Wednesday, July 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1006



স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৯

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৯

‘ডিভোর্স পেপার নিয়ে তোমাদের সব সমস্যা তো? সমস্যা আমি মিটিয়ে দিচ্ছি।’

সবার দৃষ্টি রাতুল শিকদারের দিকে, রাতুল শিকদারের ঠোঁটে মৃদু হাসি তিনি একটু থেমে আরিয়াকে ডেকে সেই কাগজটা আনতে বললেন। আরিয়া কাগজটা এনে বাবার হাতে দিল। রাতুল শিকদার কাগজটি সবার সামনে ধরে বললেন,

– এই কাগজেই তো তোমরা সাইন করেছ তাই না?

স্তব্ধ মাথা নাড়ল। রাতুল শিকদার বলতে লাগলেন,
– কিন্তু এটা ডিভোর্স পেপার নয় বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার।

সবাই চমকে গেল অরিত্রি শিকদার বললেন,
– রেজিস্ট্রি পেপার!

– হ্যা, স্তব্ধ আর স্নিগ্ধতার ইসলামিক নিয়ম সম্পূর্ণ করে বিয়ে হলেও রেজিস্ট্রি হয়নি বিয়েটা তাড়াহুড়ো করে হয়ে গেছে তাই রেজিস্ট্রির কথা মাথায় ছিল না যখনি শুনলাম তুমি ওদের ডিভোর্স করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছ তখনি বুদ্ধি করে সেই উকিলের সঙ্গে কথা বলে কাগজ বদলে দিয়েছি ওরা সাইন ঠিকই করেছে তবে রেজিস্ট্রি পেপারে।

স্তব্ধ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– তার মানে আমাদের ডিভোর্স হয়নি!

– না।

অরিত্রি শিকদার বললেন,
– কাগজটা তো আমি আর রুশি ভালো করে দেখেছিলাম তখন তো ডিভোর্স পেপার ছিল।

– হুম তখন ওইটা ডিভোর্স পেপার ছিল আমি দেখতে চেয়েছিলাম স্তব্ধের কাছে এই সম্পর্কটা কতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে তোমরা স্তব্ধকে আলাদাভাবে বুঝিয়ে সাইন করাতে চেয়েছিলে তখন স্তব্ধ রাজি হয়নি কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছিল কিন্তু তুমি আবারো উকিলের সঙ্গে কথা বলে নতুন করে ডিভোর্সের কাগজ বানিয়ে দিতে বললে তখনি এই কারসাজিটা করলাম।

– তুমি কিভাবে জানলে আমরা আবারও ডিভোর্সের কাগজ নিয়ে উকিলের সঙ্গে কথা বলেছি?

– উকিল নিজেই ফোন করে বলেছিল।

রাতুল শিকদার আবার বললেন,
– এছাড়া ওরা তিন কবুল বলে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে তালাক তো হয়নি সেক্ষেত্রে একটা কাগজে নিজের নাম লিখে সাইন করলেই যে তাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে এটা ভাবা বোকামি।

স্নিগ্ধতার ভেতরের কষ্টের একটা ভার কমলো।স্তব্ধ হেসে বলল,
– ড্যড তুমি অনেক চালাক হয়ে গেছ ইদানিং ভালো ভালো কাজ করছো একটুর জন্য সংসারটা বেঁচে গেল।

স্নিগ্ধতার হাত টেনে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
– এখন আর দিদানের ঘরে গিয়ে কি করবে চলো এখন আমাদের ঘরে।

উপস্থিত সবাই স্তব্ধের কান্ড দেখে হেসে দিল।অরিত্রি শিকদার প্রশ্ন করলেন,
– তুমি ওই উকিলের ঠিকানা জানলে কিভাবে?

আরিয়া মুচকি হেসে বলল,
– আমি বলেছি মম।

অরিত্রি শিকদার চমকে গেলেন আরিয়া পুনরায় বলল,
– আমি চাইনি মম ওরা আলাদা হোক তোমাকে বুঝিয়ে যখন লাভ হলো না তখন বাধ্য হয়েই ড্যডকে বলেছি।

অরিত্রি শিকদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– সবাই সব জানতো মাঝখানে আমি অপরাধী হয়ে গেলাম,যাক সে সব আমার ছেলে যখন স্নিগ্ধতার সঙ্গে খুশি আমার আর কোনো আপত্তি নেই।

বলেই অরিত্রি শিকদার চলে গেলেন উপস্থিত বাকিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
____________

কলেজ শেষে শিরিন বাড়ি ফিরছিল পেছন থেকে তিহান শিরিনকে ডাকল কিন্তু শিরিন শুনেও না শোনার ভান ধরে নিজের মতো হাঁটতে লাগলো।তিহান কিছুটা দৌড়ে শিরিনের সামনে এসে দাড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

– আপনি কালা নাকি কানে শুনেন না?

– শুনেছি কিন্তু এখন কথা বলার মুড নেই।

– আপনার আবার কবে মুড থাকে?

শিরিন হাঁটতে লাগলো,তিহানও পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
– আপনি স্নিগ্ধতা ভাবীর বান্ধবী?

– হুম।

– আমি ভাবীর দেবর তাহলে তো আমরা বেয়াই বেয়াইন।

– স্নিগ্ধার সঙ্গে আপনার ভাইয়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে সো আমরা বেয়াই বেয়াইন নই,স্নিগ্ধা একবার সুস্থ হয়ে যাক তারপর ওকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।

– আমার ভাইয়া থাকতে কখনও ভাবীকে আনতে পারবেন না।

– জোর জবরদস্তি নাকি? দরকার হলে আপনার ভাইয়ের নামে মামলা করবো লজ্জা করে না মায়ের কথায় বউকে ডিভোর্স দিতে।

– আরে ওদের ডিভোর্স হয়নি।

শিরিন ব্রু কুঁচকে তাকালো।তিহান পুরো ঘটনা শিরিনকে বলল, শিরিন হালকা কেশে বলল,
– সে যাই হোক আমি গেলাম বাই।

শিরিন রিকশায় উঠে চলে গেল।তিহান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,’এ কেমন মেয়ে জম্মের সময় মুখে কি মধু দেয়নি কেউ?’

স্নিগ্ধতা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে আর তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্তব্ধ।স্নিগ্ধতা বিরক্ত হয়ে বলল,

– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? আমার অস্বস্তি লাগছে।

– তুমি চোখ বন্ধ করে রাখো তাহলে অস্বস্থি লাগবে না।

– আপনি অন্যদিকে তাকান।

– বউ রেখে অন্যদিকে কেন তাকাবো? বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার দায়িত্ব।

– আবার মায়ের কথায় বউকে ডিভোর্স দেওয়াও দায়িত্ব তাই না।

– ডিভোর্স হয়নি তো।

– আপনার বাবা কাগজ পাল্টে দিয়েছিল বলে হয়নি যখন সাইন করেছিলেন তখন তো জানতেন না।

– তুমিও লাগিয়ে লাগিয়ে কথা বলতে শিখে গেছ স্নিগ্ধ।

– পরিস্থিতির চাপে পরে সবই শিখতে হয়।

– আসো আদর করে দেই।

– লাগবে না।

– তুমি বললেই হবে না আমি আদর করবোই।

– আমার থেকে দুই হাত দূরে থাকুন কাছে আসলেই চেঁচাবো।

– এতটা নিষ্ঠুর হয়ে গেলে!

স্নিগ্ধতা মুখ ঘুরিয়ে নিলো স্তব্ধের উপর অনেক অভিমান জমে আছে বাবার মৃত্যুর শোকটাও এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মেজাজ কেন জানি খিটখিটে হয়ে আছে।

শিরিনের নাম্বার থেকে স্নিগ্ধতার মোবাইলে কল এসেছে।স্নিগ্ধতা মোবাইল কানে ধরতেই শিরিন বলতে লাগলো,

– তোর শরীর কেমন এখন?

– ভালো।

– ওষুধ ঠিক মতো খাচ্ছিস?

– হুম।

স্তব্ধ নিজের মোবাইল নিয়ে উঠে গিয়ে বলল,
– তুমি কথা বলো আমি আসছি।

স্নিগ্ধতা মাথা ঝাকালো। শিরিন ফোনের অপরপাশ থেকে বলল,
– কিরে কথা বলছিস না কেন?

– বলছি তো।

– তোর হাজব্যান্ড কোথায়?

– আছে বাড়িতেই।

– ব্যাটাকে একদম কাছে ঘেষতে দিবি না উচিত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বি কত বড় সাহস বউকে ডিভোর্স দিতে যায়।

– বাদ দে এসব।

– বাদ দেওয়া যাবে না আমি তোর মতো ওতো ভালো মানুষ না আমি যা বলবো তাই করবি।

– আচ্ছা বল তুই যা বলবি তাই করবো।

– তোকে মেসেজ করে দিচ্ছি।

বলেই শিরিন কল কেটে দিল।

অরিত্রি শিকদার দরজার কাছে এসে বললেন
– ভেতরে আসবো?

অরিত্রি শিকদারের কন্ঠ শুনে একটু ভয় পেয়ে গেছে স্নিগ্ধতা। ভয়ে ভয়ে বলল,
– জ্বি আসুন।

অরিত্রি শিকদার ভেতরে প্রবেশ করলেন হাতে ফল আর দুধ নিয়ে।স্নিগ্ধতা ভয়ে জড়সড় হয়ে গেল, অরিত্রি শিকদার স্নিগ্ধতার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

– রেগে আছো আমার উপর? আমি অনেক বড় ভুল করেছি তোমাকে ঠিক ভাবে না চিনে না জেনেই বড় অন্যায় করে ফেলেছি পারলে মাফ করে দিও মা।

অরিত্রি শিকদারের এমন ব্যবহারে বেশ অবাক হয়েছে স্নিগ্ধতা যা অরিত্রি শিকদার বুঝতে পেরেছেন।তিনি মৃদু হেসে বললেন,

– একবার মা বলে ডাকবে? প্রথম যেদিন তোমার মুখে মা শব্দটা শুনেছিলাম অনেক ভালো লেগেছিল কিন্তু ভালো লাগাটা তখন গুরুত্ব দেইনি বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছি আমায় মাফ করে দাও।

স্নিগ্ধতা আবেগে কেঁদে দিল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– মা এভাবে বলবেন না।

অরিত্রি শিকদার স্নিগ্ধতার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

– আরিয়া আর স্তব্ধ ছোট থেকেই মম বলে ডেকে এসেছে তিহান বড় আম্মু বলে ডাকে মা ডাকটা এত যে মধুর শুনতে লাগে ভেতরে যে এত প্রশান্তি কাজ করে তোমার ডাকে তা অনুভব করেছি আমাকে তোমার মায়ের জায়গা দিতে পারবে কথা দিচ্ছি সবসময় মেয়ের মতো ভালোবেসে আগলে রাখব।

একদিকে বাবা হারানোর শোক আরেকদিকে মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দ, আজ পর্যন্ত এত সুন্দর করে আদর করে কেউ কথা বলেনি স্নিগ্ধতার সঙ্গে, ছোট থেকেই মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ছটফট করেছে কিন্তু শাহিলী ওয়াজেদ সেই ইচ্ছে কখনও পূরণ করেনি আজ সেই ইচ্ছে হয়তো পূরণ হবে শাশুড়ির মাধ্যমে,সবকিছু ভুলে অরিত্রি শিকদারকে জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধতা।

অরিত্রি শিকদারের চোখেও পানি চলে এসেছে এই পানি আনন্দের কেউ তো উনার জন্য খুশি হয়েছেন এতেই ভালো লাগছে।স্নিগ্ধতাকে সোজা বসিয়ে দিয়ে খাইয়ে দিতে লাগলেন।স্নিগ্ধতাও বাধ্য মেয়ের মতো খাচ্ছে, অরিত্রি শিকদার বললেন,

– আর কখনও যেন কষ্ট পেতে না দেখি তোমায় স্তব্ধের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে না পারলে আমায় বলবে।

স্নিগ্ধতা মাথা নাড়ালো, অরিত্রি শিকদার আবারও বললেন,
– মানুষ মরণশীল সবাই একদিন না একদিন এই পৃথিবী ত্যাগ করবে শুধু রয়ে যাবে প্রিয় মানুষদের স্মৃতিতে, বাবার জন্য আর কান্নাকাটি করবে না মন ভরে আল্লাহর কাছে দোয়া করবে।

স্নিগ্ধতা মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনছে, রাতুল শিকদার বাইরে থেকে সব শুনছিলেন এবার ভেতরে এসে বললেন,
– এক বাবা চলে গেছেন তো কি হয়েছে? আমি তো আছি তোমার আরেক বাবা।

– বাবা!

রাতুল শিকদার মৃদু হাসলেন অরিত্রি শিকদার বললেন,
– তুমি বিশ্রাম করো মা পরে কথা হবে।

– আচ্ছা।

অরিত্রি শিকদার রাতুল শিকদারকে বললেন,
– চলো মেয়েটাকে বিশ্রাম করতে দাও।

– তুমি যাও আমি আসছি।

অরিত্রি শিকদার চলে গেলেন রাতুল শিকদার স্নিগ্ধতার উদ্দেশ্যে বললেন,
– হায়াত মউত আল্লাহর হাতে প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্ৰহণ করতে হবে শুধু মৃত্যুর কারণটা আলাদা।

– হুম

– তুমি হয়তো ভাবতে পারো আমি কেন জোরালো ভাবে তোমার শাশুড়িকে বাধা দেইনি কেন অন্যায় মেনে নিচ্ছিলাম আজ তাহলে সত্যিটা বলি।

স্নিগ্ধতা উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো। রাতুল শিকদার বলতে লাগলেন,
– তোমার সঙ্গে স্তব্ধকে জোর করে বিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু বিয়ের পর ছেলেটা তোমার প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে মায়ায় পরে গেছে অন্যদিকে ওর মা তোমাকে পছন্দ করতেন না বোনের কথায় কিছু না ভেবেই তোমাদের আলাদা করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন স্তব্ধকে আলাদা ভাবে যখন ডিভোর্সের জন্য ফোর্স করলো স্তব্ধ রাজি হয়নি তাই সবার সামনে ব্ল্যাকমেইল করলো কিন্তু আমি তো আগেই কাগজ বদলে দিয়েছিলাম তাই কিছু বলিনি আর শেষে তোমাকে যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিল তখনও চুপ ছিলাম কারণ এটার দরকার ছিল তোমার আর স্তব্ধের একটা দূরত্বের দরকার ছিল এই দূরত্বের কারণেই স্তব্ধ তোমার শূন্যতা অনুভব করেছে একাকীত্বে ভোগেছে এলোমেলো হয়ে গেছে তোমার শাশুড়ি ছেলের কষ্ট বুঝতে পেরেছে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে অনেক সময় ভালো কিছু পাওয়ার জন্য নিজের সুখের জন্য কয়েক মুহূর্তের কষ্ট সহ্য করতে হয় কথায় আছে না দুঃখের পরে সুখ আসে। তুমি বাড়ি থেকে বের হতেই আমি শুভকে সব জানিয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু মিসেস ওয়াজেদ যে তোমার সঙ্গে এমন একটা কাজ করবে ভাবতেও পারিনি শুভ তোমায় হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার পর আমায় ফোন করেছিল আমি তখনি হাসপাতালে যাই কিন্তু তুমি অচেতন ছিলে বলে আমায় দেখতে পাওনি পরে শুভ শিরিনের কথা বলল আমিও রাজি হলাম তখন শিরিন তোমায় নিজের কাছে নিয়ে গেল আমি চেয়েছিলাম তোমাদের সম্পর্কটা যেন মজবুত হয় কখনও সামান্য কারণে ভেঙ্গে না যায় তাই এই অন্যায় হতে দিয়েছি।

কৃতজ্ঞতায় স্নিগ্ধতার চোখ ছলছল করছে। রাতুল শিকদার আবারও বললেন,
– তোমার বাবা অনেক আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি তোমার জম্মদাত্রী মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই উনার ভেতরে রোগ বাসা বেঁধেছিল বিভিন্ন দুশ্চিন্তায় তার উপর পরিবারে এত সমস্যা প্রথমবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে বেঁচে গেলেও এবার আর নিতে পারেননি।এতে ভালো হয়েছে যন্ত্রনা থেকে তো মুক্তি পেয়েছেন, তুমি আর কষ্ট পেও না, বাবার জন্য দোয়া করবে আর হ্যা এটা তোমার নিজের পরিবার।

স্নিগ্ধতা বলল,
– আপনি আমার জীবনে বাবার পরে দ্বিতীয় বাবা যে আমার জন্য এতকিছু করছেন আমি আপনার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ।

রাতুল শিকদার মৃদু হেসে স্নিগ্ধতার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন।আজ সব সুখ এসে একসঙ্গে হানা দিচ্ছে মনের দুঃখগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।

স্তব্ধ ঘরে এসে দরজা আটকে দিয়ে স্নিগ্ধতার পাশে বসে পড়ল।স্নিগ্ধতা মুখ ঘুরিয়ে নিতেই স্তব্ধ বলল,
– সবকিছু তো ঠিক হয়ে গেছে তাহলে এখনও কেন রাগ করে আছো?

– রাগ করিনি।

– আমার উপর রাগ করেছ তো।

স্নিগ্ধতা নিরব,স্তব্ধ শুতে শুতে বলল,
– দু’দিন ঠিক মতো ঘুম হয়নি অনেক ঘুম পাচ্ছে।

– আপনি এখানে ঘুমাতে পারবেন না।

– কেন কেন!

– আপনি এখানে ঘুমালে আমি নিচে গিয়ে শুয়ে থাকব।

– শোধ নিচ্ছো?

– যা মনে করেন।

– স্যরি।

– এভাবে বিরক্ত করলে চলে যাব আর খুঁজেই পাবেন না।

– হাইপার হবার কি আছে? আমি সোফায় গিয়ে ঘুমাচ্ছি।

বলেই স্তব্ধ লাইট নিভিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে স্তব্ধ আর স্নিগ্ধতার মধ্যে এখনও দূরত্ব বজায় আছে,স্তব্ধ অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু স্নিগ্ধতা দূরত্ব কমাচ্ছেই না বাড়ির সবার সঙ্গে সুন্দর করে হেসে কথা বললেও স্তব্ধের ক্ষেত্রে গম্ভীর সবাইকে সময় দিলেও স্তব্ধের জন্য কোনো সময় নেই এখনও স্তব্ধকে কষ্ট করে সোফায় ঘুমুতে হচ্ছে।

চলবে……

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৮

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৮

স্নিগ্ধতা এখন ঠিক উপলব্ধি করতে পারছে বাবার মৃত্যু। পাগলামী বন্ধ হয়ে গেছে কার কাছেই বা পাগলামী করবে নিজের বলতে তো এখন কেউ নেই। অশান্ত স্নিগ্ধতা আগের মতো চুপচাপ হয়ে গেছে কারো সঙ্গে কথা বলছে না, স্তব্ধ অনেক চেষ্টা করেও কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছে।

সারাটা দিন পানি ছাড়া মুখে কিছু তুলেনি স্নিগ্ধতা জোর করেও খাওয়ানো যায়নি কেউ তার উপর জোর খাটাতে পারছে না। স্তব্ধের ঘরের বেলকোনির মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধতা।স্তব্ধ এসে পাশে বসলো কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,

– তোমার নিরবতা আমার সহ্য হচ্ছে না একবার তো কথা বলো।

স্নিগ্ধতা নিশ্চুপ।স্তব্ধ অসহায় কন্ঠে বলল,
– আমার উপর রাগ করেছ? তুমি তো উপস্থিত ছিলে দেখলে তো মম কিভাবে ব্ল্যাকমেইল করেছিল আমি কি করতাম নিজের জীবনের থেকেও মম আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তবে তোমায় ছাড়া একটুও ভালো ছিলাম না অনেক খুঁজেছিলাম তোমায়, ভেবেছিলাম মমকে বুঝিয়ে সব ঠিক করে নিব কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল।

স্নিগ্ধতা পুর্বের মতো বসে আছে,স্তব্ধ অসহায় কন্ঠে বলল,
– বাবার কথা মনে পড়ছে?

স্নিগ্ধতা এবার নিরবতা ভেঙ্গেছে,দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো,
– আমার বাবা আর মা দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসতো পরিবারের বিপক্ষে গিয়ে দু’জন বিয়ে করেছিল নানার বাড়ির লোকেরা কখনও মেনে নেয়নি পরবর্তীতে দাদা মেনে নিলেও দাদী আর ফুফু মেনে নেননি মা’কে তারা সহ্য করতে পারতেন না শুধু দাদার জন্য বাধ্য হয়ে মেনে নেওয়ার নাটক করছিলেন তবে বাবা-মায়ের সংসার ভালোই চলছিল হঠাৎ একদিন মা জানতে পারেন তিনি মা হতে চলেছেন তারপর তাদের জীবনে আরও খুশি আসে সময় চলতে থাকে মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকে আমাকে জম্ম দিয়েই মা পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আমাকে আর বাবাকে একা রেখে চলে যান।

স্তব্ধ মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনতে লাগলো কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করল,
– তাহলে শাহিলী ওয়াজেদ কে?

স্নিগ্ধতা আবারও বলতে লাগলো,
– বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমাকে নিয়েই বাকি জীবনটা পার করবেন কিন্তু বাঁধ সাধলো আমার দাদী বাবাকে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে জোর করে নিজে মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে দেন, মা মা’রা যাওয়ার একমাস পরেই বাবা নতুন বউ নিয়ে বাড়িতে আসেন আমি তখন দুধের শিশু বাবা বিয়েটা মূলত আমার জন্যই করেছিলেন যাতে আমার মায়ের জায়গা পূরন হয়, কিন্তু মা আমায় কখনও নিজের সন্তানের চোখে দেখেনি শুভ আমার থেকে দেড় বছরের ছোট শুভ জম্মানোর পর থেকেই মায়ের আসল রূপ বের হতে থাকে শুরু হয় আমার প্রতি অনাদর আর খারাপ ব্যবহার তখন ছোট ছিলাম কিছু বুঝতাম না ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম সবটা জানতে পারলাম বুঝতে শিখলাম দাদীও আমায় সহ্য করতেন না সৎ মায়ের সঙ্গে মিলে আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন কিন্তু বাবা কিছু জানতেনও না তারপর দাদীও মা’রা যায় আমার প্রতি মায়ের ব্যবহার বাবার কাছে প্রকাশিত হতে থাকে প্রথম প্রথম বাবা প্রতিবাদ করলেও মায়ের প্রতি ভালোবাসার কারণে প্রতিবাদ করা বন্ধ করে দেয়।

স্নিগ্ধতার গলাটা এবার ভারি হয়ে আসে চোখে পানি চলে এসেছে তারপরেও বলতে থাকলো,

– জানেন এমনও অনেক দিন গেছে বাঁশের কঞ্চির মা’র খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম শরীরে অজস্র আঘাত আর ব্যথা নিয়ে গাধার মতো ঘরের সব কাজ করেছি অনেক গালিগালাজ শুনেছি, জ্বর নিয়ে সারারাত ছটফট করেছি কেউ ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেনি খাওয়া নিয়ে খোটা শুনেছি কেউ একটুও ভালোবাসেনি শুভকে কখনও মা আমার সঙ্গে কথা বলতে দিত না তবে শুভ মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে খাবার দিয়ে যেত মাঝে মাঝে কিভাবে যেন আমার কষ্ট বুঝে যেত আর ব্যথার ওষুধ দিয়ে যেত, একসময় বাড়িতে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হলো মা আমাকে তাড়ানোর জন্য বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগলেন পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইলেন তখন বাবা মা’কে আটকে দিয়েছিলেন আমিও কলেজে উঠে টিউশনি করে নিজের পড়াশোনা চালিয়েছি তারপর ভেবেছিলাম চাকরি করবো সাথে মাস্টার্সে ভর্তি হব দুঃখ কষ্ট হয়তো এবার ঘুচবে মা হয়তো একটু হলেও ভালোবাসবে কিন্তু হঠাৎ করে বিয়ে ঠিক করে ফেলে আমাকে ভয় দেখায় অদ্ভুত ব্যাপার বাবাও কিছু বলেনি নিরুপায় হয়ে অচেনা একটা লোককে বিয়ের জন্য বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়।

স্তব্ধের চোখের কোণেও পানি জমে গেছে স্নিগ্ধতা ঢুকরে কেঁদে উঠে বলল,
– তারপরেও উনাকে আমি মা বলে সম্বোধন করি কারণ বুঝ হবার পর থেকে উনাকেই মা হিসেবে জানি চিনি, উনি মা উনার দুই রূপ আমায় পেটে ধরেননি বলে আমি সৎ মেয়ে বলে আমার উপর অত্যাচার করেছেন অথচ অন্যদিকে শুভ উনার ছেলে বলে ছোট থেকে যত্ন সহকারে বড় করেছেন কোনো আচর লাগতে দেননি কই আমি তো কখনও উনাকে সৎ মা ভাবিনি সবসময় মা বলে ডেকেছি সম্মান দিয়েছি তারপরেও আমার প্রতি মনুষ্যত্বের খাতিরে একটু মায়া জন্মায়নি? এই তেইশ বছরের জীবনে আমি এতটুকু বুঝেছি নিজের মা না থাকলে জীবনের রঙ হয় বিবর্ণ সব সুখ হারিয়ে যায় কষ্ট ছাড়া কিছুই থাকে না।

স্নিগ্ধতা কাঁদতে লাগলো এই কান্না থামার না আপনজনদের হারালে চোখের পানি গুলো জলাধারে বইতে থাকে।স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধতাও স্তব্ধের বুকে মাথা রাখলো এসময় তার একটা বিশ্বস্ত জায়গা দরকার ছিল যা হয়তো পেয়ে গেছে কথাগুলো শুনে স্তব্ধের মনে আক্ষেপ হানা দিয়েছে,’মা এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? সৎ মা হয়তো পারে।’

স্নিগ্ধতা বলতে লাগলো,
– যত যাই হোক না কেন কেউ তো আপন বলতে দুনিয়াতে ছিল কেউ তো আমার ভালো চাইতো কিন্তু এখন বাবা নামক সেই মানুষটাও আর নেই আমি সম্পূর্ণ একা বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই আমার।

স্তব্ধ আরো শক্ত করে স্নিগ্ধতাকে ধরে,
– কে বলেছে তোমার আপন কেউ নেই আমি আছি তো আমার জন্য বাঁচবে তুমি, তুমি শুধু আমার হয়ে থাকবে।

– সেই তো আবার ছেড়ে চলে যাবেন আর আমি কষ্ট পাবো একা একা।

– কখনও ছেড়ে যাব না কথা দিলাম, একদিন তোমাকে ছাড়াই আমার অবস্থা খারাপ ছিল খুব একা লাগছিল জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছিল ভুল করেও তোমায় ছাড়বো না সবসময় বুকে আগলে রাখব।

স্নিগ্ধতার কান্নার বেগ কমে গেছে সেও স্তব্ধকে শক্ত করে ধরে আছে ছেড়ে দিলেই যেন চলে যাবে।

স্নিগ্ধতা না খাওয়ায় স্তব্ধও না খেয়ে আছে মনে মনে ভেবে নিয়েছে যতক্ষন না স্নিগ্ধতা মুখে কিছু তুলবে ততক্ষন নিজেও খাবে না।অরিত্রি শিকদার ছেলে এবং ছেলের বউয়ের জন্য খাবার সাজিয়ে ট্রে তে করে নিয়ে এসেছিলেন দরজা খোলাই ছিল তাই ভেতরে ঢুকতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করেই স্নিগ্ধতার জীবনের তিক্ত যন্ত্রনা দায়ক কথাগুলো শুনতে পেলেন, প্রত্যেকটা কথা শুনে উনার চোখ ভিজে গেছে।

রাতুল শিকদার অরিত্রিকে খুঁজতে খুঁজতে স্তব্ধের ঘরে দাড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলেন কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– এখানে এভাবে দাড়িয়ে আছো কেন?

অরিত্রি শিকদার কোনপ্রকার উওর না দিয়ে নিঃশব্দে ট্রে টি- টেবিলে রেখে ঘরের দিকে চলে গেলেন। রাতুল শিকদার মনে মনে বললেন,’এর আবার কি হয়েছে?’

অরিত্রি শিকদার বিছানায় বসে আছেন রাতুল শিকদার পাশে বসে বললেন,
– কি হলো? ছেলের ঘরে গিয়ে মন খারাপ করে চলে এলে কেন?

– স্নিগ্ধতার বয়সটা অনেক অল্প এই অল্প বয়সেই মেয়েটার জীবনে এত কষ্ট? যতই সৎ মা হোক না কেন মা তো,মা হয়ে কিভাবে মেয়ের সঙ্গে এমন করে মানুষ? মানছি আমি অপরাধ করেছি কিন্তু আমি নিজের ছেলের ভালো চেয়েছিলাম তবে ওই মেয়েটার তো কোনো ক্ষতি করিনি চাইওনি।

রাতুল শিকদার বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারলেন আক্ষেপের নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– এতটুকু শুনেই কষ্ট পাচ্ছো বাকি ঘটনাগুলো তো জানোই না আমি আর মি. সানজিদ ছাড়া কেউই জানতো না।

– আর কি ঘটনা?

– মি.সানজিদ আমার অফিসে অনেক বছর ধরে কাজ করছিলেন এই সূত্রেই একটা বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক ছিল সেই ক্ষেত্রেই উনার কাছ থেকে স্নিগ্ধতার সম্পর্কে সবটা জানতে পারি, জানো স্নিগ্ধতার বিয়ে ঠিক করেছিল শাহিলী ওয়াজেদ,যেই ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল সেই ছেলেটা ভালো না জেনেও টাকার লোভে এবং স্নিগ্ধতার ক্ষতির জন্য বিয়ে দিতে চেয়েছেন।

– টাকার লোভে!

– হ্যা, বিয়েটা ছিল নামমাত্র লোক দেখানো আসল কাহিনী তো ছিল অন্যকিছু শাহিলী রিয়াদ নামক ছেলেটির কাছে স্নিগ্ধতাকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন অনেক টাকার বিনিময়ে, রিয়াদকে দিয়ে অন্য একজন স্নিগ্ধতার ক্ষতি করতে চেয়েছিল তাদের প্লান ছিল বিয়ের পর স্নিগ্ধতাকে বিদেশে পাচার করে দেওয়া, স্নিগ্ধতা আমাকে একবার বাঁচিয়েছিল ব্যবহারও অনেক ভালো তারপর থেকেই ওকে স্তব্ধের জন্য পছন্দ করেছিলাম কিন্তু তোমার উপর কথা বলতে পারিনি যখন সানজিদ ওয়াজেদ এসে আমায় সবটা জানায় তখনি আমি লোক দিয়ে রিয়াদের খোঁজ খবর নেই আর সবটা জানতে পারি।

– তারপর!

– তারপর আর কি পুলিশকে খবর দিয়ে রিয়াদকে ধরিয়ে দেই আর স্তব্ধের সঙ্গে স্নিগ্ধতার বিয়ে দিয়ে বাড়িতে আনি, ভেবেছিলাম এবার হয়তো মেয়েটার কষ্ট কমবে আমার ছেলেটাও বদলাবে, স্নিগ্ধতা তোমার থেকে মায়ের ভালোবাসা পাবে কিন্তু সব হলো শুধু তোমার মনে জায়গা করে নিতে পারলো না।

অরিত্রি শিকদারের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল অপরাধবোধ ভেতরটা পুড়াচ্ছে। রাতুল শিকদার আক্ষেপ করে বললেন,

– স্নিগ্ধতা ভালো একটা মেয়ে আর ওর জীবনেই এত কষ্ট সানজিদ ওয়াজেদও মা’রা গেলেন বাবার মৃত্যু হয়তো সহ্য করতে পারেনি মেয়েটা।

অরিত্রি শিকদার চোখের পানি মুছে বললেন,
– আগে যদি পুরো ঘটনা আমায় বলতে তাহলে কখনো এমন ভুল করতাম না দু’জনকে আলাদা করতাম না।
_____________

স্তব্ধের বুকে মাথা রেখেই স্নিগ্ধতা ঘুমিয়ে গেছে আর স্তব্ধ দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে যত্ন করে স্নিগ্ধতাকে আগলে রেখেছে।স্নিগ্ধতার এমন অবস্থা দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে তার।স্নিগ্ধতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্তব্ধ আস্তে করে বলল, ‘তোমার সব কষ্ট আমি দূর করে দিব কখনো আমার থেকে দূরে যেতে দিব না মম যদি তোমায় মেনে না নেয় তাহলে আমরা দূরে কোথাও চলে যাব।

শাহিলী ওয়াজেদকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। শাহিলী ওয়াজেদের ছোট ভাই, ভাইয়ের বউ আর ভাইয়ের ছেলে থেকে গেছে এতে শুভর ভার কিছুটা কমেছে।

স্নিগ্ধতাকে জাগিয়ে জোর করে নিজ হাতে অল্প কিছু খাবার খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিয়েছে স্তব্ধ।স্নিগ্ধতার চোখগুলো ফুলে গেছে মুখটাও শুকিয়ে গেছে, স্তব্ধ স্নিগ্ধতার ক্ষত জায়গায় মলম লাগিয়ে দিয়ে বলল,

– নাও এবার শুয়ে পড়।

– আপনি কোথায় শুবেন?

স্তব্ধ ব্রু জোড়া কুঁচকে নিয়ে বলল,
– এতদিন যেখানে শুয়েছি সেখানে।

– তাহলে আমায় এখানে শুতে বলছেন কেন?

– তুমি তো এতদিন আমার পাশেই শুতে এখনও শুবে।

– তখন আমরা স্বামী-স্ত্রী ছিলাম কিন্তু এখন আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

স্তব্ধ কিছু বলার মতো পেল না স্নিগ্ধতা বিছানা থেকে নেমে গিয়ে বলল,
– আপনি আপনার ঘরে ঘুমান আমি দিদানের ঘরে শুয়ে পড়বো।

বলেই স্নিগ্ধতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল,স্তব্ধ কিছু একটা ভেবে পেছনে ছুটে গেল। রাতুল শিকদার এবং অরিত্রি শিকদার হল ঘরে ছিলেন স্নিগ্ধতাকে আসতে দেখে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

– স্নিগ্ধা মা কেমন আছো? খাবার খেয়েছ?

– জ্বি।

স্তব্ধকে অস্থির হয়ে পেছনে আসতে দেখে রাতুল শিকদার কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বললেন,

– স্নিগ্ধা মা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটোছুটি করা উচিত নয়।

স্তব্ধ স্নিগ্ধতার পাশে এসে বলল,
– আমিও এটাই বলছিলাম।

– আজ রাতটা আমি দিদানের ঘরে থাকি।

– স্তব্ধের ঘর থাকতে মায়ের ঘর কেন?

– উনার সঙ্গে তো আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে এক ঘরে থাকব কেন? এছাড়া এ বাড়িতেও আমি আর থাকতে চাই না কাল সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাব আমাকে নিয়ে কারো ভাবার দরকার নেই।

অরিত্রি শিকদার দৃষ্টি নত করে ফেললেন ছেলে আর ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস নেই।স্তব্ধ রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলল,

– মামার বাড়ির আবদার নাকি বাড়ি থেকে চলে যাবে মানে? একবার বাড়ি থেকে বের হয়ে পাখনা গজিয়ে গেছে? আমি ছাড়া তুমি আর কোথাও যেতে পারবে না আর কিসের ডিভোর্স ওইটা আমি সংশোধন করে নিব।

চলবে……

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৭

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৭

স্নিগ্ধতাদের বাড়িতে তালা লাগানো দেখে স্তব্ধ বিষন্ন মন নিয়ে গাড়ির কাছে যেতেই পেছন থেকে কেউ ডেকে বলল,
– দুলাভাই আপনি এখানে?

স্তব্ধ পেছনে ঘুরে একটা ছেলেকে দেখলো কিন্তু চিনতে পারলো না। স্তব্ধের মুখের ভঙ্গি বুঝতে পেরে ছেলেটা এগিয়ে এসে বলল,
– আমি শুভ স্নিগ্ধা আপুর ছোট ভাই।

স্তব্ধ শুভর কথা আগে শুনেছে তবে কখনও না দেখায় চিনতে অসুবিধা হয়েছে।স্তব্ধ অস্থির গলায় প্রশ্ন করল,

– স্নিগ্ধ কোথায়? বাড়িতে তালা কেন?

– বাবা আবারো হার্ট অ্যাটাক করেছে হাসপাতালে ভর্তি মাও হাসপাতালে বাড়িতে কেউ নেই তাই তালা লাগানো ছিল আমি এসেছি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে।

স্তব্ধ চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কখন এমন হয়েছে?

– আজ।

– আর স্নিগ্ধ?

– আপুর কথা জেনে কি করবেন? বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগে একবারও ভেবেছিলেন? আপনার কারণে মা আপুকে অনেক মে’রেছে আর বাবাও চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গেছেন।

স্তব্ধের ভেতর অপরাধবোধ কাজ করছে কিন্তু এ ছাড়া তো কোনো উপায় ছিল না, স্তব্ধ অননুনয় করে বলল,
– নিজের ভুল শুধরে নিতে চাই প্লিজ বলো স্নিগ্ধ কোথায়?

– স্নিগ্ধা আপুকে শিরিন আপু সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।

– শিরিন কে?

– আপুর বান্ধবী বাবার এমন অবস্থার কারণে আমি চলে এসেছি মা আপুকে সহ্য করতে পারছে না আপুকে পেলে মে’রেই ফেলবে আপুও অনেক অসুস্থ তাই শিরিন আপু নিয়ে গেছে তার বাড়িতে।

– শিরিনের বাড়ির এড্রেসটা দাও।

– শিরিন আপু তো বাসা পাল্টিয়ে ফেলেছে বর্তমান এড্রেস তো জানি না আর এখন আমায় হাসপাতালে যেতে হবে বাবা অনেক অসুস্থ।

– আচ্ছা চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

– এখন আপনার যাওয়া ঠিক হবে না মা খারাপ ব্যবহার করতে পারে।

স্তব্ধ জবাব দেওয়ার মতো কিছু পেল না তাই ওখান থেকে চলে গেল।

স্নিগ্ধতা শিরিনের সঙ্গে তার ফ্ল্যাটে এসেছে, নতুন চাকরির জন্য শিরিন কলেজের কাছাকাছি ফ্ল্যাট নিয়েছে আগে স্নিগ্ধতার বাড়ির পাশেই থাকতো। শিরিনের বাবা-মা স্নিগ্ধতাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর করেন তবে তারা বাড়িতে নেই গ্ৰামের বাড়িতে গেছেন। স্নিগ্ধতা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে কান্না করছে, শিরিন পাশে এসে বসে,

– আবারো কাঁদছিস কেন? যারা তোর কথা ভাবে না তাদের জন্য চোখের পানি অপচয় করার কি দরকার?

– আমি তো তাদের ভালোবাসি তারা আমার আপন মানুষ।

– স্তব্ধকে কি তুই ভালোবাসিস?

– হু।

– কখনও বলেছিস?

– উহু।

– বলিসনি কেন?

– বলার মতো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাই বলিনি।

– সম্পর্ক গড়ার আগেই ভেঙ্গে গেল এমনিতেও এটা হওয়ারই ছিল ছেলে মানুষকে জোর করে বিয়ে দিলে কখনো কি সম্পর্ক টিকে।

– এতে উনার তেমন দোষ নেই উনার মায়ের কারণে..

– এসব আমায় বুঝাস না তোর হাজব্যান্ড বাচ্চা নয় যে মা যা বলবে তাই শুনবে এসব বড়লোক ছেলেদের আমার চেনা আছে তোর এই ভালোমানুষীর কারণে আজ তোর এই অবস্থা তোকে যেন আর কাঁদতে না দেখি কারো সঙ্গে যোগাযোগ করারও চেষ্টা করবি না।

শিরিনের কথার উল্টো পিঠে কথা বলার সাহস নেই স্নিগ্ধতার। শাহিলী ওয়াজেদের কঠোরতার কারণেই স্নিগ্ধতা চুপচাপ স্বভাবের কখনও নিজের চঞ্চলতা প্রকাশ করতে পারেনি ছোট থেকেই অনেক মার হজম করে এত বড় হয়েছে কিন্তু মুখ ফুটে প্রতিবাদ করতে পারেনি ভয়ে।
_______________

শরীরের আঘাত গুলোর জায়গায় এখনও তিব্র ব্যথা, হাতে দাগগুলো দেখা যাচ্ছে শিরিন পরম যত্নে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে। মাঝরাতে শিরিন স্নিগ্ধতাকে টেনে ঘুম থেকে তুললো, স্নিগ্ধতা চোখ ডলতে ডলতে জিজ্ঞেস করল,

– সকাল হয়ে গেছে এত তাড়াতাড়ি?

– না, রেডি হয়ে আয় তোদের বাড়িতে যেতে হবে।

– রাতের বেলা বাড়িতে! কারো কি কিছু হয়েছে?

– গেলেই দেখতে পাবি।

স্নিগ্ধতা রেডি হয়ে আসতেই দু’জনে মিলে বের হয়ে গেল।এত রাতে গাড়ি পাওয়া দুষ্কর তাই শিরিন তার পরিচিত ক্যাব ভাড়া করেছে। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে শিরিনি স্নিগ্ধতার হাত ধরে বলল,

– যাই হয়ে যাক মন শক্ত রাখবি একদম ভেঙে পড়বি না এই দুনিয়াতে কেউ স্থায়ী নয় সবাই একদিন না একদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবে।

– কার কি হয়েছে? আচ্ছা বাবার কিছু হয়নি তো!

– বললাম তো গেলে সব জানতে পারবি।

এবার স্নিগ্ধতার অনেক চিন্তা হচ্ছে শিরিনকে আর প্রশ্ন করলো না কারণ সে জানে জিজ্ঞেস করলেও কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না।

সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছে অথচ মাঝরাত হয়ে যাওয়ার পরেও বাড়ি ফেরেনি স্তব্ধ। বাড়ির সবাই অনেক চিন্তা করছে অরিত্রি শিকদারের তো যায় যায় অবস্থা। তিহান, রাতুল শিকদার অনেকবার কল দেওয়ার পরেও স্তব্ধ ধরেনি।

বড় এক লেকের ধারে বসে আছে স্তব্ধ এই প্রথম জীবনে একাকীত্ব অনুভব হচ্ছে।স্নিগ্ধতাকে ছাড়া সে ভালো নেই অনেক চেষ্টার পরেও স্নিগ্ধতাকে খুঁজে পায়নি।বাড়ি থেকে অনেক কল এসেছে দেখেও রিসিভ করেনি সবাইকে বিরক্ত লাগছে বিড়বিড় করে বলছে,’আমার স্নিগ্ধতাকে আমার থেকে আলাদা করার জন্য সবাই দায়ী ওদের কারণেই স্নিগ্ধ আমায় একা করে দিয়ে লুকিয়ে আছে।’

স্তব্ধ নিজের চুলগুলো শক্ত করে ধরে,’একবার ফিরে এসো না স্নিগ্ধ আর কখনও তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দিব না।’

রাতুল শিকদারের নাম্বার থেকে স্তব্ধের ফোনে মেসেজ এসেছে।স্তব্ধ মেসেজ গুলো দেখতে লাগলো, মেসেজ দেখেই স্তব্ধ থমকে গেল দ্রুত গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দিল।

বাড়ির সামনে এসে স্নিগ্ধতা দাড়িয়ে আছে মুখে ভয় ফুটে উঠেছে। শিরিন বলল,

– দাড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে চল।

– মা যদি আবার মারে?

