Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1087



জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৫

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৫ম পর্ব
~মিহি

শুভ্র ড্রাইভ করছে। রুদ্ধ অনেকক্ষণ ড্রাইভ করে ক্লান্ত। পেছনের সীটে ঘুমোচ্ছে সে। এখনো অর্ধেক রাস্তা পার করা বাকি। এত দূরে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে? মাঝেমধ্যেই দ্বন্দ্বে পড়ে যাচ্ছে শুভ্র। তনয়া আর প্রেমাকে নিয়ে চিন্তাটা একটু বেশিই। তনয়ার মা শুভ্রকে অনেক বেশি ভরসা করেন। নিজের ছেলের মতো যত্ন করেন তাকে। শুভ্রও তনয়াকে নিজের আপন বোনের মতো দেখে। তাই তনয়া আর প্রেমার সাবধানতাই মুখ্য। প্রেমা একমনে ফোন স্ক্রল করছে।

-“এত ফোন টিপিস না। সাতদিনের জন্য চার্জ জমায়ে রাখ।”

-“কেন? ওখানে কি চার্জিং পয়েন্ট নাই?”

-“ইলেকট্রিসিটিই আছে কিনা সন্দেহ। তার চেয়ে বড় কথা নেটওয়ার্কও পাবি বলে মনে হয় না। সেজন্য ফোনটা সাতদিনের জন্য জীবিত রাখ।”

-“দেশে আসার পর থেকে বাবার সাথে কথা হয়নি। একবার কথা বলে নিই।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

প্রেমার মা মারা গেছে বছর তিনেক আগে। মূলত মা মারা যাওয়ার পরপরই তার এই শহরের উপর থেকে মন উঠে যায়। সেজন্যই সে পাড়ি জমায় বাবার কাছে, দূর অজানা শহরে। বাবার নম্বরে পরপর দু’বার কল করলো প্রেমা। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হলো না। বাধ্য হয়ে ফোন রেখে বসলো সে। অনেকটা সময় ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখায় এখন চোখ জ্বালা করছে তার। একটু না ঘুমালে হয়তো চোখ খুলতেই পারবে না।

-“এই শুভ্র, গাড়ি থামা। আমি একটু পেছনের সীটে যাবো। খুব ঘুম পাচ্ছে।”

-“আচ্ছা যা। রেহানকে বল সামনে আসতে।”

-“এই রেহান, সামনে আয় তো।”

শুভ্র গাড়ি থামালো। রেহান বসেছিল একেবারে সাইডে, মাঝখানে তনয়া আর অপর সাইডে রুদ্ধ। রেহান গাড়ি থেকে নামতেই তনয়াও নেমে পড়ে। তনয়াকে নামতে দেখে অবাক হয় প্রেমা।

-“কীরে তুই নামলি কেন?”

-“অনেকক্ষণ ধরে মাঝখানে বসে আছি। দমবন্ধ হয়ে আছে। আমি একটু জানালার ধারে বসবো।”

-“বাহ বাহ! আমি আসলাম আর জানালার ধারে বসতে ইচ্ছে হলো? এতক্ষণ কেন ইচ্ছে হয়নি? তোরা যে কী শুরু করছিস আমার সাথে! সবাই মিলে আমাকে পর করে দিছিস।”

-“ওরে ড্রামাকুইন রে! তুই তো আমাদের পর করে চলে গেছিস। তোর জন্য যে একজনের হৃদয় জমে জমে পাথর হয়ে গেছে তা যদি বুঝতি।”

-“এই এই! শেষের দিকে কী বিড়বিড় করলি? তোরা এত বিড়বিড় করিস কেন এখন? আগে তো এই বাজে অভ্যেস ছিল না।”

-“চুপচাপ বস, যা।”

প্রেমা মাঝখানে বসলো। রুদ্ধ জানালার সাথে হেলান দিয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। শুভ্র সামনে থেকে মুচকি মুচকি হাসছে। প্রেমা পাশে বসতেই রুদ্ধ একবার চোখ টিপটিপ করে প্রেমাকে দেখে নিল। অতঃপর জানালার পরিবর্তে প্রেমার কাঁধে হেলান দিলো। প্রেমা ভেবেছে রুদ্ধ ঘুমের ঘোরে আছে। সে বকবক করতে লাগল,” আশি কিলোর বস্তা একটা! হেলান দেওয়ার জন্য আমার কাঁধটাই পাইলি রে ষাঁড়? উফফ! ঘাড়টা শেষ আমার। কোন চালের ভাত খায় আল্লাহ মালুম।” প্রেমার বকবক থামছেই না। রুদ্ধ সবটাই শুনছে আর মনে মনে ফুঁসছে। মনে মনে বলছে,”একবার খালি হাতের নাগালে আইসো বান্ধবী, তোমারে দিয়া দশ ডজন কাপড় ধুয়ে নিব।” তবে রুদ্ধর যে খুব খারাপ লাগছে তা না। বন্ধু হিসেবে হয়তো এই কাঁধে বহুবার মাথা রেখেছে সে কিন্তু একতরফা প্রেমিক হিসেবে এই অনুভূতিটা মারাত্মক। হৃদস্পন্দনের গতিটা যেন ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। রুদ্ধ আবছাভাবে শুনতে পারছে নিজের হৃদস্পন্দনের ধুকধুক শব্দটা। আচ্ছা, প্রেমা কি অনুভব করছে তার হৃদস্পন্দনের এই ঊর্ধ্বগতি? রুদ্ধর বন্ধ চোখে প্রেমার মায়াবী মুখটা ভাসছে। বন্ধুত্বটা দীর্ঘদিনের অথচ ভালোবাসার অনুভূতিগুলো মাত্র কয়েক বছরের। রুদ্ধর ভালোবাসার ভাগ্যটা বড্ড খারাপ। যখনই সে প্রেমাকে একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করলো ঠিক সে সময়টাতেই প্রেমা উড়াল দিল, তাও হঠাৎ করে। প্রেমার চলে যাওয়াটা মেনে নিতে বড্ড সময় লেগেছিল তার কিন্তু সে কি আদৌ মানতে পেরেছিল? পারেনি। প্রতিক্ষণ, প্রতিমুহূর্ত প্রেমার স্মৃতিতে ডুব-সাঁতার কেটেছে সে।

_______________________________________________________________________________________________

-“ভাই ওবায়দুর, অনেকক্ষণ তো ড্রাইভ করলা, এখন আমারে চালাইতে দেও।”

-“সামনের হাইওয়েটা পার করেই দিচ্ছি। সম্ভবত আর আড়াই-তিন ঘণ্টার পথ বাকি।”

-“তোমার মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না?”

-“মেয়ের কথা মনে পড়ে বলেই তো এসব করছি।”

-“মানে?”

-“আমার মেয়ের বয়স বারো যখন আমার স্ত্রী আমাকে ফেলে চলে যায়। ছোটখাটো কাজ করতাম। মেয়ে সারাদিন বাসায় একা। একদিন বাড়িতে ঢুকে দেখি সারা মেঝে রক্তাক্ত। ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখি আমার বাচ্চা মেয়েটার মাথা একপাশে, শরীর অন্যপাশে। সারা মেঝে রক্ত লাল। পাগল হয়ে গেছিলাম। কত সময় পাগল ছিলাম জানা নাই। গুরুর সাথে দেখা। তিনি জানালেন আমি আমার মেয়েকে ফিরে পেতে পারি। সেজন্য এসব করছি। অশুভ শক্তি আমার চাই না, শুধু নিজের মেয়েটারে নিয়ে বাকি জীবন কাটাতে চাই।”

-“আপনার লাইগা মন খারাপ করবো কিনা বুঝতেছি না। তবে গুরুর যথেষ্ট ক্ষমতা আছে বলে আমরা মানি। অবশ্য গুরুর ক্ষমতা আমরা স্বচক্ষে দেখি নাই। যাই হোক, গুরু হয়তো পারবেন তোমায় তোমার মেয়ে ফিরিয়ে দিতে।”

রাজন চুপ হয়ে যায়। তার এখন আর নিজেকে স্বাভাবিক মানুষ মনে হয় না। কোনো স্বাভাবিক মানুষ এত ঘৃণ্য কাজ করতেই পারে না। একটা মেয়ের বাবা হয়ে অন্য মেয়েকে বলির পাঠা বানানো কি কারো পক্ষে সম্ভব? এত নিচে কী করে নেমে গেল সে? নাহ! এসব ভাবলে চলবে না। মেয়েটা যত দ্রুত চিকন কালার বনের দিকে এগোবে,তত রাজনের সুবিধা। সহজেই মেয়েটাকে ধরাশায়ী করে ফেলা যাবে কিন্তু সমস্যা হলো মেয়েটার চার বন্ধু। ছেলে তিনটাকে কোনোভাবে অন্যদিকে সরানো গেলে চিন্তা থাকতো না। চিকন কালার বনে পৌঁছে সে ব্যবস্থাও করা যাবে। আপাতত এগোনো যাক।

-“রুদ্ধ, এই রুদ্ধ! উঠ না। কী মরার মতো ঘুমোচ্ছিস! আমার কাঁধ ব্যথা হয়ে গেল।”

-“আহ হা! জ্বালাস না তো, একটু আর।”

-“তুই উঠবি নাকি ঘুষি মারবো?”

-“দজ্জাল রে দজ্জাল! এমন মেয়ে যার ঘরের বউ হবে, তার কপাল তো পুড়ছে।”

-“তোর ঘরের বউ তো হচ্ছি না। উঠ!”

প্রেমার কথায় রুদ্ধ মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,”হবে তো আমারই বউ। দরকার পড়লে এবার কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো।” রুদ্ধ উঠতে নিতেই হঠাৎ শার্টে টান লাগে। প্রেমার চুল রুদ্ধর শার্টের বাটনে আটকে আছে।

-“দেখ! তোর চুল অবধি আমাকে ছাড়তে চাইছে না আর তোর আমাকে দূরে সরানোর তাড়া!”

-“তোর শার্ট বেহায়া।”

প্রেমা চুল ছাড়াতে গিয়ে আরো প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে কিন্তু তাও সে রুদ্ধকে হাত লাগাতে দেবে না। এসব দেখে তনয়া, রেহান আর শুভ্র যে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল নেই তার। সে একমনে চুল খুলতে ব্যস্ত। একসময় হাঁপিয়ে উঠে রাগ করে চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে।

-“এই! প্রেমা, তুই আসলেই পাগল। পারছিস না যখন আমায় বললেই পারতি। নিজেকে কষ্ট দেওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না।”

-“আমি কি করবো না করবো সেটা তোর থেকে কেন শোনা লাগবে?”

প্রেমা কথাটা মজা করে বললেও তা মোটেও ভাল্লাগেনি রুদ্ধর। প্রেমার মুখে কথাটা শোনার পর তার মুখ অনেকটাই মলিন হয়ে যায়। মলিন কণ্ঠে শুভ্রকে ডাকে সে।

-“এই শুভ্র, আমি ড্রাইভ করি এখন। তুই রেস্ট নে।”

-“আরে দরকার নেই।”

-“থামাতে বলছি, থামা।”

শুভ্রও বুঝতে পেরেছে ব্যপারটা। তর্কে না গিয়ে গাড়ি থামিয়ে দিল সে। গাড়ি থেকে নেমে রুদ্ধকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললো, “দেখ রুদ্ধ, প্রেমা মছা করে বলেছে। অন্যভাবে নিস না। সুযোগটা এভাবে ছেড়ে দিস না। ভেবে দেখ কিছুক্ষণ।”

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৪

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৪র্থ পর্ব
~মিহি

ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই ধাক্কাটা খেল রুদ্ধ। আশেপাশের পরিবেশটা বুঝতে বেশ খানিক সময় লাগল। সে তো নিজের বাড়িতে ছিল। এখন গাড়িতে কী করে? তাও গাড়ির বোনেটে! কেউ কি তাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাচ্ছে? জোরে জোরে চিৎকার শুরু করলো রুদ্ধ।

-“দেখ, ষাঁড়টা চিৎকার শুরু করছে।”

-“আহা প্রেমা! ওকে ওখানেই থাকতে দে। পৌঁছানোর আগ অবধি ওকে এখানে আনার কোনো দরকার নাই।”

-“পৌঁছাতে তো অনেক সময় লাগবে।”

-“শর্টকাট আছে কী জন্য? তাছাড়া সামনের হাইওয়ে পার করলে রাস্তা শুনশান। থখন স্পিডে গাড়ি চালানো যাবে।”

-“আচ্ছা, তুই দেখেশুনে গাড়ি চালা। আমি বরং রেহান আর তনয়ার সাথে একটু গল্প করি। ঐ দুইটার তো ঘুমই ভাঙেনি ঠিকমতো।”

-“আচ্ছা কর।”

প্রেমা তনয়া আর রেহানকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছে কিন্তু এই দুইটা রুদ্ধর চেয়েও বড় কুম্ভকর্ণ। শুভ্রর মাথায় আচমকা একটা বিষয় আসে। এই ট্যুরেই যদি রুদ্ধ-প্রেমাকে মিলিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না। চটজলদি নড়েচড়ে বসে প্রেমাকে ডাকে সে।

-“এই প্রেমা শোন।রুদ্ধ তো অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ! টেনশনে সেন্সলেস হয়ে গেল না তো? ওকে বরং গাড়িতে নিই।”

-“ও আমাকে আগে খুন করবে তারপর আমাদের নিফিউ পাড়া যাওয়ার প্ল্যানটা ভেস্তে দিবে।”

-“আরে! সেরকম কিছুই হবে না। আমি গাড়ি সাইড করে ওকে নিয়ে আসছি। তুই চুপ করে বস এখানে।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ও যদি আমার উপর রাগ দেখায়, আমি তোকে ফাঁসায়ে দিব। বলবো সব তোর প্ল্যান ছিল।”

-“যদি রাগ দেখায়! দেখাবে না। চিল।”

শুভ্র প্রেমাকে সামনের সিটে বসিয়ে রেখে গাড়ির বোনেটের দিকে এগোলো। বোনেট খুলতেই রুদ্ধ কিছু না দেখে, কিছু না বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়লো শুভ্রর উপর। দু-চারটে কিল ঘুঁষি মারার পর শুভ্রর চেঁচানোতে থেমে যায় রুদ্ধ।

-“শালা তুই! তুই আমারে কিডন্যাপ করছিস? তোরে কেডা তাবিজ করছে?”

-“থাম তো! ভঙ করিস না। এখান থেকে উঠে ড্রাইভিং সীটে বস যা। তাহলেই সব জানতে পারবি। আর শোন সুযোগ কিন্তু একবারই আসে। যা বলার বলে ফেলিস। সাতটা দিন সময় আছে। সময়কে কাজে লাগাস।”

রুদ্ধ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতো একটা ভাব নিয়ে ড্রাইভিং সীটে এসে বসতেই প্রেমা খুবই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে তাকালো রুদ্ধর দিকে। ব্যস! রুদ্ধর রাগ শেষ! উপরে উপরে একটা রাগী ভাব নিয়েই ড্রাইভিং শুরু করলো।

_____________________________________________________________________________________________

-“গুরুকে বলে দিও, চমৎকার হয়েছে। ওরা নির্জন জায়গা দিয়ে ভ্রমণ করছে। তাছাড়া আমাদের গ্রামের দিকেই যাচ্ছে। যখনি দেখবো রাস্তা বদল করছে, তখনি হামলাটা হবে।”

-“ঠিক আছে। মেয়েটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।”

শ্যামলা লোকটা এখন ইউনিফর্ম পড়ে আছে। ছাইরঙা একটা ইউনিফর্ম। সবটাই সাজানো যাতে ধরা পড়লে কাটিয়ে দেওয়া যায়। ইউনিফর্মের এককোণে নেমপ্লেটে লেখা ওবায়দুর। পকেটে থাকা এনআইডিতেও এই নামটাই দেওয়া। সবটাই নকল। লোকটার আসল নাম রাজন। লোকটা ভালো গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনের সীটে আরো দুইজন লোক বসে আছে। লোক দুটোকে রাজন ঠিকমতো চেনেনা তবে গুরু পাঠিয়েছেন তার সুবিধার্থে। রাজনের মনটা বিষণ্ন। সবকিছু তার ঝামেলা মনে হচ্ছে কিন্তু করতেই হবে। এই কাজের পেছনে তার স্বার্থ আছে। স্বার্থ ছাড়া তো কেউই কুকর্মে জড়ায় না। রাজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে কি মানসিকভাবে সুস্থ আছে? নাকি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে? নিজের কাজকর্মকে সে আর মানুষের তালিকায় ফেলতে পারে না। দুদিন আগেও সে দুটো মেয়েকে পৌঁছে দিয়েছিল গুরুর কাছে। মেয়ে দুটোর অস্তিত্বের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। এক রাতের মধ্যেই দুটো জলজ্যান্ত মেয়ে উধাও। তাদের নাকি অশুভ শক্তির দরবারে প্রেরণ করা হয়েছে। এসব কি মানার যোগ্য কথা? কিন্তু মেনে নিয়েছে রাজন। শেষবারের মতো এই মেয়েটাকে গুরুর কাছে পাঠাতে পারলেই সে চিন্তামুক্ত। তার কাজ সম্পন্ন হবে আর গুরুর কাজ সম্পন্ন হলে রাজনের জীবনেও আর কোনো বিপদ থাকবে না।

-“আচ্ছা ওবায়দুর, তোমার অশুভ শক্তির কি দরকার? তুমি তো গ্রামের ভোলাভালা মানুষ।”

-“ভোলাভালা দেখেই তো সবাই সুযোগ নেয়। নিতে নিতে চুষে ফেলা আমের আঁটির মতো ছুঁড়ে ফেলেছে। আর কত সহ্য করতাম?”

