এখন! আর তোর আর আবিরের ভালোবাসা! এখন যদি তুই বলিস তুই আবিরকে ভালোবাসিস তাহলে সেটা ভালোবাসা না অন্যায় হবে। বিয়ের পরে অন্য কাউকে ভালোবাসলে তাকে ভালোবাসা না, পরকীয়া বলে। ভেবে দেখিস।”
“কিন্তু ওরা তো বিয়ের আগে থেকেই ভালোবাসে একে অপরকে। প্রিয়ক ভাইয়ায় সব নষ্টের মূল। ”
মুনির কথায় তন্নি আমার দিকে দৃঢ় দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল,
“আবিরের প্রতি তোর অনুভূতি টা আসলেই ভালোবাসা নাকি শুধুই ভালোলাগা? ভেবে দেখিস তো প্রিয়।”
আমরা আর কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। কথা বলতে বলতে যে কখন গেইটের বাইরে এসে পড়েছি তা বুঝতে পারলাম গাড়ির হর্ণের আওয়াজে। সামনে তাকাতেই দেখলাম প্রিয়ক গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি আমাদের দিকেই। সবার দৃষ্টি প্রিয়কের দিকে পড়তেই ওরা আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে তন্নি আবারও বলল,
“যা বললাম ভেবে দেখিস প্রিয়। আর প্রিয়ক ভাইয়ার প্রতি, উনার ব্যবহারের প্রতি ও খেয়াল করিস। হয়তো অন্য কিছু ফিল করতে পারবি। বাই। সাবধানে যাস।”
ওরা চলে যেতেই প্রিয়ক এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে আসে। নিজেই গেট খুলে দেয়। সকালের মত এখনও কোনো কিছু না বলেই গাড়িতে উঠে বসি। প্রিয়ক গাড়ির ডোরলক করে নিজেও বসে ড্রাইভিং করতে থাকে। পুরো রাস্তায় কোনো কথা বলি না আমি। বার দুয়েক প্রিয়ক কথা বললেও আমি তার প্রতিত্তর করিনি। তাই প্রিয়ক ও আর কোনো কথা বলে নি। তবে আমার মাথায় ঘুরছে তন্নির বলা কথাগুলো। আসলেই কি আবিরের প্রতি আমার ফিলিং ভালোলাগার? সত্যিই কি ভালোবাসি না আমি আবিরকে? প্রিয়কের দিকে কি নজর দিবো? নজর দিয়ে কি পাবো? প্রিয়কের কথা ভাবতে ভাবতেই ওর দিকে একবার দৃষ্টি চলে যায়। তার চোখে আবারও কষ্ট দেখতে পেলাম। বাট কিসের জন্য? উফফ পাগল পাগল লাগছে নিজেকে। এমনিতেই এত এত প্রশ্ন তার মধ্যে আবার আরেক প্রশ্ন এসে জমা হলো। এত প্রশ্নের উত্তর কোথায়!
দুপুরের সূর্যের তেজ কিছুটা কমে আসলে সবকিছু গোছগাছ করতে শুরু করি। মামনিও হেল্প করে তাতে। যদিও গোছানোর তেমন কিছুই নেই, তবুও সময় লাগছে। বিকালের পরপরই বের হবো আমরা। আমরা বলতে আমি আর প্রিয়ক। সাথে আমাদের ছোট বার্ডটা। গন্তব্য আমাদের বাড়ি। আমার মায়ের কাছে। দুদিন সেখানেই থাকবো আমরা। সবকিছু গোছগাছ করা হলে কিছুটা সময় রেস্ট নিয়ে নেই সবাই। আর পুনম! ওতো পাখির মত উড়তে ব্যস্ত। মামাবাড়ি যাবে সেই আনন্দে আত্মহারা। এর মাঝেই চারবার জামা পাল্টানো হয়ে গিয়েছে ওর। একেকবার একেক জামা পরে এসে দেখাচ্ছে আমাদের। আমরা যতই বলি সুন্দর লাগছে ততই যেন ওর কাছে সেটা খারাপ লাগছে। “নো। ইট’স লুকিং ব্যাড” বলে আবারও অন্য একটা ড্রেস নিয়ে আসছে। প্রতিবার একই কাজ করছে। তবুও যেন নেই কোনো বিরক্তি। আর ওর কান্ডে আমি আর মামনি হেঁসে যাচ্ছি। হাসির মাঝেই আমার দৃষ্টি যেয়ে আটকায় দরজার দিকে। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ক। হুট করেই তন্নির বলা কথা মনে পড়ল। সাথে সাথেই গভীর দৃষ্টি দিয়ে তাকালাম প্রিয়কের দিকে। তার ঠোটের কোণে মৃদুু হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। আর তার দৃষ্টিতে বন্দি হয়ে আছি আমি। তবে আমাকে তাকাতে দেখে সে তার দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেয়। আমি ও আগের মত বসে থাকি। প্রিয়ক ভিতরে এসে বলল,
“হলো তোমাদের? বের হতে হবে তো। ”
“হ্যাঁ হ্যা হয়ে গিয়েছে। বাট তুই তোর এই পাজি বোনের ব্যবস্থা কর। দেখ সেই থেকে কি শুরু করেছে। ”
মামনি বলল প্রিয়কে। প্রিয়ক মামনির কথা শেষ হতেই পুনমকে কোলে তুলে নেয়। নাক টেনে বলল,
“কি হলো আমার ফ্লাওয়ারের? ”
“লুক ভাইয়া। আই আম লুকিং ব্যাড।” বলেই মুখ বানালো পুনম। পুনম ওকে টেবিলের উপর বসিয়ে বলল,
“ইউ নো? ইউ আর অ্যা ফ্লাওয়ার। আর ফ্লাওয়ার অলয়েজ লুকিং প্রীটি। ”
“ইয়েয়ে… আই ম লুকিং প্রীটি।”
বলে নেচে উঠল পুনম। প্রিয়কের দিকে ভালে করে তাকালাম আমি। তার ঠোঁটের কোণের হাসিটা আগের দিকে চওড়া হয়েছে। ভিতর থেকেই যেন হাসছে। এই হাসি মুখের মানুষটা আমার সাথে এত বড় অন্যায় করবে? ভাবতে পারছি না। না কিছুতেই করতে পারে না। খুব বড় কোন কারন আছে এমনটা করার পিছনে। যা আজই জানতে হবে আমাকে। হ্যা আজি।
.
.
চলবে..??
.
সূর্য পূর্বাকাশে উদিত হওয়ার পূর্বেই জেগে উঠে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয় কিছু পাখপাখালি। প্রতিটি পাখির আলাদা সূরের কলকাকলীতে মেতে উঠে পুরো ধরনী। কখনো তা মিষ্টি মধুর সূর হয়ে মানব মনে একচিলতে প্রশান্তির ছোয়া ফেলে যায়। তো কখনো তা বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। তবে ভোরের পাখির মিষ্টি কলধ্বনিতে ঘুম থেকে জাগ্রত হলাম আমি। দুবার চোখ কচলে ভালো করে তাকালাম। শরীরের মাঝে চিটচিটে একটা অনূভুতি হলো। জ্বর সেরে যাওয়ায় ঘাম ছেড়েছিল বোধহয়। তার দরুন এ অবস্থা। এর মাঝে আজকেও নিজেকে প্রিয়কের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ পেলাম। আমি নড়েচড়ে উঠতেই তারও ঘুম ভেঙে গেল। খুব দ্রুত উঠে আমার কপালে হাত ছুঁইয়ে বলল,
“কেমন লাগছে এখন? দেখি জ্বর আছে কি না? যাক জ্বরটা নেই এখন।”
“ভালো।”
“খারাপ লাগলে আজ কলেজে যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় বসে রেষ্ট নে।”
“আমি ঠিক আছি। আমাকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।”
বলেই বিছানা থেকে নেমে আলমারী থেকে একসেট থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখি প্রিয়ক টেবিলের উপর গরম দুধ রাখছে। এলোমেলো ঘরটাও পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছে। ভাইয়া বরাবরই এমন। সবসময় সবকিছু পরিপাটি করে রাখাই পছন্দ করে। অগোছালো থাকলে তা নিজেই গুছিয়ে রাখে। আর আমি বরাবরই তার উল্টা। গুছানো জিনিসকেও অগুছালো করে ফেলি। প্রিয়ক আমাকে দেখে বলল,
“দুধ টা খেয়ে নে। উইকনেস থাকলে তা কেটে যাবে। আর একবারে রেডি হয়ে নিচে আছিস। আমি ড্রপ করে দেবো। ”
“আমি একাই যেতে পারব। ”
“জানি। দুবছর তো গেলিই। এবার না হয় আমিই দিয়ে আসলাম। ”
বলে বেরিয়ে গেল। আমি একবারে রেডি হয়ে নিচে নামতেই দেখা পেলাম ফুফার। টেবিলে বসে আজকের পেপার পড়ছে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চায়ের কাপেও চুমুক বসাচ্ছে। আমাকে নামতে দেখে পেপারটা পাশে রেখে বলল,
“আরে আমার মামনিটা যে। এতো তাড়াতাড়ি উঠলি কেন বলতো।”
“কলেজে যাব। তার জন্য ফুফা। ”
“প্রিয়ক বলল জ্বর এসেছিল নাকি রাতে? তা এখন কেমন লাগছে, মামনি?”
