Saturday, July 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1019



সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৮) শেষ পর্ব
লেখক: হানিফ আহমেদ

আমিনা শত চেষ্টা করছেন কান্না আটকানোর। কিন্তু কোনো ভাবেই পারছেন না কান্না আটকাতে, তবুও চেষ্টা করছেন তিনি। আজ উনার বুক ফেটে যাচ্ছে। এই পৃথিবীতে প্রিয় বলতে তার নিজের দুই সন্তানই। ১০ মিনিটের জন্য দেখা করার সুযোগ পেয়েছে ওরা। কান্না করছে বায়েজিদ এবং মালিহা। পৃথিবীতে একজন মায়ের সব থেকে কষ্ট হলো নিজের সন্তানের চোখের পানি দেখা। আমিনা সহ্য করতে পারছেন না। কোনো ভাবেই এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছেন না।
আম্মু তুমি বাড়ি কবে আসবে? বাড়িটা খুব একা লাগে আম্মু। রাতে ঘুম হয় না আমার। গলা দিয়ে ভাত নামে না আম্মু। চলো না আমাদের সাথে।
মালিহার কথাগুলো সহ্য করার ক্ষমতা তিনি পাচ্ছেন না। এই তো মনে হচ্ছে, এই বুঝি বুক ফেটে মা’রা যাবেন তিনি। শুধু বললেন,
মারে আমি যে আজ বন্দী, আমি আজ বন্দী কারাগারে। এখানে যেমন অপরাধী এবং নিরপরাধী মানুষের পঁচতে হয়। আর আমি তো একজন অপরাধীরে মা। আমি কী আর কখনো খোলা আকাশ দেখতে পাবো?
মায়ের কথা শুনে দুজনই চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বায়েজিদ শুধু দাঁড়িয়ে নিজের মায়ের মলিন মুখটা দেখে যাচ্ছে। আমিনা বললেন,
তোদের কপালে যদি আমি থাকি, তাহলে হয়তো কখনো ফিরবো তোদের মাঝে।
মালিহা বলল,
আম্মু আমি তোমার সাথে থাকবো। তোমার কাছে আমি ভালো থাকবো আম্মু। আমাকে তোমার কাছে রেখে দাও।
আমিনা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মনের মধ্যে ছোট্ট একটি কথা ফুটে উঠে।
এভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার পূর্বে একবার হলেও সন্তান দুটোর কথা ভাবতে পারতেন।
আমিনা আজ ভালো নেই। প্রতিশোধ নিয়ে ভালো থাকলেও তিনি আজ ভালো নেই। কলিজা দুইটার জন্য আজ তিনি ভালো নেই।
সময় শেষ হয়ে যায়। বায়েজিদ এবং মালিহাকে বিদায় নিতে হয়। মালিহা কান্না করছিল, যেতে চাচ্ছিল না। আমিনা দেয়ালে পিট ঠেকিয়ে কান্না করছেন। আজ ওরা ভালো নেই। আইন ঠিকই আজ তাকে চারদেয়ালে বন্দী করেছে। কিন্তু সেদিন যদি চৌধুরী পরিবারকে আইন নিজের হাতে নিয়ে নিতো। তাহলে আজ কতো মানুষ হাসতো, পুড়তো না কারো অন্তর।
কেন তাহলে এই আইন? যে আইন একটু টাকায় নিচুতে নেমে যায়।

নাওশিন হ্যাঁ বলতে ২টা মাস সময় নিয়ে নিলো।
নাওশিনের বয়স এখন আঠারো বছর তিন মাস।
আজ নাওশিনের বিয়ে। খুব সাধারণ ভাবে নিয়াজের সাথে তার বিয়ে হচ্ছে।
নাওশিনের পরনে আজ নিজের মায়ের বিয়ের শাড়ি। যা কিনে দিয়েছিলেন তার বাবা। এই শাড়ি দিয়েই স্বার্থপর মহিলাটি দ্বিতীয় বার বিয়ের স্বাদ নিয়েছে।
একটু পর পর নাওশিনের চোখ ভিজে যাচ্ছিল। আজ তার বিয়ে, কিন্তু তার আপন বলতে কেউ নেই। নেই কোনো র’ক্তের মানুষ। কিছু মানুষ বিশ্বাস করাতে বাধ্য করল, র’ক্তের না হয়েও খুব আপন হওয়া যায়। ব্যথায় ব্যথিত, সুখে সুখী, কান্নায় কান্না, সব কিছুতেই তাল মিলাতে পারে এই আপন হওয়া মানুষগুলো।
নাওশিন বউ সেজে বসে আছে নিজের বাবার রুমে। চোখে ফোটা ফোটা জল। একটুও সাজেনি নাওশিন। সাজতে তার ইচ্ছেও নেই, কী হবে এতো সেজে? কষ্ট বুকে নিয়ে কী নিজেকে সাজানো যায়?

নাওশিন বিয়েতে এমনি এমনি রাজি হয় নি।
অনেক গুলো শর্তের মাধ্যমে নাওশিন রাজি হয়েছে। এইজন্যই দুইটা মাস চলে যায় শুধ্য রাজি হতেই তার।
বিয়ের পর নিয়াজকে নিয়ে সে নিজের বাবার বাসায় থাকবে। এটাই তার সব শর্তের মা। আদিব সহ সবাই মেনে নেয় শর্তটি।
কিন্তু নিয়াজ, না নিয়াজ কোনো ভাবে এই শর্তে রাজি হয় নি। তবে তাকে রাজি করানো হয়েছে। নিয়াজের একটিই কথা।
নিজের ভাইদের ছেড়ে কোথাও যাবে না সে। তবুও তাকে রাজি করিয়েছে সবাই মিলে।
নিয়াজ রাজি হয়েছে। সে এটাই ভেবে রাজি হয়েছে যে,
বিয়ের পর নাওশিনের মনকে সে এমন ভাবে ভালো করবে, এতো ভালোবাসবে। এসব কিছুর জন্যই আস্তে আস্তে নাওশিন অতীত ভুলবে। অতীত তখন হবে শুধুই অতিথি। অতিথি যেমন হঠাৎ অসময়ে আসে বাড়িতে। নাওশিনের অতীতও হবে অসময়ে আসা অতিথি।

নিয়াজ কবুল বলে নিলেও নাওশিন তিন কবুল বলে দুইটা মিনিট নষ্ট করে নেয়। কারণ কান্নার জন্য সে কথা বলতে পারছিল না।
বিয়ের কাবিন মাত্র ১লক্ষ টাকা চেয়েছে নাওশিন। কোনো ভাবেই বেশি কাবিন চায় নি সে। একটি সম্পর্ক যদি ভালোবাসায়, বিশ্বাসে ভরে সুন্দর একটি সম্পর্ক হয়। তাহলে কী হবে এতো টাকা কাবিন নিয়ে।
নাওশিন এর বিদায় নেওয়ার সময় হয়। ছোটবেলায় অনেক বিয়ে দেখেছে সে। বিয়ের কনে নিজের বাবা, মা, ভাই এদের গলা জড়িয়ে কান্না করে বিদায় নেয়। কিন্তু আজ সে কার গলা জড়িয়ে কান্না করবে। কে আছে তার? বাবার বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে আজ, যদিও ফিরে আসবে আবার, তবুও বিয়ের নীতিতে আজ সে বাবার বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি যাচ্ছে। কারো গলা জড়িয়ে কান্না করার মতো এমন কাউকেই নাওশিন পায় নি। নীরবে শব্দ ছাড়া কান্না করছে সে, চোখ থেকে জল পড়লেও, কোনো শব্দ নেই এই বিদায়ের কান্নায়। তবে এই বিদায়ে তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে।

নিয়াজ চুপটি করে বসে আছে নাওশিনের পাশে। সবাই আজ খুব খুশি৷ এমন একটি মিষ্টি মেয়েকে নিয়াজের বউ হিসেবে পেয়ে। নাওশিন বিছানার মধ্য জায়গায় বসে আছে একটি সাধারণ শাড়ি কাপড় পরে। রাত ১১টা ছুঁইছুঁই। নিয়াজ প্রথমেই বলল,
আজকেও কী তোমার মন খা’রাপ?
নাওশিন শুধু নিজের স্বামীর প্রশ্নটি শুনল, কোনো উত্তর দিলো না।
নিয়াজ এবার নাওশিনের হাতটি নিজের মুঠোয় নেয়।
এই যে হাতটি আমি ধরতে পেরেছি। এই অধিকার কী আমার বা আর কারো ছিলো নাওশিন? না ছিলো না, কিন্তু আজ সেই অধিকার আমি পেয়েছি। আজ আমি তোমার স্বামী।
নাওশিন চোখ তুলে তাকায়। এই মানুষটিকে তো সে খুব রাগী জানতো। তাহলে আজ কোথায় সেই রাগ?
নিয়াজ আবারও বলতে শুরু করে।
বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক। যে সম্পর্কে দুইজন অপরিচিত মানুষ এক বিছানায় থাকে। সারাটা জীবন কাটানোর শপথ করে।
নাওশিন বলল,
আমার কেউ নাই জেনেও আপনি আমাকেই বিয়ে করলেন?
নিয়াজ হাসলো। আর বলল,
যার কেউ নাই, আজ তার সব আছে। তোমার আজ আমরা সবাই আছি। এই প্রশ্নটি যেন আমি আর কখনো কোনো ভাবেও না শুনি৷ ভুলেও যেন এমন প্রশ্ন না আসে মুখে।
নাওশিন চুপ থাকে। কিন্তু নিয়াজ আজ চুপ নেই।
তুমি আমার স্ত্রী। আর আমি তোমার স্বামী। আমি একজন পুরুষ হয়ে কখনো নিজের স্ত্রীর মন খা’রাপ দেখতে কখনো চাইবো না। তোমাকে এখনই হাসতে হবে। আর যদি না হাসো, তাহলে আমি,,
নাওশিন ভয় পেয়ে বলে উঠে,
তাহলে কী?
নিয়াজ মুচকি হেসে বলল,
এই মুখে যদি এখনই আমি হাসি না দেখি, তাহলে চিমটি দিয়ে কাঁদিয়ে দিবো। মন খা’রাপ করার থেকে কান্না করা ভালো।
নাওশিন নিজের অজান্তেই হেসে দেয়।
সত্যিই একটি সম্পর্ক খুব সুন্দর হয়। সুন্দর সম্পর্ক আরো সুন্দর হয় দুজন দুজনকে সম্মান করার মাধ্যমে। এই পৃথিবীতে সম্মান একটি উচ্চ আসন।
নিয়াজ সেই হাসি দেখছে। এই হাসিটি কখনো সে বিলীন হয়ে দিতে দিবে না। সে ভালোবাসবে। এতোটা ভালোবাসবে। নাওশিন যেন সারাক্ষণ তাকেই ভাবে। তাকেই যেন নিজের আকাশ বানাতে বাধ্য হয় নাওশিন।
নিয়াজ বলল,
যে কয়বার তোমার অতীত মনে হবে, ততবারই আমাকে বলবে আমার অতীত মনে হয়েছে আজ। তখন আমি এই মন খা’রাপের চেহারাকে কান্নায় রূপান্তরিত করব। কান্না করানোর হাজারো পদ্ধতি আমি জানি। হাসিখুশির দায়িত্ব ছেড়ে তখন কান্না করিয়ে অতীত ভুলিয়ে দিবো।
নাওশিন বলে উঠল,
না না আমি চিমটি খেতে পারবো না।
নিয়াজ হেসে দেয়। কষ্টে থাকা মানুষকে হাসানোর দায়িত্ব নিয়েছে। এভাবেই হাসাবে, চোখজোড়ায় খরা নামবে নাওশিনের। দুনিয়ার সব খরা হবে নাওশিনের ওই দুই চোখে।

আজ পত্রিকা জোড়ে একটিই খবর। চৌধুরী পরিবারের ৬জনের ফাঁ’সির রায় হয়েছে। এই খবরটি শুনে আজ সবাই খুব খুশী। এতোটা বছর পর আইন যেন তার পূর্ণতা পেয়েছে সঠিক বিচার করে। সেই ছয়জন জালাল চৌধুরী সহ তার পাঁচ চাচাতো ভাই৷ অন্যদের দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন শাস্তি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে কয়েকজনকে।
নিয়াজ এই খবরটি পড়ে শোনায় নাওশিনকে।
নাওশিন পেটে হাত দিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে এসে নিজের স্বামীর পাশে বসে। নাওশিন আজ খুশী। কিন্তু নিয়াজের দুই চোখে পানি। কারণ আজ তার পরিবারের খু’নিদের ফাঁ’সির রায় হয়েছে। এই পানি আনন্দের পানি।
বিয়ের চার বছর পর নাওশিন প্রেগন্যান্ট হয়েছে৷ অনেক অপেক্ষার পর নাওশিন এখন মা হতে চলছে।
নাওশিন নিজের বাবার বাসা থেকে দুই বছর পূর্বেই চলে এসেছে নিয়াজদের বিশাল বাসায়। আতিকার মৃ’ত্যুই ছিলো ওইখান থেকে চলে আসার কারণ। হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পরেছিলেন আতিকা। নিজের একমাত্র সন্তানের জন্য চিন্তা করতে করতে মৃ’ত্যুর মুখেই ধাবিত হন তিনি। উনার অপেক্ষা শেষ হয় নি। আনিক ফিরেনি৷ হয়তো আর কখনো ফিরবে না। এতো অভিমান, রাগ আর প্রতিশোধ তাকে হারিয়ে দিয়েছে নিজের মায়ের থেকে।
আতিকার অপেক্ষার সমাপ্তি হয় নিজের পৃথিবী ত্যাগ করার মাধ্যমে। অসুস্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থেকে শুধুই একটি খবরের অপেক্ষা করতেন। এই বুঝি ছেলের কোনো খবর পাবেন। কিন্তু অপেক্ষাটি পূর্ণতা পায়নি। সব অপেক্ষা যদি পূর্ণতাই পেতো, তাহলে অপেক্ষা বলতে কিছুই থাকতো না।

আজ সাতটা ভাই মিষ্টি মুখ করছে। কারণ খু’নিদের শাস্তি হচ্ছে৷ নাওশিন এসব দেখছে। তার মনে শান্তি নাই। গর্ভে একটু একটু করে বড় হচ্ছে নিজের সন্তান।
তাকে সবাই মাথায় তুলে রাখছে। তবে তাকে একা না। সাথে সাইফের স্ত্রীকেও একই ভাবে যত্ন নিচ্ছে, সাইফের স্ত্রীও মা হচ্ছে।
সবাই আজ কতো খুশী। কিন্তু নাওশিন মনে মনে এতোটা খুশী না।
এতো এতো বিচার হচ্ছে। কিন্তু তার মায়ের কোনো বিচার হচ্ছে না এখনো। সেও তো চায় বাবার খু’নির শাস্তি হোক। কিন্তু এখনো কোনো কিছুই হচ্ছে না। এতোটা বছর চলে যায়, কিন্তু কোনো কিছুই হচ্ছে না। তাহলে কী উনার শাস্তি হবে না?

যখন আকাশ লালচে হয়। তখন নীল আকাশ ভালোবাসার মানুষটিও বলে উঠে, আমি এই লালচে আকাশ ভালোবাসি।
মানুষ চোখে যা দেখে তাই তখন ভালোবাসে বা করতে চায়।
সাজেদা খা’রাপ পথে ছিলেন, তিনি সেটাই ভালোবেসেছেন। এখন যখন আকাশ লাল হওয়ার মতো উনার জীবনের পরিবর্তন হলো, তখন তিনি ভালো হতে চান।
আজ সাজেদা বুঝতে পারছেন, একটি সুযোগ পেলে তিনি একবারেই ভালো হয়ে যাবেন৷ আকাশের মতোই নিজেকে পরিবর্তন করতে চান। যেই আকাশকে সবাই ভালোবাসে, সেই আকাশের মতোই নিজেকে গড়তে চান।
কিন্তু উনার এই ইচ্ছেটা পূর্ণ হবে না। উনাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। বন্দী চারদেয়ালে পঁচতে হবে উনাকে।
এই খবরে নাওশিন একবারেই খু’শি না। কারণ সে চায় না তার বাবার খু’নি বেঁচে থাকুক এই পৃথিবীতে।
কিন্তু এটা ভেবে নিজেকে সান্তনা দেয় নাওশিন।
একটু একটু কষ্ট পেয়ে মানুষটি মৃ’ত্যুর দিকে যেতে থাকুক।
তার বাবার খু’নির শাস্তি হয়েছে। সেটা যাবজ্জীবন।
নাওশিন চুপ করে বসে এসব ভাবছিল, নিয়াজ এসে পাশে বসে। নাওশিন মাথা রাখে তার কাঁধে।
নিয়াজ নিজের হাত রাখে নাওশিনের মাথায়।
তোমার মায়ের যাবজ্জীবন হয়েছে।
উঁহু উনি আমার মা না। আমার মা তো আমার বাবার মৃ’ত্যুর দিনেই হারিয়ে গিয়েছেন।
নিয়াজ কিছু বলল না। তবে অনুভব করল নাওশিন কান্না করছে। নাওশিনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে, হ্যাঁ নাওশিন কান্না করছে।
একদম কান্না করবে না।
কিন্তু নাওশিন কথা শুনলো না। এবার শব্দ করে কেঁদে দেয়।
নাওশিন কান্না করলে আমি সবাইকে ডেকে তোমার কান্না দেখাবো সবাইকে।
নাওশিন ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। কিন্তু তবুও চোখে পানি আছেই।
কেন কান্না করছো?
আচ্ছা বলো তো, আমি কেন কোনো খা’রাপ মায়ের গর্ভেই জন্মালাম।
নিয়াজ নাওশিনের একটি হাত নিজের হাত জোড়ার ভিতর নিয়ে বলল,
নাওশিন কোনো মা কখনো খা’রাপ হয় না। মা হলো নারী জাত, আর সেই নারী জাতে কিছু নারী খা’রাপ হয়৷
তুমি ভুল বললে। আমার মা ভালো সেটা আমি মনের মধ্যেও নিয়ে আসলে মনে হয় আমার মন মিথ্যে বলে।
নিয়াজ হেসেই বলল,
তুমি যখন শিশু ছিলে তখন তোমার মা তোমায় দুধ পান করিয়েছে। কই তখন তো উনি খা’রাপ ছিলেন না। হয়তো তিনি শেষে খা’রাপ হয়েছেন। কিন্তু প্রথমে তো ভালো ছিলেন।
নাওশিন কিছু বলল না। তার ভালো লাগছে না। সেও মা হতে চলছে। তাকে হতে হবে একজন ভালো মা। খুব খুব ভালো একজন মা।

আমিনা ভেবেছিলেন। সন্ধ্যের বক পাখি হয়ে ফিরবেন নিজের বাসায়। সাগরের ঢেউ হয়ে ভিজিয়ে দিবেন পাড়। কিন্তু ভাবনা ভাবনাই থেকে যায়। সবার রায়ের পর উনার রায়ও হয়েছে। আর সেটা ফাঁ’সি।
ফাঁ’সির রায়ে একটুও কষ্ট পাননি৷ কষ্ট পেয়েছেন দুইটা সন্তানের জন্য। যদিও ওরা এখন আর কাঁদে না। কিন্তু চোখগুলো খুব লাল থাকে। দুজনই যথেষ্ট বড় হয়েছে। মায়ের সামনে চোখের পানি ফেলা যাবে না সেটা বায়েজিদ অনেক পূর্বেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু মালিহা বুঝেছে এখন।
ওরা মায়ের সামনে কোনোভাবেই কাঁদে না। উকিল ধরেছিল বায়েজিদ নিজের মামার মাধ্যমে। কিন্তু কোনো কাজ হয় নি। যাবজ্জীবন হোক, কিন্তু ফাঁ’সি না। কিন্তু রায় হলো ফাঁ’সি।
আমিনা তাকিয়ে আছেন নিজের দুই সন্তানের দিকে। ফাঁ’সি হয়ে গেলে ওরা থাকবে কীভাবে। এতো কষ্ট ওরা সহ্য করতে পারবে? আমিনা শুধুই এখন ফাঁ’সি কার্যকর হওয়ার দিন গুনছেন। চৌধুরী পরিবারের ওদের ফাঁ’সি হবে প্রথম। তারপর উনার।
আমিনার এখন বেঁচে থাকার খুব ইচ্ছে জাগছে। কিন্তু ইচ্ছেটা ইচ্ছেই রয়ে যাবে।
শাস্তি তাকে পেতেই হবে। কোনো ভাবে যদি বেঁচে যাওয়ার একটি পথ পেতেন। তাহলে হয়তো সেই পথেই হাটতেন। দুইটা সন্তানের জন্য তিনি বেঁচে থাকার দোয়া করতেন। কিন্তু তিনি যে অপরাধী।

চৌধুরী পরিবার, অহংকারী পরিবারের পতন হয়েছে। অ’ত্যাচারী পরিবারটি এখন পতনের মুখে। এই পরিবারের হাহাকারে আজ তাদের কেউ পাশে নাই। চাপা কান্নার সঙ্গী কেউ হচ্ছে না। কিন্তু মানুষ তো মানুষের জন্যই। অনেক সময় অনেকেই মিশে তাদের সাথে। একটু সঙ্গ পাওয়া জরুরী। যতোই হোক খোলা আকাশের নিচে থাকা চৌধুরী পরিবারের মানুষগুলো নিরপরাধ।
অ’ত্যাচারী মানুষ অ’ত্যাচার করবার পূর্বে কখনো ভাবে না, পতন বলে কিছু আছে।
লোভী মানুষ বুঝতেই পারে না লোভ মানুষকে শেষ করে দেয়।
পরকীয়ায় থাকা মানুষ যদি জানতো, সত্য একদিন প্রকাশ পাবে।
প্রতিশোধ নেওয়া মানুষ গুলো যদি জানতো, প্রতিশোধ নেওয়ার পর তাদের শাস্তি হবে। বাচ্চা বা আপনজন একা হয়ে যাবে।
রাগের মাথায় বাড়ি ছাড়া মানুষগুলো যদি জানতো, তাদের জন্য কেউ অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে মৃ’ত্যুর মুখে চলে যায়।
কিন্তু মানুষ জানতে চায় না। রাগ দেখাবে, কেউ কষ্ট পাচ্ছে সেটা তারা দেখতে চায় না। মানুষ মানুষের জন্য। কেউ তার প্রমাণ দেয়। আবার কেউ দূরে সরিয়ে দেয়।
সুন্দর সবাই খুঁজে। কিন্তু নিজেকে , আশেপাশকে সুন্দর করতে ভুলে যায় মানুষ।
অপরাধ আড়ালে কিংবা সামনে হোক। তার শাস্তি হবেই। এটাই সত্য। কিন্তু আমরা অপরাধ করার পূর্বে সেটা ভুলে যাই।
কষ্টের পর সুখ আসে, যেমনে কান্না করা শিশুটি বাবা বা মায়ের কোলে যেয়ে হেসে দেয়।
কষ্টে থাকলেই আ’ত্মহত্যা করতে হবে, জ্ঞান হারিয়ে যাওয়া মানুষ তখন তাই ভাবে। বেঁচে দেখুন না, নাওশিনের মতো কীভাবে জীবনটা সুন্দর হয়।
বাঁচতে হবে, বাঁচার জন্য আমরা বেঁচে থাকি। ম’রে যাওয়ার জন্য কেউ কখনো বাঁচে না। মানুষ চায় বাঁচতে, বাঁচতেই হবে। তাই তো আমাদের এতো জয় পরাজয়।

,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,সমাপ্ত,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-১৬+১৭

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৬)
লেখক: হানিফ আহমেদ

আজ নিজের বাসায় তালা ভেঙে ঢুকতে হচ্ছে নাওশিনকে।
নাওশিন বাসার ভিতর ঢুকে কয়েক ফোটা চোখের জল ফেলল। এই সেই বাসা, যেখানে তার জন্ম। কিন্তু আজ সেই বাসায় ঢুকতে হয়েছে তালা ভেঙে। হায়রে দুনিয়া!
নাওশিন বাসার চারদিকে তাকিয়ে দেখছে। তার প্রিয় বাবার হাতে গড়া সুন্দরে মুড়ানো এই বাসাটি। কতো যত্নেই না বানিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু বাসা আজ বাসার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বাসার মালিক আজ দুনিয়ায় নেই। মানুষ মাটির ঘরে থাকতে চায় না, তাদের প্রয়োজন বিশাল অট্টালিকা প্রয়োজন। চারদিকে তাকালে তো তাই দেখা যায়, কিন্তু অট্টালিকা থাকলেও এক সময় বিদায় নিতে হয় মানুষদের। মানুষগুলোর ঠাঁই হয় মাটির নিচেই।
কতো রাজাই তো অপচয়ে ছিলেন পারদর্শী। এইযে বিশাল বিশাল প্রাসাদ, আরো কতো কী তাদের পছন্দের। কিন্তু আজ তা শুধুই পরিত্যক্ত।
মানুষ সুন্দরে মুগ্ধ। তাই তো মানুষ জীবনের সবটা সময় কাটিয়ে দেয় সুন্দর খুঁজতেই। কিন্তু হায়! মুগ্ধতা তো মানুষের ভালো আচরণেও। সেই আচরণ সুন্দর করতে কখনো কাউকে অতোটা দেখা যায় না।
নাওশিন দীর্ঘশ্বাস নেয়। তাকে বাঁচতে হবে, এই স্মৃতিগুলো নিয়েই বাঁচতে হবে তাকে। নতুন করে সব শুরু করবে সে। কিন্তু সেই নতুনত্বে থাকবে না কোনো বাবা নামের মানুষ, থাকবে না কোনো মা নামের মানুষ।

আদিব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বাসা, কতোই না সুন্দর এই বাসা। কিন্তু আজ খুব নীরব। দেয়াল গুলো সাক্ষী কিছু ঘটনার। যা খুবই কষ্টদায়ক।
নাওশিন আমি আসি তাহলে।
নাওশিন বলল,
ভাইয়া আসবেন কিন্তু এই বোনটিকে দেখতে।
আদিব একটু এগিয়ে নাওশিনের কাছে এসে দাঁড়ায়। নাওশিনের ওড়না দিয়ে ঢাকা মাথায় নিজের হাত রেখে বলল,
আমরা সাত ভাই, ৭দিনে ৭জন আসবো। কতো মিল দেখেছো।
নাওশিন কিছু বলল না।
আদিব বিদায় নেয়।
আতিকা বেগম বেশ কিছুক্ষণ ধরে বাসার প্রতিটা জায়গা দেখছেন। নাওশিন তো নিজের বাসায় আসতে পেড়েছে। কিন্তু তিনি?
আতিকার ভিতরটা চিৎকার দিয়ে কান্না করছে আজ। মানুষ বলে শব্দ করে কান্নায় কেউ ম’রে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে কান্নায় মানুষ একটু একটু করে ম’রে যায়। আর সেই মৃ’ত্যু হয় ভিতরে থাকা মনের।
আতিকার চোখে আজ নিজের স্বামীর গড়া সেই বাসাটিই ভেসে উঠছে। যা দখল করে নিয়েছে আনিকের চাচারা। একটুও প্রতিবাদ করেন নি। কারণ তাদের ভাইকে যে মানুষগুলো খু’ন করেছে, ওই খু’নিরা যে নিজের আপন ভাই। তাহলে ওরা তো বাসা দখল করবেই।

নাওশিন তার বাবার রেখে যাওয়া সংসারটি আবারও সাজাবে। কিন্তু তার কাছে যে একটা টাকাও নাই। কি দিয়ে দাঁড়াবে সে? পড়ালেখাও জানে না অতো, যা জানে তা দিয়ে তো চাকরি করতে পারবে না। আর বয়সটাও মাত্র ১৬, কী ভাবে কী করবে এই বিষয় চিন্তা করে খুঁজে পাচ্ছে না নাওশিন।
নাওশিন রান্না ঘরে যায়। কেমন বিশ্রী গন্ধ আসছে। দেখতে পেলো বেশ কিছু জিনিশ পঁচে আছে।
নাওশিন সময় নিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করল। আতিকাকে সে কোনো কাজ করতে দেয় নি। ছোট্ট করে একটি বাক্য শুধু বলেছে।
আপা আপনি শুধু বসে বসে দেখুন, এই ছোট্ট নাওশিন কীভাবে সংসারটি আবার জীবন্ত করে।
আতিকাও চুপচাপ শুনেছেন নাওশিনের কথা। কারণ আজ উনি খুব ক্লান্ত। দু তিনদিন যাক, তার পর না হয় নাওশিনকে সাহায্য করবেন।
নাওশিন অনেক সময় নিয়ে রান্নাঘরটি গুছিয়ে নেয়।
ঘরে চাল ছাড়া আর কিছু পায় নি নাওশিন। ফ্রিজ খুলে অল্প কিছু মাছ এবং মাং’স পায় নাওশিন। রান্নার যা প্রয়োজন তা আছে৷ নতুন করে কিনতে হবে অনেক কিছু, কিন্ত টাকা? নাওশিনের চোখ ভিজে যায়। সে টাকা কোথায় পাবে।
হেটে নিজের বাবার রুমে যায়। বাসায় আসার পর দীর্ঘক্ষণ পর সে এই প্রথম বাবার রুমে এসেছে। ভিতরটা কেঁদে উঠল তার, এই রুমেই তার বাবাকে খু’ন করা হয়েছিল। আর এই রুমেই তার স্বার্থপর মা নিজের দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে থেকেছেন।
রুমটার চারদিকে তাকিয়ে দেখছে নাওশিন। তার বাবার রেখে যাওয়া সেই রুমটি যেন আগের মতো নাই। মনে হচ্ছে রুমটি কান্না করছে।
নাওশিনের মুখে হাসি ফুটে উঠে। কারণ সে সফল হয়েছে। তার খুব করে মনে ছিলো তার বাবা আলমারির চাবি কোথায় রাখতেন। তাই নাওশিনও সেই জায়গা দেখতে ইচ্ছা করল, তার স্বার্থপর মা ঠিক একই জায়গায় চাবি রেখেছেন। আলনাতে থাকা অনেক গুলো কাপড়ের মধ্যে একটি কাপড়ে সে চাবি খুঁজে পায়। তার বাবা বলতেন, ঘরে ডা’কাতের হানা পরলে, চাবি খুঁজতে খুঁজতে যেন সকাল হয়ে যায়। তাই আলনার কোনো কাপড়ে রেখে দিতেন চাবি।

নাওশিন আলমারি খুলে। আলমারির একটি অংশ ভরা কিছু গহনায়। এগুলো কী সব সোনা৷ তা সে বুঝতে পারছে না। আতিকাকে ডেকে আনে সে।
আপা এগুলো কী সব সোনা?
আতিকা বেশ কিছুক্ষণ হাতে নিয়ে দেখলেন।
সোনার গহনা গুলো আলাদা করলেন,
এইগুলো হলো সোনা। অন্যগুলো সোনার মতোই নকল গহনা।
নাওশিন বলল,
আপা এই সোনা বিক্রি করে আমরা অনেক দিন চলতে পারবো।
আতিকা কিছু বললেন না। নাওশিন আবারও বলল
আপা এখানে কতটুকু সোনা?
আতিকা আন্দাজে বললেন,
মনে তো হচ্ছে চার ভরির উপর হবে।
নাওশিন বলল,
তাহলে আমরা অনেক টাকা পাবো।
আতিকা এবার ধমক সুরে বললেন,
নিজের বাবার সংসার সাজাতে চাচ্ছিস, কিন্তু বাবার সোনা গুলো বিক্রি করে দিতে চাস কেন?
এই কথাটি শুনে নাওশিন চুপ হয়ে যায়। সত্যিই তো কেন সে এই সোনা বিক্রি করবে? কিন্তু চলবে কীভাবে? টাকা পাবে কোথায়।
আপা এগুলো যে আমার আব্বার সোনা, আমি বুঝব কীভাবে?
আরে পা’গলী কোনো খু’নী কখনো তার স্ত্রীকে সোনা উপহার দেয় না। ওই যে বললাম না, দেখতে সোনার মতো। কিন্তু নকল। ওইগুলো আনিছুর দিয়েছে। কারণ ওগুলো নকল। কিন্তু অবুঝ মহিলা বুঝল না।
নাওশিন আতিকার কথা চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করে নেয়৷ কারণ কোনো খা’রাপ মানুষ কীভাবে নিজের স্ত্রীকে সোনা উপহার দিয়ে টাকা খরচ করতে চাইবে?
নাওশিন আলমারি খুঁজে অনেক টাকা পায়।
সব টাকা সে আর আতিকা গুনে। সব মিলে ৮৯হাজার টাকা। নাওশিনের মনটা মুহূর্তে ভালো হয়ে যায়। আতিকাও হাসলেন। আর বললেন,
আরো খুঁজে দেখ, পাস কি না।
নাওশিন খুঁজতে থাকে। আরো কয়েক হাজার টাকা পায়। সব মিলে ৯৪হাজার টাকা।
এই টাকায় অনেক দিন চলে যাবে দুজনের। লোভী দুই ব্যক্তির টাকা।
লোভী শব্দটি নাওশিনের মনে আসতেই মুচকি হাসে।
এই পৃথিবীতে লোভী মানুষের অভাব নাই। কিন্তু ওই মানুষ গুলোর জ্ঞানের ভীষণ অভাব। লোভ মানুষের জ্ঞান খেয়ে ফেলে। লোভ হলো সাপের মতো। সাপ সামনে যতো বড় প্রাণীই দেখুক না কেন, সে সেটা খেতে চাইবেই। লোভও তেমন, লোভ চিনে শুধু বড় আর বড়। তাদের চোখে ছোট বলতে কিছু নাই। কিন্তু মানুষ ভুলে যায়। লোভ মানুষকে শান্তিতে বাঁচতে দেয় না। এই যে তার স্বার্থপর মায়ের আলমারি ভরা শাড়ি। এটা ওটার ফাঁকে ফাঁকে টাকা। কিন্তু আজ সেই মানুষটি জেলে। সত্যিই লোভ মানুষকে বেশি পাওয়ার আশা দেখিয়ে ধ্বংস করে ফেলে। আপনার মুরগি ডিম দেয়, বেশ কয়েক টাকা পেয়ে যাচ্ছেন হালি হালি ডিব বিক্রি করে৷ হঠাৎ কোভ হলো মাং’স খাওয়ার, তখন ঘরের মুরগিকেই খেয়ে নিলেন ডিম দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ এই লোভ কিন্তু ভালো৷ খা’রাপ লোভ এটি নয়।
এই মুরগি যদি অন্যের হতো, আর সেটা আপনি চুরি করতেন। তাহলেই এই লোভ হতো খা’রাপ।

