Friday, July 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1021



প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১৮

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৮তম_পর্ব

ধারা সবটুকু খাবার অনলকে খাওয়িয়ে দিলো। আর অনল বিনা অভিযোগে খেয়েও নিলো। ধারা বেশ অবাক হলো, কারণ অনল একটি বার ও করলা ভাজি নিয়ে অভিযোগ করে নি। যেখানে তার অতীব অপছন্দের খাবার সেটা। ধারা যখন খাবার খাওয়ানোর পর উঠে যেতে নিলো তখন হাতখানা টেনে ধরলো অনলো। মৃদু কন্ঠে বললো,
“একটু বসবি, কিছু বলার ছিলো”

অনলের বলার ধরণটা অন্যরকম ঠেকলো ধারার কাছে। কি বলার থাকতে পারে অনল ভাইয়ের! মূহুর্তেই হাজারো চিন্তা দলা পাকালো ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে। আচ্ছা, অনল ভাইয়ের বন্ধুদের বিনা নোটিশে নিমন্ত্রণের জেদের কথাটা তুলবে নাকি অনন্যা আপুর ব্যাপারে কিছু বলবে! অনন্যার কথা স্মরণ হতেই মুখখানা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো ধারার। সে ঈষৎ ঘাবড়ালো। ঠোঁট জোড়া ভিজালো৷ তারপর চোখ ছোট ছোট করে সুঁচালো নজরে নিপুনভাবে খুতিয়ে দেখতে লাগলো অনলকে। অনলের মুখশ্রী নির্বিকার। চোখ বরাবরের মতো শান্ত। চাহনী শীতল। ফলে মুখশ্রী দেখে অনলভাই এর মনের খবর জানার অভিযান ব্যর্থ হলো। নাহ! এখানে বসে থাকাটা সুবিধের হবে না। তাই ধারা নরম গলায় বললো,
“হাতটা ধুয়ে আসি? এটো হাতে বসতে ভালো লাগে না”
“বেশ, তাড়াতাড়ি আয়। আর শোন পালাবার চেষ্টা করবি না। সোজা হাত ধুয়ে এখানে আসবি”

অনল আবারো ল্যাপটপে নজর দিলো৷ তবে ধারার মনে হলো অনলের মৃদু কন্ঠটি ঈষৎ কঠিন হয়ে গেলো। ধারা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো, সে পালাবে না। মাঝে মাঝে ধারা বেশ অবাক হয়! তার মনের খবর লোকটি কিভাবে বুঝে যায়! পালাবার ফন্দিই করছিলো ধারা। ভেবেছিলো প্লেট রাখার নামে বড়মার ঘরে চলে যাবে অথবা বি’চ্ছু গুলোর ঘরে আশ্রয় নিবে। কিন্তু হলো না। ফলে ভদ্র মানুষের মতো প্লেট রেখে, হাত ধুয়েই আবার ফেরত আসতে হলো।

ধারা অনলের সম্মুখে বসে আছে, অনল ল্যাপটপ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন শান্ত, শীতল দৃষ্টিতে ধারার দিকে চেয়ে আছে সে। সময় পার হচ্ছে এবং ধারার মন ব্যাকুল হয়ে উঠছে। নিস্তব্ধ ঘরটি এবং অনলের শান্ত চাহনী যেনো তাকে ক্রমশ গি’লে খা’চ্ছে। চিন্তা, উদ্বিগ্নতা এবং ঈষৎ ভয়ের দরুন দাঁত নিয়ে নখ কামড়াতে লাগলো সে। তখনই অনলের তীক্ষ্ণ স্বর কানে এলো,
“নখ কামড়াস বলেই তুই দিন দিন আরোও বেশি স্টু’পি’ড হয়ে যাচ্ছিস। সাধে কি ফেলুরানী বলি”

সাথে সাথেই হাত নামিয়ে নিলো ধারা। আমতা আমতা করে বললো,
“কি জানে বলবে বলছিলে!”
“আজ হুট করে আমার বন্ধুদের দাওয়াত দিয়েছিলি কেনো? মতলব কি ছিল?”

ধারা যে ভয় পাচ্ছিলো সেটাই হলো। অনল সেই প্রশ্নই করলো, কেনো বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হলো। মাস্টারমশাই এর শ’কু’নী চোখ থেকে বাঁচা অসম্ভব৷ ধারাও কম নয়, নিজের প্রতিরক্ষার উত্তর তৈরি। প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“নতুন দম্পতিকে দাওয়াত করতে মন চাইলো, তাই করেছি। বাহ রে! তাদের বাড়ি তিনটে দিন খেয়ে দেয়ে এসেছি এটুকু তো করাই যায়। এটাকে কার্টেসি বলে। আর প্লাবণ ভাই আর স্মৃতি আপু থাকবে তাহলে ইকরাম ভাই আর রবিন ভাই বাদ কেনো যাবে! তাই দাওয়াত দিলাম”
“সত্যি?”

অনলের চাহনী ক্রমশ সূঁচালো হলো। ধারা শুকনো ঢোক গিলে বললো,
“হু”
“না আমি ভাবলাম তোর আমার অতীত ঘাটার শখ হয়েছিলো। তাই ওদের ডেকেছিস। ওদের থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমার সব নাড়িনক্ষত্র জানবি। ভুল ছিলাম তাহলে। অবশ্য তুই কি এতো ব’ল’দ নাকি! তোর কাছে তো এখনো দুখানা ইচ্ছে বাকি আছেই। চাইলেই সে দুটো সহজেই ব্যাবহার করে আমার থেকেই সব জানতে পারতি। নিশ্চয়ই আমার খবর আমার থেকে ভালো কেউ বলতে পারবে না”
“তোমাকে জিজ্ঞেস করলেই তুমি বলে দিবে?”

ধারা প্রশ্নটি করতেই জিহ্বা কাটলো। অনলের ফাঁদে সে পা দিয়ে দিয়েছে। অনল ঠোঁট চওড়া হলো। বাকা হেসে বললো,
“বউ এর দেখি আমার সম্পর্কে বিস্তার কৌতুহল! তা এতো তাল না করে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেই তো পারতি!”
“তুমি তো খালি এড়িয়ে যাও”
“তা এই বিশাল তথ্য যোগাড় করার কারণ জানতে পারি”

ধারা চুপ করে রইলো। কারণ তো আছেই, কিন্তু সেটা গলা অবধি এসেই দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। মুখে বলতে পারছে না সে। নিজের প্রণয়ের মানুষের বিস্তারিত খোঁজ দেওয়া মোটেই দোষের কিছু নয়। কিন্তু হুট করেই এই কথাটা জাহির করা যায় না। যেখানে প্রথম থেকে সেই এই মানুষটির বিরোধিতা করে এসেছে। ধারা আমতা আমতা করে বললো,
“রুমমেট সম্পর্কে কৌতুহল হওয়া কি খারাপ কিছু?”

অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর ধারার নাকটা একটু টেনে বললো,
“এতো বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কি করে! যাক, আমার ইহকালে কোনো নারীর সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো না। অনন্যা আমার খুব ই ভালো বান্ধবী ছিলো বটে। কিন্তু সেই বন্ধুত্বটা আর নেই। কারণ স্বার্থপর মানুষ আমার অপছন্দ। বন্ধুত্বের নামে যদি সে আমাকে ব্যাবহার করে তবে আমি তো মেনে নিবো না। একারণেই শেষ কটা দিন সেই মেয়েটির মুখদর্শন ও করি নি আমি। তাই নিজের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের নষ্ট চিন্তা গুলো ঝেড়ে ফেলো ফেলুরানী”

অনলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ধারা। পেটের মধ্যে হাজারো প্রজাপতি যেনো ডানা মেলেছে। মনের এক কোনায় জমে থাকা খচখচানিটা নিমিষেই বাস্পে পরিণত হচ্ছে। মূর্ছা যাওয়া প্রণয় পুষ্পটি এক পশলা শীতল বৃষ্টির ছোঁয়া জীবন্ত হয়ে উঠেছে। অজান্তেই তার ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু পরমূহুর্তেই মাহির কথাটা মনে পড়লো ধারার। সন্দিহান কন্ঠে বলে উঠলো,
“তাহলে মাহিকে কেনো বললে “এক হৃদয়ে দু নারীর স্থান হয় না”? তোমার হৃদয়ে স্থান পাওয়া নারীটি কে?”
“তোর কি মনে হয়?”

ধারার চঞ্চল চোখে চোখ রেখে শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করলো অনল। তার চাহনী আরোও শান্ত, স্থির। ঠোঁটের কোনে বিচিত্র হাসি। ধারা কিছুসময় তাকিয়ে থাকলো অনলের চোখের দিকে। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করাটা যেনো একটা বিশ্রী স্বভাব অনলের। এই স্বভাবটি অতীব অপছন্দের ধারার। মূহুর্তেই তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে হিনহিনে স্বরে ধারা বললো,
“আমি কি অন্তর্যামী? না বললে তোমার মনের কথা কিভাবে বুঝবো! আমি তো তোমার মনে বসে নেই!”

অনলের হাসিটা যেনো চওড়া হলো। দূর্বোধ্য সেই হাসি। তারপর উঠে দাঁড়ালো সে। বিছানার বালিশটা ঠিক করতে করতে বললো,
“ওটা ফাও বলেছিলাম, যেনো মাহি আমাকে আর উত্যোক্ত না করে। নারী মানেই আস্তো ঝামেলা, যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল”

তারপর শুয়ে পড়লো সে। চোখ বন্ধ করে প্রায় সাথে সাথেই আবার খুললো, মাথা উঁচিয়ে বললো,
“তোর তিনটে ইচ্ছে ফিট্টুস, আর একটা আছে। বুঝে শুনে খরচা করিস”
“একটা কেনো! দুটো আছে”
“সামান্য যোগ, বিয়োগেও তুই কাঁচা। সাধে কি ফেলুরানী বলি? সেদিন যে রিসোর্টে নিয়ে গেলাম সে বেলা! ওখানে তো একটা ইচ্ছে শেষ”
“এটা কিন্তু চিটিং”
“আন্দোলন কর তাহলে”

বলেই কাঁথা টেনে শুয়ে পড়লো অনল। ধারা সেখানেই বসে রইলো। কিছুসময় চোখের দৃষ্টিতে ক্রোধানল উগরালো। কিন্তু লাভ হলো না। লোকটি দিব্ব্যি ঘুম। পরমূহুর্তেই শান্ত হলো সে। আনমনেই ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটে উঠলো। যাক ময়দান ফাঁকা, এবার শুধু গোল করা বাকি_________

*****

জ্যৈষ্ঠের শেষ দিন, জ্বালাময়ী গরম। মাথার উপর ঘুরন্ত ফ্যানটিও যেনো শান্তি দিতে পারছে না। সর্বোচ্চ স্পিডে ঘুরছে তবে গরম একবিন্দু কমছে না। তরতর করে ঘামছে ধারা। সামনে থাকা গরম চা টা যেনো পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত জিনিস মনে হচ্ছে। তবুও সে সেটা খাচ্ছে। আর খাতায় গণিত কষছে। শনিবার বিধায় ভার্সিটি বন্ধ। তবুও শান্তি দেয় নি প্রিন্স উইলিয়াম। নাস্তা গলা থেকে নামার আগেই গম্ভীর স্বরে বললো,
“খেয়েই পড়তে বসবি”

বড় মা যা একটু প্রতিবাদ করতে চাইলেন কিন্তু ছেলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে চুপসে গেলেন। তাই বাধ্য হয়েই মুখ ফুলিয়ে পড়তে বসেছে ধারা। কখন থেকে এক চ্যাপ্টারের ম্যাথ ই করছে কিন্তু কিছুই পারছে না। লিনিয়ার এলজ্যাবরা টি পৃথিবীর সবথেকে বড় শত্রু হয়ে গিয়েছে। যা একটু ফেসবুকে ঢু মারবে সেটাও হলো না। প্রিন্স উইলিয়াম মোবাইল নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে। এর মাঝেই উপস্থিত হলো এশা এবং আশা। তাদের হাতে হাইয়ার ম্যাথের বই এবং খাতা। তাদের দেখেই ধারার চোখ চকচক করে উঠলো। অনল তাদের দেখেই ভ্রু কুচকালো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কি চাই?”
“মা পাঠিয়েছে”

বলেই আঠাশটা দাঁত বের করে হাসলো৷ যার অর্থ “আমাদের পড়াও”। অনল কপাল ঘষলো বা হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে। এই দুজনকে পড়ানো মানেই মাথার পোকা বের করে দেওয়া। যত দুনিয়ার আজিব প্রশ্ন আছে সব করবে। আপাতত তিনটে স্যার হাতে পায়ে ধরে পালিয়েছে। তারা নাকে খড় দিয়ে বলেছে,
“ম’রে গেলেও এদের পড়াবে না।”

ফলে যতবার ই ইলিয়াস কোনো নতুন স্যারের খোঁজ পাচ্ছে তারা প্রথমেই জিজ্ঞেস করছে,
“এটা কি সেই এশা আশা”

ইলিয়াস অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করছে,
“সেই এশা আশা বলতে?”
“যাদের বাড়ি থেকে শিক্ষক পালায়”

ইলিয়াসের বুঝতে বাকি থাকে না, এই মহল্লায় তার মেয়েদের বেশ নাম হয়েছে। সুতরাং তাদের পড়ানোর জন্য মাস্টার পাওয়াটা দুষ্কর ই নয়, অসম্ভব। ফলে রুবি অনলকে অনুরোধ করেছে যেনো মেয়েদুটোকে ছুটির দিন পড়াতে৷ অনল মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছাড়লো। তারপর বললো,
“মুখ বন্ধ করে ধারার পাশে যেয়ে বসবি। যা করতে বলবো চুপ করে করবি। টু শব্দ করেছিস তো কান টেনে লম্বা করে দিবো।”
“মুখ বন্ধ করলে প্রশ্ন করবো কিভাবে? আর প্রশ্ন না করলে শিখবো কিভাবে অনল ভাই? তুমি না মাষ্টার? তুমি এটাও জানো না! বাচ্চাদের প্রশ্ন করতে হয়। নয়তো ওরা হয় গা’ধা। কারণ গা’ধারা প্রশ্ন করে না”

এশার সাথে সহমত জানিয়ে আশা বলে উঠলো,
“আজ যদি নিউটন প্রশ্ন না করতো তাহলে তো মহাকর্ষ আবিষ্কার হতো না। অনল ভাই তুমি আমাদের হতাশ করলে”

আশার কথাটা শেষ হলো না তার পূর্বেই অনল বি’চ্ছু জমজের কান দুটো টেনে ধরলো, তারপর বললো,
“প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিস?”
“আহ! লাগছে, সরি সরি”
“মনে থাকে যেন”

বলেই কানটা ছেড়ে দিলো অনল। এশা কান ডলতে ডলতে স্বর খাঁদে নামিয়ে হতাশার সাথে বললো,
“বুঝলি আশা, এই পাষান দুনিয়ায় বরাবর ই দূর্বলের উপর সবলের রাজত্ব। আজ আমরা নিরুপায় বলে। মায়ের ভয় না থাকলে এই পুথিগত বিদ্যার স্যারের কাছে আসতে হতো না”
“ঠিক”

বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশা। অনল তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“কিছু বললি!”
“না, না”

বলেই ভেতরে যেয়ে বসলো তারা। অনল পড়ানো শুরু করলো। আধা ঘন্টা পর ই তিনজনের অবস্থা নাজেহাল৷ কোনো মতে ছুটে পালাতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতো। কিন্তু লাভ নেই। অনল অনড়, তার ভাবমূর্তির পরিবর্তন হলো না। সে নির্বিকার চিত্তে বসে রয়েছে। তার একের পর এক অংক করতে দিচ্ছে। ধারা অসহায় হয়ে বললো,
“অনল ভাই, ব্রেক দাও। আর মাথায় ঢুকছে না। এর পর বই টাও বলে উঠবে ছাড় মা, কাইন্দে বাঁচি”
“সহমত, আমরাও ব্রেক চাই। এই উৎপাদকে বিশ্লেষণের চোটেই আমরাই বিশ্লেষিত হয়ে যাবো অনল ভাই”

তিনজনের ক্রমশ চিৎকারে হাল ছাড়লো অনল। বিরক্ত কন্ঠে বললো,
“যা পাঁচ মিনিটের ব্রেক”
“পাঁচ মিনিট তো এই ঘর থেকে বের হতেই শেষ হয়ে যাবে”

এশার কথায় তীর্যক চাহনী নিক্ষেপ করলো অনল। ফলে তাদের আন্দোলন সেখানেই থেমে গেলো। এশা ধারার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এই, খা’টা’সের সাথে থাকো কিভাবে?”
“মাঝে মাঝে নিজেকেও একই প্রশ্ন করি”

এর মাঝেই কলিংবেলের শব্দ শোনা গেলো। এশা তখনই ছুটে গেলো সদর দরজায়। দরজা খুলতেই অবাক হলো সে। একজন মধ্যবয়স্ক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা অনলের কাছাকাছি, শুভ্র তার মুখশ্রী, ঠোঁটে অমায়িক হাসি। পরণে কালো পোলো শার্ট এবং গাঢ় নীল ডেনিম জিন্স। হাতে একখানা দামী টাইটানের ঘড়ি। এশা অবাক কন্ঠে অপরিচিত যুবককে জিজ্ঞেস করলো,
“কাকে চাই?”
“এটা কি জামাল চৌধুরীর বাড়ি”
“জ্বী! আপনি কে?”
“আমার নাম দীপ্ত, আমাকে সেলিম আহমেদ পাঠিয়েছেন……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১৭

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৭তম_পর্ব

ইকরাম ও সহমত দিলো। কিন্তু এর মাঝেই রবিন গম্ভীর মুখে বললো,
“সব রটনা, অনন্যার কথা ভুলে গেলে চলবে। আরে ফিজিক্সের টপার অনন্যা”

রবিনের কথাটা যেনো গুড়িগুড়ি বৃষ্টির আকাশের বিশ্রী বজ্রপাতের মতো ঠেকলো ধারার নিকট। প্লাবনের কথায় যাও একটু স্বস্তি পেয়েছিলো। সেই স্বস্তিখানা স্থায়ী হলো না। যাও একটু শান্তির প্রহর বইছিলো হৃদয়ে সেটুকু একেবারেই নষ্ট করে দিলো সামনে থাকা চায়ের মাঝে বিস্কিট ডুবিয়ে খাওয়া মানুষটি। নিজের অনুভূতির লহর কোনো মতে আটকে আমতা আমতা গলায় ধারা বললো,
“টপার অ..অনন্যা কে?”

রবিন তখনও বিস্কিট খাচ্ছে। তার উত্তর দেবার আগেই ইকরাম মুখ বাকিয়ে বললো,
“ও, আমরা তো জানতাম ই না! তুমি জানলা কেমনে? অফ যা গা’ধা, আজাইরা। ধারা ওর কথা কানে তুলো না। অনন্যার সাথে অনলের কিছুই ছিলো না”
“নিজেকে কি অন্তিক মাহমুদ ভাবিস! খুব না একেবারে রোস্টার হয়ে গেছিস! তোরা গা’ধা। অনন্যা যে অনলের জন্য প্রতিদিন রান্না করে আনতো সেবেলা? শোনো ধারা, তোমার কষা বড় আর টপার অনন্যার কঠিন সিন ছিলো। এখন এদের কথা যদি বিশ্বাস করে আমাকে অবিশ্বাস করো সেটা তোমার ব্যাপার”

ইকরামকে সম্পূর্ণ থামিয়ে নির্লিপ্ত চিত্তে কথাখানা বললো রবিন। ধারা পড়লো মহা বিপাকে। বুকের অন্তস্থলে “সানজিদা” এর মতো ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে। ভীষণ মাত্রা তার। হৃদয়ের আঙ্গিনায় সবকিছু উথাল পাতাল করে দিচ্ছে। সেই ঘূর্ণিঝড়ে কিশোরী মনে নব্য ফুটন্ত প্রণয় হারাবার ভয় উঁকি দিলো। নিকষকালো বিশ্রী ভয়। এতো কিছুর মাঝে ধারা আবারো অনুভব করলো সে সত্যিই প্রণয়ের বীজ বুনছে, অনল নামক প্রণয় বীজ। মাহির উপদেশ খানা স্মরণ করে বুকে একরাশ সাহস সঞ্চয় করলো সে। রবিনের মুখোমুখি হয়ে বললো,
“করলাম বিশ্বাস, এবার বলেন এই টপার অনন্যা কে?”
“তাহলে শোনো, ভার্সিটিতে আমি, অনল আর ইকরাম ছিলাম গণিতের ছাত্র। আর প্লাবণ ছিলো ফিজিক্সের। প্লাবণের সাথে পরিচয় হয়েছিলো অনলের মাধ্যমে। আমাদের ৪ জনের বন্ধুত্ব বেশ কড়া হলো। তখন একদিন টপার অনন্যার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো প্লাবণ। অনন্যা ছিলো ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট গার্ল। মেয়েটি যেমন গুনে তেমন রুপে। আমাদের ভার্সিটির সব থেকে সুন্দরী নারী ছিলো সে। সিনিয়র, জুনিয়র, ক্লাসমেট সবাই ওর উপর ফিদা। তাহলে অনল কি জিনিস। তবুও তোমার বরের আলগা ঢং, সে প্রথমে অনন্যার সাথে কোনো কথা বলতো না। তবে অনন্যার মনে যে তার প্রতি কিছু একটা আছে সেটা ভালোই বুঝা যেতো। অনন্যা অনলের সাথে হেসে কথা বলতো, তার কাছে অহেতুক গণিত বুঝতো। সেকারণে তাদের সখ্যতাও একটু বাড়লো। তারপর এলো সেই মূহুর্ত যখন তাদের এই সখ্যতা ভালোলাগায় পরিণত হলো”
“যা ব্যাটা, যাচ্ছে তাই”

রবিনের সুন্দর গোছানো গল্পে ভেটু দিলো প্লাবণ। বিরক্তিতে তার কপাল কুচকে আছে। রবিন উলটো প্রশ্ন করলো,
“একটা কথাও কি মিথ্যে ছিলো?”
“মিথ্যা ছিলো না, তবে যেমনে বলছিস সখ্যতা ভালোলাগায় পরিণত হলো এমন কিছুই হয় নি। হয়তো অনন্যা ওকে পছন্দ করতো কিন্তু অনল নয়”
“প্লাবণ ভাই দু মিনিট একটু থামেন, রবিন ভাই শেষ করেন।”