– মারবে না আমি আছি তো।

ভয়ে ভয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকছে স্নিগ্ধতা, বাড়িতে অনেক আত্নীয় স্বজনের ভীড় কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।স্নিগ্ধতার ভেতরটা কেঁপে উঠলো বসার ঘরে যেতেই থমকে গেল হাত-পা কাঁপা শুরু হয়ে গেছে।খাটিয়ায় কাফনে জড়ানো সানজিদ ওয়াজেদ শুয়ে আছে তার কিছুটা দূরে শাহিলী ওয়াজেদ আর স্নিগ্ধতার আপন ফুফু কান্না করছে কিছু মহিলা তাদের ধরে রেখেছেন।

স্নিগ্ধতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, খাটিয়ার কাছে গিয়েই ঢপ করে বসে পড়লো।শাহিলী ওয়াজেদ স্নিগ্ধতাকে দেখেই অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে বলতে লাগলেন,

– এই অপয়ার জন্য আজ আমার স্বামী মা’রা গেছে ওরে আমি মে’রে ফেলব ছাড়ো আমায়।

শিরিন স্নিগ্ধতার কাধে হাত রাখতেই স্নিগ্ধতা বাচ্চাদের মতো কান্না করতে করতে জিজ্ঞেস করল,
– বাবা এভাবে শুয়ে আছে কেন? বাবাকে সাদা কাপড় পড়ানো হয়েছে কেন?

সানজিদ ওয়াজেদকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– বাবা কি হয়েছে তোমার? কথা বলো আমার সঙ্গে ও বাবা কথা বলছো না কেন?

কোনো উওর না পেয়ে স্নিগ্ধতার পাগলামীটা বেড়ে গেল।শুভ স্নিগ্ধতাকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– বাবা আর বেঁচে নেই আপু মৃত মানুষ কিভাবে কথা বলবে?

স্নিগ্ধতা থেমে গেল একবার বাবার দিকে আরেকবার শুভর দিকে তাকালো।ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
– বাবা বেঁচে নেই?

শুভ স্নিগ্ধতাকে ছেড়ে বাবার লাশের মুখটা ঢেকে দিল। স্নিগ্ধতার মস্তিষ্কে কথাটা বারবার আঘাত করছে চারিপাশ ঝাপসা লাগছে, শরীর অসার হয়ে যাচ্ছে দাড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না। একপলক সানজিদ ওয়াজেদকে দেখেই হঠাৎ করে স্নিগ্ধতা অজ্ঞান হয়ে গেল মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগেই স্তব্ধ ধরে ফেলল, নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল।

সানজিদ ওয়াজেদের মৃত্যুর খবর শুনেই স্তব্ধ দ্রুত তাদের বাড়িতে চলে এসেছে। রাতুল শিকদার অরিত্রি শিকদার এবং তিহান নিজেদের মতো করে আলাদা এসেছে। নিস্তেজ অজ্ঞান স্নিগ্ধতাকে একটা ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল স্তব্ধ। শিরিনও পেছনে পেছনে গেল, অরিত্রি শিকদার এগিয়ে গিয়ে বললেন,

– মুখে একটু পানি ছিটিয়ে দে জ্ঞান ফিরে আসবে।

শিরিন রূঢ় কন্ঠে বলল,
– জ্ঞান ফেরানোর দরকার নেই এভাবেই থাকুক, জ্ঞান ফিরলেই আঙ্কেলের জন্য পাগলামী করবে তখন ওকে সামলানো কঠিন হবে।

তিহান এতক্ষণে শিরিনকে খেয়াল করল।শিরিনকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়েছে তবে এখন এখানে কোনো প্রশ্ন করা উচিত হবে না। অরিত্রি শিকদার ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,

– তুমি কে?

– স্নিগ্ধার বান্ধবী, আপনি কে?

অরিত্রি শিকদার মুখটা কাঁচুমাচু করে,
– স্তব্ধের মা।

– ওহ আপনি স্নিগ্ধার সেই দজ্জাল শাশুড়ি।

– কি বললে?

– কিছু না।

স্তব্ধ স্নিগ্ধতার হাত ধরতে যাবে তখনি শিরিন স্নিগ্ধতার হাত সরিয়ে দিয়ে,
– স্নিগ্ধার থেকে দূরে থাকুন এখন আর মানবতা দেখাতে হবে না ।

স্তব্ধ কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাতুল শিকদার স্তব্ধকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে গেলেন। শুভর কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, একবার বড়সড় হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছিল সেখান থেকে কোনমতে বেঁচে ফিরলেও ঠিক মতো ওষুধ না খাওয়ায় এবং অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় আবারো হার্ট অ্যাটাক করে একসময় হাসপাতালেই মা’রা যান সানজিদ ওয়াজেদ।

সানজিদ ওয়াজেদের মৃতদেহ দাফন করে সবাই বাড়িতে ফিরেছে।শুভ ভেঙ্গে পড়েছে কিভাবে সব সামলাবে তাই ভাবছে একদিকে বাবার মৃত্যুর শোক আরেকদিকে মা আর বোন। শাহিলী ওয়াজেদ স্নিগ্ধতার প্রতি নির্মম,কঠোর এবং খারাপ মা হলেও একজন আদর্শ স্ত্রী যে স্বামীকে অনেক ভালোবাসে স্বামীর মৃত্যুতে এখনও কান্নাকাটি করছেন।

স্নিগ্ধতার জ্ঞান ফিরেনি স্তব্ধ শিরিনের কারণে স্নিগ্ধতার কাছে যেতে পারছে না। শিরিন কাউকে স্নিগ্ধতার কাছাকাছি ঘেঁষতে দিচ্ছে না, অরিত্রি শিকদার অনুতপ্ত নিজের ছেলের ভালো থাকার জন্য এখন তিনি স্নিগ্ধতাকে আবারও স্তব্ধের জীবনে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন নিজের ভুল শুধরে নিতে চান।

স্তব্ধ বেশ বিরক্ত হলো, মুখে রাগ ফুটে উঠেছে শিরিনকে পরোয়া না করে এবার গিয়ে স্নিগ্ধতাকে কোলে তুলে নিলো শিরিন ধমক দিয়ে বলল,

– কোলে নিলেন কেন ওকে? নামান বলছি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন স্নিগ্ধাকে?

– আমার ওয়াইফকে যেখানে ইচ্ছে সেখানে নিয়ে যাব আপনি জিজ্ঞেস করার কে? আমাদের মাঝখানে আর যদি কেউ আসে তাহলে একদম ভালো হবে না।

বলেই স্নিগ্ধতাকে নিয়ে স্তব্ধ বেরিয়ে গেল। সবাই স্তব্ধের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
________________

স্নিগ্ধতার জ্ঞান ফিরেছে আশেপাশে তাকাতেই পরিচিত ঘর দেখতে পেল নিজেকে স্তব্ধের বিছানায় আবিষ্কার করল পরক্ষনেই বাবার লাশটা চোখে ভেসে উঠতেই বিছানা থেকে উঠতে গেল কিন্তু স্তব্ধ এসে আটকে দিল।স্নিগ্ধতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

– আমাকে যেতে দিন আমি বাবার কাছে যাব।

স্তব্ধ স্নিগ্ধতার গালে হাত রেখে বলল,
– তোমার বাবা আর বেঁচে নেই উনাকে দাফন করা হয়ে গেছে।

– আপনি মিথ্যে বলছেন সরুন আমি বাবার কাছে যাব বাবা আমায় একা রেখে চলে যেতে পারে না।

– বাস্তবতা মেনে নাও স্নিগ্ধ তোমার বাবা আর নেই।

স্নিগ্ধতা এবার জোরে কেঁদে দিল আর স্তব্ধ তাকে নিজের বুকে আগলে ধরলো।বাবা যে মা’রা গেছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে পৃথিবীতে আপন বলতে একটা মানুষই ছিল স্নিগ্ধতার,মা তো জম্ম দিয়েই ম’রে গেছে রেখে গেছে স্বার্থপর মানুষদের কাছে।

চলবে ………

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৬

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৬

কলিং বেল বেজে উঠল শাহিলী ওয়াজেদ এসে দরজা খুলে দিতেই স্নিগ্ধতাকে দেখে বেশ অবাক হলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই স্নিগ্ধতা শাহিলী ওয়াজেদকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল এই মুহূর্তে কারো সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই।শাহিলী ওয়াজেদ পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন,

– এসময় তুই একা বাড়িতে এলি? জামাই কোথায়?

স্নিগ্ধতা কোনো উত্তর দিল না নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বিছানায় নিস্তেজ ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিল। চেপে রাখা কান্না গুলো বের হয়ে আসছে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বালিশে মুখ গুজে অজস্র ধারায় কান্না করছে স্নিগ্ধতা।

শাহিলী ওয়াজেদ বাইরে থেকে চেঁচামেচি করছেন কিন্তু কোনো কথাই স্নিগ্ধতার কানে যাচ্ছে না। সানজিদ ওয়াজেদ বিছানা থেকে উঠতে পারেন না শাহিলী ওয়াজেদকে ডেকে বললেন,

– কে এসেছে কার উপর চেঁচামেচি করছো?

– তোমার অপয়া মেয়ে একা একা শশুর বাড়ী থেকে চলে এসেছে আর এসেই আমার মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে এত ডাকাডাকির পরেও একটা শব্দও করেনি।

সানজিদ ওয়াজেদ চমকায়িত কন্ঠে বললেন,
– কিহ! স্নিগ্ধা এমন করেছে?

– তোমার মেয়ের সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে যদি শশুর বাড়ীতে কোনো অঘটন ঘটিয়ে এখানে আসে তাহলে কিন্তু আমি ওকে মে’রেই ফেলব।

শাহিলী আরও কিছুক্ষণ বকাঝকা করে রান্নাঘরের দিকে গেলেন।

পুরো ঘর অগোছালো একপাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে স্তব্ধ।অরিত্রি শিকদার ছেলের ঘরে এসে চমকে গেছেন যে ছেলে এত গোছালো পরিষ্কার সে ছেলে নিজের ঘর এমন করে রেখেছে ভাবতেই অবাক লাগছে।অরিত্রি শিকদার স্তব্ধের কাধে হাত রেখে বললেন,

– একি অবস্থা করেছিস ঘরের কি হয়েছে বাবু মমকে বল।

স্তব্ধ চোখ খুলে তাকাতেই অরিত্রি শিকদার কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেন। স্তব্ধের চোখ রক্তিম বর্ণের মতো হয়ে গেছে অরিত্রি শিকদার জানতে চাইলেন,

– তোর চোখ এমন লাল হয়ে গেছে কিভাবে?

– কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার সামনে থেকে এখন যাও।

– এমন করে কথা বলছিস কেন? আমায় বল কি হয়েছে?

– কি বলার আছে তোমাকে? তোমরা আমার জীবনটাকে নিয়ে রীতিমত খেলা করছো, একজন হুটহাট জোর করে বিয়ে দিয়ে দিল সবকিছু মেনে নিয়ে যখন স্নিগ্ধকে নিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক শুরু করতে চাইলাম তখন তুমি মাঝখানে বাধা হয়ে দাড়ালে জোর করে আমার থেকে ওকে আলাদা করে দিলে, বাবা-মা হয়েছ বলে কি সন্তানের ইচ্ছে চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য নেই তোমাদের কাছে? সবসময় নিজেদের মন মতো সবকিছু চাপিয়ে দিবে, সত্যি বলতে তোমরা আমার ভালো চাও না নিজেদের ইচ্ছা আর জেদ রাখার জন্য আমাকে ব্যবহার করছো।

অরিত্রি শিকদারের চোখের কোণে পানি জমে গেছে। উনি কখনও চাননি স্তব্ধ কষ্ট পাক তিনি ভেবেছিলেন উনার সিদ্ধান্তে স্তব্ধের ভালো হবে কিন্তু ছেলের মুখ থেকে অভিযোগ শুনে নিজের উপর রাগ হচ্ছে। অরিত্রি শিকদার স্তব্ধের দিকে হাত বাড়াতেই স্তব্ধ সরে গিয়ে বলল,

– লিভ মি মম তোমার ইচ্ছে তো পূরণ হয়েছে তারপরেও কেন আমায় বিরক্ত করছো? আমার কিছু ভালো লাগছে না যাও এখান থেকে।

– আমি তোকে বিরক্ত করছি!

স্তব্ধ উওর দিল না অরিত্রি শিকদার ছেলের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন।আজ উনার মনে হচ্ছে এত বছর হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি সন্তানের মন বুঝতে পারেননি। রাতুল শিকদার স্ত্রীর পাশে এসে দাড়ালেন কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে তারপর বলতে লাগলেন,

– আমরা দু’জনেই আমাদের ছেলের ভালো চাই নাতাশাকে কখনই স্তব্ধের জন্য আমার পছন্দ ছিল না, স্নিগ্ধতার সঙ্গে বিয়েটা স্তব্ধ মেনে নিয়েছে, স্তব্ধ স্নিগ্ধতার সঙ্গেই থাকতে চায় আশা করি এটা তুমি বুঝতে পেরেছ তারপরেও কেন ছেলে আর ছেলের বউয়ের মাঝখানে বাধা হতে চাচ্ছো?কেন ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছো? তুমি কি বুঝতে পারছো না এসব করার ফলে তুমি স্তব্ধের থেকে দূরে সরে যাচ্ছো তোমার প্রতি ওর যেই সম্মান ভালোবাসা ছিল তা চলে যাচ্ছে।

অরিত্রি শিকদার আতঙ্কিত কন্ঠে বললেন,
– না আমি এমনটা চাইনি আমি চেয়েছিলাম আমার ছেলেটা যাতে সুখী হয় ভালো থাকে, রুশি আমায় বলেছিল ওদের আলাদা করে দিতে এতে নাকি স্তব্ধের ভালো হবে আমি কখনও বিবেক দিয়ে ভাবিনি রুশি যা বলেছে তাই বিশ্বাস করেছি।

– তুমি বাচ্চা নও যে নিজের সন্তানের ভালো মন্দের সিদ্ধান্ত অন্যের কাছ থেকে নিতে হবে।

রাতুল শিকদার চলে গেলেন অরিত্রি শিকদার একা হয়ে পড়লেন। বাড়িতে সবাই নিজেদের মতো চলাফেরা করে স্তব্ধ নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে কারো সঙ্গে কথা বলে না অরিত্রি শিকদার চেষ্টা করেও ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না। বাড়ির বাকি সদস্যরাও বেশি একটা কথা বলে না রাতুল শিকদারও এড়িয়ে চলছেন অরিত্রি শিকদারকে।
___________

একটা দিন কেটে গেল বেলা করে দরজা খুলল স্নিগ্ধতা চোখমুখ ফুলে গেছে কান্না করার ফলে।স্নিগ্ধতাকে দেখতেই শাহিলী ওয়াজেদ শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে জিজ্ঞেস করলেন,

– এতক্ষণ পর ঘর থেকে বের হওয়ার ইচ্ছে হলো,সত্যি করে বল এভাবে শশুর বাড়ী থেকে চলে এলি কেন?

স্নিগ্ধতা চুপ করে আছে শাহিলী ওয়াজেদ কিছু একটা ভেবে চোখ বড় বড় করে বললেন,
– তোকে কি ওরা বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে?

স্নিগ্ধতা কেঁদে দিল শাহিলী ওয়াজেদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন স্নিগ্ধতাকে আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই স্নিগ্ধতা দৌড়ে সানজিদ ওয়াজেদের ঘরে চলে গেল।

সানজিদ ওয়াজেদ অনেক চিন্তায় ছিলেন মেয়েকে দেখে চিন্তা একটু কমেছে তবে মেয়ের চোখে পানি দেখে জিজ্ঞেস করলেন,

– কাঁদছিস কেন? ওই বাড়ি থেকে এভাবে কেন চলে আসলি?

শাহিলী ওয়াজেদ পেছনে পেছনে ঘরে আসলেন মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
– তোমার মেয়েকে ওরা তাড়িয়ে দিয়েছে আমি বলে রাখলাম এই মেয়ের কোনো জায়গা নেই এই বাড়িতে সংসার আমার ছেলের কামাইতে চলে।

– চুপ করে সবটা শুনতে দাও। স্নিগ্ধা কি হয়েছে বল আমায়।

স্নিগ্ধতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– স্তব্ধ আমায় ডিভোর্স দিয়েছে উনার মা আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নেননি তাই বাড়ি থেকেও বের করে দিয়েছে।

সানজিদ ওয়াজেদ অশান্ত কন্ঠে বললেন,
– তোর শশুর কিছু বলেনি?

– বলার কিছু থাকলে তো বলবে।

সানজিদ ওয়াজেদের মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট মেয়েকে এখন কিভাবে রক্ষা করবেন নিজেই তো চলতে ফিরতে পারেন না।শাহিলী ওয়াজেদ ক্রোধ মাখা দৃষ্টিতে স্নিগ্ধতার দিকে এগিয়ে গেলেন, স্নিগ্ধতার চুলের মুঠি ধরে বসা থেকে উঠিয়ে টানতে টানতে বাহিরে নিয়ে যেতে লাগলেন। এমনিতেই মাথা ব্যথা তার উপর এভাবে চুলে আক্রমণ করার কারণে স্নিগ্ধতা হাউমাউ করে কান্না করছে, সানজিদ ওয়াজেদ চিল্লিয়ে বলছেন,

– শাহিলী ওকে ছেড়ে দাও কিছু করো না।

শাহিলী ওয়াজেদ কোনো কথা কানে না নিয়ে বসার ঘরে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিলেন স্নিগ্ধতাকে তারপর ঘর থেকে বাঁশের কঞ্চি নিয়ে এসে ইচ্ছে মতো মা’রতে লাগলেন। বাঁশের কঞ্চিটা মূলত স্নিগ্ধতার জন্যই আনা আগেও এটা দিয়ে অনেকবার মা’রা হয়েছে, স্নিগ্ধতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,

– মা আর মে’রো না খুব ব্যথা লাগছে ও মা….

এত অনুনয় বিনয়ও শাহিলী ওয়াজেদের নির্দয় মনকে দমাতে পারলো না এখনও স্নিগ্ধতাকে মে’রেই যাচ্ছেন।শুভ একটু বাহিরে গেছিল বাড়িতে ফিরতেই মায়ের এমন পাশবিক আচরণ দেখে দৌড়ে শাহিলী ওয়াজেদকে থামানোর চেষ্টা করলো। শাহিলী ওয়াজেদ রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

– শুভ সরে যা সামনে থেকে এই মেয়েকে আজ মে’রেই ফেলব অনেক জ্বালাচ্ছে।

রাগে যেন শাহিলী ওয়াজেদের শক্তি বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে উনাকে থামানোই দুষ্কর।শুভ শাহিলী ওয়াজেদকে থামাতে না পেরে স্নিগ্ধতাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে লাগল।এত আঘাত লাগায় স্নিগ্ধতা জ্ঞান হারিয়েছে শুভ বোনকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে শাহিলী ওয়াজেদ অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছেন।

স্তব্ধ রেডি হয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হলো।অরিত্রি শিকদার পেছন থেকে ডেকে বললেন,
– নাস্তা করে যা স্তব্ধ।

স্তব্ধ শুনেও না শোনার ভান ধরে দ্রুত হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। স্তব্ধের এমন ব্যবহার মা হয়ে মেনে নিতে পারছেন না অরিত্রি শিকদার উনার কাছে ছেলের খুশি সবার আগে। স্তব্ধ সারারাত ধরে অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর যাই হয়ে যাক স্নিগ্ধতাকে সে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে না দরকার হলে তাকে নিয়ে দূরে চলে যাবে।
_____________

বিষন্ন মন নিয়ে নিজের ক্লাস শেষ করে তিহান টিচার্স রুমের দিকে যাচ্ছিল পথিমধ্যে কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল ভালো করে তাকাতেই শিরিনকে দেখতে পেল। শিরিন কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,

– আমার মাথাটা ফেটেই গেছে রে এই লম্বু দেখে হাঁটতে পারেন না?

– আমি দেখেই হাঁটছিলাম হঠাৎ যে কোনো বটগাছ চলে আসবে আমি কি করে জানবো?

– এই এই আপনি কাকে বটগাছ বললেন?

– আমার সামনে যে আছে তাকেই বলেছি।

– এত বড় অপমান আপনাকে তো আমি…

কথার মাঝেই শিরিনের মোবাইল বেজে উঠলো। শিরিন রিসিভ করে কানে ধরতেই অপরপাশ থেকে কেউ কিছু বলল শিরিন মনোযোগ সহকারে শুনে বলল,

– তুই ওর কাছেই থাক আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসছি।

শিরিনের মুখে অস্থিরতা বিরাজ করছে দ্রুত পা ফেলে হাঁটা ধরলো তিহানও তার পেছনে ছুটলো। শিরিন প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে বলল,

– স্যার এখন আমার ইমার্জেন্সি ছুটির প্রয়োজন আমার বোন অসুস্থ হয়ে পড়েছে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এখনি আমাকে যেতে হবে।

প্রিন্সিপাল বললেন,
– আচ্ছা আপনি যান ফ্রি হলে একটা এপ্লিকেশন জমা দিয়েন।

– ধন্যবাদ স্যার।

আর এক মুহূর্তও না দাড়িয়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে গেল শিরিন।

শুভ স্নিগ্ধতাকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করেছে, স্নিগ্ধতার এমন অবস্থা দেখে মহিলা ডাক্তার পুলিশ কেইস করার কথা বলেছিল শুভ অনেক বুঝিয়ে নিষেধ করেছে। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে মা’রায় অনেক জায়গা কেটে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে আবার কিছু কিছু জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে, শরীর ক্লান্ত এবং তীব্র জ্বর।

শিরিন রিসিপশন থেকে জেনে তারপর কেবিনের দিকে এলো।শুভকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
– স্নিগ্ধার কি অবস্থা কেমন আছে?

– তেমন ভালো না কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তাই তোমায় ফোন করেছি তুমি ছাড়া আপুকে কেউ সামলাতে পারবে না।

– একদম ঠিক করেছিস দাড়া আমি স্নিগ্ধার সঙ্গে দেখা করে আসি।

শুভর ফোনে শাহিলী ওয়াজেদের কল আসলো কয়েক সেকেন্ড কথা বলে শুভ মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে বলল,

– শিরিন আপু বাবা আবার হার্ট অ্যাটাক করেছে আমাকে বাড়ি যেতে হবে তুমি আপুর কাছে থাকো।

– যা আর এখন স্নিগ্ধাকে কিছু জানানোর দরকার নেই এমনিতেই ওর অবস্থা ভালো না ফোন করে আমায় সবটা জানাস।

– ঠিক আছে।

শুভ বেরিয়ে গেল, শিরিন স্নিগ্ধতার কেবিনে ঢুকলো।স্নিগ্ধতা শুয়ে আছে চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে শিরিনকে দেখতেই বসার চেষ্টা করলো। শিরিন কাছে গিয়ে বসতে সাহায্য করলো,স্নিগ্ধতা বসেই শিরিনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। এতক্ষণ এমন একটা জায়গার প্রয়োজন ছিল তার যেখানে মাথা রেখে কান্না আর দুঃখগুলো বিসর্জন দিতে পারবে। শিরিন হচ্ছে স্নিগ্ধতার বেস্ট ফ্রেন্ড একসঙ্গে দু’জনে পড়াশোনা শেষ করেছে, স্নিগ্ধতার সুখ দুঃখ প্রকাশের মাধ্যম ছিল শিরিন।

শিরিন স্নিগ্ধতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– কি হয়েছে? তোর হাজব্যান্ড কোথায়?

কথাগুলো গলায় আটকে যাচ্ছে তারপরেও স্নিগ্ধতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল

– স্তব্ধ আমায় ছেড়ে দিয়েছে উনার মা আমায় পছন্দ করেন না, বিশ্বাস কর আমার কোনো দোষ ছিল না ওই বাড়ি থেকে আমায় বের করে দিয়েছে বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর মা সবটা শুনে আমায় মে’রেছে তুই বল আমি কোথায় যেতাম? কোথাও যাওয়ার জায়গাও তো নেই আমার জীবনেই কেন এত কষ্ট? কেন সবাই আমায় কষ্ট দেয়? আত্মহত্যা যদি পাপ না হতো..

শিরিন স্নিগ্ধতার মুখে হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– একদম এসব মুখে আনবি না কাউকে দরকার নেই কেউ কারো নয় একা বাঁচতে শিখতে হবে তোকে হাসপাতাল থেকে সোজা তুই আমার বাড়িতে যাবি।

– উহু যাব না।

– তোকে আমি জিজ্ঞেস করেছি নাকি? এখন আমি জব করি নিজের ফ্ল্যাটে থাকি তাই কোনো বাধা নেই আপনজনদের তো দেখলি কেউ তোকে ভালোবাসে না এছাড়া আমি তোকে ছাড়ছি না।

স্নিগ্ধতা কিছু বলল না।

সানজিদ ওয়াজেদের অবস্থা খুব খারাপ, বাঁচার আশা ডাক্তার ছেড়ে দিয়েছে মূলত অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং চেঁচানোর কারণেই এমন হয়েছে। শাহিলী ওয়াজেদ প্রলাপ বকছেন,

– আজ আমার স্বামীর এমন অবস্থার জন্য ওই অপয়া মেয়েটাই দায়ী, কোথায় ও শুভ? ওকে আমি গলা টিপে মে’রে ফেলব।

– এসব নাটক বন্ধ করো মা আপু নয় বরং তোমার জন্য বাবার এমন অবস্থা সব জেনেও কেন বাবার সামনে আপুকে এভাবে মা’রলে।

– তুই আমার নিজের ছেলে হয়ে এমন বলছিস?

– ভুল কিছু তো বলিনি।

স্তব্ধ অফিস থেকে আগেই বের হয়ে গেছে নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে স্নিগ্ধতার বাড়িতে গেছে কিন্তু বাড়িতে গিয়েই তালা ঝোলানো দেখে চমকে যায়, মাথা কোনভাবেই কাজ করছে না চোখের সামনে ধোয়াশা দেখতে পাচ্ছে।

চলবে…….

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৫

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৫

স্তব্ধ স্নিগ্ধতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে জ্বর কমছে না।একা হাতে স্তব্ধ স্নিগ্ধতার মাথায় পানিও ঢেলেছে,স্তব্ধ অসহায় কন্ঠে বলল,

– এই মেয়েকে দেখছি কিছু বলাও যাবে না, কিছু বললেই ভয় পায় আর জ্বর আসে।

অনেক চেষ্টা করেও ওষুধ খাওয়াতে পারেনি তাই আর কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে স্নিগ্ধতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল স্তব্ধ, এসিও বন্ধ করে দিয়েছে।

শেষ রাতের দিকে জ্বর কমে আসলো ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে স্নিগ্ধতা। ঘুম ভেঙ্গে গেছে শরীর ক্লান্ত লাগছে পাশ ফিরে তাকাতেই ঘুমন্ত স্তব্ধকে দেখতে পেল। স্তব্ধের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে গেল স্নিগ্ধতা, শরীরের সকল ক্লান্তি দূর করার জন্য এখন লম্বা একটা শাওয়ার নেওয়ার প্রয়োজন।

আধ ঘন্টা পর স্নিগ্ধতা চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।স্তব্ধ ঘুম থেকে উঠে গেছে দু’জনের চোখাচোখি হতেই স্নিগ্ধতা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। স্তব্ধ ফ্রেশ হতে চলে যেতেই স্নিগ্ধতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে গেল। জ্বর চলে গেলেও মাথা ব্যথা এখনও রয়ে গেছে তাই নিচে যেতে আর ইচ্ছে করছে না।স্তব্ধ ঘরে এসে স্নিগ্ধতার সামনে দাড়ালো রাগমিশ্রিত কন্ঠে বলল,

– সমস্যা কি তোমার? এখন দেখছি তোমার সঙ্গে কথাও বলা যাবে না কথা বললেই অসুস্থ হয়ে যাও কেন?

স্নিগ্ধতা মাথা নিচু করে রেখেছে হাতগুলো কাঁপছে, স্তব্ধ স্নিগ্ধতার দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলল,
– কাঁপছো কেন? কাঁপা কাঁপি কি তোমার জম্মগত রোগ নাকি?

এবারও স্নিগ্ধতা কিছু বলল না স্নিগ্ধতার নিরবতা স্তব্ধের রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে ধমক দিয়ে বলল,
– স্নিগ্ধ আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।

স্নিগ্ধতা বাচ্চাদের মতো কেঁদে দিল স্তব্ধ ভরকে গেছে স্নিগ্ধতার এহেম কাজে।স্নিগ্ধতা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

– আমি কি করেছি আপনি আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? সবাই আমার সঙ্গে শুধু খারাপ ব্যবহার করে কেউ আমায় ভালোবাসে না কেউ আমাকে বুঝতে চায় না।

স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে নিজের সঙ্গে আবদ্ধ করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আহ্লাদি সুরে বলল,
– কাঁদে না বউ কে বলেছে তোমায় কেউ ভালোবাসে না আমি তো….

বলেই থেমে গেল স্তব্ধ অনুভূতি উলোট পালোট হয়ে যাচ্ছে কি বলতে যাচ্ছিল নিজেই বুঝতে পারছে না।স্নিগ্ধতার কান্নায় হুস আসলো, স্নিগ্ধতার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

– স্যরি আর কখনও তোমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবো না প্লিজ তুমি কেঁদো না।

কোনো কথাতেই কাজ হচ্ছে না স্নিগ্ধতা কেঁদেই যাচ্ছে এবার স্তব্ধ বিরক্ত হয়ে আবারো ধমক দিয়ে বলল,
– ভালো কথায়ও তো দেখছি কাজ হয় না তুমি যদি এখন কান্না না থামাও আমি কিন্তু তোমাকে তেলাপোকা ভর্তি ড্রামে ফেলে দিয়ে আসব।

ভয় পেয়ে গেল স্নিগ্ধতা ভিতু দৃষ্টিতে স্তব্ধের দিকে তাকালো। কান্না থেমে গেছে কিন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নাক টানছে।স্তব্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কিছুক্ষণ পর আবারো ফিরে এলো তবে হাত করে খাবারের ট্রে নিয়ে।

স্নিগ্ধতাকে বসিয়ে হাতে খাবার ধরিয়ে দিয়ে বলল,
– দ্রুত খাবার খেয়ে নাও ওষুধ খেতে হবে।

স্নিগ্ধতা বাধ্য মেয়ের মতো খাবার খেয়ে নিলো, কারণ সে জানে এখন খেতে না চাইলে স্তব্ধ আবারো বকবে। স্তব্ধের রাগান্বিত হওয়ার কারণ স্নিগ্ধতার অজানা। ধীরে ধীরে স্তব্ধ বদলে যাচ্ছে এই বদলানো কারো চোখ এড়ায়নি এখন আর কাজের প্রতি অলসতা দেখায় না সঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত হয়, বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি আড্ডাটাও অনেক কমে গেছে সপ্তাহে এক থেকে দু’বার কিংবা কখনও কখনও যায়ও না।
.
.
আজ শুক্রবার ছুটির দিন সবাই বাড়িতে আছে।স্নিগ্ধতা চা বানিয়ে সবাইকে বসার ঘরে দিয়ে এসেছে। বিকেল হতেই রুশি এবং নাতাশার আগমন ঘটলো অরিত্রি শিকদার বাদে বাকি সবাই বেশ অবাক হয়েছে। রাতুল শিকদার জিজ্ঞেস করলেন,

– কি ব্যাপার রুশি এ সময় তুমি এ বাড়িতে?

– কেন দুলাভাই আসতে পারি না?

– তা পারবে না কেন কিন্তু কখনও এভাবে হুট করে আসনি তো।

অরিত্রি শিকদার বললেন,
– নিতু কোথায় রে রুশি?

– বাড়িতে রেখে এসেছি এসব ব্যাপারে ওর থাকতে হবে না।

রাহেলা বেগম ব্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললেন,
– কোন ব্যাপার?

– একটু অপেক্ষা করুন মা সব জানবেন।(অরিত্রি)

অরিত্রি শিকদার নিজের ঘরের দিকে গেলেন কিছুক্ষণ পর একটা কাগজ হাতে বের হলেন সবার দৃষ্টি উনার দিকে। কাগজটা স্তব্ধের সামনে রেখে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন,

– স্নিগ্ধতা…

স্নিগ্ধতা রান্নাঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে হালকা হেসে বলল,
– জ্বি মা।

– এদিকে এসে দাড়াও দরকার আছে।

স্নিগ্ধতা চুপ করে দাড়ালো।অরিত্রি শিকদার শান্ত গলায় বললেন,
– স্তব্ধ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দে।

কথাটা শুনে সবাই অনেক অবাক হয়ে গেছে রাতুল শিকদার ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
– ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে মানে? বিয়ে কি তোমার কাছে লুডু খেলা নাকি?

– আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলছি তাই মাঝখানে কেউ কথা না বললেই ভালো হবে।

– অরিত্রি…

রাতুল শিকদারকে থামিয়ে দিয়ে অরিত্রি শিকদার স্তব্ধের দিকে তাকিয়ে আবারো বলল,
– সাইন করতে বললাম তো।

স্তব্ধ ব্রু কুঁচকে,
– আবার এটা নতুন করে বানিয়ে এনেছ?

– হুম এবার সাইন কর।

স্তব্ধ কাগজটা হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– বারবার এক কথা রিপিড করছো কেন মম যা বলার সেদিনই তো বলে দিয়েছি।

– তাহলে তুই সাইন করবি না?

– উহু।

অরিত্রি শিকদার কাগজটা স্তব্ধের হাত থেকে নিয়ে স্নিগ্ধতার সামনে ধরে,
– তুমি সাইন করে দাও তুমি সাইন করলে স্তব্ধ সাইন করতে বাধ্য।

স্নিগ্ধতা স্তব্ধের দিকে তাকালো এমন এক জায়গায় যে তাকে দাড়াতে হবে কখনও ভাবতেও পারেনি।স্তব্ধ অরিত্রি শিকদারের উদ্দেশ্যে বলল,

– ওকে ফোর্স করে লাভ নেই আমি যখন বলেছি সাইন করবো না সো সাইন করবো না আর ও করবে না।

রাতুল শিকদার রাহেলা বেগম আরিয়া তিহান সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।স্নিগ্ধতার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। নাতাশা আহত কন্ঠে বলল,

– স্তব্ধ কেন এমন করছো? আঙ্কেল তোমায় জোর করে বিয়ে দিয়েছে ভুলে গেছ তুমি? প্লিজ সাইন করে দাও।

স্তব্ধ নাতাশার কথা শুনেও না শোনার ভান ধরল।অরিত্রি শিকদার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

– আগে কখনও আমার অবাধ্য হসনি আর আজ কিনা এই মেয়ের জন্য আমার উপর কথা বলছিস তুই! আমার থেকে এই মেয়েটা তোর কাছে ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে গেছে?

– আমি এখনও অবাধ্য হচ্ছি না তবে তুমি যা বলছো তা করা সম্ভব নয়।

রাহেলা বেগম সবাইকে থামিয়ে বললেন,
– বউমা দাদুভাই তো বলেই দিল ও নাত বউকে ডিভোর্স দিতে চায় না তাহলে তুমি কেন ওদের মাঝখানে আসছো?

– আমার ছেলে কি করবে কার সঙ্গে থাকবে আমি সিদ্ধান্ত নিব মা।

অরিত্রি শিকদার স্তব্ধের উদ্দেশ্যে বলল,
– তোর সাইন করতে হবে না তুই এই মেয়ের সঙ্গেই থাক আমি বেরিয়ে যাচ্ছি এই বাড়ি থেকে।

– মম পাগল হয়ে গেছ?

অরিত্রি শিকদার বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদত্ত হতেই রাতুল শিকদার পথ আটকে বললেন,
– অরিত্রি ছেলেমানুষি বাদ দাও এটা তোমার বাড়ি তোমার সংসার আর তুমিই কিনা চলে যাবে।

– হয় এই মেয়েটা এই বাড়িতে থাকবে নয় আমি থাকব।

– ও তোমার ছেলের বউ ওর সঙ্গে তোমার থাকা না থাকার কথা কিভাবে আসে।

স্তব্ধ অরিত্রি শিকদারের হাত ধরে শান্ত গলায় বলল,
– মম কেন এমন করছো? কেন স্নিগ্ধকে পছন্দ করো না?

– কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই আমি, তোমরা জানো আমি যা বলি তাই করি এই মূহূর্তে তুই যদি ডিভোর্স পেপারে সাইন না করিস তাহলে আমি একেবারে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাব আর আমায় খুঁজে পাবি না।

– মম!

অরিত্রি শিকদার পুনরায় কাগজ স্তব্ধের হাতে দিল। অরিত্রি শিকদার অনেক জেদি একজন মহিলা তিনি যা বলবেন তাই করে ছাড়বেন উনার জিদ সম্পর্কে বাড়ির সবাই অবগত সবথেকে বেশি স্তব্ধ জানে তার মায়ের সম্পর্কে।তিহান অরিত্রি শিকদারকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অরিত্রি শিকদার হাত নাড়িয়ে থামিয়ে দিলেন।

স্তব্ধ একবার স্নিগ্ধতার দিকে তাকাল, স্নিগ্ধতার কান্না পাচ্ছে ভেতরে যেন এক ঢেউ বয়ে যাচ্ছে অনেক কষ্ট করে কান্নাটা আটকে রাখার চেষ্টা করছে মনে প্রাণে চাইছে স্তব্ধ যাতে সাইন না করে সবাই যেন অরিত্রি শিকদারকে বুঝিয়ে বলে। স্নিগ্ধতার বলার মতো কিছুই নেই, নেই কোনো অধিকার স্তব্ধ যা করবে তাই মেনে নিবে।বিয়েটা যদি স্বাভাবিক ভাবে স্তব্ধের ইচ্ছেতে হতো তাহলেও হয়তো কিছু বলতে পারতো স্নিগ্ধতা। স্তব্ধ বুঝতে পারছে স্নিগ্ধতার অবস্থা কিন্তু এখন তার কিছুই করার নেই এখনকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে নইলে তার মা জিদ ধরে সত্যিই চলে যাবে যা সে সহ্য করতে পারবে না।

রাতুল শিকদারও নিরব হয়ে গেছেন স্ত্রীকে তিনি অনেক ভালোবাসেন অনেকগুলো বছর একসঙ্গে হাতে হাত রেখে পাড় করেছেন শেষ বয়সে এসে স্ত্রীকে হারাতে পারবেন না আবার এই অন্যায়ও সহ্য করা যায় না স্নিগ্ধতাকে তো তিনি নিজ দায়িত্বে ছেলের বউ করে নিয়ে এসেছেন। তবে উনার কাছে এখন নিরবতাই শ্রেয় মনে হচ্ছে।

অরিত্রি শিকদার বললেন,
– কি হলো স্তব্ধ দাড়িয়ে আছিস কেন?

স্তব্ধের হুস ফিরল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজে সাইন করে দিল।অরিত্রি, রুশি আর নাতাশার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে ভেতরে ভেতরে চমকে গেছে স্নিগ্ধতা ভালোবাসার মানুষটিকে হারানোর মতো যন্ত্রনা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।অরিত্রি শিকদার কাগজটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললেন,

– তোর কাজ শেষ এবার ঘরে যা।

– মম একবার ভেবে দেখো।

– বলছি তো ঘরে যা এই মেয়ের ব্যবস্থা আমি করছি।

ধমকের সুরে বললেন কথাটা,স্নিগ্ধতার দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না স্তব্ধ দৃষ্টি নত করে ঘরে চলে গেল।অরিত্রি শিকদার স্নিগ্ধতার হাতে কাগজ দিয়ে,

– স্তব্ধ সাইন করে দিয়েছে এবার তুমিও সাইন করে দাও কোনো নাটক সহ্য করবো না।

স্নিগ্ধতা অরিত্রি শিকদারের দিকে তাকাল, অরিত্রি শিকদার দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন বাকিদের মতো তিনি কোনভাবেই এই মেয়ের মায়ায় পড়তে চান না।রুশি ধমক দিয়ে বললেন,

– কি হলো দ্রুত সাইন করে এই বাড়ি থেকে দূর হও।

স্নিগ্ধতা সবার দিকে তাকিয়ে নিলো তারপর চুপচাপ সাইন করে দিল কাউকে নিজের কষ্ট বুঝতে দিল না।সাইন শেষ হতেই রুশি নাতাশাকে ইশারা করল। নাতাশা ইশারা অনুযায়ী স্নিগ্ধতার হাত চেপে ধরে সদর দরজার দিকে যাওয়া ধরল পথিমধ্যে রাতুল শিকদার তাদের সামনে দাড়িয়ে,

– হাত ছাড়ো।

– আঙ্কেল।

– অরিত্রির অন্যায় মেনে নিয়েছি বলে যে তোমাদেরকেও মেনে নিব ভাবলে কি করে স্নিগ্ধা মায়ের কাছেও ঘেঁষবে না।

নাতাশা স্নিগ্ধতার হাত ছেড়ে দিল রাতুল শিকদার স্নিগ্ধতার মাথায় হাত বুলিয়ে,
– আমায় মাফ করে দিও মা কথা দিয়েও কথা রাখতে পারিনি চিন্তা করো খুব শিঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্নিগ্ধতা নিশ্চুপ, রাতুল শিকদার আবারও বললেন,
– আমি তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছি চলো।

স্নিগ্ধতা এবার মুখ খুলল নত দৃষ্টিতে বলল,
– তার দরকার নেই আমি একাই যেতে পারবো।

বলেই আর কারো কথার তোয়াক্কা না করে এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল স্নিগ্ধতা।
_____________

পুরো ঘর এলোমেলো করে ফেলেছে স্তব্ধ, মাথা কাজ করছে না।বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন স্তব্ধ কখনও চায়নি স্নিগ্ধতাকে ডিভোর্স দিতে বরং অনেক চেষ্টা করে সম্পর্কটাকে মেনে নিয়েছে, ভালোবাসতে চেয়েছে স্নিগ্ধতাকে অনেক মায়াও জম্মে গেছে।

আজও প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু মায়ের জেদের কাছে হার মেনে গিয়েছে ছোট থেকেই স্তব্ধ মায়ের উপর দুর্বল। বাবার অবাধ্য হলেও মায়ের অবাধ্য কখনও হয়নি আজ দু’টানায় পড়ে গেছে স্নিগ্ধতার সঙ্গে বড় অন্যায় করে ফেলেছে কিভাবে স্নিগ্ধতার সামনে দাড়াবে নিজের মা’কে কিভাবে মানাবে এই চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

রাতুল শিকদার কঠোর গলায় রুশি এবং নাতাশাকে নিজেদের বাড়িতে চলে যেতে বলেছেন যার কারণে তারা আজ এখানে থাকতে পারেনি।অরিত্রি শিকদার বাড়িতে একা হয়ে গেছেন কেউ তার সঙ্গে কথা বলছে না। রাহেলা বেগম অসুস্থ হয়ে গেছেন, তিহানের হাত ধরে বললেন,

– একটু খোঁজ নিয়ে দেখ না নাত বউ ঠিকভাবে পৌঁছে গেছে নাকি আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে কি একটা ঘটনা ঘটলো কে এখন নাত বউকে সামলাবে?

– দিদান এমন ছটফট করলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে।

অরিত্রি শিকদার শাশুড়ির ঘরে এসে পাশে বসে বললেন,
– মা এখনও শরীর খারাপ লাগছে? মাথায় তেল দিয়ে দিব?

– তোমার কিছু করতে হবে না বউমা তুমি নিজের ঘরে যাও।

– এভাবে কেন বলছেন মা?

– কিভাবে বলবো? এতদিন তোমাকে চিনতে ভুল করেছি আমি আজ তোমার আসল রূপ দেখলাম কিভাবে পারলে মা হয়ে নিজের ছেলের জীবন এলোমেলো করে দিতে?

