Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1052



মন পায়রা পর্ব-০৮

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৮

‘ননসেন্স তোর সাহস হয় কিভাবে আমার পায়রার হাত ধরার? তোকে তো আমি মে’রে’ই ফেলব।’

কথাগুলো বলে অনবরত একটা ছেলেকে মা’রতে শুরু করল ইফাত। মুখে কয়েকটা ঘুষি দেওয়ার কারণে নাক মুখ থেকে রক্ত বের হচ্ছে পায়রা অনেক চেষ্টা করেও ইফাতের হাত থেকে ছেলেটাকে ছাড়াতে পারছে না।ইফাত ছেলেটাকে মে’রে’ই যাচ্ছে পায়রা আর না পেরে ইফাতের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ইফাত ছেলেটাকে ছেড়ে পায়রার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা, পায়রা নিজের মনের কথা জানানোর জন্য ইফাতকে মেসেজ করে একটা ঠিকানা দিয়ে দেখা করতে বলে।সেই জায়গায় পায়রা এসে ইফাতের জন্য অপেক্ষা করছিল।পায়রা একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছিল তাই জন্য বসে ছিল কিন্তু কোত্থেকে একটা পরিচিত ছেলে আচমকা পায়রার সামনে এসে হাত ধরে, ‘পায়রা কি সমস্যা তোমাকে প্রপোজ করার পর থেকে তুমি আমাকে এড়িয়ে চলো কথা বলো না কেন? গতকাল ভার্সিটিতেও গেলে না।’

ইফাত এসে আশেপাশে তাকিয়ে পায়রাকে খুঁজছিল আর তখনি তাদের দিকে নজর যেতেই মাথায় রাগ উঠে গিয়েছিল কোনো কথা না বলেই সেখানে উপস্থিত হয়ে ছেলেটিকে অনবরত পে’টা’নো শুরু করে।পায়রা অনেকবার নিষেধ করার পরেও কথা শুনেনি।

ইফাতের হাত থেকে ছাড়া পেতেই ছেলেটার কিছু বন্ধু ছেলেটাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে ছেলেটার অবস্থা খুব খারাপ।পায়রা ক্ষিপ্ত স্বরে,
– আপনি সত্যি সত্যি একটা অমানুষ এভাবে কেউ কাউকে মা’রে?

– ও তোমার হাত ধরেছিল।

– এই সামান্য কারণে আপনি ওর গায়ে হাত তুলবেন ছেলেটা আমাকে পছন্দ করে একদিন পর এখানে দেখে ভুলে হাত ধরে ফেলেছে তাই এভাবে মা’রতে হবে?

– কেন অন্য কেউ তোমার হাত ধরবে? তুমি জানো না তোমাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না।

– তবে আপনি কেন আমার হাত ধরেন?

– আমার সঙ্গে ওর তুলনা দিচ্ছো?

– আপনার সঙ্গে ওর তুলনা দিলে ওই ছেলেটাকে অপমান করা হবে। ছেলেটা আপনার মতো অমানুষ নয় আমি বলি কি আপনার মাথায় সমস্যা আছে ভালো একটা ডাক্তার দেখান আমি প্রথমেই আপনাকে ঠিক চিনেছি আপনার মতো ছেলেকে ঘৃণা ছাড়া কিছু করা যায় না।

– পায়রা তুমি কিন্তু..

– থামুন তো আপনার প্রতি দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল কিছুটা ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছিল মনের কথা জানানোর জন্য এখানে ডেকেছিলাম কিন্তু ভাগ্য ভালো তাই আবারো এমন একটা ভয়ংকর রূপ দেখলাম নইলে জীবনের বড় একটা ভুল করে ফেলতাম আর যাই হোক আপনার মতো অমানুষকে ভালোবাসা যায় না আই হেট ইউ ইফাত, আই হেট ইউ।

পায়রা আর দেরি না করে ইফাতকে রেখে চলে গেল ইফাত পায়রার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। অতিরিক্ত ভালোবাসার কারণে পায়রার সঙ্গে কাউকে দেখলেই মাথা খারাপ হয়ে যায় ইফাতের আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি কিন্তু পায়রার কথাগুলো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না খুব কষ্ট অনুভব হচ্ছে।

পায়রা বাড়িতে এসে নিজের ঘরে বসে আছে তখন রাগ দেখিয়ে ইফাতকে আজেবাজে কথা বললেও এখন নিজের খারাপ লাগছে।সাবিহা আগ্ৰহ নিয়ে পায়রার ঘরে এসে বিছানায় হেলে,

– কিরে আপু এত তাড়াতাড়ি চলে এলি ইফাত ভাইয়াকে সব বলে দিয়েছিস? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিভাবে কি?

– একদম ওই লোকটার নাম আমার সামনে উচ্চারণ করবি না ওই লোকটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই না।

– এটুকু সময়ে কি এমন হল যে তোর ভালোবাসা উবে গেছে?

পায়রা ওখানে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বলল সাবিহাকে।সাবিহা পুরো ঘটনা শুনে,
– মানছি ইফাত ভাইয়া ভুল করেছে তাই বলে তুই এসব বলবি ভাইয়াকে?

– ভুল কিছু তো বলিনি আমি না থাকলে তো ছেলেটাকে একেবারে মে’রে ফেলত।

– শোন আপু আমার মনে হয় কি…

– একদম চুপ কিছু বুঝাতে আসবি না আমায় ওই খারাপ লোকের সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই না নিজের কথা ভাব আমার কথা ভাবতে আসবি না।

– আপু!

– যা এখান থেকে একা থাকতে দে আমায়।

সাবিহা পায়রার রাগ দেখে আর কিছু বলল না নিজের ঘরে গিয়ে ইনানকে কল দিল।
_______________

ইফাত বাড়িতে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বারান্দায় বসে আছে।মন খারাপের থেকেও কষ্ট হচ্ছে বেশি চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে গোসল করার পরেও ঘেমে গেছে টি-শার্ট ভিজে গেছে চুল গুলো কপালে লেপ্টে আছে। দেখতে বিভৎস লাগছে ইতি বেগম ছেলের এমন চেহারা দেখে ভেতরে ভেতরে আতকে উঠলেন ছেলের সামনাসামনি হতে মন সায় দিচ্ছে না তাই স্বামীকে ঘটনা বললেন।

এনায়েত মির্জা নিঃশব্দে এসে ছেলের পাশে বসলেন কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে,

– কি হয়েছে তোর?

নিজের কষ্ট বাবার কাছে লুকানোর জন্য নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে,
– কিছু না বাবা।

– ভুলে যাস না তুই আমার ছেলে আমি তোর বাবা। নিজের ছেলের মুখ দেখেই বুঝতে পারি তার মনে কি চলছে জানিস তো বাবা-মা বন্ধুর মতো তাই লুকাস না কিছু মনের সব জমানো কথা বলে দে মন হালকা হবে।

ইফাত একে একে সব খুলে বলল আজ বাবাকে খুব কাছের মনে হচ্ছে ভেতরটা যেন এবার কিছুটা হালকা হয়েছে। এনায়েত মির্জা সবটা মনোযোগ সহকারে শুনে,

– সামান্য কারণে আমার ছেলে মন খারাপ করে আছে? পায়রা কথাগুলো হয়তো রেগে বলেছে রাগ কমলে সরি বলে নিস তারপরও না শুনলে রাগ ভাঙ্গাবি।

– এটা রাগ নয় বাবা ও মন থেকে এসব বলেছে কিন্তু আমি তো ওকে ভালোবাসি কিভাবে থাকব পায়রাকে ছাড়া।

– আমি পলাশের সঙ্গে কথা বলি তোদের ব্যাপারে পলাশেরও তোকে পছন্দ বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে পায়রার রাগ ঠিক হয়ে যাবে।

– কিন্তু বাবা ওর সিদ্ধান্ত না নিয়ে কিভাবে?

– আমি এভাবে তোকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবো না যা করার এবার আমি করব, আজ পর্যন্ত কোনো কিছুর জন্য তোদের দুই ভাইকে মন খারাপ করতে দেইনি আজ কিনা ভালোবাসার মানুষের জন্য মন খারাপ করবি আমি সহ্য করতে পারবো না তোর মা আর আমি আজ যাব।

ইফাত পায়রাকে নিজের করে পাওয়ার ভরসা পেল। এনায়েত মির্জা ইতি বেগমকে সবটা বলতেই তিনি মেনে নিলেন।
_______________
এনায়েত মির্জা এবং ইতি বেগম সন্ধ্যায় শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন তাদের দেখে শেখ পরিবার অনেক খুশি হয়েছে। পলাশ শেখ হেসে হেসে কথা বলছেন তাদের সঙ্গে।আবরার আর তার মা’কে আসার জন্য খবর দেওয়া হয়েছিল তারাও চলে এসেছে সবাই গল্প করছে। আসমা বেগম সবার জন্য চা নিয়ে এসে পরিবেশন করে গোমড়া মুখে,

– ভাই-ভাবী আপনাদের জানিয়ে আসা উচিত ছিল কোনো আয়োজন করতে পারলাম না বড্ড খারাপ লাগছে।

ইতি বেগম হেসে বললেন,
– এই জন্যই বলিনি এত আয়োজন দেখলে বারবার অতিথি মনে হয়।

– অতিথি হবেন কেন আপনারা আমাদের নিজেদের মানুষ।

এনায়েত মির্জা চায়ের কাপ হাত থেকে রেখে সবার দিকে একবার তাকিয়ে,
– বাড়ির সবাই তো মনে হচ্ছে এখানে আছে।

পলাশ শেখ বললেন,
– বাড়ির বড়রা সবাই আছে ছোটরা উপরে।

– বড়দেরই দরকার আসলে আজ আমরা অনেক বড় একটা কারণে এসেছি জানি না হুট করে বলা ঠিক হবে কিনা তবুও বলতে চাইছি বাকিটা আপনাদের সিদ্ধান্ত।

পলাশ শেখ প্রশ্ন করলেন,
– কি এমন জরুরী কথা এনায়েত?

– আমার বড় ছেলে ইফাতকে তো চেনো?

– চিনবো না কেন।

– ওর সম্পর্কে সব জানা তো?

– কি যে বলো এনায়েত তোমার দু’টো ছেলেই অনেক ভালো। ইফাতের মতো ছেলে লাখে একটা হয় একেবারে দায়িত্ববান ছেলে।

– আমি চাইছিলাম তোমার মেয়ে পায়রাকে আমার ছেলের বউ করে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে, ইফাতের পায়রাকে খুব পছন্দ আমাদের কোনো মেয়ে নেই আমরাও একটা মেয়ে পেয়ে যাব।

উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। পলাশ শেখ হাস্যজ্জল মুখে,
– এটা তো আমাদের সৌভাগ্য,আমারও অনেকদিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আমাদের কোনো আপত্তি নেই আমরা রাজি।

– পায়রার মতামতটাও জেনে নেই।

আসমা বেগম হেসে বললেন,
– ওর মত নিতে হবে না পায়রাও রাজি সেদিন ইফাতের নামে কত সুনাম করছিল।

– তাহলে আজই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করি?

– আমার ইচ্ছে ছিল পায়রার পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে দেওয়ার কিন্তু।

– সমস্যা নেই এনগেজমেন্ট সেরে ফেলতে তো আপত্তি নেই।

– তা সেরে ফেলাই যায়।

দুই পরিবার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে এনগেজমেন্টের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে সবাই খুশি শুধু খুশি হতে পারেনি আবরার। রাতে অনেক জোর করার জন্য ইফাতের বাবা-মা রাতের খাবার খেয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। বাড়িতে ফিরতেই ইফাত তাদের কাছে এলো ইতি বেগম মুচকি হেসে,

– তোদের এনগেজমেন্ট ঠিক করে আসলাম আগামী সপ্তাহেই এনগেজমেন্ট।

– পায়রা রাজি হয়েছে মা?

– হুম রাজি।

পায়রাও ইতোমধ্যে জেনে গেছে প্রথমে বাবাকে আপত্তি জানায় কিন্তু পলাশ শেখ মেয়ের কথা কানে তুলেননি।

ইনান ইফাতের খাটে শুয়ে আছে, ইফাত মাথায় চাপড় মেরে,
– আমার বিছানায় কি করছিস তুই?

– শুয়ে আছি আর তোর গন্ধ নিচ্ছি ভাবী আসার পর তো আর এভাবে শুতে পারবো না।

– শুরু হয়ে গেছে নাটক।

– নাটক বল যাই বল তুই তো পায়রাকে পেয়ে গেছিস কিন্তু আমি তো সাবিহাকে পেলাম না।

– আগে পড়াশোনা কমপ্লিট কর এছাড়া সাবিহা তো আর পায়রার মতো নয় তোকে খুব ভালবাসে বিয়ের সময় হলে সাবিহার সঙ্গে তোর বিয়ে দিয়ে দিব।

– তোরা না দিলে পালিয়ে যাব। এবার বল পার্টি দিবি না?

– কিসের পার্টি?

– পায়রাকে পেয়ে যাচ্ছিস।

– কিছু হলেই তোর আর বাবার পার্টি চাই আগে পুরোপুরি পেয়ে নেই তারপর পার্টি,পায়রাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে সত্যি সত্যি রাজি তো?

– চাপ নিস না রাজি না হয়ে যাবে কোথায়।

– রাজি হলেই ভালো।
_______________

‘মা তোমার সামনে সবকিছু হল অথচ তুমি কিছু বললে না। তুমি জানো না আমি ছোট থেকেই পায়রাকে ভালোবাসি?’

– আমার কি করার ছিল আবরার আমিও তো চেয়েছিলাম পায়রাকে আমার বাড়ির বউ করে নিয়ে আসব কিন্তু আসমা যদি রাগ করে সে জন্য বলতে পারিনি।আজ এনায়েত মির্জা ইফাতের জন্য পায়রার সম্বন্ধ নিয়ে আসলেন সবাই রাজিও হয়ে গেল আমি কি করতাম।

– সত্যি তোমার কিছু করার ছিল না ঠিক আছে এবার যা করার আমিই করব পায়রা শুধু আমার হবে ওই ইফাত মির্জা কি ভেবেছে সবসময় আমাকে হারিয়ে দিবে? নাহ আমি আর হারবো না পায়রাকে নিজের করে ওকে হারিয়ে দিব।

– কি করতে চাইছিস তুই?

– তা তো সময় হলেই দেখতে পাবে।

– এমন কিছু করিস না যাতে ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।

আবরার এর কোনো উত্তর দিল না বাড়ি থেকে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেল।

চলবে…..

মন পায়রা পর্ব-০৭

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৭

‘একা একা দাঁড়িয়ে আছো কেন কারো জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে নাকি?’

আজ পায়রা বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বের হয়নি।একা একা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।পায়রাদের বাড়ি থেকে ইফাতদের বাড়ি বেশ কাছে বিশ মিনিটের দূরত্ব। ইফাত যেই রাস্তা দিয়ে অফিস যায় মূলত সেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে পায়রা। পায়রারও ইফাতকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল একটা দিন ইফাতের সঙ্গ পাওয়ায় তার মনটাও ইফাতের প্রতি উতলা হয়ে উঠেছে কেন এমনটা হচ্ছে জানা নেই।
ইফাত অফিসে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে নিজেই ড্রাইভ করছে।ইফাতের নিজের গাড়ি নিজেরই ড্রাইভ করতে ভালো লাগে পায়রাকে দেখতেই গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল।পায়রা মনে মনে অনেক খুশি হয়েছে কিন্তু ইফাত যাতে বুঝতে না পারে সেজন্য স্বাভাবিক ভঙ্গিতে,

– রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি ভার্সিটিতে যাব।

– তোমাদের গাড়ি কোথায়?

– আনিনি।

– কেন?

-আপনাকে বলবো কেন?

– তাও ঠিক কিন্তু মনে হয় না এখন রিক্সা পাবে আমি তো ওদিক থেকেই আসলাম আমার গাড়িতে উঠো তোমাকে দিয়ে আসি।

পায়রা এতক্ষণ এই কথাটাই শুনতে চাইছিল মনে মনে ভাবল,’সাথে সাথে রাজি হওয়া যাবে না সন্দেহ করবে।’

– কি ভাবছো মন পায়রা?

– আপনি যেতে পারেন।

– যাব কিন্তু তোমাকে নিয়ে যাব।

– আপনার অফিস তো অন্য রাস্তায়।

– তোমার চিন্তা করতে হবে কেন তুমি ভার্সিটি পৌঁছাতে পারলেই তো হয়।

পায়রা কিছু না বলে গাড়িতে উঠে পড়ল। ইফাত গাড়ি চালাচ্ছে পায়রা আড়চোখে বারবার তাকাচ্ছে ইফাতের দিকে আর বিড়বিড় করছে,’লোকটা এত সুন্দর কেন?’

পায়রার আচরণ অদ্ভুত লাগছে ইফাতের কাছে। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে পায়রা তার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর কিছু বিড়বিড় করছে।ইফাত এবার জিজ্ঞেস করেই ফেলল,

– কিছু বলবে পায়রা?

পায়রা ইফাতের কথায় হকচকিয়ে গেছে ভাবছে ইফাত কি দেখেছে, মনে আবার সাহস জুগিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে,

– বলার হলে ডাক দিতাম।

– তাহলে লুকিয়ে দেখছো কেন? তুমি চাইলে আমাকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পারো।

পায়রার রাগ হচ্ছে সাথে লজ্জাও পাচ্ছে তবুও ইফাতকে বুঝতে দেওয়া যাবে না জানালার দিকে তাকিয়েই বলল,

– সত্যিই আপনাকে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আপনাকে দেখলেই মেয়েরা ফিদা হয়ে যায় কেন?

– আমি সুন্দর,হ্যান্ডসাম তাই ফিদা হয় এতে ভাবার কি আছে?

– আমার তো তেমন মনে হয় না।

ইফাতের মুখের ভঙ্গি সিরিয়াস হয়ে গেল অসহায় কন্ঠে,
– সত্যি মনে হয় না?

– না দেখছেন না আপনাকে আমার ভালো লাগে না।

ইফাত চিন্তায় পড়ে গেল পায়রা মনে মনে হাসছে।গাড়িটা থেমে গেল পায়রা ইফাতের দিকে তাকিয়ে,
– গাড়ি থামালেন কেন?

– তোমার ভার্সিটির সামনে এসে গেছি।

পায়রা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভার্সিটি দেখতে পেয়ে,
– এত তাড়াতাড়ি এসে গেলাম?

– তাড়াতাড়ি কোথায়?

পায়রা ইফাতকে রাগ দেখিয়ে নেমে ভার্সিটির গেইট দিয়ে ঢুকে গেল।ইফাত অবাক হয়ে তাকিয়ে,
– রাগ দেখাল কেন? আমি তো রাগার মতো কিছু করিনি।

পায়রাকে দেখে অশমি এগিয়ে এসে,
– তুই ইফাত ভাইয়ার গাড়ি করে এলি কেন?

– কেন তোর সমস্যা?

– সমস্যা হবে কেন আসলে ভাইয়া আর আমি তোর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম।

– অপেক্ষা করতে গেলি কেন?

– না ভাবলাম আজ একসাথে আসি কিন্তু খালামণির কাছে শুনলাম তুই বেরিয়ে গেছিস আর এখন ইফাত ভাইয়ার গাড়ি থেকে নামলি কি চলছে রে তোদের?

– বললাম না ইফাত আমাকে পছন্দ করে।

– কিন্তু তুই তো করিস না।

– করি না তবে করতে কতক্ষণ।
____________

ইফাত অফিসে এসে নিজের কেবিনে বসে আছে কাজে মন বসছে না মন ছটফট করছে।আরাফ কাশি দিয়ে,
– স্যার এনি প্রবলেম?

– আচ্ছা আরাফ আমাকে দেখতে কেমন লাগে?

আরাফ চমকে গিয়ে,
– বুঝলাম না স্যার।

– আমাকে দেখতে কেমন লাগে?খুব খারাপ দেখতে আমি?

– আপনি দেখতে খারাপ হবেন কেন স্যার! অফিসের কত মেয়ে আপনার জন্য পাগল।

– তাহলে পায়রা বলল যে?

– মেডামের কথা বাদ দিন তো উনি আপনার সঙ্গে মজা করেছে হয়তো।

– হতে পারে।

আরাফের কথায় আস্বস্ত হয়ে ইফাত কাজে মন দিল।আরাফ বাইরে গিয়ে অনেক হেসেছে তার স্যার প্রেমে পড়ে রাতারাতি পাল্টে গেছে।
_____________

পায়রার মন টিকছে না বাড়িতে,ইফাতের কথা মনে পড়ছে আর আনমনে মুচকি হাসছে। সাবিহার ঘরে গিয়েছিল কিন্তু সাবিহা ইনানের সঙ্গে ফোনে প্রেম করতে ব্যস্ত। বিছানায় এপিট ওপিঠ হয়ে শুয়েও ছটফটানি কমাতে পারছে না নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল,’পায়রা তুই কি ওই খারাপ লোকটার প্রেমে পড়েছিস? উহু মোটেও ওই লোকের প্রেমে পরবো না কিন্তু মন তো উনাকে মিস করছে।না না কিছুতেই উনাকে বুঝতে দেওয়া যাবে না তাহলে উনি জিতে যাবেন আর আমি কিছুতেই ইফাতের কাছে হারবো না।

ইফাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালো করে দেখছে।ইতি বেগম ঘরে এসে ছেলের হাবভাব পর্যবেক্ষণ করে,
– ইফু এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস?

ইফাত মা’কে দেখে টেনে ঘরে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে,
– আচ্ছা মা আমাকে দেখতে খারাপ লাগে?

– তুই আমার রাজপুত্রের মতো দেখতে বড় ছেলে তোকে কেন খারাপ লাগবে? মাথা খারাপ হয়েছে?

– ওহ তুমি আমার ঘরে এসময় কিছু বলবে?

– না দেখতে আসলাম কি করিস? জানিস ইনানও প্রেম করছে।

– এখন আবার ইনানকে নিয়ে পড়েছ।

– আমি দেখে আসলাম কার সঙ্গে যেন হেসে কথা বলছে।

– হয়তো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছে।

– বন্ধুর সঙ্গে এভাবে কথা বলে?

– এখনকার সময় এভাবেই কথা বলে।

– কি সময় এলো আমার দু’টো ছেলের অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছে।

– মা আমরা বড় হয়েছি ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছি তোমাদের অসম্মান হবে এমন কোনো কাজ আমরা করব না আমাদের নিয়ে চিন্তা করে প্রেশার বাড়িও না তো।

– যেদিন নিজের ছেলে-মেয়ে হবে সেদিন বুঝবি।

বলেই ইতি বেগম ইফাতের ঘর থেকে চলে গেলেন।ইফাতের মায়ের এমন আদর ভালোই লাগে দরজা আটকে শুয়ে পড়ল।ইফাতের মোবাইলটা বেজে উঠল স্ক্রিনে চোখ রাখতেই চোখ মুখ বিষ্ময়ে ভরে গেছে ভেতরে ভালো লাগা কাজ করছে।কলটা ধরে ফোন কানে ধরল দু’পাশে নিরবতা বিরাজ করছে।ইফাত নিজেই বলা শুরু করল,

– আমি ভাবতেই পারছি না আমার মন পায়রা আমাকে কল দিয়েছে! কিন্তু কথা বলছো না কেন চুপ করে থাকার জন্য কল দিয়েছ?

পায়রা মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে গিয়ে ইফাতকে কল দিল কন্ঠস্বর শোনার জন্য।ইফাত এর আগেও অনেকবার কল দিয়েছিল তাই নাম্বার ছিল কিন্তু পায়রা ইফাতকে ব্লক মেরে দিয়েছিল।আজ ব্লক খুলে কল দিয়েছে পায়রা বলল,

– আসলে নাম্বারটা মোবাইলে দেখতে পেলাম চিনতে না পেরে নাম্বারের মালিক জানার জন্য কল দিয়েছিলাম।

– তুমি তো আমাকে ব্লক করে দিয়েছিলে তাহলে নাম্বার সামনে এলো কিভাবে?

– ইয়ে মানে ব্লক লিস্ট চেক করছিলাম কিন্তু এই একটা নাম্বার পরে থাকতে দেখলাম, কেন ব্লক করেছি কাকে করেছি মনে করার জন্য কল দিলাম।

– এখন কি আবার ব্লক করবে?

– হুম, আপনি ঘুমাননি এখনও?

– শুয়ে ছিলাম তখন তোমার কল আসলো।

– বিরক্ত করলাম আপনাকে।

– ভাবলে কি করে তোমার জন্য আমি বিরক্ত হব।

পায়রা আর কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না তাই বলল,
– গুড নাইট রাখলাম।

– এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বে?

– না।

– তাহলে?

– আমি ভাবলাম আমার জন্য আপনার ঘুমের সমস্যা হচ্ছে।

– তোমার জন্য আমার কোনো সমস্যা হয় না কারণ তোমাকে আমি ভালোবাসি তোমার সবকিছুই আমার ভালো লাগে সত্যি কথা বললেই হয় তোমার ঘুম পেয়েছে।

– আমার ঘুম পায়নি এমনিতেও আমি দেরি করে ঘুমাই।

পায়রা এটাই চাচ্ছিল ইফাত যেন তার সঙ্গে কথা বলে আর তাই হলো। দু’জনের মধ্যে অনেক কথা হচ্ছে সবচেয়ে খুশি ইফাত এই প্রথম পায়রা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে।
______________
ভোরের আলো ফুটে গেছে অথচ ইফাতের ঘুম থেকে উঠার নাম নেই।ইফাত প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে উঠে নাস্তা করে অফিসে চলে যায় কিন্তু আজ ঘুম থেকেই উঠেনি।ইতি বেগম এই নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ছেলেকে ডাকতে আসলেন,

– ইফু সাড়ে নয়টা বেজে গেছে এখনও ঘুমাচ্ছিস অফিসে যাবি কখন? সারা রাত কি ঘোড়ার ঘাস কেটেছিস যে পরে পরে ঘুমাচ্ছিস?

ইফাত চোখ ঢলে দরজা খুলে দিতেই ইতি বেগম হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে বিছানা গুছাতে শুরু করলেন ইফাত বিছানায় বসে,
– বিছানা আমি গুছিয়ে নিব মা আরেকটু ঘুমিয়ে নেই তারপর।

– সারা রাত কি করেছিস?

– তোমার হবু বউমার সঙ্গে কথা বলেছি।

ইতি বেগম বালিশটা রেখে ইফাতের দিকে তাকিয়ে,
– পায়রার সঙ্গে! কিন্তু তুই না বললি পায়রা তোকে পছন্দ করে না।

– করেই তো না কিন্তু কাল হঠাৎ করেই কথা বলল।

– প্রেমের লক্ষন মনে হয় পায়রাও তোর প্রেমে পড়েছে।

– তোমার কথা সত্যি হলে ভালোই হবে।

– আজ অফিসে যাবি না?

– একটু পরে যাব।

সারা রাত কথা বলার কারণে পায়রারও ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে আজও ভার্সিটি মিস করেছে। পায়রা ভার্সিটি না যাওয়ায় সাবিহাও কলেজে যায়নি।সাবিহা একটা ফাঁকিবাজ মেয়ে কোনো কারণ পেলেই কলেজ ফাঁকি দেয়। পায়রা বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে চোখ বন্ধ সাবিহা বিছানায় ধপ করে বসে,

– আপু আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল কেন?

– ইফাতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছে।

সাবিহা চোখ বড় বড় করে অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে,
– তুই ইফাত ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলেছিস! তার মানে তুই ইফাত ভাইয়ার প্রেমে পড়েছিস?

পায়রা বিরক্ত হয়ে,
– উফ আস্তে কথা বল সবাই শুনবে।

– সত্যি তুই ইফাত ভাইয়াকে পছন্দ করিস?

– ভালোই লাগে যতটা খারাপ মনে করেছিলাম তার থেকেও ভালো আমাকে ভালোবাসে আর ইগনোর করা ঠিক হবে না।

– ভাইয়াকে বলে দিয়েছিস!

– উহু বলতে পারিনি আমি উনার কাছে হারতে চাই না এছাড়া কেমন একটা ছ্যাচড়া লাগবে।

– ভালোবাসায় আবার হার জিত বলে কিছু আছে এগুলোকে ছ্যাচড়া বলে না ছ্যাচড়া বললে এত অপমান ইগনোরের পরেও ভাইয়া তোর পেছনে পরে থাকতো না। তোকে দেখার জন্য সবার চোখের আড়ালে ছুটে আসত না।

– তাহলে কি বলিস মনের কথা বলে দেওয়া উচিত?

– অবশ্যই।

– কিভাবে বলবো লজ্জা করে।

– ঢং বাদ দে আমিও ইনানকে বলেছি তোকেও ইফাত ভাইয়া বলেছে।

– কিন্তু আমি কিভাবে বলবো?

– যেভাবে ইফাত ভাইয়া তোকে বলেছে সরাসরি গিয়ে বলে দিবি ইফাত আপনাকে আমারও ভালো লাগে যা হওয়ার হয়ে গেছে চলুন প্রেম করি কিংবা বিয়ে করে নেই।

– পাগল হয়েছিস।

– লজ্জা পেয়ে লাভ নেই এভাবে লজ্জা পেলে প্রেম আর বিয়ে করতে হবে না।

– উনাকে পাবো কোথায়?

– ঢং দেখলে বাঁচি না প্রতিদিনই তো দেখা হয় এছাড়া ফোন নাম্বার তো আছেই কোথাও দেখা করতে বল।

– আইডিয়া মন্দ নয়।

– আমাকে কিন্তু বড় একটা ট্রিট দিতে হবে।

– আচ্ছা আমার সুইট বোন দিব ট্রিট।

চলবে…….

মন পায়রা পর্ব-০৬

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৬

‘আজ আপনার জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত কাটাতে পেরেছি জানেন বাবা আমাকে কখনোই একা ছাড়ে না বন্ধুদের সঙ্গেও দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে দেয় না।বাবার কাছে কত বায়না ধরেছিলাম এই কাঁচের চুড়ি গুলো কিনে দিতে কিন্তু বাবার এক কথা এগুলো দিয়ে নাকি হাত কেটে যাবে। তবে আপনার জন্য সব স্বপ্ন গুলো পূরণ হলো অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।’

– আর কতবার ধন্যবাদ দিবে? এই ধন্যবাদ শব্দটা আমার ভালো লাগে না তারপরেও তোমার জন্য হজম করে গেছি।

– আচ্ছা আর দিব না তবে সত্যি সত্যি আমি অনেক হ্যাপি শুধু মাত্র আপনার জন্য।

বাগান বাড়ি থেকে সকালেই বেড়িয়ে গেছে সবাই। ইনান-সাবিহা অন্য একটা গাড়িতে এই গাড়িতে ইফাত আর পায়রা। ইফাত ড্রাইভ করছে আর পায়রার ছটফটানি দেখছে ইফাত ভাবতেই পারেনি পায়রা এতটা খুশি হবে। পায়রার খুশিতে ইফাতের অনেক ভালো লাগছে। পায়রার বাড়ি থেকে একটু দূরে গাড়ি থামালো ইফাত পায়রা ব্রু উঁচিয়ে,

– এখানে থামালেন কেন একেবারে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আসুন।

– তোমার পরিবার জানে তুমি ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছ এখন আমার গাড়ি থেকে নামলে তো সন্দেহ করবে।

– ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম।

পায়রা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা ধরল কিছু একটা ভেবে গাড়ির কাছে গিয়ে ইফাতের দিকে তাকিয়ে,

– এই প্রথম আপনার জন্য আমার মুহূর্তগুলো ভালো কেটেছে এই মুহূর্ত গুলো কখনও ভুলবো না।

– তুমি চাইলে এর থেকেও সুন্দর মুহূর্ত তৈরি করতে পারো হাসি খুশি থাকতে পারবে।

– কিভাবে?

– আমাকে বিয়ে করে।

– মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলুন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি কিন্তু ভালোবাসা সৃষ্টি হয়নি বাই।

পায়রা চলে যাচ্ছে যতক্ষন পায়রাকে দেখা গেল ততক্ষণই ইফাত তাকিয়ে ছিল যাওয়ার দিকে,অদৃশ্য হয়ে যেতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল ইফাত।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িং রুমে সবাইকে দেখতে পেল পায়রা।আবরার,অশমি তাদের বাবা-মাও বসে গল্প করছে বলতে গেলে রোজ তারা আসে। পায়রাকে দেখেই আতিফা বেগম কাছে ডেকে,

– কিরে কোথায় গিয়েছিলি পায়রা মা?

– বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলাম খালামণি।

অশমি পায়রার হাত ধরে,
– চুড়ি গুলো অনেক সুন্দরতো কে কিনে দিয়েছে রে পায়রা?

পায়রার মা ও জিজ্ঞেস করলেন,
– সত্যি অনেক সুন্দর এদিকে তো তেমন পাওয়া যায় না কে কিনে দিল?

পায়রা হেসে চুড়ির দিকে তাকিয়ে,
– ইফাত কিনে দিয়েছে আমি বলেছিলাম দুই হাতের জন্য দুই ডজন চুড়ি কিনে দিতে কিন্তু উনি দোকানের সব রেশমী চুড়ি আমার জন্য কিনে নিয়েছেন।

সবাই পায়রার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পায়রা এবার বুঝতে পারলো সে কি বলে ফেলেছে এখন কিভাবে এড়িয়ে যাবে ভাবছে। পলাশ শেখ বললেন,

– তোমরা তো ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলে তাহলে ইফাতকে পেলে কোথায়?

পায়রা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না তখনি সাবিহা বলে উঠল,
– আসলে জেঠু ফ্রেন্ডদের সঙ্গেই ঘুরতে গিয়েছিলাম কিন্তু ইফাত ভাইয়া আর ইনানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওই যে উনাদের বাগান বাড়ি যাচ্ছিলেন কি একটা কাজে যেন, আমরা উনাদের চিনি উনারাও আমাদের চেনেন তাই।

– ওহ।

– হ্যা তারপর উনারাও জোর করলেন যাতে উনাদের সঙ্গে যাই আর জায়গাটা নাকি সুন্দর তাই গেলাম জানো জেঠু জায়গাটা অনেক সুন্দর পায়রা আপুরও ভালো লেগেছে কি রে আপু বল।

পায়রা শান্তি পেল সাবিহার সঙ্গে তাল মিলিয়ে,
– হ্যা বাবা জায়গাটা অনেক সুন্দর আর কাছাকাছি একটা মেলা হচ্ছিল ওখানে ঘুরেও এসেছি। সারাটাদিন অনেক ভালো কেটেছে অনেক আনন্দ পেয়েছি।

পলাশ শেখ তৃপ্তির হাসি হেসে,
– তোরা খুশি হয়েছিস এটাই অনেক আমি কাজের চাপে তোদের কোথাও নিতেই পারি না।ইফাত যদি আবার ওদিকে যায় তাহলে ওকে বলে দিব যাতে তোদেরও নিয়ে যায়।

– আচ্ছা বাবা তাহলে আমরা ঘরে যাই ফ্রেশ হতে হবে।

– আচ্ছা যা।

পায়রা আর সাবিহা দু’জনে উপরে চলে গেল আবরার এবং অশমি ভালো করেই বুঝতে পারছে ফ্রেন্ড নয় বরং সরাসরি ইফাতের সঙ্গেই ওরা ঘুরতে গেছে। আসমা বেগম বললেন,
– ইফাতের জন্য তোমার এই বদমেজাজি মেয়ের মুখে আজ আনন্দ দেখলাম সবসময় এমন থাকলেই হয়।

পলাশ শেখ স্ত্রীর কথায় বললেন,
– ইফাত ছেলেটা কিন্তু এমনিতে অনেক ভালো একেবারে এনায়েতের মতো দায়িত্বশীল এমন একটা ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হতাম।

আতিফা বেগম আজ সবার সামনে আবরার আর পায়রার বিয়ের প্রস্তাব দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু এখন আর প্রস্তাব দেওয়া উচিত হবে না বলে মনে করলেন। সবার কথা শুনছেন তিনি বুঝতে পেরেছেন ইফাতকে তাদের পছন্দ হয়তো একদিন মেয়ের জামাই করে ফেলবেন।

ঘরে এসে সাবিহার গালে একটা চুমু খেয়ে পায়রা বলল,
– কি সুন্দর মতো গুছিয়ে সত্য বলে দিলি তোর জন্য আমি গর্বিত।

– চুমু দিলে হবে না গিফ্ট দে।

– ইফাত তোকে কতকিছু কিনে দিল আবার আমার কাছে চাইছিস কেন?

– ইফাত ভাইয়া দিয়েছে তুই দেসনি।

– আমার বোন বলেই তোকে দিয়েছে।

– দেখলি ইফাত ভাইয়া কত ভালো উনার সঙ্গে থাকলে তুই খুশি থাকবি এখনও সময় আছে উনাকে হ্যা বলে দে।

– আবার এক কথা যা তো।

সন্ধ্যার নাস্তা করে আবরারের পরিবার বাড়িতে চলে গেল। বাড়িতে এসে অশমি মুখ কালো করে উপরে চলে গেল আবরারেরও রাগ হচ্ছে ইফাতের উপর। আবরার অশমির পাশে বসে,
– রাগ হচ্ছে?

– হুম ইফাত পায়রার সঙ্গে সময় কাটাল ওরে চুড়িও কিনে দিল।

– তোর চুড়ি পছন্দ হয়েছে? তোকে কিনে এনে দিব ঠিক আছে।

– লাগবে না ওদের একসঙ্গে দেখলে আমার বিরক্ত লাগে রাগ হয়।

– রাগ তো আমারও হয়।
____________
ইফাত পায়রাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেছিল কিছু কাজ ছিল সেগুলো করে বাড়িতে ফিরতে ফিরতে নয়টা বেজে গেছে।ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলো খাবার টেবিলে সবাই আছে বুঝাই যাচ্ছে ওর জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল।

ইফাত খাবার খাচ্ছে বেশ কয়েকবার বাবার সাথে চোখাচোখি হয়েছে।ইফাত নিজেই বলল,
– কিছু বলবে বাবা?

– বলতে তো অনেক কিছুই চাই।

– একে একে সব বলে দাও।

– তোর মায়ের কাছ থেকে অনেক কথাই শুনলাম কিন্তু এড়িয়ে গেছি কিন্তু আজ তো সত্যি ঘটনা গুলো।

– হেয়ালি না করে কোন ঘটনা সেটা বলো।

– পলাশের মেয়ের সঙ্গে তোর কি চলছে বাবা? আমাদের বাগান বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলি ওকে নিয়ে?

ইফাতের গলায় খাবার আটকে গেছে অনবরত কাশছে।ইতি বেগমকে সরিয়ে এনায়েত মির্জা নিজেই দাঁড়িয়ে গিয়ে ছেলের দিকে পানি এগিয়ে দিলেন।ইফাত পুরো পানি খেলো, এনায়েত মির্জা জিজ্ঞেস করলেন,
– এবার ভালো লাগছে?

– হুম।

ইতি বেগম রাগি চোখে,
– খাওয়ার সময় ছেলেকে আজেবাজে প্রশ্ন করছো কেন? খেয়ে নিক।

– তুমি চুপ থাকো ইফাত বাবা তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে।

ইফাত ইনানের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল।ইনান অসহায় দৃষ্টিতে ইশারা করে বুঝাল,
– বিশ্বাস কর ভাইয়া আমি কিছু বলিনি।

ইফাত শান্ত কন্ঠে,
– হুম গিয়েছিলাম।

এনায়েত মির্জা বুকে হাত দিয়ে,
– একটা রাত ওখানেই কাটিয়েছিস?

– হুম কিন্তু তুমি বুকে হাত দিয়ে রেখেছ কেন?

– যাতে হার্টটা বেড়িয়ে না আসে। তুই একটা মেয়ের সঙ্গে এক রাত থেকেছিস?

– হুম থেকেছি তবে আলাদা ঘরে।

– তোর নানার কসম খেয়ে বল আলাদা ঘরে থেকেছিস।

ইতি বেগম ক্ষেপে গেলেন ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,
– ওই তুমি আমার বাবাকে মাঝখানে টেনে আনছো কেন?

– তুমি চুপ থাকো তো পুরো কথা শুনতে দাও,ইফু বাবা তুই বল।

– ইফু বলবে না বাজে লাগে শুনতে।

– আচ্ছা তুই উওর দে বাপ।

– তুমি বিশ্বাস করতে পারলে বাবা তোমাদের না জানিয়ে বিয়ে না করে একটা মেয়ের সঙ্গে একঘরে থাকব?

– যখন শুনেছিলাম তুই পায়রাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিস তখনও বিশ্বাস করিনি তাই আর কি জানতে চাইলাম।

– জানলে কিভাবে?

– সেটা তোর জানতে হবে না এবার বল তুই পায়রার পেছনে ঘুরঘুর করছিস কেন?

– পেছনে না আমি পায়রার সামনাসামনি ঘুরি।

এনায়েত মির্জা ইনানের দিকে তাকিয়ে,
– ইনু বাবা আমার হার্টটা চেপে ধর মনে হয় খুলে যাচ্ছে।

ইনান বোকার মতো বাবার বুক চেপে ধরল। এনায়েত মির্জা আবারো জিজ্ঞেস করল,
– ইফু বাবা কেন ঘুরিস মেয়েদের বিরক্ত করিস তুই তো এমন ছিলি না।

– আমি তো শুধু পায়রাকে বিরক্ত করি অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকাইও না।

এনায়েত মির্জা ইতি বেগমের দিকে তাকিয়ে,
– আমার বাচ্চার মা গো আমার মাথায় একটু বাতাস করো মনে হচ্ছে হার্টটা মাথার উপর দিয়ে বের হয়ে যাবে।

ইনান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– বাবা কি বলছো হার্ট মাথার উপর দিয়ে কিভাবে বের হয়?

– তুই চুপ থাক।ইফু বাবা পায়রার পিছনেই কেন ঘুরিস?

– কারণ পায়রাকে আমি ভালোবাসি।

– ইফাতের মা এ আমি কি স্বপ্ন দেখছি? আমার ইফাত কিনা একটা মেয়েকে ভালোবাসে আবার সেটা কি সুন্দর করে আমাকে বলছে।

ইতি বেগম মুখ বাঁকিয়ে,
– আমি তো আগেই বলেছিলাম বিশ্বাস করলে না তবে ছেলের পছন্দ আছে পায়রা মেয়েটাকে আমারও পছন্দ হয়েছে।

– তাহলে কি পলাশের সঙ্গে কথা বলবো?

– বলে লাভ নেই বাবা পায়রা আমাকে পছন্দই করে না।

– কেন করে না আমার এত সুন্দর শান্তশিষ্ট ছেলেকে কেউ পছন্দ না করে থাকতে পারে।(ইতি বেগম)

– জানি না আর বাবা অভিনয় একটু কমিয়ে খেয়ে নাও আমার খাওয়া শেষ আমি ঘুমাতে গেলাম।

ইফাত হাত ধুয়ে চলে গেল এনায়েত মির্জা বুক থেকে হাত সরিয়ে,
– আমি অভিনয় করছি!

ইতি বেগম ভেংচি কেটে,
– শুধু অভিনয় না নাটকও করছো।

ইতি বেগমও চলে গেলেন। এনায়েত মির্জা গালে হাত দিয়ে,
– মা ছেলে এক রকম।

অসহায় দৃষ্টিতে ইনানের দিকে তাকিয়ে,
– ইনু বাবা তুইও কি তোর মায়ের মতো হয়েছিস?

ইনান কি বলবে ভাবছে ইতি বেগম আবারো এদিকে আসছেন। দু’জনের মন রাখার জন্য ইনান হেসে বলল,
– আমি ভাইয়ার মতো হয়েছি বাবা।

এনায়েত মির্জা কপাল চাপড়িয়ে,
– কেউ আমার মতো হল না কোথায় যাব আমি ইতি গো আমার সব ছেলে তুমি কেড়ে নিলে।

ইতি বেগম টেবিলে বারি দিয়ে,
– সব বলতে কি বুঝাও তোমার মাত্র দুইটা ছেলে ছোটটাও তোমার মতো একটা নাটকবাজ হয়েছে।

– এখন আমাকে নাটকবাজ মনে হচ্ছে তোমার? বুঝেছি আমাকে আর ভালো লাগে না কেন ভালো লাগে না এখনও সবাই বলে আমাকে দেখতে নাকি ইয়াং লাগে।

– ইনান একটা কস্টেপ নিয়ে আয় তো তোর বাবার মুখে লাগিয়ে দেই।

এনায়েত মির্জা মুখে আঙ্গুল দিয়ে,
– আর কথা বলবো না চুপ করে গেলাম।

ইতি বেগম মুচকি হাসছেন।

চলবে……

মন পায়রা পর্ব-০৫

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৫

‘হাউ ডেয়ার ইউ আমাকে এভাবে কেন এনেছেন?দিন দিন আপনার সাহস বেড়েই যাচ্ছে। আমার হাত একবার শুধু খুলে দিন ইফাত তারপর দেখুন আপনার কি অবস্থা করি আমি।’

ইফাত গালে হাত দিয়ে নেশা ভরা দৃষ্টিতে পায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়রার কথায় ইফাতের কোনো ভাবান্তর হলো না।পায়রা ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় বড় রাস্তায় যেতেই পেছন থেকে কেউ পায়রার মুখে রুমাল চেপে ধরে,কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি করার পর অজ্ঞান হয়ে যায় পায়রা।জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় একটা ঘরে আবিষ্কার করল পায়রা। মুখটাও বাঁধা ছিল যার কারণে চেঁচাতে পারেনি অনেক ভয় লাগছিল তার কিন্তু পরিচিত মানুষকে দেখে ভয়টা চলে যায়।ইফাত এসে পায়রার মুখের বাঁধন খুলে দিতেই পায়রার অনেক রাগ হয় আর চেঁচিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলে।ইফাত এবার বলল,

– কি করবে হাত খুলে দিলে?

– মেরে ফেলব, যখন ইচ্ছে হবে আমাকে তুলে আনবেন? কি করেছি আমি? আমি তো কোনো ছেলের সঙ্গে হেসেও কথা বলিনি।

ইফাত মৃদু হেসে পায়রার বাঁধন খুলে দিল। পায়রার মাথা গরম হয়ে আছে রাস্তার মাঝখান থেকে এভাবে তাকে এখানে নিয়ে আসায় আজ যেন ইফাত বেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। ইফাত পায়রার হাত নিজের হাত আটকে,

– তোমার রাগমিশ্রিত মুখ আমার অনেক ভালো লাগে।

পায়রা আর রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে সর্বশক্তি দিয়ে ইফাতের গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। কিন্তু এই থাপ্পড়ও ইফাতের মুখের ভাব ভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারেনি।ইফাতের গালে আঙ্গুলের ছাপ বসে গেছে কিন্তু ঠোঁটে সেই নেশালো হাসি এখনও আছে একটুও রাগ করেনি।পায়রা যেন অবাক হয়ে গেল তার মতে এই ইফাতকে সে কিছুতেই চেনে না। ইফাত পায়রার হাতে চুমু খেয়ে,

– এই নরম হাত থাপ্পড় দিতে পারে!

– আপনার লজ্জা নেই এত অপমান করার পরেও কিভাবে আমার সামনে আসেন খারাপ লাগে না?

– ভালোবাসি তো।

– আমি বাসি না।

– এটাই তো জানতে চাই কেন ভালোবাসো না? কেন এত ইগনোর করো? কেন আমার প্রতি এত রাগ? কেন কষ্ট দিচ্ছ? প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও আমি সবকিছু বদলে ফেলব তোমার মনের মতো হয়ে যাব।

পায়রা চুপ করে আছে কোনো উত্তর নেই তবে পায়রার মনেও ইফাতের জন্য ভালোলাগা আছে কিন্তু ইফাতের এই জোর জবরদস্তি, সামান্য কারণে আঘাত ভালো লাগে না। ইফাত কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় হেসে,

– কি উত্তর নেই? উওর থাকুক কিংবা না থাকুক আমি তোমায় ভালোবাসি সবসময় এভাবেই ভালোবাসবো।আর লজ্জা এগুলোকে অপমান বলে না এগুলো আমার কাছে ভালোবাসার অন্য রকম প্রকাশ তবে যেদিন সত্যি সত্যি সবার সামনে অপমান করবে যেদিন মনে হবে তুমি মন থেকে আমায় ঘৃণা করো তোমার মধ্যে আমার জন্য এক কণা ভালোবাসা পাবো না সেদিন আর তোমার সামনে আসব না আজীবনের জন্য চোখের আড়ালে চলে যাব পাবে না আমায়।

পায়রা সাহস করে ইফাতের চোখের দিকে তাকাল।ইফাতের চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে কথাগুলো যে অধীর কষ্টে বলেছে তা ঠিক বুঝতে পারছে পায়রা।ইফাতের চোখে চোখ রেখে পায়রা জিজ্ঞেস করল,

– আপনি এমন কেন?

ইফাত এবারো মুচকি হেসে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে,
– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু তুমি খুব সেয়ানা আমার চোখ ফাঁকি দিচ্ছিলে ইগনোর করছিলে তাই এভাবে ধরে এনেছি এমনি এমনি তো কখনও বললেই আসবে না।

– বাবা-মা জানলে?

– চিন্তা নেই ইনান আর সাবিহা ম্যানেজ করে নিয়েছে। আঙ্কেলকে ওরাই বলে দিয়েছে তোমরা ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ট্যুরে গিয়েছ।

– সাবিহা সব জানতো!

সাবিহা আর ইনান ঘরে এসে,
– সারপ্রাইজ।

পায়রা চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে সাবিহার দিকে।সাবিহা পায়রার চোখের ভাষা বুঝে গেছে,
– আপু রাগ করিস না অনেকদিন ঘুরা হয় না তাই আরকি আমিও ইফাত ভাইয়ার প্লানে যোগ হয়ে গেলাম হি হি।

ইনান ইফাতকে ইশারা দিয়ে বাইরে আসতে বলল।ইফাত পায়রা আর সাবিহার উদ্দেশ্য,
– তোমরা এখানে থাকো আমরা আসছি।

বলেই বাইরে চলে এলো। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে নিজেদের একটা বাগান বাড়িতে এসেছে ইফাতরা। ইনান বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখানে অনেক বাতাস ইফাত চেয়ার টেনে বসে,

– ডাকলি কেন?

– তোর গালে আঙ্গুলের ছাপ কেন ভাইয়া?মনে হচ্ছে কেউ মে’রে’ছে আচ্ছা পায়রা তোকে!

ইফাত শান্ত গলায়,
– কিভাবে আদর করতে হয় জানে না তো তাই আদর করতে গিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে।

ইফাতের কথা শুনে ইনান হু হা করে হাসছে।ইনানের হাসি দেখে ইফাত বলল,
– ভেড়ার মতো ডাকছিস কেন?

– সিরিয়াসলি ভাইয়া আমার হাসি তোর ভেড়ার ডাক মনে হচ্ছে?

– মনে হবে কেন আমি তোকে ভেড়াই মনে করি।

– তুই যাই বলিস না কেন ভাইয়া আজ আমার হাসি বন্ধ হবে না পায়রা তোকে থাপ্পড় মা’রলো আর তুই সেটাকে আদর বলছিস প্রেমে পড়লে মানুষ বদলে যায় তোকে না দেখলে জানতেই পারতাম না।

– হুশ…

পায়রা আর সাবিহা তাদেরকে খুঁজে চলে এসেছে। পায়রা তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– আপনারা দুই ভাই মিলে এখানে বসে হাসাহাসি করেছেন তাহলে আমাদের আনলেন কেন?

ইফাত পায়রার দিকে না তাকিয়েই,
– তোমরাও চাইলে এই ভেড়াটার সঙ্গে হাসতে পারো ইনান ওদের তোর সঙ্গি করে নে।

সাবিহা কাঁচুমাচু মুখে,
– ভাইয়া আপনি ইনানকে ভেড়া বললেন!

– কেন ভালো লাগেনি?

ইনান রাগ দেখিয়ে,
– ভাইয়া তুই সবার সামনে আমাকে অপমান করতে পারিস না।

– তোর অপমান বোধ আছে!

– দাঁড়া আমিও বলে দিব তোকে……

বারান্দায় রাখা ফুলের টব থেকে একটা গোলাপ ছিঁড়ে ইফাত ইনানের মুখে ঢুকিয়ে,
– পেটের কথা পেটে রাখ মুখে আনার দরকার নেই।

ইনান মুখ থেকে ফুল বের করে,
– ওয়াক থু শেষ পর্যন্ত মুখে গোলাপ নিতে হলো এখনি বমি করতে হবে।

– যা খচ্চর ওয়াশরুমে যা।

ইনান দৌড়ে চলে গেল পায়রা আর সাবিহা হাসছে ওদের দুই ভাইয়ের এমন খুনসুটি দেখে।ইফাত ধমক দিয়ে,
– হাসছো কেন?

দু’জনে ধমক খেয়ে মুখ চেপে ধরে আছে হাসি থামছে না।ইফাত সাবিহার দিকে তাকিয়ে,
– এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন যাও গিয়ে দেখো বয়ফ্রেন্ড কি করছে।

সাবিহা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল।পায়রা আবারো একা হয়ে গেল ইফাতের কাছে।ইফাত আবারও চেয়ারে বসে পড়ল, পায়রার উদ্দেশ্যে,
-চাইলে ঘর থেকে আরেকটা চেয়ার নিয়ে এসে বসতে পারো প্রাকৃতিক পরিবেশে খারাপ লাগবে না।

পায়রা ইফাতের কথা মতো একটা চেয়ার এনে ইফাতের পাশে বসল।এটা বারান্দা বললে ভুল হবে বলতে গেলে একটা মাঝারি আকারের ছাদ, খোলামেলা জায়গা বাড়ির আশেপাশে বিশাল আকারের বড় বড় সবুজ গাছ। বেশিরভাগ ফলের গাছ। বারান্দার কাছাকাছি একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ,গাছ ভর্তি লাল আর হলুদ মিশ্রিত রঙের কৃষ্ণচূড়া ফুল ফোটে আছে। দেখতে ভালোই লাগছে আবহাওয়াটাও সুন্দর রোদও না আবার বৃষ্টিও না। চারিদিকে ঠান্ডা বাতাস বইছে ইফাতের অনেক ভালো লাগছে পছন্দের ওয়েদার, জায়গা আর পাশে পছন্দের মানুষ।

ইফাত পায়রাকে জিজ্ঞেস করল,
– কেমন লাগছে এখানে?

পায়রা মিষ্টি করে হেসে,
– খুব ভালো লাগছে এমন সৌন্দর্য সবসময় কল্পনাই করে এসেছি কখনও বাস্তব হবে ভাবতেই পারিনি আপনার জন্য আজ এত সুন্দর একটা দিন পেলাম ধন্যবাদ।

– হায়রে মেয়ে তাও ভালোবাসবে না।

– সরি।

– কেন?

– তখন থাপ্পড় মা’রা’র জন্য আসলে রাগ উঠে গেছিল আর দেখুন এর আগে আপনিও কিন্তু আমায় থাপ্পড় দিয়েছিলেন শোধ বোধ।

– আমি কি এই ব্যাপারে কিছু বলেছি?

– কখনও যদি মনে হয় ভুল বুঝেন তাই আগেই বলে রাখলাম।

– তুমি চাও না আমি তোমাকে ভুল বুঝি?

– আপনি এভাবে কথা প্যাচান কেন?

– চা খাবে?

– খাওয়া যায় তবে বানাবে কে?

ইফাত কাউকে কল দিল কিছুক্ষণ পর আরাফ দুই কাপ চা নিয়ে এগিয়ে দিল।ইফাত বলল,
– তুমি আনতে গেলে কেন? কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হত।

– আপনার চা আমি অন্য কারো হাতে দিতে পারি স্যার? আমি আসি তাহলে।

আরাফ চলে যেতেই পায়রা জিজ্ঞেস করল,
– এই ছেলেটা কি সবসময় আপনার সঙ্গে থাকে?

– সবসময় বলতে আমি যতক্ষন বাড়ির বাইরে থাকি আরাফও আমার সঙ্গেই থাকে।

– কেন থাকে?

– আরাফ আমার এসিস্ট্যান্ট আর এটাই ওর চাকরি।

– ওহ।
____________

ইনান বেসিং এ কিছুক্ষণ ওয়াক ওয়াক করে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়েছে।সাবিহা এসে চুলে বিলি কেটে,

– এইভাবে শুয়ে আছো কেন? কি হয়েছে তোমার?

– কি হয়েছে মানে দেখলে না ভাইয়া কিভাবে গোলাপটা মুখে ঢুকিয়ে দিলো ভাবলেই গা গুলিয়ে আসছে।

– সামান্য একটা গোলাপ দিয়েছে তাতে এত কাহিনী?

– তাই বলে মুখে দিবে!

– তুমি কি শুয়েই থাকবে নাকি আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে?

– ঘুরতেই তো নিয়ে আসলাম আবার কোথায় নিয়ে যাব!

– এই বাড়ির চারপাশে ঘুরবো নাকি?

– আচ্ছা আচ্ছা বিকেলে বের হব।

পায়রার আজ আর ইফাতের সঙ্গ খারাপ লাগছে না। প্রত্যেকটা মুহূর্ত ভালো কাটছে নতুন এক ইফাতকে নতুন করে দেখছে। ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্ত ছেড়ে যেতে। বিকেলে সবাই মিলে ঘুরতে বের হয়েছে জায়গাটা কিছুটা গ্ৰামের মতো ইটের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ইফাত আর পায়রা। ইনান আর সাবিহা অন্য দিকে চলে গেছে নিজেদের মতো সময় কাটাতে।

অনেকটা পথ যেতেই একটা মেলা দেখতে পেল ইফাত আর পায়রা। এতোক্ষণ দু’জনের মধ্যে নিরবতা থাকলেও পায়রা বায়না ধরে বলল,

– ইফাত চলুন না ওই মেলা থেকে ঘুরে আসি।

– মেলায় অনেক মানুষের ভিড় থাকে কোলাহল পূর্ণ জায়গা।

– তাতে কি হয়েছে?

– তোমার তো এসব পছন্দ নয়।

– যাই হোক আজ আমি মেলায় যাব প্লিজ চলুন না।

ইফাত আর কি করবে বাধ্য হয়ে পায়রাকে নিয়ে মেলায় গেল। মাঝখান দিয়ে ছোট একটা চলাচল করার মতো রাস্তা আর তার দু’পাশে সারি সারি দোকান বসেছে ছাউনি দিয়ে। পায়রা আজ অনেক খুশি হেসে হেসে এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখছে আর ইফাত মুগ্ধ হয়ে পায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। পায়রা একটা চুড়ির দোকান দেখে সামনে গিয়ে দাঁড়াল কালো রঙের কয়েকটা চুড়ি হাতরে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল,

– চুড়ি গুলো কি সুন্দর।

– আপা এই চুড়ির নাম রেশমী চুড়ি আপনার হাতে মানাবে।

পায়রা চুড়ি হাতে নিয়ে ইফাতের দিকে এগিয়ে,
– পরিয়ে দিন তো চুড়ি গুলো।

ইফাত যত্ন সহকারে পায়রার হাতে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিতেই পায়রা হাত ঝাঁকিয়ে,
– কেমন লাগছে?

– অনেক সুন্দর।

– তাহলে দুই হাতের জন্য দুই ডজন চুড়ি কিনে দিন।

এই প্রথম ইফাতের কাছে পায়রা কিছু চাইলো ইফাত কি না দিয়ে পারে।ইফাত দোকানদারের দিকে তাকিয়ে,
– আপনার দোকানের সবগুলো রেশমী চুড়ি প্যাক করে দিন।

পায়রা চমকে গিয়ে,
– আরে আমার সব লাগবে না এতগুলো দিয়ে কি করব?

– একেক দিন একেক রঙের চুড়ি পরবে তোমার হাতে কিন্তু সুন্দর মানিয়েছে।

পায়রা হাতটা একটু মেলে,
– আপনাকে এত্তগুলা ধন্যবাদ।

ইফাত প্রতিত্ত্যুরে মৃদু হাসল এই হাসিতে আজ বারবার ঘায়েল হচ্ছে পায়রা। মেলা ঘুরে বাগান বাড়িতে চলে এলো তারা আজকের রাতটা থেকেই কাল বাড়িতে চলে যাবে। রাতের বেলা সবাই মিলে গল্প করে খাওয়া দাওয়া করেছে বেশিরভাগ সময় ইনান ইফাতকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলেছে ইফাতও কম নয় সেও ইনানকে এক চুল পরিমান ছাড় দেয়নি সেও খুঁচিয়ে কথা বলেছে। দুই ভাইয়ের মধ্যেও যে এমন খুনসুটি ঝগড়া হয় ওদের না দেখলে পায়রা আর সাবিহা জানতেই পারতো না খুব ইনজয় করেছে তারা।

চলবে……..

মন পায়রা পর্ব-০৪

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৪

কালো জিন্স,সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার,জেল দিয়ে চুল গুলো আটকানো। খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে অনেক সুন্দর লাগছে ইফাতকে। ইফাত এসে এনায়েত মির্জার পাশে দাঁড়ালো, এনায়েত মির্জা সকলের উদ্দেশ্যে গলা ছেড়ে,

– লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান আজকের পার্টি হচ্ছে আমার বড় ছেলে ইফাত মির্জার জন্য।আজ ওর জন্য আমাদের কোম্পানি বড় একটা ডিল পেয়েছে। আজ আমরা অনেক খুশি এই খুশিটা সবার মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার জন্য এই পার্টির এরেঞ্জ করলাম।

সবাই সম্মিলিত হাত তালি দিয়ে ইফাতকে শুভেচ্ছা জানালো।ইফাত আর ইনান দুই ভাই দেখতে বেশ, ইনান সাবিহার সাথে গল্প করছে।সাবিহা নিজ থেকেই ইনানের সঙ্গে কথা বলতে গেছে কারণ আগে থেকেই ইনানকে ওর ভালো লাগে কিন্তু কখনও সাহস করে কথা বলতে পারেনি আজ অনেক সাহস জুগিয়ে কথা বলতে গেছে। ইনান অনেক মিশুক সহজেই সাবিহার সঙ্গে মিশে গেছে।

ইফাত তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে,অশমি একনজরে তাকিয়ে আছে ইফাতের দিকে,দৃষ্টি দিয়েই যেন ইফাতকে গিলে খাচ্ছে। পায়রা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে তার বাবা-মা,চাচা-চাচী অন্যদিকে বড়দের সঙ্গে গল্প করছে,সাবিহা ইনানের সাথে। নিজেকে একা একা লাগছে তখনি আবরার এসে,

– একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন পায়রা?

– আমি একা তাই একাই দাঁড়িয়ে আছি সঙ্গি পাবো কোথায়?

– আমি আছি তো।

পায়রা আর আবরারকে একসঙ্গে দেখে রাগে শরীর জ্বলছে ইফাতের।আরাফ ইফাতের কাছে এসে ফিসফিস করে,
– স্যার কুল রাগ কন্ট্রোল করুন এখানে সিনক্রিয়েট করলে আপনার বাবা রাগ করবেন।

ইফাত তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে আরাফের দিকে তাকাতেই আরাফ ভয় পেয়ে গেল।ইফাত বাঁকা হেসে,
– চিন্তা করো না আরাফ বাবা রাগ করবে‌ তেমন কিছুই করব না আমি।

বলেই দু’টো কুল ড্রিংকস হাতে নিয়ে পায়রা আর আবরারের দিকে এগিয়ে গিয়ে,
– মি.আবরার ওয়াহিদ হাত খালি কেন? নিন কুল ড্রিংকস খান।

আবরার হাত বাড়িয়ে নিয়ে,
– থ্যাঙ্কস।

পায়রা ইফাতের হাসির আসল মানেটা বুঝতে পেরে সুযোগ বুঝে এখান থেকে সরে গেল।ইফাত কিছুক্ষণ আবরারের সঙ্গে কথা বলে পায়রার পাশে গিয়ে,

– কি ব্যাপার পায়রা আজ এত চুপচাপ ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে আছো?

– আমি তো সবসময়ই ভদ্র।

– তাই নাকি আমি তো জানতাম না।

পায়রা যথা সম্ভব ইফাতকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।ইফাত বুঝতে পেরেছে কিন্তু তারপরেও পায়রার পিছনে লেগে আছে।পায়রা যতই ইফাতের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করুক ইফাত তো পায়রাকে ভালোবাসে।

ভালোভাবে পার্টি শেষ হয়ে গেল পুরোটা সময় ইফাত পায়রার সঙ্গে আঠার মতো লেগে ছিল।অশমি চেষ্টা করেও ইফাতের সাথে কথা বলতে পারেনি। বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেছে যে যার যার মতো চলে গেল। শেখ পরিবারও বিদায় নিলো।পায়রা যেতেই ভেতরটা খালি খালি লাগছে ইফাতের।

বাড়িতে এসে পায়রা পোশাক না পাল্টেই সপাৎ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পায়রার মা আসমা বেগম ঘরে এসে,
– কি রে তুই জামা-কাপড় না পাল্টে বিছানায় কি করছিস?

– ক্লান্ত লাগছে পরে চেঞ্জ করব।

– চেঞ্জ করে তারপর শুয়ে থাক।

– বললাম তো পরে।

পলাশ শেখ স্ত্রীর চেঁচামেচি শুনে পায়রার ঘরে এসে,
– কি হয়েছে এখানে?

– তোমার মেয়ে বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে আছে।

– পায়রা মা এটা তো ঠিক নয় যাও গিয়ে চেঞ্জ করে নাও নইলে অসুস্থ হয়ে যাবে।

পায়রা হেসে,
– ঠিক আছে বাবা।

পায়রা ওয়াশরুমে চলে গেল আসমা বেগম অবাক হয়ে,
– আমি এত করে বললাম শুনল না আর তুমি একবার বলতেই দৌড় দিলো!

পলাশ শেখ ভাব নিয়ে,
– তুমি বুঝবে না বাবা-মেয়ের ভালোবাসা।

– তোমরা থাকো ভালোবাসা নিয়ে আমি তো কেউ না।

– আহা পায়রার মা সবকিছুতেই রাগ করো।

– হ্যা আমার রাগটাই সবাই দেখে।

দু’জনে কথা বলতে বলতে নিজেদের ঘরে চলে গেল।পায়রা ফ্রেশ হয়ে এসে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।
__________________
কেটে গেছে চারদিন সকালে নাস্তা করে অফিসে চলে গেল ইফাত।ইনান ভার্সিটিতে গেছে, এনায়েত মির্জা আজ আর অফিসে যাননি।সাবিহা কলেজ ড্রেস পরে রেস্টুরেন্টে বসে আছে বারবার চারিদিকে তাকাচ্ছে কেউ তাকে দেখছে নাকি। ইনান এসে সামনের চেয়ারে বসতে বসতে,

– লেট হয়ে গেল রাস্তায় কি জ্যাম।

সাবিহার দিকে ভালো করে তাকিয়ে,
– সাবিহা কলেজ ড্রেস পরেই চলে এসেছ!

– বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার জন্য বের হয়েছি কিন্তু তুমি দেখা করতে চাইলে তাই আর কলেজে না গিয়ে এখানে চলে আসলাম।

– আহা বয়ফ্রেন্ডের জন্য কলেজ ফাঁকি দিয়েছ! ভাবতেই ভালো লাগছে।

– কেন ভুল করেছি?

– একদম না এতে তোমার প্রতি ভালোবাসা বেড়ে গেছে তবে কলেজ কিংবা পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া উচিত নয় তোমার বলা উচিত ছিল তুমি কলেজে যাবে।

– কলেজ ছাড়া বাড়ি থেকে একা একা বের হতে দেয় না সবাই এখনও আমায় বাচ্চা ভাবে।

– তুমি তো বাচ্চাই উহু তুমি আমার পিচ্চি গার্লফ্রেন্ড।

– এসব বললে তোমার সঙ্গে ব্রেকাপ করে দিব বলে দিলাম।

– আরে না না আমি মজা করলাম।

সাবিহা আগে থেকেই ইনানকে পছন্দ করত সেদিন পার্টিতে দু’জনের ভাব হয় নাম্বার আদান প্রদান হয় অনেক কথা হয় দেখা হয় এর থেকে ইনানেরও সাবিহাকে খুব ভালো লেগে যায়। তারপর আর কি দু’জন দু’জনকে মনের কথা বলে এখন প্রেম করছে।

ইনান সাবিহাকে নিয়ে ঘুরাঘরি করে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে সোজা অফিসে চলে গেছে ইফাতের কাছে।

সাবিহা সবেমাত্র ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসল তারমধ্যে পায়রা ঘরে এসে সাবিহাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে,
– কলেজের নাম করে সারাদিন কোথায় ঘুরা হয়েছে?

সাবিহা আমতা আমতা করে,
– কি বলিস আপু আমি তো কলেজেই গিয়েছিলাম।

– মিথ্যে বলিস না রাখির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ওর মাধ্যমে জানলাম তুই কলেজে যাসনি।

সাবিহা মনে মনে রাখিকে ইচ্ছে মতো বকা দিয়ে,
– আসলে আপু

– ছেলেটা কে?

– কাউকে বলবি না প্রমিস কর।

– আচ্ছা প্রমিস।

– ইনান।

– কিহহ! ইফাতের ভাই ইনান ভাইয়া?

– হুম আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি।

– কবে থেকে চলছে?

-মাত্র দু’দিন।

– বাহ ইনান ভাইয়া তো ইফাতের থেকেও ফাস্ট।

– আমি কি তোর মতো নিরামিষ নাকি? ইফাত ভাইয়া তোকে কত ভালোবাসে কিন্তু তুই সবসময় খারাপ ব্যবহার করিস। আমি এসব পারবো না ইনান অনেক সুন্দর আর ভালো ছেলে তাই প্রেম শুরু করে দিয়েছি।

– পাকা তুই আর ওই ইফাতকে আমার বিরক্ত লাগে।

– হু একদিন ঠিকই ভালোবাসবি কিন্তু দেরি যেন না হয়ে যায়।

– রাখ তোর পাকা কথা। উনাকে আমি কখনও ভালোবাসবো না।

– হুম দেখা যাবে কিন্তু তুই ইনানকে ভাইয়া বলিস ইফাত ভাইয়াকে বলিস না কেন?

– ইনান ভাইয়া খুব ভালো কিন্তু ইফাত সে গুন্ডা উনি সম্মান পাওয়ার যোগ্য না।

– তাহলে আর কি তুমি থাকো তোমার ইগো নিয়ে আমি তো ইনানকে প্রায় পেয়েই গেলাম।
_____________

ইফাত মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে ইনান ইফাতের কেবিনের ভেতরে সোফায় বসে গেইম খেলছে আর গুনগুন করে গান গাইছে।ইফাত আড়চোখে ভাইকে দেখে,
– প্রেমে পড়েছিস নাকি?

– কই নাতো।

– তাহলে পলাশ আঙ্কেলের ভাইয়ের মেয়ে সাবিহার পেছনে ঘুরঘুর করিস কেন?

ইনান মোবাইল সাইডে রেখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে,
– তুই জানলি কিভাবে?

– তুই যেভাবে আমার ঘটনা জেনেছিস।

– ফলো করছিলি আমায়।

– হুম।

– বুঝলি ভাইয়া তোর শালি আমার মন কেড়েছে সারাক্ষণ ওর ভাবনায় থাকি।

– আমার শালি?

– পায়রা তোর বউ হলে তো সাবিহা তোর শালিই হবে।

– তুই তো বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছিস।

– কেন তুই কি বিয়ে করতে চাস না?

ইফাত অসহায় মুখে,
– চাই কিন্তু পায়রা আমাকে সহ্য করতে পারে না আমি ওকে ভালোবাসি বললে ও প্রতিত্ত্যুরে বলে আমায় নাকি ঘৃণা করে।

– আমাকে দেখ ভাইয়া মাত্র চারদিনের পরিচয়ে কিভাবে মেয়ে পটিয়ে প্রেম শুরু করে দিয়েছি।

– তুই কাউকে পটাসনি সাবিহা তোকে আগে থেকেই পছন্দ করত।

– তুই জানলি কিভাবে?

– আমাকে বলেছে ওর সঙ্গে আমার কথা হয় ওর থেকেই তো পায়রার খবর নিতাম তখনি বলেছিল।

– তাহলে পায়রার তোকে ভালো লাগে না কেন?

– জানি না।

– সমস্যা নেই ভাইয়া পায়রা তোকে ভালোবাসুক কিংবা না বাসুক তুই তো বাসিস বেশি তিড়িং বিড়িং করলেই তুলে এনে বিয়ে করে নিবি আমি আছি তোর পাশে।

ইনানের কথা শুনে মুচকি হেসে ইফাত বলল,
– জোর করে কখনও ভালোবাসা হয় না আর বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনও জোর করে হয় না।
________________

অশমি গাল ফুলিয়ে ছাদে বসে আছে। আবরার অশমির পাশে বসে,
– কিরে ছাদে বসে আছিস মন খারাপ?

অশমি কোনো উত্তর দিলো না। আবরার মাথায় হাত বুলিয়ে,
– কেন মন খারাপ আমাকে বল।

– বলে লাভ নেই তুই ঠিক করতে পারবি না।

– কে বলেছে পারবো না? তুই শুধু একবার বলে দেখ।

– আমি ইফাত ভাইয়াকে খুব ভালোবাসি কিন্তু ইফাত ভাইয়া নাকি পায়রাকে ভালোবাসে এখন কি হবে ভাইয়া।

আবরারের আগে থেকেই সন্দেহ ছিল কিন্তু এখন তার সন্দেহ পুরোপুরি সঠিক হয়ে গেছে। মনের আরও কিছু দিধা মেটানোর জন্য,
– পায়রা কি ইফাতকে পছন্দ করে?

– পায়রা তো ইফাত ভাইয়াকে সহ্য করতে পারে না তবে কতদিন আর ইফাত ভাইয়া যেমন মানুষ পায়রা ঠিক একসময় ইফাত ভাইয়ার প্রেমে পড়বে।

– এটা কখনও হতে দেওয়া যাবে না তুই তো পায়রার খুব কাছের খালাতো বোন কম বান্ধবী বেশি তুই ইফাতের সম্পর্কে ওর মন আরও বিষিয়ে দিবি।

– কি বলছিস ভাইয়া আমার এক তরফা ভালোবাসার জন্য এসব করব?

– এছাড়া আর কোনো উপায় নেই কারণ আমিও পায়রাকে ছোট বেলা থেকে ভালোবেসে আসছি মা ও পায়রাকে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারে না দু’বোনের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে।

– ভাইয়া!

– ইফাতের ভালোবাসাও এক তরফা ইফাত সুখী হলে আমরা সবাই অসুখী হব যা করার আমাদের দু’জনকে করতে হবে এছাড়া পায়রা তো আর ইফাতকে পছন্দ করে না।

অশমির মুখে হাসি ফুটেছে ভাইকে আশ্বস্ত করে,
– তুই যা বলবি আমি তাই করব ভাইয়া।

– এই তো আমার গুড গার্ল বোন।

চলবে………

মন পায়রা পর্ব-০৩

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৩

‘এই মন পায়রা কেমন আছো?’

পায়রা আর তার বান্ধবীরা মিলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছিল ইফাতের ডাক শুনে সবাই তার দিকে তাকাল। পায়রার মুখে বিরক্তির ছাপ, পায়রার এক বান্ধবী বলে উঠল,
– পায়রা দেখ ছেলেটা কি সুন্দর! আমি তো ফিদা হয়ে গেলাম।

ওদের সঙ্গে অশমি ছিল ইফাতকে দেখে অশমির মুখে হাসি ফুটলেও অন্য মেয়ের মুখে ইফাতের নাম শুনে ক্ষিপ্ত স্বরে,
– একদম ওর নাম নিজের মুখে আনবি না নজরও দিবি না।

পায়রা ব্রু নাচিয়ে,
– তোর এত জ্বলে কেন অশমি?

ইফাত রাস্তা পাড় হয়ে পায়রার সামনে এসে দাঁড়াতেই ওদের কথা বন্ধ হয়ে গেছে।ইফাত হেসে পায়রাকে আবারো প্রশ্ন করল,

– কি গো আমার মন পায়রা কেমন আছো বললে না তো?

পায়রা ঝাঁঝালো কন্ঠে,
– এতক্ষণ ভালো ছিলাম কিন্তু আপনাকে দেখে আর ভালো নেই।

– হুশ আমার তোমাকে দেখে অনেক ভালো লাগছে।

পায়রা বিড়বিড় করে,
– কাল রাতেই তো দেখে আসলো আবার আজ সকাল হতে না হতেই দেখতে চলে আসলো সত্যি লোকটা পাগল।

– কিছু বললে পায়রা?

– উহু।

– ভার্সিটি না গিয়ে এখানে কি করছো?

– দেখছেন না ফুচকা খাচ্ছি আপনি খাবেন?

ইফাত নাক ছিটকে,
– না না এসব আনহাইজেনিক ফুড আমি খাই না।

– কিন্তু আমার তো ফুচকা খুব ভালো লাগে যে ছেলের ফুচকা পছন্দ নয় তাকে আমারও পছন্দ নয়।

ইফাত অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পায়রা ফুচকা খাচ্ছে আড়চোখে ইফাতকে দেখছে এবার একটা ফুচকা ইফাতের মুখের সামনে ধরে,

– হা করুন।

– বললাম তো এসব খাই না।

– ঠিক আছে খাওয়ার দরকার নেই আপনি এ জীবনে আমার মন পাবেন না।

– ফুচকার সঙ্গে মনের কি সম্পর্ক?

– সম্পর্ক আছে এখন বলুন খাবেন কি খাবেন না?

ইফাত মনে মনে নিজেকে অসংখ্য বকা দিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হা করতেই পায়রা তার মুখে একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দিলো।ফুচকায় কামড় দিতেই ইফাতের ঠোঁট লাল হয়ে গেল কিছুটা চেঁচিয়ে,

– এত ঝাল কেন? এত ঝাল মানুষ খায়!আরাফ….আরাফ…..

ইফাতের এসিস্ট্যান্ট আরাফ বসের এমন অবস্থা দেখে দ্রুত গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে এলো।ইফাত পানির বোতলটা ছো মেরে নিয়ে পুরোটা খেয়ে ফেলল। ইফাতের অবস্থা দেখে পায়রা হাসছে ইচ্ছে করেই ফুচকা ওয়ালাকে ইশারা দিয়ে ঝাল দিতে বলেছিল যাতে ইফাতকে একটা শিক্ষা দিতে পারে। ইফাত মোটামুটি ঝাল খেতে পারে কিন্তু ফুচকায় একটু বেশিই ঝাল ছিল। অশমি এগিয়ে এসে,

– ইফাত ভাইয়া ঠিক আছেন আপনি,খুব ঝাল লেগেছে তাই না? পায়রা তোর কিন্তু এটা করা মোটেও ঠিক হয়নি।

ইফাত জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে,
– আমি ঠিক আছি।

অশমি আবারো বলল,
– ঠিক আছেন মানে আপনার মুখ লাল হয়ে গেছে দাড়ান আমি চকলেট নিয়ে আসছি।

– বললাম তো ঠিক আছি।

পায়রা ভেংচি কেটে,
– তোর এত দরদ উতলে পড়ছে কেন? তোর মুখেও এবার এমন একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দিব।

অশমি রাগ দেখিয়ে,
– পারলে নিজে একটা খেয়ে দেখা সবসময় সবকিছু নিয়ে মজা করিস।

ইফাত অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে,
– আমাকে নিয়ে তোমরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছো কেন?

পায়রা আর অশমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।পায়রা অবাক হওয়ার ভঙিতে,
– আপনার জন্য আমি ঝগড়া করব কেন? ঝগড়া অশমি করছে ওর আপনার জন্য দরদ উতলে পড়ছে।

অশমি রেগে,
– বেশি হয়ে যাচ্ছে পায়রা।

ইফাত ওদের থামিয়ে,
– চুপ থাকো তো আচ্ছা পায়রা বাই পরে দেখা হবে।

ইফাত পায়রার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেল আজ গাড়ি ড্রাইভ করছে আরাফ।পায়রা এবার অশমির দিকে তাকিয়ে,
– অশমি ইফাতের জন্য তোর এত দরদ কেন ব্যাপার কি?

– কোনো ব্যাপার নেই তুই বল তোদের মধ্যে কি চলছে?

– কিছুই না তবে উনি নাকি আমায় পেয়ার করেন।

– ইফাত ভাইয়া তোকে!!

– এত অবাক হওয়ার কি আছে? আমি সুন্দরী যে কেউ পছন্দ করতেই পারে নে চল এবার ক্লাসে যেতে হবে।

অশমির মনে এখনও গেঁথে আছে ইফাত পায়রাকে পছন্দ করে কোনভাবেই যেন এটা মেনে নিতে পারছে না।

ইফাত সিটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আরাফ গাড়ি চালাচ্ছে।আরাফ ইফাতের দিকে একবার তাকিয়ে,
– স্যার আইসক্রিম খাবেন?

– এসময় আইসক্রিম খেতে যাবো কেন?

– আসলে স্যার ঝালে আপনার মুখটা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে আইসক্রিম খেলে ঝালটা কমবে ভেতরটাও ঠান্ডা লাগবে।

– আরাফ তোমার কি মনে হয় সামান্য ঝাল আমাকে কাবু করতে পারবে? অনেক গরম তো তাই মুখ লাল হয়ে গেছে।

– কিন্তু স্যার গাড়িতে এসি চলছে।

– এই গরম এসিতে যাবে না তুমি মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাও নইলে এক্সিডেন্ট করে দু’জনের হাসপাতালে গিয়ে শুয়ে থাকতে হবে।

আরাফ গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিয়ে মনে মনে,
– স্যার ভাঙবে তবে মচকাবে না।
______________
অফিসে এসে আরও এক বোতল ঠান্ডা পানি খেয়ে মিটিং এর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল ইফাত।আজ বড় একটা মিটিং আছে বিদেশি এক কোম্পানির সি ইউ এসেছে।এই মিটিং এর মাধ্যমে ডিলটা পেয়ে গেলে তাদের কোম্পানি অনেক সাফল্য অর্জন করবে। এনায়েত মির্জা এসেছে তবে মিটিং এ নিজেদের কোম্পানির হয়ে যোগ হবে ইফাত। ইফাতদের পলাশ শেখের সঙ্গে পার্টনারশিপ ছাড়াও আলাদা পারিবারিক একটা বড় বিজনেস আছে আজ সেই বিজনেস মিটিং। আবরারও এসেছে নিজেদের কোম্পানির জন্য তাদের ডিলটা প্রয়োজন।

সবাই চলে এসেছে নিজস্ব আসন গ্ৰহন করেছেন সময় মতো ইফাতও ভেতরে প্রবেশ করে নিজের জায়গায় বসল সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করল।

মিটিং শুরু হয়ে গেছে যে যার যার কোম্পানির সম্পর্কে সিভি দেখাচ্ছে। একে একে সবার কাজ শেষ হতেই ইফাত সামনে গেল সুন্দর করে নিজের কোম্পানির ভালো দিক তুলে ধরল সিভি গুলোও অনেক সুন্দর করে সাজানো।ইফাত এই পর্যন্ত অনেক বড় বড় মিটিং এ জয়েন হয়েছে নিজের বিচক্ষণতা এবং ব্যবসায়িক বুদ্ধির মাধ্যমে বড় বড় কোম্পানি গুলোর সামনে থেকে ডিল গুলো নিয়ে এসেছে। এবারো ব্যতিক্রম হলো না বিদেশি কোম্পানি সিদ্ধান্ত নিয়ে মির্জা গ্ৰুপ অফ কোম্পানিকে নিজেদের ডিলটা দিয়ে দিলেন।

ইফাত এবং এনায়েত মির্জা অনেক খুশি আজও তারা সফল। আবরারের খুব রাগ হচ্ছে ইফাতের কাছে হেরে যাওয়ায়। মিটিং শেষে আবরার ইফাতকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেছে।ইফাত তার চেয়ারে গিয়ে বসতেই এনায়েত মির্জা ভেতরে প্রবেশ করে,

– ওয়েল ডান মাই সন! এবারো তুই বাজিমাত করে দিয়েছিস আমার তো খুশি ধরছে না এতো বড় একটা ডিল আমরা পেয়ে গেলাম।

– খুশি হলে তো হবে না গিফ্ট দিতে হবে।

– ওকেহ আজ সন্ধ্যায় তোর জন্য বড় একটা পার্টির এরেঞ্জ করব আমার তরফ থেকে।

– তুমি পার্টি ছাড়া কিছু বুঝো না কেন বাবা?

– আমাদের এত বড় সাফল্য সবাইকে জানানো উচিত আর সেই মাধ্যম হচ্ছে পার্টি। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসবি আর তোর সব ফ্রেন্ডদের ইনভাইট কর।

– আচ্ছা।

এনায়েত মির্জা রাফাতকে নিয়ে চলে গেলেন আজ তিনি অনেক খুশি। বাড়িতে গিয়ে পার্টির আয়োজন শুরু করে দিলেন সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে তিনি গার্ডেনে বসে জুস খাচ্ছেন আর সবটা দেখছেন। ইতি বেগম স্বামীর কাছে এসে,

– কি শুরু করলে বুড়ো বয়সে কি ভিমরতি ধরেছে? দু’দিন পর পর কিসের পার্টি?

– এখনও ছেলেরা বিয়ে করল না নাতি-নাতনি আসলো না তুমি আমাকে বুড়ো বলছো?

– হয়েছে ঢং রেখে বলো পার্টি কিসের?

– তোমার ছেলে আজকের ডিলটাও পেয়ে গেছে। আমি অনেক টেনশনে ছিলাম কিন্তু ইফাত এত সহজে ডিলটা পেয়ে যাবে ভাবতেই পারিনি।

– ওহ এই ব্যাপার আমি তো জানতামই আমার ছেলে ঠিক পারবে।

– হয়েছে হয়েছে এবার গিয়ে দেখো শাড়ি আর গহনা পছন্দ হয়েছে কিনা।

– হুম যাচ্ছি কিন্তু তোমার ছেলেরা কোথায়?

– ইফাত অফিসে সন্ধ্যার মধ্যে চলে আসবে আর ইনানকে একটা কাজে পাঠিয়েছে।

– আচ্ছা।
________________

ইফাতদের বাড়ির সামনে সু-বিশাল বাগান সেই বাগানেই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। মিটিং এ উপস্থিত সকলকে ইনভাইট করা হয়েছে শেখ পরিবারের সবাইও আসবে। শেখ পরিবারের আর মির্জা পরিবারের ভালো সম্পর্ক থাকায় যেকোনো অনুষ্ঠানে তাদের আগে ইনভাইট করা হয় আজও তাই হয়েছে।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে কিন্তু ইফাতের আসতে দেরি হয়ে গেছে।ইফাতকে দেখে এনায়েত মির্জা কাছে এসে,
– আসতে দেরি করলি কেন?

– গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছিল।

– আজই হতে হল আচ্ছা তাড়াতাড়ি গিয়ে রেডি হয়ে আয়।

– হুম।

ইফাত দ্রুত ঘরে চলে গেল রেডি হতে কিন্তু ঘরে এসে সে অবাক হয়ে গেল।ইফাতের ঘরের মাঝখানে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পায়রা আশপাশটা দেখছে ইফাত আস্তে করে দরজা আটকে,

– এখানে কি করছো মন পায়রা? বিয়ের আগেই হাজব্যান্ডের ঘরে চলে এলে।

পায়রা আচমকা ইফাতকে দেখে ভয় পেয়ে গেছে ভিতু চোখে ইফাতের দিকে তাকিয়ে,
– আমি বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম এটা যে আপনার ঘর প্রথমে বুঝতে পারিনি।

– আগেও তো অনেকবার এসেছ তখন বাড়ি ঘুরে দেখনি?

– দেখা হয়নি বলতে গেলে সুযোগ পাইনি।

ইফাত ঠোঁটে দুষ্টু হাসি রেখে পায়রার দিকে এগুচ্ছে পায়রা পিছনে যেতে যেতে,
– এভাবে এগুচ্ছেন কেন? সরুন আমি বাবার কাছে যাব।

– তোমাকে এতটা কাছে পেয়েও যেতে দিব ভাবলে কি করে?

– আমি কিন্তু চেঁচাবো।

– জোরে জোরে চিৎকার করো আজই আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক।

– বিরক্তিকর একটা লোক আপনি আমার জীবন তেজপাতা করে দিচ্ছেন।

– আমি তোমার কাছে বিরক্তিকর হলেও তুমি আমার ভালো থাকার কারনে।

– আজ এখানে আসাই ভুল হয়েছে।

– কি আর করার ভুল তো করেই ফেলেছো তবে ভুল না করলে বাড়ি থেকে তোমায় তুলে নিয়ে আসতাম।

বলেই পায়রাকে ছেড়ে দিলো পায়রা ছুট লাগালো।ইফাত মুচকি হেসে রেডি হতে চলে গেল।

চলবে…….

মন পায়রা পর্ব-০২

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০২

‘পায়রা এসময় বাগানে কি করছিস? তোর তো ভার্সিটিতে থাকার কথা ছিল।’

আবরার হেসে কথাটা বলে পায়রার সামনে এসে দাঁড়াল।পায়রা আর আবরার খালাতো ভাই-বোন দু’জনের বাড়ি পাশাপাশি। পায়রাদের বাড়িটা তার দাদা তৈরি করে গেছে সেই সূত্রেই এখানে থাকে তার বাবা আর চাচার অনেক মিল তাই এখনও একসঙ্গে একটা পরিবার হয়ে এখনও থাকতে পারছে। পায়রার মা আসমা বেগম এবং আবরারের মা আতিফা বেগম আপন দুই বোন তাদের মনের মিলও অনেক তাই বড় বোন আতিফা বেগম স্বামীকে বাধ্য করে বোনের বাড়ির পাশে জায়গা কিনে বাড়ি করেছে যাতে প্রতিদিন দেখা সাক্ষাৎ হয়। দু’টো পরিবার এক হয়ে গেছে যখন ইচ্ছে হয় পায়রা ওদের বাড়িতে যায় আবরারও এ বাড়িতে আসে। আবরারের একটা ছোট বোন আছে নাম অশমি যার সঙ্গে পায়রার গলায় গলায় ভাব দু’জনে একসঙ্গে পড়াশোনা করে এক ইয়ারে।

পায়রার কোনো উত্তর না পেয়ে আবরার আবারো জিজ্ঞেস করল,
– কি হলো পায়রা কিছু বলছিস না যে।

আবরারকে দেখেই পায়রার মনে পড়ে গেছে ইফাতের করা ব্যবহারের কথা, মূলত আবরারের সাথে কথা বলার কারণেই ইফাতের হাতে থাপ্পড় খেতে হয়েছে ভেবেই রাগ হচ্ছে। পায়রা দৃষ্টি অন্য দিকে স্থির করে,
– ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে তাই যেতে পারিনি।

– ঘুম কাতর মেয়ে।

– কি জন্য এসেছিলে?

– কেন তোদের বাড়ি আসতে পারি না?

– পারবে না কেন? আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোনো দরকার ছিল আমার জন্য যদি সময় নষ্ট হয়।

– তোর জন্য সময় নষ্ট হবে কেন এমনিতেই তোদের দেখতে এসেছিলাম।

– তুমি থাকো তাহলে ভাইয়াআআ আমার কাজ আছে গেলাম।

– পায়রা শোন…

পায়রা শুনেও না শুনার ভান করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। আবরার অনেক আগে থেকেই পায়রাকে পছন্দ করে কিন্তু কখনও বলতে পারেনি ভয়ে যদি পায়রা ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয় কিংবা বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেয়। পায়রা যতটা পারে আবরারকে এড়িয়ে চলে আর রাগানোর জন্য কথায় কথায় ভাইয়া বলে ডাকে কিন্তু ইফাতের কারণে এখন একটু বেশি ইগনোর করে।

ইফাত অফিসে এসেছে কিন্তু কোনো কাজেই মন বসছে না বারবার পায়রার কথা মনে পড়ছে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে পায়রা যদি ভার্সিটিতে আসত তাহলে এতক্ষণে নিজের ইচ্ছেটা পূরণ করে ফেলত ইফাত। কিন্তু পায়রা আজ ভার্সিটিতে আসেনি সাবিহার কাছ থেকে জেনেছে যার কারণে মনের ইচ্ছেটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

এনায়েত মির্জা অফিসে আসেন তবে নামমাত্র আসেন কারণ বড় ছেলে ইফাতকে বিজনেসের দায়িত্ব দিয়ে তিনি শান্তিতে আছেন কাজের কোনো ঝামেলা নেই।ইনানের পড়াশোনা এখনও শেষ হয়নি বিবিএ ফাইনালে পড়ছে যার কারণে বিজনেসের দিকে সে পা বাড়ায়নি অনেকবার বলা হয়েছিল পড়াশোনার পাশাপাশি বিজনেস দেখতে কিন্তু ইনান এতটা অলস নিজের কাজটাও ভাইয়ের উপর চাপিয়ে দিয়ে ফ্রেশ মুডে আছে।

অনেক চেষ্টার পরেও ইফাত কোনো কিছুতে মন দিতে পারছে না। সবাইকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল।আজ আর কোলাহল পূর্ণ রাস্তা দিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তাই গাড়ি ঘুরিয়ে শুনশান রাস্তা দিয়ে যাওয়া শুরু করল। কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে একটা গাড়ি তার পিছু নিয়েছে আরেকটু সিওর হওয়ার জন্য ইফাত আরেকটা রাস্তা ধরল পিছনের গাড়িটাও পেছনে পেছনে আসছে এবার যা বুঝার বুঝে গেছে ইফাত।

ইফাতগাড়ির স্পিড কমিয়ে দিতেই পেছনের গাড়িটা এবার সামনে এসে ইফাতের গাড়ি আটকে দিল।ইফাতের হাসি পাচ্ছে সিটের নিচ থেকে রিভলবার বের করে পকেটে ঢুকিয়ে বেরিয়ে গেল। অপর গাড়ি থেকে কালো কাপড় দিয়ে চেহারা লুকানো চারটে লোক বের হয়ে আসলো সবার হাতে হকি খেলার স্টিক।ইফাত বুঝে গেছে লোকগুলো তাকেই মারতে এসেছে তাই রিভলবারটা আর বের করল না।

চারটে লোক ইফাতের চারপাশে রাউন্ড দিয়ে ঘুরছে।ইফাত দুই হাত ভাঁজ করে ভাব নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে,
– আমাকে মা’রার জন্য এসেছিস?

– হুম তবে পুরোপুরি মা’রার জন্য নয় শুধু হাত দু’টো ভেঙে দিতে এসেছি।

– ওহ রিয়েলি! তাহলে এভাবে ঘুরে সময় নষ্ট করছিস কেন? মা’র আমায়।

লোকগুলো একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে একটা লোক এগিয়ে এসে স্টিক দিয়ে মা’রতে যায় তখনি ইফাত লোকটির হাত ধরে পায়ে লাথি মারে সাথে সাথে লোকটি নিচে পরে গেল।ইফাত লোকটির হাত থেকে স্টিক নিয়ে বাকি গুলোকে ইচ্ছে মতো পিটিয়েছে লোকগুলো এখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

ছোটবেলায় বক্সিং অনেক প্রিয় ছিল ইফাতের। শখের বশে বক্সিং শিখেছিল তার প্রিয় বক্সার মোহাম্মদ আলী,জো লুইস। মূলত তাদের দেখেই বক্সিং এর প্রতি ভালোবাসা তবে প্রেকটিস করে না অনেকদিন হয়েছে এদের জন্য আজ কিছুটা হলেও প্রেকটিস হয়ে গেছে।

নিজের এসিস্ট্যান্ট আরাফকে ফোন দিয়ে সব ডিটেইলস বলে এদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে পুনরায় গাড়িতে উঠে চলে গেল ইফাত।
_______________

সারাদিন বাইরে ঘুরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও ইফাতের মন খারাপ ভালো হয়নি।মন ভালো করার উপায় জেনেও কাজে লাগাতে পারছে না।বাড়ি ফিরে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিল তারপর সে অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো পায়রার সঙ্গে দেখা করবে। যেই ভাবা সেই কাজ গাড়ির চাবি নিয়ে মায়ের চোখের আড়ালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল ইফাত। এখন ইতি বেগমের চোখের সামনে পড়লেই হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত কিন্তু ইফাত এখন এসব চায় না তাই লুকিয়ে বের হলো।

পায়রা রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। ঘরের লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে মোবাইল নিয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে মোবাইল টিপা শুরু করল।

গলির মোড়ে গাড়িটা রেখে পায়রার বেলকোনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে ইফাত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে,’এভাবে কি পায়রার সঙ্গে দেখা করা উচিত হবে এমনিতেই তো আমায় সহ্য করতে পারে না যদি চেঁচায়? সবাই জানলে কি লজ্জা মুখ কাউকে দেখাতে পারবো না।’

কিন্তু পরক্ষনেই মনে সাহস জুগিয়ে,’ছিহ ইফাত তুই কিনা ভয় পাচ্ছিস! যা হওয়ার হোক পায়রাকে দু’চোখ ভরে দেখে তারপরেই যাবো।’

বেলকোনির পাশ দিয়ে একটা পাইপ গেছে ইফাত দোয়া দরুদ পাঠ করে পাইপ বেয়ে উপরে উঠে এলো। বেলকোনির দরজা খোলা আছে গরমের দিন চলছে গরমের দিনে সবসময় পায়রার বেলকোনির দরজা খোলা থাকে।ইফাত দরজা দিয়ে ঘরে উঁকি দিতেই থমকে গেল, ঘর অন্ধকার কিন্তু বিছানায় এক টুকরো আলো জ্বলছে সেই আলোতে পায়রার মায়াবী মুখটা দেখা যাচ্ছে। ইফাত কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝতে সক্ষম হলো এটা মোবাইলের আলো আর তার পায়রা মোবাইল টিপছে।

ইফাত ধীরে ধীরে শব্দ না করে পায়রার পাশে গিয়ে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। এই অন্ধকারে পায়রার অস্বস্তি লাগছে মনে হচ্ছে কেউ তাকে একদৃষ্টিতে দেখছে।

আমাদের সবার ভেতরে এক অদৃশ্য তৃতীয় নয়ন আছে যার মাধ্যমে অদৃশ্য সবকিছু অনুভব করতে পারি বুঝতে পারি।পায়রা মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে সামনে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেছে জোরে চিৎকার দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই ইফাত বুঝে পায়রার মুখ চেপে ধরে,

– হুশ কোনো শব্দ শুনতে চাই না।

বলেই পায়রার মুখ ছেড়ে দিলো।পায়রা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে,
– আপনি এখানে! এত রাতে মতলব তো ভালো ঠেকছে না।

– তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হল তাই চলে আসলাম।

– দেখতে ইচ্ছে হলেই চলে আসতে হবে দাড়োয়ান যদি দেখে ফেলত কিংবা আশেপাশের মানুষ?

– এই রাতে আমাকে দেখার জন্য কেউ বসে নেই নিশ্চিন্তে থাকো।

– কিন্তু উপরে উঠলেন কিভাবে?

– তোমার বারান্দার পাশে একটা পাইপ দেখলাম ওইটা বেয়েই উঠে এসেছি।

– হায় আল্লাহ।ওইটা তো টয়লেটের পাইপ ছিহ আপনি টয়লেটের পাইপ বেয়ে ওয়াক।

ইফাত চোখ বড় করে,
– কিহহ! টয়লেটের পাইপ!

– হুম।

– শেষ পর্যন্ত তোমার জন্য টয়লেটের পাইপ বাইতে হলো।

হঠাৎ করে পায়রা হেসে দিলো ইফাত ব্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে।পায়রা হাসি থামিয়ে,
– এখন আমি জোরে জোরে চিৎকার করবো সবাইকে বলে দিব আপনি আমার সঙ্গে…..

বলেই আবারো হেসে দিলো।ইফাত বাঁকা হেসে,
– তা তুমি করতেই পারো কিন্তু ভেবে দেখেছ কি এতে তোমার সম্মান নষ্ট হবে মানুষ আজেবাজে কথা বলবে আমিও সবাইকে বলবো পায়রা আমাকে ডেকেছে তখন সবাই কি করবে বলো তো?

– কি করবে?

– বোকা মেয়ে সবাই মিলে আমাদের বিয়ে দিয়ে দিবে আর তারপর তোমাকে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে যাব তোমাকে দেখার জন্য আর কষ্টই করতে হবে না।

পায়রার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।ভিত কন্ঠে,
– আপনি সত্যিই একটা খারাপ লোক।

– হুম শুধু তোমার কাছে। আমি কি ডাকবো সবাইকে? দাঁড়াও ডাকছি।

ইফাত দরজার কাছে চলে গেল পায়রা ভয় পেয়ে দ্রুত গিয়ে ইফাতের হাত নিজের সর্বশক্তি দিয়ে টান দিতেই ইফাত পায়রাকে নিয়ে বিছানায় পড়ে গেল।ইফাত পায়রাকে ভয় দেখানোর জন্য দরজার কাছে গিয়েছিল হঠাৎ টান দেওয়ায় বেগ না পেয়ে পরে গেছে। পায়রার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই ইফাতের ঠোঁটে আঙুল রেখে,

– আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি সত্যি সত্যি সবাইকে জানাতে যাচ্ছিলেন।

– আমি কি তোমার মতো বোকা নাকি আমি তো মজা করছিলাম।

– আগে বলবেন না আরেকটু হলেই আমি জ্ঞান হারাতাম।

– এবার তুমি যদি আমার উপর থেকে না উঠো তাহলে আমি জ্ঞান হারাবো পায়রা।

পায়রার এবার হুস ফিরল নিজেকে ইফাতের উপরে দেখে খুব লজ্জা হচ্ছে দ্রুত ইফাতের উপর থেকে উঠে,
– আমি বুঝতে পারিনি।

– সমস্যা নেই এই সুন্দর মুহূর্তটা আমার ভালোই লেগেছে।

পায়রা দাঁত কিড়মিড়ে তাকিয়ে,
– দেখা শেষ এবার এখান থেকে যেতে পারেন।

– তুমি কেন যে আমায় সহ্য করতে পারো না এটাই বুঝি না সেই তো একদিন ইফাতের প্রেমেই পড়বে তারপরেও এত কষ্ট দিচ্ছো।

পায়রা চোখ পাকিয়ে,
– বাড়তি কথা পছন্দ নয় আপনি যেতে পারেন।

– আচ্ছা বাই ভালো থেকো।

ইফাত পায়রার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বেলকোনির দিকে চলে যাচ্ছে।ইফাতের হাতের ব্যান্ডেজ পায়রার চোখে পড়েছে এতে মনে মনে অনেক খুশি লাগছে আবার ইফাতের জন্য একটু মায়া হচ্ছে। ইফাত বেলকোনি থেকে ঘরে উঁকি দিয়ে,

– তোমার পাঠানো ওইসব পাতি গুন্ডা আমার কিছুই করতে পারেনি বরং নিজেরাই হাসপাতালে শুয়ে আছে আর এই হাত আমি নিজেই কেটেছি কারণ তোমার গায়ে হাত তুলেছিলাম এই হাত দিয়ে।

পায়রা করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ইফাত মৃদু হেসে,
– চিন্তা নেই এজন্য তোমাকে শাস্তি দিব না তুমি যদি নিজ হাতে আমাকে মে’রেও ফেল কোনো অভিযোগ থাকবে না আমি হাসি মুখে বরণ করে নিব কিন্তু আমার চোখের সামনে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না খুব কষ্ট হয়।

ইফাত যেভাবে উঠেছিল সেভাবেই নেমে চলে গেল।পায়রা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজ প্রথম সে ইফাতের ঠোঁটে হাসি দেখেছে। সবসময় ইফাত মুখটা গম্ভীর করে পায়রার সঙ্গে কথা বলেছে। পায়রা আনমনে বলল,

– উনার হাসিটা অনেক সুন্দর কিন্তু উনি আমাকে এতটা ভালোবাসে?
______________
‘এত রাতে কোত্থেকে ফেরা হয়েছে?কোন মেয়ে তোকে জাদু করেছে বলতো? নাহলে আমার এই শান্তশিষ্ট ছেলে সুইসাইড করতে গেল আবার আজ লুকিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো আর এত রাতে বাড়িতে ফিরল।’

– উফ মা কতবার বলবো আমি সুইসাইড করতে যাইনি আর তুমি জেগে আছো কেন? তোমার হাই প্রেশার আছে।

– এত বড় ছেলে যদি হঠাৎ করে পাল্টে যায় তাহলে মা হয়ে আমার তো রাত জাগতেই হবে। এবার বল ওই মেয়েটা কে?

– কোন মেয়ে?

– যার জন্য পাল্টে গেছিস।

– কোনো মেয়ে নেই।
পেছন থেকে ইনান এসে,

– তাহলে তুই পলাশ আঙ্কেলের মেয়ে পায়রার পেছনে ঘুরঘুর করিস কেন ভাইয়া?
ইতি বেগম চোখ বড় বড় করে,

– ইফু তুই মেয়েদের পেছনে ঘুরিস?এই দিনও দেখতে হলো আমাকে!

এতক্ষণ কিছু একটা বলে মা’কে সামলালেও এখন সামলানো খুব কঠিন ব্যাপার ইফাত ক্ষিপ্ত চোখে ইনানের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে মনে হচ্ছে ইনানকে ভৎস করে দিবে।ইনান শুকনো ঢুক গিলে জোর করে হেসে,

– মা তোমাকে যে যা বলবে তাই বিশ্বাস করে নিবে? আমি তো মজা করলাম তোমার মনে হয় ভাইয়া এসব করতে পারে?
ইতি বেগম ইনানের কান টেনে,

– তোর মজা রাখ এমনিতেই আমি চিন্তায় ম’রে যাচ্ছি মনে হয় প্রেশারটা বেড়ে গেছে চেক আপ করাতে হবে।

ইতি বেগম চলে যেতেই ইফাত চোখ পাকিয়ে,
– মায়ের সামনে এসব বলতে গেলি কেন? তুই কি আমাকে ফলো করছিস!

– এখন আর করি না তবে আগে করেছিলাম সত্যি বলতে তোর সঙ্গে কিন্তু পায়রাকে বেশ মানাবে ভাইয়া।

– হুশ…..হুশ….

ইফাত ইনানকে এড়িয়ে ঘরে চলে গেল।ইনান মাথা চুলকিয়ে,
– আমি কি মুরগি নাকি হুশ হুশ করল কেন?

চলবে…..

মন পায়রা পর্ব-০১

0

#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
সূচনা_পর্ব

‘দেখুন ভালো করে বলছি আমাকে ছেড়ে দিন।নইলে আমি কিন্তু চেঁচামেচি করব সেটা কিন্তু আপনার জন্য খারাপ হবে।’

মূহুর্তের মধ্যে মেয়েটির গালে জুড়ে থাপ্পড় পরলো। মেয়েটি মেঝেতে ছিটকে পড়ে গেল টাইলস যুক্ত মেঝেতে মাথা লেগে ফেটে গেছে রক্ত বের হচ্ছে।ছেলেটি হাটু মুড়ে সামনে বসতেই মেয়েটি মুখ তুলে তাকিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে,
– আপনি আমাকে মারলেন ইফাত? আমার অপরাধ কি? কি করেছি আমি?

ইফাত চোয়াল শক্ত করে,
– হ্যা মেরেছি তোকে নিষেধ করেছিলাম না কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলবি না তারপরেও কেন একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলি? ছেলেটা তোর হাতে স্পর্শ করেছিল কিন্তু কিছু বললে না খুব ভালো লেগেছে ছেলেটাকে তাই না?

– আবরার ভাইয়ার কথা বলছেন? আবরার ভাইয়া আমার খালাতো ভাই উনার সঙ্গে কথা বললে সমস্যা কি?

– কথা বললে সমস্যা নেই তবে হেসে গড়াগড়ি খেয়ে কথা বললে সমস্যা।

– এই জন্য আপনি এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন আমার গায়ে হাত তুললেন? আজ পর্যন্ত আমার গায়ে কেউ হাত তুলেনি একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি।

– এই জন্যই তো তোমার এমন অবস্থা দিনকে দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো হিতাহিত জ্ঞান নেই যা ইচ্ছে তাই করছো, আচ্ছা পায়রা আমি যে তোমাকে এত ভালোবাসি বুঝো না কেন?

– আপনার ভালোবাসা বুঝার কোনো ইচ্ছে নেই আমার আপনাকে আমি ঘৃণা করি।

ইফাতের রাগ বেড়ে গেছে পায়রার গাল দু’টো চেপে ধরে,
– দরকার নেই বুঝতে হবে না আমাকে,এর পরে যেন আর কোনো ছেলের সঙ্গে কথা বলতে না দেখি খুব খারাপ হয়ে যাবে।

পায়রা কোনো উত্তর দিলো না রাগে ক্ষোভে গাল দু’টো লাল হয়ে গেছে ইচ্ছে করছে ইফাতের মাথা ফাটিয়ে দিতে কিন্তু ইচ্ছে পূরণ করতে কখনোই পারবে না।

পায়রার হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে কপালে‌ ব্যান্ডেজ করে দিল ইফাত। পায়রাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভ করছে।পায়রা এখনও কাঁদছে ইফাত চুপ করে আছে।পায়রাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে আবারো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল ইফাত। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় পায়রার ডাক পড়ে,পায়রার মা আর চাচী সোফায় বসে গল্প করছিলেন পায়রাকে দেখেই ডাক দিলেন।পায়রা তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে তার মা,

– তোর কপালে কি হয়েছে? ব্যান্ডেজ কেন?

– পড়ে গিয়ে ফেটে গেছিল তাই ব্যান্ডেজ করে নিয়েছি।

– পড়লি কিভাবে?

– আবার পড়ে গিয়ে দেখাই কিভাবে পড়েছি।

– রাগছিস কেন?

পায়রা তাদেরকে এড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। পায়রার মা-চাচী চিন্তিত হয়ে পড়েন।পায়রা বদমেজাজি একটা মেয়ে কারো কথা শুনে না কাউকে ভয় পায় না কিন্তু ইফাতকে দেখলেই ওর কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে যায়।

ইফাত হচ্ছে পায়রার বাবা পলাশ শেখের বিজনেস পার্টনার এনায়েত মির্জার বড় ছেলে, আর ছোট ছেলের নাম ইনান। বিজনেস সূত্রেই দুই পরিবারের এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে,দুই পরিবারের মধ্যেই বাড়িতে যাতায়াত আছে। ইফাত প্রথম পায়রাকে দেখেছিল ইনানের জম্মদিনের পার্টিতে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে দেশের বাইরে থাকায় পায়রাকে কখনও দেখেনি ইফাত। ইনানের জম্মদিনের কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছিল আর সেদিন পায়রাকে দেখে নিজের মন হারায় আর তারপর পায়রার সম্পর্কে সব খবরাখবর নেয়।ইফাত নিজের মনের কথা কখনও চেপে রাখে না পায়রা ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরছিল সেদিন রাস্তায় হুট করে মনের কথা জানিয়ে দেয় ইফাত কিন্তু পায়রা সাথে সাথে না করে দেয়।ইফাত তো ইফাতই ছোট বেলা থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে এবারও তাই পায়রার পিছনে জোকের মতো পরে আছে।

পায়রাকে অনেকবার সবার সামনে নাকানিচুবানিও খাইয়েছে যার কারণে পায়রা ইফাতকে একদম সহ্য করতে পারে না।

পায়রা ঘরে এসে বিছানায় বসে রাগে ফুঁসছে অনেক কান্না পাচ্ছে।যতটা রাগ হচ্ছে তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে,’ইফাত আমাকে মারলো! উনার সবকিছু মানা যায় কিন্তু আজকের ঘটনা? এই উনার ভালোবাসা কিভাবে আঘাত করল একটু কষ্ট হলো না?

পায়রা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা ভালো করে দেখে নিলো, গালে এখনও পাঁচটা আঙুলের দাগ স্পষ্ট।আর কান্না থামানো যাচ্ছে না এবার বাচ্চাদের মতো কেঁদেই দিলো সঙ্গে মনে মনে বকছে ইফাতকে।

ইফাত বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় থাকা দোলনায় বসে আছে। নিজের বারান্দায় দোলনা ইফাত বসিয়েছে দু’জনে বসার মতো দোলনা যখন রাগ হয় তখন এখানেই বসে। হাতে একটা ছুড়ি হঠাৎ করে নিজের হাতে ছুড়ি দিয়ে টান দিতেই কেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করল।ব্যথায় চোখ বন্ধ করে নিলো ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে,

– এই হাত দিয়ে আমি আমার পায়রার উপর হাত তুলেছি কিন্তু কি করবো তোমাকে অন্য কারো সঙ্গে দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না খুব কষ্ট হয়।

ইফাতের মা ইতি বেগম খাবার নিয়ে এসেছিলেন।ইফাতকে ঘরে না পেয়ে বারান্দায় আসতেই যেন উনার প্রাণ পাখি উড়ে যাচ্ছিল, চেঁচিয়ে বললেন,

– ইফু হাত কাটলো কিভাবে বাবা? কত রক্ত বের হচ্ছে।

ইফাত কিছু বলল না ইফাতের মা দ্রুত ইনানকে ডেকে আনলো।ইনান এসে ভাইয়ের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে,
– ভাইয়া এইভাবে কেউ নিজের হাতের করুন অবস্থা করে?

– ব্যান্ডেজ করা শেষ এবার নিজের ঘরে যা।

– তুই একটা ঘাড়ত্যাড়া।

ইনান ইফাতের ঘর থেকে চলে গেল কিন্তু ইতি বেগমের কান্না থামছে না। কাঁদতে কাঁদতে বলছেন,
– তোর কি হয়েছে ইফু মা’কে বল। কেন সুইসাইড করতে যাচ্ছিলি? তোর কিছু হলে আমার কি হবে? মায়ের কথা একটাবার ভাবলি না।

ইফাত বিরক্ত হয়ে,
– উফ মা সুইসাইড করতে যাব কেন? রাগ উঠেছে তাই হাত কেটেছি তাও সামান্য কেটেছে সামান্য ঘটনা এত বড় করার কি আছে?

– তোর কাছে সামান্য হলেও আমার কাছে অনেককিছু অনেক কষ্ট করে জম্ম দিয়েছি তোর জীবনের মূল্য আমার কাছে অনেক।চল খেয়ে নিবি আমি খাইয়ে দিচ্ছি।

– আমি খেয়ে নিব তুমি যাও।

– ডান হাতটাই কেটেছিস খাবি কিভাবে? চুপ করে আয় খাইয়ে দেই।

ইফাত জানে তার মা কোনো কথাই শুনবে না তাই চুপ করে মায়ের হাতে খেয়ে নিলো এতে ইফাতের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল।ইফাত আর ইনান বয়সের পার্থক্য তিন বছর। ছোটবেলায় দুই ভাই পাশাপাশি চেয়ারে একসঙ্গে বসতো আর তাদের মা ইতি বেগম দু’জনকে একসাথে এক থালে করে খাইয়ে দিতেন।বড় হওয়ার পর আর কখনও মায়ের হাতে খাওয়া হয়নি বলতে গেলে নিজেই খেতে চায়নি ইনান এখনও মায়ের হাতে খায় কিন্তু ইফাতের লজ্জা করে তবে আজ যেন অনেক ভালো লাগছে ইফাতের।

ইতি বেগম ইফাতকে খাবার খাইয়ে ব্যথার ওষুধ দিয়ে বিছানায় জোর করে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এবার আর ইফাত বাঁধা দেয়নি ভালো লাগছে আজ মায়ের আদর। সবকিছু ভুলে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো ইফাত।ইফাত ঘুমাতেই ইতি বেগম ছেলের কপালে মমতাময়ী চুমু খেয়ে চলে গেলেন।
______________
মন খারাপ হলে মানুষ কান্না করে মন খারাপ দূর করার জন্য কিন্তু কান্না করেও আবার আরেক সমস্যা চোখ ব্যথা করে আবার তার সাথে সাথে মাথাও ব্যথা করে এক কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে গেলে আরেক কষ্ট হাজির।

কান্না করার কারণে পায়রার মাথা ব্যথা করছে চোখ ফুলে গেছে। বিছানায় এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে রাতে খায়নি অনেকবার ডাকা হয়েছিল কিন্তু যায়নি। রাত অনেক হয়েছে কিন্তু পায়রার চোখে ঘুম নেই তখনকার দৃশ্য বারবার চোখের সামনে ভেসে আসছে। ভেতরটা বিষিয়ে উঠছে শোয়া থেকে উঠে কাউকে কল করে,

– ওই ইফাত মির্জার এতবড় সাহস আমার গায়ে হাত তুলেছে ওকে এর জন্য শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি কিছুতেই শান্তি পাবো না।

অপরপাশের ব্যাক্তি কি বলল পায়রাই শুনতে পেল।পায়রা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– বেশি কিছু করতে হবে না যেই হাত দিয়ে আমায় আঘাত করেছে সেই হাতটার একটু করুন অবস্থা করে বেটাকে হাসপাতাল থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।

পায়রা ফোনটা রেখে দিল শয়তানি হাসি হেসে,
– এবার ইফাত আপনি বুঝবেন এই পায়রা কি চিজ।

মন হালকা করে এবং মাথা ব্যথা কমাতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো পায়রা।
____________
পায়রার ঘুম ভাঙলো বেলা এগারোটায়। রাতে দেরি করে শোয়ার জন্য এবং মাথা ব্যথার কারণে ঘুম দেরিতে ভেঙেছে।আজ আর ভার্সিটি যাওয়া হয়নি,রাতে না খাওয়ার জন্য অনেক খিদে পেয়েছে দ্রুত টেবিলে গিয়ে খাবার খেয়ে সোফায় চোখ বন্ধ করে বসে আছে।

পায়রার চাচাতো বোন সাবিহা এসে,
– আপু কি হয়েছেরে তোর কাল মাথা ফাটিয়ে আসলি রাতে খেতে নামলি না আজ আবার দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ভার্সিটি মিস দিলি।

– কোনোটাই ইচ্ছে করে করিনি।

– তোর আর ইফাত ভাইয়ার মধ্যে কি চলছে রে? সকাল সকাল ইফাত ভাইয়া ফোন করে তোর খবর নিলো?

পায়রা ব্রু উঁচিয়ে,
– উনি আমার খবর নিয়েছেন?

– হুম জিজ্ঞেস করল পায়রা কেমন আছে, খেয়েছে ভার্সিটি গিয়েছে।

– জিজ্ঞেস করতেই পারে স্বাভাবিক।

– আমাদের কেন জিজ্ঞেস করে না?

– উনাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর আমায় কেন বলছিস?

সাবিহাকে এড়িয়ে বসা থেকে উঠে বাগানে চলে গেল পায়রা মনে মনে ভাবছে,’এই লোকটা এমন কেন?এই ভালোবাসি বলে চেঁচায় আবার নিজেই আঘাত করে কিছুক্ষণ পর কষ্ট পেয়ে খোঁজ খবর নেয়।পায়রা বাগানে যেতেই পেছন থেকে,

চলবে…….

ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি পর্ব-০৫(শেষ পর্ব)

0

#ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি
৫ম এবং শেষ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

কুয়োর কতটা গভীরে চলে এসেছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। বিস্মিত দৃষ্টিতে নিজের সামনে ভেসে ওঠা নতুন দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে আছেন । অবাক হয়ে গেলেন ওগুলোর ভেতর থেকে ভেসে আসা অনেকগুলো স্বরের গুঞ্জন শুনে। চেচাতে চেচাতে একদল লোক একটা বৃদ্ধা মহিলাকে নিয়ে আসছেন এই কুয়োর কাছাকাছি। বৃদ্ধা চিৎকার করে করে লোকগুলোকে অভিশাপ দিচ্ছে। লোকগুলোও ক্ষেপে আছে মহিলার উপরে। চিৎকার করে একজন বলে উঠল, ‘বুড়ি, ডাইনি! পিশাচ! তোর ধড় থেকে মাথা আমি আলাদা করে দেব!’ এতে দা ছিল তার আগে থেকেই। ওটা নিয়ে তেড়ে গেল বৃদ্ধার দিকে।

আশেপাশের লোকগুলো দ্রুত ছুটে গিয়ে লোকটাকে বাধা দিয়ে দা টা ছিনিয়ে নিল। আরেকজন কর্তা শ্রেণীর লোক গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘এত উতলা হয়ো না! রাগ আমাদের সকলেরই আছে! উচিত বিচারই হবে আজ! আর কেউ পাগলামি করবে না!’

বুড়ি দাঁত কটমট করতে করতে লোকগুলোর দিকে তাকালো। চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমি তোদের সবাইকে খেয়ে ফেলবো! এই দেখ আমার দাঁত! এটা দিয়ে কামড়ে কুঁচিকুঁচি করে ছিড়ে খাব তোদের।’ ভয়ানক লাল দেখাচ্ছে বুড়ির দাঁত। ভালো করে তাকাতেই বোঝা গেল বুড়ির শুধু দাঁত নয়, পুরো মুখটাই রক্তে মেখে রয়েছে। একদম কুয়োর কাছে এনে একটা পিলারের সাথে শক্ত করে বাধা হলো বৃদ্ধাকে। হিসহিস শব্দ করে কামড়াতে চাচ্ছে আশেপাশে যাকে দেখছে তাকেই।

দৃশ্যটা কখনকার সময়ের তা বোঝা যাচ্ছে না এখনো। একজন লোক এগিয়ে এলো বৃদ্ধার কাছে। গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই কুয়োর ভেতর কী চলছে বল! তুই কতজন মানুষকে এই পর্যন্ত খুন করেছিস! বল, তুই!’

বৃদ্ধা এবার খিলখিল করে হাসতে লাগলো। লোকটা রেগে গিয়ে একটা লাথি বসিয়ে দিল বৃদ্ধার বুকে। গুঙিয়ে উঠল সে, ক্রোধে ভরে তাকালো লোকটার দিকে। মুখ ভরে উঠল হিংস্রতায়, বেরিয়ে এলো ফেসফ্যাসে কণ্ঠ বৃদ্ধার গলা দিয়ে, ‘আমি এতগুলো মানুষ মেরেছি তোদের যে তোরা গুণে শেষ করতে পারবি না। কুয়োর ভেতর নেমেই দেখ বিশ্বাস না হলে! আমি কুটনী বুড়ি, না! আমাকে তোরা গ্রাম থেকে তাড়িয়ে না দিলে এসব কিছুই ঘটতো না।’

‘তোকে কী আর সাধে তাড়িয়েছিলাম আমরা! তোর দুই ছেলে এক মেয়ে কেউই তোর দায়িত্ব নিতে চায়নি কূটনামির জন্য।’

লোকগুলোর মধ্যে থাকা কর্তা মতো লোকটা বলল, ‘এই বৃদ্ধা সম্পর্কে সমস্ত কথা খুলে বলো দেখি তুমি। শাস্তি হওয়ার আগে সবাই এই বুড়ির কর্মের কথা আরেকবার শুনুক, যাতে আমরা একে যেই শাস্তি দেব তা যে অন্যায় নয় সকলেই অনুধাবন করতে পারে।’

লোকটা বলা শুরু করলো, এই বৃদ্ধার নাম ফুলরেখা বাণু। তার অল্প বয়স থেকেই অন্যের সংসারে অশান্তি লাগানোর অভ্যাসের কারণে গ্রামের অনেক মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা তাকে দুচোখে দেখতে পেত না। একজনের ঘরে যেয়ে আরেকজনের বদনাম করে বেড়াত। স্বামী বা স্ত্রীর নামে মিথ্যা কুৎসা রটাতো। ফুলরেখার বিয়ে হয়েছিল একজন হয়রা গোছের নেশাখোর লোকের সাথে। যে কিনা অধিকাংশ সময় তাকে একা সংসারে ফেলে রেখে দূর দূর গ্রামে ঘুরে বেড়াত। নিজের সংসারে শান্তি ছিল না বলে কোনো সুখী স্বামী-স্ত্রীকে দেখতে পারতো না সে। এমনও হয়েছে মন্দ কথায়, কু-কথায় কারো সংসারে ভাঙন ধরছে না তখন সে কালো জাদুর আশ্রয় নিত। মানুষকে বাণ মারতো। নিজেও ওসব চর্চা করতো। লোক মুখে শোনা যায় ফুলরেখার পিতা নাকি কালো জাদুর তান্ত্রিক ছিল। তার কাছ থেকেই সে অনেক কিছু শিখেছিল।

এগুলো অবশ্য অনেক পড়ে গ্রামের লোকেরা জানতে পারে। ফুলরেখার বয়স যত বাড়তে থাকে তত গ্রামের পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করতে সে পটু হয়ে উঠে। কখনো দেবর-ভাবীর অবৈধ সম্পর্ক সম্পর্কে ইঙ্গিত করে সে। কখনো কোনো পুরুষ সম্পর্কে বলতো তাকে সে অন্য নারীর ঘর থেকে বের হতে দেখেছে। গ্রামে একজন মহিলা একটা কথা কোনো মতে শুনতে পেলে তা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর সন্দেহ বাতিক তো ছিলই। এভাবে পুরো গ্রামেই ঝগড়া-ঝাটি লাগানোর ওস্তাদ ছিল সে।

ভবঘুরে স্বামীর উপর জমা রাগগুলো ঢালতো নিজের ২ ছেলে এবং এক মেয়ের উপর। সারাক্ষণ তাদের বকাবাজি আর মারধর করতো। প্রতিবেশীরা মায়া অনুভব করে মাঝেমধ্যেই ছোট ছেলে-মেয়েগুলোকে নিজেদের বাড়িতে রেখে দিত। কারো প্রতি ভালোবাসা, মায়া, টান না থাকা তাকে আরও নিষ্ঠুর করে দিল।

একসময় স্বামী মারা গেল। সন্তানেরা বিয়ে করলো। কিন্তু ফুলরেখার মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কুটনামি, জাদু-টোনা করার অভ্যাসটা গেল না। এমনকি নিজের আপন মেয়ে এবং ছেলেদের সংসারেও ঝামেলা সৃষ্টি করতে লাগলো সে। গ্রামের সব মানুষ এতদিন ফুল রেখার সম্পর্কে সমস্ত কিছু জেনে ফেলেছে। সেই যে নারী-পুরুষ সম্পর্কিত নানা কুৎসা রটানোর কারিগর তা জেনে সকলেই তার প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠলো। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল বুড়িকে নির্বাসিত করবে। এরপর থেকেই জঙ্গলের পাশের এই জায়গাটিতে জোর করে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সন্তানেরাও বাধা দেয়নি কোনো। মাঝেমধ্যে অনেকেই তার খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে ছিল শুধু।

এরপর কয়েক মাস কেটে যায়। গ্রামে সর্বপ্রথম নিখোঁজ হয় বুড়ির নাতি, এরপর আরও ৪টি বাচ্চা মেয়ে। কোনো হদিস পাওয়া যায় না তাদের। একজন অভিযোগ করে একটা বৃদ্ধা মহিলাকে সে সমস্ত শরীর মুখ কাপড়ে ঢেকে মাঝেমধ্যে গ্রামে ঘুরঘুর করতে দেখে। বুড়ির বর্ণনা শুনে অনেকের মনেই সন্দেহ জাগে ফুলরেখা বাণুর উপর। নিষ্ঠুর ওই মহিলার পক্ষে কিছুই সম্ভব না। তাকে যেখানে নির্বাসিত করা হয়েছে সেখানে নজর রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

গ্রামে নিখোঁজ হলো ৬ষ্ঠ বাচ্চাটি। গ্রামের কিছু লোক নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে হানা দেয় ঘন জঙ্গলের পাশে বুড়ির নির্বাসিত হওয়ার পরের খড়-ছনের আবাসে। ঘরে ঢুকেই তারা দেখতে পান সেই বাচ্চা মেয়েটির থেঁতলানো শরীর। গলা থেকে পৃথক হয়ে ঘরের এক কোণে পরে রয়েছে বাচ্চাটির মাথা। কিছু দিয়ে আঘাত করে ওটার মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে নিয়েছিল বুড়ি আগেই। বুড়ির জামা আর মুখ ভর্তি হয়েছিল রক্তে।

কারো বুঝতে বাকি রইলো না আগের ৫টি বাচ্চা মেয়ে কী করে নিখোঁজ হলো। বুড়িকে চেপে ধরলো লোকগুলো। জানতে চাইলো বাকি বাচ্চাগুলো কোথায়! অনেক আঘাত সহ্য করার পর কুয়োর কথাটি বলল সে। বলল, মগজগুলো খেয়ে লাশগুলো ওখানে ফেলেছে সে।

কুয়োটা দেখে সকলেই বিস্মিত হলো। জায়গাটি তাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে না হওয়ায় কারোই অপরিচিত ছিল না। এখানে কখনই কোনো কুয়ো ছিল না। ভালো করেই জানে সবাই। তাও আবার এত গভীর কুয়ো যার তল দুপুর সূর্যের আলোতেও দেখা যায় না!

এরপরই বৃদ্ধাকে লোকগুলো ধরে এনে কুয়োর সাথে থাকা একটা খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলে।

দৃশ্য আর শব্দগুলো এতই স্পষ্ট লাগছে প্রফেসরের কাছে যে মনে হচ্ছে সবকিছু তার সামনে ঘটছে। সে অদৃশ্য কোনো মানুষ, তাই লোকগুলো তাকে দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে দেখতে হঠাৎ বৃদ্ধার শরীর মুচড়াতে লাগলো। তার হাতের বাধন আপনা-আপনি খুলে গেল। সব লোকজন বিস্মিত হয়ে দেখল বুড়ির পুরো শরীর কালো রূপ ধারণ করল। মুখ ঢেকে ফেলল গাঢ় একটা ছায়া, অদৃশ্য হয়ে গেল চোখ, কান,নাক,মুখ। চুলগুলো উপরে উঠে শূন্যে ভাসছে যেন। পা ভরে আছে অনেক গুলো সুতোর কুণ্ডলী, হাত থেকে কিলবিল করে নড়ছে ফিতার মতো চ্যাপ্টা অনেকগুলো কালো কুৎসিত বস্তু। সকলে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল।

উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা একটা হাত বাড়িয়ে দিল কর্তা গোছের লোকটার ঘাড়ের পেছনে। লোকটা কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে চারদিকে তাকালো। এরপরই ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়োর ভেতরে। বাকি যারা ছিল ভয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাতে লাগলো। এবার ছায়া অবয়বটাও ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়োয়।

নিজের পাশ দিয়েই বলিষ্ঠ লোকটাকে নীচে নেমে যেতে দেখলেন প্রফেসর। যেন এই মুহূর্তে কুয়োর উপর থেকে লাফিয়ে নেমেছে লোকটা। এরপরই সেই ছায়া অবয়বটা তার পাশে এসে পড়লো। কিন্তু ওটা বাকি দেহগুলোর মতো নীচে নেমে গেল না। উল্টো তার পাশে স্থির হয়ে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। পুরো শরীর যেন তার ঠাণ্ডায় জমে গেল। অবয়বটার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো তার কব্জি। আবার চারপাশে অন্ধকার হয়ে এলো সব। আরো নীচে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। গভীর থেকে গভীরে।

কতটা সময় শক্ত হাতটা তাকে চেপে ধরে আছে, কতটা সময় ধরে সে নিচে পড়ছে হিসাব করতে পারলেন না প্রফেসর। কিন্তু এক সময় তার পতনের সমাপ্তি ঘটলো, কব্জি চেপে ধরে রাখা হাতটা সরে গেল কোথাও। অবাক হয়ে তিনি বুঝতে পারলেন তিনি আর শূন্যে ভেসে নেই। তার পা স্পর্শ করেছে শক্ত মাটি। অবশেষে কুয়োটার তলায় পৌঁছেছেন তিনি! চারদিকে সেই লালচে আলোর আভা ফুটতে শুরু করলো। নড়তে গিয়ে প্রফেসর অনুভব করলেন শক্ত মাটিতে তার পা থাকলেও তা শুকনো মাটি নয়। হাটু সমান পানির ভেতর দাড়িয়ে রয়েছেন তিনি।

আলোর ঘনত্ব বাড়লে তিনি পানির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কুচকুচে কালো পানি। চারপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না। কিছুটা দূরে উঁচু শুকনো একটা জায়গা দেখে পানি ঠেলে অনেক কষ্টে এগিয়ে চললেন তিনি সামনের দিকে। উঁচু জায়গাটিতে উঠেই চারপাশে তাকালেন। মনে হলো কিছুটা দূরে যেন একটা বাচ্চা মেয়ের শরীর পরে রয়েছে। ওটার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। বৃষ্টি ঘুমিয়ে রয়েছে এখানে! তবে মেয়েটার মুখ এতটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে কেন!

হঠাৎ পেছনে পানি দিয়ে কারো হেটে আসার আওয়াজ পেলেন। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন একজন বৃদ্ধা উঠে এলো নোংরা কুচকুচে পানি থেকে। বৃদ্ধাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন এই সেই বৃদ্ধা ফুলরেখা। তার দিকে এগিয়ে আসছে বৃদ্ধা। কিন্তু তার চেহারায় কোনো হিংস্রতা নেই। মুহূর্তেই বৃদ্ধার চেহারা বদলে রূপ নিল সেই ছায়া অবয়বটার। পা অসাড় হয়ে এলো প্রফেসরের। বসে পড়লেন ঘুমন্ত বৃষ্টির পাশে। পরমুহূর্তেই সেই ছায়া অবয়বটার চেহারা বদলে রূপ নিল ৭ বছর বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের।

তার কাছাকাছি এখন দুজন বৃষ্টি। একজন তার পাশে শুয়ে আছে আরেকজন তার সামনে। দুজনের চেহারা হুবহু এক। কিন্তু সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে যে বহুরূপী তা বুঝতে দেরি হলো না তার। তিনি কণ্ঠে আতংক নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি? এসব কেন হচ্ছে? কী চাও তুমি?’

প্রফেসর ভেবেছিলেন বৃষ্টির মুখ থেকে ক্রুর হাসি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু না, তাকে বেশ শান্ত , ক্লান্ত আর বিষণ্ণ লাগছে। বৃষ্টিও মেঝেতে বসে পড়লো, তার মিহি কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘ ভয় পেও না, আমাদের দুজনের আজ তোমার সাহায্যের খুব দরকার। আমাদের মুক্তি দিতেই আজ তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি আমি। তোমার সামনে হাজির করেছি এই কুয়োর প্রায় সমস্ত রহস্য!’

‘এর মানে! কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর

‘ আমি ৩জন। ফুলরেখা, বৃষ্টি, আর একটা পিশাচ।’

মুহূর্তেই বৃষ্টির চেহারা বদলে রূপ নিল সেই বৃদ্ধার চেহারার। ফেসফেসে কণ্ঠে খেই ধরলেন নিজের কথার, ‘আমার আজকের অবস্থার জন্য আমিই দায়ী! তুমি এরমধ্যে দেখেছ আমি কী করে এই কুয়োয় পতিত হলাম, কী করে বৃষ্টির পরিবার আর তাকে সাহায্য করতে আসা পরিবারের লোকগুলোকে হত্যা করেছে আমারই ছায়া অবয়ব। যদিও ওটা আমি নই। না, ওটা বৃষ্টি। এখন তোমাকে শোনাই কী করে এই কুয়োটা সৃষ্ট হলো!

আমাকে যখন গ্রাম থেকে নির্বাসিত করে দেয়া হলো আমি তখন পুরোই উন্মাদ হয়ে গেলাম। আমার জীবনে এত কষ্ট, অথচ মানুষ কত সুখে বাস করে! আমার ছোট্ট বয়সে আমার কুমারী শরীর আমার বাবা ব্যবহার করেছে শয়তান সাধনায়, মায়ের মুখ কখনো দেখিনি, যার সাথে আমার বিয়ে হলো তার সামান্য ভালোবাসা পেলাম না, নিজের সন্তানরাও আমাকে কোনোদিন বোঝেনি। শপথ নিলাম পুরো গ্রামকে শেষ করে দেব।

শয়তান পুজোর পুরোটা আমি জানতাম না। সেটাই ছিল আমার ভুল। আমি আমার নাতনিকে গোপনে গিয়ে তুলে আনলাম। বলি দিলাম শয়তানকে উদ্দেশ্য করে, সাধনার সব নিয়ম মেনে। কিন্তু যে শক্তিশালী পিশাচের সাধনা আমি করলাম ওটা এলো না। সাধনার ভুলের কারণে এলো শরীরহীন এক ছায়া পিশাচ। ওটার বসবাসের জন্য চাই একটা শরীর। কিন্তু আমি ছাড়া ওই ঘরে আর কেউ ছিল না। চিরদিনের জন্য আমার শরীরের ভেতর আশ্রয় নিয়ে ফেললো ওটা। এরপর আমার শরীরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল ওটা। আমি সবই অনুভব করতে পারি, দেখতে পারি। কিন্তু কোনো কাজে বাধা দিতে পারিনা। ওটা আমাকে ব্যবহার করে শিকার করতে লাগলো একের পর এক বাচ্চা মেয়ে।

ছায়া পিশাচটা কেবল ছিল শয়তানের একটি দূত। সে তার জগতের সাথে এই জগতের বিশাল একটা যোগসূত্র তৈরি করার জন্য নিজের ক্ষমতা আর আমার শরীরকে কাজে লাগিয়ে খুঁড়তে থাকে এই কুয়ো। এরপর একদিন ধরা পড়ে যাই আমি মানে শয়তানটা। ওটা মানুষকে প্রভাবিত করে যেকোনো কাজ করাতে পারে। কিন্তু এতগুলো মানুষ দেখে ঘাবড়ে যায় সে। শুধু গ্রামের মাতবর আর আমার শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুয়োয়।

এরপরই ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। নানান পিশাচ তান্ত্রিক, পিশাচ সাধনার বিরোধী তন্ত্র সাধক এসে উপস্থিত হয় এখানে। কুয়োটার লক্ষ্য পূরণ হলে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে তা আন্দাজ করে তারা। তন্ত্র সাধনা করে বন্ধ করে দেয় এর মুখ। এরপর থেকে শয়তানটার সাথে একই শরীরে বন্ধি হয়ে আছি প্রায় একশ বছর। যতদিন না মানুষ ভুলে গেল এর কথা আর আপনি খুলে দিলেন এর মুখ!’

হতভম্ব হয়ে বৃদ্ধার দীর্ঘ বক্তব্য শুনে যাচ্ছেন প্রফেসর। অবিশ্বাস্য একটা ছেলে ভোলানো ভুতের গল্পের চরিত্র মনে হচ্ছে তার নিজেকে। তবে কথা বলার জন্য শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।

বুড়ি বলা চালিয়ে গেল ‘পিশাচটা এতদিন বন্ধি থাকায় অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাছাড়া আমিও ওটাকে সরিয়ে কী করে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিতে হয় তা আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম। পিশাচটার অনেক শক্তিও আমি ব্যবহার করতে পারি। হ্যা, এটা ঠিক, ওটা আমার শরীরে না থাকলে এত বছর আমি বেঁচে থাকতাম না। কিন্তু এও কী বেঁচে থাকা! ছায়া পিশাচটার প্রয়োজন ছিল একটা ছোট শরীর। তাই পেয়ে গেল সে সেদিন। তবে বৃষ্টির শরীরে প্রবেশ করতে পারলো না সে, তাই বৃষ্টির শরীর থেকে আত্মাটা বের করে আমার ভেতর স্থাপন করলো, হয়ে উঠল ওটা বহুরূপী। বৃষ্টির রূপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কুয়ো থেকে। আমারও শক্তিও কমে গেল নতুন রূপ পাওয়ার পর। এরপর থেকেই বৃষ্টির আসল শরীর পড়ে রয়েছে এখানে, আর ছায়া পিশাচটা করে চলেছে তার শয়তানি।

তার সম্মোহনে পরে এখন পর্যন্ত যারাই মারা গিয়েছে তাদের শরীর থেকে আত্মা আলাদা হয়ে গেলেও শরীরগুলো নিস্তার পাবে না। ওইসব গুলো শরীরে ভর করবে আরো অনেক পিশাচ শক্তি। ওগুলোর ক্ষমতাও থাকবে এটার মতো। যার ফলে ওগুলো সম্মহিত করে হত্যা করবে আরও মানুষ। তারা আরও মানুষ। এভাবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে মহা পিশাচ শক্তি। যার জন্য কিনা শুধু আমিই দায়ী!

বৃষ্টির রূপ ধরে আপনাকে কুয়োর কাছে এনেছিল পিশাচটাই হত্যা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি তোমাকে রক্ষা করলাম। এবার তুমি আমাদের রক্ষা করো।’

ভয়ানক উত্তেজনা অনুভব করছেন প্রফেসর আমির হোসেন, ‘কিভাবে! কিভাবে আমি তোমাকে আর বৃষ্টিকে মুক্ত করতে পারি! আর শেষ করতে পারি পিশাচটাকে! শেষ করতে পারি এই সমস্ত মৃত্যু খেলা চিরদিনের জন্য?’

‘তোমার পাশে যে বৃষ্টি শুয়ে আছে ওর আত্মা দূরে থাকলেও ও বেঁচে আছে। একশ বছর পর এই বাচ্চাটির সাহায্যেই শক্তি ফিরে পেয়েছে ছায়া পিশাচটা। তোমাকে খুন করতে হবে ওকে। তবেই শেষ হবে সব কিছু।’

প্রফেসরের সামনে এক মুহূর্তে চলে এলো একটি ধারালো ছুরি, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধার শরীর রূপান্তরিত হয়ে হলো বৃষ্টির চেহারায়। বৃষ্টি হাত ইশারা করে দেখাচ্ছে ঘুমন্ত বৃষ্টির দিকে। তিনি ছুরি হাতে তুলে নিলেন, ঘুরে বসলেন ঘুমন্ত ফুটফুটে মেয়েটির দিকে। উন্মুক্ত গলা তার সামনে খোলা। মেয়েটার গলায় চালিয়ে দিতে পারেন ধারালো ছুরিটা। তবেই যদি শেষ হয় সব! মুক্তি পায় ছোট মেয়েটি। এই মেয়েটিকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন তিনি আর তার স্ত্রী। শৈশবে মেয়েটা যা হারালো ফিরিয়ে দেবেন সব। ছুরিটা বৃষ্টির গলার কাছাকাছি নিয়ে এলেন তিনি।

এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে তার শরীর মন চমকে উঠল। প্রফেসরের স্ত্রীর অভিমানী কন্ঠস্বর, ‘আচ্ছা রোমান্টিক তো তোমরা দাদা-নাতনি, এই অন্ধকারের মধ্যে এই কুয়োর পাশে হাত ধরাধরি করে বসে আছ, আর আমি দুশ্চিন্তা করে মরছি!’

এক মুহূর্তে সব কিছু উলট-পালট মনে হলো প্রফেসরের কাছে। হচ্ছেটা কী! কোথাও তাকিয়ে নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলেন সমস্ত কিছু। তিনি এখন প্রাচীন কুয়োটার তল দেশে নয়। বৃষ্টি এখনো শক্ত করে তার হাত ধরে বসে আছে কুয়োটার পাশে। তার এবং বৃষ্টি দুজনের শরীরই রয়েছে কুয়োর উপরে। এতক্ষণ তার সাথে যা কিছু ঘটলো এর পুরোটাই ছলনা। হয়তো ভেসে ওঠা দৃশ্য, আর ফুলরেখার বলা ঘটনা গুলো সত্যি। তবে এইসবই বলা হয়েছে তাকে প্রভাবিত করার জন্য।

সেই পিশাচটা তাকে এমন এক পবিত্র দুনিয়ায় পাঠিয়েছে যেখানে তার প্রভাব শক্তি কাজ করে না। কুয়োর উপরে তার পাশে বসে আছে বৃষ্টির শরীর, যার ভেতর ছায়া পিশাচটার আত্মা ভর করে আছে। আর তার পাশে যে ঘুমন্ত বৃষ্টি রয়েছে এটা বৃষ্টির আসল আত্মা। এটাকে বৃষ্টির শরীর থেকে আলাদা করলেও হত্যা করার ক্ষমতা ওটার নেই। তাই তাকে দিয়ে বৃষ্টির আত্মাকে হত্যা করাতে চাইছে সে। যাতে বৃষ্টির শরীরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে আজীবনের জন্য শয়তানটা।

সে বৃষ্টির আত্মাকে খুন করার পর তাকে ধাক্কা দিয়ে কুয়োতে ফেলে দেবে শয়তানটা। তার স্ত্রীকে প্রভাবিত করে কুয়োয় ফেলতেও ঝামেলা হবে না ওটার। এরপর থেকে পুরো শক্তিশালী হয়ে একটা শিশুর শরীরের আড়ালে থেকে হত্যার মেলা চালাবে পিশাচটা।

তার মানে সে এখন একটা আত্মা, বৃষ্টিও আত্মা। সে রয়েছে আত্মার দুনিয়ায়। তার সামনে ২য় যে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে, যেটা ছায়া পিশাচটার বহুরূপী সত্তা, যা এইসবের পেছনে দায়ী ওটাও আত্মা! এক মুহূর্তে বুদ্ধি খেলে গেল প্রফেসরের মাথায়। ভন করে ঘুরে ছুরিটা বসিয়ে দিল দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টির হৃদপিণ্ড বরাবর। কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে রইলো সব কিছু যেন। এরপরই আকাশ ফাটানো একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ওটার গলা থেকে। দেখতে দেখতে মানুষের গাঢ় ছায়ায় রূপান্তরিত হলো ওটা। পুরো শরীর আগুনে পুড়ছে ওটার। পেছাতে লাগলো অবয়বটা। এক সময় ছাইয়ে রূপান্তরিত হলো। মিশে গেল কুচকুচে কালো পানিতে। শেষ সব কিছুর!

আত্মা দুলে উঠল প্রফেসরের। ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘুমন্ত ছোট মেয়েটার আত্মার উপর। শক্ত করে চেপে ধরলেন নিজের শরীরের সাথে। চারপাশে সব কিছু অন্ধকার হয়ে এলো। যখন চোখ খুললেন দেখলেন অসতর্ক ভাবে কুয়োর পাশে বসে আছেন তিনি, তারপাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বৃষ্টি, আতংক ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন তার স্ত্রী।

বৃষ্টিকে কোলে তুলে ঘরের দিকে রওনা হলেন তিনি। এটাকে অনুভব করতে পারছেন তিনি। অশুভ শক্তিটা শেষ হয়ে গেছে। তিনিই শেষ করেছেন ওটাকে। কুয়োটা বন্ধ করে দেবেন চিরদিনের জন্য তিনি। এইতো মিটিমিটি করে চোখ খুলছে ছোট মেয়েটি। এই মুখের মতো পবিত্র মুখ আর কী আছে জগতে! বিড়বিড় করছে মেয়েটি,’ বাবা,মা, কী সুন্দর বিড়াল!’

• * * * * সমাপ্ত * * * *

ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি পর্ব-০৪

0

#ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি
৪র্থ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলম বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন বেলকনির দিকে। আধো আলো-আধারীর মধ্যে অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে ওখানে একটা নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি কয়েকবার ডাকলেন, ‘কে?’ ‘কে ওখানে?’ কোনো উত্তর না পেয়ে ধকধক বুক নিয়েই এগিয়ে গেলেন সামনে।

মেয়েটার একদম পেছনে এসে দাঁড়ালেন। এমন সময় খিলখিল করে হাসতে হাসতে ঘরের আরেক কোণা দিয়ে ছুটে গেল একটি ছোট ছেলে। এই হাসি তার চেনা। তার মৃত ছেলে রাব্বির! দ্রুত ঘুরে সেদিকে তাকালেন। ছেলেটাকে দেখতে পেলেন না তিনি। ঘাড় সোজা করতেই আৎকে উঠে জমে গেলেন। তার ঠিক মুখোমুখি বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে তার মৃত স্ত্রী রেহানা। সারা মুখ, শরীর আর শাড়ি রক্তে মাখা। মাথা ফেটে থেঁতলে আছে। তবুও চেনা গেল তাকে। খোরশেদ বুঝতে পারছে না, হচ্ছেটা কী! এটা কী দুঃস্বপ্ন কোনো!

জ্বলজ্বল করে জ্বলছে রেহানার দুচোখ। থেতলে যাওয়া বিকৃত মুখটা আরো বিকৃত হয়ে আছে ক্রোধে। একটা ফেসফ্যাসে কণ্ঠ বেরিয়ে এলো রেহানার গলা থেকে, ‘আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা চরিত্রহীনতার অভিযোগ করে আমাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে এখন খুব সুখে একা জীবন যাপন করে যাচ্ছ! কী নিষ্ঠুর তুমি! আমাকে তোমার সন্তানকে, একটুও মনে পড়ে না তোমার!’

স্বপ্নই যদি হবে এটা তবে এত বাস্তব কেন! থতমত খেয়ে গেল খোরশেদ। কম্পিত কন্ঠে বললেন, ‘আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি! আমি তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই করিনি। তুমিই আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমার বেঁচে থাকার সব আশা-ভরসা নিয়ে পালিয়ে গেছ!’

‘মিথ্যা, ধোকা দিয়েছ তুমি! ভালোই যদি বাসো তাহলে চলো আমাদের সাথে এই দুনিয়ায়!’ সেই একই ক্রোধে ভরা কণ্ঠ রেহানার।

এমন সময় ছুটে এলো রাব্বি তার পেছন থেকে। বুকটা কেঁপে উঠলো ইঞ্জিনিয়ারের। থেতলে কী ভয়াবহ চেহারা হয়েছে তার প্রিয় ছেলেটার। যেদিন ওরা মারা গেল সেদিন ভালো করে ওদের দিকে তাকানোর অবস্থাতেই ছিল না সে। রাব্বি বলল, ‘আমাকে ভয় পাচ্ছ কেন বাবা! আমিই তোমার ছেলে। চলো আজ আমাদের সাথে। আমরা তোমাকে নিতে এসেছি।’

লাল আভা ঠিকরে বের হচ্ছে এখন রাব্বি আর রেহানা দুজনের চোখ থেকেই। শরীর এবং চিন্তাশক্তি দুটোই অবশ হয়ে গেল খোরশেদ আলমের। চোখের পলকেই দেখলেন তার স্ত্রী আর সন্তান ঘুরে লাফিয়ে পড়ে গেল বেলকনি থেকে। ঘাড়ের পেছনে ঠাণ্ডা স্পর্শ অনুভব করলেন তিনি। তখনই তারণা অনুভব করলো তার সমস্ত শরীর স্ত্রী আর সন্তানের কাছে যাওয়ার জন্য। দ্রুত ছুটে বেলকনি টপকে লাফিয়ে পড়লেন তিনি। রাস্তার উপর মুখ থুবড়ে পড়লেন স্ত্রী আর ছেলের মতো। আরও একটা রহস্যজনক মৃত্যু একই বিল্ডিং থেকে অভিশপ্ত তকমা দিয়ে দিল এই বিল্ডিং টাকে। এলাকার মানুষ পৌঁছে গেছে আতঙ্কের চরম সীমায়।

প্রফেসর আমির হোসেনের হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে বৃষ্টি। চোখে শুধু আধার দেখলেন কয়েক মুহূর্ত তিনি। এরপরই অনুভব করলেন অনেক উঁচু থেকে পড়ছেন তিনি নিচে। চারপাশে অন্ধকার আর অন্ধকার। তখনও তার হাত চেপে ধরে রয়েছে একটি শক্ত হাত।

ধীরে ধীরে যত নীচে নামছেন অন্ধকার ফুঁড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সামান্য আলোর আভা। ধীরে ধীরে তা গাঢ় হতে লাগলো। চারপাশে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে দেখলেন, অনেক গুলো দৃশ্য যেন ভেসে বেড়াচ্ছে এখান, ওখান দিয়ে। শরীর স্থির হয়ে গেল তার। আর পড়ছেন না। কোনো ছোট্ট একটা কুয়োর ভেতর যে তিনি নেই তা অনুভব করলেন। সামনে হঠাৎ ভেসে উঠলো একটা স্পষ্ট দৃশ্য। তিনি দেখতে পাচ্ছেন বেশ কয়েক মাস আগের একটি দৃশ্য। সেদিন তাদের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে একটা ছোট আয়োজন করছিলেন তারা।

ঐতো বৃষ্টিকে দেখা যাচ্ছে। একটি সোফায় চুপচাপ বসে আছে মেয়েটি। তার সমবয়সী কেউই ছিল না সেরাতে অনুষ্ঠানে তাই হয়তো কিছুটা মন খারাপ। সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি, কৌতূহলী হয়ে উকি দিচ্ছে বাড়ির বাইরের দিকে। এক বার চারপাশে তাকালো। বড়রা সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। বৃষ্টি ধীরে ধীরে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। তার কৌতূহলী চোখজোড়া কিছু একটা খুঁজছে। হঠাৎ একদিকে তা স্থির হয়ে গেল। একটা গাছের পাশে বসে আছে একটা ছোট বিড়াল ছানা। কী সুন্দর সাদার উপর হালকা ছোপ ছোপ বাদামি রঙ ওটার। বৃষ্টি থেকে খুব দূরে নয়।

ওটার দিকে এগিয়ে গেল বৃষ্টি। ওটা চমকে কিছুটা পিছিয়ে গেল। বৃষ্টি আরেকটু এগিয়ে গেল, ওটা আরেকটু পেছালো। সম্মোহিতের মতো ওটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো বৃষ্টি। একসময় চলে এলো বিড়াল ছানাটা সেই কুয়োর কিনারে। ধীরে ধীরে ঢাকনা সরে গেল ওটার ওপর থেকে। বৃষ্টি এবার ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে ওদিকে। হঠাৎ বিড়ালটার আকার বৃদ্ধি পেতে লাগলো, কয়েক মুহূর্তে ওটা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা আকৃতিতে রূপ নিল। বোঝার উপায় নেই কী ওটা! একটা গাঢ় কালো ছায়া যেন ওটা, অথচ মানুষের মতো অবয়ব ওটার। মুখায়ব এতই কালো যে কোনো চোখ,নাক,মুখের অস্তিত্ব বোঝা যাচ্ছে না।চুলগুলো মাথা থেকে উপরে উঠে শূন্যে ভেসে রয়েছে, পায়ের জায়গায় রয়েছে অনেক গুলো সুতোর কুণ্ডুলি।

প্রায় ভেসে এসে বৃষ্টির পেছনে এসে দাড়ালো ওটা। পুরো আতঙ্কে বিস্ফোরিত হয়ে আছে মেয়েটার মুখ।

অনেকগুলো চেপ্টা লতা কিলবিল করছে ছায়া অবয়বটার হাত থেকে। ওটাই ধীরে ধীরে স্পর্শ করলো বৃষ্টির ঘাড়। বৃষ্টির শরীর কেঁপে উঠলো। ছায়া অবয়বটা ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়োর ভেতর। ওটার পিছু নিয়ে বৃষ্টিও ঝাপিয়ে পড়লো কুয়োয়। অবাক হয়ে নিজের পাশ দিয়ে মেয়েটিকে পড়তে দেখলেন আমির হোসেন। তিনি শূন্যে ভেসে রয়েছেন। এটা কোথায়! যে শক্ত হাত তাকে চেপে রেখেছিল এতক্ষণ ওটাকে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।

আরেকটা দৃশ্য ভেসে উঠলো সামনে। হতভম্ব হয়ে তাকালেন তিনি শূন্যে। ঐতো ফরহাদকে দেখা যাচ্ছে, ছোট মেয়ে বৃষ্টিকে কোলে করে নিয়ে সোফায় শুইয়ে দিল, কেমন বিষন্ন লাগছে ফরহাদকে। ধ্যান ধরে বসে আছে। ঐতো চোখ খুলল বৃষ্টি। মুখে কেমন ক্রুর হাসি। মুহূর্তেই বৃষ্টির শরীর গলে গেল যেন, ওখানে উদয় হলো সেই কুয়োর পাশের ছায়া মানবটা। আলতো করে স্পর্শ করলো তার ফিতাগুচ্ছ হাতটা ফরহাদের ঘাড়ে। কী হয়ে গেল ফরহাদের। সে ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো বেলকনি থেকে। ঝুকে নিচে তাকালো। কোনো রাস্তা বা বাড়ি ঘরের চিহ্ন নেই। তার সামনে উদয় হয়েছে সেই প্রাচীন আধার ভরা কুয়োটা। ঝাঁপিয়ে পড়লো ফরহাদ।

প্রফেসর লক্ষ করলেন তার গা ঘেষে নীচে নেমে গেল ফরহাদের অচেতন শরীর। হচ্ছেটা কী! আবার সামনে ভেসে উঠলো আরেকটা দৃশ্য। রেহানা দাঁড়িয়ে আছে বেলকনির পাশে। তার ঘাড়ের পেছনে সেই ছায়া অবয়বটার হাতের কালো ছাপ। বেলকনির দিকে যেতে তার সামনেও উপস্থিত হলো গভীর কুয়োটা। নীচে কি যেন একটা দেখল। লাফিয়ে পড়লো সে কুয়োর ভেতর। ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া অবয়বটা হিংস্র ভঙ্গিতে। রাব্বি ছুটে এসেছে। কিছু বলল ওটা ওকে। হিংস্র ছায়া অবয়বটার হাত স্পর্শ করলো। রাব্বির ঘাড়। সেও বেলকনির ওপাশে দেখতে পেল কুয়োটাকে। সেখানে আনন্দ ভরা মুখ নিয়ে অপেক্ষা করছে ওর বাবা-মা। মুহূর্তে সেও বেলকনি থেকে লাফিয়ে পড়লো।

নিজের সামনে দিয়েই নীচে পড়ে যেতে দেখলেন প্রফেসর রেহানা আর রাব্বির দেহ। একই ভাবে রেহানার স্বামী খোরশেদ আলম, জেলখানায় থাকা ফরহাদের স্ত্রী তানিয়া এবং ভাই রাকিবের মৃত্যুর দৃশ্য ভেসে উঠলো প্রফেসরের চোখের সামনে। প্রতিটা মৃত্যুর জায়গাতেই তিনি স্পষ্ট দেখলেন সেই অশুভ বিকৃত হিংস্র চেহারার অদ্ভুত ছায়া অবয়বটাকে।

এক মুহূর্তে আবার সব অন্ধকার হয়ে এলো। প্রফেসর বুঝতে পারলেন আবার কুয়োর নীচে নেমে যাচ্ছেন তিনি। তার মস্তিষ্কের ভেতর নাড়া দিতে লাগলো এই কুয়ো সম্পর্কে তার জানা সব তথ্য। প্রফেসর আমির হোসেন যেখানে এখন থাকেন বাড়িটা ঢাকার ভেতরে হলেও ঢাকা শহর থেকে বেশ বাইরের দিকে। দুই বছর আগে জমিটা কেনেন তিনি। বসতি খুবই কম আশেপাশে। খোলা-মেলা জায়গা, প্রাকৃতিক গাছ-গাছালিতে ভরা একটি জায়গা। নিজের এত বছর ধরে জমানো টাকা, নিজের গ্রামের বাড়ির জমি-সম্পদও যখন তাদের একমাত্র সন্তান ফাহিম এর বাইক এক্সিডেন্ট হওয়ার পর কোনো কাজে লাগলো না। দুটো পা হারিয়ে ১৫ দিন হাসপাতালে ভুগে মারা গেল তখন এই দম্পতির জীবনের সমস্ত আনন্দ চলে গিয়েছিল।

সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার বাসনা জন্ম নিল মনে। তাই তখন সমস্ত টাকা খরচ করে এই বিশাল জায়গাটা কিনে স্ত্রী সহ এখানে চিরদিন বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। শিক্ষকতা থেকে অবসর নেননি এখনও প্রফেসর। এই বিশাল জায়গাটির সঙ্গেই ছিল সেই কুয়ো। খুবই পুরাতন কুয়ো যে এটি তা দেখেই বোঝা যায়। কুয়োটা যখন তিনি প্রথম দেখেন তখন
এটির মুখ সিমেন্ট, ইট দিয়ে বন্ধ করা ছিল। ইট সিমেন্ট ও যে অনেক বছর আগে করা তাও বোঝা যাচ্ছে। যার কাছ থেকে জমিটা কিনেছেন লোকটা প্রফেসরের চেয়েও বয়স্ক। তাকে কুয়োটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলেন, এটি খুবই পুরোনো এবং গভীর কুয়ো। এটাকে ভরার চেষ্টা নাকি করেছিলেন তার দাদা অনেক বছর আগে। কিন্তু কিছুতেই এটা ভরছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ইট-সিমেন্ট লেপ্টে বন্ধ করে দেন এটি। এখানে অবশ্য পৈতৃক সূত্রেই জায়গাটার মালিকানা বদল হয়েছে কয়েক শ বছর ধরে। কুয়োটার সঠিক ইতিহাস তিনি নিজেও জানেন না ভালো করে।

তাদের বংশের কেউই এখানে স্থায়ী ভাবে থাকেননি কোনোদিন। এখন যেমন থাকার পরিবেশ এক সময় তার কিছুই ছিল না। এখান থেকে অদূরেই ছিল ঘন জঙ্গল। তবে লিজ নিয়ে অনেক পরিবারই দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করেছে।

বর্তমান সময়ে অবশ্য এখানে আধুনিক জীবনের কোন উপকরণেরই অভাব নেই। প্রায় এক বছর স্বাভাবিক ভাবেই থাকেন এখানে। বেশ কিছু পুরোনো ইট-সিমেন্টের ভাঙা-চোরা বাড়ি ছিল এখানে। লোক লাগিয়ে এগুলো ভেঙে ফেলেন তিনি। কিন্তু জমে যায় অনেক রাবিশ , যা কিনা আরো নোংরা করে ফেলে জায়গাটার একটা অংশ। তখনই কুয়োটার মুখ খোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কুয়োর মুখ ভাঙতে বেশ বেগ পেতে হয় লোকদের। পুরোনো হলেও খুবই মজবুত করে বন্ধ করা হয়েছিল ওটা।

সমস্ত রাবিশ ওটার ভেতর ফেলেও আলো জ্বেলে ওটার তল দেখতে পেল না কেউ। খুবই অবাক হলেন প্রফেসর। তবে কুয়োটা অনেক কাজের তা বোঝা গেল। যেহেতু বাড়িতে ছোট ছেলে মেয়ে, কোনো জন্তু নেই তাই আলগা একটি ঢাকনা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এইতো এরপর কেটে যায় কয়েক মাস। কুয়ো থেকে কোনো বিপদের আশংকাই করেননি তিনি। কিন্তু এলো সেই বিবাহ বার্ষিকীর রাত। ৭ বছরের বৃষ্টিকে তিনি এই গভীর কুয়ো থেকে একা উঠতে দেখলেন।

প্রফেসর এখন নিশ্চিত, এরপর থেকে যতগুলো মানুষ মারা গেল এর সাথে এই কুয়োটা আর সেই রাতের সম্পর্ক রয়েছে। তাই কুয়োর ভেতর নামার পর থেকে সমস্ত দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে উদয় হয়ে গেল। কিন্তু সেই ছায়া অবয়বটা এই কুয়োয় কী করে এলো, বৃষ্টির শরীরে ওটা প্রবেশ করলো কেন, কারা কিভাবে কেন এই কুয়োটার মুখ এমন পুরু ভাবে বন্ধ করে রেখেছিল এর উত্তর তিনি জানেন না। এর উত্তর জানার জন্য তার মন উশখুশ করছে। তাছাড়া তিনি কোথায় যাচ্ছেন, তার পরিণতি কী, এসব ভেবেও মন শঙ্কায় ভরে উঠছে। বৃষ্টি কোথায় গেল!

হঠাৎ আবার স্থির হয়ে গেল তার শরীর। অন্ধকার ফুঁড়ে ছড়াতে লাগলো লালচে আভা। তার সামনে ঘুরে বেড়াতে লাগলো অনেক গুলো নতুন দৃশ্য, অনেক গুলো অপরিচিত মানুষের মুখ। এই জায়গাটি ঘিরেই বয়ে যাচ্ছে সমস্ত দৃশ্য। তার অবচেতন মন বলছে কুয়োটা এখন তার মনে জমা প্রশ্ন গুলোর উত্তর তার সামনে হাজির করছে ধীরে ধীরে । সে জানতে পারবে এই প্রাচীন কুয়োর প্রাচীন অভিশাপের মূল কথা!…..
………………………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.