আমি তাকে এতোদিন ধরে ফলো করছি প্রেমের প্রপোজাল পাঠিয়েছি আর সে আমাকে চিনতেই পারছে না??এটা কেমন কথা??তারপর আবার বল্লাম কি আজিব তুমি কলেজে আসার সেই প্রথম দিন থেকেই আমি তোমাকে ফলো করছি প্রেমের প্রপোজালও পাঠিয়েছি আর তুমি বলছো তুমি আমাকে চিনোনা??
সে উত্তর না আপনাকে তো আমি চিনিনা।আপনি তো সবসময় আড়ালে ছিলেন কখনো সামনে এসেছিলেন আমার??নিজের প্রপোজাল নিজে কি আমার সামনে নিয়ে এসেছিলেন?আনেন নি তাহলে আমি কিভাবে আপনাকে চিনবো বলেন??
এর আগে কি কখনো কথা হয়েছে আমি বল্লাম না সে বলছে তাহলে কিভাবে চিনবো বলেন??
আমিঃআসলে সরি।আমি ভাবলাম আপনি আমাকে চিনেন।সেজন্য কথা বলতে আসলাম।
জান্নাতঃহুম আমিতো আপনাকে ঠিকই চিনি আপনি যেমন আমাকে কলেজের প্রথম দিন থেকেই দেখছেন আমিও আপনাকে সেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই দেখে আসছি।
আমিতো এটা শুনে পুরাই অবাক।যে এতক্ষন বল্লো আমাকে চিনেনা।এখন সেই আবার বলছে সেই কলেজের প্রথম দিন থেকেই নাকি আমাকে দেখছে।
রহস্য আছে মেয়েটার ভিতরে।
জান্নাতঃআসলে এতক্ষন আমি মজা করছিলাম আপনার সাথে।আর আমি আপনাকে ভালো করেই চিনি।আমার ক্রাশ কে আমি চিনবো না এটা কি করে হয় বলুন??
আমিঃআপনার ক্রাশ মানে??আপনার ক্রাশ কে আবার??
জান্নাতঃকেনো আপনি আর কি।।।।।
আমিঃআমি এটা শুনে স্টোক করার মতো অবস্তা হয়ে গেলো।ও মা এতো দেখছি মেঘ না চাইতে বৃষ্টি।
এতোদিন তার নাম্বার ফেসবুক আইডি কিছুই ছিলো না।কিন্তু ওইদিন ওর নাম্বার ফেসবুক আইডি সব নিয়েছিলাম।বাসায় এসেই ফেসবুকে মেসেজ দিয়ে রাখি।
সেদিন থেকেই আমার কথা বলা শুরু হয় জান্নাতের সাথে।৪’৫ দিন পরে মেসেঞ্জারে প্রপোজ করে দেই।সেও রাজি হয়ে যায়।এভাবেই চলতে থাকে আমাদের রিলেশন। ১ বছর ২ বছর ৩ বছর ৪ বছর ৫ বছর। ৫ বছর আমাদের রিলেশন স্থায়ী ছিলো।মানে ট্রেনে যখন দেখা হয়ে তখন অলরেডি আমাদের দশ বছরের পরিচয়।
লাস্ট ইয়ার মানে যে বছর আমাদের রিলেশন ব্রেকাপ হয় সে বছরের শুরু থেকেই জান্নাতের সাথে আমার প্রচুর জগড়া হতো।সে কথায় কথায় আমাকে খোঁটা দিতো আমার চাকরি হয় না।চাকরি পাই না।বাপের টাকায় বসে বসে খাই।আচ্ছা চাকরি যদি না হয় সেটা কি আমার দোষ??
আমার কপালে চাকরি ছিলো না তাই হয়নি।একদিন রাতে জান্নাত আমাকে কল দিয়ে বলে ওকে দেখতে কাল পাত্র পক্ষ আসবে।আর এইবার কিন্তু ওর বিয়ে টা হয়েই যাবে।আমি তাকে বল্লাম আগে বিয়ে হোক তারপর বলিও। মূলত আমক হাসির ছলে তার সব কথা উড়িয়ে দিয়েছিলাম।কারণ আমার বিশ্বাস ছিলো ওর বিয়েটা হবে না।কিন্তু যেদিন পাত্র পক্ষ ওকে দেখতে আসে ওইদিন থেকেই আমার জান্নাতের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
৭ দিন ধরে আমার সাথে তার কোনো যোগাযোগ নেই।ফোন দিলে ফোন বন্ধ ফেসবুক আইডিতে কাওকে এক্টিভ দেখাচ্ছে না।ওইদিন রাতে যে কথা বলছিলাম সেটাই ছিলো আমাদের শেষ কথা।
৭ দিন পর কলেজে জান্নাতের এক ক্লাসমেট এসে আমাকে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বল্লো এটা আপনাকে জান্নাত দিতে বলেছে।আমি ওইদিন বাসায় চলে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে চিঠি পড়া শুরু করলাম।
প্রিয়,রিয়াজ
আশা করি ভালো আছো।আমি ভালো আছি কিনা সেটা জানার প্রয়োজন নেই।আমি তোমাকে সেদিন রাতে বলেছিলাম না আমাকে দেখতে আসবে।আর সেটা তুমি হাসির ছলে উড়িয়ে দিয়েছিলে।ওইদিন তারা আমকে দেখতে এসে তাদের আমাকে পছন্দ হয়ে যায়।আর সেদিনই আমাকে আন্টি পড়িয়ে দিয়ে যায়।আর সেদিন তারা আমাকে নতুন ফোন নতুন সিমে কিনে দিয়ে গিয়েছে। আর সবার সাথে যোগাযোগ বন্ধ তাছাড়া আব্বু আম্মু আমাকে কসম দিয়ে দিয়েছে আমি যাতে অন্য কারো সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখি।তাই তোমার সাথে আমার আর রিলেশন কন্টিনিউ করা সম্ভব নয়।ভালো থাকবে।
চিঠিটা পড়ে কান্নায় আমার পুরো বালিশ ভিজে গিয়েছে। সেদিন সারারাত কান্না করেছিলাম।১ মাস আর কলেজে যাইনি।কিন্তু মনে মনে সিধান্ত নিয়েছিলাম আমি ওই স্বার্থপরের চাইতে ভালো সুন্দর একটি মেয়েকে বিয়ে করবো আর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাকে দেখিয়ে দিবো।
সেদিনের পর থেকে আমার সাথে জান্নাতের আর কোনো দিন দেখাও হয়নি কথাও হয়নি।আর আজ এই ট্রেনে তার সাথে দেখা হয়ে গেলো।এগুলো চিন্তা করতে করতে কখন যে ট্রেন চট্টগ্রাম চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি।
কিন্তু জান্নাতের সাথে আমার কোনো প্রকার কোনো কথা হয়নি।তবে তাকে দেখার পর আমি বুজতে পেরেছি তার প্রতি আমি মনের ভিতরে এখনো অনেক ভালোবাসা রয়ে গিয়েছে। আমার এই জীবনে ওর সাথে আর দেখা না হলেই ভালো হতো। কিন্তু দেখা হয়ে মস্ত বড় ভুল হয়ে গিয়েছে।তার সাথে কাঁটানো সেই পূরনো স্মৃতি গুলো মনে পরে গিয়েছে। ট্রেন থেকে নেমে দুজনে দুদিকে চলে গেলাম।আমি আমার ওয়াইফ কে শ্বশুর বাড়ি। আর সে তার হাজবেন্ড এর সাথে কোথায় যাচ্ছে সেটা আমি জানিনা।
বিয়ের ৩ মাস পর বউকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি।ট্রেনে হঠাৎ করে দেখতে পাই ৫ বছর আগে আমি চাকরি পাইনি বলে যে আমাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলো সে আমাদের একই কেবিনে।তার সাথে একটি লোক বসা হয়তো তার হাজবেন্ড।আমি তাকে দেখে রীতিমতো চমকে যাই।
কেনোনা এই ৫ বছর আমার সাথে তার যোগাযোগ কিংবা কথা বলা কিংবা দেখা হওয়া কিছুই হয়নি।তবে আমি যে কেবল তাকে দেখেছি সেটা কিন্তু নয়।ইতমধ্যে সেও আমাকে দেখে ফেলেছি।
আমার মাঝে একটা কেমন যেনো নিরবতা চলে এসেছে। আমি তাকে দেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসেছি।আমার স্ত্রী বলছে এই কি হয়েছে তোমার বাহিরে কেনো যাচ্ছো আবার?(বাহিরে বলতে ট্রেনের দরজায়)কেনোনা ট্রেন এরভিতরে চলতে শুরু করে দিয়েছি।
আমি তাকে বললাম তুমি বসো আমি একটু আসছি।৫ বছর আগে আমি চাকরি পাইনি বলে যে আমাকে ত্যাগ কিরেছিলো সেই মেয়েটির নাম সাবিয়া জান্নাত।আমি ওকে জান্নাত বলেই ডাকতাম।
আমি আমার চেয়েও বেশি জান্নাত কে ভালোবাসতাম।তবে আমার কপালটা তেমন ভালো না।কেনোনা যখন যেটা দরকার আমি তখন সেটা পাইনা।কিন্তু পরে আবার সেটা ঠিকই পাই।তবে পরে পেলে কি আর হয়??
যখন যেটার দরকার তখন তো সেটারই প্রয়োজন তাই না??
ওর সাথে যখন রিলেশন ছিলো তখন ছিলো না আমার চাকরি। অনার্স পাশ করে চাকরির জন্য কতো মানুষের ধারে ধারে ঘুরেছি।কিন্তু চাকরি নামক সোনার হরিণ সেদিন আমার কপালে জোটেনি।আর আমার এই একটি চাকরির জন্যই আমি আর জান্নাত আজ দুইজন দুইদিকে।
সে তার হাজবেন্ড এর সাথে আর আমি আমার ওয়াফ এর সাথে।আজ কিন্তু এখানে আমার আর জান্নাতেরই থাকার কথা ছিলো। কিন্তু ভাগ্য আমাদের সহায় ছিলো না।ওকে ট্রেনে দেখে আমার চোঁখের কোনে কেনো জানি জল চলে এসেছে।
তার সাথে কাটানো সব মূহর্ত গুলো আমার চোখের সামনে ভেসে আছে।কেনো যা তার সাথে এখন এই মূহর্তে দেখা হতে গেলো।যাই হোক আমার স্ত্রী রুপা আবার ডাক দিলো কই রিয়াজ কোথায় তুমি ভিতরে আসছো না কেনোও??
সরি আমার নাম রিয়াজ সেটা আপনাদেরকে বলা হয়নি।পেশায় বর্তমানে আমি আর্মির শিক্ষা কোরের জেসিও অফিসার। যাকে ওয়ারেন্ট অফিসার বলে।মাষ্টার কমপ্লিট করে অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই চাকরিটা পেয়েছি।কারণ এমন একটি চাকরি সবার কপালে জোটে না।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমি ভার্সিটিতে এসে যে বিষয়টা নিয়ে পড়ার জন্য আমার লাইফের সবচাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম। আর সেই বিষয় এর জন্যই কিন্তু আমি এতো ভালো একটি চাকরি পেয়েছি। পরে আমি বুঝতে পেরেছি আসলে আল্লাহ যা করে সেটা আমাদের সকলের মঙ্গলের জন্যই করে।আর আমি যেই বিষয়টি নিয়ে লেখা পড়া করেছিলাম সেটি হলো বাংলা।
রুপা ডাক দেয়ার পর কেবিনে যেয়ে বসলাম।আর ভর্তমানে আমরা ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গামী একটি ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাচ্ছি।আর চট্টগ্রামেই আমার শ্বশুর বাড়ি। মানে রুপাদের বাড়ি।ট্রেনের সিঙ্গেল কেবিন পাইনি তাই অন্য জনদের সাথে যেতে হচ্ছে।অবশ্য অন্য জন বলতে আমাদের মতোই আরেকটি কাপল।
রুপা অলরেডি তাদের সাথে পরিচিত হয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বল্লো আপু এই আমার হাজবেন্ড।মানে জান্নাত কে বল্লো আর কি।জান্নাত এর হাজবেন্ড আমাকে হায় বল্লো।আমিও হায় বল্লাম। তবে জান্নাতকে এভাবে আরেকটি ছেলেরে সাথে বসে থাকতে দেখে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।যদিও আজ থেকে আরও ৫ বছর আগেই আমার সাথে জান্নাতের ব্রেকাপ হয়ে গিয়েছিলো।
তবুও ওর সাথে তার হাজবেন্ড কে দেখে আমার কেনো জানি খুব খারাপ লাগছিলো। আমি তাদের সাথে আর কোনো কথা বল্লাম না।তবে হ্যাঁ আমি যে জান্নাত কে আগে থেকে চিনি সেটা কিন্তু আমার স্ত্রী রুপাকে বুঝতে দেইনি।আমি জান্নাতের সাথে আপনি আপনি করেই কথা বলেছিলাম।আর জান্নাতও ঠিক একই আচরণ করেছে।
আমার মনের গহিনে থাকা যে ভালোবাসা জান্নাতের জন্য জন্মেছিলো আর আজ সে ভালোবাসা আমার স্ত্রী রুপাকে দিতে হচ্ছে।মেয়েটা আমায় খুব ভালোবাসে।একটা দিনও আমকে ছাড়া খাবার খাবে না।
আমিও ওকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।মেয়েটার মধ্যে কে যেনো একটা জাদু আছে যেটা দিয়ে খুব সহজে মানুষের মন জয় করে নিতে পারে।যেমন টা নিয়েছে আমার ক্ষেত্রে। তবে জান্নাত যে আমায় ভালোবাসতো না সেটা কিন্তু নয়।ট্রেনে রুপা জান্নাতের সাথে কথা বলছে।
আমিও শুনছি তাদের কথা গুলো।আমি কি করি কোথায় আছি এই সবই রুপা জান্নাত কে বলেছে।আর জান্নাতের হাজবেন্ড কি করে কই থাকে এই সবও জান্নাত বলেছে।তার হাজবেন্ড একটি ব্যাবসার সাথে জড়িত আছে।পারিবারিক ভাবেই নাকি তাদের বিয়ে হয়েছে।
তবে সেটা আজ থেকে আরও ৪ বছর আগে।আমাদের কবে বিয়ে হয়েছে রুপা সেটাও তাদের কাছে বল্লো। এর মাঝে রুপা জান্নাত কে জিজ্ঞেস করলো আপু একটা কথা বলবো কিছু মনে করবেন না তো..??
জান্নাত বল্লো না না সমস্যা নেই বলো। ৪ বছর হয়েছে বিয়ে করেছেন এখনো বাচ্চা কাচ্চা নিচ্ছেন না কেনো??জান্নাত আসলে এতোদিন সুমনের ব্যাবসায় খুব জামেলা ছিলো। এখন অবশ্য সব ঠিকঠাক। ইনশআল্লাহ আগামী বছর আমাদের কোল আলো করে নতুন মেহমান একজন আসবে।
আমি মনে মনে ভাবছি আজ এই সুমনের জায়গায় তো আমার থাকার কথা ছিলো কিন্তু ভাগ্য যদি খারাপ হয় তাহলে কি আর করার।আমাদের রিলেশনটা ছিলো সেই কলেজ লাইফ থেকে।
৭ বছরের রিলেশন ছিলো।জান্নাত ছিলো আমার ফাস্ট লাভ।অবশ্য আমিও জান্নাতের ফাস্ট লাভ।একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ৭ বছর রিলেশন করার পর যদি তারা বিয়ে করতে না পারে তখন সেটা যে কি কষ্টের তা শুধু তারাই জানে।অবশ্য অনেকে এরজন্য সুইসাইডও করে।
তবে আমি সেরোকম নয়।এসব চিন্তা মাঁথা থেকে যেরে ফেলে দিয়ে কিভাবে সামনে এগুনো যায় আমি সে চিন্তায় মগ্ন ছিলাম।আর সেকারণেই আজ আমি এই পজিশনে আছি।চট্টগ্রাম কলেজে আমি যখন সেকেন্ড ইয়ার তখন জান্নাত ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়।
ওকে আমি কলেজে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই ভালো লেগে যায়।কলেজে ১ বছরে অলরেডি অনেক মেয়ে দেখা শেষ কিন্তু এর ভিতরে কোনো মেয়েকেই আমার ভালো লাগেনি।কিন্তু জান্নাত কে প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায়।সেই প্রথম দিন থেকেই কলেজে ঘোষণা করে দিলাম জান্নাত আমার ওর দিকে যাতে আর কেও না তাকায়।
কলেজে একটু পাওয়ারে ছিলাম সে হিসেবে বল্লাম আর কি।কয়েকদিন ওকে ফলো করতে থাকলাম ওর বাসা কোথায় বাবা কি করে কয় ভাই বোন কারো সাথে রিলেশন আছে নাকি এই সব খবরই আমার নেয়া শেষ। আমি যে ওকে ফলো কিছু সেটা কিন্তু সে বুঝে গিয়েছে। ১ মাস পর জান্নাতের এক বান্ধবী কে দিয়ে আমি প্রেম নিবেদন পাঠাই।সেদিন সে যেটা বলেছিলো আমি সেটা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
জান্নাত নাকি তার ওই বান্ধবীকে সোজা সাপ্টা বলে দিয়েছে যা ভালোবেসে তাকে এসে সরাসরি বলতে বলিস। এতো লজ্জা নিয়ে প্রেম করবে কিভাবে।আমি সেদিন খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম এরপর মনে সাহস যুগিয়ে একদিন কলেজ ছুটির পর দেখি সে একা একা যাচ্ছে সেদিনই আমার সূযোগ।ওর পাশাপাশি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি আর ওকে বল্লাম কি ব্যাপার কেমন আছো??
‘ইফাত ভাইয়া আপু সুইসাইড করতে গিয়েছিল এখন হাসপাতালে ভর্তি,অবস্থা আশঙ্কাজনক।’
– কি বলছো এসব? যত দ্রুত সম্ভব আমি আসছি তুমি পায়রাকে দেখে রেখো।
ফোনে সাবিহার কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনে ইফাত যেন দিশেহারা হয়ে গেছে মাথা কাজ করছে না চেঁচিয়ে আরাফকে ডাকলো।আরাফ ঘরে আসতেই ইফাত বলল,
– আরাফ আমি বাংলাদেশে যাব আজই টিকিটের ব্যবস্থা করো।
– এত তাড়াতাড়ি কিভাবে?
– এতকিছু জানি না যা বলেছি তাই করো।
আরাফ মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল, ইতি বেগম সবটা শুনেছেন ভেতরে এসে,
– পাগল হয়েছিস এখন বাংলাদেশে কেন যাবি?
– মা যেতেই হবে।
– এখন কোথাও যাওয়া হবে না বিয়ের কাজ শেষ হোক তারপর।
– তোমার কথা রাখতে পারলাম না মা আমার যেতেই হবে।
গতকাল পায়রা আর সাবিহা বাড়িতে পৌঁছেছে। বাড়িতে এসেই পায়রা নিজের ঘরে ঢুকেছে আর বের হয়নি।সাবিহা সবাইকে সব বলে দিয়েছে পায়রাকে ডাকাডাকির পরেও পায়রা দরজা খুলেনি প্রথমে সবাই ভেবেছিল পরে হয়তো দরজা খুলবে কিন্তু সকাল হওয়ার পরেও দরজা খুলেনি সবার ডাকাডাকির শব্দেও কোনো সাড়াশব্দ করেনি অতঃপর দরজা ভেঙে ফেলে পলাশ শেখ ঘরে গিয়ে খোঁজাখুঁজির পর না পেয়ে বারান্দায় গিয়েই সবাই চমকে যায়। পায়রার নিথর দেহ বারান্দায় পড়ে ছিল হাত কাঁটা অনেক রক্ত বের হয়েছে।পলাশ শেখ আর তাই ভাই মিলে পায়রাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
সুইসাইড কেস বলে প্রথমে ডাক্তার ভর্তি করতে চায়নি। পলাশ শেখ তার পরিচিত বড় ডাক্তারকে ফোন করে সবটা বলতেই তিনি হাসপাতালের কাউন্টারে কথা বলেন আর তারপর পায়রাকে ভর্তি করে নেয়। অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে যার জন্য পায়রাকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে।
পলাশ শেখ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে আসমা বেগমকে আনা হয়নি। মেয়ের এমন অবস্থা দেখেই তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন সাবিহার মা উনার সঙ্গে বাড়িতেই থেকে গেছেন।
সাবিহাও কান্না করছে কেউই ভাবতে পারছে না পায়রা এমন একটা কাজ করেছে। ডাক্তারকে দেখেই পলাশ শেখ এগিয়ে গিয়ে,
– আমার মেয়ে কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে? একবার দেখা করতে দিন।
ডাক্তার গম্ভীর মুখে,
– আমরা আমাদের সাধ্যের মধ্যে যতটুকু করার করেছি এখন আল্লাহ ভরসা পেশেন্ট কোনো রেসপন্স করছে না তবে এখনও শরীরে রক্ত চলাচল করছে, শ্বাসও আছে।
বলেই ডাক্তার চলে গেলেন। পলাশ শেখ একবার পায়রাকে দূর থেকে দেখে এসেছেন ডাক্তার কাছে যেতে দেননি।
______________
রাত একটায় বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে ইফাত এবং আরাফ। ইফাত একাই আসতে চেয়েছিল কিন্তু আরাফ জোর করেই তার সঙ্গে এসেছে। সাবিহার কাছ থেকে আগেই হাসপাতালের ঠিকানা নিয়েছে। বাড়ির সবাই অমত করেছিল ইফাত কারো কথার তোয়াক্কা না করেই চলে এসেছে।
পলাশ শেখ চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন।সাবিহা জাগ্ৰত, ইফাত হাসপাতালে পৌঁছে গেছে কাউন্টার থেকে জেনে পায়রার কেবিনের সামনে চলে এসেছে সাবিহা ইফাতকে দেখেই এগিয়ে গেল। ইফাত সাবিহাকে দেখতে পেয়ে,
– পায়রার কি অবস্থা জ্ঞান ফিরেছে?