“এখন ঠিক আছি৷ ”
“তাও। আজ না গেলেই পারতি। দুদিন হলো না বিয়ের। এখনি যাওয়ার দরকার ছিল না। ”
“না ফুফা। কতদিন হয়ে গিয়েছে যায় না। পরে পিছিয়ে যাবো আমি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। বাট না খেয়ে যেতে পারবি না।”
“না খেয়ে যেতে দিলে তো।”
মামনির কথায় আমি আর ফুফা পেছনে তাকালাম। মামনি তার হাতের নাস্তার প্লেট ডাইনিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতেই বলল,
“হ্যারে প্রিয়তা। হুট করে জ্বর বাঁধালি কি করে বলতো। প্রিয়ক রাতে যে পরিমান টেনশন করছিল তা বলার বাহিরে। বারবার বলছে ওর জন্য নাকি তোর জ্বর। তুই বলতো এমনটা হয়? কারো জন্য কেউ জ্বরে পড়ে? সে যায় হোক এখন আয় খেয়ে নে। ”
প্রিয়কের প্রতিটা কাজ আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। মানুষটা আজও আমার কষ্ট সহ্য করতে পারে না। তাহলে কেন ভীনদেশে পাড়ি দেওয়ার আগে আমাকে কলঙ্কিত করে গেল? কেন কষ্টের গভীর সমুদ্রে আমাকে ফেলে গেল? সবকিছুতে শুধুই প্রশ্ন! বাট উত্তর কোথায়? প্রিয়ক এমন বিহেভ করে যেন সে কিছুই জানে না। আসলেই কি তাহলে সেদিন ভাইয়া ছিল না? না আর কিছু ভাবতে পারছি না। মাথাটা ভারভার লাগতে শুরু করে৷ এলোমেলো লাগে নিজেকে। একপা সামনে বাড়াতেই হেলে পড়ি আমি। তবে পড়ার আগেই দুহাত শক্ত করে আমাকে ধরে ফেলে। নিজেকে সামলে তার দিকে তাকাতেই দেখি সে চিম্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“ঠিক আছিস? সাবধানে যাবি তো। এখনি তো পড়ে যাচ্ছিলি। ”
ফুফা আর মামনির সামনে এমন করায় অসস্থিতে পড়ি আমি্। তা বুঝতে পেরে আমাকে ছেড়ে দেয়। তবে তা পুরোপুরি না। হাত ধরে নিয়ে চেয়ারে বসায় আমাকে। নিজেও আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। আজ পুনমের স্কুল বন্ধ থাকায় এখনও ঘুমাচ্ছে বার্ডটা। নয়তো তার কিচির-মিচির আওয়াজে মেতে থাকতো পুরো বাড়িটা। শেষ হতেই প্রিয়ক মামনিদের কাছে বিদায় নিয়ে বের হয়ে যায়। আসার আগে আমাকে উদ্দেশ্য করে “বাইরে আছি আমি। ” বলতে ভুলে না। আমিও নাস্তা শেষ করে বের হয়ে আসি। মামনি আর ফুফার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে আসতেই দেখলাম প্রিয়ক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কিছু দেখছে। আমি নজরে আসতেই ফোন রেখে গাড়ির অপর দিকের ডোর খুলে দেয়৷ জানি এখন কিছু বললেও কাজ হবে না। তাই চুপচাপ উঠে বসলাম গাড়িতে। প্রিয়ক ও গাড়িতে উঠে আমার সিট বেল্ট লাগিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ১৫মিনিট পরই গন্তব্যে পৌছে যায় আমরা৷ গাড়ি বের হবো তখন প্রিয়ক বলল,
“আবির কে? প্রিয়তা।”
তার কথায় থমকে গেলাম। আবিরের কথা প্রিয়ক জানলো কি করে? আজ নিজের চেয়েও বেশি খারাপ ওর জন্য লাগছে। মানুষটা পাগলের মত ভালোবাসে আমাকে। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম প্রশ্ন মাখা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি কিছু না বলেই বের হতে নেই। তখন প্রিয়ক আমার হাত ধরে। কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল,
“কে এই ছেলে? কি সম্পর্ক তোর সাথে? কেন ফোন দিয়েছিলিস তুই? ”
“ভালোবাসে ও আমাকে। ”
“আর তুই?”
করুণ শোনালো তার কন্ঠস্বর। তবে এ প্রশ্নে কিছু সময় চুপ থেকে দৃঢ় গলায় বললাম,
” আমিও ভালোবাসি ওকে। শুনেছে তুমি, ভালোবাসি আবিরকে।”
দৃঢ় গলায় বলে তার দিকে তাকালাম। তার চোখে রাগের বদলে সেখানে আকুলতা দেখতে পেলাম। নিরবে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে স্টিয়ারিং এ হাত রাখে সে। বুঝলাম না কোনোরুপ প্রতিক্রিয়া কেন করল না।
তবে খুব বেশি কিছু না ভেবেই নেমে চলে এলাম ক্যাম্পাসে।
ক্লাসে যেতে যেতে ভাবতে থাকি আবিরের কথা। কি জবাব দিবো আমি ওকে। আজ থেকে প্রায় ১বছর আগে পরিচয় হয়েছিল ওর সাথে। কলেজের কালচারাল প্রোগ্রামে খুব বড় বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিল আমাকে। তারপর টুকটাক মাঝে মাঝে দেখা হতো। সৌজন্যেতার খাতিরে দু একটা কথা বললেও তা ধীরে ধীরে রুপ নেই বন্ধুত্বতে। একসময় আবিরই প্রপোজ করে। তখন তাকে নিজের সবকিছু জানায়। সে কোনো রুপ আপত্তি না করেই বলেছিল,
“প্রিয়, তুমি যদি সত্যি সত্যি ও ধর্ষণের শিকার হতে, তবুও ভালোবাসতাম তোমায়। আর যা কিছু হয়ে যাক না কেন সারাজীবন ভালোবাসবো। ”
সেদিনের কথায় মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি। ধীরে ধীরে নিজেও দূর্বল হয়ে পড়ি ওর প্রতি। অথচ আজ! সবটা জানার পর কি হবে ভাবতেই বুক কেঁপে উঠছে আমার।
ক্লাস শেষ করে বের হতেই দেখলাম আবির আমার দিকে দৌড়ে আসছে। আমার সামনে এসে আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে কোনো এক জায়গায়। জায়গাটা আমার পরিচিত। প্রায় প্রায় এখানে এসে আমি আর আবির বসে থাকি। এখানে এসেই আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমার গালে নিজের দুহাত রেখে কাঁপানো কন্ঠে বলল,
“প্রিয়তা এসব কি শুনছি আমি? যা শুনছি তা কি সত্যি? বললা প্লিজ। তুমি নাকি তোমার ওই ভাইকে বিয়ে করেছো? এসব মিথ্যা। তাই না বলো। বলনা সব মিথ্যা! যে অমানুষটা তোমার জীবন নষ্ট করলো তাকে তুমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারো না। বলো না প্রিয়তা, বলো না। ”
আবিরের প্রতিটা প্রশ্ন আমাকে ভিতরে ভিতরে শেষ করে দিচ্ছে। কি জবাব দিবো আমি? এই ভয়টাই যে পাচ্ছিলাম আমি। আবির যে আমাকে কতটা ভালোবাসে তা খুব ভালো করে জানি আমি। যেখানে কেউ আমাকে বিশ্বাস করেনি সেখানে ও আমার একবার বলাতেই সবকিছু বিশ্বাস করেছিল।
“এই প্রিয়তা, চুপ করে কেন আছো? বলোনা গো সব মিথ্যা? বলো না। ”
“আবির আমার কথা শুনো। শান্ত হও প্লিজ। ”
আবির দুহাতে আমাকে ধরে বলল,
“আগে বলো যা শুনেছি সব মিথ্যা। ”
“যা শুনেছো সব সত্যি আবির। ”
মাথা নিচু করে নিলাম আমি। তখনি আবির আমাকে ধাক্কা দিল। আমি কয়েক কদম দূরে চলে গেলাম। অবাক হয়ে তাকালাম আমি ওর দিকে। ও দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে রেখেছে। বুঝতে পারলাম নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্ঠা করছে। আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে। মাথা থেকে হাত নামিয়ে ওকে বসতে বললাম। ওখানের ঘাসের উপরই বসল ও। আমি ও ওর পাশে বসলাম। ওর হাত ধরে বললাম,
“শান্ত হও প্লিজ। তুমি এমন করলে আমি কি করবো বলো? আমি ও তো ভেঙে পরবো নাকি। এমনিতেই এতকিছু সহ্য করতে করতে ক্লান্ত আমি। এক তো তুমিই ছিলে যে আমাকে বুঝতে। আজ কেন বুঝছো না। ”
“কি বুঝবো আমি? বলো কি বুঝবো? চারদিন ধরে ক্লাসে আসছো না তুমি। তিনদিন আগে তোমাকে ভার্সিটিতে না পেয়ে তোমার নাম্বারে কল করি। বাট তুমি রিসিভ করো না। রিসিভ করে তোমার কোন ভাই। সে বলল তুমি অসুস্থ। কিছুদিন আসতে পারবে না। মেনে নিলাম। তারপর থেকে রোজ ফোন করি বাট তোমার ফোন বন্ধ। আর কাল শুনছি তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। জানো যখন তোমার বিয়ের কথা শুনলাম তখন আমার অবস্থা কী হয়েছিল? জানো না তুমি। আর এখন বলছো বুঝতে? বলো এখন কি শুনবো আমি? কি বুঝবো?”
