Thursday, July 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1022



প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৮

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৮ম_পর্ব

একটা সোনালী কার্ড বের করলো ব্যাগ থেকে প্লাবণ। সুভাসিনীকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আগামী শুক্রবার আপনাদের দাওয়াত আন্টি। সবাই আসবেন৷ ছোট চাচ্চু, এশা আশা সবাই। আর বিশেষ করে তুমি জলধারা। সরি ভাবী, আসবে কিন্তু আমার বিয়েতে। না আসলে খুব রাগ করবো”

ধারা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো প্লাবণের দিকে। প্লাবণের মৃদু কন্ঠের “ভাবী” ডাকটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে অনুধাবন করতে সময় নিলো। এতো মিষ্টি ডাকটাও এতো নিষ্ঠুর হয় আগে জানা ছিলো না ধারার। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্লাবণের দেওয়া বিয়ের কার্ডটির দিকে। সোনালী বর্ণের কার্ড, বেশ কারুকার্য শোভিত। বর্ডারে লাল রেশম কাপড়ের কারুকাজ। ভেতরটা খুলতেই দেখলো রক্তিম বর্ণে লেখা৷ কনের স্থানটায় সুন্দর ফন্টে লেখা “ইশরাত জাহান স্মৃতি”

সুভাসিনী স্মিত হেসে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ, তা কবে ঠিক হলো?”
“এই তো গত পরশু”
“একটু তাড়াহুড়ো হচ্ছে না?”
“আসলে স্মৃতির বাড়িতে একটু ঝামেলা চলছে, আংকেল আন্টি সামনে হজ্জের জন্য যাবেন। স্মৃতির ও জব ট্রান্সফার হয়েছে। তাই এতো তাড়াহুড়ো”
“তা বউ মা কি পরিবারের পছন্দ না তোমার?”

সুভাসিনীর প্রশ্নে লাজুক হাসি হাসলো প্লাবণ। তার ফর্সা মুখখানা রক্তিম হয়ে উঠলো। পুরুষ মানুষ ও বুঝি লজ্জা পায়। অনল তখন ঠেস মেরে বললো,
“ও কি বলবে মা, আমি বলছি। ভালো ছেলে মুখোশধারী প্লাবণ কলেজ থেকে প্রেম করে। দশ বছরের অধিক সময় হয়ে গেছে। স্মৃতির বাসা রাজী করাতে কতো পাপড় বেলেছে হিসেব নেই। আর কিছুদিন হলে পাপড়ের ফ্যাক্টরি দিতো”

অনলের কথায় লজ্জা যেনো আরোও বাড়লো প্লাবণের। সুভাসিনী হেসে বললো,
“এই ওকে খ্যাপাস না, তাও ভালো ওর বাবা মার টেনশন নেই। মেয়ে পাওয়া এই জমানায় কি কঠিন জানিস! তোর ও ভাগ্য ভালো, ধারাটাকে ধরে বেঁ’ধে আ’ট’কে রেখেছি। নয়তো সারাজীবন তোরও চিরকুমার থাকতে হতো। প্লাবণ তুমি গা মাখিও না। আমরা সবাই যাবো। আর অনল-ধারা হলুদের আগেই চলে যাবে। ভালো বন্ধুর বিয়ে বলে কথা!”
“ধন্যবাদ আন্টি”

বসার ঘরে আনন্দটা যেনো কাটার মতো লাগছে ধারার। কখন চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে টেরটিও পায় নি। দমবন্ধ লাগছে তার। প্লাবণের যে হাসি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতো সেই হাসিটাই এখন বিষাক্ত সুই এর ন্যায় লাগছে। ধরা কন্ঠে বলে উঠলো,
“বড় মা, আমার মাথাটা ব্যাথা করছে। আমি ভেতরে ফ্রেশ হতে গেলাম”

সুভাসিনীর জবারের অপেক্ষা সে করলো না। সটান উঠে ভেতরে চলে গেলো। অনলের চোখ এড়ালো না ধারার এই আচারণ। প্লাবণের বিয়ের খবরটা শুনতেই উজ্জ্বল মুখখানায় আষাঢ়ের কালো বাদল জমেছে ব্যাপারটিতে একটু হলেও খটকা লাগলো তার।

রুমে এসেই ব্যাগটা ছুড়ে মারলো ধারার। বিষাক্ত নীল বিষাদে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে অন্তস্থল। নরম গালগুলো ভিজে যাচ্ছে সেই বিষাদসিন্ধুর ঢেউ এ। প্রচন্ড কষ্টে হৃদয়টা জ্বলছে যেনো। এতোটা কষ্ট হয় বুঝি হৃদয় ভাঙ্গনে। মাহির অবসন্ন হৃদয়টা যেনো অনুধাবণ করতে পারছে ধারা। সব কিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেলতে মন চাচ্ছে। সেই সাথে প্রচন্ড ক্রোধ জমলো প্লাবণের প্রতি। এতো কাল যদি তার প্রেমিকাই থাকে তবে কেনো ধারার প্রতি এতো মায়া দেখাতো! কেনো তার চুল এলোমেলো করে তাকে ইকলিয়ারস দিতো। সে কি বুঝতো না বাচ্চা মেয়ের মনে আবেগের সঞ্চার হচ্ছে! সে কি সত্যিই বুঝতো না! নাকি বুঝেও অবুঝ সাজতো! প্রতি জন্মদিনে এক দু টাকা জমিয়ে পরম আবেগ মিশিয়ে উপহার কিনতো ধারা। আর সেই উপহার গুলো ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে গ্রহণ করতো এই নিষ্ঠুর মানুষটি। সে কি বুঝতো না, এই কিশোরীর মন তার প্রতি আসক্ত! উপহারের কথা মনে পড়তেই ব্যাগ থেকে এবারের উপহারটি খুললো ধারার। সাদা র‍্যাপিং পেপারে মোড়া একটি উপহার। গত এক বছরে খুব কষ্টে মাসিক খরচার টাকা জমিয়ে কিনেছিলো ধারা। একটি নীল ঘড়ি, বেশি দাম নয়; তবুও ঘড়িটি ধারার বহু কষ্টে জমানো টাকা দিয়ে কেনা। মূহুর্তেই মস্তিষ্কে জেদ চাপলো। নিজ হাতে ভেঙ্গে গুড়িয়ে ফেললো ঘড়িটি। বো’কা ছিলো সে, তাই তো কিশোরী আবেগের মরিচীকার পেছনে অন্ধের মতো ছুটেছে। বিবাহিত হবার পর ও সেই আবেগ যত্নে তুলে রেখেছে। কিন্তু ঘড়িটি ভেঙ্গেও হৃদয়ের বিদগ্ধ যন্ত্রণা কমলো না। দু হাত চেপে কাঁদলো ধারা। হৃদয়ের কোনায় মূর্ছা যাওয়া প্রণয় ফুলটি আজ ম’রে গেছে, ম’রে গেছে_______

*****

প্লাবণ যাবার পর ঘরে আসলো অনল। ঘরটা নিগূঢ় আঁধারে নিমজ্জিত। নিস্তব্ধতা যেনো ঘিরে রয়েছে। অনল লাইট জ্বালাতেই চমকে উঠলো, খাটের উপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ধারা শুয়ে আছে। মেঝেতে ব্যাগটা অবহেলায় পড়ে আছে। তার সাথে পড়ে আছে একটা ভাঙ্গা ঘড়ি এবং অনেকগুলো জ্বলন্ত ছাই। অনেকগুলো কাগজ একসাথে পোড়ালে হয়তো এতো ছাই জমে। অনল কম্বল মুড়ে শুয়ে থাকা ধারার কাছে গেলো। গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“আজ ক্লাস না করে কোথায় গেছিলি?”

কিন্তু উত্তর এলো না। নিস্তব্ধতা, শুধু নিবিড় নিস্তব্ধতা। অনল মুখ গোল করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে নিয়ে কি করবে সে! কিশোরী মানছে, কিন্তু তাই বলে এতো ছেলেমানুষী করবে! আর এতো কিসের আবেগ! অনল আর বসে রইলো না। উঠে টেবিলের কাছে গেলো। অনেক গুলো খাতা জমেছে, আজ ই দেখে শেষ করতে হবে। সারপ্রাইজ টেস্টের খাতাগুলো জমে আছে। অনল প্রথমে সেগুলোই বের করলো। একের পর এক খালি খাতা দেখতে দেখতে রোল পঁচিশের খাতাটা পড়লো সামনে, “ধারা আহমেদ”। সফেদ খাতার উপর বেশ কিছু কাটাকাটি খেলার ছক আকা। ইকুয়েশন টি একবার তুলে নিচে লেখা,
“শ্রদ্ধেয় অনল ভাই, এইসব ইকুয়েশনের উত্তর আমি জানি না, আমি এই অংক জীবনেও দেখি নি। তুমি যদি আমাকে ১০ মার্কে ৪ দাও আমি কৃতার্থ থাকবো, বিনিময়ে একদিন তোমার ঘর পরিস্কার রাখবো। এখন তোমার ইচ্ছা। না দিলেও কিছু যায় আসে না, ভেবো না পা ধরছি”

অনল আনমনেই হেসে দিলো। খাতার উপরে লাল কালিতে ০ দিয়ে সামনের খাতা দেখতে লাগলো সে। একবার অবশ্য ঘাড় কাত করে ধারাকে দেখলো। এখনো কম্বলমুড়ি দিয়েই শুয়ে আসে, সন্তপর্ণে একটা নিশ্বাস গোপন করলো অনল। কবে বড় হবে মেয়েটা______

*****

পর্দার ফাঁক থেকে গা গলিয়ে সোনালী রোদ রুমে প্রবেশ করতেই ঘুম ভাঙ্গলো অনলের। উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙ্গলো। ধারা এখনো ঘুম। গতরাতে বহুবার খেতে ডেকেছিলো। উঠে নি সে। তার মাথা ব্যাথা, তাই খায় নি। অনল অবশ্য একটু চিন্তিত। সন্ধ্যায় বেশ প্রসন্ন লাগছিলো ধারাকে। তাহলে হুট করে এতোটা পরিবর্তন কেনো! কিছু একটা ভেবে ওয়াশরুমে গেলো সে। হাত মুখ ধুয়ে এসে বললো,
“উঠবি না! ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে”
“আমি যাবো না আজ, তুমি যাও”
“কাল ও তো ক্লাস করিস নি”
“ইচ্ছে করছে না অনল ভাই, ক্ষান্ত দাও”

অনল আর কথা বাড়ালো না। রেডি হয়ে বেড়িয়ে পড়লো। যাবার সময় সুভাসিনীকে বললো,
“ধারার শরীরটা ভালো নেই, একটু দেখো”

সুভাসিনী বেগম উদ্বিগ্ন হয়ে গেলেন,
“কি হয়েছে?”
“মন খারাপ হয়তো, ভার্সিটি যাবে না। তুমি দেখো, আর টেনশন নিও না। আমি আজ তাড়াতাড়ি আসবো”

অনল চলে গেলো। সুভাসিনী বেগম কিছু একটা ভাবলেন। তারপর নিজ কাজ করতে লাগলেন।

*********

ধারা উঠলো দেরি করে। মন খারাপ থাকলে ঘুম বেশি আসে তার। তাই সময়জ্ঞান হারিয়ে ঘুমালো আজ। মনটা এখন কিছুটা ভালো। কিন্তু বিষন্নতাটা সম্পূর্ণ কাটলো না। রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমের ফ্রিজের কাছে আসতেই আশা “ও মা” বলে চিৎকার দিলো। ধারাও খানিকটা ভড়কালো। তারপর বিরক্তি নিয়ে বললো,
“চেচাচ্ছিস কেনো?”
“আরেকটু হলেই আমার পরাণ পাখি খাঁচা ছাড়া হতো! এভাবে শা’ক’চু’ন্নি সেজে কে ঘুরে শুনি। নিজেকে দেখেছো আয়নায়! আলিফ লায়লায় সারারাগুল ও ভয় পাবে। ভাগ্যিস দাদাজান ছিলেন না। নয়তো হাসপাতালে ছুটতে হতো”

ধারার ডাইনিং রুমের বেসিনের আয়নার কাছে গেলো। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজেই চমকে গেলো। মুখখানা ফুলে গেছে, চোখগুলো রক্তিম এবং ফোলা, গতকালের মেকাপ পুরো মুখে লেপ্টে আসে। কাজল গলে চোখগুলো কালো আছে, রক্তিম চোখ বাহিরে কালো বড্ড ভয়ানক দেখাচ্ছে। চুলগুলো কাকের বাসার উপর ঝট লেগে আছে। সত্যি তাকে ভয়ানক লাগছে। যেনো কোনো হরর মুভির নায়িকা, এজন্যই হয়তো সেদিন অনল ভাইও ভয় পেয়েছিলো। আশা ধারার কাছে এসে বললো,
“তুমি নাকি অসুস্থ! কি হয়েছে তোমার ধারাপু? অনল ভাই কিছু বলেছে?”

ধারা উত্তর দিলো না, ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে নিজ রুমে চলে গেলো। একটু পর গরম গরম পরোটা আর ডিমভাজি নিয়ে রুমে এলো সুভাসিনী। ধারার জট বাধা চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো,
“তোর কি মন খারাপ? কি হয়েছে রে মা আমাকে বল”

ধারা নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অনুভূতির জোয়ারগুলো মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো। সুভাসিনীকে জড়িয়ে কেঁদে দিলো সে। জড়ানো স্বরে বললো,
“মার কথা মনে পড়ছে খুব”
“ধুর বোকা মেয়ে!”

সুভাসিনী জড়িয়ে ধরলো তাকে। আদর করলেন। মাদের বুকে হয়তো সুপ্ত উষ্ণতা থাকে। যত মন খারাপ ই থাকুক তাদের সংস্পর্শে উষ্ণ শান্তি পাওয়া যায়। সুভাসিনী ধারার চুল বেঁধে দিলেন, খাওয়িয়ে দিলেন। তারপর স্মিত স্বরে বললেন,
“আমাদের জীবনে অনেক কিছু হয়, যাতে আমাদের কোনো হাত থাকে না। কষ্ট হয় ঠিক ই, কিন্তু মেনে নিতে হয়। এই প্রথম তো তাই কষ্টটা বেশি। ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে”

ধারা কথা বললো না, চুপ করে বড় মার কথাটা শুনলো। সময় সবচেয়ে বড় ঔষধ। সময়ের সাথে সাথে হয়তো সত্যি সব ঠিক হয়ে যাবে________

*******

অনল ফিরলো আজ অনেক আগে। বিকালের পূর্বেই সে বাসায় উপস্থিত। ধারার কথা সারাদিন তাকে ভাবিয়েছে। তাই ল্যাব স্যাশন শেষ হতেই আজ চলে এসেছে। বাসায় আসতেই জমজ বি’চ্ছুর দেখা পেলো। অনল তখন জিজ্ঞেস করলো,
“ধারাকে দেখেছিস”
“দেখেছি না, সকালে সারারাগুলের মতো ঘুরছিলো। একটু হলেই আমি পটল তুলতাম, তারপর বড় চাচী গেলেন মানুষের মতো সাজিয়ে গুজিয়ে এসেছেন। তবে এখনো ঘর থেকে বের হয় নি। সত্যি করে বলো তো! তুমি কি করেছো?”

অনল তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া জরুরি মনে করলো না। ছুটে গেলো ঘরে। ধারা তখন বারান্দার কোনায় বসে ছিলো। অনল শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
“রেডি হ, বাহিরে যাবো আজ”
“ইচ্ছে করছে না”
“ভেবে দেখ, আইসক্রিম খাওয়াবো। শুনেছি একটা নতুন আইসক্রিম পার্লার খুলেছে। বেশ মজা নাকি। না গেলে লস তোর। এই সুযোগ সীমিত সময়ের”

ধারা বেশ ভাবলো৷ আইসক্রিম ব্যাপারটা তার দূর্বলতা। কেনো যেনো লোভ সামলাতেই পারে না। চট করেই রাজি হয়ে গেলো।

গোধূলী লগ্ন, সূর্যটা এখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। তেজহীন স্বর্ণালী আভা আছড়ে পড়ছে প্রকৃতিতে। দক্ষিণা আকাশে মেঘ জমেছে, কালো মেঘ। বাতাসও বইছে ক্ষণে ক্ষণে। হালকা গরম আছে বটে, কিন্তু শীতল বাতাসে গরমটা গায়ে লাগছে না। আইসক্রিম পার্লারের কথা বলে
দিয়াবাড়ির এ দিকে ধারাকে নিয়ে এসেছে অনল। যদিও এই সময়টা দিয়াবাড়ির সৌন্দর্য্য দেখা যায় না। তবুও ফাঁকা রাস্তায় নিবিড় পরিবেশে হাটতে মন্দ লাগে না। ধারার অবাধ্য খোলা চুল ঊড়ছে মৃদু মন্দা বাতাসে। সোনালী রোদে মুখটা জ্বলজ্বল করছে। ধারার হাতটা অনলের হাতের ফাঁকে। বলা তো যায় না, গাড়ির নিচে পড়ে গেলে। একটা পাঁচটা না একটা মাত্র কিশোরী বউ। স্মিত স্বরে বললো,
“বসবি?”
“হু”

একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো তারা। সামনে ধু ধু মাঠ। বাতাস বইছে ধারা তাকিয়ে আছে পড়ন্ত সূর্যের দিকে। তখন ই অনল প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“প্লাবণকে পছন্দ করতি?”

প্রশ্নটা শুনতেই খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ধারা। ঠোঁট চেপে চুপ করে থাকে। উত্তর দেবার ভাষা খুঁজে পায় না। খানিকটা বিব্রত ও হয়। বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে ধারা প্রশ্ন করে,
“তুমি বুঝলে কি করে?”
“তুই একটা খোলা বই, তোকে বোঝা যে বড্ড সরল”

ধারা আবার চুপ করে গেলো। কোনো কথা নেই দুজনের মাঝে। ধারা তাকিয়ে রইলো দূর অদূরের দিগন্তের পানে। অনল স্মিত হেসে বললো,
“কিশোর বয়সে আবেগ সবার ই হয়। কিছু আবেগ গাঢ় হয় তো কিছু আবেগ সময়ের সাথে বাষ্পের মতো উড়ে যায়। তবে জীবনটা অনেক বড়, এই আবেগগুলোর জন্য নিজেকে কষ্ট দিস না। তোর জন্য সবাই খুব ভাবে”
“তুমিও”
“যতই হোক বউ তো, ভাবতে হয়”
“তুমি পৃথিবীর প্রথম স্বামী হবে যে কিনা বউ এর আবেগ উবে যাওয়ায় তাকে ঘুরাতে নিয়ে এসেছো। আচ্ছা তোমার খারাপ লাগছে না, আমি অন্য কাউকে পছন্দ করতাম শুনে?”

অনল আবারো হাসলো। বিচিত্র হাসি। গোধূলী লগ্নে এই হাসিমুখটা যেনো সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর লাগছে। ধারা খেয়াল করলো অনল স্বাভাবিক ভাবে হাসলে খুবই সুন্দর লাগে তাকে। গোমড়া মানুষের হাসি বুঝি একারণেই সুন্দর। বা হাত দিয়ে ধারার অবাধ্য চুলগুলো গুজে দিলো সে কানের কাছে। তারপর পরম স্নেহজড়ানো কন্ঠে বললো,
“কারণ আমি জানি আমার বউটি ছেলেমানুষ”

অনলের এমন আচারণ বড্ড অবাক করলো ধারাকে। তার কন্ঠের বলা কথাটা বুকে যেয়ে লাগলো যেনো। লজ্জা এসে ভর করলো সমস্ত শরীরে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। বেসামাল অনুভূতি হচ্ছে তার। অনল হাত সরিয়ে নিলো। আবারো চুপচাপ। নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলো এবার ধারা। ইতস্তত গলায় বললো,
“আচ্ছা তোমার কাউকে কখনো ভালো লাগে নি? মানে প্রেম আরকি?”

অনল উত্তর দিলো না। বরং সম্পূর্ণ এড়িয়ে বললো,
“এখানের ফুচকাটা ভালো। খাবি?”
“হু, সাথে একটা আইসক্রিম ও এনো”

অনল উঠে গেলো। ধারা তার যাবার পানে চেয়ে রইলো। পোলো টি শার্ট, নীল জিন্স এর সুঠাম দেহী মানুষটাকে পেছন থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। অনেকটা হুমায়ুন স্যারের বাদল চরিত্রটির মতো। ধারা আজ বুঝলো প্রিন্স উইলিয়ামের ফ্যান কেনো বেশি। ফুচকার অর্ডার দিতে একটু দূরেই এলো অনল। সে ধারার প্রশ্নের উত্তরটি হয়তো দিতে পারতো কিন্তু ইচ্ছে হলো না তার। সঠিক সময় আসলে হয়তো দেওয়া যাবে। অর্ডার দিয়ে আইসক্রিম নিয়ে গন্তব্যে যেয়ে দেখলো স্থানটি ফাঁকা, ধারা নেই…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৭

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৭ম_পর্ব

মাঠের এক কোনায় দুটো পরিচিত মুখের দর্শন পেতেই তার পা থেমে গেছে। অনল এবং মাহিকে দেখা যাচ্ছে। মাহি মাথা নিচু করে আছে। লাজুক দৃষ্টি তার। ধারা একটু এগিয়ে গেল। লুকিয়ে এক কোনায় দাঁড়ালো সে। তখন ই মাহির মৃদু স্বর কানে এলো,
“অনলভাই, আমি আপনাকে বহুদিন যাবৎ পছন্দ করি, প্রতিবার আপনাকে সাদা কাগজে মুড়েই অনুভূতিগুলো জানিয়েছি। আর প্রতিবার ই প্রত্যাখান করেছেন, আপনি নিষ্ঠুরভাবে। অনেক সাহস করে তাই সরাসরি ই কথাগুলো বলতে চাই। আবেগ বলুন, ছেলেমানুষী বলুন আপনাকে আমার খুব ভালো লাগে৷ আপনাকে দেখলেই বুকের ভেতরটা কেমন জানে করে। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এই অনুভূতির জোয়ার সামলে রাখা কষ্টকর হচ্ছে। তাই সরাসরি ই বললাম। আপনি কি আমায় একটা সুযোগ দিবে আপনার জীবনে আসার?”

