Friday, August 1, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1004



অনুরক্তি অন্তরিক্ষ পর্ব-০১

0

#অনুরক্তি_অন্তরিক্ষ [সূচনা পর্ব]
তাসনিম তামান্না

-‘ আমি তোর সাথে এখানে রোমাঞ্চ করতে আসি নাই তাই কাঁপাকাঁপি বন্ধ কর। আর এই বিয়েটা বন্ধ কর না হলে তোর লাইফ আমি হেল করে দিবো বাচ্চা মেয়ে হয়ে আমাকে বিয়ে করার খুব শখ না? ‘

জারা তবুও কাপতে লাগলো। ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে শানের মুখোপানে শানের কথাগুলো তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। বুকের ধুকপুকি বেড়ে গেছে গলা শুকিয়ে মরুভূমিতে রূপান্তর হয়েছে সেখানে পানির ছিটেফোঁটাও নেই। জারার এতো কাছে কোনো ছেলে কখনো আসেনি। শান কথা বলতে বলতে খেয়াল হলো জারার খুব কাছে চলে গেছে সে। দূরত্ব বাড়ালো। মাথার চুল খামছে ধরে বার কয়েক শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে। জারার দিকে শান্ত চোখে, শান্ত কন্ঠে বলল

-‘ দেখো এখন তুমি স্কুলের গন্ডি পার হতে পারো নি। তোমার সামনে ফুল ফিউচার পড়ে আছে আমাকে বিয়ে করে তোমার আমার দু’জনেরই ক্যারিয়ার নষ্ট। তার চেয়ে বড় কথা আমার আর কয়দিন পর ফ্লাইট। আমি দেশের বাইরে চলে যাবো আমি চাইছি না কোনো পিছুটান রেখে যেতে। …. আই থিংক তুমি বুঝবে এবং আমার মা’কে বোঝাবে ‘

এতোক্ষণ পরে জারা মুখ খুলে মাথা নত করে বলল

-‘ আপনি এসব কি বলছেন ভাইয়া এসবের কিছু আমি জানি না! তার চেয়ে বড় কথা মনি আপনার কথা শুনবে আপনি বুঝিয়ে বলেন মনিকে ‘

-‘ আমার কথায় যদি কাজ হতো তাহলে আমি তোর কাছে আসতাম না বুঝলি? তাই তুই জোর দিয়ে বললি এ বিয়ে টা করবি না আর যদি কোনো কিছুতে কাজ না হয় তাহলে তুই বলবি তুই সু’ই*সা’ই’ড করবি না হয় অন্য কোথাও তোর রিলেশন আছে ‘

জারা ভয়ে শুকনো ঢোক গিলছে বার বার শানকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে রেগে আছে অনেক। এদিকে তুই তুমি মিশ্র ভাবে কথা বলছে জারার কাছে কেমন লাগছে শুনতে। শানের শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো সে কখনোই কাউকে বলতে পারবে না জারা এমনিতেই ভীতু মেয়ে এটা শান জানে তবুও এমন কথা বলল।

-‘ এ এ সব কথা আমি কাউকে বলতে পারবো না আপনি বলেন তাহলে কাজ হবে দেখেন’

শান বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চণর করে বলল

-‘ বাচ্চাদের মতো কথা বললে তো আর হয় না মা কখনো এসব বিশ্বাস করবে না তোমাকে যেটা বলছি সেটা করবে গট ইট?.. ‘

জারা প্রতিবাদ করে দৃঢ় কন্ঠে বলল

-‘ আমি কখনোই এসব বলতে পারবো না মনি কষ্ট পাবে ‘

শান রেগে গিয়ে কাবাডের সাথে মুখ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল

-‘ তোর সাথে যদি আমার বিয়ে হয় তাহলে তুই জানিসও না তোর জীবন আমি কিভাবে নড়ক বানিয়ে দিবো মাথায় রাখিস কথাটা ‘

দরজার ওপাশ থেকে হাসাহাসি আওয়াজ ভেসে আসছে। শানের মাথায় দপ করে রাগ উঠে গেলো পা চালিয়ে দরজা খুলে সবাইকে রাম ধমক দিলো সবাই ধমক খেয়ে কাচুমাচু করতে লাগলো। শান চলে যেতেই শানের কাজিন বোন গুলো সবাই রুমে ডুকে জারাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলো। জারা এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারি নাই। শানের বোন ইশা বলল

-‘ কি হবু ভাবি বলে ফেলো তো ভাইয়া রুমে ডুকে ওতো জোরে দরজা লাগিয়ে দিয়ে তোমার সাথে কি করলো? বাসার সবাই সেই আওয়াজ শুনতে পেয়েছে ‘

শানের চাচাতো বোন রিমতি বলল

-‘ ভাইয়া নিশ্চয়ই দরজা বন্ধ করে চু-মু-টু-মু খেয়েছে তাই না? সেজন্যই আমাদেরকে লজ্জায় কিছু বলছ না! আরে ব্যাপার না আমরা আমরাই তো বলো না বলো না কি হলো ‘

মামাতো বোন সাদিয়া চোখমুখ কুঁচকে বলল

-‘ ভাইয়া মটেও ওমন নাই নিশ্চয়ই চ-ড় মারছে দেখছ না মুখটা কেমন প্যাচার মতো করে রাখছে। ‘

একাকজন একাক কথা বলতে লাগলো জারা লজ্জায় লাল নীল হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে এলো শানের মা সবাইকে ঘর থেকে বেড় করে দিলেন। জারা ফাপ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। জারা প্রশ্নাতকচোখে তাকিয়ে বলল

-‘ এসব কি হচ্ছে মনি? আমাকে তো কিছুই বলো নি তোমরা। আর এসব কেনোই বা করছো? আমি বিয়ে করছে চাই না আমি….! ‘

-‘ কেনো আমার ছেলেকে বুঝি তোর পছন্দ নয়’

জারা চুপ হয়ে গেলো। মনে মনে বলতে লাগলো ‘একথা সবাই বুঝতে পারবে যে আমি শান ভাইয়াকে পছন্দ করি যদি কেউ ভালোভাবে খেয়াল করে এমনকি আমার আম্মুও বুঝতে পেরেছিল তাহলে কি মনিও বুঝতে পারছে বুঝতে না পারাটা কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কেনো না মনি বিচক্ষণ মানুষ সব কিছু বুজে যায় ‘

কথাটা ভেবে অতি সাবধানে লুকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিলো মুখে বলল

-‘ মনি দেখো ভাইয়া এই বিয়েতে রাজি নয় আর কারোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা ঠিক না। ভাইয়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে ‘

-‘ শোন আমি আমার ছেলেকে চিনি ও এসব করবে না। আর তোরও বুঝতে হবে তোর একটা জায়গা দরকার যেখান থেকে তোকে কেউ উপরে না ফেলতে পারে আমার ইচ্ছে ছিলো তুই বড় হলে শান নিজের পায়ে দাঁড়ালে তোদের বিয়ে দিবো কিন্তু পরিস্থিতিটা এখন ভিন্ন ‘

-‘ মনি তবুও বাদ দাও না আমি নিজে কিছু করতে চাই ‘

-‘ তার জন্য নিজের গোড়াটা শক্ত হওয়া চায়। আর এখন মানুষ বিয়ের পরেও পড়াশোনা করে আমি তো বলি নাই আমি তোকে পড়াশোনা করতে দিবো না পড়াশোনা করবি নিজের মতো চলবি কোনো বাঁধা নাই আর শানও চলে যাবে ‘

-‘ কিন্তু ভাইয়া রাজি না আমি এটা করতে পারবো না মনি তুমি বোঝার চেষ্টা করো ‘

-‘ সেটা আমি বুঝবো তুই বিয়েতে রাজি এটাই ফাইনাল ‘

-‘ মনি প্লিজ তুমি বুঝছ না

-‘ শান তোকে কিছু বলছে তাই না ‘

শানের বলা তখনকার কথাগুলো বলতে গিয়েও বলল না

-‘ না না ভাইয়া কি বলবে ‘

-‘ শোন আমাকে বোকা ভাবিস না আমি সব বুঝি শান এসেছিল আমি জানি তোকে হু/ম/কি দিয়ে গেছে আমি জানি দেখবি একবার বিয়েটা হতে দে তাহলে শান মেনে নিবে সব ‘

জারা আর কিছু বলতে পারল না। শানের মা শান্তি চলে গেলেন রুম থেকে। হয়তো শানের রুমে গেলেন। জারার আজ নিজের কাছে নিজেকে কেমন ছোট মনে হচ্ছে। অন্য দিকে আবার ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার আকুল আবেদনটা মনজুর হওয়ায় মনের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি গুলো রঙিন অম্বরিতে ডানা মেলে উড়াউড়ির করছে। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো এটা কি ঠিক হচ্ছে? জারা দীর্ঘ শ্বাস ছড়লো। এখন আর নিজের জীবনের ওপর কোনো নিশ্চয়ইতা নেই।

সব সিদ্ধান্ত শেষে খবর এলো আজ সন্ধ্যায় বিয়ে হবে। বাসায় হুলুস্থুল বাধিয়ে দিলো। খবরটা পাওয়া মাত্র জারার মনের মধ্যে কেমন খুঁত খুঁত করতে লাগলো। বিয়েটা করতে মন সাই দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হবে তো? শান রাজি হয়েছে তো নাকি মনির চাপে পড়ে রাজি হয়েছে? শানের তখনকার কথাগুলো মনে পড়তেই মনের মধ্যে অজানা ভয়েরা উঁকি দিলো। এমন হাজারো চিন্তা কল্পনা করতে লাগলো। মন বলছে কিছু ঠিক হচ্ছে না সবকিছু ভুল! সবকিছু ছেড়ে কি তাহলে তাকে দূরে কোথাও চলে যাওয়া উচিত?

চলবে কি?

ঘেউলের সংসার পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#ঘেউলের_সংসার
৪র্থ এবং শেষ পর্ব

তারা দুজন মেতে আছে পৈশাচিক কাণ্ডে। আমি ধীরে ধীরে সেই ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাইরে থেকে বাবা আর মায়ের উল্লাসের শব্দ কানে ভেসে আসছে। জুঁইয়ের করুণ পরিণতির কথা ভাবতেই আমার কান্না পেতে লাগলো। তখনই সেই অদৃশ্য নারী কন্ঠস্বরটা উদয় হলো আমার পেছন থেকে আবার, ‘ভয় নেই খোকা, দুঃখ করো না। সাহস রাখো। ভয়ানক সেই রাত এসে হাজির হয়েছে তোমার জীবনে। বাঁচা-মরার রাত। এটাকে মোকাবেলা করতে হবে তোমাকেই।’

আমি কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললাম, ‘আমার যে কী ভয় লাগছিল! আমি ভেবেছিলাম তুমি আর ফিরে আসবে না!’

‘এটা কী হয় খোকা! এতগুলো বছর ধরে অতৃপ্ত থেকে অপেক্ষা করে গেছি এই রাতটার। আজ রাতেই উপযুক্ত সময় তোমার বাবা-মা রুপি শয়তান ঘেউল দুটোকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দেয়ার। এরপর তোমাকে আর কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তুমিই হবে তোমার নিয়ন্ত্রক!’

আমি গলা সামান্য খাটো করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘
তুমি যে বলেছিলে আমি কথা বলতে পারি এটা জানলেই তারা আমাকে খুন করে ফেলবে! কিন্তু কেন করবে ওরা এটা? আমার সাহায্য ছাড়া ওরা ঘেউলের জগতে ফিরে যেতে পারবে না! তবে তারা আমাকে হত্যা করবে কেন?

‘এটা ঠিক খোকা! মানুষের আহ্বানে তারা এই জগতে এসেছিল। এবং মানুষের যে কিনা অর্ধেক মানুষ এবং অর্ধেক ঘেউল তার মাধ্যমেই এই জগৎ থেকে বিদায় নিতে পারবে তারা। কিন্তু তাদেরকে তাদের জগতে ফিরে যেতে তোমার মুখ থেকে উচ্চারিত মন্ত্রই যথেষ্ট নয়। এর জন্য দরকার তাদের নিজের সন্তান অর্থাৎ তোমার রক্ত! হ্যা, ওরাও এই রাতটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এখন শেষ বারের মতো কোনো একটা মানব সন্তানের মাংস আর রক্ত খাচ্ছে। তোমার রক্ত বা মাংস তারা খেতে পারবে না এর জন্য। মেয়েটাকে খাওয়া শেষে তোমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে উচ্চারণ করাবে সেই বিতাড়িত করার মন্ত্র। যা তাদের দুজনের কাছে সংরক্ষণ করা আছে। তারপর তোমাকে সেই মোমবাতি গুলোর মাঝে রেখে হত্যা করবে। তোমার রক্তের স্পর্শই এই জগৎ থেকে তাদের মুক্তি দেবে। এই জগৎ থেকে বিলীন হয়ে যাবে তোমরা তিনজনে। তবে তুমি যদি তাদের কথামতো মন্ত্রগুলো উচ্চারণ না করো তাহলে তোমাকে ওরা কিছুই করতে পারবে না। হয়তো কিছুটা বেশি অত্যাচার করবে তোমার উপর। তুমি যতক্ষণ পর্যন্ত মন্ত্র উচ্চারণ না করছো তোমার জীবন তাদের কাছে মূল্যবান। তুমি বেঁচে থাকবে।

‘কিন্তু তাতে কী লাভ? হয়তো আমি বেঁচে থাকবো কিন্তু আমার বাবা-মা অর্থ্যাৎ দুজন ঘেউল তারাও তো এই জগতে আটকে থাকবে, তারা আটকে থাকলে তাদের ক্ষুধার তাড়নায় মারা যাবে আরও শত শত মানুষ। আমার আরও অনেক আগেই ওদের জানানো উচিত ছিল আমি কথা বলতে পারি। তাহলে এতদিনে ওরা থাকতো অন্য জগতে। হয়তো আমি মারা যেতাম। কিন্তু বেঁচে যেত অনেক নিরপরাধ মানুষ!’ বললাম আমি বিনয়ের সাথে।

‘বাহ, খোকা! এই দুজন পিশাচের মাঝে থেকেও তোমার বয়সের তুলনায় তোমার মনুষ্যত্ববোধ সুন্দর বিস্তীত। কিন্তু ভেবে দেখ এত সহজেই এদেরকে মুক্তি পেতে দেবে তুমি? এরা এই জগতে অন্যায় ভাবে প্রবেশ করে কত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে ক্ষুধার তাড়নায়! জুঁই এবং অন্য কাজের মেয়েগুলোর কথা ভাবো। বাইরে থেকেও প্রায়ই মানুষকে বোকা বানিয়ে সন্ধ্যার পর এই বাড়িতে নিয়ে আসতো তারা। তুমি তখন ঘরে বন্ধি থাকতে। মনে পড়ে বাইরে থেকে ভেসে আসা তোমার বাবা-মায়ের পৈশাচিক হাসির কথা! হাড় চিবানোর শব্দ। ওরা যদি আমার শরীর আর তোমার বাবার শরীর দখল করে না নিত তবে আজ আমি আর একজন তোমার মতোই বিনয়ী, মানবিক চিন্তাশীল পুরুষ হতো তোমার বাবা-মা। এর আগেও কত নিষ্পাপ মানুষকে হত্যা করে এই পর্যন্ত টিকে আছে তারা।

সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছে তারা তোমাকে। আমাদের শরীর দখল করে তারা করে গেছে পৈশাচিক সব কাজ। তোমার কী মনে পড়ে না তোমার সঙ্গে কী নিষ্ঠুর ব্যবহার করে গেছে তারা! তোমার বাবা-মা যতটা না ওই ঘেউল দুটো তার চেয়ে বেশি আমি! আমি তোমাকে ভালোবাসি খোকা। তুমি কেন তোমার এত সুন্দর জীবনটাকেশয়তান ঘেউল দুটোর জন্য উৎসর্গ করবে!’

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। এবং বুঝতে পারলাম বাবা আর মায়ের প্রতি কতটা রেগে রয়েছি আমি। আমার সঙ্গে করা বাবার সমস্ত নিষ্ঠুরতা গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। জুঁই সহ, সেই মেয়েটার খণ্ডিত লাশ, বীভৎসতা সব! এই অদৃশ্য নারী কণ্ঠস্বরের প্রতি কেন আমার এত টান, বিশ্বাস আর ভালোবাসা তাও অনুমান করতে পারছি। সেই আমার প্রকৃত মা। আমার একমাত্র শুভাকাঙ্খী এই জগতে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করতে হবে তাহলে আমার এখন? এই বাড়ি থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই! আর বের হলেও এই দুজনকে আমি ধ্বংস করবো কী করে! আমি বেঁচে গেলেও তারা যে তাদের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করবে না! আর এই বাড়ির বাইরে যেতে যে তুমিই আমাকে নিষেধ করেছিলে, কারণ এই বাড়ির বাইরে তুমি আমার সাথে যেতে পারবে না!’

‘পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে খোকা। তোমার জন্য এই ঘরের চাইতে বাইরের জগৎটাই বেশি নিরাপদ। আজ রাতে তুমি ধ্বংস করবে তোমার মা-বাবা রুপি এই দুজন ঘেউলকে। নিশ্চিন্ন করে দেবে ঘেউল এবং মানুষ দুই দুনিয়া থেকে তাদের! এরপরেই তো তোমার মুক্তি!’