“পাঁচদিন আগে ভাইয়া বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে, আবির। সেদিন ক্লাস শেষ করে বাসায় যাওয়ার পর তাকে আমাদের বাসায় দেখি আমি। সেই সাথে শুরু হয় আমাদের বিয়ের কথা বার্তা৷ আমি মানা করলেও কেউ শুনে না। রাগারাগি করে রুমে চলে আসি আমি। তখন রাগের মাথায় কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। তোমাকে বলবো সেটাও মাথায় আসে নি। গোসল করে বের হয়ে তোমাকে জানানোর জন্য ফোন খুজতে যেয়ে কোথাও পায় না। আম্মুর ফোন চাইলে দেয় না। তাদের মনে হলো আমি পালাতে পারি। তাই ঘর বন্দি করা হলো আমাকে। না ছিল ফোন আর না ছিল বাইরে যাওয়ার উপায়। কাউকে আমার সাথে দেখা করার অনুমতি ও দেওয়া হলো না। আর তুমি তো চিনোই আমার বাবা কাকাকে। একজন ধর্ষিতা অপবাদের মেয়েকে যে তার ভাগ্নে বিয়ে করতে চেয়েছে এটাই বা কম কি? ধর্ষিতাকে কে বিয়ে করবে বলো? এসবের মাঝে কি করে জানাতাম আমি তোমাকে? কাঠের পুতুলের মতো আমাকে বিয়ে দেওয়া হলো। এবার তুমিই বলো কী করতে পারতাম আমি? ”
“আই ম সরি, প্রিয়তা৷ আমারই বোঝা উচিত ছিল। তোমার অসুস্থতার কথাও মনে হয় ওই অমানুষটা বলেছিল। বাট তুমি চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ধর্ষিতা হও কিংবা বিবাহিত। আমি তোমাকে ছাড়তে পারবো না। খুব ভালোবাসি যে তোমাকে।”
” নো, ফ্লাওয়ার, আপি যাবে না। ভাইয়া যাবে।”
পেছন থেকে আওয়াজ হতেই আমরা পেছনে তাকালাম।
২.
পুনম ওর ভাইয়াকে দেখেই আমার কোল থেকে নেমে ভাইয়ার কাছে গিয়ে জরিয়ে ধরে। ভাইয়া ওকে কোলে নিতেই পুনম আদুরে গলায় বলল, “ইয়েয়েয়ে… খুব মজা হবে। ”
আমি চলে আসতে নিলেই মানুষটা ডাক দিল, “প্রিয়তা! ” আমি কিছু না বলে শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম। উনিই আবার বলল,
“তোমার আজ কলেজে যেতে হবে না। কাল থেকে যেও। ”
নিচে আসতেই দেখা পেলান ফুফুর। রান্না ঘরে নাস্তা বানানোয় ব্যস্ত তিনি। আমাকে দেখেই আদুরে গলায় ডাকল,
“উঠে পড়েছিস? যাক ভালোই হলো। টেবিলে দেখ নাস্তা দেওয়া আছে৷ প্রিয়ক উঠেছে? না উঠলে ডাক দে। একসাথে খেয়ে নে দুজন। ”
“উঠেছে মামনি। পুনমের সাথে আসছে। ”
“ঠিক আছে। বস তুই। আমি হাতটা ধুয়েই আসছি। ”
“আচ্ছা মামনি৷ ”
ছোট থেকেই ফুফুকে মামনি বলি আমি। ফুফু আমার মায়ের থেকে কোন অংশে কম না। আমার জন্মের সময় মা অসুস্থ ছিল খুব। সেসময় ফুফুই আমাকে সামলে রেখেছে। অতটুকুন একটা বাচ্চা মেয়েকে সামলানো সহজ কথা নয়। যা ফুফু করেছিল। মা পুরো সময়টাই শুয়ে থাকত। আমাকে কোলে নিয়ে বসবে সেই অবস্থাটাও ছিল না। তার কারন খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়েছিল মায়ের। বিয়ের পরপরই আমার জন্ম। অত অল্প বয়সে এতটা ধকল নিতে না পারায় ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। দুই তিনমাস লেগে গিয়েছিল মায়ের সুস্থ হতে। এসময় মা আমাকে খুব বেশি যেটা করতে পারত তা হলো আমাকে খাওয়ানো আর ঘুম পাড়ানো। বাকি সবকিছু ফুফুই করতো। দাদী না থাকায় পুরোটাই ফুফুর উপর এসে পড়ে। কথা বলা শিখতেই ফুফুকে মামনি ডাকি আমি। আর ফুফু ও আমাকে মেয়ের মতো না মেয়েই মনে করে আদর যত্ন করে।
টেবিলে বসার কিছু মুহূর্ত পার না হতেই পুনম আর প্রিয়ক নিচে নেমে আসে। পুনম তখনও প্রিয়কের কোলে। পুনমকে নিয়ে বের হতে গেলেই মামনি বাঁধা দেয়। বলে,
“আগে খেয়ে নে। তারপর যা।”
“মা, অলরেডি অনেকটা লেইট হয়ে গিয়েছে। খেতে বসলে আরো লেইট হবে। এসে খেয়ে নিব।”
“কোনো লেটফেট হয়নি। এখনও অনেকটা সময় আছে । আগে খেয়ে নে। তারপর যাবি। ”
“আচ্ছা। ”
মামনির রাগের কাছে বাধ্য হতে হয় প্রিয়ককে। অবশ্য মায়ের বাধ্য ছেলেই বলা যায় প্রিয়ককে। পুনমকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়ে আমার পাশের চেয়ারে। তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় আমার। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নেই। বুঝতে পারি তার দৃৃষ্টিও আমাতেই ছিল। প্রিয়ক কোনো মতে একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে উঠে পড়ে। পুনম আগেই খেয়ে নিয়েছিল। তাই আর কিছু খায় না। পুনমকে আবার ও কোলে নিয়ে বলল,
“সবাইকে বাই বলো।”
“গুড বাই, মাম্মা, আপি।”
“গুড বাই, মাই লাভ বার্ড। ”
পুনমকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আরও একবার তার দৃষ্টিতে আবদ্ধ করে নেয় আমাকে। প্রিয়ক আর পুনম বের হয়ে যাওয়ার পর আমি আর মামনি খেয়ে নেয়। নিজের মনের ভেতরের অবস্থা ভিতরে রেখেই মামনির সাথে গল্প করে সকালটা কাটালাম।
এখন শরৎকাল। এসময়ের আকাশটা আমার খুব পছন্দের। মন খারাপ কিংবা ভালো দুটোর সাক্ষী ওই দূরের নীল সাদা রঙের মিশ্রিত আকাশ। মামনিদের ছাদের উপর একটা ছোট দোলনায় বসে আছি আমি। দোলনাটায় আসলেই ছোট। একজন সুন্দরভাবে বসতে পারবে। আর দুজন বসতে গেলে একজনের কোলে আরেকজনকে বসতে হবে। দোলনাটা আমিই বানাতে বলেছিলাম। আমার জীদের কাছে হার মেনে প্রিয়কই বানিয়ে দিয়েছিল। সেদিনটার কথা এখনও চোখে ভাসে।
তখনও এমনি শরৎকাল ছিল। হঠাৎ করেই এসেছিলাম মামনিদের বাসায়। আর এসেই কেন জানি চলে আসি ছাদে। আশপাশ দেখতে দেখতে হুট করে দোলনায় দোল খাওয়ার ইচ্ছা হলো। কিন্তু ছাদে কোনো দোলনা ছিল না। তাই দৌড়ে নিচে নেমে মামনির কাছে যায়।
“মামনি, মামনি।”
“কি হলো তোর আবার? হুট করে এসেই ছাদে চলে গেলি। আবার এখন নেমে লাফাচ্ছিস কেন?’
” উফফ মামনি। আমার কথা তো শোনো।”
“আচ্ছা বল। শুনছি।”
“ভাইয়া কোথায় বলোতো?”
“ওতো ওর ঘরেই আছে। হয়তো ঘুমাচ্ছে।”. ” এখন! কিন্তু এখন তো ভাইয়া ঘুমায় না । তাহলে?”
