সাদা মেঘের আকাশ পর্ব-১৪+১৫

0
646

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৪)
লেখক: হানিফ আহমেদ

নাওশিন খবরটি শুনে খুব অবাক হয়েছিল। তার মায়ের স্বামীকে খু’ন করা হয়েছে। আরো বেশি অবাক হয়েছে এটা জেনে, তার মায়ের স্বামী ওই চৌধুরী পরিবারের সন্তান। তার যেন অবাক হওয়ার শেষ নাই। কারণ তার মায়ের স্বামী আবার আতিকা চৌধুরীর আপন ভাই।
নাওশিন বসে আকাশ দেখছিল, আজ আকাশটা মেঘলা ছিলো। সে বন্দী চার দেয়ালে। কারণ আতিকা বেগম তাকে বাসার ভিতরে রেখে চাল কিনতে গিয়েছিলেন। চাল শেষ হয়ে গিয়েছিল।
বাসায় এসেই নাওশিনকে এই খবর দিয়েছেন তিনি। আতিকার চোখে জল আসছিল বারবার, তবুও লুকানোর হাজারো চেষ্টা মাত্র।
আতিকা এটাও বলেছেন। তিনি শুনে এসেছেন আনিছুর এর খু’ন এর দায়ে সাজেদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে। এই কথাটি শুনে নাওশিন কিছুটা অবাক হয়,
তার মা কেন খু’ন করবে? সে এই উত্তর পাচ্ছে না। নাওশিন এসব ভাবলো না আর। তার অন্তর একটুও ব্যথিত হয় নি আজ। অন্তর তো কাঁদে ভালো মানুষের জন্য। অ’ত্যাচারী মানুষের মৃ’ত্যুর জন্য আবার কিসের কান্না।

নাওশিন আতিকার পাশে বসে।
জানেন আপা আজ আমি ভীষণ খুশি।
আতিকা ছোট্ট করে প্রশ্ন করলে,
কেন?
আপা আজ একটি খা’রাপ মানুষের মৃ’ত্যুর খবর শুনেছি, তাই আজ খুব ভালো লাগছে আমার।
নাওশিনের কথাটি শুনে আতিকা কিছু বললেন না। তিনিও খুশি হতেন, এই মানুষগুলো যদি তার ভাই না হতো। তবুও তিনি আনন্দিত, কারণ স্বামীর খু’নিগুলোর শাস্তি কেউ না কেউ করে যাচ্ছে।
নাওশিন মনে মনে হাসলো, তার মায়ের স্বামীর বোনকে সে আপা ডাকে।
নাওশিন বলল,
জানেন আপা, আমি ওই বাসায় নিরাপদ ছিলাম না। আমি নিরাপদ ছিলাম না আমার মায়ের ওই খা’রাপ স্বামীর কাছে।
তিনি আবারও ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেন,
কেন?
নাওশিন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে,

আমার যখন ১১বছর বয়স। তখন আমার মায়ের স্বামী আমার শরীরে হাত দিতো। তার স্পর্শ কেমন জানি খা’রাপ লাগতো। কোনো বাবার স্পর্শ মনে হতো না আমার। রুমে একা ঘুমাতাম, গভীর রাতে কোনো কারণে ঘুম ভেঙে যেতো। তখন দেখতাম আমার মায়ের স্বামী দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমাকে কিছু করতে চাইতো। এই জন্য আমি রাতে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে ঘুমাতাম। বয়সটা ১১ছিলো তখন, ছোট হলেও পরিস্থিতি আমায় ভালো খা’রাপ শিখিয়ে দিয়েছিল। নিজেকে রক্ষা করতে হবে সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম তখনই।
আম্মা যখন জানতে চাইছিলেন, দরজা বন্ধ করে কেন ঘুমাই। তখন আমি বলছিলাম, আপনার স্বামীর কাছে আমি নিরাপদ না। কিন্তু এই কথার উত্তর খুঁজতে চাইলেন না আম্মা। উল্টো আমার নরম গালে থাপ্পড় দিয়েছিলেন।
আজ আমি খুব খুশি আপা। একটি খা’রাপ জঘন্য মানুষের খু’ন হয়েছে। আজ আমি খুব খুব খুশি আপা। যেই পুরুষ ছোট্ট মেয়ের ইজ্জত দিতে পারতো না, তার তো আরো পূর্বে খু’ন হওয়ার কথা ছিলো।

নাওশিনের মুখে নিজের ভাইয়ের এমং নোং’রামির কথা শুনে কিছুটা লজ্জা পেলেন। কেন তিনি এই পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। যেই পরিবারের প্রতিটা পুরুষই খা’রাপ, ভালো পুরুষ বলতে তিনি মেরহাবকেই জানতেন।
তিনি চুপ করে বসে আছেন।
নাওশিন কিছু বলল না। সে ভাবনায় ডুব দিলো। অনেক কিছুই তার ভাবনায় আসছে।

আনিছুর চৌধুরীর মৃত্যুর পাঁচদিন পর আমিনা বেগমকে পুলিশ ধরতে সফল হয়।
এই কয়টা দিন পা’গলের মতো খুঁজেছে আমিনাকে পুলিশের লোকেরা।
অতঃপর তারা সফল হয়।
আমিনাকে ধরতে সফল হওয়ার রাস্তা ছিলো বায়েজিদ চৌধুরী। সাজেদা বেগম যখন হামিদুর রহমানকে বলেছিলেন, বাসায় বায়েজিদ একা। ছেলেটার কেউ নাই, তাকে যেন তাদের হেফাজতে রাখে।
হামিদুর রহমান জালাল চৌধুরীর মুখে শুনেছেন আনিছুর এবং আমিনার ছেলে বায়েজিদ। তাই তিনি বায়েজিদকে অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করার পর সে বলতে কোনো ভাবেই রাজি হয় নি, তার মায়ের নাম। সে বারবার বলছিল সে সাজেদা বেগমের ছেলে।
কিন্তু হামিদুর রহমান অনেক ভাবে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন। এক সময় তিনি সফল হয়েছেন। বায়েজিদ বলেছে তার মায়ের নাম। তার মায়ের নাম আমিনা বেগম। হামিদুর রহমান ছোট্ট করে প্রশ্ন করতে চাইলেন, কিন্তু প্রথমেই প্রশ্ন করলেন না। তিনি ছোট্ট একটি পথ অবলম্বন করলেন।
তিনি জানেন, কোনো বাচ্চার সামনে তার গুণগান গাইলে সেই বাচ্চা কখনো মিথ্যে বলে না। তাই তিনিও এই কাজ করলেন,
আচ্ছা বায়েজিদ আমি শুনেছি, তুমি খুব সত্যবাদী। সব সময় সত্য কথা বলো। সত্যের পথে থাকতে পছন্দ করো। তুমি খুব ছোট হলেও সত্যের পথে তুমি খুব সাহসী।
বায়েজিদ শুধু হু শব্দটি বলল। হামিদুর রহমান বললেন,
তাহলে তুমি তোমার মা আমিনা বেগমের সাথে কীভাবে কথা বলো?
বায়েজিদ সুন্দর করে উত্তর দিয়ে দিলো।
এই যে আমার কাছে থাকা এই ফোন দিয়ে।
বায়েজিদ নিজের কাছে রাখা একটি লুকানো ফোন বের করে দেখিয়ে কথাটি বলল।
হামিদুর রহমান মনে মনে হাসলেন।
তোমার মা কোথায় সেটা আমাদের বলবে?
এবার বায়েজিদ চুপ হয়ে যায়। অনেক বার জিজ্ঞেস করেও তিনি বায়েজিদের থেকে জানতে পারলেন না।
তাই তিনি আরো একটি পথ বেঁচে নিলেন।
হামিদুর রহমান বললেন,
আমি জানি তোমার মা কোথায়?
বায়েজিদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
কোথায়?
তোমার মা জেলে। উনিই বলেছেন, তুমি উনার ছেলে।
বায়েজিদ এবার কেঁদে দেয়।
না আমার আম্মু জেলে থাকবেন কেন। আমার আম্মু তো আমার মামার সাথে আছেন।
এই কথা বলে বায়েজিদ একটি জায়গার নাম বলে।
হামিদুর বিশ্বাস রেখেছিলেন, এই পথ অবলম্বন করলে জানতে পারবেন আমিনা কোথায় আছে।
বায়েজিদের বলা জায়গাটি হামিদুর চিনলেন। কিন্তু কোথায় থাকেন, সেটা তো জানতে হবে। তাই বললেন,
তোমার মা তো জেলে। তাহলে তুমি মিথ্যে বলছ কেন?
বায়েজিদ এবার চিৎকার করে বলল,
আমি মিথ্যা বলিনি। আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি মিথ্যা ঘৃণা করি, আমি কখনো মিথ্যা বলি না।
হামিদুর রহমান মনে মনে হাসলেন। সত্যিই তিনি মিথ্যে বলছেন, সত্যটা জানার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
হামিদুর রহমান বললেন, তাহলে চলো, কার কথা সত্য সেটি তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাবে।
বায়েজিদ হুম বলল।

দরজায় শব্দ করার পর কেউ দরজা খুলে, সালাম দেয় বায়েজিদকে। আর সালাম দেওয়া মানুষটি হলো মালিহা, তার ছোটবোন।
আমিনা বেগম বাসায় পুলিশ দেখে একটুও ভয় পান নি। কারণ তিনি তো কোথাও লুকিয়ে থাকেন নি। অনেক বছর ধরেই এই বাসায় থাকেন তিনি নিজের ভাইয়ের সাথে।
হামিদুর রহমান কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই আমিনা বলে উঠলেন,
জানি আপনারা কেন এসেছেন। আপনাদের প্রশ্ন করতে হবে না। আমিই বলছি সব।
আমিই খু’ন করেছি সব, প্রতিশোধ নিতে পেরে নিজেকে আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে।
হামিদুর রহমান খুব অবাক হলেন,
উনার দেখা এই প্রথম কোনো ব্যক্তি নিজের মুখে সব স্বীকার করেছে। যে অপরাধ করে, তার মুখ দিয়ে সত্য কথা এতো সহজে বের করা যায় না। কিন্তু আমিনা তো বলেই দিলো সে এসব করেছে।
হামিদুর রহমান কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু আমিনা বলে উঠলেন।
আমাকে গ্রেফতার করুন স্যার। আমি খু’ন করেছি। জানি আমার শাস্তি হবে। কারণ আমার তো আর এতো টাকা পয়সা নাই। দিনের পর দিন মানুষ খু’ন করার পরেও মানুষ বাঁচে যায়। টাকা তাদের বাঁচিয়ে দেয়। আমায় নিয়ে চলুন স্যার।
আমিনা বেগম কথা বলে থামলেন। উনাকে গ্রেফতার করা হয়। যখন ঘর থেকে বের হয়ে আসবেন তখন কেউ উনার হাত ধরে আটকায়।
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন, আদরের মেয়ে মালিহা।
আমিনা দাঁড়িয়ে যান। পুলিশ অফিসার এর দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমাকে কী একটু সময় দিবেন?
হামিদুর রহমান মাথা নাড়ালেন।
আমিনা এবার বললেন,