‘কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?’ বিস্মিত হলাম আমি।

‘শোনো তাহলে।’

অদৃশ্য নারী কণ্ঠস্বরটা এমন কিছু কথা বলল আমাকে শিউরে উঠলাম আমি। এটা কী আধো সম্ভব! আমি কী সময় মতো কাজটা করতে পারবো! কাজটা করতে পারলে তবেই পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে এই দুটি অপশক্তি এবং আমিও বেঁচে থাকবো। কাজটা করতে না পারলেও আফসোস করার কিছু থাকবে না নিজের জন্য। হয়তো আমি মারা যাব তবে আমার মৃত্যুর সাথে এই পৃথিবী থেকে উধাও হয়ে যাবে দুজন অভিশপ্ত পিশাচও তাদের জগতে। বন্ধ হবে নিরপরাধ মানুষ হত্যা। কিন্তু খারাপ লাগবে শুধু অদৃশ্য এই নারীটির জন্য। যে কিনা মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন আমার সঙ্গে থেকে গেছে আমাকে বাঁচানোর জন্য। আমার প্রকৃত মা। তার প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়ে যাবে। ঘেউল গুলোও পাবে না তাদের কর্মের শাস্তি। না কাজটা ঠিক ভাবে করতেই হবে আমাকে। হঠাৎ অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটার অস্তিত্ব উধাও হয়ে গেল ঘরটা থেকে।

তখনই দরজার সামনে উপস্থিতি টের পেলাম দুজনের। বাবা আর মা এসে দাঁড়িয়েছেন। রক্তে গোসল হয়ে গেছে দুজনেই। আমার সামনে এসে একটা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। এরপর হাটুগেড়ে বসে পড়লো দুজনেই আমার সামনে। মাথা নত করে একসঙ্গে দুজনে বলে উঠল, ‘আশীর্বাদ করুণ প্রভু! দীর্ঘদিন এই জঘন্য মানুষের দুনিয়ায় পার করেছি আমরা। জন্ম দিয়েছি আপনাকে। বিতাড়িত করুন আমাদের এই জগৎ থেকে এই অপবিত্র রাতে। চলুন আমাদের সাথে ওই ঘরে। উচ্চারণ করুন সেই মন্ত্র!’ এই বলেই তারা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো। উন্মাদ হয়ে গেছে যেন দুজনে। আমার শরীর গুলিয়ে উঠছে। নিজেকে শান্ত রাখতে পারছি না উত্তেজনায়। অদ্ভুত কাগজটা মেলে ধরলাম চোখের সামনে। এক অদ্ভুত ভাষায় কিছু একটা লেখা রয়েছে ওটায়। কিন্তু লেখাটা আমি পড়তে পারছি এবং আশ্চর্য্য লেখাটায় কী বলা হয়েছে তাও আমি বুঝতে পারছি। এ যেন আমার খুব চেনা কোনো একটা ভাষা। পরিকল্পনা মতো তারা যা বলবে তাই করতে হবে আমাকে।

ধীরে ধীরে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে বাবা আর মায়ের ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। তারাও এসেছে আমার পিছু পিছু। জুঁইয়ের শরীরের অবশিষ্ট হাড়গোড় আর রক্তে ভিজে আছে পুরো ঘর। গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো আমার। কথামতো মোমবাতি গুলোর মাঝখানে বসে পড়লাম। মা আমার সামনে আর বাবা পেছনে বসলেন। দুজনের চোখ-মুখই আনন্দে আর উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আবার কেমন একটা বিষাদও ভর করলো ওদের মুখে। আমিও কাঁপছি। ঠোঁট যেন আঠার মতো লেগে আছে। সেই প্রতীক্ষিত সময় এসে গেছে। অদৃশ্য নারী কণ্ঠস্বরের পরিকল্পনাটা মনে করতে লাগলাম।

মানুষের পক্ষে ঘেউলকে হত্যা করা অসম্ভব। একটা ঘেউলকে হত্যা করতে পারে কেবল আরেকটা ঘেউল। দুজন মানুষের শরীর দখল করলেও মানুষের রক্ত আর মাংস ভক্ষণের মাধ্যমে আমার সামনে পেছনে বসে থাকা দুজনের শরীরই এখন ঘেউলের শরীরে রূপান্তরিত হয়েছে। তারাই কেবল এখন একে অপরকে হত্যা করতে পারবে। কাজটা ঘটবে কিভাবে, তাইতো! আমার হাতে যে মন্ত্রটি রয়েছে তা যদি উল্টো করে পড়ি এবং স্পর্শ করি আমার সামনে বসে থাকা মায়ের গলা তখন সাথে সাথেই শরীর থেকে ঘেউলটার আত্মা বেরিয়ে যাবে, সেখানে আশ্রয় নেবে মুহূর্তেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের সেই নারীটি। হ্যা তখন সে নিয়ন্ত্রণ করবে ঘেউলটির শরীর, এরপর হত্যা করবে অপর ঘেউল অর্থাৎ বাবাকে। এরপর নিজেকে। এভাবেই ঘেউলদের সৃষ্ট ফাঁদে জড়িয়ে তারা দুজনই চিরো জীবনের জন্য ধ্বংস হয়ে যাবে। বেঁচে থাকবো আমি!

বাবা আর মা দুজনেই উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছেন মুহূর্তটির জন্য। আমি কাগজটা তুলে নিয়ে দেরি না করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম উল্টো মন্ত্রটি। মায়ের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। গগনবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো সেই কণ্ঠ থেকে। বাবার প্রতিক্রিয়া পেছনে ঘুরে দেখার সময় পেলাম না। শুধু ক্রোধে ভরা একটা গোঙানি কানে এলো। সময় দিলাম না তাদের। সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরলাম মায়ের গলা। নিস্তেজ হয়ে গেল তার শরীর। বাবা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে আমার এই কাজ দেখে। তারা ভাবতেও পারেনি এমনটা ঘটতে পারে। আমি লাফিয়ে ঘরের এক কোণে চলে গেলাম। তার ঠিক পরের মুহূর্তেই মায়ের নিস্তেজ শরীরে প্রাণ ফিরে এলো। কিন্তু তার দৃষ্টিতে আমার দিকে কোনো ক্রোধ নেই। সমস্ত ক্রোধ বর্ষণ করছেন তিনি বাবার দিকে। বুঝলাম কাজ হয়ে গেছে। অদৃশ্য সেই কণ্ঠস্বরের নারীটি ভর করেছে তার ভেতর। আমাকে হত্যার দায়িত্বটা মাকেই দিয়েছিলেন বাবা। মা তার কোমরের কাছ থেকে ধারালো ছুরিটা বের করলেন। বাবা বুঝে উঠার আগেই ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাবার উপরে।

বাবা প্রতিরক্ষা করার সুযোগ পেলেন না নিজের। ছুরিটা তার গলায় গেঁথে গেল। ছুরির এক টানে তার গলনালি ছিড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। ছিটকে বের হতে লাগলো রক্ত। ক্ষোভের সঙ্গেই চিৎকার করলেন মা। এরপর ঘুরলেন আমার দিকে। ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপছি। মায়ের রক্ত মাখা মুখে মায়াবী হাসি ফুটে উঠল। ছুরিটা ফেলে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। ফুঁপিয়ে উঠে বললেন, ‘এই দিনটা! এটার জন্য অপেক্ষা করে গেছি কতদিন আমি! অবশেষে! আমার খোকা!’ আমিও শক্ত করে চেপে ধরলাম তাকে। মনে হলো আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে পেয়ে গেছি আমি। বললাম, ‘মা!’

হঠাৎই আলগা করে দিলেন তিনি আমাকে। কাঁদো কণ্ঠে বললেন, ‘এবার আমার পালা খোকা। যত দ্রুত সম্ভব আমাকে মরতে হবে না হলে নারী ঘেউলটা যাকে তুমি মা ডাকো সে আবার দখল নিতে চাইবে শরীরটা। হ্যা, তোমাকে আগে বলিনি , এই দুটো ঘেউলের সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যাব আমিও। কিন্তু তুমি এখন থেকে মুক্ত। এই বাড়ির বাইরে যাবে তুমি। মানুষের জগৎটা যে কত সুন্দর দেখতে পাবে, নিজের উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে চলো। একটা আশ্রয় তুমি পেয়ে যাবে। আর ভুলে থাকার চেষ্টা করো নিজের শৈশবের এসব স্মৃতি।’

এক মুহূর্তে আমার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এক মুহূর্তের জন্য মাকে পেয়ে আবার এত দ্রুত হারাতে হবে মানতেই পারছি না। মা শেষবারের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘খোকা তুমি মানুষ এবং ঘেউল দুটোর মিশ্রনে সৃষ্টি। তুমি যেমন মানুষ পুত্র, তেমন ঘেউল পুত্রও। নিজের মানুষ ব্যক্তিত্বকে শক্তিশালী করো, মানবিক হয়ো। কারণ একটা বয়স যখন পার করবে তুমি তোমার ভেতর দুটো স্বত্তার সৃষ্টি হবে। ঘেউলদের পৈশাচিকতা, রক্ত তৃষ্ণা, ক্ষমতা তোমার ভেতর থেকে জেগে উঠবে। ওটাকে কিছুতেই আটকানো যাবে না। ঘেউলের পুত্র করে তুলো না নিজেকে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো!’

আমি অসহায় ভাবে দাড়িয়ে রইলাম। মা ছুরিটা তুলে নিয়ে নিশ্চিত করলেন নিজের মৃত্যু। তার সেই মৃত্যু চিৎকারে কেঁপে উঠল আমার সমস্ত হৃদয়,মন,শরীর!
.
.
• * * * সমাপ্ত * * *
.
.
লেখা: #Masud_Rana

ঘেউলের সংসার পর্ব-০৩

0

#ঘেউলের_সংসার
৩য় পর্ব

মাঝরাতে একটা মেয়েলি কণ্ঠের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল আমার। জুঁইয়ের কণ্ঠ! পুরো ঘর অন্ধকার। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে নীচে নেমে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। । দরজাটা খোলা। সামান্য ধাক্কা দিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুকটা কাঁপছে ধুরু ধুরু করে। ওর কিছু হয়নিতো! সেই রাতের মতো পুরো ঘরে মোম বাতির আলোয় ভরে আছে। জায়গায় জায়গায় নকশা করে মোমবাতি রাখা। মেয়েলি কণ্ঠটার গোঙানি কানে এলো সামনের ঘরটা থেকে। বাবা-মার ঘর ওটা। ভয়ে ভয়ে তাদের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘরের ভেতরে ঢুকে দৃশ্যটা দেখে আমার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো। মনে হচ্ছে পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। জুঁইয়ের লাশ পড়ে আছে মেঝেতে, তাকে ঘিরে আছে মোমবাতির সারি। সেগুলোকে ঘিরে বসে আছে বাবা আর মা। মেয়েটার বীভৎস লাশের মুখটা হা হয়ে আছে আতঙ্কে, তার করুণ চোখ দুটো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মেঝে ভরে আছে রক্তে। আমার ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে। বাবা-মা এক মনে মোমবাতি গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে মুখ তুলে দুজনের চোখ দুটো আমার মুখের দিকে স্থির করলো। শিহরণ জাগানো সেই পৈশাচিক দৃষ্টি। ওই মুখ মানুষের সমস্ত মায়া মমতা বিসর্জন দেয়া মুখ।

তাদের সেই দৃষ্টি, মোমের কম্পিত ঝাপসা আলো, ঘর জুড়ে ছায়ার নৃত্য, রক্তাক্ত মেঝে আর লাশ আমার মাথা গুলিয়ে উঠল। আমি ধীরে ধীরে পিছাতে লাগলাম। মায়ের মুখটা কিছুটা কোমল হয়ে এলো হঠাৎ। ‘কথা বলতে যান তুমি। কিছু একটা বলো খোকা? ‘

এই প্রথম ক্রোধ অনুভব করলাম আমি নিজের মাঝে। চেঁচিয়ে বললাম, ‘মেয়েটা আমাকে তোমাদের চাইতে বেশি ভালোবাসতো। কত যত্ন করতো। আমিও ওকে ভালোবাসতাম। তোমরা কেন এমনটা করলে!’

বাবার ক্রুদ্ধ ফ্যাকাশে মুখে পৈশাচিক হাসি ফুটলো, ‘ভালোবাসা! তোমাকে যত ছোট ভেবেছিলাম অতো ছোট তুমি নও দেখছি! আমরা যা করেছি তা তোমার এবং আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল। মেয়েটা ৩য় পক্ষ। আমাদের মাঝে ৩য় পক্ষ বলে কেউ বা কিছু থাকতে পারে না! জানি একটা নারী যার কিনা শরীর নেই সে ৩য় পক্ষ হয়ে এতদিন তোমাকে পথভ্রষ্ট করে রেখেছিল। আমাদের সম্পর্কে তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে। ও তোমার ক্ষতি ছাড়া ভালো আর কিছুই চায় না। আমরাই তোমার প্রকৃত বন্ধু। ও আমাদের সম্পর্কে যা বলেছে তার সবই মিথ্যা! আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করবো না! এসো খোকা যোগ দাও আমাদের সঙ্গে। ‘

ক্রোধের সাথেই জবাব দিলাম, ‘তাতো দেখতেই পাচ্ছি! তোমরা কতো ভালো কাজ করছো! তিনিই আমাকে এতদিন রক্ষা করেছেন, এখনো করবেন! তোমাদের চাইতে অদৃশ্য সেই কন্ঠটাই আমার বেশি কাছের লোক, শুভাকাঙ্ক্ষী।’

‘হাহাহা! খোকা! ভুলে যাও ওকে তুমি। এতবছর আমাদের ভুলেই বোকাটা তোমার সাথে থাকতে পেরেছে। আমরা আন্দাজও করতে পারিনি ওর আত্মা এই বাড়ি থেকে এখনো মুক্তি পায়নি। তবে এখন ওর অবস্থা যা করেছি দুনিয়ার কোনো শক্তিই ওকে আর তোমার কাছে আনতে পারবে না। তুমি আমাদের কথামতো চলো এতেই তোমার মঙ্গল। আমরা ছাড়া তোমার আর আপন কেউ নেই।’

ভয় আর আতঙ্কে আমার মন সংকুচিত হয়ে এলো। আমি একা! কত একা! সেই অদৃশ্য নারীর কন্ঠস্বরটা আমায় বলেছিল যদি কোনোদিন ভয়ানক বিপদে আমি পড়ি এবং সাহায্য করার মতো কেউ না থাকে আমার পাশে, তখন যাতে বাবা-মার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বীতা না করি। কারণ তাদের শক্তির কাছে আমি কিছুই না। তবে একটা সময়ে আমার ক্ষমতা তাদের থেকে বেশি হবে। সেই সময়ের অপেক্ষা করতে হবে আমাকে। তাই কন্ঠটা আমি কিছুটা নমনীয় করে মায়ের কাছে গিয়ে বসে পড়লাম। মুখটা মায়াময় করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কে মা? তোমরা কারা? অদৃশ্য কন্ঠস্বরটাই বা কে?’

মা কোনো উত্তর দিলেন না। বাবা মুচকি হেসে বললেন, ‘সেসব তুমি জানতে পারবে খোকা! তবে তার আগে জেনে নাও,তুমি আমাকে, তোমার মাকে যতটা খারাপ ভাবছ আমরা ততটা খারাপ না। আমরা কেবল মানুষ হত্যা করে খাই এই যা। যার যার খাবার, সে সে খাবে। এই নিয়মটা মেনেই জগৎ চলে। বিড়াল ইঁদুর খায়, ইঁদুর শস্য, শস্য পানি খায়। মানুষও তো খাবার হিসেবে কত প্রাণ হত্যা করে। হাতে রক্ত মাখায়। আমাদের খাবারও মানুষের মাংস আর রক্ত!’

‘তোমরা মানুষ নও?’

‘না খোকা! তবে শোনো আমাদের কথা। আমাদের জগতে আমরা ঘেউল নামে পরিচিত। এই মানুষের জগতে আমাদের বলা হয় পিশাচ। কারণ আমরা মানুষের তাজা রক্ত আর মাংস খাই। আমরা এবং আমাদের রক্ত, পূর্বপুরুষ, পরবর্তী প্রজন্ম যে জগতে বাস করে সেখানে আমরা সকলেই ক্ষমতাবান। সেখানে আমরা আমাদের ক্ষুধার মাংস ও তৃষ্ণার রক্ত জোগাড় করতে এক ধরনের প্রাণী পালন করি। গুল নাম ওগুলোর। সেগুলো বিরাট আকার, কথা বলতে পারে না, লম্বা শরীর, দু পা, দুই হাত, বিশাল স্তন, মাথার উপর চুল। বুঝতেই পারছ প্রাণীগুলো দেখতে কেমন? হ্যাঁ, মানুষের মতোই। তবে ওরা এই জগতের মানুষের মতো বুদ্ধিমান কিংবা তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন প্রাণ নয়। আকারেও বিশাল বড়।

আমাদের জগতে প্রায়ই মানুষ সম্পর্কে নানান কথা শুনতাম আমরা। আমাদের জগতের বেশ কিছু অভিশপ্ত ঘেউল মানুষের পৃথিবীতে চলে আসতো। তাদের সঙ্গে নিয়ে আসতো তাদের ক্ষমতা। কিন্তু কিছুতেই মানুষের বুদ্ধি আর উচ্চারিত কিছু শব্দের কাছে নিজেরা জিততে পারতো না। ধ্বংস হয়ে যেত। আমরা আলোচনা করতাম মানুষরা দেখতে অনেকটা গুলের মতো , শুধু আকারে ছোট আর বুদ্ধিমান। তাদের মাংস আর রক্ত নাকি গুলের চাইতে হাজার গুণ ভালো। হ্যা , এখন বলতেই পারি কথাটা সত্য! তবে আমি আর তোমার মা ঘেউলের জগৎ ছেড়ে এই জগতে এসেছি অদ্ভুত ভাবেই। আমরা প্রায় শুনতাম কিছু কিছু মানুষ নাকি ঘেউলদের উপাসনা করে। এত বুদ্ধিমান, শক্তিশালী প্রাণী মানুষ! ঘেউলের উপাসনা করে আমাদের বিশ্বাস হতো না। তারা নাকি দিন রাত সাধনা করে আমাদেরকে আহ্বান করতে থাকে তাদের জগতে।

কিন্তু একদিন আমি আমার থাকার ঘরের পেছনে অদ্ভুত একটা গর্ত দেখতে পাই। নতুন সৃষ্ট। চার কোণা খাঁজকাটা গর্তটা দেখে মনে হলো হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে সৃষ্টি হয়েছে এটি। গর্তটায় উকি দিয়েও ওটার তল দেখতে পেলাম না। নাকে এলো এক অদ্ভুত সুঘ্রাণ। পুরো শরীর আমার গুলিয়ে উঠল নেশায়। সুস্বাদু কিছু একটা ওটার ভেতর অপেক্ষা করছে যেন আমার জন্য। ঝাঁপিয়ে পড়লাম গর্তটার ভেতর। কী করে জানবো আমার জগৎ থেকে এই একটা সিদ্ধান্তই আমাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে! প্রায় অনেকক্ষণ ধরে নিচে নামতে শুরু করলাম। এরপর এসে পড়লাম বিশাল একটা ঘরে। আমার সামনে গুলের মতো দেখতে কিন্তু আকারে ছোট অনেক গুলো প্রাণী। বুঝলাম ওরাই মানুষ। ওরাই আমাকে আহ্বান করে নিয়ে এসেছে।