“অনেক রাত করে ফিরেছে কাল। তাই।”
“আচ্ছা দেখছি আমি।”
বলেই মামনির আর কোনো কথা না শুনেই উপরে চলে যায় ভাইয়ার রুমে। ভাইয়া কখনও দরজা লক করে ঘুমায় না। তার খোলায় পেলাম। ভিতরে ঢুকে আসলেই ভাইয়াকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখলাম। একবার ডাকবো না ডাকবো না করেও মনের ইচ্ছা দমিয়ে না রাখতে পেরে ডাক দেই ভাইয়াকে।
‘ভাইয়া, ও ভাইয়া। ওঠো না।”
ভাইয়া একটু নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। উঠাবোই ভাইয়াকে। তাই টেবিলের উপর থাকা পানির গ্লাসের কিছুটা পানি ভাইয়ার মুখে ঢেলে দেয়। এভাবে পানি ঢালায় ভাইয়া লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। সাথে রেগেও যায়। সেসময় ভাইয়ার চোখ দেখে ভয় পেয়েছিলাম খুব। তবে ভাইয়া আমাকে দেখতেই শান্ত হয়ে যায়। সমস্ত রাগ যেন হাওয়ায় মিশে যায়। ভাইয়া সবার উপর রেগে গেলেও আমার বেলায় তা হয়ে ওঠে না। সেদিনও তাই হয়েছিল। শুধু আস্তে করে বলেছিল, “এটা কি করলি তুই?”
ভয়ে আমতা আমতা করে বলেছিলাম, “সরি ভা.ভাইয়া। তু.তুমি উঠছিলে না। তাই।”
“তাই বলে এভাবে? আর এখন এখানে কেন তুই?”
“এমনি।”
“আচ্ছা কি চাই সেটা বল। আর কিছু না চাইলে নিচে যা। মামনির সাথে কাজ কর। ”
“দোলনা। দোলনা চাই ভাইয়া৷ ”
ভাইয়া আমার কথায় অনেকটাই অবাক হয়েছিল। কেমন করে যেন দেখছিল আমাকে। যেন কোনো ভিনগ্রহের প্রাণী এসে দাঁড়িয়ে আছে ওনার সামনে। কিছুকাল পার হতেই বলল, ” মাথা কি গেছে তোর। ছোট বাচ্চা নাকি তুই? তুই দোলনা দিয়ে কী করবি? ”
ততক্ষণে আমার সব ভয় উধাও হয়ে গিয়েছে। জেদ ধরি দোলনার জন্য। না পেরে সেদিনই লোক নিয়ে এসে বানিয়েছিল দোলনাটা। দোলনা দেখে এতোটাই পছন্দ হয়েছিল যে খুশিতে ভাইয়াকে জরিয়ে ধরছিলাম। ভাইয়া আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল, “আমার পাগলিটা।” আমার খুশিটাই ছিল তার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আজ! তার জন্যই মিথ্যা অপবাদ বয়ে বেড়াচ্ছি দিনের পর দিন। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি কানে আসতেই হুস ফেরে আমার৷ দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসার সময় দুহাতের বাঁধা পায়। হুট করে এমনটা হওয়ায় ভয়ে কেঁপে উঠি। সামনে তাকাতেই দেখি প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে নিমিষেই ভয়টা কেটে যায়। কিন্তু প্রিয়ক এখানে কখন এলো তা বুঝতে পারলাম না। আমি নিজেকে তার বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিতেই ভাইয়া বলল,
“এত তাড়াহুড়ো করিস কেন সবসময়? এখনি তো পড়ে যাচ্ছিলি।”
আমি কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আবারও হাত ধরে টান দেয়। এবার টানে সোজা তার বুকে গিয়ে পড়ি। ভয় ও পায় কিছুটা। তাতে আপনা আপনিই দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরি। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে প্রিয়ক আমাকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে। আর বলল,
“আর একবার ছটফট করলে ছাদে নিয়ে যেয়ে নিচে ফেলে দিবো বলে দিলাম। চুপচাপ এভাবে থাক। ”
আমি চুপ করে রইলাম। জানি আমার ক্ষেত্রে এমনটা কখনই করবে না। তবুও চুপ করে রইলাম কি বলে সেটা শুনতে। এবার প্রিয়ক নিজেই আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাত আমার গালে রেখে বলল,
“এই পাগলী, আমার সাথে কেন কথা বলছিস না? হ্যাঁ কেন বলছিস না। আজ পাঁচদিন হলো এসেছি আমি। চার মধ্যে দুটো কথাও তুই আমার সাথে বলিস নি। সবার সাথে কথা বলছিস। এমনকি পুনমের সাথেও দুষ্টুমি করছিস। শুধু আমার সাথে কথা বলছিস না। কেন হ্যাঁ কেন? কি করেছি আমি।”
“এত কিছুর পর ও তুমি আশা করছো তোমার সাথে কথা বলবো? কি করেছো জানো না তুমি? আমার জীবনটা শেষ করে এখন বলছো কি করেছো। কি করেছো জানোনা, তাইনা ভাইয়া? কিচ্ছু জানোনা তুমি?”
চলবে….????
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন এবং অবশ্যই ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে আমাকে শুধরাতে সাহায্য করবেন। আর এতোটা অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ।)
#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি
#মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ৩
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। প্রায় একঘন্টার উপর শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছি। তবুও রাগটা কমছে না। যে মানুষটা এতো কিছু করলো, যার জন্য এত কিছু হলো, সেই এখন জিজ্ঞাসা করছে কী করেছে! মানুষটার প্রতি যা একটু সম্মান বাকি ছিল তাও যেন শেষ হতে চলেছে। নিচ থেকে মামনির ডাক কানে আসায় নিচে নেমে আসি। বেতের তৈরি সোফার উপর বসে আছে মামনি। তার পাশে পুনম আর প্রিয়ক ও আছে। পুনমের হাতে মিল্কশেক। মামনির হাতে চায়ের কাপ আর প্রিয়কের হাতে কফি মগ। মামনি আমাকে দেখে একটা চাপের কাপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“প্রিয়ক বলল মাথা ধরেছে নাকি তোর? নে এটা ধর। চা টা খেয়ে নে। দেখবি মাথা ধরাতরা সব সেরে যাবে। ”
“না মামনি। কিছু খাবো না এখন। ঠিক আছি আমি। ”
“কত ঠিক আছিস, জানি আমি। বস তো এখানে। চুপচাপ চা টা শেষ কর। ”
বাধ্য হয়েই চাপের কাপ হাতে নিলাম। আর এও বুঝতে পারলাম আমার এ সময়ে গোসলের কারন প্রিয়ক মামনিকে আমার মাথা ব্যথার অযুহাত দিয়েছে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম মনে মনে। একটু একটু করে চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছি আর প্রিয়ককে দেখছি। কতটা শান্ত ভাবে বসে কফি খাচ্ছে মানুষটা। কে বলবে এই মানুষটা কারো সুন্দর জীবনকে নিজের হাতে শেষ করে দিয়েছে। তবে এই মানুষটার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে। অনেক প্রশ্ন আছে। যার উত্তর একমাত্র তার কাছেই আসে। আর সেই উত্তর যে কোনো মূল্যেই আমার চাই।
চা প্রায় শেষের দিকে। তখন মামনিকে বললাম,
“মামনি, আমার ফোনটা দেখেছো তুমি? কয়েকদিন ধরে পাচ্ছি না। ”
“ওটা ভেঙে গেছে। তাই ফেলে দিছি। নতুন ফোন কালকেই পেয়ে যাবি।”
মামনি কিছু বলার আগেই কফি মগে আর এক চুমুক দিয়ে প্রিয়ক বলল। অত্যন্ত অবাক হয়ে তাকালাম প্রিয়কের দিকে। অথচ মানুষটার এদিকে যেন কোন ধ্যান নেই। সে তার মতো কফি খেতে ব্যস্ত। কত সহজে বলে দিল ভেঙে গেছে। যেদিন প্রিয়ক বাইরে থেকে এসেছে সেদিন থেকেই ফোনটা পাচ্ছি না। তার মানে ফোনটা প্রিয়কই সরিয়েছে। ভাবতেই মনটা আরো বিষিয়ে উঠল। সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মামনির দিকে তাকিয়ে বললাম,
“মামনি তোমার ফোনটা দাও তো। আম্মির সাথে কথা বলবো। ”
“আচ্ছা এই..”