ধারা কঠিন আগ্রহ নিয়ে প্লাবণকে থামালো। প্লাবণ মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রবিন আবারো নিজেকে শ্রেষ্ঠ গল্পকারে পরিণত করলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“যা বলছিলাম, তখন ইন্ট্রা ভার্সিটি একটা প্রোগ্রাম হলো। কম্পিটিশন বলতেই পারো, সেখানে আমাদের ভার্সিটি থেকে একটা টিম গেলো। সেই টিমে ছিলো আমাদের অনল, অনন্যা, সিএসসি এর একটা ছেলে আর মাইক্রোবায়োলজির একটা ছেলে। সেই কম্পিটিশনের পর যেনো সব বদলে গেলো। লাইব্রেরিতে অনল এবং অনন্যাকে দেখা যেতে লাগলো। অকারণে অনন্যা আমাদের সাথে আড্ডা দিতো। আহা! অনন্যার রান্নার কি স্কিল ছিলো! পোস্ত ইলিশ, বোয়াল মাছের তরকারি, বেগুন ভর্তা, গরুর কালোভুনা। অনলের জন্য ও রান্না করে আনতো। আর সেই উছিলায় আমরা খেতাম। ভার্সিটির সবাই জানতো এদের মাঝে কিছু তো চলছে। দুজন ই টপার, দুজন সুন্দর, একেবারে তাহসান-মিথিলা। কিন্তু ওই যে নজর, ভালো জুটি ঠিকে না। তাহসান-মিথিলার মতো ওদের জুটিও টিকলো না। ফোর্থ ইয়ারে কিছু একটা তো হলো! দুজন দুজনকে দেখেও অদেখা ভাব দিতো। অনলকে কতবার জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দিলো না। তারপর সেমেস্টার ফাইনাল শেষ হলো। অনল আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলো। অনন্যাও ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট৷ ভাবলাম এবার হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হলো না! অনন্যা পাড়ি দিলো অস্ট্রেলিয়া। আর সেই সুযোগে প্লাবণ হইলো টিচার৷ নয়তো এই প্লাবণের বেল ই ছিলো না। আহারে! অনন্যার রান্না, ওদের এই ঝামেলায় শা’লা আমার পেটে লা’থি পড়লো”

রবিন আফসোসের সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধারার গোলমুখটা লম্বা থেকে লম্বাটে হচ্ছে। উজ্জ্বল মুখশ্রীতে আষাঢ়ের মেঘমেদুর জমেছে। অনন্যার বর্ণনায় সে মোটামুটি বুঝে গেছে সে ছিলো আদ্যোপান্ত কেট মিডলটন। প্রিন্স উইলিয়ামের সাথে যে তাকেই মানায়। ধারার কৃষ্ণ মুখশ্রীটা স্মৃতির চোখে পড়লো। সে এই গুমোট পরিবেশ হালকা করতে বলে উঠলো,
“রবিনের বাজে কথাগুলো শুনো না। এই যে কাহিনী ছিলো এটা ওর অলস মস্তিষ্কের বানোয়াট ছাড়া কিছু না! হতেই পারে অনন্যার সাথে অনলের খুব ভালো খাতির ছিলো। মাঝে মাঝে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। তবে সেই বন্ধুত্বকে প্রণয়ের পরিচয় দিতে হবে এটা তো ঠিক নয়। আর অনল যথেষ্ট স্ট্রেটকাট ছেলে, ওর মাঝে এই লুকোচুরি ব্যাপারটা নেই। যদি অনন্যা ভালোই লাগতো অন্তত প্লাবণ জানতো”
“হ্যা, আমি তো জানতাম। অনল আমার থেকে কিছু লুকায় না”

স্মৃতির কথায় যোগদান করলো প্লাবণ। ধারা তবুও কেনো যেনো আশ্বস্ত হতে পারলো না। অনলকে সে যতবার জিজ্ঞেস করেছে সে বিচিত্র হাসি দিয়ে এড়িয়ে গেছে। তাই তার হৃদয়ের কথাটা এখনো যে অজানা। সবার দৃষ্টি তার দিকে বিধায় খানিকটা জোরপূর্বক হাসলো সে। নরম গলায় বললো,
“আরে! আমাকে নিয়ে পড়লে কেনো! আমি তো জানি রবিন ভাই কেমন গল্প বানায়৷ ঢোপ দেওয়ায় তার উপরে কেউ নেই। আমি তো শুধু শুনছিলাম সে কতো দূর যেতে পারে৷ গল্পের সিড়ি যে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাবে এটা ভাবি নি”
“তুমিও আমাকে অবিশ্বাস করলে ধারা?”

হতাশামিশ্রিত কন্ঠে রবিন বললো। ঠিক তখন ই আগমন ঘটলো অনলের। ভ্রু কুচকে চাঁপা স্বরে বললো,
“কে অবিশ্বাস করছে তোকে?”
“তোর এই স্বার্থপর বন্ধুরা এবং তোর এই পিচ্চি বউ”
“কেনো?”
“কেনো আবার! তোর আর অনন্যার মধ্যে যে সিন ছিলো মোটেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না”

অনন্যার নাম শুনতেই অনলের হাসি মিলিয়ে গেলো। প্রসন্ন মুখখানা কঠিন হয়ে উঠলো মূহুর্ত। বহু বছর বাদে এই নামটা শুনবে আশা করে নি। ভ্রু জোড়া আরোও বেশি কুঞ্চিত হলো। চোখজোড়া ছোট ছোট হয়ে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো রবিনের দিকে। রবিন তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো। কারণ অনন্যার নাম উঠলেই এই বান্দার মুখের রঙ পালটে যায়। অনল আঙ্গুলের ঢগা দিয়ে কপাল ঘষলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“অপ্রয়োজনীয় কথা বলাটা তোর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্বভাবটা বাদ দে। বয়স তো হচ্ছে, একটু বড় হ”
“কেনো, পুড়লো বুঝি!”

রবিন বাঁকা হেসে কথাটা বললো। অনল ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। দূর্বোধ্য সেই হাসি। কেউ না বুঝলেও এই হাসির অর্থ প্লাবণ জানে। অনলের এই হাসির অর্থ “বেশি বকিস না, মা’র একটাও মাটিতে পড়বে না”। অনল ধারার পাশে বসলো। একটা ক্লিপ এগিয়ে দিয়ে বললো,
“শোন ধারা, কিছু মানুষের সব কথা বিশ্বাস্য, কিছু মানুষের অর্ধেক। আর রবিন প্রজাতির সব কথাই অবিশ্বাস্য। যা বলে এক কান দিয়ে শুনবি আর আরেক কান থেকে বের করে দিবি। চুল উড়ছে তোর, বেঁধে নে”

ধারা ক্লিপ্টা হাতে নিলো। খোলা অবাধ্য চুলগুলো খোঁপায় বাধলো। ইকরাম থমথমে পরিবেশ হালকা করতে আড্ডার মোড় ঘোরালো। আড্ডা আবারো জমলো। অনল ও তার কঠিন মুখশ্রী স্বাভাবিক করে নিলো। সন্ধ্যার চা নাস্তার পর বন্ধুমহল বিদায় নিলো। যাবার সময় প্লাবণ বরাবরের মতো ধারার হাতে দুটো ইকলেয়ারস ধরিয়ে বললো,
“রবিনের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো জলধারা। তুমি এবং অনল আমার জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আমি চাই তোমরা সুখী হও৷ এখন একসাথে হবে না আলাদা সেটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তবে এইসব উটকো চিন্তার জন্য নিজেদের মাঝে দূরত্ব করো না”

প্লাবণের কথার মর্মার্থ ভালো করেই বুঝতে পারলো ধারা। প্রত্যুত্তরে কেবল হাসলো সে। তবে ক্ষীণ খচখচানিটা যেনো রয়েই গেলো, হয়তো নিজ সুপ্ত প্রণয়ের মানুষটিকে হারানোর ভয় ই এই খচখচানি________

ঘড়ির কাটা দশটার ঘরে৷ ধারাদের বাসায় সাড়ে নয়টার দিকেই খাবার খাওয়ার প্রথা। জামাল সাহেব তাড়াতাড়ি খান। এবং তিনি একা খাওয়া পছন্দ করেন না। বাড়ির প্রতিটি প্রাণীর তার সাথেই বসে খেতে হবে। সেটা তার ক্ষুদা লাগুক বা না লাগুক। যদি তখন না খাওয়া হয় তবে তার খেতে হবে একা। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করবে না। এতো বছরেও এই প্রথা বদলায় নি। আজও তাই হলো। সবার খাবার ঠিক সাড়ে নয়টায় ই শেষ। শুধু অনল বাদে। বন্ধুদের যাবার পর থেকেই বান্দা ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। আড্ডার মাঝে ফোন এসেছিলো ভার্সিটি থেকে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে তাকে। সেটাই করছে সে। ধারা দু চার ডেকেছিলো কিন্তু বান্দা উত্তর দেয় নি। সে তার ল্যাপটপেই মাথা ডুকিয়ে রেখেছে। অবশেষে হতাশ হয়ে খেতে চলে গেলো ধারা।

খাবার শেষে প্লেট হাতে রুমে ঢুকলো ধারা। বড় মা ছেলের চিন্তায় দিশেহারা। তাই ধারার হাতেই খাবার পাঠিয়েছে। ধারাও মানা করতে পারলো। কারণ তার ও চিন্তা হয় লোকটির জন্য। রুমে প্রবেশ করতে দেখা গেলো অনল তখন ও তার কাজে ব্যাস্ত। ধারা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“ল্যাপটপটির যদি মুখ থাকতো তবে সে মানবাধিকার মা’ম’লা করতো তোমার নামে। সেই কখন থেকে এর উপর অত্যাচার চালাচ্ছো। এবার ক্ষান্ত দেও”
“কালকে এই ফাইল অফিসে জমা দিতে হবে। হেড স্যারের ফোন ছিলো। মিটিং আছে”
“অসব বুঝি না, খেয়ে নাও। বড় মা খাবার পাঠিয়েছে”
“খাইয়ে দে”

ল্যাপটপ থেকে মাথা না তুলেই নির্বিকার ভাবে কথাটা বললো অনল। ধারা অবাক চোখে তাকালো অনলের দিকে। অনলের মুখ থেকে এমন কোনো কথা অত্যন্ত আকষ্মিক ঠেকলো। সে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। ঘরে আবার নিস্তব্ধতা। নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে অনল আবার বললো,
“কি হলো, খাইয়ে দে”
“তোমার হাত নেই?”
“কাজ করছি তো ধারা”

এবার চোখ তুললো অনল। অসহায় চাহনীতে তাকালো ধারার দিকে। যেনো সে সেই ৯১ এর দুর্ভিক্ষের মানুষটি যে এখন ই না খেলে জ্ঞান হারাবে। কিন্তু তার কাজ ফেলে খাওয়াটা হবে পাপ। তাই সে নিরুপায়। ধারা কিছু বললো না, চেয়ারটা টেনে অনলের পাশে বসলো। লোকমা তুলে লোকটির মুখের সামনে ধরলো। লোকটি ও দিব্বি খেতে খেতে মনোযোগী হলো কাজে। ধারার মনে হলো সময়টা যদি থেমে যেতো তবে হয়তো মন্দ হতো না। এ যেনো অন্যরকম ভালোলাগা৷ এক অন্যরকম শিহরণ। প্রিয় মানুষটার আশেপাশে থাকতেও বোধহয় ভালো লাগে। ধারার মন আকাশে যেনো এক পশলা বৃষ্টির পর রঙ্গিন রংধনু উঠেছে। ধারা সবটুকু খাবার অনলকে খাওয়িয়ে দিলো। আর অনল বিনা অভিযোগে খেয়েও নিলো। ধারা বেশ অবাক হলো, কারণ অনল একটি বারও করলা ভাজি নিয়ে অভিযোগ করে নি। যেখানে তার অতীব অপছন্দের খাবার সেটা। ধারা যখন খাবার খাওয়ানোর পর উঠে যেতে নিলো তখন হাতখানা টেনে ধরলো অনলো। মৃদু কন্ঠে বললো,
“একটু বসবি, কিছু বলার ছিলো”………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১৬

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৬তম_পর্ব

চোখ বুজে গান শুনছিলো অনল। ধারা মুখে হাত দিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের কিরণে প্রিন্স উইলিয়ামকে যেনো আরোও সুন্দর লাগছে। হঠাৎ চোখ খুললো অনল। চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো,
“কি দেখিস?”
“তোমাকে”

ধারার “তোমাকে” টুকু মস্তিষ্কে ধাবণ করতে সময় নিলো অনলের৷ মস্তিষ্ক জুড়ে যেনো মেয়েটির ঘোর লাগানো স্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ক্ষণিকের জন্য স্তদ্ধ হয়ে গেলো সে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। পড়ন্ত বিকেল, পশ্চিমে লাল আভা গাঢ় হচ্ছে। প্রস্তুতি হচ্ছে ব্যস্ত দিনের সমাপ্তির। ঈষৎ লালচে আলো আছড়ে পড়ছে ধারার ঘোর লাগা চোখে। তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত মাদকতা। অনল চোখ রাখলো ধারার সেই মাদকতাপূর্ণ চঞ্চল চোখে। দুজনের মাঝে কোনো কথা নেই। শুধুই নীরবতা। সময়টা যেনো থেমে গেছে। আশেপাশের কোলাহল যেনো তাদের ছুতে পারছে না। অনল অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। একবার ইচ্ছে করলো প্রশ্ন করতে, “কেনো?” কিন্তু প্রশ্নটি করা হলো না। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। লালচে রঙ্গে নীলাম্বরে ছেয়ে গেছে। পাখিরা যে যার ঘরে ফিরছে। অনল চোখ সরিয়ে নিলো। আশেপাশের গান থেমে গেছে। আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। অনল হাটু ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নরম গলায় বললো,
“বাসায় যেতে হবে”

ধারার ঘোরে পড়লো ছেদ৷ স্বম্বিত ফিরলো তার। উপলদ্ধি করলো এতো সময় নির্লজ্জের মতো শুধু অনলকেই দেখেছে সে। তার থেকেও বেশি লজ্জা পেলো যখন স্মরণ হলো একটু আগের বলা কথাটা, সে অকপটেই অনলকে লোলুপ দৃষ্টিতে দেখার কথাটা স্বীকার করে নিয়েছে। না জানি অনল ভাই কি ভাবছে! কি চলছে তার মনে! সে কি রাগ করেছে! নাকি লজ্জা পেয়েছে! নাকি বিরক্ত হয়েছে! ধারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। দিনের আলো মিলিয়ে গেছে, নদীর পাড়ে আঁধার নেমে গেলো এসেছে। এখন বাড়ি ফিরতে হবে। অনল অপেক্ষা করলো না ধারার জন্য। অনলকে চলে যেতে দেখে পিছু নিলো ধারা। কিশোরী মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিলো। তখনের কথা এবং কাজে কি সে রাগ করেছে! কেনো করেছে রাগ! নিজের স্বামীকে দেখা তো খারাপ নয়! আর যদি রাগ না করে থাকে তবে এমন এড়িয়ে যাচ্ছে কেনো! উত্তর পেলো না ধারা।

সারাটা রাস্তা কোনো কথা হলো না তাদের মাঝে। ধারাও কোনো কথা বলে নি, অনল ও নয়। শুধু বাইকে উঠতে উঠতে বলেছিলো,
“সাবধানে বসিস, আমি একটু জোরে চালাবো”

এটুকুই তাদের মাঝে কথা হয়েছে। এক অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হলো। ধারা বুঝলো না, অনলের আচারণের কারণ। হয়তো অনল নিজেও জানে না এই কারণ। অন্য চারটে সম্পর্কের মতো তাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক নয়, এক অদ্ভুত জড়তা দুজনের মনেই উঁকি দিচ্ছে। অনলের মনে হচ্ছে তাদের দুজনের মাঝে একটা কাঁচের দেওয়াল আছে, যা ভেদ করাটা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ধারাকে আঘাত করতে চায় না। নিজেও আঘাত পেতে চায় না। তাই দ্বিধাবোধ হয়। তাদের সম্পর্কের কি আদৌও ভবিষ্যৎ আছে! নাকি এটা শুধুমাত্র দাদাজানের একটা জেদ হয়েই থেকে যাবে! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অজানাই রয়ে গেছে। তাই নিজ থেকে দু কদম এগোলেও দু কদম পিছিয়ে আসে সে। ফলে তার অবস্থানটা একই জায়গায় আছে। ধারাও আগায় নি! ফলে সম্পর্কটা এখনো একমাস পূর্বের মতোই আছে______

বাসায় পৌছালো রাত নয়টার দিকে। ধারা বিনা বাক্যে ভেতরে চলে গেলো। মনে থেকে গেলো তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের উৎপন্ন প্রশ্ন। বাসায় প্রবেশ করতেই আশা এবং এশা ছুটে এলো অভিযোগের পুটলি নিয়ে। তাদের ছাড়া কেনো ঘুরতে যাওয়া হলো। ধারা ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আরেকবার নিয়ে যাবো”

অনল কারোর সাথে কথা বললো না। সোজা নিজ ঘরে চলে গেলো। এশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুসময় তাকিয়ে রইলো অনলের যাবার দিকে। তারপর বলে উঠলো,
“অনল ভাইরে কি কু’ত্তায় কামড়াইছে? মুখটা এমন ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো করে রাখছে কেনো?”
“জিজ্ঞেস করে আয়”

ধারা ওর চুলটা খানিকটা টেনে কথাটা বললো। এশা বা হাতে মাথা ঢলতে ঢলতে বললো,
“বলবা না বলে দিলেই হয়। ভয় দেখাও কেনো!”

ধারা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুবি দুটোর কান ধরে বললো,
“মেয়েটা মাত্র বাড়ি আসছে, একটু শান্ত দে। আর তোদের পড়া নেই! সারাক্ষণ টো টো কোম্পানির ম্যানেজারি করিস? যা নিজের রুমে পড়তে যা”

ধারা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ব্যাগটা নিয়ে নিজ ঘরে চলে গেলো। এশা এবং আশাও বাধ্য হয়ে নিজ ঘরে গেলো। মায়ের কান মলায় ফর্সা কান লাল হয়ে গেছে। তবে এশা ক্ষান্ত হলো না। ফিসফিসিয়ে বলল,
“কুছ তো গারবার হ্যা দায়া, পাতা লাগাও”

অপরদিকে ঘরে প্রবেশ করে অনলকে দেখতে পেলো না ধারা। বাথরুম থেকে ঝর্ণার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তাই আন্দাজ করা কঠিন হলো না মানুষটি কোথায়। ধারা নিজের ব্যাগটা রেখে দিলো। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। এতো লম্বা সময় বাইকে বসে মাজা ধরে এসেছে। মিনিট বিশেক বাদে অনল বের হলো টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে। বের হতেই তার চোখ গেলো শুভ্র বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমন্ত কিশোরীর দিকে। অনলের পা জোড়া এগিয়ে গেলো তার কাছে। বসলো কিশোরীর পাশে৷ ঘোর লাগা চোখে দেখছে কিশোরীকে। এক সময় বা হাত দিয়ে কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো সরিয়ে দিলো। ধীর গলায় বললো,
“আমাকে আর পাগল করিস না ধারা, একটা মানুষ বারবার ম’র’তে পারে না”

কথাটা নিস্তব্ধ ঘরেই আটকে রইলো। ঘুমন্ত কিশোরীর সেটা শোনা হলো না______

******

ক্যাফেটেরিয়ায় বন্ধুমহলের মধ্যে বসে আছে ধারা। শফিক স্যারের লিনিয়ার এলজ্যাবরা ক্লাস আজ হবে না। তাই বন্ধুমহল জড়ো হয়েছে ক্যাফেটেরিয়ায়। অবসর সময় কিভাবে কাটাতে হয় তা দিগন্ত এবং অভীকের কাছ থেকে শেখা উচিত। তাদের মধ্যে লেবু খাবার প্রতিযোগিতা চলছে। যে হারবে সে অপরজনের বাকি খাতা পরিশোধ করবে। রফিক মামা দশটা কাগজী লেবু কেটে দিতে বলেছেন। অভীকের বাকি খাতায় জমেছে ২৫৬৭ টাকা, দিগন্তের বাকি খাতায় জমেছে ২৪৬৮ টাকা৷ যেই জিতুক না কেনো তার বাকী টাকা পরিশোধ হবে। সেই আনন্দে রফিক মামার মুখ চকচক করছে। সে এই দশখানা লেবুর টাকা নিবে না। কারণ ২০০ টাকার বিনিময়ে তার যদি বাকি পরিশোধ হয় সেটাও বা কম কিসে! নীরব অতিউৎসাহীত ভাবে তাদের সাপোর্ট করছে। মোবাইল ফোনে ভিডিও ও করছে। ভার্সিটির গ্রুপে শেয়ার করবে সে। ধারার এদিকে খেয়াল নেই। দুটো দামড়া ছেলে লেবু খাবে এটা দেখার কি হলো! মাহিটা যদি থাকতো তাহলে আর খারাপ লাগতো না। কিন্তু জনাবা এখনো ক্যাম্পাস ই আসে নি। মাহির সাথে বন্ধুত্বটা আজকের না। সেই ছেলেবেলার, শুধু ধারা এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বিধায় সেও ভর্তি হয়েছে। দুজন দুজনকে ছাড়া চলতে পারে না। যতই দিগন্ত, অভীক, নীরব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোক না কেনো! মাহির সাথে যেনো মনের টানটাই আলাদা। এই যদি আজ মাহি থাকতো তবে মনের মাঝে জন্ম নেওয়া নবাগত ঝড়ের কথাগুলো তাকে বলতে পারতো। অনল ভাইয়ের প্রতি জন্মানো দূর্বলতাগুলোও বলতে পারতো। কিন্তু সে তো নেই, রাগ করে মাধবীর সাথে ঘুরছে। ধারা তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এদিকে সামনের দুটো বা’দ’রের মুখ টকের কারণে বিকৃত হয়ে গিয়েছে। তবুও হাল ছাড়ছে না। আজ একজনের বাকি পরিশোধ হবেই। এর মাঝে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় মাহি। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“কথা আছে”

মাহির কথাটা শুনতেই কিছুটা বিস্মিত হয় ধারা। কিছুসময় ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে থাকে। অপরদিকে অভীক এবং দিগন্তে নিজেদের প্রতিযোগিতা থামিয়ে দেয়। মাহি এবং ধারার ভেতরে বরফ গলছে। আজ তিনদিন পর মাহি ধারার সাথে কথা বলছে! এ যেনো আশ্চর্য! ধারা মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। ধারা দাঁড়াতেই মাহি বেড়িয়ে যায়। ধারাও পিছু নেয় মাহির। দিগন্ত লেবুর সপ্তম পিছ মুখে তুলতে তুলতে বলে,
“যাক, মাহি চু’ন্নীর সুবুদ্ধি হইছে”

বিল্ডিং পাশের সিড়িতে এসে বসে মাহি। ধারা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে বারবার ব্যাগের ফিতা টানছে। মাহি তীর্যক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তারপর তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
“কিছুই বলার নেই তোর?”
“কি বলবো?”

উলটো তেজ দেখিয়ে কথাটা বলে ধারা। মাহি ভ্রু কুচকায়। বিরক্তি যেনো বাড়লো। কন্ঠ আরোও ঝাঁঝালো করে বললো,
“বিয়ের কথাটা লুকালি কেনো? তুই তো জানতি আমি অনল ভাই এর প্রতি দূর্বল। উনত্রিশ বার তাকে চিঠি দিয়েছি।আর প্রতিবার সেটা ব্যার্থ হয়েছে। তুই যদি না লুকাতি সেটা আঠাশ বার ই হতো। ন্যাড়ার মতো সরাসরি আমি অনল ভাইকে প্রপোজ করতাম না”
“সেটা বলার জন্য তো ফোন করেছিলাম, ধরেছিলি! যেয়ে বসেছিলি মাধবীর পাশে। তা এখন শুনবি কেন?”

ধারাও কম নয়, সে তার রাগ অক্ষত রেখে কথাটা বললো। মাহি মুখ ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। তারপর শান্ত গলায় বললো,
“ক্ষোভ হয়েছিলো। অপমানিত, লজ্জিত হবার ক্ষোভ। এখন সেটা ঠান্ডা হয়েছে তাই শুনতে চাচ্ছি। বান্ধবীর উপর এটুকু ক্ষোভ তো হতেই পারে! ভেবেছিলাম, রাগ করলে তুই ও ভাঙ্গাবী। কিন্তু উলটো তুই ও ভাব মারতেছিস। নেহাত হারাতে চাই না এই বন্ধুত্ব। তাই নিজের ক্ষোভের আগুনে পানিটাও নিজেই ঢাললাম। যতই হোক, আমার তো আর বান্ধবী নেই”

মাহির কথাটা শুনে নিজেকে আটকাতে পারলো না ধারা। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ভেজা কন্ঠে বললো,
“তুই ই তো আমার ফোন ধরিস নি, জানিস আমি কতো ফোন করেছি। তোর জন্য চকলেট ও নিয়ে এসেছিলাম৷ উলটো তুই মাধবীর সাথে গিয়ে বসলি। আমার ও রাগ হলো। সরি”

দুই বান্ধবীর মাঝে জমা অভিমান জল রুপে দুজনের চোখে জমলো। কন্ঠে ভার হলো। মাহিও গলে গেলো, ধারাকে জড়িয়ে ধরলো। কতসময় তারা কাঁদলো জানা নেই। একটা সময় মন শান্ত হলো। দুজন চোখ মুছলো। বান্ধবীদের মাঝে হয়তো অভিমান হবার কোনো যুক্তি থাকে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারেও অভিমান হয়। মাহি নাক টেনে বললো,
“এবার কাহিনী বল”

ধারা সবটুকু খুলে বললো। নানাভাই এর অসুস্থতা, তার জেদ, অনল ধারার বিয়ে এবং সেই বিয়ে লুকানোর কারণ। মাহি শান্ত হয়ে শুনলো। আসলে পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো যে ধারা চাইলেও কিছু বললো না। মাহি বিজ্ঞের মতো সব শুনলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,
“তুই কি ভালোবাসিস অনল ভাই কে”

ধারা চুপ করে রইলো। নিজের মনটাকে অনেক উথাল-পাতাল করলো। মাহি অপেক্ষা করছে উত্তরের। কিছুসময় চুপ করে থেকে ধীর গলায় বললো,
“ভালোবাসা কি আমি জানি না, তবে এটুকু জানি মানুষটাকে কেন্দ্র করেই যেনো আমার সব কিছু। তেরোটা বছর যাকে বিরক্ত লাগলো, দুচোখের বিষ ছিলো। সেই মানুষটাকেই এখন সারাক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করে। তার কঠিন মুখশ্রী, গম্ভীর কন্ঠ সব ই আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। অজান্তেই লজ্জা পাই, অজান্তেই হাসি। আবার অজান্তেই অভিমান হয়। প্রণয় আমার কাছে আজও প্রহেলিকা। আমি জানি না প্রণয় কাকে বলে, তবে এটুকু জানি আমি বাজে ভাবে ফেসে গেছি। অনল ভাই যেনো একটা উত্তপ্ত নেশা। আমি প্রতিনিয়ত শুধু ডুবছি আর ডুবছি”

মাহি ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
“বান্ধবী তুমি আসলেই ফেঁসে গেছো। যাক খুশি হলাম অবশেষে তোমার রুচি এবং চোখ ভালো হলো। আমি তো ভেবেছি এখনো ওই প্লাবন ভাইতেই আটকে আছিস। তা অনল ভাই জানে ব্যাপারটা!”
“নাহ, উনাকে দেখলেই তো সব ভাষা উড়ে যায়”

মাহি কিছুসময় ভাবলো৷ তারপর বললো,
“তোর জন্য আমি আমার ব্যর্থ হৃদয়ের জ্বালা ভুলতে রাজি। যাহ, দিলাম তোকে অনল ভাই। কিন্তু কথা হচ্ছে, যেহেতু অনল ভাই ও বিয়েতে ভেটু দিয়েছিলো তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে সে কি তোকে ভালোবাসে কিনা! তাই আমার মতো ভুল তুই করবি না। আমাদের আগে জানতে হবে অনল ভাইয়ের মনে স্থান নেওয়া সেই নারীটি কে!”
“কিভাবে জানবো! উনি তো উড়িয়ে দেয় কথা। আর আমি এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই ক্যালকুলাস ধরিয়ে বলে অংক কর”
“এটাও আমাকে বলতে হবে? উফফ! আমার নাড়িনক্ষত্র যেমন তুমি জানো। তেমন অনল ভাইয়ের নাড়িনক্ষত্র জানে তার বন্ধুরা। অনল ভাইয়ের বন্ধুদের থেকে জানবি তার কোনো গার্লফ্রেন্ড ছিলো কি না! সবার রুচি তো তোর মতো না। আমি শিওর অনল ভাই এর পেছনে মানুষ পাগল ছিলো।”

মাহির কথায় ধারা খানিকটা হতাশ হয়ে পড়লো। মরা কন্ঠে বললো,
“যদি সত্যি অন্য কাউকে ভালোবাসে অনল ভাই? কি হবে?”
“তুই আমার বান্ধবী, আর নেগেটিভ কথা বলিস কেনো? বি পজেটিভ। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী— মনে রাখবি, তুই অনল ভাইয়ের বউ। যদি কেউ থেকেও থাকে তাকে খেদিয়ে জায়গা করে নিবি”

মাহির কথায় হেসে দিলো ধারা। মনের ভেতর জমা পাথর আজ নেমে গেছে। মনের যখন কথা খুলে বলে আর মনটা হালকা। হয়তো এজন্য এই মানুষগুলোকে বন্ধু বলে।

কেটে গেছে সপ্তাহ, ধারা বায়না ধরলো বাড়িতে প্লাবণ এবং স্মৃতিকে দাওয়াত করবে। সাথে ইকরাম এবং রবিন ও আসবে। বড়মার সম্মতি পেলেও অনলের প্রশ্নের সম্মুখীন হলো। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“মতলব কি তোর?”
“বারে তাদের বিয়ে খেলে, অথচ একটু দাওয়াত করবে না? ছি ছি কি কিপ্টে বন্ধু”

ধারার যুক্তির কাছে উত্তর পেলো না অনল। কিন্তু তার সন্দেহ হলো বেশ। ধারা সুবিধার নয়। যে মেয়ে হলুদের দিন বরের পেট খারাপ করতে পারে না জানি কি বুদ্ধি আটছে। তাই নিজ দায়িত্বে খাবারের উপর নজর দিলো সে। বলা যায় না! দেখা গেলো তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের আবার কোনো ষড়যন্ত্র। অবশেষে শুক্রবারে সবাই দুপুরে জমায়াত হলো। আড্ডা, গল্পে মুখরিত বাড়ি। জামাল সাহেব রবিনকে দেখে বললো,
“কি রে, তোমার পাশ হইছে?”

রবিন এই বন্ধুমহলের ফেলু ছাত্র। জামাল সাহেবের কথায় লজ্জা না পেয়ে সরাসরি বললো,
“আপনার নাতি ছিলো, তাই তো এখন খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি”

খাবার পর ছাঁদে চায়ের আড্ডা বসলো। স্মৃতির সাথে বেশ সখ্যতা হলো ধারার। আড্ডা জমলো। ভার্সিটির কুকীর্তি, সুকীর্তি নানা গল্প উঠলো ধোঁয়ার সাথে। এর মাঝে অনলের ফোন বাজলো। কথা বললে সে একটু দূরে গেলো। সেই ফাঁকে প্রশ্ন করলো ধারা,
“আচ্ছা, অনল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড ছিলো না?”

ধারার প্রশ্নে হেসে দিলো প্লাবণ এবং ইকরাম। হাসি থামিয়ে প্লাবণ বললো,
“কেনো জলধারা, বরের তথ্য নিচ্ছো বুঝি!”
“নিতেই পারি”
“চিন্তা করো না, তোমার বরটি ছিলো কষা মানুষ, নিরস না’রী’বি’দ্বে’ষী। কোনো নারীর গা ঘেষা দূরে থাক কথাও বলতো না। তাই নিশ্চিন্তে থাকো। তার কোনো মেয়ে ঘটিত কেলেঙ্কারি নেই”

ইকরাম ও সহমত দিলো। কিন্তু এর মাঝেই রবিন গম্ভীর মুখে বললো,
“সব রটনা, অনন্যার কথা ভুলে গেলে চলবে। আরে ফিজিক্সের টপার অনন্যা……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১৫

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৫তম_পর্ব

চকলেটটি এগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
“দোস্তো, সরি। আসলে সব কিছু এমন ভাবে হয়েছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। রাগ করিস না”

ধারা ভেবেছিলো কাজ হবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে মাহি উঠে দাঁড়ালো। বিনাবাক্যে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিলো। গিয়ে বসলো ধারার অতীব অপছন্দের ক্লাসমেট মাধবীর পাশে। ধারা তাকে ডাকতে চাইলো কিন্তু থেমে গেলো। মানুষের একটা বাজে প্রবৃত্তি আছে, যে সকল মানুষদের তারা অপছন্দ করে তারা চায় না তাদের পছন্দের মানুষগুলো সেই অপছন্দের মানুষের আশেপাশে থাকুক কিংবা কথাও বলুক। ধারার মাঝে এই প্রবৃত্তিটি যেনো একটু মাত্রাতিরিক্ত ই। ভার্সিটিতে ভর্তিতে হবার থেকেই মাধবী নামক মেয়েটিকে তার অপছন্দ। সব কিছুতেই তার অতিরিক্ত বোঝা ভাব। ধারার মতে মেয়েটি অতিমাত্রায় স্বার্থপর। ভার্সিটির শুরুর দিকে যখন সিনিয়র ভাই-বোনেরা র‍্যাগিং করতো তখন সেই র‍্যাগিং থেকে বাঁচার জন্য সে নিজ ক্লাসমেটদের নামে কথা লাগাতো। ফলে তার সাথে সিনিয়রদের সখ্যতা হলেও ক্লাসের বাকিদের উপর চলতো র‍্যাগিং। ধারাও সেই র‍্যাগিং এর স্বীকার। এই মাধবী মেয়েটির জন্য অহেতুক কারণে এক আপুর কাছে বকা খেতে হয়েছিলো তার। সেখান থেকেই এই মেয়েটাকে অপছন্দ তার। ধারার অপছন্দ বিধায় মাধবীকে বন্ধুমহলেরও অপছন্দ। অথচ আজ সেই মাধবীর সাথেই গিয়ে বসেছে মাহি। ফলে প্রচন্ড রাগ জমলো মনের কোনে। আগুন জ্বলে উঠলো তার মস্তিষ্কে। নিজের বান্ধবীর উপেক্ষা হয়তো এতোটা কষ্ট দিতো না, যতটা তার শত্রুর সাথে সখ্যতায় দিচ্ছে। ধারা চেয়েছিলো মাহির সাথে সব ঠিকঠাক করে নিবে। কিন্তু মাহির এমন কার্যে সেই ইচ্ছে বর্জন করেছে সে। কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে, সে আর নিজ থেকে মাহির রাগ ভাঙ্গাবে না। তার রাগ করার ইচ্ছে থাকলে করুক। তার আর অনলের বিয়ে তো নিজের ইচ্ছেতে হয় নি। তখনের পরিস্থিতিও অনুকূলে ছিলো না। তাই সে মাহিকে কিছুই জানায় নি। অনল ভাইকে মাহি পছন্দ করতো সেখানেও তার কোনো দোষ নেই, অনল ভাই তাকে প্রত্যাখান করেছে সেখানেও তার দোষ নেই। তবুও ধারা তার রাগ ভাঙ্গাবার চেষ্টা করেছিলো। অথচ মাহি কি না তাকে উপেক্ষা করে, তার উপর রাগ দেখিয়ে মাধবীর সাথে বন্ধুত্ব করতে গেছে। যাক, চুলোয় যাক সে। ধারার দায় পড়ে নি তার রাগ ভাঙ্গানোর। চকলেট টা নিক ব্যাগে পুরে ফেললো সে। এদিকে দুজন প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে দুপ্রান্তে বসতে দেখে দিগন্ত, অভীক এবং নীরব প্রচন্ড অবাক। মাহি এবং ধারা ফেবিকলের আঠার মতো। দুজন যেনো দুজন ছাড়া অচল৷ অথচ একজন দক্ষিণে বসেছে তো অন্যজন বসেছে উত্তরে। দিগন্ত অভীককে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“চু’ন্নী দুটোর আবার কি হয়েছে? একটা টেকনাফে আর আরেকটা তেতুলিয়ায় কেনো?”
“কলিযুগ চলছে রে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। নয়তো দেখ, মাহি আর ধারার মাঝেও ঝামেলা হলো”
“গুরুতর কিছুই হয়েছে। নয়তো মাধবীর পাশে মাহির বসার কথা না। এদিকে ধারাও দেখ রেগে লাল হয়ে আছে। ওতো কথাও বলছে না। খোঁজ তো নিতেই হবে”

অভীক সহমত জানালো। নীরব চুপ করে রইলো। শুধু চোখ ছোট ছোট করে মাহি এবং ধারাকে দেখলো। দুজনের মাঝে একটা থমথমে আবহাওয়া। একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছেও না। কথা তো দূরে থাক। তবে কি ফাটল ধরলো বন্ধুমহলে! স্কুল কলেজের বন্ধুত্ব গুলো অন্যরকম হয়! তখন মানুষের মন টা থাকে ছোট, সেখানে নিজের স্বার্থ ততটা থাকে না। কিন্তু ভার্সিটির বন্ধুত্ব অন্যরকম। এই জীবনে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে মানু্ষ; স্বার্থ, উচ্চাকাঙ্খার মাঝেও কিছু কিছু মানুষের একটা দল তৈরি হয়। যারা সারাদিন ই একসাথে কাটায়। এই সারাদিন একসাথে থাকলেও সিজি, নোট, নম্বর, এসাইনমেন্ট, প্রেম সব মিলে বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। এমন কত গ্রুপ আছে যা ফার্স্ট ইয়ারে তৈরি হলেও ফোর্থ ইয়ার আসতে আসতে ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। মনোমালিন্য, ঝগড়া, অভিমান, রাগ, ক্ষোভ বন্ধুত্বের মিষ্টি সম্পর্কটিকে করে তোলে তিক্ত। তারপর ভার্সিটি শেষ হয়। এক একেক জন এক একেক পথে। নিজেদের জীবন নিয়েই ব্যাস্ত। ফিরে থাকাবার সময়টিও হয় না। অবহেলায় পড়ে থাকে, ক্যাফেটেরিয়ায় কাটানো সময়, আড্ডা, গান, চায়ের কাপ। নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইট, পাথরের এই ঢাকায় সে একা, আত্নীয়রা থাকে সদূর পঞ্চগড়। এই বন্ধুমহলটিই তার পরিবার। সে চায় না এই সুখময় জায়গাটা নষ্ট হোক। সে চায় না এই পাঁচজনের মাঝে কোনো ফাটল ধরুক। রাগ, ক্ষোভ তো থাকবেই, কিন্তু দিনশেষে না হয় এই বন্ধুত্বের মিষ্টতা দিয়ে তার সমাধান হোক________

ক্লাস শেষ হল। একে একে চারটে ক্লাস, মাঝে ব্রেক থাকলেও মাহি এবং ধারার মাঝে কোনো পরিবর্তন হলো না। ক্লাস শেষ হবার পর বন্ধুমহল অপেক্ষা করছিলো ধারা এবং মাহি হয়তো কথা বলবে। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণিত করলো তারা। মাহি হনহন করে বেরিয়ে গেলো। ধারাও ব্যাগ গুছালো। সে পাত্তা দিলো না মাহির উদাসীনতার। যেনো মাহির অভিমানে তার যায় আসে না। দিগন্ত বললো,
“তোরা ধারার সাথে কথা বল, আমি মাহিকে দেখছি”

বলেই পিছু নিলো মাহির। এদিকে অভীক আর নীরব মুখোমুখি হলো ধারার। ভনিতা ছাড়াই অভীক প্রশ্ন ছুড়লো,
“কি হয়েছে তোর আর মাহির মাঝে?”

আকষ্মিক প্রশ্নে খানিকটা চমকে উঠলো ধারা। উত্তরটা গলায় আটকে থাকলেও বলতে পারলো না। শান্ত কন্ঠে বললো,
“কিছু না, ওর রাগ করতে ইচ্ছে হয়েছে করেছে”

বলেই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো ধারা। অভীক এবং নীরব তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পথে______

****

অনেক কষ্টে দৌড়ে এসে মাহিকে থামালো দিগন্ত। হাপাতে হাপাতে বললো,
“এতো জোরে হাটছিস কেনো? ট্রেন ধরবি নাকি? কখন থেকে ডাকছি, শুনিস না নাকি!”

মাহি সত্যি শুনে নি। নিজ মনেই হাটছিলো সে। কালকের পর থেকে মস্তিষ্ক যেনো অচল হয়ে গেছে। মন এবং মস্তিষ্কের রেষারেষিতে ক্লান্ত হয়ে আছ্র। নিজের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর উপর প্রবল ক্ষোভ জন্মেছে, সেই সাথে নিজের কাজেও লজ্জা লাগছে। সেদিন যদি ধারা সত্যিটা বলে দিতো তবে নির্লজ্জের মতো অনলের কাছে প্রেম নিবেদন করতো না। এখন সে বেশ বুঝতে পারছে অনল কেনো বলেছিলো “এক হৃদয়ে দুই নারীর স্থান হয় না” —- কারণ সে বিবাহিত।ধারার সাথে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। ফলে আজ মাধবীর পাশে বসেছে সে। অবশ্য অন্য জায়গায় জায়গাও ছিলো না। কারণ ধারার পাশে বসবে না। দিগন্তকে এমন পথ আটকাতে দেখে কিছুটা চমকে গেলো সে। অবাক কন্ঠে বললো,
“আমাকে ডাকছিলি কেনো?”
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“বাসায়, আর কোথায় যাবো!”
“তোর আর ধারার মধ্যে কি হয়েছে? ফেবিকলের জোর ভাঙ্গলো কেনো?”

দিগন্তের প্রশ্নে খানিকটা বিরক্ত হলো মাহি। এই ছেলের এতো কেনো মাথা ব্যাথা বুঝে না। বিরক্তিভরা স্বরে বললো,
“কেনো? ব্রেকিং নিউজ বানাবি! দশ হাত দূরে যা তুই। আমাদের ব্যাপার আমরা বুঝে নিবো। নিজের বান্ধবীর উপর রাগ ও করতে পারবো না কি? রেগে আছি। ক্ষোভ হয়েছে, কমলে যেয়ে কথা বলবো। তোর মাথা ঘামাতে হবে না”
“বাহ বা! যার জন্য করি চুরি সে বলে চোর। আমার চিন্তা হচ্ছিলো তাই এসেছি, আর আমার উপর চোটপাট করছিস। কি অদ্ভুত! শোন, আমি ব্রেকিং নিউজ করতে পারি ঠিক, কিন্তু বন্ধুদের খবর আমি পাঁচার করি না। আমার ও একটা নৈতিকতা আছে”

দুঃখভরাক্রান্ত কন্ঠে দিগন্ত বললো। মাহি এখনো ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা আস্তো নাটকবাজ। শুধু নাটক করে। বুক বাকিয়ে বললো,
“হইছে, থেমে যা। নাটক যতসব। তোর স্বভাব জানা আছে।”
“বিশ্বাস করলি না তো, মনে থাকবে। আর একটা কথা, চুপ করে থাকলে রাগ বাড়ে। তখন সেটা অভিমানে পরিণত হয় এর বরং রাগ কমিয়ে নেই। দরকার হলে কটা গা”লি দিয়ে নিস। তবুও এতোকালের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাস না”

বলেই হাটা দিলো দিগন্ত। দিগন্তের কথাটা মস্তিষ্কে গেঁথে গেলো মাহির। সত্যি ই তো রাগ মনে পুষে রাখলে অভিমান জন্ম নেয়। রাগ ভাঙ্গা সহজ, অভিমান বড়ই বিচিত্র।

*****

ভার্সিটির গেট পেরিয়ে একটু সামনে আসতেই ধারা থমকে গেলো। পড়ন্ত দুপুর, সূর্য মাথার উপর। জ্বালাময়ী রোদে পিচের রাস্তার উপর থেকেও ধোঁয়া উড়ছে যেনো। অথচ এই রোদের মধ্যেও একটা দোকানের সামনে বাইকের উপর হেলান নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনল। তার হাতে একটা পেপসির আড়াইশো এম.এল এর বোতল। সে একটু পর পর পেপসি খাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। অনল ধারাকে নিতে আসবে এটা কল্পনা করে নি সে। আজ অনলের ছুটিও ছিলো। ক্লাস নেই বিধায় সে আজ ভার্সিটি যায় নি। ধারা কিছুটা এগিয়ে যেতেই অনল সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বাইকে উঠে স্টার্ট দিতে দিতে বললো,
“তোর আজকে ফাইন হবে, বিশ মিনিট রোদে দাঁড়িয়ে আছি”
“আমি বলেছি আসতে? এসেছো কেনো?”
“তুই তো মানুষ ভালো না, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি জিজ্ঞেস করবি আমি ঠান্ডা কিছু খাব কিনা! আমার কষ্ট হয়েছে কি না! তা নয়, মুখে মুখে তর্ক জুড়ে দিচ্ছিস”
“ধন্য করেছো এসে। এখন প্রিন্স উইলিয়ামের জন্য কি করতে পারি”
“তাড়াতাড়ি বাইকে উঠে আমাকে উদ্ধার করতে পারিস”

ধারা মুখ বেকিয়ে ভেঙ্গালো অনল কে। মনটা ভালো লাগছে না। মাহির উপর চরম রাগ হচ্ছে। অকারণ যদিও, তবুও হচ্ছে রাগ। তার বেস্ট ফ্রেন্ড কেনো ওই কু’ট’নী মাধবীর পাশে বসবে! ধারা বাইকে বসতে বসতে বললো,
“বাড়ি যাবো না”
“তা এই ভরদুপুরে কই যাবি? রোদ দেখেছিস, জ্বলছে যেনো শরীর”
“আমি জানি না, তুমি জানো কই যাবা! আমি বাড়ি যাবো না এখন ব্যস”

অনল মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে মাথায় তুলে আছাড় দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারে না, ছোট বিধায় দয়া হয়। আর যদি বাসার হিটলার জানে তার ধারারাণীর গায়ে আচড় পড়েছে তাহলে অনলের জীবন দূর্বিষহ। অনেক ভেবে একটা জায়গা পেলো। যদিও পকেট গরম নয় তবুও মনে করে কার্ডটা এনেছিলো অনল। বাইক চলতে লাগলো। পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। গতি বাড়ার কারণে উষ্ণ বাতাসে উড়ছে ধারার অবাধ্য চুল। ধারা মাথা কাত করে ঠেকালো অনলের পিঠে। শক্ত হাতে তার কোমড় চেপে বসলো। ধারার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে অনলের পিঠে। ঠোঁট বেকিয়ে স্মিত হাসলো অনল। এই মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে! যত দূরে থাকতে চায় ততই যেনো মায়ার তরী তাকে টেনে নিয়ে আছে________

বাইক থামলো একটা নদীরে তীরে রিসোর্টে। ঢাকার শহর থেকে প্রায় ষাট কিলো দূরে। রিসোর্টটি ইকোপার্কের মতো বানানো। বেশ কিছু রুম আছে। রিসোর্ট ঘিরে বিশাল জায়গা। পাশ দিয়ে চিকন নদী। ভার্সিটিতে পড়ার সময় একবার পিকনিক করতে এসেছিলো অনলেরা। নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখতে বড় সুন্দর লাগে। ঘরের বাহিরে ধারার তেমন কখনো যাওয়া হয় না। অনলের ছোট ফুপুর বাড়ি কিশোরগঞ্জ। অনুষ্ঠান ব্যাতীত সেখানেও যাওয়া হয় না। যেহেতু জিদ করেছে সে বাড়ি যাবে না সেহেতু জোর করে লাভ নেই। উপরন্তু যদি বাড়িতে বলা হয় ধারা ঘুরতে চেয়েছে আর অনল তাকে নিয়ে যায় নি তবে সেদিন অনলকে ঘরেই ঢোকা বন্ধ করে দিবে জামাল সাহেব। একনায়কতন্ত্র এখনো চলছে কি না! একঅটা রুম ভাড়া করলো অনল। চাবি নিয়েই বললো,
“চল, ফ্রেশ হবি”

ধারা ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। সবুজে আবৃত রিসোর্টে এসে মাহির কথাই ভুলে গেলো সে। অনলের পিছু পিছু রুমে গেলো। বেশ বড় তাদের রুমটি। রুমে ঢুকেই জানালা খুলে দিলো ধারা। জানালা থেকে পেছনের বয়ে যাওয়া নদীঈ স্পষ্ট দেখা যায়। অনল পকেটে হাত গুজে তাকিয়ে রইলো ধারার হাস্যজ্জ্বল মুখখানার দিকে। তারপর নরম গলায় বললো,
“মাহির সাথে বনিবনা হয় নি তাই না?”