নিজের চোখের সামনে দুটো মানুষের মাথা-কাটা শরীর দেখতে পেলাম। আমার কাছে উৎসর্গ করেছে তারা। ভুল করলাম আমি। জিহ্বায় পানি চলে এলো ওগুলো দেখে। ঝাঁপিয়ে পড়লাম লাশ দুটোর উপরে। ওগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে খাবার মাধ্যমে গ্রহণ করলাম তাদের উৎসর্গ। বন্ধ হয়ে গেল আমার জগতে ফেরার পথ। তবে গুলের তুলনায় মানুষ অসাধারণ খেতে। আটকে গেলাম এই জগতের মায়ায়।

যারা আমার কাছে মানুষের রক্ত আর শরীর উৎসর্গ করতো তাদের নানান ইচ্ছা পূরণ করতে লাগলাম। এই জগতে মানুষের তুলনায় অলৌকিক ক্ষমতা ঘেউলদের অনেক বেশি। কিন্তু আমার কথা ছড়িয়ে পড়তেই মানুষের একটা দল বিদ্রোহ করলো। তাদের স্বজাতি হত্যা কিছুতেই তারা মেনে নেবে না। ভাবতে পারো খোকা, এই ছোট্ট মানুষের দলের সাথে আমি সর্বশক্তি নিয়েও পেরে উঠিনি। বিশেষ করে এরা যখন বিশেষ কিছু শব্দ উচ্চারণ করতো তখন আমার সমস্ত শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যেত। আমাকে বন্ধি করার ক্ষমতাও তাদের আছে। আমি পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। মানুষের রক্ত এবং মাংস দরকার ছিল আমার বেঁচে থাকার জন্য। এই জগতে থাকা অন্য কোনো প্রাণীরই রক্ত বা মাংসের গন্ধ সহ্য করতে পারতাম না। নানান কিছুর রূপ নিয়ে, ছল করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করে নিজের শিকারে পরিণত করতে লাগলাম।

কিন্তু যেখানেই আমি যাই সেখানেই ঘেউলদের নিয়ে সতর্ক একটা গোষ্ঠীকে দেখতে পাই। তারা আমার উপস্থিতি টের পেয়েই তাদের তন্ত্র-মন্ত্র আর সাধনা বল দিয়ে ধ্বংস করার জন্য ছুটে ছুটে খোঁজ করে আমার। তাদের সম্মিলিত শক্তির তুলনায় নিজেকে এক নগন্য প্রাণ মনে হয়। কত বছর লুকিয়ে লুকিয়ে পার করে দিয়েছি এই জগতে। একটা সময় পর অনুধাবন করলাম আমাদের থাকা উচিত আমাদের দুনিয়ায়, আর মানুষের তাদের দুনিয়ায়। দুই দুনিয়ার মিশ্রন ভয়ানক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। কিন্তু কী করে ফিরে যাব জানা ছিল না আমার।

তখনই দেখা হয় একটা মেয়ে ঘেউল এর সাথে। তোমার মা! সেও আমার মতো করেই এই জগতে চলে এসেছিল। এবং তান্ত্রিকদের ভয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। সে আমাকে জানায় কেবল একটাই উপায় আছে আমাদের জগতে ফিরে যাওয়ার। একটা মানুষ সন্তানই তন্ত্র বলে আমাদেরকে আবার আমাদের জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সন্তানটা আমাদের নিজেদের হতে হবে। কিন্তু আমরা ঘেউল। আমরা দুজন কী করে মানুষের সন্তানের জন্ম দেব! তখনই একমাত্র পথটা খুলে গেল আমাদের সামনের। আমাদের সমস্ত পৈশাচিক শক্তি বিসর্জন দিতে হবে। এর মাধ্যমে মানুষের ভেতর থেকে একজন নারী ও একজন পুরুষের আত্মা দখল করতে পারবো আমরা। মিলিত হবো দুজনে মানুষের শরীর থেকে। মেয়েটার গর্ভ থেকে যে সন্তানটা জন্ম গ্রহন করবে সেই আমাদের আবার ঘেউলদের জগতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রায় দীর্ঘদিন অনেক জায়গায় ঘুরে, অনেক মানুষ শিকার করে টিকে থাকতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু দখল করতে পারিনি কারো শরীর। এরপর এক রাতে একটা গাড়ির পিছু নিয়ে এই বাড়িতে আশ্রয় নেই আমরা। প্রাণ কেরে নেই বাড়িতে থাকা একমাত্র দম্পতি দুজনের। এরপর থেকে এই যে দেখছ আমি আর তোমার মা রয়েছি এই দুটো চেহারার শরীর নিয়ে। বাস করতে থাকি মানুষের মতো। জন্ম দেই তোমায়। অপেক্ষা করতে থাকি তোমার বড় হওয়ার আমাদের মুক্তির জন্য। তুমি বড় হলে কিন্তু কথা বলতে পেরেও এতদিন অভিনয় করে গেছ। আমাদের ফেরা হয়নি তাই আর আমাদের দুনিয়ায়! এতদিনে বেঁচে থাকার জন্য আমরা দুজন যত জন মানুষকে হত্যা করেছি এর দায় তোমার উপর পড়ে খোকা! যোগ দাও আমাদের সাথে। মুক্ত করো আমাদের! শান্তিতে থাকতে দাও এই দুনিয়ায় মানুষদের! তুমি এই ঘেউলের সংসারের একমাত্র পুত্র। ‘

দীর্ঘ কাহিনীটা শুনতে শুনতে চমকে উঠছিলাম বার বার। মাও মাথা ঝাঁকালো, মানে বাবা যা বলল সব সত্যি। আমি বললাম, ‘ যে নারী কন্ঠটা এতদিন আমার সঙ্গে কথা বলতো সে কে?’

‘তোমার মা যেই শরীরটা দখল করে আছে সেই শরীরের পূর্বের মালিক। এখন প্রেতাত্মা। বোকাটা বিশ্বাস করে তুমি আমাদের নয়, ওর সন্তান! তাই এতদিনেও তোমাকে ছেড়ে যায়নি!’ বিদ্রুপের সুরে বললেন বাবা।

কেমন এক অজানা অচেনা অনুভূতিতে মনটা কাঁপছে আমার। সেই নারীকণ্ঠটার অনুভব খুব করে আরেকবার পেতে ইচ্ছা করছে! যে আমাকে এই পরিস্থিতিতে একটু সাহস দেবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের মুক্ত করতে আমাকে কী করতে হবে?’

‘সেসব পরে। আগে শেষবারের মতো একবার এই মেয়েটার শরীরের মাংস আর রক্ত চেখে দেখ। বিশ্বাস করো এমন স্বাদ তুমি দুনিয়ার আর কিছুতেই খুঁজে পাবে না! তুমি মানব সন্তান হলেও তোমার অর্ধেকটা পিশাচ! এটা তোমার পেটে হজম হবে। হাহাহা!’

আমার প্রচণ্ড ঘৃণা আর রাগ জন্মালো লোকটার উপর। মায়ের মুখটাও এবার লাশটার উপর স্থির হয়ে গেল। হঠাৎ আমার মনে পড়লো কথাটা, অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের সতর্ক বার্তা। আমি কথা বলতে পারি জানতে পারলে বাবা-মা আমাকে খুন করে ফেলবে। তাদের যখন তাদের জগতে ফিরে যেতে আমাকে দিয়ে কথা বলানোর এতই দরকার ছিল তখন তারা আমাকে খুন করবে কেন! আমার মাধ্যমে তারা কী করে ফেরত যাবে তাদের দুনিয়ায়! আমাকে খুন করে! শিউরে উঠলাম আমি!

বাবা-মা দুজনেই বুভুক্ষুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো জুঁইয়ের লাশের উপর। আমি ধীরে পিছাতে লাগলাম দরজার দিকে। প্রচণ্ড দিশেহারা আর উত্তেজনা বোধ করছি আতঙ্কে। হঠাৎ আমার শরীর শিউরে উঠল একটা চিরচেনা স্বত্তার অস্তিত্বের উপস্থিত অনুভব করে।

আমরা তিন জন ছাড়াও ঘরে আরেকজন প্রবেশ করেছে বুঝতে পারলাম। অদৃশ্য কেউ! আমার ঘাড়ে আলতো স্পর্শ পেলাম। সেই সাথে সেই চিরচেনা নারীর অদৃশ্য কন্ঠ স্বরটা কানে এলো, ‘ভয় নেই খোকা! আমি এসে গেছি! ……………………………….
……………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

ঘেউলের সংসার পর্ব-০২

0

#ঘেউলের_সংসার
২য় পর্ব

তার ঠিক এক মাস পর আমাদের বাড়িতে আরেকটা কাজের মেয়ে এলো। মেয়েটার বয়সও আগের মেয়েগুলোর সমান। নাম জুঁই। মা মেয়েটাকে বুঝিয়ে দিলেন তারা বাড়িতে না থাকলে কিভাবে আমার খেয়াল রাখতে হবে। আমি যে কথা বলতে পারি না এটা শুনে মেয়েটার মুখে মায়া ভর করলো দেখলাম। মেয়েটা বেশ হাসি-খুশি , আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতে লাগলো। দিনের বেশির ভাগ সময় বাবা-মা বাড়ির বাইরে থাকতেন। ফিরতেন রাতে। মেয়েটা সারাদিন আমার সঙ্গে কথা বলে যায় । কথাগুলো আমার এত ভালো লাগে! ইচ্ছা করে তার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলি। কিন্তু অদৃশ্য কন্ঠস্বরটার সতর্কবাণী আমাকে বাধা দেয়। কিছুতেই কাউকে জানানো যাবে না যে আমি বোবা নই! একই ঘরে আমরা ঘুমাই।

একরাতে জুঁই নীচে বিছানা করে ঘুমিয়ে আছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকল কেউ। বাবা! আমি জড়সড় হয়ে উঠে বসলাম। বাবার মুখে মুচকি হাসি লেগে রয়েছে। এমনটা এর আগে আমি দেখিনি। তিনি আমার কাছে এসে বসলেন। আলতো করে ডান হাতটা ধরে বললেন, ‘ভয় পেও না খোকা! কেমন আছ তুমি?’

আমি ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম, এমনটা তিনি কখনো করেন না। দরজার দিকে তাকাতে দেখলাম মাও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মুখে চিরো চেনা সেই মায়াবী হাসি। তারা কী চায় এত রাতে! বাবা আমার মাথায় আলতো করে হাত বোলালেন, ‘খোকা, তোমাকে এতদিন এই পৃথিবীর সৌন্দর্য্য আর বীভৎসতা থেকে আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি। ৯ বছর পূর্ণ হলো তোমার বয়স আজ রাতে, অথচ এই বাড়ির বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো না। আমাদের ইচ্ছা তোমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেব এখন থেকে আমরা। শীঘ্রই আমরা এই বাড়ি বদল করে নতুন বাড়িতে উঠব। সেখানে দেখবে আমরা তোমার কেমন ভালো বাবা আর মা হই! তুমি স্কুলে যাবে, তোমার বন্ধু হবে, সবার সাথে মিশবে তুমি। তুমি কী আমাদের সাথে যেতে রাজি আছ?’

আনন্দে আমার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বাবা এত সুন্দর করে কথা বলছে আমার সাথে! ইচ্ছা করছে চেঁচিয়ে বলি, ‘আমি যাব বাবা!’ কিন্তু সেই অদৃশ্য নারী কন্ঠস্বরটা আমার কানের কাছে এসে বলল, ‘ না করে দাও খোকা, এই বাড়ি থেকে তুমি বের হলে ওরা তোমাকে মেরে ফেলবে। কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না!’ মুহূর্তে মুখ আমার শুকিয়ে গেল। আমি ডানে-বামে মাথা ঘুরিয়ে জানালাম আমি অন্য কোথাও যাব না। বাবার মুখের হাসি মুহূর্তেই উবে গেল। সেখানে স্থান নিল চিরচেনা ক্রুদ্ধ রুপ, রাগে কাঁপছেন তিনি। মায়ের দিকে ঘুরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি তোমায় আগেই বলেছিলাম ও এখনো এই বাড়ি ছেড়ে যায়নি! তোমার ছেলের সাথেই আছে ও। ওকে নানান বদ মতলব দিয়ে যাচ্ছে এতদিন ধরে। ওই ওকে শিখিয়ে দিচ্ছে বাড়ি ছেড়ে না যেতে। ও কী করে এখনো এই বাড়িতে থেকে গেল! বোকা মেয়ে!’

আমি ভয়ে কুঁচকে গেলাম। মা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। বাবা আমাকে উঁচু করে তুলে ঘরের এক দিকে ছুড়ে মারলেন। আমি উউউ করে গুঙিয়ে উঠলাম। একটা হাত আমার শরীরের নীচে চাপা পড়ে মচকে গেল আর মাথাটা মেঝেতে ঠুকে রক্ত ঝরতে লাগলো। প্রচণ্ড যন্ত্রনায় চারপাশে শুধু অন্ধকার দেখলাম। এরপর আর কিছু মনে নেই।

যখন চোখ খুললাম তখন আমার হাত ব্যান্ডেজ করে বাধা, হাতটা আড়াআড়িভাবে সেটে আছে বুকের সাথে। মচকে গেছে। মাথায়ও ব্যান্ডেজ বাধা। একটু নড়তে গিয়েই ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠলাম। কাজের মেয়েটিকে দেখলাম আমার পাশে বসে আছে। কাঁদো কাঁদো মুখ। চোখ মেলেছি দেখেই আমার কপালে মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘কিছু হয় নাই ভাইয়া সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবার কথা সব সময় শুনে চলবে!’ আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

পুরোপুরি সেরে উঠতে আমার মাস খানিক সময় লাগলো। এতদিনে একটুও খারাপ লাগা কাজ করেনি শুধু জুঁই এর জন্য। সে এক মুহূর্ত আমাকে ছেড়ে কোথাও যায় না। যাওয়ার জায়গাও অবশ্য নেই! তবুও বাড়িটা বেশ বড়। সারাদিন নিজের সম্পর্কে গল্প করে যায় সে। সে তার বাবা-মা কে অনেক ছোটবেলায় হারায় । এরপর অন্যের বাড়িতে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে শৈশব কাটে। কৈশোরে পা পড়তেই এক লোক ওকে চাকরি খুঁজে দেয়ার কথা বলে। কাউকে না জানিয়েই সে লোকটার সাথে এই শহরে চলে আসে। লোকটার কাছ থেকে আমার বাবা-মা ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে এরপর। এখানে সে আনন্দেই আছে। পুরো বাড়িতে ওকে যা ইচ্ছা করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, যা খুশি সে রান্না করতে পারবে, যা ইচ্ছা খেতে পারবে।
প্রায়ই নতুন পোশাক পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। শুধু একটাই শর্ত এই বাড়ি থেকে বের হওয়া যাবে না। জুঁইয়ের তেমন ইচ্ছা আছে বলেও মনে হয় না। ওর বয়স কত হবে! ১৩-১৪!

আমি নিজের বাবা-মাকে বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই ভয় করে চলি। অদৃশ্য সেই কণ্ঠস্বরের কথাগুলো বিশ্বাস করে বাবা-মাকে ভয় করার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমি লুকিয়ে অনেকবার তাদের দুজনের কথা শুনেছি। প্রথম প্রথম তাদের কথার অর্থ না বুঝলেও যখন বুঝতে শুরু করেছি তখন শিউরে উঠতাম। মায়ের কোমল চেহারার পেছনে যে এক পিশাচি আছে তা আমার বিশ্বাস হয়ে যায়। আর বাবার চেহারাটাই আমার কাছে আতঙ্কের আরেক রুপ ছিল।

মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা বেলায় বাবা বাড়িতে ঢুকেন হাঁপাতে হাঁপাতে। উত্তেজনায় তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাকে আর জুঁইকে টেনে এনে। আমাদের শোবার ঘরের ভেতর রেখে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন। আমরা দুজনেই প্রতিবাদহীন ভাবে চুপিসারে বসে থাকি।

ঘরের সব আলো তখন বন্ধ হয়ে যায়। দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে শোনা যায় বাবা আর মায়ের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ। একবার মনে হয় তারা ঝগড়া করছেন, আবার মনে হয় দুজনেই আনন্দে চিৎকার করে হাসাহাসি করছে, হঠাৎ মনে হয় কোনো একজনের গোঙানির শব্দ কানে আসছে, ওরা যেন কিছু খাচ্ছে। হাড় চিবানোর শব্দ। ভয়ে ভয়ে আমি জুঁইয়ের পাশে গিয়ে বসি। শক্ত করে ওর শরীর চেপে বসে থাকি। অন্ধকারে ওর মুখ দেখা যায় না। সেও আমার মতো ভয় পাচ্ছে কিনা বুঝতে পারি না। এরপর এক সময় দুজনেই ঘুমিয়ে যাই।

দিন, সপ্তাহ, মাস যত কাটতে থাকে তত জুঁইয়ের চঞ্চলতা কমতে থাকে। তাকে কেমন উদাস দেখায়। কম কথা বলে। আমি অনুমান করতাম বন্ধি জীবন আর তার ভালো লাগছে না। তার জন্য আমার খুব মায়া হতো। এর আগে যতগুলো মেয়ে এই বাসায় থাকতো সবাইকেই আমি পছন্দ করতাম। তাদের হঠাৎ চলে যাওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলাম। এবং শেষে তাদের কী পরিণতি হয়েছে জানতে পেরে বড় একটা মানসিক ধাক্কা পেয়েছি। জুঁইয়ের সাথেও তাই ঘটবে!কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে হারালে আমি আমার নিঃসঙ্গ জীবনে আর কোনো বন্ধু পাবো না।

অদৃশ্য সেই নারী কণ্ঠস্বরটা একরাতে আমাকে বলল, মেয়েটার প্রতি এতটা মায়া অনুভব করো না। বিপদ হবে। যা ঘটে তা ঘটতে দাও।

আমি বিরক্ত হলাম। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, তার কথা শুনতে, তার সঙ্গে বসে থাকতে, তার স্পর্শ আমাকে এতটা আনন্দ দেয়। আমি তার ক্ষতি কী করে হতে দেই!

আমি সারাবাড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি এই বাড়ি থেকে মেয়েটির পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ আছে কিনা! কিন্তু কোনো ফাক রাখেননি বাবা-মা।

একদিন। বাড়িতে বাবা-মা কেউ নেই। আমাদের শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া যে বাথরুম আছে জুঁইকে ইশারা করে ওখানে নিয়ে গেলাম। দরজাটা বন্ধ করতেই চমকে উঠে সে আমার দিকে তাকালো। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে রয়েছে। আমি তার হাত চেপে ধরে বললাম, ‘চিৎকার দিও না, আমি বোবা নই! কথা বলতে পারি!’

এক মুহূর্তে শিউরে উঠে পিছিয়ে গেল মেয়েটা। যেন জোরে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়েছে । বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তার মুখ। ঠোঁট কাঁপছে। আমি তাকে বললাম , ‘তুমি পালিয়ে যাও জুঁই, আমার বাবা-মা তোমাকে এখানে এনেছে হত্যা করার জন্য।’ এরপর বলতে শুরু করলাম কেন আমি বোবার মতো সেজে থাকি। আর বাড়িতে রাখা আগের কাজের মেয়েগুলোর কী পরিণতি হয়েছে।

জুঁই কোনো কথাই বলল না। শুধু হা করে আমার দিকে চেয়ে রইলো। নিজেকে যেন সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমি নিজেও কাঁপতে লাগলাম। আমার এই ৯ বছরের জীবনে এই প্রথম কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বললাম আমি। নিজের কন্ঠই নিজের কাছে অপরিচিত লাগলো। মেয়েটা আমার দিকে একটু এগিয়ে এলো, আলতো করে আমার চিবুক স্পর্শ করেই উল্টো ঘুরে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। কাঁদছে সে! আমি বুঝতে পারছি না আমি কী ঠিক কিছু করলাম নাকি ভুল! অদৃশ্য নারীটা কথা বলতে কেন আমায় বাধা দিল না এখন।

সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আর আমার সঙ্গে দেখা করলো না। সন্ধ্যার পর সে যখন দেখা করতে এলো তখন সে একা নয়। বাবা-মাও তার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকলো। তাদের দুজনের দৃষ্টিতেই রাগ ঝরছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে জুঁই। বাবা শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে বলল, ‘ তুই এতদিন কথা বলতে পারতিস! শুধু শুধু আমাদের সঙ্গে নাটক করেছিস! তোর জন্য আমাদের কত কষ্ট করতে হয়েছে, কত সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে জানিস! ‘ মাও রাগের স্বরে বললেন, ‘আমরা তোমাকে জন্ম দিয়েছি, বড় করেছি এভাবে ছল করে ধোকা দেয়া তোমার উচিত হয়নি! তুমি কথা বলতে পারও এটা কিনা আমাদের শুনতে হলো কাজের মেয়েটার মুখ থেকে!’

আমি যেন কাঠ হয়ে গেলাম! যাকে কিনা আমি বাঁচাতে চেয়েছি সেই কিনা আমাকে ধোকা দিল! ফুঁপিয়ে উঠল জুঁই, ‘আমাকে মাফ করে দিও ভাই। তোমার বাবা বলেছিল তুমি কথা বলতে পারো নাকি সত্যিই বোবা, এটা যদি আমি তাকে জানাতে পারি তাহলেই আমাকে মুক্তি দেবে এই বাড়ি থেকে। এই বাড়ি আর আমার ভালো লাগছে না!’

আমার চোখ ফেটে শুধু পানি গড়িয়ে পড়লো। একজন অদৃশ্য নারী যে আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকে আমাকে এতদিন রক্ষা করে এসেছে তাকে আমি অনুভব করতে পারতাম। কিন্তু নারীটির কোনো উপস্থিতি এই মুহূর্তে আশেপাশে অনুভব না করে ঘাবড়ে গেলাম। অসহায় মনে হলো নিজেকে।

বাবা ধাক্কা দিয়ে আমাকে মেঝেতে ফেলে দিলেন। বললেন, ‘কথা বলো খোকা! না হলে আমাদের আসল রূপ দেখবে এবার।’ আমি চুপ করে একবার বাবার আরেকবার মায়ের দিকে তাকালাম। তাদের কারও চেহারাতেই আমার জন্য মায়া নেই। বাবা এক মুহূর্তে নিজের পকেট থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করলেন। ছুটে গিয়ে চেপে ধরলেন ওটা জুঁইয়ের গলায়। ‘কথা বল খোকা, নইলে ওর গলা কেটে এখানেই ফেলে রেখে যাব!’

দিশেহারা বোধ করলাম আমি। চেঁচিয়ে বললাম, ‘মেরো না ওকে, থামো!’

মায়ের মুখ হা হয়ে গেল। তিনি ছুটে এলেন আমার কাছে, জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ‘এইদিনের জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম আমরা খোকা! অবশেষে এই অভিশপ্ত মানুষের দুনিয়া থেকে মুক্তি পাবো আমরা!’

খিলখিল করে হেসে উঠলেন বাবা। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন জুঁইকে সামনে থেকে। ‘আজ রাতেই তোমার মাধ্যমে আমি আর তোমার মা ফিরে যাব আমাদের দুনিয়ায়! অপেক্ষা করো তুমি!’

তাদের দুনিয়া মানে! তারা কারা!

মা আমাকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে কপালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। বাবার মুখ ভরে আছে পৈশাচিক হাসিতে। জুঁই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বাবা ওকে তুলে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে গেলেন। বন্ধ দরজার ভেতরে পুরো ঘরে আমি শুধু একা। এতটা অসহায় বোধ আমি আমার জীবনে আর করিনি কোনোদিন! …………………………………………………
……………………………..
.
.
. . . . চলবে . . . .

ঘেউলের সংসার পর্ব-০১

0

#ঘেউলের_সংসার
১ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

যখন সবে বুঝতে শিখেছি তখনই দেখতাম প্রায় প্রতি ৬-৭ মাস পর পর আমাদের বাড়িতে নতুন কাজের মেয়ে রাখা হতো। আগের মেয়েগুলো যে কোথায় যেত তা আমার বোধগম্য হয়নি দীর্ঘদিন। কিন্তু একটা রাত আমার কাছে সব কিছু পরিস্কার করে দেয়। এক রক্তাক্ত হিংস্র জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমার। তখন বয়স আমার ৯। একরাতে মেয়েলি একটা চিৎকারের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ফ্যান এবং ডিমলাইট বন্ধ দেখে বুঝলাম বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকার হাতড়ে নীচে নেমে দরজার কাছে গেলাম। দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো। কাজের মেয়েটা আমার সঙ্গে এক ঘরে মেঝেতে ঘুমায়। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না সে ঘরে আছে কিনা।

শরীরটা কেমন কেঁপে উঠল। বাবা আর মায়ের মৃদু কথা বলার শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। যেন তারা কিছু একটা কথা নিয়ে হাসি-তামাশা করছে। সাথে সাথে মেয়েলি একটা কণ্ঠের গোঙানিও কানে এলো আমার। যেন প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে শব্দটা বের হয়ে আসছে তার গলা দিয়ে। আমি জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। বাবা আর মায়ের কণ্ঠ মিলিয়ে গেল সাথে সাথেই। তাদের পায়ের আওয়াজ পেলাম, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে এদিকে। দরজার সামনে এসেই আবার দুজনে ফিসফিস করতে লাগলো। তর্ক করছে কিছু একটা নিয়ে। বুঝতে পারলাম মা আপত্তি করছে দরজা খুলতে আর বলছে, ওর বয়স এখনো হয়নি এসব দেখার। বাবা বলছেন, এখন থেকেই এসব দেখে মানিয়ে নেয়া উচিত। না হলে বড় হয়ে আপত্তি করবে।

বেশ কিছুক্ষণ তর্ক-বিতর্ক করার পর দরজাটা খোলার শব্দ পেলাম। ভয়ে ভয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম আমি। পুরো ঘর মোমের কম্পিত আলোতে ভরে আছে। মেঝের জায়গায় জায়গায় মোম জ্বালিয়ে রাখা এক বিশেষ নকশায়। আমি অবাক হয়ে বাবা আর মার মুখের দিকে তাকালাম। বাবা উল্টো দিকের ঘরের ভেতর চলে গেলেন কোনো কথা না বলেই। বাবা কখনই আমার সাথে তেমন একটা কথা বলতেন না। ওই ঘরটাও মোমবাতির আলোয় ভরে আছে। মা আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বাবার পিছু নিলেন। আমি কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ঘরটার দিকে। ঘরে ঢুকেই আমি একটা প্রচণ্ড মানসিক ধাক্কা খেলাম। এই প্রথম খেয়াল করলাম বাবা আর মায়ের হাতে, কাপড়ে আর মুখে রক্ত লেগে রয়েছে।

মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে আছে আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটা। সে যে বেঁচে নেই এটা তার গলার নিচ থেকে তৈরি হওয়া রক্তের স্রোতই সাক্ষী দিচ্ছে। মেঝের অর্ধেকের বেশি ভিজে আছে তার রক্তে । মেয়েটা চোখ দুটো বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আতঙ্কে হা হয়ে আছে মুখটা। লাশ! আতঙ্কে পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো আমার।

আমি মা আর বাবার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। বাবা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় টেনে নিয়ে ফেলে দিল মেয়েটার শরীরের উপর। গলা ফেটে বেরিয়ে আসা চিৎকারটা নিজের শরীর আর মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করলাম। বাবা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘মুখটা ওর গলার কাছে নাও খোকা, চেখে দেখ ওর রক্ত কেমন লাগে?’ আমি করুণ মুখে মায়ের দিকে তাকালাম। মায়ের চোখ দুটো কিছু একটার লোভে জ্বলজ্বল করছে। আমার দিকে তার খেয়াল নেই। বাবা আমার মাথা চেপে ধরলেন মেয়েটার গলার কাছে। আমি ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু এরমধ্যে আমার মুখে ঢুকে গেছে সামান্য রক্ত। পেট গুলিয়ে বমি চলে এলো মুখে।

ধাক্কা দিয়ে এবার আমাকে ঘরের এক কোণে পাঠিয়ে দিলেন বাবা। পরমুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন মৃত মেয়েটির শরীরের উপর, মাও যেন এই মুহূর্তটার অপেক্ষা করছিলেন। তিনিও বাবার সঙ্গে যুক্ত হলেন ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘরের দেয়ালের সাথে প্রায় মিশে গিয়ে দৃশ্যটা দেখলাম আমি। মেয়েটার পেট কামড়ে ছিড়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলল মা। বাবা মেয়েটার গলা, স্তন, বুক কামড়ে ছিড়তে লাগলো। নরম অংশ গুলো মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে। গলার সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা হলো আমার আবার, চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছা করল থামো এবার। কিন্তু কথা বলার উপর গুরুতর নিষেধ আছে আমার উপর। কারণ তারা জানেন আমি বোবা। আমার বাবা-মা যদি জানতে পারেন আমি বোবা নই, কথা বলতে পারি তাহলে সাথে সাথেই খুন করে ফেলবে আমাকে।অচেনা একটা নারী কণ্ঠ এই সাবধান বাণীই আমাকে দিচ্ছে অনেক বছর ধরে। তাই তাদের কাছে আমি একজন বোবা।

আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে। মেয়েটার শরীর খণ্ড থেকে খণ্ডতর হচ্ছে। বাবা আর মা তার রক্তে ভিজে চুপসে উঠছে। এক দৌড়ে ঘরটা থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে বিছানায় উঠে মাথার উপর বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগলাম। কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি জানি না। পরদিন ঘুম ভাঙতেই দেখলাম অনেক সকাল হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে বাইরে বের হলাম। পুরো বাড়ি খুঁজে না পেলাম বাবা আর মাকে না পেলাম কাজের মেয়েটির কোনো চিহ্ন।
এক মুহূর্তে আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল আমাদের বাড়িতে থাকা পূর্বের মেয়েগুলোর পরিণতি।

সব সময়ের মতো আমি যাতে বাড়ি থেকে বের হতে না পারি এরজন্য বাড়ির গেট বাইরে থেকে বন্ধ। জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। কয়েকটা গাছ আর বাড়ি ঘেরা উঁচু দেয়াল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না। সেইসব চিন্তা আবার আমার মাথায় খেলা করছে। কে আমি? আমার বাবা-মা এমন অদ্ভুত কেন? তারা নরখাদক! কেন তারা আমাকে বাইরের দুনিয়ায় নিয়ে যায় না! শৈশব থেকে নয় বছর বয়স পর্যন্ত এই বাড়ির বাইরে আমি যাইনি।

আমার বোবা সাজার পেছনের কাহিনীটা বলা যায়। শৈশবের সামান্য স্মৃতি আমার মনে পড়ে, মা আমাকে বারবার নানান শব্দ উচ্চারণ করে সেগুলো তার সাথে উচ্চারণ করতে বলতো। শব্দগুলোর অর্থ আমি বুঝতে পারতাম, উচ্চারণ করতেও পারতাম। কিন্তু যখনই মুখ নাড়িয়ে শব্দটি উচ্চারণ করতে যাই তখনই এক অদৃশ্য হাত আমার মুখ চেপে ধরে। কোনো শব্দই আমি করতে পারি না। বাবা আমাকে রীতিমতো শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করা শুরু করতো কথা বলার জন্য। কিন্তু আমি কেঁদে ফেললেও মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ বের করতে পারতাম না।

আবার যখন বাবা-মা সামনে থাকে না তখন আমি আরামে শব্দ উচ্চারণ করতে পারতাম। তারা আমার কাছে আসতেই অদৃশ্য হাতটা আমার মুখ চেপে ধরতো। মনে পড়ে বাবা কতটা কঠোর স্বরে চিৎকার করে আমাকে শব্দ উচ্চারণ করতে বলতো। ভয়ে আমি কাঁপতাম। কিন্তু কিচ্ছু উচ্চারণ করতে পারতাম না। একসময় তারা ধরেই নিল আমি বোবা।

ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা আমাকে এক রুমে রেখে আলাদা ঘরে ঘুমায়। একরাতে একা শুয়ে আছি। হঠাৎ ঘরে কোনো একজনের উপস্থিতি অনুভব করলাম। একটা নারীর কন্ঠস্বর কথা বলে উঠল হঠাৎ। এটা মায়ের গলা নয় চিনতে পেরে শিউরে উঠলাম। কন্ঠটা শুধু আমাকে জানালো, সেই আমাকে কথা বলতে বাধা দিয়ে এসেছে। সে আমার ভালোর জন্যই এমনটা করছে। কারণ যেদিন আমি কথা বলা শুরু করবো সেদিনই আমার বাবা-মা আমাকে খুন করে ফেলবে। আমি লাফিয়ে উঠে টর্চ জ্বালালাম। কিন্তু ঘরে কাউকেই দেখলাম না।

এরপর থেকে প্রায়ই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ উদয় হয়ে আমার পিছন দিক থেকে, আমার বাবা-মা সম্পর্কে নানা ভাবে আমাকে সতর্ক করে দিতে লাগলো। তারা যে কোনো একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে আমাকে বড় করছে তা বোঝাতে লাগলো। মাকে আমি ভালোবাসি। অদৃশ্য কন্ঠস্বর যাই বলুক আমি জানি তিনি আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। বাবার ভয়েই কথা বলতে পারলেও এখন বোবার মতো অভিনয় করে যেতে হয় আমাকে।

বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি তা আমাদের বাড়িতে আসা কাজের মেয়েগুলোর কাছ থেকেই। মা সামান্যই বলতেন। মায়ের ঘরের তাকে থাকা বেশ কিছু বই পড়েও জেনেছি অনেক কিছু। তারা যদিও জানে না যে আমি পড়তে জানি। সেই অদৃশ্য নারী কণ্ঠস্বরটাই আমার শিক্ষক এই বিষয়ে।

জানলায় দাড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না।কাজের মেয়েটিও নেই। প্রচুর ক্ষুধা লাগছে। মা কখন আসবে বুঝতে পারছি না। বাবা-মা প্রায়ই সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকেন। খাবার টেবিলের সামনে চলে এলাম। একটা বড় থালা বোল দিয়ে ঢাকা রয়েছে দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। মা নিশ্চই খাবার রেখে গেছেন। প্লেটের উপর থেকে বোলটা সরাতেই আমার গলা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইলো চিৎকারটা। কিন্তু সেই অদৃশ্য সত্তাটা চেপে ধরলো আমার মুখ। আমি ছিটকে মেঝেতে পড়ে গেলাম। প্লেটে শোভা পাচ্ছে কাজের মেয়েটির কাটা মাথা। চোখদুটো এখনো বিস্ফোরিত হয়ে তাকিয়ে আছে, মুখটা হা হয়ে আছে আতঙ্কে। আমার মুখ দিয়ে শুধু গগগগ শব্দ বের হতে লাগলো। চাপা কণ্ঠে মাটিতে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলাম।

মা কোথা থেকে বের হয়ে দৌড়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ‘আমি বলেছিলাম তোমাকে খোকা কথা বলতে শিখেনি এখনও। শুধু শুধু ওকে দিয়ে এমন পরীক্ষা নিচ্ছ! বাইরে কোথাও গেলেও ও আমাদের কথা ও কাউকে বলবে না।’

মাথা উঁচু করতেই দেখলাম কিছুটা দূরে বাবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, ‘মানুষের বাচ্চা ও, এত সহজে বিশ্বাস করা যায় না!’ এই বলেই কাটা মাথার প্লেটটা নিয়ে চলে গেলেন বাবা। আমি শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা বলল, ‘ ভয় নেই খোকা। চলো তোমাকে কিছু রান্না করে দেই।’ আমি তাকে জড়িয়ে ধরে টলতে টলতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। আরেকটা অদৃশ্য হাতও যেন আমার কাঁধ স্পর্শ করে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলো, ‘ভয় নেই কোনো, খোকা!’ …………….
…………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.

এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৭(শেষ পর্ব)

0

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৭ম_পর্ব (শেষ)

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি আবির ভাইয়া রেলিং এ নেই।
সে সত্যি সত্যি ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেছে।

আমি দৌড়ে আবির ভাইয়াকে দেখতে রেলিং এর কাছে যাই।
সাথে দাদা ভাই টাও।

দেখি আবির ভাইয়ার কিছুই হয়নি।
সে কিভাবে যেন ভেসে আছে।আর বলছে আমি কি মরে যাবো?ডুবে যাবো একবার বল?

আমি বললাম,
_আপনি কি আমার কথা শুনবেন?আপনি কি উঠে আসবেন?
নাকি আমিও লাফিয়ে পড়বো?
আমার জন্য একজন সুইসাইড করেছে এই অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
আর আপনিতো জানেন,আমি সাঁতার জানিনা।
পরলেই সাথে সাথে পোটল তুলে ফেলবো।

_না না আমি আসছি।
তুমি কিছু করোনা।

এই কথা বলে আবির ভাইয়া উঠে আসে কিছু ক্ষণের মধ্যে।

সে আসার পর আমি তাকে শুধু বলি,

_ভাইয়া কিছু কথা বলি?
_হুম বলো।
জোর করে কি ভালবাসা পাওয়া যায় বলেন?
আপনি এমন সীনক্রিয়েট করে যদি আমাকে বিয়েও করেন।
তাহলে কি আমার মন পাবেন?
আমি তো আপনাকে ভাই বলে জানি।
ভাই কে কিভাবে স্বামীর স্থান দিবো বলুন তো?
আমি কোন দিন আপনাকে মানতে পারবোনা।
প্লিজ ভাইয়া পাগলামো না করে বাইরে চলে যান।
কাজ করুন।
ভবিষ্যৎ ভালো হবে।

দাদাভাই ও আবিরকে বুঝিয়ে যান।
আমার বান্ধবীটাও চলে আসে আমাদের সাথে।

কিছু দিন পরই হঠাৎ একদিন আমার এক কাকী এসে আম্মুকে বলেন,

ভাবী, আবির বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে।
দেখতে যাবেন নাকি?

_কি বলো তুমি?
আবির এভাবে হুট করে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসবে?
এটা কিভাবে সম্ভব?
আরে ভাবী সম্ভব বলেইতো করেছে।
চলেন বউ দেখে আসি।

শুনে মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেল্লাম।
যাক একজন তো বিদেয় হলো।

পরে আস্তে আস্তে শুনতে পাই ওই যে ওই দাদাভাইটা সেদিনের ঘটনা নাকি আবির ভাইয়ার বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছিলো।
যাতে ছেলে আর এমন কদম না উঠায়।

এই কথা শুনে আবির ভাইয়ার মা একদিন প্ল্যান করে তার বোনের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যান আবির ভাইয়াকে।
খালার বাসায় ভাগ্নে বেড়াতে যাবে এটা স্বাভাবিক।
কিন্তু ওখানে গিয়ে আবির ভাইয়ার মা এমন সীন ক্রিয়েট করেন যে,এই মুহূর্তে আবির ভাইয়ার তার খালাতো বোনকে বিয়ে করতে হবে।
নইলে তার মা স্ট্রোক করে ফেলবেন হয়তো।
নয়তো নিজেই কিছু করে বসবেন।

আর তারপরই বিয়েটা হয়ে যায় আবির ভাইয়ার,তার খালাতো বোনের সাথে।

কোন মা ই চাইবেন না ছেলে ধুকে ধুকে মরুক।
তাই সে এই ব্যবস্থা নেয়াটাই জরুরি মনে করেছেন।
যেহেতু আমি রাজি না,আর আব্বুও না করে দিয়েছেন।

আবির ভাইয়ার বিয়ের খবরে আমি বেশ খুশি।
অন্তত একটা ঝামেলা তো বিদেয় হলো।

অসভ্য আমীরকে তো কোন দিন আমার পরিবার মানবেই না।
আর আমিতো জীবনেও মানবোনা তাকে।
তাকে দেখলেই এখন ঘৃণা লাগে।
মানুষটা ভালো মানুষীর আড়ালে কতই না জঘন্য ভাবে আমাদের জ্বালিয়ে গেলো।

আর তিথী ওর দুর্জয় ভাইয়াকে বলেছে,
নিধির সাথে একটা ছেলের রিলেশন আছে।যে কিনা আমাদের ক্লাসমেট কণার ভাই কল্লোলকে খুব মেরেছে।
শুধু মাত্র নিধিকে ছেলেটা পছন্দ করেছিলো বলে।
তুমি আর নিধির দিকে আগিওনা।
ও অন্য কাউকে ভালবাসে।

তিথী আরো কিছু বানিয়ে বানিয়ে বলে ওর ভাইকে,যাতে ওর ভাই আর আমার দিকে না আগায়।
আর এই কথা ও সেদিনই ওর ভাইকে বলেছে,যেদিন আমীর কল্লোলকে মেরেছিলো।
কোন বোনই চাইবেনা,তার ভাইকেও কেউ এভাবে মারুক।

আর ওর এই কথা গুলো বিশ্বাস করে তিথীর ভাই দুর্জয় ও নিজে থেকে সরে যায়।
সে বিশ্বাস করে নেয় আমার সাথে আমীরের হয়তো সত্যি রিলেশন চলছে।

যাইহোক,আমিতো অন্তত বেঁচেছি।
আমীর বাদ,আবির ভাইয়ার চ্যাপ্টারও অফ,
দুর্জয় বাদ।

বাকি রইলো কল্লোল।
ও সেই মারামারির পর সুস্থ যে হয়েছে,আর আমার সামনে আসেনি।

যে মেয়ের জন্য মরণের পথ থেকে ফিরে এসেছে।
সেই মেয়ের সামনে না আসাই স্বাভাবিক।

কিছু দিন পর আমাদের নতুন বাসা কমপ্লিট হয়ে গেলো।

আমরা নতুন বাসায় উঠলাম।
কারণ এখানে থাকার ইচ্ছে টাই মরে গিয়েছিলো এত ঝামেলার কারণে।

আর আমি ডিসিশন নিয়েছিলাম নতুন বাসায় উঠেই বোরখা পরা শুরু করবো।
যাতে কেউ না দেখতে পায় আমায়।
আর না দেখতে পেলে সমস্যাও করবেনা কোন।

ফাইনাল এক্সামের ডেইট পরলো।
এক্সাম শেষ করলাম।

রেজাল্ট দিলো,আলহামদুলিল্লাহ পাশ করলাম।

নতুন বাসায়ও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
তেমন কোন মানুষ নেই পিন মেরে কথা বলার জন্য।
বা আমাকে বিরক্ত করার জন্য।

আশেপাশের মানুষ গুলোও ভালো।
কেউ কারো খুঁটিনাটি নিয়ে পড়ে থাকেনা।

কলেজে ভর্তি হবার ডেট পরলো।

কলেজে গেলাম,যেই কলেজে ভর্তি হবো আমি।

কলেজের কাউকে আমি চিনিনা।
একদম নতুন আমি কলেজে,
শুধু আমার সাথে যারা ভর্তি হতে গিয়েছে তাদেরই চিনি।

ভর্তির সব কাজ শেষ করে যেই না আমরা চলে আসতেছি,

ঠিক তখনই কে যেন আমায় নাম ধরে ডাকলো,

_নিধিইইই

আমি পেছন ফিরে তাকালাম,কিন্তু কাউকে দেখলাম না।

আমার ফ্রেন্ডরা সবাই বল্লো,এখানে তোকে আবার কে চেনে?

অন্য কাউকে ডাকছে হয়তো।

আমরা আবারো চলে আসার জন্য পা বাড়াই।

আবারো ডাক আসে একটা,

নিধিইইইইই এই যে আমি।

দু তলায় তাকাও।

আমি দু তলায় তাকাই তবে আমি বুঝতে পারছিনা কে সে।

তারপর দেখি কেউ একজন দৌড়ে দু তলা থেকে নেমে কলেজের গেইটের সামনে হাঁপাতে হাঁপাতে আসলো।

এসেই আমার হাত থেকে পানির বোতল টা নিয়ে ঢক ঢক করে পানি পান করতে শুরু করলো।

আমি বললাম আমার এটো পানি তো।মুখ লাগিয়ে খেয়েছি।উঁচু করে খাইনি।

সে তবুও খেয়ে নিলো।

_তারপর বলো কেমন আছো?
চিনতে পেরেছো আমায়?

_হুম চিনেছি।
_কিভাবে চিনলে?আজ তো মুখ ঢেকে আসিনি আমি।হা হা হা।

আচ্ছা,এভাবে মানুষ গায়েব হয় বলোতো?
বাসা চেঞ্জ করেছো,বাসার ঠিকানাটাও দাওনি কাউকে।কত খুঁজেছি।
ফাইনাল এক্সামের সময় কণার সাথে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি।
কিন্তু দেখিনি এত স্টুডেন্ট আর গার্ডিয়ান দের ভীড়ে।

কণার ক্লাসেও পড়েনি তোমার সীট যে খবর নিবো একটু।

পালিয়েছো নাকি হুম?

_পালাইনি।
সমস্যা তো সলভ হয়েই গিয়েছিলো।
যে যার মত থাকছে।
কেউ আর জ্বালাচ্ছেনা।
তবে আমি শান্তি খুঁজছিলাম।
এখন খুব শান্তিতে আছি।
ওখানে কেউ নেই আপনাদের মত পঁচা লোক।

_কয়দিন বের হয়েছো বাইরে?
_বের হওয়া হয়না।
কলেজে আসতে হতো বলে বের হয়েছি।

_তাহলে কিভাবে বুঝলে পঁচা লোক নেই?
আছে।হয়তো তোমায় দেখেনি এখনো।

আমার ফ্রেন্ডরাও কথা বল্লো কয়েক জন কল্লোলের সাথে।

জিজ্ঞেস করলো কিসে পড়ে কল্লোল।
উত্তর দিলো অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।

আমি আচ্ছা আসি,
ভালো থাকবেন বলে চলে আসছিলাম।
তখনই কল্লোল বলে,
যাও সমস্যা নেই।
তবে আমি বেঁচে থাকতে আর পিছু ছাড়ছিনা।
২য় বার যখন আল্লাহ আবার মিলিয়ে দিয়েছেন।
এবার হাতটা ধরেই ছাড়বো।

আমার ফ্রেন্ডরা বলে উঠলো ধরে আবার ছেড়ে দিবেন?

কল্লোল হেসে দিলো।
সবাই হাসাহাসি শুরু করলো।

_আরে আমি ধরে ছেড়ে দিবো বলেছি নাকি?
তোমরাও যা হয়েছো না।

_আচ্ছা আসি তাহলে।
ভালো থাকুন।

_কাল আমি কলেজের এইখান টায় থাকবো।
এসেই এখানে চলে আসবে হুম?

_আসবোনা।আসছি।
_তোমাকে আসতেই হবে।

আমি কোন কথা না বলে চলে আসি।

আম্মুকে বাসায় গিয়ে বলি আমি বোরখা পরবো।
আমাকে আজই একটা বোরখা কিনে এনে দিবা।

আম্মু অবাক হয়ে বল্লো,সত্যি?

উত্তর দিলাম হুম।

তারপর আম্মু আমাকে একটা বোরখা কিনে এনে দিলো।

আমি অনেক দিন আর কলেজে যাইনি।

যেদিন থেকে ক্লাস শুরু হয় সেদিন প্রথম ক্লাসে যাই আমি।তাও আবার বোরখা পরে।
সেই প্রথম শুরু হয় আমার বোরখা পরা।

মনে মনে বলতে থাকি এখন আর কেউ বিরক্ত করবেনা আমায়।
না মুখ দেখবে,না জ্বালাবে।
আর না কল্লোল চিনবে।

সেদিন দুই টা ক্লাস করে আমি বাসায় চলে যাচ্ছি,
আর সেই মুহূর্তে কল্লোল আমার সামনে এসে দাঁড়ায়।

_এত দিন আসোনি কেন কলেজে?
কত ওয়েট করেছি জানো?
এত পাষাণী কেন তুমি?

_আপনি কে?
আপনাকে তো চিনিনা আমি।

_ওই মেয়ে,বোরখা পরলে আর মুখ ঢাকলেই আমি তোমাকে চিনবোনা ভেবেছো?

তোমার চোখ দেখলেই আমি বুঝি বুঝছো?
আর তোমাকে চিনতে আমার দুই মিনিট ও লাগবেনা।

তাই চিনিনা মিনিনা বাদ দাও।

_উফফ সবায় পিছু ছাড়লো,আপনি এখনো পড়ে রইলেন।
আপনি কবে ছাড়বেন পিছু?আপনি ছাড়লেই আমি মুক্ত।
_আমিতো ছাড়বোনা।
তোমাকে আমার বাহুডোরে বন্দি থাকতে হবে আজীবন।
_ধুর।
_হুর।
_হুর কি?
_হুর তুমি।
তুমি জানো হুর অনেক সুন্দর হয়।
_ধুর।
_হুর।
_ভাল্লাগেনা কিন্তু।

তখনই কল্লোল আমাদের পাশে থাকা একটা নাম না জানা ফুল গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে ধুপ করে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।

আর আমার সামনে ফুল টা এগিয়ে দিয়ে বলে।
আপনি কি আমার বোনের ভাবী হবেন?

_একটু বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছেনা?
আশেপাশে ছেলে মেয়েরা দেখছে দেখেছেন?
স্যার ম্যাডাম রা যদি চলে আসে কি হবে ভেবেছেন?

_কিচ্ছু হবেনা।
ফুল না নিলে আমি কিন্তু উঠবোনা।

আমি দৌড়ে গেইট এর সামনে গিয়ে বললাম,
আমি চলে যাচ্ছি,
আপনি সারাদিন বসে থাকেন।

_নিধিইইই তুমি কিন্তু কাজ টা ঠিক করলেনা।

রাজি না হলে এক কুয়াশার সকালে একদম তুলে নিয়ে বিয়ে করে ফেলবো কিন্তু।

আমি হাসতে হাসতে চলে আসি বাসায়।

বাসায় এসে আম্মুকে বলি সব।

আম্মু বলে, বেচারা একবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরলো।
তবুও তোর পিছু ছাড়লোনা।
আমাকে একদিন দেখাস তো ছেলেটা কেমন।

_আম্মু তুমিও না।
কি করবা ওই ছেলেকে দেখে তুমি?
_দেখতাম আরকি,আমার মেয়েকে কোন ছেলেটা এত ভালবাসে।
_হুম হইছে হইছে।

এর দুই দিন পর আমি আমার ফ্রেন্ডরা কলেজের মাঠে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ কল্লোল এসে আমাকে বলে,
নিধি আমি না আর তোমাকে প্রতিদিন বিরক্ত করতে পারবোনা।

_কেন ভাইয়া?হাঁপিয়ে গেছেন নাকি?
হাল ছাড়বেন না কিন্তু।
আরেকটু চেষ্টা করলেই আমাদের বান্ধবী পটে যাবে।
_সত্যি নিধি?
_ধুর
_হুর।

আমার ঢাকায় একটা জব হয়েছে নিধি।
জব টা খুব ভালো।
তাই হাত ছাড়া করতে চাচ্ছিনা।

_আচ্ছা, শুভ কামনা।
_আগামীকালই জয়েন করতে হবে।
তাই আজই বাসা থেকে বের হতে হবে।
_সাবধানে যাবেন।
_তুমি কারো প্রেমে পড়োনা কিন্তু।
আর আমি মাসে একদিন কলেজে এসে কলেজের খবরাখবর নিয়ে যাবো, ক্লাস করে যাবো আর তোমাকে দেখে যাবো।
তুমি ঠিক মত পড়াশোনা করো।

_আচ্ছা ঠিক আছে।
_তাহলে আসি।
_আচ্ছা।
_কণার কাছ থেকে তোমার খবর জানবো।তাই ভালো ভাবে চলাফেরা করো কিন্তু।আর আমার খবর জানতে হলে ওর কাছ থেকে জেনে নিও।

(কণাও আমার কলেজেই ভর্তি হয়েছে)

কল্লোল চলে যায়।

আমিও কিছু দিন আর কলেজে যাইনা।

কয়েক দিন পর কণা ফোন দেয় আম্মুর নাম্বারে।

আমি কলেজে যাইনা বলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছ থেকে আম্মুর নাম্বার নেয়।

কণা আমাকে চাইলে আম্মু আমাকে ফোন টা দেয়।

তারপর কণা বলে,ভাইয়া তোমার খবর জানতে বলেছে।
তুমি কলেজে আসোনা কেন?

_এমনি যাইনা।
_ভাইয়া জবে ঢুকে অনেক ব্যস্ত হয়ে গেছে।
নতুন জয়েন করেছে তো।
ছুটি নেই।
শুধু শুক্রবারে ছুটি।
শুক্রবারে নানান কাজ থাকে তাই আসতে পারছেনা।
_আচ্ছা।
তুমি কি আমার ভাইয়াকে একটুও পছন্দ করোনা?
ভাইয়া কিন্তু তোমার কথা আম্মুকেও বলেছে।
আমাদের ইন্টার শেষ হলেই আম্মু প্রস্তাব নিয়ে আসবেন।
তত দিনে ভাইয়াও নিজের পায়ে দাঁড়াক।

তাহলে ভালো আছো তো হুম?
_আলহামদুলিল্লাহ।
_তাহলে রাখছি হ্যাঁ।কলেজে আসলে দেখা হবে।
_আচ্ছা।ভালো থেকো।

_কি বল্লো তোর বান্ধবী?
কলেজে যাস না তাই কিছু বল্লো?
_হুম।

কেটে গেলো অনেক গুলো দিন।

আবার এসে গেলো সেই শীত কাল।

একদিন রাতে আম্মু আমাকে ফোন টা দিয়ে বল্লো,

তোর ক্লাসমেট ফোন করেছে।
এই নে।

_আমি ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই শুনি,

_নিধি আমি কল্লোল।
_আপনি?
আপনি আমার ক্লাসমেট?আপনি কল দিয়েছেন কিভাবে?নাম্বার পেলেন কই?
_কণার কাছ থেকে নিয়েছি নাম্বার।
নিয়েছি আগেই তবে কল দেইনি।
কল দিলে,কথা বললে আর থাকতে ইচ্ছে হতোনা এখানে।
চলে আসতে ইচ্ছে হতো।
_এখন বলছেন যে?
_আগামীকাল ৭ দিনের ছুটিতে আসতেছি।চাইলেই দেখতে পারবো।
এবার বলো,কেমন আছো তুমি?
_হুম আলহামদুলিল্লাহ।
_আমাকে জিজ্ঞেস করবেনা?
_নাহ।
_আচ্ছা না জিজ্ঞেস করলে।
আমি আমার প্রথম স্যালারি দিয়ে আম্মুর জন্য,কণার জন্য,আর তোমার জন্য কিছু কিনেছি।
কাল পেয়ে যাবা।
কাল কলেজে আসবে কিন্তু।

_নাহ,আসবোনা।
_কেন আসবেনা?
_অনেক শীত পড়েছে।আর বাইরে অনেক কুয়াশাও পড়ে সকালে।
তাই আসবোনা।
_তুমি আসবে এবং আসবেই,আর সেটা আমার টানে,আর কুয়াশার সকালেই।
এখন ঘুমাও।
_আচ্ছা।
_নিধি,
_জ্বী।
_আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।
রাখছি।

তারপর কল্লোল ফোন টা রেখে দেয়।

সকাল হলো…

জানালাটা খুলতেই দেখি,আজ অনেক বেশি কুয়াশা পড়েছে।
চারিদিক অন্ধকার।
আর শীতও পড়েছে ভীষণ।
কম্বল টা ভালো ভাবে গায়ে জড়িয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।

কিছু ক্ষণ পরেই আম্মু আমার রুমে দৌড়ে এলো,
এসে বলে,

_দেখতো নিধি,কে যেন ফোন দিয়ে কি বলছে।
কে নাকি এক্সিডেন্ট করেছে।

_আমি ফোন টা কানে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে বললাম,কে?