– এখনও ফিরেনি।
– ডাক্তার কি বললো?
– জ্ঞান কখন ফিরবে জানে না অবস্থা তেমন ভালো না।
– ও যে এমন একটা কাজ করবে ভাবতেও পারিনি।
– আপুকে কি একটু বেশি কষ্ট দিয়ে ফেললেন না ভাইয়া?
– কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি তবে আমি ভাবতেই পারিনি শেষ পর্যন্ত পায়রা এমন কিছু করবে।
– গত তিন বছর ধরে আপনার অপেক্ষা করলো অথচ আজ ম’রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
– ওয়া আলাইকুমুসসালাম, সাবিহার কাছে শুনলাম তুমি আমেরিকা ছিলে এখন এখানে?
– এমন একটা খবর শুনে কি ওখানে থাকা যায়।
পলাশ শেখ আর কিছু বললেন না রাগারাগীও করলেন না কারণ তার মেয়েটা তো ইফাতকেই চায়।
মির্জা পরিবারের সবাই পায়রার ঘটনা জেনে গেছে ইনান তাদেরকে সবটা বলেছে তাই ইফাতের উপর থেকে সব রাগ ঝেড়ে ফেলে তারাও দেশে আসবেন বলে ঠিক করেছেন, তুবার রাগ বেড়েই যাচ্ছে সে ভাবতেই পারছে না ইফাত পায়রার জন্য এভাবে চলে আসলো।
_______________
পুরো একটা দিন কেটে গেল, কিছুক্ষণ আগেই পায়রার জ্ঞান ফিরেছে পায়রার বাড়ির সবাই একেক করে পায়রার সঙ্গে দেখা করে এসেছে পায়রা কারোর সঙ্গেই কথা বলেনি। পায়রার মা পায়রাকে অনেক বকাঝকা করেছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি পায়রা চুপচাপ শুধু শুনেই গেছে কেন জানি নিজেকে অনুভূতি শূন্য মানুষ মনে হচ্ছে।কারোর কথায় কিছুই আসে যায় না তার।
সবাই বের হতেই ইফাত পায়রার বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। পায়রা হাতের ব্যান্ডেজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইফাত এসে পায়রার পাশে বসতেই পায়রা কিছুটা ভরকে গেল। ইফাতকে দেখেই ক্ষতটা ভেতরে আবারো জাগ্ৰত হয়ে গেছে, পায়রার এক হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেলো তারপর পায়রার হাত ছেড়ে তার গালে হাত রেখে,
– এমন পাগলামি কেউ করে? যদি কিছু হয়ে যেত তখন আমার কি হতো?
ইফাতের আগের ভালোবাসা,মায়া দেখতে পাচ্ছে পায়রা এতে রাগটা অভিমানে রূপ নিলো,
– কেন আপনার তুবা আছে না এখন তো সে আপনার বউ,বউকে রেখে এখানে কেন এসেছেন।
– এদিকে আরেক বউ এমন একটা কাজ করলে কি বাড়িতে বসে থাকা যায়?
পায়রা তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে ইফাতের দিকে তাকিয়ে,
– আরেক বউ মানে? কয়টা বউ আপনার? আপনি অনেক বদলে গেছেন খারাপ হয়ে গেছেন।
– আপাতত একটাই বউ তবে এখনও তাকে বিয়ে করাই হয়নি।
– তাহলে তুবা কে? সবার সামনে কিসে সাইন করলেন?
পায়রার ঠোঁটে আঙুল রেখে,
– হুশ এখন আর এসব কথা শুনতে চাই না তুমি সুস্থ হয়ে যাও তারপর বাকি কথা।
পায়রা চুপ করে গেল। মির্জা পরিবার বাংলাদেশে চলে এসেছে নিজেদের বাড়িতেই উঠেছে ইফাতকেও জানিয়েছে। তুবা হাসপাতালেই যেতে চেয়েছিল কিন্তু ইতি বেগম তাকে বাঁধা দিয়েছেন।
পায়রাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে পায়রার সঙ্গে দেখা করে ইফাত বাড়িতে চলে এসেছে। ইফাত বাড়িতে প্রবেশ করতেই তুবা ন্যাকা কান্না করে ইফাতকে ধরতে গেল ইফাত সাথে সাথে সরে গিয়ে,
– বলেছি না যখন তখন আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না।
– কিন্তু এখন তো আমি তোমার বউ।
– রিয়েলি! তোমার বউ হওয়া আমি বের করছি।
বলেই বাঁকা হাসলো ইফাত। ইতি বেগম জুস নিয়ে এসে ইফাতের হাতে দিলো ইফাত সোফায় গিয়ে বসল। ইতি বেগম জিজ্ঞেস করলেন,
– এখন কেমন আছে পায়রা?
– ভালো।
– মেয়েটাকে না কিছুতেই বুঝতে পারি না নিজে বিয়ে ভাঙলো তারপর তিন বছর পর আবার ওর সঙ্গে দেখা দেশে ফিরে কি ভয়ংকর একটা কাজ করলো।
– আসলে ও নিজেই তো এখনও নিজেকে বুঝে না তাই হুটহাট কিসব করে ফেলে পরে নিজেই কষ্ট পায়।
তুবা রাগ দেখিয়ে উপরে চলে গেল। ইফাতও ঘরে চলে গেল এখন তার ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজন।
_______________
চারদিন পার হয়ে গেল, এখন পায়রা পুরোপুরি সুস্থ হাতে এখনও ব্যান্ডেজ করা। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আসার পর আর ইফাতের দেখা পায়নি। ইফাতের পরিবারের সবাই যে বাংলাদেশে এসেছে পায়রা জেনে গেছে নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছে ইফাত তাকে সহানুভূতি দেখাতে এসেছে এখন নিজের বউ চলে আসতেই তাকে ভুলে গেছে।
দুপুরের খাবার খাওয়ার পর পলাশ শেখ পায়রাকে তৈরি হতে বলে গেছেন কোথাও নাকি তারা বের হবে পায়রা অবশ্য দ্বিমত পোষণ করেনি বাধ্য মেয়ের মতো সবার কথা শুনছে।
শেখ পরিবারের সবাই গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছে কিন্তু কোথায় যাচ্ছে পলাশ শেখ ছাড়া কেউই জানে না। পায়রা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে এবার রাস্তাটা চেনাচেনা লাগছে বাবার দিকে তাকিয়ে,
– আমরা কি বাগান বাড়িতে যাচ্ছি বাবা?
– হুম
– কেন?
– গেলেই দেখতে পাবি।
নির্দিষ্ট গন্তব্যের পর গাড়ি থামলো বাগান বাড়িতে। সবাই ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে গেল মির্জা পরিবারের সবাইকে দেখে,তারাও যে অবাক হয়েছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। অনেকদিন পর দুই পরিবার আবারো মুখোমুখি, এনায়েত মির্জা এগিয়ে এসে,
– পলাশ তোমরা?
– ইফাত আসতে বললো গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখাবে বলে।
– আমাদেরও তো বললো কিন্তু এসে দেখি ইফাত নেই।
ইতি বেগম বললেন,
– চারদিন ধরে বাড়িতেও আসলো না কোথায় যে গেছে কে জানে।
পায়রা সবার কথা শুনছে তুবাও এখানে আছে সোফায় বসে আছে আর চোখ দিয়ে যেন পায়রাকে ভৎস করে দিচ্ছে।
সবাই ধৈর্য নিয়ে বসে আছে ইফাতের অপেক্ষায়,দশ মিনিট পরেই ইফাত সবার সামনে চলে আসলো। ইতি বেগম চোখ রাঙিয়ে,
– কোথায় ছিলি কি এমন বলবি যে সবাইকে এখানে ডাকলি।
– ধীরে মা বলার জন্যই তো ডেকেছি বসো।
সবার দৃষ্টি ইফাতের দিকে। ইফাত একবার পায়রার দিকে তাকালো তারপর দৃষ্টি সরিয়ে তুবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো যা পায়রার চোখ এড়ায়নি।
ইফাত তার বাবার দিকে তাকিয়ে,
– আচ্ছা বাবা তোমার তোফায়েল আহমেদের কথা মনে আছে?
নামটা শুনে এনায়েত মির্জার কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে চিন্তিত কন্ঠে,
– কোন তোফায়েল?
– তুমি যে তোফায়েলকে চেনো।
– কিন্তু সে তো অনেক বছর আগে মা’রা গেছে একটা এক্সিডেন্টে তখন তোরা দুই ভাই ছোট ছিলি ওর নাম কেন এখানে আসলো তুই বা চিনলি কিভাবে?
– তোফায়েল আহমেদ মা’রা যায়নি মা’রা যাওয়ার নাটক সাজিয়েছে।
কেউ বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে তারপরেও ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে কিছুক্ষণ পরেই ইফাত একটা লোককে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এনায়েত মির্জা লোকটাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলেন বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
– তোফায়েল!!
– এবার চিনতে পেরেছো বাবা?
– হুম কিন্তু ও মা’রা যাওয়ার নাটক কেন করলো?
ইফাত বলা শুরু করলো,
– আমাদের পারিবারিক বিজনেসটা যখন অনেক বড় হয় তখন তুমি তোফায়েল আহমেদকে পার্টনার করে নিয়েছিলে তারপর ইনি তোমার অনেক বিশ্বাস যোগ্য হয়ে গিয়েছিল কিন্তু লোভে পড়ে একসময় তোমার সঙ্গেই বিশ্বাস ঘাতকতা করে ফেললো কোম্পানির অনেক টাকা চুরি করেছে।ধরা খাওয়ার পর অনেক মাফ চাওয়ার পরেও তুমি তাকে পুলিশে দিলে বড় একটা সাজা হয়েছিল কিন্তু কোর্ট থেকে যখন তাকে নিয়ে ফিরছিল তখনি পালিয়ে যায় এবং এক্সিডেন্টের নাটক সাজায়।
– পুলিশ যেই লাশ পেয়েছিল?
– ওইটাও সাজানো আসলে লাশটা মর্গ থেকে আনা হয়েছিল এতে তাকে সাহায্য করেছিল তার এক বন্ধু।
ইফাত এবার একটু থেমে,
– আমার আর পায়রার এনগেজমেন্টের দিনের কথা মনে আছে?
সবাই এবার মনোযোগ সহকারে তাকালো পায়রাও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। ইফাত সবার চাহনি দেখে আবারো বলতে লাগলো,
– পায়রা যেই ছবিগুলো দেখিয়েছিল তখনি বলেছিলাম ওগুলো এডিট কিন্তু কেউ বিশ্বাস করেনি তবে আমার মতো পায়রাও জানতো সত্যিই ওগুলো এডিট।
শেখ পরিবারের সবাইকেই পায়রা বিষয়টা আগেই বলেছে তাই তারা সবটা জানে। ইতি বেগম প্রশ্ন করলেন,
– জেনেও কেন এমনটা করলে পায়রা?
পায়রা কিছু বললো না মাথা নিচু করে রেখেছে ভেতরে অপরাধ বোধ কাজ করছে।ইফাত বললো,
– আমি বলছি।
সবটা ইফাত বলতেই সবাই আরো বিষ্মত হলো। সাথে ফোনালাপের সব রেকর্ডিং ও শুনিয়েছে, পলাশ শেখ বললেন,
– এগুলো কে করেছে এটাই তো এখনও জানা হলো না।
– এই যে দাঁড়িয়ে আছে তোফায়েল আহমেদ ইনিই করিয়েছেন।
– তোফায়েল করিয়েছে!(এনায়েত মির্জা)
– হুম বাবা।
– এতে ওর লাভ কি?
– লাভ ছাড়া কেউ কিছু করে না উনারও লাভ আছে, ওই যে সম্পত্তির প্রতি লোভ। সম্পত্তির প্রতি লোভ আর তোমার উপর ক্ষোভ থেকে এসব করেছে তুমি তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ায় আমাদের পরিবারের উপর উনার সব থেকে রাগ, অনেক বুদ্ধি করেই এতদিন কাজ করে গেছেন এমনকি আমার এক্সিডেন্ট তোফায়েল আহমেদ করিয়েছেন।
এনায়েত মির্জা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তোফায়েল আহমেদ মাথা নিচু করে আছে সে তো ধরা পড়ে গেছে। এনায়েত মির্জা তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে,
– আমার সঙ্গে শত্রুতা করার কারণ আছে বুঝলাম কিন্তু আমার ছেলেকে কেন মা’র’তে চাইলে?
– উওরটা আমিই দেই বাবা। বিজনেসের দায়িত্ব আমাকে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্তে ছিলে তোমার দুর্বলতা আমি আর ইনান। সেই জন্যই আমার সব খবরাখবর নিয়ে যখন জানতে পারে আমি পায়রাকে ভালোবাসি সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে পায়রাকে ব্লাকমেইল করেছে আর তারপর আমাকে মা’রা’র চেষ্টা করেছে অতঃপর সব প্লান ভেস্তে যাওয়ার পর নিজের মেয়েকে আমার পেছনে লাগিয়ে দিলো তোমরাও বোকার মতো মিষ্টি মিষ্টি কথায় গলে গেলে।
সবাই সম্মোলিত ভাবে,
– তোফায়েলের মেয়ে?
তুবা ঘামছে আর ছটফট করছে,ইফাত তুবার দিকে তাকিয়ে,
– এত ঘেমে লাভ নেই তুবা,তোমার ব্যাপারে সবটাই আমার আগে থেকেই জানা যাই হোক সবাইকে বলে রাখি তুবা হচ্ছে তোফায়েল আহমেদের মেয়ে।
– কি বলছিস! তুবা না বললো ওর বাবা-মা মা’রা গেছে?(ইতি বেগম)
– সব মিথ্যে বলেছে। আরাফকে বলেছিলাম যাতে পায়রা এবং আবরারের সব কল রেকর্ড বের করে, আবরারকে আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল তারপর সবটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়।
– এত কিছু হয়ে গেল কিন্তু তোর সঙ্গে তুবার বিয়ে হলে ওদের কি লাভ?
– ভেবেছিল একবার বিয়ে হয়ে গেলে সহজেই সব সম্পত্তি পেয়ে যাবে আর আমাকে মা’রতেও সুবিধা হবে।
তুবা বিষ্মিত হয়ে,
– এগুলো তো কারো জানার কথা নয় তুমি জানলে কিভাবে?
– যেদিন তুমি তোমার অসহায়ত্বের গল্প নিয়ে আমার মায়ের সামনে আসলে তোমাকে সন্দেহ হয়েছিল তাই ইনানকে সবটা বললাম তারপর ওই তোমার সব খবর এনে দিলো।
তুবা দাঁড়িয়ে গেল হুংকার দিয়ে,
– শুনো ইফাত তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আইনত আমরা স্বামী-স্ত্রী এছাড়া তোমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই তাই তুমি কিছু করতে পারবে না।
– আমাকে তোমার এত বোকা মনে হয়? কি যেন বললে আমরা স্বামী-স্ত্রী আচ্ছা সাইন করার আগে পেপারটা একবারও দেখেছিলে?
– মানে? পেপার তো বিয়ের ছিল।
ইফাত ইনানকে ইশারা করতেই ইনান একটা পেপার এগিয়ে দিলো তুবার দিকে।তুবা ভালো করে পেপারটা দেখছে। ইফাত বলল,
– আমাদের বাংলাদেশের যেই কোম্পানিটা আছে বাবার নামে,তুবা বাবাকে ভুলিয়ে নিজের নামে কোম্পানিটা লিখিয়ে নেয় তাই আমিও ওর পদ্ধতি অবলম্বন করে বিয়ের নাটক করে প্রোপাটি ফিরিয়ে এনেছি।
তুবা চেঁচিয়ে,
– তুমি আমার সঙ্গে চিট করেছে ইফাত তোমাকে আমি ছাড়বো না।
– আগে নিজেকে ছাড়াও।
কয়েকজন পুলিশ এসে তুবা এবং তোফায়েল আহমেদকে ধরে নিয়ে গেল। ইফাত আগেই পুলিশদের সঙ্গে কথা বলে এমন ব্যবস্থা করেছে যে এ জীবনে আর তারা ছাড়া পাবে না। এনায়েত মির্জা হাফ ছেড়ে,
– আগে যদি সবটা বলতি তাহলে আজ এমন দিন দেখতে হতো না।
– আমি যখন জেনেছি তখন তো তোমরা মিথ্যে বলে বিদেশেই নিয়ে চলে গেলে এছাড়া প্রমাণ যোগাড় করতে সময় লেগেছে তবে আরাফ আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।
– সত্যিই আরাফ আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছে।
আরাফ মৃদু হেসে,
– এটা আমার কর্তব্য স্যার।
– হুম এবার সব ঠিক হয়ে গেলেই ভালো,পলাশ এবারো কি আমার ছেলেকে তোমার মেয়ের জামাই করতে আপত্তি আছে?(এনায়েত মির্জা)
– আর লজ্জা দিও না এনায়েত যেদিন পায়রার কাছ থেকে সবটা জানতে পেরেছিলাম সেদিন নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি বুক থেকে বড় একটা বোঝা নামলো।
– তাহলে বিয়ের দিন তারিখ আজই ঠিক করে ফেলি?
– অবশ্যই।
ইফাত সবাইকে থামিয়ে দিয়ে,
– দিন তারিখ ঠিক করার দরকার নেই।
– কেন?(ইতি বেগম)
– তোমরা দিন তারিখ ঠিক করতে করতে আমার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে এর থেকে আজ সবাই এখানে আছে তাই বিয়ে আজ হবে।
– আমার ছেলেটা বিয়ে পাগল হয়ে গেছে।(ইতি
বেগম)
সবাই হেসে দিলো ইফাত এখন আর কোনো কথা গায়ে মাখছে না।ইনান কাজী নিয়ে আসলো ইফাত আগে থেকেই সব প্লান করে রেখেছে। ইফাত পায়রার কাছে বসে,
– এবার কি আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছো মন পায়রা?
পায়রা চোখ পাকিয়ে ইফাতের দিকে তাকাতেই ইফাত মৃদু হাসলো। সবার উপস্থিতিতে পায়রা এবং ইফাতের বিয়ে হয়ে গেল। দুই পরিবার নিজেদের মধ্যে আবারও নতুন সম্পর্ক গড়ে তুললো।
– আমার আরেকটা কথা আছে?
– আবার কি কথা?(এনায়েত মির্জা)
– এখনও আরেকটা বিয়ে বাকি আছে আমার ইচ্ছে আজই বিয়েটা হয়ে যাক।
– কার বিয়ে?( ইতি বেগম)
– ইনান আর সাবিহার।
ইনান আর সাবিহা একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলো ওরা ভাবতেও পারেনি ইফাত এভাবে সবার সামনে বাঁশ দিবে। সবাই অবাক হয়ে ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে ইফাত বলল,
– ওরা দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসে তোমাদের বলার মতো সাহস ওদের নেই তাই আমিই বলে দিলাম কেউ অমত করো না।
সবাই তাদের দিকে তাকালো।ওরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ইফাত সবাইকে বুঝিয়ে রাজি করিয়ে ইনান আর সাবিহার বিয়ে দিয়ে দিলো। এক দিনেই দুই ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল। মির্জা পরিবারে আজ অনেক আনন্দ একসঙ্গে দু’জন নতুন সদস্য তাদের বাড়িতে এসেছে দুই ছেলের বউ।
এনায়েত মির্জা পলাশ শেখের হাত ধরে,
– আজ আমার দুই মেয়েকে কিন্তু আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো।
– অবশ্যই কিন্তু একটাই আফসোস ধুমধাম করে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হলো না।
– তাতে কি হয়েছে বড় করে না হয় একটা অনুষ্ঠান করবো।
– হুম।
আরাফ এসে,
– আজ স্যাররা বাড়িতে যেতে পারবে না উনাদের জন্য আমি আগে থেকেই বাসর ঘর সাজিয়ে রেখেছি।
– আচ্ছা আচ্ছা তাহলে আমরাই যাই কাল সবাই বাড়িতে চলে আসবে।
______________
সবাই বাড়িতে চলে গেছে পায়রা আর সাবিহা যে যার যার ঘরে বসে আছে। ইনান ঘরে এসে দরজা আটকে দিলো, সাবিহার কাছে যেতেই সাবিহা চেঁচিয়ে,
– একদম কাছে আসবে না।
– কেন?
– দেশে ফেরার পর একদিনও আমার সঙ্গে দেখা করনি কেন?
– ভাইয়ার কাজ করছিলাম।
– আজও তাই করো।
– ভাইয়া তো ভাবীর কাছে এখন।
– তাহলে আর কি যাও গিয়ে মেঝেতে ঘুমাও এটাই তোমার শাস্তি।
– এমন করে না বউ।
– ন্যাকামো না করে যাও এখান থেকে।
বলেই সাবিহা ইনানের দিকে বালিশ ছুঁড়ে দিলো। বেচারা ইনান উপায় না পেয়ে অধীর কষ্টে নিচে গিয়ে শুয়ে রইল।
ইফাত পায়রার পাশে বসে আছে আর পায়রা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে, সে ঠিক করেছে ইফাতের সঙ্গে এখন কথা বলবে না। ইফাত টেনে পায়রাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে,
– কি কারণে এত রাগ জানতে পারি?