৬টা মাস কেটে যায়। আজ নাওশিন দাঁড়িয়ে আছে এমন একজন মানুষের সামনে, যেই মানুষটি তার গর্ভধারিণী মা। কয়েক মিনিটের জন্য দেখা করার সুযোগ পেয়েছে নাওশিন।
তার একটুও খা’রাপ লাগছে না উনাকে দেখে।
কারণ একজন খু’নিকে দেখে সে একটুও মন খা’রাপ করবে না। কার জন্য করবে? যে তার বাবার খু’নি।
নাওশিনকে জিজ্ঞেস করকেন সাজেদা।
কেমন আছিস মা?
এমন বাক্য শুনে নাওশিন হেসে দিলো।
এমন ভাক্য আপনার মুখে খুবই বেমানান। হ্যাঁ আমি ভালো আছি। আমার আব্বার খু’নির এই অবস্থা দেখে আজ আমার মনটা খুব ভালো।
সাজেদা বেগম ম’রা চোখে তাকিয়ে আছেন। কিছু বললেন না। নিজের ভাগ্যের দিকে তাকিয়ে সব মেনে নিলেন তিনি।
জানেন? আপনার ওই চোখে আমি এক সময় ভালোবাসা দেখতাম। তারপর দেখলাম আমার মৃ’ত্যু, আজ দেখতেছি আপনার চোখটাই আজ মৃ’ত।
সাজেদা বললেন,
মারে আমায় ক্ষমা করে দিস।
নাওশিন কিছু বলতে চাওয়ার পূর্বেই একজন পুলিশ বলে উঠলেন,
আপনার আরো সাত মিনিট আছে।
নাওশিন তাকায়,
ক্ষমা? কী ছিলো আমার আব্বার দোষ? আমার কী দোষ ছিলো? এতো অ’ত্যাচার। কতো আর্তনাদ করেছিলাম। কিন্তু আপনি শুনেন নি। আজ ক্ষমা চাচ্ছেন? হ্যাঁ আমি ক্ষমা করে দিয়েছি আপনাকে। তবে আইন আপনাকে তো ক্ষমা করবে না।
কয়েক মিনিট থাকা সত্ত্বেও নাওশিন বিদায় নেওয়ার জন্য পিছন ফিরতে চায়, তবে আবারও স্থির হয়ে দাঁড়ায়।
আমি আপনার ফাঁ’সির অপেক্ষা করছি। আমাকে এতিম করা মানুষটির ফাঁ’সি হোক।
সাজেদা চোখে আসা জল মুছলেন না। অতীত মনে করে সারাক্ষণ ভীষণ কষ্টে থাকেন। কিন্তু এই কষ্ট কেউ দেখে না৷ কেউ দেখতেও চায় না।
নাওশিন একজন অপরিচিত মানুষের সামনে দাঁড়ায়।
সালাম দেয়।
উনি সালামের উত্তর দিলেন।
আপনার জন্য দোয়া করি৷ যদিও আপনি খু’নি। তবুও মন থেকে চাই আপনার যেন ফাঁ’সি না হয়।
আমিনা হাসলেন, কিন্তু সামনে থাকা নাওশিনকে চিনলেন না।
আমি হলাম নাওশিন আনবার। আপনার ওই খা’রাপ স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম স্বামীর মেয়ে। কতো কঠিন না শব্দ গুলো?
আমিনা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন নাওশিনের দিকে। বায়েজিদ এর মুখে নাওশিনের কথা শুনেছেন। কিন্তু কখনো দেখতে পান নি।
নাওশিন বলল,
আপনি সত্যিই একজন প্রতিবাদী নারী। আমার সার্থক হতো আমি যদি আপনার গর্ভে হতাম। আর আপনি যদি আমার বাবার স্ত্রী হতেন।
আমিনা শুধু বললেন,
মাঝেমধ্যে তুমি আমার ছেলে মেয়ে দুটোকে দেখে রেখো। ওরা খুব অসহায়।
আমিনা নিজের বাসার ঠিকানা নাওশিনকে বলে দিয়েছেন। নাওশিন বিদায় নেয়।
অনেক অপরাধীর ভীড় থেকে সে বের হয়ে এসেছে।

চলবে,,,

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৭)
লেখক: হানিফ আহমেদ

এখন নাওশিনের বয়স আঠারো বছর এক মাস। নাওশিন আরো সুন্দর হয়েছে। অতীতের সৌন্দর্যের থেকে তার সৌন্দর্য আরো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সুন্দর এমন একটি শব্দ, যা দিন দিন বৃদ্ধি পায়। তাইতো মানুষ সুন্দরের এতো ভক্ত।
সে তার বাবার এই বাসাটিকেও নিজের মতো সুন্দর রূপ দিয়েছে।
নাওশিন মাস শেষে ১২হাজার টাকা পায়। এই টাকায় তার এবং আতিকার জীবন সুন্দর ভাবেই চলছে।
আদিব নিজের পরিবার থেকে মাস শেষে ১২হাজার টাকা নাওশিনকে দেয়। নাওশিন ততোদিন টাকা নেয় নি। যতোদিন তার কাছে আলমারিতে পাওয়া সেই টাকা গুলো ছিলো। টাকা শেষ হওয়ার পর যখন নাওশিন চাকরি করতে চায়, কিন্তু কোনো চাকরি পাচ্ছিল না। নাওশিন চাকরি খুঁজছে, এই খবর আদিব সহ তার পরিবারের সবাই শুনে খুব রাগ দেখায়।
আদিব মাস শেষে ১২হাজার টাকা দিবে এটা বলেছে। সপ্তাহ শেষে বাজার করে দিবে।
কিন্তু নাওশিন চায় কিছু করতে৷ সব শেষে সে আদিবের কথায় রাজি হয়। রাজি না হলে ওরা কষ্ট পাবে। এই দিকে তার এই সুন্দর জীবন ওদের জন্যই পাওয়া। তাই সে রাজি হয়।
আদিব সহ তার পাঁচ ভাই দুই হাজার টাকা করে মোট বারো হাজার টাকা নাওশিনকে দেয়। নিয়াজও চাকরি করে, সেও নাওশিনকে টাকা দেয়। সাইফ শুধু কোনো চাকরি করে না।
নাওশিন এই টাকা থেকে অল্প কিছু হলেও জমায়। কারণ দুজনের এতো টাকা লাগে না, সুন্দর ভাবেই এই টাকায় তারা চলতে পারে।

আতিকা বসে বসে সবজি কা’টছিলেন, নাওশিন এসে পাশে বসে উনার।
আপা এখন আবার সবজি কেন?
আদিব আসবে, তাই তরকারি রান্না করতে হবে।
নাওশিন কিছু বলল না। সে বসে বসে উনার কাজ দেখছে। একটি মৃ’ত সংসারকে এতো সুন্দর ভাবে জীবন্ত নাওশিন একা করে নি। আতিকা তাকে সাহায্য করেছেন। একটি সংসার কীভাবে সাজাতে হয় সেটা তাকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
আপা বছরের পর বছর চলে যায়, কিন্তু অপরাধীদের কোনো শাস্তি হয় না কেন?
নাওশিনের প্রশ্ন শুনে তিনি সবজি গুলো হাত থেকে রেখে বললেন,
এক মিনিটে মানুষ খু’ন করার মতো অপরাধ করা যায় রে নাওশিন। কিন্তু সেই অপরাধে অপরাধীর শাস্তি হতে হতে কয়েক বছর চলে যায়।
নাওশিন দীর্ঘশ্বাস নিলো। সত্যিই তো।
আপা আমি শুনেছি, চৌধুরী পরিবারের কম বয়সী পুরুষদের কয়দিন পূর্বেই ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। ওরা নাকি এসবের সাথে জড়িত না।
আতিকা চুপ থাকলেন। খবরটি তিনিও শুনেছেন আদিবের মুখে। ৫জনকে আইনের মাধ্যমে ছাড়িয়েছে চৌধুরী পরিবারের মানুষগুলো। এই পাঁচজন শুধুই যুবক যাদের বয়স ২৬ বা ২৭ হবে। কিন্তু অন্য কাউকেই ছাড়েনি পুলিশ। এই পাঁচজন কোনো খা’রাপ কাজের সাথে জড়িত, এরকম কোনো প্রমাণ পায় নি পুলিশ৷ অন্যরা অপরাধী, সেটা তারা স্বীকার করেছে পুলিশের অ’ত্যাচারে।

রাতের খাবার খেয়ে যেতেই হবে আদিবকে। কোনো ভাবেই ছাড়তে রাজি না আতিকা এবং নাওশিন। আদিবও এতো জোরাজুরিতে রাজি হয়। কারণ সে এসেছে একটি প্রস্তাব নিয়ে। সেটা রাতে খাবার টেবিলেই বলবে বলে ঠিক করেছে সে।
বিকেল থেকে অনেক গল্প করে আদিব ওদের সাথে। তাদের দিনগুলো এখন খুব সুন্দর। স্বাধীন ভাবে চলতে পারে তারা। পূর্বের মতো মনে আর ভয় নেই, নেই কোনো শত্রু। এরকম জীবন তো চায় সবাই। কিন্তু জীবন হলো একটি যু’দ্ধের ময়দান। এই ময়দানে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত সুখ স্পর্শ করা যায় না। জীবন তার ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতেই ব্যস্ত থাকবে, আমাদের কাজ করতে হবে সেই ধাপগুলোতে, যেন ধাপগুলো হয় খুব সুন্দর।
প্লেটে ভাত নড়াচড়া করছে আদিব। আজ কোনো এক ফাঁকে আতিকাকে মনের কথা বলেছে আদিব। এখন নাওশিনকে বলা প্রয়োজন।
আদিব বলল,

নাওশিন তোমায় কিছু বলতে চাই আমি।

নাওশিন মুখের ভিতর ভাত রেখেই বলল,
ভাইয়া ভাত খেয়ে নেই আমরা। তারপর চা খেয়ে খেয়ে আপনার কথা শুনবো।
আদিব কিছু বলল না। নিজের খাবারের দিকে মন দেয় সে।

নাওশিন তিন কাপ চা নিয়ে এসে বসে ওদের সাথে।
আদিব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

নাওশিন আমি চাই তোমাকে নিয়াজের বউ বানিয়ে আমাদের বাসায় নিয়ে যেতে।

হঠাৎ এমন কথা শুনে নাওশিন খুব অবাক হয়। এমন কথা কখনো সে কল্পনাতেও নিয়ে আসেনি। নাওশিন কিছু বলল না, ধোঁয়া উঠা চায়ে নিজের মনের মতো চুমুক দিতে থাকে নাওশিন।
আদিব আতিকার দিকে তাকায়। আতিকা ইশার দিলেন, সে যেন আবার এই কথা নাওশিনকে বলে।
আদিব বলল,
নাওশিন আমি কিছু বলছি তোমায়?
নাওশিন চায়ের কাপ হাত থেকে রাখতে রাখতে বলল,
কী বলেছেন ভাইয়া?
বাব্বাহ, তুমি তো দেখি খাওয়ার সময় খাবারের দিকেই খুব মন দাও।
আদিব কথাটি বলে হেসে দেয়।
নাওশিন চুপ হয়ে বসে আছে। সে আজ লজ্জা পাচ্ছে। আদিব বলল,

নাওশিন তোমাকে নিয়াজের বউ বানাতে চাই। আমাদের সবার মত আছে তোমাকে নিয়াজের বউ বানাতে।

নাওশিন ছোট্ট করে প্রশ্ন করল।

নিয়াজ ভাইয়ার মত?

নিয়াজেরও মত আছে। প্রথমে না করলেও সবার কথায় সে রাজি হয়। এখন তোমার মতামত শুনতেই আজ আমি এসেছি।

নাওশিন নিচের দিকে তাকিয়ে বলল,
ভাইয়া আমি বিয়ে করব না। আমি এভাবেই থাকতে পারবো। এভাবে একা এখন খুব ভালো লাগে।
আদিব একটু সময় চুপ থেকে বলল,
তুমি একা?
হ্যাঁ ভাইয়া, আমি একা খুব একাকীত্ব জীবন আমার। এভাবেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো আমি।
আদিব হেসে বলল,
তাহলে আতিকা আপা?
নাওশিন চুপ থাকে। আদিব বলল,
আপা তোমার সাথে থাকেন, তবুও বলছ তুমি একা।
ভাইয়া আপাও আমার মতো একাকীত্বের সঙ্গী। আমিও আপার মতো এভাবেই থাকতে চাই।
আদিব হাসলো নাওশিনের কথায়। আর বলল,

নাওশিন এটা একাকীত্ব না। তোমার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষ বলে তারা একা, খুব একা। কিন্তু তারা কখনো একা না। আমরা একাকীত্ব বলতে বুঝি সবার মধ্যে থাকা, চলাফেরা করা, কথা বলা, কিন্তু দিন শেষে বলি আমি একা খুব একা, আমাকে একাকীত্ব খুব আপন করে নিয়েছে। কিন্তু এই কথা কোনো ভাবেই সত্য না।
তুমি বছরের পর বছর একা বেঁচে থাকতে পারবে না। একটু একটু করে হারিয়ে যাবে। একাকীত্ব জীবন ভাবতে হবে এমন। যে লোকালয়ে থাকে না। বছরের পর বছর মানুষের দেখা পায় না। সেটাই একাকীত্ব নাওশিন। এই যে তুমি আমাদের দেখতে পারছো। ঘুমানোর পূর্বে আপাকে দেখতে পাও, ঘুম থেকে উঠে আপাকে দেখতে পাও। তুমি কখনো একা না। কিন্তু নিজেকে একা দাবি করছ। মানুষের ভীড়ে মানুষ বসবাস করে কখনো একা হয় না নাওশিন। হয়তো একাকীত্বের অভিনয় করে। আশেপাশে এতো মানুষ থাকার পরেও কেউ যদি বলে সে একা তাহলে তা কেউ বিশ্বাস করবে না।

নাওশিন চুপ থাকে। কিছুই বলল না সে। তার মনের মধ্যে একাকীত্ব বলতে ভিন্ন কিছু। সবার মধ্যে থেকেও একা মনে হওয়াই একাকীত্ব। আপনদের ভীড়ে থেকেও মানুষ খুব একা অনুভব করে নিজেকে।
আদিব আবার বলল,

সবাই চায় তুমি নিয়াজের স্ত্রী হও। তোমারও কোনো পুরুষের প্রয়োজন নাওশিন। তোমার জীবন আরো সুন্দর হবে যখন তুমি একজন বিবাহিত নারী হবে। কারো উপর ভরসা করতে পারবে। মাথার উপর একটি সুন্দর আকাশ পাবে। কেউ তোমায় ভালোবাসবে। তার দুনিয়া বানাবে তোমায়। এই দুনিয়ায় খা’রাপ সময়ে এগিয়ে আসা মানুষটি তোমার স্বামীই হবে নাওশিন। এই যে তুমি বলছ তুমি একা। এই কথা বলতে পারছো, কারণ তোমার জীবনটা এখনো পূর্ণতা পায় নি। বিয়ের মাধ্যমে তুমি নিজেকে আরো পূর্ণতা দিতে পারবে নাওশিন।

নাওশিন এতো কথার উপরে শুধু একটি কথাই বলল,

নিয়াজ ভাইয়া খুব রাগী। উনার খুব রাগ। চোখের দিকে তাকানো যায় না।

আদিব আর আতিকা দুজনেই হেসে দেয় নাওশিনের কথা শুনে। আতিকা হেসেই বললেন

তুই জানিস আমি কতোটা রাগী ছিলাম। কিন্তু আনিকের বাবা আমার রাগকে জয় করেছেন। বিয়ের পর একজন মানুষ অনেকটা পরিবর্তন হয়ে যায় রে নাওশিন। যেই মেয়ে বাবার বাড়ি সারাক্ষণ হৈচৈ করে, খাবার খেতে অমনোযোগী থাকে। সেই মেয়েই স্বামীর বাড়ি হয়ে উঠে খুব শান্তশিষ্ট । খাবারে অমনোযোগী থাকা মেয়েটা খুব মনোযোগী হয়ে যায় স্বামীর বাড়ির প্রতিটা মানুষের খাবারের প্রতি। যেই মেয়ে অল্পতে রেগে যেত, সেই মেয়ে একসময় ভুলে যায় রাগ কী। রাগ শব্দের পরিবর্তন আছে, আর সেটা হলো নতুনত্ব। নতুনত্ব এর স্বাদ পেলে মানুষ পরিবর্তন হয়। তখন মানুষের সব কিছুই পরিবর্তন হয়।
একজন ছেলে বেপরোয়া থাকে। বাবার পকেটের টাকা উড়ানোই তার কাজ। খাবার না পেলে মাথা গরম করে ফেলে। একটি ছেলে যতক্ষণ একা থাকে ততক্ষণ সে খুব রাগী, মনে করে এসবই তার সব।
কিন্তু সেই ছেলেও পরিবর্তন হয়। পরিবার নিয়ে ভাবে। স্ত্রীকে নিয়ে ভাবে। বাবার টাকা উড়ানো ছেড়ে দিয়ে কীভাবে সেই পকেটে আরো বেশি টাকা রাখা যায় সেটাই চিন্তা করে। বেপরোয়া ছেলেটি হয়ে উঠে একজন দ্বায়িত্বশীল পুরুষ। এতো দ্বায়িত্বের ঠেলায় ভুলে যায় রাগ কী।
নিয়াজকে তুই রাগী বলছিস। দেখবি বিয়ের পর তার রাগ উধাও। কারণ মানুষ যখন পরিবর্তন হয়, তখন অনেক কিছু পরিবর্তন করে।

নাওশিন চুপ। সে কোনো ভাবেই বলতে পারছে না তার মা বাবার কথা। একটি ধাক্কা তো সে খেয়েছে। বিয়ে শব্দে তার এতো মনযোগ নাই। ঘৃণা জন্মেছে তার। এতো ভালোবাসা এতো এতো ভালোবাসা। কিন্তু শেষে যদি হয় সেই ভালোবাসার খু’ন তাহলে কী হবে একটি বিয়ে নামক সম্পর্কে নিজেকে গেঁথে।
নাওশিন বলল,

আমি বিয়ে করতে পারবো না ভাইয়া। চোখের সামনে আমি আমার আব্বার লা’শ এখনো দেখতে পাই। উনিও তো বিবাহিত ছিলেন। আম্মা এতো ভালোবাসা পেয়েও খা’রাপ সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আব্বাকে উনার প্রেমিক খু’ন করেছে উনার সামনে। এতো সব দেখে বিয়ে শব্দের প্রতি আমার ঘৃণা জন্মেছে অনেক পূর্বেই। আমি পারবো না বিয়ে শব্দে নিজেকে আবদ্ধ করতে।

আদিব এতক্ষণে বুঝতে পারছে মূল কারণটি। আদিব বলল,

দু একটা সম্পর্ক দেখে কী এমন ডিসিশন নেওয়া ঠিক নাওশিন? তুমি তোমার বাবা মায়ের সম্পর্কটাই দেখেছো৷ এই পৃথিবীতে কী আর কারো বিবাহ জীবন সুখে যাচ্ছে না? তুমি আমাদের দিকে তাকাও। আমরা পাঁচটা ভাই বিবাহিত। কোথাও দেখেছো আমাদের মধ্যে খা’রাপ কিছু। এই পৃথিবীতে বিয়ে শব্দ যেমন আছে, তেমন ভাঙা একটি শব্দও আছে। কয়টা সম্পর্ক ভাঙে? দুই একটা কারণে একটি শব্দের প্রতি ঘৃণা জন্মে যাওয়া ঠিক না নাওশিন।
তুমি চোখ হাটিয়ে দেখো, এই বিয়েতে কতো মধুর সম্পর্ক। বিয়েতে যদি শুধুই কষ্ট থাকতো, তাহলে কী কেউ বিয়ে করত? নাওশিন তুমি বড় হয়েছো। বুঝতে তো অনেক পূর্বে শিখেছো। কিন্তু আজ এই কথাটি তুমি অবুঝের মতো বললে। এভাবে কখনো জীবন চলে না নাওশিন। মানুষ ধাক্কা খায় আবার ঘুরে দাঁড়ায়। তুমি বিয়ের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে দেখো না কতোই না সুখ তাতে।

নাওশিন চুপ থাকে। এই বিয়ের প্রতি তার বিশ্বাস নেই।
নাওশিন না শব্দতেই থাকে। আতিকা কিংবা আদিব তাকে রাজি করাতে পারেন নি।
আদিব শুধু বলল,
নাওশিন বোন আমার ঠান্ডা মাথায় ভাবো। ভাবনার পূর্বে নিজের চোখের সামনে যতোগুলো ভালো সম্পর্ক দেখেছো, সেগুলো চোখের সামনে রেখে ভাবো। আমরা তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো।

আদিব কথাটি বলে মনের মধ্যে চাপা কষ্ট রেখে বিদায় নেয়। রাত তখন ১০টা বাজে। আতিকা বুঝতে পেরেছেন আজ আদিব খুব কষ্ট পেয়েছে। মনে জোর নিয়েই এসেছিল। কিন্তু নাওশিন সেই মন ভেঙে দিয়েছে।

নাওশিন বসে আছে, সে ভাবছে। তার কী করা উচিত? বিয়ে, সে তো এটাই ভেবেছে কখনো বিয়ে করবে না। না শব্দটি তো বলেই দিয়েছে। বিয়ে নিয়ে অন্তত ভাবতে চায় না সে।

সকালের আলো ফুটেছে। পাখির কিচিরমিচির শব্দে নিয়াজের ঘুম ভেঙেছে। তার সাথে এখনো আদিবের সাক্ষাৎ হয় নি। আদিব বাসায় ফিরার অনেক পূর্বেই সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
নাওশিনকে যখন তার বউ বানানোর কথা সবাই বলেছিল। তখন সে খুব অবাক হয়েছিল। নাওশিনকে নিয়ে এতোটা ভাবেনি সে, বাসায় যখন ছিলো নাওশিন। তখন দু একবার তার মনে এসেছিল নাওশিনকে নিয়ে রূপকথার আকাশে উড়াল দিতে। কিন্তু সেটা ভাবনা পর্যন্তই রেখেছিল। কিন্তু সবার কথা শুনে কোনো ভাবেই রাজি হচ্ছিল না। কারণ নাওশিনের কেউ নাই। এটাই বলেছিল সে। কিন্তু তার ভাইগুলোর একটিই কথা।
নিয়াজ তুই আমাদের ভাই হয়ে কীভাবে বলতে পারলি নাওশিনের কেউ নাই। আমাদের কে আছে বল? আমাদের পরিবারকে যারা হ’ত্যা করেছে, নাওশিনের বাবাকেও তো তারাই করেছে। তোর কাছে অন্তত এই কথা শুনতে চাই নি। নাওশিনের ছয় ছয়টা ভাই আছে। আমরা ওর ভাই, আর তুই হবি ওর স্বামী।
নিয়াজ এই কথাগুলোর উত্তরে শুধু বলছিল, আচ্ছা আমি রাজি।
সকালের সুন্দর আকাশের দিকে তাকিয়ে নিয়াজ ভাবতেছে৷ নাওশিনকে কল্পনায় আঁকার চেষ্টা করতে চাচ্ছে। কিন্তু সে নিজের রুম থেকে বের হয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। আর মনে মনে ভাবলো, মনকে এতো ক্লান্ত না করে একবারে বিয়ে করাই ভালো।

ভাইয়ের মুখে নাওশিন রাজি না, শব্দটি শুনে নিয়াজ খুব অবাক হয়। আদিব নিজের ভাইয়ের মুখপানে তাকিয়ে দেখলো। না তার ভাই আজ রাগে নি। শুধু অবাক হয়েছে।
ভাইয়া নাওশিন রাজি না?
আদিব বলল,
ও বলছে তোর খুব রাগ। তোর চোখের দিকে সে তাকাতেই পারে না।
নিয়াজ এবার হেসে দেয়। ভাইয়ের পাশে নিজের মিনহাকে দেখে তার দিকেই তাকিয়ে বলল,
বুঝলে ভাবি। তোমার বর বুঝল না, নাওশিন যে রাজি। বড় ভাইকে কীভাবে বলবে আমি রাজি। তাই আমার রাগকেই দেখালো। আমাকে নিয়ে কখনো ভেবেছে বলেই তো রাগটা তার মনের মধ্যে গেঁথে আছে। ভাবি তোমরা কথা বলে দেইখো, ঝর্ণার পানির মতো গড়গড়িয়ে বলে দিবে আমি রাজি।

কথাটি বলে কেমন এক লজ্জা মাখা মুখে সে বিদায় নেয়।
মিনহা স্বামীর দিকে তাকায়।
সব সত্যটা শুনলে হয়তো নিয়াজ কষ্ট পেতো তাই না?
আদিব মাথা নাড়ায়।
আচ্ছা শুনো, ও কী সত্যিই রাজি হবে না?
আদিব চুপ থাকে।
মন খা’রাপ করে থেকো না। দেখবে ও ঠিকই রাজি হবে। ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে যখন পেরেছে। সেই ধাক্কাটাও ভুলতে পারবে।
আদিব কিছুই বলল না। সে তার ভাইয়ের কথা ভাবতেছে৷ হয়তো সে নাওশিনকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এখন যদি কষ্ট পায়, তাহলে এসবের জন্য আদিব সহ তার সব ভাই ভাইয়ের বউ দায়ী।
নাওশিন কীভাবে থাকবে বিয়ে ছাড়া। এভাবে নিজের মনের কথা বলে দেওয়ার পূর্বে হাজারো বিয়ের সম্পর্ক দেখা উচিৎ ছিলো তার।
আদিব চুপ করে বসে শুধুই ভাবছে, নাওশিন কী বিয়েতে হ্যাঁ বলবে না?

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-১৪+১৫

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৪)
লেখক: হানিফ আহমেদ

নাওশিন খবরটি শুনে খুব অবাক হয়েছিল। তার মায়ের স্বামীকে খু’ন করা হয়েছে। আরো বেশি অবাক হয়েছে এটা জেনে, তার মায়ের স্বামী ওই চৌধুরী পরিবারের সন্তান। তার যেন অবাক হওয়ার শেষ নাই। কারণ তার মায়ের স্বামী আবার আতিকা চৌধুরীর আপন ভাই।
নাওশিন বসে আকাশ দেখছিল, আজ আকাশটা মেঘলা ছিলো। সে বন্দী চার দেয়ালে। কারণ আতিকা বেগম তাকে বাসার ভিতরে রেখে চাল কিনতে গিয়েছিলেন। চাল শেষ হয়ে গিয়েছিল।
বাসায় এসেই নাওশিনকে এই খবর দিয়েছেন তিনি। আতিকার চোখে জল আসছিল বারবার, তবুও লুকানোর হাজারো চেষ্টা মাত্র।
আতিকা এটাও বলেছেন। তিনি শুনে এসেছেন আনিছুর এর খু’ন এর দায়ে সাজেদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। এই কথাটি শুনে নাওশিন কিছুটা অবাক হয়,
তার মা কেন খু’ন করবে? সে এই উত্তর পাচ্ছে না। নাওশিন এসব ভাবলো না আর। তার অন্তর একটুও ব্যথিত হয় নি আজ। অন্তর তো কাঁদে ভালো মানুষের জন্য। অ’ত্যাচারী মানুষের মৃ’ত্যুর জন্য আবার কিসের কান্না।

নাওশিন আতিকার পাশে বসে।
জানেন আপা আজ আমি ভীষণ খুশি।
আতিকা ছোট্ট করে প্রশ্ন করলে,
কেন?
আপা আজ একটি খা’রাপ মানুষের মৃ’ত্যুর খবর শুনেছি, তাই আজ খুব ভালো লাগছে আমার।
নাওশিনের কথাটি শুনে আতিকা কিছু বললেন না। তিনিও খুশি হতেন, এই মানুষগুলো যদি তার ভাই না হতো। তবুও তিনি আনন্দিত, কারণ স্বামীর খু’নিগুলোর শাস্তি কেউ না কেউ করে যাচ্ছে।
নাওশিন মনে মনে হাসলো, তার মায়ের স্বামীর বোনকে সে আপা ডাকে।
নাওশিন বলল,
জানেন আপা, আমি ওই বাসায় নিরাপদ ছিলাম না। আমি নিরাপদ ছিলাম না আমার মায়ের ওই খা’রাপ স্বামীর কাছে।
তিনি আবারও ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেন,
কেন?
নাওশিন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,

আমার যখন ১১বছর বয়স। তখন আমার মায়ের স্বামী আমার শরীরে হাত দিতো। তার স্পর্শ কেমন জানি খা’রাপ লাগতো। কোনো বাবার স্পর্শ মনে হতো না আমার। রুমে একা ঘুমাতাম, গভীর রাতে কোনো কারণে ঘুম ভেঙে যেতো। তখন দেখতাম আমার মায়ের স্বামী দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমাকে কিছু করতে চাইতো। এই জন্য আমি রাতে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে ঘুমাতাম। বয়সটা ১১ছিলো তখন, ছোট হলেও পরিস্থিতি আমায় ভালো খা’রাপ শিখিয়ে দিয়েছিল। নিজেকে রক্ষা করতে হবে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম তখনই।
আম্মা যখন জানতে চাইছিলেন, দরজা বন্ধ করে কেন ঘুমাই। তখন আমি বলছিলাম, আপনার স্বামীর কাছে আমি নিরাপদ না। কিন্তু এই কথার উত্তর খুঁজতে চাইলেন না আম্মা। উল্টো আমার নরম গালে থাপ্পড় দিয়েছিলেন।
আজ আমি খুব খুশি আপা। একটি খা’রাপ জঘন্য মানুষের খু’ন হয়েছে। আজ আমি খুব খুব খুশি আপা। যেই পুরুষ ছোট্ট মেয়ের ইজ্জত দিতে পারতো না, তার তো আরো পূর্বে খু’ন হওয়ার কথা ছিলো।

নাওশিনের মুখে নিজের ভাইয়ের এমং নোং’রামির কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলেন। কেন তিনি এই পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। যেই পরিবারের প্রতিটা পুরুষই খা’রাপ, ভালো পুরুষ বলতে তিনি মেরহাবকেই জানতেন।
তিনি চুপ করে বসে আছেন।
নাওশিন কিছু বলল না। সে ভাবনায় ডুব দিলো। অনেক কিছুই তার ভাবনায় আসছে।

আনিছুর চৌধুরীর মৃত্যুর পাঁচদিন পর আমিনা বেগমকে পুলিশ ধরতে সফল হয়।
এই কয়টা দিন পা’গলের মতো খুঁজেছে আমিনাকে পুলিশের লোকেরা।
অতঃপর তারা সফল হয়।
আমিনাকে ধরতে সফল হওয়ার রাস্তা ছিলো বায়েজিদ চৌধুরী। সাজেদা বেগম যখন হামিদুর রহমানকে বলেছিলেন, বাসায় বায়েজিদ একা। ছেলেটার কেউ নাই, তাকে যেন তাদের হেফাজতে রাখে।
হামিদুর রহমান জালাল চৌধুরীর মুখে শুনেছেন আনিছুর এবং আমিনার ছেলে বায়েজিদ। তাই তিনি বায়েজিদকে অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করার পর সে বলতে কোনো ভাবেই রাজি হয় নি, তার মায়ের নাম। সে বারবার বলছিল সে সাজেদা বেগমের ছেলে।
কিন্তু হামিদুর রহমান অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন। এক সময় তিনি সফল হয়েছেন। বায়েজিদ বলেছে তার মায়ের নাম। তার মায়ের নাম আমিনা বেগম। হামিদুর রহমান ছোট্ট করে প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন করলেন না। তিনি ছোট্ট একটি পথ অবলম্বন করলেন।
তিনি জানেন, কোনো বাচ্চার সামনে তার গুণগান গাইলে সেই বাচ্চা কখনো মিথ্যে বলে না। তাই তিনিও এই কাজ করলেন,
আচ্ছা বায়েজিদ আমি শুনেছি, তুমি খুব সত্যবাদী। সব সময় সত্য কথা বলো। সত্যের পথে থাকতে পছন্দ করো। তুমি খুব ছোট হলেও সত্যের পথে তুমি খুব সাহসী।
বায়েজিদ শুধু হু শব্দটি বলল। হামিদুর রহমান বললেন,
তাহলে তুমি তোমার মা আমিনা বেগমের সাথে কীভাবে কথা বলো?
বায়েজিদ সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দিলো।
এই যে আমার কাছে থাকা এই ফোন দিয়ে।
বায়েজিদ নিজের কাছে রাখা একটি লুকানো ফোন বের করে দেখিয়ে কথাটি বলল।
হামিদুর রহমান মনে মনে হাসলেন।
তোমার মা কোথায় সেটা আমাদের বলবে?
এবার বায়েজিদ চুপ হয়ে যায়। অনেক বার জিজ্ঞেস করেও তিনি বায়েজিদের থেকে জানতে পারলেন না।
তাই তিনি আরো একটি পথ বেঁচে নিলেন।
হামিদুর রহমান বললেন,
আমি জানি তোমার মা কোথায়?
বায়েজিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
কোথায়?
তোমার মা জেলে। উনিই বলেছেন, তুমি উনার ছেলে।
বায়েজিদ এবার কেঁদে দেয়।
না আমার আম্মু জেলে থাকবেন কেন। আমার আম্মু তো আমার মামার সাথে আছেন।
এই কথা বলে বায়েজিদ একটি জায়গার নাম বলে।
হামিদুর বিশ্বাস রেখেছিলেন, এই পথ অবলম্বন করলে জানতে পারবেন আমিনা কোথায় আছে।
বায়েজিদের বলা জায়গাটি হামিদুর চিনলেন। কিন্তু কোথায় থাকেন, সেটা তো জানতে হবে। তাই বললেন,
তোমার মা তো জেলে। তাহলে তুমি মিথ্যে বলছ কেন?
বায়েজিদ এবার চিৎকার করে বলল,
আমি মিথ্যা বলিনি। আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি মিথ্যা ঘৃণা করি, আমি কখনো মিথ্যা বলি না।
হামিদুর রহমান মনে মনে হাসলেন। সত্যিই তিনি মিথ্যে বলছেন, সত্যটা জানার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
হামিদুর রহমান বললেন, তাহলে চলো, কার কথা সত্য সেটি তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
বায়েজিদ হুম বলল।

দরজায় শব্দ করার পর কেউ দরজা খুলে, সালাম দেয় বায়েজিদকে। আর সালাম দেওয়া মানুষটি হলো মালিহা, তার ছোটবোন।
আমিনা বেগম বাসায় পুলিশ দেখে একটুও ভয় পান নি। কারণ তিনি তো কোথাও লুকিয়ে থাকেন নি। অনেক বছর ধরেই এই বাসায় থাকেন তিনি নিজের ভাইয়ের সাথে।
হামিদুর রহমান কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই আমিনা বলে উঠলেন,
জানি আপনারা কেন এসেছেন। আপনাদের প্রশ্ন করতে হবে না। আমিই বলছি সব।
আমিই খু’ন করেছি সব, প্রতিশোধ নিতে পেরে নিজেকে আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে।
হামিদুর রহমান খুব অবাক হলেন,
উনার দেখা এই প্রথম কোনো ব্যক্তি নিজের মুখে সব স্বীকার করেছে। যে অপরাধ করে, তার মুখ দিয়ে সত্য কথা এতো সহজে বের করা যায় না। কিন্তু আমিনা তো বলেই দিলো সে এসব করেছে।
হামিদুর রহমান কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু আমিনা বলে উঠলেন।
আমাকে গ্রেফতার করুন স্যার। আমি খু’ন করেছি। জানি আমার শাস্তি হবে। কারণ আমার তো আর এতো টাকা পয়সা নাই। দিনের পর দিন মানুষ খু’ন করার পরেও মানুষ বাঁচে যায়। টাকা তাদের বাঁচিয়ে দেয়। আমায় নিয়ে চলুন স্যার।
আমিনা বেগম কথা বলে থামলেন। উনাকে গ্রেফতার করা হয়। যখন ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন তখন কেউ উনার হাত ধরে আটকায়।
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, আদরের মেয়ে মালিহা।
আমিনা দাঁড়িয়ে যান। পুলিশ অফিসার এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমাকে কী একটু সময় দিবেন?
হামিদুর রহমান মাথা নাড়ালেন।
আমিনা এবার বললেন,

কাঁদিস না মা। যে দেশে অপরাধীর বিচার হয় না, সেই দেশে হাত একটু আধটু পানিতে ভেজাতে হয়। একটি কথা শুনে রাখ তোরা, ঘোলাপানিতে হাটতে হলে সতর্কতা প্রধান হাতিয়ার। কেনো জানিস? ঘোলাপানিতে উঁচু নিচু কিছুই দেখা যায় না। হাটতে হাটতে তলিয়ে যাবে বুঝতেই পারবে না। কিন্ত পরিষ্কার পানিতে মনের স্বাধীনে হাটা যায়। দুটোই কিন্তু পানি, কিন্তু পরিষ্কার বলে একটি শব্দ আছে তো।
তেমনি যেখানে অ’ন্যায় দেখবি সেখানেই রুখে দাঁড়াবি৷ অ’ন্যায়ে কোনো আপন আর পর শব্দ বলতে নাই, বড়লোক আর ছোটলোক নাই। অ’ন্যায় হলো পানির ভিন্ন ভিন্ন রঙ। চোখ বন্ধ করে রাখলে তলিয়ে যাবে।
যেই দেশে টাকা দেখে আইনের মানুষ চুপ হয়ে যায়। সেই দেশে নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। তোরা কান্না করিস না। আমার অপরাধ, আমি অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছি।

কথাগুলো বলে নিজের দুই সন্তানের কপালে চুমু এঁকে দিলেন। চোখের জল শতো চেষ্টা করে আটকিয়ে রাখলেন।
বিদায় নিলেন। বিদায়ের পূর্বে বড় ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে এক গাল মুচকি হাসলেন।
এই হাসির অর্থ হলো। তোমাদের বাঁচিয়ে দিলাম আমি। তোমরা আমার দুই সন্তানকে দেখে রেখো।
এতোটা মানুষকে একা খু’ন করা কোনো ভাবেই সহজ না। খু’নগুলো তিনিই করেছেন। কিন্তু ওদের বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়া এসব সাহায্য তিনি নিজের বড় ভাই এবং ভাইয়ের বউয়ের থেকে পেয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো ভাবেই এদের নাম কাউকেই বলবেন না। খু’ন তিনি করেছেন। ওরা তো শুধু সাহায্য করেছে।

আমিনা বসে আছেন পুলিশের গাড়িতে। দুই সন্তানের জন্য উনার মনটা খুব খা’রাপ।
অনেক কষ্টে বায়েজিদ এর খোঁজ পেয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে স্কুলে যেতেন তিনি। লুকিয়ে ছেলের সাথে দেখা করতেন।
প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন। কিন্তু সঠিক সময় পাচ্ছিলেন না। দিনের পর দিন চৌধুরী পরিবারের বাড়ির সামন ওঁৎ পেতে বসে থাকতেন। কিন্তু কোনো ভাবেই সুযোগ করতে পারছিলেন না।
তারপর হাতে সুযোগ আসে। একের পর এক খু’ন করতে থাকেন। একটুও মন খা’রাপ হয়নি। তবে মেরহাব চৌধুরীরকে খু’ন করার সময় কান্না করেছেন তিনি।
তিনি মেরহাবকে মা’রার আগমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, মনকে বুঝিয়েছেন মেরহাব তো নির্দোষ। কিন্তু মন বলেছে মেরহাব নির্দোষ না। কারণ তিনি যখন মেরহাবের কাছে গিয়েছিলেন, হাতজোড় করে বলেছিলেন,
এই চৌধুরী পরিবারে তুমিই একমাত্র ভালো মানুষ। তুমি সঠিক বিচার পাইয়ে দাও আমায়। চৌধুরী পরিবারকে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। আইন ওদের শাস্তি দিবে, যদি তুমি আমাকে সাহায্য করো। আমি কাউকে বলব না তোমার কথা। আমরা সবাই এক হবো, সাধারণ মানুষ মিলে এই পরিবারের শাস্তির ব্যবস্থা করব।
সেদিন মেরহাবের উত্তর ছিলো।
ওরা আমার পরিবার। আমার বাবা, আমার চাচা। আমি কীভাবে পারবো? ওদের শাস্তি দিয়ে আমি পারবো না আমার মা এবং চাচীদের কষ্ট দিতে। আমি ওদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না। তবে আমি ওদের খা’রাপ পথ থেকে নিয়ে আসবো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
এসব কথা আমিনার পছন্দ হয়নি। হতে পারে মেরহাব ভালো। কিন্তু সে প্রকৃত ভালো না।
মেরহাবকে খু’ন করার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, একটু ভালো হয়ে বেঁচে থাকার কী প্রয়োজন? অ’ন্যায় দেখে চুপ থাকার জন্য কী বেঁচে থাকতে হবে?
আমিনা বেগম আজ অনেক খুশি। চৌধুরী পরিবারকে পেরেছেন কাঁদাতে। যেভাবে ওরা তাকে কাঁদিয়েছিল।
নিজের স্বামীকে কোনো ভাবেই খু’ন করতে পারছিলেন না। বায়েজিদকে ছোট্ট একটি ফোন দিয়ে বলেছিলেন।
বাবা এটা রাখ, তোর ওই খা’রাপ বাবা যখনই বাসা থেকে বের হবে। তখন যেভাবেই হোক আমায় জানাবি। বায়েজিদ অনেকদিন জানিয়েছে। কিন্তু তিনি সুযোগ পাননি। সেদিনও বায়েজিদ জানিয়েছিল। সেদিন সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু খু’ন করতে পারেন নি। সে উনার কথা বলেই দুনিয়া ত্যাগ করল৷ তিনি জানতেন সত্য প্রকাশ পায়। তাই কোনো ভাবেই কখনো পালানোর চিন্তা করেন নি। তিনি আজ সফল। কষ্ট আজ তাকে গ্রাস করতে পারছে না।

আমিনাকে ধরা হয়েছে আজ দুইদিন।
সাজেদা বেগমও জেলে।
নাওশিন ছুটে গিয়েছে রাতের অন্ধকারে হামিদুর রহমান এর বাসায়। সাথে নিয়াজ এবং মিফতা। ওরাই নাওশিনকে হামিদুর রহমানের বাসায় নিয়ে গিয়েছে।
নাওশিনকে দেখে চিনে যান হামিদুর রহমান। উনার কাছে নাওশিনের ছবি ছিলো, যা ওর মা দিয়েছিল।
নিয়াজ এবং মিফতার সাথে দেখে আরো বেশি অবাক হয়েছেন।
আপনি নাওশিন না?
হামিদুর রহমান অনেকটা সময় চুপ করে বসে প্রশ্নটি করেছেন।
নাওশিন হ্যাঁ বলল।
এতোদিন কোথায় ছিলেন? আর নিয়াজ আপনি উনাকে কোথায় পেয়েছেন?
নিয়াজ এবার সবকিছু হামিদুর রহমানকে বলে। উনি সব শুনে অবাক হয়ে আছেন। তবে তিনি এখন বুঝতে পারছেন, কেন নাওশিনের মা নাওশিনকে খু’নি বলেছে। তিনি তো চৌধুরী পরিবারের সন্তানের স্ত্রী ছিলেন।
নাওশিন এবার বলল,
স্যার আমাকে সাহায্য করবেন?
বলুন।
আমার বাবা হঠাৎ ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে মৃ’ত্যু বরণ করেছিলেন৷ সবাই তা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু দিন যতোই যেতে থাকে ততোই আমার মনে হয় আমার বাবার মৃ’ত্যু স্বাভাবিক না।
আপনি যদি আমার আম্মাকে একটু শাস্তি দিয়ে উনাকে সত্যটা বলাতে পারেন। আমার বিশ্বাস আমার বাবার মৃত্যুর কোনো রহস্য আছে। আর আমার মামা খালেদ আহমেদ এবং উনার পরিবারকে ওরাই খু’ন করেছে। আপনার তো এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা। আপনি আমাদের সাহায্য করুন। ওরা আজও খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হামিদুর রহমান সব শুনে ওদের বললেন।
আমি কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে শাস্তি দিবো না। যারা দোষী, আমি তাদের ঠিকই শাস্তি দিবো। আপনারা আর অল্প কয়েকদিন আড়ালে থাকুন। এই যে চৌধুরী পরিবারে একের পর এক খু’ন হচ্ছিল, তা আনিছুর চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী আমিনা করেছে। উনাকেও আমরা ধরেছি। কোনো অপরাধী আমার থেকে বেঁচে থাকতে পারবে না।
হামিদুর রহমানের কথা শুনে নাওশিন একটুও অবাক হয়নি। সে আন্দাজ করতে পেরেছিল। তার মায়ের স্বামীর আর কোনো স্ত্রী আছে। কিন্তু এই কথা নিজের মাকে বিশ্বাস করাতে পারেনি সে।
ওরা বিদায় নেয়৷ চৌধুরী পরিবারের এই করুন দিন দেখার জন্যই নিয়াজের পরিবার অপেক্ষায় ছিলো। সেই অপেক্ষা সমাপ্তি হচ্ছে।
কিছু অপেক্ষার সমাপ্ত হয়। কারণ অপেক্ষা যদি সব সময় অপেক্ষায় থেকে যায়, তাহলে অপেক্ষা কেউ কখনো করতো না। অপেক্ষাতেও পূর্ণতা আছে বলেই মাবুষ অপেক্ষা করে। তবে সব অপেক্ষা পূর্ণতা পায় না।

চলবে,,,

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৫)
লেখক: হানিফ আহমেদ

হামিদুর রহমান বসে আছেন সাজেদার সামনে। সাজেদা কিছু বলছিলেন না। সাজেদা ভেবেছিলেন, নিজেই সব বলে দিবেন। কিন্তু অফিসারের প্রশ্নে একবারে চুপ হয়ে গিয়েছেন। মহিলা কনস্টেবল পরপর তিনটি থা’প্পড় মা’রে উনাকে।
হামিদুর রহমান বললেন,
মুখ খুলবেন নাকি আমাদের অন্য কোনো পথ বেঁচে নিতে হবে?
সাজেদা নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। কখনো কোনো ভাবেই কল্পনাতেও নিয়ে আসেন নি এই দিনগুলো। কিন্তু বাস্তব তাকে আজ বুঝিয়ে দিলো, সময় সব সময় এক থাকলেও, দিন, মাস, বছর একরকম কখনো যায় না। একটি সূর্যের আলোর দিনেরই কতো রকমের রঙ। কখনো দিন হয় মেঘলা, কখনো মৃদু বাতাসের সাথে লালচে আকাশ, কখনো বা সুন্দর একটি দিন।
হামিদুর রহমান এবার রাগী কণ্ঠে বললেন,
আপনি সব বলবেন কী না? যদি না বলতে চান, তাহলে আমরা আমিনাকে নির্দোষ বলে ছেড়ে দিবো। আর আপনাকে সব খু’নের দায়ে ফাঁ’সিতে ঝুলানোর ব্যবস্থা করব।
সাজেদা এবার তড়িঘড়ি করে বললেন,
না না! আপনারা কী জানতে চান, বলুন? আমি সব বলবো।
হামিদূর রহমান হাসলেন,
তাহলে বলুন, আপনি কেন আপনার প্রথম স্বামীকে খু’ন করেছেন?
এই প্রশ্ন পুলিশ অফিসার এর মুখে দ্বিতীয়বার শুনে তিনি পূর্বের মতো চুপ থাকলেন।
আপনি বলবেন না?
সাজেদা চোখে আসা পানি মুছে শুধু অফিসারের দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না।
আপনার মতো খু’নির চোখে পানি খুবই বেমানান। এমন অভিনয় না করে সত্য কথাগুলো বলুন।
সাজেদা বেগম চোখের দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিয়ে বলতে শুরু করলেন,

আমার প্রথম স্বামীর সাথে আমি খুব সুখী ছিলাম। মান অভিমানে এক কথায় সব কিছুতেই পরিপূর্ণ ছিলো আমাদের সংসার। কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না এই মানুষটিকে ছাড়া। দুজনের একটি সুন্দর বাচ্চা ছিলো, যার নাম নাওশিন আনবার। সত্যিই খুব সুখী ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ সব পরিবর্তন হয়ে যায়। পাশের বাসায় একটি পুরুষ এর সাথে আমার পরিচয় হয়। যার নাম আনিছুর রহমান। যখন থেকে পরিচয়, তখন আমাকে সে এটা ওটা বলে তার প্রতি আকর্ষিত করত। মাঝেমধ্যে এটা ওটা গিফট করত, কিন্তু নিতাম না। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, কীভাবে যেন তার উপর দূর্বল হয়ে যাই। সে যখন তার মনের কথা বলল, আমি মেনে নেই। মনে হয়েছিল আমি কোনো কল্পনার সাগরে সাতার কে’টে যাওয়া ১৬বছরের কিশোরী।
আমাদের সম্পর্কের ৫মাসের পর সে আমায় বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমার প্রথম স্বামী?
সে বলল, আমাকে অনেক সুখে রাখবে, অনেক অনেক টাকা দিবে। আমি লোভে পরে যাই।
সে আমায় বলছিল, রাতে আমার স্বামীর সাথে কথা বলবে। আমিও বিশ্বাস করে নেই। তার বলে দেওয়া টাইমে আমি বাসার দরজা খুলে দেই। তখন আমার স্বামী গভীর ঘুমে।
সে সরাসরি রুমে ঢুকেই আমার প্রথম স্বামীকে ঘুমের মধ্যে খু’ন করে। সেই দৃশ্য দেখে আমি খুব অবাক হয়ে যাই
কোনো ভাবে আটকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করিনি। কিন্তু মনে হয়েছিল, একজন নির্দোষ মানুষের মৃ’ত্যু দেখে যাচ্ছি আমি।
আমার প্রথম স্বামীর খু’নি আমার দ্বিতীয় স্বামী আনিছুর চৌধুরী।

হামিদুর রহমান সব শুনে দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মানুষ পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তন মানুষের মানায় না। মানুষের পরিবর্তন হতে হয় ভালো কিছুতে। যেমন দাঁত পড়ে আবার দাঁত উঠে। হালকা থেকে মানুষ মোটা হয়, মানুষ সুন্দর হয়। এটাই মানুষের পরিবর্তন। আরো অনেক পরিবর্তন আছে।
কিন্তু এ কেমন পরিবর্তন? যেই পরিবর্তনে একটি মানুষ ভুলে যায় একটি মানুষের সাথে কাটানো ভালো সব মুহূর্ত। ভুলে যায় একটি সংসারের কথা। এই পরিবর্তন মানুষের জন্য না। যে পরিবর্তন জ্ঞানের গাড়ি বন্ধ করে দেয়, এই পরিবর্তন সত্যিই মানুষের জন্য না।
হামিদুর রহমান উনার দিকে তাকালেন।
একটি সুন্দর সম্পর্ককে খু’ন করেছে এই মহিলা। হামিদুর রহমানের চোখ ভিজে যায়। কেন এই দুনিয়ায় এই পরকীয়া?
একটি সুন্দর সংসার ভেঙে যায়। মানুষ বুঝতে পারে না, সে ভুল পথে হাটছে। জ্ঞানহীন হয়ে যায় মানুষ তখন।
হামিদুর রহমান বললেন,

আপনাকে এই মুহূর্তে যদি আমি মে’রে ফেলি। তবুও মনে হবে আমার ভিতর ঘরে থাকা অন্তরটি শান্ত হবে না। আপনি একজন নারী। কীভাবে পারলেন একটি সুন্দর সংসার ভাঙতে। আপনার ফাঁ’সি হোক, এই দোয়া আমি করি।

অফিসারের কথা শুনে সাজেদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
হামিদুর রহমান আবার বললেন,

পরকীয়ার জন্য আপনারা সুন্দর সংসার ভেঙে ফেলুন। একটাবারও ভাবেন না, এটা কী ঠিক? একটি মানুষ আপনাকে নিয়ে ভাবে সেটা মুহূর্তে ভুলে যান। ঘৃণা লাগে আপনাদের মতো পরকীয়ায় থাকা মানুষগুলোকে।

সাজেদা চুপ।
হামিদুর রহমান চলে যেতে চাইলেই সাজেদা বলে উঠলেন।
আমার যদি ফাঁ’সিই হবে, তাহলে আরো কিছু সত্য শুনে যান।
তিনি এসে আবারও চেয়ারে বসলেন।

আমার যদি ফাঁ’সিই হবে, তাহলে আপনি চৌধুরী পরিবারের বিচার কেন করছেন না? নাকি আপনাদের বিচার শুধু আমাদের জন্য? যারা দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছে, আজ পর্যন্ত আপনারা তাদের জেলে ভরতে পারলেন না। আমি না হয় অপরাধী। আমার শাস্তি হবে এখন। তাহলে চৌধুরীর পরিবারে শাস্তি দিচ্ছেন না কেন।
আমার ভাইয়ের পরিবারের খু’নি ওই চৌধুরী পরিবার। কই তাদের তো কিছুই করছেন না।

হামিদুর রহমান মন দিয়ে সব কথা শুনলেন।
মহিলা কনস্টেবলকে রাগী কণ্ঠে বললেন, খুব জোরে যেন সাজেদাকে থা’প্পড় মারে। সেই কনস্টেবল তাই করে, যা সে আদেশ পেয়েছে।
সাজেদা এবার গর্জে উঠলেন,

কেন আমাকে আ’ঘাত করলেন। আপনাদের বিরুদ্ধে বলেছি বলে?

হামিদুর রহমান বললেন হাসলেন। আর বললেন,
আপনি যদি পুরুষ হতেন, তাহলে আমিই আপনাকে আধম’রা করতাম প্রথম। কিন্তু ভাগ্য ভালো আপনি নারী। আমি নারী জাতকে সম্মান করি। কারণ একজন নারী আমার মা, একজন নারী আমার বোন, একজন নারী আমার স্ত্রী, একজন নারী আমার মেয়ে। তাই আমি নারীজাতকে সম্মান করি। কিন্তু আপনাকে সম্মান কেন, আপনার চেহারা দেখতেও লজ্জা লাগছে আমার। আপনি কী একজন নারী? কীভাবে বিশ্বাস করি এই কথা? যে নারী নিজের স্বামীকে খু’ন করতে সাহায্য করে। যে নারী আপন ভাইয়ের খু’ন এর দায় নিজের গর্ভের সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। সেই নারী কী সত্যিই নারী?
কীভাবে পারলেন সেদিন নিজের মেয়েকে ফাঁসাতে। অন্তর একটুও কান্না করল না এমন মিথ্যা বলার পূর্বে?
আজ সব জেনেছি, তো সত্য বলতেছেন।

সাজেদা চুপ থাকলেন। কিছু বলার চেষ্টাও করলেন না।
হামিদুর রহমান চলে যান সাজেদার সামন থেকে।

অনেক দিন কেটে যায় ঘটনাগুলোর।
আজ সাত ভাই এক হয়েছে। সাথে নাওশিন এবং আতিকা চৌধুরীও আছেন। তাদের লুকিয়ে থাকার দিন শেষ। কিছুটা শান্তি পাচ্ছে তারা।
কঠিন জীবনের সমাপ্তি বুঝি এইবার হবে। কিন্তু এখনও যে চৌধুরী পরিবার খোলা আকাশের নিচে।
আদিবের পরিবার আবারও পূর্ণতা পায়। সবাই আজ নিজেদের বাসস্থানে ফিরেছে। আতিকা আসতে চান নি। কিন্তু সাত ভাই জোর করে নিয়ে এসেছে উনাকে। উনার একটিই কথা।
আমার আনিক এসে যদি আমাকে বাসায় না পায়?
উনি এখনও বিশ্বাস করেন আনিক ফিরে আসবে। অপেক্ষা এখনও ছেলের জন্য করেন।
আদিবের মুখে হাসি, চৌধুরী পরিবারে একজনের পর একজনের খু’ন হয়েছে। কেউ তো শাস্তি দিয়েছে এদের। এই দৃশ্যই তো দেখতে চেয়েছিল তারা।
তাদের অপেক্ষা তখনই পূর্ণতা পাবে। যখন চৌধুরী পরিবারে কোনো পুরুষ থাকবে না। থাকবে শুধু নারী, আর ছোটছোট বাচ্চারা। একটি অহংকারী পরিবারের পতন তো এভাবেই হয়।

হামিদুইর রহমান ২০জন পুলিশের লোক নিয়ে আজ চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত। বেশ কিছুদিন চুপ থাকেন, কারণ এই চৌধুরী পরিবার এতোটা চালাক যে, যদি কিছু বুঝতে পারতো। তাহলে কাউকেই গ্রেফতার করতে পারতেন না।
চৌধুরী পরিবারের কোনো পুরুষকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই গ্রেফতার করতে থাকেন।
জালাল চৌধুরীকে দিয়েই শুরু করলেন গ্রেফতার করা। মুকিত চৌধুরীকে কীভাবে গ্রেফতার করবেন? এক সেকেন্ডেরও নিশ্চয়তা নাই এই মানুষের। তাই উনাকে এভাবেই ছেড়ে দিলেন। এভাবেই কষ্ট পেয়ে বিদায় নিবে মুকিত চৌধুরী।
এক এক করে চৌধুরী পরিবারের ২৩জন পুরুষকে গ্রেফতার করেন।
বিশাল বাড়ি খুঁজে ১৬ বছরের উপর আর কোনো পুরুষ পাননি তিনি। এই ২৩ জন্যের মধ্যে সব থেকে কম বয়স যার, তারই বয়স ২৪ বছর।
সবাইকে গ্রেফতার করে নেওয়ার জন্য গাড়িতে তুলছেন।
মেরহাব চৌধুরীর দুই ভাইকে পুলিশ পায় নি। রামিনা বেগম নিজের দুই ছেলেকে নিয়ে অনেক পূর্বেই এই চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করেছেন।

গ্রেফতার করার সময় জালাল চৌধুরী জানতে চেয়েছিলেন। কেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তখন হামিদুর রহমান বলেছেন,
আপনাদের দিন শেষ। এবার আপনাদের শাস্তি পাওয়ার সময়। এতো এতো মানুষের উপর অ’ত্যাচার, এতো এতো মানুষকে খু’ন করেছেন। এবার তো তার সমাপ্তি হতে হবে। একের পর এক অন্যায় করেছেন। কিন্তু পুলিশ আপনাদের ধরেনি। হয়তো পূর্বের পুলিশ আপনাদের মতোই ছিলো। কিন্তু কালো মেঘ সরে যায়, আকাশ তার সৌন্দর্য পায়। তেমনি আইনেরও মেঘ বৃষ্টির খেলা আছে।
জালাল চৌধুরী বা উনার পরিবারের কেউ কোনো কিছু বলবার সাহস পায়নি আর।
চৌধুরী পরিবারের এই দুর্দশা দেখে আজ সাধারণ মানুষ অনেক খুশি।
আজ চৌধুরী পরিবারে হাহাকার, শুধুই নারী শিশুদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। তবে আজ এই আর্তনাদে কেউ কষ্ট পাচ্ছে না। চৌধুরী পরিবারের অ’ত্যাচারে এভাবেই তারা একদিন আর্তনাদ করেছে।

প্রতিটা পত্রিকায় এখন এই খবরে ভরে গিয়েছে। চৌধুরী পরিবারের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমানকে সবাই বাহ বাহ দিচ্ছে। প্রতিটা পত্রিকা এখন চৌধুরী পরিবারের কুকীর্তি তুলে ধরতে ব্যস্ত। কিন্তু এর পূর্বে পত্রিকার সাংবাদিক গুলো নীরব ছিলো।

আজ আদিবের পরিবার খুশি। খুশি আতিকাও। নাওশিনও আজ খুব খুশি হতো, যদি এই কথা সে না শুনতো
তার বাবাকে তার মা এবং মায়ের স্বামী খু’ন করেছে। একটু পর পর তার চোখ ভিজে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে তার বাবার দোষ কী ছিলো?
সবাই আজ আনন্দিত। কিন্তু নাওশিন বিষাদের স্পর্শ পেয়ে চুপ করে বসে আছে, বসে বসে নীল আকাশ দেখতে ব্যস্ত সে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে কষ্ট গুলো হালকা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
এ-কি নাওশিন? তোমার চোখে আজ পানি?
নিয়াজের প্রশ্ন শুনে নাওশিন চোখের পানি মুছে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলো।
আজ দেখো আমরা কতো আনন্দিত। তাহলে তুমি কেন কান্না করছো?
নাওশিন নিয়াজের দিকে তাকায়। এই মানুষটিকে সব সময় রাগী চেহারায় দেখেছে। কিন্তু আজ তাকে খুব শান্তশিষ্ট লাগছে। নাওশিন বলল,
আকাশটা দেখছেন। কতো সুন্দর। কিন্তু এই আকাশ দেখতেও আজ মনে হচ্ছে আকাশটা অন্ধকার। আমার আব্বার দোষ কী ছিলো? কেন আমার আব্বাকে ওরা খু’ন করেছে?
নিয়াজ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাওশিন জানালার পাশ থেকে এসে বিছানায় বসে। নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে।

আমার এখনো মনে আছে আমার আব্বা কখনো আম্মাকে তুই করে ডাকেন নি৷ খুব ভালোবাসতেন আম্মাকে। আমরা একসাথে প্রতিটা বিকাল আকাশ দেখতাম। আব্বাকে পা’গল হয়ে যেতে দেখতাম আম্মার একটু অসুস্থতায়। আম্মার কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেন আব্বা। এতো ভালোবাসার পরেও যদি ভালোবাসার মানুষের কাছে খু’ন হতে হয়। এই পৃথিবীতে এর থেকে বড় কোনো কষ্ট আছে? একটি পরপুরুষ এর কাছে আব্বার এতো বছরের ভালোবাসা ভুলে কীভাবে চলে যেতে পারল ওই মহিলা। আম্মা ডাকতেও ঘৃণা লাগছে।
আব্বা আমাকে বলতেন, নাওশিন মা আমার সব সময় মানুষকে ভালোবাসবি। এইযে আমি তোর মাকে ভালোবাসি, তোকে ভালোবাসি। এভাবেই মানুষকে ভালোবাসবি। আচ্ছা এতো ভালোবাসার পরেও যদি ভালোবাসার দাম না থাকে, তাহলে কী হবে মানুষকে ভালোবেসে? আজ আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে করছে না। যে পৃথিবীতে ভালোবাসার দাম নাই, এতো ভালোবাসার পরেও মানুষ পরিবর্তন হয়, সেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার জন্য শুধুই সময় নষ্ট মনে হচ্ছে।

নাওশিন কান্না করছে। আজ তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার বাবা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তার জীবন আজ অনেক সুন্দর হতো। আকাশে থাকা চাঁদটা যেমন সুন্দর। আজ সেও তেমন সুন্দর হতো, কিন্তু তার যে আকাশ নাই।
নিয়াজ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলে সান্তনা দিবে, সে বুঝতেছে না। নাওশিনের ওই জল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। নিয়াজ এর ইচ্ছে হচ্ছে জলে ভরা ওই চোখ মুছে দিতে৷ কিন্তু দিলো না, কান্না করুক, একটু কান্না ভুলিয়ে দেয় মানুষের কষ্ট।
১৬বছরের একটি মেয়ে, মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা। সৌন্দর্যের এক বিশাল রাণী সে। সেই রাণীর চোখে ফোটা ফোটা জল। ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছা মনে প্রবল। তবুও সে তাকিয়ে আছে, আকাশের বৃষ্টির যেমন সৌন্দর্য, তারও চোখের ফোটা ফোটা বৃষ্টি যেন মুগ্ধ করে দিচ্ছে তাকে। তাই ছুঁয়ে দিলো না। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর যে আকাশের রংধনু হারিয়ে যায় কোথাও।
নিয়াজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো এভাবেই। কিন্তু সে জায়গা ত্যাগ করল। বৃষ্টিও বেশিক্ষণ ভালো লাগে না, আর এটা তো চোখের জল।

আদিব বাসার ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল আকাশে আজ শুধুই সাদা মেঘ। তার ভালোই লাগছে সাদা মেঘের আকাশ দেখতে। মানুষ বলে আকাশের মেঘ ভালো লাগে না। কিন্তু তা কতটুকু সত্য সে জানে না।
আদিবের পাশে এসে মিনহা দাঁড়ায় সাথে তাদের ছেলে।
আকাশ দেখছো?
স্ত্রীর কথায় শুধু মাথা নাড়ায় আদিব।
এই মেঘে ঢাকা আকাশ তোমার ভালো লাগে?
হ্যাঁ।
মিনহা মুচকি হাসলো।
কই আর তো কারো মুখে শুনলাম না মেঘে ঢাকা আকাশ কারো ভালো লাগে।
আদিব মুচকি হেসে বলল।
ওই যে দূরে বিশাল সাদা মেঘ দেখতে পারছো? একটু সময় তাকাও। মনের মধ্যে একটি কথাই আসবে, ওই দূর প্রান্তে যেতে পারলে মনে হয় সাদা মেঘ স্পর্শ করতে পারবে। কই কারো মুখে তো কখনো শুনলাম না নীল আকাশ স্পর্শ করার কথা। নীল আকাশ তো সবাই ভালোবাসে। তোমাকে ভালোবেসে যেভাবে ছুঁয়ে দেই। সেভাবেই খুব ইচ্ছে করে সাদা মেঘ ছুঁতে। এই সাদা মেঘের মতোই আমাদের জীবন। আকাশে উড়া বিমান সাদা মেঘের ভিতর দিয়ে চলে যায়। যেভাবে আমাদের ভিতর শুধুই কষ্ট৷ সাদা মেঘের আকাশে যেমন আড়ালে থাকা বিমানের শব্দ শুনতে পারি, দেখতে পারি না। তেমনি আমাদের আর্তনাদ শোনা যায়। কিন্তু দেখা যায় না। সত্যিই কতো মিল আমাদের। তাই তো আমি সাদা মেঘের আকাশ ভালোবাসি।
মিনহা কিছু বলল না। মেঘের দিকে কিছুক্ষণ তাকানোর পর তার মনে হলো, সত্যিই যদি ওই প্রান্তে যাওয়া যেতো? তাহলে বিশাল মেঘ ছুঁয়ে দিতো।
আদিব আর মিনহা তাদের গল্পে মেতে উঠলো।
পিছন থেকে এই দৃশ্য নাওশিন দাঁড়িয়ে দেখলো। তার আজ খুব মনে পরছে বাবার কথা। এমন ভাবে কতো বিকেল কাটিয়েছে। কিন্তু আজ সে একা খুব একা। চোখের পানি মুছে নিচে চলে যায় সে।

সব কিছু কেমন নীরব। তার মায়ের স্বামীর খু’নের আজ ১মাস হয়েছে। নাওশিন নিজের সাথে নিয়ে আসা ছোট্ট ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।
বাবার কষ্টে গড়া সেই সাজানো বাসায় চলে যাবে। সেখানেই নিজেকে রাঙিয়ে রাখবে। হোক কষ্ট। তবুও সে তার বাবার স্মৃতি নিয়ে বাঁচবে। এই পৃথিবীতে হয়তো সে একা। তবুও সে সাজবে, সাজাবে নিজের রঙে এই পৃথিবীকে।
নাওশিনের হাতে ব্যাগ দেখে সবাই যেন অবাক। মিফতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
নাওশিন হাতে ব্যাগ?
ভাইয়া আমি আমার বাসায় চলে যাচ্ছি। যে বাসায় আমার বাবার সব স্মৃতি রয়েছে আমি সেখানে থাকবো।
মিফতা বলল,
কী বলো নাওশিন? তোমার বয়সটা দেখছো? ১৬বছর। এই বয়সে একটি বাসায় কীভাবে একা থাকবে?
ভাইয়া বয়সটা ১৬ হলেও, আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি৷ নিজেকে ১৬বছরের মেয়ে মনে হয় না। মনে হয় কোনো ৩০বা ৪০ বছরের নারী আমি।
নিয়াজ এবার রেগে বলল,
পিচ্চি মেয়ের পাকা কথা শুনো তোমরা। কেমন পাকা পাকা কথা।
নাওশিন রেগে যায়। নাওশিন বলল,

আপনি কী বুড়া? দুই পাটির দাঁত কী পড়ে যাচ্ছে? চুল কী পেকে যাচ্ছে? আপনার কোলে কী নাতিনাতনি নিয়ে বসে আছেন?

নিয়াজ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধুই তো পিচ্চি বলেছে।
আদিব বলল,

নাওশিন তোমার কী সমস্যা হচ্ছে এখানে থাকতে?
ভাইয়া আমি আমার বাবার বাসায় থাকবো। সেখানে বাবাকে অনুভব করে বাঁচবো। মনে হবে বাবার সাথেই আমি আছি।
আদিব বলল,
একা?
নাওশিন নিচের দিকে তাকিয়ে বলল।
হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে বলতে আমার আপন তো কেউ নাই। আমি একাই।
আদিব হালকা রেগে বলল,
আমাদের এতো গুলো মানুষের সামনে নিজেকে একা বলতেও ভয় পেলে না। এই ভুলের জন্য যদি আমরা সবাই তোমার একটি একটি চুল ছিড়ে ফেলি। তাহলে তোমার মাথায় চুল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর নিজেকে একা ভেবে নিলে।
আদিবের কথায় সবাই হেসে দেয়। মিফতা বলল,
ভাইয়া নাওশিন যখন যেতে যাচ্ছে তাকে যেতে দাও। তবে একা না।
কাকে সাথে দিবে?
আদিবের প্রশ্নে মিফতা বলল,
আতিকা আপা থাকবেন নাওশিনের সাথে। আমরাও যাবো মাঝেমধ্যে। ভাবি, আমার স্ত্রী এবং আমার ভাইদের স্ত্রী যাবে। এতে সবাই ভালো থাকবে।
আদিব উনার দিকে তাকিয়ে বলল।
আপা যাবেন?
আতিকা কিছু বললেন না। শুধু মাথা নাড়ালেন।
আতিকার খুব ভালো লাগে নাওশিনকে। এক সাথে অনেক দিন থেকেছেন। তাই আর না করলেন না।
আদিব গাড়িতে করে ওদের নিয়ে রওনা দেয়। নাওশিন অপেক্ষায় গন্তব্যে পৌঁছানোর।

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-১২+১৩

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১২)
লেখক: হানিফ আহমেদ

চৌধুরী পরিবারে একজনের পর একজন যখন খু’ন হয়ে যাচ্ছিল, তখন আড়ালে একজনের অন্তর পু’ড়ছিলো। তিনি কান্না করছিলেন আড়ালে। প্রিয়জনের একের পর এক লা’শ দেখে শুধুই চোখে আসা জল মুছেন। চৌধুরী পরিবারের কাউকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলে হয়তো উনার ভালো লাগতো। কিন্তু তিনি তা পারেন না।
চৌধুরী পরিবারের সবাই তাকে দেখে। কিন্তু তাকে তারা জড়িয়ে ধরতে পারে না সবার সামনে। সে তখন শুধুই একজন সাধারণ মানুষ।
তিনি চাইলেও পারেন না প্রিয়জনের লা’শ একবার স্পর্শ করতে। এমন না যে, তাকে চৌধুরী পরিবারের আশেপাশের বাসার মানুষগুলো চিনেনা। তাকে অনেকেই চিনে। কিন্তু শহরের বাসা বলে কথা। কতো মানুষ এসে থেকে যায়, কিছু চিহ্ন রেখে যায়। আবার নতুন আসে, আবার চলে যায়। এভাবেই একের পর এক পরিবারকে নিজের বুকে রাখে শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা ইট পাথরের বাসা গুলো।
তিনি পত্রিকায় আরো এক প্রিয় মানুষের মৃ’ত্যুর খবর পড়ে পাথরের মতো শক্ত হয়ে বসে আছেন। কে করছে একের পর এক খু’ন?
তিনি অনুভব করলেন,
হাত গুলো কাঁপছে। মৃ’ত্যুর খবর পড়ে পড়ে নিজেকে একটুও সামলিয়ে রাখতে পারছেন না। ইচ্ছে করছে কোনো ভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার। কিন্তু কে করছে এসব তিনি জানেন না।
হাত থেকে পত্রিকাটি রেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চৌধুরী বাড়ি যাবেন, ১ঘন্টা লাগবে পৌঁছাতে। আরো একটি প্রিয় মানুষের লা’শ দেখতে যাচ্ছেন তিনি।
চুপিচুপি বাসা থেকে বের হয়ে রওনা দিয়েছেন। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা। তাই একপ্রকার লুকিয়েই বাসা থেকে বের হলেন।
উনার মনের মধ্যে কিছুটা ভয় কাজ করছে। কারণ উনার শত্রুর অভাব নাই, চৌধুরী পরিবারের প্রতিটা শত্রুই উনার শত্রু। রিকশায় বসে নীল আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। নীল আকাশটা ঢেকে রেখেছে সাদা মেঘ। সাদা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। এ যেন সাদা মেঘের আকাশ। এমন আকাশ দেখে উনার অতীত মনে পরল। কোনো পরিবারকে বলেছিলেন তিনি, তোদের বংশের যে-ই বেঁচে থাকুক না কেন। ওরা হবে নীল আকাশের সাদা মেঘ। আকাশে ভেসে যাওয়া ছাড়া কোনো কাজ নাই সাদা মেঘের। এসব বলেই ভয়ংকর হ’ত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছিলেন তিনি সহ নিজের পরিবারের সাথে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, আজ তাদের উপর কেউ এমন হ’ত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে।
এই চৌধুরী পরিবারের ভয়ংকর রূপ এর কথা কী মানুষ ভুলে গিয়েছে? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলেন।
তিনি রিকশা থেকে গাড়িতে উঠলেন, তখনও মনটা খুব খা’রাপ উনার। একটি শক্তিশালী পরিবারের মানুষদের কেউ খু’ন করে যাচ্ছে, কিন্তু আজ চৌধুরী পরিবার চুপ৷ বিষয়টা সত্যিই উনাকে কাঁদায়। একটি শাস্তি প্রয়োজন, কিন্তু তিনি একা কীভাবে দিবেন।
আজ বসবেন, যেভাবে বসতেন অতীতে। সবাই এক সাথে বসা মানে ছিলো একটি পরিবারের সমাপ্তি। আজ না হয় আবার বসবেন সবাই। এভাবে চুপ থাকলে কী সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
তিনি গাড়ি থেকে নেমে হেটেই চৌধুরী বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাসা থেকে লুকিয়ে আসার কারণে নিজের বাইকটি নিয়ে আসেন নি।
দুই মিনিট হাটলেই চৌধুরী বাড়ির নিজস্ব রাস্তা। তাই হাটছেন, ভিতরে উনার জন্য আরো এক প্রিয় ভাইয়ের লা’শ অপেক্ষা করছে। মাহাব চৌধুরী উনার থেকে ৭বছরের ছোট। কিন্তু আজ সেই ভাইটি পৃথিবীতে নেই আজ।

মাহাব চৌধুরীকে এভাবে পাবে কেউই এমন কল্পনা করেনি। কারণ এই মানুষটি ছিলো বুদ্ধির দিক দিয়ে খুবই পারদর্শী। খুব রাগী হলেও মানুষটি ঠান্ডা মাথায় কাজ করতেন। আজ সেই মানুষটিকেও খু’ন হতে হলো।
অ’ত্যাচারেরও একদিন শেষ আছে। সেটা আজ সত্যিই মনে হচ্ছে সবার কাছে। যেই পরিবার একের পর এক খু’ন করত, মানুষের উপর অ’ত্যাচার করত। আজ তাদের উপর কেউ এসব চালাচ্ছে। এটাই দুনিয়ার নিয়ম।
মাহাব চৌধুরীকে তার মৃ’ত্যুর একদিন পর মাটি দেওয়া হয়। এবার চৌধুরী পরিবার গর্জে উঠার চেষ্টা করল। খু’নি সুযোগ বুঝেই কাউকে না কাউকে মে’রে যাচ্ছে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না।
চৌধুরী পরিবারের কেউই আজ সেই মানুষটিকে দেখতে পায়নি। কিন্তু এটা কী সম্ভব? সে কী খবর পায়নি মাহাবের খু’ন হয়েছে। সবাই একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছে, কিন্তু সবাই না শব্দতেই ছিল।
জালাল চৌধুরী চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, হয়তো সমস্যায় পরেছে। তাই আসতে পারেনি। আগের সবার বেলায় তো ও এসেছে।
কেউ কোনো কথা বলল না।
ও কী আমার কথা জানে? আমাকেও যে খু’ন করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা কী ও জানে?
মাশুক চৌধুরী বললেন,
হ্যাঁ আমি ফোন দিয়ে বলেছিলাম। বলেছে আসবে, কিন্তু আসেনি।
জালাল চৌধুরী চিন্তিত হয়ে বললেন,
হয়তো সময় পাচ্ছে না।

নাওশিন চুপচাপ বসে আছে। মাঝেমধ্যে আতিকার দিকে তাকাচ্ছে। উনি চুপচাপ বসে আছেন। নাওশিনের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। নাওশিন বলল,
আপা চুল টেনে দিবো?
আতিকা হেসে সম্মতি দিলেন।
নাওশিন খুব যত্নে চুলগুলো টানতে থাকে। নাওশিন প্রশ্ন করল,
আপা ভাইয়াদের কী খবর?
আতিকা শুধু বললেন, ভালো।
নাওশিন কিছু বলল না।
আতিকা এখনও জানেন না চাচাতো ভাই মাহাবের খু’ন এর কথা। জানেন না নিজের ভাই জালাল চৌধুরীর একটি হাত শরীর থেকে আলাদা করে দিয়েছে সেই খু’নী। জানলে হয়তো মন খা’রাপ করতেন। আবার নাও করতে পারতেন। স্বামীর খু’নিদের কষ্টে আবার কীসের কষ্ট।
আপা একটা কথা বলব?
বল।
আমাকে একটি কথা বলবে!
কী?
আপনি যে এই বাসায় থাকেন, এই কথা আপনার পরিবার জানে?
আতিকা একটি শব্দই বললেন,
না।
আপা আপনার ছেলের কোনো খোঁজ পাননি আর?
না পাইনি। রাগ করে কেউ চলে গেলে তার খবর কী এতো সহজে পাওয়া যায়?
নাওশিন চুপ থাকে। একটু পর আবারও প্রশ্ন করে নাওশিন,
আপা আপনার ছেলের জন্য অপেক্ষা করেন কী?
আতিকা বেগম দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বললেন,
প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষা করি। অপেক্ষা, এক দীর্ঘ অপেক্ষা৷ কখন আসবে ছেলেটা, এসে আম্মু বলে ডেকে জড়িয়ে ধরবে। অপেক্ষা করি, আমি জীবিত থাকা অবস্থায় তাকে একটি নজর দেখে যেতে। আমি তার গর্ভধারিণী মা। কৃষক সোনালী ধান কা’টার জন্য যতোটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি অপেক্ষা করি আমার ছেলের জন্য। কোকিলের ডাক শোনার জন্য যেমন মানুষ অপেক্ষা করে, কখন বসন্ত আসবে আর কোকিল ডাকবে।
আমিও অপেক্ষা করি আমার পা’গল ছেলেটাকে একটিবার দেখতে, আর সেই অপেক্ষাটা খুব বেশি কষ্ট দেয়।
অগ্রহায়ণ, বৈশাখ মাসে কৃষক ধান কা’টে। বসন্তে কোকিল ডাকে। তাদের অপেক্ষা শেষ হয়। কিন্তু আমার অপেক্ষা শেষ হয় না। প্রতিটা সকাল অপেক্ষা করি, এই বুঝি আসলো ছেলেটা। আমার অপেক্ষে দুই চোখ যতক্ষণ খোলা থাকে, ততক্ষণ।
অপেক্ষা যে করে সে জানে অপেক্ষা কতো কাঁদায়, অপেক্ষা কতো স্বপ্ন দেখায়। অপেক্ষা এনে দেয় নীরবতা। সঙ্গী করে একাকিত্ব। শুধুই অপেক্ষা।

নাওশিনের চোখজোড়া ভিজে যায় আতিকার কথা শুনে। কেউ নিজের সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে চোখের জলে গাল ভেজায়। আর কেউ সন্তানের কষ্টে হাসে। দুজনই মা। কিন্তু কতোটা পার্থক্য।
আম্মা কী আমার জন্য অপেক্ষা করেন?
নাওশিন মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকে। হয়তো না।
আতিকা বললেন,
তুই কাঁদছিস কেন?
নাওশিন চুপ থাকলো।
কাঁদিস না। সুখ একদিন আসবে। মাত্রই তো ১৬বছরের এক ছোট্ট মেয়ে। জীবনটা তো মাত্র শুরু তোর।
নাওশিন কিছু বলল না। চুপচাপ বসে আছে সে। একটু চিৎকার করে কাঁদতে পারলে তার ভালো লাগতো।

চোখজোড়া খোলে নিজেকে একটি অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করেন তিনি।
কিন্তু তিনি তো চৌধুরী বাড়ির রাস্তায় হাটছিলেন। তাহলে এই অচেনা জায়গায় কীভাবে আসলেন তিনি?
মনে করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মনে করতে পারছেন না।
নিজের হাত পা বাঁধা অবস্থায় দেখে খুব ভয় পেয়ে যান তিনি। তাহলে কী তার সাথেও কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
সামনে তাকালেন, তার সামনে পিছন ফিরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। প্রশ্ন করার চেষ্টা করতে চেয়ে নিজের মুখটি বাঁধা দেখলেন। মনের মধ্যে একটু বেশিই ভয় করছে।
এসেছিলেন নিজের প্রিয় মানুষের লা’শ দেখতে। কিন্তু হয়েছেন বন্দী।
হ্যাঁ এবার উনার মনে পড়েছে। চৌধুরী বাড়ির নিজস্ব রাস্তায় যখন প্রবেশ করবেন তখন কেউ তার নাকে কিছু চেপে ধরে।
তিনি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু খুব শক্ত করে বাঁধা।
তাহলে কী তাকেও কেউ খু’ন করবে? কিন্তু তিনি তো চৌধুরী বাড়ি থাকেন না। চৌধুরী বাড়ি থেকে অনেক বছর হলো তিনি আলাদা। তাহলে?
কিছু ভাবতে পারছেন না। কী হবে, কি করবেন এসব ভেবে ভয়ে গলা শুকিয়েছে উনার। চিৎকার কিংবা পালানো কোনোটাই করার সুযোগ নাই। সব রাস্তা বন্ধ।
সময়টা আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন। দূর কোথাও থেকে আজানের শব্দ কানে আসে। আছরের সময় এখন। তিনি বুঝতে পারছেন না, কী হবে এখন।
আজ সবাইকে নিয়ে বসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই বসা আর হলো কই, তিনি এখন দাঁড়িয়ে আছেন মৃ’ত্যুর মুখে। হয়তো খা’রাপ কিছুই ঘটবে।

সামনে থাকা মানুষটি উনার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
মুখোশ পরা মানুষটিকে দেখে বুঝতে পারছেন না কে। কিন্তু চোখজোড়া দেখে মনে হলো তিনি এই চোখজোড়া চিনেন। খুব ভালো ভাবে চিনেন। কিন্তু সঠিক মনে করতে পারছেন না, এই চেনা চোখজোড়ার মানুষটির চেহারা। কে হতে পারে?
এবার মুখোশ পরা ব্যক্তিটি কথা বলল। এর পূর্বের খু’নগুলোতে কোনো কথা বলেনি সে। তবে এবার কথা বলল সে।
তোমার মৃ’ত্যুটা হবে ভীষণ কষ্টের।
মুখোশ পরা ব্যক্তির কণ্ঠ একজন মহিলার। তিনি এবার চুপসে যান। এই কণ্ঠ তো তিনি চিনেন। এবার চেহারাটি চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। কীভাবে সম্ভব? প্রশ্নটি মনের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে। মুখে আর নিয়ে আসতে পারছেন না।
মুখোশ পরা মানুষটি আবারও বলে উঠলো,
শরীরের একটি অঙ্গ কা’টবো, আর একটু একটু করে মুখের মুখোশ খুলবো
কথাটি শুনে তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন, মহিলাটি কী বলল৷ তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না, কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমন কেউ হবে, সামনের মানুষটি।
মুখোশ পরা মহিলাটি উনার ডান হাতের একটি আঙুল কা’টে আর তাচ্ছিল্য করে বলে উঠে,
উফফ, কী ব্যথা।
তিনি ব্যথায় চিৎকার করার চেষ্টা করছেন। মনে হচ্ছে ভিতর থেকে জান পাখি বের হয়ে যাচ্ছে।
মহিলাটি এক এক করে বাকি চারটা আঙুল কা’টে।
আহা কষ্ট, আহা ব্যথা। শরীরে ভিতর জীবন্ত আত্মা রেখে শরীর থেকে প্রতিটা অঙ্গ আলাদা করার অনুভূতি জানতে চাইলে আমি বলব, আমার ভীষণ ভালো লাগে। আর তোমাকে তো খুব ভালোবেসে প্রতিটা অঙ্গ আলাদা করব, এই যে হাতের চা’কু এতোটা ধারালো না। একটি অঙ্গ আলাদা করতে আমার কতো শক্তি খরচ করতে হবে।
মহিলাটি কথা বলে কেমন এক বিশ্রী হাসি দেয়। তবে উনি দেখতে পারলেন মহিলাটির চোখ ভেজা।
নিজের মৃ’ত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারছেন তিনি। আজ এই ব্যথা কোনো ব্যথা না। সামনে থাকা মানুষটি তাকে আঘাত করছে। এই ব্যথার কাছে সব ব্যথা আজ তুচ্ছ।
মহিলা এবার চা’কু দিয়ে হাতের উপর থেকে টেনে কবজি পর্যন্ত নিয়ে আসে। এর পর আবার একই কাজ করে। সাথে নিয়ে আসা লেবুর রস ঢেলে দেয় এই গভীর ক্ষ’ত জায়গায়।
তিনি এবার সহ্য করতে পারলেন না। এই বুঝি ভিতর থেকে জানপাখি বের হয়ে যাবে।
মহিলা আবারও বলল,
কষ্ট হচ্ছে বুঝি? অনুভব হয় আজ কষ্ট?
কথাগুলো বলে বাম হাতের পাঁচ আঙুল আলাদা করে, এবং হাতের উপরের মাং’সের ভিতর দিয়ে চা’কু ঢুকিয়ে অন্য পাশ দিয়ে বের করে। এবার হাতের দুটি গর্তে লাল মরিচে মাখানো দুইটি মোরগ এর পা ঢুকিয়ে দেয়।
মৃ’ত্যু যন্ত্রণা হচ্ছে? ম’রে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে?
মহিলাটি তাচ্ছিল্য করে প্রশ্নগুলো করে।
কানের দুই লতি কা’টতে বেশি সময় নেয় সে। একটু কাটছে তো একটু তাকাচ্ছে। মানুষটি কষ্টে কাতরাচ্ছেন।
কানের লতির মধ্যে হালকা গরম পানি লাগিয়ে দিলো এবার সে।
সে হাসছে। কষ্ট দেখে হাসছে।
এমন এমন জায়গা ক্ষ’তবিক্ষত করছে সে, যেন তাড়াতাড়ি মৃ’ত্যু না হয়।
দুই পায়ে পাঁচ পাঁচ করে দশবার চা’কু ঢুকায়। সেই জায়গা গুলোতে লবণ ছিটিয়ে দেয়।
কষ্ট, ফেটে যাচ্ছে বুক।
হেসেই বলল সে।
এবার দুই পায়ের আঙুল থেকে চার আঙুল উপরে চা’কু
দিয়ে শরীর থেকে আলাদা করে।
সে এসবে এক অজানা সুখ পাচ্ছে।
একটু একটু করে একবারে মুখোশ খুলে ফেলে।
তিনি শুধু তাকিয়ে আছেন। হ্যাঁ সত্যিই দেখছেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কীভাবে সম্ভব। কখনো কল্পনা করেন নি তিনি এসব।
মহিলা এবার বিশ্রী হাসি দিয়ে মুখের বাঁধন খুলে জিহ্বা কা’টতে চাইতেই তিনি চিৎকার দিয়ে উঠলেন।
কয়েকবার চিৎকার দেওয়ার পর বুঝতে পারলেন কেউ আসছে।
সে এবার তাড়াহুড়ো করে গলায় চা’কু চালিয়ে দেয়, কিন্তু চাকু এতোটা ধারালো না। সে নিজেই এমন চা’কু নিয়ে এসেছে।
দেরি হয়ে যাবে তাই চা’কু এবার বুকে বসাতে চাইলেন। কিন্তু সেটি যেয়ে লাগে বুকের উপরে ডান হাতে পাশে।
চা’কু সহ সব কিছু নিয়ে সে পালিয়ে যায়।
কয়েক মিনিট এর মধ্যেই কয়েকজন মানুষ আসে।
একটি মানুষকে এভাবে দেখে ওরা ভয় পেয়ে যায়। মাটিতে পড়ে মানুষটি কাতরাচ্ছে। হয়তো জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।
মানুষদের মধ্যে একজন উনাকে নেওয়ার জন্য গাড়িকে ফোন করে। হসপিটাল নিতে হবে।
ভীড় হয়, ভীড়ের মধ্যে মাশুক চৌধুরী ছিলেন।
তিনি চিনতে পেরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন,
তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে আসো।
উনাকে গাড়িতে উঠানো হয়।

চৌধুরী বাড়ি থেকে ৩কিলোমিটার দূরে এই ঘটনাটি ঘটে। মাশুক চৌধুরী বের হয়েছিলেন নিজের আপন ভাই মাহাবের কবর দেখতে। কিন্তু হঠাৎ উনার মনে হয় তাকে যদি কেউ হ’ত্যা করতে চায়। তাই ভাইয়ের কবরের দিকে না যেয়ে বাড়ির দিকে হাটতে শুরু করেন। কিন্তু আবার মনে হলো না তিনি যাবেন কবরে। তাই যাচ্ছিলেন।
চৌধুরী পরিবারের কবরস্থান নিজেদের বাড়ি থেকে ২কিলোমিটার দূর। একটু বেশিই দূর।
ভাইয়ের কবর দেখে বাড়ি আসার পথেই মানুষকে দৌড়াতে দেখে তিনিও তাদের পিছন পিছন দৌড়ান। এক পর্যায়ে দেখতে পান এমন দৃশ্য যা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না।

২ব্যাগ র’ক্ত দেওয়া হয় উনাকে। চৌধুরী পরিবারের অনেকেই আছেন হসপিটালে।
রাত ১টায় উনার জ্ঞান ফিরে। তবে ডক্টর বলেছে উনি কোনো ভাবেই কথা বা কিছুই করতে পারবেন না। যেকোনো সময় মৃ’ত্যু হতে পারে।
জালাল চৌধুরী জোর করে কেভিনে যান। উনার একটি কথাই যদি সে নাই-বা বাঁচে তাহলে আমাদের দেখা করতে দিন।
রাত ৩টার দিকে উনি চোখ মেলে তাকান, কাছে নিজের আপন বড় ভাই জালাল চৌধুরীকে দেখতে পেয়ে শুধুই চোখের পানি ছাড়তে শুরু করলেন।
সমস্ত শরীর ব্যান্ডেজ করা।
জালাল চৌধুরী কান্না মাখা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,

আনিছুর ভাই আমার, কে করেছে তোকে এই অবস্থা?

আনিছুর রহমান এবার চুপ। শতো চেষ্টা করে কোনো কথা বলতে পারছেন না। জালাল চৌধুরী বারবার জিজ্ঞেস করছেন।
আনিছুর রহমান এর গলায় চা’কু চালানোর কারণে কথা বলতে পারছেন না।
অনেকবার জিজ্ঞেস করার পর আনিছুর রহমান খুব কষ্টে বললেন,

আমার স্ত্রী, সব কয়টা খু’ন সে করেছে।

মুখ দিয়ে মুহূর্তেই র’ক্ত বের হওয়া শুরু হয়। একটু পূর্বে মাত্র র’ক্ত দেওয়া হয়েছিল।
জালাল চৌধুরী তাড়াতাড়ি ডক্টর নিয়ে আসেন।
ভিতরে আনিছুর রহমানকে ডক্টর বাঁচানোর চেষ্টা করছে। রেগেমেগে বলছে আর কাজ করছে। কে বলছে এমন রোগীকে কথা বলাতে। হয়তো বেঁচে যেতো। কিন্তু এখন হয়তো আর সম্ভব না।
জালাল চৌধুরী সবার সামনে বসে আছেন। খু’নি কে জানতে পেরে সবাই শুধু অবাক হয়েছে। এতো অবাক হয়তো এর পূর্বে আর হয়নি ওরা।
কখনো কল্পনা করেনি কেউ এই কথা।

চলবে,,,

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৩)
লেখক: হানিফ আহমেদ

আনিছুর রহমান, তিনি চৌধুরী পরিবারের সন্তান। নাম আনিছুর চৌধুরী। মুহিত চৌধুরীর আদরের ছোট ছেলে। আনিছুর চৌধুরী ছিলেন একজন হিং’স্র ব্যক্তি। উনি উনার বাবা, চাচা, ভাইদের মতোই অহংকারী ব্যক্তি। অ’ত্যচার করা যেন চৌধুরী পরিবারের নেশা হয়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষের জমি, বাড়ি, বাড়ির বড় বড় গাছ থেকে শুরু করে সব কিছুই ছিনিয়ে নিতে দুই বার ভাবতো না।
এই অ’ত্যাচারীদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ভাবেই প্রতিবাদ করলেই তার শেষ পরিণতি হতো মৃ’ত্যু। তাই তো সাধারণ মানুষ নীরবে সহ্য করে যেতো। কখনো কখনো কেউ কেউ সহ্য না করতে পেরে প্রতিবাদ করত, তারপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না।
চৌধুরী পরিবার যেন ছিলো ভূমি খেকো।

আশেপাশের মানুষগুলোর জমি ছিনিয়ে নিতে নিতে চৌধুরী পরিবার জোর করে ফারুক আহমেদ (আদিব এর বড় চাচা) এর জমি দখল করে নেয়৷ চৌধুরী পরিবারের এই অ’ত্যাচার শুধু দেখে যাচ্ছিলে ফারুক আহমেদ সহ উনার পরিবার। কিন্তু যখন ওরা নিজেদের জমি দখল করে জোর করে, তখনই প্রতিবাদ শুরু হয়। থানায় মামলা হয়। চৌধুরী পরিবার এর কিছুই হয়নি সেই মামলায়। একটানা ৪বছর মামলা চলার পর যখন ফারুক আহমেদ নিজেদের জমি ফিরে পাচ্ছিলেন। তখন সালটা ছিলো ১৯৯৩ সাল।
গভীর রাতে চৌধুরী পরিবারের ১৫জন হা’মলা চালায় ফারুক আহমেদের বাড়িতে। প্রথম ভয় দেখায় যেন এই জায়গা ছেড়ে দেয়। মুহিত চৌধুরী ফারুক আহমেদকে মৃ’ত্যুর ভয় দেখিয়ে জায়গা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।
রাত গভীর হয়। চৌধুরী পরিবার ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে, মা’রার হুমকি দিচ্ছে।

ফারুক আহমেদের বড় ছেলে শফিকুল আহমেদ হঠাৎ গর্জে উঠে। তার বয়স সবে মাত্র চব্বিশ শেষ হয়ে ২৫ হয়েছিল। ফারুক আহমেদের বংশের বড় ছেলে ছিলো সে।
পরিবারের উপর এতো অ’ত্যাচার দেখে কোনো ভাবেই সহ্য করতে পারেনি সে। তাই তো গর্জে উঠে।
তোমরা কী আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে? নাকি লা’শ হয়ে বের হতে চাও?
শফিকুল এর রাগী কণ্ঠে বলা কথা শুনে মুহিত চৌধুরী বলে উঠেছিলেন,
এতো সাহস, আমাদের হুমকি দিচ্ছিস।
শুরু হয়ে যায় হাতাহাতি। চৌধুরী পরিবারের সবার কাছে অ’স্ত্র ছিলো। ফারুকের বিশাল পরিবার অ’স্ত্র ছাড়া কীভাবে এই অ’ত্যাচারের মোকাবিলা করবে, সেটা তারা জানতো না। তবুও লড়ে যাচ্ছিল। ফারুক আহমেদ এবং উনার তিন ভাই আর বড় চার ভাতিজা যাদের মধ্যে শফিকুল ছাড়া তিনজনের বয়স ছিলো ১৬থেকে ২২এর ভিতর।
এই ৮জন এবং খালেদ আহমেদ খালি হাতে লড়তে শুরু করে অ’স্ত্র ভরা হাতের সাথে।
চৌধুরী পরিবারের হাতে প্রথম খু’ন হয় শফিকুল। এই দৃশ্য কেউ মেনে নিতে পারেনি। একের পর একজনকে যখন খু’ন করতে শুরু করে ওরা। তখন ফারুক আহমেদ চিৎকার করে বলতে থাকেন, তার বংশের একজনকেও হলে যেন খালেদ বাঁচিয়ে নেয়। খালেদও আহত ছিলো। খুব কষ্টে আদিবকে নিয়ে তিনি পালিয়ে যান। কীভাবে পালিয়েছিলেন, সেটা তিনি তখন জানেন না।
চৌধুরী পরিবার নিজেদের জীবনের সব থেকে ভয়ানক হ’ত্যাকাণ্ড চালায়। একটি পরিবারের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখেনি। পরিবারের সব নারীকে হ’ত্যা করতেও তাদের হাত একটুও কাঁপেনি সেদিন।
খালেদ আহমেদ আদিবকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে, তার প্রতি একটি আক্রোশ সৃষ্টি হয় চৌধুরী পরিবারের। তাকে সেই রাতে আর খুঁজে পায় নি তারা।

এমন হ’ত্যাকাণ্ড দেখে সবাই চোখের পানি ফেলেছে সকালের আলো ফোটার পর। কিন্তু গভীর রাতে এতো এতো চিৎকার, আহাজারি এই মানুষগুলোর কানে পৌঁছায় নি। কতো আকুতির চিৎকার, কিন্তু সেদিন সবাই চুপ ছিলো। কিন্তু সকালে ওরাই চোখের পানি মুছতে ব্যস্ত। একটি পরিবারের মৃ’ত্যু। বেঁচে আছে ৭জন শিশু বয়সী ছেলে। এই দৃশ্য খুবই কষ্টের ছিলো সেদিন।
চৌধুরী পরিবার যখন জানতে পারে ফারুক আহমেদের পরিবারের ৭ছেলে সন্তান বেঁচে আছে। তখন যেন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কীভাবে সম্ভব?

২০০১ যখন চৌধুরী পরিবারের দুইজনের ফাঁ’সি হয়। তখন তারা আবারও জ্বলে উঠে। খালেদ আহমেদকে মা’রারা জন্য উঠেপড়ে লাগে৷ কিন্তু খালেদ আহমেদ কয়দিন পর পর বাসা পরিবর্তন করতে শুরু করেন। আদিব সহ সবাইকে তিনি খুব যত্নে বড় করতে শুরু করেন।
কিন্তু চৌধুরী পরিবার খালেদ আহমেদকে যেভাবেই হোক এই পৃথিবী থেকে বিদায় করবে। তাই তারা বসে, তাদের বসা মানেই কিছু ধ্বংসের কথাবার্তা চলা।
সবাই এটাই ঠিক করে, খালেদ আহমেদের বড় বোনকে হাত করতে হবে। কিন্তু সাজেদা বেগম বিবাহিত।
দিন যেতে থাকে। আনিছুর চৌধুরীকে বের করে দেয় ওরা বাড়ি থেকে। যেভাবেই হোক সাজেদাকে যেন সে বিয়ে করে।
নাওশিনের ৯বছর বয়সে তার বাবা আলতাফ হোসেন মা’রা যান। হঠাৎ তিনি ঘুমের মধ্যে মা’রা যান।
সাজেদা বেগম ৮মাসের মাথায় বিয়ে করেন আনিছুর রহমান নামের কাউকে। সাজেদা জানতেন না, আনিছুর রহমান কে। পাশের বাসায় ভাড়াটিয়া হয়ে আনিছুর থাকতেন। তিনি সফল হয়েছিলেন। সাজেদাকে নিজের ভালোবাসার ফাঁদে ফেলতে পেরেছিলেন তিনি।
আলতাফ হোসেন এর মৃ’ত্যু স্বাভাবিক ছিলো না।
গভীর রাতে সাজেদার সামনে খুব যত্ন নিয়ে খু’ন করা হয় আলতাফ হোসেনকে। আর সেই খু’ন করেছে আনিছুর চৌধুরী। সাজেদা এতোটা অন্ধ হয়েছিলেন, লোভে পরেছিলে। এতো বছরের ভালোবাসার মানুষটিকে মৃ’ত্যুর মুখে ছেড়ে দিলেন মাত্র ৫মাসের একটি অবৈধ প্রেমের সম্পর্কে।
সকালে বলা হয়, মৃত্যুটা হার্ট অ্যাটাক। ডক্টরকে বড় অংকের টাকা দিয়েছিলেন আনিছুর চৌধুরী।

খালেদ আহমেদকে খু’ন করার জন্য প্রথম খু’ন করতে হলো খালেদ আহমেদের বড় বোনের স্বামীকে।
সাজেদা চৌধুরী পরিবারের ঘৃণা ভরা কাজের কথা জানতেন। কিন্তু চৌধুরী পরিবারের কাউকে চিনতেন না।
সাজেদা যেদিন বিয়ে করেন আনিছুর চৌধুরীকে। সেদিন খালেদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
সাজেদাকে বারবার বলার পরেও সে লোভের সাগড়েই ভাসতে থাকে।
সেও হয়ে উঠে আনিছুর চৌধুরীর মতো খা’রাপ মানুষ।
আনিছুর রহমান আস্তে আস্তে বোনের বাসায় যাওয়া ছেড়ে দিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তাকে খু’ন করার একটি ফাঁদ মাত্র তার বোন।

সাজেদা বেগম যখন নিজের স্বামীর অপেক্ষা করছিলেন। যতো সময় যাচ্ছিল, ততোই যেন অপেক্ষা দিগুণ হচ্ছিল।
দরজায় শব্দ হয়।
সাজেদা দরজা খুলে পুলিশ এর লোকদের আবিষ্কার করলেন। অন্তর কেঁপে উঠে উনার, পুলিশ কেন?
অফিসার হামিদুর রহমান বললেন,
আপনাকে আমার সাথে থানায় যেতে হবে।
সাজেদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
কেন? আমার স্বামীর খোঁজ পেয়েছেন?
হামিদুর রহমান রেগে বললেন,
স্বামীকে খু’ন করার চেষ্টা চালিয়ে ভালো সাজা হচ্ছে। উনাকে সাথে নিয়ে চলো।
একজন মহিলা পুলিশকে বললে।
সাজেদা অবাক হলেন, কেঁদে দিলেন।
কী বলছেন এসব? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
জেলে যাওয়ার পর সব বুঝবে।
সাজেদা বেগমকে গাড়িতে তোলা হয়। তিনি কান্না করে যাচ্ছেন।
হামিদুর রহমান এর ফোন বেজে ওঠে। কারো সাথে কথা বললেন। তারপর সাজেদার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আপনার স্বামী আনিছুর চৌধুরীর মৃত্যু হয়েছে।
সাজেদা চিৎকার দিয়ে উঠলেন, বিশ্বাস করিনা বলে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেন।

বায়েজিদ, একা বাসায় বসে আছে। যাকে সে মা বলে ডাকতো, তাকে পুলিশ ধরে নিয়েছে। বাবা আনিছুর চৌধুরীর খু’ন করার চেষ্টায়।
ছোট্ট বায়েজিদ মুচকি হেসে যাচ্ছে একা একা বাসায় বসে।
কারণ সে সাজেদার ছেলে না। আনিছুর তাকে রাস্তা থেকে নিয়ে এসে বলছিল এই ছেলেকে রাস্তায় পেয়েছি। আমরা ওরে লালন পালন করব।
কিন্তু সাজেদা সে কথাই বিশ্বাস করেছেন। বায়েজিদকে আদর করতেন, কিন্তু নিজের মেয়েকে করতেন অবহেলা।
বায়েজিদকে আদর করলে আনিছুর চৌধুরী খুব খুশি হতেন।

জালাল চৌদুরীর কথায় পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান সাজেদাকে ধরেন।
চৌধুরী পরিবার এর মনের মধ্যে প্রশ্ন জমেছে, যা পুলিশকে জানায় নি তারা।
আনিছুর চৌধুরী শুধু বলেছেন, আমার স্ত্রী। কিন্তু কোন স্ত্রী সেটা বলেন নি।
আর চৌধুরী পরিবার কোনো ভাবেই মানতে চায় না, আনিছুর চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী সাজেদা এসব খু’ন করেছে। এইসব করেছে আনিছুর এর প্রথম স্ত্রী আমিনা বেগম। এই কথাই তারা জোর দিয়ে বিশ্বাস করে যাচ্ছে। এতো খা’রাপ ভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার মানুষটি আমিনাই হবে। আর এই আমিনা হলো আনিছুর চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী।
সবার মনে কতো মানুষের নামই মনে হয়েছে। কিন্তু আমিনার নামটি একবারের জন্যেও মনের মধ্যে আসেনি কারো। চৌধুরী পরিবারের সবার সন্দেহের খাতায় এতো এতো মানুষের নাম ছিলো যে, মধ্য দিয়ে আমিনার নামটি ভুলেই গিয়েছিল ওরা।
জালাল চৌধুরীর চোখে তো তাই সেদিন ওই মহিলার চোখজোড়া এতো পরিচিত লেগেছিল। উনার বিশ্বাস এইসব আমিনা করেছে।

আমিনা ছিলেন আনিছুর রহমানের প্রথম স্ত্রী৷ যাকে তালাক দিয়েছিলেন শুধু সাজেদাকে বিয়ে করার জন্য। আনিছুর চৌধুরী এবং আমিনা বেগমের দুই সন্তান ছিলো। যার মধ্যে বড় সন্তান বায়েজিদ, যাকে রাস্তায় পেয়েছে বলে সাজেদার বাসায় লালন পালন করাচ্ছিল। উনার মনে একটি কথাই ছিলো, যে বায়েজিদ হবে সাজেদার মৃ’ত স্বামীর সম্পত্তির মালিক। কারণ নাওশিনকে যেন কোনো কিছু না দেওয়া হয়, সেই দিকেও চিন্তা করে নাওশিনকে দিয়ে খা’রাপ ব্যবসা শুরু করার চিন্তা করেছিলেন। বায়েজিদকে খুব বুঝিয়ে এই বাসায় এনেছিলেন আনিছুর চৌধুরী। ছেলে বাবার কথায় সাজেদাকে কিছুই বলেনি। একদিকে নতুন মা পেয়ে সেও খুশি ছিলো।
কোনো পিচ্চিকে যদি কিছু বলে বলা হয়, এই কথা আর কাউকে বলবে না কিন্তু। তখন দেখা যায় সত্যিই তারা কাউকে কিছুই বলে না। কারণ বাচ্চাকে যা শিখাবেন তাই শিখবে বাচ্চা। একটি বাচ্চাকে পানির স্রোত এর সাথে তুলনা করলে খুব একটা ভুল হবে না। পানির স্রোতের সামনে যেই দিকে রাস্তা করে দিবেন সেই দিকেই পানি প্রবাহিত হবে। তেমনি বাচ্চাকে ছোটবেলায় যা শিখাবেন, সে তাই শিখবে। এবং সেই পথেই চলবে।
বায়েজিদ চৌধুরী, সে ১৩বছরের হলেও বাবার মতোই কিছুটা স্বভাব তার। তবে সেই স্বভাব হলো ভালো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। তাইতো নাওশিনকে নিজের বড় বোনের মতোই শ্রদ্ধা করত। এবং পালাতে সাহায্য করে।
আর আনিছুর চৌধুরীর দ্বিতীয় সন্তান মালিহা চৌধুরী। যাকে দুই বছর বয়সেই মায়ের সাথে দিয়েছিলেন তিনি।
আমিনা বেগম মালিহাকে নিয়েই চৌধুরী বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

আমিনা বেগম, যার কোনো দোষ ছিলো না। আনিছুর যতোই খা’রাপ হোক না কেন, তিনি তাকে খুব ভালোবাসতেন। কারণ এই মানুষটি তার স্বামী ছিলো।
মাঝেমধ্যে বুঝাতেন এভাবে খা’রাপ কাজ করে কেন মানুষকে কষ্ট দিচ্ছো বলো তো।
এভাবেই মাঝেমধ্যে শাসন করতেন। উনি বিশ্বাস করতেন, কাউকে ভালোবাসলে তাকে শাসন করার সব ধরণের অধিকার থাকে, সেই অধিকার থেকেই শাসন করতেন। আনিছুর কিছুই বলতেন না।
যখন ফারুক আহমেদ এর পরিবারকে হ’ত্যা করা হয়। তবুও জমি পান নি৷ জমি যখন পান নি, তখন চৌধুরী পরিবারের চোখ যায় ফারুক আহমেদের পরিবারের অঢেল সম্পত্তির উপর। কিন্তু খালেদ আহমেদ বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সেই পরিবারের সাত সন্তানকে।
তারপর যখন ২০০১ সালে চৌধুরী পরিবারের দুইজনের ফাঁ’সি হয়। তার পর থেকে চৌধুরী পরিবার গর্জে উঠে। খালেদ আহমেদ সহ সবাইকে খু’ন করার জন্য উঠেপড়ে লাগে৷ কিন্তু খালেদ আহমেদ খুব সতর্কে থাকতেন।
তাই তারা টার্গেট করেছিল খালেদ আহমেদের বড় বোন সাজেদাকে।
কিন্তু কে বিয়ে করবে সাজেদা কে? আর কে পারবে সাজেদার সংসার ভাঙতে?
এসব প্রশ্ন যখন সবার মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। তখন মুকিত চৌধুরী বলে উঠেছিলেন, একমাত্র আনিছুর পারবে এই কাজ করতে।
সবাই তখন আনিছুরকে জোর করে। উনিও রাজি হয়ে যান।
আমিনা তখনও উনার স্ত্রী। কিন্তু সাজেদাকে যখন তিনি নিজের কথার মধ্যে নিয়ে আসতে পারলেন। তখন চৌধুরী পরিবার থেকে নির্দেশ আসে তিনি যেন সাজেদাকে বিয়ে করেন।
সবাই আবারও বসেছে।
আমিনা কোনো ভাবেই রাজি না। যাকে ভালোবাসেন, তাকে কোনো ভাবেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে দিবেন না। একজন মেয়ে হয়ে পারবেন না, আরো একটি মেয়ের সংসার ভাঙা দেখতে।
তিনি কোনো ভাবেই কল্পনা করেন নি ৭বছরের বিবাহিত জীবন তিন কথায় ভেঙে যাবে। আনিছুর তাকে তালাক দিয়ে দেন। সেই মুহূর্তের জন্য তিনি কোনো ভাবেই প্রস্তুত ছিলেন না।
এক এক করে সবার পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলেন আমিনা। এক পর্যায়ে রাজিও হয়েছিলেন, তিনি শুধু আনিছুর এর স্ত্রী হয়ে এই বাড়িতেই থাকতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু আনিছুর তার চাচা এবং সব ভাইদের কথায় আমিনাকে তালাক দিয়েছিলেন।
আমিনা নিজের সংসার টিকিয়ে রাখতে পারেন নি। নিজের কোনো ভুল তিনি খুঁজে পাননি। সেদিন চিৎকার করে কান্না করেছিলেন। একটি মেয়ে কিংবা ছেলে বুঝে একটি সংসার ভেঙে যাওয়ার কষ্ট, যেখানে এক পাক্ষিক ভাবে সংসার ভাঙে।
আমিনাকে সেই রাতেই বিদায় করা হয়, সঙ্গে দেওয়া হয় মালিহাকে। গভীর রাতে কান্না করে করে বাবার বাড়ি গিয়েছিলেন সেদিন তিনি।
বায়েজিদ কান্না করছিল, কিন্তু কোনো ভাবেই তাকে সাথে নিয়ে আসতে পারেন নি তিনি। বায়েজিদ এর বয়স তখন ছয় ছুঁই ছুঁই।
আমিনা সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, শুধু প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য যদি তাকে তালাক দিতে পারে, তাহলে তিনিও নিজের সংসার ভেঙে যাওয়ার প্রতিশোধ নিবেন। এক এক করে চৌধুরী পরিবারের সবকেই শেষ করবেন তিনি।

আনিছুর চৌধুরীকে মাটি দেওয়ার পর চৌধুরী পরিবারের কয়েকজন যান আমিনার বাড়ি। কিন্তু সেখানে তালা ঝুলানো পায় তারা।
সবাই ভেবেছিল, তারাই খু’ন করবে আমিনাকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে আমিনাকে পাওয়া যায় নি।
জালাল চৌধুরী সবার সাথে পরামর্শ করে পুলিশকে বলে দিলেন আমিনার কথা।
সব শুনে হামিদুর রহমান যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। একটি পরিবারে এতো রহস্য? তিনি মনে মনে ভেবে নিয়েছেন, সাজেদা খু’নি৷ এখন শুনলেন আরো একটি নাম। তাই এবার তিনি ঠিক করলেন আমিনাকে গ্রেফতার করার পর চৌধুরী পরিবারের সবাইকে গ্রেফতার করবেন। ওদের শাস্তি তো প্রথম প্রয়োজন।
এইজন্যই তো সাজেদাকে এতো খা’রাপ ভাবে টর্চার করার পরেও সে বলে আসছিল সে নির্দোষ।
জালাল চৌধুরী আমিনা বেগমের কয়েকটি ছবি দিয়েছেন অফিসারের কাছে। আর সেই ছবি আনিছুর চৌধুরী এবং আমিনার বিয়ের। এই ছবি গুলো দেখেই যেন আমিনাকে ধরতে পারে পুলিশ।
সাজেদা খুব অবাক হয়েছেন। তার দ্বিতীয় স্বামী আনিছুর চৌধুরী বিবাহিত ছিলেন। তিনি ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী।
কতোটা বোকা তিনি বুঝতে পারছেন এখন। এবার তিনিও মুখ খুলবেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-১০+১১

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১০)
লেখক: হানিফ আহমেদ

তুমি?
হামিদুর রহমান খুব অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেছেন।
সে বলল,
ভিতরে প্রবেশ করার কথা বলবেন না?
হামিদুর রহমান বললেন,
আসুন।
তিনি দরজা বন্ধ করে সোফায় এসে বসলেন। মাথায় তো অনেক কিছুই আসছে। কেন এসেছে ও?
হামিদুর রহমান বললেন,
এতো রাতে আমার বাসায়? আর পালিয়েই বা আছো কেন আপনি সহ আপনার পরিবার?
নিয়াজ খুব মন খারাপ করে বলল,
স্যার আপনাকে সেদিন সব কিছু বলার পরেও আপনার মনে হয়, ওই খু’নগুলোর সাথে আমরা জড়িত?
তিনি চুপ থাকলেন৷ নিয়াজ আবারও বলল,

স্যার আমরা যদি খু’নি হতাম, তাহলে কী আমি আপনার কাছে আসতাম? লুকিয়েই থাকতাম। আমরা তো দেশের আইনের দিকেই তাকিয়ে আছি এখনো। কেন আইন নিজের হাতে তুলে নিতে যাবো। খু’ন গুলো হয়তো ওরাই করছে, নয়তো অন্য কেউ। যাদের উপর আমাদের মতোই অত্যাচার করেছে। আমরা আজ ভালো নেই। এভাবে পালিয়ে থাকতে হবে, আমরা কখনো কল্পনা করিনি। বাস্তব বড্ড কঠিন, যা কল্পনা করি তা পাই না, আর যা কখনো কল্পনাতেও নিয়ে আসিনা তাই হয় আমাদের সাথে।
স্যার বিশ্বাস করুন, খু’ন গুলো আমরা কেউ করিনি। আমরা পালিয়েছি জেল থেকে বাঁচার জন্য। আমাদের যদি আপনারা ধরে ফেলেন, তাহলে জেলে পচতে হবে আমাদের। ওরা চায় আমরা যেন এই পৃথিবীতে থাকি না। কীভাবে আকুতি করে বললে আপনি বিশ্বাস করবেন?

হামিদুর রহমান কিছুই বুঝতে পারছেন না। চার চারটা খু’ন তাহলে কে করেছে? নিয়াজের কথা কী তিনি বিশ্বাস করবেন? কিন্তু তিনি তো নিয়াজ সহ তার পরিবারকেই খুঁজছেন। তাহলে কী করবেন তিনি এখন। নিয়াজকে গ্রেফতার করবেন, নাকি ওকে বিশ্বাস করবেন।
তিনি চুপ থাকলেন, নিয়াজ আবার বলল

স্যার আপনি আমাদের সন্দেহ করে আমাদের খুঁজছেন। ওইদিকে যে আমরা যারা বাবা ডাকতাম যেই মানুষটিকে, সেই মানুষ সহ তার পরিবারকে খু’ন করা হয়েছে। দোষ দেওয়া হয়েছে অসহায় মেয়েটির উপর। কিন্তু জানেন সেই মেয়েটি সেদিন মাত্র বন্দী জীবন থেকে পালিয়ে আসছিল।
স্যার খু’নি এমন কেউ, যে নীরবে তার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু আপনারা তাদের ধরতে পারছেন না।

হামিদুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীর রুমে যেয়ে স্ত্রীকে দুই কাপ চা বানাতে বললেন। তিনি বিশ্বাস মনে ধরে রাখতে চাইলেন নিয়াজ বা তার ৬ভাই এই খু’নগুলো করেনি।
এসে নিয়াজের পাশে বসলেন।

নিয়াজ আপনাকে যদি বিশ্বাস করি। তাহলে আপনার ছয় ভাইকেই নির্দোষ ভাবতে হবে আমার।
নিয়াজ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।
হামিদুর রহমান এবার বললেন,
আপনি এতোটা জোর দিয়ে কীভাবে বলছেন যে আপনার ভাইগুলোও নির্দোষ?
নিয়াজ হেসে বলল,
স্যার আমার ভাই গুলো আমাকে সন্দেহ করছে, হয়তো আমি এসব করছি। কিন্তু আমি কিছু করিনি। র’ক্ত আমার গরম হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সেদিন আমি আপনার সাথে কথা বলে নিজেকে বুঝাই৷ আমাদের একজন সৎ অফিসার আছেন।
হামিদুর রহমান চুপ থাকলেন, ভাবতে চেষ্টা করলেন। নিয়াজ কি সত্য বলছে। নাকি বাঁচার জন্য নিজেকে ভালো সাজাচ্ছে।
নিয়াজ উনার থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে আবারও বলল,

বিশ্বাস করুন আমাকে।

হামিদুর রহমান এর স্ত্রী চা নিয়ে আসলেন। হামিদুর রহমান নিয়াজের হাতে চায়ের কাপ তুলে দেন।
নিয়াজ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,
কিছু তো বলুন আপনি। আমরা এভাবে আর কতো লুকিয়ে থাকবো?
হামিদুর রহমান বললেন,
আপনাকে না হয় বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আপনার ভাইগুলোর সাথে তো আমার কথা হয় নি।
আপনি আমার উপর বিশ্বাস রাখুন। আমার ভাইগুলো কখনো মানুষ মা’রতে পারে না।
হামিদুর রহমান হেসে বললেন,
বিশ্বাস এমন একটি জিনিস যে, নিজের হাতকেও বিশ্বাস করা যায় না। শরীরে মশা বসলে হাত সেই জায়গায় আ’ঘাত করে। বিশ্বাস শব্দটি একটি পাহাড় সমান ভারি।
নিয়াজ চুপ থাকে। কী বলবে সে৷ চায়ের কাপটি হাত থেকে রেখে বলল নিয়াজ,
আমার সাথে এক জায়গায় যাবেন?
কোথায়?
যাওয়ার পরেই বুঝবেন কোথায়।
হামিদুর রহমান চিন্তিত হলেন। তার কী যাওয়া ঠিক হবে? এতে তো তার জীবনের ঝুকি আছে। কতো পুলিশের লোককেই তো এভাবে হ’ত্যা করা হয়েছে। সে কীভাবে যাবে। তাও এতো রাত। তার কী যাওয়া ঠিক হবে?
কোনো কথা না বলে রুমের ভিতর যান তিনি।
দুই মিনিট সময় নিয়ে স্ত্রীকে ছোট্ট করে সব বললেন তিনি। তার কী যাওয়া ঠিক হবে এতো রাতে? এই প্রশ্নটি করলেন কোল থেকে ঘুমন্ত মেয়েকে বিছানায় রাখতে রাখতে।
তিনি বিশ্বাস করেন, সব থেকে ভালো পরামর্শক হলো ঘরের নারী। সেটা স্ত্রী কিংবা মা অথবা বোন, মেয়েও হতে পারে। তাই তিনি পরামর্শ চাইলেন নিজের স্ত্রীর কাছে। উনার স্ত্রী সব শুনে বললেন,
দেখো ছেলেটা তোমার কাছে এসেছে। ওর সব কথা আমি শুনতেছি। মনে তো হচ্ছে ভালো। তুমি যাও। তবে যাওয়ার পূর্বে ওর সাথে দুই মিনিট বসে ভালো মন্দ কথা বলো।
হামিদুর রহমান আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। সাহস পেয়েছেন স্ত্রীর সম্মতিতে।
নিয়াজের কাছে এসে এই বিষয়েই টুকটাক কথা বলতে শুরু করলেন। তখন উনার স্ত্রী এসে নিয়াজের নাম জিজ্ঞেস করে, এটা ওটা জিজ্ঞেস করে, তিনি সাধারণ ভাবেই তার সাথে দুই মিনিট কথা বললেন।

হামিদুর রহমান তৈরি হয়ে নিয়াজের সাথে বের হন। যাওয়ার পূর্বে ঘুমন্ত দুই মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দেন। আর স্ত্রীকে বললেন, তোমাকে এসে তোমার পাওনা দিবো ইনশা আল্লাহ। উনি শুধু হাসলেন।

নিয়াজ উনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। উনি বুঝতে পারছেন না কী করতে চাচ্ছে ও।
এই বাড়ি তো আপনাদের?
নিয়াজ হ্যাঁ বলল শুধু।
নিয়াজ তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে উনাকে নিয়ে।
হামিদুর রহমান খুব অবাক হলেন। কারণ ভিতরে তো আরো মানুষ আছে। এদের তিনি সেদিন দেখেছেন। এরা হলো নিয়াজের পাঁচ ভাইয়ের স্ত্রী।
উনি অবাক হয়ে বললেন,
এরা ভিতরে কীভাবে?
নিয়াজ খুব মন খা’রাপ করে বলল,
আমার ভাবিগুলো আজ কয়টা দিন ধরে এভাবেই ঘরবন্দী। বারবার বলার পরেও ওরা পালাবে না৷ কারণ ওরা নির্দোষ। তাই তারা পালাতে চায়নি কোনো ভাবেই। আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই তাদের ভিতরে রেখে বাহিরে তালা দিয়ে চলে যাই।
দেখুন আমার ভাবি গুলো কতোটা কষ্টে আছে। ওরা এভাবে দেয়াল বন্দী থাকার কথা? ওরা তো জানে আমরা কোনো দোষ করিনি। তবুও আমাদের পালাতে বলছে। কিন্তু ওরা পালায় নি। কতোটা কষ্টে আছি আমরা দেখুন। হয়তো আমিই প্রথম, যাদের কিনা পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে আমি তাদের একজন হয়েও একজন পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়েছি। সত্যিই আমরা ভালো নেই। ভালো নেই এই আমার ভাবি গুলো। আমার এই ভাবিটি(রবিনের স্ত্রী) দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। কতোটা কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পারছেন। ভাইয়া থাকলে কী আজ এরা কষ্ট পায়?
আমরা নির্দোষ। এভাবে লুকিয়ে থাকতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আপনি আমাদের প্রতি একটু দয়া করুন। আপনি প্রকৃত দোষী কে ধরে শাস্তি দিন।

হামিদুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন।

আপনি পালিয়ে যান। ওরা মামলা করেছে আপনি সহ আপনার ছয় ভাইয়ের উপর। আপনার ভাবিদের উপর না। তাদেরকে স্বাভাবিক ভাবেই জীবন কাটাতে বলুন। আমি তাদের বাজার থেকে শুরু করে সব কিছু করে দিবো প্রয়োজন হলে। কিন্তু আপনাদের পালিয়েই থাকতে হবে। আপনারা নির্দোষ যদি হন তাহলে ইনশা আল্লাহ স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন। এই বোনগুলোর দায়িত্ব আমি নিবো। সপ্তাহে একদিন আমি ওদের বাজার করে দিবো। আর ওরা যদি কেউ বাজার করতে পারে তাহলে তো ভালোই।

নিয়াজ যেন কিছুটা শান্ত হলো। মিনহা বলল,
আপনি আমাদের স্বাভাবিক ভাবে থাকতে দিলেই হবে। বাকিটা আমরা করতে পারবো।
হামিদুর রহমান আর কিছু বললেন না।

হামিদুর রহমান বাসায় আসেন রাত ১টার পর। নিয়াজ দিয়ে গিয়েছে উনাকে।
কেন জানি মনে হয় উনার, এই পরিবার নির্দোষ। তাইতো সুযোগ দিলেন। হয়তো এই কাজটি অসৎ, তবুও তিনি একটি সুযোগ দিলেন। পালিয়ে থাকুক।
উনার স্ত্রী উনার পাশে এসে বসলেন আর বললেন,
বলছিলাম না ছেলেটা ভালো।
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
উনার স্ত্রী ফোন হাতে দিয়ে বললেন,
দেখো।
হামিদুর রহমান তাকিয়ে দেখলেন, উনি যখন নিয়াজের সাথে কথা বলছিলেন, সেই সময়ের ভিডিও।
উনি হাসলেন, একজন পুলিশ অফিসারের স্ত্রী বলে কথা। মুচকি হেসে স্ত্রীর কপালে চুমু এঁকে দিলেন।

আরো দুইটা দিন কেটে যায় কিন্তু খু’নিকে পাওয়া যায়নি আজো। কে খুন করেছে, সেটা পুলিশ এখনও জানতে পারেনি। এই রহস্য কবে সমাধান হবে সেই অপেক্ষায় পুলিশের লোকেরা।
তবে এই চারটি খু’ন এর ঘটনায় পুলিশ ভুলে গিয়েছে খালেদ আহমেদ এর পরিবারের খু’ন এর কথা। চৌধুরী পরিবারের চাপে পুলিশ এইদিকেই মন দেয়।
খু’নি যদি খু’নের পর কোনো প্রমাণ না রাখে, তাহলে তাকে ধরা সত্যিই খুব কঠিন।

জালাল চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। সবাই বাধা দিলেও তিনি বের হন। সাথে একটি চা’কু নিয়েছেন।
আজ কিছু একটা করবেন তিনি। নিজের দুই ভাই আর ভাতিজার খু’নের বদলা নিবেন। কিন্তু কাকে কীভাবে কোথায় মা’রবেন সেটা তিনি জানেন না। উনার গন্তব্য কি সেটাও জানেন না। তবুও বের হন। চৌধুরী পরিবারে কেউ হাত দিয়েছে তিনি হাত না, মাথাটাই কা’টবেন।
এই শপথ নিয়েই তিনি বের হয়েছেন। কারো কোনো কথাই শুনেন নি তিনি।

জালাল চৌধুরী বুঝতেই পারেন নি বদলা নিতে এসে নিজেই শিকার হয়ে যাবেন। উনার হাত দুটো বাঁধা। মুখটাও বাঁধা।
শরীর কাঁপছে উনার। মনে করার চেষ্টা করলেন, কী হয়েছিল কিছুক্ষণ পূর্বে।
পিছন থেকে কেউ তাকে কিছু একটা দিয়ে অজ্ঞান করে। তার পর আর কিছুই মনে নাই। এখন চোখ মেলে নিজেকে বাঁধা অবস্থায় পান। খোলা আকাশের নিচে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। জায়গা টা তার খুব চেনা। মনে হচ্ছে তার বাড়িরই কাছে এমন কোনো জায়গা। কিন্তু পুরোপুরি ভাবে মনে করতে পারছেন না।
তার সামনে একজন মুখোশ পরা ব্যক্তি দাঁড়ায়। হাতে খুব বড় একটি রা’মদা। উনার মনে হচ্ছে এই চোখজোড়া তিনি চিনেন। কিন্তু মনে করতে পারছেন না কোনো ভাবেই।
নিজেকে ছাড়াবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন জালাল চৌধুরী। কিন্তু পারছেন না কোনো ভাবেই। শরীর থেকে ডান হাত আলাদা করার কারণে উনার মনে হচ্ছে জীবনটা বুঝি এখনই শেষ। কিন্তু খু’নি এখনও আরো তিনটি অঙ্গ কা’টবে।
ডান হাত কা’টার পর যখন ডান পা কা’টতে পায়ের বাঁধন খুলে, তখনি জালাল চৌধুরী খুব জোরে লাত্তি দেন ওই ব্যক্তিকে।
পিছন ফিরে আর তাকান নি। দৌড়াতে তাকেন। যেভাবেই হোক তাকে বাঁচতে হবে। দুই মিনিট দৌড়ানোর পর রাস্তায় থাকা অনেক মানুষ তাকে দেখে তাকে থামিয়ে মুখ থেকে বেঁধে রাখা কাপড় খুলে।
জালাল চৌধুরীকে চিনে ফেলে সবাই। উনাকে ধরাধরি করে দুই মিনিট হেটেই চৌধুরী বাড়িতে ঢুকে ওরা।
জালাল চৌধুরীর এই অবস্থা কেউই আশা করে নি।
শরীরের একটি অঙ্গ তার সাথে নাই।

জালাল চৌধুরীকে তার পরিবার তাড়াতাড়ি হসপিটালে নেওয়ার জন্য গাড়িতে তুলে। জালাল চৌধুরী তার চাচাতো ভাই মাহাব চৌধুরীকে বললেন ওই জায়গার কথা, যেখানে তাকে খু’ন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
মাহাব চৌধুরী ভাইয়ের কথা শোনে আর দেরি করেন নি। নিজের সাথে তার ছেলে এবং দুই ভাইকে নিয়ে যায়।
কিন্তু সেখানে যেয়ে শুধুই জালাল চৌধুরীর কা’টা হাতটি পায়। কোনো মানুষকেই পায় নি। সেই হাতটি নিয়ে ওরা বাড়িতে চলে আসে। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। কেউ আসে কি-না। কিন্তু কেউ আসেনি।

ভাইয়া কে করেছে এমন?

চাচাতো ভাই মাশুক চৌধুরীর প্রশ্নে জালাল চৌধুরী নিজের কা’টা হাতের ব্যান্ডেজ এর দিকে তাকিয়ে বললেন,

কোনো মহিলা ছিলো৷ পরনে বোরখা। লাথি যখন মে’রেছিলাম তখন কেমন একটা শব্দ করে উঠে। কণ্ঠ তো মহিলার। কোনো মহিলা আমাকে খু’ন করার চেষ্টা করে।
আমার ভাইগুলো এবং ভাতিজাগুলোকে হয়তো এই মহিলা মে’রেছে। আজ আমি পালাতে না পারলে হয়তো আমাকেও আজ,,,

মাশুক চৌধুরী অবাক হয়ে ভাইয়ের পাশে বসে আছেন। এই খু’ন গুলো কোনো মহিলা করছে। তাহলে কে এই মহিলা?
জালাল চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি।
ভাইয়া এবার আমরা কোনো মহিলাকেই বাঁচিয়ে রাখবো না। মেতে উঠবো আবারও। যেই মহিলাকেই শত্রু মনে হবে। সেই মহিলাই হবে আমাদের শিকার।

চলবে,,,

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১১)
লেখক: হানিফ আহমেদ

ফোনটি কান থেকে নামিয়ে চুপচাপ বসে আছেন সাজেদা বেগম। ছেলে পক্ষের সাথে এতক্ষণ কথা বললেন তিনি। ওরা জোর দিচ্ছে, নাওশিনকে তাড়াতাড়িই নিজের ঘরের বউ বানিয়ে নিতে চায়। দুইটা বছর তো অপেক্ষা করেছে তারা। এখন নাওশিনের বয়স ১৬ হয়েছে, চুপিচুপি বিয়ের কাজ সেড়ে নিলেই হয়। কেউ জানবে না। বাল্যবিবাহের মামলায় ফাঁসবেও না।
নাওশিনের যখন ১৪ বছর বয়স। তখন প্রথম তাকে কোনো ছেলে পক্ষকে দেখানো হয়। মেয়ের বিয়ে নিয়ে সাজেদা বেগম এবং আনিছুর রহমান একটি বিশেষ ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবছিলেন। তাই তো নাওশিনের বয়সের দিকে তারা তাকান নি। তাদের চোখে নাওশিন এর সুন্দরটাই প্রাধান্য পায়।
নাওশিনকে যখন ছেলে পক্ষকে দেখানো হয়েছিল। তখন ছেলের বাবা আরমান শাহার খুব পছন্দ হয়। এমন মিষ্টি মেয়েকে যদি ছেলের বউ করে নিতে পারেন, তাহলে তার পরিবারটা খুব সুন্দর হবে। এমন সুন্দর মেয়েকে তো সব বাবাই চান নিজের ছেলের বউ হিসেবে। সেই দিক দিয়ে আরমান শাহাও চান এই মেয়েই ছেলের বউ হোক। তাই তো আর নাওশিনের বয়সের দিকে তাকাননি।

নাওশিনও যেন বেঁচে যাওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছিল।
১৪বছরের নাওশিনের মনে বিয়ে নিয়ে এক নতুন অনুভূতির সৃষ্টি হয়। মনে বিয়ে শব্দ উঠলেই মুহূর্তেই মুখটি লজ্জায় লাল হয়ে যেত তার। মনের মধ্যে স্বপ্ন বুনছিল। বাবুইপাখি যেমন খুব যত্নে বাসা বুনে, তেমনি সেও বিয়ে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করে।
একটি বেঁচে যাওয়ার স্বপ্ন। অ’ত্যাচার থেকে বাঁচার স্বপ্ন।
কিন্তু সেই স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে গিয়েছিল। যখন সে তার মা এবং মায়ের স্বামীর কথা শুনতে পায়।
চোখগুলো তার ভিজতে শুরু করে। বিয়ে নিয়ে বেঁচে যাওয়ার স্বপ্নটি ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। যেই মনে বিয়ে নিয়ে অনুভূতির ভীড় জমেছিল। সেই মনেই বিয়ে নিয়ে ঘৃণা জন্মায়।

৫লক্ষ টাকা কাবিন হবে নাওশিনের বিয়ের। তারপর বিয়ে দুই মাসের মাথায় ডিভোর্স চাইবে নাওশিন।

স্বামী আনিছুর রহমান এর মুখে এমন কথা শুনে সাজেদা বেগম বললেন,

নাওশিন কী আমাদের কথায় রাজি হবে?
কেন হবে না, না হলে তাকে আমরা জোর করব।
সাজেদা বেগম বললেন,
যদি রাজি হয়ে যায়। তাহলে একসাথে কাবিনের ৫লক্ষ টাকা আমরা পেয়ে যাবো।
আনিছুর রহমান হেসে হুম বললেন।

কথাগুলো শুনে নাওশিন সেদিন দেয়ালে পিট ঠেকায়। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়তে থাকে তার। তাকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছে ওরা। এমং নোং’রা চিন্তা কীভাবে মাথায় নিয়ে আসতে পারলো এরা। মা হয়ে মেয়েকে দিয়ে এমন খা’রাপ কাজ করানোর চিন্তা মাথায় নিয়ে আসতে উনার অন্তর একটাবারের জন্যেও কেঁপে উঠলো না।
নাওশিন আবারও ওদের কথা শোনায় মন দেয়।

নাওশিন যেমন সুন্দর একটা মেয়ে। এই সুন্দর এর জন্যই কতো বড়লোক ঘরের ছেলে পাবো আমরা। প্রতিটা বিয়েই কয়েক মাস যাবে, তারপর নাওশিনকে বলব কিছু একটা নিয়ে এমন ঝগড়া করতে। যেন ডিভোর্স পর্যন্ত যায়।
স্বামীর কথা শুনে সাজেদা বেগম হেসে বললেন,
প্রতিটা কাবিন ৫লক্ষ এর উপর দেওয়ার চেষ্টা করব। তাহলে কতো টাকার মালিক হবো আমরা বুঝতে পারছো তুমি।

নাওশিন এসব শুনে এতোটা ধাক্কা খায় যে, তার আর এসব শোনার মতো শক্তি কানে ছিলো না। তাই নিজের রুমে দৌড়ে যায় সে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে শব্দহীন কান্নায় বালিশ ভেজাচ্ছিল।
বিয়ের মাধ্যমে বেঁচে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিল। কিন্তু এই বিয়ে যে তাদের ব্যবসা হবে সে কখনো বুঝতে পারেনি।
তারপর যখন সে বিয়েতে রাজি হলো না। আ’ত্মহত্যার ভয় দেখালো, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তখন থেকেই তার বন্দী জীবন শুরু হয়। কারণ রাগের মাথায় বলে ফেলছিল নাওশিন।

তোমরা আমায় দিয়ে ব্যবসা করবে। আমি বলে দিবো এসব সবাইকে। আমি বিয়ে করবো না কখনো। যে বিয়ে নিয়ে তোমরা এমন ব্যবসার কথা ভাবছো, সেই বিয়ে আমি বেঁচে থাকতে করবো না।

হয়তো এই কথাগুলো যদি ওদের সামনে প্রকাশ না করে নিজের মধ্যে রাখতো। তাহলে হয়তো দুই বছর বন্দী জীবন কাটাতে হতো না তার। ১৪বছরের ছিলো বলেই এতোটা জ্ঞান ছিলো না তার, কোথায় কী বলতে হবে তখন যদি জানতো। তাহলে কষ্ট পেতে হতো না। বিয়ের পর যদি স্বামীকে সব বলার চিন্তা করত তাহলে হয়তো জীবনটা অন্য রকম হতো। কিন্তু তার কপালটাই খা’রাপ। এইজন্যই তো বন্দী থাকতে হয়েছে চার দেয়ালে।

সাজেদা বেগম ফোন রেখে কিছুক্ষণ বসেছিলেন একা। ওরা জোর দিচ্ছে। ছেলের নাকি পড়ালেখা শেষ হয়েছে এবার তারা বিয়ের কথা বলতে চায়।
মিথ্যে বলেছিলেন, যে নাওশিন কিছুদিন সময় চায়। ভালো সেজে ছেলের বাবার সাথে কথা বলেছিলেন সাজেদা। ওরাও অপেক্ষা করবে। সাজেদা বলেন নি কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আরমান শাহার ছেলে রুমন শাহার পড়ালেখা শেষ হয়েছে। পরিবারের সবাই মিলে রুমনকে রাজি করিয়েছেন বিয়ের জন্য। এর পূর্বেও সে বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। সে যখন শুনেছিল তার জন্য ১৪বছরের কোনো নারীকে বউ সাজিয়ে নিয়ে আসবে তার পরিবার। তখনই গর্জে উঠেছিল, এতো কম বয়সের মেয়েকে কেন সে বিয়ে করবে, দুনিয়াতে কী মেয়ের অভাব?

সাজেদা বেগম স্বামীর পাশে বসে বললেন,
ওরা ফোন দিয়েছিল।
কে?
ওই-যে নাওশিনকে দেখে গিয়েছিল, ওরা।
আনিছুর রহমান এবার হাত থেকে পত্রিকা রেখে স্ত্রীর কথায় মন দিলেন।
তুমি কী বললে?
সাজেদা হাত চুলকিয়ে চুলকিয়ে বললেন,
আমি আর কী বলব, বলেছি মেয়ে এখন বিয়ের জন্য রাজি না।
আনিছুর রহমান রেগে যান,
সত্যটা বললে কী হতো?
আরে এর ভিতর যদি নাওশিনকে পুলিশ পেয়ে যায়, তখন বলবো মেয়ে বিয়ের জন্য রাজি।
আনিছুর রহমান রেগেমেগে বললেন,
পুলিশ তোমার মেয়েকে পেয়ে বুঝি তোমার হাতে তুলে দিবে?
তো?
আরে গোবরে ভরা মাথার নারী, পুলিশ তখন নাওশিনকে জেলে ভরবে।
সাজেদা চুপ থাকলেন। সত্যিই তো নাওশিনকে পুলিশ ধরতে পারলে জেলেই নিবে।
তখন না হয় বলব যে, নাওশিন নির্দোষ।
আনিছুর রহমান কিছু বলতে চেয়েও বললেন না। পত্রিকা পড়ায় মন দিলেন। সাজেদা বেগম উনার কোনো উত্তর না পেয়ে রুম ত্যাগ করলেন।

জালাল চৌধুরীর সামনে বসে আছেন পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান। তিনি জালাল চৌধুরীর হাতের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটি হাত শরীর থেকে আলাদা করেছে। হায়াত আছে বলেই সে বেঁচে আসতে পেরেছে।

আপনি দেখেছেন খু’নীকে?

পুলিশ অফিসারের প্রশ্নে তিনি বললেন,
হ্যাঁ দেখেছি। কিন্তু চিনতে পারি নি। তবে ওই খু’নি একজন মহিলা।
অফিসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেজ করলেন,
মহিলা?
হ্যাঁ মহিলা। পরনে বোরখা ছিলো৷ লাথি মা’রার পর আমি কণ্ঠ শুনেছি। মেয়েলি কণ্ঠ।
হামিদুর রহমান চুপ থাকলেন। তাহলে খু’ন গুলো কোনো মহিলা করে যাচ্ছে? কিন্তু কোনো মহিলার এতো শক্তি কী আছে, একটি পুরুষকে বেঁধে কোথাও নিয়ে যেয়ে তারপর তাকে এতো নিষ্ঠুর ভাবে খু’ন করা।
জালাল চৌধুরী উনাকে চুপ থাকতে দেখে বললেন,
আমি যখন ওই চোখজোড়া দেখেছি। তখন মনে হয়েছে, আমি ওই খু’নীকে চিনি। দেখেছি আমি, ওই চোখ কতো চেনা। কিন্তু কোনো ভাবেই মনে কর‍তে পারিনি, কে হতে পারে।
কণ্ঠ তো শুনেছিলেন?
হ্যাঁ, কিন্তু কণ্ঠ তো লাথি দেওয়ায় কেমন এক শব্দ করছে। কথা বলে নি তো সে।

হামিদুর রহমান চুপচাপ বসে থাকলেন। তাহলে সত্যিই কী নিয়াজ এবং তার পরিবার নির্দোষ। তিনি আবারও ভাবলেন, আচ্ছা এমন না তো, নিয়াজের ভাইদের স্ত্রীদের মধ্যে কেউ?
প্রশ্নটি মাথায় আসতেই উনার শরীর কেঁপে উঠলো। স্বামীদের কষ্ট তাদের সহ্য হচ্ছে না বলে কী তাদের মধ্যে কেউ এসব করে যাচ্ছে।

হামিদুর রহমান হসপিটাল থেকে চলে আসলেন। দুইজন মহিলা কনস্টেবলকে সাথে নিয়ে নিয়াজদের বাসার পাশে একটি ভুসিমাল এর দোকানে ওদের বসিয়ে চলে আসেন। তাদের পরনে তখন পুলিশের পোশাক ছিলো না।
মহিলা কনস্টেবল দুইজন পাশেই একটি ছোট্ট খাবার হোটেলে বসলেন। হোটেল থেকে বাসার গেইট দেখা যায় ভালো ভাবে।
সারা দিন চলে যায় বাসা থেকে কেউ বেরও হয়নি, এবং কেউ ভিতরে প্রবেশও করেনি।
দুজনের থেকে সব শুনে চিন্তায় পড়লেন তিনি। তাহলে কে করছে এসব?
কাকে সন্দেহ করবেন? খালেদ আহমেদ সহ তার পরিবারকে যে মে’রেছে সেও তো মেয়ে৷ তাকে সন্দেহ করবেন? কী যেন নাম, হ্যাঁ নাওশিন আনবার। কিন্তু ওই মেয়ের সাথে চৌধুরী পরিবারের কী সমস্যা।
উনি কাকে সন্দেহ করবেন, এই বিষয়ে চিন্তা করে কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না।
উনার মনে হচ্ছে খু’নি যদি নিজ থেকে না ধরা দেয়, তাহলে হয়তো থাকে ধরা কোনো ভাবেই সম্ভব না। কিন্তু খু’নি কী কখনো নিজ থেকে ধরা দেয়?

মাহাব চৌধুরী যিনি খুব শান্ত মাথার মানুষ। রেগে গেলেও বাঘের মতো গর্জন করেন না। তিনি নীরবে কাজ করার মানুষ। চাচাতো দুই ভাই এবং দুই ভাতিজাকে হারিয়ে মনটা উনার ভালো না। এখন আরেক চাচাতো ভাই জালাল চৌধুরীকেও হারাতে বসেছিলেন। ভাগ্য ভালো বলেই তাকে কিছু করতে পারেনি খু’নি।
এতক্ষণ তিনি চাচাতো ভাই জালাল চৌধুরীর পাশে বসে ছিলেন। উনার মুখ থেকে সব শুনলেন।
কোনো মহিলা এসব খু’ন করে যাচ্ছে। কে করছে এসব, কোন মহিলা। কিছুই তার মাথায় আসলো না।
মাহাব চৌধুরী হসপিটাল থেকে বের হয়ে রাস্তায় গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। উনার বড় ছেলে আরাফ চৌধুরীকে ফোন দিয়ে বলেছেন গাড়ি নিয়ে আসতে। এটাও বলেছেন, সাথে যেন আর কাউকে নিয়ে আসে।
রাস্তায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বার-বার হাতের ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন।
হঠাৎ কী ভেবে যেন রাস্তার পাশ থেকে একটি রেস্টুরেন্ট এর দিকে হাটা শুরু করলেন।
সন্ধ্যা হয়েছে মাত্র। এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না। এইজন্য রেস্টুরেন্টের দিকে হাটা শুরু করলেন। মনে মনে ভাবছেন, শুধু চায়ের জন্য রেস্টুরেন্টে যাবেন? কিন্তু অহংকার যে, চৌধুরী পরিবারের সন্তান, এসব ছাড়া কোথায় বসবে চায়ের জন্য।

নিজের হাত বাঁধা অবস্থায় দেখে ভীষণ অবাক হন মাহাব চৌধুরী।
সামনে তাকিয়ে দেখলেন, মুখোশ পরা একজন মানুষ। কথা বলতে যেয়ে দেখলেন তার মুখ বাঁধা। জোরাজোরি করেও নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হন তিনি। গাড়ির শব্দ শুনতে পারছেন। উনার মনে হচ্ছে, উনি শহরের কাছে কোথাও। কিন্তু কীভাবে এখানে আসলেন? তিনি তো হাটছিলেন, কিন্তু এভাবে তিনি।
বুঝতে পারলেন তাকে অজ্ঞান করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। কোনো একটা মানুষ দেখলো না?
মনে করার চেষ্টা করার পর উনার মনে পরল,
পিছন থেকে কেউ উনার মুখের কাছে কিছু ধরেছিল। তারপর আর কিছু মনে নেই।
সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছেন, ভাইয়ের বলা সেই খু’নি কী?
উনার মনে হচ্ছে উনিও চোখজোড়া চিনেন। কিন্তু কে এই মানুষ। বুঝতে পারছেন না, মহিলা না পুরুষ। তবে বোরখা পরা৷ তাহলে কী মহিলা?
মাহাব চৌধুরীর চোখে অনেক মহিলার চেহারা ভেসে উঠছে। কিন্তু কোনো ভাবেই এই চোখজোড়া মিকাতে পারছেন না। কে?
খু’নি ঠিক পূর্বের মতোই কাজ শুরু করে। তবে প্রথমে পা দুটো আলাদা করে। সে হয়তো এই ভূল দ্বিতীয় বার করতে চায় না, তাই প্রথমে পা থেকে শুরু করে। একটি শিকার তার থেকে পালিয়ে যায়, দিয়ে যায় তাকে লাথি। তাই আজ আর কোনো ভুল না।
শরীরের চারটি অঙ্গ আলাদা করার পর এবার সে মুখ থেকে মুখোশ খুলে।
মাহাব চৌধুরী মৃ’ত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে এই মুখটি দেখে চোখজোড়া বড় করে করে তাকান, মুহূর্তে বুকটি ক্ষ’তবিক্ষত করা হয়। তবে এবার গলাতেও চালানো হয় চা’কু। কোনো সুযোগ দিতে চাননা সে। মৃ’ত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর সে হাসি মুখে বিদায় নেয়।

আরাফ চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় নিজের বাবাকে না পেয়ে ফোন দেয়। রিং হচ্ছে, কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না। গাড়ি থেকে রাফি চৌধুরী নামে, আর বলল,
ভাইয়া তুমি দেখো চাচা কোথায় আমি বাবার কাছ থেকে আসি। রাফি, জালাল চৌধুরীর এক মাত্র ছেলে।
রাফিকে তার বাবা দেখে বললেন,
আবার কেন এসেছিস?
আরাফ ভাইয়ার সাথে এসেছি।
ওহ, কেন?
চাচা ফোন দিয়ে বললেন গাড়ি নিয়ে আসতে৷ ভাইয়া আমাকে সাথে নিয়ে আসলেন। আম্মু কোথায়?
জালাল চৌধুরী বললেন,
তোর আম্মু তো ডক্টরের সাথে কথা বলতে গিয়েছিল, আমাকে আজ রাতেই নিয়ে যাওয়া যায় কি-না সেটা জিজ্ঞেস করতে।
ওহ,
অনেক্ষণ হলো তোর আম্মু তো আসে না।
দাঁড়াও আমি দেখছি।
রাফি দরজার কাছে যেতেই নিজের মাকে দেখতে পায়।
ডক্টর বলেছে কাল সন্ধ্যায় তোমায় নিয়ে যেতে পারবো
জালাল চৌধুরী স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
এতক্ষণ পর আসলে!
আরে ডক্টর রোগী দেখছিল, তাই অপেক্ষা করতে হয়েছে। এর মধ্যে দুইবার এসেছি, বলতে পারো তুমি? চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলে দেখবে কীভাবে।
জালাল চৌধুরী মুচকি হেসে চুপ থাকলেন।
রাফির ফোনে শব্দ হতেই ফোন ধরে সে। আরাফের কল,
হ্যাঁ ভাইয়া বলো।
তাড়াতাড়ি নিচে আয়।
রাফি আন্দাজ করলো আরাফের কণ্ঠে কান্না মিশ্রিত। তবে প্রশ্ন করল না।
আসছি বলে রেখে দেয়। কারণ হয়তো চাচাকে পেয়েছে, তাই তাড়াহুড়ো করে কথা বলেছে।
তোমরা থাকো, আমি বাড়ি যাচ্ছি।
কে ফোন দিলো?
বাবার প্রশ্নে রাফি বলল,
ভাইয়া, হয়তো চাচাকে পেয়েছেন।
ওরা আর কিছু বলল না।

নিচে এসে আরাফের গাড়ি পেলেও আরাফকে পায়নি সে। ফোন দেওয়ার পর আরাফ বলল, সামনের রাস্তা দিয়ে হেটে আসতে।
সে একটু হাটার পর কিছু মানুষের ভীড় দেখে। সেখানে যায়। তারপর কিছুটা ভিতরে যেয়ে দেখতে পায় আরাফ কান্না করছে। আরাফের সামনে তার বাবা মাহাব চৌধুরীর লা’শ পড়ে আছে। রাফি ভয়ে শুধু চিৎকার দিলো চাচা বলে।

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-০৯

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(৯)
লেখক: হানিফ আহমেদ

আতিকা রুমে পায়চারি করছিলেন। তার আজ খুব মন খা’রাপ। বাজার করতে বের হয়েছিলন তিনি, নিজের পরিবারে একের পর এক খু’ন হচ্ছিল, সেই ঘটনা হজম করে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু মেরহাবের খু’ন এর কথা শুনে তিনি কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। কে নিচ্ছে প্রতিশোধ। নিজের দুই ভাই এবং ভাইয়ের ছেলের খু’নের খবর শুনে একটুও মন খা’রাপ করেন নি তিনি। কিন্তু মেরহাব, ওতো খুব ভালো ছিলো। তাকে কেন খু’ন করা হল। কে মেতেছে এই কাজে।
আতিকার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। মনের আকাশ বারবার গর্জন করছে। কোনো ভাবেই মনকে শান্ত করতে পারছে না। তার ভাইগুলো এবং চাচাতো ভাইগুলো না হয় খা’রাপ ছিলো৷ কিন্তু মেরহাব? তার কী দোষ?
এই যে মাসের পর মাস একা থাকছেন তিনি, কীভাবে চলছেন, সবই তো মেরহাব এর জন্যই। মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা নিজের ফুফুকে দিতো। চৌধুরী পরিবার তার থেকে মুখ তুলে নিলেও মেরহাব ঠিকই ছিলো। আজ সেই ভালো মানুষটিও পৃথিবীতে নেই। কাল কেউ থাকে খু’ন করেছে৷
আতিকা বেগম, যার আসল নাম আতিকা চৌধুরী। বাবা মুহিত চৌধুরী। আতিকা চৌধুরী তারা চার ভাই এক বোন। এর মধ্যে দুই ভাইকেই কেউ মে’রেছে। কিন্তু কে সেই ব্যক্তি?
আতিকা অন্যায়ের প্রতিবাদে ছিলো এক কঠিন মানুষ। প্রতিবাদে সে নিজের সৌন্দর্য লুকিয়ে এক কঠিন রূপ নিতো। অন্যায় সহ্য করার শক্তি তার ছিলো না।
চৌধুরী পরিবার এর অ’ত্যাচার তার কখনো ভালো লাগেনি৷ জোর করে মানুষের জমি দখল। মানুষকে আ’ঘাত করা, এসবের বিরুদ্ধে সে প্রতিবাদ করত তার প্রতিবাদ ভালো লাগতো না বাবা মুহিত চৌধুরীর। তাই তাকে বিয়ে দিয়েছিল একজন ব্যবসায়ীর কাছে। আতিকার স্বামী কামরুল হাসান ছিলেন চাল ব্যবসায়ী।
বিয়ের ১০বছর পর যখন আতিকা নিজের ভাগের জমি চেয়েছিল। তখন থেকেই শুরু হয় তার উপর অ’ত্যাচার।
কামরুল হাসান ব্যবসায় বড় ধাক্কা খেয়েছিলেন। ভেঙে গিয়েছিলেন তিনি। ভিতরে ভিতরে কষ্টে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। স্বামীর এই অবস্থা কোনো ভাবেই নিতে পারছিলেন না আতিকা। তাই নিজের ভাগের জমি বিক্রি করে স্বামীকে আবারও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবেন। কিন্তু সে ভুলে গিয়েছিল। তার বাবা ভাই জমি লোভী। কিন্তু সেও হাল ছাড়েনি। আর সেই হাল না ছাড়ার কারণেই হারিয়েছেন নিজের স্বামীকে।
আতিকা চৌধুরী নিজের স্বামীকে হারাবেন সেটা কখনো কল্পনা করেন নি।
কামরুল হাসানকে খু’ন করেছে তারই বাবা ভাই মিলে। ১৯৯৫সালে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যায় তার পরিবার। আতিকা এবং তার স্বামী কখনো ভাবেনি সেখানে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছিল।
মোরগ জ’বাই করে খাওয়ানো হয়েছিল সেদিন। কিন্তু গভীর রাতটা যে কোনো নিষ্ঠুর রাত হবে সেটা তিনি কখনো কল্পনা করেন নি।
রাত তখন দুইটা, জমি নিয়ে তখনো আলোচনা হচ্ছিল। কামরুল হাসান খুব অবাক হয়েছিলেন। তার স্ত্রী তার জন্য বাবার সম্পত্তি বিক্রি করতে চাচ্ছে। এই অবাক হওয়াই যেন তার শেষ অবাক হওয়া ছিলো। কামরুল হাসান যখন বলতে চেয়েছিলেন নিজের স্ত্রীকে, আমার এসব লাগবে না। কিন্তু বলতে পারেন নি।
আতিকার ভাইগুলো তার উপর ঝাপিয়ে পরে। আতিকা শতো চেষ্টা করেও পারেন নি নিজের স্বামীকে বাঁচাতে। তার ভাইগুলো চিৎকার করে বলছিল আর মা’রছিল কামরুল হাসানকে,
যার জন্য তুই সম্পত্তির ভাগ চাচ্ছিস, আজ তার শেষ দিন।
কতোটা নিষ্ঠুর ওরা, নিজের আপনজনকেও রেহাই দিলো না।
সেই মামলা এখনও আদালতে দৌড়াচ্ছে, কিন্তু কোনো কিছুই হয় নি।
মানুষ কতোটা নিষ্ঠুর যে, নিজের বোন বোনের ছেলের সামনেই বোনের স্বামীকে মে’রে ফেলে।
কামরুল হাসানের মৃ’ত্যুর সময় আনিকের বয়স ছিলো ৭বছর। নিজের বাবার মৃ’ত্যু সে তার নিজ চোখে দেখেছিল।
আজ আনিকও ঘর ছাড়া। তার মনে প্রতিশোধ এর আগু’ন জ্বলছে। কিন্তু তার মা অপেক্ষা করবেন, আইনের। আইন কি শাস্তি দেয়। সেটারই অপেক্ষায়। ২০০১যখন নিজের বাবার ফা’সি হয়, তখন একটুও মন খা’রাপ হয় নি তার। কারণ অপরাধীর শাস্তিতে মন ব্যথিত করাও একটি অপরাধ। তাই অপেক্ষা করছিলেন, হয়তো ফল পাবেন। কিন্তু আনিক এই অপেক্ষা করতে পারবে না। সে তার বাবার খু’নীদের খোলা আকাশের নিচে মুক্ত ভাবে চলাফেরা করতে দেখতে চায় না। তাই তো বাসা থেকে চলে গিয়েছে আজ ৩বছর হল। এই তিন বছরে একটাবার এর জন্যেও সে তার মায়ের কাছে আসেনি। সে প্রতিশোধ নিবে। মেরহাব পা’গলের মতো খুঁজেছে আনিককে। কিন্তু কোনো ভাবেই পায় নি। মেরহাব জানে আনিক প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু তবুও মেরহাবকে ভয় পায় আনিক। এইজন্য একটাবার সামনাসামনি কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু কোথাও পায়নি সে।
মেহরাবের সাথে একটাবার কথা বললে সে বুঝবে। এই বিশ্বাস মেহরাবের ছিলো।

আতিকার মনে একটি প্রশ্ন এসে বাসা বাঁধলো।
খু’ন গুলো কী আনিক করে যাচ্ছে? তার বড় দুই ভাই এবং শান্ত আর মেহরাব এর খু’ন হয়েছে। তার দুই চাচার ঘরের কোনো ভাই বা ভাইয়ের ছেলের খু’ন হয় নি। আতিকার অন্তর কেঁপে উঠে। তাহলে কী আনিক এসব করে যাচ্ছে? কিন্তু মেহরাবকে কেন মা’রবে আনিক? আতিকা আর কিছু ভাবতে পারছেন না। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না উনার। চিৎকার করে কান্না করলে একটু ভালো লাগতো। কিন্তু সেটাও পারবেন না।
উনি এই সাত ভাইকেও সন্দেহ করতে পারছেন না। ওরা তো চুপচাপ শুধু বাঁচতে চেয়েছিল। আইনের হাতের দিকে ওরাও তাকিয়ে আছে এখনো। তাহলে তিনি সন্দেহ কাকে করবেন।
আদিব বা তার ভাইগুলো আতিকার আসল পরিচয় জানে। আতিকাই বলেছেন সব।
কে খু’নি। সেটা আতিকা জানতে চান। কেন একজন নির্দোষ মানুষকে খু’ন করা হল। এই প্রশ্ন তিনি করবেন।
আর খু’ন গুলো যদি তার সন্তান করে থাকে। তাহলে মেহরাবের খু’ন করার জন্য তিনি তার সন্তানেরও ফা’সি চাইবেন। নির্দোষ মানুষকে কেন সে খু’ন করবে।

চৌধুরী বাড়ির কেউ এখন আর একা কোথাও বের হয় না। তাদের ভালো থাকা কেউ কেড়ে নিয়েছে। একের পর একজনকে খু’ন করে যাচ্ছে কেউ। কে করছে এসব, তারা কেউই জানে না। কার এতো সাহস হলো।
জালাল চৌধুরী চুপচাপ বসে আছেন। কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে না। নিজের দুই দুইটা ভাইকে হারিয়েছেন, হারিয়েছেন ভাইয়ের দুই ছেলেকে। কিছু করতে চাচ্ছেন। এভাবে চুপ থাকলে হয়তো আরো কাউকে হারাতে হবে।
জালাল চৌধুরী বুঝে উঠতে পারছেন না, এই খু’ন গুলো কে বা কারা করে যাচ্ছে। পুলিশ তো আদিবের পরিবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ ওরা ছাড়া আর কে হতে পারে খু’নি?
উত্তর তিনি কোনো ভাবেই পাচ্ছেন না। তাদের পরিবারের মানুষ এর উপর নজর দেওয়ার সাহস কে পেলো। সেটা তিনি দেখতে চান।

আদিব বসে আছে একটি রুমে। হাতে চায়ের কাপ। একদিকে তার মন খুব ভালো। তিন তিনটে মানুষ খু’ন হয়েছে। নিজের পরিবারের খু’নিদের খু’ন হচ্ছে৷ এতে তো ভালো লাগবেই। কিন্তু মনটা ভালো নেই। সেই খু’নের আসামী হিসেবে তাদেরকেই ওরা ফাঁসিয়ে দিয়েছে। সবাইকে কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে সুখটা অনেক পূর্বেই কেড়ে নিয়েছিল। আজ ওরা তাদের বাসস্থানটাও কেড়ে নিয়েছে। থাকতে হচ্ছে লুকিয়ে৷ সাতটা ভাই আজ সাত জায়গায়, কেউ কারো সাথে সাক্ষাৎ নাই। অপরাধ না করেও আজ তারা অপরাধী।
আরো একটি খু’ন হয়েছে আদিব।
কথাটি শুনে আদিব তাকায়, কথাটি তার বন্ধু মিসবাহ উদ্দিন বলেছেন। মাত্রই অফিস থেকে এসেছে সে।
আদিব চায়ের কাপ হাত থেকে রাখতে রাখতে বলল,
কে খু’ন হয়েছে?
মেরহাব চৌধুরী। একই ব্যক্তি খু’ন করেছে, একই ভাবে।
ওহ! শুনেছিলাম মেহরাব চৌধুরী মানুষটি ভালো। ওরা আমাদের ফাঁসাতে একের পর এক খু’ন কেন করে যাচ্ছে?
প্রশ্নে মিসবাহ চুপ। সে কীভাবে জানবে এসব।
আদিব চুপচাপ বসে আছে। একের পর একজনকে খু’ন করা হচ্ছে। কিন্তু কে করছে তা কেউ জানে না।
আদিব এভাবে লুকিয়ে থাকতে পারছে না। কোনো দোষ না করে কেন এভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে। এই পালিয়ে থাকা মানে তো পুলিশের কাছে অপরাধী হওয়া। কিন্তু এছাড়া তো উপায়ও দেখছে না। ওদের খু’ন এর দায় তাদের উপর চাপিয়ে তাদেরকে জেলে থাকতে হবে। আদিব কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার কী করা উচিত, সে জানে না।

আতিকা চায়ের কাপ হাতে নাওশিনের পাশে বসেন। এক কাপ চা নাওশিনের হাতে তুলে দিলেন।
নাওশিন চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

আপা আপনার চোখ লাল কেন?

আতিকা চুপ থাকেন। নাওশিন আবারও একই প্রশ্ন করল। এবারও উনি চুপ। তৃতীয় বার আর নাওশিন প্রশ্ন করেনি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে একের পর এক।
আতিকা বললেন,

বাসা থেকে পালিয়ে আসলি। আর বাসায় যাবি না?

নাওশিন বলল,
হ্যাঁ যাবো তো। তবে নিজেকে শক্তিশালী করে।
নাওশিনের কথায় কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু চুপ থাকেন তিনি।
আপা আপনি বাসায় একাই থাকেন সব সময়?
উনি শুধু বললেন,
হ্যাঁ তিন বছর ধরে একা থাকি।
নাওশিন জানতে চায়, কেন একা থাকেন তিনি। নাওশিনের আবদারে উনি এক এক করে সব বলে দিলেন।
নাওশিন দীর্ঘ সময় নিয়ে চুপ থেকে সব শুনে খুব অবাক হয়। উনি চৌধুরী পরিবারের মেয়ে। তার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কীভাবে পারলো এই নিষ্ঠুর কাজ করতে। নিজের পরিবারের মেয়ের স্বামীকেও রেহাই দিলো না ওরা।
আতিকা নীরবে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছেন। নাওশিন বুঝতে পেরেছিল, উনারও কোনো কষ্টের দিন আছে, যা উনাকে ভিতরে ভিতরে কষ্ট দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
উনার চোখ লাল থাকার কারণ বুঝতে পারে। তারও কষ্ট হচ্ছে একজন ভালো মানুষকে কেন কেউ খু’ন করল। নাওশিন পরক্ষণেই ভাবলো, প্রতিশোধ কী ভালো খা’রাপ বুঝে।
সে ভাবতো পৃথিবীতে তার থেকে কষ্টে হয়তো আর কোনো মানুষ নেই। কিন্তু তার ভাবনা ভুল, সেটা প্রতিটা মুহূর্তে বুঝতে পারছে।
চার দেয়ালে বন্দী থাকলে হয়তো এটাই সারাক্ষণ ভাবতো৷ সেই হয়তো সবচে দুঃখী।
তোমার মন খা’রাপ, মানুষের সাথে মিশে যাও। বুঝতে পারবে তোমার মন খা’রাপের কারণটা তুচ্ছ।
তুমি রিকশায় বসে আছো। সামনে থাকা চালকের সাথে কথা বল। তার পা ব্যথা উঠেছে ঠিকই, তোমাকে নিয়ে যেতে তার কষ্ট হচ্ছে, তবুও ক্লান্ত শরীরে হাসি মুখে তোমার সাথে কথা বলবে।
মন ভালো করার জন্য তোমাকে প্রথমে লড়াই করতে হবে৷ চুপসে বসে থাকলে কোনো কিছুই তুমি পাবে না।
নাওশিন বুঝতে পেরেছে তার থেকে হাজার কষ্টেও মানুষ বেঁচে আছে। এই পৃথিবীতে কষ্ট ছাড়া এমন কোনো মানুষ আছে বলে তার জানা নেই।

চৌধুরী পরিবারের খু’ন গুলো খুব নিখুঁত ভাবে হচ্ছে। কোনো একটি প্রমাণ পাচ্ছে না। কে করছে এসব তার কিছুই জানতে পারছে না কেউ।
জালাল চৌধুরী বাড়ির গেইট খোলা দেখে খুব অবাক হন। রাত ৮টায় কে গেইট খুলল? নাকি খোলাই ছিল?
কারো তো বাহিরে যাওয়ার কথা না। সবাই ভিতরে ভয় পেয়ে বসে আছে। নিজের বড় ভাইদের বুঝালো সে, কিন্তু সবাই কেমন ভয়ের মধ্যে আছে। চৌধুরী পরিবারে এই ভয়? জালাল চৌধুরী কোনোভাবেই আশা করেন নি। বাড়ির গেইটে তালা দিয়ে আসেন তিনি।
এতো বড় বাড়ি, এতো এতো মানুষ। কিন্তু চারটা মানুষকে কেউ মে’রে ফেলতেই সবাই চুপ। সবার বাঘের মতো গর্জন কী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে?
জালাল চৌধুরী এসবের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।

রাত ১১টা। হামিদুর রহমান নিজের চার বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে খেলা করছিলেন। ব্যস্ততার পর মেয়ের স্পর্শ পেলে তিনি সব ক্লান্তি ভুলে যান। উনার সুখ যেন উনার স্ত্রী আর দুই বাচ্চাকে ঘিরে।
তিনি খেলার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটার চুলে হালকা টান দিচ্ছেন, মেয়েটাও এতে চিৎকার করে হেসে দিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, এই টান আদরের, ভালোবাসার।
হামিদুর রহমান যখন নিজের মেয়েকে নিয়ে খুব ব্যস্ত তখনই কেউ দরজায় শব্দ করে।
হামিদুর রহমান একটু অবাক হলেন, এতো রাতে কে আসলো আবার?
মেয়েকে কোলে করে নিয়েই দরজা খুললেন। সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে খুব অবাক হলেন, এবং মনের মধ্যে ভয়ও ঢুকে। শুধু প্রশ্ন করলেন তিনি,
তুমি?

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-০৮

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(৮)
লেখক: হানিফ আহমেদ

আদিবদের বাসায় তালা ঝুলানো দেখে পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান খুব অবাক হন। এতোটাই অবাক হয়েছেন যে তার মনে হচ্ছে তিনি চোখের সামনে বিশেষ কিছু দেখেছেন। তবে তিনি তো তাদের পালাতেই একটি পথ দিয়েছিলেন, কিন্তু এরা এতো তাড়াতাড়ি যে পালাবে সেটা কখনো ভাবেন নি। এখন মনে হচ্ছে তিনি কোনো ভুল করেছেন, খুব বড় ভুল করেছেন সেদিন পালানোর পথ করে দিয়ে। তাহলে কী চৌধুরী পরিবারের খু’নের সাথে ওরা জড়িত? নির্দোষ হলে তো ওদের পালানোর কথা না। হামিদুর রহমান এবার খুব মন খারাপ করলেন, তিনি কী সৎ পথে থাকতে পেরেছেন? কিন্তু তিনি যে সেদিন নিয়াজ কে ইচ্ছে করেই সাথে করে নিয়ে যান নি। তাহলে কী তিনি সৎ পথে নেই? মুহূর্তেই চোখজোড়া ভিজে যায় তার।

নাওশিন বসে আছে আর ভাবছে। কী হচ্ছে এসব? সকালে উঠে আতিকা বেগমকে ছাড়া কাউকেই বাসায় পায়নি নাওশিন। সকালের আলো ফোটার পূর্বেই ওরা ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় লুকানোর প্রস্তুত নিয়ে নিজেদের ঠিক করা গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছে।
ওদেরও কী তার মতো অবস্থা হলো। বাসস্থান ছেড়ে আজ শুধুই পালিয়ে বেঁচে থাকার শতো চেষ্টা৷ নাওশিন দীর্ঘশ্বাস নেয়। একটি কথা তার খুব মনে পরছে আজ। এক গভীর রাতে সে আ’ত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। বন্ধ দরজার ভিতর সে যা কিছুই করুক না কেন, কেউ জানবেই না। নাওশিন সব ধরণের প্রস্তুত নিয়েছিল সেই রাতে। তার চোখজোড়া বারবার ভিজে যাচ্ছিল। তার বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বারবার বেড়েই যাচ্ছিল। তবুও সব ভাবনার শেষে তার মন তাকে বলত, আ’ত্মহত্যা কর নাওশিন।
মনের সাথে বোঝাপড়া করে যখন বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল, তবুও তার মনে হচ্ছিল আ’ত্মহত্যা করলেই বুঝি সে বেঁচে যাবে। কিন্তু মনের মধ্যে একটি প্রশ্ন উঁকি দিতো তার, ম’রে যাওয়ার মাধ্যমে কীভাবে বাঁচবে সে। এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া কী ভালো হবে তার। তখন তার বয়স ১৫বছর ছিলো।
আ’ত্মহত্যার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত একজন মানুষ বাঁচতে চায়। বেঁচে থাকার জন্য নিজের মনের সাথে লড়াই করে। মন যখন অবুঝ হয়ে যায়, তখন সেই মনের বিরুদ্ধে যেতে পারলেই একজন মানুষ বেঁচে যায়। নাওশিনও সেদিন শতো চেষ্টা করার পর মাথা থেকে আ’ত্মহত্যা এর চিন্তা মাথা থেকে নামাতে পারে। একটি কথাই বারবার মনে এনেছিল সেদিন, আমি নিজের ক্ষতি নিজে করবো না।
মানুষ কতো কষ্ট পাওয়ার পরেও বেঁচে থাকার যু’দ্ধ করে যাচ্ছে, সেটা আজ সে নিজের চোখে দেখতে পারছে।
ওই মানুষগুলো, যারা আ’ত্মহত্যা করে। তারা যদি নিজের সাথে যু’দ্ধ করে ওই চিন্তার মুহূর্ত জয় করে নিতে পারে, তাহলে সে বুঝতে পারতো। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য কতো কষ্ট করে। কিন্তু হায়! মানুষের আজ সেই ধৈর্য নাই।
আমি ভালো নেই। আমার কেউ নাই। আমি অসহায়। আমার খুব কষ্ট। আমি ম’রে যেতে চাই।
এই বাক্যগুলোই আ’ত্মহত্যার হাতিয়ার।
একবার মনকে জয় করে বেঁচেই দেখো না। তোমার থেকে কতো কষ্টে মানুষ বেঁচে থাকে।
সুখ কখনো আসবে, এই কথার উপর বিশ্বাস রেখেই প্রতিটা মানুষ বাঁচে৷

চৌধুরী পরিবারের তিনটি মানুষের খু’ন হয়। পরিবারটা আজ ভালো নেই। তারা এক সময় যে মৃ’ত্যুর খেলা মানুষের সাথে শুরু করেছিল। আজ তাদের উপর কেউ শুরু করেছে সেই কঠিন খেলা।
আজ শিহাব চৌধুরীর মৃ’ত্যুর চারদিন হয়েছে। রামিনা বেগম চুপচাপ বসে থাকেন।
বাবার মৃ’ত্যু কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না রামিনার তিন ছেলে।
শিহাব চৌধুরীর বড় ছেলে, সে একজন সরকারি কলেজের শিক্ষক। তার নাম মেহরাব চৌধুরী। ছোট দুই ভাইকে বুকে টেনে নিয়ে বুঝাচ্ছে কান্না না করতে। কিন্তু তার চোখও বারবার ভিজে আসছিল। এই খা’রাপ মানুষটির প্রথম পরিচয় হল তাদের কাছে, উনি তাদের জন্মদাতা পিতা। আর প্রতি বাবা একজন ভালো মানুষ।
মেহরাব চৌধুরী নরম কণ্ঠে নিজের সব চাচা এবং চাচাতো ভাইদের উদ্দেশ্যে বলল,
তোমাদের কী এখন শিক্ষা হওয়া উচিত না? তিন তিনটে মানুষকে কেউ খু’ন করেছে। তোমাদের কী মনে হয় না, তোমরা যাদের উপর অ’ত্যাচার করেছো। তাদের মধ্যে কেউ একজন হলেও তো প্রতিশোধ নিতে চাইবে। হয়তো প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হয়, তোমরা এখনও সেই গান গেয়ে যাচ্ছো। র’ক্তের বদলে র’ক্ত। এখন তো একটু শিক্ষা পাওয়ার কথা তোমাদের।

মেহরাব চৌধুরীকে জালাল চৌধুরী ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
তুই চুপ কর। তুই কী মনে করিস তুই একাই শিক্ষিত হয়েছিস। আমরা সেই সময়ে এসএসসি পাস করেছি। যখন সারা গ্রাম খুঁজে অল্প কিছু মানুষই শিক্ষিত ছিলো। আমাদের পরিবারের একের পর একজন মানুষকে ওরা মে’রে যাচ্ছে। আমরা কেন চুপ থাকবো। সেই পুরোনো রূপে ফিরবো। বদলা নিবো। চুপ করে থাকার মানুষ এই চৌধুরী পরিবার না।

মেহরাব দীর্ঘশ্বাস নেয়৷ ওরা যেন সেই কয়েকশো বছর পূর্বেই রয়ে গিয়েছে। তার বলতে খুব ইচ্ছে করে। একের পর এক মানুষের উপর তো সারা জীবন অ’ত্যাচার করেই গিয়েছো৷ আজ তার ফল পাচ্ছো। অ’ত্যাচার খেয়ে বেঁচে থাকা মানুষ হয়তো আজ খুব শক্তি নিয়ে ফিরেছে। হয়তো তারা নিজের প্রিয়জনদের বদলা নিচ্ছে। কিন্তু মেরহাব কিছু বলল না। এই মানুষগুলোকে সে বুঝাতে পারবে না। ক্লাসে যেমন এক ধমকে সবাইকে শান্ত করে ফেলতে পারে। কিন্তু এই মানুষগুলোকে লক্ষকোটি ধমক দিলেও ওরা শুনবে না।

মানুষ মানুষের জন্য। প্রিয় মানুষেরা অনেক সময় দূরে সরে যায়। অচেনা কেউ তখন খুব আপন হয়ে উঠে।
নাওশিনের মা যেখানে তাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছে। সেখানে অচেনা কিছু মানুষ তার খুব আপন হয়েছে। এটাই হয়তো পৃথিবীর নিয়ম। পৃথিবী তার গতিতে চলে। চলন্ত গাড়ি যেমন সামনে থাকা মানুষ কিংবা গাড়িকে আ’ঘাত করে, তেমনি পৃথিবীও আ’ঘাত করে।
নাওশিন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। কে খু’ন গুলো করছে। কিন্তু উত্তর পাচ্ছে না সে। তার মামাকে কে মে’রেছে, এখনই বা কারা ওদের মারছে। কোনো উত্তর সে পাচ্ছে না। নাওশিন আজ এই ৭ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। সবাই একেক জায়গায়। সময় কতো তাড়াতাড়িই না পরিবর্তন হয়ে যায়৷
কিন্তু খু’ন গুলো কে করছে? এই ৭ভাইয়ের মধ্যে কী কেউ? নাওশিন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তিনজন মানুষের খু’ন হয়েছে, কে এই খু’নের খেলায় মেতেছে।
নাওশিন আতিকা বেগমের কাছে যায়। একা থাকলে তার মাথাতে এসবই ঘুরবে শুধু। তার থেকে কারো সঙ্গে থাকলে অন্তত এইসব চিন্তা মাথা থেকে যাবে।
আপা কী করছেন?
আতিকা কিছু একটা ভাবছিলেন, নাওশিনের প্রশ্নে তার দিকে ফিরে তাকান।
এইতো বসে আছি। তোর বুঝি ভালো লাগছে না একা একা?
নাওশিন বলল,
এতো বছর তো একা থেকেছি। কিন্তু এখন লোকালয়ে এসে একা থাকতে ভুলে গিয়েছি আপা।
আতিকা এক গাল হেসে বললেন,
আমার হয়েছে একবারে উলটো রে নাওশিন। লোকালয় থেকে আমি আলাদা। মানুষের ভীড়ে নিজেকে খুবই একা মনে হয়। এই যে আমি তোর সাথে গল্প করছি। তবুও আমাকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে। মনে হয় একাই আমি ভালো থাকা শিখে যাচ্ছি।
নাওশিন উনার কথায় কেমন অনেক হাজারো লুকানো কথার খোঁজ পায়। তাই প্রশ্ন করল,
কেন আপা?
কিন্তু উনি উত্তর দিলেন না৷ শুধু বললেন,
আমার মাথার চুলগুলো টেনে দিবি।
নাওশিন অবাক হলো, উনি কিছু লোকাচ্ছেন।
নাওশিন আর কিছু বলল না। শুধু এটা বুঝল,
মানুষ যতোটা স্বাভাবিক দেখাতে চায় নিজেকে, আসলে মানুষ ততোটা স্বাভাবিক না। প্রতিটা মানুষের নিজস্ব একেকটি উপন্যাস আছে, আছে লুকায়িত গল্প৷ কিছু কষ্টের কবিতা, ছন্দগুলো শুধুই লুকানো চোখের পানি। তবুও মানুষ হাসে, হাসলেই যে মানুষ ভাবে সে খুব সুখী।

দুনিয়া কতোটা কঠিন, সেটা হয়তো মৃ’ত্যুর পূর্বে কোনো মানুষ আন্দাজ করতে পারে। আর সেই মৃ’ত্যু যদি হয় অস্বাভাবিক, তাহলে সত্যিই কষ্টটা দিগুণ।
মেরহাব চৌধুরী, গোবরে ফোটা এক গোলাপ৷ কলেজ থেকে ৭দিনের ছুটি নিয়ে এসেছিল। আজ তার ছুটি শেষ হয়েছে৷ মা এবং দুই ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়েছে৷ মা রামিনা বেগমকে বুকের সাথে মিশিয়ে কথা দিয়েছে সে, বিয়েটা এবার করেই নিবে। নিজের ছোট দুই ভাই রাহাত চৌধুরী এবং রায়হান চৌধুরী বারবার বলেছে ভাইয়া আমরা তোমার সাথে আসি। তোমাকে গাড়ি পর্যন্ত তুলে দিবো।
মেরহাব দুই ভাইকে বুকে জড়িয়ে বলছে শুধু।
মাকে দেখে রাখ তোরা৷ একা কোথাও বের হবি না। আমার চাচারা এবং চাচাতো ভাইদের মতো খা’রাপ পথে যাবি না। আর দুই মিনিটের রাস্তা, আমি একাই পারবো। আর মাত্র তো সকাল ১০টা। দুই মিনিটের রাস্তা না হয় এক মিনিটে হেটে যাবো।

মেরহাব চোখের পানি ফেলে সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। মুখোশ পরা, কোনো ভাবেই চিনতে পারছে না সে মানুষটিকে। মনে মনে বারবার কালেমা পড়ে নিচ্ছে। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে।
তুমি যেই হও না কেন, আমি নির্দোষ। আমাকে ছেড়ে দাও। আমার মা সহ্য করতে পারবে না আমার মৃত্যুর সংবাদ শুনলে। আমাকে ছেড়ে দাও। আমি বাঁচতে চাই। আমি আগামী প্রজন্মকে মানুষ গড়ার দায়িত্ব নিয়েছি। আমাকে খু’ন করো না, একটি প্রজন্মের শিক্ষককে তুমি খু’ন করবে তাহলে।
কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে যায়। কারণ তার মুখ বাঁধা।
পরিবারের শত্রুতা তাকেও আজ কেড়ে নিচ্ছে। প্রতিশোধ নেওয়া মানুষটি হয়তো ভালো খা’রাপ চিনে না। সে চিনে এই পরিবারের সবাই দোষী৷
মেরহাব নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো ভাবেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। সে তো কিছু করেনি। তাহলে তাকে কেন প্রতিশোধ এর আগুনে পুড়তে হবে।
মেরহাব চোখ বন্ধ করে আছে। তাকাতে পারছে না। তার দুই চোখে নিজের মা আর অনার্সে পড়া দুই ভাইয়ের মুখটিই ভাসছে। সাথে আরো একটি চোখজোড়া ভাসছে। আর সেই চোখজোড়া হলো সামনে থাকা মুখোশ পরা মানুষটি। তার মনে হচ্ছে সে চিনে, চোখজোড়া তার কতোই না চেনা।
মনে হলো তার শরীর থেকে কেউ ডান হাতটি আলাদা করে দিয়েছে৷ হ্যাঁ চোখ মেলে তাই দেখলো সে। কিন্তু তার চটপট করার কোনো উপায় নাই। চিৎকার করার শক্তি নাই। নাই প্রতিরোধ করার।
সে ব্যথা সহ্য করতে পারছে না। তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমার হয়ে আমার সব চাচা সহ চাচাতো ভাইকে বুঝাবো। আমি আগামী প্রজন্মকে ছেড়ে নিজের বাড়ির সবাইকে ভালো করার দায়িত্ব নিবো। ওদের কাজের জন্য কেন আমি ম’রব।
মুখোশ পরা মানুষটি মুখোশ খুলেন মেরহাব অনুভব করে তার শরীরের চারটি অঙ্গ নাই। ঠিক সেই পূর্বের তিনজনের মতোই তাকে খু’ন করা হচ্ছে।
চোখের সামনের মানুষটিকে দেখে আকাশটা ভেঙে যেন তার মাথায় পড়ে। কিন্তু এখন তাকে মৃ’ত্যুর স্বাদ নিতে হবে।
বুক ক্ষ’তবিক্ষত করে মৃ’ত্যু নিশ্চিত করে মানুষটি।
মেরহাব নিজের মৃ’ত্যুর পূর্বে সে খু’নীকে চিনেছে। কিন্তু সাক্ষী দেওয়ার জন্য সে আর আজ পৃথিবীতে বেঁচে নেই।

একের পর এক লা’শ, এই দৃশ্য দেখে পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান বারবার কেঁপে উঠছেন৷ চোখজোড়া ভিজে যাচ্ছে৷
বিকেল ৫টায় মেরহাবের লা’শ পাওয়া যায় তাদেরই বাড়ি থেকে ৫কিলোমিটার দূরে। হামিদুর রহমান খুব অবাক হয়েছেন। কীভাবে সম্ভব, রাস্তা দিয়ে কতো মানুষই তো হেটে যাচ্ছেম গাড়ির পর গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কেন খু’ন হতে দেখছে না। কে করছে এসব? নিয়াজের পরিবার? কিন্তু ওরা তো পালিয়ে আছে? কে মেতেছে এই কঠিন খেলায়?
বাসার আশেপাশের সবার আজ চোখে পানি। এই প্রথম চৌধুরী বাড়ির কারো মৃ’ত্যুতে সবার অন্তর কাঁদে। একজন ভালো মানুষকে হারিয়েছে তারা। একটি অহংকারে ভরা পরিবারের মধ্যে মেরহাব যেন ছিলো একটি গোলাপ। যার ঘ্রাণে সবাই মুগ্ধ ছিলো।
রামিনা বেগম এর চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছে। স্বামীর পর বড় সন্তানকে হারিয়েছেন। পেটের সন্তান না হলেও মেরহাবকে নিজের দুই সন্তানের মতো বড় করেছেন। তিনি সহ্য করতে পারছেন না। এইসবের জন্য তারই পরিবার দায়ী। কোন মানুষ প্রতিশোধ নিচ্ছে, সেই প্রতিশোধ ভালো মানুষটিকেই কেড়ে নিলো তার থেকে।
দুই ভাই চিৎকার করে কাঁদছে। কী দোষ ছিলো তাদের ভাইয়ের? শুধুই কী এই চৌধুরী পরিবারের ছেলে বলে তাকেও মৃ’ত্যুর স্বাদ নিতে হল।
রামিনা বেগম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো আজ সব স্মৃতি উনাকে গিলে খাচ্ছে। স্বজন হারানোর ব্যথা সহ্য করার ক্ষমরা খুঁজতে ব্যস্ত হতে চাচ্ছেন ওই নীল আকাশের বুকে।

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-০৭

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(৭)
লেখক: হানিফ আহমেদ

চৌধুরী পরিবারে আরো একটি খু’ন। মানিক চৌধুরী এর পর তার বড় ছেলে শান্ত চৌধুরীকে ঠিক একই ভাবে মা’রা হয়েছে। চৌধুরী বাড়িতে শুধু কান্নার শব্দই শুনতে পাচ্ছে মানুষ। বিশাল বড় চৌধুরী বাড়ি। ইট পাথরের শহরে চৌধুরী বাড়িটি যেন একটুকরো গ্রাম। চার দিকে দেয়াল ফেরানো। আর সেই দেয়ালের ভিতর অনেকগুলো বড় বড় ঘর, আছে তিনটি বিশাল পুকুর। মুহিত চৌধুরী, মুহিব চৌধুরী এবং মুকিত চৌধুরী তিন ভাইয়ের মোট ১৪ছেলেকে নিয়ে তাদের বিশাল একটি পরিবার। সেই ১৪ছেলে থেকে এখন চৌধুরী পরিবারটি অনেক অনেক বড় হয়েছে।
মুহিত এবং মুহিব চৌধুরীর ফাঁ’সি হয়েছিল ২০০১ সালে। মুকিত চৌধুরী এখনও বেঁচে আছেন। কথা বলতে পারেন না, বয়স নব্বই এর উপর৷ দুই চোখ মেলে শুধু তাকিয়েই থাকতে পারেন। এর বেশি কিছু তিনি পারেন না। অথচ এই মুকিত চৌধুরী এক সময় নিজের বড় দুই ভাইয়ের সাথে মিলে কেড়ে নিয়েছেন কতো মানুষের জমি, কেড়েছেন কতো মায়ের সন্তান, কতো নারীর স্বামীকে রাতের অন্ধকারে মে’রে গাছে ঝুলিয়েছেন।
৩জনের ১৪সন্তান। রাজত্ব যেন তাদেরই ছিলো। কেউ প্রতিবাদ করতে চাইলেই বলতো, আমাদের ১৪টি লাঠি আছে। ওদের উপর কেউ কোনো কথা বলতে পারতো না। তিন ভাই এবং নিজেদের সন্তানদের নিয়ে অ’ত্যাচার চালাতো মানুষগুলোর উপর। জোর করে মানুষের জমি দখল থেকে শুরু করে সব ধরণের খা’রাপ কাজই করতো।
আজ সেই পরিবারেই একের পর এক খু’ন হচ্ছে।
সাধারণ মানুষগুলোর অন্তর এতে একটুও আহত হয় নি। তারা যেন এক ভিন্ন সুখ পাচ্ছে। তাদের অন্তর কাঁদতো আজ, যদি কোনো ভালো মানুষকে খু’ন করা হতো৷
শিহাব চৌধুরী রেগে গর্জে উঠেছেন। সে এর শেষ দেখতে চায়। কে তার বড় ভাই এবং ভাতিজাকে খু’ন করেছে তাকে সে নিজের চোখের সামনে চায়। চৌধুরী পরিবারের দুই দুইটা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কার এতো সাহস সে দেখতে চায়।
পুলিশ অফিসারের সামনে চিৎকার করে বলে যাচ্ছে শিহাব চৌধুরী,
আপনারা চুপ করে আছেন কেন? ধরছেন না কেন ওই খু’নীদের৷ আমার ভাইয়ের পর আমার ভাতিজাকে ওরা খু’ন করেছে৷ আপনারা চুপ করে আছেন?
পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান শুধু বললেন,
এই খু’নও কী ওরাই করেছে?
শিহাব চৌধুরী এবার আরো বেশি রেগে যান। চিৎকার করে বলে উঠলেন।
আপনারা যদি ওদের জেলে ভরতে না পারেন। তাহলে আমরা তাদের কবরে পাঠাতে বাধ্য হবো। খু’নের বদলে খু’ন।
হামিদুর রহমান এবার কঠিন গলায় বললেন,
চুপ থাকুন। দোষীদের জন্য আইন আছে। আইনের কাজ আইনের মানুষ করবে।
হামিদুর রহমান চলে যান। এসেছিলেন এদের বক্তব্য শুনতে।
শিহাব চৌধুরী রেগে লাল হয়ে আছেন। তার শরীর কাঁপছে বেশি রেগে যাওয়ার কারণে। চিৎকার করে বললেন,
চুপ থাকলে চলবে না। নিজেদের তৈরি রাখো। জ্বলে উঠতে হবে, ভেঙে দিতে হবে সেই হাত, যেই হাত কেড়ে নিয়েছে আমার ভাই এবং ভাতিজাকে। কার এতো সাহস। চৌধুরী পরিবারের মানুষ খু’ন করেছে।
এই বলে ৬২বছর বয়সী শিহাব চৌধুরী বেরিয়ে যান। তার র’ক্ত এখন খুব গরম। এভাবে চুপ থাকতে পারবে না। এই শহরে কার এতো সাহস বেড়েছে যে চৌধুরী পরিবারের দিকে চোখ তুলেছে, তার তা দেখতে হবে।
শিহাবকে পিছন ডাকলেন রামিনা, কিন্তু শিহাব পিছন ফিরে তাকান নি। রামিনা হলো শিহাব চৌধুরীর দ্বিতীয় বউ। প্রথম বউয়ের মৃ’ত্যুর পরেই রামিনাকে বিয়ে করেন তিনি।
রামিনা চিৎকার করে বললেন,
তোমরা কেউ আটকাও আমার স্বামীকে। এই বয়সে এতো রেগে যাওয়া উনার শরীরের জন্য ভালো না।
রামিনার কথার উত্তরে জালাল চৌধুরী বললেন,
ভাবি, ভাইয়াকে আটকানোর প্রয়োজন নাই। বিপরীত হতে পারে। এমনিই কারো মন ভালো নেই। ভাইয়াও একটু পর দেখবেন চলে আসবেন রাগ কমে যাওয়ার পর।

বিকেল ৪টা, শহরে ধুলোবালি মাখা বাতাস। মানুষের ক্লান্ত শরীরে বাতাসের সাথে ধুলোবালিও লাগছে।
ক্লান্ত মানুষ নিজেদের গন্তব্যে ফিরতে ব্যস্ত। শহর এখন খুবই ব্যস্ত৷ কতো রঙের মানুষ এই শহরে, কেউ কারো দিকে চোখ তুলেও থাকায় না। কারো কারো হাত নিজেদের পকেটে, কখন যে পকেট কাটা পরে। সেই চিন্তাই মানুষের মনে।
শহর যখন খুব ব্যস্ত নিজের বুকে থাকা মানুষ নিয়ে। তখনই কেউ একজন ব্যস্ত নিজের কাজে। তার খুব পিপাসা, তা মেটাতেই সে খুব ব্যস্ত।
বেঁধে রাখা মানুষটির সামনে বসে আছে সে।
এইতো দিনটা হাসো হাসো করছে। আকাশটা লাল হয়ে আসছে, ঘড়ির কাটা এখনো চারটাতেই রয়েছে।
বেঁধে থাকা মানুষটি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখটাও তার বাঁধা। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধুই সাদা মেঘের আকাশ দেখতে পারছে। এই সাদা মেঘের আকাশ তাকে কিছু মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তার সামনে এখন মৃ’ত্যু দাঁড়িয়ে আছে, তার কী ঠিক হবে অতীতে যাওয়া?
তার অন্তর কাঁপছে। পারছে না কোনো ভাবে বিশ্বাস করতে, একটু পর সে এই পৃথিবীতে থাকবে না। আবারও আকাশের দিকে তাকায়, নীল আকাশটা সাদা মেঘে ঢেকে রেখেছে। এই যেন সাদা মেঘের আকাশ।
বেঁধে থাকা মানুষটি আকাশ দেখছে আর নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার শতো চেষ্টা করছে।

তোদের বংশটি একবারেই শেষ করতে পারিনি, একজনকে নিয়ে খালেদ পালিয়ে গেল। তোদের ওই একজন হলো আকাশে থাকা সাদা মেঘ। আকাশে ভেসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই যেমন ওই সাদা মেঘের, তেমনি তার আকাশ হবে সাদা মেঘের আকাশ।
এই বলে শরীর থেকে একের পর এক মাথা আলাদা করছিল সবাই মিলে।

বেঁধে থাকা মানুষটি এসব ভাবতেই কেঁপে উঠে। আজ তো এই নীল আকাশটি সাদা মেঘে ঢাকা।
কে ওই মুখোশ পরা মানুষটি? কে হতে পারে?
পিছনে হাত দুটো বাঁধা তার। মুখটাও আজ তার বন্ধ। কোনো ভাবেই শব্দ করতে পারছে না।
এবার মুখোশ খুলে মানুষটি।
মুখোশের ভিতরে থাকা মানুষটির মুখ দেখে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে। হয়তো প্রশ্ন করার, চিৎকার করার শত চেষ্টা করছে, কিন্তু আজ সে নিরুপায়।
হিং’স্র রুপে প্রথমেই দুই পা কাটতে ব্যস্ত হয়ে পরে মানুষটি।
দুই পা দুই হাত কাটার পর বুকটি ক্ষ’তবিক্ষত করে মৃ’ত্যু নিশ্চিত করে।
হাসি মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিদায় নেয় পিপাসা মিটিয়ে।

সন্ধ্যা হয়েছে। নাওশিন বসে আছে জাহেদ এবং সামিনের সামনে। সে ভাবছে হয়তো ওরা তাকে দেখতে আসছে। সে বসে আছে আতিকার পাশে। এই বাসায় আতিকা একাই থাকেন, উনার এক ছেলে ছিল। কিন্তু সে বাড়ি ছেড়েছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।
দরজার শব্দ হয়।
আতিকা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কে জিজ্ঞেস করেন, দরজার ওপাশ থেকে উত্তর আসলো,
আমি আদিব আপা।
দরজা খুললেন তিনি। আদিব এসে জাহেদ এবং সামিনকে দেখতে পেয়ে ওদের পাশে বসে।
এক এক করে মিফতা, রবিনও আসে। মিফতা বসতে বসতে বলল,

সিএনজিতে শুনলাম মানিক চৌধুরীর বড় ছেলে শান্ত চৌধুরীকেও কেউ খু’ন করেছে।

মিফতার কথায় আতিকা বলে উঠলেন,
মিফতা আস্তে কথা বল।
কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই চুপ
নাওশিন বুঝতে পারছে না ওরা সবাই কেন এখানে এসেছে। সে আর চুপ করে থাকতে পারছে না। কিন্তু কথাও বলতে পারছে না।
সামিন বাসায় বাজার আছে কী?
আদিবের প্রশ্নে সে বলল,
হ্যাঁ ভাইয়া কালকেই এক সপ্তাহের বাজার করেছি।
আদিব বলল,
যাক বাবা বাঁচা গেল। আমরা তো এখন আর কেউই লোকালয়ে বের হতে পারবো না।
রবিন বলল,
বলছিলাম না ওরা আমাদের ফাঁসানোর জন্য এমন করছে। দেখেছো আজ ওরা আমাদের পালিয়ে থাকতে বাধ্য করেছে।
ওরা যেন কী ভাবছে। রবিনের কথায় নাওশিন বুঝতে পারে। পুলিশ থেকে বেঁচে থাকার জন্য সবাই এখানে এসেছে। এই তিন রুমের বাসায় এতো জনের জায়গা হবে কীভাবে?

খু’নগুলো কে করছে, আর ওরা নিজের মানুষদের মে’রে কেন -ই বা আমাদের ফাঁসাবে।

মিফতার কথায় আদিব বলল,
আমাদের ভালো থাকা কেড়ে নেওয়ার জন্য এরা এতোটা উঠেপড়ে লেগেছে কেন? আমাদের পরিবারকে শেষ করেও ওদের মন ভরে নি? আমরা এতোটা চুপ থাকার পরেও এই অবস্থা।
আতিকা বেগম বললেন,
কারো ঠোঁট যেন আর না নড়ে। বস তোরা, আমি চা তৈরি করে নিয়ে আসি তোদের জন্য।
আদিবের বলতে ইচ্ছে হল, আপা চা গলা দিয়ে নামবে না।
কিন্তু কথাটি বলতে পারলো না।
আতিকা তাদের আপন কেউ না। উনার সাথে ২০০১সালে পরিচয় হয় কোর্টের বারান্দায়৷ আদিব যখন নিজের ভাইগুলোর চোখের পানি মুছে দিয়ে বোঝাচ্ছিল, খালেদ আহমেদও তাদের সাথে ছিলেন। সেই দিন আতিকা বেগম দূর থেকে দেখছিলেন সব। কাছে এসে তিনি জানতে চান কী হয়েছে। কিন্তু ওরা কান্না করছিল। খালেদ আহমেদের থেকে সব শুনি তিনি উনার বাসায় নিয়ে যান সেদিন ওদের। তারপর এভাবেই একটু একটু করে ওদের খুব আপন হয়ে যান তিনি।
খালেদ আহমেদ মাঝেমধ্যেই এই বাসায় ওদের নিয়ে আসতেন৷ ওরাও আতিকা বেগমকে খুব আপন করে নেয়।

রাত ১১টায় দরজায় আবারও শব্দ হয়। আতিকা পূর্বের মতোই একই কাজ করলেন। ওপাশ থেকে উত্তর আসে আপা আমি সাইফ।
দরজা খুলে দেন, সাইফ ভিতরে প্রবেশ করে।
নিয়াজ ছাড়া সবাই এখানেই উপস্থিত হয়। আজকের রাতটা তারা এখানেই থাকবে, কাল থেকে সবাই আলাদা আলাদা হ্যে যাবে।

সাইফ তুই কোথায় ছিলি?

মিফতার প্রশ্নে সাইফ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল,
ভাইয়া এক বন্ধুর বাসায় উঠেছিলাম, কিন্তু ওর বাবা সব শুনে বললেন পুলিশের ঝামেলা উনার মোটেই ভালো লাগে না। তারপর আমি এখানেই চলে আসি।
মিফতা আর কিছু বলল না। কতোটা অসহায় আজ ওরা। একা বাসায় নিজেদের স্ত্রী বাচ্চাদের রেখে আজ তাদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে।
নিয়াজ কোথায়?
আদিবের প্রশ্নে কেউ কিছু বলল না। তবে আতিকা বললেন,
নিয়াজ সকালেই ফোন করেছিল। শান্ত চৌধুরীর খু’নের কথা সে আমায় বলল। আর বলল সে তার এক বন্ধুর বাসায় উঠেছে।
কেউ আর কোনো কথা বলল না। রাত আস্তে আস্তে গভীর হচ্ছে। নাওশিন আতিকার রুমে শুয়ে আছে। তাকে কঠিন গলায় বলা হয়েছে চোখ মেলে তাকানো তার নিষেধ, ঘুমাতেই হবে তাকে। এই কঠিন গলায় কথা বলা মানুষটি হলেন আতিকা।
ওদের ছয়জনকে দুই রুমে বিছানা করে দিয়ে বললেন আতিকা,
আর কারো ফিসফিস করে কথা বলার কণ্ঠটাও আমার কানে না আসে৷ সবাই ঘুমাবে। আমি জেগেই আছি।

আতিকা বেগম নাওশিনের পাশে এসে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নাওশিনের দিকে তাকালেন তিনি, কতো ছোট মেয়েটা। কিন্তু এই বয়সেই এতো কষ্ট। আদিব সেদিন ফোন দিয়ে বলল, আপা নাওশিন নামের এক মেয়েকে তোমার বাসায় রাখবো। তারপর সব বলে। তিনিও সব শুনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, ঠিক আছে।
দুনিয়াটা কতো সুন্দর, কিন্তু এই দুনিয়ার মানুষ কেন সুন্দর নয়?

সকালে শিহাব চৌধুরীর লা’শ খুঁজে পায় তার পরিবার। এর আগের দুজনের মতোই তাকে খু’ন করা হয়েছে।
রাগ করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার এক ঘন্টা পরেই সবাই তাকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরে কিন্তু তার কোনো হদিস পাওয়া যায় নি। আজ খুঁজতে খুঁজতে একটি আবর্জনায় ভরা নালার পাশেই শিহাব চৌধুরীর লা’শ পাওয়া যায়। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, একই ব্যক্তি তাকে খু’ন করেছে। শিহাব চৌধুরীর চোখ দুটো এখনো সেই ভাবেই বড় বড় রয়েছে। মৃত্যুর পূর্বে খু’নিকে দেখে যেভাবে চোখ দুটি বড় করেছিলেন।
চৌধুরী পরিবারের আরো একজনের খু’ন। বিষয়টা এবার শহরে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে।
কে করছে এসব। চৌধুরী পরিবারের সবাই এখন খুব উত্তেজিত৷ এবার তারা এর শেষ দেখতে চায়। কে মেতেছে এই খেলায়, সেটা তারা দেখতে চায়।
স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে একরকম পা’গল হয়ে গিয়েছেন রামিনা বেগম। মানুষটা যেমনই হোক, এই মানুষ তার স্বামী। এই খা’রাপ মানুষটিকে সে স্বামী রূপে গ্রহণ করেছিল। আজ সেই মানুষটিকে কেউ খু’ন করেছে। তিন যেন পা’গল হয়ে গিয়েছেন।
শিহাব চৌধুরীর দুই স্ত্রীর ঘরে ৩ছেলে আছে। ওরা খুবই ভালো, কারণ রামিনা বেগম তাদের মা। কোনো ভালো মায়ের সন্তান কখনো খা’রাপ হয় না। শিহাব চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী যখন মা’রা যান, তখন শিহাব চৌধুরীর ১বছরের এক বাচ্চা ছিলো। উনার স্ত্রীকে কলেরায় কেড়ে নিয়েছে।
রামিনা বেগম কান্না করছেন, যতোই হোক এই মানুষ তার স্বামী। শত চেষ্টা করেও ভালো পথে নিয়ে আসতে পারেনি৷ সেই পথ মানুষটিকে খু’নের দরজায় নিয়ে যায়।

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-০৬

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(৬)
লেখক: হানিফ আহমেদ

রাত ১টা, নাওশিন গাড়িতে বসে আছে। তার সাথে আদিব এবং জাহেদ আছে। নাওশিন আজ খুব মন খা’রাপ করেছে। মনের আকাশে মেঘ জমেছে।
কেন তাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোথায় নিয়ে রাখবে তাকে।
ভাইয়া আমি কেন আপনাদের বাসায় নিরাপদ না?
নাওশিন নিজেকে চুপ করে রাখতে পারেনি, তাই তো মনে আসা প্রশ্নটি করে ফেলে।
আদিব বলল,
কারণ কাল সকালে হয়তো পুলিশ আসবে।
পুলিশ আসবে কেন?
নাওশিন অবাক হয়েই প্রশ্নটি করে।
শহরে মানিক চৌধুরী নামে একজন খু’ন হয়েছে। আর এই মানিক হলো আমাদের পরিবারের খু’নীদের মধ্যে একজন। কেউ তাকে খুব বাজে ভাবে মে’রেছে। আমাদের সন্দেহ, এই মানিককে মা’রা হয়েছে আমাদের ফাঁসাতে। এটা আমাদের আন্দাজ মাত্র। তাই পুলিশ যেকোনো সময় আসতে পারে। এইদিকে তোমার মা পুলিশকে তোমার ছবি দিয়ে বলছে তুমি তোমার মামার পরিবারকে খু’ন করেছো। পুলিশ তোমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাই আমরা বাধ্য হয়েই তোমায় নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাচ্ছি।
নাওশিন ছোট্ট করে একটি প্রশ্ন করে শুধু।
ভাইয়া সেই নিরাপদ জায়গা কোথায়?
আদিব এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গাড়ি চালাতে মন দেয়।
নাওশিন আর প্রশ্ন করল না। তার পাশে জাহেদ বসে আছে। নাওশিন চোখজোড়া বন্ধ করল, ভাবনায় ডুব দেওয়ার চেষ্টা করে।
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নাওশিন, এই ১৬বছর বয়সের জীবনে আনন্দের দিন গুলো কী তার ফিরবে কখনো? নাকি তার মৃ’ত বাবার মতো আনন্দেরও মৃ’ত্যু
হয়েছে।

নিয়াজ রুমে বসে আছে। কিছু ভাবছে সে, তার ভাবনায় আজকাল অনেক কিছুই আসে। বেশি ভাবার কারণে সে কেমন রাগী আর গম্ভীর হয়ে গিয়েছে।
একটু পূর্বেই সবাই মিলে নাওশিনকে বিদায় দিলো। নিয়াজ স্পষ্ট ভাবেই দেখতে পেয়েছেলি তখন নাওশিনের চোখে পানি ছিলো।
নিয়াজ আজ নাওশিনকে নিয়ে ভাবছে। মেয়েটা তো নিরাপদ জায়গায় ছিলো। কিন্তু ভাগ্য আবার তার সহায় হলো না। সে হয়তো এই বাসাকেই নিজের বাসস্থান ভাবতে শুরু করেছিল। কিন্তু কিছু ভাবনা, কথা, সময়, দিন যে শুরুতেই শেষ হয়ে যায়। তা হয়তো সে ভুলে গিয়েছিল।
নিয়াজ নিজের রুমে পায়চারি করছে। গভীর রাত৷ আজ তার মনটা খুব ভালো। প্রিয় মানুষগুলোকে যারা কেড়ে নিয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে আজ একজন দুনিয়া ত্যাগ করেছে৷ এখনো বেঁচে আছে ওদের বিশাল দল।
কিন্তু নিয়াজ আবার একটি প্রশ্নে এসে থেমে যায়। এই মানিককে কে মে’রেছে?
সে তো মাত্র মনে প্রতিশোধ এর আগুন জ্বালিয়েছিল। বের হয়েছিল কিছু একটা করবে। কিন্তু সে তো পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমানের সাথে দীর্ঘ ৪০মিনিট কথা বলে। হামিদুর রহমানকে সেই ১৯৯৩ সালের সেই ভয়ানক ঘটনাটি বলে। সে দেখেছে, সব শুনে পুলিশ অফিসারের চোখ ভিজেছে।
নিয়াজ বারবার বলেছে, স্যার আপনি অন্তত আমাদের বাঁচান। শান্তিতে বেঁচে থাকার পথ দেখিয়ে দেন। ওদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করুন। স্যার, যারা আমাদের থেকে আমাদের বাবা মা কে কেড়ে নিয়েছে, আপনি তাদের গ্রেফতার করুন। শাস্তি দিয়ে প্রমাণ করুন এই দেশটা খুব সুন্দর৷
স্যার আমাদের বাবা মায়ের পর আমাদের মাথার উপর যে আকাশটি ছিলো, সেটাও ওরা ভেঙে দিয়েছে। আমরা তো সব সহ্য করে বসেই ছিলাম। মন টা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য খুব ক্লান্ত হয়ে যেত, তবুও আমরা আজ পর্যন্ত দেশের আইনের দিকেই তাকিয়ে আছি। আমার বাবা মায়ের চেহারা আমার মনে নাই স্যার। সেই কালরাত্রির সময় আমি ৩বছরের ছিলাম। ছবিতে নিজের মা বাবা বোনকে দেখেছি। ভাইয়ের মুখে শুনেছি, আপু ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু সেই আপুর চেহারা আমার মনে নাই। ছবিতে দেখি আমার আপু মিষ্টি হাসি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমায় কোলে নিয়ে।
যেই মানুষটিকে বাবা ডেকে তৃষ্ণা মেটাতাম, ওরা সেই মানুষটিকেও কেড়ে নিলো। কিন্তু ফাঁসিয়ে দিলো ছোট্ট নাওশিন নামের মেয়েটিকে।
এরকম অনেক কথাই সে আজ পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমানের সাথে বলেছে। মানুষটিকে তার খুব ভালো লেগেছে। এর পূর্বের পুলিশ অফিসার ছিলো অসৎ, তাইতো খু’নি গুলো মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরামে।

নাওশিনকে নিয়ে গন্তব্যে পৌছে ওরা। নাওশিন গাড়ি থেকে নেমে দেখল একতলা বিশিষ্ট একটি বাসা। চার দিকে দেয়াল ফেরানো। অন্ধকার রাত, তবুও জায়গাটা কতো আলোকিত।
বাসার ভিতর থেকে কেউ দরজা খুলে বের হয়। অর্ধ বয়স্ক মহিলা। আদিব এবং জাহেদ মহিলাটিকে সালাম দিয়ে নাওশিনকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
নাওশিন ভেবেছিল তাকে হয়তো একা কোথাও ছেড়ে দিবে ওরা। কিন্তু তার মাথায় আসে নি, ওরা কী ভাবে কোথাও তাকে একা ছেড়ে দিবে। ওরাও তো মানুষ। আর ওরা তো তাকে বাঁচাতে চায়।
আপা আমরা তাহলে আসি। ফজরের পূর্বে আমাদের যেতে হবে৷
মহিলাটি কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলল,
চুপচাপ খাবার টেবিলে বস। খাবার নিয়ে সেই কখন থেকে বসে আছি আমি।
আদিব আর জাহেদ কোনো কথা না বলেই খাবার টেবিলে বসে যায়। মহিলাটি নাওশিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
খাবার টেবিলে যাও।
নাওশিন অবাক হয়ে তাকায়। এতো রাতে শেষ কবে খেয়েছে তার সেটাই মনে নেই।
আমার খিদে নেই।
মহিলাটি আদিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
আদিব ওরে আমার কথা কিছু বলিস নি?
আদিব মাথা নাড়িয়ে না বলে।
মহিলাটি এবার হেসে বলল,
যাও বোন খেতে বস৷ নয়তো আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিবো। আর আমি যাকে নিজ হাতে খাইয়ে দেই, তাকে তিন প্লেট ভাত খেতেই হবে।
এমন কথা শুনে নাওশিন মহিলাটির দিকে অবাক হয়ে তাকায় অল্প কিছুক্ষণ। তারপর চুপচাপ খাবার টেবিলে যায়, আর আদিব আর জাহেদের পাশে বসে।
আদিব আর জাহেদ নাওশিনের এমন অবস্থা দেখে মনে মনে হাসলো।
সবাই অল্প অল্প করে কিছু খায়৷ নাওশিনের খেতে ইচ্ছেই করছিল না। কিন্তু না খেয়েও কোনো উপায় ছিলো না।
আদিব আর জাহেদ নাওশিনকে আসি বলে নিজেদের বাসার পথে রওনা দেয়। নাওশিন ওদের যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে রইল। এই পথ ধরেই সে আজ নতুন জায়গায় এসেছে। তার নিজ বাড়ি বলতে কিছুই নেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় তার। বিশাল আকাশটি মাথার উপর থাকার পরেও, তার পৃথিবীতে কোনো আকাশ নাই।

মহিলাটি এবার নাওশিনকে তার পিছু পিছু আসতে বলল।
আমার নাম হল আতিকা বেগম। এখন আমার নামটাই জানো। পরে না হয় আস্তে আস্তে আমায় চিনবে। তবে আমি তোমায় ভালোভাবে চিনি।
নাওশিন হয়তো কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু উনি আবারও বলে উঠলেন,
সকালে কথা হবে। এখন ঘুমাও।
উনি এই বলে রুমের লাইট অফ করে চলে যান। নাওশিন দাঁড়িয়ে আছে। উনি একাই কথা বলে গিয়েছেন শুধু, তাকে কিছুই বলতে দিলেন না।
নাওশিন আস্তে আস্তে বলল,
আল্লাহ এখানে অন্তত কোনো রহস্য রেখো না। আমি একটু ভালো থাকতে চাই।

সকালের আকাশে সূর্য উঠেছে। সবার চেনা সূর্যটি প্রতিটা সকালেই নতুন ভাবে উঠে, আবার সন্ধ্যের পূর্বে ডুবে যায়।
একটি দিনের মতো যে আরো একটি দিন আসবে তা ভাবা সত্যিই বোকামি।
আদিব সহ সবাই অপেক্ষা করেছে সারাটা সকাল। না পুলিশ আসে নি। কিন্তু পুলিশের তো আসার কথা। এক এক করে সবাই নিজেদের কাজে চলে যায়। কিন্তু পুলিশ আসে নি৷ বাসায় এখন শুধু নিয়াজ একাই আছে। সেই এক মাত্র বেকার। পড়ালেখায় আছে এখনো, কিন্তু বর্তমানে তার কোনো পড়া নাই। ভার্সিটিতে আ’ন্দোলন চলছে। ভার্সিটিতে কোন স্যারকে জানি কয়েকজন ছাত্র মিলে অপমান করেছে। এসব নিয়েই ভেজাল চলছে। তাই সে বাসাতে নিজের ভাতিজা এবং ভাতিজীদের সাথে সময়টা কাটায়।

বাসার দরজায় কেউ শব্দ করে। বেশ কিছুক্ষণ শব্দ করার পর জাহেদের স্ত্রী মিনা দরজা খুলে দেয়। দরজায় পুলিশ দেখে একটুও অবাক হয় নি সে। কারণ তার স্বামী সহ সবাই তো সকাল থেকে পুলিশের অপেক্ষা করছিল। তাই সে একটুও অবাক হয় নি। স্বাভাবিক ভাবেই ওদের ভিতরে আসার প্রস্তাব করে সে।
পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমান ভিতরে প্রবেশ করে শুধু বললেন,
ঘরের পুরুষদের ডেকে আনুন।
মিনা নিয়াজকে নিয়ে আসে৷ বর্তমানে পুরুষ মানুষ বলতে একমাত্র নিয়াজই আছে।
নিয়াজ এসে সালাম দেয় ওদের। সেও তো মনে মনে অপেক্ষায় ছিলো তাদের।
বাকিরা কোথায়?
পুকিশ অফিসার হামিদুর রহমান এর প্রশ্নের উত্তরে নিয়াজ বলল,
স্যার ভাইয়ারা তো চাকরি করেন, তারা তাদের ডিউটিতে৷ আর সাইফ ভার্সিটিতে।
তিনি বললেন,
বর্তমানে বাসায় যে কয়জন সদস্য আছেন। সবাইকে ডেকে আনুন।
সবাই এসে উপস্থিত হয়।
আপনারা জানেন মানিক চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি খু’ন হয়েছে।
নিয়াজ সবার হয়ে উত্তর দেয়,
হ্যাঁ পত্রিকায় দেখেছি।
মানিক চৌধুরীকে চিনেন?
অফিসারের প্রশ্নে নিয়াজ আবারও বলল,
হ্যাঁ, আমাদের পরিবারের খু’নিদের মধ্যে এই মানিকও একজন।
হামিদুর রহমান নিয়াজকে চিনেন। একটু সময় চুপ থেকে বললেন,
মানিক চৌধুরীর আপন জনেরা আপনাদের আসামী করে মামলা করেছে।
নিয়াজ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
স্যার আমি আপনাকে কাল সব বলেছি। বাসায় আসার পর আমি শুনেছি মানিকের খু’ন হওয়ার কথা। কালকের আমার বক্তব্য শুনেও কী মনে হয় আমরা কিছু করতে পারি?
অফিসার হামিদুর রহমান চুপ থাকেন নিয়াজের প্রশ্নে। উনার সাথে আরো চারজন পুলিশের লোক আছে। নিয়াজের সাথে উনার কথা হয়েছে উনারই বাসায়। তখন তিনি ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু এখন তিনি একজন পুলিশ অফিসার। পুলিশের পোশাক তার শরীরে। তিনি বললেন,
ওরা থানায় মামলা করেছে। মানিককে আপনারা মে’রেছেন।
নিয়াজ যেন এখন কোনো নতুন অফিসারকে দেখতে পাচ্ছে।
স্যার ওরা আমাদের ফাঁসাতে চাচ্ছে।
হামিদুর রহমান শুধু বললেন,

আপনি আমাদের সাথে থানায় চলুন।

থানায় যাওয়ার কথা শুনে নিয়াজ খুব অবাক হয়। থানায় যাওয়া মানে তাকে গ্রেফতার করার কথাই বলছেন অফিসার।
নিয়াজ কোনো কথা বলার পূর্বে আরো একজন মুখ খুলল,

ও থানায় যাবে না। ও কেন থানায় যাবে? কেউ মিথ্যে মামলা দিলো আর আপনারাও তদন্ত না করে চলে আসলেন গ্রেফতার করতে। সত্যতা যাচাই করুন, তারপর আসুন।

মিনহা প্রতিবাদী সুরে কথাগুলো বলে থামে। অফিসার মিনহার দিকে তাকান। তিনি শান্ত গলায় বললেন,

এটি আমাদের ডিউটি।

মিনহা হাসলো। আর বলল,
এখন আপনাদের ডিউটির কথা বলছেন। যেদিন এই পরিবারের ১৭জন মানুষকে এক সাথে খু’ন করা হয় তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? কোথায় ছিলো আপনাদের ডিউটি? আজ আসছেন মিথ্যে মামলায় এখানে ডিউটি দেখাতে।

একজন পুলিশের লোক বলে উঠলেন,
আপনি এভাবে আমাদের সাথে কথা বলার কারণে আপনাকে এখনই এই মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারি। সেটা জানেন?
মিনহা এবার রাগী চেহারায় কঠিন গলায় সেই পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলল,
হ্যাঁ আপনাদের আইন তো তাদের জন্যই। যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করলে আপনারা কঠিন আইন দেখাবেন, তাহলে অন্যায় করা মানুষদের বেলায় আপনাদের এতো সহজ আইন কেন?
পুলিশ এর লোকটি চুপ। হামিদুর রহমান কিছু বলতে চাইলেও মিনহা আবারও বলে উঠল,
ওরা মামলা করেছে, আপনারাও চলে আসছেন। কিন্তু সেইদিন তো ওদের সবার উপর মামলা করা হয়েছিল। কী করেছিলেন আপনারা তখন? গিয়েছিলেন তাদের বাড়ি? এতো নিয়ম দেখিয়েছিলেন তাদের সেদিন? সেদিন তো আপনাদেরই এক পুলিশ অফিসার টাকা খেয়ে ওদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নিতে রাজিই হচ্ছিল না। বলছিল ডা’কাতের হ’ত্যাকাণ্ড বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। সেদিন কোথায় ছিলো এতো নিয়ম?

হামিদুর রহমান চুপ করে শুনলেন মিনহার কথা। হামিদুর রহমান মনে মনে হাসলেন। আর বললেন, মেয়েটা ভালোই প্রতিবাদী।
তিনি বললেন,
ওরা মামলা করেছে, যাদের উপর মামলা তাদের গ্রেফতার করা দ্বায়িত্ব আমাদের কর্তব্য।
মিনহা চিৎকার করে বলল, যারা মামলা করেছে তাদের উপর তো ১৯৯৩ সালে মামলা করা আছে। কই তারা তো আজো বাহিরেই আছে। যান তাদের ধরে জেলে বরুন।

পুলিশ অফিসার চুপ থাকেন। কিছুক্ষণ পর বললেন,
নিয়াজ আপনি আমাদের সাথে চলুন।
কথাটি খুব শান্ত গলাতেই বলেন তিনি। কিন্তু নিয়াজ চুপ।
হামিদুর রহমান হঠাৎ অন্য সুরে কথা বললেন।
নিয়াজ আমরা চলে যাচ্ছি। আপনি ২টার ভিতর থানায় আসুন। সাথে আপনাদের ভাইদেরকে নিয়ে।
কথাটি বলে মুচকি হেসে বিদায় নেন তিনি পুলিশের সবাইকে নিয়ে।
নিয়াজ বুঝতে পেরেছে এই হাসির মানে তাকে পালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া।
সেও পালাবে৷ বড় ভাবির দিকে তাকিয়ে নিয়াজ বলল,
ভাবি আজকের এই মুহূর্ত যদি আমার ছয়টা ভাই দেখতো, তাহলে আমার সার্থক হতো। আজ তুমি মায়ের কাজ করেছো। আমাদের মা থাকলে হয়তো এভাবেই পুকিশের সাথে তর্ক করতেন। সত্যিই ভাবি তুমি আজ মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললে। বুঝিয়ে দিলে তুমি বাসার বড় বউ। আমি জানি আমার প্রতিটা ভাবিই প্রতিবাদী। আজ আমি মুগ্ধ হয়েছি ভাবি।
মিনহা শুধু মুচকি হাসলো। আর বলল,
নিয়াজ এখনই তোমাকে পালাতে হবে।
নিয়াজ অবাক হয়,
কেন ভাবি?
তোমার ভাগ্য ভালো ওরা তোমাকে পালানোর একটি সুযোগ দিয়েছে। তুমি কোথাও চলে যাও। আর নিজেকে লুকিয়ে রাখো। আমরা তোমার ভাইয়াদের বলে দিচ্ছি ওরা যেন কোথাও চলে যায়। নয়তো অকারণে জেলে পঁচতে হবে।
নিয়াজকে কোনো কথা না বলতে দিয়েই তিনি নিজের রুমে চলে যান।
নিয়াজ বলে উঠল,
ভাবি তোমাদের এভাবে রেখে আমি কোথাও যাবো না।
রবিনের স্ত্রী তামান্না যে ২মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সে বলে উঠল,
ভাই তুমি এখনই পালাও। আমাদের নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমরা পাঁচবোন আছি। ইনশা আল্লাহ ভালো থাকবো।
নিয়াজ কিছু বলল না। সে সাহস পেয়ে গিয়েছে। যেখানে একজন গর্ভবতী নারী সাহস দিতে পারে, সেখানে তার আর কী বলার আছে।
প্রতিজন তাদের স্বামীকে ঘটে যাওয়া সব কিছু ফোন করে বললেন৷ নিয়াজ সাইফকে ফোন দিয়ে সব বলে, কোনো বন্ধুর বাসায় যেন চলে যায় সেটাও বলে।
এক কালো মেঘের ছায়া যেন তাদের গিলে খাচ্ছে।
ওরা কী থামবে না?
সুখে থাকা তো কবেই কেড়ে নিয়েছিল। একটু একটু সুখ খুঁজে পাচ্ছিল। কিন্তু আজ তাদের বাসা ছাড়া করল।
কী জন্যে এমন নোং’রা খেলা শুরু করেছে এরা?

সন্ধ্যা হয়েছে। আলোর রাজত্ব শেষে অন্ধকার এর রাজত্ব শুরু হয়।
মানিক চৌধুরীর বড় ছেলে শান্ত চৌধুরীর একটি পা ইতি মধ্যে কেটে ফেলেছে মুখোশ পরা মানুষটি।
মুখ বাঁধা শান্তের। বাঁচার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। শরীর থেকে আরো এক পা এবং দুই হাত আলাদা করে বুককে ক্ষ’তবিক্ষত করে দেয়। শান্ত তার নিশ্বাস নেওয়ার পূর্বে সামনের মানুষটি নিজের মুখোশ খুলে।
শান্ত চোখ বড় বড় করে দুনিয়া ত্যাগ করে। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তাকে কে খু’ন করছে, মুখোশ খুলে খু’নি নিজেই তাকে দেখায়৷ তার এখন শুধু র’ক্তের পিপাসা।

চলবে,,,

সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-০৫

0

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(৫)
লেখক: হানিফ আহমেদ

নিয়াজ মনে মনে ভেবেই নিয়েছে। সে শাস্তি দিবে ওই মানুষগুলোকে। যারা কেড়ে নিয়েছে তার সব প্রিয় মানুষকে। সেও এবার এক কঠিন খেলায় মেতে উঠতে চায়। সেই রাতটা এবার সে ওদের ফিরিয়ে দিতে চায়। খু’নের বদলে এবার খু’ন হবে। নিজের সুন্দর নাম নিয়াজ নাবীল থেকে এবার খু’নী নিয়াজ নাবীল হবে। চুপ থেকেও যখন শুধু হারাতেই হচ্ছে, সেখানে চুপ থাকা বোকামি। মশা কামড় দিলে যেভাবে হাত দিয়ে মা’রতে হয় মশাকে, সেভাবেই এবার প্রতিশোধ নিবে মশার মতো মে’রে।
নিয়াজ কাপড় পরে বড় ভাইয়ের রুমে যায়। আদিবের স্ত্রী মিনহাকে রুমে একা শুয়ে থাকতে দেখে প্রথমে রুমে ঢুকার অনুমতি চায়। মিনহা মিষ্টি হেসে অনুমতি দেয়।
ভাবি ভাইয়া কোথায়?
তোমার ভাইয়া তামিকে নিয়ে ছাদে গিয়েছে৷ ছেলেটা কান্না করছে ছাদে যাওয়ার জন্য।
নিয়াজ আজকাল অল্পতেই খুব রেগে যায়। মিনহার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে বলল,
এই শরীর পোড়া রোদে কেন ছাদে যাবে ওরা?
মিনহা হাসলো। আর বলল,
আমাকে রাগ না দেখিয়ে যাও ওদের ছাদ থেকে নিয়ে আসো।
কেমন স্ত্রী তুমি? স্বামীকে রোদে ছেড়ে দিয়েছো। কেমন মা তুমি? সন্তানকে রোদে ছেড়ে দিয়েছো।
নিয়াজ কথাটি বলে, ছাদে যাওয়ার জন্য রুম ত্যাগ করে।
মিনহা বিছানায় বসে পা নাড়াচ্ছে৷ দুই ঠোঁট নাড়িয়ে শুধু একটি বাক্যই বলল, এতো রাগ যে কোথা থেকে আসে ওর।
নিয়াজ ছাদে যাওয়ার সময় দেখল নাওশিন রুমে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। নিয়াজ সেই দিকে আর দৃষ্টি দিলো না। এখন তার গন্তব্য হলো ছাদ, গন্তব্য ঠিক করে নিলে আশেপাশে তাকাতে নেই।
ভাইয়া তুমি এই রোদে ছেলেটাকে নিয়ে ছাদে এসে বসে আছো, কেমন বাবা তুমি?
নিয়াজের কথা শুনে আদিব হেসে বলল,
তোর ভাতিজার নাকি রোদ ভালো লাগে। দেখ কীভাবে রোদের মধ্যে খেলা করছে।
ওর ভালো লাগল, তাই তুমিও পা পা করে ছাদে চলে আসলে।
আদিব হাসলো। কেমন বড়দের মতো তাকে শাসন করছে সে।
নিয়াজ তামিকে কোলে তুলে নেয়। ৫বছরের তামির সাথে এটা ওটা গল্প করে নিচে আসতেছে। আদিব যেন বাঁচলো, তার গরমে শরীরটা ঘেমে গিয়েছে। কিন্তু ছেলেটা বল নিয়ে এই রোদে খেলবে, কোনো ভাবেই বুঝাতে পারছিল না। ছেলেকে কাঁদিয়ে যে নিচে নিয়ে যাবে সেটাও তার ভাল লাগছিল না। নিয়াজ এসে তাকে বাঁচিয়ে দিলো।

আদিব বিছানায় বসল। মিনহা গোসল করতে ওয়াশরুমে ঢুকেছে।
তুই কোথাও যাচ্ছিস নাকি?
ভাইয়ের প্রশ্নে নিয়াজ শুধু বলল,
হ্যাঁ ভাইয়া।
তামিকে নিজের বুকে বসিয়ে ছোট ছোট হাতজোড়া ধরে নাড়াতে নাড়াতে বলল,
আচ্ছা সাবধানে থাকিস। সন্ধ্যার পূর্বেই যেন বাসায় আসা হয়।
নিয়াজ মাথা নাড়ায়।
সে রুম ত্যাগ করে। এসছিল কিছু বলতে, কিন্তু মনের কথা মনের মধ্যেই রেখে দেয়। কিছু কথা অপ্রকাশিত থাকুক।
ভাইয়ের থেকে বিদায় নেওয়ার পর নিয়াজ সাইফের রুমে যায়।
সাইফকে পড়তে দেখে তার পাশে যেয়ে বসে।

সাইফ পড়ার টেবিলে বসে পড়ছিল। সামনে তার পরীক্ষা। কিন্তু তার পড়ায় একটুও মনোযোগ নেই। তার ভাইয়েরা তাকে মজা করে ডক্টর বলে ডাকে। অথচ তার পড়া এখনো শেষ হয় নি। তার ভাইয়েরা তাকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিবে, সাইফ একজন ডক্টর। রবিন তো প্রায়ই বলে থাকে, তোকে আমরা ডক্টর ডাকি। তুই যেন আমাদের ডাকে উৎসাহিত পেয়ে ভালো ভাবে পড়তে পারিস।
তবে বাসায় কারো প্রাথমিক চিকিৎসা সাইফের মাধ্যমেই হয়ে যায়।
ভাইয়া কিছু বলবে?
নিয়াজ ছোট্ট করে শুধু প্রশ্ন করে,
আমার সাথে ঘুরতে যাবি?
ভাইয়া সামনে আমার পরীক্ষা। আচ্ছা চলো।
নিয়াজ চোখ কঠিন করে উচ্চস্বরে বলল,
মন দিয়ে পড়ালেখা কর। কোথাও যাওয়া লাগবে না তোর।
সাইফ হুম বলে মনে মনেই হেসে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। এতো রেগে যায় কেন মানুষটা। সাইফ বইয়ের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে পড়তে শুরু করে।
নিয়াজ নিজের রুমে যায়। রুমের মধ্যে কিছুক্ষণ পায়চারি করে। তার মনের ঘরে আগুন জ্বলছে। কোনো ভাবেই শান্ত হতে পারছে না সে।
তার মনে একটি বাক্যই বারবার আসছে, এবার প্রতিশোধ নিতে হবে।

নাওশিন আবারও পালানোর চিন্তা করে। সে এমন কোথাও যেতে চায়, যেখানে কেউ তাকে চিনবে না। সেও কাউকে চিনবে না। নতুন এক জায়গা। যেখানে কোনো রহস্য থাকবে না। কিছুটা হলেও সুখ পাবে। একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকা যাবে। কেউ কোনো প্রশ্ন করবে না, দিবে না অপবাদ।
পরক্ষণেই আবার ভাবে, এমন জায়গা কোথায় আছে? তার চেয়ে এখানেই থাকা ভালো। অন্তত নিরাপদে থাকা যাবে।
নাওশিন যখন এসব ভাবনায় মগ্ন, তখন তার রুমে কেউ আসে। একজন মেয়ে, মেয়েটির নাম এখনো তার জানা হয় নি। তবে সে জানে এই মেয়ে সামিন ভাইয়ার স্ত্রী। এখনও আরো দুজনের সাথে তার কথা বলা হয়নি, তারা হলেন জাহেদ এবং রবিন ভাইয়ার স্ত্রী।

তুমি একা বসে আছো, ভাবলাম তোমাকে সঙ্গ দেই। এতে তোমার ভালো লাগবে।

নাওশিন কিছু বলল না, এই বাসার সবাই কতো ভালো। কতো তাড়াতাড়ি মিশে যাচ্ছে তার সাথে।
নাওশিনকে কিছু বলতে না দেখে সে আবারও বলে,
আমি তানিশা, তোমার সামিন ভাইয়ার স্ত্রী। আমাদের বিয়ের ৭মাস হয়েছে।
এবারও নাওশিন চুপ। সে এসব কথার কী উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। কীভাবে কথা বলা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। তানিশা আবারও বলল,
দেখো মেয়েটা কীভাবে চুপ করে আছে। এভাবে মন খা’রাপ করে থাকলে চলবে নাকি।
নাওশিন এবার বলল,
হুম বলুন আপা।
কতো মিষ্টি মেয়ে তুমি। এভাবে মন খা’রাপ করে থাকলে ভালো লাগে বলো?
নাওশিন কিছু বলল না। সে মন খা’রাপের দেশের রাজা। তার কী সেখানে আর মন খা’রাপ করতে হয়। এমনিই মনটা খা’রাপ থেকে যায়। আর মন ভালো হয়ে যাওয়া মানে রাজত্ব চলে যাওয়া।
তানিশা হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ না। নাওশিনের মনটা একটু ভালো করতে চায় সে। মানুষ যে ভাবে একটু একটু করে কষ্ট পেয়ে বিশাল কষ্টের পাহাড় বানিয়ে ফেলে। সেও ঠিক সেভাবেই একটু একটু করে মন ভালো করে কষ্ট দূর করে দিবে নাওশিনের।
তানিশা বলল,
তুমি জানো তুমি কতোটা সুন্দর? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখবে, নিজেকে নিজেই ভালোবেসে ফেলবে।
নাওশিন চুপ। তানিশা এবার কিছুটা মন খা’রাপ করল।
মেয়েটা এতো চুপ থাকলে তো অসুস্থ হয়ে যাবে। এবার দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল সে,
আমার কথায় মনে দাগ পড়ে নি বুঝি। এই কথা যদি আজ কোনো ছেলে বলত, তাহলে তোমার শরীর শীতল হয়ে যেতো। মনে প্রেমের ঢেউ উঠত। মুখটি লজ্জায় লাল হয়ে যেত। আজ আমি এক মেয়ে বলে, তোমার কাছে পাত্তাই পেলাম না।
নাওশিন এবার হেসে দেয়।
আসলে আপা আমি কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছি। এর বাহিরে কিছুই না।
তানিশা হাসলো, যাক কাজে এসেছে এবার।
লজ্জা পাওয়ার কী আছে? তুমি কী নতুন বউ?
নাওশিন বুঝতে পারছে, এবার কথা না বললে এভাবেই থাকে লজ্জা দিবে এই মেয়ে। তাই সে বলল,

আপা আমায় এক কাপ চা করে দিবেন?

তানিশা হুম বলে হাসি মুখে চলে যায় নাওশিনের জন্য চা তৈরি করতে।
নাওশিন যেন বাঁচলো। চা শেষ কবে খেয়েছিল, সেটা তার মনে নেই। চা এর কথা বলা তো শুধু তানিশার থেকে বাঁচার জন্য। সে বুঝতে পারছে, তার মন ভাল করার জন্যই মেয়েটি এসেছিল। কিন্তু সে কখনো কোনো মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে না অনেক বছর হলো।

রাত ৮টার পর হঠাৎ জাহেদ খুশি মনে বাসায় ঢুকে চিৎকার করে বলতে শুরু করে, ভাইয়া তোমরা কোথায়?
সবাই জাহেদের এমন চিৎকার শুনে একত্রিত হয়।
রবিন জিজ্ঞেস করে,
কী হয়েছে ভাইয়া?
জাহেদ খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,

তোমরা জানো, মানিক চৌধুরীকে কেউ খু’ন করেছে। তাকে খুব নিষ্ঠুর ভাবে কারা যেন মে’রেছে। দুই হাত, দুই পা শরীর থেকে আলাদা। মুখটা ছাড়া সব কিছু ক্ষ’তবিক্ষত। আমার যে কি আনন্দ লাগছে তোমাদের বুঝাতে পারবো না।

মিফতা আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠল। আদিব আঙুলের রেখা ধরে গুনে বলল।
তাহলে আমাদের পরিবারের খু’নির ৩য় জন দুনিয়া ত্যাগ করল। দুইজনকে দেশের আইন ফাঁ’সিতে ঝুলালেও, এই মানিককে কে খু’ন করল।
মিফতা বলল,
ভাইয়া ওদের পা’পের পাল্লা ভারি হয়েছে। হয়তো কেউ অ’ত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মে’রে দিয়েছে মানিককে।
রবিন বলে উঠল,
ভাইয়া আমরা যে এতো খুশী হচ্ছি। কিন্তু এটা তো একটি ফাঁদ হতে পারে।
আদিব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
কিসের ফাঁদ?
ভাইয়া বুঝতে পারলে না। এই মানিকের বয়স ৭০এর অনেকটা কাছে। যদিও এতো বয়স বুঝা যায় না, কিন্তু আমরা তো জানি তার বয়সটা। যতোটা জানি মানিক চৌধুরী আজকাল এতোটা সুস্থ না। তাহলে তাকে হয়তো তার আপনজন মে’রেছে। ভাইয়া ওরা প্রভাবশালী। এই মানিককে খু’ন করে আমাদের ফাঁসানোর একটি বড় চেষ্টা হতে পারে।
সবার মুখ কালো হয়ে যায়।
আদিব সবার দিকে তাকায়।
নিয়াজ এখনও বাড়ি ফিরেনি?
সাইফ বলল,
ভাইয়া তো ঘুরতে গিয়েছে। এতক্ষণে তো এসে যাওয়ার কথা।
আদিব চিন্তিত হয়ে বলল,
ও জানে না আমাদের কতো শত্র। রাত ৮টার উপর চলল, কিন্তু ও এখনো বাহিরে কী করে?
কেউ কোনো কথা বলছে না। সবাই চুপ।
একটু পূর্বেও সবাই খুশী হয়েছিল। কিন্তু রবিনের কথা শুনে সবারই মুখটি কালো হয়ে যায়। সে যে কথাগুলো বলেছে। তা তো ফেলে দেওয়ার মতোও না। নিশ্চয় ওদের কোনো ফাঁদ।
মিফতা বলে উঠল,
ভাইয়া নাওশিনকে আর এই বাসায় রাখা যাবে না। সকাল হলেই, কিংবা রাতেই পুলিশ চলে আসতে পারে৷ রবিনের কথাটা বুঝতে পেরেছো? আমাদের ফাঁসানোর জন্যই এই খু’ন। নাওশিনকে যদি পুলিশ দেখে আমাদের বাসায়, তাহলে ওকে নিয়ে যাবে। নিরীহ একটি মেয়েকে এভাবে তো আমরা ছেড়ে দিতে পারি না ধ্বংসের মুখে।
চিন্তার উপর চিন্তা। আদিবের সব কিছু কেমন অন্ধকার অন্ধকার লাগছে। দু’চোখে পথ খোঁজে পাচ্ছে না সে। তাদের জন্য কি শান্তি নামক শব্দটি এই পৃথিবী থেকে ছুটি নিয়েছে।
নাওশিন এখন কোথায়?
তানিশা বলল,
ভাইয়া ও তো বিকেলে ঘুমিয়েছে৷ শরীরে দেখলাম হালকা জ্বর।
আদিব মন খারাপ করে বলল,
কী বলো এসব। এই মেয়েকে নিয়ে এখন কী করব আমরা। এভাবে তো ছেড়ে দিতেও পারি না আমরা। এই শহরের কোথায় যাবে ও। কিছুই তো চিনে না।
সবার মুখটাই মলিন হয়ে আছে। সবাই এখন নাওশিনকে নিয়ে ভাবছে। কী হবে নাওশিনের?

রাত ১০টা, সাত ভাই খাবার টেবিলে বসেছে খাবার খাওয়ার জন্য। সাইফ ভাত নিয়ে সোফায় যায়, সেখানে বসে খাবার খাচ্ছে। বাকি ছয়জন টেবিলে বসে আছে। নাওশিন মিনহার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভীষণ ভালো লাগছে, এভাবে সবাইকে একসাথে খাবার খেতে দেখে। এদের পর সব বাসার মেয়েরা খাবে। কতোই না সুন্দর!
নাওশিন জানেনা ওই খু’নের কথা কিছুই। তাকে একটু পূর্বেই মাত্র টেনে তোলা হয়।
আদিব নিয়াজকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল।
নিয়াজ কোথায় গিয়েছিলি তুই? সন্ধ্যার পূর্বে ফেরার কথা বলছিলাম আমি।
নিয়াজ চুপ। আদিব আবারও বলল,
তুই জানিস মানিক চৌধুরীকে কেউ খু’ন করেছে?
খাবার মুখে দিতে দিতে বলল,
হ্যাঁ শুনেছি। খাওয়া শেষে বড় ভাবি ফ্রিজে যদি মিষ্টি থাকে, তাহলে আমাদের দিয়ো তো। ভালো খবরে মিষ্টি মুখ করতে হয় তা জানো না তোমরা।
আদিব কিছু বলল না। ওরে কিছু বললেই রাগ দেখাবে। আদিব খাবার খাওয়ায় মন দিলো।
নিয়াজ কোথায় গিয়েছিলি তুই?
মিফতার প্রশ্নে ছোট্ট করে উত্তর দেয় সে।
শহরটা ঘুরে দেখতে বের হয়েছিলাম।
সত্যি তো?
নিয়াজ মুচকি হেসে বলল,
মিথ্যা বলতে যাবো কেন?
আর কেউ কোনো কথা বলল না। সবাই নিজেদের খাওয়া শেষ করল।

আজ নাওশিন একটু হলেও পেট ভরে ভাত খেতে পেরেছে।
সে এখন অপেক্ষায় আছে এই মানিক কে, যদিও বুঝতে পারছে খা’রাপ কেউ হবে। হয়তো এই পরিবারের খু’নি।
তাইতো ওরা খুশি।
নাওশিন যখন খাবার টেবিলে বসে এসব ভাবছিল। তখন আদিব এসে নাওশিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
নাওশিন তৈরি থেকো, রাত একটায় তোমাকে এই বাসা থেকে আমরা অন কোথাও নিয়ে যাবো।
নাওশিনকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই আদিব রুমে চলে যায়।
নাওশিন নিজের আশেপাশে শুধু একমাত্র সামিনকে আবিষ্কার করল।
ভাইয়া আদিব ভাইয়া কী বলে গেলেন ওই কথা? আমি তো কিছুই বুঝিনি। কোথায় নিয়ে যাবেন?
সামিন এই প্রথম নাওশিনের সাথে কথা বলছে। সেদিন ওই পাঁচজনের মধ্যে সামিনও একজন ছিলো।
বোন রে তুমি এই বাসায় নিরাপদ না। এখন রুমে যাও৷ বিশ্রাম নাও। রাতে তোমায় নতুন কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই তোমায় থাকতে হবে।
কথাটি বলে সামিনও নিজের রুমে চলে যায়।
নাওশিন রুমে যায়। তার সব কিছু অন্ধকার লাগছে৷ মাথা ঘোরাচ্ছে। তাকে কোথায় নিয়ে যাবে এরা। কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
এখানেই তো মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। তাকে কোথায় নিয়ে যাবে গভীর রাতে। আবার কী অপেক্ষা করছে তার জন্য? মনে অনেক প্রশ্ন এসে জমা হচ্ছে। কিন্তু কাকে করবে এই প্রশ্ন? তার হয়তো আর ভালো থাকা হবে না। জীবনটা এতো প্রশ্নময় আর রহস্যে ভরা কেন।
নাওশিন এখন শুধু ১টার অপেক্ষায়। মনে আসা প্রশ্ন গুলোর উত্তর তখনই পাবে।

চলবে,,,