অপর পাশ থেকে কে যেন চিৎকার করে কান্না করছে,কান্নার আওয়াজে ভয়েজ টা ঠিক মত বোঝা যাচ্ছেনা।

_নিধি, কল্লোল ভাইয়া আর নেই।
কল্লোল ভাইয়া রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
শেষ বারের মত দেখতে চাইলে আমাদের বাসায় চলে আয়।

লাইন টা কেটে গেলো।

আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
আম্মু পাশ থেকে বলছে,
_নিধি এই নিধি,কার কি হয়েছে?
কে এক্সিডেন্ট করেছে?

_আম্মু,
_হুম,
_তুমি না কল্লোল কে দেখতে চেয়েছিলে?
যেই ছেলেটা কুয়াশার সকালে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেও আমাকে ভুলেনি।

_হুম চেয়েছিলাম তো।
_চলো তাহলে আমার সাথে।ওকে শেষ বারের মত দেখে নিবা।
_কি বলছিস তুই?
_কল্লোল রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
আর কাল রাতে যে ফোন দিয়েছিলো আমায়,ও কল্লোলই ছিলো।
আমার কোন ক্লাসমেট ছিলোনা।

আমার আম্মু কথা টা শুনে চিৎকার দিয়ে কান্না করে দিয়েছে।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে আম্মুর কান্না দেখছি।

আম্মু বোরখা পরতেছে,তারপর আমাকে নিয়ে রওনা দেয় কল্লোলদের বাড়ীর উদ্দেশ্যে।

আমি ঠিক চিনিনা কল্লোলদের বাসা।
আম্মু কণাকে ফোন দিয়ে বাড়ীর ঠিক ঠিক ঠিকানা টা জেনে নেয়।

আমরা যাচ্ছি,
রাস্তা যেন আর ফুরোয় না।
যেই এলাকা ছেড়েছি সেই এলাকায় আবার পা রাখতে যাচ্ছি।

অবশেষে আমরা পৌঁছাই।
আমি ও বাড়ীতে পা রাখতেই কণা আমাকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে
চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
কিছু ক্ষণ পর কল্লোলের মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আর বলতে থাকে,দেখ আমার কল্লোলের বউ আসছে।
আমার কল্লোলের বউ আসছে।

সবাই বলতেছে,কল্লোলের মা এসব কি বলো?
মানুষ কি বলবে?
মেয়েটার তো বদনাম হবে।

কল্লোলের মা উত্তর দেয়,আমার কল্লোল ওরে খুব ভালবাসে।
আমারে কত বার বলছে,আম্মু আমি কিন্তু ওকেই বিয়ে করবো।
তুমি কিন্তু ওকেই আমার জন্য তোমার ঘরে নিয়ে আসবা।

আমি আমার ছেলেরে কথা দিছিলাম।
আমি ওরেই আমার ঘরের বউ করে নিয়ে আসবো।
যেভাবেই হোক।

দেখছো তোমরা,আমার ছেলের বউ আসছে।

আমার আম্মু কল্লোলের মাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
নিজেও চিৎকার করে কাঁদতেছে।

কল্লোলের বাবা নেই।
ওর মায়ের মত সাদাসিধে মানুষ দুনিয়ায় ২য় টি আছে কিনা আমার জানা নেই।
কল্লোল ই তার এক মাত্র সন্তান।
আর কণা তার পালিত সন্তান।

আমি কল্লোলের মাকে আমার বুক থেকে সরিয়ে ধীরেধীরে কল্লোলের কাছে যেতে লাগলাম।

কল্লোলকে ওদের উঠোনে শুইয়ে রাখা হয়েছে।

একটা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
আমি ওর সামনে গিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম।
বসে আছি,বসেই আছি।
এত ক্ষণে আমার ফ্রেন্ডরাও সবাই চলে এসেছে।
অনেকে আমার আগেই এসেছে।

আমি একজন কে বললাম,একটু কাপড় টা সরাবেন?
আমি ওকে একটু দেখবো।
ওর বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে কাপড় টা সরিয়ে দিলো।
আর বল্লো,
জানেন আপু,
কল্লোল আপনাকে অনেক ভালবাসতো।

আমি কল্লোলের মুখটা দেখে, কল্লোল বলে জোরে একটা চিৎকার দিলাম।
কিন্তু ও আমার ডাকে কোন সাড়া দিলোনা।

_দেখেন আমি এসেছি তো।
আপনি বলেছিলেন না আমি আপনার টানে আসবোই আজ।
এসেছিতো আমি।
আর কুয়াশার সকালেই এসেছি।
আপনি আমাকে দেখবেন না?

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমাকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে।
আমাকে চিৎকার করে কান্না করতে না করছে।
কিন্তু আমিতো পারছিনা কান্না থামাতে।
আমার বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
আমি পাগলের মত চিৎকার করে কান্না করে যাচ্ছি।

_আপনি না আমাকে ভালবাসেন?আমার কান্না থামাবেন না?
এই যে আমি চিৎকার করে কাঁদছি।
আপনার কি আমার জন্য কষ্ট হচ্ছেনা?

আম্মু কাঁদতে কাঁদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে,মারে ওর জন্য দোয়া কর।
এখন দোয়াটাই ওর কাজে লাগবে।
এভাবে কাঁদিস না।

কণা কণার মাও আমাকে ধরে কাঁদছে।
আমাকে থামতে বলছে।কান্না করতে না করছে।
আর বলছে,
ও না আমার জন্য একটা শাড়ী,কণার জন্য একটা ড্রেস আর তোমার জন্য একটা মোবাইল ফোন কিনেছিলো।
মোবাইল ফোন টা ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে আমার ছেলের মত।

এই বলে কণার মা আরো জোড়ে জোড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন।

কল্লোল বাইকে করে আসতেছিলো।
কুয়াশার কারণে তেমন একটা কিছু দেখা যাচ্ছিলোনা।
একটা ট্রাক এসে সব কিছু শেষ করে দিয়ে যায়।

কল্লোল অবশেষে আমার পিঁছু ছেড়ে দিলো।
ও ওর কথা রেখেছে,ও বলেছিলো মরার আগ পর্যন্ত আমার পিঁছু ছাড়বেনা।
তাই মরে গিয়ে আমায় মুক্ত করে দিয়ে গেলো।

কিছু ক্ষণ পর ওকে দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হলো।
দাফন সম্পন্ন হলো।
চলে গেলো কল্লোল।

আজও ছিলো সেই কুয়াশার সকাল।
কল্লোলকে আমি এমনই এক কুয়াশার সকালে প্রথম দেখেছিলাম।
আর আজ এক কুয়াশার সকালেই শেষ বারের মত দেখে নিলাম।

এরপর আরো অনেক কুয়াশার সকাল আসে।
শুধু কল্লোলই আসেনা।
আমি আজো আমাদের পুরাতন বাসায় গেলে কুয়াশার সকালে সেই জায়গাটায় কল্লোলকে খুঁজি,যেখানে প্রথম আমি মাফলার দিয়ে মুখ ঢাকা ছেলেটাকে দেখেছিলাম।
কিন্তু দূর দূরান্তে শুধু কুয়াশাই দেখা যায়।
ভাসা ভাসা চোখ দুটো আর দেখা যায়না।

(সমাপ্ত)

এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৬

0

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৬ষ্ঠ_পর্ব

আমি দু চোখ বন্ধ করে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে বললাম।
আমি দেখতে যাবো কণার ভাইকে।
চল আমার সাথে।

তারপর আমি আর আমার ফ্রেন্ড হেডমাস্টারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কণা আর কণার কাকীর সাথে কণার ভাইকে হসপিটালে দেখতে গেলাম।

হসপিটালে গিয়ে দেখি কল্লোল বেডে শোয়া।
তার অবস্থা খুবই খারাপ।
এই প্রথম আমি তার পুরো মুখ টা দেখলাম।
চেহারায় অসম্ভব মায়া ছেলেটার।
ডাক্তার এসে আমার সামনেই বলতে লাগলেন,আপনারা দ্রুত পেশেন্টকে শহরে নিয়ে যান।
শহরের হসপিটালে গিয়ে এডমিট করুন।
আমরা এখানে কিছু করতে পারবোনা।

কল্লোল আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
সবাই কাঁদছে।
আমি না কাঁদছি,না কিছু ভেবে পাচ্ছি।
শুধু একটা প্রশ্নই কল্লোলকে করলাম।
_আমীর আংকেল?যে আপনার শার্টের কলার ধরেছিলো?

কল্লোল মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো হুম।

দ্রুত এম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা হলো।

ধরাধরি করে কল্লোলকে এম্বুলেন্সে উঠাতে যাচ্ছে সবাই,আর সেই মুহূর্তে কল্লোল কিভাবে যেন আমার ক্রস বেলের উপরে থাকা এক্সট্রা ওড়নাটার এক কোণা ধরে ফেল্লো,

আমি তাকাতেই,
ও বল্লো,
_ভালবাসি।

তারপর আমার ওড়নাটা ওর হাত থেকে ছুটে গেলো।

ওকে এম্বুলেন্সে শুইয়ে দেয়া হলো।
ওর সাথে ওর কাকী,মা এবং কণা গেলো।

চলে গেলো এম্বুলেন্স।
আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

আমার বান্ধবী আমাকে বল্লো,চল এবার যাই।

আমি তখনো ঘোরের মধ্যে আছি।
কি থেকে কি হয়ে গেলো।

আমি স্কুলে না গিয়ে আর বাসায় চলে গেলাম।

তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাওয়ায় আম্মু জিজ্ঞেস করলো,

আজ এত তাড়াতাড়ি ছুটি?

আমি কোন কথা না বলে দৌড়ে আমার রুমে চলে গেলাম।

আম্মুও পিছু পিছু আমার কাছে আসলো।

_কি হয়েছে?বল আমাকে।
_আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,আম্মু কল্লোল।
ওই এক কুয়াশার সকালের ওই ছেলেটা।
ওর অবস্থা না খুবই খারাপ।
ওকে না আমীর খুব মেরেছে।

ও বাঁচবে তো আম্মু?
ওর কিছু হয়ে গেলে আমি তো নিজেকে কোন দিন ক্ষমা করতে পারবোনা।

আম্মু আমাকে শান্তনা দিচ্ছে।
কিচ্ছু হবেনা ওর।
তুই চিন্তা করিস না।

আম্মুকে বললাম,আম্মু ফোন টা দাও তো।

_কেন কি করবি?
_আরে দাও না।

আমি ফোন টা নিয়ে সোজা আমার প্রাইভেট স্যারের কাছে ফোন দিলাম।

আমীরের বড় ভাইয়ের কাছে।

স্যার রিসিভ করতেই স্যারকে কাঁদতে কাঁদতে এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলতে লাগলাম।

স্যার আমাকে কান্না থামাতে বললেন,
আর বললেন,আজই আমি বাসায় আসতেছি।
যা করার আমি করবো।
আপাতত তুমি কাউকে কিছু বলোনা প্লিজ।

আমিতো জানি,যে কেউ ই নিজের ভাইয়ের সম্মান বাঁচাতে চাইবে।
আর তার ভাইয়ের সম্মান মানে তার নিজেরও সম্মান।

স্যারের সাথে কথা শেষ করে আব্বুকে কল দিলাম।
আব্বু লাইন কেটে দিয়ে নিজে কল ব্যাক করলেন।

আমি ডিরেক্ট আব্বুকে বললাম,তিন দিনের মধ্যে আপনি দেশে আসবেন।
কিভাবে আসবেন আমি জানিনা।
তবে আসবেনই।

আব্বু বললেন,কি হয়েছে মামণি?
তোমার আম্মুকে দাও।
আমি বললাম,আমি যা বলেছি তাই যেন হয়।

নইলে আমি এই বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো।
কারো সাথে যাবোনা।
একাই যেদিকে দু চোখ যায় চলে যাবো।

ছোট মানুষ আমি।
আর এই বয়সের সময় টা বড্ড মারাত্মক সময়।
এই বয়সে কে কখন কি করে বসে বলা যায়না।জেদ টাও এই সময় বেশি থাকে।
তখন পরিবারের মান সম্মানের কথাও মাথায় থাকেনা।
এ সময় নিজের জেদ টাই সব থেকে বড় মনে হয়।
নিজেকেই সঠিক মনে হয়।

তাই আব্বুও বুঝে সব কিছু দ্রুত ওকে করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

রাতেই স্যার তার বাসায় আসলেন।
এসে আমীরকে ইচ্ছেমত পিটালেন।
এতে করে কিছু মানুষ জানাজানি হলো বড় ভাই ছোট ভাইকে মেরেছে।
কিন্তু কি কারণে মেরেছে তা আর কেউ সঠিক জানতে পারেনি।

বড় ভাই মেরেছে তাই আমীর আর ভাইয়ের উপর হাত তুলতে পারেনি।

পরের দিন সকালে স্যার আমাদের বাসায় আসলেন।
এসে বললেন আমরা যেন কোন রকম চিন্তা না করি।আর যা কিছু হয়েছে সব কিছুর জন্য সে নিজে মাফ চাইলেন তার ভাইয়ের তরফ থেকে।
এরপর যা করার সব কিছু যেন তার উপর ছেড়ে দেই এই কথাও বললেন তিনি।

আর জিজ্ঞেস করলেন,কল্লোলের কি অবস্থা এখন?

আমি উত্তর দিলাম জানিনা।
কোন ফোন নাম্বার বা কিছুই নেই জানার মত।

স্যার বললেন,আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি।

স্যার চলে গেলেন।

কিছু ক্ষণ পর এক প্রতিবেশী আমাদের বাসায় এসে আম্মুকে ডেকে বলতেছে,

নিধির মা শুনো।

_হুম বলেন ভাবী।
_শুনলাম নিধির জন্য নাকি মাস্টারের ভাই আমীর এক পোলারে মাইরা ফেলছে।

এত ক্ষণে এলাকা জুড়ে খবর হয়ে গেছে আমার জন্য আমীর এক ছেলেকে মেরে ফেলেছে।

আমার নিজের আপন কাকীরা ঢোল পিটাচ্ছে এলাকা জুড়ে আরো।
হাসাহাসি করছে।
চাচ্চুরা বিদেশ।

নিজের মানুষরাই যদি শত্রু হয়,সেখানে পরকে আর কি বলবো।

আমার এবং আমার পরিবারের ভেতর দিয়ে তখন কি যাচ্ছিলো তা শুধু আল্লাহ জানেন।

আমি মনে মনে শুধু দোয়া করছিলাম,আল্লাহ মানুষ যা বলে বলুক।

কিন্তু কল্লোলের কিছু যেন না হয়।
নইলে আজীবন আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।

আম্মুও দোয়া করতেছে ছেলেটার যেন কিছু না হয় আল্লাহ।

এরপর স্যারকে আম্মু কল দেয়।
আর জিজ্ঞেস করে,

এলাকার সবাই বলাবলি করছে,তোমার ভাই যাকে মেরেছে ওই ছেলেটা নাকি মারা গেছে?
কথা কি সত্যি?

_না ভাবী,ছেলেটার গত কাল খুব খারাপ অবস্থা ছিলো।
তবে এখন নাকি একটু ভালো আছে।
আমি ওর বাসার লোকের কাছ থেকেই খবর নিয়েছি।চিন্তা করবেন না।
আর নিধিকেও চিন্তা করতে না করেন।

মানসিক অশান্তির মধ্যে দুই দিন চলে যায়।

আমার আব্বুও দেশে চলে আসেন।

কল্লোলের অবস্থার উন্নতি হয়।

এদিকে আব্বুর কাছে আবিরদের বাসার লোক জন আমার জন্য প্রস্তাব পাঠান।
আবির ডিরেক্ট বলেছে নিধিকে আমার কাছে বিয়ে না দিলে আমি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবো।
স্যারের ভাইয়ের জন্য স্যারও প্রস্তাব দেন।
আম্মুর আবির ভাইয়াকে অনেক পছন্দ।
কিন্তু আব্বু এত তাড়াতাড়ি আমাকে বিয়ে দিবেন না।

আর তাছাড়া একই এলাকায় আমীর আর আবির ভাইয়া দুজন।
আবার কল্লোল ও।
এদের এক জনের কাছে বিয়ে দিলে পরবর্তীতে বাকি দুজন যে আমার কোন ক্ষতি করবেনা এর নিশ্চয়তা কি।
এই বলে আব্বু সবাইকে না করে দিলেন।

আমি আম্মুকে বললাম,আমাকে খালামণির বাসায় পাঠিয়ে দাও কয়েক দিনের জন্য।
আমার এখানে একটুও ভালো লাগছেনা।

আব্বুকে বললাম,আপনি আমার জন্য আপনার অন্য যেই জায়গা আছে।
ওখানে বাসা করেন।

আমি এই এলাকায় আর থাকবোনা।
এখানে থাকলে আমি একদিন মারাই যাবো।

আব্বু আম্মুকে বললেন,তুমি কি চাও?