-“বউ-বাচ্চা আছে?”

-“বউ আরেকজনের সাথে পালায় গেছে। একটা মেয়ে আছে।”

-“মেয়ের বাপ হইয়া মেয়ে ধরতে আইছো। মনে ডর লাগে না?”

-“আপনার মা কি জীবিত?”

-“হ, আম্মার চিকিৎসার লাইগাই গুরুর কথায় রাজি হইছি। অশুভ শক্তি পাইলে নাকি কোনো অভাব থাকবো না।”

-“আপনি যার গর্ভে জন্মেছেন, সেও মেয়ে। তাহলে আপনি ক্যামনে আসলেন মেয়ে ধরতে? ভাই রে, দুনিয়ায় কেউ খারাপ না। সবাই বাধ্য, কেউ পরিস্থিতির কাছে তো কেউ নিজের কাছে।”

-“কথা ভালোই কইছো ওবায়দুর মিয়া। গাড়ি জোরে চালাও। মাইয়াডা তো অনেক আগে চলে গেলো।”

রাজন চুপ করে গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল। ‘ওবায়দুর’ নামটা বারবার শুনতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। নিজের নামের জায়গায় অন্য কোন নাম শুনেও বিরক্তি কিংবা রাগ প্রকাশ করতে না পারাটা প্রচণ্ড অসহ্যকর একটা অনুভূতি। গাড়ির গতি আর দিনের দাবদাহ দুটোই বাড়ছে। গরমে রাজনের গলা ঘামছে। কিছু মানুষ সহজেই ঘামে। রাজন তাদের মধ্যে নয়। রাজন সহজে ঘামে না। প্রচণ্ড গরম লাগলে তবেই সে ঘামে। তাপমাত্রা কি তাহলে খুব বেড়েছে?

____________________________________________________________________________________________

-“রুদ্ধ, তোর কী হয়েছে বল তো। রাস্তা তো সামনে। তুই একটু পর পর আমার দিকে তাকাচ্ছিস কেন? দু’বছরে আমার চেহারা এতটাও বদলায়নি যে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে। চুপচাপ সামনে তাকা।”

-“তোকে দেখছি না আমি। আমি আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি রাস্তাটা এত নির্জন কেন। তোরা যে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে।”

রুদ্ধর তৎক্ষণাৎ উত্তরে পেছনের সীটের সবাই হেসে ওঠে। রেহান কাশির ভান করে খুকখুক করে কাশে। প্রেমা ভালোই বুঝতে পারছে কিছু একটা চলছে কিন্তু কেউ তাকে বলছে না। অদ্ভুত তো! দু’বছর সে দূরে ছিল তাই বলে ওর বন্ধুরা ওকে এত পর করে দিয়েছে? আর এই রুদ্ধটাই বা এমন আচরণ করছে কেন?

প্রেমার রাগান্বিত দৃষ্টির মানে স্পষ্ট বুঝছে রুদ্ধ। তার মজাই লাগছে প্রেমাকে জ্বালাতে। প্রেমা মেয়েটা এখনো বাচ্চাই আছে, কিছুই বোঝে না। আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে ছিল প্রেমা। রুদ্ধ প্রেমার হাতে হাত রাখে। প্রেমা তখনো খেয়াল করেনি। অনেকটা সময় পর সে রুদ্ধর স্পর্শটা খেয়াল করলো। তখনি চটে গিয়ে বললো,” এই আমি কি বাচ্চা? আমার হাত ধরে রেখেছিস কেন? আমি কি গাড়ি থেকে ঝাপ দিব? আজব তো!” প্রেমার কথায় রুদ্ধর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এই মেয়েকে বোঝাতে তার কত রুটি যে বেলতে হবে! এদিকে প্রেমার কাণ্ড দেখে শুভ্র, রেহান আর তনয়ার হাসি থামছে না। প্রেমা তো রাগে আগুন। সবকিছু তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আচমকা শুভ্র গান ধরলো,”বলতে গিয়ে মনে হয়, বলতে তবু দেয়না হৃদয়…” ব্যস এটুকু বলেই চুপ। প্রেমা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কী রে থামলি কেন? এত সুন্দর গান আর তুই পুরোটা গাইবি না?” শুভ্র মুচকি হেসে বললো,”যাকে বলছি সে বুঝলেই হলো, তোর বোঝা লাগবে না।” রুদ্ধ বিষম খেল। এমনিতেই সে অস্থির হয়ে আছে। তার উপর তার বন্ধুগুলো! একেকটা আস্ত শয়তান। রুদ্ধর মনের মধ্যে এখন গান বাজছে,”অল মাই ফ্রেন্ডস আর টক্সিক!” এতসবের মাঝেও রুদ্ধর মনের এককোণে একটা বিপদের সূক্ষ্ম ঘণ্টা বাজছে। ঠিক কী কারণে এমনটা মনে হচ্ছে তা রুদ্ধ জানে না তবে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যে কখনো ভুল বলেনা তার প্রমাণ সে অনেক আগে থেকেই পেয়ে আসছে।

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৩

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৩য় পর্ব
~মিহি

প্রেমা হাঁপাচ্ছে। রুদ্ধকে ঠিক সময় না সরালে হয়তো কী বিপদ হতো! আর এই রুদ্ধটা কি ছাগল? ট্রাক দেখে সরে না গিয়ে পাগলের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। রুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে প্রেমাকে দেখছে। এই দুর্ঘটনা তার মনে একটু হলেও সাহস দিয়েছে। এবার সে নিজের মনের কথা না জানিয়ে কিছুতেই প্রেমাকে যেতে দিবে না।

-“রুদ্ধ, তুই কি দিন দিন ছাগল হচ্ছিস?”

-“একজনের প্রেমে পাগল হচ্ছি।”

-“কীহ! তুই আর প্রেম? সত্যি?”

-“নাহ! মিথ্যা। খুব মাথা ধরেছে রে। চল বাড়িতে যাবো।”

-“আমি কোথায় থাকবো?”

-“আমার বাড়িতে?”

-“আমি তোর সাথে কেন থাকবো?”

-“রুশার ঘর ফাঁকা আছে, ওখানে থাকিস। আমার ঘরে থাকা লাগবে না!”

-“ইশস! আমি কি সেটা বলছি? চল তো চল।”

___________________________________________________________________________________________

-“গুরু, কাজ তো হলো না। অন্য কোনো মেয়েকে বলি দিলে কাজটা হবে না?”

-“আমি যখন বলেছি ঐ মেয়েকে লাগবে, তখন ঐ মেয়েকেই লাগবে। তোমরা যেভাবে পারো ঐ মেয়েকে নিয়ে এসো, নাহলে অশুভ শক্তিকে তুষ্ট করা যাবে না। আর ওর বন্ধুকে মারতে পারোনি, তাই না?”

-“নাহ গুরু।”

-“ওর উপর নজর রাখো। মেয়েটাকে যে করেই হোক আমাদের আয়ত্তে আনতে হবে। আমি বলেছিলাম মেয়েটা দারুণ চতুর। সামলে রাখতে হবে।”

-“আমরা চেষ্টা করছি।”

কল কেটে দিয়ে শ্যামলা লোকটা পানের পিক ফেলে রাস্তায়। এই মেয়ের পিছু নিতে হবে। পাশে বসে থাকা ট্রাক ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে নেমে পড়ে লোকটা। একটু দুরত্ব বজায় রেখে নিজের স্কুটারে করে রুদ্ধ আর প্রেমার পিছু নিতে থাকে।

রুদ্ধ আর প্রেমা একটা বাসার সামনে এসে নামতেই লোকটা একটু দূরত্বে স্কুটার থামায়। দুজন ভেতরে প্রবেশ করলে লোকটা আবারো তার গুরুকে কল দিল।

-“গুরু। ছেলে-মেয়ে তো এক বাড়িতে এসে উঠেছে।”

-“কলিযুগ! ঘোর কলিযুগ! উভয়ে যেন আমাদের কার্যের পূর্বে কোনো আপদ না ঘটাতে পারে সেদিকে নজর রাখ। কোনো অনৈতিক কার্য দেখামাত্র মেয়েটাকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে আনবি। কেউ আটকালে তাদের কার্যক্রম অবশ্যই বর্ণনা করে সর্বসম্মুখে চুনকালি মাখাবি ওদের মুখে। কোনোক্রমেই যেন বেঁচে পালাতে না পারে।”

-“আচ্ছা গুরু। আমি নজর রাখছি।”

-“আমি ধ্যানে বসবো। এখন আর আমাকে পাবি না। তটস্থকে যোগাযোগযন্ত্রটা দিয়ে যাচ্ছি। কোনো দরকার পড়িবা মাত্র ব্যাকুল হয়ে যেন যোগাযোগের চেষ্টা করিস না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে আগে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করবি।”

-“জ্বী আচ্ছা গুরু।”

শ্যামলা লোকটা কল কেটে পকেটে পড়ে থাকা দূরবীন দিয়ে রুদ্ধ প্রেমার বাড়ির দিকে নজর রাখতে শুরু করলো।

রুশার বিছানায় মাত্রই বসেছে প্রেমা। ঘর বেশ কিছু সময় বন্ধ থাকায় একটা দমবন্ধ আবহাওয়া বিরাজ করছে। দু’সপ্তাহ ধরে রুশা ক্যাম্পে। ঘরের জানালাটা খুলে দিল প্রেমা। বাইরে থেকে আসা দমকা হাওয়ায় প্রেমার এলোমেলো চুলগুলো কপাল ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার। রুদ্ধ দরজায় এসেও থেমে যায়। প্রেমা জানালার ধারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে। কোনো সিনেমার শুটিংয়ের থেকে কম সুন্দর নয় দৃশ্যটা। প্রেমে পড়ার পরবর্তী মুহূর্তগুলো বুঝি এতটাই সুন্দর হয়? দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় ধারণ করতে পারলে দারুণ হতো।

-“কী রে, দরজায় দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস? আর এত রাতে এ ঘরে আসলি যে?”

-“রুমের সুইচ ঠিক আছে কিনা চেক করতে আসলাম।”

-“ঢঙ করার জায়গা পাও না? যাও যাও, অত খাতির লাগতো না আমার।”

-“কয়দিন পর চলে যাচ্ছিস, আগেরবার তো না বলে গেছিস। সুযোগ পাইনি খাতির করার। এখন একটু খাতির-যত্ন করি।”

-“বাব্বাহ! এত ভালো হলি কবে? এই শোন না, চল আমরা সাতদিনের একটা এডভেঞ্চার ট্যুরে যাবো, কোনো ভৌতিক বাড়িতে।”

-“তোর মাথা খারাপ? তুই জানিসই আমি ভূতে ভয়…না মানে আমার ভূত পছন্দ না।”

-“তোরে কি ভূতের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছি যে ভূত পছন্দ হওয়া লাগবে? শুভ্ররে বলে ভালো একটা স্পট বের কর। আমরা কালই রওনা দেব।”

-“আমারে কোন পাপের শাস্তি দিতেছিস? আমারে ছাইড়া দে মা। এসব ভূত-প্রেতের বাঁশবাগানে আমি নাই।”

রুদ্ধর কথায় প্রেমা হাসতে হাসতে পড়ে যেতে ধরে। রুদ্ধ ধরে ফেলে তাকে। প্রেমা হাসছেই। রুদ্ধর ভূতের ভয় সেই আদিকাল থেকে। এমনিতে রাত-বিরাতে বাইরে ঘুরতে তার ভয় লাগে না কিন্তু ভূতের নাম নিলেই তার ঘাম ঝরে। বিষয়টা এমন যে ভূতের নাম নেওয়ার আগ অবধি রুদ্ধ একা একা কবরস্থানেও বসে থাকতে পারবে কিন্তু ভূতের নাম নিলেই শেষ! বাথরুমে যাওয়ার জন্যও আন্টিকে লাগবে। এই ভীতু রুদ্ধটাকে দু’বছর বড্ড মিস করেছে প্রেমা। হুট করে লন্ডনে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এখন ভুল মনে হচ্ছে। সে চাইলেই তো থেকে যেতে পারত এই চিরচেনা শহরে। নিজেকে কেন যেন প্রতারক মনে হয় প্রেমার। খুব সূক্ষ্ম একটা প্রতারণা সে করেছিল নিজের বন্ধুদের সাথে। কাউকে কিছু না জানিয়েই উড়াল দিয়েছিল এক উন্নত শহরে যার বাতাসে এখন মিশে আছে প্রেমার দীর্ঘশ্বাস। ব্যস্ত-যান্ত্রিক সে শহরে আর মন টেকে না প্রেমার। দূরে আযান দিচ্ছে।আজ আর ঘুমোনো হলো না প্রেমার। মাথায় এখন ভ্রমণের ভূত ভর করেছে। আর এই ভূতকে ছাড়ানোর উপায় হলো আরেক ভূতের সাথে যত দ্রুত সম্ভব সাক্ষাৎ করা। শুভ্রকে বলে একটা ভুতুড়ে জায়গা খুঁজতেই হবে।

___________________________________________________________________________________

-“নিফিউ পাড়ায় যাবি?”

-“এইটা কি এই পৃথিবীতেই?”

-“বাংলাদেশের মেয়ে হয়ে বাংলাদেশের অলিগলি চিনোস না? লজ্জা লাগা দরকার।”

-“লজ্জা লাগতেছে! এখন বল এডা কই।”

-“বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মধ্যবর্তী এক দুর্গম স্থানে একটি গ্রামের পাশে এই জঙ্গলটি অবস্থিত। তল্যাংময় (সাকা হাফং) চূড়ার গাঁ ঘেষা এই জঙ্গলটি বান্দরবান জেলা ও মিয়ানমারের চিন রাজ্য জুড়ে বিস্তৃত….একটা আর্টিকেল সেন্ড করছি মেসেঞ্জারে। পড় ঐটা। তাহলেই বুঝতে পারবি।”

-“জায়গা তো ইন্টারেস্টিং কিন্তু ভীতুর ডিম কি রাজি হবে?”

-“ওরে ম্যানেজ করা তো তোর বাম হাতের খেল। ক্যামনে ম্যানেজ করবি কর।”

-“আমার একার দায়িত্ব নাকি? তোরা সবাই মিলে কিছু প্ল্যান কর।”

-“আরে শোন! তুই গেলে, ও এমনেই যাবে। কোনো প্ল্যান-ট্ল্যান লাগবে না।”

-“হ! আমি তো ওর বউ লাগি!”

-“কী যে লাগিস তা তো ওই জানে।”

-“এই কী বিড়বিড় করতেছিস রে?”

-“তুই যা তো ওরে ম্যানেজ কর। আমি প্যাকিং শুরু করতেছি।”

প্রেমা কল কেটে সারা ঘরে পায়চারি করতে থাকে। রুদ্ধ একটু আগেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। মিনিমাম এক ঘণ্টা না ঘুমালে সে সারাদিন ঘেউ ঘেউ করবে। মেজাজ থাকবে তুঙ্গে। এখন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না প্রেমা। আচমকা একটা শয়তানি বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়। রুদ্ধর ঘুম হলো কুম্ভকর্ণের ঘুম। বাড়িতে এখন আগুন লাগলেও ওর ঘুম ভাঙানো যাবে না।

রুদ্ধর ঘরে ঢুকে ওর বেশ কয়েকটা কাপড় প্যাক করে প্রেমা। রুদ্ধ বিছানায় মরার মতো ঘুমোচ্ছে। রুদ্ধর বাবা-মাকে নিজের প্ল্যান জানাতেই তারা হেসে উঠে। সব ঠিকঠাক করে শুভ্রকে কল করে গাড়ি নিয়ে রুদ্ধর বাড়িতে আসতে বলে সে।

-“কীরে? রুদ্ধর বাড়িতে ডাকলি? তাও এত সকালে? তনয়া আর রেহানকে তো প্রায় ঘুম থেকে টেনে তুলে নিয়ে আসলাম।”

-“আরেকজনকে তুলতে হবে। ঘুমের ঘোরে আছে, পুরোটা তুলে গাড়ির পিছনে ফেলে আসতে হবে।”

-“কারে? রুদ্ধ? ঐ সত্তর কিলোর আলুর বস্তা? আমার কি নিজের হাড়ের উপর মায়া-দয়া নাই?”

-“তোরে একা তুলতে বলছি? দেখ, ঐ ঘুমাইছে চাদর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে। এখন তুই চাদরের এক ধার ধর, আমি আরেক ধার। তারপর এভাবে গাড়িতে নিয়ে জাষ্ট বলের মতো ছুঁড়ে মারা। ইটস সো ইজি।”

শুভ্র ক্ষতবিক্ষত দৃষ্টিতে প্রেমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই আকাম করতে গিয়ে যদি রুদ্ধর ঘুম ভাঙে, তাহলে রুদ্ধ শুভ্রকে পুঁতে ফেলবে। ঢোক গিলে প্রেমার কথায় সম্মতি দিল সে।

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০২

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#২য় পর্ব
~মিহি

-“তুমি? আমি ভাবলাম তোমার জল্লাদ বাবা বোধহয় কল করেছে। তা বাসর ঘরে বসে হঠাৎ আমায় কল?”

