Sunday, July 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1086



মা’ওয়া পর্ব-০৫(শেষ পর্ব)

0

~ মা’ওয়া ~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০৫(শেষ পর্ব)

বিচার পর্ব শুরু হতে একটু দেরিই হয়ে গেলো। বিচারের লোকজন এখনও আসা শুরু করেনি। সবাই হয়তো রাতের খাওয়া সেরে আসছে। গ্রামের লোকজন এমনিই তাড়াতাড়ি খায় আর তাড়াতাড়ি ঘুমায়। শহর হিসেবে এটা সন্ধ্যা।
রাহিমা চাচি জানালেন অন্যান্য দিন এসময়টায় হাকিম মোল্লা চাচা আর ইনজাম দুজনেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে। আজ বিচারের কারণে তাদের নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেছে। কারণ বিচারটা কোন সাধারণ নারীর না, একজন ইমামপত্নীর। তার সম্মানের দিকটা মাথায় রেখেই এই রাত্রি আয়োজন। চাচী আরো বললেন, ” রাতের অন্ধকারও একটা পর্দা।”

বিচারের ঘরে আসার আগে রাহিমা বেগম নিজের পরনের পোশাকের উপর আরেকটা জিলবাব চাপালেন। অথচ বিচার ঘরে চাদরের এপাশে সবাই মহিলা। ইশারা মনে মনে কিছুটা বিস্মিত হলেও মুখে কিছু বললো না। সে বেশ আগ্রহ নিয়েই বিচারের আয়োজন দেখছিলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিচার পর্ব শুরু হবে। চাদরের ওপাশে একাধিক পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ পেয়ে রাহিমা চাচি থম ধরে গেলেন। অথচ পুরো সন্ধ্যা অনর্গল কথা বলেছেন। ইশারা অবাক হয়ে তাকে দেখছিলো। একজন বয়স্ক মানুষের এই লজ্জাবোধ ওকেই যেন লজ্জায় ফেলে দিচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত চাচির দেখাদেখি ইশারা নিজেও মাথায় ওড়না দিতে বাধ্য হলো। কিছু পরিবেশের দাবিই এমন হয় যাকে অগ্রাহ্য করা যায়না ।

বিচারে খুব বেশি লোকের সমাগম হয়নি। হাকিম মোল্লা চাচার কঠোর নির্দেশে বাইরের কাউকেই বিচারে আসতে দেয়া হয়নি।
চাদরের ওপাশে পুরুষদের দিকে আছেন হাকিম মোল্লা চাচা সহ তার পুত্র ইঞ্জিমাম, ইমামপুত্র আব্দুল্লাহ এবং প্রয়াত ইমাম সাহেবের একমাত্র শ্যালক অর্থাৎ ইমামপত্নী নাবিলার সহোদর ভাই যিনি নিজেও একটি মাদ্রাসার উস্তায।
চাদরের এপাশে মেয়েদের দিকে আছেন রাহিমা চাচি, ইমামের বিধবা পত্নী নাবিলা ও তার প্রৌঢ়া মাতা জমিলা বিবি। বাইরের লোক বলতে একমাত্র ইশারা। সেও ইঞ্জামের ভাষায়।

বিচার শুরু হবার পরেই চাচার এক প্রশ্নে ইমামপুত্রের বুকফাটা কান্না শুনে সবাই থেমে গেলো। চাদরের এপাশে বসে সবাই আরেকটি ফোঁপানি শুনলো। ইশারা ধারণা করলো ইনি প্রয়াত ইমাম সাহেবের শ্যালক। তিনিও ভাগনের সাথে কাঁদছেন। তাদের সেই কান্না এবার সংক্রমিত হলো চাদরের এপাশেও। প্রয়াত ইমাম সাহেবের প্রৌঢ়া শ্বাশুড়ীও কেঁদে উঠলেন। বাকিরা সবাই স্তম্ভিত। চাদরের একপাশে ক্রন্দনরত কিশোর পুত্র আব্দুল্লাহ আর অপর পাশে তার ক্রন্দনরতা নানী জমিলা বিবি।
বিচারক হাকিম মোল্লা চাচা নির্বাক। বাকিদের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। ইশারা শুধু পরম বিস্ময়ে ইমাম পত্নী নাবিলাকে দেখছিলো। সে নিজে সুশ্রী বলে চাপা একটা গর্ব ছিলো তার। কিন্তু ইমামপত্নী নাবিলাকে দেখার পর নিজেকে ওর সামনে কুশ্রী মনে হতে লাগলো। কী চমৎকার দুধে আলতা গায়ের রঙ আর কী কমনীয় মুখশ্রী। যেন কোনদিন সূর্যের আলো পড়েনি ঐ ত্বকে। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না যে তিনি এতো বড় একটি পুত্রের মা। ইশারা তারচেয়ে বেশি অবাক হলো নাবিলার শক্ত মুখ দেখে। এবং সে মোটেও কাঁদছিলো না। তাকে পাথরের মুর্তির মতো মনে হচ্ছিলো।

একসময় কান্না পর্ব স্তিমিত হলো। ইশারা শুনতে পেলো, চাদরের ওপাশে নাবিলার ভাই কান্নাভেজা ভাঙা কণ্ঠে বলছেন,” ফুপাজান। আপনি মুরুব্বি। এই গ্রামের মাথা। আমরা এখন কী করবো একটা বুদ্ধি দেন। আমার মাথা আর কাজ করেনা ফুপা। এর একটা বিহিত করেন। এই পাপীষ্ঠাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার অনুমতি দেন আর নয়তো দোররা দেন মেরে ওকে রক্তাক্ত করি আমি। দেখি ওর ঐ একরত্তি শরীরে কত শক্তি ধরে। এতোবার বলেছি, এসব বাদ দে। ফিরে আয়। জান্নাতের পথ ধর। তার কানে এসব ঢোকেনা। ঐ জাহান্নামী নিজেও জাহান্নামে যাবে আমাদেরকেও নেবে।” বলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন মওলানা।
সেই কান্নার সাথে সাথে নাবিলার মাও কাঁদলেন। রাহিমা চাচির হাত ধরে বিড়বিড় করে বললেন,” আম্মা, আমি নিজেও তে অল্প বয়সের বিধবা। আপনারা তো জানেন, আমার স্বামী মারা যাবার পর থিকা জীবনের এতোগুলো বছর পর্দা পসিদার ভিতরে থাকছি। কোন পরপুরুষের দিকে চক্ষু তুইলা চাই নাই। সবুর করছি। এক হাতে এই ছয়টা পুলাপান মানুষ করছি। কারণ আমি জানি, রাসুল সাঃ বলছেন, যে নারী স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতীত্ব আর স্বামীর মাল সম্পদ রক্ষা করে, স্বামীর সামনে তার লগে কথাবার্তা সাবধানে বুইজ্যা বলে এবং শিশু সন্তান সহ বিধবা হওনের ফরেও যে নারী সন্তানগো আঁকড়াইয়া ধইরা রাখে আর তাগো ক্ষতি হওনের ডরে বিয়াশাদী না কইরা সন্তানগো দেখাশোনা করে, লালন ফালন করে সেই নারী জান্নাতী (কিতাবুল কাবায়ের – ইমাম আযযাহাবী রাঃ)। আর আমার এই মাইয়া আমার পেটে জন্ম নিয়াও আইজকা রঙগিন চশমা পিনছে। মনে করসে আমি কিছু বুজিনা। সেয় রাত বিরাইতে গুসুল করে। জিগাইলে কয় তাহাজ্জুদ পড়ুম। কত্ত বড় সিয়ানা বলেন আম্মা। সেয় কুথা থিকা এক মুবাইল জুটাইসে জানিনা। সেইহানে আবার কারে জানি বন্ধুও বানাইসে। নাউযুবিল্লাহ। হেই বেটা অহনে সমানে ফুন দেয়। কয়, বিয়া করবো। এই মাইয়ারে আমি কেমনে বুঝাই। ওরে জেনাকারিনী এই দুনিয়ার জীবন দুই দিনের । এই শরীর তো পুকামাকড়ের খাইদ্য। ” জমিলা বিবি চাপা স্বরে মেয়েকে বকতে লাগলেন।
তিনি হয়তো আরো কিছু বলতেন কিন্তু তার আগেই হাকিম মোল্লা চাচার খাকারিতে রাহিমা হাত দিয়ে তাকে থামতে ইশারা করলেন। বাকিরাও সবাই থেমে গেলো।

হাকিম মোল্লা পর্দার এপাশের বিচারপ্রার্থিনীর উদ্দেশ্যে বললেন,” এক পক্ষের কথা তো শুনলাম। এবার আব্দুল্লাহর আম্মার মতামতটাও জানতে চাই। ইঞ্জামের আম্মা, আপনি উনার কথাগুলো মন দিয়ে শুনেন। ওনার ইচ্ছেটা জানেন। কারণ ইসলাম ধর্মে বিধবা বিবাহের অনুমতি আছে। কাজেই আব্দুল্লাহর আম্মা যদি চান তাহলে শরীয়ত মতো…!”

” না ফুপা। এই গজব কইরেন না ফুপা। আমাদের মানসম্মান থাকবে না। ইমাম সাহেবের একটা সুনাম আছে এলাকায়। তার সন্তানরা থাকতে ওদের মা বিয়ে করাটা কেমন দেখায়। ” হাকিম মোল্লাকে থামিয়ে দিয়ে আব্দুল্লাহর মামা প্রবল বিরোধিতা করে উঠলেন। আব্দুল্লাহও শব্দ করে কেঁদে উঠলো প্রথমে তারপর হঠাৎ ছুটে গিয়ে পাকা দেয়ালে কপাল ঠুকতে লাগলো। এপাশে জমিলা বিবিও দু হাতে কপাল চাপড়াতে লাগলেন। মুহূর্তে পুরো বিচারিক সভা উত্তেজিত ও অশান্ত হয়ে উঠলো। উত্তেজনায় ইশারা নিজের ঠোঁটগুলো দাঁত দিয়ে শক্ত করে কামড়ে ধরলো। হায় আল্লাহ , কী হবে এই মেয়ের। এ যেন অনাঘ্রাতা, অপাপবিদ্ধা। এ তো এমন ফুল যার পত্রপল্লবে এক ফোঁটা ধূলো পড়েনি। এই মেয়েকে কী তবে জোর করে আজীবন এভাবে বেঁধে রাখা হবে ? হায়, ধর্মের নিয়মগুলো এতো কঠোর কেন। ইশারা কান্না পেয়ে গেলো হঠাৎ।

এমন সময় ইঞ্জিমামের গমগমে সুর পরিবেশটাকে কিছুটা শান্ত করলো। ইশারা শুনতে পেলো ইঞ্জিমাম বলছে ,” আব্বা আপনার অনুমতি নিয়ে আমি আব্দুল্লাহ আর ওর মামাকে দুটো প্রশ্ন করতে চাই। ”

হাকিম মোল্লা মাথা নাড়লেন। ইঞ্জিমাম বললো, ” মওলানা সাহেব। আপনি তো মাশাআল্লাহ দ্বীন জানা লোক। শারঈ বিধান জানেন। আব্দুল্লাহ এখনও ছোট ওর হয়তো জানা নাও থাকতে পারে। তবু দুজনকেই প্রশ্ন করছি। আপনারা কী রাসুল সাঃ কে অনুসরণ করেন বা নিজেকে তার উম্মত দাবি করেন ?”.

” জি অবশ্যই। ” দুজনেই সমস্বরে বললো।

” মাশাআল্লাহ। আপনারা কী রাসুল সাঃ এর স্ত্রী উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার সাথে বিয়ের ঘটনা জানেন ? মওলানা সাহেব আপনি বলুন, জানা আছে সেই ঘটনা? ”

মওলানা খানিকটা দমে গিয়ে বললেন,” জি জানা আছে জনাব।”

” মাশাআল্লাহ। তাহলে তো এটাও জানেন যে রাসুল সাঃ এর সাথে কয়েকজন সন্তানের জননী উম্মে সালামার বিয়ে হয়েছিলো তার নয় বছরের পুত্র উমারের তত্ত্বাবধানে ?”

মওলানা এবারও মাথা নাড়লেন, ” জি জনাব।”

” মাশাআল্লাহ। তাহলে এবার বলুন, আপনি কত বড় ইজ্জতদার হয়ে গেছেন যার ইজ্জত রাসুলের ইজ্জতকে টপকে গেছে ? আপনি আপনার অল্পবয়সী বিধবা বোনকে বিয়ে দিলে আপনার সম্মান লুট হয়ে যাবে কারণ তার দুটো বাচ্চা আছে। কাল যখন আপনার স্ত্রী মারা যাবে আর আপনি বিয়ে করবেন তখন আশাকরি কারো সম্মান লুটিয়ে যাবে না। কী বলেন ? যতদুর জানি, আপনার নিজেরও দুটো বাচ্চা আছে? ”

মওলানা নিরব। নিরব গোটা বিচারিক মজলিশ। ইশারা স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলো। মাত্র কয়েক মিনিট আগেই এই ছেলের ব্যবহারে সে রাগ করেছিল। পণ করেছিলো জীবনে আর ইঞ্জিমামের সাথে কথা বলবেনা। যে কিনা তার বাল্যবন্ধুকে অস্বীকার করে শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে। সেই ইঞ্জিমাম এসব কী বলছে ?

ইশারাকে বিস্মিত করে দিয়ে ইঞ্জিমাম পুনরায় বললো, ” জমিলা চাচি আপনার কথাগুলো আমি শুনেছি। চাচি আপনি মুরুব্বি মানুষ তাই সহজ করে বলি। সবাই আপনার মতো এতো দীর্ঘ সময় ধরে রোজা রাখতে পারেনা। আপনার জন্য সাধুবাদ কিন্তু যে বিধান আল্লাহতা’লা স্বয়ং রেখেছেন তার বান্দার জন্য তাতে যদি আপনাদের মানসম্মান যায় তাহলে বুঝতে হবে আল্লাহর বিধানের উপর আপনারা সন্তুষ্ট নন, নাউযুবিল্লাহ। আর রাসুল সাঃ এর যে হাদিসটা আপনি বললেন তার পাশাপাশি এটাও জেনে রাখুন, রাসুল সাঃ বলেছেন, ” যে আমার সুন্নতকে অপছন্দ করলো সে যেন আমাকেই অপছন্দ করলো। ” এ পর্যন্ত বলে থামতেই জমিলা চাচি এপাশে গুনগুন করে কেঁদে উঠলেন। মওলানা এবারও নিরব।

কেবল আব্দুল্লাহ এগিয়ে এসে ইঞ্জিমামের হাত ধরে বললো,” আপনি যা বলছেন তা সত্যিই ভাইজান?”

” সিরাহ পড়ে দেখো। উস্তাদদের জিজ্ঞেস করে জেনে নাও। তুমি জানো আমি মিথ্যে বলিনা। তাও কিনা আমার নবীর শানে? এ জিভ খসে পড়ুক।”

” আমি আম্মাজান উম্মে সালামার পুত্র উমারের মতো হতে চাই ভাইজান।” আব্দুল্লাহর কণ্ঠে অন্য রকম দীপ্তি। ইঞ্জিমাম সামান্য হাসলো।

” মাশাআল্লাহ। এটাই ঈমানী জযবা। এই ট্যাবু ভাঙতে হবে ভাই। তিনি তোমার মা এটা যেমন সত্য তেমনি তিনি আল্লাহর একজন দুর্বল বান্দি। রক্তমাংসের একজন মানুষ এটাও সত্য। কুরবানী নিজে দেয়া যায় আব্দুল্লাহ। কারো কাছ থেকে আশা করা যায় না। আল্লাহ তোমাকে একটা সুন্নাহ পালনের সুযোগ দিয়েছেন। সুযোগটা কাজে লাগাও। ”

এর পরের ঘটনাগুলো একটার পর একটা ঘটে গেলো। মওলানা এবং জমিলা বিচারের রায় মেনে নিয়ে কন্যা বিয়ের জন্য সম্মত হয়ে বিদায় নিলেন। তাঁদের শেষ প্রশ্ন ছিলো, ” লোকজন মন্দ বললে তারা কী উত্তর দিবে ? ”

হাকিম মোল্লা তাদের বললেন, ” তোমরা আমার নবীর কথা ভাবো তাহলে উত্তর পেয়ে যাবে। এই দুনিয়ায় আইনের প্রয়োগ হয় জনগনের উপর দিয়ে। আইন প্রণেতারা এর বাইরে থাকে। একমাত্র ইসলামই সেই বিধান যার আইন প্রনয়নের পর তার প্রয়োগ শুরু হয় এর নেতাকে দিয়ে। আমাদের নবীকেও সে যুগে তাঁর কিছু বিয়ের কারণে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আম্মাজান আইশা রাঃ , আম্মাজান যাইনাব বিনতে জাহাশ রাঃ যিনি তার পালক পুত্রের স্ত্রী ছিলেন। এসব বিয়ে ছিলো সেসময়ের গোঁড়ামীর মূলে কুঠারাঘাত। আমাদের নবী সেসব সহ্য করেছিলেন। আজও যখন কিছু কুলাঙ্গার আমাদের নবীর জীবনী না জেনে তাঁর একাধিক বিবাহ নিয়ে আলোচনা করে তখন তোমরা ওদের সাথে ঝগড়া করো ঠিকই কিন্তু বাস্তবে ওদের কথারই বাস্তবায়ন করো। ”

হাকিম মোল্লা থামলে ইঞ্জিমাম আব্দুল্লাহকে বললো, ” শোনো আব্দুল্লাহ দেশীয় আইনে তুমি নাবালক হলেও শরীয়া আইনে তুমি সাবালক। কারণ তোমার গোসল ফরয হয়ে গেছে। আর কয়েক বছর পর ইনশাআল্লাহ বিয়েও করে ফেলবে। মাকে এভাবে আটকে রেখোনা। বিয়েটা সহজ করে দাও তাহলেই জেনা কঠিন হয়ে যাবে। আজ বিয়ে কঠিন বলেই জেনা সহজ।”

=====
একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরলো ইশারা। রাতে ছোটমায়ের সাথে বিচারের বিষয়বস্তু নিয়ে টুকটাক আলাপ করলো। বাকি রাত ঘুম হলোনা ইশারার।
পরদিন নাস্তার টেবিলে বড়ভাইয়া জানালেন, ইশারা এখন থেকে মাসুমার কাছেই থাকবে। কলেজ খোলা থাকলে হোস্টেলে যাবে নয়তো ছুটিছাটা সহ বাকিটা সময় সে মাসুমার ঢাকার বাড়িতে থাকবে। এটা ওদের সব ভাই বোনদের মিলিত সিদ্ধান্ত। তাছাড়া মাসুমার যে দেবর ওকে বিয়ে করতে আগ্রহী তাকে বলে দেয়া হবে আরো তিনচার বছর পর আসতে। ইশারার ইন্টার্নী শেষ হবার পর। ইশারা যেন নিজের ভবিষ্যত নিয়ে একদম না ভাবে। তাছাড়া ও একজন ডাক্তার। ওর জন্য পাত্রের অভাব হবেনা ইত্যাদি। ছোটমার ব্যপারেও সবকিছু ভাবা হয়েছে। তিনি তার বাপের বাড়ি চলে যাবেন। তাকে এককালীন কিছু টাকা দিয়ে দেয়া হবে যেটা ব্যাংকে রেখে তিনি আজীবন খেতে পারবেন।

ইশারা সব শুনলো কোন মন্তব্য করলো না। গ্লাসে পানি ঢেলে নেবার সময় রুমানা আর গোধূলির অসন্তুষ্ট মুখটাও একবার দেখে নিলো। ইশারা ভালো করেই জানে ওরা মুখে হাসিখুশি ভাব ধরে রাখলেও মনে মনে নারাজ। অবশ্য ইশারার সম্পত্তি দেখাশোনার ভার মাসুমা আপার বরের হাতে চলে যাচ্ছে এটা ওদের সহ্য না হবারই কথা। আজ ইশারার চেয়ে বেশি দাম ওর সম্পত্তির।

ইশারা শান্ত মুখে পুরো নাস্তা শেষ করলো তারপর উঠে চলে গেলো ভিতরে। সেখানে ছোটমাকে দেখা গেলো মুখ গুঁজে পড়ে আছেন। ইশারা তার পাশে বসলো। পিঠে হাত রাখলো।
” কী হয়েছে মা?”
” কিছু হয়নাই।” বলে উঠে বসলেন ময়না বিবি। চাপা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন, ” আর কয়দিন বাদে তুমি চইলা যাইবা। এর লিগা মনডা খারাপ।’
” বাহ্ কী সুন্দর করে মিথ্যা বলো তো তুমি ? কার কাছ থেকে এমন করে মিথ্যা বলা শিখলে ? ”
ময়না বিবি চুপ মেরে গেলেন। ইশারা তার মাথার ঘোমটাটা ঠিক করে দিয়ে বললো,” তুমি কোথাও যাবেনা। এখানেই থাকবে। আমার কাছে।”

ময়না বিবি চমকে তাকালেন। ইশারা আর কোন কথা না বলে সোজা উঠে রাহিমা চাচির ঘরে চলে এলো। এবারও ওকে দেখে ইঞ্জিমাম দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো তবে যাবার আগে ওর বিরক্তিটা ইশারার নজর এড়ায়নি। ইশারার যখন তখন আগমন ওকে বিরক্ত করছে সন্দেহ নেই। ইশারা ওর বিরক্তি আজই শেষ করে দিবে।

ইশারা রাহিমা চাচির মুখোমুখি বসলো। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে তারপর দ্বিধা কাটিয়ে ফেললো। স্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো, ” চাচি, আমি আপনাকে ঐ দিনের ব্যপারে বলতে এসেছিলাম।”

রাহিমা প্রথমটায় হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন ইশারার দিকে। যেন ওর কথাটা ধরতে পারছেন না। তারপরই মৃদু স্বরে বললেন,” কী কথা, বলো না মা।”

ইশারা মুখ নামিয়ে বললো,’ গতকাল সারারাত আমি অনেক ভেবেছি চাচি। আপনার প্রস্তাবটা আমার জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হবে। তাই আমি স্থির করেছি আপনার পরামর্শটাই আমি বাস্তবায়ন করবো। আমি আপনার ছেলের সাথে বিয়েতে রাজি। তবে আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে চাচি। ”

” কী অনুরোধ বলো।’ রাহিমা হাসছেন।

” আমার ছোটমাকে আমি নিজের কাছে রাখতে চাই। আমি চাই ছোটমা তার জীবনের বাকি দিন তাঁর স্বামীর ভিটাতেই থাকুন। আমার বিয়ের পর আমি এখানেই থিতু হতে চাই। যেমনটা আপনি চান সাহেদ ভাই থাকুন।”

” মাশাআল্লাহ মা। খুবই সুন্দর ইচ্ছা। তা মা সাহেদ কী তোমাকে এখানে রাখতে রাজি হবে? আমি নাহয় সাহেদকে ফোন করি, করবো ? ”
ইশারা এবার জবাব না দিয়ে রাহিমার হাত ধরে মুখ লুকলো। চোরা হেসে বললো, চাচি আমি শাহেদ ভাইয়ের কথা বলিনি।”

” ওমা, তাহলে?” রাহিমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। আর ইশারার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করলো। ওর চেহারা দেখেই রাহিমা যা বোঝার বুঝে নিলেন। এবার তিনি সামান্য মুচকিও হাসলেন।

হাকিম মোল্লা চাচার বাড়ি থেকে ফিরেই ইশারা বড় ভাইয়ের কাছে এলো। আখতার তখন সবার সাথে একত্রে চা পান করছিলেন। ইশারা সবার সামনেই বললো, ” আমার কিছু কথা আছে ভাইজান। তোমাদের সবার সাথে।”

আখতার ছোটবোনের দিকে তাকালো। সস্নেহ হাসি দিয়ে বললো,” আয় না বুবু। বস এখানে। কী বলবি বল।” ওর কণ্ঠই বলে দিচ্ছে সে খুব খুশি।

” ভাইজান, আমি চাই ছোটমা এখানে থাকুন। গ্রামে এই বাড়িতে।’ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে কথাগুলো বললো ইশারা। আখতার তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু না বললেও গোধূলি তেতে উঠলো। তীক্ষ্ম স্বরে বললো,
” মানে? সে কেন এই বাড়িতে থাকবে। আর এই সিদ্ধান্ত দেবার তুই কে ? ”

” আমি লালমিয়ার ছোটমেয়ে।আর ময়না বিবি লালমিয়ার বিবাহিতা স্ত্রী। এইজন্য।” ইশারা বিচলিত হলোনা। সে শান্ত রইলো। এরইমধ্যে রুমানা বলে উঠল।

” বাহ। অনেক বড় হয়ে গেছিস মনে হয়। এখনও বিয়েশাদি হয়নি। জীবন শুরু করিসনি। আর এখনই সিদ্ধান্ত দেয়া শুরু করেছিস?”