আম্মু বললেন,আমিও চাই তুমি অন্য জায়গায়ই আমাদের বাড়ী করে দাও।

ওদের যখন বিয়ে দিয়ে দিবো।তখন না হয় শেষ বয়সে ইচ্ছে হলে আবার এখানে আসবোনে।

আব্বু আমাকে বললেন,আমার সাথে কিছু দিন থাকবেনা মামণি?
কিছু দিন থাকো আব্বুর সাথে,তারপর যেও খালামণির বাসায়।
আব্বু আছেনা এখন,কোন সমস্যা হবেনা।

আমি আচ্ছা বললাম।
পরের দিন আব্বু ইট,রড সিমেন্টের দোকানে চলে গেলেন।
সব কিনেও ফেল্লেন।

শুরু করে দিলেন আমাদের নতুন বাসা তৈরী করা।

কল্লোল এখন পুরোপুরি সুস্থ।

এর মাঝে আমার টেস্ট এক্সাম শুরু হয়।
আব্বু আমাকে প্রতি এক্সামের দিন সাথে করে এক্সাম দিতে নিয়ে যান।আবার নিয়ে আসেন।

আব্বু যত দিন আছেন আমাদের সাথে,কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হইনি আমরা।

আমাদের নতুন বাসার
অল্প কিছু কাজ বাকি আছে।
আব্বু চলে যাবেন কিছু দিনের মধ্যে।

আব্বু বলেছেন,এ বাসার ফার্নিচার সব যেন এ বাসায়ই থাকে।নেয়ার কোন দরকার নেই।তাহলেই লোকজন জানবে কোথায় নতুন বাসা আমাদের।
আর আব্বু আরো বলেন আমরা যেন ওই বাসায় একদিন হুট করে চলে যাই।
আর ওই বাসার ঠিকানা যেন কাউকে না দেই।

আব্বু আবার চলে যান বিদেশ।
আর আমাদের বলে যান,বাসার সব কাজ কমপ্লিট হলেই যেন আমরা নতুন বাসায় উঠে যাই।

আমার ছোট মামা বাকি কাজ গুলো দেখবেন।

আমরা এখন অপেক্ষায় আছি নতুন বাসায় কবে উঠবো।
আর কবে মুক্তি পাবো এই এলাকা থেকে।

আব্বু চলে যাবার কয়েক দিন পর আমার এক বান্ধবী আমাদের বাসায় আসে।

আমাকে বলে,চল একটু হাঁটতে বের হই।
কত দিন হয় হাঁটতে বের হইনা।

আম্মু বল্লো,
যা ঘুরে আয় একটু।
ভালো লাগবে।

দুজন বের হলাম।
হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর যেতেই দেখি আবির ভাইয়া ব্রিজে দাঁড়ানো।

আবির ভাইয়াকে দেখে আমি আমার বান্ধবীকে বললাম,চল অন্য রাস্তায় যাই।

ও বল্লো,আরে চল আবির ভাইয়াই তো।
কিছু হবেনা।
সে ভালো আছে।

আমি না করা সত্ত্বেও ও আমাকে টেনে ব্রিজেই নিয়ে গেলো।
আমিও গেলাম।

ব্রিজ দিয়ে হাঁটছি,
হঠাৎ আবির ভাইয়া আমার বান্ধবীকে বলে থ্যাংক ইউ।

আমি অবাক হই।
ওকে কেন আবির ভাইয়া থ্যাংক ইউ বলে।
পরে বুঝতে পারি,আবির ভাইয়া ওকে পাঠিয়েছে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।

আমার এই বান্ধবীটা আমার এলাকার বান্ধবী।সেহেতু ওর সাথে আবির ভাইয়ারও ভালো সম্পর্ক।
যেহেতু আমরা একই এলাকার সবাই।

আমি চলে আসার জন্য পা বাড়িয়েছি মাত্র,আর আবির ভাইয়া আমাকে বলে উঠেন,

কিছু দিনের মধ্যে আমি বাইরে চলে যাবো।
আর আমি চাই তোমাকে বিয়ে করে রেখে বাইরে যেতে।
এখন তোমার মতামত কি সেটা আমাকে জানাও।

কাকী আমাকে পছন্দ করেন এটা আমি জানি।
আর কাকার টা আমি দেখবো।

তুমি তোমার মতামত জানাও।

আমি ডিরেক্ট তাকে বলে দিলাম,

_আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনা।
আর তাছাড়া এখন আমি বিয়েও করবোনা।
আমার বিয়ে করতে দেরি আছে।

আমি আব্বু আম্মুর স্বপ্ন পূরণ করে তারপর যা করার করবো।
আপনি ভালো ভাবে বিদেশ যান।
এসে ভালো দেখে একটা মেয়েকে বিয়ে করেন দোয়া রইলো।

আমি কথা শেষ করতে না করতেই আবির ভাইয়া ব্রিজের রেলিং এর উপর দাঁড়িয়ে গেলো।

_এবার বল,
বিয়ে করবি আমায়?
নইলে আমি সত্যি সত্যি এখান থেকে লাফ দিবো নিধি।
তুই যখন ক্লাস ফাইভে পড়িস আমি সেই তখন থেকে তোকে মনে মনে ভালবাসি।
তোকে না পেলে আমার জীবন টাই এলোমেলো হয়ে যাবে।
আমার তিল তিল করে তোকে নিয়ে গড়া স্বপ্ন গুলো এক নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে।

প্লিজ আমাকে বিয়ে করে নে।
আমি তোকে দুনিয়ার সব সুখ এনে দিবো।
কথা দিলাম।

এদিকে আমার বান্ধবীও বলছে,
রাজি হয়ে যা নিধি।
আবির ভাইয়া অনেক ভালো।
আর ভাইয়া আপনি নামেন প্লিজ ওখান থেকে।

_আপনি কি নামবেন?
লোক জন দেখলে কি বলবে?

এর মধ্যে এক মুরুব্বি এসে হাজির।
_কি হইছে এইখানে?

_আপনার জানা লাগবে?
আপনি যান এখান থেকে।

আবির ভাইয়া পুরা উল্টা পালটা বিহেভ করছে।

আমি লোক টাকে বললাম,দাদাভাই আমাকে নিয়ে যান এখান থেকে।

_দেখ নিধি,তুই এক পা আর বাড়ালেই আমি এখান থেকে লাফ দিবো।
তুই আমায় বিয়ে করবি কি না?

_একবার তুই একবার তুমি।আপনার মাথার তার ছিঁড়ে গেছে ভাইয়া।
আপনি প্লিজ বাসায় যান।

দাদা ভাই টা আবির ভাইয়াকে নামতে বলছে।
পাগলামি করতে না করছে।

কিন্তু তার একই কথা,

_তুই আমাকে বিয়ে না করলে আমি এখান থেকে লাফ দিয়ে আমার ভালবাসার প্রমাণ দিয়ে যাবো।

আর খুব জেদ উঠে যায় আবির ভাইয়ার বাড়াবাড়িতে,
আমি চিল্লায় বলি,যা ইচ্ছা তাই করেন আপনি।
আমি আপনাকে বিয়ে করবোনা।

এ কথা বলে আমি দাদাভাই এর হাত ধরে মাত্রই দু কদম বাড়াই।
আর আমার বান্ধবী আয়ায়া বলে চিৎকার দিয়ে উঠে,

আমি পেছনে তাকিয়ে দেখি আবির ভাইয়া রেলিং এ নেই।
সে সত্যি সত্যি ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে গেছে।

চলবে,

এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৫

0

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৫

চার কদম যেতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
আর ভাবতে লাগলাম,
এই একই কথা আমি কোথায় যেন শুনেছি…
কে যেন বলেছিলো,
আমার স্পষ্ট মনে আছে,এই একই কথা আমি এর আগেও একবার শুনেছি।

কিছু ক্ষণ ভাবতেই আমার মনে পড়ে গেলো,
আপনার মেয়েরে বইলেন,ও যেন ঘোমটা দিয়ে বের হয়।
ওরে কোন পোলা যেন না দেখে।

এই কথা টা সেদিন রাতে ওই অসভ্য টা বলেছিলো।
যে আমাদের এমন পেরেশান করে বেড়াচ্ছে।
আমাদের জ্বালাতে জ্বালাতে অতিষ্ট করে দিচ্ছে।

আর আজ একই ভাবে আমীর আংকেল বলছে যে,
আজ এবং এই মুহূর্ত থেকে ঘোমটা দিয়ে যাবা যেখানেই যাবা।
কোন পোলা যেন তোমাকে দেখতে না পায়।

সেই একি কথা আমীর আংকেল বলছে,আর সেদিন ওই অসভ্য টাও একই কথা বলেছিলো।

আমি এবার পেছন ফিরে তাকালাম।

আর আমীর আংকেলকে বললাম,

আংকেল শোনেন,

_হুম বলো।
_আপনি জানেন আংকেল,সেদিন রাতে না ওই অসভ্য টার সাথে আমার আর আম্মুর কথা হয়েছিলো।

ওই অসভ্য টা না ঠিক একই ভাবে এই কথা গুলো বলেছিলো।যেই অসভ্য টা আমাদের জ্বালায়।

_কোন কথা গুলো?
_এই যে আপনি এখন যেই কথা গুলো আমাকে বললেন,

যে আমি যেন ঘোমটা দিয়ে যাই।
আর কোন ছেলে যেন আমাকে না দেখে।

_তাই নাকি?ছেলেটা তোমার ভালো চায়।আর তোমাকে ভালবাসে বলে হয়তো এ কথা বলেছে।

_আপনি কিভাবে জানেন আংকেল?
ওই ছেলে যে আমাকে ভালবাসে?
আর সে যদি আমার ভালোই চাইতো,তাহলে কি আমাকে আর আমার পরিবারকে এই ভাবে জ্বালাতো?

এগুলো কি কোন মানুষের কাজ?
দেখলেন না,এলাকার মানুষ গুলোও কত চিন্তিত আমাদের নিয়ে।

আর আপনিও কত কষ্ট করলেন,ভাইয়া আর আপনি দুজন মিলে রাতে আমাদের বাসা পাহারাও দিলেন,রাত জেগে।ঘুম নষ্ট করে।

কত কষ্ট হলো আপনাদের দুজনের।
তবুও তো লাভ হলোনা, অমানুষ টা ঠিকই আমাদের জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

_কাউকে এইভাবে গালি দিতে নেই নিধি।
_ওহ আচ্ছা,তাই নাকি?
_হ্যাঁ,এবার তুমি যাও নিধি।
_আচ্ছা ঠিক আছে।

আমি কথা বলছিলাম,আর আমীর আংকেল চোখ দুটো নামিয়ে আমার সাথে কথা বলছিলেন এতক্ষণ।

আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে সেদিন বাসায় ফিরে গেলাম।

কিছুই ভালো লাগছেনা আমার।
আর আশেপাশে যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছেনা।

বাসায় গিয়ে শুয়ে আছি আমি।
আম্মু বুঝতে পেরেছে আমার ভালো লাগছেনা।
তাই আম্মু আর কিছু না বলেই আমাকে দেখে চলে যায়।

সারাদিন কেটে গেলো।

আমি জানি আজ রাতে অসভ্য টা ঠিকই আসবে।

আজ রাতে আমি আম্মুকে বললাম,আম্মু আমার সাথে একটু জেগে থাকো।
আর আমি যা বলবো বা করবো চুপ করে দেখবা আর শুনবা।
কোন কথা বলবা না।

আম্মু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
কি করবি আর কি বলবি?
আর কাকেই বা বলবি?

আমি বললাম,পরে বলবোনে সব।

আম্মু আমার সাথে জেগে আছে।

_কিরে আর কত ক্ষণ জেগে থাকবো?
আমার শরীর ভালো লাগছেনা।

_আচ্ছা তাহলে ঘুমাও।
দরকার হলে ডাকবোনে আমি তোমায়।

_তোর এখানেই শুই।
_হুম শোও।

কিছু ক্ষণ পরই অসভ্য টার আগমন।

সে টিনে বারি দিচ্ছে।

_এবার আমি বললাম,
অযথা এমন করে কি মজা পাচ্ছেন আপনি বলুন তো?

আপনার এই অসভ্যপানা করার কথা যদি একজন জানে তাহলে আপনার খবর আছে।

সে চিকন গলায় বল্লো,
_কে জানলে আমার খবর আছে?

আমি বললাম,নাম বলবোনা।
তবে তাকে যদি বলি আপনার এই জ্বালতনের কথা।
তাহলে আপনার আর রক্ষা নেই।

_কে সে?
তোমার প্রেমিক?
নাম কি ওর?
_কে সে,কি হয় আমার,বা নাম কি তা আপনাকে বলবো কেন?
আপনি জানবেনও না কে সে।
কিন্তু যা করার সে করে ফেলবে।

_হা হা হা নাম টা শুনি।
কে আমার কি করবে,তা জানতে হবেতো।
এত বড় বুকের পাটা কার যে আমার কিছু করবে।

_সময় হোক,বুঝতে পারবেন।
অযথা এসব করা বাদ দেন।
ও জানলে দিন দুনিয়া ভুলায় ফেলবে একেবারে।

_ওরে বাবা ভয় পাইছি আমি।
কে আমার দিন দুনিয়া ভুলায় ফেলবে,ওই পুচকে ছেলে?
যে কিনা কাপুরুষের মত কুয়াশা ভরা সকালে মুখ ঢেকে তোমার সামনে আসে?
যাতে কেউ চিনতে না পারে?
এক থাপ্পড় দিলে আরেক থাপ্পড় দেবার জায়গা নাই আর ও কিনা আমার কি করবে।ওই ছেলের নাম কল্লোল তাইনা?
চিনিতো।

_তাই নাকি আমীর আংকেল?কল্লোলকেও চিনেন আপনি?উফ কি অদ্ভুত ক্ষমতা শক্তি আপনার,আপনি ঘরে বসেই কিভাবে জেনে গেলেন,যে আজ কুয়াশার সকালে আমার সামনে কল্লোল এসেছিলো,তাও আবার মুখ ঢেকে।

ছেলেটা না হয় কাপুরুষ তাই কুয়াশার সকালে আমাকে দেখতে আসে।

আর আপনি কি করেন আমীর আংকেল?
এই রাতের বেলা আমি সহ আমার পরিবারকে পেরেশানিতে ফেলতে আসেন।
এটা কি পুরুষত্ব?

_এসব কি বলছো নিধি?
আমীর কে?

_আমীর আংকেল,আপনার নাটক এবার বন্ধ করেন।
অনেক হয়েছে ভালো মানুষীর নাটক।
আপনাকে আমার পরিবার কত ভালো জানতো,আর আপনাকে।
কিন্তু আপনি কিনা এমন করতে পারলেন?

আপনি আমাকে যেদিন প্রথম প্রপোজ করেছিলেন।
বলেছিলেন,আমাকে বিয়ে করবা?
তাহলে আজীবন তোমার স্যারের কাছে পড়তে পারবা।

আমার সেদিন আপনার কথা টা বিচ্ছিরী লেগেছিলো।
কারণ আপনি আমার চাচ্চু হোন।
আপনাকে আমি কোন দিন ওই ভাবে দেখিনি।

আমি সুন্দর ভাবে বলেছিলাম।
আংকেল,আমার এসব কথা ভালো লাগেনা।
আর কখনো এগুলো বলবেন না।

আপনি বললেন,যদি বলি?
তাহলে কি করবা?

আমি বলেছিলাম,তাহলে আমি স্যার কে বলে দিবো।

আপনি সেই থেকেই আমার পিছু নিয়েছেন তাইনা?

অথচ আমি এসব ভুলেই গিয়েছিলাম।

আপনিই আবির ভাইয়াকে বারি দিয়ে ফেলে দিয়ে পালিয়েছিলেন না?

অথচ আপনিই না কি সুন্দর ভাবে অভিনয় করে দুই চারদিন আগেই আবির ভাইয়ার সাথে আমাদের বাড়ী পাহারা দিয়েছেন।

আবির ভাইয়া সেদিন বল্লো আম্মুকে,
আমরা তাহলে চলে যাই কাকী।
কেউ তো আসলোনা আজ।
আপনারা ঘুমিয়ে পড়েন।আর যেই আসুক রাতে,দরজা খুলতে বললে খুলবেন না।

সে কি বোকাই না ছিলো সেদিন আমাদের মত।

সে কি জানতো?
তার সাথেই তো অসভ্য টা দাঁড়িয়ে আছে।
সে চলে যাবার পরই অসভ্য টা বিরক্ত শুরু করবে।

আর যে রাতে বারি দিয়ে ফেলে গেলেন।
সেদিনও বেচারা বুঝেনি।
তার সাথেই যেই মানুষটা পাহারা দিলো আমাদের।
সেই মানুষটাই তাকে আঘাত করে পালালো।
বেচারা পরে একা একাও আমাদের পাহারা দিয়েছে।
আর আমি কিনা ক্ষাণিক সময়ের জন্য তাকে ভুল বুঝতে বসেছিলাম।
আম্মু ঠিকই মানুষ চিনে।
আম্মু বলেছিলো আবিরকে আমি চিনি।ও তো জীবনেও এমন করবেনা

আর কি প্ল্যানই না ছিলো আপনার।
বিরক্তও করেন আপনি।
পাহারাও দেন আপনি।
যাতে কেউ সন্দেহ অবদি না করতে পারে।

প্লিজ চলে যান।
আপনার সব কিছুই ফাঁস হয়ে গেছে।
যদি চান এই সব অন্য কেউ না জানুক।
তাহলে প্লিজ আর বিরক্ত করবেন না।

আমীর আংকেল চুপচাপ আমার কথা গুলো শুনেছে এতক্ষণ।

তারপর তার নিরবতা ভেঙে বল্লো,
সরি।
কেউ যেন কিছু না জানে কিছু।
এমন কি ভাইয়াও না।
আসি।

চলে গেলো অসভ্য ওরফে আমীর আংকেল।

আম্মু অবাক হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।

তারপর আমাকে বলে,
আমি ওকে অনেক ভালো জানতামরে।

আচ্ছা তুই এসব বললি কেন,
যে একজন জানলে ওর খবর আছে।
আরো কত কি।

_আম্মু,না হলে জানতাম কি করে যে এটাই আমীর।
_বুঝলাম না কিছু।
বুঝিয়ে বল।

_আরে আম্মু,আজ সকালে ওই ছেলে টা আবার এসেছিলো।
কুয়াশার মধ্যে মুখ ঢেকে আসা ছেলেটা।
আর তখনই আমীর আংকেল এসে পড়েছে ওখানে।

আমি তার তখনকার কয়েকটা কথায় আন্দাজ করেছিলাম,আমীর আর আমাদের জ্বালাতন করা ছেলেটা একই মানুষ।

আর সে ছাড়া কল্লোলকে,মানে কুয়াশায় মুখ ঢেকে আসা ছেলেটাকে কেউ দেখেনি আমার কাছে আসতে।

আমার মনে হচ্ছিলো,এমন ভাবে তাকে কিছু বললে,হয়তো তার মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে যাবে।

নয়তো সে কল্লোলকে খুঁজা শুরু করবে।
কারণ আজ সে আমায় তার সাথে দেখেছে।

আর কল্লোল ছেলেটা হয়তো পছন্দ করে আমায়।
আর অবশ্যই সে আমাকে দেখতে আবার আসবে।

আর তাকে এই আমীর খুঁজে বের করলে বা কিছু বললে,তা তখন কল্লোল আমাকে ঠিকই বলবে।

আর তখনই বুঝা যাবে উনিই সে কিনা।

কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সব প্রমাণ হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।

সে নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে গেলো আরকি।

_আচ্ছা বাদ দে,কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।আজ এবং এখানেই সব ভুলে যা।
এই জঘন্য অধ্যায় এখানেই বন্ধ করে দে।

_হুম আম্মু।
ঘুমাও এখন যাও।

পরের দিন আর পড়তে যাইনি।

লেইট করে ঘুম থেকে উঠে স্কুলে চলে গিয়েছি।

ক্লাস করছি একের পর এক।

চার নাম্বার ক্লাস শেষ হবে মাত্র দুই তিন মিনিটের মত বাকি।
তারপরই টিফিন টাইম।

সেই মুহূর্তে একটা মহিলা কণা কণা কণারে বলতে বলতে কান্না করতে করতে ক্লাস রুমে ঢোকেন।
স্যার ও ক্লাসেই তখন।

আমার সামনের বেঞ্চে বসে থাকা আমার ক্লাসমেট কণা চমকে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

_কি হয়েছে কাকী?
এভাবে কান্না করতেছেন কেন?

