আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১৮+১৯

0
1950

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৮
#সুমাইয়া মনি।

আজই নতুন কোচিং সেন্টারে যাওয়া শুরু করেছে নবনী। সঙ্গে মায়াও। তিনটার দিকে কোচিং । আগের মতো নবনীর জীবন এখন আর সহজ নেই। সে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়। অনেক ব্যস্ত রাখতে চায় পড়াশোনার মাঝে। যতটা ব্যস্ত রাখতে পারলে নিভ্রকে সে ভুলে যেতে পারবে। ভুলে যেতে পারবে পুরনো অতীত! তাই সে নতুনে কোচিং সেন্টারে জয়েন্ট হয়েছে। সকালে কলেজ,তারপর কোচিং, বাড়িতে ফিরে যতটুকু সময় পায় এতে সে আদার্স বই গুলো পড়ে। তারপর সন্ধ্যের দিকে নিয়ানকে পড়ায় এবং নিজেও পড়তে বসে। এখন আর আসরের সময় পড়ে না। রুটিং চেঞ্জ হয়েছে তার। এবং-কি সে নিজের মধ্যেও অনেকটা চেঞ্জ এনেছে। আরো চেঞ্জ আনবে আশা করে সে।

ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই নিভ্রর মুখোমুখি পড়ে যায়। নিভ্র টমিকে নিয়ে গেট থেকে বের হচ্ছিল ঘুরতে যাওয়ার জন্য। চোখাচোখি হয়ে যায় তাঁদের। নবনীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। অস্বস্তি লাগছে তার। পুরোনো ক্ষততে পুনোরায় কেউ যেন আঘাত এনেছে। সে তো বলেছিল তার বাড়ির ত্রিসীমায় না আসতে। মন স্থির করে সেও চাইছিল না যেতে। কিন্তু নিয়তি আজ তাকে তার মুখোমুখি হতে বাধ্য করেছে। তবে সে কাবু হবে না। দ্রুতই নজর সরিয়ে নেয় সে। গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে পা চালিয়ে আগে ছুঁটে চলে। নিভ্রকে করুণ ভাবে ইগনোর করেছে সে।
বুঝতে পেরে রাগ হয় তার। নিভ্রর চেহারায় ফুটে উঠে রাগের আভাস। প্রকাশ করে না। নবনীর পরিবর্তনে সে যেমন অবাক, তেমন রাগও হচ্ছে এখন। যে মেয়ে কি-না ক’দিন আগে তার নামেতেই আসক্ত ছিল। আজ তাকে ইগনোরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দাঁড়িয়ে থাকে না সে, টমিকে নিয়ে উলটো দিকে অগ্রসর হয়।

কিছু দূর আসতেই নবনীর হাঁটার গতি কমে আসে। বুকের মাঝে ব্যথা অনুভব হয়। কিন্তু সে আগের ন্যায় ভেঙে পড়ে না। এমন দিন তার সামনে রোজ আসবে। তাকে ভেঙ্গে পড়লে হবে না। নিজেকে যথেষ্ট সংযত রাখতে হবে। আরো কিছুটা এগোতেই মায়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার। দু’জনে মিলে রিকশায় চড়ে কোচিং সেন্টারে পৌঁছায়।
_____________
সেদিনের পর আরো দু’দিন কেঁটে যায়। নবনী এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। কারো জন্য জীবন থেমে রাখলে চলবে না। তার-ও সামনে গোটা ভবিষ্যত পড়ে আছে। ভেবে সে এগিয়ে চলেছে। নিভ্রর কথা ভেবে কষ্ট পেয়ে বুক ভাসিয়ে দুঃখ ব্যতীত আর কিচ্ছু মিলবে না। তাই সে-সব ভুলে যেতে বসেছে। মন থেকে সরিয়ে দিতে চায় সে।

পরের দিন হঠাৎ মাহবুব হাসান ছুটি নিয়ে পরিবারের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসে শ্বশুর বাড়ি। মূলত তার শালার বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে তাঁদের এখানে আসা। নবনীর আপত্তি ছিল না যাওয়ার। কিন্তু তাকে একা রেখে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। মাহবুব হাসানের কঁড়া নির্দেশনায় তাকে আসতে বাধ্য করেছে। কিছুক্ষণ আগেই তারা তনুজা ভিলায় পৌঁছায়। নবনীর মামা-মামী সহ আরো অনেক আত্মীয় স্বজনরা তাদের নিয়ে মেতে উঠেছে। নিলুফা বেগমের মা-বাবা অনেক আগেই মারা গিয়েছে। তারা দুই ভাই-বোন। এতদিন পর নিলাজ হোসাইন বোনকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। কুশল বিনিময় আপ্যায়নের মাধ্যমে তাদের মধ্যে কথপোকথন আরম্ভ হয়। নবনীকে বড়দের কাছ থেকে সরিয়ে তনুজা তার কক্ষে নিয়ে আসে।