গোধূলি পাশ থেকে ফোড়ন কাটলো, ” বুঝবে না কেন। দুদিন ধরে তো ঐ বাড়ি থেকেই বুদ্ধি ধার নিচ্ছে। কত বুদ্ধি গজাবে এখন মাথায়? ”

ইশারা ম্লান হাসলো। ” ঠিকই বলেছো আপু। আমার বুদ্ধি আসলেই গজাতে শুরু করেছে। যেদিন থেকে আমার পায়ের নিচে মাটি সরে গেছে সেদিন থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি আমার ফেরার জায়গাটা নাই হয়ে গেছে। তোমরা সবাই একদিন যার যার বাড়ি ফিরবে। তোমাদের ঘরে। আর আমি ফিরবো হোস্টেল। সেখান থেকে বড়আপার বাড়ি। আরেক হোস্টেল। অন্তত আমার জন্য। আর এভাবে ততদিন চলবে যতদিন আমার নিজের কোন ঘর না হয়।”

” কেন, একথা হবে কেন। তুই একদিন ডাক্তার হবি। কত নাম ডাক হবে তোর। তোর এতো ভাবনার কী আছে? ” রুমানা বললো। তবে তার জবাব দেবার আগেই আখতারুজ্জামান নরম সুরে বললেন, ” আচ্ছা, আমরা কী তোর কেউ না? এভাবে করুণ গলায় কথা বলছিস কেন রে? ” আখতারের গলা কিছুটা ভিজে এসেছে বলে মনে হলো ইশারার। সে বললো,
” তোমরা তো অবশ্যই অনেক কিছু তবে সেটা সাময়িক। ঠিক একটা ওয়েটিং রুমের মতো যেটা না হলে গন্তব্য বদলানো কঠিন। আমি আমার গন্তব্য যেতে চাই ভাইয়া। যেখানে আমি ফিরতে পারবো। যেখানে গেলে আমার মনে হবে, ‘ আই এম হোম। যেটা আমার একখন্ড আশ্রয়। আমার মা’ওয়া।”

-” বাব্বাহ, এতো কিছু ঠিক করে ফেলেছিস। তা এটা কী করে ভাবলি যে তোর কথায় ছোটমাকে এখানে থাকার অনুমতি দেব আমরা?” মাসুমা বললো।

‘ তোমাদের কাছে তো অনুমতি চাইনি আপা। যেটা বাবা নিজে দিয়ে গেছেন সেটা থেকে তো তোমরা তাকে বঞ্চিত করতে পারবেনা। এটা জুলুম।”

” ছোটমা নিজে না দাবী নামায় স্বাক্ষর করে তার মতামত জানিয়ে দিয়েছেন। এখন আর এসব বলে লাভ নাই।’ রুমানা মুখ ভ্যাঙচানোর মতো করে বললো। ইশারা মুচকি হেসে বললো,” সেটা কোর্ট বুঝবে। স্বামী মারা যাবার দ্বিতীয় দিনে কেউ কাউকে লিখে পড়ে জমি দিয়ে দেয় এটা আজ প্রথম জানলাম। যাই হোক, ভাইয়া, তোমাকে বলছি। তুমি আমার বড় ভাই। আমার বর্তমান অভিভাবক। যদিও আইনগত ভাবে আমি নিজেই বিয়ে করতে পারি তবু আমি চাইবো অন্তত আমার আকদের দিন তুমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমার গন্তব্য বদলে দাও। আমার অভিভাবক হয়ে আমাকে আমার স্বামী পর্যন্ত পৌঁছে দাও।”

মুহূর্তেই শোরগোল পড়ে গেলো ঘরের মধ্যে। মাসুমা রুমানা গোধূলি একসাথে চেঁচাতে শুরু করলো। গোধূলী তো বলেই বসলো, বাপ মরেছে দুদিনও হয়নি। আর উনার মনে রঙ লেগেছে। কেবল আখতার নিরব বিস্ময়ে বোনকে দেখতে লাগলো। ইশারা ওদের কোন কথারই কোন জবাব দিলো না। এক মুহূর্তের জন্য ওর নিজেকে নাবিলা বলেও মনে হলো।
আখতার এবার প্রশ্ন করলো,” ছেলেটা কে রে ? ”

ইশারা মুখ নামালো। নাম বললো। মাসুমা গোধূলি আর রুমানার মুখে এবার তালা পড়ে গেলো। বিস্ময়ে তাদের চোখে পলক পড়ছে না। আখতার শুধু বললো,” যা বলছিস ভেবে বলছিস তো? ”

” জি ভাইয়া। ঠান্ডা মাথায়। ইনফ্যাক্ট আমার ইচ্ছের কথাটা একটু আগে জানিয়েও এসেছি চাচিকে। দুদিন বাদে তোমরা সবাই চলে যাবে। আমারও কলেজ খুলে যাবে। তোমরা এই গ্রামে আবার কোনদিন আসবে কিনা জানিনা। এলেও সবাইকে একসাথে পাবো কিনা তাও অনিশ্চিত। এসব কিছু ভেবেই আমি চলে যাবার আগে নিজের জন্য একটা গন্তব্য রচনা করতে চাইছি। ওটা হবে আমার ঘর,আমার আশ্রয়।”

” হম, আমি অবশ্য সাহেদকে ধারণা করেছিলাম। ও ডাক্তার ছিল। তুইও ডাক্তার হবি দুদিন বাদে। মানাতো তোদেরকে। ”

“দুজনেই ডাক্তার হলে সব ঠিকমতো চলবে এমন কোন যুক্তি নেই ভাইয়াা। ইনজাম মানুষ হিসেবে সাহেদের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে।”

” যাক তুই সংসার করবি তুই ভাল বুঝিস।
ইনজাম তো আবার তোর বাল্যবন্ধু। ” বলে আখতার থেমে গেলো। এবার আর কেউ কোন কথা বললো না। আখতার এই প্রথম ইশারার কাঁধে হাত রাখলো। মৃদু স্বরে বললো, ” আমি বেঁচে থাকতে তুই নিজের বিয়ের কথা নিজে চালাচালি করবি এটা তো ঠিক না। চল, আমাকে চাচার কাছে নিয়ে চল।”

======
ঠিক পাঁচদিন পরের কথা। এক অনাঢ়ম্বর পরিবেশে খুবই ঘরোয়া পরিসরে ইশারার বিয়ে হয়ে গেলো ইনজিমামের সাথে। মায়ের জরুরী তলব পেয়ে সাহেদ আগেই চলে এসেছিলো গ্রামে। তবে এবার আর প্রতিবারের মতো পরদিনই দৌড় মারেনি। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। মায়ের খুশিতে সেও খুঁশি। আনন্দে আবেগে দারুণ আপ্লুত।

খুশি না শুধু একজন। আকদের রাতেই তার রাগান্বিত মুখ দেখলেন রাহিমা। অসহায়ের মতো বললেন,” আমি কী করবো ? ইশারাই তো বললো ও আকদের পরদিনই চট্টগ্রাম চলে যাবে। ওর কলেজ খুলে যাবে। এদিকে তোর ভাইও যাবার জন্য পাগল। কাকে কাকে আটকাবো।

” সেজ ভাই যাচ্ছে যাক। তাই বলে বিয়ের পরদিনই কনে উধাও হবে ? সেই কবে না কবে আবার ছুটি হবে সেদিন ফিরবে। কোন মানে হয়?”

‘ তুই একটু কথা বলে দেখ না ওকে দুই একদিন রাখতে পারিস কিনা।” অনিশ্চয়তার সাথে বললেন রাহিমা।

মায়ের সাথে কথা শেষ করেই সরাসরি লালমিয়া ব্যপারীর বাড়ি চলে এল ইঞ্জিমাম। এ বাড়িতে আখতারদের সবার আজ যাওয়ার ধুম পড়েছে। গতরাতে বোনের আকদ সম্পন্ন করে সবাই অনেকটা হালকা মেজাজে আছে। চলে যাবার গোছগাছ চলছে। আগামী কাল সাত সকালেই মাসুমা আর রুমানা রওনা দিবে। গোধূলি বেরোবে বেলা বারোটার দিকে। আখতার যাবেন পরশু।
তিনি ইঞ্জিমামকে দেখেই সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। তারপর ওর হাত ধরে বললেন, ” আমার বোনটাকে দেখে রেখো। সাথে ছোটমাকেও।”

” জি, ইনশাআল্লাহ। ” মনে মনে বললো, আমাকে তো বললেন এবার বোনকে বলে যান আমাকে ফেলে যেন আজই না যায়।

আখতার নিজেই বললেন,” যাও ভেতরে যাও। ইশারা ছোটমার ঘরেই আছে।”

ইঞ্জিমাম সামান্য মাথা নেড়ে ছোটমার ঘরের দরজায় টোকা দিলো। দরাজ কণ্ঠে সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলে ময়না বিবি গুটিশুটি মেরে একপাশে সরে বেরিয়ে গেলেন। ইঞ্জিমাম দেখলো ইশারা বাঁধাছাদা করছে। যাত্রার প্রস্তুতি। ইঞ্জিমাম নিরবে কিছুক্ষণ ইশারার প্যাকিং দেখলো। তারপর ওর হাত ধরে ওকে থামালে ইশারা পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো,” কী হয়েছে ? ”

” এসবের মানে কী? তুই কালই চলে যাবি এটা কেমন কথা? ”

” পরশু আমার ক্লাস। মিস দিতে পারবো না।”

” তাহলে পরশুই যা। আমি তোকে নিয়ে দিয়ে আসবো। আজ বা কাল আমি কোন অবস্থাতেই তোকে যেতে দেবো না। ”

” উপায় নেই ইনজি। আমাকে কালই যেতে হবে।” নির্বিকার ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেও ইনজির শক্ত বাহুবন্ধনে ভাষা হারিয়ে ফেললো। ইনজি কাতর স্বরে বললো, ” কেন এরকম করছিস?”

” প্রতিশোধ নিচ্ছি। ” বলে মুখ গম্ভীর করতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেললো ইশারা।

ইঞ্জিমাম ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ” যাসনা প্লিজ, কষ্ট পাচ্ছি।”

” উচিত শিক্ষা। “ওর দিকে না তাকিয়েই উচ্চারণ করলো ইশারা।

‘ হম, আসলেই উচিত শিক্ষা হচ্ছে আমার।” বলে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলো ইশারার দিকে। ওর করুণ ভঙ্গিমা এবার ইশারাকে দুর্বল করে ফেললো। সে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলো এক চওড়া বুকের দেয়ালে। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো ওর। ইনজিমাম ওকে সামলে নিতে চাইলো। মৃদু শব্দে বললো,” কান্না করার কী হলো?”

” প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছি। ইচ্ছে করছে না যাই।’

‘ নাহ্, এতোটা দুর্বল হলে চলবে কেন। সময়মতোই যাবি। হাসিমুখেই যাবি। আমিই তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবো। যেভাবে তোকে হারাম অবস্থায় পেয়ে সাময়িক লোভে পড়ে নিজের জন্য হালাল করে নেইনি। আজও তোকে হালাল পেয়ে আমার বাকি দিনগুলোর স্বস্তি হারাম করবো না। এটা তো আল্লাহর রহমত যে আমরা একে অন্যের গন্তব্য হতে পারছি। আমাদের একজীবনের আশ্রয়। ”
ইশারা কোন কথা বললো না। কেবল মন দিয়ে উপলব্ধি করতে লাগলো প্রিয়জনের নৈকট্যকে। ”

~সমাপ্ত~

মা’ওয়া পর্ব-০৪

0

~মা’ওয়া~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০৪

সময়টা মাগরিবের নামাজের পরপর। যখন কিছুটা ছায়া ঘনাতে থাকে। গাছের ছায়ায় আর ঝোঁপের নিচে। থোকা থোকা অন্ধকার জমতে শুরু করছে। এরকম একটা সময়ে রাহিমা চাচির সাথে তার পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে এলো ইশারা। চাচির সাথে হাঁটতে ভালোও লাগছিল ওর। চাচি মানুষটা বয়সে বৃদ্ধ হলেও মনের দিক থেকে বেশ তরুণী। হাঁটতে হাঁটতে অনেক ধরণের গল্প করলেন তিনি। জীবনের উদ্দেশ্য বোঝালেন। ইশারা চাচিকে যতই দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে। দিনের আলোয় ঘরের আড়ালে ঘোমটা দেয়া চাচিকে দেখে বোঝাই যায়না আসলে তিনি কতটা প্রানোচ্ছ্বল। সন্ধ্যে মেলাবার পর তিনি নিজেই প্রস্তাব করেছেন ইশারাকে। বলেছেন, ” চলো মা, একটু হাইটা আসি। এই সময়টা ব্যাটাছেলেরা কেউ বাড়ায় না। তোমার চাচা আর ইনজাম এসময় ঘরে ঢুকে কেতাব খুলে বসে আর আমি পুরো বাড়ি তিনচক্কর মারি। হাঁটাও হয় আবার গাছগুলোর যত্নও নেয়া হয়।” সেটা শুনেই বেরোনো।

আবছা আলোয় হাঁটতে গিয়ে নিজেকে বেশ রহস্যময়ী মনে হচ্ছিলো ইশারার। এর আগে গ্রামে এলে দুতিন দিনের বেশি থাকেনি ইশারা। সেই তিনদিনও ঘরে বসে গল্পের বই পড়েই কেটে যেতো। সারাদিনে হয়তো একবার চাচির বাড়ি উঁকি দিতো আর নয়তো চলে আসার দিন দায়সারা গোছের একটা সাক্ষাৎ। কিন্তু এবারের ভ্রমন সম্পূর্ণ আলাদা। আজ নিজের বাড়ি পর হয়ে যাওয়ায় মাত্র একদিনেই চাচি ওর কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। তার কাছে আসতে ভালো লাগছে ইশারার। কথা বলে সময় কাটাতে ভালো লাগছে। বাড়িতে সবাই থাকলেও মনের কাছাকাছি আজ কেউ নেই। সবারই চেহারায় যেন একটা আলগা মুখোশ ঝুলছে। যে কোন মুহূর্তে খসে পড়বে ওটা।

আজ সকালে চাচির কথায় বড় ভাইয়া আর মাসুমা আপা বিচার পেছানোর কথায় রাজী হলেও সন্ধ্যেটা নষ্ট করতে রাজি হয়নি। সবাই দল বেঁধে বেরিয়েছে বাবার পরিত্যক্ত সাম্রাজ্য দেখতে। যদিও মুখে বলেছে গ্রাম ঘুরে দেখবে কিন্তু ওদের গা টিপাটিপি আর কুটকুট হাসি দেখেই অনুমান করেছে ইশারা। এক রাতে ধনী হয়ে যাবার আনন্দে বিভোর সবাই। ইশারা ইচ্ছে করেই ওদের সাথে যায়নি। গেলে ভালো লাগবে না জানে বলেই যায়নি।

পুরোটা বিকেল আজ ছোটমার সাথেই ছিল। সন্ধ্যার খানিক আগে ছোটমাকে দেখতে তার আত্মীয় স্বজন এলে মাকে বলে চাচিদের বাড়ি চলে এসেছে ইশারা। চাচির এখানেই মাগরিব পড়েছে। অবশ্য সে একা নয়। নামাজ গত দুদিন ধরে ওর বাকি ভাইবোনেরাও পড়ছে। হয়তো বাবার চলে যাওয়া উপলক্ষেই চলছে এটা । কতদিন এমন চলবে ইশারা নিজেও জানেনা। তবে সে নিজের মনে মনে ঠিক করেছে এবার থেকে আর নামাজ ছাড়বেনা।

” এই যে, এটা হলো আমার সাহেদের চেম্বার।” চাচির ডাকে সম্বিত ফিরলো ইশারার। ভালো করে তাকাতেই দেখলো একটা দোচালা ঘর। ঘরটায় তালা দেয়া। ইশারা অবাক হলো। বললো, ” সাহেদ ভাই এখানে বসেন নাকি? ”

” আরে না। সবদিন তো বসেনা। প্রতি শনিবার বসে। শুক্রবার রাতে বাড়ি চলে আসে। রাতটা থেকে পরদিন শনিবার সকাল থেকেই এখানে বসে। দুপুরে খানিক জিরিয়ে যাবার আগে বিকেলে আরো একঘন্টা। এটা তোমার চাচারই ইচ্ছা এবং আদেশও। বাপের আদেশ মেনেই গত এক বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে এটা করার চেষ্টা করে সাহেদ। গ্রামের দরিদ্রদের বিনামূল্য চিকিৎসা করে। আজকাল ওর ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় নিয়ম মেনে প্রতি শুক্রবার আসতে পারে না। মাসে দুবার আসে। না এলে তোমার চাচা অনেক রাগ করে।”

ইশারার ভালো লাগলো উদ্যোগটা। মুচকি হেসে বলে বসলো,” বাহ ভালো তো। আমি ডাক্তার হয়ে গেলে আমিও গ্রামে এসে রুগী দেখবো।”
ওর কথা শুনে রাহিমা উজ্জ্বল চোখে তাকালেন। হেসে বললেন, ” তুমি চাইলে সেই ব্যবস্থাও হতে পারে।”

” মানে ? কীভাবে? ”

রাহিমা এবার এগিয়ে এসে ইশারার হাত ধরলেন,” আজ সকালে এই কথাটা বলার জন্যই আমি তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ইচ্ছে ছিল তোমার ছোটমার সামনেই বলি। কিন্তু অন্যান্য প্রসঙ্গ এসে যাওয়ায় আর বলা হয়নি।” রাহিমাকে ইতস্তত করতে দেখে ইশারা অভয় দানের হাসি হাসলো।

” এতো হেজিটেট করার কী আছে চাচি। বলুন না। আমি তো আপনার মেয়ের মতোই।”

” তা তো অবশ্যই। আমি নিজেও তোমাকে ঐ চোখেই দেখি। দেখো মা, তুমি এখন সাবালিকা। নিজের ব্যপারে ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা তোমার আছে। এদিকে তোমার ভাইবোনরাও সবাই এখন গ্রামে। পরে চাইলেও ওদেরকে গ্রামে একসাথে জোটানো সম্ভব হবে না। নইলে আমি আরো অপেক্ষা করতাম। কী জানি আবার কবে সবাই এক হয়। হবে কিনা তাই বা কে জানে। ” রাহিমা থামলেন। ইশারার কৌতুহল বাড়লো। রাহিমা দ্বিধা কাটিয়ে উঠলেন। আস্থার সাথেই বলতে লাগলেন, ” শোনো মা, আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। তুমি লালমিয়া ভাইয়ের মেয়ে। আয়না ভাবিও আমার অনেক শ্রদ্ধার একজন মানুষ। তার উপর তোমার বাবা মা দুজনেই চলে গেছেন। তুমি নিজেও হয়তো আর এক সপ্তাহ এই গ্রামে আছো। সবমিলিয়ে কথাটা এখনই বলতে হচ্ছে। তুমি কিছু মনে করোনা যেন ” বলে রাহিমা কিছুক্ষণ থামলেন। তারপর ইশারার দিকে তাকিয়ে বললেন ,” আমার সাহেদকে তো তুমি মোটামুটি ভালো করেই জানো। ও তোমার চাচাজান বা ইনজামের মতো ধার্মিক হয়নি তবে বাপের স্বভাব ওদের সব ভাই বোনের রক্তে। ছেলে আমার অসৎ পথে পা বাড়ায়নি। বিয়ের কথা অনেকদিন ধরেই বলছিলাম। ও বলে তোমার পছন্দে বিয়ে করবো। গতকাল তোমাকে দেখার পর থেকেই সাহেদের এই কথাটা মাথায় ঘুরছে আমার। আমি বলি কী মা, বিয়ে তো একদিন করবেই। তাহলে আর দেরি কেন। আজ বুধবার। কাল বাদে পরশু সাহেদ গ্রামে আসবে। তুমি চাইলে সাহেদের সাথে কথা বলে দেখতে পারো। তারপর নাহয় তোমার মতামতটা জানাও। আখতার মাসুমা রুমানা সহ তোমার সব ভাই বোনই তো আছে এখানে। আমার তো মনে হয় ওরাও খুশি হবে। আমি বলি কী, সাহেদকে তুমি আগে দেখো কারণ ওকে তুমি অনেক আগে দেখেছো। ইদানিং তো আর দেখোনি। তাই ওকে দেখো, কথা বলো। তারপর সিদ্ধান্ত নাও। আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছো তো মা ? ”

ইশারার চেহারা এবার আপেলের রঙ ধরলো। যত বিদুষিনীই হোক না কেন, বিয়ের কথায় লজ্জা পায়না এমন নারী বোধহয় জগতে নেই। সে মুখ নামিয়ে বললো ,” এখনই বিয়ে? আমার পড়াশোনা তো শেষ হয়নি চাচি ? ”

” জানি। আমাদের দেশে পড়াশোনা শেষ না হলে বিয়ে করা যায়না। বাকি সব করা যায়। ওতে কেউ বাধা দেয়না। নিরুৎসাহিত করে বলে না, পড়াশোনা শেষ হয়নি এখনই প্রেম কিসের। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কিংবা ক্লাস শেষ করে প্রেমিকাকে নিয়ে আড্ডা দিলে কারো পড়াশোনা নষ্ট হবার ভয় জাগেনা কিন্তু যেই না বিয়ের কথা উঠবে তখনই রব উঠবে। সংসার করবে না পড়বে। আগেকার দিনে যেসব মেয়েরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখো তারা সবাই বিয়ে করে বাচ্চা কোলে নিয়েই এসব করেছে। বরং বিবাহ বহির্ভূত অস্থিরতা মানুষকে পড়াশোনাতে বিচলিত করে, বিয়ে করে ঠান্ডা মাথায় পড়তে বসলে তা আর হয়না। বাকি রইলো পরিবারের সমর্থন। এটা তুমি পুরোপুরি পাবে। কাজেই ও নিয়ে একদম ভেবোনা। সাহেদকে তোমার পছন্দ হয়ে গেলে বিয়ের পরের সময় নিয়ে তোমাকে একটুও ভাবতে হবেনা। ঐ চিন্তা ইনশাআল্লাহ আমার। ”

ইশারাকে নিরব দেখে আর কথা বাড়ালেন না রাহিমা। তার মনে হলো তার যা যা বলার তা তিনি বলে ফেলেছেন। এরপরেও আর এটা নিয়ে কথা বলা মানে ওকে চাপ দেয়া। সেটা তিনি করবেন না। এরপরের ভূমিকা ইশারাকে নিতে হবে। ওর আগ্রহ না দেখলে তিনি আর এ নিয়ে কথা তোলার পক্ষপাতি নন।

ওরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে চলে এলো।শোনা গেলো ঈশার নামাজের পরই বিচার কার্য শুরু হবে। রাহিমা অযু করতে ঢুকলে ইশারা পাশের ঘরে চলে এলো। চাচির কাছে শুনেছে এই ঘরটাতেই নাকি বিচার হবে।

ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালো ইশারা। ঘরটা আয়তনে বিশাল। গ্রামাঞ্চলের ঘরগুলো যেমন হয় এটা তারচেয়েও কিছু বড়। দুদিকেই বড় বড় ঝরোকা। সেগুলো দিয়ে এলোপাতাড়ি বাতাস আসছে। ওগুলিকে জানালা বলতে ইচ্ছে করলো না ইশারার। ছোট ছোট চারটা করে কপাট। শহরের স্লাইড করা থাই গ্লাসের জানালার মতো নয়।

রাহিমা চাচিদের বাড়িটা এমনিতেই পুরোনো ধাঁচের। শহুরে অনেক সুবিধা থাকলেও ডিজাইনটা সেই পুরোনো ধাঁচেরই। প্রাচীন জমিদার বাড়ির মতো। একটু আগে চাচির কাছেই শুনেছে এই রুমটা ইনজিমামের। সে নাকি আজকাল গ্রামেই থিতু হয়েছে। চাচার মাদ্রাসা বড় করবে বলে গোঁ ধরেছে। অথচ ওর পড়াশোনা বেশ ভালো। ইশারার ধারণাকে টপকে গেছে ইনজির প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা। সে চাইলেই রাজধানীর যে কোন নামকরা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু এই বেকুবটা নাকি ইচ্ছা করেছে সে গ্রামেই থাকবে। এখানকার মাদ্রাসা দেখাশোনা করবে। ওর মতে সবাই যদি উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ায় তাহলে অজপাঁড়াগাঁর রত্নগুলোকে শাণিত করবে কে। এদেরকেও তো বড় হবার সুযোগ দিতে হবে। এমনটাই নাকি ইনজামের বক্তব্য। ওর এসব কথার কাছে হার মেনে রাহিমা চাচি এখন কিছু বলা ছেড়ে দিয়েছেন। সেই থেকে ছেলে এখানেই পড়ে আছে। সবশুনে ইশারাও মন্তব্য না করে পারেনি। সে বলেছে, ” ইনজি গায়ে গতরে বাড়লে কী হবে চাচি ! বুদ্ধিতে গবেটই রয়ে গেলো। এই গ্রামে কী কোন ফিউচার আছে আপনিই বলুন।”
শুনে রাহিমা হেসেছেন কিছু বলেন নি।