মাহির কথাগুলো শান্তভাবে শুনলো অনল। তার মুখশ্রী বরাবরের মতোই কঠিন, নির্বিকার। মাহির ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে গেছে। গোল গালে রক্ত জমেছে। চোখ নামিয়ে রেখেছে সে। কন্ঠ ও জড়ানো লাগছে। অপরদিকে ধারার মনের ভেতর এক অজানা ঘূর্নিঝড় শুরু হলো। এক অস্বস্তি অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরলো। এই অনুভূতির উৎস তার জানা নেই। তবে মাহির উপর ক্ষীন ক্ষোভ হলো, মেয়েটা এতোকাল তাকে প্রেমকবুতর বানাতো। তাকে পিয়ন বানিয়ে চিঠি পাঠাতো। অথচ অনল ভাইকে প্রণয় নিবেদনের ব্যাপারটা চেপে গেলো। কতবার তাকে শুধালো অথচ মেয়েটা কিছুই বললো না। ধারার ভালো লাগছে না। খুব অসহনীয় অনুভূতি হচ্ছে তার, কেনো জানা নেই। উপহার দেবার ইচ্ছেটা ম’রে গেলো। চুলোয় যাক উপহার। তার অনলের উত্তর জানার আগ্রহ হচ্ছে। কিন্তু পরমূহুর্তেই অন্তরাত্মা বাধ সাধলো, সে কেনো উত্তেজিত হচ্ছে! মাহি তো প্রিন্স উইলিয়ামকে পছন্দ করে। তাকে মনের কথা বলায় দোষ কি! লুকিয়ে চোরের ন্যায় তাদের কথা শোনা কি খুব দরকার! তবুও যে মনটা আকুপাকু করছে, সব যুক্তিকে হার মানাচ্ছে অবুঝ মন। এমন অনুভূতিটা এই প্রথম হচ্ছে। অনল এখনো নির্বাক সে ঘড়ির দিকে একবার দেখেই হাতদুটো পকেটে পুরলো। ধারা আরোও ভালো করে শুনতে আরেকটু এগিয়ে আসতেই শুকনো খড় শব্দ করে উঠলো। মাহি চমকে বললো,
“ওখানে কেউ আছে হয়তো!”
“বেড়াল হতে পারে, হয়তো মালিকের কাছ থেকে পালিয়ে খাবার চুরি করতে এসেছে”

নির্লিপ্ত স্বরে বলো অনল। বেড়াল, শেষমেশ বেড়াল বললো সে ধারাকে। কথাটা কানে আসতেই মন বিষিয়ে উঠলো। অজানা কারণে সকল আগ্রহ হারিয়ে গেলো। অজানা কারণেই খুব রাগ হলো অনলের উপর। সেখানে থাকার ইচ্ছে হলো না তার। হনহন করে চলে গেলো সেখান থেকে। এর মাঝে ভুলেও গেলো প্লাবণকে উপহার দেবার কথা ছিলো। এদিকে অনল এখনো শব্দ হবার জায়গায় তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনায় বিচিত্র হাসি উঁকি দিলো। মাহি অধৈর্য্য কন্ঠে বললো,
“উত্তর দিবেন না, অনল ভাই?”

******

ধারা বাড়ি ফিরলো এক রাশ চিন্তা নিয়ে। কোনো মতে একটা রিক্সা ঠিক করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে সে। তার মস্তিষ্কে নিউরণগুলো জড়ানো লাগছে। যেনো তাদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। ঘরে প্রবেশ করতেই সুভাসিনী বেগম বললো,
“তুই একা কেনো? অনল কোথায়?”
“তোমার ছেলে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে”

আনমনেই কথাটা বললো ধারা। ব্যাগটা সোফায় রেখেই ধপ করে বসলো সে। জমজ বি’চ্ছু টিভি দেখছিলো সেখানে। ধারার থমথমে মুখখানা দেখে এশা একটু এগিয়ে এসে বললো,
“ধারাপু তোমার কি পেট খারাপ? নাকি কোষ্ঠ্যকাঠিন্য হয়েছে?”

কথাটা শুনতেই কড়া চোখে তাকালো ধারা। তখন এশা বললো,
“না তোমার মুখটা বাবার মতো লাগছে। সকালে বাবার বাথরুম ক্লিয়ার না হলে এমন ই মুখ বাঁকিয়ে রাখে। বলো তো আশা ইসবগুলের ভুসি গুলিয়ে দিচ্ছে”
“কানের নিচে মা’র’লে মাথায় জমা সব ভূসি বেড়িয়ে যাবে। বে’য়া’দ’প কোথাকার”

বলেই হনহন করে ঘরে চলে গেলো ধারা। এশা কিছুসময় বেকুবের মতো চেয়ে রইলো। তারপর হতাশ স্বরে বললো,
“বুঝলি আশা, মানুষের ভালো করতে নেই। এ দুনিয়ায় শুভাকাঙ্ক্ষীদের কদর নেই”
“ঠিক”

আশা সহমত প্রকাশ করলো। তারপর তারা পুনরায় টিভি তেই মনোনিবেশ করলো।

ধারা রুমে পায়চারি করছে। তার চিন্তা এখনো মাঠের কোনায় অনলেই আটকে আছে। অনল ভাই কি তার বিয়ের কথাটা বলে দিয়েছে! তার ভরসা নেই, বলে দিতেই পারে। তখন মাহি তার উপর চটে যাবে, এতোবড় সত্য লুকিয়েছে ধারা। এই ব্যাপারটা ভেবে তার দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আবার মনে হচ্ছে এমন টা তো তাও হতে পারে। এমন ও হতে পারে অনল ভাই মাহির প্রম নিবেদনে গলে গেছে। মাহি যথেষ্ট সুন্দরী। গোলগাল মুখ, ছোটখাটো ফর্সা মেয়ে। চোখগুলো কাজলকালো, গোলাপী ঠোঁট, মাজা অবধি সাপের ন্যায় বেয়ে আসা কেশ। কি মিষ্টি গায়, তার সুরেলা কন্ঠের প্রেমিক অনেক। এমন মেয়ে প্রেম নিবেদন করলে যেকোনো পুরুষ গলে যাবে। অনল ভাই ও তো পুরুষ ই। কথাটা ভাবতেই এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো ধারার। আগের চিন্তাগুলো মূহুর্তেই বাস্পায়িত হয়ে গেলো৷ নতুন চিন্তা ভর করলো মস্তিষ্কে, যদি অনল মাহির প্রেম নিবেদনে গলে যায় তবে কি হবে! অদ্ভুত বিষন্নতা ঘিরে ধরলো ধারাকে। এই বিষন্নতার কারণ সে জানে না, সত্যি জানে না_____

*****

অনল ফিরলো সন্ধ্যার পরে। অবশেষে তার ব্যস্ত দিনের অবসান হলো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীর নিয়ে সে ফিরলো ঘরে। জ্যামের কারণে আজ অনেক দেরি হয়ে গেছে। জ্যামে বসে ছিলো প্রায় আধা ঘন্টা৷ বাড়ি ফেরার তাড়া তো সবাই ই। সারাদিনের সকল ব্যস্ততার ইতি টেনে ঘরে ফেরা। তাই এই সময়ে ইট পাথরের ঢাকায় যানের লাইন হয়। এটাই তো তার চিরচেনা অস্তিত্ব।

ঘরে ঢুকতেই দেখা গেলো পুরো পরিবার বসার ঘরে। মুড়ি পার্টি হচ্ছে। টিভি তে উত্তম কুমারের ছায়াছবি “মৌচাক” চলছে। এই সিনেমাটি জামাল সাহেবের অতিপ্রিয়। যখন ই টিভিতে হয় তিনি সুভাসিনীকে মুড়ি মাখতে বলেন। মুড়ি খেতে খেতে সিনেমাটা দেখেন তিনি। আজ তার সাথে রাজ্জাক, ইলিয়াস, রুবি এবং এশা-আশা ও যুক্ত হয়েছে। ইলিয়াস অনলকে দেখেই বললো,
“বাপ খাবি নাকি?”
“নাহ, তোমরাই খাও”
“তা খাবা ক্যান, তুমি হলে মাস্টারমশাই। তোমাকে দিতে হবে মন্ডামিঠাই। মুড়িমাখা তোমার মুখে রচবে না”
“তোমাদের ই ছেলে, কি করবো! জমিদার রক্ত”

স্মিত হেসে চাচ্চুকে উত্তর দিলো। তারপর সুভাসিনীকে বললো,
“মা পারলে এককাপ চা দিও। মাথা ধরেছে”

বলেই নিজ রুমে চলে গেলো সে। রুমে ঢুকতেই ধারা ছুটে এলো। সে এতোসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। অপেক্ষা করছিলো অনলের ফেরার। বিকেল তার কাটলো বিষন্ন। ফলে অনলকে দেখতেই উৎফুল্ল স্বরে বললো,
“তুমি এসে পড়েছো? এতো দেরি হলো যে!”

ধারার ব্যাস্ততায় খানিকটা ভড়কালো অনল। অবাক স্বরে বললো,
“আমার বাড়ি ফেরা নিয়ে তো ইহজীবনে তোকে এতোটা উৎসাহিত দেখি নি। মতলব কি?”
“তুমি সবসময় মতলব খুজো কেনো? একই ঘরে থাকি, চিন্তা হতে পারে না”
“বাবা রে! আমার জন্য ধারার চিন্তা। বেশ বউদের মতো কথা শিখেছিস তো!”

বলেই হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে চলে গেলো সে। অন্যদিকে ধারার মনটা ছটফট করছে। বারবার মাহির কথাটা জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে। কিন্তু বিব্রতবোধ ও হচ্ছে। অনল ভাই যদি বলে, “তোকে কেনো বলবো! তুই তো এই বিয়েই মানিস না তাহলে অধিকার কিসের”

তখন লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারবে না। মন এবং মস্তিষ্কের এই অসহনীয় দ্বন্দে আর প্রশ্নটি করা হলো না ধারার। ফলে বিকেলের মতো রাতটিও কাটলো অস্থিরতায়______

*****

সকালের সোনালী সূর্য উদিত হবার আগেই ভাঙ্গলো ধারার ঘুম। অবশ্য ঘুম হলে তো ভাঙ্গার প্রশ্ন আসে। তার ঘুম ই হয় নি। শুধু এপাশ ওপাশ করেছে। রক্তিম হয়ে আছে চোখজোড়া। কিছুসময় সিলিং এর ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থেকেই উঠে পড়লো সে। নামায পড়ে দাঁড়ালো বারান্দায়। মৃদু রোদ কোমল ছোঁয়া দিচ্ছে বারান্দায় কোনায় রাখা শিউলি ফুলের টবটিতে। গণিতের মানু্ষের গাছের প্রতি শখটা অবাককর হলেও অনলের গাছ লাগাবার শখ আছে। বারান্দায় ছোট ছোট ফুলের টব ঝুলিয়ে রাখা৷ সকালে এই মিষ্টি গন্ধ নাকে আসলেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে। তবে আজ তেমনটা হলো না। বরং ধারার মাথায় মাহি সংক্রান্ত প্রশ্নই ঘুরতে লাগলো৷

ভার্সিটিতে আজও অনলের সাথেই এলো ধারা। গেট থেকে বহু দূরে থেমে গেলো। তারপর একা একা এলো ভার্সিটিতে। গেট পার হতেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির নিচে দেখা পেলো মাহির। তাকে অবসন্ন দেখালো। উদাস চোখ তাকিয়ে আছে কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুটন্ত রক্তিম ফুলের দিকে। ধারা ছুটে গেলো তার কাছে। তাকে দেখেই মন খারাপ হয়ে গেলো ধারার। চোখজোড়া ফুলে আছে, ভেজা চোখ, ঠোঁটজোড়া শুষ্ক। বিষন্নতা যেনো তাকে ঘিরেই। কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বেই বললো,
“আমি আর বেলতলার বাসিন্দা নই ধারা। হাল ছেড়ে দিয়েছি”

কথাটা শুনতেই বেশ অবাক হলো ধারা। তখন মাহি খুলে বললো গতকালের কাহিনী। অনল তার প্রেম নিবেদন বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করেছে। ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে বলেছে,
“মাহি তোমাকে আমার ভালো লাগে না। তাই মরীচিকার পেছনে ছুটো না। আমি তোমাকে প্রহেলিকার মধ্যে রাখতে চাই না। ক্ষমা করবে এই প্রেম নিবেদন আমি গ্রহণ করতে পারবো না”

তার কন্ঠ ছিলো শান্ত, শীতল। বেশ নিপুন ভাবেই সে জানালো সে মাহিকে পছন্দ করে না। মাহি যখন তাকে পুনরায় শুধালো,
“কেনো? আমার কি সমস্যা?”

তখন স্মিত হেসে অনল বললো,
“এক হৃদয়ে দু নারীর স্থান হয় না”

বলেই সে প্রস্থান করলো। ধারা অবাক নয়নে চেয়ে রইলো। মাহির মুখে কথাগুলো শুনতেই মনের মাঝে জমে থাকা মেঘমেদুর কেটে গেলো। উঠলো লাল আভায় মোড়ানো সূর্য। অজানা কারণে প্রসন্নতায় ভরে উঠলো হৃদয়ের অন্তস্থল। আবার পরমূহুর্তেই মাহির ভঙ্গুর হৃদয়ের জন্য সমবেদনা জানালো। মাহিকে সান্ত্বনা দিলো। মাহি তাকে জড়িয়ে কাঁদলো বেশ কিছু সময়। তবে এসবের মাঝে একটা প্রশ্ন ও উঁকি দিলো কিশোরী ধারার মনে, জটিল প্রশ্ন। তাহলো অনল ভাই কাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছে! প্রিন্স উইলিয়াম ও বুঝি কাউকে পছন্দ করে!

মাহির মন খারাপ ব্যাপারটা বন্ধুমহল মোটেই মানলো না। তারা সিদ্ধান্ত নিলো আজ ক্লাস বাঙ্ক দিবে। সেটাই হলো। এমন কি পড়ুয়া নীরব ও সায় নিলো। আজ তারা ক্লাস করবে না। বন্ধুমহল বাসে করে পৌছালো বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্স এ। পাঁচটা টিকিট কাটলো তারা। সারাদিন হই হুল্লোড়, সিনেমা দেখা, খাওয়া দাওয়ার মাঝেই কাটলো। ফলে আবেগে ভেসে যাওয়া মাহির মনটা কিছুটা হলেও ভালো হলো। মাঝে ধারার মোবাইল বেজেছিলো ঠিক কিন্তু ধারা পাত্তা দিলো না। বন্ধুদের সাথে আনন্দ করে বাড়িতে পৌছালো তখন সন্ধ্যে সাতটা। প্রশ্নের মুখোমুখি হবে জানা তবুও সে ভয় পেলো না। তবে সে তো জানতো না, বাড়িতে নতুন চমক তার প্রতীক্ষায় আছে। যখন প্রবেশ করলো তখন ই দেখলো বসার ঘরে প্লাবণ ভাই বসে আছে। বড়মার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। প্লাবণ ভাইকে দেখতেই গতকালের উপহারের কথা মনে পড়লো৷ সেটা এখনো ব্যাগেই আছে। মাহি আর অনলের কথা ভাবতে ভাবতে উপহারের কথাই সে ভুলে গেছে। ধারাকে দেখতেই প্লাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো জলধারা?”
“এই তো ভালো, আপনি?”
“জম্পেস। আসো বসো”

ধারাও ব্যাগখানা না রেখেই বসলো। অবশ্য তার দিকে একজন কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তবে এখন তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো ধারা। প্রসন্ন চিত্তে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কতো দিন পর এলেন, এখন তো আপনাকে দেখাই যায় না”
“আসলে সময় ই হয় না। আজ একটা বিশেষ কারণে এসেছি। ভালো হয়েছে তুমিও এখানে আসো”

বলেই একটা সোনালী কার্ড বের করলো ব্যাগ থেকে। সুভাসিনীকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“আগামী শুক্রবার আপনাদের দাওয়াত আন্টি। সবাই আসবেন৷ ছোট চাচ্চু, এশা আশা সবাই। আর বিশেষ করে তুমি জলধারা। সরি ভাবী, আসবে কিন্তু আমার বিয়েতে………

চলবে

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৬

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৬ষ্ঠ_পর্ব

কিন্তু কথায় আছে, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়”। দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকেই পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো দিগন্তের। তীর্যক নয়নে সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি তার বন্ধুদের একজন। ধারা কিছু বলার পূর্বেই সে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“অনল স্যারের সাথে তোর কি সম্পর্ক?”

প্রশ্নটি শুনতেই পিলে চমকে উঠলো ধারার। চুরি করতে যেয়ে অপরিপক্ক চোরেরা ধরা পড়ে গেলে যেমন আমতা আমতা করে ঠিক তেমন আমতা আমতা করতে লাগলো সে। মস্তিষ্কটা হুট করেই যেনো ল্যাপটপ এর উইন্ডোজ শাটডাউনের মতো বন্ধ হয়ে গেছে। উত্তরটা অতি সরল তবুও যেনো ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ধারা। আমতা আমতা করে বললো,
“কিসের সম্পর্ক, কোনো সম্পর্ক নেই! উনাকে তো এর আগে আমি দেখি নি”
“অনল স্যারের বাইক থেকে তোকে নামতে দেখেছি আমি, ঝেড়ে কাশ। লুকিয়ে লাভ নেই”

শীতল অবিচলিত কন্ঠে কথাটা বললো দিগন্ত। ধারা বুঝলো মিথ্যের পাহাড় বানিয়ে লাভ নেই। দিগন্তের শ’কু’নী নজর তাকে দেখে ফেলেছে। দিগন্তের এই পেইজ থ্রি রিপোর্টারদের মতো সকল জায়গায় উপস্থিত হবার ব্যাপারটা বড্ড অপছন্দ ধারার। যখন ই কিছু হয় সবার আগে সেটা তার নজরেই পড়তে হয়। উপরন্তু সেই খবরটা বিবিসি চ্যানেলের মতো সারা ক্লাসে ছড়াবার মতো মহান কাজটিও সে নিজ দায়িত্ব মনে করে পালন করে। একটা ছেলে যে এতোটা চু’গ’ল’খোর হতে পারে ওকে না দেখিতে ধারা জানতো না। তবুও তার সাথে ধারার সখ্যতা আছে। কারণ ব্রেকিং নিউজ শুনতে কার না ভালো লাগে। ল্যাব স্যাশনের মাঝে হুট হাট কে কাকে প্রপোজ করলো, কোন মেয়ের কোন সিনিয়রের উপর ক্রাস, কোন জোড়া কপোত কপোতী স্যারের নজরে পড়লো, কোন কোন গ্যাং মা’রা’মা’রি করে মাথা ফা’টা’লো ব্যাপারগুলোর মশলাদার গল্প শুনতে খুব একটা মন্দ লাগে না। ছাত্র হিসেবে ডাহা ফেলু হলেও খবর প্রচারে সে একশ তে একশ। এখন তাকে যদি ধারা জানায় সে শ্রদ্ধেয় নতুন স্যারের স্ত্রী, তাহলে পরদিন সকালে সে হয়ে যাবে ভার্সিটির জমজমাট খবর। ধারা চায় না হট টপিক হতে। বন্ধুমহলে আলোচনা, সমালোচনার মধ্যমনি হওয়াটা ততটা খারাপ নয় যতটা তাকে এড়িয়ে চলাটা। স্যারের বউ এর সাথে কে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলবে! যা একটু অনলের নামে দু চারটি সমালোচনা শুনে কান জুড়াতো আর হিহি হাহা করতো সেটাও হবে না। গাল ফুলিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। হতাশ গলায় বললো,
“আর লুকিয়ে লাভ নেই তাই তো”
“ঠিক তাই চাঁদ, বলে ফেলো। কেনো তার বাইকে চড়ে এলি? কে হয় উনি?”
“দেখ তুই তো জানিস আমি মামাবাড়িতে মানুষ”
“হ্যা, তো?”
“অনল ভাই, মানে আমাদের অনল স্যার আমার বড় মামার ছেলে। উনি আমার মামাতো ভাই। সে কারণেই তার বাইকে চড়ে আসা। যদি আমার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু কি করবো বড়দের কথার অমান্য করা আমার স্বভাবে নেই”

ধারার কথা শেষ হবার আগেই তীব্রর স্বরে দিগন্ত বলে উঠলো,
“স্যার তোর মামাতো ভাই আগে বলিস নি কেনো?”

সাথে সাথে ধারা তার মুখ চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এজন্য বলি নি, তোর পেট তো ফাটা ঢোল। একটা কথা চেপে রাখতে পারিস না। শুধু মাহি জানে, কারণ ও আমার স্কুলের বান্ধবী। আর খবরদার দিগন্ত, ক্লাসে কেউ যদি জানে আমি তোর দাঁত ভে’ঙ্গে দিবো”

নিজ মুখ ছাড়াতে ছাড়াতে দিগন্ত বলে উঠলো,
“এতে এতো লুকোচুরির কি আছে! বরং এটা তো আরোও ভালো! ক্লাসের লোক তোকে মাথায় তুলে নাচবে”
“হ্যা, কিন্তু যখন দেখবে ওই অনল স্যার আমাকে দু পয়সার দাম দেয় না সেই মাথা থেকেই আছাড় মেরে ফেলে দেবে। তুই ভাই আমার, একটু চুপ করে থাক। সময় হলে আমি নিজেই বলবো”
“তোর ভাই হতে আমার বয়েই গেছে”

মিনমিনিয়ে কথাটা বললো দিগন্ত। ফলে ধারার কানে গেলো না। সত্যি লুকানোকে কি মিথ্যের কাতারে ফেলা যায়! প্রশ্নটির উত্তর জানে না ধারা। তবে ভার্সিটি জীবনে খানিকটা শান্তির জন্য এই পথটাই বেশি উপযুক্ত লাগলো তার কাছে। হৃদয়ের অন্তস্থলে কিঞ্চিত খচখচানি থাকলো অবশ্য, ঠিক কেনো জানা নেই! হয়তো অব্যক্ত অর্ধেক সত্যিখানাই কারণ। ধারা বেশি ভাবলো না। দিগন্তের সাথে পা বাড়ালো ক্লাসের পানে। এদিকে তাদের দুজনকে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে এতোসময় লক্ষ্য করছিলো কেউ। দৃষ্টিটি প্রখর এবং সুচালো, যতসময় তাদের দেখা যায় ঠিক ততসময় তাকিয়ে থাকলো সে। তারপর গমন করলো নিজ গন্তব্যে________

ক্লাসে আজ বেশ রমরমা পরিবেশ। কেক আনা হয়েছে, একটা প্লাস্টিকের ছু’রির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আজ একটা বিশেষ দিন। আজ প্লাবণ স্যারের জন্মদিন। গত সেমিস্টারে মানুষটি তাদের ক্যামিস্ট্রি কোর্স নিয়েছিলো। ধারার মতো পুরো ক্লাস তার ভক্ত। কারণ পয়তাল্লিশ মানুষের একজন ও ফেল করে নি। বরং সবার কোর্সে গ্রেড ছিলো ভালো। তাই সকলের তার প্রতি ভালোবাসাটাও মাত্রাতিরিক্ত। ফেসবুকের জামানায় স্যারে জন্মদিন জানা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়, সে তো অনল স্যার নন যার ফেসবুক আসে কি না ব্যাপারটা সন্দিহান। আর পছন্দের স্যারের জন্মদিন পালন করা আজ একটা ফ্যাশন ই বলা যায়। ফলে প্লাবণ স্যারের জন্মদিন পালনের জন্য ই এতো আয়োজন। ধারাও ঠিক সে কারণেই হালকা সেজেগুজে এসেছে। কিশোরী মনের আবেগ ই হোক না, তাকে যত্ন করতে দোষ কোথায়! সে তো আর মনের কথাটা উজার করে বলছে না। শুধু মানুষটার বিশেষদিন পালন করবে। প্লাবণ ভাই এর জন্য সে একটা উপহার ও কিনেছে। কেক কাটার পর দিবে। ক্লাসের ক্লাস রিপ্রেজেনটেটিভ প্লাবণকে ডেকে আনলো। প্লাবণের ক্লাস না থাকায় সে এলোও। এতো চমৎকার আয়োজন দেখে আবেগে আপ্লুত ও হলো। কিন্তু ধারার উপহার দেওয়াটা হলো না। সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিলো একটাই মানুষ অনল, কেক কাটার সাথে সাথেই সে তার ক্যালকুলাসের বই নিয়ে হাজির হলো। প্লাবণ কোনো মতে বললো,
“সবাইকে অনেক ধন্যবাদ, এমন বার্থডে হবে জানতাম না। সত্যি ভালো লেগেছে। কেকটা কেটে তোমরা খেয়ে নাও। অনল স্যার যেহেতু দাঁড়িয়ে আসেন আর আমি সময় নিবো না। আরো একবার বলবো ধন্যবাদ”

প্লাবণ বেড়িয়ে গেলে ছাত্ররা কেক খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবাই খেলেও ধারা খেলো না। কারণ তার স্বযত্নে আনা উপহারটি এখন তার হাতেই রয়ে গেলো। প্লাবণকে দেওয়া হলো না। এদিকে চরম বিরক্তি ফুটে উঠলো অনলের মুখে। একেই গরমে শার্টখানা ভিজে গেছে অথচ তার ক্লাসের বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ছাত্ররা মনের সুখে কেক খাচ্ছে, এদের কারোর ই হয়তো মনেও নেই আর দু মাস পর সেমিস্টার ফাইনাল। বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি ঘষতে ঘষতে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বললো,
“হয়েছে তোমাদের?”
“জ্বী স্যার”

অনল সময় নষ্ট না করেই ভেতরে প্রবেশ করলো। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিমায় বললো,
“এই যে পেপার। প্রত্যেকে পাস করে দাও। আজ তোমাদের সারপ্রাইজ টেস্ট নিবো”

সারপ্রাইজ টেস্টের কথাটা বিশাল এট্যোম বো’ম্ব এর মতো কাজ করলো। ছাত্রছাত্রীদের উল্লাসগুলো মূহুর্তেই উবে গেলো। রিপ্রেজেনটেটিভ আমতা আমতা করে বললো,
“স্যার, সারপ্রাইজ টেস্ট?”
“হ্যা, দশ মার্কের। এটা ক্লাস এস্যাসমেন্টের সাথে যুক্ত হবে। ফাস্ট পেপার পাস করো”

সকলের মুখ থমথমে। পরীক্ষা শুরু হলো, অনল পায়চারি করছে। ধারার বেঞ্চের সামনে এসেই সে দাঁড়িয়ে গেল। সূঁচালো চোখে দেখলো ধারার সফেদ খাতা। রোল ব্যাতীত একটা লাইন ও লেখা নেই। সে প্রশ্ন ও তুলে নি। অনল কিছুসময় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করলো। যার অর্থ, “তুই ক্লাসে কি একটু মনোযোগী হতে পারিস না! আমার বউ এতো গ’বে’ট কেনো!” কিন্তু তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ধারা তার সাদা খাতা কাটাকাটি খেলতে লাগলো। সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অনল। তারপর আবার হাটতে লাগলো। ব্যাপারটা দিগন্তের চোখ এড়ালো না।

ক্লাস শেষে বন্ধুমহল বসলো ক্যাফেটেরিয়ায়। আজ ল্যাব নেই। সব ক্লাসের ঝামেলাও শেষ। নীরব ক্যাফেটেরিয়ার কাউন্টারের রফিক মামাকে বললো,
“মামা, সবাইকে সামুচা আর তরমুজের শরবত দাও তো”
“দেতাছি, বসো। এই ছোটন, পাঁচ নম্বর টেবিলে পাঁচটা সামুচা আর ৫টা জুস দে”

এর মাঝেই অভীক বলে উঠলো,
“অনল স্যার আজ কি কাজটা করলো? সারপ্রাইজ টেস্ট! আরে জানিয়ে পরীক্ষা নিলেও পাই দশে দুই সেখানে সারপ্রাইজ টেস্ট নেবার কি মানে? আমি সাদা খাতা জমা দিয়েছে। নীরবকে উঠিয়ে দিলো। ধ্যাত”
“ভালো হয়েছে, তোমরা লেকচার তুলবা না আর মার্ক চাবা সেটা তো হবে না। এটা পরশুদিন ই করিয়েছিলো ক্লাসে”
“এজন্য তো তোকে এতো ভালোবাসি। আজ নোট খাতাটা নিয়ে যাবো”

নীরব এবং অভিকের কথার মাঝেই দিগন্ত বলে উঠলো,
“ধারা তো নিশ্চয়ই দশে দশ পাবি!”
“এটা কেনো মনে হলো?”
“অদ্ভুত তোর ভাই তোকে জানায় নি, এটা হতে পারে?”

যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। দিগন্ত কথাটা ফাস ই করে দিলো। অমনি সকলের দৃষ্টি তার দিকে ঘুরে গেলো। দিগন্তের দিকে কটমট করে চাইলেও সে তা উপেক্ষা করে বললো,
“ক্লাসে কেউ পাস না করলেও ধারা ঠিক ই পাস করবে”
“অনল স্যার তোর ভাই? আগে বলিস নি কেনো?”
“এতো বড় কথাটা তুই চেপে গেলি?”

সকলের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে উঠলো ধারা। তাই বাধ্য হয়ে খোলসা করলো তার এবং অনলের সম্পর্কটি। সব শুনে অভীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“ঠিক বলেছিস, এই কাজিনগুলো নষ্টের গোড়া। দেখ না আমার কাজিন জিআরই তে ভালো নম্বর পেয়ে জার্মানি তে স্কোলারশিপ পেয়েছে। আমার ফুপু সুন্দর মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে হাজির। ফলে সেই মিষ্টিতে ভ্যাজানো কথাগুলো আমার নসিবে জুটলো। বাবা তো বলেই দিয়েছে এবার যদি আমি রিটেক খাই সোজা বাড়ি ছাড়া করবে”

এতো আলোচনার মাঝেও মাহিকে দেখা গেলো চুপচাপ। সে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। ধারা দু চার বার জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিলো না। ম্লান হেসে বললো,
“কিছুই হয় নি”

হঠাৎ সে উঠে বললো,
“তোরা খা, আমি একটু আসছি”
“কোথায় যাস”
“কাজ আছে”

আর প্রশ্ন করলো না ধারা। নির্বাক চাহনীতে মাহির যাওয়া দেখলো। তখন ই উপহারের কথা স্মরণ হলো। সেও বললো,
“তোরা খা, আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি”

ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়েই একাডেমিক বিল্ডিং এর দিকে হাটা দিলো ধারা। তার ভার্সিটির একাডেমিক এ উলটো দিক থেকে যেতে কোথায় একটা মাঠ পড়ে, সেখানে নরম ঘাসের উপর বসে আড্ডা দেয় ছাত্ররা। দুপুর বেলায় মাঠটা প্রায় থাকে নির্জন। সূর্যের জ্বলন্ত রোদ সরাসরি পড়ে বিধায় এই সময়ে এখানে কেউ আসে না৷ তাই এই পথটাই বেছে নিলো ধারা। প্লাবণ ভাইকে উপহার দেওয়াটা কারোর নজরে না পড়াই ভালো। ধারা বিল্ডিং এর দিকে বাক নিতেই থেমে গেলো সে। মাঠের এক কোনায় দুটো পরিচিত মুখের দর্শন পেতেই তার পা থেমে গেছে। অনল এবং মাহিকে দেখা যাচ্ছে। মাহি মাথা নিচু করে আছে। লাজুক দৃষ্টি তার। ধারা একটু এগিয়ে গেল। লুকিয়ে এক কোনায় দাঁড়ালো সে। তখন ই মাহির মৃদু স্বর কানে এলো,
“অনলভাই, আমি আপনাকে বহুদিন যাবৎ পছন্দ করি………

চলবে

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৫

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৫ম_পর্ব

ভয়মিশ্রিত চোখে পেছনে ফিরতেই মনে হলো অবয়বটি তার কাছে আসছে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়লো সে। জোড়ানো স্বরে চেঁচালো,
“ভু…..ত, ভু…ত”

সাথে সাথেই অবয়বটি লাইট জ্বালালো এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরাতে সরাতে নিদারুণ অসহায় কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, ভুত না। আমি ধারা”

অনল এখনো ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ধারার দিকে। ধারা খেয়াল করলো সে প্রচন্ড ঘামছে। তার ঠোঁটের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখগুলো বিস্ফোরিত হয়ে আছে। মুখ ফুলিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ভীত সন্ত্রস্ত অনলকে দেখে ধারাও খানিকটা বিচলিত হয়ে যায়। টেবিলে রাখা বোতলটি এগিয়ে বলে,
“শান্ত হও, আমি। পানি খাও, ভালো লাগবে”

অনল কাঁপা হাতে পানির বোতলটা নিলো। এক নিঃশ্বাসে পানি খেলো সে। এখন একটু স্বাভাবিক লাগছে। ভয়টা এখনোও পুরোপুরি কাটে নি। বুকটা ঈষৎ কাঁপছে, হৃদস্পন্দন বেসামাল এখনো। হয়তো পালস অক্সিমিটারে মাপলে শ এর উপরে পালস পাওয়া যাবে। অনল কিঞ্চিত স্বাভাবিক হতেই ফট করে ধারা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তুমি কি ভুতে ভয় পাও, অনল ভাই?”

প্রশ্নটা কর্ণপাত হতেই তীব্র লজ্জা ঘিরে ধরলো অনলকে। আঠাশ বছরের তাগড়া যুবক নাকি ভুতে ভয় পায়, ব্যাপারটা শুধু হাস্যকর ই নয়; চরম লজ্জাজনক। উপরন্তু এতোকাল তার ভাবগাম্ভীর্যের জন্য ছোট ছোট ভাই বোনদের মাঝে একটা দাপট আছে। বড় হবার কারণে সবার উপর একটা রাজত্ব খাটানোর অধিকারটি তার জন্মলগ্ন থেকে প্রাপ্ত। সেখানে এতোবড় দূর্বলতাটি যদি প্রকাশ্যে চলে আসে তবে মান ইজ্জতের আর রেহাই হবে না। তার থেকেও বড় কথা একজন গণিতের টিচার কিনা ভূতে ভয় পায়, এ যদি সমাজ জানে তবে আর মুখ দেখাবার জায়গা থাকবে না। অবশ্য এতে তার দোষ নেই। ভয় একটা প্রবৃত্তি, যা মনের অজান্তেই চুপিসারে ঢুকে পরে মনের গহীনে। তারপর ধীরে ধীরে তা বিস্তার লাভ করে। শাখা প্রশাখা মেলে নিজের রাজত্ব তৈরি করে। মস্তিষ্কের অজান্তেই এই ভয়ের বিস্তার হয়। তারপর কোনো একটা ঘটনায় ঘাপটি মারা ভয় লাফিয়ে বেড়িয়ে পড়ে। অনলের সাথেও তাই হয়েছে। ছোটবেলার বিশ্রী স্মৃতিটুকু এতোকাল বুকের ভেতরে ঘাপটি মেরে ছিলো। হটাৎ ওই রুপে ধারাকে দেখেই তা বেড়িয়ে এসেছে। এটার যুক্তিও অনল তৈরি করেছে। তার মনে ছিলো না ধারা এখানে থাকে, সারাদিনের ক্লান্তিতে তার মস্তিষ্ক প্রায় বন্ধ হবার পর্যায়ে ছিলো। আলো আঁধারে মিশ্রণে ওভাবে ধারার অবয়বে তার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তাই অজান্তেই “ভুত, ভুত” বলে চেঁচিয়েছে। এটা অবচেতন মনের কারসাজি ব্যাতীত কিছুই নই। যদি হিমুর মতো বেখেয়ালি, আধ্যাত্মিক চরিত্র ভয় পেতে পারে, মিছির আলির মতো শক্ত মস্তিষ্কের, নিপুন চিন্তার বুদ্ধিমান চরিত্র ভয় পেতে পারে; এতো অনল। সার্লোক হোমস ও এক বার ভয় পেয়েছিলো। কবে মনে নেই অনলের। গলা খাকারি দিয়ে ধারার প্রশ্ন এড়াতে সে প্রতিবাদী স্বরে উত্তর দিলো,
“আমি মো…মোটেই ভুতে ভ..ভয় পাই না”
“তাহলে চেঁচালে কেনো?”
“আর কেনো! সাঁঝবেলায় এমন শা’ক’চু’ন্নি সেজে ঘুরলে যে কেউ ভয় পাবে। আমি ক্লান্ত, তাই হুট করে আয়নায় তোকে দেখে একটু বিচলিত হয়ে গেছিলাম। মোটেই ভয় পাই নি”

অনলের জড়ানো কথাগুলো এতোসময় শুনছিলো ধারা। কিন্তু আর কিছুতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। রগচটা, গম্ভীর, দাম্ভিক, আত্নজেদী, কঠিন অনল কিনা ভুতে ভয় পায়। মানা যায়! এটা তো কাজিন মহলে আগুনের মতো ছড়িয়ে যাবে। অনলের এতোকালের রাজত্বকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে এই একটা তথ্য ই যথেষ্ট। ধারা হাসতে হাসতে খাটে শুয়ে পড়লো। শুধু জমজ বি’চ্ছুদের জানালেই এটা ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে। অপরদিকে নিজের কাজে নিজের উপর ই রাগ হচ্ছে অনলের। এতোকালের সুপ্ত দূর্বলতাকে কিনা ধারার কাছেই ধরা পড়লো। ধমকের স্বরে বললো,
“পা’গ’লে’র ন্যায় হাসছিস কেনো? হাসি থামা”

বলেই ওয়াশরুমে ছুটলো সে। ধারার হাসি থামছেই না। বিশেষ করে, অনলের বিব্রত মুখখানা। কানজোড়া লজ্জায় রক্তিম হয়ে আছে। বিকেলের মন খারাপগুলো কোথায় যেনো উবে গেলো। কালো মেঘগুলো সরে উদিত হলো স্বর্ণালী কুসুম প্রভা। অবশেষে বাগে পাওয়া গেলো প্রিন্স উইলিয়ামকে_______

খাবার টেবিলে অনল চুপ করে থাকলো। বিব্রত, লজ্জা, ক্রোধে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। খাওয়াটাও গলা দিয়ে নামলো না। ছোট মামা তাকে দু বার জিজ্ঞেস করল,
“তোর কি শরীর খারাপ আব্বা?”
“না, চাচু। একটু ক্লান্ত”

অনলের চুপসানো মুখখানা প্রচন্ড প্রশান্তি দিচ্ছে ধারাকে। সে প্রসন্নমুখে খাবার খাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এভারেস্ট জয় করেছে সে। এতো বড় অস্ত্রটিকে গভীর চিন্তার সাথে ব্যাবহার করবে সে। এশা ধারাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করেই বসলো,
“ধারাপু কি হয়েছে? একটু পর পর মৃ’গী রোগীর মতো কেঁপে কেঁপে হাসছো কেনো?”
“লটারি পেয়েছি”
“কত টাকার?”
“অমূল্য লটারি”

এশা বুঝলো না কিছু। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বললো, “এই মহিলার মাথা গেছে”

ধারার প্রসন্নতা নজর এড়ালো না। এই মেয়ের ভরসা নেই। কখন ধুপধাপ কাহিনী ফাস করে দিবে ঠিক নেই। তাই কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো অনল। সিদ্ধান্ত আপোশের।

খাবার পর প্রসন্নচিত্তে রুমে ঢুকতেই অনলের মুখোমুখি হলো ধারা। তীর্যক চাহনী, নির্বিকার মুখশ্রীটাকে উপেক্ষা করেই ধারা ঢুকে পড়লো ঘরে। তখন ই অনল ই তাকে ডেকে উঠলো। ধারা আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবে?”