কাঁদিস না মা। যে দেশে অপরাধীর বিচার হয় না, সেই দেশে হাত একটু আধটু পানিতে ভেজাতে হয়। একটি কথা শুনে রাখ তোরা, ঘোলাপানিতে হাটতে হলে সতর্কতা প্রধান হাতিয়ার। কেনো জানিস? ঘোলাপানিতে উঁচু নিচু কিছুই দেখা যায় না। হাটতে হাটতে তলিয়ে যাবে বুঝতেই পারবে না। কিন্ত পরিষ্কার পানিতে মনের স্বাধীনে হাটা যায়। দুটোই কিন্তু পানি, কিন্তু পরিষ্কার বলে একটি শব্দ আছে তো।
তেমনি যেখানে অ’ন্যায় দেখবি সেখানেই রুখে দাঁড়াবি৷ অ’ন্যায়ে কোনো আপন আর পর শব্দ বলতে নাই, বড়লোক আর ছোটলোক নাই। অ’ন্যায় হলো পানির ভিন্ন ভিন্ন রঙ। চোখ বন্ধ করে রাখলে তলিয়ে যাবে।
যেই দেশে টাকা দেখে আইনের মানুষ চুপ হয়ে যায়। সেই দেশে নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হয়। তোরা কান্না করিস না। আমার অপরাধ, আমি অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছি।

কথাগুলো বলে নিজের দুই সন্তানের কপালে চুমু এঁকে দিলেন। চোখের জল শতো চেষ্টা করে আটকিয়ে রাখলেন।
বিদায় নিলেন। বিদায়ের পূর্বে বড় ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে এক গাল মুচকি হাসলেন।
এই হাসির অর্থ হলো। তোমাদের বাঁচিয়ে দিলাম আমি। তোমরা আমার দুই সন্তানকে দেখে রেখো।
এতোটা মানুষকে একা খু’ন করা কোনো ভাবেই সহজ না। খু’নগুলো তিনিই করেছেন। কিন্তু ওদের বেঁধে কোথাও নিয়ে যাওয়া এসব সাহায্য তিনি নিজের বড় ভাই এবং ভাইয়ের বউয়ের থেকে পেয়েছেন। কিন্তু তিনি কোনো ভাবেই এদের নাম কাউকেই বলবেন না। খু’ন তিনি করেছেন। ওরা তো শুধু সাহায্য করেছে।

আমিনা বসে আছেন পুলিশের গাড়িতে। দুই সন্তানের জন্য উনার মনটা খুব খা’রাপ।
অনেক কষ্টে বায়েজিদ এর খোঁজ পেয়েছিলেন। মাঝেমধ্যে স্কুলে যেতেন তিনি। লুকিয়ে ছেলের সাথে দেখা করতেন।
প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্তা অনেক দিন ধরেই করে আসছিলেন। কিন্তু সঠিক সময় পাচ্ছিলেন না। দিনের পর দিন চৌধুরী পরিবারের বাড়ির সামন ওঁৎ পেতে বসে থাকতেন। কিন্তু কোনো ভাবেই সুযোগ করতে পারছিলেন না।
তারপর হাতে সুযোগ আসে। একের পর এক খু’ন করতে থাকেন। একটুও মন খা’রাপ হয়নি। তবে মেরহাব চৌধুরীরকে খু’ন করার সময় কান্না করেছেন তিনি।
তিনি মেরহাবকে মা’রার আগমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, মনকে বুঝিয়েছেন মেরহাব তো নির্দোষ। কিন্তু মন বলেছে মেরহাব নির্দোষ না। কারণ তিনি যখন মেরহাবের কাছে গিয়েছিলেন, হাতজোড় করে বলেছিলেন,
এই চৌধুরী পরিবারে তুমিই একমাত্র ভালো মানুষ। তুমি সঠিক বিচার পাইয়ে দাও আমায়। চৌধুরী পরিবারকে শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। আইন ওদের শাস্তি দিবে, যদি তুমি আমাকে সাহায্য করো। আমি কাউকে বলব না তোমার কথা। আমরা সবাই এক হবো, সাধারণ মানুষ মিলে এই পরিবারের শাস্তির ব্যবস্থা করব।
সেদিন মেরহাবের উত্তর ছিলো।
ওরা আমার পরিবার। আমার বাবা, আমার চাচা। আমি কীভাবে পারবো? ওদের শাস্তি দিয়ে আমি পারবো না আমার মা এবং চাচীদের কষ্ট দিতে। আমি ওদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না। তবে আমি ওদের খা’রাপ পথ থেকে নিয়ে আসবো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
এসব কথা আমিনার পছন্দ হয়নি। হতে পারে মেরহাব ভালো। কিন্তু সে প্রকৃত ভালো না।
মেরহাবকে খু’ন করার সময় বারবার মনে হচ্ছিল, একটু ভালো হয়ে বেঁচে থাকার কী প্রয়োজন? অ’ন্যায় দেখে চুপ থাকার জন্য কী বেঁচে থাকতে হবে?
আমিনা বেগম আজ অনেক খুশি। চৌধুরী পরিবারকে পেরেছেন কাঁদাতে। যেভাবে ওরা তাকে কাঁদিয়েছিল।
নিজের স্বামীকে কোনো ভাবেই খু’ন করতে পারছিলেন না। বায়েজিদকে ছোট্ট একটি ফোন দিয়ে বলেছিলেন।
বাবা এটা রাখ, তোর ওই খা’রাপ বাবা যখনই বাসা থেকে বের হবে। তখন যেভাবেই হোক আমায় জানাবি। বায়েজিদ অনেকদিন জানিয়েছে। কিন্তু তিনি সুযোগ পাননি। সেদিনও বায়েজিদ জানিয়েছিল। সেদিন সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু খু’ন করতে পারেন নি। সে উনার কথা বলেই দুনিয়া ত্যাগ করল৷ তিনি জানতেন সত্য প্রকাশ পায়। তাই কোনো ভাবেই কখনো পালানোর চিন্তা করেন নি। তিনি আজ সফল। কষ্ট আজ তাকে গ্রাস করতে পারছে না।

আমিনাকে ধরা হয়েছে আজ দুইদিন।
সাজেদা বেগমও জেলে।
নাওশিন ছুটে গিয়েছে রাতের অন্ধকারে হামিদুর রহমান এর বাসায়। সাথে নিয়াজ এবং মিফতা। ওরাই নাওশিনকে হামিদুর রহমানের বাসায় নিয়ে গিয়েছে।
নাওশিনকে দেখে চিনে যান হামিদুর রহমান। উনার কাছে নাওশিনের ছবি ছিলো, যা ওর মা দিয়েছিল।
নিয়াজ এবং মিফতার সাথে দেখে আরো বেশি অবাক হয়েছেন।
আপনি নাওশিন না?
হামিদুর রহমান অনেকটা সময় চুপ করে বসে প্রশ্নটি করেছেন।
নাওশিন হ্যাঁ বলল।
এতোদিন কোথায় ছিলেন? আর নিয়াজ আপনি উনাকে কোথায় পেয়েছেন?
নিয়াজ এবার সবকিছু হামিদুর রহমানকে বলে। উনি সব শুনে অবাক হয়ে আছেন। তবে তিনি এখন বুঝতে পারছেন, কেন নাওশিনের মা নাওশিনকে খু’নি বলেছে। তিনি তো চৌধুরী পরিবারের সন্তানের স্ত্রী ছিলেন।
নাওশিন এবার বলল,
স্যার আমাকে সাহায্য করবেন?
বলুন।
আমার বাবা হঠাৎ ঘুমের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে মৃ’ত্যু বরণ করেছিলেন৷ সবাই তা বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু দিন যতোই যেতে থাকে ততোই আমার মনে হয় আমার বাবার মৃ’ত্যু স্বাভাবিক না।
আপনি যদি আমার আম্মাকে একটু শাস্তি দিয়ে উনাকে সত্যটা বলাতে পারেন। আমার বিশ্বাস আমার বাবার মৃত্যুর কোনো রহস্য আছে। আর আমার মামা খালেদ আহমেদ এবং উনার পরিবারকে ওরাই খু’ন করেছে। আপনার তো এতক্ষণে বুঝে যাওয়ার কথা। আপনি আমাদের সাহায্য করুন। ওরা আজও খোলা আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হামিদুর রহমান সব শুনে ওদের বললেন।
আমি কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে শাস্তি দিবো না। যারা দোষী, আমি তাদের ঠিকই শাস্তি দিবো। আপনারা আর অল্প কয়েকদিন আড়ালে থাকুন। এই যে চৌধুরী পরিবারে একের পর এক খু’ন হচ্ছিল, তা আনিছুর চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী আমিনা করেছে। উনাকেও আমরা ধরেছি। কোনো অপরাধী আমার থেকে বেঁচে থাকতে পারবে না।
হামিদুর রহমানের কথা শুনে নাওশিন একটুও অবাক হয়নি। সে আন্দাজ করতে পেরেছিল। তার মায়ের স্বামীর আর কোনো স্ত্রী আছে। কিন্তু এই কথা নিজের মাকে বিশ্বাস করাতে পারেনি সে।
ওরা বিদায় নেয়৷ চৌধুরী পরিবারের এই করুন দিন দেখার জন্যই নিয়াজের পরিবার অপেক্ষায় ছিলো। সেই অপেক্ষা সমাপ্তি হচ্ছে।
কিছু অপেক্ষার সমাপ্ত হয়। কারণ অপেক্ষা যদি সব সময় অপেক্ষায় থেকে যায়, তাহলে অপেক্ষা কেউ কখনো করতো না। অপেক্ষাতেও পূর্ণতা আছে বলেই মাবুষ অপেক্ষা করে। তবে সব অপেক্ষা পূর্ণতা পায় না।

চলবে,,,

#সাদা_মেঘের_আকাশ
(১৫)
লেখক: হানিফ আহমেদ

হামিদুর রহমান বসে আছেন সাজেদার সামনে। সাজেদা কিছু বলছিলেন না। সাজেদা ভেবেছিলেন, নিজেই সব বলে দিবেন। কিন্তু অফিসারের প্রশ্নে একবারে চুপ হয়ে গিয়েছেন। মহিলা কনস্টেবল পরপর তিনটি থা’প্পড় মা’রে উনাকে।
হামিদুর রহমান বললেন,
মুখ খুলবেন নাকি আমাদের অন্য কোনো পথ বেঁচে নিতে হবে?
সাজেদা নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। কখনো কোনো ভাবেই কল্পনাতেও নিয়ে আসেন নি এই দিনগুলো। কিন্তু বাস্তব তাকে আজ বুঝিয়ে দিলো, সময় সব সময় এক থাকলেও, দিন, মাস, বছর একরকম কখনো যায় না। একটি সূর্যের আলোর দিনেরই কতো রকমের রঙ। কখনো দিন হয় মেঘলা, কখনো মৃদু বাতাসের সাথে লালচে আকাশ, কখনো বা সুন্দর একটি দিন।
হামিদুর রহমান এবার রাগী কণ্ঠে বললেন,
আপনি সব বলবেন কী না? যদি না বলতে চান, তাহলে আমরা আমিনাকে নির্দোষ বলে ছেড়ে দিবো। আর আপনাকে সব খু’নের দায়ে ফাঁ’সিতে ঝুলানোর ব্যবস্থা করব।
সাজেদা এবার তড়িঘড়ি করে বললেন,
না না! আপনারা কী জানতে চান, বলুন? আমি সব বলবো।
হামিদূর রহমান হাসলেন,
তাহলে বলুন, আপনি কেন আপনার প্রথম স্বামীকে খু’ন করেছেন?
এই প্রশ্ন পুলিশ অফিসার এর মুখে দ্বিতীয়বার শুনে তিনি পূর্বের মতো চুপ থাকলেন।
আপনি বলবেন না?
সাজেদা চোখে আসা পানি মুছে শুধু অফিসারের দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না।
আপনার মতো খু’নির চোখে পানি খুবই বেমানান। এমন অভিনয় না করে সত্য কথাগুলো বলুন।
সাজেদা বেগম চোখের দৃষ্টি ফ্লোরের দিকে নিয়ে বলতে শুরু করলেন,

আমার প্রথম স্বামীর সাথে আমি খুব সুখী ছিলাম। মান অভিমানে এক কথায় সব কিছুতেই পরিপূর্ণ ছিলো আমাদের সংসার। কখনো কল্পনাও করতে পারতাম না এই মানুষটিকে ছাড়া। দুজনের একটি সুন্দর বাচ্চা ছিলো, যার নাম নাওশিন আনবার। সত্যিই খুব সুখী ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ সব পরিবর্তন হয়ে যায়। পাশের বাসায় একটি পুরুষ এর সাথে আমার পরিচয় হয়। যার নাম আনিছুর রহমান। যখন থেকে পরিচয়, তখন আমাকে সে এটা ওটা বলে তার প্রতি আকর্ষিত করত। মাঝেমধ্যে এটা ওটা গিফট করত, কিন্তু নিতাম না। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, কীভাবে যেন তার উপর দূর্বল হয়ে যাই। সে যখন তার মনের কথা বলল, আমি মেনে নেই। মনে হয়েছিল আমি কোনো কল্পনার সাগরে সাতার কে’টে যাওয়া ১৬বছরের কিশোরী।
আমাদের সম্পর্কের ৫মাসের পর সে আমায় বিয়ে করতে চায়। কিন্তু আমার প্রথম স্বামী?
সে বলল, আমাকে অনেক সুখে রাখবে, অনেক অনেক টাকা দিবে। আমি লোভে পরে যাই।
সে আমায় বলছিল, রাতে আমার স্বামীর সাথে কথা বলবে। আমিও বিশ্বাস করে নেই। তার বলে দেওয়া টাইমে আমি বাসার দরজা খুলে দেই। তখন আমার স্বামী গভীর ঘুমে।
সে সরাসরি রুমে ঢুকেই আমার প্রথম স্বামীকে ঘুমের মধ্যে খু’ন করে। সেই দৃশ্য দেখে আমি খুব অবাক হয়ে যাই
কোনো ভাবে আটকানোর চেষ্টা পর্যন্ত করিনি। কিন্তু মনে হয়েছিল, একজন নির্দোষ মানুষের মৃ’ত্যু দেখে যাচ্ছি আমি।
আমার প্রথম স্বামীর খু’নি আমার দ্বিতীয় স্বামী আনিছুর চৌধুরী।

হামিদুর রহমান সব শুনে দীর্ঘশ্বাস নিলেন। মানুষ পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তন মানুষের মানায় না। মানুষের পরিবর্তন হতে হয় ভালো কিছুতে। যেমন দাঁত পড়ে আবার দাঁত উঠে। হালকা থেকে মানুষ মোটা হয়, মানুষ সুন্দর হয়। এটাই মানুষের পরিবর্তন। আরো অনেক পরিবর্তন আছে।
কিন্তু এ কেমন পরিবর্তন? যেই পরিবর্তনে একটি মানুষ ভুলে যায় একটি মানুষের সাথে কাটানো ভালো সব মুহূর্ত। ভুলে যায় একটি সংসারের কথা। এই পরিবর্তন মানুষের জন্য না। যে পরিবর্তন জ্ঞানের গাড়ি বন্ধ করে দেয়, এই পরিবর্তন সত্যিই মানুষের জন্য না।
হামিদুর রহমান উনার দিকে তাকালেন।
একটি সুন্দর সম্পর্ককে খু’ন করেছে এই মহিলা। হামিদুর রহমানের চোখ ভিজে যায়। কেন এই দুনিয়ায় এই পরকীয়া?
একটি সুন্দর সংসার ভেঙে যায়। মানুষ বুঝতে পারে না, সে ভুল পথে হাটছে। জ্ঞানহীন হয়ে যায় মানুষ তখন।
হামিদুর রহমান বললেন,

আপনাকে এই মুহূর্তে যদি আমি মে’রে ফেলি। তবুও মনে হবে আমার ভিতর ঘরে থাকা অন্তরটি শান্ত হবে না। আপনি একজন নারী। কীভাবে পারলেন একটি সুন্দর সংসার ভাঙতে। আপনার ফাঁ’সি হোক, এই দোয়া আমি করি।

অফিসারের কথা শুনে সাজেদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
হামিদুর রহমান আবার বললেন,

পরকীয়ার জন্য আপনারা সুন্দর সংসার ভেঙে ফেলুন। একটাবারও ভাবেন না, এটা কী ঠিক? একটি মানুষ আপনাকে নিয়ে ভাবে সেটা মুহূর্তে ভুলে যান। ঘৃণা লাগে আপনাদের মতো পরকীয়ায় থাকা মানুষগুলোকে।

সাজেদা চুপ।
হামিদুর রহমান চলে যেতে চাইলেই সাজেদা বলে উঠলেন।
আমার যদি ফাঁ’সিই হবে, তাহলে আরো কিছু সত্য শুনে যান।
তিনি এসে আবারও চেয়ারে বসলেন।

আমার যদি ফাঁ’সিই হবে, তাহলে আপনি চৌধুরী পরিবারের বিচার কেন করছেন না? নাকি আপনাদের বিচার শুধু আমাদের জন্য? যারা দিনের পর দিন অপরাধ করে যাচ্ছে, আজ পর্যন্ত আপনারা তাদের জেলে ভরতে পারলেন না। আমি না হয় অপরাধী। আমার শাস্তি হবে এখন। তাহলে চৌধুরীর পরিবারে শাস্তি দিচ্ছেন না কেন।
আমার ভাইয়ের পরিবারের খু’নি ওই চৌধুরী পরিবার। কই তাদের তো কিছুই করছেন না।

হামিদুর রহমান মন দিয়ে সব কথা শুনলেন।
মহিলা কনস্টেবলকে রাগী কণ্ঠে বললেন, খুব জোরে যেন সাজেদাকে থা’প্পড় মারে। সেই কনস্টেবল তাই করে, যা সে আদেশ পেয়েছে।
সাজেদা এবার গর্জে উঠলেন,

কেন আমাকে আ’ঘাত করলেন। আপনাদের বিরুদ্ধে বলেছি বলে?

হামিদুর রহমান বললেন হাসলেন। আর বললেন,
আপনি যদি পুরুষ হতেন, তাহলে আমিই আপনাকে আধম’রা করতাম প্রথম। কিন্তু ভাগ্য ভালো আপনি নারী। আমি নারী জাতকে সম্মান করি। কারণ একজন নারী আমার মা, একজন নারী আমার বোন, একজন নারী আমার স্ত্রী, একজন নারী আমার মেয়ে। তাই আমি নারীজাতকে সম্মান করি। কিন্তু আপনাকে সম্মান কেন, আপনার চেহারা দেখতেও লজ্জা লাগছে আমার। আপনি কী একজন নারী? কীভাবে বিশ্বাস করি এই কথা? যে নারী নিজের স্বামীকে খু’ন করতে সাহায্য করে। যে নারী আপন ভাইয়ের খু’ন এর দায় নিজের গর্ভের সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে পারে। সেই নারী কী সত্যিই নারী?
কীভাবে পারলেন সেদিন নিজের মেয়েকে ফাঁসাতে। অন্তর একটুও কান্না করল না এমন মিথ্যা বলার পূর্বে?
আজ সব জেনেছি, তো সত্য বলতেছেন।

সাজেদা চুপ থাকলেন। কিছু বলার চেষ্টাও করলেন না।
হামিদুর রহমান চলে যান সাজেদার সামন থেকে।

অনেক দিন কেটে যায় ঘটনাগুলোর।
আজ সাত ভাই এক হয়েছে। সাথে নাওশিন এবং আতিকা চৌধুরীও আছেন। তাদের লুকিয়ে থাকার দিন শেষ। কিছুটা শান্তি পাচ্ছে তারা।
কঠিন জীবনের সমাপ্তি বুঝি এইবার হবে। কিন্তু এখনও যে চৌধুরী পরিবার খোলা আকাশের নিচে।
আদিবের পরিবার আবারও পূর্ণতা পায়। সবাই আজ নিজেদের বাসস্থানে ফিরেছে। আতিকা আসতে চান নি। কিন্তু সাত ভাই জোর করে নিয়ে এসেছে উনাকে। উনার একটিই কথা।
আমার আনিক এসে যদি আমাকে বাসায় না পায়?
উনি এখনও বিশ্বাস করেন আনিক ফিরে আসবে। অপেক্ষা এখনও ছেলের জন্য করেন।
আদিবের মুখে হাসি, চৌধুরী পরিবারে একজনের পর একজনের খু’ন হয়েছে। কেউ তো শাস্তি দিয়েছে এদের। এই দৃশ্যই তো দেখতে চেয়েছিল তারা।
তাদের অপেক্ষা তখনই পূর্ণতা পাবে। যখন চৌধুরী পরিবারে কোনো পুরুষ থাকবে না। থাকবে শুধু নারী, আর ছোটছোট বাচ্চারা। একটি অহংকারী পরিবারের পতন তো এভাবেই হয়।

হামিদুইর রহমান ২০জন পুলিশের লোক নিয়ে আজ চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত। বেশ কিছুদিন চুপ থাকেন, কারণ এই চৌধুরী পরিবার এতোটা চালাক যে, যদি কিছু বুঝতে পারতো। তাহলে কাউকেই গ্রেফতার করতে পারতেন না।
চৌধুরী পরিবারের কোনো পুরুষকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই গ্রেফতার করতে থাকেন।
জালাল চৌধুরীকে দিয়েই শুরু করলেন গ্রেফতার করা। মুকিত চৌধুরীকে কীভাবে গ্রেফতার করবেন? এক সেকেন্ডেরও নিশ্চয়তা নাই এই মানুষের। তাই উনাকে এভাবেই ছেড়ে দিলেন। এভাবেই কষ্ট পেয়ে বিদায় নিবে মুকিত চৌধুরী।
এক এক করে চৌধুরী পরিবারের ২৩জন পুরুষকে গ্রেফতার করেন।
বিশাল বাড়ি খুঁজে ১৬ বছরের উপর আর কোনো পুরুষ পাননি তিনি। এই ২৩ জন্যের মধ্যে সব থেকে কম বয়স যার, তারই বয়স ২৪ বছর।
সবাইকে গ্রেফতার করে নেওয়ার জন্য গাড়িতে তুলছেন।
মেরহাব চৌধুরীর দুই ভাইকে পুলিশ পায় নি। রামিনা বেগম নিজের দুই ছেলেকে নিয়ে অনেক পূর্বেই এই চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করেছেন।

গ্রেফতার করার সময় জালাল চৌধুরী জানতে চেয়েছিলেন। কেন তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তখন হামিদুর রহমান বলেছেন,
আপনাদের দিন শেষ। এবার আপনাদের শাস্তি পাওয়ার সময়। এতো এতো মানুষের উপর অ’ত্যাচার, এতো এতো মানুষকে খু’ন করেছেন। এবার তো তার সমাপ্তি হতে হবে। একের পর এক অন্যায় করেছেন। কিন্তু পুলিশ আপনাদের ধরেনি। হয়তো পূর্বের পুলিশ আপনাদের মতোই ছিলো। কিন্তু কালো মেঘ সরে যায়, আকাশ তার সৌন্দর্য পায়। তেমনি আইনেরও মেঘ বৃষ্টির খেলা আছে।
জালাল চৌধুরী বা উনার পরিবারের কেউ কোনো কিছু বলবার সাহস পায়নি আর।
চৌধুরী পরিবারের এই দুর্দশা দেখে আজ সাধারণ মানুষ অনেক খুশি।
আজ চৌধুরী পরিবারে হাহাকার, শুধুই নারী শিশুদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। তবে আজ এই আর্তনাদে কেউ কষ্ট পাচ্ছে না। চৌধুরী পরিবারের অ’ত্যাচারে এভাবেই তারা একদিন আর্তনাদ করেছে।

প্রতিটা পত্রিকায় এখন এই খবরে ভরে গিয়েছে। চৌধুরী পরিবারের সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ অফিসার হামিদুর রহমানকে সবাই বাহ বাহ দিচ্ছে। প্রতিটা পত্রিকা এখন চৌধুরী পরিবারের কুকীর্তি তুলে ধরতে ব্যস্ত। কিন্তু এর পূর্বে পত্রিকার সাংবাদিক গুলো নীরব ছিলো।

আজ আদিবের পরিবার খুশি। খুশি আতিকাও। নাওশিনও আজ খুব খুশি হতো, যদি এই কথা সে না শুনতো
তার বাবাকে তার মা এবং মায়ের স্বামী খু’ন করেছে। একটু পর পর তার চোখ ভিজে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে তার বাবার দোষ কী ছিলো?
সবাই আজ আনন্দিত। কিন্তু নাওশিন বিষাদের স্পর্শ পেয়ে চুপ করে বসে আছে, বসে বসে নীল আকাশ দেখতে ব্যস্ত সে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে কষ্ট গুলো হালকা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে।
এ-কি নাওশিন? তোমার চোখে আজ পানি?
নিয়াজের প্রশ্ন শুনে নাওশিন চোখের পানি মুছে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলো।
আজ দেখো আমরা কতো আনন্দিত। তাহলে তুমি কেন কান্না করছো?
নাওশিন নিয়াজের দিকে তাকায়। এই মানুষটিকে সব সময় রাগী চেহারায় দেখেছে। কিন্তু আজ তাকে খুব শান্তশিষ্ট লাগছে। নাওশিন বলল,
আকাশটা দেখছেন। কতো সুন্দর। কিন্তু এই আকাশ দেখতেও আজ মনে হচ্ছে আকাশটা অন্ধকার। আমার আব্বার দোষ কী ছিলো? কেন আমার আব্বাকে ওরা খু’ন করেছে?
নিয়াজ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাওশিন জানালার পাশ থেকে এসে বিছানায় বসে। নিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে।

আমার এখনো মনে আছে আমার আব্বা কখনো আম্মাকে তুই করে ডাকেন নি৷ খুব ভালোবাসতেন আম্মাকে। আমরা একসাথে প্রতিটা বিকাল আকাশ দেখতাম। আব্বাকে পা’গল হয়ে যেতে দেখতাম আম্মার একটু অসুস্থতায়। আম্মার কোনো ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেন আব্বা। এতো ভালোবাসার পরেও যদি ভালোবাসার মানুষের কাছে খু’ন হতে হয়। এই পৃথিবীতে এর থেকে বড় কোনো কষ্ট আছে? একটি পরপুরুষ এর কাছে আব্বার এতো বছরের ভালোবাসা ভুলে কীভাবে চলে যেতে পারল ওই মহিলা। আম্মা ডাকতেও ঘৃণা লাগছে।
আব্বা আমাকে বলতেন, নাওশিন মা আমার সব সময় মানুষকে ভালোবাসবি। এইযে আমি তোর মাকে ভালোবাসি, তোকে ভালোবাসি। এভাবেই মানুষকে ভালোবাসবি। আচ্ছা এতো ভালোবাসার পরেও যদি ভালোবাসার দাম না থাকে, তাহলে কী হবে মানুষকে ভালোবেসে? আজ আমার বেঁচে থাকার ইচ্ছে করছে না। যে পৃথিবীতে ভালোবাসার দাম নাই, এতো ভালোবাসার পরেও মানুষ পরিবর্তন হয়, সেই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার জন্য শুধুই সময় নষ্ট মনে হচ্ছে।

নাওশিন কান্না করছে। আজ তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার বাবা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো তার জীবন আজ অনেক সুন্দর হতো। আকাশে থাকা চাঁদটা যেমন সুন্দর। আজ সেও তেমন সুন্দর হতো, কিন্তু তার যে আকাশ নাই।
নিয়াজ চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলে সান্তনা দিবে, সে বুঝতেছে না। নাওশিনের ওই জল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। নিয়াজ এর ইচ্ছে হচ্ছে জলে ভরা ওই চোখ মুছে দিতে৷ কিন্তু দিলো না, কান্না করুক, একটু কান্না ভুলিয়ে দেয় মানুষের কষ্ট।
১৬বছরের একটি মেয়ে, মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা। সৌন্দর্যের এক বিশাল রাণী সে। সেই রাণীর চোখে ফোটা ফোটা জল। ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছা মনে প্রবল। তবুও সে তাকিয়ে আছে, আকাশের বৃষ্টির যেমন সৌন্দর্য, তারও চোখের ফোটা ফোটা বৃষ্টি যেন মুগ্ধ করে দিচ্ছে তাকে। তাই ছুঁয়ে দিলো না। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর যে আকাশের রংধনু হারিয়ে যায় কোথাও।
নিয়াজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো এভাবেই। কিন্তু সে জায়গা ত্যাগ করল। বৃষ্টিও বেশিক্ষণ ভালো লাগে না, আর এটা তো চোখের জল।

আদিব বাসার ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল আকাশে আজ শুধুই সাদা মেঘ। তার ভালোই লাগছে সাদা মেঘের আকাশ দেখতে। মানুষ বলে আকাশের মেঘ ভালো লাগে না। কিন্তু তা কতটুকু সত্য সে জানে না।
আদিবের পাশে এসে মিনহা দাঁড়ায় সাথে তাদের ছেলে।
আকাশ দেখছো?
স্ত্রীর কথায় শুধু মাথা নাড়ায় আদিব।
এই মেঘে ঢাকা আকাশ তোমার ভালো লাগে?
হ্যাঁ।
মিনহা মুচকি হাসলো।
কই আর তো কারো মুখে শুনলাম না মেঘে ঢাকা আকাশ কারো ভালো লাগে।
আদিব মুচকি হেসে বলল।
ওই যে দূরে বিশাল সাদা মেঘ দেখতে পারছো? একটু সময় তাকাও। মনের মধ্যে একটি কথাই আসবে, ওই দূর প্রান্তে যেতে পারলে মনে হয় সাদা মেঘ স্পর্শ করতে পারবে। কই কারো মুখে তো কখনো শুনলাম না নীল আকাশ স্পর্শ করার কথা। নীল আকাশ তো সবাই ভালোবাসে। তোমাকে ভালোবেসে যেভাবে ছুঁয়ে দেই। সেভাবেই খুব ইচ্ছে করে সাদা মেঘ ছুঁতে। এই সাদা মেঘের মতোই আমাদের জীবন। আকাশে উড়া বিমান সাদা মেঘের ভিতর দিয়ে চলে যায়। যেভাবে আমাদের ভিতর শুধুই কষ্ট৷ সাদা মেঘের আকাশে যেমন আড়ালে থাকা বিমানের শব্দ শুনতে পারি, দেখতে পারি না। তেমনি আমাদের আর্তনাদ শোনা যায়। কিন্তু দেখা যায় না। সত্যিই কতো মিল আমাদের। তাই তো আমি সাদা মেঘের আকাশ ভালোবাসি।
মিনহা কিছু বলল না। মেঘের দিকে কিছুক্ষণ তাকানোর পর তার মনে হলো, সত্যিই যদি ওই প্রান্তে যাওয়া যেতো? তাহলে বিশাল মেঘ ছুঁয়ে দিতো।
আদিব আর মিনহা তাদের গল্পে মেতে উঠলো।
পিছন থেকে এই দৃশ্য নাওশিন দাঁড়িয়ে দেখলো। তার আজ খুব মনে পরছে বাবার কথা। এমন ভাবে কতো বিকেল কাটিয়েছে। কিন্তু আজ সে একা খুব একা। চোখের পানি মুছে নিচে চলে যায় সে।

সব কিছু কেমন নীরব। তার মায়ের স্বামীর খু’নের আজ ১মাস হয়েছে। নাওশিন নিজের সাথে নিয়ে আসা ছোট্ট ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।
বাবার কষ্টে গড়া সেই সাজানো বাসায় চলে যাবে। সেখানেই নিজেকে রাঙিয়ে রাখবে। হোক কষ্ট। তবুও সে তার বাবার স্মৃতি নিয়ে বাঁচবে। এই পৃথিবীতে হয়তো সে একা। তবুও সে সাজবে, সাজাবে নিজের রঙে এই পৃথিবীকে।
নাওশিনের হাতে ব্যাগ দেখে সবাই যেন অবাক। মিফতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
নাওশিন হাতে ব্যাগ?
ভাইয়া আমি আমার বাসায় চলে যাচ্ছি। যে বাসায় আমার বাবার সব স্মৃতি রয়েছে আমি সেখানে থাকবো।
মিফতা বলল,
কী বলো নাওশিন? তোমার বয়সটা দেখছো? ১৬বছর। এই বয়সে একটি বাসায় কীভাবে একা থাকবে?
ভাইয়া বয়সটা ১৬ হলেও, আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি৷ নিজেকে ১৬বছরের মেয়ে মনে হয় না। মনে হয় কোনো ৩০বা ৪০ বছরের নারী আমি।
নিয়াজ এবার রেগে বলল,
পিচ্চি মেয়ের পাকা কথা শুনো তোমরা। কেমন পাকা পাকা কথা।
নাওশিন রেগে যায়। নাওশিন বলল,

আপনি কী বুড়া? দুই পাটির দাঁত কী পড়ে যাচ্ছে? চুল কী পেকে যাচ্ছে? আপনার কোলে কী নাতিনাতনি নিয়ে বসে আছেন?

নিয়াজ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুধুই তো পিচ্চি বলেছে।
আদিব বলল,

নাওশিন তোমার কী সমস্যা হচ্ছে এখানে থাকতে?
ভাইয়া আমি আমার বাবার বাসায় থাকবো। সেখানে বাবাকে অনুভব করে বাঁচবো। মনে হবে বাবার সাথেই আমি আছি।
আদিব বলল,
একা?
নাওশিন নিচের দিকে তাকিয়ে বলল।
হ্যাঁ, এই পৃথিবীতে বলতে আমার আপন তো কেউ নাই। আমি একাই।
আদিব হালকা রেগে বলল,
আমাদের এতো গুলো মানুষের সামনে নিজেকে একা বলতেও ভয় পেলে না। এই ভুলের জন্য যদি আমরা সবাই তোমার একটি একটি চুল ছিড়ে ফেলি। তাহলে তোমার মাথায় চুল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর নিজেকে একা ভেবে নিলে।
আদিবের কথায় সবাই হেসে দেয়। মিফতা বলল,
ভাইয়া নাওশিন যখন যেতে যাচ্ছে তাকে যেতে দাও। তবে একা না।
কাকে সাথে দিবে?
আদিবের প্রশ্নে মিফতা বলল,
আতিকা আপা থাকবেন নাওশিনের সাথে। আমরাও যাবো মাঝেমধ্যে। ভাবি, আমার স্ত্রী এবং আমার ভাইদের স্ত্রী যাবে। এতে সবাই ভালো থাকবে।
আদিব উনার দিকে তাকিয়ে বলল।
আপা যাবেন?
আতিকা কিছু বললেন না। শুধু মাথা নাড়ালেন।
আতিকার খুব ভালো লাগে নাওশিনকে। এক সাথে অনেক দিন থেকেছেন। তাই আর না করলেন না।
আদিব গাড়িতে করে ওদের নিয়ে রওনা দেয়। নাওশিন অপেক্ষায় গন্তব্যে পৌঁছানোর।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে