জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নীল আকাশ দেখছিল নাওশিন। অনেক বছর হলো আকাশ দেখা হয় নি তার। তার নীল আকাশ ভীষণ পছন্দের। মাঝেমধ্যেই বাবার সাথে বসে নীল আকাশ দেখতো। বাবা আলতাফ হোসেন প্রায়ই নিজের প্রিয় স্ত্রী এবং মেয়েকে নিয়ে ছাদে বসে আকাশ দেখতেন। বলতেন, ‘ভালোবাসা যদি নীল আকাশের মতো পরিষ্কার হয়, তাহলে সেই ভালোবাসা যেন রাতের আকাশের ওই সুন্দর চাঁদ।’ সাজেদা বেগমের সাথে নানান গল্পে মেতে উঠতেন। সেই মুহূর্ত গুলো কতোই না মধুর ছিলো। নাওশিনের ৯বছর বয়সে তার প্রিয় বাবা আলতাফ হোসেন মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করেন। সবার মুখে সে শুনেছে, তার বাবা ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক করে মৃ’ত্যু বরণ করেছিলেন।
কিন্তু যতোই সময় যাচ্ছে, তার ততোই মনে হচ্ছে তার বাবার মৃ’ত্যু স্বাভাবিক মৃ’ত্যু ছিলো না।
নাওশিন খুব কাছ থেকে দেখেছে নিজের প্রিয় মানুষকে পালটে যেতে। পৃথিবীতে তার প্রিয় বলতে অল্প কিছু মানুষই ছিলো৷ তার মধ্যে একজন তার মা। কিন্তু বাবার মৃ’ত্যুর পর দেখেছে সেই প্রিয় মানুষটিকে অল্প অল্প করে পরিবর্তন হতে।
পরিবর্তন শব্দটি অনেকটা মাথার উপরের বিশাল আকাশের মতোই। আকাশটি যতক্ষণ নীল, ততক্ষণ ওই আকাশ সবার ভালো লাগে। কিন্তু আকাশে যখন কালো মেঘ জমে, তখন মানুষ ঘরে আশ্রয় নেয়। কারণ আকাশের এই পরিবর্তন কেউ চায় না।
নাওশিন পরিবর্তন শব্দের অর্থ শিখবার পূর্বেই নিজের প্রিয় মা’কে পরিবর্তন হতে দেখেছে। যেই মানুষটি পৃথিবীর সব সুখ বলতে নিজের স্বামীকেই বুঝতো। সেই মানুষটি নিজের প্রিয় স্বামীর মৃত্যুর ৮মাসের মাথায় বিয়ে করে আনিছুর রহমানকে।
বাবার হাত ধরে থাকার বয়সে বাবাকে হারিয়েছে নাওশিন। বুঝেছিল মা তো আছেন। কিন্তু তখনই বুঝল সে পৃথিবীতে খুব একা। যখন পুতুল খেলার বয়সে তাকে ঘর মুছতে হতো, কাজ করলে ভাত পেটে যাবে, নয়তো না খেয়ে থাকতে হবে।
তবুও মাঝেমধ্যে নাওশিন খুব খুশী হতো। যখন পৃথিবীর আরো একজন প্রিয় মানুষ যিনি তার প্রিয় মামা খালেদ আহমেদ, উনার সাথে ঘুরতে যেতো, কিংবা তাদের বাসায় কিছুদিনের জন্য থাকতে যেতো।
হাতে কলম থাকার বয়সে সে বালতি ভরা কাপড় ধুতে শিখে যায়।
তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিল। পৃথিবী ততোদিন ভালো, যতোদিন এই পৃথিবীতে প্রিয় মানুষগুলো বেঁচে থাকেন।
নাওশিন যখন নিজের জীবনকে পড়তে খুব ব্যস্ত। তখন তার মনে হলো তার থেকেও তো হাজার গুণ কষ্ট পেয়েও মানুষ বেঁচে আছে।
মাঝেমধ্যে ভাবতো নাওশিন, বন্দী চার দেয়ালে আ’ত্মহত্যা করবে। কিন্তু নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যু’দ্ধ করত। বেঁচে থাকার জন্য বারবার তাকে নিজের মনের বিরুদ্ধে যেতে হতো। মন যখন বলতো এই পৃথিবী তোমার না। তখন নাওশিন বলতো, না এই পৃথিবী আমার। পৃথিবীটাকে আমি উপভোগ করার জন্যে হলেও বাঁচবো।
নাওশিন খুব কঠিন মুহুর্ত কাটিয়েছে। এই দিন গুলো হয়তো তাঁর অন্য রকম হতে পারতো, যদি তার প্রিয় বাবা বেঁচে থাকতেন।
পড়ালেখায় খুব মনোযোগী থাকার পরেও যখন তাকে আর পড়তে দেওয়া হয় নি। তখন তার ভীষণ কষ্ট হতো। পৃথিবী অসহ্যকর লাগতো। তার বাবা বলতেন, আমি আমার নাওশিনকে অনেক বড় করব। আমার নাওশিন মা যেমন সুন্দর, তার লেখাটাও তার মতোই সুন্দর।
হ্যাঁ আজ সে ১৬বছর বয়সের এক যুবতী। বড় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু বাবার বলা সেই অনেক বড় শব্দটি আর কখনো হওয়া হবে না।
ভাতের প্লেট হাতে পারুল এসে নাওশিনের পাশে বসে। নাওশিন তখনও আকাশ দেখতে ব্যস্ত। পারুল নাওশিনকে খুব আস্তে করে বলল,
ভাত খেয়ে নাও নাওশিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল।
নাওশিন আকাশ দেখতেই ব্যস্ত। হয়তো তার কানে পারুলের বলা কথা যায় নি।
পারুল আবারও বলল,
নাওশিন আমি কিছু বলেছি তোমায়!
নাওশিন পারুলের দিকে তাকায়। ভাতের প্লেট হাতে দেখে নাওশিন শুধু বলল,
আমার খিদে নাই।
আমি যদি আমার হাতে খাইয়ে দেই তবুও?
নাওশিন কোনো কথা না বলে হা করে।
পারুল মিষ্টি হেসে নাওশিনকে খাইয়ে দিতে শুরু করে।
নাওশিনের মনে আছে। তার পরিবর্তন হওয়া মা তাকে বলেছিলেন, কেউ যদি কোনো আবদার করে। আর সেই আবদার যদি সৎ এবং ভালো হয়। তোর মনে হয়ে, তুই সেই আবদার মেটাতে পারবি। তাহলে আবদার করা মানুষটিকে কখনো ফিরিয়ে দিবি না।
নাওশিন ঠিকই পারুলের আবদারটি রাখে, সে তার মায়ের সেই কথাটি এখনো মেনে যাওয়ার চেষ্টা করে প্রতিনিয়ত। সব কিছুকে এক পাশে রেখে একটি শব্দতেই সে সব কিছু ভুলে যেতো, তিনি আমার মা।
কয়েক বার ভাত মুখে দেওয়ার পর বমি করে দেয় নাওশিন। এই খাবার তার পেটে হজম হতে চায় না। পারুল নাওশিনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়।
কী হয়েছে বোন? শরীর খারাপ?
নাওশিনের চোখ দিয়ে পানি এসেছে বমি করার কারণে। খুব কষ্টে বলল সে,
আপা আমি ভাত খেতে পারছি না। এই ভাত পেটে যাওয়ার পর আমার কেমন জানি লাগে।
পারুল ছোট্ট করে প্রশ্ন করে,
তোমার কি খেতে ইচ্ছে করে?
নাওশিন বলল,
শুকনো রুটি আর এক গ্লাস পানি।
এই খাবার খেয়েই তো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কাটিয়েছে। যেই খাবার মুখে নিলেই তার বমি আসতো, আজ সেই খাবারই তার মন খুব করে চায়। এই খাবার এর মাধ্যমেই যে তাকে অ’ত্যাচার করা হতো। নাকে তার ভিন্ন ভিন্ন তরকারির ঘ্রাণ আসতো। কিন্তু খাবার বেলায় তার সামনে শুকনো রুটি আর এক গ্লাস পানি থাকতো। আর পাশেই তার মা আর মায়ের স্বামী ঘ্রাণ যুক্ত তরকারি দিয়ে ভাত খেতেন। প্রথমে অনেক প্রশ্ন করত, কান্না করত। কিন্তু ওদের মন গলত না।
খালেদ আহমেদ এবং তার পরিবারের মৃত্যুর আজ ৪দিন।
নাওশিনকে ওরা তার মামাকে শেষ দেখাটাও দেখতে দেয় নি। কারণ ওদের জানাযায় পুলিশ এর লোক উপস্থিত ছিলো। সেখানে নাওশিনের মা ছিলো। কারণ ভাইকে শেষ দেখা দেখবে, তাই আসছিল।
সেখানে কীভাবে নাওশিনকে নিয়ে যাবে ওরা। কীভাবে পুলিশের হাতে নির্দোষ নাওশিনকে তুলে দিতে পারে তারা।
আদিব তো সবাইকে বলেই দিয়েছে নাওশিন নির্দোষ। কিন্তু নিয়াজ মানতে নারাজ। সে বিশ্বাস করে নাওশিন খু’ন করেছে ওদের। তাকে কোনো ভাবেই বিশ্বাস করাতে পারছে না সবাই। তার এক কঠিন বক্তব্য।
নাওশিন যদি খু’ন না করে ওদের, তাহলে সে সেখানে কী করছিল? তোমরা যেয়ে কেন অন্য কাউকেই পাওনি, কেন নাওশিনকেই পেলে? সে কী তার মামার বাসা চিনে না? সে কী তার মামাকে চিনে নি? এই খু’ন গুলো নাওশিন করেছে।
নিয়াজের এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কেউ দিতে পারছে না। সত্যিই তো নাওশিন সেখানে কী করছিল, তারা কী তা জানে? দুনিয়াতে এতো মানুষ থাকার পরেও নাওশিনকেই কেন সেই বাসায় পেতে হল?
সবাই যখন চুপ নিয়াজের এমন প্রশ্নে। তখন আদিব নাওশিনকে ডেকে আনে। এই কথার উত্তরগুলো নাওশিনই দিতে পারবে।
নাওশিন এসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখ মলিন হলেও নিয়াজের মুখ খুব কঠিন। নাওশিনকে উদ্দেশ্য করে এই সব কয়টি প্রশ্ন করে নিয়াজ। নাওশিন আদিবের দিকে তাকায়, সেও নাওশিনের উত্তরের অপেক্ষায়। নাওশিন চুপ করে আছে। নাওশিনকে কথা না বলতে দেখে নিয়াজ ধমক দিয়ে বলল, মুখ দিয়ে কী কথা আসছে না তোমার?
নাওশিন এতো কঠিন গলায় ধমক খেয়ে কেঁদে দেয়।
আদিব চোখের ইশারায় নিয়াজকে শান্ত হতে বলে। আদিব বলল,
নাওশিন নিয়াজের করা প্রশ্ন গুলো আমাদের সবার প্রশ্ন। তুমি চুপ না থেকে উত্তর দাও। আমার বিশ্বাস তুমি মানুষ মা’রতে পারো না। কিন্তু আমার ভাইটা এসব বিশ্বাস করতে পারছে না কোনো ভাবেই। তাই তুমি চুপ না থেকে উত্তর দাও ওর প্রশ্নের।
নাওশিন দীর্ঘশ্বাস নেয়, কপাল ঘেমেছে তার। চোখে এখনো পানির অংশ দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন আর প্রশ্ন। একটু ভালোভাবেই তো বাঁচতে পালিয়েছিল, কিন্তু বাস্তব এতো কঠিন কেন?
নাওশিন বলতে শুরু করে,
আমি দুইটা বছর ধরে ঘর বন্দী। আমার উপর এতোটা অ’ত্যাচার করেছে আমার মা আর তার স্বামী যে, এখনো ভাত মুখে নিলে সব অ’ত্যাচার এর কথা মনে পরে যায়।
আমাকে দিয়ে আমার মায়ের স্বামী একটি ব্যবসা শুরু করতে চেয়েছিল। এক জঘন্য খেলায় মেতে উঠতে চেয়েছিল। সেই খেলায় মেতে উঠতে আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজেই প্রতিবাদ করতে শুরু করি। তারপর থেকেই ঘরবন্দী। আমাকে তিন বেলা ১টি রুটি করে আর এক গ্লাস পানি খেতে দিতো। জানিনা কীভাবে বেঁচে আছি আমি। পিচ্চি ভাই বায়েজিদ মাঝেমধ্যে লুকিয়ে করে দু একটি রুটি আমাকে খেতে দিতো। খুব কষ্ট হতো আমার। সেদিন রাতে বায়েজিদ আমাকে পালাতে সাহায্য করে। বায়েজিদকে আমার মায়ের স্বামী রাস্তায় পেয়ে এনেছে বলে দাবী করে, কিন্তু তার মতোই বায়েজিদ এর চেহারা। এই বিষয়ে কখনো আমার মাকে মাথা ঘামাতে দেখি নি।
সেই রাতের আগের রাত বায়েজিদ আমাকে পালাতে সাহায্য করবে বলেছিল, তারপর আমি নিজেকে তৈরি করি, কারণ আমাকে পালাতে হবে।
রাতের কোনো এক সময়ে বায়েজিদ বাহির থেকে দরজা খুলে দেয়৷ তারপর আমি পালিয়ে যাই। এই কাজে বায়েজিদকে সন্দেহ করবে না। কারণ বাসায় একজন কাজের মহিলাও আছে। সন্দেহ কাকে করবে সেটা ওদের বিষয়।
আমি অন্ধকার রাস্তায় হাটছিলাম। একা, গভীর রাত। মনের মধ্যে ভয়ের ঢেউ, কখন কী হয়। শরীর ক্লান্ত৷ হাটতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। এক পর্যায়ে একটি বাসার দরজা খোলা পাই, বাসার গেইট খোলা ছিল, তাই দরজা যে খোলা সেটাও দেখতে পাই। আমি তখন কিছু না ভেবেই বাসায় প্রবেশ করি। মাথায় তখন এক মুঠো ভাতের চিন্তা ছিলো।
শেষ পর্যন্ত বলে থেমে নাওশিন।
বিশ্বাস করুন আমি আমার মামার বাসা চিনতাম না। অনেক পূর্বে আমি আমার মামার বাসায় গিয়েছিলাম৷ আমার বিশ্বাস এই বাসা নতুন, মামার নতুন কোনো বাসা। এই শহরে আমি মুক্ত ভাবে চলাফেরা করি না অনেক বছর।
আমি জানতাম না ওই ফ্লোরে থাকা মানুষটি আমার মামা ছিলেন। তাহলে আমি ভয় পেতাম না, মানুষটিকে জড়িয়ে ধরতাম নিজের বুকের সাথে। একবার দেখেই ভয় পেয়েছিলাম, দ্বিতীয় বার তাকাতে পারিনি। এতোটা নিষ্ঠুর ভাবে আমার মামাকে ঘা’তকের দল ক্ষ’তবিক্ষত করেছিল। চেনার কোনো উপায় ছিলো না।
আমাকে বিশ্বাস করুন। অ’ত্যাচার যাদের খাবার তারা কখনো মিথ্যে বলে না, তারা কখনো মিথে বলে না।
শেষের বাক্যটি শুনে আদিব নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। আদিব নাওশিনের কাছে যায়। চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
বোন কাঁদিস না। আমি জানি তুই মানুষ মা’রতে পারিস না। নিয়াজও এখন সেই কথা বিশ্বাস করবে। তুই আমাদের চিনতে না পারিস আমরা তোকে খুব ভালো করে চিনি। তোর মামার কাছে তোর অনেকগুলো ফটো আছে। সেগুলো আমাদের দেখাতেন। তোকে তো খুব ছোটবেলায় দেখেছিলাম। তোকে দেখিনি তখন, যখন তোর মা আ,,,
আদিব থেমে যায়। কথাটি মুখের মধ্যে রেখে দেয়। নাওশিন চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে আর চোখজোড়া থেকে কতো পানি ফেলবে। একটু সুখও কী তার কপালে নেই।
নাওশিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
আদিব মিনহাকে বলল নাওশিনকে রুমে নিয়ে যেতে৷
স্বামীর আদেশ পেয়ে মিনহা নাওশিনকে রুমে নিয়ে যায়।
নিয়াজ শুধু শুধু মেয়েটিকে কাঁদিয়ে দিলি।
মিফতার কথায় নিয়াজ চুপ৷
নিয়াজ শুধু বলল,
আমি মনকে বুঝ দিতে পারছি না ভাইয়া। তোমরা যদি এভাবে চুপ থাকো তাহলে আমি আমার পরিবারের সবাইকে যারা খু’ন করেছে৷ তাদের এক এক করে খু’ন করে জেলে যাবো৷ আমি আর পারছি না চুপ থাকতে। কী পেয়েছো চুপ থেকে? সেই তো ওরা আবার খু’নের খেলায় মেতে উঠলো।
নিয়াজের কথায় আদিব ধমক সুরে বলল।
নিয়াজ তোর কী মনে হয়, আমরা চুপ আছি? তোর র’ক্ত কী একাই গরম হয়? আমাদের কী গরম হয় না। আমরা চুপ নাই নিয়াজ। ওদের দুজনের ফাঁ’সি হয়েছে। দেশে যদি ভালো আইন থাকতো। তাহলে ওদের সবার শাস্তি হতো। এই যে তুই নাওশিনকে সন্দেহ করলি, এই মেয়েটাকে যদি তুই পুলিশে দিয়ে দেস, তাহলে আইন চিবিয়ে চিবিয়ে খাবে নিরীহ নাওশিনকে। বেঁচে যাবে দোষী মানুষগুলো। আইন নিজের হাতে নিবো না বলেই চুপ আছি। ওরা একটু জমির জন্য আজো এমন করতেছে৷ শুধুই কী জমি না-কি অন্য কিছু আছে সেটাও দেখবো এবার। তুই দয়া করে চুপ থাক ভাই। এভাবে উত্তেজিত হলে আমাদের চলবে না। আমরা নিরুপায়। আমাদের চাকরি করে খেতে হয়। আমার বা মিফতা কিংবা জাহেদের কিছু হলে আমাদের বাচ্চাকে কে দেখবে? বাবা চাচাদের মৃ’ত্যুর পর আমরা কতোটা অসহায় ছিলাম, দেখেছিস তো নিজের চোখেই।
জমি নিয়ে ওরা আজো কেন আমাদের পিছনেই লেগে আছে। কেন একের পর এক হ’ত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে তা তো আমরা জানবো ইনশা আল্লাহ।
নিয়াজ কোনো কথা না বলে নিজের রুমে চলে যায়। সে এভাবে চুপ করতে থাকতে পারবে না।
আদিব দীর্ঘশ্বাস নেয়, তাদের উপর কী আর কোনো ঝড়তুফান আসতে যাচ্ছে?
পা’গলী মেয়েটা বুঝেছিল, সে পালিয়ে বেঁচে যাবে আমাদের থেকে। বলেছিল, আমরা যেন তাকে না খুঁজি। এখন তো পুলিশ খুঁজবে থাকে।
সাজেদা বেগম কথাটি বলে বিশ্রী হাসিতে মেতে উঠলেন।
আনিছুর রহমান সেই হাসি দেখছেন আর মনে মনে হাসছেন। তিনি নিজের স্ত্রীকে নিজের মতোই পাষাণ করতে পেরেছেন।
সাজেদার চোখে একটুও পানি নেই। আপন ছোট ভাইয়ের মৃ’ত্যুতে তার অন্তর একটুও ব্যথিত হয় নি।
পুলিশ যখন উনাকে প্রশ্ন করেছিল,
আপনার ভাইয়ের খু’ন কে করতে পারে? কাউকে কি সন্দেহ হয় আপনার?
পুলিশের এই প্রশ্নে কান্নার অভিনয় করে খুব সুন্দর ভাবে নিজের মেয়েকে খু’নী বানিয়ে দিয়েছেন। পুলিশ অফিসার তখন খুব অবাক হয়েছিল। মা হয়ে সন্তানকেই খু’নী বলে দাবি করে নিলো।
পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান। ১মাসও হয় নি এই থানায় এসেছেন। তিনি একজন সৎ অফিসার।
নাওশিন নিজেকে অনেকটাই স্বাভাবিক করে নিয়েছে। অনেক দিন ধরেই তো নিজের মামার সাথে সাক্ষাৎ বা দেখা নেই। এসব ভেবেই নিজেকে স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। নাওশিন ড্রয়িং রুমে যায়, সেখানে আদিব কে বসে থাকতে দেখে। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। রাত প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই।
নাওশিন এসে আদিবের সামনে দাঁড়ায়। আদিবের চোখে এখনও পানি। নাওশিন কিছুতেই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। এরা তার মামাকে কেন বাবা বলল৷ কিছুতেই বিষয়টা বুঝতে পারছে না সে।
আদিব নাওশিনকে দেখে বসতে বলে পাশে, কিন্তু নাওশিন দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করল।
আপনি আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিবেন?
আদিব হুম বলল।
আমার মামা আপনাদের বাবা হন কীভাবে? আমার মামার তো দুই মেয়ে। তাহলে আপনারা আমার মামাকে তখন বাবা বললেন কেন?
নাওশিনের প্রশ্নে আদিব চুপ থাকলো। সে এখন কোনোভাবেই অতীত মনে করতে চাচ্ছে না। কষ্টে ভরা অতীত মনে করে কষ্টটা দিগুণ করতে কোনো ভাবেই চাচ্ছে না সে।
নাওশিন আবারও প্রশ্ন করে,
বলুন তো কিছু!
তোমার কী এখনই শোনা লাগবে নাওশিন?
নাওশিন মাথা নাড়িয়ে হুম বুঝায়।
আদিব দীর্ঘশ্বাস নেয়।
তোমার মামা খালেদ আহমেদ কীভাবে আমাদের বাবা হন সেটাই তো জানতে চাচ্ছো? তার আগে আরো কিছু কথা মন দিয়ে শুনতে হবে তোমায়। পারবে?
হুম খুব পারবো।
আদিব বলতে শুরু করে।
এই যে আমাদের সাত ভাইকে দেখছো তুমি। আসলে আমরা আপন ভাই না। আমার আপন ভাই হলো নিয়াজ নাবীল। বাকি পাঁচজন হলো আমার তিন চাচার সন্তান। আমার বাবা তাঁরা চার ভাই ছিলেন।
নাওশিন কথার মধ্যেই প্রশ্ন করে বসল,
তাহলে আমার মামাকে কেন বাবা ডাকলেন, বললেন আমার মামা আপনাদের বাবা।
আদিবের রাগ হলো কথার মাঝখানে কথা বলা দেখে। তবুও শান্ত ভাবেই বলল,
ধৈর্য নিয়ে শুনবে তো সব। তারপর না হয় কথা বলবে।
নাওশিন চুপ থাকলো।
চারজনের ঘরে আমরা অনেকগুলো ভাইবোন ছিলাম। কিন্তু এখন আমরা বেঁচে আছি মাত্র ৭জন। প্রশ্ন মনে জন্মেছে নিশ্চয়ই! মন দিয়ে শুনো।
এখন দিনগুলো কতো রঙিন তাই না? এখন ক্যালেন্ডার এর পাতায় ২০১৫ চলছে। কিন্তু আমি তোমায় যা বলবো, তা ঘটেছে ১৯৯৩সালে।
১৯৯৩ সালে আমার বয়স ছিলো ১০বছর। আমরা বেঁচে থাকা সাত ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র আমারই মনে আছে বাবা মা, চাচা চাচীদের চেহারাটা। অন্যদের কিছু কিছু, ওরা সবাই তো আমার থেকেও ছোট।
আমি ১৯৯৩সালের সেই রাতটির কথা কোনোভাবেই ভুলতে পারি না। যেই রাত কেড়ে নিয়েছে আমার সব প্রিয় মানুষকে, সেই রাত আমি কেমনে ভুলিতে পারি।
গভীর রাতে যখন ১৫জন মানুষের একটি দল আমাদের চোখের সামনে এক এক করে আমাদের পরিবারের প্রতিটা সদস্যের শরীর থেকে মাথা আলাদা করছিল, সেই সব কথা আমি কীভাবে ভুলতে পারি।
আদিব কথাগুলো বলে চোখের পানি মুছে নিলো। নাওশিন মন দিয়ে শুনছে সব কথা। তার আগ্রহ বেড়েই যাচ্ছে। সাথে মনে একের পর এক প্রশ্ন আসা যাওয়া করছে।
আদিব আবারও বলতে শুরু করে।
ওরা ১৫জন আমার পরিবারের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখেনি। আমার বড় চাচা যখন চিৎকার করে বলছিলেন। খালেদ তুই আমার বংশের একজন সন্তানকেও হলে বাঁচা। আমাদের বংশ যেন এভাবে থেমে না যায়। জানো নাওশিন আমার চাচার সেই কথাটি আজো আমার কানে বাজে। তোমার মামা আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন। ছোট চাচার বন্ধু ছিলেন তোমার মামা। পড়ালেখা শেষ করে যখন কোনো চাকরি পাচ্ছিলেন না, তখন তোমার মামা চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কোনো ছোট কাজ হলেও করবেন, তখন ছোট চাচা গাড়ির চালানোর কাজ দেন। তোমার মামা আমাদের পরিবারের একজন ছিলেন। সব সময় আমাদের বাসায় থাকতেন। আমরা তো তোমার মামার সাথে খেলতাম। হাসিখুশি একটি বিশাল পরিবারকে আমি সেই রাতে থেমে যেতে দেখেছি। ওই অন্ধকার রাত আসলে এখনো আমি ভয় পাই নাওশিন।
আমার বড় চাচার কথায় যখন তোমার মামা প্রথমে আমার হাত ধরেছিলেন, তখন দেখেছি আমার বাবা আমার মাকে ওদের হাত থেকে বাচাতে ঝাপিয়ে পড়তে ওদের উপর। তোমার মামা আমাকে গাড়িতে তোলার পূর্ব পর্যন্ত আমি দেখেছি আমার বাবার শরীর থেকে ঘা’তকের দলেরা খুব হিং’স্র ভাবে মাথা আলাদা করতে। সেদিন চিৎকার করেছি খুব। কিন্তু একটা মানুষও সাহায্য করতে আসে নি। কোনো মানুষ তাদের বাড়ির দরজা কেন, জানালাটা পর্যন্ত খুলেনি।
তোমার মামা আমাকে নিয়ে বাড়ির পিছনে একটি বাগানে লুকিয়েছিল, কারণ গাড়ির চাবি ছিলো না উনার কাছে। তোমার মামাকে ওরা আহত করেছিল খুব খা’রাপ ভাবে। আমার মুখ চেপে ধরে বসেছিলেন তিনি।
আদিবের কণ্ঠ বারবার ভেঙে আসছিল কথাগুলো বলার সময়। কিন্তু তবুও সে বলে যাচ্ছে।
নাওশিন কিছুটা প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে। তবুও শেষ পর্যন্ত শোনার অপেক্ষা তার। নিজেকেই সবচে দুঃখী ভাবতো৷ চার দেয়াল থেকে মুক্ত হওয়ার পর তার থেকেও দুঃখী মানুষ আজ সে দেখতে পারছে।
আদিব অতীত মনে করে ক্লান্ত আজ। তবুও বলতে শুরু করে সে,
ফজরের আজান যখন পড়ে তখন ওরা এক এক করে সবাই নিজেদের ধারালো অ’স্ত্র হাতে নিয়ে বের হয়ে চলে যায়। তবে আমার বাবা চাচারাও ওদের র’ক্তাক্ত করেছিলেন। হয়তো লড়াই করে করেই একেকজন মৃ’ত্যুর বরণ করেছেন।
আমরা যখন বাসায় ঢুকলাম, তখন ভিতরে শুধু র’ক্ত আর র’ক্ত ছিলো৷ তোমার মামাকে দেখেছি পা’গলের মতো একটি লা’শের পর অন্য লা’শ দেখতে। কিন্তু কাউকেই বেঁচে থাকতে দেখিনি। কারো শরীর থেকে মাথা আলাদা, কারো শরীর ক্ষ’তবিক্ষত। তবে আমার চাচাদের রুমে বিছানার নিচে এক এক করে পিচ্চি মিফতা, জাহেদ, সামিন, রবিন এবং ৯মাসের সাইফকে পাই আমি আর তোমার মামা। নিয়াজ আমার বড় আপুর সাথে থাকতো, আপুকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। তাকেও আমার আপু বিছানার নিচে রেখে দেয়। তাকেও বিছানার নিচে পাই। কিন্তু আমার আপুকে ক্ষ’তবিক্ষত লাশ হিসেবে পাই।
এই আমরা সাত ভাই আজো বেঁচে আছি। আমার চাচিগুলো এবং আমার আপুর মনের কেমন মিল দেখো। ওরা একই কাজ করেছে তাই আমার এই ছয় ভাই বেঁচে আছে এখনও।
একটি নির্মম গণহ’ত্যা করে ঘা’তকের দল। যেই রাতে রাতের প্রথম ভাগে আমরা সবাই কতো হাসিখুশিই না ছিলাম। সেই রাতের শেষের অংশে পরিবারের ১৭জন মানুষকে হারালাম আমরা। বড় চাচার ৫ছেলের মধ্যে শুধু মিফতাই বেঁচে আছে। এভাবে আমরা হারাই আমাদের বাবা মা সহ ৯ভাই বোনকে।
মানুষ কতোটা নি’ষ্ঠুর হলে একটি পরিবারের সবাইকে মে’রে ফেলে। সেই প্রশ্ন উত্তর আমি আজো পাইনি। আমি এখনও মাঝেমধ্যে রাতে স্বপ্নে দেখি সেই রাত। ঘুম ভেঙে যায়, সারা রাত কাটাতে হয় তখন নির্ঘুমে।
আদিব কথা বলে থামে। গাল গড়িয়ে পানি পড়ছে। ঠোঁট কাঁপছে তার। হয়তো শব্দ করে কান্না করতে চাচ্ছে সে। কিন্তু কান্না থামানোর শত চেষ্টা করে যাচ্ছে আদিব।
নাওশিন নিজের কষ্টের কথা ভাবলো। উঁহু তার কষ্ট তো কিছুই না। এই কষ্ট একবারেই তুচ্ছ। মানুষ কতো কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছে। একটি পরিবারের ১৭জন মানুষকে একই রাতে খু’ন করা হয়েছে। এই কষ্ট তো পাহাড় সমান। পরিবারটা কতোই না সুখে ছিলো। সবাই যৌথ ভাবে থাকতো। তাদের মধ্যে কতোই না ভালোবাসা ছিলো।
পৃথিবী আজ ভালো থাকতো, যদি কিছু জঘ’ণ্য মানুষ না থাকতো।
নাওশিন এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। সে তার মামার মৃ’ত্যুতে যে কষ্ট পেয়েছে, তা এখন অতি সামান্য লাগছে তার কাছে।
নাওশিন চুপ করে আছে। আদিব আবারও বলতে শুরু করে।
তোমার মামা আমাদের সাতজনকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবেন। কিন্তু আমার পরিবারের সবাইকে মাটি দেওয়ার পর, পুলিশ আমাদের অনাথ আশ্রমে পাঠাবে, আমাদের কেউ নাই। এটাই তাদের বক্তব্য ছিলো। নয় মাসের সাইফ যে ছোট চাচার একমাত্র সন্তান, তাকে এক পুলিশ কনস্টেবল নিবে। অথচ আমাদের পরিবারের সবার মৃত্যুর দুইদিন হয়েছিল। আমাদের পরিবারের লা’শ কাঁধে নেওয়ার মতো আপন কেউ ছিলো না। এতোটাই গণহ’ত্যা চালিয়েছিল ওরা।
কিন্তু তোমার মামা আমাদের নিজের কাছেই রাখবেন। এই সেই বাড়ি, যে বাড়িতে আমরা আমাদের সবাইকে হারিয়েছি। পিচ্চি ভাইগুলো মা বাবাকে না পেয়ে দিনের পর দিন কান্না করতো। তোমার মামা বিয়ে করেন। তোমার মামা আর মামি মিলে আমাদের সাত ভাইকে বড় করেন। বাচ্চা নিতে দেরি করেন তিনি, শুধু আমাদের বড় করতে, লালন পালন করতে অনিয়ম হবে, তাই। সাইফ যখন তোমার মামাকে আব্বা শব্দটি ডাকে, তারপর থেকে আমরাও তোমার মামাকে বাবা ডাকতে শুরু করি। সাইফ তার ১৩বছর বয়সে জানতে পেরেছিল তোমার মামা তার বাবা না আর তোমার মামি তার মা না। সেদিন থেকে তোমার মামিকে আন্টি ডাকলেও মামাকে আব্বা ডাক ছাড়তে পারেনি। এভাবেই তোমার মামা ছিলেন আমাদের বাবা।
তোমার মা’ও আমাদের ভালোবাসতেন৷ কিন্তু,,
আদিব থেমে যায়।
নাওশিন এখন বুঝতে পারে, তাকে কীভাবে সবাই চিনে। কিন্তু সে তো এদের এই প্রথম দেখেছে। এর পূর্বেও কখনো দেখেনি। দিনের পর দিন ছোটবেলায় মামার বাড়ি থেকেছে সে। কিন্তু এদের কাউকেই তো সেখানে দেখেনি। কোনো ভাবেই মনে করতে পারলো না। সে কোথায় এদের কাউকেই দেখেনি। কিন্তু ওরা তাকে কতো ভালোভাবেই না চিনে।
নাওশিন সব শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। কিছুই বলতে পারছে না সে।
এই পৃথিবী কতোই না সুন্দর। কিন্তু কিছু কারণে পৃথিবী হয়ে উঠে কারো কাছে খুবই অসহ্যকর।
নাওশিনের জানতে ইচ্ছে হয় এতোটা মানুষকে কেন মে’রেছে। নিশ্চয় কোনো কারণ তো আছে।
যারা আপনাদের বাবা মাকে মে’রেছে। তারা কেন মে’রেছিল? নাকি তারা ডা’কাতের দল ছিলো?
নাওশিনের প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকে আদিব। তারপর বলল,
আমার বাবার গ্রাম সম্পর্কের চাচাতো ভাই ছিলো ওরা। খুব প্রভাবশালী ছিলো ওরা। ওদের সাথে আমাদের জমি নিয়ে। বছরের পর বছর জমি নিয়ে মামলা, জোরপূর্বক ভাবে আমাদের জমি নিজেদের নামে করে নিতে চেয়েছিল। ওই জমি আমার দাদা ওদের বাবার থেকে কিনেছিলেন। কিন্তু ওরা সেটা নিজেদের বলেই দাবি করে, কাগজ সব ঠিক হওয়ার পরেও ওরা একই কাজ করে।
এই যে এখন দেখতে পারছো, একের পর এক বাসা আর বাসা। সেই সময় এইসব কিছু ছিলো জমি, এভাবে ঘনবসতি ছিলো না। যেই জমি নিয়ে ভেজাল চলছিল, সেই জমিতেই আমাদের পরিবারের ১৭জনকে কবর দেওয়া হয়। ওরা সেই জমি পায় নি, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের সবাইকে। হয়তো ভেবেছিল ওরা কোনো হ’ত্যাকাণ্ড চালালেই পেয়ে যাবে জমি। চালিয়েওছে। কিন্তু জমি পায়নি, সেই জমিতে ঠাঁই পেয়েছে কিছু লা’শ, আর তারাই হলো আমাদের প্রিয়জন।
ওদের কোনো শাস্তি হয় নি?
নাওশিনের প্রশ্ন শুনে হাসলো আদিব।
হ্যাঁ হয়েছে, তবে ২০০১ সালে ওদের দুইজনের ফাঁ’সি দিয়ে বুঝিয়েছে দেশে আইন আছে। কিন্তু অন্য সবাই খোলা আকাশের নিচে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এইযে কালকে তোমার মামার পরিবারকে হ’ত্যা করা হয়েছে সেটা ওরাই করেছে। ওরা আরো একটি হ’ত্যা করেছে, সেটি তো,,
আদিব থেমে যায়। নাওশিন বুঝে উঠতে পারছে না। কি বলতে চাচ্ছিল মানুষটি। নাওশিন আর প্রশ্ন করেনি।
নাওশিনের খুব ঘুম পেয়েছে। নাওশিন ঘুমাবে।
আদিবকে ঘুমাবে বলে নিজের রুমে চলে যায়। তাকে একটি রুম দিয়েছে ওরা। সেই রুমে ঘুমাবে সে। কিছু রহস্যের সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু আসলেই কী রহস্যের সমাপ্তি হয়েছে? নাওশিন প্রশ্নের সাগরে ভেসে না যেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
আদিব রুমে যায়, তারও ঘুম প্রয়োজন।
তুমি ফ্লোরে থাকা পুরুষটির লা’শ দেখেছিলে?
নাওশিন চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসেছিল৷ মিফতা মাহবুবের প্রশ্নটি শুনে চোখ মেলে তাকায় নাওশিন, ছোট্ট করে শুধু বলল।
না।
মিফতা দীর্ঘশ্বাস নেয়। তার চোখে জল টলমল করছে।
নাওশিন চুপচাপ বসে আছে। অনেক প্রশ্নই তো করতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছে প্রশ্নগুলো করতে। তবুও সে প্রশ্ন করল,
আপনারা ওই চারজনকে মে’রেছেন?
নাওশিনের প্রশ্নে মিফতা জল ভরা চোখে শুধুই হাসলো।
মিফতা নাওশিনের পাশে বসল। নাওশিন এবার বিছানার একবারে শেষ মাথায় চলে যায়। ভয়ে কাঁপছে সে। নাওশিনকে এভাবে ভয় পেতে দেখে মিফতা উঠে দাঁড়ায়। তার বুঝতে অসুবিধা হয় নি, তার বিছানায় বসার জন্যই মেয়েটা খুব ভয় পেয়েছে।
পারুল, এই পারুল এদিকে আসো।
মিফতার ডাক শুনে একটি মেয়ে রুমে ঢুকে। নাওশিন মেয়েটিকে সকালেই দেখেছে, এখন নাম জানতে পারল। পারুল, অনেক সুন্দর নাম।
হুম বলো।
মিফতা চোখের পানি মুছে বলল,
নাওশিনকে কাপড় দাও। ওর গোসল করা প্রয়োজন এখন।
মিফতা কথাটি বলে মুহূর্তেই রুম ত্যাগ করে।
নাওশিন দেখতে পায় পারুলের চোখেও পানি৷
নাওশিনকে খুব ভাবাচ্ছে। সে এখন একটি রহস্যে ভরা বাড়ির ভিতরে আছে। একের পর এক প্রশ্ন তার মনের ঘরে এসে জমা হচ্ছেই।
আপনার চোখে পানি কি জন্য?
নাওশিনের প্রশ্নে পারুল মাথা নাড়িয়ে বুঝাতে চাইলো তার চোখে পানি নেই। কিন্তু সে ঠিকই দেখেছে চোখের কোণে পানি জমে আছে পারুলের।
এই নাও কাপড়।
কাপড় হাতে নিয়ে এক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পারুল। সে নাওশিনকে এক অন্যরকম দৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে। এই দিকে যে নাওশিন কাপড় নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছে, সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই তার। নাওশিন হাতজোড়া থেকে কাপড়গুলো নিয়ে ‘আপা’ শব্দটি দুইবার উচ্চারণ করল। কিন্তু পারুল তাকিয়েই আছে।
পারুল নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নেয়৷
কষ্ট লুকিয়ে কীভাবে এতো স্বাভাবিক থাকো নাওশিন?
এমন প্রশ্নে আবারও অবাক হয় নাওশিন। একের পর এক অবাক হয়েই যাচ্ছে সে, তার সাথে এসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতেছে না সে। তবে নাওশিন এবার এই কথার উত্তর দিলো।
আপনি যেভাবে চোখের পানি আড়াল করে মাথা নাড়িয়ে চোখে পানি নেই বলে দাবি করতে পেরেছেন। অথচ আমি আপনার এই মায়াবী চোখে স্পর্শ পানি দেখতে পেয়েছিলাম।
আমিও না হয় লক্ষকোটি কষ্ট বুকে নিয়ে স্বাভাবিক থাকার নাটক করি একটু।
নাওশিন কথাগুলো বলে একটু সময় নীরব থাকে। আবারও নাওশিন বলতে শুরু করে,
একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন আপা?
পারুল ইশারায় ‘হ্যাঁ’ বলল।
আপনারা সবাই আমাকে কীভাবে চিনেন?
নাওশিনের এমন প্রশ্নে পারুল চুপ করে আছে। তার যেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই।
নাওশিন অপেক্ষা করে আবারও বলল,
বলুন!
পারুল শুধু বলল,
গোসলটা করে নাও।
কথাটি বলে পারুল রুম ত্যাক করে। নাওশিন এবার আর অবাক হয় নি। ঘর থেকে পালানোর পর থেকে তো অবাক হয়েই যাচ্ছে।
এই যে ওই রহস্যময় বাসা থেকে এই বাসায় এসেছে তারপর থেকে এখানের সবাইকে দেখে একটু একটু করে অবাক হচ্ছে সে। তার এখন অবাক হওয়ার একটি ছোট্ট আকাশ আছে, ওই আকাশে অবাক হওয়ার হাজারো তারার মেলা।
নাওশিন ক্লান্ত শরীর নিয়ে গোসল করার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে।
সাজেদা বেগমের সকালের ঘুম ভেঙেছিল স্বামী আনিছুর রহমান এর চিৎকার চেচামেচিতে। কারণ জানতে চাইলে আনিছুর রহমান চিৎকার করে বলেছিলেন,
তোমার মেয়ে নাওশিন পালিয়েছে।
স্বামীর মুখে এমন বাক্য শুনে আর স্বামীর এই কঠিন চেহারা দেখে দৌড়ে মেয়ের রুমে যান। হ্যাঁ নাওশিন সত্যিই পালিয়েছে।
বিছানার ঠিক মধ্য জায়গায় কাগজটি দেখে তা হাতে নেন।
মেয়ের ওমন কষ্টের অনুভূতি গুলো পড়ে একটুও মন খা’রাপ হয় নি। উলটো স্বামীর মতো চেহারায় কঠিন রূপ নিয়ে কেমন বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে উঠলেন,
দেখো লিখেছে,
‘তুমি থেকে আপনি বলার কষ্ট জানেন আম্মা?’
অথচ এর পরেই এই কাগজেই কতোবার তুমি বলে সম্বোধন করল আমায়।
পিছন থেকে ছোট্ট বায়েজিদ বলে উঠলো,
আম্মু তুমি কখনো কাউকে তুমি থেকে আপনি শব্দে ডেকেছিলে? প্রিয় কোনো মানুষকে আপনি ডাকতে চাওয়ার শতো চেষ্টা করা হয় মাত্র। তবুও তুমি শব্দটি চলে আসে বারবার।
আরো কিছু বলতে চেয়েছিল ১৩বছরের বায়েজিদ, কিন্তু আনিছুর রহমানের রাগী চেহারা দেখে ছেলেটি একবারে নীরব হয়ে যায়।
এই মেয়ে যদি মাটির নিচেও লুকাতে চায়, আমি সেখান থেকেও তাকে বের করবো। এতো সাহস কীভাবে হয় ওর? ওর শরীর টু’করো টু’করো না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নাই।
স্বামীর এমন গর্জে উঠা কণ্ঠে বলা কথার উপর সাজেদা বেগম বললেন,
শান্ত হও তুমি। বাহির থেকে দরজা বন্ধ হওয়ার পরেও কীভাবে ও পালাতে পারে, কে পালাতে সাহায্য করেছে নাওশিনকে?
ওরা যখন নাওশিন কীভাবে পালিয়েছে সেই সন্দেহের তীরটি বায়েজিদের দিকে নিতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সাজেদার ফোনে কল আসে। ফোনে কথা বলার পরেই তিনজন কোথায় যেন বের হয়ে যায়।
দুপুর ১২টা, নাওশিন কিছুই খাচ্ছে না। কেন জানি তার গলা দিয়ে আজ খাবার যাচ্ছে না। অথচ তার সামনে বাহারি রকমের খাবার ছিলো। তার ভিতর ঘরটি কান্না করছে। সে-তো পালিয়েছিল একটু ভালো ভাবে বাঁচতে, কিছু মানুষের শাস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে আসলো আজ।
সকাল ৯টায় ওরা বের হয়েছিল নাওশিনকে বাসায় রেখে।
মিফতা ছাড়া আর কাউকে এখনো আর দেখতে পায় নি সে। নাওশিন চোখ দু’টো বন্ধ করে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার শত চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ওই চারজনকে কে মে’রেছে? এরা সবাই কী ডা’কাতের দল? তাকেই বা কীভাবে চিনে?
এরকম হাজারো প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছিল নাওশিন, তখন পারুল এসে নাওশিনকে ডেকে যায়।
নাওশিন বিশাল ড্রয়িং রুমে এসে সবাইকে আবিষ্কার করল৷ সে যেন কিছু লালচোখের মানুষের ভীড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। সবার চোখ কেন লাল? নাওশিন এতো প্রশ্ন আর নিতে পারছে না।
তুমি ওই বাসায় কীভাবে গিয়েছিলে?
নিয়াজ নাবীলের এই প্রশ্নে নাওশিন চুপ থাকে। নিয়াজ সে ওই পাঁচজনের বাহিরের একজন। এই বাসায় এসে নাওশিন তাকে আবিষ্কার করেছিল।
নাওশিনকে চুপ থাকতে দেখে নিয়াজ চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,
কেন খু’ন করেছো ওই চারজন নিরীহ মানুষকে?
নাওশিন কেঁদে দেয়। তার ভিতর ফেটে যাচ্ছে। ১৬বছর বয়সে কি মানুষ খু’ন করা যায়? খু’নীর তকমা যদি এভাবেই লাগতে হতো, তাহলে সে নিজের আপন মানুষদের খু’ন করতো।
নাওশিন ভাবনার সাগরে ভেসে যাচ্ছে। কেউ তাকে কিছু প্রশ্ন করেছে, সেই দিকে তার খেয়াল নেই।
নাওশিন,,,,
নিয়াজ আবারও চিৎকার করল।
নাওশিন সবার দিকে তাকিয়ে আছে। নাওশিন বুঝে নিয়েছে, তাকে চুপ থাকলে চলবে না। তাই বলতে শুরু করে।
ভাইয়া, ১৬বছর বয়সে কেউ কাউকে কখনো মা’রতে পারে না। আমি কাউকে খু’ন করিনি। আমি তো একটু আশ্রয় চেয়েছিলাম। দরজা খোলা দেখেই প্রবেশ করেছিলাম। ভাইয়া আমি দুই বছর ধরে চার দেয়ালে বন্দী হয়ে ছিলাম। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমি কীভাবে মানুষ খু’ন করবো? আমি একটু ভালো ভেবে বেঁচে থাকার জন্য পালিয়েছিলাম। আমি একটু স্বাভাবিক জীবনে বাঁচতে চাই ভাইয়া। অ’ত্যাচারের ভারে আমি আজ খুবই ক্লান্ত।
নাওশিন কান্না করছে, দুই চোখে তার নাম না জানা দুটো ঝর্ণা। সমান ধারায় পানি পরে যাচ্ছে তার। সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
একটু ভালো ভাবেই তো বাঁচতে চেয়েছি আমি। মশার র’ক্ত দেখলেই আমি ভয় পাই ভাইয়া, আমি কীভাবে মানুষ খু’ন করবো। আমি আমার মা বাবার আদরের কন্যা ছিলাম। শরীরে মশা যখন র’ক্ত খেয়ে খুব বড় হয়ে যেত, সে মশাকে না মে’রে তাড়িয়ে দিতাম। কারণ আমি র’ক্ত ভয় পাই। বিশ্বাস করুন আমায়।
নিয়াজ এবার নিজের কণ্ঠ শান্ত করল। চোখে আসা পানি মুছে নাওশিনের দিকে একটি পত্রিকা এগিয়ে দিতে চেয়েছিল মাত্র৷ কিন্তু নাওশিন আবারও বলতে শুরু করে,
আমি কাল রাত থেকে ভেবেই যাচ্ছি। আপনারা ওই চারজনকে মে’রেছেন। আপনারা যখন আমাকে আপনাদের সাথে আসতে বলেছিলেন, তখন গাড়িতে সারাটা সময় আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলাম। তাকালেই যদি আপনারা আমায় মে’রে ফেলেন। তবুও সাহস করে আমি এসেছি। আমি এক সাহসী বাবার সন্তান ছিলাম। বন্দী জীবন আমাকে ভীতু করে দিলেও আমি এখনো সাহসী। ১৬বছরের মেয়ে হলেও আমি নিজেকে ৮০বছরের বয়স্ক নারীর সাথে নিজের তুলনা করতে পারি, কারণ এতো কষ্ট ৮০বছরের মহিলারাও তাদের জীবনে পায় না। আপনারা আমাকে চিনেন, জানিনা কীভাবে চিনেন। এইজন্যই আমি সব প্রশ্ন এক পাশে রেখে আপনাদের সাথে এসেছিলাম। খু’নী তকমা না লাগিয়ে আমাকে মে’রে ফেলুন। এখন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাও হারিয়ে ফেলেছি আমি।
সবাই চুপ হয়ে আছে। নীরব দর্শকের মতো শুনেই যাচ্ছে। সবার চোখেই পানি। কেউ কোনো কথা বলছে না।
নাওশিন ছোট্ট করে দুইটি বাক্য বলল,
ওই পুরুষ আপনাদের কী হয়?
আমাকে এখানে রেখে আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?
নাওশিন বুঝতে পেরেছে ওরা শুধু নীরব দর্শকের ন্যায় শুনেই যাবে। তাই নিজের বুকে জমে থাকা কথাগুলো চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল।
আদিব মাহমুদ এবার নাওশিনের প্রশ্নের উত্তরগুলো দেওয়ার জন্য মুখ খুললো।
ওই পুরুষটি আমাদের বাবা। উনি আমাদের ৭ভাইয়ের পিতা। আমাদের আকাশ। উনি আমাদের মাথার উপরে থাকা বিশাল আকাশ ছিলেন।
কথাটি বলে আদিব নিজের চোখে আসা পানি মুছতে থাকে পরনের সাদা পাঞ্জাবি দিয়ে। পাঞ্জাবিতে এখনো লাল র’ক্ত লেগে আছে। এই র’ক্ত তাদের বাবার। যাকে একটু পূর্বে পুলিশ নিয়ে গিয়েছে।
যেই মানুষটি গাছের ছায়া ছিলো, আজ সেই মানুষটি এই পৃথিবীতে নেই। পুরুষ জাতিকে নাকি চিৎকার করে কান্না করতে মানা। কিন্তু তার খুব ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে।
বাবা শব্দটি শুনে নাওশিন তাকিয়ে আছে ওদের দিকে, সবার চোখের বাঁধ যেন ভেঙে গিয়েছে। নাওশিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সে একজন দর্শক, শুধুই দর্শক।
কে মে’রেছে উনাদের?
নাওশিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্নটি করল,
নিয়াজ নিজের হাতে থাকা পত্রিকাটি নাওশিনের দিকে এগিয়ে দেয়।
নাওশিন পত্রিকাটি হাতে নিয়ে সেটি পড়তে শুরু করে৷ তার শরীরটি জমে যাওয়া শীতল বরফের ন্যায় হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। হাত দুটো বৃদ্ধদের হাতের ন্যায় কাঁপছে। এমন কিছু সে কল্পনা করেনি কখনো৷ হাত থেকে পত্রিকাটি পড়ে যায়।
দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছে নাওশিন। ঠোঁট কামড়িয়ে বা মুখ চেপে কান্না করতে পারলো না সে। চিৎকার করে কেঁদে দেয় নাওশিন। মুখ দিয়ে শুধু একটি কথাই বের হয়।
আমাকে ওই বাসায় নিয়ে যাও। আমি শেষ দেখাটা দেখবো। আমি খু’ন করিনি, আমাকে নিয়ে যাও ওই বাসায়। আমি শেষবারের মতো দে,,
মাটিতে লুটে পড়ে নাওশিন। সাথে সাথেই জ্ঞান হারায় সে।
নাওশিনকে পারুল এবং মিনহা দুজন ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। নাওশিনকে ডাকলেও আর চোখ মেলে তাকায় নি। বন্ধ চোখের কোণে এখনো পানি জমে আছে। পানির ছিটা দিলেও নাওশিন চোখ মেলে তাকায় নি। সবাই নাওশিন বলে চিৎকার করলেও সেই ডাক তার কানে পৌঁছায় নি।
সাইফ নিশ্চিত হয়, হ্যাঁ নাওশিন হারিয়েছে। সাইফ একজন ডক্টর৷
সে সবাইকে শান্ত হতে বলে, একটু পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
নিয়াজ, আদিব, মিফতা, সামিন, রবিন এবং জাহেদ ছয় ছয়টা ভাই রুমের বাহিরে সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এক দিকে প্রিয় মানুষটিকে হারানো, অন্যদিকে এই নাওশিনের এই অবস্থা৷ তাদের ভালো থাকাটা যেন কেড়ে নিয়েছে। আজ তাদের কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে এইসব মুহূর্ত গুলো। ওরা কী শুধুই চোখের পানি ফেলবে?
সাত ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আদিব। কষ্ট তো তার বেশি হচ্ছে। সব কিছু ভুলে তো ভালোভাবেই বাঁচতে চেয়েছিল।
নাওশিনের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়।
নিয়াজ এবং সাইফ ছাড়া অন্যরা বিবাহিত। এই বিশাল পরিবারে এখন সুখের ছায়া। মাথার উপরের আকাশটি ভেঙে পরেছে তাদের।
কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। নাওশিন কি করছিল সেখানে?
বেশ কিছুক্ষণের পর নাওশিনের জ্ঞান ফিরে।
সাইফ নাওশিনকে ঘুমের ওষুধ জোর করে খাইয়ে দিয়েছে।
এমনিতেই খুব দূর্বল নাওশিন। এতো চাপ নেওয়ার শক্তি নেই নাওশিনের। এমন ওমন কিছু হলে নাওশিনকে বাঁচানো যাবে না।
রাত ৯টা,
নাওশিনের ঘুম ভেঙেছে। আদিবের স্ত্রী মিনহা বসে আছে তার পাশে। মিনহা নাওশিনকে মন ভরে দেখছিল। এই বয়সে মেয়েটা কতোটা কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। নাওশিনকে চোখ খুলতে দেখে জিজ্ঞেস করে মিনহা। কেমন লাগছে এখন?
কিন্তু নাওশিন নীরব হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।
এক এক করে সবাই রুমের ভিতর ঢুকে।
আদিব এসে নাওশিনের মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন লাগছে এখন।
কিন্তু নাওশিন কেঁদেই যাচ্ছে।
নাওশিন চোখের পানি মুছে নিজ থেকেই বলতে শুরু করে।
সবাই বিশ্বাস করুন, আমি আমার মামাকে খু’ন করিনি। আমি তো আমার মামাকে ভীষণ ভালোবাসি। কীভাবে পারবো প্রিয় মানুষকে খুন করতে। আমি তো আজ মাত্র পালিয়েছি। আমি মামার বাসাতেও যাই নি। বিশ্বাস করুন সবাই আমাকে। আমার মা আমাকে না পেয়ে আমার উপর মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন। এই পত্রিকায় যা লেখা আছে সব মিথ্যা। আমাকে তো ওই বাসায় পেয়েছিলেন আপনারা। তাহলে কীভাবে আমি খু’ন করবো?
সাইফ বুঝতে পেরেছে, জ্ঞান হারানোর পূর্বে সে পত্রিকায় যা পড়েছিল। তার আংশিক কিছু মনে আছে।
ইশারা করে সবাইকে চুপ থাকতে। কিন্তু জাহেদ বলে উঠলো,
নাওশিন কাল রাতে তুমি ওই ফ্লোরে থাকা পুরুষটিকে ভালোভাবে দেখোনি। ওই পুরুষই তোমার মামা, খালেদ আহমেদ। কাল আমরা অবাক হয়েছিলাম তুমি চিনতে পারোনি আমাদের বাবাকে।
তোমার মামাকে খু’ন তুমি করেছো সেটা তোমার মা বলেছে। তোমার মামি সহ তোমার পিচ্চি দুই মামাতো বোনকে তুমিই খু’ন করেছো। এই কথাগুলো তোমার মা পুলিশকে বলেছে।
জাহেদের কথাগুলো শুনে সাইফ আল্লাহকে ডাকছে। নাওশিন যেন সহ্য করতে পারে। এটাই বারবার মনে মনে বলে যাচ্ছে।
নাওশিন কথাগুলো শুনে মুখ তুলে জাহেদের দিকে তাকায়। পত্রিকায় কি লেখা ছিল, সেটা মুহূর্তে মনে হয়ে যায়।
আমি আমার মামার কাছে যাবো। একটাবারের জন্য আমি আমার মামাকে দেখবো। বিশ্বাস করুন আমার মামাকে আমি খু’ন করিনি।
নাওশিন কথা বলেই যাচ্ছে।
আমি আমার মামার লা’শ সামনে রেখেও চিনতে পারিনি। কতোটা অভাগা আমি। আমাকে আমার মামার কাছে নিয়ে যান৷ আমি এখন কার কাছে যাবো?
সাইফ সবাইকে রুম ত্যাগ করতে বলে। এখানে সবাই থাকলে খা’রাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।
ও একা থাকুক, কান্না করুক। মন হালকা হবে।
সবাই রুম ত্যাগ করে।
নাওশিন কান্না করছে। তার ভাগ্যটা এমন কেন?
এখান থেকে তাকে পালাতে হবে। নয়তো এরা পুলিশে দিয়ে দিবে তাকে।
জন্মদাত্রী মা হয়ে কীভাবে এতো বড় অপবাদ দিতে পারলো ওই মহিলা।
নাওশিন আস্তে করে বলল, আম্মা ডাকতেও ঘৃ’ণা লাগছে এখন।
কেঁদে যাচ্ছে একা একা। কষ্টের সমাপ্তি বুঝেছিল, কিন্তু তা এখন দিগুণ।
আপনার স্বামীর কাছে আমি নিরাপদ না আম্মা।
কথাটি বলার পর সেদিন থাপ্পড় খেয়েছিল নাওশিন আনবার। তখন তার বয়স ১১বছর ছিলো। আজ সে ১৬বছরের সুন্দরে মুড়ানো এক চাঁদ।
সত্যিই সে নিজের মায়ের স্বামীর কাছে একটুও নিরাপদ ছিলো না। ১১বছর বয়সে যখন তার নরম গালে থাপ্পড় পরেছিল এই কথাটি বলার কারণে। সেদিনই সে বুঝতে পেরেছিল, উত্তাপ মরুতে ফোটা কোনো অজানা নামের ফুল সে। ঘ্রাণ, সৌন্দর্য সবই আছে, কিন্তু ফুলের নামটি কেউ জানে না। কিন্তু তার যে নাম আছে, নাওশিন আনবার।
সাদা পৃষ্ঠাতে আজ সে কিছু লিখবে, কিন্তু তার হাতে একটুও শক্তি নেই। তবুও কলম হাতে নিয়েছে সে।
চোখের পানির ফোটা সাদা কাগজে পরল আবারও শুকিয়ে যায় উপরে থাকা তিন পাকার বাতাসে। আজ তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আজ তার অন্তর পুড়ছে, একটু সুখের আশা তাকে আবারও বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। পোড়া অন্তরে, ক্লান্ত শরীরে একটু সুখ পেতে চায়। কিন্তু পাবে কী?
গায়ে থাকা ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো নাওশিন। কলম চালালো সাদা কাগজে, আজ কিছু অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটাবে সে। যে অধ্যায়গুলো শুধুই তার আকাশে জমে থাকা কালো মেঘ।
তুমি থেকে আপনি শব্দে যাওয়ার কষ্টটা কী আপনি বুঝেন আম্মা? উত্তর টা হয়তো আমার আর শোনা হবে না। উত্তরটি হয়তো ‘না’ আসবেই।
মনে আছে আম্মা! আমার তখন ১১বছর বয়স। জানতে চেয়েছিলে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে কেন ঘুমাতে যাই আমি। উত্তরে বলেছিলাম, আপনার স্বামীর কাছে আমি নিরাপদ না আম্মা।
আমার নরম গালে সেদিন আপনি খুব জোরেই থাপ্পড় মেরেছিলেন। সেই থাপ্পড় আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল এই পৃথিবীতে আমি খুব একা। ওই রাতের অন্ধকারে থাকা একক চাঁদের মতোই আমিও একা।
আপনি চাইলেই আমার কথাটির অর্থ খুঁজতে পারতেন আম্মা।
আমি কী আপনার গর্ভের সন্তান ছিলাম না? মা হয়ে কীভাবে সৎ মায়ের মতো ব্যবহার করতে পারতে?
আজ শুধু কিছু প্রশ্ন-ই করে যাবো আপনাকে। আমার আকাশের মেঘ সরে যখন সূর্যের দেখা পাবো, সেদিনই সব প্রশ্নের উত্তর শুনবো আমি।
শেষ কবে আমাকে এক টুকরো মাছ খেতে দিয়েছিলে আম্মা, বলতে পারবে? আমি কী আপনার গর্ভের সন্তান ছিলাম না?
সন্তানের সুখ তো মায়ের বুকে মাথা রাখা, আমাকে শেষ কবে নিজের বুকের সাথে মিশিয়েছিলে আম্মা?
আম্মা আপনি তিন বেলা পেট ভরে খাবার খেয়েছেন, বলতে পারো আম্মা আমাকে শেষ কবে ভাত খেতে দিয়েছিলে? আমি ভুলে গিয়েছি ভাতের সাথে তরকারির স্বাদ কেমন হয়।
ভেবেছিলাম আমার ১৬বছরের এই জীবনের সব প্রশ্ন আজ আপনাকে করবো, কিন্তু আমার হাতে শক্তি নেই আম্মা। চোখ দু’টো আজ বর্ষণ করছে খুব। বছরের পর বছর যদি আমাকে ভাত নামক খাবারটি না দেওয়া হয়, তাহলে আমার শক্তি থাকবে আম্মা? আমি জানি না আমি কীভাবে বেঁচে আছি। রুটি নামক শুকনো খাবার খেয়ে হয়তো আমার বেঁচে থাকার কথা না, তবুও আল্লাহ আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন৷
একটা সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতাম, আম্মা আমায় মে*রে ফেলো। কিন্তু আমাকে ক্ষুধার্ত রেখো না।
পৃথিবীতে সব থেকে কষ্ট কী জানেন আম্মা? সব থেকে কষ্ট হলো, ক্ষুধার্ত থাকা।
আম্মা আপনি লোভের সাগরে থাকা জাহাজের নাবিক হয়ে নিজের মেয়েকেই বছরের পর বছর কষ্ট দিয়েছো।
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি আজ। অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ হবে খুব তাড়াতাড়ি। সেদিন আপনার আর আপনার স্বামীর জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। আমি ফিরবো, আপনাদের খুঁজতে হবে না আমায়। আমাকে খুঁজলেও হয়তো আপনারা পাবেন না, তবে আমি খুব শক্তিশালী হয়েই ফিরবো৷
রাত ৩টা, কু’কুরের ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দই নাওশিনের কানে আসছে না।
সে পিছন ফিরে তাকাবে না, ল্যাম্পপোস্ট এর আলোয় ক্লান্ত শরীর নিয়ে খুব কষ্টে হেটে যাচ্ছে সে। দুই বছরের বন্দী জীবন থেকে আজ সে মুক্তি পেয়েছে। কখনো ভাবেনি নাওশিন, আজ সে পালাতে পারবে।
হাতে একটি কাপড়ের ব্যাগ, অতি সামান্য জিনিস-ই আছে ব্যাগে।
মনের ঘরে খুব ভয় কাজ করছে তার। এইতো মনে হচ্ছে তার, গভীর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেটে যাচ্ছে সে। কিন্তু তার মাথার উপর ল্যাম্পপোস্ট এর আলো জ্বলছে, একটু অন্ধকারের পর আবার আলোর দেখা পাচ্ছে সে। তবুও তার অনুভব হচ্ছে সে গভীর জঙ্গলে থাকা কোনো ক্ষুধার্ত বাঘের খাবার, তাকে পালাতেই হবে।
নাওশিন জানে না সে হাটতে হাটতে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। তবে সে বুঝতে পারছে আরো একটু পরেই ফজরের আজান দিবে।
একটি বাসার সামনে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাঁড়ায় নাওশিন। রাস্তায় চোখের সামনে যতো বাসা তার চোখে পরেছে, প্রতিটি বাসার গেইট ভিতর থেকেই বন্ধ ছিলো৷
কিন্তু নাওশিন এখন যে বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই বাসার গেইট সহ বাসার ভিতরে ঢোকার দরজাটাও খোলা।
নাওশিন একটু আশ্রয় খুঁজেছিল, আল্লাহ তাকে হয়তো তা পাইয়ে দিয়েছেন।
নাওশিন কোনো কিছু না ভেবেই খোলা বাসায় ঢুকে পরে।
বাসায় ঢুকেই তার মাথায় আর কোনো চিন্তাই আসেনি। শুধু একটি চিন্তাই পাহাড়ের পিছনে থাকা সাদা মেঘের মতো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, আর তা হলো রান্নাঘর কোন দিকে।
রান্নাঘরে ঢুকেই অল্প কিছু ভাত পেয়েছে নাওশিন। কিন্তু তরকারি খুঁজে পায়নি রান্নাঘরে। আর কোনো কিছু না ভেবেই ভাতে পানি দিয়ে খেতে শুরু করে সে। ভাত প্রথমবার মুখে দিতেই বমি চলে আসে তার, খুব কষ্টে নিজেকে ঠিক রাখে। একটু মনে করার চেষ্টা করল নাওশিন, হ্যাঁ নিজের ১২বছর বয়সে শেষ বার ভাত খেয়েছিল সে।
ভাতের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি টপটপ করে ফেলে যাচ্ছে নাওশিন। মনের ঘরে প্রশ্ন এসে বাসা বেঁধেছে, ভাতের সাথে কী তরকারির স্বাদ পাবে না সে?
তার ভাত আর তরকারির সাথে সাক্ষাৎ নেই অনেক বছর হলো৷ তাই তো আজ সাদা ভাত মুখে নিতেই বমি চলে আসে।
তার কাছে আজ এই সাদা ভাত পৃথিবীর সব থেকে সুস্বাদু খাবার মনে হচ্ছে।
কথায় আছে না,
‘ক্ষুধার্ত পেটে কেউ বিষ খেলেও মৃ*ত্যু না হওয়া পর্যন্ত সেই বিষও মধুর মতো লাগে।’
ছোটবেলা নাওশিন নিজের মামাকে একবার প্রশ্ন করেছিল, আচ্ছা মামা পথশিশুদের ওই পঁচা খাবার খেতে ঘৃণা লাগে না কেন?
মামা খালেদ আহমেদ হেসে বলছিলেন সেদিন, মা’রে ওরা হলো ক্ষুধার্ত শিশু। ওদের যদি প্রশ্ন করিস, এই খাবার কী সুস্বাদু? ওরা চোখে ভরা জল নিয়ে বলবে, হ্যাঁ খুব মজা।
নাওশিন আর ভাত খেতে পারলো না। ভাত কয়েকবার মুখে দেওয়ার পর তার মনে হচ্ছে এখনই ভিতর থেকে সব বমির মাধ্যমে বের হয়ে আসবে। ভাতের প্লেট হাত থেকে রাখে নাওশিন। অল্প একটু পানি খায়। অনুভব করতে পারল নাওশিন, শরীরে একটু শক্তি পাচ্ছে এখন।
নাওশিনের মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করে। মনের ঘরে প্রশ্ন এসে উঁকি দিলো৷ সে কার বাসায় ঢুকেছে? এতো রাতে কীভাবে কোনো বাসার গেইট, দরজা খোলা থাকে?
তার ভাবনার ঘরে এই প্রশ্নগুলো এতক্ষণ আসেনি, কারণ সে ক্ষুধার্ত ছিলো।
আরে ক্ষুধার্ত বাঘ শিকারে বের হয়, কিন্তু ভরা পেটে থাকা বাঘটি কখনো শিকারের জন্য ছোটাছুটি করে না। সে তো ক্ষুধার্ত থেকেই খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ভরা পেটে এসেছে।
নাওশিন আস্তে আস্তে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে একটি রুমে আসে। পায়ের নিচে পানি অনুভব করে সে। চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নাওশিন শুধু চিৎকার দেয়, তার চিৎকার বাসার বাহিরে বের হয় নি। তার কণ্ঠস্বর বরফের মতো জমেছে তো অনেক পূর্বেই।
র*ক্তে লাল হয়ে আছে ফ্লোর। নাওশিন আর দ্বিতীয় বার নিচের দিকে তাকাতে পারেনি। তার আর বুঝতে বাকি নেই, এই বাসায় নিশ্চয়ই খারা*প কিছু ঘটেছে। তাইতো এতো রাতেও এই বাসার দরজা খোলা। নাওশিন ভয়ার্ত শরীর নিয়ে এক পা এক পা করে সামনে এগুতেই খুব ভয় পেয়ে যায়। তার শরীর কাঁপছে। শরীর ঘেমেছে মূহুর্তেই। সামনের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে।
কারণ তার সামনে র’ক্তাক্ত ক্ষ’তবিক্ষত একজন পুরুষ ফ্লোরে পড়ে আছে। তার আর বুঝতে বাকি নেই পুরুষটি যে আর বেঁচে নেই।
নাওশিন থরথর করে কাঁপছে। এমন কিছুর সাথে সাক্ষাৎ হবে জানলে সে এই বাসায় প্রবেশ করত না। কিন্তু মানুষ যে ভবিষ্যৎ জানে না।
নাওশিন নিজের বুকে একটু সাহস নিয়ে আরেকটু সামনের দিকে যায়। পুরুষটির দিকে ভালো ভাবে তাকানোর পূর্বেই বাসার দরজা দিয়ে এক এক করে পাঁচজন পুরুষ ঢুকে৷ নাওশিন এবার একটু বেশিই ভয় পেয়ে যায়। এরা কারা? এরাই কী ফ্লোরে থাকা পুরুষটিকে মে’রেছে?
তাহলে কী তার আর এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হবে না? কিন্তু সে-তো বাঁচতে চায়, এই বেঁচে থাকার জন্যই বন্দী চার দেয়াল থেকে পালিয়েছে।
কিন্তু আমি তো কোনো অপরাধ করিনি৷ হ্যাঁ একটি অপরাধ করেছি, আর সেটা হলো এই বাসায় প্রবেশ করেছি।
ভাবনার শহরে কথাগুলো উঁকি দিতেই ভীষণভাবে ভয় পেয়ে যায় নাওশিন। সে অপেক্ষা করছে ওদের মুখোমুখি হওয়ার।
নাওশিন দেখলো ফ্লোরে থাকা পুরুষকে দেখে ওরাও খুব অবাক হয়েছে। ওদের মধ্য থেকে একজন নাওশিনকে দেখেই হাতে থাকা লা’ঠি সামনের দিকে এনে কঠিন গলায় প্রশ্ন করল,
কে তুমি?
মানুষটির প্রশ্নে বাকি চারজন সামনের দিকে তাকায়।
এইদিকে নাওশিন সব কিছু অন্ধকার দেখছে। আজকের এই দৃশ্য থেকে তার বন্দী জীবন ভালো ছিলো৷ নিজের মনের সাথে নিজেই কথা বলে যাচ্ছে।
নাওশিনের সামনে ওই পাঁচজন পুরুষ এসে দাঁড়ায়। নাওশিন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে, আর কাঁপছে খুব।
এই মেয়েকে তো আমি চিনি। তুমি এখানে?
বাক্যটি শুনে নাওশিন কেঁপে উঠে। ওদের মধ্যে কেউ থাকে চিনে! নাওশিন মাথা তুলে তাকায়। না-তো সে এদের কাউকে চিনে না। কয়েক সেকেন্ডের দৃষ্টিতে বুঝতে পারে, এই পাঁচজন টগবগে যুবক কীংবা ত্রিশ এর কাছাকাছি বয়স ওদের।
নাওশিন নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে চেয়েও পারলো না। এতোটা কাঁপছে যে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
তুমি নাওশিন আনবার?
এই প্রশ্নে এবার একটু বেশিই অবাক হয় নাওশিন। ওরা নাম জানলো কীভাবে? কে ওরা?
নাওশিনের মনে হাজারো প্রশ্নের ঢেউ উঠেছে, কিন্তু মনের মধ্যে উঠা ঢেউ মুখে নিয়ে আসতে পারছে না।
এ যেনো সাগরের বুকে থাকা বিশাল ঢেউ যা এসে সাগর পাড় ভিজিয়ে দিতে পারছে না।
নাওশিন চুপ। সে কোনো কথা বলছে না। কী বলবে, সে খুঁজে পাচ্ছে না। বন্দী দেয়ালের অ’ত্যাচার আজ তার কাছে তুচ্ছ মনে হচ্ছে এই আজকের দিনের কাছে। হাজারো চেষ্টা করেও নিজের বুকে সাহস জমাতে পারছে না। কিন্তু সে-তো কখনো এতো ভীতু ছিলো না। তাহলে কী এই বন্দী জীবন থাকে ভীতু করে দিয়েছে?
পুরুষটি আবার প্রশ্ন করল,
তুমি এখানে কী ভাবে এসেছো? কথা বলছো না কেন নাওশিন?
নাওশিন আবারও পুরুষটির দিকে তাকায়। তার দিকে পাঁচ পাঁচটি মুখ তাকিয়ে আছে। পাঁচজনের চোখেই পানি টলমল করছে৷ এই তো মনে হচ্ছে আকাশ গর্জন করার পর যেমন ঝুম বৃষ্টি আসে। ঠিক ওদের চোখের পানিও চোখ ফেটে বের হওয়ার অপেক্ষায়।
কিন্তু ওদের চোখে পানি কেন?
নাওশিন কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না। তার মনে হাজারো প্রশ্ন এসে জমেছে।
পুরুষটি আবারও বলল,
সাইফ উপরে গিয়ে দেখ তো ওরা বেঁচে আছে কী?
নাওশিন অবাক হলো, উপরে কী তাহলে আরো মানুষ আছে?
নাওশিন ঠিক শুনতে পেয়েছে, কথাটি বলার সময় পুরুষটির কণ্ঠস্বর ভেঙে আসছিল।
এভাবে চুপ থেকো না নাওশিন। আমরা তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি জা,,,
পুরুষটি থেমে যায়, কিছু বলতে চেয়েও থেমে যায় সে। নাওশিন মাথা তুলে তাকায় আবার। কী বলতে চেয়েছিল এই মানুষটি?
এই পাঁচজনের মধ্যে কী এতো রহস্য? আর এই বাসাতে ঠিক কী হয়েছে? এরা কী ডা’কাতের দল? আসলে এরা কারা?
হাজারো প্রশ্নের উঁকিঝুঁকিতে নাওশিনের মুখ আজ বন্ধ। কোনো কথা বলার শক্তি নেই তার।
ভাইয়া উপরে আন্টি, পিচ্চি দু’টো কেও খু’ন করা হয়েছে। এতো খা’রাপ ভাবে মেরেছে যে আমি তৃতীয় বার আর তাকানোর সাহস পাই নি।
সাইফের কথা শুনে বাকি চারজনের মধ্য থেকে একজন চোখের পানি মুছে শুধু বলল,
আমরা একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছি আসতে।
নাওশিন দর্শকের ন্যায় শুধু কথা শুনে যাচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটু পূর্বেও এদের কতো কী ভেবেছিল সে, কিন্তু এরা মাত্রই এসেছে। তাহলে চার চারটা মানুষকে কে মে’রেছে?
নাওশিনের দিকে তাকিয়ে একজন বলে উঠলো,
মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে নে। ফজরের আজান এর সময় হয়েছে, এখনই হয়তো আজান দিবে।
কথাটি শুনে নাওশিন এবার নড়েচড়ে বসল,
আয়ায়ায়ায়ামাকে কোথায়ায়ায় নিবেন আপনারা?
খুব কষ্টে প্রশ্নটি করে নাওশিন।
আমরা জানি তুমি এদের কাউকে খু’ন করো নি। কোনো কথা না বলে আমাদের সাথে চলো। ভয় পেয়ো না।
নাওশিন আঁতকে উঠল। ওরা তাকে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাতে যাচ্ছে এই খু’নগুলো সে করেছে। নাওশিন চোখ বন্ধ করে আছে, চোখ থেকে টপটপ করে পানি ফেলে যাচ্ছে। অ’ত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য তাকে আজ কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করালো।
তুমি এভাবে চুপ থাকলে, সকালের আলোয় সবাই তোমাকেই খু’নী বলবে নাওশিন। আমরা পুলিশকে চাইলেই খবর দিতে পারি, কিন্তু এই দেশের আইন,,, থাক এসব। আমরা জানি তুমি কে, কী তোমার পরিচয়। নির্ভয়ে চলতে পারো আমাদের সাথে।
নাওশিন যেন দোটানায় পড়ে যায়৷ সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কী করবে সে? তাকে কীভাবে চিনে এরা? তাহলে এরা কী তার মা বা তার মায়ের স্বামীর পরিচিত কেউ?
এই চারজনকে কী এরাই মে’রেছে?
নাওশিন সব প্রশ্নকে এক পাশে রেখে ছোট্ট একটি প্রশ্ন নিজের মন কে করল,
আমি তো খু’নগুলো হতেও দেখিনি। কিন্তু এই মানুষদের দেখেছি। তাহলে কী এই মানুষগুলো আমাকে ওই চারজনের মতো কোথাও নিয়ে?
নাওশিন মাথা চেপে ধরলো। তাকে পালাতে হবে।
নাওশিন ছোট্ট করে শুধু বলল,
চলুন।
এতো আনন্দ মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো যখন স্মৃতি ছুটে এলো, উৎকুন্ঠিত হয়ে বললো,
“ধারা, আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে”
স্মৃতির কথাটা শুনতেই ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো ধারার। এক অজানা ভয়ে বুকে কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। কথাগুলো দলা পাকাচ্ছে। তবুও খুব কষ্টে বললো,
“কেনো? হাসপাতালে কেনো?”
“অনলদের একটা ছোট এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। প্লাবণ মাত্র ফোন দিয়ে জানালো। আমি ওখানে যাচ্ছি। তুমি যাবে?”
কথাটা মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে সময় নিলো ধারার। সে কিছুসময় ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলো। বুকের ভেতরটা মূহুর্তেই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। এমনটা তো হবার ছিলো না। আজকের দিনটি তার জীবনের সবচেয়ে সুখময় দিন ছিলো। প্রকৃতি কি তবে তার জীবনে সুখটি লিখেন নি? একটি বই এ পড়েছিলো, “পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ সম্ভবত কষ্ট পাবার জন্যই জন্মায়। টাকা পয়সার কষ্ট নয়, মানসিক কষ্ট”—- ধারার সাথেও কি তাই হবে? তার প্রণয় প্রহেলিকা কি প্রহেলিকা হয়েই রইবে? ভাবতেই অবাধ্য ঝড় হানা দিলো হৃদয়ের অন্তস্থলে, তার চোখে জমলো কিছু বিষন্নতা। স্মৃতি ধারাকে হালকা করে ধা’ক্কা দিলো। নরম কন্ঠে বললো,
“তুমি কি যাবে?”
ধারা কিছু না বলে মাথা উপর নিচ দোলালো শুধু। কথাগুলো যেনো দলা পাকিয়ে গিয়েছে তার। অপরদিকে রাজ্জাক ধপ করে বসে পড়লো, সুভাসিনীর অশ্রু বাধ মানছে না। স্মৃতি কিছু বলতেও পারছে না, কারণ প্লাবণ তাকে শুধু হাসপাতালের নামটুকুই বলেছে আর কিছুই বলে নি। জামাল সাহেবকে দেখা গেলো সবচেয়ে স্থির। তিনি রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“ইলিয়াস তুমি ধারার সাথে যাও। রাজ্জাক এখানে থাকুক”
ইলিয়াস মাথা নাড়ালো। ধারা, স্মৃতি, বন্ধুমহল এবং ইলিয়াস রওনা দিলো হাসপাতালের পথে। পুরোটা রাস্তা থমথমে হয়ে ছিলো ধারা। শুধু শান্ত নজরে তাকিয়ে ছিলো পিচঢালা পথের জন্য। তার চোখের সামনে ভাসছে গতরাতের স্বর্ণালী মূহুর্তগুলো। বিয়ের জন্য কনে বরকে আলাদা ঘরে রাখার নিয়ম জারি করেছিলেন সুভাসিনী। যখন উৎসবে মুখর ঘরটি ঘুমন্ত তখন চুপিসারে মই এর সাহায্যে এসেছিলো অনল। কোনো মতে বারান্দায় উঠে ধীর কন্ঠে ডাকলো ধারাকে। অনলের কন্ঠ শুনেই চমকে উঠলো ধারা। আগে পাশে চোখ গেলো। জমজেরা ঘুমে কাঁদা। তারা ঘুম মানে একদিকে শান্তি। নয়তো সারাঘরে মাইক দিয়ে জানিয়ে দিতো। ধারা চুপিসারে পা টিপে এগিয়ে গেলো বারান্দায়। অনল রেলিং পেরিয়ে প্রবেশ করলো, ধারাকে দেখতেই মুখে ফুটে উঠলো মুগ্ধ হাসি। ধারা অবাক কন্ঠে বললো,
“এতো রাতে আসলে যে?”
“কি করবো, তোর শ্বাশুড়ী যে প্যারাটা দিচ্ছে। বর বউ কিনা আলাদা থাকবে মানা যায়?”
অনলের অভিযোগে খিলখিল করে হেসে উঠলো ধারা। তারপর বললো,
“বিয়ে করার জিদ তো তোমার ছিলো? ভুগো”
“বি’চ্ছুগুলো ঘুম?”
“হ্যা, তুমি মই পেলে কিভাবে?”
“আমার টিম আছে না?”
ধারা উঁকি দিতেই দেখলো প্লাবণ এবং রবিন দাঁড়িয়ে আছে। ধারা এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো। বন্ধু হবার পুরো ফয়দা তুলছে অনল। নয়তো রাত তিনটে তে এভাবে পাহারা দিতে দাঁড় করায়। অনল ধারার দিকে অপলক চাহনীতে তাকিয়ে আছে। পূর্ণচন্দ্রিমায় নিজের চন্দ্রিমাকে দেখতে এক অসামান্য শান্তি অনুভূত হচ্ছে। অনল ধীর কন্ঠে বললো,
“আমার ঘুম হচ্ছে না ধারা, কি করা উচিত?”
“কেনো ঘুম হচ্ছে না কেনো?”
“বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে, তুই ছাড়া যেনো সব শুন্য”
“আর একটা রাত, তারপর আর শুন্য লাগবে না”
“আজ পৃথিবীর জন্য জ্যোৎস্না রাত, আমার জ্যোৎস্নাবিলাসটা নাহয় তুলে রাখলাম আগামীকালের জন্য। আমার প্রণয়িনীর সাথেই না হয় জ্যোৎস্নাটা দেখবো”
বলেই ধারার কপালে উষ্ণছোঁয়া দেয় অনল। ধারা অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিতে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে হলদে পাঞ্জাবীতে প্রিন্স উইলিয়াম কে। জ্যোৎস্নায় যেনো তার সৌন্দর্য্য একটু বেশি মনোমুগ্ধকর লাগছে। ধারা বেহায়ার মতো কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। তার চোখে চোখ রেখে মৃদু কন্ঠে আওড়ালো,
“তুমি প্রণয়ে বাধিবে
নাকি প্রহেলিকায় রাখবে?
আমি প্রণয়িনী তোমায় চাই
প্রহেলিকার দ্বার খোল
চলো হৃদয়ে হারাই” (জান্নাতুল মিতু)
ধারা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে। এরপর শাড়িটা তুলে ছুটে ভেতরে। ভেতরে যেতেই করিডোরে দেখা যায় প্লাবণ এবং রবিনকে। তাদের দেখতেই ধারা ব্যাগ্র কন্ঠে শুধায়,
“অনল ভাই কোথায়?”
প্লাবণ এবং রবিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ইকরাম তখন ঔষধ হাতে প্রবেশ করে। ধারার চোখ টলমলে হয়ে রয়েছে। প্লাবণ ধীর কন্ঠে বলে,
“সরি ধারা, তোমার এই সুন্দর দিনটা আমাদের জন্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে”
“হয়েছেটা কি বলবেন তো, সে কোথায়?”
“আসো আমাদের সাথে”
বলেই একটা রুমে নিয়ে যায় ধারাকে। সারাটা পথ তার হৃদস্পন্দন বাড়াই ছিলো। রুমে প্রবেশ করতেই ধারা হতবাক হয়ে গেলো। দীপ্ত, সেলিম সাহেব এবং তিশাও সেখানে উপস্থিত। আর শুভ্র বিছানায় অর্ধশায়িত অনল। অনলের বা পা টা বালিশের উপর রাখা। পায়ে্র পাতায় প্লাস্টার লাগানো। ধারাকে দেখতেই অনল অবাক কন্ঠে শুধালো,
“তুই এখানে কেনো?”
“প্লাবন ভাইয়া আনিয়েছেন”
অনল প্লাবণের দিকে চোখ পাঁকালো। প্লাবণ বললো,
“উপায় কি? তুই যে জিদ করেছিলি? সে কিছুতেই হাসপাতালে থাকবে না। এদিকে পায়ে প্লাস্টার লাগা”
“আমার বিয়ে কি এই হাসপাতালে থেকে হবে”
প্লাবণ এবং অনলের মাঝে বাধলো তর্কযুদ্ধ। ধারা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে একটা সময় বিরক্ত হয়ে বললো,
“হয়েছেটা কি একটু বলবে?”
“তোমার বর, অতিউৎসাহে পা ভেঙ্গে বসে আছে”
প্লাবণ পুরো ঘটনাটি বিশ্লেষণ করলো। সিড়ি থেকে নামার সময় বেখেয়ালীতে অনল খেয়াল করে নি সেখানে পানি ছিলো। সকালবেলায় বিনা নোটিশে বৃষ্টি হবার জন্য সিড়িতে হালকা পানি জমেছিলো। ফলে পানিতে পিছলা খেয়ে এক সিড়ি মিস করে ফেলে। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় সে। রবিন এবং ইকরাম তাড়াতাড়ি তাকে তুলে ধরে। কিন্তু বিপাক বাধে যখন দাঁড়াতে গেলে দেখে পা আর ফেলতে পারছে না। ফলে তারা কোনো মতে ধরে ধরে তাকে গাড়িতে তোলে। অনলকে গাড়িতে তোলার সময় দীপ্তদের সাথে দেখা হয়। ঘটনাক্রমে তারা তিনজনও যুক্ত হয়। সেন্টারের বদলে প্লাবণ গাড়ি নিয়ে আসে হাসপাতালে। ডাক্তার এক্স রে করে জানান তার পায়ের পাতা ফ্রাকচার হয়েছে। ফলে সেখান প্লাস্টার করে দিয়েছেন। কিন্তু অনল তো অনল; সে মোটেই হাসপাতালে থাকবে না। সে এখন তার বিয়েতেই যাবে। তাই বাধ্য হয়ে প্লাবণ স্মৃতিকে ফোন করে। শুধু বলে,
“ধারাকে নিয়ে আসো”
সেলিম সাহেব ও বোঝাবার চেষ্টা করেছে অনলকে, কিন্তু ফলাফল শুণ্য। দীপ্তও এটাও বলে,
“ভাঙ্গা পায়ে বিয়ে করবে? ছবিতে কেমন আসবে বলো? এর চেয়ে মাস খানেক পর বিয়েটা করো”
“আমি কি ছবি তোলার জন্য বিয়ে করছি? আমি আমার বউ কে বিয়ে করবো। আর আজ ই করবো”
অনলের যুক্তির সামনে যেনো সকলেই ব্যার্থ। ধারা হাসবে না কাঁদবে বুঝে পেলো না। প্রিন্স উইলিয়ামকে এই প্রথম এতো জেদীরুপে দেখলো সে। নির্বিকার চিত্তে, ভাবগুরুগম্ভীর মানুষটি আজ বাচ্চার মতো জেদ করছে, ভেবেই ভালো লাগছে তার। এই জিদটিও তো তার জন্য। ধারা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ডাক্তার কি রিলিজ দিয়েছে?”
“হ্যা, ডাক্তার বলেছে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো, তোমার বর ই বলছে সে কমিউনিটি সেন্টারে যাবে”
ধারা একটু থেমে বললো,
“আপনার একটু বাহিরে যান, আমি কথা বলে দেখছি”
ধারার কথায় কেউ বাধা দিলো না। সবাই বাহিরে চলে গেলো। ইলিয়াস জানিয়ে দিলো,
“আরে চিন্তা কইরো না। কিছু হয় নি, সিড়ি দিয়ে পড়ে পা ভাঙ্গছে। পায়ে পট্টি লাগছে। বেড রেস্ট দিছে”
সবাই চলে গেলে ধারা তার সামনে দাঁড়ায়। মাঝায় হাত দিয়ে বলে,
“জেদ করছো কেনো?”
“এখন তুই লেকচার দিবি না”
“আজব, তুমি এই অবস্থায় বিয়ে করবে?”
অনল একটু চুপ করে রইলো। তারপর কন্ঠ নরম করে বললো,
“আজকের দিনটার জন্য এতোদিন প্রতীক্ষা করেছি, প্লিজ ধারা বাধা দিস না। আর আমাদের জীবনে তো কখনোই কিছু স্বাভাবিক ছিলো না। বিয়েটাও না হয় একটু ভিন্নভাবেই হোক”
অনলের অদ্ভুত যুক্তির কাছে হার মানলো ধারা। অবশেষে ভাঙ্গা পায়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ হলো। ইলিয়াস তো বলেই উঠলো,
“এই না হলো, আমার ভাতিজা। একটু আকটু পা-টা ভাঙ্গলে কিছুই হয় না। বিয়েটাই আসল”
অনল বিয়েতে পৌছালো ভাঙ্গা পা নিয়ে হুইল চেয়ারে। বিয়েটাও হলো খুব সুন্দর ভাবে। এদিকে এশা আশাকে দেখালো উদাশ। অনল ভাইয়ের জুতো চু’রি করেও লাভ হলো না। কারণ অনল দাঁত বের করে বললো,
“ওই জুতো বেঁচে ঝালমুড়ি খাস”
ফলে জমজেরা অন্য বুদ্ধি বের করলো। কোন ফাঁকে তারা দীপ্ত, প্লাবণ, রবিন এবং ইকরামের জুতো চুরি করে নিলো। বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“অনল ভাই, তুমি না হুইল চেয়ারে চলে যাবে। তোমার বন্ধুরা কি করবে? তারা যদি খালি পায়ে যেতে চায় আমাদের আপত্তি নেই”
দীপ্ত পড়লো মহাবিপাকে। এই জুতোজোড়া বাদে নগ্ন পায়ে যেতে একেবারেই রাজী নয় সে। ফলে অনলকে অসহায় কন্ঠে বললো,
“অনল, ওরা যা চায় দিয়ে দাও। নয়তো এই বোনেরা আমাকে শান্তি দিবে না। ওদের ভরসা নেই”
অনল অতিসন্তপর্ণে তপ্ত নিঃশ্বাস গোপন করলো। এই ধানী লংকারা তার পকেট খসাবেই। চারজনের জুতো আটহাজারের মধ্যে ছাড়ালো। এর মাঝে মাহি দিগন্তকে আলাদা করে টেনে নিলো। দিগন্ত অবাক কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবি?”
“আমার বাসায় সম্মন্ধ দেখছে। আমি তিন বছর ঠেকিয়ে রাখতে পারবো। এরপর কি করবি তুই বুঝে নে”
কথাটা বুঝতে না পেরে সে অবাক কন্ঠে বললো,
“মানে কি?”
“বোঝা লাগবে না তোমার। তুমি মুড়ি খাও। রা’ম’ছা’গ’ল কোথাকার”
বলেই গজগজ করতে করতে চলে গেলো মাহি। দিগন্ত বললো,
“মাহি আমি সত্যি বুঝি নি, যাস নে”
আজ জামাল সাহেবকে দেখালো সব থেকে আনন্দিত। অবশেষে তিনি দায়িত্বমুক্ত। সেলিম সাহেব তার কাছে এলেন। ধীর কন্ঠে বললেন,
“কাকা, আমি রাতে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাচ্ছি। মেয়েটাকে দেখবেন”
জামাল সাহেব উত্তর দিলেন না। শুধু মৃদু হাসলেন। অভিমানের পাহাড়টা ভাঙ্গছে, একটু একটু করে। মানুষটাই তো নেই। এই মেকি অভিমান করে কি হবে!
নিগুঢ় রাত, পুর্ণ্যচন্দ্রিমা নয় আজ তবুও উজ্জ্বল রুপালী আলোতে ঝলমল করছে আধারের শহর। মৃদু বাতাসে উড়ছে ধারার খোলা চুল। অনলের টবের শিউলি ফুলের মৃদু গন্ধ মম করছে বারান্দা। অনলের ঘাড়ে মাথা রেখে আছে ধারা, তার স্থির চাহনী নীলাম্বরের দিকে। অনল আলতো হাতে তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। হঠাৎ কি মনে করে বললো,
“খুব ভয় পেয়েছিলি তাই না? তোর চোখের গলা কাজল ই সেটার প্রমাণ ছিলো”
“তোমাকে হারাবার ভয়টা এতোটা প্রখর হবে জানা ছিলো না, পুরোটা রাস্তা ভেতরে ঝড় চলছিলো। তোমাকে ছাড়া যে সবকিছু শুন্য লাগে, হাহাকার করে উঠে আমার পৃথিবীটা”
অনল হাসলো, মেয়েটির প্রণয় উপভোগ করতে শান্তি লাগছে। অবশেষে তাদের প্রণয় প্রহেলিকা পরিণয়ের রুপ নিয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবতেও প্রশান্তি লাগে, হাজার ঝড়ের মাঝেও সে একা নয়। এই রমনীটি থাকবে সারাটাজীবন, প্রতি মূহুর্ত, প্রতিক্ষণ। অনল নরম গলায় বললো,
“আমার তপ্ত মরুভূমির এক পশলা বৃষ্টি তুমি, আমার ঠিকানাই তো তুমি। তাই তো আজ জিদ ধরেছিলাম। তুমিহীনা আমার প্রণয় প্রহেলিকা যে অসম্পূর্ণ”
“ভালোবাসো?”
“অব্যাক্তভাবে ভালোবাসি”
ধারা আলতো করে হাসলো, পাছে গড়িয়ে পড়লো একবিন্দু অশ্রু। এই অশ্রু বিষাদের নয়, এই অশ্রু পূর্নতার। তাদের প্রণয়ের পূর্ণতার। ধারা ধরা গলায় বললো,
“একটা গান শূনাবে? আমার যে বহুদিনের স্বপ্ন”
অনল অমত করলো না, বা হাতে আগলে ধরলো ধারার কাঁধ। সুর তুললো জ্যোৎস্না্য লেপ্টে থাকা রজনীর মায়ায়,
“একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি
তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী
একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি
তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি
রচি মম ফাল্গুনী”
ধারা চোখ বুঝে রয়েছে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে শুনছে অনলের গান। গানটির মাঝে যেনো হাজারো আবদার, হাজারো অনুভূতি, হাজারো ভালোবাসা। মুগ্ধতার অপর নাম ই তো প্রিন্স উইলিয়াম। তাই তো বারে বারে বলতে ইচ্ছে করে, “আমি তোমার, শুধু তোমার প্রণয়িনী”
।।সমাপ্ত।।
(অবশেষে ইতি টানলাম, বহু প্রতীক্ষিত গল্পের। এই গল্পটি চলাকালীন বহু ভালোবাসা পেয়েছি। আশাকরি অন্তিম পর্বেও তেমন ভালোবাসা পাবো। গল্পটি কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না। ইনশাআল্লাহ ঈদে নতুন গল্প নিয়ে ফিরে আসবো। ততদিন ভালোবাসা রইলো)
বাসায় ফিরতেই সকলকে জড়ো করলো অনল। ধারাও বুঝে পেলো না কি হয়েছে। জামাল সাহেব, রাজ্জাক, ইলিয়াস রুবি, জমজদ্বয় বেশ অবাক। কৌতুহলের বশে সুভাসিনী বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে?”
“আমার সবাইকে কিছু বলার আছে। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি”
অনলের কথায় সকলেই বিস্মিত হলো। কৌতুহলী নজরে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অপরদিকে ধারার হৃদয়ে জমলো একরাশ ভয়। দীপ্ত যে কোম্পানির চাকরির কথাটা বলেছিলো সেটা কি তবে গ্রহণ করেছে অনল৷ হয়তো সেটাই বলার জন্য সকলকে জড়ো করেছে। বুকচিরে তপ্ত নিঃশ্বাস বের হলো ধারার৷ অহেতুক অভিমান সে করবে না, অনল যে সিদ্ধান্তই নেক না কেনো সে তার পাশে রইবে। কারণ সে অনলকে বিশ্বাস করে। জামাল সাহেব বেশ অধৈর্য্য হলেন। একেই তার শরীরটা আজকাল খুব একটা ভালো নেই, তারপর এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ এ তার অস্বস্তি বাড়ছে। সে হুংকার ছেড়ে বললেন,
“এতো ভনিতা না কইরে খোলশা করে কও কি কবা?”
“আমি ধারাকে বিয়ে করতে চাই”
অনলের কথায় আক্কেলগুড়ুম হবার উপক্রম। ধারার চোখজোড়াও বিস্ফারিত হবার যোগাড়। লোকটা বলে কি! রাজ্জাক সাহেব ভ্রু কুচকে অবাক কন্ঠে বললেন,
“বিয়ে করা বউকে আবার বিয়ে করবি?”
“হ্যা, আপত্তি আছে তোমাদের? থাকলে বলো। এজন্যই সবাইকে জড়ো করেছি”
অনলের কন্ঠে জড়তা নেই। সে মজাও করছে বলে মনে হচ্ছে না। তার ব্যক্তিত্বে অহেতুক মজাঠাট্টা করাটা নেই। থাকলেও সেটা পরিবারের কাছে গোপনীয়। পরিবারের কাছে সে এক কথার মানুষ। এশা এর মাঝে আশাকে খোঁচা দিলো, ফিসফিসিয়ে বললো,
“চেরাগআলীর ডোজে কি অনলভাই ঘাবড়ে গেছে?”
“লোকটার মনে হয় মাথামুথা আওলায়ে ফেলছে। অতিবুদ্ধিমানদের এমনটা হয়। আমি তো আগেই জানতাম ধারাপুর সাথে থাকতে থাকতে এমন হবেই”
অপরদিকে বড়দের সকলের মাঝে বেশ উত্তেজনা। ধারাকে আবার বিয়ে করার কথাটা তাদের উত্তেজনার কারণ নয় কারণটা হলো হঠাৎ এই প্রস্তাবের পেছনের উৎসটি। অনলের সকলের হতবাক মুখের দিকে একপলক চেয়ে গাল ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে জামাল সাহেবের হাতে দিলো। তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“তোমাদের মেয়েটি এখন সাবালিকা। আমি ওর বার্থ সার্টিফিকেট ঠিক করিয়েছি। শুধু তাই নয়। ওর আইডিকার্ড ও সপ্তাহ খানেকের মধ্যে চলে আসবে। সুতরাং এবার আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়েতে ঝামেলা নেই। আর বাকি রইলো আবার বিয়ের কথা। গতবার তোমরা আমার বিয়ে দিয়েছিলে তাও আমাদের অমতে। অনেকটা ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল করে। এবার বিয়েটা আমাদের সম্মতিতেই হোক। মানুষ জীবনে একবার ই বিয়ে করে। সেই দিনটা সোনালী ফ্রেমে বাধাই করে রাখে। কিন্তু তোমরা যেভাবে বিয়ে দিয়েছিলে, আমার মনে হয় না সেটা কালো ফ্রেমেও বাঁধানোর মতো। একটা ছবিও নেই। বাচ্চাকাচ্চা হলে তো দেখাতেও পারবো না। তাই আমি আবার আমার বউকেই বিয়ে করতে চাই। তাও ধুমধাম করে।”
অনলের কথাগুলো শুনে সকলের মুখে মিটিমিটি হাসি। তবে এতোদিনে ছেলের অন্তস্থলে প্রণয়ের ফুলটি ফুটলো। অন্যদিকে অনলের কথাগুলো শুনে লজ্জায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বড় বড় পা ফেলিয়ে রুমের দিকে হাটা দিলো। লোকটির কি সত্যি মুখে কিছুই বাঁধে না। মূহুর্তেই রক্তিম হয়ে উঠলো কোমল গালজোড়া। এতো লজ্জার মাঝেও এক প্রশান্তিতে হৃদয় ছেয়ে আছে। তার প্রিন্স উইলিয়াম তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। উপরন্তু সে আবার বধু বেশে সাজবে। সাজবে প্রিন্স উইলিয়ামের জন্য। কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে মনের ব্যালকনির একটুকরো কুসুম প্রভা ঠাঁয় নিলো। মুখখানা দুহাতে ডেকে নিলো ধারা। ইস! এতো লজ্জা আজ কেনো ভিড়লো! এর মাঝেই ঘরে প্রবেশ করে অনল। ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ধারার দিকে। শক্ত হাতের বেষ্টনীতে আকড়ে ধরলো ধারার কোমড়। থুতনী ঠেকালো ধারার কাঁধে। আলতো কন্ঠে বললো,
“ওখান থেকে চলে এলি যে!”
“দাঁড়িয়ে থেকে তোমার কথা শুনতাম! দেখা যেতো ওখানে বাচ্চাকাচ্চার বিয়ের প্লান ও করে ফেলতে”
“বউ বুঝি লজ্জা পেয়েছে! এখন ই লজ্জা পেলে হবে! এবার কিন্তু ঘরের বাহিরে রাত কাটাবো না আমি। তখন লজ্জা পেলেও আমি কিছু নির্লজ্জ হবো”
“ধ্যাত”
ধারা মুখ লুকালো অনলের বক্ষস্থলে। আড়ষ্টতা তাকে কাহিল করে তুলছে। অনল নিঃশব্দে হাসলো। হাতের বাধন করলো আরোও নিবিড়। ধারার কেশে বা হাতটা ডুবালো। আলতো করে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
“সকালে এই সার্টিফিকেট এর কাজেই গিয়েছিলাম। তাই তোকে ভার্সিটিতে দিতে পারি নি। রাগ করিস নি তো!”
“একেবারেই না। জানো যখন বলছিলে তুমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছো, আমি ভেবেছিলাম তুমি হয়তো অস্ট্রেলিয়ার চাকরিটার কথা বলবে”
“তুই জানতি কিভাবে? আমি তো তোকে এই কথাটা বলি নি”
অনলের কন্ঠে বিস্ময়। ধারা ধীর কন্ঠে বললো,
“দীপ্ত ভাই বললেন, আসলে এই চাকরিটা সেলিম আহমেদ ই দিয়েছিলো”
অনল কিছু সময় চুপ থাকলো, তারপর নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“ভাগ্যিস আমি অফারটা নেই নি। আরেকটু হলেই ফাঁদে পা দিতাম। ধন্যবাদ”
“কেনো?”
“আমার জীবনে আসার জন্য। আমাকে এতোটা আপন করে দেবার জন্য। আমার প্রণয়িনী হবার জন্য। গোটা তুইটা আমার হবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ”
ধারা আর কথা বললো না। শুধু চুপ লরে লেপ্টে রইলো অনলের বুকে। লোকটির হৃদস্পন্দন শুনতেও বেশ ভালো লাগে তার। যেনো কোনো মধুর ধ্বনি। এর মাঝেই অনলের ফোন বেজে উঠলো। মূহুর্তটিতে ছেদ পড়ায় একটু বিরক্ত হলো অনল। কিন্তু ফোনের নাম্বারটি দেখা মাত্র দেরি করলো না। অধীর কন্ঠে বললো,
“শিহাব ভাই, রেজাল্ট দিয়েছে”
“হ্যা, অনল। মাত্র বোর্ডে টাঙ্গালো। তোমার বউ তো ছক্কা পিটিয়েছে। এতো কঠিন প্রশ্নেও সে এ পেয়েছে। ভাবা যায়। আনসারী স্যারের মাথায় হাত। উনি কি করবেন বুঝছেন না। উপরন্তু যে মেয়েটি কমপ্লেইন করেছিলো সে এসে স্বীকারোক্তি দিয়েছে হিংসের বশে সে এই কাজ করেছে। হয়তো মেয়েটিকে বছরখানেকের জন্য রাস্টিকেট করবেন। আর তোমার বিষয়টা কাল আসলেই জানতে পারবে। আনসারী স্যারের মুখখানা দেখার মতো ছিলো অনল”
শিহাবের কথাটি শুনতেই প্রফুল্লচিত্তে অনল বললো,
“ধন্যবাদ ভাই, এতো ভালো একটা খবরের জন্য। রাখছি”
ফোন রেখে অনল ছুটে এলো ধারার কাছে। শিহাবের নাম শুনতেই ধারার বুক ধক করে উঠেছিলো। বিকালে রেজাল্ট প্রকাশের কথা। এতো কিছুর মাঝে সে ভুলেই গিয়েছিলো ব্যাপারটা। ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,
“আমি কি তোমার মান রাখতে পেরেছি?”
“আলবত! দেখতে হবে না বউটি কার। আমরা জিতে গেছি ধারা, তুই সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছিস তুই ও পারিস”
“তুমি খুশি তো?”
“ধুর পা’গ’লি! যেখানে তুই আমার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিস, আমি কি অখুশি হতে পারি। আজ আমার থেকে খুশি হয়তো কেউ নয়। আবারো ধন্যবাদ আমার জীবনে আসার জন্য। আমার প্রণয়টাকে এতো যতনে রাখার জন্য। ভালোবাসি, গোটা তুই টাকে ভালোবাসি”
ধারা টলমলে চোখে তাকিয়ে রইলো অনলের চোখের দিকে। নিদারুণ মাদকতা যেনো এই নয়নজোড়ায়। হৃদয়টা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। অনল উষ্ণ ঠোঁট ছোয়ালো ধারার অশ্রুসিক্ত চোখে। নরম কন্ঠে বললো,
“এই চোখজোড়া যে আমার বড্ড প্রিয়। তার এই অলংকারটুকু কিভাবে নষ্ট হতে দেই!”
*******
নিগূঢ় রাত, অনল গভীর ঘুমে। ধারা এখন নির্ঘুম জেগে আছে। মনে একটি বিশ্রী কৌতুহল জেগেছে। সেলিম সাহেবের চিঠি পড়ার এক দুর্বার ইচ্ছে তাকে ঘুমুতে দিচ্ছে। হৃদয় আর মস্তিষ্ক বারবার যেনো যুদ্ধ করছে। মস্তিষ্ক বারবার তাকে বাধা দিচ্ছে। অথচ হৃদয় বলছে ‘একটি বার পড়লে কি হবে?’ অবশেষে জয়ী হৃদয় হলো। ধারা চুপিসারে চিঠিগুলো নিয়ে বসলো। ল্যাম্পের আলোর নিচে রাখলো চিঠিগুলো। সময়ের ছাপ চিঠিগুলোতে স্পষ্ট। সাদা কাগজ হয়ে উঠেছে বেরঙ বল পেনের কালির বর্ণ হয়ে উঠেছে বিবর্ণ। গোটা গোটা করে লেখা। ধারা পড়তে লাগলো চিঠি গুলো।
প্রিয় সুরাইয়া,
আমার সালাম নিও। গত চিঠিতে জানতে চেয়েছিলে আমি কেমন আছি। আমি ভালো আছি। শুধু এখানে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে। কষ্টটি অবশ্য নিজের সৃষ্ট। আসলে কি বলতো! মানুষ না সুখ খুঁজতে ভালোবাসে। কিন্তু তারা অনুসন্ধানে এতোই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে যে সুখটা সামনে থাকলেও বুঝে না। আমার মতো অভাগা আর কি। এই দেখো না, সুখ খুঁজতে এখানে আসা। সুখী হতে রোকসানাকে বিয়ে করা। অথচ আমি পৃথিবীর সব থেকে অসুখী। আফসোস খুব বাজে জিনিস। কুড়ে কুড়ে খায় এই আফসোস। দেখো না, এখন আফসোস হয়। দেশে কি সুখে ছিলাম আমরা। এতো অর্থ ছিলো না। কিন্তু সুখে ছিলাম বলো। রোজ খেটে আসতাম, তুমি আমার অপেক্ষায় থাকতে। আমি তোমার জন্য বকুল ফুলের মালা নিয়ে আসতাম। তোমার হাতে দিতেই কি লজ্জা তোমার। অথচ অর্থ আমাকে এতোই অমানুষ করে দিলো যে সুখটাও চোখে ধরলো না। আসলে একটা ক্ষোভ ছিলো, বাবাকে মিথ্যে প্রমাণ করার ক্ষোভ। বাবার তোমাকে বেশ পছন্দ ছিলো জানো তো। তোমার জন্য গ্রাম থেকে সবথেকে বড় মাছটা সেই পাঠাতেন। আমার কাছে আদিক্ষেতা মনে হতো। আমার এখনো মনে আছে বিয়ের দিনও বাবা আমাকে থা’প্প’ড় দিয়েছিলেন আমি বিয়ে করতে চাচ্ছিলাম না বিধায়। এখন মনে হয় জানো আমার তো অ’জা’তের সাথে বিয়েটা না হলে হয়তো তুমি ভালো থাকতে। আমি হিরের মূল্য বুঝি নি সুরাইয়া। কাঁচের পেছনে ছুটেছি। আচ্ছা! তোমার বড্ড অভিমান তাই না! তাইতো আমি আসার আগেই পাড়ি দিলে। সেদিন যদি একটু আগে আসতাম তোমায় দেখতে পেতাম। তোমার ক্ষমার আমি যোগ্য নই, আমি চাই না তুমি আমাকে ক্ষমা করো। তবে আরেকটি বার তোমাকে দেখতে বড় ইচ্ছে করে। আরেকটিবার তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে। সুরাইয়া, আমি কি এই গ্লানি বয়েই সারাটাজীবন কাটাবো। ওপারে কি মিলবে দেখা! পরজীবনে একটি তোমায় দেখার স্বাদ যে রয়েই গেলো গো! তুমি আমাকে অন্যভাবেও তো শাস্তি দিতে পারতে। এই আত্মগ্লানি যে বড্ড নিষ্ঠুর সুরাইয়া। আচ্ছা! আমি যদি আমি যদি অন্যায় না করতাম তুমি কি থাকতে আমার সাথে, আমার পাশে থাকতে! আফসোস উত্তরটা পাওয়া হলো না।
ইতি
পা’পী সেলিম
ধারা আর পড়লো না। রেখে দিলো চিঠিগুলো। দম আটকে আসছে। খুব রাগ হচ্ছে মানুষটির প্রতি। আবার এক কোনে দয়াও হচ্ছে। যে মানুষের দোষী সে মানুষটাই আজ নেই। তার ক্ষমাটা ইহজীবনে জুটলো না তার। চোখ মুছে নিলো ধারা। চুপিসারে শুয়ে পড়লো অনলের পাশে। অনলের গা ঘেষে শুতেই বলিষ্ঠ হাত টেনে নিলো তাকে বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ঘুমিয়ে যা, বেশি ভাবিস না”
ধারা অবাক হলো বটে। তবে কিছু বললো না। শান্ত বাচ্চার মতো গুটিশুটি মেরে লেপ্টে রইলো অনলের বুকে_______
*********
সেলিম সাহেবদের প্যাকিং শেষ পর্যায়ে। তারা আগামীকাল ই অস্ট্রেলিয়ায় ফেরত যাবেন। অবশেষে তার কাজ শেষ হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে সে নিশ্চিন্ত। অনল তার অফার ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই সে বেশ খুশি। মাঝে মাঝে হেরে যেয়েও আনন্দ হয়। এর মাঝে ডোরবেল বাজলো। সেলিম সাহেব নিজে খুললেন। খুলতেই বেশ অবাক হলেন৷ কারণ ধারা দাঁড়িয়ে আছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। হয়তো আবারো কথা শুনাতে এসেছে। এটা তার প্রাপ্য। তাই অমলিন কন্ঠে বললেন,
“ভেতরে আসো”
“একটু কথা আছে। বেশি সময় নিবো না”
“আসো”
ধারা ভেতরে এলো। সেলিম সাহেব তার ব্যালকনিতে নিয়ে দাঁড়ালেন। সেখানে বেতের চেয়ার পাতা। সেখানেই বসলো ধারা। আকাশে সাদা মেঘের মেলা। শরতের তাপ মুখে আছড়ে পড়ছে তার। ধারা তার চিঠিগুলো এগিয়ে দিলো সেলিম সাহেবের দিকে। তিনি অবাক কন্ঠে বললেন,
“এগুলো তোমার কাছে?”
“পেয়েছি, একটা-দুটো পড়েছি ও। যেহেতু মালিক আমি না তাই ফিরিয়ে দিলাম। আপনাকে কিছু কথা বলবো, প্রথম আমি চ্যালেঞ্জ জিতে গেছি। অবশ্য এটা বলার প্রয়োজন নেই। আপনার ব্যাগ গোছানো দেখে বোঝা যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত, সেদিন আপনাকে অনেককিছু বলে ফেলেছিলাম, বয়সে আপনি বড় এটা আমার বলা উচিত হয় নি৷ যদিও আপনি কথা শোনার মতোই কাজ করেছেন। যাক গে, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তা হলো আমি আর আপনার প্রতি ক্ষোভ, রাগ, অভিমান রাখবো না। এগুলো অহেতুক। শুধু শুধু আমার কষ্ট হয়। আর একটা অনুরোধ, আমার উপর এই জো’র’পূ’র্ব’ক ভালোবাসাটা চাপিয়ে দিবেন না। সম্পর্ক তৈরি হতে সময় লাগে। ভালোবাসা জোর করে আসে না। মন থেকে আসে। মা আপনাকে অনেক ভালোবাসতো। আপনি এই ভালোবাসার মূল্য দিতে পারেন নি। হয়তো আপনার শাস্তিটুকু ওই অনুতাপের মাঝেই আছে। মানুষটা তো নেই। আফসোস, তার ক্ষমাটা আপনার ভাগ্যে নেই। যাই হোক, আজ উঠছি। আর আগামী শুক্রবার আমার বিয়ে। আসবেন, ভাববেন না আমি দিলাম। দাওয়াতটা নানাভাই দিয়েছেন”
বলেই উঠে দাঁড়ালো ধারা। সেলিম সাহেব সেখানেই বসে রইলেন। মেয়েটাকে এতো শান্ত এই প্রথম দেখলেন। মেয়ের ক্ষমা হয়তো পেলেন, কিন্তু “বাবা” ডাকের আফসোস টা রয়েই গেলো। অবশ্য এই শাস্তিটুকু প্রাপ্য। কিছু অন্যায় ভোলা যায় না। কিছু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হয় না______
*******
শুক্রবার,
লাল বেনারসিতে বসে আছে ধারা। অস্বাভাবিক সুন্দর লাগছে তাকে। সে অধীর হয়ে প্রতীক্ষা করছে অনলের আসার। কমিউনিটি সেন্টারে স্টেজে সে বসে আছে। অপরদিকে অনল এবং তার বন্ধুরা বর পক্ষের গাড়ি নিয়ে আসছে। বাড়ির সকলে এখানে উপস্থিত কনেপক্ষ হিসেবে৷ এবার অনলের গাড়ির আসার পালা। প্লাবণ ই এই বুদ্ধি বের করেছে। এক বাড়িতে বিয়ে বলে কি কনেপক্ষ, বরপক্ষের নিয়ম কানন মানবে না। বন্ধুমহল ও এসেছে ধারাকে সাহস দিতে। বান্ধবীর বিয়ে বলে কথা! অবশ্য এসবে আরেকটি কান্ড ঘটেছে। বিবিসি দিগন্ত তার এলমেলো হৃদয়টা মাহির সম্মুখে রেখেছে। মাহির উত্তর জানা হয় নি। জমজের দায়িত্ব জুতোর উপর। তারা ধারাপুর বোন হিসেবেই আছে। তাদের পুরো বাহিনী সকাল থেকে জুতো লুকিয়ে রেখেছে। এতো আনন্দ মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো যখন স্মৃতি ছুটে এলো, উৎকুন্ঠিত হয়ে বললো,
“ধারা, আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে”……………
লাগাতার কলিংবেল বাজছে। কেউ খুলছে না দরজা। জ্বরে ক্লান্ত দীপ্ত বাধ্য হয়ে উঠলো। গতকালের কান্ডের পর তার জ্বর এসেছে। ধুম জ্বর। সে কোনো মতে উঠে দরজা খুললো। খুলতেই খানিকটা চমকে উঠলো, কারণ বাহিরে ধারা দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখশ্রী শক্ত, চোখ থেকে গেলো জ্বলন্ত অগ্নি বর্ষিত হচ্ছে। ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে সে দীপ্তের দিকে তাকিয়ে আছে। ধারাকে দেখে কিছুসময় বিমূঢ় রইলো দীপ্ত। কারণ ধারার এখানে আসার ব্যাপারটি বেশ আশ্চর্যজনক। নিজেকে কিছুসময় বাদে সামলে দীপ্ত জিজ্ঞাসু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ধারা তুমি হঠাৎ?”
ধারার এরুপ প্রশ্নে আরোও একবার থতমত খেয়ে গেলো দীপ্ত। ধারার শীতল কন্ঠে একরাশ ক্রোধ সুপ্ত। দীপ্ত চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“ধারা কি হয়েছে? তুমি এরকম বিহেভ কেনো করছো?”
“কি হয়েছে সেটা আমি আপনাকে বলবো না, আমি এখানে সেলিম আহমেদের সাথে কথা বলতে এসেছি। দয়া করে তাকে ডেকে দিন নয়তো আপনাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকতে আমি বাধ্য হব”
দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষীপ্ত কন্ঠে কথাটা বললো ধারা। দীপ্ত ও আর কথা বাড়ালো না। আন্দাজ কিছু একটা করেছে ঠিক ই কিন্তু বাবা মেয়ের মাঝে তার প্রবেশ অযৌক্তিক। ফলে সে দরজা ছেড়ে দিলো। মলিন কন্ঠে বললো,
“তুমি ভেতরে এসে বসো, আমি আংকেলকে ডেকে দিচ্ছি”
“আমি এখানে বসতে আসি নি, উনাকে তাড়াতাড়ি ডাকুন”
দীপ্তের কষ্ট করে ডাকার প্রয়োজন হলো না, সেলিম সাহেব নিজেই হেটে এলেন বসার ঘরে। তাকে দেখতেই চোখজোড়া ধপ করে জ্বলে উঠলো। অসামান্য ঘৃণা, ক্রোধে, বিষাদে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লো সে। নিজেকে সংযত রাখা যেনো অসম্ভব হয়ে পড়লো। তার মুখোমুখি হয়ে তীব্র কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“আমার সুখের জীবন মূহুর্তের মধ্যে এলোমেলো করে কি লাভ হলো আপনার? অনলভাইকে সকলের সামনে অপমানিত করে কি সুখ পেয়েছেন? একজন সৎ মানুষকে অপবাদ দিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছেন?”
“এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কেনো বলছো? সরাসরি জিজ্ঞেস করো”
“তাহলে সরাসরি বলছি, আপনি মাধবীকে কেনো টাকা দিয়েছিলেন? টাকা দিয়ে অনলভাই এর নামে কমপ্লেইন করিয়েছেন আপনি? আপনি ভালো করেই জানতেন এমন কিছুতে তার চাকরি হারাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কি জানতেন না?”
সেলিম সাহেব উত্তর দিলেন না শুধু শান্ত চিত্তে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। ধারা রীতিমতো কাঁপছে, তার রাগ সংযমহারা হয়ে উঠেছে। ক্রোধ, বিশ্বাসভাঙ্গার কষ্টে জর্জরিত ধারা আজ উ’ম্মা’দ প্রায়। তার কণ্ঠ কাঁপছে। ঠোঁট কামড়ে কিছু সময় ঘনঘন শ্বাস নিলো সে। তারপর কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি একটা বই তে পড়েছিলাম জানেন, “পৃথিবীতে অনেক খারাপ পুরুষ রয়েছে কিন্তু একটাও খারাপ বাবা নেই” লেখক ভুল ছিলেন। আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বাবা। যে নিজের মেয়ের সুখ দেখতে পারেন না”
“আমি তো বলেছিলাম, আমি তার পরীক্ষা নিব। পরীক্ষা কি সহজ হয় ধারা?”
“কি প্রমাণ করতে চাইছেন বলুন তো? আপনি আমাকে খুব স্নেহ করেন? আমার জন্য আপনি খুব চিন্তিত? এসব করে কিচ্ছু প্রমাণিত হয় না সেলিম আহমেদ। আরোও আমার চোখে আজ নিচে নেমে গেছেন আপনি। আমি আপনাকে ঘৃণা করতেও ঘৃণা করি। আফসোস হয় আমার আপনি আমার বাবা। কোথায় ছিলো এই স্নেহ যখন আমি পা ভেঙ্গে বিছানায় পড়ে ছিলাম? এই ভালোবাসাগুলো কোথায় ছিলো যখন আমার মার মৃ’ত্যুর পর পর ওই মহিলাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন? কোথায় ছিলো যখন আমি আমার জন্মদিনে আপনার অপেক্ষা করতাম? কোথায় ছিলো এই ভালোবাসা? ভালোবাসা জোর করলেই হয় না, সেটা অনুভূতির ব্যাপার। যা আপনি কখনোই বুঝবেন না। এখন এই সব আমার বিরক্তিকর লাগছে। বিরক্তিকর। আচ্ছা, একটিবার আপনার মনে হলো না সেই মানুষটিকে তো আমি ভালোবাসি, এখন আমি কিভাবে তার সম্মুখে দাঁড়াবো? আজ আমার জন্য মানুষটিকে এতোটা অপমানিত হতে হচ্ছে। অনলভাই এর মুখোমুখি কিভাবে হবো আমি?”
“সে যদি সত্যি তোমাকে ভালোবাসে তবে কি এসবে কিছু যায় আসবে?”
এবার মুখ খুললেন সেলিম সাহেব। তার কন্ঠ শান্ত, তার কপালে ভাঁজ নেই। শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সে। তার উক্তিটি শুনে যেনো আরোও নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে পড়লো ধারা, সুপ্ত রাগগুলো অগ্নিরুপে ঝড়লো,
“ভালোবাসা আপনি শিখাবেন আমাকে? যে কিনা শুধু আমার মা একটু সেকেলে, সরলসোজা ছিলো বলে তাকে ঠ’কা’তে একটিবার ও ভাবে নি। আপনি আমাকে শিখাবেন? লজ্জা করছে না? আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় মার বদলে আপনি মা’রা গেলেন না কেনো? অনাথ হওয়াও অনেক ভালো ছিলো এর চেয়ে”
“ধারা, কি বলছো?”
দীপ্ত সাথে সাথে বাঁধ সাধলো। ধারা কঠিন চোখে তার দিকে তাকাতেই সে চুপ হয়ে গেলো। সেলিম সাহেব এখনো শান্ত। সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শান্ত দৃষ্টিতে। ধারা দু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো, অশ্রুরা বাঁধ মানছে না। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“আমি কিভাবে অনলভাইকে মুখ দেখাবো, কিভাবে চোখে চোখ রাখবো? পরীক্ষার নামে আমাদের সম্পর্কে ছেদ করিয়ে শান্তি পেয়েছেন আপনি? এটাই তো চেয়েছিলেন। আজ অনল ভাই হারে নি আমি হেরে গেছি। আমি হেরে গেছি”
“কেনো মুখ দেখাতে পারবি না তুই? কেউ কি তোর মুখে কালি লাগিয়ে দিয়েছে? নাকি আমার চোখে নে’বা হয়েছে?”
কথাটা কর্ণপাত হতেই পেছনে তাকালো ধারা, ঝাপসা নয়নে দেখলো দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে অনল। ধারা বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকলো অনলের দিকে। অনলকে দেখে সেলিম সাহেবের ভ্রু কুঞ্চিত হয়। মাহিকে ফোন করতেই মাহি সবকিছু খুলে বলে অনলকে। এবং এটাও বলে ধারা রাগ মাথায় ভার্সিটি ছেড়েছে। অনলের বুঝতে বাকি নেই তার বউটি কোথায়! সময় নষ্ট না করেই সে সেলিম সাহেবের বাসায় উপস্থিত হয়। দীপ্ত দরজা না দেবার কারণে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতেই ধারা এবং সেলিম সাহেবের অনেক কথোপকথন ই শুনতে পায়। বাবা মেয়ের মাঝে প্রবেশ করার ইচ্ছে তার ও ছিলো না। কিন্তু ধারাকে এভাবে বিধ্বস্ত ও দেখতে পারছে না সে। তাই বাধ্য হয়েই কথাটা বলে। অনল কারোর অনুমতি ছাড়াই ভেতরে প্রবেশ করে, ধারার ডানহাতটা নিজের হাতের ফাঁকের মাঝে গলিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলে,
“আমার ভালোবাসা এতোটা ঠুঙ্কো নয়, সামান্য ব্যাপারে তার ভিত্তি নড়ে যাবে। যখন বলেছি ভালোবাসি তার মানে শেষ নিঃশ্বাস অবধি ভালোবাসি তোকে”
আর সেলিম সাহেবের দিকে তাকায় সে। তার চোখে চোখ রেখে নির্লিপ্ত কন্ঠ বলে,
“আমার বউকে নিয়ে যাচ্ছি। আর থাকলো পরীক্ষা– আমি সারাজীবন প্রথম হওয়া ছাত্র, হারতে আমি শিখিনি। আপনার পরীক্ষাতেও ফুল মার্ক নিয়েই পাশ করবো”
বলেই ধারাকে নিয়ে বেড়িয়ে যায় অনল। অনলরা চলে গেলে দীপ্ত উৎকুন্ঠিত হয়ে বলে,
“সত্যটা কেনো বললেন না আংকেল?”
“সত্য সবসমইয় আপেক্ষিক দীপ্ত, এটা ব্যাক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করে। তোমার কি মনে হয় ধারা বুঝতো? উলটো ওর ক্ষোভ বাড়তো। তবে তুমি ঠিক বলেছিলে, অনল ছেলেটার দম আছে। হয়তো এবার আমি হেরে যাবো”
সেলিম সাহেবের ঠোঁটের কোনায় মলিন হাসি ফুটে উঠলো। দীপ্ত সত্যি বুঝে না, লোকটি এমন কেনো? এভাবে মেয়ের চোখে নিচে নেমে কি সুখ?
********
ধারাকে নিয়ে নিজ ঘরে আসলো অনল। ধারা কেঁদেকেটে ফোলা মুখখানার জন্য বসার ঘরে দাদাজানের কাছে প্রশ্নের স্বীকার হতে হয়েছে অনলের। সুভাসিনী তো ধারার মুখ দেখেই চিন্তায় এক শেষ। বারবার একই প্রশ্ন,
“এই অনল, তুই কি করেছিস? সত্যি করে বল নয়তো আমি কিন্তু বয়স দেখবো না এখনই আমার বেলন নিয়ে আসবো”
বেলনটা সুভাসিনীর প্রিয় অ’স্ত্র। ছোটবেলায় এই বেলনের মা’র কম খায় নি অনল। যখন ই তিল থেকে তাল খসেছে সুভাসিনীর হাতে বেলন আর অনলের পা দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত। জামাল সাহেবও কম নন। তিনি তো ত্যাজ্য নাতী করার হুমকি দিয়েই বসলেন,
“ওর বাপ একটা হা’রা’মী, আমার ধারারাণীরে শান্তি দিচ্ছে না। আর তুই ও ওরে কষ্ট দিচ্ছোস? আমি এখনো ম’রি নি। রুবি আমার লাঠি কই?”
এই পাগল পরিবারকে কি করে বোঝায় কান্ডটিতে তার হাত নেই। একটা সময় বিরক্ত হয়ে অনল বলে উঠলো,
“তোমরা কি থামবা? আমার বউ একেই কেঁদে ভেসে যাচ্ছে উপর থেকে তোমরা এক এক জন কি শুরু করছো? আগে আমি জানি আমার বউ কাঁদছে কেনো? তারপর না হয় তোমরা আমাকে পি’টা’ও”
বলেই ধারাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে সে। ধারা এখনো নিঃশব্দে কাঁদছে। ঠোঁট কামড়ে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে সে। অনল তার কাছে যেতেই সে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো,
“আমাকে ক্ষমা দিও”
ধারার কথায় বিস্মিত হলো অনল। বিমূঢ় কন্ঠে বললো,
“কেনো?”
“আজ আমি যদি ঐ লোকটাকে চ্যালেঞ্জ না করতাম তোমার সাথে এমন হতো না। আজ আমার জন্য তোমার জীবনে এতো ঝড়। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আসলে আমি ই অপায়া, যার জীবনের সাথে জড়াই তার জীবনেই দূর্ভোগ বয়ে আনি। তাই তো মাকেও হারিয়েছি। আজ যদি তোমার জীবনে আমি না থাকতাম তোমার সাথে এমন কিছুই হতো না। সব আমার জন্য। এর চেয়ে তো আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই শ্রেয় ছিলো…”
কথাটা শেষ হবার আগেই অনলের উষ্ণ ঠোঁটজোড়া চেপে ধরলো ধারার পাতলা ঠোঁটজোড়া। আকস্মিক ঘটনায় থমকে গেলো ধারা। উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়ায় কেঁপে উঠলো সে। মেরুদন্ড বেয়ে বয়ে গেলো উষ্ণ রক্তের প্রবাহ। হৃদস্পন্দন হয়ে উঠলো বেসামাল। আবেশে চোখ বুঝে এলো। সাথে সাথে গড়িয়ে পড়লো জমে থাকা নোনা বিষাদ। তপ্ত অনুভূতির প্রহর কাঁটলো। অনল তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
“বড্ড বেশি বকিস, এর পর থেকে এই প্রক্রিয়াটাই খাটাবো আমি”
ধারা কিছু বললো না। শুধু নতমস্তক দাঁড়িয়ে রইলো। অনল আলতো হাতে তার মুখখানা তুললো। ঘোরলাগা মাদকতাপূর্ণ কন্ঠে বললো,
“তোর জন্য সব পরীক্ষা সই। এমন হাজারো অপবাদ নিতে পারি আমি। যদিও একটু ফিল্মী ডায়ালগ, কিন্তু আমি সত্যি পারবো। আর কোনোদিন আমার থেকে আলাদা হবার কথা বলবি না। আর আমার কাছে উত্তর চেয়েছিলি না, উত্তরটা হলো, আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে””
ধারা মাথা তুলে তাকালো অনলের গভীর নয়নজোড়ায়। অবাধ্য মায়া, কিছু দূর্লভ ইচ্ছে, নিষিদ্ধ আবেগ। ধারার হৃদয়ও হয়ে উঠলো নড়বড়ে। পায়ের পাতায় ভর করে বাহুর বেষ্টনীতে বাঁধলো অনলের গলা। তপ্ত ঠোঁটের স্পর্শে ছুয়ে দিলো অনলের কপাল, মুখশ্রী। স্পর্শ প্রগাঢ় হলো। নিয়ন্ত্রণ হারা হলো কামনা। অধৈর্য্য হলো দুটো হৃদয়। আদিমলীলায় মাতলো তারা। বাহিরে কেবল সাঁজ। চন্দ্রমাও মেঘের কোল থেকে বের হয় নি। মেঘেদের গর্জন শোনা যাচ্ছে। আবারো বৃষ্টি নামবে আঁধারে ঘেরা নগরীতে। অন্যপাশে প্রণয়লীলা মত্ত হৃদয়জোড়ার হুশ নেই। কিছু তপ্ত নিঃশ্বাস, কিছু আর্তনাদ আর একসমুদ্র সুখ। তাদের প্রণয় প্রহেলিকা ডূবন্ত শীতল কক্ষ_______
ক্লান্ত ধারার ঘুমন্ত মুখখানায় অপলক মায়া নিয়ে তাকিয়ে আছে অনল। কাঁদার জন্য ঈষৎ ফুলে গেছে মুখ, তবুও যেনো অসামান্য মায়া জড়িয়ে আছে। আলো আধারের মায়ায় এক অদ্ভুত মাদকতা। যে মাদকতায় অনল শতবারো ডুবতে রাজি। ভাঁজ পড়া কপালে চুমু খেলো সে। কানে মুখ ঠেকিয়ে ধীর স্বরে বললো,
“তোরে ছেড়ে আমিও যে অপুর্ণ ধারা, কিভাবে আলাদা হই?”
তখন ই নিস্তব্ধতা বেধ করে বেজে উঠলো মোবাইলটা। বিরক্ত হলো অনল। ধারাও নড়ে উঠলো। সাথে সাথেই ফোনের সাউন্ড কমিয়ে দিলো অনল। ধারা শান্ত হয়ে গেলো। ভাঁজটা মিলিয়ে গেলো কপালের। অনলে নিঃশব্দে হাসলো। তারপর টিশার্ট্ এ গলা ঢুকিয়ে ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। রিসিভ করে সালাম দিতেই অপরপাশ থেকে শুনলো,
“অনল, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে”……………………………
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৪০তম_পর্ব
তখন ই নিস্তব্ধতা বেধ করে বেজে উঠলো মোবাইলটা। বিরক্ত হলো অনল। ধারাও নড়ে উঠলো। সাথে সাথেই ফোনের সাউন্ড কমিয়ে দিলো অনল। ধারা শান্ত হয়ে গেলো। ভাঁজটা মিলিয়ে গেলো কপালের। অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর টিশার্ট এ গলা ঢুকিয়ে ফোনটা নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। রিসিভ করে সালাম দিতেই অপরপাশ থেকে শুনলো,
“অনল, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছে”
“কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো?”
স্বাভাবিক কন্ঠে প্রশ্নটি করলো অনল। অপরপাশ থেকে তার কলিগ শিহাব বললো,
“ওরা কোনো প্রমাণ পায় নি। প্রতিটি খাতা পুনরায় চেক করা হয়েছে। বিশেষ করে ধারার খাতা। তোমার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পায় নি। আজ স্যারদের মিটিং হয়েছিলো। আমার মনে হয় তারা ধারার পরীক্ষাটি আরেকবার নিবে। এই প্রস্তাব আনসারী স্যার ই দিলেন। যেহেতু প্রতিটা স্টুডেন্ট এখানে জড়িত নয় সুতরাং শুধু ধারার পরীক্ষাটি নেওয়াটাই উনি যুক্তিযুক্ত মনে করছেন। বাকি স্যাররাও মত দিয়েছেন। ধারাকে প্রস্তুত রাখো। প্রশ্ন আনসারী স্যার নিজে করবেন”
“আচ্ছা, আমি দেখছি”
“আর একটা কথা, যদি ধারা একই গ্রেড না পায় এই এক্সামে তবে হয়তো ধারাকে এক বছরের জন্য রাস্টিকেট করা হবে”
অনল কিছু সময় চুপ করে থাকলো। ঘাড় ফিরিয়ে ঘুমন্ত প্রণয়িনীকে এক নজর দেখলো নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। বাহিরের সোডিয়ামের লাইটের একাংশ প্রবেশ করছে আঁধারী নগরীতে। আবছা হলদে আলোতে কোমল মুখখানা দেখতেই এক শান্ত প্রশান্তি বয়ে গেলো মনে। এখন ভয় হচ্ছে না। যা হবে দেখা যাবে। মানুষ তো বাঁচেই একবার, এভাবে থমকে থমকে বাঁচার কি মানে! এতো কিসের ভয়! যখন যোদ্ধাই ভয় পাচ্ছে না, তাহলে সেনাপতির ভয় পাওয়া কি সাজে? সাজে না। নিঃশব্দে হাসলো অনল। তার চোখ ও যেনো হাসছে। শিহাবের কথার প্রত্যুত্তরে বললো,
“শিহাব ভাই, আমার বউটি মারাত্মক সাহসী। যে এসব পরীক্ষাতে ভয় পায় না। তাই যাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক না কেনো সে তৈরি। আর আমি তো আছি, আমার ছোট যোদ্ধাটিকে ঠিক ই পার করে দিবো”
অনলের উত্তর শুনে শিহাব হাসলো। তারপর বললো,
“তোমার থেকে এমন উত্তর ই আসা করছিলাম, থাকো রাখলাম”
ফোন কেটে দিলো শিহাব। অনল মাথা তুলে তাকালো মেঘাচ্ছন্ন কালো অম্বরের দিকে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। তারপর একটা মেইল করলো অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানিতে, এখন সেখানের সময় সকাল ৯টা। তাই মেইলটা এখন ই পাঠানো প্রয়োজন। কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে অনল। মেইলটা করার পর ফিরে গেলো বিছানায়। ঘুমন্ত রমনীকে বুকে তুলে নিলো। প্রগাঢ়ভাবে লেপ্টে রাখলো নিজের সাথে, কৃষ্ণ চুলের মাঝে নাক ডুবিয়ে বললো,
“আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয়-উৎস হতে”
********
ভাদ্রের প্রথম সকাল, নীল অম্বরে তুলোর ন্যায় সাদা মেঘের ভেলা ছুটছে। ফকফকে নীর্মল রোদে প্রজ্বলিত শহর। শরতের আভা যেমন বাতাসেও। শিউলির মৃদু গন্ধ মিশে গেছে সমীরে। এই নির্মল সকালে কৃষ্ণাচূড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে ধারা৷ অবশেষে পরীক্ষাখানা হচ্ছে। একটু পর তা শুরু হবে। কাঁধের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সে। একটু ভয় হচ্ছে, না অনেক ভয় হচ্ছে। এই ক দিন অনল তাকে সর্বোচ্চ দিয়ে প্রস্তুত করেছে। তবে ভয় তো থাকেই৷ ধারা ভেবেছিলো অনল ভাই হয়তো ভার্সিটিতে দিয়ে যাবে কিন্তু তার একটি জরুরি কাজ পড়ে যাবার দরুণ সে আসতে পারে নি। তবে ধারা ভয় পাবে না। তাকে এই যুদ্ধে জিততেই হবে। নিজের জন্য নয়, অনলের জন্য। উপরন্তু ওই মানুষটির মুখে ঝা’মা ঘ’ষে দেবার ইচ্ছে যে মনে অফুরন্ত। যখন ধারা এই পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করবে তখন সে ওই লোকটির সম্মুখে দাঁড়াবে। মুখ্যম জবাব দিবে সে। এর মাঝেই বন্ধুমহলের আগমণ ঘটে। বন্ধুমহলকে দেখেই মুখে হাসি ফুটে উঠে ধারা। নীরব এগিয়ে এসে শান্ত কন্ঠে বলে,
“ভয় পাবি না, যাই প্রশ্ন আসুক তুই পারবি ইনশাআল্লাহ”
ধারা কিছুই বলে না শুধু মাথা নাড়ায়। মাহি ধারাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করবো। অল দ্যা বেস্ট”
ধারা অমলিন হাসে। তারপর পা বাড়ায় পরীক্ষাহলের দিকে। বন্ধুমহল সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। অভীক খানিকটা থমথমে কন্ঠে বলে,
“পরীক্ষা ধারার, ভয় আমার হচ্ছে”
“আমার বিশ্বাস ও পারবেই, ওর জিদ তো জানি। ঠিক পারবে।”
বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে দিগন্ত কথাটি বলে। দিগন্তের কথায় শুনে মাহি বলে উঠে,
“আজকাল আমাদের বিবিসি বেশ বড় হয়ে গেছে দেখেছিস। আগের মতো আর বাচ্চামি করে না”
“ধারার গু’তা’নি খেয়ে ঠিক হয়ে গেছে”
নীরব হেসে কথাটা বলে উঠে। তখন নিঃশব্দে হাসে দিগন্ত। তারপর বেশ ভাব নিয়ে বলে উঠে,
“জীবনের নাম ই পরিবর্তন৷ মানুষ বদলায়, অনুভূতি বদলায়। আরোও কতকিছু বদলায়”
“তোর অনুভূতি বদলে গেছে?”
নীরবের প্রশ্ন আবারো হাসে দিগন্ত। দূর্বোধ্য সেই হাসি। উত্তর না দিয়েই পা বাড়ায় ক্লাসের দিকে।
ধারার পরীক্ষা শেষ হয় যথাসময়ে। পরীক্ষা হল থেকে বের হয় থমথমে মুখ নিয়ে। প্রশ্নটি বেশ কঠিন ছিলো বটে। তবে ধারা একটি মার্ক ও ছাড়ে নি। সব উত্তর দিয়ে এসেছে। তবুও একটা সূক্ষ্ণ ভয় হচ্ছেই। পরীক্ষা হল থেকে বের হতেই বন্ধুমহলের দেখা পেলো। তারা অপেক্ষা করছিলো তার জন্য। তবে যার অপেক্ষায় সে ছিলো সেই মানুষটি এখনো আসে নি। মাহি চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“পরীক্ষা কেমন হয়েছে? সব লিখেছিস?”
“হয়েছে খারাপ না। স্যাররা বললেন রেজাল্ট নাকি বিকেলেই দিয়ে দিবেন”
“চিন্তা করিস না। ইনশাআল্লাহ কিচ্ছু খারাপ হবে না”
ধারা নিস্প্রভ হাসলো। চিন্তা না করতে চাইলেও অজস্র চিন্তারা মস্তিষ্কে বাসা বেঁধেছে। নিকষকালো বিশ্রী ভয় তার ভেতরটাকে বারবার দূর্বল করে দিচ্ছে। এর মাঝেই ধারার ফোনটা বেজে উঠলো। অচেনা নম্বরটি দেখতেই ভ্রু কুঞ্চিত হলো তার। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফোনটি রিসিভ করলো।
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম”
“ওয়ালাইকুম সালাম, আমি দীপ্ত বলছি”
দীপ্তের কন্ঠ শুনতেই অকল্পনীয় বিরজতি এসে ভর করলো তারা মুখশ্রীতে। সে বিনা বাক্যে ফোনটি কেটে দিতে উদ্ধত হলে দীপ্ত বলে উঠলো,
“ধারা, একমিনিট আমার কথাটা শুনো। ফোন কেটো না”
“কি শুনাবেন? আর কিছু শোনবার বাকি আছে?”
“হ্যা, অনেককিছু বাকি আছে। প্লিজ তুমি একটু তোমাদের ভার্সিটির শহীদ মিনারের এই দিকটা আসবে? আমি ওখানেই আছি। প্লিজ”
ধারা কিছু উত্তর দিলো না। সাথে সাথেই ফোনটা কেঁটে দিলো। ধারার পরিবর্তিত মুখভঙ্গি দেখে অভীক শুধালো,
“কি হয়েছে?”
ধারা উত্তর দিলো না। শুধু ভ্রু কুচকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে।
********
ভার্সিটির গেট থেকে পশ্চিমে শহীদ মিনারটি অবস্থিত। শহীদ মিনারের শেষ সিড়িতে নগ্ন পায়ে বসে রয়েছে দীপ্ত। সে প্রতিক্ষিত ধারার জন্য। আজ কারোর কথায় এখানে আসে নি দীপ্ত। নিজের ইচ্ছেতেই এসেছে। এই কদিন যাবৎ নিজের মধ্যেই বেশ এলোমেলো হয়ে আছে সে। অনুতাপ জিনিসটি ভীষণ খারাপ, এই অনুতাপের দরুন ই বাধ্য হয়ে এখানে আসা। কিছু কথা যে এখনো না বলাই থেকে গেলো। সেই কথাগুলো হয়তো বলে লাভ হবে না, কিন্তু বলাটা প্রয়োজন। এর মাঝেই একটি চিকন তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে আসে দীপ্তের,
“কি কথা বলবেন? আমি মাত্র দশ মিনিট সময় দিবো আপনাকে”
দীপ্ত মাথা তুলে তাকালো, ক্ষুদ্ধ নয়নে ধারা তার দিকে তাকিয়ে আছে। খানিকটা হাফ ছাড়লো সে, ভেবেছিলো ধারা হয়তো তার সাথে দেখা করবে না। দীপ্ত উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে আসলো ধারার দিকে। মৃদু হেসে বললো,
“কেমন আছো?”
“আমার খালি সময় নেই, যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন”
তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো দীপ্ত। তার কথাগুলো কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারলো না। এলোমেলো চিন্তা গুলো ধারা কতটুকু বুঝবে তাও বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু পকেট থেকে কিছু কাগজ বের করলো। বেশ যত্নে ভাঁজ করে রাখা কাগজ। ধারার ভ্রু কুঞ্চিত হলো, কন্ঠে এক রাশ কৌতুহল নিয়ে শুধালো,
“এগুলো কি?”
“চিঠি”
“কার?”
“একজন অনুতপ্ত ব্যাক্তির”
হেয়ালীটা ধরতে পারলো ধারা, বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“এসব ঢং নিজের কাছে রাখুন”
“আমি জানি তুমি আংকেলের উপর ভীষণ ক্ষুদ্ধ, হওয়াটাই যৌক্তিক। আসলে আমার বাবা আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে আমিও এমন রিয়েক্ট ই করতাম। কিন্তু কি জানো! আংকেল তোমাকে খুব ভালোবাসে”
“ভালোবাসার নমুনা আমি দেখেছি”
“মাধবীর সাথে ঘটিত ব্যাপারটার একাংশ ই জানো তুমি। বাকিটুকু একটু শুনবে? তুমি যেদিন আমার সাথে ঘোরাঘুরি করেছিলে সেদিন কথায় কথায় তুমি মাধবীর কথা বলেছিলে। সেখান থেকেই মাধবীর ব্যাপারটা আমার মাথায় গাঁথে। আংকেলের সাথে তোমার চ্যালেঞ্জের পর আংকেল প্লান করেন, যে অনলের চাকরির একটা প্রবলেম তৈরি করবেন এবং আমাদের কোম্পানির একটা সাব কোম্পানী থেকে খুব বড় একখানা অফার দিবেন। এখন যদি কোনো তার চাকরির সমস্যা না হয় এই কোম্পানির অফারটি নেবার কোনো কারণ নেই অনলের। এখন চাকরিতে কিভাবে প্রবলেম করা যায় সেই উপায় খুঁজতে খুঁজতে আমি মাধবীকে খুঁজে বের করি। মাধবীর সাথে আমি কথা বলে এটা বুঝতে পারি যে ওর তোমার প্রতি অসম্ভব রাগ বা ঈর্ষা। সে এমনেও তোমার আর অনলের সম্পর্কের ব্যাপারে ক্ষুদ্ধ ছিলো, উপরন্তু তোমার রেজাল্ট ও ভালো হয়। সে এমনেই কমপ্লেইনটা করতো। মাধবীর পরিবারে হুট করে অর্থনৈতিক ঝামেলা হবার কারণে মাধবী কাজের খোঁজও করছিলো। তাই আমরা ওর সাথে একটা ডিল করি, ও প্রথমে অনলের নামে কমপ্লেইন করবে। যদি অনলের কোনো সমস্যা হয় তবে আমরা ওকে কোম্পানির অফারটা দিবো। অনল এক্সসেপ্ট করুক বা না করুক মাধবী তার কমপ্লেইনটা ফেরত নিবে এবং ওর মোটিভ যে খারাপ সেটা সে অথোরিটিকে জানাবে। হয়তো ওর বিরুদ্ধে একশন নেওয়া হবে। ওকে রাস্টিকেট করা হবে। সেটা আমরা বুঝে নিবো। ওর জব বা টাকা পয়সার ঝামেলা হবে না। যেহেতু খুব বড় এমাউণ্ট তাই মাধবীও রাজি হয়ে যায়। আর কথা অনুযায়ী আগামী সপ্তাহেই মাধবী কাজটা করতো। কিন্তু এর মাঝেই তুমি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিতে রাজি হয়ে গেছো। আমাদের প্লান সম্পর্কে জেনে গেছো। অনলকে অলরেডি অফারটা দেওয়াও হয়ে গেছে। ধারা আংকেলের পদ্ধতি খুব বিশ্রী, অসহনীয়। কিন্তু সে কখনোই তোমার সংসার ভাঙ্গতে চাননি। শুধু পরীক্ষা করতে চেয়েছেন অনলকে। কারণ সে চায় না তার মেয়ে সেটা ভুগুক যা সুরাইয়া আন্টি ভুগেছে। সে অনুতপ্ত ধারা। ঐ সময়ে করা ভুল তার প্রতি মূহুর্তটকে হেল এ পরিণত করেছে। রোকসানা আন্টিকে সে বিয়ে করেছিলো নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য। যার শাস্তি সে পাচ্ছে, হয়তো সারাজীবন পাবে। আর থাকলো তোমাকে প্রত্যাখ্যান করার কথা, সে তোমাকে প্রত্যাখ্যান করে নি। তোমার নানাবাড়ি ই কখনো তোমাকে নিতে দেয় নি। আর তুমি এখানে যতটা ভালো ছিলে সেলিম আংকেলের সাথে থাকতে না। তাই কখনো সেলিম আংকেল তোমাকে জোর করে নি। এখন তুমি জিজ্ঞেস করতেই পারো আমি কিভাবে এতো কিছু জানি, কারণ আমি সেই মানুষটির সাথে বিগত বারো বছর আছি। আমার বয়স তখন পনেরো, সেলিম আংকেলের একটি এক্সিডেন্ট হয়। উনি তো প্রাণে বেঁচে যায় কিন্তু ওই গাড়িতে বাকি যারা ছিলেন তারা মা’রা যান। ওখানে আমার প্যারেন্টস ছিলো। এককথায় ধরতে গেলে আমার অনাথ হবার কিছুটা দোষ তার। সেই অনুতাপে আমাকে সে এডোপ্ট করেন। সেই থেকে আমি উনার সাথে। উনাকে আমি বুঝি না, উনার মন আমি পড়তে পারি না। তবে প্রতিরাতে আঁকাশের নিচে তোমাদের ছবি হাতে ঠিক ই দেখি আমি। আমি বলবো না তাকে ক্ষমা করে দাও, শুধু বলবো এতোটা অভিমান পুষো না। অভিমানের অস্তিত্ব মানুষটি পর্যন্ত ই”
ধারা একটিও বাক্য বললো না। শুধু শান্ত ভাবে কথাগুলো শুনলো। তারপর সেই কাগজগুলো হাতে নিলো। মনের মাঝে ঝড় চলছে। গাঢ় অভিমানের প্রলেপের ভেতর মূর্ছাপ্রায় ছোট মেয়েটি বাবার স্নেহের কাঙ্গাল হৃদয়টা বারবার হাহাকার করছে। মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে আছে। কিছু বলার আগেই অনলের কঠিন হাতজোড়া দীপ্তের কলার টেনে ধরল। হিনহিনে কন্ঠে বললো,
“কি চাই এখানে?”
মেয়েটির স্বর কর্ণপাত হতেই তিনজন বিস্মিত নজরে পেছনে তাকালো। তাদের কিছু বুঝার আগেই মেয়েটি ছুটে এলো দীপ্তের দিকে। সজোরে চ”ড় বসিয়ে দিলো দীপ্তের গালে। অনল পরিস্থিতি দেখে ছেড়ে দিলো দীপ্তের কলার। মেয়েটি সেই সুযোগে দীপ্তের কলার টেনে ধরলো। ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বললো,
“তুমি কি ভেবেছো, বাংলাদেশে আসলে আমি তোমার কীর্তি জানবো না। তুমি আমাকে ছেড়ে এখানে অন্য মেয়ের সাথে আ’কা’ম করতেছো। এভাবে ঠ’কা’লে আমাকে?”
“তুমি ভুল ভাবছো তিশা”
“ও আমার চোখ কি অন্ধ, আমি বুঝি না। কে এই মেয়ে। বল কে এই মেয়ে, নয়তো আমি তোমার ছা’ল তুলে নিবো”
মেয়েটির ক্রোধ বাড়লো, সে কলার ছেড়ে দীপ্তের ঝাঁকরা চুল টে’নে ধরলো। এদিকে অনল এবং ধারা হা হয়ে তাকিয়ে আছে দীপ্ত এবং মেয়েটির দিকে। মেয়েটি ক্রমেই তার চুল টেনেই যাচ্ছে। দীপ্ত আর না পেরে বলেই উঠলো,
“আরে, ও ধারা। আমার ওর সাথে কিছু নাই। লিভ মি প্লিজ, ইটস হা’টিং তিশু”
এবার মেয়েটি থামলো। ভ্রু কুচকে কঠিন দৃষ্টি প্রয়োগ করলো সে ধারার দিকে। কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
“তুমি ধারা?”
“হ্যা”
ভীত কন্ঠে উত্তর দিলো ধারা। অনল এখনো বিস্মিত। হচ্ছেটা কি বুঝতে পারছে না সে। দীপ্ত তার কাঁকের বাসা চুলগুলো কে ঠিক করে বললো,
“ও তিশা, আমার ফিয়ান্সে। একটূ এরকম”
দীপ্তের কথায় চোখ বিস্ফারিত হলো অনলের। সে ভেবেছিলো দীপ্ত হয়তো ধারাকে পছন্দ করে। অথবা তার খারাপ কোনো মনোবাঞ্ছা রয়েছে। এখন দেখছে তার বাগদত্তাও আছে। ফলে আরোও ক্রোধিত হলো অনল,
“তোমার মতো পুরুষ তো আমি দেখি নি, হবু বউ থাকা স্বত্তেও আমার বউ কে লাইন মারো”
“নো, নো, নো। আমি ধারাকে কখনোই লাইন মারি। তিশু ট্রাস্ট মি। আমি ধারাকে বোনের নজরে দেখি”
দীপ্তের কথা শুনে মেয়েটি একটু লজ্জিত হলো। দীপ্তের চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো,
“সরি, আমি বুঝি নি ও ধারা। আসলে কিছুদিন যাবৎ কিছু আইডি থেকে আমাকে ম্যাসেজ করা হচ্ছিলো। ফার্স্টে ইগ্নোর করলেও তোমার আর ধারার ছবি দেখে আমি টেম্পার রাখতে পারি নি। আসলে ওর নাম শুনেছি শুধু। কখনো ছবি তো দেখি নি। তাই তো কালকের প্রথম ফ্লাইটেই চলে এলাম। সরি, লেগেছে?”
অনল এবং ধারার বুঝতে বাকি রইলো না কাজটি কাদের। কিন্তু বি’চ্ছু দুটো তিশাকে কিভাবে খুঁজে নিলো বিশাল বিস্ময়ের ব্যাপার। অনল আর অপেক্ষা করলো। দীপ্ত এবং তিশার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই ধারাকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো। ধারা সারা রাস্তা নিশ্চুপ ই ছিলো। নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বাসায় ফিরতেই সকলকে জড়ো করলো অনল। ধারাও বুঝে পেলো না কি হয়েছে। জামাল সাহেব, রাজ্জাক, ইলিয়াস রুবি, জমজদ্বয় বেশ অবাক। কৌতুহলের বশে সুভাসিনী বলে উঠলেন,
“কি হয়েছে?”
“আমার সবাইকে কিছু বলার আছে। আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি”……………
ফ্লাস লাইটটা হাতের কাছে মারতেই দেখলো টকটকে লাল তরল। অজানা ভয়টি ক্রমশ তীব্র হলো দীপ্তের। অমনেই চিৎকার করে জ্ঞান হারালো সে। এদিকে উপর তালার জানালায় কান লাগানো জমজেরা তার চিৎকার শুনেই হাই ফাইভ দিয়ে বলে উঠলো,
“চেরাগআলী এবার বাছা কই যাবা”
কথাটি বলেই তারা পৈশাচিক হাসি দেবার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো। গলার স্বরে টান খেয়ে উভয় ই কাঁশতে লাগলো। এই পুরো বুদ্ধিটি এশা আশার। শিল্পী দাদীর নাতনী ফাইজা তাদের বান্ধবী, আসলে ঠিম বান্ধবী বলা চলে না। বি’চ্ছুদ্বয়ের সাথে তার সখ্যতার কারণ তাদের দ’স্যু’প’না। এই দ’স্যু’প’নার কারণে স্কুলে তাদের দাপট ই আলাদা৷ সারা ক্লাসের মেয়েরা তাদের ভয় পায়। বলা তো যায় কখন কার উপর তাদের ক্রোধানল বর্ষণ হয়। ঠিক একারণে ফাইজাও তাদের সমীহ করে চলে। আর বি’চ্ছু’রাও সেটার সম্পূর্ণ ফয়দা তুলে। আজ ফাইজার জন্মদিন বটে কিন্তু তাদের দাওয়াতটি তারা নিজেই নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ফাইজাকে বলেছে আজ এবাড়িতে তারা থাকবে। ফাইজাও বাধ্য তাদের কথা মেনে নিলো। কেক কাটার পর তারা কেক দেবার উছিলাতে নিচে এসেছে। রোকসানা দরজা খুলেছিলো। রোকসানাকে কথায় ব্যস্ত রেখেছিলো আশা এবং ফাইসা। সেই সুযোগে এশা দীপ্তের ঘরে ঢুকে। দীপ্ত বাসায় না থাকার সুযোগে অনলের ঘর থেকে চুরি করা ছোট ব্লুতুথ স্পীকার ঘরের এক গুপ্ত জায়গায় রেখে দেয় এবং পলিথিনের এক ব্যাগ লা জল রং ঘোলা তার বিছানায় দিয়ে দেয়। তারপর দীপ্ত ফেরার অপেক্ষা করে।দীপ্ত ফিরতেই সারা বিল্ডিং এর মেইন সুইচ সিড়িঘড় থেকে বন্ধ করে দেয় আশা। ফলে লোডশেডিং এর একটা পরিবেশ তৈরি হয়। এশা তখন ঠিক দীপ্তের ঘরের উপর তালার ঘরে অবস্থান নিয়েছিলো। সেই জানালা থেকে একটি কর্কশীট কাটা নারী অবয়ব সুতোয় ঝুলিয়ে দীপ্তের জানালার সামনে ধরে সে। দীপ্তের ঘরের জানালা দেওয়া ফলে অন্ধকারে কর্কশীটের সেই কাটা অংশটিকে নিকষকালো নারী অবয়ব মনে হয়। দীপ্তে ফ্লাশ লাইট ধরার আগেই তা নিপুন ভাবে উঠিয়ে নেয় এশা। ফলে ফ্লাশ লাইট মারতেই অবয়ব হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। উপরন্তু পুরোনো বিল্ডিং হওয়ায় উপর তালা থেকে খুব সহজেই ব্লুথুত কানেকশন পাচ্ছিলো তারা। ফলে ফাইজার মোবাইল থেকেই ভুতুরে হাসি এবং কথার রেকর্ডিং চালিয়ে দেয়। এই বাড়ির নামে গুজবটিও পাড়ায় তারাই ছড়িয়ে ছিলো। যা বিগত সপ্তাহখানেক দীপ্ত শুনেছে। তার ঘরটির সিলিং ফ্যানেই নাকি ঝু’লে মেয়েটি আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিলো। ডাক্তার হলেও মানুষের অবচেতন মনে ভীতি জন্মায়। সপ্তাহ খানেক এই ভীতিটা মনে সঞ্চার করেছিলো দীপ্ত। কিন্তু তোয়াক্কা করে নি। তবে আজ তার সাথে হওয়া ঘটনাগুলোয় সেই ভীতি প্রকোষ্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। ফলে যখন ই বিছানায় রাখা ঘন তরল তার হাতে লেগেছে অমনি তার মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়েছে দীপ্ত। অন্যদিকে নিজের ফাঁদে আটকানো ঘুঘুর চিৎকারে এশা আশার খুশি যেনো ধরে না। ফাইজা এক কোনায় দাঁড়িয়ে অসহায় কন্ঠে বললো,
“ভাইয়াটা ভালো, এমন করে ভয় দেখানোটা ঠিক হয় নি”
সাথে সাথেই তেঁতে উঠলো আশা৷ ধমকের সুরে বললো,
“অস্ট্রেলিয়ান চেরাগআলীর সাথে উচিত কাজ করেছি। আমাদের সাথে খুব ভাব দেখাচ্ছিলো। নে, এবার ভয়ে কুপকাত হ। আমাদের ধারাপুকে নিয়ে যাবার হু’ম’কি দেয়। কি সাহস! ওর সাথে আর কি কি করি দেখ!”
ফাইজা শুকনো ঢোক গিললো। এশা আশার পৈশাচিক হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীপ্তের সাথে ভালো কিছু হবে না।
দীপ্তের চিৎকারে ছুটে আসলেন সেলিম এবং রোকসানা। ততসময়ে ঘরের লাইট চলে এসেছে। ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেখলেন দীপ্তের গা লালে রক্তিম হয়ে আছে। ছেলেটা মূর্ছা গেছে। পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফিরলো তার। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“ভু…ভুত, এই ঘরে ভু…ত”
“কি বলছো দীপ্ত, আমি রোকসানা আন্টি”
সেলিম সাহেব উঠে বসালেন দীপ্তকে। দীপ্ত ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তার জড়তা এখনো কাটে নি। বুকের স্পন্দন লাগাম ছাড়া। পালস অক্সিমিটারে মাপলে ১২০ এর উপর হবে হয়তো। সেলিম সাহেব তাকে বাড়ির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
“কি হয়েছে?”
দীপ্ত পানিটুকু এক নিঃশ্বাসে খেয়ে নিলো। তারপর একটু জিরিয়ে পুরো ঘটনাটা বললো। ঘটনাটি শুনতেই রোকসানা রক্তশুণ্য হয়ে গেলো। ভুতে তার বিশাল ভয়। সে উত্তেজিত হয়ে বললেন,
“আমি এখানে থাকবো না, আমি দেশে যাবো”
কিন্তু সেলিম সাহেব নির্বিকার। তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“ডাক্তার হয়ে ভয় পাচ্ছো দীপ্ত! ভুত টুত হয় না। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আর রোকসানা তুমি যেতে চাইলে আমি টিকিট কেটে দিবো”
সেলিম সাহেবের এমন নির্বিকার আচারণে বেশ রোকসানার মনক্ষুন্ন হলো৷ বরাবর এই লোকটির এমন দায়সারাভাব। এদিকে ভীত, সন্ত্রস্ত দীপ্ত এখনো থমথমে দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে ভুল ছিলো কি সব!
***********
ক্যালকুলাসের বই এর প্রথম চ্যাপ্টার থেকে ম্যাথ করা শুরু করেছে ধারা। তাকে আজ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাকে প্রমাণ করতে হবে অনল ভাই প্রশ্ন দেয় নি তাকে। তার সাথে ভেদাভেদ করে নি। ভালোবাসাও বেশ অবাককর জিনিস। প্রণয়ের আবেগে মানুষ সব কিছু করতেও দ্বিধাবোধ করে নি। নয়তো যে ধারাকে বকেও অনল পড়াতে বসাতে পারে না সেই ধারা কিনা নিজে নিজে পড়তে বসেছে তাও ভার্সিটি থেকে আসার পর থেকেই। অনল অবশ্য এখনো ফিরে নি। ধারা তাকে ফোন ও করে নি। অভিমানটা বজায় রেখেছে। যদিও বড়মাকে দশবারের মতো জিজ্ঞেস করেছে, “তোমার ছেলে আসে না কেনো?”
বড়মা মটরশুটি ছিলতে ছিলতে বললো,
“তুই ফোন দে”
“না, ওর সাথে কথা নেই”
বড় মা হাসতে হাসতে বললো,
“গোসা হয়েছে নাকি!”
ধারা উত্তর দেয় নি। গোসা হয়েছে বটে। খুব হয়েছে। এবং অনল যদি গোসা না ভাঙ্গায় তবে এই অভিমান থাকবেই। ধারা অংকটি কষতে কষতেই কেটে দিলো। মন বসছে না। মানুষটি আসে না কেনো! এতো দেরি তো হবার কথা নয়। উঠে বারান্দার দিকে যাবে তখন ই কলিংবেল বাজলো। ধারা আবার বসে পড়লো টেবিলে। মিনিট দশেক বাদে ঘরে প্রবেশ করলো অনল। ধারা বেশ মনোযোগী ভাব নিয়ে বসে আছে। অনল এক নজর তার দিকে তাকিয়েই টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কোনো কথা৷ বললো না সে। তবে ধারাও কম নয়, সেও তার রাগ অক্ষত রাখবে। কিছুতেই দমাবে না সে। মিনিট দশেক বাদে গোসল সেরে বের হলো অনল। চুলের গোড়া থেকে পানির রেখা মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। টিশার্টের গলার খানিকটাও ভেজা। টাওয়ালটি দিকে দায়সারাভাবে সে মাথা মুছতে লাগলো। মাঝে আড়চোখে একবার ধারাকেও দেখলো। সে চোখ মুখ খিঁচে তাকিয়ে আছে খাতার দিকে। মুখের ভঙ্গিমাতে অসম্ভব কাঠিন্য। অনল ঠিক তার পেছনে দাঁড়ালো। উঁকি দিতেই দেখলো অংকের একমাথায় এসে আটকে আছে ধারা। কিছুতে সামনে এগোতে পারছে না। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর পাশ থেকে একটি কলম নিয়ে ঝুকে পরের লাইনটি লিখে দিলো। অনল ঝুকতেই চমকে উঠলো ধারা। পাশ ফিরতেই অনলের সাথে চোখাচোখি হলো। অনলের ভেজা চুল থেকে এখনো জলরাশি পড়ছে। ধারার খাতাটাও ভিজলো কিঞ্চিত৷ ধারা চোখ সরিয়ে নিলো। ধারার এরুপ কাজে অনলের হাসি চওড়া হলো। সে একুয়েশন খানা লিখেই সোজা হয়ে ধারালো। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“শুধু শুধু তখন আমি রাগ দেখাই নি। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত সেটা আমার জানা। ব্যাপারটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়। ফ্যাক্ট এর। কেউ বিদ্বান হলে ওরা তোমার উপরের জিনিস। প্রশ্নটি কত কঠিন হতে পারে ধারণা নেই! তারপর ও যদি কেউ মুখ ফুলিয়ে থাকে আমার করার কিছু নেই”
অনলের কথায় ধারার সুপ্ত জিদটা যেনো আরোও ধপ করে জ্ব’লে উঠলো। আত্মদাম্ভিক মেয়েটি ধারা। সে যতই অলসতা দেখাক, কিংবা অনাগ্রহ প্রকাশ করুক না কেনো! কেউ তার দক্ষতার উপর প্রশ্ন করলে সেটা মোটেই সহ্য হয় না তার। অনল এর আগেও তাকে ফেলুরাণী বলতো। তবে আজকের কথাটা যেনো আত্মসম্মানে লাগলো। মনে মনে স্থির করলো তাকে যদি পরীক্ষা দিতেই হয় সে দিবে, এবং সবাইকে দেখিয়ে দিবে তার মার্কটি নিজস্ব অর্জিত। ধারা তাই বিনাবাক্য ক্ষয়ে আরোও মনোযোগ দিয়ে অংক কষতে লাগলো৷ অনল ঈষৎ অবাক হলো৷ ভেবেছিলো হয়তো ধারা হতাশ হবে। কিন্তু না, সে আরোও দ্বিগুণ উৎসাহে পড়াশোনা করছে। যেনো সে প্রতীক্ষাবদ্ধ, যেভাবেই হোক তাকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। অনল অপলক নয়নে চেয়ে রইলো ধারার দিকে। সেই চাহনীতে ছিলো শুধুই মুগ্ধতা।
ধারার পড়া শেষ হলো বেশ রাতে। ঘড়ির দিকে তাকালো সে। তিনটা বাজে। বাহু জোড়া উঁচু করে শরীরে টান দিলো। মাজা ধরে এসেছে বসে থাকতে থাকতে। চোখ বুলালো ঘরে। অনল নেই। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার লাইট জ্বলছে না। ঘরের লাইট এবং বাহিরের নিকষ আধার মিলে আলোআধারী মায়া তৈরি করেছে। সেই মায়ায় অনলকে যেনো আরোও বেশি মায়াবী লাগছে। বিশাল দেহী মানুষটাকে ঘিরেই যেনো রাজ্যের মায়া। গাঢ় অভিমানের জন্য একটু যে কথা বলবে সে আর হলো না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। তারপর বিছানাটা ঠিক করেই গা এলিয়ে দিলো ধারা। বিছানায় শুতেই রাজ্যের ঘুম এসে ভর করলো চোখে। কিছুসময় পর ই অনুভব করলো এক শক্ত হাত তাকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে মুখ গুজতেই উষ্ণ নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়লো ঘাড়ে। নরম কন্ঠটি কানে ভেসে এলো,
“আমি তোকে বিশ্বাস করি ধারা, নিজের থেকেও তোর উপর আমার অধিক বিশ্বাস। কিন্তু আমি যে তোর ক্ষতি হতে দেখতে পারবো না। কি উত্তর দিবো তখন নিজেকে। আমার জন্য তোর ক্ষতি হলে নিজেকে যে ক্ষমা করতে পারবো না রে। কখনই পারবো না”
ধারা চোখ খুললো না। ঘুমের প্রহরে স্বপ্ন এবং বাস্তবতাকে আলাদা করতে চাইলো না। থাকুক কিছু মিষ্টি স্বপ্ন, ক্ষতি কি!
ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো অনলের বলিষ্ট বুকে। কিছুসময় ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। রাতের ওই কথাগুলো কি সত্যি প্রিন্স উইলিয়াম বলেছিলো নাকি তা নিছক স্বপ্ন ছিলো বুঝে উঠতে পারছে না। ধারা বেশি মাথা নষ্ট করলো না। আজ ক্লাস সকালে বিধায় ছুটে তৈরি হলো সে। কোনোমতে একটি রুটি গুজেই ছুটলো ক্লাসে।
বাড়ি থেকে বের হতেই ধাক্কা খেলো এশা আশার সাথে। তাদের বেশ উৎফুল্ল দেখালো। দুটো কি জানে আলাপ করছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। কারণ বুঝে উঠতে পারলো না ধারা। জিজ্ঞেস করার সুযোগ ও পেলো না ধারা। ছুটলো সে ক্লাসের উদ্দেশ্যে।
ক্লাসে পৌছাতেই দেখা গেলো বন্ধুমহল জোট বেঁধে আছে। ধারা কাছে যেতেই তাদের কথা বন্ধ হয়ে গেলো। ধারা অবাক কন্ঠে মাহিকে শুধালো,
“কি হয়েছে? কি নিয়ে আলাপ করছিলি?”
তখন দিগন্ত একটি ছবি বের করে ধারার হাতে মোবাইলটা দিলো। মোবাইলের ছবিটি দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড়। ছবিতে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে। সে একটি যুবকের সাথে কথা বলছে। যুবকটি আর কেউ নয় বরং দীপ্ত……..
চলবে
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৮তম_পর্ব
মোবাইলের ছবিটি দেখতেই চোখ বিস্ফারিত হবার জোগাড়। ছবিতে মাধবীকে দেখা যাচ্ছে। সে একটি যুবকের সাথে কথা বলছে। যুবকটি আর কেউ নয় বরং দীপ্ত। দীপ্তকে মাধবীর সাথে দেখতেই মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে গেলো ধারার। সে ভেবে পাচ্ছে না এদুজনের যোগসূত্র কি! ধারা জিজ্ঞাসু কন্ঠে দিগন্তকে শুধালো,
“এই ছবি কই থেকে পেয়েছিস?”
“কাল তোরা যখন বের হয়ে গেলি, তারপর আমি আর অভীক মাধবীর পিছু নেই। ও খুব চিন্তিত ছিলো। তারপর ও একটা গলির সামনে দাঁড়িয়ে ও কাউকে ফোন করলো। ফোন করার মিনিট পঁচিশের মধ্যেই এই ছেলেটা ওখানে উপস্থিত হয়। এই ছেলেটাই সেদিন ভার্সিটিতে এসেছিলো। তোর বিয়ের কথাটা ফাঁ’স করেদিলো। তাই সাথে সাথেই আমি ছবিটা তুলে নেই। ওরা বেশ কিছুসময় কথা বলছিলো। কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় কিছুই শুনতে পাই নি”
ধারা এখনো চেয়ে রয়েছে ছবিটির দিক।তার মনে হাজারো সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিলো অন্তস্থলে। সাথে সাথেই সেলিম আহমেদের সাথে হওয়া শান্ত যু’দ্ধের কথা স্মরণে এলো। মনের ভেতরে সুপ্ত ঘৃণাটা মাথাচাড়া দিলো। বিদ্রোহ করে উঠলো অবুধ চিত্ত। তিতকুটে অনুভূতিতে মুখশ্রীতে জড়ো হলো বিরক্তি। বাবা হিসেবে না স্বীকার করলেও মানুষটি এতোটা নিচে নামবে কল্পনাও করে নি ধারা। ধারার শক্ত মুখশ্রী দেখে মাহি জিজ্ঞেস করলো,
“কি ভাবছিস?”
“ভাবছি কেউ এতোটা নিচে কিভাবে নামে!”
ধারার কথার মর্মার্থটা বুঝলো না বন্ধুমহলের কেউ। তবে নীরব বললো,
“আমরা ওকে এই ছবি নিয়ে ব্লা’ক’মে’ই’ল করতেই পারি, এটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। আর এতে আমাদের বিবিসি দিগন্ত আমাদের সাহায্য করতে পারে”
“হ্যা, আমি অলরেডি এই ছবি ছড়িয়েও দিয়েছি। মাধবীকে এবার ধরলেই ও আমাদের কাছে সব উগড়ে দিতে পারবে”
ধারা মলিন হাসি হাসলো। যেখানে নিজের বাবা তার সুখটা পায়ে পিসছে প্রতিনিয়ত, সেখানে তার বন্ধুমহল সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে তার এবং অনলের অপবাদ মিটাতে। সত্যি, আপনজন রক্তের টানে হয় না, হয় আ’ত্মা’র টানে।
*******
সেলিম সাহেবের মুখ কঠিন হয়ে আছে, সে তন্ন তন্ন করে নিজের কাপড়ের মাঝে নিজের উইলের কাগজখানা খুঁজছেন। কিন্তু কিছুতেই পাচ্ছেন না। তার স্মরণশক্তি এতোটাও খারাপ নয়। তার স্পষ্ট মনে আছে সে কাগজখানা এখানেই রেখেছিলেন। তাকে বিধ্বস্ত লাগছে। কপালে জমেছে নোনাজলের বিন্দু। কাগজটি হারিয়ে গেলে পুনরায় আবারো তাকে বানাতে হবে। কাগজটি কি কেউ সরিয়ে নিয়েছে! এমন কাজ একজন ই করতে পারে! রোকসানা। ঠিক সেই সময়টিতেই রোকসানার আগমন ঘটলো ঘরে। তাকে দেখেই গম্ভীর কন্ঠে সেলিম সাহেব প্রশ্ন ছুড়লেন,
“তুমি আমার আলমারী ঘাটাঘাটি করেছিলে?”
প্রশ্নটি কর্ণপাত হতেই চমকে উঠলো রোকসানা। আমতা আমতা করে বললো,
“না, আমি কেনো তোমার জিনিসে হাত দিবো?”
“তাহলে আমার উইলের কাগজটি কোথায়?”
রোকসানা থতমত খেয়ে গেলো। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করলো, লাভ হলো না। সেলিম সাহেবের বিশ্বাস অটল। তিনি জে’রা শুরু করে দিলেন,
“কোথায় রেখেছো রোকসানা কাগজটা?”
“আমি দেখি ই নি কাগজ!”
“আমি আর একবার জিজ্ঞেস করবো! কোথায় আমার কাগজ?”
সেলিম সাহেবের মস্তিষ্কে কথাটা অনুধাবণ হতে সময় নিলো। কেউ কতটা ক্ষুদ্ধ হলে এমন কাজ করতে পারে! তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“পুড়িয়ে দিয়েছো মানে?”
“মানে টা স্পষ্ট, আমি পুড়িয়ে দিয়েছি। আজব, যে মেয়ে তোমাকে বাবা বলেই মানে না তাকে তুমি সম্পত্তির অর্ধেক দিয়ে দিবে আর আমি বসে বসে দেখবো!”
“আমার জিনিস আমার মেয়েকে দিবো, তোমার থেকে তো শুনবো না আমি!”
“কেনো শুনবে না সেলিম! তোমার শুনতে হবে, এই মেয়ের জন্যই তুমি কখনো সন্তান নাও নি। এখন এই মেয়ের জন্য তুমি আমাকে ঠকাবে, আর আমি সেটা মেনে নিবো! অনেক হয়েছে আর নয়। আমি আর নিজের সুখের বিসর্জন দিতে পারছি না।”
রোকসানার কথাগুলো শুনতেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলেন না সেলিম সাহেব। তীব্র স্বরে বলে উঠলেন,
“তোমার সুখ বিসর্জিত হয়েছে! সত্যি রোকসানা! তাহলে সব জেনেশুনে আমাকে কেনো বিয়ে করেছিলে? আমি নাহয় স্বার্থপর মানুষ, তোমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য ছিলো আমার উন্নতিতে যেনো বাঁধা না পড়ে। তুমি কেনো রাজি হয়েছিলে! আমি তো বলেই ছিলাম, আমার একটি মেয়ে আছে। আমি আর কোনো সন্তান চাই না। তখন তুমি রাজী হলে কেনো! তখন তো বেশ আনন্দিত ছিলে তুমি। কারণ তোমার কাছে তখন আমার বউ হওয়াটাই জরুরি ছিলো। তোমার কাছে আমার অর্থই সবথেকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। বিসর্জন তুমি দাও নি রোকসানা। আমার জন্য যদি কেউ বিসর্জন দেয় সে সুরাইয়া। তুমি নও। আমি তো তোমার প্রাপ্যটা তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার হক কিন্তু আমি মারি নি। সুতরাং আমার মেয়েকে আমি কি দিবো না দিবো সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যপার। এর মাঝে দয়া করে তুমি এসো না।”
বলেই ঘর থেকে বের হলেন সেলিম সাহেব। রোকসানা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। চোখ মুখ রক্তিম হয়ে রয়েছে তার। লোকটির মনে আজ ও যেন সুরাইয়ার ই বসবাস। কখনোই যেনো সেই স্থান তার হবে না। বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে তার। এখনো মনে আছে মুমূর্ষু সুরাইয়ার জন্য লেখা চিঠিগুলো এখনো সযত্নে উঠিয়ে রেখেছেন সেলিম সাহেব। কখনো পাঠানোর সুযোগটি ই হয় নি। কারণ সেই মানুষটি ই আজ নেই_______
ক্লাস শেষ হতেই মাধবীর মুখোমুখি হলো ধারা। ছবিটি সম্মুখে রেখে বললো,
“এই লোকটিকে কিভাবে চিনো তুমি?”
মাধবী খানিকটা চমকে উঠলো। সে গাইগুই করে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু ধারার হুমকির সামনে জোর খাটলো না। ফলে একে একে সকল কথাটা ফাঁ*স করতেই হলো।
****
অনল ল্যাপটপের সম্মুখে বসে রয়েছে। তার মুখখানা শক্ত হয়ে আছে, বিশাল একখানা সুযোগ তার সামনে। অস্ট্রেলিয়ার বেশ বড় একটা কোম্পানি থেকে একটা চাকরির অফার পেয়েছে কাল রাতে। ইন্টারভিউটি হবে অনলাইনে। তারপর তারা জানাবে ফলাফল৷ চাকরির ঝামেলার কারণে অনল আজ সকালে ইন্টারভিউ দিয়েছে। এখন তাদের মেইল এসেছে। অনলের চাকরি হয়েছে। তারা নেক্সট সপ্তাহেই অনলকে জয়েন করতে বলেছে। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে, অনল তো প্রথমেই ধারাকে নিয়ে যেতে পারবে না। এখন কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। স্যালারিও বিশাল, সুযোগটি বেশ চমৎকার। কিন্তু ধারাকে ছেড়ে যাওয়াটা মন সায় দিচ্ছে না। বেশ কতক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে ল্যাপটপের দিকে। কিছুই মাথায় আসছে না। কি করা উচিত! অফারটি ছেড়ে চাকরির এই টানাপোড়েন চলবেই। বুঝে উঠতে পারছে না অনল। মাথাটা ধরে এসেছে। একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হয়না। যে ভাবা সেই কাজ। ল্যাপটপ বন্ধ করে দিলো অনল। সাথে সাথেই ধারার ক্যালকুলাস বই টা পড়ে গেলো। মেয়েটি কালকে পড়ে এখানেই রেখে দিয়েছে বই। অনল নিঃশব্দে হাসলো। বইটি তুলতেই তার ভেতর থেকে একটি কাগজ পড়লো নিচে। সেটা তুলে হাতে নিতেই দেখলো গোটা গোটা করে কিছু লেখা। অনল পড়তে লাগলো লেখাগুলো।
অনলভাই,
এই চিঠিখানা বহু কষ্টে লিখতে বসেছি আজ। আমার মনের সকল অগোছালো চিন্তাগুলো একটা কাগজে উপস্থাপন করবো। এটা এতোটা কষ্ট হবে জানা ছিলো না। আমি নিজেও সে বিস্তার ভাবনার জোয়ারে ভাসছি গো। চিন্তাগুলো সব যেনো ভাসমান। আচ্ছা, এই ভালোবাসা কি! এই অনুভুতিগুলো কি! বহুপূর্বে একখানা চিঠি লিখেছিলাম। কই এতো তো কষ্ট হয় নি। এত এলোমেলো ছিলো না তো আমার চিন্তাগুলো। শব্দগুলো ছিলো সুসজ্জিত। তবে তোমার বেলায় এমন কেনো? তোমার বেলায় আমার মস্তিষ্ক অচল কেনো অনল ভাই। আজ মাহি আমায় প্রশ্ন করল, “ভালোবাসিস তাকে?” আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কিভাবে পারবো বলো, এই ভালোবাসা নামক অনুভূতিটি যে অচেনা আমার কাছে। তুমি আমার কাছে কোনোকালেই প্রিয় ছিলে না, ছিলে অতি অপ্রিয় ব্যক্তি। বিরক্ত হতাম তোমার প্রতি কার্যে, অসামান্য রাগ হতো তোমার উপর। অথচ তোমার কাছে এক অকল্পনীয় শান্তি আছে। শতবিপদেও তোমার নামটি ই আমার কল্পনায় আসে অনল ভাই। তোমার জীবনে অন্যকেউ আসবে ভাবতেই তোমাকে হারাবার টলমলে ভয়ে বুক কেঁপে উঠে। এই বিয়েটায় আমার আপত্তিটি ছিলো সর্বাধিক। অথচ দেখো আজ তোমার থেকে দূরত্ব আমার সহ্য হচ্ছে না। সব থেকে তিতকুটে অনুভূতিটিও তোমার উপস্থিতিতে মধুর হয়ে উঠে। তোমার বড় বড় হাতের ফাঁকের উষ্ণতাটি যে আমার সবচেয়ে প্রিয়। তোমার দূর্বোধ্য স্নিগ্ধ হাসিতে বারবার হারাতে চাই আমি। তোমার বলিষ্ট বুকে মুখ গুজে তোমার মাদকতায় ডুবতে চাই। আমার একটা ছোট স্বপ্ন আছে অনলভাই জানো, যা আমাকে প্রায়শ ই ভাবায়। স্বপ্নটি তোমাকে নিয়ে। কোনো এক গোধূলীতে আমি বসে রয়েছি তোমার সাথে। তুমি গান গাইছো, আমি অধীর হয়ে চেয়ে রয়েছি তোমার পানে। কি অদ্ভুত তাই না! যদি আমার এই এলোমেলো চিন্তাগুলো, আমার বদ্ধ মস্তিষ্কে তোমার নামের আবেগ গুলোকে যদি প্রণয় বলে তবে হ্যা, আমি তোমার প্রণয়িনী। বিয়ের রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, আমার কি মনে হয় তোমার মতো দাম্ভিক, আত্মজেদী মানুষটির ভেতর যে র’ক্ত”মাং’সে’র’সে’র হৃদযন্ত্রটি আছে তা আমার জন্য স্পন্দিত হয়! আমি সত্যি জানি না অনল ভাই, তবে তোমার জন্য আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়। তোমার মতো আত্নদাম্ভিক, জেদি, রাগী, অসহ্য মানুষটির জন্যই আমার হৃদয় স্পন্দিত হয়, হাজার বার। তোমার প্রতি আমার প্রণয়টা বরাবর ই একটা গোলকধাঁধা, অনল ভাই; নিছক প্রহেলিকা। এই দূর্বোধ্য আবেগের উত্তর আমি আজও পাই নি। অথচ এই প্রণয় প্রহেলিকা যে আমার জীবনের অস্তিত্বে মিশে যাবে কে জানতো! কে জানতো! এই প্রহেলিকার চোরাবালিতে আমি একটু একটু করে গ্রাস হবো। কে জানতো বলো! আমার এই আবেগের কি উত্তর আছে তোমার কাছে অনল ভাই? আমার স্বপ্নটি সত্য হবে? তোমার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে——-
ইতি
তোমার প্রণয়িনী
ধারা
এই চিঠিটি ধারা বহুপূর্বে লিখেছিলো। দেবার সময় টি ই হয় নি। অনল অনুভব করলো তার হৃদস্পন্দন বেসামাল হয়ে উঠেছে। সাথে সাথেই সে ধারাকে ফোন লাগালো। ফোন বাজছে কিন্তু কেউ ধরছে না। এখন ধারার ছুটি হয়ে যাবার কথা। অথচ সে এখনো বাড়িতে ফিরে নি। ফলে বাধ্য হয়ে মাহিকে ফোন দিলো অনল।
******
লাগাতার কলিংবেল বাজছে। কেউ খুলছে না দরজা। জ্বরে ক্লান্ত দীপ্ত বাধ্য হয়ে উঠলো। গতকালের কান্ডের পর তার জ্বর এসেছে। ধুম জ্বর। সে কোনো মতে উঠে দরজা খুললো। খুলতেই খানিকটা চমকে উঠলো, কারণ বাহিরে ধারা দাঁড়িয়ে আছে………..
তখন ই সেখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো। অনলকে দেখতেই সে বললো,
“ধারা, হেড স্যারের রুমে”
দিগন্তের কথাটা শুনতেই অনলের বুঝতে বাকি রইলো না কাহিনী। সে যা সন্দেহ করছিলো সেটাই হয়েছে। ধারা তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিয়ে ঠিক লড়াই করতে চলে গেছে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো! কেনো বুঝতে চায় না সবকিছুর একটা পদ্ধতি রয়েছে। র’ণ’চ’ন্ডী হওয়া সর্বদা মানায় না। এতো সময় তো সন্দেহের তোর অনলের উপর ছিলো এখন ধারার উপরও সেটা বর্তাবে। অনল আর দাঁড়ালো না। সে সোজা চলে গেলো ডিপার্টমেন্ট হেড আনসারী সাহেবের কেবিনের কাছে। অনলের ছুটে যাওয়া মাহির মনে সন্দেহ তৈরি করলো সে দিগন্তকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাহিনী কি?”
“সকালবেলা ধারা আমাকে ফোন করেছিলো। আমি তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ফোন ধরতেই ধারা ঠান্ডা গলায় ভার্সিটিতে আসার কথার বললো। আমিও দেরি না করে চলে এলাম। ভার্সিটিতে আসার পর ও আমাকে বললো সে আনসারী স্যারের রুমে যাবে। সে তার সাথে অনল স্যারের ব্যাপারে কথা বলবে। এবং আমাকেও সাক্ষী দিতে হবে সেদিন করিডোরে যা হয়ে তা আমি রাগের বশে বলেছি। তার কোনো সত্যতা নেই। মাধবীর (গত পর্বে আমি মাধবীর নামের বদলে মালতী লিখেছিলাম) হয়তো বুঝতে ভুল হয়েছে। অনল স্যার কোনো পার্শিয়ালিটি করে নি”
“তুই কি স্যারকে স্বীকারোক্তি দিয়েছিস?”
মাহি অবাক কন্ঠে প্রশ্নটি করলো৷ দিগন্ত একটু থেমে বললো,
“হ্যা, আর উপায় কি! ভুল তো আমার হয়েছে। আমার জন্য একটা নির্দোষ মানুষ তো ভুগতে পারে না। কিন্তু স্যার বিশ্বাস কতোটুকু করেছে জানি না। আমাকে সে ক্লাসে যেতে বললো৷ ধারা এখনো স্যারের সাথেই কথা বলছে”
দিগন্তের কথাটি শুনে মাহি তার কাঁধে চা’প’ড় মেরে বললো,
“আমার তোর উপর গর্ব হচ্ছে। প্রাউড অফ ইউ দোস্ত। এটাই না আমাদের দিগন্ত”
মাহির কথাটা শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো দিগন্ত। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। অগোছালো হৃদয়টা হুট করে প্রচন্ড জোরে স্পন্দিত হচ্ছে। এক অজানা ভালোলাগা অনুভূত হচ্ছে। তাড়াতাড়ি মাহির হাত সরিয়ে বললো,
“লজ্জা লাগে না, ছেলেদের গায়ে হাত দিস। অ’স’ভ্য মহিলা”
বলেই হনহন করে হাটা দিলো সে। মাহি বেকুবের মতো চেয়ে রইলো তার দিকে। ভুল টা কি হলো! দিগন্ত একটা চা’প’ড়ে এতো ক্ষেপে গেলো কেনো!
********
হেড অফ ডিপার্টমেন্ট “ম্যাথেমেটিক্স”, আব্দুল আনসারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধারা। তার হাত পা এখনো ঈষৎ কাঁপছে। আনসারী সাহেব চোখের চশমাটা মুছে পড়লেন। তারপর অফিস ক্লার্ক হাফিজকে ডাকলেন। রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“এক কাপ চা দাও”
হাফিজ ও সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। চাও চলে এলো মিনিট দশেকের মাঝে। আনসারী সাহেব আয়েশ করে চুমুক দিলেন৷ তারপর তীর্যক নজরে তাকালো ধারার দিকে। ধারা এখনো ভীত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। শুকনো ঢোক গিললো সে। এতো সময় সে এবং দিগন্ত ই স্যারের সাথে কথা বলেছে। সে কি বুঝলেন সেটা তিনি প্রকাশ করেন নি। উপরন্তু শুধু তীর্যক নজরেই দেখে গেছে ধারার দিকে। তারপর সে শান্ত কন্ঠে বললেন,
“দিগন্ত তুমি ক্লাসে যাও। আর ধারা তুমি এখানে থাকো”
তারপর থেকেই তিনি ধারাকে দাঁড় করিয়েই রেখেছেন। যত সময় যাচ্ছে ধারার ভয় গাঢ় হচ্ছে। হিতে বিপরীত হবার ভয়। ভালো করতে যেয়ে যদি অনল আরোও বাজে ভাবে এই চোরাবালিতে আটকে যায় নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না ধারা। এর মাঝেই আনসারী সাহেবের গম্ভীর কন্ঠ কানে এলো,
“দেখো ধারা, তুমি যা বলছো আমি বুঝেছি। তোমার ধারণা তোমার ক্লাসমেটের একটা ভুল ধারণা হয়েছে। বুঝলাম। কিন্তু তোমার বা ওই ছেলেটা দিগন্ত, তার স্বীকারোক্তিতে খুব একটা যায় আসবে না। তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিক। ডিসিশন আমরা তখন নিবো। তবে তোমাদের দুজনের স্বীকারোক্তিতে কিছুই প্রমাণ হয় না। চোর যদি এসে বলে সে চুরি করে নি তাহলে সত্য বদলায় না। আর আমি এখানে ছাত্রছাত্রীদের ইনভলভ করতে চাচ্ছি না, আমাদের বিষয় আমরা দেখে নিবো”
অবশেষে চা খাওয়া শেষ করে আনসারী সাহেব মুখ খুললেন। তার কথা শোনার পর পর ই ধারা প্রতিবাদ করে উঠলো,
“স্যার, মাধবীর কাছেও কিন্তু প্রমাণ ছিলো না। সেও দিগন্তের কথাটা শুনেই আপনাকে কমপ্লেইন করেছে”
“সেজন্য ই তো আমরা তদন্ত করছি। প্রমাণ হলে অনলের শাস্তি হবে না। এখানে আমার কিছুই করার নেই। সব কিছুর একটা সিস্টেম আছে৷ তুমি বরং যাও”
বলেই আনসারী সাহেব তার যাবতীয় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আজকে ফোর্থ ইয়ারের ক্লাস নিতে হবে। হাতে অনেক কাজ। মিটিং ও আছে দুপুরের পর। ধারার মুখে আষাঢ়ের মেঘ মেদুর জমলো। নিয়ম কাননের বাহানা দিয়ে স্যার তার কথা উপেক্ষা করে যাচ্ছে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। কিন্তু হার মানবে না সে। শান্ত কন্ঠে বললো,
“স্যার, আপনাদের সন্দেহ তো আমার রেজাল্ট নিয়ে। আমার মতো খারাপ ছাত্রী কি করে ভালো করে। তাহলে আমি যদি দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেই তবেও কি আপনাদের একই সন্দেহ থাকবে?”
এবার চোখ তুলে চাইলেন আনসারী সাহেব। তার চোখ চকচক করছে। তার মাথায় দ্বিতীয় বার পরীক্ষা নেবার চিন্তা ছিলো। তদন্ত যাই হোক সে আবারো পরীক্ষা নিতেন। এই রেজাল্ট বাতিল করে দিতেন। তবে ধারা নিজেই জালে পা দিয়েছে। সন্দেহ ধারাকে নিয়ে। তাহলে পুরো ক্লাসের পরীক্ষা নিয়ে কি হবে! ধারার পরীক্ষা নিলেই তো সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। আনসারী সাহেব হাসলেন, দুর্বোধ্য হাসি। তারপর বললেন,
“বুঝে বলছো?”
“জ্বী স্যার”
“যদি তুমি একই গ্রেড না পাও তবে কিন্তু তোমাকে রাস্টিকেট করার অধিকার প্রশাসন রাখে। সাথে অনলকে সাসপেন্ড। ভেবে দেখো”
ধারা শুকনো ঢোক গিললো। তার বুক কাঁপছে। কিন্তু অনলের জন্য এতোটুকু তার করতেই হবে। গাল ফুলিয়ে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। তারপর আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
“জ্বী স্যার, আমি রাজি”
আনসারী সাহেবের হাসি প্রশস্ত হলো। তিনি বললেন,
“ক্লাসে যাও। তদন্ত শেষ হলেই তোমাদের জানানো হবে। আমার একার হাতে তো কিছু নেই”
আনসারী সাহেবের মুখ দেখে ধারার মনে হয়েছিলো তিনি ধারার প্রস্তাবে রাজী। কিন্তু তার শেষ উক্তি ধারাকে আবার হতাশ করলো। ক্ষণিকের জন্য উৎফুল্ল মুখশ্রী পুনরায় হতাশায় ডুবলো। ধারা নতমস্তক বেরিয়ে এলো আনসারী স্যারের কেবিন থেকে। কেবিন থেকে বের হতেই ধারার দেখা মিললো অনলের সাথে। সে কিছু বলার পূর্বেই অনল খপ করে তার হাত চেপে ধরলো। টেনে নিলে চললো ধারাকে। তার মুখশ্রী কঠিন হয়ে আছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে সে। ধারা বারবার বলছে,
“আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছো?”
কিন্তু তার কথাটা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেলো অনল। তার সারা শরীর ঈষৎ কাঁপছে। চোয়াল জোড়া শক্ত হয়ে আছে।
মিনিট দশেক বাদে ডিপার্মেন্টাল বিল্ডিং এর একটা ফাঁকা স্থানে এসে দাঁড়ালো অনল। হাতখানা ছেড়ে দিলো সে ধারার। ফর্সা হাত রক্তিম হয়ে গেছে রুক্ষ্ম হাতের পেষ্টনে। অসম্ভব রাগ হলো ধারার। সে তীব্র স্বরে বললো,
“কি হয়েছে তোমার? উ’ম্মা’দের মতো টেনে আনলে কেনো?”
“স্যারের রুমে কেনো গিয়েছিলি?”
প্রচন্ড শীতল কন্ঠে কথাটা শুধালো অনল। তার চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে আছে তবে দৃষ্টি বরফ শীতল। ধারা তার চোখের দিকে তাকাতেই কেঁপে উঠলো। আমতা আমতা করে বললো,
“কথা বলতে গিয়েছিলাম”
“সব জায়গায় তোর নাকটা ডুকাতেই হবে? পাকনামি না করলে হয় না? আচ্ছা! একবার আমাকে জিজ্ঞেস করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? একা একা কেনো গেলি?”
অনলের প্রশ্নের বর্ষণে খিল হারিয়ে ফেললো ধারার। অগোছালো ভাবে বললো,
“আমার দ্বারা চুপ করে থাকাটা সম্ভব হলো না। ঘটনাটা তো আমাকে কেন্দ্রিক। তাই আমি স্যারকে বোঝাতে গিয়েছিলাম”
“বুঝেছে সে?”
ধারা মাথা নামিয়ে নিলো। তারপর নাড়িয়ে নেতিবাচক উত্তর দিলো। অসহায় কন্ঠে বলল,
“আমি তাকে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার কথাটাও বলেছি। তবুও শুনে নি”
ধারার কথাটা শুনেই ক্রোধে ফেটে পড়লো অনল। তীব্র স্বরে বললো,
“তোর মাথা ঠিক আছে? দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিবি। তোর কি নিজেকে গণিতের বিদ্যাসাগর মনে হয়।সেই তো টেনেটুনে পাশ করিস। এ পেয়েছিস বলে মনে করছিস তুই বিদ্বান হয়ে গেছিস। এক লাইন লিখেই তো ইকুয়েশন ভুলে যাস। তোর মনে হয় তারা প্রশ্ন সোজা করবে। যদি সেম গ্রেড না উঠে তোকে রাস্টিকেট করবে! ওরা তো বসেই আছে প্রমাণ করার জন্য। কে বলেছিলো পাকনামি করতে তোকে?”
অনলের ক্রোধানলের মুখোমুখি এই প্রথম ধারা হয়েছে। ফ্যালফ্যালিয়ে সে তাকিয়ে রইলো অনলের দিকে। উত্তর দিতে ইচ্ছে হলো, “আমি তো তোমার জন্য করেছি” কিন্তু উত্তরটা মুখ থেকে বের হলো না। শুধু চোখ থেকে বেয়ে পড়লো এক বিন্দু অশ্রু। না চাইতেও তার চোখে ভিড় হলো অশ্রুর। অস্পষ্ট স্বরে বললো,
“আমি পারবো, দেখো”
অনল সাথে সাথে দেয়ালে সজোরে আঘাত করলো। অনলের এমন আচারণে কেঁপে উঠলো ধারা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো অনল। তার শরীর কাঁপছে। আঘাত করায় হাতটা রক্তিম হয়ে উঠেছে। বা হাত দিয়ে কপালের চামড়া টেনে ধরলো অনল। এরপর ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
“ধারা, সবখানে একটা নিয়ম থাকে। মনমতো করলেই হয় না। তোর কি মনে হয় আনসারী স্যার তোর কথা বিশ্বাস করেছে? না তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন। আর তুই সেই সুযোগ দিয়ে দিলি। আমাকে সাসপেন্ড করলেও তারা চাকরি থেকে তো বাদ দিতেন না। আমি তো বলেছিলাম আমি সামলে নিবো। একটু বিশ্বাস রাখতে পারলি না?”
“কিন্তু, আমি তো”
“আমি তোর সাহায্য চেয়েছি কি? চাই নি। তাহলে?”
এবার মুখ ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনল। তারপর বললো,
“অনেক সাহায্য করেছি। এবার ক্লাসে যা। আমার টা আমাকে বুঝতে দে।”
বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো অনল। ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। অনলের যাবার পানে টলমলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ধারা মাথা তুলে থাকালো নীলাম্বরের দিকে। আকাশেও যেনো বিষন্নতা ছেয়ে আছে। বিষাদমাখা স্বরে বললো,
“আমি সত্যি পারতাম। আমার জন্য নয়, তোমার জন্য আমি ঠিক পারতাম”
********
ক্লাস শেষ হয়েছে। বিকেলে ল্যাব থাকায় ক্যাফেটেরিয়াতে খেতে এসেছে বন্ধুমহল। ধারার মেঘ মেদুর মুখখানা দেখে বন্ধুরা বার বার জিজ্ঞেস করলো কিন্তু ধারা উত্তর দিলো না। রফিক মামা বন্ধুমহলকে দেখেই বললেন,
“কি গো সিনিয়র ভাই বোনেরা, কি হাল? দেখাই তো মিলে না। সিনিয়র হইয়ে কি হাওয়া হয়ে গেলে। এই রফিক মামারে ভুলে গেলা?”
“ভুলি নি বলেই তো আসা। দাও তো পাঁচটা গরম ভাত। আর তরকারি কি আছে?”
“আছে অনেক কিছুই আইসে দেখো”
রফিক মামার কথায় মাহি উঠলো। ধারাকে ঠেললো, কিন্তু সে উঠতে চাইলো না। সকালের ঘটনাটা এখনো চোখে ভাসছে। তখন হুট করে মাহি বলে উঠলো,
“এই ধারা, অনল ভাই এর সাথে ক্যাফের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ওই মেয়েটা কে?”
মাহির কথায় ধারার নজর গেলো ক্যাফেটেরিয়ার বাহিরে। তাদের ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেশ দূরে একটা গাছের পাশে অনলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। মেয়েটি আর কেউ নয় অনন্যা। ক্যাফেটেরিয়া থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের। না চাইতেই অনলের সাথে অনন্যার দাঁড়িয়ে থাকাটা দৃষ্টিকটু ঠেকলো। অকল্পনীয় কিছু চিন্তা মস্তিষ্ক ছেয়ে গেলো ধারার। বুকে অজানা ভয় হানা দিলো। ধারা উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে হেটে সেদিকে রওনা দিলো। মাহিও তার পিছু নিলো। অনল এবং অনন্যা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে কিছুটা দূরে একটা ঝোঁপের পিছনে আশ্রয় নিলো ধারা। সে লুকিয়ে তাদের কথা শুনবে। যদিও এই স্বভাব টি অতি কুৎসিত। কিন্তু তার মনে জন্মানো সন্দেহ এর চেয়েও কুৎসিত। সে যদি এখন সামনে যেয়ে দাঁড়ায় তারা কথা বলবে না। কিন্তু সেটা হওয়া যাবে না। আর সকালের ঘটনার পর অনলের সামনে যাওয়া মানে ক্ষুধার্ত বা’ঘে’র সামনে পড়া। তাই সে লুকিয়েই কথাটা শুনবে। মাহি এসে দেখলো ধারা ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে আছে। মাহিও হাতু গেড়ে তার পাশে বসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“এখানে কি করিস?”
“নিজের বরের উপর নজরদারি। টু শব্দ করবি না। শুনতে দে”
মাহি আর কথা বাড়ালো না। তখনই অনলের শীতল কন্ঠে শোনা গেলো,
“আমি তো একবার মানা করেছি অনন্যা তাহলে কেনো বারবার আমাকে অফার দিচ্ছো?”
“আমি তোর ভালো চাই অনল। রাইট নাউ তোর যা অবস্থা, তোর কি মনে হয় এ ছাড়া কোনো অপশন আছে? ওরা তোকে সাসপেন্ড করবে। ফলে তোর ক্যারিয়ার নষ্ট হবে। অস্ট্রেলিয়ায় অনেক সুযোগ তোর। তোর জিআরই স্কোর ভালো, আর এই প্রজেক্টে কাজ করলে তোর ভিসার কোনো প্রবলেম হবে না। তুই হাইয়ার স্টাডি করতে পারবি। আমার সুপারভাইজার তোকে মাথায় করে রাখবে৷ আর সত্যি বলতে, এই প্রজেক্টটা তো তোর স্বপ্ন ছিলো”
অনন্যার কথা শুনেই তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় অনল। সাথে সাথেই ভেসে উঠলো ভার্সিটি জীবনের কথা। ভেসে উঠলো ইন্ট্রা ভার্সিটি প্রোগ্রামটির কথা। সেই কম্পিটিশনে একটি প্রজেক্ট নিয়ে অনল, অনন্যা এবং তাদের বাকি দুজন টিমমেট কাজ করছিলো। কম্পিটিশনে তাদের চারজনের কষ্টের ফল ছিলো এই প্রজেক্ট। সব চেয়ে বেশি আশা ছিলো অনলের প্রজেক্টটি নিয়ে। কিন্তু সব কিছু মূহুর্তেই তছনছ হয়ে গেলো। অনন্যা সবার অগোচরে সেই প্রজেক্টটি সাবমিট করলো অস্ট্রেলিয়ার একটি বড় ইউনিভার্সিটির টিচারের কাছে। ফলে খুব সহজেই তার স্কোলারশিপ হয়ে যায়। অনল যখন ব্যাপারটা জানতে পারে তখন সে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলো অনন্যাকে। অনন্যা হেসে বলেছিলো,
“আমি তোকে ইউজ করি নি অনল, তোরা আমাকে সাহায্য করেছিস”
ঘটনাটি স্মরণ হতেই অসীম বিরক্তি এবং ঘৃণা মুখে ফুটে উঠে অনলের। সে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
“আমার ফিউচার নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না অনন্যা। তুমি বরং তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো। আমারটা আমি বুঝে নিবো। আসলে কি বলতো! তোমার মতো স্বার্থপর মানুষ অন্য কারোর কথা ভাবতেই পারে না। এর মাঝেও কোনো স্বার্থ আছে তোমার। আমার তো মনে হয় তুমি নিজের জন্যই আমাকে অফার দিচ্ছো। হয়তো সেই প্রজেক্টে কোথাও আটকেছো। ফলে আমাকে তোমার প্রয়োজন হচ্ছে। যাক গে! আমি আবারো বলবো, আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না। আমি এখানে আমার জীবনে সুখী আছি”
অনলের কথাটা শেষ হতেই হিনহিনে কন্ঠে অনন্যা বলে উঠলো,
“আমাকে সবসময় স্বার্থপর মনে হয় তোর! সবসময় আমাকেই দোষী করে এসেছিস। আচ্ছা তোর বউ স্বার্থপর নয়। তোকে বিপদে ঝুলিয়ে ঠিক ই তো গা ঢাকা দিয়ে আছে! কি করেছে তোর অপবাদকে মিটাতে?”…………..
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৬তম_পর্ব
অনলের কথাটা শেষ হতেই হিনহিনে কন্ঠে অনন্যা বলে উঠলো,
“আমাকে সবসময় স্বার্থপর মনে হয় তোর! সবসময় আমাকেই দোষী করে এসেছিস। আচ্ছা তোর বউ স্বার্থপর নয়। তোকে বিপদে ঝুলিয়ে ঠিক ই তো গা ঢাকা দিয়ে আছে! কি করেছে তোর অপবাদ সরাতে?”
কথাটা কর্ণপাত হতেই চোখ মুখ খিঁচে উঠলো অনলের। তীর্যক, বরফ শীতল দৃষ্টিতে তাকালো সে অনন্যার দিকে। শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমার বউ কি করেছে না করেছে সেই কৈফিয়ত আমি তোমাকে দিবো না অনন্যা। নিজের দায়রাতে থাকো। সীমা লঙ্ঘন করো না। আমি শান্ত আছি, শান্ত থাকতে দাও”
অনলের এমন আচারণে চমকালো অনন্যা। অনলের শীতল তীর্যক দৃষ্টি এবং মুখের কাঠিন্য নজরে আসতেই ঈষৎ ঘাবড়ে গেলো সে। তবুও কাঁপা স্বরে বললো,
“আমি সীমাতেই আছি অনল, তুই ই নিজের চোখে ভালোবাসার কাপড় বেঁধে অন্ধ হয়ে আছিস! আমি শুধু তোকে বাস্তবতা দেখাচ্ছি”
“আমি কোনো ছোট বাচ্চা নই যে বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য বুঝে না। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি তোমার নিজস্ব জাগতিক দুনিয়া থেকে বের হতে পারছো না। তাই তো সবাইকে নিজের মতো মনে করছো। আমার ধারাটা বয়সে আমার থেকে অনেক ছোটো। ফলে আমি বা আমার পরিবার কখনোই ওর উপর আঁচ আসতে দেই নি। সাধ্য অনুযায়ী রাজকুমারীর মতো তাকে রাখা হয়েছে, ফলস্বরুপ এখনো পৃথিবীর রুক্ষ্ণ, নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক তার ধারণা স্বল্প। এই জটিল ব্যাপারে জড়ালে তার ভবিষ্যতের উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। তবুও মেয়েটি শুধু আমার চাকরি রক্ষার্থে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার আর্জি দিতেও পিছ পা হয় নি। সে জানে যদি তার রেজাল্ট আগের থেকে একটু খারাপ হয় প্রশাসন তাকে বহিষ্কার করতে পারে। তবুও মেয়েটি ভয় করে নি। আমার জন্য এই বিপদে ঝাপিয়ে পড়েছে। সুতরাং তোমার চোখ দিয়ে আমার ধারার প্রয়োজনীয়তাবোধ করছি না আমি। নিজের সীমার মাঝে থাকো অনন্যা। আমার বন্ধু হবার অধিকার তুমি হারিয়েছো। সুতরাং আমাকে উত্যোক্ত করা বন্ধ করো”
অনলের শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো অপমানের ধারালো ছুরির মতো বিঁধলো অনন্যার হৃদয়ের। চরম অপমান এবং ক্রোধে বিধ্বস্ত হয়ে পড়লো সে। শুভ্র মুখখানা হয়ে উঠলো নিমেষেই রক্তিম। নিজের আত্মসম্মানের খাতিরে আর দাঁড়ালো না সে। হনহন করে ছুটলো সে। অনল তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। চরম বিরক্তি হচ্ছে তার। মেয়ে না হলে হয়তো মে’রে’ই বসতো। ধারার নামে অহেতুক কথা কখনোই সহ্য হয় না তার। দুপকেটে হাত দিয়ে ঝোপটির কাছে আসলো সে। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বললো,
“লুকিয়ে কারোর কথা শোনাটা মোটেই ঠিক নয়। এটা একটা বদগুন”
কথাটি কর্ণপাত হতেই মাথা তুলে তাকালো ধারা এবং মাহি। চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লো তারা। এর চেয়েও অবাককর বিষয় অনল টের পেলো কি করে! সে কি প্রথম থেকেই জানতো। সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়ালো তারা দুজন। কোনো কথা না বলেই উল্টো দিকে হাটা দিলো তারা। ধারা কথা বলবে না অনলের সাথে। প্রচন্ড অভিমান হয়েছে তার। যদিও যখন অনন্যাকে মুখের উপর সঠিক জবাব দিচ্ছিলো তখন মনে এক অকল্পনীয় শান্তি লাগছিলো। হৃদয় পুলকিত হয়ে উঠছিলো এই ভেবে অনল তাকে ভুল বুঝে নি। কিন্তু সেই পুলক টিকসই হলো না। মূহুর্তেই সকালের কথাগুলো ভেবে তেতো হয়ে উঠলো হৃদয়। যদি এতোই ভালোবাসে তবে একটু বিশ্বাস রাখলে কি এমন ক্ষতি হতো! অনলও ধারাকে আটকালো না। ঠোঁটের কোনে এক অমলিন হাসি ফুটিয়ে চেয়ে রইলো ধারার যাবার পানে। মেয়েটি সত্যি ছেলেমানুষ।
ল্যাব স্যাশনাল শেষ হবার পরও বন্ধুমহল প্রস্থান করলো না। তারা দাঁড়িয়ে রইলো ডিপার্টমেন্টের বাহিরে। প্রতীক্ষা মাধবীর। মেয়েটির সাথে আজ মুখোমুখি বোঝাপড়া হবে। ধারার মুখ কঠিন হয়ে আছে। মাধবীর সাথে একটা এস্পার ওস্পার করেই ছাড়বে সে। মাহি তাকে ঠান্ডা করার জন্য বললো,
“মাথা গরম করবি না। শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করবি। তাও শান্তভাবে, উগ্র হলেই আমাদের গুটি বের হয়ে যাবে। সেটা করা যাবে না”
“এক কথা এই নিয়ে গুনে গুনে ছ বার বলেছিস, এবার থাম”
“হ্যা, কারণ তুমি যে রণচন্ডীরুপ ধারণ করো আমার ভয় হয়, কখন না মাধবীর মাথা ফাটিয়ে দিস। তাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। একটা ভুল আর আমাদের পাঁচজনের লাইফ শেষ। আমরা সবাই সিড়ির ওখানে আছি। দিগন্ত তোদের কথোপকথন রেকর্ড ও করবে। ও তোকে উস্কালেও তুই শান্ত থাকবি”
“হ্যা, হ্যা, বুঝেছিস। এবার একটু থাম আম্মা”
মাহি আর কথা বাড়ালো না। তারা প্রমাণ জড়ো করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাধবীর এই কমপ্লেইনের পেছনের আসল উদ্দ্যেশ্যটা বের করাই তার উদ্দেশ্য। এই বুদ্ধিটা অবশ্য দিগন্তের মাথা থেকে বের হয়েছে। সে ল্যাবের মাঝে সকলকে জড়ো করে। তারপর নিজের বুদ্ধিটা বর্ণনা করে। ধারা মাধবীকে প্রশ্ন করবে, বারংবার তাকে উছকে দিবে। সিড়ির নিচে থাকবে বন্ধুমহল। মাধবী একটা পর্যায়ে তার কমপ্লেইনের কারণটা মুখ ফসকে বলবেই। সেটার ভিডিও করবে দিগন্ত। তারপর সেটা দিয়েই মাধবীকে তুর্কিনাচন নাচানো যাবে৷ দিগন্তের মাথা থেকে এমন একটা বুদ্ধি শুনেই তো অবাক বন্ধুমহল। নীরব অবাক কন্ঠে বললো,
“ভাই বলে দে, কোথা থেকে ছাপিয়েছিস! তোর মাথায় এই বুদ্ধি অসম্ভব”
“কেনো? আমি কি গা’ধা নাকি গ’রু? আমার মাথায় কি কি বুদ্ধি আছে তোরা কল্পনা করতে পারবি না। আমি হলাম এ যুগের শার্লক”
দিগন্তের কথায় সকলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে। যার অর্থ “ঢপ কম মার”। ফলে সে গাইগুই করে স্বীকার করলো,
“একটা মুভি থেকে ছাপানো”
“এবার লাইনে আসো”
নীরবের কথায় ধারাও হেসে দিলো। এই সবের মধ্যে তাদের বন্ধুত্বের শীতলতাও খানিকটা হলেও কমে গেলো। বন্ধুমহল তাদের আগের বেশে চলে এসেছে— “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে”।
অপেক্ষার সময় বাড়ছে। অবশেষে মাধবী বের হলো তার কাজ শেষ করে। বন্ধুমহল মোবাইল নিয়ে প্রস্তুত। মাধবী ধারার মুখোমুখি হলো। ধারাকে দেখতেই খানিকটা চমকালো সে। ধারার কঠিন মুখ এবং রক্তিম চোখে যে কেউ ভয় পাবে। মাধবী পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই ধারা বাধ সাধলো। শান্ত গলায় বললো,
“মাধবী, আমার তোমার সাথে কথা আছে”
“আমার নেই, আমার কাজ কাছে। আমাকে যেতে দাও”
“প্রশ্নের উত্তর না পেলে তো যেতে দিবো না”
“আজব তো! এটা কি মামদোবাজি?”
খানিকটা ভীত কন্ঠেই মাধবী বললো। ধারা অবাক হলো। মাধবীর মতো মেয়ে এতোটা ভয় পাচ্ছে কেনো! ধারা তার গলা নরম করলো। খানিকটা ধরা গলায় বললো,
“তোমার সাথে তো শত্রুতা আমার মাধবী, অনলস্যারের সাথে এমনটা করলে কেন? আজ বিনা অপরাধে সে ভুগছে!”
“বিনা অপরাধ! তোমার মতো মেয়ে এতো ভালো নম্বর পায় আর আমি সারাদিন পড়েও সেই একই নম্বর পাই তাহলে বিনা অপরাধ কিভাবে? তুমি নিজেই চিন্তা করো তুমি কি এতো ভালো রেজাল্ট করার যোগ্য। কি জানো তুমি! কখনো পাঁচ ছ খানা টিউশনি করিয়েছো শুধু সেমিষ্টার ফি দেবার জন্য? তোমাদের মতো মেয়েরা বুঝবে না। কত কষ্ট করে আমরা আমাদের ভবিষ্যত গড়ি। এই বৃষ্টি রোদ উপেক্ষা করে টাকা কামাই করি। কারণ তোমাদের মতো কেউ মুখে তুলে দেবার মতো নেই। দেখো ধারা, আমি কি কেনো করেছি সেটার কৈফিয়ত তোমাকে দিবো না। আমার মনে হয়েছে পার্শিয়ালিটি হয়েছে আমি কমপ্লেইন করেছি। ব্যাস। যেতে দাও এবার”
বলেই হনহন করে হেটে চলে গেলো মাধবী। ধারা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ধারার মনে হলো মাধবী তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। সে কিছু একটা লুকাচ্ছে। সে ধারার চোখে চোখ রাখতেই ভয় পাচ্ছিলো। বন্ধুমহল সিড়ির নিচ থেকে বেড়িয়ে এলো। হতাশ কন্ঠে দিগন্ত বললো,
“কি চালাক! কি সুন্দর করে সাজানো উত্তর দিলো। আমি ভেবেছিলাম ও ধারার প্রতি হিংসে প্রকাশ করবে। কিন্তু না! সে পাশ কাটিয়ে কথাটা বললো।”
“আমার মনে হয় ও কিছু একটা লুকাচ্ছে”
চিন্তিত ধারা কথাটা বললো। নীরব ও সায় দিলো। নীরব অবাক কন্ঠে বলল,
“এই এক বছর কখনো শুনলাম না মাধবীর টিউশন করা লাগে। ওর কোনো অর্থনৈতিক ঝামেলা আছে। ধারার সাথে কথা বললেই সে সর্বদা একটা দাম্ভিকতা প্রকাশ করতো। হিংসাত্মক তার পরিকল্পনা। আজ হুট করে এই টোনে কথা বললো কেনো? ও কি কোনো ঝামেলাতে আছে?”
“খোঁজ নিতে হবে”
বেশ বিজ্ঞভাব নিয়ে দিগন্ত কথাটা বললো। বন্ধুমহল ও সায় দিলো দিগন্তের কথায়। বের তো করতেই হবে মাধবীর এমন পরিবর্তিত আচারণের কারণ_______
বাসায় ফিরে নিজ ঘরে যেতেই কানে এলো এশা আশার কথা। ধারা দরজা ঠেলে উঁকি দিলো তাদের ঘরে। তারা বেশ সুন্দর করে সাজগোজ করছে। এশা নিজেকে আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে দেখছে। তারপর আশাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন লাগছে?”
সাথেই সাথেই তাদের চু’লো’চু’লি শুরু হয়ে গেলো। সুন্দর বাঁধা চুলগুলো হয়ে গেলো এলোমেলো। অবস্থা বেগতিক দেখে ধারা দুটোর কান ম’লে দিলো। তারপর দুটোকে আলাদা করলো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“এতো সাজের বাহার কেনো?”
নিজের কান ঢলতে ঢলতে এশা বললো,
“ঘুরতে যাচ্ছি”
“কোথায়?”
“পাশের বাড়ির ফাইজার জন্মদিন। আজ রাত ওখানেই থাকবো। তাই সাজগোজ করছি। সবার সামনে ভাবের ব্যাপার আছে তো”
ধারা কি উত্তর দিবে বুঝে পেলো৷ না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“এটাকেই বলে কারোর পৌষমাস, কারোর সর্বনাশ।”
“পৌষমাস না ধারাপু এটা শ্রাবণ মাস। তাও শেষের দিক। তুমি তো দেখি মাস ও জানো না। আবার বলো ভার্সিটিতে পড়ি”
আশার কথায় এশাও দাঁত বের করে হাসলো। ধারা আশার কান টে’নে বললো,
“এবার বল, কি বলছিলি! আমি কি জানি না”
“ছাড়ো ছাড়ো, তুমি জানো না এমন কোনো জিনিস আছে। তুমি তো সর্বজ্ঞানী, মহামহিলা”
“মহামহিলা কি!”
“মহাপুরুষের স্ত্রীবাচক শব্দ মহামহিলা। এভাবে তো জেন্ডার ডিসক্রিমিনিশন করা ঠিক না। মহিলারাও তো মহান হতে পারে। তাই আমরা এই শব্দটির আবিষ্কার করেছি”
ধারা হতাশ হয়ে উঠলো। শুধু শুধু কি এদের কেউ পড়াতে চায় না। এদের সাথে কথা বলা আর পিলারে মা’থা ঠোকানো এক। ধারা কিছু না বলেই বেড়িয়ে গেলো। আশা বললো,
“ধারাপু কি হতাশ?”
“হ্যা, আমাদের মতো জ্ঞানীদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না। তাই হতাশ হয়ে গেছে।”
এশার কথায় সায় দিলো আশা। তারা নিজেদের গোছগাছেই ব্যাস্ত_______
নিজের ঘরের এককোনার সোফায় বসে আছেন সেলিম সাহেব। তার হাতে একটি ছবি, ছবিটিতে একটি নারীর কোলে একটি ছোট বাচ্চা। বাচ্চাটির বয়স তিন কি চার। দুটো ছোট ছোট ঝুটি মাথায়। চোখ বুঝে, সব দাঁত বের করে মেয়েটি হাসছে। তাকে দেখে নারীটিও হাসছে। সেলিম সাহেব বারবার ছুয়ে দেখছেন ছবিটি। এই ছবিটি সুরাইয়া এবং ধারার৷ অস্ট্রেলিয়ায় যাবার সময় এই ছবিটিই নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কে জানতো এটাই তার কাছে সুরাইয়ার শেষ ছবি হবে। মাঝে মাঝে আফসোসগুলো অনুতাপে পরিণত হয়। কাটার মতো বিধে হৃদয়ে। এমন সময় আগমন হয় দীপ্তের। দীপ্তকে দেখেই ছবিটা উলটে রাখেন সেলিম সাহেব। তার অগোচরে অশ্রু মুছে নিলেন। তারপর হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“কি খবর?”
“অনলের ভার্সিটিতে ঝামেলা হয়েছে। মে বি ওকে সাসপেন্ড করা হবে”
“তাহলে আমাদের অফারটি দিয়ে দাও”
“জ্বী, আংকেল”
বলেই দীপ্ত কিছুসময় দাঁড়ালো। তার মুখে জিজ্ঞাসা স্পষ্ট। সেলিম সাহেব নিজের চশমা টগিক করে বললেন,
“কিছু বলবে?”
“আংকেল এগুলো করা কি ঠিক হচ্ছে। দে আর হ্যাপি, আর অনল ইজ এ গুড গায়। ও ধারাকে অনেক লাভ করে”
“আকাঙ্ক্ষা ভালো দীপ্ত, কিন্তু উচ্চাকাঙ্খা পতনের মূল। মানুষ উচ্চাকাঙ্খার জন্যই অনেক ভুল করে। আমি চাই না আমার জন্য সে পরিণতি সুরাইয়ার হয়েছে সেই পরিণতি আমার মেয়ের হোক। সে না মানলেও আমার তো দায়িত্ব আছে”
“সাপোজ অনল এক্সসেপ্ট করে নিলো আমাদের অফার তখন?”
একটু থেমে প্রশ্নটি করলো দীপ্ত। সেলিম সাহেব হাসলেন। তারপর বললেন,
“ফেল ঘোষণা করবো, আমিও দেখি ওর কাছে কোনটা জরুরী। ক্যারিয়ার না আমার মেয়ে”
দীপ্ত আর কথা বাড়ালো না। সে জানে এই লোকের মাথায় ঠিক চলছে তা বোঝা খুব ই দুষ্কর ব্যাপার। তাই সে বেড়িয়ে আসলো ঘর থেকে। তখন ই কারেন্ট চলে গেলো তাদের বাসার। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফোনের ফ্লাস লাইটটা জ্বালালো দীপ্ত। তারপর কোনো মতে নিজ ঘরে গেলো সে। নিজ ঘরে যেতেই অনুভূত হলো ঘরে সে একা নয়। কেউ তো আছে ঘরে। তখন ই দেখতে পেলো জানালার উপর একটি নিকষকালো ছায়া। দীপ্ত ফ্লাস লাইটটি তাক করতেই যেনো মিলিয়ে গেলো ছায়াটি। মনের ভুল ভেবে দীপ্ত গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। সাথে সাথেই একটি ভয়ংকর হাসির শব্দ কানে এলো তার। ভয়ংকর চিকন কন্ঠে বললো,
“চলে যা, চলে যা। আমার ঘর থেকে চলে যা”
কন্ঠটি শুনতেই বুক কেঁপে উঠলো দীপ্তের। গতকাল ই শুনেছিলো এই বাড়িতে নাকি একটি মেয়ে আ’ত্ম’হ’ত্যা করেছিলো। তখন তার বিশ্বাস না হলেও এখন যেনো অজানা ভয় মস্তিষ্ককে কাবু করে তুলেছে। তড়িঘড়ি করে উঠতেই মনে হলো হাতে কোনো গরম তরল লেগে আছে। ফ্লাস লাইটটা হাতের কাছে মারতেই দেখলো টকটকে লাল তরল। অজানা ভয়টি ক্রমশ তীব্র হলো দীপ্তের। অমনেই চিৎকার করে জ্ঞান হারালো সে। এদিকে উপর তালার জানালায় কান লাগানো জমজেরা তার চিৎকার শুনেই হাই ফাইভ দিয়ে বলে উঠলো,
“চেরাগআলী এবার বাছা কই যাবা”…………
এশা যখন খুব নিপুন ভাবে শেষ তেলাপোকাটি ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢোকাচ্ছিলো। তখন ই কানে এলো,
“তোমরা এখানে কি করছো?”
রাশভারী কন্ঠটি কানে আসতেই কেঁপে উঠলো আশা এবং এশা। হাতের তেলাপোকাটা সেখানেই ছেড়ে দিলো তারা তারপর শুকনো ঢোক গিলে পেছনে ফিরলো। বেশ নিপুনদক্ষ চোর দক্ষতা দেখিয়েও যখন ধরা খায় তখন তাদের অবস্থা যেমন হয় আজ তাদের অবস্থাটি তেমন। পেছনে ফিরতেই আরোও ভয় পেলো তারা। কারণ পেছনে সেলিম সাহেব এবং দীপ্ত দাঁড়িয়ে আছে। সেলিম সাহেব তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যতই নির্ভীক বলে নিজেদের আখ্যা করুক না কেনো জমজেরাও ভয় পায়। এবং বড্ড বাজে ভাবে ভয় পায়। উপরন্তু সেলিম সাহেবের দৃষ্টি যে কেউ ভয় পাবে। তারা তো তার হাটুর থেকেও ছোট দুটো মেয়ে। তাদের প্রাণ ও খাঁচা ছাড়া হচ্ছে। বুক টিপটিপ করছে। কেনো করছে জানা নেই! সেলিম সাহেব তাদের ধমক দিবে সেই ভয় নাকি বাড়ির লোক জানাজানি হবে সেই ভয়! জানা নেই। তবে মা জানলে আবার মূর্তির জন্য কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখবেন! অপমানিত হতে হবে মহল্লায়! ভেবেই নিকষকালো ভয়টা আরোও গাঢ় হলো। সেলিম সাহেব পুনরায় শুধালেন,
“হাটু গেড়ে কি করছিলে? হাতে কি তোমাদের?”
এশা চুপ করে গেলো। এতো বুদ্ধিমান মস্তিষ্কটাও যেনো ফাঁকা ফাঁকা হয়ে গেছে। হবে নাই বা কেনো! কঠিন জেরার মুখোমুখি তারা। জেরা আগেও হয়েছে! কিন্তু সেটা রুবি বা অনল বা ধারার কাছে। এদের কাছে জেরা হওয়াটা ডালভাত। কিন্তু সেলিম সাহেবের মতো মানুষের কাছে জেরা হওয়াটা যেনো প্রচন্ড ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন। সেলিম সাহেব এশা এবং আশার কাছে সেই দৈত্যটি যিনি জোর করে তাদের ধারাপুকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে এসেছেন। তাই তো অস্ট্রেলিয়ান ফুফাকে তাড়াতে নিজেদের ছোট মস্তিষ্কে যা বুদ্ধি আসছে তাই প্রয়োগ করছে তারা। দৈত্যের কাছে ধরা খাওয়া কতোটা ভয়ংকর সেটা তাদের অকল্পনীয়। সেলিম সাহেব নিপুন দৃষ্টিতে দেখলেন মেয়েদুটোর দিকে। সাদা স্কুল ড্রেস পরহিতা জমজেরা ঈষৎ কাঁপছে। তারা ভীত সন্তস্ত্র চাহনীতে তার দিকে তাকিয়ে আছে যেনো তিনি কোনো ছেলেধরা। তাদের কপালে ঘাম জমেছে। তারা একটা পর পর নিজেদের গলায় ঝুলোনো স্কার্ফটি টানছে। সেলিম সাহেব বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“কি খুঁজছিলে তোমরা মা? বলো, দীপ্ত খুঁজে দিবে! আর তোমরা কারা? এখানে কেনো! এবাড়ি তে তো থাকো না! দেখে মনে হচ্ছে স্কুল থেকে এসেছো। তাহলে বাড়ি যাও। এখানে কেনো?”
এশা আশা এখনো চুপ তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। ফুপা কি তাদের চিনতে পারে নি! তারা কি নিজেদের পরিচয় দিবে নাকি গোপন করবে! এর মধ্যেই দীপ্ত বলে উঠলো,
“আংকেল ওরা ইলিয়াস মামার মেয়ে। হয়তো ওদের বল এখানে চলে এসেছে। সেটা খুঁজছিলো। ওরা প্রায়ই বাহিরে খেলাধুলা করে। আপনাকে দেখে হয়তো ভয় পেয়েছে”
দীপ্ত এর কথাটা কর্ণপাত হতেই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো এশা আশা। দীপ্ত যা বলছে একেবারে দাহা মিথ্যে। তবে কি সে তাদের সাহায্য করছে! কিন্তু চেরাগআলী তাদের সাহায্য কেনো করছে! নাহ! এই প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়! গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো কিভাবে অস্ট্রেলিয়ান ফুপার এই এলাকা থেকে প্রাণ নিয়ে পালানো যায়। ফুপার হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে পরে চেরাগআলীকে নিয়ে ভাবা যাবে। সেলিম সাহেব দীপ্তের কথা শুনেই হেসে দিলেন। মানুষটাকে যতটা ভয়ংকর লাগছিলো হাসিমুখে তাকে ততটা ভয়ংকর লাগছে না, বরং কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেছে, ক্রোধাগ্নি মুখশ্রী হয়ে উঠেছে নির্মল। তিনি হেসে বললো,
“ও তোমরা জামাল কাকার নাতীন। তাই বলো, আমি লাস্ট যেবার এসেছি ইলিয়াস কেবল বিয়ে করেছিলো। তোমরা ছিলেই না। তাই চিনতে পারি নি। চকলেট খাও! দাঁড়াও”
বলেই পকেট থেকে দুটো লজেন্স বের করে এশা আশার হাতে দিলো। এশা আশা এখনো বিস্মিত। এই দানব হুট করে আলাদিনের জিন কিভাবে হলো বুঝে উঠতে পারছে না তারা। তারপর তাদের মাথায় দু হাত রেখে বললো,
“বাড়ি যাও, ক্লান্ত শরীরে এতোটা হুটোপুটি ঠিক না। আর পড়াশোনা ভালো করে করো। যাও”
এশা আশা বিল্ডিং থেকে বের হতেই হাফ ছাড়লো। এশা আশাকে বললো,
“এখন কিছু দিন আন্ডারগ্রাউন্ড হতে হবে”
“হু, ঠিক। এই ফুপার মতিগতি ভালো না। ধরা খেলে আর আস্তো থাকবো না”
এর মধ্যেই পেছন থেকে একটি পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
“টুইন্স, দাঁড়াও”
অতিপরিচিত কন্ঠটি চিনতে সময় লাগলো না এশা আশার। পেছনে তাকাতেই দেখলো দীপ্ত ছুটে এসেছে। মিষ্টি করে হেসে মুঠোবন্ধি বা হাতটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমাদের একটা জিনিস রেখে যাচ্ছো তো! প্রিয় বন্ধুটিকে নিবে না?”
আশা অবাক কন্ঠে বললো,
“কি?”
দীপ্ত মুঠো খুললো। মুঠো খুলতেই বেড়িয়ে এলো সেই তেলাপোকাটি। তেলাপোকাটি মৃত। মৃত তেলাপোকা দেখে খানিকটা নয় পুরোপুরি থ পেরে গেলো জমজরা। তাদের থমকে যাওয়া মুখশ্রী দেখে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো দীপ্ত। তারপর বললো,
“ইঁদুর তবে শেষ হলো, আমি তো ভেবেছিলাম ইঁদুরের বংশকে দত্তক নিয়েছো। তো এখন কি তেলাপোকা সাপ্লাই এর ধান্দা?”
এশা আশা উত্তর দিলো না। শুধু ভ্রু কুচকে দীপ্তকে দেখতে লাগলো। দীপ্ত হাসি প্রসারিত করে বললো,
“লাভ নেই, তোমাদের ধারাপুকে এবার আমরা নিয়েই যাবো। রাক্ষস বুড়ির মতো একটা খাঁচায় আটকে রাখবো। বেশ হবে না?”
“আমাদের ধারাপুকে নেওয়া এতো সোজা?”
“দেখি কিভাবে আটকাও”
বলেই মৃত তেলাপোকাটা ফেলে হাত ঝেড়ে বাসার দিকে পা বাড়ালো৷ এশা আশা ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি প্রয়োগ করলো কিন্তু কাজে দিলো না। ফলে ব্যার্থ আশা বলে উঠলো,
“এবার আর চুপ থাকা যায় না, চেরাগআলী কিভাবে চ্যালেঞ্জ করলো দেখলি!”
“হুম, এতোদিন মিডিয়াম পন্থায় যাচ্ছিলাম। এখন হার্ড পন্থা ব্যাবহার করতেই হবে। ও না ওর চোদ্দগুষ্টি দেশ ছেড়ে পালাবে”
দাঁত কিড়কিড় করে কথাটা বললো এশা। যা একটু আন্ডারগ্রাউন্ড যাবার কথা ভাবছিলো এবার সেটি হচ্ছে না_______
********
করিডোরে নোটিশবোর্ড ঝুলছে। অবশেষে ক্ষুদ্র মানবজীবনের ফলাফলের পালা। পরীক্ষাতে এতোটা ভয় করে না ওতটা তার ফলাফল দেখতে করে। পরীক্ষার সময় মনের মাধুরী মিশিয়ে কিছু একটা লিখে আসলেই হলো কিন্তু পুলসিরাতের সময় তো সেই ফলাফল। পাশ, ফেল, সিজি হাবিজাবি টাই মানুষকে নাজেহাল করে তোলে৷ যেমনটা বন্ধুমহলের ক্ষেত্রে হচ্ছে। ভীত পাঁচজোড়া নজর তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে আছে নিজেদের রেজাল্ট দেখার জন্য। ভালোই তো সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস চলছিলো এই রেজাল্টের ফাড়া গেলে বাঁচা যায়। ভিড় ঠেলে দিগন্ত ভেতরে ঢুকলো। একে একে রেজাল্ট দেখলো। বরাবরের মতো ফার্স্ট হলো নীরব। শান্তির ব্যাপার একজন ও ফেল করে নি। অভীকের সিজি কোনো মতে ৩.৩০ এর কাছে, মাহির ৩.৪০ দিগন্তের টা কোনো মতে ৩.০৫। আর ধারা একেবারে কাটায় কাটায় ৩.২৫৷ মেয়েটি আরোও ভালো করতো। ধারা তো খুশিতে আত্মহারা। এজন্য নয় সে তার সিজি ভালো। নাহ, এজন্য যে সে এখন অনলকে যেতে বলবে “চল না ঘুরে আসি অজানাতে”। অনল স্যার কাউকেই নাকানিচুবানি দেয় নি। সবাই পাশ করে গেছে ভালোভাবে। মাহি উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বলে উঠলো,
” কি রে ধারা, তুই তো ছক্কা হাকিয়েছিস। কই টেনেটুনে পাশ আর কই ৩.২৫”
“কার বউ দেখতে হবে না! একজন গণিতমাষ্টারের বউ যদি ফেল করে, সমাজে মুখ দেখাবে কিভাবে!”
ধারার কথা শুনে অভীক বলে উঠলো,
“বুঝলি না, ধারার রেজাল্টের রহস্য অনল স্যারের ভালোবাসা। তা স্যারকে বল, আমাদের ও একটু পড়াতে”
“তুই নীরবের কাছেই পড়। সে শুধু আমাকে পড়ায়। আমার পার্সোনাল টিউটর”
“হিংসুটে ধারারানী”
“ভালো হইছে। থাক আমি আসছি”
বলেই ধারা ছুটলো। বন্ধুমহলে উৎসাহ বেশ। ধারা চলে গেলে অভীক দিগন্তের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,
“ক্যাফেতে পার্টি করবি নাকি অন্য কোথাও”
“যেখানে তোরা বলিস”
এর মাঝেই মাহি বলে উঠলো,
“আমার হচ্ছে না, বাড়ি যেতে হবে আজ। তোরা যা”
“একা যাবি? আমি দিয়ে আসি?”
দিগন্তের প্রস্তাব খানা শুনতেই সকলের নজর যায় দিগন্তের দিকে। মাহির মুখ হা হয়ে আছে। দিগন্ত তাকে নিয়ে যাবার কথা বলছে এ যেনো অষ্টম কোনো আশ্চর্য! সকলের হতবাক নজর দেখে দিগন্ত শুধালো,
“কি হয়েছে?”
“তুই মাহি চু’ন্নীকে বাড়ি দিয়ে আসবি?”
“হ্যা, সমস্যা কোথায়? আর এমনিতেও ধারাও নেই। তাই আজ সেলিব্রেশন বাদ দেই। আর মাহি একা একা এই সময় যাবে। আমি দিয়ে আসলে তো ক্ষতি কি!”
“না ক্ষতি নেই, কিন্তু কখনো মাহির প্রতি তোর এতো দরদ তো দেখি নি, তাই”
“আজাইরা, এই চল তো মাহি। অভীকের কথার আগামাথা নেই। ওর কথার মাঝে পড়লে যাওয়া হবে না”
বলেই হাটা দিলো দিগন্ত। মাহিও তার পিছু নিলো। এই ভরদুপুরে বাড়ি যাওয়াটা একটা ঝামেলা বটে। এদিকে অভীক নীরবকে বললো,
“কেস কি নীরব বাবা?”
“নতুন প্রেমের ফুল ফুটবে ফুটবে ভাব! শুধু প্রেমের অভাব”
**********
অনলের রুমের কাছে আসতেই আশপাশটা দেখে নিলো ধারা। ছুটির সময় বিধায় স্যারদের আনাগোনা নেই। সেই ফাঁকে অনলের রুমে ঢুকতে হবে। কিন্তু যেই অনলের রুমে লক মোচড় দিলো অমনি তা খুলে গেলো। ভেতর থেকে কেউ দরজাটা খুললো। এই মানুষটি আর কেউ নয় বরং অনন্যা। অনন্যাকে দেখে রীতিমতো অবাক হলো ধারা। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অনন্যা বলে উঠলো,
“ভালো আছো?”
“জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”
“আমিও ভালো! এই ভার্সিটির স্টুডেন্ট নাকি?”
“হ্যা, আমি ম্যাথ ডিপার্টমেন্ট সেকেন্ড ইয়ার। আপনি এখানে?”
“তোমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছি। পার্মানেন্ট না, পার্ট টাইম ক্লাস নিবো। অনলের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। আসি”
ধারার উত্তরের অপেক্ষা করলো না অনন্যা। হনহন করে হেটে চলে গেলো। অনন্যার হুট করে জয়েন করাটা খটকা লাগলো ধারার। সে ভেতরে পা বাড়ালো। রুমে ঢুকতেই দর্শন হলো অনলের কঠিন মুখশ্রীর। তার মুখখানা শক্ত হয়ে রয়েছে। চোখজোড়া রক্তিম। কপালের বা পাশে শিরা ফুলে উঠেছে। ধারা নরম গলায় বললো,
“আসবো?”
ধারার কন্ঠ শুনতেই চোখ তুললো অনল। নির্বিকার কন্ঠে বললো,
“তুই? ক্লাস শেষ?”
“হ্যা, তোমার সাথে দেখা করতে এলাম। বাড়ি যাবে না?”
“হু, যাবো। দশ মিনিটের একটা কাজ আছে। করে নেই?”
“আচ্ছা”
বলেই চেয়ারটা টেনে বসলো ধারা। একবার ইচ্ছে হলো অনন্যা আপুর কথাটা তুলবে কিন্তু অনলের কঠিন মুখশ্রী দেখে আর সাহস হলো না। তার বুঝতে বাকি নেই অনল তার রাগ সংবরণ করে রেখেছে। অনল ল্যাপটপে হাত চালাতে চালাতে কিছু একটা ভেবে বললো,
“রেজাল্ট দিয়েছে, দেখেছিস?”
“সেটা দেখেই তো ছুটে আসা। তা কোথায় নিয়ে যাবে আমায়৷ বলেছিলে তো আমাকে হানিমুনে নিয়ে যাবে”
“তোর মনে আছে?”
হাত থামিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো অনল। ধারা উৎসাহিত কন্ঠে বললো,
“বাহ রে! থাকবে না। তুমি জানো আমি এই ঘোরার লোভে কত কষ্ট করেছি। আমি কিছু বাহানা শুনছি না। নিয়ে যাবে মানে যাবে”
“আচ্ছা, যাবো। তবে ছুটি পেলে। এখন সেমিষ্টার শুরু। কিভাবে ছুটি নেই? এর চেয়ে একটু অপেক্ষা কর। ছুটি পাই। নিয়ে যাবো”
কথাটা শুনতেই ধারার উৎসাহে পানি পড়ে গেলো। অভিমানী কন্ঠে বললো,
“সব তোমার বাহানা। নেবে না বলে দিলেই হয়। কথা ঘোরাচ্ছো কেনো?”
“ঘোরালাম কোথায়! যাবো তো, এখন তুই যদি একদিনের ছুটিতে ঘুরে আসতে চাস সেটা আলাদা কথা। আর দশদিনের একটা জম্পেশ বান্দরবান ট্যুর দিতে চাস সেটা আলাদা কথা। কোনটা চাই বল”
ধারা গভীর চিন্তায় পড়লো, এদিকে ঘোরার মন ও হচ্ছে আবার একদিন ঘুরলে পোশাবেও না। তাই বাধ্য হয়ে বললো,
“বেশ, জম্পেশ ঘুরবো। কিন্তু আমি ঘুরতে যাবো, কোনো বাহানা চাই না। সামনের যে ছুটি পাবো তাতেই যাবো”
“যথাআজ্ঞা মহারাণী। চল কাজ শেষ”
বলেই ল্যাপটপ টা ব্যাগে পুরলো অনল। তখন ই রয়ে সয়ে ধারা বললো,
“আচ্ছা, অনন্যা আপু কি সত্যি জয়েন করেছে? না আসলে তোমার ঘরে ঢুকতেই ওকে দেখলাম তো”
অনন্যার কথাটা শুনতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো অনল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“হ্যা, তাই তো বললো!”
“তা তোমার রুমে কি করছিলো?”
একটু কৌতুহলী কন্ঠেই কথাটা বললো ধারা। অনল ধারার মুখের দিকে তাকালো। মুখ ই বলে দিচ্ছে মনে কত কত প্রশ্নেরা উঁকি মারছে। উপরন্তু কিঞ্চিত ঈর্ষাও যেনো দেখতে পেলো সে। অনল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তারপর খানিকটা মজার ছলে বললো,
“প্রেম নিবেদন করতে এসেছিলো!”
“কি?”
অনলের আকস্মিক উত্তরে মাথাটা শুন্য হয়ে গেলো। হুট করে বুকটা ধক করে উঠলো। ফলে কৌতুহল মনের আবেগ মুখে উঠে এলো। খানিকটা ভীত হয়ে উঠলো মন। ফলে উচ্ছ্বাসিত মুখখানা হয়ে উঠলো রক্তশূন্য। ধারার মুখশ্রীর অনবদ্য মুখভঙ্গি দেখেই হেসে উঠলো অনল। মাথায় আলতো করে গাট্টা মেরে বললো,
“ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে আর চাপ দিস না। ফেটে যাবে। ও এসেছিলো একটা অফার নিয়ে। যা আমি মানা করে দিয়েছি। চিন্তা করিস না। প্রেম নিবেদন দিলেও তা মানাই করতাম। আমার ধারারানীর জায়গা নেওয়া কি এতো সোজা। অবশ্য কি দিন ছিলো, স্বর্ণালী দিন। কত শত প্রেম নিবেদন। শুধু যারটার প্রতীক্ষা করতাম, তারটাই পেলাম না। আফসোস”
“কার প্রতীক্ষা করতে?”
অভিমান ধরা গলায় বললো ধারা। তখন তার কানে মুখ ঠেকিয়ে খাঁদে নামানো স্বরে বললো,
“তোর, একটা প্রেম নিবেদন তো আমারো পাপ্য ছিলো”
জ্বালাময়ী গরমে কুপকাত সকলে এর মাঝে অংকের বোঝা মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কোনো মতে ক্লাসের সমাপ্তি ঘটিয়েই যেনো হাঁফ ছাড়লো ধারা এবং মাহি। রেজাল্টের আনন্দটা বেশি স্থায়ী হলো না। তার আগেই স্যার ম্যাডামদের ক্লাস টেস্টে খ’ড়া ঝুললো। ব্রেকের মাঝে একটা ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিতেই যাবে অমনি একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“অনল স্যারকে নিয়ে মিটিং হচ্ছে। তাকে সাসপেন্ড করা হবে”……….
চলবে
মুশফিকা রহমান মৈথি
#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩৪তম_পর্ব
ব্রেকের মাঝে একটা ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিতেই যাবে অমনি একটা মেয়ে বলে উঠলো,
“অনল স্যারকে নিয়ে মিটিং হচ্ছে। তাকে সাসপেন্ড করা হবে”
মেয়েটির কথাটা বুঝতে সময় নিলো ধারার মস্তিষ্ক। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো সে মেয়েটির দিকে। “সাস্পেন্ড” শব্দটি পেন্ডুলামের মতো ঘুরছে। মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো যেনো হুট করেই অকেজো হয়ে পড়লো। সুউচ্চ বিল্ডিং এর উপর থেকে নিচে ফেলে দিলে যেমন অনুভূতি হয় ধারার অনুভূতিটা ঠিক তেমন। মেয়েটির কথায় ক্লাসে বেশ আলোড়ন তৈরি হলো। সকলে ঘিরে ধরলো তাকে। জানতে চাইলো কারণ কি! মেয়েটি একটু থেমে বললো,
“দাঁড়া, দাঁড়া বলছি। আমি উপরে স্যারের সিগনেচার নিতে গিয়েছিলাম। তখন ই দেখি মিটিং রুমে সবাই জড়ো হয়েছে। ভেতরের অফিস ক্লার্ক হাফিজ ভাইকে শুধালাম কারণ কি! তখন উনি বললো, আমাদের মধ্যে কেউ নাকি হেডের কাছে কমপ্লেইন করেছে। অনল স্যার প্রশ্ন আউট করেছেন। প্রশ্ন আউট করেছে নিজের কোর্সে। এবং শুধু নাই নয়, উনি খাতা দেখার সময় ও পার্শিয়ালিটি করেছেন।”
“কে করেছে কমপ্লেইন?”
মাহি অস্থির কন্ঠে প্রশ্নটি করে উঠে। মেয়েটি অসহায় কন্ঠে বলে,
“সেটা আমি কি করে বলবো। হাফিজ ভাই ও চুপ করে আছেন। সেটার মিটিং হচ্ছে। অনল ভাই কে প্রশ্ন করা হচ্ছে। তদন্ত কমিটি করা হবে। তবে হাফিজ ভাই বললো, অনল স্যারকে হয়তো সাসপেন্ড করা হবে। আগেও এমন হয়েছিলো।”
সকলের মাঝে একটা গুঞ্জন তৈরি হলো। এর মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“কিন্তু উনি তো প্রশ্ন আউট করেন নি। তাহলে এই ক্লেমটা কে করেছে! আর খাতায় পার্শিয়ালিটির তো প্রশ্ন ই আসছে না। আমাদের সবাই ভালো ভাবেই তো পাশ করেছি উনার সাবজেক্ট এ। তাহলে এই ক্লেইমের তো ভিত্তি নেই”
“ঠিক, এই ক্লেইম টা করেছে কে?”
সকলের মাঝে গুঞ্জন উঠলো। সবাই নিজেরাই বলছে, “আমি তো করি নি, আমি তো করি নি। কে করেছে জানি না!” এর মাঝে ধারা নিস্তব্ধ। সে চুপ করে বসে রয়েছে। অনলের উপর দিয়ে কি ঝড় চলছে কল্পনাও করতে পারছে না। কিন্তু প্রশ্নটি হলো, এতো বড় অপবাদটা দিলো কে? মাহি তার ঘাড়ে হাত রেখে বললো,
“চিন্তা করিস না, এমন অপবাদে অনল ভাই এর কিছু হবে না”
মিটিং রুমে মোট সাত জন শিক্ষকের সামনে বসে রয়েছে অনল। হেড অফ ডিপার্টমেন্ট আব্দুল আনসারী সাহেব চোখের চশমাটা নামিয়ে বললো,
“দেখো অনল, আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আছে তুমি এই কাজটা করেছো। প্রথমত তুমি কাউকে জানাও নি তোমার ওয়াইফ ওই ক্লাসের স্টুডেন্ট। এটা তুই অথোরটির কাছে গোপন করে গেছো। উপরন্তু তুমি নিজেই বলো যে মেয়েটির গত সেমিষ্টারে এতো বাজে রেজাল্ট করলো। সে এই সেমিষ্টারে কি করে ৩.২৫ পায়। শুধু তাই নয়। তোমার কোর্স ছাড়া কোনো কোর্সে কি সে ভালো করেছে? বি, বি মাইনাস এমন গ্রেড উঠেছে। শুধু তোমার কোর্সেই এ। তাও ক্লাস এসেসমেন্টে সে পেয়েছে ত্রিশে তিন। এই কাজটা তোমার থেকে এক্সপেক্টেড ছিলো না অনল। তোমার কি কিছু বলার আছে?”
আনসারী সাহেবের কথা শেষ হতেই অনল ধীর গলায় বললো,
“স্যার, আমি জানি না আপনার এমন কেনো মনে হচ্ছে! আপনি আমার কোর্সের এভারেজ রেজাল্ট দেখুন। ৪৫ জনে একজনও ফেল করে নি। এদের সবার এসেসমেন্টে নম্বর কম। আপনার কি মনে হয়েছে কেউ খারাপ করেছে? আর ক্যালকুলাস আমি একা নেই নি। শিহাব স্যার ও নিয়েছেন। আমাদের কোর্সের প্রশ্ন ও মডারেট হয়েছে। এরপর ও আপনি আমাকে সন্দেহ করলে আমার কিছুই বলার নেই। আমার ওয়াইফকে ভালো রেজাল্ট করাবো, খাতায় পার্শিয়ালিটি করবো আমি এমন মানুষ নই। আমার নৈতিকতা আছে। যখন এই ভার্সিটির টিচার হয়েছিলাম সেই নৈতিকতা নিয়েই আমি এসেছিলাম। হ্যা, এটা সঠিক যে আমি এডমিনিস্ট্রেশনকে ধারার কথাটা জানাই নি। সেটারও কারণ আছে। আমাদের বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেছে। আমার জয়েনিং এর পর। তাই ব্যাপারটি আমি লুকিয়ে গেছি। যদি এজন্য আমাকে শাস্তি দেওয়া হয় আমার আপত্তি নেই। তবে আমি আমার দায়িত্বে কোনো গাফেলতি করি নি। আমি কোনো প্রশ্ন আউট করি নি। খাতাগুলো অফিসে রয়েছে। তদন্ত করে দেখতে পারেন। মডারেটর স্যার যিনি ছিলেন তাকেও জিজ্ঞেস করতে পারেন। শুধু শুধু একটি মেয়ের কথা শুনে আমার উপর এলিগেশন দেওয়াটা কতটা ঠিক আমার জানা নেই”
উপস্থিত সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শিহাব ও বললো, সে কোনো পশ্ন আউট করে নি। ডিপার্টমেন্টাল হেড আনসারী সাহেব বললেন,
“তুমি এখন যেতে পারো অনল। আজ তোমার ক্লাস নেবার প্রয়োজন নেই।”
“জ্বী”
বলেই উঠে দাঁড়ালো অনল। তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আছে। মুখ কঠিন। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো সে। মাঝে মাঝে সততার প্রমাণ দেওয়া এতোটা কঠিন কেনো! সে আন্দাজ করেছিলো এমন কিছু একটা হতে পারে। সে ভেবেছিলো কমপ্লেইন টা দিগন্ত করবে। কারণ এই প্রশ্নের সন্দেহটা তার মনেই জেগেছিলো। কিন্তু সে কমপ্লেইন করে নি। করেছে মাধবী নামের একটি মেয়ে। ব্যাপারটা জানতেই বেশ অবাক হয়েছিলো অনল। তবে অনল ও কাঁচা মানুষ নয়। সেও যথেষ্ট প্রমাণ নিজ পক্ষে রেখেছে, কিন্তু স্যারেরা সেটা বিশ্বাস না করলে তার করার কিছুই নেই। মিটিং রুম থেকে বের হতেই ধারার দর্শন পেলো অনল। মেয়েটি থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ টলমল করছে। অনলকে দেখেই সে এগিয়ে এলো। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“তোমাকে ওরা সাসপেন্ড করে দিয়েছে?”
“এতো সোজা? মাত্র তদন্ত কমিটি করা হচ্ছে। তারপর আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ পেতে হবে। তারপর আমাকে সাসপেন্ড করবে।”
স্মিত হেসে কথাটা বললো অনল। ধারা অধৈর্য্য হয়ে বললো,
“কিন্তু করবে টা কেনো? তুমি তো অন্যায় করো নি”
“তাদের ধারণা আমি তোকে প্রশ্ন দিয়েছি। তুই সেই প্রশ্ন সবাইকে দিয়েছিস। আবার তোর বেলায় খাতা দেখাতেও আমি পার্শিয়ালিটি করেছি। মাবধী নামের একটি মেয়ে নাকি কমপ্লেইন করেছে। আমিও বলেছি প্রমাণ করুক। তারপর না হয় বাকিটা দেখা যাবে। চিন্তা করিস না, আমার কিছু হবে না। বড় জোড় চাকরি যাবে। করলাম না শিক্ষকতা। বেকার বরে আপত্তি নেই তো তোর?”
ধারা অবাক নয়নে মানুষটির দিকে চেয়ে আছে। এতো বড় বিপদেও সে এতো শান্ত কি করে! না চাইতেও অপরাধবোধ হলো ধারার। কোথাও না কোথাও তার ও দোষ ছিলো। তার বন্ধুর জন্যই আজ ব্যাপারটা এতোদূর গড়িয়েছে। সেদিন যদি দিগন্ত এবং তার মাঝে ঝামেলা না হতো তাহলে সেই সুযোগটা মাবধী নিতে পারতো না। সেদিন করিডোরে মাবধীও ছিলো। মাবধী ধারার উপর শোধ তুলতেই এই কমপ্লেইন করেছে। কিন্তু এই ঝামেলাগুলোর ফলস্বরূপ অনলকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। কথাটা ভাবতেই হৃদয়ের অন্তস্থলে চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো। ধারার লম্বাটে মুখখানা দেখেই অনলের হাসি চওড়া হল। মেয়েটির মুখে নিজের জন্য দুঃচিন্তা এবং ভীতি দেখে এক অসামান্য শান্তি অনুভূত হলো অনলের। ধারার হাতটা নিজের মুঠোবন্দি করে বললো,
“আজ আমার ক্লাস নেই, ঘুরতে যাবি?”
“তোমার চিন্তা হচ্ছে না?”
“চিন্তা করলে যদি কিছু লাভ হতো, চিন্তা করতাম। কিন্তু আফসোস লাভ নেই। তুই ও চিন্তা করিস না। আমার কিচ্ছু হবে না। হ্যা, এখন ভেবে দেখতে পারিস বেকার স্বামীর সাথে থাকবি কি না! না থাকতে চাইলে”
“আর একবার যদি এই কথাটা তুলেছো তো দেখবে আমি করি। বাসায় যেয়ে লংকাকান্ড বাঁধাবো বলে দিচ্ছি। একেই চিন্তা হচ্ছে উপরে বারবার এক কথা!”
বেশ ক্ষিপ্ত কন্ঠে কথাটা বললো ধারা। অনল নিঃশব্দে হাসলো। তারপর বললো,
“ব্যাগ নিয়ে আয়। একটা সুন্দর জায়গায় নিয়ে যাবো তোকে”
“কোথায়?”
“যেয়েই দেখতে পাবি”
ধারা আর কথা বাড়ালো না। ব্যাগ নিয়ে আসলো ক্লাস থেকে। অনল বাইকে স্টার্ট দিলো। পিচঢালা পথ চিরে এগিয়ে গেলো গন্তব্যে।
শ্রাবণের মাঝামাঝি সময়। বিনা নোটিসে বৃষ্টির ঝোক যেনো আরোও বেড়ে গেছে। ইট পাথরের শহর পেরিয়ে নিরিবিলি এলাকা। চিকন রাস্তা, দু পাশে মাঠ তাতে হাটুজল পানি। অনলের বাইক চলছে। ধারা অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখছে। রোদের তেজ কমে এসেছে। দক্ষিণ আকাশের কোনে কালো মেঘ জমেছে৷ মেঘের গর্জন কানে আসছে। এখনই শ্রাবণের বর্ষণ হবে, ভিজে যাবে উত্তপ্ত পৃথিবী। বাইক মোড় ঘুরলো। একটা বিশাল মাঠের মাঝে দেওয়াল ঘেরা একটা জায়গায় বাইক থামালো অনল। ধারা অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো জায়গাটির দিকে। একটি লোহার কেঁচিগেট৷ অনল গেটটিতে আওয়াজ করতেই। একজন ছুটে গেট খুললো। অনল স্মিত স্বরে বললো,
“কেমন আছেন চাচা?”
“এই তো আল্লায় যেমন রাখছে। তুমি কেমন আছো?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ, কাজ কতদূর?”
“আজকে কামে আসে নাই কেউ। তুমি ভেতরে আসো, নিজেই দেইখে নিও”
অনল হেসে বললো,
“বউ মা নিয়ে আসছি। যার বাড়ি সেই দেখুক”
অনলের কথাটা শুনতেই অবাক হলো ধারা। তার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,
“চাচার সাথে ভেতরে যা। আমি বাইক রেখে আসছি”
ধারাও তার কথা শুনলো। সে ভেতরে গেলো। ভেতরে যেতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। একটি অর্ধ নির্মিত বাড়ি। মাত্র ছাদ ঢালাই দেওয়া হচ্ছে। রড, বালি, সিমেন্টের স্তুপ নিচে জড়ো হয়ে আছে। বাড়িটি এক তালার কাঠামো আপাতত দেওয়া। ইটের সিড়ি উঠে গেছে। এখনো রুম করা হয় নি। বৃদ্ধ মানুষটি বললো,
“এই বছরে কাম শেষ হয়ে যাবে। আসলে স্যার তো আসার সময় পায় না। আমি ই ওদের দিয়ে করাই। মিস্ত্রীরা কাম চোর, কাছে না থাকলে কাম করে না”
ধারা উত্তর দিলো না। সে শুধু অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো ইটের কাঠামোর দিকে। এর মাঝেই অনল এলো। বলিষ্ট হাতের ফাঁকে ধারার হাতটি পুরে বললো,
“ভেতরে না গেলে বুঝবি কিছু?”
বলেই ধারাকে নিয়ে গেলো বাড়িটিতে। সাবধানে উঠালো সে। পিলার গুলো এখনো ঢালাই দেওয়া হয় নি। শুধু কাঠামো করা। অনল ধারাকে ঘুরয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালো। শেষমেশ একটা স্থানে এনে বললো,
“এটা আমাদের রুম হবে। তোর যেমন ইচ্ছে তেমন করে সাজিয়ে নিস”
“এসব কবে করলে?”
অনল বাকা হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো ধারাকে। তার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বললো,
“বহুদিন আগে। তোর সাথে বিয়ের পর ই তোকে কিছু দেবার ইচ্ছে ছিলো৷ শহরের মাঝে আমার ভালো লাগে নি। প্লাবণ এই জায়গার খোঁজ দেয়। আমিও সস্তা পেয়ে জমিটা কিনলাম। তারপর এই আসতে আসতে বাড়ির নকশা করলাম। চেয়েছিলাম যখন বাড়িটা শেষ হবে তখন তোকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বহুবছর পার হবে বাড়ি শেষ হতে”
অনল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর ধীর কন্ঠে বললো,
“আমরা যখন বুড়ো হয়ে যাবো, বাচ্চাকাচ্চারা বড় হয়ে যাবে, তাদের বিয়েশাদী হয়ে যাবে তখন আমরা বুড়াবুড়ি এখানে এসে থাকবো। নিরিবিলি, নির্মল পরিবেশ। যেখানে কোনো কোলাহল নেই, কোনো ঝঞ্জাট নেই। শুধু আমি আর তুই। আর আমাদের প্রণয়। আমি তো বাহির নাম ও ঠিক করেছি, “প্রণয় প্রহেলিকা”। আমাদের প্রণয় প্রহেলিকার সাক্ষী এই বাড়ি। তোর পছন্দ হয়েছে?”
ধারা নিশ্চুপ। শুধু একটু পর পর ডুকরে উঠার শব্দ আসছে। অনল অনুভব করলো তার বউ টি কাঁদছে। অনল তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখখানা আদলে করে বললো,
“পছন্দ হয় নি”
ধারা উত্তর দিলো না। শুধু অনলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সে কাঁদছে। তার নোনাজলের ঢেউ অনলের শার্ট ভিজিয়ে দিলো খানিকটা। কিন্তু ধারা এখনো কাঁদছে। অনল ধারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
“কাঁদছিস কেনো?”
“তুমি আমাকে এতোটা ভালোবেসো না। আমার নিজেকে অসহায় লাগে। বারবার মনে হয় এতোটা সুখের আমি যোগ্য নই। এই সুখের বিনিময়ে তোমাকে দেবার কিছুই নেই আমার। আমি যে কাঙ্গাল। আমি কোথায় রাখবো বলো তোমার এই প্রণয়গুলো?”
অস্পষ্ট স্বরে কোনোমতে কথাটা বললো ধারা। সে বারবার ডুকরে উঠছে। অনলের হাসি প্রসারিত হলো। হাতের বেষ্টনী শক্ত করলো। নিবিড় ভাবে ধরে রাখলো ধারাকে। ধীর কন্ঠে শুধু বললো,
“পা’গ’লী”
*********
সারাটা রাত নির্ঘুম কাটলো ধারার। দু চোখ এক করতে পারলো না সে। অনল যদিও তাকে নিজের বুকে আগলে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে বলেছে, কিন্তু সেটি হলো না। অনলের ঘুমন্ত মুখখানা নিষ্পলক চোখে দেখলো এবং একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো সে।
পরদিন যখন অনলের ঘুম ভাঙ্গলো তখন পাশে ধারাকে পেলো না সে। ভেবেছিলো মেয়েটি বাথরুমে আছে। কিন্তু সেখানেও তাকে পাওয়া গেলো না। মাকে শুধাতেই সে বললো,
“ধারা তো না খেয়েই ভার্সিটি চলে গেছে”
অনলের মনে খটকা লাগলো। সে যতটুকু জানে ধারার ক্লাস আজ সাড়ে দশটায়। সুতরাং এতো সকালে যাবার কোনো মানেই নেই। অনল দেরি করলো না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে গেলো ভার্সিটি। ক্লাসের সামনে যেতেই মাহির সাথে দেখা হলো তার। ধারার কথা জিজ্ঞেস করতেই সে উত্তর দিলো,
“অনল ভাই, আমি তো ওকে আসার পর দেখি নি।”
“তোমাদের কি আজ আগে আগে আসার কথা?”
“না তো”
তখন ই সেখানে দিগন্ত উপস্থিত হলো। অনলকে দেখতেই সে বললো,
“ধারা, হেড স্যারের রুমে”…………