চরম ইতস্ততা লক্ষ্য করা গেলো অনলের মাঝে। কিভাবে কথাটা বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু বলতে তো হবেই, কোনো মতে গড়গড় করে বললো,
“আজ সন্ধ্যায় যা হয়েছে সেটা যেনো এই ঘরের বাহিরে না যায়”
“কোন কথাটা? তুমি ভুতে ভয় পাও?”
“ভয় পাই না, একটু ঘাবড়ে গেছিলাম”

খানিকটা প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলো অনল। ধারা ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো। তারপর বিস্তর ভাব দিয়ে বললো,
“আমার বয়েই গেছে তোমার আদেশ মানতে! প্রিন্স উইলিয়াম বলি বলে মনে করো না সত্যি সত্যি তুমি প্রিন্স উইলিয়াম। আমি আমার মর্জির মালিক।”

বলেই চলে যেতে নিলে চট করে তার হাতটি টেনে ধরলো অনল। হ্যাচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলো। আকস্মিক কাজে খানিকটা চমকে উঠলো ধারা। তাদের মধ্যকার দূরত্ব বেশি না, অনলের উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে ধারার মুখশ্রীতে। সুগভীর চাহনী ধারার চোখের মাঝে আবদ্ধ আর তার শক্ত বাহুর বেষ্টনীতে ধারা আবদ্ধ। এক মাদক গন্ধ নাকে এলো ধারার। গন্ধটি কি অনলের স্বতন্ত্র! জানা নেই। অনলের এমন কাজে ক্ষণিকের জন্য হলো ঈষৎ কেঁপে উঠলো ধারা। ভীষণ লজ্জা ভর করলো সমস্ত শরীরে। আত্মবিশ্বাসগুলো উবে গেলো। কিছু বলার আগেই অনল বললো,
“এক মাঘে শীত যায় না, প্রথম বার রিকুয়েষ্ট করছি। ভাব দেখাস না। ঘুরে ফিরে এই ঘরেই থাকবি তুই”

তারপর বাঁকা হেসে ছেড়ে দিলো সে ধারাকে। আবারো কুপোকাত হলো ধারা। তীব্র অপমান, লজ্জা, ক্রোধের সংমিশ্রণে গা জ্বলে উঠলো। ঝাঝালো স্বরে বললো,
“ভয় দেখাচ্ছো, আমি ভয় পাই না”
“আচ্ছা যা, যদি তুই ঘটনাটা চেপে যাস আমি তোর যেকোনো তিনটে ইচ্ছে পূরণ করবো। যেকোনো তিনটে। যা বলবি তাই”

ধারা সন্দিহান নজরে চাইলো তার দিকে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না দাম্ভিক প্রিন্স উইলিয়াম তার সাথে আপোশ করতে চাচ্ছে। ধারা কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
“বেশ, চারটে। এর মধ্যে একটি আজ থেকে আমি ঘুমানোত সময় লাইট অফ থাকবে। আর বাকিগুলো ভেবে দেখবো”
“বেশ রাজী আমি। কিন্তু এশা, আশা যেনো ঘুণাক্ষরেও সন্ধ্যের ঘটনা না জানে”
“বেশ। আর কিছু?”
“না”

আপোশ করে নিলেও ধারা বেশ চিন্তিত, ঠ’কে গেলো না তো! চারটে ইচ্ছের তো একটি ই শেষ। আর তিনটে কি এমন চাওয়া যায় যাতে এই প্রিন্স উইলিয়ামের অ’রা’জ’ক’তা’ থেকে মুক্তি পাবে সে। অন্যদিকে ধারার দিকে সুগভীর নয়নে তাকিয়ে স্মিত হাসে অনল। এতো ছেলেমানুষ কেনো মেয়েটা! হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর কখনো পাবে না সে_________

*****

ধারার ঘুম ভাঙ্গলো বেশ সকালে, উষ্ণ কোমল প্রভা পর্দা ভেদ করে চুপি চুপি তখন রুমে প্রবেশ করছে। মৃদু নরম সোনালী রোদ। চোখ কচলে উঠে বসলো ধারা। কোলবালিশের দেওয়ালের ওপাশের জায়গাটা শীতল। অনল নেই, খানিকটা অবাক হলো কিন্তু গা মাখালো না। আজকাল তার মনটা ফুরফুরে। অনলের ঘরে থাকলেও খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না। এখন আর সে কাজের বাহানায় লাইট জ্বালিয়ে উত্যোক্ত করে না ধারাকে। ফলে নির্বিঘ্নে ঘুমায় ধারা। ক্লাসেও মোটামুটি ভালোই চলছে। মাহিটাও সেদিনের পর চিঠি দেবার জিদ করে নি। গা টানা দিয়ে উঠলো ধারা৷ আজ তাড়াতাড়ি যাবে ভার্সিটিতে। নাস্তাটাও করবে ক্যাফেটেরিয়াতে। আজ একটা বিশেষ দিন। তাই লেট করা যাবে না। ঝটপট তৈরি হলো সে। মুখ ধুয়ে বই খাতা গুছিয়ে নিলো। সাদা একটা জামা পড়ে নিলো, চুল গুলো একপাশে নিয়ে বেনুনী বাধলো। ঠোঁটে দিলো মিস্টি রঙ্গের লিপস্টিক। বেশ ভালো করে সেজেগুজেই বের হচ্ছিলো। তখন ই বাধলো বিপদ। জামাল সাহেব বসার ঘরে চা খাচ্ছিলেন। ধারাকে বের হতে দেখেই উনি নতুন ফরমান জারি করলেন,
“আজ থেকে তোমারে কলেজে অনল দিয়ে আসবে। ওই তোমারে নিয়ে আসবে”

অনল তখন নাস্তা করতে ব্যাস্ত৷ নানাভাই এর এমন অযৌক্তিক ফরমানের কোনো প্রতিবাদ সে করলো না। কিন্তু ধারা বলে উঠলো,
“কেনো? আমি তো একাই যেতে পারি”
“তাতে কি ধারারানী! যাইবা তো একই জায়গায়। তোমার স্বামীও তোমার দায়িত্ব নিক। যাতে তোমার বাপ আমার উপর আঙ্গুল না তুলতে পারে”

নানাভাই এর যুক্তির কাছে কোনো যুক্তি দেখাতে পারলো না ধারা। সুভাসিনী ও হেসে বললো,
“একদম ঠিক বাবা, আমার কি টেনসন হয় বলবেন না। মেয়ে মানুষ একা একা যাতায়াত করে। দিনকাল তো ভালো না। আর ছেলেরা যা পা’জি। আমার ধারাও তো কম সুন্দরী না। যদি উঠিয়ে নিয়ে যায়”
“মানুষের বুদ্ধির এতো আকাল পড়ে নি, যে ধারাকে তুলে নিয়ে যাবে। জানের মায়া সবার থাকে”

মিনমিনিয়ে কথাটা বলেই উঠে গেলো অনল। ধীরে বললেও কথাটা ঠিক কানে গেলো ধারার। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে যদি কাউকে ভস্ম করা যেনো তবে আজ অনলকে করতো সে। নানাভাইকে যুক্তি দেখাতে যেও পারলো না। বৃদ্ধ মানুষটির কাছে যেনো সব কিছুর উত্তর আছে। তাই বাধ্য হয়েই অনলের সাথে যেতে হবে তাকে। বের হতেই দেখলো প্রিন্স উইলিয়াম তার যানে উঠে বসে আসেন। ব্যস্ত গলায় বললো,
“আসুন, মহারাণী। এই দা’সকে কৃতার্থ করুন”

মনে মনে হাজার গালমন্দ করলেও নুখে প্রকাশ করলো না। উঠে বসলো অনলের বাইকে। পিচের রাস্তা চুরে চললো অনলের বাইকটি।

ভার্সিটির গেট থেকে বেশ দূরত্বে আসতেই ধারা ব্যাস্ত কন্ঠে বললো,
“এখানে রাখো, আর যেও না”
“কেনো?”
“আমি চাই না, তোমার সাথে আমাকে কেউ দেখুক। হট টপিক হয়ে যাবো”

অনল বাইক থামাতেই নেমে পড়লো ধারা। অনল কিছু বলার আগেই ছুটলো সে। অনল চেয়ে রইলো ধারার যাবার পানে। আশপাশ নিবিড় পর্যবেক্ষণের পর ভার্সিটিতে প্রবেশ করলো ধারা। তার বন্ধুমহল বা ক্লাসের কাউকেই নিজরে পড়ে নি। কিন্তু ওই যে কথায় আছে, “যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়”। দীর্ঘ প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাসের দিকেই পা বাড়াতেই মুখোমুখি হলো দিগন্তের। তীর্যক নয়নে সে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি তার বন্ধুদের একজন। ধারা কিছু বলার পূর্বেই সে শান্ত স্বরে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“অনল স্যারের সাথে তোর কি সম্পর্ক?”……….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৪

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৪র্থ_পর্ব

কিন্তু এই খুশি টেকসই হলো না। যখন একটা মৃদু স্বর কানে এলো,
“উপস, ভুল সময়ে চলে এলাম নাকি?”

ধারার প্রশান্তির ঢেউ তিক্ত বিষাদে পরিণত হলো। যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেইটাই হলো, অবশেষে মানুষটির মুখোমুখি হতেই হলো। অনল দরজার দিকে তাকাতে দেখলো তার প্রিয় বন্ধু প্লাবণ দাঁড়িয়ে আছে। প্লাবণকে দেখামাত্র নিজের পরিস্থিতির জ্ঞান হলো তার। সাথে সাথে ধারার হাত থেকে নিজের কলার ছাড়িয়ে নিলো। নিজের শার্ট ঠিক করতে করতে বললো বিব্রত কন্ঠে বললো,
“আরে আয় আয়, আসলে…”

অনলের কিছু বলার পূর্বেই প্লাবণ তার ভুবন ভোলানো হাসি হাসলো৷ তারপর ধারাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন আছো, জলধারা?”

ধারা এক কোনায় শিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুভূতি গুলো বেসামাল হয়ে উঠেছে৷ হৃদমাঝারে কালবৈশাখী ঝড় হচ্ছে। ধারা এই আশঙ্কাটাই করছিলো। এই কিশোরী আবেগের মুখোমুখি হবার ভয়। প্রচন্ড বিষাদের অনুভূতি হচ্ছে। অনুভূতিগুলো অব্যক্ত। সব যেনো তিক্ত দুঃস্বপ্নের ন্যায় লাগছে। হয়তো ঘুম ভাঙ্গলেই দেখবে, সব আগের মতো নির্মল, প্রশান্ত। কিন্তু সে তো হবার ছিলো না। ধারার মুখে কথা নেই সে শুধু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্লাবণের হাস্যজ্জ্বল মুখের পানে। প্রচন্ড আবেগ তার ভেতরটাকে তছনছ করে দিচ্ছে। সে জানতো মানুষটির মুখোমুখি হলে প্রচন্ড কষ্ট হবে। কিন্তু কষ্টের মাত্রাটা জানা ছিলো না। বর্তমানে এই মাত্রার খোঁজ মিললো তার। ধারাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্লাবণ পুনরায় প্রশ্ন করলো, তখন কোনো মনে নিজেকে সামলে জড়ানো গলায় উত্তর দিলো,
“ভালো”

ধারার আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে হলো না। সে পালাতে পারলে যেনো বাঁচে। কোনো মতে বললো,
“তোমরা কথা বলো আমি আসছি”

কোনো মতে যেনো ছুটে পালালো সে। ধারার এরুপ জড়তা নজর এড়ালো না অনলের। আড়চোখে নিপুনভাবে লক্ষ্য করলো সে ধারাকে। ধারা চলে গেছে প্লাবণ অনলের মুখোমুখি বসলো। সেও এই ভার্সিটির ই শিক্ষক৷ তবে তার স্থায়ীকাল অনলের থেকে বেশি। অনল বললো,
“ট্যাং খাবি?”
“খাওয়াই যায়, যা গরম”
“আচ্ছা”

মিনিট দশেকের মাঝে হাসেম মামা দুগ্লাস বরফ দেওয়া ট্যাং দিয়ে এলেন। একটা অনল নিজে নিলো, অন্যটি প্লাবণ। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে প্লাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“তোকে ফোন করেছিলাম, দুদিন মোটে ফোন ধরলি না। আফিয়া আপুর বিয়েতে এতো ব্যস্ত হয়ে পরেছিলি নাকি?”
“আসলে, বিয়ের কাজে ব্যাস্ত ছিলাম”
“তাই বলে এতো, ভাবটা এমন যেনো নিজের বিয়ে ছিলো”
“হ্যা নিজের ই বিয়ের কাজে ব্যস্ত ছিলাম”

কথাটা শোনামাত্র বিষম খায় প্লাবণ। কাশতে কাশতে নাকে মুখে উঠে যায় তার ট্যাং। অনল একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়। নিজেকে সামলে হতবাক কন্ঠে অনলকে জিজ্ঞেস করে,
“সত্যি?”

অনল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এক চুমুকে ট্যাংটুকু শেষ করে। তারপর বিবাহবিভ্রাটের সম্পূর্ণ কাহিনী খুলে বলে প্লাবণকে। প্লাবণের মুখ স্তম্ভিত। অবশেষে কি না অনল বিয়ে করলো!

ভার্সিটির পিচঢালা রাস্তার পাশ দিয়ে হাটছে ধারা। বড্ড এলোমেলো পায়ে হাটছে। মৃদুমন্দা বাতাসে তার এলোকেশ অবাধ্য হয়ে উড়ছে। দক্ষিণ আকাশে মেঘের আনাগোনা। স্বর্ণালী তেজী সূর্যটাও মেঘের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে। কৃষ্ণাচূড়া গাছটির নিচে দাঁড়াতে থেমে গেলো ধারা। উদাস নয়নে তাকালো নীলাম্বরের পানে। তার মনমন্দিরেও আজ মেঘমেদুর জমেছে। এখনি হয়তো ঝুমঝুম করে বৃষ্টি হবে। ভেসে যাবে সব তিক্ততা, ভেসে যাবে সব আবেগ। মাঝে জড় বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকবে ধারা। অতীতের পৃষ্ঠা উল্টাতে ইচ্ছে করলো তার। সেই সুখমিশ্রিত অতীত। যেখানে তার প্রথম সাক্ষাত হয়েছিলো প্লাবণের সাথে। প্লাবণ যখন প্রথম তাদের বাড়ি অনলের সাথে এসেছিলো তখন ধারা মাত্র ক্লাস সেভেন এ পড়ে। লম্বা অনলের সমান, ফর্সা মুখশ্রী, খাড়া নাক, সুগভীর উদাসীন নয়ন আর মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল। বেশ নায়ক নায়ক দেখতে পুরুষটি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করেছিলো,
“নাম কি তোমার?”
“ধারা”
“জলধারা?”

সেখান থেকে ধারার নাম হলো জলধারা। কি চমৎকার আচারণ। ধারা মুগ্ধ হয়ে দেখলো মানুষটিকে। প্রতিদিন একটা দুটাকা দামের ইকলিয়ারস নিতে আসতো। ধারাকে দেখলেই চুলগুলো এলোমেলো করে হাতে ধরিয়ে দিতো। এই স্নিগ্ধ স্মৃতিগুলো কিশোরী আবেগ হয়ে কখন যে মনের জমিনে বীজ রুপে রোপিত হবে, কে জানতো! এই ভার্সিটির লেকচারার প্লাবণ কথাটি জানার সাথে সাথেই ধারার জিদ হলো এই ভার্সিটির ছাত্রী হবে। তারপর সিনেমার মতো একটা সময় প্রেমপত্র পাঠাবে প্লাবণকে। কিন্তু সবই এখন স্বপ্ন। নানাভাই এর জিদের কাছে কিশোরী আবেগ ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো৷ আবেগের সেই রঙ্গিন ফুলটাও আজ ঝড়তে বসেছে। ধারা ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো সন্তপর্ণে। এই কিশোরী আবেগখানা তুলে রাখবে সে সংগোপনে। ধারা খেয়াল করলো বৃষ্টি নামছে, দুয়েক ফোটা করে করে অঝর ধারায় নামলো বৃষ্টি। ভালোই হলো, চোখের জোয়ারটা বৃষ্টির দাপটে ঢাকা পড়ে গেলো অবশেষে_________

অনলের বর্ণনা শোনার পর নিজের হাসি আর থামাতে পারলো না প্লাবণ। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সে। অনল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। প্লাবণের হাসি তাকে বিরক্ত করছে। বন্ধুর দূর্দিনে কেউ এভাবে হাসে? এজন্য ই হয়তো বলে “কারোর পৌষমাস, কারোর স’র্ব’না’শ”। বিরক্তির স্বরে বললো,
“হাসি থামা, হলুদ দাঁত দেখতে ভালো লাগছে না”

প্লাবণ কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললো,
“চটিস না, তবে বলতেই হবে দাদাকে হ্যাটস অফ। নয়তো আমাদের নারী বি’দ্বে’ষী অনল কি না বিয়ে করে। তাও জলধারাকে? ভাবা যায়”
“আমি মোটেই নারী বি’দ্বে’ষী নই। এগুলো তোদের বিকৃত মস্তিষ্কের রটনা”
“ও তাই না! তাহলে অনল সাহেব বলুন তো, এতো সুন্দর সুন্দর নারীদের কোমল প্রেমপত্রগুলো আপনার ডাইরিতে স্থান না পেয়ে কেনো ডাস্টবিনে স্থান পায়?”
“এই ঘটনাকে নারী বি’দ্বে’ষী রুপে ব্যাখা না করে অন্য ভাবেও তো ব্যাখ্যা করা যায়। এই ধর, যে নারীদের প্রেমপত্র আমি পাই তাদের আমার মনে ধরে না; আর যাকে মনে ধরেছে তার প্রেমপত্র এখনো পাই নি”

প্লাবণ কিছুসময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে অনলের মুখপানে। অনলের বিরক্ত বাড়ে। কাছের বন্ধুটি অতি বিরক্তিকর। প্লাবণ আবারো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে বলে,
“আর কত শক দিবি ভাই। এক দিনে দুইটা ব্রেকিং নিউজ। অনলের বিয়ে আবার অনলের কোনো নারীকে মনে ধরেছে। তা বলি রোমিও তোর বিয়ে হয়ে গেছে। এখন মনে ধরেও লাভ নেই”
“ধ্যাত, অফ যা তো। তোদের মতো মানুষের জন্যই রোম পুড়েছিলো বুঝলি!”
“নাহ! আমাদের জন্য না, তোমার মতো এক রোমিও এর জন্য পুড়েছিলো। আমরা তো শুধু দর্শক। আচ্ছা মজা বাদ দে! এই বিয়েটাকে নিয়ে কিছু ভেবেছিস? কিভাবে কি করবি?”

এবার চুপ করে গেলো অনল। থমথমে হয়ে গেলো মুখ। গাম্ভীর্য ছেয়ে এলো মুখে। রাশভারি কন্ঠে বললো,
“এটা তো আমারো চিন্তা। আসলে ধারাটা যে বড্ড ছেলেমানুষ, শুধু তাই নয় বড্ড জেদি, সেন্সিটিভ। ওর স্বভাবটা খুব ভাবাচ্ছে বুঝলি। আমাদের মধ্যে কোনো কালেই সখ্যতা ছিলো না। আমি বাম বললে তাকে ডান বলতেই হবে। আর ফুপি মারা যাবার পর থেকে মা-বাবা, দাদাজান তাকে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মতো রেখেছে। ও কি মানিয়ে নিতে পারবে আমার সাথে! আমি কি পারবো ওর মনের মতো হতে। প্রচন্ড ভাবাচ্ছে। আর গরম তেলে পানি ঢালার মানুষ আমার শ্বশুর তথা ফুপা তো আসেন নি। উনি দেশে আসলে তৃতীয় মহাযু’দ্ধ বাধবে। ভালো লাগে না।”

প্লাবণ ম্লান হাসলো। অনলের মাঝে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করলো সে। নিপুনভাবে দেখে নিলো বন্ধুর মনটি। কিছুসময় চুপ করে থেকে বললো,
“এতো ভাবিস না, সম্পর্কগুলো গণিতের কোনো ইকুয়েশন নয়। এতো ভেবে চিন্তে কিছুই হয় না। সময়ের উপর ছেড়ে দে। সময় ঠিক বলে দেবে কি করা উচিত। আর অন্য নারীতে মনোনিবেশ না করে বউ এর উপর নজর দাও। আসলাম”

অনল হেসে দিলো। বউ, হ্যা বউ ই তো। রাগী, জিদি, এক ঘুয়ে রনচন্ডী বউ, তার ধারা________

ধারা বাসায় পৌছালো একেবারে কাকভেজা রুপে। ছাতার অভাবে ভিজতে হলো বিনা নোটিশের বর্ষায়। বাসায় ঢুকতেই বড় মার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো তাকে,
“ভিজলি কিভাবে? ছাতা নিস নি? আর সকালে খেয়ে যাস নি কেনো? হুড়মুড়িয়ে চলে গেলি? খেয়েছিস কিছু?”
“না”
“যা, কাপড় বদলে আয়। খাবার দিচ্ছি খেয়ে নে”

বিষন্ন মনটার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই মাথা দুলিয়ে রওনা দিলো নিজ ঘরের পানে। ঘরের দরজা খুলতেই মাথার উপর আরো এক দফা বাজ পড়লো। তার ঘর তো ঘর নয় আস্তো গোয়াল ঘর। সব জিনিস এদিক অদিক অবহেলায় পড়ে রয়েছে। আর খাটের উপর ছোটমামার জমজ দু কন্যে এশা এবং আশা একে অপরের চুল টানছে। ঠিক কি কারণে তাদের ঝগড়া চলছে জানা নেই। একেই মন খারাপের স্তুপ, উপরে এমন অসহনীয় অবস্থা ঘরের। ধারার মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো। তেড়ে যেয়ে দুটোকে দুটো গাট্টা মেরে দিলো। কড়া কন্ঠে বললো,
“এটা কি মাছের বাজার? তোরা কি মানুষ হবি না?”
“ধারাপু আমার দোষ নেই। এই আশাটাই আমার ক্লিপ নিয়েছে”
“এটা তোর না, ধারাপুর ক্লিপ। আর খাটের এপাশ আমার”

ধারা মেজাজ আরোও তিরিক্ষি হলো৷ তীব্র স্বরে বললো,
“এই চুপ, বের হ আমার ঘর থেকে। এখন ই বের হবি”

জমজ বি’চ্ছু দুটো তাদের আঠাশটি দাঁত বের করে বললো,
“তা হচ্ছে না, দাদাজান এই ঘর আমাদের দিয়েছেন। বলেছেন এই ঘরে এখন আমরা থাকবো”

ধারার বুঝতে বাকি রইলো না এই বিনা নোটিশে ছোটমামার আগমণের কারণ। হয়তো সকালে নিজ ঘর থেকে বের হতে দেখে ফেলেছিলেন নানাভাই। তাই দাবার ঘোড়ার চাল চেলেছেন। ছোটমামা এবং পরিবারকে নিয়ে এসেছেন। আর ধারার ঘর সপে দিয়েছেন নিজের একান্ত সেনাপতি জমজদের হাতে। উফ! দাদা, নাতি দুটোই একই রকম। হাড় জ্বা’লি’য়ে দিলো একেবারে। নানাভাইকে ভালোবাসে বলে এই অত্যাচারগুলো মুখ বুজে মেনে নিতে হচ্ছে ধারা। আর নয়, এর বিহিত চাই ই চাই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছুটলো সে নানাভাই এর ঘরে

বিছানায় হেলান দিয়ে জামাল সাহেব আপন মনে শ্রীকান্ত বই টি পড়ছেন। বয়স হলেও বই তার খুব ই ভালো লাগে। শরৎচন্দ্রের এক একটা লেখা তার খুব ই পছন্দ। অসুস্থতা তো আছেই, কিন্তু মনকে সতেজ রাখাটা জরুরি। জীবন তো ক্ষণস্থায়ী। আজ নয়তো কাল, পরকালে তো যেতেই হবে। তাই নিজেকে আটকে রাখেন না তিনি। বই পড়েন, কবিতা লিখেন। ব্যস্ত যুবক বয়সে যা করেন নি, সেগুলোই করেন। এমন সময় আগমণ ঘটলো তার ছোট ছেলে ইলিয়াসের। তার কপালে চিন্তার সূক্ষ্ণ রেখা। মোটা ফ্রেমের চশমা নামিয়ে সেলিম সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু কইবা আব্বা?”
“আব্বা, বিপদ হয়ে গেছে”
“কি হইছে?”
“সেলিম ভাই ধারা আর অনলের বিয়ে সম্পর্কে জেনে গেছে। আমাকে ফোন করেছিলো। খুব চেতে আছেন উনি। বিশ্রী গা’লি’গা’লা’জ ও করেছেন”

শান্ত মুখটা চট করেই শক্ত হয়ে উঠলো জামাল সাহেবের। বুকের মধ্যখানে একটা তীব্র ব্যাথা অনুভূত হলো। কিন্তু ইলিয়াসকে বুঝতে দিলেন না। তীব্র স্বরে বললো,
“ওই খা***** পুতের সাহস কি করে হয় ফোন দেওয়ার। ওর লজ্জা করে না”
“আব্বা, উত্তেজিত হবেন না। সেলিম ভাই চাইলেই তো হবে না। আমরা তো আছি”
“ও আসুক, আমিও দেখাম ওই বে’য়া’দ’ব কি করে? আমার মাইয়াডারে মাই’রে শান্ত হয় নাই! এখন নাতীনডারে মা’র’তে চায়। ফাজিল পোলা”
“আব্বা, শান্ত হন। উনি এই মাসের শেষে আসবে। চিন্তা করবেন না, অনল ধারাকে সামলে নিবে। আপনি অসুস্থ। আপনি উত্তেজিত হবেন না”

জামাল সাহেব আরোও তীব্র হুংকার ছাড়লেন। ইচ্ছে মতো গালমন্দ করলেন সেলিম সাহবকে। কিন্তু কথাগুলো ধারার কানঅবধি পৌছালো না। বাবা আসবে কথাটাই তার জন্য যথেষ্ট ছিলো। এলোমেলো পায়ে রওনা দিলো অনলের রুমে। বা’ঘে’র ডে’রাতেই প্রবেশ করলো সে। গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। অনুভূতিগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। প্রচন্ড কান্না। ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো টের টিও পেলো না। এই ঘুমটি দীর্ঘকালের হলে হয়তো ভালো হয়তো, চিরকালের হলে হয়তো ধারা মুক্তি পেতো________

অনল বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে। কাজ শেষ করে, আড্ডা দিতে দিতে কখন বিকেল ফুরিয়ে গেছে টেরটি পায় নি। জ্যামও ছিলো হালকা, ব্যস্ত দিনের নিস্পত্তির পর সবাই বাড়ি ফিরতে ব্যাস্ত। তাই যানজট তো হবেই। অনল বাড়িতে ঢুকতেই ছোট মামার দেখা পেলো। নিস্প্রভ কন্ঠে সালাম দিয়েই রুমে গেলো সে। বড্ড ক্লান্ত শরীর। এতো দিন পর টানা কথা বলেছে সে। গলাও ব্যাথা করছে। নীরব, নিস্তব্ধ আঁধারে নিমজ্জিত ঘরে প্রবেশ করতেই প্রশান্তির স্নিগ্ধ ঢেউ বয়ে এলো অনলের হৃদয়ে। কি শান্ত, পরিবেশ! অনল লাইট না জ্বালিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। ঘড়ি, মানিব্যাগ সব রাখলো সেখানে। তারপর আয়নার দিকে তাকাতেই দেখলো একটা কালো অবয়বের প্রতিবিম্ব। প্রতিবিম্ব টি ঠিক তার পেছনে। অগোছালো চুল মুখের সামনে লেপ্টে আছে, উদ্ভ্রান্ত শান্ত দৃষ্টি। জামাকাপড় এলোমেলো। ক্লান্ত মস্তিষ্ক মূহুর্তেই জমে গেলো। বুকটা কেঁপে উঠলো অনলের। তার ঘরে কারোর উপস্থিতি হতে পারে কথাটা যেনো মাথায় ই ছিলো না। প্রচন্ড ভয় তাকে ঘিরে ধরলো। কপালে ঘাম জমতে লাগলো। ভয়মিশ্রিত চোখে পেছনে ফিরতেই মনে হলো অবয়বটি তার কাছে আসছে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে বসে পড়লো সে। জোড়ানো স্বরে চেঁচালো,
“ভু…..ত, ভু…ত”

সাথে সাথেই অবয়বটি লাইট জ্বালাতো। এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরাতে সরাতে নিদারুণ অসহায় কন্ঠে বললো,
“অনল ভাই, ভুত না। আমি ধারা”…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০৩

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#৩য়_পর্ব

নতুন স্যার প্রসন্ন চিত্তে বললেন,
“গুড মর্নিং”

কিন্তু গুড মর্নিংটি ধারার চিন্তার জোয়ারে আঘাত হানলো। বাস্তবে ফিরতেই দারুণ বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরলো। যথারীতি তার মাথায় বজ্রপাত হলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো সামনের মানুষটির দিকে। অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে অজান্তেই বের হলো,
“অনল ভাই”

ধারার মস্তিষ্ক অকেজো লাগছে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরিহিত ফিটফাট ব্যাক্তিটি হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাদামাটা মুখশ্রীতে স্মিত হাসি। হাতে মার্কার। মোটা ক্যালকুলাসের বই টি খুলে অংক তুলতে লাগলো। এদিকে ধারার মস্তিষ্ক শূন্য, তার স্নায়ুকোষে রেষারেষি চলছে। অনল নামক ব্যাক্তিটি এখানে! শুধু এখানে নয় সে তার কোর্স টিচার। ব্যাপারখানা ভাবতেই মাথাটা ঘুরে উঠলো। অজস্র চিন্তা মস্তিষ্ক হানা দিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল। ধারার মনে হলো সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। অনল তার বহুদিনের প্রাইভেট চাকরিটি ছেড়ে একটা নতুন চাকরি নিয়েছে; ব্যাপারটা ধারার অবগত ছিলো। কারণ যেদিন অনলের চাকরির এপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছিলো সে পুরো পরিবারকে জম্পেশ বিরিয়ানি খাইয়েছিলো। মহা আনন্দিত অনলকে সেদিন স্বাভাবিক মানুষের ন্যায় হাসতেও দেখেছিলো সে। অবশ্য হবে নাই বা কেনো! বড় মা বলেছিলো, এই চাকরিটি নাকি অনলের স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু এই চাকরি যে শিক্ষকতা এবং তাও তার ভার্সিটির; সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি ধারার। বাড়িতে একই ঘরে লোকটির সাথে থাকাটা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। হাড় মাং’স জ্বা’লি’য়ে দিচ্ছে তথাকথিত প্রিন্স উইলিয়াম। গতরাতের কথাই ধরা যাক, হিংসুটে লোকটি ঘরের লাইট জ্বালিয়ে রেখেছিলো। এদিকে লাইটের তীব্র আলোটা পড়ছিলো সরাসরি ধারার চোখে। ধারা যখন বিনয়ী স্বরে বলেছিলো,
“অনল ভাই, লাইট অফ করো। আমি ঘুমাবো”

অনল তখন ল্যাপটপে কাজ করছিলো। চোখ স্থির রেখেই ঠোঁট বাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসলো সে। যার অর্থ “আসো, এবার খেলা হবে”। অনলের নির্বিকার মুখশ্রীর এই মিছকে হাসিটি ধারার অতিপরিচিত। ধারা বুঝলো সে অসহায়। এই মানুষটি হাতে না মে’রে তাকে ভাতে মা’র’বে। কাজ করতে করতেই অনল ঠেস মারা স্বরে বললো,
“আমি কাজ করছি। আর আমার ঘরের লাইট সারা রাত অন থাকে”

ধারা তীর্যক চাহনীতে তাকিয়ে রইলো নিষ্ঠুর মানুষটির দিকে। প্রচন্ড ক্রোধ তখন ভর করলো সমস্ত শরীরে। ক্রোধের অগ্নিতে যেনো লোমকুপ অবধি জ্বলছিলো। কিন্তু সে নিরুপায়, কারণ এই ঘরটি সত্যি ই অনলের। তার রাজত্ব এখানে। লোকটি এতোটা স্বার্থপর কেনো! প্রশ্নের উত্তরটি সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে খুঁজছে ধারা। গতরাতে ঘুম না হবার আরোও একটি মুখ্যম কারণ এই ক্রোধও। বাড়িতে অশান্তির পর ভেবেছিলো যাক ভার্সিটির কয়েক ঘন্টা জীবন শান্তিময় হবে৷ কিন্তু সেখানেও এই মানুষটির আগমণ৷ অনল মৃদু হেসে পড়াতে ব্যাস্ত, এদিকে ধারার মন পড়াতে নেই। সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনলের দিকে। অনল তাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। যেনো ধারার অস্তিত্ব নেই। এর মাঝেই মাহি ধাক্কা দিলো তাকে। চিন্তার প্রহরে বাধা পড়লো। পাশে ফিরতেই সে ফিসফিস করে বললো,
“অনল ভাই এখানে চাকরি নিয়েছে বলিস নি কেনো? আগে জানলে আমি সেজেগুজে আসতাম”
“হ্যা, প্রিন্স উইলিয়াম আমার অনুমতির জন্য যেনো বসে ছিলো। এতো বড় ধাক্কা খাবো জানলে আজ ক্লাসেই আসতাম না”
“আচ্ছা, তোর সমস্যা কি বলতো? অনল ভাই এর কথা আসলেই তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠিস কেনো?”
“কারণ তোর প্রাণপ্রিয় অনল ভাই এর জন্য আমার জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে। আর তোকেও বলিহারি, আটাশবার প্রেমপত্র দিয়ে ছ্যা’কা খেয়েছিস। তাও কিভাবে ভাই এখনো লেগেই আছিস? আমি হলে তো কচু গাছে গ’লা দ’ড়ি দিতাম অপমানে। ন্যা’ড়া একবার বেলতলায় যায়৷ আমার তো মনে হচ্ছে তুই বেলতলার বাসিন্দা, তাও পারমানেন্ট।”
“ও তুই বুঝবি না। শেক্সপিয়ার বলেছেন ফেইলিউর ইজ দ্যা কি অফ সাক্সসেস”
“তোকে পার্সোনালি বলেছে? আর এটা শেক্সপিয়ার না রবার্ট ব্রুস বলেছে”
“হলো, কেউ তো বলেছে। একবার না পারিলে দেখো শতবার। মাত্র তো উনত্রিশ বার দেখেছি। এখনো শ হতে বহুদেরি”
“উনত্রিশ বার মানে?”

মাহি ধারার প্রত্যুত্তোরে কোনো কথা বললো না। বরং শুভ্র দাঁতগুলো বের করে হাসি মুখে ধারার দিকে তাকালো। যার অর্থ “আজ তুমি আবারো আমার প্রেমকবুতর হবে”। ধারার অস্থির কন্ঠে বললো,
” না, আলবত না”
“প্লিজ”
“পারবো না আমি”
“তপনের সামুচা খাওয়াবো, সাথে তরমুজের ঠান্ডা শরবত”
“না, নো, নেভার, কাভিনেহী”
“প্লিজ দোস্ত, বান্ধবীর জন্য এতোটুকু করতে পারবি না। ভাব, একবার তোর ভাবি হয়ে গেলে জীবন জিঙ্গালালা। প্লিজ, আমি তোর এসাইনমেন্ট ও করে দিবো”

অন্য সময় হলে এসাইনমেন্টের লোভটি হয়তো ধারার নৈতিকতাকে নাড়িয়ে দিতো। চট করে নিয়ে নিতো মাহির চিঠি। শত রিস্ক নিয়ে হয়েও বা’ঘে’র ডে’রায় ফেলে আসতো। এরপর প্রিন্স উইলিয়াম বুঝে বেড়াতো। কিন্তু আজ কেনো যেনো সাহস হচ্ছে না, ইচ্ছেটাও নেই। সাহস না হবার কারণ ধারা এখন অনলের ওই ডে’রাতেই থাকে আর ইচ্ছে না হবার কারণটা ধারার নিজেও জানা নেই। গাল ফুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। অধৈর্য হয়ে বলে,
“দেখ মাহি, আমার সমস্যা চিঠি পৌছে দেওয়ায় না। সমস্যা খ’চ্চ’র মানুষটার ঠেস দেওয়া কথা শোনায়। ও ঠিক আমার সামনে আসবে, খচাৎ করে তোরে চিঠি ছিড়ে ফেলে দিবে। বান্ধবী হয়ে এটা কার দেখতে ভালো লাগে। এর চেয়ে বরং সুদর্শন পুরুষকেই যেহেতু মন দিবি, তাহলে দিগন্ত, অভীক, নীরব এদের দেখ৷ হ্যা হয়তো প্রিন্স উইলিয়াম না কিন্তু মনের দিক থেকে তারাও রাজা সিরাজ-উদ-দৌলা”

মাহির মনটা মিয়ে গেলো খানিকটা। সেই কিশোরী কাল থেকে একজন পুরুষের প্রতি ই সে আকর্ষিত হয়েছে। এটাকে কিশোরী মনের আবেগ বলে নাকি ভালোবাসা তার জানা নেই। তাই তো এতো প্রত্যাখ্যানের পর আবারো চিঠি পাঠাবার সাহস করছে সে। মাহি আবেগী কন্ঠে বললো,
“এভাবে হয় না ধারা, ওরা আমার বন্ধু। কিন্তু অনল ভাই ক্রাস। এই অনুভূতিটা অব্যক্ত। আমি বোঝাতে পারবো না। উনাকে দেখলে আমার সবকিছু কেমন যেনো রঙ্গিন লাগে। উনি আমার সাথে কালেভদ্রে যদি কথা বলে আমার লজ্জায় মিশে যেতে মন চায়। কথাও জড়িয়ে যায়। এই অনুভূতিটাকে বোঝাতে পারবো না। যেদিন তোর এমন টা অনুভূত হবে, সেদিন বুঝবি আমি কেনো বেলতলায় পারমানেন্ট বাসিন্দা”

ধারা চুপ করে গেলো। তর্কে হেরে গেছে সে। কারণ এই অনুভূতিটার পরিচয় সে পেয়েছে। তার মনের আঙ্গিনাতেও সুপ্ত ভালোলাগার বীজ যে সেও বুনে রেখেছে। এই ভয়টা তার ভেতরটাকে বারবার উথাল-পাতাল করে দিচ্ছে। মানুষটার সামনে লেগে কি শক্ত থাকতে পারবে নাকি তীব্র বেদনায় আচ্ছাদিত হবে তার সমস্ত হৃদয়। ভাবতেই পুনরায় মস্তিষ্ক যেনো দূর্বল হয়ে উঠলো। বিষন্নতা গ’লা চে’পে ধরলো। অবুঝ মন বুঝলো মাহির মনোস্থিতি। তাই হাত বাড়ালো চিঠি নেবার জন্য। কিন্তু বিধিবাম, তখন কঠিন কন্ঠ কর্ণপাত হলো,
“যদি ক্লাসে কথা বলতেই আসা হয়, তবে আমার ক্লাসে আসার প্রয়োজন নেই। আমি দুজন নিয়েও ক্লাস করতে রাজি। যদি তারা এটেনটিভ হয়”

কথাটা সে সরাসরি ধারার দিকে তাকিয়েই বললো। ফলে সারাক্লাসের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো ধারা। পেছন বেঞ্চে বসে থাকা অভীক কলম দিয়ে খোঁচালো তাকে। ফলে ধারার স্বম্বিত ফিরলো। সামনে থাকাতেই মুখোমুখি হলো অনলের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির, নির্বিকার শক্ত মুখশ্রীর। তাড়াতাড়ি মাথা নামিয়ে ফেললো। ভেবেছিলো হয়তো এখানেই ক্ষান্ত হবে অনল। কিন্তু না, সে রীতিমতো বললো,
“তুমি, সেকেন্ড কলাম, ফোর্থ রো, সেকেন্ড ওয়ান। দাঁড়াও। এতোক্ষণ যা বুঝিয়েছি বুঝেছো?”

ধারা বুঝলো এটা প্রিন্স উইলিয়ামের অপমান করার ফন্দি। সারা ক্লাসের নজর তার দিকে। ছোটবেলায় ষাট সত্তর জনের ক্লাসে ভু’তের মতো দাঁড়িয়ে থাকাটা ততোটা গুরুতর ছিলো না যতটা না ভার্সিটি মাত্র পয়তাল্লিশ জন মানুষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা। সকলের তীক্ষ্ণ, বিস্মিত দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতি যেনো দ্বিতীয়টি নেই। ধারা কোনো মতে মাথা দুলিয়ে বললো,
“জ্বী”
“তাহলে পরের ইকোয়েশনটি কি হবে?”

অনলের নির্লিপ্ত প্রশ্নের উত্তর নেই ধারার কাছে। কারণ সে তার একটা কথাও শুনে নি, বোঝা তো দূরের কথা। ধারাকে মাথানিচু করে থাকতে দেখে অনল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বা হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপাল ঘষলো। তারপর শান্ত কন্ঠে বললো,
“দেখো, তোমাদের পানিশমেন্ট দেবার বয়স নেই। যথেষ্ট বড় তোমরা, ভার্সিটিতে পড়ো। অনেকে এখানে এন.আইডি. ধারী। সুতরাং তোমাদের বোকাঝকা করা অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার। অন্য স্যাররা কেমন আমি জানি না, তবে আমার ক্লাস মাছের বাজার হবে এটা আমার পছন্দ নয়। এখানে কথা হবে ক্যালকুলাস বিষয়ক। আজ প্রথম দিন তাই কিছু বলবো না। তবে এর পর থেকে কথা বলার ইচ্ছে হলে সোজা বাহিরে চলে যাবে। আমি তোমাদের উপস্থিতির মার্ক কাটবো না। তবে যদি আমি দেখি আমাকে ডিসটার্ব করছো। তবে পরীক্ষায় বসা মুশকিল হয়ে যাবে”

নীরব ক্লাস। সকলের মুখে আতঙ্ক। সুন্দর মানুষের বাক্য এতোটা কঠোর হতে পারে সেটা যেনো অবিশ্বাস্য। এদিকে ধারা এখনো নতমস্তক দাঁড়িয়ে আছে। রাগ, ক্ষোভ, অপমান সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে যেনো একাকার হয়ে গেছে। নোনাজল রুপে চোখে বিদ্রোহ করছে। এখন ই যেনো তারা মুক্তি পাবে। অনল ভাই এমন টা না করলেও পারতেন! সে ইচ্ছে করে এমনটা করেছে, যেনো শোধ তুলতে পারে৷ অনল তাকে বসতে বললে সে বসে যায়। কিন্তু সারাটা ক্লাস নীরব ই থাকে। মাহিও গুটিয়ে যায়। বান্ধবীকে চিঠি দেবার জিদ ছেড়ে দেয়।

ক্লাস শেষে ধারাকে পাওয়া যায় না। নীরব, দিগন্ত, অভীক মাহিকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু মাহি উত্তর দিতে পারে না। ক্লাস শেষ হতেই ধারা হনহন করে বেড়য়ে যায়। তার পিছু নেবার চেষ্টা করলে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অতিপ্রিয় বান্ধবী হবার কারণে ধারার কড়া নজরের অর্থ সে বুঝে যায়। ফলে বন্ধুমহল বিনা ধারায় ক্যাফেটেরিয়ায় যায়।

ক্লাস করে এসে বইটা অবহেলায় টেবিলের উপর রাখে অনল। পঞ্চাশ মিনিট টানা কথা বলার অভ্যাস নেই। বলে টেবিলের উপর রাখা বোতল থেকে এক নিঃশ্বাসে পানি পান করে সে। এক ঘন্টা পর আরো একটা ক্লাস আছে। মাথার উপর ফ্যানটা ঘুরছে তবুও যেনো অসহনীয় উত্তাপে ঝা ঝা করছে শরীর। শার্টের হাতাটা গুটিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয়। তখন পিয়ন হাসেম মামা আসেন। বিনয়ী স্বরে বলে,
“স্যার কি কিছু লাগবে?”
“ঠান্ডা কিছু হবে?”
“ট্যাং দেই?”
“দিন”

হাসেম মামা চলে যাবার পর ডান বাহু চোখের উপর দিয়ে বসে থাকে। একটু শান্তি লাগছে। পরমূহুর্তেই ক্লাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা স্মরণে আসে। ধারার মূর্ছা যাওয়া ভারাক্রান্ত মুখশ্রী ভাসছে। এতোটা কড়া না হলেও হতো। কিন্তু মেয়েটা এতো কথা বলে। প্রথমে দু-তিন বার উপেক্ষা করলেও শেষমেশ ক্রোধ ধরে রাখতে পারলো না। আজ বুঝেছে তার রেজাল্ট কেনো বাজে! ক্লাসে খেয়াল না থাকলে কি রেজাল্ট ভালো হবে! এর মাঝেই সজোরে দরজা খোলার শব্দ আসে। অনল ভাবে হাসেম মামা হয়তো এসেছেন। কিন্তু ভুল, এতো ধারা। রক্তিম চোখে, রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। অনল সোজা হয়ে বসলো। হালকা কেশে, স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কি চাই?”

উত্তরটা পাওয়া হলো না। বরং তড়িৎ বেগে তার নিকট ছুটে এলো ধারা। শার্টের কলার চেপে ধরে তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“প্রশ্নটা আমারো কি চাই? বাড়িতে জ্বা’লি’য়ে শান্তি হচ্ছে না? এখানেও আমাকে জ্বা’লা’তে হবে? শোধ তুলছিলে তাই না? ক্লাসে আমাকে অপমান করে খুব মজা পেয়েছো? শোনো অনলভাই, এক মাঘে শীত যায় না। এখানে আমি তোমার ছাত্রী, কিন্তু বাসায় আমি তোমার বউ। তোমাকে কিভাবে তুর্কীনাচন নাচাই সেটা দেখো। আমার নাম ও ধারা, মনে রেখো”

অনল বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। “বউ” শব্দটি তার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে পৌছাতে সময় নিলো। তার মুখে কোনো কথা নেই। সব কথা যেনো বাস্পায়িত হয়ে গেছে। চোখগুলো বিস্ফোরিত। অপলক দৃষ্টিতে শুধু রুদ্ররুপী ধারাকে দেখছে সে। ধারা বুঝলো না, সে কি ভয় পেয়েছে নাকি অতি শকে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তবে প্রিন্স উইলিয়ামকে এভাবে থামিয়ে দিতে পেরে নিজেকে বাহবা দিতে ইচ্ছে হলো তার। এক প্রশান্তির ঢেউ বয়ে গেলো যেনো। এটাকেই হয়তো আত্মশান্তি বলে। কিন্তু এই খুশি টেকসই হলো না। যখন একটা মৃদু স্বর কানে এলো,
“উপস, ভুল সময়ে চলে এলাম নাকি?”

ধারার প্রশান্তির ঢেউ তিক্ত বিষাদে পরিণত হলো। যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেইটাই হলো……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০২

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#২য়_পর্ব

তন্দ্রা কাটতেই ধাতস্থ হলো, সে ভারী কিছুর উপর শুয়ে আছে। চোখ না খুলেই হাতড়ালো কিছু সময়। কিন্তু বুঝতে পারলো না এটা কি বিছানা নাকি মেঝে। তখন ই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“স্পর্শ করা শেষ হলে হাতটা সরা”

শীতল কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ঘুম পেছনের জানালা দিয়ে পালালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হীম বয়ে গেলো। তড়াক করে চোখ খুললো ধারা। চোখ খুলতেই দেখলো যাকে সে মেঝে ভাবছিলো সেটা ছিলো অনলের বলিষ্ঠ বুক। সে এতোসময় অনলের বুকের উপর ঘুমাচ্ছিলো। মাথা তুলতেই অনলের গভীর কালো নয়নে আটক হলো তার নয়নজোড়া৷ শান্ত অথচ সুগাঢ় দৃষ্টি হৃদয়ের অন্তস্থলে এক অসহ্য অনুভূতি ডানা মিললো৷ কিশোরী হৃদয়ে শিহরণ জাগালো। এই প্রথম কোনো পুরুষের এতোটা সন্নীকটে এসেছে সে। এ যেনো এক না বলা অনুভূতি। কোমল গালজোড়ায় রক্ত জমলো, ধীরে রক্তিম হয়ে উঠলো। অনলের সুগভীর নয়নে তাকিয়ে থাকার সাহস হলো না। তড়িৎ গতিতে সরে পড়লো সে। বিছানায় অপর কোনায় গুটিসুটি মেরে বসলো। দৃষ্টি মেঝেতে নিয়ে গেলো। অনল ও উঠে বসলো। তার মনোস্থিতি ঠাহর করা দুষ্কর। শ্যাম মুখশ্রীটা নির্বিকার বরাবরই। ধারার মনে হয়, মানুষের মুখশ্রী তার মনের দর্পন। এই বাক্যটি খাটে না কেবল অনলের ক্ষেত্রে, কারণ তার মুখশ্রী দেখে মনের ছিটাফোঁটাও বোঝা যায় না। ডান্ত চাহনী, নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা। অবিচল, অনড় অনল। ধারা আড়চোখে একবার চাইলো তার বরটির দিকে। অন্যদিকে তাকিয়ে রয়েছে, বেশ ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। হয়তো এতোটাসময় ধারাকে বুকে নিয়ে রেখেছে বিধায় কষ্ট হয়েছে। কিন্তু একটা ব্যাপার ধারার কিশোরী মনে প্রশ্ন সৃষ্টি করলো, অনল ভাই এর কানজোড়া কেনো রক্তিম দেখাচ্ছে! তার কি কানে ব্যাথা! নাকি আজ বিয়ের দিন ও বড়মা তার কান মুলেছে! প্রশ্নটা মুখ ফসকে বের হতে যেয়েও হলো না। কারণ প্রিন্স উইলিয়ামকে এখন চটানো যাবে না! এর থেকেও কঠিন প্রশ্ন তাকে করতে হবে। সে প্রশ্ন হলো বৃহৎ প্রশ্ন দশ মার্কের। এই এক দু মার্কের প্রশ্ন করার মানেই নেই। অনল মুখ গোল করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। ঈষৎ বিব্রত স্বরে বললো,
“তুই এখানে ঘুমা, আমি বাহিরে যাচ্ছি। ওরা কেউ নেই বাহিরে। এখন বাহিরে গেলে সমস্যা হবে না। সব কয়টা হয়েছে মীর জাফর। আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য দাদাজানের কাছে ঘু’ষ খেয়েছে। ভালো লাগে না। যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই।”

অনল উঠে দাঁড়ালো। সাদা পাঞ্জাবীর হাতাটি কনুই অবধি ঘোটালো। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলগুলো বা হাত দিয়ে টেনে পেছনে নিলো। বিছানার পাশের টেবিলে অবিহেলিত ভাবে রাখা মানিব্যাগ এবং সিগারেটের প্যাকেটটা পকেটে পুরে বাহিরের দিকে পা বাড়াতেই ধারা থমথমে স্বরে বলে উঠলো,
“কেনো বিয়েতে রাজী হলে তুমি অনল ভাই? তুমি না বলেছে এই বিয়ে তুমি করবে না। তাহলে কেনো রাজী হলে?”
“ধারা সারাদিন খুব ক্লান্তি গেছে। আমরা এসব নিয়ে কালকে কথা বলবো। তুই রেস্ট নে”

বেশ শান্ত এবং ধীর কন্ঠে কথাটা বললো অনল। সে মোটেই এখন এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছে না। দাদাজানের ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল এর কাছে পরাজিত হবার পর অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত নিয়ে তার ভাবতে ইচ্ছে হয় নি। সে সত্যি জানে না অদূর ভবিষ্যতে তার এবং ধারার পরিণয়ে প্রণয়ের ছাপ থাকবে কি না। নাকি কেবল প্রহেলিকা হয়েই থেকে যাবে এই বিয়েটুকু। ধারার কিশোরী মনটি যে এখনো অবুঝ। অনলের উত্তরটি ধারাকে শান্ত করার বদলে আরোও অস্থির করে তুললো। ভেতরের জমায়িত অভিমানগুলো ক্রোধের রুপ নিলো। চুপ করে সহ্য করা সম্ভব হলো না। বিদ্রোহ করে উঠলো কিশোরী ধারা। অভিমানী স্বরে বললো,
“কাল কেনো! আমার আজ ই বিহিত চাই। নানাভাই এর সামনে তো খুব বলছিলে আমার মতো স্টু’পি’ড মেয়ের জন্য জীবন জ্বলাঞ্জলি দিতে পারবে না। সেই সিদ্ধান্তের কি হলো! নাকি বিয়ের পর মত বদলে নিয়েছো? এক দিনেই মন বদলে গেলো নাকি। আমি এই বিয়ে মানি না, পারবো না আমি এই অযাচিত সম্পর্ক বয়ে নিতে। অনল ভাই আমার ও ইচ্ছে আছে, পছন্দ আছে। নানাভাই বৃদ্ধ মানুষ সে না হয় বুঝে নি। কিন্তু তুমি! তুমি কি করে পারলে? আমার জীবনটাকে নিয়ে জু’য়াখে’লা খেলতে একবারও বিবেকে বাধলো না। তুমি নাকি অতিশিক্ষিত মানুষ! তোমার মতো বিচক্ষণ মানুষ আর হয় না! কি হলো সে সবের? কেনো এমনটা করলে তুমি! নাকি আমার সাথে শোধ তুলতে করলে এমনটা! তোমাকে বিরক্ত করার শোধ! আমি উত্তর চাই অনল ভাই! উত্তর দেও। এখন দিবে, আজ ই দিবে”

অনল এতোসময় হাতমুষ্টিবদ্ধ করে শুনছিলো। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তার। সারাদিনের ধকলে শরীর এবং মন উভয় ই ক্লান্ত। তার মাঝে এই তীক্ষ্ণ প্রশ্নগুলো যেনো শান্ত মস্তিষ্কে আগুন ধরিয়ে দিলো। শান্ত অনল অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো। পেছনে ঘুরেই ঝুকে দাঁড়ালো ধারার দিকে। ধারার চোখে চোখ রাখলো। অনলের এমন কাজে খানিকটা ভড়কালো ধারা। ঈষৎ কেঁপে উঠলো সে। অনলের জ্বলন্ত চোখজোড়ার তাকাতেই গলাটা শুকিয়ে গেলো ধারার। কিন্তু সেদিকে অনলের ভ্রুক্ষেপ হলো না। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“তোর কি মনে হয়, আমি তোকে ভালোবাসি? আমার বুকের মধ্যখানে তোর জন্য অনুভূতিরা জোয়ার আনে? আমার বদ্ধ মস্তিষ্কে তোর নামের সুপ্ত আবেগ আছে! যা প্রতিনিয়ত আমি লালন করি পরম যত্নে! আত্মজেদি, দাম্ভিক মানুষের মাঝে যে র’ক্ত’মাং’সের হৃদযন্ত্রটা তা তোর জন্য স্পন্দিত হয় প্রতিক্ষণ। স্পন্দনগুলো বেসামাল হয়ে যায় তোর জন্য! তোর তাই মনে হয়?”

ধারা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনলের দৃষ্টির দিকে। শান্ত দিঘীর মতো চোখজোড়া জ্বলছে, ছাই ছাপা আগুনের মাঝে জ্বলন্ত সেই কয়লাটির মতো জ্বলছে। ধারা উত্তর দিলো না। তবে এক তীক্ষ্ণ হাহাকার করে উঠলো ভেতরটা। অনল সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ক্রোধ সংবরন করলো বড় বড় শ্বাস ছেড়ে। তারপর শীতল কন্ঠে বললো,
“তোর যেমন হাতপা বাঁধা, আমারো। দাদাজানের শরীর খারাপ। সে অসুস্থতাকে ঢাল বানিয়েছে। আর সত্যি বলতে তোকে সে মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসে। আমি চাই না, তোর জন্য অযথা চিন্তা করতে করতে সে অসুস্থ হোক। আমি চাই না, বেলাশেষে একজন ব্যর্থ নাতীর ট্যাগ মাথায় নিতে। তার কিছু হলে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাবো। আর বাকি রইলো এই বিয়ে। আমি আমার সর্বস্ব দিবো, যেনো তোর কোনো অসুবিধা না হয়। আমার পক্ষ থেকে কখনোই কোনো অসুবিধা হবে না। তুই আমার স্পেস এ প্রবেশ করবি না। আমিও তোর স্পেসে যাবো না। এতোকাল যেমন ছিলাম সেভাবেই থাকবো। এই সম্পর্কটার শেষ বাক্য বলার অধিকার শুধু তোর। কথা দিলাম”

ধারাকে কোনো উত্তর দেবার সুযোগটি দিলো না অনল। হনহন করে বেড়িয়ে গেলো সে। নীরব আঁধারে বসে রইলো ধারা। ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে উঠলো পরিবেশ। নিবিড় নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো ঘরটিতে। ধারা উঠে দাঁড়ালো জানালার কাছে। আকাশ দেখা যাচ্ছে। আজ চাঁদটাও গা ঢাকা দিয়েছে বিক্ষিপ্ত কালো মেঘের আড়ালে। এক হাহাকার বিদ্ধমান। হাহাকারটি কি তার হৃদয়ে নাকি প্রকৃতিতে জানা নেই। তবে চোখ গুলো শান্ত রইলো না। বিষাদসিন্ধু উপচে উঠলো। অনলের কথাগুলো অবিবেচকের মতো ন্যায়। তবুও কেনো যেনো অশান্ত হয়ে উঠলো নিবৃত্ত চিত্ত। মানুষটি সত্যি প্রহেলিকা, যাকে বোঝাই দায় হয়ে উঠেছে তার সাথে সারাটিজীবন কি করে পার করবে ধারা, জানা নেই। কিছুই জানা নেই_______

পরদিন ধারার ফোলা চোখমুখের জন্য হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো সুভাসিনী বেগমের কাছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিতে পারলো না। চুপ করে খাবার টেবিলে বসলো সে। সেখানে অনলের মুখোমুখি হলো। তারও মুখশ্রীতে বিষন্নতার ছাপ পেলো, নির্ঘুম রক্তিম চোখ জোড়া নামিয়ে রাখলো সে। অপরদিকে জামাল সাহেবকে দেখা গেলো অতিপ্রসন্ন। কে বলবে তার চার দিন আগে হার্ট এট্যাক হয়েছিলো। তিনি দিব্যি রুটিতে ভাজি পুরে খাচ্ছেন৷ অবশ্য চিন্তা না থাকলে সবাই ই সুস্থ থাকে। এই দুশ্চিন্তাই সকল রোগের উৎস। নাস্তার টেবিলে সকলে বসলে অনল থমথমে গলায় বলে উঠে,
“আমাদের আজ ঢাকা যেতে হবে। তোমরা জানো আমার নতুন চাকরি। আগামীকাল জয়েন না হলে বিপদ হবে। এই বিয়ের অজুহাতে অহেতুক এক সপ্তাহ পিছিয়েছি। উপরন্তু ধারার ও ক্লাস আছে। এভাবে অফ দিলে ফেল মারবে নিশ্চিত। তাই বিয়ের যেহেতু সব অনুষ্ঠান শেষ তাই আমাদের ঢাকা যাওয়া উচিত”
“বৌভাত ছাড়া বিয়ে হয়? আফিয়ার পরশু বৌভাত। আর তোদেরটাও তাও বাকি”

সুভাসিনী বেগমের কথা শেষ না হতেই অনল বাধ সাধলো। হিনহিনে স্বরে বলে উঠলো,
“আর কতো? ফাজলামির লিমিট থাকা উচিত। দাদাজানের অসুস্থতার কথা ভেবে বিয়ে করেছি বলে তোমরা আমাদের নিয়ে সার্কাস শুরু করবে সেটা তো মানতে পারবো না। প্লিজ এবার রেহাই চাই। এবার ক্ষান্ত হও। প্লিজ। হাত জোর করছি”

অনল কথাটা বলেই হনহন করে ভেতরে চলে যায়। নাস্তার টেবিলে এক অস্থির নীরবতা নেমে আসে। জামাল সাহেব অপরাধী নজরে তাকিয়ে থাকেন নাতোর যাবার পানে। জিদ দেখিয়ে কি ভুল করে ফেললেন! প্রশ্ন উঁকি দিতেই জেদী অন্তরাত্না প্রতিবাদ করলো। যা করেছেন নাতী-নাতনীর খুশির জন্য করেছেন, ওরা এখন না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝবে। অপরদিকে ধারা চিন্তিত হয়ে উঠলো। চিন্তার কারণ ভার্সিটি, বিয়ে খেতে এসে নিজের বিয়ে হয়ে যাবার মতো নাটকীয় ঘটনাটি প্রকাশ পেলে বন্ধুমহলে নিউজ হয়ে যাবে সে। বিশেষ শিরোনাম হবার ভয়টা তাকে প্রচন্ডভাবে নাড়িয়ে দিলো। আরোও একটি ভয় ও মাথাচড়া দিয়ে উঠলো। সাথে সাথে প্রচন্ড তিতকুটে একটা যন্ত্রণা অনুভূত হলো। যন্ত্রণাটির নাম জানা নেই ধারার_______

ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছটা নুয়ে পড়েছে। স্বর্ণালী সকাল, লাল কৃষ্ণচূড়া, নীল অম্বর, মৃদু বাতাস— এ যেনো কবির লেখা কোনো কবিতার পটভূমি। এতো সৌন্দর্যের মাঝেও এক মনরাখাপ বিরাজমান। বিষন্নতা যেনো সৌন্দর্যকে আরোও ভয়ানক সুন্দর করে তোলে। কিন্তু ধারা উপেক্ষা করলো এই সৌন্দর্য্য। ব্যাগটা শক্ত করে ধরে এলোমেলো পায়ে সে হাটছে ক্লাসের দিকে। ঘুমহীন আরোও একটি রাত কাটলো, তাও আবার অনলের ঘরে। যে ঘরটিকে বা’ঘে’র ডেরা মতো মনে হতো সেই ঘরে ঘুম না আসাটাই স্বাভাবিক৷ আরোও একবার নানাভাই এর জন্য ধারাকে অনলের ঘরেই যেতে হলো। একই বিছানায় থেকেও যেনো তাদের মাঝে ছিলো ক্রোশের মতো দূরত্ব। ঘুমহীন রাতটি শেষ হলেই যেনো বাঁচে সে। পূব আকাশে রক্তিম সূর্যটি নিজের অস্তিত্বের জানান দিতেই উঠে পড়লো ধারা। তারপর নিজ ঘরে প্রস্থান করলো। ঘুমন্ত অনল টের পেলো কি না কে জানে। তারপর নয়টা বাজতেই চলে এলো ভার্সিটিতে। নানাভাই এর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না সে। ক্লাসে আসতেই মাহির দেখা মিললো। ধারার ভালো বান্ধবী বিধায় দুজনের মাঝে বেশ সখ্যতাও আছে। মাহি হুট করে প্রশ্ন ছুড়লো,
“কি রে বিয়ের কি অবস্থা?”

প্রশ্নটি শুনেই বেশ চমকে উঠলো ধারা। ওরা কি জেনে গেছে! মাহি তখন বললো,
“আরে আফিয়া আপুর বিয়ে”

ধারা যেনো হাফ ছাড়লো। ছোট একটা “হু” বলেই বসলো বেঞ্চে। ধারার বিষন্নতা ভাবালো খুব মাহিকে। কিন্তু সে ঘাটালো না। উল্টো বললো,
“আজ আমাদের নতুন স্যার আসবে। আবদুল্লাহ স্যার তো কানাডা চলে গেলেন। উনার হাফ কোর্স নতুন লেকচারার পূরণ করবে। মেয়েরা বলছিলো না কি বেশ সুদর্শন। তুই দেখেছিস?”

মাহির কথাগুলো যেনো বাস্পের মতো উড়ে যাচ্ছে। ধারার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নিজের বিবাহবিভ্রাটের সত্যতা নিয়েই চিন্তিত৷ এর মাঝেই দশটা বাজলো। আজকের দিনের মতো ক্লাস শুরু হলো। নতুন স্যারের আগমন ঘটলো। নতুন স্যার প্রসন্ন চিত্তে বললেন,
“গুড মর্নিং”

কিন্তু গুড মর্নিংটি ধারার চিন্তার জোয়ারে আঘাত হানলো। বাস্তবে ফিরতেই দারুণ বিস্ময় তাকে ঘিরে ধরলো। যথারীতি তার মাথায় বজ্রপাত হলো। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো সামনের মানুষটির দিকে। অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে অজান্তেই বের হলো,
“অনল ভাই”…….

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

প্রণয় প্রহেলিকা পর্ব-০১ | গল্প পোকা রোমান্টিক ধারাবাহিক গল্প

0

#প্রণয়_প্রহেলিকা
#সূচনা_পর্ব
মুশফিকা রহমান মৈথি

খালাতো বোনের বিয়ে খেতে এসে আকস্মিকভাবে নিজের বিয়ে হবে যাবে তা কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি ধারা। এখনো যেনো সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সম্মুখে বসে থাকা অতিউৎসাহী মানুষদের দিকে। তাদের মুখে এতোটুকু অনুশোচনা নেই। একটি মেয়েকে জো/র/পূ/র্ব/ক বিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ তাদের আহ্লাদের সীমা নেই। অবশ্য জো/র/পূ/র্ব/ক কথাটি সম্পূর্ণরুপে ভুল। তারা মোটেই ধারাকে জো/র করে নি, করেছে ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল। কথাটা ভাবতেই হৃদয়ের অন্তস্থলে তিতকুটে অনুভূতিটা মাথাচড়া দিলো। এমনটা তো হবার কথা ছিলো না। খালাতো বোন আফিয়ার বিয়েতে বউ যাত্রী হয়ে এসেছিলো সে। অথচ আজ নিজের ই বিয়ে হয়ে গেলো।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চারদিন আগে। বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছিলো, হুট করেই ধারার নানাভাই জামাল আহমেদ বুক চেপে ধরেন। প্রচন্ড ব্যাথায় তার মুখ নীলাভ বর্ণ ধারণ করে। ছটফট শুরু করেন তিনি। অবস্থার অবনতি দেখে ধারার বড় মামা রাজ্জাক আহমেদ তাড়াতাড়ি প্বার্শবর্তী হাসপাতালে তাকে ভর্তি করান। বাড়ির সকলের মুখ থমথমে। শুভ অনুষ্ঠান না কালো প্রহরে পরিণত হয়! করিডোরে থমথমে মুখে বসে ছিলো ধারা। হৃদয়ের ভীষণ প্রিয় নানাভাইকে অসুস্থতা তাকে ভেতর থেকেই দূর্বল করে দিচ্ছিলো। ঘণ্টাখানেক বাদে ডাক্তার বের হন, তিনি জানান,
“উনার অবস্থা এখন মোটামুটি ভালো। ব্যাথা প্রশমিত করতে ঔষধ দিয়েছি। তবে আমার মনে হয় উনার হার্ট এট্যাক হয়েছে। কিছু টেস্ট দিয়েছি, রিপোর্ট আসলে বলতে পারবো”

ডাক্তারের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন রাজ্জাক সাহেব। বয়স সত্তরের গোড়ায় হলেও বাবা তার যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। দৃষ্টি খানিকটা ক্ষীণ ছাড়া তেমন কোনো রোগ-ব্যাধি জামাল সাহেবের নেই। সঠিক সময় ভোজন এবং নিয়মিত হাটাচলা করাই তার স্বভাব। সেখানে এতো বড় রোগ তার শরীরে জন্ম নিয়েছে, অথচ ছেলে হিসেবে তার এই সম্পর্কিত জ্ঞান নেই। বেশ ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। নিজেকে একজন ব্যর্থ ছেলে মনে হতে লাগলো। এর মাঝেই নার্স জানিয়ে যায় জামাল সাহেব নিজের পরিবারের লোকেদের সাথে দেখা করতে চায়। প্রথমে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম ভেতরে গেলেন। মিনিট পনেরো বাদে থমথমে মুখে বের হলেন। গম্ভীর রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“বাবা অনল এবং ধারার সাথে দেখা করতে চান”

অনল ধারার মামাতো ভাই। সে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগমের একমাত্র ছেলে এবং জামাল সাহেবের বড় নাতী। তৃতীয় প্রজন্মের বড় ছেলে বিধায় এই বাড়িতে তার দাপট ও বেশ কড়া। হবে নাই বা কেনো! সর্বদা ভালো ছাত্রের ট্যাগ যে লাগানো। শুধু তাই নয় সুদর্শন পুরুষ হিসেবে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা আছে ধারার বান্ধবী মহলে। কেউ কেউ তার জন্য প্রেমপত্র লিখেছে। কিন্তু সে নির্বিকার চিত্তে তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। তার মনে কেউ তার যোগ্য নয়। ধারার ঠিক কারণেই লোকটিকে অপছন্দ। নিজেকে যথারীতি প্রিন্স উইলিয়াম ভাবা ব্যাক্তিটি সর্বদাই যেনো তার উপর নিজের আধিপত্য খাটাতে চায়। ধারা আড়চোখে অনলের দিকে তাকালো। লোকটি যেনো নির্বিকার। মোবাইলটা পকেটে পুরেই দাদার কেবিনের দিকে পা বাড়ালো সে। ধারাও একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে পিছু নিলো তার। কেবিনে প্রবেশ করতেই শুভ্র বিছানায় শায়িত নানাভাইকে দেখে নিজেকে আটকাতে পারলো না ধারা। প্রিয়মানুষটিকে হারানোর অনুভূতি হুল্লোড় করলো। ধারা ছুটে গেলো নানার কাছে। সে চায় না মায়ের মতো নানাকেও হারাতে। নানাভাই নিস্প্রভ হাসি একে বললেন,
“কি গো ধারারানী, কান্দো নাকি! কাইন্দো না! সবার ই তো যাইতে হয়”
“এসব কথা না বললে নয় দাদাজান? আপনি যথেষ্ট ফিট। ইনশাআল্লাহ কিছু হবে না”

নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বললো অনল। ক্ষীন বিরক্তিও ছিলো। তাকে বিচলিত দেখালো না। অপরদিকে ধারার কেঁদে কেটে একসার। আর তার কান্না যেনো অনলের বিরক্তির উৎস। এবার বেশ আবেগী কন্ঠে জামাল সাহেব বললেন,
“আমার ম/র/তে ভয় নেই। শুধু একখান চিন্তাই দূর্বল করে দিচ্ছে৷ আমি চলে গেলে আমার ধারারানীর কি হইবো?”
“নানাভাই, এভাবে বলবেন না”

জড়ানো কন্ঠে ধারা কথা বলছে, কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠবার জোগাড়। এদিকে ভ্রু কুচকে উঠে অনলের। সে খানিকটা বিস্মিত স্বরে বলে,
“ধারার কি হবে! ও তো বানের জলে ভেসে নেই। এতোকাল যেমন আমাদের কাছে থেকেছে আজ ও তাই থাকবে”
“তুমি বোঝো না অনল, এতোকাল ওর বাপ আমার উপরে কথা কইতে পারে নি। তাই ওরে নিতে পারে নি। কিন্তু আমি ম’র’লে ও হয়ে যাবে লাগাম ছাড়া ষা’ড়। জো’র করে ধারারানীকে লয়ে যাবে। আর তুমি কিছু করতেও পারবা না। ধারারানী ওই মহিলার কাছে থাকতে পারবে না। আমার ভাইবেই মন বইসে যায়। তাই আমি একখান সিদ্ধান্ত নিছি। ধারারানী, আমারে তুমি ভালোবাসো না?”
“খুব খুব, ভালোবাসি নানাভাই”
“তাইলে আমার এক খান কথা রাখবা? নানাভাই কে শেষ কথা”
“আপনি যা বললেন তাই রাখবো”
“তাইলে তুমি অনলরে বিয়া করবা। কথা দাও, তোমাদের সুখী সংসার দেখে ম’ই’রেও শান্তি পাবো”

কথাটা বজ্রপাতের মতো ঠেকলো ধারার কাছে। স্নায়ুকোষ কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কথাটা মস্তিষ্কে পেন্ডুলামের ন্যায় ঘুরতে লাগলো। বিমূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো,
“জ্বী?”
“এইটাই একমাত্র উপায়। তোর বাপ আজ কখনো তোরে জো’র করতে পারবো না। আর রাজ্জাকের ও জো’র থাকবে। তার ভাগনীরে নিতে পারবে, পুত্রবধুরে না”
“অসম্ভব”

জামাল সাহেবের কথার তীব্র প্রতিবাদ জানালো অনল। ক্ষীন কন্ঠে বলে উঠলো,
“পা’গ’ল নাকি! ধারা আর আমি, অসম্ভব। আমি এই বিয়ে করবো না। আমাদের বয়সের ডিফারেন্স দেখেছেন। ও কেবল উনিশে পা রেখেছে। আর এদিকে আমি আঠাশ। এতো বয়সের ডিফারেন্সে বিয়ে করা অসম্ভব। উপরন্তু ও এখন কেবল ভার্সিটিতে উঠেছে। বিয়ে করে সংসার করার থেকে ওর এখন পড়াশোনা করা বেশি জরুরি। আর আপনার নাতনীর মতো একটা স্টু’পি’ড মেয়েকে বিয়ে করে নিজের জীবনের জ্বলাঞ্জলি দেবার ইচ্ছে নেই। আমি এসব আবদার মানতে পারবো না। আপনি রেস্ট নেন৷ ইনশাআল্লাহ আপনার কিছু হবেও না”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো অনল। অনলের স্টু’পি’ড কথাটা কর্ণপাত হতেই কান গরম হয়ে গেলো ধারার। অন্যসময় হলে চার কথা শুনিয়ে দিতো। কিন্তু অবস্থা অনুকূলে নেই। তাই চুপ থাকাই শ্রেয়। উপরন্তু সে যে মূর্তি রুপে সে বের হয়েছে তাতে বিয়ে হবে না। তাই মূহুর্তে উঠা রাগ জল হয়ে গেলো। অপরদিকে জামাল সাহেব নাতির ঝাড়ি খেয়ে চুপ মেরে গেলেন। ধারা স্মিত হেসে বললো,
“নানাভাই, ঘুমান। আমি আসছি”

ধারা ভেবেছিলো বিয়ের ফাড়াটা হয়তো কেটে গেছে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করলেন জামাল সাহেব। তিনি কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন, বিয়েটা দিয়েই ছাড়বেন। জামাল সাহেবের রিপোর্ট এলো, হার্টে ব্লক ধরা পড়লো। এই বয়সে অপারেশন করা অসম্ভব। অপারেশনে মৃ’ত্যু ঝুকি আছে বিধায় ডাক্তার মানা করে দিলেন। এদিকে জামাল সাহেব ছেলে ও ছেলের বউ এর উপর আবেগী অত্যাচার চালান। ফলে রাজ্জাক সাহেব এবং সুভাসিনী বেগম আবেগের তাড়নায় তার দলে ভিড়লেন। অনল অবিচল, সে বিয়ে করবেই না। কিন্তু বিধিবাম, জামাল সাহেবের আবার বুকে ব্যাথা শুরু হলো। ডাক্তার ও তাকে চিন্তামুক্ত রাখতে নির্দেশ দিলেন। ফলে সত্তর বছরের বৃদ্ধের জিদের সামনে হেরে গেলো আঠাশ বছরের যুবকের নীতি। বাধ্য হয়ে নিজ বধুরুপে গ্রহণ করতে হলো ধারাকে। একই মঞ্চে বিনা নোটিশে বিয়ে হয় আফিয়ার এবং অনল ধারার। এখন লাল বেনারসী পড়ে ঘোমটা দিয়ে ফুলসজ্জিত বিছানায় বসে রয়েছে সে। তাও এমন এক ব্যাক্তির প্রতীক্ষায় যাকে দু চোখে সহ্য হয় না।

ধারার বড় মা সুভাসিনী বেগম প্রসন্নমুখে ঘরে প্রবেশ করলো। ধারা টলমলে দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। তিনি ধারার মনোস্থিতি ঠাহর করতে পারলেন হয়তো। সবাইকে বের হতে বললেন কয়েক মূহুর্তের জন্য। তারপর ধারার পাশে বসলেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে বললেন,
“রাগ করেছিস বড় মার উপর?”
“হু, খুব রাগ করেছি। কেনো করলে তোমরা এমন? এভাবে ইমোশনাল ব্লা’ক’মে’ই’ল কেনো করলে?”
“কি করবো বল, বাবার শরীরটা তো ভালো নেই। তার ইচ্ছের দামটুকু যদি না দিতে পারি সারাজীবন দায়ী থেকে যাবো। আর সত্যি বলতে, আমিও মনে মনে চাচ্ছিলাম যেনো তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও না যাস। তোকে বিয়ে দেবার কথা ভাবলেই বুক কাঁপতো। তাই অমত করলাম না। জানি আমার ছেলেটা একটু দাম্ভিক, একটু তেতো স্বভাবের। কিন্তু ও তোকে খুব সুখে রাখবে দেখিস! আচ্ছা তুই খুশি নস, আমার কাছেই সারাজীবন থাকবি”

বড়মার আবেগী স্বরে বলা কথাটার সম্মতি না দিয়ে পারলো না। ধারার বয়স তখন কেবল ছয় যখন তার মা সুরাইয়া বেগম ইন্তেকাল করেন। তখন থেকেই নানাবাড়িতে তার বেড়ে উঠা। মায়ের মৃ’ত্যুর পর অনাথ ধারাকে সামনে বসে থাকা নারীটি মাতৃস্নেহে মানুষ করেছে। তাই তাকে কষ্ট দেবার কথা ভাবতেই অস্থিরতা সৃষ্টি হয় ধারার মাঝে। মনে হাজারো অভিযোগ থাকলেও কিছুই বলে না সে। সুভাসিনী বেগম ধারার ললাটে চুমু একে বলেন,
“চিন্তা করিস না, ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে”

সুভাসিনী বেগমের প্রস্থানের পর ডুকরে উঠে ধারা। অনুভূতিগুলো লাগাম ছাড়া হয়ে যায়। কিশোরী হৃদয়ের মাঝে যে প্রণয়ের অঙ্কুরোদগম হয়েছিলো তা এখন পরিস্ফুটিত হয়ে ফুটন্ত গোলাপের রুপ নিয়েছে। সেখানে অনলের আগমন সে ফুলটিকে ঝড়িয়ে দিতে সক্ষম। এই অযাচিত সম্পর্কটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ধারা৷ মুখশ্রীতে হাত দিয়ে কিছুসময় কাঁদে সে। ভাগ্যের এমন প্রহেলিকায় যেনো নিজেকে অসহায় লাগছে ধারার, বড্ড অসহায়!

সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে টেরটিও পায় নি। সেই বেনারসী, সেই সাজেই বিছানায় উপর হয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে। অবশ্য ঘুমাবে নাই বা কেনো, এই চারদিন বিয়ের টেনশনে এক বিন্দুও ঘুম হয় নি। ধারার মনে হচ্ছিলো এসব একটা বিশ্রী দুঃস্বপ্ন হলে মন্দ হতো৷ ঘুম থেকে চোখ খুলতেই দেখবে সব মিথ্যে, কিছুই ঘটে নি। কিন্তু তা হলো না। তন্দ্রা কাটতেই ধাতস্থ হলো, সে ভারী কিছুর উপর শুয়ে আছে। চোখ না খুলেই হাতড়ালো কিছু সময়। কিন্তু বুঝতে পারলো না এটা কি বিছানা নাকি মেঝে। তখন ই শীতল কন্ঠ কানে এলো,
“স্পর্শ করা শেষ হলে হাতটা সরা”

শীতল কন্ঠ কর্ণপাত হতেই ঘুম পেছনের জানালা দিয়ে পালালো। শিরদাঁড়া বেয়ে হীম বয়ে গেলো। তড়াক করে চোখ খুললো ধারা। চোখ খুলতেই দেখলো যাকে সে মেঝে ভাবছিলো সেটা ছিলো অনলের বলিষ্ঠ বুক…………

চলবে

ভুলোনা আমায় পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব

0

#ভুলোনা_আমায়
#অন্তিম_পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

তপ্ত গরমের বিদায়ের পর কনকনে শীতের আগমন ঘটে। চারিদিকে কুয়াশা আচ্ছন্ন হয়ে আছে,এক স্থানে থাকা অবস্থায় আরেক স্থানের কিছুই দেখার সুযোগ নেই। পুকুরের পানি থেকে কেমন ধুঁয়ার মতো উঠছে, চারিদিকে কোন পশু পাখির গতগম্ব নেই। শীতের আভাসে সবাই সবার নীড়ে অবস্থানরত।যখন সূর্য মামা উদিত হবে তখন সবাই তাদের নীড় ছেড়ে বের হবে এই তাদের পণ ।
টুসি পুকুর পাড়ের ঢেলনাতে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে পুকুরের ধুঁয়া উঠা পানির দিকে। পাতলা একটা চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে নিজেকে। মনে হচ্ছে শীতেরা তাকে ছুঁতে পারছে না।শীত নিবারণ নিয়ে নেই কোন ভাবান্তর।মাত্র‌ই ভোরের আলো ফুটেছে, তার উপর শীতের সকাল বোঝাই যাচ্ছে কতো শীত।সকলে নামায পড়ে কম্বল অথবা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে আর সে শীতকে অবজ্ঞা করে, এখানে বসে অনিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে আছে পুকুরের পানিতে।

যখন মানুষের মনে কষ্ট পাহাড় সম তৈরি হয়, তখন শরীরের কষ্ট অনুভব হয় না।আর কষ্ট থেকেই মানুষ আত্ম’হ’ত্যার মতো পাপ করে বসে। তখন শরীরের কষ্টের কথা ভাবেনা, মনের কষ্টগুলোই বড় হয়ে উঠে। অথচ আল্লাহ তা’আলা বলেন,
— তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে আত্মহত্যা করবে তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ[১]

আত্মহত্যাকারীর জন্য পরকালে কঠোর আজাবের ঘোষণা এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়।আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবিজি সা: বলেছেন,-‘যে ব্যক্তি পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে অনুরূপভাবে আত্মহত্যা করতেই থাকবে এবং এটিই হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, তার বিষ তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে সর্বক্ষণ বিষ পান করে আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর এটা হবে তার স্থায়ী বাসস্থান। আর যে ব্যক্তি লৌহাস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে লৌহাস্ত্রই তার হাতে থাকবে, জাহান্নামে সে তা নিজ পেটে ঢুকাতে থাকবে,আর সেখানে সে চিরস্থায়ীভাবে থাকবে[২]
হজরত জুন্দুব বিন আব্দুল্লাহ রা: রাসুল সা: থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন,- ‘একজন ব্যক্তি জখম হলে, সে (অধৈর্য হয়ে) আত্মহত্যা করে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ বললেন, ‘আমার বান্দাহ আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম।[৩]

উপরিউক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পাপ দুটি নেই।তাই আমরা যত‌ই দুঃখ কষ্টে পুড়ে ছাই হ‌ইনা কেন আমাদের মনে রাখতে হবে এই দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়,আমরা কেবল কিছুদিনের অতিথি কেবল। কোরআন শরীফ এর এই আয়াত টা মনে রাখতে হবে, “জেনে রেখো,আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে”[৪]
.
.
হঠাৎ দুটো গরম হাতের স্পর্শে বিদ্যুৎ পিষ্টের ন্যায় চমকে উঠে টুসি।হাত দুটো ছাড়িয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ায় টুসি। সামনে থাকা ব্যক্তিকে দেখে আঁখি দুটো আপনাআপনি বড় হয়ে গেল। “লেখিকা ইসরাত বিনতে ইসহাক” সামনে থাকা ব্যক্তির অধরপল্লবে মৃদু হাসি দুলছে। শীতের কারণে মাথায় হুডি দেওয়া, দুই হাত পকেটে গুঁজে রাখা।
টুসি’র এলোমেলো মস্তিষ্ক যখন স্থির হয়ে আসে তখন পাশ কেটে চলে যাওয়া ধরে। সোহান তখন দ্রুত টুসি’র বাম হাতটা আঁকড়ে ধরে। রাগে দুঃখে হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় টুসি‌। এতে করে খুব ব্যাথিত হয়ে করুন চাহনিতে তাকিয়ে থাকে সোহান।
নিরবতা ভেঙ্গে বলে,
— আমাকে কোন ভাবেই মাফ করা যায় না? আমি তো জানতাম না তুমি অসুস্থ ছিলে,জানলে সেদিন কখনোই ওভাবে কথা বলতাম না।তা ছাড়া তুমি তো জানো আম্মার প্রতি কতটা দূর্বল আমি। আব্বা মারা যাওয়ার পর খুব কষ্ট করে আমাদের পড়াশোনা করে মানুষ করেছেন তার কথা কি করে অবিশ্বাস করতাম বলো? তবে আর কখনো এমন ভুল হবে না ইনশা আল্লাহ। তোমাদের দুজনের সব কথা প্রথমে শুনবো তারপর যা বলার বলবো। তবুও আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না, তোমার কন্ঠস্বর শুনতে পাইনা বলে আমার হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।প্লিজ একটু কথা বলো?

টুসি’র চোখ পানি টলটল করছে,তাই নিজেকে আড়াল করতে দৌড়ে ঘরে চলে যায়।
.
গতকাল বিকাল সাড়ে পাঁচটায় সোহান দেশে ফিরে। তারপর বাসায় ফিরে দেখে রোকেয়া বেগম মনমরা হয়ে একা বসে আছে। সোহান কে দেখতে পেয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠে। সোহান কুশল বিনিময় করে টুসি’র কথা তুলে। তখন রোকেয়া বেগম নিজের ভুল স্বীকার করে টুসি’কে ফিরিয়ে আনতে বলে।মিরার কথা জিজ্ঞাসা করলে রোকেয়া বেগম জানায় সে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে, আরমানকে বলেছে আলাদা বাসা ভাড়া না নিলে সে এ বাসায় ফিরবে না। এদিকে আরমান সদ্য জন্ম নেওয়া মেয়েকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলে রোকেয়া বেগমের হাতে পায়ে ধরে অন্যত্র বাসা ভাড়া করে চলে গিয়েছে! সেই থেকে রোকেয়া বেগম কাজের মহিলা কে নিয়ে বাসায় একা আছেন।

হয়তো এভাবেই তার অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছেন তিনি।

তারপর সোহান টুসি কে ফিরিয়ে আনতে যাবে বললে রোকেয়া বেগম বললেন,তিনিও সাথে যাবেন।সোহান অমত না করে রোকেয়া বেগম কে তৈরি হতে বলে নিজের রুমে গেল। রুমটা কেমন অন্ধকারে ডুবে আছে। কত মাস যাবত কেউ থাকে না বলে কেমন শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। এমনিতে রোকেয়া বেগম কাজের মহিলা কে দিয়ে ঝাড়ু মুছা করিয়েছেন এটুকুই।যাই হোক হাতে থাকা টলি ব্যাগটা থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে একটা ছোট ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল সোহান। তারপর টলি ব্যাগটা রুমের একপাশে রেখে দিয়ে বাহিরে এসে রোকেয়া বেগম কে তারা দিয়ে বললো,
— আম্মা তাড়া তাড়ি চলো না হয় গাড়ি পেতে বেগ পেতে হবে।

অতঃপর এই ভোরে গ্রামে এসে পৌঁছায় তারা। রোকেয়া বেগম কে তার বাড়িতে রেখে এসে সোহান এ বাড়ি চলে আসে। এসে দরজায় কড়াঘাত করতে রোজিনা বেগম দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। সোহান সালাম দিলে তার বিষ্ময় ভাব কাটে, তারপর সোহান কে কঠোর গলায় বলেন,
— এখানে কেন এসেছো তুমি? আমার মনে হয় তোমার এখানে আসার কোনো প্রয়োজন নেই আর!চলে যাও!

সোহান করুন কন্ঠে বলে,
— আমি ভুল করেছি মামি, আমাকে এই প্রথম বারের মতো মাফ করে দিন। কথা দিচ্ছি আর কখনো এমন ভুল করবো না ইনশা আল্লাহ। আপনারা আমাকে মাফ না করলে আমার আল্লাহ যে আমাকে মাফ করবেন না।

রোজিনা বেগম শুনলেন না, তিনি ঘরের ভিতর চলে গেলেন। তখন টুসি’র দাদি আসে, বৃদ্ধা মলিন মুখশ্রী করে বললেন,
— তোমার থেইকা এমন ধারা কাম আশা করি নাই ভাই! তুমি কেমনে পারলা আমার কলিজার টুকরা নাতনিরে কষ্ট দিতে?

সোহান বৃদ্ধার হাত দুটো ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
— দাদি আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ? দেখেন শুধুমাত্র নিজের অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে দেশে চলে এসেছি। আমার আরো কয়েক বছর পর দেশে ফিরার কথা ছিল এবং কি বলেছি আর বিদেশে যাবো না! দেশে থেকেই কাজ করবো। আমার পরিবর্তে অন্য কাউকে নিয়োগ করা হবে বিদেশে ব্যাবসায় পরিচালনা করার জন্য।প্লিজ দাদি ওর সাথে আমাকে দেখা করার সুযোগ করে দিন প্লিজ? আমি আপনার কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।

সোহান কে এতোটা বিচলিত দেখে বৃদ্ধা বললেন,টুসি পুকুর পাড়ে বসে আছে।যা শুনে খুব অবাক হয় সোহান।এই শীতের মাঝে মেয়েটা পুকুর পাড়ে বসে কি করে?যে মেয়েটা কিনা এতো ঘুম কাতুরে, এখন তো তার লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার কথা।আর না ভেবে সোহান বৃদ্ধা কে “জাযাকিল্লাহু খাইরন” বলে দ্রুত পায়ে পুকুর পাড়ে চলে যায়। বৃদ্ধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তার নাতনির এখন যদি একটু মন ভালো হয়..
.
.
সন্ধ্যাবেলা বৈঠক বসে! সেখানে টুসি’র পরিবারের সকলে উপস্থিত। মহিলারা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছে।
অপরদিকে সোহানের আম্মা,মামা, মামাতো ভাই সকলে উপস্থিত আছেন।
স্বপন তালুকদার প্রথমেই কথা তুলেন দেনাপাওনা নিয়ে! তিনি সোহানের দিকে আঙুল তুলে বললেন,
— আমার মেয়েকে দুই হাত উজাড় করে সমস্ত ফার্নিচার দিতে চেয়েছিলাম আমি! কিন্তু তুমি বলেছিলে এসব যৌতুকের আওতায় পরে তাই তুমি নিতে চাও না। অথচ সেদিন তোমার আম্মা সামান্য একটা পানির জগ নিয়ে আমার মেয়েকে কথা শুনালেন। মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পরে ছিল একটা বার গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নাই! তুমিও তোমার আম্মার কথা শুনে আমার মেয়েকে কথা শুনাতে ছাড়লে না, এরপরেও আমি কোন ভরসায় আমার মেয়েকে তোমার এবং তোমার আম্মার হাতে দিতে পারি?

তারপর বাদবাকি সবার উদ্দেশ্যে বললেন,
— আপনারাই এর জবাব দিন আমি কি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে মেয়ে কে আর দিব না?

সোহান মাথা নিচু করে বলে,
— কথাটা বলতে কষ্ট হচ্ছে তবুও বলছি, মানুষজনকে টাকা পয়সা দিয়ে কতক্ষন ভালো থাকা যায়? আপনি মানুষকে দিয়ে খাইয়ে যত লোভ দেখাবেন সে ততই আপনার থেকে প্রত্যাশা করবে।তার চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলবে।তাই দিয়ে খাইয়ে কখনো ভালো থাকা যায় না।যে সম্পর্কে কোন চাহিদা থাকে না, থাকে মায়া,মহাব্বত, ভালোবাসা সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় আজীবন।
যাই হোক আমি কথা দিচ্ছি ভবিষ্যতে এক‌ই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না ইনশা আল্লাহ।

সোহানের কথা শেষ হলে তার মামা দুলাল তালুকদার মিনতি করে বললেন,
— ভাইজান আমার বোনটা ভুল করে ফেলছে এবারের মতো মাফ চাই। আমাদের ফিরিয়ে দিবেন না দয়া করে।

এরপর বাকিরা এটা ওটা বলে তর্কে যাওয়ার আগে স্বপন তালুকদার সবাই কে থামিয়ে বললেন,
— ঠিক আছে আমি মাফ করে দিচ্ছি, তবে আমি আমার মেয়ের চোখের পানি দ্বিতীয় বার সহ্য করবো না।

অতঃপর সব কিছু মিটমাট হয়ে যায় “আলহামদুলিল্লাহ”।
.
.
অন্ধকার ঘরে ঢুকে ফোনের ফ্লাস জ্বালিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয় সোহান। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে এগিয়ে যায় সামনে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে। কাছে গিয়ে কোন কথা না বলে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। সামনে থাকা ব্যক্তিটি ডুকরে কেঁদে ওঠে। সোহান তাকে ঘুড়িয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
— আর নয় প্লিজ। অনেক কাঁদতে হয়েছে আমার জন্য। আমাকে মাফ করে দাও..এই বলে পা ধরার জন্য উদ্যত হলে টুসি ঝাপটে ধরে সোহান কে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— আমাকে এমন অপরাধী করবেন না। আপনার বিরহ আমি সহ্য করতে পারিনি বলে সেদিন আম্মার মুখে মুখে তর্ক করে ফেলেছিলাম। আমাকে মাফ করে দিন..

সোহান টুসি’কে চুপ করিয়ে বললো, পুরোনো কথা আমরা ভুলে যাবো কেমন? তবে কি জানো সম্পর্কে অভিমান থাকা ভালো তাহলে আরো গভীর ভাবে উপলব্ধি করা যায়।টুসি বিরতিহীন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সোহান হেসে অজস্র আদরে ভরিয়ে দেয় তার প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখশ্রী জোরে।এর প্রতিদানে টুসিও চুপ থাকে না….
________
রেফারেন্স:-
[১](সূরা আন নিসা আয়াত-২৯,৩০)
[২](বোখারি ও মুসলিম)
[৩](বোখারি)।
[৪][সূরা বাক্বারাঃ২১৪]
__________

🍀 সমাপ্ত 🍀

(আসসালামু আলাইকুম।
অতঃপর গল্পটার ইতি টেনে দিলাম।আপনারা যারা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমার পাশে ছিলেন, সাপোর্ট+ভালোবাসা দিয়েছেন তাদের কে “জাযাকিল্লাহু খাইরন”💚

সবশেষে,

ভুলোনা আমায় পর্ব-১৬

0

#ভুলোনা_আমায়
#পর্ব-১৬
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

কাঠের জানালা গলিয়ে বাহিরের তাকিয়ে আছে টুসি, ঘরের সাথে পেয়ারা গাছটায় দোয়েল পাখি বসে আছে। মাঝে মাঝে পাতা থেকে পোকা শিকার করে খাচ্ছে।
রোজিনা বেগম মেয়ের নিরবতা দেখে অধৈর্য হয়ে পরলেন। আদুরে গলায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— বলনা মা সোহানের সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে? তোর অসুস্থতার খবর নিতে একবার ও কল করলো না কেন?

টুসি’র শরীর শিউরে উঠে, এখনো জ্বর পুরোপুরি কমেনি। মায়ের কথায় জবাব না দিয়ে চুপ করেই বসে আছে। তখন তার দাদি নিছাপুছা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে ব‌ইন তোর দাদিরে কবি না কি অইছে?ক না ব‌ইন কি অইছে?

টুসি নিরবে চোখের পানি ফেলে বলতে শুরু করে। তারপর প্রথম থেকে সবটা বললো।বলা শেষে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে।আর বলে আম্মু বিশ্বাস করো এর বেশি কিছু বলিনি আমি।
মেয়ের এমন বাঁধ ভাঙা চিৎকারে নিজেকে সামলাতে পারলো না রোজিনা, পানিতে ঝাঁপসা হয়ে এলো চোখ দুটো। সে তো জানে তার মেয়ে অবুঝ হলেও কখনো মিথ্যা কথা বলে না।পাশে বসে থাকা বৃদ্ধা মহিলা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
— রোকেয়া এমন কাম করছে আমার নাতনির লগে? আজকে অয় আমার নিজের মাইয়া না বলে এই কাম করতে পারলো! আমার মাইয়া অইলে এই কাম কক্ষনো করতো না।

রোকেয়া বেগম পাশের ঘরের চাচাতো বোন হয় স্বপন তালুকদারের। আগে সম্পর্কটা এরকম ছিল।স্বপন তালুকদার পুরোনো বাড়ি ছেড়ে নতুন বাড়ি তৈরি করে চলে এসেছে, রোকেয়া বেগমদের বাড়ি থেকে।তো একদিন রোকেয়া বেগম এর ভাই দুলাল তালুকদার বিয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব রাখে। স্বপন তালুকদার প্রথমেই নাকুচ করে দেয় কিন্তু বাড়ির লোকজনের কাছে রোজিনা বেগম শুনেছেন সোহান খুব ভালো ধার্মিক ছেলে। ধার্মিক ছেলে তো কখনো খারাপ হয় না তাই রোজিনা বেগম সবাই কে বোঝান। সেই থেকেই বিয়ের সূচনা হয়।

বর্তমানে রোজিনা বেগম নিজের কপাল নিজে থাপ্পাড়ান। নিজেকে দোষারোপ করেন ভাবেন তিনি যদি আগ্রহ না দেখাতেন তাহলে তার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হতো না।

এদিকে মা দাদির থেকে সবকিছু শুনে স্বপন তালুকদার এবং আনাস আর বুখারী খুব খেপে আছে। পারে তো সোহানের পরিবার কে ধ্বংস করে দেয়!আনাস আর বুখারী তো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তাদের বোনকে আর বাসায় পাঠাবে না। পাঠিয়ে দিবে ডিবোর্স পেপার।
.
.
দশ দিন পর,
আনাসের ফোনে কল করে সোহান!আনাস বিদেশি নাম্বার দেখে চিনতে পারে না প্রথমে।পরে যখন সোহান সালাম দিয়ে বলে ভাইজান আমি সোহান বলছি! তখন চিনতে পারে, চিনতে পেরে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আনাস বলে আমি কাজে ব্যস্ত আছি। কি দরকারে কল করেছো তাড়াতাড়ি বলো?

সোহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
— আজকে তিন চার দিন যাবত টুসি’র ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ওরে একটু বলবেন ফোনটা যেন অন করে?
— আমার বোনের সাথে তোমার কোন কথা আছে বলে আমি মনে করি না। আমার বোন মরলো না বাঁচলো ক‌ই এতো দিন তো একবার ও খোঁজ খবর নিলে না। এখন কিসের কথা?

সোহান খুব কষ্ট পেলো টুসি’র মরা বাঁচা নিয়ে এভাবে বলাতে।তাই বললো,
— ভাইয়া প্লীজ এভাবে বলবেন না, আমি সবসময় ওর জন্য দো’আ করি আল্লাহ তা’আলা যেন ওরে সর্বদা সুস্থ রাখেন।
— এতো গুলো দিন যাবত বোনটা আমার মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে ক‌ই একবার ও কল করে জানতে চাইছো তুমি?যাই হোক আমাদের বোনকে আমরা খুব যত্নে রাখবো সেই তৌফিক আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন। আশা করবো তুমি কোন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।

তারপর আনাস কল কেটে দেয়। এদিকে সোহান পাগল প্রায়।তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কি হয়েছে? সোহানের সাথে রাগ করে আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে বসেনি তো? ইয়া আল্লাহ আমি এই ভিনদেশে থেকে কি করবো? কিভাবে টুসি’র খবর নিব?

সোহানের কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজেকে নিজেই পিটাতে ইচ্ছে করছে।টুসির কি হয়েছে?এসব চিন্তায় উল্টো পাল্টা কথা মাথায় আসছে। খুব অনুতপ্ত ফিল করছে।তার বোঝা উচিৎ ছিল যার সাথে রাগ দেখাচ্ছে সে একজন নাবালিকা মেয়ে। এখনো তার মস্তিষ্ক পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। ঠিক ভুল বুঝতে শিখেনি। তাছাড়া রাগারাগী করাটা কোন সলিউশন না।সব সময় মাথা ঠান্ডা রেখে বিবেচনা করে দেখতে হয়। দুই পক্ষেরই কথা শুনতে হয়। কথায় আছে এক হাতে তালি বাজে না ঠিক তেমনি এক পক্ষের সমস্ত দোষ থাকে না।
.
.
আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা মনে করে মায়েরা কোন অন্যায় করতে পারে না। আমার শিক্ষক বলতেন, মানুষ অন্যায় করবে না তো কি গরু ছাগল অন্যায় ভুল করবে? ঠিক তেমনি মানুষ মাত্রই ভুল।আমরা সবাই ভুল ত্রুটি করে থাকি। হয়তো কেউ জেনে বুঝে করি আর কেউ না জেনে করি।
আবার অনেকে আছে মা অন্যায় করেছে জেনেও চুপ করে থাকে,তারা মনে করে মা কে কিছু বললে মা কষ্ট পাবেন। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটার ও যে কষ্ট বলে কিছু আছে তা কখনোই বুঝতে পারে না। কেননা সে পরের ঘরের মেয়ে।তার কষ্ট বলে কিছু থাকতে নেই। সেই পরের ঘরের মেয়েটার শ্বশুরবাড়িতে কোন মূল্য আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কেননা সে শ্বশুরবাড়ি আসার সময় বাপের বাড়ি ত্যাগ করে তো আসেই সাথে যৌতুক নামের মালপত্র নিয়ে আসতে হয়। অথচ বাবা মা তার আদরের নারী ছেঁড়া ধন টাই দিয়ে দিচ্ছে,এর থেকে মূল্যবান আর কি হতে পারে?
মেয়েরাই মেয়েদের মূল্য দিতে জানে না, সেখানে বাদবাকি মানুষের কথা কি আর বলবো?আজো আমাদের সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে শুনলে মানুষ মুখ বাকায়।অথচ তারাও কিন্তু একজন নারী।

আল্লাহ আজ্জা ওয়াজাল তার অসীম জ্ঞান দ্বারা কোন কিছুকে সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যা চান তাই ই সৃষ্টি করেন এবং এভাবে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কাকে তিনি পুত্র সন্তান দান করবেন, কাকে কন্যা সন্তান দান করবেন, কাকে উভয়ই দান করবেন আর কাকে বন্ধ্যা রাখবেন। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে আল কুরআনে বলেছেন, “তিনি যা চান সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে পুত্র ও কন্যা উভয়ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করেন। তিনি তো সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।[১]

আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনে স্পষ্টভাবে কন্যা সন্তানকে “সুসংবাদ” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত।[২]

উপরিউক্ত হাদীস থেকে বোঝা যায় কন্যা সন্তান ঘরে সুসংবাদ ভয়ে আনে। এবং আল্লাহ তা’আলা তার ইচ্ছাতেই কন্যা সন্তান বা পুত্র সন্তান দান করেন।যারা এ নিয়ে মন খারাপ করে বা কটাক্ষ করে কথা বলে তাদের উপর আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ট হন।
আল্লাহ তা’আলা সবাই কে বোঝার তৌফিক দান করুন আমিন।
.
.
সোহান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে,টুসির কি হয়েছে? এখন কেমন আছে?তা না জানা পর্যন্ত শান্তি নেই।তাই গ্রামে মামাতো ভাই মিনহাজ তালুকদার কে কল করে সবটা খুলে বলে। সবটা শুনে মিনহাজ তালুকদার কথা দেয় খবর নিয়ে সোহানকে জানাবেন।”লেখিকা ইসরাত বিনতে ইসহাক” অতঃপর একজন মহিলা কে দিয়ে খবর নিয়ে সোহান কে তিনি টুসি’র অসুস্থতার খবর জানান।
টুসি’র টায়ফয়েড হয়েছে শুনে সোহান খুব ভেঙ্গে পরে,মেহুল কে সবটা জানায়।মেহুল তার আদরের ভাবীর খারাপ অবস্থা শুনে তার বর কে নিয়ে দুদিনের জন্য গ্রামে আসে।
টুসিকে দেখে খুব ব্যাথিত হলো,টুসি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখন অবশ্য আগের থেকে অনেকটা ভালো আলহামদুলিল্লাহ।

মেহুল সবার সাথে কুশল বিনিময় করে টুসি’র সাথে বসে কথা বলছে এর মধ্যে সোহান কল করে।মেহুল কিছু না বলে কল রিসিভ করে ফোনের ক্যামেরা টুসি’র দিকে তাক করে রাখে। সোহান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে, আজকে প্রায় বিশ দিন পর দেখছে তাকে। কেমন মলিন মুখশ্রী হয়ে আছে, চোখ জোড়া ঢেবে গিয়েছে। চাপা গায়ের রঙ হয়ে গিয়েছে। গায়ে পরিহিত কামিজটা ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছে।
টুসি’র এমন করুন অবস্থা দেখে সোহানের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।যা দেখে মেহুল বলে উঠলো,
— ভাইয়া তুমি কাঁদছো? কেঁদো না ভাইয়া ভাবী এখন আগের চেয়ে সুস্থ আছে আলহামদুলিল্লাহ।

মেহুলের কথায় চমকে তাকায় টুসি!তার বুঝতে বাকি থাকে না ফোনের অপর প্রান্তের মানুষটা কে!তাই সাথে সাথে মেহুলের থেকে ফোনটা নিয়ে কল কেটে দেয় টুসি।মেহুল অনেক বলেও টুসি’কে বোঝাতে পারে না যে তার ভাই ভুল করেছে সে এখন খুব আফসোস করছে। একটাবার মাফ চাওয়ার সুযোগ চায় সে। কিন্তু না টুসি কথা বলবে না মানে বলবেই না। শেষে মেহুল আশাহত হয়ে ফিরে যায় তার শহরে।
.
.
কেটে যায় দিন পেরিয়ে মাস।টুসি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে। তবে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থাকে।ভাবীরা কতো কথা বলে মন ভালো করতে চায় কিন্তু ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসে।এর মাঝে রোকেয়া বেগম কল করে রোজিনা বেগমের সাথে তার কাজের অনুতপ্ত প্রকাশ করে। কিন্তু তালুকদার বাড়ির সবাই কঠোর হয়ে বসে আছে তারা কিছুতেই আর মেয়ে দিবেন না।টুসি’র এস সি রেজাল্ট প্রকাশিত,টুসি এ-গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।আর মেহুল পেয়েছে এ-প্লাস। দু’জনের রেজাল্ট ই আলহামদুলিল্লাহ ভালো হয়েছে। ভর্তির সময় হলে মেহুল ঢাকায় ভর্তি হয় আর টুসি’কে গ্রামের এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়।টুসি নিয়মিত কলেজে আসা যাওয়া শুরু করে, এতে করে যদি কষ্ট গুলো কিঞ্চিৎ ভুলে থাকা যায় তাহলে ক্ষতি কি?

অপরদিকে সোহান কয়েক মাসের ছুটিতে দেশে আসার জন্য বন্ধবস্ত করছে!….
_______
রেফারেন্স:-
[১][আশ-শূরা ৪২/৪৯,৫০]
[২] [আন-নাহাল ১৬/৫৮]
_______

#চলবে.. ইনশা আল্লাহ।