ঠুকঠাক শব্দ হচ্ছে। দুজন কিশোর একটা বড় চাদর ধরে আছে। আর ইনজাম চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে দেয়ালে পেরেক ঠুকছে। সম্ভবত ঘরের মাঝখানে চাদর ঝুলিয়ে ঘরটাকে দুভাগ করার ব্যবস্থা হচ্ছে। ইশারা আস্তে করে বাচ্চা ছেলে দুটোর হাত থেকে চাদরটা নিয়ে নিলো। ইনজাম তখনও বিশেষ মনোযোগে পেরেক ঠোকার কাজ করছে। পেছনের ঘটনা সম্পর্কে সে অবহিত নয়।

ঠোকার কাজ শেষে চাদর নেবার জন্য ঘুরে তাকাতেই ইলেকট্রিক শক খেলো ইনজাম। চাদর হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইশারা। ওকে তাকাতে দেখেই হাসলো সে।
ভ্রু নাচিয়ে বললো, ” কী রে চারচোখ ? তোর চশমা কই ? চাচি না বললে তো তোকে চিনতামই না।” ইশারার মুখে সেই পুরোনো দুষ্টু হাসি।
ইনজাম ওর কথার জবাব দিলোনা। ইশারা কিছুটা বিস্মিতই হলো এবার।

” কী রে ? আমাকে তুই চিনতে পারিসনি ? দেখলেই অমন পালাস ? বড়দের দেখলে যে সালাম দিতে হয় তাও জানিস না নাকি ? এই বুঝি তোর ধর্মীয় শিক্ষা ? ” বলে কপট রাগে মুচকি হাসলো ইশরা। যেন ইনজামের চালাকি ধরে ফেলেছে।

ইনজাম পাথরের মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলো। তারপর কিশোর দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো, “এ্যাই , তোমাদেরকে কী বলেছিলাম যে কেউ এসে চাইলেই চাদর দিয়ে দেবে? হ্যাঁ ? “শেষের শব্দটা ধমকের সুরে বললো ইনজাম। তাতেই বিস্মিত হলো ইশারা। সে একবার ইনজামকে আরেকবার কিশোরকে দেখলো।

অবাক বিস্ময়ে বললো, ” তুই ওদের বকছিস কেন ? চাদরটা তো আমিই নিলাম । কেমন কাঠখোট্টা হয়ে গেছিস তুই ? ” ইশারা এটা বলার সাথে সাথেই চিকন কণ্ঠে বললো কিশোরদের একজন বলে উঠলো,” আমরা দেইনি উস্তায। উনি টান দিলেন। আমরা ছেড়ে দিয়েছি।”

” হাপ্ ! চাদর ছেড়েছো কেন ? আবার বলো টান দিয়েছে। টান দিলেই দিয়ে দেবে নাকি ? বোকার দল।” ধমক মেরে কথাগুলো বলে ইশারার দিকে হাত বাড়ালো ইনজি তবে নজর ফেরালো না।
ভারি স্বরে বললো, ” চাদরটা দিন।” ইশারার বিস্ময় উপচে পড়লো এবার। তবে চাদরটা এগিয়ে দিলো না । ইনজাম বাচ্চা দুটোকে হাত তুলে ইঙ্গিত করলে তারাই ইশারার হাত থেকে চাদর নিয়ে নিলো।

ইশারা আর কোন কথা না বলে চুপচাপ ওদের কাজ দেখতে লাগলো দাঁড়িয়ে। হঠাৎ ওর মনে হলো ইনজাম বেশ অস্বস্তি বোধ করছে ওর তীক্ষ দৃষ্টির সামনে। অথচ একটা সময় কত চমৎকার ঠাট্টার সম্পর্ক ছিল ওদের। দুজনে কত গল্প ঠাট্টায় সময় পার করেছে। আর আজ?

চাদর মেলা হয়ে যাবার পর ইনজাম চেয়ার থেকে নামলে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো ইশারা। অনেকটা পথ আটকে দাঁড়ানোর মত করে। বললো, ” তুই বোধহয় আমাকে চিনিস নি ? আমি ইশারা। ”

” চিনবো না কেন। ভালো করেই চিনি।” বলে নিজের হাতুড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো সে। তাতেই রেগে গেলো ইশারা।

‘ তুই আমার দিকে তাকালে কী তোর চোখ খসে পড়বে। এ্যাই কাঠমোল্লা বান্দর, তাকা নয়তো আগের মতো ধাক্কা খাবি।”

” ইশারা। ঝামেলা করিস না। সর এখান থেকে।”শেষ পর্যন্ত পুরোনো মেজাজে তেতে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো ইনজাম। ইশারার রাগ এবার অভিমানে রূপ নিলো।

” ওহ..তারমানে আমাকে আপনি চিনতে পেরেছেন। তাহলে এতোক্ষণ বড় বড় ভাব নিচ্ছিলেন কেন? একটু আগে তো আপনি বলেও ডাকা হচ্ছিলো। হাতে পায়ে বড় হয়ে নিজেকে বিরাট হুজুর ভাবা শুরু করেছিস তাই না ? বড়দের সম্মানটাও করতে জানিস না। ”

” আমি তোকে সম্মান করি বলেই ওভাবে বলেছি। তুই তোকারী এই বয়সে মানায় না। আমরা এখন আর ছোট নেই যে সব কথায় তামাশা করবি। ”

” তাই নাকি ? তা এই বয়সে কী মানায় বলতো শুনি ?” ইনজাম জবাব দিলো না। ইশারা অভিমানাহত স্বরে বললো,” আব্বা মারা গেলো। একটা সান্ত্বনাবাক্য বলেছিস তুই আমাকে ? এটা কেমনতর দ্বীনদারী যে আপনজনদের বিপদে পাশে এসে দাঁড়াস না। চোরের মতো পালিয়ে বেড়াস।” ইনজাম চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো এবার। ইতোমধ্যে কিশোর দুটো চলে যেতে ধরলে ইনজাম ওদের আটকালো। তাতে ইশারার বিস্ময় বাড়লো।

” কী অদ্ভুত।তোর চোখে আমি তবে খারাপ মেয়ে? ”

” আমি কী তাই বলেছি ? ”

” বলিস নি তবে প্রথম দিন থেকেই না চেনার ভান করছিস। এখন ছেলেগুলোকে আটকালি। কেন ? তোর কী ধারণা ওরা না থাকলে আমি তোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো ? তোর রক্ত চুষে খাবো ? ” রাগে গলা আটকে গেলো ইশারার।

ইনজাম এবার সরাসরি ইশারার দিকে তাকালো। পরনারী ইশারার দিকে তাকানো প্রথম এবং শেষ চাহনী।

” তুই আমার গায়ের মাহরাম ইশারা। আমার মা বোন খালা ফুপু না। তোকে একাকী দেখলে শয়তান একা তোর মাথায় না আমার মাথায়ও ভর করতে পারে। তুই ঝাঁপিয়ে না পরলেও আমি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। জানিসই তো মানুষ মাত্রই ভন্ডামীর আঁধার।”

” তুই কোনটা ? ভন্ড না সাধু? ”

” কোনটাই না, সর সামনে থেকে। শহরে থেকে একদম ফাত্রা হয়ে গেছিস তুই।”

” আর তুই হয়েছিস ভন্ড।”

” এই তো ঠিক বুঝেছিস। এরপর থেকে আমার সামনে আর আসিস না।”

” এলে কী হবে ? জানিস দুদিন পর আমি তোর ভাবি হতে যাচ্ছি? গুরুজন। আর ভাবি মায়ের মতোন।”

” ভাবি কখনও মায়ের মতো না ইশারা। ভাই মরলে ভাবিকে বিয়ে করা যায়। সে মায়ের মতো হয় কী করে ? বোন হয় মায়ের মতোন। খালা ফুপু দাদি নানী এরা মায়ের মতোন। কারণ যারা মায়ের মতো বা বোনের মতো তাদের দিকে তাকালেও বাজে চিন্তা করা যায় না। কারণ তাদের সাথে বিয়েটাই হারাম। যারা তা নয় তাদের থেকে নজর সরিয়ে ফেলতে হয় নয়তো ওয়াসওয়াসা জন্মায় । যাক্, তুই এসব বুঝবি না। এবার দয়া করে সর আমার পথ থেকে। ”

চলবে,,

মা’ওয়া পর্ব-০৩

0

~মা’ওয়া~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০৩

ইশারাকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন ময়না বিবি। ইশারার নিজেও কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তবে এবার সে নিজেকে সামলে নিতে পারলো।
মৃদু অনুযোগের সুরে বললো , “এবার একটু কিছু খাও আম্মা। দাঁড়াও, আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি। ”

ময়না বিবি ধীরে ধীরে দুপাশে মাথা নাড়লেন। খাবেননা।
ইশারা কিছুটা তড়পে উঠলো, ” না খেয়ে থাকলে কার উপকার হবে শুনি ? বাবার যাবার সময় হয়েছে সে চলে গেছে। তোমাকে তো বাঁচতে হবে। না খেয়ে মরবে নাকি ? ”
ময়না ছলছলে চোখে ইশারার দিকে তাকালেন। চোখের পানিতে অন্যরকম দ্যুতি। হাত বাড়িয়ে ইশারাকে কাছে টেনে ফের হু হু করে কাঁদলেন। ইশারার কেন যেন হঠাৎ বিরক্ত লাগতে শুরু করেছে সবকিছু। উষ্মা চাপতে না পেরে বলেই ফেললো, ” তুমি এভাবে কাঁদলে আমি কাল পরশুই হোস্টেলে চলে যাবো। থাকবো না এখানে। কাঁদো তুমি সারাদিন বসে বসে ।”

রাগটা কাজে দিলো। এতোক্ষণে কথা বলে উঠলেন ময়না বিবি। দ্রুত বলে উঠলেন,” না, মা। তুমি যায়োনা। তুমি গেলে আমি একলা হইয়া যামু। এই দুইন্যাত আমার অহন তুমি ছাড়া আর কেউ নাই গো মা। আমি যে অহন এতিম।’ বলতে বলতে ময়নার চোখে পানিতে ভরে গেলো।

ইশারা এবার উঠে দাঁড়ালো। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে ঘাড় ফিরিয়ে বললো, ” স্বামী মরলে মানুষ এতিম হয়না আম্মা, হয় বিধবা। আর আমি যদি সত্যিই তোমার মেয়ে হয়ে থাকি তাহলে আমার কথা তোমাকে শুনতে হবে। অল্প হলেও খেতে হবে। পাশের বাড়ি রাহিমা চাচি আমাকে বলেছেন যে তুমি গতরাত থেকে না খেয়ে আছো। এদিকে এখন বাজে বেলা তিনটা। উঠো, হাত মুখ ধোও। আমি তোমার জন্য অল্প করে বিরিয়ানী নিয়ে আসি।”

” বিরানি খামু না মা। কয় আহে। আমারে তুমি দুইটা বিস্কুট দ্যাও, তাইতেই হইবো।”

” অসম্ভব। খালি পেটে বিস্কুট খেতে পারবে না তুমি । পেটে গ্যাস হবে। তারমধ্যে এখানকার বিস্কুটগুলোতে আটা আর ডালডা ছাড়া কিচ্ছু নেই। আমি দেখছি তোমার জন্য অন্য কিছুর ব্যবস্থা করা যায় কিনা। এ বাড়িতে তো নাকি চুলা জ্বালানো যাবেনা। এই নিয়মটা কেন তুমি জানো আম্মা ? ”

ইশারা চাইছে ময়না স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলুক। তার আচরণ ইশারার ভালো লাগছে না। বিছানা থেকে উঠে বসতে গিয়েই থরথর করে কাঁপছে। তাকাচ্ছেও কেমন ব্ল্যাঙ্ক চোখে। অনেক সময় বড় ধরণের শক পেলে মানুষ এমন ভারসম্যহীন আচরণ করে। ছোটমা কী আসলেই ভয়ঙ্কর শক খেয়েছেন ? নাকি বাইরে সবাই যা বলছে সেটাই ঠিক ? ছোটমা কী আসলেই অভিনয় করছেন ?

ইশারা বেরিয়ে এসে ঘরের পেছন দিয়ে রাহিমা চাচিদের বাড়ি চলে এলো। চাচির ঘরে ঢোকার মুখেই গতকালকের মুশকো জোয়ান পালোয়ানটাকে দেখে থমকে গেলো ইশারা। তবে ওরচেয়ে বেশি থমকালো ঐ পালোয়ানটা নিজেই। চাচির সাথে কোন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো সে। কথা অসমাপ্ত রেখেই দ্রুত ঘর ছাড়লো সে। ইশারাকে দেখে রাহিমা নিজেই এগিয়ে এলেন।

” কী রে মা ? কিছু বলবি ? ”

” চাচি একটু সাদা ভাত আর ডাল হবে ? আম্মার জন্য নিতাম। বাড়িতে চুলা জ্বালানো নিষেধ। আগামী তিনদিন চুলা জ্বালানো যাবেনা। বুঝতে পারছিনা কীভাবে কী করবো। আমার তো একটু গার্গেলও করা দরকার। গলাটা খুশখুশ করছে। ”

রাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” চুলা জ্বালাতে পারবে না কেন মা? এমন তো কোন নিয়ম নেই। তুমি বাড়ি গিয়েই চুলা জ্বালবে।”

“তাহলে গোধূলি যে বলছিলো…!”।

রাহিমাকে মাথা নেড়ে ফ্রিজের দিকে যেতে দেখে অর্ধেক বলেই থেমে গেলো ইশারা। রাহিমা ফ্রিজ থেকে খাবারের বাটি বের করতে করতে বললেন,” আমাদের দেশের মানুষজন সব কিছু নিয়ে একটা রহস্য রহস্য খেলতে ভালবাসে। নবী সাঃ বললেন, যাদের আপনজন মারা গেছে তাদের জন্য দিনটা কষ্টের। রেঁধে খাবার মানসিকতা থাকেনা। তোমাদের (আত্মীয়) উচিত তাদের খাবার পাঠানো। ব্যাস্, সেই ‘উচিত’ শব্দটাকেই এরা এভাবে নিয়েছে আর চুলা জ্বালানোকে হারাম করে দিয়েছে। কী আর বলবো রে মা !” বলতে বলতে ছোট্ট একটা টিফিন ক্যারিয়ারে তিনি সাদা ভাত, লাউয়ের বিচির ভর্তা, করলা ভাজি আর ডিমের দোঁপেয়াজা সাজিয়ে ফেললেন। ইশারা চোখ কপালে তুলে কিছু বলতে যাচ্ছিল। রাহিমার মৃদু ধমকে সে থেমে গেলো।

” এটা তুমি আর তোমার ছোট আম্মা দুজনেই খাবে। ভর্তাটা ভালো হয়েছে। খেয়ে দেখো। লায়লার মায়ের ভর্তার হাত অসাধারণ।”

” লায়লা কে ? ঐযে তখন যে মেয়েটাকে দেখলাম সেই মেয়েটা? ”

” হ্যাঁ। ঐটাই লায়লা। ”

” ওহ। চাচি আপনি এতো খাবার দিয়েছেন। সবটা তো খেতে পারবো না। রয়ে যাবে অনেকটা।

” সমস্যা নাই। বাকি খাবার ফ্রিজে রেখে দিও, রাতে গরম করে খেয়ে নেবে। আর গোধূলি চুলা জ্বালাতে মানা করলে ওকে জিজ্ঞেশ করবে চুলার পরিবর্তে ওভেন বা হিটার জ্বালানো যাবে কিনা। এটার হুকুম কী। ” বলেই চাচি মুচকি হাসলেন। আর তা সংক্রমিত হলো ইশারার মাঝেও। সারাদিনে এই প্রথম ইশারা হাসলো। বললো, ” আমি তাহলে যাই চাচি।”

” আচ্ছা এসো। ”

” ওহ , চাচি আরেকটা কথা জানতে চাচ্ছিলাম।” বলতে বলতে গেট থেকে ফিরে এলো ইশারা।

” দুপুরে দেখলাম একজন চাচাজানকে গোসল করিয়ে দিচ্ছেন। ওনাকে আমার খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো। আপনাকে জিজ্ঞেস করবো কিন্তু কথার তোড়ে একদম ভুলে গেছি তখন। কে উনি ? ”

” ওমাহ, উনি মানে কী। ও তো আমাদের ইনজি…!” রাহিমার কোঁচকানো মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেলো । ইশারার অবস্থা আরো শোচনীয়। অস্ফুটে উচ্চারণ করলো সে।

” ইনজি মানে ? আপনি কী আপনাদের ইনজিমামের কথা বলছেন ? মানে ঐ যে চশমা পরতো, শুকনো মতো…? ”

সুহাসিনী রাহিমাকে এবার দেখা গেলো আসল রূপে। তিনি হেসে গড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন ইশারার বলার ভঙ্গি দেখে। কী ভেবে নিজেকে সংযত করে নিলেন। ইশারার কাঁধ ছুঁয়ে বললেন,” ওর গল্প পড়ে অন্যসময় করা যাবে। এখন তোমার মায়ের কাছে যাও মা। তাকে একটু কিছু খাওয়াও।”

” ওহ হ্যাঁ। আচ্ছা, আমি যাই চাচি। ” বিস্ময়ের প্রবল রেশটুকু নিয়েই বাড়ি ফিরলো ইশারা। ওর মাথায় কোনভাবেই আসছে না একজন মানুষ এমন আমূল বদলে যেতে পারে কীভাবে। কোথায় পাঁচ বছর আগের সেই তালপাতার সেপাই। আর কোথায় এ ? এ তো যে দেখা যায় রীতিমত তাগড়া যুবক।

ঘরে ঢোকার মুখেই রুমানার মুখোমুখি পড়ে গেলো ইশারা। যদিও সে পেছনের পথ দিয়েই বাড়িতে ঢুকেছে। সেকারণেই হয়তো রুমানা টের পায়নি। ইশারাকে দেখে খানিক চমকে গেলেও দৃশ্যত নির্লিপ্ত রইলো।

ইশারা ঘরে ঢুকে রুমানাকে মায়ের সামনে বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলো। মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য যে সে আসেনি তা তো নিশ্চিত। তাহলে ঘটনা কী ! কৌতুহল চেপে মুখোভাব স্বাভাবিক রেখেই হাতের টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপর রাখলো ইশারা। ঘাড় ফেরাতে দেখলো ছোটমা একটা হলদে কাগজে টিপসই দিচ্ছেন।

ইশারাকে তাকাতে দেখে ওকে দুচোখের ঝাপটায় কিছু বোঝাবার চেষ্টা করলো রুমানা। ইশারা সেটাকে বিশেষ গুরুত্ব দিলো না। কাছে গিয়ে বললো, ” এটা কী রুমানা আপা ? ”

ততক্ষণে টিপসই দেবার কাজ শেষ। ইশারা কাগজটা হাতে নিতেই দেখলো সেটি একটি না-দাবি নামা। তাতে প্রথম পক্ষ এবং দ্বিতীয় পক্ষের দুটো কলাম রয়েছে। ছোট মায়ের টিপ সইটা প্রথম পক্ষের কলামে। নিচে ব্রাকেটে সনাক্তকারীর স্বাক্ষর রয়েছে। ইশারার বিস্ময় খানিক আগের বিস্ময়কে ছাড়িয়ে গেলো যা ইনজিমামের কথা জানার পর হয়েছিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” বাহ্, টিপসই দেবার আগেই সনাক্তকারী সই করে ফেলেছে ? সে জানলো কীভাবে এখানে কার সই হবে? ” ইশারা হাতের কাগজটা মেলে ধরলো রুমানার দিকে। সে ওটাকে ছোঁ মেরে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে বললো, ” সেটা তোর না বুঝলেও চলবে ইশারা।”

” হ্যাঁ, তা তো চলবেই। বাবা মারা যাবার পর তোমরা সবাই মিলে যা শুরু করেছো তা তো নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। দুটো দিনও যেতে দিলেনা। আজই তোমাদের সব ফায়সালা হওয়া চাই ? তোমরা এমন কেন করছো আপা ? সম্পত্তি কী পালিয়ে যাচ্ছে ? আর তোমরা কেন ছোটমাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করতে চাইছো ? তিনি কী বাবার কেউ নন ? ”

” চুপ কর। চ্যাঁচাবি না। সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আমার বাপের ভিটেতে। বিয়ে করে এখন ওয়ারিশ বনে গেছে। আমরা লালমিয়ার রক্ত। আমরা তার ওয়ারিশ। আর কেউ না। তাছাড়া তাকে তো আমরা ঠকাচ্ছি না। একটা ভালো এমাউন্ট তাকে দিয়ে দেয়া হবে। আর কী চাই ? ”

” এটা কত বড় অন্যায় ভাবতেও পারছো না। এতো তাড়াতাড়ি তোমরা এভাবে সবকিছু করতে পারছো কী করে রুমানাপু ? ” কান্না এসে কণ্ঠরোধ করলো ইশারার। ছোট মায়ের দিকে তাকালো। পাথরের মুর্তির মতো বসে আছেন ময়না বিবি।রুমানা ততক্ষণে চলে গিয়েছে। ইশারা ময়নার সামনে বসলো।

” তুমি টিপসই দিলে কেন মা ? ”

” ওরা চাইলো। ” অথর্বের ভঙ্গিতে কথাটা বললেন ময়না। শেষ করলেন ‘তাই দিলাম’ শব্দ দিয়ে।

” চাইলেই দিয়ে দেবে ? জানতে চাইবে না কিসের সই দিচ্ছো ? ”
ময়না তাকালেন। কিছু বলতে গিয়েও মুখ নামিয়ে নিলেন। ইশারা বিরক্তিচেপে উঠে গেল। একটা প্লেট ধুয়ে তাতে সামান্য ভাত আর ভাজি ভর্তা সাজিয়ে ছোটমায়ের সামনে ধরলো। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটা হাতে নিলেন। ইশারা পানি ঢালতে ঢালতেই তার নির্লিপ্ত আচরণ লক্ষ্য করছিলো।

একপর্যায়ে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ” খাচ্ছোনা কেন মা? খাও।”

ময়না ভাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ” লোকটা না খাইয়া আছে।”

ইশারা প্রথমে কথাটা ধরতে না পারলেও পরক্ষণে বুঝতে পেরে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,” খাও তো আম্মা। বাবা এখন খাওয়া খাদ্য গ্রহন করার অবস্থাতে নেই। এসময় কী হয় তা আমি পুরোপুরি জানি না। তবে যতটুকু বুঝি মৃতদের খাবারের দরকার হয়না। কাজেই এসব চিন্তা বাদ দাও আর ভাতটুকু খাও। অল্প করে দিয়েছি। সবটুকু খাবে। ”

ময়না ইশারার দিকে তাকালেন। ইশারার মনে হলো ছোটমা তাকিয়েও ওকে দেখছেন না। দৃষ্টিটা ফাঁকা।
বিড়বিড় করে বললেন, “জানো মা, আমার প্রথম স্বামী আমারে অনেক মারতো। রুজ মারতো। খারাপভাবে মারতো। আমি বাঞ্জা না মা। আমার পয়লা বাচ্চা হের ঘুষিতে প্যাটেই মরসে। আমি কোন দোষঘাট করলে আমারে সারা রাইত খাটের কিনারে খাড়া করায়া থুইতো। মাইর খাইতে আমার ততটা খারাপ লাগতো না, ক্যান, সৎমায়ের ঘরে বহুত মাইর খাইছি তো। সইয়া গেছে কিন্তুক সারারাইত খাড়ায়া থাকতে বড় কষ্ট অইতো। ঘুমে চোখ ভাইঙ্গা আইতো। একদিন মাটিতে বইস্যা দেওয়ালে ঠেস দিয়া ঘুমায়া পড়ছিলাম। তানি উইঠা আমারে দেইক্কা চেইত্যা গেলেন। আমারে না ডাইক্যা আচক্কা আইস্যা সিনার মইদ্যে ইমুন লাত্থি দিলেন যে আমার বামদিকের বুকে জখম অইয়া গেলো। আমি উয়াশ লইতে পারতাছিলাম না। হেই ব্যাথা আমার জখমে চাক্কা বানলো। ইমুন বিষ…!”