পায়রা নিশ্চুপ। ইফাত পায়রার থুতনি ধরে,
– এত বাঁধা পেরিয়ে এতদিন পর আজ আমরা এক হলাম আর তুমি কিনা এভাবে চুপ করে আছো মন পায়রা?
– আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আমার উপর অভিমান করে আমার থেকে দূরে ছিলেন কিন্তু আপনি সব জানতেন তারপরেও কেন এমন করলেন ? একদিন আমায় না দেখে থাকতে পারতেন না তাহলে তিনটা বছর কিভাবে পারলেন এই আপনার ভালোবাসা?
– আমার ভালোবাসা যদি এখনও না বুঝতে পারো তাহলে কিছু বলার নেই তবে এটা বলবো তুমি কখন কি করেছ, কোথায় গিয়েছ এবং কি পোশাক পরিধান করেছ সব খবর কিন্তু আমি রাখতাম তুমি আমায় না দেখলেও আমি রোজ তোমায় দেখতাম।
– আপনি তো আমেরিকা ছিলেন!
– দূর বোকা মেয়ে, হাতের মুঠোয় মোবাইল থাকতে কাউকে দেখার জন্য কষ্ট করতে হয় নাকি?
– কিছু বুঝলাম না।
– রোজ একবার হলেও সাবিহা ভিডিও কল দিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলার বাহানা দিয়ে যখন তোমার কাছে যেত তখনি তোমাকে দেখতাম।
পায়রা চমকে,
– সাবিহা সব জানতো?
– হুম।
– তবে সাবিহা যে বলেছিল
– ওইসব আমি বলতে বলেছিলাম তাই বলেছে আর ইনানের সঙ্গে সাবিহার সম্পর্কটা ছিল ইনান অনেকবার বাংলাদেশে এসে সাবিহার সঙ্গে দেখা করে গেছে।
– ওহ সবাই সব জানতো শুধু আমিই জানতাম না তিনটা বছর শুধু আমি কষ্ট পেলাম।
– কষ্ট কি আমি কম পেয়েছি? তোমাকে ভালোবাসি বলার পর থেকে কম কষ্ট দিয়েছ আমায়? সবসময় অপমান করেছ তারপরেও ভালোবেসে গেছি যখন সবার সামনে অপমান করেছিলে থাপ্পড় মেরেছিলে আবরারের হাত থেকে আংটি পড়েছিলে তখন আমার ভেতরে কি চলছিল আমিই জানি।
ইফাত থেমে আবার বলল,
– যখন সুস্থ হয়ে গেছিলাম বাবা-মা বললো কিছুদিনের জন্য আমেরিকা থেকে ঘুরতে যাবো সবাই তারপর চলে আসব আমিও রাজি হয়েছিলাম কিন্তু ওখানে যাওয়ার পর এমনভাবে আটকে দিলো আর ফিরতেই পারলাম না তাই বলে তোমার প্রতি ভালোবাসা কিন্তু কমেনি।
– একবার বলতে পারতেন।
– চাইনি বলতে, একটা সময় আমার মনে হয়েছিল জোর করে ভালোবাসা হয় না তাই এত দূর ছিলাম তোমার থেকে। যারা মন থেকে ভালোবাসে তারা কখনও প্রিয় মানুষটির উপর বেশিদিন অভিমান করে থাকতে পারে না আমিও পারিনি, তোমার জায়গায় যদি আমি থাকতাম হয়তো আমিও এটাই করতাম কারণ কথায় আছে না বিপদের সময় কখনও মাথায় বুদ্ধি আসে না। আমি চাইলেই তোমাকে নিজের করে পেতে পারতাম কিন্তু এতে কি কোনো লাভ হতো তুমি কি আদৌ আমাকে আমার মতো ভালোবাসতে পারতে আমার কষ্ট উপলব্ধি করতে পারতে? না বরং তুমি খুব সহজেই আমায় পেয়ে যেতে হয়তো একটা সময় গিয়ে সম্পর্কে সমস্যা হতো তাই তোমার থেকে দূরে ছিলাম বুঝতাম তুমি কষ্ট পাচ্ছো তবুও কিছু করার ছিল না আমি চেয়েছি তুমি মন থেকে আমায় চাও,যখন মনে হয়েছে সত্যি তুমি আমায় ভালোবাসো আমিও তোমায় দেখা দিলাম।
– ওই ডিল আমেরিকা যাওয়া ওগুলো সব!
– আমারই কাজ আমি তোমাকে আমি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলাম অনেক মাথা খাটিয়ে।
– আমার ভুলের জন্য এতদিন আমাদের দু’জনকে কষ্ট পেতে হয়েছে।
– মাঝে মাঝে কম বেশি সবার ভুল হয় আর ভালোবাসার মানুষের ছোট খাটো ভুল ক্ষমা করে দিতে হয় প্রথমে অনেক রাগ হয়েছিল কিন্তু যখন তোমার জায়গায় নিজেকে রেখে ভেবেছিলাম তখন সব রাগ চলে গিয়েছিল।
পায়রা কেঁদে দিলো ঝাঁপিয়ে পড়লো ইফাতের বুকে। ইফাত বাঁধা দিলো না সেও শক্ত করে পায়রাকে ধরলো। পায়রা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে,
– আর কখনও এমন ভুল করবো না ভালোবাসি ইফাত কথা দিন সবসময় আমার পাশে থাকবেন।
– কথা দিলাম কখনও আমার মন পায়রার থেকে দূরে যাবো না কষ্ট দিবো না।
‘সাবিহা রেডি হতে দেরি হয় কারো? তোর জন্য তো এবার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।’
– আপু আরেকটু অপেক্ষা কর লিপস্টিকটা দিয়ে নেই।
– এমন ভাবে সাজুগুজু করছিস মনে হচ্ছে ওখানে তোর জন্য পাত্রপক্ষ দাঁড়িয়ে আছে।
– কোথাও গেলে একটু সাজতে হয় নে চল এবার আমি রেডি।
– হুম চল।
বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পায়রা আর সাবিহা এয়ারপোর্টে চলে গেল পলাশ শেখ নিজেই এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পায়রা বাঁধা দিয়েছে।
নাম এনাউন্স করতেই সবাই গিয়ে ফ্লাইটে উঠে গেল কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দিলো। পায়রা জানালার পাশে বসে আছে আর সাবিহা পায়রার পাশে বসে মোবাইলে কারো সঙ্গে চেটিং করছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। পায়রা ব্রু উঁচিয়ে,
– আচ্ছা সাবিহা সত্যিই কি তোর আর ইনান ভাইয়ার ব্রেকাপ হয়ে গেছে।
সাবিহা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– এর আগেও অনেকবার বলেছি হ্যা ব্রেকাপ হয়েছে তাহলে আবার কেন প্রশ্ন করছিস?
– তোরা তো দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসতি তারপরেও কেন?
– তোদের এই ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমাদের সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
পায়রা অবাক হয়ে,
– আমার জন্য?
– হ্যা তোর জন্য, তোর জন্য দুই পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে তাই ইনান চায়নি সম্পর্কটা রাখতে তার ধারণা তার মা আমাদের সম্পর্ক মানবে না।
পায়রা পুনরায় জানালার দিকে তাকালো বলার মতো কিছুই নেই তার। এখন পায়রা খুব করে উপলব্ধি করছে তার জন্য শুধু ইফাত নয় বরং নিজের বোন আর ইনানও অনেক কষ্ট পেয়েছে।
প্রায় পনেরো ঘন্টা জার্নির পর অবশেষে আমেরিকায় পা রাখলো পায়রা আর সাবিহা। তাদের সঙ্গে অফিসের দু’জন স্টাফ এসেছে। এয়ারপোর্টে আসতেই একজন লোক পায়রার কাছে এসে ইংরেজিতে বলল,
– আমেরিকায় আপনাদের স্বাগতম স্যার আপনাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।
– শুধুই কি আমাদের?
– না ম্যাম সবার জন্যই এই ব্যবস্থা তবে আপনাদের জন্য আমাকে।
– ওহ।
লোকটির সঙ্গে তার গাড়িতে করে হোটেলে চলে গেল। লোকটি তাদের রুম দেখিয়ে চলে গেল এবং বলে গেল কিছু দরকার হলে যেন তাকে বলে।
পায়রা চেয়েছিল দুই বোন এক রুমেই থাকতে কিন্তু সাবিহা আচমকা না করে দিলো সে নাকি আলাদা রুমে থাকবে পায়রা আর জোর করেনি। পায়রা পোশাক পাল্টে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
_________________
মিটিং আরও দু’দিন পরে হবে এই দু’দিন সিইও নিজের পক্ষ থেকে তাদের ঘুরার খরচ বহন করবে এতে পায়রার প্রথমে আপত্তি থাকলেও বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে তবে এখনও সে সিইও কে দেখেনি।
যে যার যার মতো ইনজয় করছে শুধু পায়রা বাদে এখন আর সঙ্গ ভালো লাগে না নিঃসঙ্গ থাকতেই ভালো লাগে। আগের থেকে পায়রা অনেক বদলে গেছে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কথা বলে সবার সাথে,হাসিটাও এখন আর মন থেকে আসে না শুধু লোক দেখানো হাসি।
সাবিহা এখন ভার্সিটিতে পড়ে আগের থেকে বেশ ফর্সা হয়েছে চুল গুলোও পায়রার মতোই কোমর ছেড়েছে ব্যবহার চাল চলন আগের মতোই আছে।
সময় খুব দ্রুত চলে যায়,দু’দিন কেটে গেছে আজ মিটিং শুরু হবে দশটায়। সাদা জিন্স,কালো শার্ট আর উপরে সাদা রঙের কোর্ট পরিধান করেছে পায়রা, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা দেখতে পুরো বিজনেসওমেন লাগছে।
সাবিহা পলকহীন দৃষ্টিতে পায়রার পানে তাকিয়ে আছে পায়রা খেয়াল করতেই সাবিহাকে প্রশ্ন করল,
– এভাবে কি দেখছিস?
– তোমাকে আপু।
– আগে কখনও দেখিসনি?
– দেখেছি তবে এমন করে নয় আজ তোকে অনেক সুন্দর লাগছে।
– থ্যাঙ্কিউ।
– আমাকেও তোর সঙ্গে নিয়ে যা না।
– ভেতরে কি তোকে ঢুকতে দিবে।
– সমস্যা নেই আমি বাইরে বসে থাকব তারপরেও নিয়ে যা একা একা এখানে বোরিং লাগবে।
– আচ্ছা চল।
সাবিহা খুশি হয়ে পায়রার সঙ্গে বের হলো।সাবিহা আগেই রেডি হয়ে নিয়েছিল আর তারপর পায়রাকে রাজি করালো।
অনেক বড় অফিস নিচে বড় বড় গাড়ি পার্কিং করা অনেক সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। ভেতরে জনমানবে পরিপূর্ণ যে যার যার কাজে ব্যস্ত অন্যদিকে তাকানোর ইচ্ছে যেন তাদের মধ্যে নেই। পায়রা বাইরে খেয়াল করেছে বড় একটা সাইনবোর্ডে কোম্পানির নাম লেখা ই.এম প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিটি কোম্পানির সিইও শুধু মিটিং রুমে প্রবেশ করতে পারবে তাই পায়রা সব কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে সাবিহা আর তার দু’জন স্টাফকে বাহিরে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো।
ভেতরটা অনেক বড় লম্বা একটা টেবিল তার দুইপাশে সাড়ি করে টেবিল রাখা টেবিলের শেষ মাথায় একটা বড় চেয়ার হয়তো ওই চেয়ারেই সিইও বসবে ঠিক সামনে বড় একটা পর্দা।যে যার যার চেয়ারে বসে আছে পায়রা ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা মধ্য বয়স্ক লোক একটা চেয়ার টেনে পায়রাকে বসতে বললো পায়রা বসলো।
একটা লোক ইতোমধ্যে এসে বলে গেছে তাদের স্যার আসছেন। পায়রার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে অনেক নার্ভাস হয়ে গেছে এর আগেও অনেক মিটিং এ উপস্থিত ছিল কিন্তু আজকের মতো একা নয় হয় বাবা সঙ্গে ছিল নয় অফিসের কেউ না কেউ ছিল।
সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ই.এম কোম্পানির সিইও ভেতরে প্রবেশ করলেন সবাই দাঁড়িয়ে গেল। পায়রা পূর্বের ন্যায় বসে আছে লোকটাকে দেখার জন্য পেছনে ঘুরতেই চমকে গেল। সিইও এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো কিন্তু পায়রার দৃষ্টি তার দিকে স্থির ভেতরে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে মাথা ঝিমঝিম করছে লোকটি হেসে হেসে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে এবার সে পায়রার দিকে তাকালো পায়রার সেদিকে খেয়াল নেই পায়রা তো তাকে দেখতে ব্যস্ত।
লোকটি পায়রার সামনে তুড়ি বাজিয়ে,
– আর ইউ ওকে?
– ইফাত!
লোকটি আর কেউ নয় ইফাত। ইফাত পায়রার চোখের সামনে, পায়রা ইফাতকে দেখে অবাক হলেও ইফাতের যেন সেদিকে কোনো হেলদুল নেই মুখে সেই মৃদু হাসি যা দেখে পায়রা বারবার ঘায়েল হয়। ইফাত পায়রার চোখের দিকে তাকিয়ে,
– আমি ই.এম কোম্পানির সিইও ইফাত মির্জা চেনেন আমায়?
পায়রা কোনো উত্তর দিলো না ইফাতের কাছ থেকে আপনি সম্বোধন শুনে ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। পায়রার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ইফাত বলল,
– মিস পায়রা….ওয়েট! মিস নাকি মিসেস?
পায়রা বুঝতে পারলো চিনেও না চেনার ভান ধরছে ইফাত সবার সামনে। পায়রা জোরপূর্বক নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে,
– মিস পায়রা শেখ।
– মিস পায়রা তাহলে আপনার প্রেজেন্টেশনটা দিয়েই শুরু করি?
– সিউর।
কিছুটা নার্ভাস লাগলেও এখন পুরোপুরি নার্ভাস হয়ে গেছে পায়রা বিশেষ করে ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে ইফাতের এমন ব্যবহারে মনে মনে ভাবছে,’উনি কি সত্যি আমায় ভুলে গেছেন? এমন অচেনার মতো কথা বলছে কেন?
ইফাত পায়রাকে ডেকে,
– কি ভাবছেন? তাড়াতাড়ি করুন আমার আরও কাজ আছে।
পায়রা সব ভাবনা ভুলে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিজের প্রেজেন্টেশন সবার সামনে উপস্থাপন করলো।
একে একে বাকি কোম্পানির সিইওরা নিজের কোম্পানি উপস্থাপন করলো। ইফাত কাউকে ফোন দিলো দুয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেতরে আরাফ প্রবেশ করলো। পায়রা যেন আরেক দফা চমকে গেল, অনেকবার আরাফকে ইফাতের খবর জিজ্ঞেস করার পরেও আরাফ ইফাতের খবর দেয়নি উল্টো বলেছে সে নাকি জানে না অথচ পূর্বের ন্যায় আরাফ ইফাতের সঙ্গেই আছে।
আরাফ ইফাতের কাছে গিয়ে,
– স্যার বলুন।
– উনাদের ফাইল গুলো নিয়ে যাও ডিল কোন কোম্পানি পাবে পরশুর মধ্যে জানিয়ে দিবো।
– ঠিক আছে স্যার।
বলেই আরাফ সবার কাছ থেকে ফাইল গুলো নিয়ে চলে গেল।আরাফও এমন ভাব করলো যেন পায়রাকে চেনেই না।ইফাত সবার উদ্দেশ্যে,
– তো আপনারা ভালো করে ঘুরা ঘুরি করুন সমস্যা হলে আপনাদের জন্য নিয়োজিত লোকদের বলবেন।
সবাই সম্মোলিত ভাবে হ্যা বললো। একজন লোক বলে উঠলেন,
– মি.ইফাত মির্জা আপনার বিয়ের দাওয়াত কিন্তু পেলাম না নাকি দেওয়ার ইচ্ছে নেই।
– কাল মেহেদী অনুষ্ঠান হবে ভেবেছিলাম সবাইকে বিকেলেই বলবো এখন যেহেতু কথা উঠলো তাহলে অপেক্ষা করার দরকার কি এখনি দিয়ে দিলাম দাওয়াত।
পায়রা ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে তার মাথায় সবকিছু গুলিয়ে গেছে বুঝতে পারছে না ইফাতের বিয়ে মানে। ইফাত পায়রাকে বলল,
– মিস.পায়রা আপনিও কিন্তু আসবেন কোনো বাহানা শুনবো না।
পায়রার উওরের অপেক্ষা না করে দাঁড়িয়ে পড়লো ইফাত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। যে যার যার মতো চলে যেতে লাগলো হঠাৎ পায়রার মনে হলো,’এ আমি কি করছি এতদিন পর ইফাতকে কাছে পেয়েও এভাবে চলে যেতে দিচ্ছি না না ইফাতের সঙ্গে আমার কথা বলতেই হবে।’
পায়রা ছুটে বেরিয়ে গেল, সাবিহা পায়রাকে দেখে আপু বলে ডাক দিলো কিন্তু সেদিকে পায়রার কোনো খেয়াল নেই পায়রা কিছুটা দৌড়ে যাচ্ছে। ইফাত গাড়িতে উঠার জন্য দরজা খুললো ভেতরে ঢুকতে যাবে পেছন থেকে পায়রা ডাক দিলো,
– ইফাত।
ইফাত সোজা হয়ে দাঁড়ালো কিন্তু পেছনে ফিরলো না হয়তো বুঝে গেছে কে তাকে ডেকেছে। পায়রা ইফাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
– এভাবে আমাকে ইগনোর করছেন কেন? না চেনার ভান কেন করছেন?
– না চেনার ভান কখন করলাম? রেসপেক্ট দিয়েই তো কথা বললাম।
– কোথায় ছিলেন তিন বছর?
– আপনাকে কেন বলবো?
– আপনি করে বলছেন কেন?
– অপরিচিতদের আপনিই বলতে হয়।
– আমি অপরিচিত!
– হুম।
– তাহলে আগে কেন তুমি বলতেন?
– আগের সঙ্গে এখনের অনেক তফাৎ আছে তাই আগের কথা না ভাবাই ভালো।
– সত্যি সত্যি আপনি বিয়ে করছেন?
– হুম বিয়ে না করে আর কতদিন।
পায়রা আর তাকাতে পারছে না চোখ ছলছল করছে দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির করেছে। ইফাত গম্ভীর মুখে,
– আপনি বিয়ে করেননি?
– উহু।
– আপনার আবরার কোথায়? ওর সঙ্গে না আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে,
– আমার কাজ আছে আজ আসি কাল তো দেখা হবেই আসবেন কিন্তু।
ইফাত গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। পায়রা ঠাই দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা পায়রার কাঁধে হাত রাখতেই পায়রা কেঁদে দিলো।সাবিহা পায়রাকে শান্তনা দিয়ে,
– কাঁদছিস কেন আপু সবাই দেখছে।
– ইফাত অন্য কাউকে বিয়ে করবে আমাকে আর ভালোবাসে না।
– সব কথা শুনবো আগে হোটেলে যেয়ে নেই তারপর।
সাবিহা অনেক কষ্টে পায়রাকে নিয়ে হোটেলে চলে গেল। পায়রা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে কান্না করছে আর বিলাপ করছে। সাবিহা মাথায় হাত বুলিয়ে,
– এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।
– অসুস্থ হলে হবো কার কি আমি জানি আমি ভুল করেছি তখন আমার কাছে আমার পরিবারের নিরাপত্তা আমার কাছে সবকিছু ছিল তাই ওসব করেছি কিন্তু সেজন্য তিনটা বছর কত কষ্ট করেছি এমন কোনো দিন বাদ যায়নি আমি ইফাতের জন্য কান্না করিনি সব ভুলে ইফাতকে খুঁজেছি উনার কথা ভেবেছি কিন্তু উনি কি করলেন আমায় ভুলে গেলেন আবার নাকি বিয়েও করবেন হাসি মুখে আমায় ইনভাইট করলেন বাহ।
– আমার সামনে এসব বললে হবে না ইফাত ভাইয়ার সামনে বলতে হবে।
– উনি তো আমার কথা শুনলেন না।
– কাল তো আমরা ওখানে যাবো তখন সুযোগ বুঝে বলে দিবি।
– কাল উনার মেহেদী অনুষ্ঠান।
– আমি আছি তো।
পায়রা বাচ্চাদের মতো সাবিহার কথা মেনে নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
________________
বাড়িতে মানুষজনের আনাগোনা জাঁকজমক ভাবে বাড়ি সাজানো হয়েছে। বড় বড় গায়ক-গায়িকাদের আনা হয়েছে গান গাওয়ার জন্য। এনায়েত মির্জার বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা তিনদিন ধরে শুধু উৎসব হবে আজ থেকেই শুরু। বড় স্টেজ করা হয়েছে যেখানে নাচ গান হবে আর তার থেকে খানিকটা দূরে। বড় দু’টো সিংহাসনের মতো চেয়ার পাশাপাশি রাখা।
সন্ধ্যার পর সবাই চলে এসেছে। পায়রা আর সাবিহাকে আনার জন্য আরাফ নিজে গিয়েছে। পায়রা আরাফকে অনেক প্রশ্ন করেছে কিন্তু আরাফ শুনেও না শোনার ভান ধরে ছিল।
পায়রা আর সাবিহা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি থাকলেও ভেতরটা যেন ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে পায়রার। ইফাত সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর তার পাশে একটা মেয়ে ইফাতের হাত ধরে নামছে দু’জনের মুখেই হাসি। দু’জনে গিয়ে ওই চেয়ার দুটিতে বসলো, মেয়েটির মুখের গঠন বেশ ভালো তবে অনেক মেকআপ করা যার দরুন চামড়ার আসল রঙ বুঝা দায়। ইফাতের পরনে কালো একটা পাঞ্জাবী যার উপরে সোনালী রঙের স্টোনের কাজ মেয়েটাও ইফাতের সঙ্গে ম্যাচিং করে একই রঙ এবং কাজের শাড়ি পড়েছে। পায়রা ভাবছে,’ আজ এভাবে ইফাতের পাশে আমার থাকার কথা ছিল তাহলে কেন এমনটা হলো?’
পায়রা আর নিতে পারছে না মনে হচ্ছে এখনি যেন মাথা ঘুরে যাবে সাবিহার হাত আরো শক্ত করে ধরলো। সাবিহা বোনকে শান্তনা দিয়ে,
– আপু নিজেকে শক্ত কর সবার সামনে একদম ভেঙে পরবি না।
ইতি বেগম এনায়েত মির্জাও চলে এলেন এতক্ষণ পর ইনানকে দেখা গেল। ইতি বেগম পায়রাকে দেখে এগিয়ে এসে,
– কেমন আছো পায়রা?
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ, তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?
– সবাই ভালো।
– ইফাতের হবু বউকে কেমন লাগছে? দু’জনকে বেশ মানিয়েছে তাই না জানো আমি তুবাকে পছন্দ করেছি ইফাতের জন্য।
এতক্ষণ পর জানা গেল মেয়েটির নাম তুবা কিন্তু ইতি বেগমের কথা যেন পায়রার কাছে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো।ইতি বেগম আবারো বলা শুরু করলেন,
– তোমার বিয়ে হয়েছে নিশ্চই তোমার হাজব্যান্ড কোথায়?
– আমি অবিবাহিত।
– কি বলো এখনও বিয়ে হয়নি সেদিন না তোমার বাবা তোমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করলো।
– হয়নি বিয়ে।
– ওহ।
ইতি বেগমকে তার ননদ ডাক দিতেই তিনি চলে গেলেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে পায়রা শুধু ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছে ইফাতের কোনো হেলেদুল নেই পায়রার দিকে একবারও তাকায়নি সে তো নিজের হবু বউয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত দু’জনের মুখে কি সুন্দর হাসি।
প্রোগ্ৰাম কিছুক্ষণের জন্য থামানো হয়েছে শোনা যাচ্ছে আজই নাকি দু’জনের বিয়ের রেজিস্ট্রি হবে তারপর মেহেদী পড়ানো হবে পরশু ইসলামিক শরিয়া মোতাবেক বিয়ে হবে।
সবাই উৎসুক হয়ে তাদের ঘিরে রেখেছে একজন কালো কোর্ট পরিহিত লোক কাগজ নিয়ে বসে আছে। ইফাত আর তুবা নামক মেয়েটাও গিয়ে বসেছে, তুবা সেই তখন থেকেই ইফাতের হাত ধরে আছে ছাড়ছেই না পায়রার ভেতর পুড়ছে। লোকটা সাইন করার জন্য একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। সাবিহা পায়রাকে ঝাঁকিয়ে,
– আপু তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস একবার সাইন হয়ে গেলে তোর কিছু করার থাকবে না ইফাত ভাইয়াকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলবি।
তুবা ইতোমধ্যে সাইন করে দিয়েছে ইফাতও হাতে কলম তুলে নিলো সাইন করার জন্য যেই সাইন করতে যাবে তৎক্ষণাৎ কেউ তার হাত থেকে কলমটা নিয়ে গেল।ইফাত ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে পায়রাকে দেখতে পেল বসা থেকে উঠে,
– কলম কেন নিলেন?
পায়রা সবার সামনেই ইফাতকে জড়িয়ে ধরলো এতে সবাই চমকে গেছে কিন্তু ইফাত চুপ করে আছে। পায়রা কান্না জড়িত কন্ঠে,
– তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না আমি তোমাকে ভালোবাসি ইফাত আমি মানছি আমি ভুল করেছি তাই বলে এত বড় শাস্তি দিতে পারো না এই তিনটা বছর কি কম কষ্ট পেয়েছি প্লিজ এমনটা করো না।
তুবা যেন অনেক রেগে গেছে সেও দাঁড়িয়ে গেল মুহুর্তে পায়রাকে এক টানে ইফাতের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মা’রা’র জন্য উদ্ধত হলো তখনি ইফাত তুবার হাত ধরে ফেলে। ইফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেছে তুবা ইফাত ক্ষীণ স্বরে,
– নিজের লিমিটে থাকার চেষ্টা করবে নইলে হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না।
বলেই তুবার হাত ছেড়ে দিয়ে পায়রার দিকে তাকিয়ে,
– যখন আমি বারবার ভালোবাসি বলে তোমার কাছে গিয়েছিলাম তখন অনেক অপমান করেছ তারপরেও ভালোবেসে গেছি তারপর কি করলে সবার সামনে অপমান করলে থাপ্পড় মা’র’লে আর এখন এসেছ ভালোবাসা দেখাতে? সমস্যা থাকতেই পারে তবে উচিত ছিল আমাকে জানানোর তাহলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতিতে আমাদের পরতে হতো না অতীত মনে করতে চাই না তুমি তোমার মতো থাকো আমাকেও আমার মতো থাকতে দাও এই বিয়ে হচ্ছে তোমার ইচ্ছে না হলে তুমি চলে যেতে পারো।
– ইফাত!
– প্লিজ এসব ড্রামা করো না তোমার ড্রামায় আমি গলছি না।
পায়রাকে নিজের থেকে সরিয়ে ইফাত পুনরায় বসে পড়লো তুবাও বসেছে। ইফাত দ্রুত কাগজে সাইন করে দিতেই সবাই করতালি দিয়ে স্বাগতম জানালো। পায়রার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে দৌড়ে এখান থেকে বেরিয়ে গেল।সাবিহাও আর দেরি না করে পায়রার পেছনে পেছনে গেল তার ভয় হচ্ছে পায়রাকে নিয়ে।
হোটেলে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বিছানায় বসলো পায়রা।সাবিহা ভয়ে ভয়ে পায়রার পাশে বসে পায়রাকে পর্যবেক্ষণ করছে কিছুক্ষণ আগে বাচ্চাদের মতো কাঁদলেও এখন চোখে কোনো পানি নেই পুরো শান্ত। পায়রা উঠে গেল আলমারির সামনে কাপড় বের করে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে,
– সাবিহা সব গুছিয়ে নে আজ আমরা বাড়ি ফিরবো।
– আজ! কিন্তু আপু আমাদের তো চারদিন পর ফেরার কথা।
– যা বলছি তাই কর।
সাবিহা চুপচাপ গিয়ে সব গুছগাছ শুরু করলো। হোটেল থেকে বের হতে রাত এগারোটা বাজলো বারোটার একটা ফ্লাইট আছে সেটায় করেই তারা বাংলাদেশে ফিরবে।
‘এই মাঝরাতে তুমি আমার বাড়িতে কি করছো? তোমার বাবা জানে তো তার মেয়ে যে অন্যের বাড়িতে লুকিয়ে প্রবেশ করেছে?
ইনান আর পায়রা এনায়েত মির্জার কাছে ধরা পড়ে গেছে। ইফাত ঘুমিয়েছে নাকি দেখার জন্য এনায়েত মির্জা ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন।ইফাতের ঘর দু’তলায় আর এনায়েত মির্জা এবং ইতি বেগম নিচ তলায় থাকেন।ড্রয়িং রুম পেরিয়ে তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয় আর তখনি অন্ধকারে দু’জন ব্যক্তির অবয়ব দেখে আলো জ্বালিয়ে পায়রাকে দেখে তিব্র রেগে গেছেন এনায়েত মির্জা। পায়রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে কিছু বলার মতো মুখ নেই তার এনায়েত মির্জা পায়রার মৌনতা দেখে আরও চটে গিয়ে,
– চুপ করে আছো কেন? আমার বাড়িতে কি চাই? ইনান তুই এখানে কেন?
এনায়েত মির্জা ব্রু জোড়া খানিকটা কুঁচকে,
– আমার বড় ছেলেকে অপমান করে এখন কি ছোট ছেলের পেছনে লেগেছ?
ইনান আর পায়রা এনায়েত মির্জার দিকে তাকালো ইনান প্রতিবাদ করে,
– বাবা কি বলছো এসব?
পায়রা অসহায় কন্ঠে,
– এসব কি বলছেন আঙ্কেল ইনান ভাইয়াকে আমি সবসময় নিজের ভাই মনে করি।
ইতি বেগম ইফাতের দাদীও উঠে ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে তারা কিছুক্ষণ আগেই ইফাতের কাছ থেকে এসে শুয়েছিল তাই কথার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। পায়রাকে দেখে ইফাতের দাদী মুখ বাঁকিয়ে,
– এই মাইয়া এত রাইতে এনে কি করে?
ইতি বেগম শাশুড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে,
– তুমি এখানে কেন পায়রা? ভেতরে আসলে কিভাবে?
– ইফাতকে দেখতে এসেছি।
– দাদু ভাইরে দেখতে আইছো? কাইল কত কথা কইলা তোমার লাইগা আমার নাতির এমন অবস্থা হইছে আবার কি ক্ষতির করার ইচ্ছা আছে?
পায়রা টলমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– আমি জানি আমি অনেক বড় ভুল করেছি তাও একবার ইফাতের সঙ্গে আমায় দেখা করতে দিন তারপর চলে যাবো।
– আমার ছেলের সঙ্গে আর কখনও তোমার দেখা হবে না আমি থাকতে কখনোই না।(ইতি বেগম)
– আন্টি প্লিজ এমন বলবেন না শুধু একবার দেখা করতে দিন এই তিনটা দিন অনেক কষ্টে ছিলাম ইফাতের সঙ্গে দেখা করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি আজ এতকাছে এসে না দেখে কিভাবে চলে যাবো।
– একদম কান্না করবে না চোখের পানি দিয়ে আমাদের মন ভুলাতে পারবে না।
ইফাত জেগেই ছিল বাইরের চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে উঠে বসেছে পায়ে অনেক ব্যথা ব্যান্ডজ করা যার কারণে হেঁটে দরজা পর্যন্ত যাওয়াই অসম্ভব। কথাগুলো শুনার চেষ্টা করেও পুরোপুরি শুনা যাচ্ছে না শুধু চেঁচামেচির মতো শব্দ ভেসে আসছে। মনের ভেতরটা ছটফট করছে ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না কিন্তু নিচে যাওয়ার অবস্থায় সে নেই তাই গলা খাঁকারি দিয়ে,
– মা নিচে এত আওয়াজ হচ্ছে কিসের? কিছু কি হয়েছে?
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পায়রার ভেতরে যেন ঠান্ডা এক স্রোত বয়ে গেল।ইতি বেগম আর ইফাতের দাদীর চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট তারা কেউই চায় না ইফাত আর পায়রা মুখোমুখি হোক। ইফাতের দাদী ইতি বেগমের উদ্দেশ্যে,
– বউমা আমি দাদু ভাইয়ের কাছে যাই তোমরা মিলে এই মাইয়ারে বাইর করো বাড়ি থাইকা।
– আপনি সিড়ি বেয়ে যেতে পারবেন মা?
– পারমু যা বলছি তাড়াতাড়ি করো আমি চাই না এই মাইয়ার কারণে আমার নাতি কষ্ট পাক।
ইতি বেগম শক্ত করে পায়রার হাত ধরলো। পায়রা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে,
– আন্টি ছাড়ুন আমায় আমি ইফাতের কাছে যাবো এমন করবেন না।
– একদম চুপ আমি চাই না ইফাত জানুক তুমি এখানে এসেছ।
ইনান এসে,
– মা এমন করছো কেন? একবার দেখা করতে দাও তারপর না হয় তাড়িয়ে দিও।
– তুই চুপ কর আগে ওকে বিদায় করি তারপর তোকেও দেখে নিবো।
বলেই পায়রাকে টানতে টানতে নিয়ে গেইটের বাইরে বের করে দিলো। পায়রা অনেক অনুরোধ করেও একবার ইফাতকে দেখতে পারলো না কথাও বলতে পারলো না।
ইফাতের দাদী ইফাতের ঘরে আসতেই ইফাত প্রশ্ন করল,
– তুমি উপরে উঠতে গেলে কেন আর নিচে কি এমন হয়েছে?
– ওইসব তোর ভাবতে হইবো না তুই ঘুমা।
– আগে বলো কি হয়েছে?
– ইনান দাদুভাই দেরি করে বাড়ি আইছে বইলা তোর মা রাগারাগী করছে।
– ইনান তো বাড়িতেই ছিল সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করে গেল।
– মনে হয় আবার বাহির হইছিল তুই ঘুমা আমি চুলে বিলি কেটে দেই।
ইফাত আর কিছু না বলে চুপ করে শুয়ে পড়ল ইফাতের দাদী তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে ইফাত চোখ বন্ধ করে রেখেছে। একপর্যায়ে ইফাত ঘুমিয়ে পড়তেই তার দাদী দরজা পুনরায় চাপিয়ে চলে গেলেন। ইতি বেগম শাশুড়ির দিকে এগুতে উনি বললেন,
– চিন্তা করো না বউমা আমি বানিয়ে একটা কথা বলে দিয়েছি।
– ঘুমিয়েছে?
– হুম।
– মা আপনিও শুবেন চলুন।
পায়রা বাড়িতে আসতেই সদর দরজা খোলা দেখলো ভেতরে আলো জ্বলছে ভয়ে ভয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই বাড়ির সবাইকে দেখে অবাক হয়ে গেল। পায়রাকে দেখেই পলাশ শেখ গিয়ে ঠাসিয়ে একটা চড় মা’র’লো। পায়রা বেগ না পেয়ে নিচে পড়ে গেছে। পলাশ শেখ জোরে চেঁচিয়ে,
– তোর জন্য আর কত অপমানিত হবো? তুই নিজেই ইফাতের নামে খারাপ কথা বললি ছবি দেখালি আর আজ তুই এত রাতে লুকিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েছিস?
পায়রা গালে হাত দিয়ে রেখেছে চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মনে মনে প্রশ্ন করছে,’বাবা জানলো কিভাবে?’
পলাশ শেখ ধমক দিয়ে,
– তোর জন্য দুই পরিবারের এতদিনের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে তাও কিছু বলিনি আজ এমন একটা ঘটনা ঘটালি সেটা আবার এনায়েতের কাছ থেকে শুনতে হলো, কি লজ্জা।
– আমি বাধ্য হয়ে কাল ওইসব বলেছি আমি তো ইফাতকে…
আবরার দ্রুত এসে পায়রাকে থামিয়ে দিয়ে,
-আঙ্কেল যা হওয়ার হয়ে গেছে, সাবিহা পায়রাকে ঘরে নিয়ে যা।
সাবিহা পায়রাকে নিয়ে দ্রুত ঘরে চলে গেল। আবরার পলাশ শেখের কাছে গিয়ে,
– খালু এমন করলে হিতে বিপরীত হবে আমাদের উচিত পায়রাকে ভালো করে বুঝানো তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
পলাশ শেখ আবরারের কথায় সায় দিলেন। আবরার এই সুযোগে পলাশ শেখের সঙ্গে অনেক সখ্যতা গড়ে তুলেছে এবং বিশ্বাস যোগ্য হয়ে গেছে যার দরুন আবরারের সব কথা নিঃসন্দেহে মেনে নেন।
সাবিহা পায়রাকে নিয়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে,
– দেখা হয়েছে ভাইয়ার সঙ্গে? সব বলেছিস?
পায়রা একে একে সব কথা বলল সাবিহাকে।সাবিহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,
– কি থেকে কি হয়ে গেল তোর উচিত ছিল প্রথমেই সবটা ইফাত ভাইয়াকে জানানো তাহলে হয়তো আজ এমনটা হতো না।
– এখন ওইসব ভেবে কি হবে তখন আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম মাথা কাজ করছিল না ভেবেছিলাম পরে সবাইকে বুঝিয়ে দিব কিন্তু পরিবেশ কি হয়ে গেল ইফাতকে একটু চোখের দেখাও দেখতে পারলাম না।
– ইফাত ভাইয়া সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তার আগে কিছু করা সম্ভব নয় আর হ্যা জেঠুর সামনে ইফাত ভাইয়ার নাম উচ্চারণ করবি না।
– বাবাকে সব বললে ঠিক বুঝবে।
– এখন কিছুই বুঝবে না বুঝলেও আবরার ভাইয়া কিছু বুঝতে দিবে না এই তিনদিনে জেঠুকে নিজের কথার ছলে ভুলিয়েছেন এখন উনার কথাই জেঠুর ঠিক মনে হয়।
– তাহলে তো আবরার ভাইয়াকে বিয়ে করতে হবে।
– সবার সামনে রাজি হয়ে যাবি কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করবি কেন ইফাত ভাইয়ার বাবাকে জেঠু বলেছিল তোর পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে দিবে তুই যদি এবারো জেঠুর কথা মতো চলিস তাহলে এখনও তেমনটাই হবে।
– হুম যা বলবি আমি শুনবো ইফাতকে পাওয়ার জন্য সব করতে রাজি আমি।
__________________
পেরিয়ে গেছে তিন বছর।এই তিন বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে শুধু বদলায়নি ইফাতের প্রতি পায়রার ভালোবাসা। পায়রা পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছে আবরারের সঙ্গে বিয়েটাও ভেঙ্গে দিয়েছে পলাশ শেখ রাগারাগী করলেও পায়রা একান্তে সবটা বুঝিয়ে বলতেই তিনিও মেনে নিয়েছিলেন। আবরার পায়রাকে অনেক অনুরোধ করেছিল কিন্তু পায়রা আবরারকে কোনো সুযোগ দেয়নি।
অশমির বিয়ে হয়ে গেছে বলতে গেলে জোর করে দেওয়া হয়েছে আবরার নিজেই ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছে বোনকে। অশমি এখন নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত পায়রার কাছে অনেক ক্ষমা চেয়েছে পায়রাও ক্ষমা করে দিয়েছে। আড়াই বছর অপেক্ষা এবং চেষ্টা করেও পায়রার মন পায়নি আবরার,শেষে আতিফা বেগম বাধ্য করে আবরারকে বিয়ে দেয় প্রথমে না মানলেও এখন মেনে নিয়েছে বিয়েটা তবে সুখে নেই।
তিন বছর অতিবাহিত হলো অথচ এই তিন বছরে একটাবারের জন্যও ইফাতকে দেখতে পায়নি পায়রা অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি যে ইচ্ছে করে হারায় তাকে খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।
সেদিন পায়রাকে পুনরায় ঘর বন্দি করা হয়।সাবিহার কথা মতো সে সবটা যখন মেনে নিয়ে সবার সামনে পরিবর্তন হওয়ার নাটক করলো তখন সবাই আবারো পায়রাকে স্বাধীনতা দেয়। আবারো ভার্সিটি যাওয়া শুরু করেছিল পায়রা তারপর ইফাতের সঙ্গে দেখা করার জন্য অনেক চেষ্টা করে কিন্তু ইফাতের কোনো খোঁজ পায় না।
ইফাতের বাড়িতেও গেছে দারোয়ানের কাছ থেকে জানা গেছে তারা বাড়িতে নেই কোথায় গেছে জানে না। অফিসে গিয়ে আরাফকেও জিজ্ঞেস করেছে তারও এক কথা জানি না।সবাই সব জানে কিন্তু কেউই কিছু বলবে না তাই নিজেই খোঁজছিল আর তিন বছর পেরিয়ে গেল দেখা মিললো না। ইনানের নাম্বারে ফোন করেছিল,ইনান পায়রাকে ব্লক করে দিয়েছে। ইফাতের নাম্বার ব্লক ছাড়িয়ে ফোন দিলেও কাজ হয়নি নাম্বার বন্ধ।
তিনবছর ধরে প্রতিদিন পায়রা এই নাম্বারে কল দেয় এই আশায় হয়তো একদিন বন্ধ সিম চালু হবে আর ইফাতের সেই কন্ঠস্বর শুনবে আশা পূর্ণতা পায়নি। পায়রার ধারণা সাবিহা সবটা জানে কিন্তু সাবিহা আজ পর্যন্ত মুখ খুলেনি।
পায়রা অফিসে নিজের কেবিনে বসে আছে। তাদের কোম্পানি এখন বেশ নামকরা এতে পায়রার অবদান অনেক ।অল্প সময়ে ব্যবসা শিখে গেছে পায়রা,পলাশ শেখ এখন আর তেমন অফিসে আসেন না মেয়ের উপর দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন। পায়রা বসে বসে ল্যাপটপে কিছু করছে তার ম্যানেজার ভেতরে প্রবেশ করে,
– ম্যাম আমাদের কোম্পানির জন্য বড় একটা কাজের সুযোগ আছে এতে কোম্পানি আরো বড় করা যাবে।
পায়রা তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– প্রতিপক্ষ কোম্পানি কয়টা?
– ম্যাম পাঁচটা।
– এই কাজটা পাওয়ার জন্য যা যা করতে হয় করুন।
– ম্যাম এ জন্য আপনাকে আমেরিকা যেতে হবে কোম্পানিটা ওখানকার তবে কোম্পানির সিইও বাংলাদেশী ওরা চাইছে এবারের কাজটা বাংলাদেশের ভালো কোনো কোম্পানিকে দিতে ছয়টা কোম্পানির মধ্যে আমাদের কোম্পানিকেও সিলেক্ট করেছে।
– কোম্পানির সিইও সিলেক্ট করেছে নাকি?
– উনার কোম্পানির এই বিষয়ক নির্ধারিত লোক করেছে আর উনার পি.এ আমাদের জানিয়েছে।
– কবে যেতে হবে?
– এক সপ্তাহ পরে মিটিং হবে তাই যত আগে যাওয়া যায়।
– আপনি যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।
– ঠিক আছে ম্যাম।
পায়রা অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল।পলাশ শেখ সোফায় বসে চা খাচ্ছেন উনার পাশে সবেমাত্র এসে আসমা বেগম বসলেন। পলাশ শেখ চায়ের কাপ টি টেবিলে রেখে মুখটা গম্ভীর করে,
– বুঝলে আসমা পায়রার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে আমার।কি একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেল মির্জা পরিবারের কোনো খবর পেলাম না আমাদের মেয়েটাও ইফাতের অপেক্ষায় তিনটা বছর কাটিয়েছে।
– মেয়ের জন্য কি আমার কম চিন্তা হয়? যতই ও ভালো থাকার অভিনয় করুক আমি তো জানি সবার আড়ালে রাতে চোখের পানি দিয়ে বালিশ ভেজায় মা হয়ে কি এসব সহ্য করা যায়।
– ও তো এক জিদ নিয়েই বসে আছে ইফাত ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবে না এমনটা আর কতদিন চলবে কম চেষ্টা তো করিনি কিন্তু কি হলো ইফাতকে কোথাও পাইনি।
পায়রা বাড়িতে চলে এসেছে, পায়রাকে দেখেই দু’জনে থেমে গেল। পায়রা বাবার পাশে বসে,
– কি কথা হচ্ছিল? আমাকে দেখেই থেমে গেলে যে।
– বাবা আমাদের কোম্পানির জন্য বড় একটা কাজের সুযোগ পেয়েছি তাও আবার আমেরিকার এক কোম্পানির সঙ্গে।
– এটা বেশ ভালো খবর।
– কিন্তু এ জন্য আমাকে আমেরিকা যেতে হবে।
– একা একা তোর কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।(আসমা বেগম)
পায়রা বাবার দিকে তাকিয়ে,
– বাবা মা’কে বুঝাও প্লিজ।
সাবিহা ভার্সিটি থেকে সবেমাত্র বাড়িতে আসলো ওদের কথা কিছুটা শুনে উৎসুক হয়ে,
– সমস্যা নেই আমিও আপুর সঙ্গে যাবো তাহলে আর তোমাদের চিন্তা থাকবে না আর আমিই আপুকে দেখে রাখবো।
পায়রা সাবিহার কান টেনে,
– পাকামি হচ্ছে? পড়াশোনা নেই?
– কিছুদিন আগেই পরীক্ষা গেছে আপাতত এখন আমি ফ্রি এই সুযোগে একটু ঘুরে আসা হবে অনেকদিন ঘুরা হয় না।
পলাশ শেখ আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হেসে,
– তাহলে ঠিক আছে দুই বোন মিলে ঘুরে আয় সাথে কাজটাও হয়ে যাক।
– তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই (আসমা বেগম)
সিদ্ধান্ত হয়ে গেল আগামীকাল পায়রা এবং সাবিহা আমেরিকা যাবে তাদের সঙ্গে অফিসের কিছু স্টাফও যাবে।
পায়রা ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় চলে গেল।এই বারান্দায় আসলে বারবার ইফাতের কথা মনে পড়ে কারণ যখন পায়রাকে দেখতে ইচ্ছে হতো তখন এই বারান্দা দিয়েই তো তার কাছে আসতো। পায়রা ইফাতের ছবিটা বের করে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে আছে,ছবিটা পায়রাই তুলেছিল লুকিয়ে গত তিন বছর ধরে এই ছবি দেখেই কষ্ট নিবারণ করছে।
ছবির দিকে তাকিয়ে অভিমানী সুরে,
– এই আপনার ভালোবাসা ইফাত? আপনি আমায় বলেছিলেন কখনও আমায় ছেড়ে যাবেন না তাহলে আজ কেন আড়াল হয়ে গেলেন? কেন নিজেকে লুকিয়ে নিলেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন না আপনার মন পায়রার অনেক কষ্ট হচ্ছে আপনাকে ছাড়া থাকতে?
‘আপু সর্বনাশ হয়ে গেছে ইফাত ভাইয়ার বড় এক্সিডেন্ট হয়েছে।’
পায়রা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– কি যা তা বলছিস?
– যা তা নয় সত্যি কথা গতকাল এখান থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এক্সিডেন্ট হয় অবস্থা খুব খারাপ।
পায়রার মাথা যেন ঝিমঝিম করছে। ঘুম থেকে উঠতে অনেক বেলা হয়ে গেছে বাড়ির সবার ডাকে বাধ্য হয়েই দরজা খুলে দেয়। আসমা বেগম জোর করে খাবার খাইয়ে চলে যেতেই বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল পায়রা,কিন্তু সাবিহার এমন কথায় মাথা কাজ করছে না চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর ছটফট বেড়ে গেছে। পায়রা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে,
– কোন হাসপাতালে আছে ইফাত? এখনি যেতে হবে আমায়।
– তুই গিয়ে কি করবি কাল তো কম অপমান করিসনি তাহলে এখন কেন যেতে চাইছিস?
– পাকামি করবি না এমনিতেই খুব চিন্তা হচ্ছে।
– আমি পাকামি করছি না তোর কি মনে হয় না আজ ইফাত ভাইয়ার এমন অবস্থার জন্য তুই দায়ী। তোকে ভালোবেসে নিজের করে চেয়েছিল এটা কি অন্যায়?
পায়রার মনেও যেন এখন এই কথাই ঘুরছে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে।সাবিহা পায়রার ঘর থেকে চলে গেল, পায়রা মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দ্রুত নিচে নামলো বাড়ি থেকে বের হতে যাবে তখনি পলাশ শেখ পেছন থেকে ডেকে,
– কোথায় যাচ্ছিস পায়রা?
পায়রার চোখ এখনও ভিজে আছে, কাঁপা কাঁপা গলায়,
– বাবা ইফাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে।
পলাশ শেখ ব্রু কুঁচকে,
– কবে?
– গতকাল রাতে।
– এখন কেমন আছে?
– অবস্থা খুব খারাপ।
– আচ্ছা তুই ঘরে যা।
– না বাবা আমি ইফাতের কাছে যাবো নিয়ে যাবে?
কোত্থেকে যেন আবরার চলে এলো পায়রার কাছাকাছি যেতে যেতে,
– কালকের কথা তোর মনে নেই পায়রা? ওই খারাপ ছেলেটাকে আজ দেখতে যেতে চাইছিস।
– আমি কিছু মনে করতে চাই না আমি শুধু ইফাতের কাছে যেতে চাই।
বলেই পায়রা সদর দরজার দিকে যাওয়া ধরলো কিন্তু যেতে পারলো না আবরার পায়রার হাত ধরে নিয়েছে। আবরার রাগ দেখিয়ে,
– তুই কোথাও যাচ্ছিস না ইফাত ম’রে যাক তাতে আমাদের কি? ইফাতের সঙ্গে আমি তোকে দেখা করতে দিবো না।
– আবরার ভাইয়া বেশি হয়ে যাচ্ছে তোমার সাহস হয় কি করে আমার হাত ধরার?
আবরার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পলাশ শেখের দিকে তাকিয়ে,
– খালু পায়রাকে যেতে দেওয়া উচিত হবে না কালকের ঘটনা আমরা সবাই দেখেছি এর পরেও…
পলাশ শেখ একটু ভেবে,
– হুম পায়রা ঘরে যা কোথাও যাওয়া হচ্ছে না তোর ইফাতের নাম মুখেও আনবি না আর।
– বাবা এমনটা বলো না আমার ইফাতের কাছে যেতেই হবে।
কেউ আর পায়রার কথা কানে নিলো না আবরার টানতে টানতে পায়রাকে ঘরে নিয়ে গেল। পায়রাকে ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজা আটকে দিলো আবরার। আবরার কিছুতেই চায় না পায়রার সঙ্গে ইফাতের দেখা হোক।
______________
কিছুক্ষণ আগেই ইফাতের জ্ঞান ফিরেছে, মাথা আর হাতে ব্যান্ডজ করা পায়েও কিছুটা আঘাত লেগেছে, হাতে স্যালাইন লাগানো। ইতি বেগম ভেতরে প্রবেশ করেই ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। এনায়েত মির্জা পাশে বসে,
– অনেক কষ্ট হচ্ছে তাই না রে?
ইফাত জোরপূর্বক হেসে,
– না বাবা।
– আরও দু’দিন হাসপাতালে থাকতে হবে তারপর বাড়ি।
ইফাত কিছু বলল না।ইতি বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে,
– দেখে গাড়ি চালাতে পারিস না? কিছু হয়ে গেলে আমার কি হতো?
– দেখেই চালাচ্ছিলাম কিন্তু উল্টো পাশ থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মা’রে গাড়িতে, গাড়ির সাথে সাথে আমার অবস্থাও এমন হয়ে গেল।
একটা নার্স আর ডাক্তার ভেতরে প্রবেশ করে,
– পেশেন্টের সঙ্গে আর কথা বলা যাবে না এখন বিশ্রামের সময়।
ইফাতকে একটা ইনজেকশন পুশ করে ডাক্তার,নার্স চলে গেল।ইতি বেগম এনায়েত মির্জাও কিছুক্ষণ থেকে বেরিয়ে গেল।
ইফাতের দাদী নাতির এক্সিডেন্টের খবর শুনে অসুস্থ হয়ে গেছেন হাসপাতালে আসার জন্য অনেক বলেছেন কিন্তু এনায়েত মির্জা আনেননি যদি আরও অসুস্থ হয়ে যায় এই ভয়ে।
ইতি বেগম বাধ্য হয়ে বাড়িতে চলে গেছেন একদিকে ছেলে হাসপাতালে ভর্তি আরেকদিকে শাশুড়িও অসুস্থ। এনায়েত মির্জা এবং আরাফ হাসপাতালে বসে আছে ইনানকে ইতি বেগমের সঙ্গে পাঠানো হয়েছে।
এনায়েত মির্জা আরাফকে ডেকে,
– যেই ট্রাকের জন্য ইফাতের এক্সিডেন্ট হয়েছে সেই ট্রাক আর ট্রাক মালিকের পুরো ডিটেইলস আমার চাই।
– আমি সকালেই লোক লাগিয়ে দিয়েছি বড় স্যার।
– খুব ভালো,তুমি অনেক উপকার করেছ আরাফ।
– এটা আমার কর্তব্য ইফাত স্যারকে আমিও আপনাদের মতো ভালোবাসি, স্যারের সঙ্গে অনেক দিন ধরে আছি এটুকু সামান্য।
এনায়েত মির্জা আরাফের কাধে হাত রাখলেন।
পায়রা পুরো ঘর উলোট পালোট করে ফেলেছে দরজা ধাক্কানোর পরেও কেউ খুলেনি। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে , হঠাৎ করেই কিছু একটা ভেবে মোবাইল হাতে নিলো।ইনানের নাম্বার পায়রার কাছে আছে তাই ইনানকে কল দিলো কিন্তু ইনান কল ধরছে না অনেকবার কল দেওয়ার পরেও একই অবস্থা। আর কোনো উপায় না পেয়ে এবার সাবিহাকে কল দিতেই সাবিহা রিসিভ করে,
– কি হয়েছে বল?
– আমাকে ঘরে আটকে রেখেছে প্লিজ বের কর এখান থেকে ইফাতের সঙ্গে আমার দেখা করতেই হবে আমি নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই একটা সুযোগ করে দে।
– তোর কষ্ট বুঝতে পারছি কিন্তু তোকে ঘর থেকে বের করা সম্ভব নয় আবরার ভাইয়া এখনও আমাদের বাড়িতেই ঘরে তালা দেওয়া চাবিও তার কাছে।
– আমি কি ইফাতকে দেখতে পারবো না?
– আমি দেখছি কি করা যায় আর চিন্তা করিস না ইফাত ভাইয়ার জ্ঞান ফিরেছে এখনও হাসপাতালে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ হলে না হয় দেখা করবি।
পায়রা আর কিছু বলল না ফোনটা রেখে দিলো ইফাতের জ্ঞান ফেরার কথা শুনে ভয় কিছুটা কমেছে তবে চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হয়নি।
আবরার নিজের বাড়িতে যেতেই আতিফা বেগম ছেলেকে ডেকে,
– এভাবে পায়রাকে আটকে রাখা তোর উচিত হয়নি।
– ওকে আটকে না রাখলে ইফাতের কাছে চলে যেত।
– জোর করে কোনো কিছুই হয় না নিজ যোগ্যতায় অর্জন করে নিতে হয় তোর কি মনে হয় এভাবে আটকে রাখলেই পায়রা ইফাতকে ভুলে যাবে?
– ভুলতে ও বাধ্য না ভুললেও সমস্যা নেই বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।
– তোর ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের কারণে ওই সময় তোদের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম এখন বুঝতে পারছি কতবড় ভুল করেছি হয়তো আমাকেও ভোগতে হবে।
– এতকিছু চিন্তা করো না তো আমি ঘরে গেলাম।
আতিফা বেগম নাস্তা নিয়ে আবরারের ঘরে গেছিলেন আবরার ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছিল আর তখনি সবটা তিনি শুনেন।আবরারকে অনেক বুঝান কিন্তু আবরার কিছু বুঝলো না বরং উনাকে বলল,’তুমি যদি এসব কাউকে বলে দাও তাহলে আমি নিজের ক্ষতি করে ফেলব মা।’
ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্যায় চুপ করে মেনে নিয়েছেন।
_______________
দু’দিন কেটে গেল ইফাতের অবস্থা আগের থেকে বেশ ভালো কিন্তু ঠিক মতো হাঁটতে পারে না পায়ের ক্ষত এখনও পুরোপুরি ভালো হয়নি ডাক্তার বলে দিয়েছে এক মাস বিশ্রাম নিতে হবে। ইফাতকে ইনান আর আরাফ মিলে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।ড্রয়িং রুমে দাদীর সঙ্গে দেখা করে তার অভিমান ভাঙিয়ে তারপর নিজের ঘরে গেছে বলতে গেলে আরাফ দিয়ে এসেছে।
তিনদিন ধরে খাঁচার বন্দি পাখিদের মতো পায়রাও বন্দি হয়ে আছে নিজের ঘরে।মেয়ের কান্নাকাটি, অভিমানে পলাশ শেখের মন গললেও আবরারের বিভিন্ন যৌক্তিক কথায় আবারো কঠোর হয়ে গেছেন। আবরারের পরামর্শে এনায়েত মির্জার সঙ্গে পার্টনারশিপ বিজনেসটাও শেষ করে দিয়েছেন, ইফাতের কানেও খবরটা পৌঁছে গেছে।
একটা ভুল বোঝাবুঝিতেই দুই পরিবারের এতদিনের সম্পর্ক মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেছে।
রাত সাড়ে দশটা ছুঁইছুঁই বাড়ির সবাই রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেছে আবরার নিজে এসে পায়রার খাবার দিয়ে পুনরায় ঘরে তালা দিয়ে চলে গেছে। আবরারক সহ্য হচ্ছে না পায়রার খাবার যেমন রেখে গেছে তেমনি আছে। পায়রার মোবাইলে সাবিহার নাম্বার থেকে ফোন আসতেই পায়রা রিসিভ করে কানে ধরল। সাবিহা অপরপাশ থেকে,
– আপু এক কাজ করলে কেমন হয় ইফাত ভাইয়া যেভাবে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসতো তুইও সেভাবেই ঘর থেকে বেরিয়ে যা কেউ টের পাবে না।
পায়রার কথা শুনতেই মনে মনে নিজেকে তিরষ্কার করে,’ এই বুদ্ধিটা কেন তোর মাথায় আসলো না পায়রা’?
পায়রার সাড়াশব্দ না পেয়ে সাবিহা অধৈর্য হয়ে,
– আপু শুনতে পাচ্ছিস?
– হ্যা বল।
– ইফাত ভাইয়ার বাসা তো চিনিসই, ইনানকে সব বলে দিয়েছি। ইনান তোকে লুকিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিবে সাবধানে যাস যাতে ওদের বাড়ির কেউ জানতে না পারে।
– আচ্ছা ধন্যবাদ রে।
– ধন্যবাদ দিতে হবে না যা বলছি তাই কর সাথে মোবাইল আর টাকা নিয়ে যাস, টাকা আছে তো তোর কাছে?
– হুম আছে।
পায়রা দরজা ভেতর দিয়ে আটকে দিলো যাতে তালা খুলেও ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে না পারে তারপর কাধ ব্যাগ নিয়ে বারান্দার পাশের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে গেল। ইনান গেটের কাছে পায়রার জন্য অপেক্ষা করছে সাবিহা তাকে সবটা বলেছে প্রথমে রাজি না হলেও নিজের ভাইয়ের কথা ভেবে পরে রাজি হয়েছে।
ইফাতদের বাড়ির সামনে আসতে আসতে প্রায় বারোটা বেজে গেছে। লুকিয়ে হেঁটে হেঁটে আসতেই এতোটা সময় লেগেছে আর রাতে গাড়িও ঠিক মতো পাওয়া যায় না পাওয়া গেলেও খালি গাড়িতে একা উঠা অনেক ঝুঁকি।
সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন শুধু ঘুম নেই ইফাতের চোখে বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে অন্ধকার ঘর কি ভাবনায় মত্ত হয়ে আছে তা সেই জানে। দরজা চাপানো রয়েছে হেঁটে গিয়ে দরজা আটকানোর মতো শক্তি পায়ে নেই তবে ডাক্তার বলেছে ঠিক মতো ওষুধ খেলে এবং বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে শিঘ্রই।
পায়রা ইফাতের বাড়ির সামনে এসে ইনানকে ফোন দিলো। ইনান পায়রার ফোন পেয়ে গেইটের কাছে এগিয়ে গিয়ে পায়রাকে দেখতে পেয়ে,
– যখন সময় ছিল তখন অবহেলা করলে এখন সবাই তোমাদের সম্পর্কের বিরুদ্ধে তখন এসেছ।
– আমি ইফাতের কাছে যাবো।
– ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তো ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি বাবা-মা দেখলে আমাকে কি যে করবে কে জানে।
পায়রা ইনানের পিছু পিছু যাচ্ছে। ইনান ইচ্ছে মতো সুযোগ পেয়ে পায়রাকে কথা শুনাচ্ছে আর সামনে এগুচ্ছে।
– ভাইয়ার সম্পর্কে জেনেও ভুল বুঝে চরিত্রহীন উপাধি দিলে এখন আবার কি মতলবে দেখা করতে এসেছ বলো তো? সাবিহার কথা ফেলতে পারি না তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি নইলে কখনও তোমার সঙ্গে ভাইয়ার দেখা করাতাম না।
অন্য সময় হলে হয়তো পায়রা রেগে যেত কিন্তু আজ পায়রা একটুও রাগছে না কারণ সে জানে দোষটা সম্পূর্ণ তার। পায়রা ভেবে নিয়েছে যা হওয়ার হোক আজ সব সত্য ইফাতকে বলে দিয়ে সব ভুল বোঝাবুঝি ঠিক করে নিবে।
পায়রা ইনানকে প্রশ্ন করল,
– ইফাত কি জানে আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে আসছি?
– না।
– জানলে কি দেখা করতো না ইফাত কি আমার উপর রেগে আছে?
– জানি না।
পায়রা আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না বাড়ির ভেতরে তারা প্রবেশ করেছে ইনান ভালো করে আবারো চারিদিক দেখে নিলো কেউ আছে কিনা কিন্তু না কাউকে দেখা গেল না। সবাই ঘুমাচ্ছে ভেবে মনে মনে খুশি হলো ইনান পায়রাকে ফিসফিস করে বলল,
– শুনো পায়রা আস্তে আস্তে পা ফেলে আসবে কেউ দেখে ফেললেই বিপদ।
পায়রা মাথা ঝাকালো তারপর দু’জনে সিঁড়ির কাছাকাছি গেল তৎক্ষণাৎ ড্রয়িং রুমের বড় ঝাড়বাতি জ্বলে উঠলো ইনানের ভেতরটা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে।ইনান আর পায়রা পেছনে ঘুরেই ভয় পেয়ে গেছে ইনান রীতিমত ঘামতে শুরু করে দিয়েছে।
‘এমন একটা চরিত্রহীন ছেলেকে আমি কখনও বিয়ে করতে পারবো না কোনো এনগেজমেন্ট হবে না, আজ এনগেজমেন্ট হয়ে গেলে বিয়েও করতে হবে চাইলেও কেউ আটকাতে পারবে না তাই যা বলার আগেই সবাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে হয়েছে আমার।’
সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পায়রার দিকে এখানে উপস্থিত সবাই মোটামুটি ইফাতকে চেনে তার সম্পর্কে জানে এমন একটা কথায় অবাক হওয়াই স্বাভাবিক।ইফাত পায়রাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে,
– কি বলছো এসব কে চরিত্রহীন?
– আপনি মি. ইফাত মির্জা।কি ভাবেন নিজেকে? সবকিছু আপনার ইচ্ছেতে হবে না এবার আর কিছু আপনার ইচ্ছায় হবে না কোনভাবেই আমি আপনাকে আমার জীবনে চাই না আমি।
এনায়েত মির্জা রাগান্বিত হয়ে,
– পায়রা কোনো প্রমাণ ছাড়া আমার ছেলের নামে এমন অপবাদ দিতে পারো না।
পলাশ শেখও তাল মিলিয়ে,
– ইফাতকে আমরা ভালো করেই চিনি এটাও জানি ও কেমন ছেলে তাই সবার সামনে আজেবাজে কথা না বলে আংটি পরেনে।
– আমি প্রমাণ ছাড়া কথা বলছি না।
বলেই পায়রা স্টেজ থেকে নেমে সাবিহার হাত থেকে বক্সটা এনে ছবিগুলো বের করে বাবা আর এনায়েত মির্জার হাতে দিলো। সাবিহা জানে না বক্সে কি আছে পায়রা রাখতে বলেছিল তাই সেও রেখেছে।
এনায়েত মির্জা এবং পলাশ শেখের মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে।ইতি বেগম,আসমা বেগমও দেখলো এবার ইফাত বাবার হাত থেকে ছবিগুলো নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে,
– বিশ্বাস করো এই মেয়েকে আমি চিনি না আর এভাবে! দেখেই বুঝা যাচ্ছে এডিট করা হয়েছে ছবিগুলো।
পায়রা উচ্চ কন্ঠে,
– এগুলো এডিট নয় আপনার চরিত্র যে খারাপ এগুলো না দেখলে জানতেই পারতাম না।
ইফাত পায়রার দুই বাহু ধরে,
– তুমি তো জানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি তারপরেও কিভাবে এসবে বিশ্বাস করে ভুল বুঝছো? কেন এমন অপবাদ দিচ্ছো?
পলাশ শেখ এগিয়ে ইফাতকে পায়রার কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে,
– একদম আমার মেয়ের কাছে আসবে না আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি।
আবরারের থমথমে মুখে হাসি ফুটেছে অশমিও মহাখুশি।সুযোগ পেয়ে আবরার পলাশ শেখের কাছে গিয়ে,
– আমি আগেই বলেছি কিন্তু পায়রা বিশ্বাস করেনি যাক সঠিক সময়ে সবটা পায়রা জেনেছে।
এনায়েত মির্জা গম্ভীর মুখে,
– দেখো পলাশ যে যত যাই দেখাক এবং বলুক না কেন আমি কখনও আমার ছেলেকে অবিশ্বাস করবো না কারণ আমি জানি আমার ইফাত কেমন আমাদের উচিত ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলা ছবিগুলোও যাচাই করা উচিত।
আবরার চেঁচিয়ে,
– আর কিসের কথা আপনাদের সঙ্গে? যা জানার সবাই জেনেই গেছ।
এনায়েত মির্জা ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছেন তার মুখের উপর এভাবে কথা বলার জন্য কিন্তু অতি কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইফাতের কোনো দিকে খেয়াল নেই তার দৃষ্টি শুধু পায়রার দিকে স্থির। পায়রারও অনেক কষ্ট হচ্ছে ইফাতের দিকে তাকানোর সাহস হচ্ছে না তার।
ইফাত আবারো পায়রার কাছাকাছি গিয়ে হাত ধরে,
– কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসেনা কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝতে পারোনা পায়রা।
– ভুল বুঝার কিছু নেই আপনাকে আমি আগে থেকেই পছন্দ করিনা তা আমি বলেছি আপনার জন্য ঘৃণা আরো বেড়ে গেছে লজ্জা থাকলে এই মুখ আমাকে আর দেখাবেন না রিকোয়েস্ট করছি।
ইফাত নাছোড়বান্দা পায়রার এক হাত চেপে ধরে রেখেছে পায়রা ছাড়াতেই পারছে না। ইফাত পায়রার গালে এক হাত রেখে,
– আমি তোমাকে ছাড়া আর থাকতে পারবো না আমাকে সময় দাও আমি প্রমাণ করে দিব ছবিগুলো মিথ্যে।
সঙ্গে সঙ্গে পায়রা জোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো ইফাতের গালে। সবার মধ্যে শরগোল বেঁধে গেছে যে যার সাথে কানাঘুষা করছে। ইফাতের চোখ রক্ত বর্ণ ধারণ করেছে ঠোঁট জোড়া কাঁপছে আগেও একবার পায়রা তাকে থাপ্পড় দিয়েছিল কিন্তু তখন কোনো প্রতিক্রিয়া না হলেও আজ রাগ, কষ্ট আর লজ্জা ভেতরে হানা দিয়েছে সবার সামনে প্রিয় মানুষের এমন অপমান আর অপবাদ মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
ইফাতের দাদীও এখানে উপস্থিত ছিলেন তিনি বসা থেকে উঠে তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে,
– অনেক হয়েছে সবকিছু এতক্ষণ শুনছিলাম কিন্তু এখন যা হলো তা মেনে নেওয়ার মতো না শোন এনায়েত এই মেয়েকে কোনভাবেই আমার নাতির সঙ্গে বিয়ে দেবো না।
এনায়েত মির্জা ইফাতের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর ক্ষিপ্ত স্বরে,
– হুম মা তোমার সঙ্গে আমিও একমত কাউকে কিছু বুঝানোর নেই আর।
পলাশ শেখও রেগে,
– আমরাও এই ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিবো না এনগেজমেন্ট হবে না।
আসমা বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে,
– হুটহাট এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয় সবটা পরিষ্কার ভাবে না জেনে সামান্য একটা কারণে এমনটা করা ঠিক হবে না বিয়ে তো আর এখনি হয়ে যাচ্ছে না সবেমাত্র এনগেজমেন্ট পরে না হয়
– তুমি থামো আর কিছু শুনতে চাই না।
– লোক হাসিয়ে….
আতিফা বেগম এগিয়ে এসে বোনের কাঁধে হাত রেখে,
– লোক হাসবে না তোরা চাইলে আজ পায়রার এনগেজমেন্ট হবে আমার ছেলে আবরারের সঙ্গে।
– আপা!
– আমার অনেক ইচ্ছে ছিল পায়রাকে নিজের বাড়িতে বউ করে নিয়ে যাওয়ার কিন্তু তখন বলতে পারিনি এখন সঠিক সময় বলে দিলাম আশা করি কোনো আপত্তি নেই তোদের।
পলাশ শেখ কিছু না ভেবেই বললেন,
– হুম রাজি আবরার এদিকে এসে পায়রাকে আংটি পরিয়ে দাও।
আবরার হাস্যজ্জল মুখে এগিয়ে আসতেই আতিফা বেগম নিজের আঙ্গুল থেকে একটা আংটি খুলে আবরারের হাতে দিয়ে,
– যা পরিয়ে দে।
পায়রা ভাবতে পারেনি যে এমন একটা ঝামেলায় তাকে পড়তে হবে সে ব্যাপারটা অনেক সহজ ভাবে মিটে যাবে ভেবেছিল। আবরার পায়রার দিকে এগিয়ে গেল ইফাত চেঁচিয়ে,
– পায়রা তুমি এমনটা করতে পারো না আবরার তুমি কেন মাঝখানে আসছো?
এনায়েত মির্জা দ্রুত এসে ইফাতের হাত চেপে ধরে,
– ইফু ব্যস চল এখান থেকে।
– বাবা তুমি আটকাও অন্তত।
এনায়েত মির্জা ইনানকে এদিকে আসতে ইশারা দিলেন ছেলের কষ্ট নিজ চোখে সহ্য করতে পারছেন না তবে নিজের সম্মান বিসর্জন দিতেও তিনি রাজি নন।ইনান এসে ভাইকে ধরলো। পায়রা এক পলক ইফাতের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো বেশিক্ষণ তাকানোর সাহস নেই ওই চোখে। আবরার পায়রার আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে দিলো, ইফাতের চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়তেই হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুছে ইনানকে সরিয়ে বেরিয়ে গেল বাগান বাড়ি থেকে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এই আশা নিয়ে হয়তো পায়রা আটকাবে কিন্তু সব আশা ভুল প্রমাণিত হলো।
এনায়েত মির্জা পরিবার নিয়ে ইফাতের পেছনে গেল কিন্তু ধরতে পারলো না ইফাত নিজের গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।ইতি বেগম চিন্তিত হয়ে,
– আমার খুব চিন্তা হচ্ছে ইফাতের জন্য।
এনায়েত মির্জারও কম চিন্তা হচ্ছে না তারপরেও নিজেকে শক্ত করে আর বাকিদের সামলাতে,
– চিন্তা করতে হবে না বাড়িতে যেতে হবে গাড়িতে উঠো।
ইফাতের কানে পায়রার প্রত্যেকটা কথা বাজছে, চোখে ভেসে উঠছে সেই দৃশ্য গুলো মন অশান্ত হয়ে উঠেছে চোখ গুলো এখনও লাল হয়ে আছে ভেতরের আর্তনাদ চাপিয়ে রেখেছে কষ্টগুলো যেন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আজ কষ্টকে লুকাতে এক অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করতে যাচ্ছে ইফাত, গাড়িটা থামালো এক বাড়ের সামনে ভেতরে প্রবেশ করে সোজা চলে গেল কাঁচের বোতল দিয়ে সাড়ি করা টেবিলের পাশে বোতল খুলে ইচ্ছে মতো খেতে থাকলো তৃষ্ণা মিটালো। তারপর কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে কষ্ট কিছুতেই কমছে না বরং বেশি মনে পড়ছে। নেশাও যেন আজ ইফাতকে গ্ৰাস করতে পারছে না বাড় থেকে বেরিয়ে আবারো গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
চোখে আবছা দেখছে ইফাত তারপরেও অধিক কষ্টে গাড়ি চালাচ্ছে কিছু দূর যেতেই হঠাৎ করেই উল্টো পাশ থেকে একটা বড় ট্রাক এসে গাড়িটাকে জোরে ধাক্কা মা’র’লো।
______________
পায়রা ফ্লোরে হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে কান্না করছে ওই অচেনা নাম্বারে অনেক কল দিয়েছিল কিন্তু পায়রাকে ব্লক করে দিয়েছে। পায়রা নিজেকে দোষারোপ করে,
– আজ আমার জন্য ইফাতকে অপমানিত হতে হয়েছে কষ্ট পেতে হয়েছে আমি ইফাতের ভালোবাসাকে সবার সামনে ছোট করেছি কিন্তু কি করতাম আমার হাতে তো কিছু ছিল না এটা না করলে বাবার ক্ষতি হয়ে যেত।
একটু থেমে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে,
– আমি ইফাতকে বুঝিয়ে বলবো আমি জানি উনি ঠিক আমাকে বুঝবে।
অনুষ্ঠান থেকে বাড়িতে ফিরে পায়রা ঘরে এসে দরজা আটকে কান্না করছে এখনও পোশাক পাল্টায়নি।
আবরারের আজ আনন্দের দিন বিছানায় আধ শোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করে গুনগুন করে গান গাইছে।অশমি চুপচাপ আবরারের পাশে বসে আছে, আবরার বোনের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে,
– কিরে মুখ এমন ফুলিয়ে রেখেছিস কেন?
– এসব তোর কাজ তাই না ভাইয়া?
– ছবিগুলোর বুদ্ধি আমার কিন্তু পায়রাকে দিয়ে ইফাতকে অপমান আরেকজনের বুদ্ধি।
– সে কে?
– একটা মেয়ে জানি না কিভাবে জেনেছে আমি ইফাতকে সহ্য করতে পারি না পায়রাকে পছন্দ করি। নিজেই আমাকে কল করে আমার সাহায্য চাইলো যেহেতু আমাদের লাভ হবে তাই রাজি হয়ে গেছি।
– কে মেয়েটা?
– জানি না চেহারাও দেখিনি শুধু ফোনে কথা হয়েছে এখন আবার আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে, তবে যাই হোক কাজ কিন্তু আমাদের মনের মতোই হয়েছে।
– আমাদের নয় তোর মনের মতো হয়েছে পায়রার সঙ্গে সহজেই তোর এনগেজমেন্ট হয়েছে কিন্তু ইফাতকে আমি কিভাবে পাবো?
– তোর ভাই আছে তো আমি বুঝে নিবো তুই ঘরে যা।
– আচ্ছা।
অশমি চলে যেতেই ঘরের দরজা আটকে আবরার বাঁকা হেসে,
– আমি ইফাতকে নিজের শত্রু মনে করি আর শত্রুর সঙ্গে নিজের আদরের বোনকে বিয়ে দিব একদম নয়।
_____________
ড্রয়িং রুমে বসে আছে সবাই সবার মুখে চিন্তার ছাপ। ইফাতের দাদীকে জোর করে খাইয়ে ঘরে দিয়ে এসেছে ইতি বেগম।রাত ১:০০ টা বাজে কিন্তু এখনও ইফাতের কোনো খবর নেই ইনান আর এনায়েত মির্জা মিলে অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু মোবাইল বন্ধ। ইফাতের বন্ধু, এসিস্ট্যান্ট আরাফকেও ফোন করে জিজ্ঞেস করা হয়েছে কেউ কোনো খোঁজ জানে না।ইতি বেগম কান্না করে দিয়েছেন ইনান অনেক বুঝিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে।
রাত পেরিয়ে সকাল হয়ে গেছে এখনও ইফাতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এনায়েত মির্জা উঠে দাঁড়ালেন ইনানের দিকে তাকিয়ে,
– তোর মা আর দাদীকে দেখিস আমি দেখি ইফুর খবর পাই কিনা।
– তুমি বাড়িতে থাকো বাবা এখন তোমাকে কোথাও যেতে হবে না আমি ভাইয়ার খবর নিচ্ছি।
কথার মাঝেই এনায়েত মির্জার মোবাইল বেজে উঠলো পরিচিত নাম্বার থেকে কল এসেছে। এনায়েত মির্জা রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপাশ থেকে বিচলিত কন্ঠে আরাফ বলল,
– স্যার একটা বড় এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।
– কার এক্সিডেন্ট?
– ইফাত স্যারের এক্সডিন্ট হয়েছে একটা ট্রাক এসে স্যারের গাড়িতে ধাক্কা মা’রে। স্যারের অবস্থা খুব খারাপ দ্রুত আপনারা হাসপাতালে আসুন।
– ইফাতের এক্সডিন্ট হয়েছে আমাদের এখনি হাসপাতালে যেতে হবে।
ইতি বেগম কথাটা শুনেই কান্না করে দিলেন।ইনান মা’কে ধরে,
– মা এখন কান্না করার সময় নয় হাসপাতালে যেতে হবে।
দ্রুত তারা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল ইনান কাজের লোককে দাদীর খেয়াল রাখতে বলে গেছে।
আরাফ হাসপাতালে ইফাতের কেবিনের সামনে বসে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফাতের বাড়ির লোকজন চলে এসেছে সবাই আরাফের দিকে এগিয়ে যেতেই আরাফ বলল,
– স্যারকে ও.টিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঢুকে গেছে অনেক রক্ত বের হয়েছে।
– বড় স্যার রাতে কল দিয়ে জানাতেই আমি বেরিয়ে পড়ি স্যারকে খুঁজতে স্যারের গার্ডদের নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়ে যাই আপনাদের বাড়ির কাছাকাছি এক্সিডেন্ট হয়েছে।
ইতি বেগম কান্না করেই যাচ্ছেন এনায়েত মির্জা কপালে হাত দিয়ে একপাশে বসে আছে স্ত্রীকে স্বান্তনা দেওয়ার অবস্থায় তিনি নেই যতোই কঠোর হোক না কেন ছেলেদের তিনি অনেক ভালোবাসেন। ইতি বেগম ইতোমধ্যে জ্ঞান হারিয়েছেন কাঁদতে কাঁদতে,ইনান দু’জন নার্সকে ডেকে আনে এখন তারাই ইতি বেগমকে দেখছে।
‘ইফাতের সঙ্গে তোমার এনগেজমেন্ট যদি হয়ে যায় তাহলে কিন্তু তোমার পরিবারের বড় ক্ষতি হয়ে যাবে তোমার বাবাকে পথে বসতে হবে ওয়েট এর থেকে যদি তোমার বাবাকে মে’রে ফেলি তাহলে? এখন ভেবে নাও তুমি কাকে চাও তুমি চাইলে আমাকে অবিশ্বাস করতেই পারো তবে কোনো কিছু হয়ে গেলে আমার দোষ দিতে পারবে না আমি তোমাকে আগেই সাবধান করে দিলাম পায়রা।’
– কে আপনি? হুমকি দিচ্ছেন আমায়? ইফাতের সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়া বা না হওয়ায় আপনার কি লাভ হবে?
– এতকিছু জেনে তুমি কি করবে আমার সব হিসেব মির্জা পরিবারের সঙ্গে আমি চাই না তোমার পরিবারের ক্ষতি হোক তাই সাবধান করে দিলাম।
– আমি কারো হুমকিকে ভয় পাই না যা করার করে নিন।
কলটা কেটে গেল পায়রা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো অপরপাশের ব্যক্তি কল কেটে দিয়েছে। আগামীকাল ইফাত-পায়রার এনগেজমেন্ট বাড়ির সবাই খুব ব্যস্ত। এনায়েত মির্জা চেয়েছিলেন তাদের বাড়িতে এর আয়োজন করতে কিন্তু পলাশ শেখ মানতে নারাজ তিনি চান নিজেদের বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে অবশেষে দু’জনে ঠিক করলো অনুষ্ঠান হবে তাদের পার্টনারশিপ বিজনেস অফিসের পাশে দু’জনের কিনা বড় বাগান বাড়িতে। পায়রা বাড়ির সবার সাথে শপিং করে এসে ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল আর তখনি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে আর হুমকি দেয়। পায়রার চিন্তা হচ্ছে আর ভাবছে,’কে এই লোকটা? মির্জা পরিবারের সঙ্গে কি শত্রুতা? ইফাত আর আমার এনগেজমেন্ট হলে বাবার কেন ক্ষতি করবে?
পায়রা নিজেকে শান্ত করে,
– হয়তো এমনি ভয় দেখানোর জন্য বলেছে এসব ভেবে কাজ নেই।
মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে ঘুমিয়ে গেল পায়রা, শরীরটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে।
অশমি আবরারের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবরার দেখেও এড়িয়ে গেল অশমি কান্না জড়িত কন্ঠে,
– ভাইয়া তুই কিছুই করতে পারলি না কাল ইফাত আর পায়রার এনগেজমেন্ট।
– এনগেজমেন্ট হবে বিয়ে তো আর হয়ে যাচ্ছে না।
– এনগেজমেন্ট হয়ে গেলে বিয়ে হতে কতদিন?
– হলে হোক।
– হোক মানে? তুই সবটা জানিস বিশেষ করে তুইও তো পায়রাকে ভালোবাসিস।
– এখন আর কি করার আছে সব চেষ্টাই তো করলাম লাভ হলো না।
অশমি বুঝতে পারছে না আবরারের কি হয়েছে কেন এমন করছে।আবরারের সঙ্গে কথা বলে লাভ হবে না ভেবে চলে গেল অশমি।
_____________
এনায়েত মির্জা কাছের কিছু আত্মীয় স্বজন পরিচিতদের ইনভাইট করেছেন। যেহেতু এনগেজমেন্ট হবে তাই সব আত্মীয় স্বজনকে বলা হয়নি দেশের বাইরেও অনেক আত্মীয় স্বজন আছে একেবারে বিয়েতে সবাইকে দাওয়াত দিবে। ইনান বড় ভাইয়ের এনগেজমেন্টের জন্য নিজে সব দায়িত্ব নিয়েছে বাগান বাড়ির পুরো ডেকোরেশন নিজ দায়িত্বে পছন্দ মতো করছে।
ইফাতের মুখে আজ এক তৃপ্তির হাসি প্রশস্ত হয়ে আছে হয়তো নিজের প্রেয়সিকে পাওয়ার আনন্দ এটা। অফিসের সব কাজ সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কারণ দু’দিন সে অফিসে আসতে পারবে না।
সাবিহার সঙ্গে ইনানের দু’দিন ধরে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে না।সাবিহা অনেকবার ফোন করেছে কিন্তু বাজতে বাজতে একসময় কেটে গেছে, হুয়াটসএপেও অনেক মেসেজ দিয়েছে কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি।প্রিয় মানুষের এমন অবহেলা যেন কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না খুব কষ্ট হচ্ছে বারবার নিজেকে প্রশ্ন করছে,’আমি কি কোনো অন্যায় করেছি? কেন ইনান আমার সঙ্গে কথা বলছে না আমায় কি ভুলে গেল?
কিছু ভালো লাগছে না তাই সোজা পায়রার ঘরের দিকে চলে গেল। পায়রার ঘরের দরজা একটু মেলে উঁকি মেরে পায়রাকে ঘুমাতে দেখে সাড়াশব্দ না করে আবারো নিজের ঘরে চলে গেল সাবিহা।
ইতি বেগম শাশুড়ির ঘরে বসে গল্প করছেন। ইফাতের দাদী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তারপর বললেন,
– ইফাত দাদু ভাইয়ের মুখটা দেখেছো বউমা? কি হাসি খুশি আমার নাতিটা, মেয়েটাকে সত্যিই অনেক ভালবাসে মনে হয়।
ইতি বেগম প্রতিত্ত্যুরে বললেন,
– হুম মা কি বলবো পায়রার জন্য আপনার নাতির হাবভাব সব বদলে গেছে সেদিন কি যে এক ঘটনা ঘটিয়েছে।
– কি ঘটনা?
শরীরে জ্বর নিয়ে পায়রাকে দেখতে যাওয়ার পুরো ঘটনা ইতি বেগম শাশুড়িকে বললেন। তিনিও চমকে গিয়ে,
– এত দূর অবধি চলে গেছে ইফাত দাদু ভাই!
– হ্যা মা।
বলেই দু’জনে হেসে দিলো।
______________
বাইরে চেঁচামেচির শব্দে পায়রার ঘুম ভেঙ্গে গেছে মুখে পানি দিয়ে নিচে যাওয়ার জন্য হাঁটা ধরলো। ঘুম ভাঙ্গলেও ঘুমের রেশ এখনও কাটেনি নিচে যেতেই পায়রা দেখতে পেল তার বাবা সোফায় বসে আছে হাত ব্যান্ডেজ অবস্থায় গলায় ঝুলানো আর তার পাশে বসে মা কান্না করছে আর তার চাচি তার মা’কে সামলাচ্ছেন। পায়রা দ্রুত গিয়ে বাবার পাশে বসে,
– তোমার হাতে ব্যান্ডেজ কেন বাবা? কি হয়েছে?
পলাশ শেখ ক্লান্ত কন্ঠে,
– অফিস থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবো ঠিক সেই সময় একটা চলন্ত বাইক এসে হাতে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে চলে গেল মনে হয় ছিনতাইকারী ছিল।
পায়রার ভেতরটা কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে,
– ছিনতাইকারী হলে কিছু না নিয়ে আঘাত করলো কেন?
– হয়তো আশেপাশের মানুষজনের কারণে নিতে পারেনি।
– ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিবে চলো।
– আগে তোর মা’কে একটু থামতে বল কান্না করেই যাচ্ছে।
আসমা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে,
– কি একটা বিপদ গেছে তোমার উপর দিয়ে আমি কান্না করবো না তো কি করবো।
– মা কান্না করলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে যাও বাবাকে ঘরে নিয়ে যাও এখন বিশ্রামের প্রয়োজন।
পলাশ শেখকে ধরে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেওয়া হলো। পায়রার মন উসখুস করছে ঘরে গিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেল কিন্তু ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার ভেসে উঠেছে পায়রা রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপাশ থেকে বলল,
– এবার বিশ্বাস হলো? আমার কথা মতো কাজ না হলে এর থেকেও বড় কিছু হয়ে যাবে তোমার বাবার তখন কিন্তু নাও বেঁচে ফিরতে পারে।
– কেন এমন করছেন আপনি? কি ক্ষতি করেছি আমরা আপনার?
– তোমরা কিছুই করনি তাই তো তোমাদের সাবধান করে দিলাম তবে আমার কথা না শুনলে তোমার সুন্দর পরিবার শেষ হয়ে যাবে।
– আর যদি আপনার কথা মতো কাজ করি?
– তাহলে তোমার পরিবারের কিছু হবে না।
– আমি রাজি কি কি করতে হবে আপনি বলুন।
– এই তো গুড গার্ল, যা করতে হবে টেক্সট করে দিচ্ছি আর কোনো চালাকি করবে না এতে তোমার ক্ষতি।
লোকটা কল কেটে দিয়েছে পায়রা মোবাইল পাশে রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। হাঁটু মুড়ে বসে,
– আমাকে ক্ষমা করবেন ইফাত পরিবারকে বাঁচাতে এটা করতেই হবে আমাকে আশা করি আমাকে ভুল বুঝবেন না দেরিতে হোক আমাদের মিল একদিন হবেই।
ইনান সব আয়োজন সম্পন্ন করে রাতে বাড়ি ফিরে খাবার খেয়ে বিছানায় বসে সাবিহাকে কল দিলো। সাথে সাথে কলটা রিসিভ হয়ে গেল এতক্ষণ যেন এর আশায় মোবাইল নিয়ে বসে ছিল সাবিহা। দু’পাশে নিরবতা বিরাজ করছে এবার ইনান নিরবতা ভেঙ্গে বলল,
– মনে হচ্ছে কেউ আমার উপরে রেগে আছে রাগের কারণটা কি জানতে পারি?
সাবিহা ভেবে নিয়েছিল যখনি ইনান ওর সঙ্গে কথা বলতে আসবে তখনি বেশ কড়া করে কিছু কথা শুনিয়ে দিবে সবকিছু গুছগাছ করে নিয়েছিল মনে মনে কিন্তু ইনানের নেশালো কন্ঠ শুনে নিমিষেই কথাগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে,
– গত দু’দিন ধরে একের পর এক কল দিয়ে গেলাম কেউ ধরার প্রয়োজন মনে করলো না এদিকে আমি যে কারো অপেক্ষায় বসে ছিলাম তা কি কেউ বুঝতে পারেনি নাকি ভালোবাসা দু’দিনে উড়ে পালিয়েছে।
– এই নিজের ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস? ভাইয়ার এনগেজমেন্টের সব দায়িত্ব নিজে নিয়েছিলাম কাজ করতে করতে সময় পাইনি তবে এই নয় যে আমি আমার মহারানীকে ভুলে গেছি প্রতিটা মুহূর্ত তোমার কথা মনে পড়েছে আজ সময় পেতেই কল দিয়েছি।
– জানো কত চিন্তা হচ্ছিল সাথে কষ্ট হচ্ছিল খুব।
– ভিডিও কল দেই?
– দাও।
ইনান ভিডিও কল দিয়ে সাবিহাকে দু’চোখ ভরে দেখে নিলো। দু’জন দু’দিনের জমে থাকা কথাগুলো বলে নিচ্ছে।সাবিহার রাগও নিমিষেই মিলিয়ে গেছে।
________________
আজ রাতে ইফাত আর পায়রার এনগেজমেন্টের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই খুশি থাকলেও পায়রা খুশি হতে পারছে না সকাল থেকেই চুপচাপ সাবিহা অনেকবার লক্ষ্য করেছে জিজ্ঞেসও করেছে কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। একটা মেসেজ আসায় বাড়ির বাইরে গিয়েছিল বাইরে যেতেই এক অপরিচিত ব্যক্তি একটা বক্স পায়রার হাতে দিয়ে চলে যায়। পায়রা ওতো মাথা না ঘামিয়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘরে এসে বক্সটা খুলতেই চমকে গেল। সবকিছুই যেন এখন তার কাছে অনেকটা পরিষ্কার সেদিন যেই ছবিগুলো অশমি পায়রাকে দেখিয়েছিল ঠিক সেই ছবিগুলোই এখানে শুধু অশমির জায়গায় অন্য এক অপরিচিত মেয়ে। পায়রা ছবির মেয়েটার দিকে চোখ রেখে,
– এগুলো কি অশমি আর আবরারের প্লান? ইফাতের সঙ্গে আমার ভুল বুঝাতে না পেরে এখন এই পথ বেছে নিয়েছে? তাহলে অশমির ছবি পাল্টে এই অপরিচিত মেয়ের সঙ্গে কেন এডিট করলো?
কিছুক্ষণ ভেবে,
– আবরার ভাইয়া কিভাবে হবে?আর যাই করুক আবরার ভাইয়া আমার বাবা কিংবা পরিবারের কোনো ক্ষতি করবে না তাহলে কি হচ্ছে এসব।
পায়রার মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো, পায়রা মেসেজ পড়তে লাগলো,
‘ উল্টা পাল্টা চিন্তা করে আসল কাজটা যেন নষ্ট না হয় আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি এতে কিন্তু তোমার বাবার বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
পায়রার মনে ভয়টা তিব্র হয়ে গেছে মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে নিজের মনকে শক্ত করে সব ঠিকঠাক করে নিলো।
পায়রার সঙ্গে গতকাল থেকে কথা এবং দেখা না হলেও ইফিতের কোনো আক্ষেপ নেই কারণ সে জানে আজ তাদের সম্পর্কের নতুন রূপ পেতে যাচ্ছে আর তারপর পায়রা শুধুই তার।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে বাগান বাড়ি অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে চারিদিকে হরেক রঙের আলো জ্বলছে অনেক সুন্দর ডেকোরেশন করা হয়েছে। শেখ পরিবার, মির্জা পরিবার চলে এসেছে সবাই সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে অতিথি আপ্যায়ন করছে। পায়রা আর সাবিহা পার্লারে গেছে সাবিহার জোরাজুরিতেই পায়রা বাধ্য হয়ে গেছে ওখান থেকেই দু’জনে এই জায়গায় চলে আসবে।
ইফাতের সব বন্ধুরা উপস্থিত সবাই পায়রাকে দেখতে আগ্ৰহী।ইফাতের চোখও এত এত মানুষের ভিড়ে পায়রাকে খুঁজছে। ইতি বেগম ছেলের কাছে এসে,
– পায়রা সাবিহার সঙ্গে পার্লারে গেছে, আসতে আরও দশ মিনিট লাগবে।
ইফাত মাথা চুলকিয়ে মৃদু হাসলো।আসমা বেগম ডাকতেই ইতি বেগম তার কাছে চলে গেল।ইনান এসে ইফাতের কাঁধে হাত রেখে,
– বুঝলি ভাইয়া আমাদের দুই ভাইয়ের অবস্থা সেইম দু’জনেই প্রমিকাকে দেখতে না পেয়ে হা হুতাশ করছি।
ইফাত নিজের কাঁধ থেকে ইনানের হাত সরিয়ে,
– আমি হা হুতাশ করছিলাম না শুধু দেখছিলাম পায়রা কোথায়।
– তোর সত্যিটা অস্বীকার করার স্বভাব আর গেল না।
– তোরও আমাকে পিঞ্চ মে’রে কথা বলার স্বভাব গেল না।
ইনানের দৃষ্টি অন্যদিকে চলে গেছে ইফাত খোঁচা মে’রে,
– ওদিকে কি দেখছিস?
– তোর বউ আর শালিকে দেখছি।
ইনানের কথায় কপাল কুঁচকে দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই ইফাতের ঠোঁটে হাসি ফুটেছে। পায়রা গর্জিয়াস ল্যাহেঙ্গা পড়েছে ইফাতই দিয়েছে নিজে পছন্দ করে এবং নিজেও তার সঙ্গে ম্যাচিং করে শার্টের উপর ব্লেজার পড়েছে। ইনান ইফাতের কাছ থেকে সরে গেল সাবিহাও সুযোগ বুঝে ইনানের কাছে গেছে।
ইফাতকে দেখে পায়রার মুখেও হাসি ফুটেছে কিন্তু কিছু একটা মনে হতেই মুখটা মলিন হয়ে গেছে।ইফাত পায়রার কাছে যাচ্ছিল কিন্তু পায়রা ইফাতকে ইগনোর করে নিজের মায়ের কাছে চলে গেল ইফাতের মনটা খারাপ হয়ে গেল।ইফাতের একটা বন্ধু ইফাতের কাছে এসে,
– মুখের হাসি আবার কোথায় চলে গেল?
আরেকজন এসে,
– আজ তো তোর খুশির দিন মনের মানুষকে পেয়ে যাবি।
ওদের কথায় ইফাত মনকে বুঝিয়ে হাসার চেষ্টা করলো। এনায়েত মির্জা আর পলাশ শেখ পাশাপাশি দাঁড়ালো দু’জনের হাতে দু’টো মাইক। দু’জনে মিলে এনাউন্স করে দিলো ইফাত আর পায়রার এনগেজমেন্টের সবাই সম্মোলিত হাত তালি দিলো।
ইফাত আর পায়রা দু’জনেই স্টেজে চলে আসলো তাদের ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে।ইতি বেগম ইফাতের হাতে একটা আংটি দিলো আসমা বেগম এসেও পায়রার হাতে তাদের আনা আংটি দিলো। ইফাত পায়রার ডান হাত নিজের বাম হাত দিয়ে ধরে ডান হাতে থাকা আংটিটা পায়রার আঙ্গুলে পরানোর জন্য হাত বাড়াতেই পায়রা ইফাতের হাতটা ঝাড়া দিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। পায়রার এমন কাজে সবাই বিষ্মিত হয়ে গেছে ইফাত জোরপূর্বক হেসে,
– হাত সরিয়ে নিলে কেন?
– আমি আপনার হাত থেকে আংটি পরবো না।
পলাশ শেখ এগিয়ে এসে,
– আংটি না পরলে কিভাবে হবে? কথা না বলে পরে নে।
‘দেখ পায়রা আমি ইফাতকে অনেক ভালোবাসি ইফাতও আমায় ভালোবাসতো কিন্তু মাঝখানে তুই এসে পড়ায় আমাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেছে আমি অনেকবার তোকে বলার চেষ্টা করেছি বলতে পারিনি কিন্তু আজ না বলে উপায় নেই আমি চুপ থাকলে তোর আর আমার দু’জনের জীবন হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো অশমি। পায়রা কপাল কুঁচকে অশমির দিকে তাকিয়ে আছে। সকাল হতেই আজ অশমি পায়রার ঘরে এসেছে আর তারপর পায়রাকে নিজের সামনে বসিয়ে একদমে কথাগুলো বলল।
পায়রা তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে অশমিকে ভালো করে দেখে নিয়ে,
– তারপর?
অশমি কিছুটা অবাক হয়ে,
– সবটাই তোকে বলেছি এর পর আবার কি?
– সবটা বলা শেষ?
– হুম।
পায়রা হো হা করে হেসে দিল পায়রার হঠাৎ এমন হাসি দেখে অশমি ভড়কে গেছে।অশমি ভিতু কন্ঠে,
– এভাবে হাসছিস কেন?
– তোর এসব বানানো কথা শুনে হাসি পাচ্ছে ইফাতের নামে এসব বলার আর মানুষ পেলি না।
– তোর আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না ঠিক আছে আমি প্রমাণ দিচ্ছি।
পায়রার হাসি মিলিয়ে গেল ভাবছে কি প্রমাণ দিবে অশমি। অশমি সাথে করে খামটা এনেছে,খামটা পায়রার দিকে এগিয়ে দিল পায়রা খামটার ভেতর থেকে ছবিগুলো ভালো করে দেখল। ছবিগুলোতে স্পষ্টভাবে ইফাত আর অশমিকে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। মনে মনে অশমি হাসছে, পায়রা অশমির দিকে তাকিয়ে,
– এখানে কি সবগুলো ছবিই আছে?
– হ্যা সবগুলোই আছে।
পায়রা ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা দেশলাই বক্স নিয়ে আসলো অশমি জিজ্ঞেস করল,
– এটা দিয়ে কি হবে?
– দেখতে থাক।
বলেই পায়রা ঘরের দরজা আটকে দিল তারপর ছবিগুলো খামে ভরে আগুন জ্বালিয়ে দিল।অশমি কাছে গিয়ে,
– কি করলি এটা ছবিগুলো পুড়িয়ে দিলি কেন?
– যাতে এসব অন্য কারো চোখে না পড়ে।
– তুই তোদের বিয়েটা ভেঙ্গে দিবি তো?
– তোর এই সস্তা এডিট করা কিছু ছবি দেখিয়ে আমার চোখে ইফাতকে খারাপ করতে চাস তুই?তুই কি ভেবেছিস এসব দেখালেই আমি ইফাতকে ভুল বুঝে বিয়ে ভেঙে দিব তাহলে বলতে হয় তোর ভাবনা ভুল।
– তুই আমাকে কিন্তু অবিশ্বাস করছিস পায়রা।
– আঙ্গুলটা যেহেতু তুই ইফাতের দিকে তুলেছিস সেহেতু তোকে অবিশ্বাস করাটাই স্বাভাবিক তোর যে ইফাতের উপর নজর আছে এটা আমি আগেই বুঝেছি তোর হাবভাব দেখে আর আজ তুই তার প্রমাণ দিলি।
পায়রা একটু থেমে আবার বলা শুরু করল,
– যে ছেলেটাকে এত অপমান আজেবাজে কথা বলার পরেও বারবার ভালোবাসি বলে পেছনে পরে থাকে শরীরে জ্বর নিয়ে মাঝরাতে গাড়ি চালিয়ে দেওয়াল টপকে পাইপ বেয়ে আমায় একটাবার চোখের দেখা দেখতে আসে তোর জন্য তাকে অবিশ্বাস করব ভাবলি কিভাবে?ইফাতকে তোর নাম বললেই তো ঠিক মতো চিনতে পারবে না আর তুই এসেছিস এসব ছবি নিয়ে আমার কান ভাঙাতে?
– হ্যা আমি ইফাতকে ভালোবাসি যেদিন প্রথম ইনানের জম্মদিনে দেখেছি সেদিন নিজের মন হারিয়েছে আমি এত সহজে ইফাতকে হারাতে চাই না তুই তো ইফাতকে পছন্দ করিস না তাহলে সরে আয়।
– সরতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি সরতে দিলেন কোথায়? আমি অপছন্দ করি ইফাতকে নয় বরং ইফাতের ভয়ংকর রাগটাকে আমার প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসাকে,তোর কথায় আমি ইফাতকে নিজের থেকে দূরে সরাতে পারবো না বলতে গেলে আমি চাইলেও উনি আমাকে যেতে দিবেন না তাই আমাকে না বলে ইফাতের সঙ্গে কথা বল গিয়ে।
অশমি আর কিছু বলল না পায়রার কথাগুলো সেও বুঝতে পেরেছে চুপ করে উঠে গেল ঘর থেকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে পায়রা ডেকে,
– শোন অযথা ইফাতের কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে লাভ নেই তুইও জানিস আমিও জানি সবটা আর হ্যা তোর ভাইকে বলে দিস ইফাতের পেছনে না লেগে নিজে যাতে ভালো কিছু করে তাহলে এমনিতেই সব জায়গায় সম্মানিত এবং সফল হবে।
অশমি নিজের বাড়িতে চলে গেল। আবরার অপেক্ষা করছে কখন অশমি আসবে এবং তার কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানবে।
অশমি ওখানে ঘটে যাওয়া সব কিছু আবরারকে বলে দিল।আবরারের খুব রাগ হচ্ছে কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই বিয়ে ভাঙ্গার সব উপায় শেষ।
_____________
‘আমারে তো ইফাত দাদু ভাইয়ের নিয়া আসার কথা ছিল কিন্তু এনায়েত নিয়ে আসলো ইফাত কই বউ?’
– অফিসে অনেক কাজের চাপ তাই আর কি ইফাতকে বলা হয়নি আপনার ছেলেই গেল আপনাকে আনতে।
– শুনলাম ইফাতের জন্য নাকি মেয়ে দেখছো?
– হ্যা মা আপনার নাতির নিজের পছন্দ করা মেয়ে আর দু’দিন পরেই এনগেজমেন্ট।
– একেবারে বিয়ে ঠিক করলেই হয়ে যেত আবার এনগেজমেন্ট।
– মেয়ের বাবা চাইছেন মেয়ের পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে দিতে তাই এখন এনগেজমেন্ট সেরে নিব পরে না হয় বিয়ে।
– আমগো সময় এসব আছিল না এখনকার যুগে কত কি নিয়ম।
ইতি বেগম হাসলেন।আজ গ্ৰাম থেকে এনায়েত মির্জার মা এসেছেন মূলত ইফাতের এনগেজমেন্টের কারণে।শহর ভালো না লাগার কারণে উনি নিজ ইচ্ছায় গ্ৰামে থাকেন এনায়েত মির্জা এবং ইতি বেগম অনেক চেষ্টা করেও উনাকে একেবারে এই বাড়িতে নিয়ে আসতে পারেননি।
‘খালাম্মা গ্ৰাম থেকে এসেছে পায়রাকে নাকি দেখতে চেয়েছে তাই এনায়েত বলল পায়রাকে নিয়ে ওদের বাড়ি থেকে যেন ঘুরে আসি।’
– পায়রা কি যেতে রাজি হবে?
– আমি বললে ঠিক যাবে আর যাই হোক বাবার কথা পায়রা ফেলতে পারবে না।
পায়রা এদিক দিয়ে যাচ্ছিল পলাশ শেখ আর ইতি বেগমের কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেল ঘরের ভেতরে ঢুকে,
– আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে মনে হয়?
– উনি বয়স্ক মানুষ উনি আসবেন না তোকে নিয়েই ঘুরে আসবো।
– এখন আবার ওই বাড়িতে যেতে হবে!
– এখন না কাল যাবো।
– না গেলে হয় না বাবা?
– না বড়দের কথা শুনতে হয়।
– আচ্ছা।
পায়রা মুখ গোমড়া করে চলে গেল পলাশ শেখ ইতি বেগমের উদ্দেশ্যে,
– দেখলে কি সহজে রাজি হয়ে গেল।
– হুম বাবা ভক্ত হয়ে ভালো হয়েছে সামলানো তো যায় নাহলে কি যে হতো।
___________
রাতে বাড়িতে ফিরে ইফাত ফ্রেশ হয়ে দাদীর ঘরে চলে গেল।তার দাদী বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ইফাতকে দেখেই উঠে বসলেন ইফাত পাশে বসে,
– কেমন আছো দাদী?
– আলহামদুলিল্লাহ দাদু ভাই তুই কেমন আছিস?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ।
– অফিস থেকে সবেমাত্র ফিরলি নাকি?
– কিছুক্ষণ আগে আসলাম এসে ফ্রেশ হয়েই তোমার কাছে চলে আসলাম।
– শুনলাম তোর নাকি বিয়ে মেয়ে নাকি নিজে পছন্দ করেছিস?
– হুম।
– নতুন বউ পেয়ে আবার বুড়ো বউকে ভুলে যাস না।
– কি যে বলো না তুমিই তো আমার প্রথম বউ তোমাকে কি ভুলতে পারি?
ইনান ভেতরে এসে কথাগুলো শুনে ফুরণ কেটে,
– ওইটা তোর নয় আমার বউ লজ্জা করে না হবু বউ রেখে ছোট ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দিতে?
ইনানের কথায় তাদের দাদী হেসে দিলেন ইফাত ব্রু নাচিয়ে,
– তোর লজ্জা করে না গার্লফ্রেন্ড রেখে অন্য একজনকে নিজের বউ দাবি করতে?
ওদের দাদী চমকে গিয়ে,
– ছোট দাদু ভাই তুইও প্রেম করিস!
ইনান দ্রুত কাছে গিয়ে,
– আস্তে কথা বলো দাদী তোমার পূত্র বধূ শুনলে বাড়িতে ঘুর্নিঝড় হয়ে যাবে।
ইফাত মজা করে,
– দাদী তুমি মা’কে বলে দিও তাহলে দুই ভাইয়ের বিয়ে একসঙ্গে হয়ে যাবে।
ইনান অসহায় কন্ঠে,
– নারে ভাইয়া আমার বেলা মা অনেক কঠোর বলে দিয়েছে যদি জানতে পারে তাহলে নাকি আমার ঘাড় থেকে পেত্নি নামাবে।
– সাবিহা তাহলে পেত্নি!
বলেই হাসতে লাগল ইফাত।ইফাতের সঙ্গে তাদের দাদীও তাল মিলালো।ইনান ইফাতকে রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি ইতি বেগম ভেতরে প্রবেশ করে,
– গল্প পরে হবে এখন সবাই খেতে এসো।
ইতি বেগম শাশুড়িকে নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে গেলেন দুই ভাইও পেছন পেছন গেল। সবাই একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে যে যার যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেল।
___________
ইতি বেগম সার্ভেন্টদের নিয়ে রান্নার তোড়জোড় করছেন।আজ শেখ পরিবারের সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে কারণ তার শাশুড়ি পায়রাকে দেখতে চেয়েছে।ইফাতকে নিষেধ করায় সে আর অফিসে যায়নি ইনান আগে থেকেই জানতে পেরে গেছে তাই ভার্সিটি না গিয়ে বসে আছে কখন সাবিহার দেখা পাবে সেই আশায়।
দুপুরের আগেই শেখ পরিবার চলে এসেছে পায়রার সঙ্গে ইফাতের দাদীর পরিচয় হয়ে গেছে।ইফাতের দাদীর পায়রাকে পছন্দ হয়েছে।পায়রা আর তার পরিবার বাড়িতে আসার পর ইফাত সব জানতে পেরেছে সবাই নিচে বসে গল্প করছে সাবিহা এদিক ওদিক তাকিয়ে ইনানকে খুঁজছে পায়রা চুপ করে বসে সবার কথা শুনছে। ইনান সবাইকে সালাম জানিয়ে বলল,
– পায়রা ভাবী আর সাবিহা তোমরা এখানে বসে আছো কেন? চলো উপরে যাই।
সাবিহা এতক্ষণে হাফ ছেড়ে বাঁচলো দ্রুত দাঁড়িয়ে,
– হ্যা চলো এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।
ইতি বেগম এসে,
– পায়রা আর সাবিহা তোমরা বরং ইনানের সঙ্গে যাও ভালো লাগবে।
সাবিহা পায়রার হাত ধরে,
– আচ্ছা আন্টি।
পায়রার ইচ্ছে হচ্ছিল না যেতে কারণ সে জানে উপরে গেলেই একা হয়ে যাবে সবার চোখের আড়ালে গেলেই ইনান আর সাবিহা উধাও হয়ে যাবে। ইনানের সঙ্গে দু’জনে উপরে চলে গেল পায়রার কথাই ঠিক হলো ইনান পায়রার দিকে হেসে তাকিয়ে,
– পায়রা ভাবী ওই বাম পাশেই ভাইয়ার ঘর।
পায়রা ব্রু নাচিয়ে,
– তো?
– ভাইয়া বাসায় আছে যাও গিয়ে গল্প করো সময় কেটে যাবে।
– ঢং রেখে বলে ফেলেন সাবিহার সঙ্গে আলাদা সময় কাটাবেন।
– এত সহজে বুঝে গেলে অথচ ভাইয়াকে বুঝলে না।
পায়রা এবার চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ওরা দু’জন চলে গেল। পায়রা কিছুক্ষণ ভেবে নিচে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো পেছনে ঘুরে সামনে পা বাড়াতেই কেউ তাকে জোরে টেনে ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দিল। পায়রা মানুষটির দিকে না তাকিয়েই বুঝে গেছে কে সে। পায়রা ইফাতের দিকে রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইফাতের মুখে হাসি।ইফাত দুষ্টুমি করে,
– কেমন লাগছে শশুর বাড়িতে মন পায়রা?
– একদম ভালো না।
– কেন কেন?
– শশুরের অভদ্র বাজে ছেলের জন্য।
এই কথাটায় ইফাত যেন বেশ মজা পেয়েছে উৎসুক হয়ে,
– স্বিকার করলে আমি তোমার জামাই!
পায়রা এবার যেন আকাশ থেকে পড়লো অবাক হয়ে,
– কখন বললাম এ কথা?
– এখনি তো বললে, আমার বাবা তোমার শশুর হলে আমি তোমার জামাই লাগি জামাই বুঝছো।
পায়রার ইচ্ছে হচ্ছে নিজের গালে কয়েকটা চড় মা’র’তে মনে মনে আওড়াচ্ছে,’দূর না ভেবেই কি বলতে কি বলে দিলাম।
পায়রার সামনে তুড়ি বাজিয়ে,
– আমায় সামনে রেখে কি এত ভাবছো?
– কিছু না।
ইফাত বিছানায় বসে,
– দাঁড়িয়ে না থেকে বসো।
পায়রা ইফাতের থেকে দূরত্ব রেখে বসল। মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভেতরে কিছুটা সাহস জুগিয়ে,
– অশমির সঙ্গে কখনও আলাদা কথা হয়েছে আপনার?
ইফাত প্রশ্নসহিত দৃষ্টিতে,
– কে অশমি?
পায়রা অবাক হয়ে,
– আপনি অশমিকে চেনেন না?
ইফাত একটু ভেবে,
– এ নামে কাউকে চিনি বলে তো মনে হয় না।
– আবরার ভাইয়ার বোন ওই যে ফুচকা খেতে গিয়ে আপনার ঝাল লাগায় একটা মেয়ে এগিয়ে এলো আমার সঙ্গে রাগ করলো।
– ওই মেয়েটার নাম অশমি! এমনিতে কয়েকবার দেখেছিলাম নাম জানা হয়নি।
দু’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে তবে মুষলধারে নয় হঠাৎ করেই আকাশ কালো রঙ ধারণ করে বৃষ্টি শুরু হয় আবার কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি শেষ হয়ে রোদ নামে।আজও হঠাৎ করেই বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেছে সকাল থেকে আবহাওয়া বেশ ভালো ছিল কিন্তু মুহূর্তেই খারাপ। ভার্সিটি ছুটি হয়েছে দশ মিনিট আগে কিন্তু ভার্সিটির চারিপাশ জনমানবে ভরা। আজ আবরার পায়রা এবং অশমিকে নিতে এসেছিল পায়রার বৃষ্টি খুব পছন্দের তাই আবরারকে দেখা মাত্র লুকিয়ে পড়েছে। অশমি গাড়িতে উঠে গেছে কিন্তু পায়রাকে এখনও দেখতে পায়নি আবরার।অশমিও অনেকবার খুঁজেছে পায়নি আবরার একনাগাড়ে পায়রাকে কল দিচ্ছে পায়রা এবার বিরক্ত নিয়ে কল ধরে,
– কি হয়েছে ভাইয়া?
– কোথায় তুই?তোর জন্য কখন ধরে অপেক্ষা করছি।
– আমি বেরিয়ে গেছি তোমরাও চলে যাও।
– বেরিয়ে গেছিস মানে? আমি যে নিতে এলাম।
– তুমি তো অশমিকে নিতে এসেছিলে নিয়ে চলে আসো রাখলাম।
পায়রা কল কেটে দিল।আবরারের রাগ হচ্ছে বুঝতে পারছে পায়রা তাকে ইগনোর করছে।অশমি জিজ্ঞেস করল,
– কি বলল পায়রা?
– ও নাকি চলে গেছে।
– এই বৃষ্টির মধ্যে কখন গেল?
– জানি না কি আর করার চলে গেছে যখন।
আবরার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বোনকে নিয়ে চলে গেল।আবরারের গাড়ি যেতেই পায়রা ভিড় থেকে বের হয়ে বাইরে বের হল। বৃষ্টিতে ভিজতে গেলে সবসময় কেউ না কেউ বাঁধা দেয় কিন্তু আজ যেন সব বাঁধা অতিক্রম করে পায়রা বৃষ্টিতে ভিজছে মনে মনে ভেবে নিয়েছে আজ ভিজতে ভিজতে বাড়িতে যাবে।
রাস্তায় তেমন কোনো মানুষ নেই বৃষ্টি শুরু হতেই রাস্তার কিছু পথচারীরা দোকানের ছাউনিতে আশ্রয় নিয়েছে যাদের কাছে ছাতা ছিল তারা ছাতা মাথায় দিয়ে যাতায়াত করছে। পায়রা পুরোপুরি ভিজে গেছে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাও ভিজে গেছে কিন্তু তাতে কোনো হেলদোল নেই সে তো বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আপনমনে হাঁটছে।
পায়রার সামনে আচমকা একটা গাড়ি এসে থেমে যায় হুট করে এমন হওয়ায় কিছুটা হকচকিয়ে গেছে পায়রা কিন্তু গাড়ি দেখেই বুঝে গেছে এটা কার গাড়ি। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ইফাত পায়রার দিকে তাকিয়ে,
– এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছো কেন? অসুস্থ হয়ে যাবে তো।
– তাতে আপনার কি সবসময় পেছনে পরে থাকে।
– আমার অনেক কিছু তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠো।
পায়রা কিছু না বলে গাড়ির পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে ইফাত আর কোনো উপায় না পেয়ে গাড়ির পেছনের সিট থেকে ছাতা নিয়ে নেমে পড়লো। দ্রুত গিয়ে পায়রার মাথার উপর ছাতা ধরে,
– গাড়িতে চলো আমি বাড়িতে দিয়ে আসছি।
– আপনাকে কি আমি বলেছি বাড়িতে দিয়ে আসতে এত মাতবরি করেন কেন?
– আমার যা ইচ্ছে করবো।
– আমিও।
– উহু আমি যা বলবো তুমি তাই করবে।
– জোর জবরদস্তি নাকি?
– যা মনে করো।
– সরুন সামনে থেকে আমাকে যেতে দিন।
– মাথা গরম করো না জানো তো আমার রাগ উঠলে আমি কি করতে পারি তাই চুপচাপ গাড়িতে উঠো।
পায়রাও ইফাতের হাত থেকে ছাতাটা টেনে ফেলে দিয়ে রাগ দেখিয়ে,
– যা করার করে নিন আমি আপনাকে মুটেও ভয় পাইনা।
ছাতা ফেলে দেওয়ার কারণে ইফাতও অনেকটা ভিজে গেছে।পায়রা আবারও ইফাতকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে সাথে সাথে ইফাত পায়রার হাত ধরে টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে যাওয়া শুরু করল পায়রা ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।
ইফাত গাড়ি চালাচ্ছে পায়রা পাশের সিটে বসে আছে। মুখে অন্ধকার নেমে এসেছে ইফাত কোনো কথা বলল না কারণ হিতে বিপরীত হবে। পায়রার বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ি থেকে নেমে কোনদিকে না তাকিয়ে পায়রা ভেতরে চলে গেল ইফাতও গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল।
ভেজা অবস্থায় বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের ঝাড়ি খেতে হয়েছে পায়রার এতে রাগ বেড়ে গেছে ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় পাল্টে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।
ইফাত চুপিসারে বাড়িতে এসে নিজের ঘরে চলে গেল ভেবেছে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্রুত চেঞ্জ করে ফেলবে কিন্তু তার আসায় পানি ঢেলে দিল তার মা। নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই ইতি বেগমকে দেখে চমকে গেছে ইফাত।ইতি বেগম ছেলের এমন অবস্থা দেখে ব্রু কুঁচকে,
– কিরে তুই ভিজলি কিভাবে?
– বৃষ্টিতে ভিজে গেছি।
– কিভাবে?
– তোমায় এখন দেখাব কি করে!
– দেখাতে হবে কেন আমি বলতে চাইছি গাড়িতে ছাতা থাকার পরেও ভিজলি কিভাবে?
– এত প্রশ্ন করছো কেন মা তুমি কি গোয়েন্দা হয়ে গেছো?
– তোদের দুই ভাইয়ের জন্য হতে হয়েছে।
– তুমি আমার ঘরে এ সময়?
– গুছাতে এসেছিলাম।
– ওহ।
– দাঁড়িয়ে না থেকে জামা-কাপড় পাল্টে আয় আমি গরম কফি আনছি তোর তো বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে।
ইফাত দ্রুত ওয়াশরুমে চলে গেল একেবারে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। ঘরে আসতেই টেবিলে ধুঁয়া উঠা কফির কাপ চোখে পড়তেই ইফাত সোফায় বসে কফি পুরোটা শেষ করল। বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না শরীরটা কেমন যেন ব্যথা লাগছে ইফাতের। বিছানায় গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে গেছে ইফাত, ইতি বেগম খাবার নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু খাওয়াতে পারেননি।
________________
অশমি টিভি দেখছিল আবরার পাশে বসে একটা খাম এগিয়ে দিল অশমিও খামটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে,
– এতে কি আছে ভাইয়া?
আবরার বাঁকা হেসে,
– খুলে দেখ।
অশমি খামটা খুলতেই ভেতরে কিছু ছবি দেখতে পেল ছবিগুলো বের করে ভালো ভাবে দেখতেই চমকে গেল ভাইয়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আবরার হেসে,
– এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
– এই ছবিগুলো কিভাবে কি আমি তো কখনও..
– আরে বোকা এগুলো আমার পরিচিত এক স্টুডিও থেকে এডিট করিয়েছি।
– কিন্তু এগুলো দিয়ে কি হবে? মা-বাবা দেখলে আমাকে মে’রে’ই ফেলবে।
– ওরা কেউ দেখবে না এই ছবিগুলো শুধু পায়রার জন্য।
– পায়রার জন্য!
– হ্যা এই ছবিগুলোর মাধ্যমেই আমাদের চাওয়া পূরণ হবে তুই কাল একান্তে ছবিগুলো নিয়ে পায়রার কাছে যাবি তারপর আমি যা যা শিখিয়ে দিব ঠিক তাই তাই বলবি ব্যস তারপরেই কাজ শেষ।
অশমি খুশিতে গদগদ হয়ে,
– উফ ভাইয়া তোর কি বুদ্ধি।
আবরার হাসলো।অশমিকে কি কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দিল অশমিও ভালো করে বুঝে নিলো এখন শুধু কালকের অপেক্ষা।
_______________
‘তুমি আমার কল রিসিভ করতে দেরি করলে কেন? এখন কি আমাকে ভালো লাগে না? সারাদিন কোন মেয়ের কাছে ছিলে উওর দাও।
– সাবিহা তুমি আমাকে সন্দেহ করছো? এই তোমার ভালোবাসা? আমি তো খাওয়ার সময়ও তোমার কথা ভাবি ঘুমানোর সময় তোমাকে কল্পনা করি আর তুমি কিনা।
– তাহলে আমার কল ধরছিলে না কেন?
– একটা কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই ধরতে পারিনি তবে এখন পুরোপুরি ফ্রি আজ সারারাত তোমার সঙ্গে কথা বলবো।
– কাল কলেজে যেতে হবে ইনান।দেরি করে ঘুমালে সকালে উঠতে দেরি হয়ে যাবে কলেজেও যেতে পারবো না তখন মা আমাকে বকবে।
– আচ্ছা ঘুমাও গুড নাইট কাল দেখা হবে আমাদের।
– ঠিক আছে গুড নাইট।
সাবিহা আর ইনান দু’জন দু’জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঘুমাতে চলে গেল।
_____________
মাঝরাতে ইফাতের ঘুম ভেঙ্গে গেল শরীর এখনও দুর্বল এবং গরম।ইতি বেগম এতক্ষণ ইফাতের ঘরেই ছিলেন জ্বর কমার জন্য মাথায় পানি ঢেলেছেন। ইফাতের জ্বর কমতেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেছেন।ইফাত ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে মাথাটা এখনও ধরে আছে তৎক্ষণাৎ কিছু একটা ভেবে,
– সামান্য একটু বৃষ্টিতে ভিজেই আমার এমন হাল তাহলে পায়রা তো অনেকক্ষণ ভিজেছে। পায়রা ঠিক আছে তো?
পায়রার জন্য ইফাতের অনেক চিন্তা হচ্ছে মোবাইল হাতে নিয়ে পায়রার নাম্বারে কল দিল কিন্তু আশাহত হল পায়রা পুনরায় তার নাম্বার ব্লক লিস্টে রেখে দিয়েছে। ইফাতের চিন্তা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে কোনো উপায় না পেয়ে আলমারি থেকে একটা শার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
পায়রারও অনেক জ্বর এসেছিল আসমা বেগম জোর করে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন যার কারণে জ্বর তেমন কাবু করতে পারেনি পায়রাকে। পায়রা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, ইফাত এর আগেও পায়রার ঘরে পাইপ বেয়ে আসায় একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে আজও ঠিক সেভাবেই পায়রার ঘরে প্রবেশ করেছে। ঘরটা পুরো অন্ধকার ইফাত মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে ভেতরে গেল। পায়রার ঘরের দরজা খোলা ইফাত গিয়ে দ্রুত লাগিয়ে দিল যাতে কেউ তাকে না দেখে। বিছানার একপাশে বসে পায়রার কপালে হাত রাখল তেমন জ্বর নেই তবে শরীরটা একটু গরম।কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পায়রার ঘুম হালকা হয়ে গেছে পিটপিট করে চোখ খুলে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে,
– আপনি!!
ইফাত পায়রার ঠোঁটে আঙুল রেখে,
– আসতে কথা বলো কেউ শুনে ফেলবে।
পায়রা উঠে বসে,
– আপনি কেন আসলেন? আজ তো দেখা হয়েছে আমাদের।
– দেখা করার জন্য আসিনি।
– তাহলে?
– বৃষ্টিতে ভেজার কারণে আমার জ্বর এসেছিল তাই মনে হল তোমারও যদি জ্বর আসে এসব ভেবেই দেখতে চলে এসেছি কল করেছিলাম কিন্তু তুমি তো আবার ব্লক করে দিয়েছো।
পায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সে ভেবে পাচ্ছে না এই লোকটার কি মাথায় সমস্যা নাকি তাকে একটু বেশিই ভালোবাসে।পায়রা ইফাতের কপালে হাত রাখতেই ইফাত বলল,
– কি হয়েছে?
– আপনার শরীর তো এখনও গরম জ্বর পুরোপুরি কমেনি আগে এসেছেন ঠিক আছে তাই বলে অসুখ নিয়ে আসতে হবে?
– বললাম তো চিন্তা হচ্ছিল না আসলে চিন্তার কারণে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে যেতাম।
– আপনি কি পাগল? কোনো মানুষ এভাবে নিজের কথা না ভেবে এমন পাগলামি করে?
– পাগল নাকি জানি না তবে তোমার মতে তো আমি পাগলই।
বাইরে থেকে পায়রার দরজায় টোকা পরলো। পায়রা আর ইফাত দু’জন দু’জনের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করল। বাইরে থেকে পলাশ শেখ বলে উঠলেন,
– পায়রা মা কার সঙ্গে কথা বলছিস? জ্বর কমেছে?
পায়রা উঁচু গলায়,
– কই কারো সঙ্গে কথা বলছি না তো।
– দরজাটা খোল।
– বাবা আমি শুয়ে আছি ঘুম পাচ্ছে কাল কথা হবে গুড নাইট।
পলাশ শেখ আর কিছু বললেন না সোজা নিজের ঘরে চলে গেলেন।ইফাত পায়রার দিকে তাকিয়ে,
– তুমি তাহলে ঘুমাও আমি আসি।
ইফাত উঠতে যাচ্ছিল পায়রা হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে,
– যাচ্ছেন মানে এখনি তো এলেন।যাবেন যখন এলেন কেন?
– আমি তো তোমায় দেখতে এসেছিলাম কিন্তু তুমি জেগে যাবে বুঝতে পারিনি দেখা শেষ এখন চলে যাব।
– সাবধানে যাবেন পৌঁছে একটা কল দিয়েন।
– বললাম তো তুমি ব্লক করে রেখেছ।
– ব্লক খুলে দিচ্ছি কল দিতে ভুলবেন না কিন্তু।
ইফাত প্রতিত্ত্যুরে মৃদু হাসল তারপর যেভাবে উঠেছিল সেভাবেই নেমে গেছে। পায়রা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইফাতের যাওয়া দেখছে।ইফাত চলে যেতেই ঘরে এসে বিছানায় বসে, ‘সত্যি এই লোকটাকে নিয়ে পারা যায় না এতদিন পাগল মনে হতো এখন পুরোপুরি অদ্ভুত মনে হয় নাহলে কেউ অসুস্থতা নিয়ে এভাবে আসে।’
ইফাত আজও ইতি বেগমের কাছে ধরা খেয়ে গেছে।ইতি বেগম ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে রেগে আছে।ইফাত ঢুক গিলে,
– মা…
– একদম চুপ অসুস্থ শরীর নিয়ে কোথায় গিয়েছিলি? নিশ্চই পায়রার কাছে আচ্ছা কাল কি দেখতে পারতি না অসুখ নিয়ে কেন যেতে হবে?
– আসলে মা ও বৃষ্টিতে ভিজেছিল তাই আর কি
– তাই আর কি নিজের কথা ভুলে ওর সেবা করতে গেলে।
– উহু দেখতে গিয়েছিলাম।
– দেখা হয়ে গেছে?
– হুম।
– জ্বর কমেছে পায়রার?
– হুম।
– তাহলে এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়।