তনুজা নবনীর বড়। তারাও নবনীদের মতো দুই ভাই-বোন। তনুজা বড়। ভাই ছোট। এতদিন পর নবনীকে পেয়ে তনুজাও খুব খুশি। সে তার উজ্জ্বল চেহারার মাধ্যমে সেটা প্রকাশ পাচ্ছিল। কিন্তু নবনী একটু উদাস ছিল। তবে সেটা তনুজার সামনে প্রকাশ করে না। ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করছিল সে। তবে অদ্ভুত বিষয়। জামা-কাপড় কমে সে এক গাদা বই সঙ্গে নিয়ে এসেছে। দেখে তনুজা হেসে ফেলে। ভেংচি দিয়ে বলে,
-“তুই কী এখানে পরিক্ষা দিতে এসেছিস নাকি? এত বই এনেছিস যে?”

-“জীবনের প্রথম পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলাম না। নতুন করে কি আর পরিক্ষা দিবো আপু?” তাচ্ছিল্য হেসে বলে নবনী।

-“বুঝলাম না।”

-“বাদ দেও। আমি আগে ফ্রেশ হতে চাই। পরে হবু দুলাভাই-এর ব্যাপারে এসে সব জানব।”

তনুজা কিছুটা লজ্জা পেয়ে হেসে উত্তর দেয় ‘আচ্ছা’।
নবনী জামা নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোয়।
.
.
এদিকে আপনদের বাড়িতেও বিয়ের তোড়জোড় চলছে। কাল গায়ে হলুদ। কিছুক্ষণ আগেই পুরো বাড়িটি লাইটিং ফিট করা হয়েছে। আগের তুলনায় বাড়িটি এখন ঝকঝকে তকতকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। হলুদের সব জিনিসপত্র আগে বাগে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে তনুজাদের বাড়িতে। এতে আদি সাহায্য করছে। বাড়িতে কম বয়সি ছেলে মানুষ বলতে আপাতত আদি আর আপনই। আপন বিয়ের অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। তাই বাকি আলাদা কাজ গুলো আদিকে দেখতে হচ্ছে।
তনুজাদের বাড়ির মতো তাঁদের বাড়িতেও মেহমানদের আনাগোনা চলছে। বাকি দিক সামলে নিচ্ছে ঘরের গিন্নি রা।
_____________
বেশ লম্বা সফরে আসার ফলে নবনী খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে তাড়াতাড়ি তার চোখে ঘুমও চলে আসে। চোখ খুলে একদম সকালে। জানালা দিয়ে এক ফালি রোদ এসে নবনীর বাঁ চোখে লাগে। হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ে সে। চোখ কচলাতে থাকে। ফজরের নামাজ আজ মিস হয়ে গেছে তার। ভেবে সে কিছুটা আহত হয়। তনুজা তখন কেবল রুমে প্রবেশ করছিল। নবনীকে বিছানায় উঠে বসে থাকতে দেখে মিষ্টিমুখে বলে,
-“উঠেছিস? এবার তা হলে ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। বাবা,ফুফাজি ডাকছে তোকে।”

-“আসছি, যাও।” এতটুকু উত্তর দিয়েই নবনীর ব্রাশ হাতে ওয়াশরুমে আসে। একেবারে ফ্রেশ হয়ে তবেই হল রুমে পৌঁছায়। সবাই তখন টেবিলে বসা ছিল। সে-ও একটা চেয়ার টেনে বসে। খাওয়া দাওয়ার মাঝে নানারকম কথায় মসগুল সবাই। টপিক তনুজার গায়ে হলুদের বিষয় নিয়ে। নবনী খেয়ে যাচ্ছে এবং সবার কথা শুনছে। খাওয়া শেষ করে সে একাই উঠে চলে আসে রুমে। একটি বই নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। অনুষ্ঠান নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা নেই।
.
সন্ধ্যার দিকে পার্লারের দু’জন মেয়ে আসে তনুজাকে সাজাতে। রাতে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য তাকে তৈরি করছে। নবনী হলুদ রঙের একটি গাউন নিয়ে পাশের রুমে এসে চেঞ্জ করে নেয়। চোখে মোটা কাজল ও ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক, কানে ঝুমকা পড়ার মাধ্যমে সাজ কমপ্লিট করে। চুল গুলো খোঁপা করে গাজরা পেঁচায়। পাশের রুমে এসে দেখে তনুজার সাজানো তখনো শেষ হয়নি।
নবনী কিছুটা বিরক্ত হয়ে হৈ-হুল্লোড় চিল্লাপাল্লা থেকে একটু দূরে সরে বাড়ির গার্ডেনে আসে। সেখানের অপজিট দিকে ফুলের বাগান রয়েছে। তার পাশ ঘেঁষে আছে লোহার তৈরি মাঝারী আকারের দোলনা। এখানে মাঝেমধ্যে নিলাজ হোসাইন অবসর সময় কাটায়। অনুষ্ঠানের আয়োজন ছাদে করা হয়েছে। বিশাল বাড়ির ছাদ তাদের। তাই সেন্টার ছাড়া বাড়িতেই হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে করে আত্মীয়দেরও খুব একটা কষ্ট হবে না ভেবেই এই ব্যবস্থা করা হয়।

নবনী কোলাহল বিহীন সেখানে বসে কিছু সময় কাটায়। ফোনে তাহাসানের ‘দূরে’ গানটি প্লে করে তাঁরাভরা আকাশের দিকে নজর তাক করে। ঝিরিঝিরি বাতাসও ছিল। ব্যস! এতটুকুই নবনীর জন্য যথেষ্ট ছিল। গভীরভাবে তলিয়ে যায় মনােরমা প্রাকৃতিক পরিমন্ডলে। পরম আবেশে চোখ জোড়া কেবল বন্ধ করতে যাবে হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগে নবনীর ডান বাহুতে জোরে টান পড়ে। এক টানে তাকে উঠানো হয় দোলনা থেকে। তার পিঠ গিয়ে সজোরে কারো পাঁজরে এসে ধাক্কা লাগে। বাহু ছেড়ে হাতটি সোজা নবনীর পেটের ওপরে এসে পিছনের দিকে তাকে আলতো ভাবে ঠেস দিয়ে রাখে। চমকে উঠে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে নবনী। আচমকা বিকট শব্দ হয়ে দোলনার ওপরে একটি মাঝারি আকারের বাঁশ পড়ে। সম্ভবত ছাদের ওপর থেকে পড়েছে সেটি। শব্দে নবনী লাফিয়ে উঠে চোখ চটজলদি খুলে ফেলে। ভীষণ ভয় পেয়ে যায় সে। সাউন্ড বক্সের শব্দে বিকট শব্দটি ছড়ায় না৷ কেউ শুনতে ও দেখতে পায় না এমন শােচনীয় দৃশ্য। ভয়ে বুক ধুকধুক করছে নবনীর। ঘাম জড়ো হয়েছে কপালে। এই বাঁশটি ঠিক তার মাথার ওপর পড়তে পারতো, যদি না তাকে আগন্তুক ব্যক্তিটি না টেনে উঠাতো।
মারাত্মক দূর্ঘটনা ঘটে যেত। ভেবেই গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠে তার। হাতের মুঠোয় ওড়না খামচে ধরে। পিছনের ব্যক্তিটি তখনো পরম যত্নে তাকে সেভাবেই আগলে ধরে রেখেছে। এমন ঘটনায় নবনী হতবাক, ভীতিগ্রস্ত। রেশ কাঁটছে না তার। কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় দেখে পাশে সরে পিছনে ঘুরে তাকায়। সে চিনতে পারে সেই আগন্তুক ব্যক্তিকে। তার চেহারা নবনীর কাছে এখন স্পষ্ট!
.
.
.
#চলবে?

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৯
#সুমাইয়া মনি।

-“আমি দুঃখিত! আপনি ঠিক আছেন তো?” এক হাত তুলে নবনীর উদ্দেশ্যে নরম স্বরে প্রশ্ন করে আদি। তার দুঃখিত বলার মূল কারণ নবনীকে পেঁচিয়ে ধরা। নবনী বিস্ময় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। চোখ পিটপিটিয়ে গালের ওপরে আসা ছোট চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে নেয়। আদিকে দেখে সে কিছুটা হলেও অবাক হয়।

আদি তনুজার বিয়ের লেহেঙ্গা দিতে এসেছিল এই বাড়িতে। সব কিছু পাঠানো হয়েছে ঠিকিই, কিন্তু লেহেঙ্গাটিই বাদ পড়ে গেছে। তাই নিজে এসেছে অপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে। ওদের বাড়িতেও বেশ ধুমধাম করে আপনের গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগেই সে এ বাড়িতে এসেছে। বাইক নিয়ে এসেছিল। তাই দ্রুত পৌঁছে গেছে। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই গার্ডেনে বসা হলুদ একজন তরুনীর ওপর নজর পড়ে। সে একাই উল্টোদিকে ঘুরে বসেছিল। যার দরুণ মুখ দেখেতে পায় নি আদি। বাড়ির বাকি সবার আওয়াজ ছাদের ওপর থেকে ও বাড়ির পিছনের দিক থেকে আসছিল। অনুষ্ঠান ওপরে হলেও, রান্নাবান্নার কাজ বাড়ির পিছনে দিকটায় হচ্ছিল। আদি বাইক থেকে নেমে লেহেঙ্গার বাক্সাটি হাতে নিতে যাবে তখনই কি যেন মনে করে ছাদের দিকে তাকায়। তখনই তার নজরে পড়ে একটি বাঁশের ওপর। একটি মাজারি আকারের বাঁশ চিনে দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ভাবতে ভাবতে এক দিকে কাত হয়ে আরো নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে বাঁশটি। আদি দ্রুতই নবনীর দিকে ছুঁড়তে আরম্ভ করে এবং একটুর জন্য সে তাকে বাঁচিয়ে নেয়। আদির জন্যই নবনী এখন সুস্থ রয়েছে। আর নয়তো এতক্ষণে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে যেত। সঠিক সময়ে নবনীকে দোলনা থেকে টেনে তুলেছে সে।
অতি কষ্টে নবনী নিজেকে স্বাভাবিক করে। নরম স্বরে উত্তর দেয়,
-“জি, ঠিক আছি।”

-“পেন্ডেল কিভাবে সাজিয়েছে? এখনই তো আপনি আহত হয়ে যেতেন।” মেকি রাগ ঝেড়ে বলে আদি।

-“শুকরিয়া!” একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নিয়ে বলে।

-“আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। নয়তো যে কোনো সময় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে।”

-“প্লিজ! মামাকে বলবেন না। শুনলে আমার ওপর ক্ষেপে যাবে।” কিছুটা বিনয়ী কন্ঠে বলে।

আদি সেকেন্ড কয়েক চুপ থেকে উত্তর দেয়,
-“আচ্ছা বলব না। তবে তাকে সতর্ক করতে হবে।”

-“সেটা করুন সমস্যা নেই।”

-“ঠিক আছে। বাই দ্য ওয়ে, আপনি সেই লাইব্রেরির নবনী না?”

এতক্ষণে নবনী আদির দিকে ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাঁজ করে তাকায়। সে এতক্ষণ আদিকে চিনতে পারে নি। এখন চিনতে পেরেছে লাইব্রেরি বলার ফলে। আদি নবনীর চাহনিকে উপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করে,
-“আপনার মামা হয় তনুজা ভাবির আব্বু রাইট?”

-“জি, তনুজা আপু আমার মামাতো বোন।”

-“তাহলে তো সম্পর্কে আমরা বেয়াই-বেয়াইন!” মুচকি হেসে বলে আদি।

জোর পূর্বক হেসে উত্তরে ‘হুম’ বলে।

-“আমার সঙ্গেই ভেতরে চলুন আপনি। একা না থাকাই ভালো, যদি আবার কোনো বিপদজনক পরিস্থিতিতে পড়ে যান।”

নবনী এবার কিছু বলে না। হেঁটে চলে সামনের দিকে। ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে মাঝ পথেই নিলাজ হোসাইন ও মাহবুব হাসানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। নবনী আগে চলে যায়। আদি তাঁদের সঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে কথপোকথন চালায়।
সে ঘটনাটি চাপিয়ে যায় এবং সে বুঝতে পারে মাহবুব হাসান নবনীর বাবা হন। আরো কিছুক্ষণ কথা বলে লেহেঙ্গা তাঁদের কাছে দিয়ে সে ফিরে আসে।
দুই বাড়িতেই বেশ সুন্দর ভাবে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের পর্ব শুরু হয়। আনন্দে মেনে উঠে দু’টি পরিবার।
________________
মাথা ব্যথার চোটে ঘুম হারাম হয়ে গেছে নিভ্রর। ঘড়িতে তখন বারোটা দুই মিনিট। চোখের ঘুমের ‘ঘ’ খানা উধাও। ন’টায় থানা থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে কিছু ফাইলে নজর বুলাতেই বারোটা বেজে যায়। ঘুমাতে যাওয়ার পর পরই আরম্ভ হয় মাথা যন্ত্রণা। এক গাধা ঔষধের জুরির মধ্যে থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেইন কিলার পেল না। মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তার। এই মুহূর্তে কারো কাছে যে সাহায্য চাইবে তারও উপায় নেই। তার বাড়ির নাক বরাবর নবনীদের বাড়ি রয়েছে। তাদের বাড়িতে যে যাবে তারও উপায় নেই। মনে হচ্ছে এই যন্ত্রণা নিয়েই সারারাত কাঁটাতে হবে। ভাবতে ভাবতেই হোয়াটসঅ্যাপে কল আসে৷ স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চারদিক থেকে বিরক্ত এসে ঘিরে ধরে তাকে। কেটে ফোন সাইলেন্ট করে খাটের ওপর বসে। বালিশ ঠিক করে চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে রাখে।
যেভাবেই হোক তাকে ঘুমাতে হবে। নয়তো সারারাত যন্ত্রণায় ভুগতে হবে। ছটফট করতে করতে এক সময় সে ঘুমিয়ে যায়।
.
.
.
সকালে…..

রাতে নবনীর ঠিক মতো ঘুম হয়নি। শুধু নবনীর নয়, বাকি রাও ঘুমাইনি। সারাদিন সবাই ফুর্তিতে মেতে ছিল। কিন্তু নবনীর ঘুম না হবার কারণ ছিল আলাদা। এক্সিডেন্টের দৃশ্য তার এখনো চোখে ভাসছে। আদি না থাকলে কি যে হতো সেটা ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে তার। দুই বার তাকে বিপদ থেকে রক্ষে করেছে। তখন সেখানে উপস্থিত অবস্থায় আদির বিষয় কিছু জানা হয়নি তার। তনুজাকে স্ট্রেজে বসা অবস্থায় আদির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই পরিচয় পেয়ে যায়। ঘাড়ে হাত রেখে চুপ গুলো সরিয়ে কফিতে চুমুক বসায় নবনী। কিছুক্ষণ আগেই কফি হাতে সে বারান্দায় এসেছে। বাহিরে রোদ বেশি নেই। সকাল থেকেই আকাশ কেমন মেঘ মেঘ করছে। দৃষ্টি সেদিকে তাক করে এতক্ষণ আদির কথা ভাবছিল। পরক্ষণেই তনুজার ডাক পড়ে তার। রুমে এসে দেখে তনুজা মাথার হাত রেখে খাটে বসে রয়েছে। তার নাকমুখ কোঁচকান এবং চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো অসুস্থ বোধ করছে। নবনী এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কী হয়েছে আপু?”

-“মাথাটা খুব ধরেছে। আমার চুলের ক্লিপগুলো একটু খুলে দে নবনী।”

-“দিচ্ছি!” বলেই এক চুমুকে কফি পান করে গ্লাস টেবিলের উপর রাখে। তারপর ক্লিপ খুলতে আরম্ভ করে। এরি মাঝে তনুজা আনমনা হয়ে যায়। মৃদু হাসি ফুটে উঠে তার ঠোঁটে। এ হাসি যেন বলে দিচ্ছে তার মনের কোণেতে বসবাস করা প্রিয় মানুষটির কথা। নবনীর চোখে ধরা পড়ে। সে কৌতূূহল বশত জিজ্ঞেস করে,
-“ভাবছো কারো কথা?”

তনুজা সরাসরি বলে ফেলে,
-“হ্যাঁ!”

-“হবু দুলাভাইয়ের কথা নাকি?”

তনুজা লজ্জামিশ্রিত হাসি দেয়। মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ সম্মতি দেয়।

নবনী স্মিত হাসে। তার অনুমান সঠিক হয়েছে। একটু দুষ্টমি করে বলে,
-“খুব ভালোবাসো বুঝি তাকে?”

-“মারাত্মক!”

-“আহা! তা আপন দুলাভাই? সে তোমাকে কতটুকু ভালোবাসে?”

কথাটা শুনে তনুজার হাসি মুখখানা কেমন গম্ভীর হয়ে যায়। তবুও ঠোঁটে হাসি রেখে বলে,
-“বাসে!”

-“শুধু বাসে?”

তনুজা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রয়। নবনী ফের ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই উত্তরে নরম স্বরে বলে,
-“আমি আপনকে প্রথম দিন দেখেই পছন্দ করি ফেলি। আর যখন জানতে পারি ওর পরিবারের সবাই আমাকে পছন্দ করেছে, তখন আমি আরো খুশি হই। আস্তেধীরে কথা বলতে বলতে আমি আপনের ওপর অনেক দুর্বল হয়ে পড়ি। কিন্তু নবনী, আপন মনে হয় আমাকে পছন্দ করে না।” মন খারাপ করে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে।

-“কি করে বুঝলে আপু? বিয়ে তো হচ্ছে তোমাদের।”

-“ফোনে আপন আমার সঙ্গে কথা বলার সময় শুধু বাহানা খুঁজে ফোন রেখে দেওয়ার। আর ভালোবাসার বিষয়ে কথা বলতেই চায় না। যেন মনে হয় ও ভালোবাসাকে ঘৃণা করে।”

ঘৃণা শব্দটি কানে আসতেই নবনীর নিভ্রর কথা মনে পড়ে যায়। কানে প্রতিধ্বনি হতে থাকে নিভ্রর সেই কঠোর বাক্য গুলো। যেগুলো নবনীর বুকের মধ্যে এখনো তীরের মতো বিঁধে রয়েছে। মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সে। অতীতের স্মৃতি গুলো আজ তাকে আবার পীড়া দিতে হাজির হয়েছে। নবনীকে নিশ্চল হয়ে যেতে দেখে তনুজা কনুই দিয়ে গুঁতো দেয়। বলে,
-“তোর আবার কী হলো?”

নবনী ফিরে আসে অতীত থেকে। চোখ পিটপিটিয়ে কৃত্রিম হেসে বলে,
-“কিছু না আপু।”

তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
-“আমি আপনকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। ওর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে ভেবেই আমি ভীষণ হ্যাপি। এখন হয়তো আপন একটু নড়বড়ে। তবে বিয়ের পর আমি ঠিক মানিয়ে নিবো।” লাস্টের কথাটুকু বলে মুচকি হাসে। নবনী তনুজার কথা প্রতিত্তোরে মৃদু হাসে। নবনী অনুভব করে আপনকে তনুজা কতটা ভালোবাসে।
___________
আপদের বাড়িতে তাড়াহুড়ো পড়ে গেছে। বারোটার দিকে মেয়ে পক্ষের বাড়িতে উপস্থিত হতে হবে তাদের। তাই সবাই যে যার মতো রেডি হতে ব্যস্ত। আদি সবে মাত্র গোসল সেরে নিজের রুম থেকে চুল মুছতে মুছতে আপনের রুমে আসে। খাটের উপর বিয়ের শেরওয়ানি সহ যাবতিও সব জীনিস রাখা। অথচ, আপন ফোন হাতে মাথা নত করে বসে আছে। সম্ভবত সে ফোনে কিছু একটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
আদি দরজার সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকেই বলে,
-“রেডি হচ্ছিস না কেন আপন?”

আদির স্বর শুনে আপন দ্রুত ফোন লক করে ফেলে। মাথা তুলে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলে,
-“হচ্ছি।”

-“দেরি করলে চাচ্চু ক্ষেপে যাবে, জানিস নিশ্চয়।”

-“হুম।”

-“আমি রেডি করিয়ে দেবো?”

-“নো থ্যাংক’স। তুই নিজে রেডি হয়ে নে।”

-“ওকে!” দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে ফিরে যায় আদি।

আপন গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ বসে রয়। পরক্ষণে সে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাতে উঠিয়ে নেয় তার বিয়ের শেরওয়ানি।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

Sumaiya Moni

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে