Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1018



MEANINGLESS LIFE PARTNER Part-01

0

#MEANINGLESS_LIFE_PARTNER
পর্ব:সূচনা
#লেখিকা_Arshi_khan

আট বছরের একটা মেয়েকে বিয়ে করার মতো মিনিংলেস একটা কাজ করতে বাধ্য করেছে আমার ফেমেলির লোক।ওর মতো বাচ্চাকে যে এখন ও মাঝেমধ্যেই বিছানার উপর হিসু করে সে কিনা আমার বিয়ে করা বউ। ভাবতেই সারা শরীর ঝংকার দিয়ে উঠছে।গাড়িতে বসে যখন ওকে নিয়ে ফিরছি ও ওর টেডি নিয়ে আমার আম্মুর কোলে ঘুমে বিভোর। বাড়ি ফিরতে এখন ও ঢের দেরি ততক্ষণ এ আমার পরিচয় টা আপনাদের দিয়ে নেই।
আমার নাম মোহাম্মদ আয়ান শেখ।বয়স এক সপ্তাহ আগেই পনের পেড়িয়ে ষোল তে পা দিলাম আরকি।এইবার ক্লাস টেইন এ উঠেছি।আমি আমার বাবা আর মায়ের প্রথম সন্তান। আমার পড়ে আরো তিনজন আছে।আমেনা ,আছমা এবং আয়েশা।আমার ফেমেলির মধ্যেই মানে চৌদ্দ গোষ্ঠীর প্রথম ছেলে সন্তান আমি এই।আমাদের ফেমেলি যৌথ ফেমেলি।তিন চাচা ও আমার আব্বুর মোট বারোজন সন্তান। তার মধ্যেই আমি এই একমাত্র পুত্র সন্তান।আমার দাদাজান হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেই সুবাধে অনার শখ জাগে আমার বিয়ে দেখে অককা তুলার।আর সেই জন্য ঐ বুড়ার কথাতে আমার আব্বু মহাশয় এই পদক্ষেপ নেন।কারো মিনিংলেস শখ পূরণ করতে এইটুকু বাচ্চার সাথে আমার বিয়ে করিয়ে দেন।সকালে পালাতে চেয়েছিলাম কিন্ত আব্বুর মেন গেটে বসে জালি বেতে তেল দেওয়া দেখে আবার চুপচাপ ঘরে ফিরে গেছিলাম।জদিও এমন বিয়ে আমি মানতে নারাজ।কিন্ত কিছুই করার নেই।আর রইল পরে আমার বউ তার নাম মোসাঃ রুতবা হোসাইন ।বয়স তো আগেই বললাম আট বছর। বাবা মায়ের বড় মেয়ে।ওর পরে একটা ছেলেও আছে আমার শশুর এর।সে এখন ও কোলেই চরে বেড়ায়।কারণ তার বয়স মাত্র দেড় বছর। রুতবা এইবার ক্লাস থ্রি তে পড়ছে।আমার শশুর মশায় আব্বুর বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার সুবাদে আমার দাদার মনের বাসনা পূরণ করতে পিছপা হয়নি।এদিকে আমি আছি মহা টেনশন এ।আমার তেরো বছরের একটা গার্লফ্রেন্ড আছে।ও আমার স্কুল এর ক্লাস সেভেন এ পরে।ওকে আমার ভিষন ভাল লাগে।কিন্ত ও যখন জানবে ওকে রেখে আমি রুতবা কে বিয়ে করেছি তখন ও ভিষন কষ্ট পাবে।কারণ ও ও আমাকে পছন্দ করে।(আয়ান গাড়ির বাইরে তাকিয়েই মন খারাপ করে)

আন্টি আমি চিপস খাব।(ঘুমের থেকে উঠেই রুতবা)

এই নাও মা।আর শোন নতুন জায়গাতে কিছু খেতে মন চাইলে আমাকে এসে বলবে যদি অন্য কাউকে লজ্জা লাগেতো কেমন!(আম্মু রুতবার মাথায় হাত দিয়ে)

আচ্ছা। আয়ান ভাই তুমি খাবে নাও?(চিপস এর প্যাকেট আয়ান কে এগিয়ে দিয়ে)

তুমি এই খাও।(বিরক্তিকর সুরে আয়ান)

আঙ্কেল আপনি খাবেন?(চিপস এগিয়ে রুতবা,)

না আম্মু তুমি খাও।(আব্বু মুচকি হেসে)

আন্টি খাও?(রুতবা মুচকি হেসে)

না আম্মু আমার পেট ভরা তুমি খাও আমি পরে খাবনে।(মুচকি হেসে আম্মু)

সে মনের আনন্দে চিপস খাচ্ছে। তার যে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে হল তা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই।কারণ বিয়েটা তার কাছে অনেকটা পুতুল বিয়ের মতো ছিল। আমি ওর দিকে তাকাতেই মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। আমার বয়স প্রাপ্য বয়স না হলেও বিয়ে সংসার বউ এসব বিষয়ক ধারণা বেশ আছে।তার উপর সাইন্স এর স্টুডেন্ট হওয়ার সুবাদে সব কিছু একটু বেশিই আয়ত্তে আনতে আমার সময় লাগেনা।তাই আমার কাছে রুত শুধুমাত্র একজন #MEANINGLESS_LIFE_PARTNER হিসেবেই গন্য হবে।রুতবা কে সবাই রুতবা বললেও আমি কোনদিন রুতবা বলে ডাকিনা।আমার কাছে ওর নামের এই রুত অংশ টুকুই ভাল লাগে।এসব হাজার ভাবনার মাঝেই আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলাম। আমার বাড়ি বিক্রমপুর এ অবস্থিত ।আর রুত দের বাড়ি আমার বাড়ির থেকে আরো এক ঘন্টার পথ।তাও বিক্রমপুর এর আরেক গ্রামে অবস্থিত। যাইহোক রুতকে শাড়ি পড়ানোর কারণে ও হাটতে পারছেনা আর গাড়িতে তিনজন এর সিট পেছনে তাই আম্মু ওকে কোলেই রেখেছিল। কিন্ত আম্মুর পা জিম ধরার কারণে গাড়ির থেকে নামতেই ওকে আমার কোলে দিয়ে দিয়েছে।অনেক বিয়েতে দেখেছি হাজবেন্ড রা তাদের বউ দের পাঁজকোলে তুলে বাড়ি প্রবেশ করে।আর আমি আমার বউ কে এক প্রকার বাচ্চাদের যেভাবে নেয় সেইভাবে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছি।দাদুর শরীর অসুস্থ দেখে আর দুইজন এই বাচ্চা দেখে বিয়ের কোন আওয়াজ করা হয়নি।তবে আমরা বড় হলে আমাদের বড় করে অনুষ্ঠান করার চিন্তা করে রাখা হয়েছে।মানে আরো দশ বারো বছর আমার নিজের বউ কে একজন গার্ডিয়ান হিসাবে লালন পালন করে বড় করে তারপর বউ হিসাবে পাচ্ছি। ওকে কোলে করে আনতে আমার কেন জানি একটুও কষ্ট হয়নি।কারণ ও ওনেক শুকনা আর বয়স অনুযায়ি গ্রথ একটু কম।ওকে কোলে নিয়ে এই আমি সোজা দাদুর ঘরে গেছি।সে দেখে কান্না করে ভাসিয়ে দিচ্ছে সাথে আমার বাড়ির সবাই ও মরা কান্না জুড়ে দিয়েছে।শুধু আম্মু বাদে।কারণ আম্মু খুব স্ট্রং পার্সোনালির পার্সোন।তিনি এক হাতে পুরো সংসার সামলান বললেই চলে। আর সবাই ও কাজ করে কিন্তু আম্মু বাড়ির বড় বউ হিসাবে বেশ বিচক্ষণ।যদিও আব্বু বিদেশ থাকার কারণে আব্বু বড় হওয়ার সত্ত্বেও আমার মেজ বাবা আর সেজ বাবা বিয়ে করে ফেলেছিল।তাই আমি তাদের পাচঁ মেয়ের থেকে তিন জনের ছোট।আর দুইজন আমার ছোট।ওদের সবার সাথেও পরিচিত হবা কোনদিন। কারণ আমার গল্প যে অনেক বড় হতে চলেছে।দাদুর রুমে রুত কে রেখেই আমি আমার রুমে চলে এসেছি।আমাদের বাড়িটা তে ছয়টা বড় বড় রুম দিয়ে উঠানো হয়েছে।তিনটা তিনটা করে সেম ডিজাইন করে দুই সাইটে ঘর আর মাঝখানে উঠান।প্রতিটা ঘরের ভেতর তিনটা করে রুম।তবে আমাদের টা তে দুইতালা কাঠের ও টিনের ঘর বলা চলে।কারণ আর কারো ছেলে নেই বলে আমার দাদু তাদের একতালা টিনের ঘর তুলে দিয়েছেন। যদিও সব আব্বুর পাঠানো বিদেশ এর টাকা দিয়ে।আর আমার জন্য শুধু আমার আব্বুর দুইতালা ঘর পেয়েছে।দুইতালাতে আমার দুই বোন ঘুমায়।আর নিচের তালায় এক রুম আব্বু আর আম্মুর সাথে আয়েশার। অন্য রুমটা আমার এই রুমের ভেতর একটা ছোট টয়লেট বানিয়ে দিয়েছে আব্বু ।যাতে রাতে আমার বা আমার ছোট বোনদের বাইরে যেতে ভয় না লাগে।আমি রুমে এসে পাঞ্জাবি টা খুলে রুমের গেটের উপর মেলে দিলাম।অনেক ঘেমে পাঞ্জাবি ভিজে একাকার। তারপর বাড়ির উত্তর দিকের আম গাছের দিকে চলে গেলাম। নতুন কয়েকটা আম পেকেছে ছোট বাবার গাছের।আর এই গরমের রাতে ঘুম আনানোন বেস্ট ওয়ে এই পাকা আম।দাদুর রুম থেকে ধীরে ধীরে সবাই বেরিয়ে যার যার ঘরে চলে যাচ্ছে। কারণ অলরেডি নয়টা বাজে।এমনে সময় আটটা সাড়ে আটটার মধ্যেই সবাই গেট লক করে দেয়।কারণ দেশ গ্রামে রাত জাগে না মানুষ ।আমি গাছ থেকে কোঠা দিয়ে পাকা আম পেরে সেখানেই খাওয়া শুরু করে দিলাম। একটা রেখে তাও আম্মুর জন্য। কারণ আমার বোনেরা তেমন পাকা আম খায়না।রুম থেকে হাসির শব্দ আসছে।এদিকে ব্যাঙ এর ডাক আর মশার উপদ্রব এ আমার অবস্হা খারাপ তাই আম খেতে খেতেই আবার রুমে চলে আসছি।এসে দেখি রুত আর আয়েশা বসে হাড়িপাতিল দিয়ে খেলছে।আমি দেখেও না দেখার ভান করে রুমে এসে আরাম করে আম খাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর দেখি রুত এই রুমের দিকে একবার তাকায় আবার খেলাতে মন দেয়।আবার তাকায়।তাই আমি ওকে ডাক দিলাম।
এই রুত এদিকে এসো।(আয়ান রুতবার উদ্দেশ্য)

হ্যা আয়ান ভাইয়া কিছু বলবে?(আয়ান এর হাতের দিকে তাকিয়েই রুতবা)

তাকিয়ে ছিলা কেন?(আয়ান ব্রু নাচিয়ে)

এমনেই।(এখন ও হাতের দিকে তাকিয়েই রুতবা)

আচ্ছা তাহলে যাও খেল।(আয়ান বলেই আবার আম খেতে লাগল)

কি পচা ছেলে আয়ান ভাইয়া জান আম আমার অনেক পছন্দের তাও পাকা আম অথচ একটু খেতে সাধল না।আমিতো তখন চিপস সেধে ছিলাম।তাহলে আমাকে একটু আম দিলে কি হতো?(বিরবির করে রুতবা খেলার জায়গাতে এসে )

কিছুক্ষণ পর আম্মু রুমে আসল পোলাও আর গরুর মাংস নিয়ে।আম খেয়ে পেট ভরে গেছে।তাই আম্মুকে বললাম সবাই খেয়ে আমার জন্য রেখে দিতে পরে খাব।সবার রান্না একসাথে করা হলেও খাবার যে যার ঘরেই খায়।কারণ একেকজন এর পোলাপাইন একেক রকম। বড় ছোট নিয়ে মারামারি কারাকারি এর জন্য সবাই আলাদা খায়।মানুষ বুঝে খাবার বেড়ে দেওয়ার পর যে যার রুমে চলে যায়।তাই আমি একটু দেরিতে খাই সব সময়ই।
রুতবা আর আয়েশাকে আম্মু খাইয়ে দিচ্ছে। কারণ দুইজন এই হাত দিয়ে খেতে পারেনা।আয়েশা আর রুত এক মাসের ছোট বড়।আর আমার আর দুইবোন আমেনা তের বছর আর আছমার এগারো বছর। যাইহোক ওরা খাবার খাচ্ছে দেখে আমি একটু টিভি ছাড়লাম।আজকে শুক্রবার ছিল কিন্তু সিনবাদ টা দেখতে পারিনি।আমার সবচেয়ে প্রিয় নাটক।কি আর করা বিটিভিতে ছায়াছবি ছেড়েছে তাই দেখতে লাগলাম। আর এদিকে গান শুনে রুত খাবার রেখে নাচতে শুরু করেছে।তাই রিমোট রেখে আমি নিজের রুমে চলে আসলাম। আর আসার আগে আম্মুর হাতে একটা আম দিয়ে আসলাম।প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে তাই সেন্টো গেঞ্জি খুলে লাইট অফ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।
হঠাৎই নাকে পাকা আমের গ্রান পেতেই আমি সামনে হাতরাতে লাগলাম। হাতে ছোট শরীর লাগতেই লাফিয়ে উঠলাম ।
ভূত ভূত ভূত (চিৎকার করে আয়ান)

কি হয়েছে বাবা?(আম্মু দৌড়ে এসে আয়ান এর উদ্দেশ্য)

আমার বিছায় কেউ শুয়ে আছে?(আতঙ্কিত কন্ঠে আয়ান)

হ্যা রুতবা ঘুমিযেছে।তা তুই চিৎকার করলি কেন বাবা?(আম্মু লাইট জ্বালিয়ে আয়ান এর হাত ধরে)

ও এখানে কেন?(বিরক্তিকর সুরে আয়ান)

উপরে যেই খাট সেখানে আমেনা আর আছমা ঘুমায় আমাদের সাথে আয়েশা আছে।আর তুই তো জানিস রুতবা তোর আর আয়েশার সাথে ছাড়া থাকতে চায়না।তাই তোর এখানে ঘুমিয়েছে।(আম্মু শান্ত সুরে)

তা শুয়েছে ভাল কথা আম নিয়ে কেন আমার খাটে উঠছে পিপড়া আসব তো?(মুখ ভার করে আয়ান)

তুই নাকি কিছুক্ষণ আগে আম খেয়েছিলি ওকে সাধিস নাই কেন বাবা?(আম্মু আয়ান এর হাত ধরে)

ওতো চায়নি আর আমেনা আছমা আর আয়েশা তো পাকা আম খায়না তাই ওকে ও সাধা হয়নি।কেন কোন সমস্যা?(আয়ান ব্রু কুচকে)

তা নিয়ে কিছুক্ষণ আগে কান্না করে বিচার দিয়েছে আমাদের কাছে।যে ওকে না দিয়ে তুই আম খেয়েছিলি আর ও তাকানোর কারণে ওকে ডেকেও নাকি আম দেসনি এতে ও কষ্ট পেয়েছে।তাই আমাকে যখন আমটা দিলি ও চেয়ে নিয়ে তারপর ঘুমিয়েছে।সকালে উঠে খাবে বলে।(আম্মু রুতবার পাশে বসে ওকে সোজা করে বালিশে শুইয়ে)

ও চাইলে তো আমি দিতাম এই।ও চাইতে পারল না!(আয়ান হালকা রাগ করে)

ওকে দেখেছিস কারো চাওয়ার অপেক্ষা করে।চাওয়ার আগেই সবাইকে দেয় তারপর নিজে খায়।তাহলে তুই কেন ওর চাওয়ার অপেক্ষা করবি?আর একটা কথা বাবা বিয়েটা যেভাবেই হোক ও তোমার বউ ওর ভাল মন্দ সব আমাদের থেকে বেশি তুমি বুঝবে।যদিও ছোট বাচ্চা। কালকে বা পরশু এসে ওর আব্বু আম্মু নিয়ে যাবে।কিন্ত ও যখন মাঝেমধ্যেই আসবে তখন ও লজ্জা বা সংকচ এর কারণে কিছু না চাইতেও পারে।আর আমার মতে তুমি বুঝদার ছেলে ওর ভাল মন্দ সব কিছু তুমি দেখে রাখবে।তাই কিছু খেতে নিলে ওকে দিয়ে খাবে।আবার ওকে জিজ্ঞেস করবে কিছু খেতে চায় কিনা?বুঝলে বাবা?(আম্মু আয়ান এর উদ্দেশ্য)

আচ্ছা ঠিক আছে এই কথা যতদিন ও আমার কাছে থাকবে আমি মনে রাখব এসব বিষয়।এখন যাও ঘুমাতে নাহলে আয়েশা উঠে যাবে আর কান্না করবে।(আয়ান আম্মুর উদ্দেশ্য )

আচ্ছা। (বলেই ঘুমাতে চলে আসলাম আম্মু )

আমি আবার গিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটা সময় ঘুমে বিভোর হয়ে গেলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই এমন কিছু দেখলাম যা দেখে লজ্জার কারণে না কিছু বলতে পারছি আর না কিছু করতে। কি একটা মুশকিল এ পড়লাম রে বাবা!(আয়ান মনে মনে)

****************(চলবে)************

রূপকথা পর্ব-০৯(অন্তিম পর্ব)

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#অন্তিম_পর্ব

[১৯]
বাড়ির বিস্তৃত উঠান জুড়ে খেলা করে তৈরি হয়ে নিলো মাহতাব। পাঁচ বছর বয়স তার। খোরশেদ এর ছেলে। পা টিপে টিপে ফুফির রুমের সামনে দাঁড়ালো। পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে দেখলো ফুফির তৈরি হওয়া কতদূর। আজ তাদের স্কুলে গার্ডিয়ান ডাকা হয়েছে। মাহতাবের গার্ডিয়ান হিসেবে রূপকথা আছে। তাই আর খোরশেদ বা তার স্ত্রী যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা।
কালো রঙের একটা সুতি শাড়ি পড়ে চোখে গাঢ় করে কাজল টানলো রূপকথা। মনের মতো করে নিজেকে গুছিয়ে নিলো। এখন আর কারো কথার ধার ধারেনা সে। নিজের মর্জি মতো চলে। এখন মানুষগুলো তার ব্যাপারে নাক গলাতে আসেনা। বহু আগেই সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রূপকথা খপ করে মাহতাবের হাত ধরতেই খিলখিল করে হাসলো বাচ্চাটি। কোলে তুলে নিয়ে নাস্তা করতে গেলো।

পড়ার পাট চুকিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা পদে চাকরী হয়েছে রূপকথার। এতদূর পৌঁছানোর পথটা সহজ ছিলোনা। নানা প্রতিকূলতা, অর্থসংকট এর ভেতর দিয়ে এ পর্যায়ে এসেছে। এতে খোরশেদের অবদান সর্বোচ্চ। একটুকরো জমি ও বিক্রি করে দিয়েছে রূপকথার পড়ার খরচের জন্য। এখন তাকে কেউ কালো বলে কটূ’ক্তি করার মতো শক্তি বা সাহস কোনোটাই পায়না। শিক্ষক একজন সম্মানিত মানুষ। তাকে কিভাবে অসম্মান করা যায়?
আজ দেখতে আসবে রূপকথাকে। মা চাচ্ছেন এবার বিয়েটা করে ফেলুক রূপকথা। ছেলে তার সাথেই পড়াশোনা করেছে। সেই থেকেই ভালোলাগা। রূপকথা দ্বিতীয়বার গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ভুল করেনি। রূপকথাকে উত্যক্ত করার মতো ভুল করেনি আফিফ। এতবছর যাবত পড়েছিলো মেয়েটার পেছনে। অবশেষে পরিবারকে রাজি করিয়ে নতুন জীবনে পা বাড়াতে চাইছে। আফিফ ভালো ছেলে। যদি দুই পরিবারের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হয়ে যায় তাহলে আর না করবেনা রূপকথা। এবার বিয়েটা করা উচিত।

উপমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশরাফুল সহ এলাকার কিছু ছেলেপেলের জন্য মেয়েটাকে টিকিয়ে রাখা যাচ্ছিলোনা। তাই উপমাকে বিয়ে দিয়েছে। তার দুটো ফুটফুটে মেয়ে বাবু আছে।

মামুন এখন বিদেশেই আছে। দুইবছর অন্তর অন্তর বাড়ি ফেরে। সুখের সংসার তার। তারও দুইটা বাচ্চা আছে।
সবাইকে শা’স্তি দেওয়া যায়না। কিছু মানুষের শাস্তি উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিতে হয়। ইহকাল হোক বা পরকাল, তার উপযুক্ত শা’স্তি সে পাবে।
সবারই একটা গতি হয়েছে। এবার নিজেকে নিয়ে ভাবার পালা।
নাস্তা করে মাহতাবকে সঙ্গে নিয়েই স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে রূপকথা।

গার্ডিয়ানদেরকে একটা কক্ষে ডাকা হলো। বাচ্চাদের শেখানো নিয়ে অনেক শিক্ষকই অনেক ধরনের আলোচনা করলেন, বক্তব্য দিলেন। এবার একজন শিক্ষক মাইক্রোফোন সামনে নিয়ে রূপকথাকে গার্ডিয়ানদের উদ্দেশ্য করে কিছু বলতে বললেন।
মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে উজ্জ্বল চেহারায় তাকালো রূপকথা। সবাইকে সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে শুরু করলো তার বক্তব্য।

-” আমরা চাই আমাদের সন্তানরা অন্যদের চেয়ে ভালো করুক। পড়াশোনায় মনোযোগী ভাব ধরে রাখুক। কিন্তু আমাদের চাওয়াটা কতটুকু কর্যকর হয়?
আমি এখানে আসার পর একজন গার্ডিয়ানকে দেখলাম বাচ্চাকে মা’রধর করছেন। বাচ্চা পছন্দের জামা পড়ে আসতে চেয়েছিলো। হয়তো ক’টূক্তির ভ’য়ে মা পড়তে দেয়নি। তাই স্কুলে এসেও কান্নাকাটি থামছেনা বাচ্চাটির। তাই মা শাসন করেছেন।”
কথাটি বলে স্মিত হাসলো রূপকথা। ফের মুখ খুললো,

-“সবার উদ্দেশ্যে বলছি আপনার সন্তানের দিকে মনযোগ দিন। তার মন পড়ার চেষ্টা করুন। সে কি চায় সেটা বুঝুন।
আমার দিকে তাকান, আমি ও একজন কালো মানুষ। সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হচ্ছে মায়ের বুক। সর্বপ্রথম বাচ্চাটি মায়ের কাছ থেকে ভালোবাসা পায়। আপনি তো মা। তাহলে আপনার সন্তানদের মাঝে কেনো এত ভেদাভেদ? যখন আপনার একটি সন্তান ফর্সা হলো তাকে জন্মদিতে আপনার যতটুকু কষ্ট করতে হয়েছে। একটা কালো সন্তান জন্ম দিতেও তো আপনার ততটুকুই কষ্ট হয়েছে। দশমাস দশদিন পেটে ধরার বাইরে ও তাকে লালন করতে আপনার কষ্ট হয়েছে। তাহলে কেনো আপনারা দুটো সন্তানকে আলাদা করে দেখেন? যে সন্তানটা ফর্সা হলো সে কি আপনাকে আলাদা করে কিছু দিলো? যে কালো হলো সে কি আপনার কিছু খোয়ালো? কালো সন্তানটা যখন একটু সাজতে চায়, পছন্দের রং এর জামা পড়তে চায়, সুন্দরদের মাঝে ঘুরতে চায় সেখানে আপনারা বাঁধা দেন। কেনো বাঁধা দেন? ভ’য় হয়? যে আপনার সন্তানকে কেউ বা’জে বলুক, কুৎ’সিত বলুক। তখন আপনার কষ্ট হবে। তাই নিজেই আগে থেকে সন্তানকে তার পছন্দ থেকে সরিয়ে রাখছেন। আচ্ছা আপনি যে তাকে প্রতিনিয়ত আক্ষেপের জালে ফেলে কষ্ট দিয়ে কথা বলছেন তখন আপনার খারাপ লাগছেনা? কষ্ট হচ্ছে না?

আপনারা ভুল করছেন। আপনার ফর্সা সন্তানটিকে যেমন সবকিছুতে স্বাধীনতা দিচ্ছেন তখন কালোটিকে কেনো নয়? মনে রাখবেন যখন মানুষ দেখবে বাচ্চাটিকে পরিবার থেকেই নিচু করে রাখা হয়েছে তখন মানুষ আরও চেষ্টা করবে সে বাচ্চাটাকে ছোট করার। একবার ও ভেবে দেখেছেন বাবা মায়ের কটূ’ক্তিতে সন্তানের কতটা মানসিক যন্ত্রনা হয়? কালো সাদা দুটোই আল্লাহর সৃষ্টি। তাহলে আল্লাহর একটা সৃষ্টিকে সাদরে গ্রহণ করছেন। অপরটিকে কেনো হেলা করছেন?
আপনি একজন বাবা হয়ে এই সন্তানকে লালন করার জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন না? আপনার কষ্ট হচ্ছে না? তাহলে কোন স্বার্থে নিজের সন্তানকে ছোট করছেন?
একটা বাচ্চা সর্বপ্রথম পরিবারের কাছ থেকে অবহেলিত হয়। যার ফলে সমাজও তাকে অবহেলা করে। আপনি যখন নিজের সন্তানকে গুরুত্ব দেবেন, কারো দুটো কটূ’ক্তির সঠিক জবাব দেবেন তখন দেখবেন সেই মানুষগুলোর মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সমাজ আর আপনার সন্তানকে তু’চ্ছ করছেনা। তাই নিজের সন্তানকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। কথাগুলো আমি আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। যখন থেকে আমি পরিবারের সাপোর্ট পেলাম তখনই আমার দুনিয়া বদলে গেলো। মানুষের ক’টূক্তি গুলো প্রশংসায় রূপ নিলো।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় নারী পুরুষের সমান অধিকারের আগে প্রয়োজন কালো সাদার বৈষম্য দূর করা। কালো সাদার সমান অধিকার দেওয়া। আপনি আপনার সন্তানকে গুরুত্ব দিন, তখন দেখবেন অন্যরাও গুরুত্ব দিচ্ছে। আপনার সন্তান অন্যায় করেছে নিজে শাসন করুন। নিজে শাসন না করে অন্যদের হাতে একবার ছেড়ে দিন, দেখবেন মানুষগুলো বারবার অনুমতি ছাড়া আপনার সন্তানকে শাসন করতে আসবে। সবার আগে পরিবার থেকে গুরুত্ব দিতে শিখুন। দেখবেন পুরো পৃথিবী গুরুত্ব দিতে শিখে যাবে। পড়ালেখার জন্য প্রয়োজন একটা পরিষ্কার, প্রফুল্ল, সুস্থ মস্তিষ্ক। যেখানে প্রতিনিয়ত অবহেলায় সন্তানকে বিষিয়ে তুলছেন, তাকে মানসিক ও শারীরিক যন্ত্রণায় পিষ্ট করছেন, সেখানে ভালো পড়াশোনা আশা করছেন কিভাবে? পরিবার আর সমাজের অবহেলায় অনেক ভালো শিক্ষার্থীরা ও ঝরে যাচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে একটা প্রথা এখনো প্রচলিত আছে।
“মেয়ে মানুষের এত পড়ালেখায় কি হবে? মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোনোর আগেই বিদায় করো তাকে।”

মেয়ের শিক্ষা সুনিশ্চিত করুন। যদি মেয়েটি কালো হয় তাহলে সারাজীবন শশুর বাড়ীতে অব’হেলার শিকার হয়েই দিন পার করবে। সবাই একটাই ধারণা পোষণ করবে,” ডিভোর্সি মেয়েকে কে বিয়ে করবে?”। এই ভ’য়ে সে ও আর মুখ খুলে কিছু বলতে চাইবেনা। অত্যা’চার সহ্য করে যাবে। তার পরবর্তী প্রজন্ম ও একইভাবে কা’টবে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলো কেউ পেছন থেকে আ’ঘা’ত করার সুযোগ পাবেনা। একজন শিক্ষিত মেয়ে সর্বক্ষেত্রে প্রতিবাদ করার সক্ষমতা রাখে। কিছু হয়ে গেলেও তার জীবন নিয়ে আর আপনাদের চিন্তা করতে হবেনা।

সমাজ বদলাতে হবেনা। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। কালো-সাদা মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করা বন্ধ করুন। নারী শিক্ষায় অগ্রসর হোন। দেখবেন সমাজে আর বিশৃঙ্খলা থাকবেনা। একটা সুশৃঙ্খল সমাজ, একটা সুশৃঙ্খল জাতি উপহার পাবেন।”

রূপকথা খেয়াল করে দেখলো অনেকেই মাথানিচু করে আছেন। বিশেষ করে বাচ্চাটির মা। হয়তো অনুশোচনায় দ’গ্ধ হচ্ছে, হয়তো তাদের সঠিক বুঝ হয়েছে। এখানে মামুন ও উপস্থিত আছে। বিদেশ থেকে গত মাসে ফিরেছে। তার মেয়েটি ও এখানেই পড়াশোনা করে। সেই হিসেবেই এসেছে।

আজ আর ক্লাস হলোনা। সকল কার্যক্রম শেষ করে বাড়ি ফেরার পথেই মামুনের ডাকে পা জোড়া থেমে গেলো। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই পিছু ফিরলো রূপকথা। মামুন গভীর দৃষ্টি ফেলে বলল,

-“নিজের জীবনে সুখী আছো?”

রূপকথা স্মিত হেসে বলল,
-“এতটাই সুখী যে, মাঝেমাঝে সুখকে প্রশ্ন করি ‘দুঃখ কি জিনিস গো’ ?”

-“ভালোই শুদ্ধ বলছো।”

শব্দ করে হাসলো রূপকথা।
-“আপনি বিদেশ গিয়ে শুদ্ধ ভাষা শিখেছেন, আর আমি আগ থেকেই শুদ্ধ বাংলা জানি। যেখানে যেমন খাপ খায়, সেখানে তেমন ভাষা ব্যবহার করি। তাছাড়া একজন শিক্ষিকার ভাষা কেমন হওয়া উচিত আপনিই ভালো বোঝেন। আসছি।”

মামুন একবার আফসোস করেই ফেললো,
-“ইশ কেনো মেয়েটাকে বিয়ে করলাম না?”

[২০]
বিকেলেই রূপকথাকে দেখতে এলো আফিফ এর পরিবার। চেয়েছিলেন ছেলের জন্য সুন্দরী একটা বউ ঘরে তুলবেন। কিন্তু ছেলের যেহেতু পছন্দ তাই আর দ্বিমত করলেননা। আফিফ বলল রূপকথা মনের দিক দিয়ে সেরা সুন্দরী।
দু’পরিবার থেকেই বিয়ের কথা পাকা হলো।

রূপকথা আর আফিফকে আলাদা কথা বলতে দেওয়া হলো। আফিফকে রূপকথা তার মন খারাপের সঙ্গিনী বকুল তলায় নিয়ে আসলো। গাছের মোটা, শক্ত শেকড়ে পাশাপাশি বসলো। এই জায়গায় কতশত স্মৃতি জমে আছে সেসব মনে পড়তেই তাচ্ছিল্য হাসলো রূপকথা।

আফিফ বলল,
-“বিয়েটা অবশেষে করছো তাহলে?”

রূপকথা মুখ খুললোনা। শুধু মলিন হাসলো।

আফিফ বিষাদ মাখা চোয়ালে তাকিয়ে বলল,
-“পরিবারের কথায় বিয়ে করছো? তবে থাক। আমি অপেক্ষা করে যাবো। তোমার যখন মনে হবে তখনই এসো।”

ভালো লাগলোনা রূপকথার। এরকম কতশত বাণী মামুন ও তাকে শুনিয়েছে। তবে আফিফের ব্যাপারটা আলাদা। কতবছর যাবত তার পেছনে পড়ে আছে। কয়েকবছর পুরোটা না চিনলেও অনেকটা চেনা হয়ে গিয়েছে তাকে।
রূপকথা আফিফকে স্বাভাবিক করতেই বলল,
-“বিয়েটা নিজ ইচ্ছেতে করছি।”

আফিফ চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
-“একবার ভালোবেসে দেখো।”

রূপকথা বলল,
-“একান্তভাবে মন খুঁজে পেলে অবশ্যই ভালোবাসবো। জীবন তো আর থেমে থাকেনা। একজনের শূন্যস্থান পূরণের জন্য অপরজন চলে আসে। জীবন ফুরিয়ে যায়। মাঝে কিছু সুখ, কিছু দুঃখ উঁকি দিয়ে যায়। এর মাঝে ভালোবাসা হয়ে যায়।”

আফিফ খানিক বিরক্তির সুরে বলল,
-“এত কঠিন কেনো তুমি, মেয়ে?”

রূপকথা রহস্যময়ী হাসি দিলো। ফিসফিসানো গলায় বলল,
-“কারণ আমি নারী, আমি অনন্যাময়ী, আমি বিষাদিনী, আমিই রূপকথা।”

বিলের পাড় ঘেষে ছুটলো রূপকথা। তার বহুদিনের কল্পনাটি যেনো বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। কল্পলার জগতের মতো আজ তার পড়নে হলুদ শাড়ি। চোখ, ঠোঁট দুটোই রাঙানো। খোলা চুলের দোল খাওয়া দৃশ্য। মিষ্টি হাসিতে সত্যিই আজ তাকে রূপকথার রাজকন্যার মতো লাগছে।
আফিফ বসে থেকেই উপভোগ করতে লাগলো সেই মনমাতানো দৃশ্য।

#সমাপ্ত।

রূপকথা পর্ব-০৮

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৮

[১৮]
রোদ, বৃষ্টির মিষ্টি সকালটা আজ আর মন কাড়ছে না রূপকথার। এক দিকে বিরহ যন্ত্রণা, অপরদিকে মা জানালেন তাকে আজ দেখতে আসবে। ফলাফল তার জানাই আছে। প্রতিবারই ফলাফল একই হয়। আলেয়া বেগম সকাল থেকে আর কাজ করতে দেননি রূপকথাকে। এক বাটি হলুদ দিয়ে বললেন,
-“মুখে হলুদ মাইখা নে। চেহারা চকচকে হইবো।”

অনিচ্ছা স্বত্বে ও মায়ের চাপে পড়ে রূপ বাড়ানোর কাজে লেগে পড়ে। আর কেউ না জানুক, উপমা ঠিকই জানে তার বুবুর ক্ষ’ত গুলো। তার নিজেরই বুক ফেটে কান্না আসছে। খোরশেদ মেহমানদের জন্য বাজার থেকে ফল নিয়ে আসলো। খুশি খুশি পাত্রপক্ষের সামনে রূপকথাকে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রতিবার পাত্রপক্ষ উপমাকে পছন্দ করে যায়। তাই এবার উপমাকে লুকিয়ে রেখেছেন আলেয়া বেগম। তাতে ও লাভ হলোনা। এবার ও ফলাফল একটাই আসলো। রূপকথাকে পছন্দ করলোনা পাত্রপক্ষ। বিকেলে ঘটকের কাছ থেকে খবর পেয়েছে পাত্রপক্ষ নাকচ করে দিয়েছে। ঘটক এটাও জানালেন,
-“বড় মাইয়ার লাইগা ছোডডারে ক্যান ধইরা রখবেন? কতকাল ধইরা রাখবেন? এর চাইতে মাইয়া ছোডডারেই বিয়া দিয়া দেন। আমার কাছে আরও ভালা পাত্র আছে।”

আলেয়া বেগম অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তিক্ততার রো’গ বাসা বেঁধেছে। না জানি কোনদিন ম’রে যান। রূপকথার উপর ক্ষো’ভ হলো উনার। অহেতুক রা’গে কথায় কথায় খোঁচা মে’রে চলেছেন মেয়েকে। নিজেও শান্তি পাচ্ছেন না, আবার মেয়েকেও শান্তি দিচ্ছেন না।
-“আমার পোলার বারবার টেহা খরচ করাইয়া শান্তি হয়নাই। কোনোদিকে চইলা যাইতে পারস না? নাইলে ম’র’তে পারস না?”

রূপকথা পানি পান জরতে এসে আর পানি পান করলোনা। কলপাড়ে গিয়ে কিছু খুঁজলো। ফের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। মায়ের ব’কাগুলো এখনো বন্ধ হয়নি। হাতের মুঠো থেকে হাঁড়িপাতিল মাজা তারজালি দিয়ে চামড়ায় ঘষা দিলো। এই চামড়ার উপর তার অনিহা জন্মে গেছে, অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত দুঃখ, ক্ষো’ভে উত্তেজিত হয়ে তারজালি দিয়ে নিজের চামড়া ঝষে চলেছে। চামড়া ছিঁলে ছোপ ছোপ র’ক্ত দেখা যাচ্ছে। একসময় ক্লান্ত হয়ে চিৎকার করে কাঁদলো রূপকথা। কালো রং কেনো তার জন্য অভি’শাপ হয়ে এলো? বাইরে তুমুল ঝড়। রূপকথার কান্নার শব্দ আর কারো কানে পৌঁছালোনা।
রাতে উপমা মায়ের সাথে ঘুমালো। রূপকথা আর দরজা খুললোনা। রাতে খেতেও বের হলোনা। মা উপমাকে দিয়ে ডাকিয়েছেন। নিজে রাগ দেখিয়ে ডাকলেননা। খোরশেদ অনেকবার ডেকেছে। রূপকথার একটাই উত্তর,
-“খামু না আমি। তোমরা খাও।”

খোরশেদ কয়েকবার ডেকেও যখন লাভ হলোনা তখন আর বাড়াবাড়ি করলোনা। রাতের খাবার খেয়ে সকলেই ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত্রি এগারোটা কি বারোটা হবে। খোরশেদের পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। টয়লেটে যাওয়া প্রয়োজন। বাইরে প্রচুর ঝড় উঠেছে। এই ঝড়ের মধ্যে টয়লেটে যেতেও ইচ্ছে করছেনা। প্রকৃতির ডাকে তো আর সাড়া না দিয়ে পারা যায়না। তাই টর্চ নিয়ে লম্বা ডাটের ছাতা মাথায় ঘর থেকে বের হলো। দ্রুত কাজ সেরে বেরিয়ে আসলো। হাত পা ধোয়ার জন্য কলপাড়ে যাওয়ার সময় আশেপাশে টর্চ মেরে তাকালো। হঠাৎই তার চোখদুটো স্থির হয়ে গেলো।
আমগাছের ডালে কি যেনো দাপাদাপি করতে দেখা যাচ্ছে। খোরশেদ প্রথমে ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সেখানে কি আছে? যখনই মস্তিষ্কে স্পষ্ট হলো মানুষের পায়ের মতোই দেখা যাচ্ছে তখন আর দেরি করলোনা। মাথায় একটাই নাম গেঁথে গিয়েছে। দৌঁড়ে আমগাছের তলায় গেলো। ছাতা ফেলে দিয়ে দাপাদাপি করা পা জোড়া জড়িয়ে ধরলো। আমগাছের মোটা ডালে গলায় দড়ি বেঁধে মৃ’ত্যুর প্রহর গুনছিলো রূপকথা।
খোরশেদের শ্বাস আটকে আসছে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছেনা। মাকে কিভাবে ডাকবে? ডাকলেও এই ঝড়ের মধ্যে কারো কানেই কথা পৌঁছাবেনা। দিকবিদিকশুন্য হয়ে গেলো খোরশেদ। হাউমাউ করে কেঁদে রূপকথাকে বলল,
-“রূপ, এই রূপ। তুই ক্যান এমন করতে গেলি? দোহাই লাগে তোর, আমারে সাহায্য কর তোরে নামাইতে। তোর কিছু হইলে আমরা ম’ইরা যামু রূপ। তুই সাহায্য না করলে আমি তরে নামাইতে পারুমনা। দয়া কইরা এমন শাস্তি আমগোরে দিস না।”

খোরশেদ ওভাবেই পা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আশেপাশে কিছু চোখে পড়ছেনা, যার উপর ভর করে রূপকথাকে নামাবে। যতক্ষণ না রূপকথা সাহায্য করছে ততক্ষণ সে কিছুই করতে পারবেনা।
রূপকথা রুদ্ধশ্বাস করা কন্ঠে বলল,
-“আমারে বাঁইচা থাকতে দেও। আমি মই’রা গিয়া একেবারে বাঁইচা থাকতে চাই।”

খোরশেদ ভ’য় দেখানোর চেষ্টা করলো রূপকথাকে।
-“তুই যদি আমারে সাহায্য না করস তয় আমিও তর সাথে এই ডালেই ঝুইলা পড়ুম।”

তড়াক করে উঠলো রূপকথা। অস্থির হয়ে গেলো। ভাইয়া কেনো ম’রবে? তাহলে মা আর উপমার কি হবে? হাজারও ভাবনা চিন্তার পর খোরশেদের কথায় রাজি হলো সে। রূপকথাকে নামানোর পর সে মাটিতে বসে চিৎকার করে কেঁদে বলল,
-“আমার আর বাঁইচা থাকতে মন চায়না ভাইয়া। মাইনষে আমারে খোঁ’টা দেয়। তা সহ্য করন যায়। কিন্তু মায়ে যখন আমার জন্ম নিয়া আফসোস করে তখন আর আমি সইতে পারিনা। ক্যান আমি কালা হইলাম?”

খোরশেদ সিদ্ধান্ত নিলো মায়ের সাথে একটা বিহিত করেই ছাড়বে। তার আগে রূপকথাকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে নিতে বলে খোরশেদ মায়ের ঘরে গেলো। ঘুমন্ত আলেয়া বেগমকে জাগিয়ে ফেললো। পাশে ঘুমিয়ে থাকা উপমা ও জেগে গেলো। খোরশেদের চোখে পানি দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লো আলেয়া বেগম। উপমাকে খোরশেদ রূপকথার ঘরে পাঠিয়ে দিলো। মাকে রূপকথার ঘটনা খুলে বলতেই পুরো বাড়ি মাতিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন তিনি।
-“দশ মাস দশদিন যে মাইয়ারে পেটে নিয়া কষ্ট করলাম, এতবড় করলাম। হেয় আমার কথা না ভাইবা ম’রতে গেছে? ক্যামনে পারলো? একবার ও আমার কথা মনে হয়নাই?”

খোরশেদ রাগত সুরে বলল,
-“তুমি ক্যামনে পারলা এতকষ্টের সন্তানরে কষ্ট দিয়া কথা কইতে? তুমি জানো? রূপ তোমার কথা নিতে না পাইরাই জীবন ব’লি দিতে গেছে।”

তখনই আলেয়া বেগমের মনে পড়ে গেলো বিকেলে তিনি রূপকথাকে ম’রতে বলেছেন। এটাতো রাগের বশে বলেছেন। তাই বলে সত্যি সত্যি এমন করবে মেয়েটা? মায়েরা তো মেয়েদের কতকথাই বলে বলে ধারণা করলেন আলেয়া বেগম।

আর দেরি করলেননা। দৌঁড়ে রূপকথার ঘরে গেলো। জামা পাল্টে ভেজা চুল নিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো রূপকথা। আলেয়া বেগম গিয়ে মেয়েকে ঝাপটে ধরলেন। রূপকথার শরীর একেবারে ঠান্ডা হয়ে আছে। তিনি অনুভব করলেন রূপকথা ঢলে পড়ছে।

“রূপরে” বলে চিৎকার দিয়ে কাঁথা দিয়ে জড়িয়ে ঝাপটে ধরে শুইয়ে দিলেন মেয়েকে। উপমা কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। বুবুর মাথার পাশে গামছা নিয়ে বসেছে চুল মুছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

পরেরদিন সকালের পরিবেশ একেবারে শান্ত, স্নিগ্ধ। কেউ আর রূপকথাকে কিছু জিজ্ঞেস করে ক্ষ’ত বাড়িয়ে দেয়নি। আলেয়া বেগম যথাসম্ভব মেয়ের সাথে নরম আচরণ করছেন।

[১৮]
এদিকে খোরশেদ ঘটক লাগিয়ে দিয়েছে রূপকথার জন্য পাত্র খুঁজতে। ঘটক প্রচুর টাকা চায়। তবুও তার শর্তে রাজি হলো খোরশেদ। বোনের কষ্ট আর নিতে পারছেনা সে। হয়তো বিয়ে হয়ে গেলে লোকে আর তাকে নিয়ে কানাকানি করবেনা। তবে ভ’য় ও হচ্ছে খোরশেদের। তার বোনকে শশুর বাড়ীতে অত্যা’চারিত হতে হবে নাতো?
ঘটক যতগুলো পাত্রের সন্ধান দিয়েছে তাদের প্রায় অনেকেই যৌ’তুক চাচ্ছে আকাশসম, বাকিদের বয়স হয়েছে, ছেলেমেয়ে বিয়ে দিয়েছে এমন বুড়ো লোক। রূপকথাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে পরিবার। এটা দেখে মা ভাইকে কাছে ডাকলো রূপকথা। দুজনই পাশে বসলো। রূপকথা শান্ত, গভীর চোখে তাকিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
-“আমার কিছু কথা রাখবা?”

আলেয়া বেগম কৌতুহল দেখিয়ে বললেন,
-“কি কথা?”

রূপকথা মা আর ভাইয়ের চেহারায় তাকিয়ে ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল,
-” আমি এহনই বিয়ার চিন্তা করতাছিনা। আমি পড়তে চাই। আমার জন্যই তো উপমার বিয়া বন্ধ হইয়া রইছে তাইনা? তারে বিয়া দিতে চাইলে দেও। আমি কিছু মনে করুমনা। তয় আমারে এহনই বিয়া দিতে চাইওনা। আমি প্রস্তুত না। দোহাই লাগে আমার পড়া বন্ধ কইরোনা।”

কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা চললো। আলেয়া বেগম হতভম্ব হয়ে রইলেন। তিনি কিছু বলতে নিলেই খপ করে তার হাত ধরে থামিয়ে দিলো খোরশেদ। লম্বা শ্বাস ছেড়ে রূপকথার উদ্দেশ্যে বলল,
-“তুই যেইটা ভালা বুঝবি হেইটাই কর। আমি তর পাশে আছি। তবুও তুই দ্বিতীয়বার নিজের ক্ষ’তি করতে যাইসনা। আমরা কেউ ভালা থাকতে পারুমনা তরে ছাড়া।”

রূপকথা খোরশেদের হাত শক্ত করে ধরে অভয় দিয়ে বলল,
-“কথা দিলাম নিজের কোনো ক্ষ’তি করবোনা।”

খোরশেদ স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।
ভাইয়ের কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে রূপকথা মায়ের দিকে তাকালো। আলেয়া বেগম ও আর বাড়াবাড়ি করলেননা। প্রথমবার মেয়ের কথায় প্রাধান্য দিলেন। রূপকথা ঠিক করেছে পুরোদমে পড়াশোনা শুরু করবে। টেষ্ট পরীক্ষা নখদর্পনে। এতদিন প্রেমলীলায় আর পড়াশোনা ঠিক করে হয়ে ওঠেনি। সে আর পিছু ফিরে চাইবেনা। সফলতার পেছনে ছুটবে সে। একসময় বুড়ো লোকগুলো নয়, একজন সফল মানুষই তার পেছনে ছুটবে। নিজেকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে, এখন যারা তাকে কালো বলে হেলা করছে তারাই একদিন তাকে সম্মান করবে। মনের সংকল্পকে দৃঢ় করলো রূপকথা। এখন থেকে সময় নষ্ট করবেনা। মায়ের কাছ থেকে উঠে পড়লো রূপকথা। একবার বকুল তলায় যাওয়া দরকার। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো বকুল সই এর সাথে দেখা হয়না, ভাব বিনিময় হয়না। তার মন খারাপের একমাত্র সঙ্গী ওই মুক বকুল সই।
#চলবে……..

রূপকথা পর্ব-০৭

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭

[১৫]
গতবছর বড় দুলাভাইকে একটা স্মার্টফোনের কথা বলেছিলো খোরশেদ। তখন দুলাভাই বললেন,
-“তোমার এহন সময় কই টাচ মোবাইল চালানোর?”

এরপর আর খোরশেদ দ্বিতীয়বার মুখ খোলেনি। এবার হঠাৎ কি মনে করে দুলাভাই একটা নোকিয়া স্মার্টফোন নিয়ে আসলো খোরশেদ কে দিতে। অবশ্য খোরশেদের হাতে এখন একটা সেকেন্ড হ্যান্ড স্মার্টফোন আছে। তবুও মা বলে দিলেন ফোনটা যাতে খোরশেদ ফিরিয়ে না দেয়। এতে দুলাভাই এর অপমান হবে। বড় আপার ও সংসারে অশান্তি হবে। তাই খোরশেদ ফোনটা হাতে নিয়ে হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করলো,
-“এই মোবাইলের দাম কত নিলো, দুলাভাই?”

বড় দুলাভাই বাঁকা সুরেই জবাব দিলেন,
-“ক্যান, তুমি টেহা দিবা নাকি?”
চুপ থেকে তারপরই আবার বললেন,
-“উনিশ হাজার।”

কিছুই বললোনা খোরশেদ। মাঝেমাঝে আপন মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও এসব মানুষের মুখের উপর শক্ত জবাব দেওয়া যায়না। ফোনটা দেখলে কেউই বলবেনা এটা উনিশ হাজার টাকার ফোন। একটা নোকিয়া ১ ফোনের দাম গুগলে সার্চ দিলেই বলা যাবে কত টাকা?
সেই ফোনটি খোরশেদ নিজে ব্যবহার করলোনা। ঘরে উপমা আর রূপকথা আছে। তাদেরকে দিলো। তারা, গান, মুভি দেখে। একটা সিম দিয়ে ইমো চালু করে দিয়েছে খোরশেদ। সেই ফোনই রূপকথার প্রেমের সাক্ষী। রাতে চুপিচুপি মামুনের সাথে কতশত প্রেমালাপ, সুখ-দুঃখের কথা জুড়ে দেয়। চুটিয়ে প্রেম চলছে দুজনের। নিয়ম করে বকুল তলায় দেখা করা। মামুনের বেকার জীবনের গল্প করা সব মিলিয়েই বেশ চলছে। উপমা জানে ব্যাপারটা। সারাদিন বোনের সাথেই থাকে। এরকম একটা ব্যাপার টের পাওয়া কোনো ব্যাপার না। তাই রূপকথা ও আর উপমার কাছে লুকোয়নি কিছু।

[১৬]
খোরশেদের পায়ের ব্যান্ডেজ খোলা হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে। এখন ঠিক ভাবে হাঁটাচলা করতে পারে। তবে আলেয়া বেগম এখনই ছেলেকে কাজে যেতে দিচ্ছেন না। খোরশেদের সুস্থ হওয়াতে মামুনের আসা যাওয়া একেবারেই কমে গিয়েছে তাদের বাড়ীতে।
সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে মামুনের মিসড কল আসলো। এর মানে সে বকুল তলায় আছে। রূপকথা সুযোগ খুঁজলো বের হওয়ার। আগে অকপটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেও এখন দ্বিধা কাজ করে, ভ’য় হয়। মনে হয় কেউ জেনে যাবে তাদের প্রেমের ব্যাপার। উপমাকে বলেই ছুটলো বকুল তলায়।

মামুন ঝরে যাওয়া শুকনো বকুল ফুলের একটি মালা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছে। পকেটে করে একমুঠো বকুল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ভাবির কাছ থেকে সুঁই-সুতো জোগাড় করে ছোট্ট মালা গেঁথে নিয়েছিলো। ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে, কিন্তু যত্ন করা ভালোবাসাটা শুকায়নি। রূপকথা মাথায় ওড়না টেনে চারপাশ জহুরি নজরে দেখে সামনে তাকাতেই ভ’য় পেলো। তার একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে মামুন। সে যখন এদিক ওদিক দেখছিলো তখনই মামুনের দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপে। সে হুট করেই রূপকথার কাছে এসে দাঁড়ায় ভ’য় দেখাবে বলে। রূপকথা ভ’য় পেয়ে বুকে থুতু দিলো। মামুন খিলখিল করে হাসলো।
রূপকথা গাল ফুলিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অভিমানী কন্ঠে বলল,
-“ভ’য়ের চো’টে যদি মই’রা যাইতাম?”

মামুনের বুক ধড়ফড় করে উঠলো। কড়া চোখে তাকিয়ে সাবধান করলো,
-“খব’রদার! আর এইসব অলক্ষুণে কথা কইবানা। আমি ম’রা’র পর তোমার যা খুশি কইও।”

রূপকথার চোখে পানি এসে ভীড় করলো। সবার কাছ থেকে অবহেলা পেয়ে একটা ভালোবাসার মানুষ পেলে কে হারাতে চায়? হারাতে সবাই ভ’য় পায়। ওড়নার একাংশ দিয়ে চোখ মুছে নিলো সে।
মামুন মুচকি হেসে রূপকথাকে উল্টো ঘুরিয়ে দিলো। গলার জন্য গাঁথা মালাটি চুলের খোঁপায় প্যাঁচিয়ে দিলো।
রূপকথা চুলে হাত দিয়ে অনুভব করলো। বিষন্ন মনটা হুট করেই ভালো হয়ে গেলো। চমৎকার ভালোলাগার অনুভূতি হলো।
মামুন বলল,

-“কয়েকদিন দেহা হইবোনা। ফোনেই কথা কমু। আব্বা আম্মা সহ সবাই মিলে বেড়াইতে যামু মামুর বাড়িত।”

রূপকথার হাসিখুশি মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো। কতদিন দেখা হবেনা তাদের? কিন্তু হাসিমুখেই বিদায় জানালো মামুনকে। কাল সকালেই মামুনরা বেড়াতে যাবে। আযান পড়ার আগেই রূপকথা বাড়িতে ফিরলো। এমন দুমুখো সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে দেখে আলেয়া বেগম কথা শোনাতে ছাড়লেননা। বকা’বকি করলেন কিছুক্ষণ। রূপকথা চুপ করেই ছিলো। মা নিজ থেকেই আবার থেমে গেলেন।

[১৬]
আশরাফুলের জ্বালাতন যেনো বেড়েই চলেছে। এখন আর উপমার ভ’য় হয়না, বেশ রা’গ হয়। এত বেহা’য়া মানুষ হয়? তাকে চ’ড়, থা’প্পড়, কোনো কথা বলেও দমিয়ে রাখা যায়না। কিছু বললেই সে হাসে। পিছু পিছু আসে।
আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে খোরশেদের মুখোমুখি হলো উপমা, রূপকথা। পেছনেই ছিলো আশরাফুল। বোনদের বি’রক্ত করছে দেখে ক্ষে’পে গেলো খোরশেদ। আশরাফুলকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলো। আশরাফুল কি দমে থাকার পাত্র? সে ও কয়েক ঘা দিলো। দুজনের মধ্যে এক পর্যায়ে হাতা’হাতি শুরু হলো। উপমা ভ’য়ে কেঁদে ফেললো। রূপকথা দুজনকেই দুদিকে সরানোর চেষ্টায় ব্যর্থ।
চু’রির আসামি ধরতে পুলিশ যাচ্ছিলো সিএনজি দিয়ে। রাস্তায় দুজন ছেলের মধ্যে মা’রা’মা’রি দেখে তারা নেমে পড়লো। উপমা কেঁদেকে’টে বলল ছেলেটা তাদের বিরক্ত করছে। এখন প্রতিবাদ করায় তার ভাইকে ও মা’রছে। পুলিশ ধরে নিলো আশরাফুলকে। হাতের লাঠি দিয়ে একটা আ’ঘাত করে বলল,
-“রাস্তাঘাটে ইভটিজিং করবি মেয়েদের? চল থানায় চল। পেছনে কয়েক ঘা পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আশরাফুল একই ভাবে হেসে বলল,
-“কিচ্ছু ঠিক হইবোনা। ভালোবাসা আরও বাইড়া যাইবো।”

আশরাফুলকে আরেক ঘা দিয়ে পুলিশ বলল,
-“ভালোবাসা আর ভালোবাসা থাকবেনা। মা’ইরের চো’টে ভালোবাসা পালাবে।”

আশরাফুল এখনো হাসছে। উপমার দিকে তাকিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো। হাত বাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে উপমার উদ্দেশ্যে বলল,
-“ভালো থাইকো বউ। কালকের মধ্যেই বিরক্ত করবার জন্য তোমার জামাই জেল ভাইঙ্গা আইয়া পড়বো। মন খারাপ কইরোনা।”

খোরশেদ দুবোনকেই ধমকে উঠে বলল,
-“এই পোলা যে তোগোরে বিরক্ত করে, কইলিনা ক্যান? কোনো বি’পদ হইলে কি হইতো?”

রূপকথা, উপমা দুজনই মাথানিচু করে দিলো। বাড়িতে জানালে ব্যাপারটা আরও ঘেঁটে যেতো। তাই দুবোনের একবোন ও জানায় নি কিছু। কিন্তু এটা ভাবলোনা তারা দুজন মেয়ে। বড় কোনো বি’পদ হতে পারতো।

[১৭]
মামুন যাওয়ার দুদিন পর্যন্ত তাদের দুজনের লুকিয়ে চু’রিয়ে ফোনে প্রেমালাপ হলেও তৃতীয় দিন থেকেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। মামুনের ফোন বারবার বন্ধ বলছে। রূপকথা নিজের মনকে বুঝালো হয়তো বিদ্যুৎ নেই বলে ফোনে চার্জ দিতে পারেনি। কিন্তু সময়টা যখন গড়াতে গড়াতে সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো তখন আর নিজ মনকে বুঝ দিতে না পেরে কেঁদে গাল ভাসালো রূপকথা। বিরহ যন্ত্রনায় ভেতরটা আর্তনাদ করে উঠলো।
তার ঠিক দুদিন পরই মামুন গ্রামে ফিরলো। রূপকথা খবর পেয়েছে সে নাকি মামাতো বোন বিয়ে করে ঘরে উঠেছে। গ্রামের খবর ঘর পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনা। বাতাসের বেগে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখে মুখে একই বুলি ‘মামুন মামাতো বোইন বিয়া করসে’।
কথাটি শুনেই প্রথম ধাক্কা খেলো রূপকথা। একে একে সব স্পষ্ট হচ্ছে। এজন্যই তার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তাচ্ছিল্য হাসলো রূপকথা। তার সাথে তো সবাই ছলনা করে। তারই ভুল ছিলো। সুন্দরী মেয়ে রেখে কেউ কেনো তার মতো কুৎ’সিত মেয়েকে বিয়ে করবে? চোখ ফেটে জল গড়ালো। হাউমাউ করে কাঁদলোনা। তার নিয়তি বরাবরই নিষ্ঠু’রতা করে। আজ কল করে মামুনের নাম্বার খোলা পেলো, কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। শেষে রূপকথা বাংলায় গোটাগোটা অক্ষরে বার্তা পাঠালো,
-“শ্যাষ বারের মতো আমার লগে দেহা করেন। এরপর ইহজীবনে আর আমার মুখ দেখতে হইবোনা আমনের।”

কাজ হলো মনে হয়। সন্ধ্যার পর হারিকেন হাতে বকুল তলায় পৌঁছে গেলো রূপকথা। মামুন আগে থেকেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ মুখ মলিন, ফ্যাকাশে দেখা যাচ্ছে। রূপকথাকে দেখে দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করছে। রূপকথা নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। একভাবে বলে ফেললো,
-“খুব সুন্দরী আমনের বউ, তাইনা?”

ঢোক গিললো মামুন। নিজেকে প্রস্তুত করে জবাব দিলো,
-“বিশ্বাস করো কোকিল পাখি, আমি কিছুই জানতাম না। আব্বা আম্মা মামার বাড়ি নিয়া মামাতো বোইনের লগে বিয়া দিবো আমি জানতাম না। তোমার কথা কইয়া ও লাভ হয়নাই। আব্বা আম্মা তোমারে বিয়া করাইবোনা। তাছাড়া মামা আমার বিদেশ যাওনের সব ব্যবস্থা কইরা দিবো। তাই আব্বা বেশি জোর দিয়াই বিয়া করাইলো।”

মামুন থামতেই মলিন হাসলো রূপকথা। কারো যদি ইচ্ছে পূরণ হয় সাথে সুন্দরী বউ তাহলে সে কেনো বিয়েতে না করবে? একদম ঠিক করেছে মামুন। তার মতো কালা, পোড়াকপালিকে বিয়ে করে তাকে সারাজীবন পস্তাতে হতো। কোনোমতে কাঁপা কাঁপা স্বরে রূপকথা শুধালো,
-“তারে যত্ন কইরা ভালোবাইসেন।”

আর দাঁড়ালোনা। বাঁধ ভাঙা কান্নারা উপচে পড়ছে। হারিকেন হাতে ছুটে চললো রূপকথা। ‘সত্যিই সুখ মরিচীকা’। মামুন চোখের পানি লুকিয়ে বিড়বিড় করে শুধালো,
-“আমি ও যে তোমারে ভালোবাসছিলাম কোকিল পাখি। কিন্তু জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাইয়া সেটা কামে লাগাইয়া ফালাইছি। তোমার লগে অন্যায় কইরা ফালাইছি।”

রবীন্দ্র সংগীতের সুরগুলোই যেনো স্পষ্ট ভাবে রূপকথার অপ্রকাশিত অনুভূতিগুলোর ভাবানুবাদ।

“যদি আরও কারে ভালোবাসো,
যদি আরও ফিরে নাহি আসো।
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেনো পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো
আমার ও পরাণ ও যাহা চায়।”

রূপকথার প্রতিটি নিশ্চুপ চিৎকারের সাক্ষী ছিলো তার বিছানা,বালিশ। কতবার যে আর্তনাদে, যন্ত্রণায় বিছানা খামছে ধরেছিলো। তার ছটফট দেখে উপমা ভ’য় পেয়ে মাকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারলোনা। রূপকথা উপমাকে ঝাপটে ধরে হিসহিস কন্ঠ বলল,
-” উপমারে আমি মনে হয় ম’ই’রা যামু।”

উপমা কেঁদে ফেললো। বুবুর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। এখনই আর মাকে জানালোনা উপমা। এদিকে বুবুর ছটফট দেখে ও সহ্য করতে পারছেনা। রূপকথা গলা কা’টা মুরগীর মতো ছটফট করেই চলেছে। চোখ দিয়ে গলগলিয়ে পানি ঝরছে।

#চলবে……

রূপকথা পর্ব-০৬

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৬

[১২]
প্রতিদিন নিয়ম করে বকুল তলায় যাওয়া হয় না। তবে সুযোগ পেলেই একছুটে পাখি উড়ে এসে আঁচড়ে পড়ে। ইদানীং রূপকথাদের বাড়িতে মামুন ভাইয়ের আনাগোনা বেড়েই চলেছে। তার ভাবভঙ্গি বলছে সে বিশেষ কিছু চায়। নয়তো বেকার খাটার মতো লোক মামুন নয়। খোরশেদের খোঁজ নেওয়ার নাম করে রূপকথার সাথে চোখেচোখে আলাপন বেশ ভালোই চলছে।

আজ সময় মিলতেই সন্ধ্যা নামার পূর্বে বকুল তলায় হাজির হলো রূপকথা। এই একটা জায়গা আসলে মন ভালো না হয়ে থাকতেই পারেনা। বকুল সই যে তার মন খারাপের সঙ্গী। বাতাসের দাপটে ঝরঝরে পুষ্পবৃষ্টি মনে আনন্দের সঞ্চার করে। একমুঠো ঝরা বকুল ফুল হাতের তালুতে নিয়ে খানিক সময় তাকিয়ে রইলো রূপকথা।
-“তোর মতো কইরা আমি ও একদিন ঝইরা যামু। শুধু আমি ক্যান? এই দুনিয়ার সব মাইনষেই ঝইরা যাইবো। মিষ্সা যাইবো মাটির তলায়। তবুও তাদের কি অহং’কার।”

বকুল ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পেছন থেকে কারো পদধ্বনি শুনতে পেলো রূপকথা। পায়ের শব্দ ক্রমশ নিকটে শুনতে পাচ্ছে। একবার পেছন ঘুরে তাকালো। দেখতে পেলো মামুন ভাইকে। তাকে দেখতে পেয়েই জড়োসড়ো হয়ে বসলো রূপকথা। মামুন পাশে এসেই ধপ করে শক্ত শেকড়ে অবস্থান নিলো। একগাল হেসে বলল,

-“কোকিল পাখির সন্ধানে আমার মেলা কাঠখড় পোহাইতে হইলো।”

রূপকথা মাথায় ওড়না টেনে বাঁকা সুরেই শুধালো,
-“কেউ লাগে কইছিলো আমার খোঁজ করতে।”

হাসলো মামুন। ঠোঁট প্রসারিত হলো, চোখ হাসলো। কিন্তু শব্দ হলোনা। নিশ্চুপে পেছন থেকে হাত সামনে নিয়ে আসলো। রূপকথার সামনে একটা প্যাকেট ধরলো।

রূপকথার চোখের দৃষ্টি প্যাকেট থেকে সরে মামুনের উপর পড়লো। তার দৃষ্টির অর্থ বোঝাতে মামুন বলল,
-“খুইলা দ্যাহো কি আছে।”

একবার মামুনের দিকে তাকিয়ে ফের প্যাকেটে চোখ রাখলো। কাগজে মোড়ানো প্যাকেট একটানে ছিঁড়ে ফেললো। শক্ত শেকড়ের সামনে নরম ঘাসের ওপর শব্দ করে কিছু জিনিস পড়লো ঝনঝন শব্দে। অবাকের শীর্ষে পৌঁছে একে একে জিনিসগুলো হাতে তুলে নিলো রূপকথা। দশটাকা দামের একটা কাজল, একটা আলতার শিশি আর এক মুঠো লাল রেশমি চুড়ি। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলো রূপকথা।
মামুন অভিভূত নজরে তাকিয়ে রইলো। রূপকথা জানতে চাইলো,
-“বেকার মানুষ টেহা পাইলেন কই?”

-“হেইডা তোমার না ভাবলেও চলবো।”

রূপকথা ছেঁড়া কাগজে জিনিসগুলো মুড়িয়ে নিলো। মামুনের হাতে ফেরত দিয়ে বলল,
-“কালা ঠ্যাং এ আলতা মানায় না, কালা চোখে কাজল মানায় না, কালা হাতে লাল রং মানায়না।”

ক্ষুব্ধ হলো মামুন। ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল,
-“কে কইলো তোমারে? আমি চাই তুমি এগুলা দিয়া আমার সামনে আসো। আমি তোমার কৃষ্ণ ঝলকানি রূপে মুগ্ধ হইয়া চাইয়া থাকতে চাই।”

রূপকথা কঠিন হয়ে উঠলো। কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“ক্যান? ক্যান আমার আমনের কথা হুনা লাগবো? কেডা আমনে?”

-“আমি তোমার সুখ কোকিল পাখি?”

মামুনের এমন উত্তরে চমকে উঠলো রূপকথা। বিমূঢ় হলো। কি ভয়া’নক কথা। কেউ একবার শুনলেই সর্ব’নাশ হতো। বিষ্ময় কাটিয়ে উঠলো রূপকথা। মনে মনে সেও মামুন ভাইকে চায়। মানুষটা তার সাথে কত বিনয়ের সাথে মধুর সুর দিয়ে কথা বলে। লজ্জা হলো রূপকথার। কিন্তু মূহুর্তেই মনে পড়লো সমাজ, পরিবার। আর যাইহোক কোনো পরিবারে কালো বউয়ের স্থান কেমন হয় তার একটা ধারণা হয়ে গিয়েছে তার। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বিলের জলে তাকিয়ে রইলো।

মামুন বিচলিত হলো রূপকথাকে দেখে। উৎকন্ঠা নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হইছে কোকিল পাখি?”

রূপকথা ঢোক গিললো।
-“পিরিতে আমার ভীষণ ড’র।”

ঝট করেই রূপকথার হাত চেপে ধরলো মামুন।
গায়ে কাঁ’টা দিয়ে উঠলে রূপকথার। গ্রামে গঞ্জে এমন হাত ধ’রাধ’রি দেখা গেলেই কেলেঙ্কারি বাঁধে। ভাগ্যিস এটা নির্জন জায়গা। মানুষের আনাগোনা চলেনা বললেই চলে। তাইতো এমন শান্ত, কোলাহলহীন, স্বজল পরিবেশে একটু সুখ খুঁজতে আসে রূপকথা। চারদিকে আধার নামছে একটু একটু করে। রূপকথা ঝট করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“আমি বাড়িত যাই। আযান দিয়া দিলে মায়ে মা’র’বো।”

মামুন আর একবার হাত ধরার সাহস করে ফেললো। রূপকথার চোখে চোখ রেখে অভ’য় দিলো,
-“আমি সব সামলাইয়া নিমু। তুমি খালি আমার সুখের কারণ হও।”

মুহূর্তেই চোখজোড়া ভিজে উঠলো রূপকথার। প্রচন্ড আবেগ কাজ করলো। ইচ্ছে করলো মানুষটার বুক ছিঁড়ে লুকিয়ে পড়তে।

[১৩]
পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছে। মাস তিনেক পরই টেষ্ট পরীক্ষা। নকশিকাঁথার ফোঁড়ন গুনতে গুনতেই আর পড়ায় মনযোগ দেওয়া হয়না রূপকথার। তবে রীতিমতো স্কুলে যাওয়ার চেষ্টা করে। মা ঘরে নেই। কোনো দরকারে পাশের বাড়িতে গিয়েছে। ভাইয়া শুয়ে আছে। উপমা ও বোধহয় হাঁটতে বেরিয়েছে। সারাদিন বসে বসে নকশিকাঁথার সেলাই করতে করতে কোমর আর হাতের দ’ফার’ফা অবস্থা। মোক্ষম সুযোগ পেয়ে হাত ছাড়া করলোনা রূপকথা। একটুকরো কাপড়ে কলম চালিয়ে নিলো। সেই কলমের আঁকিবুঁকিতে সুঁই-সুতো চালিয়ে তৈরি করে নিলো ছোট্ট রুমাল। সম্পূর্ণ রুমালে চোখ বুলিয়ে আনন্দে হাসলো সে। ঝটপট জামাকাপড়ের ভেতর লুকিয়ে রাখলো।

উপমা একটু স্বস্তির জন্য বেরিয়েছে ঠিকই, কিন্তু স্বস্তি পেলোনা। অস্বস্তিরা ঝাঁকুনি দিয়ে চেপে ধরলো তাকে। আশরাফুল ছেলেটা তাকে চোখের তৃষ্ণায় জ্বালিয়ে মা’রছে। এমন বেয়া’দব বাড়ির ছেলে হয়ে সে কি আর ভালো হবে?
আসলেই কি বাড়ি কখনো খা’রাপ হয়? বাড়ির মানুষগুলোর কর্মের উপর নির্ভর করে মানুষ বাড়ি নিয়ে ইচ্ছে মতো একটা মন্তব্য করে ফেলে। উপমা আশরাফুলকে দেখেই বাড়িমুখো হলো। পা চালিয়ে আশরাফুল তার সাথ ধরলো। পুরুষের সাথে পা চালিয়ে টেকা মুশকিল। উপমাও পারলোনা আগে আগে বাড়ি ফিরতে। পথিমধ্যে ঝটপট উপমার হাত চেপে ধরলো আশরাফুল। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে কাঠ হলো। ধড়ফড় শব্দ ক্রমশ বাড়তে লাগলো। দূরে দুজন লোককে আসতে দেখা যাচ্ছে। উপমা ভ’য়ে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আকস্মিক এক কাজ করে বসলো। আশরাফুলের গালে চ’ড় বসিয়ে দিলো।
চ’ড় দেওয়ার পর তার মনে পড়লো সে কি করেছে। বি’পদ বুঝি ঘা’ড়ে চেপেছে? কিন্তু খানিক পরেই অবাক হলো উপমা। আশরাফুল রা’গ করলোনা। বরং গালে হাত চেপে দুপাটি দাঁত বের করে হাসলো। যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে।
বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে রেখে বলল,
-“এই ছোঁয়া পাওয়ার লাগি জনম ভর চ’ড় খাইতে রাজি আছি।”

উপমা এটা ভেবেই রেগে যাচ্ছে ছেলেটা কেনো রাগলোনা? কেনো তার পিছু ছাড়লোনা?
ততক্ষণে মানুষগুলোর চোখে পড়ে গিয়েছে তারা দুজন। একজন মধ্যেবয়স্ক লোক বললেন,
-“কি চলে এইহানে? এইডা আকাম-কুকাম করনের জায়গা না। এই গেরামে এসব চলবোনা।”

উপমার চোখে পানি টলমল করছে। লোকগুলো তাকে খা’রাপ ভাবছে? দুজন ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখলেই তাদের ধারণা একজায়গাতে গিয়েই আটকা পড়ে।
আশরাফুল উপমার জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটির দিকে তাকালো। বেয়া’দবির সুরে বলল,
-“চাচা গেরামে সুন্দর সুন্দর মাইয়া মানষ বাইড়া যাইতাছে। কি করুম কন? পাত্তা দিতাছেনা, তাই জোর কইরা পাত্তা পাইবার চাইতাছি। কি খেমটি মাইয়া মাইনষের। আমার গালে থা’বড়া মারলো?”

লোকদুটো আড়চোখে উপমাকে দেখলেন। আশরাফুল জমরদ বাড়ির ছেলে। তারা ভালো না। তাই লোকদুটোর মতিগতি এবার ঘুরলো। উপমাকে বাড়ি যেতে বলে আশরাফুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“গেরামের মাইয়াগো লগে এসব না করলে তোমগো বাড়ির পোলাগো ভাত হজম হয়না?”

আশরাফুল তার জবাব না দিয়ে বলল,
-” কি করলেন চাচা? পাখি যাইতে দিলেন গা? এহন তো পাখির খোঁজে আমনের বাড়ি যাওন লাগবো।”

লোকদুটো ঘৃণার দৃষ্টি ফেলে বিড়বিড় করে বললেন,
-“অস’ইভ্য পোলা।”

আশরাফুল দুর্বোধ্য হাসলো। কাকে কোথায় কি বলে থামাতে হয় তা আশরাফুলের জানা আছে। তাদের দুজনকে একসাথে দেখেই লোকদুটো আজ কি কান্ড বাঁধিয়ে দিতো। নিজেদের খুঁটিই এখনো শক্ত করতে পারেনি আসে জমরদ বাড়ির পোলাপানের খুঁটি নিয়ে কথা বলতে।

[১৪]
দুপুরের জমানো থালাবাসন ধুয়ে বসতেই মা ডাকদিলেন তার মাথায় তেল দিয়ে দিতে। উপমা বলে দিয়েছে সে পারবেনা। মাথায় তেল দিয়ে সিঁথি দেওয়ার চেয়ে কোমর ব্যথা করে নকশিকাঁথা সেলাই করা ঢের ভালো মনে হয় তার কাছে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে রূপকথাকে ডাকলেন আলেয়া বেগম। মায়ের মাথায় তেল দিয়ে নকশিকাঁথা নিয়ে বসে পড়লো। কতদিন একাজ করতে হবে কে জানে? বিরক্তি ধরে যায়। কিন্তু মায়ের ভ’য়ে টু শব্দ করতে পারেনা দুবোন। মুখ খুললেই চ্যালাকাঠ দিয়ে উত্তম মধ্যম পড়বে দুজনের পিঠে। এখন ভাই ও সুস্থ নয় যে সে দৌঁড়ে এসে মাকে বাঁধা দেবে। আলেয়া বেগমের রা’গটা খুবই খা’রাপ। পান থেকে চুন খসলেই মেয়েদের গায়ে হাত তোলেন। আবার রাতে চুপি চুপি দরদ দেখিয়ে গাল ভাসিয়ে কাঁদেন।

আলেয়া বেগম নিজেও নকশিকাঁথা নিয়ে বসলেন। এত এত নকশিকাঁথার অর্ডার পাওয়ার কারণ হলো এখন মানুষ এসব কাজ করতে চায়না। হাতে দুটো টাকা হলেই কাজ করাতে লোক খুঁজে বেড়ায়। এক দিক দিয়ে বেশ ভালোই হলো আলেয়া বেগমের। দুটো পয়সা বেশি হাতে আসবে। ছেলের ঔষধের খরচ, সংসার খরচ এসবের তুলনায় এই টাকা অতি নগন্য। মা উঠে ঘরে যেতেই উপমা, রূপকথা হাত ছেড়ে বসলো। টনটন করছে প্রতিটি আঙ্গুলের শিরায় শিরায়।
মামুন আজ আবার তাদের বাড়ি আসলো। আলেয়া বেগমের সাথে মামুনের এখন বেশ খাতির হয়েছে। একবার যদি টের পান তার বাড়িতে কোন লো’ভে মামুন আসে তাহলে বাড়ির দরজায় কাঁ’টা ফেলতেও দুবার ভাববেননা। মেয়ে কালো হয়েছে তো কি হয়েছে? বেকার ছেলের কাছে কেনো বিয়ে দিতে হবে?

আমাদের বর্তমান সমাজটাই এমন। নিজের বেলায় আমরা ষোলো আনা বুঝি। ছেলে বেকার হলেও কালো মেয়ে বিয়ে করাবেনা পরিবার। আবার মেয়ে কালো হয়েছে তো কি হয়েছে? বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া যাবেনা। এই বিভেদ আমরা মানুষরাই সৃষ্টি করেছি। আমার যতটুকু আছে, আমি চাইবো তারচেয়ে উঁচুতে ছেলে কিংবা মেয়েকে বিয়ে দিতে। পৃথিবীর মানুষগুলো টাকা আর রূপের দাস।

মামুন একবার লুকোচুরি করে রূপকথাকে দেখলো। তারপরই আলেয়া বেগমের কথায় কান দিলো, কিন্তু মন দিলোনা। রূপকথা উঠে ঘরে গেলো। রুমালটা লুকিয়ে এসে আগের জায়গায় বসলো।
মাকে বলল,
-“ভাইয়া মনে হয় তোমারে ডাকছিলো মা।”

আলেয়া বেগম দ্রুত পা ফেলে ঘরে গেলেন। উপমা নিচ দিকে তাকিয়ে সেলাই করছে। রূপকথা সুযোগ পেয়ে রুমালটা মামুনের হাতে গুঁজে দিলো। সে চুপচাপ পকেটে রুমাল গুঁজে বসে রইলো। উপমা টের পেলেও বুবুকে বিব্রত করতে চাইলোনা। আলেয়া বেগম এসে বললেন,
-“কই খোরশেদ ডাকলো আমারে? হেয় তো ঘুমে।”

-“মনে হয় আমি ভুল হুনছি।”

মামুন বিদায় নিলো। রূপকথাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রুমালখানা খুলে ধরলো। মুহূর্তেই তার অধর কোনে এক চিলতে হাসি ফুটলো। একটুকরো খয়েরী কাপড়ে সাদা সুতোর বুনন। রূপকথা আঁকিবুঁকি শেষে রুমালের মাঝখানে লিখে দিয়েছে “আমনে আমার অন্তরের মানুষ”।

#চলবে…….

রূপকথা পর্ব-০৫

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৫

[৯]
মিষ্টি কিরণ ছড়িয়ে দেওয়ার নিমিত্তে প্রভাকর নিমজ্জিত। ক্ষণকাল সময় নিয়েই মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলে। মিইয়ে যায় তার তেজ। দক্ষিণাবহ হু হু করে তেজ বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কিশোরীদের উত্তেজনা। পশ্চিমাকাশে কৃষ্ণ আবর মেলা বসিয়েছে। ব্যাগ থেকে পলিথিন বের করে তাতে বই ঢুকিয়ে নিলো তিন কিশোরী। পলিথিন উপুড় করে গিট্টু দেওয়া অংশ ব্যাগের তলায় ফেললো। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ইতিমধ্যে সূচনা হয়ে গিয়েছে। মেঘের গর্জনে ব্যাগ আঁকড়ে ধরলো। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে ছন্দ পেলো। তালে তালে পা চললো। জুতা হাতে নিয়ে পিচ ঢালা নির্জন রাস্তায় দৌঁড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিলো রূপকথা, উপমা, তাহমিনা। সকাল থেকে আকাশের অবস্থা ভালো ছিলোনা। তাই বুদ্ধি করে পলিথিন নিয়ে এসেছে তিনজনে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে যখন হাঁপিয়ে গেলো? তখনই হাঁটুতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গেলো রূপকথা। তার থেকে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ালো উপমা, তাহমিনা। আকাশে মুখ করে বৃষ্টি স্বাদ আস্বাদন করছে রূপকথা। নেত্রপল্লব তিরতির করে কেঁপে উঠছে। গায়ের জামাটা বেশ আঁটসাঁট ভাবেই লেপ্টে আছে। বৃষ্টির পানি ধূয়ে দিচ্ছে সমস্ত শরীর, সমস্ত গ্লানি, বিষাদ। রূপকথা মনে মনে এক ইচ্ছে পোষণ করলো,
“ইশ! বৃষ্টির পানি যদি আমার শইলের রংটা ও ধূইয়া দিতো।”

পাশাপাশি চরণ ফেলে বাড়ি পৌঁছালো। পাকা রাস্তা থেকে নামলে খানিক কর্দমাক্ত মাটির রাস্তা রয়েছে। বৃষ্টির সময় জায়গাটার অবস্থা একেবারে করুণ হয়ে থাকে। টাকনুর উপর থেকে অনেকখানি পায়জামা উন্নমিত করে কাঁদায় পা ডুবিয়ে বাড়ির ফটকে এসে থামলো উপমা, রূপকথা। ঘরের ভেতর ডুকতেই দুঃসহ বিষাদে ছেয়ে গেলো মন। সুতীব্র বেদনা আঁকড়ে ধরলো। চিকচিক করে চক্ষু কোটরে জমে থাকা জলে পাপড়ি গুলো আদ্র হয়ে উঠলো রূপকথার। লম্বা হয়ে শুয়ে আছে খোরশেদ। পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ প্যাঁচানো।
কাজ করতে গিয়ে চালের উপর থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গিয়েছে। রূপকথার কোমল হাতখানি ছুঁয়ে দিলো ভাইয়ের ভগ্ন পা খানা। ঈষৎ ব্যথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করলো খোরশেদ। ভ’য়ে আড়ষ্ট হয়ে সাথে সাথে হাত সরিয়ে তটস্থ হয়ে রইলো রূপকথা।
খোরশেদ বোনের করুণ চেহারা দেখে অল্প শব্দে হাসলো।

আলেয়া বেগমের চিন্তার শেষ যেনো হতে হতেও হয়না। রাত বাড়লে তার চিন্তাগুলো ধাপে ধাপে উন্নিত হয়। ছেলেটা পা ভে’ঙে বসে আছে। কেমন করে চলবে সংসার? কোনোরকম ওই ছেলের রোজগারেই দিনাতিপাত করেন। এখন সেই সম্বল টুকু অবশিষ্ট রইলোনা। সংসারের সমস্ত ভার, বোঝা ঘাড়ে নিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে ছেলেটা। না জানি কোনদিন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে তেমন চিন্তা না থাকলেও রূপকথার চিন্তায় যেনো ম’রি ম’রি দশা। রা’গের চোটে চারটে খানি কথা শোনাতেও বাঁধেনা তার। তিনি নিজের মতো করে সন্তানের ভালো চান। কিন্তু একটি বার খতিয়ে দেখেননা “আমি যেভাবে চাইছি সেভাবে কি আমার সন্তান ভালো আছে?”
কোমরের ব্যথার জন্য বসা থেকে হঠাৎই দাঁড়িয়ে যেতে পারেননা আলেয়া বেগম। দাঁতে দাঁত কে’টে ব্যথা হজম করেন। ছেলে-মেয়েদের জানতে দেননা।
আলেয়া বেগমের শরীরখানা ঘুণে ধরা কাঠের মতো। উপরটা ভালো দেখা গেলেও ভেতরটা ভঙ্গুর। সেজো মেয়ে মমতার সাথে ফোনে কথা বলছিলেন তিনি।

-“জামাইর লগে কত মাইনষের ওঠাবসা। হেয় কি পারেনা তার শালিটারে নিয়া বিয়া দিতে?”

স্পিকার অন করা ছিলো। নয়তো আলেয়া বেগম কথা বুঝেননা। তার হাতে অল্পদামি একটা নোকিয়া বাটন ফোন আছে। মেয়েরা ফোন দিলে এটা দিয়েই কথা বলে। ওপাশ থেকে মমতার বিরস কন্ঠস্বর শোনা গেলো,
-“উনার লগের একটা ভালা পোলা আছিলো। বিয়ার লাইগা যখন মাইয়া খুঁজছে তহন আমি আপনেগো জামাইরে কইছিলাম রূপকথার কথা কইবার লাই। উনি কইলেন তারা সুন্দরী মাইয়া খোঁজে। রূপ কালা। ওর কথা কইতেও তো উনার শরম করে। মাইনষে কইবো নিজের কালা শালিটারে গইচ্ছা দিতাছে।”

রূপকথা শুনলো কথাগুলো। এ আর এমন কি? প্রতিদিনই অহরহ তাকে নিন্দে কথার জালে ডুবতে হচ্ছে। যদি সে হাঁস হতো তবে এই কথার জল গা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারতো। আফসোস হচ্ছে রূপকথার। “ক্যান হাঁস হইলাম না?”

[১০]
আজকে আকাশ ভীষণ একা। তার বুকে চাঁদ নেই। তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য একটা তারকা ও আজ অবশিষ্ট নেই। রাতের আকাশ ভয়াবহ অন্ধকার ঠেকছে। জীবনটা ও তো অন্ধকার। মাঝেমাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো ক্ষণিকের দীপ্তি দেখতে পায়। নিমিষেই তা আবার হারিয়ে যায়, পূনরায় অন্ধকার তার জায়গায় বহাল হয়ে রয়। পড়তে বসে জানালার ফাঁকে চোখ রেখেই কথাগুলো ভাবছিলো রূপকথা। তাদের ঘরে এক অপ্রত্যাশিত মানবের আগমনে চমকে ওঠে রূপকথা। হাতুড়িপে’টার শব্দ, কম্পন টের পায় বক্ষ খাঁচায়। সহসা থেমে গেলো সে, আশ্চর্য হলো। মানুষটা এখানে কি করছে?

মামুন খোরশেদের পাশেই খাটে বসলো। দৃষ্টি তার চেয়ারে বসা রমনীর পানে। খোরশেদের কথায় নড়েচড়ে বসে মামুন। ফের তাকায় রূপকথার দিকে। তার কেনো জানেনা মনে হচ্ছে আল্লাহ কিছু মানুষকে কালো বানিয়ে ও সমস্ত রূপ ঢেলে দেয় তার চেহারায়। এক লোভনীয় মাধুর্য খুঁজে পাওয়া যায় সেই মানুষগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এমন মানুষের প্রেমে বারংবার ম’রা যায়। এমনি এমনি তো আর মেয়েটার নাম কোকিল পাখি দেয় নি সে। ভীষণ আন্তরিকতার সাথেই খোরশেদের ভালোমন্দ খোঁজ নিলো মামুন। পাশেই আলেয়া বেগম বিষন্ন বদনে বসা ছিলেন। মামুন বলল,
-“কোনো সাহায্য লাগলে বইলেন চাচি। আমরা তো আপনাগো পোলার মতো। যহনই দরকার হইবো ডাক দিবেন।”

ভরসা পেলেন আলেয়া বেগম। এরকম সাহস দিয়ে কথা বলার মতো লোকজন আজকাল পাওয়া যায় না। আলেয়া বেগম ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলেন।
-“বস বাবা, চা খাইয়া যাইবা।”

মামুন বাঁধা দিতেই সাবধানী গলায় শুধালো,
-“এহন এত কষ্ট করন লাগবোনা চাচি। মোড়ে দোকানে গ্যালেই চা খাওন যাইবো। আমনে বসেন।”

আলেয়া বেগম বাঁধা মানলেননা। মামুনকে জোরদার করে বসিয়ে উঠে গেলেন চা আনতে। রূপকথার দৃষ্টি বইয়ে, মন ডানপাশে বসে থাকা মানুষটির মাঝে। না চাইতেও আজ মন ব্যাঙের মতো লাফিয়ে মামুনের উপর পড়তে চাইছে। সে ও আজ বাঁধা দিলোনা। দৃষ্টি বিনিময় হচ্ছেনা দুজনের, কিন্তু পাশাপাশি মন বিনিময় হচ্ছে।
মায়ের কাছ থেকে পরে জানতে পারলো মামুনই পা ভা’ঙার পর খোরশেদকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।

[১১]
খোরশেদ পা ভে’ঙে ঘরে ঢুকেছে কয়েকদিন হলো। সংসার তো আর এমনি এমনি চলবেনা। তেল না থাকলে যেমন গাড়ি চলেনা, টাকা না থাকলেও সংসার চলেনা। মানুষ বলে টাকা ছাড়া ও সুখী হওয়া যায়। কথাটি ভুল। সুখী হওয়ার জন্য বেঁচে থাকা প্রয়োজন। আর বেঁচে থাকতে হলে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রয়োজন হয়না, তবে টাকার প্রয়োজন হয়। টাকার পেছনে দুনিয়া ছোটে। ঘরে বছরান্তে চাষ করা চাল আছে। চাল ছাড়া ও তো বাকি জিনিসের প্রয়োজন হয়। তেল, নুন ছাড়া রান্না হয়? টাকার প্রয়োজনে কয়েকজনের নকশিকাঁথা বানিয়ে দেওয়ার অর্ডার নিলো আলেয়া বেগম। কিছু নিজে করছেন। কিছু মেয়েদেরকে দিয়ে করাচ্ছেন। ঘরে সদাই-পাতি লাগবে। এখন বাজারে যাবে কে?
তখনই আলেয়া বেগম দেখা পেলেন মামুনের। তাদের বাড়ির সামনেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আলেয়া বেগম গলার স্বর উঁচু করেই ডাকলেন,
-“বাবা, বাড়ির ভিতরে আসো। ওইহানে দাঁড়াইয়া কি করো?”

মামুন উঁকিঝুঁকি দিয়ে রূপকথাকে দেখার চেষ্টা করছিলো। আলেয়া বেগমের চোখে পড়ে যাবে সে, এটা ভাবতে পারেনি। কৃত্রিম হেসে ইতিউতি করেই বলল,
-“ভাবছিলাম খোরশেদের খবর জিগাইতে যামু কি যামুনা। এহন আমনেই ডাক দিলেন।”

আলেয়া বেগম হেসে বললেন,
-“আইবা, যাইবা এত ভাবনের কি আছে?”

মামুন বাড়ির ভেতর ঢুকে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলো রূপকথা আর উপমা বসে বসে নকশিকাঁথায় নকশা করছে। সে আলেয়া বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
-“চাচির কিছু লাগবো?”

আলেয়া বেগম ভনিতা ছাড়াই বললেন,
-“হ বাবা। কিছু সদাই-পাতি লাগতো। বাজারে যাওনের মানুষ নাই।”

মামুন বলল,
-“আমি আছি ক্যান? আমনে আমারে নিজের পোলা মনে করেননা চাচি। যান বাজারের ব্যাগ লইয়া আসেন।”

আলেয়া বেগম উঠান ছেড়ে ঘরে গেলেন টাকা আর ব্যাগ আনতে। মামুন চট করে উঠে দাঁড়ালো। উপমাকে বলল,
-“উপমা আপু একটু পানি দিবা?”

কেউ পানি চাইলে না করতে নেই। তাই উপমা হাতের কাজ রেখে পানির জন্য গেলো। রূপকথার পাশে বসলো মামুন। মিইয়ে গেলো রূপকথা। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। নরম গাল জোড়া গরম হয়ে উঠলো। ফর্সা হলে দৃষ্টিগোচর হতো তার আরক্তিম নাক, গাল। মামুন ফিসফিস গলায় বলল,
-“আমারে একখান রুমাল বানাইয়া দিবা, কোকিল পাখি?”

রূপকথা গুটিয়ে নিলো নিজেকে। তার ভীষণ লজ্জা হচ্ছে। মানুষটা তার এত কাছে কেনো বসেছে? সে কি টের পায়না হৃদয়ের কম্পন?

আলেয়া বেগমের গলা শুনেই চট জলদি নিজ জায়গায় অবস্থান করলো মামুন। আলেয়া বেগমের হাত থেকে টাকা আর বাজারের ব্যাগ, ফর্দ হাতে ছুটলো বাজারে। এদিকে উপমা পানি নিয়ে এসে দেখে মামুন চলে যাচ্ছে। পানির গ্লাস হাত থেকে রাখতেই ঢকঢক করে গিলে নিলো রূপকথা। যেনো কতকাল ধরে সে তৃষ্ণার্ত।

স্কুল যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো আশরাফুল। সে ও জমরদ বাড়ির ছেলে। বিনয়ের সাথে রূপকথাকে শুধালো,
-“বুবু একটু কথা কওনের সুযোগ দিবেন? উপমার লগে আমার জরুরি কথা আছে।”

চরম বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে আসলো রূপকথার। এই ছেলে নির্ঘাত তার চেয়ে তিন-চার বছরের বড় হবে। তাকে বুবু কেনো ডাকছে? তাও আবার উপমার সাথে কথা বলতে চায়। মতলব কি? জেদ ধরলো রূপকথা। কাঠকাঠ গলায় বলল,
-“কি কওনের আছে। আমার সামনেই কন। উপমা আমনের লগে একলা কথা কইবোনা।”

এতক্ষণ ভ’য় পাচ্ছিলো উপমা। সে যখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তখন ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি কি বলে যা স্পষ্ট শোনার আগেই দৌঁড়ে পালায় সে। এ বাড়ির ছেলে মানুষ খুব খা’রাপ। বুবুর কথায় ভ’য় কাটলো তার।
আশরাফুল লাজলজ্জা হীন ভাবেই বলল,
-“বুবুর সামনে কইতে চাইছিলাম না। আপনে যহন চান তাইলে হুনেন।”
উপমার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল,
-“আশিকরে আমি আদর কইরা বুঝাইয়া দিছি। হেয় এহন আর তোমারে চিডি দিবোনা। আইতে যাইতে সালাম দিবো ভাবী কইয়া। তুমি খালি একবার কইয়া দিবা কে তোমার লগে খারাপ ব্যবহার করে। আমি তার কইলজা ছিঁইড়া নিমু। আমার বউয়ের উপর বদ নজর আমি সহ্য করুম না।”

আশরাফুলের কথা শুনে রা’গে নাকের পাটা ফুলে উঠলো রূপকথার। উপমার হাত চেপে ধরে সামনে চললো। পেছন পেছন আশরাফুল হেসে হেলতে দুলতে আসছে। রূপকথা হাত জোড় করে বলল,
-“দয়া কইরা পেছন পেছন আইবেননা। লোকে আমগোরে খারাপ কইবো।”

#চলবে…….

রূপকথা পর্ব-০৪

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৪

[৭]
আইরিনের বিয়ের পূর্বে হলুদের দিন বিকেলেই ফুফুর বাড়িতে উপস্থিত হয় রূপকথা আর উপমা। সাথে মা ও এসেছেন। ভাইয়া আগামীকাল আসবেন। আইরিনের বিয়েতে রূপকথাকে দেখে উপস্থিত লোকজন তাকে বাঁকা চোখে দেখছে। আইরিন রূপকথার ছোট, উপমার সমবয়সী। তার আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অথচ রূপকথা ড্যাং ড্যাং করে বিয়েতে চলে এসেছে। একজন তো সব জানার পরও টিট’কিরি করে বলেই বসলো,

-“তোমার তো এহনো বিয়া হয়নাই, তাইনা?”

মহিলাটি সঠিক জায়গায় তীর ছুঁড়ে মনে মনে বেশ আনন্দ আস্বাদন করছেন। রূপকথা কষ্টগুলো পি’ষে ফে’লে কৃত্রিম হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
-“না, আমি তো এহনো পড়তাছি।”

মহিলাটি চরম বিষ্ময় প্রকাশ করলেন। মুখ হা করে মুখে হাত দিয়ে বসলেন। যেনো রূপকথা এক বেফাঁস কথা বলে গুরুতর অন্যায় করে ফেলেছে। চোখ দুখানা ঈষৎ বড় করে বললেন,
-“এহনো পড়ালেহা করো? মাইয়া মাইনষের এত বেশি পড়ালেহা করণ ভালা না। এহন যুগ ভালা না। কত অঘটন আজকালকার জামানার পোলামাইয়ারা ঘটায় তা কইতে ও শরম করে।”

-“সবাই কি আর এক হইলো?”
রূপকথার উত্তরে মহিলাটি মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
-“যারা বেশি পড়ালেহা করে তাগো স্বভাব আর ভালা হয়না। সবই এক। মাইয়া মাইনষের এত পড়ন ভালা না।”

চলে গেলেন মহিলাটি। তার বিড়বিড় করে বলা কথাটি কান এড়ালোনা রূপকথার।

-“নাই রূপের ছিঁ’ড়ি। আবার পড়ালেহার ভাব দেহাইতে আহে।”

আর কত? কত হজম করবে রূপকথা? ভেতরে ভেতরে বিধ্বস্ত হলো, আ’ঘাতে আ’ঘা’তে রক্তক্ষরণ হলো। সত্যি সে আর শক্তি পাচ্ছেনা। তার দুঃখগুলো বলার জন্য মায়ের কোলকে ও পূঁজি করতে পারছেনা। চোখের পানি আর কত ঝরাবে? রূপকথা মনে মনে এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো। অন্তত তার সন্তানকে সে তার মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে দেবেনা। পরক্ষণেই তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“কপালে বিয়াই জুটলোনা, পোলাপান আইবো কই থেইকা?”

হলুদের অনুষ্ঠানে সবাই হলুদ রঙা শাড়ি পড়বে। রূপকথা তাহমিনার কাছ থেকে একটি হলুদ শাড়ি নিয়ে এসেছিলো পড়ার জন্য। হলুদ শাড়ি পড়ার শখ তার বহুদিনের। বিয়ের উছিলায় তার শখ ও পূরণ হবে। মাঝ বরাবর সিঁথি করে ঘাড়ের কাছে খোঁপা করলো। চোখের রেখায় গাঢ় কাজল টানলো। উপমার থেকে নিয়ে কটকটে লাল রঙা লিপস্টিক ঠোঁটে ছোঁয়ানোর আগেই আলেয়া বেগম চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
-“ঠোঁটে এগুলা কি দিতাছস? কেমন দেহা যায়? হালকা রঙের কিছু দে ঠোঁটে। আর কাজল এত গাঢ় করলি ক্যান? তোর চোক্ষের নিচ এ্যামনিতেই কালা। কাজল ছড়াইলে আরও বি’চ্ছিরি দেহা যাইবো।”

নিজের হাতে সুতি শাড়ির আঁচল দিয়ে রূপকথার চোখের কাজল মুছে দিলেন আলেয়া বেগম।
তিক্ত বিষাদে মন ডুবে গেলো। নিজের মন মতো সাজ টুকু ও তার কপালে জুটলোনা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপকথা। সে খুব ভালো শাড়ি পড়াতে জানে। উপমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে দাঁড়াতেই কয়েকজন মেয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরলো শাড়ি পড়িয়ে দিতে। রূপকথা স্বাচ্ছন্দে তাদের শাড়িতে হাত রাখলো। একজন জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কি পিনবা?”

রূপকথা মিষ্টি হেসে বলল,
-“ওই যে হলুদ কাপড় আছে।”

মেয়েটা চোখমুখ কুঁচকে বলল,
-“হলুদ? তোমার চামড়ার রং একেবারে ফকফকা হইয়া দেহা যাইবো। হলুদ রং কি আর কালা মাইনষেরে মানায়? তুমি আমার কাছ থেইকা একটা নিয়া পিনবা।”

রূপকথা কিছু বলার আগেই উপমা জবাব দিলো,
-“ক্যান? হলুদ রঙ এ কি হইছে? আমার বুবুরে সব রঙেই মানায়। আমার তো বুবুরে সব রকমেই ভালা লাগে।”

শাড়ি পড়িয়ে দিতেই সবাই বেরিয়ে যায়। উপমা বলল,
-“তুমি যাইবা না বুবু? তাড়াতাড়ি কাপড় পিন্দা লও। আমি খাড়াইতাছি।”

রূপকথা স্বাভাবিক গলায় বলল,
-“তুই যা, আমি আইতাছি। বেশি দেরি হইবোনা।”

উপমা সায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। রূপকথা আর বের হলোনা। হলুদ শাড়িটির ভাঁজ ও খুললোনা। আবার ব্যাগে ঢুকিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। বালিশে মাথা রেখে নেত্রপল্লব বন্ধ করতেই চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু’ফোটা জল গড়ালো। ভিজিয়ে দিলো নরম গাল জোড়া।
“আব্বা ক্যান আমার নাম রূপকথা রাখলা? সবাই আমার রূপ নিয়া ক্যান প্রশ্ন তোলে?”

সবাই বাইরে কত আনন্দ করছে। সবাই উপস্থিত থাকলেও রূপকথাকে দেখতে পেলেননা আলেয়া বেগম। তার চোখ জোড়া হন্যে হয়ে মেয়েকে খুঁজছে। অবশেষে উপমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-“তোর বুবু কই?”

-“বুবু আইবো কইয়া এহনো আইলোনা। আমি যাইয়া দেইখা আসি।”

উপমাকে থামিয়ে দিলেন আলেয়া বেগম।
-“তুই থাক। আমি যাইয়া দেহি।”

আলেয়া বেগম কয়েকটা রুম খুঁজে রূপকথাকে পেলেন। শুয়ে আছে মেয়েটা। গালজোড়া ভেজা। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো আলেয়া বেগমের। মেয়েটা পোড়াকপালি। তার রংটাই তার জন্য অভি’শাপ। আলেয়া বেগমের ভ’য় হয় মেয়েটাকে নিয়ে। এই বুঝি কেউ তার মেয়েটাকে কুৎ’সিত বলল, ক’ষ্ট দিয়ে কথা বলল, তাই তিনি নিজ থেকেই মেয়েকে সেসব থেকে দূরে রাখেন। যেসব রঙে দেখলে মানুষ টিটকিরি করবে। মেয়েটা কোন কারণে বাইরে গেলোনা?
আলেয়া বেগম ডান হাতে মেয়ের গাল ছুঁয়ে দিলেন। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ যে প্রতিটি সন্তানের বড্ড চেনা। রূপকথার ও চিনতে ভুল হলোনা। চোখ বন্ধ করেই শুয়েছিল সে। মায়ের ছোঁয়া পেয়ে ঝট করে চোখ খুলে তাকায়। চোখের সাদা অংশে লাল বর্ণ ছড়িয়েছে। আলেয়া বেগম আৎকে উঠে কোমল গলায় শুধালেন,
-“কি হইছে আম্মা? নিচে গেলিনা ক্যান? শরীল খারাপ?”

রূপকথা উঠার চেষ্টা করলোনা। বলতে ইচ্ছে করলো “আমার ভীষণ মন খারাপ।” কিন্তু বলতে পারলোনা।
মিথ্যার আশ্রয় নিলো। সেভাবেই শুয়ে থেকে বললো,
-“মাথাডা ধরসে। এর লাইগাই গেলামনা।”

আলেয়া বেগম তড়িঘড়ি করে বললেন,
-“আচমকা মাথা ধরলো ক্যান? আইচ্ছা আমি নাপা টেবলেট পাই কিনা দেইখা আসি।”

রূপকথা ফিসফিস করে বলল,
-“মাথা ব্যথার ঔষধ না আইনা, অন্তর ব্যথার ঔষধ আইনো।”

আলেয়া বেগমের কর্ণধারে পৌঁছালোনা কথাটি। তিনি ঔষধের খোঁজে চলে গেলেন।

[৮]
বিয়ে বাড়ি থেকে বিকেলেই ফিরেছে সবাই। মন ভালো করার একমাত্র সঙ্গী বকুল সই। রূপকথা দেরি করলোনা। ছুটে চলে গেলো বকুল তলায়। প্রাণভরে শ্বাস নিলো। এ দুদিন যেনো দমবন্ধকর পরিবেশে মন পাখির বেড়ে ওঠা বাঁধা পেয়েছিলো। খোলা আকাশের নিচে নিজেকে এখন মুক্ত এক ছোট্ট পাখি মনে হচ্ছে। দুটো ডানা থাকলেই উড়ে যেতো। একে একে মানুষের নিন্দাগুলো মনে পড়তেই কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো রূপকথা। নীলাম্বরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“ওই আকাশ তুই এই মানুষগুলারে বুঝাইতে পারবি? তাগোরে কইয়া দিবি? আমার চামড়া কালা কিন্তু অন্তর কালা না।”

থামলো রূপকথা। বেরিয়ে আসলো তান্ডবহীন এক শান্ত দীর্ঘশ্বাস।
“আমার কল্পনায় আমিই সেরা সুন্দরী”
নেত্রপল্লব বন্ধ করে নিলো রূপকথা। কল্পনা জগতে তার পদচারণ ঘটলো। সে অনুভব করলো কল্পনায় সে বড্ড সুখী মানুষ। বিলের জলে ভাসা লাল পদ্ম।
আলতা পায়ে হলুদ রঙা শাড়ি পড়ে চোখে মোটা কাজল, ঠোঁটে টকটকে রং এর বাহার, হাতে বকুল ফুলের একখানা মালা, লম্বা আঁচল মাটিতে ছড়িয়ে বিলের পাড় ঘেষে ছুটে চলে যাচ্ছে কৃষ্ণবতী। ছোটার তালে তালে কৃষ্ণ কেশরের খোঁপাটি আলগা হয়ে পিঠ ছুঁয়ে কোমর ছুঁয়ে দিলো। বকুলতলায় এসে থামতেই শুরু হলো ঝরঝরে পুষ্পবৃষ্টি। আবিষ্ট হয়ে রইলো নিজ কল্পনায়। সত্যিই তো সে সুখী। রূপকথা সে, রূপকথার রাজকন্যা। রাজকুমার নেই, তবে আসবে। একদিন ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাজকুমার ঠিকই আসবে।

-“কই ছিলা কোকিল পাখি? দুইডা দিন কোকিলা কন্ঠস্বর না শুনতে পাইরা আমার বুকের উতালপাতাল ঝড় কি টের পাওনাই?”

মোহনীয় ব্যাকুল কন্ঠস্বরে কল্পনা জগতের ইতি ঘটালো রূপকথা। বিধ্বস্ত রমণীর মনে ঈষৎ ঢেউ খেলে গেলো। কি চায় মানুষটা? রূপকথা চোখে চোখ রাখলো। নির্নিমেষ চেয়ে রইলো। নিরবতা কাটাতে ঢিমে স্বরে খানিকটা দ্বিধা নিয়েই শুধালো,
-“আমনের উদ্দেশ্য কী?”

হাসলো মামুন। ভুবন ভোলানো চওড়া হাসি। চোখজোড়া ক্রমশ সরু হয়ে আসলো। তাকে ভীষণ চমৎকার দেখালো। মাদকতায় আসক্ত চোখজোড়া চেয়ে রইলো কৃষ্ণবতীর পানে। আবিষ্ট কন্ঠে শুধালো,
-“প্রার্থনায় কেবল কোকিল পাখি।”

রূপকথা চমকালো, থমকালো, ভড়কালো। ঘোর লাগলো মনে। অন্তঃকরণে আইঢাই শুরু হলো। অস্থির, ব্যাকুল, চঞ্চল হয়ে উঠলো চোখজোড়া। খানিক পরেই বাস্তবতা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো,

“মি’থ্যের বোনা জালে পা দিও না সই,
বাস্তবতা ভীষণ কঠিন, তোমার জায়গা কই?
সৌন্দর্যে মন ভোলানো পুরুষজাতির স্বভাব,
নতুন খাঁচায় চোখ জুড়াবে, পিরিতিতে জমবে ধুলো,
ভালোবাসায় বুঝবে তুমি অভাব।
নারীই তোমার পরম শ’ত্রু, নিন্দে তার বাণী,
ধরার বুকে আছড়ে পড়া তুমিই বিষাদিনী।”

মলিন হাসলো রূপকথা। অকপটে,নির্দ্বিধায় শুধালো,
-“বাস্তবতা ভীষণ চেনা।”

সুগভীর, নির্মল মামুনের দৃষ্টি। নিমেষহারা চোখজোড়া চনমনে ভঙ্গিতে হাসলো। জোরালো কন্ঠে শুধালো,
-“প্রার্থনা একদিন ঠাঁই পাবে বাস্তবতায়।”

রূপকথার মনে ভয়ঙ্কর এক ইচ্ছে জাগলো। শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ হাতখানা তার পেলব হাতের স্পর্শে আঁকড়ে ধরতে চাইলো। মনে মনে চাইলো,”প্রার্থনায় মানুষটা সফল হোক।”

বকুল গাছের শক্ত শেকড়ে বসে পড়লো রূপকথা। পাশে বেশ খানিক জায়গা রাখলো। মামুন ভনিতা ছাড়াই পাশে বসলো। দুজনের বয়সে বিস্তর ফারাক। কিন্তু মনে? আদৌ কি ফারাক আছে? রূপকথা আড়চোখে একবার তাকালো মামুনের দিকে। মামুন তার দিকেই চেয়ে আছে নিমেষহীনভাবে। রূপকথার দৃষ্টি থামলো বিলের জলে। সুর হয়ে বেরিয়ে আসলো মনের কিছু সুপ্ত কথন।

“কিছুদিন মনে মনে..,
কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোণে,
কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোণে,
শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে।
কিছুদিন মনে মনে…..”

“ইশারায় কইবি কথা ঘোটে-মাঠে…
ইশারায় কইবি কথা ঘোটে-মাঠে,
দেখিস যেনো কেউ না জানে, কেউ না বোঝে, কেউ না শোনে……
কিছুদিন মনে মনে…..”

“শ্যামকে যখন পড়বে মনে,
চাইবি কালো মেঘের পানে,
ওরে শ্যামকে যখন পড়বে মনে…..
ও তুই চাইবি কালো মেঘের পানে……”

হুট করেই বিনা বার্তায় বৃষ্টি নামলো। রয়েসয়ে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। রূপকথার চরণ দুখানা ছুটে চললো বাড়ি পথে। রহস্যময় হেসে শুধালো,
-“সুখ যে মরিচীকা।”

মামুনের চোখ দুখানা স্থির রইলো রমণীর যাত্রাপথে।

#চলবে……

রূপকথা পর্ব-০৩

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৩

[৪]
রাতের ভারী বর্ষণের পর প্রকৃতিতে দেখা দিয়েছে সতেজতা। কচি কিশলয়ে জমে থাকা দু-এক ফোঁটা পানি যেন সূর্যের কিরণ পেতেই ঝলমল করে উঠলো। উঠানের মাটি বালু যুক্ত হওয়ায় ঝপাৎ করেই বৃষ্টির পানি শুষে নিলো। কলপাড়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় নজর পড়লো রূপকথার। মামুন ভাই তাদের বাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছে। সামনে এগোচ্ছে ঠিকই কিন্তু চো’রের মতো উঁকিঝুঁকি দিয়ে তাদের বাড়ির ভেতর কিছু খুঁজে যাচ্ছে। রূপকথার চোখে চোখ পড়তেই কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে ভুবন ভোলানো হাসি দিলো। লজ্জা পেয়ে চট করেই সরে গেলো রূপকথা। সালমান মামুনের পিঠে চাপড় মেরে বলল,

-“এরম মাইনষের বাড়িত কি খোঁজো বন্ধু? এ বাড়ির সুন্দরী মাইয়া মনে ধরসে নাকি?”

-“ধূর ব্যাডা। সব কিছুতেই তোগো ইয়ার্কি করন লাগে। আমি তো গাছ দেখতাছি।”

সালমান বাহু দিয়ে মামুনের পিঠে মৃদু ধা’ক্কা মে’রে বলল,
-“বুঝি বুঝি। এইসব ইন্দুর, টিকটিকির লেজ বহু আগেই মা’ইরা আইছি।”

মামুন আর বাড়াবাড়ি করলোনা। আপনাআপনি সালমানের কথা বন্ধ হয়ে গেলো।
মায়ের কাজ এগিয়ে দিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও স্কুলের উদ্দেশ্যে বের হলো দুই বোন। পথে গিয়েই উপমা থেমে গেলো। রূপকথা পিছু তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিরে, খাড়াই গেলি ক্যান?”

উপমার আতঙ্কিত চেহারায় ভালো করে নজর পড়তেই উতলা হয়ে উঠলো রূপকথা। চরম উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কি হইছে?”

উপমা অসহায় চোখে তাকিয়ে বুবুর দিকে পেছন দিক দিয়ে দাঁড়ালো। ভাঙা গলায় বলল,
-“আমি স্কুলে যাইতে পারুমনা বুবু।”

রূপকথা তিরিক্ষি গলায় ঝট করেই বলে ফেললো,
-“তোর কি আক্কেল জ্ঞান নাই? না কইতেই তালগাছের মতোন লম্বা হইয়া গেলি? তারিখ মনে থাকে না?”

-“এত কিছু আমার মনে থাকেনা বুবু। কি দরকার এসব ঝামেলা হওনের? কত কিছুই তো দান করন যায়। এসব দান করন যায়না? তাইলে আমি কাউরে দান কইরা বি’পদ মুক্ত হইতাম।”

উপমার কথা শুনে ধমকে উঠলো রূপকথা। কড়া শাসনের সুরে বলল,
-“সাবধানে বাড়িত যাইবি। তিড়িংবিড়িং করবিনা। ওড়না দিয়া পেছনদিক ঢাইকা রাখ।”

উপমা পেছন দিকে ওড়না জড়িয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতেই কোমরের অংশ থেকে নিচের দিকের সাদা পায়জামা রঙিন হয়ে গেলো। জমরদ বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কতগুলো ছোকরা উপমার দিকে আঙ্গুল তাক করে হাসাহাসি করতে লাগলো। লজ্জায়, অপ’মানে, ভ’য়ে সিটিয়ে গেলো উপমা। এ বাড়ির ছেলেগুলো বড্ড বেয়া’দব। মেয়েদের দেখলে খারাপ কথা বলে। বাড়ির মেয়েলোকেরা সারাদিন রাস্তায় থাকে। ছোট ছোট বাচ্চারা মুখে মুখে গা’লি দেয়। অথচ এদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়না। এবাড়ির ছেলেগুলো একদিন একটা মেয়ের পেছন দিকে কোমরের নিচের অংশে লাঠি দিয়ে আ’ঘা’ত করে বসে। এদের ভাষা ব্যবহার খা’রা’প বলে কেউ বিচার নিয়ে আসেনা। রাস্তায় বুবুকে দেখলেও খা’রা’প কথা বলে। কালি বলে ব্যঙ্গ করে। উপমার খারাপ লাগে, খুব খারাপ লাগে। কই তার বুবু এতটা কালো? বুবুকে তার সবচেয়ে সুন্দরী মনে হয়। বড় বড় চোখদুটোতে যখন জলে চিকচিক করে তখন মনে হয় বিলের জলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। লোকে কেনো তার বুবুকে নি’ন্দা করে?
সব ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় আশিকের হুট করে আগমনে।

জোর করে উপমার হাত ধরে একটুকরো কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল,
-“তোর লাইগা টেহা দিয়া জলিলের হাতে চিডি লেহাইছি। কাইল আমার চিডির উত্তর দিবি।”

অতিরিক্ত ভ’য় আর জড়তার কারণে শব্দ করে কেঁদে ওঠে উপমা।
মামুনকে সবসময়ই পাড়ায় পাড়ায়, দোকানে দেখা যায়। রং চায়ে তৃষ্ণা মেটাতেই জমরদ বাড়ির সামনের দোকানে এসেছিলো মামুন। উপস্থিত ঘটনা দেখে ধমক দিলো আশিককে। উপমাকে বলল,
-“তাড়াতাড়ি বাড়িত যাও উপমা আপু। এইহানে খাড়াইয়া থাকন ঠিক না।”

উপমা একবার তটস্থ দৃষ্টিতে তাকালো আশিকের দিকে, আবার তাকালো মামুনের দিকে। মামুন আশ্বস্ত করতেই ভরসা পেয়ে এক ছুটে বাড়ি এসে থামলো উপমা। উপমাকে স্কুলে না গিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখেই আলেয়া বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। মেয়ের অবস্থা দেখে সব আন্দাজ করে ফেললেন। মেয়েটার উপর চরম রা’গ ও হলো। এত বড় দা’মড়ি হয়েছে এখনো এসব ব্যাপারে তার হেয়ালিপনা। ইচ্ছে করছে ধরে উ’ত্তম ম’ধ্যম দিতে। আপাতত ক্ষান্ত হলেন। আলেয়া বেগমের এই একটা বদ অভ্যেস। রা’গ হলেই ছেলেমেয়েদের পিঠের উপর রা’গ ঝাড়েন।

স্কুল থেকে তাহমিনার সঙ্গে বাড়ির রাস্তায় উঠলো রূপকথা। তাহমিনাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি পৌঁছালো। টেবিলে ব্যাগ রেখে আগে উপমাকে দেখতে গেলো। একটা বালিশ জড়িয়ে এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে উপমা। আল্লাহ নিজ হাতে তার চার বোনকে রং ঢেলে দিয়েছেন। বোনদের সৌন্দর্য দেখে রূপকথা মুগ্ধ হয়। এই রূপের পেছনেই মানুষ হন্যে হয়ে ছুটে। রূপকথা মনে মনে আফসোস করে বলে,

-“রূপ থাকলে আমার ও নিজস্ব একটা মানুষ হইতো। যার উপর খালি আমারই হক থাকতো।”

গোসল করতে গিয়ে চাচাতো বোনের দেখা পেলো। দুজন মিলেই অনেকক্ষণ ধরে সাঁতার কাটলো। ঘরে এসে ভাতের প্লেট নিয়ে বসতেই আলেয়া বেগম বললেন,
-“আইরিনের বিয়া ঠিক হইছে। তোর ফুফু আইজ আইয়া অনেকবার কইরা কইয়া গেছে বিয়াত যাওনের লাগি। তোর আব্বা থাকলে কি ভাগ্নীর বিয়াত না যাইয়া থাকতো?”

ভাত মাখতে মাখতেই রূপকথা বলে উঠলো,
-“তুমি কি কও? যাইবা?”

-“টেহা পয়সা ও তো লাগবো। আগে দেহি তোর ভাই আসলে আলাপ কইরা দেখমু।”

আলেয়া বেগমের কথায় রূপকথা মিনমিন করে বলল,
-“যদি বিয়াতে যাও তাইলে আমি কি পায়ে দিমু? আমার তো ভালা জুতা নাই।”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন আলেয়া বেগম। মেয়েকে হ্যাঁ, না কিছুই না বলে উঠে পড়লেন। খাবার খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠানে গিয়ে বসলো রূপকথা। ততক্ষণে উপমা ঘুম ছেড়ে উঠে পড়লো। কলপাড় থেকে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে এসে রূপকথার পাশে বসলো। উপমার চোখমুখ মাত্রাতিরিক্ত ফোলা দেখে রূপকথা ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“তোর চোখমুখ এমন ফোলা ক্যান? দিনের বেলা ঘুমাইলে চোখমুখ ফুইলা যায়, তয় এতটা ফোলে না।”

বুবুর কাছে কিছুই লুকিয়ে রাখতে পারেনা উপমা। ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে বুবুকে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদে রূপকথার বুক ভাসিয়ে দিয়ে আজকের ঘটনা বর্ণনা করলো। বুকের ভেতর ছ্যাৎ করে উঠলো রূপকথার। একবার ছেলেগুলোর নজর পড়েছে মানে তার বোনের জন্য সামনে শনি অপেক্ষা করছে। উপমাকে আগলে নিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,
-“তুই এহন আর পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবিনা। কোথাও যাইলে আমার লগে যাইবি।”

উপমা সায় জানিয়ে রূপকথাকে ঝাপটে ধরে বসে রইলো। আলেয়া বেগম তীক্ষ্ণ চোখে দুইবোনকে পরোখ করে বললেন,
-“কি হইছে দুইডার?”

রূপকথা কথা কাটিয়ে বলল,
-“উপমার পেট ব্যথা। এর লাইগাই কানতাছে।”

গরম পানি খাইতে ক ওরে। আর কিছু বললেন না আলেয়া বেগম। নিজের খুঁটিনাটি কাজে মন দিলেন।

[৫]
সূর্যের উত্তপ্ত দাপুটে মগজ গলে পড়ার উপক্রম। কড়া রোদে সকালের ঝুলিয়ে দেওয়া মরা মাছটি শুকিয়ে শুঁটকি হয়ে গেছে। চারপাশে মাছি ভনভন করছে। মাছ থেকে এক উটকো গন্ধ নাসাপথে প্রবেশ করতেই গা গুলিয়ে আসলো খোরশেদের। গলা শুকিয়ে কাঠ। এমন রোদের মধ্যে কাজ করছে অথচ গৃহস্থ একগ্লাস পানি এগিয়ে দিচ্ছে না। চুক্তি কাজে আবার খাবার কিসের? খোরশেদ আপাতত কাঠমিস্ত্রীর কাজ করছে। চালের উপর বসে টিন গাঁথছে। আজ হাঁটের তারিখ। কাজের টাকা হাতে আসবে। গত রাতে মাকে বলে দিয়েছে আইরিনের বিয়েতে যাওয়ার জন্য। কিছু না দিলেও অন্তত এক হাজার টাকা তো দিতে হবে। চাল গাঁথা শেষ করে নিচে নেমে আসলো। গামছায় ঘাম মুছে কলপাড়ে গিয়ে কল চেপে পানি পান করলো। দুইমিনিট না জিরোতেই আবার সবাই কাজে নেমে পড়লো। বসে থাকা লোকের ভাত নাই।

রাতে টাকা হাতে পেয়ে আর বাজার করলোনা খোরশেদ। মায়ের হাতে টাকা তুলে দিলো।
আলেয়া বেগমের হাতে কিছু ডিম বেচা টাকা ছিলো। এক হাজার টাকা বিয়েতে দিবেন বলে আলাদা করে ছেলেকে বাকিটাকা বাজার করার জন্য ফেরত দিলেন। নিজের কাছে যে টাকা ছিলো সেগুলো নিয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে বিকেলেই বাজারে গেলেন। দুই মেয়েকে দুইজোড়া জুতা কিনে দেবেন। বোরকা পড়ে মায়ের সাথে জুতা দোকানে ঢুকলো দুইবোন। জুতা ও পছন্দ হলো। দুজনেই এক রকম জুতা পছন্দ করেছে। সাতশ চাইছে একজোড়া জুতার দাম। অনেক দরকষাকষি করে চারশো তে এসে থামলেন আলেয়া বেগম। দুইজোড়া জুতার দামই আটশ টাকা। দোকানি ছেলেটা কিছুতেই এই মূল্যে জুতা দেবেনা। সে বলছে,
-“আরোও কম দামি জুতা ও আছে আন্টি। আপনি সেগুলো নিতে পারেন।”

আলেয়া বেগম অনড় হয়ে বললেন,
-“দেখো বাবা, এই জুতাগুলার দাম এমনিতেই আমি বেশি কইয়া ফালাইছি। এহন প্যাকেটে ভইরা দেও।”

ছেলেটি বলল,
-“আন্টি আপনাকে জুতা ভালোটা দেখিয়েছি। মেয়ে সুন্দরটা বিয়ে দিতে টাকা লাগবেনা। তার চাহিদা এমনিতেই বেশি। কিন্তু কালোটাকে বিয়ে দিতে টাকা দেওয়া লাগবে। তাহলে আপনিই বুঝেন ভালো খারাপ।”

বোরকার আড়ালে ঢোক গিললো রূপকথা। খারাপ লাগছে তার। উপমা ছ্যাৎ করে উঠে বলল,
-“লাগবো না জুতা কিনন। আসো তো মা। এ্যাই বুবু চলো।”

রূপকথার হাত ধরে উপমা বেরিয়ে গেলো। আলেয়া বেগম বেরিয়ে যাওয়া ধরতেই ছেলেগুলো পেছন থেকে ডেকে জুতা প্যাকেট করে দিয়ে বলল,
-“টাকা দেন আন্টি। আপনি বলে কম রেখেছি। অন্য কাস্টমারদের কাছে কিন্তু এক হাজার টাকার কম রাখতামনা।”

আলেয়া বেগম টাকা দিয়ে বেরিয়ে আসলেন। উপমাকে সামনে পেয়ে ধমক দিলেন। কোথায় কেমন ব্যবহার করতে হয় জানা নেই মেয়েগুলোর। এমনিতেই একজনের জন্য অন্যজন আটকে আছে। ব্যবহার দেখলে সারাজীবন আইবুড়ী হয়ে থাকতে হবে।

বাড়িতে ফিরে বোরকা খুলেই একছুটে বকুল তলায় পা বাড়ালো রূপকথা। তার ভীষণ মন খারাপ। মন খারাপ হলেই সে বকুল তলায় ছুটে আসে। মানুষগুলো কেনো বারবার গায়ের রং নিয়ে তাকে বিব্রত করে, খোঁটা দেয়, নিন্দা করে?
এলাকায় বড় একটা বকুল ফুলের গাছ আছে। তার পাশেই একটা বিল রয়েছে। গাছের মোটা শক্ত শেকড়ে হাঁটু উবু করে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে পড়লো রূপকথা। বাতাসের দমকলে পুষ্পবৃষ্টি হলো। ছুঁয়ে দিলো রূপকথার গতর। মাথা তুলে উপরে চোখ তুলে তাকালো রূপকথা। অধর কোনে কৃতজ্ঞতার হাসি টেনে বলল,

-“বকুল সঙ্গী। যহনই মন খারাপ থাকে তহনই তোর কাছে ছুইটা আসি। তুই তোর সুরভীত শরীরখানা ঝরাইয়া আমার মন খারাপ সারাই ফেলার অদ্ভুত একখান ক্ষমতার নিয়া থাকস। জানিস বকুল সই তোর মতো কইরা কেউ আমার মন ভালা করতে পারেনা।”

তাচ্ছিল্য মাখা চোয়ালে ঝরে যাওয়া কয়েকটা বকুল ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বলল,

-“দুনিয়াইতে সুন্দর মাইনষের অভাব নাই, কিন্তু দেখার মতো এক জোড়া সুন্দর চোখের বড়ই অভাব। যদি সুন্দর চোখ থাকতো, তয় কালা-সাদার কোনো ভেদাভেদ থাকতো না। সুন্দর চোখ দিয়া সবকিছুই সুন্দর দেহা যাইতো।”

#চলবে……..

রূপকথা পর্ব-০২

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০২

[৩]
শুক্রবার দিন থাকায় আজ আর স্কুল যাওয়ার প্যারা ছিলোনা। এবছর দশম শ্রেণিতে উঠেছে রূপকথা। পড়ালেখা করলেও কথাবার্তায় আঞ্চলিকতার ছাপ বিদ্যমান। আমরা যতই শুদ্ধ বাংলা জানিনা কেনো? আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি। বয়স সতের বছর। গ্রাম অঞ্চলে মেয়েদের একটু বেশি বয়স করেই ভর্তি করানো হয়। তবে বিয়েটা অবশ্যই পিরিয়ড হওয়ার পরপরই দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এখনো সবার মাঝে আধুনিকতা আসেনি। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে এখনো অনেক পরিবার অসচেতন।

মায়ের হাতে বেগুন এনে দিয়ে হাতে হাতে কয়েকটা কাজ করে দিলো রূপকথা। দুপুরের রান্না শেষ হলো। বাড়ির জামাইদের খাবার দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হলো। সবাই খেতে বসে গেছে অথচ একটা মাত্র শা’লা খোরশেদ এর জন্য অপেক্ষা করলোনা। দুলাভাইরা বাড়িতে আছে। তাই খোরশেদ আজ আধা বেলা কাজ করেই বাড়ি ফিরলো। গোসল করে আসলেই চারজন মিলে খেতে পারতো। অথচ খোরশেদের গোসল পর্যন্ত বাড়ির জামাইরা অপেক্ষা করতে পারলোনা। আজানের পর পর গোসল করে আসলেই নাকি তাদের খাবার দিতে হয়। নয়তো শরীরে কাঁপন ধরে। ক্ষুধা সহ্য করতে পারেনা। খোরশেদ গোসল করে এসে দেখলো দুলাভাই দের খাওয়া শেষ। খানিক কষ্ট পেলো খোরশেদ। তবে প্রকাশ করলোনা। বোনেরা এখনো খায়নি। খোরশেদ বারান্দায় গিয়ে বোনেদের সাথে পাটিতে বসে পড়লো। সব ভাইবোন একসাথে খাচ্ছে। ভালো তরকারি জামাইদের রাতের খাবারের জন্য আলাদা করে রেখে সবজি দিয়েই সবাই খাচ্ছে। আলেয়া বেগম ঢাকনা তুলে এক টুকরো মাছ ছেলের পাতে তুলে দিলেন। খোরশেদ একবার বোনেদের প্লেটে চোখ বুলিয়ে দেখলো সবাই সবজি দিয়েই খাচ্ছে। স্মিত হেসে সে বলল,
-‘এহন মাছ খাইতে মন চায়না মা। সবজি দেও। সবজি দিয়াই খামু।”

আলেয়া বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসলেন। তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন তার ছেলে কেনো মাছ খাচ্ছে না। তাই জোর করেই খোরশেদের পাতে মাছ টুকরো তুলে দিলেন। ভালো করে ভাত মেখে লোকমা তৈরি করলো খোরশেদ। প্রথম লোকমা মায়ের সামনে ধরলো। আলেয়া বেগমের চোখে পানি। খোরশেদ ইশারায় বলল হা করতে। আলেয়া বেগম হা করলেন। একে একে বড় বুবু থেকে শুরু করে ছোট বোন উপমাকে পর্যন্ত খাইয়ে দিলো খোরশেদ। প্রতিটা ভাই বোনের চোখে পানি। খোরশেদ মেকি শাসনের সুরে সবাইকে বলল,
-“একদম কেউ কানবা না। আব্বা বাঁইচা থাকলে কি করতো? কও। কবে আবার সবগুলা ভাই বোইন একলগে হমু তার ঠিক আছে?”

অল্পতেও সুখী হওয়া যায়। সুখী হতে বেশি কিছু লাগেনা। একটা ছেলে খোরশেদই কি সুন্দর মা থেকে সব বোনের মুখে হাসি ফোটালো। আবার খোরশেদই পারতো মা সহ সকল বোনকে কাঁদাতে। পুরুষের একটু ভালোবাসার উষ্ণতায় নারী মোমের মতো গলে যায়। আবার পুরুষের খারাপ ব্যবহারের উষ্ণতায় সেই নারীই গলে গিয়ে পুনরায় শক্ত হয়ে যায়।

[৪]
ভোরের সুমধুর আজানের ধ্বনিতে বিছানা ছেড়ে উঠলো আলেয়া বেগম। একে একে মেয়েদের ঘরের দরজায় দাড়িয়ে ডেকে নিলেন। তিন মেয়ে চারচালা ঘরের তিনটা রুমে ঘুমিয়েছে। আরেকটা রুমে খোরশেদ। আলেয়া বেগম ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার ছোট্ট রুমে ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে ঘুমিয়েছেন। সবাই উঠে টয়লেট আর কলপাড়ে সিরিয়াল ধরেছে। উপমা টয়লেটে ঢুকেছে অনেকক্ষণ হলো। রূপকথা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কিছুকক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার পরও কেউ বের হলোনা। এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। পেট বারে বারে পাঁক দিচ্ছে। টিনের দরজায় কয়েকটা আঘাত করেই রূপকথা বলল,
-“টয়লেটে কে ঢুকসো? বাইর হও না ক্যান। আমার টয়লেট এখানেই পইড়া যাইতাছে।”

উপমা কথা বললনা। একেবারে সেরে ধীরে সুস্থে সে বের হলো। উপমাকে বের হতে দেখে রূপকথা কটমট করে বলল,
-“এতক্ষণ যে আমি ডাকতে ডাকতে ম’ই’রা যাইতেছিলাম আওয়াজ দিলি না ক্যান?”

উপমা আমতা আমতা করে বলল,
-“টয়লেটে থাইকা কথা কইলে নাকি হায়াত কইমা যায়। তাইতো আমি কথা কইনাই বুবু।”

রূপকথা উপমার কথায় বিষ্ময় প্রকাশ করলোনা। টয়লেটে যাওয়া জরুরি। নয়তো দেখা যাবে অন্য বুবু এসে ঢুকে যাবে টয়লেটে। আর এদিকে তার কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।

সকালে নাস্তা করে বুবুরা দুলাভাই দের সাথে শশুর বাড়ী চলে গেলো। খোরশেদ কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো। উপমা কিছুক্ষণ টইটই করে ঘুরে আসলো। রূপকথা সকালের এঁটো বাসনকোসন ধুয়ে মাকে কাজ এগিয়ে দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসলো। আকাশি আর সাদা রঙের সরকারি স্কুলের ড্রেস গায়ে জড়িয়ে দুবোন বের হলো স্কুলের উদ্দেশ্যে। উপমা ক্লাস এইট এ পড়ে। একই স্কুলে দু’বোনের পড়াশোনা।

মামুন। ছেলেটা বেকার। সারাদিন পাড়ায়, রাস্তায়, এ গলি ও গলি, দোকানে তাকে দেখা যায়। ফাইভ পাস ছেলে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বই দেওয়ার পর ভাঙারির কাছে বই বিক্রি করে বাদাম বুট খেয়ে পড়ালেখা সেখানেই গিলে খেয়েছে। ছোটখাটো বিভিন্ন কাজ আছে যেগুলো সে করবেনা। তার আশা সে বিদেশ যাবে। তারপর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠাবে দেশে। তাই যতদিন না বিদেশ যেতে পারছে ততদিন সে কোনো কাজ করবেনা। বাবাকে অবশ্য বলেছিলো ধারদেনা, লোন নিয়ে তাকে বিদেশ পাঠাতে। বাবা কিছুতেই রাজি নয়। যে ছেলে দেশে কাজকর্ম করতে আলসেমি করে সে বিদেশে গিয়ে কষ্টের কাজ করবে? যদি কাজ না করলো? আবার দেশে ফেরত আসলো তাহলো এতগুলো দেনা কে শোধ করবে?

স্কুল ড্রেসে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দুজন কিশোরীকে কাঁচা রাস্তা ধরে আসতে দেখা গেলো। দূর থেকেই মামুন চিনে গেলো কিশোরী দুটির একজন কোকিল পাখি আরেকজন উপমা। শুক্রবার ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই তারা এই পথ দিয়ে স্কুলে যায়। মাথা নিচু করে হেঁটে যাচ্ছিলো রূপকথা। মামুনের সুরেলা কন্ঠে পা জোড়া থেমে যায়।

-“কুহ্! কুহ্! কুহ্!”

উপমা থেমে গিয়ে মামুনের দিকে তাকায়।
মামুন চমৎকার এক টুকরো হাসি উপহার দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলল,

-“কই যাও উপমা আপু।”

উপমা ত্যাড়া ভাবে উত্তর দেয়।
-“বিয়ার দাওয়াতে যাইতাছি। আমনে যাইবেন?”

মামুন চোখ সরু করে বলল,
-“মিথ্যা কও ক্যান উপমা আপু। তুমিতো ইস্কুলে যাও।”

উপমা মুখ ভেটকি দিয়ে বলল,
-“তাইলে আবার জিগান ক্যান?”

রূপকথা মাথানিচু করে উপমার হাত চেপে ধরলো। মামুন থতমত খেয়ে গেলো। সে বুজতে পেরেছে ভাব জমাতে গিয়ে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করে ফেলেছে। তাই আর কথা বাড়ালোনা। শার্টের পকেট থেকে টেস্টি হজমী বের করে দুটো উপমার হাতে দিলো, দুটো রূপকথার হাতে।
উপমা টেস্টি হজমী দুটো নিয়েই পা বাড়ালো। রূপকথা পা বাড়ানোর আগেই গোপনে রূপকথার হাতের ভাঁজে আরও পাঁচটা টেস্টি হজমী দিয়ে মিটিমিটি হাসলো মামুন। রূপকথা কোনোদিকে না তাকিয়েই ব্যাগে টেস্টি হজমী ঢুকিয়ে লজ্জা মিশ্রিত হাসলো। পা চালিয়ে উপমার বরাবর হলো। পেছনে একবার ঘুরে দেখলো মামুন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে পড়ে যাওয়ায় আরেকটু লজ্জায় মিইয়ে গেলো রূপকথা।

স্কুলে পৌঁছে সামনের বেঞ্চে জায়গা থাকা সত্ত্বেও রূপকথার জায়গা হলোনা। অন্যান্য মেয়েরা রূপকথাকে দেখে বই রেখে নিজের বান্ধবীদের জন্য জায়গা রেখে দিলো। কিছুক্ষণ তর্ক করার পরও যখন তিনজনের সাথে পেরে উঠলোনা তখন রূপকথা পেছনে গিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ পরই তার সই এলো। তাহমিনা। মেয়েটির মনে কোনো অহংকার নেই। বাবা কত বড়লোক, মেয়েটা কত সুন্দরী। অথচ সে এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রূপকথার সাথে ভাব জমিয়েছে। এখনো দুজনের গলায় গলায় ভাব। তাহমিনা ব্যাগ এনে রূপকথার সাথেই বসলো। ব্যাগ থেকে একমুঠো চকলেট বের করে রূপকথাকে দিলো।

-“এই ল। এগুলা আব্বায় বিদেশ থেইকা আনছে। ভিতরে নাইকল দেয়া। খাইতে অনেক স্বাদ।”

রূপকথা খুশিমনে চকলেটগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো। এখন খাবেনা। বাড়িতে গিয়ে উপমাকে নিয়ে খাবে। এসব বিদেশি চকলেট তারা সচরাচর চোখে দেখেনা। এইতো তাহমিনা দিলো আর রূপকথা পেলো। সে যদি এখন খেয়ে নেয় তার ছোট বোনটাতো আর পাবেনা। তাই রেখেই দিলো। দুপুরে টিফিন টাইমে রূপকথা রুটি আর তরকারি বের করলো। তাহমিনা সব সময় টাকা নিয়ে আসে। তাহমিনাকে ধরে বসিয়ে দিলো রূপকথা। দুজনে মিলে রুটি ভাগাভাগি করে খেলো। অনেকেই তাদের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেটকি দিচ্ছে। হয়তো তাহমিনার কাছে তাদের প্রশ্ন,’এই জঘ’ন্য দেখতে মেয়েটার সাথে কিভাবে খাবার ভাগ করে খাচ্ছে?’

ঘরে বিদ্যুৎ নেই। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে বাজ পড়ছে। বৃষ্টি আসার পূর্ব মুহূর্ত। হু হু করে বাতাস বইছে। আগের দিনের হারিকেন টা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন আলেয়া বেগম। ধানের তুঁষ দিয়ে মেজে ঘষে পরিষ্কার করেছেন। বিদ্যুৎ না থাকলে সম্বল হিসেবে কাজ করে। সেই হারিকেনের আলোতে পড়তে বসেছে রূপকথা আর উপমা। উপমা পড়তে বসেছে বললে ভুল হবে। সে বসে বসে দৃশ্য আঁকছে। চমৎকার দৃশ্য সে ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারে। বৃষ্টি হওয়ার ভ’য়ে বাইরের শুকনো লাকড়ি সব আঁটি করে রাখছেন আলেয়া বেগম। মাটির পিঁড়া ঢেকে রাখতে হবে। নয়তো বৃষ্টির পানিতে মাটি সব ধুয়ে যাবে। হাঁক ছেড়ে রূপকথাকে ডাকলেন,

-“রূপ। এত কিসের পড়ালেহা? আমার লগে আইয়া কাম কর।”

রূপকথা বিরক্তির সুরে বলল,
-“ওপপ! মা, উপমারে ডাক দেও। সামনে আমার পরীক্ষা আছে। আমি কাম করতে পারুমনা।”

খেঁকিয়ে উঠলেন আলেয়া বেগম। বাইরে থেকেই চেঁচিয়ে বললেন,
-” কিসের পড়ালেহা? পড়ালেহা কইরা মাস্টরি করবি? কাম কর। রূপ দিয়া তো জামাইর বাড়িত খাইতে পারবিনা। কাম কইরা খাওন লাগবো। পড়ালেহা ভাত খাওয়াইতো না। কি ফরম পূরণ নাকি কি কয়। হে সময় যে কত হাজার টেহা লাগবো। কেডায় দিবো? এহন থেইকাই পড়ালেহার মায়া ছাইড়া দে।”

মায়ের কথায় টলমলে চোখের পানি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলো রূপকথা। বুবুরে কাঁদতে দেখে উপমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর পা টিপে টিপে বাইরে গেলো। খোরশেদ বাড়িতেই ঢুকছিলো। মায়ের কথা শুনে বলল,
-“মা তুমি এমন কথা কও ক্যান? আমি আছিনা? আল্লাহ টেহার এক ব্যবস্থা করবোই। তুমি ওগো পড়ালেহা বন্ধ করার কথা কইবানা।”

আলেয়া বেগম ছেলের কথায় ব্যাগড়া দিলেন।
-“তুই চুপ থাক। নুন আনতে পানতা পুরায়। হেয় আবার দুই দুইডা দা’মড়ি ছেরিরে পড়াইবো।”

উপমা পা টিপে টিপে লাকড়ির আঁটি ধরতে গেলেই একটা লাকড়ি নিয়ে উপমার পিঠে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিলেন আালেয়া বেগম।
উপমা ও মা, ও আব্বা বলে যখন চিৎকার দিলো তখন খোরশেদ এসে ধরলো। রূপকথা ও দৌঁড়ে আসলো।

আলেয়া বেগম বলে দিলেন,
-“খবরদার কারো আমার কামে হাত দেওন লাগতোনা। আমার কাম আমিই করুম। আমি ম’রলেই আমার দুঃখ বুঝবি সবগুলা। আমি পালতেছি সব নবাবের বেটি। আগে তিনটা পালছি। এহন আরও দুইটা পালতেছি।”

রূপকথা ভ’য়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। খোরশেদ ইশারায় বোঝালো কাজে হাত লাগাতে। নয়তো এই জেদ কাল পর্যন্ত ধরে রেখেই দুইবোনকে মা’রবে। ভাইয়ের ইশারায় রূপকথা প্লাস্টিক এনে ঘরের পিঁড়া ঢেকে নিলো। আঁটি সব ঘরে তুলতেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামলো।
স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো রূপকথা। খোরশেদ মায়ের আড়ালে এসে রূপকথার মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-“তুই পড়ালেহায় মন দিয়া যা। টেহার ব্যবস্থা আমি করুম।”

#চলবে……

রূপকথা পর্ব-০১

0

#রূপকথা
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#সূচনা_পর্ব

[১]
প্রেমিকের প্রত্যাখান শেষে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ী পৌঁছাতেই পাত্র পক্ষ দেখতে এলো রূপকথাকে। নিয়তি বড়ই অদ্ভুত। ভাগ্য বিড়ম্বনা বলেও একটা কথা আছে। পাত্রপক্ষ ও তাকে পছন্দ করলোনা। রূপকথাকে পছন্দ না করার কারণ একটাই,কিশোরী কৃষ্ণকায়া অধিকারী। আজকাল মানুষতো সাদা চামড়া খোঁজে। সে দিক থেকে রূপকথা নিতান্তই সাদামাটা।

[২]
হানিফ হাসানের চতুর্থ কন্যা রূপকথা। বড় তিন কন্যার রূপের প্রশংসায় যখন পাড়াপড়শি পঞ্চমুখ তখনও হানিফ হাসানের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। বড় কন্যা শাহিনূরের চেয়ে মেজো কন্যা মায়া বেশি রূপবতী। তার চেয়ে সেজো কন্যা মমতা আরও বেশি রূপবতী। এবারের সন্তান টা যদি কন্যা হয় তবে সে নিশ্চয়ই আরও রূপবতী হবে। একেবারে রূপকথার রাজকন্যা। তাই হানিফ হাসান আগে থেকেই নাম ঠিক করে রাখলেন এবার যদি আল্লাহ তাকে কন্যা সন্তান দেন তবে তার নাম রাখবে রূপকথা।
আল্লাহ হানিফ হাসানকে চাওয়া অনুযায়ী এবার ও কন্যা সন্তান দিলেন। মেয়েকে কোলে নিয়ে কোমল চুমুতে ভরিয়ে তুলে নাম দিলেন রূপকথা। রূপকথা রূপবতী হয়েছে ঠিকই, তবে সেটা অন্তরের দিক দিয়ে। গায়েগতরে ফর্সা হলেই তাকে রূপবতী বলেনা।
একটা বাচ্চা যখন পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয় তখন সে সাদা চামড়া নিয়েই আসে। গায়ের রংটা সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়। সময়ই বলে দেয় বাচ্চাটার রং কেমন হবে? ঠিক তেমনই দিন কয়েক পেরুতেই রূপকথার চামড়ার রং ফোটে উঠলো। হানিফ হাসানের আদর একটু ও কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। যত দিন পেরুলো ততই লোকমুখে সমালোচনার মধ্যমণি হয়ে উঠলো হানিফ হাসানের মেয়ে রূপকথা।

ইশ হানিফের তিনটা মেয়ের রং যেনো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু শেষ মেয়েটার রং এমন কেনো? দেখলে মনে হয় কেঁচো হেঁটে যাচ্ছে। তিনটা ময়ূরের মাঝে একটা কাক।

রূপকথার পর কোল আলো করে আরও একটি কন্যা সন্তান এলো। স্কুল যাওয়ার পথে, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায়তেই রূপকথাকে কথা শুনতে হয়। তবে সে প্রত্যুত্তর করেনা। এসব মানুষতো তাকে খাওয়ায় না। এসব নিন্দাসূচক বানী শুনলে কানে তুলো দিয়ে চুপচাপ হেঁটে চলে যায়। বাবার সামনে কেউ তার গায়ের রং নিয়ে কথা বলতে পারেনা। হানিফ হাসান সেই মানুষ গুলোকে চারটে কথা শুনিয়ে দেওয়ার বদলে মেয়ের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে এমন সব উক্তি করে যে মানুষ তার সামনে কিছু বলার সাহস করেনা। বাবা তাকে অল্পদিন সময় দিয়েই শেষ ঠিকানায় পাড়ি জমালো। দুঃখের দিন বাড়লো বলে।

মানুষগুলোর নিন্দাতে তার কিছুই আসে যায়না। সবচেয়ে বেশি দুঃখ লাগে যখন তার মা বোন ও তার রংকে তুচ্ছ করে। সবাই সৌন্দর্য্যের পূজারী। একদিন তো মেজো বুবু বলেই দিলো,

-“বাজারে ফর্সা হওনের কত কিরিম আইছে। ভাইয়ারে কইয়া কিরিম আইনা একটু মাখ। আমাগোরে তো ব্যাডারে চিলের মতো উড়াল দিয়া লইয়া গেছে। তোরে ও তো কারো কাছে গছাইয়া দিতে হইবো।”

বোনের কথা শুনে গলা কেঁপে উঠলো রূপকথার। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষাদ ঢুকলো। ভেতরটা মুচড়ে আসলো যখন সাথে মা ও সুর মেলালো। মা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-“আল্লাহই ভালা জানে এ জীবনে কি এমন বড় পাপ করলাম। যার কারণে আল্লাহ আমার মাইয়াডারে কালা বানাইছে। যদি তুই আরেকটু সুন্দর হইতি আমার আর দুঃখ থাকতোনা। একটু কি কিরিম টিরিম আছে হেইগুলা মাখিস। এহন তো সচরাচর মাইয়ারা এসব কিরিম মুখে, হাতে, বইরে মাখেই।”

মাথা নিচু করে রাখলো রূপকথা। মায়ের চোখের দিকে তাকালেই তার এখন কান্না পাবে। ভীষণ কান্না। প্রিয় মানুষের দেওয়া যন্ত্রনাগুলো বড্ড পোড়ায়। সে তো মায়েরই গর্ভের সন্তান। চামড়া কালো এটা কি তার দোষ? কি হবে ক্রিম মেখে চামড়া সাদা করে? যদি অন্তরটাই কালো হয়? সবাই তাকে নিন্দা করে। অন্তত মায়ের কাছে সে এমন কথা আশা করতে পারেনি। সবাই বলে সন্তানের সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল হচ্ছে মায়ের বুক। সেখানে মায়ের কথার আ’ঘা’তেই যদি সন্তানের বুক ক্ষ’তবিক্ষ’ত হয় তবে সে কোথায় গিয়ে আশ্রয় খুঁজবে? কিছুটা সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপকথা। মা বোনের কথাটাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল,
-” এসব ঝামেলা আমারে দিয়া হইতো না। আমি যে আইলসা কে যাইবো প্রতি রাইতের বেলা এত কষ্ট করতে?”

উঠে বাড়ির বাইরে পা বাড়ালো রূপকথা। পেছন থেকে মায়ের স্পষ্ট বানী তার কান এড়ালোনা।

-“এমনেই আমারে একদিন শেষ করবি। বুঝবি যেদিন তোর শোকে আমি ম’রুম।”

আর বাড়ীর বাইরে যাওয়া হলোনা রূপকথার। চুপচাপ বারান্দার ছোট্ট ঘরটিতে গিয়ে চৌকির উপর উঠে বসলো। গ্রিল হীন কাঠের খোলা বারান্দার ফাঁক গলিয়ে আকাশে চোখ রাখলো। কষ্টগুলোকে উজাড় করে দিয়ে নিরবে কেঁদে উঠলো রূপকথা। হুট করে ছোট্ট ঘরটিতে বড় বুবু শাহিনূরের আগমন। রূপকথাকে কাঁদতে দেখেই বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
-“কিরে রূপ কান্দস ক্যান? কি হইছে তোর?”

চোখের পানি আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করলোনা রূপকথা। তবে ব্যাপারটা খুব সূক্ষ্ম ভাবে আড়াল করলো। হেঁচকি তুলে বলল,
-“আব্বার কথা খুব মনে পড়ছে বুবু।”

এবার শব্দ করেই কাঁদলো রূপকথা। একহাতে বোনকে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে স্থির হয়ে রইলো শাহিনূর। চোখ জোড়া পানিতে টইটম্বুর। আব্বারে যে তার ও মনে পড়ে। কতই না আদর করতো। ভাত খাওয়ার সময় পাঁচটা মেয়ে একটা ছেলে কাউকে রেখে তিনি খেতে বসতেননা। শাহিনূরের পরই খোরশেদ এর জন্ম হয়। ছেলে হলেও সে ও বাকি বোনেদের মতো রূপ লাবন্য নিয়েই জন্ম নিয়েছে। খেতে বসে বড় থেকে ক্রমান্বয়ে ছোট মেয়ে পর্যন্ত সবার মুখে এক লোকমা খাবার তুলে দিয়ে তবেই হানিফ হাসান মুখে খাবার তুলতেন। টানাপোড়োনের মাঝেও ছিলো তার সুখের সংসার। একজনের রোজগারের ছয় সন্তান সহ তাদের আটজনের পরিবার সুন্দরভাবে কে’টে যেতো। কতই না সুখের ছিলো দিনগুলো। তবে সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলোনা। বছর পাঁচেক আগে গত হলেন হানিফ হাসান। ছোট মেয়ে উপমার বয়স যখন নয় বছর তখনই হঠাৎ করেই মা’রা গেলেন। পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে সংসারের হাল ধরলো খোরশেদ। গ্রামেগঞ্জে যখন যে কাজ পায় তখন সে কাজ করেই সংসার চালায়। বড় তিনটা বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন বাকি আছে ছোট দুইটা বোন। রূপকথা আর উপমা। রূপকথার বিয়ে হয়ে গেলেই উপমাকে নিয়ে আর চিন্তা নেই। এখন থেকেই চারদিক থেকে উপমার জন্য পাত্রপক্ষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। রূপকথার আগেই তাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু একটা বোন রেখে আরেকটা বোনকে বিয়ে দিয়ে তার অপমান কিভাবে করবে খোরশেদ? রূপকথাকে সে ও বাবার মতোই ভালোবাসে। যতটা বাবা রূপকথাকে ভালোবাসতো? ঠিক ততটা না বাসতে পারলেও কম কিন্তু বাসেনা।

বাইরে চুলা ঘর থেকে মা শাহিনূরকে ডাক দিলেন।
তিনটা মেয়ের জামাই ই শশুর বাড়ীতে আছে। তাদের কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেটারই তদারকি করছে আলেয়া বেগম। জামাইরা বলে কিছু করা লাগবেনা আম্মা। আপনারা যা দিয়া খাবেন আমরা ও তা দিয়াই খাবো। কিন্তু সামনে ভালো খাবার না হলেও জাত যায়, মান যায়। একটা ছেলের রোজগারেই কোনোমতে সংসার টিকে আছে। ছেলেটা তার মানুষ হয়েছে বটে। করিম মিয়ার তিনটা ছেলে। অথচ একটা ও মানুষ হয়নি। বাবা মাকে ভাগে খাওয়াতে গিয়েও তাদের কত বাহানাবাজী। সে দিক থেকে আলেয়া বেগম আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করেন। যদি ছেলেটা অমানুষ হতো তাহলে মেয়েদের নিয়ে তিনি কার দুয়ারে যেতেন? এজন্যই বলে আল্লাহ তার বান্দাকে একেবারে মা’রেন না। কাউকে না কাউকে বান্দার রিজিকের উচিলা করে ঠিকই পাঠিয়ে দেন।

মায়ের ডাকে শাহিনূর চুলা ঘরে গেলো। চোখ মুছে বুবুর পিছু পিছু রূপকথাও বের হলো। রূপকথাকে দেখে আলেয়া বেগম বলে উঠলেন,

-“ক্ষেতে গিয়া কয়ডা বেগুন নিয়া আয়। তরকারির লগে ভর্তা ও বানান যাইবো।”

মাথায় ওড়ানা দিয়ে নিজেদের ক্ষেতে ছুটলো রূপকথা। বাড়ির থেকে কিছু দূর সামনে তাদের একটা জমি আছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সবজির চাষ করে রূপকথার মা। উপমাকে সহজে ঘরে পাওয়া যায়না। পাড়ায় পাড়ায় ঘোরা তার অভ্যেস। তাই অগত্যা রূপকথাকেই যেতে হলো।
ক্ষেতে প্রবেশ করে বোঁটা থেকে বেগুন ছিঁড়ে ওড়নায় পুড়ে নিচ্ছে রূপকথা। নেওয়া শেষ হতেই ওড়না মুঠো করে নিরবে মাথানিচু করে হেঁটে বাড়ির দিকেই আসছিলো।

-“ওড়নায় কি নিয়া যাও কোকিল পাখি?”

পা জোড়া থেমে গেলো রূপকথার। মামুন ভাইরে দেখলেই তার কলিজায় কামড় মারে। যেনো কতবছর ধরে তাদের মধ্যে ভাব। কত অবলীলায় মানুষটি তার সাথে কথা বলে। কেমন যেনো নেশা ধরানো গলা মানুষটার। যখন হাসে তখন মন চায় শুধু চেয়ে থাকতে।
রূপকথা পেছন না ঘুরেই চাপা গলায় বলল,

-“মা বেগুন নিতে পাঠাইছে।”

মামুন ঘুরে সামনে এসে দাঁড়ালো। রূপকথার ওড়না থেকে দুটো বেগুন নিয়ে বলল,
-“বেকার মানুষ তোমার কাছ থেইকা দুইটা বেগুন নিলাম। দাবি রাখবা না কিন্তু। যাও কোকিল পাখি।”

রূপকথা বুঝলোনা এই কাঁচা রান্নাছাড়া বেগুন দিয়ে কি করবে মানুষটা? রূপকথার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলো।
-“মামুন ভাই, আপনি আমারে ক্যান কোকিল পাখি ডাকেন?”
ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখলোনা। তাই ইতিউতি করে প্রশ্নটি করেই ফেললো।

মামুন হেসে উঠে বলল,
-“তোমার মিষ্টি কন্ঠ শুনলেই আমার মনে হয় আশপাশ দিয়া পাখি ঘুরঘুর করতাছে। এমন সুরেলা কন্ঠ কোকিল পাখি ছাড়া আর কার হইতে পারে? তাই তোমার লগে মিলাইয়া নাম দিলাম কোকিল পাখি।”

ধরা গলায় রূপকথা বলল,
-“সবার মতো আপনে ও তো কাক ডাকতে পারেন।”

মামুন স্মিত হেসে বলল,
-“যারা তোমারে কাক কয়। আসল কাক তো তারাই। যারা কা কা ছাড়া কিছুই পারেনা। সে সকল কাক রা কি বুঝবে কোকিল পাখির কোকিলা কন্ঠস্বর।”

#চলবে……