– আমি ওর জীবন ভালো করে সাজিয়ে দিতে চাইছি।

– একবার ছেলের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে এসো তারপর কথা বলো।

এসবের পরে স্তব্ধের সঙ্গে কথা বলতেই ভুলে গেছিল অরিত্রি শিকদার দ্রুত বসা থেকে উঠে স্তব্ধের ঘরের দিকে যাওয়া ধরলো।

চলবে……

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৪

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৪

নৌকায় করে হাওর বিলের মাঝামাঝি অবস্থান করছে স্তব্ধ,স্নিগ্ধতা। বাতাসে স্তব্ধের সিল্কি চুলগুলো বারবার কপালে চলে আসছে আর স্তব্ধ হাত দিয়ে সেগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিচ্ছে স্নিগ্ধতা আড়চোখে স্তব্ধকে দেখতে ব্যস্ত মনে মনে বলছে,’এই ছেলেটা একটু বেশিই সুন্দর।’

স্নিগ্ধতাকে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল স্তব্ধ, স্নিগ্ধতা পূর্বের ন্যায় দাড়িয়ে আছে স্তব্ধের এমন কাজ কর্মে স্নিগ্ধতা অভ্যস্ত হয়ে গেছে।স্তব্ধ আহ্লাদি কন্ঠে বলল,

– মহারানী এবার চলুন এখান থেকে বাড়িতে যেতে হবে তো।

– এত তাড়াতাড়ি? এখনও তো পুরো হাওর ঘুরাই হলো না।

– এখন পুরো হাওর ঘুরতে গেলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভোর হয়ে যাবে আরেকদিন হাতে অনেক সময় নিয়ে এসে পুরোটা ঘুরে যাব।

স্নিগ্ধতা মনটা খারাপ করে বলল,
– আচ্ছা চলুন।

– রাগ করেছ?

– উহু।

– আমার তো মনে হচ্ছে আমার বউ রাগ করেছে।

স্নিগ্ধতা কিছু বলল না স্তব্ধ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি এনে বলল,
– বউ রাগ করেছে জামাই হয়ে এটা মেনে নেওয়া অনৈতিক কাজ আসো তোমাকে হাম্মি দিয়ে রাগ ভাঙিয়ে দেই।

স্তব্ধের এমন কথা শুনে স্নিগ্ধতা কিছুটা চেঁচিয়ে,
– না আমি রাগ করিনি চলুন বাড়িতে যাব।

– উহু স্নিগ্ধ বেইবি এসব বললে আমি শুনছি না আমি তোমার রাগ ভাঙাবোই।

– আমি এবার জোরে জোরে কান্না করবো।

স্তব্ধ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– কান্না করবে কেন? কোথায় কি হয়েছে?

– এখনও কিছু হয়নি কিন্তু আপনি এখানে আমার সঙ্গে কিছু করলে কান্না করবো।

– আমার মতো একটা ভদ্র ছেলে তোমার সঙ্গে কি করবে? আমি তো শুধু হাম্মি দিতে চাইলাম।

– দেওয়া যাবে না মানুষ দেখবে।

– ওহ এই ব্যাপার দাড়াও ওদেরকে অন্যদিকে ঘুরতে বলি।

– এ কেমন লোক আমার কপালে জুটল? লাজ লজ্জা কিছু নেই।

– কি বলো আমার অনেক লজ্জা।

– তার নমুনা দেখতেই পাচ্ছি বাড়িতে যাব চলুন।

– বাড়িতে যাওয়ার এত তাড়া কিসের? দু তিনটে বাচ্চা রেখে এসেছ নাকি?

– আপনিই তো বললেন বাড়িতে যেতে হবে।

– আমি হাম্মি খাওয়ার কথাও বলেছি।

স্নিগ্ধতা কপালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে রইল এবার সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর একটা কথাও বলবে না। স্নিগ্ধতাকে চুপ থাকতে দেখে স্তব্ধ বলল,
– আচ্ছা বাড়িতে যাই চলো তারপর হাম্মি দিব।

স্নিগ্ধতা এবারও কথা বলল না। নৌকা পাড়ে গিয়ে থামলো, স্তব্ধ এবং স্নিগ্ধতা দু’জনে নেমে গিয়ে গাড়িতে উঠল।
.
.
স্নিগ্ধতাকে নিয়ে শপিং করে রাতের ডিনার সেরে তারপর বাড়ি ফিরল স্তব্ধ।বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়েছে বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছে। স্নিগ্ধতা বালিশে শুতেই স্তব্ধ স্নিগ্ধতার আঙুলে চামটি কেটে বলল,

– বাড়িতে এসে তোমায় হাম্মি দেওয়ার কথা ছিল।

– এখনও ভুলেননি!

– হাম্মি কি ভুলার জিনিস নাকি? বউকে ঘুমানোর আগে হাম্মি দেওয়া জামাই হিসেবে আমার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর আমি আমার কাজে অবজ্ঞা করতে পারি না।

স্নিগ্ধতা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– আপনার মতো কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকিবাজ ছেলে আমি দু’টো দেখিনি আপনার বাবা তো আপনাকে টেনে হিচড়ে অফিসে নিয়ে যায় আবার বড় বড় কথা বলেন।

– তুমি বউ বউয়ের মতো রোমান্টিক কথা বলবা তা না করে তুমি কেন ঠেস দিয়ে কথা বলে অপমান করবে আজব।

– গুড নাইট।

– আমার হাম্মি?

– ঘুমান।

স্নিগ্ধতা চোখ বুজে নিলো, স্তব্ধ পরাজিত ভঙ্গিতে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করল।
______________

রাত পেরিয়ে আরো একটা দিনের আগমন হলো। তিহানের গাড়ি চলছে কলেজের দিকে,ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে তিহান পেছনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে হঠাৎ কাউকে দেখে ড্রাইভারকে সাইড করে গাড়ি থামাতে বলল। তিহান জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলল,

– এই পিচ্চি থুরি এই শিরিন ম্যাডাম।

শিরিন কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তিহানের দিকে তাকিয়ে ব্রু জোড়া কুঁচকে নিলো।তিহান আবারো ডেকে বলল,

– এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন?

– রিক্সার জন্য।

– মনে হয় না এখন রিক্সা পাবেন আমিও কলেজে যাচ্ছি গাড়িতে উঠুন একসঙ্গে যাওয়া যাক।

– দরকার নেই আপনি যান।

– আপনাকে রেখে তো যেতে পারি না এক জায়গায়ই তো দু’জনে যাব।

– বললাম তো আপনি যান।

– আপনি কি আমার সঙ্গে যেতে ভয় পাচ্ছেন?

শিরিন রেগে গিয়ে বলল,
– শিরিন কাউকে ভয় পায় না।

– তাহলে গাড়িতে উঠছেন না কেন?

শিরিন আর উপায় না পেয়ে গাড়িতে উঠে গেল।তিহানকে মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– গাড়িতে উঠেছি বলে এই নয় আপনার সঙ্গে ঝামেলা মিটে গেছে।

– আপনি কি আরো ঝগড়া করতে চান!

– ঝগড়া করা আপনার স্বভাব আমি তো শুধু উওর দেই।

– ওহ আচ্ছা।

তিহান আড়চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘নিজে ঝগড়া করে আমার নামে দোষ দেয় অসভ্য মেয়ে।’

গাড়ি কলেজের সামনে থামতেই শিরিন দ্রুত নেমে গিয়ে ভেতরে চলে গেল।তিহান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে,’একটা ধন্যবাদ দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না!’

রাহেলা বেগমের পায়ে ব্যথা বেড়েছে স্নিগ্ধতা কুসুম গরম তেল দিয়ে পা টিপে দিচ্ছে। রাহেলা বেগম চোখ বন্ধ করে বললেন,
– ব্যথাটা কমেছে তোর হাতে জাদু আছে নাত বউ, এবার আমার পাশে এসে একটু বস।

স্নিগ্ধতা রাহেলা বেগমের পাশে গিয়ে বসল। রাহেলা বেগম আবারো বললেন,
– একটা পান বানিয়ে দে।

– একটু আগেই পান খেলে এখন আবার।

– দে না।

– ডাক্তার তোমায় এত পান খেতে নিষেধ করেছে দিদান।

– তুইও বাকিদের মতো বলছিস?

– তোমার ভালোর জন্যই বলছি।

রাহেলা বেগমের ঘরে এলেই স্নিগ্ধতার একাকীত্ব দূর হয়। রাতুল শিকদার ইদানিং অফিসে খুব ব্যস্ত থাকেন তবে স্নিগ্ধতার খবর নিতে ভুলেন না সানজিদ ওয়াজেদ বাবা হয়ে মেয়ের জন্য যা করতে পারেননি রাতুল শিকদার স্নিগ্ধতার জন্য তাই করছেন নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখছেন।স্তব্ধ আগের থেকে কিছুটা ম্যাচিউর হয়েছে।

স্নিগ্ধতার মোবাইলে একটা নাম্বার থেকে আটটা কল এসেছে। পরিচিত ভেবে স্নিগ্ধতা কল ব্যাক করতেই আদ্রিক কল রিসিভ করে বলল,

– অতঃপর তুমি কলটা ধরলে স্নিগ্ধতা।

আদ্রিকের কন্ঠস্বর শুনে স্নিগ্ধতার ভেতরে পুরনো ভয়ের সঞ্চার হলো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
-আ..আদ্রিক!

– চিনেছ তবে? যাই হোক অনেকদিন তোমার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় না একবার কি আমার সঙ্গে দেখা করবে?

– আপনি কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন? কেন এমন করছেন?

– তা তো তুমি বেশ ভালো করেই জানো, তোমার সঙ্গে আমার অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে, তোমার হাজব্যান্ড স্তব্ধ শিকদার শুধুমাত্র তোমার কারণে আদ্রিক খাঁনের গায়ে হাত তুলেছে তোমাদের দু’জনকেই এর ফল ভোগ করতে হবে তবে তোমাকে অত কষ্ট দিব না।

– স্তব্ধ আপনাকে আমার কারণে মে’রেছে!

– কেন তোমায় কিছু বলেনি?

– বাবার কাছ থেকে শুনেছি আপনাকে মে’রেছে কিন্তু কারণটা জানি না আমার জন্য কেন মা’রলো?

– স্তব্ধের কাছ থেকে জেনে নিও আর হ্যা খুব শিঘ্রই আমাদের দেখা হবে আর সেদিন তোমাকে আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না স্নিগ্ধা রানী।

কল কেটে দিল আদ্রিক। মোবাইল পাশে রেখে বিছানায় বসে পড়ল স্নিগ্ধতা বিষ্মিত স্বরে বলল,’আমার কারণে আদ্রিককে উনি মে’রেছেন কি এমন ঘটেছে কি বলেছে আদ্রিক আমার নামে? পুরোটা যদি জানে তাহলে কি হবে আদ্রিকের! আবারও ঝড়ের মতো জীবনে আসতে চাইছে আদ্রিক স্তব্ধের কোনো ক্ষতি করে দিবে না তো?

সন্ধ্যা থেকে নিজেকে ঘরবন্দি করে রেখেছে স্নিগ্ধতা নিচে যেতে ইচ্ছে করছিল না রাতে খাওয়া হয়নি। ঘরে সন্ধ্যাবাতিও জ্বালানো হয়নি। রাতে বাড়ি ফিরে নিজের ঘর অন্ধকার দেখে বেশ বিরক্ত হলো স্তব্ধ। আলো জ্বালাতেই বিছানায় স্নিগ্ধতাকে শুয়ে থাকতে দেখল। স্নিগ্ধতা টের পেয়েছে স্তব্ধ এসেছে কিন্তু স্তব্ধ চুপচাপ আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় বসলো,স্নিগ্ধতা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,
– এখানে খাবার নিয়ে আসব নাকি নিচে যাবেন?

– খেয়ে এসেছি।

– ওহ।

কিছুক্ষণ দু’জনের মধ্যে নিরবতা চললো স্তব্ধ নিরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর গলায় বলল,
– একটা কথা কি জানো স্নিগ্ধ? কাউকে কাছে টেনে নিতে যেমন আমার সময় লাগে না তেমনি কাউকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতেও সময় লাগে না।

স্নিগ্ধতা অস্থির গলায় বলল,
– হঠাৎ এই কথা? আমাকেই বা কেন বলছেন?

– বলতে বাধ্য করেছ তুমি, তোমাকে যেমন নিজের ওয়াইফ হিসেবে মেনে নিতে এবং কাছে টানতে বেশি সময় লাগেনি তেমনি তোমাকে আমার থেকে দূরে সরাতে বেশি সময় লাগবে না তবে তোমাকে আমি নিজের থেকে দূরে সরাবো না কারণ তুমি এ ক’দিনেই আমার জীবনের বিশেষ একটা অংশ হয়ে গেছ যাই করো না কেন আমাকে জানিয়ে এবং ভেবে চিন্তে করবে তুমি না জানালেও আমি কিন্তু কোনভাবে সব জেনে যাব আর যদি জেনে যাই আর তোমার কারণে আমি কষ্ট পাই সেদিন তুমি আমার ভয়ংকর রূপ দেখতে পাবে আশা করি কথাগুলো মাথায় রাখবে আমি চাই না তোমার সঙ্গে খারাপ কিছু করতে।

স্তব্ধের ঠান্ডা হুমকি গুলো স্নিগ্ধতার ভেতরে কম্পন সৃষ্টি করছে।স্তব্ধ উল্টো পাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে, স্নিগ্ধতাও পাশে শুয়ে পড়ল শরীর গরম হয়ে যাচ্ছে শীত লাগছে একের পর এক ঝড় তার জীবনেই কেন আসে বুঝতে পারে না যখনি সুখ ধরা দেয় তখনি কষ্ট গুলো এসে মাঝখানে বাঁধা সৃষ্টি করে। চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে নিজের মায়ের মুখটা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে,স্নিগ্ধতার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,’মা কেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমায় একা ফেলে গেলে আমার যে তোমাকে খুব দরকার, তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমানোর দরকার একটু ভালোবাসার দরকার।’

কথাগুলো ভেতরেই আটকে আছে বলা আর হচ্ছে না। চোখগুলো খুলতে পারছে না মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে এই যন্ত্রনা নিরাময়ের ওষুধের খোঁজ এখনও স্নিগ্ধতা পায়নি। শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে চেষ্টা করেও নড়াতে পারছে না বাবার কথা মনে পড়ছে কেন জানি মনটা কু ডেকে উঠছে হঠাৎ করেই বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করছে স্নিগ্ধতার। বিড়বিড় করে বলছে,’বাবা তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধা মা বলে ডাকবে?’

স্নিগ্ধতার গুঙরানির শব্দে পাশ ফিরে তাকালো স্তব্ধ, নরম কন্ঠে ডাক দিলো,
– স্নিগ্ধ কি হয়েছে?

কোনো উওর এলো না স্নিগ্ধতা বিড়বিড় করে কথা বলেই যাচ্ছে স্তব্ধ শোনার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না।স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো,স্নিগ্ধতার শরীর অনেক গরম জ্বর এসেছে স্তব্ধ শোয়া থেকে উঠে আলো জ্বালিয়ে থার্মোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করতেই চমকে গেল বিষ্মিত স্বরে বলল,

– ১০৪ ডিগ্ৰি জ্বর!

ভয় আর অস্থিরতা একসঙ্গে দেখা দিলে স্নিগ্ধতার জ্বর উঠে এটা যেন তার এক রোগ। ছোট থেকেই অনেক এমন হয়েছে তখন ভয়ের কারণ ছিলেন শাহিলী ওয়াজেদ। এমন অনেক রাত গেছে স্নিগ্ধতা জ্বর নিয়ে বিছানায় ছটফট করেছে কিন্তু কাক পক্ষীও টের পায়নি শাহিলী ওয়াজেদের ভয়ে কখনও মুখ ফুটে সানজিদ ওয়াজেদকে কিছু বলতে পারেনি। সানজিদ ওয়াজেদও বাড়িতে অশান্তি হওয়ার ভয়ে কখনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি তবে এ নিয়ে মনে মনে অনেক অভিমান পুষে রাখলেও বাহিরে কখনও প্রকাশ করেনি স্নিগ্ধতা। কোনো অভিযোগও করেনি। আজ স্নিগ্ধতার এই জ্বরের ছটফটানি দূর করার জন্য সেবা করার জন্য একটা নিজের মানুষ হয়েছে ভালো মন্দ দেখার মতো একটা মানুষ হয়েছে।

সুখ বারবার তার কাছে আসতে চাইছে আবার চলেও যাচ্ছে।

চলবে……..

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১৩

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৩

অরিত্রি শিকদার,রুশি,নাতাশা একসঙ্গে পাশাপাশি বসে আছে তাদের ঠিক সামনে সোফায় বসে আছে স্তব্ধ।অরিত্রি শিকদার একটা কাগজ স্তব্ধের দিকে এগিয়ে দিতেই স্তব্ধ প্রশ্ন করল,

– এই পেপারটা কিসের মম?

– তোর আর স্নিগ্ধতার ডিভোর্স পেপার চটজলদি সাইন করে দে।

স্তব্ধের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল তিক্ষ্ম কন্ঠে বলল,
– আর ইউ ক্রেজি মম স্নিগ্ধকে কেন ডিভোর্স দিতে যাব আমি?

– ভুলে যাস না তোর ড্যড তোকে জোর করে বিয়েটা করিয়েছে অন্যের কারণে কেন নিজের জীবন নষ্ট করবি?

– তোমাকে কে বলেছে আমি অন্যের জন্য নিজের জীবন নষ্ট করছি?

– মানে?

– আচ্ছা ধরো তোমার কথায় পেপারে আমি সাইন করে দিলাম তারপর কি হবে?

– নাতাশার সঙ্গে তোর বিয়ে দিব।

স্তব্ধ মৃদু হেসে বলল,
– কিন্তু নাতাশাকে তো আমার জীবন সঙ্গিনী হিসেবে পছন্দ নয়।

নাতাশা বিচলিত কন্ঠে বলল,
– স্তব্ধ কি বলছো এসব?

– আমি আমার মমের সঙ্গে কথা বলছি কেউ মাঝখানে কথা না বললে খুশি হতাম।

রুশি হাত দিয়ে নাতাশাকে থামিয়ে দিল অরিত্রি শিকদার বললেন,
– আমার নাতাশাকে পছন্দ এছাড়া বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে ভালো লাগা শুরু হবে।

– আমিও তো এটাই বুঝাতে চাচ্ছি তোমায়, স্নিগ্ধর সঙ্গে বিয়েটা যখন হয়ে গেছে ধীরে ধীরে সম্পর্ক ঠিক হয়ে যাবে আর এ ক’দিনে স্নিগ্ধর প্রতি আমার একটা মায়া জম্মে গেছে ওকে ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

– স্তব্ধ মুখে মুখে তর্ক করবি না যা বলছি তাই কর এতে সাইন করে দে তুই সাইন করলে স্নিগ্ধতাও সাইন করতে বাধ্য থাকবে।

স্তব্ধ মায়ের হাত থেকে পেপারটা নিয়ে দেখতে লাগল উপস্থিত সবার মুখে হাসি স্পষ্ট। কিন্তু হাসিটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না স্তব্ধ পেপারটা ছিঁড়ে অসংখ্য টুকরো করে অরিত্রি শিকদারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

– ড্যড না হয় আমায় জোর করে বিয়ে দিয়েছে কিন্তু তুমি কি করছো? বিবাহিত ছেলের ডিভোর্স করিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাচ্ছো তাও আবার অমতে।

– তুই বুঝার চেষ্টা কর।

– আমি কিছু বুঝতে চাই না স্নিগ্ধকে আমি ছাড়ছি না বিয়ে যেভাবেই হোক ও আমার ওয়াইফ এটাই বড় পরিচয়, ওর প্রতি আমার একটা মায়া জম্মে গেছে এই মায়া থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয় এছাড়া আমার এমন কোনো পিছু টান নেই যে ওকে ছেড়ে দিতে হবে জীবনটা আমার, কে আমার জীবনে থাকবে আর থাকবে না আমাকেই ডিসাইড করতে দাও তুমিও স্নিগ্ধকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নাও এটাই ভালো হবে।

রুশির দিকে তাকিয়ে,
– আন্টি বাংলাদেশে ছেলের কি অভাব পড়েছে যে বোনের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করতে হবে? ঠিক করেছ মানলাম এখন তো আমি বিবাহিত তারপরেও কেন বিবাহিত ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছো? ছেলের অভাব পড়লে ড্যডকে বলো ভালো একটা ছেলে খুঁজে দিবে যেভাবে আমার জন্য স্নিগ্ধকে খুঁজে এনেছে।

স্তব্ধ উঠে অরিত্রি শিকদারের ঘর থেকে বেরিয়ে গেল রুশি আর নাতাশার মুখটা চুপসে গেছে অরিত্রি শিকদার ছেলের কথাগুলো শুনে অবাক হয়ে গেছেন।

রাতুল শিকদার এদের কানাঘুষা টের পেয়ে আজ অফিসে যাননি।অরিত্রি শিকদার যখন স্তব্ধকে ঘরে ডাকলেন তখনি সতর্ক হয়ে আরিয়াকে নিয়ে দরজার আড়ালে দাড়িয়ে ছিলেন সবটা শোনার জন্য প্রথমে এদের কথা শুনে বেশ রেগে গিয়েছিলেন কিন্তু স্তব্ধের বলা কথাগুলো শুনে মুহূর্তেই মনে মনে খুশি হয়েছেন।

রাহেলা বেগমের ঘরে রাতুল শিকদার আর আরিয়া এসে বসলো ওদের সঙ্গে তিহানও যোগ দিল। রাহেলা বেগম পান চিবোতে চিবোতে বললেন,

– কিরে তোদের বাপ মেয়েকে এত খুশি লাগছে কেন?

– আরে মা আর বলো না তোমার নাতি তো স্নিগ্ধতাকে মেনে নিয়েছে উহু মেনে নিয়েছে বললে ভুল হবে অরিত্রির মুখের উপর কথাও বলে দিয়েছে।

– বিস্তারিত বল।

আরিয়া পুরোটা রাহেলা বেগমকে বলতেই তিনিও খুশি হয়ে গেলেন। সবার হাতে একটা করে পান দিয়ে,
– এই খুশিতে একটা পান খা, আমি বলেছিলাম না আমার স্তব্ধ দাদুভাই আর যাই করুক না কেন সম্পর্কের মান বুঝে।
______________

আজ কলেজে তিহানের জয়েনিং ডেট। নতুন কয়েকজন শিক্ষক জয়েন করায় কলেজের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।তিহান কলেজে প্রবেশ করে আশেপাশে তাকালো প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে হবে কিন্তু প্রিন্সিপালের রুম কোনদিকে তা জানা নেই কাকে জিজ্ঞেস করবে ভাবতে ভাবতে সামনে এগিয়ে গেল একটা মেয়েকে দেখে ডেকে বলল,

– এই পিচ্চি মেয়ে শুনো।

মেয়েটি আশেপাশে তাকিয়ে তিহানের দিকে দৃষ্টি দিল তিহান মৃদু হেসে বলল,
– তোমাকেই ডেকেছি আচ্ছা প্রিন্সপাল স্যারের রুম কোথায় বলতে পারবে?

মেয়েটি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– আমাকে দেখে আপনার পিচ্চি মনে হয়? চোখে সমস্যা নাকি?

– তোমাকে দেখে তো পিচ্চিই মনে হচ্ছে।

– ইডিয়ট।

বলেই মেয়েটি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হাঁটা ধরলো তিহান পুনরায় ডেকে বলল,
– পিচ্চি প্রিন্সিপালের রুমটা তো দেখিয়ে দিয়ে যাও।

মেয়েটি যেতে যেতে বলল,
– পারবো না খুঁজে নিন।

তিহান ক্লান্ত কন্ঠে বলল,’ছোট ছোট মেয়েদের পিচ্চি বললেও দোষ?

কলেজের একজন স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে প্রিন্সিপালের রুম খুজে পেল তিহান।প্রিন্সিপালের রুমে ঢুকতেই বেশ অবাক হলো মনে মনে বলল,’এই পিচ্চি ঝগড়ুটে মেয়ে এখানে কেন?’

তিহানকে দেখে প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে স্বাগতম জানালো এবং বাকিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে এবার সেই মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন,

– ইনি হচ্ছেন শিরিন সুলতানা ফাইন্যান্সের শিক্ষিকা হিসেবে কলেজে নতুন জয়েন করেছেন।

তিহানের চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেছে চমকায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
– ইনি শিক্ষিকা!

– হ্যা।

– আমি তো ভেবেছিলাম কলেজের স্টুডেন্ট।

প্রিন্সিপাল হেসে দিলেন শিরিন দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– মাথায় গোবর থাকলে এসব ভাবাটাই স্বাভাবিক।

– আমার মাথায় গোবর?

– তা নয় তো কি? আপনার মাথায় অনেক গোবর আছে সাথে সমস্যাও থাকতে পারে সময় থাকতে ভালো ডাক্তার দেখান।

– মিস ঝগড়ুটে বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে আপনি মেয়ে বলে কিছু বললাম না।

– আপনি কিছু বললে আমি কি ছেড়ে দিব? আপনার সব কয়টা চুল ছিঁড়ে দিব।

– মেয়েরা এছাড়া পারেটা কি? আমি আপনাকে মাথায় তুলে আছাড় মা’রবো।

শিরিন প্রিন্সিপালের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– স্যার দেখুন এই অসভ্য লোকটা আমার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে।

প্রিন্সিপাল ঝগড়া থামানোর জন্য,
– আহা আপনারা এখন এভাবে ঝগড়া করবেন না ঝগড়ার জন্য বাকি দিন পরে আছে।

শিরিন ক্রুব্ধ স্বরে বলল,
– আমায় কেন বলছেন? ঝগড়া তো এই খাটাস ব্যাটায় করছে।

তিহান ধমক দিয়ে,
– এবার কিন্তু সত্যি সত্যি আপনাকে মাথায় তুলে আছাড় দিব।

শিরিন কিছু বলতে যাবে তৎক্ষণাৎ প্রিন্সিপাল থামিয়ে দিল অনেক কষ্টে দু’জনের ঝগড়ার ইতি টেনে দু’জনকে দু’দিকে সরিয়ে দিল।

পুরো অনুষ্ঠানে ঝগড়া করতে না পারলেও দৃষ্টি দিয়ে দু’জন দু’জনকে ঝলসে দিয়েছে।
_________

রুশি দুই মেয়েকে নিয়ে গতকাল নিজের বাড়িতে চলে গেছে তবে ফোন করে অরিত্রি শিকদারকে বারবার কু বুদ্ধি দিয়েই যাচ্ছে।তিহান সোফায় বসে আছে আর বিড়বিড় করে কিছু বলছে, স্নিগ্ধতা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– ভাইয়া কাকে বিড়বিড় করে বকা দিচ্ছেন?

তিহান কফির মগ হাতে নিয়ে বলল,
– আজ একটা ঝগড়ুটে মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে জানো ভাবী মেয়েটা অনেক ঝগড়ুটে।

– ভাইয়া আপনি তো কলেজে গিয়েছিলেন।

– হুম মেয়েটার সঙ্গে তো কলেজেই ঝগড়া হয়েছে।

– কেন ঝগড়া হলো?

– মেয়েটা দেখতে পিচ্চিদের মতো তাই আমি পিচ্চি বলে ডেকেছি কিন্তু পরে শুনি সে নাকি আমার মতোই কলেজে নতুন টিচার হিসেবে জয়েন করেছে এতে আমার দোষ কিসের তাকে দেখলে বয়স বুঝা যায় না।

স্নিগ্ধতা মৃদু হাসলো,তিহান ব্রু নাচিয়ে,
– তুমি হাসছো ভাবী?

– কই না তো।

– যত খুশি হেসে নাও ওই ঝগড়ুটে মেয়েকে যদি টাইট দিতে না পেরেছি আমার নামও তিহান শিকদার না হু।

– আগে কফি খেয়ে নিন তারপর কিভাবে টাইট দিবেন ভেবে দেখা যাবে।

– আচ্ছা।
.
.
.
নিশ্চিন্তে স্তব্ধ ঘুমাচ্ছে আর তার ঠিক পাশে শুয়ে ঘুমন্ত স্তব্ধকে এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে স্নিগ্ধতা। ঠোঁটে লাজুক হাসি, জাগ্ৰত স্তব্ধের থেকে ঘুমন্ত স্তব্ধকে অধিক ভালো লাগছে স্নিগ্ধতার। জেগে থাকলে লজ্জায় স্তব্ধের দিকে তাকানোরও সাহস নেই কিন্তু ঘুমালে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেও সমস্যা নেই কেউ দেখতেও পারবে না লজ্জায়ও পড়তে হবে না। স্নিগ্ধতার ইচ্ছে হচ্ছে স্তব্ধকে ছুঁয়ে দিতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই ভয়ে ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখলো।

স্তব্ধের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,’একেই কি বলে ভালোবাসা? আমিও কি আপনাকে ভালোবাসি স্তব্ধ? হয়তো ভালোবাসি তবে কখনও হয়তো মুখ ফুটে বলা হবে না আপনি কি বুঝে নিতে পারবেন আমার ভালোবাসা?’

তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় চোখের পাতা বুজে গেল ঘুমে তলিয়ে গেল স্নিগ্ধতা।

আজানের ধ্বনিতে স্তব্ধের ঘুম ভেঙ্গে গেছে রাতে দেরিতে ঘুমানোয় স্নিগ্ধতা এখনও ঘুমিয়ে আছে। স্তব্ধের একবার স্নিগ্ধতাকে ডাকতে ইচ্ছে করল কিন্তু মন সায় দিল না স্নিগ্ধতার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

একে একে সব ছেলেরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে চলে গেছে। তিহান ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে সেকেন্ড ইয়ারের ব্যবসায় বিভাগের প্রথম ক্লাসটাই আজ তার কিন্তু রাস্তায় জ্যামের কারণে ক্লাসে আসতে পনের মিনিট দেরি হয়ে গেছে।

তিহান ক্লাসের দরজার সামনে দাড়াতেই ভেতরে শিরিনকে দেখতে পেল। শিরিন নিজের মতো ক্লাস নিচ্ছে, শিরিনের ক্লাস ছিল থার্ড পিরিয়ডে কিন্তু তিহানের দেরি হওয়ায় প্রিন্সিপাল তাকে এই ক্লাসে ঢুকিয়ে দিল। তিহান ডায়রীতে রুটিন চেক করে বলল,’রুটিন তো ঠিকই আছে তাহলে এই ঝগড়ুটে এই পিরিয়ডের ক্লাসে কি করে?’

তিহান গলা খাঁকারি দিয়ে শিরিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– হ্যালো মিস শুনুন।

শিরিন ব্রু কুঁচকে তিহানের কাছে এসে,
– কি?

– এখন আমার ক্লাস নেওয়ার কথা আপনি কেন এসেছেন?

– প্রিন্সিপাল স্যার বলেছেন তাই।

– আচ্ছা আপনি যান আমি আমার ক্লাস নেই।

– উহু আমি যখন এসেছি আমিই ক্লাস নিব আপনি থার্ড পিরিয়ডে এসে নিজের ক্লাস নিয়েন।

– বললেই হলো নাকি? রুটিন অনুযায়ী আমার ক্লাস সো আমি নিব।

– একজন টিচার হয়ে টাইম মেইনটেইন করে চলতে পারেন না আবার বড় বড় কথা বলেন আপনার পনের মিনিট লেইট হয়েছে তাই বাইরে গিয়ে দাড়ান আমাকে আমার ক্লাস করতে দিন।

বলেই শিরিন ক্লাসের ভেতরে ঢুকে গেল।তিহান বাইরে গিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে বলতে লাগল,’আমি কি ইচ্ছে করে দেরি করেছি নাকি? সব দোষ তো ওই জ্যামের।’

দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে আছে স্নিগ্ধতা মোবাইলের রিংটোন বাজতেই ঠোঁটের কোণে হাসি প্রশস্ত হলো। ফোনটা কানে ধরতেই অপরপাশ থেকে স্তব্ধ বলল,
– খেয়েছ দুপুরে?

– হুম, আপনি?

– খেয়েছি, কি করছো?

– কিছু না।

– আচ্ছা বিকেলে রেডি হয়ে থেকো আমরা ঘুরতে বের হব।

কোনো উওর না শুনে স্তব্ধ কল কেটে দিল,স্নিগ্ধতা যেন এটাই চেয়েছিল খুশি মনে কোন পোশাক পরবে ঠিক করতে লাগল।
_____________

বর্ষায় হাওরের ভিন্ন এক সৌন্দর্য দেখা যায় এই সৌন্দর্য মন ভালো করতে বেশ পটু, বর্ষায় হাওর ভ্রমণ কম বেশি সবারই ভালো লাগে।স্তব্ধ প্রতিবছর বর্ষায় বন্ধুদের সঙ্গে হাওর ভ্রমণে বের হয় এখনও বর্ষাকাল চলছে হাওরগুলো পানিতে পরিপূর্ণ।

হাওরের নাম শুনলেই প্রথমেই মনে পড়ে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওর।দুপাশের জলাধার এবং কনকনে শীতল বাতাস যেকোন মানুষের মন ভালো করার ওষুধ।

দীর্ঘক্ষণ ড্রাইভিং করে স্নিগ্ধতাকে নিয়ে মিঠামইনে পৌঁছালো স্তব্ধ। গাড়িতে বসেও স্নিগ্ধতা জানতো না কোথায় যাচ্ছে তারা জায়গাটা দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না।গাড়ি একপাশে সাইড করে স্নিগ্ধতার হাত ধরে সামনে এগুতে এগুতে স্তব্ধ বলল,

– এটা হচ্ছে মিঠামইন হাওর আগে অনেকবার বন্ধুদের সঙ্গে আসা হয়েছে ভাবলাম এবার না হয় বউ নিয়ে আসি।

স্নিগ্ধতা মুচকি হেসে বলল,
– একবার আমার সব বান্ধবীরা মিলে এখানে ঘুরতে আসার প্লান করেছিল আমারও আসার ইচ্ছে ছিল বাবা রাজি হলেও মা রাজি হয়নি তাই কখনও আসা হয়নি আজ আপনি ইচ্ছেটা পূরণ করে দিলেন।

স্তব্ধ স্নিগ্ধতার সঙ্গে আরেকটু ঘেষে দাড়িয়ে,
– এর জন্য তো আমি একটা গিফট তোমার থেকে ডিজার্ভ করি তাই না?

– কি গিফট?

– বেশি কিছু না একটা চুমু দিলেই হবে আমি কিছু মনে করবো না।

স্নিগ্ধতা চোখ গরম করে,
– আপনার মুখে কিছু আটকায় না লজ্জা শরম নেই?

– লজ্জা নারীদের ভূষণ এছাড়া বউকে চুমু দিতে লজ্জা কিসের দিনে দশ বারোটা চুমু খাওয়া স্বামীদের প্রধান কর্তব্য।

– নিয়মটা নিশ্চই আপনি বানিয়েছেন?

– আশ্চর্য জানলে কিভাবে!

– আপনার সঙ্গে কথা বলা মানে লজ্জা শরম বিসর্জন দেওয়া।

চলবে…..

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১২

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১২

‘আমাদের বাড়িতে এত সুন্দরী রমণী কোত্থেকে এলো? তুমি কি ভুল করে এখানে চলে এসেছ নাকি কারো সঙ্গে এসেছ?

আগন্তুক অপরিচিত লোকটার কথা শুনে স্নিগ্ধতা তাজ্জব বনে গেল। কলিং বেলের শব্দে সদর দরজা খুলতেই একটা অপরিচিত ছেলেকে দেখতে পায় স্নিগ্ধতা,ছেলেটা কথাগুলো স্নিগ্ধতাকে বলল‌। ছেলেটি কোনো জবাব না পেয়ে পুনরায় বলল,

– তুমি কি কথা বলতে পারো না? ওকেহ নো প্রবলেম তোমার হয়ে আমি না হয় কথা বলবো বাই দ্য ওয়ে তোমাকে কিন্তু আমার পছন্দ হয়েছে।

স্নিগ্ধতা এবার মুখ খুলল ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
– ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সঙ্গে? এমনিতেই চেনা জানা নেই বাড়িতে চলে এসেছেন এখন আবার আজেবাজে কথা বলছেন।

– আমি তিহান ধীরে ধীরে চেনাজানা হয়ে যাবে।

– ওখানেই থেমে যা আর একটা কথাও বলবি না।

স্তব্ধের শান্ত গলায় হুমকি শুনে সবাই স্তব্ধের দিকে তাকালো।তিহান নামক ছেলেটি দৌড়ে গিয়ে স্তব্ধের সঙ্গে কোলাকুলি করে,
– স্তব্ধ ভাই কেমন আছিস?

– ভালো হঠাৎ করে কিছু না বলে চলে এলি তোর তো আরও এক মাস পরে আসার কথা ছিল।

– সারপ্রাইজ! তোমাদের সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য মিথ্যে বলে চলে এলাম।

– সারপ্রাইজ ভালো ছিল।

– বাকিরা কোথায় ভাইয়া?

– বাড়িতেই আছে।

তিহানের চেঁচামেচি শুনে সবাই হল ঘরে চলে আসলো। অরিত্রি শিকদার গদগদ হয়ে তিহানের কাধে হাত রেখে বললেন,
– আমার আরেকটা ছেলে চলে এসেছে কি যে খুশি লাগছে।

– বড় আম্মু কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলো কেমন আছো?

– তোকে দেখে এখন অনেক ভালো আছি।

বাকিদের সঙ্গে কথা বলে এবার রাহেলা বেগমের পাশে তিহান বসলো গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– ডার্লিং এত শুকিয়ে গেছ কেন? নিশ্চই আমার বিরহে খাওয়া দাওয়া করনি ঠিক মতো?

রাহেলা বেগম তিহানের কান মুলে দিয়ে,
– এসে গেছে আরেক বাঁদর, এতদিন বাইরে থাকার পরেও বদলাসনি।

– বদলায় গিরগিটি আমি তো মানুষ।

– হ্যা দেখতেই পাচ্ছি রাতুল মেয়ে দেখা শুরু করে দে এবার তিহান দাদুভাইয়ের বিয়েটাও দিয়ে দিতে হবে তাহলে বাড়িতে আর বাঁদর থাকবে না।

তিহান লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে,
– মেয়ে দেখতে হবে না দিদান তোমরা শুধু কাজী ডাকো।

তিহানের এহেম কথায় সবাই বিষ্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।স্তব্ধ উচ্ছসিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– তুই তো সবকিছুতে ফার্স্ট তিহান, বিয়ের জন্য মেয়েও পছন্দ করে রেখেছিস!

– আরে না ভাইয়া তুই যা ভাবছিস তা না মেয়ে আমার এখনি পছন্দ হয়েছে তাও আবার বাড়িতে ঢুকেই।

সবাই আরও একদফা অবাক হলো। রাতুল শিকদার জানতে চাইলেন,
– বাড়িতে এসে মেয়ে পছন্দ হয়েছে! বলিস কি? কোন মেয়ে?

তিহান লাজুক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধতার দিকে আঙুল দেখিয়ে,
– ওকে আমার পছন্দ হয়েছে।

তিহানের আঙুল বরাবর স্নিগ্ধতার দিকে তাকিয়ে আবারো অবাক হলো সবাই। স্নিগ্ধতা এতক্ষণ দর্শকের মতো সবটা দেখলেও এখন যেন মাথায় বাজ পড়লো। স্তব্ধ তিহানের ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

– শেষ পর্যন্ত বড় ভাইয়ের আপন বউয়ের দিকে নজর দিলি?

তিহানের মুখ থেকে হাসিটা উধাও হয়ে গেল কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে,
– বড় ভাইয়ের বউ?

রাতুল শিকদার বললেন,
– ও হচ্ছে স্নিগ্ধতা স্তব্ধের বউ।

– হুয়াট! ভাইয়া বিয়ে করল কিভাবে?

– আমি করিয়েছি বাকিটা পরে জানতে পারবি।

তিহান আহত দৃষ্টিতে সবার দিকে চোখ বুলালো।স্তব্ধ তিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
– কষ্ট পায় না ও হচ্ছে তোর ভাবী আর ভাবী মাতৃ সমতুল্য।

– ভাবী এত সুন্দর কেন ভাইয়া?

– ভাই সুন্দর হলে বোনও সুন্দর হয় যেহেতু তুই সুন্দর সেহেতু স্নিগ্ধ তোর বোন হিসেবে নিজেও সুন্দর।

– হতে চাইলাম সাইয়া বানিয়ে দিল ভাইয়া পোড়া কপাল আমার, আসসালামু আলাইকুম ভাবী মনে কিছু নিয়ো না।

স্নিগ্ধতা সালামের জবাব নিয়ে ঘরে চলে গেল। উপস্থিত সবাই হেসে দিল, রাহেলা বেগম বললেন,
– তিহান দাদুভাই এত দূর থেকে এলে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নাও গিয়ে।

– আচ্ছা দিদান।

তিহান নিজের ঘরের দিকে চলে গেল।স্নিগ্ধতা বিছানায় বসে পা দোলাচ্ছে, স্তব্ধ এসে স্নিগ্ধতার পাশে বসে পড়লো মুখটা মলিন করে বলল,

– আমার কপালে যে অনেক দুর্ভোগ আছে এটা ইতোমধ্যে বুঝে গেছি।

স্নিগ্ধতা স্তব্ধের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কিসের জন্য দুর্ভোগ?

– বউয়ের জন্য।

স্নিগ্ধতা বুঝতে না পেরে ব্রু কুঁচকালো,স্তব্ধ তার দৃষ্টি বুঝতে পেরে,
– সবার নজর কেন আমার বউয়ের দিকে? মেয়ের কি অভাব পড়েছে নাকি যে বিবাহিত এক নারীর পেছনে লাগতে হবে?

– তো কে কে আপনার বউয়ের পেছনে লেগেছে?

– মিলির বিয়ের সময় একটা ছেলে লাগলো আজ নিজের ছোট ভাই লাগলো আবার অফিসে এসে আ..

স্তব্ধ থেমে গেল কি বলতে যাচ্ছিল বুঝতে পেরে নিজেকে মনে মনে কয়েকটা গালি দিল।স্নিগ্ধতা জিজ্ঞেস করল,
– থামলেন কেন? অফিসে কে এসেছিল?

– অফিসে তো কত মানুষই আসে কাজের জন্য।

– আপনার ভাইও আছে জানতাম না তো, আচ্ছা আপনারা কয় ভাই বোন?

– আপু আর আমি আপন ভাই বোন অর্থাৎ দুই জন আর তিহান হচ্ছে আমার চাচাতো ভাই ড্যড এর আপন ভাইয়ের ছেলে।

– ওহ উনার বাবা-মা আসেননি কেন?

– বাবা-মা নেই, চাচ্চু তিহান ছোট থাকতেই মা’রা গেছেন তারপর ওর মা অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছে এরপর থেকে ড্যড মম বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করছে এক মায়ের পেটের না হলেও আমরা আপন দুই ভাই, পড়াশোনার জন্য এতদিন দেশের বাইরে ছিল পড়াশোনা শেষে ওখানেই চাকরি নিয়েছিল কিন্তু মম ড্যড এর চাপে একেবারে চলে এসেছে।

– ওহ।
______________

‘ভাবী কি আমার উপর রাগ করেছ? তখনকার জন্য আই এম রিয়েলি স্যরি।’

স্নিগ্ধতা মৃদু হেসে বলল,
– ইটস্ ওকেহ ভাইয়া।

– তুমি কিন্তু অনেক সুন্দর ভাবী আগে কেন আমার চোখে পড়লে না? আচ্ছা ভাবী তোমার কি কোনো বোন আছে?

– না একটা ভাই আছে।

তিহান আহত কন্ঠে বলল,
– অনেক কষ্ট পেলাম ভাবী।

স্নিগ্ধতা তিহানের ফেইস দেখে হাসলো।

তিহানের আসার খবর শুনে আরিয়া আবারো নৌসিনকে নিয়ে বাড়িতে এসেছে।নৌসিন দৌড়ে এসে স্নিগ্ধতাকে ধরে,
– মামী।

নৌসিনকে কোলে নিয়ে চুমু খেয়ে স্নিগ্ধতা বলল,
– এতদিন পর মামীর কথা মনে পড়লো?

– আম্মুকে বলেথি আম্মু আসথে দেয়নি।

স্নিগ্ধতা নৌসিনকে নিয়ে ঘরে চলে গেল।আরিয়া তিহানের পাশ ঘেঁষে বসে,
– খবর কি তোর কেমন আছিস?