অনলের প্রশ্নে নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। তারপর রাগান্বিত গলায় বললো,
“আমি ওর রাগ ভাঙ্গাবো না। আমার উপর চেত দেখিয়ে মাধবীর পাশে গিয়ে বসেছে। ও মাধবীকে নিয়েই থাকুক”

অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর কাছে এসে তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
“হিংসুটে বউ আমার। ফ্রেশ হয়ে নে। এখানে হোটেল আছে। ভাত খেয়ে নিবো। তারপর রোদ কমলে বের হবো। আমি বাসায় জানিয়ে দিচ্ছি”

ধারা ঘাড় কাত করে সম্মতি দিয়েই ছুটলো বাথরুমে। অনলের মুখে “বউ” টুকু শুনেই তার ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠলো। হৃদয়টা এই বেড়িয়ে যাবে। বাথরুমে আয়নার সামনে নিজেকে একবার দেখলো। এই প্রথম একাকীত্বে অনলের সাথে কোথাও ঘুরতে এসেছে সে। মনের মাঝে এক অন্য শিহরণ জাগছে। আয়নায় নিজেকে দেখে বললো,
“এতো লজ্জা পাবার কি আছে? এটা তো অনল ভাই”

পরমূহুর্তে মন উত্তর দিলো, “হ্যা, অনল ভাই। তাই তো লজ্জাটা বেশি লাগছে”

ধারা দুহাত দিয়ে মুখ ডাকলো। পরমূহুর্তেই বললো,
“ধারা তুই পুরাই গেছিস”

********

পড়ন্ত বিকেল, সূর্য হেলে পড়েছে দিগন্তের সীমানায়। গোলাকার কমলা সূর্যটিকে নদীর পানিতে আরোও বড় লাগছে। সোনালী আলোতে চিকচিক করছে নদীর স্বচ্ছ পানি। মৃদু বাতাস বইছে। ধারা চুল খোলা। হাটু গেড়ে সে এবং অনল বসে আছে নদীর পাড়ে। এক পাশে বন্ধুদের একটা দল গান গাচ্ছে।
“প্রথমত আমি তোমাকে চাই,
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই,
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই…

নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই,
রাত ভোর হলে আমি তোমাকে চাই,
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই,
সন্ধ্যের অবকাশে তোমাকে চাই…”

চোখ বুজে গান শুনছিলো অনল। ধারা মুখে হাত দিয়ে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের কিরণে প্রিন্স উইলিয়ামকে যেনো আরোও সুন্দর লাগছে। হঠাৎ চোখ খুললো অনল। চোখ ছোট ছোট করে প্রশ্ন করলো,
“কি দেখিস?”
“তোমাকে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১৪

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৪তম_পর্ব

ধারা কিছু বলার পূর্বেই মাহি বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,
“অনল ভাই এর রুমে ধারা থাকে?”
“ওমা, স্বামীর ঘরে স্ত্রী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। স্বামী স্ত্রী কি আলাদা রুমে থাকে?”

সুভাসিনীর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলা কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় নিলো মাহির। সে উদ্ভ্রান্তের মতো কিছুসময় তাকিয়ে রইলো। নিউরণ গুলো রেষারেষি করছে একটা শব্দে “স্বামী-স্ত্রী”। তার বিস্মিত নজর পড়লো ধারার উপর। ধারা ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। কপালে তার ঘাম জমছে। মুখশ্রীতে ক্ষীন আতঙ্ক হাটে হাড়ি ভাঙ্গার। অস্পষ্ট দলা পাকানো স্বরে বললো,
“স্বামী স্ত্রী! মানে?”

ধারা উত্তর খুজছে কিন্তু পাচ্ছে না। মস্তিষ্কটা হুট করেই উইন্ডোজ কম্পিউটারের মতো শাট ডাউন দিয়েছে। মিথ্যের জটলার মাঝে যেনো নিজেই আটকে গেছে। পরমূহুর্তেই নিজের অপারগতার উপর ধিক্কার জানালো সে। সাথেই মাহির সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার পূর্বাভাস পেলো। কিছু বলার আগেই সুভাসিনী অতি উৎসাহের সাথে বলে উঠলো,
“হ্যা, অনল এবং ধারার তো বিয়ে হয়েছে। কি রে ধারা? মাহিকে জানাস নি?”

ধারার উত্তর এলো না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এক এক করে সব মিথ্যে ফাঁস হচ্ছে এবং সে নির্বাক দর্শকের মতো দেখছে। কারণ করার কিছুই নেই। এদিকে মাহির ভেতরটা চুরমার হচ্ছে। সে যেনো বারংবার সপ্তম আসমান থেকে পড়ছে, আবার কেউ তাকে তুলে ধরছে এবং সে আবার পড়ছে। মস্তিষ্ক অসাড় হয়ে যাচ্ছে। খুব কষ্টে বললো,
“কবে বিয়ে হয়েছে ওদের!”
“আফিয়ার বিয়ের দিন ই”

মাহি মাথা ঘুরে উঠলো। প্রায় এক মাস পূর্বের ঘটনা অথচ তার প্রাণের বান্ধবী নিপুন ভাবে তার থেকে চেপে গেছে। অথচ এই বান্ধবীকেই নিজের প্রেম কবুতর বানাতে বসেছিলো মাহি। স্ত্রীকে দিয়ে স্বামীর কাছে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছিলো অজ্ঞাত মানবী। নিজের বোকামীর উপর নিজেই লজ্জিত হলো সে। মাহি দাঁড়িয়ে রইলো ভুতের মতো। তার মুখে কোনো শব্দ নেই। শুধু স্থির শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের বান্ধবীর দিকে। সুভাসিনী বেগম আজ অতি উৎসাহী। সে প্রফুল্ল কন্ঠে বললো,
“তুমি জানো না, এটা তো জানতাম না। দাঁড়কো তুমি বসো আমি কালোজাম বানিয়ে আনছি। বিয়ের খবর মিষ্টিমুখ করে খেতে হয়”

প্রচন্ড লজ্জা, ক্রোধ, অপমানে বিব্রত মাহি আজ দাঁড়াতে পারছে না। ভেতরটা যেনো চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কোনো মতে বললো,
“আন্টি লাগবে না, বিয়ের খবরে মিষ্টিমুখ হয়ে গেছে। আর মিষ্টি খাবো না। আর এমনেও আমি মিষ্টি তেমন খাই না। আজ চলি, আমার একটু কাজ আছে। ধারাকে দেখতে এসেছিলাম, দেখা হয়ে গেছে”

বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো মাহি। সুভাসিনী বুঝলেন না ঠিক, মেয়েটার আচারণ বেশ বিচিত্র ঠেকলো তার কাছে। অবাক কন্ঠে বললেন,
“কি হলো! মেয়েটা চলে গেলো কেনো?”

ধারা উত্তর দিলো না, বরং ক্রুদ্ধ বান্ধবীর পেছনে ছুটলো। আকুল গলায় নাম ধরে বেশ কবার ডাকলো কিন্তু মাহি তা উপেক্ষা করলো। একটা রিক্সায় চেপে নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। ধারা দাঁড়িয়ে রইলো লোহার কেঁচিগেটে। অসহায়ের ন্যায় মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। বান্ধবী হারানীর যন্ত্রণা অনুভূত হলো কিশোরীর মনে।

ঘরে ফিরলে সুভাসিনীকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো ধারা। তার লম্বাটে মুখখানা দেখে সুভাসিনী চিন্তিত গলায় বললেন,
“কি হলো! তোর মুখটা বাংলার পাঁচের মতো লাগছে কেনো?”

ধারা হতাশ কন্ঠে বললো,
“আসলে কেউ জানতো বিয়ের খবর টা। আমি কাউকে বলি নি”
“ওওওওও”

ধারার কথায় সুভাসিনী ঠিক কি বুঝলেন জানা নেই। তবে তিনি মুখে হাত দিয়ে কিছুসময় ভাবলেন। তারপর ঠোঁটে হাসি একে বললেন,
“আরে, বান্ধবীরা এমন ই হয়। কিছু লুকালেই রেগে যায়। তুই মন খারাপ করিস না। কালকে ভার্সিটি গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরিস। দেখবি ওর মন ভালো হয়ে যাবে, ওর রাগ পড়ে যাবে। তুই বরং রুমে যা আমি কালোজাম বানিয়ে নিয়ে আসছি”

সুভাসিনী রান্নাঘরে চলে গেলেন। ধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। বড়মা তো আর জানে না, মাহির এই রাগ যে সে রাগ নয়। ভঙ্গুর হৃদয়ের সুপ্ত রাগ, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলে যে রাগের উৎপত্তি হয় মাহির রাগটি সেই রাগ। শুধু জড়িয়ে ধরলে যদি কমে তবে তো ভালোই। কিন্তু মাহির সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট হবার সাথে সাথে আরোও একটা সূক্ষ্ম ভয় মনে জন্মালো। বন্ধুমহল যদি জেনে যায় তবে কি হবে! বন্ধুমহল জানা মানে দিগন্ত জানা, দিগন্ত জানা মানে ভার্সিটি জানা। আর ভার্সিটি যদি জেনে যায় তবে কি হবে! নানাবিধ কুচিন্তা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ককে ঘিরে ধরলো। ধারা আর চিন্তা করতে পারলো না। নিজ ঘরে যেয়ে ফোন হাতে নিলো। ডায়াল করলো মাহির নাম্বারে। কিন্তু ফোনটা কেউ ধরলো না। অবহেলায় বাজতে থাকলো মাহির মোবাইল_______

*****

অনল ফিরলো সন্ধ্যার অনেক পরে। জ্যামের মাঝে বসে থেকে থেকে নাজেহাল অবস্থা তার। ঘামে ভিজে গেছে নীল শার্টটা। কপালের সিল্কি চুলগুলোও লেপ্টে আছে ভেজার কারণে। আজ দেরী হবার কারণ প্লাবণ। বিয়েতে কলেজের তেমন কাউকে দাওয়াত দেয় নি সে। তাই আজ পরিচিত শিক্ষকদের বাহিরে খাওয়িয়েছে। অনলের যাবার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু প্লাবণ নাছোড়বান্দা, তাই বাধ্য হয়ে যেতেই হলো। বাসায় এসেই দেখলো ডাইনিং টেবিলে বেশ জটলা। কালোজাম বানানোর জন্য মাছির মতো সবাই আক্রমণ করেছে। জামাল সাহেবের দাঁতের অবস্থা খুব খারাপ। সর্বোচ্চ দশ দাঁত গুনে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ৷ তবুও সে কালোজাম খাচ্ছেন। রাজ্জাক একেবারে ছোট ছোট করে কেটে দিয়েছেন, যেনো বাবা তার খেতে পারে। ইলিয়াস তো হাটছে আর টুপ করে একটা কালোজাম মুখে পুড়ে নিচ্ছে। অনল মাকে দেখে বললো,
“আজ এতো আনন্দের কারণ?”

সুভাসিনী ছেলের মুখখানা ধরে আদর করলেন, তারপর একটা কালোজাম মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন,
“কারণ ছাড়া আনন্দিত হওয়া যায় না নাকি!”

অনল উত্তর দিতে পারলো না কারণ মুখ ভর্তি মিষ্টি। এতো আনন্দের মাঝেও এশা আশাকে দেখা গেলো ফ্রিজের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ কুচকুচে কালো হয়ে আছে। অনল মিষ্টি খেয়ে রুবিকে জিজ্ঞেস করলো,
“এদুটো কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
“শাস্তি দিয়েছি, সাইন্স প্রজেক্টের নামে আকাম করছিলো। দেখো না কালোবাদরের মতো মুখ করে রেখেছে। এজন্য শাস্তি সারাদিন এই ঘরে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। মানুষ হাটবে, চলবে আর এদুটোকে দেখবে। দেখে দেখে হাসবে। এরপরও যদি না শুধরায় একদম বাহিরের দরজার সামনে দাঁড় করাবো কান ধরিয়ে”

রুবির কথার প্রতিবাদ করলো এশা। বিনয়ী স্বরে বললো,
“সাইন্স প্রজেক্ট ই করছিলাম। ফর্মুলায় হালকা ঝামেলা হয়ে গেছে। সব পরীক্ষা যে সফল হয় তা তো না। কিছু কিছু পরীক্ষা বিফলেও যায়। তবেই তো তাদের বিজ্ঞানী বলে”
“মারবো টেনে এক চ’ড়, বিজ্ঞানী হয়েছেন মহারাণীরা”

রুবির রাম ধমকে দমে গেলো এশা। আশা ও মাথা নামিয়ে নিলো। তারা এখনো কান ধরেই দাঁড়িয়ে আছে। অনল মাথা ঘামালো না বেশি। এই দুটো কখনোই শুধরাবে না। সে ক্লান্ত স্বরে বললো,
“আমার বউ কোথায়?”
“ঘরেই আছে। কত বললাম, আসলো না। মন খারাপ হয়তো”

সুভাসিনী রান্নাঘর থেকে বলে উঠলেন। অনল কিছু একটা ভাবলো তারপর পা বাড়ালো নিজ ঘরের দিকে।

ঘরে ঢুকে ব্যাগখানা রাখলো অনল। তার জিজ্ঞাসু চোখ পুরো ঘরটি একবার দেখলো। ধারাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। টাওয়ালটা ঘাড়ে নিয়ে সে পা বাড়ালো বারান্দার দিকে। তার আন্দাজ সঠিক। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছেন মহারাণী। তার চোখ মোবাইলে আটকে আছে। গোল মুখখানা লম্বাটে দেখাচ্ছে। অনল হাত ভাজ করে হেলান দিলো দরজায়। ঠেস মারা কন্ঠে বললো,
“কি রে ফেলুরানী, এখানে পা ছড়িয়ে কি করছিস”

কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ভ্রু কুচকে এলো ধারার। তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো অনলের দিকে। ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
“ফেলুরানী বলছো কেনো?”
“৩০ এ ৩ পেয়েছিস, আর কি বলবো? ১০০ মার্কে তো পাবি ১০। ফেল করারো পর্যায় থাকে, তোর সেটাও নেই”

অন্যসময় ধারা তেড়ে আসতো। কিন্তু আজ তা হলো না উলটো ঠোঁট উলটে বললো,
“মহাকান্ড হয়ে গেছে?”
“কি?”

ভ্রু কুচকে অনল শুধালো। ধারা উঠে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,
“মাহি না জেনে গেছে আমাদের বিয়ের কথা, রেগে ঘর ছেড়ে চলে গেছে”
“আমাদের বিয়ের কথা জেনে ও ওর বাড়ি ছাড়বে কেনো?”
“ধুর, না। আমাদের বাসায় আসছিলো। বড় মা হাটে হাড়ি ভাঙ্গতেই সে রেগে বেড়িয়ে গেলো। আমি ফোন করছি, ধরছে না”

অনল বেশ উদাসীনতার সাথে বললো, “ও”। তারপর সে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ধারা অপেক্ষা করছিলো অনল হয়তো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাবে। কিন্তু শুধু হতাশাই হাতে পেলো। লোকটা একেবারেই নির্বিকার। মিনিট দশেক বাদে, ওয়াশরুম থেকে বের হল অনল। পরণে একটা ট্রাওজার আর কালো পোলো শার্ট। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে তাকালো ধারার দিকে। ধারার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। সে এখনো চিন্তিত চিত্তে মাহিকেই ফোন দিচ্ছে৷ অনল মুখ গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর টেবিলে বসতে বসতে বললো,
“পড়তে বয়, ফেলুরানী। আর এক মাস আছে। আমি চাই না, মানু্ষ আমাকে ফেলুর বর বলুক”

ধারা তার কথা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে বললো,
“আচ্ছা, তোমার কি মনে হয় মাহি কি আমার উপরে খুব রাগ করেছে?”
“ওর ইচ্ছে হয়েছে রাগ করেছে। তুই এখন যেটা করতে পারিস, সেটা হলো ক্যালকুলাস বইটা নিয়ে চ্যাপ্টার ১ থেকে শুরু করে ৩ পর্যন্ত ম্যাথ গুলোর সমাধান”

ধারা অনলের মুখোমুখি বসলো, চিন্তিত, ব্যগ্র কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমার চিন্তা হচ্ছে”
“কেনো বলতো! কিসের এতো চিন্তা?”
“আজিব, ও আমার ফোন ধরছে না। সেই কখন থেকে আমি ওকেই ফোন করছি। সতেরোবার ফোন করেছি, ধরে নি। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও যদি বন্ধুত্ব ভেঙ্গে দেয় তখন!”
“ও”

অনলের উদাসীনতায় কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। কিছুসময় তীর্যক জ্বালাময়ী দৃষ্টি প্রয়োগ করলো কিন্তু অনলের বিকার হলো না। বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“ও, ও ছাড়া তোমার কি কিছু বলার নেই! না থাকলে থাকো, আমার মাথা খেয়ো না”

বলেই উঠতে গেলে হাতখানা টেনে ধরলো অনল। হ্যাচকা টানে তাকে আগের জায়গায় বসালো। কিছুসময় শান্ত দৃষ্টি বিনিময় হলো তাদের মাঝে। তারপর অনল তার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে নিলো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুই একটু বেশি চিন্তা করছিস না?”
“করা উচিত নয়?”
“একেবারেই না। হ্যা, মাহি তোর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। এমন তার আমার প্রতি একটা আবেগ ছিলো। কিন্তু আমি তো আমার উত্তর দিয়েছি। আমার মনের উপর কর্তৃত্ব আমার একান্ত নিজস্বের। আমার ওকে প্রত্যাখান করায় তো তোর কোনো দোষ নেই। আমাদের বিয়ের আগেও আমি তার প্রেমপত্র ফিরিয়ে দিয়েছি। সুতরাং এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে চাপ দিস না। বরং এটা ভাব ফেলুরানী থেকে কিভাবে ধারারানীতে ফেরা যায়! আমি তো ভেবেছি, তুই ৩ পাওয়ার লজ্জায় গা ঢাকা দিয়েছিস। আমাকে হতাশ করলি রে ধারা। শেষমেশ আমার বউ ফেল্টু?”

অনলের কথায় শব্দ করে হেসে উঠলো ধারা। এতোসময় খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। কুচিন্তারা মস্তিষ্ক দখলে নিয়ে ছিলো। কিন্তু এখন যেনো সেই চিন্তার ঘন কালো মেঘগুলো সরে গিয়েছে। মনমন্দিরে কুসুমপ্রভা উঁকি দিয়েছে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো,
“তাহলে আমার কি করা উচিত?”
“ওই যে বললাম, ক্যালকুলাস”
“যথাআজ্ঞা মাষ্টারমশাই”

অনল নিঃশব্দে হাসলো। বা হাতটা অজান্তেই চলে গেলো ধারার গালের কাছে। আলতো হাতে হালকা টেনে দিলো সে। সাথে সাথেই জমে গেলো ধারা৷ হৃদপিন্ডের রক্তস্রোত যেনো বাড়লো। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। সামনে থাকা মানুষটির দিকে। এই অনুভূতিটির নাম কি! ভালোলাগা! আবেগ নাকি প্রণয়!

******

ক্লাসরুমে ঢুকতেই মাহির দেখা পেলো ধারা। আজ একটু তাড়াতাড়ি ই এসেছে। অনলের ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও মানুষটিকে ঠেলে উঠিয়ে সকাল সাতটায়। তারপর টেনে হিচড়ে তাকে নিয়ে এসেছে কলেজে। অবশ্য এতে ধারার দোষ নেই, কারণ নানাভাই এর হুকুম ধারা একা কোথাও যাবে না। গেটের থেকে একটু দূরে বাইক থামতেই বিনাবাক্যে ধারা ছুটলো ভার্সিটির দিকে। কারণ এখন মুখ্যম হলো মাহির মুখোমুখি হওয়া। অনল পিছন থেকে ডাকলো,
“আস্তে যা”

কিন্তু ধারা তা কানে তুললো না। সে যা ভেবেছে তাই হয়েছে, মাহি আজ তার জন্য কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে অপেক্ষা করে নি। সোজা ক্লাসে এসে পড়েছে। মেয়েটা বড্ড অভিমানী, ধারার ভাষায় প্রচুর সেন্টি খায়। তিল থেকে তাল খসলেই তার মুখ ভার হয়ে যায়। তবে ধারার জানা আছে অভিমান কিভাবে ভাঙ্গানো যায়। সে সোজা যেয়ে মাহির পাশে বসে পড়লো। ব্যাগ থেকে একটা ক্যাডবেরির বড় চকলেট বের করলো। চকলেটটি অবশ্য জোর পূর্বক অনলকে দিয়েই কেনানো হয়েছে। কারণ সেটা মাহির পছন্দ। সকাল সকাল এই চকলেটের জন্য বেঁচারাকে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কিন্তু বিবাহিত মানুষের গণতন্ত্র একটাই, বউ এর দাবি। বাঁচো, ম’রো মানতেই হবে। অনলের ও সেটাই করতে হয়েছে। সেই কথা না হয় তোলা থাক। চকলেটটি এগিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,
“দোস্তো, সরি। আসলে সব কিছু এমন ভাবে হয়েছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। রাগ করিস না”

ধারা ভেবেছিলো কাজ হবে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করে মাহি উঠে দাঁড়ালো। বিনাবাক্যে নিজের ব্যাগ কাঁধে নিলো। গিয়ে বসলো ধারার অতীব অপছন্দের ক্লাসমেট মাধবীর পাশে……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১৩

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১৩তম_পর্ব

বই এর উপর ই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ধারা। ল্যাপটপের কাজ শেষে পাশে তাকাতেই দেখলো মহারাণী ঘুমে কাঁদা। গণিতের খাতা কাটাকুটিতে ভরপুর। এর মাঝে ছোট্ট করে লেখা,
“নিরস, কঠিন, খ’চ্চ’র মানব”

অনল লেখাটি দেখে হাসলো। তারপর সব বন্ধ করে ধারাকে তুলে নিলো কোলে। তখনই চোখ মেলে তাকালো ধারা। দুজনের চোখাচোখি হলো। হুট করে এমন চোখ খোলায় অনল বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। ধারার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বুঝে উঠতে পারছে না কি করা উচিত। তার মুখখানা সেই চোরের মতো হয়ে গেলো যে কিনা চুরি করার আগেই ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু মাস্টারমশাই তো চুরি করতে যাচ্ছিলেন না। তিনি তো শুধু ধারাকে বিছানা অবধি পৌছে দিয়ে যাচ্ছিলেন। অনল বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলো। একবার মনে হলো এখন ই ধারাকে কোল থেকে নামিয়ে দিবে, কিন্তু ব্যাপারটা কি শোভনীয় দেখাবে। আবার মনে হলো ধারার সেই শান্ত দৃষ্টিকে সম্পূর্ণরুপে উপেক্ষা করে নিজ কার্য সম্পাদন করবে। কিন্তু দুইটি উপায়ের কোনটি বেছে নিবে বুঝে উঠতে পারলো না। আর ধারার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করাটা যেনো দায় হয়ে উঠেছে। অপরদিকে নিজেকে প্রিন্স উইলিয়ামের কোলে আবিষ্কার করে বেশ বড়সড় ঝটকা খেলো ধারা। অজান্তেই হৃদস্পন্দনের বেগ বাড়লো। বুকটা যেনো হাতুড়ি নিয়ে রীতিমতো জেমস এর গানের তালে ড্রাম বাজাচ্ছে। হাত পা অসাড় হয়ে গেলো ধারার। মেরুদন্ড বেয়ে উষ্ণ রক্ত বয়ে গেলো তার৷ একঅন্যরকম শিহরণে নরম গাল জোড়ায় রক্ত জমতে লাগলো। লজ্জাবতী গাছের সকল লজ্জা যেনো তাকে ঘিরে ধরলো। মার্কেটে অনলকে আকষ্মিকভাবে জড়িয়ে ধরার সময় ও এমনটা অনুভূত হয় নি ধারার। বেশ কিছুক্ষণ প্রিন্স উইলিয়ামের দীঘির মতো শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। এই কাজটা যে বড্ড বিপজ্জনক কিছু সেটা টের পেতে সময় নিলো না। হৃদয়ের মধ্যস্থলে যখন অস্বস্তিখানা মাত্রা ছাড়ালো তখনই চোখ বুজে নিলো ধারা। সে এই অদ্ভুত অনুভূতির জোয়ার সামলাতে পারছে না। এক অজানা আতঙ্ক জন্মালো ধারার বুকে। কেনো এই আতঙ্ক! প্রণয়ের শুভারম্ভের নাকি অজান্তেই অনলের চোখে গভীরত্বে বিলীন হয়ে যাবার জানা নেই ধারার। তবে অনুভূতি গুলো অন্যরকম। চুম্বকের ন্যায় এই আকর্ষণ। অজান্তেই প্রিন্স উইলিয়ামের প্রতি এক দূর্বলতা তৈরি হচ্ছে কিশোরী ধারার হৃদয়ের অন্তস্থলে। এই দূর্বলতাটা সে অনুভব করতে পারছে তবে এর উৎস টা তার অজানা। তার মনে হচ্ছে অজান্তেই চোরাবালিতে পা রেখেছে সে, যেখানে তলিয়ে যাওয়া অবধারিত_____

ধারা চোখ বুজে নিলে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয় অনল। হাফ ছেড়ে যেনো বেঁচেছে সে। সে ভাবলো ধারা হয়তো এখনো ঘুমের মাঝেই। হয়তো চোখ এমনেই খুলেছে, তার ঘুম ভাঙ্গে নি। কথাটা ভাবতেই বিব্রতবোধটা খানিকটা কমলো অনলের। চটজলদি ধারাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো সে। তারপর লাইটটি বন্ধ করে বারান্দায় চলে গেলো। হৃদস্পন্দনের গতি অজান্তেই বেড়ে গেছে। ঘরের নিস্তব্ধতায় শ্বাস নিতেও যেনো অস্বস্তি হচ্ছিলো অনলের। বারান্দার রেলিং দুহাত রেখে কিছুসময় জোরে জোরে শ্বাস নিলো সে। কানজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। অনল একবার পেছনে তাকালো। আকাশে তখন পূর্ণচন্দ্রিমা, রুপালী আলো বারান্দা হয়ে প্রবেশ করছে আঁধারে নিমজ্জিত নিস্তব্ধ ঘরে। আলো আধারের এই মায়াবী খেলায় শুভ্র বিছানায় শায়িত নারীটির দিকে অপলক নজরে তাকিয়ে থাকলো অনল। বুকের অন্তস্থলে এক চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো তার। পরমূহুর্তেই নজর সরিয়ে নিলো। ঘুমন্ত কিশোরীটি কি যুবকের এই ব্যাথাটি অনুধাবণ করতে পারবে? হয়তো না! তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো অনল। ক্লান্ত চোখজোড়া তাকিয়ে রইলো শূন্য আকাশের সেই পূর্ণ চন্দ্রিমার দিকে। অপেক্ষা সেই প্রহরের, যখন কিশোরী হৃদয়েও প্রণয়ের ফুল ফুটবে_________

********

ধারার ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। চোখ মেলে তাকালো সিলিং এর দিকে। মরচে পড়া আদিমযুগের ফ্যানটা ঘুরছে। ক্যাচর ক্যাচর শব্দ হচ্ছে। ফ্যানটা সবসময় এমন শব্দ ই করে, কিন্তু তার অস্তিত্ব শুধু নিস্তব্ধতায় বুঝা যায়। ধারা পাশ ফিরলো। মোটা কোলবালিশের প্রাচীরের ওপারে ঘুমন্ত যুবকের শান্ত মুখশ্রী দেখতে পেলো সে। প্রিন্স উইলিয়ামকে ঘুমন্ত অবস্থায় সবথেকে ভালো লাগে ধারার। নেই কোন তিক্ত বাণী, কঠিন মুখশ্রীটাও শান্ত বাচ্চার মতো স্নিগ্ধ দেখায়। কঠিন মুখশ্রীটা বরাবর ই নির্বিকার ছিলো। তার মনে কি চলতো কখনোই আন্দাজ করতে পারতো না ধারা। তবে এখন পারে, মাঝে মাঝে এই মুখশ্রী বিব্রত হয়, মাঝে মাঝে উৎকন্ঠা দেখা যায়, কখনো গম্ভীর তো কখনো হাস্যজ্জ্বল। প্রিন্স উইলিয়াম ও যে সাধারণ মানুষের মতো আবেগপ্রবণ হতে পারে সেটা আগে না জানলেও এখন জানে ধারা। আনমতেই হাসলো সে। মনের মাঝে এক অবাধ্য চিন্তা মাথাচড়া দিলো। এই ঘুমন্ত শান্ত মুখশ্রীটা একবার ছুয়ে দেখার অবাধ্য ইচ্ছে। পরমূহুর্তেই নিজেকে শাসালো কঠিন ভাবে। মুখের প্রায় কাছে যাওয়া হাতখানা টেনে নিলো। আজকাল অবান্তর ইচ্ছে তার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। মস্তিষ্কটা জুড়ে প্রকট ভাবে অনলভাই বিস্তার করছে। এটা ঠিক নয়। প্রচন্ড বিপজ্জনক ব্যাপার। মাথা ঝাকালো ধারা। তার অবাধ্য চিন্তাগুলো এক গভীর প্রকোষ্ঠে তালাবদ্ধ করলো। তারপর উঠে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। ধারা চলে যেতেই চোখ খুললো অনল। ঠোঁট খানা বিস্তারিত হলো। ফুটে উঠলো বিচিত্র হাসি_________

ক্যাফেটেরিয়ায় বসেছে বন্ধুমহল। আজ তারা গম্ভীর। কারোর মুখে হাসি নেই। দিগন্ত যে কিনা সর্বদা ব্রেকিং নিউজ দেবার তালে থাকে তার মুখও রক্তশূন্য। ক্যান্টিনের রফিক মামা খানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
“কি গো সামুচা দিবো নি?”

নীরব খানিক থমথমে গলায় বললো,
“না মামা, সামুচায় দুঃখ ঘুচবে না। তুমি বরং ডিম প্যাটিস দাও”
“হইছে টা কি! এমন মুখ লটকায় আছো কেনো? সবগুলোরে দেখে মনে হচ্ছে এক একটারে কেউ পি’ডা’ই’ছে”
“হাতে মা’রে নি মামা! ভাতে মা’রছে”

রফিক মামা খানিকটা অবাক হলেন। তার মুখে কৌতুহল জাগলো। ধারাদের এই দলের সাথে তার খাতির অন্য রকম। সারা ভার্সিটির খবর এই দলের কাছ থেকেই পাওয়া যায় কি না। নীরব হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার কন্ঠ বসা। ভারাক্রান্ত গলায় বললো,
“আমাদের নতুন কোর্স টিচার এবার আমাদের নাকানি চুবানি খাওয়িয়ে ছাড়বেন। আমি ব্যাতীত একজন ও পাশ করবে কি না সন্দেহ”

নীরবের কথা শুনে কৌতুহল মরে গেলো রফিক মামার। ভেবেছিলো বড় কোনো খবর কিন্তু এটা তো ভার্সিটির হরহামেশার কথা। ছেলেমেয়ে রিটেক খায় এটা নতুন কি! খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললো,
“এ আবার এমন কি! রিটেক খাইয়ে এক বছর ঝুইলে থাকবা, এটা তো খুব ই নর্মাল। আমি ভাবলাম কি না কি!”

রফিক মামার কথায় আশ্বস্ত হলো না তারা। তারা এখনো আগের মতোই বসে রয়েছে। তাদের ক্লাস এসেসমেন্টের রেজাল্ট দিয়েছে। নীরব ব্যাতীত একজন ও ৪ কিংবা ৫ এর উপরে পায় নি। দিগন্ত ভেবেছিলো সারপ্রাইজ টেস্ট টা হয়তো অনল স্যার বাদ দিবেন কিন্তু সে তা করে নি। এখানেই নম্বর এমন নাজেহাল, মেইন পরীক্ষায় যে কি হবে সেটা নিয়ে এই চারজন খুব ই চিন্তিত। এর মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“এই ব্যাটাকে প্রথম থেকেই বিরক্ত লাগে, কি শত্রুতা কে জানে। অন্তত পক্ষে স্টেপের মার্ক তো দিতেই পারতো। মার্ক চেয়েছি কিডনী তো না”

তার সাথে সম্পূর্ণ সহমত জানালো অভীক। ক্ষোভ জড়ানো স্বরে বললো,
“ব্যাটা, নিজের পার্সোনাল লাইফের ক্ষোভ আমাদের উপর দিয়ে মিটায়। শান্তি পাবে না দেখিস। চিন্তা কর ধারার মামাতো ভাই অথচ ওকে সবচেয়ে কম দিয়েছে, তিন। এটা কোনো বিচার! দেখিস এই লোক জীবনে সুখী হবে না, ওর গার্লফ্রেন্ড অন্য কারোর সাথে ভেগে যাবে। যা একটু বিয়ে হবে, বউ ও থাকবে না। আমাদের সাথে যা করছে উপরের একজন দেখছে, শান্তি পাবে এই অনল স্যার”
“ওর উপর শোধ তুলতে হবে। মনে আছে আরিফ স্যারের উপর জনগণ কিভাবে শোধ তুলেছিলো। এর উপরও সেই ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে। মানা যায়! পয়তাল্লিশ জনের মাঝে মাত্র ৪ জন বিশের উপর পেয়েছে, আর সব দশের নিচে। ক্লাসের সবাই এমনেই ক্ষেপে আছে। একটা মিটিং ডাকলেই হবে”

দিগন্তের কথা শেষ না হতেই ধারা ভেটো দিলো। কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
“আচ্ছা, তোদের সমস্যা কি বলতো! নিজের ব্যর্থতার দোষ অনল স্যারের উপর দিচ্ছিস কেনো! উনি তো ক্লাসের লেকচারের বাহিরে ম্যাথ দেন না। তাহলে শুধু শুধু তার উপর এতো চেতছিস কেনো? পড়বি না তাহলে মার্ক কি মুখ দেখে দিবে!”
“তুই চ্যাততেছিস কেনো? অদ্ভুত তো! হুট করে ভাই এর উপর দরদ উতলে উঠলো নাকি! স্টেপের মার্ক সবাই দেয়! সে তো দিতে পারতো?”
“অদ্ভুত স্টেপের মাঝেও যদি ভুল করে রাখিস মার্ক দিবে কিভাবে? যতসব। মাথায় তো শুধু নষ্ট বুদ্ধি জমিয়ে রেখেছিস। এসব ছাড় আর একটু পড়”

বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। হনহন করে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেড়িয়ে গেলো। ধারার এমন পরিবর্তন যেনো কারোর হজম হলো না। আগে এই মেয়েই সকলের সাথে বসে অনলের পিন্ডি চটকাতো। অথচ আজ হুট করেই চেতে উঠলো, যেখানে সবথেকে কম নম্বর সেই পেয়েছে। দিগন্ত বিস্মিত গলায় বললো,
“যা বাবা! কি হলো! এই ধারা আজ উলটো ধারায় চলছে কেনো? কি এমন বললাম ক্ষেপে লাল হয়ে গেলো! কি রে মাহি! ওর কি হয়েছে জানিস!”

মাহি কিছুসময় মাথা চুলকালো, তারপর হতাশ গলায় বললো,
“বিষয়টা আমিও বুঝলাম না, অনল ভাইকে যে মানুষ দু চোখে দেখতে পারে না সেই মানুষ আজ উনার পক্ষ নিলো। সূর্য কি উলটো দিকে উঠলো”

সবার মুখে চিন্তা, চিন্তার কারণ ধারার এমন পরিবর্তন। এ দিকে মাহির ও ব্যাপারটা বোধগম্য হলো না। সে ভাবলো হয়তো ধারার মন খারাপ। বেশ কিছুদিন যাবৎ ই তাকে অন্যমনস্ক লাগছে৷ হয়তো প্লাবণ ভাইএর বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপার। ঘনিষ্ঠতার জন্য ধারার মনের খবর একটু হলেও সে রাখে। তাই ঠিক করলো এখন তার সাথে কথা বলবে না, বরং বিকেলে সোজা বাসায় যাবে। তখন ই সব রহস্যের উদঘাটন করবে সে। বন্ধুমহল আবার কথায় মজলো। তাদের আড্ডার মুল বিষয় হলো চরম কঠিন এবং খ’চ্চ’র অনল স্যার________

গোধলী লগ্ন, ভেজা চুলে বারান্দার মেঝেতে বসে আছে ধারা। আজ মনটা ভালো নেই, তখন বন্ধুদের উপর না চেঁচালেও পারতো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলো না। কেনো যেনো অনলের নামে অবান্তর কথাগুলো শুনতে ভালো লাগলো না। লোকটি তার কাজের প্রতি কতোটা নিষ্ঠাবান সেটা ধারা জানে। উপরন্তু আরিফ স্যারের সাথে ঘটিত কাহিনী সে জানে। বেচারা স্যার শেষ অবধি ভার্সিটি ছাড়তে বাধ্য হন। সে চায় না অনল ভাইয়ের সাথে এমন কিছু হোক। এই চাকরীটি তার স্বপ্নের চাকরি। এতোকাল বহু কাঠখড় পুড়িয়েছে এই চাকরিটির জন্য। আগে হলে হয়তো সে উদাসীন থাকতে পারতো। কিন্তু এখন উদাসীন থাকাটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। অনল ভাই মানুষটার কোনো ক্ষতি হোক সে চায় না। হুট করেই নিবৃত্ত মস্তিষ্ক অবুঝ মনটিকে প্রশ্ন করে বসলো,
“কেনো তার এতো পরিবর্তন! কেনো সর্বদা অনল নামক মানুষটাকেই নিয়ে সে চিন্তিত?”

মস্তিষ্কের প্রশ্নে থমকে গেলো হৃদয়। তারপর উত্তর দিলো,
“কারণ মানুষটি ভালো”
“শুধু কি তাই?”

চুল গুলো টেনে ধরলো ধারা। মন এবং মস্তিষ্কের রেষারেষিতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে সে। মানুষটির প্রতি তার এক অদ্ভুত মায়া কাজ করে। এ যেনো সম্মহনী কোনো কালো জাদু! চোখজোড়া নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকে, হৃদয়ের অন্তস্থলে তার জন্য এক শুন্যতা কাজ করে! সবকিছুই যেনো প্রহেলিকা। বিশাল অদ্ভুত প্রহেলিকা। এই চিন্তার ঢেউ এ ছেদ ঘটায় বড় মা। তীব্র স্বরে চেঁচিয়ে বলেন,
“ধারা, মাহি এসেছে”

মাহির নাম শুনতেই সকল চিন্তারা ভো দৌড় দেয়। মাহি এই বাড়িতে খুব এক টা আসে না। কিন্তু আজ বিনা নোটিসে তার আগমণে ধারা খুশিতে গদগদ হবার বদলে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। চটজলদি উঠে দাঁড়ালো সে। ছুটে গেলো বসার ঘরে। মাহি তখন বড়মার সাথেই গল্প করছে। ধারাকে দেখেই সুভাসিনী বললো,
“যা মাহিকে নিয়ে ভেতরে যা, আমি নাস্তা নিয়ে আসছি”

ধারা পড়লো মহা বিপাকে, সে মাহিকে নিজের আগের ঘরে নিয়ে যেতে পারবে না কারণ সেখানে জমজেরা দরজা আটকে কিছু গোপন কাজ করছে। আর অনলের ঘরে নিয়ে যেতে পারছে না। ধারাকে ভুতের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুভাসিনী আবার বললো,
“কি রে, নিয়ে যা ওকে”
“এশারা ঘর আটকে রেখেছে”
“এশাদের ঘরে কেনো যাবি! অদ্ভুত তো! তোর আর অনলের ঘরে নিয়ে যা”

ধারা কিছু বলার পূর্বেই মাহি বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে বসলো,
“অনল ভাই এর রুমে ধারা থাকে?”
“ওমা, স্বামীর ঘরে স্ত্রী থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক………

চলবে

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১২

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১২তম_পর্ব

একটা সময় ফোনটা রিসিভ হলো। ধারা আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমি ধারা। আমরা মার্কেটে আটকা পড়েছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো। বাসা থেকে দু রোড সামনে সে কাপড়ের মার্কেট সেটা”

ধারার কথা শেষ হবার আগেই ফোন কেটে গেলো। ধারা আবারো ফোন দিলো কিন্তু ফোন ধরলো না কেউ। চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা, অনল কি আসবে না। বাহিরে তীব্র শব্দ শোনা যাচ্ছে, ভাঙ্গচুর হচ্ছে, লাঠালাঠি হচ্ছে। শব্দগুলো কর্ণকুহরে আসতেই বুকে জমা ত্রাশ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারা জমজদ্বয়ের হাত শক্ত করে ধরে বয়ে রইলো। এশা এবং আশার মুখ থমথমে, সারাক্ষণ দুষ্টবুদ্ধি মাথায় নিয়ে ঘোরা মানুষও যখন শান্ত হয়ে যায় বুঝতে হবে পরিস্থিতি কত ভয়ানক। দোকানী পুলিশকে ফোন দিলো। আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“স্যার, আমি সমবায় মার্কেটের একজন দোকানদার। এখানে কিছু ছেলেপেলে মারপিট করছে, দোকান ভাঙ্গচুর করছে। আমি শাটার দিয়ে দোকানেই বসে রয়েছি। স্যার, একটু জলদি আসুন। আমার এবং কাস্টোমারের জীবন ঝুকিপূর্ণ”

ওপাশ থেকে ইন্সপেক্টর কি বললো বোঝা গেলো না। ধারা চুপ করে বসে আসে। মনে মনে সকল দোয়া দুরুদ পড়ছে। সে নিজের জন্য আতঙ্কিত সেটা কিন্তু নয়। সে আতঙ্কিত ছোট বোনগুলোর জন্য। নিজ দায়িত্বে বেশ চড়াও হয়ে তাদের মার্কেটে নিয়ে এসেছে। বড় মা কে বলেছে,
“আরে আমি ওদের খেয়াল রাখতে পারবো। আমার বয়সে তুমি তো মা হয়ে গিয়েছিলে আর আমি এই দুটো সামলাতে পারবো না। আর মার্কেট তো কাছেই। যাবো আর আসবো”

সেই বড়াই সব ধুলোয় মিশে গেছে। এই বিপদে পড়বে জানলে কখনোই এমন বড়াই করে আসতো না। ভয়, আতঙ্ক, ত্রাশে তার কপালে ঘাম জমছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বিনয়ী স্বরে দোকানীকে বললো,
“আংকেল, একটু পানি হবে?”

দোকানী স্মিত হেসে পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। কিন্তু পানিটা খাওয়া হলো। শাটারের উপর তীব্র আঘাতের শব্দ এলো। দা”ঙ্গা”কারীরা দোকান অবধি চলে এসেছে। হয়তো শাটার ভেঙ্গে দোকানে হামলা করার ধান্দা। ধারা কেঁপে উঠলো। দোকানী বললো,
“ভয় পেও না, আমার শাটার মজবুত আছে। ঢুকতে পারবে না। আর আমি ভেতর থেকে তিনটা তালা দিছি”

ধারা দোকানীর কথায় আশ্বস্ত হতে পারলো না। বুকে জমা ভয়টা তীব্র আকার নিলো। তারা কি সত্যি ঢুকে পড়বে! তারপর কি হবে! আচ্ছা অনল কি সত্যি আসবে না! অনলের কথা মনে পড়তেই পুনরায় ফোন করলো তাকে। কিন্তু এবারো হতাশাই জুটলো। এই আতঙ্কের মধ্যেও আশা এশাকে খোঁচালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভয় পাইছিস?”
“না! নিরস্ত্র বিধায় চুপ করে আছি। সাহসী আমি বটেই তবে নির্বুদ্ধি নই। খালি হাতে বাঘের ডেরায় যাই না”
“কত গোপ মারবি, ফেকুচন্দ্র! স্বীকার কর ভয় পাইছিস”
“আমি কি তোর মতো ভীতু?”

দুজনের মধ্যে বেশ রেষারেষি লাগলো। একেই বিপদ, কিভাবে বাসায় যাবে মাথায় আসছে না। উপরন্তু জমজদ্বয়ের কিচিরমিচির শুনে ক্রোধ সামলাতে পারলো না ধারা। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“চুপ, একদম প্যাপু করবি না। ঝিম ধরে বসে থাক। আরেকবার যদি টু শব্দ করেছিস তো শাটার খুলে দুটোকে বাহিরে দিয়ে আসবো”

ধারার রামধমক কাজে দিলো। দুজনে সাময়িক কালের জন্য চুপ করে গেলো ঠিকই কিন্তু এশা ফাকতালে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ভয়ে মহিলার মাথা আওলায়ে গেছে। চুপ থাকাই শ্রেয়”

সময় অতিবাহিত হলো। শাটারের উপর আঘাতের মাত্রা কমলো। ধারা পা এলিয়ে বসে আছে। তার কোলে জমজদ্বয় মাথা দিয়ে অর্ধশোয়া। দোকানী তার কাজ করছে। যেনো কিছুই হয় নি। হঠাৎ সাইরেনের আওয়াজ কানে এলো। মানুষের ছোটাছুটির শব্দ ও কানে এলো। কিছুমানুষের আর্তনাদ ও শোনা গেলো। ধারার সোজা হয়ে বসলো। বেশ কৌতুহল তার মুখে। দোকানী বললো,
“পুলিশ চলে এসেছে, এখন ভয় নেই। এগুলোকে পি’টা’য়ে সোজা করে দিবে। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে যাও”

ধারা মৃদু হাসলো। কিন্তু বুকে একটা চাপা কষ্ট জমা হলো। অভিমান হলো অনলের উপর, সে ধারার বিপদ জেনেও এলো না। চোর ধরার ঐ দিন লোকটার বেশ ভয়ার্ত চেহারা দেখেছিলো ধারা। ভেবেছিলো হয়তো কঠিন মানুষটির হৃদয়ে তার প্রতি টান রয়েছে। তাই তো তাকে হারাবার ভয় ছিলো। কিন্তু সবকিছু মিথ্যে লাগছে। এই অভিমানের কারণটি জানা নেই ধারার। তবে চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যাথা হৃদয়ের অন্তস্থল ছেয়ে গেলো। এশা বলল,
“ধারাপু, এবার বাড়ি যেতে পারবো মনে হয়”

ধারা উত্তর দেবার আগেই শাটারে তীব্র আঘাত কর্ণপাত হলো। আঘাতটি লাঠির নয়, হাতের। দোকানী চিন্তিত হয়ে পড়লো। গ্যাঞ্জাম থেমে গেলে শাটারে কে আঘাত করবে। তখন ই গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ শোনা গেলো,
“ধারা, এশা, আশা। তোরা কি এখানে? ধারা? এখানে থাকলে উত্তর দে”

কন্ঠটি চিনতে সময় লাগলো না। মূহুর্তেই বুকের মধ্যস্থলে জমা মেঘমেদুর কেটে গেলো ধারার। অভিমান জল রুপে নয়নে জমলো। ভেজা কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমরা এই দোকানে”

দোকানী কিছু বোঝার আগে তাকে বললো,
“আংকেল প্লিজ শাটার খুলে দেন, আমার বর বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে”

দোকানী সময় নষ্ট করলো না। তাড়াতাড়ি খুলে দিলেন দোকানের শাটার। শাটার খুলতেই অনলকে দেখা গেলো। ভয়ার্ত, আতঙ্কিত মুখশ্রী, সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো, উশকোখুশকো, ঘর্মাক্ত শার্টটি গায়ে লেপ্টে আছে। হাতের তালু লাল হয়ে আছে। হয়তো প্রতিটি বদ্ধ দোকানের শাটারে আঘাত করেছে সে। ডানহাত দিয়ে ঠোঁটের উপর জমা ঘাম মুছে নিলো। রীতিমতো হাপাচ্ছে সে। ধারা তার মুখের দিকে টলমলে চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। তারপর কি যেনো হলো তার। ছুটে গেলো অনলের কাছে। জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালো তার বলিষ্ঠ বুকে। ধারার এমন কার্যে কিছুটা অবাক হলো অনল। অপ্রস্তুত হলো বটে, তবে ধারাকে বুক থেকে সরালো না। বরং নিবিড় ভাবে দু হাতের বেষ্টিনীবদ্ধ করলো। এশা আশাও ছুটে অনলের কাছে এলো। অনলকে দেখে তারা ভয় পায় ঠিক ই তবে ভয়টি স্বস্তির। তাদের বিশ্বাস অনল ভাই থাকলে কিছু হবার জো নেই। অনল খেয়াল করলো ধারা ঈষৎ কাঁপছে। তার বুকে উষ্ণ জলধারা বইছে। ধারা কি কাঁদছে! আসলে তখন ধারার আতঙ্কিত কন্ঠ শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলো। মূহুর্তে বুকটা ধক করে উঠেছিলো। তাই ফোন কেটে, হাতের কাজ ছেড়ে ছুটে চলে এসেছে সে। বাইকের গতি কতটা ছিলো নিজেও জানে না। ধারা এরপর ফোন করেছিলো ঠিক কিন্তু ধরতে পারে নি। মার্কেটের কাছে আসতেই দেখলো দা’ঙ্গা আগুনের ফুলকির ন্যায় উত্তপ্ত। এই দা”ঙ্গার মধ্যে প্রবেশ করলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। বিপদ আরোও বাড়বে ধারার। যতই হোক অনল তো সুপার হিরো নয়। পচিশ ত্রিশ জনকে মেরে মাটিয়ে লুটিয়ে দিবে। তাই বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হবে। ফলে অনল ছুটলো নিকটবর্তী থানায়। সেখানে ইন্সপেক্টর একটু ব্যাস্ত থাকায় তাদের আসতে এতো দেরি হয়েছে। যতই হোক দল বল নিয়ে আসতে হবে বলে কথা! অবশেষে পুলিশের সাথেই এসেছে অনল। একের পর এক প্রতিটি দোকানের শাটারে কড়া নেড়েছে। কিন্তু ধারার শব্দ পায় নি। ধারার মোবাইলেও ফোন করেছিলো ফোন বন্ধ পেয়েছে। অবশেষে বাধা পেড়িয়ে ধারাকে পেয়েছে সে। ধারাকে পাওয়া মাত্র হৃদয়ের কোঠরের ঝড় থেমে গেছে। এক মৃদু শীতল হাওয়া বয়ে গেছে হৃদয় জুড়ে৷ তাই লোকের সামনে জড়িয়ে ধরাতে খানিকটা অপ্রস্তুত হলেও বাধা দেয় নি অনল।

ধারা কান্না থামিয়েছে কিন্তু এখনো কিছুক্ষণ বাদে বাদে ডুকরে উঠছে। কাঁপছে ঈষৎ। অনল তার মুখটা আলতো হাতে তুললো। ভেজা চোখজোড়া মুছে নরম গলায় বললো,
“ভয় পেয়েছিলি?”

ধারা কেবল মাথা নাড়ালো যার অর্থ সে ভয় পেয়েছে। অনল ঠোঁট চওড়া করে হাসলো। তারপর ধারাকে দাঁড় করিয়ে দোকানীকে ধন্যবাদ জানালো। তিনটে মেয়েকে সে আশ্রয় দিয়েছে, বিপদ থেকে রক্ষা করেছে এটা কম কিসের। আজকালের ব্যাস্ত ইট পাথরের শহরে আপন মানুষের বিপদে কেউ এগিয়ে আসে না। সেখানে একজন অচেনা মানুষ তাদের এই দা’ঙ্গা তে সহায়তা করবে ব্যাপারটা অকল্পনীয়। দা’ঙ্গাকারীরা অনেকেই পালিয়েছে। দশ বারো জনকে পুলিশ ধরেছে, মা’র’তে মা’র’তে তাদের জিপে পুরেছেন। অনল জমজদ্বয়কে রিক্সশায় তুলে দিলো। ধারাকে বললো,
“বাইকে উঠ”

ধারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অবশেষে মিনিট দশেক বাদে বাড়িতে পৌছালো তারা। বাড়িতে ঢোকার পূর্বে জমজদ্বয় ধারার ওড়না টেনে ধরলো৷ গলার স্বর খাঁদে নামিয়ে বললো,
“আমরা যে ভয় পেয়েছি এটা কাউকে বলো না, প্রেস্টিজের বারোটা বেজে যাবে”

ধারা নিঃশব্দে হাসলো শুধু। বাসায় আসতেই অনলকে দেখে বড়মা হাজারো প্রশ্ন করলেন। অনল বললো,
“পানি দাও, গলা টা ভিজাই। তোমার ভাগ্নি যা দৌড় করালো। গলা কাঠ হয়ে গেছে”

রুবি পানি এগিয়ে দিলো। এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে সকল ঘটনা খুলে বললো অনল। সুভাসিনী এবং রুবির আতঙ্ক দেখে কে! জারি করা হলো আজ থেকে এই তিনজন একা কোথাও যাবে না। অনল, অথবা রাজ্জাক অথবা ইলিয়াস থাকবে তাদের সাথে। এরা ব্যস্ত থাকলে এরা বের হবে না। এশা আশা কিছু বললো না, কারণ ধারা কোনো প্রতিবাদ করে নি। বেচারি বেশ ভয় পেয়েছে। যে কান্ড ঘটেছে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। সুভাসিনী তার কপালে চুমো খেয়ে বললো,
“যদি তোর কিছু হয়ে যেতো, কি করতাম বলতো! এর চেয়ে তুই আমার সামনে থাক, ভালো থাক। আমাকে না বলে একা একা বের হবি না”
“যাহা আজ্ঞা বড় মা”

সুভাসিনী বেগম স্মিত হাসলেন। অনল ভেতরে চলে গেলো। এখানে দাঁড়িয়ে কাজ নেই। মা, মেয়ে বুঝুক নিজেদেরটা। ভার্সিটিতে ফোন করে জানিয়ে দিলো আজ ল্যাব স্যাশন নিতে পারবে না সে। অন্য কেউ যেনো নিয়ে নেয়। অন্যদের সাথে কথা বললেও ধারার চোখ অনলকেই দেখে যাচ্ছে। এক স্বস্তি কাজ করে মানুষটা থাকলে। এই অনুভূতিটা বেশ বিচিত্র। এতোকাল অনল ভাই ছিলো কেবলই দাম্ভিক প্রিন্স উইলিয়াম, এখনও সে প্রিন্স উইলিয়ামই আছে। তবে এই প্রিন্স উইলিয়ামটিকে চোখ বুঝে বিশ্বাস করা যায়_________

******

রাতের খাবার পর ধারা ঘরে প্রবেশ করলো। বিছানা করে যেই ঘুমাতে যাবে তখনই গম্ভীর কন্ঠ কানে এলো,
“এই ফাকিবাজ, এদিক শোন”

শখের নরম বালিশটা রেখে পেছনে তাকালো ধারা। অনল তখন ল্যাপটপে কাজ করছে। হয়তো আগামীদিনের লেকচার গোছাচ্ছে। সে ল্যাপটপ থেকে চোখ তুললো না। ওখানে বসেই কথাটা বললো৷ ধারা কিঞ্চিত বিরক্ত হলো। যা একটু ঘুমোবে সেটার জোগাড় নেই। মুখ বিকৃত করে বললো,
“কি হয়েছে?”
“অ’ভ’দ্র মেয়েছেলে, এখানে আসতে বললাম তো। বড়দের সম্মান করতে শেখ”
“বাহ বা, তা আজ সূর্য্যি কোন দিকে উঠলো। আমি তো ভাবলাম আমার সাথে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছো”
“এটা মনে হবার কারণ?”
“প্লাবণ ভাই এর বিয়ের পর থেকে তো এড়িয়েই চলছো। আজ নিজ থেকে কথা বলছো তো হজম হচ্ছে না”

ধারা এগিয়ে আসতে আসতে ঠেস মেরে কথাটা বললো। অনল উত্তর দিলো না। হ্যা, প্লাবণের বিয়ের পর সে ধারার সাথে দরকার ব্যাতীত কথা বলে নি। স্মৃতির কথাগুলো তাকে প্রচন্ড ভাবাচ্ছিলো। নানাবিধ চিন্তা মস্তিষ্ক ঘিরে রেখেছিলো। সত্যি বলতে তাদের বিয়ে একমাস হতে চলেছে অথচ সম্পর্কটা কোনদিক যাচ্ছে নিজেও জানে। ধারাকে বিয়ের রাতেই বলেছে কোনো প্রকার জোর সে করবে না, কিন্তু ধারা যদি তার থেকে মুক্তি চায় তখন কি করবে সে! প্রহেলিকার পেছনে ছুটছে না তো সে! উপরন্তু ফুপা অর্থাৎ সেলিম সাহেব আসলে কি ঘাপলা বাধায় কে জানে! সব কিছু মিলায়ে প্রচন্ড ঘেটে ছিলো অনল। কিন্তু আজকের ঘটনা তাকে সম্পূর্ণ নাড়িয়ে দিয়েছে। তাই গভীর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনল। ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে নষ্ট করবে না।
“কি হলো, ডাকলে কেনো”

ধারার প্রশ্নে চিন্তার ঘোরে ছেদ পড়লো অনলের। ধারার দিকে মোটা ক্যালকুলাসের বইটা এগিয়ে বললো,
“পড়তে বয়”
“অনল ভাই! এখন কে পড়ে?”
“আমার বউ, বেশি বকিস না। সিটি, টেস্ট এ যা পেয়েছো তাতে তোমার অবস্থা বোঝা যাচ্ছে, ইহজীবনে আমার কোর্সে পাস করে লাগবে না। তাই পড়তে বয়। এখন থেকে প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা আমার কাছে পড়বি। প্যা পু করিস না। পড়তে বয়”

ধারা আর তর্ক করলো না। গোমড়া মুখে পড়তে বসলো। কড়া বর তার না পড়ে উপায় নেই। অনল বই এর গোটা গোটা অংক দাগিয়ে বললো,
“কর”

বাধ্য হয়ে গণিতের সূত্রের মাঝে মন ডুবাতে হলো ধারার। মাঝে মাঝে আড়চোখে দেখছিলো কঠিন মুখশ্রীকে। আচ্ছা একটা মানুষ এতো সিরিয়াস হয়! একটু তো স্বাভাবিক কথাও বলা যায়। না শুধু পড়, পড়, পড়।

বহুদিন বাদে গণিতের চাপে ঘুম জড়ো হলো ধারার নেত্রে। বই এর উপর ই উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো ধারা। ল্যাপটপের কাজ শেষে পাশে তাকাতেই দেখলো মহারাণী ঘুমে কাঁদা। গণিতের খাতা কাটাকুটিতে ভরপুর। এর মাঝে ছোট্ট করে লেখা,
“নিরস, কঠিন, খ’চ্চ’র মানব”

অনল লেখাটি দেখে হাসলো। তারপর সব বন্ধ করে ধারাকে তুলে নিলো কোলে। তখনই চোখ মেলে তাকালো ধারা……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১১

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১১তম_পর্ব

ধারা কার কথা ছেড়ে কার কথার উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। তখন ই অনল বলে উঠলো,
“বিয়ে তে এসেছো, বিয়ে খাও না। এখানে মজলিস বসানোর কি মানে!”

সুভাসিনী বেগম উত্তর দিতেই যাবেন তখন শোনা গেলো, বিয়ে হবে না। বউ নাকি পালিয়েছে। কথাটা কর্ণপাত হতেই বিস্মিত হলো অনল এবং ধারা। বউ পালিয়েছে মানে কি! স্মৃতি এবং প্লাবণের সম্পর্কটি সেই কলেজ থেকে। একটু রগচটা, দাম্ভিক, আত্মজেদী হলেও মেয়েটি প্লাবণকে প্রচন্ড ভালোবাসে। কত পাগলামী করেছে সে সেটার সাক্ষী প্লাবণের এই বন্ধুমহল। অনল কিছুসময় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর সুভাসিনীকে বললো,
“তোমরা দাঁড়াও, আমি প্লাবণের কাছে যাচ্ছি”

বলেই সে ছুটলো বরের স্টেজের দিকে। ধারাও পিছু নিলো তার। বহুকৌতুহল তাকে ঘিরে ধরেছে। যদি প্রেমের বিয়েই হয় তবে বউ পালাবে কেনো!

স্টেজের কাছে আসতেই দেখা গেলো প্লাবণ একটি চিরকুট হাতে বসে রয়েছে। তার মুখ কঠিন হয়ে আছে। সর্বদা হাসিখুশি মানুষটিকে এমনভাবে দেখবে কল্পনা করে নি ধারা। তবে একটা জিনিস তীব্র ভাবে অনুভব করলো সে। তার প্লাবণের জন্য সমবেদনা হচ্ছে ঠিক ই কিন্তু তার প্রেমিকা পালিয়ে যাওয়ায় অত্যন্ত খুশি কিংবা তার হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ায় অত্যন্ত কষ্ট তার হচ্ছে না। হয়তো প্লাবণের প্রতি অনুভূতিটা কেবল ই কিশোরী আবেগ ছিলো যা এখন সম্পূর্ণরুপে বাস্পায়িত হয়ে গিয়েছে। অনল প্লাবণের হাত থেকে কাগজ খানা নিলো। সেখানে লেখা
“পারলে আমায় ক্ষমা করো। কিন্তু এই মূহুর্তে তোমায় বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”

কথাখানা পড়ামাত্র অনলের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। প্রচন্ড ক্রোধ মস্তিষ্কে চড়ে বসলো। তীব্র স্বরে বললো,
“এসব ফাজলামির মানে কি? এতো বছরের প্রণয় আজ পরিণয়ে পরিণত হচ্ছে। তাহলে সে কিভাবে বলে সম্ভব নয়। অনুভূতির কি দাম নেই নাকি?”

প্রাবণ চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“বিয়ে হবে, তোরা টেনশন নিস না। আমি জানি ও কোথায়!”

প্লাবণের কথায় রবিন ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
“তুই জানিস মানে? কোথায় স্মৃতি?”

প্লাবণ উত্তর দিলো না বরং হনহন করে স্টেজ থেকে নেমে গেলো। অনল বন্ধুদের বললো,
“তোরা থাক, আমি যাচ্ছি ওর সাথে”

অনল যেতে ধরলে তার পাঞ্জাবী টেনে ধরলো ধারা। বিনয়ী, নরম স্বরে বললো,
“আমি যাবো তোমার সাথে?”

অনল কিছু একটা ভেবে বললো,
“চল”

*********

কমিউনিটি সেন্টারের ছাঁদের ট্যাংকির পাশে লাল বেনারসী পরিহিত নারী বসে রয়েছে। ট্যাংকিতে হেলান দিয়ে, হাটুজোড়ায় মাথা নুইয়ে সে বসে রয়েছে। তার বেনারসি শাড়ির আঁচলটি বাতাসে উড়ছে। খোঁপা করা সুন্দর পরিপাটি চুলগুলোয় ট্যাংকির খসে পড়া চুনের গুড়া দেখা গেলো। কিন্তু মেয়েটির সেদিকে খেয়াল নেই।প্লাবণ তার মাথার পাগড়িটি খুলে অনলের হাতে দিলো। তারপর সেই মেয়েটির পাশে গিয়ে বসলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“এখানে কি করছিস? নিচে সবাই তোকে খুঁজছে। আন্টির তো মূর্ছা যাবার মতো অবস্থা। সবাই ভাবছে তুই আমাকে ধোঁকা দিয়ে অন্য ছেলের সাথে পালিয়েছিস। আমার মায়ের কান্না যদি দেখতি”

প্লাবণের কন্ঠ শুনেই মেয়েটি তড়াক করে উঠে বসলো। তার চোখে বিস্ময়। ভেজা কন্ঠে বলল,
“তুই এখানে?”
“আমার হবু বউ যদি চিরকুট নিয়ে ছাঁদের ট্যাংকির পাশে লুকিয়ে থাকে আমার কি করার আছে? কি ভেবেছিলি, স্মৃতি? একটা চিরকুট দিয়ে আমার থেকে পালিয়ে যাবি! এতো সোজা?”

স্মৃতি কিছুই বললো না। চুপ করে রইলো কিছু সময়। তার মুখশ্রীতে বিষন্নতার ছাপ। চোখগুলো ভেজা। সে তাকিয়ে রইলো উন্মুক্ত আকাশের দিকে। এদিকে ধারা তাকিয়ে রইলো স্মৃতির দিকে। কি সুন্দর মেয়েটি। শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী, টানা টানা চোখ। বউ সাজে কি মায়াবী লাগছে তাকে। অথচ বিয়ের দিন সে ছাঁদে লুকিয়ে আছে। অনল ও ধারাও নিশ্চুপ। ছাঁদটি যেনো নিস্তব্ধতায় ডুবে গিয়েছে। কিছুসময় বাদে সেই নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো স্মৃতি,
“মিলি আপুর ডিভোর্স হয়ে গেছে। ইমরান ভাইয়া প্রচন্ড তার উপর। ভাবা যায়! সাত বছরের প্রেম, তারপর আটবছরের সংসার। সম্পর্কগুলো বুঝি এমন ই হয়! একটা সময় ভালোবাসার মানুষটির প্রতি বুঝি অনীহা চলে আছে? ইমরান ভাই অকপটে বলে দিলো, তার একঘেয়েমি লাইফ ভালো লাগছে না। সে নাকি এই সম্পর্কে নতুনত্ব পাচ্ছে না। তাই সে মিলি আপুকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো।”
“একারণে তুই ভয় পেয়েছিস?”
“ভয় পাবো না কেনো? আমাদের এই দশ বছরের রিলেশনে ক বার ব্রেকআপ হয়েছে বলতো? কতবার আমি তোর উপরে রেগে ফোন অফ করে রেখেছি, সপ্তাহ এর পর সপ্তাহ কথাও হয় নি। তুই ও একই কাজ করেছিস!”
“তখন আমরা বাচ্চা ছিলাম স্মৃতি”
“বিয়ের পর যে এমন হবে না তার কি গ্যারেন্টি! এটা বিয়ে এখানে ব্রেকাপ হয় না হয় ডিভোর্স। যেখানে প্যাচাপ এর ওয়ে থাকে না। কি গ্যারেন্টি! তুই আমার ফেডাপ হয়ে যাবি না! আমার বদঅভ্যাস, আমার রাগ, জেদ এগুলোর উপর তুই বিরক্ত হবি না। এই তো চারদিন আগে, মেজাজ খারাপ করে ফণ রেখে দিলি, কত ফোন করলাম এই চারদিন একটি বারো ফোন ধরেছিস তুই! না, ধরিস নি। সমাজের জন্য আমি বিয়ে করতে চাই না প্লাবণ। আমি বিয়ে করতে চাই কারণ তোর সাথে সারাটাজীবন কাটাতে চাই। কিন্তু মিলি আপুর ঘটনা শোনার পর থেকে আমার আর সাহস হচ্ছে না। একসাথে থাকবো চব্বিশটা ঘন্টা, আমাদের পছন্দ অপছন্দ গুলোকে মিলিয়ে মিশিয়ে হবে আমাদের সংসার। যদি সেটা না মিলে! যদি আমাদের ঝগড়ার মিটমাট না হয়! যদি আমাদের সুখময় স্মৃতিগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠে। কি করবো তখন! তোর সাথে কাটানো সময় গুলো অনেক স্পেশাল প্লাবণ। ছোট ছোট মূহুর্ত, ছোট ছোট কাজ। আমি চাই না সেগুলো বিষাক্ত হয়ে উঠুক। হয়তো আমি কাউকেই বিয়ে করতে পারবো না। সারাজীবন কুমারী থাকবো। কিন্তু আমি চাই না, আমাদের সম্পর্কটাও ইমরান ভাই এবং মিলি আপুর মতো হোক”

প্লাবণ এতো সময় চুপ করে স্মৃতির কথাগুলো শুনছিলো। স্মৃতি কন্ঠ দলা পাকাচ্ছে, চোখ টলমল করছে। সে টিস্যু দিয়ে চোখ মুচছে। ফলে মেকাপ হালকা উঠে উঠে যাচ্ছে। প্লাবণ মুখ গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। জ্বালাময়ী রোদের কারণে তার শরীর ঘামে সিক্ত হয়ে আছে। রুমাল বের করে ঘামটা মুছে নিলো সে। তারপর বললো,
“বুঝলাম, চল এবার নিচে সবাই অপেক্ষা করছে”
“আমি যাবো না”

দৃঢ় কন্ঠে কথাটা বললো স্মৃতি। এবার প্লাবণের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, কড়া স্বরে বলল,
“আংকেল আন্টি তোরে কখনো মা/রে নি তাই না? এইজন্য তোর এই অবস্থা! তোর কি মনে হয় এটা ফাজলামি হচ্ছে! আমি আমার পরিবারকে নিজে ফাজলামি করছি! এতোকাল তোর সব জিদ মেনে আসছি বলে মাথায় উঠে নাচবি এটা তো মানতে পারবো না। দেখ স্মৃতি আমি এক থেকে দশ গুনবো। এর মধ্যে যদি না উঠিস, তুলে নিয়ে যাবো আমি!”

স্মৃতি বিস্মিত নজরে তাকিয়ে রইলো প্লাবণের দিকে। শান্ত মানুষেরা রেগে গেলে ভয়ংকর রুপ ধারণ করে; আজ স্বচক্ষে দেখলো সে। প্লাবণের মতো শান্ত মানুষটির রাগান্বিত রুপে খানিকটা ভয়ও পেলো সে। মাথা নুইয়ে বসে রইলো সে। প্লাবণ আবারো গরম নিঃশ্বাস ফেললো। এবার কিছুটা নরম গলায় বললো,
“স্মৃতি, ভয় যেমন তোর হচ্ছে আমারো হচ্ছে। এতোকাল আমরা প্রেমিক প্রেমিকা ছিলাম, এখন হবো স্বামী স্ত্রী। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা অনেক আলাদা, বিচিত্র কিন্তু এই সম্পর্কটা পবিত্র। এখানে কোনো লুকোচুরির জায়গা নেই, এখানে কোনো অবিশ্বাসের জায়গা নেই। হ্যা, ঝগড়া হবে, ঝামেলা হবে, কখনো জীবনে কড়া রোদের দেখা মিলবে তো কখনো বৃষ্টির মতো শীতলতা ছেয়ে যাবে। তবে বটবৃক্ষের ন্যায় একে অপরকে আগলে রাখবো। এটাই তো বিবাহিত জীবন। আর মিলি আপু আর ইমরান ভাইয়ার মতোই যে আমাদের বিয়ে হবে এমনটা তো নয়। তারা ভিন্ন মানুষ আমরা ভিন্ন মানুষ। হ্যা, তোর উপর আমার রাগ হয়, ক্ষোভ হয় কিন্তু বিরক্তি আছে না। কারণ এই স্মৃতিটাকে আমি ভালোবাসি। সময়ের সাথে সাথে সেই ভালোবাসাটা গাঢ় হচ্ছে। নয়তো ভাব, আমি কেনো ছুটে আসবো এই ছাদে। যদি তোর উপর বিরক্ত হতাম তাহলে চিরকুট পেয়ে দেবদাসের মতো ফিরে যেতাম তাই না! কিন্তু আমি জানি তুই ভয় পেয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে আছিস। আর বাকি রইলো ফোন না ধরা, আমার ফোন আমার কাছেই নেই। বিয়ের আগে কনের সাথে কথা বলতে হয় না। তাই আমার ফুপি ফোন নিজ আয়ত্তে নিয়ে রেখেছেন। সরি, আমার বোঝা উচিত ছিলো, আমার রাগ করে ফোন কেটে দেওয়ায় তুই চিন্তা করবি, উদ্বিগ্ন হবি। কে জানতো! এই উদ্বিগ্নতায় তুই বিয়ের দিন এমন কিছু করবি! এবার কি যাবি! নাকি তুলে নিয়ে যেতে হবে! কারণ বিয়ে না করে আমি যাচ্ছি না”

স্মৃতি নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। ফট করে উঠে প্লাবণকে জড়িয়ে ধরলো। জড়ানো স্বরে বললো,
“সরি, ভয় পেয়ে গেছিলাম”
“ইটস ওকে, এই বিয়ে সারাজীবন মনে থাকবে। এতো এপিক বিয়ে কারোর হয় নি, সেখানে হলুদের দিন বরের পেট খারাপ। বিয়ের দিন বউ বিয়ে করবে না বলে ট্যাংকির নিচে লুকিয়ে আছে। স্মরণীয় বিয়ে। আমার বিয়ে গ্রিনিস বুকে সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে”

বলেই নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো স্মৃতিকে। এদিকে ধারার মুখেও হাসি, অবশেষে প্লাবণ ভাইয়ের বিয়েটা হচ্ছে। কিন্তু অনলের মুখ দেখা গেলো কঠিন। কিছু নিয়ে সে বড্ড চিন্তিত। ধারা যখন তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো, “কি ভাবছো?” অনল উত্তর দিলো না। বরং কঠিন মুখে বললো,
“কিছু না”

ধারা আর ঘাটালো না। অবশেষে প্লাবণ এবং স্মৃতির বিয়েটা হলো। অবশ্য প্লাবণকে নিয়ে রবিন বেশ হাসিঠাট্টা ও করলো। বন্ধুমহলে এমন বিচিত্র বিয়ে কজনের হয়েছে! কিন্তু অনলকে দেখা গেলো শান্ত। অনল বরাবর ই চুপচাপ বিধায় কেউ ঘাটালো না, তবে তার কঠিন, চিন্তিত মুখখানা ধারার নজর এড়ালো না। কি নিয়ে এতো ভাবছে অনল ভাই!

*******

জৈষ্ঠ্যমাসের প্রথম দিন, সূর্য্যিমামার আলাদা দাপট। কড়া রোদে উত্তপ্ত পৃথিবী। ক্ষীন বাতাস বইছে সেটাও বেশ উত্তপ্ত। রোদের প্রভাবে গা ঘেমে একসার। এদিকে পশ্চিম আকাশে সফেদ মেঘেরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি হবার কোনো মতলব নেই। এই গরমে বি’চ্ছুজোড়ার সাথে মার্কেটে এসেছে ধারা। তাদের নাকি নতুন জুতো লাগবে। এখানের নতুন স্কুলে নাইনে ভর্তি হচ্ছে তারা। আগে ছোট মামারা থাকতেন ময়মনসিংহে। ওখানেই ছিলো মামার ব্যাবসা ছিলো। কিন্তু এই বছর তার পার্টনার তাকে বিশাল ধো’কা দিয়েছে। প্রতারণা করে সকল টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে ময়মনসিংহে থাকা দুষ্কর হয়ে উঠেছে ইলয়াসের জন্য। নানাভাই কথাটা জানতেন ফলে তিনি ছেলেকে নিজ বাড়তে ডেকে নেন। এতোকাল সবাই জানতো বেড়াতে এসেছে ইলিয়াস ও পরিবার। কিন্তু গতরাতে যখন ইলিয়াস বললো,
“এশা এবং আশাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। আগামী সপ্তাহ থেকে ওদের ক্লাস”

তখন সবার বোধগম্য হলো ব্যাপারটা কি! জামাল সাহেব ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। তিনি গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ছা’গ’লটাকে বলছিলাম আমার ব্যাবসা ছেড়ে অন্য জায়গায় যাস না। কিন্তু শুনে নি। অতি শিক্ষিত ছা’গ’ল কি না! যাক এখন যখন সে আমার কাছে ফেরত এসেছেই তাই আমার বাজারে দোকানটা ইলিয়াস ই সামলাবে। আর এই বাড়িতেই ভাড়া থাকবে”

রাজ্জাক বাবার কথায় বলে উঠলেন,
“ভাড়া কেনো থাকবে বাবা! এটা তো ওর বাসা ই”
“কে বলছে? এটা আমার বাসা! তুমি আমার ছেলে, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবো নি তাই তোমার ভাড়া মওকুফ। কিন্তু এই ছাগলটা সেটা করে নি। তাই ওকে ভাড়া দিতে হবে”

ইলিয়াস কিছু বললেন না। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। রুবি অবশ্য সুভাসিনীকে আফসোস করে বললো,
“বাবা, এমন কেনো আপা?”
“বয়স্ক মানুষ তো, ছেড়ে দাও”

সেজন্য ধারা এবং জমজ বি’চ্ছুরা মার্কেটে এসেছে। নতুন স্কুলের ইউনিফর্ম, জুতো এবং যাবতীয় জিনিস কেনবার জন্য। তারা শপিং ই করছিলো, অমনি মানুষের ছোটাছুটি শুরু হলো। ধারা দুজনের হাত শক্ত করে ধরলো। একজন পুরুষকে ডেকে বললো,
“আংকেল সবাই দৌড়াচ্ছে কেনো?”
“দা/ঙ্গা লাগছে, মা/র/পি/ট হচ্ছে। এখন সব বন্ধ, বাড়ি যান তাড়াতাড়ি”

কথাটা শোনামাত্র ধারার বুক কেঁপে উঠলো। মার্কেট বাসা থেকে বেশি দূরে নয় সেকারণেই বোনদের দিয়ে সে এসেছে। কিন্তু ঝামেলায় পড়বে কল্পনাও করে নি। এশা এবং আশার হাত শক্ত করে ধরে সেই মার্কেট থেকে বের হতে যাবে অমনি দেখলো দা/ঙ্গা দলেরা মার্কেটের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রথম জমজেরাও ভয় পেলো। ধারা উপায় না পেয়ে একটা দোকানের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিলো। দোকানী ক্ষতির ভয়ে শাটার দিয়ে দিলো। ধারা ভেবে পাচ্ছে না কি করবে! বাসায় ফোন দিবে! কিন্তু বাসায় তো শুধু বড় মা এবং ছোট মামী। মামারা তো কাজে গেছেন। তখন ই স্মরণ হলো অনলের কথা। ফোনটা বের করে ডায়াল করলো অনলের নাম্বার। ফোন বাজছে কিন্তু ধরছে না। ধারা আবারোও ফোন করলো, একটা সময় ফোনটা রিসিভ হলো। ধারা আতঙ্কিত কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, আমি ধারা। আমরা মার্কেটে আটকা পড়েছি। প্লিজ তাড়াতাড়ি আসো। বাসা থেকে দু রোড সামনে সে কাপড়ের মার্কেট সেটা”

ধারার কথা শেষ হবার আগেই ফোন কেটে গেলো। ধারা আবারো ফোন দিলো কিন্তু ফোন ধরলো না কেউ। চিন্তায় পড়ে গেলো ধারা, অনল কি আসবে না………..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-১০

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#১০ম_পর্ব

এর মাঝে ঘটলো আরেক বিপদ। বরের পেট খারাপ, সে শুধু বাথরুমে যাচ্ছে আর আসছে। হলুদ লাগাবার জন্য ও বসতে পারছে না। যেই একটু এসে বসছে অমনি পেট গুরগুর করছে আর ছুটতে হচ্ছে তাকে। প্লাবণের এমন অবস্থায় ধারাকে দেখা গেলো মিটিমিটি হাসতে। অনলের চোখ ব্যাপারটা এড়ালো না। তখন সে ধারার কানে মুখ ঠেকিয়ে বললো,
“কাজটা তোর তাই না?”

হঠাৎ করে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলো ধারা। স্বয়ংক্রিয়ভাবে হাত চলে গেলো কানের কাছে। অনলের দিকে তাকাতেই আরেকদফা চমকালো, চোখদ্বয় ছোট ছোট করে তার দিকে কিটমিট করে তাকিয়ে আছে লোকটি। খানিকটা গলা খাঁকারি দিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিলো,
“প্রমাণ আছে যে এটা আমার কাজ? যত দোষ নন্দ ঘোষ। যাও যাও! নিজের বন্ধুকে দেখো গে”

বলেই নজর সরিয়ে নিলো। অনল এখনো সূচালো নজরে ধারার দিকে তাকিয়ে আছে। ধারা সামনের দিকে তাকালো, সেখানে বেশ চমৎকার ভাবে লেখা “প্লাবণের গায়ে হলুদ”। লেখাটি দেখে তার ঠোঁটের কোনায় জমে থাকা হাসিটি বিস্তারিত হলো। হ্যা, কাজটি ধারার। একে বলে “ঠান্ডা মাথার প্রতিশোধ”। অবশ্য এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব জমজ বি’চ্ছুদের। এইসব অদ্ভুত শ’য়’তা’নি বুদ্ধি সরল ধারার মাথা থেকে কখনোই বের হয় না। এই তো গত পরশু রাতের কথা, খাবার পর ধারা তার পুরানো ঘরে যায়। এখন এটা তার ঘর নয়, এখন এটা দ’স্যুদ্বয়ের আস্তানা। ধারাকে দেখতেই ওরা ফট করে সোজা হয়ে বসে। এশা আশাকে কনুই দিয়ে গু’তো দিয়ে বলে,
“ধারাপু এখানে মানে তুই কিছু করছিস?”

আশা চোখ উপরে তুলে মিনিট দুয়েক ভাবে। তারপর বলে,
“আজ কিছু করি না, তবে গতকাল ওর একটা ওড়ণা দিয়ে চা মুছছিলাম। তবে আমি প্রমাণ রাখি নি”
“তাইলে মহিলা আসছে কেন?”
“জিজ্ঞেস কর তুই”

আশাকে চোখ রাঙ্গিয়ে বিনয়ী স্বরে এশা প্রশ্ন করে,
“ধারাপু, কিছু বলবা?”

ধারা ধপ করে বিছানায় বসে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। ফলে জমজদের বুকে ভয় জমে। তারা দুজন দোয়া পড়ে বুকে ফু দেয়। অনল এবং ধারাকে অত্যন্ত ভয় পায় তারা। কেনো পায় নিজেরাও জানে না। যদিও ধারা তাদের অনেক আদর করে কিন্তু শাসন করার সময় পিছপা হয় না। এশা যখন আবার জিজ্ঞেস করে,
“কিছু লাগবে তোমার?”
“আচ্ছা ধর, কারোর উপর শোধ তুলতে চাস কি করবি?”

এশা সন্দীহান চোখে তাকায় ধারার দিকে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“শোধটা কি তুমি নিবা?”
“আরে না, আমার বান্ধবী! বল না”
“অনেক উপায় আছে, তুমি কোনটা নিতে চাও? ইজি, মিডিয়াম নাকি হার্ড?”

বেশ ভাব নিয়ে গা এলিয়ে দিয়ে এশা বলে। এশার কথা শুনে মাথা ঘুরে ওঠার জোগাড় ধারার। অবাক কন্ঠে বলে,
“ক্যাটাগরিও আছে?”
“অবশ্যই আছে, এই ধরো যদি পরিবার বা আত্নীয় বা শিক্ষকদের উপর কোনো শোধ তুলতে হয় আমরা ইজি ওয়েতে যাই। পাশের বাড়ির আন্টি বা পাড়ার ব’দ’মা’ই’শ’দের শায়েস্তার জন্য মিডিয়াম। আর হার্ডটা এখনো এপ্লাই করি নি। এতোটা ক্ষোভ হয় নি কখনো”
“থাক থাক, ইজি, ইজি ই যথেষ্ট”

ধারার কথা শুনে এশা দাঁত বের করে হাসে। তারপর আশাকে বলে,
“ফর্মুলা নম্বর ২০৩ টা দে তো”

আশাও মাথা দুলিয়ে টেবিলের ডেস্কের ভেতর থেকে একটা ছোট কৌটা বের করে এশার হাতে দেয়। এশা কৌটাটা ধারার হাতে দিয়ে বলে,
“এটা স্পেশাল ঔষধ, বেশি ব্যবহার করবা না। আধা চামচ খাবারে আর পাখি এক বেলা বাথরুমে”
“সাইড ইফেক্ট?”
“স্যালাইন খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে বাবার চায়ে মিলিয়ে দেই। কিন্তু শোধ তুলবাটা কার উপর?”

ধারার বিচিত্র ভাবে হাসে। তারপর চোখ টিপ্পনী দিয়ে বলে,
“সিক্রেট”

বিয়ে বাড়ি আসার পর এখানে প্লাবণের মা ফুফুর সাথে বেশ সখ্যতা হয় ধারার। ফলে বিকালে যখন তারা সবার জন্য চা-কফি বানাচ্ছিলো ধারার গল্পের ছলে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। ফাক তালে প্লাবণের কফির মগে আধা চামচ মিশিয়ে দেয় ফর্মুলা নম্বর ২০৩। যার ফলাফলরুপে প্লাবণকে শুধু বাথরুম টু স্টেজ আর স্টেজ টু বাথরুম ই করতে হচ্ছে। বুকে জমে থাকা ক্ষোভটা আজ বের করে বেশ শান্তি লাগছে ধারার। যদিও এখানে প্লাবণের তেমন দোষ নেই, কিন্তু একেবারেই যে নেই তা কিন্তু নয়। সে বুঝেও অবুঝ ভান করতো! কিশোরীর আবেগকে প্রশয় দিতো। সে কি সত্যি বুঝতো না, কেনো একটা মেয়ে তাকে এতোটা প্রাধান্য দেয়। তবে আজ শোধ তুলে সম্পূর্ণরুমে নষ্ট আবেগকে বিদায় জানালো ধারা। সে আর আবেগে ভাসবে না, কারণ ন্যাড়া বেলতলায় একবার ই যায়_________

প্লাবণের হলুদ অনুষ্ঠান অবশেষে সম্পন্ন হলো। অনুষ্ঠান ঠিক ই হলো কিন্তু তা হলো বড় বিচিত্র ভাবে। বরকে হলুদ লাগানো হলো, কিন্তু তা স্টেজে না, বাথরুমের পাশে চেয়ার বসিয়ে। মিষ্টিমুখের বদলে খাওয়ানো হলো কাঁচা কলা ভর্তা দিয়ে ভাত, আর পানির বদলে স্যালাইন। এই বুদ্ধিটি প্লাবণের মায়ের। যতই হোক একমাত্র পুত্রের গায়ে হলুদ, পেট খারাপ বলে তো সেটা আটকে রাখতে পারেন না। বেচারা প্লাবণ পড়লো বড্ড বিপাকে, মাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো তবে কাজে দিলো না। ফলে সব বিনাবাক্যে মেনে নিতে হলো।

হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলে ছাঁদে আড্ডা জমলো, প্লাবনের কাজিনবর্গ, বন্ধুমহল। অনল এবং ধারাও সেখানে বসলো। প্লাবণ স্যালাইনের বোতল হাতে উপস্থিত হলো। এখন বাথরুমে যাওয়াটা বন্ধ হয়েছে, ঔষধ খেয়ে কিছুটা হলেও এখন স্বাভাবিক। এমন একটা হলুদ কাটবে ইহজীবনে ভাবে নি। প্লাবণকে দেখেই রবিন বললো,
“কি পেট টাইট হলো! নাকি এখনো বেড টু বাথরুম, বাথরুম টু বেড?”

প্লাবণ অগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করলো৷ একটু লজ্জায়ও পড়লো, ছোট ছোট বোনদের সামনে এমন কথা। এই রবিনের মুখে কখনো কিছুই আটকায় না। সর্বদা মুখড়া সে। হুটহাট কিছু একটা বলে লজ্জা দিয়ে দিবে। শুধু স্বচ্ছ মনের কারণেই পাড় পেয়ে গেলো। ধারা মিটিমিটি হাসলো। অনলের চোখ এড়ালো না সেই হাসি। কথায় কথায় গানের আড্ডা বসলো। রবিন হেরো গলায় গান গাইলো। সেই গান শুনে প্লাবণের এক বোন বলে উঠলো,
“ভাই থামেন, রাস্তার কুকুরগুলোও পালিয়ে যাচ্ছে আপনার গানে”

কিন্তু এতে রবিনের কিচ্ছু যায় আসে না সে গান গাইছেই। এর মাঝে প্লাবণের আরেক বোন বলে উঠলো,
“অনল ভাইয়া আপনি একটা গান গেয়ে শোনান”

কথাটা শুনতেই ধারা তীর্যক চাহনী নিক্ষেপ করলো মেয়েটির দিকে। মেয়েটাকে বহুক্ষণ যাবৎ লক্ষ্য করছে সে, অনলের প্রতি যেনো তার আদিক্ষেতা একটু বেশি। ধারা একটা ব্যাপার মোটেই বুঝতে পারলো না, মেয়েটার সমস্যা কি! একবার ছলে বলে ছবি তুলতে আসে, হলুদ লাগাতে চায়, এখন আবার গানের বাহানা। আরে এই প্রিন্স উইলিয়াম কি মধু নাকি যে মৌমাছির মতো তাকে ঘিরে ধরতে হবে! কথাগুলো মনেই রাখলো! যার যা খুশি করুক তার কি!

সকলের বায়নাকে নাকোচ করতে পারলো না অনল। অনলের গানের গলা যে ভালো এটা অজানা নয়। কিছু মানুষ আছে যাদের অনেক গুন থাকে। অনল তেমন ই, এই গানের জন্য স্কুল কলেজ থেকে কম পুরষ্কার সে পায় নি। ধারাও মুখে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে চাইলো তার দিকে। কত বছর পর অনল ভাই গান গাইবে, ব্যাপারটা কি হাতছাড়া করা যায়! অনল প্লাবণের গিটারটা নিলো। টুং টাং করে বাজলো সুর,
“আজ ঠোঁটের কোলাজ থামালো কাজ
মন, তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম
নাম, বুকের বোতাম, হারানো খাম
আজ কেন যে খুঁজে পেলাম

দিন এখনও রঙিন
এই দিন এখনও রঙিন
তাকে আদরে তুলে রাখলাম
আজ ঠোঁটের কোলাজ থামালো কাজ
মন, তোমাকে ছুঁয়ে দিলাম”

আমাবস্যা বিধায় আকাশে চাঁদ নেই, বিক্ষিপ্ত কালো মেঘের আকাশটা আরোও কালচে লাগছে। ছাঁদের এদিকটাতেও আলো নেই। আঁধারে ডুবন্ত এই মূহুর্তটিকে সুরের জোয়ারে ডুবিয়ে দিলো প্রিন্স উইলিয়ামের মনোমুগ্ধকর কন্ঠ। ধারা যেনো হারিয়ে গেলো সেই সুরের জোয়ারে। তবে একটা ব্যাপার খুব ভাবালো, এতো আঁধারের মাঝেও কেনো যেনো তার মনে হলো অনলের চোখজোড়া তাকেই দেখছে। যেনো তার জন্যই গাওয়া এই গান। এটা কি কল্পনা নাকি বাস্তব জানে না ধারা। যদি অনল তার জন্য ই গেয়ে থাকে, তবে…. বেশি ভাবলো না ধারার। মরীচিকা হলে আবারোও পিছলা খেতে হবে। দরকার কি! থাক না কিছু সুন্দর মূহুর্ত স্বর্ণালী খামে মুড়িয়ে, না হয় কোনো এক সময় উলটে পালটে দেখবে ক্ষণ_________

*******

আজ প্লাবণের বিয়ে, জুম্মার বাদে বিয়ে। জমজমাট অবস্থা। এক দ্বন্দ কারোর শান্তি নেই। ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি লেগেই আছে। অনল রেডি হয়ে গেছে বহু আগে। ধারা এখন তৈরি হয় নি। শাড়ির কুচিটা কিছুতেই সামলাতে পারছে না৷ গতদিন জামদানি শাড়ি ছিলো তবুও তার বহু কষ্ট হয়েছে, আজ তো সিল্কের শাড়ি। শুধু পিছলে যাচ্ছে কুঁচি। কুচি সামলাতে নাজেহাল সে। যখন সকলে বের হতে উদ্ধত হলো তখন দেখা গেলো ধারা নেই। ফলে অনল তাকে খুঁজতে এলো। গতদিনের কাজের পর থেকে রুমে নক না করে ঢুকে না সে। দরজায় নক পড়তেই ধারা বললো,
“কে?”
“আমি, অনল। আর কত দেরি? বরপক্ষের গাড়ি বের হবে। সবাই রেডি তুই বাদে”
“দু মিনিট”
“সেই আধঘন্টা থেকে শুনছি। আর কত দুই মিনিট লাগবে?”

