Monday, June 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1058



অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৭

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৭।
গভীর রাত। ইট পাথরের রাস্তায় জনমানবশূন্য হয়ে আছে। শব্দ ভেসে আসছে শুধু কেউ একজনের প্রাণপনে দৌঁড়ে চলার। নিরবতায় ঘিড়ে থাকা চারপাশ আর ঝিঁঝি পোকার ডাক এক ভৌতিক অনুভূতির সৃষ্টি করছে যেন।অনেকটা পথ ছুটে চলায় খালি পায়ের চোট গুলো থেকে বেড়িয়ে আসা রক্ত গুলো সাক্ষী দিচ্ছে জয়নবের কঠিন একটি পথ পাড়ি দেয়ার। জয়নব এবার থামলো। হাপাতে লাগলো। অপরিচিত এক শহরে কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না। বুক ফাঁটা চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে জয়নবের। জয়নব এবার চারপাশে তাকালো। যত দূর দেখা যায় বড় বড় গাছ আর জঙ্গল। হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে শেয়ালের হাঁক। ভয়ে গলা শুকিয়ে যাচ্ছে জয়নবের। জয়নব আর দৌঁড়াতে পারছে না। চাঁদের হালকা আলোয় একটি বট গাছের নিচে ঠাই নিয়েছে সে । গাছের দিকে হেলে এবার তার বুকের ডান পাশের ক্ষতটি দেখলো জয়নব। কিছুক্ষণ আগেই ধারালো ছুরি চালিয়েছে এখানে, এবং বের করে নিয়েছে ইউয়ানের ফিট করা ডিভাইসটি। জয়নব এবার ক্ষতটিতে আবারো ভালো করে কাপড় বেঁধে নিলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে আবারো আঁধারের মাঝে জায়গাটি দেখতে বৃথা চেষ্টা করলো জয়নব। ব্যর্থ হলো আবারো। হা করে হতাশার শ্বাসটি ফেললো। ধীরে ধীরে চোখ বুজে গা এলিয়ে দিলো গাছের সাথে চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরোনো স্মৃতি। আদর, জয়নবের বাবা-মা, রুফাইদা। সবার কথা…এসব ভাবতে ভাবতেই এক পর্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে জয়নব। যখন চোখ খুলে তখন নিজেকে পায়.. এক আলিশান বাংলোর একটি কামরায়। চারিদিকে তখন আলো ফুঁটেছে। সোলালী রোদের আলো খেলা করছে ঘরটির আনাচে-কানাচে। নিজেকে এভাবে অন্য একটি জায়গায় আবিষ্কার করেই ভয়ে কেঁপে উঠলো জয়নব। বিড়বিড় করে বলল,

” ইউয়ান আমাকে আবার ধরে ফেলেছে?”

মনের কোনের ভয় নিয়ে নিচে নেমে এলো জয়নব। ঠিক তখনি একটি চিকন কন্ঠ ভেসে আসলো, যে ইংরেজিতে বলে যাচ্ছে,

” ম্যাম গুড মর্নিং। এখন কেমন লাগছে?”

জয়নবের মাথা কাজ করছে না। সামনের ব্যক্তটিকে দেখে যতটুকু বুঝতে পেরেছে, মহিলাটি মাঝ বয়সি নারী, হয়তো এখানের সার্ভেন্ট। জয়নব মাথা কাত করলো,

” ইয়া আই এ’ম ফাইন। আপনি কি বলতে পারবেন আমি এখানে কিভাবে এলাম?”

মহিলাটি মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো,

” আমাদের প্রিন্স আপনাকে নিয়ে এসেছিলো মিস!”

জয়নব ভাবনায় পড়ে গেলো, এই প্রিন্সটা আবারকে? ইউয়ান নয় তো?” জয়নব আবার জিজ্ঞেস করলো,

” আপনাদের প্রিন্স কোথায় এখন?”

মহিলাটি আবার বলল,

” জানি না মিস। ”

” আচ্ছা।”

এর পর আবার নিরবতা। জয়নব ভেবে যাচ্ছে তার সাথে হচ্ছে টা কি? কেনোই বা একের পর এক নতুন মানুষ এন্ট্রি হচ্ছে তার জীবনে, কেউ ভালো, তো কেউ খারাপ।মেডিকেল কলেজের ঢুকা, প্রতিশোধ নিয়া থেকে শুরু করে এই ভীনদেশে এসে হারিয়ে ফেলা তার স্বামীকে। সব যেন এক গোলোক ধাঁধা। কিছু ঠিক হওয়ার বদলে সব আরো গুলিয়ে যাচ্ছে। কবে হবে এর শেষ? এসবের মাঝের মুল কাহিনি কি? কেনোই বা জয়নব এসবেন মাঝে জড়িয়ে? সব কিছু যেন কোনো গল্পকে হার মানায়। জয়নব তার ভাবনার দরজা থেকে বের হয়ে মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমি কি একটা ফোন করতে পারি?”
” শিউর ম্যাম!”

জয়নব খুশি হয়ে গেলো। টুট টুট করে টেলিফোনের বাতাম গুলো স্পিডে চালিয়ে গেলো। ফোনের ওপাশের প্রতিটি রিং বুকের ভিতর হাতুড়ি পিটাবার মতো শব্দ করে যাচ্ছে। এক পর্যায় ফোনটি উঠালো কেউ। হ্যালো বলতেই জয়নব গড়গড় করে বলতে লাগলো,

” কুয়াশা… ই’টস মি.. জয়নব!”

কুয়াশা অবাক হয়ে হাজারটা প্রশ্ন বিদ্ধ করলো। জয়নব শুরু থেকে শেষ বলতেই কুয়াশা ঠিকানা জানতে চাইলো। কাজের মহিলা থেকে ঠিকানা নিয়ে জয়নব জানাতেই কুয়াশা আধঘন্টার মধ্য আসবে বলে জানালো। জয়নব মনে মনে খুশি হলেও বুঝতে পারছে না.. সব কি সত্যি এত সহজে হয়ে যাচ্ছে? নাকি নতুন কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস? জয়নব তবুও নিজে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। কাজে মহিলাটি তাকে খাবার টেবিলের দিকে ইশারা করে বলল,

” ম্যাম কিছু খেয়ে নিন। প্রিন্স বলেছেন নাস্তা করে যেতে।”

জয়নবের এত কিছুর মধ্যে তাদের প্রিন্সের কথা তো ভুলেই গেছিলো। এবার মনের মধ্যে কেমন জানি প্রশ্ন উঁকি দিতে লাগলো,

” কে এই প্রিন্স?”

প্রায় ১০ মিনিটের মাথায় একটি গাড়ি এসে থামলো বিশাল বড় বাড়িটির সামনে। জয়নব এক প্রকার দৌড়ে বেড়িয়ে এলো। কুয়াশাকে দেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো জয়নব। বান্ধবীকে এতদিন পরে পেয়ে চোখের কোনে জল টলমল করে উঠলো দুজনের। কুয়াশা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,

” আই মিস ইউ জয়নব। তোকে সুস্থ সবল দেখে ভালো লাগাচ্ছে অনেক। তুই দেখি আরো সুন্দরী হয়ে গেছিস, ছেলে হলে এখনি তোকে নিয়ে পালাতাম!”

জয়নব হেসে ফেললো। কাঁধের উপর চাপড় মেরে বলল,
” শুরু হয়ে গেছে তোর আবল তাবল কথা। এখান থেকে চল এখন!”

কুয়াশা সম্মতি দিলো। গাড়ির কাছে আসতেই অন্য প্রান্তের দরজাটি খুলে একজন সুদর্ষণ পুরুষকে নামতে দেখে জয়নব বরফের মতো জমে গলো। রোবটের মতো থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো একজায়গায়।

” জান, কেমন আছিস?”
মেহজাবের কাতর কন্ঠ জয়নবের ভেতরটা নাড়িয়ে দিলো। কিশোর জীবনের প্রথম ক্রাশটি ছিলো তার খালাতো ভাই মেহজাব। মেহজাব নিজেও পছন্দ করতো জয়নবকে, কিন্তু মেহজাবের পরিবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গেছে জয়নবকে সব সময়, যেখানে রুফাইদা ছিলো তাদের রাজকন্যা। তখন না জানলেও এখন জানে জয়নব, তার পরিচিত, তার আইড্যান্টি ছিলোনা বলেই। মেহজাবকে দেখে জয়নব খুব একটা খুশি হয়নি, তবে চমকে গেছে সে। কুয়াশার মুখে জয়নবের বিয়ের কথা শুনে মেহজাব খুব আহত হয়ে গেলেও আদর মিসিং শুনে মনের কোনে এক ফোঁটা আশার আলো দেখা দেয়। তাই তো তার এখানে আশা।মেহজাব এগিয়ে গেলো জয়নবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের ভিতর মিশিয়ে নিতে চায় সে। কিন্তু জয়নব দু কদম পিছিয়ে গেলো।তা দেখে মেহজাব থেমে গেলো। বুকের ভিতরে কাঁচ ভাঙার মতো শব্দ হচ্ছে যেন তার।

কয়েক ঘন্টা পর…..

কুয়াশা বলল,

” তুই সত্যি আদকে খুঁজতে চাষ?কিন্তু কিভাবে?”

জয়নব জানালা দিয়ে বাহিরের পরিবেশ দেখছে। দূরে একটি ডালে দুটি পাখি বসে গল্প করছে তাদের নিজস্ব ভাষায়। জয়নব বলল,

” আমায় ভালোবেসে ডা. আদর অনেক কিছু সাফার করেছে। এবার না হয় আমি হই তার প্রণয়ে অন্তর্দহন। ”

কুয়াশা হাসলো। এক পলক মেহজাবের থমথমে মুখটির দিকে তাকিয়ে থেকে। আবার প্রশ্ন করলো,

” তুই আর কিছু জানিস? ইউয়ান তোকে আর কি বলেছে?”

” তেমন কিছুই না। শুধু বলেছে, আদরকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ব্ল্যাক হোল, মাটির তলায় যাষ্ট এসব বলেছে।”

মেহজাব ব্ল্যাক হোল কথাটি শোনে রিয়েক্ট করলো,

” কি বললে? ”

” ব্ল্যাক হোল!”

মেহজাব বলল,

” দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এই দেশে অনেক গুলো এরিয়া আছে যেখানে মাটির নিজে অন্য দলের মানুষদের অত্যচারের জন্য ঘর করা হয়। এই শহরে এমন তিনটি জায়গা রয়েছে। এই ঘর গুলোকে কালো গর্ত বা ব্ল্যাক হোল বলা হয়। কিন্তু এগুলো তো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”

জয়নব যেন আসার ঝলক দেখতে পেলো,
” মেহজাব ভাইয়া! প্লিজ আদরকে খুঁজতে সাহায্য করো!”

মেহজাব বুকের ভিতর পাথর রেখে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। জয়নবের মায়াবী চোখ জোড়ায় জলের টলমল সে কিভাবে সইতে পারবে? একটা সময় ছিলো জয়নবের জন্য কিছু করতে পারেনি সে। কিন্তু এবার করবেই।

——————

এভাবেই দু’টো দিন কেঁটে গেলো। মেহজাব তার পাওয়ার ইউস করে তিনটি এলাকার খোঁজ করলো। এবং পেয়েও গেলো। গত দুইটি ব্ল্যাক হোল দিয়ে ভড়ে ফেলা। এবার তৃতীয়টির খোঁজে যাচ্ছে তারা। কিন্তু গন্তব্যের যত কাছেই যাচ্ছে না কেন? জয়নব আবকতার শেষ চুড়ায়…

শুধু মুখ ফেঁটে বলল,
” এইটাতো আদরের বাবার বাড়ি!”

কুয়াশা বলল,

” কি বলছিস?”

” সত্যি বলছি! আদর নিজেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলো!”

” কিন্তু কিভাবে? এই বাড়িটি বা এই এরিয়াটা তো পরিত্যক্ত। ”

জয়নবের লোম দাঁড়িয়ে গেলো গায়ের। বলল,

” আমি লাস্ট এ বাড়িটি থেকেই গায়েব হয়েছিলাম!”

কুয়াশা আর মেহজাব একে অপরের দিক তাকালো। ঠিক তখনি মেহজাব বলল,

” আমার মনে একটা প্রশ্ন ছিলো জায়নব!”

” কেমন প্রশ্ন?”

” আদর আর ইউয়ান কি সত্যি ভাই? নাকি এরা এক জনই?”

প্রশ্নটি শুনে জয়নব হতভম্ব হয়ে গেলো,

” হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছেন?”

” তোমার সব কথা শোনার পর আর এই বাড়িটি দেখার পর মনে হচ্ছে। এসবের পিছনে অন্য বড় কোনো কারণ আছে। কারণ এই বাড়িটি যাদের ছিলো, তার প্রায় দশবছর আগেই পুড়ে মারা গেছে। আর তোমার কথা মতোই সেই লোকটি ব্রিটিশ আর্মি ছিলেন এবং তার দুটি ছেলে ছিলো জমজ, একজনের নাম এরিক অন্য জনের নাম এরিকস্যান।”

জয়নবের মাথা এবার ঘুরতে লাগলো। কি হচ্ছে এসব তার সাথে?এ আবার নতুন কি কাহিনি??

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৬

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৬।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌

কোনো এক বিকেলেতে…
ধবরে তুমি হাত..
হাটবো পায় পায়..
শব্দ হবে রিনিঝিনি নূপুরের..
তোমার পায়..
চারিদিকে ঘন কালো মেঘ ঘিরবে..
শব্দ করে বাদ্য-যন্ত্রের মতো
গুড় মুড় গুড় মুড় …
পাখি ফিরবে ঘরে..
মানব ছাড়বে রাস্তা..
আধাঁর নামবে, নামবে মুষলধারে বৃষ্টি।
ভিজবো আমি আর তুমি..
ডুবে যাবো মিষ্টি ভালোবাসায়….

আকাশে আজ মেঘের কান্না। শীতের আরোপ। টিপ টিপ বৃষ্টিতে সেই আরোপ থেকে মুক্ত পেতে চাইছে যেন। বাহিরের আঁধার, তাল মিলিয়েছে। বৃষ্টির ঠান্ডা পানির বিন্দু ফোঁটা প্রবেশ করছে মাস্টার বেডরুমটিতে। খোলা জানালার বড় পর্দা ফড়ফড় শব্দ করে উড়ছে। মিষ্টি কিছু ফুলে ঘ্রাণে ঘর ভর্তি…। জয়নব টিপ টিপ করে চোখ খুললো। শরীরটা তার ভিষণ ব্যথা। মনে হচ্ছে ১০০ টা চাবুকের আঘাত পড়ছে সারা গা জুড়ে। জয়নব ধীরে ধীরে উঠে বসলো। কানের মাঝে ভেসে এলো কিছু কথা গান । পুরোনো কিছু স্মৃতি পাতা উল্টালো। চোখের কোনে জল টলমলে ভড়িয়ে গেলো। এই তো না সেদিন, কাছের মানুষটির মুখ থেকে এমন কিছুই শব্দই না শুনে ছিলো সে। কিশোরী বয়সটা তো এই ছন্দে ঢুবে ছিলো তার মন প্রাণ। কিন্তু সেই ব্যক্তটি যে তখন হারিয়ে গেছিলো। তার পত্র প্রেমিকের প্রথম দেখার সময় টা এখনো মনে আছে জয়নবের। কলেজ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে চলে এসেছিলো ব্রীজে। কিন্তু সেদিন সেই মানুষটি এলো না। এর পর…. ধোয়াশার মতো মিশে গেলো। জয়নব পুরোনো স্মৃতি ভেবেই চোখের কোনে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠলো সচ্ছ নোনা জল। জয়নবের কিছুক্ষণ আগেই জ্ঞান ফিরেছে। নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে সে জ্ঞান হারাবের আগেই কি হয়েছিলো, সব ধীরে ধীরে বুঝতে পারলো ।

ঠিক তখনি খেয়াল করলো তার বা পাশের সোফা টায় কেউ বসে আছে। জয়নব ভালো করে তাকালো। আলো আধাঁরি খেলার মাঝে চিন্তে বিন্দু মাত্র অসুবিধা হলো যে সামনের ব্যক্তিটি কে… জয়নবের কেন জানি ভয় লাগলো। জানালা দিয়ে বয়ে আসা শীতল হাওয়া শরীরের মাঝে লাগতেই লোম যেন দাঁড়িয়ে গেলো জয়নবের। এক মুহূর্তে মনে হলো তার ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে হাত পা.. জমে গেছে জিব৷ তবু-ও বহুত কষ্টে বিছানা ছেড়ে মাটিতে পা ফেললো। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

” ডা. আদর… ইট’স ইউ?”

ব্যক্তিটি কথা বলল না.। কিন্তু জয়নবের মনে হলো এক তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া তার শরীরের ভিতর বাহির ছেদ করে চলে যাচ্ছে। তার উপস্থিতি কিছু ভয়াবহ অনুভূতির সৃষ্টি করছে। জয়নব থেমে গেলো। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে আবার বলল,

” আদর…!”

এই পর্যায় রুমটির ভিতরে ঝলমলে করে উঠলো আলোর রাশি…। হঠাৎ আলোয় জয়নব চোখ মেলে তাকাতেই পাড়লো না… আর যখন তাকালো? সামনের ব্যক্তিটির মুখ নিজে নুয়ে রাখা। জয়নবের এ পর্যায় ভয় করতে লাগলো। গলা যেন শুকিয়ে যেতে লাগলো। মনে মনে ভাবলো,

” আদরের উপস্থিত এভাবে তো আমাকে কখনো কাঁপায় নি? তাহলে? সে কি আদর না??”

জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। নিরবতার বিরাজমান। তবুও যেন জয়নবের ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ তীব্র। এবার ব্যক্তিটি নিজেই তাকালো সরাসরি। চোখে মুখে ঠান্ডা। জয়নব সোজাসোজি লোকটির চোখেরর দিকে তাকালো। সাথে সাথে দু কদম পিছিয়ে পড়লো। ভয়ে রীতিমতো হাত পা কাঁপতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলল,

” এ- তো আ… দরের ভাই…!”

জয়নবকে এভাবে কাঁপতে ব্যক্তিটি কথা বলল,

“জান? আর ইউ স্ক্যারেড?”

জয়নব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো সামনের ব্যক্তিটি ঘন কালো কুচকুচে চোখ জোড়ায়…! সে কি বলবে? কি করবে? বুঝতে পাড়ছে না। তার মনে পড়ছে বার বার… এই চোখ জোড়া যে পরিচিত। খুব কাছে থেকে দেখেছে এই চোখ জোড়া…হঠাৎ কিছু মনে পড়লো। বুকের মাঝে ধক করে উঠলো জয়নবের। হালকা চিৎকার করেই বলল,

” ইউ ইউ আর ন’ট আদর?”

ব্যক্তিটি হাসলো। হাত দুটি সোফার দু পাশে রেখে আরাম করে বসলো। মুচকি হাসি দিয়ে বললো,

” সো, হো আ’ই অ্যাম?”

ব্যক্তিটির কন্ঠে তাচ্ছিল্য মাখা। জয়নবের ভয়ে এদিকে গা হীম। সারা শরীর জুড়ে হয়ে আসচ্ছে অসাড়। মনে পড়ছে বার বার হোস্টের প্রথম রাতের সেই চোখ জোড়ার কথা… সেই তীক্ষ্ণ কন্ঠের বলা কিছু কথা….,

” তুমি আমার অন্ধকার রাজ্যের রাণী!”

জয়নব এবার পিছিয়ে যেতে লাগলো ভয় মিশ্রীত কন্ঠে বলল,

” ইউয়ান…!”

ইউয়ান হাসলো। বলল,,

” ওহো বেবি গার্ল ইউ নো মি?”

জয়নব এবার পালাবার জন্য পিছনে ফিরে এক দৌড় লাগালো। এবং দরজা খোলা চেষ্টা করলো। কিন্তু.. কিন্তু দরজা লকড। পিছন থেকে আবারো ভেসে এলো ইউয়ানের কন্ঠ,

” সিলি গার্ল? তুমি পালাতে পারবে না!”

জয়নব চেষ্টা চালিয়ে গেলো। তার মনে হতে লাগলো এই জায়গায় বেশিক্ষণ থাকলে মরে যাবে মাথা ফেটে। সে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,,

” সামবডি হ্যাল্প’স মি। প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর। আন্টি, আন্টি হ্যাল্প। আদর? হোয়ার আর ইউ? প্লিজ হ্যাল্প প্লিজ!”

কিন্তু কোনো রেসপন্স করলো না কেউ। শুধু শোনা গেলো দূরে কোথাও ডেকে উঠা শিয়ালের হাঁক। জয়নব কাঁদতে লাগলো। বাড়ি দিতে দিতে হাতে ছাল তুলে ফেললো। কিন্তু এলো না সাহায্যের জন্য। ঠিক তখনি পিছন থেকে জয়নবের কোমল কোমর শক্ত করে জড়িয়ে নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে নিলো ইউয়ান। তার স্পর্শ গায়ে লাগতেই জয়নব থেমে গেলো। কাঁপতে কাঁপতে পিছনে ফিরতে চাইলো তখনি কানের কাছে ভেসে এলো ইউয়ানের গরম শ্বাস আর তার গলা,

” কেউ আসবে না এখানে সিলি গার্ল!”

জয়নব থমকে গেলো কিছুক্ষণ। তার পরেই ছুটতে চাইলো। বাঁধণ হারা হতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। হেরে গেলো। ইউয়ানের কন্ঠ আবার ভেসে এলো,

” তোমার আদর তোমার কাছে পৌঁছাতে পারবেনা জান। এখানে শুধু ইউয়ানের রাজ৷ ”

জয়নব মুখ খুললো,

” আমাকে যেতে দিন! ”

ইউয়ান হাসলো,

” সিলি গার্ল। তোমাকে কাছে পেতে এত এত ছক কসলাম যেতে দেবো বলে? নো।”

জয়নব ফুপিয়ে উঠলো,

” আদর? আদর কই?”

” সে তো মাটির তলায়!”

জয়নব চকিতে তাকালো। লাল লাল চোখ নিয়ে প্রশ্ন বিদ্ধ করল,

” আপনি নিজের ভাইয়ের সাথে কি করেছেন?”

“তেমন কিছু না যাষ্ট লুকিয়ে রেখেছি!”

জয়নব অবাক হয়ে বলল,

” এমন কেন করছেন? আমাকেই বা কেন আটকে রেখেছেন? ”

এ পর্যায় বাধন মুক্ত হলো জয়নব। ইউয়ানের চোয়াল আরো শক্ত হলো। হাতের মুঠো শক্ত করে বন্ধ করে বলল,

” আমার তোমাকে চাই জান!”

জয়নবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পাড়লো। চেঁচিয়ে বলল,

” ভুলে যাবেন না আমি আপনার ভাইয়ে স্ত্রী। ”

ইউয়ান হাসলো। জয়নব ইউয়ানের হাসি দেখে কেঁপে উঠলো। ভয়ংকর সেই হাসি। ইউয়ান আবারো জয়নবের কাছে আসতে লাগলো আর জয়নব ভয়ে পিছিয়ে যেতে লাগলো। ইউয়ান এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

” ইউ আর মাইন। সেই প্রথম থেকে। যখন থেকে তোমাকে আমি দেখেছি। ভালো আমি তোমাকে বেসেছি। কাছে আমি তোমার গিয়েছি। তোমার শরীরের রক্ত আমি টেষ্ট করেছি। মধ্যে থেকে আদর এসে আমার জিনিসকে কেড়ে নিয়ে চলে গেলো? আর আমি বুঝি তা বসে বসে দেখবো? নাহ্। এই দেখো তোমাকে আমি আমার কাছে নিয়ে এসেছি। এবার তুমি হবে আমার স্ত্রী। ”

জয়নব থেমে গেলো। পিছনে মস্ত বড় দেয়াল বাঁধা দিলো তাকে। ইউয়ান মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লো জয়নবের।আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে লাগলো জয়নবের নাম মুখ আর ঠোঁট জয়নব ভয়ে আধ মরা যেন। ইউয়ান আবার বলল,

” তুমি খুব সুন্দর জান!”

জয়নবের গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। ইউয়ানকে ধাক্কা দিয়ে নিজ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলল,

” আপনি নিকৃষ্ট জীব। ”

ইউয়াস হাসতে লাগলো হো হো করে। এতে জয়নব ঘাবড়ে গেলো। ইউয়ান আবারো জয়নবের গা ঘেসে দাঁড়িয়ে পড়লো। জয়নবের চিবুক টেনে বলল,

” ইয়েস! আই এ’ম! জানো আমি যখন প্রথম তোমায় দেখি? সেদিন ভেবেছিলাম তোমার বোন রুফাইদার মতো-ই তোমার ব্লাডের স্বাদ হবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম তোমার ব্লাডে এক তীক্ষ্ণ ঝাঁঝালো ধাক আছে। যা মাথায় চড়ে বসে। ভেবেছিলাম রুফাইদার শরীরের মাংস আমি টেষ্ট করবো, কিন্তু মাঝখানে আদর এসে ওকে বাঁচিয়ে নিলো। শালা কখনো এমন করে নি জানো? যেই তুমি এলো আদর পাল্টে গেলো। ছেড়ে দিলো সব৷ কিন্তু আমি? আমি ওর মতো বেকুব নই। তাই তো ও আজ মাটির তলায়… আর তুমি আমার বাহু ডোরে আবদ্ধ! ”

জয়নবের কান যেন ফেঁটে যাবে এবার। সে ভয়ে ভয়ে বলল,

” তার মানে আদর এসবের মাঝে ছিলো না?”

” নাহ্! বেচার তোমাকে প্রতিবার বাঁচিয়েছে।”

জয়নবের মন এবার ভার হয়ে গেলো। চোখের সামনে ভেসে এলো আদরের মুখটি। জয়নবের চোখ থেকে অজানতেই গড়িয়ে পড়লো জল। তীক্ষ্ণ ধাঁরালো কিছু নিজের গলায় অনুভব করতেই জয়নবের ধ্যান ভাঙ্গলো। জয়নব বুঝলো ইউয়ান তার গলায় কামড় বসিয়েছে। জয়নব চিৎকার করে উঠলো,

” আহ্….!”

তীব্র ব্যথায় জয়নবের মনে হচ্ছে মরেই যাবে। জয়নব যখন আর লড়াই করতে না পেরে পাশে থাকা ফুলদানি নিয়ে ইউয়ানের মাথায় বাড়ি বসালো। ইউয়ান চিৎকার করে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এদিকে জয়নবের কলারবন থেকে গড় গড় করে ব্লাড বেড়িয়ে যেতে লাগলো। জয়নব নিজেও মাটিতে বসে পড়লো। চোখের সামনে সব ঘোলা দেখতে লাগলো। এক পর্যায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

পরবর্তী যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন যেন আসমানের চাঁদ হাতে পেলো। জয়নব দেখলো ঘরে কেউ নেই অথচ বন্ধ দরজাটা সটান করে খোলা। জয়নব এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌঁড়াতে লাগলো। ঠিক তখনি একটি আওয়াজ হলো জয়নবের ভিতর থেকে। জয়নব থেমে গেলো। শরীরের ভিতরে কোনো ডিভাইস মনে হলো এক্টিভ হয়ে গেছে। আর
সেখান থেকে ভেসে আসচ্ছে,

” কাম ব্যাক জান… আদারওয়াইজ আই কিল আদর!”

জয়নবের পা অচল হয়ে গেলো। ঢুকরে কেঁদে উঠলো। এবং নিজে থপ করে বসে পড়লো। পিছন থেকে ধীরে পায়ে এগিয়ে এলো কেউ। যার ছায়া জয়নবকে ঢেকে দিলো। জেন গিলে নিলো জয়নবকে তার ভিতরে…. ইউয়ান এগিয়ে এসে জয়নবের সামনে হাটু গেরে বসলো। মিষ্টি হেসে বলল,

” তুমি পালাতে পারবে না জান। যেখানেই যাবে, আমি ঠিক এভাবেই জেনে যাবো। জানো কেনো? কারণ তোমার ভিতরে একটা চিপ আমি লাগিয়েছি তুমি যখন যেখানেই থাকবে না কেন… আমি বুঝে যাবো!”

জয়নব অঝড়ে কেঁদে যেতে লাগলো। কান্না রত কন্ঠে বলল,

” কি চাইছেন আপনি আমার কাছে। কেন এসব করছেন?”

ইউয়ান জয়নবের মাথার চুলে আলতো ভাবে হাক বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

” ম্যারি মি!”

জয়নবের কান্না থেমে গেলো। সারা শরীরে টগবগ করে উঠলো রক্ত। ঠাস করে এক চর বসিয়ে দিলো ইয়ানের গালে। ইউয়ান চোখ বন্ধ করে ফেললো। ফর্সা গালে লাল হাতে দাগ স্পষ্ট। জয়নব চেচিয়ে বলল,

” আপনি কতটা নির্লজ্জ। নিজের ভাইয়ের বউকে বিয়ে করতে চাইছেন? আদর জানলে আপনাকে আস্তো রাখবেনা। ”

ইউয়ান নিজের গালে হাত বুলিয়ে বলল,

” আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি কার বউ। তুমি এখন শুধু আমার।”

জয়নব ইউয়ানকে আরেকটা থাপ্পড় মারতে নিলো। রাগে তার গা কাঁপছে। কিন্তু ইউয়ান ধরে ফেললো জয়নবের হাতের কব্জি এবং জোরে মোচড় দিলো। জয়নবের ব্যথায় মাথা ঘুরে উঠলো। ইউয়ান বিশ্রী হেসে বলল,

” ডোন্ট টু ড্যায়ার বেবস। ডোন্ট! আমি আদর নই যে, তোমার এসব সহ্য করবো। সো স্টোপ।”

বলেই জয়নবকে কোলে তুলে নিলো। এবং আগের রুমে এনে বিছায়া বসিয়ে দিলো। জয়নব কাতর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

” প্লিজ ট্যাল মি, আদর কোথায়?”

ইউয়ান জয়নবের খুব কাছে চলে এলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে একটা গভীর চুমু বর্ষণ করলো। জয়নব শিউরে উঠলো। ইউয়ান ফিসফিস করে বলল,

” ব্ল্যাক হোল!”

জয়নব কিছুই বুঝতে পারলো তাকিয়ে রইলো শুধু ড্যাব ড্যাব করে…….ইউয়ান চলে গেলো। কিন্তু জয়নব নিশ্চুপ। বাকরুদ্ধ। মাথায় ঘুরছে হাজার রহস্য, হাজার প্রশ্ন। সব থেকে বড় কথা….

” ডা. আদর কই? আর এই ব্ল্যাক হোলের রহস্য কি?”

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৫

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৫।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌

সূর্য সেই কখন পাড়ি জমিয়েছে। রেখে গেছে তার ছি
ছিটেফোঁটা আলো। যেন কুড়িয়ে নিচ্ছে সেই আলো প্রকৃতির অপরূপ । চারিদিকে ঝাপিয়ে নেমে এলো কিছুক্ষণের মাঝেই কালি অন্ধকার। দূরে পাহাড়, গাছ-পালা কালো ছায়াময়। দূর দিগন্তে থেকে থেকে চলে যাচ্ছে উড়ে পাখিদের দল। জয়নব শূণ্য দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে গাড়ির জানালার বাহিরে। পাশেই বসে আছে আদর। চোখ-মুখ শক্ত। জয়নবের বড্ড অস্বস্তি লাগতে শুরু করেছে। গাড়ির এই অস্বস্তিকর পিনপতন নিরবতা ভেঙ্গে জয়নব কথা শুরু করলো….

” ডা. আদর… আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদরের চোখ-মুখেরের মাঝে রাগের স্পষ্টতা…গভীর। যা দেখে জয়নব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চুপ মেরে গেলো। এবং আবার বাহিরে তাকিয়ে রইলো উদ্দেশ্য হীন… ঠিক সেই মুহূর্তে জয়নব শুনতে পেলে আদরের ঠান্ডা গলা…

” তোমার এটা করা উচিত হয়-নি জয়নব! তুমি জানো না… কত বড় ফাদে পা ফেলেছো তুমি!”

এই-টুকু শুনে জয়নব কিছুটা চমকে গেলে-ও পরমুহূর্তেই হেসে দিলো ফিক করে। তা দেখে আদরে ভ্রু যুগল কুচকে গেলো। জয়নব সেই মুহূর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

” হে জানি তো! যে দিন থেকে আপনাকে বিয়ে করেছি? সেদিন থেকেই মৃত্যু-কে আপন করে নিয়েছি ”

আদর কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তার মনের কোনে, কথাটি যেন সূচের মতো বিধলো। এবার আর রাগ নেই চোখে মুখে। ফুঁটে উঠেছে বেদনার ছাপ। আদর তখন অনুভূতিহীন কন্ঠে বলল,

” তোমার কাছে কি আমি এতটাই খারাপ জান?”

জয়নব ফিকে হাসলো। বলল,

” এর থেকে-ও বেশি!”

এবার বুকের ভেতরটা ভার মনে হলো আদরের। তার ফ্যাকাসে চোখ জোড়াতে নেমে এলো ভয়ংকর বেদনা। আবারো শুরু হলো তাদের মাঝে অদ্ভুত নিরবতা…

ডা. আদর জয়নবকে সে-ই প্রথম দেখাতে-ই পছন্দ করে ফেলেছিলো। যখন জয়নব ছিলো ছোটটি… অভিনব যখন রুফাইদা আর তার ছোট বোন জয়নবের ছবি তাকে দেখিয়ে ছিলো? ঠিক তখন থেকে-ই….
সেই ছোট মেয়েটির আষ্টেপৃষ্টে এভাবে বাঁধা পড়ে যাবে আদর কখন-ও জানতো না। তখন ছিলো শুধু ছোট মেয়েটির প্রতি ভালোলাগা…. কিন্তু যখন মেয়েটি তার স্টুডেন্ট হিসেবে এলো? আদর হারিয়ে গেলো। প্রণয়ে প্রণয়ে দহন করে দিলো তাকে। কত রাত এই ছোট মেয়েটিকে কোনো বিরতি ছাড়া-ই দেখেছে৷ কত যত ছুটে গেছে গভীর রাতের আধারে। যার কিছুটি জানে না জয়নব। আদর ভাবনার গহ্বর অতলে যখন ঢুবে? ঠিক তখনি তাদের গাড়ি গিড়ে ফেলে কয়েকটি গাড়ি। আদর সাথে সাথে ব্রেক কসে। ধীরে ধীরে নেমে আসা কালো পোশাক ধারী লোক ঘিরে ধরে তাদের গাড়ি। জয়নব ভয়ে তাকিয়ে রইলো শুধু আদরের দিকে। আদর ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো তাদের দিকে। বুঝতে আর বাকি নেই এরা কারা…..।

তখনি গাড়ির গ্লাসে লম্বাটে শেতাঙ্গ এর লোক নক করে। এবং স্পষ্ট ইংরেজিতে বলে উঠে,

” স্যার… বস আমাদের সাথে আপনাকে যেতে বলেছেন?”

আদর মাথা নাড়লো। ঠিক তখনি চোখ বড় বড় করে বলল,

” কোন বস? আর আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদর চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণের মাঝে-ই বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে তারা। এবং জয়নবের হাত ধরে তাদের গাড়িতে বসে পড়লো। জয়নব এত এত লোক দেখে ভয়ে আধমরা। হাজারো প্রশ্ন তার চোখে। সে বলল,

” ডা. আদর আপনি কি বলবেন আমরা কোথায় যাচ্ছি?”

আদর এবারো চুপ। গাড়ির সিটে হেলে চোখ বুঝে রইলো। জয়নবের এবার মনের মাঝে কেমন করতে লাগলো। সে এবার রাগে ফোঁসফোঁস করে উঠলো,

” আপনি কি কিছু বলবেন? এরা কারা? আর… আর আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

আদর চোখ বুঝে তখন ঠোঁট নাড়লো,

” তুমি সাপের লেজে পা দিয়েছো। সে কি ছোবল দিবে না?”

জয়নব না বুঝতে পেরে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। তখন আদর হেসে বলল,

” ওয়েট করো কিছুক্ষণের মাঝে-ই সব জেনে যাবে!”

জয়নব চুপ করলো ঠিকি। কিন্তু মনের মাঝে অস্থীকর অনুভূতি নিয়ে। অচেনা ভয় নিয়ে বসেই রইলো।

ঘন্টা খানিক পর….

বড় একটি আলিশান বাড়ির সামনে এসে থামলো আদরের বি এম ডাব্লিউ। জয়নব হা করে দেখছে বাড়িটি। বিট্রিশদের বাড়ির মতো… না না বাড়ি নয় যেন মহল….

” এসো!”

আদরের কন্ঠে ভাঙ্গলো ধ্যান জয়নবের। আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে করতে নেমেলো সে। সুবিশাল অট্টালিকা ঘিরে আছে হাজার হাজার গার্ডসরা। এরা যেন ফিকে করে চলছে এই অট্রালিকার সুন্দর্য।

খট খট আওয়াজ তুলে যখন তারা ভিতরে ঢুকলো তখন যেন আরো চমক। বাড়ির প্রবেশ রাস্তায় একটি বড় ছবি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে হাসোজ্জল কিছু মুখ যা ফ্রেমে বাধাই করা। জয়নব থমকে ছবিটি দেখে। একজন ব্রিটিশ আর্মির সাথে দাঁড়িয়ে আছে এক বঙ্গললনা আর তার পাশেই দাঁড়ানো দুটি সুঠামো সুদর্শণ ছেলে। কাকতালীয় ভাবে ছেলে দুটি জমজ। আর তার থেকে বড় কথা… ছেলে দুজনের চেহারা সেইম। এ দেখে জয়নব চমকে বলে উঠলো,

” ডা. আদর আপনি কোনটা? আর এখানেই বা আপনার ছবি কেনো?”

আদর কিছু বলল না ছবিটি সামনে তার শক্ত পক্ত চোয়াল নিয়ে চেয়ে রইলো। জয়নব আবারো একই প্রশ্ন করতেই আদর তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

“নান ওফ ইউর বিজনেস। ”

জয়নবের ভ্রু কুচকে গেলো। সে বলল,

“আশ্চর্য! এখানে আপনার ছবি, তা কি আমি জানতে পারি না? কেন এখানে আপনার ছবি? কেনোই বা এসেছি এখানে আমরা?”

আদর ভাবলেশহীন ভাবে বলল,

” নো!”

” বাট হোয়াই? আমার কি জানার অধিকার নেই?”

আদর এবার সরাসরি তাকালো জয়নবের দিকে। দু কদম এগিয়ে এলো। ঠোঁটের কোনো অভিব্যক্তিহীন হাসি। জয়নবের হঠাৎ মনে হলো, এই মুহূর্তে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আদর বুঝি অন্য কেউ? জয়নবের মনের কোনো অজানা ভয় হতে লাগলো৷ তখনি আদরের কন্ঠে ভেসে এলো,

” যা হচ্ছে, যা হবে হতে দাও। এই সবে তোমার কোনো কাজ নেই। ডা. সাহির মরে গেছে। তোমার ইনতেকাম, তোমার বদলা তোমার প্রতিশোধ যেটাই বলো, শেষ। আর এখান থেকে নতুন ভাবে অধ্যায় আমি লিখবো। আর এখানের রুলস হবে শুধু-ই আমার। সো বি কোয়াইট। ”

জয়নব এবার খেপে গেলো,

” কি সব আবল তাবল বলছেন? আপনার কথার আগা মাথা তো কিছু-ই বুঝতে পারছি না। আমাকে সব ক্লিয়ার করুন!”

আদর আবার হাসলো। লিভিং রুমের সোফার রাজকীয় স্টাইলে বসলো। এবং বলল,

” তোমার যতটুকু জানার ততটুকু আপাতত জানো। এর বেশি জেনে তোমার কাজ নেই! আর হ্যাঁ এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো!”

জয়নব আরেকদফা চমকালো,

” এখানে থাকবো? এখানে থাকবো কেন? এটা কি আপনার বাড়ি নাকি? সত্যি করে বলুন তো? আপনি আবার আমার সাথে নতুন কোনো গেইম খেলছেন নিশ্চয়ই? আবারো কোনো নতুন নাটক শুরু করেছেন??”

আদর রহস্যময় হাসলো। বসা থেকে উঠে এসে জয়নবের বাহু জোড়ায় শক্ত করে চেপে ধরে হিসহিসি করে বলল,

” জীবন একটা নাট্যমঞ্চ। ”

বলেই হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো জয়নবকে। জয়নব ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু আদরের দিক।

খট খট করে জুতার শব্দ শোনা গেলো সিঁড়ির কোঠার কাছে। জয়নব সাথে সাথে তাকালে৷ একজন মাঝ বয়সি মহিলা পড়নে একটি সুন্দর কলাপাতা রঙ্গে ড্রেস। সেই ছবিটির মহিলাটি। মহিলাটি হেসে এগিয়ে এলো। দু হাত বাড়িয়ে গদগদ সুরে টেনে নিলো বুকে আদরকে,

” ওহো মাই স্যান। ইউ কাম ব্যাক। আই মিসড ইউ সো মাচ!”

আদর নিজে-ও মহিলাকে জড়িয়ে নিলো। কিছুক্ষণ আগের অভিব্যক্তহীন মুখ এখন হাস্যজ্বল। আদর বলল,

” আমি-ও তোমায় অনেক মিস করেছি মা।”

জয়নব মা কথাটি শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। জয়নব জানতো আদরের মা ছোট বেলায় মারা গেছে। তাই তো ডা. সাহির ভ্যারনিকাকে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু??? এই কিন্তুটা টার উত্তর সে মিলাতে পারছে না। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখছে। ঠিক তখনি মহিলাটি জয়নবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” আমাদের বাড়ির বউ নাকি?”

আদর প্রতি উত্তর হাসি উপহার দিলো। তখনি মহিলাটি এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নিলো জয়নবকে। এবং খুশিতে বলল,

” ওয়েলকাম হোম। ”

জয়নব সৌজন্যে পূর্বক হাসলো। তখনি মহিলাটি বলল,

” আমি অর্ণিকা আদরের মা।”

জয়নব চোখ বড় বড় করে বলে ফেললো,

” কিন্তু আদর বলেছিলো?”

মহিলা জয়নবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

” এটাই যে আমি মারা গেছি?”

জয়নব স্ট্যাচুর মতো মাথা নাড়লো। অর্ণিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

” সে অনেক কথা মা। আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে!”

জয়নব চুপ করে রইলো। ভিতরে ভিতরে এক গাদা রাগ পুশতে লাগলো। এই লোকটা তাকে কত মিথ্যা কথা বলেছে? সামনে আর কত সত্যি জানবে জয়নব? এটি কি সবে শুরু? আচ্ছা আদরের চেহারার পিছনে আর-ও ভয়ংকর কোনো চেহারা নেই তো?

জয়নব শুঁকনো ঢুক গিললো। আদরের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক। অর্ণিকা বলল,

” ওকে ঘরে নিয়ে যা, তোর বাবা আসচ্ছে কিছুক্ষণের মাঝেই, তারপর এক সাথে ডিনার করবো কেমন?”

আদর মাথা নাড়লো। অর্ণিকা জয়নবের মাথায় হাত বুলিয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো। অর্ণিকা দেয়ালের পিছনে হারিয়ে যেতেই জয়নব রাগে ক্ষোভে আদরের মুখো মুখো দাঁড়িয়ে বলল,

” বাবা মানে? ডা. সাহির আপনার বাবা নয়? উনি তো মারা গেছেন। আমি মেরেছি বেঁচে গেলো কিভাবে? আর উনি আপনার মা হলে ভ্যারোনিকা কে? ”

আদর এত এত প্রশ্ন শুনেও চুপ। আর ভাবলেশহীন। তা দেখে জয়নবের মাথা আরো খারাপ হতে লাগলো। সে এবার আদরে কলার চেপে চেচিয়ে বলল,

” আমাকে সত্যি টা বলুন। ডা. সাহির উনিকে তাহলে?”

আদরের চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটে উঠলো। জয়নবের হাত দুটো ছাড়িয়ে নিলো। এবং জয়নবের দিকে রাঙ্গানিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

” ডা. সাহির আমার বাবা নয়। উনি শুধু পেয়াদা। ”

জয়নব ভ্রু কুচকে বলল,

” মানে।”

আদর উত্তর দিলো না। উল্টো জয়নবের হাতের কব্জি ধরে টেনে নিয়ে গেলো সিড়ির ঘরের দিকে……….

এবং একটি ঘরের ভিতরে এনে জয়নবে ধাক্কা দিয়ে বিছায় ফেলে দিয়ে তার শক্ত থমথমে কন্ঠে বলল,

” তোমার যতটুকু জানার জেনেছো। এর পর একটি প্রশ্ন নয়। আর হ্যাঁ ডা. সাহির এমনিতে মরতো। তোমার হাতে না মরলেও সে আমার হাতেই মরতো৷ সো দ্যা চ্যাপ্টার ইজ ক্লোজড। স্বামীর সংসারে এসেছো। মন দিয়ে সংসার করো। আর কোনো দিকে কান, নাক দিয়েও না। এর ফল ভালো হবে না কিন্তু!”

বলেই গট গট করে বেড়িয়ে গেলো আদর। জয়নব এখন-ও বিছানার উপর। তার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এটি কি সেই আদর? নাকি অন্য কেউ? আচ্ছা আদরের বদলে অন্য কেউ নয়তো???

জয়নব আবারো আকাশ কুসুম ভাবতে লাগলো। ঠিক তখনি দরজা আবার খুলে গেলো। এবং সাথে সাথে ভিতরে ঢুকলো দুজন নার্স একজন ডাক্তার। এদের দেখেই জয়নবের চোখ মুখ কুচকে গেলো।

” আপনারা? এখানে কেন? কি চাই? ”

কেউ কিছু বলল না। উল্টো নার্স দুজন এসে বেঁধে ফেললো জয়নবের হাত পা। আর ডাক্তার একটি ইনজেকশন বের করে পুশ করে দিলো। সাথে সাথে ঘোলাটে হয়ে গেলো জয়নবের দুনিয়া। চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগলো নোনা জল। চোখ বোঝার আগে শুধু দেখতে পেল আদরের আদল খানি। ভাবলেশহীন ভাবে প্যাকেটে হাত গুঁজে আছে সে। জয়নব এবার চোখ বুঝে ফেললো। কি হতে চলছে জয়নবের সাথে। কেন করছে আদর এসব? এগুলো করার পিছনে কি লুকিয়ে আছে কোনো বড় উদ্দেশ্য????

চলবে,

ভুল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।

অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৪

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৪।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌

আমেরিকার কোনো এক শহরে…. নিরব চারপাশ। এক দুই কিলোমিটার পর পর একটি বাড়ি এই শহরে…. জনশূন্য একেবারেই কম। ভিআইপি শহরের অন্তর্ভুক্ত একটি শহর। সাজানো-গোছানো মনোরোম পরিবেশ। কোলোহল মুক্ত এই পরিবেশে আজ কিছুটা কোলাহল সৃষ্টি হলো পুলিশের হুইসলার এর জন্য।

দিনটি সকাল…. চারিদিকে খেলা করছে মিষ্টি রোদ। ঠান্ডার সাথে পাল্লায় নেমে যেন প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত…। এই মিষ্টি সকাল কারো কারো জন্য যেন দুঃখজনক..

একটি দোতালা বাড়ি ঘিরে আছে পুলিশ। বাড়িটি থেকে ভেসে আসচ্ছে কান্নার শব্দ। জনশূন্য এই জায়গায় এখন মানুষের সমাগম। সবার মুখে এক কথা… ডা. সাহিল ইজ ডেথ!” ডা. সাহিল মারা গেছে!” তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। কেউ কেউ বলছে… উনি সুসাইড করেছেন! আদো কোনটা সত্যি? নিজ কক্ষের বেলকনির নিচে পার্ক করা গাড়ির উপর পাওয়া গেছে তার লাশ…. দেখে মনে হচ্ছে কেউ নখ দিয়ে খামচে নিয়েছে শরীরের চামড়া রক্তাক্ত শরীর…. তারপরেও মনে হচ্ছে এটি সুসাইড….! আসলে কোনটা সত্য?

ডা. সাহিলে স্ত্রী ভ্যারোনিকা… যিনি আমেরিকার একজন ডাক্তার । উনি কান্না করে যাচ্ছেন। পুলিশ তাকে নানান প্রশ্ন করে চলেছেন। তার উত্তর একটাই…

” আমি কিছু জানি না… কাল রাতেও সব ঠিক ছিলো… এক সাথে আমরা পার্টিতে গেছিলাম… তারপর বাসায় ফিরে এলেন তিনি। আমার একটা সার্জারি থাকায় আমি চলে গেছিলাম হসপিটালে। সকালে ফিরে দেখি… উনি… উনি…”

বলতে বলতেই কেঁদে দিলেন। পুলিশ ডেড বডি নিয়ে গেলেন। ডা. আদর, ডা. অভিনব এবং রুফাইদা আর জয়নব-ও এসেছে এখানে। নিজের বাবা মরে যাওয়ার খবরে ভেঙে পরেছে অভিনব-ও। রুফাইদা সামলে নিচ্ছে তাকে…..! কিন্তু ডা. আদর কঠিন মুখে তাকিয়ে আছে জয়নবের দিকে। জয়নব ভাবলেশহীন….

কি হয়েছিলো ডা. সাহিলের সাথে………

লাল, হলুদ আলোয় সজ্জিত হয়ে আছে ক্লাব। ডা. সাহিল নিজের বউ ছেড়ে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে অন্য এক রমনীর সাথে। থেকে থেকে করছে আলিঙ্গন। ভ্যারোনিকা দূর থেকে কষ্ট পেলেও.. কিছু করার নেই… ডা. সাহিলকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন উনি। কিছুটা আবার পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে বৈকি…. ভ্যারোনিকা না সইতে পেরে সরেই গেলেন। নিজ স্বামীকে অন্য কারো বাহু ডোরে কেই বা দেখতে চায়?

সাহিল ড্রীংক করছিলো। এতটাই ডুবে ছিলো নেশায়… যে বুঝতেও পারলো না…. কখন কেউ এসে তার গ্লাসে বিষাক্ত ব্লিচড ডেলে দিলো। গটগট করে যখন খেয়ে নিলো সবটুকু । কেমন জানি তিক্ততা অনুভব করলো সে। তবুও পাত্তা দিলো না সে….

কিছুক্ষণ পর ভ্যারোনিকা এসে বলল,

” আমার যেতে হবে, সার্জারি আছে একটা!”

নেশায় বুদ সাহিল হাত নাড়ালো। দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো ভ্যারোনিকা। বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো ক্লাব থেকে। কিন্তু সকালে যখন ফিরলো? সাহিল আর নেই…৷৷

জয়নব সাহিলের ডেথ বডির সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসলো। খোলা চোখ জোড়া সাহিলের… দেখে ভয়ংকর মনে হচ্ছে। এই বুঝি ছুটে এসে চেপে ধরবে জয়নবের গলা। জয়নব ভয় পেলো কিছুটা। তবুও চুপ রইলো। কিছু মুহূর্ত এভাবেই কেঁটে গেলো। পুলিশ লাশ নিয়ে বিদেয় হলো। তার পর মুহূর্তেই একটা শক্ত পক্ত হাত চেপে ধরলো জয়নবের হাত…. টেনে নিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। জয়নব ভয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো। সামনে ভেসে উঠলো আদরের হিংস্র মূর্তি। জয়নব শুকনো ঢুক গিললো। ভয়ে ভয়ে বলল,

” আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

আদর তার ফ্যাকাসে চোখ জোড়া মেলে ঠান্ডা দৃষ্টিতে তাকালো। জয়নবের বুক কেঁপে উঠলো। যেমন একটি সাপের পায়ে পা দিলে যেভাবে ছোবল দিতে চায়? ঠিক তেমনি ছোবল দিবে যেন আদরের দৃষ্টি। জয়নব চোখ সরিয়ে নিলো। গাড়িতে উঠবে ঠিক সেই মুহূর্তে রুফাইদার আওয়াজ ভেসে এলো,

” ডা. আদর জয়নবকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?”

আদর জয়নবকে বসিয়ে নিজেও বসছিলো রুফাইদার কন্ঠ শুনে থেমে গেলো। রুফাইদার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

” আমার বউকে আমি কোথায় নিয়ে যাবো? তা বলতে আপনাকে আমি বাধ্য নই!”

রুফাইদা ভ্রু জোড়া কুচকে তাচ্ছিল্য ভাবে বলল,

” বউ! হাহ্। কাউকে জোর করে বিয়ে করলেই কেউ বউ হয়ে যায় না মি.!”

আদর এবার ক্ষ্যাপে গেলো। মুখের অভিব্যক্তি পরিবর্তন হতে লাগলো। বলল,

” ভাবি আজকাল খুব কথা বলতে শিখেন দেখছি। ডা. সাহিল মরার পিছনে যদি আপনার হাত হয়? আমি কিন্তু ছেড়ে দেবো না কাউকো!”

রুফাইদা ঘাবড়ে গেলো। তা দেখে চট জলদি জয়নব বলল,

” বড়পু আমি বাসায় গিয়ে তোমার সাথে কথা বলবো!”

রুফাইদা মাথা নাড়লো। তীক্ষ্ণ দৃস্টি মেলে তাকালো আদরের দিকে। আদর আর কোনো দিকে না তাকিয়ে গাড়ি চালিয়ে স্বা করে চলে গেলো।

আজ কদিন যাবত আদর জয়নবকে একটি ফোন দিয়েছিলো কথা বলার জন্য। কিছুটা ছাড় দিয়ে ছিলো বন্দিজীবন থেকে। কিন্তু তার এই সুযোগের ব্যবহার জয়নব করে দিয়েছে। তাই তো আজ সাহিল নেই….! এদিকে জয়নব ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। সব কিছু উপেক্ষা করলেও আদরকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। লোকটি তাকে যেমন পাগলের মতো ভালোবাসে, তেমনি তার পালক বাবা সাহিলকেও ভালোবাসতো। যদিও লোকটির চরিত্র ভালো ছিলো না। তাতে কি? আদরের মতো ছেলেকে মাটি থেকে কুড়িয়ে এনেছিলেন, লালনপালন করে বড় করেছেন, দু মুঠো ভাত দিয়েছেন। সেই লোকটির মরার পিছনের কারণ তারই বউ.. তার ভালোবাসা। জয়নব যেন সাহিলকে কিছু করতে না পারে… তাইতো বিয়ে করেছিলো সে জয়নবকে। আর অথচ তাই হলো! সাহিল আজ মৃত। ভাবতেই আদরের মুখের এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হতে লাগলো।

এদিকে জয়নব ভয়ে গুটিশুটি মেরে থাকলে-ও মনে তার শান্তি। জয়নব যানে আদর তাকে বকাঝকা ছাড়া তেমন একটা কিছু করবে না। বড়োজোর ঘর বন্দি করবে আবার। তাতে কি? তার প্রতিশোধ নিয়া তো হয়েছে! কিন্তু আসলেই কি সত্যি জয়নবের শত্রু শেষ হয়েছিলো? জয়নব সব বাদ দিয়ে ভাবনায় চলে গেলো,

কাল রাতে রুফাইদার সাহায্য বিষাক্ত ব্লিচডটি মিলিয়ে দেয় সাহিলের ড্রিংক্সে। তার পর থেকেই শুরু হয় হ্যালুসিনেশন। এর মাঝেই আসে একটি ফোনকল…. ওপাশ থেকে ভেসে আসে তীক্ষ্ণ ধারালো কন্ঠে,

” সাহিল… তোর মরার সময় ঘনিয়ে এসেছে।৷ সামনে দেখ এখন পর্যন্ত যাদের মেরেছিস! সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

সাহিলের মাথায় কথা গুলো কেমন যেনো ঘুরপাক খেতে লাগলো। সামনে তাকিয়ে দেখলো, দাঁড়িয়ে আছে আয়ান, দেবাশীষের মেয়ে, ওয়ার্ড বয় দুজন, এছাড়া আছে অনেকেই… যাদের অপারেশনের মাঝে কিডনি গুর্দা ফুসফুস চুরি করে নিয়েছিলো সে। ডা. সাহিল চোখ ঢলে ভালো করে চাইলে, নাহ্ সে স্বপ্ন দেখছেনা এটা বাস্তব। দাঁড়িয়ে আছে শত শত মৃত মানুষ। যাদের শরীর থেকে বেড়ি যাচ্ছে পুঁজ, পোকা মাকড়। দেখেই বমিতে ভাসিয়ে দিলেন সাহিল। ভয়ে চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তার। সুন্দরী রমনী ছেড়ে এক রকম পালিয়ে বাসায় চলে আসেন উনি। কিন্তু তাতেও রক্ষে নেই। মৃত দেহে গুলো তাকে তারা করছে যেন। এদের শরীর থেকে বেড়িয়া আসা ময়লা গুলো সাহিলের শরীরে উঠতে লাগলো। সাহিল নিজের শরীর থেকে খামচে খামচে সরাতে লাগলো সব। ঠিক তখনি আয়ান এসেই তার মাথাটা খুলে দিলো। রক্ত ফিনকি যেয়ে যেনো মাখিয়ে দিচ্ছে সাহিলের শরীর। আরেক জন এসে যেন সাহিলের হাত ধরলো। দুইটা ওয়ার্ড বয় ধারালো ছুঁড়ি নিয়ে যেন সাহিলের পেটের এফোড় ওফোড় করে দিলো। সাহিলের কল্পনায় সাহিলকে কাতর করে দিতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সক্ষম হলেও মৃত দেহে গুলো যখন তাকে ঘিরে ধরলো তখনি নিজ রুমের ব্যালকনিতে থেকে ঝাঁপিয়ে পরে সে ঠিক গাড়ির উপর। আর সেখানেই ডেথ। মৃত দেহ গুলো যেন হাসতে থাকলো তার দিকে তাকিয়ে।

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০৩

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
৩।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌

অন্ধকার ঘরটিতে বিছনার উপর এলোমেলো
হয়ে শুয়ে থাকা জয়নব কাঁদতে কাঁদতে এবার হাতে লাগলো। আদরের কিছুক্ষন আগে করা আঘাতে ঠোঁটের কোনে কেঁটে রক্ত বেড়িয়ে গেছিলো। এখন শুকিয়ে আছে। গালে পড়েছে লাল দাগ। গলার মাঝেও রয়েছে আদরের হাতের ছাপ। কৃষ্ণভো মুখখানার হাসিটির বড্ড ভয়ঙ্কর লাগছে এবার। জয়নব এবার সটান করে উঠে বসলো। ঘরটিতে আছে কোনায় কোনায় ক্যামেরা। সব দিকে নজর বুলিয়ে নিরীহ মানুষের মতো চলে গেল ওয়াশরুম। হাই কমোডের উপর বসে পড়লো সে। পাশেই একটি কাঠের কারুকাজ করা সুন্দর একটি টেবিল। তার উপর একটি আয়না। যার উপর ভেসে উঠেছে জয়নবের প্রতিছবি। জয়নব হাসলো। কমাডের পিছন থেকে বের করলো একটি পলি। তার ভিতরে থাকা ক্ষুদ্র একটি ফোন বের করে ডায়াল করলো একটি নাম্বার….

রিং হচ্ছে…
ওপাশ থেকে ভেসে এলো চিকন একটি কন্ঠ…..
জয়নব বলল,

” কুয়াশা… কি খবর?”

কুয়াশা ধীমি আওয়াজ ভেসে এলো,

” এদিকে সব ঠিক। তোর কথা বল! আদর তোকে টর্চার করছে না তো?”

জয়নব আয়নায় নিজের কাঁটা ঠোঁট আর গলার দাগ টা দেখে মৃদু হাসলো।

” নাহ্, কিছু করেনি! ”

” আচ্ছা তো নেক্সট প্ল্যান কি?”

” ডা. সাহির!”

কুয়াশা হাসলো। বলল,

” অ্যাল দ্যা বেস্ট! দেখা হচ্ছে তাহলে আমাদের!”

“খুব শীঘ্রই! ”

জয়নব আবারো বাকা হাসলো। আয়নায় নিজের প্রতিছবি ছুয়ে দিয়ে ভাবলো কিছু অতীত…..

ডা. আদরের সাথে সেই রাতে বিয়ের পর তাকে নিয়ে চলে আসে একটি বাঙলো বাড়িতে। চারিদিক নিস্তব্ধতা, আর সবুজে ঘেরা মাঝ বরাবর দোতলা একটি বাড়ি। চারিদিকে হাট্টা গাট্টা বডিগার্ড…।
জয়নব ভয়ে জড়সড় হয়ে পিছু পিছু । একটি আলিশান ঘরের এসে থেমে গেলো তারা। ডা. আদর তার দাম্ভিকপূর্ণ মুখ খানায় এক অদ্ভুত হাসি এঁকে রেখে। জয়নব তখনো হিমশিম খাচ্ছে নিজের ডিসিশনের উপর। জয়নব ভয়ে ভয়ে চোখ ঘোরালো আসপাশটায়….

ঠিক তখনি কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ ঘনিয়ে এলো ঘরটির কাছে। জয়নব চমকে পিছনে তাকালো। মাথা তার ঘুরছে অগনিত প্রশ্ন। দরজার ওপাশটায় নরম আলো। লোক গুলো মুখ স্পষ্ট নয়… জয়নবের মনে হলো, আদর হয়তো তাকেও তার বোনের মতো বন্দিনী করে রাখবে, হাত-পা বেঁধে টর্চার করাবে। কিন্তু তার ভাবনার ফোঁড়ন ভেঙ্গে গেলো তখন…. যখন আদর একজন উকিল, একজন কাজি আর কিছু কালো পোশাক পরিহিত লোকজনকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। জয়নবের চোখে মুখে তখনো অবাকতা… সে কি বলবে, কি করবে এই মুহূর্তে বুঝতেই পারছেনা। ঠিক তখনি আদর চুটকী বাজালো তার মুখের সামনে। জয়নবের ধ্যানক্ষন যেন ফিরে এলো৷ আদরের দিকে তার ডাগড় ডাগড় চোখে চেয়ে থেকে বলল,

” আমার বোন কোথায়?”

আদর হাসলো মুচকি। জয়নবের মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো। দু হাতে জয়নবে মুখটি তার হাতের মাঝে ভরে মাদক লাগানো কন্ঠে বলল,

” টেনশন করো না জান। আগে বিয়ে হোক? ভাবির সাথে দেখা করিয়ে আনবো!”

“কিন্তু…!”

মুখের কথাটুকু বলতে দিলো না আদর। নরম তুলতুলে ঠোঁটের উপর তর্জনী আঙ্গুল চেপে ধরলো।

“শুশ্… নো মোর ওয়ার্ডস!”

জয়নব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো আদরের ফ্যাকাসে চোখ জোড়ার দিকে। আদর এবার কাজিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” বিয়ে পড়ানো শুরু করুন! ”

হুজুর সঙ্গে সঙ্গে সব রেডি করে ফেললেন। উকিল নিজেও সব গুছিয়ে নিলে যখন কবুল বলার সময় হলো, জয়নব হু হু করে কেঁদে দিলো। কোনো মতোই যখন বলতে পারছিলো না কবুল? তখন আদর জড়িয়ে দরে সবার সামনে। লুকিয়ে ফেলে জয়নবকে তার বুকের মাঝে। নরম আওয়াজে সামলাতে থাকে জয়নবকে।

” জান.. ডোন্ট ক্রাই। প্লিজ কবুল বলো। কাঁদে না জান। বিয়ে হলেই তো যাবো আমরা রুফাইদা ভাবিকে দেখতে।”

জয়নব এবার শান্ত হলো। একে একে ভেসে উঠলো তার পালক বাবা-মা আর বড় বোন রুফাইদার মুখটি। ভেসে উঠতে লাগলো তাদের ছোট সংসারের হাসি খুশি, খুনসুটির মুহূর্ত গুলোর কথা…. জয়নব চোখের ভারি পল্লব জোড়া বুঝে নিলো। নিজেকে শক্ত করলো। আদরের বাহুডোরেই কবুল বলল। আদরের মনে তখন যেন বয়ে গেলো নরম উঞ্চতা। মনের কোনে শুরু হলো যেন আনন্দ মেলা। কোথাও যেন শব্দ করে ফুটলো আতশবাজি। আদরের মনে সুখে সীমা রইলো না। শক্ত করে চেপে ধরে চুমু দিলো মাথায়…! আবেগ মিশ্রীত কন্ঠে বলল,

” জান থ্যাঙ্ক ইউ। আই লাভ ইউ। আই লাভ ইউ সো মাচ…!”

কিন্তু জয়নব শান্ত ছিলো। কঠিন নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে যেন তার দেহে। সব ফর্মালিটি যখন শেষ? জয়নব তখন তার ঠোঁট নাড়লো।

” আমি আপুর কাছে যাবো প্লিজ!”

কাতর কন্ঠে বলল জয়নব। জয়নবের কন্ঠে কতটা মায়া কতটা কষ্ট ছিলো? আদর ঠিক বুঝতে পেরেছে। আদর বলল,

” চলো!”

জয়নব না চাইতেও তার মুখে হাসির রেখা ফুঁটে উঠলো। আদর তা দেখে নিজেও হাসলো। কাছে টেনে নিয়ে বেড়িয়ে গেলো তারা।

কিছুক্ষণ পর….

বাসার পিছনের সাইডে এসে দাঁড়ালো তারা। জয়নব অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে বলল,

” এইখানে কেনো?”

আদর জয়নবের গালে হাত বুলিয়ে বলল,

” এখনি জানতে পারবে!”

কিছু দূর যাওয়ার পর একটি ঘরের সামনে এসে পড়লো তারা। সুন্দর গোছানো পরিপাটি রুমটির এক কোনায় খাঁচার মাঝে বন্দী রুফাইদা তার পাশেই বসে আছে অভিনব তার পায়েও শিকল পড়ানো। খাঁচার ফাক দিয়ে, রুফাইদার হাত তার হাতের মুঠোয় ভরে রেখেছে। দুজনেই জেনে গভীর নির্দ্রায়। দেখে মনে হচ্ছে একটা যুগলের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই খাঁচা আর শিকল। জয়নবের বুক মোচড় দিয়ে উঠলো। আদর কাউকে ডেকে বলল,

” খুলে দাও!”

খাঁচার দরজা খুলে গেলো। এত দিনের বিচ্ছেদের বোনের জন্য আকুলতা আর সইতো পারলো না সে। এক ছুটে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদতে কাঁদতে ডুকরে উঠলো। এদিকে শরীরে কারো ভর অনুভব করতেই রুফাইদা তার প্রাণহীন চোখ জোড়া নিয়ে তাকালো। বোনকে নিজের এতো কাছে দেখে যেন শক্ড খেলে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যেন রুফািদার। মনে হচ্ছে কোনো ভ্রম। মনে হচ্ছে তার স্মৃতি শক্তি খেলা করছে তার সাথে। বার বার চোখের পলক ফেলে ধাতস্থ করলো নিজেকে। যখন বুঝতে পারলো এটি তার ভ্রম নয়! তখনি বোন জড়িয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো রুফাইদা। রুফাইদার কান্নার শব্দে অভিনব নিজেও জেগে উঠলো। অবাক হয়ে দেখতে লাগলো দু বোনের ক্রোন্দন।

এভাবেই কিছু মুহূর্তে কেঁটে গেলো। রুফাইদার যখন হুশ এলো, তার বোন এখানে কি করছে? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো সে,

” তুই তুই কি করছিস এখানে? কেনো এসেছিস এই জাহান্নামে? ”

জয়নব মুচকি হেসে বলল,

” তোমাকে বাঁচাতে বড়পু!”

রুফাইদা অবাক হয়ে বলল,

” তোর এখানে মোটেও আসা উচিত হয়নি! চলে যা যত জলদি সম্ভব চলে যা।”

” আপু আমি তোমাকে মুক্ত করতেই এসেছি। ”

রুফাইদা ম্লান হাসলো। বলল,

” আমার মুক্তি নেই জয়নব। এখানে যারা চলে আসে? তাদের কখনো মুক্তি নেই!”

জয়নব রুফাইদার মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে বলল,

” আছে আপু মুক্তি আছে, আমি তোমাকে মুক্ত করবো!”

রুফাইদার চোখ মুখ যেন চক চক করে উঠলো। বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করতে লাগলো সে। মুলত এত মাস এভাবে একটি রুমে বন্দি থাকতে থাকতে ওর মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। তখনি আদরের দিকে তাকালো জয়নব। আদর যখন তাদের কাছে এলো রুফাইদা ভীত বাচ্চাদের মতো গুটিয়ে নিলো নিজেকে। লুকিয়ে ফেললো জয়নবের পিছনে। তা দেখে আদর বলল,

” রুফাইদা ভাবি! আজ থেকে আপনি মুক্ত। অভিনব ভাইয়ার সাথে আপনি নতুন জীবন শুরু করবেন।”

রুফাইদা ভয়ে ভয়ে তাকালো। জয়নবের পিছন থেকেই বলল,

” সত্যি!”

আদর মাথা নাড়লো। তখনি পিছন থেকে অভিনব হুংকার ছেড়ে বলল,

” আদর? আবার কি নতুন খেলায় মেতেছিস তুই?”

আদর মুচকি হেসে ভাইয়ের কাছে গিয়ে পায়ের শিকল খুলে দিলো,

” ভাই নতুন জীবন শুরু করো। শুভ কমনা তোমাদের!”

অভিনব বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলো শুধু, হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে আদরের মুখের অভিব্যক্তি। এই হাসির পিছনের রহস্য টা কি?”

সেদিন সত্যি রুফাইদা আর অভিনবকে ছেঁড়ে দেয়া হলো। রুফাইদাকে ভালো ট্রিটমেন্টের জন্য দেশের বাহিরে পাঠিয়ে দিলো অভিনবের সাথে। এতে তারা অনেক খুশি।বোনের খুশিতে জয়নব নিজেও খুশি ছিলো সেদিন । এর পর দিন যেতে লাগলো, সময় কাঁটতে লাগলো। বছর ঘুরতে লাগলো। কিন্তু আদর তার প্রণয়ের দহনে পুরতে লাগলো। তার বড় কারণ ছিল জয়নবের গড়া অদৃশ্য দেয়াল। আদর জয়নবের কাছে অনেক আসতে চেয়েছে, গভীর ভাবে আপন করতে চেয়েছে কিন্তু জয়নব যেন সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলো তাকে। এর পরেই জয়নব সুযোগ বুঝে তার শত্রুদের পথ থেকে সরাতে চাইলো। কিন্তু যখন সে পালাতে চাইলো এই চারদেয়ালের বন্দী শলা থেকে… তখনি ধরা পরে গেলো আদরের কাছে……!

এসব ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জয়নব।।

———-

” বেলেনা উদ্ভিদ? ”

” হ্যাঁ বেলেনা উদ্ভিদ! এই উদ্ভিদের ব্লিচ দিয়েই মারা হয়েছে এদের!”

” এটা আবার কেমন উদ্ভিদ? আর কিভাবে মারা হলো এটি দ্বারা?”

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আবির। ফরেনসিক ল্যাবের ডাক্তার তখন বলে উঠে,

বেলাদোনা একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, সোলানাসি পরিবারে অন্তর্ভুক্ত, ইতালিয়ান থেকে অনুবাদ করা অর্থ “সুন্দরী মহিলা”। লোকে একে বেলাদোনা, ক্রেজি চেরি, স্লিপ বোকা, রাবিদ বেরি, কুকুরের চেরি এবং অন্যান্য নাম বলে।

প্রাচীন মিশরের মহিলারা তাদের চোখে বেলডোনা রস পুঁতে ফেলেন, যখন শিষ্যরা সঞ্চারিত হন এবং একটি জাদুকরী ঝলক চোখে উপস্থিত হয়েছিল। গালেও রস দিয়ে মাখানো হত এবং এ থেকে তারা একটি উজ্জ্বল ব্লাশ অর্জন করেছিল।

সর্বকালে, বেলাদোনা অন্যতম বিষাক্ত উদ্ভিদ হিসাবে বিবেচিত হত। যে ব্যক্তি বেরিটি খেয়েছিল তার চলাফেরা করার, হাসতে আগ্রহ ছিল, সেখানে ভিজ্যুয়াল এবং শ্রাবণ হ্যালুসিনেশন এবং উড়ানের অনুভূতি ছিল। মধ্যযুগে, বেলাদোনা ডাইনিট্রাক্ট ড্রিঙ্কস এবং মলমগুলির অংশ ছিল। মহিলারা, এই জাতীয় ককটেল পান করেছেন বা এই জাতীয় ক্রিম গন্ধ পেয়ে নিজেকে হতবাক করেছেন এবং তাদের কাছে যেমন মনে হয়েছিল, “বাতাসে উড়েছিলেন”।
এর একটি ঘটনা অবশ্যি আছে।
প্রাচীন কালে, ইতালির একটি শহরে বেলাদোনা নামে এক সুন্দরী মহিলা থাকতেন। এই মহিলার একটি অপ্রীতিকর বৈশিষ্ট্য ছিল: তিনি কথা বলার সাথে সাথে তার জিহ্বা নোংরা শব্দের জলপ্রপাতটি ছড়িয়ে দিল। ছোটবেলায় মেয়েটি তার মায়ের সতর্কবাণী শুনে না, বনে অজানা একটি কালো বেরি খেয়েছিল এবং তার মন হারিয়ে যায়। সময়ের সাথে সাথে, তার মন সাফ হয়ে গেছে, এবং অবাধ্য ভাষা অবাধ্যতার অনুস্মারক হিসাবে রয়ে গেছে। একবার শহরে একজন ঘোরাফেরা করল। বেলাদোনের বাড়িতে গিয়ে তিনি তার কাছে জল চেয়েছিলেন। জবাবে দুষ্টু কথায় স্রোতের কথা শুনে বৃদ্ধা তার কর্মীদের সাথে মাটিতে আঘাত করলেন এবং বললেন:

তবে আপনি সর্বদা বিষাক্ত হন, তবে … মানুষের পক্ষে উপকারী।”

সেই থেকে, মহিলাটি অদৃশ্য হয়ে গেছে, এবং তার উঠানে একটি নতুন উদ্ভিদ হাজির হয়েছে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি থেকে, নোংরা বেগুনি রঙের বেল আকারের ফুলগুলি তার উপর খুলতে শুরু করে। এবং গ্রীষ্মের শেষে, চেনি চকচকে কালো-বেগুনি বেরগুলি ছোট চেরির মতো পাকা হয়।

হাজার বছর আগেও আভিচেনা লিখেছিলেন: “বেলেনা এমন একটি বিষ যা পাগলামি সৃষ্টি করে, স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে, শ্বাসরোধ ও দানবীর কারণ হয়।”

আবির এসব শুনে শুকনো ঢুক গিললো। মেহজাব নিজেও চকিত হয়েছে। একেকটা খুনের জন্য কতটুকু গেঠেছে খুনিটা! তখনি মেহজাব বলল,

” আগের লাশ গুলো থেকে কেন বুঝতে পারলেন না মরার কারণ! আর এটাই বা বুঝলেন কিভাবে!”

ডাক্তার হেসে বললেন,

” ভালো প্রশ্ন! ব্লিচডের যে কোনও অংশই বিষাক্ত। উদ্ভিদে রয়েছে বিষাক্ত অ্যালকোলয়েড, তেতো গ্লাইকোসাইড, ফ্যাটি অয়েল, এট্রপাইন গ্রুপ, রেজিন। ফুলের সময়কালে বিষের সর্বাধিক সামগ্রী। বেলিনে থাকা এট্রপাইন একটি নিউরোটক্সিক এবং সাইকোট্রপিক প্রভাব ফেলে। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রাণঘাতী ডোজ 100 মিলিগ্রাম পদার্থ, 10 মিলিগ্রাম শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত। অ্যাট্রপাইন ত্বকের মাধ্যমে খুব দ্রুত শোষিত হয়। পদার্থটি প্রস্রাবে 14 ঘন্টার মধ্যে নির্গত হয়। আর আগের লাশ গুলোতে তোমরা এখানে পাঠাতে পাঠাতে পুরো ২৪ ঘন্টা পার করে ফেলতে এবারের কেইস টা ভিন্ন।”

মেহজাব বাঁকা হাসলো। একজন মানুষ কতটা রিসার্চ করেছে এই খুন গুলো করতে। এতটুকু সময় যদি ভালো কাজে ব্যয় করতো। হয়তো দেশ উন্নতি হতো। মেহজাবের তবুও বলতে ইচ্ছে করলো,

” ব্রিলিয়ান্ট! ”

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০২

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয়_খন্ড
২।
সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
❌(কপি করা নিষেধ) ❌

দিন থমথমে… গুমাটে ভাব। যেন যে কোনো সময়.. ঝাপিয়ে নামবে আকাশের বুক চিঁড়ে বেদনা অশ্রু। ঠিক যেন কিশোরী মেয়ের মুখ। আকাশ পানে চেয়ে মেহজাব ভাবলো…

“অম্বর টা আজ সত্যি হয়তো অভিমান করে আছে! কার উপর হতে পারে? নিশ্চয় কোনো মনের কেউ..!”

মেহজাবে ভাবনার ফোঁড়ন পড়লো। আবির গাড়ি ব্রেক কসলো একটি দো তালা বাড়ির সামনে। বলল,

” স্যার মাহাদ খানের বাসায় এসে পড়েছি আমরা!”

মেহজাব মাথা নাড়লো। দাম্ভিক মুখখানায় ভেসে উঠলো গম্ভীরতা৷ তারা বেড়িয়ে এলো গাড়ি থেকে। এবং ভিতরে চলল।

” মাহাদকে আমি নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ঘৃণা করি!”

নড়েচড়ে বসলো আবির,

” কেনো ম্যাম?”

নুড়ির চোখ জোড়া জল টলমল,

” একটা পশু লোকটা!”

” কি বলছেন?”

“স্যতি বলছি। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা.. আর -ও? ভালো হয়েছে ও মরে গেছে!”

আবির বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে তাকালো মেহজাবের দিকে। মেহজাব শীতল দৃষ্টি মেলে আছে। যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে। এবার ঠোঁট নড়লো তার..

” এমন ধারণার কারণটা কি মিসেস?”

নুড়ি এবার দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো,

” ওর অনেক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিলো। কতটা নিকৃষ্ট ছিলো সে আমি জানি। আমাকে যখন ইচ্ছে তখন ফিজিক্যাল টর্চার করতো নরপশুটা!”

বলেই ফুপিয়ে উঠলো নুড়ি। আবির স্তম্ভীত। মেহজাব ভাবলেশহীন। বলল,

” আপনি বলতে চাইছেন? আপনার বর আপনাকে মারধর করতো!”

নুড়ি চুপ করে গেলো। মাথা নত করে বসে রইলো। লক্ষ করলো দুজনেই চোখে মুখে ফুটে উঠেছে লজ্জার ভাব।

” মেম সরি ফোর দ্যাট ইনভেস্টিগেশনের জন্য আমাদের জানা প্রয়োজন।”

নুড়ি থেমে থেমে বলল,

“সেক্সচুয়াল ব্যাপারে স্যাডিস্ট গোছের ছিলে মাহাদ!”

নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়লো আবার। মুখে দু হাত চাঁপা দিয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলো। আবির আর মেহজাব চুপ করে রইলো। কোনো কিছুই বলল না আর।

আধঘন্টা পর…

অফিস রুমের রোলিং চেয়ারে বসে পেপার ওয়েট ঘুড়িয়ে চলছে মেহজাব। আরেক হাতে দামি ব্রেন্ডের সিগারেট। তার সামনেই বসে আছে আবির। অনেকক্ষণ চুপ থেকে আবির এবার ঠোঁট নাড়লো।

” বিগতো খুন হওয়া মানুষ গুলোর স্বভাব চরিত্রের সাথে অনেকটা মিল স্যার।লোকগুলো স্যাডিস্ট। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়।”

সিগারেটটা আবারো ঠোঁটে ছুয়ে ধোঁয়া ছাড়লো,

” দুটো লিংক আছে এদের, এক হসপিটাল… দুই
স্যাডিজম। তার মানে এই দুটো কানেকশনের জন্যই এদের কোনো মরতে হয়েছে না তো?”

” কিন্তু স্যার কথা হচ্ছে, এদের খুনটা হচ্ছে কিভাবে তাই তো ধরতে পারা যাচ্ছে না!”

“ফরেনসিক রিপোর্ট কি বলে?”

” এইটাই যে নরমাল মৃত্যু। ”

” নরমাল হলে এমন বেঁধে টেধে কেন ফেলবে জঙ্গলে?”

” কথা তো সেটাই!”

মেহজাব জোরালো শ্বাস ছাড়লো। তারপর আবার বলল,

” মেডিকেল স্টুডেন্টদের লিষ্ট রেডি হয়েছে? ”

” জি স্যার। জয়নব আর রুফাইদার বান্ধবী বলতে তেমন কাউকে পাওয়া যায় নি। তবে চিনে অনেকেই। তার মাঝে আনিকা নামের একটি মেয়ে আছে জয়নবের ব্যাচের। ”

” তার কি বক্তব্য? ”

” বিশেষ কিছু না। তবে একটা কথা মনে হচ্ছে কাজে লাগতে পারে!”

“কি?”

” ডা. দেবাশীষ নামের একজন ছিলেন, তার মৃত্যু হয় খুব রহস্য ময় ভাবে। উনি আবার ছিলেন ওই কলেজের মেইন কালপ্রিট। অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত। জয়নব মেয়েটি সে সময় রূপক নামের একজন সি আই ডিকে হেল্প করে ছিলো। ধরা পরার কদিন পরেই সে রহস্য ময় ভাবে মারা যায়। মানে হোটেল রুমে সুইসাইড করে।”

” স্ট্রেইঞ্জ।”

“শুধু তাই নয় একজন স্টুডেন্ট ও ভুত ভুত বলে ঝাপিয়ে পড়েছিলো শপিং মল থেকে!”

” এদের মাঝে কানেকশন আছে কি?”

” জ্বি স্যার দুটোর মাঝেই জয়নবের উপস্থিত ছিলো। তবে দুটোই আত্মহত্য বলা হয় রিপোর্টে!”

দু আঙুল কঁপালে ছুঁয়ে কিছু ভাবলো এবার মেহজাব। তারপর বলল,

” কেইস টা সত্যি কমপ্লিকেইটেড। আর ডা. সাহির, ডা. অভিনব, আর ডা. আদরের কোনো খবর?”

” এখন পর্যন্ত না স্যার। তবে ডা. আদর মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ হবার বছর খানেক আগেই হারিয়ে গেছিলেন। কারো কারো মতে উনি হয়তো পৃথিবীতেই নেই। আবার কেউ কেউ ডা. আদর নামে কাউকে চিনেই না। ইনফেক্ট আমি তলিয়ে দেখেছি ব্যাপারটা, বাংলাদেশের কোথাও এই নামের কেউ যেন জম্মই নেয় নি!”

” ডা. আদর এভাবে উদাও হবার কি কারণ থাকতে পারে? ”

বিড় বিড় করে বলল মেহজাব। তখনি আবিরের যেন কিছু মনে পড়লো এমন ভঙ্গিমা করে বলল,

” আর একটি কথা স্যার। আনিকার কথা অনুযায়ী, যেদিন ডা. আদর গায়েব হয়, সেদিনের পর থেকে জয়নবকেও কোথাও পাওয়া যায় নি।”

মেহজাবের চোখে মুখে একটা চাপা রাগ আর হতাশা দেখা দিলো। মনে মনে বলল,

” কেন আমি সময় মতো সব জানতে পেলাম না? ডা. আদর কি তাহলে জয়নবকে গুম করে দিয়েছিলো?”

————-

আন্ধকার ঘরের মধ্য আলিশান বিছানার উপর বসে হাটুতে মুখ গুঁজে কেঁদে যাচ্ছে জয়নব। ঘরময় কান্নার শব্দ গুঞ্জন হচ্ছে। ঠিক সেই সময় ক্লিক করে ঘরের দরজা খুলে গেলো। আওয়াজটা শুনেই কেঁপে উঠলো জয়নবের আত্মা। জয়নব ভয়ে ভয় মাথা তুললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছায়া মুর্তি কারো। লোকটির মাদকাসক্তের মতো শরীরের ঘ্রাণ ঘরের চারিদিকে ফুলের মতো সুভাষ ছাড়াচ্ছে। জয়নবের কাছে এই ঘ্রাণ, এই সুভাষ পরিচিত। ছায়া মুর্তিটি এবার ঘরে লাইট ওন করলো। সূর্যের আলোর মতো প্রতিফলিত হলো ঘরের আলো। ছায়া মুর্তির মুখটি এবার সুস্পষ্ট। জয়নব ভয়ে চাদর খামচে ধরলো। সুদর্শন যুবক তার সামনে দাম্ভিকপূর্ণ মুখখানায় দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীবাদেশে আজো তিল দুটি ঝলমলে করছে। জয়নব এবার ব্যক্তিটির চোখের দিকে তাকালো। চোখের মনি এবার ফ্যাকাসে নয় বরং কুচকুচে কালো। হয়তো আবারো লেন্স পরেছে লোকটি। এবার লোকটি ঠান্ডা কন্ঠ বলল,

” জান…! আর কত পালাবার চেষ্টা করবে?”

জয়নব চুপটি মেরে বসে চোখের জল ফেলতে লাগলো। আদর এবার এগিয়ে এলো। বাম হাতে শক্ত করে মুখটি তুলে ধরলো তার মুখ বরাবর। জয়নব ভয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। আদর আবার বলল,

“, এই খান থেকে আর পালাতে পারবে না তুমি জান। এইটা বাংলাদেশ নয়। যে যখন ইচ্ছে পালিয়ে গেলে আর খুন করে চলে এলে!”

জয়নবের চোখ ভয়ের সাথে এবার ঘৃণা দেখা গেলো। আবারো সে বন্দিনী হয়ে গেলো। তীর্যক হেসে বলল,

” আমাকে কোনো খাঁচার মাঝে বন্দি করেও লাভ হবে না আপনার। আমি বের হবোই!”

কথাটুকু শেষ হবার আগেই সাপটে এক থাপর পড়লো জয়নবের গালে৷ জয়নব বিছানার মাঝেই ছিটকে পড়লো। আর তখনি আদর গলা চেপে ধরলো জয়নবের বিছনার উপর। জয়নবের মনে হল, আজ সে এখানেই মরে যাবে। সে জানে ডা. আদরের রাগ কতটুকু খারাপ। সে জয়নবকে অনেক ভালোবাসে। এতটাই যে… বছর তিনেক আগেই তার রাজ্যে বন্দিনী করে রেখে দিয়েছিলো তাকে। কিন্তু গত ছ ‘ মাস আগেই আদরের বিশ্বাস অর্জন করে ফিরে এসেছিলো বাংলাদেশ। পর পর চারটে খুন করে লুকিয়ে দেশ ছাড়তে চেয়ে ছিলো জয়নব। কিন্তু… আদর… আদর নামের ভয়ঙ্কর লোকটির হাত থেকে রেহাই সে পায়নি। আদর জানতো, তার নেক্সট টার্গেট তার পিতা ডা,. সাহির। তাই হয়তো এত টাইট সিকিউরিটির মাঝে আছে লোকটি। নয় তো এবার তার পালাই ছিলো। জয়নবের শ্বা নিতে এবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। ধীরে ধীরে হাত- পা ছোড়াছুড়ি বন্ধ করে দিচ্ছে। ঠিক সেই সময় আদর ছেড়ে দিলো তাকে। দাঁতে দাঁত চেপে, আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল,

” আমার থেকে পালাতে পারবে না জান। আমি তোমাকে ছাড়বো না কখনো। তুমি পাতালে লুকিয়ে থাকলেও। আমার খুঁজে বের করতে সময় লাগবে না। আমাকে আর ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না। এত বছর ধরে আমি যা করিনি তা করতে অতন্ত্য বাঁধ্য করো না!”

জয়নব এবার ভয় পেয়ে গেলো৷ আবার হাত পা গুটিয়ে ফুপিয়ে উঠলো। বিড়বিড় করে বলল,

” আমি একদিন তোমাকেও মেরে ফেলবো!”

আদর হাসলো এবার। যেন ছোট বাচ্চা কোনো মজার কথা বলছে। জয়নবের মাথা পরম যত্নে হাত বুলিয়ে বেড়িয়ে গেলো আদর। সাথে সাথে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো ক্লিক শব্দ করে। জয়নব রাগে দুঃখ দরজার উপর ফুলদানি ছুঁড়ে মারলো। কাঁচের দরজাটি ভাঙ্গার বদলে ঝনঝন শব্দ করে ফুলদানিটা টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। জয়নব আবারো ফঁপাতে লাগলো। এই নরক থেকে সে কবে রক্ষা পাবে? কবে? কবে?..

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় ২ পর্ব-০১

0

#অন্তর্দহন_প্রণয়
#দ্বিতীয় খন্ড
#সুরাইয়া_সাত্তার_ঊর্মি
১।

চাঁদনী রাত।
প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে এই প্রসর রাতে। ফকফক করছে শির উঁচু করা পাহাড় পর্বত, গাছ-পালা। থৈ থৈ করছে নদীর জল। তাল মিলিয়ে বহমান বাতাস। ভেসে ভেসে আশা নিশাচর পাখির গমগম।থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে শেয়ালের হাক। ঠিক সেই মুহূর্তে শাস্যময়ী প্রকৃতির বুক চিঁড়ে সাই সাই করে চলে গেলো এক যান্ত্রিক বাহন। পিচ ঢালা রাস্তার ধার থেকে নেমে এলো গাড়িটি কাঁচা রাস্তায়। থেমে গেলো বড় ঝোপের ধারে।নেমে এলো দুজন মানব। নির্জন পরিবেশে এদিকে মানুষের দেখা পাওয়া দুষ্কর। মানব দুটি এদিক-ওদিক চাইলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আগাগোড়া কালো কাপড়ে ঢাকা। যেন অন্ধকারেই মিশিয়ে দিতে চাইছে নিজে উপস্থিত। ভিরু ভিরু পায়ে গাড়ির পিছনে এলো তারা। পিছনের সিট থেকে একটি বস্তা টেনে ছেঁচড়ে দূরে ঝোঁপটির কাছে এলো। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। দূরে জোনাকি পোকার টিমটিম আলো। যেন এক মুঠো জ্বলজ্বল তারা ধরা দিলো পৃথিবীর বুকে। মানব দুটি আশপাশটা আবার দেখে ঝোঁপের ধারে ফেলে দিলো বস্তাটি। পসর রাতের আলোয় মানব দুটির চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তারা দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলো।

ভোরের আলো ফুটেছে । বাহিরে এখন ফুটফুটে ভোর। বাতাস হুহু করে বয়ে যাচ্ছে। মেজহাব মাত্রই নামাজ শেষ করে জগিং-এর উদ্দশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। ছুটতে ছুটতে চলে এলো বড় রাস্তা ধরে লেকের পাশে। ঘন্টা খানেক দৌড়ে হাফিয়ে বসে পড়লো লেকের ধারে। সারা শরীর ঘেমে জর্জরিত। জ্যাকেটের চেনটা খুলে ফেললো সে। সারা মুখের বিন্দু দানা ঘাম হারিয়ে গেলো রুমালের ভাঁজের ফাকে। এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখ মেলে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। মিষ্টি রোদের সোনালী আলো পড়ছে পানিতে। একটি পরিচিত মুখের প্রতিছবি আবছা ভেসে উঠলো যেন পানির উপর।তাৎক্ষণিক বন্ধ করে নিলো চোখ জোড়া। ভিতর থেকে বেড়িয়ে এলো দীর্ঘ শ্বাস। কিন্তু পুরোনো অতীত কি কখনো পিছু ছাড়ে? যেমন এখন-ও ভেসে আসচ্ছে কানের মাঝে কিশোরীর খিলখিল হাসির শব্দ। মেজহাব সচকিতে তাকালো। নাহ্.. সব তার ভ্রম। আবার-ও গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। পরিবেশের নিস্তব্ধতা চিঁড়ে বেজে উঠলো তীক্ষ্ণ ফোনের আওয়াজ। ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো বয়স্ক পুরুষালী এক কন্ঠ,

“মেহজাব হোয়ার আর ইউ? তোমার আমাকে খুব প্রয়োজন!বড্ড বিপদে পড়েছি আমি!”

মেহজাব ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। বলল,

“কেনো বস? ভাবিজী বুঝি আবার বের করে দিয়েছেন ঘর থেকে?

ওপাশ থেকে সিরিয়াস ভাবে বলল,

“মেহজাব মজার সময় নয়। একটি কেইস এসেছে খুব ক্রিটিক্যাল।”

মেহজাব এবার গম্ভীর হয়ে এলো। ওপাশের মানুষটিকে আসচ্ছি বলে কেঁটে দিলো কলটি। এবং নিজের অতীতের তালা বন্ধ করে দৌঁড়াতে শুরু করলো। গন্তব্য আপাতত বাড়ি।

***

টিভির চ্যানেলে এই নিয়ে হয়তো হাজারবার বলে কয়ে কান ঝালাপালা করে চলেছে দু’টি সংবাদ। বিশিষ্ট শিল্পপতি মুহিত চৌধুরী খুন।তার উপর বাড়ছে গনধর্ষণ। দিন দিন গুম হচ্ছে রমনী, তরণীরা পাওয়া যাচ্ছে ঘন ঘন লাশ। টিভির পর্দার ওপাশের রমণী তার ঠোঁট নাড়িয়ে বলে যাচ্ছে স্পষ্ট সুরে,

“পর পর চারটি খুন, ধরণ এক, সময় এক, খুনিও কি এক? কে এই খুনি? পুলিশ এখন পর্যন্ত একটি খুনের রহস্য-ও বের করতে পারেনি। না পেরেছেন গন ধর্ষনের কারীদের ধরতে। গোপন অর্থ জানা গিয়েছে কেইসটি এবার হস্তান্তর করা হবে সি আই ডির কাছে।এই কেইশ সম্পর্কে নতুন নতুন আপডেট জানতে চোখ রাখুন চ্যানেল টোয়েন্টিতে।”

ছোট শ্বাস গিলে টিভি ওফ করে দিলেন অফিসার জায়েদ। রিপোর্টাররা হাত ধুয়ে পিছনে পড়েছে যেন। কি করবে এবার জায়েদ? এই কেইস সলভ না করতে পাড়লে নাক কাটবে তাদের ডিপার্টমেন্টের। আবারো মাথা গরম হয়ে গেলো জায়েদের। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে মনে হচ্ছে। উনি বার বার মাথায় বরফের ব্যগটা চেপে ধরছেন। নাহ্ শান্তি নেই যেন। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের দরজায় নক পরে। জায়েদ গলা উঁচিয়ে বলে,

“কাম.. কামিং।”

মেজহাব হাসি হাসি মুখ করে ঢুকলো রুমটিতে। স্যারকে দেখে এক লম্বা সালাম দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। স্যার তাকালেন এক ঝলক। ছেলেটিকে দেখেই জায়েদের মন ভালো হয়ে গেলো। মাথা থেকে নেমে গেলো যেন ৮০ মন বস্তার ভর। এই সুঠাম, সুন্দর, লাল ফর্সা, দীর্ঘকায় ছেলেটি বরাবর ফিটফাট। হাসির ঝলক মুখখানায় কমই দেখা যায়। যদিও যতবার তার সাথে জায়েদের কথা হয় মন, প্রাণ ভরে যায়। একটা যেন সুখে থাকা টনিক। আজো অসম্ভব সুন্দর লাগছে ক্যাজুয়াল ফরমাল ড্রেস কোডে। হালকা রঙ্গের শার্ট আর কালো প্যান্ট। তার উপর একটি কোর্ড। চুল গুলো গুছিয়ে পিছনে সেট করে রাখা। লম্বাটে মুখ, শক্ত চোয়াল। হাসি হাসি মুখটিতে দু টো টোল পড়ে ডেবে যায়। খারা নাক। ধারালো আর কাট কাট চেহারা অধিকারী মেজহাব। ডিপার্টমেন্টে ওর রূপে মেয়েদের হাল যেন মরি মরি। জায়েদের বড্ড আফসোস হয়। আহ.. আজ যদি তার একটা মেয়ে থাকতো? ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিতো মেজহাবকে। মেজহাবকে এভাবে লক্ষ করতে দেখে হাসলো সে মিটিমিটি। গলা ঝেড়ে বলল,

“স্যার? আমায় দেখা শেষ হলে বরং জরুরি তলবটা কেন করেছেন, তা নিয়ে কথা বলি?”