” আম্মা। প্লিজ থামো। এসব শুনতে চাচ্ছিনা। ”

” তুমার বাবার লগে বিয়ার পর তানি আমারে চিকিৎসা করাইলেন। ঢাকায় হইলোনা বইলা ইন্ডিয়াত নিলেন। আমার ব্যাদনা কমলো। আমারে তানি অবসর পাইলেই তুমার মায়ের গল্প শুনাইতেন।” ইশারা দেখলো বাবার কথা বলতে গিয়ে মুখটা কেমন আদুরে হয়ে গেছে ছোটমায়ের। ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধার চোখে কিশোরীর হাসি। ইশারা বিস্ময় নিয়ে ছোটমার চেহারা আর চোখগুলো দেখতে লাগলো। কেমন চকচক করছে ওগুলো।

” তানি বলতো, কেমনে কইরা তুমার মায় আর তানি ভাব ভালোবাসা করছে। শুইন্যা আমিও তুমার মায়ের মতোন কইরা তারে খেদমত করনের চ্যাষ্টা করতাম। তানি একদিন হাইস্যা কইলেন। এইসব বাদ দ্যাও। তুমি আয়নার মতো পারবানা। ডাইন হাতের কাম বাও হাতে অয় না। শুইন্যা আমি মুখ কালা করলে তানি বলতো, তয় বাও হাতের কামও ডাইন হাতে অয় না। তুমি তুমার মতোন থাকো। আয়নারে তার জায়গায় থাকতে দ্যাও। আল্লা সাক্ষী আমি পরতেক দিন নিজেরে আয়না বিবি বানাইয়া তানির খেদমত করনের চ্যাষ্টা করসি। তানি হাসতেন। তবু আমারে কিছু কইতেন না। কোনদিন বকাবাজি করতেন না। তুইমুই করতেন না। অামি আমার জীবনে এত সরমান পাইনাই যা তুমার বাপে আমারে দিসিল। ফকিন্নি থিকা রাজরানী হইসিলাম। তয় আমি আয়না হইতে পারিনাই। গতকাইল রাইতে কী হইসে জানো ? তুমার বাজান, আমারে ডাইক্কা কয়, তুমারে ছাইড়া যাইতে কষ্ট লাগতাসে ময়না পাখি। তুমি তো পুলাহান মানুষ। কেমনে সব সামলাইবা। শুইন্যা আমি তো বুবা হইয়া গেছি। ষাইট বচ্ছরের বুড়ি আমি। আমি পুলাহান কেমনে অইলাম। তানি কইলেন, মনে হয় বাঁচুম না। তুমার কাছে সত্য কই, তোমারে অামি অনেক ভালো পাইছি ময়না পাখি। তুমি অনেক ভালো মাইয়া। আল্লায় যিমুন তুমারে বেহেস্তে ফাডায়। আমি কইছি আফনে লগে থাইক্কেন তাইলেই অইব। সেয় কী জানি কইতে চাইলো তারপর চুপ মাইরা গেলো। এমুন চুপ মারলো। আর কতা কইলো না।” বলেই হাতের প্লেটটা সরিয়ে রাখলেন ময়না বিবি।

বললেন,” আমি ভাত খামুনা মা। আমার গলা দিয়া ভাত নামবো না।”

ইশারার চোখ ভিজে এসেছিলো। বারকয়েক ঢোক গিলে খুব হালকা গলায় বললো,” বাবার এখন তার প্রথম স্ত্রী আয়নাবিবির সাথে দেখা হবে। দুজনে কথা হবে। তোমার কথা এখন তার মনে থাকবে না। কাজেই না খেয়ে থাকাটা একদম অনর্থক । তারচে ঠিকমতো খেয়ে নাও আর বাবার জন্য দোয়া করো। তুমি না খেলে আমিও খাবো না বলে দিচ্ছি।”

কথাগুলো বলে ইশারা ময়না বিবির পাশে এসে বসলো। মৃদু স্বরে বললো ,” আচ্ছা, আমি কী তোমার কেউ না ? ”

ময়না বিবির চোখ এখন ভরা বর্ষার পশ্চিমাকাশ। কিছু বলতে যাবেন তার আগেই ইশারা তাড়া দিলো,” আর কোন কথা না। আগে চুপচাপ খেয়ে নাও। এতো
বারবার আর সাধতে পারবো না বলে দিলাম।”

জমাট কান্নাগুলোকে কলজে নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাসের সাথে বাষ্পাকারে বাইরে বের করে দিলেন ময়না। নিতান্ত অনীহাভরে ভাতের দানাগুলো নাড়াচাড়া শুরু করলেন। নিকট অতীতের সোনালী স্মৃতিগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। দিনগুলোর আকর্ষণ কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে যাচ্ছে কপালপোড়া ময়নাবিবির জন্য।

======

পরদিন রাহিমা চাচি নিজেই এলেন ইশারাদের বাসায়। ময়নাবিবির সাথে দেখা করতে। তাকে দেখে দু গ্লাস শরবত বানালো ইশারা। ইশারার ইচ্ছে চাচির সুবাদে ছোটমাও একগ্লাস শরবত খেয়ে নিন। ইশারার চালাকিটা ময়না বুঝতে পারলেও কিছু বললেন না। নির্বিবাদে খেয়ে নিলেন শরবতটা।

রাহিমা ইশারার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” আজ সকালে আখতার গিয়েছিলো আমার বাসায়। আজ রাতেই নাকি সালিশ বসাবে ? ”

ইশারা বিস্মিত হলো, ” কিসের সালিশ ? ভাইয়া তো আমাকে কিছুই বলে নি।”

” সেকি,, তুমি তাহলে কিছু জানো না ?

” না তো। কী বলেছে ভাইয়া ? ”

” না তেমন কিছু না। সালিশে যেন তোমার চাচাজান উপস্থিত থাকে সেটাই অনুরোধ করলো। এদিকে আরেক ঝামেলা বেঁধেছে। তোমার চাচাজান আজ তোমাদের বিচারে থাকতে পারবে না। আমাদের বাড়িতেই আজ এক মস্ত বিচার বসবে। তাকে ঐ বিচারে থাকতে হবে। তোমাদের বাড়ির সালিশটা কাল রাখলে ভালো হতো। আজ রাতের বিচারটা বেশি জরুরী। ”

” আমি তো কিছু জানিই না চাচি। আমাকে কেউ কিছু জানায়ও নাই। আপনি একটু কষ্ট করে যাবার আগে ভাইজানকে বলে যাবেন চাচি।”

” হ্যাঁ, তা তো বলতেই হবে। ঐ বিচারটা খুব জরুরী। ”

” ওহ্, কী নিয়ে ঐ বিচার চাচি ? জায়গা জমি? ”

” না রে মা। বিচারটা বড় জটিল। এক ছেলে তার নিজের মায়ের নামেই বিচার চেয়েছে।”

” মায়ের বিচার ? ঠিক বুঝলাম না চাচি।” ইশারা আগ্রহী হলো।

” আমাদের কিতাবখানারই একটা ছেলে। সেই তার মায়ের নামে বিচার চেয়েছে। ” বলে সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাহিমা। ইশারার কৌতুহল বাড়লো।

” মায়ের বিচার? কীসের ? ”

রাহিমা কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন। তারপর বললেন,
” ছেলেটার বাবা আমাদের এই গ্রামেরই একটা ছোটখাট মসজিদের ইমাম। বয়স কম, স্ত্রীও অল্পবয়সী। তাদের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে এই ছেলেটাই বড়। মেয়ে অনেক ছোট। দুই ভাই বোন। মাত্র দুই মাস আগে ইমাম সাহেব মারা গেছেন। ছেলেটা হঠাৎ তার মায়ের চারিত্রিক সমস্যা নিয়ে বিচার চাইতে এসেছে তোমার চাচাজানের কাছে। সবাই বলছে, ইমামের বৌ কে দোররা মারা উচিত। সেই নিয়েই সালিশ। আমাদের বাড়িতেই বসবে এই সালিশটা।”

ইশারার কষ্ট বাড়লো। চারিদিকে এসব কী হচ্ছে। একজন ইমামের স্ত্রী হয়ে পদস্খলন ঘটবে এটা কেমন ধরণের কথা !

ইশারা ছটফটিয়ে উঠে বললো, ” চাচি, আমি কী এই বিচারের সময় উপস্থিত থাকতে পারি ? ”

” না, মা। মহিলাদের তো বিচারে থাকার অনুমতি নেই।”

” তাহলে ইমামপত্নী নিজের পক্ষের সাফাই দিবেন কীভাবে। ছেলে যদি তার নামে মিথ্যে অপবাদ দেয় ?”

” নিজের ছেলে মিথ্যে অপবাদ দিবে ? ” রাহিমা প্রশ্ন করলেন। তারপরই বললেন, ” ইমামের স্ত্রীকে আসতে বলেছে তোমার চাচা। সে আমার ঘরে বসে থাকবে। তার যা বক্তব্য সে আমাকে বলবে। আমার কাছ থেকে শুনে ইনজি ওর বাবাকে জানাবে। এভাবেই হবে সালিশটা।”

” চাচি প্লিজ আমি থাকতে চাই আজকের সালিশটাতে। আমাকে থাকার অনুমতি দিন।”

রাহিমা খানিক ইতস্তত করলেন। ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন,” ইনজিটা বড় রাগ করে এসব বিচারে বাইরের কাউকে রাখলে।”

” আশ্চর্য, ইনজির এতো বড় সাহস সে আমাকে বাইরের মানুষ মনে করে ? ওকে বলবেন, তোর ইশারা বুবু থাকতে চাইছে বিচারে। তুই ঝামেলা করলে তোর কান মলে দেবে সে। ”

চলবে,,

মা’ওয়া পর্ব-০২

0

~মা’ওয়া~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০২

বাদশাহ আলমগীর—
কুমারে তাহার পড়াইতো এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ -শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরু চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধূলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।

ইশারাকে দেখেই থেমে গেলো মেয়েটা। চট করে মুখ ঘুরিয়ে একবার শিক্ষিকাকে দেখলো। তারপর আরেকদফা ইশারাকে। এবার শিক্ষিকার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলো মেয়েটা।
মিহি সুরে ডাকলো ,’ নানিই…।”
শিক্ষিকা তখনও মগ্ন হয়ে সেলাই ফোঁড়াই নিয়ে কসরত করেই যাচ্ছেন। পুঁচকে ছাত্রীর রিনরিনে কণ্ঠ তার কানে পৌঁছেনি। তবে আবৃত্তিকারকের থেমে যাওয়া তাকে সচকিত করেছে।
মগ্নতার রেশ কাটিয়ে মুখ তুললেন ,” কী হলো থামলি কেন রে লায়লা..? ” বলতে বলতেই সামনে দাঁড়ানো ইশারাকে দেখলেন তিনি। চশমার কাঁচটা ওপর নিচ করে ঠাহর করার চেষ্টা করলেন বারদুয়েক।
ইশারা সালাম দিলে ত্রস্তে হাতের সরঞ্জাম একপাশে সরিয়ে রাখলেন। কিছুটা ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন,” তুমি লালমিয়া ভাইয়ের ছোট মেয়ে জুমানা ইশরাত না ?”

” জি, চাচি। ” বলেই মলিন হাসলো ইশারা। চাচি ওকে ওর পুরোনামে ডাকেন। শুধু ইশারা বলতে নাকি ভাল লাগেনা। সামান্য ঝুঁকে তার পা ছুঁতে গেলে তিনি সভয়ে পা টেনে নিলেন। একইসাথে খপ করে ইশারার হাত দুটো ধরে ফেললেন।

” না না, পা ছুঁয়ে সালাম করোনা মা। পা ছুঁয়ে না।” বলতে বলতেই বিছানা ছাড়লেন তিনি। এরই মধ্যে ছাত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন ,” আজ এ পর্যন্তই থাক রে লায়লা। আজ তোর ছুটি। ”
লায়লা আনন্দিত মুখে আরেকবার ইশারাকে দেখলো। শুধু আনন্দবোধ না, কিছুটা কৃতজ্ঞতাও মিশে আছে বুঝি ঐ চকচকে চোখ জোড়ায়। ইশারার এমনটাই মনে হলো। ভাল লাগলো দেখে যে এরা অল্পতেই কত খুশি ।
ইশারার হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানার পাশে রাখা সোফাটায় বসলেন হাকিম মোল্লা চাচার স্ত্রী রাহিমা বেগম। স্নেহভরা চোখে ইশারাকে ভাল করে দেখে মাথায় হাত রেখে বললেন,” কেমন আছো মা ? ”

মাথা নাড়লো ইশারা। তারপর চাচিরই বলা একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ায় বললো, ” আলহামদুলিল্লাহ।”

” বাহ্ সুন্দর জবাব। আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল। সর্বাবস্থায় প্রশংসা শুধু আল্লাহর জন্যই। তা মা তুমি আজ আসতে এতো দেরি করলে কেন ? ওরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলো তোমার জন্য।”

ইশারা মুখ নামালো এ কথায়। ওকে নিরবে কাঁদতে দেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন রাহিমা বেগম। তাতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো ইশারা। বিড়বিড় করে বাবার চলে যাওয়া আর দেখা করতে না পারার আক্ষেপ ঝরে পড়লো সেই কান্নাতে। তবে তা বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারলো না রাহিমার কারণে। তিনি সযত্নে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন,” ছিঃ এভাবে কাঁদে না মা। কিছু কান্না মাইয়্যাতের জন্য আযাবের কারণ হয়। এসব বলেনা। সবর করো।আল্লাহতা’লা আমাদের দুনিয়াতে পাঠানোর আগেই তো সব বলে নিয়েছেন। আমাদের জানানো হয়েছে, যে একদিন আমাদের সবাইকে তাঁর কাছেই ফিরতে হবে। একথা জানার পর এতো কান্নার যৌক্তিকতা কী বলো ? ”

” কান্না পেলে কী করবো বলুন? আমার যে আপন বলতে কেউ রইলো না চাচি। বাবা আমাকে কতটা স্নেহ করতেন তা তো আপনি জানেন। আমার নিজেরও একমাত্র আহ্লাদের জায়গা ছিল বাবা। এই মায়া অগ্রাহ্য করি কী করে চাচি।”

” হ্যাঁ, তা ঠিক। অগ্রাহ্য করার উপায় নেই আর করবোও না। আমাদের মায়াও লাগবে আমরা কাঁদবোও। বরং মায়া তো আল্লাহর রহমত যা বান্দার মনে মাখনের মতো জমে থাকে। সামান্য উত্তাপেই গলে গলে জল হয়ে ঝরে পড়ে। কিন্তু কান্নার সময় মুখ বন্ধ রাখতে হবে মা। কারণ কান্নার সময় মুখ দিয়ে যা বের হয় তা প্রলাপ, বিলাপ, সত্যের অপলাপ। পুরোটাই শয়তানের কাজ। আর কাঁদতে কাঁদতে আবেগে বলা কথা থেকেই রবের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পেয়ে যায়। এই যে বললে, বাবা আর কটা দিন কেন থাকলো না। এটা একদম ভুল কথা। তিনি ততদিনই ছিলেন যতদিন থাকা তার জন্য কল্যানকর ছিল। ”

কথাগুলো শোনার পর ইশারা এবার নিজেকে সামলে নেবার প্রয়াস পেলো। চোখ মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলো।
রাহিমা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললেন,” আল্লাহতা’লা আমাদের সবকিছু বলে কয়েই এখানে পাঠিয়েছেন। বেঁচে থাকার প্রতিমুহূর্তে আমরা জানি মারা যেতে হবে। তবু মৃত্যুর মুহূর্তে আমাদের আহাজারি বেরিয়ে পড়ে। সাহাবীদের এমনটা হতো না। তাঁরা সবর করতেন। কারণ তারা প্রতিদিনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতেন আর আমরা অপেক্ষা করি দীর্ঘজীবনের। কান্না কী আর সাধে বেরোয়?”

” এভাবে ভাবতে গেলে তো দুনিয়াতে মন বসাতে পারবো না চাচি। সারাক্ষণ মনে হবে কেন এতো কিছু ? এই যে আমি কষ্ট করে লেখাপড়া করছি। এতো দৌড়ঝাঁপ। তাহলে আপনিই বলুন, কেনই বা এতো কষ্ট আর কিসের এতো আয়োজন। সব যদি শেষই হয়ে যায় ? তাহলে আমার ডাক্তারি পড়ে লাভ কী ?তখন মনে হবেনা ঘরে বসে থাকি? ” ইশারা বলে চললো। রাহিমা মন দিয়ে ইশারার ক্ষেদোক্তি অনুভব করলেন। ইশারা তখনও ঘাড় বাঁকা করে বলে চলেছে,” এভাবে ভাবলে তো আমরা আর এগোতেই পারবোনা চাচি। তখন তসবিহ আর জায়নামাজ নিয়েই পড়ে থাকতে হবে। দুনিয়া আর আখেরাত কী এক করে ভাবা সম্ভব ? ” ইশারা থামলো। রাহিমা মুচকি হাসলেন।

” কেন সম্ভব না মা ? আখিরাতের জন্যই তো এই দুনিয়াটা। আখিরাত পেতে হলে দুনিয়ার বিকল্প নেই। দুনিয়াকেই আখিরাতের জন্য প্রয়োজন। যেমনটা প্রয়োজন হয় নৌকা চালাতে পানির। পানির পরিমান বেশি হলে নৌকা ডুবে যাবে আর কম হলে চড়ায় আটকে যাবে। তেমনই দুনিয়া বেশি হলে তুমি ডুবে যাবে আর দুনিয়া কম হলে চড়ায় আটকে যাবে। দুনিয়া যথেষ্ট না পেলে আখিরাত পাবে কী করে বলো ? আর রইলো তোমার ডাক্তারি। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সুস্থ থাকা জরুরী। কাজেই তোমার এই ডাক্তারি পড়া মোটেও অনর্থক নয় মা বরং এটা অনেক বেশি জরুরী। নইলে আমাদের মুসলিম মহিলাগুলো কাদের কাছে যাবে চিকিৎসার জন্য বলো তো ? মুসলিম মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য পেশাগুলোর মধ্যে অবশ্যই ডাক্তারি একটি। যেগুলো নিষেধ করা হয়েছে সেগুলোর কোনটাই জীবনের প্রয়োজনে নয়। তোমার কী মনে হয় নেচে গেয়ে শরীর প্রদর্শন করে বেড়ানো কী একজন মহিলার জন্য জরুরী? অবশ্যই না। বরং ঝুঁকিপূর্ণ। আর এখানেই ইসলামের নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু ইবলিশ আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে ইসলাম কাঠখোট্টাদের ধর্ম। মেয়েদের বন্দি করে রাখার ধর্ম। অথচ ইসলাম শতভাগ নারীবাদী একটা ধর্ম। এই ধর্ম মেয়েদের অধিকার আর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যপারে যতটা সোচ্চার ততটা অন্য কোন মতবাদে নেই। ইসলাম নারীদের সমানাধিকারে না ন্যায্য অধিকারে বিশ্বাসী। আমরা তো বোকা, তাই ঠেলাঠেলি করে অধিকার আদায় করতে যাই যেখানে আমাদের প্ল্যাটফরমই আলাদা। দেখো মা পৃথিবীতে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। এতোবড় জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে বিশ্বের কোন দেশ মাথাতুলে দাঁড়াতে পারবে না। আমাদেরকে তাদের লাগবেই। তারা আমাদের নায্য অধিকার দিতে বাধ্য। কিন্তু দেখো আমরা মেয়েরাই তাদের কাজ কত সহজ করে দিয়েছি। তারা এখন আমাদের ঘরে বাইরে খাটিয়ে মারে আর আমাদের দিয়েই পয়সা রোজগার করে। বিনিময়ে আমাদের সামনে স্বাধীন আর বিখ্যাত হবার মূলোটা ঝুলিয়ে রাখে। আর আমরা আবেগি মেয়েগুলো ধরে নেই আমরা স্বাধীন। আমার জানামতে পুরুষের মনোরঞ্জন না করে ঐসব পেশায় তুমি দাঁড়াতেই পারবে না। ইসলাম আমাদের শুধু সেসব পেশাতে যেতে মানা করে। ডাক্তারি পড়তে মানা করেনা। শিক্ষকতা করতে মানা করেনা। নার্সিং মানা করেনা। নিরাপদ আর বৈধ ব্যবসা করতে মানা করেনা।

ইশারা স্বস্তির হাসি হাসলো এবার। তবে রাহিমার হাসি ম্লান হয়ে এলো।
“তোমরা কখনও ভেবে দেখেছো মা, আজ যদি পৃথিবীর তাবৎ মহিলা তারকারা একসাথে শোবিজ জগত ছেড়ে ঘরে বসে যায় তাহলে কার সবচে বড় ক্ষতি হবে ? ক্ষতি তাদেরই হবে যারা মেয়েদের পণ্য বানিয়ে বাজারে ব্যবহার করে। পৃথিবীর বহু সাম্রাজ্যবাদীদের পতন ঘটে যাবে। তারা স্রেফ ধ্বসে পড়বে।শত শত কোম্পানী পথে বসে যাবে। বহু ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে যাবে। কারণ আমরা মহিলারা নিজেদের জান-জীবন, যৌবন, সততা আর সৌন্দর্য দিয়ে সংসারকে উচ্ছন্নে ফেলে তাদের গোডাউন ভরে দিচ্ছি। তাদের মালামাল করে দিচ্ছি সামান্য কিছু অর্থ আর সুনামের আশায়। মনে আখিরাতের ভয়টা থাকলে আমরা মেয়েরা এতোটা বিগড়ে যেতাম না। বুঝেশুনে চলতাম। চারিদিকে তাকিয়ে দেখো মেয়েরা সৌন্দর্য লুকালেই নিয়মনীতি আর ইউনিফর্মের রব উঠছে অথচ সেজেগুজে বেরোলে সেটা অটোমেটিক নিয়মে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। কারণ আমরা পর্দায় গেলে তাদের লস। এতো সহজে তারা এটা হতে দেবেনা। এই বুঝ সব মেয়েদের আসতে আসতে পৃথিবীই ধ্বংস হয়ে যাবে মা। কাজেই আখিরাত নিয়ে না ভেবে অন্তত আমাদের মুসলিমাদের কোন উপায় নেই। কারণ আমরা বিশ্বাস করি পৃথিবী ক্ষণিকের। ” বলে রাহিমা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
ইশারা আবারও মুগ্ধ হলো চাচির কথা শুনে। ওর মনে হলো আসলেই রাহিমা চাচি বেশ ভাল বলতে পারেন। ছোটবেলাতেও সে দেখেছে চাচি যখন মহিলাদের তালিম দিতেন তখন সে নিজেও বসে বসে শুনতো মাঝেমধ্যেই।

ইশারা জানে গোটা গ্রামে সুভাষিনী বলে সুনাম আছে চাচির। তবে তিনি শুধু সুভাষিনীই নন সুহাসিনীও। সুন্দর করে হাসেন চাচি। তাঁর মেধা সম্পর্কেও অনেক কথাই শুনেছে ইশারা। তিনি নাকি খুব অল্প বয়সেই হিফজ সম্পন্ন করেছেন। জ্ঞান হবার পর থেকে সে নিজেও দেখে আসছে চাচিকে। বড়ই বুদ্ধিমতী মহিলা তিনি। চাচির ছেলেমেয়ে গুলোও ঐ পদেরই। চাচির মতোই মেধাবী। চাচি তার পুরো যৌবনকালই হাকিম মোল্লা চাচার মাদ্রাসার পেছনে ব্যয় করেছেন। তার কাছ থেকে শিখে কতশত ছাত্রী যে নিজেরা মাদ্রাসা দিয়ে বসেছে তার সংখ্যা চাচি নিজেও হয়তো জানেন না। চাচার গড়া মাদ্রাসার মহিলা বিভাগে মুহতামীম হিসেবে আছেন অনেকদিন ধরেই। চাচির ছেলেমেয়েরাও সবাই দেশে বিদেশে বিভিন্ন কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত আছে। ইশারা জানে চাচির বড় ছেলে আশরাফ ভাই ঢাকার কোন এক নামকরা মসজিদের ইমাম ও খতিব। মেজ ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সেজছেলে সাহেদ তো আরো একধাপ এগিয়ে। সে ঢাকার নামকরা একটা সরকারী হাসপাতালে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। ইশারার সাথে একসময় বেশ সখ্যতাও ছিল এই সাহেদের। সাহেদ ভাই যখন মেডিকেলে পড়েন ইশারা তখন সবেমাত্র স্কু্ল শেষ করার পাঁয়তারা করছে । চাচির দুই মেয়ের দুজনই গৃহিনী। তবে তাদের একজন তার শ্বশুরবাড়ি এলাকায় ছোটখাট মাদ্রাসা চালায়। অপরজন একটা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করে বলে শুনেছে ইশারা। সবচেয়ে ছোট ছেলেটা ইশারার সমবয়সী বা মাস ছয়েকের ছোট হবে। শেষবার যেবার এসেছিলো সেদিনই শুনেছে সে নাকি ভারতের বিখ্যাত একটা মাদ্রাসায় চান্স পেয়ে সেখানেই পড়াশোনা করছে গত দুই বছর ধরে। তবে বাকিদের সাথে কমবেশি দেখাসাক্ষাৎ হলেও চাচির ঐ ছেলেটার সাথেই ঠিকমতো দেখা হয়নি ইশারার। ইশারার এসএসসি দেবার আগেই সে ঢাকা চলে গিয়েছিলো। তখনই একবার দেখা হয়েছিলো। রোগাপটকা শরীর আর চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা। ওকে দেখলেই চশমা টান দিয়ে নিয়ে নিতো ইশারা আর বলতো কয় আঙ্গুল বল্ তো ? ”

রাহিমা এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেলেন। আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন। ইশারার কলেজের খোঁজখবর নিলেন। একপর্যায়ে আবছাভাবে জানতে চাইলেন,” তোমার ফুপুরা কেউ আসেনি? তাদের কাউকে দেখলাম না যে !”

” জি না চাচি। ফুপিদের খবর দেয়া হয়নি।” জড়ানো কণ্ঠে জানালো ইশারা। বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই ফুপুদের সাথে ওদের ভাইবোনদের দুরত্ব বেড়ে গেছে কারন তারা বাবাকে সমর্থন করেছিলো। এ কারণেই তাদের কাউকেই জানানো হয়নি খবরটা। রাহিমা শিউরে উঠলেন।

” সেকি ? ওদের জানাওনি ? এটা তো ঠিক হলো না মা। হাজার হোক তোমার বাবা তাদের ভাই।”

” তা তো ঠিক আছে চাচি। কিন্তু কে খবর দেবে বলুন ? সবাই তো এখানে আছে সম্পত্তি বন্টনের ধান্ধায়।” বলতে গিয়ে লালচে হলো ইশারার চেহারা।

রাহিমা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গান্তরে বললেন, “আচ্ছা, তুমি একটু বসো। আমি তোমার জন্য শরবত করে আনি।”

” না চাচি আমি কিছু খাবো না এখন। ঐদিকে বাড়িতে সবাই বসে আছে। আমি বরং যাই।”

” এখানে আর কদিন আছো তুমি ? ”

” এই তো ছুটি ফুরালেই চলে যাবো। এমনিতেও আমাদের কলেজ আগামী কাল থেকে এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ দিয়ে দিচ্ছে। আমি বাবার খবর পেয়ে একদিন আগেই চলে এসেছি আরকি।”

” ওহ আচ্ছা। এরপর থেকে ছুটি হলে কী আর গ্রামে আসবে ? ‘

ইশারা মুখ নামালো,” কার কাছে আসবো চাচি। এখানে কার বাসায় থাকবো ? গ্রামে তো আমার কেউ রইলো না। ”

” ঢাকায় কোন বোনের বাড়িতে উঠবে বলে ভেবে…!”

” না চাচি। আমি আগেই ঠিক করেছি আমি কোন বোনের বাড়ি থাকবোনা।” রাহিমার কথা শেষ করতে না দিয়ে আগেভাগেই বলে বসলো ইশারা। শুনে রাহিমা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মৃদু স্বরে বললেন,” তোমাকে নিয়ে তোমার বাবা খুব চিন্তা করতো জানো। তোমার ছোট মা এটা নিয়ে আমার সাথে কয়েকবার কথা বলেছে। ময়না চাইতো তোমার ব্যপারে আমি তোমার বড় ভাই বোনদের সাথে কথা বলি। হয়তো এটা তোমার বাবারও ইচ্ছে ছিল কিন্তু এরপরেও ময়না ভাবি একা এতোটা সাহস পেতেন না। তিনি তোমার আপন মা তো নন।”

” কী ব্যপার নিয়ে চাচি ? ”

” তোমার ভবিষ্যত নিয়ে মা।” কিছুটা ইতস্তত করে বলেই ফেললেন রাহিমা।

ইশারাকে দমে যেতে দেখে ফের বললেন,” আমি নিজেও তোমাকে বলি মা। তুমি এভাবে আর একা থেকোনা। আপাতত কোন ভাই বা বোনের সাথে গিয়ে ওঠো আর যত দ্রুত সম্ভব নিজের চারপাশে বেড়া দাও।”

” বেড়া মানে ? ” বড় বড় চোখ মেলে তাকালো ইশারা। রাহিমা হাসলেন ইশারার অজ্ঞতায়।

” বেড়া মানে বোঝোনি ? বেড়া মানে স্বামী। মেয়েরা যদি ফুল বাগান হয় তবে স্বামী হয় তার বেড়া। যার বেড়া যত মজবুত তার বাগান তত সুরক্ষিত। ”

” ওহ্, এগুলো তো পুরোনো দিনের কথা চাচি। আর আমি এখনই বিয়ের কথা ভাবছিনা। আমার এখনও পড়াশোনা বাকি।” আরক্তমুখে বললো ইশারা।

রাহিমা ইশারার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ” যুগ কখনও বদলায় না মা। বদলায় মানুষ। দুইশো বছর আগেও সূর্য পূর্বে উঠতো আর পশ্চিমে অস্ত যেতো আজও তেমনই। নারী জাতি সে যুগেও নারী ছিল আর এ যুগেও সে নারীই। তার কাঠামো বদলায় নি। বরং বদলেছে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। যাই হোক, এটা তোমার নিজেকেই ভাবতে হবে।

রাহিমা আরো কিছু বলতে গিয়েও আর বললেন না। তার নিজের কিছু গোপন ইচ্ছে মনের কুঠুরিতে গোপনই রেখে দিলেন। তবে ইশারার মত না নিয়ে তিনি তার ছেলের সাথে কথা বলার পক্ষপাতি নন। ইশারার মতটা জেনেই তবে সাহেদকে জানাবেন। ওরা দুজনেই ডাক্তার। সম্পর্কটা মন্দ হবেনা। ইশারা মেয়েটার ভেতর দ্বীনের বুঝ কম হলেও মেয়েটার ব্যাসিক ভালো। হেদায়েতেরও লক্ষণ আছে। তবে আজই এসব কথা বলাটা ভাল দেখাবে না। বেচারির বাপটা আজই মারা গেলো। দুটো দিন যাক। ভেবে নিজেকে প্রবোধ দিলেন রাহিমা।

রাহিমা বেগমের সাথে আরো কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজেদের বাড়িতে ফিরে এলো ইশারা।
বাড়িতে ফিরেই অবাক হয়ে গেলো সে। বাড়ির পরিবেশ আমূল বদলে গেছে। পুরো বাড়িতে যেন উৎসবের আমেজ। এ যেন বিয়েবাড়ি। অন্তত খুব বেশি পার্থক্য নেই। দুপুরের জন্য খাবার এসেছে কোন এক প্রতিবেশির বাড়ি থেকে। বিশাল একটা ডেগ ভর্তি বিরিয়ানী। ঢাকনা সরাতেই সুঘ্রানে ভেসে উঠলো পুরো উঠোন।

বড় ভাই আখতারকে দেখা গেলো লোকজনকে আদেশ করছেন উঠানেই চেয়ার আর টেবিল ফেলার জন্য। সম্ভবত উঠানেই খেতে বসার বন্দোবস্ত করা হবে। কে যেন একজন ত্রিপল টানাতে গেল।

আখতারুজজ্জামান ইশারাকে দেখেই বললেন,” বুঝলি ইশারা। যে কদিন গ্রামে আছি। সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া করবো। তাই নকল ডাইনিং স্পেশ বানিয়ে ফেললাম। ঘুঘু পাখির ডাক শুনবি আর খাবি। হা হা…মনের ভু্লে হাসতে গিয়েও সামলে নিলেন নিজেকে।

ইশারা কিছু না বলে বারান্দায় উঠে এলো। সেখানে বড়আপা আর তাদের শ্বশুড়বাড়ির লোকদের জটলা দেখে এড়িয়ে যেতে চাইলো সে। সবারই একটা বাড়তি আগ্রহ যেন ওকে ঘিরে। দেখলেই থুতনী নেড়ে, ‘ আহারে সিয়ানা মাইয়াটা’ শুনলেই গা জ্বলে যাচ্ছে ইশারার।

গোধূলির পাশ দিয়ে যাবার সময় বাধা পেলো। ওর কাঁধ খামচে ধরে ওকে থামালো গোধূলি। চাপা ক্রোধে বলতে লাগলো,” বড়আপার কান্ডটা দেখেছিস ? গুষ্টিশুদ্ধ ডেকে এনেছে। আর এরা এমন হাভাতে গোষ্ঠী বলামাত্রই সব দলবেঁধে বসে গেলো। বড়আপা এখন এগুলারে খেতে বসাবে। খাবার শর্ট পড়বে দেখিস তুই।”

গোধূলির কথার জবাব না দিয়ে নিরব বিস্ময়ে বড়বোনদের নির্লজ্জ কান্ডজ্ঞানহীনতা দেখতে দেখতে নিজের মনেই মরমে মরে যেতে লাগলো ইশারা। মাসুমার শ্বশুরবাড়ি পাশের গ্রামেই। প্রতিবেশি আত্মীয় বলে তারা সবাই দলবেঁধে এসেছিলো এখানে। উদ্দেশ্য রথ দেখার পাশাপাশি কলা বেচা। ঘটনা সেরকমই মনে হচ্ছে। কারণ বড়আপার সাথে যারই দেখা হচ্ছে তাকেই তিনি ধরে ধরে শোনাচ্ছেন ,” আরে, আগামী দুতিনদিন তো কোথাও নড়তেই পারবো না। বাবা চলে যাবার খবরটা শোনার পর থেকেই শরীরে জোর পাচ্ছিনা আমি। এদিকের শ্বশুরবাড়িও যাওয়া দরকার। তাই ওদেরকেই ফোনে ডাকলাম যে তোরাই আয়…।”

ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইশারা। মৃদু স্বরে বললো, ” আমি বিরিয়ানী খাবোনা, তোমরা খাও। ইনশাআল্লাহ, শর্ট পড়বেনা। ”

” আহা ঢং। তোর একজনের খাবার যেন দশজন খাবে। ”
ইশারা জবাব না দিয়ে সরে যেতে ধরলে গোধূলি হঠাৎ ওর কব্জি চেপে ধরে বারান্দার একপাশে টেনে আনলো। ওর কান্ড দেখে অবাক না হয়ে পারলো না ইশারা। গোধূলি ওর গলার স্বরকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের খাদে নামিয়ে এনে বলতে লাগলো ।

“ইশু শোন্, রুমানা কিন্তু তোকে ওর দেবরের জন্য বাগাবার তালে আছে। তুই একদম সরাসরি মানা করে দিবি।”

-” মানে ? ” শূণ্য চোখে তাকালো ইশারা। গোধূলির কথাগুলো বুঝতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে ওর।

” মানে আবার কী ? নিজের ডাক্তার বোনকে দিয়ে দেবরের উপর ছড়ি ঘোরাবে। সবাই জানে তুই শান্তশিষ্ট নরম প্রকৃতির। কাজেই তোকে অপারেট করা সহজ। রুমানা তো আর এমনিতেই দেবরের নাম নেয়নি। এক ঢিলে দুই পাখি মারবে রুমানা। আমি নিশ্চিত এটা ওর নগদ চাল। দেবর বিয়ে করতে চাইছে টাইছে এসব কিছু না। বরং রুমানাই তোকে দিয়ে ওর মালদার দেবরকে বাগাবে। বুঝেছিস কিছু ? রুমানা তো নিজেকে বেশি চালাক মনে করে। ভেবেছে কিছু বুঝিনা। হাড়ির একটা দানা টিপলেই পুরো হাঁড়ির খবর জানা হয়ে যায় আমার।”

” আমাকে দিয়ে বাগাতে পারবে কে বললো? ” নির্বিকার ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো ইশারা। সে গোধূলিকে যতোই দেখছে ততই যেন অবাক হচ্ছে। এই মানসিকতা নিয়ে সে ব্যাঙ্কে চাকরি করে কীভাবে অাল্লাহই জানে। হঠাৎই চাচির একটা কথা আবছা ভাবে একটা কথা মনে এলো ওর। এই দুনিয়ায় আসলে কেউ কারো না। সবাই স্বার্থপর।

” আপা, আমি ছোটমার কাছে গেলাম।” বলে গোধূলির হাত ছাড়িয়ে ভেতর দিকে পা বাড়ালে ফের বাধা পেলো।

” এ্যাই দাঁড়া। বিরিয়ানী না খেলে কী খাবি তবে ? ”

” খিদে পায়নি এখনও। আর পেলেও সাদা ভাতই খাবো। ডাল দিয়ে।”

” সেকি। ভাত কোথায় পাবি ? ” চোখ কপালে উঠলো গোধূলির।

” কেন রেঁধে নেবো।”

” তুই কী পাগল ? আগামী তিনদিন এ বাড়িতে চুলা জ্বলবে না। এতে মৃতের অমঙ্গল হয়।”

” কেন ? চুলা জ্বালানোর সাথে মঙ্গল অমঙ্গলের কী আছে ? ”

” অতশত জানিনা বাপু। মুরুব্বিরা যা শিখিয়েছে তাই মানছি। ”

” আমি ভেতরে গেলাম গোধূলি আপা। ছোটমা ঘরে একা। তার সাথে কারো থাকা দরকার।”

” আরে দুর। একা….হুঁহ, ন্যাকা। গিয়ে দেখ, সে এখন মহাসুখে আছে। মনে মনে লাড্ডু ফুটছে । বড় পুকুর পাবার আশায় সে এখন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। ”

” তুমি কীভাবে জানলে আপু ? ” ইশারা চেয়ে রইলো গোধুলির দিকে। কোন ফাঁকে এতো জটিলটা ভর করলো গোধুলির মনে কে জানে। কত নির্বিচারে মন্তব্য করে যাচ্ছে সে।

” জানা লাগে নাকি ? সে তো আমার বাবাকে বুড়ো দেখেই বিয়ে করেছিলো। ভালো করেই জানতো বুড়ো আগে মরবে। তাহলে সম্পত্তির লোভে বিয়ে করে এখন দুঃখের ভাব দেখালে মানবো কেন! ”

ইশারা বিস্ময়াহত কণ্ঠে বললো,” তুমি নিজেও তো শোয়েব ভাইয়ের বেতন আর সম্পদের পরিমাণ জেনে বিয়ে করেছিলে। নইলে নাকি তুমি সিকিওরড ফিল করবে না। আমি কী ধরে নেবো শোয়েব ভাই মারা গেলে তুমি ওর পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হবে এই আশায় খুশি ? তোমার ছেলেমেয়ে দুটোই এখনও নাবালক। তুমি চাইলে ওদের সম্পত্তি দেখাশোনার ভারও পাবে। তারমানে কী শোয়েব ভাইয়ের মৃত্যু তোমার কাছে কাঙ্খিত কিছু ? ”

ইশারার এ কথায় গোধূলি এবার রেগে গেলো। তবে রাগ প্রকাশের সুযোগ দিলোনা ওকে ইশারা। সে হনহনিয়ে ছোটমায়ের রুমের দিকে চলে গেলো। তাঁর দরজায় দাঁড়াতেই চোখে পানি চলে এলো ইশারার। বাবার একটা লুঙ্গি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন তিনি। দুচোখ বুঁজে রেখেছেন। ইশারার পায়ের শব্দে চোখ মেলে উঠে বসে আস্তে করে লুঙ্গিখানা সরিয়ে রাখলেন তিনি।
চলবে,,

মা’ওয়া পর্ব-০১

0

~মা’ওয়া~
মোর্শেদা হোসেন রুবি
পর্ব-০১

” ইয়ে আম্মা, আমাকে এক কাপ র’টি করে দিতে বলুন তো কাউকে।” খসখসে কণ্ঠে বললেন বাড়ির বড় ছেলে আখতারুজ্জামান। চোখ থেকে চশমা খুলে সেটা পরিস্কার করে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে মুখ তুলে ঘড়ি দেখলেন। তারপর পুরো ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নিলেন এক পরত।

দুপুর বারোটা। একটু আগেই দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে। গোরস্থান থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে ড্রইংরূমে এসে বসেছেন আখতারুজ্জামান। বাকি ভাইবোনেরাও আছে। সবারই চেহারাতেই একটা কপট দুঃখী ভাব লটকানো। অথচ এই মৃত্যুটার জন্য একেকজনের অপেক্ষার অন্ত ছিল না। সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আখতার। কান্নার শব্দে ঘাড় ফিরালেন।

ইশারা কাঁদছে। তাদের সবার ছোট বোন। বাবার সবচেয়ে আদরের মেয়ে ইশারা। অথচ সেই বেচারিই কিনা আজ বাবাকে মিস করেছে। শেষ দেখাটা দেখতে পারেনি। ওর ট্রেন পুরো চার ঘন্টা লেট ছিল বলে পৌঁছুতে দেরি হয়। ইশারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। পড়াশোনার সুবাদে সেখানকার হোস্টেলেই থাকতে হয় ওকে। এদিকে দিন পড়েছে গরমের। সারারাতের পর এই তপ্ত দুপুর পর্যন্ত বাবাকে আর ফেলে রাখা যাচ্ছিলো না। যার ফলে ইশারা পৌঁছানোর আগেই গোর দিয়ে ফেলার আদেশ দিতে হয়েছে আখতারকে।

আর এদিকে পৌঁছানোর পর থেকেই কান্না শুরু হয়েছে ইশারার। সেই থেকে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে সে। আখতারুজ্জামানের বিরক্ত লাগছে খুব। একটা মানুষ কত কাঁদতে পারে। এই মেয়ে মেডিকেল কলেজে চান্স পেলো কীভাবে ভেবে পায়না আখতারুজ্জামান। সারাজীবন তেলাপোকা দেখলে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আর কমিকস পড়ে হি হি করে হাসা যে মেয়ের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সে কীভাবে মেডিকেলে চান্স পায় আখতারুজ্জামানের মাথায় ঢোকেনা। বিরক্তি নিয়েই আড়চোখে বোনকে দেখলো। এখন ফিঁচ ফিঁচ করে কাঁদছে আর ওড়নাতে চোখ মুছে যাচ্ছে। আশ্চর্য, একটা মানুষ বুড়ো হয়ে ঝুলে ছিল, সে যে মরেছে এটা তো তার জন্যেও ভালো। সারাজীবন বেঁচে থাকবে নাকি।

বিরক্তিতে অকারণেই দুবার কাশলো আকতার। এই কাশি সাধারণ কাশি না। সাংকেতিক কাশি। আলাপ তোলার কাশি। কিন্তু কাশিতে বিশেষ কাজ হলো না। আখতারুজ্জামান দেখলো ভাইবোনেরা সব মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তারমানে এদের ইচ্ছা আলাপটা আখতারুজ্জামানই তুলুক। সব ধান্ধাবাজের দল। রাগ লাগলেও চুপ করে রইলো আখতার। কিছুক্ষণ উসখুস করে বললো,” কই চা দিতে বললাম না ? ”

খাটের এক কোণে চুপ করে বসে ছিলেন ময়না বেগম। বড় ছেলের কথায় সদ্যবিধবা ময়না বেগম দিশেহারা ভঙ্গিতে বাকিদের দিকে তাকালেন। ছেলে দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় ওর কথার অর্ধেকই বুঝতে পারেন না ময়না বেগম। র’ টি কী জিনিস জানেন না তিনি। বাকিরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই সেজ মেয়ে গোধূলি ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালো ,” আমি দিচ্ছি বড় ভাইয়া।” বলে গোধূলি বেরিয়ে গেল। তার নিজেরও হয়তো মজলিশটাতে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। ওর চলে যাওয়া দেখে তাই মনে হলো ময়নার। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ভয়ে ভয়ে ঘরের বাকি সদস্যদের দিকে তাকালেন। সবাই থম ধরে বসে আছে। পরিবেশটা ঝড় ওঠার আগের আবহাওয়ার। ঝড় ওঠার আগে যেমন থেমে যায় চারদিক। তারপর ধূলো উড়িয়ে লঘুচালে এক টুকরো বাতাস এসে কিছু খড়কুটোর ঘূর্ণি তৈরী করে। তারপরেই ধুন্ধুমার কান্ড শুরু হয়ে যায়। লন্ডভন্ড করে রেখে যায় চারিদিক। ময়না বিবির আশঙ্কা বুড়োর ছেলে মেয়েরাও আজ হয়তো তাই করবে। শেষ পর্যন্ত তার পায়ের নিচে স্বামীর একচিলতে ভিটেটুকু থাকবে তো । নইলে কোথায় যাবেন তিনি। এই শেষ বয়সে ?

আখতারুজ্জামানকে ভয় পাবার প্রধান কারণ ওর চন্ডাল রাগ। ময়না বিবির সাথে ওর বাবার বিয়ের দিন এই ছেলেই সবচেয়ে বেশি ঝগড়া করেছিলো। তখন সে সবেমাত্র পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরীতে ঢুকেছে এবং বিয়েও করেছে। বাকিরা তখনও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেদিন আখতারুজ্জামানের দেখাদেখি বাকি ছেলেমেয়েরাও তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছিল বুড়োর সাথে। সে কী ঝগড়া। ব্যতিক্রম ছিল ইশারা। লালমিয়ার সবচে ছোট মেয়ে। লালমিয়া ময়না বিবির দ্বিতীয় স্বামী। বয়সেও ময়নার থেকে বেশ এগিয়ে। ময়না বিবির প্রথম স্বামী তালাক দিয়েছিল ময়না নিঃসন্তান বলে। অথচ তার কয়েক বছর পরেই তার এই নিঃসন্তান হবার কারণেই লালমিয়ার সাথে বিয়ে হয় তার। মানুষের জীবন কতইনা বিচিত্র। যে দোষে তিনি প্রথম স্বামীর ঘর কতে পারলেন না সেই একই দোষের কারণে দ্বিতীয় স্বামী বেছে নিলেন তাকে। অযোগ্যতাই সেদিন যোগ্যতা হয়ে গিয়েছিলো ময়না বিবির। যেদিন তিনি এ বাড়িতে প্রথম পা রেখেছিলেন সেদিনের কথা এখনও মনে আছে তার। ইশারা তখন ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। তাকে দেখেই ফিক করে হেসে দিয়েছিল ছোট্ট এতিম মেয়েটা। ওকে দেখেই সেদিন বড় মায়া পড়ে গিয়েছিল ময়নার।

লাল মিয়ার প্রথম স্ত্রী আয়না বিবির মৃত্যুর মাস ছয়েক পরেই নিঃসন্তান ময়নাকে বিয়ে করে ঘরে তোলেন বুড়ো। ময়নার নিজের বয়সও ততদিনে চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। লালমিয়ার ছেলেমেয়েরা তাদের এই বিয়েটা মেনে নিতে পারেননি। হয়তো লালমিয়ার প্রয়োজনটা তার ছেলেমেয়ের কাছে ততটা প্রবল বলে মনে হয়নি বলেই। তাদের মতে বাবার তখন তসবীহ জপার বয়স। এখন কিসের বিয়ে ? তাছাড়া এই বুড়ো বয়সে বিয়ে করলে লোকে কী বলবে। তার নতুন শ্বশুরবাড়িই বা কী বলবে। আখতারুজ্জামানের একথায় বাকি ভাইবোনেরা সমর্থন জোগালেও ইশারা নিরব ছিল। সে বেচারি তখনও নিতান্তই কিশোরী।
তবে বাকি ছেলেমেয়েদের তুমুল বিরোধীতার মুখেও সেদিন অনড় ছিলেন বৃদ্ধ লালমিয়া। ওদের চোখের সামনে দিয়েই তিনি প্রৌঢ়া ময়না বিবিকে নিয়ে সংসার শুরু করেছিলেন। বুড়ো বুড়ির সংসার। তাঁর এককথা, আমার একজন সঙ্গী লাগবে। আমার ব্যক্তিগত দেখাশোনার জন্যই একজন সঙ্গী দরকার। কার পা ধরতে যাবো আমি ? কোন বেটিরে সাথে রেখে গুনাহগার হবো। সব কথা কী তোমাদের বলে বোঝাতে হবে ?”

বাবার এহেন কথায় ছেলেমেয়েরা মহা ক্ষেপে উঠেছিলো সেদিন। তাদের মতে, এতে তাদের মৃত মাকে অপমান করা হচ্ছে । লালমিয়া তবু নির্বিকার। তিনি এক কথার মানুষ। শুধু এতোটুকুই বলেছেন, ” সারাজীবন ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতাম বলে তোমরা আমাকে গোঁড়া বলতে। আজ দেখো গোঁড়া আসলে কে। নিঃসঙ্গ পিতামাতার প্রয়োজনে তাদের হালাল সঙ্গি বেছে নেয়াটা যাদের চোখে অসম্মানের, গোঁড়া মূলত তারাই। যে বিধানে আইনগত, সামাজিক বা ধর্মীয় বাধা নেই সেই বিধানকে লজ্জা ধরে নিয়ে নিছক একটা সংস্কারকে লালন করার নামই হলো গোঁড়ামি। যারা গার্লফ্রেন্ড আর পরকীয়ার মতো হারামকে হালকা চোখে দেখে আর দ্বিতীয় বিয়ে করাকে বলে লুচ্চামি আসল গোঁড়া তো তারাই। প্রয়োজনকে খাটো করে দেখে নিজেদের মনগড়া পছন্দকে ব্যক্তিস্বাধীনতা বলা লোকেরাই আজকের দিনের বড় গোঁড়া। কাজেই গোঁড়া আমি না, গোঁড়া তোমরা। তোমরাই আজ গোঁড়ামি করছো।”

বুড়োর সপাট জবাবের সামনে সব ছেলেমেয়ে কিছুটা মিইয়ে গিয়েছিল। কেবল ইশারাই একা খুশি ছিল এবং বাবার বিয়ের পরেও সে স্বাভাবিক ছিল। নতুন মায়ের আন্তরিক ব্যবহার আর যত্ন আত্তি ওর কচি মন জুড়িয়ে দিয়েছিল প্রথম থেকেই। ফলে লালমিয়ার ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র ইশারাই ময়না বিবিকে মা বলে ডেকেছে। বাকি ছেলেমেয়েদের কেউ ময়না বিবিকে মা বলে ডাকেনি, মন থেকেও মেনে নেয়নি। তবে বুড়োর একথার পর তারা আর কথাও বাড়ায়নি। এর মূল কারণ সত্তোরর্ধো লালমিয়া তখনও যথেষ্ট দাপুটে। একাই বিশাল অঙ্কের টাকা লেনদেন করতেন। লোকজন লাগিয়ে জমিজিরাত দেখাশোনা করতেন। যৌবনে ঢাকায় দশ কাঠা জায়গা কিনে বাড়িঘর তুলে হুলুস্থুল কান্ড করেছেন। শেষ বয়সে এসে ইশারাকে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে ময়না বিবিকে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন। ঢাকার বাড়ির ফ্ল্যাটগুলো আগেই ছেলেমেয়েদের নামে লিখে দিয়েছিলেন। মারা যাবার কয়েক মাস আগে সবাইকে এও জানিয়ে দিয়েছেন যে, গ্রামে যে দুটো পুকুর আছে তার বড়টা ময়নাবিবির নামে থাকবে আর ছোটটার আয় থেকে মাদ্রাসার খরচ বের হবে কারণ ওটাতে মাছের চাষ হয়। বাকি রইলো কিছু জমি আর এই ভিটে বাড়ি। এগুলোও তিনি ন্যায়সঙ্গতভাবে বন্টন করে যাবেন। কেউ যেন এগুলো নিয়ে দ্বিমত পোষণ না করে। এটাই ছিল ছেলে মেয়েদের সাথে লালমিয়ার শেষ কথা। এরপর গত কয়েক বছর তিনি বিছানায় একা তড়পেছেন কিন্তু শেষ বয়সের সাথী ময়না বিবি আর ছোট মেয়ে ইশারাকে ছাড়া আর কাউকে পাশে পাননি।

গোধূলি চা এনে দিলে তাতে নিঃশব্দে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললো আখতারুজ্জামান। বাকিরা সবাই উসখুস করতে লাগলো। বড় ভাইয়ের আগে কথা বলার ইচ্ছে কারোরই নেই। কারণ ইতোমধ্যেই ফোনে ফোনে তাদের যোগাযোগ হয়ে গিয়েছে। কে কী বলবে তার একটা ছোটখাট মহড়াও দেয়া হয়েছে। ময়নাবিবিকে বড়পুকুর দেবার কোন ইচ্ছেই তাদের নেই। সে বড় জোর উত্তরের তিন শতাংশ জমিটা পেতে পারে। কিন্তু এ কথা বললে ময়না বিবির বাপের বাড়ির দিকের লোকেরা ঝামেলা করতে পারে ভেবেই তারা কথা বলার দায়িত্ব আখতারুজ্জামানকে দিয়ে রেখেছে। সে বাড়ির বড় ছেলে। তার কথার ওজনই আলাদা।

একসময় নিরবতা ভাঙলো। লালমিয়ার মেজমেয়ে রুমানা কথা বলে উঠলো। সে বর্তমানে একটা স্কুলের সহকারী শিক্ষক পদে আছে। বোনদের মধ্যে সেই একটু কড়া মেজাজের। রুমানাই এবার বড় ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” এভাবে সারারাত বসে থাকলেও কোন সমাধান আসবে না ভাইয়া। একটা কিছু তো করতে হবে। দুদিন বাদে সবাই আমরা যার যার জায়গায় ফিরে যাবো। এখানে জমিজমা তো সবই পড়ে থাকবে । তাছাড়া ছোট আম্মা এখানে একা। জায়গাজমি বারো ভুতে লুটেপুটে খাবে। এতো টাকার লেনদেন। এসব এভাবে ফেলে যাবার কোন মানে হয়না। “বলেই থেমে গেলো রুমানা। যে কোন কথা মুখের ওপর বলে দেবার স্বভাবটা ওর পুরোনো। বিগত দশবছর ধরেই সে স্বামী সন্তান সহ খুলনা আছে। বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আজ ভোরেই গ্রামে ছুটে এসেছে সে। তবে ওর স্বামী আসতে পারেনি। সে নাকি ব্যস্ত। তাই স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখানকার জায়গাজমির ভাগ বন্টন হয়ে গেলেই রুমানা উড়াল দেবে। আখতারের জোর ধারণা জামাই ব্যাটার শ্বশুড়ের মৃতদেহ দেখার চেয়ে জায়গাজমির টেনশনটাই বেশি ছিল। সেকারণেই একমুহূর্ত দেরি না করে বউছেলেকে ঠেলে পাঠিয়েছে। আখতার পুনরায় কাশলো।

” কিছু একটা করতে হবে তা আমিও জানি। কী করতে হবে তোরাই বল একটু শুনি। ”

” আমরা আর নতুন করে কী বলবো ভাইজান। আমরা থাকতে থাকতেই যদি জায়গা জমি নিয়ে না বসি তাহলে আর বসা হবেনা। এ বাড়িতে আমাদের আর কী আছে যে পিছুটান থাকবে। এক বাবা বেঁচে ছিলেন তবু ফোন টোন দিয়ে কথা বলতাম। এখন তো আর কেউ নেই। যারা আছে সবই বসে আছে সম্পত্তির আশায়। বাপ আমাদের। আর সম্পত্তি বারোভূতের। ” মেজ মেয়ে রুমানার স্বরে ব্যঙ্গ স্পষ্ট। ময়না বিবি ঘোমটায় মুখ ঢাকলেন। তার দিকের লোক বলতে তার এক ভাই আর এক বোন জামাই। তারা এখনও কিছু বলার সুযোগ পায়নি।

ইতোমধ্যে লাল মিয়ার বড় মেয়ে মাসুমা চেঁচিয়ে উঠলো। সে এমনিতে চুপচাপ। কথাও বলে কম। কিন্তু যখন বলে তখন বাকিদের বলার উপায় থাকেনা এতোটাই তীর্যক তার কথা। মাসুমা ধমকের সুরে বললো,” জায়গা জমি করে করে যে একেকজন মাথা খারাপ শুরু করলি। ইশারার কী হবে একবার ভেবেছিস ? আমাদের সবারই ঘর সংসার দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে আব্বা। ইশারাটার তো বিয়েটাও দেখে যেতে পারলো না। ওর কথা একবার ভাববিনা ? ওর দায়িত্ব কে নেবে ? ”

একথায় সবাই যেন একটু নতুন করে নড়েচড়ে বসলো। কেবল ইশারা একাই চট করে উঠে দাঁড়ালো। একমুহূর্ত দেরি না করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো সে ঐ কথাগুলো শুনে। ওর চোখগুলো তখনও বেশ লাল।

আখতারুজ্জামান কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবার আগেই রুমানা বলে উঠলো,” ইশারার বিয়ে নিয়ে ভাবার কী আছে। সে এখন ডাক্তারি পড়ছে। ওর জন্য কী ছেলের অভাব ? আমার দেবরই কতবার আগ্রহ দেখালো। আমি পড়াশোনা শেষ হবার কথা বলে টলে থামিয়ে রেখেছি। তাছাড়া ওর নিজের নামে ফ্ল্যাট আছে। দুদিন পরে নিজেও ভালো রোজগারে নামবে। ওর কথা আলাদা করে ভাবার তো কিছু নেই।”

ময়না বিবি এবার ভয়ে ভয়ে মুখ খুললেন। তিনি এই প্রসঙ্গটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন যেন। ভেজা কণ্ঠে বললেন,” আমার কথায় কিছু মনে কইরোনা তোমরা। আল্লায় দিলে তোমরা সবাই যথেষ্ট বুঝদার। তোমাগো নিজেগোও ছেলেমেয়ে অাছে। এইটা তো বুঝো যে ছেলেমেয়ে যতই শিক্ষিত আর লায়েক হউক না কেন। তার বিয়েটা ময়মুরুব্বিগরেই করানো লাগে। আমি যদিও ইশারার আপন মা না। তারপরেও আমি চাই ওর বিয়েটা সুন্দরভাবে শরীয়ত মাইনা হউক। যুগের লগে তাল মিলাইতে যাইয়া ওরে তোমরা একলা ছাইড়া দিওনা বাবারা। এইটা খালি আমার একলার অনুরোধ না, এইটা তোমাদের বাবারও অনুরোধ।” ময়না বিবি থামলেন। ঘরের সবাই এবার বেশ সরব হয়ে উঠলো।

বাইরে বারান্দায় দাঁড়ানো ইশারা এ পর্যন্ত শুনে আর বাকিটা শোনার জন্য দাঁড়ালো না। আস্তে করে উঠোনে নেমে পড়লো সে। তার ভালো করেই জানা আছে এরপরের কথাগুলো কী হবে। তাই বাকিটা আর শুনতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেও মনটা পশ্চিমাকাশের মতোই ভার হয়ে আছে। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে বাবা আর বেঁচে নেই। তিনি আর কোনদিন ফোন দিয়ে বলবেন না, কী রে, মা ? কিছু লাগবে নাকি রে ইশু ? ”

হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির বাইরে চলে এলো ইশারা। পাশেই হাকিম মোল্লা চাচার বাড়ি। হাকিম মোল্লা চাচা এখনও বেঁচে আছেন। ইশারা বাড়ি এলেই তাঁর সাথে দেখা করে। সম্পর্কে বাবার দুর সম্পর্কের ভাই হলেও দুই বাড়ির সম্পর্কটা অন্যান্য প্রতিবেশিদের মতোই। বিশেষ বাড়াবাড়ি খাতির নেই। এর বড় কারণ এই বাড়িতে তাদের আসাযাওয়া একেবারেই কম। নেই বললেই চলে। হাকিম মোল্লা চাচার স্ত্রী’র কাছে ইশারা একসময় আরবি পড়তো। পরে লেখাপড়ার জন্য ঢাকা চলে যাবার পর আর পুরোটা শেখা হয়ে ওঠেনি। তবে গ্রামে এলে একবার চাচির সাথে দেখা হতোই ইশারার। বড় মায়াবতী মহিলা।

আজ অনেকদিন পর মোল্লা বাড়িতে এসে পুরোনো ভালো লাগাটা কাজ করছে ইশারার। চাচি সবসময়ই আন্তরিক। ইশারাকে ভীষণ স্নেহ করেন।

চাচিদের উঠোনে পা রাখতেই থমকে দাঁড়ালো ইশারা। মোল্লা চাচাদের বাড়ির বিরাট উঠানের এককোণে একটা বড় গামলা পেতে রাখা হয়েছে। তাতে সম্ভবত কুসুম গরম পানি নেয়া হয়েছে। কেননা সেই পাত্র থেকেই মগ ভরে ভরে পানি তুলে চাচার গায়ে ঢালার কাজ চলছে। যিনি কাজটা করছেন তাকে দেখতে পাচ্ছেনা ইশারা। তবে তার চওড়া মাংসল পিঠ আর ভারি উরু এখান থেকেই চোখে পড়ছে ইশারার। লুঙ্গিটাকে রীতিমত হাঁটুর উপর তুলে জলচৌকিতে বসে মোল্লা চাচার পায়ে সাবান মাখাচ্ছেন তিনি। আর মোল্লা চাচা মহানন্দে চেয়ারে হেলান দিয়ে সেই দলাই মলাই উপোভোগ করছেন। বোঝাই যাচ্ছে এ ধরণের গোসলে তিনি দারুণভাবে অভ্যস্ত।

ইশারাকে তিনিই প্রথম দেখলেন। চোখে চশমা না থাকায় চোখগুলো কুঁচকে ফেলে বললেন,” কে ওখানে ? ”
ইশারা সালাম দেবার মুহূর্তেই টের পেলো মোটা গর্দানের অধিকারী লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখলো ওকে। তাকে চিনতে না পারলেও ইশারা অনুমান করলো এটা মোল্লা চাচার ছেলেদেরই কেউ হবে। যদিও এমন পালোয়ানদেহী কাউকে আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা ইশারার। তবে লোকটার ওকে দেখে ভীষণভাবে গুটিয়ে যাওয়াটা উপোভোগ করলো সে।

মুহূর্তেই গোটানো লুঙ্গি নামিয়ে লোমশ উরু ঢাকলো লোকটা। মোল্লা চাচার চেয়ারের পাশ থেকে তোয়ালেটা টেনে এমন ভাবে নিজের পিঠসহ মাথাটাকে ঢাকলো যেন ইশারা নয় তিনিই কোন লাজুক কুমারী কন্যা। যাকে দেখে ফেললে তার মান চলে যাবে।
ইশারা কয়েক পা এগিয়ে গেলো ওদের দিকে। মোল্লা চাচাকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দিলো। আর একইসাথে পরম বিস্ময় নিয়ে তোয়ালে ঢাকা পালোয়ানকে আরেকবার দেখে নিলো ইশারা।

[চলবে ইনশাআল্লাহ]

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-১০(শেষ পর্ব)

1

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#শেষ পর্ব
~মিহি

-“রুদ্ধ সাহেব! এসেছেন তবে। ভেবেছিলাম এই অপরাধীকে বোধহয় আর বিশ্বাস করবেন না।”

-“যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।”

-“আফনান শাহরিয়ারের নাম শুনেছেন?”

-“আমার বান্ধবী প্রেমার বাবা তিনি।”

কথাটা শোনামাত্র ভ্রু কুঁচকালো রাজন। পরক্ষণেই আবারো বলতে শুরু করল,

-“খুব বেশি সময় আমাকে দেওয়া হয়নি। তাই খুব সংক্ষেপে বলি। আমি একটা দলের হয়ে কাজ করতাম। নারী পাচার দল আর কী! পরবর্তীতে সে দল থেকে বেরিয়ে নিজের একটা দল বানিয়ে ফেলি। ফলে আগের দলের খ্যাতি অনেকটাই কমে যায়। ঐ দলের লিডার নানান চক্রান্ত করে আমাকে জেলে পাঠায়। সেসব না বলি। জেল থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চেয়েছিলাম তখন আমার মেয়েকে খুন করা হয়। আমার পাপের ফল! একদিন সংবাদ পাই ‘গুরু’ নামের এক লোক আমার মেয়েকে ফেরাতে পারবে অশুভ শক্তি দ্বারা। বদ্ধ উন্মাদ আমি তখন। যে যা বলত, মেনে নিতাম। তোমার বান্ধবীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার আদেশ পেলাম। ওরা অবশ্য চেয়েছিল আমার হাত দিয়ে প্রেমাকে মেরে আমাকে একেবারে জেলে পাঠিয়ে দিতে, আবারো! সেটা হলো না।”

-“লিডারটাকে চেনেন আপনি? তাহলে পুলিশকে ওনার তথ্য দিন।”

-“লিডারের নাম আফনান শাহরিয়ার। একমাত্র আমিই তার আসল নাম জানতাম। সেজন্যই আমাকে সরাতে চেয়েছিল।”

-“প্রেমার বাবা? ওনি প্রেমাকে কিডন্যাপ করার অর্ডার কেন দিলেন?”

-“একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। প্রেমার জীবন নিয়ে! প্রেমার আসল বাবা উনি নন। ওনি প্রেমার মায়ের দ্বিতীয় স্বামী, সম্পত্তির লোভে প্রেমার মাকে বিয়ে করেছিলেন।”

-“আপনি কি সত্যি বলছেন নাকি ম্যানুপিউলেট করার চেষ্টা করছেন?”

-“আপনার কাছে মিথ্যে বলে আদতে আমার কোনো লাভ আছে কি?”

-“প্রেমার বাবার উপর আপনি যে অভিযোগ তুলছেন, তার কোনো প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”

-“যে মূর্তিটা তোমরা পেয়েছো, তার মধ্যে একটা চিপ আছে। ঐটা চেক করতে হবে, তাহলেই সব প্রমাণ পাবে।”

-“পুলিশকে না বলে এসব কথা আমাকে কেন বলছেন? সরাসরি পুলিশকে জানালেই পারতেন।”

-“পুলিশের কিছু সদস্যও ঐ লোকটার সাথে জড়িত। এতটা সময় ঐ লোকের গ্যাংয়ে থেকেছি, অনেক কিছুই জানি। আমি এখন অবধি কাউকে ভরসা করে উঠতে পারিনি তবে আমি জানি তুমি প্রেমাকে ভালোবাসো। ওকে বাঁচানোর জন্য তুমি সব করতে পারবে। এই ভরসাতেই তোমাকে সত্যিটা বলার ঝুঁকি নিলাম।”

-“আপনাকে কে বলল আমি প্রেমাকে ভালোবাসি?”

-“ভালোবাসা- সে কি মুখে বলার জিনিস? প্রিয়তমার বিপদে যার উদ্বিগ্ন চোখ পলক ফেলে না, নিজের জীবনের ধার ধারে না, তার অনুভূতি আমার কাছে ধরা দিবে না? শোনো, আমিও ভালোবেসেছিলাম কাউকে, হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন দিয়ে। তীব্র ভালোবাসা ছিল তো, হারিয়েছি তাকে। তার প্রতারণার স্বাদটাও বিষাক্ত মনে হয় নি। বাদ দাও এসব। তুমি এখন কী করবে ভাবছো?”

-“আমারও একটা ঝুঁকি নিতে হবে। আমার জানাশোনা একজন প্রভাবশালী মানুষ আছেন তবে তিনি আমার সাহায্য করবেন কিনা জানিনা। চেষ্টা করে দেখতে হবে।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও তুমি।”

-“আচ্ছা ওয়েট! পুলিশ যদি ঐ লোকটার সাথে মিলেই থাকে, তবে আপনার সাথে আমাকে দেখা করতে দিল কেন?”

-“তুমি কি ভেবেছো পুলিশ স্টেশন থেকে কল গেছে তোমার কাছে? নাহ! কলটা আমি করিয়েছিলাম, একজনকে টাকা দিয়ে। তুমি পুলিশ স্টেশনে এসে দেখা করার কথা বলেছো, তোমাকে ডাকা হয়েছে সেটা বলোনি। তাই তারা দেখা করতে দিয়েছে।”

-“আপনি কিভাবে বুঝলেন আমি ডাকার কথা বলবো না?”

-“রিস্ক নিয়েছিলাম একটু। আচ্ছা, তোমার মনে হয়না আমি খুব খারাপ মানুষ?”

-“কয়েক ঘণ্টা আগ অবধি মনে হতো, এখন মনে হচ্ছে না। আপনি খারাপের মুখোশ পড়া একজন ভদ্রলোক।”

-“ওহ আরেকটা কথা! প্রেমাও তোমায় ভালোবাসে। তোমার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে।”

রাজনের কথা শুনে রুদ্ধ আর কিছু বলে না, স্রেফ হাসে। রুদ্ধ বের হতেই একডন পুলিশ ব্যতিব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করে,”লোকটা কী বললো তোমায়?” রুদ্ধ খানিকটা চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলে,”লোকটা নাকি কিছুই জানেনা। এসব কেউ তাকে দিয়ে করায়নি। সে স্বেচ্ছায় করেছে।” রুদ্ধর কথা শেষ হওয়ামাত্র পুলিশের মুখ থেকে চিন্তার ছাপটা সরে যায় যা রুদ্ধর দৃষ্টি এড়ায় না।

________________________________________________________

বাড়িতে ফিরে রুদ্ধ কেবলই বসতে যাবে এমন সময় টুং করে একটা মেসেজের শব্দ এলো। মেসেজ ওপেন করতেই দেখে প্রেমার মেসেজ,

‘রুদ্ধ, আমি চলে যাচ্ছি। বাবা আর কোনোভাবেই আমাকে এখানে রাখতে চান না। একটা কথা…থাক দরকার নাই। তোরা ভালো থাকিস আর শোন! বিয়ে করে নে এবার। বুড়ো হচ্ছিস। নিজের খেয়াল রাখিস।’

প্রেমার মেসেজে রুদ্ধর পৃথিবী যেন থমকে গেল। প্রেমার বাবা যদি প্রেমাকে নিয়ে চলে যায়, তাহলে আর তাকে বাঁচানোর কোনো সুযোগ থাকবে না তার কাছে। এখন একটাই উপায় আছে। দ্রুত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বের হয় রুদ্ধ।

মাত্রই একটু ঘুমিয়েছেন আদনান রাহমান। বাইরের চেঁচামেচিতে দৌড়ে উঠে এলেন। বিশাল বাড়িতে একা তিনি, বাইরে একজন গার্ড আছে কেবল। বাইরে আসতেই দেখলেন রুদ্ধ গেটে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখামাত্র দৌড়ে এলো তার কাছে। রুদ্ধর উপর তার অবশ্য আর রাগ নেই। বিয়ের রাতেই অদৃতা তাকে কল করে সব বলেছিল। রুদ্ধর সাজানো নাটক, অদৃতা আর আদিলের লুকোচুরি প্রেম সবটাই। তিনি নিজের মেয়ের উপর বড্ড খুশি হয়েছিলেন। অন্তত তার মেয়ে দিনশেষে হলেও সত্যটা জানিয়ে সংসার শুরু করেছে। রুদ্ধর কাছে মাফ চাইতে চেয়েছিলেন তবে সুযোগ হয় নি। তবে আজ রুদ্ধর উপস্থিতিটা তাকে নিশ্চিন্ত করল।
তিনি কিছু বলার আগেই রুদ্ধ বলতে শুরু করলো,

-“আঙ্কেল! আগের কথা সব ভুলে যান। আমায় দয়া করে একটু সাহায্য করুন।”

-“তোমার উপর রাগ নেই আমার বরং আমি খুশি। অদৃতা সবটাই বলেছে আমায়। তুমি ভেতরে এসো।”

-“সে সময় নেই আঙ্কেল।”

-“আচ্ছা, কী হয়েছে সেটা বলো।”

রুদ্ধ শুরু থেকে শেষ সবটুকুই সংক্ষেপে বললো। রুদ্ধর কথা শুনে আদনান রাহমান কিছুক্ষণ ভেবে বললেন,” আচ্ছা বুঝেছি। আমার জানা একজন বিশ্বস্ত অফিসার আছে। আমি তার টিমসহ এয়ারপোর্টে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে প্রেমাকে আটকাও। এয়ারপোর্টে কোনো সমস্যা হলে আমায় কল দিও।”

আদনান রাহমানের কথা বলতে দেরি আছে, রুদ্ধর যেতে দেরি নেই। প্রেমাকে হারাতে চায় না সে, কিছুতেই না…

_______________________________________________

এয়ারপোর্টে একটা গণ্ডগোল স্পষ্ট দৃশ্যমান! বাধ্য হয়ে জার্নি টাইম দু’ঘণ্টা পেছানো হয়েছে। আফনান শাহরিয়ারকে ঘিরে পুলিশের দল। তিনি কিছুক্ষণ পর পর ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে রুদ্ধর দিকে তাকাচ্ছেন। অবশেষে তিনি স্বীকার করলেন তিনি প্রেমার সৎ বাবা এবং সবটাই তিনি ঈরেছেন সম্পত্তির জন্য। প্রেমা বাংলাদেশে মারা গেলে তার উপর কেউ সন্দেহ করত না তাই তিনি এই প্ল্যান করেন আর রাজনকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্য ছিল তাকে রাস্তা থেকে সরানো। রাজন আফনান শাহরিয়ারের আসল রূপটা জানতো। যদিও ও কাউকে বলবে কিনা নিশ্চিত ছিলেন না তিনি তবুও এই ভয় নিয়ে বাঁচতে চান নি। সবটা শোনার পর পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করলো। আদনান রাহমান রুদ্ধর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রুদ্ধ কৃতজ্ঞতাসূচক ধন্যবাদ জানালো। প্রেমা মূর্তির ন্যায় বসে আছে এক কোণে। তার কাছে জীবনের এতগুলো বছর মিথ্যে হয়ে গেছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারছে না সে। রুদ্ধ ঠিক কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না কিন্তু কথাগুলো আজ তাকে বলতেই হবে।

-“এই প্রেমা! শোন!”

-“হুহ, শুনছি।”

-“তুই কি আমার উপর রেগে আছিস?”

-“নাহ।”

-“ওহ আচ্ছা।”

রুদ্ধ চুপ হয়ে যায়। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। তাই বারবার প্রেমার দিকে তাকাচ্ছে। “তুই কি কিছু বলবি?” প্রেমার প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় সে। এদিকে প্রেমা ভেবে রেখেছে যদি রুদ্ধ আজও কিছু না বলে তাহলে প্রথমে জুতো খুলে ওকে পেটাবে তারপর ফ্লাইট ধরে চলে যাবে। রুদ্ধর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না তবুও অনেক কষ্ট মিইয়ে যাওয়া গলায় হ্যাঁ বলল।

-“তো বল কী বলবি।”

-“আসলে হয়েছে কী…না মানে..আমি আ…আসলে…তো…তোকে…না মানে..আমি …”

-“এক থাপ্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিতে ইচ্ছে করতেছে।(বিড়বিড় করে)”

-“তুই কিছু বললি?”

-“তুই কী বলবি সেটা শোনার অপেক্ষায় আছি।”

-“কিছু না।”

মুহূর্তের মধ্যে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল প্রেমার। উঠে বললো,”বেশ থাক! আমার ফ্লাইটের টাইম হয়ে গেছে। আমি যাবো।” প্রেমার কথায় রুদ্ধর হাত পা কাঁপতে শুরু করল। প্রেমা চলে যাবে? কেন? রুদ্ধর মাথায় আর কিছু আসলো না। চোখ বন্ধ করে বলে ফেলল,” প্রেমা আমি তোকে খুব ভালোবাসি।” রুদ্ধ ঠিক করে রেখেছে প্রেমা না বলে দিলে সে সোজা উল্টো দিকে ঘুরে চলে যাবে। প্রেমাকে নিজের মুখটাও দেখাবে না। “দেখ রুদ্ধ! উই আর জাস্ট ফ্রেন্ডস! এর বাইরে আমি কিছু ভাবি না..” প্রেমা আর কিছু বলার আগেই রুদ্ধ পেছনে ঘুরলো। চোখের পানিটা অন্তত প্রেমার সামনে পড়তে দেওয়া যাবে না। পেছনে ঘুরে চোখ খুলতেই টুপ করে চোখ বেয়ে জল গড়ালো। বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সে জল মুছতেই প্রেমা পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়লো রুদ্ধর উপর। একরকম জাপটে ধরলো তাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় বোবা হয়ে গেছে রুদ্ধ। প্রেমা তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেই বলল,”এত বছর লাগলো বলতে? ছাগল একটা!” রুদ্ধ চোখ পিটপিট করছে। স্বপ্ন দেখছে না তো সে?! এই খাদকটা অবশেষে তার ঘরেই যাচ্ছে? সত্যিই? আচমকা প্রেমা রুদ্ধকে ছেড়ে দিয়ে প্রশ্ন করলো,”আচ্ছা, তুই কী করে জানলি বাবা আমায় মেরে ফেলতে চায়? তোকে কে বললো?” রুদ্ধ বোধহয় সুযোগ পেল। সাহস নিয়ে প্রেমার কানের কাছে গিয়ে বললো,”বাসর রাতে বলবো!” রুদ্ধর বলতে দেরি, প্রেমার ‘অসভ্য! নির্লজ্জ’ আখ্যা দিতে দিতে রুদ্ধর পিঠে কিল বসাতে দেরি নেই।

সমাপ্ত||

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৯

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৯ম পর্ব
~মিহি

-“কীরে প্রেমা কোথায়? তুই না বললি প্রেমা এখানে আছে।”

-“আরে ছিলই তো! কোথায় চলে গেল? ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সেজন্য আমি শুয়ে রেখে চলে গেছিলাম তোদের খুঁজতে। এখন ও এখানে নেই! অদ্ভুত তো!”

-“তুই যেখানে দাঁড়িয়ে আছিস, সেখানে মাটি খোড়া হয়েছে। তার মানে এখানে কিছু একটা ছিল আর সেটা নিতেই প্রেমাকে পাঠানো হয়েছিল। প্রেমা কি দেখেছিল তোকে?”

-“নাহ! দেখার আগেই তো অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো।”

-“কোনো একটা রহস্য অবশ্যই আছে। ঐদিকে একটা জায়গার নিচে সুড়ঙ্গের মতো কিছু একটা আছে। সেদিকে এগোতেই শুভ্রর জালে জড়িয়ে যাওয়া, এখানে প্রেমার আসা আবার হারিয়েও যাওয়া! কাছু একটা রহস্য আছেই। এসব কিছু ঐ লোকটা একা করতে পারবে? এখানে তো ঠিকঠাক সিগন্যালও পায় না। লোকটা কারো সাথে কন্ট্যাক্টও করতে পারছে না। একা একা এতকিছু কিভাবে করছে সে?”

-“কোথায় সুড়ঙ্গ দেখলি?”

-“চল দেখাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে সব রহস্য ওখানেই সামাধান হবে।”

রুদ্ধ, রেহান আর শুভ্র আবারো এগোয় সুড়ঙ্গের দিকে। এই জঙ্গলের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে সুড়ঙ্গে পৌঁছানো কঠিন। তার উপর সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চারদিকে সামান্য আলোর রেশ রয়েছে। সুড়ঙ্গ অবধি পৌঁছাতে পৌঁছাতে যদি রাত হয়, তবে সেখানে গিয়ে আদৌ তারা কিছু করতে পারবে? একে তো কিছুই চেনে না সে জায়গার। তাছাড়া আগেরবার গিয়ে যে ফাঁদ দেখে এসেছে, দ্বিতীয়বার না জানি আরো বড় কোন ফাঁদ অপেক্ষা করছে! এতসব ভাবলে তো আর এগোনো যাবে না কিন্তু এগোতে তো হবেই।

____________________________________

প্রেমা মূর্তিটা দেওয়ার পরপরই রাজন প্রেমাকে আঘাত করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল কিন্তু তনয়ার জন্য তা সম্ভব হলো না। তনয়ার হাতের বাঁধন আলগা হওয়ায় সে তা খুলে ফেলেছিল আগেই। অপেক্ষায় ছিল শুধু প্রেমার আসার। প্রেমা আসামাত্র দুজন মিলে অতর্কিত ভাবে মারতে থাকে রাজনকে। রাজন নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়টুকু পায় না। মারের চোটে বেহুশ হয়ে যায়। রাজন পড়ে যেতেই প্রেমা আর তনয়া দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে। মূর্তিটা এখনো প্রেমার হাতে মুষ্টিবদ্ধ। রাজন প্রেমা আর তনয়াকে যে জায়গায় রেখেছিল তা ছিল মাটির নিচে। এ জায়গা যে অনেক আগে বানানো হয়েছে তাও স্পষ্ট বুঝলো প্রেমা। দৌড়ে বাইরে আসতেই কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো সে। কিন্তু পড়লো না, কেউ একজন প্রেমার কাঁধে দুইহাত রেখে ধরলো তাকে। প্রেমা ভয়ে চিৎকার দিতে নিল। পরক্ষণেই মানুষটার হাত প্রেমার মুখ চেপে ধরলো। প্রেমা কামড় দিল হাতে।

-“উফ! রাক্ষসী একটা! এত জোরে কেউ কামড় দেয়?”

-“রুদ্ধর বাচ্চা! কই ছিলি তুই? ঠিক আছিস? তোর কিছু হয়নি তো?”

রুদ্ধকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রেমা। চোখ বেয়ে অঝোরে পানি গড়াচ্ছে। রুদ্ধ মুচকি হাসছে। মেয়েটাও তবে তাকে ভালোবেসেই ফেললো? নাকি শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে এত চিন্তা? শুধুমাত্র বন্ধুর জন্য এত আতঙ্কিত হয় কেউ? কই রেহান কিংবা শুভ্রকে তো জড়িয়ে ধরে কাঁদলো না প্রেমা। ওরাও তো বিপদে পড়েছিল। রুদ্ধর কেন যেন মনে হচ্ছে প্রেমাও তাকে ভালোবাসে তবে সে ভালোবাসা অপ্রকাশিত রাখতে চায়।

-“রুদ্ধ! বলে ফেল কিন্তু। এখনো সুযোগ আছে।”

-“কী রে রুদ্ধ,বলবি না?”

রেহান আর শুভ্র সমানে রুদ্ধকে খোঁচাচ্ছে আর রুদ্ধ বেচারা তো কথাই বলতে পারছে না। পড়ে থাকা লোকটার ফোন নিয়ে বেশ অনেকটা সময় পার করে জঙ্গল থেকে বের হয় সকলে। রুদ্ধ প্রথমেই কল দেয় পুলিশকে। তারপর পাঁচজন রাস্তার এক ধারে বসে পুলিশের অপেক্ষা করতে থাকে। রুদ্ধ সুযোগ খুঁজছে প্রেমাকে মনের কথাটা বলে দেওয়ার কিন্তু কিছুতেই সাহসে কুলাচ্ছে না। রুদ্ধর মাথায় আচমকা একটা মিউজিক ভিডিওর দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। অনেক পুরোনো একটা গান। কী যেন ছিল গানটা! ওহ হ্যাঁ, ‘সখীরে সখীরে।’ ছেলেটা তার বান্ধবীকে ভালোবাসত। বান্ধবী ছেলেটার মনের কথা জানার জন্য আরেকজনের সাথে প্রেমের নাটক করে। এটা দেখে ছেলেটা ঠিক করে মেয়েটাকে ছেড়ে চলে যাবে। তারপর স্টেশনে এসে মেয়েটা ছেলেটাকে থাপ্পড় মেরে প্রপোজ করতে বলে। আচ্ছা, রুদ্ধ প্রেমাকে কিভাবে প্রপোজ করবে? যেন তেন ভাবে প্রপোজ করলে যদি প্রেমাও মেয়েটার মতো করে বলে, “বুদ্ধু! এভাবে কেউ প্রপোজ করে? ফিল্ম দেখিস না?” ধূর! কিছুই ভাবতে পারছে না রুদ্ধ। আপাদমস্তক তার ঢলছে, মাথার ভিতর সবকিছু ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। প্রেমার পাশে বসতেও হাত-পা কাঁপছে। রুদ্ধর এসব কাণ্ড প্রেমা বাদে কারোরই চোখ এড়াচ্ছে না। শুভ্র তো কিছুক্ষণ পর পর বিরক্ত হয়ে রুদ্ধর গোষ্ঠী উদ্ধার করছে।

রুদ্ধ নিজেও মনে মনে বিরক্ত। সে বিড়বিড় করেই যাচ্ছে, “রুদ্ধরে! তুই এত ভীতু কবে থেকে হলি! সামান্য তিনটা শব্দ!বলে দে প্রেমাকে। আচ্ছা, প্রেমার পায়ে কি হাইহিল? হাই হিল দিয়ে মারলে কেমন ব্যথা লাগে? প্রেমা কি জুতো খুলে মারবে নাকি হাত দিয়েই মারবে? ধুরো! কিসব ভাবতেছি! না মরেই ভূত হওয়ার মতো হাবিজাবি চিন্তা। মনে মনে কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নিই…আচ্ছা, শুরুটা করবো কিভাবে? প্রেমা, আমি না তোকে খুব ভালোবাসি! এভাবে বলবো? কেমন যেন বেখাপ্পা লাগতেছে!” রুদ্ধর বিড়বিড় শেষ হওয়ার আগেই পুলিশ চলে আসলো। রুদ্ধ মনে মনে কটমট করে উঠলো। বাংলাদেশের পুলিশ কবে থেকে এত ফাস্ট হলো? পরক্ষণেই খেয়াল হলো এরা লোক্যাল থানার পুলিশ।সম্ভবত ময়মনসিংহের আশেপাশের কোনো এলাকার। পুলিশ এসেই লোকটার খোঁজ করলেন। রুদ্ধ যেতে চাইলে শুভ্র তাকে আর প্রেমাকে সময় দিয়ে পুলিশকে নিয়ে চলে গেল। রেহান,তনয়াও গেল পিছু পিছু। রুদ্ধ দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। এটা তার পুরোনো অভ্যেস। যখনি ঘাবড়ে যায়, তখনি এই কাজটা করে। প্রেমা কেবলই তাকিয়ে তাকিয়ে রুদ্ধর কাণ্ডকীর্তি দেখছে। রুদ্ধ কি এখনো কিছু বলবে না? সে কি তবে ভালোবাসেনা প্রেমাকে? প্রেমা রুদ্ধকে ভালোবেসেছিল সেই দু’বছর আগেই কিন্তু হঠাৎ জানতে পারল রুদ্ধ অন্য কাউকে ভালোবাসে। সত্যতা যাচাইয়ের ব্যপারটা তখন তার মাথায় আসেনি। রুদ্ধর উপস্থিতিটাও তখন তার জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। বাধ্য হয়ে কাউকে না জানিয়ে উড়াল দিল অচেনা রাজ্যে। এত বছর ফিরে দেশে ফিরে জানলো, দু’বছর রুদ্ধর থেকে দূরে থাকাটা কেবলই একটা বুল বোঝাবুঝির ফল। রুদ্ধটা এত বোকা কেন? এবারেও যদি সে ভালোবাসার কথা না জানায় তবে প্রেমা আর ফিরবে না, কখনোই না। প্রেমা নিজেকে কথা দিয়েছে। রুদ্ধ যদি সত্যি তাকে ভালোবেসে থাকে, অন্তত হারিয়ে ফেলার ভয়ে হলেও সব স্বীকার করত!

________________________________________________

প্রেমা বারবার রুদ্ধর দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখ ছলছল করছে। প্রেমার বাবা পুলিশের মাধ্যমে সব ঘটনা জেনে নিজের ইমার্জেন্সি প্লেনে করে দেশে এসেছেন। প্রেমাকে নিয়ে আজকের মধ্যেই তিনি ফিরবেন। ইতিমধ্যে টিকিটও কেটে ফেলেছেন। প্রেমা ভেবেছিল রুদ্ধ হয়তো এবার তাকে আটকাবে, নিজের ভালোবাসার কথা স্বীকার করবে কিন্তু রুদ্ধ তো কিছু বললো না। হয়তো রুদ্ধ তাকে ভালোই বাসে না।

এদিকে রুদ্ধর ভেতরে যে কী চলছে তা শুধু সে-ই জানে। সকাল হতেই তার মনপাখি আবারো উড়াল দিবে তাকে ফেলে অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুদ্ধ। পুলিশ স্টেশন থেকে কল এসেছে। লোকটার জ্ঞান ফিরেছে। সে কিছু বলতে চায়। রুদ্ধ বুঝে উঠতে পারে না পুলিশ বাদ দিয়ে তার সাথে লোকটার কি কথা? অবশ্য এত না ঘেঁটে সরাসরি গেলেই জানা যায়। যদিও রুদ্ধর মন-মেজাজ ঠিক নেই, তবুও দরকার ভেবে রুদ্ধ লোকটার সাথে দেখা করার জন্য মনঃস্থির করে তবে রুদ্ধ তখনো জানতো না লোকটার সাথে দেখা করাটাই তার জীবনকে একেবারে উলট-পালট করে দিতে চলেছে।

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৮

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৮ম পর্ব
~মিহি

প্রেমার মাথা ঘুরছে। তার শরীরে ঠিক কতটুকু ড্রাগ ইনজেক্ট করা হয়েছে সে জানেনা কিন্তু ড্রাগের মাত্রাটা যে খুব কম নয় তাও স্পষ্ট অনুধাবন করতে পারছে। প্রেমাকে একটা কাজ দেওয়া হয়েছে। সময়ের মধ্যে কাজটা সমাধান করতে না পারলে তনয়াকে নিজের জীবন হারাতে হবে। প্রেমা কিছুতেই চায় না সেটা। নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তার তনয়াকে বাঁচাতে হবে। প্রেমার কাজটাও যে খুব সহজ তা নয়। এই জঙ্গলের কোনো এক কোণে একটা সোনালি বর্ণের ছোটখাটো নারীমূর্তি লুকিয়ে রেখেছে রাজন। তাকে সেই মূর্তিটা খুঁজে বের করতে হবে। কিছু ক্লু তাকে দেওয়া হয়েছে ঠিকই কিন্তু ড্রাগের ডোজে সে আপাতত মানসিক ভারসাম্যহীনের মতো আচরণ করতে শুরু করেছে।

রাজনের খেলাটা বেশ মজা লাগছে। অবশ্য খেলাটা হুট করেই মাথায় আসলেও এর পেছনে তার একটা বিস্তর স্বার্থ আছে। পুলিশের কাছে ধরা দেওয়ার আগে রাজন একটা স্মাগলিংয়ের সাথে জড়িত ছিল। প্রায় ডজনখানেক প্রত্নতাত্ত্বিক মূর্তি সে বিদেশে চড়া দামে পাচারও করেছে
শেষমুহূর্তে এসে এই মূর্তিটা সে এই জঙ্গলে লুকিয়েছিল যেন ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারে। প্রেমাকে কাজে লাগিয়েই সে মূর্তিটা হাতাতে চায়। তারপর প্রেমা, তনয়া দুজনকেই মেরে ফেলবে। গুরুর লোকগুলোর মুখ থেকে এখনো পুরো সত্যিটা শোনেনি রাজন। শোনার কি দরকার আছে? গুরু কেন রাজনকেই বোকা বানাতে চেয়েছিল? সে নিজেও তো এই কিডন্যাপিংটা করতে পারত। গোলমালের গন্ধটা রাজন পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু সে মত্ত তার বিকৃত খেলায় যা তাকে এইমুহূর্তে চরম তৃপ্তি দিচ্ছে।

রাজনের হাসিটা তনয়ার একদম পছন্দ হচ্ছে না। তার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তার বাড়িতে বলে এসেছে আগামী সাতদিনের জন্য তারা ঘুরতে যাবে। শুভ্রর কথা বিশ্বাস করেই হয়তো কেউ তাদের খুঁজতে আসছে না, এমনকি যোগাযোগের চেষ্টাও করছে না। এই ঘুরতে আসাটাই যে তনয়ার কাল হবে জানলে সে কখনোই আসতো না। এমনকি কাউকেই আসতে দিত না। রাজন এখনো হাসছে। লোকটার হাসির মাঝে এক ধরনের পাগলামি লক্ষ করেছে তনয়া। স্বাভাবিক মানুষ যেভাবে হাসে, লোকটা সেভাবে হাসে না। লোকটার হাসি অনেকটা থ্রিলার মুভির ভিলেনগুলোর মতন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া। মনে একটাই প্রশ্ন, প্রেমা কি পারবে লোকটার দেওয়া কাজ শেষ করে ফিরতে?

______________________________

রুদ্ধ পড়ে আছে ঘাসের উপর। অনেকক্ষণ থেকে তার মুখে পানি ছিটাচ্ছে শুভ্র কিন্তু রুদ্ধ চোখ খুলছে না। শুভ্র তাও খুশি এই ভেবে যে অন্তত রুদ্ধকে সে খুঁজে পেয়েছে। রুদ্ধর পাশেই বসে আছে সে। আচমকা তার চোখ পড়ল রুদ্ধর ঘাড়ের দিকে, রুদ্ধর গাড়ে ইনজেকশনের দাগ। রুদ্ধকে কি ড্রাগ টাইপ কিছু দেওয়া হয়েছে? মুহূর্তেই আঁতকে ওঠে সে। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর তাদের সাথে কি কি হয়েছে সব মনে করার চেষ্টা করে। ব্যর্থ চেষ্টা! একবিন্দুও কিছু মনে করতে পারে না। শুভ্রর নিজের উপর রাগ হচ্ছে। সব দোষ তার! এই এডভেঞ্চারে আসার কোনো মানেই ছিল না। ইচ্ছে করে বিপদ ডেকে এনেছে সে। বেটটা এক্সেপ্ট না করলেও পারত সে! সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ট্যুর গ্রুপে পরিচিত এবং বেশ এডভেঞ্চারাস হওয়ার সুবাদে অপরিচিত একটা মেয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল চিকন কালার বনে আসার জন্য। তখনো সে এটা নিয়ে এত সিরিয়াসলি ভাবেনি। কিন্তু যখন সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করা হলো, তখনি তার মাথায় আসলো জায়গাটার কথা। এখন কেন যেন সবকিছু প্রি-প্ল্যানড মনে হচ্ছে শুভ্রর। হুট করেই প্রেমার দেশে ফেরার পরপরই এতকিছু ঘটে যাওয়া কোনোভাবেই কো-ইনসিডেন্সের মধ্যে পড়ে না। কেউ জেনে-বুঝে এসব কিছু প্ল্যান করেছে কিন্তু কেন? আর প্রেমার দেশে ফেরার সাথেই এই প্ল্যানের কী যোগসূত্র রয়েছে? সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে শুভ্রর।

ধীরে ধীরে চোখ খুলছে রুদ্ধ। চোখ খুলতেই সামনে শুভ্রকে দেখে খুশাতে চোখ জ্বলজ্বল করতে লাগলো। ইচ্ছে করল এখনি শুভ্রকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু শক্তিটুকু পেল না শরীরে।

-“শুভ্র!”

-“তুই রিল্যাক্স হ। তোর শরীরে অনেক আঘাত লেগেছে। কোনোভাবে এখান থেকে বের হয়ে আগে ডাক্তার দেখাতে হবে।”

-“প্রেমা আর তনয়াকে ছাড়া আমরা কোনভাবেই ফিরতে পারবো না।”

-“তোর কি মনে হচ্ছে লোকটা ওদেরকেও এই জঙ্গলে রেখেছে?”

-“মনে হচ্ছে কারণ লোকটা একটা খেলা খেলতে চাইছে। নাসলে আমাদের এভাবে এখানে ফেলে রাখত না। অবশ্যই কিছু একটা চলছে লোকটার মাথায়।”

-“আমার মনে হচ্ছে সবকিছু প্রি-প্ল্যানড।”

শুভ্র বেটের কথাটা রুদ্ধকে বলল। রুদ্ধরও সন্দেহ হচ্ছে। নিশ্চিত কোনো একটা ঝামেলা আছে এসব কিছুর মাঝে। সবকিছু বোঝার আগে প্রেমা আর তনয়াকে খুঁজতে হবে।

-“রেহান কই?”

-“ঐ নড়তে পারছে না। একটা গাছের নিচে বসায়ে আসছি। ও ঠিকই আছে। চিন্তা করিস না।”

-“কোনদিকে যাওয়া যায় বল তো।”

-“আপাতত সোজাই চল।”

-“আচ্ছা চল।”

রুদ্ধ আর শুভ্র সামনের দিকে এগোতে থাকে।

প্রেমার হাসি পাচ্ছে। কোন ধরনের ড্রাগ তার রক্তে প্রবাহিত হচ্ছে জানা নেই তার। একটু আগেই কান্না পাচ্ছিল, এখন হাসি পাচ্ছে। কখনো বা প্যানিক হচ্ছে! এসব সামলে মূর্তি খোঁজাটা কিভাবে সম্ভব তার পক্ষে? তবুও হাল ছাড়েনা প্রেমা। মনে করার চেষ্টা করে লোকটা কী কী বলেছিল কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক মনে করতে পারেনা শুধু মনে পড়ে মূর্তিটা একটা বড় গাছের নিচে পুঁতে রাখা আছে আর গাছটার উপর একটা ত্রিশূলের চিহ্ন এঁকে রেখেছিল সে। এতগুলো গাছের মধ্যে সে গাছ খুঁজতে যাওয়া অনর্থক। তার চেয়ে বড় কথা লোকটা কত বছর আগে চিহ্ন এঁকেছিল আল্লাহ মালুম! এতদিনে কি সেই চিহ্নের চিহ্নটুকু অবশিষ্ট আছে? একটু হাঁটতেই হাঁপিয়ে উঠছে প্রেমা কিন্তু চিহ্নটা তো তাকে খুঁজতে হবেই। প্রেমা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় থাকতে পারে গাছটা। নাহ! এভাবে হাঁটলে পাওয়া যাবে না। কিছু তো বিশেষত্ব আছে গাছটার, যার জন্য লোকটা ঐ গাছের নিচেই মূর্তিটা লুকিয়েছিল। আশেপাশের সব গাছই তো একরকম। একটু একটু করে জঙ্গলের গভীর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে প্রেমা। আচমকা খেয়াল করে একটা অবয়ব। অবয়বটার দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সে। লোকটা যে গাছে হেলান দিয়ে আছে, সে গাছটা একেবারে সবুজ-সজীব। অথচ বনের অন্য গাছগুলোর চামড়া অবধি শুকিয়ে এসেছে। নির্ঘাত কোনো একটা রহস্য আছে। প্রেমা ধীর পায়ে এগোচ্ছে। সামনে থাকা লোকটা তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। আচমকা চোখের সামনে অন্ধকার ছেঁয়ে আসে প্রেমার। সশব্দে পড়ে যায় শুকনো পাতার উপর।

পাতার মর্মর শব্দে আহত শরীর নিয়ে পিছনে তাকাতেই প্রেমাকে দেখতে পায় রেহান। প্রেমা তখন বেহুশ অবস্থায়। চিৎকার করে শুভ্রকে ডাকে ফে কিন্তু শুভ্র অবধি রেহানের গলার আওয়াজ পৌঁছায় না। রেহান ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই উঠতে পারছে না। শেষমেশ শরীরের উপর সর্বোচ্চ জোর দিয়ে উঠে প্রেমাকে গাছের নিচে শুয়ে দেয় সে। আলতো করে প্রেমার গালে থাপ্পড় দিয়ে তাকে ডাকতে শুরু করে কিন্তু প্রেমা চোখ খুলছে না। রেহান যে একা কিছু করতে পারবে না তা সে নিজেও জানে। তাই প্রেমাকে সাবধানে রেখে সে শুভ্রকে খোঁজা শুরু করে।

-“অনেকক্ষণ ধরেই তো হাঁটছি রে রুদ্ধ। সব কেমন যেন গোলকধাঁধায় মতো। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এখন কী হবে?”

-“একটা জিনিস খেয়াল করেছিস?”

-“কী?”

-“এই জায়গায় পা রাখলে অদ্ভুত একটা শব্দ আছে যেন নিচে কোনো দরজা আছে।”

-“দেখি তো…হ্যাঁ তাই তো। এখন কী করবি?”

-“আগেই নিচে নামা যাবে। এটা কোনো ফাঁদ হতে পারে। আশপাশটা দেখে আসি চল।”

রুদ্ধর কথামতো শুভ্র যে-ই না সামনে এগোবে, অমনি একটা জাল এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই রক্তাক্ত হাতে আরো ব্যথা পায় সে। রুদ্ধ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এমনটা আশা করেনি সে।

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৭

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৭ম পর্ব
~মিহি

শুভ্র আর রেহানকে এক হ্যান্ডকাফে আটকানো হয়েছে। দুজনেরই আঘাতপ্রাপ্ত হাত ব্যতীত অপর হাতে হ্যান্ডকাফ। চাইলেই ঘাতক তাদেরকে বন্দি করতে পারত কিন্তু সে সেটা চাচ্ছে না। আশেপাশে তাকিয়ে রুদ্ধকে খোঁজার চেষ্টা করছে দুজনেই। সমস্যা হচ্ছে দুজনকে একদিকেই যেতে হচ্ছে। সামান্য দুরত্ব রেখেও হাঁটা যাচ্ছে না। রেহানের টলমল অবস্থা। ছেলেটা এমনিতেই একটু দুর্বল, তার উপর আঘাত লেগেছে। রেহানের জন্য একটু পর পর শুভ্রকে বসতে হচ্ছে। রেহান ঠিকমতো উঠতেই পারছে না। সবকিছু অন্ধকার দেখছে সে। শুভ্র চারপাশে খুঁজছে। জঙ্গলটা ঠিক কতটা গভীর তা সে জানেনা তবে গুগল থেকে জানা তথ্যের ভিত্তিতে এটা একটা রহস্যময় জঙ্গল। এখান থেকে বের হওয়াটা যে সহজ হবে না তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে শুভ্র। আপাতত রুদ্ধকে খুঁজে পেলে অনেকটা উপকার হবে। ছেলেটা আদৌ সুস্থ আছে তো?

শুভ্র একটু এগোতেই বেশ কিছু পায়ের ছাপ দেখতে পেল। এসব কোনভাবে রুদ্ধর নয় তো? কিংবা সেই লোকটার যে তাদেরকে এখানে এনেছে আর প্রেমা আর তনয়াকে বন্দি করে রেখেছে? রেহান নড়তে পারছে না। এভাবে ওকে সাথে নিয়ে এগোনো সম্ভব না। আশেপাশে ভারি কোনো পাথর খোঁজে সে। খুব বড় না, মাঝারি সাইজের একটা পাথর খুঁজে পায়। রেহান তো পাথর দেখামাত্র ভ্রু কুঁচকায়ে ফেলে।

-“তুই কি এই পাথর দিয়ে আমার হাত থেঁতলে দিয়ে আমাকে ফেলে পালাতে চাচ্ছিস?”

-“ছাগল রে! পা চলে না তোর আর মুখ থামে না। ইচ্ছে করতেছে পাথর দিয়ে তোর মুখ থেতলে দেই। চুপ করে বসে থাক। হাত রাখ মাটিতে।”

-“না, আমি রাখবো না।”

-“ভাই, প্লিজ! এই বিপদের সময় ঢঙ করিস না। আল্লাহর দোহাই লাগে।”

রেহান হাত রাখলো মাটিতে। শুভ্র বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে হ্যান্ডকাফটাতে জোরেসোরে একটা আঘাত করল। রেহানের চিৎকারে এক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। পরমুহূর্তেই আলহামদুলিল্লাহ পড়লো। রেহানের হাত ঠিক আছে, হ্যান্ডকাফটাও খুলেছে। রেহানকে একটা গাছের পাশে বসিয়ে পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে লাগল শুভ্র। আট নম্বর জুতোর ছাপ, এটা রুদ্ধরই। মনে মনে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হলো সে। একবার রুদ্ধকে পেয়ে গেলে সবাই মিলে প্রেমা আর তনয়াকে খুঁজে বের করাটা ব্যপার নাহ।

রুদ্ধর প্রচণ্ড মাথা ঘুরছে। কিছুতেই চারফাশ স্পষ্ট দেখতে পারছে না সে। অবশ্য চাইলেই একটু বসতে পারে কিন্তু এই মুহূর্তে প্রত্যেকটা সেকেন্ড তার জন্য দামি। হাতের ঘড়িটাও নেই, সূর্যের আলো জঙ্গলের গাছগুলো আড়াল করে ফেলেছে। সন্ধ্যে নামলে চারপাশটা বিদঘুটে অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন আর নিজের ছায়ারও সন্ধান পাওয়া যাবে না। রুদ্ধর কেন যেন মনে হচ্ছে সে বারবার ঘুরে ফিরে একই জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছে। অবশ্য এটা তার ভুল ধারণা কেননা জঙ্গলের প্রতিটা মোড় একই রকম। রুদ্ধ ঠিক করলো তার যাওয়ার চিহ্ন রাখবে। যদিও হে তখনো আশেপাশে কোনো চিহ্ন রাখার মতো বস্তু খুঁজে পায়নি। ঝাপসা চোখে বারবার প্রেমার ছবি কল্পনা করছে সে। আফসোস হচ্ছে, কেন সে আগেই প্রেমাকে সব বললো না? দুই বছর আগে যে ভুলটা হে করেছিল, সেই একই ভুলটা আবারো কী করে করতে পারল সে! আগেরবার প্রেমা হারিয়েছিল নিজের ইচ্ছেতে, ফিরেছেও কিন্তু এবার যদি আর না ফিরে? রুদ্ধ যদি আর কখনো প্রেমাকে ফিরে না পায়? বুকের ভেতরে একরাশ শুন্যতা জমাট বাঁধে রুদ্ধর। হিংস্র পশুর চিৎকারের শব্দ শুনতে পাচ্ছে রুদ্ধ। একবার মনে হচ্ছে চিৎকারটা সত্যি, একবার মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশন। আশেপাশের সবকিছুই হ্যালুসিনেশন মনে হচ্ছে তার। কপাল থেকে রক্ত পড়া এখনো বন্ধ হয়নি। ঘাস দিয়ে কিছুক্ষণ আটকে ছিল কিন্তু এখন আবারো রক্ত স্বগতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। রুদ্ধর যত চিন্তা তার বন্ধুদের নিয়ে। তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এখানে আসতে রাজি হওয়া।

রাজন গুরুর পাঠানো লোক দুটোকে বেঁধে রেখেছে। রীতিমতো লোকগুলো স্বীকারও করে ফেলেছে ‘গুরু’ আসলে কোনো সাধক নয়। সে একজন ছোটখাটো স*ন্ত্রাসী। লোকের থেকে টাকা নিয়ে কিডন্যাপ করা, খু*ন করা এসব তার পেশার অন্তর্ভুক্ত। রাজনের একমুহূর্তের জন্য নিজেকে চরম বোকা একজন মানুষ মনে হয়। মেয়ের শোকে সে একদম বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠেছে। এখন তার তীক্ষ্ম মস্তিষ্কটা সচল হচ্ছে যে মস্তিষ্কে জং ধরিয়ে পালিয়েছে রুখমিনী। অবশ্য মেয়েটাকে সে বড় বেশিই ভালোবেসেছিল। নারী পাচার দলের সাথে দীর্ঘদিন থাকার পর রাজনের মনে হলো তার নিজের একটা দল থাকবে। ঐ দল থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজের দল গঠনের চেষ্টা করল সে কিন্তু কেউই তার দলে আসতে রাজি নয়। বাধ্য হয়ে একাই কাজ করতে শুরু করলো। মাসখানেক যাওয়ার পর তার বেশ নামডাক শুরু হলো চারদিকে। বেশ কয়েকজন তার দলে যোগ দিল। আগের নারী পাচার দলটা খেই হারিয়ে ফেলল। সবকিছু ভালোই চলছিল। একদিক রুখমিনী নামের এক মেয়েকে আনা হলো পাচারের জন্য। ভয়াবহ সুন্দরী না হলেও সে মেয়ের চোখে নির্ঘাত কোনো ভয়ঙ্করী মায়া কিংবা বশীকরণ ক্ষমতা ছিল। তার বলেই রাজনকে বশ করে বিয়ে করে ফেলল সে। রাজনের জীবনে ভালো পরিবর্তন আনার শত চেষ্টা তার। অবশেষে সে রাজনকে শর্ত দিয়ে বসলো রাজন যেন পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে নিজের শাস্তি মেনে নেয়। রাজন তখন রুখমিনীর প্রেমে মাতোয়ারা। সে তাই করলো। দলটা রসাতলে গেল। রাজনের স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়ার কারণে শাস্তি কমিয়ে চার বছরে আনা হলো। রাজনের জেলে সময় কাটত অপেক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে। অথচ তার ঘরে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, তার বিন্দুমাত্র খবর সে রাখেনি। রাজন যে দলে কাজ করত, সে দলের লিডার রুখমিনীকে পাঠিয়েছিল। রাজন টোপটা ভালোই গিলেছিল। রাজনের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে সবাই আবার আগের দলে ফেরে। আগের দলটা আবারো সিংহাসনে বসে। রুখমিনী যে রাজনকে ভালোবাসত তাও সত্যি নয়। রাজন চার বছর পর জেল থেকে বের হয়ে জানতে পারে তার চার বছরের একটা মেয়ে আছে। কথাটা মিথ্যে! মেয়েটা রাজনের নয়, রুখমিনীর প্রেমিকের। যার সাথে সে পালিয়েছে নিজের মেয়ের তোয়াক্কা না করে। রাজন জেল থেকে বের হয়ে খুব সাধারণ চাকরিতে ঢোকে যেন মেয়ের জীবন নষ্ট না হয় কিন্তু অতীতের কুকর্মের ফল তাকে পেতেই হয়েছে। শত শত মেয়ের জীবন নষ্ট করার ফল সে পেয়েছে নিজের মেয়েটাকে হারিয়ে।

প্রেমা আর তনয়ার হাত এক দড়ি দিয়ে বাঁধা। দুটো চেয়ারকে এক জায়গায় করে একসাথে হাত বাঁধা হয়েছে। প্রেমার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে দুজনকেই। তনয়া ধীরে ধীরে চোখ খোলে। ঝাপসা চোখে দেখতে পায় একটা ঘর। চারপাশে মাটি, অনেকটা সুড়ঙ্গের মতো। তনয়ার সামনেই দুটো লোক মেঝেতে পড়ে আছে। এই দুটো লোক গাড়িতে ছিল সেই লোকটার সাথে। লোক দুটোর অবস্থা দেখেই আঁতকে উঠলো তনয়া।

মানুষ ভুল করে, রাজনও করেছে। ভুলের মাশুলটাও দিয়েছে সে কিন্তু এখন তো আর কিছু হারানোর বাকি নেই। সমস্ত মায়া ইতিমধ্যেই ত্যাগ করে ফেলেছে। তাহলে কেন পুরনো খেলাটায় ফিরতে পারবে না সে? প্রেমা আর তনয়া দুজনের মধ্যে যেকোনো একজনকে নিয়ে খেলতে হবে। কাকে বাইরে পাঠাবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। একটা কাগজে দুজনের নাম লিখে সে। অতঃপর কাগজ দুটো মেঝেতে ফেলে। সেখান থেকে যেকোনো একটা কাগজ তুলে হাতে নেয়। কাগজের ভাঁজ খুলতেই জ্বলজ্বল করে ওঠে একটা নাম। রাজনের মুখের হাসি বহমান থাকে। সে যেই নামটা চেয়েছিল সেটাই উঠেছে। প্রত্যাশা আর ভাগ্য মিলে গেলে যে অনুভূতি হয়, তার মতো সুখের বোধহয় কিছু হয় না আর সেই সুখকর মুহূর্তটাই উপভোগ করছে রাজন।

চলবে…

জাস্ট ফ্রেন্ডস পর্ব-০৬

0

#জাস্ট ফ্রেন্ডস
#৬ষ্ঠ পর্ব
~মিহি

রুদ্ধর রাগ কমেনি এখনো। অবশ্য এটাকে রাগ বলা চলে না, বড়জোর অভিমান বলা যায়। কেননা এর আগেও বহুবার প্রেমা তাকে খোঁটা দিয়েছে, তাতে কখনো রুদ্ধর মনে কোনো প্রভাব পড়েনি কিন্তু এবার সবকিছু ভিন্ন। অনুভূতি আর অনুভূতির প্রকাশ সবকিছুই এক ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপিত হচ্ছে। কিছুটা দূরে একটা দোকান দেখতে পেল রুদ্ধ। এতটা রাস্তা পেরিয়ে এসে এখানে দোকান? এরপর বোধহয় কোথাও দোকান পাওয়া যাবে না। এখান থেকে কিছু কিনে খাওয়া-দাওয়াটা সেরে ফেলতে পারলে বাঁচা যায়। এই ভেবে গাড়ি থামালো রুদ্ধ।

-“কীরে রুদ্ধ, গাড়ি থামালি যে?”

-“ঐ যে দেখ রেহান, দোকান। চল কিছু নাস্তা কিনে আনি।”

-“শুভ্র তো খাবার এনেছে।”

-“সেসব ওখানের জন্য জমিয়ে রাখ। সব তো শুকনো খাবার। এখান থেকে আপাতত কিছু খেয়ে যাই।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

-“সবাই না হয় একটু বের হয়ে বাইরের বাতাস খেয়ে আসি। অনেকক্ষণ তো গাড়িতে বসে থাকা হলো।”

-“ঠিক বলেছিস।”

রুদ্ধর কথা শুনে সবাই এক এক করে গাড়ি থেকে নামলো। রুদ্ধ প্রেমার থেকে একটু দূরে দূরেই থাকছে। এটা যে সে ইচ্ছে করে করছে এমন না, প্রেমার প্রতি তার অভিমানটা অনেক আগে থেকে ছিল। এই ছোট্ট ঘটনা সেই ছোট্ট বহ্নি শিখাটাকে আগুনের জ্বলন্ত গোলায় পরিণত করেছে। রাগের বশে সে প্রেমাকে উল্টোপাল্টা কিছু বলে ফেলতে পারে এই ভয়েই সে প্রেমার থেকে দূরে দূরে থাকছে। প্রেমা অবশ্য বিষয়টা এখনো আন্দাজ করতে পারেনি। পারলে হয়তো এতক্ষণে বকবক করে রুদ্ধর মাথা খেয়ে ফেলতো।

_______________________

-“ওবায়দুর ভাই, কই যাও?”

-“পরিস্থিতিটা হাতে আনার ব্যবস্থা করতে।”

রাজন আর দাঁড়ালো না। গাড়ির ব্রেক ফেইল করতে হবে তাকে। যাতে সবাই সামনের মোড়েই ধাক্কাটা খায়। অনেকটা ঝুঁকি আছে এতে। তবে একবার গুরুর বলা মেয়েটাকে হাতে পেলে বাকিগুলোকে মরার জন্য ফেলে দিলেও অসুবিধে নেই। শুনশান রাস্তা, মেরে ফেলে গেলেও দেখার কেউ নেই। আচমকা রাজনের মাথায় অদ্ভুত একটা শয়তানি ইচ্ছেশক্তি চেপে বসে। মাথার পাগলামি পোকাটা কি আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো? নাহ! এটা হতে পারে না। যে পাগলামির জন্য তাকে শৈশব নষ্ট করে জেলে যেতে হয়েছিল, সেই পাগলামিটা আবার করে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করতে চায় না সে।

রুদ্ধ এসে গাড়িতে বসার পরপরই প্রেমা পাশের সিটটা দখল করল। প্রেমা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই লক্ষ করেছে রুদ্ধ তাকে এড়িয়ে চলছে। ঠিক কী কারণে এড়িয়ে চলছে তা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।

-“এই রুদ্ধ, তুই কি রেগে আছিস আমার উপর? এত রুড কবে থেকে হলি তুই? আমার রুদ্ধ তো কখনোই এমন ছিল না।”

-“তোর রুদ্ধ? রুদ্ধ তোর কবে হলো?”

-“ওমা তোর মনে নেই? কত সাধনা করে তোকে পটিয়ে বন্ধুত্ব করেছিলাম। সেই থেকেই তো তুই আমার।”

-“তাই বুঝি?”

-“হ্যাঁ তাই। এখন একটু হাস। এরকম রাগী রাগী মুখে একদম রামছাগল লাগতেছে তোরে।”

রুদ্ধ হেসে ফেলে। তার লজ্জা লাগছে, কোনো কারণ ছাড়াই। মূলত ‘আমার রুদ্ধ’ শব্দটা তার মন কেড়েছে। সামান্য দুটো শব্দ অথচ রুদ্ধর শরীর বেয়ে বিদ্যুতের ঝংকার বয়ে চলেছে শুধু ঐ দুটো শব্দের কারণে।

গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রুদ্ধ মনোযোগ দিয়ে প্রেমার বকবক শুনছে। গুগল ম্যাপে দেখলো সামনে রাস্তা দুদিকে গেছে আর সামনের দিকে বিশাল খাদ। রুদ্ধ গাড়ি ব্রেক করার চেষ্টা করে। কিন্তু ব্রেক কিছুতেই কাজ করছে না। রুদ্ধর মনে হচ্ছে যেন তার নিঃশ্বাসটাই বুঝি বন্ধ হয়ে এলো। সামনেই খাদ, মনে হচ্ছে স্টিয়ারিংটাও যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

-“গাড়ি থেকে লাফ দে।”

-“কেন? তুই একা যাবি?”

-“ফাজলামি করার সময় না এটা। সামনেই খাদ, গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে। সম্ভবত আর পাঁচ-ছ’ মিনিটেই সামনে খাদ পড়তে পারে। যত দ্রুত সম্ভব লাফ দে তোরা।”

-“আর তুই?”

-“তোরা লাফ দিলে আমিও নেমে পড়বো কোনোভাবে।”

-“এত স্পিডে চলছে! কীভাবে লাফ দিব?”

ঠিক এমন সময় রুদ্ধর চোখ পড়লো গাড়ির গ্লাসে। পিছন থেকে একটা গাড়ি আসছে। গাড়িটি পাশ ঘেঁষে চলতে শুরু করলো। গাড়ির ভেতর থেকে শ্যামলামতন লোকটা বলে উঠল,”এনি প্রবলেম ভাই?” রুদ্ধ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

-“ভাই, আমাদের গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না। সামনেই খাদ।”

-“আচ্ছা। আমি আমার গাড়ি আপনাদের গাড়ির পাশে নিচ্ছি। আপনারা জানালা দিয়ে বের হয়ে পার হয়ে আসুন।”

-“আচ্ছা। প্রেমা, তুই আগে যা।”

প্রেমা দ্বিধায় ভুগছিল কিন্তু রুদ্ধর রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে আর দ্বিধায় পড়ার সময় পেল না। সময় বেশি নেই। প্রেমার পর তনয়াকে পাঠালো রুদ্ধ। এরপর রেহান যেতে যাচ্ছিল এমন সময় পাশের গাড়িটি থেমে যায়। রুদ্ধ ঝাপসা চোখে শুধু দেখল পেছনে পড়ে থাকা গাড়ি থেকে একটা লোককে বের হয়ে নষ্ট গাড়িটাতে লাথি মারতে। রুদ্ধ চোখ বন্ধ করে ফেলল। পেছন থেকে প্রেমার চিৎকারটা শোনার পরপরই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো…

___________________________________________________________________________________________________

‘পা…পা…পানিইই…’ পিপাসায় ছটফট করতে করতে ঝাপসা চোখে এলোমেলো পা ফেলছে রুদ্ধ। কপাল ফেটে রক্তে মাখামাখি অবস্থা। চারিদিকে জঙ্গল। ঠিক কীভাবে এখানে এসেছে সে তা জানা নেই। জ্ঞান ফেরার পর হাতের সাথে একটা কাগজ বাঁধা পায়। কাগজে লেখা,

‘Let’s begin this game in this mysterious forest..Either try to find me or your live…Both options will make you reach to me…’

রুদ্ধর লেখাটা পড়তে অনেকটা সময় লেগেছে কেননা চোখের একপাশ থেকে এখনো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রুদ্ধর এখন সেই শ্যামলা লোকটার উপর সন্দেহ হচ্ছে। নিজের বোকামির জন্য প্রেমা আর তনয়ার জীবনটা না বিপদে ফেলে দেয় রুদ্ধ! এই চিন্তা তাকে ক্রমশ খেয়ে চলেছে। শুভ্র কিংবা রেহান কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না সে। চারদিকে জঙ্গল। এটাই কি থবে চিকন কালার বন? এক্সিডেন্ট তো অনেকটা দূরে হয়েছিল তাহলে এখানে কি করে এলো সে? রুদ্ধ চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে শেষ মুহূর্তে কী হয়েছিল। কোনোভাবে স্টিয়ারিংটা বামে ঘুরিয়েছিল রুদ্ধ। ফলে গাড়িটা খাদে না পড়ে গাছের সাথে ধাক্কা লাগে কিন্তু সেই ধাক্কাও খুব একটা হালকা ছিল না। স্টিয়ারিংয়ে মাথা লাগে রুদ্ধর আর শুভ্র, রেহান দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ে। রুদ্ধর কিছুই ভালোভাবে খেয়াল নেই। কোথায় আছে সে! তাও জানে না। আর এই চিরকুটটাই বা কে দিল তাকে? তাহলে কি এমনটা হয়েছে যে রুদ্ধর এক্সিডেন্ট হওয়ার পর লোকটা তাকে নিজের গাড়িতে তুলে এখানে এনে ফেলে দিয়েছে? তাহলে শুভ্র আর রেহানেরও তো আশেপাশেই থাকার কথা। ওরা কোথায়? রুদ্ধ বারকয়েক চিৎকার করে উঠে শুভ্র আর রেহানের নাম ধরে। নাহ! শুভ্র আর রেহানের পাত্তা নেই। ওদেরকেও ধরে নিয়ে যায়নি তো লোকটা?

রাজনের মাথা ধরেছে। শয়তানি পোকাটা এতবছর পর মাথায় চড়ার ফল। রাজন দরিদ্র পরিবার সন্তান, দশ বছর বয়সেই বাবা-মাকে হারায়। অতঃপর এতিমখানাই হয় তার একমাত্র স্থান। এতিমখানার জীবনটা তার মনকে ভালো রাখতে পারেনি। সেখান থেকে পালিয়ে এক নারী পাচার দলের সাথে যোগ দেয়। তার দায়িত্ব ছিল মেয়েগুলোর উপর নজর রাখা। নজর রাখার ব্যাপ্তিটা অনেক সময় অনেকটা দীর্ঘও হত। দেখা যেত এক-দু’মাস মেয়েগুলোর উপর তাকে নজর রাখতে হচ্ছে। এই সময়টাতে নিজের আনন্দের জন্য সে মাঝে মাঝেই বিকৃত মস্তিষ্কের কিছু খেলা উদ্ভাবন করত। মেয়েগুলোর মধ্যে যেকোনো একজনকে টার্গেট করত, তাকে ছেড়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে জঙ্গলের মাঝ বরাবর রেখে আসা হত। মেয়েটাকে সুযোগ দিত পালানোর কিন্তু মেয়েটা মূল রাস্তায় আসলেই তাকে ঢলে পড়তে হত মৃত্যুর মুখে। এই পাচার কাজ হত চিকন কালার বনে। বনের বাইরে থাকত দুজন রক্ষী। মেয়েগুলো পালিয়ে বের হলেই শ্যুট! কোনো কথা নেই। এতগুলো মেয়ের মাঝে দু’একজন মরলেও তাদের কিছু যায়-আসত না। বরং এক দলের একজনকে মারলে তাদেরই লাভ, অন্যরা ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। কী সুন্দর জীবন ছিল ঐটা! সব শেষ হয়ে গেল, সব! কোনো এক মহাপুরুষ বলেছেন,”পৃথিবীতে যাবতীয় অনিষ্টের পেছনে নারীর হাত থাকবেই।” আজ কথাটা পুনরায় রাজনের মাথায় ঘুরছে। আসলেই নারীর জন্যই তার জীবনটা এরকম বদলেছে। পরিবর্তনটা ইতিবাচক না নেতিবাচক আজও বুঝে উঠতে পারেনি সে। তবে ঘটনাগুলো এখনো চোখের সামনে ভাসে।

চলবে…