Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1056



তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৭

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৭

লাইব্রেরিতে বসে একধ্যানে বইয়ের দিকে চেয়ে আছে রাই। স্যারের লেকচারের মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। কঠিন ইংরেজিতে কিসব লিখে গেছে! রাইয়ের মন চাচ্ছে স্যারের টাক মাথায় ঢিল মেরে আলু গজানোর সুযোগ করে দিতে। ঠিক সে সময় রাইয়ের ফোনের রিং বেজে ওঠে। রোজ ফোন করেছে। রাই ফোনটা রিসিভ করে নিজের অবস্থান জানিয়ে ফোনটা রেখে দেবে ঠিক তখনই ওর চোখ পড়লো এক পরিচিত নোটিফিকেশনে। যেটার আশা করা সে ছেড়ে দিয়েছিল। রাই ম্যাসেজটা সীন করে। অনন্যসুলভ এক ফন্টে লেখা তাঁর বাক্যগুলো,

“আমি বাংলাদেশে এসেছি জিয়নকাঠি। তোমাকে আমি ঠিক খুজে বের করবো। নতুন একটা গান বের হয়েছে শুনেছো? আরমান মালিকের। গানটা আমি বাংলায় অনুবাদ করে গাইবো, শুধু তোমার জন্য। তুমি শুনবে তো? দেড় বছর হয়ে গেল তোমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আইডিতে এসেও আমার সঙ্গে কথা বলো না। তাই ভেবেছিলাম একেবারে দেশে ফিরে, তোমাকে খুজে বের করে,আমার সামনে তোমাকে দাঁড় করিয়ে কথা বলবো। আজ সকালেই এসেছি, অল্পকিছুদিনেই তোমাকে খুজে পেয়ে যাবো।সামনে এলে তোমার উত্তরটা জানাবে তো? আর লিরিকটা দেখ, খানিকটা এমন। তবে সংযোজন বিয়োজন করে পরে শব্দগুলো বদলাবো। এবার নিশ্চই বলবে না এটা ভালোবাসা নয়, এটাই ভালোবাসা। তুমি বুঝবে সেটা মনিমালা।

এসে ছিলে এভাবে তুমি
যেন নতুন এক স্বপ্ন হয়ে
শুধু স্মৃতি রয়ে গেল দেখো
যেটা আগে আমাদের ছিল না যে

হুহু,, প্রশ্ন করি নিজেকে
কেন দূরে আছি
তোমার থেকে
যেতে যেতে শুনে যাও সেটা…

অঁধরে তোমার নাম
হৃদয়ে তোমার স্মৃতি
তুমি আমার হলে না তাতে কি?
তবুও আমার জান তুমি…. 💙💙 [অনুবাদ হয়না জানি তবুও গানের সুরটা মিলিয়ে অনুবাদ করলাম। গানটি বাস্তবেই রোজের বড্ড প্রিয়। ]

রাইয়ের হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়ে গেল।সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভীর এসেছে দেশে? সত্যিই এসেছে? ভীর যদি রাইয়ের খোঁজ পেয়ে যায়? কি করবে রাই? রোজ এসে চেয়ার টেনে রাইয়ের পাশে বসলো। রাইয়ের দিকে ওর মনোযোগ নেই। খাতা টেনে সে নোটস করতে শুরু করে দিয়েছে। রাইয়ের সাড়া-শব্দ না পেয়ে রোজ পাশ ফিরে তাকায়। রাইয়ের চোখে পানি, মেঝেতে ফোন পড়ে আছে। স্ক্রীন ফেটে কাঁচও ছড়িয়েছে আশেপাশে। রোজ সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রাইকে প্রশ্ন করে,

-“কি হয়েছে? কাঁপছিস কেন? আর ইয়্যু ওকে রাই? ”

রাই উত্তর দিতে পারলো না। রোজ নিচ থেকে ফোনটা তুলে ফোনের উপরের গ্লাসটা খুলে ফেলে দিল। এরপর ফোন অন করল। ভীরের ম্যাসেজটা দেখে রোজের কপালে ভাঁজ পড়ে। রাইয়ের ভেতরের ঝড়টাও উপলব্ধি করে। রোজ ফোন রেখে বলল,

-“ভালো তো! আসতে দে। চিনে নিক সে নিজের প্রিয় জিয়নকাঠিকে। আমিও কেমিস্ট্রিটা দেখতে চাই। এমন প্রেমিক সচারচর পাওয়া যায়না বুঝলি! দেশ পাড়ি দিয়ে প্রেমিকার টানে আসছে। গুড, ভেরি গুড। ”

-“তুই স্বাভাবিক কি করে আছিস রোজ, বুঝতে পারছিস কি হতে চলেছে?ভীর দেশে চলে এসেছে। যে ছেলে এত দূর আসতে পারে সে কতটা ডেসপারেট মনিমালার জন্য, টের পাচ্ছিস? হী লাভস হিজ জিয়নকাঠি।”

-“তো আমার কি করা উচিত? সে এসেছে এটা ঢাকঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবো? নাকি তোর মত হাত পা ছড়িয়ে ম’রাকান্না জুড়ে দেবো? টেক ইট ইজি রাই। বি নরমাল, ঢাকা শহরে হাজার হাজার মেয়ে। তাদের মাঝ থেকে সে এত সহজে খুজে পাবে না মনিমালাকে। কারন মনিমালা না চাইলে তাকে পাওয়া অসম্ভব। তবে জিয়নকাঠির কথা আলাদা! ”

-“ও ঠিক আসবে। ”

-“আসলে কি হয়, দেখা যাবে। এবার কান্না থামা আর পড়ায় মনোযোগ দে। ”

রাই বইখাতা তড়িঘড়ি করে গুছিয়ে বেরিয়ে গেল।রোজ হাতে থাকা রাইয়ের ফোনটার দিকে চেয়ে রাইকে ডাকে, রাই শুনলো না সে ডাক। অদ্ভুত! ফোনটা তো নিয়ে যাবে। রোজ ফোনটা অন করে কনভারশেসন পুনরায় পড়লো। হিন্দি গানটা তাঁরও বেশ প্রিয়। ভীর বাংলায় ট্রান্সলেট করেছে। বাংলায় কেমন লাগবে প্রিয় গানটি?রোজ নিজেই গুনগুনিয়ে ওঠে, লিরিকগুলো পড়ে। তখনই ফালাক এসে রোজের পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। রোজ একনজর ফালাকের দিকে চেয়ে খাতার দিকে তাকালো। ফালাক উপেক্ষাটি মেনে নিতে পারলো না। সে স্বল্প আওয়াজে বলে,

-“কি সমস্যা তোমার? ”

-“শাড়ি পেয়েছেন? মুগ্ধতার চেয়ারের নিচেই ছিল। ”

-“ওটা সেই শাড়ি নয়,সেটা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। আমি আমার শাড়িটা চাই। ”

-“দুঃখিত! রোজ নিজের ব্যবহৃত জিনিস কাউকে দেয় না। বিশেষ করে আপনাকে তো দেওয়াই যাবে না। ”

-“কেন? ”

-“কারন জানতে চান? ” সকৌতুকে বলল।

-“হ্যাঁ।” স্পষ্ট উত্তর।

-“আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে ভাইয়া। তবুও আমার পেছনে কেন পড়ে আছেন? আমি আপনার টাইপের নই। ইউজ করে ফেলা দেওয়া বস্তুসম নই। আপনি বরং নতুন কোনো মেয়ের সামনে গিয়ে নিজের এই আলগা পিরিত দেখান। ”

-“কারন বলো। ” গঠিন গলায় প্রশ্ন করে।

-“ওকে ফাইন। আপনি আমার শরীরের ঘ্রাণ পছন্দ করেন। সেজন্য ওই শাড়িটা চাচ্ছেন। যেটা দিতে, আমি চাচ্ছি না। কলেজের প্রথম দিন আপনি আমার ওরনা থেকেও ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন। কাজগুলো অদ্ভুত নয়? ”

-“বুঝেছ তাহলে। ”

-“আমাকে বোকা মনে করলে সেটা আপনার ভুল। তবে এই ধরনের নোংরামি আমার সঙ্গে করতে আসবেন না।”

-“নোংরামি? ” রেগে চিল্লিয়ে।

-“আস্তে কথা বলুন। এটা লাইব্রেরি। আর হ্যাঁ নোংরামি। এসব নোংরা কাজ।আপনি নোংরা মানুষ। যে গার্লফ্রেন্ড থাকতেও অন্য মেয়ের কাছে আসার চেষ্টা করে তাকে ভালো মানুষ মনে করিনা আমি।কজ, আমি বৈধ সম্পর্ক পছন্দ করি।”

-“ওকে ফাইন। চলো বিয়ে করবো। ”

রোজ খাতায় মনোযোগ দিয়ে ফিচেল হাসে। ফালাক রেগে বলল, “কি হলো ওঠো। ”

-“আপনি আমার যোগ্য নন। ”

-“কি বললে? ”

-“বললাম আপনি আমার যোগ্য নন। তাছাড়া আমি এই বিয়েশাদীতে আগ্রহী নই। অল সো আমি ওয়াইফ অর গার্লফ্রেন্ড ম্যাটেরিয়ালও না। আপনি যদি ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ করার কথা বলেন, তাহলে বললো আমি সেসবেও আগ্রহী নই। আশা করি বুঝেছেন। ”

অপমানে থমথমে হয়ে গেল ফালাকের মুখ। অতি কষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
-“কাজটা ঠিক করলে না। আমি তোমাকে সম্মান দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তুমি আমাকে অপমান করলে! ”

-“আপনার কাছে কি আমি সম্মান চেয়েছি? যেচে পড়ে সম্মান দিতে এসেছেন কেন? আত্মসম্মান নেই নাকি? এত গায়ে পড়া কেন আপনি? যান এখান থেকে। ”

ফালাক রেগেমেগে উঠে গেল। চেহারা লাল হয়ে আছে রাগে।চোখজোড়া যেন অগ্নিকুণ্ড। রোজ ফিরেও তাকাল না ফালাকের যাওয়ার পথে। খাতায় মনোযোগ দিয়ে সে লিখতে ব্যস্ত। ফালাক লাইব্রেরির বাইরে পা রাখতেই রোজ নিজের ডায়েরি খুলে নীলরঙা জেলপেন দিয়ে গোটা অক্ষরে লেখে।

“এই রাজত্বের উপযুক্ত রাজা সে। তবে অতিধূর্ততার পাশাপাশি কিছুটা বোকাও।”

🍁🍁🍁

অয়ন্তির বিয়ের দিন! রোজ কালো ল্যাহেঙ্গা পড়েছে। সারা বাড়ি জুড়ে মেহমান, ডেকোরেটর, পার্লারের লোকজন। রোজের হাতে ফুলের ঝুড়ি। সে ফুলগুলো নিয়ে সিড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। এমন সময় সে প্রকান্ড এক শক্ত পিলারে ধাক্কা খেয়ে ল্যাহেঙ্গায় বেঁধে পড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই পিলারটা তাঁর একহাতে রোজের কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফেললো। রোজ চোখ-মুখ খিচে ঝুড়িটা শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তবুও ঝাঁকুনিতে কিছুটা ফুল উপরের দিকে ছড়িয়ে ওদের মুখের ওপর এসে পড়লো। রোজ দ্রুতই চেহারা স্বাভাবিক করে সামনে তাকায়। দুটি যুগল নেত্র একত্রিত হতেই রোজ স্তব্ধ হয়ে যায়। ছেলেটির ঠোঁটের কোনায় মিষ্টি লাজুক হাসি। শ্যামবর্ণের ছেলেটার চেহারার সবথেকে আকর্ষনীয় সৌন্দর্য রোজ মুহূর্তেই আবিষ্কার করে ফেলে। ছেলেটা হেসে রোজের গলার দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।রোজ বিরক্তচোখে গলার দিকটা দেখার চেষ্টা করতেই ছেলেটা ফু দিয়ে গলার ওপর লেগে থাকা পাপড়িটা ফেলে দিল। রোজ আবারও বিরক্তবোধ করে বলে ওঠে,

-“এটা কোনো রোম্যান্টিক সিনেমা না। যে এভাবে চেপে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করবেন মিস্টার…? ”

-“শাহজাহান, মাই ডিয়ার মমতাজ। ”

-“তাজমহল বানিয়ে তারপর শাহজাহান হতে আসবেন ইডিয়েট পিলার। সরুন.. ”

রোজ ছেলেটার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগলে ছেলেটা হেসে বলে,

-“বন্ধুর শালিকা এত রুড? বাই দ্যা ওয়ে, আমার নামই শাহজাহান। শাহ্ভীর শাহজাহান। তুমি আমাকে ভীর ডাকতে পারো। ওটা আমার নিক নেম। ”

রোজ ফিচেল হেসে ভীরের কাছে আসলো। এরপর ভীরের দিকে ঝুঁকে হুইস্কি গলায় বলে,

-“আমার সঙ্গে ফ্লাটিং করার উপযুক্ত স্কিল আপনার নেই গায়কসাহেব। কারন আপনি ফ্লাটিংয়ে যে স্কুলের ছাত্র আমি সেখানকার হেডমিস্ট্রেস! আমি যদি এক বার ফ্লাটিং শুরু করি, দিন-দুনিয়া ভুলে যাবেন। সো স্টে এ্যা ওয়ে ফ্রম মি। আমার থেকে দূরে থাকুন। বাড়িতে আমার, হীরামনের অনেক বান্ধবি আছে। ওদের সঙ্গে লাইন মা’রার ট্রাই করুন। কাজে দেবে। ”

-“কিন্তু আমার মন তো তোমাকে পছন্দ করে। তাহলে ওদেরকে কেন পটানোর চেষ্টা করবো? মানুষের উচিত মনের কথা শোনা। আমি তো শুনেছি, এবার তোমার পালা। ”

-“শুনলাম প্রেমিকার টানে এদেশে এসেছেন। তো তাকে বাদ দিয়ে হঠাৎ আমাকে প্রেমের আবেগী লাইন বলছেন কেন? কয়টা লাগে? ”

-“শীট! শীট! শীট! জেনে ফেলেছ? এখানটা জ্বলে উঠল ভীষণভাবে। বুঝলে?” বুকের বাম’পাশে হাত ঠেকিয়ে ইশারা করে বলল।

-“কানে ভেসে আসলো শব্দ গুলো তাই শুনে ফেলেছি। জানলাম তো এই মাত্র, আর আপনার কথাতেই নিশ্চিত হলাম। ”

-“সবাই তোমার ব্যাপারে যা বলল, আর যা জানলাম তা যথার্থই ছিল।” বাঁকা হেসে।

-“আমার ব্যাপারে অতিরিক্ত জানার চেষ্টা করবেন না। কারন জানতে জানতে কি জেনে ফেলবেন, তাতে নিজে এবং নিজের অনুভূতি দুটোই বিপদে পড়ে যাবেন।”চলে যেতে যেতে বলল রোজ।

-“মানে? ”

-“রোজ কাউকে মানে বোঝাতে অভ্যস্ত নয়। নিজে খুজে বের করুন মানের… মানে…”

রোজ ঝুড়ি নিয়ে চলে যেতেই ভীর বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। সে হলুদ দিতে এসেছিল। আরশানের শালিকা আছে শুনে রোজকে দেখতে এসেছি ভীর। কিন্তু এমন শালি? ওর জন্য ভীরের বিয়েবাড়ির পুরো আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল।

চলবে?

[রিচেইক করিনি, ব্যস্ততা নিয়েই লিখেছি তাই ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৬

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৬

মুগ্ধতার সামনে বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে রোজ। ক্রোধান্বিত দৃষ্টি তাঁর, হাতে ধাঁরালো ছু’রি। মুগ্ধতার মুখ টেপ দিয়ে আটকে রাখা। রোজ বেশ কিছুসময় মুগ্ধতার দিকে চেয়ে থেকে বলে,

-“নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছো কি করে তুমি? ”

মুগ্ধতার তরফ থেকে জবাব আসে না। রোজ শব্দ করে হাসে। মুগ্ধতার বা’হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল সামান্য একটু কা’টার সঙ্গে সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গেছে মেয়েটা।একটুতে যার এই অবস্থা সে এত গরম দেখায় কিভাবে? রোজের চোখে-মুখে ফুটে উঠলো বিরক্তি। মেজাজ তিক্ততায় ঘেরা। মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছে না সে। এমন সময় ফালাকের সহসা আগমনে রোজ সরুচোখে তাকায়। ফালাক রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে। রোজ সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলে,

-“আপনার এই ননীর পুতুলকে নিয়ে যান।দূর্বলকে রোজ আ’ঘাত করে না।একে একটু সবল হতে সাহায্য করবেন প্লিজ। রাগটা ততদিন চেপে রাখবো নিজের মাঝে। ”

ফালাক উত্তর না দিয়ে মুগ্ধতার বাঁধন খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কড়া সিকিউরিটির মধ্যে মুগ্ধতাকে অপহরণ করে রোজ বুঝিয়ে দিয়েছে ফালাকের রাগের থেকে ওর জেদ কত ভয়ঙ্কর। ফালাকের ক্রোধ বাড়লেও সে কিছু বলল না। মুগ্ধতার তেমন কোনো ক্ষতি করেনি রোজ তাই নিজের রাগটাকেও নিয়ন্ত্রণ করে ফেললো সে। রোজ যেতে যেতে বলল,

-“যাকে এত ভালোবাসেন, তাকে কষ্ট পেতে দেখে যেমন অনুভব করলেন!আমিও তেমনটাই অনুভব করেছিলাম যখন ঘড়িটা ও পুকুরে ফেলেছিল। এবার বুঝলেন তো ওর ওপর কেন রাগ হচ্ছে আমার। ”

ফালাক এবার উত্তর দিল, কিন্তু সে উত্তর রোজের কান অবধি পৌঁছালো না। রোজ চলে গেল বাড়িতে। বিয়ের কাজ বাকি। যতদ্রুত সম্ভব কাজগুলো সমাপ্ত করতে হবে।

🍁🍁🍁

রোজ বাড়িতে এসে দেখলো ওর জন্য একটা পার্সেল এসেছে।নীলরঙা পার্সেল। নীল কাগজে খুব সুন্দর করে মোড়ানো পার্সেলটা দেখামাত্র রোজের ভালো লেগে যায়। রোজের বাবাও রোজকে এভাবেই প্যাকিং করে গিফট দিত। রোজ পার্সেলটা খুলে দেখলো তাতে নীল রঙা একটা চিরকুট আর শাড়ি গহনা। লাল বেনারসি দেখে রোজ সন্দিগ্ধচোখে তাকায়। ভুল করে অয়ন্তির পার্সেল চলে আসলো নাকি? রোজ চিরকুট খুলে পড়তে শুরু করে।

💙চাঁদ! নামটা তোমার জন্য একদম পার্ফেক্ট। আমার সমকক্ষ কেউ হতে পারবে এটা কখনও ভাবিনি আমি। তোমাকে দেখার পর মনে হলো, রাজত্ব করা শুধু আমি একা নই, আরও একজন মানুষ জানে। আমার পথের কা’টা হওয়ার জন্য ধন্যবাদ। কাটা দিয়ে কাটা তোলা মনে হয় আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।তবে আমি তুমি নামক কা’টাটা তুলতে চাই না। কারণ তুমি নামক কা’টাটা ঠিক আমার বুকে বিদ্ধ হয়েছে।এই যন্ত্রণা আমি পেতে চাইনি, তবুও তুমি দিলে। এর শাস্তি কি তোমার প্রাপ্য নয়? ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা নয়। তোমাকে আমার প্রয়োজন, শুধু সেই কারনেই আমার মন তোমাকে চায়। স্বেচ্ছায় ধরা দেবে না জানি। তাই জোরপূর্বক তোমাকে নিজের করতে হবে।সাবধানে থেকো, আমি মানুষটা তোমার থেকেও বেশি প্রতিশোধ পরায়ণ। আমাকে আ’ঘাত করে তুমি বেঁচে যাবে এই ধারণা করা তোমার কাল হয়ে দাড়াবে। আর চাঁদ নামটা কেন তোমার জন্য পার্ফেক্ট সেটা নাহয় আস্তে আস্তে জানলে। আমার কোনো তাড়া নেই, ধীরেসুস্থে তোমাকে পরাজিত করে আমি তোমায় আমার কন্টকরাজ্যে নিয়ে আসবো। রাজা হিসেবে আমি মন্দ নই, কিন্তু তোমাকে রাজ্যের রানি হিসেবে রাখতে চাইনা। আসলে তোমাকে কেন চাই সেটা নিজেও জানি না। শুধু জানি, আমার যেটা ভালো লাগে,যেটা একবার পেতে চাই, সেটা শুধু আমার হবে। আর কারোর না। কেউ যদি আমার জিনিসে নজর দেয় তাহলে তাঁর চোখ উপড়ে মার্বেল খেললেও শান্তি পাইনা আমি। তাই নিজেকে অন্যকারোর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলবে না আশা করি। কারন তুমি অন্যকাউকে নিজের জীবনে আনার চেষ্টা করলে তাঁর জীবনের সঙ্গে সঙ্গে তোমাকেও শেষ করে ফেলবে এই হিং’স্র রাজা।

শাড়িটা আমার ভালো লাগলো বলে পাঠালাম। ভেবেছি তোমাকে পরাজিত করে যেদিন নিজের কাছে নিয়ে আসবো সেদিন তোমার পরনে এই শাড়িটা থাকবে। এটা অতি মূল্যবান আমার কাছে।এটা যত্ন করে নিজের কাছে রাখবে। ভুলেও আমার দেওয়া কোনো জিনিসের অমর্যাদা করবে না। কারন আমাকে বা আমার জিনিস অসম্মান করার ফল অত্যন্ত ভয়াবহ। 💙

রোজ এবারের জিনিসগুলো ফেললো না। গুছিয়ে রেখে দিল আলামারিতে,কারন জিনিসগুলো প্রেরকের সামনে পোড়ানোর মজাটাই আলাদা। সে ভাবলো কি করে তাঁর পছন্দ ও ইচ্ছানুয়ায়ী রোজের জীবন চলবে?এত বোকা রাজা রাজত্ব করতে শিখেছে কিভাবে? রোজের দুঃখ হলো।রাজত্ব করাটা কি তাকে শেখানো উচিত? অবশ্যই হ্যাঁ।এত সাহস দেখানোর ফলস্বরূপ রোজ তাকে রাজত্ব করা শেখাবে। এটাও বোঝাবে রানি হিসেবে রোজকে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, যে রানিই তাকে কোথাকার কোন রাজা রানি হিসেবে রাখবে কিনা ভাববে! এটা তো রানির জন্য অসম্মানজনক। আর রোজের মতো রানি নিজের সম্মান নষ্ট করা একদমই পছন্দ করে না। কারন এটা তাঁর অহংকার নয় অলংকার!

🍁🍁🍁

রেস্তরাঁয় বসে পুডিং খাচ্ছে সারিম। পাশেই আরশান ও অয়ন্তি। সারিম ওদের সঙ্গে আসতে চায়নি, রোজ বার বার মানা করে দিয়েছিলো দাদাই আর হীরামনের সঙ্গে যাওয়ার জেদ করবে না,ওদের একা ঘুরতে যেতে দেবে, তুমি ফারিয়া আন্টিদের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু আরশান নিজেই জোর করে ওকে আনলো। সারিম আরশানের দিকে তাকিয়ে অয়ন্তির দিকে তাকালো। দুজনেই নিশ্চুপ।কেউ কথা বলছে না কেন? সারিম খেতে খেতে বলে ওঠে,

-“তোমরা কেউ কথা বলছো না কেন? ”

আরশান সারিমের দিকে তাকায়। সারিম উত্তরের জন্য খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আরশান হেসে বলে,

-“আমি তো সবসময় বলি। তোমার হীরামনকে জিজ্ঞেস করো, সে কেন চুপ থাকে। কখনও কথা বলে না আমার সঙ্গে। এটা কি ঠিক? ”

-“একদম না। হীরামন তুমি দাদাইয়ের সঙ্গে কথা বলো না কেন? ”

অয়ন্তি কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,
-“কেউ যদি ভুলভাল উপহার পাঠায় তাঁর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে? কেউ রাগিয়ে দিলে তুমি তাঁর সঙ্গে কথা বলবে সারিম? ”

-“না, কারন রেগে কথা বলতে গেলে অনেক ভুল কথা বলে ফেলা হয়। আপিয়া বলে রাগ হলে শান্ত থাকতে হয়। ”

আরশান নরম কন্ঠে বলে,
-“কেউ যদি না বুঝে ভুল করে। তাহলে তাকে ক্ষমা করা উচিত। ”

সারিম সায় দিল, “হ্যাঁ, এটাও ঠিক। ”

অয়ন্তি কিছু বললো না। কফি পানে মনোযোগ দিলো। কিছুসময় আগে আরশান সবার সামনে ওকে অপ্রস্তুত করে দিয়েছে। মা-বাবার সামনে গতকাল রাতের ঝগড়া বলে দিয়ে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। অয়ন্তি মনে মনে ঠিক করেছে আরশানের সঙ্গে বিয়ের আগের দিন অবধি কথাই বলবে না। এটা ওর শাস্তি। আরশানের সে শাস্তি পছন্দ না। সারিম বোকা চাহুনি নিক্ষেপ করে বলে,

-“আমি বাথরুমে যাবো। ”

আরশান সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়, “ছোট নাকি বড়?”

-“বড়! ”

আরশান উঠে ওকে নিয়ে বাথরুমে গেল। কিন্তু সারিম দুমিনিটেই কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসে। আরশান ভ্রু কুঁচকে বলে,

-“হয়েছে? ”

-“তুমি এখানে কি করছো দাদাই? ”

-“দাড়িয়ে আছি। কেন? ”

-“উফ তুমি কি বোকা, আমি তোমাদের একা রেখে চলে আসলাম। আর তুমি এখানে দাড়িয়ে আছো? ”

-“মানে? ”

-“মানে আপিয়া বলেছে তোমাদের একা গল্প করতে দিতে, একা ঘুরতে যেতে দিতে। ”

আরশান ঠোঁট টিপে হেসে বলে,
-“তাই? তো, তোমার আপিয়া এটা কেন বলেছে? ”

সারিম ঠোঁট উল্টে বলল, “তা তো জানিনা। কিন্তু ভালো কোনো কারনেই বলেছে। আমার আপিয়ার অনেক বুদ্ধি বুঝলে। সে ভালো কথা বলে সবসময়,ভালো কাজ করে।”

-“তা তো বটেই। আমরাই বোকা। ”

-“এবার তুমি যাও, হীরামনের রাগ ভাঙাও। আমি এই রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখি। তুমি ওনাদের বলে দাও, যেটায় সাতরঙা জুস থাকে। ওটা আমাকে বানিয়ে দিতে। নীল রঙের জুসটা বেশি দেবে। আমার ওটা ভালো লাগে। রেইম্বো জুস ওটার নাম। ”

আরশান হেসে জুসের অর্ডার দিয়ে টেবিলে ফিরে যায়। ওয়েটারকে বলে সারিমকে রেস্তরা ঘুরিয়ে দেখাতে। অয়ন্তি গম্ভিরমুখে বসে আছে। আরশান রাগ বাড়িয়ে দিতে বলল,

-“নরমাল হও কুসুম। তোমাকে শাঁকচুন্নির মত লাগছে।”

অয়ন্তি তেতে উঠে বলে, “তা তো লাগবেই। পুরান হয়ে গেছি না? নতুন তাজা ফুল চাই আপনার। শুকিয়ে যাওয়া এই কুসুম দিয়ে আর কাজ চলবে? চলবে না তো। ”

-“সেকি! তুমি শুকিয়ে গেছো নাকি? দেখে তো মনে হয় কয়েক কেজি ওজন বেড়েছে তোমার। ফুটবলের মতো গোল হয়ে যাচ্ছো। ”

-“বাপের বাড়ি খেয়ে নিচ্ছি। আপনার বাড়িতে ভাতের চেয়ে খোঁটা বেশি শোনা লাগবে তাই। ”

-“আমি কখন খোঁটা দেই? তবে হ্যাঁ আমার বাড়িতে গেলে তোমাকে ডায়েট করতে হবে। কারন আমার স্লিম মেয়ে পছন্দ। মিনি সাইজের হাতির বাচ্চা না। ”

-“আবার খোঁটা, আমি হাতির বাচ্চা? তো যান কোনো টিকটিকির বাচ্চা খুজে বিয়ে করেন। ”

-“ওত ছোটখাট বাচ্চামানুষ চাইনা আমার। ”

-“আপনার কি চাই তা জানা আছে আমার। নতুন নতুন ফুলের ঘ্রাণ লাগে আপনার। কলেজে কত ইনা মিনা টিনা ছিল জানি না ভেবেছেন? ”

-“ইনা মিনা কোথ থেকে আসলো? আমার তিনটা এক্স ছিল। তাঁর মধ্যে দুই নাম্বারটা টিনা। প্রথমটার নাম তুবা ছিল আর লাস্টটার নাম নিশা। ”

-“চরিত্রহীন লোক। ”

-“তুমি এমন ভাব করছো যেন তোমার বয়ফ্রেন্ড ছিলো না? ”

-“ছিল না। কারন আমি চেয়েছিলাম আমার বরের সাথে প্রেম করতে। তাও বিয়ের পর, এজন্যই তো এতদিন আপনার সঙ্গে তেমন কথা বলিনি। রোজ ভেবেছে প্রেম করেছি, তবুও অস্বীকার করিনি আমি। আর সামান্য একটা কথায় আপনি আমাকে সবার সামনে খোঁটা দিলেন। ”

-“তো কি করবো? বিয়ে ঠিক হয়েছে। একসপ্তাহ পরেই বিয়ে অথচ তুমি আমার সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে চাও না। এটা ঠিক? ”

-“আপনি যখন যখন ফোন করেন, সারিম রোজ তখন সামনেই থাকে। ওদের সামনে ফোন ধরলে আপনি যা বলেন তাতে আমার লজ্জা লাগে। লজ্জা পেলে সারিম প্রশ্ন করে, রোজ হাসে। তখন আমার লজ্জা আরও বেড়ে যায়। ”

অয়ন্তির অভিমানি কন্ঠস্বরে আরশান হেসে দেয়। বলে, “আহারে! বেচারি লাজুক বউটা আমার ভীষণ লজ্জায় পড়েছে। আমি তো জানতাম না, আচ্ছা বিয়ের পরেই নাহয় লজ্জা দেবো। এখন যাস্ট ভালোমন্দ কথা। ওকে?”

-“ওকে।”

🍁🍁🍁

-“লা’শটা দাফন করে দাও। ”

রোজের কথায় ইফতি চোখ বড় বড় করে তাকালো। রোজ বিরক্তকন্ঠে বলে,

-“এভাবে তাকাবে না। তোমার চোখগুলো ব্যাঙের মতো লাগে। ”

-“কিন্তু ও তো ম’রেনি। ”

রোজ এবার বেশ জোরে পায়ের কাছে ভান ধরে পড়ে থাকা ছেলেটার পেট বরাবর লা’থি দিলো। সে নড়লো না। রোজের ভয়ে ভান ধরেই পড়ে থাকলো। কারন রোজ যদি টের পায় সে সজ্ঞানে আছে তাহলে প্রচন্ড মা’র খাবে। রোজ আরও তিনটে লা’থি দিয়ে বলে,

-“না ম’রলে জিন্দা কবর দিয়ে দাও। এমনিতেও শ্বাস নিচ্ছে না। যাও দাফনটা দ্রুত কর, ইটস মাই অর্ডার।”

ইফতি আরও দুজন স্টাফ ডেকে ছেলেটাকে তুলতে গেলে ছেলেটা উঠে বসে। রোজ চেয়ারে হেলান দিল। চিবুক হাতের উল্টোপাশে ভর দিয়ে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে রোজ। দৃষ্টি স্থির, অথচ মেজাজ চড়াও হয়ে আছে ওর। ছেলেটা প্রায় দিনই অয়ন্তিকে বিরক্ত করে। আরশানের সঙ্গে এই ছেলেটার জন্যই গত কাল রাতে অয়ন্তি ঝগড়া হয়েছে। ছাদে যাওয়ার সময় রোজ শুনেছিলো ওদের কথোপকথন। অয়ন্তির জীবনে কোনো জটিলতা চায় না রোজ,তাই ইফতিকে দিয়ে অয়ন্তির বন্ধুর কাছ থেকে ছেলেটার পরিচয় ও স্বয়ং ছেলেটাকে জোগাড় করে এনেছিলো। আনার পর থেকে ছেলেটা সব অস্বীকার করেছে। ইফতি পেটানোর পর যা একটু স্বীকার করেছিলো রোজকে দেখে পুরোই পাল্টি খেলো। সে রোজকে দেখে ভেবেছিল রোজ অভিযোগ করেছে। তাই সে বাঁচার জন্য বলেছে “আমি অয়ন্তিকে না রোজকে দেখতে যেতাম,রোজকে পছন্দ করি আমি। রোজ অয়ন্তির বোন, ওর সঙ্গে ঘুরতো। আপনারা ভুল ভাবছেন। অয়ন্তির বিয়ে ঠিক, ওকে কেন বিরক্ত করবো আমি? ” ব্যাস। ইফতির হাত থেকে লাঠি নিয়ে রোজ নিজে ওকে থার্ড ডিগ্রি দিতে শুরু করলো, একপর্যায়ে ছেলেটা শ্বাস বন্ধ করে মরার মতো পড়ে রইলো। যেন রোজরা ভয় পেয়ে ছেড়ে দেয়।কিন্তু রোজ তো দাফনের কথা বলছে। ছেলেটা উঠে রোজের পায়ের কাছে বসে পড়ে। রোজ চেয়ার ঘুরিয়ে বলে,

-“এটাকে আমার সামনে থেকে সরাও, ইভটিজিংসহ যা যা কেস মনে আসে, ওর মামলায় ঠুকে জেলে ভরে দাও। ”

-“আর করবো না, অয়ন্তির তৃসীমানাতেও আর যাবো না। প্লিজ ছেড়ে দাও। আমি অয়ন্তি কেন কাউকে বিরক্ত করবো না সবাইকে বোন না, মায়ের নজরে দেখবো। ”

-“আবার বলো! ”

ছেলেটা পুনরায় কথাগুলো বলতেই রোজ ওকে ছেড়ে দিতে বলে। ছেলেটা ছাড়া পেয়ে ছুটে চলে যায়। ইফতি সন্দিহান কন্ঠে বলে,

-“তুমি কি ওকে সত্যিই দাফন করতে বলেছিলে? নাকি ভয় দেখিয়ে কথা আদায় করলে? ”

-“কয়েক ঘা দিয়ে ছেড়ে দিলে ও আবার হীরামনকে বিরক্ত করতো। এবার তা করার কথা চিন্তাও করবে না। কারন ও বুঝে গেছে, আমি ঠান্ডা মাথায় মানুষ মা’রতে জানি। ”

-“তোমাকে দেখলে তেমনটাই মনে হয়। ”

রোজ উঠে ফোনে চোখ নিবদ্ধ করে যেতে যেতে বলল,
-” আমাকে বিশ্লেষণ করা তোমার কাজ নয়। তদন্তে মনোযোগ দাও। ডাফার। ”

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৫

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৫

আজ সকালে আরশান এসেছে অয়ন্তিদের বাড়িতে। বিয়ের কেনাকাটা করার জন্য ফারিয়া নিজের হবু পুত্রবধুকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। সারিম স্কুল থেকে ফিরে আরশানকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে ব্যাগ জুতা খুলেই সোফার ওপর বসে পড়লো। আরশান মৃদু হেসে পাশে রাখা প্যাকেটটা সারিমকে দিলো। সারিম প্যাকেটটা নিয়ে দেখলো তাতে বিভিন্ন ধরনের খেলনা। প্লেন, কার, গান(বন্দুক)। সারিম বন্দুকটা আগে বের করে সেটা আরশানের দিকে তাক করে বলে,

-“জানো দাদাই।ওহ! ভাইয়া, আসলে আমি আর আমার আপিয়া সবসময় বলতাম, আমাদের ভাইয়া থাকলে তাকে দাদাই ডাকবো। তাই ভুল করে বলে ফেললাম। স্যরি। ”

-“তুমি দাদাই ডাকো সারিম। সমস্যা নেই। ”

-“আচ্ছা। জানো দাদাই আমার আপিয়ার কাছে এমন বন্দুক আছে। কিন্তু আসল বন্দুক। নকল না, সে বন্দুক থেকে গুলিও বের হয়। ”

-“তাই? আর কি কি আছে তোমার আপিয়ার? ”

-“আপিয়ার কাছে অনেক বড় বড় বই আছে, ছু’রি, রড, লাঠি,বড় বড় তলোয়ার আছে। রাজাদের যেমন থাকে না? ঠিক তেমন। ”

-“বাপরে! এতকিছু আছে? ”

-“হুম। আমি বড় হলে আপিয়া ওগুলো আমাকে দেবে।”

-“তুমি কি করবে ওগুলো দিয়ে? ”

-“আপিয়া যেখানে চাকুরি করে, আমিও সেখানে গিয়ে চাকুরি করবো। ওখানে বন্দুক, ছু’রি চাকু দিয়ে, ঢিসুম ঢিসুম করে কাজ হয়।”

-“না। তুমি ওই চাকুরি করবে না। ” ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল রোজ।

সারিম অভিমানি দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করতেই রোজ হেসে সবটা সামলানোর জন্য বলল,
-” তুমি ডাক্তার হবে। ছু’রি, কা’টাছেড়ার কাজ ওখানেও হয়। বুঝেছ? ”

-“ঠিক আছে। আমি এগুলো নিয়ে ঘরে যাই? ”

-“যাও। ”

সারিম চলে যেতেই রোজ আরশানের সামনে এসে বসে। আরশানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে সে মলিন হেসে বলে।
-“গুড চয়েজ।”

আরশান থতমত খেয়ে তাকালো। বাচ্চা রোজ অনেক বড় হয়েছে এখন। শেষ যেবার দেখেছিল রোজের বয়স তখন ছয়, কি সাত। চেহারার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগের থেকেও গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয়েছে, গলার স্বর পরিবর্তন হয়েছে, তাকানোর স্টাইল বদলেছে। অল্পতে কেঁদে ফেলা বাচ্চাটার কঠিন রূপ বেশ আশ্চর্যজনক। এই মেয়েটা কি সেই মেয়ে? যে অয়ন্তির সঙ্গে প্রতিদিন ছাদে এক্কাদোক্কা খেলতো, পড়ে গেলে নাক টেনে কেঁদে উঠতো। অয়ন্তির থেকেও যে মেয়েটা বেশি লাজুক ছিল সে এখন অয়ন্তির পরামর্শদাতা। বাড়ির কোনো কাজ তাকে জিজ্ঞেস না করে করা হয় না। কতটা মানসিক পরিপক্বতা তাঁর মাঝে এসেছে। বাবা মায়ের মৃত্যুতেই কি এত পরিবর্তন এনেছে? আরশানের নিরবতা লক্ষ করে রোজ বলে ওঠে,

-“আমাকে বোধ হয় চেনেন নি। আমি সাইরাহ্ সীরাত রোজা। সাফোয়ান আনসারী ও মিফতাহুল মেহরিন রেণুর বড় মেয়ে। অয়ন্তির বোন। ”

-“তোমাকে চিনি আমি। ”

-“কিভাবে? আমি তো আপনাদের চিনি না। ”

-“তোমার মনে নেই হয়তো। তোমাকে ছোটবেলায় ললিপপ কিনে দিতাম আমি। ”

-“আজ আনেননি? ”

-“এখনও খাও নাকি? ”

-“না খেলেও, আনলে গুরুত্ব বোঝা যেত। যাই হোক, হীরামনকে নিয়ে যাবেন শুনলাম,সারিমও বায়না করছে যাবে বলে। ওকে কি নিয়ে যাওয়া যাবে? ও শান্ত বাচ্চা একদম দুষ্টুমি করে না। জ্বালাবেও না। শুধু ঘুরতে যাবে তাই আমিও না করতে পারছি না। আমি তো ওকে নিয়ে যেতে পারি না। হীরামনই নিয়ে যায়। আজ হঠাৎ বায়না করছে কেন বুঝতে পারছি না। ওকে না বলতে কষ্ট হয় আমার। বাবাই মামনির জন্য এমনিতেই কষ্ট পায়, যদি ওর ইচ্ছেপূরণ না করি ছেলেটা আরও কষ্ট পাবে। ”

আরশান চুপচাপ শুনছে।মেয়েটার কন্ঠস্বর দারুন স্পষ্ট। রেডিও জকি হিসেবে তাকে এ্যাপোয়েন্ট করলে মন্দ হয় না।রেডিও সেন্টারে একজন আরজে প্রয়োজন। সপ্তাহে একদিন দেড় ঘন্টার শো করবে, মাসে ত্রিশ হাজার বেতন। অফারটা কি করবে সে? অপমানিত হবে না তো রোজ? অনেক ভেবে আরশান ঠিক করলো এসব চিন্তা বাদ দেবে। হবু শালিকা মাইন্ড করলে বিপদ। তবে রোজ আরশানের চেহারা দেখে সবটা বুঝে ফেললো এবং তা সম্মুখে বলে দিল,

-“রেডিও সেন্টার আমার জন্য না। ”

আরশান হতচকিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করলো। ভয়ে গা কেঁপে উঠলো। রোজের আচমকা বলা কথাটা ওর পুরো ভাবনা নাড়িয়ে দিলো। মনে মনে কি ভাবছে এটা রোজ কিভাবে জানলো? রোজ আবারও হেসে বলে,

-“আমি মেন্টালিস্ট নই। কিন্তু মাঝে মাঝে চেহারার ভাব ভঙ্গি দেখে অনেকটা বুঝে যাই। আপনাদের একটা বড় রেডিও স্টেশন আছে। আপনিই ওটার দেখাশোনা করেন। আপনার ভাবনাচিন্তা সব ওটা ঘিরে। তাই স্বল্প অনুমানের বশে বলেছি কথাটা। ভয় পাবার দরকার নেই। আমি এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিচ্ছি। বসুন, কফি পান করুন। হীরামন চলে আসবে। ”

আরশান রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। সত্যিই ভয়ে ঘেমে গেছে সে। রোজ এসির পাওয়ার বাড়িয়ে চলে গেলো। অয়ন্তি আর সারিম গুছিয়ে নিচে নামে। অয়ন্তিকে দেখে আরশান বাঁকা হাসে। অয়ন্তি লজ্জায় কুকড়ে গেলো। আরশানের দেওয়া শাড়িটাই আজ সে পড়েছে। লালরঙা শাড়িটির সঙ্গে মিলিয়ে চুড়ি পড়েছে। চোখে কাজল, চুল খোঁপা করা। সুলেমান সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা।

🍁🍁🍁

বিছানায় বসে পুরোনো দিনগুলোর কথা ভাবছিল রোজ। গোয়েন্দা দেখলেও যখন ভয় লাগতো, যখন সে জানতো না তাঁর বাবা গোয়েন্দা। পুলিশ দেখামাত্র যখন সে দৌড়ে পালাতো তখন আনসারী সাহেব হাসতেন আর বলতেন, সব পুলিশ খারাপ হয় না। রোজ শুনতো না। বলতো, সব পুলিশ খারাপ, ঘুসখোর, অকারণে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করে। যেদিন আনসারী সাহেব জানতে পারলেন তাকে মা’রার পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেদিন তিনি রোজকে ডেকে নিজের পেশার কথা, সব দায়িত্ব কর্তব্যের কথা জানিয়েছিলেন। রোজ বলেছিল সে তাঁর বাবার মত হতে চায়। এত দ্রুত ইচ্ছেটা বাস্তবে রূপ নেবে তা রোজ কল্পনাও করেনি।

রোজের বয়স এখন তেইশ! তেইশ বছর বয়সে সে সবে মাত্র অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে? না। রোজের ইন্টার এক্সাম হয় যখন ওর বয়স উনিশ। সে সিলেটের এক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। সেই বছরই রোজের বাবাকে হত্যা করার পরিকল্পনা সফল করেন তাঁর শত্রুরা। রোজ তখন দিশেহারা হয়ে যায়। সারিম ছিল ওর একমাত্র কাছের মানুষ।

রোজ বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল এবং সারিমের বায়োলজিক্যাল বাবা ছিলেন একজন খু’নি। মা ছিল না সারিমের। সারিমের বাবা যখন আনসারী সাহেবের হাতে নিহত হয় সারিম তখন দুধের শিশু। সারিমকে দেখে মায়া হয় আনসারী সাহেবের। তাই তিনি সারিমকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। নিজের পরিচয়ে বড় করেন।যেন সে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পায়।

রেণুর খোঁজ পাওয়া যায়নি। সবাই মনে করে আনসারী সাহেবকে মা’রার সময় রেণু চলে আসায় তাকেও হত্যা করা হয়েছে এবং লা’শটা গুম করে দেওয়া হয়েছে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর সারিমের দায়িত্ব এসে পড়ে রোজের ওপর। তিন বছরের বাচ্চাকে নিয়ে সে ঢাকায় চলে আসে। বাবার পেশাকে নিজের করতে তিনবছর লেগে যায়। চারবছরের পরিশ্রম শেষে সে আবারও ডোনেশন দিয়ে নিজের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করতে এসেছে। সেদিক থেকে হিসেব করলে রোজ মুগ্ধতারই বয়সী। কিন্তু রোজের বয়সের এই সূক্ষ্ম বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয় বলে সেটা শুধু প্রিনসিপ্যাল স্যারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করা হয়েছে। নিজের নামের পাশ থেকে আনসারী শব্দটাও বাতিল করা হয়েছে পরিবারের জন্য। তবে সারিমের নাম সারিম আনসারী রিজভী রেখেছিলেন আনসারী সাহেব নিজে। তাই ওর নাম বদলানো হয়নি। ইউনিটের সবথেকে অল্পবয়সী অফিসার রোজ। সবার মতভেদ আছে এই বিষয়টি নিয়ে। অনেকে বলে এত অল্প বয়সে, সবেমাত্র ভার্সিটিতে উঠে কি করে এমন একটা চাকুরি জুটিয়েছে সে? নানারকম তর্কবিতর্কও শুনেছে সে। সমালোচনা শুনেছে অন্যান্য অফিসারের কাছ থেকে। বিষয়টা হচ্ছে বাবার চাকুরি ছেলে পেতে পারতো যদি যোগ্যতা থাকে, সেদিক থেকে রোজ সকল ধরনের বাঁধাবিপত্তি পার করে নিজের যোগ্যতায় বাবার পেশাকে নিজের পেশা করেছে। পাছে লোকে কি বলল তাতে কি এসে যায়?

তবে এখানে শুধু রোজের যোগ্যতা না, আনসারী সাহেবের ক্ষমতাও লেগেছিলো। আনসারী সাহেব আগে থেকেই আইজি সাহেবকে রোজের কথা বলে রেখেছিলেন। তাই আইজি সাহেব নিজে রোজকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, রোজের দেখভাল করেছেন। আর আজ রোজ সফল। বাস্তবে এমন চিত্র বিরল হলেও রোজ সেটা বাস্তবে করতে পেরেছে এটাই তো অনেক।

সংক্ষেপে বলা যায়, রোজ তাঁর বাবার পরিবর্তে এই পেশায় নিয়োজিত। নিজেকে সে কঠিন করেছে, বদল করেছে নিজ প্রচেষ্টায়।

তবে রোজের উদ্দেশ্য ভিন্ন। শুধু বাবা-মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে সে ইউনিটে জয়েন করেনি। প্রতিশোধ তো যখন তখন নেওয়া যায়,কারন হত্যাকারীদের রোজ চেনে। কিন্তু রোজ চায় তাদের খুজে বের করতে যাদের ছাড়া রোজ অসম্পূর্ণ!

🍁🍁🍁

বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখে লম্বা শ্বাস নিলো ছেলেটি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে নিজেদের রিসোর্টে উঠলো। এখানে তাদের বাড়ি আছে তবে তা সিলেটে। ঢাকায় রিসোর্ট আছে শুধু। সে আপাতত ঢাকা ছাড়তে চায়না। সেজন্য বাড়ি ফিরে সময় নষ্ট না করে ঢাকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। ছেলেটা পেশায় কন্ঠশিল্পী। ফেসবুকে একটা মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আলাপ তাঁর। মেয়েটাকে সে দেখেনি, কখনও কন্ঠ শোনেনি। মেয়েটার আইডির নাম ছিল “মনিমালা”। সে নাম দিয়েছিলো ‘জিয়নকাঠি’। কারন মেয়েটা আশার পর ওর জীবন বদলে গিয়েছিল। হতাশার থেকে মুক্তি ও বাঁচবার নতুন উপায় ছিল মেয়েটি। এজন্যই তাঁর নাম সে জিয়নকাঠি রেখেছিল যার অর্থ “বাঁচবার উপায়বিশেষ।” রূপকথায় বর্ণিত প্রাণসঞ্চারের মন্ত্রপূত কাঠিবিশেষ। মেয়েটিও তাঁর কাছে ঠিক রূপকথার মত ছিল। যাকে সে সর্বদা কল্পনা করে গেছে, তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জেনেছে, কিছু তথ্য শুনেছে। তবে বাস্তবে তাকে পায়নি। না দেখে, না শুনে এক অচেনা, অজানা মেয়ের প্রেমে পড়ে যাবে,তা কস্মিনকালেও ভাবেনি ছেলেটি। মেয়েটা কেমন? বয়স কেমন? দেখতে কেমন কিছুই জানে না। এমনকি মেয়েটা তাকে ভালোবাসে কিনা সেটাও জানে না সে। মেয়েটাকে প্রপোজ করার পর মেয়েটি বলেছিল,

-“আমাকে না দেখে, আমার কন্ঠ না শুনে আমাকে খুজে বের করতে পারলেই আমি আপনাকে সুযোগ দেবো। কারন আমি মানুষটা সবার মত ভাবতে পারিনা। সবাইকে ভালোবাসতে পারিনা, ভীর! আমার জীবনটা সবার মত সহজ নয়। কঠিন! ভীষণ কঠিন! ”

ছেলেটার আইডির নাম ছিল ভীর! ছেলেটাও নিজের সম্পর্কে তেমন কিছু বলেনি মেয়েটাকে। টুকটাক ভালো মন্দ কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাদের ইন্টারনেটওয়ালা ফ্রেন্ডশীপ। তবে এই বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেবে? সেটা একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন।

চলবে?

[নাইস, নেক্সট কমেন্ট না করে, এক দু লাইনে অনুভূতি জানিয়ে যাবেন। ]

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৪

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৪

রাইয়ের পাশে ধপ করে বসে পড়লো রোজ। রাই ভয়ে কেঁপে ওঠে, রোজ মৃদু হেসে বলে, “এত ভয় কিসের তোর?” রাই উত্তর দিল না। মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর আসন কেটে বসলো দুজনে। রোজের হাতে মুঠোফোন আর রাই ফোনে কারোর সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত। ঠান্ডা শীতল বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে। রাই মাঝে মাঝে সচেতন দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। তা দেখে রোজ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। মেয়েটার ভয় যে সিনিওর সেই দলটাকে নিয়ে তা স্পষ্ট বুঝলো রোজ। দলটা বেশ পাঁকাপোক্ত। গতকাল খোজ নিয়ে জেনেছে রোজ, ওরা পলিটিক্স করে। ফালাক ওদের লিডার, ফালাকের পর মেহমেদ ও তারপর সিয়াম। মুগ্ধতা ফালাকের ‘ত’ বোন। কিন্তু ওটা শুধু শোনার বিষয়। জানায় বিষয় হচ্ছে ওদের দুজনের মধ্যে রসায়নজনিত কর্মকান্ড চলছে। মুগ্ধতার আচরণে রোজ বুঝেছিল যে মুগ্ধতা ফালাককে ভালোবাসে আর এখন নিশ্চিত হলো। এক সুস্থ স্বাভাবিক জুটির মাঝে এসে রোজ নিজেকে কাবাবের হাড্ডির সঙ্গেও তুলনা করে ফেললো। কিন্তু আদৌ কি সেই ধারনা ঠিক?

রোজরা বসেছে আমগাছের নিচে। পাঁকা আমের মধুর ঘ্রাণ নাকে বারি খাচ্ছে কিয়ৎক্ষণ পর পর। রোজ চোখ বন্ধ করে গাছের সঙ্গে মাথা লাগিয়ে দিলো।রাই নিজেও রোজের দেখাদেখি হেলান দিয়ে বসে।কিন্তু স্থির থাকতে পারে না।লালপিপড়া এসে ওর উরু বরাবর কামড় দিতেই রাই লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। রাইয়ের লাফ দেখে হাসে রোজ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিজেও উঠে বসে। ক্লাসের সময় হয়েছে। রোজ রাই ব্যাগ তুলে ক্লাসের উদ্দেশ্যে যেতে শুরু করার এক পর্যায়ে মুগ্ধতা ও তাঁর সঙ্গীদের সামনে পড়লো ওরা। রোজের পাশে আসতেই মুগ্ধতা বেশ জোরে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলো রোজকে। রোজ নিজেকে সামলাতে পারলেও মুগ্ধতার ব্যাগের চেইনে লেগে রোজের হাতঘড়িটা পড়ে গেলো নিচে। রোজের চোখ লাল হয়ে উঠলো রাগে। রোজ টু শব্দ না করে ঝুঁকে ঘড়িটা নিতে গেলে মুগ্ধতা দ্রুত সেটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে অনুরোধের সুরে বলল,

-“ঘড়িটা দাও আপু। ”

মুগ্ধতা ঘড়িটা নেড়ে চেড়ে দেখে।পুরোনো আমলের এক কালো চেইনের ঘড়ি।এমন ঘড়ি মুগ্ধতার বাড়ির কাজের লোকের বাচ্চারাও ব্যবহার করে না। কিন্তু রোজের এই ঘড়ির ওপর অনেক টান দেখে মুগ্ধতা ফিচেল হাসে। রোজ আবারও কিছুটা শব্দ করে বলে,

-“আপু আমার ঘড়িটা দাও। ”

রোজের উঁচু কন্ঠে মানুষ তাকিয়ে পড়লো ওদের দিকে। কয়েকজন এগিয়েও আসে। মুগ্ধতা ঘড়িটা ছুড়ে দিলো ওর বান্ধবির কাছে। এরপর বলল,

-“ওর কাছ থেকে নাও। ”

রোজ মুগ্ধতার বান্ধবি মিথিলার সামনে গিয়ে ঘড়িটা চাইতেই মিথিলা ঘড়িটা ছুড়ে দিল নিকিতার কাছে। রোজ হতাশ কন্ঠে বলে,

-“এমন কেন করছো? ঘড়িটা দাও প্লিজ। আমাকে ওটা আমার বাবাই দিয়েছিলো। প্লিজ দাও। ”

মুগ্ধতা ব্যঙ্গ করে বলে,
-“এত সস্তা ঘড়ি? তোমার বাবাকে বলবে নতুন একটা ভালো ঘড়ি কিনে দিতে,সে না পারলে আমি টাকা দিচ্ছি নিয়ে যাও।নতুন একটা ঘড়ি কিনে নিও।”

-“ওটা আমার দাদু বাবাইকে দিয়েছিলো আর বাবাই আমাকে উপহার দিয়েছিল, এর মূল্য টাকার পরিমানে হিসেব করা যাবে না আপু। আমার ফোন, চেইন যা ইচ্ছে নাও।কিন্তু ওটা দাও প্লিজ। ওটা ছাড়া আমার চলবে না।”

রোজের আকুতি মিশ্রিত মুগ্ধতার মেজাজ ঠান্ডা করে দিলো। গতকালের রাগটা একটু একটু কমছে। রোজকে টাইট দেওয়ার ভালো উপায় পেয়েছে। সবাই দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছে ঘটনাটির। ওদের ছুড়ে মা’রার খেলাটায় রোজ না চাইতেও ঢুকে গেলো। জড়িয়ে গেলো সে নতুন এক ঝামেলায়। যেটা সে একদমই চায়নি। সে চেয়েছিল ঠান্ডা, স্বাভাবিক একটা কলেজ লাইফ।গতকালের সেই মেজাজ আর সে দেখাতে চায়নি। কিন্তু এরা ছেড়ে দেবে না ওকে। ঘড়িটার জন্য রোজ প্রায় দশমানিট ছুটাছুটি করে। মুগ্ধতা বলে,

-“ছুঁয়াছুঁয়ি খেলা অনেক হয়েছে। এবার নতুন কোনো খেলা দেখতে চাই আমি। মিথি ঘড়িটা দে। ”

মিথিলা ঘড়িটা দিতেই মুগ্ধতা ঘড়িটা পাশের পুকুরের মাঝ বরাবর ফেলে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে পুকুরে ঝাঁপ দিল রোজ। সবাই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাইয়ের হাতে রোজের ব্যাগ। সবাই স্তব্ধ নয়নে চেয়ে আছে পুকুরের দিকে।পাঁচমিনিট হয়ে গেল রোজ উঠছে না। সবাই ভয়ে চিন্তায় স্যারদের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো। মুগ্ধতা ভয় পায় সেটা শুনে। প্রিনসিপ্যালের কানে এই কথাটা উঠলে জঘন্য একটা ব্যাপার রটে যাবে। মুগ্ধতা ফালাককে ফোন করে আর্জেন্ট ডাকলো। ফালাক মাঠে বসেছিল।ফোন পেয়ে সে দুমিনিটের মাথায় ছুটে আসে। মুগ্ধতা নিজের তরফ থেকে বানিয়ে বানিয়ে পুরো ঘটনা চক্র উল্টে পাল্টে বললো। রাই বাঁধা দিতে গেলে মিথিলা ভয় দেখালো। ভয়ে রাইও মুখ খুলতে পারলো না। রোজ উঠলো দশ মিনিট পর।চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। হাতে ঘড়ি, পরনের সাদা জামা শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে। ফালাক পলকহীন তাকিয়ে রইলো রোজের দিকে। এরপর মেহমেদকে কল করার জন্য কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। রোজ পুকুর থেকে উঠলো না। ছেলেরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। কয়েকজন তো ভিডিও করছে। রোজ আবারও ডুব দিলো। সিয়াম মাঝ থেকে রাইকে টেনে নিয়ে রাইয়ের হাতে চাদর আর একটা নীল রঙা শাড়ি ধরিয়ে দেয়। রাই চোখ বড় বড় করে তাকায়। পেটিকোট, ব্লাউজও এনেছে। রাই ব্লাউজের দিকে সরু চোখে তাকায়। রোজের শরীরের মাপের ব্লাউজ। মাপ জানলো কি করে এরা? রাই পুকুরপাড়ে গিয়ে রোজকে ডেকে চাদর ছুড়ে দিলো। রোজ শরীরে চাদর পেঁচিয়ে ওঠার চিন্তা করছে এমন সময় ফালাক ধমকের স্বরে বলে,

-“মেহমেদ!যারা ভিডিও করছে,সবার ফোন কেড়ে রাখ। কারোর ফোন ফেরত দিবি না। কেউ কিছু বললে তাকে আমার কাছে আনবি। আমি শহীদ স্যারের কাছে যাচ্ছি।”

ফালাকের এক কথাতেই পুকুরপাড় ফাঁকা হয়ে গেলো। ফালাক মুগ্ধতাদের নিয়ে চলে যায়। রোজ উঠে ওদের ডিপার্টমেন্টের ওয়াসরুমে গেলো। শাড়িটা পড়ে সে চুলগুলো খুলে রাখলো। ফালাকের উদ্দেশ্য রোজকে সেফ করা ছিল। কিন্তু ফালাক এটা কেন করল? রোজ সেসব ভাবনাকে মাথা থেকে ফেলে ঘড়িটা নিয়ে বসে। ব্যাটারির সমস্যা নাকি পানি ঢুকে খারাপ হয়ে গেল? চলছে না কেন ঘড়িটা? ঠিক সে সময় ফালাকের কন্ঠ শুনতে পায় রোজ। ফালাক বলছে,

-“আমার কাছে দাও, আমি ঠিক করে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো। ”

-“দরকার নেই। আর কাপড়ের জন্য ধন্যবাদ। শাড়ির বদলে পাঞ্জাবি কিনে পাঠিয়ে দেবো। কত টাকা লেগেছে শাড়িতে? ”

-“পাঞ্জাবি লাগবে না। শাড়িটাই ফেরত দিও। ”

-“ওকে। ”

-“মুগ্ধতার কাজের জন্য লজ্জিত আমি। ওকে মাফ করে দিও। ও আর এমন করবে না। ঘড়িটা দাও আমি ঠিক করে দেবো। ”

-“বললাম তো লাগবে না। কেন বিরক্ত করছেন? কি চান?আমি স্যরি বললে হবে? ওকে, বলছি। স্যরি, স্যরি, স্যরি। এবার রেহাই দেন। আমি একা থাকতে চাই। গো প্লিজ। ”

-“ইয়্যু আর ইনসাল্টিং মি নাও।”

-“অপমানবোধ থাকলে চলে যাচ্ছেন না কেন? কেন বিরক্ত করছেন? যান, এখান থেকে। আপনার প্রেমিকা মুগ্ধতাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন তাইনা? ভাবছেন ওকে আমি এর জন্য কঠিন শাস্তি দেবো। তাহলে বলবো যেটা ভাবছেন সেটা একদম সঠিক। এই অন্যায়ের জন্য ওকে আমি কঠিন শাস্তি দিবো। তাই গিয়ে ওকে বাঁচানোর প্রস্তুতি নেন। ”

-“কি করবে তুমি? ”

-“ওর হাত কে’টে ফেলবো। এ্যান্ড আই মিন ইট। যাস্ট কে’টে ফেলবো হাতটা। জিভটা ছিড়ে ফেলবো কারন ওই জিভ,ঠোঁট,কন্ঠ দিয়ে সে আমার বাবাইয়ের প্রিয় জিনিসকে সস্তা বলেছে, টাকার খোঁটা দিয়েছে।”

-“ওর কিছু হলে, তোমাকে আমি আস্ত রাখবো ভেবেছ? ওকে কিছু করার কথা মাথা থেকে বের করে ফেলো। নাহলে ফালাকের রাগের শিকার হবে। ফালাকের রাগ কতটা ভয়ঙ্কর তা তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। ”

-“চ্যালেঞ্জ এক্সেপ্টেড। আর রোজ কখনও বাজিতে হারে না। আপনার রাগের চেয়ে আমার জেদ অধিক ভয়ঙ্কর। এটার প্রমাণ শীগ্রহই পাবেন। গুড বাই। ”

বাড়ি ফেরার পথে একই রকম আরেকটা শাড়ি কিনলো রোজ। ফালাককে ফেরত দেওয়ার জন্য। পরনের শাড়ি সে ফেরত দেবে না। কারন রোজ নিজেকে এবং নিজের ব্যবহৃত জিনিস যাকে তাকে ছুঁতে দেয়না। বাড়ি পৌঁছে রোজ পরনের শাড়িটা খুলে দলামোচা করে আলামারির ভেতর ছুড়ে মা’রে। পাঁচ হাজার টাকার শাড়ি পোড়ানো ঠিক হবে না। কাউকে দিলে সে পড়তে পারবে।

🍁🍁🍁

ফারদিন মাহতাবের বড় ছেলে আরশান মাহতাব তৈমুর ও সুলেমান আহনাফের মেয়ে অয়ন্তি আহনাফ জুঁইয়ের বিবাহের তারিখ ঠিক করা হয়েছে। আজ দুজনের আংটি বদল হলো। সুলেমান সাহেব প্রথমে রোজের না থাকা নিয়ে ফোঁড়ন কাটলেও অবশেষে পাঁকাপাকি কথা বলা শেষ হয়েছে। যাওয়ার পথে আরশান অয়ন্তির জন্য আনা স্পেশাল গিফটটা সারিমের কাছে রেখে যায়। সারিম এখন সেটা নিয়ে লুকিয়েচুরিয়ে যাচ্ছে ওর হীরামনের ঘরের দিকে। পা টিপে টিপে হাটছে সারিম। রোজ শাওয়ার নিয়ে সবেমাত্র বেরিয়েছে। কাপড় নেড়ে দিয়ে সে সারিমকে পড়ার জন্য ডাকতে যাচ্ছিলো। কিন্তু করিডোরে সারিমকে চোরের মত হাটতে দেখে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।অয়ন্তির ঘরে যাচ্ছে সে,হাতে গিফটবক্স। রোজ মৃদু হেসে বলে,

-“ভাই আমার পিয়নের কাজও করতে জানে?”

সারিমের ঘরে এসে টেবিলের ওপর খোলা বইখাতা ঠিক করে গুছিয়ে রাখার সময় রোজ খেয়াল করলো সারিমের খাতার ওপর গোটা অক্ষরে লেখা ””লিখে দাও””। রোজ খানিকক্ষণ খাতা ঘাটাঘাটি করেও কিছু পেলো না। আজকের নতুন টপিক পড়ানোর কথা ছিল। সারিম সেটাও বের করেনি, রোজ লিখতে বলেছিলো কিছু শব্দের অর্থ তাও লেখেনি। সারিম গিফটা দিয়ে ঘরে এসেই বলল,

-“হোমওয়ার্ক পেয়েছো? সবটুকু লেখা হয়েছে আপিয়া? কিছু বাদ যায় নি তো? ”

-“সব তো ফাঁকা নক্ষত্র! তুমি দিন দিন ফাঁকিবাজ হয়ে যাচ্ছো। লেখোনি কেন? ”

-“লিখতেই তো গিয়েছিলাম। বললামও তো লিখে দাও। লিখে দেয়নি? ”

-“তোমার পড়া কে লিখে দেবে? বাহানা করবে না, সব লিখবে এখন”

-“আমি কেন লিখবো? কতক্ষণ হয়ে গেলো, ওকে তো বলেছি লিখে দিতে। লেখেনি কেন? শুধু পড়বে নাকি? পড়া হচ্ছে কিনা লিখে দেখাবে না? ও লিখে না দিলে তুমি খাতা দেখে বুঝবা কি করে ও ঠিক লিখেছে কিনা?”

-“কে লিখে দেবে? কার কথা বলছো?”

-“কেন শয়তান! আজ সকালে আমার বন্ধু তামিমের মা এসেছিলো,আমাকে নিয়ে যেতে। তামিমের জন্মদিন ছিল বলে দুপুরে দাওয়াত ছিল না? হীরামন আর আমি গিয়েছিলাম। তারপর ওখানে গিয়ে তামিমের ঘরে বসি। তামিমের বই খোলা ছিল বলে আন্টি চিৎকার করে বলছিল। বই খোলা রাখলে শয়তানে পড়ে। তাই আমি বই খুলে রেখেছিলাম। যাতে ওরাও পড়তে পারে। কিন্তু শুধু পড়বে? ওদের তো লিখতেও ইচ্ছে করবে। তাই আমি খাতায় লিখে গেলাম লিখে দাও। যদি ওরা লজ্জা পায়, আমার খাতায় লিখতে, তাই। ওরা লিখলো না কেন আপিয়া? আমার খাতা কি ওদের পছন্দ হয়নি? তামিমের বই তো আরও ছেড়া, ওর বই পড়লে আমার নতুন বই পড়ে না কেন? ”

রোজ স্তব্ধচোখে তাকালো। সারিম দুঃখি মুখে উত্তরের প্রত্যাশায় চেয়ে আছে। এমন ধরনের কথা সারিম এই প্রথম শুনেছে তাই হয়তো বিশ্বাস করে ফেলেছে। ছোট্ট, অবুঝ এই ভাইটাকে নিয়ে কি করবে রোজ? এত কিউট করে গাল ফুলিয়ে রাখে সারিম যে রোজ শব্দ করে হেসে দেয়। রোজের হাসির ঝংকার শুনে সারিম চোখ তুলে তাকায়। আপিয়ার হাসি ওর বড্ড প্রিয়। প্রায় তিন বছর হলো ওর আপিয়া এভাবে হাসে না। সারিম মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থেকে বলে,

-“তোমার হাসিটা অনেক সুন্দর আপিয়া। একদম বার্বিডলের মত লাগে। তুমি এখন আর হাসো না কেন?”

রোজ হাসি থামিয়ে বলে,
-“পড়া করো, কোনো শয়তান এসে তোমার পড়া করে দিয়ে যাবে না। এসব তামিমকে বকা দিতে বলেছেন আন্টি। এসব মিথ্যা কথা। বুঝেছ?”

-“সবাই মিথ্যা কথা বলে কেন? ”

রোজ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
-“তোমার নাকি পায়ে ব্যাথা লেগেছে? কোথায় লেগেছে দেখি।”

তামিম প্যান্ট উঁচু করে ধরে। গোড়ালিতে ছিলে গেছে অনেকটা। রোজ মলম লাগিয়ে দিয়ে বলে,

-“ছুটাছুটি করবে, তবে সাবধানে। সামনে তোমার স্কুলে এ্যানুয়েল প্রোগ্রাম আছে না? তুমি কিসে কিসে নাম দিতে চাও আমাকে বলে দিও। আমি তোমার মিসকে বলে দেবো।

-“দৌড়, লাফ, ছবি আঁকা, অংক,সাতার,যেমন খুশি তেমন সাজো।”

-“এতো কিছু? আচ্ছা বলে দেবো। তা, যেমন খুশি তেমন সাজোতে কি সাঁজবে তুমি?”

-“দেশপ্রেমিক! মুক্তিযোদ্ধা। প্রথমে রাজকুমার সাজতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমাদের দাদা মুক্তিযোদ্ধা ছিল তাই না? আমি দাদা সাঁজবো। আচ্ছা আপিয়া মুক্তিযোদ্ধা তো তাদের বলে যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছে। আর যারা দেশকে ভালোবাসে তারা দেশপ্রেমিক। তাইনা?”

-“হুম। আজকের টপিক এটা। দেশ। সাধারণ জ্ঞান বইটা বের করো। ”

🍁🍁🍁

-“আমি তোমার কাছে আসছি 💙জিয়নকাঠি💙। তুমি যা চাও তাই হবে। তোমাকে না দেখে, তোমার কন্ঠ না শুনেই তোমাকে খুজে বের করবে তোমার প্রেমে পড়ে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা এই কাঙাল প্রেমিক।”

কথাগুলো বলে ব্যাগে পাসপোর্ট ও ভিসা ঢুকিয়ে নিল ছেলেটি।ঠোঁটে বিস্তর হাসির রেখা।চোখে প্রিয় মানুষটির খুব নিকটে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। মনে, তাকে একবার ছুঁয়ে দেখার স্পৃহা। গন্তব্য বাংলাদেশ ও তাঁর রাজধানীর এক মিষ্টি বাসিন্দার সম্মুখদর্শন। ভারতের সীমানা পেরিয়ে আজ সে রওনা দেবে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে।সে কি খুজে পাবে নিজের “জিয়নকাঠি”কে? মনের আশঙ্কাকে দমন করে মেজাজটা ফুরফুরে করে সে চলল নিজের বাবা-মা’কে তাড়া দিতে।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০৩

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৩

ঘড়ির কাটা রাত এগারোটা বেজে আটাশ মিনিট! বড় চাচ্চুর ডাকে ঘুম ভা’ঙে রোজের। এত রাতে চাচ্চু ডাকছেন কেন? কি হয়েছে? মস্তিষ্কে আতঙ্ক পরিলক্ষিত হতেই রোজ উঠে বসে। পাশ থেকে চশমা নিয়ে পড়ে নিল চোখে। হাই তুলতে তুলতে সে গায়ের ওপর থেকে কম্বল সরায়। এরপর উঠে দরজা খোলে। বড় চাচ্চু বেশ চিন্তিত চোখে চেয়ে আছেন। রোজ কিছু বলবে তার আগেই তিনি কোমল কন্ঠে বললেন,

-“একটু বসার ঘরে আয়। জরুরি কথা আছে। ”

চাচ্চু চলে গেলেন। রোজ বাথরুমে যায়। ব্রাশ করে, মুখে পানি দিয়ে তারপর আসে বসার ঘরে। চাচি, অয়ন্তিও বসে আছে সেখানে। চাচ্চু এলেন মিনিট পাঁচেক পরে। রোজ ততক্ষনে ভাত নিয়ে বসেছে। রাতে খাওয়া হয়নি ওর। চাচ্চু রোজের দিকে একনজর চেয়ে চিন্তিত মুখ করে সোফায় বসলেন।রোজ ভ্রু কুঁচকে ফেলল নিমিষে।ভাত মেখে মুখে তুলতে যাচ্ছিলো,হাতটাও থমকে গেল। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। চাচ্চু সেটা লক্ষ করে বললেন,

-“খা। চিন্তার কিছু নেই। ”

রোজ হাত ধুয়ে উঠে পড়ে।বাড়ির কারোর মলিন চেহারা দেখার পর গলা দিয়ে ভাত নামবে না। রোজের হেলদোল না দেখে চাচি নিজেই ভাত মাখতে শুরু করলেন। রোজ কিছু বলল না। চাচ্চু বলতে শুরু করলেন।

-“তোর বাবার বন্ধু ফারদিন মাহতাবকে চিনিস রোজ? কিংবা তাঁর ছেলেদের? ”

রোজ অপ্রতিভ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বলে,
-“না। তবে নাম শুনেছি, তাও বছর সাত-আট আগে। এটাও শুনেছি তারা এই জেলাতেই থাকে। তবে আমার সঙ্গে তাদের তেমন পরিচয় নেই। তাদের কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে কেন? ”

-“না, এমনি।”

-“কি হয়েছে? এনিথিং রং চাচ্চু? ”

-“না, ওরা অয়ন্তির জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।হয়তো আগামীকাল অয়ন্তিকে দেখতেও আসবেন।”

-“এতে চিন্তিত হবার কি আছে? আসবে, খাবে, দেখবে, চলে যাবে। পছন্দ হলে হ্যাঁ বলবে নাহলে না। ”

রোজের কথা শুনেই ভীষম খেলো অয়ন্তি। রোজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। চাচির চেহারা থমথমে, চাচ্চু চিন্তিত, অয়ন্তি ভীষম খাচ্ছে। যার অর্থ বাড়ির সবাই বিষয়টা আগে থেকেই জানে একমাত্র রোজ বাদে। রোজের কন্ঠ এবার আরও স্পষ্ট শোনালো,

-“হীরামন প্রেম করছে? ”

অয়ন্তি তড়িঘড়ি করে বলে,
-“না, না, বিশ্বাস কর ব্যাপারটা সেরকম না। আমি ইচ্ছে করে করিনি কিছু। ”

অয়ন্তির বিচলতাই সবটা খোলসা করে দিলো। রোজের ভাবমূর্তি তখনও স্বাভাবিক। তবে ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চেহারায় ছড়িয়ে পড়লো গাম্ভীর্যতা। চাচ্চু নিশ্চুপ চেয়ে আছেন, চাচির অবস্থাও তাই। রোজ অবিশ্রান্ত কন্ঠে বলে,

-“আমি প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করি না। সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত ও ব্যাপার। আমার জন্য তুমি কেন এসবের থেকে দূরে থাকবে। ভালোবাসা তো খারাপ নয়। যেহেতু তোমাদের সবার ওদেরকে পছন্দ সুতরাং কথা এগোও। বিয়েটা হীরামন করবে আমি না। তাছাড়া সম্পর্ক তোমাদের সঙ্গে হচ্ছে আমার সঙ্গে না। আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র চারটা মানুষকে ঘিরে তোমরা তিনজন আর সারিম। তাই তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমারও আপত্তি নেই। ওরা আসুক, কলমা পড়িয়ে নিক বা বিয়ের তারিখ ঠিক করে যাক। ”

চাচ্চু হতাশ কন্ঠে বলেন,”বিয়েতে তুই থাকবি তো? ”

রোজ প্রথমে উত্তর দিল না। কিছুসময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর বলল,
-“জরুরি হলে থাকবো। প্রয়োজন ছাড়া থাকতে হবে কেন? তাছাড়া ইউনিটে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে। সেগুলো শেষ করত হবে। নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, সেখানেও পড়ার চাপ আছে। আমি তো গত কয়েকদিন ধরে এটা ভাবছিলাম যে আমি যদি এখানে না থেকে অন্যকোথাও সিফট হই তাহলে ভালো হয়।”

-“মানে? বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি ছেড়ে কোথায় থাকবে? ”

-“উহু, নক্ষত্র এখানেই থাকবে। শুধু আমি চলে যাবো। বাবাই কি বলতো ভুলে গেছ? এই পেশার কথা ভুলে গেছ? যখন তখন…”

-“থাম। আজেবাজে কথা ছাড়া মুখে কিছু আসে না তাই না? কিচ্ছু হবে না তোর। আর বিয়েটাও তোকে ছাড়া হবে না। তাছাড়া তোর হীরামনের বিয়ের কাজগুলো কে করবে? শুনি!”

-“কাজ আমি করে দেবো। কিন্তু বিয়েশাদীর সময় প্লিজ থাকতে বলো না। আমার বিরক্ত লাগে এসব। ”

-“তোর বিয়ের জন্যও অনেক প্রস্তাব আসছে। ”

রোজ খেতে খেতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, “মানা করে দাও সবাইকে। এসব বিয়ে আমার জন্য না। ”

-“সারাজীবন একা থাকবি? ”

-“একা কোথায়? তোমরা তো আছোই। ”

🍁🍁🍁

ভোর হতেই রাই ফোন করল।রোজ আজ কলেজে যাবে কিনা সেটা জানার জন্যই ফোন করেছে সে।রোজ ফোন রিসিভ করে ব্যস্তকন্ঠে বলে,
-“বল”

-“কলেজে আসবি? ”

-“হ্যাঁ। ক্লাস আছে মে’বি। তুই আসবি? ”

-“আমি তো ডেইলি যাই। ক্লাস না থাকলেও ঘুরেফিরে সব দেখেশুনে চলে আসি। কিন্তু গতকাল কি হয়েছিলো রে তোর? আমার মনে হয় তোর ওপর প্রেতাত্মা ভর করেছিল। নাহলে ওসব কান্ড ঘটাতে পারতিস? আর তুই না বললি চুল খুলবি না। তাহলে পরে খুললি কেন? ”

-“প্রথমে খুলবো না ভেবেছিলাম বলেই বেনী খুলে খোপা করেছিলাম। পরে ওরা পানি ঢেলে চুল ভিজিয়ে দিলো। ভেজা চুল বাঁধা থাকলে গন্ধ হয়। তাই খুলেছিলাম।কেন কোনো সমস্যা হয়েছে? ”

-“ভাইয়ার বন্ধুরা তোকে দেখে তো পুরাই ফিদাহ দোস্ত। আমি ছিলাম তোর সাথে তাই সব প্যারা আমার ওপর এসে পড়েছে। জনে জনে এসে তোর কথা জিজ্ঞেস করছে। তোর নাম, বাড়ি ঘর, সিঙ্গেল কিনা? আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছে প্রশ্নের চক্করে। ”

-“উত্তরে কি বলেছিস? ”

-“যা সত্য তাই। তোর নাম, তুই সিঙ্গেল। এসব শোনার পর থেকে কলের পর কল আসছে। ”

-“এবার বলবি, আমি বিবাহিত, দুটো বাচ্চাও আছে। দুই নাম্বার বরের সংসার করছি, ওকে? এখন ফোন রাখ। আমি আসন অনুশীলন করছি। ”

ফোন রাখ বললেও ফোনটা নিজেই কাটলো রোজ। এই প্রেম,ভালোলাগায় রোজের ঘোরতর আপত্তি আছে। সে সহ্যই করতে পারে না এসব। ওর মন হয় সবাই শুধু ওর বাহ্যিক দিকগুলো, বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছে সে। তাই এসবের ওপর থেকে ও আগ্রহবোধ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি। সৌন্দর্যে সে সর্বদা আকর্ষণবোধ করবে এটা স্বাভাবিক। তবে এর নাম চট করেই ভালোবাসা দেওয়া ঠিক না। কারন এর ফলাফল কতটা যন্ত্রণাদায়ক রোজ তা ভালো করেই জানে।

রোজ আসন ছেড়ে উঠে দাড়ালো। ঘর্মাক্ত শরীরে স্লিভ লেস গেঞ্জিটা লেপ্টে আছে। পাশ থেকে পানির বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি গিলে সে তোয়ালে ঝোলালো গলায়। চিন্তামুক্ত হতে কিছু আসন অনুশীলন করছিল সে। কিন্তু কাজ হলো না, চিন্তার পরিবর্তে রাগ এসে হানা দিল মস্তিষ্কে।

সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে গেল রোজ। নয়টায় ফারদিন সাহেবরা আসবেন। প্রথম আলাপে রোজের না থাকলেও চলবে তাই রোজ সোজা ইউনিটে চলে আসে।নতুন একটা কেস ফাইল হয়েছে। বেশ কিছু দিন যাবৎ পুরুষদের খন্ডবিখন্ড কিছু লা’শ পাওয়া যাচ্ছে, কেসটা তদন্তের ভার এসে পড়েছে রোজের ওপর। রোজ ফাইল খুলে, লা’শের ছবি, বর্ণনা পড়ে বন্ধ করে ফেলল ফাইলটা। সামনেই ইফতি বমি করছে। ভয়ঙ্কর ছবিগুলো দেখে সহ্য করতে পারেনি। রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এমন কেন ছেলেটা? ভয় পেলে এমন পেশায় এসেছে কেন? ভীতুর ডিম একটা। রোজ পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,

-“বাড়িতে চুড়ি পড়ে বসে থাকবে।গোবরগণেশ! ছেলে।”

-“নিজেই দেখুন ম্যাম, এভাবে কেউ খু’ন করে? লা’শটা দেখেই তো বমি আসছে। কিভাবে কে’টেছে। কোনো মানুষের কাজ না এগুলো। ”

রোজ বিরক্তিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। রাইয়ের মতো এই ছেলেও ভুতের প্যাঁচাল পাড়বে। তাই আগেই বলে ওঠে,

-“তুমিও ভুত প্রেতের কথা তুলো না তো। এসব ভুতটুত বলে কিছু হয় না। মানুষের কাজ এগুলো। সাইকিক কোনো কিলারের কাজ। ভুতের নয়। ”

ইফতি বিরবির করে বলল, “ঠিকই ধরেছেন। রতনে রতন চেনে। আপনি যেমন, তেমন কোনো মানুষই হবে।”

রোজ ইফতির চেহারা পড়ে বলল, “ঠিক। আমার মতই কেউ। কিন্তু আমি কেমন তা তুমি জানলে কি করে? ”

ইফতি থতমত খেয়ে তাকালো। ভড়কালো, চমকালো। রোজ বুঝলো কি করে ইফতি মনে মনে কি বলেছে? রোজ দৃষ্টি হাতঘড়ির দিকে রেখে বলে,

-“সাড়ে ন’টা বাজে।মর্গে যাও, পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো আর কেসের পরিপূর্ণ তথ্য কালেক্ট করে আনো। আমি বিকেলে এসে দেখবো। ”

-“জি ম্যাম। ”

-“শোনো, ”

-“ইয়েস ম্যাম। ”

-“আমি তোমার ছোট,তাই নাম ধরে ডাকো। ম্যাম বলতে হবে না। ”

-“সিনিওর অফিসারকে সম্মান দেওয়াটাও রুলস ম্যাম। না মানলে, স্যার রেগে যাবেন। ”

-“রাগবে না।বলবে আমি অনুমতি দিয়েছি। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ম্যাম ডাকটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।ইয়্যু ক্যান কল মি রোজা অর রোজ। ”

-“ওকে রোজ। ”

🍁🍁🍁

কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ এক বাচ্চা এসে রোজের হাতে ছোট্ট এক চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। রোজ সন্দিগ্ধচোখে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে ডাকে। কিন্তু বাচ্চাটা সাড়া দিল না। রোজ চিরকুট খুলে দেখে,

❤️একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘ বরণ কেশ,
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ।
দুই চোখে তার আহা রে কী মায়া?
নদীর জলে পড়লো কন্যার ছায়া।
তাহার কথা বলি,
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌড়াইয়া চলি।

কন্যার ছিল দীঘল চুল, তাহার কেশে জবা ফুল।
সেই ফুল পানিতে ফেইলা কন্যা করলো ভুল।
কন্যা ভুল করিস না,
ও কন্যা ভুল করিস না,
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলবো না।

গানটা হুমায়ুন আহমেদ তোমার মতই কোনো কন্যাকে নিয়ে ভেবে লিখেছিলেন হয়তো। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা তোমার জন্যই লেখা হয়েছে। তোমার রূপের যথার্থ বর্ণনাই আছে। চুল, চোখ! “নদীর জলে” কেটে পানিতে বসিয়ে নেবে আর “জবা ফুল”কেটে রাবার ব্যান্ড! গানটা কোনো এক সময় নিজকন্ঠে তোমায় শোনানোর ইচ্ছে জাগছে মনে। কিন্তু নিরুপায় আমি তা পারছি না। কেন পারছি না? কারন তুমি আমায় তা করতে দিচ্ছো না। এমন কেন তুমি? ভালোবাসা অন্যায় না, ভুল না। পাপও না। তাহলে? এত আপত্তি কিসের তোমার? যদি আমায় নিয়ে কোনো ভাবনা থাকে তোমার তাহলে চিরকুটটি রেখে দাও। নাহলে ফেলে দাও। ❤️

রোজ চিরকুটটি পড়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল ডাস্টবিনে। রোজের মনে পড়লো গতকাল হাতের ফাঁক থেকে রাবার ব্যান্ড পড়ে গিয়েছিল। ছেলেটা বোধ হয় সেটা কুড়িয়ে নিয়েছে। রোজ যেতে যেতে বলে,

-“প্রেমিক না, তুমি একটা টোকাই। বেয়াদব টোকাই যে মেয়েদের জিনিস কুড়িয়ে বেড়ায়। আমার রাজকুমার কোনো টোকাই হবে না।সে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবে। রোজের উপযুক্ত হওয়ার সকল গুণ তাঁর আগে থেকেই থাকবে। নিজেকে পরিবর্তন করে আমার মনের মত হতে হবে না তাকে। যে আমার জন্য নিজেকে বদলাবে, সে নতুন কাউকে পেলে তাঁর জন্য আবারও বদলে যেতে পারে। আর আমার পরিবর্তনশীল মস্তিষ্কের মানুষ পছন্দ না। ”

চলবে?
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনুভূতি প্রকাশ করে যাবেন। ধন্যবাদ❤️]

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০২

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০২

ক্যাম্পাসের সামনে দাড়িয়ে হাতঘড়িটা ঠিক করছে রোজ। পাশে রাই দাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। মেহমেদ আসছে ওদের দিকেই, সঙ্গে আরও তিনচারটা ছেলে। রোজের সামনে এসে মেহমেদ গলা পরিষ্কার করে খুক খুক করে কেঁশে উঠতেই রোজ তাকে ইগনোর করে বাম দিকের রাস্তা বরাবর হাটা শুরু করলো। রাই নড়তে পারছে না। কারন সামনে তিনচারজন পাঁচিল তৈরি করে রেখেছে। রোজ একবার পেছনে ফিরে তাকালো।

-“রাই? ”

রাই চটজলদি বলে ওঠে, “আমাকে নিয়ে যা। ব’জ্জা’ত মেয়ে। ”

রোজ ফেরত আসলো। মেহমেদ কঠোর কন্ঠে বলল,
-“চলো।”

-“কোথায়?”

-“ফালাকের কাছে। ওকে থা’প্পড় কেন মে’রেছো? কোন সাহসে? প্রথমদিন এসেই সিনিওরদের সঙ্গে ঝামেলা? তাও ফালাকের সঙ্গে। চেনো ওকে? ”

-“না। আর আমার মনে হয় না তাকে চেনার প্রয়োজন আমার আছে। আমার কখনও প্রয়োজন পড়লে নিজেই চিনে নিতে পারবো। আপনাদের বাড়তি সাহায্য লাগবে না।”

-“বড্ড বেশি ফটর ফটর করো। মুখে বুলি ফুঁটেছে খুব তাইনা? ”

-“না, সবাই বলে, ছোট থেকেই আমার মুখে ধান দিলে খই ফোঁটে। বুলির ব্যাপারটা কেউ বলেনি। তাই জানিও না। ”

-” লাস্টবার বলছি, চলো।”

রোজ রাইয়ের দিকে তাকালো। প্রায় কেঁদে ফেলেছে ও। অল্পতে কেঁদে ফেলে কেন মেয়েটা? অদ্ভুত! কি এমন হয়েছে যে ওকে নাকের জল চোখের জল এক করতে হবে। রোজ ক্লান্ত গলায় জবাব দেয়।

-“ক্ষুধা লেগেছে। ক্যান্টিনে এখন কি পাওয়া যাবে? বাইরে না গিয়ে যদি ক্যান্টিনে যাই, আপনাদের নেতা সেখানে আসবেন? তাহলে তাকে ক্যান্টিনে আসতে বলুন। দেখি সে কি বলে, কি বলার জন্য এতগুলো চামচা পাঠিয়েছে।”

মেহমেদ রেগে গেল। কিন্তু ফালাকের বারন থাকার জন্য সেই রাগ প্রকাশ করতে পারছে না,মুগ্ধতা আর ওর বেশ কিছু বন্ধু ইতিমধ্যেই ক্যান্টিনে প্রবেশ করেছে।রোজের বুঝতে বাকি রইল না রাইয়ের কান্নার কারন কি? এরা ওদের র‍্যাগিং করবে। সেজন্যই ভয় পাচ্ছে রাই। কিন্তু র‍্যাগিং তো অপরাধমূলক কর্মকান্ড। কলেজের সুনামের সঙ্গে র‍্যাগিং শব্দটা রোজ শোনেনি আগে। এখানে এমন কিছু হয় সেটা প্রায় বছর চারেক আগে শুনেছিলো। সব তো আপাতত বন্ধ, প্রিন্সিপ্যাল স্যার নিজে এই ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তারপরেও এরা ওর সঙ্গে র‍্যাগ ডে র‍্যাগ ডে খেলা খেলবে? রোজের ঠোঁটের কোনায় সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে। তবে খেলা যাক, তাদের সঙ্গে অতিপরিচিত র‍্যাগিং র‍্যাগিং খেলাটা। রাই বসে পড়ে চিন্তায়। রোজ রাইয়ের হাত টেনে ওকে দাড় করিয়ে বলে,

-“চিল ইয়ার! চল গিয়ে দেখি ভাইয়ারা কেন ডাকছেন।”

রাই রোজের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
-“চিল ছুটায় দেবে। ওদের চিনোস না তো, কাইন্দা কূল পাবি না। চোখ দিয়ে পানি বের কইরা ছাড়বে দেহিস। ”

-“অনেকদিন হলো কাঁদি না। কাঁদার অনুভূতি প্রায় ভুলে গেছি। যদি কাঁদাতে পারে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো ওদের প্রতি। এবার চল। ”

-“কি মতলব রে তোর? ঠান্ডা কেন এত? অস্বাভাবিক আচরণ করছিস। ”

-“আমি এমনই। চল, নাহলে ওরা তোকে কোলে তুলে নিয়ে যাবে। দেখ কেমন শেয়ালের মত তাকাচ্ছে। বাই এ্যানি চান্স তোকে মুরগির লেগপিস ভাবছে না তো? আমি তো চললাম, সাথে এলে আয়। নাহলে থাক ওদের সঙ্গে। ”

-“এই না, না আসছি আমি। আমাকে একা ফেলে যাবি না তুই। এরা আমারে ছিড়ে খাবে। ”

-“পা চালিয়ে আয়।”

ক্যান্টিনে প্রবেশ করতেই রোজের ওপর পানির ঝাপটা এসে পড়ে। সামনে বোতল হাতে মুগ্ধতা হাসছে। রোজ রাগলো না বরং ওরও হাসি পাচ্ছে কারন মুগ্ধতার এই হাসি সে বেশিক্ষণ টিকতে দেবে না। সুন্দর চেহারার এই মেয়েটি কাঁদলে চিড়িয়াখানার সাদা বানরগুলোর মতো দেখাবে। যেটা দেখলে বরাবরই রোজের হাসি পায়। রাই যাবে যাবে করেও গেটের কাছে আটকে আছে।রোজের ওপর পানি ছুড়েছে ওর ওপর যদি ডিম টমেটো ছোড়ে? কেমন দেখাবে তখন?ভাবতেই ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেল রাইয়ের। রোজ কাধের ব্যাগটা রাইয়ের হাতে দিয়ে ডান হাতে মুখের সমস্ত পানি ঝেরে নিচে ফেললো। এরপর বাঁধা ভেজা চুলের রাবার ব্যান্ড খুলে ফেললো। পিঠময় ঘন কালো চুলগুলো ছড়িয়ে পড়তেই সকলে হা করে চেয়ে রইলো। কোমর ছাড়িয়ে চুল রোজের। হাটু প্রায় ছুঁইছুঁই করছে। খোপা করে থাকায় এতক্ষণ বোঝা যায়নি ওর চুলের পরিমাণ। এবার দেখা যাচ্ছে। এত বড় চুল সচারচর দেখা যায় না। খুব কমই দেখা যায়। রোজ চুলগুলো ঝেরে হাত দিয়ে চুল ব্রাশ করে বলে,

-“উফ! কি গরম। বরফ পাওয়া যাবে? ”

সবাই সন্দিগ্ধচোখে তাকালো। রোজ রাগ হয়নি? বরং বরফ চাচ্ছে? ফালাক দূরে দাড়িয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে রোজের দিকে। রোজ সেটা দেখে এগিয়ে যায়। ফালাকের চোখের পলক পড়ে না। রোজ তর্জনি দিয়ে কপাল ঘসে বলল,

-“কি বলবেন জলদি বলুন। কাজ আছে আমার। ”

ফালাক জবাব দিল না। সিয়াম এগিয়ে এসে বলল,
-“স্যরি বলো ভাইকে। ”

-“কেন?”

-“কারন ভুল করেছো তুমি। আর ভুলের শাস্তি পেতে না চাইলে ক্ষমা চাও। ভাই দয়ালু মানুষ, ক্ষমা করে দেবেন। জলদি স্যরি বলো। ”

-“যে ভুল আমি করিনি তাঁর জন্য ক্ষমা কেন চাইবো? ”

ফালাক গম্ভির গলায় শুধালো,
-“ভুল করোনি? ”

-“না।”

ফালাক মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে। মেহমেদ হাসির অর্থ বুঝে নিজেও চেয়ার টেনে বসলো। সিয়াম ক্যান্টিন থেকে নুডুলস, বার্গার, পাস্তা এনেছে। ফালাক মৃদু হেসে বলে,

-“বসো। ”

রোজ বসে পড়লো। রাই স্বাভাবিক পরিবেশ দেখে চলে আসলো ভেতরে। রোজের পাশের চেয়ারটা টেনে বসল রাই। সিয়াম খাবারগুলো টেবিলের ওপর রাখে। রোজ খাবারের দিকে তাকিয়ে রাইয়ের দিকে তাকালো। এরপর ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রাইয়ের হাতে দিয়ে বলে,

-“তোর জন্য খাবার কিনে আন। ”

ফালাক এক ভ্রু উচু করে প্রশ্ন করে,
-“একা খাবে? চাপ হয়ে যাবে নতুন মানুষ! বন্ধুকে সঙ্গে রাখো। এগুলো শেষ না করে উঠতে পারবে না তোমরা। এগুলো শেষ না হলে তোমাদের সেটাই করতে হবে যেটা আমি চাইবো। ”

-“আর যদি খেতে পারি? তখন? ”

-“কি চাও? ”

-“রিভেঞ্জ! যদি বাজিটা আমি জিতি, এগুলো সব খেতে পারি। তাহলে আমি যা চাইবো তাই করতে পারবো।আপনি আমাকে এই কথাটা দিলে আমি আপনার শর্তে রাজি।”

ফালাক, মেহমেদ, মুগ্ধতাসহ সবাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। ফালাক সবার পক্ষ থেকে বাজি স্বীকার করে বলে,

-“ওকে। তবে খাবারের টুইস্ট আনতে কিছু সস দরকার। সিয়াম চিলিসস আন। সঙ্গে কোল্ডড্রিংক আর কাঁচা মরিচ। ”

সিয়াম দ্রব্যগুলো এনে দিলো। ফালাক যত্নসহকারে বার্গারের মধ্যে কাঁচা মরিচ ঢুকিয়ে দিলো। নুডুলস ও পাস্তার ওপর ঢেলে দিল চিলিসসের পুরো বোতল। রাই ঘেমে উঠলো তা দেখে। ফালাক চামচ দিয়ে সস আর পাস্তা নুডুলস মিশিয়ে চামচটা ঠিক করে রোজের হাতে ধরিয়ে দেয়। রোজ ব্যাগ থেকে চুইংগাম বের করে চিবুচ্ছে। ফালাক হেসে বলে,

-“নাও। খেয়ে ফেলো চটপট। বাজি যখন ধরেছো তখন ভেবেচিন্তেই বোধ হয় ধরেছো।তাই আমিও আমার নরম হৃদয়টার মায়াকে এখানে আসতে দিলাম না। ”

রোজ চুইংগাম ফেলে বলল,
-“তাকে নিজের কাছেই রাখুন। আমার সামনে তাকে না আনাই ভালো।কারন আমি মানুষটা নরমশরম মানুষকে বড্ড পছন্দ করি। তাদের দেখলে আমার শক্ত, কঠিন মনটা নিমিষে গলে যায়। সেদিক থেকে আপনি পার্ফেক্ট আমার আসল মেজাজ সহ্য করার জন্য।”

রোজ কথাগুলো বলে রাইয়ের দিকে তাকালো। সে বসে আছে চুপচাপ। মেহমেদ রাইকে ধমক দিয়ে বলে,

-“কি ব্যাপার খাচ্ছো না কেন?”

রাই ভয়ে একচামচ মুখে দিতেই ঝালে ওর মুখ জ্বলে উঠলো। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। রোজ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,

-“তোকে বললাম না নতুন খাবার আনতে। কথা শুনিস না কেন? যা, খাবার কিনে আন। আমি একাই সব খেতে পারবো। ”

মুগ্ধতা ব্যাঙ্গসুরে বলে,
-“কনফিডেন্স ভালো তবে ওভার কনফিডেন্স না। ”

রোজের হাসি চওড়া হলো। সে সকৌতুকে বলল,
-“চামচামি ভালো, ওভার চামচামি না। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। ”

মুগ্ধতা তেড়ে আসতেই মেহমেদ ওকে আটকালো। তা দেখে রোজ তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি হেসে চামচ হাতে নিল। এরপর টু-শব্দও শোনা গেল না। রোজ খেতে আরম্ভ করে। চেহারা স্বাভাবিক, ঝালে শিসানোর আওয়াজও নেই। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকায়। রোজ থামছে না। খেতে খেতে পাস্তা শেষ। নুডুলসের প্লেট ধরতেই রাই আটকালো। রোজ স্বল্পস্বরে বলল,

-“আ’ম ওকে। ডোন্ট ওয়ারি রাই। তুই খেতে থাক, তোর আলসারের প্রবলেম আছে, না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে। খা তুই। ”

রাই খেলো না। গলা থেকে নামছে না খাবার। সবার অবস্থা একই। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই। হতবাক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে রোজের দিকে। ফালাকও চিন্তিত চোখে তাকালো। মেয়েটা জিতে গেলে কি করতে বলবে? সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। প্রশ্ন করা বাদে যা ইচ্ছে করুক আপত্তি নেই ফালাকের।

রোজ খাওয়া শেষ করে ঢেকুর তুলে বলে,
-“মুগ্ধতা আপু, বরফ এনে দেবে একটু? ”

মুগ্ধতা চোখ রাঙাতেই, সিয়াম বরফ আনলো।রোজ সে বরফের টুকরোগুলো নেড়ে চেড়ে মুগ্ধতার হাত টেনে বরফের বাটির মধ্যে ঠেসে ধরলো। সবাই উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে আসতেই রোজ বলে,

-“বাজিতে জিতেছি আমি। এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবো। কেউ বাঁধা দিতে আসবেন না প্লিজ। ফালাক আপনি আপনার কথা রাখবেন না? তখন তো আপনি সহ আপনার সব চ্যালারা মাথা নাড়লেন। মুগ্ধতাও তো নাড়লো। এখন বাঁধা দিলে হবে? ”

সবাই পিছিয়ে গেলো।অতারিক্ত ঠান্ডায় মুগ্ধতার হাতের চামড়া শক্ত হয়ে আছে। যন্ত্রণা হয়। মুগ্ধতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। রোজ প্রায় কুড়ি মিনিট পর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

-“আমি মানুষটা ওতটাও ভালো নই যতটা ভেবেছো। তাই আমার পেছনে লাগতে এসো না,তোমাদের লেজে আমি পা দেইনি তবুও ছোঁবল দিতে আসছো। তাই সাবধান করছি, আমি সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফনা টেনে ছেড়ার মত সাপুরিয়া। একবার যাকে ধরি, তার জীবন ধ্বংস করে দেই। তোমাদের অন্যায় নিতান্তই তুচ্ছ তাই সামান্য ট্রেইলার দেখালাম। আমি সত্যিই চাইনা তোমাকে বা তোমাদের ক্লাইম্যাক্স দেখাতে। ”

রোজ ফোন বের করে সময় দেখছে। ব্যাগ গুছিয়ে সে রাইয়ের দিকে তাকালো।ঠিক তখনই ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুলিশ অফিসার এসে রোজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“স্যার আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনার ফোন বন্ধ তাই আমাকে পাঠানো হয়েছে। বিকেল চারটায় মিটিং এখন তিনটা বাজে,অফিসের গাড়িতে গেলে তাড়াতাড়ি হবে। ”

রোজ আঙ্গুল তুলে বলে,
-“স্কুটার এনেছি আমি।চারটার আগে পৌঁছে যাবো। তবে এরপর থেকে আমাকে ফোনে না পেলে কলেজে আসবেন না। এটা আমার প্রফেশনাল সাইট নয়। তাই সবাই সবটা ভালো নজরে দেখবে না। গো নাও।ওহ হ্যা, আমার বন্ধুকে নামিয়ে দেবেন ওর বাড়িতে। রাই ওদের সঙ্গে যা। ওরা তোকে সেফলি বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কেউ হ্যারাস করার সুযোগ পাবে না। ”

কথাটা সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল রোজ।রাই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে চলে গেল। রোজও বের হয়। যেতে যেতে রোজ শোনে মুগ্ধতা চেঁচিয়ে বলছে, “সাইকো গার্ল”রোজ মৃদু হাসে।হাসিতে মেতে ওঠে ওর চক্ষুদ্বয়ও। ঠোঁটের হাসি বজায় রেখেই রোজ পেছনে ফিরে জবাব দিল,

-“রাইট।”

শব্দটির তীক্ষ্ণতা আন্দাজ করার মত না। ধাঁরালো, এক হুমকির মতো শোনালো। রোজের ক্রোধান্বিত চাহুনিতে মুগ্ধতা ভয় পেয়ে যায়। মুগ্ধতাসহ ওর বন্ধুরা পিঁছিয়ে গেল কয়েক কদম। রোজের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। সে হেসে ফালাকের দিকে একনজর তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে। এতক্ষণ দম খিচে ছিল মেহমেদ সিয়াম। মেহমেদ এবার দম ছেড়ে বলল,

-“ফালাকের ডুবলিকেট।”

জবাবে ফালাকও এক ধাঁরালো দৃষ্টির সঙ্গে এক চিলতে হাসি উপহার দেয়।

🍁🍁🍁

অয়ন্তির ফুড পয়জনিং হয়েছে। এজন্যই পেটে ব্যাথা ও বমি হচ্ছে। গতকাল লুকিয়ে লুকিয়ে ফুচকা, চটপটি, মুড়িমাখাসহ নানা ধরনের ফাস্টফুড খাওয়ার ফল এটা।ইফতি সকালে ভুল করে অয়ন্তির বদলে অয়ন্তিকা নামক একজনের রিপোর্ট নিয়ে চলে এসেছিল। রোজ অয়ন্তির রিপোর্ট চেক করে বলে,

-“এবার ঠিকঠাক রিপোর্ট এনেছো। গোয়েন্দা তুমি, আর তোমার কাজ এমন অগোছালো কেন? তোমাকে কি নতুন করে শেখাতে হবে সব? ডাফার! তোমাকে সিলেক্ট করেছে কে? তাঁর ট্রিটমেন্ট আগে করানো উচিত দ্যেন তোমার। ”

-“স্যরি ম্যাম। আসলে আমি নাম ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ভুল হয়ে গেছে। ”

-“ইটস ওকে। সারাদিন তো মনে হয় চিন্তায় পেটে কিছু পড়েনি। বাড়িতে চলে যাও, আজ তোমার ছুটি। ”

-“কিন্তু ম্যাম। ”

-“বললাম তো ছুটি। বিরক্ত করবে না একদম। গাড়ি বের করো আমিও বাড়ি ফিরবো। ”

-“ওকে। ”

বাড়িতে ফিরেই রোজ শুনতে পেলো তাঁর অতিআদরের ছোট ভাই সারা বাড়িময় জুড়ে দৌড়ে আশ্চর্যজনক এক বাক্য আওড়ে চলেছে। রোজ নিজের শ্রবণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ করে শোনার চেষ্টা করল সে আদৌ ঠিক শুনছে কিনা।কিন্তু না, ঠিকই শুনছে। রোজের ছোটভাই সারিম গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে আর বলছে,

-“আমি প্রেগনেন্ট, আমারও বাচ্চা হবে, আমার তিনটা হবে, আমার চারটা হবে, আমি ওদের শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাবো।”

রোজের মগজ ফাঁকা হয়ে আসলো। চারপাশে এতশত প্রেগনেন্টের কথা শুনে রোজের নিজের হাতও ওর পেট স্পর্শ করলো।সকালে শুনলো অয়ন্তির ভুল প্রেগনেন্সির রিপোর্ট, দুপুরে রাইয়ের পেটের আলসারের ব্যাথা, এখন আবার সারিমের প্রেগনেন্সি। হচ্ছে টা কি? সাতবছরের ছেলে বাচ্চা এসব কোথ থেকে জানলো? কোথ থেকে শুনলো? কে বলেছে? এতটুকু বাচ্চাকে আবোলতাবল কে শেখাচ্ছে? রোজ বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সারিম ছুটে এসে রোজকে জড়িয়ে ধরে। বলে,

-“আপিয়া আজ দুটো চকলেট দেবে।একটা আমার আর একটা আমার বাচ্চার।আমি প্রেগনেন্ট জানো? ”

রোজ হেসে বলল,
-“তাই? কে বলেছে তোমাকে এসব? কিভাবে প্রেগনেন্ট হলে তুমি?”

-“কুকুর কামড়ালে চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন দিতে হয় কারন, ইঞ্জেকশন না দিলে পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়। হীরামন বলেছে আমায়।এটাও বলেছে বিড়াল কামড়ালেও ঠিক এভাবে বাচ্চা হয়। এজন্যই তো আমি বিড়াল ধরিনা। কিন্তু আজ তোমার মিনিক্যাট আমায় কামড়েছে। এখন তো আমার পেটেও বাচ্চা হবে। আমার সব বন্ধুদের আমি বলেছি, আমাদের বাড়িতে অনেক বিড়াল আসবে ওরা কিনবে বলেছে। আমি আমার বাচ্চা বিড়ালগুলো ওদের কাছে বেঁচে বড়লোক হয়ে যাবো। ভালো বুদ্ধি না?”

রোজ সারিমের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল। এরপর নিজের ঘরে যেতে যেতে বলল,

-“এসব মিথ্যা কথা, সারিম। বিড়ালের গায়ে জার্মস থাকে তাই হীরামন তোমায় এসব বলেছে যেন তুমি আর বিড়াল নিয়ে মাখামাখি না করো। আর কুকুর যদি কামড়ায় তাহলে বাচ্চা হবে না। তোমাকে তো সব জেনে নিতে হবে। তুমি ব্রেভ বাচ্চা তাই এখন থেকে ঠিক ভুল শিখতে হবে। শোনো, কুকুরের কামড় অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক এবং মারাত্নক হয়। কুকুরের কামড় থেকে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। রেবিস নামক ভাইরাস থেকে জলাতঙ্ক রোগ হয়ে থাকে। এটি একটি স্নায়ুর রোগ।মানে নাড়ির অসুখ হয়। রেবিস ভাইরাস কুকুরের লালা থেকে ক্ষতস্থানে লেগে যায় এবং সেখান থেকে স্নায়ুতে পৌঁছে জলাতঙ্ক রোগে সৃষ্টি করে। বুঝেছ?
আর বিড়ালের মুখে ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মানুষের দেহে গেলে মানুষের শরীরের ক্ষতি হতে পারে। তুমি তো ছোট। যদি বিড়ালের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ব্যাথা পাও তাই হীরামন তোমাকে বাচ্চার কথা বলেছে। আসলে ওসব ভুল। ”

-“তাহলে আমার বন্ধুদের আমি বিড়াল দেবো কি করে? আমি তো ওদের বলে রেখেছি।আনসারীর ছেলে কথার খেলাফ করবে? ” মুখ ভার করে বলল।

-“আমি এনে দেবো। এবার খুশি?”

-“হুম অনেক। কিন্তু বাবাই আর মামনি কবে আসবে আপিয়া? ”

রোজের হাসিমুখ মলিন হয়ে গেল। এই প্রশ্নটার উত্তর সে কখনই সারিমকে দিতে পারবে না। বাকিসব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও এই প্রশ্নের উত্তর তো জানা নেই রোজের। কিভাবে ছোট ভাইকে বলবে সে? তাদের মা বাবা ফিরবে না। তারা একেবারের জন্য ঘুরতে গেছে। রোজ সারিমের মাথায় হাত বুলিয়ে, সারিমের কপালে চুঁমু খেয়ে বলে,

-“কেন?আপিয়ার কাছে থাকতে ভালো লাগে না? বাবাই মামনি ঘুরতে গেছে, তাদের বিরক্ত করতে চায় আমার নক্ষত্র? ”

সারিম মাথা দুদিকে নাড়িয়ে “না”বোধক উত্তর দিল।রোজ ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে সারিমের হাতে দিয়ে বলে,

-“তারা ফিরে আসবে নক্ষত্র। তুমি তাদের কথা না ভেবে পড়ায় মনোযোগ দাও। অঙ্কে বাংলায় নাকি একশতে একশ পেয়েছ? ইংরেজিতে আটানব্বই।”

-“হুম। ইংরেজিতে বানান ভুল করেছি। ” মন খারাপ করে বলল।

-“তাতে কি? আমার নক্ষত্র পরের বার একশ পাবে। এতে মন খারাপ করতে আছে? ভালো নাম্বার পেয়েছো। আরেকটু চেষ্টা করলে আরও ভালো হবে। ”

-“তোমার মত ভালো হবে আপিয়া?”

-“আমার থেকেও ভালো হবে। যাও চকলেট খাও আর হীরামনের সঙ্গে গল্প কর। আমি পরে পড়ার সময় ডাক দিবো। ”

-“তোমার মাথা ব্যাথা করছে? আমি টিপে দেবো? ”

রোজ সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। সত্যিই কাজের চাপে আর কলেজের কান্ডে রেগে মাথা ধরে আছে ওর। এখন ঘুমাতে যাচ্ছিলো তাই। কিন্তু সারিম বুঝলো কি করে? রোজ ‘না’ সূচক মাথা নাড়লে সারিম বিজ্ঞকন্ঠে বলে,

-“আমি ছোট কিন্তু এতটাও না, তোমার কষ্ট হলে আমি বুঝি। চলো, শুয়ে পড়ো। আমি টিপে দিচ্ছি। দেখবে ব্যাথা ভ্যানিশ হয়ে যাবে। কোনো না শুনবো না আমি। তোমার নক্ষত্র তোমার থেকেও জেদি। হুহ।”

সারিমের আবদার ফেলতে পারলো না রোজ। বিছানায় উঠে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বালিশে মাথা রাখা মাত্র সারিমের ছোট ছোট আঙ্গুলের স্পর্শ পেল কপালে। শান্ত হলো মন। ঘুমঘুম ভাব চলে আসলো। মুহূর্তেই রোজ তলিয়ে গেল ঘুমের অতলে।

চলবে?

তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০১

0

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#সূচনা_পর্ব

-” অয়ন্তি ম্যাডাম প্রেগনেন্ট। এই যে তাঁর প্রেগনেন্সি রিপোর্ট। ম্যাম। দেখুন স্পষ্ট লেখা আছে রিপোর্ট পজিটিভ। আমি মিথ্যা বলছি না।” কোমল কন্ঠে বলল।

-“হীরামন অবিবাহিত। তাই ওর প্রেগনেন্ট হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কার না কার রিপোর্ট দেখেছো, সেটা নিয়ে হম্বি-তম্বি না করে ওর রিপোর্ট খুজে বের কর। এ্যান্ড গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার নাও! ফাস্ট। তোমাকে দেখলে রাগ হচ্ছে আমার। অকালকুষ্মাণ্ড ছেলে একটা। ”

হাতে থাকা কেস’ফাইলগুলো চেক করতে করতে বলে উঠলো রোজ। রোজের কথা শুনে সামনে দাড়িয়ে থাকা ইফতি পুনরায় ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। অয়ন্তি রোজের বড় চাচ্চুর মেয়ে। রোজ তাকে হীরামন বলে ডাকে। ইফতি চলে যেতেই রোজ অয়ন্তিকে ফোন করে ওর হালচাল জিজ্ঞেস করল । গতকাল রাত থেকে অয়ন্তির পেটে ব্যাথা, বমি হচ্ছে। এখন কিছুটা ঠিক হয়েছে জেনে ফোনটা রেখে দিলো রোজ। আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার দরকার। চান্স পাওয়ার পর থেকে আর কলেজে যাওয়ায়ই হয়নি। ভর্তিটাও হয়নি। আজ গিয়ে ভর্তি হয়ে আসতে হবে। হাতের ফাইলগুলো তাকের ওপর রেখে রোজ বাথরুমে ঢুকে যায়। নীলরঙা একটা থ্রিপিচ পড়ে চুলগুলো বেণী করে নিল সে।

🍁🍁🍁

স্কুটার কলেজের গ্যারাজে পার্ক করার পর থেকেই রোজ লক্ষ করছে ওকে কিছু ছেলে ফলো করছে। সেই কলেজ গেট থেকেই পিঁছু নিয়েছে। ভর্তির জন্য সবাই সবার ডিপার্টমেন্টের সামনে নতুবা ভেতরে আছে বলে রাস্তাটাও বেশ ফাঁকা। কিছুদূর যেতে না যেতেই পেছন থেকে কেউ ওর ওরনা টেনে ধরে। রোজ থমকে দাঁড়াল। চট করে পেছনে ফেরার অভ্যাস নেই ওর। রোজ বাহাতে ওরনা পেঁচিয়ে টান দিতেই পায়ে ব্যাথা অনুভব করে। টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ে গেল রোজ। এবার মেজাজ তুঙ্গে উঠে যায়। রোজ পেছনে ফিরেই দেখলো একটা ছেলে ওর ওরনা ধরে দাড়িয়ে আছে। পাশে দেখে কিছু ছেলে দৌড়ে যাচ্ছে। এরাই তো ওকে ফলো করে এতদূর এসেছে। রোজ সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার হাত থেকে ওরনা কেড়ে নিয়ে সপাটে চর লাগাতেই ছেলেটার দৃষ্টি জ্বলে উঠলো। সে নিজেও রোজের গালে পাল্টা আঘাত ফিরিয়ে দেয়। স্তব্ধ রোজ বিস্ময় নিয়ে তাকায়। ছেলেটার পাশে আরও কিছু ছেলেপুলে চলে আসে। রোজ স্বল্পভাষী। তাই সংক্ষেপে বলে,

-“আমার গায়ে হাত তুলে ঠিক করেন নি। অসভ্যতামির একটা লিমিট আছে। যেটা ক্রস করে গেছেন। ”

ছেলেটার পাশে দাড়ানো ছেলেগুলোর মধ্যে একজন এগিয়ে আসতেই ছেলেটা বাঁধা দিলো। তিক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

-“তোমাকে বাঁচিয়ে যদি অসভ্যতামি করে থাকি তাহলে চরটা আমার প্রাপ্য ছিল।আর তুমি বিনা কারনে আমায় চর মেরেছো যার কারনে এই চরটা তোমার প্রাপ্য। ইডিয়েট গার্ল। ”

রোজ বুকের সামনে দু হাত গুজে দাঁড়ায়। ছেলেগুলোর দলবল চটে গেছে ভীষণভাবে। রোজকে তারা তোয়াক্কা করবে না তা তাদের হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তা দেখেও রোজের বিন্দুমাত্র ভাবভঙ্গির পরিবর্তন হলো না। সে ব্যস্ত সামনে দাড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে খুঁটিয়ে দেখতে। এর মাঝেই একটা মেয়ে এসে রোজের গালে থা’প্পড় দিয়ে বসে। রোজ হতভম্ব দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে এই মেয়েটার কি সমস্যা? মেয়েটাকে কিছু বলার মত ভাষা খুজে পেল না রোজ। মেয়েটাই নিজে বলতে শুরু করে,

-“হাও ডেয়ার ইয়্যু? হও ডেয়ার ইয়্যু টু টাচ হিম? তোমার সাহস হলো কি করে ফালাককে মা’রার? ইয়্যু সিলি চিপ গার্ল। ”

ফালাক এবার কঠিন গলায় বলে,
-“এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার মুগ্ধতা। তুমি এর মধ্যে ঢুকছো কেন? কেউ এটার মধ্যে ঢুকবে না। দেখছো না আমি সবাইকে মানা করেছি। ”

-“শী হিট ইয়্যু ফালাক। তোমাকে মে’রেছে ও। তাও বিনা কারনে। তবুও আমি চুপ থাকবো?”

-“থাকবে। কারন আমার ওপর করা আঘাতের পাল্টা আঘাত আমি নিজেই করতে জানি। আমার তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন নেই। যাও এখান থেকে। ”

মুগ্ধতা ফালাকের কন্ঠে রাগের আভাস পেয়ে চলে যেতে শুরু করলে রোজ কোমল কন্ঠে ডাকলো,

-“এক মিনিট। ”

মুগ্ধতা পেছনে ঘুরে তাকায়। রোজ এগিয়ে গিয়ে বেশ জোরে একটা চর কষিয়ে বসালো মুগ্ধতার গালে। সবাই হা করে চেয়ে আছে। মুগ্ধতা রেগেমেগে একাকার। সেই দৃশ্য রোজ পুরোপুরি উপেক্ষা করে ফালাকের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,

-“ঘরে মা বোন থাকলে কোনো মেয়ের সম্মান নিয়ে এই ধরনের ফালতু মজা করার কথা নয়। যদি আপনার বাড়িতে মা বোন না থাকে আমার বাড়িতে আসবেন। ভাইকে কিভাবে ট্রিট ও ট্রেনিং দিতে হয় তা হাতে কলমে শিখিয়ে দেবো। এবার যেতে পারেন আপনারা।”

রোজের বন্ধু রাইমা স্কুটার পার্ক করে ছুটে আসলো। সব ঘটনাই সচক্ষে দেখেছে সে। তাই সে জানে এখানে রোজ বা ফালাক কারোরই দোষ নেই। অথচ গুনে গুনে তিনটে থা’প্পড় তিনজনের গালে পড়লো। প্রথম ভুলটা রোজের, দ্বিতীয়টা ফালাকের, তৃতীয় এই পাগল মুগ্ধতার যে বিনা কারনে, বিনা উদ্দেশ্যে দুটো মানুষের মধ্যে ডান হাত, বা হাত চালান করে বেড়ায়। রাই সামনে আসতেই ফালাক গম্ভির চোখে রাইকে পর্যবেক্ষণ করলো। এরপর রাশভারি কন্ঠে বলল,

-“নিজের বন্ধুকে সামলাও, নাহলে বিপদে পড়ে যাবে। আমার এমন অপমান আমি সহ্য করবো না। এর শাস্তি ওকে পেতে হবে। ”

রাই পরিস্থিতির এবং পরিবেশের উত্তপ্ততা লক্ষ করে আকুতির স্বরে বলল,
-“প্লিজ ভাইয়া, এবারের মত মাফ করে দিন। ও নতুন, কিছু জানে না। তাই ভুল করে ফেলেছে। ”

ফালাকের পাশ থেকে অতিকষ্টে চুপ করে থাকা ছেলেটি বলে ওঠে,
-“ভাইয়ের কাছে মাফ চাইতে বলো। নাহলে তোমাদের এই কলেজে পড়া হারাম করে ছাড়বো। ”

রোজ ফোন বের করে দেখলো পাঁচটা মিসড কল। ইফতি কল দিয়েছে।এই অকর্মণ্য ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। কোনো কাজ ঢঙ করে করতে পারেনা। রোজ সাইডে এসে ফোন রিসিভ করে কথা বলতেই রাই হতবুদ্ধি হয়ে তাকালো।ফালাকসহ সবাই বেশ ক্ষেপেছে। কিন্তু তা প্রকাশ করলো না। আশেপাশে নানা কথা শুরু হয়েছে। বারুদের মত তিনথাপ্পড়ের কাহিনি প্রচার হয়ে গেলো। কিন্তু থাপ্পড় তো চারটা পড়েছে? রোজের গালে দুটো। আর সেই রোজই কিনা আরামসে পাশ কাটিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত। ফালাক চলে গেল ওখান থেকে। পেছন পেছন গেল ওর চ্যালারাও।

রাই এসে রোজের হাত টেনে ওকে ক্যান্টিনের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। রোজ বিরক্ত হয়ে হাত ছাড়িয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় বলে,

-“আগে ভর্তি হয়ে নেই। তারপর ক্যান্টিনে যাবো। এখন ক্যান্টিন দেখে লাভ নেই। আজ বাইরে খাবো, ট্রিট আমি দিবো। ”

রাই উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
-“তুই এত স্বাভাবিক কিভাবে আছিস? তোর পরাণে ভয় নেই? কাদের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছিস জানিস? কলেজের টপ ক্রাশের একটা। জুনিওরদের চোখের মনি, স্যারদের প্রিয় ছাত্র। মেয়েদের কলিজার ক্রাশ। ”

-“সো?”

-“ওরা তোকে হ্যারাস করবে। ”

-“করুক। যখন করতে আসবে তখন তুই সুযোগ বুঝে কেটে পড়বি। ব্যাস ঝামেলা শেষ। ”

-“ফালাক ভাইকে স্যরি বলে দিলেই প্রবলেম সলভ। উনি তো তোর ভালোই চেয়েছে। বখাটেগুলো তোর ওরনা টেনে তোর ওপর হামলে পড়তে যাচ্ছিলো, উনি এসে সবটা সামলালো আর তুই ওনাকেই মা’রলি? ”

-“কারন সামলানোর নাম করে উনিও সেম কাজটাই করতে যাচ্ছিলেন। ”

-“উনি এরকম না। মেয়েদের সম্মান করতে জানেন। তুই ভুল বুঝেছিস। ”

-“বাঁচানোর হলে, ওরনা ধরে রাখতেন না। বাঁচানোর কাজ শেষ হতেই ছেড়ে দিতেই। উনি ওরনা ধরে ঘ্রাণ নিচ্ছিলো, এটা বাঁচানোর কোন স্বভাবে পড়ে? তোর এই নাকে কান্না বন্ধ কর। নাহলে এখানেই বুলেট তোর পেটে পাঠিয়ে দেবো। ”

রাই থেমে গেলো। ফালাকের রাগের কথা যেমন জানে ও তেমন রোজের রাগের কথাও জানে। কোনো অংশে কম না এরা। তাই কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রোজের পিঁছু যেতে লাগলো রাই। রোজকে হাতছাড়া করা যাবে না। করলে পুরো দোষ আর জ্বালাগুলো ওর ঘাড়ে এসে বর্তাবে। দেখা গেল রোজকে না পেয়ে রাইয়ের ওপরেই প্রতিশোধ নিয়ে নিলো ওরা।রাই দ্রুত রোজের পাশে গিয়ে রোজের পাশাপাশি হাটতে শুরু করে। রোজ তা দেখে আবারও বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে ফেললো।

🍁🍁🍁

চার বোতল পানি পান করেও স্থির থাকতে পারছে না ফালাক।রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।কোথাকার কোন মেয়ে এসে প্রথমদিনই ফালাককে মা’রলো? এটা সহ্যের সীমা অতিক্রম করার মত ভাবনা। যে ফালাককে একনজর দেখার জন্য মেয়েরা হা হুতাশ করে তাকে মা’রলো? রেগে চেয়ারে লা’থি দিল ফালাক। চেয়ার উল্টে পড়লো মেহমেদের সামনে। মেহমেদ চেয়ার ঠিক করে বলল,

-“কি হয়েছে? এমন করছিস কেন? এ্যাই ফালাকের কি হয়েছে রে? ” (সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে)

পেছন থেকে সিয়াম এসে বলে,
-“ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে এসে ভাইকে থা’প্পড় মে’রে ঠান্ডা মস্তিষ্কে কে’টে পড়েছে। ”

কি সাংঘাতিক কথা। মেহমেদ নিজেও এবার রেগে গেল। ওর বন্ধুকে মে’রে চলে যায় কোন মেয়ে? সেটা দেখা দরকার। কিন্তু আগে ফালাককে ঠান্ডা করতে হবে। যেভাবে রেগে গেছে তাতে আগ্নেয়গিরির লাভা ফুটতে ফুটতে যার তাঁর ওপর গিয়ে পড়বে। মেহমেদ এগিয়ে এসে বলে,

-“শান্ত হ। ওকে পানিশমেন্ট দেওয়া হবে। আমি দেখছি ব্যাপারটা। ”

-“আই ওয়ান্ট হার মেহমেদ। ওকে কেউ টাচ করবি না। ডেকে সোজা আমার সামনে নিয়ে আসবি। সেটা খুব দ্রুত। আই কান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ। কান্ট! ”

-“যদি না আসে, জোর করতে হবে তো। ”

-“ও আসবে। সি’জ ডিফরেন্ট ফ্রম অ্যানাদার গার্ল। ”

মেহমেদ কথা বাড়ালো না ফালাকের আত্মবিশ্বাস দেখে। মেয়েটা আসবে এটা ফালাক নিশ্চিত হয়ে কিভাবে বলে দিল? মেয়েটা কি ফালাকের পূর্বপরিচিত? না, তা হলে ফালাককে কেন মা’রবে? কিন্তু কিছু একটা তো আছেই। যাক আপাতত র‍্যাগিং করার জন্য কোনো একটা মুরগি তো পাওয়া গেল। প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো কাউকে র‍্যাগিং করা হয় না।আজ সুযোগ এসেছে হাতে। এটাকে কাজে লাগাতে হবে।

চলবে।

তুই হবি শুধু আমার সিজন-০১ পড়তে লেখাটি উপর ক্লিক করুন।

নিষিদ্ধ প্রেম পর্ব-১০(শেষ পর্ব)

0

#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|১০|
~
রাইমা আর অরিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজনেরই চোখ মুখ বিষন্ন হয়ে আছে। অরিকের গায়ের সাদা পাঞ্জাবীটা দেখে রাইমা মৃদু হাসল। তবে সেই হাসির কোনো প্রাণ নেই। রাইমা অনেকক্ষণ সময় নিল। অরিক তার মুখ পানে চেয়ে রইল কিছু শোনার অপেক্ষায়। রাইমা এক পর্যায়ে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। অরিকের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,

‘আপনি বলেছিলেন না আপনাকে শাস্তি দেয়ার কথা। বলেছিলেন আমি যেন আপনার বন্ধুকে ক্ষমা করে দেই, যা শাস্তি দেয়ার আপনাকে দেই। তবে তাই হোক। আমি ক্ষমা করে দিব আপনার বন্ধুকে। তবে তার বিনিময়ে আমার একটা শর্ত আছে।’

অরিক চোখ বুজে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘কি শর্ত?’

রাইমা চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকাল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে গম্ভীর সুরে বললো,

‘আপনাকে এখন বাইরে গিয়ে সবার সামনে সবটা সত্যি বলতে হবে। আপনি আমার সাথে যা যা করেছেন তা সব। আর এই সমস্ত কিছু শোনার পর যদি আপনার আর আমার পরিবার আপনাকে ক্ষমা করে দেয়, তবে আমিও আপনাকে ক্ষমা করে দিব। কিন্তু তার জন্য আগে আপনাকে এই কথাগুলো সবাইকে বলতে হবে। আর এটাই আপনার শর্ত কিংবা আবার শাস্তিও বলতে পারেন।’

অরিক স্তব্ধ হয়ে গেল। এবার তার কি বলা উচিত? তার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো তো কোনো সঠিক উত্তর পাঠাচ্ছে না। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এসব কথা শোনার পর তার মায়ের কি অবস্থা হবে সেটা ভেবে তার বুক কেঁপে উঠছে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা ক্রমাগত তার স্পন্দন বাড়িয়ে যাচ্ছে। ভয় হচ্ছে খুব। কিন্ত তাও সে মেনে নিল। নিজেকে মানিয়ে নিল। বুঝে নিল, অন্যায় করলে শাস্তি পেতেই হবে। আর তারও শাস্তি পাওয়ার সময় চলে এসেছে। তাই সে ঠিক করলো বলে দিবে সবাই কে সবটা। সত্যিটা যতই তেতো হোক না কেন সবাই ঠিকই বাধ্য হয়ে সেটা হজম করে নেয়। আর এই মানুষগুলোও সেটা পারবে যেই মানুষগুলো অধীর আগ্রহে বাইরে অপেক্ষা করে চলছে তাদের মতামত শোনার জন্য।

অরিক জোরে দম নিল। হাত দিয়ে কপালের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো,

‘ঠিক আছে, আমি সবাইকে সবটা বলবো।’
.
.
দুজনেই শক্ত মনে ড্রয়িং রুমে সকলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সবার উৎসুক দৃষ্টি তাদেরকে ঘিরে। যেন সবাই একটা ‘হ্যাঁ’ এর অপেক্ষায় মত্ত।

অরিক নিজেকে শক্ত করলো। কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই যেন তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ইশ, তখন যদি এই মুখটা একবার তার মনে ভেসে উঠত, তবে জীবনেও এই ঘৃণ্য কাজটা সে করতে পারতো না। অরিকের শরীর ঘামছে, বুকটা কাঁপছে। সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললো,

‘আমার সবাইকে কিছু বলার আছে।’

অরিকের মা জবাবে বললেন,

‘হ্যাঁ বাবা, আমরা তো তখন থেকেই অপেক্ষা করছি তোমাদের মতামত শোনার জন্য। কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ বলো?’

‘সিদ্ধান্তের কথায় পরে আসছি মা। তার আগে আমার অন্য কিছু বলার আছে।’

সবাই বুঝতে পারছে না অরিক ঠিক কি বলতে চাইছে। রাইমার বাবা তখন বললেন,

‘ঠিক আছে বাবা, বলো তুমি কি বলবে? আমরা শুনছি তোমার কথা।’

অরিক এবার একবার মায়ের দিকে তাকাল তো একবার রাইমার দিকে তাকাল। বুক ধরফর করছে তার। মাথার চুলগুলো ঘামে লেপ্টে আছে। অরিক চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজেকে সর্বোচ্চ কঠিন করে বললো,

‘মা, আমি অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। আমি জানি তুমি আমার সেই ভুলের কথা জানার পর আমাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। তাও ক্ষমা চাচ্ছি। শুনেছি সন্তান হাজার টা ভুল করার পরও মা তাকে ক্ষমা করে দেয়। তাই ক্ষমা চেয়ে নিলাম, যদি পারো কোনোদিন আমায় ক্ষমা করে দিও।’

অরিকের মা হতভম্ব হয়ে তার ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। কি বলছে সে? তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তাই রেগে গেলেন তিনি। ধমক দিয়ে বললেন,

‘কি সব বলছো বলতো? কি অন্যায়ের কথা বলছো? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘বলছি মা, সবটা বলছি। মা, এক মাস আগে এক রাতে আমি বলেছিলাম না, আমি আজ রাতে নিরবের বাসায় থাকব। সেই রাতে অামি নিরবের বাসায় না থেকে পার্টিতে চলে যাই। সেখানে অনেক মানুষ ছিল। আর আমাদের বয়সী ছেলে মেয়েরা সব তখন নাচ গান আর ড্রিং করাতে ব্যস্ত ছিল। ঐ সময় আমিও এসব খেয়ে ফেলি। অনেকটাই খেয়ে ফেলি। আর তারপর আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। সারারাত উন্মাদের মতো নাচানাচি আর ড্রিংস করার পর ভোরের দিকে আমরা সেখান থেকে বের হই। আর তখন সেই রাস্তায় রাইমা ও ছিল। হয়তো সেই পথেই কোথাও যাচ্ছিল। নেশাগ্রস্ত থাকায় তখন একা রাস্তায় একটা মেয়েকে দেখে আমি টিচ করে বসি। আর রাইমা তখন রেগে যায় আর রেগে গিয়ে সে আমাকে চড় মেরে বসে। সেই চড়টাই আমার মস্তিষ্ককে পুরোপুরি বিগড়ে দেয়। আর তখন আমি রাগের বসে..(থেমে একটু দম নেয়)..রাগের বসে ওকে আমি র-রে’প করে বসি। আর এই কথাটা ও কাউকে বলেনি। ওর মা বাবা কষ্ট পাবে বলে নিজের মনেই সবটা চেপে রেখেছিল। ম-মা ত-তোমার ছেলে একজন ধর্ষক। এবার তুমি তোমার ছেলেকে শাস্তি দাও মা, খুব কঠিন শাস্তি দাও।’

অরিকের কন্ঠ থেমে যায়। আর পারছে না সে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। তার গালের উপর উষ্ণ কিছুর স্পর্শ পেতেই সে অনুভব করে সে কাঁদছে।
.

পুরো বাড়ি জুড়ে পিনপতন নিরবতা কাজ করছে। প্রত্যেকটা মানুষ যেন নিষ্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। রাইমা তখন তার মা বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেজা গলায় বলে উঠে,

‘মা বাবা, তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। সেদিন পারিনি আমি তোমাদের কিছু বলতে। মনে হচ্ছিল তোমরা সহ্য করতে পারবে না। কিন্ত কতদিন আর লুকিয়ে রাখতাম বলো? আর যে পারছিলাম না। তাই আজ উনাকে দিয়েই উনার অন্যায়টা সবার মাঝে আনি। সেদিনের রাতটা আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক রাত ছিল। আগের দিন ভার্সিটি বন্ধ দেওয়ায় ভেবেছিলাম কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসে সবাইকে সারপ্রাইজ দিব। তাই রাতের ট্রেনেই বেরিয়ে যাই। আর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাতের শেষ প্রহর এসে পড়ে। চারদিকে যখন নতুন এক দিনের সূচনা ঘটছিল। অন্ধকারের পর যখন আবারও পৃথিবী নতুন আলোতে সাজতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক সেসময় আমার জীবনের আলোটা নিভে যায়। আমার দিনটা অন্ধকারে ঢেকে যায়। আমি কখনও ভাবিও নি মা বাবাকে সারপ্রাইজ দিতে এসে আমার জীবনেও এত বড়ো সারপ্রাইজ ঘটে যাবে। আমি ঐ রাতটা কখনও ভুলতে পারবো না। তবে তোমাদের জন্য জীবনের ঐ কালো অধ্যায়টাকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে পারবো। এবার তোমরাই সিদ্ধান্ত নাও, আমার এখন কি করা উচিত?’

নিস্তব্ধতার বুক চিরে রাইমার মায়ের গগন বিদারী কান্নার শব্দ শোনা গেল। সেই কান্নার তীক্ষ্ণ সুর সকলের হৃদয়কে যেন খান খান করে দিচ্ছে। রাইমা এবার আর মাকে আটকাল না। মায়ের সাথে সেও চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় যে ছিল সে। কবে সে একটু মন খুলে কাঁদতে পারবে। কবে তার মায়ের বুকে মাথা রেখে তার কষ্ট লাগব করতে পারবে। এবার শান্তি পাচ্ছে সে। ভীষণ শান্তি।
.
.
রাইমার পরিবারের সবার চোখ থেকেই সমান তালে জল পড়ছে। তারা যেন এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু। এত কিছু হয়ে গেল এই মেয়েটার সাথে অথচ তারা কেউ কিছু বুঝলো না? নিজেদের বোকামীতে নিজেরাই এখন মাথা চাপড়াচ্ছে। রাইমা মামা চাচারা রেগে গিয়ে অরিককে মারতে পর্যন্ত গিয়েছিলেন কিন্তু রাইমা বাঁধা দেওয়ায় আর পারেননি। অরিক এখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঐদিকে লিমা সোবহান কাঁপা কাঁপা হাতে তার ফোনটা হাতে নিলেন। তারপর কার একটা নাম্বারে কল করে বললেন,

‘আমার ছেলে একজন ধর্ষক। আপনারা এসে তাকে গ্রেফতার করুন। আমি আমার ছেলেসহ ”” এই জায়গায় আছি। আপনারা প্লীজ চলে আসুন।’

সবার আর বুঝতে বাকি ছিল না তিনি কাকে কল দিয়েছেন। সকলেই এবার শান্ত হয়। অরিকের মা বোন নিরব হয়ে বসে আছে। তারা আজ থেকে এক ধর্ষকের মা আর বোন। কথাটা ভাবতেই কলিজা কেঁপে উঠল তাদের। তাও একটা টু শব্দ করলো না কেউ। অরিক এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলল। তার মনে হলো সে আর তার এই মুখ কোনোদিন মাকে দেখাতে পারবে না।

পুলিশ এল। তদন্ত করলো অনেক। অরিক আবারও তার সব দোষ স্বীকার করলো। মায়ের সামনে তার ছেলেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো। ছেলের বিয়েতে এসেছিল এক বুক আনন্দ নিয়ে সেই আনন্দ এখন বিষাদে পরিণত হয়েছে তার। তিনি এখন বাড়ি ফিরে যাবেন তবে শূন্য বুকে। একজন ধর্ষকের মায়ের তো এটাই প্রাপ্য।
যাওয়ার আগে রাইমার পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন। আর তারাও তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।
.
.
অরিক বর্তমানে জেলে। রাইমার বলা শেষ কথাগুলো এখনও তার মস্তিষ্কে বিচরণ করে,

‘কি পরিমাণ কষ্ট পেলে একজন মা তার ছেলেকে নিজে পুলিশের হাতে তুলে দেয় জানেন? হয়তো জানেন না। কিন্তু আজ থেকে জানবেন। আমি আপনাকে চাইলেই ক্ষমা করে দিতে পারতাম। কিন্তু আমার বিবেক আমাকে সেটা করতে দেয়নি। তাই আমি বাধ্য হয়েছি এত কিছু করতে। পারলে আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আর আমি আশা আল্লাহও আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন হয়তো। আর হ্যাঁ একটা কথা, আপনাকে আমি কোনদিন ভুলবো না। আমার এই তেইশ বছরের জীবনে আপনি আমার এক চির স্মরণীয় অধ্যায়, সরি কালো অধ্যায়। যে অধ্যায়কে আমি আমার জীবন থেকে কখনোই মুছে ফেলতে পারবো না, কখনোই না।’

“সমাপ্ত”

নিষিদ্ধ প্রেম পর্ব-০৯

0

#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৯|
~
চোখের ভারি পল্লবগুলো মেলে ধরতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরটা যেন অবশ লাগছে। হাত পা নাড়াতে পারছে না। মাথায় চিন চিন ব্যথা করছে। চোখগুলো যখন খুব কষ্টে একটু মেলল, রাইমার কাছে তখন মনে হলো চারপাশটা যেন সাদা ধোঁয়ায় পরিপূর্ণ। কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে। শরীরটা ভার হয়ে আছে। কষ্ট করে আস্তে আস্তে তাকানোর চেষ্টা করলো রাইমা। প্রথমেই বুঝে উঠতে পারলো না সে কোথায় আছে। আবছা চোখের দৃষ্টি পাশে অরিকের উপর পড়তেই তার মস্তিষ্ক যেন জেগে উঠল। একটু নড়ল। ব্রু কুঁচকাল। নিজেকে অরিকের গাড়িতে আবিষ্কার করে চমকে গেল সে। গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না। তাও কষ্ট করে সে বলে উঠল,

‘আ-আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’

রাইমার কন্ঠ শুনে অরিক তার দিকে তাকাল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‘যাক জ্ঞান ফিরেছে তাহলে।’

রাইমা জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। বুঝে উঠতে পারছে না কিছু। পেছনে তাকিয়ে দেখল নিরবও আছে। এবার সে অনেকটা অস্থির হয়ে উঠল। ক্ষিপ্ত কন্ঠে দম নিয়ে বললো,

‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? আবার আমার সাথে কি করতে চাইছেন? গাড়ি থামান বলছি। প্লীজ, গাড়ি থামান। আমি আপনাদের সাথে কোথাও যাব না। গাড়ি থামান..’

রাইমা অনেক বেশি অস্থির হয়ে উঠল। গাড়ির দরজা ধরে টানাটানি করতে লাগল। অরিক এক হাতে তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করে বললো,

‘শান্ত হোন রাইমা। আমরা আপনাকে নিয়ে আপনার বাসায় যাচ্ছি। অন্য কোথাও আমরা যাচ্ছি না। দেখুন এটা আপনার বাসার রাস্তা।’

রাইমা এবার খেয়াল করলো। হ্যাঁ, এই রাস্তাটা পরিচিত তার। তাও সে ঠিক শান্ত হতে পারলো না। নিজের হাত থেকে এক ঝটকায় অরিকের হাতটা সরিয়ে দিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললো,

‘তারমানে এতক্ষণ আমি আপনাদের কাছে ছিলাম। কই আমার তো কিছু মনে পড়ছে না। আমার তো মনে আছে আমি আমার বাগানে ছিলাম হঠাৎ..হঠাৎ তখন কেউ একজন পেছন থেকে আমার মুখে কিছু একটা চেপে ধরে। আর তারপরই আস্তে আস্তে আমার শরীর অবশ হয়ে যায়। তার মানে এসব আপনার কাজ? আমাকে অজ্ঞান করে আবার আপনারা আমার সাথে খারাপ কিছু করেছেন। কেন? কেন আপনারা আমার সাথে এমন করছেন? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের? কেন করছেন আমার সাথে এমন?’

রাইমা কাঁদতে আরাম্ভ করে। অরিক আর না পেরে গাড়িটা রাস্তার এক পাশে দাঁড় করায়। গাড়ি থেমে যেতে দেখে রাইমা দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যেতে চায়। কিন্তু অরিকের জন্য পারে না। অরিক রাইমার দুই বাহু চেপে ধরে তাকে তার দিকে ঘুরিয়ে নেয়। তারপর সে রাইমার চোখের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলে,

‘আমাদের ভুল বুঝছেন রাইমা। আপনার সাথে খারাপ কিছু হয়নি। বিশ্বাস করুন, আপনি এখন একদম ঠিক আছেন। আর হ্যাঁ এটা সত্যি যে, এসব কিছু নিরব করেছিল। ও চেয়েছিল আপনার সাথে যেন আমার বিয়েটা না হয়। আমার বন্ধু তাই আমাকে বাঁচাতে এসব করেছে। কিন্তু আমার বুঝানোর পর ও বুঝেছে। ওর কোনো দোষ নেই রাইমা। যা দোষ সব আমার। আমি আপনাকে রেপ করেছি। আপনাকে মানসিক কষ্ট দিয়েছি। তার জন্য শাস্তি দিতে হলে আমাকে দিবেন। কিন্তু প্লীজ ওকে ক্ষমা করে দিন। আমার জন্য ও ফেঁসেছে। সেদিন ও আমাকে অনেক বাঁধা দিয়েছিল, কিন্তু আমি শুনিনি। সব দোষ আমার রাইমা। প্লীজ, আপনি ওর উপর আমার দায়ভার চাপাবেন না। ও সত্যিই নির্দোষ।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা কাঁপছিল অরিকের। সে তখন রাইমাকে ছেড়ে দিয়ে তার সিটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজলো। রাইমা নিষ্প্রভ তাকিয়ে রইল তার দিকে। পেছনে নিরবও স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সে বুঝতে পারছে তার বন্ধু এখন তার ভুলের জন্য অনেক বেশি পস্তাচ্ছে। কিন্তু, সময় থাকতে তো আর সে বুঝল না।
.
পিনপতন নিরবতা কাটিয়ে অরিকের নির্লিপ্ত কন্ঠটা বেজে উঠল। সে ঘাড় কাত করে রাইমার দিকে তাকাল। ক্ষীণ সুরে বললো,

‘আমি জানি না রাইমা আপনি আমাকে কেন বিয়ে করতে চাইছেন? তবে এইটুকু জানি এই বিয়েটা আর পাঁচটা বিয়ের মতো স্বাভাবিক না। বিয়ের পরও হয়তো আপনি আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন না। হয়তো স্বামী হিসেবে মেনেই নিবেন না কোনো দিন। (একটু থেমে) আমার ভুলের জন্য আমি এখন ভীষণ ভাবে অনুতপ্ত। আমি জানি আপনি সেটা বিশ্বাস করবেন না। আজকে আমি আপনার মা বাবাকে দেখে উপলব্ধি করতে পেরেছি যে আমি কত বড়ো ভুল করেছি। ঐ মানুষগুলো আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসে। রাইমা…রাইমা এখন আমার মনে হচ্ছে আমার লাইফের সবথেকে খারাপ সময় আজকের দিনটা। আমি এতদিন আপনাকে সহ্য করতে পারতাম না কিন্তু আজ আপনাকে না পেয়ে আমার নিজেরই খুব অস্থির লাগছিল। বার বার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। আমার জন্য আপনি কষ্ট পেয়েছেন, আপনার পুরো পরিবার কষ্ট পেয়েছে। আমি আমার অন্যায় স্বীকার করে নিচ্ছি। আপনি বলেছিলেন, আমাকে এত সহজে পুলিশে দিবেন না। খুব কষ্ট দিবেন আমায়। আমি আপনার সেই কষ্ট মাথা পেতে নিতে রাজি আছি। আপনার যা ইচ্ছে আমার সাথে তাই করতে পারেন। যত শাস্তি দেওয়ার দিতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে শুধু একটাই চাওয়া, এসবের মধ্যে নিরবকে আনবেন না। আর বাড়িতে গিয়ে প্লীজ কাউকে বলবেন না যে নিরব আপনাকে কিডন্যাপ করেছিল। এটা আপনার কাছে আমার অনুরোধ, প্লীজ রাইমা!’

অরিকের চোখগুলো ছলছল করছে। রাইমা তার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল। সে কিছু বুঝতে পারছে না সে কি বলবে? কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় সেটা এই মুহুর্তে তার মাথায় কাজ করছে না। কি করবে সে ক্ষমা করে দিবে? ক্ষমা করা যায় এদের? যদি আবার একই কাজ করে বসে। যদি ভুলে যায় এসব? তখন, তখন কি করবে সে?

রাইমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করে। সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে সিটে হেলান দিয়ে বসে। ক্লান্ত কন্ঠে বলে,

‘আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে। আমাকে বাসায় নিয়ে চলুন প্লীজ!’

অরিক আর কিছু বললো না। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার তাদের গন্তব্যের পথে রওনা দিল।
.
.
রাইমাকে ধরে আস্তে আস্তে বাসার ভেতর নিয়ে গেল অরিক। তাকে দেখা মাত্রই বাড়ির সবাই ছুটে এল তার কাছে। তার মা বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। চোখে মুখে তার অনেক চুমু খেল। যেন তারা আবার তাদের প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। রাইমার মা এখনও কেঁদে চলছে। রাইমা তাই তার মায়ের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললো,

‘আমি তো এসে গেছি মা, তাহলে এখনো কেন কাঁদছো?’

তার কথায় তার মা কোনো জবাব দিলেন না। মেয়েকে কেবল বুকে জড়িয়ে ধরে রইলেন।
.

পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর পরই রাইমাকে সবাই প্রশ্ন করতে লাগল, সে কোথায় ছিল? কেন বাইরে গিয়েছিল? আর অরিক তাকে কোথায় পেয়েছে? আর কত কত প্রশ্ন। অরিকের মেজাজ বিগড়ে গেল সবার এত এত প্রশ্ন শুনে। সে রেগে গিয়ে বললো,

‘ও কোনো ছেলের হাত ধরে পালায়নি যে আপনারা ওকে এসব প্রশ্ন করবেন। ওকে কি..’

অরিক কথাটা শেষ করার আগেই রাইমা মাঝপথে বলে উঠে,

‘আমাকে কারা যেন কিডন্যাপ করেছিল বাবা। কিন্তু আমি তাদের কাউকে চিনি না। হয়তো কেউ এই বিয়েটা ভাঙতে চেয়েছিল। তাই সেই ব্যক্তি আমাকে কিডন্যাপ করার পর আবার অরিককে ফোন করে আমার নামে অনেক উল্টা পাল্টা কথা বলে। কিন্তু উনি এসব বিশ্বাস না করে উল্টো সেই নাম্বারের লোকেশন ট্র্যাক করে আমার কাছ অবধি পৌঁছে যান। তারপর উনি ওদের পুলিশের ভয় টয় দেখিয়ে আমাকে ওদের কাছ থেকে নিয়ে আসতে সফল হোন। আমার তখনও জ্ঞান ছিল না। মাঝ রাস্তায় জ্ঞান ফেরার পর উনি আমাকে সবকিছু বলেন।’

এতসব মিথ্যে বলে রাইমা নিশ্চুপ হয়ে যায়। তার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে এক নাগাড়ে এত মিথ্যে বলে ফেলেছে, তাও আবার এই মানুষগুলো জন্য। অরিক নিরব দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেল রাইমার কথা শুনে। এদিকে সবাই আবার অনেক উত্তেজিত হয়ে পড়ল এসব কথা শুনে। রাইমার বাবা অরিককে জিগ্যেস করলো,

‘বাবা, ঐ লোকটা কে ছিল? ও কেন আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করেছে, কিছু বলেছে তোমাকে?’

অরিক ইতস্তত কন্ঠে বললো,

‘না আংকেল, আসলে ওর সাথে এত কথা আমরা বলেনি। আমি আর নিরব গিয়েছিলাম। গিয়েই আমাদের মধ্যে ছোট খাটো মারামারি লেগে গিয়েছিল। কিন্তু ও একা থাকায় আর পারেনি আর কি। তাই পালিয়ে যায়। আমরা তখন রাইমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়াই আর ওর কথা মনে ছিল না।’

রাইমা বাঁকা চোখে অরিকের দিকে তাকায়। অরিক অপ্রস্তুত হয় পড়ে তাতে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। আর রাইমা তখন মনে মনে বলে,

‘একটু সুযোগ দিয়েছি বলে নিজেকে এখন হিরো বানিয়ে ফেলছে।’
.
.
এত এত ঝামেলা শেষে এবার কিছুটা শান্ত হলো সবাই। দুই পরিবারের মধ্যে আবারও কথোপকথন হলো। এবং তারা আবারও হাসিমুখে বিয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু রাইমা হঠাৎ বলে উঠল,

‘আমার অরিকের সাথে কিছু কথা বলার আছে। তারপর আমরা এই ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাব।’
.
.
চলবে..

নিষিদ্ধ প্রেম পর্ব-০৮

0

#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৮|
~
নিরবের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে অরিক বেশ খানিকটা অবাক হলো। এই জায়াগাটায় এর আগে কখনও আসেনি সে। মেইন শহর থেকে অনেকটা ভেতরে। গাড়ি নিয়ে আসতে অনেকটা সময় লেগেছে। চারপাশে আর তেমন কোনো বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে না। রাস্তাঘাটও বেশ শুনশান।

গাড়ি থেকে নেমেই অরিক নিরবকে কল করলো।

‘কিরে চলে এসেছিস?’

‘হ্যাঁ, কোথায় তুই?’

‘তুই যেখানে থেমেছিস, সেখানে থেকে ডানে একটা রাস্তা গিয়েছে দেখ। সেই রাস্তা দিয়ে কিছুটা পথ আগালেই একটা পুরাতন ভাঙা বিল্ডিং দেখতে পাবি, আমি সেখানেই আছি। চলে আয়।’

‘ঠিক আছে, রাখ। আমি আসছি।’

অরিক কলটা কেটে দিয়ে নিরবের বলা পথে চলতে লাগল। ডানের রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা হাঁটার পর সে সেই বিল্ডিংটা দেখতে পেল। ভেতরে ঢুকল সে। ডান বামে দুটো করে রুম। আর মাঝখান দিয়ে একটা সিড়ি উপরে উঠে গিয়েছে। অরিক এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখল কেউ নেই। সে এবার নিরবের নাম ধরে ডাকল,,

‘নিরব, নিরব! কোথায় তুই?’

নিরব বেরিয়ে এল। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার বিশ্ব জয়ের হাসি। তাকে দেখা মাত্রই অরিক কপাল কুঁচকাল। বিচলিত হয়ে বললো,

‘রাইমা কোথায়?’

নিরব বিদ্রুপের সুরে বললো,

‘বাবা অরিক, কি ব্যাপার বলতো? তুই তো দেখছি ঐ মেয়ের জন্য দেওয়ানা হয়ে উঠেছিস। দুদিন আগেও না তুই ওকে সহ্য করতে পারতি না। তাহলে হঠাৎ এত প্রেম!’

অরিক রেগে যায়। ধমকে উঠে বলে,

‘দেখ নিরব, এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে। আর রাগাস না আমাকে। রাইমা কই সেটা বল? আর তুই ওকে এখানে কেন নিয়ে এসেছিস? আমি বলেছি তোকে এমন কিছু করতে? অতিরিক্ত পন্ডিতি না করলে হয় না, না?’

নিরব হতাশ হয়ে বললো,

‘যাহ বাবা! যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর। এই জন্যই কারোর ভালো করতে নেই। যাকগে সেসব তোর হবু বউ ঐ রুমে আছে। এখনও ড্রাগ পুষ করেনি। তুই যখন এসে গেছিস তখন তুই’ই কর।’

অরিক বাঁকা চোখে নিরবের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে ভেতরে চলে গেল। রুমে ঢুকেই চমকে গেল সে। রাইমাকে চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার মাথা ঝুঁকে আছে নিচের দিকে। বড়ো বড়ো চুলগুলো সব মুখের সামনে পড়ে আছে। কোনরূপ নড়া চড়া করছে না। তবে কি ওর জ্ঞান নেই?

অরিক ছুটে গেল তার কাছে। দুহাত দিয়ে রাইমার মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে মুখটা উপরে তুললো। চোখ বুজা। তার মানে সত্যিই জ্ঞান নেই ওর। অরিক রাগে নিরবের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘এই তুই কি করেছিস ওর সাথে? ওর জ্ঞান নেই কেন?’

‘আরে ব্রো চিল। আনার সময় রুমাল চেপে সেন্সল্যাস করেছিলাম। তাই এখনও ওর জ্ঞান ফেরেনি। এতে করে ভালোই হয়েছে। জ্ঞান থাকলে কি আর ওকে এভাবে আটকে রাখা যেত? যে মেয়ে, বাবা রে বাবা!’

অরিকের রাগটা যেন আরো বেড়ে গেল। সে জোরে চেঁচিয়ে উঠল,

‘তোকে বলেছি আমি এত কিছু করতে? শালা, সব সময় অতিরিক্ত করিস। ঐদিকে ওর মা বাবার কি অবস্থা জানিস? এখন ওর জ্ঞান ফিরবে কখন কে জানে?’

অরিকের এহেন ব্যবহার নিরবের মোটেও ভালো লাগেনি। সে তো ভেবেছিল তার এই কাজে অরিক খুব খুশি হবে, কারণ সে তো চেয়েছিল’ই বিয়েটা না করার জন্য। তাহলে এখন আবার এভাবে রিয়েক্ট করছে কেন? নিরব কিছুক্ষণ বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সে তার পকেট থেকে একটা ইনজেকশন বের করে অরিকের কাছে গিয়ে বললো,

‘নে দোস্ত, এটা ওর শরীরে পুষ কর। মাইয়াটা মরে গেলেই শান্তি। তোর আর আমার দুজনের বিপদ’ই শেষ।’

‘ব*ল শেষ হবে। এমনিতেই এক ঝামেলায় ফেঁসে আছি। তুমি এখন আসছো আরেক ঝামেলা লাগাতে। এতদিন ছিলাম ধর্ষক এখন আবার খুনি হবো। শালা, যা ভাগ এখান থেকে।’

অরিক ক্রোধ নিয়ে কথাগুলো বললো। নিরব কিছুটা রাগি গলায় বললো,

‘আরে তুই বুঝতে পারছিস না কেন? এই মেয়ে বেঁচে থাকলেও আমাদের মরতে হবে। তোর কি মনে হয় এই মেয়ে আমাদের ফাঁসিতে না ঝুলিয়ে ছাড়বে, জীবনেও ছাড়বে না। তাই সময় থাকতে মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করে ফেল। আর তুই যদি না পারিস সর তবে, আমিই ওকে ইনজেকশন টা দিয়ে দিচ্ছি।’

নিরব এগিয়ে আসতেই অরিক তার থেকে থেকে টান মেরে ইনজেকশন টা নিয়ে দূরে ছুড়ে মারে। নিরব এতে খুব রেগে যায়,,

‘কি করলি তুই এটা? তুই জানিস ঐ ড্রাগটার দাম কত?’

‘না জানি না। আর জানতেও চাই না। আমি না করার পরেও তুই কোন সাহসে ওকে ইনজেকশন দিতে যাচ্ছিলি? আমি না করেছি মানে না। খবরদার আমার কথার উপরে যাবি তো।’

অরিকের কথায় নিরব এবার অনেক বেশি ক্ষেপে গেল। কড়া গলায় বললো,

‘হ্যাঁ, সবসময় আমাকেই তোর কথা শুনে চলতে হবে। আর তুই জীবনেও আমার কথা শুনবি না। সেদিন আমি না করেছিলাম না এই মেয়েটার সাথে এমন করিস না। সেদিনও তুই আমার কথা শুনিস নি। তোর যা মন চেয়েছে তুই তাই করেছিস। আর তোর ভুলে আজ আমিও ফেঁসে গেছি। এখন আমাকেও তোর পাপের ভার নিতে হবে। কেন, সবসময় আমি কেন তোর কথা শুনবো? তুই তো আমার কথা কোনোদিন শুনিস না। তাই আমিও তোর কথা শুনবো না। এই মেয়ে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবে না। আমি তোর জন্য ফাঁসতে পারবো না। আমি ওকে মেরেই ছাড়ব।’

এই বলে নিরব এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে পড়ে থাকা একটা বিশাল ইটের টুকরা নিয়ে ছুটে এল রাইমার মাথায় আঘাত করবে বলে। কিন্তু সে আঘাত করার আগেই অরিক তাকে ধরে ফেলে। হাত থেকে ইট’টা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। তার বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠে। চিৎকার দিয়ে উঠে সে। বলে,

‘কি করছিলি তুই? পাগল হয়ে গিয়েছিস? কেন এসব করছিস? তোর সাথে কিছু হবে না। অন্যায় করেছি আমি, শাস্তি পেলে আমি পাবো। তুই কেন এত ভয় পাচ্ছিস? আমি তোর কিছু হতে দিব না। কিন্তু তাই বলে তুই এখন এইভাবে মেয়েটাকে মারতে চাইছিস? এই ইট দিয়ে আঘাত করলে কি হতো বুঝতে পারছিস?’

‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি। আর বুঝতে পারছি বলেই এমনটা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুই আমাকে কেন আটকাচ্ছিস? তুই কি ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস নাকি? বল আমায়? ইতিমধ্যেই এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলি?’

তপ্ত কন্ঠে কথাগুলো বললো নিরব। অরিক নিজেও বুঝতে পারছে না তার কি হয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও যে মেয়েটাকে সে সহ্য করতে পারতো না এখন সেই মেয়েটার জন্যই তার মায়া হচ্ছে। আর এটা কেন হচ্ছে সেটা সে বুঝতে পারছে না। অরিক জিভ দিয়ে তার শুকনো ঠোঁট জোড়া ভেজাল। তারপর নরম গলায় বললো,

‘না, আমি ওর প্রেমে পড়েনি। কিছুক্ষণ আগে আমিও ওর খারাপ চেয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস কর, ওর নিখোঁজ হওয়ার খবরটা ওর মা বাবার কানে যাওয়ার পর থেকেই উনারা খুব ভেঙে পড়েছেন। উনাদের অবস্থা দেখে আমার নিজেরই খুব মায়া লাগছিল। রাইমার আম্মু হাউ মাউ করে কাঁদছিলেন। আশে পাশের মানুষগুলো যায় নয় তাই বলেছেন। এতকিছুর মাঝে থেকে আমার বারবার তখন মনে পড়ছিল আজ যদি রাইমার জায়গায় নিরা থাকতো। তবে আমার আর মায়ের অবস্থাটাও ঠিক এরকম হতো। আমি জানি ও বেঁচে থাকলে আমার’ই ক্ষতি। কিন্তু ও মারা গেলে ওর পুরো পরিবারে ক্ষতি। ওকে ছাড়া ওর পরিবার নিঃস্ব। যেমন আমরা আমাদের নিরাকে ছাড়া। তাই আমি এখন পারছি না রে। নিজের একটা ভুলকে ঢাকতে এখন আমি একসাথে এতগুলো প্রাণ নিতে পারবো না। প্লীজ দোস্ত ছেড়ে দে মেয়েটাকে। আমি তোকে প্রমিস করছি, তোর কিছু হবে না। আমি আমার ঘাড়ে সব দোষ তুলে নিব। আর রাইমাকেও আমি বুঝাবো। কিন্তু এখন আপাতত তুই একটু বোঝ, প্লীজ!’

অনেক বোঝানোর পর নিরব বুঝলো। মনের ভেতর বিশাল ক্রোধ নিয়েই সে রাইমার বাঁধন খুলে দিল। মেয়েটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আর কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে অরিক তাকে কোলে তুলে নিল। তারপর আস্তে করে গাড়িতে গিয়ে বসাল। গাড়ির ভেতরে থাকা একটা পানির বোতল থেকে কিছুটা পানি নিয়ে তার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। তারপর সে গিয়ে বসলো ড্রাইভিং সিটে। নিরবকেও অনেক বুঝিয়ে তাদের সাথে নিল। সে গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখল তার মা কল দিচ্ছে। কলটা রিসিভ করলো সে।

তার মা তখন উৎকণ্ঠা নিয়ে বললো,

‘তুমি আবার কোথায় গিয়েছ অরিক? তোমাকে না পেয়ে তো এখানে সবার টেনশন আরো বেড়েছে।’

সে মৃদু হেসে বললো,

‘আর টেনশন করতে হবে না মা। সবাই কে বলে দাও রাইমাকে পাওয়া গিয়েছে। ও এখন আমার সাথেই আছে। আমরা বাসায় আসছি।’
.
.
চলবে..