জায়েদ হতাশ নিশ্বাস ছেড়ে বলল,

“তুমিই একমাত্র ভরসা বাবা। তোমাকে দেখেই শান্তি পাই। নয়তো কবেই হয়তো পটল তুলতাম।”

প্রতিউত্তরে হেসে উঠলো মেজহাব। জায়েদ আবার বলল,

“শহরটাতে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। দিনের পর দিন খুনের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। না খুনিকে ধরা যাচ্ছে, না কিভাবে খুন হচ্ছে তা ধরা যাচ্ছে।”

মেজহাব মন দিয়ে কথা গুলো শুনছে। আর টেবিলের উপর রাখা পেপার ওয়েটটা ঘুরাচ্ছে। সে বলল,

“স্যার কোনো ক্লুই পাওয়া যাচ্ছে না? ”

“নাহ্ কোনো ক্লুই নেই। আছে শুধু এতটুকুই খুন করা আগে ভিক্টিমকে একটি নোট পাঠানো হয়। আর নোট পাওয়ার পরের দিন ভিক্টিম হাওয়া। খুন করার ২৪ ঘন্টা পর লাশ পাওয়া যায়, গাজিপুর ভাওয়ালগড়ের আশে পাশে।”

মেজহাবের কঁপালে এবার ভাজ পরে। এই পর্যন্ত ৪টি খুন হয়েছে। আর ডেড বডি সব কয়টা পাওয়া যাচ্ছে গাজীপুরের জঙ্গলে। স্ট্রেঞ্জ? সে বলল,

“স্যার খুনির হয়তো গাজীপুর ভাওয়াল গড়ের সাথে কোনো লিংক আছে। নয়তো সেখানেই কেন বার বার লাশ পাওয়া যাচ্ছে?”

“সেটাইতো ধরতে পারছিনা আমরা। উপর থেকে পেশার আসচ্ছে বুঝতেই পারছো সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে মাহাদের খুন। সোজা তো ছেঁড়ে দেবে না তারা? পেশার দিয়েই যাচ্ছে। তাই তো তোমাকে ঢাকা। এবারের মতো আমাকে বাঁচাও! নয়তো শেষ বয়সে এসে চাকরি হারাতে হবে আমার।”

কেমন কাঁদোকাঁদো মুখ করে ফেললো যেন জায়েদ। বড্ড হাসি পেলো তার বসের কান্ডে। ঠোঁট চেপে হাসিটুকু গিলে। আসাস দিল,

“স্যার চিন্তা করবেন না। ইন শা আল্লাহ। এই খুনির কান টেনে আপনার পায়ের কাছে ফেলবো।”

জায়েদ হাসলো এবার। বলল,

“তুমি না থাকলে যে কি হতো আমার! আচ্ছা তাহলে নেমে পর তোমার টিম নিয়ে কাজে!”

মেজহাব মাথা নাড়ালো। আরো একবার সালাম দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অলস দৃষ্টি কিছুখন তাকিয়ে জায়েদ আবারো টিভিটা অন করলো। সেই একটি খবর দৃশ্যপট হলো।

——-

বেধড়ক পেটানো হচ্ছে কাউকে জেলখানার চৌখুপির মতো একটি রুমে মাঝে। রিমান্ডে নিয়া হয়েছে কান কাটা মন্সুর নামের একটি মধ্য বয়সি লোককে। লোকটি কিছুতেই তার অপরাধ শিকার করছেই না। আবির এবার চেঁচিয়ে বলল,

“শালাকে ডিম থ্যারাপি দিতে হবে।নয়তো মুখ খুলবেই না!”

আবিরের কথায় বাকি দুজন কনস্টেবল হৈ হৈ করে সম্মতি দিলো। ঠিক তখনি আবির্ভাব হলো একজন আগুন্তকের। লোকটির পায়ের বুট জুতোর শব্দ থেমে গেলো সব। মন্সুর অতি আগ্রহে চাইলো দরজার দিকে। লোকটি ভিতরে এলো। আবছা আঁধারে দেখা গেলো মুখমন্ডল। আবির সহ দুজন কনস্টেবল স্ব শব্দ সালাম ঠুকলো আগুন্তকে। আগুন্তক মাথা নাড়লো। টেবিলের উল্টো পাশে রাখা চেয়ারটি বসলো। মন্সুর একটি যেন স্বস্তি পেলো। কাল থেকে বেধড়ক পিটিয়ে যাচ্ছে এই সুদর্শন স্যারটি। তার এই ধুলাই যার জন্য বেঘাত ঘটলো তাকে একবার নিভু নিভু চোখে দেখলো। ঘরের টিমটিম আলোয় একজন অত্যন্ত সুন্দর দীর্ঘকায় দেহের লম্বাচওড়া একটি লোক উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মন্সুর হা করে রইলো, এত সুন্দর যুবক সে দেখেছেই বড় পর্দায়, হিরোদের। মন্সুরের ভাবনার ফোড়ন কেঁটে সুদর্শণ যুবকটি বলল,

” এত কষ্ট করার কি আছে আবির? চামড়া ছিলে পৃথিবীর সব থেকে ঝাল মরিচ গুঁড়ো লাগিয়ে দেও.. তোমার কষ্টটা অতন্ত্য কমবে। আর তারো!”

মন্সুরের মুখ চুপসে গেলো। ভয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্বীকার করলো সব….

আবির হা হয়ে তাকিয়ে রইলো মেহজাবের দিকে। মেহজাব তখন ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে সিগারেট ধারালো। এক দলা কুন্ডলী পাকানো ধোয়া নাক মুখ দিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল,,

” নতুন কেইস হতে পেয়েছি আবির। সব কিছু আবার শুরু থেকে শুরু করতে হবে। কাহিনির শুরুটার রহস্য পেলেই… মধ্যাংশ মিলে যাবে… আর শেষটা না হয়.. আমরা লিখবো…!”

আবির মাথা নাড়ালো। দু’জনে এসে দাঁড়ালো একটি রুমের ভিতরে।চারিদিকে যান্ত্রিক জিনিস পথ। পাশেই বোর্ড। দামী দামী উন্নত মানের কম্পিউটার। আবির একটি ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল,

” স্যার… এই খুন গুলোর মাঝে একটি জিনিস কমন। ”

” কোন জিনিস? ”

” মেডিকেল কলেজ। ”

“মেডিকেল কলেজ?”

“জ্বি স্যার..! তবে এই কলেজটি দুবছর আগে বন্ধ হয়ে গেছিলো।”

” বন্ধ হয়ে গেছিলো? কিন্তু কেন?”

” ফাইল মোতাবেক ওই হসপিটাল ক্রাইম চলতো। যা হাতে নাতে ধরা পরার পর.. হসপিটালটি বন্ধ করে দেয়া হয়। সে বছর এ নিয়ে অনেক হাঙ্গামা-ও হয়। অনেক স্টুডেন্ট তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। এবং তাদের কোনো কলেজ এন্ট্রি দিচ্ছিলো না। শেষ পর্যন্ত সরকারের রিকোয়েস্টে কয়েক টা কলেজ স্টুডেন্টদের সুযোগ দেয়। তবে অনেক স্টুডেন্ট এর মাঝে গায়েব হয়ে যায়, আবার কেউ বা বিদেশে চলে যায়..!”

মেহজাব আবারো সিগারেট ধারালো,

” ইন্টারেস্টিং! তা ওই কলেজ থেকে কারা কারা গায়েব হয়েছে? যাদের আতা-পাতা নেই।”

আবির গড়গড় করে বলল,

” ডাঃ সাহির, ডাঃ অভিনব, ডাঃ আদর আর দুজন স্টুডেন্ট জয়নব, কুয়াশা!”

মেহজাব গম্ভীর হয়ে গেলো। মুখের ভাব ভঙ্গি পাল্টে গেলো। বিড়বিড় করে বলল,

” জয়নব! হোয়ার আর ইউ??

———

একটা হিংস্র বাঘের থেকে কিছুটা দূর গুটিশুটি মেরে বসে আছে জয়নব। ভয়ে নিজের হাত এত শক্ত করে মুঠ করেছে যে নখ গিথে হাতের তালু থেকে রক্ত পড়া শুরু করেছে। দু হাটুতে মুখ গুজে থরথর করে কাঁপছে। জয়নব নিশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর টাইগারের গর্জনে মা মা করে চেচিয়ে যাচ্ছে জয়নব জয়নবের শ্যামবর্ণ মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ক্ষীণ পায়ের আওয়াজ ভেসে ভেসে এলো কানে। টাইগার যে জয়নবের খুব কাছে ছিলো, সে এবার পিছিয়ে গিয়ে ভদ্র ছেলের মতো চুপচাপ বসে পড়লো। জয়নব এবার মাথা তুলে তাকালো। ফর্সা চেহারা আর গম্ভীরপূর্ণ দাম্ভিক মুখখানা নিয়ে এক হাটুতে ভর করে বসে পড়লো জলজ্যান্ত টাইগারের সামনে। টাইগারের মাথায় হাত বুলিয়ে মাংসের বড় পিস দিলো তার পেল্টের সামনে। চেটে পুটে খেতে লাগলো টাইগার। জয়নব এসব দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন চোখে তাকিয়ে রইলো আদরের দিকে। আদর তার ফ্যাকাসে বরফ দৃষ্টিতে জয়নবের দিক তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

” আজ থেকে আমার ছেলেই তোমার খেয়াল রাখবে।”

জয়নব বিস্ময়ে কাঠ। কান্না করতেই ভুলে গেছে। আদর আবার বলল,

“আমার থেকে পালাবার চেস্টা করো না জান। ভালো হবে না খুব একটা! তার ডেমো কিন্তু একটু দেখিয়েছি!”

জয়নব ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো। মানুষের সাথে পেরে উঠতে পারবে হাজার বার। কিন্তু কিন্তু একটা বাঘ?? কিভাবে পারবে এই নরক থেকে পালাতে জয়নব? কিভাবে পারবে? বাকি শত্রুদের শেষ করতে? কিভাবে পারবে? এই গ্যামের মাস্টার মাইন্ডকে খুঁজে বের করতে??

চলবে,

অন্তর্দহন প্রণয় সিজন-০১ গল্পটি পড়তে লেখার উপর ক্লিক করুন।

প্রত্যাশা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

1

#গল্প
প্রত্যাশা
#পর্ব_৩ (শেষ পর্ব)
-শাতিল রাফিয়া

রিকশায় বসে আমি মাকে ফোন দিলাম।

– হ্যাঁ প্রত্যাশা বল।
– বাবা কেমন আছেন, মা?
মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- একই রকম।
আমি কম্পিত গলায় বললাম- আমার মনে হয় বাবার আর চিকিৎসা করানো হবে না।
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন- কেন?

আমি মাকে সব খুলে বললাম।

এরপর জিজ্ঞেস করলাম- তুমিই বল মা এভাবে কি মানসম্মান বিসর্জন দিয়ে থাকা যায়? আজ যা হয়েছে আমার মনে হয় না ইরফানের মা আর লোন দেবেন। উনি তো আর লোন দেন না। উনি জাস্ট আমাকে কিনে নিতে চান।
মা নিরাসক্ত গলায় প্রশ্ন করলেন- চলে আসতে চাইছিস?
– হ্যাঁ।
– টিউশনির টাকা দিয়ে কয়দিন চলবে?

আমি কোন উত্তর দিলাম না।

মা আবার প্রশ্ন করলেন- লোন কিভাবে শোধ করবি?

আমি আবারও নিরুত্তর রইলাম। শুধু চোখ উপচে পানি পড়তে থাকে।

মা বললেন- আবেগের বশে এসে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিলে তো হবে না।
– তাহলে তুমি চাও আমি ওখানে থাকি? যেখানে আমার বিন্দুমাত্র সম্মান নেই, সেখানে থাকি?
– আমি জোর করছি না প্রত্যাশা। তুই ইরফানের সাথে কথা বল। তাকে জিজ্ঞেস কর সে কি চায়?
– সে যা চায় তা তো আমাকে আগেই বলে দিয়েছে…
– কিন্তু এভাবে তো জীবন চলতে পারে না। আমি বলব তুই আগে ইরফানের সাথে কথা বল। তারপর সিদ্ধান্ত নে। আর চলে আসতে চাইলে অবশ্যই আসতে পারিস। তোর ওপর আমার ভরসা আছে।

টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরলাম। আমি ভেবেছিলাম ইরফান আবার বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার গাড়ি বাইরেই দেখলাম। তার মানে সে ঘরেই আছে।

আমি ঢুকতেই শাশুড়িমা ঠান্ডা গলায় বললেন- আমার ঘরে একবার এসো প্রত্যাশা।

আমি চোখ কুঁচকে ফেললাম। কি বলবেন উনি? বাসা থেকে বের করে দেবেন নাকি? দিলে আমিও চলে যাব।

উনার পেছন পেছন উনার ঘরে গেলাম।

উনি গম্ভীরমুখে বললেন- বোস।

আমি চেয়ারে বসলে উনি খাটে আমার সামনাসামনি বসলেন।

এরপর থেমে থেমে বললেন- ইরফান আজ সারাদিন বাসায় আছে। কতক্ষণ থাকবে আমি জানি না।

আমি তার দিকে তাকালাম। উনি কি বলতে চাইছেন?

উনি উঠে গিয়ে আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে আমাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন- এটা নাও আর ঘরে গিয়ে খোল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- কি এটা?
– রুমে গিয়ে খুলে দেখ। বুঝতে পারবে।

আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে প্যাকেটটা নিয়ে রুমে গেলাম। ইরফান খাটে আধাশোয়া হয়ে টেলিভিশন দেখছে।

আমাকে দেখে বলে- হাই! কেমন হল টিউশনি?

আমি কোন উত্তর দিলাম না। একরাশ কৌতূহল নিয়ে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ইরফান এবার জিজ্ঞেস করে- কি এটা প্রত্যাশা?
– মা দিয়েছেন।
– খোল। খুলে দেখ।

প্যাকেটটা খুলে আমি হতবাক হয়ে গেলাম! আমার নিজেকে কীটের মতো মনে হতে লাগলো। উনি এটা কি দিলেন আমাকে?

প্যাকেটের ভেতর পাতলা ফিনফিনে একটা জর্জেটের শাড়ি! যেটা পরা আর না পরা একই কথা!

রাগে আমি কাঁপতে থাকি! শাশুড়ি মায়ের কথা কানে বাজতে থাকে- ইরফান আজ সারাদিন বাসায়! রুমে যাও!

আমি হঠাৎই চিৎকার করে ভেউভেউ করে কেঁদে দিলাম! ইরফান ততক্ষণে আবার টিভির দিকে মন দিয়েছিল। আমার কান্না শুনে চমকে আমার দিকে তাকালো।

এরপর দ্রুত আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে- কি হয়েছে তোমার?

আমার সব রাগ গিয়ে তার ওপর পড়ল।

আমি তার কলার খামচে ধরে তীব্র গলায় বললাম- তুমি কি চাও? আমি এটা পরে তোমার সামনে আসি?

ইরফান অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো! তারপর শাড়িটার দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকে ফেললো।

আমার হাত তার কলার থেকে সরিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল- এরকম কিছু চাইলে অনেক আগেই জোর করতে পারতাম।
আমি ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললাম- তোমার মা কেন বোঝেন না আমি এত নীচ না? আমার মধ্যেও আত্মসম্মানবোধ আছে? বাবার চিকিৎসার টাকা দিয়েছেন বলে কি উনি আমাকে কিনে নিয়েছেন?

ইরফান আমার গাল থেকে চোখের পানি মুছে দেয়।

সে হঠাৎই আমার দুইগাল তার দুইহাত দিয়ে ধরে বলে- আই অ্যাম স্যরি। স্যরি যে আমার জন্য তোমাকে এত বড় একটা অপমান সহ্য করতে হলো!

আমার কি হলো আমি নিজেও জানি না।

আমি তার হাত ধরে বললাম- ইরফান আমরা কি পারি না একটা স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে? আমরা কি নিজেদের বোঝার জন্য, জানার জন্য একটু সময় দিতে পারি না?
ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- আমাকে ক্ষমা করো প্রত্যাশা! আমি পারব না। আমার পক্ষে আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। কাউকে মন দেওয়া সম্ভব নয়। এসবের ওপর থেকে বিশ্বাস অনেক আগেই উঠে গেছে।
– কিন্তু সব মেয়ে সামারা নয় ইরফান! একজনের কাছ থেকে ধোঁকা খেয়ে তুমি বাকী সব মেয়েকে এক কাতারে কি করে ফেলতে পার?

ইরফানের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল!

সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে- ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে মিলে আমাকে চিট করেছিল। আমাকে শুধুমাত্র ইউজ করেছে ওরা! টাকার জন্য!
ইরফান নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- আমি পারব না প্রত্যাশা।
– ঠিক আছে। ভালোবাসতে হবে না। কিন্তু ঠিক সময় মতো তো বাসায় ফিরতে পার। ছুটির দিনগুলোতে তো বাসায় থাকতে পার। তুমি যেই অভ্যাস গড়ে তুলেছ, তা তো তোমাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে ইরফান!
– আমি বাসায় থাকলেই কি সব সমস্যার সমাধান হবে প্রত্যাশা? তখন মা বলবেন নাতি-নাতনিদের কথা!
আমি এবার চোখমুখ শক্ত করে বললাম- তাহলে তুমি ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো। আমার পক্ষে এত অপমান সহ্য করে আর থাকা সম্ভব নয়। আজ তো তোমার মা অপমানের চূড়ান্ত করলেন!

আমি শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আবার হুহু করে কেঁদে দিলাম!

ইরফান হঠাৎ আমাকে একবার জড়িয়ে ধরে! আমি কেঁপে উঠলাম! এসময় একটা সাপোর্টের সত্যি খুব দরকার ছিল আমার।

একটুপর আমাকে ছেড়ে দিয়ে সে বলে- ঠিক আছ তুমি?

আমি চোখ মুছে মাথা নাড়লাম।

ইরফান এবার একটা কাঁচি এনে বলে- ধর।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি করব?
– আহা ধরই না!

আমি কাঁচিটা ধরলে সে শাড়িটা খুলে আমার সামনে ধরে বলে- কাটো এবার। একদম মাঝখান দিয়ে কেটে অর্ধেক করে ফেল।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম- এসব ছেলেমানুষি করছ কেন?
ইরফান মৃদু হেসে বলে- তোমার জন্য! বিশ্বাস করো শান্তি লাগবে অনেক।

আমি সত্যি সত্যি শাড়িটা কেটে ফেললাম মাঝখান দিয়ে। এরপর কি হল জানি না। শাড়িটা আমি ইচ্ছামতো কাটতে লাগলাম। মনের সসম্পূর্ণ ঝাল শাড়িটার ওপর মেটালাম! শাড়িটা কুটি কুটি হয়ে গেল!

ইরফান এবার সব টুকরো প্যাকেটটাতে ঢুকিয়ে বলে- এবার বারান্দা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেও।

আমি এবারও তাই করলাম।

ইরফান আমার দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করে- লাগছে না শান্তি?
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম- বুঝতে পারছি না। খুব আজব লাগছে!

আমি এবার হেসে দিলাম।

ইরফান বলে- আমার অফিসের কাজে বাইরে যেতে হবে। বাবা আর দুলাভাই গিয়েছেন। উনারা একসপ্তাহ পরেই ব্যাক করবেন। আমি টু উইকস পর আসব। ফিরে এসে আমি ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দেব।

আমি মাথা নাড়লাম!

ইরফান এগিয়ে এসে বলে- প্রত্যাশা এই দুই সপ্তাহ আমি একটু ভাবতে চাই। কেন যেন…
– কেন যেন কি?
– তোমার সাথে শাড়ি নিয়ে এই কার্যকলাপ করতে করতে মনে হল হয়তো আমাদের মেন্টালিটি ম্যাচ করতেও পারে!

আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকালাম!

ইরফান বলে- আমি তোমাকে জানাব। আর এই দুই সপ্তাহ তুমি তোমার বাবার বাসায় গিয়ে থাকবে। কজ মায়ের কোন ঠিক নেই। কি না কি আবার বলবে!

আমি হঠাৎ করেই ইরফানের জন্য একটা টান অনুভব করি।
***

আজ ইরফানের ফেরার কথা। প্রথম চার-পাঁচদিন ইরফান প্রতিদিন ফোন করেছে। তারপর আর করেনি। আমাদের আহামরি সেরকম কোন কথা হয়নি যদিও। কেমন আছি, বাবা কেমন আছেন, ডিনার হয়েছে কি না- এই কয়েকটা রুটিনমাফিক সাধারণ কথাবার্তা। কিন্তু চার-পাঁচদিন পর তার ফোন না পেয়ে আমার মধ্যে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করলাম। আমি নিজেই তাকে ফোন করলাম।
ইরফান ফোন ধরল।

স্বাভাবিক কথাবার্তা বলে বলল- আমি বিজি আছি তো, সময় বুঝে ফোন করব।

কেন জানি না আমার মনে হল সে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি অন্য একটা ব্যাপার আছে। মনে হল সে কোন কিছু নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত।

আজ আমার শশুড়বাড়িতে গেলাম।

শাশুড়িমা আমাকে দেখে বললেন- এসে পড়েছ? কিন্তু ইরফান তো আরো ক’দিন পরে ফিরবে।

আমি কিছুটা অবাক হলাম! ইরফান আজ ফিরবে না, কিন্তু আমাকে একবারও জানালো না!

সবার সাথে হাই-হ্যালো করে ফিরে আসার সময় শুনতে পেলাম শাশুড়িমা বিড়বিড় করে বলছেন – এরপরের বার আসলে একবারে ফিরে যেতে হবে!

ব্যাপারটা কি? আমি খুব একটা পাত্তা দিলাম না। হয়তো উনি আমাকে বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়ার কথা ভাবছেন।

আমি আজ আবার ইরফানকে ফোন দিলাম।

সে ফোন ধরলো বেশ দেরী করে এবং ধরার পরে বলে- স্যরি। আজ ফিরতে পারিনি। আমার কয়েকদিন দেরী হবে প্রত্যাশা। আমি ফিরে তোমাকে জানাব।
আমি বললাম- তোমার একটা ডিসিশন নেওয়ার কথা ছিল।

ইরফান হঠাৎই চুপ করে গেল!

একটুপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- সব জানাব প্রত্যাশা। আগে ফিরে নেই।

এক সপ্তাহ, দুই সপ্তাহ করে করে ইরফান পুরো মাস কাটিয়ে দিল। এই একমাসে কয়েকটা ঘটনা ঘটলো।

বাবার শরীরের উন্নতি হল না। বরং আরো অবনতি হতে লাগল। বাবা কেমোর ধকল সহ্যই করতে পারছিলেন না বলে কেমো বন্ধ করে দেওয়া হলো।
যেই ছোট কোম্পানিটায় আবেদন করেছিলাম, সেখানে আমার চাকরিটা হয়ে গেল। ছোট কোম্পানি, ছোট চাকরি, বেতনও কম। কিন্তু আমার নিজের চেষ্টায় আমার প্রথম চাকরি!

সবচেয়ে খুশি হলেন বাবা। তার চোখে পানি দেখতে পেলাম খবরটা শুনে।

ইরফানকে ফোনে জানিয়েছিলাম।

সে বেশ আনন্দিত গলায় বলেছে- কংগ্রাচুলেশনস!

আমার শশুড়বাড়িতে মিষ্টিসহ গিয়ে খবরটা দিলাম। আমার পোস্ট আর বেতন শুনে আমার শাশুড়িমা হাসতে হাসতে পারলে গড়াগড়ি খান!

একবার বলেই ফেললেন- আর এই টাকা দিয়ে তুমি লোন শোধ করার প্রত্যাশা রাখো, প্রত্যাশা?

আমার ননাশ আর দুলাভাইও দেখলাম ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটিয়ে রেখেছে মুখে।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম! উনারা এত বড়লোক মানুষ, অথচ কি নিচু চিন্তাভাবনা!
***

ইরফানের ফোন দেখে আমি চমকে উঠলাম!

– হ্যালো।
– প্রত্যাশা আমি ফিরেছি। তোমার বাসার নিচে আছি। চল।

সে এভাবে হুট করে ফিরে এসে বলছে ‘চল’! কি আজব!

নামার আগে আমি আমার টিউশনির বেতনের পুরোটাই নিলাম। এটা আজ আমার শাশুড়িমাকে দেব। তার লোনের প্রথম কিস্তি। আমি নিচে নেমে গাড়িতে উঠলাম। ইরফানের দিকে তাকালাম। সে মুখটাকে গম্ভীর করে রেখেছে।

আমি স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করলাম- কখন এসেছ?
ইরফান উত্তর দিল- তিনদিন আগে।

আমি এবার আরও চমকে উঠলাম! তিনদিন আগে এসেছে অথচ কেউ আমাকে জানায়নি!

– তিনদিন আগে এসেও কিছু বললে না যে?

ইরফান কোন উত্তর না দিয়ে চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগল। আমার খুব অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই।

আমি ধীরে ধীরে বললাম- ইরফান, তুমি চাইলে আরো সময় নিতে পার। কি হয়েছে তোমার?

ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল কিন্তু কোন জবাব দিল না।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে ইরফান বলে- তুমি সোজা আমাদের রুমে চলে যাবে। কারো সাথে কোন কথা বলবে না।
– কেন?
– কারণ তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। যাও আমি পার্ক করে আসছি।

ইরফানের আচরণ দুর্বোধ্য লাগছে! তবুও আমি তার কথামতোই কারো সাথে কথা না বলে আমাদের রুমে চলে আসলাম। অবশ্য রুমে আসার সময় কাউকে দেখিনি যে কথা বলব!

ইরফান কিছুক্ষণের মধ্যেই রুমে এল।

আমি ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কি হয়েছে একটু বলবে?
ইরফান মাথা নেড়ে বলল- বলব। আমি এখন তোমাকে কয়েকটা কথা বলব। আমার সব কথা মন দিয়ে শুনবে, তারপর তুমি কথা বলবে। ঠিক আছে?

আমি মাথা নাড়লাম।

ইরফান এবার থেমে থেমে বলে- ওখানে গিয়ে আমার সামারার সঙ্গে দেখা হয়েছিল প্রত্যাশা। এন্ড আই কেইম টু নো দ্যাট ও আমার সাথে প্রতারণা করেনি।

আমি হা করে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ইরফান বলে- তোমাকে খুলে বলি। যা হয়েছিল, সব রবিনের দোষ ছিল। রবিন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। ও সামারাকে পছন্দ করতো। কিন্তু সামারা রবিনকে পছন্দ করত না। তাই রবিন রেগে কতগুলো ফেক ছবি বানিয়ে আমাকে দেখিয়েছিল। সেটা দেখেই আমি সামারার সাথে ব্রেকআপ করেছিলাম, রবিনের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। রবিন ভেবেছিল আমি সামারার জীবন থেকে সরে গেলে ও ইজিলি সামারাকে পেয়ে যাবে। বাট হি ওয়াজ রঙ। সামারা বিদেশে শিফট করেছিল। এবার সামারার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি চলে যাচ্ছিলাম। বাট সামারা বলেছিল যেন একবার শুধু সত্যিটা জানি। এরপর ও আমাকে আর কখনো ডিস্টার্ব করবে না। এখানে থাকতেও সামারা অনেকবার রিকোয়েস্ট করেছিল আরেকবার দেখা করার। আমি এতটাই হার্ট হয়েছিলাম যে শুনিনি ওর কথা। এবার ওর সব কথা শুনে বুঝতে পারলাম আমি ভুল করেছি। সামারা রবিনের সাথেও যোগাযোগ করিয়েছে, রবিন স্বীকার করেছে ও ইচ্ছাকৃত সামারাকে পাওয়ার জন্য এসব করেছে। সামারাকে পায়নি। কিন্তু ও নিজেও ভালো নেই। ওর ওয়াইফের সাথেও ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে। আর ও এখন অনেক অনুতপ্ত। ও স্বীকার করেছে তখন ঝোঁকের বশে এসব করা উচিৎ হয়নি…

এই পুরো কাহিনি শুনে আমি ফ্যালফ্যাল করে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি এবার বুঝতে পেরেছি সে কি বলতে চাইছে।

ইরফান ধীরে ধীরে বলে- এই ক’দিন আমি সামারার সাথে কাটিয়েছি। তিনদিন আগে ও আমার সাথেই ফিরেছে। আমাদের আবার প্যাচ আপ হয়েছে। এন্ড উই ওয়ান্ট টু ম্যারি। সামারাকে আমি তোমার কথা বলেছি। ও বলেছে আমাদের ডিভোর্স হলে এরপর আমরা বিয়ে করব। ওর প্রবলেম নেই।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম! সে কি বলছে, আর আমি কি আশা করেছিলাম! ইরফানকে ভালো না বাসলেও ওর প্রতি আমি একটা টান অনুভব করছিলাম। সে যখন বলেছিল ‘ভেবে দেখবে’ কেন জানি মনে একটা আশা জেগেছিল! সে আমাকে ভালবাসতে পারবে না, কিন্তু বান্ধবীকে ভুল বুঝেছিল বলে তাকে ঠিক কাছে টেনে নিতে পারবে!

আমার দৃষ্টি দেখে ইরফান আমার কাঁধ ধরে বলে- প্রত্যাশা! আই অ্যাম স্যরি। বাট আমি বলেছিলাম আমি ভেবে দেখব। আর আমি এটাও বলেছিলাম আমি নিজেকে রাজি করাতে না পারলে আমি এসে ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দেব। আমি অলরেডি আমাদের ডিভোর্স পেপার রেডি করতে দিয়েছি। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবার চিকিৎসার দায়ভার নিতে পারি।

বাহ! কি সুন্দর কথা! সে কি আমাকে দয়া দেখাচ্ছে?

আমি হঠাৎই হেসে বললাম- এই বাসায় সবার মধ্যে আমি তোমাকে মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু অন্যান্য সবার মতো তুমিও অমানুষ!

ইরফান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে!

সে ধীরে ধীরে বলে- লোন হিসেবেই নিলে না হয়! আর তুমি টাইম নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে নাও!
আমি এবার শান্ত স্বরে বললাম- আমার নেওয়ার কিচ্ছু নেই। এই বাড়ির একটা জিনিসও আমি নিয়ে যাব না।

বাসায় যাওয়ার আগে শাশুড়ি মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে বললাম- আপনি যে লোন দিয়েছিলেন, তার প্রথম কিস্তিটা আজ দিলাম। বাকীটাও দিয়ে দেব।
শাশুড়িমা বাঁকা হাসি হেসে বললেন- রেখে দাও তোমার কাছে। লাগবে না। তোমার বাবার ট্রিটমেন্টে কাজে লাগবে। এখন তো সামারাই আমার ছেলেকে সামলাবে, আমার কাছ থেকে আর লোন নিতে পারবে না।
আমি হেসে বললাম- আমি যেটা পারিনি, সেটা সামারা যেন পারে সেই দোয়া রইল। আমি নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারিনি।

টাকাটা টেবিলের ওপর রেখে দিলাম।

আমি বের হওয়ার সময় ইরফান বলে- এসো তোমাকে নামিয়ে দেই।
– এই গাড়িতে তোমার পাশে সামারাকেই মানাবে। আসি। ভালো থেক। আর দোয়া করো তোমাদের দেওয়া অপমান গুলো যেন আমি খুব শীঘ্রি ভুলে যেতে পারি।
***

আজ আমার হাতে ডিভোর্স পেপার এসেছে। সাথে ইরফানের একটা ম্যাসেজ।
“তুমি সাইন করে পাঠিয়ে দিও। এরপর আমিও সাইন করে ফাইনাল করে ফেলব।”

আমি একফোঁটা কাঁদলাম না।

মাকে কথাটা বলে আমি তখুনি সাইন করে দিতাম কিন্তু প্রমি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে- বাবা ডাকছেন। তাড়াতাড়ি এসো। বাবা কেমন যেন করছেন।

আমি ছুটে বাবার কাছে গেলাম!

বাবা কেমন যেন করছেন!

আমি তার হাত ধরলাম। প্রমিকে এম্বুলেন্স কল করতে বললাম।

বাবা হঠাৎই বললেন- তোকে ইরফান ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে?
– না তো!
– মিথ্যা বলিস না। আমি শুনেছি তোর মাকে তুই বলছিলি!

আমি হঠাৎই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম! এতক্ষণের জমিয়ে রাখা বরফ গলে গেল বাবার সামনে!

বাবা আমার মাথায় হাত রেখে কষ্ট করে বললেন- কাঁদছিস কেন? তুই কোন দোষ করিসনি। নিজের মানসম্মানও বিসর্জন দিসনি। তুই কেন কাঁদছিস?

বাবা হাঁপাতে লাগলেন।

আমি চিৎকার দিয়ে বললাম- প্রমি করেছিস ফোন?
– আসছে আপু।
বাবা আবার বললেন- শক্ত হ মা। ওদের অপমানের উপযুক্ত জবাব দে। চাকরি পেয়েছিস, আরো ভালো চাকরি খোঁজ। ওদের দেওয়া লোন ওদের মুখে ছুঁড়ে মার। আরো পড়ালেখা করে আরো বড় হ মা!
– বাবা তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ, আর কিছু তোমাকে বলতে হবে না!
বাবা বললেন- আমার দোয়া তোর সাথে থাকবে।

আমি বাবার বুকের ওপর মাথা রেখে ফোঁপাতে লাগলাম। বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেই আমার বাবা পৃথিবী ত্যাগ করলেন। আমরা হসপিটালে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা তখন বেঁচে ছিলেন না।

হাসপাতাল থেকে বাবাকে নিয়ে কোথায় মাটি দেব, কি করব, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। প্রমি মাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। কারণ মা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।

আমাদের যেসব আত্মীয়স্বজন আছেন, ফোন করলেই ভাবেন আমরা বুঝি টাকার জন্য ফোন করেছি। তারা কেউ ইদানিং আমাদের ফোন ধরেন না। আজ ধরবেন কী না তাও বুঝতে পারছি না।

তাই আমি ইরফানকে একটা ফোন দিলাম। সে তো সাহায্য করবে।

ইরফান একবার রিং বাজতেই আমার ফোন কেটে ম্যাসেজ দিল- “আমি সামারার সাথে একটু বিজি আছি। তুমি সাইন হয়ে গেলে পাঠিয়ে দিও।”

তার ম্যাসেজ দেখে আমি হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। আমি এবার আমার এক মামাকে ফোন দিলাম। মামা ফোনটা ধরলেন। বাবাকে বাদ আছর মাটি দেওয়া হল।
***

বাবা মারা গেছেন আজ চারদিন হল। বেঁচে থাকতে কেউ একদিনও খোঁজ নেয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর অনেকেই আহা-উহু করতে লাগল। সেই সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে আমার আর ইরফানের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে লাগল।

আজ একটু আগে আমার ফুপু বিদায় নিয়েছে। কেউ বেল দিলে প্রমি দরজা খুলে আমাকে ডাক দিল।

আমি গিয়ে দেখি ইরফান আর তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ইরফানের মায়ের মুখে অপরাধী ভাব। ইরফানের চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি।

ইরফান প্রায় ছুটে এসে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে- তুমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছ?
– না।
– থ্যাংক গড। আমিও করিনি এখনো। আই অ্যাম সো স্যরি ফর ইওর লস! বাট আমাকে মাফ করে দাও প্রত্যাশা! আমাকে আর একবার ক্ষমা করে দাও! আমি… আমি কথা দিচ্ছি আমি এবার সব ঠিক করে দেব।

আমি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম- কি বলতে চাও পরিষ্কার করে বল!
ইরফান বলে- সামারা আসলেই চীট করেছে। তখনও করেছিল, এখন আবার করছিল। ওর আর রবিনের প্ল্যান ছিল বিয়ের শপিং এর সব গহনা, শাড়ি নিয়ে পালিয়ে যাওয়া। আমি ওদের হাতেনাতে ধরেছি!
-মানে টা কি?

কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ইরফান যেটা বোঝাল সেটা হল- সামারা আর রবিনের আগে থেকেই রিলেশন ছিল। সামারা ইরফানের টাকার জন্য তার সাথে নাটক করেছিল। এরপর রবিন আর সামারার ঝগড়া লেগেছিল। তখন রবিন রেগে গিয়ে ইরফানকে সামারা আর তার কিছু ছবি দেখায়। এরপর ইরফানের দু’জনের কারো সঙ্গেই কোন যোগাযোগ থাকে না। কিন্তু আম আর দুধ আবার মিলে যায়। সামারা আর রবিন বিদেশে চলে যায়। সেখানে বিয়ে করে। কিন্তু ওখানে বেশি সুবিধা করতে পারছিল না বলে রবিন আবার দেশে চলে আসে। সামারা একটা কোর্স করছিল। সেটা শেষ হওয়ার কয়েকদিন বাকি ছিল। তখনই একদিন সে ইরফানকে দেখে।
রবিনের সাথে প্ল্যান সাজিয়ে সে নিজে থেকে একদিন ইচ্ছে করে ইরফানের সামনে পড়ে যায়। এরপর ইরফানকে মিথ্যা ভুলভাল বুঝিয়ে তার সাথে দেশে এসে বিয়ের নাটক সাজায়। তাদের প্ল্যান ছিল বিয়ের সব গহনা নিয়ে আবার পালাবে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ইরফান সামারাকে একদিন সারপ্রাইজ দিতে তার বাসায় আগেই পৌঁছে যায়। আর সে সামারা আর রবিনকে একসাথে ধরে।

ইরফান হাত জোর করে বলে- চল প্রত্যাশা। আমি সেবার আমার মনকে যখন রাজি করিয়ে ফেলেছি তোমার সাথে একসাথে থাকার চেষ্টা করব বলে, তখনই সামারা এসে আমাকে তছনছ করে দিয়েছে! প্লিজ আরেকটা সুযোগ আমায় দেও। আমরা একসাথে ভাল থাকব প্রত্যাশা!
আমি খুব ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলাম- তোমার কি মনে হয় তুমি আরেকটা সুযোগ পাওয়ার যোগ্য? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখ। আমি কি তোমার টেনিস বল নাকি পুতুল? এই নিয়ে গেলে, এই ফেলে দিলে? আর ভবিষ্যতে তুমি যে আর অন্য কোন সম্পর্কে জড়াবে না সেটার গ্যারান্টি আছে?
ইরফান মাথা নিচু করে বলে- জড়াব না। প্রমিজ।
আমি আজ মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম- আচ্ছা ইরফান, তোমার ক্যারেক্টর খারাপ, তোমার মদের নেশা আছে, আরো কত কি! কিন্তু আমার চরিত্রে আজ পর্যন্ত কোন দাগ লাগেনি। তাহলে আমি কেন তোমার সাথে যাব?
এতক্ষণে ইরফানের মা বললেন- আমাদের ভুল হয়ে গেছে প্রত্যাশা। যাও তোমার ব্যাগ নিয়ে এসো। চল আমাদের সাথে। উই আর স্যরি।

আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম।

এরপর ডিভোর্স পেপার সাইন করে নিয়ে এসে ইরফানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম- তুমি মুক্ত। আমি তোমার সাথে থাকব না। বাবা নেই ঠিকই, কিন্তু বাবা বলে গেছেন মাথা নত না করতে।

ইরফান মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

তার মা হতভম্ব হয়ে গেছেন। উনি হয়তো আশা করেছিলেন যে আমি ব্যাগ আনতে গিয়েছি!

আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম- আপনার বাকি টাকাটাও আমি দিয়ে দেব। আপনারা এখন আসতে পারেন।
***

দুই বছর পর।

আজ আমি ভীষণ খুশি। তার দুইটা কারণ।

আজ আমি ইরফানের মায়ের সব টাকা পরিশোধ করেছি। বাড়ি ভাড়া, প্রমির পড়ার খরচ, নিজের মাস্টার্স সব মিলিয়ে টাকা শোধ করতে একটু সময় লেগেছে। কিন্তু আজ আমি পেরেছি।

এই দুই বছরে অনেক স্ট্রাগল করেছি। পাড়া-পড়শী অনেক কথা বলেছে। আমি সবার কথার উত্তর দিয়েছি।

ডিভোর্স নিয়ে কেউ কথা উঠালে আমি বলতাম- আমার কাছে ওদের সবার নাম্বার আছে। আপনি বলুন কার কাছ থেকে ডিভোর্সের কাহিনী শুনতে চান। তাকে ফোন করে দেই।

যখন কেউ বলত আমার জন্য প্রমির বিয়ে হবে না সে উত্তর দিত- আচ্ছা আপনি তো আমার কেউ নন। আমার জন্য আপনার এত চিন্তা কেন? আমি আমার জুড়ি নিয়েই পৃথিবীতে এসেছি।

আমি চাকরির পাশাপাশি শুক্রবার-শনিবার টিউশনি করেছি। পাশাপাশি মাস্টার্স করেছি। প্রমি এখন মেডিকেল কলেজে পড়ছে।

আর আজ দেশের একটা নামকরা কোম্পানি থেকে আমি ডাক পেয়েছি। বেশ বড় পোস্টে আজ আমার চাকরি কনফার্ম হয়েছে। ভাল বেতন, চমৎকার সুযোগ সুবিধা।

ইরফানের সাথে আমি আর কোন যোগাযোগ রাখিনি। সে চেষ্টা করেছিল বেশ কয়েকবার। আমি পাত্তা দেইনি। যখন আমার তার সাপোর্টের সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তখনই সে ছিল না!

আমি এখন ছাদে দাঁড়িয়ে আছি।

আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম- তুমি বেঁচে থাকতে তোমাকে দেখাতে পারিনি। কিন্তু আজ আমি সফল বাবা। তোমার কথা আমি রাখতে পেরেছি। নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করে, নিজে আত্মনির্ভরশীল হয়েছি।
তোমার কথা আমি রেখেছি বাবা। তোমার ইচ্ছে পূরণ করেছি। তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা।

আমার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
[সমাপ্ত]

প্রত্যাশা পর্ব-০২

0

#গল্প
প্রত্যাশা
#পর্ব_২
-শাতিল রাফিয়া

আমার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে নায়ক উঠে দাঁড়িয়ে বাবাকে সালাম দিল।

বাবা খুবই ক্লান্ত। কুশল বিনিময় করার মত অবস্থা তাঁর নেই। উনি শুধু মাথা নাড়লেন। মা এমন সময় তাড়াতাড়ি এলেন।

নায়কের দিকে তাকিয়ে বললেন- বাবা একটু বোস।

এরপর আমাদের তিনজনকে নিয়ে মা ভেতরে ঢুকে গেলেন। বাবাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মা আমাকে হাত ধরে টেনে কোণায় নিয়ে গেলেন।

এরপর ফিসফিস করে বললেন- বিয়ের পর ছেলেটা প্রথম এসেছে আর এদিকে বাসায় ভাত, ডাল আর ডিম ছাড়া কিচ্ছু নেই। কি লজ্জা! আর ওকে বসিয়ে রেখে আমি যেতেও পারছি না। তুই… আচ্ছা না থাক। আমি প্রমিকে পাঠাই। তুই গিয়ে কথা বল।

মা ঘুরে চলে যাওয়ার আগেই আমি হাত টান দিয়ে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- এটা কে?
মা বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললেন- কি বললি?
আমি শান্ত সুরে আবার জিজ্ঞেস করলাম- এটা কে?
– কে মানে? তুই ইরফানকে চিনিস না? তার ছবি-টবি কিছু দেখিসনি?

মুহূর্তে আমার মুখ শক্ত হয়ে গেল! তার মানে ঠিক সন্দেহ করেছিলাম। না আমি ইরফানকে কখনো দেখিনি। বিয়ের আগে তাকে দেখার কোন ইচ্ছে আমার হয়নি। বিয়েটা তো আর মন থেকে করিনি। বিয়ের পরে তাকে দেখার যেটুকু ইচ্ছে জন্মেছিল, ইরফান বিয়ের রাতে আমাকে রেখে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে চলে যাওয়ায় সেই ইচ্ছেও মরে গেছে। এক বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে তার ওপর!

আমি কঠিন গলায় মাকে প্রশ্ন করলাম- সে এখানে কী করছে?
মা অবাক হয়ে উত্তর দিলেন- কী করবে আবার? তোকে নিয়ে যেতে এসেছে। আচ্ছা তুই গিয়ে কথা বল। আমি প্রমিকে খাবার কিনতে পাঠাই।
আমি মাকে বললাম- কাউকে কোথাও পাঠাতে হবে না। আড়াইশো টাকা দিয়ে যে গ্রিল হাফ মুরগি কিনে আনবে সেটা হয়তো সে ছুঁয়েও দেখবে না। সে আরো অনেক ভালো খাবার খেয়ে অভ্যস্ত। এই আড়াইশো টাকার মুরগি নয়।
– কী বলছিস এসব?
– ঠিকই বলছি মা। পঁচিশ লাখ লিখতে কয়টা শূন্য দেব সেটা যেমন আমাদের হিসাব করতে হয়, সেরকমই আড়াইশো লিখতে ক’টা শূন্য লাগে সেটা ওদের চিন্তা করতে হয়!

মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি ইরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে মোবাইলে কিছু একটা করছিল।

আমাকে দেখে বলল- চল?

আমি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লাম। মনে হচ্ছে আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। যে মানুষটাকে বিয়ে করেছি, তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে এটা কি ধরনের বাক্যালাপ হল?

ইরফান মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। দরজার দিকে রওনা দিয়ে আমার থেমে গেল।

পেছন ফিরে মাকে বলল- আসি।
মা বললেন- অনেক কষ্ট করলে। কিছু খাওয়াতেই পারলাম না। বুঝতেই পারছ বাবা…
মাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সে যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে বলে- ঠিক আছে।

অবশ্য তার বিরক্তিটা সে তাড়াতাড়ি লুকিয়েও ফেলল। বুঝতে পেরেছি আমাকে নিতে আসার কোন ইচ্ছেই তার ছিল না। এসেছে হয়তো শাশুড়িমায়ের কথায়।

আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ইরফান নিজেই গাড়ির দরজা খুলে দিল। আমি সামনে বসলাম। ইরফান ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। আমাদের এই ভাঙাচোরা এলাকার তুলনায় তার গাড়ি অনেক দামী, অনেক স্ট্যান্ডার্ড, হাইফাই। সেটা নিয়ে অবশ্য তাকে বিচলিত মনে হল না। সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই রওনা দিল।

পথে সে কোন কথাই বলল না। আমি যে তার নতুন বিবাহিত স্ত্রী, তার পাশেই বসে আছি, এটা মনে হয় সে ভুলেই গেছে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে গাড়ি সিগন্যালে আটকাল।
সে হঠাৎই এফএম রেডিও অন করে।

একজন আরজে বলছেন – “পছন্দের মানুষকে প্রিয় গান শোনাতে আমাদের ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট করুন। এখন প্লে করছি জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী হাবিব ওয়াহিদের কণ্ঠে ‘হৃদয়ের কথা’ সিনেমা থেকে ‘ভালবাসবো বাসবো রে বন্ধু’ গানটি। গানটি অনিক তার গার্লফ্রেন্ড নীলাকে ডেডিকে…”

এটুক বলতেই ইরফান রেডিও স্টেশন পাল্টে দিল।

এরপরের চ্যানেলে ‘নয়নও সরসী কেন ভরেছে জলে’ বাজছে।

আবার বদল।

এরপরের চ্যানেলে আরজে বললেন- “লিসেনার্স চলুন আজ জোছনায় ভিজে আসি। শুনে আসি এই ‘মন জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি’ চমৎকার ট্র‍্যাকটি…”

ইরফান ঘটাং করে রেডিওটা বন্ধ করে বলে- দুচ্ছাই! সবখানে শুধু প্রেম আর ভালোবাসা! শালার!

আমি হা করে তার কান্ডকারখানা দেখছি!

গালিটা দিয়ে সে জিহ্বায় কামড় দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে- স্যরি! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তুমি যে পাশে আছ খেয়াল ছিল না। সবসময় বন্ধুদের সাথে এভাবেই কথা বলি তো!

আমার ক্রোধে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। চোখে পানি চলে আসল!

সে অবাক হয়ে, অপ্রস্তুত হয়ে বলে- কাঁদছো কেন? স্যরি বললাম তো!
আমি অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম- ভালোই তো পার্টি, ক্লাব, মদ-গাঁজা আর নারীসঙ্গ নিয়ে ছিলে। হঠাৎ এই বিয়ে করার ভূত মাথায় কেন চাপলো?

সে আমার প্রশ্ন শুনে আমার দিকে চমকে তাকাল! তার মুখে হঠাৎই একটা মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।
আমি হঠাৎ তার হাসি দেখে কেঁপে উঠলাম। সে দেখতে যতটা না সুন্দর, হাসলে তাকে শতগুণ বেশি সুন্দর লাগে। কেমন নেশা ধরিয়ে দেয় সেই হাসি!
ততক্ষণে সিগন্যাল ছেড়ে দিয়েছে।

সে হাসিটা ধরে রেখেই সামনের দিকে তাকিয়ে গাড়ি টান দিল।

এরপর ধীরে ধীরে উত্তর দিল- বিয়ে করার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না প্রত্যাশা। তবে কি জানো, বিয়েটা আমাকে করতেই হতো। সবাই এমন চাপাচাপি করছিল। কী আর বলব! মনে হচ্ছিল বনে-বাঁদাড়ে পালিয়ে যাই।
আমি দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করলাম- বিয়েটা আমাকেই করতে হল? বনে পালিয়ে যেতে! আমার মত এত লোয়ার ক্লাস এক…
আমার কথার মাঝখানেই ইরফান বলল- তোমার ক্লাস, কাস্ট এসব নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। আমি কখনোই মানুষের এসব ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমার কাছে তোমাকে বিয়ে করা আর আমাদের হাই ক্লাস সোসাইটির কাউকে বিয়ে করা একই কথা। তার কারণ তুমি থাকবে তোমার মত, আমি আমার মতো। আমি যেমন তোমাকে ঘাঁটাব না, তুমিও আমার পার্সোনাল লাইফে কোন ইন্টারফেয়ার করবে না? ওকে?

আমি কোন উত্তর দিতে পারলাম না।

ইরফান আবার বলে- বাই দ্যা ওয়ে, তবে একটা কথা কিন্তু সত্যি।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে সে বলে- তোমার ছবি দেখে আমার মাথা সত্যিই কিছুক্ষণ হ্যাং হয়ে গিয়েছিল। তুমি দেখতে যেরকম সুন্দর, ঠিক সেরকম নিজেকে মেন্টেইন করেছ! কিভাবে করলে বল তো? আই মিন মেয়েরা নিজেকে ফিট রাখার জন্য জীমে যায়, চেহারার উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পার্লারে যায়। বাট স্যরি টু সে, তোমাদের ইকোনোমিক কন্ডিশন তো এরকম ছিল না!

আমার ইচ্ছে করল ইরফানের টুঁটি চেপে ধরি! এগুলো কী ধরনের কথা! ছি! সে কি চোখে আঙুল দিয়ে আমাকে আমার অবস্থান দেখিয়ে দিচ্ছে?

আমার উত্তর না পেয়ে ইরফান আবার বলে- তো যেটা বলছিলাম, আমার পার্সোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করবে না। ওকে?
এইবার আর না পেরে আমি মুখ খুললাম- নো। নট ওকে। তোমার মা আমাকে নিয়ে এসেছেন তোমাকে সঠিক পথে ফেরানোর জন্য। আর এইজন্য উনি আমার মাকে লোন দিয়েছেন, বাবার চিকিৎসার টাকা দিয়ে আমাকে বেঁধে রাখছেন। আ…

কথা শেষ না করে আমি হঠাৎই হাউহাউ করে কান্না করে দিলাম। ইরফান এবার হঠাৎই গাড়িটা একসাইডে দাঁড়া করাল।

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে একটু গম্ভীর গলায় বলল- শোন প্রত্যাশা। আমি তোমাকে সোজাসুজি কয়েকটা কথা বলি।
আমি চোখ মুছে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম- বল।
– প্রত্যাশা রোজ রোজ একই খাবার খেতে কারোরই ভালো লাগে না। আমিও ঠিক সেরকম প্রতিদিন অফিস কর, বাসায় এসে স্ত্রীর সাথে সময় কাটাও, পরদিন আবার অফিস যাও, সপ্তাহান্তে ঘুরতে যাও, এই একই কাজ বারবার করতে পারব না।

আমি বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম!

ইরফান বলে- আবার সেরকমই সবসময় বাইরের খাবার খেতেও ভালো লাগে না। তখন মানুষের ফ্যামিলির দরকার হয়, কাছের মানুষের দরকার হয়। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কী বোঝাতে চাইছি?

আমি ডানে বামে মাথা নাড়লাম।

ইরফান স্বাভাবিক গলায় বলল- আমি প্রতিদিন বাসায় আসব না। আবার এমনও নয় যে কোনদিনই আসব না। আমি আসি আর না আসি, যা ইচ্ছে তাই করি না কেন, তুমি এসবে মাথা ঘামাবে না। আমিও তোমার কাছে কিচ্ছু আশা করব না, কিচ্ছু চাইব না। তুমি তোমার মতো থাকবে, আমি আমার মতো।

তার কথা শুনে আমি অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছি।

জিজ্ঞেস করলাম- খাবার খাওয়া আর একসাথে থাকার বিষয়টা কি এক?
– আমার কাছে এক।
– কিন্তু সবাই তো থাকছে। তোমার মতো জঘন্যরকম চিন্তাভাবনা করলে তো কেউ একসাথে থাকতেই পারতো না।
– আমিও একসময় সবার মতই ছিলাম। সবার মতই চিন্তা করতাম।
– তাহলে বিয়েটা করেছ কেন?
– বললাম তো সবাই মিলে ঘ্যানঘ্যান করে জীবন নরক বানিয়ে দিচ্ছিল।
আমি এবার চিৎকার করে বললাম- চমৎকার! নিজের জীবন নরক হয়ে যাচ্ছিল বলে তুমি বিয়ে করে আমার জীবন নরক বানিয়ে দিলে ইরফান?
ইরফান কঠিন গলায় উত্তর দেয়- প্রত্যাশা আমি তোমার জীবন দোজখ বানাইনি। বরং তুমি উপকৃত হয়েছ আমাকে বিয়ে করে। তোমার বাবার চিকিৎসা হচ্ছে, তুমি সেফলি থাকতে পারছ। তোমার বাবার চিকিৎসাটাই কিন্তু মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট এই সময়ে।

আমি নিষ্পলক চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে রইলাম! সে আমাকে কতটা ছোট করল সে কি জানে? সে কি আমাকে লোভী ভেবেছে? আমি তো চাকরি করে তাদের লোন শোধ করে দেব। আমাদের মত মেয়েদেরও যে আত্মসম্মানবোধ আছে সেটা হয়তো সে মনেই করে না।
আমার চোখ ছলছল হয়ে গেল।

ইরফান হঠাৎই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে- স্যরি। আমি যদি কোনভাবে তোমাকে হার্ট করে থাকি, দেন আই অ্যাম স্যরি! আমি আসলে অনেক টায়ার্ড। দুপুরে এসেছি, এরপরে বিকেলেই মা তোমাকে আনতে পাঠিয়ে দিলেন। তার মধ্যে এসব কথাবার্তা! সব মিলিয়ে অসহ্য লাগছে। আই নিড রেস্ট! আই অ্যাম ভেরি স্যরি, প্রত্যাশা।

আমি অন্যদিকে তাকালাম। ইরফান আবার গাড়ি স্টার্ট করল।

বেশ কিছুদিন পার হয়েছে…

আমার একেকটা দিন বিষাক্ত লাগে। বাবার অবস্থার কোন উন্নতি নেই। কারণ বাবা ঠিকমতো কেমো নিতে পারছেন না। কেমোর ধকল সহ্য করতে পারছেন না। তাঁর শরীর ভীষণ খারাপ।

তার ওপর আমার শাশুড়িমা আমার ওপর প্রচন্ড অসন্তুষ্ট। আমি এসেও তার ছেলেকে বেঁধে রাখতে পারছি না। এটা নিয়ে তিনি সারাক্ষণ তার অসন্তোষ প্রকাশ করে যাচ্ছেন।

একদিন বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললাম- আপনার ছেলে তো বাসায়ই থাকে না। আমি তার সাথে কথা বলব কখন?
শাশুড়িমা কঠিন গলায় বললেন- কেন বাসায় থাকবে না? সুন্দরী বউ এনে দিয়েছি তার পরেও বাসায় কেন থাকবে না? তুমি একটু সেজেগুজে থাকতে পার না ও আসার পর? একটু হাসিখুশি থাকতে পার না? সবসময় মুখটাকে মরা মাছের মত করে রাখ। কত করে বললাম একটা স্লিভলেস ব্লাউজ বানাও, অথবা কত ধরনের জামাকাপড় পাওয়া যায় আজকাল…
আমি তার কথার মাঝখানে আঁতকে উঠে প্রায় চিৎকার করে বললাম- মা প্লিজ। আমাকে এতটা নিচে নামাবেন না। আমি এটা কখনোই পারব না। আমার মানসিকতা এত নিচু নয়।

আমি কিছুতেই শাশুড়িমাকে বোঝাতে পারি না এই সম্পর্ক শুরু করার আগে আমার সাথে ইরফানের মনের মিল হওয়া প্রয়োজন। আমি আগে তার মনের ভেতর ঢুকতে চাই। আগে আমি তাকে ভালবাসি, ভাল করে বুঝি, সে আমার মনে এসে ধরা দিক এরপর।
কিন্তু ইরফান অধিকাংশ দিন বাসায় ফেরে না। কোন কোন দিন আবার একাই বাসায় থাকে। আবার কোন কোন দিন আমার শশুড় মশাই অফিস থেকে তাকে ঘাড় ধরে বাড়ি নিয়ে আসেন।

বাসায় থাকলে সে মুখটাকে বিষের মতো বানিয়ে রুমে বসে থাকে। কথা বললেও হু-হা করে উত্তর দেয়। নিজে থেকে কোন প্রশ্ন করে না। কতক্ষণ একা একা বকবক করে যাওয়া যায়?

এরমধ্যে একদিন শাশুড়িমাকে বলেছিলাম- মা আমি চাকরি করতে চাই।
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন- কেন? টাকাপয়সার কি অভাব আছে তোমার? আর তুমি চাকরি করলে সবাই কী বলবে? আমরা বাড়ির বউকে বাইরে কাজ করতে পাঠাই!

তার চিন্তাধারা দেখে আমি মাথা ঘুরে পড়েই যাচ্ছিলাম!

এরপর কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- আমি আপনার লোনের টাকাটা ফেরত দিতে চাই। সেজন্য চাকরি কর‍তে চাই। আপনাদের তো অনেক পরিচিত আছে। একটা অফিসে ঢ…
– এক কথা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করবে না তো! আর আমি আগেই বলেছি টাকা ফেরত দিতে হবে না। আমি তোমার বাবার চিকিৎসার সব টাকা দেব। তার বদলে দয়া করে তুমি সংসারে মন দাও। ইরফানকে আটকে রাখ নিজের মায়ায়।
– তাহলে আমি মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে যাই?
শাশুড়িমা মাথায় হাত দিয়ে বললেন- যা পড়েছ, অনেক হয়েছে।
আমি রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কেন? আপনারা শিক্ষিত ছেলের বউ চান না?
– যে বউ ছেলেকেই ধরে রাখতে পারে না, সে শিক্ষিত না মূর্খ সেটা দিয়ে কী আসে যায়?

উনার মানসিকতা দেখে আমার আর উত্তর দেওয়ার কোন রুচি হল না।

যেহেতু আমাকে ওরা চাকরিতে ঢোকাবে না আমি নিজেই আমার সিভি বিভিন্ন অফিসে পাঠালাম। অনেক ক্ষেত্রে ক্রাইটেরিয়া ম্যাচ করে না। তবুও পাঠিয়ে দিলাম। তাদের দরকার হলে ঠিকই ডাকবে। একটা ছোট অফিস খুঁজে পেলাম সেখানের সার্কুলারে লেখা ছিল ‘ফ্রেশারস আর এনকারেজড টু এপ্লাই।’ অনেক আশা নিয়ে সেখানেও পাঠিয়ে দিলাম।

টিউশনিতে অনেকদিন যাইনি। স্নেহকে বাদ দিয়ে যেই দুইটা টিউশনি করাতাম সেখানে ফোন দিলাম। বাবার অসুস্থতার কথা জানালাম। দুই পরিবারই আমার সমস্যা বুঝল। এবং আবার পড়ানো শুরু করতে বলল।

পরদিন আমি সকালে তৈরি হয়ে নামলাম।

শাশুড়িমা আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন- কোথায় যাচ্ছ? আজ তোমার বাবার কেমো আছে?
আমি শান্ত গলায় বললাম- মা আমি টিউশনিতে যাচ্ছি।
– টিউশনিতে মানে?
– স্নেহ ছাড়াও আমি আরও দুইজনকে পড়াতাম। তারা আবার পড়ানো শুরু করতে বলেছেন।
শাশুড়িমা বললেন- ক’বার বলেছি যে চাকরি করতে হবে না। তোমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে না? টিউশনি করে কয় টাকা কামাবে তুমি? সেই টাকার আবার গরম দেখাচ্ছ আমাকে?
আমি অনেক কষ্ট করে নিজের মেজাজ ঠান্ডা রেখে বললাম- জ্বি না। আপনার টাকার দরকার না থাকলেও আমাদের আত্মসম্মানবোধ আছে। সেজন্যই টাকাটা ফেরত দেব। আর তাই চাকরিও করব। এখন যতদিন চাকরি না পাচ্ছি, ততদিন আমি টিউশনি করব। আর মাস্টার্সও করব। সেটার জন্যও টাকা যোগাড় করতে হবে। তাই আমার চাকরি করতে হবে।

শাশুড়িমায়ের চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেল।

– এখন টিউশনি করে তুমি বাড়ির মানসম্মান ডোবাবে? আর এত ছোট ঘরের মেয়েদের না আত্মসম্মানবোধ কম থাকাই ভালো।

নাহ! আর পারলাম না। মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।

আমি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম- আপনাদের বাড়ির বউ চাকরি করতে পারবে না, টিউশনি করতে পারবে না, মাস্টার্স করতে পারবে না। তার কাজটা কী? শুধু স্বামীকে নিজের আঁচলে বেঁধে রাখা? কিন্তু বাড়ির মেয়ে যে চাকরি করছে, ক্যারিয়ার নিয়ে সে এতই ব্যস্ত যে নিজের ছেলেকেই টাইম দিতে পারে না, সেই বেলায় কিছু হয় না, তাইনা? হতে পারে আপনারা অনেক বড়লোক, দুইহাতে পয়সা ওড়াতে পারেন, কিন্তু মন থেকে শিক্ষিত হওয়া এখনো অনেক বাকী আছে।
শাশুড়িমা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন- তুমি ইরিনার সাথে তোমার নিজের তুলনা করছ? তোমার স্ট্যান্ডার্ড দেখেছ? আর ওর স্ট্যান্ডার্ড দেখ। শোন মেয়ে, আমার মেয়ে তোমাদের মত কোন অগাবগা অফিসে কেরানির চাকরি করে না। সে বড় পজিশনে নাম করা অফিসে জব করে। তোমার জবটাও যদি ওই পর্যায়ের হতো, তাহলে কখনোই নিষেধ করতাম না।
– মা, আপু কি প্রথমেই এত ভাল পজিশনে জব পেয়ে গেছেন? হয়তো। আপনারা এত নামীদামী ফ্যামিলি, হয়তো সেই জোরেই পেয়েছেন। কিন্তু আমার বাবা এত হাইফাই না। আমার মামা-চাচারও জোর নেই। তাই আমাকে কেরানির চাকরি দিয়েই শুরু করতে হবে।

সকালের এই চেঁচামেচিতে ইরিনা আপু চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে এল। আমার শশুর আর দুলাভাই অফিসের কাজে বাইরে গেছেন।

আপু বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে- সাত সকালে এত চেঁচামেচি কিসের? এটা কি বাসা না বাজার?
শাশুড়িমা মুখ বাঁকিয়ে বললেন- বাজার বানাতে আর বাকি কী রেখেছে? লো স্ট্যান্ডার্ডের মেয়েরা যেরকম হয় আর কি!
আমি কাষ্ঠ হেসে বললাম- অথচ এই লো স্ট্যান্ডার্ডের মেয়েটাকে নিজের ছেলের বউ করার জন্য একদিন আপনি আমার মায়ের কাছে কত অনুনয় করেছিলেন!
এরপর শাশুড়িমা আমার নামে একগাদা নালিশ করলে আপু চোখ কুঁচকে বলে- ওহ মা! যার যা স্ট্যান্ডার্ড বোঝ না? ওদের সোসাইটিটা এরকমই। সকালবেলা উঠে এর-ওর সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে।

ঠিক তখুনি ইরফান বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। তার চুল উশকোখুশকো, জামাকাপড় অগোছালো, চোখ লাল।

সে ঢুকে জিজ্ঞেস করে- সকাল বেলায় বাসায় কি মহাসমাবেশ বসিয়েছ?

ইরফানকে এই অবস্থায় দেখে আমি মুখে বিদ্রূপাত্মক হাসি ফুটিয়ে বললাম- ঠিকই বলেছেন আপু। আমরা তো তাও সকালবেলা এর-ওর সাথে ঝগড়া করি। আর আপনাদের সোসাইটিতে সব কাজ হয় রাতের আঁধারে। রাতেরবেলা স্ত্রীকে রেখে অন্য মেয়ের সাথে! ছি!
ইরফান যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে- কী হচ্ছে এখানে? কেউ কি আমাকে বলবে?
শাশুড়িমা চেঁচিয়ে বললেন- কী আবার হবে! তোমার বউ চাকরি করতে যাচ্ছে। তাও যেই সেই চাকরি নয়! টিউশনি করতে যাচ্ছেন উনি!
ইরফান অবাক হয়ে বলল- হ্যাঁ তো যাক না! সমস্যাটা কোথায়?
– এই বাড়ির বউ হয়ে টিউশনি করাবে?
– ওর গায়ে কি ট্যাগ লাগানো আছে ও কোন বাড়ির বউ? আর আমি তো বুঝতে পারছি না এই বাড়ির বউ হয়ে টিউশনি করলে কি সমস্যা? কোন কাজই তো ছোট নয়!
শাশুড়িমা কাষ্ঠ হেসে উত্তর দিলেন- গলায় মোটা চেন পরে, হাতে ভারী চুড়ি, দামী শাড়ি পরে, দামী গাড়িতে চেপে টিউশনি করাতে গেলে সবারই চোখে পড়ে।
আমি এবার শান্ত গলায় বললাম- এসব গয়নাগাটি আমি চাইনি আপনার কাছে। আপনিই আমাকে দিয়েছেন। আর আমি একবারও বলিনি আমি টিউশনিতে যাওয়ার জন্য আপনাদের গাড়ি নেব!
চুড়িগুলো খুলে উনাকে ফেরত দিয়ে বললাম- আপনি রেখে দিন আপনার চুড়ি। আমার এসবের প্রতি কোন আকর্ষণ নেই।
উনি মুখ ঘুরিয়ে বললেন- যেটা আমি একবার কাউকে দেই, তা আর ফেরত নেই না।

চেনটাও খুলতে চাচ্ছিলাম, ইরফান হঠাৎই এগিয়ে এল। আমার হাত থেকে চুড়ি গুলো নিয়ে আমার হাতেই আবার পরিয়ে দিল। এই প্রথমবার ইরফান আমার হাত ধরল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম!

ইরফান শান্ত গলায় বলল- বাইরে আমার গাড়ি আছে। ড্রাইভারও আছে। গাড়ি নিয়ে যাও। আর তোমাকে যখন দেওয়া হয়েছে, এই চুড়িগুলো তোমারই। এটা ফেরত দেওয়ার কিছু নেই।
ইরফান তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা অনেক বেশি মর্যাদার। সেটা যারা দাঁড়ায় তারাই বোঝে।
এরপর ইরিনা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল- অনেক মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তারা কিন্তু জানে নিজে ইনকাম করাটা কতটা সম্মানের, তবুও অন্য কোন মেয়েকে আত্মনির্ভরশীল হতে দেখলে তাদের জ্বলে!

শাশুড়িমা আর ইরিনা আপুর জ্বলন্ত দৃষ্টির সামনে দিয়ে ইরফান ওপরে উঠে গেল। আর আমিও বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি বের হওয়া মাত্র সব ড্রাইভার এলার্ট হয়ে গেল। কেউ কেউ তো গাড়ি স্টার্টও দিয়ে দিল। দারোয়ান তাড়াতাড়ি গেট খুলে দিল। আমি তাদের সামনে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে বের হলাম। একটা রিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসে তাদের অবাক দৃষ্টির সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। রিকশায় বসে নিজের চুড়ি, চেন, আংটি সব খুলে ব্যাগে রেখে দিলাম। যে যাই বলুক আমার আত্মমর্যাদাবোধ আছে। আর আমি কিছুতেই তার জলাঞ্জলি দেব না।

[চলবে]

প্রত্যাশা পর্ব-০১

0

#গল্প
প্রত্যাশা
#পর্ব_১
-শাতিল রাফিয়া

শাশুড়িমা যখন খুব আশা নিয়ে প্রশ্ন করলেন- পারবে না মা আমার ছেলেটাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে?
আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললাম- না।

শাশুড়িমা চমকে উঠলেন! মনে হয় এই ধরনের কোন উত্তর তিনি আশা করেননি।

– তুমি একটু চেষ্টা করলেই…
তার কথার মাঝ পথেই আমি বললাম- মা আপনি মনে হয় সিনেমার খুব ভক্ত। তাই এগুলো বলছেন। কিন্তু এটা আমার বাস্তব জীবন। আর বাস্তবে এইসব হয় না।

শাশুড়িমা চুপ করে রইলেন।

– আমার মাকে জানিয়েছিলেন এসব?
মাথা নেড়ে শাশুড়িমা বললেন- না। উনি টাকা ধার নিয়েছেন। ফেরত দিয়ে দেবেন।
আমি চোখ কুঁচকে বললাম- এত টাকা ফেরত দেবেন কীভাবে?
– উনি বলেছেন সময় নিয়ে ফেরত দিয়ে দেবেন। কিন্তু আমি তোমার মাকে বলেছি, তোমাকেও বলছি তোমাদের টাকা ফেরত দিতে হবে না। তুমি প্লিজ আমার ছেলেটাকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। এইটুকু করবে না আমার জন্য?
আমি বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম- যেটা আপনারা এতদিন ধরে পারেননি, আপনি মা, আপনার কথাই যেখানে শোনেনি, সেখানে আমি কীভাবে পারব বলুন?
– পারবে। তুমি ওকে তোমার রূপ, যৌবন দিয়ে আটকে রাখতে পারবে না বাসায়? এটা একটা কথা বললে?

এতক্ষণ শাশুড়ির কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল। এবার রীতিমত ঘৃণা হল! ছি! কী নীচ চিন্তাভাবনা! চেহারাই কি সব? আমাকে লাস্যময়ী সেজে তার ছেলেকে আটকে রাখতে হবে! ছি ছি!
আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল মনের মিল। একজন মানুষের মনের ভেতরে ঢোকা, তাকে ভালবাসা। এরপর বাকি সব।

আমি আমার গলার উত্তাপ পুরোটা প্রকাশ করে বললাম- আমার পক্ষে এত নিচে নামা সম্ভব নয়। আর আপনার ছেলে এরকম খারাপ চরিত্রের হলে বিয়ে করতে রাজি হল কেন?
– আমরা রাজি করিয়েছি।
– আপনি যেভাবে বিয়ে করাতে রাজি করিয়েছেন, সেভাবেই খারাপ পথ থেকে সরিয়ে আনতে পারতেন।
– আসলে আমরা ছবি দেখানোর জন্য রাজি করিয়েছিলাম। আর তোমার ছবি দেখে ও বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেছি মা! এরপর ভাবলাম বিয়ে করালে বউ এসে যদি সঠিক পথে আনতে পারে!
– ছি! কী বাজে চিন্তাধারা আপনাদের! এজন্যই তো আমার মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। যার বাবার জোর নেই!
– ব্যাপারটা এরকম নয়।
– একদমই এরকম। আর আপনি যদি ভেবে থাকেন, আমি আপনার কাতর গলা শুনে, এই কাঁদোকাঁদো চেহারা দেখে গলে যাব তবে ভুল ভাবছেন। আমার জীবন কোন মুভি নয়, আপনি সেই মুভির ডিরেক্টরও নন। আর আমিও কোন নায়িকা নই। আমি আগামীকাল বাসায় চলে যাব।

শাশুড়িমার চোখে তীব্র অসন্তুষ্টি দেখতে পেলাম। নতুন বউয়ের মুখ থেকে এরকম কটকট করে কথা বলাটা উনি মনে হয় মেনে নিতে পারছেন না।

আমার কথা শুনে থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার বাবার চিকিৎসার তাহলে কী হবে? কয়কাল ধরে টাকা যোগাড় করবে? কার থেকে ধার নেবে?

এই প্রথমবার আমার মুখ থেকে কোন কথা বের হল না।

শাশুড়িমা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন- ভেবে দেখ প্রত্যাশা।

আমি তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম! উনি আমার দৃষ্টি উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেলেন।
***

একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। আমরা দুইবোন। আমি বড়, প্রত্যাশা। আর আমার ছোটবোন প্রমি। আমার বাবার লেখাপড়ার খুবই ইচ্ছা এবং আগ্রহ ছিল। কিন্তু বাবার কম বয়সে দাদা মারা যাওয়ায় এবং সংসারের বড় ছেলে হওয়ায় দায়িত্ব এসে পড়েছিল বাবার কাঁধে। পরিবারের সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাবা বেশি একটা পড়াশোনা করার সুযোগ পাননি।
তবে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজের সন্তানদের পড়াবেন। তাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন যাতে তারা আত্মনির্ভরশীল হতে পারে, চাকরি করতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।

তাই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠলেও পড়ালেখাটা আমাদেরকে ঠিকভাবেই করতে হয়েছে। বাবা দরকার লাগলে নিজে দুইদিন না খেয়ে থেকেছেন, কিন্তু আমাদের টিউশনের ব্যাপারে, বইখাতা কেনার ব্যাপারে কখনো কার্পণ্য করেননি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

বড় হওয়ার সাথে সাথে আমরা দুইবোনই বেশ সুন্দরী, রূপবতী হয়ে উঠেছিলাম। মা সবসময় বলতেন ‘কানের পাশে কাজল দিয়ে একটা দাগ দিয়ে রাখবি।’

প্রথম দিকে নিজের সৌন্দর্য উপভোগ করলেও ধীরে ধীরে একটু বিরক্ত লাগতে থাকে। প্রথম প্রথম যখন উড়ো চিঠি আসতো, সৌন্দর্যের বর্ণনা লেখা থাকত, তখন স্বভাবতই বয়সের কারণে ভালো লাগতো। বড় হতে হতে এত চিঠি আসতে থাকে যে বিরক্ত হয়ে গেলাম। আর সব চিঠির বিষয়বস্তু শুধুমাত্র রূপের মাধুর্য্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বড় হওয়ার পর দৈহিক এবং শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা লেখা নোংরা চিঠিপত্র আসতে থাকে।
পাড়ার বখাটেরা বিরক্ত করে, ফোন দিয়ে আউল ফাউল কথা বলে।

খুব সুন্দরী ছিলাম বলে অনেক আগে থেকেই আমাদের বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। মা অনেকগুলোতেই বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার এক কথা।
“পড়াশোনা শেষ করে, চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত কোন বিয়ে নয়।”

আমি এবার মাত্র অনার্স শেষ করেছি। মাস্টার্সের জন্য আমি এবং বাবা দুইজন মিলেই টাকা জমাচ্ছি। আমি দুইটা টিউশনি করি।
প্রমি এবার ইন্টার দিয়েছে। সে বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে।

মা এবার আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য প্রচন্ড চাপ দিচ্ছেন। বাবার কথার কোন নড়চড় হবে না। আর আমারও এখন বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই।

মা রেগে উঠে বলেন- দিও না বিয়ে। দুই মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাক। আরে কেন বোঝ না বয়স হয়ে গেলে আর ভাল প্রস্তাব আসে না। কত ছেলেরা বিরক্ত করছে, আজেবাজে কথা বলছে। একটা অঘটন ঘটে গেলে এই পড়ালেখা, চাকরি সব মাথায় উঠবে বুঝলে?
বাবা মুচকি হেসে বলেন- দুর্ঘটনার ভয়ে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব? কিচ্ছু হবে না। আমার মেয়েরা চাকরি করে একটা ভালো জায়গায় বাসা নেবে বুঝেছ?

মা না বুঝে আরও চেঁচামেচি শুরু করেন।

এভাবে চলছিল, কিন্তু একদিন হঠাৎই বাবা অসুস্থ হয়ে গেলেন।
বাবাকে হাসপাতালে নেওয়া হল। পরীক্ষা নীরিক্ষার পরে জানতে পারলাম বাবার লাংস ক্যান্সার হয়েছে। দ্বিতীয় স্টেজে আছে। ডাক্তার তাড়াতাড়ি কেমোথেরাপি শুরু করতে বললেন। এরপর একটা সার্জারী করতে হবে।

আগেই বলেছি আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। মাস্টার্সের জন্য একটু জমানো টাকা ছিল। সেটা প্রথম দফায় সব টেস্ট করতে, ডাক্তার দেখাতে, এসব করতে করতেই শেষ! আমরা মহা বিপদে পড়লাম। যেখানেই চাকরির চেষ্টা করছি, মাস্টার্স খুঁজছে। অথবা এক্সপেরিয়েন্স চাইছে। আমরা থাকিও ভাড়া বাসায়। আত্মীয়স্বজনের কাছে হাত পেতেও তেমন লাভ হল না। আমি যেখানে টিউশন করি, তাদের কাছে এডভান্স চেয়েছিলাম। কিন্তু তারাও কোন সাহায্য করতে পারলেন না।

এমন সময় আমাদের বাড়িওয়ালা আমার জন্য আরেকটা টিউশনির সন্ধান নিয়ে এলেন। বাড়িওয়ালা আংকেলের স্ত্রীর বান্ধবীর পরিচিত কেউ। বাচ্চাটা ক্লাস থ্রি-তে পড়ে। তার মা-বাবা নিজেদের ক্যারিয়ার নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত। সে থাকে তার নানা-নানুর সঙ্গে।
আমি শুনেই নিষেধ করে দিচ্ছিলাম কারণ এই এক-দুই হাজার টাকার চাকরিতে আমার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু বাড়িওয়ালা বললেন উনারা বাংলাদেশের নামকরা বড়লোক পরিবার। পনেরো হাজার টাকা দেবে মাসে। বাচ্চাটা খুবই দুষ্টু, নানুর কথা শুনতে চায় না। তার কাছে পড়তে চায় না। তাই হোম টিউটর রাখা হচ্ছে। পনেরো হাজার টাকাও এখন আমার কাছে ঠুনকো। কিন্তু তবুও এবার রাজি হলাম। অন্তত বাবার ওষুধটা তো কিনতে পারব। আর যেহেতু অনেক বড়লোক পরিবার, আমি এডভান্স চাইলে নিশ্চয়ই দেবেন।

বাসা বদলে আরো কমদামী ছোট বাসায় উঠলাম। এই এলাকাটা আরো খারাপ। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কিছু কমবয়সী ছোকরা যেন ‘গিলে ফেলবে’ এই নজরে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই।

আমার টিউশনির প্রথমদিন এল। যাকে পড়াব তার নাম ‘স্নেহ’।

স্নেহ আসলেই দুষ্টু একটি ছেলে। কোন কথা একবারে শুনতে চায় না। অনেক কষ্টে তাকে কখনো বুঝিয়ে, কখনো বকে, কখনো বা আদর করে পড়াতে হয়। স্নেহকে অন্য বাচ্চাদের চেয়ে অনেক বেশি সময় দিতে হয়। একদিন তাকে পড়াতে পড়াতে রাত হয়ে গেল। এর মধ্যে মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সেদিন স্নেহের নানু নিজে গাড়ি দিয়ে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে আমার কষ্ট ফলপ্রসূ হল। স্নেহ পরীক্ষায় আগের বারের চেয়ে অনেক উন্নতি করল। স্নেহের মা-বাবা, নানা-নানু সবাই আমার ওপর খুব খুশি হল।

ভাবলাম এবার উনাদের কাছে কিছু টাকা অ্যাডভান্স চাইব। উনারা নিশ্চয়ই দেবেন।

কিন্তু তার আগেই একদিন বাসায় গিয়ে শুনি স্নেহের নানু স্নেহের মামার সাথে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। আমি এই তিনমাস ধরে স্নেহকে পড়াচ্ছি, কিন্তু তার কোন মামাকে দেখিনি। পরে জানতে পেরেছি তার মামা সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ফেরে। তাই কোনদিন দেখা হয়নি।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কোথায় উনারা আর কোথায় আমি? কোথায় রাজপুত্র আর কোথায় ঘুঁটে কুড়ুনি?

মা শুনে প্রথমেই একবাক্যে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন ‘আমাদের আর আপনাদের স্ট্যান্ডার্ড একেবারেই মেলে না! আর আমাদের সেই অবস্থা নেই যে এত খরচা করে মেয়ে বিয়ে দেব!’

এরপর কী হয়েছিল বা স্নেহের নানু কী করে মাকে রাজি করিয়েছিলেন জানি না।

কিন্তু একদিন মা আমার হাত ধরে বললেন- বিয়েতে রাজি হয়ে যা। তোর এখানে বিয়ে হলে, প্রমিরও সুবিধা হবে। এই এলাকাটা অনেক খারাপ। বখাটেরা কীভাবে বিরক্ত করে, দেখতেই পাচ্ছিস। আমি সবসময় ভয়ে থাকি না জানি কোন অঘটন ঘটে যায়। এমনিই তোর বাবাকে নিয়ে চিন্তায় আছি। ওখানে বিয়ে হলে তুই ভাল থাকবি, ওরা একটা চাকরিতেও ঢুকিয়ে দিতে পারবে। সেই টাকা দিয়ে তোর বাবার চিকিৎসা করাতে পারব। তোর বাবার চিকিৎসার কথাটা ভাব অন্তত।

আর কিছু না হলেও বাবার চিকিৎসার কথা ভেবে রাজি হয়েছিলাম। সত্যিই তো ওরা আমাকে একটা চাকরিতে ঢুকিয়ে দিতে পারবে।
অবশ্য খুব বেশি ভাবার অবকাশ আমাকে দেওয়া হয়নি। কারণ আমার মতামত না নিয়েই মা পরের সপ্তাহে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন।

বাবা বিয়েতে একেবারেই রাজি ছিলেন না।

বাবা বলেছিলেন- যতদিন হায়াত আছে আমি বাঁচব। চিকিৎসা করালেই আমার হায়াত বাড়বে না।

বাবাকে মা ঠান্ডা করেছিলেন এই বলে যে ওরা বিয়ের পরেও আমাকে পড়াবে, চাকরি করতে দেবে। আর এত বড় বাড়ির বউ হওয়ার ভাগ্য সবার হয় না। আরও কি কি যেন বলেছিলেন।

একদিন প্রচন্ড অনাড়ম্বরভাবে আমার সাথে স্নেহের মামার বিয়ে হয়ে গেল। তার মামার নাম ইরফান। বিয়েতে ওরা যে শাড়ি দিয়েছিল সেই শাড়ি আর ওরা যে গয়না দিয়েছিল সেটা পরেছি। সাজার মধ্যে প্রমি ঠোঁটে একটু লাল লিপস্টিক ঘঁষে দিল।

ইরফানকে আমি কোনদিন চোখে দেখিনি। দেখার ইচ্ছেও হয়নি সত্যি। এই বিয়েটা একেবারেই অনিচ্ছায় বাবার চিকিৎসার জন্য করেছি।

বিয়ের সময়ও ইরফানকে দেখলাম না। বিয়ের পর গাড়িতে আমার সাথে আমার শাশুড়িমা আর ননাশ বসেছিলেন। ইরফান কোথায় কিছুই জানি না।

বাসায় পৌঁছানোর পরে ইরিনা আপু (আমার ননাশ) আমাকে একটা রুমে ঢুকিয়ে দেয়। এতদিন স্নেহকে আমি তাদের বিশাল হলঘরের মত ডাইনিং রুমে পড়িয়েছি। আজ প্রথম আমি দোতলায় আসলাম। আর রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকে আমি খুবই অবাক হলাম! একজন নায়কের ছবি বড় করে দেওয়ালে টানানো। নায়কটা কে আমি সেটা চিনতে পারছি না। আজকাল অনেক নতুন নতুন ইয়াং নায়ক-নায়িকার আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু এত বড় একজন মানুষ কেন একটা নায়কের ছবি নিজের ঘরে টাঙিয়ে রাখবে? লোকটা পাগল-টাগল নয় তো?

মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘুমে ঢুলছিলাম। এই বিয়ে নিয়ে আমার মনে কোন আশা, ইচ্ছা, আগ্রহ, উত্তেজনা, আনন্দ কিচ্ছুই ছিল না। বাবার জন্য বিয়েটা করতে হবে বলে করেছিলাম।

এমন সময় দরজা খোলার শব্দে আমি ধড়মড় করে জেগে উঠি। আমার শাশুড়ি এসেছেন।

উনি আমার পাশে বসে হেসে বললেন- তুমি ঘুমিয়ে পড়। আসলে ইরফান ফ্রেন্ডদের সাথে বাইরে গেছে। আগামীকাল ফিরবে।

উনার কথা শুনে আমার ঘুম হাওয়া হয়ে গেল! বিয়ের রাতে নববধূকে রেখে কেউ যে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে পারে এই তাজ্জব ঘটনা আমার নিজের সাথে না ঘটলে আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না!

শাশুড়িমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- তোমাকে ক’টা কথা বলি প্রত্যাশা! কঠিন কিছু সত্য। আসলে ইরফানের কিছু বাজে আর খারাপ অভ্যাস আছে। রাত-বিরেতে পার্টি করা, ড্রিংক করা, এভাবে রাতে বাসায় না ফেরা, ঘুরতে চলে যাওয়া…

আমার বিস্ফারিত নয়ন দেখে উনি থেমে গেলেন। আমি ভাবছি এই কথাগুলো মানুষ অবলীলায় কী করে বলে ফেলতে পারে?

শাশুড়িমা তাড়াতাড়ি বললেন- না! ও আসলেই এরকম ছিল না। সামারা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে ওর রিলেশন ছিল। খুবই দহরম-মহরম। মেয়েটা ওকে চিট করেছিল। তারপর থেকে ও এরকম বখে গেছে। আর কাউকে বিশ্বাস করে না। মেয়েদের ওপর প্রচন্ড অনীহা! কাউকে মান্য করে না।
এরপর আশা নিয়ে প্রশ্ন করলেন- পারবে না মা আমার ছেলেটাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে?
***

শাশুড়িমা চলে গেলে আমি মাকে ফোন দিলাম।

দাঁতে দাঁত চেপে বললাম- তুমি কি করে আমাকে এখানে বিয়ে দিতে পারলে?

এরপর আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। নিজেকে প্রচন্ড ক্ষুদ্র তুচ্ছ মনে হতে লাগল।

মা ধৈর্য ধরে সব শুনলেন।

এরপর বললেন- আমি সত্যি জানতাম না ইরফান এরকম। জানলে বিয়েটা কখনোই হতে দিতাম না। তোর বাবা মরে গেলেও না। তোর শাশুড়ি নিজে থেকেই আমাকে লোনের কথা বলেছিলেন। আমি চাইনি। উনি নিজেই আমাকে লোন দিয়েছেন। আমি নিষেধও করেছিলাম। আমি বলেছিলাম আমাদের স্ট্যান্ডার্ড মেলে না। আমাদের সোসাইটি এত হাই না। আমাদের এত টাকাপয়সা নেই।
– কি বলেছিলেন উনি?
– বলেছিলেন আমাদের তো অনেক আছে। আমরা আর টাকা দিয়ে কী করব? কিন্তু আপনার মেয়েটা যে কত লক্ষী সেটা তো নিজের চোখে দেখেছি। এই লক্ষী মেয়েটাকে কী করে হাতছাড়া করব, বলুন?
আমি ফোঁপাতে ফোঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম- আমি এবার কী করব?
মা বললেন- বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। জীবনটাও নয়। এই বিয়ে করলাম, আর এই ছেড়ে দিলাম ব্যাপারটা এরকমও নয়। তোর শাশুড়ির কাছ থেকে যে লোন নিয়েছি তার মধ্যে কিছু টাকা অলরেডি খরচ হয়ে গেছে। আগামীকাল তোর বাবার প্রথম কেমোথেরাপি। সেটার টাকাটাও যোগাড় হয়েছে তোর শাশুড়ির কাছ থেকে নেওয়া লোন থেকেই। আমি বলি কি তুই উনাদের বলে একটা চাকরিতে ঢোক, এরপর টাকা আয় করে উনাদের লোনটা শোধ করে দে। স্নেহের কথা বাদ দিলাম, কিন্তু তোর আগের টিউশন তো আছেই। আর এর মাঝে চেষ্টা কর তোর আর ইরফানের সম্পর্ক সহজ করার। ও… ও যদি নিজেকে শুধরে নিতে পারে!আর তোর শাশুড়ির কথাই তো শেষ কথা নয়। তুই ইরফানের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা কর। এরপরেও যদি একসাথে থাকতে না পারিস, তুই ডিভোর্স দিয়ে চলে আসিস। আমি নিষেধ করব না। কিন্তু চেষ্টা না করেই এভাবে হাল ছেড়ে দিস না মা। আর এখন তোর ডিভোর্স হয়ে গেলে কি পরিমাণ বদনাম রটবে সেটা তুই নিজেও জানিস! আর.. আর এখন তোর বাবার কথাটা ভাব। প্রমির কথাটা ভাব।
তোর বাবা সুস্থ থাকলে আমি কখনোই তোকে ওখানে থাকতে বলতাম না।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সারারাত নির্ঘুম কাটল। সকালে বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিচে নামলাম। আমি গিয়ে বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যাব। নিচে ডাইনিং টেবিলে আমার শশুড়-শাশুড়ি বসে ছিলেন। তাদের সালাম দিলাম। তাদের সাথে একসাথে নাস্তা করলাম।
ইরিনা আপু, দুলাভাই আর স্নেহ এখনো ওঠেইনি। আর ইরফান, তাকে দেখলাম না। সে এখনো ফেরেনি।

শাশুড়িমা আমাকে গাড়ি দিয়ে পাঠালেন। শুধু তাই নয়, জোরজবরদস্তি করে আমার হাতে নগদ কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন। আমার নিজেকে প্রচন্ড ছোট লাগছে। এভাবে কি আমাকে বেঁধে রাখছে? ছি!

আপাতত আমি এসব কিছু ভাবছি না। শুধুমাত্র বাবার কথা চিন্তা করছি। মা বাবাকে এসব কিচ্ছু জানাননি। টেনশন করে আবার শরীর খারাপ করবে।

হসপিটালে যেতে যেতে বাবা বললেন- তোর অনেক ভাল বিয়ে হয়েছে মা। সুখে থাকবি। তবে একটা কথা মনে রাখিস। নিজে কামাই করবি কিন্তু। আর পড়াটা শেষ করবি। নিজে স্বাবলম্বী হবি। আগেও বলতাম, এখনো বলছি। চাকরি করবি, নিজের পায়ে দাঁড়াবি। তোর মা যে লোন নিয়েছে, সেটা শোধ করবি।

আমার চোখ ফেটে কান্না আসছে। শুধুমাত্র আমি জানি আমার মনের ভেতর কি তুফান চলছে! ভালো থাকব? যার সাথে বিয়ে হয়েছে তাকে একনজর দেখতে পর্যন্ত পারলাম না! আর আমি নাকি ভাল থাকব। আমার শ্বশুরবাড়ি আমাকে টাকা দিয়ে কিনে রাখছে আর আমি নাকি ভালো থাকব!

প্রথম কেমো দিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাবার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমি, বাবা আর প্রমি গিয়েছিলাম। মা বাসায় ছিলেন।

বাসায় এসে আমি চমকে উঠলাম! গতকাল ইরফানের ঘরে যে নায়কের ছবি দেখেছিলাম সেই নায়ক আমাদের বাসায় বসে আছে। সে একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে আছে। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? আমি কি ভুল দেখছি?

আমাকে আরো হতবাক করে দিয়ে নায়ক আমাকে বলে ওঠে- তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বাসায় চল প্রত্যাশা!

মানে কি? এই নায়ক কি তবে ইরফান?

[চলবে]