“মায়েরটা নেওয়ার দরকার নেই। আমার টা নিয়ে যা। ”
মামনিকে বাধা দিয়ে প্রিয়ক তার ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কথাটা বলল। রাগ লাগছিল খুব। মামনির সামনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে চাইনি। তাই ফোনটা নিয়ে উপরে চলে আসি। আসার সময় মামনিকে আসছি বলেই এসেছি। তবে প্রিয়ককে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করিনি। তবে তার দৃষ্টি যে আমার যাওয়ার পানে ছিল তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।
রুমে এসেই আগে মায়ের নাম্বারে ফোন দেওয়ার জন্য ফোন অন করতেই দেখলাম লক দেওয়া। প্রিয়ক না খুলেই আমার কাছে ফোন দেওয়ার জন্য রাগ হলো খুব। দু একবার চেষ্ঠা করেও যখন খুলতে পারলাম না তখন পিছন থেকে আওয়াজ এলো।
“উল্টা পাল্টা পাসওয়ার্ড দিয়ে ট্রাই না করে সঠিকটা দিলেই তো খুলে যায়। তোর দেওয়া পাসওয়ার্ডটাই আছে। ”
প্রিয়কের কথায় চরম মাত্রায় অবাক হলাম। আজ থেকে আরো চার বছর আগে ভাইয়া যখন নতুন ফোন কিনে তখন ফোনটা সবার প্রথম আমি হাতে নিয়েছিলাম। দুষ্টুমি করে আমার নাম লিখে পাসওয়ার্ড দিয়ে দেই৷ ভাইয়া তা দেখে আমাকে কিছুই বলে নি। শুধু মুচকি হেসেছিল শুধু। কিন্তু এটা তো সেই ফোন নয়। অন্য আরেকটা৷ লক স্ক্রিনে আমার নাম লিখতেই তা আনলক হয়ে যায়। একটু বেশিই অবাক হয় আমি। প্রিয়কের দিকে তাকাতেই দেখলাম হালকা হাসির রেখা ফুটে আছে। যেন চোখে হাসছে মনে হলো। আমি কিছু না বলেই আম্মিকে ফোন দিলাম। আর প্রিয়ক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই নিচে চলে যায়।
ফোনের ওপাশ থেকে আম্মির কন্ঠস্বর পেতেই ঢুকরে কেঁদে ফেললাম আমি। আম্মি আমাকে শান্ত হতে বলে।
“পাগল মেয়ে আমার। এভাবে কাঁদে নাকি কেউ? চুপ যা তো। আমার লক্ষী। ”
“তুমি কেমন আছো আম্মি। তোমাকে ভীষণ মিস করছি।”
“আমি ঠিক আছি। আর আমি এও জানি তুই ও ভালো থাকবি ওখানে। ওখানে যে তোর আর এক মা আছে। ”
“হুম, আম্মি। কিন্তু ভাইয়াকে যখন দেখি রাগে আগুন জলে। মনে হয় খু*ন করে ফেলি তাকে। ”
“শান্ত হ। আমার মেয়েটা এত অধৈর্য কবে হলো? যে ধৈর্য ধরে সবকিছু সামলায় একদিনের এতটা ধৈর্যহারা হয়ে গেল।”
“আম্মি, তাকে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না আমার।”
“অধৈর্য হইস না মা আমার। একটু সবুর কর। আর প্রিয়ককে জিজ্ঞেস করছিলি কেন করেছিল এমনটা সে? কিছু বলেছে?”
“না আম্মি। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করি নি। তার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। ”
“জানি রে। তবুও বলতে তো হবেই। আমি ও যে জানতে চাই আমার ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটার গায়ে কেন মিথ্যা কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে গেল? কেনই বা তোকে বিয়ে করল?”
“আচ্ছা আম্মি। সময় সুযোগ বুঝে জানতে চাইবো।”
“ঠিক আছে। মন খারাপ করবি না একদম। নিজেকে শক্ত করে রাখবি। মায়ের মতো দূর্বল হবি না একদম। ”
“হুম।”
আরো কিছু কথা বলে ফোন রেখে দিলাম আমি। তারপরই কিছু একটা মনে পড়তেই ফোনের গ্যালারিতে গেলাম। এখানের অবস্থাও সেই পূর্বের ন্যায়। আমার অজস্র ছবি আর ভিডিওতে ভর্তি হয়ে আছে। এগুলো একসময় খুব প্রিয় থাকলেও আজ তা যেন সহ্য হচ্ছে না। আমার সমস্ত ছবি আর ভিডিও ডিলেট করে দেয় ফোন থেকে। তাতে কিছুটা শান্ত মনে হয় নিজেকে। ডায়াল প্যাডে গিয়ে খুব সাবধানে একটা নাম্বার উঠিয়ে কল করি। দুবার রিং হওয়ার পর ও রিসিভ না হওয়ায় ডিলেট করে দেই নাম্বারটা। ফোন নিয়ে নিচে যেতে গেলেই রিং বেজে ওঠে ফোনের। স্ক্রিনে পরিচিত নাম্বার দেখতেই তা রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আসা শব্দে বুক কেঁপে উঠল আমার। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই “এখনও কথা বলা শেষ হয়নি?”
শব্দে পিছনে তাকাতেই দেখলাম প্রিয়ক দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কিছু না বলে ফোন কেটে দেয়৷ “হয়েছে।” বলে ফোন তার হাতে দিতেই মনে পড়ে নাম্বারটা ডিলেট করা হয়নি। যদি দেখে তাহলে কি হবে ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসে আমার। আবার ফোন চাইবো তার আগেই প্রিয়ক ফোন নিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রিয়ক বেরিয়ে যেতেই বিছানায় ধপ করে বসে পড়ি। টেনশন আর ভয়ে নিজেকে পাগল পাগল লাগছে আমার। কিন্তু কিছু মুহুর্ত পার হতেই প্রিয়ক হন্তদন্ত হয়ে আবারও রুমে আসে। আর এসেই আমার গলা টিপে ধরে। আর বলে,
“বড্ড বার বেড়েছিস তুই। তোর সাহস কি করে হলো ছবিগুলো ডিলেট করার? বল কি করে হলো? ”
শ্বাস আটকে আসে আমার। তবুও ছাড়ার নাম নেই। তার চোখমুখ থেকে যেন আগুন ঝরছে। আর সে আগুনে আমাকে পুড়িয়ে ছাই না করা পর্যন্ত নিভবে না। একসময় হুট করেই আমাকে ছেড়ে দেয়। ছাড় পেতেই তার থেকে খানিকটা দূরে সরে যায়। বার কয়েক জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকি। সেই সাথে কাশি তো আছেই। প্রিয়ক আমার দিকে আবার ও অগ্রসর হতে নিলেই নিজেকে গুটিয়ে নেই। তবে এবার তার চোখে রাগ নয়, যেন কষ্ট দেখতে পেলাম আমি। বাট সেটা কিসের কষ্ট? আমার এই অবস্থা দেখে নাকি আমাকে শেষ করতে না পারায়! উত্তর পেলাম না কোনো। এর মাঝেই প্রিয়ক আমাকে তার বুকে জরিয়ে নেয়। আমি ছাড়াতে গেলে শুনতে পায়,
“আই ম সরি, প্রিয়তা। আই রেলি সরি। বিশ্বাস কর তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। তুই বল তোকে কখনও কষ্ট দিতে পারি আমি? বললা? পারি আমি।”
শেষের কথাগুলো আমার গালে হাত রেখে বলল। আমার সারা মুখে তার উষ্ণ পরশ বুলাতে থাকে পাগলের মতো। সেই মুহূর্তে মনে হলো আমি অন্য কোথায় রয়েছি। প্রিয়ক তখন পাগলের মতো করছিল। যেন কষ্ট আমি না, ও পেয়েছে। কিন্তু কেন? আমার কষ্টে সে কেন পাগলের মতো করছে?