ধারা কিছু সময় চুপ করে রইলো। তারপর দরজাটা খুলে একটু মুখ বের করে বললো,
“একটু হেল্প লাগবে, আন্টি আছে আশেপাশে?”
“না আন্টি ব্যস্ত”
“কেউ নেই মহিলা!”
“না, সবাই নিচে”

ধারা মুখটা চিন্তায় ছেয়ে গেলো! তারপর বললো,
“তুমি কুঁচি ধরতে পারো? আমি বহুসময় চেষ্টা করেছি, ছুটে যাচ্ছে”

ধারার অসহায় মুখখানা দেখে মানা করতে পারলো না অনল। আর দেরিও হচ্ছে। তাও বাধ্য হয়ে গণিতের মাস্টারমশাইকে ছোট বউ এর কুঁচি ধরতেই হলো। অনলের স্পর্শ যখন ই লাগছিলো কেঁপে উঠছিলো ধারা। অনল যতই সংযত রাখতে চাচ্ছিলো কিন্তু একবার না একবার স্পর্শ হচ্ছিলো। রুক্ষ্ণ বিশাল হাতের উষ্ণ স্পর্শগুলো লাগলেই জমে যাচ্ছিলো ধারা। মেরুদন্ড বেয়ে বয়ে যাচ্ছিলো উষ্ণ রক্তের ধারা। একটা সময় শাড়ির কুচি সমস্যার সমাধান হলো। ধারা তাড়াতাড়ি খোপা করে নিলো চুলগুলো। অনল তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ তার চোখে বাঁধলো ধারার ঘাড়ের কালো তিলটি। ফর্সা গায়ে যেনো নজরটিকার মতো লাগছে তিলটিকে। নজরটিকাতেও ঘোরে পড়া যায় জানা ছিলো না অনল। কখন সেটাকে ছুয়ে দেবার অবাধ্য ইচ্ছে তাকে ঘিরে ধরলো নিজেও হয়তো জানে না। অজান্তেই পা জোড়া এগিয়ে গেলো ধারার দিকে। ঘাড়ের উপর উষ্ণ নিঃশ্বাস পেতেই আয়নায় চোখ গেলো ধারার। অনল ঠিক তার পেছনে, ঘোর লাগা মাদক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তীব্র লজ্জা অনুভব করলো ধারা। অজান্তেই নরম গালজোড়া উষ্ণ হয়ে উঠলো। দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। শাড়ির আঁচলটা চেপে ধরলো। কোনো মতে বললো,
“অনল ভাই”

ধারার স্মিত ধীর স্বর মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। অনলের হুশ ফিরলো। সে যেনো সম্মোহনের ভেতর ছিলো। স্বম্বিত ফিরতেই চোখ সরিয়ে নেয়। আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
“আমি নিচে যাচ্ছি, দুই মিনিটে আয়”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে যায় অনল। ধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। এখনো লজ্জায় চোখ তুলতে পারছে না সে। এতো লজ্জা কেনো লাগছে তার!

বিয়েটা একটা কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছে। অবশেষে বরযাত্রী পৌছালো সেন্টারে৷ স্মৃতির মা বেশ আদরে বরণ করলেন জামাইকে। গেটে চাঁ’দা’বা’জি’ হলো কিন্তু বেশি সুবিধা করতে পারলো না বউ এর বোনেরা। প্লাবণকে বসানো হলো বরের চেয়ারে। ধারা দেখা পেলো নিজ পরিবারের। ইলিয়াস তাকে দেখেই বললো,
“তোর মামীকে বোঝা তো! আমি শুধু বলেছি এতো সাজের কি দরকার ছিলো! তুমি তো এমনেই সুচিত্রা সেন। রেগে ফুলে আছে”

ধারা কিছু বলার আগেই সুভাসিনী বেগমের প্রশ্নের ট্রেন চললো,
“তোকে রোগা লাগছে কেনো? খাস নি নাকি? এই অনল তুই ওর খেয়াল নিস নি?”

ধারা কার কথা ছেড়ে কার কথার উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারলো না। তখন ই অনল বলে উঠলো,
“বিয়ে তে এসেছো, বিয়ে খাও না। এখানে মজলিস বসানোর কি মানে!”

সুভাসিনী বেগম উত্তর দিতেই যাবেন তখন শোনা গেলো, বিয়ে হবে না। বউ নাকি পালিয়েছে………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৯

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৯ম_পর্ব

ফুচকার অর্ডার দিতে একটু দূরেই এলো অনল। সে ধারার প্রশ্নের উত্তরটি হয়তো দিতে পারতো কিন্তু ইচ্ছে হলো না তার। সঠিক সময় আসলে হয়তো দেওয়া যাবে। অর্ডার দিয়ে আইসক্রিম নিয়ে গন্তব্যে যেয়ে দেখলো স্থানটি ফাঁকা, ধারা নেই। জায়গাটি সম্পূর্ণ ফাঁকা। অনল আশেপাশে চোখ ঘোরালো। কিন্তু মেয়েটি যেনো বাতাসে উবে গেছে। বিচলিত হয়ে পড়লো অনল। উদ্বিগ্ন চোখে দেখলো চারপাশটি। আশেপাশের কপোত-কপোতী জোড়াদের অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা এখানে একটি মেয়ে ছিলো, নীল জামা পড়া, চুল খোলা, উনিশ বছর, গোলগাল। দেখেছেন?”

প্রেমে ব্যাঘাত ঘটায় তারা যেনো বিরক্ত ই হলো। খানিকটা ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
“না ভাই, দেখি নি”

অনলের দুঃশ্চিন্তা বাড়লো। মস্তিষ্কটা কাজ করছে না। ঘামছে সে অজান্তেই। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেছে ট্রেনের মতো। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উচাটন তৈরি হলো। কোথায় গেলো মেয়েটি! ও তো এখানের কিছুই চিনে না। নাহ! এভাবে অস্থির হলে চলবে না। অস্থিরতায় মস্তিষ্কের নিউরণ কাজ করে না। তাই তাকে শান্ত হতে হবে। চোখ বন্ধ করে, মুখ ফুলিয়ে বার খানেক জোরে জোরে গরম শ্বাস ফেললো সে। তারপর খুঁজতে লাগলো ধারাকে। দিয়াবাড়ির এক মাথা থেকে খোঁজা শুরু করতে হবে। অনল তাই করলো। আইসক্রিমটা ফেলে পায়ের গতি বাড়ালো সে। আইসক্রিমটা পড়ে রইলো পরম অবহেলায়। সময় অতিবাহিত হতে লাগলো, ধারাকে পাচ্ছে না সে। বুকের ভেতর এক নিকষকালো ভয় জমতে লাগলো! মেয়েটি কি বিপদে পড়লো! কোথায় সে! একটা সময় যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লো পা জোড়া, তখন ই একটা চিকন মেয়েলী কন্ঠ কানে আসলো,
“আর করবি চু’রি? বল করবি?”

কন্ঠটি শুনেই চোখ চলে গেলো উৎপত্তিস্থলে। বেশ জনগণের জটলা। অনেক মানুষের ভিড়। কোনোমতে ভিড় ঠেলে ভিতরে যেতেই আক্কেলগুড়ুম অনলের। একটা ছেলের যথারীতি চুল টানছে ধারা, এবং ইচ্ছেমতো মারছে। লোকেরা আশেপাশে জড় হয়ে যেনো ম্যাটিনি শো দেখছে। ধারা তার চুল টানছে আর বলছে,
“আর করবি চু’রি? বল! আর করবি? সাহস দেখে তাজ্জব বনে গেলাম, আমার ব্যাগ নিয়ে পালাস”

ধারার রুদ্ররুপ দেখে কেউ সাহস পাচ্ছে না তাকে আটকানোর। কেউ কেউ তো মহাউৎসাহে ভিডিও করছে। অনল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই মেয়ের বিপদের ভয় পাচ্ছিলো সে! অথচ সে এখানে চোর পি’টা’চ্ছে। একজন লোক ভিডিও করতে করতে বললো,
“আপা, জোস তাই না ভাই? এক্কেরে বা/ঘি/নী”
“হু, বহুত জোস”
“চিনেন নাকি?”
“আমার বউ আর আমি চিনবো না, তা কি হয়!”

অনলের কথা শুনে লোকটি আর কথা বললো না। উলটো ভিডিও করা বন্ধ করে দিলো অনলের কড়া চাহনীতে। আর দাঁড়িয়ে রইলো না অনল। এগিয়ে গিয়ে কোনোমতে ধারার দুহাত ছাড়ালো চোরটির চুল থেকে। কোনো মতে ঠেকালো ধারাকে। চোরটি ফাঁক পেয়ে এক দৌড়ে পালালো। অতিউৎসাহী লোকেরা ধাওয়া দিলো, কাজে দিলো না। ধারার চেঁচিয়ে বললো,
“চোর পালালো, ধরো ওকে”
“থাম, ম’রে যাবে বেঁচারা”
“কিসের বেঁচারা, জানো আমার ব্যাগ নিয়ে পালাতে গেছিলো। ভাগ্যিস, ধরতে পেরেছি”

অনল ধারার দুহাত শক্ত করে ধরে রাখলো৷ ধারা এখনো ছটপট করছে। অধৈর্য্য অনল আর নিজেকে শান্ত রাখতে পাড়লো না। কড়া স্বরে বললো,
“তোর কি আক্কেল হবে না? একটা মেয়ে হয়ে চোরের পেছনে ছুটেছিস! যদি লেগে যেতো? ওদের কাছে অ”স্ত্র থাকে জানিস না? তোর কিছু হয়ে গেলে! জানিস, আমি পাগলের মতো তোকে খুজছিলাম। ভয়ে প্রাণের পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো। আর জনাবা এখানে ল্যাডি জ্যাকি চ্যাং হয়ে চোর পে’টা’চ্ছে’ন”
“সরি, আসলে আমার ব্যাগ”
“কি আছে ব্যাগে? হিরা নাকি মনিরত্ন?”
“সরি”

মাথা নামিয়ে নিলো ধারা। মুখশ্রীতে আষাঢ়ের কালোমেঘ জমলো তার। ঠোঁট বাকিয়ে রেখেছে সে। হয়তো এখনই কেঁদে দিবে। অনল বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর ধারার নরম হাতটা নিজের হাতের ফাঁকে নিলো। গম্ভীর স্বরে বললো,
“হাত যেনো না ছাড়া হয়। নয়তো খবর আছে”
“তুমি কি খুব ভয় পেয়েছিলে?”
“হু”
“কেনো?”
“বাসায় একটা হিটলার আছে না। যদি শুনতো তোকে হারিয়ে ফেলেছি৷ আমাকে ত্যাজ্য নাতী করতো। ত্যাজ্য নাতী হতে চাই না”

ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো অনল৷ তার কন্ঠ জড়ানো। বেশ হাপাচ্ছে সে। বলিষ্ট বুকখানা এখনো উঠানামা করছে। ধারা নরম গলায় বললো,
“শুধু এটুকুই?”

অনল চুপ করে রইলো। হাতটা আরোও শক্ত করে ধরলো। যেনো ছেড়ে দিলেই পাখি উড়াল দিবে। ধারা অনুভব করলো অনলের হাতটা বেশ উষ্ণ। রুক্ষ্ণ, বিশাল হাতের মাঝেও যে এতো উষ্ণতা থাকবে সেটা আশা করে নি। আড়নজরে তাকালো অনলের মুখের দিকে। শ্যামমুখটা ঘেমে একাকার। ভ্রুযুগল এখনো কুঞ্চিত। চোখে ভীতি, কিসের ভীতি! শুধুই ত্যাজ্য নাতী হবার ভয়! নাকি অন্যকিছু! কে জানে!

পশ্চিম আকাশে রক্তিম সূর্যের আভা দেখা যাচ্ছে। সূর্যটা ডুবন্ত। দিবাকালের সমাপ্তির পর, রাত্রির সূচনা। পাখিরা উড়ছে নিজ গৃহে যাবার তালে। বাতাসটাও ধীর গতিতে বইছে। অনল বাইক চালাচ্ছে, তার ঘাড়ে হাত রেখে বসে আছে ধারা। ধারার আজ বিকেলটা খুব ভালো কেটেছে। অনল গরম দেখালেও তার সাথে বেশি রুঢ় হয় নি। আজ নতুন ভাবে আবিষ্কার করলো সে অনলকে। সে তার হাতটা একটিবারের জন্য ও ছাড়ে নি, ঘেমে গেলেও ছাড়ে নি। তাকে ফুসকা খাওয়িয়েছে, দুটো আইসক্রিম খাওয়িয়েছে। তারপর বেশ কিছু ছবি তুলে দিয়েছে। তখন বেশ হুমড়ি তুমড়ি করেছিলো ঠিক কারণ দোষটা তার ছিলো। ওই সময় মাথায় ই ছিলো না, চোরদের কাছে ছু’রি, চা’কু থাকে। সত্যি ই তো, যদি পেটে ঢু’কি’য়ে দিতো। তখন অপারেশন করতে হতো। ইশ! কি একটা কান্ড হতো! এগুলো কিছুই ভাবে নি ধারা, আসলে ব্যাগটি খুব প্রিয়। এটা ভার্সিটিতে উঠার পর বড় মা কিনে দিয়েছে। তখন থেকে তার কাছেই এটা। কিভাবে চুরি হতে দিলো। সেই ব্যাগে তার মোবাইল, ভার্সিটির আইডি কার্ড, কত কিছু। সেটা হয়তো মনিরত্ন না, কিন্তু দামী তো। অনল সেটা বুঝবে না, সন্তপর্ণে একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো ধারা_____

বাইক থামলো বাড়ির গেটে। ধারা নামতেই অনল প্রশ্ন ছুড়লো,
“মন ভালো হয়েছে তো?”
“হু”
“প্লাবণের বিয়েতে যাচ্ছিস তো?”

ধারার মিনিট কয়েক চুপ করে রইলো, তারপর বললো,
“যেতে তো হবেই। আমি যাবো”

বলেই ভেতরে পা বাড়ালো। তখন ই পেছন থেকে অনল ডেকে উঠলো,
“শোন”
“কিছু বলবে?”
“না কিছু না, যা”

বলেই গ্যারেজে বাইকটা রাখতে ব্যস্ত হলো অনল। ধারার কিছু সময় বলদের মতো তাকিয়ে রইলো। লোকটি এমন কেনো! সত্যি একটা প্রহেলিকা অনল ভাই!

*******

বুধবার, সকাল সকাল প্লাবণদের বাড়িতে চলে এলো অনল এবং ধারা। কলেজের বন্ধু বিধায় আগে আসার জন্য অনুরোধ করেছিলো। অনল ও আপত্তি করলো না। কত বছর পর সব ভার্সিটি এবং কলেজের বন্ধুদের আসর বসবে। আসলে কাজের ব্যস্ততায় কখনো সেই সুযোগ হয় না। রবিন, ইকরাম, সমীর এদের সবার সাথে আজ দেখা হবে। প্লাবণের মা ধারাকে দেখেই বললো,
“বউ মা তো ছোট? এই ছোট মেয়ের কাছে নিজেকে সপে দিলি অনল!”

অনল শুধু হাসলো, উত্তর দিলো না। ধারা কিছুটা শিটিয়ে গেলো, নতুন পরিবেশ, অচেনা সবাই। এর মাঝে নিজেকে মানিয়ে নিতে একটু সময় তো লাগবে৷ প্লাবণ তাকে দেখে বললো,
“যাক তুমি এসেছো দেখে খুব খুশি হলাম জলধারা”

ধারা জোরপূর্বক হেসে বললো,
“আপনার বিয়ে আর আমি আসবো না হয়! আপনি আমার দেবর বলে কথা”

কথাটা শুনতেই বিষম খেলো অনল৷ কোনোমতে হাসি থামিয়ে রাখলো সে। ধারার কথাটা যে স্যাটায়ার ছিলো কেউ না বুঝুক সে ঠিক ই বুঝেছে।

ধারা, অনল নতুন বিবাহিত জুটি বিধায় তাদের জন্য একটা আলাদা ঘরের ব্যাবস্থা করা হলো। এই পুরো বিল্ডিং টি প্লাবণের পরিবারের৷ প্লাবণের ছোট চাচারা থাকে নিচ তলায়, বড় চাচা উপর তালায়। মাঝের এক তালায় ছোট ফুপু থাকেন। ছোট ফুপুর বাসার একটা রুম বরাদ্ধ হলো অনল এবং ধারার জন্য। অনল রুমে এসেই গা এলিয়ে দিলো। স্মিত হেসে বললো,
“বোর হচ্ছিস?”
“না, তবে একটু অস্বস্তি হচ্ছে। সকলে কেমন আমাকে ঘিরে ধরেছে। মনে হচ্ছে আমি চিড়িয়াখানার একটা জ’ন্ত। আর টিকিট দিয়ে আমাকে দেখতে হবে”
“ভুল তো নয়”
“অনল ভাই, ভালো হবে না কিন্তু”

অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। সুন্দর, স্বচ্ছ হাসি। তারপর বললো,
“প্লাবণকে যেমন ওবাড়ির সবাই ভালোবাসে, এবাড়িতে আমাকেও সবাই ভালোবাসে। আমি যে বন্ধুদের মাঝে সবার আগে বিয়ে করবো, কেউ মানতে পারে নি। তাই এতো আগ্রহ। সয়ে যাবে”
“ওহ! তুমি বুঝি না’রী’বি’দ্বে’ষী ছিলে?”
“এটা কি প্লাবণ বলেছে?”
“না ইকরাম ভাই বলছিলো”
“কানে নিবি না, এসব রটনা”
“নিলাম না, আমার কি!”
“সত্যি ই কিছু না!”

ধারা উত্তর দিলো না। লাগেজটা বের করে বললো,
“তালা খুলে দাও। আমার শাড়ি বের করবো”
“সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান এখন শাড়ি কেনো বের করবি?”
“আজিব! গুছানো লাগবে না। প্রস্তুতির ব্যাপার আছে!”
“যার বিয়ে তার হুস নেই, উনি আসছে সাজতে। পারবো না, আমি ঘুমাবো এখন। আর কোনো আওয়াজ করবি না। যদি আওয়াজ শুনেছি তো দেখিস”
“অনল ভাই”
“চুপ”

বলেই হাতটা চোখের উপর দিয়ে শুয়ে রইলো অনল। ধারার ইচ্ছে করলো কয়েক দফা কথা শুনাতে। কিন্তু কিছু বললো না, এই শোধটা তোলাই থাক।

হলুদের সন্ধ্যে, আলোকসজ্জায় সেজেছে প্লাবণদের বাড়ি। সবাই ছেলের হলুদের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। অনল, ইকরাম এবং রবিনের দায়িত্ব পড়লো খাওয়া দাওয়া এবং ডেকোরেশনের। প্লাবণের ভাইবোনেরা তাদের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। কারণ ফেসবুকে দিতে হবে। কেউ কেউ তো টিকটক ও বানাচ্ছে। ফলে এই তিনজনকে গা’ধা খাটুনি খাটতে হচ্ছে। দুপুরে খাওয়ার সুযোগ ও হয় নি। মোটামুটি কাজ এগিয়ে রবিন বললো,
“এই ফলের ডালাটা দেখছিস? আন্টি চাচ্ছে”
“দাঁড়া আমাদের ঘরে ফুপু রেখেছেন হয়তো। এনে দিচ্ছি”

বলেই অনল নিচে গেলো। নিজ ঘর বিধায় নক না করেই ঢুকে পড়লো। রুমে ঢুকতেই তার পা জমে গেলো। ধারা তখন শাড়ি পড়ছিলো৷ এলোমেলো কুচি মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আয়নায় অনলের প্রতিবিম্ব দেখেই কোনো মতে আঁচল টেনে দিলো সে৷ তীব্র আতঙ্কিত স্বরে বলল,
“নক করবে না? এভাবে ঢুকে কেউ?”

অনল কিছুসময় নির্বিকার চিত্তে তাকিয়ে রইলো ধারার দিকে। তারপর আশেপাশে দেখে ফলের ডালাটা তুলে নিলো। তারপর সে বেড়িয়ে যেতে যেতে নির্লিপ্ত স্বরে বললো,
“কেউ যদি এতো বুড়ি হবার পরও দরজায় লক না করতে পারে, সেখানে এভাবেই ঢুকে পড়ে মানুষ”

কথাটা বলেই বেড়িয়ে গেলো অনল। ধারা জিব কাটলো দাঁত দিয়ে। লকটা লাগাতেই ভুলে গিয়েছিলো সে। মাথায় গাট্টা দিয়ে দরজার লক লাগালো। ভাগ্যিস অনল ই ছিলো!

অনল দাঁড়িয়ে আছে স্টেজের পাশে। তার হাতে ফলের ডালা। রবিন তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে? তোর কান লাল হয়ে আছে কেনো?”
“কিছু না, এলার্জি হয়তো”

মৃদু হেসে কথাটা বললো অনল। রবিন অবাক চোখে অনলের দিকে তাকিয়ে রইলো। দুপুরে তো খাবার ই জুটলো না, এলার্জি হবে টা কিভাবে!

হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। ধারা হলুদের বাটি নিয়ে উপস্থিত হলো। হলুদ জামদানি, হালকা রুপার গহনা, হালকা সাজ। সকলের চোখ যেনো তার দিকেই। প্লাবণের একটা বোন তার খোপায় বেলীর মালা বেঁধে দিলো। ফলে আরোও যেনো সুন্দর লাগছে তাকে। নতুন বউ টাইপ একটা ভাইব আসছে তার থেকে। কেউ সুন্দর বললে সেও লাজুক হাসি হাসছে। প্লাবণের মা তার কানের নিচে কাজলের টিপও দিয়ে দিলেন। ধারা হলুদের বাটি রেখে অনলের পাশে এসে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বললো,
“কেমন লাগছে আমাকে?”
“সং এর মতো”

না তাকিয়ে কথাটা বললো অনল। ধারা পাল্টা বলে উঠলো,
“নিজেকে দেখেছো! সং এর বউ তো সং ই লাগবে”

অনল কিছু বললো না। শুধু ধারার হাতটা নিজ হাতের ফাঁকে গলিয়ে রাখলো। এর মাঝে ঘটলো আরেক বিপদ। বরের পেট খারাপ, সে শুধু বাথরুমে যাচ্ছে আর আসছে। হলুদ লাগাবার জন্য ও বসতে পারছে না। যেই একটু এসে বসছে অমনি পেট গুরগুর করছে আর ছুটতে হচ্ছে তাকে। প্লাবণের এমন অবস্থায় ধারাকে দেখা গেলো মিটিমিটি হাসতে। অনলের চোখ ব্যাপারটা এড়ালো না। তখন সে ধারার কানে মুখ ঠেকিয়ে বললো,
“কাজটা তোর তাই না?”…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি