Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1055



প্রণয় স্রোতে পর্ব-০২

0

#প্রণয় স্রোতে
#পর্বঃ২
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)

পাশাপাশি বেলকনি তাও কিছুটা দূ’র’ত্ব।চৌধুরি বাড়িটি দুতলা।সামনের দিকের ঠিক মাঝ বরাবর সিঁড়ি। আর ডান পাশের শেষে ও বাম পাশের শেষে বেলকনি।এক বেলকনি থেকে অন্য বেলকনি সরাসরি দেখা যায় তবে দূরত্ব টা কম না।ফুলে সাজানো ঘরটা অ’স’হ্য মনে হচ্ছিল বহ্নির কাছে তাইতো একটু শীতল বাতাস নিতে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিল বহ্নি।তবে এখানে এসে যে এমন অ’প্র’ত্যা’শি’ত কিছু দেখতে পাবে ভাবিনি।ইয়ারাবদের ঘরের আলো কিছুটা এসে পড়ছে বেলকনিতে ও।আর সেখানেই দুজন দাঁড়িয়ে গল্প করছে।বহ্নির হঠাৎই মনে পড়ে গেল ইয়ারাব এর সেই ই’চ্ছে’টার কথা।সে বলেছিল তাদের প্রথম রাত তারা গ’ল্প করে কাটাবে।একে অপরকে জানবে।বহ্নি ও সেটাই ভেবে রেখেছিল। কি’ন্তু ভা’গ্য কি করল?ইয়ারাব নিজের মনের ই’চ্ছে পূরণ করল তবে বহ্নি এর সাথে নয়, তানভি এর সাথে।

এক দৃ’ষ্টি’তে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যে কখন বহ্নি এর চোখ ঝা’প’সা হয়ে এসেছে সেটা বুঝতে পারল না বহ্নি।তবে দরজা খোলার শব্দ শুনে পেছনে ফিরে বুঝতে পারল সে চোখে ঝাপসা দেখছে।আর এ জন্য অ’শ্রু কণা দায়ী। আরাব বহ্নি কে খাটে দেখতে না পেয়ে একটু অবাক হলো ঠিকই তবে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো।কারণ বেলকনিতে একটা না’রী’মূ’র্তির অবয় স্প’ষ্ট। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল আরাব। ত’ত’ক্ষ’ণে বহ্নি চোখ মুছে ফেলেছে। দৃ’ষ্টি রেখেছে শূন্যে। আরাব পাশে এসে দাঁ’ড়া’লো তবে কোনো শব্দ করল না। বহ্নি সবটা বুঝে ও কোনো সাড়া দিল না।

কেটে গেল কিছু মু’হূ’র্ত।দুজনেই চুপচাপ। নিরবতা ভেঙে আরাব বলে উঠল,

“আমার ভাই এর ওপর তোমার অনেক রাগ না?”

বহ্নি স্থি’র।দৃষ্টি তখনও কালোতে আবৃত আকাশপানে।

বহ্নি এর এমন গা ছাড়া ভাব পছন্দ হলো না আরাবের।তখন ও গাড়িতে তাকে ইগনোর করেছে আবার এখন ও তাকে ইগনোর করছে!আরাব বহ্নিকে নিশ্চুপ দেখে হঠাৎই হাত ধরে হেঁ’চ’কা টান দিলো।মূহুর্তেই বহ্নি টাল সামলাতে না পেরে আরাবের বুকের ওপর গিয়ে পড়ে। হঠাৎই এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য দুজনেই অ’প্র’স্তু’ত হয়। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের এত নিকটে এসে যেন দিশেহারা হয়ে পড়ল বহ্নি। নিজেকে ছাড়ানোর জন্য জোর দিল।তবে আরাব নি’র্বি’কা’র!বহ্নি এর অস্বস্তি টা যেন চোখে পড়ছে না তার।বহ্নি নিজের সাথেই চেপে ধরে রাখল আরাব।

“আমাকে ছাড়ো প্লিজ!”

বহ্নি এর কাতর স্বরে বলা কথাটা যেন ঠিক হৃদয়ে গিয়ে বিধল আরাবের।এমন কাতর স্ব’রে কেউ কখনো কোনোদিন আরাবের সামনে বলিনি।নাকি বহ্নি এর কথাটা আরাবের কাছে বেশি কাতর মনে হলো।উত্তর জানা নেই আরাবের। বহ্নি কে ছেড়ে একটু দূরে দাঁ’ড়ালো আরাব।

“সরি!একচুয়ালি আমি ওভাবে ধরতে চায়নি কিন্তু তুমি এমনভাবে ইগনোর করছিলে যে!”

আমতা আমতা করে বলে উঠল আরাব।তার নিজের হৃ’দ’পি’ণ্ড ও তো এখন দিশেহারা।এই প্রথম কোনো নারী জায়গা পেল তার ব’ক্ষ’স্থ’লে।আর অ’দ্ভু’ত’ভাবে শীতলতা ছুয়ে গেল আরাবের মনের মধ্যে।কিছুক্ষণ নিরব থেকে আরাব বলে উঠল,

“দেখ বহ্নি, যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। হয়তো তোমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা ভালো কিছু না!তবে আমি চায় তুমি ভাইকে ক্ষ’মা করে দাও!”

আরাবের কথা শুনে তাচ্ছিল্য হাসল বহ্নি।তবে ওই বিষয়ে কিছু বলল না।কিছুক্ষণ মৌণ থেকে তারপর বলে উঠল,

“আমি তোমার সাথে বেড শেয়ার করতে পারব না।আই নিড টাইম।তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।আমি বেলকনিতে থাকতে পারব!”

আরাব আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল এমন কিছু হবে তবে তাই আর কথা বাড়ালো না।চলে এলো নিজের ঘরে। লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল।পুরো ঘরে কোনো আলো নেই।সবটা আঁ’ধা’র। যেমনটা এখন বহ্নি এর মনের কোন।

দূর আকাশ এর দিকে তাকিয়ে বহ্নি বিরবির করে উঠল,

“আমি খুব খারাপ।আর তাই আমার সাথে বাকিরা ও খারাপ থাকবে।”

কথাগুলো বলতে বলতে দুচোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়তে লাগল বহ্নি এর।
_______________
সূর্য দি’গ’ন্তে বিরাজ করছে বেশ কিছুক্ষণ হলো।কিন্তু যখনই সূর্য নিজের তী’র্য’ক চাহনিতে পৃথিবীতে চাইলো তখনই সেই তীর্যক চাহনির রেশে ঘুম ছুটে গেল তানভি এর।নিজের অ’ব’স্থা’ন বুঝতে সময় লাগলো কিছুটা।

চোখ খুলে বেলকনি বাইরের দৃ’শ্য দেখে তানভি অবগত হলো তারা এখনো বেলকনিতে আছে। ইয়ারাব আর তানভি একে ওপরের কাধকে বালিশ বানিয়ে গ’ল্প করতে করতে বেলকনিতেই ঘুমিয়ে গেছে।নিরবে হাসল তানভি। এমন একটা দিন আসবে সেটা হয়তো কিছু দিন আগে ও তার অবগত ছিল না। ইয়ারাবকে ডেকে নিয়ে ঘরে চলে এলো তানভি।ফজরের ও’য়া’ক্ত আর বেশিক্ষণ নেই। জলদি নামাজ আদায় করতে হবে।
_________________
ফজরের ওয়াক্তে প্রতিদিন ওঠার অভ্যাস হওয়ায় আজ ও সকাল সকালই ঘুম ভাঙল বহ্নি এর।তবে ঘুম থেকে উঠে এত বড় সা’র’প্রা’ই’জ পাবে বহ্নি সেটা ছিল ক’ল্প’না’তী’ত।

আরাব বহ্নি কে আ’ষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরে নি’দ্রা’ম’গ্ন হয়ে আছে।কিছুক্ষণের জন্য কিংকতব্যবিমূড় হয়ে যায় বহ্নি। এটা কি করে স’ম্ভ’ব?সে তো বেলকনিতে ছিল। তাহলে বেডে এলো কি করে? তানভি ও বহ্নি কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাতো সেজন্য ঘুমের মাঝে টের পায়নি বহ্নি। কি’ন্তু!

নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় বহ্নি।প্রচন্ড রাগ হওয়া স্ব’ত্বে’ও কিছু বলল না। ফ্রেশ হয়ে নামাজ টা আগে আদায় করতে হবে! প্রশ্নের জবাব টা না হয় পরে নেবে সে।এগুলো ভেবেই এক রাশ ক্ষো’ভ নিয়ে সেখান থেকে প্র’স্থা’ন করল বহ্নি।
_____________
প্রতিদিনের মতো আজ ও বেলা করে উঠল আরাব।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়ির কাটা ৯ টা ছুঁইছুঁই। আশেপাশে বহ্নি কে না দেখতে পেয়ে অবাক হলো আরাব।তার ধারণা অনুযায়ী কিছু ঘটে নি। সে ভেবেছিল বহ্নি এর চেচামেচি তে ঘুম ভাঙবে তার।কারণ বহ্নি কে ঘুমন্ত অবস্থায় কাল বেলকনি থেকে ঘরে নিয়ে এসেছে সে।তা ও আবার কোলে করে! এত সহজে তো বহ্নি আরাবকে ছাড়বে না।ভাবতেই ঠোঁটের কোনে মি’ষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠল আরাব এর। তার বউটা যে নরমসরম বা দূর্বল নয়,সে আন্দাজ আগে থেকেই আছে আরাবের।এখন দেখার পালা তার দ’জ্জা’ল বউ এই অপরাধে তাকে কি শা’স্তি দেয়?

নামাজ পড়েই বহ্নি আরাবের ফুফির ঘরে গিয়ে বসে রইল।নানা রকম কথা বলল তার সাথে। কারণ একটাই! আরাব!কাল রাতে নিশ্চয়ই এমনি এমনি বহ্নি কে ঘরে আনেনি।কোলে করেই এনেছে! এটা মাথাতে আসলেই আরাবের মাথা ফাটিয়ে দিতে ই’চ্ছে করছে বহ্নি এর। তাইতো ফুফির ঘরে এসে বসে আছে সে।

ব্রে’ক’ফা’স্ট টেবিলে বসে আছে সবাই।আজ স’ন্ধ্যা’য় ওদের রিসিপশান।সেটা নিয়েই নিজেদের ফুফির সাথে টুকটাক কথা বলছে আরাব আর ইয়ারাব। বহ্নি চুপচাপ খাচ্ছে। তানভি ও তাই। তবে খাওয়ার মধ্যে মাঝে মাঝে ইয়ারাব এর দু’ষ্টু’মিতে খাবার গলায় আটকে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে তানভি এর।তবে সেদিকে কারো ল’ক্ষ্য না থকলে ও বহ্নি এর চোখ এড়ালো না কিছুই।

খাওয়া শেষে সকলে চা নিয়ে বসল। আরাব, ইয়ারাব দুজনেই ব্রে’ক’ফা’স্ট এর পরে চা খায়।সেজন্য বাকিরা ও শেষে চা নিলো।তবে চা মুখে দিতেই ইয়ারাব এর চোখমুখ কুচকে এলো।এটা চা নাকি করলার রস।বাকিরা নির্বিঘ্নে চা খাচ্ছে। শুধুমাত্র ইয়ারাব এর এমন অবস্থা। সকলের সামনে কিছু বলতে ও পারছে না।যতই হোক সামনে তার সদ্য বিয়ে করা বউ আর ছোট ভাইয়ের বউ আছে।তাই বাধ্য হয়ে চোখ মুখ বিকৃত করে কোনো রকম চা টা শেষ করে উঠল ইয়ারাব। তবে যাওয়ার আগে যদি একবার বহ্নি এর দিকে তাকাতো তাহলে চোখে পড়ত তার মিটিমিটি হাসি।

চলবে,

প্রণয় স্রোতে পর্ব-০১

0

#প্রণয় স্রোতে
#সূচনা_পর্ব
#লেখিকা আরোহি জান্নাত (ছদ্মনাম)

“আমার ভাই এর জীবনটা ন’ষ্ট করার জন্য এই বিয়েতে তুমি রাজি হয়েছিলে তাই তো মিস.বহ্নি।ওহ সরি মিসেস বহ্নি।”

সদ্য বিয়ে করা বউকে গাড়িতে বসিয়ে কথাটা বলে উঠল আরাব।

আজ একটু আগেই আজাদ ভিলাতে দুটো বিয়ের কা’র্য’ক্র’ম স’ম্পূ’র্ণ হয়েছে।হাসিখুশি দুই পরিবার নিজেদের মধ্যে আ’ত্মী’য়’তা’র ব’ন্ধ’ন সৃ’ষ্টি করেছে।বিয়ে শেষে নিজের বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করলো দুই নব দ’ম্প’তি আর তাদের পরিবার।তবে চলতি গাড়িতে নিজের সদ্য বিয়ে করা বউয়ের উ’দ্দে’শ্যে কথাটা বলে উঠল আরাব।
বহ্নি নির্বিকার।দৃ’ষ্টি তার জানালার দিকে স্থির।আকাশটা নিকাশ কালোতে নিমজ্জিত না হলে ও জ্যোতিতে ভরপুর ও নয়।গুমোট মেঘে পরিপূর্ণ। আর সেই আকাশকেই এক মনে প’র্য’বে’ক্ষ’ণ করে চলছে বহ্নি।বহ্নি এর কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে পুনরায় একই প্রশ্ন করে উঠল আরাব।এবার আরাবের দিকে চাইলো বহ্নি। শান্ত তার দৃ’ষ্টি। আরাবের দিকে চেয়েই বহ্নি উল্টো প্রশ্ন করে উঠল,

“তোমার এমন কেন মনে হচ্ছে যে আমি তোমার ভাই এর ক্ষতি করব?”

বহ্নি এর প্রশ্ন শুনে দমে গেল আরাব।খোঁচা টা যে ঠিক জায়গায় লেগেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না বহ্নির। মুখে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আবার ও আকাশ দেখাতে ব্য’স্ত হয়ে গেল বহ্নি। তবে দৃষ্টি আাকাশের দিকে আছে মানেই যে মনটা ও আকাশের কাছে এটা ভাবা ভুল। বহ্নি তো হিসাব কষতে ব্যাস্ত গত ৩৭ দিনের হিসাব।যেটা বহ্নি কে ভেঙে চূরে পাথরে পরিণত করেছে অথবা সৃষ্টি করেছে একটা কু’ৎ’সি’ত মনের।

এখান থেকে ঠিক ৩৭ দিন আগে চৌধুরি বাড়ির বড় ছেলে ইয়ারাব চৌধুরির জন্য পাত্রী দেখতে আসা হয় আজাদ ভিলাতে।নারায়ণগ’ঞ্জ এর জমিদার বংশের ছেলে।আবার ঢাকাতে বড় ব্যাবসা আছে এটা শুনে আর না করেন নি তোহান আজাদ।বহ্নি কে দেখতে আসে ইয়ারাব এর ফুফি উ’জ্জ’য়ী’নি চৌধুরি আর ভাই আরাব চৌধুরি। জানা যায়,কয়েকদিন আগেই নাকি ইয়ারাব বহ্নি কে রাস্তায় দেখেছে আর পছন্দ হয়েছে। নিজের মায়ের সমান ফুফির কাছে নি’র্ধি’দ্বা’য় সেটা জানায় ইয়ারাব। আর তার ফুফি ও সময় নষ্ট না করে ইয়ারাব এর জন্য বহ্নি কে দেখতে চলে আসে।

এক মাসের মাথাতে এনগেজ’মে’ন্ট হওয়ার প্র’তি’শ্রু’তি দিয়ে সেখান থেকে বিদায় নেয় আরাবের পরিবার।তবে যাওয়ার আগে বহ্নি এর হাতে এক টুকরো কাগজ দিয়ে যায় আরাব।যেখানে ইয়ারাব এর ফোন নম্বর ছিল।

বড় বোনের বিয়েতে তানভি ও আবেগে আ’প্লু’ত।সব কিছুই ভালে ভাবে ঘটছিল।উজ্জয়ীনি চৌধুরী কথামতে এক মাসের মাথায় এনগেজমে’ন্ট এর জন্য ও আসেন।তবে সবটা ওলট পালট হয়ে যায় যখন ইয়ারাব বহ্নি কে দেখে বলে ওঠে তার পছন্দ হওয়া মেয়েটি বহ্নি নয়।সে তানভি।

সকলের তখন হতভম্ব হয়ে যায় ইয়ারাব এর কথায়।কত বড় একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে সেটা সকলেই বুঝতে পারে।

ইয়ারাব রাস্তায় এক পলক তানভিকে দেখে।না জানে তার নাম,না পরিচয়।তবে খোঁ’জ নিয়ে জানতে পারে তানভি তোহান আজাদ এর মেয়ে।ব্যস ইয়ারাব তার ফুফিকে জানায়।তোহান আজাদ এর বড় মেয়ে বহ্নি। তাই বিয়ের প্রস্তাব আসাতে সে অবশ্যই বহ্নি কে উজ্জয়ীনি চৌধুরি এর সামনে উ’প’স্থি’ত করেন।কারণ এটাই স্বাভাবিক। তবে এনগেজমেন্ট এর দিন এমন অ’প্র’ত্যা’শি’ত কিছু ঘটবে সেটা আশা ছিল না কারোর।

বহ্নি এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল সেদিন।আর ভেবে চলেছিল বিগত এক মাস ইয়ারাব এর সাথে কাটানো মু’হূ’র্ত।না! তারা দেখা করেনি! তবে ইয়ারাব প্রতি নিয়ত বহ্নি কে ফোন করত।নানা রকম স্ব’প্ন সাজাতো দুজন।বহ্নি এর শু’স্ক হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ঝরেছিল ইয়ারাব এর প্রণয় বাণীগুলো।কিন্তু এখন সে সবই যেন মরিচিকা।

উজ্জয়ীনি চৌধুরি আর তোহান আজাদ মিলে সেদিন ভেবে কূল কিনারা করতে পারছিলেন না কি করবেন! উজ্জয়ীনি চৌধুরির পক্ষে সম্ভব ছিল না ইয়ারাব এর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বহ্নি এর সাথে বিয়ে দেওয়া।আর না তোহান আজাদ এর পক্ষে সম্ভব ছিল বড় মেয়ের স্ব’প্ন’গু’লো’কে গলা টিপে মেরে তার হবু বরের সাথে তার ছোট বোন তানভির বিয়ে দেওয়া।ইয়ারাব ও অনুতপ্ত হয় বিগত দিনগুলো নিয়ে। যে মেয়েটাকে ক’ল্প’না করে হাজার স্বপ্ন সাজিয়েছিল ইয়ারাব। বাস্তবে সেখানে ছিল তার বড় বোন।

যখন দিশেহারা পড়ে সবাই তখনই উজ্জয়ীনি চৌধুরি এক অন্য রকম সিদ্ধান্ত নেন। ইয়ারাব এর সাথে তানভি আর আরাব এর সাথে বহ্নি এর বিয়ের প্রস্তাব দেন তোহান আজাদের কাছে। তোহান আজাদ ও সবটা ভেবে দেখেন।এই মূহুর্তে এটাই সবচেয়ে ভালো পরামর্শ তাই তিনি ও আর দ্বি’ম’ত করেন না।আংটি বদলের মাধ্যমে সেদিন আরাবের অ’র্ধ অধিকার হয়ে যায় বহ্নি আর তানভি ইয়ারাব এর।

সেদিন সব মিটে যাওয়ার পর তোহান আজাদ বহ্নি জিজ্ঞেস করেন, সে কি কোনো ভুল করল এভাবে আরাবের সাথে বহ্নি এর এনগেজমেন্ট আর বিয়েতে রাজি হয়ে? কিন্তু বহ্নি সেদিন তার বাবাকে কিছুই বলে নি।সে মেনে নিয়েছে সবটা! এছাড়া তানভি ও বহ্নি এর কাছে জিজ্ঞেস করেছিল সে ইয়ারাব কে বিয়ে করবে কিনা!

সেদিন বড্ড হাসি পেয়েছিল বহ্নির।তবে সবাইকে সবদিক থেকে আস্বস্ত করেছিল।কারণ সবটা সবাই জেনে ও ওর ওপর কি সুন্দর চাপিয়ে দিল।বহ্নি জানে সে বিয়েতে রাজি না হলে ইয়ারাব আর আরাবের পরিবার ফিরে যাবে। তানভি এতে কিছু যায় আসবে না কিন্তু বহ্নি!সে তো এই কয়দিনে নিজের একটা আলাদা জগৎ তৈরি করেছিল যেখানে শুধু প্রেমের ফুল ছিল অথচ ইয়ারাব কি সুন্দর ভুল বোঝাবুঝির দোহায় দিয়ে তার সদ্য গড়ে ওঠা ফুলের বাগানটাকে পিসে চলে গেল।এর শা’স্তি তো তাকে পেতে হবে!আর তার জন্য যদি তাকে আরাবকে বিয়ে ও করতে হয় তবে সে রাজি।

সকল রীতিনীতি শেষে বাড়ির দুই বউকে পাঠানো হলো বাসর ঘরে।তানভি এক রাশ ভয় আর ভালোলাগার সংমিশ্রণে বসে আছে ইয়ারাব এর ঘরে। চারিদিকে ফুলে ফুলে সজ্জিত। মেঝের এক কোনো কিছু মোমবাতি ও আছে। মোমবাতির দিকে তাকাতেই যেন লজ্জারা এসে ভীড় করল তানভি এর হৃদয় কোণে। হুট করে যে এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে সেটা ভাবেনি তানভি।এই তো এক স’প্তা’হ আগে ও বড় বোনের বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। বিয়েতে এটা হবে, ওটা হবে বলে কত আনন্দ ছিল। জিজু এটা করবে ওটা করবে বলে বহ্নি কে কয়েকবার ল’জ্জা ও দিয়েছে সে।অথচ সেই মানুষটার বউ হয়ে আজ তার ঘরে বসে আছে তানভি। মানুষটা তাকে পছন্দ করে,ভালোবেসে এই বিয়েটা করেছে এটা ভাবতেই যেন আরো বেশি ল’জ্জা লাগতে লাগল তানভি এর।

কিছুক্ষণ পরেই সেই ল’জ্জা’য় রাঙা হয়ে ওঠা মানবির স্বা’মী নামক মানুষটির আগমন ঘটল ঘরে। শুভ্র রঙের শেরওয়ানিতে এক অন্য রকম মাধুর্য চোখে বিধছে তানভি এর।লজ্জা আর অ’স্ব’স্তি’তে মানুষটির দিকে একবার ও তাকায়নি তানভি।কিন্তু তার স্বামী নামক ব্যাক্তিটি যে এতটা সুন্দর সেটা আগে জানলে সারাদিন ড্যাবড্যব করে তাকিয়ে থাকত তানভি। নিজের ভাবনাতে অবাক হলো তানভি।এসব কি ভাবছে সে!

ইয়ারাব নিশ্বব্দে এগিয়ে এলো।ইয়ারাব এগিয়ে আসতেই আরো জড়োসড়ো হয়ে বসল তানভি।হৃ’দ’পি’ণ্ড অ’স্বা’ভাবিক হারে ছুটছে।তানভিকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ইয়ারাব বলে উঠল, চলো আগে নামাজটা পড়ে নেই তানভি ও দ্বি’রু’ক্তি করল না দুজনেই নামাজ পড়ে নিলো।ইয়ারাব একেবারে ফ্রেশ হয়ে নামাজে বসেছিল তবে তানভি তখনও বিয়ের সাজে থাকায় নামাজ শেষে তাকে ও ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল ইয়ারাব।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে ইয়ারাব। তার থেকে সামান্য দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে তানভি।

“আ’ম সরি তানভি।”

হঠাৎ ইয়ারাব এর কন্ঠে সরি শুনে অবাক হলো তানভি।ঠিক কি জন্য সরি বলল ইয়ারাব সেটা বুঝতে পারলো না।তখন ইয়ারাব তানভি এর দিকে ফিরে বলে উঠল,

“তুমি ভেবে তোমার বোনের সাথে এক মাস সময় কাটানোর জন্য সরি।জানো, এই এক মাস আমি বহ্নি এর সাথে অনেক গ’ল্প করেছি।মাঝে মাঝে ল’জ্জা ও দিয়েছি ওকে! তবে কখনোই সীমা ল’ঙ্ঘ’ন করে কথা বলিনি।তবু ও আমি দুঃখিত!”

ইয়ারাব এর কথা শুনে ভালে লাগল তানভি এর।সে ও জানে সবটা মি’স’আ’ন্ড্রা’স’ট্যা’নিং ছিল তারপর ও ইয়ারাব তাকে সবটা বুঝিয়ে বলার চে’ষ্টা করছে এটা ভেবেই অদ্ভুত ভালো লাগা গ্রাস করল তানভি কে।

“আপনি যেটা করেছেন সেটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ওসব ভেবে আর কষ্ট পাবেন না।আপু নিজেকে সামলে নিয়েছে!”

মাটির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে উঠল তানভি।কেন যেন তাকাতে পারলো না ইয়ারাব এর দিকে। ইয়ারাব তানভির হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো।ইয়ারাব এর বাহুতে নিজের বাহুর স্পর্শ যেন বিদ্যুৎ এর ন্যায় লাগলো তানভি এর।ইয়ারাব তানভিকে নিজের পাশে দাড় করিয়ে তানভি এর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠল,

“আজ সারারাত গ’ল্প করব আমরা।”

আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো তানভি এর।নিজেকে বড্ড সুখী মনে হলো।কিন্তু তার অবচেতন মন জানতে ও পারল না।দূর থেকে এক দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে কেউ।

চলবে,

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১৫ (শেষ)

ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে রোজ ফালাক। বাড়িতে কথা চলছে আগামী কাল হয়তো ওদের বিয়েটা সম্পন্ন হবে। আকাশে আজ পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে। গোল রূপার থালার মত শুভ্র স্নিগ্ধ চাঁদটার আশেপাশে মিটিমিটি জ্বলছে চাঁদের সাথি তারারা। রোজের দৃষ্টি ফালাকের ওপর নিবদ্ধ একধ্যানে সে চেয়ে আছে ফালাকের শুভ্র মুখশ্রীতে। আসলেই মানুষটা অতিরিক্ত ফর্সা। শরীরের সবুজাভ শিরাগুলোও দেখা যায়। তাঁর ভেতরে তপ্ত র’ক্ত চলাচলও স্পষ্ট বোঝা যায়।মানুষটার গালের ছোট করে কাঁটা চাপদাড়ি। রোজের কলেজের দিনটার কথা মনে পড়লো। সেদিন ক্লিনসেভ ছিল, মানুষটা হাসলে তাঁর ডান গালের মধ্যভাগে টোল পড়ে। চোখে ঘন পাপড়ি। বিধাতা হয়তো নিজের কুদরত উপুড় করে ঢেলে তৈরি করেছে এই সুদর্শন শুভ্রমানবটাকে। ফালাকের পরনে শুধু ট্রাউজার। গেঞ্জি ছিল একটু আগে ভুলবশতভাবে কফি পড়ে ভিজে গেছে বলে খুলে রেখেছে। রোজের চোখ এবার ওর শরীরে পড়ল। মানুষটার শরীরে কোনো দাগ নেই। রোমশ ধবধবে সাদা বুকটাও চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শুধু পেটের কাছে চিকন করে একটা কা’টা দাগ। রোজের মনে পড়লো এটার ওরই দেওয়া। মুহূর্তেই একরাশ বিষাদ এসে হানা দিল রোজের মনের কোনে। আনমনেই সে নিজের হাতটা বাড়িয়ে ফালাকের পেটের ওপর রাখলো।ফালাক ভড়কে,চমকে তাকালো। কিন্তু সে চমক প্রকাশ করলো না। রোজ কা’টা জায়াগা টুকুতে হাত বুলিয়ে বলে,

-“কেন জানি না, এটা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। কেন বলুন তো? বাবাই-মামনি, নক্ষত্র-হীরামন আর চাচ্চু বড়াম্মুর পরে আপনার কষ্টে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ”

ফালাক জবাব না দিয়ে রোজের হাত চেপে ধরল। এর পর হ্যাচকা টানে রোজকে নিজের কাছে টেনে নিলো। উদম শরীরের ঠিক ডানপাশে গিয়ে লাগলো রোজের মাথা। শীলত বুকের সঙ্গে মিশিয়ে দাড় করিয়ে রাখলো ফালাক। রোজ অনুভব করল ফালাকের হৃদস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক নয়। এমনকি রোজকে জড়িয়ে ধরেও টলছে ফালাক। পুরোনো নিজেকে খুজে পেয়ে রোজ অবাক হলো। সেই ছোট্ট বেলার মত নাকমুখ ফুলিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর। নিজের কাঠিন্যভাব মিটিয়ে ফালাকের বুকে মুখ গুজে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এটা কি ঠিক হবে? ন্যাকামি হবে না তো? রোজের চোখের কার্নিশ বেয়ে তপ্ত তরল ফালাকের বুকের ওপর পড়তেই ফালাক আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রোজকে। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা। রোজ নিজেই বলল,

-“জানেন,আমাকে অনেকে ভালোবাসা দেখিয়েছে। অনেকে বুঝিয়েছে নিজের অনুভূতি। আমি দেখেছি সব, বুঝেছি সব। কিন্তু কেউ সাহস করে আমাকে নিজের কাছে টানতে পারেনি। সবাই অনুমতির আশায় ছিলো। কিন্তু তুশিব নামক ছেলেটা একবার আমার হাত ধরতে গিয়েছিলো। তখন কোনো একটা মিশন নিয়ে কাজে ব্যস্ত ছিলাম আমি। বরাবরের মত তাকেও একটা চর মে’রেছিলাম।তারপর থেকে ওকে প্রায় দেখতাম আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। হয়তো বোঝাতো সে আমাকে সম্মান করে, ভালোবাসে। কিন্তু আমার মন ওকে একদমই সহ্য করতে পারতো না। পুরোনো এক ফোনকলের কথা মনে করিয়ে দিত, তাঁর বিশ্বাসঘা’তকা মনে করিয়ে দিত। ছেলেদের বিশ্বাস করাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রেমে ভরসা ছিল না। বারংবার মনে হতো আমি হয়ত এমন কিছু হারিয়েছে যেটা নিজের অজান্তে আমার মনের সঙ্গে যুক্ত। ”

-“পুরোনো কথা বাদ দে চাঁদ। ”

-“তুশিবকে কেন মে’রেছেন? ”

-“তোকে ও নিজের করতে চেয়েছিল। আমার চাঁদকে অন্য কোনো মানুষ নিজের করবে এটা আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম? তোকে ছুঁতে চেয়েছে এটা মেনে নিতাম? তোকে তো বলেছি চাঁদ, তোর হাজারটা রোমিও আশিক থাকলেও তুই শুধু আমার হবি। আর কারোর না। তোকে অন্য পুরুষ ছোঁবে সেটা মানতে পারবো না আমি। তুই আমার আসক্তি চাঁদ, এই নেশায় মত্ত আমি। এটা ছাড়া আমার চলবে না। এব্যাপারে আমি প্রচন্ড স্বার্থপর। তোর ভাগ আমি কাউকে দেবো না। কাউকে না। ”

-“মেহমেদ ভাই যে মুগ্ধতাকে পছন্দ করতেন। এটা কি জানতেন আপনি? ”

-“সর্বপ্রথম কথাটা ও নিজেই আমায় জানিয়েছিলো। সেজন্যই আমি মুগ্ধতাকে সঙ্গে রাখতাম। ইরফান চাচার জন্য ওর কোনো ক্ষতি হোক সেটা চাইতাম না। কিন্তু ও ভুল করেই চলেছে। তবুও ওকে শাস্তি দেইনি মেহমেদের কথা ভেবে। তোর ওপর আঘা’ত করার পরও চুপ ছিলাম এটা ভেবে, এখানে ওর ভুল নেই।তুই কি সেজন্য কষ্ট পেয়েছিস? ”

-“আমাকে এই চিনলেন? ছাড়ুন আমাকে। ”

-“মনে করে দেখ, আমি নিজে তোকে টানিনি। তুই প্রথম আমাকে টাচ করেছিস তারপর আমি। নিজ থেকে যখন একবার এসেছিস কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না।আর স্যরি আমি মজা করছিলাম। আমি জানতাম পুরো সত্যটা জানলে তুই মুগ্ধতাকে ছেড়ে দিবি। তাই বাড়তি ঝামেলা করিনি। ”

রোজ নিশ্চুপ। ওর পরিবার পরিপূর্ণ আজ। প্রতিটা ভালোবাসার মানুষ নিজের ভালোবাসা পেয়েছে। ভীর রাই বাচ্চা এ্যাডোপ্ট করার চিন্তা করছে। মেহমেদকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে মুগ্ধতা।অয়ন্তি সন্তানসম্ভবা। ফালাক পলিটিক্যাল লাইফ ছেড়ে পুরোপুরি কলেজে মনোযোগী হবে। আনসারী সাহেব পুনরায় চাকুরিতে জয়েন করবেন। সবটা আগের মত স্বাভাবিক শান্তিময়। এমনটাই তো চেয়েছিল রোজ।একটা স্বাভাবিক জীবন। ভালোবাসায় ভর্তি একটা বাড়ি। রোজ চোখ বুজে এই নিরব নিস্তব্ধ পরিবেশে ফালাকের হৃদস্পন্দন শুনছে। রোজের খেয়াল হলো ফালাকের বুকের ডানপাশে সে মাথা রেখেছে। রোজ মাথা তুলে ফালাকের দিকে তাকায়। ফালাক সে দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে,

-“আবার কি? মাথা রাখ। ”

-“আপনার হার্ট? ”

-“রাইট সাইডে। আ’ম এক্সেপ্শনাল। ”

-“নো, ইয়্যু আর পার্ফেক্ট। আপনার সবকিছুই সঠিক। ”

-“সঠিক হয়ে কি লাভ? যদি ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসাই না পাই! ”

-“আপনি বোধ হয় আমার কথাগুলো খেয়াল করে শোনেন নি। আমার মনের সঙ্গে যুক্ত ফোনকলের মানুষ কে? আপনার মনে হয় এমন কথা আমি এমনি এমনি বলবো? আমার প্রথম আবেগ নিয়ে মিথ্যে বলবো? উহু। শুভ্রমানবকে রোজ ভালোবাসে! তবে নতুন করে তাকে ভালোবাসা শেখাতে হবে নীরদ। আপনার মত করেই আপনাকে ভালোবাসতে চাই। পাগলামি করতে চাই, ভালোবাসা প্রকাশ করতে চাই কিন্তু এগুলো পারি না আমি। আপনি কি পারবেন না চাঁদকে ভালোবাসতে শেখাতে? শুভ্রমানব কিন্তু ফোনে অনেক ধানাইপানাই করে প্রেমের কথা বোঝাতো। আমার সেই শুভ্রমানবকে ভালো লাগে। তাঁর তুমি ডাকটা ভালো লাগে তবে তাঁর মুখের তুই ডাকটা আমার বড্ড প্রিয়। রেগে গেলে তুই তুই করে যে ঝারিগুলো দেয় সেগুলো বড্ড প্রিয়। তাকে সেভাবে পেলে চাঁদ আহ্লাদি হয়ে যেত সেই মুহূর্তগুলো প্রিয়। আপনি কি আমাকে সেই সময়টাতে নিয়ে যেতে পারবেন শুভ্রমানব? সেই রঙিন জগৎ ফিরিয়ে দিতে পারবেন? প্রথম প্রেমের প্রথম অনুভূতিগুলো। তাহলেই আমি ভালোবাসবো আপনাকে। ”

-“সত্যি তো? ”

-“তিন সত্যি। চাঁদ ভালোবাসবে তাঁর শুভ্রমানবকে। এই গল্পের হিরোকে ভালো না বেসে হিরোইন যাবে কোথায়? শুভ্রমানবকে বাদ দিয়ে যে চাঁদ অসম্পূর্ণ।”

-“তোমরা কি করছ এখানে?আপিয়া? ”

সারিমের কন্ঠস্বর শুনে দুজন দুদিকে ছিটকে চলে গেল। সারিম এগিয়ে এসে চোখ ডলে বলল, “কি করছিলে?”

ফালাক অপ্রস্তুত হয়ে কেঁশে উঠলো। কিন্তু রোজ শান্ত। সে সারিমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“নক্ষত্র এখানে এত রাতে কেন এসেছে? ”

-“বাবাই তোমাকে ডাকছে। কাল তোমাদের বিয়ে তাই শাড়িটারি কিনে এনেছে দাদাই। সেসব দেখাবে বলে..”

-“তাহলে চলো যাই। ”

-“দাদাভাইয়ের গায়ে জামা নেই কেন? ”

-“কফি পড়েছে। ”

-“ওহ চলো। ”

সারিম যেতে শুরু করলে রোজ ইশারায় ফালাককে জানালো সারিম কিছু দেখেনি। এমনিতেই আবছা আলো। তাঁরওপর সারিম ঘুম থেকে উঠে ঢুলতে ঢুলতে এসেছে। ফালাক লম্বা শ্বাস ফেলল। রোজ হেসে নিচে চলে যায়। ফালাকও আসে পিঁছু পিঁছু।

🍁🍁🍁

বিয়ের রাত! ঘরটাকে সুন্দর করে সাঁজিয়েছে সিয়ামরা।রোজ ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফালাক আসলো, রোজ সালাম দিয়ে সালাত আদায় করে নেয়। এরপর আবারও ব্যালকোনিতে এসে দাড়ায়। ফালাক পেছন থেকে রোজকে জড়িয়ে ধরে রোজের কাঁধে চিবুক রাখে। দাড়ির খোঁচা লেগে রোজের গলায় খানিকটা লাল হয়ে গেল। রোজ কঠিন গলায় ফালাককে দূরে যেতে বলে। কিন্তু ফালাক তা না করে আরও কাছে টেনে নিল রোজকে। রোজ বুঝলো ইনি বারণ শুনবেন না। তাই বারণ না করে বলল..

-“আমার গল্পটায় কোনো অপূর্ণতা নেই শুভ্রমানব। সব টা পরিপূর্ণ। আমার জীবনের অধ্যায়গুলো ট্রাজেডিতে ভরা। কিন্তু আপনাকে পাওয়ার পর সেই বিয়োগান্তক স্মৃতি মুছে গেছে। ভাবছি এরপরের কাহিনিগুলোতে কিছুটা পরিবর্তন আনবো। সেখানে শুধু ভালোবাসা থাকবে। শুভ্রমানব ও চাঁদের ভালোবাসা। যেটা কখনও আমাদের মাঝে সেভাবে ছিল না। আমি ভালোবাসি আপনাকে। কখনও কষ্ট দেবেন না আমাকে। আপনার থেকে পাওয়া কষ্টগুলো সহ্য করতে পারি না আমি।”

-“দেবো না।”

🍁🍁🍁
পরিশিষ্টঃ কয়েক বছর পর, সোহানা মুক্ত হয়ে নিজেকে সংশোধন করে ফিরে আসে নিজের ছেলের কাছে। মেহমেদ মুগ্ধতার বিবাহ সম্পন্ন হয়। সিয়াম প্রেমে পড়ে এক জুনিওর মেয়ের। রাই’রা একটা ছেলে বাবু দত্তক নিয়েছে। অয়ন্তির যমজ মেয়ে হয়েছে। রোজের আর একবছর আছে গ্রাজুয়েশনের। ফালাক প্রভাষক পদেই নিয়োজিত। সারিম বড় হচ্ছে, ইদানিং তাঁর মেয়ে বন্ধুর তালিকা তরতর করে বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রশ্নও। এই তো আজ সকালে সারিম রোজকে প্রশ্ন করেছে,

-“আপিয়া কিস করলে কি হয়? দাদাভাই তোমাকে কখনও কিস করেছে? তোমার কেমন লেগেছে? টিভিতে দেখলাম একটা ছেলে একটা মেয়ের ঠোঁটে কিস করছে। আমার গালেও তো প্রিয়তা কিস দেয়। কিন্তু আমি তো কিছু বুঝি না। কেমন লাগে তাও না। কিন্তু ওর নাকি ভালো লাগে। ”

-“কিস? কখন দেখেছ? ”

-“সেদিন দাদাভাই টিভি দেখছিল। আমি এসেই তো দেখলাম। ”

রোজ মনে মনে বলল, “আপনার টিভি দেখা বন্ধ শুভ্রমানব। একদম বন্ধ, কোনো রোম্যান্টিক সিনেমা চলবে না। এবার বুঝেছি ডেইলি পাগলামি কেন করেন। অসভ্য একটা। ”

-“আপিয়া। বলো.. ”

-“প্রিয়তার কাছ থেকে শুনবে। বাই দ্যা ওয়ে প্রিয়তা কে? ”

-“আমার গার্লফ্রেন্ড।আমরা বড় হয়ে বিয়ে করবো। ” লাজুক স্বরে বলল সারিম।

রোজ চোখ বড় বড় করে তাকায়। এইটুকু একটা বাচ্চা বলে কি? এর বয়সে তো রোজ কিস শব্দটাও হয়তো শোনেনি। সব দোষ ফালাকের। যখন তখন তাঁর অদ্ভুত রোম্যান্টিক ভাব জাগে। সারিমকেও পাঁকিয়ে ফেলেছে। রোজও বোধ হয় শুনেছিল ফালাক সারিমকে বলছে, “গার্লফ্রেন্ড বানাবা বেঁছে বেঁছে। যাকে নিয়ে সারাজীবন থাকতে পারবে তেমন বন্ধু বানাবে। ঠিক আমার মত।” রোজ মানছে সারিমের কোনো এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই বলেছে এসব। তাই বলে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে? সারিম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রোজ হেসে বলে,

-“আগে বড় হও। তারপর এসব নিয়ে ভাববে। এখন শুধু পড়াশোনা। নাহলে আপিয়া কষ্ট পাবে। বুঝেছ? ”

সারিম মাথা দুলিয়ে যেতে যেতে বলল, “ঠিক আছে। তবে মেয়ে কিন্তু প্রিয়তাই থাকবে আপিয়া।দাদাভাইয়ের মত আমিও একটা বন্ধুই রাখবো। ”

ঠিক তখন অয়ন্তির দুটো মেয়ে এসে রোজের ওরনা টেনে বলে, “চোটম্মা গয়প্পো চুনবো,লাজা-লানির গয়প্পো।”

রোজ দুজনকে কোলে নিয়ে চলল ঘরের দিকে। প্রতিদিন দুপুরে রোজের কাছে গল্প শুনেই ঘুমায় ওরা। আনসারী সাহেব পাশের বিল্ডিংটা কিনেছেন। তাই সব সময় ওরা একসঙ্গে থাকতে পারে। সারিম তো বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকে। প্রতি বিকেলে নানু দাদুদের সঙ্গে ঘুরতে যায় অয়ন্তির মেয়ে জিয়া ও তুর্বী। সারিমের রোজকার ডিউটি ভাগ্নিদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। রোজ ওর জীবনের পুরো কাহিনিটাই গল্প করে শোনায় তুর্বী ও জিয়াকে। একসময় হয়তো ওরা জানতে পারবে এই রাজারানির আসল পরিচয়। রোজ তৃপ্ত চোখে আবারও বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো এই মিষ্টি মধুর জীবনটার জন্য। ওর ছাড়া ছাড়া গল্পটার এমন সুমধুর পরিসমাপ্তির জন্য।

সমাপ্ত।

পরিচয়গুলো…..
ফালাক মাহতাব নীরদ💙
ভাই- আরশান
বাবা-ফারদিন
মা-ফারিয়া
মামা-ফারুক
চাচা -ইরফান
চাচাতো বোন -মুগ্ধতা
বন্ধুরা -মেহমেদ, সিয়াম..

সাইরাহ সীরাত রোজা (রোজ)💙
ভাই -সারিম
বাবা-সাফোয়ান আনসারী
মা- রেণু
বড়চাচা-সুলেমান
চাচি -নাম উল্লেখ নেই (বড়াম্মু)
চাচাতো বোন-অয়ন্তি
বন্ধু-রাই
সহকর্মী -ইফতি (রাইয়ের ভাই।)

মুগ্ধতা💞
বাবা -ইরফান

ভীর💞
মা-সোহানা
বাবা-নাম উল্লেখ নেই
🍁
রাইয়ের বাচ্চা- রাইয়ের বাচ্চা হবে না। এটা ওর অতিতের কোনো দূর্ঘটনা। টেনে লম্বা করা হয়নি কাহিনি।
🍁
রোজের বাবা সাফোয়ান এবং চাচ্চু সুলেমান একই মায়ের গর্ভের সন্তান। এবং ফারিয়া ও ফারুক অন্য মায়ের গর্ভের সন্তান। তাই তারা সৎ ভাইবোন।
🍁
মনিমালা রোজের আইডি। রোজের আইডি দিয়ে রাই ভীরের সঙ্গে কথা বলেছে। ভীর মনিমালা ভেবে রাইকে ভালোবেসেছে। তাই জিয়নকাঠি হচ্ছে রাই।

[এতদিন পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ সবাইকে। 💙]

তুই হবি শুধু আমার সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-১৪

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১৪

গভীর রাত! ঝিঁঝিঁপোকার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছে না। রোজ ফোন গেমস খেলছে। ওর সামনে পড়ে আছে দুটো ছেলে। দুজনেই অজ্ঞান। রাত পার না করে জাগবে না তারা। পুরো দুটো দিন এখানে থেকে রোজ বুঝতে পেরেছে ফালাক কেন এতবছর চুপ ছিলো। ইরফান মাহতাব মঞ্জিল আর সুলেমান সাহেবদের ওপর কঠোর নজরদারি চালাচ্ছিলেন। রেণু এবং আনসারী সাহেবকেও আলাদা জায়গায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ফালাক শুধু চাচ্ছিলো তারা একত্রিত হোক। তারপর সে তাদের মুক্ত করবে। আনসারী সাহেব অথবা রেণু বিচ্ছিন্ন থাকলে একজনকে মুক্ত করতে গেলে আরেকজনকে মে’রে ফেলতো ইরফান। নিজের চাচা এতজঘন্য তা কল্পনা করতে গিয়েও শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে ফালাকের। পাশাপাশি সুলেমান সাহেবদের এবং ওর পরিবারও ইরফানের ক্রোধের সম্মুখিন হতো। হয়তো সুযোগটা ফালাকের হাতে এবার এসেছে। এজন্যই সে আনসারী সাহেবদের মুক্ত করেছে দ্বিধাহীন হয়ে। ফালাককে এতগুলো বছর ভুল বুঝে ঠিক করেনি রোজ এটা বুঝতে পেরে অনুতপ্ত সে। শুভ্রমানব কখনও ভুল ছিলই না। সে সর্বদা তাঁর চাঁদের কথা ভেবেছে। চাঁদের খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে। এমন একটা মানুষকে রোজ দূরে ঠেলে দিচ্ছে? এটা ঠিক নয়। ফিরে গিয়ে রোজ এর জন্য নিশ্চই ক্ষমা চাইবে।

সকালে ইরফানরা ঘরে প্রবেশ করতেই ওদের পায়ে শ্যুট করে রোজ। ইরফানের হাতে থাকা গানগুলোও কেড়ে নেয়। সোহানা রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করতেই পেছন থেকে ইরফানের লোক ছুটে আসে। কিন্তু ঘর অবধি তারা আসতে পারে না। রাতেই রোজ ফালাককে ফোনে নিজের অবস্থান জানিয়েছিলো।তাই ফালাক সকাল হতে না হতেই চলে এসেছে। বাইরে অপেক্ষা করছিল ফালাক ইরফানদের জন্য। আগেই ভেতরে ঢোকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বলে ইরফানদের আসার পর এসেছে ওরা। রোজ কোনো কথা বলল না, কোনো কৈফিয়ত দিলো না। সোহানার বুক বরাবর গু’লি করার জন্য বন্দুক তুলতেই দেখলো ফালাকের সঙ্গে ভীরও এসেছে। বন্দুক নামিয়ে ফেলে রোজ। ছেলের সামনে মা’কে হত্যা করার মত জঘণ্য কাজটা করতে চায়না সে। ভীর সব জানে এখন, ও নিজেই ঠিক করুক ও কি চায়। যদি মায়ের মুক্তি চায় রোজ তা মঞ্জুর করবে। রোজ পিছিয়ে গেল। মুগ্ধতাও আসছে। মেয়েটাকে দেখে রোজের আজ রাগ হলো না। করুনা জাগছে মনে। এই মেয়েটা নিজের বাবাকে কত ভালোবাসে অথচ ওর বাবা? রোজ অভিও কনভারশেসন ফালাককে রাতেই পাঠিয়েছিল। ফালাক নিশ্চই শুনিয়েছে সব। রোজের মাথা ঘুরে উঠলো। দূর্বলতার কারনে, র’ক্তক্ষরণে হয়তো শরীরের শক্তি অনেকাংশই কমে গেছে। রোজ টলে উঠতেই ফালাক এসে রোজকে ধরে ফেললো।

-“ঠিক আছিস চাঁদ? ”

-“হুম। ওদের কেন আনলেন? কষ্ট পাবে তো। ”

-“আজ থেকে সবার কথা ভাবা বন্ধ তোর। শুধু নিজের কথা ভাববি। নিজের যত্ন নিবি। শরীরের কি হাল হয়েছে টের পাচ্ছিস? দাড়াতেও পারছিস না ঠিক করে। ”

-“যে নারীর জন্য কোনো পুরুষ এভাবে কাঁদে, এতটা ভালোবাসে সে নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবতী। আমাকে এমন সৌভাগ্য দেওয়ার পরিবর্তে আমি আপনাকে ভালো,, ”

গু’লির আওয়াজ শোনা গেল। ফালাক রোজ দুজনেই কেঁপে উঠলো। আরেকটা গু’লির শব্দ শোনা যেতেই ওরা পেছনে ফিরে তাকায়। মেহমেদ ইরফানের কপাল বরাবর গু’লি করেছে। আর ইরফানের হাতের ব’ন্দুকের গু’লি মুগ্ধতার বুকে। রোজ অবাক হয়ে তাকায়। রোজকে বাঁচানোর জন্য মুগ্ধতা নিজে ওদের সামনে আসলো? রোজ দূর্বল কন্ঠে বলে,

-“আমি ঠিক আছি শুভ্রমানব। মুগ্ধতাকে দেখুন। আমার জন্য যেন কারোর প্রাণ না যায় শুভ্রমানব। ”

বলতে বলতেই ফালাকের বুকে ঢলে পড়লো রোজ। বহু কষ্টে রাত জেগেছিলো। কিন্তু স্বস্তি আর শান্তিতে চোখ আর মেলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। মেহমেদ মুগ্ধতাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই ফালাক ভীর ও সিয়ামের দিকে তাকালো। সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“চাচার লা’শটা দাফন করার ব্যবস্থা কর। বাকিদের পুলিশের হাতে তুলে দে। সাফোয়ান আঙ্কেল কেসটা হ্যান্ডেল করবে। ”

এরপর ভীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“সব তো জানো। দেখ তোমার মা’কে কি করতে চাও। তুমি মায়ের মুক্তি চাইলে চাঁদ সেটাতেই মত দেবে। কিন্তু চাঁদের ওপর অন্যায় করা হবে। চাঁদকে, আঙ্কেল আন্টিদের এত কষ্ট দেওয়ার পরিবর্তের তাঁর কিছুটা শাস্তি পাওয়া দরকার ছিল। নাহলে নিজেকে শুধরাবেন না উনি।ওনার ভেতরের কুৎসিত ভ্রান্ত মনোভাব বদলাবে না। তোমার বউয়ের প্রতি যে অ’ত্যা’চার করেছে তাও ঠিক ছিল না। ”

-“আম্মা’কে ভালোবাসি আমি। কিন্তু তাঁর চরিত্রের সংশোধন প্রয়োজন। বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তিনি হয়তো একসময় লোভ করেছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে তিনিও আম্মাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। আমাদের বিশ্বাস ভে’ঙে আম্মা এমন করবেন তা আমরা কল্পনাও করিনি। ছেলে হিসেবে তাঁর মুক্তি কামনা করলেও আমি বলবো, তোমাদের যেটা মন চায় সেটা করো। তবে তাকে কষ্ট কম দিও! প্লিজ।”

-“ওনাকে সংশোধনাগারে পাঠাতে বলবো। জেলে গেলে মস্তিষ্ক আরও বিকৃত হবে। আঙ্কেল চান উনি শুধু নিজেকে সংশোধন করুক। কারোর ওনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আর। ওনাকে তুলে ধরো। সিয়াম নিয়ে যাবেন ওনাকে। ”

ভীর সোহানাকে ধরতে আসলে সোহানা ফোস করে উঠলেন,
-“ছোঁবে না। মায়ের বদলে যে ছেলে অন্যদের বিশ্বাস করে, অন্যের কথা শোনে তাঁর স্পর্শ চাই না আমি। ”

ভীর তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
-“তুমি নিজেকে পরিবর্তন করো আম্মা। নাহলে বুঝবে না কারা তোমার বন্ধু আর কারা শত্রু। তুমি নিজের জেদ আর রাগটাকে বড় করে দেখছো। অপমানটাকে বেশি মূল্য দিয়েছ। যে লোকটা তোমাকে ভালোবাসেনি তাঁর সঙ্গে কি তুমি আদৌ ভালো থাকতে?তাকে যতটা ভালোবেসেছিলে, আমাদের যদি তাঁর একাংশও ভালোবাসতে তাহলে এমন করতে পারতে না। আমি বলছি না সাফোয়ান আঙ্কেলকে ভালোবেসে ভুল করেছ, তাকে ভালোবাসা ভুল নয়। আমি মানছি এটা। কিন্তু তোমার একগুয়ে স্বভাব ভুল ছিল। তাই তোমার সংশোধনের প্রয়োজন। সিয়াম নিয়ে যাও ওনাকে। ”

🍁🍁🍁

ঘুম ভাঙতেই রোজ নিজেকে ফালাকের ঘরে ফালাকের বিছানার ওপর দেখতে পেল। সামনেই আনসারী সাহেব ও রেণু বসে আছেন। ফালাক ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। রোজ চারবছর পাঁচমাস পর আজ সশব্দে কেঁদে উঠলো। আনসারী সাহেব মৃদু হেসে বলে উঠলেন,

-“উহু! কাঁদে না। কাঁদলে কিন্তু বাবাই জড়িয়ে ধরতে দেবে না।”

রোজ অভিমানি দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করতেই দেখলো সারিম দরজার কোনায় দাঁড়িয়ে নাক টেনে কাঁদছে। রেণুও তাকালো দরজার কোনায়। সারিমকে দেখে রেণু রোজকে রেখে দ্রুত সারিমের কাছে গিয়ে সারিমকে জড়িয়ে ধরলেন। কিন্তু রোজ জানে এই কান্না মামনি থামাতে পারবে না। বাবাইও পারবে না। তাই সে হেসে বলল,

-“আপিয়ার কাছে নক্ষত্র কেন আসলো না? আপিয়া কিন্তু কষ্ট পাচ্ছে। ”

কথাটা শোনা মাত্র রেণুকে ছেড়ে সারিম দৌড়ে রোজের কোলের ওপর এসে পড়লো। রোজ সারিমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-“কি হয়েছে? কাঁদছো কেন? বাবাই মামনি তো ফিরে এসেছে। তারা আর তোমাকে একা রেখে কোথাও ঘুরতে যাবে না। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে, মেঘের দেশ, পাহাড় সবজায়গায় ঘুরবে। ”

-“আপিয়া আমি কি এ্যাডোপ্টেড? আমি তোমাদের আপন নই? আমি কি খু’নির ছেলে? ”

রোজ চমকালো। আনসারী সাহেবরাও চমকালেন। এই কথা সারিমকে কে বলেছে? এজন্যই কি সারিম এখন আগের তুলনায় বেশি চুপচাপ?রোজ সারিমকে বুকে টেনে বলে,

-“কে বলেছে এসব মিথ্যে কথা? ”

-“ভীর ভাইয়ার আম্মু।উনি এসেছিলেন সেদিন তোমাকে খুজতে। বাড়িতে কেউ ছিল না। চাচ্চু অসুস্থ হয়ে গেলে বড়াম্মু তাকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল। তখন এসে উনি বললেন আমি নাকি তোমার ভাই না। বাবাই মামনি নাকি আমার বাবাই মামনি না। আমাকে নাকি রাস্তা থেকে তুলে এনেছ। আমি এ্যাডোপ্টেড মানে অন্যদের বাচ্চা। ”

রোজ সারিমের চোখের পানি মুছে বলল,
-“কোথাকার কে এসে তোমাকে মিথ্যে কথা বলে চলে গেল আর তুমি তা বিশ্বাস করে কাঁদছো? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার আপিয়া না? বাবাই মামনি কি তোমার থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে? দেখো আমি কাঁদছি তাও মামনি আমাকে কিছু বলল না। তোমার কাছে চলে গেল। বাবাই তোমার পায়ের ব্যাথা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিল। আমাকে কি দিয়েছে? আমাকে কি বলল? কাঁদলে নাকি সে আমাকে তাকে জড়িয়ে ধরতে দেবে না। তুমি আমার ভাই না হলে এমন বলত? ভেবে বলো। ”

সারিম ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “না তো। তাহলে আমি তোমার আপন ভাই বলো আপিয়া? বাবাই মামনি আমার বলো? শুধু আমার।”

-“হুম। সব তোমার, আমাকে টুকিয়ে এনেছে তাইনা? বাবাই মামনি আমারও বুঝলে? ”

-“না শুধু আমার। তোমাকে আমি আদরের ভাগ দেবো না। ” কাঁদার মধ্যে হেসে বলল।

-“আমি জোর করে নেবো। ”

-“তবুও দেবো না। ”

-“আমি তো নেবোই। দেখি কে আটকায়। মামনি বলো তুমি আমাকে আঁদর করবে না? ”

রেণু সারিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “নক্ষত্র’কে জিজ্ঞেস কর। সে বললে করবো না হলে না। ”

রোজ দুঃখি মুখ করে বলে, “নক্ষত্র তো তোমাদের পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছে। আমাকে আর ভালেবাসে না। ”

-“বাসি তো। ” আবারও কেঁদে ফেলল সারিম।

-“কোথায় বাসো? তখন থেকে আমার ভা’ঙা হাতের ওপর বসে আছো। তোমার মনেই নেই আপিয়া ব্যাথা পাচ্ছে।”

-“ব্যাথা পাচ্ছো তুমি? ”

-“হুম তো। ”

-“আমি ব্যথা দেবো না। আমি আমার বাবাইয়ের কোলে যাবো। ”

সারিম উঠে আনসারী সাহেবের কোলে বসল। রোজ মিটিমিটি হেসে বলে,
-“কখনও কারোর আজেবাজে কথা শুনে কাঁদবে না। তুমি আপিয়াকে বিশ্বাস করো না? “সারিম মাথা দুলায়।

-“বিশ্বাস করলে আমার কাছে এসে প্রশ্ন করবে। যত প্রশ্ন করবে তত জানতে পারবে। বুঝেছ? ”

-“হ্যাঁ। এবার আমি নিচে খেলতে যাই? ”

-“যাও। ”

সারিম চলে গেল। আনসারী সাহেব রোজের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“আমি জানতাম, আমরা না থাকলেও সারিম তোমার কাছে ভালো থাকবে। ”

-“সব ঠিক আছে। কিন্তু কোটি টাকার সম্পত্তি আমার নামে কেন করেছ? ”

-“কারন তুমি স্পেশাল মামনি। ”

-“সেটা তো ঠিক। কার মেয়ে দেখতে হবে না? “ভাব নিয়ে বলে।

-“তা তো বটেই। তোমাকে সবার সামনে কেন আনিনি? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চই খুজে পেয়েছো।”

-“টাকা আমার নামে ছিল সেজন্য? ”

-“হুম। ইরফান প্রচন্ড স্বার্থপর। যদি তখন টাকাগুলো ভাগ ভাগ করে দিতাম তাহলে সবার প্রাণের ঝুঁকি থেকে যেত। তোমার বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক শক্তি সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম। তাই টাকাগুলো তোমার নামে লিখে গিয়েছিলাম।”

-“কিন্তু দাদা এমন অন্যায় কাজ কেন করলেন? সবটা তোমার নামে দিয়ে, ”

-“আসলে বাবা পরীক্ষা করছিলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের মন। আমাকে বলেই রেখেছিলেন সব ঠিক থাকলে আমি যেন সম্পত্তি আর টাকা ভাগবাটোয়ারা করে দেই।”

-“ওহ। দাদাও দেখছি তোমার মত ছিলেন। পরীক্ষাপ্রেমি মানুষ। যাই হোক, তোমাদের শরীরের কি অবস্থা সেটাই তো বললে না। ”

-“ফালাক দুদিন হাসপাতালে বন্ধ করে রেখেছিলো। তাই একদম সুস্থ আমরা। আমাদের চিন্তা করো না। তোমার ফালাক ভাইয়া তোমারও কম যত্ন করেনি। ভাইয়ার এই স্নেহপূর্ণ ভালোবাসা কখনও ভুলবে না। সবসময় সম্মান করবি। বুঝেছ? তোমাদের শত্রুতা ঝগড়াঝাঁটি সব বন্ধ।”

-“ভাইয়া? ”

-“হুম। ভাইয়াই তো, কেন? বিয়াই ভেবে ইয়ার্কি করা বন্ধ একদম। উনি তোমার ফুপাতো ভাই তাই সর্বদা সম্মান করবে। বড়ভাইয়ের নজরে দেখবে। ”

-“শুধু আমাকে বলছো কেন? তাকেও বলো সে যেন আমাকে বোনের নজরে দেখে। সে তো আমাকে অন্যকিছু ভাবে। ”

-“কি ভাবে? ”

-“জিজ্ঞেস করো তাকে। ”

আনসারী সাহেব ফালাককে ডাক দিতেই ফালাক এসে হাজির। সব কথাই শুনেছে সে। মামার সামনে এভাবে লজ্জায় ফেলার কোনো মানে হয়? ফালাক বিনম্র কন্ঠে বলল,

-“জি মামামনি। ”

-“তুমি নাকি রোজকে বোন ভাবো না। শুনেছি শত্রুতা করে বেরিয়েছ। এখন যখন সব মিটে গেছে তখন ওসব শত্রুতা বন্ধ। তোমার বোন তোমাকে যথাযথ সম্মান না দিলে আমাকে বলবে। ”

-“জি। ”

-“এই তো সব মিটে গেল। ”

-“সব মিটে গেল? কখন? কিভাবে? ” অবাক হয়ে বলল রোজ।

-“এই যে এইমাত্র। ”

-“তো ভাইয়াআআআআ! সব মিটে গেছে? আপনি আমাকে বোন ভাবতে প্রস্তুত? ”

ফালাক কেঁশে ওঠে। রোজ ঠোঁট টিপে হাসে। রেণু চোখ রাঙালো আনসারী সাহেবকে। তিনি অয়ন্তির মুখে সব শুনেছেন। কিন্তু তাঁর বর এখনও কিছু বুঝতে পারেনি বলে হতাশ হলেন। ফালাক দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আনসারী সাহেব বললেন,

-“ওর আবার কি হলো? ”

রেণু দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তোমার বুঝতে হবেনা। মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো। ”

-“কার সাথে?মা তোমার কি কোনো পছন্দ আছে?ছেলে কি করে? বাবা-মা কে? কোথায় থাকে?”

-“মাথামোটা। ” রেণুর চাপা কন্ঠস্বর।

রোজ হেসে বলে,”তোমার বন্ধুর ছেলে পাত্র হলে আমার আপত্তি নেই বাবাই।”

আনসারী সাহেব এতক্ষণে বুঝলেন। চোখ পাঁকিয়ে তাকালেন। ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললেন,
-“ওদের গুষ্টির ছেলেরা কি দিন-দুনিয়ায় মেয়ে খুজে পায়না? বেঁছে বেঁছে আমার মেয়ে আর বোনদের পেছনে লাগে। আমি আগে টের পেলে খাল কেটে এমন কুমির আনতাম না। ”

-“আমার দোষ নেই। তোমার বন্ধুর ছেলেই আটবছর ধরে লাইন মা’রছে। আমি নিরীহ, অবলা মেয়ে শুধু তাঁর ধৈর্য, কষ্টকে সম্মান জানাচ্ছি। তবে হার আমি মানবো না। ওনাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবো। ট্রাকের নাম্বার ভুল বলার কারনে।”

-“এই না হলে আমার মেয়ে? একদম ছাড় দিবি না। ”

রেণু চিমটি দিয়ে বলে, “কি শেখাচ্ছ মেয়েকে? চলো। এখান থেকে।”

-“কি শেখাচ্ছি মানে? আমাদের বংশের তিন তিনটে মেয়ে হাতিয়ে নিলো ওরা বাপ-ছেলে মিলে। এর মানে বোঝো? আমাদের ওপর দাসত্ব ফলানোর চেষ্টা। ফারিয়াকে কম জ্বালিয়েছে ফারদিন? অয়ন্তিকে কম জ্বালিয়েছে আরশান? আমার মেয়েকে যদি বিরক্ত করে আমি চুপ থাকবো? ”

-“এটা ওদের দুজনের ব্যাপার। তুমি বাপ হয়ে নাক গলাচ্ছ কেন? অদ্ভুত মানুষ! ”

রোজ শুয়ে পড়লো। বাবাই মামনির খুব জোর ঝগড়া লাগবে এবার। এরা জীবনের এতগুলো বছর পরও বাচ্চাদের মত ঝগড়া করে। মনে হয় সেই কুড়ি-পঁচিশে আটকে আছে তাদের বয়স। রেণুকে আবেগী এক কিশোরী মনে হয়, আনসারী সাহেবকে মনে হয় সদ্য প্রেমে পড়া এক যুবক। অথচ তাদের মেয়ে পাথর? এটা কি মেনে নেওয়া যায়?

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-১৩

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১৩

কেসটা ক্লোজড করে বাড়িতে ফিরছিলো রোজ। নির্জন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের আলোই সঙ্গী। রাত প্রায় দুইটা। দূরে একটা চায়ের দোকান থেকে হলদেটে জ্যোতি এসে পড়ছে পিচঢালা রাস্তায়। আজ গাড়িটা ইফতির সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছে। ইফতির ছেলেটা অসুস্থ, ওকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়া, ছুটোছুটি গাড়ি ছাড়া সম্ভব না। বেশ কিছুসময় হয়েছে রোজ টের পাচ্ছে ওকে কেউ ফলো করছে।পায়ের অস্পষ্ট আওয়াজও কানে ভেসে আসছে। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়েও কাউকে খুজে পেল না সে। চৌরাস্তার সামনে আসতেই রোজ হুট করে টের পেল ওর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। রোজ কোমরে গুজে রাখা গানটা বের করে ট্রিগার প্রেস করল। ততক্ষণে চারপাঁচটা হাত এসে পড়লো ওর ওপর। মুখে রুমাল চেপে ধরতেই রোজ ক্লোরোফমের ঘ্রাণ পেল। চোখ দুটো বুজে আসলো মুহূর্তেই। মনে মনে বলল,

-“আ’ই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইট।”

🍁🍁🍁

ইরফানের নতুন প্রেজেক্ট সাঁজেক ভ্যালির পাশেই একটি রিসোর্ট নিয়ে। ফালাকের অনুমান আনসারী সাহেব ও রেণুকে ওখানেই রাখা হয়েছে। অর্ধনির্মিত রিসোর্টটি একদম ফাঁকা। দু একজন পাহারাদার রাখা হয়েছে তারাও রাতের খাবার খেতে চলে গেছে। এই সুযোগটা কাজে লাগালো ফালাক। ভেতরে ঢুকে সে পর্যবেক্ষণ করলো পুরো রিসোর্ট। গ্রাউন্ডফ্লোরের ঘরটা তালাবন্ধ। ফালাক গান বের করে সাইলেন্সার লাগিয়ে তালায় শ্যুট করতেই তালা ভেঙে যায়। ফালাক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত ঘরটায় ঢুকে পড়লো। বিধ্বস্ত রেণু ও আনসারী সাহেব এককোনায় ঘুমাচ্ছেন। চেহারার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। ফালাক নিজের লোকদের ডেকে ওনাদের বাইরে বের করে আনে। ঠিক সেসময় ওর ফোনে সিয়ামের কল আসে। ফালাক ফোন রিসিভ করে কানে ধরে বের হতে হতে বলল,

-“বল। ওদিকের কি অবস্থা? চাঁদ বাড়িতে পৌঁছেছে? ”

-“ভাই আমি বাড়ির সামনেই ছিলাম। তিনটা বাজার পর যখন ভাবি আসলো না। তখন ভাবির ইউনিটের দিকেও গেলাম। দারোয়ান বলল, ভাবি দেড়টার পর পরই বের হয়েছে। সারা রাস্তা, এলাকা তন্ন তন্ন করে খুজেছে সবাই। ভাবি কোথাও নেই। আর ভাবি নাকি রেজিগনেশন লেটারও জমা দিয়েছেন। তার মানে কোনো কেসের জন্য তিনি যাননি। ”

ফালাক ফোন কেটে দেওয়ালে ঘু’সি দিলো। রোজের এই বদঅভ্যাস জীবনেও যাবে না সেটা ফালাকের বোঝা উচিত ছিল। দুপুরের ঘটনাগুলো বলার সময় তো রোজ একবারও বলল না চাকরিটা আজই ছাড়ছে। এই মেয়ে ওর ধারণার বাইরের সাব্জেক্ট। ফালাক রাগে কিড়মিড় করে উঠলো। দাঁতে দাঁত ঘসে বলল,

-“এটা ঠিক করলি না চাঁদ। তোর জন্য, শুধুমাত্র তোর জন্য আমি আজকেই তোর বাবা মাকে উদ্ধার করতে বেরিয়েছি। আর তুই? এটা বুঝলি না, আমি এতদিন এতবছর কেন চুপ ছিলাম? তুই বড্ড খারাপ চাঁদ। বড্ড খারাপ।”

ফালাক দ্রুতই রওনা দিল ঢাকার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে ইরফানের দু’চামচাকেও শ্যুট করল।যাতে আনসারী সাহেবদের মুক্ত হবার খবর ইরফান বা তাঁর কোনো চ্যালার কানে না যায়।

🍁🍁🍁

রোজের সামনে ইরফান দাড়িয়ে। হাতে কিছু কাগজপত্র আর কলম।রোজ ইরফানকে দেখে অগোচরে স্মিত হাসে। সোহানাও সকাল সকাল চলে এসেছে। রোজের দৃষ্টিনত হয়। কিছুক্ষণ পূর্বের কথোপকথন কানে এখনও বেজে চলেছে। আনসারী সাহেবের কোটি টাকা আছে? কই রোজ তো জানে না, ওর বাবার এত টাকা। কিসের টাকা? কোথাকার টাকা? রোজের নামে দলিল করা সব টাকাগুলোর হদিশ এরা কোথায় পেল? কিন্তু সোহানার পরের কথাগুলো শুনে সবটা পরিষ্কার হলো। আনসারী সাহেবের নামেই দাদা নিজের যাবতীয় সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন।সুলেমান চাচ্চু, ফারিয়া বা ফারুক কাউকে সম্পত্তি তো দূরে একটা পয়সাও দেননি। কিন্তু কেন? দাদা এমন কেন করেছিল? তিন ছেলেমেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারন কি? আর আনসারী সাহেবইবা ওনার এত প্রিয় কেন? রোজের কৌতুহল বাড়ছে। কিছু একটা তো ছিল দাদার মনে। কিন্তু কি সেটা? আর সেই টাকাগুলো রোজের নামেইবা কেন দলিল করলেন আনসারী সাহেব? আনসারী সাহেব ন্যায়পরায়ণ মানুষ তিনি তো চাইলেই নিজের ভাইবোনকে ভাগ করে দিতে পারতেন। তিনি সেটা না করে শুধু রোজকে দিলেন?

রোজের হাতের বাঁধন প্রায় খুলে গেছে। রোজ চাইলেই নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। কিন্তু না, এখন মুক্ত হয়ে গেলে ইরফানের পরিকল্পনা জানা যাবে না।তাই নেশার ঘোরে থাকার ভান করেই পড়ে রইলো রোজ। ইরফানের কিছু চামচা এসে কয়েকঘা দিয়ে ক্ষান্ত হলো। ব্যাথায় রোজের শরীর টনটন করছে। গতকালই বুলেট ঢুকলো আর আজ সেখানেই লাঠির আঘা’ত। কিছু সময় পর ইরফান নিজে এসে রোজকে জাগানোর জন্য রোজের মুখের ওপর পানি ঢালে। রোজ পিটপিট করে তাকায়। ইরফান কাগজটা এগিয়ে দিয়ে বলে,

-“খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা মা? এখানে পরপর তিনটা সাইন করে দাও। তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। ”

রোজ ব্যাথায় গোঙালো। হাত তোলার মত অবস্থা নেই এটাও বোঝালো। ইরফান বিরক্ত কন্ঠে বলল,

-“সোনার ডিমপাড়া হাঁসটার যত্ন নিতে বলেছিলাম। আধ ম’রা বানিয়েছে কে? এখন সাইন করতে না পারলে তাদের কবরে পাঠাবো আমি। ”

ইরফানের লোকগুলো ভেতরে চলে আসে। চেহারায় চিন্তার ছাঁপ। ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,

-“কি হয়েছে? ”

-“মুগ্ধতা ম্যাডামকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফালাক মনে হয় ডেকেছিলো। ওর কাছে যাওয়ার পর ফেরেনি। সিয়ামকে ধরেছিলাম, মুখ খুলছে না। ”

-“জাহান্নামের যাক! একটা মেয়ে গেলে কিছু হবেনা। ”

রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কেমন বাবা এটা? কিভাবে কথা বলছে। একটা মেয়ে গেলে কিছু হবে না মানে? এর আরও ছেলে-মেয়ে আছে নাকি? রোজের মনে পড়লো ইরফানের অতিত ঘাটতে গিয়ে ওর প্রেমিকাদের লিস্ট পেয়েছিলো। সেখানে একজনের সঙ্গে বেশ মাখামাখি ভাব ছিল। বর্তমানে সে ভারতে। তাঁর দুটো ছেলে আছে। কিন্তু স্বামীর খোজ নেই।রোজের চোখ লাল হয়ে আসে। এরা কত নিকৃষ্ট। এদের উচিত শিক্ষা দিয়েছে আনসারী সাহেব ও রেণু। এদের আরও শাস্তি দেওয়া উচিত। সেটা রোজ দেবে। আগে আনসারী সাহেব ও রেণু ছাড়া পাক। মুগ্ধতাদের ব্যাপারে যখন উনি এতটা উদাসিন। ওনার যখন আরও বউবাচ্চা আছে, তাদের সঙ্গে ভালো আছেন। তাহলে ওনার ভালোথাকার যথাযথ ব্যবস্থা রোজ নিজে করবে। নরকের কীটকে নরকেই পাঠাবে। ভাবতে ভাবতেই রোজের এটাও মনে পড়লো ওনার সেই ছেলেদের মধ্যে একজন অভিনেতা। জল তাহলে এতদূর গড়িয়েছে। ওখান থেকেই হয়তো সোহানার সাথে তাঁর পরিচয়। অঙ্কগুলো মিলে যেতেই রোজ তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সাইন করা তো দূরে একফোটা কালিও সে কাগজের ওপর ফেলবে না। তাতে এরা যা করার করে নিক। কিন্তু চ্যালাদের শেষের কথাটা শুনে রোজের চেহারা চকচক করে উঠলো। ঠোঁটে ফুটলো অদৃশ্য হাসির রেখা।

-“আনসারী ও রেণুকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে ফালাক। ”

ইরফান রেগে ছেলেটার কলার চেপে ধরে অদ্ভুতভাবে গোঙিয়ে উঠলেন। ছেলেটার কাধ ঝাঁকিয়ে বললেন,

-“কি বললি? ফালাক? ফালাক ওই জায়গার খোঁজ পেলো কি করে? কে বলেছে? ”

-“মুগ্ধতা ম্যাডাম সাবু ভাইয়ের কাছে জিজ্ঞেস করেছিল ভাই বলে দিয়েছে রাঙামাটিতে নতুন প্রজেক্ট হচ্ছে। বোধ হয় ফালাক মুগ্ধতা ম্যাডামের থেকে জেনে নিয়ে..”

ইরফান ছেলেটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে রোজের দিকে তাকালেন। রোজ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ইরফান রেগে সবাইকে রোজের ওপর নজর রাখতে বলে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ হতেই রোজ চোখ মেলে তাকায়। ফালাক ওর দেওয়া কথা এত দ্রুত রাখবে তা অকল্পনীয় ছিলো। রোজ মৃদু হেসে বলে,

-“রোজ ঋণ রাখে না। সেদিন ছাদে রোজ যেটা বলেছিল সেটা সত্য ছিল ফালাক। আপনার এই ঋণও আমি রাখবো না। এই ঋণ রোজ আপনাকে আপনার চাঁদকে ফিরিয়ে দিয়ে শোধ করবে। শুভ্রমানব তাঁর চাঁদকে পাবে। সম্পূর্ণ রূপে, সম্পূর্ণভাবে। আমি ফিরবো। ”

🍁🍁🍁

বিকেলের দিকে ইরফান ও সোহানা আবার আসলেন। রোজ তখন ঘুমে ঢুলছে। কিন্তু মস্তিষ্কে ওনাদের বাক্য আসতেই রোজের শ্রবণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ হলো। সোহানা বেশ রেগে বলছেন,

-“তুমি তোমার কথা রাখতে পারছো না ইরফান। কথা ছিল রোজ,রেণু ম’রবে। আর তুমি সাফোয়ানকে আমার হাতে তুলে দেবে। কোথায় সাফোয়ান? কোথায় রেণু? টাকা তো কম নাওনি। তোমার ছেলেরাও কম টাকা পায়নি। তাহলে কাজের কাজটা কি হলো? ”

-“ফালাককে ঠিক এটা সেটা বোঝানো যাবে।ওকে নিয়ে চিন্তা করো না। রোজ সাইনটা একবার করুক। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তিগুলো আমার হোক। তারপর রেণু রোজের লা’শ আমি তোমার সামনে এনে ফেলবো। কিন্তু সাফোয়ানকে নিয়ে এই বুড়ো বয়সে কি করবে? তোমার স্বামী সংসার ছেলে। ওদের নিয়ে থাকো। ”

-“সাফোয়ান আমার জেদ ইরফান। আমাকে প্রত্যাখ্যান করে ও আমার ইগোহার্ট করেছে। কি ছিল না আমার? টাকা, গাড়ি, বাড়ি, রূপ, যৌবন। তবুও রেণুর মত এক ফকিন্নির বাচ্চাকে ভালোবেসেছে। আমাকে অপমান করেছে। আমি নিজের অপমান এত সহজে ভুলবো? আর বর সংসার কে চেয়েছিল? ভীরের বাবা আমাকে টাকার জন্য, একটা নিশ্চিত জীবনের জন্য বিয়ে করেছিল। তাকে সেটা দিয়েছি আমি। ওকে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় টাকা-বাড়ি-গাড়ি দিয়ে বিদায় করা যাবে। ভীরকে সামলানো যেত, কিন্তু সেও সাফোয়ানের মত দুটাকার একটা মেয়ে বিয়ে করে আমার পুরোনো ক্ষতে পুনরায় আঘা’ত করেছে। মেয়েটাকে দু-চক্ষে দেখতে পারিনা আমি। ওটার ব্যবস্থা করলে ভীর কিছুদিন মানসিক চাপে ভুগে ঠিক হয়ে যাবে। ততদিনে ভীরের বাপটাকে মে’রে ফেলবো যেভাবে শশুড়টাকে মে’রেছিলাম। আর তারপর? রোজরা না থাকলে সাফোনয়ানকে হাত করে ভীরের নতুন বাবা বানাতে বাড়তি কোনো চাপ থাকবে না। ভীরও স্বাচ্ছন্দ্যে তাকে গ্রহণ করবে। ”

-“সালাম নিও আপা। বি’ষের চেয়েও বি’ষা’ক্ত তুমি। এই টাইপের মহিলা আমি জীবনে দেখিনি। কবেকার প্রেম এখনও টিকিয়ে রেখেছ। এতগুলো খু’ন করাচ্ছো এক বুড়োর জন্য? ”

-“আমার প্রতিশোধ এটা। আর রোজ আমার ব্যাপারে জানে। যে কোনো সময় ও ভীরকে এসব বলে দিতে পারে। তাই তোমাকে বলেছিলাম ওকে দ্রুত তুলে আনতে।এবার নিজের কাজ মিটিয়ে ওকে শে’ষ করো।”

রোজ নিজের খোঁপার ভেতরে গুজে রাখা মাইক্রফোন সামনের থাই গ্লাসে দেখে ফিচেল হাসে। এত খারাপ মহিলা রোজ এই প্রথম দেখলো। এদের দুজনকে না মে’রে রোজ যাবে না। এদের মত কীটের শাস্তি একমাত্র মৃত্যু। রোজ নিশ্চিন্তে একটা লম্বাঘুমের উদ্দেশ্যে চোখ বন্ধ করলো। মনটা আজ বেশ প্রসন্ন, বাবাই মামনি ফিরে এসেছে যে।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-১২

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১২

রোজের সামনে সাফোয়ান আনসারীর কলেজ জীবনের বন্ধুদের একটা সাদা-কালো ছবি পড়ে আছে। সেখানে আনসারী সাহেবের পাশেই হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছেন সোহানা।যিনি আনসারী সাহেবকে নাকি পাগলের মত ভালোবাসতেন। রেণুকে বিয়ে করার তারিখ নাকি নিকটেই চলে এসেছিলো। ঠিক তখন সোহানা আনসারী সাহেবকে নিজের মনের কথা জানান। আর আনসারী সাহেব তার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। বাবার হতে হতে না হওয়া প্রেয়সীর কাহিনি জেনে রোজ কি বলবে? কি ভাবে সবটা নেবে বুঝে উঠতেই পারছিল না। তখন ওর সামনে আসে আরও একটি অতৃপ্ত প্রেমিকের কাহিনি। সেই অতৃপ্ত প্রেমিক হচ্ছে ইরফান। যিনি নাকি রেণুকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। রোজ বিদ্রুপ হেসে বলে,

-“স্বার্থপর মানুষ সব।স্বার্থের নাম ভালোবাসা দিয়েছিল। এদের তো কে’টে টুকরো টুকরো করা উচিত। বিয়েশাদী করে ছেলে-মেয়ে জন্ম দেওয়ার পরেও এমন লেইম এস্কিউজ যারা দেয় তাদের জিভ কে’টে ফেলা উচিত। ”

রোজ ছবিটার এক কোনায় আগুন জ্বালিয়ে দিল।ইরফান অবশ্য ভালোবাসার কারনে নয়, সাফোয়ান সাহেবের টাকার জন্য ও রোজকে মা’রার জন্য এমন করছেন। তবে সোহানা নামক নারীটি আসলেই ভালো বেসেছিলেন। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর বাদেও যে নারী পরপুরুষকে ভালোবেসে যেতে পারে তাঁর ব্যাপারে রোজ ভাবতে চায়না। এই নারী সে, যে নিজের কারনে শশুড়কে অবধি মে’রে ফেলেছেন।রোজের খারাপ লাগে ভীরের বাবার জন্য। কিন্তু তিনিও তো খুব একটা ধোঁয়া তুলসি পাতা নন। সোহানার টাকার লোভে সোহানাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। সোহানার বাবা ছিলেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। সে হিসেবে সোহানা বাবার একমাত্র মেয়ে হবার সুবাদে সব সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। কিন্তু ভীর? সে তো একজন ভালো মানুষ। তাঁর মা-বাবার অন্যায়ের শাস্তি রোজ তাকে কিভাবে দেবে? এজন্যই শেষ মুহূর্তে প্রতিশোধের আগুনে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলো রোজ। মুগ্ধতার মা’য়ের সম্পর্কে যতটা জেনেছে রোজ তাতে তিনি নরম মনের একজন স্বচ্ছ নারী যে নিজের স্বামী ও মেয়েকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। তাঁর ভালোবাসার কিছু সুন্দর কাহিনি শোনার পর তাকেও কষ্ট দিতে রোজের মন সায় দিচ্ছে না। কিছু পাপিকে শাস্তি দিতে গিয়ে কিছু নির্দোষ মানুষকে কষ্ট দেওয়া অনুচিত। শুধুমাত্র এদের দুজনের জীবনের কথা আর নিজের জীবনের বেদনার মিল পেয়ে রোজ চায়না প্রতিশোধ নিতে। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ কতটা যন্ত্র’ণাদায়ক তা রোজের থেকে ভালো কে জানে? ফালাকের প্রতি মুগ্ধতার একপাক্ষিক যে তীব্র ভালোবাসা সেটাও অন্যায় নয়। তবে রোজকে হ’ত্যার চেষ্টা করাটা অন্যায়। তাই ওকে কিছুটা হলেও শাস্তি দিতে চেয়েছিল রোজ। কিন্তু এটা করলে প্রতিশোধের অবস্থা আগে যা ছিল সেটাই থেকে যাবে। ইরফানের রাগ কমবে না।

সাফোয়ান আনসারী খু’ন হওয়ার মিথ্যা কাহিনি এবং রেণুর নিখোঁজ দুটোই সোহানা নিজে করিয়েছেন। বলা যায় বাপকা বেটি সে। বাবার মতই অভিনয় সম্পর্কে তাঁর দারুন জ্ঞান এবং অভিনয় করার দক্ষতা আছে। তবে ইরফান সাহায্য না করলে সবটা সম্ভব হত না। সে নিজের সন্ত্র’স জীবনের কিছুটা জ্ঞান উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিল এই অপহরণে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন জানা যায় সাফোয়ান সাহেবের সব সম্পত্তির মালিক তাঁর মেয়ে। অথচ তাঁর মেয়ের খোঁজ কেউ জানে না। স্বয়ং ফারদিন মাহতাবরাও না। আরশান দেখেছে ঠিক কিন্তু সেটা ইরফান জানতেন না। ব্যাস শুরু হলো রোজকে খোঁজার চেষ্টা। কিন্তু রোজ তো নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলেছিল। সারিম বাড়িতে থাকলেও রোজ থাকতো না। তাই রোজের ব্যাপারে তারা জানতে পারেনি। শেষ দিকে কিছুদিন আগে টের পেয়েছে সবাই। এজন্যই মুগ্ধতা রোজকে মা’রার চেষ্টা করল। মূলত বাবার কথা মেনে কাজটা করেছে সে, ফালাকের জন্য না। এটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো রোজকে। ফালাকের শান্ত স্থির চেহারা দেখে মনে হয়েছে সে সবটাই জানে। এজন্য চুপ ছিল। রোজকে রাগিয়ে দেয়নি। চাঁদের শুভ্রমানবের এই গুনটা চাঁদের ভালো লাগে। চাঁদের মুখ ফুটে কিছু বলা লাগে না। কথা পাড়লে মানুষটা আপনাআপনি সব বুঝে যায়। তবে প্রথমদিকে চাচার কথায় গলে গিয়ে যে বোকামি করেছে সেটা হয়তো এবার সংশোধন করবে সে।

যেদিন আনসারী সাহেবদের অপহরণ করে লরিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেদিন ফালাক চাচার সঙ্গে সেখানেই ছিল। আইজি সাহেব তদন্তের কারনে সেখানে গিয়ে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করেন তখন ফালাক চাচার কথা শুনে চাচাকে বিশ্বাস করে বলেছিল ওটা চাচার কাজের ট্রাক। ট্রাকের নাম্বারও ইরফান যা বলেছিল সেটাই আওড়েছিলো। এটা সে না জেনে করেছিলো। যেটা রোজ কিছুদিন আগে সিয়ামের কাছ থেকে শুনেছে। যে ভুল মানুষ না জেনে করে, না বুঝে করে তাঁর জন্য রাগ পুষে রাখাটা ঠিক নয়। রোজ তো এটা ভেবেছিল যে ফালাকেরও এর পেছনে হাত আছে। তাই ফালাকের সঙ্গে শত্রুতা করে গিয়েছে।কিন্তু না,মাহতাব মঞ্জিলের কেউ এবিষয়ে কিছু জানে না। শুধু ইরফান আর বর্তমানে ফালাক জানে।

🍁🍁🍁

ফালাকের সামনে নিশ্চুপ দাড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। হঠাৎ ফালাকের ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সে। কি কারনে ডেকেছে ফালাক? তাও এত তাড়া দিয়ে? আর এসেধরে সে শুধু এটা পর্যবেক্ষণ করেছে, ক্ষ্যাপাটে বাঘ পুনরায় ক্ষেপেছে। কিন্তু কেন? নিরবতা ভে’ঙে মুগ্ধতাই প্রশ্ন করে,

-“কিছু বলবে না যখন তখন ডেকেছো কেন? ফালাক।”

-“ভাইয়া ডাকবে। ফালাক বলে সম্বোধন করার সুযোগ হারিয়েছো তুমি। তুমি বলেছিলে আমার নাম ধরে ডাকতে ভালোলাগে তোমার সেজন্য পার্মিশন দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ভালোবাসা বা আমার ভালোবাসাকে আ’ঘাত করার অনুমতি, সাহস কোনোটা কি দিয়েছি?” চেঁচিয়ে বলল শেষের কথাটা।

মুগ্ধতা ভয়ে পেছনের দিকে কয়েক কদম পিঁছিয়ে গেল। ফালাকের ব্যবহার ইদানিং বেশ বদলেছে।আগে কখনও ধমক দিত না, রাগ হত না। যথেষ্ট স্নেহপূর্ণভাবে কথা বলতো। রোজ আসার পর থেকে রাগ যেন ওর সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কথা নেই, বার্তা নেই দুমদাম রেগে আগুন হয়ে যায়। মুগ্ধতার নিরব থাকা ফালাকের রাগ আরও বাড়িয়ে দিলো। বোন বলে যথেষ্ট সহ্য করেছে সে। কিন্তু মুগ্ধতা এবার নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফালাক পুনরায় ধমকে ওঠে,

-“উত্তর দিচ্ছো না কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো। ”

-“আমি তোমাকে ভালোবাসি এটার জন্য তোমার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে? ”

-“হ্যাঁ হবে।একশবার নিতে হবে। তোমার এই পাগলামির জন্য আমি নিজের ভালোবাসা হারাতে বসেছি।(রাগ দমন করে বলল) তুমি খুব ভালো করে জানো আমি ওতটাও মহৎ নই যে তুমি আর তোমার এই ননসেন্স ভালোবাসার জন্য আমি নিজের এত বছরের ভালোবাসাকে ছেড়ে দেবো। ”

-“এত বছরের মানে? কাকে ভালোবাসো তুমি? ”

-“সে প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে দেবো না। তুমি এটা বলো বউমনির বোনকে গু’লি করেছো কেন? সমস্যা কি তোমার? মেয়েটাকে ক্ষ্যাপালে তোমার কি হাল হবে তার অনুমান করেছ কখনও? না করলে আজ কল্পনা করে নাও। তোমার শরীর টুক’রো টুক’রো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর খ’ন্ডবিখ’ন্ড তুমি ভেসে ভেসে নর্দমার পানি আরও দূষিত করছো।”

-“তুমি আর বাবা থাকতে আমার কি হবে? ”

-“আমি?তোমার মনে হয় আমি আর তোমাকে বাঁচাবো? আমার জীবন নিয়ে তোমরা খেলছো আর আমি তোমাদের বাঁচানোর জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছি!না? তোমার ব্রেইনে কি একটুও বুদ্ধি নেই? ইডিয়েট গার্ল। ”

-“এভাবে কথা বলছো কেন? আমি বাবাকে বলে দেবো। তুমি এমন করেছো আমার সঙ্গে।”

-“যা, গিয়ে বল তোর ওই স্বার্থপর বাপকে। আমিও দেখতে চাই সে তোকে কতটা ভালোাসে। আরে! তোকে যদি কে’টে ভাসিয়েও দেই, তবুও ওর কিছু যাবে আসবে না। ও শুধু নিজেকে ভালোবাসে। জীবন তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে তাও লোভ কমেনি। ”

মুগ্ধতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি এসব কি বলছো?”

-“ফালতু কথা বলে মাথা গরম করিস না। অনেক কষ্টে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছি। ”

-“কি চাও তুমি? ”

-“তোদের প্রজেক্ট কোথায় হচ্ছে? কোন এরিয়া। শুধু সে টুকু জানতে চাই। ”

-“এটার জন্য তুমি এমন করলে? ”

-“এরিয়া!!!” চেঁচিয়ে।

-“রাঙামাটি। ”

-“মেহমেদ এটাকে আটকে রাখ। খবর যেন পাঁচার করতে না পারে। আমি ফিরে আসা না অবধি আটকে রাখবি। ছাড়বি না। এসে এর ব্যবস্থা করছি।ব্লাডি বি*”

🍁🍁🍁

“রোজ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা, সবার সামনে আমায় ভালোবাসেন দেখালেও উনি আমাকে পছন্দ করেন না। বাড়ির সব কাজ আমাকে দিয়ে করান, এমনকি শুধু কাজ না, বিশ্রিভাবে কথা বলেন, গায়েও হাত তোলেন। আমার বাচ্চার কথাটা জানেন তিনি। ওটা নিয়ে আমাকে অনেক.. মাঝে মাঝে ম’রে যেতে ইচ্ছে করে। শুধু ভীরের জন্য পারছি না। কি করবো, কোথায় যাবো কিছু বুঝতে পারছি না। তোকে তো বলেছিলাম সংসার আমার জন্য না। তবুও কেন জোর করলি?ওনাদের তো বাচ্চা পাওয়ার কামনা থাকবেই। এতে তো ওনাদের কোনো দোষ নেই। ভীর আমার সঙ্গে থাকে কতক্ষণ? সে সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। তখন ওকে তো এসব বলা যায় না। প্লিজ কিছু জানাস। আমি ম্যাসেজ করছি দেখলে মা রেগে যাবেন। শোন রাতে ফোন দিস। দিনে ফোন দিলে সবাই দেখবে। ”

ম্যাসেজটা পড়ে রোজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কালনাগিনী খোলস পাল্টাবে জানতো রোজ। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? সেটা ভাবেনি। ভীরকেও দোষ দেওয়া যায় না। সে তো জানেনা কিছু, জানলে নিশ্চই কোনো ব্যবস্থা করতো। রোজ হাতের কফিমগ টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে গেল ইউনিটের উদ্দেশ্যে। শেষের সেই কেসটা নিয়ে বসবে আজ।

ইফতির কাছ থেকে সব তথ্য পাওয়ার পর রোজ যেটা বুঝতে পারলো তা হচ্ছে। ছেলে চারটি রোজের আশে পাশেই ছিল। রোজ তাদের নিজের চারপাশে প্রায় সময় দেখেছে। যেটা এতদিন মনে পড়েনি। রোজের পরিচিত ছেলেগুলোকে বেঁছে বেঁছে কে মা’রবে? লাস্ট ছেলেটা তুশিব। আর খু’নটা বেশি না, দশদিন আগে হয়েছে। ভালো করে সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোজ যা বুঝলো তা হচ্ছে। কাজটা ফালাকের। তুশিবও সিরিয়া’ল কিলার তাই আগের তিনটা খু’ন সে করেছে। তাঁর প্রমাণও আছে। তবে তুশিবকে ফালাক মে’রেছে। রোজ ফাইলগুলো ক্লোজ্ড করে দিল। এই কেসের তদন্ত করে লাভ নেই। ফালাক কোনো প্রমাণ রাখেনি। এটাকে অন্যগ্যাংয়ের নামে চালিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। ইফতি ফানুশের মত উড়ে গিয়ে খবরটা জানিয়ে দিল সবাইকে। যে এটা বিপরীত কোনো দলের কাজ।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-১১

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১১

প্রায় সপ্তাহখানেক বাদে সারিমের কান্নাকা’টি দেখে রোজ বাধ্য হয়ে ওকে নিয়ে ফালাকদের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। ফালাক তখন ঘুমাচ্ছে। মুগ্ধতা বসার ঘরে অয়ন্তির সঙ্গে আড্ডা দিতে ব্যস্ত। সারিম বাড়িতে ঢুকেই অয়ন্তির কাছে ছুটে চলে যায়। আগন্তুকের আগমন লক্ষ করে মুগ্ধতা দরজার দিকে তাকালো। রোজ তখনও মুগ্ধতাকে দেখেনি। সে ওরনার মাথা দিয়ে কপালের ঘামগুলো মুছে মন্থর গতিতে এগিয়ে আসছে। মুগ্ধতা নিজের কর্তনকৃত আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে রোষ ভরা দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। রোজ এগিয়ে এসে অয়ন্তি ও সারিমের উদ্দেশ্যে বলল,

-“ওকে রাখো হীরামন। আমি বিকেলে এসে নিয়ে যাবো।”

মুগ্ধতা হেসে বলল, “একি! রোজ তুমি এখানে? ”

রোজের নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়িয়ে জবাব দিল, “ওকে দিতে আসলাম। ”

কথাটা বলে রোজ চলে যেতে লাগলে মুগ্ধতা আটকায় ওকে। রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মুগ্ধতা বলে,

-“চলে যাচ্ছো কেন? চলো তোমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখাই। বউমনি তোমার বোনকে নিয়ে গেলাম। ”

-“আমার কাজ আছে আপু। আমাকে যেতে হবে। পরে সময় নিয়ে দেখা যাবো। ”

-“তা বললে কি করে হয়? আজ প্রথম আসলে। একটু ঘুরেফিরে, খাওয়াদাওয়া করে তারপর যাও। ”

অয়ন্তির দিকে একনজর তাকিয়ে রোজ সম্মতি দিলো মুগ্ধতার কথায়। মুগ্ধতা রোজকে নিয়ে সবার আগে ফালাকের ঘরে গেলো। রোজ বোধ হয় জানত মুগ্ধতা এমন কিছু করবে।তাই নির্বিকার হেটে চলল। ফালাক বিছানার ওপর উবু হয়ে ঘুমাচ্ছে। পরনে সাদা শার্ট আর কালো ট্রাউজার। মুগ্ধতা রোজকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বলে,

-“এই মানুষটা শুধু আমার। যদি ওকে কেড়ে নিতে চাও তাহলেও ওকে পাবে না তুমি। কারন আমি না পেলে ওকে কেউ পাবে না।”

-“তোমাকে উনি ভালোবাসেন না? আমি তো জানি যে উনি আর তুমি গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড। অন্যের বয়ফ্রেন্ডকে নিজের করার কোনো প্রবৃত্তি আমার নেই।ডোন্ট ওয়ারি”

-“বাসতো। তুমি আসার পর থেকে কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। সব দোষ তোমার।”

রোজ কিছু বলল না। মেজাজ তাঁর জলন্ত লাভা হয়ে আছে। কি বলছে তার মানে জানে মেয়েটা?এই মেয়েটা ঠিক ওর বাপের মত স্বার্থপর। নিজের স্বার্থে ঘা লাগলে সবকিছু করতে পারে। ফালাকের ঘুম ভে’ঙে গেছে ততক্ষণে। ফালাক উঠে রোজ ও মুগ্ধতার দিকে একনজর তাকিয়ে বাথরুমে চলে গেল। মুগ্ধতা কিছুটা অবাক হয়ে তাকায়। রোজকে দেখেও ফালাক নির্লিপ্ত? রোজ বলে,

-“তোমার কথা শেষ হলে আমি এবার যেতে পারি? ”

-“তোমাদের মধ্যে সত্যিই কিছু চলছে না? ”

-“না। ”

মুগ্ধতা খানিক খুশি হয়ে চলে গেল। হঠাৎ পিঠে ব্যাথা করে উঠলো রোজের। রোজ কয়েকমুহূর্ত স্তব্ধ দাড়িয়ে চলে যেতে শুরু করলেই ফালাক পেছন থেকে ওর হাত টেনে ধরে। এরপর ওকে দরজার কোনা থেকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। ফালাকের দৃষ্টি ভেজা। তা দেখে রোজের মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না। ফালাকই বলতে শুরু করে,

-“কেন করছিস এমন? ভুল বুঝে কেন দূরে ঠেলে দিচ্ছিস। বিশ্বাস কর সেদিন আমি না জেনেই ওসব বলেছিলাম। ”

-“করলাম। এবার হাত ছাড়ুন। ”

-“কি হয়েছে তোর? এমন ব্যবহার কেন করছিস? তুই রাগ হ, আমাকে মা’র, যা ইচ্ছে কর। তবুও এভাবে চুপ করে থাকিস না। তোর নিরবতা সহ্য করা যায় না। এই সাত সাতটা দিন রাগ করিস নি, সিয়ামদের সঙ্গেও তালে তাল দিয়েছিস। কেন? কেন করছিস এমন? ”

-“আমিও ভুল করেছি সেজন্য ভুলটা সংশোধন করছি। আপনার ভুল ছিল না। সেটা আমি জেনেছি। তাই এসব মনে রেখে কষ্ট পাবেন না। ”

-“কি জেনেছিস? ”

-“আপনার সাহায্য যেহেতু আমার লাগবে তাই সত্যটা বলা যেতেই পারে।কিন্তু আপনাকেও আমায় কথা দিতে হবে। আমি যা যা বলবো তা শুধু আপনি জানবেন আর কেউ না।”

-“ওকে। ”

-“বাবাই মামনি বেঁচে আছে। ভীরের প্যারেন্টস আর মুগ্ধতার বাবার কাছে। আপনি মুগ্ধতার বাবাকে বিশ্বাস করে বোকামি করেছিলেন ফালাক। এজন্য আপনাকে আমি বোকা বলেছি। মুগ্ধতার বাবা মানে আপনার চাচা মানুষটা নিজেকে যেমন ভালো দেখিয়েছেন উনি আসলে তেমন নয়। আপনি সেদিন লরির নাম্বার চেপে গিয়ে যে ভুলটা করেছিলেন তাতে আমার পুরো জীবনটা শেষ হতে হতে বেঁচেছে। কিন্তু পরে যখন মাথা ঠান্ডা হলো। ছাদে আপনার কথা শুনলাম, দাদাইয়ের কথা, আপনার চ্যালাপ্যালাদের মুখে আপনার বর্ণনা শুনলাম তখন বুঝলাম এখানে আপনার কোনো ভুল নেই। চাচার ওপর অগাধ বিশ্বাস করা ভুল নয়। কিন্তু চাচাতো বোনের পাগলামি সহ্য করে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন সেটা ভুল। ওই পাগল মেয়ে আপনার গার্লফ্রেন্ড বলে নিজেকে পরিচয় দেয়। আপনি এটার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলেন না সেটা ভালো তবে আমাকে নিয়ে যেটা করছে তার জন্য চুপ থাকবো না আমি।”

-“কি করতে চাস? ”

-“এই খেলার সমাপ্তি।আর সহ্য করতে পারছি না আমি। আপনি আমার স্বল্পসময়ের বন্ধু ছিলেন। তাছাড়া আপনার বাবা আমার বাবার বন্ধু সেজন্য রাগ পুষে না রেখে এবার সব অশান্তির পরিসমাপ্তি করা উচিত। এই মেয়েটার সঙ্গেও আমার ঝামেলা নেই, আপনাকে নিয়ে সে যা ভাবে ভাবুক। আপনাদের সম্পর্ক নিয়েও আমার আপত্তি নেই। তবে আপনাদের মাঝে আপনারা আমায় বারবার কেন টানছেন? ”

-“মুগ্ধতা কিছু বলেছে? নেগেটিভ কিছু? তোর খারাপ লেগেছে? একবার বল চাঁদ।”

-“খারাপ তো মানুষের তখন লাগে যখন সত্য বলে জানা শব্দগুলো মিথ্যে প্রমানিত হয়। আপনাকে আমি খারাপ বলে জানতাম এটা ভুল ছিল। আরও যেসব তথ্য জানি তাও বোধ হয় আমার জানা ঠিক হয়নি।”

-“কি জানিস তুই? ”

-“যেটা আমাকে কেউ জানাতে চায়নি।আমি সে সবকিছু জানি। আসছি, আমার কাজ আছে। ”

-“পিয়াল, তুশিব, রামীম, নিহাল, আয়মান কে চাঁদ? ”

-“খুজে বের করুন। আমি কেন বলবো? ”

-“ওরা তোকে ভালোবাসে। তোকে সবাই চায়, কিন্তু তুই কাকে চাস? কার হতে চাস? চাঁদ? ”

-“কারোর না। ”

-“আমি তোকে ভালোবাসি চাঁদ। ”

-“জানি। ”

-“এটাও জেনে রাখ, হাজারটা রোমিও থাকলেও তুই হবি শুধু আমার। তোর মন মস্তিষ্ক সব জুড়ে শুধু আমি থাকবো।”

রোজ বিরক্ত কন্ঠে বলে,
-“প্রেম ভালোবাসায় আমার আগ্রহ কোনোকালেই ছিল না নীরদ। এটা জানো তুমি। তোমাকে আমি বন্ধু ভেবে মনের সব কথা বলতাম। ”

তুমি সম্বোধন করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল রোজ। এরপর থেমে থেমে বলতে শুরু করে,
-” আপনার মনে আছে আপনার গায়ের রঙের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম? বলেছিলেন ‘সবাই বলে শ্বেতাঙ্গ ” আমি সেদিন আপনাকে একটা নাম দিয়েছিলাম। আবেগের প্রথম ধাপে আপনি ছিলেন আমার প্রথম আবেগ। আপনাকে নিয়ে কল্পনার শেষ ছিল না আমার।শুভ্রমানব নামটা আজও আমার হৃদয়ে এক বিশাল অংশ জুড়ে আছে। আপনি আমার, শুধুমাত্র আমার শুভ্রমানব হয়ে সারাজীবন থাকবেন কিন্তু বিয়ে ভালোবাসা আমার জীবনের লক্ষ্য নয়।

আমার জীবনে সারিম আর বাবাই মামনিকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করাই মূল উদ্দেশ্য। জানেন,,আমিও সবার মত স্বাভাবিক একটা জীবন চেয়েছিলাম। সবার মতো আমি নিজেও আমার এই কঠিন রূপ কঠিন জীবন চাইনি। পরিস্থিতি আমায় এমন করেছে। আপনার একটা ভুল আমাকে এমন করে তুলেছে। আমি খু’ন করতে চাই না, র’ক্ত দেখতে চাইনা।আগে পুলিশ,খু’ন, খু’নি দেখলে প্রচন্ড ভয় লাগতো আর এখন? মাছ কা’টার মত মানুষ কা’টি।

কষ্টে আমার বুক ভার হয়ে আসে। কিন্তু নিজের রাগ, ইগোর কারনে কারোর বুকে মাথা রাখার সাহস হয়না। প্রচন্ড জেদি আমি। এটা সত্য কিন্তু আগে এমন ছিলাম না।

খুব সাধারণ একটা মেয়ে ছিলাম যার অনেক রঙিন স্বপ্ন ছিল। একসময় বন্ধুদের সঙ্গে বর বিয়ে নিয়ে গল্পে মেতে থাকা আমি এখন কোনো ছেলের প্রতি আগ্রহ খুজে পাইনা। মনে হয়, আমার জীবনটা অতিস্বল্প। এই স্বল্প জীবনে এত ভারি ভারি দায়িত্ব কর্তব্য, কথা দেওয়া আমার দ্বারা হবে না।আপনাকে না দেখে যতটা আবেগে ভেসেছিলাম, দেখার পর সেটুকুও পাইনি। সত্য বলতে আমার মাঝে অনুভূতি নেই শুভ্রমানব। আমি কাউকে ভালোবাসতে জানি না। পারি না। ভীরের সঙ্গেও প্রথম প্রথম নাটকটা করেছিলাম ওকে দেশে এনে ওর বাবা মাকে শাস্তি দিতে। কিন্তু কি লাভ এতে? আমি ওদের শাস্তি দেবো আর ওদের ছেলেমেয়ে প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠবে,যেমনটা আমি উঠেছিলাম। এভাবে শান্তি আসে না। শান্তি পেতে গেলে একজনকে হারতে হবে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি হারবো। ওদের জিততে দেবো। একবার জিতে গেলে আর কি চাই ওদের? প্রতিশোধের আগুণ দাবানলের থেকেও ভয়ঙ্কর শুভ্রমানব।

সারিম বড় হচ্ছে, হীরামন, দাদাই, এতগুলো পরিবার। সবাই যে ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে, শুধুমাত্র আমার জন্য। আমাকে আপনি ভালোবাসেন, আমার পার্ফিউম গুলো রাখেন, ঘ্রাণটা ফেবারিট তো আপনার। তবুও আমাকে নিয়ে কোনো প্রত্যাশা রাখবেন না।আমি জানি বাবাই মামনিকে শেষ করবে না তারা। কারন তারা বাবা মামনিকে কষ্টে দেখতে চায়। তাঁর জন্য ওরা আমাকে মা’রবে। কারন বাবাই মামনির সুখের একমাত্র কারন ছিলাম আমি। কিন্তু সারিম আছে, আমি না থাকলেও ও ঠিক আমার বাবাই মামনিকে দেখে রাখবে। ওকে তেমন শিক্ষাই দিয়েছি আমি। তেমনভাবে গড়েছি। তাছাড়া আপনারা তো আছেন। আমি চাই আমার গল্পটার পূর্ণতা। আমাকে ছাড়া সবাইকে নিয়ে যদি সেটা সম্পূর্ণ হয় তাহলে সেটাই অনেক। আপনি বলেছিলেন আমাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে চান। মৃত্যুর আগে আপনার ইচ্ছেটাও পূর্ণ করে যাবো। তবে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে যে, ইরফানের কাছ থেকে মামনিদের খোজ জোগাড় করে দেবেন। আমার জন্য এটুকু করতে কোনো আপত্তি নেই তো আপনার? ”

ফালাক রোজকে টেনে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিল। রোজ প্রতিক্রিয়াহীন। দৈহিক কোনো টান বা মানসিক কোনো অনুভূতি জাগলো না। ফালাকের হাত রোজের পিঠের ভাজে পড়তেই রোজ ব্যাথায় নড়ে ওঠে।ফালাক ভড়কে হাতের দিকে তাকালো।কালো জামাটা ভিজে। ঘামে নয়, র’ক্তে। ফালাক উতলা কন্ঠে বলে,

-“তোর কি হয়েছে চাঁদ? র’ক্ত কিসের? ”

-“মুগ্ধতা যেতে যেতে গু’লি করেছে। বাড়ির ভেতরে এমন শত্রুতা নেভানোর কারন বুঝলাম না। পাগল, ছিট ওয়ালা মেয়ে। সম্ভবত বুলেট ধার ঘেসে বেড়িয়ে গেছে। তেমন ব্যাথা লাগছে না বলে পাত্তা দেইনি। এর শাস্তি প্রাপ্য ওর। সেটার কথাই প্রথমদিক থেকে বলছিলাম। ”

-“পাগল তুই? দেখি কোথায় লেগেছে? মুগ্ধতার কথা আপাতত বাদ দে। ওকে আমি পরে দেখে নেবো।”

-“ওর নিশানা ঠিকঠাক না, তাই কাঁধের কিছুটা নিচে লেগেছে। আমি যাওয়ার পথে হসপিটাল হয়ে যাবো। চিন্তা করবেন না ”

-“আমাকে নিজের শরীর বিলিয়ে দিতে হবে না চাঁদ। এই খেলাটার সমাপ্তি আমিও চাই। বিশ্বাসঘা’ত’কতার ফল তারা তিক্তই পাবে। তোর কিছু হবে না, আমাকে তুই ভালোবাসিস না তাইনা? সমস্যা নেই। আমি তোকে জোর করবো না।তবে তোকেও অন্যকারো হতে দেখতে পারবো না। র’ক্তক্ষরণ বাড়ছে। হসপিটালে যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোর সমস্যা না থাকলে ড্রেসিং আমি করিয়ে দেই? ”

-“হসপিটালে গেলে মহিলা ডাক্তার না থাকলে পুরুষ ডাক্তারদের দিয়েই ড্রেসিং করাতে হত। সেক্ষেত্রে আপনি করলেও আমার আপত্তি নেই। ”

রোজ বাথরুমে ঢুকে জামা খুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বের হয়। ফালাক ফাস্টএইড বক্স নিয়ে খাটের ওপর বসে আছে। রোজ ফালাকের সামনে গিয়ে বসে। ফালাকের দৃষ্টি রোজের কা’টাদাগযুক্ত শরীরে। কালসিটে দাগে পরিপূর্ন রোজের সর্বাঙ্গ। ফালাক নড়েচড়ে বসে। রোজ হেসে বলে,

-“ভয় পাচ্ছেন নাকি? ভাবছেন ফর্সা সুন্দর চেহারার মেয়েটার শরীরে এত দাগ? এই পর্যন্ত আটটা মিশন কমপ্লিট করেছি। সেখান থেকেই আঘাত পেয়ে পেয়ে শরীরের এই হাল। ব্যাথা পেতে পেতে, আ’ঘাতের স্বাদ পেতে পেতে এখন আমার শরীর শুধু একটা পাথর। যা আমাকে অনিচ্ছায় টেনে নিয়ে যেতে হচ্ছে।দেখলেন তো গুলির আঘাতটাও টের পাইনি। সবসময় শরীরে কোনো না কোনো আঘাত থাকেই। তাই নতুন করে ব্যাথা পাওয়ার অনুভূতি পাইনা। নিন জলদি ড্রেসিং করিয়ে দিন। নতুন একটা কেস নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছি।ওটা শেষ করে মামনিদের খোজে বের হতে হবে।বুঝলেন, গোয়েন্দার চাকুরিটাও ছেড়ে দেবো এবার। ”

ফালাক তুলা বের করতে করতে বলে,
-“কষ্টগুলো সব তুই একা পেলি চাঁদ। এর পুরো দোষটাই আমার। সেজন্য তোকে আর কোথাও যেতে দেবো না আমি।তোর বাবাই আর মামনিকে আনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি নিচ্ছি। তুই বরং এখানেই থাক। তোকে ছাড়া সারিমের চলবে কিভাবে? ছেলেটা তো তাঁর আপিয়া বলতে পাগল। ”

-“শুধু ওর জন্যই চুপ আছি শুভ্রমানব। নাহলে এতদিনে কেউটেগুলোর বিষ তাদের ওপরেই উগড়ে ফেলতাম। শুধু ভেবেছি, আমার কিছু হলে সারিমের কি হবে? সারিম আমার নিজের ভাই নয়, তাতে কি? ও আমার বাবাই মামনির ছোট সন্তান। আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি। সবেমাত্র ছেলেটার বয়স সাত বছরে পড়েছে, এত দ্রুত ওকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে চাইনা আমি। ওর মেধা ভালো, ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। শুধু আমার জন্য ওর জীবন নষ্ট হবে?বলুন। ”

-“এই কা’টাদাগগুলো কিসের?”

-“ওগুলো, একবার আমাকে অপহরণ করেছিল একটা গ্যাং। ওরাই স্টিলের বড় যে ছু’রি আছে না? সেগুলো দিয়ে আঘাত করেছিলো। তিনদিন বেহুশ ছিলাম। পরে ইফতি আমায় উদ্ধার করে। ইফতি ছেলেটা কিন্তু বেশ মজার। আমি সামনে থাকলে বোকা বিড়াল সেজে থাকে আর না থাকলে বাঘা শের। সমস্যা হচ্ছে ও জয়েন করেছে তিনবছর হলো। আর আমি আছি চারবছর। প্রথম বছর আমি জয়েন করে যে পোস্টে ছিলাম। দুবছর পর তাঁর থেকে পদোন্নতি করেছি। আর ও নতুন এসে জুনিওর পোস্টে চাকুরি করছে। এজন্যই হয়তো সিনিওর হিসেবে বেশি রেসপেক্ট করে।”

-“হয়ে গেছে। যা জামা পড়ে আয়। ”

রোজ উঠে চলে গেল। জামাকাপড় পড়ে বেরিয়ে এসে রোজ হেসে বলল,

-“আমার শরীরের ওপর তো আপনার কোনো আকর্ষন দেখলাম না। আকর্ষন কি কা’টাছে’ড়া দেখে মিটে গেল? নাকি টান’ই ছিলনা ?”

-“আর কত অপমান করবি? ”

-“আচ্ছা আর করবো না। বসুন গল্প করি। অনেকদিন পর মনে হচ্ছে পুরোনো শুভ্রমানবকে পেয়েছি। বুঝলেন, গল্প করার নেশাটা এখনও যায়নি। ”

রোজ নতজানু হয়ে বসলো। ফালাক হেলান দিয়ে বসে।রোজ মৃদু হেসে বলে,

-“পৃথিবিতে এমন কিছু সত্য আছে যা আমাদের পরিবার জানে। কিন্তু আমরা জানি না। তারা আমাদের জানাতে চায়নি, জানতে দেয়নি। তবে তাঁর মধ্যে একটা সত্য আমি জেনেছি। আপনি কি সেটা জানেন?”

-“কোনটা? ”

-“তাঁর মানে জানেন না। আচ্ছা আমি বলছি। আপনার বাবা শুধু বাবাইয়ের বন্ধু নয়। আপনাদের সঙ্গে আমার ও আমাদের আরও একটা সম্পর্ক আছে। সেটা এটার থেকেও বেশি মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কি জানেন?”

-“হেয়ালি করবি না চাঁদ। সরাসরি বল। ” খানিকটা ভীত কন্ঠে বলল।

-“আপনার মা ফারিয়া আর মামা ফারুক আমার বাবাই সাফোয়ান ও চাচ্চু সুলেমানের সৎ ভাইবোন। সম্পর্কে আমি আপনার মামাতো বোন। এবং আপনি আমার ফুপাতো ভাই। দাদা কথাগুলো মৃ’ত্যুর সময় জানিয়ে গিয়েছিলেন। তখন মনে হয় আপনার জন্ম হয়নি, দাদাই হয়েছিল। আপনার বাবার সঙ্গে আমার বাবার বন্ধুত্ব অনেক আগের তাই তারা তিক্ত সম্পর্ক না টেনে বন্ধুত্বের মধুর সম্পর্কই বজায় রেখেছিলেন। বিশ্বাস না হলে বাড়িতে বলে দেখুন। আমি কথাগুলো দুঃসম্পর্কের এক দাদির কাছে শুনেছি যখন সিলেট থেকে সারিমকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম তখন।কিন্তু কাউকে এটা বুঝতে দেইনি যে আমি সব জানি। সবাই জানলে কষ্ট পেত।”

-“আমি এটা জানতাম। তবে বুঝিনি তুইও জেনে ফেলবি। ভাই বা অয়ন্তিরা এসব জানে না। ”

-“হুম।আপনি জেনে ফেলবেন সেটা আমিও অনুমান করেছিলাম। কারন আমরা দুজনেই অনেকটা একরকম তবে আপনি আমার প্রতি দূর্বল কিন্তু আমি আপনার প্রতি দূর্বল নই। এটাই মূল পার্থক্য। যাই হোক, আসল কথায় আসি। আপনার ভালোবাসাকে আমি সম্মান করি শুভ্রমানব। তবে আবারও বলছি, আপনাকে কখনও ভালোবাসবো কিনা জানা নেই আমার।

আচ্ছা আমাকে এবার যেতে হবে। আপনি প্লিজ মামনিদের খোঁজটা জেনে রাখবেন। আপনার ক্ষমতাও তো কম না। ওহ আরও একটা প্রশ্ন, কলেজে থাকতেন কেন? আপনার তো মনে হয় আরও তিনচার বছর আগে কলেজের পাট চুকেছে।”

-“বিসিএস দিয়েছি। তোদের কলেজের প্রভাষক পদে জয়েন করবো। ইন্টারভিউয়ের ডেট পড়েছিল সেদিন তাই গিয়েছিলাম। আর তোর পুকুরে পড়ার দিন স্যার ডেকেছিলেন। লাইব্রেরির দিন বই নিতে গিয়েছিলাম।”

-“কি সাংঘাতিক। কলেজের প্রভাষককে থা’প্পর মে’রে বদনাম করে দিলাম নাকি? ভাগ্গিস আপনার চ্যালারা ছিল। তাই ঘটনা তেমন রটেনি। বেস্ট অব লাক টু ইউর নিউ চ্যাপ্টার। গুড বাই। ”

রোজ চলে যেতেই ফালাক বলে ওঠে,
-“ভয়ঙ্কর তথ্যগুলো দেখছি সব তোর জানা চাঁদ।তোকে নিয়ে যে কি করি। শান্ত থাকলে লাই পেয়ে মগডালে উঠিস। আর রেগে গেলে চটে যাস। তবে আপাতত তোর জন্য আমার শান্ত স্বভাবই উপযুক্ত। কারন এসবের মধ্যে তোকে আর জড়াতে দেবো না আমি। তোর শরীরের ক্ষতগুলো মুছে যাবে এবার। তোর কষ্টগুলো মিটে যাবে। তোর রঙিন দুনিয়া তুই আবার ফিরে পাবি। আর তোর শুভ্রমানব ফিরে পাবে তাঁর আহ্লাদি চাঁদকে।”

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-১০

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১০ (বোনাস)

রাইভীরের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। রোজ এখনও চুপচাপ বসে আছে।ইফতিকে আসতে বলেছে বোনের বিদায়ীর জন্য। রোজ এখনও বসে আছে শুধু ভীরের মা সোহানা রাইকে কেমনভাবে গ্রহণ করবে সেটা দেখার জন্য। তিনি বিয়ের সময় ছিলেন না। ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বসে ছিলেন। ভীরের বাবা অবশ্য সবাইকে দেখে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন “ছেলেটা ঠিক আমার মত হয়েছে, আমি যেমন ওর মা’কে ভালোবেসে সবার অমতে বিয়ে করেছিলাম। সেও করেছে। আমি তো বেশ ভালো আছি সোহানাকে নিয়ে, ও’ও যেন সুখী হয়। ” কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে মহাশয়ের দুমদাম বোম ফাঁটছে তা রোজ বেশ টের পেয়েছে। তাঁর প্রিয় স্ত্রী তাকে এত সহজে ছাড়বেন না। তবে রোজের আফসোস থেকে গেল একটা বিষয় নিয়েই। খেলাটা সে এভাবে খেলতে চায়নি। আরও সময় নিতে চেয়েছিলো। ভীরের আড়ি পাতার কারনে সবটা ভেস্তে গেল। ভীরকে কঠিন একটা শাস্তি দিলে মন শান্ত হত কিন্তু রাইয়ের কথা ভেবে সেই চিন্তা মাথা থেকে বের করে ফেললো। তবে অন্তরে তাঁর ভয় থেকে যায়। রোজ যাদের জন্য এসব করলো তারা এরপরেও কি ভালো থাকবে? শত্রুরা নিশ্চই চুপ করে বসে থাকবে না। রোজের চেহারায় বিষন্নতা ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। একদিক আলোকিত হলে অন্যদিকে যে আঁধারে নিমজ্জিত হবে তা রোজ জানে। কিন্তু রোজ তো চায়নি ওরা কষ্ট পাক। সারিম এসে ভীরের পাশে বসে বলল,

-“আপিয়া আজ দু দুটো বিয়ে হলো। তোমার বিয়েটা কবে হবে? ”

রোজ নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,
-“তুমি ভাইয়া খোজো। তোমার যাকে পছন্দ আমি তাকেই বিয়ে করবো। ”

সারিম দ্রুতগতিতে বলে,
-“তাহলে ফালাক ভাইয়াকে করে ফেলো। আজ তিনটে বিয়ে হয়ে যাক। আমি সবাইকে বলবো আমাদের বাড়ি তিনখুশির বাড়ি। আগে আমরা তিনজন ভাইবোন ছিলাম, আজ তিনটা বিয়েও হবে। ”

রোজ কিছুটা মিইয়ে পড়া কন্ঠে বলে,
-“এসব নিয়ে পরে কথা বলবো। তুমি খেয়েছ? তোমার না, খেয়ে ঘুমানোর কথা? গত তিনদিন ধরে রাতজেগে চোখের নিচে কালি পড়েছে। শুকিয়ে গেছ নক্ষত্র। যাও ঘুমিয়ে পড়। ”

সারিম বিয়ের কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়ে অভিমান নিয়ে বলে, “বিদায়ী দেখবো না? ”

-“যখন বিদায়ী হবে আমি তোমাকে ডেকে দেবো। এখন গিয়ে ঘুমাও। বিদায়ী সন্ধ্যার পর হবে। বুঝেছ? ”

-“ঠিক আছে। কিন্তু ফালাক ভাইয়ার কথাটা মনে রেখ। ভাইয়া খুব ভালো, আমাকে অনেক আদরও করে। তুমি ওনাকে বিয়ে করলে আমি ফালাক ভাইয়াকে প্রিয়ভাই বলে ডাকবো। ”

ফালাক এসে সবেমাত্র দাঁড়িয়েছিল। সারিমের পুরো কথাটাই শুনেছে। সে অপেক্ষা করছে রোজের উত্তরের। সারিমকে উত্তর না দিয়ে রোজ থাকে না। সারিম যেটাই প্রশ্ন করুক না কেন, সারিম উত্তর পাবে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফালাককে দেখে রোজ হেসে বলে,

-“আসলে কি হয়েছে জানো নক্ষত্র? উনি যদি ঠিক সময় বিয়ে করতো।ওনার তোমার মতো একটা ছেলে থাকত। উনি তোমার বাবার মত, তাই বেশি আদর করে।তুমি বরং ওনাকে চাচা বলে ডাকবে।”

সারিম বোকা চোখে তাকালো। আশেপাশের সবাই দম ফাটিয়ে হেসে ওঠে। ফালাক জ্বলে উঠলো মুহূর্তেই। রোজ নিজেও চাপা হাসে। সারিম প্রশ্ন করে,

-“চাচা ডাকবো?তুমিও কি চাচা ডাকবে আপিয়া? আগে তুমি ডাকো তারপর আমি ডাকবো। ওই তো ফালাক ভাইয়া না, না ফালাক চাচ্চু দাড়িয়ে। ডাকো চাচ্চু। তুমি ডাকলেই কিন্তু আমি ডাকবো। নাহলে ডাকবো না।”

ফালাক দ্রুত ফোন কানে দিয়ে কে’টে পড়লো ওখান থেকে। রোজকে বিশ্বাস নেই চাচ্চু কেন দাদা, নানা, কাকা, মামা, আব্বাও ডেকে উঠতে পারে। যাকে বউ করার স্বপ্ন আট বছর ধরে দেখছে তাঁর মুখ থেকে এই বিষাক্ত ডাকগুলো সহ্য হবে না। ফালাক চলে যেতেই সারিম বলে উঠল,

-“চাচ্চু ফোনটা কানে ধরে ওভাবে চলে গেল কেন? কেউ তো ফোন করেনি, আমি লকস্ক্রিনে দেখলাম। ফোন না করলেও কথা বলা যায়? আচ্ছা আপিয়া এটা কি নতুন কোনো টেকনোলজি? আমাকে তুমি বলোনি কেন?”

-“এটাকে কে’টেপড়ানোলজি বলে নক্ষত্র। যখন বড় হবে তখন বুঝবে। আমি তখন ভালো করে বোঝাবো। এখন যাও ঘুমিয়ে পড়। ”

সারিম চলে যেতেই হাসির রোল পড়ে গেল চারপাশে। বেকায়দা লজ্জায় পড়ে ফালাক শেষে বাড়ি ছেড়েই চলে যায়। মনে মনে বলে, “শালা ফাঁসানোর আর সময় পেলো না। ভরা বিয়েবাড়িটাই পেলো এভাবে ইজ্জত খাওয়ার জন্য? হবুবউটাও হয়েছে জাঁদরেল। ”

আরশান অয়ন্তি ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলছে।রোজ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করতেই ও শুনতে পেলো ফালাক আর রোজের নাকি চলছে। রোজ তেতে উঠল, চলছে মানে?কি চলছে?র’ক্তার’ক্তিই শেষ হলো না আর লোকটা সবার মাথায় উল্টাপাল্টা ভরে দিয়েছে? মুগ্ধতা কোথায়?মুগ্ধতার কানে কথাটা চালান হচ্ছে না? সেদিন তো ভালোই গরম দেখালো, দারুন খেলা দেখালো আজ কোথায় সে? নিজের বয়ফ্রেন্ডকে সামলে রাখতে জানে না আবার রোজের পেছনে লাগতে আসে। ফালাককে সামনে পেলে গনধোলাই খাওয়াবে রোজ। মুগ্ধতা যদি ঠেকাতে আসে তাহলে রোজ নিজে ওকে ঝুলিয়ে পেটাবে। রোজ উঠে পড়তেই দেখলো সবাই ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। কি অদ্ভুত! বিয়ে বাড়িতে দুই দুইটা বর-বউ তাদের রেখে সবাই ওকে দেখছে কেন? রোজ কিছুদূর যেতেই হোচট খেয়ে পড়ে যেতে লাগলে সিয়াম এসে ধরে ফেলল। মুখে বলল,

-“সাবধানে চলবেন তো ভাবি। এখুনি তো পড়ে যেতেন।”

রোজ কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”থাবড়ে গাল লাল করে দেবো বেয়াদব। আমি তোমার ভাবি লাগি?”

-“না, মা। আমরা সবাই আপনাকে মায়ের নজরে দেখি। কিন্তু আম্মা বলে তো ডাকা সম্ভব না। ভাইকে তো ভাই বলি। তাই আপনাকে ভাবি বলতে হচ্ছে। ভাবি না ডেকে ছোট বউমনি বলবো? নাকি রাজরানি মানে হচ্ছে রোজারানি? রোজরানি?”

-“আমার সামনে আর একমিনিট দাঁড়ালে তোমার ঠ্যাঙ ভে’ঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। ”

সিয়াম দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেল।ফালাক বলে রেখেছিল। রোজ রেগে গেলে খু’ন করতেও পিছপা হয়না। তাই সে কথা মাথায় রেখে সিয়াম শুধু গেল না একপ্রকার দৌড়ে, ছুটে চলে গেল। রোজ বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে ফেলে। চারঘন্টাও হয়নি ছাদের ঘটনার। এইভাবে সে শত্রুতা নেভাচ্ছে? একদম রোজের জায়গামত ঘা দিয়ে নেভাচ্ছে। এর থেকে অন্য কোনো কিছু রোজের রাগের মাত্রা বাড়াতে সক্ষম না। ভাবি, ভাই শুনে যতটা রাগ হচ্ছে অন্যকিছুতে হত না। কারন রোজ ঠান্ডা মাথাতে সবটা সামলাতে জানে।শুধু এটাতেই মনে হচ্ছে এক কড়াই গরম তেলের মধ্যে এক ফোটা পানি দিলে যেমন চিরচির করে ওঠে রোজেরও তেমন অনুভূত হচ্ছে। রোজ ঘরে আসতে আসতে প্রায় দশ বারোজন রোজকে সালাম দিয়ে ভাবি ভাবি করে চেঁচালো। রোজ রেগে হনহনিয়ে ঘরে চলে আসে। ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। জনে জনে মানুষ আসছে আর ছাগলের মত ভ্যাবি ভ্যাবি করছে। গায়ক বর, জকি বরের থেকেও পলিটিশিয়ানদের জোর বেশি নাকি? কোন দল করে কে জানে? এত শুভাকাঙ্ক্ষী কোথ থেকে আসে? কলেজেও কতগুলো আছে। ভাই ছাড়া চোখের পলকও ফেলতে পারে না। এগুলো ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া শ্বাস নেয় কেন?

রাতে বিদায়ীর সময় বেশ কান্নাকাটি হলো। রোজের তা দেখে বিরক্তি ছাড়া আর কোনো অনুভূতি প্রকাশ পেল না। একঘন্টার রাস্তাই তো পার করে যাচ্ছে। তাতে এত কেঁদে ভাসানোর কি আছে? রোজের চিন্তা হলো রাইকে নিয়ে। সোহানা বেগম, মহিলা সুবিধার না। রোজ হলে ঠিক টাইট দিতে পারতো। রাই তা পারবে না, তার ওপর বাচ্চা নিয়ে রাইয়ের দূর্বলতাও আছে। সেজন্য রাই তো মুখই খুলবে না। রোজ সবার সামনে থেকে ভীরকে ডেকে আড়ালে নিয়ে যায়। এরপর সরাসরি বলে,

-“আপনার মা রাইকে পছন্দ করেন না। এটা বুঝেছেন? নাকি চোখে পড়েনি? ”

-“ওসব কিছু না রোজ। হঠাৎ এসব হয়েছে বলে আম্মা শকের মধ্যে আছে। পরে ঠিক মানিয়ে নেবে। তুমি চিন্তা করো না। আর সকালের কাজের জন্য লজ্জিত আমি।”

-“রাইকে আমি আপনার ভরসায় পাঠাচ্ছি। আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।নাহলে আপনার এই প্রেমকাহিনি আমি শোককাহিনিতে পরিণত করবো। এ্যান্ড আই মিন ইট। আমার ব্যাপারে নিশ্চই শুনেছেন। আমি কিন্তু অন্যায় মেনে নেবো না। আপনি স্বেচ্ছায় ওকে বিয়ে করে নিজের জীবনে এনেছেন। এরপর যদি ওকে কোনোরূপ টর্চার করা হয়, বাচ্চা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়… ”

-“আমি কথা দিচ্ছি। এসব কিচ্ছু হবে না। ”

-“ধন্যবাদ। ”

সোহানা রোজকে ভীরের সঙ্গে দেখে এগিয়ে আসলেন। এরপর মধুর হেসে বললেন,
-“চিন্তা করো না মা, বিয়েটা যেভাবেই হোক। মেনে নিয়েছি। আমার কাছে আমার ছেলের সুখের থেকে আর কোনোকিছু বেশি বড় না। ”

রোজ তাচ্ছিল্য করে বলে,
-“সেটাই নিজের সন্তানের সুখের জন্য সবাই সবটা করে। কিন্তু পরের সন্তানের কথা একবার চিন্তা করেও দেখে না।”

সোহানা খোঁচাটা বুঝতে পারলেও ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বললেন, “দিন-দুনিয়া বড়ই অদ্ভুত। ভালো থেকো। ভীর চলো। ”

সোহানা ভীরকে নিয়ে যেতে লাগলে রোজ পেছনে ঘুরে তাকায়। সহ্য হচ্ছে না আর। মহিলাটা একদম বিষধর। সময় সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করতে জানেন। ভীরের সামনে ভালো মা হওয়ার অভিনয়টা কি সুন্দর করে করলেন।রোজের মনে হলো প্রতিশোধটা প্রথমে এনাকে দিয়ে শুর করা উচিত। স্বার্থপর সুবিধাবাদী মহিলা।

অয়ন্তির বিদায়ীর সময় সবাই একে একে এসে রোজের কাছ থেকেও বিদায় নিলো।মুখে ভাবি ডাক বহাল রইল, রোজ মনে মনে ঠিক করে নিল, হয় এদের ভাবি ডাক থাকবে নয়তো ভাই। ভাই না থাকলে ভাবি ডাকেরও সম্ভাবনা নেই। ওদিকে সারিমের কান্না দেখে রোজের মনটা বিষাদে ভরে উঠলো। সারিমকে ডেকে সে ঘরে নিয়ে যায়। আজ সারারাত সে সারিমকে গল্প শোনাবে। ছোটবেলায় রোজ কত বোকা ছিল, ভীতু ছিল, কিভাবে মা’র খেয়ে কান্না করতো, সেসবই অভিনয় করে দেখিয়ে সারিমকে ঠান্ডা করলো সে।

রাতে রাইয়ের সঙ্গে কথা বলে রোজ জানলো সোহানা রাইকে মেনে নিয়েছেন পুরোপুরি এবং মেয়ের মতই যত্ন করছেন। রোজ ফোন রেখে দেয়। মহিলাটির ব্যবহারে কারোর কোনো সন্দেহ থাকবে না এমন ব্যবস্থাই তিনি করছেন। যাক রাই ভালো থাকলেই হলো।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৯

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৯

বিয়ে বাড়িতে আসার পর ভীরকে দেখে রাইয়ের কান্না অধিক হারে বেড়েছে। ভীর রোজের পরিচিত? নাকি রোজ নিজেও ওর কথা জানতো না? রাই চুপচাপ এক কোনায় দাড়িয়ে দেখছে বিয়েটা। কাজি সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। রোজ এলো কিছু সময় বাদেই। দুহাতে বড়সড় ব্যান্ডেজ নিয়ে। রোজকে দেখে রাই এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করবে তাঁর আগেই ওর সামনে একটা শ্যামবর্ণের হাত এসে থামলো। হাতের ওপর সফেদ রুমাল। রাই চোখ তুলে তাকায়। ভীর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রাই ভীরকে উপেক্ষা করে চলে গেল। ভীর থতমত খেয়ে তাকায়। ব্যাপারটা কি হলো? ভীর তো উপকারই করতে এসেছিলো। কেঁদেকেটে মেক আপ নষ্ট করে পেতনি সাঁজছিল মেয়েটা।তাই রুমাল দিল যেন লেপ্টে যাওয়া কাজল লিপস্টিক মুছে সে কনের সুন্দরী বোনেদের মত চলা ফেরা করতে পারে। আর মেয়েটা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল? দেশের মেয়েগুলো সব ভদ্রতা, সভ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। রোজ একজন সকালে কথা শোনালো আর এই একজন অপমান করে চলে গেল।

রোজের কাছে এসে রোজের হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে রাই। রোজ ফোনে ইফতির সঙ্গে কথা বলছিলো। রাইয়ের কান্না শুনে ইফতি উত্তেজিত কন্ঠে বলে,

-” কি হয়েছে ওর? কাঁদছে কেন? রোজ কথা বলো। ”

-“কিচ্ছু হয়নি। তোমার বোন মিনিটে মিনিটে কাঁদে এটা নতুন কিছু না।তুমি ডেথস্পটে যাও,আমিও ঘন্টাখানেক পর আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত কাউকে ভেতরে এলাউ করবে না। ”

-“আচ্ছা। রাইকে দেখে রেখো একটু। ”

-“ওর চিন্তা করতে হবে না। আমার বাড়িতে বাঘভাল্লুক নেই যে তোমার বোনকে খেয়ে ফেলবে। রাখছি। ”

ফোন রেখে রোজ রাইকে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে গেল। ভীর পুরোটা লক্ষ করে সন্দিগ্ধচোখে তাকায়। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না সে, তবে কৌতুহল বাড়ছে। তাই ভীর চুপিসারে রোজের ঘরের সামনে চলে গেল। ফালাক শেরওয়ানী বদল করে এসে ভীরকে রোজের ঘরের সামনে আড়ি পাততে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায়। এদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না ফালাকের। বিশেষ করে ভীর রোজের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে এটা সহ্য করা বেশ মুশকিল।

রোজ রাইকে সোজা দাঁড় করিয়ে বলল,
-“একদম শান্ত হবি। তাও দু মিনিটের মধ্যে। নাহলে এই কান্না থামানোর বন্দোবস্ত আমি করবো। ”

রাই হিচকি তুলে কাঁদে। রোজের তা সহ্য হলো না। সে খানিকটা ধমকে বলল,
-“স্টপ ক্রাইং রাই। কেন কাঁদছিস? তোর জীবনটা জটিল এতে তো তোর কোনো হাত নেই। তাহলে কেন করছিস এমন? শরীর খারাপ করবে তো, সোনা। কান্না থামা। ”

রোজের শেষ কথাটুকুতে রাইয়ের কান্না থেমে গেলো। রোজ এবার কঠিন গলায় বলল,
-“তুই যদি কান্না না থামাস আমি কিন্তু ভীরকে সত্যটা বলে দেবো রাই। বলে দেবো আমিই মনিমালা। আর,,,”

দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনতেই থেমে গেল রোজ। রাইয়ের চোখের পানি মুছে সে দরজা খুললো,সঙ্গে সঙ্গে ভীর জড়িয়ে ধরলো রোজকে। দৃশ্যটি দেখামাত্র রোজ, ফালাক রাই তিনজনেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ফালাক হাত মুঠোবন্দি করে এগিয়ে আসে। কিন্তু পরের ঘটনাটি দেখামাত্র রাগে সারা শরীর কেঁপে উঠল। ভীর রোজকে শুধু জড়িয়ে ধরেনি, রোজের কপালে চুঁমু খেয়ে ভালোবাসার কথা অবধি বলছে। মনিমালা বলে ডাকছে। একদিনের মাঝে ডাকনামও পরিবর্তন করে ফেলেছে রোজ? এজন্যই ফালাককে সে সহ্য করতে পারছে না। এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল ফালাক। ওদিকে ভীরের চুঁমাচুঁমি দেখে রাইয়ের কান্না থেমে গেছে। রোজ কাঠের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাই ভীরকে ভালো না বাসলে এখনই ভীরের অবস্থা শোচনীয় করে তুলতো রোজ। তাই লম্বা শ্বাস ফেলে রোজ কোমল কন্ঠে বলল,

-“স্টপ ইট ভীর। ছাড়ুন আমাকে। ”

ভীর কেঁদে উঠল, “তুমি যখন আমাকে চিনতে, জানতে তাহলে সকালে ওমন করলে কেন জিয়নকাঠি? কেন? আমি কি ভুল করেছি বলো। কেন আমার থেকে দূরে যেতে চাচ্ছো? বুঝতে চাচ্ছো না কেন আমি ভালোবাসি তোমাকে। আই লাভ ইয়্যু সো মাচ জিয়নকাঠি। তোমার জীবন কঠিন হলেও আমার আপত্তি নেই, তোমার পেশা তোমার স্বভাব কোনো কিছুতে আপত্তি নেই। আমি শুধু তোমাকে চাই। শুধু তোমাকে। ”

ভীর পাগলের মত কথা বলতে শুরু করলো। থামাথামি নেই দেখে রোজ সটান চর কষিয়ে বসালো ওর গালে। ভীর বাকরুদ্ধ তাকালো। রোজ ভীরকে ঘরের ভেতরে এনে দরজা বন্ধ করে বলে,

-“বুঝলাম না। আমার হাতে চর না খেয়ে কেউ থামেনা কেন? আর দুঃখিত আমি চর মারতে চাইনি। আপনি থামছিলেন না বলেই কাজটা করতে বাধ্য হয়েছি। নরম গলায় কাজ হচ্ছিলো না, আমি কথা বললেও আপনি আমার কথা শুনছিলেন না। তাই মেন্টালি একটা শক দিয়ে আপনাকে চুপ করাতে হলো। এবার আশা করি শুনবেন। ”

রোজ খাটের ওপর আসন কেটে বসে বলল,
-“প্রথমটুকু শুনেই আপনার আমাকে টাচ করাটা ভুল হয়েছে। পুরোটুকু শোনা উচিত ছিল।
মনিমালা আমার আইডি, প্রথমদিকে হয়তো আমি কথা বলেছি আপনার সঙ্গে। তবে আপনার জিয়নকাঠি আমি নই।আপনার কথা আমার বিরক্ত লাগতো। একদিন রাই আমার ফোনটা নিয়ে ওর ভাই ইফতিকে কল করেছিল। তখনই আপনার ম্যাসেজ ওর চোখে পড়ে। আমার কাছ থেকে শুনে ও আপনার সঙ্গে প্রাঙ্ক করতে গিয়েছিলো। কিন্তু দুমাস পর জানলাম আপনাদের মধ্যে সেই একটা কাহিনি চলছে। মানে, আমার আইডি দিয়ে, আমার বান্ধবি আমার ওপর লাট্টু খাওয়া ছেলেটার ওপর লাট্টু খেয়ে বসে আছে। তারপর আমি আইডিটা ওকে দিয়ে দেই। তারপর আপনাদের কনভারশেসন বাড়ে, ওর নাম জিয়নকাঠি রাখেন।ওকে প্রপোজ করেন। এসব কাহিনি শুনে আমি প্রথমে ওকে মানা করেছিলাম এমন না করতে। কারন আপনি প্রায় উন্মাদের মতো ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু শুধু আপনি নন, রাইও আপনার জন্য পাগল। না দেখে, না জেনে, না শুনে এমন প্রেমের সূচনা আমি এই প্রথম দেখলাম। রাই আপনাকে ভালোবাসে আর আপনি যদি জিয়নকাঠিকে ভালোবাসেন তাহলে আপনার জিয়নকাঠি আপনার সামনেই বসে আছে। যান কয়েকটা চুঁমু টপাটপ তাকে খেয়ে ফেলুন। তবে কাজটা করার আগে রাইয়ের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা দরকার আপনার।

রাই অনাথ। ওর ভাই আমার সঙ্গেই কাজ করে। সেই সূত্রে ওকে চিনেছি আমি। আর এখন ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য নেই যা আমি জানি না। ওর বাবা হার্টএ্যাটাক করে মা’রা গেছেন আর মা আচমকা। হয়তো ওর বাবার শোকে। কারন তার কোনো রোগ শনাক্ত করা যায়নি। ইফতি বিবাহিত তাঁর দুটো বাচ্চা আছে। এটা হচ্ছে ওর পারিবারিক অবস্থা। এবার আসি শুধু ওর কথায়, ও আপনাকে বলেছিলো ও সবাইকে ভালোবাসতে পারবে না, ওর জীবনটা কঠিন। কেন বলেছিল এই কথা? সব তো নরমালই আছে তাইনা? কারন রাইয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছে। একমাসের বিয়ে, ছেলেটার চরিত্র ভালো ছিল না এটা ইফতি জানতো না। মাসের মাথাতেই ওর তালাক হয়ে যায়। এবং বছর দুয়েক আগে ও জানতে পারে “সি উইল নেভার বি এ্যা মাদার।” ও কখনও মা হতে পারবে না। একটা মেয়ের জীবন জটিল হওয়ার জন্য এই তথ্যটাই কি যথেষ্ট নয়? আপনার ভালোবাসা তখন কতটুকু থাকবে যখন জানবেন আপনি বাবা হতে পারবেন না। আপনার স্ত্রী কখনও সন্তান জন্ম দিতে পারবে না,এসব কারনেই রাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। ও আপনাকে ভালোবাসলেও আপনার হতে চায়না। ”

ভীর রাইয়ের দিকে তাকালো। নিশ্চুপ মেয়েটার চোখের পানিতে বেডসীট ভিজে গেছে। ভীর উচ্চস্বরে হেসে বলে,

-“এই সামান্য একটা কারনে? ”

রোজ হেসে বলল, “মহত্ব দেখাতে আসবেন না। এসবে ওর জীবন চলবে না। জানতে চেয়েছিলেন সবকিছু। জানিয়ে দিলাম। এবার বিদায় হন। সেলেব্রিটি মানুষ তাই অপমান করছি না। বিসাইডস বেস্টুর ভালোবাসা নাহলে আপনার হাত আর ঠোঁটের এমন অবস্থা করতাম যে আগামী ছ’মাস তা কোনো কাজেই লাগতো না। ”

-“সারিম তোমার কি হয়? ”

রোজ সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো। ভীর হেসে বলল,
-“শুধু জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায়না। তোমার বাবা মা তাঁর প্রমান দিয়ে গেছে রোজ। সারিম যে তোমার নিজের ভাই নয় তা জানি আমি। তোমার বাবা যদি সারিমের থেকে পিতৃত্বের স্বাদ পেতে পারে আমি কেন পারবো না? জিয়নকাঠিকে ভালোবাসার সময় আমি এসব ভেবে ভালোবাসিনি। আমি শুধু মানুষটাকে ভালো বেসেছিলাম। এমনও তো হতে পারতো, ওটা ফেক আইডি, কোনো মধ্যবয়স্ক নারীর বা বিবাহিত কারোর। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় আছে। তাই আমার ভালোবাসায় সামান্য একটা কারন কখনও বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না। রাইকে আমি বিয়ে করবো এটাই ফাইনাল। ”

রোজ ভীরের আর রাইয়ের হাত ধরে বলল,
-“তাহলে শুভকাজে দেরি কিসের? আপনার মা রাইকে পছন্দ করেন। তখন শুনছিলাম তিনি বলছিলেন এমন একটা মেয়ে পেলে তিনি পুত্রবধু করবেন। কাজি যখন আছে তখন বিয়েটা সেরে নেওয়া যাক। আমিও দেখতে চাই আপনার সাহস আর ভালোবাসার দৌড় কতদূর।”

রাই বাঁধা দিল কিন্তু ভীর কিছু বললো না। কাজির সামনে গিয়ে রোজ চেহারা স্বাভাবিক করে বলল,

-“দাড়ান কাজিসাহেব আরও একটা বিয়ে দিতে হবে আপনাকে। এই দুজনও বিয়ে করবে। উপস্থিত সবাইকে জানাতে চাই এরা দীর্ঘদিন প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। আর ওরা চায় বিয়ে করতে, আন্টি আপনার কোনো সমস্যা আছে? থাকলেও বিয়েটা আপনার ছেলে করবে তাই ওনার ভালো উনি বুঝে নেবেন। কাজি সাহেব কি কি রিচুয়াল আছে বলে দিন ওদের। নোরা রাইকে নিয়ে যা, সাঁজিয়ে আন। আর মেহমেদ ভাই আপনি ভীরকে নিয়ে যান। ”

এটোম বোম ফাঁটিয়ে রোজ কাজির পাশে বসে পড়লো।সবাই এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। পাঁচমিনিটে বাড়ির পরিবেশটাই বদলে গেছে। রোজ যে ভীষণাকারে রেগে আছে তা সবাই টের পেলো। রোজের হাতে বন্দুক। মনে হচ্ছে ধমকে ধামকে বিয়ে করানো হচ্ছে। কিন্তু রোজ শুধু চায় ভীর কি করে সেটা দেখতে। ফালাককে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। চলে গেছে হয়তো। ভালো হয়েছে। ওকে দেখলে রাগ বাড়তো। ভীরের মায়ের বোধ হয় এই পরিবেশটা পছন্দ হলো না। অতীব সুন্দর চেহারাটি কেমন থমথমে হয়ে আছে। ভীরের বাবার অবস্থাও তাই। ওনাদের এমন চেহারা রোজের মনে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দিলো। রোজ মনে মনে বলে,

-“এটাকেই হয়তো রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলে আঙ্কেল। আপনিও আপনার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে পাশে দন্ডায়মান এক কালনাগিনীকে বাড়িতে তুলে এনেছিলেন। আর আজ আমি সেই কালনাগিনীর বিষদাঁত ভাঙলাম। খুব শীঘ্র তাঁর ফনাটাও ছিড়ে ফেলবো। প্রতিশোধ নেওয়ার খেলাটা তো সবে শুরু। ”

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৮

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৮

-“আপনি এখানে? ”
রোজের প্রশ্নে ফালাক সরুচোখে তাকালো। রোজ হাত দিয়ে ল্যাহেঙ্গা উঁচু করে ধরে, প্রশ্নবোধক চাহুনি নিক্ষেপ করে আছে। ফালাক চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে নিল। আরশান গাড়ি থেকে নামছে,বাবারাও আরশানের সঙ্গে আসছেন। রোজ পুনরায় প্রশ্নটি করে। ফালাক জবাব দিল না। ধীরে ধীরে বারান্দা জনশূণ্য হয়ে যেতেই সে রোজের হাত চেপে ধরে। এরপর টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগলো। রোজ বিস্মিত হয়ে বলল,

-“কি অদ্ভুত! টানছেন কেন? আরে, আরে ছাড়ুন। কেন এসেছেন এখানে? ভারি অসভ্য তো! আরে ভাই ছাড়েন না কেন? ”

ছাদে আপাতত কেউ নেই। ফালাক একটু আগে এসেই দেখে গিয়েছিলো। তাই রোজকে সে ছাদে টেনে নিয়ে আসলো। ছাদের দরজা লাগিয়ে সে রোজের হাত ছেড়ে দেয়। রোজের হাত লাল হয়ে গেছে। রোজ হাতে সামান্য ফুঁ দিয়ে বলে,

-“অসভ্যতার চূড়ান্ত,, ”

-“তোমার কাছে কোনো পার্সেল এসেছিল? ” রোজকে থামিয়ে বলে উঠল।

-“কেন? ”

-“বাড়তি কথা বলবে না। শুধু উত্তর দেবে। এসেছিল? হ্যাঁ কি না। ”

-“হ্যাঁ। ”

-“কি লেখা ছিল তাতে? ”

-“এক বোকা রাজার হুমকিমূলক চিঠি। ”

-“ওটা তোমায় মুগ্ধতা পাঠিয়েছিলো। ”

-“ওহ প্লিজ! আমি সমকামী না, আ’ম নট এ লেসবিয়ান ভাইয়া। তাই এসব বলবেন না প্লিজ!”

রোজ চোখ বুজে তাচ্ছিল্য করে হেসে অভিনয় করে বলে ওঠে বাক্যটা।ফালাক হতভম্ব চোখে তাকায়। রোজ পরক্ষণেই নিজের চেহারা স্বাভাবিক করে বলে,

-“আপনি দাদাইয়ের ছোট ভাই, এটা সত্যিই অনেক পরে জেনেছি। সেদিন লাইব্রেরিতেই আপনার ব্যবহার দেখে বুঝেছিলাম। তাঁরছেড়া আরশানের তাঁরকা’টা ছোট ভাই ফালাক। পার্ফেক্ট কম্বিনেশন আপনাদের। কিন্তু এই চিরকুটের কাহিনি বুঝলাম না। মুগ্ধতা কেন চিঠি দেবে আমায়? এমন বিশ্রি রসিকতা আমার পছন্দ নয়। ”

-“বেয়াইন হও!আর আমাদের সম্পর্কে রসিকতা থাকবে না এটা হতে পারে? ”

রোজের হাত পেছনের দিকে নিয়ে মুচড়ে ধরে ফালাক। রোজের দৃষ্টি ফালাকের চেহারায় নিবদ্ধ। রাগে সারা শরীর রি রি করে উঠলো রোজের। এটা কেমন ধারা মশকরা? মুগ্ধতা পাঠিয়েছে শাড়ি গহনা, এটা বলে সে সেদিনের কথাটার শোধ নিলো? রোজ বলেছিল সে বিয়েশাদীতে আগ্রহী নয়, ওয়াইফ গার্লফ্রেন্ড ম্যাটেরিয়াল না। সেজন্য? মহা বেয়াদব তো ছেলেটা। রোজ বলল,

-“মিথ্যা বলা কেউ আপনার থেকে শিখুক। ”

-“আমি মিথ্যা বলছি না। ওটা আসলেই মুগ্ধতা পার্সেল করেছিল। রোজা নামটা বউমনির বোনের আর মুগ্ধতা জানে না তুমি বউমনির বোন।তাই ওর হাতেই পার্সেলটা দিয়েছিলাম আমি। আর ও নিজে সেটা তোমার ঠিকানা দেখে পাঠিয়েছে।আর কি বললে?বোকা রাজা? হুমকি? হুমকির তো কিছুই লিখিনি। তোমার সেদিনের ব্যবহারে আমার রাগ যে কতটা বেড়েছে তা তোমায় বলে বোঝানো যাবে না। আমার এই রাগটা যার তার ওপর গিয়ে পড়ছে।ভাইয়ার বিয়েতে অবধি আসছিলাম না। কোনো কাজে মন দিতে পারছিলাম না। রাগটা দ্রুত মিটিয়ে দাও। এমন কিছু করো, যাতে আমার রাগ চলে যায়। ফাস্ট।”

রোজের হাতের কালো চুড়িগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছাদের মেঝেতে পড়ছে। রক্ত বেরিয়ে টপটপ করে পড়ছে। ফালাকের রাগের বহিঃপ্রকাশ রোজের হাতের ওপর দারুনভাবে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। হাতের শিরা কেটে যেতেই র’ক্তক্ষরণ বেড়ে গেল। রোজের চেহারায় ব্যাথায় আভাস পাওয়া গেলো। রোজ চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,

-“আমাকে পাওয়া সহজ হবে না। রোজ যেকোনো রাজা বা রাজত্বের রানি হবে না। তাছাড়া আপনি তো আমায় রানি করতে চাননা। আমি শুধু আপনার প্রয়োজন। তাই না?রাজত্ব বাড়াতে আমায় চান আপনি। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না। আপনি আমার শত্রু আর শত্রুই থাকবেন। এই শত্রুতা বহমান থাকবে ফালাক মাহতাব নীরদ! ”

-“শত্রুতা ঘোচাতেও চাই না আমি। তোমার মতো শত্রু পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। ”

-“সত্যিই সৌভাগ্যবান আপনি। এবার হাতটা ছাড়ুন। ব্যাথা পাচ্ছি আমি।”

-“রোজ ব্যাথাও পায়? ”

-“বিশ্বাসঘা’ত’কদের আ’ঘা’তে। লেট মি গো নাও প্লিজ। বিয়েটা শুরু করা উচিত। আমি না থাকলে ওরা শুরু করবে না। যেতে হবে তাই। ”

-“আগে আমার রাগ মেটাও। তারপর। ”

-“কি চান? ”

-“যেসব তুমি চাও না। আমার সম্পূর্ণ তুমিটাকেই চাই। শরীর ও মন দুটো দিক থেকেই। বাট নাও যেটা দিতে সেদিন অস্বীকার করেছিলে সেটা চাই। তোমার গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা।”

-“বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না। পৃথিবির সবথেকে নিকৃষ্ট মানুষ আমি আপনাকে ভাবি। আপনার যা চাই নিয়ে ছাড়ুন। কারন আপনি আমার ধৈয্য ও সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছেন। বিয়েটাতে কোনোপ্রকার ঝামেলা চাই না বলে চুপ আছি। নাহলে আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার মতো সুযোগ রোজ হাতছাড়া করতো না।”

-“ওহ হো! থ্যাংক্স চাঁদ। ” বাঁকা হেসে।

ফালাক রোজের গলায় মুখ গুজতেই রোজ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।ফালাকের হাতের বাঁধন আলগা হয়। রোজ হাত ঝারা দিয়ে সামনে আনলো। এরপর কোমরে গুজে রাখা ছোট চাকু বের করে ফালাকের পেট বরাবর টান দিল। শেরওয়ানী ছিড়ে ফালাকের পেটের চামড়া কে’টে গেল মুহূর্তেই। ফালাক গলা থেকে মুখ তুলে ফেলে। এরপর হেসে গলায় ঠোঁট গভীরভাবে ছুঁইয়ে ছোট করে চুঁমু খেয়ে মাথা তুললো। রোজ চাকুটা ঘুরিয়ে পেটের ওপর পাশেও সূক্ষ্মভাবে টেনে দেয়। ফালাক এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। রোজ চাকুর উপর থেকে রক্তগুলো হাত দিয়ে মুছে বলে,

-“আমি আপনার মতো প্রতিশোধ পরায়ণ নই তবে ঋণ রাখতে পছন্দ করি না। আমার হাত থেকে রক্ত বের করে শত্রুতা মনে করিয়ে যে উপকারটা করে আমায় ঋণী করলেন তাঁর বদলে এটুকু আপনার প্রাপ্য ছিলো। আর আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখিয়ে যে অন্যায় করেছেন তার শাস্তিও অতিশিঘ্র পাবেন। ”

-“শত্রুতা তুই নিজে তৈরি করেছিলি চাঁদ। আমি না। ”

-“আমাকে তুই বলে সম্বোধন করবেন না। আর আমার নাম সাইরাহ্ সীরাত রোজা। রোজ বললেও হয়। এসব চাঁদ তারা বলা বন্ধ করুন। ”

-“ভুল আমি করিনি, ভুল তোর ছিল। তাই শত্রতা আমিও সমানভাবে নেভাবো। আমাকে না দেখে, না জেনে, না শুনে যেই শত্রুতা এতবছর পুষে রেখেছিলি সেটা প্রকাশ করার সময় এসেছে।তবে মনে রাখিস আমি সেদিনও,”

ফালাকের কথা শেষ করতে না দিয়ে রোজ দ্রুত বলে উঠল,
-“ভাগ্গিস আপনাকে চিনতাম না আমি। আপনার মুখদর্শনও আমার জন্য পাপের সমান। তাই এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিশ্চই করবে রোজ। ”

রোজ চলে যেতেই ফালাক নিজের পেটের দিকে আর মেঝেতে পড়ে থাকা রোজের র’ক্তের দিকে চাইলো।এটা ওর চাঁদ না। চাঁদ হতেই পারে না। যে মেয়েটাকে ফালাক এতবছর ধরে পেতে চাইলো। তাঁর মন পাওয়া যে সহজ হবে না সেটা জানতো ফালাক। তবে এতটা কঠিন হবে তা কল্পনাও করেনি আগে। একটা ভুল কতগুলো মানুষ ও তাদের জীবন নষ্ট করে দিলো। ফালাকের রাগ বেড়ে যাচ্ছে। মনে চাচ্ছে এই মুহূর্তে রোজকে নিয়ে গিয়ে সেই ভুল সংশোধন করতে। কিন্তু এটা করা যাবে না। তাহলে খেলায় ভুল চাল দেওয়া হবে। তাতে তাদের জীবনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। রোজের এত পরিশ্রম, ফালাকের এত ধৈর্য সবকিছুর ফল তিক্ত হতে দেবে না ফালাক।

🍁🍁🍁

রোজের জীবনের প্রথম দশটি বছর ঢাকাতেই কেটেছিল। ওর বয়স যখন দশ তখন ওরা সিলেটে চলে যায়।তাই আরশান রোজকে চিনতো।বাবার কাজের সূত্রে আনসারী সাহেবের কাছে আসার সময় সে প্রায়ই অয়ন্তি ও রোজকে দেখতো।তবে তাঁর ছোটভাই ফালাক কখনও রোজদের দেখেনি। সে ছিলো কানাডায় নিজের মামাদের বাড়িতে।

আজ থেকে আট বছর আগে রোজের বয়স যখন সবে পনেরো আর ফালাকের তেইশ! ফালাক ও রোজের রাজারানি হওয়ার গল্পটা তখন থেকেই শুরু হয়েছিলো।বলতে গেলে অতিতের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে,তখন ফালাক ছিল তেইশ বছরের যুবক যখন রোজের সম্পর্কে সে প্রথম জেনেছিল। আর আজ রোজ তেইশ বছরের যুবতী যখন সে ফালাককে চিনেছে, জেনেছে।

রোজ, আনসারী সাহেব এবং রেণুর সঙ্গে যখন সিলেটে ছিলো তখন ফারদিন সাহেবরা সেখানে তাদের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলেন। ফালাক আরশানও গিয়েছিলো। কিন্তু সেদিন রোজ বাড়িতে ছিল না। রোজ গিয়েছিলো স্কুলের পিকনিকে। ফালাক বাড়িটা ঘুরে দেখার সময় সোফার ওপর রোজের স্কার্ফ পায়। প্রথমে তোয়ালে ভেবে সে ভুল করে স্কার্ফ দিয়েই মুখ মুছে ফেলে। মুখ মোছার সময় একটা অপরিচিত ভিন্ন মিষ্টি সুভাস পায় ফালাক। পরে জানতে পারে আনসারী সাহেব তাঁর একমাত্র প্রিয় কন্যার জন্মদিন উপলক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁর বন্ধুকে দিয়ে অতীব সুন্দর এবং ব্যায়বহুল পার্ফিউম আনিয়েছেন। ঘ্রাণটা সেটারই। আর রোজ নাকি এই পার্ফিউম ছাড়া অন্য পার্ফিউম ব্যবহার করে না। ফালাক পার্ফিউমটা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলো। স্কার্ফের ঘ্রাণটায় পার্ফিউমের থেকেও বেশি মাদকতা ছিল। বাড়িতে কিংবা আনসারী সাহবদের ফোনেও রোজের কোনো ছবি ছিল না। আনসারী সাহেব কখনও রোজকে সামনে আনেননি নিজের পেশার জন্য। সর্বদা রেণুই বাবার ভূমিকা পালন করেছে, আনসারী সাহেব শুধু দূর থেকে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। তাই ফালাক রোজকে তখনও দেখতে পায়নি। তবে আরশানের কাছ থেকে জেনেছিলো রোজ দেখতে শুনতে ভালো।ফালাক স্কার্ফটা নিজের সঙ্গে করেই ঢাকাতে নিয়ে আসে। প্রায়ই কল দিয়ে আনসারী সাহেবদের খোঁজখবর নিতে শুরু করে। উদ্দেশ্য একটাই পরিচিত পরিবারটির অপরিচিত মেয়েটার কন্ঠ শোনা, তাঁর চেহারা দেখা। এভাবেই একদিন ফোন করতে করতে ফালাক অপেক্ষা করছিল। “যদি আজ রোজ ফোনটা ধরে”। এই কামনা বারবার করছিল। অপেক্ষার ফলও মিষ্টি হলো। রোজ বাড়ি ফিরে দেখলো মায়ের ফোনটা বেজে চলছে অনবরত। রেণু বাথরুমে গোসল করছে দেখে রোজ ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলো। ফালাকের হৃদপিন্ড কেঁপে ওঠে, কন্ঠস্বরও টলে যায়। রোজ প্রশ্ন করে,

-“হ্যালো কে? মামনি নেই, পরে ফোন করুন। ”

-“আমি ফারদিন মাহতাবের ছেলে ফা..”

-“ফারদিন মাহতাব! সেটা আবার কে? আমি চিনতে পারছি না দুঃখিত।”

-“তোমার বাবার বন্ধু। তুমি কি রোজ? ”

-“হুম। ”

-“কেমন আছো? ”

-“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন? ”

-“আলহামদুলিল্লাহ। ”

-“মামনি বের হয়েছে। দাড়ান ফোন দিচ্ছি। ”

-“না, আমার কথা শোনো। হ্যালো, হ্যালো রোজ।”

রোজ শুনলো না। ফোনটা রেণুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। বেচারা ফালাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনের দিকে তাকায়। ফালাকের হাতে রোজের স্কার্ফটা। স্কার্ফটা নাকের কাছে নিয়ে লম্বা শ্বাস নিল ফালাক। সেদিনের পর থেকেই ফালাক রোজদের বাড়িতে ফোন করা পুরো দমে চালু করে। মাঝে মাঝে তুমি থেকে তুই সম্বোধনেও চলে আসতো স্বল্প পরিসরের বন্ধুকথন। তবে ফালাক ওকে নিজের নাম নীরদ বলে। কারন মায়ের পরে যাকে সে এতটা ভালোবাসে তাঁর মুখ থেকে মায়ের দেওয়া ডাকনামটাই বেশি ভালো লাগবে। ফালাকের পাগলামি বাড়ে।সে হুটহাট সিলেটে গিয়েও উপস্থিত হত। কিন্তু ও যখন যখন যেত রোজ তখন তখন কোনো না কোনো কাজে বাইরে থাকতো। ফালাক তাঁর নিষ্ঠুর ভাগ্যকে নির্মমভাবে দোষারোপ করে। তাই বোধ হয় ভাগ্যটাও নিজের নির্মমতা প্রকাশ করলো। প্রেমের গল্পটা শুরু হবার আগেই শেষ করে দিলো। মাস তিনেকের মধ্যেই ওদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলো আনসারী সাহেবের সিম বদলানোর কারনে।

কলেজের প্রথমদিন রোজের ওরনা ছেলেগুলোর হাত থেকে ছাড়িয়ে ফেলার পর যখন বাতাসের গতিবেগের কারনে ওরনাটি উড়ে ফালাকের মুখের ওপর এসে পড়েছিলো। ফালাকের ঘ্রাণেন্দ্রিয় তখনই পরিচিত ঘ্রাণটির কথা জানান দিয়েছিল। ফালাক নিশ্চিত হতেই ওরনা ধরে ঘ্রাণ নিতে গিয়েছিল কিন্তু রোজের হাতে থা’প্পড় খেয়ে অবস্থা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। এরপর খোঁজ নিয়ে যখন রোজের পুরো নাম ঠিকানা ও পরিচয় জানে তখন বোঝে এটা সেই মেয়েটা যাকে সে নিজের পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ ভাবে। ওর চাঁদ ভাবে। পৃথিবির যেমন দ্বিতীয় কোনো উপগ্রহ নেই, আসবে না। ওর জীবনেও দ্বিতীয় কোনো নারী নেই আর আসবেও না। তবে ফালাক এটাও জানতে পারে রোজ সাধারণ কাউকে জীবনসঙ্গী বানাবে না, নিজের মতই কোনো এক কঠিন স্বভাব চরিত্রের মানুষকে নির্বাচন করবে। কারন ওর চাঁদ আলাদা,সব মেয়েদের থেকে, সবার থেকে। ফালাক পলিটিক্স করে, প্রচন্ড রাগি, সাইকিক বিষয়গুলো প্লাস পয়েন্ট হলেও রোজের ব্যাপারগুলোতে সে ভীষণ নরম। রোজের কথা আসলে সে কঠিন হতে পারে না।এই অতি খারাপ দূর্বলতা নিয়েও সে চেষ্টা করেছে রোজের মতো করে রোজকে জেতার। কিন্তু মেয়েটার জেদ অনেক। আর সবথেকে বড় বাঁধা অতিতের কিছু ভুল। সেগুলো সংশোধন করতে সময় লাগবে, মেয়েটা তো ভুল বুঝে আরও দূরে চলে যাচ্ছে। শত্রুতা করে বেড়াচ্ছে। ফালাক কি পারবে ওর মন থেকে বিষাদময় ঘটনাগুলো মুছতে? নতুন করে ওকে পুরোনো রোজ করে তুলতে। যে মেয়েটা ভালোবাসতে ভালোবাসতো তাকে ফিরিয়ে আনতে।

চলবে?