– ভালো আপু।

– ড্যড এর সঙ্গে অফিসে বসবি নাকি অন্যকিছু?

– ভাবছি বিসিএস ক্যাডার হব তারপর কচি কচি মেয়ে পটাবো।

তিহানের কথায় আরিয়া হেসে দিল দুষ্টুমি করে বলল,
– তারপর লোকজন দু’জনকে চাচা ভাতিজি বলে সম্বোধন করবে।

– মনটা ভেঙ্গে দিলি।

– সত্যি করে বল কি করবি এবার?

– বিসিএসে টিকে গিয়েছি স্বনামধন্য সরকারি কলেজের ইংরেজি টিচার হিসেবে এক সপ্তাহ পরেই জয়েন করবো।

– ভালো তো, তোর মতো যদি স্তব্ধ হতো আরও ভালো হতো ড্যড টেনে হিচড়ে অফিসে নিয়ে যায়।

– বিয়ে দিয়েছ না এবার ভাইয়া শুধরে যাবে।

– আর শুধরানো মম আর আন্টি মিলে ওদের আলাদা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

– দিদানের কাছ থেকে শুনেছি তবে চাপ নিস না ভাইয়া আছে না ভাবীকে আগলে রাখবে।

– এর জন্য ওদেরকে দু’জন দু’জনের প্রেমে ফেলতে হবে যেভাবে বিয়ে হয়েছে স্তব্ধ এখন মেনে নিলেও মমের কথায় যদি পিছিয়ে যায়।

– ওহ এ ব্যাপার! এসবে আমার অনেক অভিজ্ঞতা আছে প্রেমে কিভাবে ফেলতে হয় তুই শুধু দেখতে থাক আপু।
.
.
.
আদ্রিক হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে তবে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। মাথায় আর নাকে এখনও ব্যান্ডেজ করা, আশরাফ খাঁন ছেলের সামনে বসে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,

– আমার ছেলের গায়ে হাত! শিকদার পরিবারকে আমি ছাড়বো না আমার ভালো মানুষি দেখেছে এবার দেখবে আশরাফ খাঁন নিজের ছেলের জন্য কি করতে পারে।

– দোষটা পুরো শিকদার পরিবারের নয় দোষ ছিল স্নিগ্ধতার এখন স্তব্ধকেও ভোগতে হবে এর পরিমাণ, আদ্রিক খাঁনের গায়ে হাত তোলা আমিও দেখে নিব তোমার কিছু করতে হবে না বাবা।

আশরাফ খাঁন আদ্রিকের কাধে হাত রেখে,
– যা ভালো বুঝিস কর।

আশরাফ খাঁন ঘর থেকে বের হতেই আদ্রিক কাউকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে বাঁকা হাসলো।
____________

রাত হলেও তেমন একটা অন্ধকার নেই চাঁদের আলোয় আবছা আবছা সবকিছু দেখা যাচ্ছে চারিদিকে মানুষজনের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে শোনা যাচ্ছে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। শীতল বাতাস বইছে, ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধতা।

আরিয়া জোর করে স্নিগ্ধতাকে লাল বেনারসি পড়িয়ে নতুন বউয়ের মতো সাজিয়ে দিয়েছে আর বলেছে,’ভাই বলেছে এগুলো পরিধান করে ছাদে যেতে ওখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’

কথাটা শুনে অনেক লজ্জা পেয়েছে স্নিগ্ধতা সাথে অবাকও হয়েছে স্তব্ধ তাকে এ কথা বলেছে কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না তবুও আরিয়ার জোরাজুরিতে সেজে ছাদে আসতে হয়েছে কিন্তু ছাদে এসে স্তব্ধের দেখা মিললো না।

আবহাওয়া বেশ ভালো লাগছে তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে স্নিগ্ধতা অপেক্ষা করছে স্তব্ধের জন্য। স্তব্ধ সবেমাত্র বাড়িতে আসলো নিজের ঘরে গিয়ে গোসল করে বের হতেই তিহানের দেখা পেল। ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল,

– এসময় আমার ঘরে কিছু বলবি তিহান?

তিহান মাথা চুলকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– ভাবী কখন ধরে তোর জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে আর তুই এখনও ঘরে।

স্তব্ধ ব্রু নাচিয়ে,
– স্নিগ্ধ আমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছে! কেন অপেক্ষা করছে?

– আমি জানি নাকি কি জন্য অপেক্ষা করছে? শুধু বলল তোকে যেন ছাদে পাঠিয়ে দেই।

– মাথায় কি ভূত চেপেছে নাকি? তুই জিজ্ঞেস করতে পারলি না কেন ডাকছে?

– সিরিয়াসলি ভাইয়া তুই এত আনরোমান্টিক কিভাবে হলি তোর নতুন বউ তোকে এই পূর্ণিমা রাতে ছাদে ডাকছে আর তুই কিনা এসব বলছিস তোর জায়গায় আমি থাকলে দৌড়ে চলে যেতাম।

স্তব্ধ আমতা আমতা করে,
– আমি মোটেও আনরোমান্টিক নই।

– তাহলে এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন ছাদে গিয়ে বউকে জড়িয়ে ধরে রোমাঞ্চ কর আর প্রমাণ করে দে তুই রোমান্টিক বীর পুরুষ।

স্তব্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,
– হুম যাচ্ছি।

টাওয়াল রেখে ছাদের দিকে যাওয়া ধরলো স্তব্ধ। আরিয়া তিহানের কাধে হাত রেখে,
-প্লান এবার কাজে দিবে মনে হচ্ছে।

– চল আপু গিয়ে দেখি কি হয়।

আরিয়া তিহানের মাথায় চাপড় মে’রে,
– অসভ্য ঘরে যা ভাই ভাবীর প্রেম দেখার বয়স তোর হয়নি।

তিহান মাথা ডলতে ডলতে ঘরে চলে গেল আরিয়াও হেসে চলে গেল। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকার ফলে পা ব্যথা হয়ে গেছে কিছুটা ভয়ও অনুভব হচ্ছে, স্তব্ধের দেখা না পেয়ে নিচে চলে যাওয়ার জন্য পেছনে ঘুরতেই কারো বুকের সঙ্গে মাথায় বারি খেল স্নিগ্ধতা। মাথা তুলতেই স্তব্ধকে দেখে ঠোঁটের কোণে আপনাআপনি হাসি চলে এলো।

স্তব্ধ স্নিগ্ধতার থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল চাঁদের আলোয় ভালো করে স্নিগ্ধতার দিকে চোখ বুলিয়ে,
– আমার বউটাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে যে কেউ দেখলেই প্রেমে পড়ে যাবে।

স্নিগ্ধতা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল স্তব্ধ পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে স্নিগ্ধতার কাধে থুতনি ঠেকাল মুহূর্তেই স্নিগ্ধতার শরীরে এক কম্পন বয়ে গেল যা স্তব্ধ অনুভব করতে পেরেছে।স্তব্ধ অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,

– আমার বউ দেখছি অনেক রোমান্টিক হয়ে গেছে সাজুগুজু করে আমায় ছাদে ডাকলো, ডাকলেই যখন লজ্জা পাচ্ছো কেন? লজ্জা পেলে তোমায় অনেক সুন্দর লাগে তোমার মধ্যে কিছু একটা আছে যা বারবার আমায় টানে।

স্নিগ্ধতা চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আমি ডেকেছি মানে? আপনিই তো আরিয়া আপুকে আমায় সাজিয়ে ছাদে পাঠাতে বললেন।

স্নিগ্ধতাকে ছেড়ে কপাল চুলকিয়ে স্তব্ধ বলল,
– বলার হলে তো আমি নিজেই তোমাকে বলতে পারতাম আমাকে তিহান বলল তুমি নাকি আমার জন্য ছাদে অপেক্ষা করছো।

– আমি বলিনি বিশ্বাস করুন।

স্তব্ধ কিছু একটা ভেবে দোলনায় বসে হাতের ইশারা দিয়ে স্নিগ্ধতাকে ডাকলো।স্নিগ্ধতাও স্তব্ধের পাশে এসে চুপ করে বসলো।এক হাত দিয়ে স্নিগ্ধতাকে নিজের সঙ্গে আবদ্ধ করে স্তব্ধ বলল,
– সে যাই হোক কে ডাকলো কে না ডাকলো তাতে কি আসে যায়, একটা জিনিস খেয়াল করেছ আজকের রাতটা অনেক সুন্দর।

– হুম চাঁদটা বেশি সুন্দর।

– কিন্তু আমার তো চাঁদের থেকেও অন্যকিছুকে সুন্দর লাগছে।

– কোনটাকে?

– তোমাকে।

লজ্জায় স্নিগ্ধতার গালে লাল আভা পড়েছে দৃষ্টি নত করে ফেলল।স্তব্ধ মুচকি হেসে বলল,
– তুমি তো দেখছি লজ্জা পেতে পেতে আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিবে,জানো না লজ্জা পেলে তোমায় অনেক সুন্দর লাগে।

– আর আপনি লজ্জা দিতে দিতে আমার হার্ট অ্যাটাক করাবেন।

বলেই স্নিগ্ধতা উঠতে নেয় কিন্তু স্তব্ধ তার হাত টেনে পুনরায় নিজের সঙ্গে আবদ্ধ করে,
– আমার বউকে আমি লজ্জা দিব কার কি?

– কারো কিছু না ঘরে চলুন।

– উহু আজ সারারাত এখানে বসে আমরা গল্প করবো।

চলবে………

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১১

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১১

‘শুধুমাত্র এক রাতের জন্য স্নিগ্ধতা ওয়াজেদকে আমার চাই তাকে পাওয়ার জন্য অনেক কিছু করেছি কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি তুমি আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে দাও স্তব্ধ বিনিময়ে যা চাইবে তাই দিব।’

কথাটা শেষ হতেই চেয়ার থেকে আদ্রিক ছিটকে নিচে পড়ে গেল নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে।নাকে হাত দিয়ে সামনে তাকাতেই কলিজা কেঁপে উঠলো, স্তব্ধ চোয়াল শক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাড়িয়ে আছে কপালের রগ ফুলে গেছে চোখ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। স্তব্ধ আদ্রিকের কলার ধরে টেনে উঠিয়ে আরও তিন চারটে ঘুষি মে’রে কর্কশ কন্ঠে বলল,

– আমার স্নিগ্ধকে নিয়ে এত বাজে কথা বলার সাহস হয় কিভাবে তোর?

আদ্রিক নিজেকে স্তব্ধের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে,
– স্তব্ধ শান্ত হও রাগের মাথায় কিন্তু নিজের বিপদ ডেকে আনছো।

– নিজের বিপদ তুই ডেকে এনেছিস আমার প্রপার্টির দিকে নজর দিয়েছিস তোকে আমি..

স্তব্ধ ছটফট করছে চঞ্চল দৃষ্টিতে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে আদ্রিককে আঘাত করতে লাগল। আদ্রিকের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে জ্ঞান হারানোর উপক্রম তবুও স্তব্ধ থামছে না আদ্রিকের চেঁচানোর শব্দ শুনে কিছু স্টাফ ভেতরে এসে স্তব্ধকে থামানোর চেষ্টা করছে। স্তব্ধ কারো কথা শুনছে না ইচ্ছে করছে আদ্রিককে মে’রে ফেলতে মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজায় হাত দিতে চেয়েছে।

অনেক চেষ্টার পর কয়েকজন স্তব্ধকে অনেক কষ্টে আটকালো বাকি কয়েকজন এম্বুলেন্সে খবর দিয়ে আদ্রিককে নিয়ে বাহিরে চলে গেল এতক্ষণে আদ্রিক জ্ঞান হারিয়েছে রাগের বসে জায়গায় বেজায়গায় আঘাত করেছে স্তব্ধ।

স্তব্ধ চেয়ারে ঢপ করে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে টেবিলে রাখা পানির গ্লাস খালি করে ফেলল। তিক্ষ্ম দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
– এখনও এখানে দাড়িয়ে আছেন কেন? নিজেদের কাজে যান।

স্তব্ধের ধমকে সবাই ভয় পেয়ে দ্রুত স্তব্ধের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। স্তব্ধ চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে এসিটা বাড়িয়ে দিল। বারবার চেষ্টা করেও রাগ কমাতে পারছে না স্নিগ্ধতার কথা মনে পড়ছে, মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা শুরু হয়েছে বসা থেকে উঠে গাড়ির চাবি নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেল স্তব্ধ।

অরিত্রি শিকদার,রুশি,নাতাশা তিনজন গোল হয়ে বসে আছে।রুশির হাতে ডিভোর্স পেপার নাতাশা উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,

– আমার ভাবতেই হ্যাপি লাগছে এই কাগজে সাইন হয়ে গেলেই স্তব্ধের জীবন থেকে স্নিগ্ধতা নামক মেয়েটি দূর হবে।

– আস্তে বল কেউ শুনে ফেলবে তো।(রুশি)

নাতাশা মুখে আঙ্গুল দিয়ে সতর্ক হয়ে গেল,অরিত্রি শিকদার মনমরা হয়ে কিছু ভাবছেন, রুশি বোনের কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,

– কি রে আপা তোর আবার কি হলো? কি ভাবছিস?

– স্নিগ্ধতা মেয়েটা অনেক ভালো কি সুন্দর করে সবার সঙ্গে কথা বলে আচ্ছা আমরা ওর সঙ্গে অন্যায় করছি না তো?

– কোনো অন্যায় হচ্ছে না স্তব্ধ এবং নাতাশার বিয়ে আমরা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি স্নিগ্ধতা মাঝখানে চলে এসেছিল তবে সমস্যা নেই যাওয়ার সময় হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিব।

অরিত্রি শিকদার খুশি হতে পারলেন না। দাড়িয়ে গিয়ে বললেন,
– সবাই এসময় ঘরে বসে থাকলে মা সন্দেহ করতে পারে চল নিচে যাই।

– হুম চল আপা এমনিতেও এটা আমার চা খাওয়ার সময়।

সবাই হল ঘরে গিয়ে বসলো,অরিত্রি শিকদার রাহেলা বেগমকেও নিয়ে এসে সোফায় বসালেন।স্নিগ্ধতা চা বানিয়ে এনে সবাইকে দিতেই অরিত্রি শিকদার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন,

– সালেহাকে বলো তো মায়ের বিছানা গুছিয়ে দিয়ে আসতে।

– সালেহা আন্টি তো রাতের খাবার তৈরি করছে আমি গুছিয়ে দিয়ে আসছি মা।

স্নিগ্ধতা হাস্যজ্জল মুখে চলে গেল রাহেলা বেগমের ঘরের দিকে। সবাই চা খাচ্ছে আর খোশ মেজাজে গল্প করছে রাতুল শিকদার আসতে আসতে রাত হবে। কলিং বেল বাজতে লাগল সালেহা গিয়ে দরজা খুলে দিতেই স্তব্ধ ভেতরে প্রবেশ করল। সবার দৃষ্টি স্তব্ধের দিকে,স্তব্ধকে এলোমেলো লাগছে টাই ঢিলে হয়ে আছে ঠোঁটের কোণে অল্প কিছু রক্ত শুকিয়ে আছে।অরিত্রি শিকদার প্রশ্ন করলেন,

– স্তব্ধ বাবু তোকে এমন দেখতে লাগছে কেন? ঠোঁটের কোণে রক্ত কেন? কি হয়েছে?

– আমি ঠিক আছি স্নিগ্ধ কোথায় ওকে ঘরে পাঠিয়ে দিও।

কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরে চলে গেল স্তব্ধ।রুশি নাতাশাকে ইশারায় কিছু বলতেই নাতাশা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে চলে গেল।

স্তব্ধ কোট আর টাই খুলে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে পেছনে ঘুরতেই নাতাশাকে দেখে মুখটা পূর্বের ন্যায় মলিন হয়ে গেল।নাতাশা স্তব্ধকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,

– হেই স্তব্ধ কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখা হলো অথচ আমার সঙ্গে কথা বললে না।

– মন মেজাজ ভালো না কি বলতে কি বলে দিব ঠিক নেই তাই এখান থেকে যাও পরে কথা হবে।

– মন ভালো না কেন? আমায় বলো আমি ঠিক করে দিচ্ছি।

– এই ক্ষমতা তোমার নেই যেতে বলেছি তোমায়।

স্নিগ্ধতা রাহেলা বেগমের ঘর গুছিয়ে হল ঘরে এলো। রুশি মৃদু হেসে বলল,
– তুমি অনেক ভালো চা বানাও আমার জন্য আরেক কাপ চা বানিয়ে দিবে?

– অবশ্যই আমি নিয়ে আসছি।

রাহেলা বেগম বাধা দিয়ে বললেন,
– বেশি চা খাওয়া ভালো না রুচি নষ্ট হয়ে যায় নাত বউ ঘরে যা দাদুভাই এসেছে দেখ কি লাগবে।

স্তব্ধের কথা শুনে স্নিগ্ধতার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে মাথা নাড়িয়ে দ্রুত ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। দরজার সামনে দাড়াতেই স্নিগ্ধতার চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, স্তব্ধকে নাতাশা জড়িয়ে ধরে আছে স্তব্ধও নিরব। দরজার দিকে মুখ ঘুরে ছিল বলে স্নিগ্ধতাকে দেখতে সময় লাগেনি স্তব্ধের। চোখাচোখি হতেই স্নিগ্ধতা সেখান থেকে রান্নাঘরে চলে গেল।

স্তব্ধ নাতাশাকে নিজের থেকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে,
– এখন আমি বিবাহিত যখন তখন এভাবে আমার কাছে আসবে না নইলে আমি এমন ব্যবস্থা করবো যা তোমার কল্পনার বাইরে নাউ গেট আউট।

স্তব্ধের এমন ব্যবহারে নাতাশা হতভম্ব হয়ে গেল। স্তব্ধের দৃষ্টিতে রাগ স্পষ্ট ভয়ে নাতাশা স্তব্ধের ঘর ত্যাগ করল।স্তব্ধ আলমারি থেকে পোশাক বের করে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

সালেহার সঙ্গে স্নিগ্ধতা রাতের খাবার তৈরি করছে মনে বিষাদের ছায়া পড়েছে দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠছে অনেক অভিমান হচ্ছে নিজের মনকে শান্তনা দেওয়ার জন্য নিজেই নিজেকে বলছে,’উনার বাবা যদি উনাকে বাধ্য না করতো তাহলে তো আজ আমার জায়গায় নাতাশার থাকার কথা ছিল এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক আমার প্রতি উনার কোনো ভালোবাসা নেই,কেন কষ্ট পাচ্ছি আমি আমার কষ্টের মূল্য কারো কাছেই নেই।’

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে কাজে মন দিল স্নিগ্ধতা।
_____________

রাতুল শিকদার বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়েছে আজকে। বাড়িতে ঢুকেই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন,
– স্তব্ধ….স্তব্ধ..

রাতুল শিকদারের চিৎকারে সবাই হল ঘরে চলে এসেছে। রাতুল শিকদার রেগে আছেন স্তব্ধকে দেখে রাগের পরিমাণ বেড়ে গেছে, স্তব্ধ চুপচাপ মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।অরিত্রি শিকদার জানতে চাইলেন,

– এসেই চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছ কেন?

অরিত্রি শিকদারের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে স্তব্ধের সামনে গিয়ে কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
– আদ্রিক খাঁনকে কেন মে’রেছিস?

স্তব্ধ নিরুও্যর, রাতুল শিকদার পুনরায় চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
– উওর দিচ্ছিস না কেন? কেন মে’রেছিস?

এবারো স্তব্ধ কিছু বলল না অন্য দিকে দৃষ্টি স্থির করে দাড়িয়ে আছে। রাতুল শিকদার রাগে কাঁপতে কাঁপতে কষিয়ে একটা চড় দিলেন স্তব্ধকে, উপস্থিত সকলে হতভম্ব হয়ে গেছে স্নিগ্ধতা রাহেলা বেগমের ঘরে ছিল, রাতুল শিকদারের ক্ষিপ্ত স্বর শুনে হল ঘরে আসতেই এমন ঘটনা নিজ চোখে দেখে সেও থমকে গেছে।

স্তব্ধ ভাবলেশহীন ভাবে আগের মতো দাড়িয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি এখানে,অরিত্রি শিকদার রাতুল শিকদারের মুখোমুখি দাড়িয়ে,

– এত বড় ছেলের গায়ে তুমি হাত তুললে? আজ পর্যন্ত ওর গায়ে কখনও কেউ আমরা হাত তুলিনি আর আজ তুমি!

– এটাই সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম যার পরিণতি আজ আমায় ভোগ করতে হচ্ছে ছোটবেলা থেকে শাসনে রাখলে এমন বিগড়াতো না।

– কি এমন করেছে স্তব্ধ?

– আশরাফ খাঁনেকে চেনো না তার ছেলে আদ্রিক খাঁনকে তোমার ছেলে মে’রেছে, এতটা নির্মম ভাবে মে’রেছে ছেলেটার এখনও জ্ঞান ফেরেনি আইসিইউতে ভর্তি আশরাফ খাঁন আমাকে শাসিয়ে পর্যন্ত গেছে।

যাই করুক না কেন কখনও কোনো ঝামেলা কিংবা কারো সঙ্গে মারপিট পর্যন্ত করেনি স্তব্ধ কেউ ভাবতেও পারছে না স্তব্ধ এমন একটা কাজ করেছে।অরিত্রি শিকদার ছেলের সামনে গিয়ে শান্ত গলায় বললেন,

– তোর ড্যড কি বলছে সত্যি সত্যি তুই আদ্রিককে মে’রেছিস?

স্তব্ধ এখনও শান্ত কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল,
– হুম মে’রেছি।

– কেন মে’রেছিস?(রাতুল শিকদার)

– মা’র খাওয়ার কাজ করেছিল তাই মে’রেছি।

– সেটাই জানতে চাচ্ছি কি এমন করেছে যে তুই নির্মম ভাবে মে’রেছিস?

– বলতে ইচ্ছুক নই।

– অরিত্রি ছেলেকে কিছু বলো রাগে কিন্তু আমার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।

রাতুল শিকদারের এমন রাগ দেখে অরিত্রি শিকদারেরও ভয় করছে নিজের ভয়কে লুকিয়ে রাখার মিথ্যে চেষ্টা করে,

– স্তব্ধ তোর ড্যড যা জিজ্ঞেস করছে তার উওর দে।

– উওর দেওয়ার মতো প্রশ্ন করলে উওর ঠিকই দিতাম।

– আশরাফ খাঁনের পাওয়ার আমাদের থেকে কোনো অংশে কম নয় এই ঘটনা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তোর কোনো ধারণা আছে?

– তোমার ভয় পাওয়ার দরকার নেই আমার ব্যাপার আমি বুঝে নিব।

বলেই স্তব্ধ দাড়িয়ে গেল স্নিগ্ধতার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল,
– এখানে দাড়িয়ে আছো কেন? ঘরে আসো।

কারো দিকে না তাকিয়ে ঘরে চলে গেল স্তব্ধ, স্নিগ্ধতাও স্তব্ধের পেছনে ছুট লাগালো। রাতুল শিকদার ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
– দিনে দিনে ছেলে বিগড়ে যাচ্ছে আশরাফ খাঁনকে এখন কি বলবো।

স্নিগ্ধতা ঘরে প্রবেশ করে বিছানার একপাশে বসলো স্তব্ধকে কেন জানি খুব ভয় লাগছে তার কাছে।স্তব্ধ দরজা আটকে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দিল স্নিগ্ধতার বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে ভয়ে। স্নিগ্ধতা এখনও বসে আছে এসির নিচে থাকার পরেও ঘামছে, আচমকা স্তব্ধ স্নিগ্ধতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো এতে স্নিগ্ধতা কেঁপে উঠলো। স্তব্ধ স্নিগ্ধতার একটা হাত শক্ত করে ধরে চুমু খেয়ে বলল,

– মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছে একটু হাত বুলিয়ে দিবে?

– হুম।

স্নিগ্ধতা যত্ন সহকারে স্তব্ধের চুলে বিলি কেটে দিতে লাগল,স্তব্ধ চোখ বন্ধ করে শীতল কন্ঠে বলল,
– আমাকে তোমার ভয় লাগছে?

– উহু।

– তাহলে কাঁপছো কেন?

স্নিগ্ধতা চুপ এই স্তব্ধের সঙ্গে সে পরিচিত নয় আজ এক অন্যরকম স্তব্ধকে দেখছে সে। মনে একটা প্রশ্নই উঁকি দিচ্ছে,’স্তব্ধ আদ্রিককে কেন মা’রলো?’ কিন্তু সাহসের অভাবে জিজ্ঞেস করা হলো না।

সব রাগ উধাও হয়ে গেছে স্তব্ধ স্নিগ্ধতার কোলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে।স্নিগ্ধতার চোখে ঘুম নেই ডিম লাইটের আবছা আলোয় স্তব্ধের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
_____________

আঘাত অনেক গুরুতর হওয়ায় আদ্রিকের এখনও জ্ঞান ফেরেনি।আশরাফ খাঁন আইসিইউর সামনে বসে আছেন,আদ্রিকের মা পাশেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

রুশি ছটফট করতে করতে অরিত্রি শিকদারকে বললেন,
– আপা ডিভোর্স পেপারে সাইন করাবে কখন?

– এখন এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল রাতুল অনেক রেগে আছে স্তব্ধও অপ্রত্যাশিত একটা কাজ করল এখন এগুলো নিয়ে কথা বললে হিতে বিপরীত হবে পরিস্থিতি ঠান্ডা হোক তারপর সব হবে।

নাতাশা মুখ ভার করে,
– আরও অপেক্ষা করতে হবে আন্টি?

– ভালো কিছুর জন্য একটু অপেক্ষা করতে হয়।

চলবে…..

স্তব্ধের স্নিগ্ধতা পর্ব-১০

0

#স্তব্ধের_স্নিগ্ধতা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১০

রাত দশটা ছুঁইছুঁই স্তব্ধ এখনও বাড়ি ফেরেনি,স্নিগ্ধতা খেয়ে শুয়ে আছে ঘুমানোর জন্য। এ ক’দিনে স্তব্ধের চলাফেরা সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছে স্নিগ্ধতা। স্তব্ধ প্রতিদিন রাতে দেরি করে ফেরে বাইরেই খেয়ে আসে।

স্নিগ্ধতার সাইলেন্ট করা মোবাইলে আলো জ্বলে উঠেছে স্ক্রীনে শাহিলী ওয়াজেদের নাম্বার দেখেই স্নিগ্ধতার ভেতরে ভয় কাজ করছে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই শুভর গলা ভেসে এলো,

– হ্যালো আপু..

– শুভ তুই!এতদিন পর আমাকে মনে পড়লো?

– মা তোর সঙ্গে কথা বলতে না দিলে আমি কি করবো।

– মায়ের নাম্বার থেকে কল দিলি যে মা এখন কিছু বলবে না?

– বাবা হাসপাতালে ভর্তি অফিসে থাকাকালীন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে অফিসের লোকেরাই হাসপাতালে ভর্তি করেছে মা অনেক কান্না করছে তুই আসতে পারবি?

এমন একটা খবর শুনে স্নিগ্ধতা আতকে উঠেছে ভেতরে তিব্র ভয় হানা দিয়েছে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল,
– তুই লোকেশন পাঠা আমি আসছি।

কল কেটে বোরকা আর হিজাব পড়ে রেডি হয়ে নিলো স্নিগ্ধতা। খাওয়া দাওয়া শেষ করে যে যার যার ঘরে চলে গেছে হল ঘর ফাঁকা কাউকে বলে যাওয়ার মতো অবস্থায় নেই স্নিগ্ধতা।হল ঘর পেরিয়ে সদর দরজার কাছে যেতেই পেছন থেকে অরিত্রি শিকদার হাঁক ছেড়ে বললেন,

– এই রাত বিরেতে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

স্নিগ্ধতা ভয়ে ভয়ে উওর দিল,
– আমার বাবা অসুস্থ তাই হাসপাতালে যাচ্ছি।

– এত রাতে একা একা যাওয়া ঠিক হবে না স্তব্ধকে নিয়ে যাও।

– উনি এখনও ফেরেননি।

অরিত্রি শিকদার একটু ভেবে বললেন,
– যতই হোক তুমি এখনও আমার ছেলের বউ একা যেতে দিতে পারি না চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

স্নিগ্ধতা অবাক হলো তবে কিছু বলল না এখন বাবার কাছে যাওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।অরিত্রি শিকদার ঘর থেকে পার্স নিয়ে এসে স্নিগ্ধতাকে নিয়ে গাড়িতে বসলো।স্নিগ্ধতার উদ্দেশ্যে বললেন,

– ড্রাইভারকে লোকেশন বলো।

স্নিগ্ধতা লোকেশন বলতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। সানজিদ ওয়াজেদ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে,শাহিলী ওয়াজেদ পাশে বসে কান্না করছেন সাথে অনেক বিলাপ বকছেন। সানজিদ ওয়াজেদ বিরক্ত হয়ে বললেন,

– একটু থামবে ম’রা কান্না জুড়ে দিয়েছ কেন?

– আমি ম’রা কান্না করছি? শুভরে দেখ তোর বাবা আমায় কি বলে।

শুভও বিরক্ত হয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
– মা এবার থামো তো শুনলে না ডাক্তার বলে গেল বাবার বিশ্রামের প্রয়োজন কথা বলতেও তো নিষেধ করেছে।

– আমি কথা বললে তোর বাবা অসুস্থ হয়ে যাবে নাকি? ঠিক আছে আমি বাইরে গিয়ে বসলাম।

শাহিলী ওয়াজেদ বাইরে গিয়ে বসে রইলেন।স্নিগ্ধতা এবং অরিত্রি শিকদার হাসপাতালে পৌঁছে গেল, রিসিপশন থেকে বিস্তারিত জেনে স্নিগ্ধতা সানজিদ ওয়াজেদের কেবিনে ঢুকে গেল। স্নিগ্ধতাকে দেখে সানজিদ ওয়াজেদ-শাহিলী ওয়াজেদ দু’জনেই বেশ অবাক হয়েছেন। বাবাকে চোখের সামনে এমন অবস্থায় দেখে চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে স্নিগ্ধতার। সানজিদ ওয়াজেদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে,

– কাদিস না মা আমি এখন সুস্থ আছি।

– আমি ডাক্তারের কাছ থেকে সব শুনেছি তোমার এবার থেকে বেড রেস্ট নিতে হবে আর ছোটাছুটি করতে পারবে না।

– ডাক্তাররা এসব একটু বলেই তবে তুই এত রাতে কিভাবে এলি? সঙ্গে কে এসেছে?

– শাশুড়ি মা নিয়ে এসেছে।

– ওহ

স্তব্ধ বাড়িতে ফিরেছে পুরো ঘর খুঁজেও স্নিগ্ধতাকে না পেয়ে কপালের রেখা কুঁচকে এসেছে।স্নিগ্ধতার মোবাইলটাও বিছানায় রাখা,স্তব্ধ দিদানের ঘরে যাওয়ার জন্য বের হলো যদি স্নিগ্ধতা ওখানে থাকে এই আশায়। রাহেলা বেগম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধের কারণেই উনার এত ঘুম আশেপাশে কি হচ্ছে তারও খোঁজখবর থাকে না।

স্নিগ্ধতাকে দিদানের ঘরেও না পেয়ে অনেক চিন্তায় পড়ে গেছে স্তব্ধ। সালেহাকে কিছুক্ষণ ডাকলো স্তব্ধের ডাক শুনে সালেহা দ্রুত হল ঘরে আসতেই স্তব্ধ জিজ্ঞেস করল,

– আন্টি স্নিগ্ধকে দেখেছ? স্নিগ্ধ কোথায়?

– তারে তো তোমার মায়ের সঙ্গে বাইরে যাইতে দেখলাম।

– হুয়াট! স্নিগ্ধ মমের সঙ্গে গেছে এত রাতে, কোথায় গেছে জানো কিছু?

– না বাবা তা জানি না, তবে তোমার বউ কানতাছিল।

– কাঁদছিল!

– হয়।

স্তব্ধ ঘেমে গেছে সাথে ভয়ও হচ্ছে বিড়বিড় করে বলল,’মমের সঙ্গে বের হয়েছে, কে জানে মমের ভেতরে কি চলছে যদি স্নিগ্ধের কিছু করে দেয়? না না মমকে কল দেই।’

স্তব্ধ অরিত্রি শিকদারকে কল দেওয়া শুরু করল কয়েকবার রিং হওয়ার পর অরিত্রি শিকদার কল ধরে বললেন,

– কল করছিস কেন?

– স্নিগ্ধ কোথায় মম? কোথায় নিয়ে গেছ ওকে? ঠিক আছে তো ও?

– বউয়ের জন্য অনেক চিন্তা হচ্ছে নাকি?

– মম প্লিজ বলো স্নিগ্ধকে কোথায় নিয়ে গেছ?

– ওর বাবা অসুস্থ তুই বাড়িতে ছিলি না তাই আমাকেই নিয়ে আসতে হলো হাসপাতালে।

– ওকে ফোনটা দাও।

– ওর বাবার কাছে আছে।

– হাসপাতালের নাম বলো আমি আসছি।

– এখন আর আসার দরকার নেই আমরাই চলে আসব।

অরিত্রি শিকদার কল কেটে দিলেন,স্তব্ধ আবারো কল দেওয়া শুরু করল কিন্তু রিসিভ হলো না। মায়ের কথা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না স্নিগ্ধতার জন্য চিন্তা হচ্ছে।

স্নিগ্ধতা অরিত্রি শিকদারের কাছে গিয়ে বলল,
– মা আমি বাবার কাছে থাকি?

মা ডাকটা শুনে অরিত্রি শিকদার কিছুক্ষণ স্নিগ্ধতার দিকে তাকিয়ে রইল, এমন চাহনি দেখে স্নিগ্ধতার ভয় পেয়ে গেছে।স্তব্ধ-আরিয়া সবসময় মম বলেই ডাকে কখনও মা ডাকটা শোনা হয়নি আজ প্রথম কারো থেকে মা ডাক শোনায় অরিত্রি শিকদারের মনটা যেন ভরে গেছে।স্নিগ্ধতার মাথায় হাত রেখে বললেন,

– আজ থাকার দরকার নেই এখন বাড়িতে যাব কাল সকালে না হয় স্তব্ধের সঙ্গে এসে আবার দেখে যাবে।

স্নিগ্ধতা মাথা নাড়িয়ে সানজিদ ওয়াজেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অরিত্রি শিকদারের সঙ্গে হাসপাতাল থেকে বের হলো। শাহিলী ওয়াজেদ শুভর কাছে গিয়ে,

– স্নিগ্ধা জানলো কিভাবে তোর বাবা যে অসুস্থ হাসপাতালের ঠিকানা পেল কোথায়?

– আমি ফোন করে জানিয়েছি।

– নাম্বার পেলি কোথায়?

– তোমার মোবাইল থেকে।

– আমার অনুমতি ছাড়া কেন তুই স্নিগ্ধাকে জানালি? নিষেধ করেছিলাম না কোনো কথা নেই ওই মেয়ের সঙ্গে।

– তুমি আপুকে নিজের মেয়ে না মানলেও ও আমার বড় বোন আমি তাকে ত্যাগ করতে পারবো না বাবার এমন অবস্থার কথা ওর জানার অধিকার আছে অনেক করেছ আর নয়।

– নিজের মায়ের থেকে সৎ বোন আপন হয়ে গেছে তোর কাছে?

– তোমরা দু’জনেই আমার কাছে আপন তোমার সঙ্গে আপুকে নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না।

বলেই শুভ দেরি না করে শাহিলী ওয়াজেদের সামনে থেকে চলে গেল।শাহিলী ওয়াজেদ দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
– বিয়ে হয়ে গেছে বলে পাখনা গজিয়ে গেছে তাই না এখন আমার ছেলেটাকে আমার অবাধ্য করছিস।

কলিং বেল বাজতেই স্তব্ধ গিয়ে দরজা খুলে দিল।অরিত্রি শিকদার ভেতরে ঢুকে গেল পেছনে স্নিগ্ধতাও ছিল।স্নিগ্ধতাকে দেখে স্তব্ধের ভেতর থেকে ভার কমলো আলতো করে স্নিগ্ধতাকে জড়িয়ে ধরলো আচমকা এমন ঘটায় স্নিগ্ধতা কেঁপে উঠলো অরিত্রি শিকদার ছেলের কান্ড দেখে অবাক হয়ে গেছে।স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে ছেড়ে বলল,

– কত টেনশন হচ্ছিল জানো একটাবার আমায় কল করে বলতে পারতে।

– মনে ছিল না।

অরিত্রি শিকদার ঘরে চলে গেলেন।স্তব্ধ স্নিগ্ধতার হাত ধরে,
– ঘরে চলো।

স্নিগ্ধতা বাধ্য মেয়ের মতো স্তব্ধের সঙ্গে ঘরে গেল। দু’জনে ফ্রেশ হয়ে বসলো,স্তব্ধ জিজ্ঞেস করল,
– তোমার বাবা এখন কেমন আছেন?

– মোটামুটি ভালো।

– আর কখনও আমায় না বলে এভাবে কোথাও যাবে না আমি না থাকলে একটা কল কিংবা টেক্সট দিবে বুঝলে।

স্নিগ্ধতা মাথা নাড়িয়ে বলল,
– কাল আমায় একবার বাড়িতে নিয়ে যাবেন?

– আচ্ছা এবার ঘুমাও।

দু’জনেই শুয়ে পড়লো কিন্তু স্নিগ্ধতার চোখে ঘুম নেই বাবার মুখ বারবার ভেসে উঠছে।আজ পর্যন্ত বাবাকে এইভাবে অসুস্থ হতে কখনও দেখেনি সে প্রিয়জন হারানোর ভয় কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে ভেতরটা।
______________

রাতে দেরি করে ঘুমালেও আজ স্তব্ধ স্নিগ্ধতাকে ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েছে নামাজের জন্য দু’জন একসঙ্গে নামাজ পড়েছে। খাবার টেবিলে যাওয়ার পর রাতুল শিকদার প্রশ্ন করলেন,

– স্নিগ্ধা মা শুনলাম তোমার বাবা নাকি অসুস্থ?

– হুম।

– গতকাল রাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ভাগ্যিস তোমার শাশুড়ি জেগে ছিল, স্তব্ধ স্নিগ্ধা মাকে নিয়ে ওর বাড়িতে যাস আজকে।

– হুম (স্তব্ধ)
.
.
.
দুইটা দিন কেটে গেল, সানজিদ ওয়াজেদ এখন সুস্থ তবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন শুভর চাকরি হয়ে গেছে পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করে সংসারের দায়িত্ব নিয়েছে।স্তব্ধ এবং স্নিগ্ধতা দু’জনেই সানজিদ ওয়াজেদকে বাড়িতে গিয়ে দেখে এসেছে।

বাড়িতে অনেক রান্নাবান্না হচ্ছে অরিত্রি শিকদার নিজে সবকিছু তদারকি করছেন। রুশি এবং তার মেয়েরা কিছুদিন বেড়ানোর জন্য চলে এসেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে অরিত্রি শিকদার এবং রুশি নিজেদের ঘরে গেলেন দুই বোন গল্প করার জন্য। স্তব্ধ অফিসে গিয়েছে বাবার সঙ্গে, স্নিগ্ধতা ঘরে বসে একটা বই পড়ছিল তখনি ঘরে নাতাশা আর নিতু এলো।স্নিগ্ধতা তাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,

– বসো।

নাতাশা আর নিতু সোফায় বসলো নাতাশা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
– এই ঘরটা আমার হওয়ার কথা ছিল তোমার জায়গায় আমার থাকার কথা ছিল কিন্তু নিয়তি সবকিছু বদলে দিল।

স্নিগ্ধতার হাসি মিলিয়ে গেল নাতাশার কথাগুলোতে কষ্ট লুকিয়ে আছে বুঝা যাচ্ছে এতে স্নিগ্ধতার বেশ খারাপ লাগছে কিন্তু কি করার এতে তো তার কোনো হাত ছিল না। নাতাশা আবারো বলতে লাগল,

– আমরা এসেছি বলে কি তোমার বিরক্ত লাগছে?

স্নিগ্ধতা তৎক্ষণাৎ মুখে আবারো হাসি ফুটিয়ে জবাব দিল,
– না না তা হবে কেন আমার তো ভালোই লাগছে এতক্ষণ একা বসে ছিলাম এখন তোমরা এলে একাকীত্ব দূর হলো।

– স্তব্ধের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি স্বাভাবিক?

– হুম।

– আমার কেন জানি মনে হচ্ছে না আমি থাকতে স্তব্ধ তোমায় মেনে নিবে ভাবা যায় না।

স্নিগ্ধতা এবারো চুপ করে রইল,স্নিগ্ধতার মুখের এমন অবয়ব দেখে নাতাশার আনন্দ হচ্ছে। মোবাইল বেজে উঠতেই নাতাশা চলে গেল এখন শুধু ঘরে স্নিগ্ধতা আর নিতু আছে।

নিতু স্নিগ্ধতার গা ঘেষে বসলো স্নিগ্ধতা হেসে জিজ্ঞেস করল,
– তুমি কোন ক্লাসে পড়?

– ক্লাস টেন।

– ভালো তো।

– তুমি কোন ক্লাসে পড় ভাবী?

স্নিগ্ধতা নিতুর গাল টেনে দিয়ে,
– আমার পড়াশোনা শেষ।

– তুমি তো তাহলে অনেক বড়!

– হুহ।

– চলো না ভাবী লুডু খেলি।

– এখন লুডু খেলবে?

– হুম চলো না।

নিতু মোবাইলে লুডু বের করল তারপর দু’জনে মিলে খেলা শুরু করল।

‘উকিলের সঙ্গে কথা শেষ ডিভোর্স পেপার তৈরি হয়ে গেছে আজ বিকেলে হাতে পেয়ে যাব।’

– যাক শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো।

– আজ রাতেই দু’জনের কাছ থেকে সাইন করিয়ে কাল স্নিগ্ধতাকে বের করে দিব কিন্তু রাতুলকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে যদি বেঁকে বসে।

– আপা দুলাভাইয়ের কথা তোর চিন্তা করতে হবে না স্তব্ধের বিয়ে দেওয়ার সময় একবারও কি তোর কথা ভেবেছিল তাহলে তুই কেন ভাববি?

– তাও ঠিক আমার ছেলের ভালো আমিই বুঝবো শোন রুশি নাতাশার সঙ্গে বিয়েটাও খুব দ্রুত দিয়ে দিব।

– তা আর বলতে সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।

রাতুল শিকদার স্তব্ধকে সবটা বুঝিয়ে একটা কাজে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছেন।স্তব্ধ ল্যাপটপে মনোযোগ সহকারে কাজ করছে একজন দরজার বাইরে থেকে বলল,

– আসতে পারি?

স্তব্ধ সেদিকে তাকালো আদ্রিককে দেখে অনেকটা অবাক হয়েছে হেসে বলল,
– আরে আদ্রিক যে ভেতরে এসো।

আদ্রিক ভেতরে আসলো একটা চেয়ার টেনে স্তব্ধের সামনে বসে পড়লো।স্তব্ধ জিজ্ঞেস করল,
– হঠাৎ কি মনে করে এখানে এলে?

– তোমার সঙ্গে একটা ডিল করতে এসেছিলাম।

স্তব্ধ ব্রু কুঁচকে,
– আমার সঙ্গে ডিল? ড্যড তো এখন অফিসে নেই।

– আঙ্কেল থাকলেই কি না থাকলেই কি আমার তো তোমাকে দরকার।

– কি ডিল শুনি।

– তোমাদের একটা বড় টেন্ডার আটকে আছে আমি চাইলে আমার বাবার পাওয়ার দিয়ে সহজেই টেন্ডারটা ছাড়িয়ে আনতে পারি তার জন্য তোমাকে আমার ছোট একটা আবদার পূরণ করতে হবে, তুমি আমার কাজ করে দিবে আর আমি তোমার কাজ করে দিব।

– আমি তোমার আবদার পূরণ করতে পারবো! কি আবদার?

চলবে……..