-“একটা ধন্যবাদ তোমার প্রাপ্য রুদ্ধ। তাই কল দিলাম। আমার ফোন ফেলে ভুল করে বাবারটা নিয়ে এসেছি। তাই এটা থেকেই কল দিলাম।”

-“বেশ। ধন্যবাদ দেওয়া শেষ। এখন আদিলের কাছে যাও। নাহলে বেচারা আমাকে অভিশাপ দিবে এখন।”

অদৃতা হেসে কলটা কাটে। প্রেমা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুদ্ধ কথা শেষ করামাত্র সে আবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এখন চার নম্বর প্লেট চলে তার। রুদ্ধ হা হয়ে দেখছে।

-“আর কত খাবি, হাতি!”

-“চুপ কর শালা সজারু। আমাকে খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিবিনা। তোর চেয়ে বিশ কেজি কম আমার ওজন।”

-“তুই যে এত খাস, মোটা হস না ক্যান? খাবারগুলা যায় কই? তোর বাবার লকারে?”

-“এহ তুই যা তো, যাহ! আমাকে শান্তিতে খেতে দে।”

-“আরে বের হবো তোকে নিয়ে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর।”

-“কই যাবি? তাও এই মাঝরাতে?”

-“তনয়া, শুভ্র, রেহান সবাই অপেক্ষা করছে।”

-“কীহ! আমি এসেছি ওরা জেনেও গেছে? তোর পেটে একটা কথা থাকেনা? বললামই তো মাত্র সাতদিনের জন্য এসেছি। ওদের সাথে দেখা হলে তো একমাসেও দেশে ফিরতে পারবো না।”

-“লন্ডন তোর দেশ হলে, এইটা কি বিদেশ? ভাব কম খা! তুই আসছিস আর ওরা জানবে না? ভাবলি কেমনে? চল তাড়াতাড়ি নাহলে ওরা লাঠি নিয়ে আমার বাড়ি ভাঙতে আসবে।”

প্রেমা খাওয়া থামিয়ে উঠে হাত ধুয়ে নেয়, আনমনে হাসে। এখনো কত গভীর তাদের বন্ধুত্ব। যেন চোখ বন্ধ করলেই ভার্সিটি লাইফের স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখে।

_____________________________________________________________________________________

শুভ্র একমনে সুর তুলছে গিটারে। তনয়ার গান আর রেহানের অপ্রয়োজনীয় বাদশাহর বিট দেওয়া! এসব দেখে হাসতে হাসতে একদিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রেমা। আর রুদ্ধ এলো আটচল্লিশতম জুটির ব্রেকআপ করিয়ে দেওয়ার আনন্দে ট্রিট দিতে। প্রেমা রুদ্ধর কাজ দেখে মুখ কুঁচকায়।

-“দেখিস এত জুটির অভিশাপ লাগবে তোরে যে তোর জীবনেও বিয়ে হবে না।”

-“না হলো। তুই আছিস, তোরে দিয়ে কাপড় ধোয়ায়ে নিব, রান্না করে নিব। হাত-পা কি তুই টিপে দিবি নাকি তার জন্য লোক রাখা লাগবে?”

-“বান্দরের বংশধর! দূর হ এখান থেকে।”

-“তুই জলহস্তীর বংশধর।”

“এহ তোরা থামবি?” বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে রেহান। প্রেমা আর রুদ্ধ একে অপরকে ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এটা দেখে বাকিরা হেসে ওঠে। শুভ্র গিটার বাজানো থামিয়ে বলে ওঠে, “হ্যাঁ হ্যাঁ! খুব তো রাগ দেখানো হচ্ছে। দেখবোনি কয় ন্যানোসেকেন্ড টেকে এই রাগ! চোখের সামনে এক বাটি আইসক্রিম রাখলেই যার রাগ ফুঁস হবে, সে আবার ভেংচিও কাটে!”

“কী রে? ইহজগতে আছিস না পরজগতে? ভালোমতো বস বাইকে, পড়ে যাবি তো। তখন আবার তোর বিলেতি বাপ আমার নামে কেস করবে।” রুদ্ধর ডাকে ঘোর কাটলো প্রেমার। আগের দিনগুলোর স্মৃতি তার মানসপটে জ্বলজ্বল করছে। কত সুন্দর ছিল দিনগুলো। যখন তখন দেখা হতো, কথা হতো, মাঝরাত অবধি আড্ডা হতো।

রুদ্ধ বাইক চালাচ্ছে। পেছনে বসে আগের স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টায় মত্ত প্রেমা। রুদ্ধ একাধারে বকবক করে চলেছে। বহুদিন বাদে এমন করে রুদ্ধর পিছনে বসে অন্ধকার রাস্তা পার করছে প্রেমা। মনে মনে সে একবার প্রার্থনা করে, “এ পথ যেন কখনো শেষ না হয়!”

_________________________________________________________________________________________

শুভ্রর গিটারে সুর উঠছে। তনয়া গাইছে,”কফি হাউজের সেই আড্ডাটা…” রেহান চায়ের কাপে আড্ডা জমাতে ব্যস্ত। প্রেমার চোখ আনন্দে ছলছল করছে। রুদ্ধ আড়াল থেকে দেখছে প্রেমার হাসিমাখা মুখ। এই মেয়েটা চিরতরে তার বাঁধনে আবদ্ধ হতে পারতো কিন্তু হলো না। “আমরা শুধু বন্ধু” কথাটা খুব সুন্দর কিন্তু এই সম্পর্কে একপক্ষীয় ভালোবাসা থাকলে, অনুভূতিটা হয়ে ওঠে মারাত্মক যন্ত্রণার। রুদ্ধ প্রেমাকে চিনতো স্কুল লাইফ থেকেই। ভার্সিটি অবধি তারা শুধু বন্ধুই ছিল। অনুভূতির সূচনা হলো খুব আকস্মিকভাবে কিন্তু খুব ধীরগতিতে। এক ব্যস্ত সন্ধ্যায় নিয়নবাতির আলোয় প্রেমার হাসিটা আগুনের ন্যায় ঝলসে দিয়েছিল রুদ্ধর অন্তরটাকে। অতঃপর প্রেমার চোখের প্রতিটি পলক ফেলাও যেন গুণে গুণে রাখতো রুদ্ধ। তনয়া, শুভ্র, রেহান বিষয়টা বেশ ভালোই আন্দাজ করতে পেরেছিল কিন্তু প্রেমা বোঝেনি। মেয়েরা নাকি চারহাত দূর থেকেও বুঝতে পারে কে তার সম্পর্কে কী ভাবছে। তাহলে দুহাতের নাগালে থেকেও কেন প্রেমা বুঝলো না রুদ্ধর অনুভূতিটুকু? এতটা অপ্রকাশিত ছিল তা? নাকি প্রেমা বুঝতেই চায়নি রুদ্ধকে?

-“রুদ্ধ? তুই কি এবারও সুযোগটা হারিয়ে ফেলবি?”

-“রেহান, আস্তে কথা বল। প্রেমা শুনে ফেলবে।”

-“ওহ আচ্ছা! তার মানে এবারও তুই ওকে কিছুই জানাবি না, ইভেন জানতে দিবিও না।”

-“আমি চাই না আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হোক। প্রেমার আমার প্রতি কোনো ফিলিংস নেই রে।”

-“ফিলিংস নাই দেইখাই তো ছুটে আইছে তোমার বিয়ের কথা শুইনা। তোমার মিয়া আজাইরা ভয়! যাও, বলা লাগবে না তোমার। কয়দিন পর একটা এনআরআইরে বিয়া করবো, তখন তার বিয়েতে খাবার সার্ভ কইরো তুমি।”

রুদ্ধ ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় রেহানের দিকে। অবশ্য রেহান ভুল কিছু বলেনি। বয়স তো থেমে নেই, প্রেমাও বিয়ে করবে একদিন। হয়তো ছেলেটা রুদ্ধ হবে না। আর সাতটাদিন, তারপরেই ওড়ে যাবে রুদ্ধর পাখিটা। ভাবতেই বুকের মধ্যে ক্ষরণ অনুভব করে রুদ্ধ।

-“এই এই রুদ্ধ, শোন তো। নেক্সট সাতদিনের জন্য দারুণ কিছু প্ল্যান কর তো। চল কোথাও থেকে ট্যুর দিয়ে আসি।”

-“তুই দেশেই আসছিস সাতদিনের জন্য। সাতদিনের মধ্যে একদিন গেছেই। এখন হঠাৎ কী প্ল্যানিং করবো আমি?”

-“সুন্দরবন যাই?”

-“তারপর একটা বাঘ এসে তোকে খেয়ে নিক।”

-“ধূর ছাতার মাথা! সবসময় আউল-ফাউল কথা না বললে তোর হয় না? দেখ, সাতটা দিনই তো আছি আমি, তারপর তো চলেই যাবো।”

প্রেমার কথাটা তীরের মতো এসে লাগে রুদ্ধর বুকে। সে কিছু বলে না, কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। শুভ্রর ভ্রমণ বিষয়গুলো নিয়ে অগাধ জ্ঞান। তার বেশ কয়েক দিন ধরেই এক জায়গায় যাওয়ার বেশ ইচ্ছে কিন্তু এখনো কাউকে বলেনি।

-“কীরে শুভ্র? কী এতো ভাবিস?”

-“কিছুনা রে। একটা জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবছি। আজ সবাই বাসায় চল। এসব নিয়ে কাল সকালে দেখি।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

শুভ্রর কথার জবাব দিয়ে রুদ্ধর দিকে তাকালো প্রেমা। চোখের ইঙ্গিতে স্পষ্ট বুঝে গেল রুদ্ধ। বিদায় অনুষ্ঠান শেষ করে প্রেমাকে নিয়ে আবারো ছুটে চললো। প্রেমা মেয়েটা পাগলাটে! এত কিছু খেলো, তাও এখন তার রাস্তার পাশের আইসক্রিম খেতে হবে। রাত তিনটায় কোন পাগল তার জন্য আইসক্রিমের স্টল নিয়ে বসে আছে আল্লাহ মালুম।

মিনিট বিশেক পর এক চৌরাস্তার মোড়ে একটা আইসক্রিমের স্টল দেখতে পেল প্রেমা। সাথে সাথে তার লাফালাফি শুরু। রুদ্ধ বাধ্য হয়ে বাইক থামিয়ে আইসক্রিম আনতে গেল। রুদ্ধর অবাক লাগে প্রেমা তাকে যেভাবে ট্রিট করে, সেভাবে কোনো বন্ধুদের মধ্যকার সম্পর্ক হয় না। অনেকটা প্রেমিকার মতোই বিহেভ করে প্রেমা রুদ্ধর কাছে আসলে। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতে রুদ্ধ দুটো আইসক্রিম নিয়ে সামনে এগোলো। প্রেমা দৌড়ে এসে দুটো আইসক্রিমই রুদ্ধর হাত থেকে নিয়ে এক দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে। রুদ্ধ হালকা হেসে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হচ্ছে।

রাতের নিস্তব্ধ রাস্তা। আচমকা হেডলাইটের আলো এসে চোখে বাঁধে রুদ্ধর। রাস্তার ঐ পাশ থেকে প্রেমার চিৎকার বুঝে ওঠার আগেই চোখ পড়ে বেসামালভাবে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসা ট্রাকের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে রুদ্ধ। পা যেন জমে গিয়েছে তার। শেষবার প্রেমার দিকে তাকালে আবিষ্কার করে ছুটতে থাকা এক সুন্দরী রমনীর চিন্তিত, আশঙ্কায়িত মুখখানা।

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০১

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#সূচনা পর্ব
~মিহি

-“তোমার আসলেই লজ্জা নাই প্রেমা? তোমার লজ্জা করলো না নিজের প্রাক্তনের বিয়েতে এসে কব্জি ডুবিয়ে খেতে? ছেলেরা এত নির্লজ্জ হয় জানতাম কিন্তু তুমি এত বেহায়া? তাও পড়ে এসেছো এক পুরনো আমলের শাড়ি! লজ্জা লাগেনা তোমার?”

-“বাহ রে! এত শখ করে দাওয়াত দিলা আর আমি আসবো না ভাবলে কী করে? তোমাকে বিয়ে করে কার জীবনটা ধ্বংস হচ্ছে সেটা অন্তত দেখি।”
মুহূর্তের মধ্যে সবার তীক্ষ্ম নজর এসে পড়লো রুদ্ধ আর প্রেমার উপর। ইতিমধ্যে কানাকানিও শুরু হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি চলছে। সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে উঠতে চলেছে জায়গাটা। রুদ্ধ প্রেমাকে বেশ কড়া কিছু কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয় কিন্তু তার আগেই প্রেমা গ্লাসের অবশিষ্ট জুসটুকু রুদ্ধর মুখে ছুঁড়ে মারে। রুদ্ধর অপমানিত মুখটা রাগে লাল হয়ে উঠে। প্রেমার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারে সে। এতক্ষণ সবাই চুপ করে থাকলেও এবার কানাকানি শুরু হয়। রুদ্ধ কটমট করে তাকিয়ে থাকে প্রেমার দিকে।

-“তুই কি যাবি এখান থেকে? রাস্তার মেয়ের মতো আচরণ করিস না। খেতে এসেছিস, খেয়ে চলে যা।”

-“খেয়ে ছেড়ে দেওয়ার অভ্যাস আমার নেই মি.রুদ্ধ মির্জা। তোমার বিয়ে আমি কিছুতেই হতে দিচ্ছি না। দরকার পড়লে আমি পুলিশ ডাকবো।”

-“হা হা হা! আমার হবু শ্বশুর এসব পুলিশদের তার প্যান্টের ব্যাকপকেটে রাখে আর তুমি আমায় পুলিশের ভয় দেখাও? লাইক সিরিয়াসলি? গেট আউট অফ হিয়ার।”

-“আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুমি এই বিয়ে ভাঙবে নাকি আমি আরো সিন ক্রিয়েট করবো?”

রুদ্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুদ্ধর হবু শ্বশুর আদনান রাহমান সেখানে এলেন। বেশ রাগী দৃষ্টিতে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। অতঃপর বিনয়ের সহিত প্রেমাকে বসতে বললেন। প্রেমা বসলো।

-“এই মেয়ে, নাম কী তোমার?”

-“প..প্রে..প্রেমা।”

-“ভয় পেয়ো না। সত্যি বলো।”

-“আঙ্কেল! আপনি যার সাথে আপনার মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছেন, তার সাথে আমার প্রায় চার বছরের সম্পর্ক। এমনকি ও আমায় কথা দিয়েছিল আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবে না অথচ এখন আমায় মিথ্যে বলে আপনার মেয়েকে বিয়ে করছে। কারণটা হলো আপনার টাকা।”

-“তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে?”

-“আমাদের বেশ কিছু ছবি আছে একসাথে।”

-“আজকাল কত ছবিই তো মর্ফ করা যায়। কিভাবে বিশ্বাস করবো তোমায়?”

-“আপনি একজন ক্ষমতাশালী নেতা। যদিও আমার আপনার চোখের উপর সন্দেহ নেই কিন্তু তবুও একজন ভালো মানের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে ডেকে চেক করে নিতে পারেন এটা মর্ফ নাকি আসল।”

আদনান রাহমান কিছুটা অপমানিতবোধ করলেন। ছবিগুলো হাতে নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। রুদ্ধ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আদনান রাহমান একবার তাকালেন বধূবেশে থাকা তার ছোট কন্যা অদৃতার দিকে। অদৃতার চোখ ছলছল করছে। আদনান রাহমানের কপালে ঘাম, চিন্তায় ভাঁজ পড়ছে কপালে। আজ বিয়ে না হলে বড়সড় কোনো বিপদ আসন্ন। কী যে করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। অদৃতার মা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনিই সামলেছেন তার দুই মেয়েকে। সব দেখে-বিচার করে রুদ্ধকে যোগ্য পাত্র মনে হয়েছিল বলেই বিয়েটা ঠিক করেছিলেন কিন্তু রুদ্ধ যে এমন বের হবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি। এই মুহূর্তে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে তার। অদৃতা মারাত্মক সুন্দরী, একদম নিজের মায়ের মতো। যার কারণে আশেপাশের সকলের নজর সবসময় অদৃতার দিকে। বেশ কয়েক মাস ধরেই মেয়েটা অসুস্থ। ডাক্তার দেখিয়ে লাভ হয়নি। এক খ্যাতনামা পীর বলেছেন অদৃতাকে পাওয়ার জন্য কেউ একজন কালো যাদু করেছে যার দরুন অদৃতা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তিনি আরোও বলেছেন আজকের তারিখের মধ্যে অদৃতার বিয়ে না হলে অদৃতার বড়সড় বিপদ হবে। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই বিয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো করা।

রুদ্ধকে আদনান সাহেব চেনেন এক অনুষ্ঠানের বদৌলতে। ছেলেটাকে দেখেই তার মনে হয়েছিল ভদ্র, উচ্চ বংশোদ্ভূত ছেলে অথচ এত নিচ তার কর্মকাণ্ড! কী সুন্দর একটা মেয়ের কোলে শুয়ে ছবি অবধি তুলিয়ে অন্য একজনের জন্য কবুল বলতে বসেছে। যাই হয়ে যাক, এ ছেলের সাথে তিনি তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারেন না। বুকে ক্ষীণ ক্ষীণ ব্যথা হচ্ছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। এমন সময় আশার শেষ আলোটা উপলব্ধি করতে পারেন তিনি। বড় মেয়ে তন্নী দৌড়ে আসে।

-“বাবা, আমার দেবর আদিল বিয়ে করবে অদৃতাকে। তূমি দয়া করে এ ছেলের সাথে বিয়ে দিও না ওকে। আমি জানি তুমি কখনোই চাওনি পরিবারের দুই মেয়েকেই এক বাড়িতে পাঠাতে কিন্তু এই মুহূর্তে সেটাই কি ভালো হবে না?”

-“তুই ঠিক বলেছিস মা! আমি এই রুদ্ধর সাথে আমার কলিজার টুকরোর বিয়ে দিতে পারিনা। তুই আদিলকে ডাক। এখানেই বিয়ে হবে ওদের। রুদ্ধ, তুমি কি তোমার পরিবার নিয়ে সসম্মানে যাবে নাকি তোমারও নিজের হবু বউয়ের বিয়ে দেখার শখ আছে? তোমাকে যে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিচ্ছি তা কিন্তু ভেবো না। তোমার পরিণতি কী হবে তা আমি পরে ভেবে দেখবো।”

রুদ্ধ তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। এতটা অপমান সহ্য করা যায় না। রুদ্ধর পরিবারও বেশ রেগে আছে। সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় তারা। বিয়েটা মেয়ের বাড়িতে ঠিক করা হয়েছিল! নিজের বাড়িতে হলে হয়তো পাড়া প্রতিবেশী যারা বিয়েতে আসেননি, তাদের সামনেও নাক কাটা যেত।

বিয়ে বাড়িতে সকলের মুখ একটু আগেও গম্ভীর ছিল তবে এখন যেন সব স্বাভাবিক। সবার হাসিমুখের ভীড়ে একজনের ঠোঁটে দেখা যাচ্ছে শয়তানি হাসি। এত জাঁকজমকের মাঝে খুব সাধারণ সেই তীক্ষ্ম হাসিটা কারো নজরের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ার কথা না, হচ্ছেও না।

খুব সুন্দরভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়। আদনান রাহমান খুশিতে কাঁদছেন। তার ছোট্ট পরীটা আজ অন্য কারো ঘরে চলে যাবে ভাবতেই বিষণ্ণতা তাকে ঘিরে ধরছে। মেয়ের মুখটা বারবার দেখছেন তিনি। সেই ছোট্ট মেয়েটা আজ কত্ত বড় হয়ে গেছে! সবার অলক্ষ্যে চোখের জল ফেলেন তিনি।

______________________________________________________________________________________

-“কীরে কোনটা খাবি? স্প্রাইট নাকি স্পিড?”

-“থাম! বিরিয়ানিটা তো শেষ করতে দে।”

-“তুই কী রে! বিয়ে বাড়িতে এত খেলি! এখানে এসে তিন প্লেট বিরিয়ানি খেলি, তাও তোর পেট ভরছে না? দেখতো তো ঝাঁটার কাঠি অথচ খাস হাতির মতো।”

-“নজর দিবিনা শালা। তোর বিয়ে ভাঙার জন্য কত্ত পরিশ্রম করলাম আর তুই আমারে সামান্য তিন প্লেট বিরিয়ানি খাওয়াতেও কিপ্টামি দেখাচ্ছিস? আন্টি, দেখো তোমার ছেলে কিপ্টা!”

হেসে উঠেন রুদ্ধর মা আফিয়া চৌধুরী। পাশেই রুদ্ধর বাবা রাদিফ চৌধুরী বিরিয়ানির স্বাদ নিতে ব্যস্ত। আফিয়ার খুশি মুখে আচমকা হালকা বিষণ্ণতার ছাপ পায় রুদ্ধ।

-“কী হলো মা? মন খারাপ তোমার?”

-“এত কিছু করার কোনো দরকার ছিল রুদ্ধ? আমরা সরাসরি বিয়েটা ভেঙে দিলেই হতো! এত লোক ডেকে, অনুষ্ঠান করে, অপমানিত হয়ে বিয়ে ভাঙার তো কোনো কারণ ছিল না।”

-“আচ্ছা মা, আমরা বিয়ে ভেঙে দিলে আদনান সাহেব যে অন্য কোনো ছেলের সাথে অদৃতার বিয়ে ঠিক করতেন না তা কি তুমি নিশ্চিত?”

-“এই আদনান রাহমানের মাথার সমস্যা আছে বুঝছিস! নিজের মেয়ের মনের কথাও বোঝেনি। আর মেয়েটাই বা কী! একবার নিজের বাবাকে বলে তো দেখবে নিজের পছন্দের কথা। তা না করে তোকে হাতে আনলো আর তুইও আমার সরল সোজা বাচ্চা! রাজি হয়ে গেলি ওদের দুজনের বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতে।”

এই মুহূর্তে প্রেমা বেশ রেগে গেল। মেকি রাগ দেখিয়ে বলল, “বাহ রে! আর আমি যে তোমার সরল সোজা ছেলের জন্য লন্ডন থেকে ছূটে এলাম, সেটা বুঝি কিছুনা আন্টি?” রুদ্ধ জোরে হেসে ওঠে। প্রেমা আনমনে রুদ্ধর হাসিটা খেয়াল করে। বুকে একটা ক্ষীণ ব্যথা অনুভব করছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যথা কমানোর চেষ্টা করে। অতঃপর বিরিয়ানি খেতে খেতে কথা বলতে শুরু করে।

-“তা আন্টি, তোমার ছেলের যে মানহানি হলো, এখন ওকে কেউ বিয়ে করবে?”

-“কেউ না করলে তুই আছিস না!”

-“হ! আমার ঠ্যাকা! তোরে জিগাইছি আমি? আন্টিরে জিগাইছি। তুই চুপ থাকবি। শয়তান, বাঁদর একটা!”

রুদ্ধ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। আচমকা ফোনের ভাইব্রেশনে কিছুটা চমকে ফোন হাতে নিল সে। স্ক্রিণে জ্বলজ্বল করতে থাকা নম্বরটা দেখে নিমেষেই ঘাম ছুটে যায় তার। ঢোক গিলে ফোনটা রিসিভ করে সে।

চলবে…

ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি পর্ব-১৬(শেষ পর্ব)

0

#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১৬

বিভিন্ন রকম রঙ বেরঙের আলোক রশ্মিতে আলোকিত হয়ে আছে চারপাশ। ব্যস্ততায় দম ফেলানোর উপায় নেই কারো কারো। মামনি আজ সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। যদিও এখানে অনেকেই আছে। সেই সাথে আছে রিক্তা আপু ও। হয়তো প্রিয়কই এনেছে তাদের। আম্মিও এসেছে। তবে বাবা আসেনি। হয়তো আসবেও না। একটা সুক্ষ্ম ব্যাথাা অনুভব হয়৷ বাবার যতই অপছন্দের হই না কেন আমি, বাবাতো আমার কাছে প্রিয় ছিল। দিনশেষে একপলক তাকে দেখলেও তো শান্তি লাগতো। অথচ কত মাস হয়ে গেল বাবাকে দেখিনি আমি। দেখিনি বললে ভুল হবে। দেখেছি তবে তা আড়ালে থেকে। আজ আমার এতবড় দিনে বাবা এখানে নেই। ভাবতেই একটা চাঁপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ভিতর থেকে।
আজ আমার গায়ে হলুদ। নতুন করে সবটা করা হয়েছে। আগের বার কোনো মতে শুধু বিয়েটাই সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাতে ছিল না কোন জাঁকজমক। আর না ছিল কোনো উৎসব মুখর পরিবেশ। তবে এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে উপস্থিত প্রতিটা ব্যক্তি বিভিন্ন ভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করছে। কেউ গান গেয়ে, তো কেউ নাচের মাধ্যমে মাতিয়ে রাখছে এই হলুদ সন্ধ্যাকে। মুনি, হাসি, তন্নি, রিয়ন আর সাথে নয়নাও এসেছে। হলুদের সাজে পিচ্চি নয়নাকে দারুন লাগছে আমার কাছে। গোলগাল মুখশ্রীতে অদ্ভুত এক মায়া আছে। যে মায়ায় সহজেই যে কাউকে বেঁধে ফেলতে পারবে। এর আগে দুতিনবার কথা হলেও আজ মেয়েটাকে অন্যরুপে আবিষ্কার করলাম। না খুব বেশি চঞ্চল আর না গম্ভীর। দুইটা মিলিয়ে একদম পার্ফেক্ট। নয়না বেশ কয়েকবার আমার আশেপাশে এসে ঘুরঘুর করে গেছে। একবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি হয়েছে? কিছু বলবে?”
নয়না আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপু তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। আমার বিয়ের সময় ও কি আমাকে এমন সুন্দর লাগবে?”
বলেই প্রশ্নমাখা চোখে তাকিয়ে থাকল। আশেপাশে রিয়নকে খুজলাম। একটু দূরেই এখানে আসা মেহমানদের সাথে কথা বলছে ও। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মৃদু হেঁসে নয়নাকে বললাম,
“হুম লাগবে তো। বাট কতটা সুন্দর লাগবে সেটা তোমাকে রিয়ন ভালো বলতে পারবে। ওকে যেয়ে জিজ্ঞাসা করো।”
নয়না একবার রিয়নের দিকে তাকিয়ে আচ্ছা বলে চলে গেল। তবে রিয়নের দিকে নয়, উল্টো দিকে। মনে হলো লজ্জা পেয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে হেঁসে দিলাম আমি। ঠিক তখনি হুড়মুড় করে হাসি আর তন্নি এসে আমায় জরিয়ে ধরল। হাসি বলল,
“কিরে এত হাসছিস যে। জিজুর কথা মনে পড়ল। ”
“ধ্যাত, কি সব বলিস না। আমি কি এমনিতে হাসতে পারি না। ”
হাসি বলল,
“তা পারিস। কিন্তু এখন সন্দেহ হচ্ছে। ”
“থামবি তোরা। নয়তো মাইর খাবি এখন। ”
“দেখ দোস্ত, তোর হলুদে আইছি। মাইর খাইতে না। তয় ভাবছিলাম কিছু ক্রাস খামু। বাট তোর তো কোন দেবর ও নাই। আচ্ছা প্রিয়ক জিজুর কোনো বন্ধু ও কি নাই। এত নিরামিষ কেন সব?”
বলেই মুখ বানালো। আমি আর তন্নি তা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। তন্নি হাসতে হাসতেই বলল,
“আহারে, বেচারী। ”
তন্নির কথা শেষ হতেই হাসি তন্নির পিঠে কিল বসিয়ে দিল। তন্নি ওকে মারতে নিলেই হাসি দৌড় দেয়। তা দেখে হাসি বাড়ে আমার।
“এভাবে হেঁসো নাগো প্রিয়, বুকে লাগে যে আমার।”
হঠাৎ এমন কথায় স্তব্ধ হয়ে যায়। এই কণ্ঠের মানুষটা যে প্রিয়ক নয় তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলাম। হালকা ভাবে পিছনে তাকাতেই যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। হ্যাঁ এটা আবির।
মনের মাঝে এলোমেলো ভাবনা আসছিল বারবার। আবির এখানে কেন আসবে? কে ডেকেছে ওকে? আমি যখন এসব ভাবনায় ব্যস্ত তখন আবির কিছু একটা আমার মুখের উপর স্প্রে করে দেয়। আর আমি চোখে ঝাপসা দেখতে দেখতে ঢুলে পড়ি সেথায়। ঝাপসা চোখে মানুষটাকে এদিকেই আসতে দেখেছিলাম।

তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব হতেই নড়ে চড়ে উঠি আমি। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে যখন জ্ঞান হারানোর পূর্বের কথা স্মরণে আসে তখন জাগ্রত হই। তাড়াতাড়ি উঠে বসতে নিলেই হাতে টান পড়ে। মৃদু আর্তনাদ করে আবারও শুয়ে পড়ি। ভালো করে চোখ মেলতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করি। হাতে লাগানো ক্যানেলায় টান পড়েছিল একটু আগে। আশেপাশে চোখ পড়তেই সবার প্রথমে নজরে এলো প্রিয়কের মুখখানি। চোখেমুখে কেমন বিষন্নতার ছাপ পড়েছে। অথচ কিছু সময় পূর্বেও কতটা প্রানবন্ত ছিল মানুষটা। আচ্ছা কত সময় পার হয়েছে? আবির কোথায়? আর আমিই বা এখানে এলাম কখন? আমার ভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে প্রিয়ক আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বেশি চিন্তা করিস না। সব ঠিক আছে। ঘাবড়ানোর কিছু হয় নি। আর কিছু হতেও দিবো না। ”

তখনও সবটা আমার মাথার উপর দিয়ে গেল। তবুও তার দেওয়া আশ্বাস যেন মন বুঝে গেল। নিরবে সম্মতি দিয়ে ওভাবেই শুয়ে থাকি। তবে ভাবনারা থেমে নেই। তারা তাদের মত ছুটে চলেছে। খুব বেশি মানুষ না হওয়ায় মোটামুটি ফাঁকা পরিবেশই ছিল। আম্মি আর মামনি যে সব মহিলারা এসেছিলেন তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছিলেন। মুনি, হাসি ওরাও নিজেদের মতো ব্যস্ত ছিল। তা খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। এতটুকু সময়ের মাঝে আবির কি করে আসল? আর কি ছিল সেই স্প্রেতে? কি উদ্দেশ্য ছিল ওর? এসব ভাবনার মাঝে দুচোখে নেমে এলো ঘুম। গভীর ঘুম!

একটা অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। চোখ মেলে তাকিয়ে নিজেকে কারো বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ পেলাম। তারই হার্টবিটের মৃদু আওয়াজে ঘুম ভেঙেছে আমার। তবে তাকিয়ে অবাক হলাম। বাইরে হয়তো এখন গভীর রাত। রাতজাগা নিশাচর পাখি ছাড়া আর কেউ জেগে আছে বলে সন্দেহ। এর মাঝে প্রিয়ক চেয়ে আছে আমার পানে। ঘুমাইনি কেন মানুষটা? এত কিসের চিন্তা তার?
আমাকে চোখ মেলতে দেখে অস্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“কি হয়েছে প্রিয়তা। কষ্ট হচ্ছে? পানি খাবি? ”
বলেই উঠে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে পানি নিতে যায়। আমি তার হাত ধরে বাঁধা দিলে সে আমার দিকে প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি মৃদু স্বরে বললাম,
“তোমার কি হয়েছে? ঘুমাই নি কেন? এতো অস্থির হচ্ছো কেন?”
মুহুর্তেই মানুষটা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল,
“কই কিছু হয়নি তো। তোর শরীর ভালোনা। তাই চিন্তিত ছিলাম। আর কিছু না। ”
আমি শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। একজন মানুষ ঠিক কতটা ভালোবাসলে তার প্রেয়সীর জন্য এতটা ব্যাকুল হয়? প্রিয়ক আমাকে বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রাখে। তার হৃৎস্পন্দন তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে। প্রিয়ক আমার মাথায় এক হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“কাল বিয়েটা ক্যান্সেল করি?”
আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালাম। যে মানুষটা সবচেয়ে বেশি আনন্দিত, এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করে এসেছে সে আজ এমন কথা বলছে। আস্তে করে শুধু কারন জানতে চাইলাম তার কাছে। প্রিয়ক বলল,
“তোর শরীর ভালোনা। এ অবস্থায় এতটা ধকল নেওয়া ঠিক হবে না। তাই।”
“তার দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”
“কতটা ঠিক আছিস তা ভালো করেই জানি। একটুর জন্য হারাতে বসেছিলাম তোকে।”
“মানে!”
আমার প্রশ্নের আর কোনো উত্তর না দিয়ে আমাকে ঘুমিয়ে যেতে বলে। মনের মাঝে প্রশ্নরা উঁকি মারলেও আর কিছু বললাম না। চুপ করে প্রিয়কের বুকের মাঝে মিশে রইলাম। তবে বেশিক্ষণ জেগে থাকার শক্তি ছিল না। ঘুমিয়ে পড়ি।

সূর্যের তীক্ষ্ণ আলোক রশ্মি ঘরে প্রবেশ করতেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। উঠে বসতে নিলে হাতে টান খাই। মৃদু আর্তনাদ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে। টানের উৎস খুজতেই দেখলাম হাতে স্যালাইন লাগানো।
“আস্তে উঠ। নয়তো ব্যাথা পাবি।”
রিক্তা আপু বলল। আমি আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“তুমি এখানে? আর স্যালাইন.. ”
“প্রিয়ক ভাইয়া থাকতে বলেছে আমাকে। ভাইয়া একটু কাজে গেছে তাই। আর তোর শরীর খুব দূর্বল। এজন্য ডক্টর স্যালাইন দিয়ে গেছে। আপাতত কয়েক ঘন্টা এভাবেই থাকতে হবে।”
আপুর কথা শুনে অবাক হই। তারমানে কি প্রিয়ক বিয়ের ডেট পিছিয়ে দিয়েছে?
আপুকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপু বিয়ের কি হবে তাহলে?”
“তুই সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই হবে না। ভাইয়া সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস বেশি কাউকে জানানো হয়নি। নয়তো সম্মানের প্রশ্ন উঠত। ”
আপু মৃদু হেসে জবাব দিল। আমি কিছু বলতে নিবো তার আগে আপু আবর বলল,
“হয়ছে তোকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। যা করার ভাইয়া করবে। তুই চুপচাপ শুয়ে থাক। নয়তো আমি বকা খাবো ভাইয়ার কাছে।”

সূর্যের তেজ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে আমার মাঝের অস্থিরতা। সকাল থেকে মানুষটাকে দেখা হয়নি। কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানি না। ঘুমটা বড্ড বেশি হয়েছে আমার। সারাটা সময় প্রায় ঘুমেই কাটছে। হাতের স্যালাইন এখনও চলছে। রিক্তা আপু এখন পাশে নেই। ছোট পিচ্ছিটাকে খাওয়াতে গিয়েছে। বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে ফোন হাতে নিয়ে ডায়ালপ্যাডে গিয়ে খুব পরিচিত নাম্বারে কল দেই। প্রথম রিং হতেই রিসিভ করে মানুষটা। ভেসে আসে তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
“তুই ঠিক আছিস? কোনো প্রবলেম হচ্ছে না তো। দেখ একদম উঠার চেষ্টা করবি না। চুপচাপ শুয়ে থাক। নয়তো হাতে ব্যাথা পাবি..।
” আমি ঠিক আছি।”
আমার কথায় মানুষটার কথা আটকে যায়। তারপর বললাম,
” তুমি কোথায়? ”
“একটু কাজে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবো। চিন্তা করিস না।”
“খেয়েছো কিছু? নাকি না খেয়েই আছো?”
“হুম খেয়েছি। ”
আরো কিছু কথা বলে ফোন রেখে দেয় মানুষটা। সবটা আমার ঠিক থাকা নিয়ে।

সন্ধ্যার আকাশে সূর্যাস্তের পর আজানের সুমধুর ধ্বনিতে আলোড়িত হয় প্রকৃতি। তার কিছু সময় পর দেখা পায় মানুষটার। ঠিক কী কাজে গিয়েছিল তা জানা নেই আমার। তবে বড্ড ক্লান্ত ছিল তার মুখখানি। একপলক আমার দিকে তাকিয়ে ওয়াসরুমে চলে যায়। তখনও শুয়ে আছি আমি। স্যালাইন শেষ হলেও উঠতে মানা। কিছুসময় পর বের হয় প্রিয়ক। শাওয়ার নিয়েছে একবারে। এখন কিছুটা ফ্রেস লাগছে মানুষটাকে। আমার পাশে এসে আমাকে ধরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসায়। তারপর আমার কপালে উষ্ণ ছোঁয়া দিয়ে বলল,
“এখন কেমন লাগছে?”
“ভালো।”
“খেয়েছিস কিছু?”
“না।”
“আচ্ছা বস। আমি খাবার আনছি। ”
” তার দরকার নেই। আমি এনেছি। তোমাদের দুজনের জন্যই এনেছি।”

দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম রিক্তা আপু খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকছে। ভিতরে এসে টেবিলের উপর খাবার রেখে বলল,
“ফুফি পাঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি দুজনে খেয়ে নাও। সারাদিন তো মনে হয় না কিছু খেয়েছো।”
তারপর আপি চলে যায়। প্রিয়ক নিজের হাতে খাবার মাখিয়ে আমাকে খাইয়ে দেয়। সেই সাথে নিজেও খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে প্রিয়ক বলল,
“ছাদে যাবি? ”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে উঠতে নিলে বাধা দেয়। তারপর নিজেই আমাকে কোলে তুলে নেয়। এরপর খুব সাবধানে আমাকে নিয়ে ছাদে আসে। তাকে মানা করলেও শুনে না। ছাদে আসার পর আমাকে দোলনায় বসে দিয়ে নিজে দোল দিতে থাকে। আকাশের চাঁদটা আজ পূর্ন গোলাকার রুপে আছে। হয়তো পূ্র্নিমা আজ। আমাদের মাঝে হয়না কোনো কথা। তবুও মুহুর্তটা অনেকটা রোমাঞ্চকর মনে হয়।

আবারও সেজে উঠেছে পুরো বাড়ি। সাজানো হয়েছে বাড়ির গেট থেকে ছাদ পর্যন্ত সবটাই। রঙ বেরঙের আলোয় আলোকিত চারপাশ। এরই মাঝে বধু বেশে বসে আছি আমি। বাইরে নয়, ছাদেই করা হয়েছে সব আয়োজন। স্টেজে বসে থাকা অবস্থায় তন্নি আসে আমার কাছে। এসেই বলল
“বলেছিলাম না প্রিয়ক ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে। এখন মিলল তো আমার কথা।”
“আসলেই। মানুষটা এতটা ভালো কবে বাসল? বুঝতেই পারলাম না।”
“আমরা তোর হলুদের দিন বুঝেছিলাম। পাগলের মতো করছিল মানুষটা। স্টেজে এসে যখন দেখল তুই শুয়ে আছিস। ভেবেছিল হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিস। কিন্তু কয়েকবার ডাকার পর ও যখন উঠলি না পাগলের মতো করছিল। তারপর হুট করেই নজর যায় গেইটের দিকে। আবিরকে বের হতে দেখে। যা বুঝার বুঝে গিয়েছিল। পাগলের মতো চিৎকার করছিল। তার ডাক শুনে আমরা সবাই ছুটে আসি। তোর চোখে মুখে পানির ছিটা দেওয়ার পর ও তোর জ্ঞান ফেরে না। তখন যদি তুই ভাইয়াকে দেখতিস। তাহলে বুঝতিস। এরপরেই তোকে কোলে করে গাড়িতে বসায়। আমি, তোর ফুফি, আর আন্টি গিয়েছিলাম সাথে। ভাইয়া সারারাস্তা অস্থিরতায় ছিল। হাসপাতালে পৌঁছেই তোকে ইমারজেন্সিতে নেওয়া হয়। প্রায় কয়েক ঘন্টা পর তারা বের হয়। এর পুরো সময়টা পাগলের মতো করছিল প্রিয়ক ভাইয়া। ডক্তর যখন জানাই তোর জ্ঞান ফিরেছে এখন ঠিক আছিস তখন যেয়ে কিছুটা শান্ত হয়। তখন আমরা জানতে পারি তোকে এমন একটা কেমিক্যাল দেওয়া হয়েছিল যাতে প্রথম অবস্থায় অজ্ঞান হলেও ধীরে ধীরে মৃত্যু হয়। আর একটু দেরি হলে হয়তো তোকে..”
আর বলতে পারে না তন্নি। আমাকে জরিয়ে ধরে। বুঝতে বাকি নেই মানুষটার সেসময় কি অবস্থা হয়েছিল। অথচ আমার সামনে কতটা শান্ত ছিল। মানুষটার প্রতি নিজের অনুভূতি দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর আবির! নিজের কাজ হাসিল করতে না পারায় আমাকেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল? ভাবতেই অবাক লাগে এক সময় এই মানুষটাকেই নিজের একজন ভালো বন্ধু ভেবেছিলাম। সেই সাথে মনে হয়েছিল তাকে..। আর ভাবতে পারি না। বর এসেছে বর এসেছে ধ্বনি কানে আসতেই এক অদ্ভুত ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়ে সারা অঙ্গে।

মৃদু মোমের আলোয় আলোকিত আর বেলি ফুলের সুবাসে মুখরিত হয়ে আছে ঘরটি। খুব সুন্দর করে গোলাপ আর বেলি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। তারই মাঝে মোমবাতির আবছা আলোয় এক অন্য রকম পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রিয়ক আমার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“পছন্দ হয়েছে? আমি সাজিয়েছি সবটা।”
আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাই। প্রিয়ক আমাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে আমার কাঁধে থুতনি রাখে। মৃদুস্বরে বলল,
“বউয়ের সাজে আমার ছোট পুতুলটাকে এতটা সুন্দর লাগে তা জানা ছিল আমার। ”
বলেই আমার কাঁধে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দেয়। কেঁপে উঠি আমি। নিজের আঁচল শক্ত করে মুটোয় ধরে রাখি। মানুষটা মাথার উপরের ওরনাটা খুব সাবধানে খুলে পাশে রাখে। আমার ঘাড়ে তার ছোঁয়া পেতেই আবারও কেঁপে উঠি। চাইলেও একচুল ও সরতে পারি না আমি। এক অস্থিরতা বয়ে চলছিল সারা শরীরে। মানুষটার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে আমার সারা পিঠ জুরে। তার ছোয়া যত গাড়ো হচ্ছে আমি ততই বরফে পরিনত হচ্ছি।
কাঁপানো কন্ঠে প্রিয়কের ডাকে মৃদু কেঁপে উঠি। মানুষটা সেভাবেই বলল,
“নিজেকে হারাতে দিবি তোর মাঝে? বিলীন হতে চাই তোর ভালোবাসায়। রাঙাতে চাই তোকে নিজের ভালোবাসার রঙে। দিবি কি সেই অধিকার? ”
আমি মুখে কিছুই বলতে পারি না। শুধু তার দিকে ফিরে তাকে জরিয়ে নেই। মানুষটা বোধহয় তার উত্তর পেয়ে গিয়েছে। আমাকে কোলে তুলে নেয়। জানি কেউ দেখবে না আমাদের। তবুও মুখ লুকায় তার বুকের মাঝে। সে আমার কপালে উষ্ণ পরশে আরো আপন করে নেয়। মৃদু স্বরে বলল,
“ভালেবাসি আমার প্রেয়সী। খুব ভালোবাসি।”

সমাপ্ত

ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি পর্ব-১৫

0

#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১৫

দিন যায়, মাস যায়, যায় বছর। প্রকৃতি পাল্টায় তার রুপ। আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমিতে ছয়টি ঋতুর আবর্তন ঘটলেও প্রভাব দেখা দেয় তিনটির। গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীত। এখন প্রকৃতি পুরো দুস্তর শীতের চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিয়েছে। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আশে চারপাশ। দৃষ্টির নিকটে থাকা বস্তুও অদৃশ্যমান। এরই মাঝে কম্বল মুড়ি দিয়ে প্রশান্তির ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছে প্রিয়ক। তাকে দেখে একটা দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপল। সেটা পূরন করতেই সব জানালার পর্দা সরিয়ে দিই। তারপর খুব সাবধানে একটা রুমাল ভিজিয়ে এনে কম্বল উঠিয়ে প্রিয়কের মুখের উপর বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা ফেলি। দুয়েক ফোঁটা পড়তেই লাফিয়ে ওঠে প্রিয়ক। আর আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠি। প্রিয়ক রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসব কি ছেলেমানুষী, প্রিয়তা। পাগল হয়ে গেলি নাকি?”
তারপর মুখের উপর পড়া পানির বিন্দুগুলো মুছে নেয়। আর আমি তখনও হেঁসে চলেছি। এরপর হুট করেই প্রিয়ক আমাকে বেডে ফেলে দিয়ে সেই ভেজা রুমাল আমার সারামুখ গলায় লাগিয়ে দেয়। হঠাৎ এমন হওয়ায় আমি ঘাবড়ে যায়। শীত শীত অনুভূতি হতেই প্রিয়ককে ধাক্কা মে’রে সরিয়ে দিতে চাইলে আমার দুহাত নিজের হাত দিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরে। আর বলল,
“দেখ এবার কেমন লাগে? ”
কেমন লাগছিল তো তা বুঝতে পারছিলাম না। অদ্ভুত এক অনুভূতি। অস্থির লাগছিল। তার দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছিল না। দৃষ্টি নামিয়ে নিই৷ ঠান্ডা অনুভুতি ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেই তাকিয়ে আছে। প্রিয়ক মৃদু স্বরে বলল,
“প্রিয়তা৷ ”
প্রিয়কের ডাকে তার দিকে ফিরতেই সে নেশালো কণ্ঠে বলল,
“এমন পাগলামি আর করিস না। এই পাগল একবার পাগলামি শুরু করলে তখন কিন্তু খুব করে পস্তাতে হবে। যা সহ্য করতে পারবি তো?”
প্রিয়কের কথার অর্থ খুব ভালো করেই অনুভর করতে পারছি আমি। হালকা লজ্জাভাব এসে ভর করে। নিজেকে কম্বলের মাঝে লুকিয়ে নিই৷ প্রিয়ক আর কিছু না বলে উঠে ওয়াসরুমে চলে যায়। প্রিয়ক যেতেই আমি নিচে চলে আসি।

শীত মানেই এক অন্য রকম আনন্দ। চারদিকে নানা রকম পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। হরেক রকমের মজার মজার পিঠা। সেই সাথে আছে বাহারি সব খাবার। যা দেখেই মনটা নেচে ওঠে। শুধুমাত্র এই একটি কারনে শীত আমার পছন্দের একটি ঋতু। তবে এসময় কষ্ট লাগে সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর জন্য। যা এই শীতের তীব্রতা সহ্য করেও পড়ে থাকে রাস্তার অলিতে-গলিতে। একটা পাতলা কাপড় পর্যন্ত থাকে না অনেকের কাছে। তাদের জন্য শীতটা বড্ড কষ্টের। গরমে তাও সহ্য করতে পারলেও শীতের তীব্রতা যত বাড়ে মানুষের কষ্টের পরিমান ততবাড়ে। এত কষ্ট সহ্য করেও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্ঠা চালায়। তাইতো নিজের অবস্থানের কথা মনে করে মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে বারবার শুকরিয়া আদায় করি। আর প্রার্থনা ওই সব মানুষগুলোর জন্য।

“আপি আপি! কি ভাবছো তুমি?”
হঠাৎ ডাকে হুস ফেরে আমার। পুনম আমার গায়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাটু ভেঙে ওর সামনে বসে বললাম,
“কই কিছুনাতো। বাট আমার বার্ডটা আজ এত তাড়াতাড়ি উঠেছে কেন? ”

মুখটা ছোট করে পুনম বলল,
“আব্বু উঠিয়ে দিয়েছে।”

বুঝতে পারলাম জোর করে উঠানো হয়েছে ওকে। ওর মন খারাপ দুর করতে বললাম,
“চলো আমরা ছাদে যায়। দোল খাবো।”
“ইয়েয়েয়ে…।”
বলেই লাফিয়ে উঠল। পুনম কে নিয়ে ছাদে চলে এলাম। আসার আগে রুমের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়েছিলাম প্রিয়ক বেড়িয়েছে কিনা। না বের হয়নি। আর মামনি তখন বিভিন্ন রকম পিঠা বানানোয় ব্যস্ত। ছাদে এসে পুনমকে দোলনায় বসিয়ে দোল দিতে থাকি। প্রতি দোলে একটা ঠান্ডা হাওয়া ছুঁইয়ে যাচ্ছে আমাদের। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর এক শীতল স্রোত বয়ে যায় কানের নিচ থেকে ঘাড়ে। থমকে যায় আমি। না এটা প্রকৃতির শীতলতা নয়, অন্য শীতলতা৷ পিছনে ফিরতে গেলেই মৃদু কণ্ঠে শুনতে পাই,
“তোকে ছোয়ার অধিকার শুধু আমার। এই বাতাস কেন, কাউকে সেই অধিকার দেই নি আমি। ”
থমকে যায় আমি। থেমে যায় আমার হাত। অন্য কিছু ফিল করতে পারছিলাম না। মানুষটা দিনদিন কেমন যেন হয়ে উঠেছে। তার পাগলামি বেড়েছে। বেড়েছে আমাকে নিয়ে তার অনুভূতিগুলো। এরই মাঝে পিছন থেকে আমার দুহাতের উপর নিজের দুহাত রেখে হালকা ভাবে দোলনায় দোল দেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“আই লাভ ইউ, প্রিয়তা।”
বলেই কানের লতিতে হালকা বাইট দিয়ে মৃদু হেসে নিচে চলে যায়। আর আমি! সেখানেই থমকে থাকি। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলেছে এক অন্যরকম শিহরণ।

ফাইনাল পরীক্ষার শেষদিন আজ। সব পরীক্ষা আলহামদুলিল্লাহ ভালোই হয়েছে। হল থেকে বের হতেই দেখলাম প্রিয়ক দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজ গাড়ি নিয়ে আসিনি। আমি প্রিয়কের কাছে যেতেই ও একটা রিকশা ডেকে তাতে আমাকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পড়ে। আমি উঠে বসে তাকে বলি,
“আজ গাড়ি আনোনি কেন?”
“রিকসায় ঘুরবো তাই। অনেকদিন হলো রিক্সায় যাওয়া হয়না। ”

আসলেই তাই। লাস্ট কবে গেছি জানা নেই। তাই আর কথা বাড়ালাম না। প্রিয়ক আমাকে নিয়ে একটা পার্কে আসে। চারপাশটা খুব সুন্দর করে সাজানো। বিভিন্ন রঙ বেরঙের দেশি বিদেশি প্রজাতির ফুলে ছেয়ে আছে চারপাশ। এর মাঝে কেউ হাঁটছে তো কেউ পার্কে থাকা বেঞ্চে বসে গল্প করছে। কিছু বাচ্চারা দৌড়াতে ব্যস্ত। তাদের সাথে ছুটছে তাদের মা। প্রিয়ক আমাকে নিয়ে হেঁটে চলেছে চারপাশে। তবে বাচ্চাদের সাথে তাদের মাকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। আম্মিকে এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে কথা হলেও দেখি না অনেক দিন হলো। ওই ঘটনার পর আর মাকে দেখার সুযোগ হয়নি। হুট করেই কান্না পাচ্ছিল আমার।
“এই প্রিয়তা, কি ভাবছিস বলতো?”
প্রিয়কের ডাকে তার দিকে ফিরে তাকাই। আমার মলিন মুখ দেখে তার চোখ ছোট হয়ে এলো। আমার গালে হাত রেখে অস্থির হয়ে বলল,
“খারাপ লাগছে? কি হয়েছে বল? খারাপ লাগলে চল বাসায় চলে যাবো।”
“আম্মিকে খুব মনে পড়ছে। দেখতে ইচ্ছা করছে আম্মিকে।”
আমি আস্তে করে বললাম। প্রিয়ক আমার কথায় মৃদু হেঁসে বলল,
“তাহলে সামনে তাকা “।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালাম। আমাদের থেকে দু তিনহাত দূরেই আম্মি দাঁড়িয়ে আছে। আম্মিকে দেখে যেয়ে জরিয়ে ধরি। আম্মি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

সারাটা বিকাল আম্মির সাথেই ছিলাম আমরা। সন্ধ্যা নামার পূর্বেই আম্মিকে পৌছে দিয়ে আসি। তবে সে বাসায় যাওয়ার সুযোগ নেই। আম্মিকে পৌঁছে দিয়ে প্রিয়ক আমাকে সেই সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে আসে। এখান থেকে সুর্যাস্তের অপরুপ দৃশ্য যেন চোখ জুরিয়ে যায়। সূর্যের লাল কমলা মিশ্রিত রুপ এক অন্যরকম রুপ সৃষ্টি করে। যা এই মুহুর্তে প্রিয়কের বুকের সাথে মিশে অনুভব করছি। প্রিয়ক পেছন থেকে দুহাতে জরিয়ে রেখেছে। তার হাতদুটি আবদ্ধ হয়ে আছে আমার নিতম্বে। আমার কাঁধে মুখ রেখে সূর্যাস্ত দেখতে ব্যস্ত মানুষটা। হয়তো বা আমাকে দেখতে।

সময়! যাকে চাইলেও নিজের ৃতো করে রাখা যায় না। সে তার মত বয়ে চলে অভিরাম ধারায়। ঠিক তেমনি শীত কেটে গিয়ে প্রকৃতিতে নেমে এলো বসন্তের ছোয়া। নতুন সাজে মুখরিত হয়ে উঠল ধরনী। নানান সাজে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করতে ব্যস্ত প্রকৃতি প্রেমীরা। প্রেমিক যুগল ব্যস্ত তার মনের মানুষটির মন রাঙাতে। কেউ বা ব্যস্ত তার অভিমানী প্রেয়সীর মান ভাঙাতে। একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙে আর হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি। সেদিকেই অপরুপ দৃষ্টিতে চেয়ে তাকে প্রেমিক পুরুষটি। বাসন্তি রঙে সবাই নিজেকে সাজালেও প্রেমিক পুরুষটির কাছে তার প্রেয়সীই যেন সবচেয়ে মোহময়ী। প্রিয়কের ফ্লাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পিচঢালা পথে প্রেমিক যুগলের হাতে হাত রেখে চলার দৃশ্য দেখে চলেছি আমি। এমন সময় পিছন থেকে প্রিয় মানুষের ছোয়া নিজের দুগালে পেতেই আপনা আপনি আমার হাত সেখানে চলে গেল। প্রিয়ক দুহাতে রঙ নিয়ে তা আমার গালে লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজের আমার গালের সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিজেকেও রাঙিয়ে নিয়েছে। তাতে লজ্জা পেলাম আমি। প্রিয়ক ওর বাহু বন্ধনে আমাকে আবদ্ধ করে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“এখন নিজেকে এই রঙেই রাঙিয়ে নে। আর তো ৫দিন। তারপর আমার রঙে রাঙাবো। ”
লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিই আমি। প্রিয়ক আমার চিবুক ধরে উঠিয়ে তার ওষ্ঠ ছোয়ায় আমার ওষ্ঠে। চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায়। দুহাতে শক্ত করে চেপে ধরি নিজের শাড়ির আঁচল। আর পাঁচদিন পর আমাদের বিয়ে। এবার আর কোনো জোর করে নয়, বরং সেচ্ছায়। দুজনের সম্মতিতে বিয়ে। থাকবে না নিজেদের মধ্যে আর কোন সংকোচ। ভাবতেই অদ্ভুত অনুভূতি ভিতরটা দখল করে নেয়। এর মাঝে প্রিয়ক আমাকে ছেড়ে ভিতরে চলে যায়। একটু পর ফিরে আসে একটি ফুলের গাজরা নিয়ে। তা খুব যত্ন করে পরিয়ে দেয় আমার খোঁপায়। পরানো শেষ হতেই আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে প্রিয়ক বলল,
“এবার ঠিক আছে। একদম পারফেক্ট। আমার বসন্তকন্যা।”

.
.
চলবে..??

ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি পর্ব-১৪

0

#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১৪

দেখতে দেখতে কেটে গেল আরও দুই সপ্তাহ। আজ প্রিয়কের দেশে ফেরার দিন। সব থেকে খুশির দিন আমার জন্য। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা, তারপরই অপেক্ষার পালা শেষ। পুরো ব্যস্ত আমি আজ। প্রিয়কের পছন্দের খাবার রান্না করেছি নিজ হাতে। মামনিও হেল্প করেছে। আজ সময় যেন কাটছেই না। তবুও অপেক্ষার পালা শেষ হয়। আমারও হলো। বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যার আভাস আসতেই প্রিয় মানুষটার দর্শন পেলাম। তার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকাতেই সারাদিনের ক্লান্তি নিমিষেই হারিয়ে গেল। তবে তার সামনে যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না আমার। কেমন যেন এক অনুভূতি। যা বলে বোঝানোর মত নয়। আড়াল থেকেই দেখে চলেছিলাম মানুষটাকে। এক সময় তার দৃষ্টিতে আবদ্ধ হই আমি। চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে লুকিয়ে নিই৷ তবে তার ওষ্ঠদ্বয়ের মৃদু হাসি নজর এড়ায় না৷ কোনোমতে সেখান থেকে পালিয়ে নিজের রুমে চলে আসি। বুকের মাঝে এক অদ্ভুত অনূভুতির সৃষ্টি হলো। যা এর আগে কখনো হয়েছে বলে মনে হয় না। গেট খোলার আওয়াজে বুঝতে পারি প্রিয়ক রুমে এসেছে। সে রুমে আসতেই আমি চলে যেতে নিই। তবে তা আর হয় না। হাত ধরে এক টানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। হঠাৎ এমন হওয়ায় ঘাবড়ে যায় আমি। লুটিয়ে পড়ি তার বুকের মাঝে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে মানুষটা তার শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে নেয় আমাকে। মৃদু কন্ঠে বলে উঠে,
” আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন?”
“কই পালাচ্ছি? ”
আমতা আমতা করে জবাব দিই আমি। প্রিয়ক তার চোখে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল,
“তাহলে লুকাচ্ছিস কেন নিজেকে? আর লজ্জা পাচ্ছিস কেন?”
“ধ্যাত। কি সব বলো না তুমি। ছাড়ো তো। ”
বলে প্রিয়ককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসি। আসার সময় তার উচ্চ শব্দের হাসির আওয়াজ হৃদমাঝারে ঝংকার তুলে। বাইরে এসে সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। বুকে হাত দিয়ে হাঁপাতে থাকি। কেন এমন হচ্ছে আমার সাথে? মানুষটা তো আর নতুন নয়। তাহলে?
“এই ভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন তুই?”
কথায় চমকে উঠি। খেয়ালই করিনি মামনি যে এখানে। এখন মামনি আমাকে কি ভাবছে কে জানে? কোনো মতে বলি,
“তাড়াতাড়ি নেমেছিতো। তাই।”
বলে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আছি। আঁড়চোখে পিছনে তাকাতেই দেখতে পেলাম মামনি মিটমিট করে হেঁসে চলেছেন। আমি আর কিছু না বলে পুনমের কাছে চলে যায়।

মাঝরাত। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে সময় এখন তিনটার ও বেশি। শীতের আগমনী সূর আসতেই চারপাশ মৃদু শীতলতায় ছেয়ে গিয়েছে। সারাদিন গরম ভাব থাকলেও রাত নামতেই প্রকৃতিতে নেমে আসে শীতের ঠান্ডা আবহাওয়া। এরই মাঝে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায় আমার। ভালো করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলাম একজোড়া গভীর দৃষ্টিতে আবদ্ধ আমি। তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। অদ্ভুত শিহরন বয়ে যায় রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজেকে প্রিয়কের বুকের মাঝে লুকিয়ে নিলাম। যেন মানুষটাও আমায় দেখতে না পারে। মামুষটা তার ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণ পরশ আঁকে আমার ললাটে। দিশেহারা হই আমি। আরো বেশি করে গুটিয়ে নিই নিজেকে।

সূর্যের সোনালী আলোয় ঝলমল করে উঠে প্রকৃতি। শীতের আগমনী বার্তাকে টেক্কা দিয়ে রবি নিজের উত্তাপে ধরনিতে ছড়িয়ে দিতে থাকে উষ্ণতা। পাখিদের কলকাকলীতে মুখরিত হয় চারপাশ। কর্মব্যস্ত মানুষ ছুটে চলে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যে। আর আমাদের সারাবাড়িতে ছোটাছুটি করে চলেছে আমাদের ছোট বার্ডটা। আমার কাছে সে পাখির মত চঞ্চল হলেও প্রিয়কের কাছে সে ফুলের মতো স্নিগ্ধ আর পবিত্র। মানুষটার প্রান আমাদের পুনম। ওকে স্কুলের জন্য রেডি করতে প্রতিদিন সকালে আমাকে ওর পিছনে ছুটতে হয়। এক মিনিটও স্থির হয় না। প্রায় ১ঘন্টা ওর পিছনে ব্যয় করার পর রেডি করাতে পারি। ওকে রেডি করিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নিই। আগের মতোই প্রিয়কই আমাদেরকে ড্রপ করে দিবে। মামনির থেকে বিদায় নিয়ে আমরা রওনা দেই। প্রথমে পুনমকে স্কুলে দিয়ে তারপর আমাকে নিয়ে যায়। ক্যাম্পাসের সামনে এসে আমাকে নামিয়ে দেয়। সেই সাথে প্রিয়ক ও নেমে আসে। ক্যাম্পাসের বাইরেই অপেক্ষা করছে হাসি, মুনিয়া, তন্নি আর রিয়ন। সেদিকে এগিয়ে যায় আমরা দুজন। প্রিয়ককে দেখে হাসি ফুটে উঠল সবার মুখে। বিভিন্ন কথা বার্তায় পার হয় বেশ কিছু সময়। তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে প্রিয়ক চলে যায়। আর আমরাও ক্লাসে চলে যায়। ক্লাস শেষ করে বাহিরে আসতেই দেখলাম আবির গেইটের বাইরে পায়চারি করছে। আমাদের দেখে এগিয়ে আসে। এসেই বলল,
“এসব কি প্রিয়তা। তোমাদের না ডিভোর্স হওয়ার কথা। তাহলে এখনো কেন ওই অমানুষটা তোমার সাথে?”
আবিরের কথা শেষ হতেই খুব জোরে থাপ্পড় মারলাম ওকে। যথাসম্ভব নিজের রাগ চেপে বললাম,
“অমামুষ প্রিয়ক নয়, অমানুষ তুমি।”
আমার কথা আর থাপ্পড়ে বিস্মিত হয়ে থাকিয়ে থাকে আবির। কিন্তু পরক্ষণেই চোখে মুখে ধরা দেয় রাগভাব। তবে তা খুব সাবধানে এড়িয়ে যায়। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া দেখে নেয়। যা দেখে হাসি পাই আমার। নিজের গালে হাত রেখে বলে,
“মাথা কি পুরোটাই গেছ তোমার। তুমি আমাকে মারছো। তোমার প্রিয়ককে মারা উচিত। তা না করে আমাকে! কি করেছি আমি? শুধু তো তোমাকে ভালোবেসেছি৷ আর তো কিছুনা। ”
আবিরের কথা শেষ হতেই আমি তাচ্ছিল্য স্বরে হেসে বললাম,
“ভালোবাসো? লজ্জা করে না এই কথাটা বলতে? তোমার মত ছেলেরা কখনই কাউকে ভালোবাসতে পারে না। পারে শুধু মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করতে। আর তা ছাড়া তোমাদের কাছে তো মেয়েদের অনুভূতির কোনো মূল্যেই নেই। তোমরা তো মেয়েদের শরীরটা দেখো। নিজেদের কামনার সঙ্গী মনে করো৷ এছাড়া তো আর কিছু না। যেমনটা আমাকে করতে চেয়েছিলে৷”
“এসব কি বলছো প্রিয়তা৷ পাগল হয়ে গেছো তুমি? নিশ্চয় তোমার ওই ভাই তোমাকে আমার বিরুদ্ধে বলেছে তাই না। তুমি কি করে আমাকে এমন ভাবতে পারো?”
“কেন নিজের বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে আমার সাথে অভিনয় করো নি? কলেজ প্রোগ্রামের দিন নিজের বন্ধুদের দিয়ে আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করে নিজেই তা থেকে বের করে এনে আমার সামনে ভালো সাজোনি? অস্বীকার করতে পারবে আমাকে নিজের কামনা.. ছিঃ আমার বলতেও বাঁধছে। ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। যে তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। নিজের একজন বন্ধু মনে করতাম। ভাবতাম তোমায় ভালোবাসি আমি। এসবের জন্য নিজেকেই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছা হয়। আর কত গুলে মেয়ের জীবন নষ্ট করবে তুমি? কম মেয়ের জীবন নিয়ে তো আর খেলো নি। আর কত?”

আমার কথা শেষ হতেই আবির আবার ও নিজের সাফাই দিয়ে বলতে লাগল,
“দেখো প্রিয়, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। যা ভাবছো তার কোনোটাই সত্যি না। আমি এরকম কিছু করিনি। বিশ্বাস করো। আমি..
” হে আবির। এতদিন এত কষ্ট করে কী লাভ হলো বলতো। সেই তো পাখি অন্য খাঁচায় বন্দি হয়ে গেল৷ তোর তো কোনো পাত্তাই রইলো না।’
কেউ একজন বলে উঠল। তার কথার প্রতিত্তোরে অন্য একজন বলল,
‘আসলেই আবির। এবারের বাজিটা বোধহয় হারতে চলেছিস তুই।’
বলেই হেঁসে উঠল সবাই।
‘ তাহলে তোরা এখনও আবিরকে চিনলিই না। আবির কখনও কোনো বাজিতে হারেনি। আর আগেও হারবে না। প্রিয়তাকে তো আমার বেডে আনবোই৷ আজ হোক বা কাল। ওকে আসতেই হবে।’
আবিবের কথা শেষ হতেই অন্য কারো কন্ঠে শোনা গেল,
‘আর কি করে আনবি বলতো? বিয়ে তো হয়ে গেল ওর। ‘
‘তাতে কি হয়েছে? আমি প্রিয়তার সামনে নিজেকে এমন ভাবে উপস্থাপন করেছি যে ও ভাবছে আমি ওকে এতটাই ভালোবাসি, ওর জন্য নিজের জীবন দিতেও রাজি৷ প্রিয়তা বড্ড ইমোশনাল বুঝলি। একটুতেই দূর্বল হয়ে পড়ে। ‘
‘দেখা যাক। তবে এবার কিন্তু আমাদেরও ভাগ দিতে হবে। একা একা খেলে চলবে না কিন্তু। ‘
‘সে আর বলতে। বেচারী। ধর্ষিতা না হয়েও তার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। এবার তা সত্যি সত্যিই হবে।’
শোনা গেল উচ্চস্বরে কিছু নোংরা হাসির আওয়াজ। ”
একটা ভয়েস রেকর্ড ছিল এটা৷ যা শোনার পর আর কিছু বলার থাকলো না আবিরের। তার কথা সেখানেই আটকে গেল। তবে বের হয়ে এলো তার আসল রুপ। যা সবসময় লুকিয়ে রেখেছিল আমার থেকে।
“ও তাহলে সব জেনে গেছিস৷ ভালোই হলো৷ আর নাটক করতে হবে না। আমিও বোর হয়ে গেছি এক নাটক করে করে৷ হ্যাঁ সবটাই আমিই করেছি। এরকম বাজি প্রায় প্রায় ধরি আমরা। তোকে নিয়েও বাজি ধরে ওরা। তাই প্রোগ্রামের দিন অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমার বন্ধুদেরই বলেছিলাম তোর উপর আক্রমণ করতে৷ যাতে তোকে সেখান থেকে সেইফ করে তোর কাছাকাছি আসতে পারি৷ আর হলো ও তাই। তুই আমার কাছে শুধু মাত্র আমার বেড পার্টনার হওয়ার যোগ্য। আমার ভালোবাসার নয়৷ ”
আবিরের কথা শেষ হতেই আমি আবিরের গালে আরো একটা থাপ্পড় মারলাম। এবার আবির আমাকে মারতে নিলেই চোখ বুঁজে নিই। কিন্তু কিছুকাল পার হওয়ার পর ও কোনোরুপ আঘাত না পাওয়ায় চোখ মেলে তাকাই। প্রথমেই চোখ যায় প্রিয়কের উপর। আমার দিকে উঠানো আবিরের হাত শক্ত করে ধরে আছে মানুষটা। হাতে মোচড় দিতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠে আবির। প্রিয়ক বলল,
“জন্ম থেকেই প্রতিটা বিপদে ওর ঢাল হয়ে থেকেছি আমি। কোনো আঘাত ওর শরীরকে স্পর্শ করতে দেই নি। ওকে কেউ সামান্য আঘাত করলে তার অবস্থা এমন করেছি যে দ্বিতীয়বার ওর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস হয়নি। আর সেখানে তুই আমার প্রিয়তার এত বড় ক্ষতি করতে চেয়েছিলি। সেটা জেনেও চুপ ছিলাম শুধু মাত্র সঠিক সময়ের জন্য। আর আজ তুই ওকে আঘাত করতে নিয়েছিলি। ”
বলে আরো শক্ত করে মোচড় দেয়। আবিবের চোখমুখ তখন দেখার মতো ছিল। আমি প্রিয়ককে ছাড়িয়ে নিই। প্রিয়ক ওর হাত ছেড়ে বলল,
“এর পর যদি প্রিয়তার আশেপাশেও তোকে দেখেছি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। আর প্রিয়তার ক্ষতি করার কথা স্বপ্নেও ভাবতে যাইস না। তাহলে সেখানেই মরবি। মনে রাখিস যতদিন আমি বেঁচে আছি ততদিন প্রিয়তার গায়ে কোনো রকম আঘাত আমি লাগতে দিবো না।”
প্রিয়কের কথা শেষ হতেই আমার হাত ধরে নিয়ে আসে। বাকিদের বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসি আমরা। গাড়ি চলতে শুরু করলে চোখ বুঁজে সিটে মাথা এলিয়ে দিই। আবিরের ব্যাপারে এসব কথা প্রিয়ক আমাকে জানিয়েছিল বাইরে যাওয়ার আগে। সেদিন নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল। আবিরের কথা জানার পর প্রিয়ক আবিরের সম্পর্কে সব খোজখবর নেয়৷ যখন এই সত্যিটা জেনেছিল তখন প্রিয়কের মাঝে ঠিক কী চলছিল তা বুঝতে বাকি থাকে না। আবির এরআগেও অনেকগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও জড়িত আছে অনেক খারাপ কাজে। ফলে প্রিয়কের এখানে না থাকার সময়ে যদি আবির জানতো আমি ওর ব্যাপারে সব জানি। তাহলে আমার ক্ষতি করতে পারতো। আর ভাবতে পারছি না। এতটা নিখুঁত অভিনয় মানুষ কিভাবে করে? প্রিয়ক হয়তো আমার অবস্থা বুঝেছিল। একহাতে আমাকে তার বুকের মাঝে নিয়ে নেয়। শক্ত করে জরিয়ে রাখে।
.
.
চলবে..??

ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি পর্ব-১৩

0

#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১৩

আজ থেকে দেড় মাস আগের ঘটনা। তখন মাঝ রাত। চারপাশে ছেয়ে আছে নিস্তব্দতা। প্রকৃতি ধারন করেছে শান্ত আর নির্মল রুপ। বাড়ির সবাই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেও ঘুম ছিল না আমার চোখে। হয়তো আরো একটি মানব শরীরও জেগে ছিল। সে আর কেউ নয়, প্রিয়ক। আমি যখন নরম তুলার বিছানায় শুয়েও ছটফট করছি তখনি আমার রুমের দরজা খোলার মৃদু আওয়াজ পায়। যা শান্ত প্রকৃতিতে ঝড় আওয়াজ তোলে। কেউ একজন দরজা ভেদ করে খুব সন্তর্পণে এগিয়ে আসে আমার নিকটে। একসময় তার হাতের কোমল ছোয়া পড়ে আমার মাথায়। ধীরে ধীরে স্পর্শ বৃদ্ধি পায়। বুঝতে বাকি থাকে না আম্মি এসেছে। আম্মির প্রতি সেসময় খুব বেশি অভিমান জমা ছিল মনে। তাই আমার মাথা থেকে আম্মির হাত সরিয়ে দিতে নেই। তখনি আম্মির কিছু কথা শুনে থমকে যাই আমি। আম্মি মৃদু কন্ঠে বলল,
“মায়ের উপর খুব রাগ হয়েছিস তাই না রে মা। কিন্তু বিশ্বাস কর তোর মা যে নিরুপায়। আর কোন উপায় যে নেই আমার কাছে। আমার সবচেয়ে বড় ধন তুই। তোকে বাঁচাতে যা করা লাগে সব করবো রে মা। প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে হলেও তোকে রক্ষা করবো রে।

আম্মির কথা শেষ হতেই উঠে বসি আমি। আমাকে উঠতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায় আম্মি। আম্মি হয়তো ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আম্মি তাড়াতাড়ি চলে যেতে নিলে আমি আম্মির হাত ধরে নেই। আম্মিকে বিছানায় বসিয়ে বললাম,
“আমাকে বাঁচাতে মানে কি আম্মি? কে মারবে আমাকে? কার থেকে ভয় পাচ্ছো তুমি?”
আম্মি আমতা আমতা করে বলল,
“কি সব বলছিস প্রিয়। তোকে আবার কে মারবে। উল্টা পাল্টা শুনেছিস তুই।”

“উল্টা পাল্টা শুনিনি আম্মি। ঠিকই শুনেছি। প্লিজ আম্মি, সত্যিটা বলো। আমাকে কসম দিয়ে তুমি আটকে রেখেছো। কেন আম্মি? ”
“দেখ প্রিয়৷ বাড়াবাড়ি করিস না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়। আর কাল ডিভোর্স পেপার আসলে তাতে সুন্দর মতো সাইন করে দিবি। কোনোরুপ পাগলামী করবি না৷ ”

বলে আম্মি চলে যেতে নিলে আমি বললাম,
“প্রিয়ক ডিভোর্স হতে দিবে না আম্মি। কিছুতেই হতে দিবে না। ”
“দিতে হবে ওকে। দেখ প্রিয়তা, মা আমার। পাগলামী করিস না। তুই না আমার লক্ষী মেয়ে। আমার সব কথা শুনিস। তাহলে এখন এমন কেন করছিস? আমি আমার এক মেয়েকে হারিয়েছি। তোকে হারাতে পারবো না রে মা। ”

মায়ের শেষ কথায় অবাক হয়েছিলাম আমি। কারন আমার জানা মতে আমার কোন বোন কখনই ছিল না। তাহলে আম্মি এ কথা কেন বলল? আম্মিকে বললাম,
“আর এক মেয়ে মানে কি আম্মি? আমার আর একটা বোন ছিল? ”

আম্মি হয়তো তখন বুঝতে পেরেছিল কথা বলতে গিয়ে গোপনীয় কথা বলে ফেলেছে। আম্মি কথা ঘুরাতে আমতা আমতা করে বলল,
“কি. কি সব বলছিস? কিসের বোন? ভুলভাল বলছিস।”
বলেই চলে যেতে নিলে আমি আম্মিকে আটকায়।
“আম্মি সত্যি করে বলো তো? কে মারবে আমাকে? আর আমার বোনের কি হয়েছিল?”
“আমি কিছু বলতে পারবো না। ছাড় আমায়।”
“বলতে তো তোমায় হবে মামী।”
হঠাৎ আগত কন্ঠে আমি আর আম্মি দরজার দিকে তাকায়। প্রিয়ক ভিতরে প্রবেশ করেছে। ভিতরে প্রবেশ করে সতর্কতার সাথে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসে আমাদের দিকে। এসেই আম্মির এক হাত নিজের দুহাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি মামী। কিন্তু বুঝতে পারছি না কি এমন কারন আছে যার জন্য তুমি ভয় পাচ্ছো? কে মারবে প্রিয়তাকে? কারো এতটা সাহস হবে না যে এ পরিবারের মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাবে। আর তো সেখানে প্রিয়তাকে আঘাত করা! তাহলে কেন ভয় পাচ্ছো মামী? কেন নিজের কসমের বেড়াজালে ওকে আবদ্ধ করছো? যদি আমার উপর রেগে থাকো তাহলে আমাকে শাস্তি দাও। কেন দুজনকেই শাস্তি দিচ্ছো? আর মামী আরেক মেয়ে মানে কি? প্রিয়তায় তো তোমার একমাত্র মেয়ে। তাহলে আরেক মেয়ে কোথা থেকে আসল? আর সে হারিয়ে গেল কি করে? প্লিজ মামী বলো আমাদের। এই তোমাকে ছুয়ে কথা দিলাম প্রিয়তার উপর কোনো রকম আঘাত আসতে দিবো না মামী। ওর শরীরে কোনো আঘাত লাগার আগে তা আমার উপর নিয়ে নিবো। বিশ্বাস করো আমায়।”

প্রিয়কের কথা শেষ হতেই নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে আমার আম্মি। খুব কম সময় আমি আমার আম্মিকে কাঁদতে দেখেছি। আম্মিকে শক্ত করে জরিয়ে ধরি আমি। আম্মি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“জানিস ই তো তোরা। বাবা মাকে ছোট বেলায় হারিয়েছিলাম আমি। যেই চাচা চাচী আয়রা বলতে পাগল ছিল তারাই বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার সম্পত্তিতে জোর করে ভাগ বসালেন। আর আমাকে বের করে দিলেন। ঠাঁই হলো মামা বাড়িতে। সেখানেও থেকে দুবেলা ভাতের সাথে কিছু কটু কথাও গিলতাম। স্কুলের পড়া তো আগেই বাদ হয়ে গিয়েছিল। এর মাঝে তোর দাদা আমাকে তোর বাবার জন্য দেখতে এলেন। বয়স কম ছিল আমার। সেই সাথে সৌন্দর্য থাকার কারনে তারা পছন্দ করে। আর মামা মামীকেও আর আমার বোজা বইতে হবে না। তাই তারাও রাজি হয়ে গেল। বিয়ের তিনমাসের মাথায় নিজের ভিতর অন্য প্রানের অস্তিত্ব টের পেলাম। তখন তোর বাবা খুব খুশি ছিল। বদরাগী হলেও সেসময় আমার খুব খেয়াল রাখত। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল যখন পরীক্ষা করার পর জানতে পারে সেই ছোট প্রানটা ছেলে নয়, বরং মেয়ে। তখন শুরু হয় তার পরিবর্তন। এরই মাঝে একদিন এসে বলল ‘তৈরি হয়ে নাও। চেকআপের জন্য যেতে হবে।’ আমিও কিছু না ভেবে তৈরী হয়ে নিলাম। হাসপাতালে যাওয়ার পর চেকআপের আগে তোর বাবা আমাকে পানি খেতে দেয়। আর সেটা খাওয়ায় ছিল আমার সবচেয়ে বড় ভুল। তাতে ঘুমের ঔষধ দেওয়া ছিল। যার ফলে চেকআপ করার সময় ঘুমিয়ে যায় আমি। আর যখন ঘুম থেকে উঠি তখন নিজের ভিতর খালি খালি লাগে। বুঝতে পারি সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তখন থেকে তোর বাবার প্রতি রাগ ছিল আমার। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোথায় যাবো বল। যাওয়ার জায়গা যে ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে থেকে যায়। এর পর কেটে যায় আর পাঁচ মাস। সেসময় আবারও নিজের ভিতর প্রানের অস্তিত্ব টের পায়। তুই এসেছিলি। এবারও পরীক্ষায় যখন দেখল মেয়ে, তখনও তোকে মে’রে ফেলতে চেয়েছিল। অনেক কাকুতিমিনতি করার পর শুনেছিল আমার কথা। তুই যখন জন্ম নিলি ভয় হতো আমার। আমি তো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তোর খেয়াল রাখতে পারতাম না। রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারতাম না। ভয় হতো। বারবার মনে হতো এই বুঝি তোকে মে’রে ফেলল। কিন্তু সেসময় তোর মামনি তোকে সামলালো। নিজের মেয়ের মতো সব সময় তোর যত্ন নিত। ”
একটু থেমে প্রিয়কের দিকে তাকিয়ে বলল,
“সেই সাথে ছিলি তুই প্রিয়ক। মাত্র সাত বছর বয়স তখন তোর। তবুও কত সুন্দর করে প্রিয়তার খেয়াল রাখতিস। যেন একটা পুতুল ছিল তোর কাছে ও। যত দিন গিয়েছে তোর ভালোবাসা বেড়েছে প্রিয়র প্রতি। ওর সামান্য আঘাতে অস্থির হয়ে পড়তিস তুই। এত কিছু করার পর তোর উপর রাগ করে থাকি কি করে? তুই যে অজান্তেই আমার মেয়েটার আরো একটা বিপদ হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলিস।”
আম্মির সব কথা আমরা নিরব শ্রোতার মত শুনছিলাম। এর মাঝে কখন যে আমাদের দুজনের চোখ ভিজে গিয়েছে তা টের পায়নি আমরা কেউই। প্রিয়ক বলল,
“কোন বিপদ মামী? কিসের কথা বলছো তুমি?”
আম্মি তখন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“তোর মনে আছে প্রিয়। এজবার স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসেছিলি? সে কি কান্না তোর। তোকে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করলে বলেছিলি একটা ছেলে তোজে বাজে কথা বলেছে। অন্য মেয়েদের সাথেও বাজে ব্যবহার করেছে। মেয়েদের ওরনা নিয়েও টানাটানি করেছিল। সে আর কেউ নয়,রায়ান। যার সাথে তোর বাবা তোর বিয়ে ঠিক করছিল। সবটাই জানতো তোর বাবা। তবুও জেনে শুনে তোকে ওখানে দিতে চেয়েছিল। এবাড়ির কারো সাহস নেই তোর বাবা চাচ্চুর উপর কথা বলার৷ তাই প্রিয়কের সেদিনের কথাও কেউ শোনেনি। ”
এরপর আম্মি রায়ানের সাথে আমার বিয়ের মাধ্যমে যে ব্যবসার সম্পর্কের কথাও বললেন। সবমশোনার পর বলার মতো কিছু ছিল না আমাদের কাছে। প্রিয়ক ও চুপ করে শুনছিল। যে মামাকে সবসময় সম্মান করে এসেছে সেই মামার এই রুপ হয়তো তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
নিচু কন্ঠে প্রিয়ক বলল,
“মামা এইরকম করতে পারে বিশ্বাস হয় না। নিজের মেয়েকে কিভাবে মারার কথা ভাবতে পারে? আর তুমি এত কিছু কি করে সহ্য করছো মামী?

