Tuesday, August 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1050



আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-২২+২৩

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২২
#সুমাইয়া মনি।

দু তিনদিন ধরে নিভ্রর কাছে সব কিছুই কেমন বিরক্ত ও বোরিং ফিল হচ্ছে। থানায় মন বসছে না। বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়াতেও অনিহা। বিতৃষ্ণা অনুভব করছে সে। কেন? কি কারণে? সেটা তার অজানা! কাল রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেছে। সারাদিন ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল। যার দরুণ কারো কলই পীক করা হয়নি, এবং-কি ফ্যামিলিরও না। রাত বারোটার দিকে নিভ্র ওর বাবার ফোনে কল দেয়। কেননা সে সারাদিনে বহুবার কল দিয়েছে। তাই তাকেই আগে কল করে। বেশিক্ষণ কথা বলতে পারে না। এরি মাঝেই সে গাম্ভীর্য মুডে রেগে কিছু বাক্য বলেই ভোর পাঁচটার দিকে কুমিল্লার উদ্দেশ্য রওয়ানা হতে বলে তাকে। এভাবে তাকে কখনোই বাড়িতে আসতে বলেনি। হঠাৎ ভোর পাঁচার দিকে রওয়ানা দেওয়ার কথা শুনে সে অনেকটা অবাক হয়। বাবার কথা অমান্য করার ছেলে সে নয়। কথা অনুযায়ী গাড়ি নিয়ে রাতেই রওয়ানা হয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। যেতে যখন হবে, তখন আগে ভাগে গেলে ক্ষতি কি এই ভেবে, ছুটি নিয়ে নেয় চার-পাঁচ দিনের।

বাড়ির গলি পথে আসতে আসতে এসব ভেবে চলেছে সে। সারারাত ড্রাইভ করেছে। ঘড়িতে নয়টা ছুঁই ছুঁই।
প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে সে। আর মাত্র পাঁচ মিনিটের রাস্তা বলা চলে। তার মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন? হঠাৎ করে বাড়িতে আসার জরুরীতলব করার কারণ কী?
ব্লু রঙের আলিশান বাড়ির সরু রাস্তা দিয়ে প্রবেশ করে তার গাড়িটি। পাশেই বড়ো করে নাম লিখা আকন ভিলা। আকন নিভ্রর দাদার নাম। পুরো নাম আকন উদ্দীন। তিনি মারা যাওয়ার পূর্বে বাড়িটি বানানো হয়, এবং তার নাম-ই দেওয়া হয়। গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নেয় সে। সারারাত ড্রাইভ করেও তার শরীর কেন জানি ক্লান্ত লাগছে না। বাড়ির দিকে তাকাতেই মনটা ফুরফুরা হয়ে গেল। ব্যাগ বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। ভেতরে প্রবেশ করে কিছু পথ এগোতেই হল রুমের ডাইনিং টেবিলে বাবা,চাচ্চুকে বসা দেখতে পায়। বাড়ির সবাই জানত নিভ্র আসবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আসবে সেটা তাদের জানা ছিল না। নিভ্র আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে নিজের বাবা ও চাচাকে সালাম দিলেন। তারা উত্তর নেয়। নিভ্রর চাচ্চু কিছু বলতে যাবে তখনই নিভ্রর কাকি মা এগিয়ে আসে। তার সঙ্গে একটি মেয়েও ছিল। আকাশী রঙের শাড়ী পড়া। মাথায় ঘোনটা। চেহারা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না।

-“কেমন আসিস নিভ্র? কত শুকিয়ে গেছিস তুই। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করিস না বোধ হয়।”

-“কোথায়? ঠিকিই তো আছি কাকি মা। বেশি মোটা হলে সবাই আমাকে দেখে মটু পুলিশ বলে ডাকবে যে। তোমার ছেলেকে মটু বলে ডাকবে। এটা নিশ্চয় ভালো লাগবে না তোমার।” মৃদু হেসে বলে নিভ্র।

-“হুম, তাই তো। আগে ভেবে দেখিনি।” কিছুটা ভাবার ভঙ্গিতে বললেন তিনি।

নিভ্রর ঠোঁটের হাসি কিছুটা চওড়া হয়। হঠাৎ নজর পড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মেয়েটির উপর। নিভ্র নজর সরিয়ে নিয়ে কাকি মা’র উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখে,
-“ওনি নিশ্চয় নতুন ভাবী আপনের ওয়াইফ?”

সে ঘুরে তাকায় পিছনে। জবাব না দিয়ে হেঁটে সঙ্গে করে নিয়ে এসে নিভ্রর সামনে দাঁড় করিয়ে মাথার ঘোনটা একটু পেছনে টেনে বলেন,
-“আপন নয়, তোর ছোট ভাই আদির বউ নবনীতা নূর।”

নিভ্রর কান যেন তবধা হয়ে গেছে। প্রতিধ্বনি হচ্ছে নামটি বার বার। চোখ মাজারি আকার ধারণ করেছে নবনীকে দেখে। সে বাক্‌শূন্য অবাক, বিস্মিত। কয়েক মিনিটের জন্য যেন চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে নিভ্র। নবনীর দৃষ্টি আগের দিন গুলোর মতো নত। সামনে যে নিভ্র দাঁড়িয়ে আছে এতে তার ভাবান্তর এবং কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না নিভ্রর। স্বাভাবিক দেখাচ্ছে নবনীকে। রানী খাতুন নবনীর উদ্দেশ্য করে নিভ্রকে দেখিয়ে বলে,
-“নবনী ও হচ্ছে তোমার বড়ো ভাসুর নিভ্র আহমেদ। সালাম দেও।”

নবনী স্বভাবসুলভতা বজায় রেখে চোখ তুলে তাকায় নিভ্রর চোখের দিকে। ধীর ও শান্ত কন্ঠে বলে,
-“আসসালামু আলাইকুম! ভাইয়া।”

সালামের জবাব দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছে না নিভ্র। তার যে কিছুতেই ঘোর কাটছে না। অবাক চাহনি তার বার বার বলছে যা সচক্ষে দেখছে সেগুলো আদৌও সত্যি কি-না। আদি বলেছিল আপনের বিয়ে হবে। মেয়ের নামও বলেছিল। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে নবনীকে দেখে এক জাঁক প্রশ্ন এসে মাথায় হানা দিচ্ছে। উত্তর পাওয়া যে বড্ড জরুরী।
তখন পাশের ঘর থেকে আদি বেরিয়ে আসে। নিভ্রকে দেখে মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
-“ভাইয়া কখন এলে তুমি?”

নিভ্রর ঘোর কেঁটে যায় কিছুটা। ঘুরে তাকিয়ে কৃত্রিম হেসে উত্তর দেয়,
-“মাত্রই।”

-“এসো বোসো খেতে। এক সঙ্গে নাস্তা করি।”

-“তার আগে আব্বু, চাচ্চুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”

-“সব কথা বলা হবে তোমায়। এই জন্যই তোমাকে কুমিল্লা আসতে বলা হয়েছে। ফোনে সব কথা বলা যায় না।” আজীম উদ্দীন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে।

আজমল উদ্দীন রানী খাতুনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
-“নবনীকে রুমে নিয়ে যাও। নাস্তা রুমে দেওয়ার ব্যবস্থা করো ওর।”

রানী খাতুন তার কথা অনুয়ায়ী নবনীকে আদির রুমে নিয়ে যায়। সেখানেই নবনীকে খাবার দিয়ে আসে সে। বেরিয়ে আসে হল রুমে। এতক্ষণে নবনীর বুকের মাঝে বয়ে যাওয়া ঝড় গুলো উপচে পড়ে। দরজা বন্ধ করে পাথরের মতো ধুম করে ফ্লোরে বসে পড়ে। চোখের অশ্রুগুলো মুক্তোর মতো গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে ফ্লোরে। পুরোনো স্মৃতি, ক্ষত তাজা হয়েছে আজ। যে অতীত থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে, সেই অতীত তার জীবনের সঙ্গে নতুন ভাবে জুড়ে গিয়েছে। হল রুমে বের হবার পর নিভ্রর নাম শুনেই তার বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠে। আর যখন কন্ঠের স্বর শুনে, তখন সে আরো শিওর হয় এটাই সেই নিভ্র। যাকে এক সময় গভীর ভাবে ভালোবেসে ছিল। দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিল বুকের ভেতরটা। বার বার কেন নিয়তি তার সঙ্গে এভাবে খেলছে? ভেবেই ঘনঘন অশ্রুবর্ষণ হয় চোখ থেকে। তখন পরিস্থিতি সামলে নিতে নিজেকে যে কিভাবে শক্তপোক্ত ভাবে উপস্থাপন করেছে সবার সামনে, একমাত্র সে-ই ভালো জানে। কিন্তু সে কিছুতেই দূর্বল হবে না। তাকে বুঝাতে হবে সে খুব ভালো আছে। অতীত ভুলে গিয়েছে বহুকাল আগেই। চোখ মুছে ফেলে সে। নিজেকে নিজেই আশ্বাস দেয়।
.
-“পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে মানসম্মান হারাতে বলেছিলাম। শুধু মাত্র আদির জন্য পারিপার্শ্বিক অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে। সম্মানহানি থেকে মুক্ত হয়েছি আমরা।” আজীম উদ্দীন কথা গুলো বলে নিভ্রর পানে তাকায়। এতক্ষণে বিয়ে বাড়ির পুরো ঘটনা পুনরায় নিভ্রকে তিনি খুলে বলেন। নিভ্র চুপ করে শুনেছে। আপন বাদে আদি, রানী খাতুন ও রুবিন বানু ছিলেন। নবনীর বাড়ির সবাই কেথায় বেড়াতে গিয়েছে এটা নিভ্র জানে। কিন্তু তারা যে কুমিল্লা তার মামাত বোনের বিয়েতে এসেছে, সেটা তার জানা ছিল না।

নিভ্র এসব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থির নবনীতে। সে তার আপন ছোট ভাইয়ের ওয়াইফ ভাবতেই রাগে চোখমুখ খিঁচে আসে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ওঁকে। আজমল উদ্দীন বলেন,
-“তোমাকে আরো একটি কারণের জন্য কুমিল্লা আনা হয়েছে…..”

-“কারণটি নিশ্চয় বিয়ে?” ক্ষোভিত কন্ঠে চটজলদি বলে উঠে নিভ্র।

-“হ্যাঁ! বড়ো ভাইয়ের আগে ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বিষয়টি সমাজের চোখে বেমানান।”

-“তোমরা এখনো সেই সমাজ নিয়েই পড়ে আছো। কবে বের হবে সেখান থেকে? আর কত ভাববে সমাজের কথা?” নিভ্র কিছুটা রাগী কন্ঠে বলে।

-“সমাজেই যখন আমাদের বসবাস, ওঠাবসা, তখন তার কথা মাথায় রাখতেই হবে। তোমাকে বিয়ে করতে হবে। এবার কোনো অজুহাত আমি শুনবো না।” ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলে আজীম উদ্দীন।

নিভ্র রাগে নাকের পাঠা ফুলিয়ে রাখে। মুখে কিছু বলে না। ব্যাগ নিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে আসে। একে তো সে নবনীকে দেখে ক্ষেপে আছে। তার ওপর বিয়ের প্রসঙ্গ তোলার কারণে আরো ক্ষেপে যায়। নিভ্রর রাগের ধারণা তাদের আছে। তাই কিছুক্ষণের জন্য তাকে একা ছেড়ে দেয় তারা।

রুমে আসতেই কাঁধের ব্যাগ সজোরে বিছানার ওপর ছুঁড়ে মারে নিভ্র। রীতিমতো রাগে তার শরীর কাপছে। একে তো নবনী, দ্বিতীয় বিয়ের জন্য ফোস করার কারণে ভীষণ রাগ লাগছে তার। বিয়ের ব্যাপারটি বাদ দিলেও নবনীর বিষয়টি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারছে না সে। হোক এক্সিডেন্টলি বিয়ে হয়ে গেছে, তবুও মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ছোট ভাইয়ের বউ হিসাবে নবনীকে কিছুতেই দেখতে চায় না ।
সে কথা বলবে নবনীর সঙ্গে। চলে যেতে বলতে তার ভাইয়ের জীবন থেকে।
.
নাস্তা খেয়ে নবনী রুম থেকে বের হয় না। বেলকনিতে এসে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রয়। একটু আগেই তার পরিবারের সকলের সঙ্গে কথা বলেছে সে। দুপুরের দিকে আদি ও তাকে নিতে আসবে তারা। মন কিছুটা হলেও শান্ত হয়েছে। কিন্তু নিভ্রর কথা মনে পড়তেই মনে আঁধার নেমে আসে। কেমন যেন সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। আচ্ছা, দুঃস্বপ্ন হয়ে যেতে পারে না? নয়তো মিরাক্লেল হয়ে যাক!
তার ভাবনার ছেদ ঘটে আদির আগমনে। গলা খাঁকনি দিয়ে নবনীর এক হাত দুরত্ব রেখে দাঁড়ায়। নবনী দৃষ্টি কিছুটা নত করে রাখে। আদি নিজ থেকে বলে উঠে,
-“বিছানার উপর শাড়ী রাখা আছে। দেখবেন পছন্দ হয়েছে কি-না।”

নবনী ছোট করে বলে,
-“জি, দেখবো।”

আদি সেখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়। দু’জনার মধ্যে নীরবতা এসে জড়ো হয়। আদি পুনোরায় নিরবচ্ছিন্নতা ঘটিয়ে বলে,
-“দুঃখবিলাস বলে একটা টার্ম আছে, বুঝেন?”

নবনী আদির পানে তাকায়। তার চাহনি দেখে আদি নিজেও তাকায়। নবনী চোখ সরিয়ে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,
-“নাহ!”

-“যাদের জীবনে সুখের অভাব, দুঃখ পেতে পেতে একসময় তারা দুঃখটাকেই উপভোগ করতে থাকে। দুঃখটাকে তারা নিজের সঙ্গী বানিয়ে নেয়। এটাই দুঃখবিলাস।”

হঠাৎ আদির দুঃখবিলাস নিয়ে বর্ণনা দেওয়ার কারণ নবনী বুঝতে পারছে না। তবে সে সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিয়েছে। আদি পুনরুক্তি নমর স্বরে বলে,
-“কেন দুঃখবিলাস নিয়ে বর্ণনা দিলাম জানেন? কারণ এই দুনিয়ার বুকে অনেক মানুষই আছে দুঃখবিলাসে বেঁচে আছে। আবার অনেকের বেঁচে থাকার আশাটাই মরে গেছে। আপনি, আমি যদি নিজের দিক থেকে দেখি, তাহলে আমাদের কষ্ট সেই মানুষদের কাছে অতি তুচ্ছ বলে মনে হবে!”

নবনী চোখ জোড়া হালকা ভাবে বন্ধ করে নিয়ে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আদি জানে না তার মধ্যেও এক চিতলে দুঃখের রেশ লুকিয়ে রয়েছে। আর সেই দুঃক্ষের পুরো রশি এই সংসারের মধ্যে আবদ্ধ। প্রতিনিয়তে তার মুখোমুখি হতে হবে।

-“দুঃখিত! আসলে কাল রাতে আমাদের পরিবারের সদস্য যে আরেকজন আছে তার কথা বলতে ভুলে গিয়েছে। নিভ্র ভাইয়া।”

ফের নিভ্রর নামটি শুনে নবনী চোখ জোড়া চট করে বন্ধ করে নেয়। মেনে নিতে হবে তাকে। এখানে থাকলে নিভ্রর নাম সহ তারও মুখোমুখি হতে হবে। ভেবেই তার বুক ভার হয়ে আসে। আদির কথা বের শুনতে পায় নবনী। চোখ মেলে তাকায় সে।

-“আচ্ছা আপানার নিভ্র ভাইয়াকে কেমন লেগেছে? প্রথম দেখেছেন তাই হয়তো গম্ভীর, রাগী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ভাইয়া যথেষ্ট শান্ত স্বভাবের। অতিরিক্ত রাগকেও সে নিয়ন্ত্রণ আনার ক্ষমতা রাখে।”

যে মানুষটিকে কাছ থেকে দেখেছে, চিনেছে, এক সঙ্গে পাশাপাশি থাকাও হয়েছে। তার সম্পর্কে যে কিছুই অজানা নয়। না নতুন করে জানার আছে। উল্টো সে নিভ্রর স্বভাব, চরিত্রের বিবরণ দিতে পারবে। নবনী আদির চোখের দিকে তাকায়। ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“আপনার ভাইয়াকে আমি অতি নিকট থেকে চিনি। তার সম্পর্কে সব ধারণা আছে আমার। তাকে নিয়ে কিছু না বললেও চলবে।”

আদির ভ্রুকুটি কিঞ্চিৎ কুঁচকে আসে। কৌতূহল জেগে যায় মনে। সপ্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকায় নবনীর দিকে। নিভ্রকে আগে থেকে চেনার কারণ সে বুঝতে পারছে না।
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২৩
#সুমাইয়া মনি।

দিনের বেলায়ও দরজা, জানালা বন্ধ করে অন্ধকার কক্ষে বসে আছে তনুজা। পরনে এখনো বিয়ের লেহেঙ্গা, সাজসজ্জা চেহারাতে লেপ্টে রয়েছে। এলোমেলো চুল। হাতের মেহেদী চকচক করছে। ডান হাতের তালুর এক পাশে এ অক্ষরটি লিখা। নজর যতবার পড়ছে তার, আপনাআপনি অশ্রু ঝরেছে। খাওয়া তো দূর, পানিও মুখে তুলেনি এখন পর্যন্ত। তনুজার এমন অবস্থা দেখে চিন্তিত বাড়ির সবাই। কিভাবে ওঁকে স্বাভাবিক করবে, কেউ বুঝতে পারছে না।
নবনী ও আদি কিছুক্ষণ আগেই এ বাড়িতে হয়েছে। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে তনুজার রুমে আসে নবনী। ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। আলো রুমে প্রবেশ করতেই তনুজা কপাল কুঁচকে ফেলে। নবনীর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। এসে পাশে বসে নবনী। দু গালে হাত রেখে তার দিকে ফিরিয়ে করুণ চোখে তাকায় সে। কনে সাজ এখনো আছে তার চেহারাতে। শুধু নেই উজ্জ্বল ভাবটা। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখখানা। নবনী কোমল কাতর স্বরে বলে,
-“আপু আমার দিকে তাকাও। দেখো আমি কত হ্যাপি থাকার চেষ্টা করছি। তুমি কেন পারবে না? আমাদের ভাগ্য যে আল্লাহ নিজের হাতে লিখেছেন। সাধ্য নেই বদলানোর। ওনি যা করেন, ভালোর জন্যই করে।”

তনুজা কেঁদে ফেলে। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
-“আপন ভাইয়ারও তোমার মতো একই অবস্থা আপু। চাইলে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারো তুমি। আর নিজেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসো আপু।”

-“কী করব আমি?” কান্নারত কণ্ঠে বলে।

-“আপাতত আগে নিজেকে গুছিয়ে নেও। যতটা অগোছালো হয়েছো, তার চেয়ে বেশি।”

চুপ থেকে নবনীকে জড়িয়ে ধরে আরো কয়েক ফোঁটা চোখের পানি বিসর্জন দেয়। নবনী পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু কাঁদতে বারন করে না। কাঁদলে যে মন হালকা হয়, সেটা সে জানে।

আদিকে গেস্ট রুমে একা একা বসে আছে। এক গাদা নাস্তা তার সামনে রাখা। একা খেতে মন চাইছে না। মনে মনে নবনীর কথা ভাবে। তার ভাবনা বিফলে যায় না। হঠাৎ-ই নবনীর আগমন হয়। কিছুটা হলেও আদি খুশি হয়। নবনী তার দিকে এগিয়ে আসতেই আদি প্রথমে জিজ্ঞেস করে তনুজার কথা,
-“তনুজা আপু কোথায়?”

-“তার রুমে আছে।”

-“স্বাভাবিক হয়েছি কি?”

-“এত তাড়াতাড়ি হবে বলে মনে হচ্ছে না।”

আদি চোখ নামিয়ে চুপ করে রয়। বুঝতে পারে আপন, তনুজার অবস্থা একই। আপন হারিয়েছে তার প্রেয়সীকে, তনুজা হারিয়েছে যাকে বিয়ে করার আশা নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছিল তাকে। দু’জনার কূলকিনারা এক। আদি চুপ হয়ে যাওয়াতে নবনী বলে,
-“খাচ্ছেন না যে?”

আদি চোখ তুলে তাকায়। বলে,
-“আচ্ছা আমাকে কী আপনাদের রাক্ষস বলে মনে হয়?”

নবনী বুঝতে পারে কেন রাক্ষসের প্রসঙ্গ সে তুলেছে। উত্তরে বলে,
-“আপনি এ বাড়ির এক মাত্র ভাগ্নি জামাই। এতটুকু আপ্যায়ন তো সামান্য। শ্বশুর বাড়ির কথা তো বাদই দিলাম।”

-“এতটুকু বলছেন? এগুলো আমি একা খাব?”

-“না পারলে আপনার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে করে কেন নিয়ে আসলেন না?”

-“বন্ধু তো আপাতত কাছে নেই, তবে নিভ্র ভাইয়াকে জোর করে নিয়ে আসলে ভালো হতো।”

মুখ চুপসে যায় তার। যতোই ভুলে থাকতে চায়। আদি কথার মাঝে একবার হলেও মনে করিয়ে দেয়।

-“ওহ! ভাইয়ার কথা বলাতে কাল আপনার কথা মনে পড়লো। আপনি তো বলেন নি ভাইয়াকে আপনি অতি নিকট থেকে কিভাবে চিনেন। কিন্তু ভাইয়া বলেছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ভাইয়া বলেছে আপনি নাকি তার প্রতিবেশী ছিলেন। রাইট?”

-“জি।”

-“বরাবর বাড়ি আপনাদের।”

-“জি।”

-“তাহলে তো আপনি ভাইয়াকে খুব ভালো করেই চিনেন?”

-“জি, সেটা বলতে পারেন।” কথাটি বলে নবনী ভাবে নিভ্র হয়তো তার বিষয়টি চাপিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে নিশ্চয় কোনো গভীর কারণ লুকিয়ে আছে।

-“আমি সেদিন দেখলাম না কেন আপনাকে? ওহ! দেখেছি কলেজে।”

-“কোনদিন?”

-“ভুলে গেলেন। আমাদের ফাস্ট মিট হয়েছিল কিন্তু লাইব্রেরিতে।”

-“আপনি কি আমাদের কলেজে পড়েছিলেন?”

-“আরে না। আপনের বিয়ের কার্ড নিয়ে সেদিন সকালে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসি। ভাইয়া নাকি তার কিছু কলিগদের বিয়ের দাওয়াত দিবে তাই। তারপর সকালে ভাইয়ার সঙ্গে বের হই থানার উদ্দেশ্যে। তার আগে আপনাদের কলেজে আসি। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কিছু জুরুরী কথা বলবে ভাইয়া এই জন্য। ভাইয়া কথা নিচে বলছিল। এই ফাঁকে আমি লাইব্রেরিতে যাই। আর তখন কাকতালীয় ভাবে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়। ভাইয়ার জরুরী মিটিং ছিল। তাই গায়ে হলুদ,চলনে উপস্থিত থাকতে পারেনি। বৌ ভাতের অনুষ্ঠান এক দিন পিছিয়ে দেওয়া হয় ভাইয়ার জন্য। কিন্তু…? ডাউট ক্লিয়ার?”

-“জি।”

-“রাতের বাসে চড়ে পরেরদিন সকালে কুমিল্লা ফিরে আসি। এই জন্য বোধহয় আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয় নি।”

-“দেখা হলে হয়তো আমি আপনাকে বিয়ে করতাম না।” মনে মনে বলে নবনী।

-“শুনুন নবীনতা।”

বুক কেঁপে উঠে নবনীর। পুরো নাম ধরে নিভ্র ব্যতীত আর কেউ ডাকতো না। আদির মুখে পুরো নাম শুনে অস্বস্তি লাগছে তার। দ্রুত বলে উঠে,
-“আমাকে শুধু নবনী বলে ডাকলে খুশি হবো, নবনীতা না বলে।”

-“আপনি যদি খুশি হন তাহলে নবনী বলেই ডাকবো।”

-“আচ্ছা।”

-“এখন শুনুন। এই খাবার গুলো আমি একা খেতে পারব না। আপনাকে আমার সঙ্গে খেতে হবে।”

-“আপনি শুরু করুন, আমি আসছি।”

-“না, প্লিজ যাবেন না। একা খুব বোরিং লাগছে। খেতে হবে না, আপনি শুধু পাশে বসে থাকুন।” কিছুটা মিনতি স্বরে বলে।

নবনী মৃদু হাসি প্রধান করে বলে,
-“আচ্ছা যাব না, আপনি খেতে আরম্ভ করুন।”

-“ধন্যবাদ।” স্মিত হেসে বলে।

আদি খাচ্ছে আর নানান বিষয় নিয়ে আলাপ করছে। নবনী কথায় সায় দিচ্ছে। দরজার অপর পাশে দাঁড়িয়ে নিলুফা বেগম ওদের কথপোকথন শুনে ভেতরে প্রবেশ করে না।
বাহিরে দাঁড়িয়ে রয়। ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে,
-“নবনীর জীবন কেন যে এতটা কঠিন ভাবে বিধাতা বানিয়েছে জানি না। নিভ্রর কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার পর হুট করে বিয়ে হয়ে গেল। ভেবেছিলাম শ্বশুর বাড়িতে হয়তো ভালো থাকবে। কিন্তু নিয়তি আবার ওর জীবনের মোড় উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলো। অতীত ফিরে এসেছে। জানি না মেয়েটার জীবনের শেষ পরিনতি কী লিখা আছে!” কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে চলে যায়। এ বাড়িতে আসার পর নিভ্রর কথা জানতে পারে আদির কাছ থেকে। প্রথমে তার ঘটকা লাগে। নবনীকে জিজ্ঞেস করতেই নিভ্রর তার বড় ভাসুর সেটা জানতে পারে। মেয়ের জন্য খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে তার।
___________________
রাতে….

জরুরী তলব দেওয়ার ফলে তাকে কুমিল্লা আসতে হয়। এতে সে জিনানকে বলে আসতে পারে না। জিনান নিভ্রর বাড়িতে এসে দেখে তালা ঝুলানো। নিভ্রকে কল দিয়ে জানতে পারে সে কুমিল্লা। হঠাৎ করে যাওয়ার মূল কারণ জানতে চাইলে সংক্ষেপে সব খুলে বলে। জিনান নিজেও অবাক নবনীর কথা শুনে। নিভ্রর বিয়ের কথা শুনে জিনান কিছু বলে না। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর নিভ্র নিজেই ফোন কেঁটে দেয়। জিনান ভাবতে থাকে নিভ্র, নবনীর কথা। যখন আদি জানতে পারবে নিভ্রকে এক সময় নবনী ভালোবাসতো তখন কেমন রিয়েক্ট করবে ভাবে সে।

না খেয়ে শুয়ে পড়ে নিভ্র। আজীম উদ্দীন কয়েক বার নিভ্রকে আদির সঙ্গে যেতে বলেছিল ঐবাড়িতে। কিন্তু নিভ্র যায় নি। যাবে না কঁড়া গলায় নিষেধ করে। খুব জেদ হচ্ছে তার। কেন? কী কারণে? প্রশ্ন হয়ে লটকে আছে। এটি একটি গভীর প্রশ্ন? উত্তর কোথায় লুকিয়ে আছে জানা নেই তার।
__________
-“আপনি বিছানায় ঘুমান। আমি নিচে চাদর বিছিয়ে ঘুমাবো।” নবনী কথাটি আদির উদ্দেশ্যে বলে চাদর বিছাতে আরম্ভ করে।

আদি খাটের ওপর বসেই বলে উঠে,
-“সেকি! নাহ সেটা হবে না৷ আপনি বরং ওপরে ঘুমান। আমি নিচে শুই।”

-“দরকার নেই। শুয়ে পড়ুন।”

-“উঁহু! হবে না।” বলেই আদি নিচে নেমে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। নবনী একটু সরে দাঁড়িয়ে আদির পানে তাকায়। চোখাচোখি হয় তাদের। নজর আগে সরিয়ে নেয় নবনী। আদি নবনীর দিকে নজর তাক করে রাখে। এই দু’দিন নবনীকে দেখে তার মনে হয় স্বভাব-চরিত্র ভালো প্রকৃতির। চুপচাপ থাকে, মাথা নিচু করে কথা বলে। বেশ শান্তশিষ্ট সে। সৌন্দর্যের দিক থেকে দেখলে রূপবতী নারী বলা চলে। যেকোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নিতে জানে, ঠিক তার মতো।

-“শুনছেন?” নবনীর আওয়াজ শুনে আদির ভাবনা কেটে যায়। এতক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নেয়। নবনী বিছানা বিছিয়ে নিয়েছে। এখন শুধু শোবার পালা।

-“শুনে পড়ুন যান।” ফের নবনী বলে উঠে।

আদি বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে। জড়তা-সংকোচ ফেলে বলে,
-“আচ্ছা চলুন আজ রাতে আমরা গল্প করে সময় কাঁটিয়ে দেই।”

নবনী কাঁথা কেবল হাতে নিয়েছে গায়ে দিবে বলে। আদির কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় তার দিকে। ঠোঁটে স্মিত হাসি তার স্পষ্ট। নবনী যত চাইছে আদির কাছ থেকে এড়িয়ে চলতে, ততই আদি আগ বাড়িতে তার নিকট এগিয়ে আসছে। এক রাশ স্নিগ্ধ বিমুগ্ধতা ছেঁয়ে আছে তার চোখে, ঠোঁটে, আদলে। তার এমন বন্ধুসুলভ আচরণ, মনোমুগ্ধকর হাসি দেখে যে কোনো মেয়ে মোহগ্রস্ত হবে। দুই ভাই দুই প্রকৃতির। এক ভাই কঠিন, তো আরেক ভাই নরম, শান্ত!
নবনী চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। মনের মধ্যে তার জড়তা সৃষ্টি হয়। বলে,
-“আমি ঘুমাব।”

-“আচ্ছা ফোস করব না। গুড নাইট!” বলেই সে চিৎ হয়ে শুয়ে বালিশে মাথা রাখে। নবনী লাইট অফ করে দেয়। অন্ধকার হয়ে যায় পুরো রুম। বন্ধ রুমে দু’জন মানুষ দুই স্থানে শুয়ে রয়েছে। অথচ, কিছু দিন আগেও তারা দু প্রান্তের বাসিন্দা ছিল। আজ এক প্রান্তের বাসিন্দা হয়েও তাদের মধ্যকার দূরত্ব বেশখানিকটা জুড়ে রয়েছে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-২০+২১

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২০
#সুমাইয়া মনি।

আড়ম্বরপূর্ণ কমিউনিটি সেন্টারটি আরো জমজমাট হয়ে উঠে বর আসার ফলে। বরযাত্রীকে ভেতরে নিয়ে আসা হয়। কিছু মেয়েদের মুখে বর এসেছে বাক্যটি শুনে তনুজা লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখে। তার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। তনুজাকে নবনী খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। বোনের লজ্জামিশ্রিত হাসি দেখে সে-ও খুশি হয়। সামান্য কিছু খাবার খাওয়ানোর পর নবনী নিজেও খেয়ে নেয়। নিচে বরযাত্রীদের খাওয়া – দাওয়ার পর্ব আরম্ভ হয়। বরকেও খাবার দেওয়া হয় খেতে। আপন আদি সহ ওদের আরো কিছু ফ্রেন্ড, ভাইরা মিলে খাবার খাচ্ছে।
ঘন্টাখানিক পর বিয়ে পড়ানো শুরু করে কাজী সাহেব।
আপন অতিরিক্ত ঘামছে। বার বার রুমাল দ্বারা কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছে। আদি বিষয়টি লক্ষ্য করে। সবাইকে উপস্থিত দেখে কিছু বলে না। কাজী সাহেব খাতাটি আপনের দিকে এগিয়ে দেয় সাইন করতে। আপন কিছুটা কাঁপা হাতে কলম তুলে নেয়। সাইন করতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তে আপনের একজন ফ্রেন্ড এসে ওর কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে সরে যায়। স্তব্ধ বাকরুদ্ধ হয়ে পাথরের ন্যায় চুপটি করে বসে রয় কলম ধরা অবস্থায়। উপস্থিত সবার নজর এখন আপনের ওপর। আদি পরিস্থিতি সামনে নেওয়ার জন্যে আপনে কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“আপন সাইন কর ব্রো।”

আদির কথা শেষ হতেই আপনের হাত থেকে আপনাআপনি কলম গড়িয়ে পড়ে যায়। মাথার পাগড়ি খুলে পাশে রেখে সে উঠে দাঁড়ায়। সবার চোখেমুখে বিস্ময় ভাব ফুটে উঠে আপনের ব্যবহারে। আপন বহু কষ্টে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠে,
-“আমি বিয়ে করতে পারব না।”

পুরো হলটি নিশ্চুপ হয়ে যায়। আপনের কথার প্রতিধ্বনি হয় হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। চোখমুখ কালো হয়ে যায় নিলাজ হোসাইন, মাহবুব হাসান সহ বাকি আত্মীয়দের। বিয়ের আসরে বরের মুখে এমন কথাটি কতটা যন্ত্রণা অপমানসূচক, একমাত্র মেয়ের বাবারাই বুঝতে পারবে সেটি। আজিম উদ্দীন, আজমল উদ্দীন মুখ চাওয়াচায়ি করছে দু’জনার। তারাও বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছে না। আপন সবাইকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া ধরলে পিছন থেকে আদি আপনের হাত ধরে থামিয়ে ধীরে কন্ঠে বলে,
-“এসব কী বলছিস তুই? কোথায় যাচ্ছিস? আমাদের মানসম্মান……”

পুরো কথাটি আদিকে বলতে না দিয়ে আপন কিছুটা জোরেশোরে বলে উঠে,
-“মানসম্মান? যে মেয়েটি আমাকে ভালোবেসে অপেক্ষা করতে করতে সুইসাইড করেছে, তার সামনে মানসম্মান অতি তুচ্ছ! ”

বিস্মিত আদি আপনের কথা শুনে। অবাক চোখেমুখে চেয়ে রয় আপনের পানে। সে বলেছে তার ভালোবাসার কোনো মানুষ নেই। তবে সে কার কথা বলল এই মাত্র। ফের প্রশ্ন রাখে আপনের উদ্দেশ্যে আদি,
-“মেয়েটি মানে? কে সে?”

-“আমার ভালোবাসা, তনুশ্রী। সে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে ওপারে পাড়ি জমিয়েছে।” বলতে বলতে আপনের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।

সবার মুখ থমথমে হয়ে যায়। আপনের মুখে তনুশ্রী নামটি শুনে আদির পরিবাবের সবার বুঝতে বাকি থাকে না কে এই তনুশ্রী। হতবিহ্বল দৃষ্টি রাখে আপনের ওপর। আজিম উদ্দীন উঠে আপনের কাছে এসে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
-“যা হবার হয়ে গেছে। তুমি তনুজাকে বিয়ে করে নেও। বিয়ের পর সব কথা হবে।”

-“কিভাবে চাচ্চু? কিভাবে কথাটি বলতে পারলে? এই তোমার আইন।”

আজিম উদ্দীন ক্ষেপে গিয়ে ‘আপন’ নামটি উচ্চারণ করলেন।
আপন কথা বন্ধ রাখে না। বলে,
-“ঐ দিকে আমার প্রেয়সীর চিতা জ্বলবে। আর আমি এসব ভুলে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করব, কিভাবে?”

-“আপন তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো, কাউকে কথা দিয়ে কথার খেলাফ আমরা করি না।” ক্ষুব্ধ কন্ঠে বললেন।

-“আর আমি তো তোমাদের সুখের জন্য অনেক আগেই তনুশ্রীকে দেওয়া কথার খেলাফ করেছি। তার কী হবে চাচ্চু?” করুণ কন্ঠে বলে আপন।

-“এসব বলার সময় এখন নয়। আগে বিয়ে হোক…”

আপনের চোখের কোণায় জমে থাকা জল গুলো মুছে কঠোর কন্ঠে বলে,
-“আমায় মাফ করো চাচ্চু। আমি তনুজাকে বিয়ে করে ওর জীবনটা নষ্ট করতে পারব না। চললাম!” বলেই সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।

পিছন থেকে আজমল উদ্দীন ‘আপন’ বলে কয়েক বার নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু সাড়া পেল না আপনের। লজ্জায় অপমানে মুখ খুঁচিয়ে আসে তার। আপনের দ্বারা এমন ব্যবহার কেউ মেনে নিতে পারছে না। আদি নিরব স্রোতার মতো সব শুনেছে। তবে আপনের লাস্টের কথাটিতে সে সহমত। নিলাজ হোসাইন এবার রেগে গিয়ে আজিম উদ্দীনের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“এভাবে আমাদের অপমান করাটা কি জরুরি ছিল। আগে কেন বলেন নি আপনের হিন্দু ধর্মের একজন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে রয়েছে।”

-“দুঃখিত! আমরা সত্যি এই বিষয়টি জানতাম না বেয়াই।” কিছুটা আহত স্বরে বললেন আজিম উদ্দীন।

-“বেয়াই বলে সম্মোধন করেন কোন হিসাবে? বিয়ের আসর থেকে বিয়ে ভেঙে যাওয়া যে মেয়ের বাবার কাছে কতটা যন্ত্রণাদায়ক অপমান, সেটা আপনাদের বোধগম্য নয়।” কাঠিন্য স্বরে কথা গুলো বললেন।

মাথা নত করে আজিম উদ্দীন, আজমল উদ্দীন তার কথা গুলো শুনছে। এমন অপমানসূচক কথা তাদের মেনে নিতে বিবেকে বাঁধছে। তবুও শুনতে হবে।

মাহবুব হাসান নিলাজ হোসাইনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
-“তুমি একটু শান্ত হও। আমি দেখছি বিষয়টি।”

-“কিভাবে শান্ত হবো? কি দেখবে তুমি। সব তো চোখের সামনে ঘটে গেল। আমার মেয়ের জীবন ধ্বংস হতে চলেছে।” লাস্টের কথাটি বলে সে অসহায় ভাবে পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন। তার যেমন রাগ হচ্ছে, তেমনি মেয়ের জন্য দুঃখ লাগছে। কী জবাব দিবে মেয়েকে। সে যে অধিক আশা ভরসা নিয়ে বধূ সেজে বসে আছে। কখন বাবা তার পছন্দের সুপাত্রের হাতে তাকে তুলে দিবে।

আদি তার বাবা, চাচ্চুর মানসম্মানের অবস্থা বুঝতে পারছে। সঙ্গে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবার উপক্রম হয়েছে। সে চুপ থাকতে পারে না। এগিয়ে এসে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দৃঢ়তা ফেলে বললেন,
-“আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি তনুজাকে বিয়ে করতে রাজি আছি।”

এক চিতলে রোদের জন্য সকালটি যেমন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তেমনই আদির কথা শুনে সবাই এক বিন্দু আশার আলো খুঁজে পায়। মুখ তুলে তারা আদির দিকে তাকায়। আদি তাঁদের উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজ থেকে ফের বলে,
-“আপন ঠিকিই বলে গেছে। এই মুহূর্তে আপন যদি তনুজাকে বিয়ে করতো। তাহলে কখনোই সুখি হতে পারতো না আপনাদের মেয়ে। ভাঙা মন কাঁচের ন্যায় সমতুল্য। জোড়া লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আপনের অবস্থা ঠিক একই। ও-তো আপনার মেয়ের জীবন আরো বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে। সঙ্গে আমার দায়িত্ব। আমি নিরদ্বিধায় আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে প্রস্তুত আছি।”

নিলাজ হোসাইনের চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠে। এগিয়ে এসে আদির উদ্দেশ্যে অসহায় কন্ঠে বলে,
-“সত্যি! তুমি বিয়ে করবে আমার মেয়েকে?”

-“হ্যাঁ!”

আজিম উদ্দীন আদির কাছে এসে বললেন,
-“আমাদেরও কোনো আপত্তি নেই।”

-“তাহলে বিয়ে পড়ানো হোক।” মাহবুব হাসান বললেন।

-“কিন্তু তার আগে আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন। তার সম্মতি নেওয়া দরকার।” আদি বলে।

-“আমি কথা বলছি। একটু অপেক্ষা করুন আপনারা।” নিলাজ হোসাইন কথাটি বলেই ছুঁটে চললেন তার মেয়ের কক্ষের দিকে। তিনি ভেতরে প্রবেশ করে নিজেরা ক’জন থেকে বাকিদের বের করে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর….

তনুজা পাথরের মতো শক্ত হয়ে ওড়না খাঁমচে ধরে উলটো দিকে মুখ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। এক হাত বুকের কাছে রেখে মাথা নত করে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। পিছন থেকে তার বাবা বিনীত স্বরে বিয়ের জন্য রাজি হতে বলছে তাকে। কিন্তু তনুজা কিছুতেই রাজি হতে পারছে না। কিভাবে সে রাজি হবে? যাকে এতদিন ধরে ভালোবেসেছে। মনের ঘরে যার বিচরন। তাকে ভুলে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। এমনই কি হয় তাহলে এক তরফা ভালোবাসা! এত কষ্ট, এত যন্ত্রণাদায়ক। আর শুনতে পারছে না বাবার মিনতি। কান্না কণ্ঠে পিছনে ফিরে বলে,
-“থামো বাবা, থামো! আমি পারব না বিয়ে করতে। আমাকে তুমি মাফ করো প্লিজ!”

-“মা আমার মানসম্মান আর তোর নিজের কথা একবার ভেবে দেখ। এই মুহূর্তে তোর বিয়ে না হলে, পরে তোকে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।”

-“এর চেয়ে কঠির পরিস্থিতি আর কি হতে পারে বাবা। আমার….. ” বাকিটা বলার আগেই অঝোরে কাঁদতে থাকে তনুজা।

মেয়ের কান্না দেখে সে নিজেও কেঁদে দেয়। তনুজার মা আমেনা বেগম, নিলুফা বেগম এগিয়ে আসে তনুজার কাছে। তাদের চোখেও পানি বিদ্যমান। নবনী এক কোণায় দাঁড়িয়ে তাঁদের সবার কথপোকথন শুনছে। চোখের কোণায় কিছু অশ্রু তারও জমা হয়েছে।

-“মা দয়া কর তোর বাবার ওপরে। বিয়ে করে নে।”

তনুজা কান্নার ফলে কিছু বলতে পারছে না। আমেনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদে চলেছে। আড়ম্বরপূর্ণ কমিউনিটি সেন্টারটি নিমিষেই বেদনাপূর্ণে পরিনত হয়। সৃষ্টি হয় এক ক্লেশকর পরিবেশ!

আধাঘন্টা পর নিলাজ হোসাইন ও মাহবুব হাসান রুম থেকে বের হয়। আদিদের দিকে এগিয়ে আসতেই আজিম উদ্দীন বললেন,
-“রাজি হয়েছে তনুজা?”

নিলাজ হোসাইন কন্ঠ খাদে ফেলে বললেন,
-“হু,,একটা কথা বলার ছিল আপনাদের।”

আদি দ্রুত উঠে এগিয়ে এসে বলে,
-“আঙ্কেল এমনেতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। আগে বিয়ে হোক, তারপর আপনি যা বলার বইলেন। কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পড়ান।”

-“আদি আগে আমাদের কথাটা শুনে নেও।” মাহবুব হাসান বলেন।

-“পরে শুনবো আঙ্কেল।” কিছুটা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে আদি।

আর কেউ কোনো কথা বলে না। কাজী বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করে। কবুল বলার পর সাইনে করে দেয় আদি। কাজী সাহেব উঠে কনের কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। সঙ্গে আজিম উদ্দীন, আজমল উদ্দীনও আসে। দোয়া মোনাজাতের মাধ্যমে বিয়ে সম্পূর্ণ হয়। আদি তৎক্ষনাৎ উঠে একটু দূরে এসে আপনকে কল দেয়। কিন্তু আপন ফোন তুলে না। ওর সেই বন্ধুটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে সব। কাল রাতে তনুশ্রী বিষ খেয়ে সুইসাইড করেছে। সব জায়গা থেকে তনুশ্রীকে ব্লক করার ফলে আপন অবধি খবরটি পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

গভীর ভালোবাসা ছিল আপন তনুশ্রীর। কুমার দত্তের মেয়ে তনুশ্রী। কুমার দত্ত পেশায় একজন ক্রিমিনাল লয়ার ছিলেন। অনেক আগে থেকেই কুমার দত্তের সঙ্গে আজমল উদ্দীনের দ্বন্দ্ব ছিলেন কোনো এক কেস নিয়ে। সেই দ্বন্দ্ব আস্তেধীরে দ্বিগুণ হয়। এবং নতুনে শুরু হয় আজিম উদ্দীনের সঙ্গে। তনুশ্রী হিন্দু তাতে কোনো সমস্যা ছিল না। সমস্যা ছিল কুমার দত্তকে নিয়ে। সে শুধু সৎ লোকদের বিরূদ্ধে লড়াই করতেন। তনুশ্রীও ছিল একজন ক্রিমিনাল লয়ার। রাগ, জেদের বশে তাদের সম্পর্ক হয়। আপন একজন সি,আই,ডি অফিসার। এই বিষয়টি পরিবার, তনুশ্রী বাদে বাহিরের লোকরা জানে না।বহুবার তনুশ্রীকে ক্রিমিনাল লয়ারের পদ থেকে সরে আসতে বলেছে। কিন্তু বাবা-মায়ের এক মাত্র সন্তান হবার কারণে বাবার পদ সে কিছুতেই ছাড়তে রাজি ছিল না। ওঁদের সম্পর্কের কথা দু’জন বন্ধু বাদে কেউ জানতো না। এমনকি আদিও না। আপন কয়েকবার বাবা, চাচ্চুকে বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারেনি। তাই সে তাদের সুখের কথা ভেবে তনুশ্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে। এটাই ছিল তার ভুল! যার কারণে তনুশ্রীর মৃত্যু ঘটল! আপন জানে তনুশ্রী ভীষণ জেদি একটি মেয়ে। তার জেদের বশেই আজ তার মৃত্যু হয়েছে।

কল দিয়ে যখন আপনকে পাচ্ছিল না। তখন আদি নিজে আপনের কাছে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু একেবারে কনে সঙ্গে নিয়ে যাবার বার্তাটি বলে আজমল উদ্দীন। ইচ্ছে না থাকা শর্তেও থেকে যেতে হয় আদিকে। কিছুক্ষণ বাদেই রওয়ানা হয় তারা। তনুজা নয়, এখন শুধু মাথায় আপনের কথা ভনভনিয়ে ঘুরছে তার। তনুশ্রীর জন্য আপন নিজে না ভুল কিছু করে বসে। বাড়ি যাওয়ার মাঝপথেই আদি নেমে যায়। একটি টেক্সি নিয়ে সোজা তনুশ্রীর বাড়িতে আসে। বাড়ির ঠিকানা আপনের বন্ধুর কাছ থেকে নিয়েছিল। বাড়িতে কেউ ছিল না। সবাই শশানে গিয়েছে। আদি সেখান থেকে শশানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। মিনিট দশের পর সে পৌঁছে যায়।

শশানের বাহিরে আপন একটি গাছের ডালের ওপর হাত
রেখে ঝাপসা চোখেমুখে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে জ্বলন্ত অগ্নির চিতায় তার ভালোবাসার মানুষটি পুড়ছে, অন্যদিকে তার হৃদয় পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে! এ যে এক করুণ মর্মান্তিক দৃশ্য। আলতোভাবে কাঁধে স্পর্শ পায় আপন। চোখ মুছে ঘুরে তাকিয়ে আদিকে দেখে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। আদি আপনের পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। আশ্বাস আশা দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তার নেই, কাছ থেকে আপনের কষ্টকে অনুভব করা ছাড়া।
________________
রাতে…

আপনকে সঙ্গে নিয়ে আদি বাড়ি ফিরে। তনুশ্রীর বিষয় নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না আপনের সঙ্গে। আপনকে আদির রুমে দিয়ে এসে কাকি মাকে খাবার খাইয়ে দিতে বলে এবং সে আজ রাতে আপনের সঙ্গে থাকবে কথাটি বলে আপনের কক্ষে চলে আসে। আসার আগে আজমল উদ্দীন তাকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিল। আদি ক্লান্তির বাহানা দিয়ে এড়িয়ে যায়। আজ বিয়ে ছিল আপনের। যার দরুণ তার রুমেই বাসর ঘর সাজানো হয়েছে। কিন্তু মোড় ঘুরে গেছে। আদির রুম যে তাড়াহুড়ো করে সাজাবে সেই মনমানসিকতা এখন আর কারো মধ্যে নেই। ছোট্টখাটো একটি ঝড় বয়ে গেছে তাদের ওপর থেকে। তাই তাকে বাধ্য হয়ে আপনের রুমে যেতে হচ্ছে। এক রাতেরই তো ব্যাপার। মানিয়ে নিবে সে।
রুমের কাছে আসতেই তনুজার কথা মনে পড়ে তার। একবারের জন্যও কথা তো দূর দেখার সুযোগ হয়নি তাকে।
কি থেকে কি হয়ে গেল ভেবেই আদি সরু নিঃশ্বাস ফেলে প্রবেশ করে রুমে। বিছানার মাঝখান বরাবর মাথায় ঘোনটা টেনে বসে আছে তনুজা। চোখ ঢা’কা, শুধু ঠোঁট ও টানা নথ সহ নাক দেখা যাচ্ছে। আপন কিছুক্ষণ মৌন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। কি বলে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। যে-ই মানুষটিকে এতদিন ভাবি বলে সম্মোধন করেছে। আজ সে তার অর্ধাঙ্গিনী! আল্লাহর কি লীলাখেলা। দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে নরম স্বরে বলে,
-“আপনি চেঞ্জ করে শুয়ে পড়ুন। আমি আজ রাতে আপনের সঙ্গে ঘুমাবো।”

প্রতুত্তর আসে না তনুজার কাছ থেকে। সে চুপ করে সেভাবেই বসে রয়। আদি বুঝতে পারে তাকে মেনে নিতে সংকোচ বোধ করছে। আপাতত কিছুটা স্বাভাবিক করতে চায় পরিস্থিতি। সে ফের বলে,
-“আমি আপনাকে নাম ধরে ডাকবো। এতে আপনার কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করছি না তনুজা?”

এবার মৃদুস্বরে উত্তর আসে,
-“তনুজা নয়, আমি নবনী।” কথাটি বলে নবনী মাথার ঘোমটা সরিয়ে দৃষ্টি নত রাখে।

আদি যেন ছোট্ট একটা ধাক্কা খেলো। আকস্মিকতায় হতভম্ব চোখে তাকায় সে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিস্ময় চোখমুখ কুঁচকে আসে তার। চোখের সামনে তনুজার বদলে সয়ং নবনীকে দেখে চমকে উঠে । আসলেই কি সে সঠিক দেখছে? নজর সরিয়ে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কিভাবে কী হয়েছে। তনুজার স্থানে নবনী কিভাবে এলো? তাহলে কি একটু আগে চাচ্চু আর তখন নিলাজ আঙ্কেল বিয়ে পড়াবার আগে নবনীর কথাই বলতে চেয়েছিল?
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_২১
#সুমাইয়া মনি।

-“আমার কিছু বলার এবং করার কিছু ছিল না। জোরাজুরি করার পরও তনুজা আপু যখন বিয়েতে রাজি হচ্ছিল না, তখন মামা আমাকে আপুর বদলে আপনার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার কথা বলে। আব্বু প্রথমে আপত্তি করে। কিন্তু পরে মামার মিনতীর কাছে হাড় মানতে হয় তাকে। মামা যখন আমার মাথায় হাত রেখে আমাকে বিয়ের কথা বললেন। তার অসহায় চোখ দু’টি দেখে আমি তাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি। সব পিছনে ফেলে রেখে রাজি হয়ে যাই বিয়েতে। বাবা-মায়ের পর মামাকে ভীষণ ভালোবাসি। ভালো লাগছে মামার জন্য কিছু করতে পেরে।” কোমল স্বরে কথা গুলো বলে নবনী মাথা তুলে তাকায় আদির দিকে।

আদি এতক্ষণ নবনীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনছিল। মামার জন্য নিজের জীবনকে বিসর্জন দিয়েছে। ভেবেই নবনীর প্রতি শ্রদ্ধা তৈরি হয় তার মনে। নজর সরিয়ে নিয়ে সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“আপনার আমার জীবনের মোড় একি ভাবে ঘুরে গিয়েছে। আপনি আপনার মামার জন্য স্যাকরিফাইস করেছেন। আর আমি পরিবারের জন্য।”

-“আল্লাহ যা করেন, ভালোর জন্যই নাকি করে। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা জানি না। আচ্ছা আপনিও কী জানতেন না আপন ভাইয়ার সম্পর্কের কথা?”

-“আপনের এতটা কাছে ছিলাম, ক্লোস ছিলাম। বন্ধুর মতো চলাচল করতাম। অথচ আপন আমাকে তার ভালোবাসার মানুষটির সম্পর্কে কিছুই বলেনি। ভাবতেই কেমন অদ্ভুত লাগে।”

-“না বলার পিছনে হয়তো কোনো গভীর কারণ ছিল। আপনি কি জানতেন না আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে? কেননা আপনার বাবা,চাচ্চু তারা তো বিষয়টি জানতো।”

-“আমি সত্যিই জানতাম না বরের মতো কনেও পাল্টে গেছে। আপনার মামা বিয়ে পড়ানোর আগে আমাকে বলতে চেয়েছিল, আমি শুনিনি। কিছুক্ষণ আগেও চাচ্চু মেবি আপনার কথাই বলার জন্য ডেকেছে। ইগনোর করে চলে এসেছি। তাই তো আপনাকে দেখে আমি শকট!” কথা গুলো বলে আদি খাটের এপাশে এসে বসে।

নবনী দৃষ্টি নত করে নিরব হয়ে রয়। তাঁদের মধ্যে এখন নিরবতা বিদ্যমান। সেকেন্ড কয়েক অতিবাহিত হতেই আদি ফের বলে,
-“একটা প্রশ্ন করি?”

নবনী চোখ তুলে তাকায়। আদির নজর সামনের দিকে। নরম স্বরে বলে,
-“জি, প্রশ্ন করতে পারেন।”

-“আপনি কী আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন?”

মিনিট কয়েক চুপ করে রয় নবনী। প্রতিত্তোরে কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। মিনিট কয়েক পর দৃষ্টি নিচু করে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“নাহ! এ বিয়েতে বড়দের দোয়া রয়েছে। তাদের নির্দেশে বিয়ে হয়েছে। তাই আমি এটা কখনোই চাইবো না। এটা আমার নিয়তি। আমি নিরদ্বিধায় মেনে নিতে প্রস্তুত আছি।”

নবনীর কথায় আদি স্বস্তির প্রশ্বাস ফেলে। যেভাবেই হোক, জানা বা অজানা বশে বিয়ে তো হয়েই গেছে। সে নিজেও চায় না ডিভোর্স হোক। সময় দিবে! প্রচুর সময় দিবে, যাতে করে তাদের সম্পর্কটা আর দশটা স্বামী – স্ত্রীদের মতো সুন্দর হয়। আদি ভাবনা ফেলে বলে,
-“আমি চাই আগে আমাদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরি হোক। আমাকে মেনে নিতে আপনার সময় লাগবে। আপনি যতদিন চান সময় নিতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

আদির এ কথাটিতে নবনীর উদ্‌বেগহীনতা কেঁটে যায়। বুঝতে পারে আদিও ডিভোর্সের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। সে আরো ভাবে স্বামী স্ত্রীর পবিত্র বন্ধনকে অস্বীকার করবে না। সময় দিবে! তাঁদের এই সম্পর্ককে সময় দিবে, যেন পবিত্র বন্ধনটি অটুট হয় চিরকাল। অতীত ভুলে গিয়ে ভবিষ্যতকে আঁকড়ে ধরে সে বাঁচার চেষ্টা করবে।

-“শুনুন?” আদি নরম স্বরে নবনীকে ডাকে।

নবনীর ভাবনা থেকে ফিরে আসে। বলে,
-“বলুন?”

-“আমি আপনার নাম ধরে ডাকতে চাই।”

-“জি, ডাকতে পারেন।”

-“আচ্ছা আপনি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েন।”

-“হুম!” ছোট উত্তর দেয়।

আদি উঠে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। বের হবার আগে বলে,
-“কিছু প্রয়োজন পড়লে আম্মু বা কাকি মাকে বলবেন।”

নবনী মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব জানায়। আদি প্রস্থান করে। নবনী নজর বুলিয়ে নেয় রুমের চারদিক। ফুলদিয়ে রুমটি খুব যত্ন করে জানানো হয়েছে। কিন্তু আফসোস! যাদের জন্য সাজানো হয়েছে তারাই মিসিং। ভাগ্য তাকে আজ অন্যের বাসর ঘরে বসিয়ে রেখেছে। পাশের দেয়ালে আপনের একটি ছবি টাঙানো দেখতে পায়। তনুজার ফোনে আপনের ছবি দেখেছিল, আর এখন ছবিতে দেখছে। সরু নিশ্বাস ছাড়ে সে। খাট থেকে নেমে লাগেজ থেকে একটি থ্রিপিস বের করে।
.
খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না আদির। এদিকে আপনও খাবার খায় নি। অনেক জোরাজোরি করারও পরও কিছু মুখে তুলেনি সে। আদি রুমে এসে দেখে আপন ফোন হাতে নিয়ে এক পলকে চেয়ে আছে। চোখেমুখে তার কান্নার ছাপ। আদি হেঁটে কিছুটা কাছে আসতেই স্ক্রিনে একটি মেয়ের ছবি দেখতে পায়। সে বুঝতে পারে মেয়েটি তনুশ্রী। আদি পাশের টেবিল থেকে খাবারের প্লেট নিতেই আপনের দৃঢ় কন্ঠে স্বর শুনতে পায়। বলে,
-“খাব না আদি। জোর না করলে খুশি হবো।” ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলে।

আদি খাবারের প্লেট পাশে রেখে দেয়। আপনের কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তুই,আমি এটা জানি। তবুও……”

-“আমি থেমে থাকতে চাই নি। আমাকে বাধ্য করেছে তনুশ্রী! কেন করল এটা আদি। বল? একটু বল না ভাই? ওর সঙ্গে আমার মিল না হলেও এটা ভেবে খুশি থাকতাম, যাক ও ভালো – খারাপ যে ভাবে আছে, আছে তো। কিন্তু এখন? তনুশ্রী এ ভুবনে নেই ভাবতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।” আদির দিকে তাকিয়ে কেঁদে বলে আপন।

আদি চুপ করে ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ রাখে। উত্তর দেওয়ার মতো জবাব তার জানা নেই। আপন চোখ মুছে স্বাভাবিক কন্ঠ এনে বলে,
-“আমার ওপর তোর রাগ আছে জানি। তনুশ্রীর বিষয়টি চাপিয়ে গিয়ে মিথ্যে বলেছি তাই। কিন্তু ভাই বিশ্বাস কর, আমি ওঁকে পুরোপুরি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যে তনুশ্রী….! ” বাকিটা বলার আগেই ফের তার গলা ধরে আসে। বহু কষ্টে কান্না আটকিয়ে পুনরায় বলে,
-“আমাকে মাফ করিস, মিথ্যে বলার জন্য।”

-“এসব শুনতে চাই না আমি। যা হবার হয়ে গেছে। আমি শুধু চাই তুই নতুন করে আবার শুরু কর। এখনো গোটা ভবিষ্যত তোর পড়ে আসে সামনে।”

আদির দিকে অসহায় চোখে তাকায় আপন। আদি ফের বলে,
-“শুয়ে পড়। ফোন দে আমার কাছে।” বলেই ফোন নিয়ে নেয় আদি।

আপন অশ্রুসিক্ত চোখে ছোট বাচ্চাদের মতো গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। আদি পাশে শুয়ে লাইট অফ করে দেয়। পুরো রুম জুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। আদি চিৎ হয়ে শুয়ে এক হাত কপালের ওপর রেখে আজকের ঘটনা পুনরায় ভাবতে থাকে। জীবন কত বিচিত্রময়। কখন কোথা থেকে মোড় ঘুরে যায় কেউ বলতে পারে না।
___________________
সকালে…

মাথায় আলতো হাতের স্পর্শে নবনীর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে রানী খাতুন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নবনী তড়িঘড়ি করে উঠে বসে ওড়না ঠিক করে নেয়। কিছুটা লজ্জা অনুভব করে সে। রানী খাতুন মৃদু হেসে বলেন,
-“সমস্যা নেই বৌমা, আমাকে নিজের মা মনে করতে পারো।”

নবনী একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। কিছু বলে না। সে আবার বলে,
-“আজ এ বাড়িতে তোমার প্রথম দিন শুরু। দোয়া করি, সুখি হও তুমি। এটা তোমার ছোট মায়ের আর্শীবাদ!”

-“জি, দোয়া করবেন।” নরম স্বরে বলে উঠে নবনী।

সে মুচকি হাসে। তখনই রুমে প্রবেশ করে আদির মা রুবিনা বানু।
-“রানী নবনী কি ওঠেছে ঘুম থেকে?” মুখে আওড়াতে আওড়াতে এগিয়ে আসেন।

দু’জানর দৃষ্টি তার ওপর পড়ে। রুবিনা বানু তাদের নিকট এসে ফের বলেন,
-“তাহলে তুমি উঠে গেছো। আসলে তোমার কোনো ননদ নেই। তাই ননদের দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে। কিন্তু এখন যখন তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছো। মেয়ের শখ পূরন হবে আমাদের।”

নবনী নরম ভঙ্গিতে তাকিয়ে তার কথা শুনে। রানী খাতুন বলেন,
-“অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে তনুজার ওপর, সঙ্গে তোমারও। জানি না মেয়েটা এখন কেমন আছে। তোমার জন্যও খারাপ লাগছে। এত তাড়াতাড়ি নিশ্চয় তোমার আব্বু, আম্মু বিয়ে দিতে চায় নি।”

-“এটা আমার ভাগ্যে ছিল আন্টি।”

-“আন্টি নয় ছোট মা বলো। আর ওনি তোমার শ্বাশুড়ি। তাকে বড় মা বলে ডাকবে।”

-“জি, ছোট মা।”

-“এবার উঠে যাও। নাস্তা বানানো শেষ। গল্পগুজব পরে হবে।”

-“আচ্ছা।”

দু’জনেই প্রস্থান করে। নবনী ভাবে এক মা ফেলে এসেছে, দু মা পেয়েছে। তারা নিশ্চয় তাকে যথেষ্ট স্নেহ করবে। সংসার সম্পর্কে ধারণা নেই বললেই চলে তার। তবুও সে চেষ্টা করবে সব কিছু গুছিয়ে নেওয়ার। সঙ্গে পড়াশোনাও রানিং করবে। এই বিষয়ে আদির সঙ্গে আলাপ করবে ভাবে সে।
.
.
.
.
#চলবে?

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১৮+১৯

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৮
#সুমাইয়া মনি।

আজই নতুন কোচিং সেন্টারে যাওয়া শুরু করেছে নবনী। সঙ্গে মায়াও। তিনটার দিকে কোচিং । আগের মতো নবনীর জীবন এখন আর সহজ নেই। সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়। অনেক ব্যস্ত রাখতে চায় পড়াশোনার মাঝে। যতটা ব্যস্ত রাখতে পারলে নিভ্রকে সে ভুলে যেতে পারবে। ভুলে যেতে পারবে পুরনো অতীত! তাই সে নতুনে কোচিং সেন্টারে জয়েন্ট হয়েছে। সকালে কলেজ,তারপর কোচিং, বাড়িতে ফিরে যতটুকু সময় পায় এতে সে আদার্স বই গুলো পড়ে। তারপর সন্ধ্যের দিকে নিয়ানকে পড়ায় এবং নিজেও পড়তে বসে। এখন আর আসরের সময় পড়ে না। রুটিং চেঞ্জ হয়েছে তার। এবং-কি সে নিজের মধ্যেও অনেকটা চেঞ্জ এনেছে। আরো চেঞ্জ আনবে আশা করে সে।

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই নিভ্রর মুখোমুখি পড়ে যায়। নিভ্র টমিকে নিয়ে গেট থেকে বের হচ্ছিল ঘুরতে যাওয়ার জন্য। চোখাচোখি হয়ে যায় তাঁদের। নবনীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। অস্বস্তি লাগছে তার। পুরোনো ক্ষততে পুনোরায় কেউ যেন আঘাত এনেছে। সে তো বলেছিল তার বাড়ির ত্রিসীমায় না আসতে। মন স্থির করে সেও চাইছিল না যেতে। কিন্তু নিয়তি আজ তাকে তার মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে। তবে সে কাবু হবে না। দ্রুতই নজর সরিয়ে নেয় সে। গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে পা চালিয়ে আগে ছুঁটে চলে। নিভ্রকে করুণ ভাবে ইগনোর করেছে সে।
বুঝতে পেরে রাগ হয় তার। নিভ্রর চেহারায় ফুটে উঠে রাগের আভাস। প্রকাশ করে না। নবনীর পরিবর্তনে সে যেমন অবাক, তেমন রাগও হচ্ছে এখন। যে মেয়ে কি-না ক’দিন আগে তার নামেতেই আসক্ত ছিল। আজ তাকে ইগনোরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দাঁড়িয়ে থাকে না সে, টমিকে নিয়ে উলটো দিকে অগ্রসর হয়।

কিছু দূর আসতেই নবনীর হাঁটার গতি কমে আসে। বুকের মাঝে ব্যথা অনুভব হয়। কিন্তু সে আগের ন্যায় ভেঙে পড়ে না। এমন দিন তার সামনে রোজ আসবে। তাকে ভেঙ্গে পড়লে হবে না। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখতে হবে। আরো কিছুটা এগোতেই মায়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার। দু’জনে মিলে রিকশায় চড়ে কোচিং সেন্টারে পৌঁছায়।
_____________
সেদিনের পর আরো দু’দিন কেঁটে যায়। নবনী এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কারো জন্য জীবন থেমে রাখলে চলবে না। তার-ও সামনে গোটা ভবিষ্যত পড়ে আছে। ভেবে সে এগিয়ে চলেছে। নিভ্রর কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে বুক ভাসিয়ে দুঃখ ব্যতীত আর কিচ্ছু মিলবে না। তাই সে-সব ভুলে যেতে বসেছে। মন থেকে সরিয়ে দিতে চায় সে।

পরের দিন হঠাৎ মাহবুব হাসান ছুটি নিয়ে পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে শ্বশুর বাড়ি। মূলত তার শালার বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে তাঁদের এখানে আসা। নবনীর আপত্তি ছিল না যাওয়ার। কিন্তু তাকে একা রেখে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। মাহবুব হাসানের কঁড়া নির্দেশনায় তাকে আসতে বাধ্য করেছে। কিছুক্ষণ আগেই তারা তনুজা ভিলায় পৌঁছায়। নবনীর মামা-মামী সহ আরো অনেক আত্মীয় স্বজনরা তাদের নিয়ে মেতে উঠেছে। নিলুফা বেগমের মা-বাবা অনেক আগেই মারা গিয়েছে। তারা দুই ভাই-বোন। এতদিন পর নিলাজ হোসাইন বোনকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। কুশল বিনিময় আপ্যায়নের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথপোকথন আরম্ভ হয়। নবনীকে বড়দের কাছ থেকে সরিয়ে তনুজা তার কক্ষে নিয়ে আসে।

তনুজা নবনীর বড়। তারাও নবনীদের মতো দুই ভাই-বোন। তনুজা বড়। ভাই ছোট। এতদিন পর নবনীকে পেয়ে তনুজাও খুব খুশি। সে তার উজ্জ্বল চেহারার মাধ্যমে সেটা প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু নবনী একটু উদাস ছিল। তবে সেটা তনুজার সামনে প্রকাশ করে না। ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করছিল সে। তবে অদ্ভুত বিষয়। জামা-কাপড় কমে সে এক গাদা বই সঙ্গে নিয়ে এসেছে। দেখে তনুজা হেসে ফেলে। ভেংচি দিয়ে বলে,
-“তুই কী এখানে পরিক্ষা দিতে এসেছিস নাকি? এত বই এনেছিস যে?”

-“জীবনের প্রথম পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। নতুন করে কি আর পরিক্ষা দিবো আপু?” তাচ্ছিল্য হেসে বলে নবনী।

-“বুঝলাম না।”

-“বাদ দেও। আমি আগে ফ্রেশ হতে চাই। পরে হবু দুলাভাই-এর ব্যাপারে এসে সব জানব।”

তনুজা কিছুটা লজ্জা পেয়ে হেসে উত্তর দেয় ‘আচ্ছা’।
নবনী জামা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোয়।
.
.
এদিকে আপনদের বাড়িতেও বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কাল গায়ে হলুদ। কিছুক্ষণ আগেই পুরো বাড়িটি লাইটিং ফিট করা হয়েছে। আগের তুলনায় বাড়িটি এখন ঝকঝকে তকতকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। হলুদের সব জিনিসপত্র আগে বাগে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তনুজাদের বাড়িতে। এতে আদি সাহায্য করছে। বাড়িতে কম বয়সি ছেলে মানুষ বলতে আপাতত আদি আর আপনই। আপন বিয়ের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। তাই বাকি আলাদা কাজ গুলো আদিকে দেখতে হচ্ছে।
তনুজাদের বাড়ির মতো তাঁদের বাড়িতেও মেহমানদের আনাগোনা চলছে। বাকি দিক সামলে নিচ্ছে ঘরের গিন্নি রা।
_____________
বেশ লম্বা সফরে আসার ফলে নবনী খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি তার চোখে ঘুমও চলে আসে। চোখ খুলে একদম সকালে। জানালা দিয়ে এক ফালি রোদ এসে নবনীর বাঁ চোখে লাগে। হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে সে। চোখ কচলাতে থাকে। ফজরের নামাজ আজ মিস হয়ে গেছে তার। ভেবে সে কিছুটা আহত হয়। তনুজা তখন কেবল রুমে প্রবেশ করছিল। নবনীকে বিছানায় উঠে বসে থাকতে দেখে মিষ্টিমুখে বলে,
-“উঠেছিস? এবার তা হলে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। বাবা,ফুফাজি ডাকছে তোকে।”

-“আসছি, যাও।” এতটুকু উত্তর দিয়েই নবনীর ব্রাশ হাতে ওয়াশরুমে আসে। একেবারে ফ্রেশ হয়ে তবেই হল রুমে পৌঁছায়। সবাই তখন টেবিলে বসা ছিল। সে-ও একটা চেয়ার টেনে বসে। খাওয়া দাওয়ার মাঝে নানারকম কথায় মসগুল সবাই। টপিক তনুজার গায়ে হলুদের বিষয় নিয়ে। নবনী খেয়ে যাচ্ছে এবং সবার কথা শুনছে। খাওয়া শেষ করে সে একাই উঠে চলে আসে রুমে। একটি বই নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। অনুষ্ঠান নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা নেই।
.
সন্ধ্যার দিকে পার্লারের দু’জন মেয়ে আসে তনুজাকে সাজাতে। রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য তাকে তৈরি করছে। নবনী হলুদ রঙের একটি গাউন নিয়ে পাশের রুমে এসে চেঞ্জ করে নেয়। চোখে মোটা কাজল ও ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক, কানে ঝুমকা পড়ার মাধ্যমে সাজ কমপ্লিট করে। চুল গুলো খোঁপা করে গাজরা পেঁচায়। পাশের রুমে এসে দেখে তনুজার সাজানো তখনো শেষ হয়নি।
নবনী কিছুটা বিরক্ত হয়ে হৈ-হুল্লোড় চিল্লাপাল্লা থেকে একটু দূরে সরে বাড়ির গার্ডেনে আসে। সেখানের অপজিট দিকে ফুলের বাগান রয়েছে। তার পাশ ঘেঁষে আছে লোহার তৈরি মাঝারী আকারের দোলনা। এখানে মাঝেমধ্যে নিলাজ হোসাইন অবসর সময় কাটায়। অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাদে করা হয়েছে। বিশাল বাড়ির ছাদ তাদের। তাই সেন্টার ছাড়া বাড়িতেই হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে করে আত্মীয়দেরও খুব একটা কষ্ট হবে না ভেবেই এই ব্যবস্থা করা হয়।

নবনী কোলাহল বিহীন সেখানে বসে কিছু সময় কাটায়। ফোনে তাহাসানের ‘দূরে’ গানটি প্লে করে তাঁরাভরা আকাশের দিকে নজর তাক করে। ঝিরিঝিরি বাতাসও ছিল। ব্যস! এতটুকুই নবনীর জন্য যথেষ্ট ছিল। গভীরভাবে তলিয়ে যায় মনােরমা প্রাকৃতিক পরিমন্ডলে। পরম আবেশে চোখ জোড়া কেবল বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগে নবনীর ডান বাহুতে জোরে টান পড়ে। এক টানে তাকে উঠানো হয় দোলনা থেকে। তার পিঠ গিয়ে সজোরে কারো পাঁজরে এসে ধাক্কা লাগে। বাহু ছেড়ে হাতটি সোজা নবনীর পেটের ওপরে এসে পিছনের দিকে তাকে আলতো ভাবে ঠেস দিয়ে রাখে। চমকে উঠে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে নবনী। আচমকা বিকট শব্দ হয়ে দোলনার ওপরে একটি মাঝারি আকারের বাঁশ পড়ে। সম্ভবত ছাদের ওপর থেকে পড়েছে সেটি। শব্দে নবনী লাফিয়ে উঠে চোখ চটজলদি খুলে ফেলে। ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। সাউন্ড বক্সের শব্দে বিকট শব্দটি ছড়ায় না৷ কেউ শুনতে ও দেখতে পায় না এমন শােচনীয় দৃশ্য। ভয়ে বুক ধুকধুক করছে নবনীর। ঘাম জড়ো হয়েছে কপালে। এই বাঁশটি ঠিক তার মাথার ওপর পড়তে পারতো, যদি না তাকে আগন্তুক ব্যক্তিটি না টেনে উঠাতো।
মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে যেত। ভেবেই গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার। হাতের মুঠোয় ওড়না খামচে ধরে। পিছনের ব্যক্তিটি তখনো পরম যত্নে তাকে সেভাবেই আগলে ধরে রেখেছে। এমন ঘটনায় নবনী হতবাক, ভীতিগ্রস্ত। রেশ কাঁটছে না তার। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় দেখে পাশে সরে পিছনে ঘুরে তাকায়। সে চিনতে পারে সেই আগন্তুক ব্যক্তিকে। তার চেহারা নবনীর কাছে এখন স্পষ্ট!
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৯
#সুমাইয়া মনি।

-“আমি দুঃখিত! আপনি ঠিক আছেন তো?” এক হাত তুলে নবনীর উদ্দেশ্যে নরম স্বরে প্রশ্ন করে আদি। তার দুঃখিত বলার মূল কারণ নবনীকে পেঁচিয়ে ধরা। নবনী বিস্ময় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। চোখ পিটপিটিয়ে গালের ওপরে আসা ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে নেয়। আদিকে দেখে সে কিছুটা হলেও অবাক হয়।

আদি তনুজার বিয়ের লেহেঙ্গা দিতে এসেছিল এই বাড়িতে। সব কিছু পাঠানো হয়েছে ঠিকিই, কিন্তু লেহেঙ্গাটিই বাদ পড়ে গেছে। তাই নিজে এসেছে অপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে। ওদের বাড়িতেও বেশ ধুমধাম করে আপনের গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগেই সে এ বাড়িতে এসেছে। বাইক নিয়ে এসেছিল। তাই দ্রুত পৌঁছে গেছে। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই গার্ডেনে বসা হলুদ একজন তরুনীর ওপর নজর পড়ে। সে একাই উল্টোদিকে ঘুরে বসেছিল। যার দরুণ মুখ দেখেতে পায় নি আদি। বাড়ির বাকি সবার আওয়াজ ছাদের ওপর থেকে ও বাড়ির পিছনের দিক থেকে আসছিল। অনুষ্ঠান ওপরে হলেও, রান্নাবান্নার কাজ বাড়ির পিছনে দিকটায় হচ্ছিল। আদি বাইক থেকে নেমে লেহেঙ্গার বাক্সাটি হাতে নিতে যাবে তখনই কি যেন মনে করে ছাদের দিকে তাকায়। তখনই তার নজরে পড়ে একটি বাঁশের ওপর। একটি মাজারি আকারের বাঁশ চিনে দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ভাবতে ভাবতে এক দিকে কাত হয়ে আরো নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাঁশটি। আদি দ্রুতই নবনীর দিকে ছুঁড়তে আরম্ভ করে এবং একটুর জন্য সে তাকে বাঁচিয়ে নেয়। আদির জন্যই নবনী এখন সুস্থ রয়েছে। আর নয়তো এতক্ষণে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যেত। সঠিক সময়ে নবনীকে দোলনা থেকে টেনে তুলেছে সে।
অতি কষ্টে নবনী নিজেকে স্বাভাবিক করে। নরম স্বরে উত্তর দেয়,
-“জি, ঠিক আছি।”

-“পেন্ডেল কিভাবে সাজিয়েছে? এখনই তো আপনি আহত হয়ে যেতেন।” মেকি রাগ ঝেড়ে বলে আদি।

-“শুকরিয়া!” একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিয়ে বলে।

-“আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। নয়তো যে কোনো সময় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে।”

-“প্লিজ! মামাকে বলবেন না। শুনলে আমার ওপর ক্ষেপে যাবে।” কিছুটা বিনয়ী কন্ঠে বলে।

আদি সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে উত্তর দেয়,
-“আচ্ছা বলব না। তবে তাকে সতর্ক করতে হবে।”

-“সেটা করুন সমস্যা নেই।”

-“ঠিক আছে। বাই দ্য ওয়ে, আপনি সেই লাইব্রেরির নবনী না?”

এতক্ষণে নবনী আদির দিকে ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে তাকায়। সে এতক্ষণ আদিকে চিনতে পারে নি। এখন চিনতে পেরেছে লাইব্রেরি বলার ফলে। আদি নবনীর চাহনিকে উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করে,
-“আপনার মামা হয় তনুজা ভাবির আব্বু রাইট?”

-“জি, তনুজা আপু আমার মামাতো বোন।”

-“তাহলে তো সম্পর্কে আমরা বেয়াই-বেয়াইন!” মুচকি হেসে বলে আদি।

জোর পূর্বক হেসে উত্তরে ‘হুম’ বলে।

-“আমার সঙ্গেই ভেতরে চলুন আপনি। একা না থাকাই ভালো, যদি আবার কোনো বিপদজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যান।”

নবনী এবার কিছু বলে না। হেঁটে চলে সামনের দিকে। ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে মাঝ পথেই নিলাজ হোসাইন ও মাহবুব হাসানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নবনী আগে চলে যায়। আদি তাঁদের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে কথপোকথন চালায়।
সে ঘটনাটি চাপিয়ে যায় এবং সে বুঝতে পারে মাহবুব হাসান নবনীর বাবা হন। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে লেহেঙ্গা তাঁদের কাছে দিয়ে সে ফিরে আসে।
দুই বাড়িতেই বেশ সুন্দর ভাবে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের পর্ব শুরু হয়। আনন্দে মেনে উঠে দু’টি পরিবার।
________________
মাথা ব্যথার চোটে ঘুম হারাম হয়ে গেছে নিভ্রর। ঘড়িতে তখন বারোটা দুই মিনিট। চোখের ঘুমের ‘ঘ’ খানা উধাও। ন’টায় থানা থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে কিছু ফাইলে নজর বুলাতেই বারোটা বেজে যায়। ঘুমাতে যাওয়ার পর পরই আরম্ভ হয় মাথা যন্ত্রণা। এক গাধা ঔষধের জুরির মধ্যে থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেইন কিলার পেল না। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার। এই মুহূর্তে কারো কাছে যে সাহায্য চাইবে তারও উপায় নেই। তার বাড়ির নাক বরাবর নবনীদের বাড়ি রয়েছে। তাদের বাড়িতে যে যাবে তারও উপায় নেই। মনে হচ্ছে এই যন্ত্রণা নিয়েই সারারাত কাঁটাতে হবে। ভাবতে ভাবতেই হোয়াটসঅ্যাপে কল আসে৷ স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চারদিক থেকে বিরক্ত এসে ঘিরে ধরে তাকে। কেটে ফোন সাইলেন্ট করে খাটের ওপর বসে। বালিশ ঠিক করে চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখে।
যেভাবেই হোক তাকে ঘুমাতে হবে। নয়তো সারারাত যন্ত্রণায় ভুগতে হবে। ছটফট করতে করতে এক সময় সে ঘুমিয়ে যায়।
.
.
.
সকালে…..

রাতে নবনীর ঠিক মতো ঘুম হয়নি। শুধু নবনীর নয়, বাকি রাও ঘুমাইনি। সারাদিন সবাই ফুর্তিতে মেতে ছিল। কিন্তু নবনীর ঘুম না হবার কারণ ছিল আলাদা। এক্সিডেন্টের দৃশ্য তার এখনো চোখে ভাসছে। আদি না থাকলে কি যে হতো সেটা ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে তার। দুই বার তাকে বিপদ থেকে রক্ষে করেছে। তখন সেখানে উপস্থিত অবস্থায় আদির বিষয় কিছু জানা হয়নি তার। তনুজাকে স্ট্রেজে বসা অবস্থায় আদির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই পরিচয় পেয়ে যায়। ঘাড়ে হাত রেখে চুপ গুলো সরিয়ে কফিতে চুমুক বসায় নবনী। কিছুক্ষণ আগেই কফি হাতে সে বারান্দায় এসেছে। বাহিরে রোদ বেশি নেই। সকাল থেকেই আকাশ কেমন মেঘ মেঘ করছে। দৃষ্টি সেদিকে তাক করে এতক্ষণ আদির কথা ভাবছিল। পরক্ষণেই তনুজার ডাক পড়ে তার। রুমে এসে দেখে তনুজা মাথার হাত রেখে খাটে বসে রয়েছে। তার নাকমুখ কোঁচকান এবং চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো অসুস্থ বোধ করছে। নবনী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কী হয়েছে আপু?”

-“মাথাটা খুব ধরেছে। আমার চুলের ক্লিপগুলো একটু খুলে দে নবনী।”

-“দিচ্ছি!” বলেই এক চুমুকে কফি পান করে গ্লাস টেবিলের উপর রাখে। তারপর ক্লিপ খুলতে আরম্ভ করে। এরি মাঝে তনুজা আনমনা হয়ে যায়। মৃদু হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটে। এ হাসি যেন বলে দিচ্ছে তার মনের কোণেতে বসবাস করা প্রিয় মানুষটির কথা। নবনীর চোখে ধরা পড়ে। সে কৌতূূহল বশত জিজ্ঞেস করে,
-“ভাবছো কারো কথা?”

তনুজা সরাসরি বলে ফেলে,
-“হ্যাঁ!”

-“হবু দুলাভাইয়ের কথা নাকি?”

তনুজা লজ্জামিশ্রিত হাসি দেয়। মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ সম্মতি দেয়।

নবনী স্মিত হাসে। তার অনুমান সঠিক হয়েছে। একটু দুষ্টমি করে বলে,
-“খুব ভালোবাসো বুঝি তাকে?”

-“মারাত্মক!”

-“আহা! তা আপন দুলাভাই? সে তোমাকে কতটুকু ভালোবাসে?”

কথাটা শুনে তনুজার হাসি মুখখানা কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। তবুও ঠোঁটে হাসি রেখে বলে,
-“বাসে!”

-“শুধু বাসে?”

তনুজা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রয়। নবনী ফের ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই উত্তরে নরম স্বরে বলে,
-“আমি আপনকে প্রথম দিন দেখেই পছন্দ করি ফেলি। আর যখন জানতে পারি ওর পরিবারের সবাই আমাকে পছন্দ করেছে, তখন আমি আরো খুশি হই। আস্তেধীরে কথা বলতে বলতে আমি আপনের ওপর অনেক দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু নবনী, আপন মনে হয় আমাকে পছন্দ করে না।” মন খারাপ করে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে।

-“কি করে বুঝলে আপু? বিয়ে তো হচ্ছে তোমাদের।”

-“ফোনে আপন আমার সঙ্গে কথা বলার সময় শুধু বাহানা খুঁজে ফোন রেখে দেওয়ার। আর ভালোবাসার বিষয়ে কথা বলতেই চায় না। যেন মনে হয় ও ভালোবাসাকে ঘৃণা করে।”

ঘৃণা শব্দটি কানে আসতেই নবনীর নিভ্রর কথা মনে পড়ে যায়। কানে প্রতিধ্বনি হতে থাকে নিভ্রর সেই কঠোর বাক্য গুলো। যেগুলো নবনীর বুকের মধ্যে এখনো তীরের মতো বিঁধে রয়েছে। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সে। অতীতের স্মৃতি গুলো আজ তাকে আবার পীড়া দিতে হাজির হয়েছে। নবনীকে নিশ্চল হয়ে যেতে দেখে তনুজা কনুই দিয়ে গুঁতো দেয়। বলে,
-“তোর আবার কী হলো?”

নবনী ফিরে আসে অতীত থেকে। চোখ পিটপিটিয়ে কৃত্রিম হেসে বলে,
-“কিছু না আপু।”

তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
-“আমি আপনকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে ভেবেই আমি ভীষণ হ্যাপি। এখন হয়তো আপন একটু নড়বড়ে। তবে বিয়ের পর আমি ঠিক মানিয়ে নিবো।” লাস্টের কথাটুকু বলে মুচকি হাসে। নবনী তনুজার কথা প্রতিত্তোরে মৃদু হাসে। নবনী অনুভব করে আপনকে তনুজা কতটা ভালোবাসে।
___________
আপদের বাড়িতে তাড়াহুড়ো পড়ে গেছে। বারোটার দিকে মেয়ে পক্ষের বাড়িতে উপস্থিত হতে হবে তাদের। তাই সবাই যে যার মতো রেডি হতে ব্যস্ত। আদি সবে মাত্র গোসল সেরে নিজের রুম থেকে চুল মুছতে মুছতে আপনের রুমে আসে। খাটের উপর বিয়ের শেরওয়ানি সহ যাবতিও সব জীনিস রাখা। অথচ, আপন ফোন হাতে মাথা নত করে বসে আছে। সম্ভবত সে ফোনে কিছু একটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
আদি দরজার সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকেই বলে,
-“রেডি হচ্ছিস না কেন আপন?”

আদির স্বর শুনে আপন দ্রুত ফোন লক করে ফেলে। মাথা তুলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“হচ্ছি।”

-“দেরি করলে চাচ্চু ক্ষেপে যাবে, জানিস নিশ্চয়।”

-“হুম।”

-“আমি রেডি করিয়ে দেবো?”

-“নো থ্যাংক’স। তুই নিজে রেডি হয়ে নে।”

-“ওকে!” দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ফিরে যায় আদি।

আপন গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বসে রয়। পরক্ষণে সে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে উঠিয়ে নেয় তার বিয়ের শেরওয়ানি।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

Sumaiya Moni

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১৬+১৭

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৬
#সুমাইয়া_মনি।

নতুন এক সকালের সূচনা হল। আগের দিনের মতো নবনী রেডি হয়ে নাস্তা করে বের হয় কলেজের উদ্দেশ্যে। গেট দিয়ে বের হতেই একজন ডেলিভারি বয়কে নিভ্রর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। বুঝতে পারে খাবার দিতে এসেছে। সেদিনের পর থেকে নিভ্রকে খাবার দেওয়া তো দূর, নিলুফা বেগম তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে বোধ করছে না। নবনী পাত্তা দেয় না। নিজের মতো হেঁটে চলেছে। কিছু দূর আসতেই রিকশা পেয়ে যায়। চলে আসে কলেজে। আজকের মতো ক্লাস রুমে এসে বই পড়তে আরম্ভ করে। মায়া তার পাশেই মুখ মলিন করে বসে আছে। দিন দিন নবনীকে নতুন রূপে উপস্থিত হতে দেখছে সে। অতি বকবক করা মেয়েটি, আজ নিরব! ক্লেশ অনুভব হয় তার। নবনীর আচরণ তাকে প্রচণ্ড ভাবাচ্ছে। ঘন্টা পড়ে। ক্লাস আরম্ভ হয়।
ঘন্টাখানিক পর তিনটি ক্লাস শেষ হয়। নবনী পরের ক্লাসটি করে না। তার আগেই মায়াকে কিছু না বলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে হাঁটা ধরে। তখনই সামনে নিভ্রকে দেখতে পায়। গতিপথ থেমে যায় তার। বুকের পুরনো ক্ষত গুলো ধকধক করে উঠে। নিভ্র একজন টিচারের সঙ্গে কথা বলতে। মন ও নিজেকে স্থির করে। হেরে গেলে চলবে না। নিজেকে শক্ত করতেই হবে।

হাতের মুঠ শক্ত করে আগের ন্যায় পা চালায়। দ্রুত তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। নিভ্র নবনীকে দেখেছে। একবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে ফেলে।
লাইব্রেরিতে এসে একটি সিটে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। কষ্টে কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু নাহ! আর সে নরম হবে না। কয়েক বার বড়ো নিশ্বাস নিয়ে একটি বই পড়তে আরম্ভ করে। লাইব্রেরিতে তেমন কেউ নেই।

হঠাৎ করে সেদিনের সেই পাঁচজন মেয়ে লাইব্রেরিতে উপস্থিত হয়। যাদেরকে নিভ্রর থেকে দূরে থাকার ওয়ার্নিং দিয়েছিল নবনী। তারা নবনীকে একা পেয়ে ঘিরে দাঁড়ায়। নবনী মুখ তুলে তাঁদের দিকে তাকায়। চিনতে তার বেগ পেতে হয় না। তারা সবাই নবনীর এক বেচ সিনিয়র। নজর বইয়ের দিকে তাক করে সে ফের পড়তে আরম্ভ করে।
একজন মেয়ে নবনীর কাছ থেকে বই ছিনিয়ে নিয়ে সজোরে টেবিলের উপর রাখে। বলে,
-“কিরে তোর পুলিশ আশিক এসেছে। আর তুই এখানে বসে বই পড়ছিস। যা যা তার কাছে যা।”

নবনীর মুখ থমথমে হয়ে যায়। বুঝতে পারে সেদিনের সেই কথাটির ভিত্তি করে আজ তাকে এভাবে বলছে। নবনী নরম ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে,
-“সে আমার আশিক না। আর সেদিনের জন্য আমি দুঃখিত আপু। দয়া করে আমাকে বই পড়তে দিন।”

-“তুই বই পড়লে, তোর আসিক তো সেখান থেকে চলে যাবে। তখন কী হবে?” অন্য একজন মেয়ে বলে।

-“আশিকের সঙ্গে মনে হচ্ছে ঝগড়া হয়েছে। তাই তো বই পড়তে ব্যস্ত তার আশিকি।” অন্য একজন মেয়েকে চোখ টিপ মেরে করে মেয়েটি।

নবনী এবার রেগে যায়। মেকি রাগ নিয়ে বলে,
-“বার বার আশিক বলবেন না। সে আমার আশিক নয় আপু।”

-“এই তোর রাগ হচ্ছে। রাগ দেখাবো তো আমরা।” আঙ্গুল তুলে বলে একটি মেয়ে।

-“এভাবে বললে নিশ্চয় যে কারো রাগ উঠবে।” নবনী বলে।

-“সেদিন তোকে কিছু বলিনি। আজ তোকে ছোট একটা শিক্ষা দিবো আমাদের ওয়ার্নিং দেওয়ার জন্য।” রেগে বলে মেয়েটি।

নবনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় তাঁদের দিকে। আগের দিনের মতো হলে চওড়া জবাব দিয়ে দিতো তাঁদের। কিন্তু এখন আর তার কারো উপর রাগ বা কথা বলার ইচ্ছে নেই। সব যেন ভেতর থেকে মরে পঁচে গেছে। জীবিত হওয়া সুনিশ্চিত। আচমকা পিছন থেকে একটি ছেলের কঠোর কন্ঠের স্বর ভেসে আসে। সকলের নজর পেছনের দিকে অচেনা ছেলেটির ওপর। নবনী নিজেও সেদিকে তাকায় ।

-“এখানে বই-পুস্তক ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়না। আর এটা লাইব্রেরি। লিভ!”

ছেলেটির কথা শুনে মেয়েরা খানিকটা ভয় পায়। দেরি না করে দ্রুত লাইব্রেরি ত্যাগ করে তারা। নবনী ছেলেটির দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। ছেলেটির নজর এখন নবনীর ওপর। দেখতে বেশ সুদর্শন সে। শ্যামলা গায়ের রং। কালো শার্ট-প্যান্ট পরিধান, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। ডান হাতে তার কালো ঘড়ি। বাম হাতে একটি বই।
বুকশেলফের পেছনে থাকায় কেউ তাকে খেয়াল করেনি। সে সেখানে দাঁড়িয়ে বই ঘাটছিল। ছেলেটি হাসি মুখে হেঁটে নবনীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে নবনী নজর সরিয়ে নিয়ে বই পড়ার প্রস্তুতি নেয়। ছেলেটি হাসি মুখে নবনীর উদ্দেশ্যে বলে,
-“এখানে বসতে পারি?”

নবনী না তাকিয়েই কোমল স্বরে বলে,
-“জি!”

ছেলেটি চেয়ার টেনে বসে বইটি টেবিলের উপর রাখে। নবনী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। একজন অচেনা অজানা ছেলের সামনে বসতে বিব্রত লাগছে। চোখ তুলে তাকায় না, বইয়ের দিকে তাকিয়ে রয় সে। ছেলেটি পুনরায় মৃদুস্বরে বলে,
-“আপনাকে কী তারা রোজ ডিসটার্ব করে?”

-“নাহ!” ছোট করে উত্তর দেয়।

-“আপনারা হয়তো আমাকে দেখেন নি। আমি পেছন দিকটায় ছিলাম। আপনাদের কথপোকথনের লাস্টের দিকে সামনে আসি। একটি মেয়ের কথা শুনতে পাই। তারা আপনাকে ডিসটার্ব করেছে দেখে তাদের চলে যেতে বলেছি। ভুল করেছি কি?” কথাটা শেষ করেই ভ্রু জোড়া হালকা উঁচু করে সে।

নবনী তার দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক হেসে বলে,
-“নাহ! আপনি ঠিক করেছেন। লাইব্রেরিতে বসে কথা না বলাই ভালো।”

-“অবশ্য! কেউ নেই এখানে। এই জন্য তারা বেশিই সুযোগ পেয়েছে। বাই দ্যা ওয়ে, আমি আদি মাহমুদ। আপনি?”

-“নবনী।”

-“শুধু?”

-“হুম।”

-“কোন ইয়ার?”

-“ইন্টার ফাস্ট ইয়ার।”

-“এখানেই থাকেন?”

-“জি সামনের কলোনিতে।”

-“নাম?”

-“বলতে ইচ্ছুক নই!”

-“আপনি মেবি আমার সঙ্গে কথা বলতে বিব্রত হচ্ছেন বা বিরক্ত?”

-“জি!”

-“আপনি পড়ুন। আমি উঠি। আল্লাহ হাফেজ! ”

-“জি, আসসালামু আলাইকুম!”

আদি মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিয়ে লাইব্রেরি ত্যাগ করে। নবনী বই পড়তে আরম্ভ করে। আদি যেতেই মায়া সেখানে উপস্থিত হয়। চট করে বসেই তীব্র গতিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নবনীর পানে,
-“ছেলেটি কে ছিল? তুই তাকে চিনিস?”

নবনী বিরক্ত নিয়ে মুখ তুলে তাকায়। বলে,
-“নিশ্চয় তুই এতক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে দেখেছিস আমার সঙ্গে তাকে কথা বলতে?”

-“তোর অনুমান সঠিক! আমি তোকে লাইব্রেরিতে খুঁজতে এসে দেখি তুই তার সঙ্গে কথা বলছিস।”

নবনী সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“আদি মাহমুদ তার নাম। বাকি ডিটেইলস জানি না। আর আমি তাকে চিনিও না।”

-“তাহলে কথা বললি যে?”

ছোট্ট করে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মায়াকে বলে সে। মায়া রাগ নিয়ে বলে,
-“সাহস তো কম না ওদের। প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে কমপ্লেইন করব।”

-“অযথা ঝামেলায় পরতে চাই না। বাদ দে!”

-“ঝামেলা কিসের? আমি তো…..”

-“স্টপ থাক, আমি বই পড়বো এখন।” বাকি কথা বলার আগেই মায়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে নবনী।

মায়া চুপ করে চেয়ে রয় নবনীর মুখের দিকে। সে ভাবছে, যে মেয়ে নিজে থেকেই ঝামেলা ঘাঁড়ে করে নিয়ে আসতো, আজ সে নিজেই তার থেকে দূরে থাকতে চাইছে। বড়োই ভাববার বিষয়!
_____________________
বিকালে নবনী নিয়ানকে নিয়ে মার্কেট থেকে বাড়িতে ফিরছিল। কলোনির ছোট ছেলেরা তখন ক্রিকেট খেলছিল। কিছুটা সামনে এগোতেই অনিচ্ছাকৃত ভাবে আচমকাই একটি বল এসে নবনীর বাঁ পায়ের হাঁটুতে লাগে।
সেখানে উপস্থিত সবার নজর এখন নবনীর ওপর। ছেলে গুলো ভয় পেয়ে যায়। কারণ নবনীর রাগের ধারণা তাঁদের আছে। নবনী তাদের দিকে শান্ত চোখে তাকায়। বল এতোটা জোরেও লাগেনি। তেমন ব্যথা লাগেনি তার। নিয়ান রাগে ফুঁসছে। কেননা তার বড়ো বোনের গায়ে তারা বল মেরেছে। হোক সেটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে।
রেগেমেগে বলে,
-“আপু বল নিয়ে নেও, ওদের দিবে না।”

নবনী নিয়ানের কথা শুনে কিছু বলে না। বল হাতে উঠিয়ে নিয়ানের হাত ধরে হেঁটে একটি ছেলের সামনে এসে বলটি তার হাতের মধ্যে দিয়ে সোজা হাঁটা ধরল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় সবাই। নবনীর এমন আচরণ মেনে নিতে পারছে না তারা। নিয়ান নিজেও। কিন্তু পরক্ষণে নিয়ার তার বোনের পরিবর্তন কথা মনে পড়ে। মুখ কালো হয়ে যায় তার।

এই অবাক দৃশ্য আরো একজন ব্যক্তি পেছন দাঁড়িয়ে দেখছিল। ব্যক্তিটি ছিল নিভ্র। টমিকে নিয়ে পাশের পার্কে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েছিল। কেননা ক’দিন যাবত টমি অদ্ভুত আচরণ করছে। ঠিক মতো খাচ্ছে না। ডাকাডাকিও করছে না। সেই জন্য নিভ্র টমিকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল। ফিরে আসার সময় মাঝ পথে নবনী ও নিয়ানকে হেঁটে যেতে দেখে। সে বলের ঘটনাটিও দেখেছিল। কিন্তু নবনীর এমন নরমাল আচরণ দেখে সে আশ্চর্য! সে ভেবেছিল এই বুঝি ছেলেগুলোর ওপর চিল্লাপাল্লা আরম্ভ করবে। কিন্তু না! উল্টো তাকে বিস্মিত করে দেয়।
.
বাড়িতে ফিরে নিয়ানের জন্য কিনে আনা গেঞ্জিপ্যান্ট গুলো নিলুফা বেগমকে দেখায়। তারপর সে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। নবনী চলে যাওয়ার পর নিয়ান কিছুক্ষণ আগের ঘটনা তার কাছে পেশ করে। নিলুফা বেগম শুনে হতাশাজনিত গভীর সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় নবনী। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ডুবে যায় সেদিনের সেই মুহূর্তে। যেদিন নিভ্র তার হাত ধরে ছিল। এবং নিজে তাদের বদলে মা’র খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে হাত এগিয়ে দিয়েছিল। ডুকরে কেঁদে উঠে সে। দ্রুত হাতের উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে। নাহ! কিছুতেই সে দুর্বল হতে চায় না৷ তাকে শক্ত হতে হবে। প্রচণ্ড শক্ত! কঠিন হতে হবে, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। বলহীন, দুর্বল হলে চলবে না।
.
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৭
#সুমাইয়া মনি।

সারাদিন রুমেই সীমাবদ্ধ সে। কারো সঙ্গে এখন আর নিজ থেকে কথা বলে না। পাঁচটি প্রশ্ন করলে উত্তর আসে এক দু’টির। মেয়েকে পরিবর্তন হতে বলেছে ঠিকিই। কিন্তু এমন পরিবর্তন নিলুফা বেগম কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। এতটা পরিবর্তন কেউ কি করে হতে পারে। ভেবেই সে ব্যাকুল! এতে করে সে নিভ্রর দোষ দিতে চায় না। সবার চয়েস, চিন্তাভাবনা এক নয়। তবুও তার এভাবে বলা উচিত হয়নি। নবনীর পরিবর্তন মাহবুব হাসানেরও নজরে পড়েছে। আগে বাড়িতে ফিরলে তার সঙ্গে তেমন কথা না হলেও, পাশের রুম থেকে নবনীর কথার আওয়াজ সে তার রুমে বসে শুনতে পেতো। মাঝেসাঝে সে নিজেও মেয়ের বাচ্চামো স্বভাবের কথাবার্তা শুনে হেসে ফেলতো। তার কাছে ভালো লাগত। কিন্তু ইদানীং নবনীর রুম থেকে আগের মতো কথার আওয়াজ সে শুনতে পায় না। এক দিন দু দিন মানা যায়। চার-পাঁচ দিনের বেশি হয়ে গেল তবুও একই অবস্থা। এ ক’দিনে নবনীর সঙ্গে তার ঠিক মতো দেখা হয়নি। সকালে নবনীর ঘুম থেকে উঠার আগে বের হয়ে যান তিনি, রাতে বাড়ি ফিরে। তখন নবনী ঘুমিয়ে যায়। সে এই বিষয়ে নিলুফা বেগমের কাছে আলাপ করেছিল। নবনীর অসুস্থতার কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে সে।
আজ সে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সারাদিন বাড়িতে থাকবে। পরিবারের সবার সঙ্গে সময় কাটাবে।

ড্রইংরুমে বসে নিউজ পেপারে নজর বুলাচ্ছিলেন। তখনই নবনী ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের এসে খেতে বসে।
মাহবুব হাসান পেপারের ওপর থেকে নজর সরিয়ে শান্ত গলায় শুধালো,
-“নবনী মা! এখানে এসো।”

নবনী পাথরের ন্যায় চুপ করে রয়। আব্বু ডাক শুনে যেতে ইচ্ছে করছে না। কেননা সে যে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। সেটা সে দেখলেই বুঝতে পারবে। সব চিন্তা ভাবনা জেড়ে ফেলে সে উঠে মাহবুব হাসানের পাশে গিয়ে বসে। এক নজরেই মেয়েকে দেখে তার মুখে মেঘের কালো ছায়া এসে জড়ো হয়। এ কি হাল মেয়ের! চোখমুখ শুঁকিয়ে গেছে। অনেকটা কালো দাঁগ পড়েছে চোখের নিচের অংশে। চেহারায় আগের মতো উজ্জ্বলতা ভাব নেই। কেমন রোগা রোগা দেখাচ্ছে। তিনি পরম আবেশে নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“তোমার চেহারার এমন অবস্থা কেন মা? নিলুফা তোমার মেয়ের এমন অবস্থা কি করে হলো? কি হয়েছিল ওর।” হাঁকিয়ে বললেন তার উদ্দেশ্যে।

সে রান্না ঘর থেকে ছুঁটে আসে। নবনী ততক্ষণে কৃত্রিম হেসে বলে,
-“আব্বু আমার শরীর একদম ঠিক আছে। আমি পুরোপুরি সুস্থ।”

-“মোটেও না। মিথ্যে বলিস না।” নবনীর উদ্দেশ্যে কথাটি বলে নিলুফা বেগমের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
-“মেয়ের কী হয়েছে শুনি? সারাদিন ঘরে থেকে কি করো যে ছেলেমেয়েদের ওপর ঠিক মতো নজর রাখতে পার না।”

মুখ থমথমে করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তিনি ইনিয়েবিনিয়ে বলতে নিলে নবনী বলে উঠে,
-“আব্বু আমি এখন একদম ঠিক আছি সত্যি! আজ আমার ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে, তাই দ্রুত যেতে হবে। কলেজ থেকে এসে কথা বলব।” উঠে দাঁড়িয়ে একটি পরোটা ভাজ করে মুখে পুরে খেতে খেতে গেট খুলে হাঁটা ধরে।

মাহবুব হাসান মেকি রাগ নিয়ে বলেন,
-“এই জন্যই নবনীর শরীরের এই অবস্থা। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে না ও।”

-“বলে কয়ে খাওয়ানো যায় না তোমার মেয়েকে। কি করার আছে বলো?”

উত্তরে কিছু বললেন না তিনি। পেপার পড়তে আরম্ভ করলেন। নিলুফা বেগম সরু নিশ্বাস ত্যাগ করে রান্না ঘরে এলেন।

নবনী বাহিরে এসে হাতের পরোটাটি পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। খেতে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে সামনের দিকে হাঁটা ধরল।
______________
আদি আপনকে জোর করে তার বিয়ের শেরওয়ানি পরাচ্ছে।
মূলত আপনের গায়ে ফিটফাট হবে কিনা সেটা দেখার উদ্দেশ্য আদির। আপন পরতে ইচ্ছুক নয়। বিরক্ত হয়ে আদির হাত থেকে শেরওয়ানি নিয়ে ছুঁড়ে মারে খাটের উপর। আঙ্গুল তুলে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
-“পড়ব না, বিরক্ত করিস না প্লিজ আদি!”

-“ওকে!” বলেই খানের ওপর শুয়ে এক হাত দিয়ে ভর রেখে আপনের উদ্দেশ্যে বলে,
-“কাল একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে।”

-“নিশ্চয় তাকে মারাত্মক ভাবে বিরক্ত করেছিস?” খেঁকিয়ে বলে উঠে আপন।

-“আরে না। উল্টো তাকে যারা বিরক্ত করেছে তাঁদের ভাগিয়েছি।”

কথাটা হজম করতে আপনের কষ্ট হচ্ছে। যে কি-না মানুষকে বিরক্ত করতে উস্তাদ! সে নাকি অন্য কাউকে বিরক্ত করার জন্য তাড়িয়েছে। বিষয়টি মানানসই নয়!
আদি ছোট করে কালকের ঘটনা বলে তাকে। আপন চোখ পিটপিট করে বলে,
-“মেয়েটির নাম?”

-“নবনী।”

-“শুধুই নবনী। আগে,পিছনে কিছু নেই?”

-“আছে মেবি। আমাকে বলেনি।”

-“দেখতে কেমন?”

-“আহামরি সুন্দরী না হলেও। যে কারো নজরে পড়ার মতো।”

-“তোর নজরে পড়ে যায় নি তো সে।”

-“হপ! একদিনের পরিচয় ভালোবাসা, নট সম্ভব!”

-“তোকে ভাউ দিলো না তাই তো।”

-“সে আমাকে দেখে কিছুটা বিরক্ত বোধ করেছিল। তাই আমি সরে গেছি। তবে একটা বিষয় নোট করার মতো।”

-“কী?”

-“মেয়েটি যথেষ্ট শান্তশিষ্ট নরম ভদ্র বলে মনে হলো। কথা কম বলতে মেবি পছন্দ করে। আর বই পড়তে ভীষণ পছন্দ করে।”

-“তোর মতো?”

-“আমি তো মাঝেমধ্যে বই পড়ি। সব সময় না।”

-“আর কিছু বলবি?”

-“কেন?”

-“লিভ মি।”

-“যাব না। এখনো তোর বিরক্তের চাপটার বাকি রয়েছে।”

-“এক্ষুনি যা এখান থেকে।” রেগে আঙ্গুল দিয়ে গেটের দিকে দেখিয়ে বলে আপন।

আদি হেসে ফেলে। আপনকে যেমন বিরক্ত করতে তার ভালো লাগে, তেমন রাগাতেই বড্ড আনন্দ মিলে তার। উঠে দাঁড়ায় সে বলে,
-“শেরওয়ানি ভাঁজ করে রেখে দিস। বিয়ের সময়ও যদি এটা না পড়িস, তাহলে আমিই পড়বো।”

-“ব্যস! তোর এই দোয়া আল্লাহ যেন কবুল করে নেয়।”

আদি ফের হাসে। আপনের কথায় সে তেমন গুরুত্ব দেয় না। হেসে বের হয়ে যায় রুম থেকে। আপন শেরওয়ানির দিকে নজর তাক করে রাখে।
_____________
কাল রাতে একটি ব্যাংক চুরি হওয়ার হাত থেকে রক্ষে পেয়েছে। চোরদের রাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে। নিভ্র সকালে সেখানে এসেছে। দুপুর হয়ে এসেছে। এখনো অবধি সে এখানে রয়েছে। কিভাবে চুরি করার পরিকল্পনা করেছে। সেটার ইনভেস্টিগেশন করছে। ব্যাংকের মেনেজারের সঙ্গে অনেকক্ষণ যাবত কথা বলে। এবং তার হাবভাবের মধ্যমে বুঝতে পারে সেও চোরের সঙ্গে জড়িত। তাই তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নিভ্র সেখান থেকে চলে আসার সময় রাস্তায় নবনী ও মায়াকে দেখতে পায়। খুব শান্ত ভঙ্গিতে নবনী হেঁটে চলেছে। আগের মতো উচ্ছ্বসিত হাসি মুখখানা এখন আর নেই তার। এক নজরে পর্যবেক্ষণ করে সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। তাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। সে নিজের মতোই থাকতে চায়। হ্যাঁ! সে জানে তার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। এতে তার আপত্তি বা কোনো মাথা ব্যথা নেই বললেই চলে। সে ভুলে যেতে চায় নবনী নামের কোনো মেয়েকে চিনে কি-না। টনিও কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে। আশা করছে সে ক্যাথিকে ছাড়া আরো ভালো থাকবে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

Sumaiya Moni

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১৪+১৫

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৪
#সুমাইয়া_মনি।

নদীর স্রোতের ন্যায় সময় কেঁটে যায়। কেঁটে যায় আরো এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে মানুষের জীবনে কম, বেশি অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটে। বদলে যেতে পারে জীবনের মোড়! যেমন মোড় ঘুরেছে নবনীর। এক সপ্তাহের মাথায় তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন জীবনের প্রান্ত। যেখানে শুধু বিষাদে পরিপূর্ণ!
বেডের সঙ্গে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে নবনী। গরমে গা গেমে একাকার। কারেন্ট থাকা শর্তেও পাখা অন করেনি সে। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। চুল গুলো ভেজা। পানি পড়ে ভিজে যাচ্ছে বিছানার চাদর। মন মরা হয়ে ভাবছে শুধু নিভ্রর কথা। যাকে সে মনের আসরে বসিয়েছে, বিষাদ যন্ত্রণা দায়ক অসহ্যকর কষ্ট দিয়ে সে বেরিয়েছে।
বার বার চোখের পাতায় সেই দিনটির কথা ভেসে উঠছে। যে দিনটি ছিল বিষাক্ত দিন! প্রচণ্ড বিষাক্ত জড়িত দিন।

অতীত…

সকাল সকাল তৈরি নবনী। খুশি,নোমানের বিয়ের উপলক্ষে ছোটখাটো আয়োজন করা হয়েছে । আয়োজনটি ঘরোয়া ভাবেই হবে। সেখানেই যাবে সে আর মায়া। সকালেই যেতে বলেছে ওদের। হলুদ রঙের গ্রাউন। হালকা সাজ। হাতে মেচিং কাঁচের চুড়ি। চোখে কাজল পড়ে পার্স হাতে ড্রইংরুমে আসে। নিলুফা বেগমের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বের হয় বাড়ি থেকে।
গ্রাউনটা একটু লম্বা হওয়ায় ধরে উঁচু করে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। এতে সে বিব্রত হচ্ছে। মেইন রাস্তায় আসতেই নিভ্রর গাড়ি ওর ঠিক সামনে দিয়ে যেতে দেখে এক হাত তুলে স্যার বলে ডাক দেয়। নিভ্র নবনীর আওয়াজ শুনতে পায়। থেমে যায় সে। পিছনে গাড়ি ঘুরিয়ে এনে নবনীর সামনে থামায়। নিভ্র এখন পুরোপুরি সুস্থ। কাঁচ নামিয়ে নবনীকে জিজ্ঞেস করে,
-“কোথায় যাচ্ছো?”

-“খুশির বাড়িতে।” কোমল স্বরে উত্তর দেয় নবনী।

-“ওহ!”

নবনী মাথা চুলকিয়ে দৃষ্টি ওপর, নিচ করে বলে,
-“আপনি কী আমায় একটু সেই বাড়িতে পৌঁচ্ছে দিবেন?”

নিভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রয়। মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলে,
-“আসো!”

নবনীর খুশি কে দেখে! দরজা খুলেই ঢুকে পড়ে গাড়িতে। এক পলকে নিভ্রকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয় সে। সাদা শার্ট।ফিট জামার হাতায় পেশিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখে রে ব্যানের কালো চশমা। হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে তাকে। নবনী নিজে নিজেই সিট বেল্ট পড়ে নিয়ে বলে,
-“চলুন স্যার।”

নিভ্র নবনীর কথাতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। চলতে আরম্ভ করে গাড়ি। মধ্যমমানের গতিতে গাড়ি ছুঁটে চলেছে। নবনী আড়চোখে নিভ্রর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। তার শান্ত শক্ত নজর স্থির সামনের দিকে। দু হাত গাড়ির স্টিয়ারিং এ রাখা। নিভ্রর এমন শান্তশিষ্ট রাগী ভাব নবনী তার মনের গোপন কোঠরিতে আবদ্ধ করে রেখেছে বহু আগেও।
তার কাছে বেশ ভালো লাগে নিভ্রর এমন মুখখানা।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে নিভ্র গাড়ি থামালের একটি নির্জন স্থানে।
নবনী কিছুটা অবাক হয়। আশেপাশে তাকিয়ে নিভ্রর দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টি ফেলতেই, নিভ্র গম্ভীর কণ্ঠে নিজ থেকে বলে উঠে,
-“আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই নবনীতা। গাড়িতে বসেই।”

নবনী নিভ্রর কথায় ছোট্ট করে উত্তর দেয়,
-“বলেন স্যার!”

হঠাৎ নিভ্রর চোখেমুখে যেন রাগী ভাব ফুটে উঠলো। সে সেটা দেখে আরো অবাক হয়। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিভ্রর দিকে। মাথায় একটি প্রশ্ন বেজে উঠলো, ‘কী বলতে চায় সে?’। বাঁকা চোখে তাকার তার দিকে। নিভ্র বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে চশমা খুলে নবনীর চোখে চোখ রেখে বলে,
-“তুমি আমাকে ভালোবাসো নবনীতা?”

নবনী চমকানো দৃষ্টিতে তাকায় নিভ্রর পানে। চোখেমুখে তার বিস্ময়! নিভ্রর এমন প্রশ্নে দৃষ্টি তার কিংকর্তব্যবিমূঢ! আশেপাশে যেমন নির্জন। তেমনই তাদের মাঝেও এখন নিরবতা বিদ্যমান। নিভ্র চোখেমুখে বিরক্ত বোধ নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
-“রোজ তুমি আমার বাড়ির সামনে গোলাপ ফুল রাখতে, রাইট?”

নজর নিচু করে ফেলে নবনী। সত্যতা আজ তার সামনে। হ্যাঁ! সে নিজেই প্রতিদিন সকালে নিভ্রর বাড়ির সামনে চুরি চুুপে ফুল রেখে আসতো। আর এমন ভান ধরে থাকত, সে কিছুই জানে না। কিন্তু তাকে খুব ভাবাচ্ছে। নিভ্রর তো এটা জানার কথা নয়। কিভাবে এই ছোট্ট রহস্য উদঘাটন করল ভাবছে সে। নিভ্র ফের নবনীর উদ্দেশ্য করে বলে,
-“বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগান হয়েছে। আই থিঙ্ক, এবার তোমার বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না। আমি কিভাবে জানলাম।”

ধরা সে পড়ে গেছে। এখন আর মিথ্যে বলে লাভ নেই। মিথ্যে বললে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তাই ছোট্ট করে উত্তরে বলে,
-“আমিই রাখতাম।”

রাগে নিভ্র বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপালে একবার স্লাইড করে। বলে,
-“ভালোবাসো তুমি আমাকে। সেটা আমি এ ক’দিনে বুঝতে পেরেছি। কিভাবে জানো?”

নবনী চুপ করে রয়। সে জানে কিভাবে। তবুও সে শুনতে চায় নিভ্রর মুখ থেকে। নিভ্র বলতে আরম্ভ করে,
-“আমার জন্য খাবার বাড়লে তার থেকে এক চামিচ আগে নিজে খেতে। গ্লাসে পানি ঢালার পর এক চুমুক পানি খেয়ে নেও। এবং-কি লাস্টের অবশিষ্ট খাবার ও গ্লাসের পানি টুকুও।”

লজ্জায় মাথা নইয়ে রাখে নবনী। কথা বলার কোনো ক্ষমতা তার মধ্যে নেই। নিভ্র যা যা বলেছে সবই ঠিক। এসব সে সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেছে। নিভ্র চোয়াল জোড়া শক্ত করে বলে,
-“ছোট্ট থেকেই আমি ভালোবাসা নামক জিনিসটিকে ঘৃণা করি। ভালোবাসা মানে আমার কাছে পরিবার। তাঁদের ছাড়া ভালোবাসা আমার কাছে অতি ক্ষুদ্র বস্তু মাত্র। প্রথম থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগত না। এখনোও না। তুমি কিভাবে ভাবলে তোমার এমন পাগলামোকে আমি প্রধান্য দেবো, ভালোবাসার নজরে দেখবো। ভুল ধারণা ছিল তোমার।”

মুখের জবাব যেন বন্ধ হয়েগেছে তার। বার বার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে তাকে ভালো লাগে না কথাটি। দ্রুত হৃৎস্পন্দনের ধকধকানি ভেড়ে গেছে।
নিভ্র কথা গুলো শান্ত ভাবে বললেও, একেকটা কথা বিষের চেয়ে কম লাগছে না তার নিকট। সে ফের ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে বলে,
-“ভালোবাসা ছাড়! তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবার ক্ষমতা রাখ না। সবে মেট্রিক পরিক্ষা দিয়ে কলেজে উঠেছো। তোমার মাথায় এমন অহেতুক পাগলামি কিভাবে চাপলো। এখনকার ছেলেমেয়েরা নাই-টেনে উঠলেই অনেক কিছু জেনে যায়, বাস্তবতা বুঝে যায়। কলেজে উঠে কেউ কেউ ম্যাচিউরডও হয়ে যায়। আর তুমি নিজেকে দেখো। ইমম্যাচিউর মেয়ে তুমি। যাই হোক, আজকের পর থেকে তুমি আমার বাড়ির ত্রিসীমার ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। আমি চাই না তুমি আমার সামনে আসো।”

যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে বুকের মাঝে। এ যে কষ্টের যুদ্ধ!
সে বাকরুদ্ধ! অসহ্যকর কষ্ট হচ্ছে মনে। ভালোবাসার মানুষটির মুখে আজ এমন ধারালো কথা শুনতে হবে, জানা ছিল না। কথা গুলো না বললে কি হতো না। হৃদয় একবারও কেঁপে উঠলো না তার। কাঁপপেই বা কেন? সে তো তাকে ভালোবাসে না। চোখ ছলছল করে উঠে তার। মনে হচ্ছে এখনোই বৃষ্টিরূপে তা বর্ষিত হবে। যাবে না সে তার চোখের ত্রিসীমানায়! বেশ কিছুক্ষণ কেঁটে যায় এমন নিরবে। নবনী নিজেকে কোনোমতে স্বাভাবিক করে গাড়ির দরজা খুলে বের হতে নিলেই নিভ্র থামিয়ে দেয়।

-“আমি যখন এনেছি তোমাকে। আমিই বাড়িতে দিয়ে আসবো। গাড়ি থেকে বের হবে না।” কিছু ধমকের স্বরে বলে।

অসহ্য যন্ত্রণা দেওয়া মানুষটির কথা সে শুনবে নাকি বুঝতে পারছে না। তবে না শুনে উপায় নেই। সে নিভ্রর সামনে নিজের কষ্টকে প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই সে গেট লাগিয়ে বসে। নিভ্র গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে,
-“কোথায় যাবে ব…”

বাকিটা বলার আগেই নবনী দ্রুত আওড়ায়,
-“বাসায়!”

নিভ্র নববীর দিকে একবার তাকায়। দৃষ্টি নত, চোখে তার পানি ছলছল। পাত্তা না দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় সে। আগের ন্যায় গাড়ি চলতে থাকে। একেকটা মিনিট নবনীর কাছে অতি বিষাক্ত মনে হচ্ছে। ভাবছে কখন বাড়িতে পৌঁছাবে।
যে মানুষটি বলেছে তার ধারেকাছে না যেতে।এখন তার সঙ্গে বসে থাকতে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে জোরে জোরে কাঁদতে পারলে ভালো হতো। তাও পারছে না সে। তার সামনে নিজেকে অসহায় ভাবে প্রকাশিত করতে চাইছে না।
কয়েক মিনিট পর বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামে। নবনী তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে চলে আসে। চোখের পানি তার এখনো চোখের কোটরেই জমাট বেঁধে আছে। যে কোনো সময় তা পড়ে যাবে। দু বার কলিং বেল বাজার পর দরজা খুলে দেয় নিলুফা বেগম। সে অবাক! চোখের কাজল লেপ্টান। চেহারার সেই হাসি-খুশির ভাব বিলিন হয়ে কান্নারতে পরিণত। মেয়ের চোখমুখ দেখে তার বুঝতে বাকি থাকে না কিছু একটা হয়েছে। ভালো বা খারাপ!

নবনী চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরে তাকে। মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে যায় সে। তার বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে। কোনোমতে পিঠে তার বুলিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে নবনীকে। নবনীর কান্না শুনে নিয়ানও উপস্থিত হয় ড্রইংরুমে। বোনকে এভাবে কাঁদতে আজ প্রথম দেখল। মুখ কালো হয়ে যায় তার। সোফায় বসিয়ে মেয়েকে শান্ত করে শোনার চেষ্টা করে মূল ঘটনা। কিন্ত নবনীর কান্নার গতি যেন থামবার নয়। কেঁদে চলেছে সে একাধারে। মেয়ের এমন কান্না সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শেষে ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে। নবনী হেঁচকি টেনে পুরো ব্যাপার খুলে বলে তাকে।
সে পুরো থম মেরে যায়। নিয়ান তেমন কিছু না বুঝতে পারলেও, এতটুকু ঠিক বুঝেছে নিভ্র স্যার তার বোনকে কষ্ট দিয়েছে। মনে মনে ক্ষোভ জন্মায় তার মনে।

অতীত থেকে বেরিয়ে আসে নবনী। হুঁশ ফিরে তার কারো হাতের স্পর্শে। নিলুফা বেগম নবনী পাশে বসে ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায় তার দিকে। চেহারার উজ্জ্বল, চঞ্চলতা ভাব নেই। মুখ শুকিয়ে গেছে মেয়ের। নিলুফা বেগম মেয়ের এমন কষ্ট সহ্য করতে পারছে না। স্বাভাবিক! কোনো মা-বাবাই সন্তানের কষ্টে সুখে থাকতে পারবে না।
নবনী ধীরেধীরে তার কাঁদের ওপর মাথা রাখে। নিলুফা বেগম নবনীর মাথায় বিলি কেঁটে দিয়ে বলে,
-“বাস্তবতা থেকে মানুষ শিখে। তুই এখন রিয়েল বাস্তবতার সম্মুখীন। তোর মধ্যে ম্যাচুরিটি ছিল না। নিভ্র তো ঠিক বলেছে। সারাদিন দুষ্টুমি, পড়া ফাঁকিবাজি আরো কত কি করতি তুই। মানুষ অন্যান্য বই পড়েও জ্ঞান অর্জন করে, শিখে। কিন্তু তুই ঠিক মতো একাডেমিক বই পড়তি না, আদার্স বই পড়া তো দূরের কথা! তাই তোর মধ্যে ম্যাচিউরিটি নেই বললেই চলে। নিভ্র তোকে কথা শুনিয়েছে। তোর ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছে। এতেই তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস। কেন? সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে নিজের মতো করে জীবন শুরু কর। নিজেকে সময় দেয়, ভালোবাসতে শিখ।”

অতি কষ্টে নবনী মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। তার কথা গুলো সঠিক। সে চায় নিজেকে নতুন রূপে রুপান্তরিত করতে। পারবে কী? কিছু প্রশ্নের উত্তর অপূর্ণ থেকে যায়। নিলুফা বেগম নবনীর দিকে নরম ভঙ্গিতে তাকায়। নবনী চোখ মুছে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“অবুঝ মানুষরা ধাক্কা না খেলে কিছু শিখতে পারে না আম্মু। আমি বুঝেছি। চরম বাস্তবতা দেখিয়েছে আমাকে। নিজেকে নতুন ভাবে গুছিয়ে নিতে চাই।”

মেয়ের কথা শুনে কিছুটা হলেও খুশি হন সে। মাথায় হাত রেখে বলেন,
-“নামাজ শেষ করে খেতে আয়।”

-“আসছি!”
______________
জিনান মুখ ভার করে বসে আছে নিভ্রর পাশের সোফাটিতে। নিভ্রর ভাবভঙ্গি আগের দিনের মতো শান্ত। সে সযত্নে তার পিস্তল মুছতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগেই জিনান বাড়িতে এসেছে। নিভ্র নবনীকে বলা সব কথা বলেছে। জিনান শুনে প্রথমে অবাক হলেও, পরক্ষণে মুখ কালো হয়ে যায়। নিভ্র জিনানকে নিরবতা পালন করতে দেখে বলে,
-“কিছু বলছিস না যে?”

সে আজ নিভ্রর ওপর বিরক্ত বোধ করছে। যেটা কখনো হয়নি। নিভ্রকে পারফেক্ট মনে হতো। সবার চেয়ে আলাদা সে। কিন্তু তার মধ্যেও যে এতটা কঁড়া বিবেকবুদ্ধি আবির্ভূত। অনুমান ছিল না তার। মেয়েটা না হয় ভালোবেসেছে। তার জন্য তাকে এভাবে অপমানসূচক কথা শুনাতে হবে। জিনান চুপ থাকতে পারে না আর। মেকি রাগ নিয়ে বলল,
-“তোর মনে নবনীকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই মানলাম। তাই বলে তুই ওঁকে এভাবে অপমান করে কথা বলতে পারিস না।”

নিভ্র পিস্তল পাশে রেখে বলে,
-“অপমান তো করিনি। লাভ সাবজেক্ট এবং ম্যাচিউরিটি নিয়ে কথা বলেছি।”

-“অর্ধাঙ্গিনী হবার ক্ষমতা রাখে না। এটা কেন বলতে গেলি। আবার ত্রিসীমানায় আসতে নিষেধ করলি। ভুলে গেলি, নবনীর উপকারের কথা।”

-“নবনীতার হয়ে, আমাকে খোঁটা দিচ্ছিস। আর আমি তো কাউকে বলিনি আমাকে সাহায্য করতে। উপকারের কথা, সেটা তো দূরেই থাক!”

-“জাস্ট বলছি! এটাকে খোঁটা বলে না। তোকে কিছু বলার নেই আমার। যাই বলিনি না কেন, বেহুদা মনে হবে আমার কথা।”

-“নবনীতার সাবজেক্ট নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।”

-“বলবও নাহ!”

-“ধন্যবাদ!” বলেই ফোন হাতে নেয় নিভ্র।

জিনান ওঠে গেটের সামনে আসে। বের হবার আগে বলে,
-“আমি গেলাম।”

-“আচ্ছা!”

জিনান প্রস্থান করে। নিভ্র ফোন ঘাটতে থাকে। জিনানের রাগকে সে পরোয়া করে না। তার কোনো ভাবান্তর নেই যে তার মাধ্যমে একজন মেয়ের মন ভেঙে গেছে। তাও করুণ ভাবে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৫
#সুমাইয়া_মনি।

আকাশের বুক চিঁড়ে পূর্বদিগন্ত থেকে সূর্য উদিত হয়। পাখিরা গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে ডেকে চলেছে।
বেলা আটটা বাজে। নিলুফা বেগম নবনীকে সাতটা থেকে ডাকা আরম্ভ করেছে। কিন্তু নবনীর কোনো রেসপন্স নেই।
এক ঘন্টা যাবত সে ডেকে ডেকে অস্থির। পরিশেষে সে রান্নাঘরে চলে আসে। আটটা চল্লিশ মিনিটে সে ফের ডাকতে আসে। দরজায় করাঘাত করতে যাবার পূর্বেই নবনী দরজা খুলে দেয়। নিলুফা বেগম কিছুটা চমকে যায়। দরজা খোলার কারণে নয়, নবনীকে দেখে। টানা দু দিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে সে। নিজেকে সংযত করে পাল্টেছে নতুন রূপে। আজ নবনী অন্যরকম ভাবে নিজেকে সাজিয়েছে। ব্লু রঙের থ্রিপিস, সঙ্গে মেচিং করে হিজাব পড়েছে। ডান হাতে সাইট ব্যাগ। চেহারায় উজ্জ্বলতা ভাব নেই বললেই চলে। তবুও সাজসজ্জাহীন নবনীকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। নিলুফা বেগম নবনীকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই নবনী অতি গম্ভীর মুখে বলে,
-“রেডি হচ্ছিলাম। এত ডাকার কোনো কারণ দেখছি না আম্মু।”

সে কিছু বলে না। নবনী বের হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। খাবার ভাড়া ছিল। অর্ধেক রুটি ছিঁড়ে ভাজি দিয়ে খেতে আরম্ভ করে। একটা রুটি খেয়েই পানি পান করে নবনী। নিলুফা বেগম এগিয়ে এসে আরেকটি রুটি প্লেটে দিতে নিলেই নবনী ওঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“খাওয়া শেষ। আমি কলেজে যাচ্ছি আম্মু।” বলে সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় বাহিরে।

মেয়ের এমন গম্ভীর আচরণ দেখে সে হতবাক। তবে সে এটা ভেবে স্বস্তি পায় নবনী নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। পরিবর্তন করতে।
.
রিকশা নিয়ে সোজা কলেজে আসে নবনী। ক্লাস রুমে আসতেই মায়ার সঙ্গে তার দেখা হয়। মায়ার সিটে বসে সে। কোনো কথা না বলে ব্যাগ থেকে একটি উপন্যাসের বই বের করে পড়তে আরম্ভ করে। রীতিমতো মতো মায়া নবনীকে দেখে অবাক। কৌতুহল নিয়ে চেয়ে রয়। পরক্ষণে জিজ্ঞেস করে,
-“ফোন না ধরার কারণ বলবি? আর খুশিদের বাড়িতে যাওয়ার লাস্ট মুহূর্তে কী হয়েছিল। জানতে পারি কী?”

নবনীর বই পড়ায় মগ্ন। মায়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নয় সে। মায়া বড়ো নিশ্বাস ত্যাগ করে। নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদু স্বরে বলে,
-“আমি সব জানি নবনী। জিনান আমাকে সব বলেছে।”

নবনী পড়া বন্ধ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-“এই প্রসংগে কথা না বললে আমি খুশি হবো মায়া।”

চোখ তুলে তাকায় মায়া নবনীর দিকে। নবনীর এমন পরিবর্তন মানা যাচ্ছে না। খুব ভাবাচ্ছে তাকে। সে চুপ করে রয়। আপাতত নবনীকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে ভেবে।
____________________
আপনের বিয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আছে। কার্ড অলরেডি আত্মীয়দের বাড়িতে পৌঁছানো হয়ে গেছে। বাকি যারা আছে তাদেরকে আদি নিজে গিয়ে কার্ড দিয়ে এসেছে।
আপন তার কক্ষে ডায়েরীতে কিছু একটা লিখছিল। তখন আদির আগমনে সে লেখা বন্ধ করে দেয়। ডায়েরী বন্ধ করে ঢয়ারে রাখে। আদি বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। গরমে ঘেমে গেছে সে। আপন দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করতেই আদি বলে উঠে,
-“বিয়ে তোর, সব কাজ করতে হচ্ছে আমার। হোয়াই ব্রো?”

-“ভাই ভাইয়ের বিয়েতে কাজ করতে না তো কে করবে বল?”

-“ভালো কথা! তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি বিরক্ত করব কাকে? ইশশ! একটা বোনও নেই আমার। যাতে পরবর্তী তাকে টর্চার করব।” আফসোস নিয়ে বলে আদি।

-“কী আজব তুই আদি।”

-“ব্রো, তুই কাকি মাকে বলে একটা বোনের ব্যবস্থা করতে বল না।”

-“বোনের না। বউয়ের ব্যবস্থা করতে পারি করব?”

-“আহা! বউকে বিরক্ত টর্চার করা যায় নাকি।”

-“তাহলে কী রোমান্টিক টর্চার করবি?”

-“রাইট ব্রো! মনের কথা বলে দিলি তুই।” বলেই হেসে ফেলে।

আপন মনে মনে আওড়ায়,
-“শয়তান একটা।”

-“শয়তান না। ফাজিল বল, ফাজিল!”

-“হবে একটা।”

-“যাক! তনুজা ভাবির সঙ্গে আর কথা হয়েছে?”

-“তা জেনে তুই কী করবি?”

-“বাজার থেকে পেঁপে এনেছি। জেনে ব্লেন্ডারে পেঁপের সঙ্গে মিক্স করে খাব।”

-“দেখ আদি, বিরক্ত করবি না আমায়।”

-“আর ক’দিনই তো। তারপর আর বিরক্ত করব না ব্রো।”

আপন কথা বলে না। বিরক্ত হয়ে ফোন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আদি বাঁকা হাসে।
__________________
নিভ্র তার কেবিনে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। হঠাৎ তার ফোনের টোন বেজে উঠে। দৃষ্টি ফোনের দিকে নিবদ্ধ করে।
চট করে টেক্সটটি পড়ে ফেলে। সেখানে লিখা ছিল,
-“ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করতে চাই না। আমাকে সঠিক পথ দেখানো ও বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুকরিয়া! জায়রা।”

টেক্সটটি পড়ে নিভ্র স্মিত হাসে। পরক্ষণে সে তার মনোযোগ কাজে লাগায়। বেশ কিছুক্ষণ পর চেয়ারে হেলান দিয়ে হাই তুলে। ঘাড়ে হাত রেখে ডান দিক, বাঁ দিকে কাত করে।
ফোন হাতে নিয়ে ডায়ালিস্টে যেতেই নবনীর নাম্বার নজরে পড়ে যায়। লাস্ট কথা হয়েছিল পাঁচ-ছয় দিন আগে।
সে পাত্তা দেয় না। সেখান থেকে জিনানের নাম্বারটি বের করে কল দেয়। তাকে বাসায় আসতে বলে। জিনান বিকালে আসবে বলে জানায়। অতঃপর ফোন রেখে সে আবার তার কাজে মন দেয়।
——–
একটার দিকে বাড়ি ফিরে নবনী। রুমে ঢুকে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর হুমায়ুন আহমেদের একটি উপন্যাস নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। বেশ কিছুক্ষণ পর ক্যাথি নবনীর নিকট আসে। নবনী ক্যাথির পানে তাকায়। সেদিনের পর থেকে ক্যাথিকে টমির কাছে যেতে দেওয়া হয়না।যেতে দিতেও চান না। আর ক্যাথিকে তার নিকট আসতে দেয়নি। মন স্থির করে সে ক্যাথিকে দিয়ে দিবে কাউকে। কেননা ক্যাথিকে দেখলেই টমির কথা তার মরে পড়ে যায়, তারপর নিভ্রর কথা। তাই সে চায় না ক্যাথি তার সঙ্গে থাকুক।
নবনী সেই জানালার দিকে তাকায়। যেখান থেকে রোজ সে নিভ্রকে দেখতো। সে-ই জানালা নবনী সেদিনই বন্ধ করে দিয়েছে। আর খোলা হবে না সেটি। আগের মতো বন্ধ হয়ে থাকবে। নবনী হাঁকিয়ে নিয়ানকে ডাক দেয়।
নিয়ান পাশের রুম থেকে ছুঁটে আসে এ রুমে। এসে জিজ্ঞেস করে,
-“ডেকেছো আপু?”

-“ক্যাথিকে নিয়ে যা। আর ও যেন আমার রুমে না আসে।”

-“আচ্ছা!”

-“আর শোন।”

-“বলো আপু।”

নবনী ওর ব্যাগের ভেতর থেকে ওর মার্বেল গুলো বের করে নিয়ানের হাতে দেয়। বলে,
-“তোর মার্বেল গুলো নে। বাহিরে গিয়ে খেলা কর।”

আগের দিনের মতো হলে নিয়ান মার্বেল পেলে বেশ খুশি হতো। কিন্তু আজ কেন যেন ওর ভেতর থেকে খুশি ভাবটা প্রকাশ পাচ্ছে না। যেন সে অখুশি! বোনের কষ্ট সে ঢের উপলব্ধি করতে পারছে। বুঝতে পারছে সে এখন আর আগের মতো নেই। সারাক্ষণ কেমন মনমরা হয়ে রয়। মার্বেল দেওয়ার পরও নিয়ানকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নবনী বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ক্যাথিকে নিয়ে যা নিয়ান। আর সন্ধ্যার পর আমার কাছে পড়তে আসবি। আজ থেকে তোকে আমিই পড়াবো।”

নিয়ান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। যে বোন তাকে পড়াতে ইচ্ছুক ছিল না। আজ সে পড়ানোর কথা বলছে। বোনের এমন পরিবর্তন সবার মতো তাকেও পীড়া দিচ্ছে। পরিশেষে সে ক্যাথিকে সঙ্গে নিয়ে রুম ত্যাগ করে। নবনী চুল তুলে কপালে আঙ্গুল বুলাতে থাকে। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাহির থেকে নিলুফা বেগম নবনীর কথা সব শুনেছে। নবনী নিয়াককে ডাকার পর পরই সে রুমের বাহিরে এসে উপস্থিত হয়। অতঃপর সে তাদের কথা শুনতে পারে।
ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। মেয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। যাকে বলে মারাত্মক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনকে আঁকড়ে ধরে সে যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে পারে।
এই কামনাই করে সে!
.
.
.
#চলবে?

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১২+১৩

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_ ১২
#সুমাইয়া_মনি।

-“তুমি নার্ভাস হচ্ছো, সেটা দেখেছি নবনীতা।”

এতক্ষণ চুপ করে ছিল। কিন্তু নিভ্রর পুনরায় কথা শুনে সে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। স্বস্তির নিঃশ্বাস! সে ভেবেছিল হয়তো নিভ্র দেখে ফেলেছে তার ল্যাং মারার দৃশ্য। কিন্তু না! সে দেখেনি। বেঁচে গেছে তাহলে। নবনী ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“জি!”

-“জি কী? কথা বলো। আমার বেশ বিরক্ত লাগছে। এভাবে চুপচাপ বসে থেকো না।”

মৃদু আওয়াজ করে বলে,
-“কী বলব? ”

-“ইচ্ছে!”

-“আমি কথা বলা শুরু করলে আপনি যে টুকু সুস্থ আছেন, সে টুকু অসুস্থ হয়ে যাবেন স্যার।” বিড়বিড় করে কথাটা বলে নবনী।

-“কিছু বললে?”নবনীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

-“না স্যার।”

-“ওহ!”

বেশ কিছুক্ষণ দু’জনে চুপ করে রয়। পরে নবনী নিজে থেকেই কিছু বলতে যাবে তখনই একজন সিনিয়র অফিসার কেবিনে প্রবেশ করে। সঙ্গে একজন কনস্টেবলও ছিল। নিভ্র তাকে বসেই সেলুট দেয়। নবনী ওঠে পিছনে এসে সোফায় বসে। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে তাদের দিকে তাকায়। কাবাবের মধ্যে হাড্ডি হতে এসেছে। অফিসার না, হাড্ডি স্যার তারা। বিড়বিড় করে বলে ভেংচি কাটে নবনী। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হয় তাদের মধ্যে। নবনী বোর হয়ে যাচ্ছে। কাকে যে ভালোবেসেছে। যে কিনা অসুস্থ অবস্থাও কাজের বিষয় নিয়ে কথা বলছে। সেকেন্ড কয়েক পরই তারা চলে যায়। নবনী কিছুটা হলেও স্বস্থি পায়।
টুলে গিয়ে বসতেই একজন নার্স আসে নিভ্রকে দেখতে। নবনী ফের টুল থেকে ওঠে সরে দাঁড়ায়। নার্সটি নিভ্রকে শারিরীক সুস্থতার কথা জিজ্ঞেস করে। নিভ্র সুস্থ বার্তাটি বলতেই নার্সটি ফিরে যায়। নবনী নখ কামড়াচ্ছে। মনে মনে বলছে, “আর কেউ বাকি আছে!” বলা শেষ হতেই নিলুফা বেগম হাজির হয় নিয়ানকে নিয়ে। নিভ্র তাকে দেখে সালাম দেয়। উত্তর দিতে দিতে সে টুলে বসে। এখন নিজের ওপর রাগ হচ্ছে। কেন যে বলতে গেল কথাটি।

আধাঘন্টা সে সেখানে থাকে। নিভ্রর সঙ্গে কথা বলে। নিলুফা বেগম নিভ্রর জন্য কিছু ফল এনেছিল। সেগুলো নবনী কেটে দেয় নিভ্রকে খেতে। এক পিস আপেল মুখে পুরে বিরক্ত ফেইসে তাদের পানে তাকিয়ে আছে নবনী। বিশ মিনিট পরই নবনীর আম্মু চলে যায়। নবনী সরু নিশ্বাস ফেলে টুলে বসে। এবার কেউ না আসুন। খুব করে চায় সে।
————-
মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে। জিনান তার পাশেই বসা। কিছুক্ষণ আগে সে পার্কে এসেছে। যেখানে মায়া আগে থেকেই তার জন্য অপেক্ষা করছিল। চার-পাঁচ মিনিট কেটে যায়। তবুও মায়া কিছু বলে না। জিনান মায়ার এমন নিরবতা দেখে সে নিজেও বিব্রতবোধ করছে। শেষে সে নীরবতা অন্তিম করে বলে,
-“তুমি কী সত্যি আমাকে বিয়ে করবে?”

আরো লজ্জায় পড়ে যায় মায়া। সে ভাবছে এটা না বলে অন্য কিছুও তো বলতে পারতো। কিন্তু পরক্ষণে ভাবে ডিরেক্ট জিজ্ঞেস করে ভালো করেছে। উত্তরের আশায় মায়ার পানে চেয়ে আছে জিনান। সেটা মায়া বুঝতে পেরে মাথা উপর,নিচ দুলিয়ে হ্যাঁ সম্মতি দেয়। জিনান মনে মনে বেশ খুশি।
চট করে মায়ার এক হাত ধরে ফেলে। বিস্ময় চোখে তাকায় মায়া। জিনান মায়ার চাহনি দেখে মুচকি হাসে। যে হাসি দেখে মায়া লজ্জায় মাথা আগের ন্যায় নুইয়ে রাখে। তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। সেই অধ্যায় শুধু ভালোবাসায় ছড়াছড়ি।
___________
সন্ধ্যার দিকে নবনী বাড়িতে ফিরে। অবশ্য সে আসতে চেয়েছিল না নিভ্র তাকে যেতে বলেছে, যার দরুণ সে আর থাকতে পারেনি। রাতে ওর সঙ্গে জিনান থাকবে বলে আসে। পাশের সোফায় জিনান শুয়ে পড়ে। নিভ্র তার বেডে আধশোয়া অবস্থায় বসে ছিল। জিনান নিভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“শুইয়ে দেবো তোকে?”

-“না থাক! একটু পড়ে শুই। আরো কিছুক্ষণ বসি।”

-“বোস তাহলে।”

-“তারপর তোর খবর কি বল?”

-“গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে।” খুশি হয়ে বলে।

-“প্রেমের নাকি বিয়ের?”

-“দুটোই!”

-“বাহ!”

-“বাহ! বলিস না। আমি প্রেম, বিয়ে এক সঙ্গে করব। আর তুই শালা আজীবন সিঙ্গেল থেকে যাবি।” মেকি রাখ নিয়ে বলে জিনান।

নিভ্র হেসে ফেলে। বলে,
-“আমার বিয়ে নিয়ে তোর এত মাথা ব্যথা কেন বুঝতেছি না।”

-“দোস্ত তুই আমার। তাই চিন্তা হয়। এই-যে আজ তুই এখানে শুয়ে আছিস না। শুধু মাত্র সিঙ্গেল থাকার জন্য। যদি বিয়ে করতি বা একটা গার্লফ্রেন্ড থাকতো তাহলে তার কথা চিন্তা করে বেপরোয়া গিরি কম করতি।”

-“এসব ফালতু কথা। ভাগ্যের ওপর কারো হাত নেই। যেটা সয়ং আল্লাহ লিখে রাখে। সেটা হবেই। তুই, আমি অন্য কেউ চেষ্টা করেও আটকাতে পারব না।”

-“তোর বচন-প্রবচনকে পিস্তলের ভেতর ভরে রাখ। আমাকে বলার কোনে প্রয়োজন নেই।” বলেই মুখ ঘুরিয়ে রাখে জিনান।

-“আমি নিশ্চিত! আমার ব্যাপারে তোকে কেই কুপরামর্শ দিয়েছে। তো সেই ব্যক্তিটি কে?”

-“কে দিবে শুনি? এমন কেউ আছে নাকি। আজাইরা কথা বলিস, যেটা না লাগে।” উত্তেজিত হয়ে ওঠে বসে বলে জিনান।

-“ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? হঠাৎ ঝগড়া করার মুড হলো নাকি?” শাস্ত গলায় প্রশ্ন করে।

-“অহেতুক কথা বললে ক্ষেপে যাবোই।” বলেই নিভ্রর কাছে এসে ওঁকে ধরে বেডে পুরোপুরি শুইয়ে দেয়। তারপর সোফায় এসে নিজেও ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। নিভ্র জিনানের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। খুব ভালোলাগে যখন বুঝতে পারে ওর প্রিয় মানুষগুলো ওঁকে নিয়ে মন থেকে ভাবে, ভালোবাসে।
বিয়ে ব্যাপার নিয়ে ওর আম্মুও কয়েকবার রাগারাগি করেছে। কিন্তু এতে নিভ্রর কোনো ভাবান্তর নেই। কিছুক্ষণ বাদে সে-ও ঘুমিয়ে যায়।
______________
রাত পেরিয়ে সকাল হয়। তারপর দিন, তারপর এক সপ্তাহ কেটে যায়। আজ হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হয় নিভ্রকে। হাত এখন অনেকটাই ভালো। আর ক’দিন রেস্ট নিলে অতি দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠবে। কিছুক্ষণ আগেই নিভ্র বাড়িতে ফিরে। টমি নিভ্রকে দেখেই খুশিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকদিনের জমে থাকা ভালোবাসায় ভরে দেয় তাকে। কোলে গিয়ে বসে থাকে।
নিভ্র সে নিজেও টমিকে আদর করে দেয়। ক্যাথিকে কোলে তুলে পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে নবনী। জিনানও সঙ্গে ছিল।
ভালোবাসা আদান-প্রদান শেষ হলে ভেতরে আসে। আজ নবনী নিজের হাতে রান্না করেছে। সব কিছু গুছিয়ে রেখেছে টেবিলে। এই এক সপ্তাহে নবনী অল্প সল্প করে রান্না শিখেছে শুধু মাত্র নিভ্রর জন্য। হাসপাতালে প্রতিদিন সে নিজে রান্না করে নিয়ে যেত। কখনো আবার নিলুফা বেগমও রান্না করে দিতো। ফ্রেশ হয়ে এসে খাবার খেতে বসে। জিনানও বসে যায় খেতে। দু’জনকে খাবার সার্ভ করে দেয় নবনী।
খাওয়া দাওয়া শেষ হলে জিনান চলে যাওয়ার জন্য বাহিরে আসে। নবনীও ওর পিছু পিছু আসে।

-“ভাইয়া শুনুন? ”

পিছন ফিরে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কিছু বলবে?”

-“হ্যাঁ!”

-“বলো?”

-“পাঁচটা ইংরেজি অক্ষর একটু ভাঙ্গিয়ে দিন।”

-“মানে?” ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে।

-“মানে হলো, S, O ডবল R, R, Y এটার উচ্চারণ কী হবে?”

-“সিম্পেল, Sorry…”

-“ইট’স ওকে ভাইয়া। আমি কিছু মনে করিনি। সেদিনের ব্যাপার তো আমি অনেক আগেই ভুলে গেছি। স্যরি বলার প্রয়োজন নেই।”

-“তুমি…….” বলেই হেসে জিনান চোখ ডেকে ফেলে। নবনী চালাকচতুর মেয়ে সেটা জানত। কিন্তু এতটা চালাক! আজ তার ধারণা হলো। সেদিনের ব্যাপারটি নিয়ে, সে নিজে থেকে স্যরি না বলে, তাকে দিয়েই স্যরি বলিয়েছে। অন্য কৌশলে। নবনীও হাসে। বলে,
-“আমিও স্যরি ভাইয়া।”

-“আমাকে দিয়ে আগে স্যরি বলিয়ে, এখন নিজে স্যরি বলছো।”

-“আপনি আগে আমাকে পাগল বলেছিলেন। তাই স্যরি আগে আমি ডিজার্ভ করি।”

-“যাক, মেনে নিলাম। প্রচণ্ড চাকাল তুমি নবনী।”

নবনী জিব্বা অল্প বের করে এক চোখ টিপ দেয় জিনানের দিকে তাকিয়ে। জিনান ফের হাসে। নবনীর মাথার আলতো করে হাত রেখে ধাক্কা দেয়। তারপর বলে,

-“আচ্ছা আমি গেলাম। নিভ্রর দিকে খেয়াল রেখো।”

-“অবশ্যই!”

মুচকি হেসে জিনান চলে যায়। নবনী ফিরে আসে ঘরে। নিভ্র বাগানের পেছন থেকে বের হয়। জিনান বের হবার আগেই নিভ্র আগে বাগানে এসেছে ফুল গাছ দেখতে। তারা দু’জন ওঁকে দেখেনি। বাগানে বসেই নিভ্র তাদের কথপোকথন শুনতে পায়। নবনীর কথা শুনে সে নিজেও হাসে। মানতেই হবে নবনী অধিক চালাকচতুর মেয়ে! তাইতো কলাকৌশলে খুব সহজেই স্যরি বলিয়ে নিলো জিনানের কাছ থেকে। নবনীর এই বিষয়টি নিভ্রর কাছে ভালো লাগে।
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৩
#সুমাইয়া_মনি।

কলেজে এসে নবনী খুশির নিকট আসে। বিয়ের পর আজ প্রথম খুশি কলেজে এসেছে। নবনী খুশিকে দেখে আনন্দে বিমোহিত। মায়াও ততক্ষণে ওদের নিকট আসে। তিন বান্ধবী তাদের কথপোকথন শুরু করে।

-“কেমন চলছে তোর বিবাহিত জীবন?” হেসে প্রশ্ন করে নবনী।

-“আল্লাহর রহমতে খুব ভালো। নোমান আগের থেকে অনেক ভালো হয়ে গেছে। আর ওর বাবা,মাও আমাকে মেনে নিয়েছে।”

-“বাহ! সেটা তো ভালো খবর।” মায়া বলে।

-“হুম,এবার তোদের খবর বল?”

-“আমার খবরে পরে আসি। আগে মায়ার খবর শোন। অতি শীঘ্রই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে।”

খুশি আবার হয়ে বলে,
-“কার সঙ্গে? ”

-“ঐ যে! নিভ্র স্যারের বন্ধু জিনান ভাইয়ার সঙ্গে।”

-“কংগ্রাচুলেশনস! মায়া।” খুশি হয়ে বলে।

-“পরে দিস। এখনো ঠিক হয়নি।” মায়া বলে।

-“কেন?”

-“শুক্রবার আসবে বলেছে ওর বাবা,মা আমাদের বাড়িতে। ভাবতেই খুব নার্ভাস লাগছে।”

-“নার্ভাস হোস না। ঠিক হয়ে যাবে সব। ঐ নবনী তোর কথা বল এখন।” নবনীকে গুঁতো দিয়ে বলে।

-“আমার গাড়ি চলা না রে বোইন।” দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গালে হাত রেখে বলে।

-“গাড়ি মানে?”

-“নবনী নিভ্র স্যারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।” ভেংচি দিয়ে বলে মায়া।

-“তাই নাকি।”

-“হুম।”

-“তাকে বলে দে, তোর ভালোবাসার কথা।”

-“মাথা খারাপ! গুলি করে দেবে ঠুস করে।”

খুশি হাসে। বলে,
-“আরে তেমন কিছু হবে না। বলে তো দেখ।”

-“দেখি!”

-“দেখি নয়, বলবিই।”

নবনী ভাবছে। তিন বান্ধবীর মধ্যে আরো কিছুক্ষণ কথপোকথন হয়। তারপর তারা ক্লাসে আসে।
_________________
জায়রাকে আজ কোর্টে চালান করা হবে। সঙ্গে গ্যাংয়ের লিডার রজব আলিকেও। এই জন্য আজ নিভ্রকে থানায় আসতে হয়। জায়রাকে নিয়ে যাওয়ার আগে নিভ্র দেখা করতে আসে। সেদিনের পর জায়রাকে আর কোনো ধরনের টর্চার করা হয় না। কারণ সে সব কিছু স্বীকার করেছে। ফ্লোরের এক পাশে মুখ গোমড়া করে বসে আসে জায়রা। চেহারার রং বদলে গিয়েছে। যেন সে কতকাল যাবত এখানে বন্দী হয়ে আছে। লকাপের গেট খোলার শব্দে জায়রা কিছুটা নড়েচড়ে বসে সেদিকে তাকায়। নিভ্রকে দেখে সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। নিভ্র আজ ইউনিফর্ম ছাড়া এসেছে। একবার জায়রার পানে চেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
-“রজব আলির সম্পর্কে সব সঠিক বার্তা পেশ করবেন কোর্টে। এতে করে আপনার শাস্তি কম হবে।”

জায়রা কিছু বলে না। নিরব হয়ে রয়। নিভ্র ফের বলে,
-“আপনার কোনো দোষ নেই। রজব আলি তার খারাপ কাজে আপনাকে ব্যবহার করেছে। আপনি চাইলে আমি আপনাকে আপনার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে পারি।”

জায়রা এবার মুখ খুলে। কিছুটা তেজ কন্ঠে বলে,
-“আমার কেউ নেই। ”

-“অনাথ আপনি? নাকি বেঁচে থেকেও…..”

কটমট চোখে তাকায় জায়রা নিভ্রর দিকে। নিভ্র জায়রার রাগকে পাত্তা দেয় না। বলে,
-“পারিবারিক বিষয় নিয়ে আমার কোনো মতামত নেই।”

-“তাহলে জিজ্ঞেস করছেন কেন?” রেগে বলে।

-“আপনাকে সাহায্য করতে। দেখুন, আপনার বিষয় আমার তেমন কোনো আইডিয়া নেই। তবে আপনাকে সুরক্ষিত ভাবে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চাই।”

আহত চোখে তাকায় জায়রা। নিভ্রকে দেখা মাত্রই তার গা জ্বলে যাচ্ছে। আর সে কি-না তাকে সুরক্ষিত ভাবে বাড়িতে পৌঁছে দিতে চায়। অবাক হয় সে। নিভ্র বলে,
-“বলুন?”

জায়রা মুখ খুলে না। দৃষ্টি নত করে রাখে। নিভ্র নিজে থেকেই বলে,
-“আচ্ছা এখন না বললে কোর্ট থেকে ফিরে এসে কনস্টেবলের কাছে বলবেন। নিয়ে চলো তাকে।” নিভ্র হনহনিয়ে চলে যায়৷ একজন মেয়ে কনস্টেবল তাকে ধরে নিয়ে লকাপ থেকে বের হয়। গাড়িতে বসিয়ে কোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় তারা।
________________
রাতে….

নবনী এখন নিভ্রর বাড়িতে উপস্থিত। ড্রইংরুমে বসে সে পায়চারী করছে। মূলত সে নিভ্রর জন্য অপেক্ষা করছে। একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নজর বুলিয়ে ন্যায়। দশটা ছুঁই ছুঁই। ধুপ করে সোফায় বসে। হেলান দিয়ে, মনে মনে বেশ ভীষণ বিরক্ত বোধ করছে। সুস্থ হতে পারিনি তার মধ্যেই কাজ শুরু। বিরক্তিকর লোক বটে! তবে হঠাৎ নবনী ওঠে বসে। এখন নিজেকে নিভ্রর ওয়াইফ বলে মনে হচ্ছে। কেননা নিভ্র এত রাত করে বাড়ি ফিরলে, তার অর্ধাঙ্গিনী ঠিক এভাবে অপেক্ষা করতো। ভাবতেই নবনী লজ্জা মিশ্রিত হাসি দেয়। ঠিক তখনই গাড়ির আওয়াজ শুনতে পায়। নিভ্র এসেছে সেটা বুঝতে পারে সে। দ্রুত বাহিরে গিয়ে মেইন গেট খুলে দেয়। গাড়ি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে নিভ্র। নবনী গেট লাগিয়ে দেয়। নিভ্র গাড়ি রেখে ভেতরে আসে। নবনী তখন টেবিলে খাবার বাড়ছিল।
নিভ্র নবনীর উদ্দেশ্যে বলে,
-“তুমি এখনো যাও নি কেন?”

নবনী ফিরে তাকায়। নরম স্বরে বলে,
-“চলে গেলে গেট কে খুলে দিতো? আর খাবারই বা কে বেড়ে দিতো?”

-“আগের মতো আমিই সব করে নিতাম।”

নবনী মুখ কালো করে বলে,
-“জিনান ভাইয়া আপনার দিকে খেয়াল রাখতে বলেছে। সেটাই করছি আমি।”

জিনানের বলা কথাটি মনে পড়ে তার। কাল সে এটাই যাওয়ার সময় নবনীকে বলে গিয়েছিল। আর সেই কথাটি নবনী অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে ব্যস্ত। ভেবেই নিভ্র সরু নিশ্বাস ফেলে। চুপ থাকতে দেখে নবনী চোখ তুলে নিভ্রর দিকে তাকায়। পরক্ষণে দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়। নিভ্র নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে।” বলে ভেতরে চলে যায়।

নবনী আগের ন্যায় খাবার বাড়তে থাকে। কিছুক্ষণ পর নিভ্র ফিরে এসে খেতে বসে।

-“তুমি খেয়েছো?” নবনীর দিকে না তাকিয়ে প্রশ্ন করে সে।

-“জি,না!”

নিভ্র কথাটা শুনে বিরক্ত বোধ করে। ওর সঙ্গে খেতে বসতে বলতে হবে এটা ভেবে তার বিরক্ত লাগছে। তবুও জোর করে বলে,
-“বোসো খেতে।”

বলতে দেরি নবনীর প্লেট নিয়ে খেতে বসতে দেরি হয়না। মনে হচ্ছে সে এতক্ষণ নিভ্রর জবাবের আশায় ছিল। এক সঙ্গে দু’জন খাচ্ছে। নবনী খাচ্ছে কম নিভ্রকে দেখে নিচ্ছে মন ভরে। এ দেখা যেন কখনোই শেষ হবে না। আধাঘন্টা পর খাওয়ার পর্ব শেষ হয়। নিভ্র এবার নবনীকে বাড়িতে ফিরে যেতে বলে। নবনী চুপি চুপি চোরের মতো বাড়িতে ফিরে। মেইন গেটের চাবি আগে থেকেই ছিল। যদি তার আব্বু জানতে পারে এত রাতে মেয়ে অন্যের বাড়িতে ছিল। বিরাট ঝামেলা বাঁধিয়ে দিবে। তাই চোরের পদ্ধতি অবলম্বন করা।
__________________
সকালে…….

নিভ্র হাতে গোলাপ ফুল নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রাগ, বিরক্ত দুটোই তাকে ঘিরে ধরেছে। কে সে? যে বার বার তাকে এভাবে গোলাপ ফুল দিয়ে বিব্রত করছে। মেজাজ চওড়া হয়ে আছে তার। তখনই জিনান তার বাইক নিয়ে এসে হাজির হয়। বাইক থেকে নেমে নিভ্রর দিকে তাকাতেই ফুলের ওপর নজর পড়ে। এগিয়ে আসতে আসতে মুচকি হেসে বলে,
-“আমার জন্য ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছিলি নাকি?”

-“প্রশ্নই আসে না।”

-“তাহলে কাউকে প্রপোজ করবি?”

-“কক্ষনো না।”

-“তাহলে?”

-“তোর স্মৃতিশক্তি হারিয়েছে।” বিরক্ত নিয়ে বলে।

-“কিহ! ওহ হ্যাঁ! মনে পড়েছে। সেই অচেনা ছেলেটি আবারও গোলাপ ফুল দিয়েছে নিশ্চয়ই?”

-“ছেলে কিভাবে বুঝলি?”

-“মেয়ে কিভাবে বুঝবো? আবার হিজড়াও হতে পারে।” দুষ্টু হেসে।

-“সেট-আপ!”

জিনান হাসতে থাকে। নিভ্র রাগী দৃষ্টিতে ফুলটির দিকে তাকায়। রাগ হচ্ছে ফুল দেওয়া আগন্তুক ব্যক্তির ওপর। লুকিয়ে ফুল দেওয়ার কারণ সে বুঝতে পারছে না। জিনান হেসে হেসেই বলে,
-“তুই যেমন, ফুল দেওয়া ব্যক্তিটিও ঠিক তেমনই হতে পারে। তাই তো কেউ কারো সামনে আসতে চাইছে না। তবে এই আড়াল থেকে ভালোবাসা আর ক’দিন। তুই পুলিশ, খুঁজে বের কর চোরকে। যে চুরি করে ফুল রেখে যায় তোর বাড়ির সামনে।”

-“খুঁজে তো বের করবোই। যখন তাকে পাবো না, চরম শাস্তি পেতে হবে তাকে।”

-“হ্যাঁ! সে রোমান্টিক শাস্তিযোগ্য!” মাথা দুলিয়ে বলে।

-“ইয়ার্কি বন্ধ কর। ভেতরে আয়।”

-“চল চল।”
.
.
.
#চলবে?

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১০+১১

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_ ১০
#সুমাইয়া মনি।

-“যারা সত্যিকারের ভালোবাসে, সত্যিকারের ভালোবাসা পায়, আসলে তারাই ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারে।ভালোবাসা মানুষকে পরিবর্তন করে, নতুন কিছুর স্বাদ দেয়, অভ্যাস করায়। একবার তনুজাকে মন থেকে ভালোবেসে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবি ভালোবাসা কী।” আদি এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে আপনের পানে তাকায়।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে আপনকে ভালোবাসার ব্যাথা বুঝানোর চেষ্টা করছিল আদি। কিন্তু আপন, সে বুঝতেই চাইছে না। আপন আদির ওপর থেকে নজর সরিয়ে নেয়। সামনের দিকে তাক করে বলে,
-“তুই তো কাউকে ভালোবাসিস না। ভালোবাসা নিয়ে এত ব্যাখ্যা কিভাবে দিলি?”

-“ভালোবাসলেই যে ভালোবাসার ব্যাখ্যা জানা থাকতে হবে। এমন তো কোনো কথা নেই। আমি তোর আর তনুজার ভালোবাসার কথা বলছি। একটা কথা বল। তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস বা পছন্দ করিস? ”

-“ফালতু কথা।”

-“কথার মধ্যে জ্বোল আছে।”

-“কিসের জ্বোল?” ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে আপন।

-“পঁচা জ্বোল!” মৃদু হেসে।

-“মজা নিচ্ছিস?” মেকি রাগ দেখিয়ে বলে।

-“হয়তোবা! ”

আপন ক্ষেপে যায়। মানুষকে বিরক্ত করা আদির জন্মগত অভ্যেস বলা চলে। পৈচাশিক আনন্দ মিলে তাতে। বিষেস করে আপনকে বিরক্ত করতে আদি ঢের মজা পায়। আপন কিছু বলে না। ইচ্ছে করছে না কথা বলছে। আদি বলে,
-“আপন, আমার কাছ থেকে এমন কিছু গোপন কথা লুকিয়ে রাখিস না। যাতে করে ভবিষ্যতে তোর কোনো সমস্যা হয়। ”

আপন কিছুক্ষণ থম মেরে রয়। পরক্ষণে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
-“এমন কোনো গোপন কথা থাকলে আমি অবশ্যই বলতাম।”

-“হলো না।” ঘাড়ে হাত রেখে বলে।

-“কী হলো না।”

-“জেনে বলছি।” বলেই প্রস্থান করে আদি। আপন বিরক্ত চোখে মুখে আদির যাওয়ার পানে তাকায়। সে ঠিক বুঝেছে, যাওয়ার আগে ওঁকে একটু বিরক্ত বানিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে সরু নিশ্বাস ছাড়ে।
———————-
সকালে জিনান নিভ্রর বাড়িতে আসে। চোখাচোখি হয়ে যায় নবনীর সঙ্গে। সে তখন গাছে পানি দিচ্ছিল। মুখ ঘুরিয়ে নেয় নবনী। জিনান চোখ পিটপিট করে প্রশ্নাতীত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নিভ্র তখন ইউনিফর্ম পড়ছিল।
জিনান ভেতরে ঢুকেই বিছানায় বসে পড়ে। নিভ্র জিনানকে দেখে অবাক হয়না। বরঞ্চ জিজ্ঞেস করে,
-“এত সকালে কী মনে করে আমার বাড়িতে আসলি?”

-“তোকে কিছু বলতে চাই।”

-“বল।”

-“মায়ার বিষয়।”

-“বল, আমি শুনছি।”

-“কাল মায়াকে….! সব ভাঙিয়ে বলে নিভ্রকে। নিভ্র ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় সব শুনে। জিনান থামে। নিভ্র হাতের ওয়াচ পড়তে পড়তে বলে,
-“লাভ সম্পর্কে আমার ধারণা অতি ক্ষুদ্র। কাঁচাও বলতে পারিস। আমি তেমন কিছু বলব না। শুধু বলব অপেক্ষা কর।”

-“যদি মিস কল না দেয়।” আহত কন্ঠে বলে।

-“ভাগ্যে নেই। ফরগেট ইট!”

-“এমন করে বলিস না, খুব লাগে।” বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলে।

নিভ্র স্মিত হাসে। জিনান জিজ্ঞেস করে,
-“নবন্ন আই মিন নবনী এখানে কেন?”

-“গাছে পানি দেওয়ার জন্য।”

-“পানি দিচ্ছে কেন গাছে?”

-“শাস্তি?”

-“কিসের?”

-“গাড়িতে বলব চল।” বলেই নিভ্র বের হয়। জিনান পিছু পিছু যেতে থাকে। নিভ্র গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে। জিনান ওঠে বসে। গাড়ি চালিয়ে গেট বরাবর এসে থেকে যায়। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে নিভ্র নবনীকে বলে,
-“পানি দেওয়া হলে গেট বন্ধ করে দিয়ে চলে যেও।”

-“জি, স্যার।” মাথা নত করে।

নিভ্র চলে যাওয়া ধরলে নবনী পিছন থেকে ডাক দেয়। বলে,
-“শুনুন স্যার।”

-“বলো।” ঘুরে পিছনে তাকিয়ে।

ইনিয়েবিনিয়ে মাথা চুলকিয়ে লজ্জা ভঙ্গিতে বলে,
-“কালকের জন্য স্যরি স্যার!”

নিভ্র সুনিয়ত চেয়ে রয়। সেকেন্ড কয়েক পর ছোট করে ‘হু’ উচ্চারণ করেই গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে গেট দিয়ে বের হয়। নবনী বড়ো নিশ্বাস ফেলে গেট লাগিয়ে দেয়।
.
-“মাথার মধ্যে প্রশ্ন ঘুরছে। উত্তর কী দিবি?”

-“বলছি..” নবনীর বিষয় সব খুলে বলে জিনানকে। সেই আগন্তুক ব্যক্তির কথাও বলে, যে রোজ গোলাপ ফুল দিয়ে যায় গেটের সামনে। আজ-ও দিয়েছিল। জিনান এক হাত জানালার সঙ্গে ঠেস দিয়ে বলে,
-“সব বুঝলাম। বাট ফুল দেওয়া ব্যক্তিটি কে? মেয়ে নাকি ছেলে?”

-“খুব শীঘ্রই জানতে পারব।”

-“হুমম!”

নিভ্র বলে,
-“নবনীতা এখনো ইমম্যাচিউর। বাচ্চামো স্বভাবগত।”

-“কিন্তু কাল যেটা বলেছে ও তোকে। তাতে মনে হচ্ছে সত্যি নবনী তোকে পছন্দ করে।”

-“সেটআপ! জিনান। কালকে ও আমাকে খেয়াল করে নি। কোনো ঘোরের মধ্যে ছিল। তাই বলেছে। হ্যাঁ! আমার রাগ হয়েছে। বাট পরে মানিয়ে নিয়েছি।”

-“এটাও বুঝলাম। বিয়ে-টিয়ে করবি না?”

-“দেরি হবে।”

-“পছন্দের কেউ আছে?”

-“নো ম্যান। আমি মেয়েদের প্রতি এতটা ইন্টারেস্ট নই।”

-“একদিন ঠিক হয়ে যাবি। যেদিন ভালোবাসার মানুষটিকে খুঁজে পাবি।”

-“সো, সেই দিন আসুক।”

-“এসে যাবে।”

-“ওকে।”

দু’জনের কথা বলার মাধ্যমে থানায় পৌঁছায়। কেবিনে না এসে লকাপে রাখা জায়রাকে দেখার জন্য যায়। সঙ্গে জিনান ও সে-ই দু’জন পুলিশ ছিল। রাতে ইলেকট্রনিক শক দেওয়া হয়েছে জায়রাকে। তবুও সে মুখ খুলে নি। সারারাত ঘুমাতেও দেওয়া হয়নি তাকে। নিভ্র ভেতরে এসে জায়রার মুখের দিকে তাকায়। কালকের উজ্জ্বল চেহারার মেয়েটিকে আজ মরা মরা লাগছে। মুখ শুকিয়ে কালো দেখাচ্ছে। পরিপাটি চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আদলে মাখোমাখো। এক কনস্টেবল নিভ্রর সামনে একটি চেয়ার এগিয়ে দেয়। চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে। জায়রা নিভ্রর উপস্থিতি টের পেয়েছে। অগ্নিমুখে নিভ্রর পানে তাকায় সে। নিভ্র বেশ শান্ত স্বরে বলে,
-“এক দিনে কি হাল হয়েছে আপনার। সব কিছু বলে দিলে এমনটা হতো না মিস.জায়রা।”

-“বলব না।” ক্রোধ কণ্ঠে বলে জায়রা।

-“সত্যিই বলবেন না?”

-“মরে গেলেও না।”

-“আপনার বাঁচার কোনো উপায় আমি দেখছি না। ” বলেই লেডি কনস্টেবলকে চোখের ইশারা করে। লেডি কনস্টেবলটি পিস্তল তাক করে জায়রার মাথা বরাবর। জায়রা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়। নরম হয়ে আসে সে। নিভ্র চোখে চোখ রেখে বলে,
-“বলব!”

নিভ্রর ঠোঁট তৃপ্তিময় হাসি ফুটে ওঠে। বলে,
-“এই তো বললেন, মরে গেলেও বলবেন না।”

রাগে ফুঁসছে জায়রা। নিভ্র ফের বলে,
-“টেল মি?”

গড়গড় করে জায়রা সব সত্যি বলে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভ্র তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মেইন সেই গ্যাংদের ধরার জন্য।
———————–
দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে মায়া। জিনানকে মিস কল দিবে কী, দিবে না। ভেবেই অস্থিরতা এসে জেঁকে বসেছে ঘাড়ে, সরে যাওয়ার নাম নিচ্ছে না। নবনী জুস খাচ্ছে সঙ্গে মায়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
সান্ত্বনা কম বিরক্ত বেশি হচ্ছে। একটা মিস কল দেওয়ার জন্য এত ভাবার কি আছে বুঝতেছে না সে। সকালে জিনানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা বলে মায়াকে। তেমন কোনো রিয়াকশন দেয় না মায়া।
নবনী বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বলে,
-“ক্লাসে যাবি, নাকি এখানেই বসে থাকবি?”

-“যাব!” ছোট করে উত্তর দেয়।

-“চল!” বলেই ওঠে দাঁড়িয়ে যায় নবনী। মায়া তখনো বসে থাকে। নবনী ফের বলে,
-“কী হলো?”

মায়া ওঠে দাঁড়ায়। নবনী মায়ার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“মায়া তোর মন যেটা বলে, সেটা কর। আমাকে দেখ। আমার যখন যা ইচ্ছে হয়, তখন তাই করি।”

-“তাহলে কল দিবো?”

-“যদি মন সায় দেয় তো!” দু কাঁধ উঁচু করে বলে।

মায়া পুনরায় ভাবতে আরম্ভ করে। নবনী হাত ধরে টেনে ক্লাস রুমে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর ঘন্টা পড়ে। ক্লাস শুরু হয় তাদের।
_____________
অন্যপ্রান্তে…

গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় নিভ্রকে হাসপাতালে আনা হয়। ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। ডান হাতের বাহুতে গুলি লেগেছে। রক্তে পুরো শরীর মাখোমাখো অবস্থা। পুলিশ ফোর্স নিয়ে আস্তানায় উপস্থিত হতেই আপর গ্যাংয়ের লোকরা টের পেয়ে যায়। অনবরত গুলিবর্ষণ করতে আরম্ভ করে নিভ্রদের ওপর। প্রায় অনেকের হাতে,পায়ে গুলি করে আহত করে নিভ্র। কিন্তু শেষ একটি গুলি এসে ডান পাশের বাহুতে লাগে তার। নিভ্র দূর্বল হয়ে যায়। তিনজন কনস্টেবল তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে। বাকিরা সেখানে থেকে তাঁদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। আহতদের হাসপাতালের উদ্দেশ্যে পাঠায়। ওটির ভেতরে ঢুকানো হয় নিভ্রকে। রীতিমতো অপারেশনও শুরু করা হয়েছে।
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_ ১১
#সুমাইয়া মনি।

তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছায় নবনী। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার। ঝাপসা চোখ জোড়া বার বার মুছে নিচ্ছে ওড়না দিয়ে। আশেপাশে সব কিছুকে উপেক্ষা করে সে কেবিনের দিকে দৌড়ে আসতে থাকে।
পথ যেন কমছে না। দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
সকালে গাছে পানি দিতে এসে তালা ঝুলানো দেখে বাড়িতে। টমি বাহিরে ছিল। বাগানের পাশে তার ছোট্ট ঘর আছে । নবনীকে দেখে এগিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে টমি বেশ খুদার্ত। টমির জন্য খাবার নিয়ে আসে বাসা থেকে। টমি দ্রুত খেতে শুরু করে। খুদায় এতটাই কাতর ছিল যে ক্যাথির দিকে আজ আর তাকানোর সময় হয়নি তার।
নবনী ভাবতে আরম্ভ করে, কখনোই তালা ঝুলানো দেখে নি। আজ হঠাৎ কি হলো? কোথাও গেলে তো বলে যেতো। তাহলে কি রাতে বাড়িতে ফিরে নি নিভ্র স্যার। আর ভাবে না। ডিরেক্ট কল দেয় নিভ্রর নাম্বারে। ফোন একবার বাজতেই পীক করে জিনান। তাঁদের মধ্যে কথপোকথন হয়। তখনই জানতে পারে নিভ্রর গুলি লাগার ব্যাপার। বাকরুদ্ধ সে। থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরে আসে। হাউমাউ করে কেঁদে নিলুফা বেগমকে বলে। সে দ্রুত হাসপাতালে যেতে বলে।

ঘোলাটে চোখে জিনান সহ আরো কিছু পুলিশকে নজরে পড়ে নবনীর। সে কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়েই উত্তেজিত হয়ে জিনানকে প্রশ্ন করে,
-“এখন কেমন আছে স্যার? ডাক্তার কী বলেছে? সুস্থ হয়ে যাবেন তো তিনি?”

-“শান্ত হও নবনী, নিভ্র এখন ঠিক আছে। ঘুমোচ্ছে। গুলি বের করা হয়েছে। খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে।”

জিনানের কথা শুনেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। চোখ পিটপিটে বলে,
-“ভেতরে যেতে পারব কী?”

-“ডাক্তার ভেতরে যেতে এলাউ করছে না।”

মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় তার। তবুও এই ভেবে সে শান্ত হয় নিভ্র ঠিক আছে। পাশের একটি সিটে বসে চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে শুকরিয়া আদায় করে। ভয়টা তার একটু হলেও কেঁটেছে।
পুলিশদের আনাগোনা আরো বেড়ে যায়। কেউ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে, আবার কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে জিনানের সঙ্গে আলাপনে ব্যস্ত। নবনীর মাথায় হঠাৎ নিভ্রর পরিবারের কথা খেয়াল আসে। এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটল অথচ, নিভ্রর পরিবারের কাউকে দেখতে পেল না। বেশ ভাবাচ্ছে ওঁকে। পুলিশরা জিনানের সামনে থেকে সরে যেতেই পুনরায় নবনী তাকে জিজ্ঞেস করে,
-“নিভ্র স্যারের পরিবারের কোনে সদস্য এলো না কেন ভাইয়া?”

-“তাদের জানানো হয়নি। নিভ্রর কঁড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।”

-“কেন?”

-“কাউকে টেনশনে ফেলতে চায় না। আর এমনেতেও এটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও কয়েকবার আহত হয়েছে। তখনো কিছু বলে নি তাদের। সুস্থ হবার পর জানিয়েছে।”

নবনী চুপ মেরে রয়। কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। এত বড়ো একটি ঘটনা ঘটে গেল, অথচ তাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করছে না। শুধু মাত্র তার জন্য চিন্তিত হবে তাই? বিষয়টি কেমন বেমানান লাগছে নিজের কাছে। কী অদ্ভুত লোক নিভ্র!

দু তিন ঘন্টা অতিবাহিত হয়। এগারোটার দিকে নিভ্রর ঘুম ভাঙ্গে। প্রথমে কয়েকজন পুলিশরা তার সঙ্গে দেখা করে। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ চলে তাদের মধ্যে। সবাই যাওয়ার পর, শেষে জিনান আর নবনী যায় নিভ্রর সঙ্গে দেখা করতে। নিভ্রর হাতে ক্যানেলা লাগান। বেডের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে। নিভ্র নবনীকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু সেটা তাদের বুঝতে দেয় না। নবনী নিভ্রর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিচুস্বরে বলে,
-“আপনি এখন কেমন আছেন স্যার?”

-“আলহামদুলিল্লাহ! ভালো ফিল করছি।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রয়। পরক্ষণে দ্বিধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন করে,
-“কিভাবে হলো এসব?”

-“আচমকাই ঘটে গেল। তুমি কী একা এসেছো এখানে?”

নবনী মাথা উপর নিচ নাড়ায়। নিভ্র ফের বলে,
-“এখন তাহলে বাড়িতে যাও। টমিকে কিছু খাবার খেতে দিও। আর তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সকালের নাস্তা করো নি। ”

নিভ্রর কথায় নবনীর মনে পড়ে সকালের নাস্তার কথা। আসলেই সে নাস্তা না করেই এখানে চলে এসেছে। নিভ্রর কথা শুনেই সে টেনশনে বিদিক হয়ে গিয়েছিল। যার দরুণ নাস্তা করা হয়নি তার।

-” যাও নবনীতা!” কিছুটা জোরেই বলে ফেলে নিভ্র।

নবনী চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি নিচু রেখে মিনমিন করে বলে,
-“যাব! কিন্তু আমি কী আপনার সঙ্গে থাকতে পারি বিকালে?”

-“কোনো প্রয়োজন নেই। জিনান আছে। ও থাকবে আমার সঙ্গে।”

নবনী আর কিছু বলে না। নিভ্র যখন একবার বলে দিয়েছে, তখন তার কথায় কোনো নড়চড় হবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। জিনান পাশের টুল টেনে বসে। বলে,
-“এখন কেমন লাগছে তোর? হাতে কী ব্যথা করছে?”

-“আই এম আল রাইট! বাট সল্প ব্যথা আছে।”

-“ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভাবছি আন্টিকে বলব…. ”

-“খবরদার! ভুলেও এ কাজ করিস না। আম্মুর সঙ্গে পরশুদিন রাতে কথা হয়েছে আমার। তারপর আর কথা হয়নি। আমার ফোন দে কথা বলি।”

জিনান ওর পকেট থেকে নিভ্রর ফোন বের করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ ওর আম্মুর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে। দুর্ঘটনার পুরো বিষয়টি চেপে যায়। এখন সে ডিউটিতে আছে, মিথ্যে বার্তাটি বলে তাকে। সে-ও সেটি বিশ্বাস করে নেয়। যাকে বলে অন্ধবিশ্বাস!
কথা শেষ করে ফোন পাশে রেখে দেয় সে। জিনান বলে,
-“এক্টিং ভালোই পারিস। বাই দ্য ওয়ে, নবনীকে আসতে বল।”

-“মাথা নষ্ট।”

-“কেন সমস্যা কী? আমি তো এখন থাকতে পারছি না দোস্ত। আমাকে মায়ার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।”

-“মায়া ফোন দিয়েছে?”

-“হ্যাঁ! সম্মতি পেয়েছি।”

-“যাক ভালো। তুই যা! কিছু দরকার পড়লে নার্সদের ডেকে নিবো।”

-“আমি যাব এবং নবনীকেও পাঠিয়ে দেবো।”

-“নাহ!”

-“বলতে হবে না তোকে। শুয়ে থাক। আমি গেলাম।” বলেই ওঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় জিনান। নিভ্র অস্বস্তিকর নিশ্বাস ত্যাগ করে। নবনী মানেই অস্বস্তি! কেন যে ওঁকে মেনে নিতে পারছে না, অজানা!
__________________
অনেকক্ষণ যাবত তনুজা একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে। মূলত সে আপনের জন্য অপেক্ষা করছে। আজকে আপনের জন্মদিন। তাই সে আপনকে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলে। যাতে আপনের জন্মদিনটি সে উৎযাপন করতে পাবে। আজ তাদের ফাস্ট মিটও বলা চলে। তাই তনুজা একটু বেশিই এক্সাইটেড! সই একটার দিকে আপন রেস্টুরেন্টে এসে হাজির হয়। প্রথম টেবিলেই তনুজা বসে ছিল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে অপরাধী স্বরে মৃদু হেসে বলে,
-“স্যরি! লেট করে ফেললাম।”

-“ইট’স ওকে।” মিষ্টি করে হেসে বলে।

আপন ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলে,
-“লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। কি খাবেন বলুন?”

-“আগে কেক কেটে নিন, ওয়েটার!” বলেই ওয়েটারকে ডাকতে লাগলো।

একজন ওয়েটার এক পাউন্ডের চকলেট কেক নিয়ে এসে টেবিলে রেখে যায়। সঙ্গে কোঁকা কোলা। তনুজা হাতের ছুরিটা এগিয়ে দেয় আপনের দিকে। মোমবাতি বিহীন কেকটি কেটে তনুজাকে খাইয়ে দেয়। তনুজাও এক পিস নিয়ে আপনকে অল্প করে খাওয়ায়। দু’জনেই লাঞ্চ করতে করতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে।
———————
একটা পনেরো মিনিটে নবনী হাসপাতালে পৌঁছায়। জিনান ওঁকে ফোন দিয়ে হাসপাতালে আসতে বলে, নবনী অনেক খুশি হয়। তাই দ্রুত গোসল করে নামাজ পড়ে কোনোমতে খেয়েই রওয়ানা হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার সময় নিলুফা বেগল বলে দেয় সে বিকালে যাবে নিভ্রকে দেখতে। এতে নবনীর আপত্তি নেই। সে আসুক যে কোনো সময়৷ কেবিনে প্রবেশ করতেই নবনীর মেজাজ তুঙ্গে ওঠে যায়। যখন দেখতে পায় একজন নার্স টিস্যু দ্বারা নিভ্রর মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। সে আইডিয়া করে নেয়, নার্সটি ঠিক নিভ্রকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। কারণ ট্রেতে এঁটো খাবারের বাটি,প্লেট ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়। নিভ্রর দিকে কোনো মেয়ে তাকিয়ে থাকুক, সেটা সে কিছুতেই মেনে নিবে না। আর এদিকে নার্সটি কি-না ওঁকে খাইয়ে দিয়েছে। ভেবেই নবনীর মাথায় রাগ চড়ে বসে। নিভ্র নবনীকে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মনে মনে জিনানের ওপর বেশ বিরক্ত হয়। পরে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দাঁড়িয়ে আছো কেন নবনীতা? ভেতরে এসো।”

নিভ্রর কথা শুনে নবনী নিজেকে কিছুটা প্রকৃতিস্থ করে। নার্সটিও নবনীর দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। নার্স ট্রে হাতে বেরিয়া যাওয়ার ধরছিল। নিভ্রর আগচরে নবনী নার্সটির দিকে তাকিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়েই নবনী ল্যাং মেরে নার্সটিকে ফেলে দেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে নার্স। হাতের ট্রেটি ফ্লোরে পড়ে ঝনঝন শব্দ হয়। নিভ্র একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। ফোন টিপতে থাকে। নিভ্রর সামনে মানবতার খাতির দেখিয়ে নার্সটিকে ধরতে যায় নবনী। না বুঝার ভান ধরে বলে,
-“একটু দেখে হাঁটবেন তো। দেখলেন তো অবশেষে কি হলো। উঠুন!” বলেই নার্সটিকে টেনে তুলে। অপমানে নার্সটির মুখ থমথমে হয়ে যায়। হওয়াটা স্বাভাবিক। নিভ্রর মতো সুদর্শন যুবকের সামনে এভাবে পড়ে যেতে হবে। সেটা সে মেনে নিতে পারছে না। অবশ্য, এতে তার কোনো দোষ ছিল না। না সে ইচ্ছে করে পড়েছে। তাকে ফেলা হয়েছে। ল্যাং মেরে!

ট্রেতে সব কিছু পুনরায় উঠিয়ে দেয় নবনী। নার্স ট্রে হাতে নিয়েই দ্রুত প্রস্থান করে। নবনী মনে মনে বেশ আনন্দিত। চরম ভাবে শায়েস্তা হয়েছে সে। এগিয়ে এসে দৃষ্টি নিচু রেখে টুলে বসে। রুমে শুধু তারা দু’জন উপস্থিত। নার্ভাস লাগছে নবনীর। নিভ্র ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন কনস্টেবলের মেসেজ পড়ছে। যেটা কনস্টেবলটি একটু আগে সেন্ড করেছে। হঠাৎ নবনীর দিকে তাকায়। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
-“আমি দেখেছি নবনীতা!”

চট করে মাথা তুলে নিভ্রর দিকে তাকায়। চোখেমুখে তার বিস্ময়! নিভ্রর নজর শান্ত এবং ফোনের ওপর। ছোট একটা ঢোক গিয়ে। নিভ্র কী দেখার কথা বলছে, সেটা নবনীর বুঝতে অসুবিধা হয়না। ভয়তে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে তার। আজ কপালে শনিরদশা আছেই, শিওর! ধুর! কেন যে ল্যাং মারতে গেল। ভেবেই সে নিজের ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

Sumaiya Moni

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-০৯

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_ ৯
#সুমাইয়া_মনি।

পানির ছিটা পড়তেই জায়রার হুঁশ ফিরে। চোখ পিটপিট করে মেলে চারদিকে তাকায়। একটু মাথায় জোর দিতেই মনে পড়ে যায় সকালের ঘটনা। আর এখন রাত। ওঠে বসে। সামনে দু’জন লেডি কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছে। একজন হাঁকিয়ে ‘স্যার’ বলে ডাক দেয়। এক মিনিট অতিবাহিত হতেই নিভ্র দু’জন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। জায়রা ততক্ষণে ওঠে বসতে সক্ষম হয়। নিভ্রকে দেখা মাত্রই রাগ চড়ে বসে তার। নিভ্র জায়রার মুখোমুখি চেয়ারে বসে। পায়ের উপর পা উঠিয়ে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তীক্ষ্ণ নজর ফেলে বলে,
-“প্রচুর ঘুমিয়েছেন মিস.জায়রা। এবার আমাদেরও একটু ঘুমাতে সাহায্য করুন।”

জায়রা নিভ্রর কথার তাৎপর্য ঠিক বুঝতে পারে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,
-“আমি কিছু বলতে পারব না।”

-“না বললে, আমরা চেন সে ঘুমাবো কী করে মিস.জায়রা।”

জায়রা মুখ ঘুরেই রাখে। কিছু বলে না। নিভ্র পকেট থেকে রুমাল বের করে সানগ্লাস মুছতে মুছতে ফের বলে,
-“হাতে সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি বলে ফেলুন। ওকে, আপনাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। টাইম স্ট্রাট নাউ..”

জায়রা নিভ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে ওঠে,
-“বৃথা চেষ্টা।”

-“তাহলে আর কি করার। লেডি কনস্টেবলরা আপনার একটু খাতির যত্ন করুক।” বলেই ওঠে চলে যায় নিভ্র, সঙ্গে পুলিশ দু’জনও। লেডি কনস্টেবল দু’জন জায়রাকে ঘিরে দাঁড়ায়। জায়রার মুখ শুঁকিয়ে আসে। বুঝতে পারে সে এবার চরম ভাবে ফেঁসে গেছে।

নিভ্র বাহিরে বের হয় দু’জন পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে।
-“কঁড়া নজর রাখবে। যদি সে স্বীকার করতে প্রস্তুত হয় তখনই আমাকে ইনফর্ম করবে।”

-“ইয়েস, স্যার।”

নিভ্র গাড়িতে ওঠে বসে। থানা থেকে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
.
নবনী জিনান ও মায়ার কথা ভাবছে। ক্যান্টিনে বসে মায়া জিনানের বলা সব কথা খুলে বলে। শুনে প্রথমে নবনী একটু ক্ষেপে গেলেও পরে মায়ার কিছু কথা শুনে নিজেকে শাস্ত করে। আসলে তারা যতোটা খারাপ ভাবছে জিনানকে। সে ততটাও খারাপ নয়। এটা তার তারা বুঝতে পারে। এসবকে ছুঁটে ফেলে নবনীর নিভ্রর কথা মনে পড়ে। তখনই মনে প্রেমের ঘন্টি বেজে ওঠে। মুখে গান গেয়ে নাচতে নাচতে রুম থেকে ড্রইংরুমে বের হয়।

-“আমি তোমার মনের ভেতর, একবার ঘুরে আসতে চাই। আমায় কতটা ভালোবাসো সে-ই কথাটা জানতে চাই। ভালো,,ভালো….।” গান গাইতে গাইতে সোফায় বসে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে নবনী। আর তখনই মাথা তুলে ওপরে তাকাতেই গানের বাকি লাইন বলা বন্ধ হয়ে যায়। কেননা, নবনী গান ও নাচতে এতটাই ব্যস্ত ছিল ড্রইংরুমে যে কেউ উপস্থিত আছে সেটা খেয়াল করার সময় টুকুও হলো না। বসেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল নিভ্রর কোলে। নিভ্র অবাক চোখে নবনীকে দেখছে। কিছু বলার ভাষা আপাতত তার মাথাতে নেই। নবনী সে তো স্বপ্ন মনে করে নিভ্রর পানে চেয়ে আছে। একজনের চোখেমুখে বিস্মিত ভাব, আরেক জনের চোখে এক সাগর ভালোবাসা! নবনী মিষ্টি হেসে নিভ্রকে দেখতে দেখতে বলে ওঠে,
-“আমি আপনাতেই আসক্ত!”

-“হোয়াট?” বলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে দাঁড়ায় নিভ্র।

চট নেশা কেঁটে যায় নবনীর। যে নেশা একটু আগে নিভ্রকে দেখার পানে হয়েছিল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছে নবনী। স্বপ্ন নাকি সত্যি! বুঝতে অসুবিধা হয়না এখন। তার মানে এতক্ষণ নিভ্রর কোলে মাথা রেখে বলেছিল, ভাবতেই নবনীর লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসে। নিভ্রর চাহনি তখনি নবনীর ওপর স্থির। নবনী হাত জাগিয়ে উৎকন্ঠে বলে,
-“স্যরি,স্যরি স্যার।” বলেই বো দৌড় রুমে। ঠাস করে দরজা লাগিয়ে বিছানার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। লজ্জায় বিড়বিড় করে শীট! শীট! বলছে।

এদিকে নিভ্রর কানে এখনো নবনীর বলার কথাটি প্রতিধ্বনি হচ্ছে। অস্বস্তিকর লাগছে তার।
একদিন পর পর খাবার পাঠানোর জন্য নিভ্র মিসেস.নিলুফা বেগমের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন। এই কলোনিতে সে-ই একমাত্র ব্যক্তি, যে নিভ্রকে কিছু না কিছু রেঁধে পাঠায়। মূলত সেটা নিষেধ করার জন্য তার আজ এখানে আসা। নিভ্র উপস্থিত হতেই চা বানাতে চলে যায় নিলুফা বেগম। আর ততক্ষণেই ঘটে যায় এমন কাণ্ড। নিভ্রর কেমন অদ্ভুত লাগছে। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের স্পর্শে যায় নি। নবনীর কোলে মাথা রাখার দৃশ্য চোখে ভাবসেই কেমন অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরছে। সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সোজা বাহিরে আসে। কয়েকবার বড়ো নিঃশ্বাস নিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে।

নিলুফা বেগম রান্নাঘর থেকে চা-নাস্তা নিয়ে এসে দেখে নিভ্র নেই। নিয়ানও এখানে বসা ছিল না।তাই ওঁকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই নিভ্র কথা। হুট করে নজর পড়ে নবনীর রুমের দিকে। দরজা বন্ধ। কিন্তু এতক্ষণ ঠিক খোলা ছিল। হয়তো ও নিশ্চয় জানে নিভ্র না বলে কেন চলে গেল। সে এগিয়ে যায় নবনীর রুমের দিকে। দরজায় করাঘাত করে।
নবনী দরজার আঘাত শুনেই লজ্জা ফেলে ওঠে এসে দরজা খুলে দেয়। নিলুফা বেগম ভেতরে এসেই জিজ্ঞেস করে,
-“নিভ্র কোথায়?”

-“এই যে আমার চোখের ভেতরে।” বলেই এক চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।

নিলুফা বেগম নবনীর মাথায় গাঁট্টা মেরে বলে,
-“ফাজলামো করছিস?”

-“ফাজলামো তুমি করছো আমার সঙ্গে। ” বলেই কোমড়ে হাত রাখে নবনী।

-“কখন?”

-“নিভ্র স্যার আমাদের বাসায় এসেছে। সেটা আমাকে আগে বলো নি কেন?”

-” বললে কি তুই চা-নাশতার জোগার করে দিতি?”

-“দিতাম।”

-“এহহ! কুইরা মাতারি।” ভেংচি কেটে বললেন।

-“ভেঙ্গাবা না। একটু আগে কত বড় কেলেংকারী ঘটিয়ে ফেলেছি আমি জানো না।”

-“কেলেংকারী তোর কাছে এসেছে, নাকি তুই নিজে কেলেংকারীর কাছে গিয়েছিলি?” ভাবার ভঙ্গিতে বলেন।

-“কথা পেঁচানো কেউ তোমার কাছ থেকে শিখুক।”

-“নবনী।”

-“এত কথা পেঁচাও ক্যা’রে মা…।” মাথায় হাত দিয়ে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল।

-“বল কী কেলেংকারী করেছিস? আর নিভ্র কেন চলে গেল?”

-“কিছুক্ষণ আগে…..” সব খুলে বলে নবনী। মায়ের সামনে সে নিজেও লজ্জা মাথা চুলকাতে আরাম্ভ করে।

নিলুফা বেগম অবাক হয়ে গালে হাত রেখে বলে,
-“এত সুন্দর সিন আমার সামনে পড়ল না।”

-“যাও, তুমিও না আম্মু।” ন্যাকামো করে বলে নবনী।

-“থামা তোর ন্যাকামি। সত্যি করে বল তোর মনে কী চলছে?” ধমকের স্বরে বলে।

-“আমার মনে নিভ্র নিভ্র চলছে আম্মু।” বুড়ো আঙ্গুলের নখ খুঁটে বলে নবনী।

-“পছন্দ নাকি ভালোবাসা?”

-“দুটোই। ”

-“যাক শুনে খুশি হলাম।” কিছুটা নাক ছিটকানো ভঙ্গিতে বলেন।

-“সত্যি।” খুশি মুডে।

-“এত খুশি হোস না। আমি খুশি হয়েছি এই কারণে। নিভ্রর মতো একজন ছেলে তো জীবনে এসে কুইনের গুঁতো দিয়ে তোকে সোজা করুক।”

-“ভালো দোয়া করতে কী ডাক্তারের নিষেধ আছে?”

-“তোর জন্য এই দোয়াই আসে মন থেকে। যাই হোক, পড়াশোনার পাশাপাশি চালিয়ে যা, আমি সঙ্গে আছি। তবে, রেজাল্ট যেন ঠিকঠাক থাকে। নাহলে পিঠের ছালা সরিয়ে দেবো, পিটানোর দায়িত্ব তোর আব্বুর।”

-“ঝুলেছি!” চোখ বন্ধ করে মাথা একটু নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে বলে।
নিলুফা বেগম নবনীর মাথায় শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে গুঁতো দিয়ে বলে,
-“বুঝেছি হবে, ঝুলেছি না।”

-“থুক্কু।” দাঁত বের করে হেসে।

-“হুম।” বলেই সে চলে যায়। নবনী খুশিতে বিছানার উপর ফের ঝাপিয়ে পড়ে। একটি বালিশ জড়িয়ে ধরে নিভ্রর সঙ্গে ঘটে যাওয়ার ঘটনা ভাবতে থাকে।
_______
নিভ্র ঝর্ণা ছেড়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। একটু আগে ঘটে যাওয়ার কথা ভাবছে। অজানা রাগ এসে জেঁকে বসেছে তার মাথায়। সে যেমন শান্তশিষ্ট, তেমনই প্রচণ্ড রাগী। কথায় আছে শান্ত মানুষরা ক্ষেপে গেলে দুনিয়া এক করার ক্ষমতা রাখে। নিভ্ররও ঠিক তেমনই ফিল হচ্ছে। শাওয়ার নেওয়ার ইচ্ছে না থাকাও, রাগের বশে নিতে হচ্ছে। আজকাল নবনীকে নিভ্রর একদমই সহ্য হয় নয়। কারণ নিভ্রর অজানা। বেশ কিছুক্ষণ শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে বাহিরে।
রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ভাইব্রেশনে থাকা ফোনটি কাঁপতে থাকে। স্ক্রিনে তাকাতেই বুঝে যায় কে কল দিয়েছে। নাম্বারটি তার চিরচেনা অতি আপন মানুষটির। পীক কথা কথা বলে সে।
.
.
.
#চলবে?

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-০৮

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_৮
#সুমাইয়া_মনি।

-“স্যার মেয়েটি কে?” নিভ্রকে দেখা মাত্রই ক্রোধ নিয়ে বলে ওঠে নবনী।

নবনীর কন্ঠে এমন রাগ আজ প্রথম নয় এর আগেও দেখেছে। কিন্তু আজকের রাগ যেন অন্য কিছু বলছে। জিজ্ঞেস নয় আদেশ করছে। চোখেমুখে এক রাশ চিন্তিত ছাপ। নিভ্র মাত্রই কফি বানিয়ে কিচেন থেকে বাহিরে এসেছে। আর তখনই নবনীর তীক্ষ্ণত্ব কন্ঠের স্বর শুনে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
-“সে একটি মিসিং কেস নিয়ে এসেছে। আপাতত সে আমার গেস্ট হিসেবে পরিচিত।”

শুনে বুকের ভেতর থেকে যেন ভারী পাথরটা সরে গেল নবনীর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নীরবে। নিভ্র ফের নবনীর উদ্দেশ্যে বলে,
-“গাছে পানি দেওয়া শেষ?”

-“জি!”

-“কলেজে যাও।”

-“আচ্ছা।” বলেই মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে প্রস্থান করে।

নিভ্র এবার মেয়েটির দিকে তাকায়। বলে,
-“মিস.জায়রা আপনি বসুন।”

জায়রা বসে। সে নিভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আপনি কি থানায় গিয়ে কেইস ফাইল করবেন?”

-“জি,আপনি কিছুক্ষণ বসুন। কফি খা’ন, আমি রেডি হয়ে আসছি।”

মাথা দুলিয়ে সায় দেয় জায়রা। নিভ্র তার কক্ষে এসে দ্রুত রেডি হয়ে নেয়। আজ ব্রেকফাস্ট অফিসে করবে। কিছুক্ষণ পর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে থানার উদ্দেশ্যে। নবনী মাঝ রাস্তায় নিভ্রর গাড়ি দেখতে পায়। কেন জানি ওর মনটা খচখচ করছে। আনমনে হেঁটে চলেছে সে।
.
গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে।হঠাৎ মাঝ পথে জায়রা তার ব্যাগ থেকে পিস্তল ফের করে নিভ্রর দিকে তাক করে ধরে। বলে,
-“চালাকি তো করবেনই না অফিসার। তাহলে আমার পিস্তলের একটা গুলি, আর আপনি সোজা ওপরে।”

নিভ্র হেসে ফেলে। সামনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-“পিস্তল বের করতে একটু দেরি করে ফেললেন না মিস.জায়রা। আরো আগে বের করা উচিত ছিল।”

ভ্রু কুঁচকে ফেলে জায়রা। নিভ্রর কথার ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, পিস্তল তাক করাতেও তার কিচ্ছু যায় আসে না। মনে হচ্ছে সে আগে থেকেই এমন আলামত পেয়েছিল। জায়রাকে এভাবে থম মেরে বসে থাকতে দেখে নিভ্র শব্দ করে হাসে। বলে,
-“প্রশ্ন জানছে মনে?”

জায়রা কিছু বলে না। চুপ করে রয়। নিভ্র তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,
-“ক্রিমিনালদের চোখে মায়া থাকে না। আপনার চোখ দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি। সেথায় মিথ্যের সাগর বইছে।”

-“বাহ! পুলিশ অফিসারের তো দেখছি ভালোই গুন আছে। তবে এখন আর কোনো লাভ নেই।”

নিভ্র ফের জায়রার কথায় অবজ্ঞাসূচক হাসে। এ হাসি যেন বলে দিচ্ছে নিভ্রর শান্ত ভঙ্গির মধ্যে থাকা বিস্তৃত হিংস্রতার ছলাকলা। কিলিং লুক নিয়ে জায়রার চোখের দিকে তাকিয়ে সানগ্লাস পড়ে। তারপর ঠোঁট কুঞ্চিত করে জিভের সাহায্যে শিস বাজাতে আরম্ভ করে।
এরি মাঝে জায়রার চোখ আস্তেধীরে ঝাপসা হয়ে আসছে। মাথা ঘুরছে। পিস্তল পড়ে যায় হাত থেকে। সে নিজেও ঢলে পড়ে সিটে। অজ্ঞান হয়ে যায় জায়রা নামের অচেনা মেয়েটি। নিভ্র এক নজর তাকিয়ে বাঁকা হেসে মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।
আগে থেকেই নিভ্রর জানা ছিল মেয়েটি ছদ্মবেশে অন্য কোনো মতলবে এসেছে। এভাবে এত সকালে কেউ কেন নিভ্রর বাড়িতে আসবে, তাও মিসিং কেস নিয়ে। আগেই সে আইডিয়া করেছিল, কোনো আগন্তুক শত্রু তাকে মারার জন্য বা ফাঁদে ফেলার উদ্দেশ্যে প্লান করে পাঠিয়েছে তাকে। যেটা বুঝতে নিভ্রর অসুবিধা হয় না। তাই তো নিভ্র নিজেও মাথা খাঁটিয়ে চাল চালে। কফির মধ্যে এমন এক মেডিসিন মিশিয়ে দেয় যার ইফেক্ট দশ-পনেরো মিনিট পর কাজ শুরু করে। নিভ্র জায়রার আসল উদ্দেশ্য জেনেও চুপ ছিল। শুধু অজ্ঞান হবার অপেক্ষা করছিল। আর সে সফল হয়।
.
.
মায়া নবনীর জন্য কলেজের বাহিরে অপেক্ষা করছিল। দশ মিনিট আগে ফোন দিয়ে বলেছে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। কিন্তু এখনো না আসার কারণে এখন তার অপেক্ষা করতে হচ্ছে। কঁড়া রোদ। ভ্যাপসা গরম অনুভব করছে। বার বার ওড়না দিয়ে বাতাস করছে। বিরক্ত মায়া।

-“হাই!” বলে কিউটি স্মাইল দিয়ে মায়ার সামনে এগিয়ে আসে জিনান।

মায়া জিনানকে দেখেই অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে আসে জিনানের। তবুও সে আগ বাড়িতে মায়ার সামনে এসে বলে,
-“আমাকে দেখে রাগ হচ্ছে না-কি বিরক্ত?”

-“দুটোই!” অকপটে বলে ওঠে মায়া।

-“স্যরি বললে কী রাগ,বিরক্ত ভেনিস হবে?” সুন্দর করে গুছিয়ে কথাটা বলে মায়ার চোখের পানে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।

মায়া জিনানের দিকে একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে বলে,
-“এখানে কেন এসেছেন?”

-“আমার উত্তর কিন্তু এটা নয়। প্রশ্ন আমি আগে করেছিলাম।”

মায়া বিরক্তিতে মুখ থেকে ‘চ’ উচ্চারণ করে। একে তো নবনীর খবর নেই, তার ওপর গরম। আবার এর মধ্যে হাজির হয়েছে জিনান। সব মিলিয়ে মায়া বিরক্তিতে মাখোমাখো।
উত্তর না দিয়ে চুপ থাকতে দেখে জিনান ফের বলে ওঠে,
-“বিরক্ত হচ্ছেন বুঝতে পেরেছি। আমি কিছু কথা বলেই চলে যাব।”

মায়া এবারও উত্তর দেয় না। দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না। জিনান নিজেই বলে,
-“সেদিনের জন্য স্যরি। আমি দ্বিতীয় বার আপনাকে থানায় দেখি। আমার ভালো গেলে যায় আপনাকে। ভালোবাসার মধ্যে আমি যাব না। ডিরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনি কী আমাকে বিয়ে করবেন?” শীতল একটি বাতাস যেন মায়ার শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায়। বুকের মাঝে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। বেশ ক’জন ছেলের কাছ থেকে সে প্রপোজ পেয়েছে। কিন্তু আজ কোনো ছেলের মুখ থেকে বিয়ের প্রস্তাব পাবার অনুভূতি সে কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছে না। সরু চোখে চেয়ে রয় জিনানে পানে। মৃদু হেসে জিনান ফের বলে,
-“এভাবে তাকাবেন না। আমি সত্যি আমার অর্ধাঙ্গিনী বানাতে চাইছি আপনাকে। ভেবে বলবেন। নাম্বার এই ভিজিটিং কার্ডে আছে। কল দেওয়ার দরকার নেই। যদি আপনি রাজি থাকেন জাস্ট একটা মিসড কল দিবেন। আমি হ্যাঁ সংকেত পেয়ে যাব। আর যদি একান্তই না বলে দিতে চান, তবে নো ডিরেক্ট কল, নো মিসড কল, নো টেক্সট। আমি আপনার জীবন থেকে সরে যাব। আর কক্ষনো আমি আপনার সামনে আসব না। ভালো থাকবেন।” কার্ডটি মায়ার হাতে গুঁজে দিয়ে জিনান জায়গা প্রস্থান করে। যতক্ষণ না আড়াল হচ্ছে ততক্ষণ মায়া জিনানের যাওয়ার পানে চেয়ে রয়। কোনো এক ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে।

আচমকাই সজোরে নবনীর থাপ্পড় পড়ে মায়ার পিঠে। ঘোর কেটে যায় মায়ার। নবনীর দিকে তাকিয়ে প্রচুর ঘামছে সে। নবনী টেরা চোখে তাকায়। বলে,
-“হলো কি? ”

-“বি..বিয়ে..” কাঁপা স্বরে আনমনে বলে মায়া।

-“কী! বিয়ে?..”

মায়া চোখ পিটপিটয়ে নবনীর দিকে তাকায়। বলে,
-“তুই ক্যান্টিনে চল বলছি।” হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল মায়া।
————————-
-“আপনি কী আমার সঙ্গে কথা বলতে বিরক্ত বোধ করছেন?” তনুজা নরম স্বরে প্রশ্নটি করে বসে আপনকে।

আপন ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে,
-“আসলে আমি একটু ব্যস্ত আছি। তাই পরে কথা বলি?”

-“ঠিক আছে। ফ্রি হলেই আমাকে কল দিবেন।”

-“শিওর!” বলেই তনুজার আগে আপন ফোন কেঁটে দেয়। স্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস ফেলে পাশের বইটি নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে সে।

-“এই তোর ব্যস্ততা?” অকপটে বলে আদি। নজর তার ফোনের ওপর।

আপন বইয়ের ভাঁজে হাত রেখে বিরক্ত স্বরে বলে,
-“বললাম তো আমার ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না।”

-“কেমন পুরুষ তুই? বিয়ের আগে সবাই হবু বউয়ের সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত থাকে। আর তুই কি-না কথাই বলতে চাইছিস না।”

-“সবার সঙ্গে মিলালে তো হবে না। এখন কথা বলিস না বই পড়তে দে আমাকে।”

-“লুস।”

-“আদি!”

-“হুম।”

-“আমি ঢিলা না।”

-“ঢিলা কখন বললাম।”

-“একটু আগে ইংরেজিতে লুস বলেছিস।”

-“লুস বলেছি, ঢিলা তো বলি নি।”

-“একই তো হলো।”

-“ব্রো, আমি লুস তোকেই বলেছি সেটা তুই কি কর বুঝলি?”

-“কথা বাড়াস না আদি।” বিরক্ত স্বরে।

-“অভ্যেস তোর, আমার না।”

-“ইডিয়ট!”

-“থ্যাংক’স!”

আপন আর কিছু বলে না। রেগে বইয়ে ভাঁজে মুখ ডোবায়। আদি একবার আপনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফোনের স্ক্রিনে তাকায়। আপনকে ছোট্ট টর্চার করল তখন মিথ্যে কথা বলার জন্য। যেটা আপন বুঝতে পারেনি।
.
.
.
#চলবে?

আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-০৭

0

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_৭
#সুমাইয়া_মনি।

শিশির ভেজা প্রকৃতির আস্তরণ ভেদ করে সূয্যিমামা আলাে ছড়ায়। সকালের মিষ্টি রােদ খুবই ভালাে লাগে। স্নিগ্ধ বাতাস শরীরে শিহরণ জাগায়। নিভ্র আজ জগিং করতে গিয়েছিল। ফিরে আসার পর দরজার সামনে দুটি গোলাপ ফুল দেখতে পায়। সঙ্গে কোনো চিরকুট ছিল না। শুধু ফুল রাখা ছিল। হাতে তুলে নেয়। তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করছে। অদ্ভুত বিষয় হলো? কাল এবং আজ সকালে এই সময়ই দরজার সামনে গোলাপ ফুল পেয়েছে। এর আগে কখনোই সে পায়নি।
বেশি মাথা ঘামায় না। ফুল গুলো নিয়ে পানি ভর্তি একটি কাঁচের গ্লাসের মধ্যে রেখে দেয়। সেখানে আরো দু’টি ফুল রাখা ছিল। কালকের ফুল ছিল সে-ই ফুল দু’টি।
একটু পর নবনীর আগমন ঘটে। আজ আর টমি নবনীকে দেখে ঘেউঘেউ আওয়াজ তুলে না। কারণ নবনী সঙ্গে করে তার ক্যাথিকে নিয়ে এসেছে। টমি শান্ত হয়ে ক্যাথিকে দেখছে।
দেখে মনে হচ্ছে তার ক্যাথিকে মনে ধরেছে। বাহিরে ক্যাথিকে রেখে সে ভেতরে আসে। প্রথমে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়ে “নিভ্র স্যার” বলে ডাকতে ডাকতে রুমে উঁকি দেয়।

কোনো সাড়া শব্দ পায়না। নবনী রুমে প্রবেশ করে। কেমন ইতস্তত বোধ করছিল। তবুও সে রুমের ভেতরেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ডানে-বামে তাকায়। বিছানার ওপর নিভ্রর ইউনিফর্ম রাখা ছিল সঙ্গে পুলিশের টুপি। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে নবনীর মাথায়। একবারের জন্য নিভ্রর কথা মাথা থেকে ঝেড়ে বসে। টিফিনবাক্স টেবিলের ওপর রেখে টুপিটা হাতে উঠিয়ে নেয়। ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে টুপিটি মাথায় পড়ে। সেখানে কালো রঙের সানগ্লাস রাখা ছিল। সেটি উঠিয়ে চোখে দেয়। এখন একদম পুলিশ ম্যাডামের মতো লাগছে নবনীকে।

ভাব নিয়ে দু বার পায়চারি করে নবনী। নাকের ডগায় সানগ্লাস নামিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে মুড নিয়ে বলে,
-“আমি হলাম মিসেস.নিভ্র আহমেদ।”

-“কবে হয়েছো মিসেস. নিভ্র আহমেদ?” ক্ষুব্ধ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল নিভ্র।

নবনী আয়নার মধ্যে নিভ্রকে দেখতে পায়। ওর ঠিক চার-পাঁচ হাত পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে সে। পরনে সেদিনের সেই স্লিক নাইটি। হঠাৎ নিভ্রর কন্ঠের স্বর শুনে ভড়কে ওঠলো। নিমিষেই নবনীর মুখমন্ডল হয়ে গেল বিবর্ণ। ধীরেধীরে পিছনে ফিরে নিভ্রর রাগান্বিত চেহারা দেখতে পায় সে। কিছু বলার সাহস হয় না তার। বুক দুরুদুরু করছে। এই বুঝি সে রাগের বশে কিছু একটা করে বসছে। ভেবেই নবনীর হাত-পা অবশ।
নিজেরই এখন আফসোস হচ্ছে। কেন যে বলতে হলো কথাটা। না না কেন যে রুমে ঢুকলাম। আগে কেন সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখলাম না নায়ক গোছলখানায় আছে, কি নেই? তার হাজারটা ভুলচুক ধরতে ব্যস্ত সে। কিন্তু এখন আর বলে লাভ নেই। কথায় আছে, ভাবিয়া করিও কাজ। করিয়া ভাবিও না। প্রবাদটি নবনীর সঙ্গে একদম মিলে গেছে।

কিছুক্ষণ পর…..

বড়ো একটি গর্তে বালতি দিয়ে জল ঢালছে নবনী। যত জল ঢালছে সব জল শুঁকিয়ে যাচ্ছে। শুকানোরই কথা। ক’দিন আগেই নিভ্র বাড়ির পিছনটায় দু’জন লোক দিয়ে মাটি খুঁড়ে গর্ত বানিয়েছে ছোট হাউস বানানোর জন্য। দেখতে অনেকটাই কূয়োর মতো। সেখানেই নবনী বালতিতে পানি ক্যারি করে নিয়ে এসে জল ঢালছে। এটা নবনীর শাস্তি। সয়ং নিভ্র দিয়েছে তখনকার বলা কথাটির জন্য। বলে গেছে পুরো কূয়োয় যেন পানি ভরে রাখে। নবনী শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিল। কিন্তু বিপত্তি হয় তখন, যখন দেখে পানি ঢালছে আর উধাও হয়ে যাচ্ছে। এবার নিয়ে দশবার হবে। সব পানি মাটিতে চুষে নিয়ে যাচ্ছে। বালতি রেখে নবনী কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়। রাগ হচ্ছে তার। নিভ্র অফিসে চলে গেছে। যাওয়ার সময় কঁড়া গলায় বলে গেছে, এসে যেন পুরো গর্তে পানি ভর্তি দেখে। আজ নবনীর কলেজে যাওয়া হবে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কি করা যায়। কিভাবে গর্তে পানি ভরা যায়।

ভাবতেই আইডিয়া পেয়ে যায়। দৌড়ে ফুলের বাগানে আসে। সেখানে পাইপ রাখা ছিল। সম্ভবত নিভ্র পাইপ দিয়ে ফুল গাছে পানি দেয়। সেটি নিয়ে ছুটে আসে গর্তের কাছে। এখন আরাম করে পানি গর্তে দিচ্ছে। নেই ঝামেলা,নেই কষ্ট।
পানি দিতে দিতে নিভ্রকে তখনকার বলা কথাটি মনে করতে থাকে। লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসে।
.
আজ নবনী কলেজে আসেনি দেখে মায়া কয়েকবার কল দেয়। কিন্তু নবনী ফোন ধরে না। ধরবেই বা কি করে ফোন বাড়িতে, আর সে নিভ্রর বাড়িতে। শেষে বিরক্ত হয়ে আর কল দেয় না। ক্লাসে চলে যায়।
_______
নিভ্র অফিসে বসে নবনীর কথা ভাবে। মেয়েটা কী জন্মগত পাগল, না-কি মাথায় আঘাত পেয়ে এমন পাগলামি করছে?
স্বভাব, আচরণ মোটেও স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না তার কাছে। আর না হলে কি কেউ এভাবে অন্যের ওয়াইফ হিসাবে দাবী করে! ভেবেই মৃদু হাসে সে। পরক্ষণে মনে পড়ে নবনীর শাস্তির কথা৷ একবার ফোন দেওয়ার কথা ভাবে। অবশ্য সকালে আসার সময় নাম্বার নিয়েছিল নবনীর কাছ থেকে। কিন্তু কল দিতে প্রস্তুত নয় সে। সেলফোন হাতে নিয়েও রেখে দেয়।

একটার দিকে নবনী বাড়িতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিলুফা বেগমের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ভুলভাল বুঝিয়ে রুমে এসে শাওয়ার নেয়। নামাজ পড়ে খাবার খেয়ে ক্যাথিও খাবার খাইয়ে দেয়। তারপর দু’জনেই বের হয় নিভ্রর বাড়ির উদ্দেশ্যে। এসে দেখে নিভ্র অলরেডি বাসায়। কিছুক্ষণ আগেই এসেছে। আজ খাবার সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। খেয়েও নিয়েছে। নবনী ক্যাথিকে কোলে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নিভ্র তখন কিচেনে ছিল। এঁটো থালা পরিষ্কার করছিল।
নবনী ক্যাথিকে ছেড়ে দেয় বাহিরে। তারপর কিচেনে ঢুকতে যেতেই নিভ্রর একদম মুখোমুখি পড়ে যায়। নবনী সরে দাঁড়ায় না। নিভ্রকে একদম কাছ থেকে দেখে নিচ্ছে। এ দেখা যেন শেষ হবার নয়। মনে মনে চাইছে সময়টা এখানেই স্থির হয়ে যাক। দেখে নিক মন ভরে আরো কিছুক্ষণ! কিন্তু এমনটা হয় না। নিভ্র একটু পিছনে সরে হাতে তালি দিয়ে ‘নবনীতা’ বলে ডাক দেয়। চৈতন্য ফিরে পায় সে। লজ্জায় মাথা নত করে ফেলে। সরে দাঁড়ায়। নিভ্র বিরক্ত মুখে বলে,
-“হোয়াট?”

-“পানি ভরেছি গর্তে। এখন আমার শাস্তি কী শেষ হয়েছে স্যার?” মৃদুস্বরে বলে নবনী।

-“প্রথমত, গর্তে পানি নেই, দ্বিতীয়, তুমি চিটিং করেছো। পাইপ দিয়ে পানি দিয়েছো গর্তে।”

মাথা তুলে অবাক চোখে নিভ্রর পানে তাকায় নবনী। পানি দেওয়া শেষ করার পর পাইপ গুছিয়ে ঘরের ভেতরে এনে রেখেছে। যাতে করে নিভ্র বুঝতে না পারে সে পাইপ দিয়ে পানি দিয়েছে। ভ্রুকুটি কিঞ্চিত বাঁকিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবনী। নিভ্র আঙ্গুল তুলে বলে,
-” ধরা পড়ে গেছ, তাই আফসোস হচ্ছে। যে নিজেকে চালাক বলে মনে করে, সেই বড্ড বোকা। তুমি যদি পাইপটি বাগানেও রেখে আসতে তবুও আমি বুঝতে পারতাম পাইপ দ্বারা পানি দেওয়া হয়েছিল গর্তে।”

-“কিভাবে স্যার?” মিনমিন করে বলে।

-“সিক্রেট!”

পাল্টা প্রশ্ন করে না নবনী। নিভ্র হেঁটে ড্রইংরুমে এসে বসে। নবনী কিচেনের দরজার সামনেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। ভুলেই গিয়েছিল সে পুলিশের সঙ্গে চালাকি করতে গিয়েছিল। তাইতো ধরা পড়ে গেল। নিভ্র নবনীকে ডেকে তার সামনে এনে দাঁড় করায়। গম্ভীর চোখেমুখে বলে,
-“আজকে যেটা বলেছো, আর করেছো। তার জন্য তোমার ডাবল শাস্তি হবে।”

নবনী চোরের মতো দাঁড়িয়ে থেকে নরম স্বরে বলে,
-“আপনি যে শাস্তি দিবেন আমি সেটা মাথা নত করে নিবো।”

-“অলরেডি করেছো।”

-“কী?” ভ্রু কুঁচকে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করে।

-“মাথা নত।”

শুনেই মাথা ফের নত করে ফেলে। নিভ্রর রাগ হয়। একবার বলা শর্তেও এই মেয়ে কেন যে সবসময় মাথা নত করে রাখে, বোঝার বাহিরে। নিভ্র সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“প্রতিদিন আমার বাড়িতে এসে ফুল গাছে পানি দিবে। দুই বেলা। সকাল, সন্ধ্যা।”

-“ঠিক আছে স্যার। আর কিছু?”

-“নাহ! তুমি ডগ কবে কিনেছো?”

-“কালকে।”

-“কেন?”

-“পুষবো তাই।”

-“সত্যি কথা বলো নবনীতা। ” কঁড়া গলায় শুধায়।

-“আপনার কুকুরের জন্য কিনেছিলাম।” আমতা আমতা করে বলে।

-“কারণ?”

-“টমি আমাকে দেখলেই ঘেউঘেউ করে। আমার ভীষণ ভয় লাগে। তাই ওর জন্য মেয়ে কুকুর কিনেছি। যাতে করে টমি আমাকে দেখলে আর না চিল্লায়। আর এমনেতেও টমি কতদিন আর সিঙ্গেল থাকবে। ওর তো মিঙ্গেল হতে ইচ্ছে করে তাই না।” নক খুঁটতে খুঁটতে কথা গুলো বলে নবনী।

নিভ্রর চোখেমুখে অপ্রীতিকর ছাপ। কপালে একবার হাত রেখে অপ্রসন্ন ভাবে সরু নিশ্বাস ফেলে। আগে ভেবেছিল অর্ধেক পাগল, এখন পুরো পাগলের প্রমান দিয়েছে সে। নবনী একবার নিভ্রর দিকে তাকিয়ে, আবার নজর নিচু করে রাখে।
নিভ্র কপালের ওপর থেকে হাত সরিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে,
-“তুমি যে মেন্টালি সিক্, তোমার পরিবার জানে বিষয়টা?”

-“নাহ! আপনি গিয়ে বলুন স্যার।”

-“ও মাউ গড!” বলেই বিরক্তিতে মাথার দু পাশে হাত রাখে নিভ্র।

নবনী মুখ টিপে হাসে। নিভ্রকে কথার জ্বালে ফেলে টর্চার করে বেশ মজা পাচ্ছে সে। তারপর স্বাভাবিক হয়ে পূনরায় বলে,
-“স্যার,আপনার কি মাথা ব্যথা করছে?”

-“এতক্ষণ মাথা ব্যথা ছিল না। তোমার কথা শুনে শুরু হয়েছে ব্যথা।” রুষ্ট কন্ঠে বলে নিভ্র।

-“স্যার এক কাপ কফি বানিয়ে দেই,খে’লে হয়তো মাথা ব্যথা কমে যেতে পারে।”

-“গো..।”

-“আচ্ছা। ”

নবনী খুশি হয়ে কিচেনের দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু মাঝপথে নিভ্র থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কিচেনে কোথায় যাচ্ছো?”

-“কফি বানাতে।”

-“আমি তোমাকে কফি বানাতে বলেছি?” ভর্ৎসনা স্বরে বলে।

-“আপনিই তো বললেন গো! আমি ভাবলাম হয়তো কফি বানাতে যেতে বলেছেন।” ইতস্তত বোধ নিয়ে অস্ফুট স্বরে উত্তর দেয়।

বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে নিভ্র। রাগ নিয়ে এক প্রকার চিল্লিয়ে বলল,
-“ইউ ক্যান গো…!”

নবনী এক দৌড়ে বাহিরে চলে যায়। নিভ্র সোফার সঙ্গে হেলান দেয়। মাথা খারাপ করে দিয়েছে। নবনী চলে যাওয়াতে নিভ্র কিছুটা স্বস্থি পায়। এদিকে নবনী বাহিরে এসে টমির কাছ থেকে ছোঁ মেরে ক্যাথিকে নিয়ে নেয়। রাগ দেখিয়ে আঙ্গুল তুলে বলে,
-“টমির বাচ্চা সর আমার ক্যাথির কাছ থেকে।” বলেই হাঁটা ধরে। নিভ্রর রাগ টমির ওপর দেখাল। বেচারা টমি নবনীর ব্যবহারে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। বোবা প্রাণী কিছু বলতেও পারছে না। মানুষ হলে এতক্ষণে ঠিকই জিজ্ঞেস করতো।
________________________
পরদিন সকাল আটটার দিকে নবনী গাছে জল দিতে আসে নিভ্রর বাড়িতে। প্রথমে বাড়ির ভেতরে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে গাছে জল দেওয়ার কথা ভাবে, তারপর না হয় ভেতরে যাওয়া যাবে। ভাবা অনুযায়ী কাজে লেগে পড়ে সে। খুব যত্নসহকারে ফুল গাছে পানি দেয়। কিছু আগাছা পরিষ্কারও করে দেয়। সব কাজ সম্পূর্ণ করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। ড্রইংরুমে উপস্থিত অচেনা রূপবতী এক বালিকাকে দেখে নবনী থামকাল। পরনে তার গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজ। তিনি একাই বসে ছিলেন। নবনীর আগমনে সেও তার দিকে তাকায়। নবনী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। মনে তার হাজারো প্রশ্ন? কে এই অচেনা বালিকা? নিভ্র স্যারের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? তাহলে কি সে তাকে হারাতে বসেছে! ভাবতেই বুক ভার অনুভব করে সে। বুকে চিনচিন ব্যথা আরম্ভ হয়। এ কোন নতুন ঝড়ের আলামত!
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।