#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৭|
~
একটু আড়াল হয়ে অরিক কাউকে একটা কল লাগাল। কলটা রিসিভ হতেই সে বললো,
‘মেয়েটাকে কোথায় রেখেছিস?’
ওপাশের ব্যক্তিটি তখন অবাক কন্ঠে জবাব দিল,
‘ভাই, আমরা তো এখনও ঐ মেয়েকে কিডন্যাপ করতে পারেনি। বাড়ির পেছন দিকটায় আমরা আছি। সুযোগ বুঝে কাজটা হয়ে যাবে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’
টনক নড়ল অরিকের। তার লোকেরা যদি রাইমাকে কিডন্যাপ না করে থাকে তাহলে ঐ মেয়ে কোথায় গেল? অরিক চিন্তিত গলায় বললো,
‘আচ্ছা এক কাজ কর, তোরা আপাতত এখান থেকে চলে যা। প্রয়োজন পড়লে আবার ডাকব তোদের।’
‘ঠিক আছে ভাই।’
কলটা কাটল অরিক। এবার চিন্তার কালো মেঘ তার মনেও হানা দিল। সে বাড়ির ভেতর গিয়ে খেয়াল করলো সবার চোখ মুখ থমথমে। যেন কেউই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না। অরিক শুকনো ঢোক গিলল। রাইমার বাবা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন রুমের এক কোণে। যাকে এটা ওটা বলে ভরসা দিচ্ছে তার ছোট ভাই’রা। অরিক গিয়ে সেখানে বসলো। মৃদু সুরে জিগ্যেস করলো,
‘রাইমা ঠিক কখন থেকে নিখোঁজ হয়েছে? আপনারা কিছু জানেন?’
সেখানে থাকা রাইমার ছোট মামা জবাবে বললো,
‘প্রায় ঘন্টা দেড় এক আগে। মেয়েটা বাইরে ছিল, আসলে মন খারাপ ছিল তো তাই তার বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। এতটুকু পর্যন্ত ওর কাজিনরা দেখেছে। তারপর হঠাৎ করে আমার মেয়ে ওকে রেডি করানোর জন্য ডাকতে এসে দেখে বাগানের কোথাও ও নেই। ইনফ্যাক্ট পুরো বাড়ির কোত্থাও নেই। ফোনটা তার রুমে পড়ে আছে। এই যে দুই ঘন্টা হতে চললো তাও তো ওর কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘ওর কোনো ফ্রেন্ড বাসায় খবর নিয়েছেন? যদি ওদের কারোর বাসায় যেয়ে থাকে।’
‘চেনা পরিচিত সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে কোথাও নেই।’
অরিকের মুখটা চুপসে গেল। অবচেতন হয়ে পড়ে থাকা রাইমার বাবার মুখ থেকে এবার কিছু আওয়াজ বেরুল। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
‘আ-আমার মেয়েটাকে সবাই খারাপ বলছে। বলছে যে ও নাকি কোন ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমি তো চিনি আমার মেয়েকে, আমার মেয়ে কখনো এমন কোনো কাজ করতে পারে না যেটাতে তার মা বাবার অসম্মান হবে। নিশ্চয়ই আমার মেয়ের সাথে কোনো অন্যায় হয়েছে। না হলে আমার মেয়ে কখনোই এমনটা করতে পারে না।’
এই বলে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। অরিক বিধ্বস্ত নয়নে চেয়ে রইল মানুষটার দিকে। মেয়েকে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেন পাগলপ্রায় অবস্থা হয়েছে তার। একটু আগেও রাইমার নিখোঁজ হওয়ার খবরটা শুনে ভীষণ খুশি হলেও এখন তার আর ভালো লাগছে না। অন্য সবার মতো তার মনও দুশ্চিন্তায় ভরে গেল। কোথায় গেল মেয়েটা? এমনটা তো নয় যে তাকে বিয়ে করবে বলে পালিয়ে গিয়েছে, সেই তো চেয়েছে বিয়েটা করার জন্য, তাহলে? এখানে কি তৃতীয় কারোর হাত আছে? অরিক ভাবতে থাকে।
রাইমার বাবা এবার ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেন। যার জন্য উনার শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। সবাই মিলে হাজার বুঝালে তিনি বুঝছেন না। বারবার উঠে বাইরে চলে যেতে চাইছেন, মেয়ে নাকি নিজেই খুঁজে বের করবেন। কিন্তু এখন বাইরে গেলেই তার শরীরের আরো অবনতি ঘটবে, তাই বাকিরা তাকে আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু উনি শুনবেনই না। এসব দেখে অরিক উনার পাশে বসে উনার হাতদুটো জড়িয়ে ধরলো। রাইমার বাবা ভেজা চোখগুলো অরিকের মুখের উপর গিয়ে স্থির হলো। অরিক চাপা নিশ্বাস ফেলল। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বললো,
‘এত অস্থির হবেন না আংকেল। রাইমা ঠিক চলে আসবে। আমরা এতগুলো মানুষ আছি, সবাই মিলে খুঁজব ওকে। আপনি বলেছেন না, আপনার মেয়ে কোনো ভুল করতে পারে না; আমিও সেটাই বিশ্বাস করি। রাইমা কোনো ভুল করেনি তাই ওর সাথেও কোনো ভুল হবে না। শুধু আপনি একটু ধৈর্য্য ধরুন প্লীজ।’
অরিকের কথা শুনে এবার কিছুটা হলেও তিনি শান্ত হলেন। জবাব দিলেন না কোনো, দেয়ালটায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলেন কেবল।
.
অরিকদের সাথে তাদের কিছু আত্মীয় এসেছিল। তারা এখন এই নিয়ে খুব কানাঘুষা করছে। যার অধিকাংশ কথায় রাইমার বাবার কানে যাচ্ছে। বাকি সবাইও সেসব শুনছে কিন্তু বলতে পারছে না কিছু। কিন্তু এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার অরিক রেগে গেল যখন সে তার এক আত্মীয়ের মুখে শুনল যে,
‘আরে আজ কালকার মেয়ে না, এদের আবার বিয়ে টিয়ে নিয়ে এত চিন্তা আছে নাকি? এরা তো বিয়ের আগেই পোয়াতি হয়ে বসে থাকে। দেখ গিয়ে অ্যা ও নিশ্চয়ই এই কাজ করে বসেছে তাই এখন আর পথ না পেয়ে পালিয়েছে।’
অরিক চেঁচিয়ে উঠল। বললো,
‘বাজে কথা বলা বন্ধ করুন। এখানে থেকে ফালতু কথা না বলে চুপচাপ চলে যান। যদি বিয়ে হয়, তবে আপনার বাসায় একটা বিরিয়ানির প্যাকেট পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এখন আপনি আসতে পারেন।’
মহিলাটি বড়ো বড়ো চোখ করে তাকাল। অপমানে গা জ্বলে উঠল তার। অরিক এখনও দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলাটি ফুসতে ফুসতে অরিকের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘শেষ পর্যন্ত আবার একটা ঘর পালানো মেয়েকে ছেলের বউ করোনা যেন! হু’
ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। অরিক তখন বললো,
‘বাকি যারা উনার কথার সাথে তাল মেলাচ্ছিলেন উনারাও চলে যেতে পারেন। এখানে কোনো সার্কাস হচ্ছে না যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রং দেখবেন।’
কিছু মানুষ সত্যি সত্যিই বেরিয়ে গেল। আর এখন কেবল অরিকের পরিবারের ঘনিষ্ঠ কিছু লোকজনই রয়েছে।
অরিক তখন তার মায়ের কাছে গিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠে। তাকিয়ে দেখে নিরব কল করছে। কলটা কেটে দেয়ে সে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আবার কল চলে আসে। অরিক এবার বিরক্ত হয়ে বাইরে গেল তারপর তার কলটা রিসিভ করলো। সে কিছু বলার আগেই নিরব বলে উঠল,
‘কি রে দোস্ত, কেমন এনজয় করছিস? বউ ছাড়া বিয়ে!’
অরিক বুঝে উঠতে পারল না ঠিক। কপাল কুঁচকে বললো,
‘মানে?’
‘মানে হলো তোর বউ তো নেই সেখানে…সে তো এখন আমার কাছে।’
‘হুয়াট!’
জোরে চেঁচিয়ে উঠে অরিক। নিরব হাসতে হাসতে বলে,
‘আরে আস্তে। এবার বল কেমন দিলাম? শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আটকাতে পারলাম তো? এবার বল এই মেয়ের সাথে কি করা যায়? এই কয়দিন যা জ্বালিয়েছে না। ভাবছি আমার কাছে একটা মারাত্মক ড্রাগের ডোস আছে সেটাই পুষ করবো ওর শরীরে। আমি জানি ও সেটার রিয়েকশন সহ্য করতে পারবে না। হয় মরবে নয়তো আধমরা হয়ে বাকিটা জীবন কাটাতে হবে। ভালো হবে না বল? আমাদের আর তখন কোনো টেনশন থাকবে না।’
‘খবরদার নিরব, এসব কিচ্ছু করবি না তুই। আমার ব্যাপার আমি বুঝে নিতাম। তুই কোন সাহসে আমাকে কিছু না বলে ওকে কিডন্যাপ করলি? ওর গায়ে যেন এইটুকুও আঁচড় না লাগে। কোথায় আছিস বল আমি এক্ষুণি আসছি।’
নিরব হাসতে হাসতে বলে,
‘বাহ, প্রেম তো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে দেখছি।’
শক্ত গলায় অরিক বলে উঠে,
‘বাজে কথা না বলে জলদি ঠিকানা দে।’
নিরব ঠিকানাটা দিতেই অরিক কাউকে কিছু না বলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
.
.
চলবে..
#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৬|
~
ছিমছাম ভাবে হলুদের অনুষ্ঠানটা হয়ে গেল। দুইবাড়িতেই আহামরি কোনো আয়োজন নেই। বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হচ্ছে বিধায় বাইরের তেমন কাউকে আপাতত জানানো হয়নি। উদ্দেশ্য পরে বড়ো করে অনুষ্ঠান করা হবে। এখন কেবল আকদ করা হবে আরকি।
.
হলুদের শাড়িটা এখনও রাইমার গায়ে জড়ানো। গালে, গলায় এক গাদা হলুদ লেগে আছে তার। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কোমর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। শুষ্ক ঠোঁট জোড়া কাঁপছে খানিক। চোখ থেকে তার অনর্গল পানি পড়ে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে যে খুব। এইভাবে এসব কিছু তারও মানতে কষ্ট হচ্ছে। কোনোভাবেই ভুলে থাকতে পারছে না। মা বাবার হাসি মুখটার দিকে তাকালে যেন আরো কষ্ট হয় তার। বুকটা কেঁপে উঠে যখন মনে পড়ে এই হাসিটা আর বেশি দিন থাকবে না।
রাইমা অনেকক্ষণ কাঁদে। দরজা আটকে নিশ্চুপে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দেয়। এবার তার মাথা ব্যথা করছে। আর পারছে না। চোখ মুখ ভয়ানক ফুলে গেছে। নিজেকে আয়নায় দেখে ঘাবড়ে যায় সে। মা দেখলে নির্ঘাত বুঝে যাবে সে যে কেঁদেছে। তখন মাও কান্না জুড়ে দিবে। রাইমা তাই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুম থেকে গোসল সেরে বের হলো। ভালোভাবে চোখ মুখ মুছে মুখে অনেকটা পাউডার মাখলো যেন লাল লাল ভাবটা অতটাও বোঝা না যায়। চোখগুলো ভালোমতো বুঝে নিল। কিন্তু তাও মায়ের চোখ ফাঁকি দেয়া আর কি এত সহজ? রাইমা জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। মুখে মিথ্যে মিথ্যে একটা হাসির রেখা ফুটাল। তারপর দরজা খুলে বাইরে বের হলো সে। বাড়িতে অনেক বেশি মেহমান না এলেও মা আর বাবার বাড়ির মামা চাচারা এসেছে। আর তাদের সাথে এসেছে তাদের বিচ্ছুর দলগুলো। পুরো বাড়ি ঝমঝম করছে যেন তাদের কোলাহলে। সবার কত ব্যস্ততা। মা, চাচিরা রান্নাঘরে ব্যস্ত। মামিরা সব নানান রকম পিঠা বানাচ্ছে। বাবা কাকারা বসেছে জটিল সব হিসাব নিকাশে। পিচ্চিগুলো ছুটাছুটি করছে পুরো বাড়ি জুড়ে। রাইমার প্রিয় কিছু কাজিনও আছে। যারা এই মুহুর্তে মেহেদি পড়ায় ব্যস্ত। রাইমাকেও বলেছিল মেহেদি পরতে তবে সে তখন বারণ করে দিয়েছিল, বলেছিল পরে পরবে। সবার মধ্যে কত কত উত্তেজনা। অথচ তার মনে কোন অনুভূতি নেই। যেন আত্মাহীন এক জ্যান্ত শরীর কেবল চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাইমার খুব কষ্ট হচ্ছে এই মানুষগুলোকে দেখে, তাদের এত আগ্রহকে দেখে। মনে হচ্ছে ইশ, যদি আর পাঁচটা মেয়ের মত সেও তার বিয়েটাকে এনজয় করতে পারতো!
.
.
বাইরে মাগরিবের আযান হচ্ছে। দিনের আলো কেটে গিয়ে রাতের আধার তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে। আর এই রাত পেরুলেই অরিকের বিয়ে। অরিকের বাড়িতেও কোনো আয়োজনের কমতি নেই। লিমা সোবহান সৌখিন মানুষ। অনুষ্ঠানটা ছোট খাটো পরিসরের মধ্যে হলেও তিনি কোনো জিনিসের কমতি রাখেননি। কিছুক্ষণ আগেই মেয়ের বাড়িতে এক গাদা ঢালা পাঠিয়েছেন। এখন আবার নিরাকে বসিয়ে দিয়েছেন অরিকের হাতে মেহেদি দিয়ে দেওয়ার জন্য। এই নিয়ে অরিক মারাত্মক কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। সে কোনোমতেই মেহেদি দিবে না অন্যদিকে তার মা তাকে দেওয়াবেই। একটু হলেও মেহেদি তার হাতে ছোঁয়াতেই হবে। মেহেদি ছাড়া হলুদ সম্পন্ন হয় না, এটাই উনার দাবি। তাই হাজার ঝড় তুফান করেও অরিক বাঁচতে পারল না, শেষ পর্যন্ত তাকে তার মা’র কাছে হার মানতেই হলো।
নিরাকে কড়া গলায় সে বলে দিল কেবল একটুখানি মেহেদি দিতে, যদি বেশি হয়েছে তবে এই মেহেদি নাকি তার গালে মাখাবে সে। নিরাকে হুমকি ধুমকি দিয়ে সে চোয়াল শক্ত করে অন্যদিকে মুখ করে বসে রইল। বেশি সময় রাখল না দশ মিনিট পরই নিরা বললো,
‘ভাইয়া শেষ।’
অরিক ঘুরে তাকাতে তাকাতেই নিরা মেহেদি নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়ল। অরিক তার বাম হাতটার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাল। হাতের তালুতে ‘রাইমা’ নামটা দেখতেই যেন তার গায়ে আগুন জ্বলে উঠল। চিৎকার দিয়ে উঠল সে,
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে অরিক গিয়ে তার হাত ধুঁয়ে ফেলল। সাবান দিয়ে ঘষে ঘষে সেই নামটা উঠাতে চাইল। তাও পুরোপুরি উঠল না। হাতটা মুখের সামনে ধরে সে রাগি গলায় বললো,
‘উফফ, এই নামটাও দেখছি তার মালিকের মতো, আমার হাতে আঠার মতো লেগে গিয়েছে। শালা, কপালটাই খারাপ। হাজারটা ধ/র্ষ/ণ করেও যেখানে এই দেশে মানুষের কোন শা/স্তিই হচ্ছে না সেখানে একটা ধ/র্ষ/ণ করেই আমার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শা*লি একটা জিনিস আছে। একেবারে যেন দাবানল!’
কথাগুলো বলে বিরক্ত ভরা নিশ্বাস ফেলে সে নিজের রুমে চলে গেল। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিরবকে কল লাগাল। নিরব কল রিসিভ করতেই সে বললো,
‘কালকে কখন আসবি?’
নিরব মৃদু সুরে বলে,
‘সরি রে দোস্ত, কাল আসতে পারবো না।’
অরিকের রাগ হলেও সে কিছু বললো না। তপ্ত কন্ঠে বললো,
‘ঠিক আছে, রাখছি।’
কল কেটে দিল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো,
‘বিপদের সময় বন্ধুরাও স্বার্থপর হয়ে যায়।’
.
.
রাত অনেক গভীর হলো। চারদিকের হৈ চৈ নিভে গিয়ে এখন একদম নিস্তব্ধ। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে সবাই এখন তলিয়ে গেছে গভীর ঘুমে। ঘুম নেই কেবল দুই জোড়া চোখে। রাইমার ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি তার দক্ষিণের জানলার পর্দাগুলোর দিকে। মুক্ত স্বাধীন স্নিগ্ধ বাতাসে কি সুন্দর উড়ছে তারা। ইশ, সেও যদি তাদের মতো মুক্ত হতে পারতো! যদি পারতো এই অভিশাপের জীবন থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে!
অন্যদিকে বারান্দার কোণে দাঁড়িয়ে আরেক জোড়া চোখ আকাশ দেখতে ব্যস্ত। আগে কখনো সে এভাবে আকাশ দেখেনি। তবে আজ কেন? আজকের দিনটা কি অন্য দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন? হয়তো তাই! কাল তো আবার তার বিয়ে, জানে হবে না। তাও আপাত দৃষ্টিতে তো বলা যায়, কাল তার বিয়ে। তারও একটা বউ হবে। ‘বউ’ এই শব্দটা মাথায় আসতেই তার রাইমার কথা মনে পড়ে গেল। রাইমার শুকনো মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। হঠাৎ করেই কেন যেন তার মনে হলো, মেয়েটার সাথে সে খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে। আজ যদি এমনটা না হতো। এটা যদি একটা স্বাভাবিক বিয়ে হতো, তবে সে হাসি মুখে রাইমাকে মেনে নিত। মেয়েটা মায়াবী। বড়ো বড়ো চোখগুলোতে অসম্ভব মায়া আছে তার। কিন্তু এখন সেই মায়ার বদলে এই চোখ জোড়াতে দেখা যায় কেবল আক্রোশ। যেন উপছে পড়া আগুনের লাভা। কি ভয়ংকর সেই চাহনি! চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস নেই অরিক। না দুর্বল হলে চলবে না। তাহলে ঐ মেয়ে তাকে আরো পেয়ে বসবে। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। আগে থেকেই সব প্ল্যানিং করা, এবার শুধু কালকের দিনের অপেক্ষা।
________________________________________
বর যাত্রী কনের বাড়িতে পা রাখতেই শোনা গেল এক মারাত্মক ঘটনা। কনেকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। মিনিটে সে খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বরের আর বরণ হলো না। অরিকের বাড়ির লোকজনও যেন আকাশ থেকে পড়ল। রাইমার বাবা দুশ্চিন্তা আর ভয়ে একেবারে ভেঙে পড়লেন। রাইমার চাচা মামারা কোনোরকমে মেহমানদের ভেতরে আনলেন। বাড়ির মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেছে। ভেতরের রুম থেকে রাইমার মায়ের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। এদিকে বর পক্ষের মানুষজন সব হতভম্ব হয়ে বসে আছে। যেন এখনও তারা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তবে এই সব কিছুর মাঝেও যে খুব নিশ্চিন্ত সে হলো অরিক। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। যেন সে এই মুহূর্তটার জন্যই আগে থেকে অপেক্ষা করছিল।
.
.
চলবে..
#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৫|
~
দুই দিন পেরিয়ে গেল। পরদিন এক বিকেলে অরিক গেল কাছেরই একটা কফি শপে। রাইমাকেও সে সেখানে আসতে বলেছে। অরিক আগে আগেই পৌঁছে গেছিল। তাই সে কফি শপের এক কোণে সে গিয়ে বসল। হাতে ফোনটা নিয়ে দেখল চারটা পঁচিশ বাজে। সে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রায় পনেরো মিনিট পর সেখানে রাইমার আগমন ঘটে। অরিকের অগোছাল দৃষ্টি হঠাৎ রাইমার উপর পড়তেই সে যেন কিছুক্ষণের জন্য আটকে গেল। খেয়াল করে দেখল, মেয়েটা ভীষণ সুন্দর। আর তার সবথেকে সুন্দর জিনিসটা হলো তার চুল। একেবারে কোমর ছুঁয়েছে। বিনুনি বাঁধা চুলে যেন স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। রাইমা এসে চেয়ার টেনে বসতেই অরিক চোখ নামিয়ে ফেলল। নিজের আগের মুডে ফিরে গেল সে। গম্ভীর গম্ভীর চোখ মুখ করে রাইমার দিকে তাকাল। রাইমা তখন বিরস মুখে তাকে জিগ্যেস করলো,
‘কেন ডেকেছেন আমায়?’
‘বলছি।’
এইটুকু বলে অরিক প্রথমে একজন ওয়েটারকে ডেকে দুইটা কফি অর্ডার দিয়ে নিল। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার পর অরিক দুহাত টেবিলের উপর রেখে সোজা হয়ে বসল। চোখ বুজে একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর মিহি কন্ঠে বললো,
‘আমি সরি রাইমা। আমি জানি আমি খুব ভুল করেছি, জঘন্য ভুল করেছি। এই ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না। তাও আমি ক্ষমা চাইছি, মন থেকে চাইছি। প্লীজ রাইমা, প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি আর এত প্রেসার নিতে পারছি না। হ্যাঁ, আমি আপনাকে বিয়ে করবো। আর পাঁচটা মানুষের মতো আমরাও ছোট্ট একটা সংসার গড়ে তুলবো। আমি আপনাকে প্রমিস করছি, নিজের সবটুকু দিয়ে আমি চেষ্টা করবো আপনার সব কষ্ট দূর করে দেওয়ার জন্য। আপনি প্লীজ আমাকে একটা সুযোগ দিন, প্লীজ।’
অরিক থামল। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে তার। রাইমা অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল অরিকের দিকে। তার মধ্যে কোনো হেল দোল নেই। অরিক থমথমে কন্ঠে জিগ্যেস করলো,
‘আচ্ছা, আপনার তো বোন আছে। বোনকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসেন? যদি আজকে আপনার বোনের সাথে এমন কিছু হয়, যদি তার চরিত্রেও কেউ এইভাবে কালি মেখে দেয়; তবে আপনি কি করবেন? পারবেন সেই লোকটাকে ক্ষমা করে দিতে? নিজের মনকে একবার প্রশ্ন করে দেখুন তো সে কি বলে। যদি আপনার মন বলে হ্যাঁ আপনি ঐ ব্যাক্তিকে ক্ষমা করে দিতে পারবেন, তবে ঠিক আছে আমিও আপনাকে ক্ষমা করে দেব। এবার আপনিই বলুন, কি বলছে আপনার মন? পারবেন ক্ষমা করতে?’
অরিক তার কথার পিঠে আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। সে থম মেরে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। রাইমা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
‘পারবেন না তাই তো? কারণ ও তো আপনার বোন, আপনার পৃথিবী। নিজের বোনের বেলায় যেটা ভাবতে পারেন, সেটা অন্যের বোনের বেলায় কেন ভাবতে পারেন না বলুন তো? আমার হয়তো ভাই নেই তবে আমার তো মা বাবা আছে, ওদের কাছে আমি অক্সিজের। ওদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। জানেন আমার মা বাবা এখনও কিছুই জানেন না। জানলে বাঁচবে না। মরে যাবে। আপনি একবার ভাবুন তো আপনি কি করেছেন। শুধু একটা না তিন তিনটা প্রাণকে আপনি মেরে ফেলেছেন। একটা সুন্দর জীবন, সুন্দর পরিবারকে নষ্ট করে দিয়েছেন। জানেন আমি কিভাবে বেঁচে আছি? নিজের এই শরীরটা দেখলে কতটা ঘৃণা লাগে জানেন? ইচ্ছে করে নিজেকে নিজে শেষ করে দেই। কিন্তু পারি না, মা বাবার জন্য পারি না। আপনি এই কষ্ট কোনোদিনও বুঝবেন না। কারণ আপনি তো কোন মানুষ না, কেবল যৌন ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত এক প্রাণী। মন, মস্তিষ্ক, বিবেক কোনোটাই আপনার নেই।’
এইটুকু বলে রাইমা থামল। জোরে দম ফেলে আবারও সে বললো,
‘ক্ষমা করবেন আমাকে, আপনার মতো একটা মানুষকে আমি কখনো ক্ষমা করতে পারব না।’
কথাটা শেষ করেই রাইমা উঠে দাঁড়ায়। তারপর হনহন করে বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। অরিক স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। শেষের কথাগুলো খুব লেগেছে তার। এখন মনে হচ্ছে ক্ষমা চাওয়ারই উচিত হয়নি। নিরবের আইডিয়া শুনতে গিয়ে আবারও একবার অপমানিত হলো সে। রাগে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিল। কপালের রগ ফুলে উঠল তখন। এইভাবে অপমান আজ পর্যন্ত কেউ করেনি তাকে। মেয়েটা ইচ্ছে করেই এমন করছে। চাইলেই তাকে ক্ষমা করে দিতে পারতো। কিন্তু তা না করে সে ব্যাপারটাকে আরো জটিল করছে। সে ইচ্ছে করেই ঝামেলা পাকাতে চাইছে। তবে এবার অরিকও আর চুপ থাকবে না। সেও এবার দেখবে এই মেয়ে আর কি কি করতে পারে।
.
.
বিয়ের দিন ঘনিয়ে এল। দুই বাড়িতেই বিয়ের প্রস্তুতি চলে জড়সড় ভাবে। কিন্তু যাদের বিয়ে তাদের মাঝেই কোনরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। কোনরকমে যেন দিন পাড় করছে কেবল। মনের মধ্যে দুজনেরই চলছে মারাত্মক বিদ্বেষ। দুজনেই যেন কেবল সময়ের অপেক্ষায় অপেক্ষাকৃত। যত সময় গড়াবে সুন্দর মুহুর্তগুলো ততো তাড়াতাড়ি কেটে যাবে। তারপর আসবে সেই কুৎসিত মুহূর্তগুলো। যেই মুহূর্তগুলো কখনো কেউ ভুলতে পারবে না। মস্তিষ্কের স্মৃতির কৌটায় বিচ্ছিরি কিছু স্মৃতি হিসেবে সেগুলো জমা থাকবে আজীবন।
.
.
হলুদ শেষে ছাদ থেকে নেমে এল অরিক। রুমে এসে কাকে যেন একটা কল লাগাল। সেই কল রিসিভ হতেই সে উদ্বেগ নিয়ে বললো,
‘যা যা বলেছি সব মনে আছে তো? কোন গন্ডগোল যেন না হয়। নয়তো এক পয়সাও পাবি না।’
ঐ পাশের মানুষটি অরিককে আশ্বাস দিয়ে বললো,
‘কোন চিন্তা করবেন না ভাই। সময় মতো সব কিছু হয়ে যাবে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
এবার যেন কিছুটা হলেও প্রশান্তি পাচ্ছে অরিক। ফোনটা বিছানায় রেখে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হলুদে ভূত সেজে আছে। তখন সে গালের হলুদটা আলতো হাতে মুছতে মুছতে বললো,
‘বিয়ে করার খুব শখ তাই না? এবার বুঝবে তুমি ডেয়ার, কার সাথে পাঙ্গা নিতে এসেছো।’
কথাটা বলেই বাঁকা হাসল সে। তারপর একটা টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে..
#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৪|
~
রাইমা মিষ্টি হাসল অরিকদের দেখে। তবে সেই মিষ্টি হাসিটাও ক্যাকটাসের কাটার মত গিয়ে বিঁধল অরিক আর নিরবের বুকে। দুজনেই গম্ভীর গম্ভীর চোখ মুখ নিয়ে সেদিকে গেল। অরিকের বোন নিরা রাইমাকে পেয়ে খুব খুশি। আর লিমা সোবহানও খুশি হলেন ভীষণ। রাইমা আর তার মা’র সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সকলে ভেতরে গেলেন। অরিক আর নিরব পেছন পেছন হাঁটছে। পা যেন চলছে না তাদের। নিরব বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে কোনোরকমে পালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু অরিকের জন্য পারছে না।
তারা একটা বড়ো শাড়ির শো রুমে ঢুকে। একে একে শাড়ি দেখতে থাকে সকলে। তখনও অরিক আর নিরব অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকে। সেসময় নিরা তাদের কাছে আসে। বলে,
‘এই ভাইয়া, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঐদিকে এসো, ভাবির জন্য শাড়ি পছন্দ করে দিবে।’
অরিক কড়া গলায় জবাব দিল,
‘আমি কেন পছন্দ করবো? যার জন্য শাড়ি কিনবে সে তো নিজেই এসেছে। তাকে গিয়ে জিগ্যেস কর। আমাকে এসবের মধ্যে একদম টানবি না।’
নিরা বিরক্ত কন্ঠে বললো,
‘উফফ ভাইয়া, তুমি এমন কেন বলতো? একটু তো রোমান্টিক হতে পারো। নিজের হবু বউকে একটু শাড়ি বেছে দিলে কি হয়? এই নিরব ভাইয়া আপনি বলেন না কিছু!’
নিরব বোকা বোকা হেসে নিরার কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও তো সেটাই বলছিলাম। এই দোস্ত যা তো, ভাবিকে একটু হেল্প কর।’
অরিক দাঁত কিড়মিড়িয়ে নিরবের দিকে তাকাল। যেন এক্ষুণি তাকে আস্ত চিবিয়ে ফেলবে। নিরব ভয়ে ছোট্ট ঢোক গিলে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। নিরা অরিকের হাত টেনে বলে,
‘চল না ভাইয়া।’
সেসময় আবার অরিকের মাও তাকে ডেকে উঠে। এবার আর ছাড়া পাবে না সে। মা যখন ডাকছে তখন যেতেই হবে, নয়তো সকলের সামনে এসেই ঝাড়ি দেওয়া শুরু করবে। অরিক বিরক্ত ভঙিতে এগিয়ে গেল সেদিকে। নিরা তাকে নিয়ে দাঁড় করালো রাইমার পাশে। এতে যেন তার আরো গা জ্বলে উঠল। দুহাত পকেটে পুরে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লিমা সোবহান তখন একটা লাল কাতান শাড়ি দেখিয়ে বললো,
‘বাবা, দেখতো এই শাড়ি টা কেমন?’
অরিক পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘মা, আমি শাড়ির ব্যাপারে অত কিছু বুঝি নাকি? তুমি আছো, এই যে আন্টি আছেন, তোমরা দেখ না। আমাকে কেন এসবের মাঝে টানছো?’
স্বাভাবিক ভাবেই এই কথাটা রাইমার মায়ের কাছে ভালো লাগে না। মন খচখচ করে উঠল তার। ছেলের কি তবে এই বিয়েতে মত নেই? নাহলে সে এত বিরক্ত কেন? রাইমা তার মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সে অবাক দৃষ্টিতে অরিককে দেখছে। সেও টের পায় তার মায়ের মনে হয়তো সন্দেহ জেগেছে। তাই সে দাঁতে দাঁত চেপে অরিককে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘এই যে মি. ভালো ভাবে কথা বলুন। আপনার কথা শুনে যদি আমার মায়ের মনে কোনোপ্রকার সন্দেহ জাগে তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। আপনার ইচ্ছে থাকুক আর না থাকুক হাসি মুখে মেনে নিন সবটা।’
রাইমার থ্রেড শুনে রাগে ধপধপ করতে থাকে অরিকের মস্তিষ্ক। এইটুকুনি একটা মেয়ে তাকে এইভাবে থ্রেড দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে…
রাগ টা দমিয়ে নিল। জোরপূর্বক মুখে হাসি টেনে নিল। অস্বস্তিতে মাথা চুলকিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
‘না মানে আম্মু এই শাড়িটা অত একটা ভাল লাগছে না। তুমি ঐ ডার্ক রেড কালার টা দেখ।’
তার কথা মতো দোকানদার সেই শাড়িটা নামিয়ে দিল। অরিক সেটা ঘেটে ঘেটে দেখে বললো,
‘বাহ, এটা বেশ সুন্দর। রাইমাকে সুন্দর মানাবে।’
অরিকের কথা শুনে দুই মা’ই মুচকি মুচকি হাসল। নিরাও লাফিয়ে উঠে বললো,
‘এই না হলো আমার ভাই! কত সুন্দর বুঝে গেল বউকে কোনটাতে বেশি মানাবে।’
অরিক মেকি হেসে শাড়িটা রেখে দিল। রাইমা তখন শাড়ি টা হাতে নিয়ে বললো,
‘কিন্তু আমার এটা পছন্দ হয়নি। আমি আন্টির পছন্দ করা ঐ রেড কাতানটাই নিব।’
এবার অনেক বেশিই বিরক্ত হলো অরিক। যদি নিজের পছন্দেই নিতে হয় তাহলে ঢং করে আর তাকে পছন্দ করতে বলা হলো কেন? সে তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
‘সমস্যা নেই। আপনার যেটা পছন্দ আপনি সেটাই নিন।’
তারপর অরিক আর কোনো কথা বললো না। জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কেবল।
.
অনেক কিছু কেনাকাটা হলো। কিন্তু কথা হলো এর মাঝেই নিরব ভেগে গিয়েছে। এই নিয়ে চরম ক্ষেপে আছে অরিক। ছেলেটাকে একবার হাতে পেলে আর আস্ত রাখবে না। একে তো এই নিয়ে রাগ তার উপর শপিং করতে এসে ঘুরতে ঘুরতে তার অবস্থা খারাপ। রাইমার জন্য রাগ দেখিয়ে কিছু বলতেও পারছে না। মেয়েটা চোখের ইশারা দিতেই যেন অদ্ভুত ভাবে সে চুপ হয়ে যায়। নিজেকে নিজেই থাপড়াতে মন চাচ্ছে তার। একটা ছেলে হয়ে সে এইভাবে একটা মেয়েকে ভয় পাচ্ছে! ভাবতেই রাগে কেঁপে উঠছে সে।
.
সবশেষে বেরিয়ে আসার সময় রাইমা আর অরিককে একটু আলাদা সময় দেয়া হলো কথা বলার জন্য। সেখানেও অরিক চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল কেবল। রাইমা হাসল। যেন বিদ্রুপ ছড়িয়ে পড়ছে সেই হাসিতে। বললো,
‘আহারে, আমার হবু বরটার চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করেন না বুঝি?’
অরিক নাক পাল্লা ফুলিয়ে রাগ দমানোর চেষ্টা করছে। রাইমা বুঝলো ব্যাপারটা। সে আবারও হাসল। এক কদম এগিয়ে এসে বললো,
‘অতিরিক্ত রাগ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়, জানেন তো? আর দেখবেন, আপনার এই অতিরিক্ত রাগ আপনারও ধ্বংস বয়ে আনবে।’
অরিক তাও কিছু বললো না। কেবল দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। রাইমা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে সেখান থেকে চলে গেল। রাইমা চলে যেতেই অরিক তার সামনে থাকা দেয়ালটায় সজোরে ঘুষি মারল। দাঁতে দাঁত চেপে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
‘না, এবার এই মেয়ের একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।’
.
.
বাসায় ফিরে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল অরিক। মন মেজাজ একেবারে তুঙ্গে উঠে আছে তার। অনেকক্ষণ সে চোখ বুজে শুয়ে রইল। হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা হাতে নিয়ে সে দেখল নিরব কল দিচ্ছে। রাগে যেন ঘি পড়ল এবার। কলটা রিসিভ করেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগল তাকে। বেচারা ভয়ে চুপচাপ সব হজম করে নিল। এক পর্যায়ে অরিকও হয়রান হয়ে দম ফেলল। তখন নিরব ভয়ে ভয়ে বললো,
‘দোস্ত, আসলে খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল তো তাই চলে আসতে হয়েছে। না হলে আমি জীবনেও আসতাম না।’
‘চুপ কর শালা। আমাকে এইসব ফালতু কথা বলে বোঝাতে আসবি না।’
অরিকের ধমক শুনে নিরব আবারও চুপসে গেল। তবে নিজের মনে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বললো,
‘দোস্ত, আমার মাথায় আরেকটা আইডিয়া এসেছে?’
‘তোর বা*লের আইডিয়া তোর কাছেই রাখ।’
‘আরে না, একবার শুনেই দেখ না।’
ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অরিক বললো,
‘কি আইডিয়া?’
‘শোন, তুই একবার রাইমার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলে দেখ। তুই ওর কাছে ক্ষমা চা, একেবারে আকুতি মিনতি করে ক্ষমা চাইবি। তুই ওকে বুঝিয়ে বলবি যে তোর যা হয়েছে ভুল হয়েছে। বলবি যে তুইও ওকে বিয়ে করতে চাস। অন্য সবার মত একটা স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক গড়তে চাস। এইভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে এটা ওটা বলে তুই ওকে বোঝানোর চেষ্টা করবি। তারপর দেখ ও কি বলে।’
‘তোর মনে হয় ঐ মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইলেই ও আমাকে ক্ষমা করে দিবে?’
‘আরে তুই চেয়েই দেখ না। মেয়েদের মন গলতে দু মিনিটও লাগে না। তুই শুধু একটু ইমোশনালী কথা বলিস তাহলেই হবে।’
অরিক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে অনিশ্চিত গলায় বললো,
‘আচ্ছা ঠিক আছে। ওর সাথে কথা বলে দেখি তাহলে। তবে তাতেও যদি না হয়, তবে আমি এর অন্য ব্যবস্থা নিব। এইভাবে আর একে আমি সহ্য করতে পারবো না।’
.
.
চলবে..
#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|৩|
~
রাইমা ফোন রাখতেই তার রুমে তার মা এলেন। রুফাইদা খানম হাতে কিছু গয়না নিয়ে এসে বিছানার এক কোণে বসলেন। তারপর রাইমা কে ইশারা দিয়ে তার পাশে বসতে বললেন। রাইমাও বসলো। রুফাইদা খানম একে একে গয়না গুলো আলাদা করে সুন্দর করে রাখলেন। তারপর তারমধ্য থেকে একটা মোটা চেইন আর এক জোড়া দুল রাইমার হাতে দিয়ে বললেন,
‘এইগুলো তোকে দিলাম মা। মা’র স্মৃতি হিসেবে তোর কাছে রেখে দিস।’
রাইমা তার হাতের গয়নাগুলোর দিকে তাকাল তারপর আবার চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। বিষন্ন হেসে বললো,
‘মা, তুমি আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। তোমাকে মনে রাখার জন্য আমার কোনো জিনিসের প্রয়োজন নেই। আমার মনে, প্রাণে, মস্তিষ্কে আজীবন তুমি আর বাবা থাকবে। তোমাদের মনে রাখার জন্য আমার এসবের প্রয়োজন নেই মা।’
রাইমা মৃদু হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘তা আমি জানি মা। কিন্তু আমি তো তোর মা, মা হয়ে মেয়েকে তার বিয়েতে কিছু দিব না? আমার আহামরি কিছু নেই রে মা। এই যে এই গয়নাগুলো তোকে দিলাম, আর বাকি দুইটা চেইন আমি আমার নাতি নাতনিদের জন্য রেখে দিলাম; ভবিষ্যতে ওদের দিতে হবে না।’
কথাগুলো বলতেই উনার মুখে যেন অন্যরকম একটা হাসি ফুটে উঠল। মায়ের ঐ হাসি মুখখানা দেখে রাইমার মন ধক করে উঠল। এইটুকু সময়ে নাতি নাতনি কে নিয়েও ভেবে ফেলেছেন তিনি অথচ তার মা জানেও না তার মনে কি চলছে। তার সাথে কি হয়েছে, সে কিভাবে দিন কাটাচ্ছ?
রাইমা কিছু বললো না। কিছু মিথ্যে স্বপ্ন দেখে যদি কারো মনে সুখ আসে তবে থাকুক না সেই সুখ টা। কি দরকার সত্য বলে সেটাকে বিগড়ে দেওয়ার?
‘যা এইগুলো আলমারি তে রেখে আয়। তারপর গোসল করে খেয়ে দেয়ে রেডি হো, বাইরে যেতে হবে।’
আলমারি খুলতে খুলতে রাইমা জিগ্যেস করলো,
‘কোথায় যাবে মা?’
‘ওমা মার্কেটে যেতে হবে না। কয়দিন পর বিয়ে, কিছুই তো শপিং করা হয়নি।’
রাইমা ঘুরে তাকাল। আলমারিটা বন্ধ করে আবারও এসে মায়ের পাশে বসলো। মায়ের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে অপরাধি কন্ঠে বললো,
‘আচ্ছা মা, আমি তো আজ পর্যন্ত তোমার কাছ থেকে কিচ্ছু লুকাই নি। যখন যা করেছি সব বলেছি তোমায়। তুমিও আমাকে সবসময় সাপোর্ট করেছ। যদি কোনোদিন শুনো আমি তোমার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েছি আর সেটা খুব বড়ো কিছু, তাহলে আমাকে ক্ষমা করতে পারবে?’
রুফাইদা খানমের কপালে এবার ভাজ পড়ল। মেয়ের গালে হাত রেখে চিন্তিত কন্ঠে তিনি বললেন,
‘কি হয়েছে মা তোর? কোনো সমস্যা? কি লুকানোর কথা বলছিস?’
রাইমার বুকটা কাঁপছে। আর পারছে না যেন। নিজের সাথে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ংকর ঘটনা টা চিৎকার করে মা কে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। মা যে সহ্য করতে পারবে না। হাই প্রেশারের রোগী, স্ট্রোক করবে সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু এতকিছু মনে চেপে রেখেও থাকতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে খুব।
রাইমা কোনো জবাব না দিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরল। রুফাইদা খানম যেন এতে আরো অবাক হলেন। কিন্তু তিনি এখনই কিছু বললেন না। মেয়ে কে তিনি বিশ্বাস করেন, ভরসা করেন। তাই এখন আর এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তিনি বললেন,
‘আমি জানি তুই এমন কিছু করবি না যার জন্য আমি তোকে ক্ষমা করতে পারবো না। তোর প্রতি আমাদের সেই আস্থা আছে। এখন এসব বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি গোসল করে আয়, আমি রান্নাঘরে যাচ্ছি।’
মা কে ছেড়ে মুচকি হেসে রাইমা মাথা নাড়াল। তারপর মা চলে যেতেই বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকল গোসল করতে।
.
.
‘মা আমি শপিং এ যেতে পারবো না আমার কাজ আছে।’
‘একটা দিব ধরে। তোমার কাজ মানেই তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া। চুপচাপ রেডি হও। রাইমারাও বেরিয়েছে। ওদের সাথেই আমরা শপিং করবো।’
‘কিহহ!’
চেঁচিয়ে উঠল অরিক। নাক মুখ কুঁচকে বললো,
‘ইম্পসিবল! ওদের সাথে আমি কিছুতেই শপিং করবো না।’
লিমা সোবহান এবার রেগে গেলেন। বললেন,
‘আমার হাতে মার খেয়ো না কিন্তু। তুমি এখন যথেষ্ঠ বড়ো হয়েছো, এই বয়সে মা’র হাতে মার খাওয়াটা শোভা পায় না। তাই ভালো ভালো বলছি রেডি হয়ে গাড়ি বের করো আমি আর নিরা নিচে নামছি।’
কথাটা বলে তিনি সোজা বেরিয়ে গেলেন। এদিকে অরিক রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। আবার ঐ মেয়েকে দেখতে হবে। আবার এর কথা শুনতে হবে। উফফ, পারছে না নিজের চুল নিজে ছিড়ে ফেলতে। রাগে কোনোরকমে রেডি হয়ে অরিক নিচে গ্যারেজে চলে গেল গাড়ি বের করতে। তারপর সে গাড়িটা বাইরে বের করে নিরব কে একটা কল লাগাল,
‘কই আছিস?’
‘বাসায়, কেন?’
‘আমার সাথে একটু বেরুতে হবে।’
‘কোথায় যাবি?’
‘মা আর নিরা কে নিয়ে একটু শপিং এ যাবো।’
‘ওহহ, বিয়ের শপিং করবি নাকি? তাহলে এক কাজ করিস তোর আর আমার জন্য কাফনের কাপড় টাও কিনে রাখিস। কারণ তোর বিয়ের পরপরই তো এটা আমাদের লাগবে, তাই না?’
বিদ্রুপের সুরে কথা টা বলে নিরব। অরিক ক্ষেপে গিয়ে বলে,
‘লাথি খাবি শালা। কথা কম বলে তাড়াতাড়ি বাড়ির সামনে আয়।’
‘তা না হয় এলাম। কিন্তু এটা বলতো ঐ মেয়ে আবার তোদের সাথে শপিং করবে না তো?’
অরিক জানে নিরব কে সত্যি টা বললে ও জীবনেও তার সাথে যাবে না। তাই সে মিথ্যে বললো,
‘আরে না ও যাবে না। আমি, মা আর নিরা যাব শুধু।’
‘তাহলে ঠিক আছে। আমি আসছি।’
ফোনটা পকেটে রেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে অরিক। বন্ধু পাশে থাকলে কিছুটা হলেও ভয় কম লাগবে তার। নয়তো ঐ মেয়ের কথা আর তাকানোর ধরন দেখলেই বুক কেঁপে উঠে যেন। উফফ, সাংঘাতিক একটা মেয়ে। সেদিন যেভাবে ওকে ছেড়ে এসেছিল, বাঁচবে না বলেই তো মনে হয়েছিল। অথচ সে এখন দিব্যি বেঁচে আছে। শুধু বেঁচে আছে বললে ভুল হবে, তাকে জ্বালিয়ে মারছে। কথাগুলো ভেবেই ভীষণ রকম বিরক্ত হলো অরিক। গাড়িতে উঠে ঠাস করে দরজা টা লাগিয়ে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর অরিকের মা আর বোন এসে গাড়িতে বসতেই সে গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুটা পথ গিয়ে মাঝ রাস্তা থেকে নিরব কেও পিক করে নিল।
প্রায় আধ ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে তারা মার্কেটে এসে পৌঁছাল।
নিরব ফার্স্টে গাড়ি থেকে নেমে লুকিং গ্লাস দিয়ে চুলগুলো একটু ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনের বিশাল শপিং মলটার দিকে তাকাতেই তার যেন হুশ উড়ে গেল। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেই উল্টো দিকে হাঁটা দিতেই অরিক এসে পেছন থেকে কলার টেনে ধরলো।
‘কই যাস বেটা?’
নিরব পেছনে ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘তুই না বললি এই মেয়ে আসবে না। তাহলে ঐটা কে?’
‘ঐটা যেই হোক না কেন তোকে এত পাত্তা দিতে হবে না। তুই শুধু আমার সাথে সাথে থাকবি এইটুকুই তোর কাজ।’
নিরব অসহায়ের মতো অরিকের দিকে তাকাল, যেন এখনি কান্না করে দিবে। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে এই ছেলেটাকে এক্ষুণি খুন করে দিতে। শালা নিজে তো মরবে মরবে সাথে তাকেও মারবে।
.
চলবে..
#নিষিদ্ধ প্রেম
#জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
|২|
~
‘মা, আমি ঐ মেয়েকে বিয়ে করবো না।’
কাপড় ভাজ করছিলেন লিমা সোবহান, ছেলের তিক্ত কন্ঠ শোনে ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকালেন। বিরক্তিতে ব্রু কুঁচকে বললেন,
‘কেন? কি সমস্যা?’
অরিক নাক মুখ ফুলিয়ে কঠোর গলায় বললো,
‘আমার ওকে পছন্দ হয়নি তাই।’
ছেলের কথায় বিরক্তির মাত্রা টা যেন আরো বাড়ল। তিনি বললেন,
‘পছন্দ না হওয়ার কি কারণ? মেয়ে রূপে গুণে সবদিক থেকে একদম পারফেক্ট। তাহলে, কি জন্য তোমার তাকে পছন্দ হলো না?’
‘মা, ওর কথার ধরণ আমার ভালো লাগেনি।’
লিমা সোবহান এবার জোরে নিশ্বাস নিলেন। ছেলের সমস্যা টা যেন ধরতে পেরেছেন। ছেলের কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। বুকের উপর দুহাত ভাজ করে গম্ভীর সুরে বললেন,
‘এখন আর এসব কথা বলে কোনো লাভ নেই অরিক। কাল আমাদের পাকা কথা বলা হয়ে গিয়েছে। পরের সপ্তাহে তোমাদের বিয়ে। অযথা ভেজাল বাঁধিও না। আমি জানি তুমি ইচ্ছে করেই বিয়ে টা ভাঙতে চাইছো। আর ঐ মেয়ে কে পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণ’ই আমি দেখছি না। তোমার বাবার আর আমার ওকে যথেষ্ট পছন্দ হয়েছে। সেক্ষেত্রে তোমার পছন্দ না হলেও চলবে। তোমার পছন্দের মেয়ে গুলোকে আমার দেখা আছে। ঐ ধরনের মেয়েকে আমি কখনো আমার বাড়ির বউ বানাবো না। তাই এখন এসব বাদ দিয়ে বিয়ের প্রিপারেশন নাও, যাও।’
অরিকের চোখ মুখ কালো হয়ে যায়। মা কে কি করে বোঝাবে, কেন সে এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে না। সত্যি’টাও তো বলতে পারছে না। মা জানলে তাকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারবে না। এদিকে সে এটাও টের পাচ্ছে তার জন্য সামনে খুব খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে। ঐ মেয়ে তাকে এমনি এমনি বিয়ে করছে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে তার কোনো ভয়ানক উদ্দেশ্য আছে। শুনেছে মেয়েদের যখন আর কিছু হারানোর ভয় থাকে না তখন নাকি তারা জানোয়ারের চেয়েও হিংস্র হয়ে উঠে। তবে কি এবার তাকেও রাইমার হিংস্রতার স্বীকার হতে হবে?
কথাগুলো ভাবতেই গলা শুকিয়ে উঠে তার। যেই ছেলেটা আজ পর্যন্ত কাউকে পরোয়া করতো না সে আজ এক সাধারণ মেয়ের ভয়ে এইভাবে অস্থির হয়ে উঠছে? নিজেকেই যেন চিনতে পারছে না অরিক। তার এই একটা ভুল তার জীবনটাকে যে ঠিক কিভাবে এলোমেলো করে দিবে সেটা সম্পর্কে আদৌ তার কোনো ধারনা নেই।
.
মায়ের কথায় মন মরা হয়ে রুমে এসে বসলো অরিক। অস্থির মনটা কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। শুয়ে বসে কোনোকিছুতেই শান্তি মিলছে না যেন। এসির পাওয়ার টা আরো কমিয়ে দিল। যেন একটু হলেও শরীরের উষ্ণতা টা কমে। মনে যেন প্রশান্তি পায়। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে নিরবকে কল লাগাল। ওপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই অরিক বলে উঠল,
‘ফ্রি থাকলে এক্ষুণি বাসায় আয়।’
নিরব আর কথা বাড়াল না সোজা অরিকদের বাসায় চলে এলো। ছয়তলা বিল্ডিং এর চারতলায় এক বিশাল এপার্টমেন্টে থাকে তারা। লিফট থেকে নেমেই সোজা অরিকের রুমে গিয়ে ঢুকল নিরব। বিছানায় এলোমেলো হয়ে শুয়ে থাকা অরিকের অবস্থা দেখেই নিরব টের পেল সে কতটা দুশ্চিন্তায় আছে। নিরব গিয়ে বসলো তার পাশে। ক্ষীণ সুরে বললো,
‘দোস্ত, কি হবে এখন?’
অরিক চোখ তুলে তাকাল। ক্ষেপা কন্ঠে বললো,
‘কি হবে সেটা আগে থেকেই জানলে কি আর এখন এত দুশ্চিন্তা করতাম?’
‘হ্যাঁ, তাও ঠিক। কিন্তু দোস্ত, ঐ মেয়ে চায় টা কি বলতো? তুই ওকে রেপ করলি অথচ ও তোকে কিছুই করলো না উল্টো তোকে বিয়ে করতে চাইছে? ব্যাপার টা না ঠিক আমার মাথায় ঢুকছে না রে।’
অরিক উঠে বসল। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
‘সেটাই তো আমি বূঝতে পারছি না। মেয়েটা আসলে চায় কি? তার মনে কি চলছে? এইটুকু আমি নিশ্চিত যে এমনি এমনি এই মেয়ে আমাকে বিয়ে করছে না নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো গভীর উদ্দেশ্য আছে।’
নিরব ভয়ার্ত দৃষ্টিতে অরিকের দিকে তাকায়। বলে,
‘তোর জন্য আমিও ফেঁসে গেছি। সেদিন বারবার বারণ করেছিলাম, শুনিস নি আমার কথা। ইচ্ছে মতো মেয়েটার সাথে..আর এইদিকে আমি কিছু না করেও ফেঁসে গেছি। ঐ মেয়ে আমাকেও ছাড়বে না। যেভাবে কালকে আমার দিকে তাকাচ্ছিল!’
অরিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
‘সেদিন অনেক বেশি নেশা করে ফেলেছিলাম। নেশার ঘোরে যে এসব করে ফেলব জীবনে কল্পনাও করেনি। আর ঐ মেয়ে অত রাতে ঐ রাস্তায় কি করছিল? আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো আমি তখন নেশার ঘোরে ছিলাম তাই ওকে একটু টিচ করে ফেলি; তাই বলে কি ও আমাকে চড় মারবে? এই একটা চড়েই তো আমার মাথা গরম হয়ে যায়, তাই রাগ সামলাতে না পেরে এতকিছু করে ফেলি। এখন বুঝতে পারছি কি করেছি, কিন্তু এখন আর কিছু করারও নেই। না জানি আমার কপালে কি আছে?’
চোখ বুজে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে থাকে অরিক। নিরব ভীত সন্ত্রস্ত মন নিয়ে বসে বসে ভাবতে থাকে কি করা যায়। ভাবতে ভাবতেই সে হঠাৎ বলে উঠে,
‘দোস্ত, এক কাজ কর তুই মেয়েটার কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। দরকার পড়লে পা ধরে ক্ষমা চা। আমার মনে হয় মেয়ে টা তোকে ক্ষমা করে দিবে।’
অরিক হতাশ কন্ঠে বলে,
‘একটা মেয়ের সবথেকে মূল্যবান সম্পত্তিই হলো তার সতীত্ব। সেই সতীত্বটাকেই আমি নষ্ট করে দিয়েছি। তোর কি মনে হয়, মেয়েটা আমাকে এত সহজে ক্ষমা করে দিবে?’
নিরব চুপ হয়ে যায়। না দিবে না। সে যদি মেয়ে হতো তবে সেও দিত না। কিন্তু ঐ যে পুরুষ মানুষ, রাগের বশে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। সেই ভুলের প্রায়াশ্চিত্ত তো এবার তাদের করতেই হবে।
.
.
অনেকক্ষণ বসে দুই বন্ধু কথা বললো। তারপর এক সময় নিরব চলে গেল তার বাসার দিকে। কেউই কোনো উপায় আওড়াতে পারলো না। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হয়ে এক পর্যায়ে তারা আশাই ছেড়ে দিল। ভেবে নিল ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।
নিরব যেতেই অরিক গোসলের জন্য উঠল। টাওয়াল টা গলায় ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ সে তার ফোনে পরপর অনেক গুলো নোটিফিকেশনের শব্দ পেল। সে এগিয়ে গিয়ে বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল কিসের এত নোটিফিকেশন। ফোনের স্ক্রিনে তখন একটা আননোন নাম্বার থেকে কিছু ম্যাসেজ দেখতে পেল। অরিক সেটা দেখার জন্য হুয়াটস অ্যাপ এ ঢুকল। তারপর সেই নাম্বারে গিয়ে দেখল অনেকগুলো ছবি। আর সেই ছবিগুলো আর কারোর না রাইমার। বেশ কয়েকটা শাড়ি গায়ে দিয়ে তোলা ছবি। তার নিচে একটা ছোট্ট ম্যাসেজ, ‘আচ্ছা, কোন শাড়ি টা তে আমাকে বেশি মানাচ্ছে একটু বলুন তো!’ অরিক এবার নিশ্চিত হলো এটা রাইমার নাম্বার। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ বিরক্তও হলো সে। এই মেয়েটা তাকে কেন ম্যাসেজ দিচ্ছে? সিন করেও রিপ্লাই দিল না। ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল সে।
.
.
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে চুল মুছতে মুছতে কৌতুহল বসত অরিক আবার ফোনটা চেক করলো। চোখ যেন এবার বেরিয়ে আসবে তার। একশো বিশ টা ম্যাসেজ। আর এটা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। তাড়াতাড়ি সে ইনবক্স ওপেন করে দেখে রাইমা তাকে লাগাতার ম্যাসেজ দিয়েই যাচ্ছে। তার একটা তে লেখা, ‘সিন করেও রিপ্লাই দিচ্ছেন না কেন মি. অরিক সোবহান? এত ভয় পান আমায়?’ পাশে দুইটা হা হা ইমুজি। ম্যাসেজ টা দেখা মাত্রই রাগে চোখ মুখ লাল হয়ে উঠে অরিকের। সে ডিরেক্ট কল দেয় সেই নাম্বারে। সঙ্গে সঙ্গেই রিসিভ হয়ে যায়। রাগি গলায় অরিক বলে,
‘কি শুরু করেছেন আপনি? এত ম্যাসেজ কেন দিচ্ছেন?’
ওপাশ থেকে ক্ষীণ হাসির শব্দ শুনতে পেল সে। জবাবে রাইমা বললো,
‘বারে আমি বুঝি আমার হবু বরকে ম্যাসেজ দিতে পারবো না?’
রাগ টা ধপ করে বেড়ে যায় অরিকের। চেঁচিয়ে উঠে বলে,
‘মজা করা বন্ধ করুন। ইচ্ছে করে করছেন এসব তাই না? আমি জানি আপনার উদ্দেশ্য খুব খারাপ। তাই যা বলার সরাসরি বলুন, অযথা এত নাটক করবেন না।’
রাইমা বাঁকা হাসে। বলে,
‘নাটক করছি? বাহ, আপনি তো খুব চালাক! যাই হোক, আমার নাটকে কিন্তু আপনার পরিবার খুব সুন্দর ফেঁসে গেছে। এবার আপনার পালা। জানেন তো আপনি আমার জীবনে খুব স্পেশাল একটা পারসন। আপনাকে আমি আমার জীবন থেকে দূরে সরে যেতে দিব না। আপনাকে আমার লাগবে, আমার অন্ধকার জীবনের প্রতিটা হিসাব নিকাশ মেটানোর জন্য আপনাকে আমার প্রয়োজন। তাই নাটক বলুন আর যাই বলুন, আপনাকে আমি ফাঁসিয়েই ছাড়ব।’
কথাটা বলেই বিকট শব্দে হেসে কলটা কেটে দেয় রাইমা। অরিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনরূপ প্রতিক্রিয়া নেই তার মাঝে। তবে কি সত্যিই তার সাথে ভয়ানক কিছু হতে চলছে?
পাত্রী দেখতে এসে রীতিমতো ভূত দেখার মতো চমকে গেল অরিক সোবহান। অক্ষিপটে ভেসে উঠল তার কিছুদিনের আগের সেই মূহুর্তগুলো। তবে সে’ই কিন্তু একা চমকালো না, তার পাশে বসে থাকা তার বন্ধু নিরবও সমান তালে চমকেছে। নিরব খুব মনোযোগ সহিত তার সামনে বসে থাকা রমনীর আপাদমস্তক পরখ করে নিশ্চিত হলো এই সেই মেয়ে। ঘাম ছুটে গেল তার। হাত দিয়ে কপাল মুছে বন্ধুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘দোস্ত, এটা সেই মেয়েটা না যাকে কয়দিন আগে তুই ধ*..’
বাকি কথা বলার আগেই অরিক নিরবের হাত চাপড়ে ধরল। চোখ গরম করে তাকিয়ে চুপ থাকতে বললো তাকে। দমে গেল নিরব, কিন্তু মনের ভয় কমে নি তার। মেয়েটার এই নীরব চাহনী যেন তাদের ভয় কে আরো বাড়িয়ে তুলছে।
.
বাড়ির বড়ো’রা কথা বলবে তাই সেই ফাঁকে অরিক আর রাইমা কেও আলাদা রুমে দেয়া হলো একটু কথা বলার জন্য। রাইমার কাজিনরা তাদের রুমে রেখে বেরিয়ে গেল। অরিকের চোখ মুখ শুকনো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ভীষণ ভীত। চোখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। রাইমাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। গভীর মনোযোগে পর্যবেক্ষণ করলো সে অরিক কে। তারপর সে অরিকের দিকে দু কদম এগিয়ে গিয়ে বললো,
‘আমাকে চিনতে পারছেন?’
অরিক এবার তাকাল। সেই চাহনী তে ভয় ছাড়া যেন আর কিছুই দেখতে পারছে না রাইমা। রাইমা হাসল খুব। বললো,
‘একি আপনাকে এত ভীত দেখাচ্ছে কেন? ভয় পাবেন না, আমি কাউকে কিছু বলবো না।’
‘আমাকে চিনতে পেরেও কাউকে কিছু বলবেন না কেন? চাইলে আপনি এখনি আমাকে পুলিশে দিতে পারেন। আমি যা অন্যায় করেছি তার জন্য তো আমার কঠিন শাস্তি হবে। তাহলে আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিতে চাইছেন কেন? কি উদ্দেশ্য আপনার?’
রাইমা আরেক দফা হাসল। সুন্দরী মেয়েদের হাসি সুন্দর হলেও এই মুহুর্তে রাইমার হাসিটাকে ঠিক সুন্দর উপাধি টা দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ তার এই হাসিতে সৌন্দর্য নেই আছে বুক ভরা যন্ত্রণা আর হাহাকার। রাইমা হাসি থামাল। আরো কিছুটা এগিয়ে গেল অরিকের দিকে। রাইমার হঠাৎ এত কাছে আসায় অরিক কিছুটা ঘাবড়ে গেল। এক কদম পিছিয়ে যেতেই রাইমা বিদ্রুপের সুরে বললো,
‘ওমা পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন? আজ আর কাছে আসতে মন চাইছে না? সেদিন তো আমার খুব কাছে এসেছিলেন। আমার শরীরের প্রতিটা অঙ্গ প্রতঙ্গ ছুঁয়েছিলেন। সেদিন এই ভয় কই ছিল? নিজের সমস্ত বাসনা মিটিয়ে আমাকে রাস্তায় ফেলে রেখে তো দিব্যি বন্ধুকে নিয়ে চলে এসেছিলেন। তবে আজ কেন এত ইতস্তত বোধ করছেন? এই যে আমি আপনার কত কাছে, ছোঁ’ন আমায়। কি হলো, পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
অরিক রেগে যায় তার কথায়। এখানে আসার আগে যদি একবার মেয়ের ছবি টা দেখে আসতো তাহলে আর তাকে এই সিচুয়েশনে পড়তে হতো না। নিজের দোষেই তার আজ এই হাল। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে সে বললো,
‘শুনুন, এসব ফালতু কথা বলা বন্ধ করুন। আমি জানি আমি একজন ধর্ষক, আমি আপনাকে ধর্ষণ করেছি, এটা এক্ষুণি গিয়ে আপনি আপনার পরিবার কে জানিয়ে দিন। তারপর পুলিশ ডেকে এনে আমাকে গ্রেফতার করিয়ে দিন। আর এত নাটক করবেন না। অনেক করেছেন।’
রাইমা এদিক ওদিক তাকিয়ে জোরে একটা নিশ্বাস নিল। কথাগুলো দুর্মর গতিতে মস্তিষ্কে আলোড়ন তৈরি করছে তার। সে তাই শক্ত গলায় বললো,
‘না, আপনাকে আমি পুলিশে দিব না। না আমি এই ব্যপার টা কাউকে জানাব। আমার পরিবারের আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আর আমার মনে হয় আপনার পরিবারেরও আমাকে খুব পছন্দ। আপনার মা’র কথা শুনে তো তাই মনে হলো। এখন যখন দুই পরিবারেরই সবকিছু পছন্দ তবে আমি আর বেঁকে বসবো না। আপনাকেই আমি বিয়ে করবো।’
অরিক হতভম্ব হয়ে পড়ল। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। অদ্ভুত! একটা মেয়ে কি করে তার ধর্ষক কে বিয়ে করতে রাজি হয়? তাও আবার এত সহজে? অরিকের সন্দেহ হয়। মন বলছে তার, মেয়েটার মাথায় অন্য কিছু চলছে। নিশ্চয়ই আগে থেকে কিছু প্ল্যান করে রেখেছে সে। না না এই মেয়েকে কোনোমতেই বিয়ে করা যাবে না। অরিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। সাফ গলায় জানিয়ে দেয়, সে তাকে কোনো ভাবেই বিয়ে করবে না।
রাইমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে জবাবে বললো,
‘বিয়ে তো আপনাকে করতেই হবে অরিক সোবহান। আর আমাকেই করতে হবে।’
‘মগের মুল্লুক নাকি? বলেছি তো আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। এখন আপনি যদি সবাই কে সবটা বলে দিতে চান তো বলে দিতে পারেন। আমার কিছু যায় আসে না।’
কথাটা উচ্চস্বরে বলে দু’পকেটে হাত দিয়ে অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়াল সে। রাইমা বাঁকা হাসল। বললো,
‘আপনি যতটা সহজ ভাবছেন সবকিছু কিন্তু অতটাও সহজ না মি. অরিক সোবহান। কি বলুন তো, আমার না খুব শখ ছিল আমার একটা সংসার হবে, ছোট্ট ভালোবাসার একটা সংসার। সেখানে আমি আর আমার স্বামী অনেক সুখে থাকব। তারপর একদিন সেই ছোট্ট সংসার কে পরিপূর্ণ করে দেওয়ার জন্য আমাদের একটা ছোট্ট পরী আসবে। যে তার জাদু দিয়ে আমাদের সুখ কে আরো বাড়িয়ে দিবে।(একটু থেমে) কিন্তু..কিন্ত আপনি কিছু হতে দিলেন না। সব কিছু নষ্ট করে দিলেন। আমাকে ধর্ষিতা বানালেন। চরিত্রে কালি মাখালেন। আমার সতীত্ব হরণ করলেন। আমাকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে ছাড়লেন। এখন..এখন আপনিই বলুন, আমাকে কে বিয়ে করবে? কেউ কি যেচে পড়ে কোনো ধর্ষিতা কে বিয়ে করে? করে না তো। তাই এখন আপনাকেই আমার বিয়ে করতে হবে। আপনি চান কিংবা না চান আমিই আপনার বউ হবো।’
কথাগুলো শেষ করেই চটজলদি চোখ মুছে নিল রাইমা। হঠাৎ করেই খুব কান্না পাচ্ছে তার। সেই ভয়ংকর মুহুর্তগুলো বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। নিজের দেয়া সেই বিভৎস চিৎকারগুলো যেন নিজের কানেই বাজছে। পারছে না সে, না পারছে মরতে না পারছে বেঁচে থাকতে। আর চোখের সামনের এই মানুষটাকে দেখে যেন তার এই যন্ত্রণা আরো বেড়ে গিয়েছে। খুব তো চলছিল তার সুন্দর, সাধারণ জীবন টা। হঠাৎ কোথ থেকে এই অচেনা মানুষটা এসে অমানুষের মতো তার জীবন টা নষ্ট করে দিল। ধ্বংস করে দিল তার সমস্ত স্বপ্ন। এর জন্য সে কোনোদিনও এই মানুষটাকে ক্ষমা করতে পারবে না। কোনোদিনও না।
.
.
চলবে..?
“পাপ মানুষকে ধংস করে দেয়..। মানুষ থেকে করে তোলে অমানুষ, হিংস্র, পশু। তখন তার মনে মা, মেয়ে, বোন বলে কিছু থাকে না, যা থাকে তা হলো নারী আর তার শরীর….! প্রতিবছর এই নারীদের উপর অত্যাচারের হার বাড়ছে, ধর্ষণ বাড়ছে, নারী হত্যা বাড়ছে। এসব কিছু থেকে রুখে দাঁড়াতে আমরা অনেক রকম চেষ্টা করে চলেছি। তবে আমাদের এঁকা হাতে এসব সম্ভব নয়… এর জন্য প্রয়োজন সকল জনগনের সহযোগীতার। আশা করছি আপনারা আমার পাশে থাকবেন!”
বক্তব্যটি দিয়ে শেষ করলেন রাহুল খন্দকার। সাথে সাথে শুরু হলো উপস্থিত সবার করতালি। জয়নব ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ে রইলো নিজের বাবার দিকে। মিলাতে চাইলে বাহিরের রূপটা সাথে ভিতরের রূপটা… কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না জয়নব… এই কালো মনের মানুষটিকে কিভাবে সবাই সাদা মনের মানুষ মনে করে??? জয়নব তাচ্ছিল্য হাসলো এবার… যে নিজের কর্মের আড়ালে নারীদের বস্তু, খাবার বানায়? সে আজ সকলকে ভাষণ দিচ্ছে নারী নির্যাতন রুখতে। জয়নব হাসতে লাগলো। এই দেহে এই লোকের রক্ত ভাবতেই গা শিরশির করে উঠলো। আচ্ছা… এখন যদি সে হাতের রগটা কেঁটে দেয়? তাহলে তো এই লোকের রক্ত বেড়িয়ে যাওয়ার কথা? তাই না? কিন্তু দেহ? এই দেহ কি করবে সে? এই লোকেরই তো অংশ সে। এই লোকের চোখ,নাক,মুখ সব যেন জয়নবের মুখের আদলে বসানো। শুধু গায়ের রং টা চাপ। জয়নব হতাশার শ্বাস ফেললো। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো নিজের বাবা নামের পশুটির দিকে… আর ভাবছে কিছু ঘন্টা আগের কথা গুলো….
” জান… ”
আদরের হাতের স্পর্শ চুলের ভাজে পেতেই আদরের বুকে উপর থেকে মাথা তুলে জয়নব। ফোলা চোখ, ঘুমাচ্ছন্ন মুখ। কখন যে ঘুমিয়ে গেছিলো জানা নেই তার।আদর জয়নবের চোখের কোনে জমে উঠা ছলছল পানি মুছে দিলো। বলল,
” জান.. কাঁদছো কেনো?”
” আমি আপনাকে মারতে চাইনি! কিন্তু কিভাবে কি থেকে কি হয়ে গেলো… আমাকে ক্ষমা করে দিন!”
ঢুকরে উঠলো জয়নব। মাথা নত করে কাঁদতে লাগলো। কান্নার শব্দ না হলেও কেঁপে কেঁপে উঠছে দেহখান। আদর জয়নবের থুতনী ধরে মুখ উঁচু করলো,
” জান তোমার উপর আমার কোনো রাগ… কোনো ক্ষোভ নেই। কারণ কি জানো?”
জয়নব অবুঝের মতো মাথা নাড়ালো। তা দেখে আদরের মন চাইলো গাল টেনে দিতে জয়নবের। কিন্তু নিজের ভাবনা গুলো বাদ দিয়ে দাম্ভিক মুখ খানায় গম্ভীরতা ছেয়ে বলল,
” তোমার বাবা.. শুধু আমাদের সাথে নয়.. তোমার সাথে.. ইনফ্যাক্ট পুরো নারী জাতিদের সাথে বেইমানি করছে!”
জয়নব বড় বড় চোখ করে তাকালো। আদর বলতে থাকলো,
” তোমার বাবা একজন ক্যানিবাল!”
জয়নব বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো,
” কি বলছেন এসব?”
আদর বলল,
” এটাই সত্যি। তোমার বাবা একজন মানুষ খেকো।”
জয়নবের এবার হাত পা ঠান্ডা হওয়ার উপক্রম। ভয়ে ভয়ে বলল,
” আপনারাও? আমি শুনেছি রুফাইদা আপু বলেছিলো..অভিনব স্যার নাকি রুফাইদা আপুর সামনে খেয়েছে!”
আদর হতভম্ব হয়ে গেলো। কোন কথার পৃষ্ঠে মেয়েটি কোন কথা বলছে। আদরের মন চাইলো জোরে জোরে হাসতে। তবুও নিজেকে সামলে বলল,
” নাহ্..আমরা ক্যানিবাল নই। রুফাইদাকে শুধু ভয় দেখাবার জন্য এসব করা!”
” এসব কিছুর মাঝে রুফািদা আপুকে কেন টানলেন? তার শোকে বাবা..!”
আবারো চোখে পানি টল টল করতে লাগলো। আদর বলল,
” আমরা রুফাইদাকেই তুমি ভেবেছিলাম!”
জয়নব চেয়ে রইলো। আদর বলতে লাগলো,
” রুফাইদাকে কোনো রকম হার্ম করতে চাইনি আমরা। ইনফ্যাক্ট যখন জানতে পারি যাকে আমরা ধরে রেখেছি সে অন্য কেউ, তাকে আর কিচ্ছু করিনি। তবে হ্যা না চাইতেও তাকে আমাদের কাজে লাগিয়েছি। ”
” কিভাবে?”
” তোমাকে আমাদের হসপিটাল আসতে বাধ্য করতে।”
জয়নব চোখ বড় বড় করে চাইলো। আদর শুরু থেকে শুরু করলো,
” আমার বাবা একবার তোমার বাবাকে তার কুকর্মের সাথে হাতে নাতে ধরে। উনি তখন নারী পাচারকারী ছিলেন। তার সাথে আমাদের উন্নত দেশ গুলো মধ্যে এখনো অনেক ক্যানিবাল রয়েছে, এবং এমন অনেক রেস্টুরেন্ট যেখানে মানুষের মাংস সাপ্লাই করতো। এভাবেই নিজের কুৎসিত চেহারা সমাজ সেবার আড়ালে লুকিয়ে রাখেন উনি।”
জয়নবের মন চাইলো এসব শোনার আগে সে মরেই যেতো? নয়তো কখনোই না জানতো তার পিত্র পরিচয়। আদর আবার বলতে শুরু করে,
” জান জানো? তুমি এক মাত্র তোমার বাবার ধংসের কারণ হবে!”
” তোমার নানা ছিলেন জমিদারের পুত্র । তার এক মাত্র মেয়েই ছিলো নয়নতারা। মেয়েকে অনেক ভালোবাসতেন। আর তোমার মা প্রেমে পড়ে যায় তোমার বাবার। আবেগে আপ্লুত হয়ে তোমার মা তোমার বাবাকে বিয়ে করে নিয়ে হাজির হয়। তোমার নানা এতে আর আপত্তি করে নি। সব ঠিক চলছিলো। হঠাৎ কি হলো তোমার নানা সিঁড়ি থেকে পরে গেলো। এবং পরলোকে গমন করলো। এভাবেই দিন যেতে লাগলো।একদিন তোমার মার সামনে সব সত্যি চলে আসে। এবং এটিও জানতে পারে… তোমার নানা তোমার বাবা সম্পর্কে সব জানতে পেরে গেছিলো। উনি নয়নতারাকে বলতে চেয়ে ছিলো।কিন্তু আর বলা হয় নি। নয়নতারা এসব কিছু জানতে পারার পর তোমার বাবা সম্পর্কে খোঁজ লাগাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে জানতে পারে.. রাহুল তার ঘারে বন্দুক রেখে চালিয়ে যাচ্ছে। নয়নতারাকে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। তার লক্ষ্য ছিলো তার বাবার সম্পত্তি, আর তার নাম। আর সিটিজেনশিপ। কারণ তোমার মা তখন আমেরিকার সিটিজেন। যার আঁড়ালে নিজের কালো কাজ গুলো লুকাবে। হলোও তাই। সে বাংলাদেশ সহ নানান জায়গায় মেডিকেল কলেজ খুলে। আর ডাক্তারী পেশার আড়ালে চলতে থাকে হত্যা, পাচার, ধর্ষন। শুধু তাই নয়… মেয়েদের উপর করা হলো এক্সপেরিমেন্ট। আর সব থেকে মজার বিষয় কি জানো?”
” তুমি, রুফাইদা, কুয়াশা, সাজিয়া.. যে মেডিকেলে পড়তে? তাও কিন্তু তোমার বাবার।”
জয়নব ভাষা হারিয়ে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইলো। আদর বলতে লাগলো,
” তোমার মা যখন জানতে পারে.. তোমার বাবার সাথে এসব নিয়ে তুমুল ঝগড়া-ঝাটি শুরু করে। এক পর্যায় তোমার মার গায়ে হাত তুলে তোমার বাবা.. বন্দি করে দেয় তাকে। তুুুমি কি জানো জান… তোমার মা এখনো জীবিত। কিন্তু জিন্দা লাশ।”
জয়নব ঢুকরে উঠলো,
“মা… আমার মা বেঁচে আছে? আপনি সত্যি বলছেন?”
আদর মাথা নাড়ালো। পাশে থেকে ল্যাপট্যাপের দিকে ইশারা করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
” জান ল্যাপট্যাপ!”
জয়নব এগিয়ে দিলো। আদর ল্যাপটপ অন করে একটি ফাইলে ঢুকলো। সর্ব প্রথম যার ছবি আসে… সে জয়নবের বাবা। জয়নব ঘৃণিত মুখ নিয়ে চাইলো। তার পরেই জ্বলজ্বল করে উঠলো সুন্দরী রমনীর খিল খিল করা হাসির ছবিটি। হাসিটা যেন একদম জয়নবের মতো। জয়নব মুখ চেঁপে কেঁদে উঠলো,
” আমার মা…!”
আদর এর পর আরেকটি ছবি বের করলো। হসপিটালের কাপর জড়িয়ে সিলিং এর পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নয়নতারা। একদম নিস্তেজ। বয়সের ছাপ পড়ছে। তবে এক ফোঁটা সুন্দরর্য কমেনি। আদর বলল,
” উনার বর্তমান অবস্থা। তোমার বাবা তোমার মাকে এতই টর্চার করেছে যে উনি এখন এই দুনিয়াতে থেকেও নেই। তবে জানে মারে নি। আর মারবেও না… যত দিন না তোমাকে পাচ্ছে!”
” কারণ এক মাত্র তুমিই তোমার বাবাকে ধংস করতে পারো আবার তোমার বাবাকে পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী ব্যক্তি বানাতে পারো। আর এক মাত্র এই কারণেই ছিলো.. তোমাকে আমরা মারতে চাইতাম। কিন্তু এই যে আমার মনটা? দিলো না। উল্টো পাগলের মতো ভালোবেসে ফেললো তোমাকে।”
বলেই জয়নবের কঁপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো আদর। জয়নব বলল,
” আমার সাথে এসবের কি কানেকশন? ”
” আছে… তোমার মা খুব বুদ্ধি মতি বলতে গেলে। তোমার নানা মারা যাওয়ার সময় তার পুরো সম্পত্তি তোমার মাকে দিয়ে যায়। আর তোমার মা তোমার নামে করে দেয়। তোমার ২৫ বছর পূর্ণ হলেই তুমি জমিদার বাড়ির নতুন মালিক। শুধু তাই নয়… তোমার বাবা যত কুকর্ম করেছে তার সব প্রুভ তোমার কাছে চলে আসবে। ইনফ্যাক্ট তুমি যদি উনার হাতে পর.. তাহলে উনি তোমার মাধ্যমে আরো পাউয়ার ফুল হয়ে যাবে এবং তোমাকেও তোমার মায়ের মতো হাল করবে।”
জয়নব আবার একই প্রশ্ন করলো,
” কিন্তু আমি কিভাবে?”
” তোমার হাতে ছাপ আর তোমার চোখ জান… ওই যে বললাম তোমার মা খুব চালাক ছিলেন। তার সকল কৃত কর্ম এবং সব দলিল পত্র ইন্টার্নেশনাল লকাপে রাখেছেন। যার পাসওয়ার্ড এক মাত্র তুমি। যখন এমন হয় তখন তুমি খুব ছোট। এর পরেই তোমার মা তোমাকে সাইদ আঙ্কেলের কাছে দিয়ে দেন। সাঈদ আঙ্কেল তখন থেকে একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক আর গোয়েন্দার লোক ছিলেন। তোমার মা তার সাহায্য নেয়। আর আজ তুমি এখানে! জানো এখানে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস কি? ওই লকাপ তোমার বাবার কাছে। উনি দিনে রাতে দেখে অথচ টাচ করতে পারে না। তার এক মাত্র কারণ তুমি ছাড়া যদি কেউ তা টাপ করে তাহলে ডিস্ট্রয় হয়ে যাবে। এবং তোমার বাবা সব হারাবে। ইনফ্যাক্ট তোর ২৫ বছরের আগে যদি তোমাাে উনি না পায় তাহলে তার যত সহায় সম্পত্তি আছে সব ট্রাস্টে চলে যাবে। তখন তোমার বাবা একজন সাধারণ মানুষ হয়ে যাবে। তাইতো তোমাকে উনি হণ্য হয়ে খুঁজে যাচ্ছেন। আর এই জন্যই তোমাকে আমি নিজের কাছে রেখেছি। আর রইলো সেই লকাপ তা আজ পর্যন্ত তার হিফাজতেই রাখা থাকলেও এখন আর নেই।”
” নেই মানে? কোথায় তাহলে?”
তখনি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো কত গুলো পা। তার মধ্য থেকে ভেসে এলো মেহজাবের কন্ঠ,
” এখন সেটা আমাদের কাছে জয়নব!”
জয়নব বিস্ময় নিয়ে চায়। তা দেখে হাসে মেহজাব। বলে,
“কুয়াশা আমাকে সব বলেছে জয়নব..!ওদের এই মিশনে আমিও আছি! মুলত আমি এখানে এসেছিলাম এই জন্যই কিন্তু এখানে কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ বেড়িয়ে এলো। সব থেকে বড় মাস্টারমান্ডের চেহারা এবার স্পষ্ট হলো।”
জয়নব খুশি হলো। যদিও মনে মনে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তবে এতটাও ভঙ্গুর নয় সে। যেখানে রুফাইদার জন্য বদলা সে নিতে পেরেছে… এইটা তো নিজের মায়ের লড়াই.. পুরো দেশের নারীদের লড়াই। জয়নব সপ্তপর্ণ শ্বাস ছাড়লো। অতীত থেকে বেড়িয়ে বর্তামনে পা রাখলো। রাহুলের মুখোমুখি হয়ে সকলের সামনে বলল,
” বাবা…! ”
রাহুল খন্দকার খানিকটা অবাক হলেও মেয়েটির চেহারা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না এই সে তার হারিয়ে যাওয়া মেয়ে। সকলের সামনে অভিনয় করলো রাহুল। মেয়েকে কাছে টেনে ক্রোদনে ভেঙে পড়লো। জয়নব নিজেও তালে তাল মিলালো। উপস্থিত জনগন বাবা মেয়ের মিলন মেলা দেখে আবেগী হলেন। অভিনয়ের এক পর্যায় জয়নব বলল,
” বাবা তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে!”
রাহুল ভ্রু কুচকালো। তার মাথাতেও এখন কিচ্ছু কাজ করছে না। যেই মেয়েকে চিরুনি তল্লাশি করে খুঁজে পায়নি সে হুট করেই কই থেকে এলো। এবং এলো তো এলো সবার সামনে। যেখানে রাহুল মুখ খুলে কিছু বলতে ও পারছে না। তাই সে জয়নবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলল। জয়নব কুটিল হাসলো। হাতের রিমোট চাপ দিতেই একে একে ভেসে উঠলো রাহুলের সাদা মনের কালো, কুৎসিত দিক, দুনিয়া। উপস্থিত সকলেই এতক্ষণ যারা আবেগী হচ্ছিলো তারা ক্রোদে ফেঁটে পরলো। এখানে উপস্থিত নারীদের বলল,
” উনি আপনাদের সব থেকে বড় অপরাধী। আমি আপনাদের হাতেই দিতে চাই। আপনারা যা শাস্তি দিতে চান.. তাই দিতে পারেন।”
” পৃথিবীতে শুনেছি বাবা নাকি তার সন্তানের বিশেষ করে মেয়ের জীবনের সুপার হিরো হয়। কিন্তু আপনি একজন নিকৃষ্ট মানুষ। একটিবার কি মনে হয় নি এসব করার সময়? আপনার মেয়ে আছে?”
জয়নব আবার কিছু মনে করার চেষ্টা করে বলল,
” ও হ্যাঁ আপনি না বললেন? পাপ মানুষকে ধংস করে দেয়..। মানুষ থেকে করে তোলে অমানুষ, হিংস্র, পশু। তখন তার মনে মা, মেয়ে, বোন বলে কিছু থাকে না, যা থাকে তা হলো নারী আর তার শরীর….! একদম ঠিক বলেছেন… আপনি একজন নর পশু। খুব শখ তো আপনার নারীকে মাংসে পরিনিত করার? আজ আপনাকে আমি বুঝাবো মানুষ খাদ্য হলে কেমন লাগে?”
বলেই মেহজাবকে ইশারা করে জয়নব। মেহজাব কিছু পুলিশের সাথে এসে তাকে নিয়ে গেলো।
জয়নব বাঁকা হাসলো। তারপর হেঁটে চলে গেলো আদরের কাছে। আদর দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। জয়নবকে দেখেই আদর জড়িয়ে ধরলো। শেষ পর্যন্ত এই অন্তর্দহন শেষ হলো। এবার প্রণয়ের শুরু। কিন্তু জয়নব নাক ছিটকে বলল,
” সত্যি করে বলুন তো? আপনি মানুষের মাংস খেয়েছেন কি না? একদস মিথ্যা নয়!”
আদর মশকরা করে বলল,
” হ্যাঁ একবার টেস্ট করেছিলাম তো।”
“ছিঃ! আপনি কখনো টাচ করবেন না আমাকে। ইয়াক.. থু থু।”
আদর অবুঝের মতো বলল,
” এমন করছো কেন? আমি তো খেয়ে ব্রাশ করে নিয়েছিলাম!”
জয়নব আরো রাগে ফেঁটে পড়লো। বলল,
” আপনি আমাকে ছুঁবেন না। আমার বমি আসচ্ছে।”
আদর হো হো করে হেসে দিলো। এবং ঝাঁপটে ধরলো জয়নবকে। জয়নব তখনো ধাক্কাতেই লাগলো। এভাবেই চলতে লাগলো তাদের খুনসুটি। তারা এবার হসপিটালের দিকে রওনা হলো। জয়নব শেষ পর্যন্ত তার মাকে দেখবে বুকে জড়িয়ে নিবে। আর অনেক অনেক ভালোবাসবে তার মাকে।
আর ওই দিকে….. গহীন এক জঙ্গলের ভিতর বেঁধে রাখা হয়েছে রাহুলকে। তার চার পাশে ঘুরছে নরখাদক বা ক্যানিবালিজম। এদের দেখেই মনে হচ্ছে এরা মানুষিক ভাবে অসুস্থ। ঠিক তখনি একজন এসেই রহুলের হাত টেনে ধরে এক কোপ বসালো। আর রাহুল গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো। নিজের হাতকে এভাবে চাবিয়ে খেতে দেখে বমি করে ভাসিয়ে দিলো সে। এর পরেই আবার আরেক হাত একই ভাবে কেঁটে নিলো তারা। ধীরে ধীরে কেঁটে, ছিঁড়ে, খুবলে নিতে থাকলো রাহুলের প্রতিটি অঙ্গ পঙ্গ। রাহুলের চিৎকার পুরো জঙ্গলে হারিয়ে যেতে লাগলো। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালো। পরবর্তী চোখ খুলতে আবারো একই রকম হাল হতে লাগলো তার। ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়লো রাহুল। জয়নব রাহুলের সাথে তাই করেছে যেটা করেছিলো ডা. সাহিল, ডা. দেবাশীষ আর তার সহযোগীদের সাথে। হ্যালোজিনেশন। সেই মৌমাছির বিষাক্ত মধু আর ধুতরাফুল দিয়ে। এভাবেই তিলে তিলে মরবে রাহুল। একে বারে মরে গেলে তো সে রেহাই পেয়ে যাবে। কিন্তু রাহুলের পাপ তো এত ছোট নয়? তাকে মরতে হবে ভয়ংকর মৃত্যু।
সমাপ্ত
বিঃদ্রঃ ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। এতদিন এই গল্পটা আঁটকে রেখেছি বলে। আজ ফাইনালি শেষ হলো।
জয়নব বিছানা থেকে নেমে পড়লো। ঘাবড়ে যাওয়া কন্ঠে হাত দিয়ে দরজার কড়া নাড়তে লাগলো,
” দরজা খুলুন কে আছেন? হেল্প?”
বাহির থেকে কারো পায়ের শব্দ হতেই জয়নব থেমে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবারো আওয়াজ করতে শুরু করলো। দরজার কড়া ঘাত বৃদ্ধি হতে দেখে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা কুয়াশা দরজা খুলে দিলো,
” জয়নব এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?”
কুয়াশাকে দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো জয়নব। চোখে মুখে ঘৃণা স্পষ্ট। মুখ কুচকে অন্য দিকে তাকিয়ে রূঢ় কন্ঠে বলল,
” আমরা কাছে কি চাই তোদের? কেন এভাবে খেলছিস তোরা? আমার বাবা-মা, বোন-ভাই… এরা কেন সাফার করছে এসব কিছুতে?”
জয়নব অভিব্যক্তিহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো। কুয়াশা জয়নবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” তুই যেটাকে সাফার বলছিস না? ওটা আমাদের বেলা কিছুই না… আমরা যা ভোগ করছি.. আমরা যতটুকু সহ্য করেছি? তার বিন্দু মাত্র তুই করিসনি!”
জয়নব অবাক দৃষ্টিতে চাইলো। শক্ত গলায় বলল,
” বলতে কি চাইছিস তুই?”
কুয়াশা হাসলো। বলল,
” যাকে তুই গুলি মেরে জমের বাড়ি পাঠালি না? সে আদর উরফ প্রিন্স… না থাকলে তোকেও মেরে কেঁটে কবে ভাসিয়ে দিতাম আমরা জানিস?”
জয়নব চমকে উঠলো। নিজের বান্ধবীর মুখে জয়নবকে মেরে ফেলার কথা শোনে দুই কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। এই কি সেই তার বান্ধবী। যে নাকি মরতে পর্যন্ত রাজি ছিলো জয়নবের জন্য! জয়নবকে চোখে মুখে বিস্ময়কর ভাব দেখে কুয়াশা আবারো হেসে ফেললো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো,
” জানিস? আমাদের একটা বড় পরিবার ছিলো। যেখানে দাদু-দিদা, চাচা-চাচী, ভাই-বোন সবাই ছিলো। ভালোবাসায় ভরপুর ছিল আমাদের পরিবার। আমার বাবা আর আদর ভাইয়ার বাবা ছিলেন আর্মি। বছর ঘুরতেই যখন তারা বাড়ি ফিরতো? হৈ-হুল্লোড়েে মেতে উঠতো সবাই। কিন্তু একদিন আমাদের এই খুশিতে গ্রহন লাগাতে চলে এলো তোর বাবা।”
জয়নবের বুকের ভিতর কেমন যেন একটা করে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,
” আমার বাবা… রাহুল খন্দকার! ”
কুয়াশা জয়নবের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
” হ্যাঁ তোর বাবা… একজন দেশদ্রোহী। অথচ দেখ আজ তিনি এই ভিনদেশের মাটিতে উনাকে পূজা করা হয়… নোবেল মানুষদের মাঝে একজন মানা হয়। অথচ এই লোকটার জন্য আজ আমার বাবা- মা, আদর ভাইয়ের বাবা-মা, কেউ নেই পৃথিবীতে…!”
এ পর্যায় ধরে এলো কুয়াশার কন্ঠ। জয়নব নিজের বাবা… নিজের পরিবার সম্পর্কে এত দিন অবগত ছিলো না। যেই নিজের পরিবার আর তার বাবার কথা শুনলো? মনের কোনে এক চিলতে আশা জেগে উঠলো। তার বাবা… তারো বাবা আছে?? জয়নব নিজের ভাবনা চিন্তার মাঝেই আনমনে নিজের মনের ইচ্ছে প্রকাশ করে বসলো,
” আমি… আমি কি আমার বাবাকে দেখতে পারবো?”
কুয়াশা এবার চেঁচিয়ে বলল,
” বাহ্… বাহ্ ভাই বাহ্…! যে পিতার বছরের পর বছর খবর ছিলো না.. তাকে দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছিস তুই? আর যে তোকে এতটা বছর আগলে রাখলো? ভালোবাসলো? অথচ একটা বার তার কথা জিজ্ঞেস করলি না পর্যন্ত? ”
জয়নব কিছুই বুঝতে পারলো না যেন। তাকিয়ে রইলো শুধু। কিছুক্ষণ পর রা বের হলো,
” কি বলতে চাইছিস তুই!”
” আদর ভাইয়া..! কাল থেকে হুঁশ ফিরেনি তার। ২৪ ঘন্টার মাঝে জ্ঞান না ফিরলে… আমরা তাকে হয়তো হারিয়ে ফেলবো!”
জয়নবের নিজেকে অপরাধী মনে করতে লাগলো। সত্যি তো। ও কতটা স্বার্থপর হয়ে গেছে। এ সব ভাবতে ভাবতে চলতে লাগলো কুয়াশার পিছনে। কুয়াশা একটা বড় রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজা ঠেলে ভিতরে চলে এলো। জয়নব গুটি গুটি পায়ে পিছনে ঢুকতেই বুকের ভিতর ধক করে উঠলো। আদরের নিথর দেহো পড়ে আছে বিছানায়। ফ্যাকাসে মুখ, শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট আর চলছে ড্রীপ দেখে জয়নবের বুক হু হু করে উঠলো।ইশ কি হাল করেছে মানুষটার জয়নব। তখনি কুয়াশার ভেজা গলা শোনা গেলো,
” জানিস জান… আদর ভাইয়া আমাদের পরিবারের জান ছিলো। উনি না থাকলে আজ আমি, সাজিয়াপি, ইউয়ান এখনো কোনো রাস্তার ধারে বাস করতে হতো। খেতে হতো ডাস্টবিনে ফেলা যাওয়া খাবার গুলো। জানিস ভাইয়া কখনো কারো কাছ হাত পাততে শিখেনি। আমাদেরও শিখান নি…এর থেকে ভালো মনে হতো তার কাছে ডাস্টবিনে ফেলে যাওয়া আধা খাওয়া খাবার গুলো। আমরা রোজ অপেক্ষা করতাম জানিস? কখন কোনো ভালো খাবার যদি ফেলে যেতো? একদিন এসব সইতে না পেরে আদর ভাইয়া আমাদের জন্য কাজ করতে শুরু করে দিলেন। দিন রাত খেটে আমাদের জন্য খাবার আনতো, কাপড় আনতো। ভাইয়ার কত সেক্রিফাইস করেছে আমাদের জন্য জানিস? যে ছেলে বাড়িতে এক বেলা মাংস রান্না না হলে মুখে খাবার তুলতো না… মাছ হলে সেদিন খাবার বন্ধ ছিলো… সে ছেলে কি না খেয়েছে। ”
হু হু করে কেঁদে উঠলো কুয়াশা। শব্দহীন কান্নার শ্রোত জয়নবের চোখেও। জয়নব আদরের পাশে গিয়ে বসলো। হাতে হাত ছুঁলো। আহ্ কত দিন পর এই লোকটির স্পর্শ পেয়েছে। জয়নব আদরের কঁপালে হাত বুলালো। এই ছেলেটি নাকি এত কষ্ট করেছে জীবন? কই এই ছেলের নিস্প্রভ চাহনি দেখে কেউ কখনো বুঝবে না, তার অতীত টা কেমন ছিলো।সত্যি তো।আদরের ব্যক্তিত্বটাই বুঝি ছিলো অন্য রকম? আদরের সাথে থাকা কালীন কখনো জয়নবকে এঁকা ছাড়েনি আদর। উল্টো ওকে সাহায্য করেছে প্রতিটা প্রতিশোধ নিবার জন্য।জয়নব আদরের হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে রইলো। কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে বড্ড ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,
” এসব কিছু তোর বাবার জন্য জান। এক মাত্র তোর বাবার জন্য!”
জয়নব আর এসব সহ্য হলো না। কখন থেকে তার বাবা এঁটা করেছে, তার বাবা ওটা করেছে শুনতে শুনতে জয়নব ক্লান্ত। সে তো তার বাবাকে চেনে না, জানে না। ছোট থেকে তো সাইফকেই বাবা বলে জানতো। হঠাৎ করেই উদয় হওয়া বাবা আর তার নামে শোনা কথা গুলো হজম করতে না পেরে খানিকটা জোরেই বলল,
” কি করেছে আমার বাবা?”
কুয়াশা বলল,
” কি করেনি সেটা বল? তোর বাবার জন্য আমাদের পরিবারকে সমাজ ছাড়া হতে হয়েছিলো। এক মাত্র তোর বাবার জন্য আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এক মাত্র তোর বাবার জন্য আমার বাবা আর চাচ্চুকে শহীদের দরজা দেয়ার বদলে জঙ্গিবাদ বলা হয়।”
জয়নব এবার বিস্ময়ে আকাশ চুড়ায়। এসব কি শুনছে সে। কুয়াশা বলতে থাকলো,
” দিনটি ছিল রমজান মাসের শেষ রোজা। বাহিরে প্রবল ঝড়। পরিবারের সবাই তখন বাসায়। আজান দিবে ঠিক সেই সময়…. হঠাৎ আমাদের পুরো বাড়ি পুলিশে ঘিরে ফেলে। আজানের মুহূর্তে মুখে পানি টুকু নিতে দেয়নি তারা। আমাদের সবাইকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন আইন ছিলো খুব কঠিন.. তারউপর দেশদ্রোহীর তমকা। পরে আমরা জানতে পারি… এক মিশনে বাবা আর চাচ্চু তোর বাবার অনৈতিক কাজের খবর পেয়েছে তারা। আমেরিকার মতো জায়গায় ১১ টা ব্ল্যাক হোলের মাঝে লুকিয়ে আছে তার রহস্য। এসব কিছু বাবা আর চাচ্চু প্রুফ সহ জোগাড় করেছিলো। লাস্ট পর্যন্ত আইনের কাছে জাবার আগেই তাদের দেশদ্রোহীর তকমাটা লাগিয়ে দিলেন। তবে সেদিন কোনো প্রুভ না থাকায় ছেড়ে দিলেন আমাদের। তবে সেই কাল রাত্রী যেন আরো কালো হতে চলছিলো। কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিলে আমাদের বাসায়…. সেই আগুলো আমরা চারজন বের হয়ে তো এলাম! আর সবাই সেখানেই জ্বলে পুরে ছাই হয়ে গেলো!”
কুয়াশার চোখে এবার যেন ভেষে উঠলো সেই রাতটি। আগুন জ্বলছে, তাদের ঘর জ্বলছে, তার বাবা-মা ছোট ভাইটি জ্বলছে। চিৎকার ভেসে আসচ্ছে। কুয়াশা হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। দু চোখে মুখে হাত চেঁপে ধরলো। বাবা-মা ছোট ভাই আকাশের কথা এখনো মনে পরে কুয়াশার। জয়নব কুয়াশার পাশে এসে বসলো। ওর কাঁধে হাত দিতেই এক ঝাটকায় সরিয়ে দিলো কুয়াশা। আঙ্গুল তুলে বলল,
” দরদ দেখাতে আসবি না। বাপে আমাদের কষ্ট দেয় আর মেয়ে দয়া দেখাতে আসে।”
জয়নব চুপ করে রইলো। ওর কি দোষ এসবে?তখনি কুয়াশা বলল,
” তুই কি ভাবছিস আমি জানি… এ-টাইতো? তুই কেন? কেন তোকেই এসবে টানা হলো?”
জয়নব সত্যি জানতে চায়। সে বড় বড় চোখ করে চেয়ে বলল,
” হ্যাঁ আমি জানতে চাই সব… সব কিছু!”
কুয়াশা কান্নার মাঝেই রহস্যদায়ক হাসলো,
” সব রাক্ষসের আত্মা থাকে কোনো এক পাখির ভিতর।”
জয়নব হা হয়ে গেলো। রাক্ষস, আত্মা, পাখি? এসবের মানে টা কি? কুয়াশা চট করে উঠে দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে বড় বড় পা ফেলে ছুটে চলে গেলো সে। জয়নব তার মাথার মাঝে চলা হাজার টা প্রশ্ন নিয়ে আবারো চলে এলো আদরের কাছে। আদরের বুকে হালকা করে মাথা রেখে ফোপাঁতে ফোঁপাতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো… জয়নব জানেই না….
এদিকে আদর চোখ খুললো। বুকের মাঝে জয়নবকে দেখে থম মেরে রইলো। পরক্ষণেই জয়নব তাকে গুলি করেছে ভাবতেই চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। কি করবে এবার আদর? ভুলে যাবে সব? নাকি বদলা নিবে জয়নবের কাছ থেকে? কি হবে জয়নবের? কি হবে তার বাবা রাহুলের? আর কিভাবে করবে জয়নবকে ব্যবহার তার বাবার বিরুদ্ধে???
#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয় খন্ড
#পর্ব-৮
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
মেহজাব আর কুয়াশার সাথে নেমে এলো জয়নব গাড়ি থেকে। সময়টা দুপুর ১২ টা। চারিদিকে আলোর ছিঁটেফোঁটা শুধু। গা ছমছম পরিবেশ। অথচ এই বাড়িটিতে গত একটা সপ্তাহ আগেই জয়নব এসেছিলো আদরের সাথে। সব কিছু এখন কেমন ধোঁয়াশা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এক অফুরন্ত পথে হাটছে জয়নব। এর শেষ কই?
জয়নব তার ভাবনার মাঝেই একটি চিৎকার শুনতে পেলো। ওঁরা বাড়ির সামনে গহিন জঙ্গল ধরে হেটে আসচ্ছিলো। অথচ এই জঙ্গল সে সেদিন দেখেনি। অবশ্যই কিভাবে দেখবে? তাদের তো রাতে আনা হয়েছিলো কিনা? জয়নব আর মেহজাব পিছনে ফিরলো। কুয়াশা নেই। কঁপালে দুটো ভাজ পড়লো জয়নবের। এদিক- সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কুয়াশা? কুয়াশা কোথায় গেলো?”
” আমার পিছনেই তো ছিলো!”
মেহজাব নিজেও চিন্তায় পড়ে গেলো। ঠিক সেই মুহূর্তে আবারো চিৎকার শোনা গেলো। জয়নবের বুঝতে বাকি নেই এটি কুয়াশার গলা। জয়নব দৌঁড়ে ছুটে গেলো সেই জায়গায়…. কিন্তু বড় বড় গাছ-পালা আর পোঁকামাকরের ডাক শোনা ছাড়া আর কিছুই নেই। জয়নব মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। পিছনে তাকিয়ে মেহজাবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ভাইয়া… কুয়াশা… ভাইয়া… ভাইয়া.. তুমি কই?”
জয়নব আত্মাকে উঠলো। মেহজাব কোথায় চলে গেলো? সে এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো। গহীন জঙ্গলের ভিতর দৌঁড়াতে লাগলো জয়নব। পায়ের নিচে পিশে যাও মরা পাতার মর্মর শব্দ কি বিকট। জয়নব খুঁজতে লাগলো তাদের. ঝড়ে বেঁকে যাওয়া গাছটার সামনে এসে দাঁড়ালো সে,
” কুয়াশা… ভাইয়া… তোমরা কই? ভাইয়া……”
জয়নবের কণ্ঠস্বর ফিরে ফিরে আসচ্ছে। জয়নব সেখানেই হাটু গুঁজে বসে পড়লো। বিলাপ করতে লাগলো। কি হচ্ছে তার সাথে? জয়নব নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলো। নাহ্… তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না… তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছাতেই হবে। এসব ভেবেই নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো জয়নব। মেহজাব আসার আগে তাকে একটি ছোট রিভলবার ধরিয়ে দিয়েছিলো। বলেছিলো,
” সাহায্য করবে তোকে!”
দোনোমোনো করেও নিয়েছিলো। কাছে রেখেছিলো। জয়নব এবার হাঁটা ধরলো পরিত্যক্ত বাড়িটির ভিতরের দিকে। ভিতরে ঢুকতে চোখ দুটি ছানাবড়া জয়নব এর। এই বাড়িটি সেদিন কত সুসজ্জিত ছিলো… আর আজ? ঘুটঘুটে অন্ধকার। আলো যতটুকু আছে তাতে কোনো ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে। কখনো কখনো ঝাঁপটা মেরে উড়ে যাওয়া পাখির আওয়াজ ভেসে আসচ্ছে। জয়নব তার পকেট থেকে একটি লাইট বের পথে আর চারপাশের দেয়ালে মারলো। যদি কোনো ক্লু পাওয়া যায়? জয়নবের ভাবনার মতো কোনো কিছু পেলো না জয়নব। সব পুড়ে ছাই। জয়নবে যেন কি মনে হলো? সে যেই রুমটি থেকে গায়েব হয়েছিলো? চলে এলো সিঁড়ি বেয়ে রুমটির কাছে। ধাক্কা দিয়ে খুলে দিলো। অন্ধকার রুমটির ভিতরে লাইটের আলো পড়তেই ধমকে গেলো জয়নব। এই ঘরটিতে ছবিতে ভরপুর। এখানে এসব কিসের ছবি? জয়নব এগিয়ে গেলো। এই জীর্ণ শীর্ণ বাড়িটির ভিতরে এই রুমটি এতো পরিপাটি? কিভাবে? জয়নব ভিতরে পা বাড়ালো। প্রথম যে ছবিটিতে আলো পড়লো তা একটি ফ্যামেলি পিকচার। যেখনে দুটো ছেলে আর দুজন মধ্যে বয়স্ক মহিলা পুরুষ। বাচ্চা দুটোর একটির চোখ জোড়া আদরের চোখের মতো ফ্যাকাসে। জয়নব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই বাড়িতে ঢুকে যেই ছবিটি সে আগে দেখেছিলো সেখানে আর এখানের মাঝে বড্ড ফারাক… আর তা হচ্ছে এদের বাবা-মা। জয়নব বুঝে গেছে… সেদিন যে মহিলাকে আদর মা ডাকছিলো সে আসলে তার মা নয় অন্য কেউ। তাহলে তাকে কেন মিথ্যা কথা বলল আদর? তাহলে কি আদর তাকে ঠকিয়েছে? জয়নব এবার আরেকটি ছবির দিকে আলো ফেলতেই বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো। এ যে আর কেউ না? এই ছবিটি তার বাবা সাইফের যার উপর বড় করে রেড মার্ক করা। এভাবেই প্রতিটা ছবিতে লাইট ফেলতে জয়নবের ভয়ে হাত পা জমে যেতে লাগলো। চোখ দিয়ে পড়তে লাগলো অনর্গল নোনা জল। সাইফ, ডাক্তার সাহিল, এমন কি এখন পর্যন্ত জয়নব যাদের মেরেছে তাদের ছবিও এখানে? জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। গলার ভিতরে তিক্ত কিছু অনুভব করলো। এসব কি? জয়নব লাষ্ট যে ছবিটিতে লাইট মারলো? তা আর কেউ না…. মেহজাব। জয়নব এবার ঘাবড়ে গেলো। দু কদম পিছিয়ে গেলো ভয়ে। পিছনে কিছু একটার সাথে ধাম করে ধাক্কা খেতেই ফ্লোর দু ভাগ হয়ে যেতেই জয়নব নিচে পড়ে গর্তের ভিতর পরে গেলো।জয়নব মাটিতে পড়তেই ধাম করে শব্দ হলো। হাত-পা এবং কি কঁপাল ফেঁটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে গেলো। জয়নব ‘আহ্’ করে চেচিয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে নিজেকে হুঁশে আনলো জয়নব। এই অন্ধকার গর্তের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেললে চলবে না। জয়নব অন্ধকারের মাঝেই হাতরাতে লাগলো। পরে যাওয়ার সময় লাইটটা যেন কোথা পরে গেছে…।
জয়নব অন্ধকারের মাঝেই গর্তের মধ্য হাঁটতে লাগলো। কালো কুচকুচে অন্ধকার। ভেসে আসছে ভ্যাপসা গন্ধ। জয়নব যেন হারিয়ে যেতে লাগলো অন্ধকারের মাঝে। সেই মুহূর্তেই একটি লাইটার জ্বলে উঠলো। লাইটারের আলোতে ভেসে উঠলো ফ্যাকাসে সেই পরিচিত চোখ জোড়া। জয়নব সেদিকে তাকাতেই থমকে গেলো। চিনা পরিচিত গলা শোনা,
” শেষ পর্যন্ত তুমি আমাকে খুঁজে বের করলেই জান?”
আদরের ভাবলেশহীন কন্ঠে চোখ জোড়া ভড়ে এলো জয়নবের। এই ব্যক্তিটির জন্যই বুঝ দগ্ধ হচ্ছে। জ্বলে পুরে ছাই হচ্ছে। হচ্ছে প্রয়ণে প্রণয়ে অন্তর্দহন! জয়নবের বুকের উপর যেন কেউ পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। নিজের কষ্ট টুকু লুকিয়ে ফেলতে বৃথা চেষ্টা করলো, ধরে আসা কন্ঠে বলল,
” এমন কেন করলেন আপনি? এভাবে ধোঁকা দিলেন আমায়? কি দোষ ছিলো আমার??”
জয়নবের চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো। মাথায় চোট পাওয়ার ফলে ঘুরছে সব। তবুও বহু কষ্টে দাঁড়িয়ে আছে সে। ডা. আদর লাইটারের আলোর মাঝেই চোখ রেখে আছে। জয়নবের প্রশ্নবিদ্ধ চেয়ে থাকা জয়নবের উদ্দেশ্যে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে বলল,
” তোমার বাবার জন্য জান…!”
জয়নব চকিতে তাকালো….
” বাবা.. বাবার জন্য মানে? আরে আমার বাবা তো আপনাদের জন্য মারা গেছে। তার সন্তানকে যে কেড়ে নিয়েছেন!”
আদর হাসলো। বাম হাতে চুটকি বাঁজাতেই ফকে ফকে হয়ে গেলো সব। তীব্র আলো চোখে বাঁজতেই নিচে বসে পড়লো জয়নব। চোখ দুটি জ্বলছে খুব। আদর তখন স্থীর। ওকে ঘিরে যেন আছে অন্ধকার গোলোক। জয়নব ধীরে ধীরে চোখ খুললো। চোখ দুটি লাল হয়ে গেছে জয়নবের। মাথা গড়িয়ে পড়া রক্তের ফোঁটা গুলো টপ টপ করে পড়ছে এবার মাটিতে। আদর এবার উঠে এলো। মাটিতে পড়ে থাকা জয়নবের মাথাটা তুলে নিজের বুকের মাঝে রাখলো। পরম যত্নে আদরে জয়নবের মুখের আদল খানি হাত দুটোর মাঝে ভড়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” জান…রুফাইদা আমাদের টার্গেট ছিলো না… ছিলে তো তুমি!”
জয়নবের চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেলো। আদর কথা আগে বাড়ালো,
” সাইফ আঙ্কেলের পালক মেয়ে রুফাইদা ভেবেই আমরা ওকে উঠিয়ে ছিলাম। কিন্তু যখন জানতে পারি সেই মানুষটা যাকে আমরা খুঁজছি? সে আর কেও না… তুমি! তখনি বড় ধরনের গেইম খেলে ফেললাম আমরা!”
জয়নবের চোখ জোড়া এবার বুঁজে আসতে চাইছে, আধো খোলা চোখ জোড়া নিয়ে দেখছে এই মানুষটাকে এই মানুষটা কি সত্যি সেই? জয়নব তার ভাড়ি পল্লব গুলো শক্ত করে বুঝে নিলো। তা দেখে আদর হাসলো চোখের কোনের জল টুকু মুছে দিয়ে বলল,
” জান.. টুইস্ট তো এখনো বাকি!”
জয়নব আবার চোখ মেললো। গায়ের সব শক্তি শুসে নিয়েছে যেন কেউ। তখনি আদরের গম্ভীর কন্ঠে শোনা গেলো,
” আমরা আদরের কাজিন জয়নব! আর আমি তোমার দেবর!”
সাজিয়া, ইউয়ান আর কুয়াশা এক সাথে কথা বলতেই জয়নবে পুরো পৃথিবী ঘুরতে লাগলো। জয়নব অনেক কষ্টে বলল,
” সাজিয়া আপু তুমি… তুমি তো মারা গেছো? আর কুয়াশা তুই তো….!”
” তোর বন্ধু তাই তো? ”
জয়নব জিন্দালাশের মতো শুধু চেয়ে রইলো। সবাই… সবাই তার সাথে এভাবে গেইম খেললো? তাহলে মেহজাব? মেহজাব কই? কিছু সময় অতিবাহিত হতেই জয়নব জিজ্ঞেস করলো,
” মেহজাব ভাইয়া…!”
এবার আদরের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। জয়নবের দিকে তাকিয়ে বলল,
” শালা বাবুকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে। ”
জয়নব বুঝতে পেরে আদরের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
” তাকে ছেঁড়ে দিন!”
আদরের ঠোঁটের কোনে ভয়ানক হাসি। বলল,
” এর জন্য তোমাকে অনেক বড় বলিদান দিতে হবে জান!”
ইউয়ান এতক্ষণে মুখ খুললো,
” ভাইয়া… ভাবিকে এভাবে কেন কষ্ট দিচ্ছো? ছোট প্রাণ। ”
বলেই বাঁকা হাসলো। জয়নব এসব ঠাট্টা বুঝতে পেরে আদরকে ধাঁকিয়ে উঠে পড়লো। মেহজাবের দেয়া বন্দুকটা পকেট থেকে বের করে পয়েন্ট করে বসলো আদরের দিক। আদর মুচকি হাসলো,
” জান … তুমি কি আমাকে মারতে পারবে?”
জয়নবের এত দিনের রাগ, ক্ষোভ, ধোঁকায় সব কিছু মিলিয়ে হিংস্র করে তুলেছে। জয়নব চেঁচালো,
” মেহজাব ভাইয়া কোথায়??? নয়তো আমি আপনাকে মারতে এক মিনিটও ভাববো না!”
আদর হাসলো। বন্ধুকে খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
” আমি প্রতিনিযত মরছি জান… তুমি আমাকে কি মারবে? তুমি আমাকে কখনো মারতে পারবে না জান।”
জয়নবের মাথা জেনো ভুত চেপে বসেছে। সে কিছু না ভেবেই বন্দুকের টিগার চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে গুলি এসে লাগলো আদরের বুকে। আদর একেবারে থম মেরে গেলো। বুকের মাঝে হাত রেখে জয়নবের দিকে তাঁকালো। জয়নব তখন কাঁপছে। হাতে বন্দুক টা-ও ছুটে পড়ে গেছে দূরে। আদর জয়নবের সামনে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লো। হাসতে হাসতে বলল,
” জান… ইউ আর ব্রেভ গার্ল। ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের হাতে মারতে সত্যি সাহস লাগে।”