Sunday, June 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1053



ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি পর্ব-০৩

0

#ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি
৩য় পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

একই বিল্ডিং থেকে পর পর দুটো এমন মর্মান্তিক মৃ’ত্যু’র ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করলো সবখানে। প্রথমে তানিয়া আর রাকিব মিলে ধাক্কা দিয়ে ৮ তলার বেলকনি থেকে বৃষ্টির পিতা ফরহাদকে ফেলে দিয়ে হ’ত্যা করলো। তার মাস খানেক পরেই বৃষ্টিকে আশ্রয় দেয়া একি বিল্ডিং এর একি ফ্লোরের রেহানার তার সন্তানকে নিয়ে বেলকনি থেকে লাফিয়ে পড়ে আ”ত্মহ’ত্যা করলো। দুটো ঘটনার সাক্ষীই একজন ৭ বছরের বাচ্চা মেয়ে। এটা কাকতলীয় কিছু বলেই বিশ্বাস করলো অধিকাংশ মানুষ। বৃষ্টি নামের ফুটফুটে মিষ্টি মেয়েটার প্রতি সহানুভূতি অনুভব করলো।

তবুও কেউ কেউ এটাও চুপিসারে বলতে লাগলো এই ছোট মেয়েটাই অপয়া। তাকে তার নানা বা দাদার বাসাতেই পাঠিয়ে দেয়া উচিত। সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। স্ত্রী এবং পুত্রের শোক ভালোমতো কাটেনি ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলমের। বৃষ্টিকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটেই থাকেন তিনি। বৃষ্টি একদিন বলল, ‘কাকা আমার এই বিল্ডিং এ থাকতে ভালো লাগে না, শুধু ভয় ভয় করে! আমি আমির দাদুর বাড়িতে গিয়ে থাকবো।’ খোরশেদ কিছুটা অবাক হলো। সে যতটুকু জানে বৃষ্টির দাদুর নাম নুরুল ইসলাম। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার এই দাদু কোথায় থাকেন?’

এরপর বৃষ্টি বলতে লাগলো প্রফেসর আমির সম্পর্কে যতটুকু সে জানে। বৃষ্টি মেয়েটাকে আজকাল অসহ্য লাগছিল তার। কিন্তু হঠাৎ করে তাড়িয়েও দিতে পারছিলেন না। ভালো করে একটু খোঁজ করতেই প্রফেসর আমির হোসেনের বাড়ির সন্ধান পেলেন। এও জানতে পারলেন রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল লোকটার সাথে বৃষ্টির বাবার। পুলিশের সাহায্য নিল খোরশেদ। পুলিশ বৃষ্টিকে অনুরোধ করলো, আপন রক্তের কারো কাছে থাকাটাই তোমার জন্য এখন ভালো হবে, দূর সম্পর্কের মানুষের কাছে না থেকে।

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো বৃষ্টি। জেদ করলো আমির দাদুর বাড়িতেই সে যাবে। দাদু তাকে অনেক ভালোবাসে। অগত্যা বৃষ্টিকে আর বাধা দিল না পুলিশ। খোরশেদকে অনুরোধ করলেন পৌঁছে দিতে। তার বেশ কিছু পোশাক একটা ব্যাগে ভরে একটা গাড়ি রিজার্ভ করে খোরশেদ আলম প্রফেসর আমির হোসেনের বাড়ির দিকে রওনা হলেন।

প্রফেসর আমির হোসেনের বাড়ির পেছনের অংশ: কুয়োটার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছোট হাত আর ভেসে আসা হাসি যে ফরহাদের মেয়ে বৃষ্টির তাতে প্রফেসরের কোনো সন্দেহ নেই। তাকে খুব করে টানছে একটা মায়া। এগিয়ে গেলেন তিনি কুয়োটার আরেকটু সামনে। জানেন মেয়েটার হাত শুধু স্পর্শ করতে হবে তাকে এরপর ওই হাতটাই তাকে টেনে নিয়ে যাবে কুয়োর তলে। চোখের সামনে ভেসে উঠবে এক অনন্য নতুন জগৎ! তিনি ডান হাতটা উঁচু করলেন, ধীরে ধীরে এগিয়ে দিতে লাগলেন সামনের দিকে।

‘হচ্ছেটা কী এখানে?’

চমকে পেছনে তাকালেন আমির হোসেন। তার স্ত্রী আশা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমির হোসেনকে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, ‘রোজ রাতে এই কুয়োটার কাছে আসার কী দরকার পড়ে তোমার বুঝি না! বুড়ো হয়ে যাচ্ছ! কোনো দুর্ঘটনা যদি ঘটে!’

হুস ফিরে এলো প্রফেসরের। এক মুহূর্তে অনুধাবন করতে পারলেন কী করতে চলেছিলেন তিনি। তার স্ত্রী এসময় না এলে মহা ভয়ানক এক পরিস্থিতির শিকার হতেন তিনি। কুয়োটার ভেতরে এমন কিছু একটা আছে যা মানুষের চিন্তা শক্তিকে লোপ করিয়ে প্রভাবিত করে যা খুশি তাই করাতে পারে। এটাই তাকে এখানে টেনে এনেছিল। স্বপ্নেও ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা আছে ওটার। বিব্রত হয়ে দ্রুত ঢেকে দিলেন কুয়োটা। এরপর স্ত্রীর পিছু পিছু ঘরে ফিরে গেলেন।

পরদিন টিভিতে যে খবর দেখলেন তাতে তার শরীরের সব রক্ত যেন জমে গেল। বৃষ্টিকে দেখাচ্ছে টিভিতে। বৃষ্টিকে যে পরিবার আশ্রয় দিয়েছিল সে পরিবারের কর্ত্রী তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে বেলকনি থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে মারা গিয়েছে। স্বামীকে ধোকা দেয়ার পাপবোধ থেকে নাকি আত্মহত্যাটা করেছেন। তার মন আবার বলে উঠল ঘটনাটি কাকতলীয় নয়। সেরাত, বৃষ্টি আর এই প্রাচীন কুয়োটার সাথে এর কোনো না কোনো সম্পর্ক রয়েছেই। এরপর সপ্তাহ খানেক কেটে গিয়েছে।

খোরশেদ আলম ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললেন। চিৎকার করে বৃষ্টিই দেখিয়ে দিল প্রফেসরের বাড়িটা। তার চোখ-মুখ থেকে আনন্দ যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। এত খুশি হতে মেয়েটাকে অনেক দিন দেখেনি খোরশেদ। কেমন একটা মায়া মায়া অনুভব করলো সে মেয়েটার প্রতি। বড় গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো দুজনেই।

কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে রীতিমতো দম বন্ধ হয়ে এলো প্রফেসর আমির হোসেনের। বৃষ্টি দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সামনে! স্বপ্ন দেখছে নাকি সে!বৃষ্টির মুখ আনন্দে বিস্তিত হয়ে আছে। সে ‘দাদু!’ বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। হতভম্ব ভাব কেটে গেল প্রফেসরের। মেয়েটার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ের এক মুহূর্ত নিজেকে তিরস্কার করলেন, এই মিষ্টি মেয়েটাকে নিয়ে কিনা কী সন্দেহ করেছিলেন তিনি! এর মধ্যে বিন্দুমাত্র দোষ থাকতে পারে না! চুমু খেলেন বাচ্চা মেয়েটির কপালে, তুলে নিলেন কোলে।

পরিচিত হলেন ইঞ্জিনিয়ার লোকটার সাথে। লোকটাকে দেখেই চিনেছিলেন তিনি। ইনিই আশ্রয় দিয়ে এসেছে এতদিন বৃষ্টিকে। মর্মান্তিক ট্রাজিডি বয়ে গেছে লোকটার উপর দিয়ের। লোকটা সমস্ত কথাই খুলে বললেন প্রফেসরকে। প্রফেসর আর তার স্ত্রী ছাড়া এত বড় বাড়িতে আর কেউ থাকে না। বৃষ্টির দায়িত্ব নিতে এক মুহূর্ত ভাবলেন না প্রফেসরের স্ত্রী নাজমা খাতুন। কোলে নিয়ে আদর করতে করতে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন তিনি।

খোরশেদ সাহেব বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। এক মুহূর্ত মেয়েটার জন্য হুহু করে উঠল তার হৃদয়টা। এখন তার আপন বলতে তার কেউ রইলো না। রেহানার শেষ ইচ্ছা ছিল এই মেয়েটাকে দত্তক নেয়া। সিদ্ধান্ত নিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে চেষ্টা করবে মেয়েটাকে দত্তক নিতে।

বৃষ্টির সাথে গল্প করে খেলে-ধুলেই সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় পার করে দিলেন প্রফেসর। সন্ধ্যার বেশ খানিকটা পর প্রফেসর রিডিং রুমে বসে ছিলেন। হঠাৎ তার স্ত্রী ব্যগ্র হয়ে ছুটে এলেন, ‘বৃষ্টিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি, দেখেছ ওকে?’

বুকটা খচ করে উঠলো প্রফেসরের। মুখ তবুও শান্ত করে বললেন, ‘দেখছি দাড়াও!’ ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেলেন তিনি বাড়ির পেছনে। আজ হয়তো পূর্ণিমা রাত! চারদিকে জ্যোৎস্নায় ফকফকে হয়ে আছে। তিনি দূর থেকেই দেখতে পেলেন একটা বাচ্চা মেয়ে বসে আছে কুয়োর একেবারে কিনার ঘেষে। তিনি ছুটে গেলেন সেখানে, ‘বৃষ্টি, তুমি এখানে কী করছ! চলে এসো বলছি ! পড়ে যাবে!’

খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা। শরীর কেঁপে উঠলো প্রফেসরের। হাসিটা অদ্ভুত আর বাচ্চা সুলভ নয়। আহ্বান করলো বৃষ্টি তাকে , ‘এদিকে আসো দাদু, বসো আমার পাশে!’

এগিয়ে গেলেন তিনি বৃষ্টির কাছে। অসতর্ক ভঙ্গিতে ঝুকে পড়লো বৃষ্টি কুয়োর দিকে। হেসে বলল, ‘ওখানে তাকালে শুধু আঁধার দেখা যায়, দেখেছ তুমি? আসলে কী ওখানে শুধুই আঁধার আছে! সেখানে যে কত রহস্য লুকিয়ে আছে তা তোমার জানতে ইচ্ছা করে না দাদু!’

বাচ্চাসুলভ কথা এগুলো নয়। কৌতূহলী দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। মেয়েটার চোখ দুটো এত লাল লাগছে কেন!

‘তুমি এই কুয়োর রহস্য জানতে চাও না দাদু! চলো আজ তোমাকে এর রহস্য দেখিয়ে নিয়ে আসি! একটি হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। কপাল ভিজে উঠছে বৃদ্ধ লোকটার। সে আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি?’

খিলখিল করে আবার হেসে উঠলো মেয়েটা হাত-পা ছুড়ে। ‘তুমি আমায় চেন না বুড়ো!’

কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে রাখলেন আমির হোসেন। তারপর উচ্চারণ করলেন, ‘সেরাতে কুয়োয় পড়ে গিয়েছিল বৃষ্টি! আমি ছুটে এলাম। এরপরই কুয়ো থেকে উঠে এলে তুমি। আমি এতদিন ভাবতাম এসব ভুল! মনের বিকৃত ভুল চিন্তা। কিন্তু সব সত্যি! তুমি বৃষ্টি নও! তার রূপ ধরে উঠে আসা অন্য কেউ! কী চাও তুমি! এখানে কেন আবার ফিরে এলে!’

‘কী বলছ এসব তুমি পাগলের মতো দাদু! মনে যা আসছে তাই! আমিই বৃষ্টি! আমি এখানে আসবো না তো কোথায় যাব। নিজের ঘর ছেড়ে বুঝি দূরে থাকতে ভালো লাগে! দেখ না তোমার কাছে ফিরে আসার জন্য আমি কী কাণ্ড ঘটালাম! যারাই আমাকে বাঁধনে আটকাতে চেয়েছে কী পরিণতি হয়েছে তাদের!’

বিস্ফোরিত হয়ে উঠল আমির হোসেনের চোখ জোড়া। নিজের মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা কী একটা জটিল সমস্যা যেন সমাধান হয়ে গেল কয়েক মুহূর্তে। মন বলে উঠলো, তুমি যা সন্দেহ করেছিলে তাই। মেয়েটাই সমস্ত কিছুর মুলে। সে শিশুর পবিত্র চেহারার পেছনে লুকিয়ে থাকা এক পিশাচি। আর মেয়েটার মূলে রয়েছে প্রাচীন কুয়ো। মূলের সন্ধানে যাও! কুয়োর ভেতর নামো। ভেদ করো সমস্ত রহস্য!

মেয়েটার চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে লালচে আভা। ‘এসো দাদু! ভয় কিসের!’ মাথার পেছনে ঠাণ্ডা শীতল একটা স্পর্শ অনুভব করলেন বৃদ্ধ প্রফেসর। হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে বৃষ্টির মুখ। শক্ত করে চেপে ধরলো সে বৃদ্ধের হাত।

জেল খানার গরাদের পেছনের একটা ঘরে শুয়ে আছে তানিয়া। জগতের সমস্ত বিষণ্ণতা এসে ভর করে আছে তার চোখে মুখে। এক রাতেই যে এভাবে তার সুন্দর সোনার সংসার তছনছ করে কেউ তাকে ধাক্কা মেরে নরকে ফেলে দিতে পারে কয়েক মাস আগে কোনো জ্যোতিষী এই ভবিষ্যৎবাণী দিলেও সে হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু এখন তা বাস্তব! নিজের স্বামী ফরহাদের মৃত্যু এখনো মেনে নিতে পারছে না সে। তার উপরে ফরহাদকে খুনের অভিযোগে তাকেই ধরে আনা হয়েছে! ভাতৃসম রাকিব আর তাকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে অবৈধ সম্পর্কের গুঞ্জন। এর কোনো মানে হয়!

বৃষ্টির সেরাতে কী হয়েছিল! নিজের আপন মেয়ে কেন মিথ্যা বলে তাদের এত বড় সর্বনাশ করবে! এইসবই ভাবছিল শুয়ে শুয়ে সে। এমন সময় একটা ঠাণ্ডা বাতাসের স্রোত বয়ে গেল তার শরীরের উপর দিয়ে। চমকে উঠে বসলো সে। হালকা ডিম লাইটের আলোতে গরাদের ওপাশে একটা মানুষের অবয়ব দেখতে পেল সে। কে? নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। গরাদ ভেদ করে লোকটার শরীর ঢুকে এলো ঘরের ভেতরে।

পুরো শরীর জমে গেল তার লোকটা আরেকটু তার কাছে এগিয়ে আসতে। ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। ওর সারা শরীর রক্তে চুবচুব করছে। একটা হাত মচকে উল্টো দিকে ঘুরে আছে, মাথা থেকে সরে ঝুলে আছে তার ঘিলু! ফরহাদের যে লাশ সেদিন রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছিল ওটাই যেন কবর খুঁড়ে উঠে এসেছে! থরথর করে কাঁপছে সে। চিৎকার করতে পারছে না। ফেসফ্যাসে শব্দ বেরিয়ে এলো ফরহাদের কণ্ঠ ফুঁড়ে, ‘কেমন আছ তুমি তানিয়া! আমাকে খুন করে বেশ আরামে ঘুমাচ্ছ দেখি, তোমার খুনি বন্ধুকে সাথে নিয়ে ঘুমালে না কেন? কী দোষ করেছিলাম আমি! কেন তুমি ধোকা দিলে আমায়! কেন তোমরা দুজনে মিলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বেলকনি থেকে ফেলে খুন করলে!’

‘বিশ্বাস করো ফরহাদ, এসব কিছুই সত্যি না!’ সামান্য জোর এসেছে তানিয়ার কণ্ঠে।

‘চুপ! তুই বিশ্বাসঘাতিনী। এখন তুই আমার সঙ্গী হবি মৃত্যুর পরের এই নিঃসঙ্গ জীবনে!’

আর কোনো কথা বলতে পারলো না তানিয়া। ফরহাদ মচকানো হাতটা একটানে সোজা করে শক্ত করে চেপে ধরলো তার গলা। ছটফট করতে লাগলো সে। হাত-পা ছুড়তে লাগলো, পিপাসা গলা শুকিয়ে এলো, ফুসফুস ভরে এলো শূন্যতায়। একসময় নিস্তেজ হয়ে গেল তার শরীর।

ধপাধপ শব্দ শুনে ছুটে এলো এক কনস্টেবল। দ্রুত গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো। বিস্মিত হয়ে দেখলো আতঙ্কে বড় বড় হয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটার খোলা দুই চোখ, মুখ হা হয়ে খোলা। বেশ কিছুক্ষণ লাগলো তার এটা বুঝতে যে মেয়েটা মারা গেছে।

সেরাতে পুরুষদের কয়েদখানা থেকে খবর এলো আরেক কয়েদির দম বন্ধ হয়ে মরার খবর। ছেলেটার নাম রাকিব। ফরহাদের খালাতো ভাই এবং তার হত্যা মামলার ২য় আসামী।

চুপচাপ নিজের ঘরের বিছানায় বসে আছে ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলম। বৃষ্টিকে আজ প্রফেসর আমির হোসেনের ওখানে রেখে আসার পর থেকে বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে। জানেন ঘুম আসবে না। তবুও একটু চেষ্টা করবেন ঘুমানোর। এমন সময় তার মনে হলো একটা বাচ্চা ছেলে যেন দৌড়ে গেল দরজার সামনে দিয়ে। কম্পিত বুক নিয়েই বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। আৎকে উঠলেন তিনি! চোখে ভুল দেখছেন নাকি! ঝাপসা আলোতে দেখা যাচ্ছে একটা নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে বেলকনিতে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি সেদিকে।……………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . . .
.
.

ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি পর্ব-০২

0

#ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি
২য় পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

ফরহাদকে খুনের অভিযোগে থানায় নিয়ে যাওয়া হলো তার স্ত্রী তানিয়া এবং খালাতো ভাই রাকিবকে। পরকীয়া প্রেম, তা থেকে নৃশংস খুন, একটি বাচ্চা মেয়ের করুণ খুনের সাক্ষী। পুরো বিষয়টাই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল সবার মাঝে। সবাই যা জানে তার চেয়ে বেশি কিছু জানতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। রিপোর্টাররাও তাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো বৃষ্টির সাক্ষাৎকার নিতে। মেয়েটার বয়স ভুলে ভালো শিরোনামের খোঁজে করে চলল আজব সব প্রশ্ন। তার যেহেতু কোনো অভিভাবক ঢাকায় নেই , প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের মানুষরাই তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে রাখলো। বিরক্ত হলো তারা মেয়েটাকে এমন উৎপাত করায়। ঝগড়া, বকা-বাজি করে দূর করতে লাগলো সাংবাদিক আর অতি উৎসাহী মানুষ দের।

ফরহাদের ফ্ল্যাটের ঠিক বিপরীত পাশের ফ্ল্যাটে বাস করা ইঞ্জিনিয়ার খোরশেদ আলম আর তার স্ত্রী রেহানার সাথে সুসম্পর্ক ছিল বৃষ্টির পরিবারের। তারা কারো অনুরোধ ছাড়াই এসব ঝামেলা যতদিন না মিটছে বা বৃষ্টির আত্মীয়ের খোঁজ না পাওয়া যাচ্ছে ততদিন বৃষ্টিকে পালন করার দায়িত্ব নিলেন। এরমধ্যে বৃষ্টির বাবা ফরহাদ এবং মা তানিয়ার গ্রামের বাড়ির আত্মীয়রা খবর পেয়ে ছুটে আসে ঢাকায়। তারা বৃষ্টিকে তাদের সাথে নিয়ে যেতে চাইলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। সে জানায় কিছুতেই এই বিল্ডিং ছেড়ে যাবে না সে কোথাও। রেহানাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, বলে ‘আমি তোমার সাথে থাকবো কাকি! ওদের কাছে যাবো না, প্লিজ!’ এত মিষ্টি একটা মেয়ে, এক অদ্ভুত মায়া আর টান অনুভব করে রেহানা মেয়েটার প্রতি।

সে বৃষ্টির আত্মীয়দের অনুরোধ করেন মেয়েটার মানসিক ধাক্কা সামলাতে সময় লাগবে। এখন কিছুদিন এখানেই থাক। রেহানার একমাত্র ছেলে রাব্বির সাথেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব আছে বৃষ্টির। দুজনে একি স্কুলে পড়ে। মেয়েটা যেহেতু নিজের অধিকাংশ সময় শহরে কাটিয়েছে, আত্মীয়দের প্রতি টান সৃষ্টি হয়নি। তাই এই অবস্থায় অপরিচিত কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না! তারাও আপত্তি করেনি। উল্টো তাদের দেখে মেয়েটা ভয় পেয়ে দূরে সরে গেল বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে গেল। এরপর থেকে রেহানার পরিবারের সাথেই থাকতে শুরু করে বৃষ্টি। অন্যান্য ফ্ল্যাটের সবার ভালোবাসার নজরও রইলো ওর উপর। পুলিশি তদন্ত, আইনি মামলা থেকে ছোট এই মেয়েটিকে দূরে রাখার ব্যবস্থা করে চলল তারা।

প্রায় এক মাস কেটে গেল। সমবয়সী ছেলে রাব্বির সাথে ঘরেই খেলে, টিভি দেখে, রেহানার কাছে নানান গল্প শুনে দিন কাটায় এখন বৃষ্টি। এরমধ্যে ভুল করেও কখনো বাবা-মা বা রাকিব কাকার প্রসঙ্গ তোলেনি সে। একদম স্বাভাবিক শিশুর মতো আচরণ করছে। এতে স্বস্তিই অনুভব করলেন খোরশেদ আর রেহানা। রোজ রাতে ডান পাশে রাব্বি আর বাম পাশে বৃষ্টিকে নিয়ে গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়ান রেহানা। মাঝেমধ্যে রাব্বি আর বৃষ্টির আড়ালে ফিসফিস করতে দেখা যায় খোরশেদ আর রেহানাকে। তারা জটিল একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা ভাবছেন। যদিও বুঝতে পারছেন না। এরমধ্যে আইনি ঝামেলা থাকবে কতটুকু, বৃষ্টির নানা বা দাদার বাড়ির আত্মীয়রা কতটুকু সমর্থন দেবেন বা এত দ্রুত সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে কিনা। বৃষ্টিকে ভালোবেসে ফেলেছে তারা।

তারা নিজেদের ২য় সন্তান হিসেবে দত্তক নিতে চান মেয়েটিকে। একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবার না পেলে মেয়েটার সারা জীবন যে নষ্ট হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যত বড় হবে সে তত গাঢ় ভাবে বুঝতে পারবে তার অস্বাভাবিক অনাথ হওয়ার কারণ। দিন কাটতে লাগলো।

একরাত। রাব্বি আর বৃষ্টিকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে রেহানা। কথাচ্ছলে রেহানা বৃষ্টির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ আমাদের তোমার কেমন লাগে আম্মু ?’

হাসতে হাসতে বৃষ্টি জবাব দিল, ‘অনেক অনেক ভালো।’

‘তুমি সারা জীবন আমাদের সাথে থাকতে চাও? রাব্বির সাথে খেলবে, এক স্কুলে পড়বে? তোমাকে আমরা তোমার বাবা-মার মতো করে বড় করে তুলবো।’

বৃষ্টি এক মুহূর্তে চুপসে গেল। রেহানা বৃষ্টির মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল। বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ তোলা ভুল হয়েছে হয়তো। এক মুহূর্তে মেয়েটার পুরো মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠোঁট যেন ক্রোধে কাঁপছে। সে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমি কোনো বন্ধি না যে কারো সাথে সারাজীবন থাকবো! অনেক দিন বন্ধি থেকেছি আর নয়! তোমরা আমাকে আর বন্ধি করে রাখতে পারবে না!’

ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল রেহানা এই সামান্য কথায় মেয়েটার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। এক মুহূর্তের জন্য রেহানার মনের ভুল হলো মেয়েটার চোখ দুটো লাল আকার ধারণ করে জ্বলছে। বৃষ্টি বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে অন্য ঘরে চলে গেল। রেহানা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এমন আচরণ বৃষ্টিকে কখনো করতে দেখেনি সে এত দিনে। রাব্বি ঘুমিয়ে পড়েছিল তাকে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে বৃষ্টির পিছু নিল সে। বৃষ্টি এসে দাঁড়িয়েছে বেলকনিতে। কেমন একটা অজানা ভয় কাজ করল হঠাৎ রেহানার মনে। এখনো বাড়ি ফেরেনি খোরশেদ। ঘড়িতে ১০টা ৩০ বাজে।

বৃষ্টির একদম পেছনে এসে দাড়ালো রেহানা। আলতো করে মেয়েটার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, ‘ রাগ করো না আম্মু, আমি এমনিতেই বলছিলাম, তুমি যদি না চাও আমরা তোমাকে আটকে রাখবো না। তুমি যেখানে চাও সেখানেই যেতে দেব তোমাকে।’

বৃষ্টি এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ধীরে ধীরে ঘাড় সামান্য বাঁকা করে রেহানার দিকে তাকালো। তার চোখে এমন দৃষ্টি দেখে রেহানার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। বৃষ্টির দুচোখ ঠিকরে বের হচ্ছে লাল আভা। কি হিংস্র লাগছে এইটুক বাচ্চা মেয়েটাকে। কয়েক পা পিছিয়ে এলো রেহানা আৎকে। বৃষ্টি খিলখিল করে হেসে উঠলো, এরপর বিদ্রুপ করে বলতে লাগলো, ‘বিশ্বাসঘাতক! তুমি কী ভেবেছ, তোমার সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না!’

অসাড় হয়ে এলো রেহানার পা। এই কণ্ঠ কী আসলেও বৃষ্টির কিনা বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি বলে চলল, ‘তুমি একটা ধোকাবাজ, নষ্টা মহিলা! রাব্বি আসলে তোমার ছেলে কিন্তু ওর বাবা খোরশেদ কাকা না। অন্য কেউ! তুমি এতদিন এটা লুকিয়ে গেছ! তোমার সম্পর্ক আছে অন্য এক পুরুষের সাথে। তুমি ধোকা দিয়েছ নিজের স্বামী আর সন্তানকে। আজ রাতেই তোমার স্বামী আর ছেলে জানতে পারবে সমস্ত কথা। তোমাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না ওরা! আমাকে তুমি সারাজীবন বন্ধি করে রাখবে,না! দেখ কী মজা হয় এখন!’

এইসব কথা একটা ৭ বছরের বাচ্চা মেয়ের মুখ থেকে বের হতে পারে তা স্বচক্ষে কেউ না দেখলে বিশ্বাস করবে না। বৃষ্টির চোখ থেকে বের হওয়া লাল আভা দেখার পর থেকেই একটা ঘোরে চলে গেছে রেহানা। তার চিন্তা করার শক্তি লোপ পেয়েছে, চলার বা কথা বলার শক্তিও তার নেই। হতভম্ব হয়ে বিস্ফোরিত চোখ মেলে দাঁড়িয়ে রইলো সে। রেহানা অনেক কষ্টে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি ধোকাবাজ! রাব্বি, খোরশেদের ছেলে নয়! ও আমার অবৈধ সন্তান! এমন কথা তুমি কী করে বলতে পারলে বৃষ্টি আম্মু! ‘

বৃষ্টি এগিয়ে এলো তার আরো কাছে, ফিসফিস করে বলল, ‘ এটাই সত্যি কাকি, তুমি ভাবো, বিশ্বাস করো। এখনই তোমার স্বামী চলে এসে সব জেনে যাবে। তোমার সন্তান বাকি জীবন তোমাকে অভিশাপ দেবে। ভেবে দেখ তোমার এখন কী করা উচিত! লজ্জা, লজ্জা!’

‘কিন্তু সে কী করে জানবে, তুমি কী করে জানো এসব, তুমি যা বললে তাতো আমি নিজেই জানতাম না! আমি কী সত্যিই নষ্টা আর ধোকাবাজ!’ ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল রেহানা। তার চিন্তা শক্তি ফিরে আসছে। বৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠল, বলল, ‘ তুমিই নষ্টা, ধোকা দিয়েছ স্বামীকে এতগুলো বছর! তুমিই তাকে জানাবে সত্যিটা! এখন তোমার যা করণীয় তা কর!’

‘কী করণীয় আমার!’

‘সম্মান বাঁচাও!’

ঘুমের ঘোরে মানুষ যেভাবে হাঁটে সেভাবে হেঁটে রিডিং টেবিলের কাছে চলে এলো রেহানা। একটা কলম আর খাতা তুলে নিল সামনে। টেবিলের দিকে ঝুঁকে ৫মিনিট সময় ব্যয় করে কিছু একটা লিখল। কলম দিয়ে ওটা চাপা দিয়ে হেটে হেটে ফিরলো আবার বেলকনিতে। হঠাৎই ঘাড়ের পেছনে শীতল একটা বাতাস অনুভব করলো সে। চোখের সামনে ভেসে উঠল রাব্বি, খোরশেদ আলমের মুখ,আর ফরহাদের লাশের ছবি। বিড়বিড় করে বললেন, ‘পাপ করেছি আমি, এর প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে। আমি নষ্টা, ধোকাবাজ! আমার শাস্তি চাই!’

খিলখিল করে হেসে উঠলো বৃষ্টি। আর কিছু ভাবলো না রেহানা। এক মুহূর্তে ছুটে গিয়ে বেলকনির রেলিং টপকে ঝাঁপিয়ে পড়লো রাস্তায়। মুখ থুবড়ে পড়লো রাস্তায় তার শরীরটা কয়েক মুহূর্তেই। হয়তো কয়েক মিনিট প্রাণ ছিল তার দেহে। ছটফট করলো শরীরটা। এরপরই মারা গেল সে। মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে রয়েছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে রাস্তাটা। খুব বেশিদিন হয়নি এই রাস্তাটাই শুষে নিয়েছিল সেদিন ফরহাদের তাজা রক্ত। সময়টাতে মানুষের চলাচল বেশ ভালোই ছিল। সকলে চমকে উঠলেন ভারী কিছু পড়ার শব্দে। ছুটে আসলেন লাশটার কাছে। এমন বীভৎস মৃত্যুর সাক্ষী হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন মুহূর্তেই লোকগুলো। তবুও লাশটা ফেলে পালিয়ে যাওয়া যায় না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সবাই।

সেখানে দাঁড়িয়ে হেসেই চলেছে বৃষ্টি। যেন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। মানুষকে কত সহজে মিথ্যা বিশ্বাস দিয়ে প্রভাবিত করা যায়! এমন কী নিজেকেও পুরোপুরি বিশ্বাস করে না সে। তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে রাব্বি। ঘুম থেকে জেগে কী ঘটছে বুঝতে পারেনি, চোখ ডলতে ডলতে অবাক হয়ে বৃষ্টির হাসি দেখছে। মা কোথায়!

বৃষ্টি ঘুরে তার দিকে তাকাতেই ভয়ে কুকড়ে উঠলো রাব্বি। একই চেহারা হলেও এযে তার চিরচেনা খেলার সঙ্গী বৃষ্টি নয় এক মুহূর্তে বুঝে ফেলল সে। বৃষ্টি তার দিকে এগিয়ে এলো। বলল, ‘একটা মজার জিনিস দেখবে রাব্বি! বারান্দার রেলিং দিয়ে উকি দাও, দেখ তোমার মা কী করছে!’ রাব্বি বিস্মিত হলো। প্রায় ঠেলতে ঠেলতে তাকে বেলকনিতে পাঠাল বৃষ্টি। নিজে আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো। মা-বাবার করা নিষেধ আছে ছোটদের বেলকনিতে যাওয়া যাবে না। বৃষ্টি বলল, ‘রেলিং ধরে উঁচু হয়ে নীচে উকি দাও, মজার একটা দৃশ্য দেখবে।’ সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে সে, মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রেলিং এর কাছে যেতে তার ভয় করছে। বৃষ্টি ধমকে উঠলো। কিছুটা এগিয়ে রেলিং ধরে উঁচু হয়ে ঝুকে দেখার চেষ্টা করলো সে রাস্তাটা।

নিচ থেকে একটা লোক উপরে তাকিয়েই অসতর্কভাবে ছোট ছেলেটাকে রেলিং এ উঠতে দেখলো। চেঁচিয়ে উঠলো সে, ‘এই ছেলে পড়ে যাবে তো!’ বাকিরাও লাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে উপরে তাকালো। অনুমান করলো ওখান থেকেই লাফিয়ে পড়েছে মেয়েটা। চিৎকার করলো একত্রিত হয়ে সবাই, ‘এই ছেলে! কী করছো তুমি! নীচে নেমে মায়ের কাছে যাও।’

বৃষ্টি হেসে উঠলো আবার। বলল, ‘মায়ের কাছে যাও খোকা!’ পরমুহূর্তেই রাব্বি গলার পেছনে শীতল একটা হাতের স্পর্শ পেল। ওটার ধাক্কায় তাল হারিয়ে ফেলল সে। পা উঠে এলো রেলিং এর খাঁজ থেকে উপরে, মাথা ঝুকে পড়তে লাগলো সামনে। রেলিং টপকে নীচে নামতে লাগলো তার ছোট শরীর। রাস্তার লোকগুলো হতভম্ব হয়ে ছুটে গেল ছেলেটাকে ধরার জন্য। কিন্তু তার আগেই রাস্তায় আছড়ে পড়ল ছেলেটির শরীর! থেতলে গেল ছোট্ট শরীরটা! আর্তনাদ আর হৈচৈ এ অস্থির হয়ে উঠলো রাস্তা, পরিবেশ। ছুটে আসতে লাগলো মানুষ। যারা দুটো ক্ষত বিক্ষত লাশ দেখল তারা যে এরপর কতরাত ঘুমাতে পারেনি এর হিসাব মেলা অসম্ভব! এতই বীভৎস দেখালো ওগুলোকে।

নিজের স্ত্রী আর একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে উন্মাদের মতো ছটফট করে কাঁদতে লাগলো খোরশেদ আলম। সমস্ত রাগ এসে পড়ছে ছোট ওই মেয়েটার উপর। বৃষ্টি মেয়েটাই অপয়া! কিন্তু মেয়েটার উপর রাগ করে কী লাভ! ওর যে কোনো দোষ নেই ওদের মৃত্যুর পেছনে তাও বুঝতে পারছে সে। এইটুকু বাচ্চা মেয়ে জীবন, মৃত্যুর কী বোঝে! পুলিশ অবশ্য স্বীকার করে নিয়েছে এটা একটা আত্মহত্যা। লাশ দুটো ময়না-তদন্ত করতে পাঠানোর পরই পুলিশ তল্লাশি চালিয়েছে পুরো ফ্ল্যাটটায়। সহজেই খুঁজে পেয়েছে সুইসাইড নোট।

কিন্তু যেকারণে রেহানা আত্মহত্যা করেছে তা অবিশ্বাস্য লাগছে খোরশেদের কাছে। মেয়েটা শুধু তার স্ত্রী নয়, কলেজের বান্ধবী, প্রেমিকা এরপর এই সম্পর্কে জড়িয়েছে তারা। রেহানা তাকে ধোকা দেয়ার চেয়ে নিজের মৃত্যুকে আগে বেছে নিত। সে কিনা সম্পর্কে জড়াবে অন্য কোনো পুরুষের সাথে! রেহানা আত্মহত্যা পত্রে লিখেছে, ‘তার অগোচরে আরেকজন পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ায় সে অনেক বছর আগে। আবেগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তার গর্ভে আসে রাব্বি। নিজের ভুল বুঝতে পারে সে হঠাৎ। কিন্তু খোরশেদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার ভয়ে এতদিন জানায়নি সে। কিন্তু মানসিক চাপ আর পাপবোধ তাকে গিলে খাচ্ছে। তাই আত্মহত্যা করছে সে। রাব্বি তাদের সন্তান নয়। এ মুখ কাউকে দেখাতে পারবে না সে।’

হাতের লেখা যে রেহানার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খোরশেদ মনে-প্রাণে জানে এসব মিথ্যা। কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই এটা বিশ্বাস করতে রাব্বি তার আর রেহানার সন্তান। কিন্তু রেহানা এমন টা কেন লিখবে! কেন আত্বহত্যা করবে জীবন নিয়ে এত আশাবাদী থাকা মেয়েটা! ছোট্ট রাব্বি কী দোষ করেছিল!

বৃষ্টি জানায় সে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ রেহানা কাকীর কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় তার। উঠে দেখে রাব্বিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে কাকি। বলছে , ‘ ওকে বলিস আমায় ক্ষমা করে দিতে।’ এরপরই ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে রেহানা বেলকনি থেকে। বৃষ্টি কিছু বুঝে উঠার আগেই তার পিছু পিছু ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে রাব্বিও। পুলিশ অনেক খুঁজেও আর কোনো নতুন তথ্য জোগাড় করতে পারে না। ছোট মেয়েটার কথা অবিশ্বাস করারও কিছু নেই।

প্রাচীন কুয়োটার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রফেসর আমির হোসেন। রাত নেমে এসেছে, কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছে তার মনের ভেতর। এই কুয়োটার ভেতরে যেন লুকিয়ে রয়েছে অনেক রহস্য। যার কিছুই তিনি জানেন না। তার মন বলছে কুয়োর ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়লেই কেবল জানতে পারবেন সেই রহস্যটা কী! আজকাল প্রায় রাতেই দুঃস্বপ্নে এই কুয়োটাকে দেখতে পান তিনি। কেউ যেন তাকে ডাকছে এর ভেতর থেকে, বলছে ভেতরে নেমে আসো। তিনি ভেতরে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেন। তখনই আচমকা ঘুম ভেঙে যায় তার। ধড়ফড় করে জেগে ওঠেন তিনি।

ফরহাদের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বৃষ্টির সেরাতে কুয়ো থেকে উঠে আসার বিষয়টাও মাথা থেকে যায়নি। এরমধ্যে অবশ্য বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে ওই বিল্ডিং এর যে পরিবারটি তাকে আশ্রয় দিয়েছেন তারা কারো সঙ্গেই দেখা করতে দিচ্ছে না মেয়েটিকে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানান কৌতূহলী মানুষ নাকি প্রায়ই মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার জন্য তাদের বিরক্ত করেন। প্রফেসর বুঝতে পারছেন পরিবারটি যা করছে বৃষ্টির ভালোর জন্যই করছে। তাই আর বিরক্ত করলেন না পরিবারটিকে। কী দরকার মেয়েটার জীবনে ঘটা ভয়াবহ ঘটনাটা খুঁচিয়ে তার সামনে বারবার উপস্থিত করা। হয়তো মেয়েটা সম্পর্কে তার মনের সন্দেহ অমূলক! কিন্তু তাকে বেশ বিরক্ত করছে এই কুয়োটা! একটা নেশার মতো টানছে তাকে।

তিনি ধীরে ধীরে কুয়োটার আরো কাছে এগিয়ে গেলেন, উকি দিয়ে তাকালেন অন্ধকার গহ্বরের ভেতর। একটা ছোট হাত যেন সেই মুহূর্তে বেরিয়ে এলো অন্ধকার ফুঁড়ে, তাকে আহ্বান করছে কুয়োয় নামতে। খিলখিল একটা পরিচিত হাসির শব্দ ভেসে এলো কানে। …………………………………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.

ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি পর্ব-০১

0

#ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি
১ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

‘কাকু তুমিও আজ আমাদের সাথে ঘুমাও না, বাবা বাইরে গেলে যেভাবে এক বিছানায় আমি, মা আর তুমি ঘুমাই।’
.
রাকিবের বুকে যেন প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিয়েছে কেউ, সে হতভম্ব হয়ে বড় ভাইয়ের ছোট মেয়ে বৃষ্টিকে বলল, ‘এসব তুমি কী বলছ মা, পাগলের মতো!’

ফরহাদ খেতে বসে এক লোকমা খাবার কেবল মুখে পুড়েছে এমন সময় বেডরুম থেকে কথাটা কানে ঢোকায় তার গলায় খাবারটা আটকে গেল। তার স্ত্রী তানিয়া টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মুখটাও একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেল মুহূর্তেই। কথাটার অর্থ এমনই কুৎসিত শোনালো যে একমুহূর্তে তার মাথাটা ঘুরে উঠলো। সে ছুটে গেল নিজের মেয়ের কাছে, ‘একি বলছিস তুই?’

বৃষ্টি ফ্যালফ্যাল করে তাকালো মায়ের দিকে। আবার বলল, ‘সেদিন বাবা যখন খুলনা গেল সেরাতে না, তুমি রাকিব কাকাকে কল করে বাড়ি আসতে বললাম, আমরা তিনজন এক বিছানায় ঘুমালাম।’ তানিয়া রেগে এক চড় বসিয়ে দিল বৃষ্টির গালে। কাঁদতে কাঁদতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাবার কাছে চলে গেল সে।

রাকিবের মুখ পুরোই ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে লজ্জায় ছুটে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। তানিয়া কিছুই যেন বুঝতে পারছে না এসব নোংরা কথা ৭ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ের থেকে কী করে বের হয়। এসব সত্যি নয়, এটা ফরহাদকে বলতে যেতেও তার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। মেয়ের মুখ আর দেখতে ইচ্ছা করছে না তার। সে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় ছুটে গিয়ে বালিশ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

ফরহাদ স্তম্ভিত হয়ে খাবার টেবিলে বসে আছে। তার কোলে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা। রাকিবকে সে আপন ছোট ভাইয়ের মতো দেখতো। দুই মাস আগে গ্রাম থেকে শহরে এনে সেই ওকে এখানে একটা কাজ আর থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। সম্পর্কে সে তার খালাতো ভাই হয়। সে যতদূর দেখেছে তানিয়া আপন ছোট ভাইয়ের মতো ব্যবহার করে এসেছে তার সাথে। কিন্তু মেয়ের কথা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। তার অগোচরে তাদের দুজনের ভেতর যে কোনো অবৈধ সম্পর্ক থাকতে পারে তা সে ভেবেই পাচ্ছে না।

বৃষ্টি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো। ওকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে সে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলো তার পাশে দুই ঘণ্টার মতো। অতিরিক্ত চিন্তা করতে করতে ঘোরের জগতে চলে গেছে সে। এমন সময় ঘাড়ের পেছনে হালকা ঠাণ্ডা কিছুর স্পর্শ পেতে শিউরে উঠল তার সারা শরীর। শরীরে অদ্ভুত এক রকম প্রশান্তি অনুভব করছেন এখন। কয়েক মুহূর্ত প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতার পর এমন শান্তি তার ঘোরকে ঘোরতর করে ফেলল। ফরহাদ ধীরে ধীরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। স্ত্রীর ঘরটাও ভেতর থেকে বন্ধ। সে হেঁটে এসে দাড়ালো বেলকনিতে।

বেলকনির লোহার রেলিং বড়জোর ৪ফুট উঁচু। সে দাড়িয়ে আছে ৯ তলা একটা বিল্ডিং এর ৮তলার দক্ষিণ পাশের ফ্ল্যাটের বেলকনিতে। কয়েক মুহূর্ত শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে সেখানে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো নিজের মা-বাবা, প্রিয় আত্মীয়-বন্ধু, স্ত্রী তানিয়া,মেয়ে বৃষ্টি আর রাকিবের ছবি। রেলিং টপকে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে নিচে। রাস্তার এপাশে গতরাতে এক ট্রাক ইটা এনে রেখেছিল কেউ। ওগুলোর উপরই মুখ থুবড়ে পড়লো সে। মুহূর্তে মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে এলো। রক্তের স্রোত বইতে লাগলো মুখে নিচ থেকে। কয়েকবার শরীরটা সামান্য কেঁপে একদম নিস্তেজ হয়ে গেল। ছুটে এলো বিল্ডিং এর দারোয়ান। শুরু করলো চেঁচামেচি। একে একে জ্বলতে লাগলো বিল্ডিং এর সমস্ত ফ্ল্যাটের আলো।

লোকের ভিড় লাগলো, পুলিশ আসলো, রাকিবও ফরহাদের আত্মহত্যার খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। তানিয়া নির্বাক হয়ে গেল। এসব কী ঘটছে তার সাথে। নিশ্চই এগুলো সত্যি নয়, কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে সে। পরদিন পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হলো রাকিব আর তানিয়াকে ফরহাদের খুনের দায়ে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তারা দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে বেলকনি থেকে ফেলে দিয়েছে ফরহাদকে।

রাতটা কোনোরকম কাটলো। পুলিশ বুঝতে পারছিল না কিভাবে তদন্ত শুরু করবে। প্রতিবেশীরা বলছিল ফরহাদ হাসি-খুশি, মিশুক, সৎ সুখী একজন মানুষ ছিল। কোনো রকম অশান্তির খবর তাদের কাছে নেই। তানিয়ার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করেও জটিল কিছু জিজ্ঞেস করেনি তারা। কিন্তু তাদের ছোট্ট মেয়ে বৃষ্টিকে দেখে মনে হলো বাবার মৃত্যুতে বিচলিত হয়নি একটুও। কেমন যেন রাগে ফুঁসছে। তদন্ত অফিসার তাকে জিজ্ঞেস করলো, তার বাবা-মায়ের কোনো ঝামেলা চলছিল কিনা! কিন্তু এরপর বৃষ্টি যা বলল, আৎকে উঠলেন স্বয়ং পুলিশ অফিসার।

বৃষ্টি জানালো গতরাতে সে ঘুমিয়ে ছিল। এমন সময় বাবা-মা আর রাকিব কাকার চিৎকার শুনে জেগে উঠে সে। তার মা আর রাকিব কাকাকে তার বাবা ধমকাচ্ছিলেন। বলছিলেন পুলিশে দেবে রাকিবকে। তখনই মা আর কাকা মিলে গলা চেপে ধরে তার বাবার। তারপর ধাক্কাতে ধাক্কাতে বেলকনিতে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দেয়। মেয়ের মুখ থেকে এমন কথা শুনে শোকের মধ্যেও বড় একটা শক খেল তানিয়া। বৃষ্টি এসব কী বলছে, এর এক বিন্দুও যে সত্যি নয়। সে ঘরে চুপচাপ বসে ছিল মন খারাপ করে। মানুষের চেঁচামেচি শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর লোক মুখে শুনে বুঝতে পারে তাকে ভুল বুঝে ফরহাদ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু তার মেয়ে গতরাত থেকে এত বানিয়ে বানিয়ে বাজে কথা কেন বলছে! সে চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘তুই আমাদের সাথে এমন কেন করছিস, তোর মিথ্যা কথার জন্য তোর বাবা আত্মহত্যা করেছে, এখন আবার আরেকটা মিথ্যা বলছিস! তোকে আমি খুন করে ফেলবো!’

ছুটে গেল তানিয়া মেয়ের দিকে। বৃষ্টি ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। অফিসার আটকালেন তানিয়াকে।এরপরই তানিয়াকে আর রাকিবকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। বৃষ্টির সাথে আরেকটু কৌশলে কথা বলে অফিসার জানতে পারেন তাকে ঘুম পাড়িয়ে বাবা বাড়িতে না থাকলে প্রায়ই মা আর রাকিব কাকা এক সঙ্গে সময় কাটাতেন। পুলিশের কোনো সন্দেহই রইল না এই খুন নিয়ে। ‘স্ত্রীর পরকীয়া, পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে গোপন মুহূর্তে স্বামীর হাতে ধরা খাওয়া, সম্মান বাঁচাতে স্বামীকে খুন।’ একেবারেই সাধারণ একটা মামলা।

রাকিব হতভম্ব হয়ে আছে গত রাত থেকে। সে বৃষ্টিকে আপন সন্তানের মতই স্নেহ করতো, তানিয়াকে নিজের বোনের মতো স্নেহ করতো। আর ফরহাদ ভাইকে সে কী করে অসম্মান করবে যে তার এত বড় উপকার করেছে! গত রাতে বৃষ্টি যে অভিযোগ তুলেছে তার বিরুদ্ধে এই ধরনের কোনো চিন্তা স্বপ্নেও সে মাথায় আনেনি কোনোদিন। এমন সে কেন করবে! দুই মাস পর রেখা নামের একটি মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার! যখন ফরহাদ ভাই বাড়িতে থাকতেন না খুব কমই আসতেন বৃষ্টিদের বাড়িতে। তাও শুধু দিনে , প্রয়োজন পড়লে। রাতে আসার তো প্রশ্নই উঠে না।

আর বৃষ্টি কিনা তার বাবার সামনে বলল, তানিয়া আপুর সাথে সে এক বিছানায় ঘুমায়! সে অভিমানে হতবিহ্বল হয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেরিয়েছে লজ্জায় মাথা নিচু করে। মাঝরাতে একজন কল করে জানালো ফরহাদ ভাইয়ের আত্মহত্যার কথা। ছুটে এসেছিল সে। আর পরদিন কিনা ফরহাদ ভাইয়ের খুনের অভিযোগ ওইটুকু মেয়ে তুলল তার বিরুদ্ধে! বৃষ্টির এই বয়সে এতটা বোধ কিছুতেই হয়নি। নিশ্চই কেউ তাকে দিয়ে এসব বলাচ্ছে কিন্তু কে!

বৃষ্টি কী বুঝতে পারছে না তার দুটো মিথ্যা কথায় তার বাবা মারা গেল! আর মা আর কাকা সারাজীবনের জন্য জেলে চলে যাচ্ছে! এমনটা কেন হচ্ছে!

পুরো মিডিয়া জগতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে গেল। ‘পরকীয়া প্রেমিকের সঙ্গে মিলে স্বামীকে খুন।’ শিরোনামে ফলাও করে বেড়াতে লাগলো এই ঘটনার রোমাঞ্চকর খবর। ঢাকায় আপন আর কেউ ছিল না ছোট মেয়েটার। প্রতিবেশিরাই ফুটফুটে মেয়েটিকে নিজেদের মাঝে রেখে দিলেন যাতে এমন বীভৎস নোংরা ঘটনার প্রভাব তার শৈশবে গেঁথে না থাকে। কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে বিন্দুমাত্র দুঃখ, মা-বাবাকে নিয়ে কৌতূহলতা দেখা দিল না। সে যেন এসবের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তার দৃঢ় মনোবলের সকলেই প্রশংসা করলো।

প্রফেসর আমির হোসেন শুয়ে রয়েছেন তার বিছানায়। এক অচেনা, অজানা ভয়ে জমে যাচ্ছে তার শরীর। তার হাতে একটি পত্রিকার পাতা। সেখানে একটা পরকীয়া খুনের ঘটনা উল্লেখ করা আছে। খুনের ভিক্টিম ফরহাদ হোসেনকে খুব ভালো করেই চেনেন তিনি। রাকিব নামে তার খালাতো ভাইটিকে ফরহাদের অনুরোধে সেই তার একটা ফ্যাক্টরিতে চাকুরী দিয়েছিল। ফরহাদ তার ছেলের বয়সী হলেও ভালো বন্ধুত্ব ছিল তাদের। তানিয়া সম্পর্কে সে যতটুকু জানে এমন ব্যাক্তিত্বের একটি মেয়ে এরকম অবৈধ সম্পর্কে জড়াবে না। ফরহাদের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে টুকটাক জানতেন তিনি। আর খুন করাতো অনেক বড় ব্যাপার। বৃষ্টি মেয়েটাকেও তিনি সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন।এখানে সমস্যা হচ্ছে এই সমস্ত অভিযোগ গুলো আসছে তাদেরই মেয়ে বৃষ্টির কাছ থেকে। এইটুকু একটা মেয়ে যে মিথ্যা কথা বলবে তা কেউই বিশ্বাস করবে না। কারণ কেন মেয়েটা মিথ্যা বলবে!

তবে এক অজানা কারণে এই ছোট মেয়েটিকেই সন্দেহ করছেন প্রফেসর। এর পেছনে এক অদ্ভুত যুক্তি রয়েছে। গত এক সপ্তাহ আগে নিজের ২১ তম বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে বাড়িতে ছোটখাটো একটা আয়োজন করেন তিনি। আমন্ত্রিত ছিল ফরহাদ, তানিয়া এবং বৃষ্টি। সন্ধ্যার পর হাসি ঠাট্টায় আলাপে মশগুল হয়ে উঠে বাড়িটি। প্রফেসরের বাড়িটি সাদামাটা হলেও বাড়ির পেছনে আর সামনে বেশ খোলামেলা জায়গা। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি খোঁজ করলেন বৃষ্টির। বৃষ্টিকে ঘরের কোথাও দেখতে না পেয়ে তার বুকটা কেমন ধক করে উঠলো আমির হোসেনের। বাড়ির বেশ খানিকটা পেছনের দিকে একটা খোলা কুয়ো রয়েছে। খুব প্রাচীন আর গভীর। ওটাকে বর্তমানে আবর্জনা ফেলানোর কাজে ব্যবহার করেন তিনি। কুয়াটার পার তেমন উঁচু নয়। আজ বিকেলে কাজ করার পর তিনি ঢাকনাটা দিয়ে এসেছিলেন কিনা মনে পড়ছে না!

মেয়েটা ওদিকে যায়নিতো! গেলে দূর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগবে না। তিনি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সেদিকে চলে গেলেন। আশেপাশে বৃষ্টির দেখা পাওয়া গেল না। তিনি প্রায় ছুটে কুয়োর কাছে চলে এলেন। হায় খোদা! কুয়োর ঢাকনাটা খোলা! আর কুয়োর পাশের কাদামাটিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছোট জুতোর ছাপ। টর্চ আনেননি। তবুও ঝুকে পড়লেন কুয়োর দিকে। অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ বাচ্চা একটি মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দে তার হাড় কেঁপে উঠলো। কুয়োর নিচ থেকে বৃষ্টির শব্দ বারি খেতে খেতে উপরে পৌঁছাল, ‘দাদু , আমি নিচে, দারুন মজা হচ্ছে এখানে।’ তিনি ভয় পেয়ে বললেন, ‘তুমি পড়ে গেছ মামুনি?’

‘না, ও আমাকে নিয়ে এসেছে এখানে ডেকে, এখানে কী যে সুন্দর জায়গা তুমি বিশ্বাস করবে না। দাঁড়াও আমি উঠে আসছি!’ বৃষ্টির কণ্ঠ।

এরপরেই অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো একটি বাচ্চা মেয়ের হাত। পুরো হাত কাঁদায় ঢাকা। এত অসম্ভব! দড়ি দিয়েও কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের এই কুয়োতে নামা কিংবা ওঠা অসম্ভব! প্রায় লাফ দিয়ে কুয়ো থেকে বেরিয়ে এলো বৃষ্টি। তার পুরো শরীর ভয়ানক দুর্গন্ধে ভরা আর কাঁদায় মাখামাখি। তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তোমায় নিয়ে গিয়েছিল ওটার ভেতর!’

‘একটা কালো কুচকুচে দেখতে মানুষ। তার নাকি কোনো শরীর নেই! তাই সে আমার সঙ্গে আমার শরীরে থাকবে এখন থেকে। তাই ওর ঘর দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। এই দেখ আমার ভেতর সে!’

মুহূর্তেই বৃষ্টির চোখ জোড়া লাল হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো যেন দুটি তীক্ষ্ণ দাঁত! একি দেখছেন তিনি। আৎকে উঠে পেছাতে গিয়ে কাঁদায় পিছলিয়ে পড়ে গেলেন তিনি। খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা। তাকে টেনে কাদা থেকে উঠলো মেয়েটা। তার শরীরে এমন ঐশ্বরিক শক্তি কোথা থেকে এলো ভেবে কুল পেলেন না তিনি।

বৃষ্টির বাবা , মা সহ কয়েকজন বৃষ্টিকে আর তাকে খুঁজতে এদিকে চলে এলেন। দুজনকে কাঁদায় এভাবে মাখামাখি দেখে চমকে গেলেন। বৃষ্টি হাসতে হাসতে বলল, ‘দাদা আমাকে ধরতে পারেনি! দৌড়া দৌড়ি খেলছিলাম , দেখ কিভাবে দুজনে পরে গেছি!’ তানিয়াও হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো, ‘একি করেছ তোমরা, শরীর থেকে কী বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে তোমাদের, চল এখনই গোসল করিয়ে দেই, আচ্ছা দাদি-নাতনির জুটি হয়েছে তো!’ সবাই হেসে উঠল।

মেয়েটার উপস্থিত মিথ্যা বলার জ্ঞান দেখে চমকে উঠলেন প্রফেসর। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখলেন তা বিশ্বাস করাও তার পক্ষে সম্ভব না। মাথা পুরোই জমে গেল তার। তিনি কোনো মতে ঘরে ফিরে এলেন।

এরপর এক সপ্তাহ দেখা হয়নি পরিবারটার সাথে তার। কিন্তু তার মন বলছে পরিবারের এই অনাকাঙ্খিত ট্রাজিডির পেছনে সেই দিনের ঘটনা এবং বৃষ্টি মেয়েটা কোনো না কোনো ভাবে দায়ী। দায়ী এই কুয়োটাও। মেয়েটা এখন কোথায় আছে তিনি জানেন না। এই ঘটনার সমস্ত খোঁজ তাকে নিতে হবে। জানতে হবে এসবের যোগ সূত্র কী!……..
……………………………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .
.

কেউ কথা রাখেনি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

গল্পঃ কেউ কথা রাখেনি
পর্বঃ শেষ (২য় অংশ)
নিঝুম জামান

.
মিথিলার মৃ/ত্যু/র কিছুদিন পরেই মিথিলার বাবা-মা জানতে পারে আরাফ বিদেশে বিয়ে করেছে।
সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না, তেমনি আরাফের গোপনে করা দ্বিতীয় বিয়ের খবরও গোপন থাকে নি।
মিথিলার মা সেদিন আরাফকে বলেছিল,

— আমাকে মেয়েকে তুমি ঠকিয়েছো, সময়ের পরিবর্তনে তুমিও একদিন ঠকবে। সেদিন বুঝবে
অন্যকে ঠকিয়ে ভালো থাকা যায় না। আমার মেয়েটা মরার আগেও তোমাকে দেখার জন্য ছটপট করছিল, বারবার অনুনয় করেছিল কিন্তু তুমি আসো নি। অথচ নতুন বিয়ে করে সংসার করছিলে। আমার মেয়েটা তো তোমাকে কম ভালো বাসে নি, তার বিনিময়ে তুমি ওর সাথে প্রতারনা করেছো।তুমি একজন নিষ্ঠুর পাষান।
কান্না বন্ধ করো,(ধমকের সুরে) একদম ন্যাকা কান্না
কাঁদবে না। এসব ন্যাকা কান্না একদম সহ্য হয় না
আমার। এখন কাঁদলে কি হবে, যখন তাকে যত্ন করে রাখার ছিল, তখন তো রাখ নি।

আরাফ নিশ্চুপ ছিল। কোনো উত্তর দিতে পারেই নি।পারবে কি করে? সে তো সত্যিই অপরাধী।
.
একমাস দেশে থাকার পরে আবারও বিদেশে পাড়ি জমায় আরাফ। যাওয়ার আগে আফরিনকে নিয়ে
যেতে চেয়েছিল কিন্তু মিথির মা আফরিনকে দেয় নি।
তার সাফ কথা, আমরা যতদিন বেঁচে থাকব আফরিন আমাদের সাথেই থাকবে। ওকে আমরা দেব না। তোমার মতো মিথ্যাবাদীর কাছে তো
দেওয়ার কথাই আসে না।
আরাফও আর বেশি কিছু বলতে পারে নি।
.
আফরিন ওর নানা-নানীর কাছে থাকে। ওর নানীই
ওর মায়ের অভাব পূরন করে মানুষ করে। এজন্যই লোকে বলে, নানী হচ্ছে দ্বিতীয় মা।
কিন্তু মা তো মা-ই। আফরিনের মাঝে মাঝেই মায়ের জন্য অনেক মন-খারাপ লাগে। তার মা বেঁচে থাকলে সেও নিশ্চয়ই বাবার সাথে থাকতো।
.
আফরিন বড় হয়েছে। দেখতে পুরো ওর মায়ের মতো হয়েছে। তবে রাগটা অনেক বেশি। বাবাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। বড় হওয়ার পরে ওর মায়ের সাথে বাবার করা আচরণ সবটাই জানতে পারে। আরাফও প্রায় আঠারো বছর বিদেশে কাটিয়ে দেশে ফিরেছে। তার দ্বিতীয় স্ত্রী এলিসা তাকে ধোঁকা দিয়ে ছেড়ে চলে গিয়ে গিয়েছে। আঠারো বছর সংসার করেও আরাফকে আপন করে নেয় নি এলিসা। যেই এলিসার প্রেমে পড়ে মিথিকে অবহেলা করেছিল সেই এলিসাই তাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে। তাই সে দেশে চলে এসেছে। কিছুদিন আগে বিদেশ থেকে এসে প্রথম যখন আফরিনকে আরাফ দেখতে পায়, ও তখন চমকে উঠেছিল। অবিকল মিথির মতো দেখতে।
আরাফ তখন গিয়েছিল বাবা হিসেবে আফরিনকে
নিজের কাছে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। আরাফের মা স্ট্রোক করে গত হয়েছেন পাঁচ বছর হলো।বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র আপন বলতে এখন আফরিনই।কিন্তু আফরিন সরাসরি বলে দিয়েছে,

— যে বাবা ছোটবেলা থেকে তার সন্তানের প্রতি
দায়িত্ব পালন করে নি, সে বাবার কাছে আমি যাব না।

–মা, বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে আমার সাথে বিদেশে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার নানু
তোমাকে আমার সাথে যেতে দেয় নি। তারা তোমাকে
রেখে দিয়েছিল। (অনুনয়ের সুরে)

— বাহ, চমৎকার কথা বললে। সন্তানের ওপর কার অধিকার বেশি? তার পিতার নাকি তার নানা-নানীর? আমাকে না হয় যেতে দেয় নি তোমার সাথে, তুমি তো পারতে ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করতে, আমি তো তোমার একমাত্রই মেয়ে ছিলাম বাবা আমার খরচটাও তো পাঠাতে পারতে কিন্তু তুমি তা করো নি। নানা-নানুর ওপরই সব দায়িত্ব রেখে চোরের মত বিদেশে পলায়ন করেছিলে। এখন যখন আমি বড় হয়ে গেছি, এখন এসেছো পিতার অধিকার নিয়ে। না পেয়েচি তোমার ভালোবাসা, না পেয়েছি তোমার কিছু। কেন যাব তোমার সাথে?

এবারও আরাফ নিশ্চুপ। সত্যিই গত আঠারোটা বছর সে বাবা হিসেবে সন্তানের কোনো দায়িত্বই পালন করে নি।
.
.
আরাফ একাই থাকে। আজ তার কেউ নেই। বড্ড একা সে। মিথিলাকে অবহেলা করার শাস্তি পাচ্ছে এখন। মানসিক যন্ত্রণার পাশাপাশি
শরীরটাও ভীষণ অসুস্থ। মন ভালো না থাকলে শরীর কীভাবে ভালো থাকবে?আফরিনকে দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। হয়ত এমন করেই একদিন মিথিলা তাকে দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু
আরাফ বেশ ভালো করে জানে আফরিনকে
আসতে বললে সে আসবে না। খুবই জেদী মেয়ে।
.
মিথিলা উচ্চশিক্ষিত হয়ে ওর মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারলেও ওর মেয়ে আফরিন তার নানীর
স্বপ্ন পূরণের চেষ্টায় পরিশ্রম করে যাচ্ছে। সামনের সপ্তাহে আফরিন স্কলারশিপ পেয়ে জাপান যাচ্ছে।
যাওয়ার আগে একদিন ওর মামা এসে ওকে বলল,

— আফরিন, যাওয়ার আগে একবার অন্তততোমার বাবাকে দেখে যেও। বড্ড অসুস্থ তিনি। তোমাকে বারবার দেখার আকুতি জানাচ্ছে।

–আমার সময় নেই মামা, তুমি জানিয়ে দিও।

–এমন করো না আফরিন। হাজার হোক, লোকটা তোমার বাবা। তোমার একবার দেখে আসা উচিত।

আফরিন আর বেশি কিছু বলল না। ও টেবিলে বসে কিছু লিখছিল আর কাঁদছিল। যেদিন জাপানে চলে যাবে সেদিন তার বৃদ্ধ নানীকে সালাম করে আসার সময় হাতে একটা চিঠি দিয়েছিল আর বলেছিল তার জন্মদাতা পিতার কাছে পৌঁছে দিতে। আফরিনের
কথা অনুযায়ী আরাফের কাছে চিঠি পৌঁছে গেল।
অসুস্থ আরাফ তার মেয়ের চিঠির কথা শুনে খুশিতে
ডগমগ হয়ে গেলেন। কিন্তু এ ডিজিটাল যুগে মোবাইলে ফোন না দিয়ে চিঠি লিখলো কেনো মেয়েটা? বেশি কিছু না ভেবে চিঠিটা খুলল। সেখানে লিখা,

বাবা,
আশা করি, এতকাল ভালো ছিলে,সুখে ছিলে, এখনো আছো। আমি হয়ত চিঠি না লিখে ফোনেই সব কথা বলতে পারতাম কিন্তু চিঠিটা পড়ে যাতে তোমার আমার মায়ের কথা মনে পড়ে সেই জন্য লিখা। যদিও মাকে আমি বুঝ হওয়ার পরে দেখি নি। তবে মায়ের সব ঘটনা আমি জানি। মায়ের ব্রেইন
টিউমার ধরা পরার পরে নাকি সবসময় শুধু তোমায় চাতক পাখির মতো দেখতে চাইতো কিন্তু তুমি স্বার্থপরের মতো দূরে ঠেলে দিয়েছিলে। আজ আঠারো বছর পরে দেখ সেই কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঘটছে তোমার সাথে। আল্লাহ কাউকে ছাড় দিলেও ছেড়ে দেয় না। তুমিও আমাকে দেখার অনেক
ইচ্ছাপোষন করছো তবে তোমাকে
দেখতে আসতে কেনো জানি মন সায় দিচ্ছে
না।
তাই আসলাম না। আমাকে মাফ করে দিও। জানি সন্তান হিসেবে তোমার সাথে এমন ব্যবহার করা উচিত নয়।

(আফরিন)

চিঠি পড়ে আরাফের আজ একটুও কান্না আসলো না। সে জানতো তার করা ভুলের শা/স্তি একদিন ঠিকই পাবে। স্ত্রী- মেয়ে সবাই তাকে একাকী জীবনে ফেলে গেছে।
এটাই কি তার বিচার?
মানুষ ঠিকই তার করা পাপের কিংবা ভুলের শাস্তি পায়। কেউ দেরীতে কেউবা তাড়াতাড়ি।

….(সমাপ্ত)…

[ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।]

কেউ কথা রাখেনি পর্ব-০৫

0

গল্পঃ কেউ কথা রাখেনি
পর্বঃ০৫ (শেষ পর্ব- ১ম অংশ)
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

কিছুক্ষন পর নার্স এসে আমাকে ইনজেকশন দেয়।
আস্তে আস্তে আমার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে।
কে জানে এই দুইটি চোখ আর কখনো খুলবে না কিনা?
.
টানা চারঘন্টা মিথিলার অপারেশন চললো। ওটির বাইরে বসে মিথিলার মা কখনো আফরিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আবার কখনো দোয়া-দরুদ পড়ছে। মনে মনে একটাই প্রার্থনা তার মেয়েটা যেন ফিরে আসে।

মিথিলার জীবন অপারেশন থিয়েটারেই
থেমে গিয়েছিল। মিথিলা আর ফিরে আসে নি।
মিথিলার অপারেশন ঠিকঠাকই হয়েছিল কিন্তু
ওর জ্ঞান আর ফিরে নি। একবুক চাপা কষ্ট নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সকলের কাছ থেকে। মিথিলার ছোট্ট মেয়ে আফরিন হারিয়ে
ছিল ওর পৃথিবীর সবচেয়ে দামী সম্পদটিকে, আপন মানুষটিকে।
দীর্ঘ তিনবছর পরে আরাফও সেদিন বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিল কিন্তু মিথিলাকে আর জীবিত
দেখতে পায় নি। এসেছিল মিথিলার জীবনের শেষ যাত্রায় অংশ নিতে। মিথিলার শেষবারের কথাগুলো মনে করে বারবার আফসোস হচ্ছিল আরাফের।
হয়ত এত অবহেলার কারণে মিথিলাকে হারিয়ে ফেলেছে আরাফ।
যথারীতি মিথিলার দাফনকাজ সম্পন্ন হলো।
আরাফ কিছুতেই যেন মিথিলার মৃ*ত্যুকে মেনে নিতে পারছে না। প্রচুর কান্না পাচ্ছে ওর।
মেয়েটা ওকে প্রচন্ড ভালোবেসে পরিবারের অমতে
পালিয়ে এসে বিয়ে করেছিল। তার বিনিময়ে আরাফ
এক বিদেশিনীর প্রেমে মত্ত হয়ে ওর ভালোবাসা, ওর আত্মত্যাগ ভুলে গিয়ে ওকে বড্ড অবহেলা করেছে, ওকে ঠকিয়েছে এ ভুলের কি কোনো ক্ষমা
হবে?
.
দুইদিন পরে,
আরাফ আলমারি থেকে মিথির শাড়িগুলো বুকে জড়িয়ে নিরবে কাঁদছিল। হঠাৎ চোখ পড়লো
আলমারিতে রাখা অনেকগুলো ছোট ছোট রঙিন
কাগজের ওপর। হাতে নেওয়ার পর দেখলো সেখানে
সযত্নে অনেক কিছু লিখা। আরাফ চিরকুটগুলো
পড়া শুরু করলো,পাশে তারিখও লিখা। সেখানে অনেক অভিমান নিয়ে লেখা,

‘তোমার কি কখনো আমাকে মনে পড়ে না?
আমাদের খুনসুটিতে ভরা রঙিন দিনগুলো কি ভুলে গেছো?’

এরপর আরেকটা চিরকুটে লিখা,

‘পহেলা ফাল্গুনে আমারও ভীষণ ইচ্ছে হয় অন্য কাপলদের মতো হলুদপরী সেজে তোমার সাথে ঘুরার? কবে আসবে সেদিন? ‘

‘ জানো আরাফ, তোমাকে যখন খুব মিস করি তখন
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। জানি সেখানে
তোমার দেখা পাব না। কিন্তু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেই যে, দুজন তো একই আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে
একই আকাশ দেখছি। আচ্ছা, তুমি কি এখন আর
আগের মতো আমাকে ভালোবাসো না?
#কেউ_কথা_রাখেনি_ভালোবাসেনি
কেউ চুপিচুপি পায়ে কাছে আসে নি।’

এভাবে আরাফ আরো কয়েকটি চিরকুট পড়লো।
শেষ চিরকুটটা ছিল মিথির অপারেশনের কয়েকদিন আগে লিখা। অনেক বড় ছিল।সেখানে লিখা ছিল-

‘ তুমি যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিলে তুমি শীঘ্রই ফিরে আসবে কিন্তু তুমি আসো নি। আমাকে দেওয়া
কথা রাখো নি। অথচ আমি ঠিকই আমার কথা রাখতে পরিবারের অমতে চলে এসেছিলাম। আমার হাতে
সময় খুব কম। এ পৃথিবীতে বেশিদিন বাঁচব না।
যেদিন চলে যাব সেদিন ঠিকই আমাকে খুঁজবে কিন্তু
আমাকে কোথাও পাবে না,কোথাও না। তোমার
কথা মনে পড়লে আমি চিরকুটগুলো লিখি।
এখন তো ব্যস্ততার জন্য আমার সাথে ফোনেও
ঠিকমত কথা বলো না। তুমি কথা রাখো নি।
#কেউ_কথা_রাখেনি।
.
আরাফ চিরকুটগুলো পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আগে মিথির যতটা কেয়ার করতো, ভালোবাসত বিদেশে যাওয়ার একবছর পরে মিথির কথা ভুলে এক বিদেশিনীর প্রেমে পড়ছিল।
বিদেশিনীর প্রেমে মশগুল হয়ে মিথিকে অবহেলা করেছে। একবছর হয়েছে আরাফ এলিসার সাথে
বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল। আরাফ কখনোই
মিথিকে ঠকাতে চায় নি, কিন্তু এলিসাকে দেখে
মিথির কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎ আরাফ
দেখল মিথি ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ও আরাফকে
বলছে,

— ভালোই হয়েছে আরাফ তোমার কাছ থেকে ঠকার আগেই আমি ম*রে গেছি। না হয় তোমার
দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনলে আমি এমনিই ম*রে যেতাম। কত শতদিন, কত প্রহর তোমার অপেক্ষায় কাটিয়েছি । প্রতিশ্রুতি করে যখন রাখতে পারবে
না,কে বলেছিল তোমায় প্রতিশ্রুতি করতে? ভালোই
যখন বাসতে পারবে না তখন কেন আমাকে বিয়ে করেছিলে? তুমি কথা দিয়ে কথা রাখ নি। হারিয়ে গেলে খুঁজে কি লাভ? যেখানে বেঁচে থাকতে খোঁজ নাও নি।
#কেউ_কথা_রাখেনি_ভালোবাসেনি।

— আ-আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও মিথি। আমি না বুঝে ভুল করেছি।

— কিছু ভুলের কোন ক্ষমা হয় না আরাফ।
বলে ধীরে ধীরে মিথিলার অবয়বটি ধীরে ধীরে মুছে
যেতে লাগল।
আরাফ বুঝতে পারলো এতক্ষণ সে
মিথিলাকে নিয়ে কল্পনা করছিল। তবে কল্পনার মিথিলা ঠিকই বলেছে,

‘কিছু ভুলের কোন ক্ষমা হয় না।’

#চলবে
#কেউ_কথা_রাখেনি
#নিঝুম_জামান

[ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। ]

কেউ কথা রাখেনি পর্ব-০৪

0

গল্পঃ কেউ কথা রাখেনি
পর্বঃ ০৪
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

আরাফ বিদেশে চলে যাওয়ার দশদিন পরে আমার কোল জুড়ে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান এলো। কয়েকদিনের জন্য মেয়েকে দেখতে পারল না আরাফ, ভাবতেই অনেক খারাপ লাগলো। আরাফ ভিডিওকলে মেয়েকে দেখে মেয়ের নাম রাখল “আফরিন”।
নতুন অতিথির আগমনে আমাদের দুই বাড়িতেই আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। মেয়ে হওয়ার একমাস পরেই আমার শ্বাশুড়ি এসে আমাকে নিয়ে গেলেন।
শ্বাশুড়ি আম্মার আচরণ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।
আগের মতো এতো বকাঝকা কিংবা কথায় কথায় খোঁটা দেয় না। তবে এ বাড়িতে আসার পর থেকে আরাফের জন্য মনটা অনেক কাঁদে। যদিও প্রতিদিন ভিডিওকলে ওর সাথে
আমার কথা হয়, তবুও মনের কোণে শূন্যতা অনুভব
করি।
.
এসএসসি পরীক্ষায় আমি বেশ ভালো রেজাল্টই করি। লুকিয়ে পড়ে যে ৪.৩৩ পেয়েছি এটাই আমার সাত কপালের ভাগ্য। এখন পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির কেউ জানে না আমি যে এখনো পড়াশোনা করছি।আরাফের কাছ থেকে কলেজে ভর্তি হওয়ার অনুমতি নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে সামলিয়ে, ঘরের কাজ সামলিয়ে পড়তে বসাটা খুব কঠিন! আরাফ থাকলে হয়ত ব্যাপারটা কিছুটা হলেও ম্যানেজ করতো। পড়তে বসতেও খুব ভালো লাগে না।

মাঝে মাঝে পূর্নিমার রাতে রুমের জানালাটা খুলে জোৎস্না দেখি আর আরাফের জন্য চাপা অভিমান জমিয়ে রাখি। ওর কি একটুও ইচ্ছে করে না আমার সাথে জোৎস্নাবিলাস করতে? আমাকে রেখে বিদেশে পাড়ি না জমালেই তো পারত? দেশেই কোনো কাজ
নাহয় করতো, সংসারে অভাব থাকলে না হয় থাকতো, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ তো হতো! চোখের সামনে তো অন্তত ভালোবাসার মানুষটিকে দেখতাম।
.
.
দেখতে দেখতে কেটে গেছে দুই-দুইটা বছর। এইচএসসি পাশ করে ফেলেছি। যদিও রেজাল্ট অনেক খারাপ হয়েছে।
আমার মেয়েটাও কথা বলতে শিখে গেছে। আধো- আধো করে অনেক কথাই বলে। আরাফ দেশে এখনো ফিরে নি।
ওকে দেশে আসতে বললে আমাকে নানারকম বাহানা দেয়। কখনো আমার ওর বলা কথাগুলো বিশ্বাস হয়, আবার কখনো বিশ্বাস হতে চায় না।
ওর আচার-আচরণও অনেক বদলে গেছে। আমার জন্য পাগলামি করা আগের আরাফ নেই।

ইদানীং আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হয়। হয়ত প্রিয় মানুষটা আজ পাশে নেই বলে আমার এমন হয়।
মাঝে মাঝে গাঁ কাপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তখন মনে হয় ইশ! আরাফ যদি কপালে হাত দিয়ে বলতো তোমার তো জ্বরে গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। তখন হয়ত জ্বর কমে যেত।
একদিন হঠাৎ ড্রয়িংরুমে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেলাম। পরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম শ্বাশুড়ীর রুমে।
আমার মা, আম্মা, ননদ, আমার মেয়ে সবাই আমার পাশে বসে আছে। আমাকে চোখ খুলতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলেন,,

— এখন তোর কেমন লাগছে মিথি?

আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
–কি হয়েছিল আমার, মা?

–তুই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি। মনে হয় তোর শরীরটা অনেক দূর্বল। চারঘন্টা পরে তোর জ্ঞান ফিরলো। বেয়ান তো তোর জ্ঞান ফিরছিল না বলে ভয় পেয়ে গেছিল। আমাকে কল দিয়ে বলল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসতে। এসে দেখি তোর জ্ঞান নেই।

–ওহহ আচ্ছা। (মিথি)
.
এরপর প্রায়ই আমার মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হতো, আমি প্রায়ই অজ্ঞান হয়ে যেতাম। আমার এমন ঘনঘন অজ্ঞান হওয়া দেখে আমার মা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার মাথায় বিভিন্ন
পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেয়। মাথার সব
পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখে ডাক্তার আমাকে বলে,

–আপনার মাথায় ব্রেইন টিউমার হয়েছে। এজন্যই
আপনার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা হতো, ঘনঘন অজ্ঞান হয়ে যেতেন।

আমার মনে এমনই একটা সন্দেহ হচ্ছিল। হয়ত ভয়ংকর কোনো রোগ আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে।
আজ সেই সন্দেহটাই সত্যি হলো। রোগের কথা শুনে আমার ভয় লাগলো না। ডাক্তারের কথা শুনে আমার মা হকচকিয়ে উঠলেন। আর উত্তেজিত হয়ে বললেন,

–কি বলছেন ডাক্তার সাহেব? এখন কি হবে আমার মেয়ের? অপারেশন করলে সুস্থ হয়ে যাবে তাই না?

–আপনি শান্ত হোন। অপারেশন করা যাবে না কিনা সেটা টিউমারের অবস্থানের ওপর জানতে হবে।
আর অপারেশন সাকসেসফুল হবে নাকি হবে না সেটা একমাত্র আল্লাহই ভালো বলতে পারবে। ব্রেইন টিউমারের অপারেশন রোগীর জ্ঞান ফিরার ওপর ডিপেন্ড করে। জ্ঞান ফিরতেও পারে, আবার নাও ফিরতে পারে।
তবে যদিও অপারেশন করা হয় তবে দ্রুত করানো দরকার কেননা টিউমার থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে, একবার ক্যান্সার হলে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

[ ★ব্রেইন টিউমার সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। তাই ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়]

ডাক্তারের কথা শুনে মা সেখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। আমি মাকে নিয়ে চলে এলাম।
চিন্তায় আমার ঘুম হচ্ছিল না। আমার কিছু হলে আমার দুই বছরের নিষ্পাপ আফরিনের কি হবে?
নিজের চেয়েও আফরিনের জন্য চিন্তা বেশি হতো।
আমি মা/রা গেলে আরাফ আবার বিয়ে করার
পর আফরিনকে আদর করবে তো?
পরবর্তী একসপ্তাহ আমার মাথায় অনেক টেস্ট করা হলো। ডাক্তাররা অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল আমার অপারেশন করবে, যদিও তা আমার জন্য
ঝুকিঁপূর্ণ। অপারেশন এবং পরবর্তী খরচের জন্য আমার প্রায় নয় লাখ টাকার প্রয়োজন।
এতো টাকার কথা শুনে আমি শ্বাশুড়ির মুখের দিকে তাকানো যায় না। তিনি কিছুতেই আমার অপারেশনের জন্য এত টাকা খরচ করতে ইচ্ছুক নন। তিনি কথার আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করেন, পরের মেয়ের জন্য এতটাকা নষ্টের কোনো মানে হয় না। অথচ আরাফ প্রতিমাসে প্রায় দেড়লাখ টাকার মতো পাঠায়।
আম্মার কথা শুনে আমার বাবা-মা তো খুবই ক্ষেপে গেলেন। বাবা বললেন,

–ও যদি পরের মেয়েই হয় তাহলে আজ থেকে আমার মেয়ে আপনার বাড়িতে আর যাবে না। আমিই আমার মেয়ের চিকিৎসা করব।
.
যদিও পরে আরাফ আমার চিকিৎসার জন্য একসাথে সাত লাখ টাকা পাঠিয়েছিল। আমার অপারেশন করার দিন ঠিক হয়ে গেল। আমি আরাফকে বারবার ফোনে বলছিলাম, অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে একবার তোমাকে দেখতে চাই। আমি আর নাও ফিরতে পারি। শেষবার অন্তত তোমাকে দেখতে চাই। সেদিনও আরাফ বলেছিল ওর পক্ষে এখন আসা সম্ভব না। আল্লাহ ভরসা।

সেদিন আমার ভীষণ অভিমান হয়েছিল ওর ওপর। চাই না আমার টাকা-পয়সা, আমি শুধু আমার ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পেতে চাই।
.
অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলাম হয়ত আমাকে আরাফ না বলেই
চলে আসবে। কিন্তু সে আসে নি। আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। অপারেশন থিয়েটার হতে হয়ত আর বেঁচে ফিরতে পারব না।উনিশ বছরের জীবনটা ভালো-মন্দ মিলিয়েই কেটেছে। আফরিনকে আদর করে মায়ের কাছে দিলাম। কোমড় অবধি লম্বা চুল কেটে ফেলতে হয়েছিল অপারেশনের জন্য। দুই রাকাত নামাজ পড়ার উদ্দেশ্য অযু করি। ওয়াশরুম থেকে
বের হওয়ার সময় বেসিনের আয়নায় নিজেকে
এক নজর দেখে চলে আসি। নামাজ শেষ হলে আমাকে ওটিতে ঢোকানো হয়।
কিছুক্ষন পর নার্স এসে আমাকে ইনজেকশন দেয়।
আস্তে আস্তে আমার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে।
কে জানে এই দুইটি চোখ আর কখনো খুলবে না কিনা?

#চলবে
#কেউ_কথা_রাখেনি
#নিঝুম_জামান (ছদ্মনাম)

(ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।)

কেউ কথা রাখেনি পর্ব-২+৩

0

গল্পঃ কেউ কথা রাখে নি
পর্বঃ ০২ ও ০৩
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

আরাফ কসমেটিকসের দোকান দেওয়ার পর
থেকেই লাভের মুখ দেখতে থাকে। মোটামুটি আমাদের ব্যবসা ভালোই চলতে থাকে। আমিও গোপনে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকি। আমার পড়াশোনার কথা শুধুমাত্র আরাফ
জানতো। রাতে আমি পড়তে বসতাম। যাতে কেউ টের না পায়।
বাড়ির সকলে জানলে আমাকে আর আস্ত রাখবে না। তবে সারাদিন সংসারের কাজ করে রাতে
পড়তে বসাটা অনেক কঠিন। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে, ঘুম বাদ দিয়ে পড়ায় মন দেই। সত্যিকথা বলতে বিয়ের আগে পড়াশোনার জন্য এতো খাটুনি করি নি, এখন যতটা করছি।
মা একটা কথা প্রায়ই বলতো,
“সুযোগ থাকতে মানুষ কাজে লাগায় না, কিন্তু সুযোগ যখন থাকে না তখন মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে কাজ সম্পন্ন করার চেষ্টা করে।”

মায়ের কথাটা আজ মনে পড়ছে খুব। আমার অবস্থাও ঠিক এমনই হয়েছে।
.
কিন্তু এই গোপনে পড়াশোনা বেশিদিন চালাতে
পারি নি। একদিন গভীর রাতে পড়তে পড়তে
ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। বই-খাতা গোছাতে ভুলে গিয়েছিলাম। পরদিন সকালে উঠে ঘরের সব
কাজ করতে গিয়ে বই লুকানোর কথা ভুলে
যাই, ছোট ননদ তুলি দেখে ফেলে আমার বই-খাতাগুলো; দেখতে দেরী শ্বাশুড়ি মায়ের
কাছে কথা লাগাতে দেরী হয় না। আম্মা তো
আমার পড়ার খবর শুনে রেগে আগুন! যেখানে
তার ছেলে ম্যাট্রিক ফেল, সেখানে বউয়ের পড়াশোনা করা তো মারাত্মক অপরাধ। কোথায় গেল তার “মা” ডাক, আর কোথায় তার সুমধুর কথা! ইচ্ছেমত খারাপ খারাপ ভাষায় গালি-গালাজ করল আমাকে আর বই-খাতাগুলো চোখের সামনে আগুন ধরিয়ে দিল। বইগুলো পুড়তে দেখেও সাহস হলো না কিছু বলার। আমি কিছুই বললাম না, চুপচাপ চোখের জল ফেলতে লাগলাম।।
.
সন্ধ্যায় আরাফ বাড়ি এসে দেখে মিথিলার চোখ-মুখ ফোলা। আরাফ বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল হয়ত ওর মা মিথিলাকে বকেছে। মিথিলাকে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে তোমার? চোখ-মুখ ফোলা কেনো? মা বকেছে?

–হুম, আমার বই-খাতাগুলো আম্মা পুড়িয়ে ফেলেছে।
বলে মিথিলা আবার কেঁদে দিল। আরাফ মিথিলার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,

–থাক মিথি, কেঁদো না। আমি তোমার বই-খাতা জোগাড় করে দিব। আমার এক বন্ধুর বোন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ওর বই,গাইড এনে দিব। তবে একটা শর্ত আছে।

–কি শর্ত?

— তুমি যত পড়তে চাও আমি পড়াব সেটা কেউ টের পাবে না। কিন্তু কথা দিতে হবে পড়াশোনা কমপ্লিট করার পর আমার সাথে বেইমানি করতে পারবা না। আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।

–তুমি আমাকে নিয়ে এতো ভয় করছো আরাফ। আমি কি ছেড়ে যাওয়ার জন্য তোমার কাছে এসেছি?

আরাফ কিছুটা থতমত খেয়ে বলল,
–আরে না, আমি সেটা বলতে চাই নি। আমি জানি তুমি অনেক ভালো মেয়ে। কিন্তু একটা কথা কি জানো? প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অনেকেই তার অতীতের ঘটনা মনে করে না। তখন নিজের চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করে। আমার এক চাচা দুইবছর প্রেমের করে বিয়ে করে। তার ওয়াইফ মানে আমার কাকি তখন ইন্টার সেকেন্ড পড়তো। কাকিকে সব রকমের সাপোর্ট দিয়ে মাস্টার্স পাশ করায়। এরপর কাকি চাকরি করার ইচ্ছা পোষণ করে। চাচা চাকরি করতেও অনুমতি দেয়। কাকি পরে হাইস্কুলে চাকরি পায়। পাওয়ার পরে কি হয়েছে জানো?

— না,জানি না আর জানতেও চাই না। কখনোই তোমায় ছেড়ে যাব না আরাফ। ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোমায়। তোমার জন্যই আমি আমার পরিবারকে ছেড়ে এসেছি। তুমি আমাকে সারাজীবন আগলে রেখো, এভাবেই ভালোবেসো।

–তা তো অবশ্যই প্রিয়তমা..
বলে আরাফ মিথির হাতে একটা চুমো দেয়।
.
.
সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মধ্যে দিয়েই কেটে গেছে প্রায় আটমাস। আমি ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছি।
আমার পড়াশোনা চালিয়ে নিতে প্রচুর সাপোর্ট করেছে আরাফ। নাইনের বার্ষিক পরীক্ষার সময় আম্মাকে মেনেজ করে আমাদের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে আরাফ। যাতে আমাদের বাড়িতে গিয়ে ভালোমত পরীক্ষা দিতে পারি। পরীক্ষার শুরু হওয়ার আগে আমাকে বাড়ির গেট থেকে নিয়ে যেত আবার পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতো। তবে কোনোদিন আমাদের বাড়িতে ঢুকত না।
সামনে এসএসসি পরীক্ষার টেস্ট পরীক্ষা। শ্বশুরবাড়িতেই লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ি। কিন্তু হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি।
একদিকে আমার পড়াশোনা করে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা, অন্যদিকে আমার গর্ভে একজন বেড়ে উঠছে।
বয়সটাও আমার কম, যার কারনে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে পারি না।

তাহলে কি আমি আমার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সংসারে মন দিব?

#চলবে?
#কেউ_কথা_রাখে_নি
#নিঝুম_জামান

(ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়।)

পর্বঃ০৩

একদিকে আমার পড়াশোনা করে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা, অন্যদিকে আমার গর্ভে একজন বেড়ে উঠছে।
বয়সটাও আমার কম, যার কারনে সবকিছু হ্যান্ডেল করতে পারি না।

তাহলে কি আমি আমার পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সংসারে মন দিব?
.
আরাফ আমার প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে তো খুশিতে আত্মহারা। শ্বশুরবাড়িতেও সবাই শুনে বেশ খুশি হলো। আরাফ আমার ভালোমত রেস্ট নেওয়ার কথা চিন্তা করে কিছুদিনের জন্য আমাকে বাপের বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল।আম্মাও তাতে সায় দিলেন। কারন এবাড়িতে থাকলে সারাদিনই আমার কাজ করতে হয়। পরদিনই আমি ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশ্য। অবশ্য আমি একা না, আরাফ আমাকে বাড়ির গেট অবধি পৌঁছে দিয়েছে। বাড়িতে ঢুকে নি। তার কারণ আরাফকে বাবা-মা এখনো হয়ত মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেয় নি। বাবা-মা বিয়ের পর এখন পর্যন্ত আরাফের সাথে সরাসরি কিংবা ফোনে কথা বলে নি। এমনকি কখনো আমাদের বাড়িতেও আসতে বলে নি। যতটুকু বলেছে আমাকে মাধ্যম হিসেবে বলেছে। তাই
আরাফও আমাদের বাড়িতে আসে না।
.
বাড়িতে যাওয়ার পর আমাকে দেখে মায়ের মুখে সেকি বিশাল হাসি! ছোটভাইটাও দৌড়ে আমার কাছে চলে এসেছে। অনেকদিন পরে তাদের দেখে আমারও বুকটা ভরে গেল।

— মা,কেমন আছো তোমরা সবাই?

–ভালো রে, তুই কেমন আছিস? তুই এমন শুকিয়ে গেছিস কেনো? ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করিস না?

–মা, তুমি আজীবনই আমাকে শুকনা দেখলে..
খাওয়া – দাওয়া ঠিকমতই করি। তা বাবার শরীরটা কেমন? ব্যবসা কেমন চলছে?

–ভালোই আছে। ব্যবসা আগের মতোই চলছে। তোর বাবা চাইছে আরেকটা কাপড়ের দোকান দিতে। কিন্তু আমি বলছি দুই-দুইটা দোকান সামলানো কঠিন কাজ! তারচেয়ে টাকাগুলো ব্যাংকে রেখে দিলেই ভালো হবে।

— বাবা যা ভালো বুঝে তাই করুক।
.
রাতে সোফায় শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছি। মা এসে আমাকে পড়ার কথা জিজ্ঞেস করছেন। মায়ের মুখে পড়াশোনার কথা শুনে আমি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু মা ঘুরে-ফিরে আমার পড়ালেখার কথাই বলছেন। আমি আমতা-আমতা করে মাকে সবকিছু খুলে বললাম। প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনে প্রথমে মায়ের মুখটা খুশিতে ভরে উঠলেও কিছুক্ষন পর মুখটা কালো হয়ে গেল। আমি মাকে বললাম,

–সবকিছু সামলিয়ে আমি কীভাবে পড়াশোনা কন্টিনিউ করব মা? তুমিই বলো..

— আমি তো দুশ্চিন্তা করছি তোকে নিয়ে। তোর বয়স কম, এতো কম বয়সে মা হতে গিয়ে আল্লাহ না করুক কোনো সমস্যা যাতে না হয়। প্রেগনেন্সি চলাকালীন সময়ে কত রকমের শারীরিক জটিলতা দেখা দেয়। আর পড়াশোনা কন্টিনিউ তো অবশ্যই করবি। আমার বিশ্বাস তুই চেষ্টা করলে সবকিছু করতে পারবি । ‘যে রাধে, সে চুলও বাঁধে।’

মায়ের কথা শুনে আমি কিছু বললাম না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম যেভাবেই হোক পড়াশোনাটা চালিয়ে যাব।
.
.
.
আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।
আমাদের বাড়িতে থেকে প্রিপারেশন ভালোই নিয়েছি। এই কয়েকমাসে শ্বশুরবাড়িতে দুই/তিনবার গিয়েছি। তাও দুই/একদিনের জন্য। প্রেগ্ন্যাসির বাহানা দিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে এসেছি
যাতে ঠিকঠাক পরীক্ষা দিতে পারি। পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসে কোয়েশ্চেন মিলাচ্ছি হঠাৎ আমার বাবা তড়িঘড়ি করে বাড়ি আসলেন। এমন সময়ে বাবা কখনো বাড়ি আসে না। বাবা এসেই আমার ধরে ডাকাডাকি শুরু করলেন।

–মিথি, এই মিথি, (রাগী গলায়)

আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গেলাম বাবার কাছে।
–কি হয়েছে বাবা? ডাকছিলে কেনো?

— “নিজে বিয়ে করেছিস ভালো কথা! এমন বখাটে, গুন্ডা, ছ্যাচড়া ছেলেকেই বিয়ে করতে হলো? জানিস তোর জামাই কি করেছে? তোর জামাই প্রতিদিন জুয়া খেলে। জুয়া খেলে নিজের কসমেটিকসের ব্যবসা তো হারিয়েছেই সাথে আজকে জুয়া খেলতে টাকা নিতে আমার দোকানে এসেছিল। কর্মচারীদের সাথে মারপিট করে ক্যাশবক্স থেকে টাকা নিয়ে গেছে। আমি তখন দোকানে ছিলাম না, থাকলে তোর জামাইকে থাপড়ে গাল ফুলিয়ে দিতাম।
অসভ্য, অভদ্র, বদমাইশ কোথাকার! আজকে আবার লোকমুখে জানতেও পারলাম নেশা-টেশাও নাকি করে। তুই বলেছিলি বিয়ের পর আরাফ ভাল হয়ে গেছে। তুই ভালো পথে ফিরিয়ে এনেছিস, এই হলো তার ভালো হওয়ার নমুনা। আমি কথা বলি
না বলে নাকি তোর জামাই আমাদের বাড়ি আসে না! কপাল ভালো যে আসে না ;আসলে কি যে হতো তাই ভাবছি।
গ্রামের মধ্যে আমার একটা ভালো সুনাম, সম্মান ছিল সেটা তুই নষ্ট করেছিস। তবুও তোকে কিছু বলি নি। এখন তোর জামাই শুরু করেছে বদমাইশি।
ছিঃ আমার ভাবতেও ঘৃণা লাগছে আমার মেয়ের জামাই জুয়ারি, নেশাখোর, বখাটে গুন্ডা। ”

বাবা ক্ষিপ্ত কন্ঠে আমাকে কথাগুলো বললেন। আমার বুঝ হবার পর থেকে কোনোদিনই আমাকে বকাঝকা করতে দেখি নি। তাই বাবার কথাগুলো আমার কলিজায় গিয়ে বিঁধলো। কষ্টে আমার চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো।
একথা আছে না, “পর মানুষে দুঃখ দিলে দুঃখ মনে হয় না, আপন মানুষ কষ্ট দিলে মেনে নেওয়া যায় না”
বাবার জায়গায় অন্য কেউ কথাগুলো বললে আমি এতটাও কষ্ট পেতাম না।

— মিথি, তোমার ফ্যাচঁফ্যাচ করে কান্না বাদ দিয়ে রুমে যাও। (ধমক দিয়ে)

বাবার ধমকে আমি হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম আর দৌড়ে রুমে চলে এলাম। মা তখন বাড়িতে ছিলেন না, ছোটভাই সাইফের স্কুলে গিয়েছিলেন ওকে আনতে।
রুমে বসে অনেকক্ষণ কাঁদলাম, ‘ মনে মনে ভাবলাম অনেক হয়েছে আর না; পালিয়ে বিয়ে করার শাস্তি পাচ্ছি আমি। সবার চোখে শুধু আমিই দোষী, শ্বশুরবাড়ি-বাপেরবাড়িতে শুধু আমিই বকা খাই। আজকে আরাফকে সাথে আমার বোঝাপড়া হবে।’ ড্রেস পাল্টে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
সেখানে গিয়ে আম্মার সাথে, তুলির সাথে কিছুক্ষন কথা বললাম। আম্মা হয়ত জানে না আরাফ এতো বড় কান্ড ঘটিয়েছে। অবশ্য জানলেও বা কি! আমার শ্বাশুড়ি আম্মার মতে ছেলেরা হাজার দোষ করলেও তাদের কোন দোষ হয় না।
আমার রুমে আসার পরে দেখি আরাফ শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে। আমাকে দেখে আরাফ বলল,

–একি তুমি! না বলে চলে যে?

–এসে কি তোমার অসুবিধা করলাম নাকি? শুনলাম তুমি নাকি জুয়া খেলো, নেশা করো?
রাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

–এসব কথা তোমাকে কে বলেছে, তোমার বাপ?

–অসভ্যের মত কথা বলছো কেনো? আমার বাবা তোমার কি হয়? আর আমি যা শুনেছি এসব কি সত্যি? জুয়া খেলে দোকান খুইয়েছো, নেশা করে টাকা নষ্ট করো। ছিঃ তোমার জন্য আমার কত শুনতে হয় সবার থেকে। তুমি না বলেছিলি তুমি ভালো হয়ে গেছো?

আরাফ কিছুক্ষন চুপ থেকে উত্তর দিল,
— মানুষ ভালো হতে চাইলেই এত সহজে খারাপ পথ থেকে বের হতে পারে না। জুয়া খেলেছি ঠিক আছে,কিন্তু নেশা করার অভ্যাস নাই আমার। ওইকথা মানুষ মিথ্যা বলেছে। আর তোমার বাপের টাকা আমি পাঠিয়ে দিব দুইদিন পরে, সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমার। টাকাটা অনেক দরকার ছিল তাই এনেছি।

–কি কতক্ষণ ধরে তোমার বাপ,তোমার বাপ করছো? আমার বাবাকে আব্বা বলতে পারো না? আর তোমার গুন্ডামির জন্য আমার কত কথা শুনতে হয় জানো? টাকা দরকার ছিল ভালো কথা, আমাদের দোকান থেকেই আনতে হলো তোমার?

–না,পারি না। তোমার বাপকে আব্বা ডাকতে পারব না। আমার গুন্ডামির কথা কি আজকে নতুন শুনলে নাকি? আমি তো এমনই ছিলাম। সব জেনেই তো স্বইচ্ছায় আমাকে বিয়ে করেছো।

–তাই বলে তুমি ভালো পথে আসবেনা। তোমার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আমি তোমাকে বিয়ে করে
বড্ড ভুল করে ফেলেছি।

–ভুল তুমি করো নি,ভুল করেছি আমি তোমাকে পড়াশোনা করতে দেওয়ার সুযোগ দিয়ে। যেই মিথিলাকে হাজার কথা শুনালেও কোন উত্তর দিত না,সে আজ আমার কাজের কৈফিয়ত চাচ্ছে, আমাকে উঁচুগলায় কথা শোনাচ্ছে। মা ঠিকই বলতো..

–এখানে পড়াশোনা টেনে আনবে না একদম। কখনো কিছু বলি না বলে এই না যে আমি উচুগলায় কথা বলতে জানি না। আর তোমাকে খারাপ পথ থেকে সরিয়ে আনাটা কি আমার অপরাধ?

— হ্যাঁ,অপরাধ। যেখানে আমার বাবা-মা আমাকে কিছু বলে না সেখানে তুমি বলার কে? আজ থেকে তোমার পড়াশোনা বন্ধ। তুমি আর পরীক্ষা দিতে যেতে পারবে না। আজ থেকে এবাড়িতেই থাকবে।

— বললেই হলো নাকি? দুইদিন পরে আমার আরেকটা পরীক্ষা। আমি এখনি চলে যাব।

–তুমি যেতে পারবে না
বলে আরাফ আমাকে বিছানায় ধাক্কা মেরে ফেলে বাইরে থেকে দরজা আটকে চলে গেল।
আমি আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তাহলে কি আমার পড়াশোনার স্বপ্ন এখানেই শেষ। নিজের পছন্দে আরাফকে বিয়ে করে আমি বড্ড ভুল করেছি। বড্ড ভুল!
.
সন্ধ্যার পরে মা ফোন দিলেন, মাকে হাবিজাবি বুঝিয়ে ফোনটা রাখলাম।
.
.
অনেক রাতে আরাফ বাড়িতে ফিরে এলো। সাথে আইসক্রিম আর চকলেট। আমার হাতে দিয়ে বলল,

— আমার ওপর রাগ করে থেকো না মিথি। তখন রাগে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। খারাপ ব্যবহারও করে ফেলেছি, সরি। তোমার না আইসক্রিম-চকলেট পছন্দ তাই এগুলো এনেছি,
নাও। (আরাফ)

আমি চকলেট-আইসক্রিম হাতে নিলাম না। গাল ফুলিয়ে আরেকদিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।

–কি হলো রাগ কমে নি? আরে পড়াশোনা করতে দিব না বলে এত রাগ করেছো,? আমি তো এমনি বলেছি। কালকে সকালেই তোমাদের বাড়ি তোমাকে রেখে আসব।

আরাফের কথা শুনে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। ওকে বললাম,
–আর কখনো এরকম কথা বলবে না।

–আচ্ছা,বলব না। রাগ কমেছে?

–হুম।

–জানো, ঠিক করেছি আমি ভালো হয়ে যাব। আর জুয়া খেলব না। আমি ভাবছি বিদেশ চলে যাব।
.
.
পরদিন আরাফ আমাকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে আসলো।
পরীক্ষাও ঠিকঠাক মতো শেষ করলাম। এভাবেই কেটে গেল দুইমাস। আমার বাবু হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো। এরমাঝেই শুনলাম আরাফের কাগজপত্র ঠিকঠাক হয়ে গেছে। একসপ্তাহের ভিতরে সিঙ্গাপুর চলে যাবে। ওর চলে যাওয়ার কথা শুনে বুকের ভেতর চাপাকষ্ট জমা হলো। ওকে ছাড়া আমি থাকব কি করে? মানুষটা যে আমার ভরসা ছিল। যার মুখের দিকে আমি শ্বশুরবাড়ির হাজার কষ্ট মেনে নিতে পারি।
আরাফ দেশের বাইরে চলে যাওয়ার আগে আমার ফ্যামিলির সাথে ওর ঝামেলাটা মিটে গিয়েছিল। বাবা তার অনাগত নাতি/নাতনির কথা ভেবে সবকিছু ভুলে আরাফকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেয়।
.
আরাফ যেদিন সিঙ্গাপুরে চলে যাচ্ছিল সেদিন এয়ারপোর্টে আমি নিজের কান্না ধরে রাখতে পারি নি। ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি আমি। আরাফকে জিজ্ঞেস করি,

–আবার কবে দেখা হবে আমাদের? আমি যদি বাবু হতে গিয়ে ম/রে যাই, তাহলে আমাকে কি দেখতে আসবে?

–ধুর পাগলী। তোমার কিচ্ছু হবে না, আল্লাহ ভরসা।
খুব শীঘ্রই আমি চলে আসব। আর আমাদের ফোনে তো কথা হবেই।
বলেই আরাফ আমাকে ছাড়িয়ে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে চলে গেল। ওর চলে যাওয়াটা আমি পলকহীনভাবে তাকিয়ে দেখলাম। আমাদের যদি
আর কখনো দেখা না হয়?
আচ্ছা,এটাই কি আমাদের শেষ দেখা?

#চলবে?
#নিঝুম_জামান
#কেউ_কথা_রাখেনি

কেউ কথা রাখেনি পর্ব-০১

0

#সূচনা_পর্ব
#কেউ_কথা_রাখেনি
#নিঝুম_জামান

যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন বাবা-মায়ের সম্মানের কথা না ভেবে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে চলে আসি। তখন কল্পনাও করি নি এর পরবর্তী ফলাফল যে আমার জীবনটাকে নরকতুল্য করে তুলবে।

নাইনে পড়ি বয়স আর কতই বা পনেরো কিংবা ষোলো! চোখে তখন হাজারো রঙিন স্বপ্ন! আবেগের বশে ভালো- মন্দ কিছুই চিন্তা করে নিজের সুখের আশায় আরাফের সাথে পালিয়ে যাই।
পালিয়ে যাওয়ার দুইদিন পরে বাবা-মা আমাকে পুলিশের মাধ্যমে খুঁজে নিয়ে আসে। বাড়িতে এনে আমাকে মা অনেক মারে; কিন্তু মারলে আর কি হবে! মান-সম্মান যা নষ্ট হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।পুরো এলাকায়, বিশেষ করে চায়ের দোকানগুলোতে আমাকে নিয়ে খবর-বৈঠক চলতো।
আমাদের বাড়িতে দুই পরিবারের মধ্যে বিচার-শালিশ ডাকা হয়। বিচারে আমার বাবা- মা আমাকে আরাফের কাছে দিতে চায় নি। তারা আমাকে আরাফের কাছ থেকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ভীষণ জেদ করেছিলাম। বলেছিলাম আরাফকে না পেলে আমি বি/ষ খাব।
আমার জেদের কাছে হেরে বাবা-মা আমাকে আরাফের হাতে তুলে দিলো। আমার মা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,

“জীবনে অনেক ভুল করলি রে মিথি!! খোঁজ নিয়ে জেনেছি আরাফ মোটেও ভালো ছেলে না। বখাটে টাইপের ছেলে। তবে মা হিসেবে তোকে দোয়া করে দিচ্ছি, জীবনে যাতে সুখী হস।”

মায়ের কথাগুলো সেদিন শুনতে আমার বিরক্ত আর অসহ্য লাগছিল। মনে হচ্ছিল মা দুই লাইন বেশি বোঝে।
.
.
বাবা-মায়ের মতামতের মূল্য না দিয়ে শ্বশুরবাড়িতে নতুন সংসার বাঁধার আশায় পা রাখি।
শ্বশুরবাড়ির কেউই আমাকে দুইচোখে দেখতে পারত না। একমাত্র আমার হাজবেন্ড আরাফ ছাড়া। আরাফ ছিল বেকার। যার কারণে উঠতে-বসতে সকলের কথা শুনতে হতো। বাড়ির সবকাজ আমাকে দিয়ে করাতো। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় জীবনে নিজের কোনো কাজই করি নি। সেই আমি প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ঘরের রান্না থেকে শুরু করে সব কাজ করতাম। বাসন মাজা, পরিবারের সব সদস্যর কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা ; এককথায় বলতে গেলে বাড়ির চব্বিশ ঘণ্টার কাজের বুয়া। যখন একটু অবসর পেতাম তখন একটু বিশ্রাম নিতে গেলে শ্বাশুড়ি চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিত। তার সাথে ইন্ধন যোগাতো আমার ছোট ননদ তুলি। আর সংসারে শ্বশুর ছিল কাঠের পুতুল।শ্বাশুড়ি কথাই ছিল আসল কথা,তার মুখের ওপর কেউ কথা বলার সাহস পেত না।
.
আরাফ সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু এভাবে তো আর চলে না। পড়াশোনা করে নি আরাফ। ম্যাট্রিকে ফেল করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল। ওকে বললাম কোনো দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ নিতে। আমার কথা শুনে আরাফ আট হাজার টাকার বেতনে দোকানে কাজ নেয়। দোকানে কর্মচারী হিসেবে খাটবে একথা শুনে শ্বাশুড়ি তো আমার ওপর রেগে আগুন। তার ছেলে হয়ে অন্যের দোকানে কর্মচারী খাটবে, ব্যাপারটা তার মানসম্মানে লাগে। লোকে কি বলবে?

আমি তখন সাহস করে উত্তর দেই যে, বেকার বসে থাকার চেয়ে দু’টাকা উপার্জন করা ভালো।

আমার কথা শুনে শ্বাশুড়ির মুখে যত খারাপ কথা আছে সব আমাকে শোনায়। বাবা-মা তুলে গালিগালাজ করে। মনে মনে অনেক খারাপ লাগছিল কিন্তু এত গালি শোনার পরও আমি কোন প্রতিবাদ করতে পারি নি। ছোটবেলা থেকেই আমি চাপা স্বভাবের। কাউকে কিছু বলতাম না। ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে দোষ না থাকা সত্ত্বেও মার খেয়ে আসতাম। আবার আমাকে কেউ হাজারকথা শুনিয়ে দিলেও আমি কোন উত্তর দিতাম না। এখনো কেউ কিছু বললে তার প্রতিবাদ করতে পারি না। শুধু নিজেকে এককথা বলে সান্ত্বনা দেই,
” একচুপ শত সুখ।”
.
এর মাঝে অনেকদিন কেটে গেছে।একদিন হঠাৎ শ্বাশুড়ি আমাকে ডেকে বলেন,
— মিথিলা মা আমার, এদিকে আয়। তোর সাথে কিছু কথা আছে।

শ্বাশুড়ির মুখে ‘মা’ ডাক শুনে সপ্তাশ্চর্য হয়ে গেলাম। এবাড়িতে আসার পর থেকে তিনি কোনোদিন ভালো করে ডাক দিয়ে দেখেন নি, সারাক্ষন ঝাড়ির ওপর রাখতো। আজ তিনিই কিনা ‘মা’ বলে সম্বোধন করছেন। আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম তার দিকে। আমি আমাকে সোফায় তার পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

— দেখ.. আরাফ যদি অন্যের দোকানে কর্মচারী খাটে, তাহলে ব্যাপারটা আমাদের জন্য কেমন অসম্মানের দেখায় না? তার চেয়ে তুই এক কাজ কর তোর বাপের বাড়ি কিছু টাকা নিয়ে আয় সেই টাকা দিয়ে আরাফ ব্যবসা করবে না হয় বিদেশে চলে যাবে।

আমি কিছু টাকার কথা শুনে আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম,

–কিছু টাকা বলতে আসলে কত টাকা আম্মা?

–এই ধর, পাঁচ-সাত লাখ টাকা। তোর বাপের তো টাকা-পয়সার কমতি নেই। একটাই মেয়ের জামাই,তাকে দিবে না তো কাকে দিবে?

ওনার কথা শুনে আমার মাথা রীতিমতো ঘোরাচ্ছে।
পাঁচ-সাত টাকা নাকি কিছু টাকা মনে হয়। তবে বাবা-মায়ের কাছে আবদার করলে না দিবে এমন না কিন্তু আমি টাকা চাইব কোন মুখে? তাদের কথার তোয়াক্কা না করে আরাফের সাথে চলে এসেছি, এখন টাকা চাইতেও তো লজ্জা লাগবে।

–কিরে মা? কিছু বলবি না।

আরাফের মায়ের এমন মধুর সুরের কথা শুনে মিথিলা বলল,

–আচ্ছা, আম্মা আমি ভেবে দেখব।

মিথিলার এমন অনিশ্চিত কথা শুনে আরাফের মায়ের ভালো লাগলো না। মিথিলার আড়ালে মুখ ভেংচি কাটলো।
.
.
.
বিয়ের পরে এই প্রথম আমাদের বাড়ি গেলাম। আমার মা আমাকে দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! মায়ের কান্না দেখে আমিও কেঁদে দিই।
মা আমার গালে-মুখে চুমু দিতে দিতে ভরিয়ে ফেলে।তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করে,

— শ্বশুরবাড়িতে ভালো আছিস তো মিথি? তোকে সবাই ভালোবাসে তো?

আমি কি উত্তর দিব ভেবে পাচ্ছি না। আরাফ ছাড়া কেউ আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে না। সকলে ঝাড়ির ওপরে রাখে। বাড়িতে থাকতে আমাকে খারাপ ব্যবহার তো দূরে থাক, কেউ কোনোদিন গলা উচু করে একটা ধমকও দেয় নি। সেই আমার সাথে শ্বশুরবাড়িতে কি খারাপ ব্যবহার করে! তার একমাত্র কারন আমি পালিয়ে বিয়ে করেছি। মাকে চোখমুখ মুছে হাসি মুখে উত্তর দিলাম,

–হ্যাঁ, মা খুব আছি। তারা আমায় খুব ভা-ভালোবাসে।

মাকে মিথ্যা বললাম কারণ মা জানলে ওই বাড়িতে আমাকে আর যেতে দিবে না আর আমিও আরাফকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমার এক কাজিন রীতি আপুকে বলতে শুনতাম, শ্বশুরবাড়িতে সবকিছু চুপচাপ মানিয়ে নিতে হয়। না হয় সংসারে অশান্তি হয়।

–তোর কথা বলার ধরণ শুনে বিশ্বাস হচ্ছে না মিথি।
তারপর মা নিজে নিজেই বিলাপ করে কেঁদে কেঁদে বলা শুরু করলো,

–তুই কেনো একাজটা করলি? কেনো পালিয়ে গেলি? তোর বয়সই বা কত? তুই সংসারের তো কিছুই বুঝিস না। আমি জানি ওরা আমার মেয়েটাকে ভালোবাসে না। কষ্ট দেয়, অনেক কষ্ট দেয়।

মায়ের কথা শুনে আমার চোখ বেয়ে নি:শব্দে পানি পড়তে লাগলো। সত্যিই পনেরো বছরের একটা ছোট মেয়ে আমি তার ওপর শ্বশুরবাড়িতে সবকাজ একা হাতে সামলাই।

–মিথি, তুই ঠিকমত পড়াশোনা করিস তো? নাকি সেটাও ছেড়ে দিয়েছিস?

–মা, আমি আরাফকে আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। ও বলেছে ওর মায়ের কথা-ই শেষ কথা। আমার শ্বাশুড়ি মা পড়তে দিতে চান না। তিনি বলেন, বাড়ির বউদের এতো পড়ে কি লাভ? বেশি পড়লে বউরা জামাইয়ের মুখের ওপরে কথা বলে। গুরুজনদের সম্মান করতে চায় না। যেখানে আরাফই স্কুলের পাঠ চুকাতে পারে নি সেখানে তার বউয়ের শিক্ষিত হলে ওকে দাম দিবে না।

আমি শ্বাশুড়ি আম্মাকে অনেক বোঝানোর ট্রাই করেছি । কিন্তু তিনি আমার পড়াশোনার ব্যাপারে কোন কথাই শুনতে চান না।

— ছিঃ তোর শ্বাশুড়ির মন-মানসিকতা এত নিচ! তারা মোটেও ভালো মানুষ না।
কিন্তু তোকে তো উচ্চ শিক্ষিত হতে হবে। তোর পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হবে। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ইউনিভার্সিটির প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই আমার পরিবার বাধ্য করে বিয়ের পিঁড়ি বসতে। বিয়ের আগে তোর নানা আমাকে বলে বিয়ের পরে যত ইচ্ছে পড়িস তারা বলেছে তোকে পড়াবে। কিন্তু বিয়ের পরে তোর দাদীর সাথে পড়াশোনার ব্যপারে কথা বলতে গেলে তিনিও তোর শ্বাশুড়ির মত কথা বলেন।
জানিস মিথি আমার না খুব ইচ্ছে ছিল আমি পড়তে পারি নি তো কি হয়েছে! তোকে উচ্চ শিক্ষিত বানিয়ে সেই আশা পূরণ করব। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস!

কেঁদে কেঁদে কথাগুলো মা বললেন। মায়ের কথা শুনে আমার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠল। সত্যিই তো মেয়ে হিসেবে আমার উচিত ছিল মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা। কিন্তু নিজের দেখা আবেগীয় রঙিন স্বপ্ন দেখে জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছি, যার পরিণাম এখন ভোগ করছি। হয়ত বাবা-মায়ের অমতে বিয়ে করার শাস্তি পাচ্ছি আমি।
.
রাতে বাবা বাড়ি ফিরলে আমাকে দেখে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। আমি বাবা বলে গলা জড়িয়ে ধরতেই বাবার সব মান-অভিমান নিমিষেই চলে গেল। অনেকদিন পরে বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের সাথে রাতের খাবার খেলাম।
.
পরদিন মায়ের সাথে আমি স্কুলে যাই। মা স্কুলের আগের বেতন পরিশোধ করে স্যার-ম্যাডামদের সাথে আমার পড়াশোনার কথা বলে যাতে আমি রেগুলার স্কুলে যেতে না পারলেও যাতে তারা আমাকে পরীক্ষা দিতে দেয়; আরো অনেক কথাবার্তা বলে। বাড়ি এসে আমার নিজেকে অনেক হালকা লাগে, অন্তত এতদিনে মায়ের একটা স্বপ্ন পূরণ করার লক্ষ্যে নেমেছি।
বাড়ি আসার দুইদিন পরে মাকে কথায় কথায় শ্বাশুড়ির টাকা চাওয়ার ব্যাপারটা খুলে বলি। আমার কথা শুনে মা কিছুক্ষন আমার মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আমাকে বলে বাবা বাড়ি ফিরলে মা এ নিয়ে কথা বলবেন। বাবার সাথে মা এ ব্যাপারে কথা বললে বাবা কিছু বলে না। আমি ভেবেছি হয়ত বাবা টাকা দিবে না, কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বাবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বাবা আলমারি খুলে আমার হাতে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে বলে,

–“আরাফকে বলিস এ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে। অযথা খরচ করিস না। তোর বিয়ের জন্য টাকাগুলো জমানো শুরু করেছিলাম ব্যাংকে। ”

বাবাও আমার বিয়ে নিয়ে হয়ত অনেক স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু আমি কি কাজটা করেছি? নিজের কাছেই নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে। বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম তারপর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমার শ্বশুরবাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে বেশি দূরে না। রিকশা দিয়ে যেতে আধাঘন্টার মতো সময় লাগে। আমি একাই বাপের বাড়ি গিয়েছিলাম এখন একাই ফিরছি, শ্বশুরবাড়ির কেউ আমার সাথে যায় নি। এমনকি আরাফও না। কারণ আমাদের বাড়ির সাথে শ্বশুরবাড়ির সম্পর্ক খুব একটা ভালো না।
শ্বশুরবাড়ি ফিরে শ্বাশুড়ির হাতে টাকা দিয়ে বললাম,

— এই নিন টাকা আম্মা। বাবা বলেছে এই টাকা দিয়ে আরাফকে ব্যবসা করতে, অযথা খরচ করতে নিষেধ করেছে।

আমার হাতে টাকাগুলো দেখে শ্বাশুড়ির চোখে-মুখে হাসির ঝলক দেখা গেল। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

–যাও মা, হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে হয়ে নাও। তুমি আজকে কি খাবে সেটা আগে বলো?

শ্বাশুড়ি আম্মার কথা শুনে আমি এক মুহূর্তে কথা হারিয়ে ফেললাম। আমাকে মা বলে সম্বোধন করছে, তার ওপর আবার আমি কি খাব? সেটা জানতে চাইছে।একটা মানুষ কীভাবে এতো পরিবর্তন হয়ে গেল? আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে রুমে চলে এলাম।
.
রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো আরাফ মার্কেটে একটা দোকান ভাড়া নিয়ে সেখানে কসমেটিকসের বিজনেস করবে। তবে শ্বাশুড়ি আম্মা আকারে-ইঙ্গিতে আমাকে বারবার আরো বেশি টাকা এনে দেওয়ার কথা বলছিল। আমি সব বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলাম।

চলবে

নব্যদিনের সূচনা পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

0

#নব্যদিনের সূচনা
হুমাইয়া হুর
(৭)

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করছিলাম নিজেকে। পেটটা কিছুটা ফুলে উঠেছে। মুখ গুলোও যেন আগের তুলনায় গোল গোল লাগছে।জীবনে কি থেকে কি হয়ে যায় তা আমাদের চিন্তায় উর্ধে। কখনো ভাবতে পারি নি আমার জীবনে এমন সুখের অনুভুতি আসবে।তবে সুখ কি টিকবে আমার জীবনে? নাকি কালবৈশাখীর সূচনা ঘটবে?

সময় বহমান।কারো জন্য অপেক্ষা করে না।মুগ্ধ এবং আমার বিয়ের পাঁচ মাস হতে চলল।আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।আগের মত ঝগড়া এখন আর হয় না।আমাদের সম্পর্ক টা আট দশটা স্বামী স্ত্রী মত হয়ে গিয়েছে।অবশ্য শুরুটা মুগ্ধ নিজেই করছিলো । মনের ভিতরে নতুন নতুন অনুভূতি তৈরি করেছিলো।ভালোবেসে ফেলেছিলাম মুগ্ধের পাগলামি কে।

এখন আমি আর কিয়া আপু হোস্টেলে থাকি না। বড় বাবা অর্থাৎ আমার বড় চাচ্চা আমাদের একটা ফ্লাট কিনে দিয়েছে। আমি মুগ্ধ আর কিয়া আপু সেখানেই থাকি। ভার্সিটি ও যাওয়া হয় না শারীরিক অসুস্থতার জন্য। তিন মাসে প্রেগন্যান্ট আমি।ছোট একটা জান আমার ভিতর বেড়ে উঠছে।আমি যেন অনুভব করতে পারছিলাম সেটা। সোহানের ভয়ে আমার এখনো ভার্সিটি যাওয়া হয়ে উঠেনি।কিয়া আপু আমার সব নোট নিয়ে আসতেন।আমার পড়াশোনায় হেল্প করতেন । মুগ্ধ বড় চাচার বিজনেসে জয়েন করেছে। কিন্তু দিন কয়েক পর সেমিস্টার ফাইনাল।তাই এখন ভার্সিটি যেতে হবে।মা হবো জেনে মুগ্ধ আমায় কোনো কাজই ই করতে দিতো না।এমনকি পরিক্ষা দিতেও দিবে না। কি পরিক্ষা না দিলে কি হয়। তাই রাজী করালাম।

এত দিন যাওয়ার পর মন থেকে সোহানের ভয় কমে গিয়েছিল ভেবেছিলাম সোহান হয়তো আমার পিছু ছেড়েছে। সেদিনের পর থেকে সোহানের সাথে আমার কোনো কথা হয় নি।

যেহেতু পরিক্ষা ভালো মতোই পড়া পড়তে হবে।কিয়া আপু আর মুগ্ধ মশাই যতটা পারত আমার খেয়াল রাখত।একা ছাড়তো না কখনো।

প্রথম দিন পরিক্ষায় ভার্সিটি যাওয়া সময় ভয়ে ভয়ে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম সোহান হয়তো আমায় খুজে পেয়ে যাবে।কিন্তু এমন কিছু মনে হয় নি।তবে মাঝে মাঝে মত হতো কেউ হয়তো গভীর ভাবে আমাকে দেখতে।চারপাশে কেউ ছিলো না তেমন।তবুও ভয় ভয়ে কাটত দিনগুলো।

সেমিস্টার ফাইনাল শেষ এক মাস আগে। প্রেগনেন্সি চার মাস চলছিলো।দিন গুলো হাসি তামাশার মধ্যেই যাচ্ছিলো আমার।তবে শরীর টা ভালো না তেমন। বাড়ি থেকে কল এসছিলো।বড় চাচা অসুস্থ। কিয়া আপু সেখানে গিয়েছে।আমার অসুস্থতার কারনে মুগ্ধ যেতে পারেনি।

সেদিন সকাল থেকেই আকাশে ঘন কালো মেঘ।দিন চারেক যাবৎ বৃষ্টি যেনো থামছেই না।সকাল থেকে আকাশ যেনো অভিমান করে ছিলো।ধুম করে বজ্র পড়ার শব্দের মুহুর্তে মধ্যেই শুরু হলো তুমুল ঝড়। প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো আমার সেদিন।বাতাশের শব্দ, গাছপালার নড়াচড়ার শব্দ বিদ্যুৎ এর ঝলকানি যেন ভয়ানক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলো সেদিন।এমনি সময় ভয় না লাগলেও সেদিন কেন জানি খুব ভয় পেয়েছিলা।বড় চাচা অসুস্থ।হার্ট এট্যাক এসেছিলো তার। তুমুল বর্ষনের কারনে মুগ্ধ সেদিন হসপিটালেই আটকা পড়েছিলো।বার বার আসতে চাইলেও আমি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলাম দরকার নেই।কে জানত এটাই কাল হয়ে দাড়াবে আমার জীবনে?

বিকেল পেড়িয়ে সন্ধা হয়ে আসল।কি করবো ভেবে পাচ্ছাছিলাম না।এমনি সময় হলে মুগ্ধ বা কিয়া আপু পাশে থাকে।মনেই হয় না যেনো একা আছি।কোনো কিছু ভালো লাগছিলো না।মুগ্ধ কে ফোন করছিলাম কিন্তু তার ফোন লাগছিল না। হয়তো বৃষ্টির কারণে নেটওয়ার্কের সমস্যা হয়েছিল।কি করবো যখন ভেবে পাচ্ছিলাম না তাই ভাবকাম কিছুক্ষন টিভি দেখি।হটাৎ দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল।এ সময় আবার কে আসবে? মুগ্ধ নয়তো? ও আসবে আগে জানায় নি তো ? আসতেও পারে।ভাবতে ভাবতে দরজাটা আমি খুলে দিয়েছিলাম কিন্তু দরজার ওপরে যা দেখলাম তা দেখে আমার ভয়ে নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল। সামনে মুগ্ধ নয় বরং দাঁড়িয়েছিল সোহান।যে দেখে আমার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সোহান এখানে কিভাবে আসলো? তার তো এখানে ঠিকানা জানার কথা নয়। এখন কি করবো আমি? হাগের শিরা উপশিরা যেনো ঠান্ডা হয়ে আসছিলো আমার।তাড়াতাড়ি করে দরজা আটকে দিতে চাইলাম।কিন্তু সোহান আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। দরজা টা লগিয়ে দিলো।ভয়ে আমার পা থরথর কাপছিলো। সোহান আমার কাছে আসতে লাগলে। আমার ওড়না টা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে নিল।আমি কোনোরকম সরে গিয়ে নিজেকে কিয়া আপুর রুমে আটকে নিলাম।প্রচন্ড বেগে কান্না শুরু করলাম। আল্লাহ এবার কি আমার সহায় হবে না?

রুমের ভিতর ফোন খুজতে থাকলাম। আমার ফোনটা টিভির রুমে। আসলে ভাগ্য পাশে না থাকলে যা হয় আর কি । ফোনে রুম ও ছিলো না। সোহান অনবরত দরজা ধাক্কাছে।এক পর্যায়ে ভেঙে ফেলল দরজা টা।আমার চুলের মুঠি বরাবর ধরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে।নিচে পড়তে যেয়ে বিছানার চাদদের কোনা ধরে ঠাই হয়ে দাড়িয়ে রইলাম আমার যা কিছু হয়ে যাক আমার বাচ্চা টা যেনো বেঁচে যায়।সোহান আমার দিকে তেড়ে আসলো।সোহানের নিশ্বাস যেন আমার ঘাড়ের উপর পড়ছিলো।মুখটা আমার কানের কাছে নিয়ে বলল,

`কি ভাবিয়াছিলা সুন্দরী। তুই আমার সামনে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়িয়া বেরাবি আমি চেয়ে চেয়ে দেখব? ওহ নো যদি ভেবে থাকো তাহলে সেটা তোমার ভুল।শুনলাম বিয়ে করে বাসর নাকি সেড়ে ফেলছো? এই এই আমার মধ্যে কি করতি ছিলো রে? তোর জন্য আমার এত বড় লস হয়ে গেলো।আমার ক্লায়েন্ট আমার থেকে সব টাকা নিয়ে গেলো,আর তুই ভাবলি এই সোহান তোকে ভুলে গিয়েছে? হা হা হাসালি।আমি ফাঁদ পেতেছিলাম।আর তুই নিজেই ধরা দিয়েছিস। দেখ আজ তোর সামনে আমি। ঐ দিন তো রীতি আমাকে তোর সাথে কিছু করতে দেয় নি।আজকে কে বাচাবে তোমায় খুকি? শেষ মেষ এই সোহানের হাতেই তো ধরা দিলি’

বলে আমায় ছেড়ে দিয়ে গড়া ফাটিয়ে হাসছিলো সেদিন।আমি যেন অসহায় ছিলাম।আমরা মেয়েরা যতই সাহসীকতার কথা বলি? কিন্তু একটা সময় দুর্বল হয়ে পড়ি।মুগ্ধ কোথায় আপনি।

সোহান আমার মুখ চেপে ধরল। আমি যেনো চেষ্ঠা করছিলাম তার থেকে নিজেকে বাঁচানোর।
,হাতের কাছে একটা কলম পেলে তা সোহানে চোখের বসিয়ে দিতে গেলে সোহান আমার হাত চেপে ধরে। ধস্তা`ধস্তির এক পর্যায়ে সোহান সোহানের হাত এ আমি কলমের নিপ বসিয়ে দেই। সোহান ব্যাথায় আমার হাত ছেড়ে দেয়।সুযোগ বুঝে আমি দৌড় দেই টিভির রুমে।ফোন টা হাতে নিয়ে অনবরত মুগ্ধের ফোনে কল দেই।কল ঢুকছিলো না।বৃষ্টির কারনে নেট ওয়ার্ক ও যেন পাচ্ছিলো না।এখন আমি কি করব?

ততক্ষণে সোহান চলে এসেছিলো আমার কাছে।তার নীলাভ চোখ যেন রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিলো। নিজের বেল্ট খুলে আমায় মারতে শুরু করল। হটাৎ একটা বাড়ি লেগে উঠল আমার পেটের উপর। ব্যাথায় কুকড়িয়ে উঠলাম আমি। কোনো মতে সোহনের পা ধরে মিনতি করতে লাগলাম আমায় যেন ছেড়ে দেয়। আমার বাচ্চাকে যেনো মেরে না ফেলে।

বাচ্চার কথা শুনতেই সোহান থেকে গেলো।নিষ্প্রাণ নিস্তব্ধ চোখে আমার দিক তাকালো।ভাবলাম এবার হয় তো আমায় ছেড়ে দেবে। আমাকে ভুল প্রমাণিত করে সোহান ঘর কাপিয়ে উচ্চস্বরে হাসতে লগলো।সোহানের হাসিতে যেন নৃশংসতা বিরাজ করছিলো।সোহান ধীরে ধীরে আমার কাছে আসতে লাগল।

ভোর রাত। রাতের বাবার শরীর বেশি খারাপ থাকায় আর তুমুল ঝড় হওয়ার কারণে মুগ্ধ বাসায় যেতে পারে নি।মেঘনাকে অনেক বার কল করেছে কিন্তু অপাস থেকে নট রিচেবেল শব্দটি ভেসে আসে। তাই বাবার শরীর কিছুটা ভালো হলে সোহান বাসার উদ্দেশ্য রওনা দেয়।বাসায় এসে দরজার এক্সট্রা চাবি থাকায় লক খুলতে সমস্যা হয়নি মুগ্ধের।বাসায় ঢুকে চার পাশ এলো মেলা হয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে যায় মুগ্ধ। তবে মেঘনার কিছু হলো না তো।সারা ঘরে মেঘনাকে খুঁজতে থাকে।মনে যেন তার কি ডাক গাইছিলো।রান্নাঘরে যেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মুগ্ধ। বাকরুদ্ধ হয়ে যায় মুগ্ধ। তার সারাপৃথিবী যেন উলটো হয়ে যায় এক মুহুর্তে।

রক্ত দিয়ে তলানো রান্না ঘরে মেঝে।মেঘনা..

সমাপ্ত।

নব্যদিনের সূচনা পর্ব-০৬

0

#নব্যদিনের সূচনা
হুমাইরা হুর
(৬)

চারিপাশে ফুলের গন্ধে মো মো করছে। রঙ বেরঙের ফুল দিয়ে পুরো রুম সাজানো হয়েছে। চারপাশে জন্য ফুলের মেলা বসেছে।

ভয়, জড়তা, অস্থিরতা সব কিছু নিয়ে বসেছিলাম বাসর ঘরে।হ্যা বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার তাও পারিবারিক ভাবে।কখনো ভাবতেও পারি নি মুহূর্তের মধ্যে আমার জীবন এভাবে বদলে যাবে। নব্যদিনের সূচনা হলো তবে?

কিছুদিন আগে…

সোহানের কল আসার পর নিজেকে যেন পাগল মনে হচ্ছিল। সাথে সাথে কল কেটে দিয়েছিলাম। যার ভয়ে আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম সে রাজশাহী আসছে।ভাবতেই গলা শুকিয়ে আসছিলো।তাহলে কি বিপদ আমার পিছু ছাড়বে না? হটাৎ ফোনে টুংটাং করে শব্দ আসল।চেক করে দেখলাম সোহান এর মেসেজ।

মেসেজে লেখা ছিল —

`খুব বাড়া বেড়ে ছিলিস তাই না? ডানা গজিয়েছে গিয়েছিল, সমস্যা নেই যতদিন আমি না আসছি উঠে নে। ইচ্ছেমতো উড়ে নে।আমি আসছি, সোহান আসছে তোর ডানা কাটতে রাজশাহীতে।ভেবেছিলি রাজশাহী যেয়ে আমার থেকে পার পেয়ে যাবি? আর আমি পুলিশ হয়েও তোর খোঁজ পাবনা? এতটাই বোকা মনে হয় তোর আমাকে? তুই যে ভার্সিটিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ফুড়তি করছিস তা আমি ভালোভাবে জানি।তুই যে আমার সেনার ডিম পাড়া হাঁস তোকে ছেড়ে থাকি কি করে বল?`

মেসেজটা পড়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।হাত পা থরথড় করে কাপছিলো।না আমি আবার সেই নরকে ফিরে যেতে চাই না, খুব কষ্ট করে এখান পর্যন্ত এসেছি।আবার ফিরতে চাই না, যে করেই হোক বাঁচতে হবে আমার।তাড়াতাড়ি ফোনটা বন্ধ করে রাখলাম। না ফোনটা কাছে রাখা যাবে না।গায়ে উড়না জরিয়ে নিয়ে হল থেকে বের হয়ে গেলাম।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়েছে। সেই বাটন ফোনটা বেচে দিলাম। আর সিম টাও ফেলে দিলাম সামনে থাকা ড্রেনে। জমানো টাকার ভিতর হাজার তিন টাকা দিয়ে পুড়োনো একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফোন আর নতুন কিনলাম।ফোন ছাড়া চলা দুষ্কর।

দিন চারেক পার হয়ে গেলো আমার ভয়ে ভয়ে।কখন সোহান চলে আসে সেই ভয়ে রাতে ঘুম ও হতো না। যতই হোক আমি মেয়ে।আর সোহান পুলিশ।পুলিশের কাছে যেয়েও কোনো লাভ হবে বলে মনে হলো না।আজ কিয়া আপু তার বাড়ি চলে যাবে।এই মানুষটা আমায় অনেক সাহায্য করেছে।হলে হাতে গোণা খুব কম ছাত্রী ই রয়েছে।যে যার যার বাসায় চলে গিয়েছে।কিয়া আপু আমাকে একা রেখে চলে যেতে চাইছিলো না। আমি জোর করায় রাজি হলো। কিয়া আপু আর আমি এক সাথেই বের হলাম। আপুর উদ্দেশ্য তার বাড়ীর পথে যাওয়া আর আমার বাজারে যাওয়া।

আপুকে বিদায় দিয়ে বাজারের উদ্দেশ্য যাচ্ছিলাম।হটাৎ নজরে পড়ল মন কেড়ে নেওয়া নীলাভ চোখের সেই সু্র্দশন ছেলে টার উপর। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো।সামনে সোহান দাড়িয়ে ছিলো।তাহলে সোহান কি আমায় খুঁজে পেয়ে যাবে? কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। সোহান কে পিছন দিকে তাকাতে আমি আড়াল হয়ে গেলাম। না আমাকে পালাতেই হবে।

কিন্তু এখানে থাকলে তো সোহান আমাকে খুজে পেয়ে যাবে।তড়ি হড়ি করে কিয়া আপুকে ফোন করলাম।তিনি অনেক বার তার সাথে যাওয়ার জন্য জোড় করেছিলেন।কিন্তু আমি রাজী হয় নি। কিয়া আপুকে ফোন দিয়ে হল এ আসতে বললাম।আপুকে অগত্যা হলে আসতে হলো৷ আসলে আমি তার সাথে তার বাড়ি যাওয়ার বায়না করলাম।কেননা সোহানের থেকে বাঁচতে হবে আমার এই মুহুর্তে এখান থেকে দুরে যেতে হবে। আমি যাওয়ার কথা বলতেই কিয়া আপু খুশি তে আমায় জরিয়ে ধরলেন।তিনি যেন এটাই চাইছিলেন।রেডি হয়ে কিয়ার আপুর সাথে রওয়ানা হলাম।জানি না কি হতে চলেছে আগামীতে?

রাজশাহী গ্রামের দিক এটা।গ্রাম হলেও পুরোপুরি শহরের ভাব হয়ে গিয়েছে জায়গাটায়। খুব দূরে না হল থেকে জায়গাটা। যাতায়াতে ঘন্টা এক সময় লাগে। কিয়া আপু ভ্যানের ভাড়াটা মিটিয়ে দিলো।সামনে দেখতে পেলাম দোতলা ডুপ্লেক্স বাড়িটা।বাইড়ে থেকে দেখতে খুব ই সুন্দর লাগছে।মনে হচ্ছে কোনো এক রাজার অট্টালিকা। কিয়া আপুকে দেখে দাড়োয়ান তাড়াতাড়ি এসে গেট খুলে দিলাম। দাড়োয়ান চাচা যেন কেমন অদ্ভুত নজরে আমাকে দেখছিলো। বিষয়টা কেমন জানি লাগলো।কিয়া আপুর পেছন পেছন বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

বাড়িটার নিখুত ডিজাইন যেনো যে কারো মন কেড়ে নেবে।হয়তো বাড়ির মালিক অনেক সৌখিন।বাড়ির সামনে যেন বাগান করা।আশ্চর্য নিখুত ভাবে বাড়িটার ডিজাইন লক্ষ করে বুঝেছিলাম কিছু আমাদের বাড়ির মত। যদিও সে বাড়িটা বাবা মারা যাওয়ার পড় মা বেচে দিয়েছিলেন পরে নতুন স্বামী কে নিয়ে নতুন আরেক বাড়ি কেনেন।

যাক সেসব। কিয়া আপু তার বাড়ি নিয়ে গেলেন আমাকে।বাড়িতে ঢুকতেই দুটো পিচ্চি এসে আপুকে জড়িয়ে ধরল। পিচ্চি গুলো দেখতে মাশাল্লাহ। কেয়া আপু বললেন পিচ্চি দুটো তার ছোট চাচার মেয়ে।পিচ্চি গুলো আমায় দেখে আমার দিকে এসল। আবার দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছিলো যেন আমি ভুত। পিচ্চি গুলোর চেচামেচি তে বাড়ির লোকজন সব বের হয়ে আসলো।কিয়া আপুর মা এসে কিয়া আপুকে জড়িয়ে ধরলেন।সবাই কেয়া আপুকে দেখে অনেক খুশি হলেন।তাদের দেখে মনে হচ্ছে অনেক অভিজাত্য তা বিরাজ করছে। কিয়া আপুকে দেখে কখনো ভাবিনি তিনি এত বড় বাড়ির মেয়ে। তার মধ্যে আমি কখনো কোনো অহংকার দেখি নি। কিয়া আপু বাড়ির সবার সাথে তার রুমমেট বলে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগল।বাড়ির সবাই যেন কেমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার আসায় তারা খুশি হন নি।সৌজন্যের খাতিরে ভালো ব্যবহার করছে।। কিন্তু আমার করার যে কিছু নেই সোহান হন্নতন্ন হয়ে আমায় খুজছে।ওখানে থাকলে তো যোকোনো সময় আমার খোজ পেয়ে যাবে।তাই অনিচ্ছাকৃত আমার এখানে আসতে হয়েছে। কিয়া আপুর একজন কাজের লোককে ডেকে আমাকে আমাকে তার রুমে রেখে আসতে বললেন।কিয়া আপু নাকি তার দীদুনের সাথে দেখা করতে যাবে।তিনি নাকি প্যারালাইসড।কথা না বাড়িয়ে কাজের লোকের সাথে আমি কিয়া আপুর রুমের দিকে চলে গেলাম। জার্নি করার ফলে অনেক কান্ত লাগছিলো।তাই ফ্রেস হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঘুম ঘুম ভাঙতেই দেখি কিয়া আপু পাশে বসে আছে।রাত হয়ে গিয়েছে।সেই ঘুমিয়েছিলাম দুপুরে।আমাকে দেখে কিয়া বলে উঠল খাওয়া কথা। কিয়া আপু আমাকে নিয়ে খাবার টেবিলে বসালেন। একে একে বাড়ির সবায় এসে টেবিলে বসলেন।কিয়া আপুর আব্বু আসলেন।সকালে দেখি নি তাকে।

কিয়া আপু আমাকে খেতে বললেন।সবার বলায় আমি খাওয়া শুরু করলাম।কিয়া আপুর আব্বু আমার পরিবারের কথা জিগ্যেস করলেন। আমি খেতে খেতে উওর দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার বাড়ির কথা জিগ্যেস করতেই খাওয়া থামিয়ে সবার দিকে তাকালাম সবাই কেমন করে যেন আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। আশ্চর্য তারা এমন ভাবে কেন তাকিয়ে আছে?ঠিকমত খাবার যেন খেতে পারছিলাম না।কিয়া আপুর বাবা আর ফুফু যেন নিজে উঠে এলেন আর আমার পাতে খাবার বেড়ে দিলেন। দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।হটাৎ করে এত আদর যত্ন কিভাবে। কেনো মতে খাওয়া শেষ করলাম।

পরের কিয়ার আপুর বাবা আমায় ডেকে পাঠালেন। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম তা দেখে আমি মুহুর্তের মধ্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম।আমার দিদুন বিছানায় শুয়ে আছেন। তার চেহারা আমার আবছা আবছা মনে ছিলো।কিয়া আপুর বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

রাজিব আমায় ফোন দিয়েছিয়ে বলেছিলো সায়নের মেয়েকে সাথে আজ সে কথা বলেছে।রাজীব হলো আমার বাবার সেই লেকচারার বন্ধু । আমিও আফনান কে তোর ব্যাপারে খোজ নিতে বললাম।কিন্তু সকল তথ্য দেওয়ার আগেই রাজীব অসুস্থ হয়ে হার্ট অ্যাটাক এ মারা গেলো। তোকে আর খুজে পাওয়ার আসা নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। সায়ন মারা যাওয়ার পর তোর মা রিয়াদকে বিয়ে করে নিলো।আমরা তোকে আসতে চাইলেও মুনিয়া তা হতে দিলো না।বাড়ি গাড়ি সব বেচে কোথায় চলে গেলো।আমরা তোর খোজ ও পেলাম না।রাজীব যেদিন ফোন দিয়েছিলো নতুন করে যেন আশার আলো পেয়েছিলাম।কিন্তু তাও যখন শেষ হয়ে গিয়েছিলো নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হতো।নিজের ভাইয়ের অংশকে আমি দেখে রাখতে পারলাম না । একদিন কিয়ার সাথে কথা বলার সময় কথায় কথায় মেঘনা নামটা উঠে এসেছিলো। আমি ততটা গুরুত্ব দেই নি।কিন্তু আজ তোকে দেখার পর আমার সায়নের কথা মনে পড়ে গিয়েছিলো। তোর ভার্সিটিতে খোজ লাগিয়ে জানতে পারি তুই আমদের সায়নের ই মেয়ে।আমাদের সিদরাতুল।

কথা গুলো শুনে আমি যেন বাকহারা হয়েগিয়েছিলাম।তাহলে কিয়া আপু আমার চাচাত বোন আর কিয়া আপুর বাবা আমার আপন বড় চাচা।তাহলে কি আমার পরিবার আমি খুজে পেয়েছি? অজান্তেই নিজের বাড়ি চলে এসেছি? এটাকি ভাগ্যের খেলা? বিষাদ ময় জীবন থেকে সুখ সাগরে চলে এসেছি?

বাড়ির সবায় কে সত্যিটা জানালে সবায় অনেক খুশি হয়।সবথেকে বেশি খুশি হয় কিয়া আপু।নিজেকে আমার বোন রুপে পেয়ে তিনি যেন অনেক খুশি।আমি খুশি হতে পারছিলম না।তাহলে কি সব দুঃখের অবসান ঘটবে?

দেখতে দেখে দিন তিন চলে গেলো।পরিবার পেয়ে যেনো আমি অনেক খুশি।সবায় আমাকে খুব ভালোবাসে।বড় চাচা মনে হয় আমার প্রতি জান উজার করে দেন।সেদিনই এত গুলো জামা এনে দিলে সাথে নিউ মডেলের আইফোন। যেখানে আমি তিন হাজার এর সেকেন্ডে হ্যান্ড ফোন চালাতাম সেখানে আমার কাছে লাক্ষ টাকার উপরে ফোন।

ঈদের আগের রাত, চাঁদ রাত।বাড়ি ভর্তি আয়োজন।মেহেদী গন্ধে চারিপাশ মো মো করছে। জীবনের সেরা ঈদ যেন আজ। বড় চাচার ছেলে আসবে আজ। যাকে আমি এতদিন ধরে খুজেছি।

সকালে উঠে চারিপাশে আনন্দে উৎসবে মেতে উঠেছে সবাই।কিয়া আপু আমাকে সাজিয়ে দিচ্ছে।বাড়ির সবাই নামাজে গিয়েছে।

সামনে মুগ্ধ কে দেখে আমার রাগ উটে গেলো।এই ছেলেটা আমার পিছু কেনো ছাড়ে না? আর মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল যখন জানতে পারলাম মুগ্ধ সাহেব আর কেউ নয় আমার বড় চাচার ছেলে আফনান আহযাব মুগ্ধ। যাকে এত দিন ধরে সহ্য করে আসছি সেই আমার কাজিন। কথাটা শুনে মেজাজ তুরঙ্গে উঠে গিয়েছিলো। কে জানত এই শয়তানটার সাথেই আমার জীবন বাধা পড়ে যাবে?

ঈদের ছুটি শেষ। আমাদের আবার ভার্সিটি ফিরতে হবে।এত দিন যেন সোহানের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।মনে ভয় বাঁধতে লাগল। বড় চাচাকে সব ঘটনা জাগলে আমাকে আশ্বাস দেন কিছু হবে না।

একদিন বড় চাচা আমাকে তার রুমে ডাকেন। আমাকে যা বললেন তা শুনে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। বড় চাচা মুগ্ধের সাথে আমার বিয়ে দিতে চান। তাহলে তার আর কোনো চিন্তা থাকবে।এটা শুনে শুনে আশ্চর্য হয়ে ছিলাম যে মুগ্ধ বিয়েতে রাজি অনেক বোঝানো অনেক বোঝানোর পর পরিবারের কথার মধ্যে আমিও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম সেদিন বিকেলে কাজী তাকিয়ে দেখে আমাদের বিয়ে পড়িয়ে দিলেন বড় চাচা। বদলে গেলো আমার জীবন।এতদিন যেটা আমার দাদাবাড়ী ছিলো সেটা আজ আমার শশুড় বাড়ীও হলে গেলো।তাহলে কি আজ থেকে হলো নব্যদিনের সূচনা?

চলবে?