আম্মি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
“কি করবো বল। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই যে আমার। ”
একটু থেমে আম্মি আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“সব তো শুনলি। এবার আর কোনো পাগলামি করিস না। ডিভোর্স এখন তোদের দুজনের জন্যই মঙ্গল। নয়তো কি হবে তা আমি আর ভাবতে চাই না। ”

“এসব জানার পর তো প্রিয়তাকে ছাড়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না মামী।
প্রিয়কের কথা শুনে আম্মি ওর দিকে তাকিয়ে রইল৷ প্রিয়ক আাবারও বলল,
” হ্যাঁ মামী। আমি কখনই ওকে ডিভোর্স দিবো না মামী। ওর জন্মের পর যেম একটা ছোট পুতুলের মতো খেয়াল রেখেছিলাম ওর তেমনি এখনও রাখবো। মামর সম্পর্কে আজ যা জানলাম তারপর তো ওকে এখানে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। মামা নিজের স্বার্থের জন্য প্রিয়তাকে নিয়ে যে কি করবে তা ভাবতে পারছি না।”
“কিন্তু..
আম্মির কথা কেটে প্রিয়ক বলল,
” কোনো কিন্তু নয় মামী। প্রিয়তার কোনো ক্ষতি আমি হতে দিবো না। কথা দিচ্ছি তোমাকে। তুমি শুধু তোমার দেওয়া কসম প্রিয়তার উপর থেকে উঠিয়ে নাও। ”

প্রিয়কের কথায় ভরসা পায় আম্মি। আমার উপর থেকে উঠিয়ে নেই তার কসম। পরেরদিন সকালে খুব ঝামেলা হয়। ডিভোর্সের জন্য অস্বীকার করলে বাবা আমার গায়ে হাত তোলে। দ্বিতীয়বার আমাকে আঘাত করতে গেলে আমার ঢাল হয়ে থাকে প্রিয়ক। ফলে বাবা আমার সাথে তার আর কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানাই। সেখান থেকে চলে আসি আমরা। মামনি আর ফুফাও আমাদের সাথে চলে আসে। এখানে আসার পর মামনি প্রিয়কের উপর রেগে থাকে খুব। তবুও তা খুব একটা প্রকাশ করে না। একসপ্তাহ কেটে যায় এভাবেই। এর মাঝে একদিন প্রিয়কের ফোনে ফোন আসে তার অফিস থেকে। মাস দুয়েকের জন্য তাকে বাইরে যেতে হবে। প্রিয়ক যেতে না চাইলেও আমি তাকে যেতে বলি। তবে যাওয়ার আগে আমাকে আবিরের সম্পর্কে বেশ কিছু বিষয় জানিয়ে যায়। আর সেই সাথে সতর্ক করে রেখে যায়। প্রিয়কের কথা মানতেই এখনও আবিরের সাথে কথা বলি আমি। কারন যা বলেছে তার পর প্রিয়কের এখানে অনুপস্থিতি আমার জন্য বিপদজনক। তবে দুদিন আগেই প্রিয়ক জানতে পেরেছে পর ডায়েরি আমার কাছে। ফলে রেগে যায় আমার উপর। দুদিন আমার সাথে কথা বলে না। তবে প্রিয়কের এখান থেকে যাওয়ার পর মামনির রাগ পড়ে গেছে। কারন মামনি ও সব সত্যিটা জানতে পারে। সেই সাথে মামনির কাছে শুনেছিলাম ছোট ফুফির কাহিনী।

ফোনের রিংটোনের শব্দে নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসি। ম্যাসেজ এসেছে। ম্যাসেজের প্রেরক আর কেউ নয়, প্রিয়কই। ছোট বার্তায় লেখা,
“ঘুমিয়ে পড়। রাত জাগা আমার পছন্দ নয়।”
এই ছোট কথাটাই আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যথেষ্ট। যে মানুষটার আমার রাত জাগা পছন্দ নয়, অথচ সেই মানুষটাই রাতের পর রাত জেগে তার গল্পে আমাকে সাজিয়েছে। ফোনটা পাশে রেখে চোখ বুজে শুয়ে পড়ি। একসময় পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে।
.
.
চলবে..??

ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি পর্ব-১২

0

#ওহে প্রেয়সী ভালোবাসি
মারিয়া মীম (ছদ্মনাম)
পর্ব ১২

গোধূলী বেলা। আমার আর মামনির একটা প্রিয় সময়। এসময়টা একান্ত আমাদের। সকল কাজ থেকে ছুটি নিয়ে আমি আর মামনি গল্প করতে বসি। সারাদিনের সমস্ত কথা শেয়ার করি একে অপরের সাথে। আর আমাদের সঙ্গি হয় দু কাপ গরম চা। চায়ের অভ্যাস মামনির থাকলেও আমার ছিল না। তবে ইদানিং মামনির পাল্লায় পড়ে অভ্যাসটা আমারও হয়েছে। মামনির রুমের বারান্দায় বসে ব্যস্ত পাখিদের নীড়ে ফেরা দেখতে দেখতে চাপের কাপে এক চুমুক দিয়ে মামনি বলল,
“কথা হয়েছে ওর সাথে? ”
“না, মামনি। ”
“এতটা রাগ কেন করলো? কি করেছিস সত্যি করে বল তো?”
“মামনি তুৃমিও। ”
এমন সময় মামনির ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার নাম্বার দেখে বুক কেঁপে উঠে। মামনি মৃদু হেসে ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“যা কথা বলে আয়।”
আমিও আর কিছু না বলে ফোন নিয়ে আমাদের রুমে চলে আসি। রিসিভ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো মানুষটার ক্লান্ত মুখটি। আমাকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আমি বলে উঠলাম,
“আর কতদিন রাগ করে থাকবা? দুদিন তো হলো। এবার তো কথা বলো।”
“দেখ প্রিয়তা, ফোনটা মাকে দে। তুই কেন ফোনটা রিসিভ করেছিস? মা কই?”
“ঠিক আছে দিচ্ছি আমি। আর ফোন দিবে না আমাকে। কখনোই না।”
বলে ফোন কাটতে নিলেই ও পাশ থেকে প্রিয়ক বলল,
“সাহস বেশি হয়ছে তাই না। এবার আসি। দেখবো কোথায় আছে এতো সাহস? ”
আমি শুধু মৃদু হাসলাম। প্রিয়ক তা দেখে বলল,
“একদম হাসবি না। জানে মে*রে ফেলব।”
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম,
“আসছো কবে?”
“খুব শীগ্রই। কলেজে গিয়েছিলি? ক্লাস কেমন চলছে?”
“গিয়েছিলাম। আর সামনের মাসে এক্সাম। ”
“চিন্তা করিস না। তার আগেই চলে আসবো। ”

এরপর বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে নিচে মামনির কাছে চলে আসি। ততক্ষণে মামনি রাতের রান্নার ব্যবস্থা করছে। আমিও কিচেনে যেয়ে মামনিকে সাহায্য করতে লাগলাম। গল্প কথায় রাতের রান্না শেষ করে ফ্রেস হয়ে পুনমকে পড়াতে বসি আমি। পুনমকে পড়ানো শেষ হলে রাতের খাবার সবাই একসাথে খেয়ে যে যার রুমে চলে যায়। একসময় প্রকৃতিতে নেমে আসে নিরবতা।

এতগুলো বছর ধরে যে দিনটার অপেক্ষায় থেকেছি, প্রতিটি প্রহর গুনেছি আজ সেই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটেছে। ছোট পুতুলটাকে আজ কনের সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। কনের সাজে কাউকে এতোটা মোহময়ী লাগে তা আগে জানা ছিল না আমার। মনে হচ্ছিল চোখের পলকে পুতুলটা বড় হয়ে গিয়েছে৷ কাজল কালো আখিতে যেন ভর করেছে রাজ্যের সব মায়া। এই মায়ার সাগরের অতল গহ্বরে প্রতিনিয়তই নিমজ্জিত হচ্ছি আমি। এতটা মায়া কি আসলেই থাকতে আছে কারো? না নেই৷ তবে তা আমার প্রেয়সীর আছে৷ পুরোটাই মায়ায় জড়ানো আমার প্রেয়সী। যাকে ভালোবেসে মরতেও রাজি আমি। তার মিষ্টি কন্ঠে যখন তিন অক্ষরের একটি শব্দ পরপর তিনবার উচ্চারিত হল তখন মনে হচ্ছিল আমার ভালোবাসা সার্থক। আমার প্রেয়সী শুধুই আমার। ছোট পুতুলটা সারা জীবন আমার বুকের মাঝে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে। আর আমি তাকে আগলে রাখবো সারাজীবন। তার মায়াভরা আঁখিতে পেতে দেব না কোনো কষ্টের ছোয়া। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তাকে এনে দিতে না পারলেও তার ভাগ্যের সবটুকু সুখ তাকে দিবো। আমি আর কিছু চাই না। শুধু আমার প্রেয়সীকে বলতে চাই, ‘#ওহে_প্রেয়সী_ভালোবাসি’। একবার নয়, বারবার। হাজার বার।

গভীর রাত। প্রতিটা মানুষ ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালেও কিছু রাতজাগা পাখির মতো জেগে আছি আমিও। আর আমার সঙ্গি প্রিয়কের ডায়েরি। ডায়েরীর প্রতিটা পাতায় রয়েছে আমার প্রতি তার সমস্ত অনুভুতি। এই ডায়েরী পড়েই জেনেছিলাম প্রিয়কের সেদিনের বলা কথাগুলো মিথ্যা। আমার বিয়ে ভাঙার যে কারন প্রিয়ক আমাকে এবং বাকিদের বলেছিল তা ছিল অসম্পূর্ণ। কিছুটা সত্য থাকলেও বেশিরভাগটাই ছিল মিথ্যা। এই ডায়েরীরই একটা পাতায় খুব সুন্দর করে লেখা ছিল দুবছর আগের সেই রাতের কথা।

“জানিস প্রজাপতি। আজ একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। তোকে সবসময় যে পুতুলটার গল্প বলি সেই পুতুলটার নাকি বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। অথচ আমি জানিই না। এই এটা ভাবিস না আমার সাথে হয়েছে। অন্য কারো সাথে হয়েছে। যেই পুতুলটাকে ছোট থেকে ভালোবেসে আসলাম, সেই পুতুলটা নাকি অন্যকারো বুকের মাঝে নিজের লজ্জা লুকাবে? ভাবতে পারছিস? যাকে নিয়ে হাজারও স্বপ্ন সাজিয়েছি আমি, সে আমার স্বপ্ন ভেঙে অন্যকারোর স্বপ্নচারিনী হবে। বুঝতেই পারলাম না কবে পুতুলটা এতো বড় হয়ে গেল যে তাকে আমার কাছ থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার ভালোবাসার মানুষটার উপর আমার আর কোনো অধিকার থাকবে না৷ তার উপর নাকি অন্য কারো অধিকার থাকবে। এই প্রজাপতি, এমনটা হলে আমি বাঁচবো কী করে বলতে পারিস? ওকে ছাড়া নিঃশ্বাস নিবো কি করে? আমার তো এখনি এসব ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কি করে সইবো ওকে অন্য কারো সাথে? বল না রে প্রজাপতি। তুই কেন কথা বলতে পারিস না হ্যা৷ তাহলে ওকে বলত পারতিস। জানিস পাগলীটা কখনই নিজের বাবা মায়ের অবাধ্য হয় না। আচ্ছা যদি পাগলীটা জানে যে তার প্রিয়ক ভাইয়া তাকে কতটা ভালোবাসে, কতটা পাগল তার জন্য তাহলে কি সে তার বাবা মায়ের অবাধ্য হবে? আমি না আর কিছু ভাবতে পারছি না। আচ্ছা যদি পাগলীটা অন্য কারোরই হবে তাহলে আমার মনে এতটা জায়গা কেন দখল করে নিলো? কেন নিলো কেন?”

নিজের অজান্তেই চোখের কোনে এসে ভীর করে কিছু নোনাপানি। কয়েক ফোঁটা চোখের কোণ বেয়ে ঝরে পড়ে। এটা ওই দিন লেখা যেদিন প্রিয়ক আমার বিয়ের কথা জেনেছিল। ঠিক কতটা ভালোবাসতো আমাকে তা হয়তো সে নিজেও জানতো না। কতটা কষ্ট পেয়েছিল তা একমাত্র সে আর সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত অন্য কেউ হয়তো জানতেও পারেনি। কিন্তু এখন বুজতে পারি তার ভালোবাসার গভীরতা। তবে তাকে হারিয়ে নয়, বরং পেয়ে বুঝেছি। না সেদিন আমাদের বিয়ে ভাঙে নি। ভাঙতে দেয়নি প্রিয়ক। তবে সেদিনের পর থেকে দুবাড়ির সম্পর্কে ফাটল ধরেছে। বাবা মায়ের সাথে খুব কম কথা হয় আমার। বাবার প্রতি অভিমানের পাহাড় জন্ম নিয়েছে মনের মাঝে। বাবানামক ব্যক্তিটার কাছে কখনই প্রিয় ছিলাম না আমি। বাবা সবসময় চাইতেন তার একটা ছেলে হোক। কিন্তু জন্ম নিলাম আমি। আমার জন্মের পর বাবা নাকি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু আমার জন্মের পর পাঁচটি বছর কেটে যাওয়ার পরও যখন আম্মি আর কনসিভ করলেন না তখন বাবার চিন্তা হয়। আম্মিকে ডাক্তার দেখালে জানা যায় আম্মি আর কখনই সন্তান ধারন করতে পারবেন না। তখন জানা আমাকে জন্ম দেওয়ার সময় মায়ের অসুস্থতার আরো একটি কারন ছিল আম্মি তার পরবর্তী সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারিয়েছিল। সেই থেকেই বাবার রাগ আমার আর মায়ের উপর। ছোট থেকেই দেখতাম বাবা মায়ের মনোমালিন্য। তবে তা কেন তখন বুঝতে না পারলেও এখন জানি। আমার প্রতি বাধ্য হয়ে যতটা ভালোবাসা যাই ততটাই বাসতেন তিনি। সবার সামনে বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল কঠোর। যার ফলে কেউ কিছু বলার সাহস পেত না। শুধু বাবা নয়, আমার বড় চাচ্চুও কঠোর প্রকৃতির মানুষ৷ ছোট চাচ্চুই কেবল নরম মনের। যার ফলে বাবা বা বড় চাচ্চুর কথার পিঠে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না। আমাকে করা অবহেলা সবার চোখে পড়লেও তারা ভাবত বাবা তো এমনি। তাই খুব বেশি কিছু মনে করতেন না।
বাবা তার বন্ধুর ছেলে রায়ানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছিল ও শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য। উনারা শুধু যে বন্ধু ছিল তা নয়, বরং ছিল ব্যবসায়ের অংশীদার। যার ফলস্বরূপ বড় একটা প্রোজেক্ট পেতে চলেছিল বাবা। সেটাও আমার আর রায়ানের বিয়ের মাধ্যমে। তাই তো সবকিছু ঠিক করার পর বাবা বাসায় জানায়। আম্মিকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেন নি। আর পরিবারের বাকিরাও বাবার উপর কথা বলেন না, তাই তারাও মত দিয়ে দেয়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক সপ্তাহ পরই রায়ানের সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রিয়কের কারনে তা হয়নি। ওই মিথ্যা বদনামে তারা ভেঙে দেয় তাদের ছেলের সাথে আমার বিয়ে। তারা কোনো ধর্ষিতা মেয়েকে নিজের বাড়ির বউ করতে রাজি না। ফলে বাবার কাছ থেকেও প্রোজেক্টটা হাতছাড়া হয়ে যায়। বাবার সাথে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেয় তারা। যার ফলস্বরূপ বিশাল বড় ক্ষতি হয় আমাদের ব্যবসায়ের। যার জন্য বাবার রাগ আমার উপর আরো বেড়ে যায়। তাই তো সেদিন বাবা আমার গায়ে হাত পর্যন্ত উঠিয়েছিল। আমার জন্য সব হারানোই আমার একটি কথাও সেদিন তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। আর যখন জানতে পারল এতকিছু হয়েছিল প্রিয়কের জন্য। তখন আমার উপর জমানো সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল প্রিয়কের উপর। তাই সেদিন সবটা জানার পর পুরোনো সমস্ত ক্ষতির কারন প্রিয়ককে করে তা থেকেই আমাদের ডিভোর্স। মা এক্ষেত্রে বাঁধা দিলে অত্যন্ত কঠোর কন্ঠে বাবা আম্মিকে বলেছিল,
“হয় ওদের ডিভোর্স হবে এবং তোমার মেয়ে তোমার কোলে থাকবে। নয়তো তোমাকে আমি তালাক দেবো আর তোমার মেয়েকে মে*রে ফেলবো। আর তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি যা বলি তাই করি। তোমার ওই মেয়েকে মারতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না। তাই যেকোনো একটা বেঁচে নেও।”
আর এটা সত্যি। বাবার আমাকে মা’র’তে খুব বেশি কষ্ট হতো না। খুব বেশি কেন হয়তো একটুও হতো না। কারন শুনেছিলাম আমার জন্মের আগে আম্মি আরো একবার কনসিভ করেছিল। কিন্তু আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে যখন জানতে পারে সেটা মেয়ে ছিল, তখন বাবা আম্মিকে জোর করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এবোর্শন করিয়ে এনেছিল। তাছাড়া বাবার নির্মমতার শিকার আরো একজন হয়েছিল। সে হলো আমার ছোট ফুফি। তাকে দেখেনি আমি। এবাড়িতে আসার পর মামনির কাছে শুনেছিলাম, ছোট ফুফি আমাদের এলাকার একটি ছেলেকে ভালোবাসত। কিন্তু আমার দাদা ছোট ফুফির বিয়ে অন্যত্র ঠিক করে। তাতে ছোট ফুফি রাজি হয় না। এবং সবাইকে তার পছন্দের কথা জানায়। রাগে ফেটে পড়ে আমার দাদা, বড়চাচ্চু আর বাবা। নিজের সম্মান রক্ষা করতে ফুফিকে মে*রে ফেলে। খুবই নির্মম মৃত্যু হয়েছিল ফুফির। অথচ সবাই জানে ফুফি দূর্ঘটনায় মা*রা গিয়েছে। সেটা বাড়ির বড়রা জানলেও জানা ছিল না আমাদের। তাই আম্মির ভয় ছিল সত্যিই যদি আমাকে মে*রে ফেলে। সে জন্য বাধ্য হয়েই আম্মি আমাকে দিয়ে ডিভোর্সের কথা বলায়। নিজের সংসার বাঁচাতে নয়, বরং আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে মায়ের কঠিন রুপ ছিল আমার প্রতি।
.
.
চলবে..??