সারাদিন নিজের উত্তাপে পুরো ধরনীকে উত্তপ্ত করে রাখলেও সন্ধ্যা নামলেই যেন নিজেকে আড়ালে লুকিয়ে ফেলে দূর আকাশে থাকা নক্ষত্রটি। সে সময় প্রকৃতি সেজে উঠে অন্য রকম এক সৌন্দর্যে। এক সময় তা রুপ নিতে থাকে কালো আঁধারের। সেই আঁধারকে আবার আলোকিত করতে উদয় হয় অন্য আরেকটি গ্রহ। তাতে হয়তো পুরো ধরনী আলোকিত হয় না। তবুও আলোকিত করার অনির্বাণ চেষ্টা তার। তবে কৃত্রিম আলোয় ঠিকই আলোকিত হয় ধরনী। সেই কৃত্রিম আলোর মৃদু রেখা সারা রুমে পড়তেই চোখে পড়ল প্রিয়ককে। রাতের খাবার খেয়ে এসে নিজে শুয়ে পড়লেও রাতজাগা পাখির মত জেগে আছে প্রিয়ক। কাল রাতের মতো আজও তার হাতে কলমটি রয়েছে। তা দ্বারা কিছু লিখে চলেছে একটু পর পর। এই মুহূর্তে একটা নিষিদ্ধ ইচ্ছা মনের মাঝে জাগ্রত হলো। তবে তা করা হলো না। এলোমেলো চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম তা আর টের পেলাম না।
কপালে কিছু শীতল স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় আমার। মস্তিষ্ক জাগ্রত হলেও হতে পারল না চোখদুটি। বড্ড ক্লান্ত মনে হলো তাকে। মেলতে কষ্ট হচ্ছে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই আবছা আলোয় প্রিয়কের মুখটা চোখে পড়ল। কিছু একটা করছে সে। একটু পরই ঠান্ডা কিছু আমার কপালে রাখতেই কেঁপে উঠলাম আমি। উঠতে গেলে নিজের শরীরের উপর প্রচন্ড ভার মনে হলো। জ্বর এসেছে বুঝতে আর বাকি রইলো না। আর প্রিয়ক যে মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে তাও বুঝতে পারলাম। ছোট বেলা থেকেই এই অভ্যাসটা আছে আমার। ভয় পেলে জ্বর চলে আসে। সন্ধ্যায় প্রিয়কের হুট করে ওমন করায় যে ভয় পেয়েছিলাম এটা তারই পরিনাম। প্রিয়ককে কিছু বলতে চাইলেও কন্ঠস্বর থেকে কোনো ধ্বনি বের হলো না। শুধু ঠোঁট নাড়াতে পারলাম। তাতে প্রিয়ক কি বুঝল কে জানে। তবে আমাকে বলল,
“কথা বলিস না। চুপ করে শুয়ে থাক। ঠিক হয়ে যাবে।”
প্রিয়কের কন্ঠস্বর অন্য রকম ছিল। অনেকক্ষণ কান্না করলে বা জোর করে কান্না আটকে রাখলে যেমম শোনা যায় ঠিক তেমন। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে অন্য রকম আলোড়ন সৃষ্টি হতে লাগল।
যে মানুষটার জন্য ধর্ষিতার তকমা গায়ে লেগেছিল সেই মানুষটার জন্যই আজ বউ সেজে বসে আছি। নিজেকে আরো একবার ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখে পরখ করে নিলাম। কোথাও কোনো কমতি নেই। মানুষটা যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই সাজানো হয়েছে আমাকে। সকলের সামনে মহান সেজে ঘুরে বেড়ানো মানুষটাই যে আমার ধর্ষিতা হওয়ার জন্য দায়ী তা সকলেরই অজানা। ধর্ষিতা না হয়েও এই মানুষটার জন্য সবার চোখে ধর্ষিতা হয়েছিলাম আমি। তিনটি বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি এই অসহ্য যন্ত্রণা।
মানুষটা আর কেউ না, আমারই আপন ফুফাতো ভাই। সেদিনটার কথা কখনও ভুলতে পারবো না আমি। তখন আমি মাত্র এসএসসি পরীক্ষার্থী। আর সেদিন ছিল আমার লাস্ট পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষা হওয়ায় খুব খুশি ছিলাম আমি। অনেক দিনের ছুটি কাটাতে পারবো ভেবেই মনটা নেচে উঠেছিল। বান্ধবীদের সাথে আড্ডা শেষে যে যার নিজের পথে চলে গিয়েছিলাম। আমি ও আমার বাসায় যাওয়ার পথে পা বাড়ায়। সেসময় হুট করেই সেখানে ভাইয়া চলে আসে। তাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। তবে ভাইয়া আমাকে খুব ভালোবাসতো। তাই ভাইয়াকে সম্মান করতাম। ভাইয়া সেদিন আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমি যেতে না চাইলেও তার কথা রাখতে যায়। সেখানে যাওয়ার পরে ভাইয়াকে বাসার কথা বললে ভাইয়া জানায় ভাইয়া নাকি বাসায় বলে দিয়েছে আমি আজ এখানে থাকবো। সকাল হলে ভাইয়া আমাকে দিয়ে আসবে। আমার কাছে ফোন না থাকায় বাবা মার সাথে কথা বলার সুযোগ হয়না। তাই ভাইয়ার কথা মেনে সেখানেই থেকে যায়। তবে ভাইয়া সেদিন বিকালে আমাকে নিয়ে ঘুরতেও যায়। সন্ধ্যায় ফুসকা আর আইসক্রিম ও খাওয়ায়। এই দুটো জিনিস ছিল আমার দূর্বলতা। তারই সুযোগ নিয়েছিল ভাইয়া। সন্ধ্যার পর বাসায় আসতেই ঘুমে চোখ লেগে আসে। ভাইয়া আমাকে একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমি রুমে যেয়ে শুয়ে পড়ি। একসময় পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
কিন্তু পরেরদিন সকালটা ছিল আমার জন্য ভয়াবহ। কিছু চাপা আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। মাথাটা ভার ভার লাগে। উঠে আসেপাশে দেখতেই থমকে যায় আমি। আমি তখন আমারই রুমে ছিলাম। আমার বেডের পাশে মা, কাকী সহ আরো অনেকে আছে। মা মুখে আঁচল পুরে দিয়ে কান্না করছে। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারি বাইরে থেকে যখন বার বার কানে ধর্ষিতা শব্দটা আসতে থাকে।
আশেপাশের প্রতিবেশীরা আমাকে আমার নামে না, ধর্ষিতা বলে ডাকতে থাকে। পরে মায়ের কাছে জানতে পারি কাল পরীক্ষা দিয়ে বাসায় না আসায় খুব চিন্তায় ছিল সবাই। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আমাকে খোজা হয়নি। কিন্তু আমার খোজ মেলেনি। তখন সবার ধারনা আমাকে কেউ অপহরণ করেছে। নয়তো আমি পালিয়ে গেছি। তখন আমার মাথায় একটা কথায় ঘুরছিল “আমি তো ভাইয়ার ওখানে ছিলাম। ভাইয়া বলল ভাইয়া বাসায় বলেছে। তাহলে এসব কি? আর আমিই বা এখানে এলাম কি করে?” শেষ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যায় মায়ের কাছেই। সারারাত টেনশনে ঘুম হয়নি কারোরই। ভোরের দিকে বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ কানে আসতেই সবাই ছুটে বাইরে আসে। ততক্ষণে গাড়িটা চলে যায় সবার চোখের আড়ালে। কিন্তু ফেলে যায় আমাকে। তাও অজ্ঞান অবস্থায়। আমার ড্রেস ছিল এলোমেলো। কয়েক জায়গা ছেড়াও। সবাই ধরে নিল আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি। তখনও সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। কি হচ্ছিল এসব কিছুই বোধগম্য হলো না আমার। মা কাকিকে ভাইয়ার কথা বলতেই সবাই আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। মা একটা থাপ্পড় ও মারে আমার গালে। ভাইয়া নাকি আগেরদিনই দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। আর আমি মিথ্যা বলছি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তখন, যখন মাকে বললাম ভাইয়াকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে। ভাইয়ার ফোন লাগে না। পরেরদিন ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যায়। আর তা সত্যিই দেশের বাইরের নাম্বার। আর ভাইয়া বেমালুম মিথ্যা বলে দিল আমার নামে। ভাইয়ার সাথে নাকি দেখাই হয়নি আমার।
সবাই বুঝে নিল আমি মিথ্যা বলছি। লেগে গেল ধর্ষিতার তকমা। ধর্ষণের শিকার না হয়েও আমি হয়ে গেলাম ধর্ষিতা।
ওই ঘটনার কিছুদিন পর জানতে পারি আমার বিয়ে ভেঙে গেছে। অথচ এই বিয়ের কথা জানতামই না আমি। পরিবারের বড়রাই ঠিক করেছিল পরীক্ষার পর বিয়ে আমার। আগে জানাইনি পরীক্ষা খারাপ হবে বলে। এরপর আর কোনো প্রস্তাব আসেনি আমার জন্য। কেনই বা আসবে? কে চাইবে একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে? কে চাইবে এমন মেয়ে? এর মাঝে কেটে গেল আরো দুটি বছর৷ সময় পার হলেও আমার অবস্থা পরিবর্তন হয়নি তখনও। তবে তার মাঝে সবার জন্য সুখবর নিয়ে এলো আমার ফুফু। ভাইয়া আমাকে বিয়ে করতে চায়। পরিবারের সবাই খুশি হলেও খুশি হলাম না আমি। যার জন্য আমার এই অবস্থা তাকে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারবো না আমি। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না। ঠিক করল আমার বিয়ে। ফুফুর আদরের হওয়ায় আমাকে মেনে নিতে তার অসুবিধা হলো না। তারপর আর কি! আজকের এই দিন।
বউ সাজে সেজেছি আমি তার জন্য। তারই ঘরের ফুলের সাজানো বাসরে বসে সেই মানুষটারই অপেক্ষা করছি। যে আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। বিয়েটা খুব বেশি জাঁকজমক ভাবে হয়নি। তাই বিয়ের রাতে যেসব হাসি মজা হয় তার কোনোটাই নেই আমার বিয়েতে। যদিও তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। যেখানে এই বিয়েটা আমার কাছে একটা অভিশাপ, সেখানে কীসের মজা আর কীসের আনন্দ!
কিছু সময় পার হতেই দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ পেলাম। বুঝতে বাকি নেই তার আগমন হয়েছে। সবটা বুঝতে পেরেও নির্বিকার হয়ে বসে থাকলাম। কোনোরুপ রেসপন্স করিনি আমি। তার স্থির দৃষ্টি যে আমাতে নিবদ্ধ তা তার দিকে না তাকিয়েও খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছিলাম। একসময় দৃষ্টি সরিয়ে শীতল কন্ঠে বলল,
“চেঞ্জ কর ফ্রেস হয়ে এসো, প্রিয়তা। রাত অনেক হয়েছে। ”
আমি কোনো প্রতুত্তর না করে সুটকেস থেকে সুতির থ্রি-পিস বের করে ওয়াসরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রেস হয়ে বাইরে আসতেই চোখ পড়ল মানুষটার উপর। এর মধ্যে নিজেও চেঞ্জ করে নিয়েছে। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। একটুপরেই আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“শুয়ে পড়ো, প্রিয়তা।”
সেসময় তার চোখে কিছু একটা ছিল। সেটা ঠিক কী ছিল তা বুঝতে পারলাম না। বুঝার চেষ্টা টাও করিনি। তবে তাকে অনেক কিছু বলার ছিল আমার, অনেক কথা জানার ছিল যার কোনোটাই করে উঠতে পারিনি। যেখানে মানুষটাকে দেখতেই বিতৃষ্ণা কাজ করছে আর তো সেখানে কথা! চুপচাপ শুয়ে পড়ি আমি। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তার গভীর চাহনি। আরো কুছু সময় কেটে যাওয়ার পর ও যখন চোখে ঘুম নামক বস্তু নামল না, তখন তাকাতেই দেখতে পারলাম রুমে অন্ধকার নেমে এসেছে৷ এরই মাঝে টেবিল ল্যাম্পের মৃদু আলোয় কিছু একটা লিখতে দেখলাম মানুষটাকে। বাসর রাতেও মানুষ পড়ে ভাবতেই হাসি পেল। একসময় সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।
সকালের মৃদু আলোয় ঘরটা আলোকিত হতেই ঘুম ভেঙে গেল আমার। চোখ মেলে তাকাতেই নিজের অবস্থানের কথা স্বরণ হতেই ইষৎ কেঁপে উঠলাম। মানুষটার বুকের সাথে লেপ্টে রয়েছি আমি। তার প্রতি রাগ আর ঘৃণার জন্ম নিতে শুরু করে৷ কিন্তু ভালো করে খেয়াল করতেই বুঝলাম সে নয়, আমি নিজের তাকে জরিয়ে রেখেছি। ঘুমের মাঝে এমনটা কখন করেছি ভাতেই রাগটা নিজের উপর হলো। সেই সাথে লজ্জা এসে জমা হলো আমার চোখেমুখে। ভাগ্যিস এখনও জাগে নি মানুষটা। নয়তো কি কেলেংকারীই না হতো। খুব দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে ফ্রেস হতে চলে যায় আমি। একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে দেখি মানুষটা তখনও গভীর ঘুমে। আমি রুম থেকে বের হতেই মুখোমুখি হলাম ফুফাতো বোন পুনমের সাথে। ওর বয়স খুব বেশি না, এবার নয়তে পা দিবে। একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে তৃতীয় শ্রেনীতে পড়ে। আমাকে দেখেই তার দুহাত মেলে ধরল কোলে নেওয়ার জন্য। এত বড় হয়ে যাওয়ার পর ও আমার কোলে তার উঠা লাগবেই৷ কোলে উঠতেই বললাম,
“আমার বার্ডটা কি স্কুলে যাচ্ছে?”
“ইয়েস আপি, ইয়েস। ”
“বাট এতো আরলি কেন? হ্যুয়াই?”
” লুক, ইট’স নট আরলি, ইট’স টেন এ এম।”
পুনম ওর হাতের ঘড়ি দেখিয়ে বলল। টাইম শুনে কিছুটা চমকে উঠলাম। এত বেলা করে উঠেছি ভাবতেই অবাক লাগছে। যে মেয়ে সূর্য উঠার সাথে সাথে উঠে সে আজ এত লেট। অবশ্য যে উঠিয়ে দেয় সেই মানুষটা তো! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। আমাকে কিছু বলতে না দেখে পুনম আবার ও বলল,
“ইউ আর লেইট, আপি।”
“ইয়াপ, আই ম লেট।”
“তুমি কি তাহলে যাবে না?’
” নো, ফ্লাওয়ার, আপি যাবে না। ভাইয়া যাবে।”
পেছন থেকে আওয়াজ হতেই আমরা পেছনে তাকালাম।
সকাল বেলা রুম থেকে বের হয়ে আমি বাবা বাবা বলে চেঁচাতে চেঁচাতে নিচে এলাম। কালকের পর থেকে আমি বাবাকে এক মুহুর্তের জন্যও দেখতে পাই নি, সেই সকালে বাবা বাসা থেকে দরকারি কাজের জন্য বের হয়েছিল তার পর থেকে আর দেখিনি বাবাকে, এমন কি হৃদান ভাইয়ের লাশের কাছেও না। আমার চেঁচামেচি শুনে বাসার সবাই বসার রুমে চলে এলো, সবার দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হলাম।সবার চোখের কোণে পানি জমে আছে, আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,, বাবা কোথায় মামনি?কাল থেকে বাবা কে কোথায়ও দেখছি না যে?
মামনি আমার প্রশ্ন শুনে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন, ভাইয়া এতোক্ষণ শান্ত ছিল কিন্তু আমার প্রশ্ন শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
তোমার বাবা কোথায় সেটা আমি জানি স্নিগ্ধা।
পিছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখি আফিফ বুকে দুই হাত ভাঝ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম,,কি জানো তুমি? বাবা কোথায়,,
একটু আমার সাথে এইদিকে এসো তো।
আমি আফিফের পিছু পিছু বাসার বাইরে বাগানের কাছে চলে এলাম,আফিফ আমাকে বেঞ্চে বসতে বললে আমি বেঞ্চে বসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,,বলো আমার বাবা কোথায়?
আফিফ উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আর তার পর বললো,,
জানি না।
তাহলে তুমি বললে কেন যে তুমি জানো আমার বাবা কোথায়?
সেটা তো তোমাকে বাইরে আনার জন্য ডেকেছি আমি। নাহলে তো তুমি বাইরে আসতে না এই টুকু বলেই হঠাৎ আফিফ আমার দিকে ঘুরে আমার গলায় ছুরি ধরলো। আমি ওর এমন কর্মকান্ডে ভয় পেয়ে গেলাম খুব, তোতলাতে তোতলাতে বললাম,,,
ত ত তুমি আমার গলায় ছুরি ধরেছো কেন? আমাকে মা’র’তে চাও নাকি তুমি,এ এই টা সরাও আমার গলা থেকে, লেগে যাবে আমার।
হা হা হ,সরাবো বলে কি ধরেছি না কি গলায়? মা’রবো বলেই তো এখানে নিয়ে এসেছি তোমাকে।
ত তুমি আমাকে মা’রতে চাও কেন? আমি কি করেছি তোমার?
কি করেছো তুমি হ্যা? বলো কি করো নি আমার সাথে। তোমার কারনে আমাকে জ্বেলে যেতে হয়েছিল, তুমি স্বরযন্ত্র করে আমাকে জেলে পাঠিয়ে ছিলে। জানো আমাকে পুলিশ ধরে জেলে নিয়ে যাওয়ার পর খুব কষ্ট হয়েছিল ওখানে আমার। প্রতিদিন ওরা মা’র তো আমাকে, শক্ত লাঠি দিয়ে প্রচুর মেরেছে আমাকে।হাত পা ব্যাথা হয়ে যেতো হাঁটতে পারতাম না, কেঁদে কেঁদে বলতাম আমাকে ছেড়ে দাও কিন্তু ওরা আমাকে ছেড়ে দেয় নি। আমার চোখের পানির কোনো দাম দেয় নি ওরা,আর এই সব কিছু হয়েছে তোমার জন্য শুধু মাত্র তোমার জন্য। তখনি আমি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিলাম আমার মতো এতো ভয়ানক কষ্ট আমি তোমাকে ও দেবো, তোমাকে ও কাদাবো আমি।তার পর তোমাকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিবো, তোমাকে কষ্ট দেওয়ার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে তোমার ভালোবাসার মানুষ।তাকে যদি আমি শেষ করে দেই তাহলে তুমি বেঁচে থেকেও মরে যাবে তখন তোমাকে শেষ করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।তাই আমি তোমার বয়ফ্রেন্ড খুঁজতে শুরু করেছিলাম, একদিন তোমার ডায়েরী ঘেঁটে দেখলাম আয়াশ তোমার ভালোবাসার মানুষ। তাকে তুমি খুব ভালো বাসো ব্যাস আমি সেদিনই আয়াশ কে তুলে নিয়ে যাই। কিন্তু যখন আয়াশ কে অর্ধমৃত করে ফেলেছি তখন আমার লোক আমাকে ফোন করে বলল যে আয়াশের সাথে তোমার রিলেশনশিপ ভেঙে গেছে, আর তোমার বর্তমান ভালোবাসার মানুষ হৃদান যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।কি আর করা যাবে তখন আয়াশ কে ওই অবস্থায় ওর বাসার সামনে ফেলে আসতে হলো আমাকে।তার পর প্ল্যানিং শুরু করলাম হৃদান কে মা’রার কিন্তু ওকে একা পাওয়া টা খুব কষ্টকর ছিল। দুই দিন আগে জানতে পারলাম হৃদান অফিসের কাজে শহরের বাইরে গেছে আর কালকে ফিরবে, আমার কাছে হৃদান কে মা’রার এর থেকে বেশী ভালো সুযোগ আর হয় না তাই কালকে আমার প্ল্যান মতো ট্রাকের ধাক্কায় হৃদান কে শেষ করে দিয়েছি আমি আর এখন বাকি আছো তুমি। এখন তোমাকে শেষ করে দিতে পারলেই আমার মন টা শান্তি পাবে, না হলে তোমাকে যতোদিন বেঁচে থাকতে দেখবো আমার মাথা তত খারাপ হতে থাকবে।নাও বেইবি ইউর ট্রান,গুড বাই বেইবি।।
আফিফের কথা শুনে আমি যতো টা অবাক হলাম তার থেকে বেশি মাথায় রাগ চেপে বসলো। আমার হৃদান ভাই কে ও এক্সিডেন্ট করিয়ে মেরে ফেলেছে এই কথাটাই আমার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিলো। আমি এক ঝটকায় আফিফের হাত থেকে হঠাৎ করে ছুরি টা টান দিয়ে নিয়ে নিলাম, এই ভাবে হঠাৎ করে টান দেওয়ায় আমার গলাতে হালকা আঁচড় কেটে গেল ছুরি দিয়ে। আমি এমন একটা কাজ করে বসবো এটা হয়তো আফিফ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে গেল,যেই মেয়ে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়ে এইভাবে সাহস দেখিয়ে ওর হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে নিবে এটা ওর স্বপ্নাতিত। আমি আফিফের হাত থেকে ছুরি টা নিয়ে দাড়িয়ে ওর গলাতেই ধরলাম, চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম,,, তুই আমার হৃদান ভাই কে মেরে ফেলেছিস আবার এটা গর্ব করে বলছিস আমাকে? আমার জীবনে সুখ পাখি একটু ধরা দিতে চেয়েছিলো কিন্তু তুই সেটা কে শেষ করে দিয়েছিস আফিফ। এবার তুই আমাকে কি মা’রবি আমি নিজেই তোকে মেরে ফেলবো, আমার হৃদান ভাই কে মা’রার শাস্তি আমি নিজে হাতে দেবো তোকে এর পরে আমার জেল হবে না কি হবে হোক কিন্তু আমি তোকে ছাড়বো না।
আফিফের দিকে আগুন চোখে তাকালাম আমি, ওর মুখে একটা অন্যরকম ভয় কাজ করছে।যেটা দেখে মনে হচ্ছে ও আমার হুমকি তে নয় অন্যকিছু তে মারাত্মক ভয় পেয়েছে।ও ঠিক তাকিয়ে আছে আমার পিছন দিকে, আমার দিকে নয়, আমি অনেকটাই অবাক হয়ে ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমার পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। পিছনে ঘুরে তাকিয়ে আমার হাত থেকে ছুরি টা পড়ে গেল, হাত পা কাপাকাপি শুরু করলো আমার। মাত্র কয়েক ফুট দুরত্বের ব্যবধানে হৃদান ভাই হাসি মুখে দাঁড়িয়ে, গায়ে হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পড়া।আফিফের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমি ভুত বলে যেই চেঁচাতে যাবো তখনি হৃদান ভাই এগিয়ে এসে আমার মুখে হাত চেপে ধরলো। আমার মুখে হাত চেপে ধরে চোখ দিয়ে কাকে কি যেন ইশারা করলো, আমি ধরেই নিয়েছি এটা একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি।হৃদান ভাই কে খুব ভালোবাসি তো তাই হয়তো ও বেঁচে আছে এটা স্বপ্নে দেখছি,এক হাত দিয়ে আরেক হাতে চিমটি কাটলাম, সঙ্গেই ব্যাথা পেলাম খুব। মুখে অস্ফুট স্বরে আহ্ বলে উঠলাম কিন্তু মুখে হাত চাপা থাকার কারণে শব্দ বাইরে এলো না।হৃদান ভাই আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,,, একদম ভয় পাওয়ার চেষ্টা ও করবি না। আমি মরে যাই নি বেঁচে আছি।
এই টুকু বলে হৃদান ভাই আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল, আমি বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম হৃদান ভাইয়ের দিকে।চোখ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার,কাল যাকে লাশ হিসেবে দেখলাম আজ সে জীবিত জলজ্যান্ত অবস্থায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে সে বেঁচে আছে। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হৃদান ভাই কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম, কেন জানি মনে হচ্ছে এটা আমার স্বপ্ন তার পরেও স্বপ্নে হৃদান ভাই কে কাছে পেয়েছি তাকে জড়িয়ে ধরতে বাধা কোথায়। হোক না এটা স্বপ্ন তার পরেও তো পেয়েছি ওকে,কাদছি আর ভাবছি মানুষ তাহলে স্বপ্নেও কাঁদতে পারে। তখন হঠাৎ করে কে যেন বললো,, এই নির্লজ্জ মাইয়া, বাসার সবার সামনে একটা ছেলে কে জড়িয়ে ধরে আছিস?বলি লজ্জা করছে না তোর সবার সামনে এইভাবে প্রেম করতে?
আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি বাসার সবাই কিছু টা দূরে দাঁড়িয়ে। ওদের সাথে বাবা ও আরো কয়েক জন পুলিশ সদস্য আফিফের হাতে হাতকড়া লাগিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমি এইসব দেখে অবাকের চরম সিমায় পৌঁছে গেলাম। এইসব কি হচ্ছে, পুলিশ এইখানে কেন?
হৃদান ভাই হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারলো তাই বললো,, তুই খুব অবাক হচ্ছিস জানি। তাহলে শোন, আমি সত্যিই মারা যাই নাই স্নিগ্ধ। কালকে তুই আমাকে লাশ হিসেবে দেখিছিলি ঠিকই কিন্তু আমি তখন জীবিত ছিলাম।লাশ সেজে মৃত্যুর এই নাটক টা করতে হয়েছিল আফিফের মুখ দিয়ে সবকিছু স্বীকার করানোর জন্য। কালকে সকালে যখন আমি আমার কাজ শেষ করে অফিস থেকে বাসার পথে ফিরছিলাম তখন ফুপা আমাকে ফোন করে আফিফের প্ল্যানিং এর ব্যাপারে বলে,আফিফ যখন ফোনে কারো সাথে এই প্ল্যানের ব্যাপারে কথা বলছিল তখন ফুপা সবকিছু শুনে ফেলে আর আমাকে ফোন করে বলে।ফুপার কাছ থেকে আমি সবকিছু শুনে একটা প্ল্যান করি আফিফের জন্য। আমি আগেই জানতে পেরেছিলাম আয়াশের কথা, আয়াশ কে যে আফিফ মেরেছে সেটা আমি গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলাম আর তার কারণ যে তুই সেটাও জেনে ছিলাম। সেই কারণেই আমার গাড়িতে আমি অটো ড্রাইভ সেট করে দিয়ে এক্সিডেন্ট স্পোটের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যাই আর একটু পরেই গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়। কিন্তু আফিফের কাছে আমার মৃত্যুর ব্যাপার টা সত্যি করার জন্য পুলিশের সাহায্য নিয়ে নিজের মিথ্যা মৃত্যুর নাটক টা করি। আমি জানতাম আমি মারা যাওয়ার পর আফিফ তোকে মেরে ফেলতে চাইবে আর কেউ কাওকে মেরে ফেলার আগে তাকে কেন মা’রছে সেই সত্যি টা ওকে জানায়।ব্যাস আমরা সবাই এই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিলাম আর আমাকে এইসব কিছু করতে সাহায্য করেছে বাসার সবাই সাথে তোর ছোট ফুপিও। উনি মা হলেও নিজের সন্তানের অন্যায় কে প্রশ্রয় দেননি তাই তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন।
পরক্ষনেই হৃদান ভাই আমার গালে একটা হাত রেখে বলল,আই এম সরি স্নিগ্ধ। তোকে খুব কষ্ট দিয়েছি এই মিথ্যে নাটক করে তার জন্য রিয়েলি ভেরি সরি। কিন্তু দেখ আমি তোকে বেশিক্ষণ কষ্ট দেই নি আফিফের সত্যি এতো তাড়াতাড়ি সামনে চলে এসেছে যে তোকে এক দিনের বেশি কষ্ট পেতে হয় নি।
_______________________________
ছাদের এক কোণে হৃদান ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে বসে আছি আমি।যেই যায়গায় একদিন বসে শাস্তি পেয়েছিলাম আজ সেই জায়গায় বসে ভালোবাসা পাচ্ছি। তখন পুলিশ আফিফ কে ধরে নিয়ে গেছে আর এইবার তার অনেক দিনের জেল হবে সেটাও বলে গেছে।এতে ফুপি কষ্ট পান নি বরং খুশি হয়েছে যে তিনি তার ছেলে কে যখন মানুষ করতে পারেন নি তাহলে সেই ছেলে যখন শাস্তি পাবে তখন তার শাস্তি তে কষ্ট পাওয়া উচিত নয়।হৃদান ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,, স্নিগ্ধ তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,, হুম ভালোবাসি খুব বেশি ভালোবাসি তোমায়। আমিও তোমার স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায় জড়িয়ে গেছি খুব করে, ঠিক তোমার মত যেমন করে তুমি জড়িয়েছো।
হৃদান ভাই আমার কথা শুনে ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে সামনের দিকে তাকালো,আজ তার খুব আনন্দের দিন। ভালোবাসার মানুষ টির মুখ থেকে সে ভালোবাসি শব্দ টি শুনতে পেয়েছে যে।