_তখন ওর কাকী এসে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে তোর ভাইকে কে বা কারা যেন অনেক মেরেছে।
ও এখন হসপিটালে ভর্তি।
অবস্থা বেশি ভালোনা।
চল তাড়াতাড়ি চল।

কণা তখন চিৎকার দিয়ে বলে,কল্লোল ভাইয়া।কিভাবে হলো কাকী,কিভাবে হলো?

_আর তোর সাথে পড়ে,নিধি নামের নাকি একটা মেয়ে আছে।ওই মেয়েটাকেও নিয়ে চল।

কণা আমার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ওর কাকীকে জিজ্ঞেস করলো।
নিধিকে কেন?

_কল্লোল,বার বার বলেছে কণা আর নিধিকে আমি দেখবো।আমার কাছে ওদের একটু নিয়ে এসো।

তোর মা জিজ্ঞেস করেছে নিধি কে?
কল্লোল শুধু বলেছে কণার ক্লাসমেট।

স্যার কণার কাকীকে বলেন,যান নিয়ে যান কণাকে।
কিন্তু নিধিকে আমি যেতে দিতে পারবোনা।
কারণ নিধির কোন সম্পর্ক নেই আপনাদের সাথে।
আর যদি এরপর কোন সমস্যা হয় নিধির।
এই দায়ভার কে নেবে?

কণার কাকী দু হাত জড় করে স্যারকে বললেন,স্যার ছেলেটার অবস্থা বেশি ভালোনা।
মানুষের শেষ ইচ্ছে বলেও তো কথা আছে।
যেতে দিন স্যার ওকে।
কোন সমস্যা হবেনা ওর।আমি কথা দিলাম।

স্যার আমাকে বললেন তুমি যাবে?

কণার কাকী আমাকে বললেন,মা চলো।
হাতে ধরি তোমার আমি।
ছেলেটার অবস্থা খুবই খারাপ।একবার চোখের দেখাইতো দেখবে।
তারপর চলে এসো তুমি।

টিফিনের বেল পড়ে গেলো।
স্যার বললেন,আপনি হেড মাস্টারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসেন।
তিনি হেড মাস্টারের কাছে গেলেন কণাকে আর কণার কাকীকে।

আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার দিকে তাকালো।
আমাকে ধরে বলতে লাগলো,তুই কেন এমন চুপ হয়ে গেলি?
কি হলো তোর?
আর কে এই কল্লোল?
তোকে কেন দেখতে চাইলো।
আমি তখনও চুপ।

এবার তিথী আমার কাছে আসলো,এসে বল্লো,আমার ভাইয়ের মত কণার ভাইও বুঝি তোকে পছন্দ করে?
আমার ভাই তোকে দেখতে গিয়ে এক্সিডেন্ট করে হসপিটালে গেলো।
আর এই ছেলেকে কারা মেরে হসপিটালে পাঠালো।
আর কার কার ভাই তোকে পছন্দ করে হসপিটালে যাবে আমি এটা ভাবছি।

_তুই চুপ থাক তিথী।
আজাইরা কথা বার্তা বলা শুরু করেছিস।ওই নিধি,কণার ভাই তোকে কেন দেখতে চাইলো বল?
কণার ভাই কল্লোল কি কুয়াশার সকালের মুখ বেধে আসা সেই কল্লোল?
কথা বল।(আমার বান্ধবী)

আমি দু চোখ বন্ধ করে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে বললাম।
আমি যাবো দেখতে কণার ভাইকে।
চল আমার সাথে।

চলবে,

এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৪

0

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৪র্থ_পর্ব

আর আবির ভাইয়া চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বলে,
নিধি বিশ্বাস কর আমি না।
এই দেখ,আমাকে বারি দিয়ে ফেলে চলে গেলো ও…

আম্মু আবির ভাইয়ার নামটা শুনে আর ভাইয়ার কথা শুনে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো।

কারণ আম্মু আবির ভাইয়াকে অনেক স্নেহ করে।

আম্মু এবার আবির ভাইয়ার গায়ে হাত বুলাচ্ছে আর বলছে,কোথাও লাগেনিতো তোর?

আমি আম্মুকে ডেকে বললাম,কেন এমন আহ্লাদ দেখাচ্ছো?

চলে এসো।

_বিশ্বাস করেন কাকী আমি প্রতিদিন আপনাদের বাসায় পাহারা দেই।
দেখার জন্য যে, কে এমন করে।

আজ হাতে নাতে ধরে ফেলতাম,কিন্তু ও আমাকে বারি দিয়ে ফেলে দেয়।
আর আমি অন্ধকারের কারণে ওর মুখ টা দেখতে পাইনি।

আমি তোকে বিশ্বাস করি।
ওঠ এখন।
যা বাসায় যা।
কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।

আমাদের বাসা টা অনেকটা ছাড়া বাড়ীর মত।
একটু দূরে দূরে একেক টা বাসা।আবির ভাইয়াদের বাসাটা বেশি কাছে।
একটু দূরে বলে আর সবাই ঘুমাচ্ছে বলে কেউ শুনতে পায়নি আমাদের কথা গুলো হয়তো।

আবির ভাইয়া চলে যায় আর আম্মুও রুমে চলে আসে।

আম্মু আমাকে বোঝায়,

_দেখ,আবিরকে ভুল বুঝিস না।
ও দেখবি সত্যিই সব সত্যি কথা বলছে।
আমি ওকে ওর ছোট বেলা থেকে চিনি।
ও এমন ছেলে না।

_আম্মু,
যা হবার হয়েছে।
এখন শুবে চলো।ভালো লাগছেনা আমার।

আমি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ি।
আর ভাবতে থাকি,আসলেই কি আবির ভাইয়া সত্যি বলছে?
আমিও তো আবির ভাইয়াকে ছোট বেলা থেকে চিনি।
আবির ভাইয়া এমন জঘন্য কাজ করার মত ছেলেই না।
নাহ সে হবেনা।
আমি অযথাই ভুলভাল ভাবছি।

সকাল হলো,

আমি প্রতিদিনের মত পড়তে যাচ্ছি।
স্যার শুক্র বার বাদে প্রতি দিন পড়ান।
পড়ে আবার ওখান থেকে আজ স্কুলে যাবো।
বাসা থেকে স্কুল ড্রেস পরে একবারে বের হয়েছি।

রাস্তা দিয়ে মাথা নিচু করে রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছি।

_তুমি কি জানো,দুই বেণিতে যে তোমাকে দারুণ লাগে?

কথা টা শুনেই পেছন ফিরে তাকালাম।

তাকাতেই দেখি,কল্লোল নামের ছেলেটা,যে মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে আসে আমার সামনে।

_আপনি কি জানেন,এই ভাবে মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে রাখলে আপনাকে গু*ন্ডাদের মত লাগে?গরু চোরের মত লাগে?

কল্লোল এবার হা হা করে হাসছে।

_আমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে তাইতো?

_আপনাকে কেন দেখতে ইচ্ছে করবে?
আপনি কেন এভাবে আমার পিছু নিচ্ছেন বলুন তো?

কে আপনি?
আর কি চান আমার কাছে?

_কিছু চাইনা।তোমাকে আমার ভালো লাগে।
তোমাকে দেখলে দিন ভালো যায় আমার।
তাই তোমাকে দেখতে আসি।

নিজের ভালো কে না চায় বলো?

_আচ্ছা,সত্যি করে বলুন তো,
আপনিই সেই ছেলে তাইনা?
যে আমাদের এমন ভাবে পেরেশান করছেন?

সত্যি করে বলুন।

_বুঝলাম না।
কে পেরেশান করছে?কোন সমস্যা হয়েছে?
বলোতো শুনি।

_কিছুনা,আপনি যান এখান থেকে।

আর তখনই একটা পরিচিত কন্ঠের আওয়াজ শুনতে পাই আমি।

নিধি, কি হয়েছে?
এই ছেলে কি বিরক্ত করছে তোমাকে?

তাকিয়ে দেখি আমীর আংকেল।
আমীর আংকেল আমার প্রাইভেট টিচারের ভাই।
উনার ভাইয়ের কাছে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত পড়েছি।
স্যার আমাকে বাসায় এসে পড়াতেন।

স্যার অনেক ভালো মানুষ।
আমাকে অনেক স্নেহ করতেন।
এখনো দেখা হলে ডেকে কথা বলেন।

আমাদের এলাকায় স্যারের মত সুন্দর আর একটা ছেলেও ছিলোনা তখন।

এমন কোন মেয়ে ছিলোনা আমাদের এলাকায় যে তাকে পছন্দ না করতেন।

স্যার পড়াতে এসে একেক সময় আমাকে একেকটা ঘটনা বলে হাসতেন।

স্যার আমার সাথে স্যার কম বন্ধু বেশি ছিলেন।

আর আমাদের বয়সের ডিফারেন্স ছিলো দশ বছরের মত।

আমি যখন ক্লাস এইটে উঠি।
তখন আমার কয়েক টা বান্ধবী আমাকে বলেছিলোও।
ঝুলে পড় স্যারের গলায়।

যেমন শিক্ষিত।
তেমন সুন্দর।
এমন ছেলে আজকাল পাওয়া যায়না।

আমি ওদের ধমক দিয়ে বলতাম,
স্যার আমার কাকা হয়।
আর তাছাড়া দশ বছরের বড় উনি আমার।

আর স্যার দের উপর আবার ভালবাসা কিভাবে আসে?
স্যার রা গুরুজন।
এদের সম্মান দিতে শিখ।

ওরা আমাকে বুঝাতো,১০ বছর বেশি একটা বয়স হলো?

দশ বছর কোন ব্যাপার না।
দেখিস না স্যারকে দেখলে মনেই হয়না সে যে আমাদের দশ বছরের বড়।

আমি ওদের কথায় বিরক্ত হতাম।
কারণ স্যারকে আমি ওই নজরে কখনো দেখিনি।

স্যারের জন্য আমার মায়া হয় এখনো।
সম্মান করি শ্রদ্ধা করি।
ভালোও বাসি,তবে স্যার হিসেবে।
তার জন্য মনের ভেতর অনন্তকাল আমার অটুট এক সম্মান
থাকবে।

স্যার চাকুরির সুবাদে অন্যত্র চলে যান বলে ক্লাস নাইন থেকে আমার স্কুলের টিচার দের কাছে গিয়ে পড়তে হয়।

স্যার চলে যাবার আগে আমাকে আর আম্মুকে বলে যান,
পড়ার বিষয়ে কোন রকম সমস্যা হলে বা কোন রকম কোন কিছু দরকার হলে আমি আর আম্মু যেন তার ভাইয়ের কাছে চলে যাই।
তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিবেন।
আর কিছু দরকার হলে এনে দিবেন।
স্যার তার ভাইকে বলে যাবেন।

স্যার যাবার আগে তার ভাইকে বলে যান।
তার ভাইকে দিয়ে আম্মু মাঝে সাঝে ওষুধপাতি লাগলে আনান।

তবে আমি কখনো পড়ার জন্য তার কাছে যাইনি।
কারণ স্যার যাবার পর পরই আমি স্কুলের স্যারের কাছে পড়া শুরু করে দেই।

আমীর আংকেল আবার চেঁচিয়ে বললেন,
নিধি এই ছেলে কি বল্লো তোমাকে?
ও কি তোমার সাথে কোন ঝামেলা করছে?

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম,
না।

তাহলে কি বল্লো তোমাকে?

আমি বললাম,এমনিতেই।কিছু বলেনি।

আমীর আংকেল এবার কল্লোলের শার্টের কলার ধরে বলেন,

আর কোন দিন তোকে যদি নিধির আশেপাশে দেখি,তাহলে সেদিনই হবে তোর জীবনের শেষ দিন।
কথাটা মনে রাখিস যা।

আমি কল্লোলকে বললাম চলে যান প্লিজ।

আমি অবাক হয়ে গেলাম আমীর আংকেলের ব্যবহার দেখে।
উনি কেন ছেলেটার সাথে এমন করলো।
এত রেগেই বা গেলেন কেন?

কল্লোল চলে গেলো।

কল্লোল চলে যাবার পর আমীর আংকেল আমাকে বলেন,

আজ এবং এই মুহূর্ত থেকে ঘোমটা দিয়ে যাবা যেখানেই যাবা।
কোন পোলা যেন তোমাকে দেখতে না পায়।

আমি আচ্ছা বলে মাথা নিচু করে হাঁটা শুরু করলাম।

চার কদম যেতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
আর ভাবতে লাগলাম,
এই একই কথা আমি কোথায় যেন শুনেছি…
কে যেন বলেছিলো,
আমার স্পষ্ট মনে আছে,এই একই কথা আমি এর আগেও একবার শুনেছি।

চলবে?

এক কুয়াশার সকাল পর্ব-০৩

0

#এক কুয়াশার সকাল
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#৩য়_পর্ব

আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তিথীকে বললাম,
তোর ভাইয়ার গায়ে দেয়া টিশার্ট টা আমার ব্যাগের ভেতর সেদিন কিভাবে আসলো?আর এদিকে আমার সারা শরীর কাঁপছে।আমার মনে হচ্ছে আমি বোধয় এখনই সেন্সলেস হয়ে যাবো।

তিথী আমাকে ইশারা দিয়ে চুপ করতে বল্লো,
আমি তবুও ওকে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম,
বল তোর ভাইয়ার টিশার্ট আমার ব্যাগে কিভাবে আসলো?
তাও আবার রক্তে ভেজা টিশার্ট।

তিথী আমাকে আবার ইশারা দিলো।আমি এবার চুপ হলাম।
আর মনস্থির করলাম পড়াটা শেষ হলেই ওকে আবার জিজ্ঞেস করবো।

তিথী এবার সবার চোখ ফাঁকি দিতে আর কথা কাটানোর জন্য আমাকে চোখ টিপে বল্লো,আরে এক রকমের টিশার্ট থাকতে পারেনা?

দুনিয়ায় তো একই রকম টিশার্ট হাজার টা আছে।
তুই অযথাই ভুলভাল বকছিস।

এই যে স্যার এসে গেছে।এবার সবাই চুপচাপ বস।

আমি জানি তিথী মিথ্যে বাহানা দিচ্ছে।
আর আমি এও জানি,যে টিশার্ট টা আমার ব্যাগে ছিলো,ওটা আর কারোনা ওটা ওর ভাইয়েরই টিশার্ট।

আর এই ছেলেটা একদিন আমাকে ডেকে বলেছিলো,আমার সাথে একদিন চা পান করা যাবে?

আমি না বলে চলে গিয়েছিলাম।

এই টুকুর জন্য তিথীর ভাই আমার সাথে এমন করবে?
এমন হয়রানি করবে আমাকে?

পড়া শেষে আমার তিথীর সাথে কথা বলতে হবে।

পড়া শেষ হতে না হতেই তিথীকে ডেকে আমি বাইরে নিয়ে গেলাম।

আমি কিছু বলার আগেই তিথী আমাকে বল্লো,হ্যাঁ ওটা আমার ভাইয়েরই টিশার্ট।
আমি তোকে সব খুলে বলছি।

আমরা যখন ক্লাস এইটে পড়ি।
ভাইয়া একদিন আমাকে ডেকে বল্লো,
আচ্ছা শোন তিথী,

তোর সাথেই পড়ে ক্লাস এইটে, একটা মেয়ে আছে,
মেয়েটার বাসা স্কুলের দক্ষিণ দিকে।
মেয়েটার নাম নিধি।
ফর্সা মত মেয়েটা,প্রায় সময় মেয়েটা স্কুলে আসে মেকাপ করে গাল লাল করে।
লিপ্সটিক দেয়না,চোখ সাজায় না।
গাল দুটো মেকাপ দিয়ে লাল করে আসে।
চিনিস মেয়েটাকে?

তুই জানিস নিধি আমি সেদিন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম ভাইয়ার কথা শুনে।

আমি ভাইয়াকে বললাম,হ্যাঁ ভাইয়া।
চিনি আমি নিধিকে।
ও আমার খুব কাছের বান্ধবী।
আর হাসতে হাসতে বললাম,ও মেকাপ করে আসেনা।

একটু রোদে গেলেই,কিংবা একটু হেঁটে আসলেই ওর গাল দুটোতে হালকা গোলাপি আভা এসে যায়।

একদিন তো স্কুলের স্যারও ওকে দাঁড় করিয়ে বলেছিলো,নিধি তুমি প্রতিদিন মেকাপ করে আসো কেন?

কাল থেকে আর মেকাপ করে আসবেনা।
কলেজে যখন যাবে,তখন মেকাপ করে যেও।
কেউ কিছু বলবেনা।

নিধি ধীরেধীরে উত্তর দিলো,

স্যার আমিতো মেকাপ করিনা।

স্যার এবার ধমক দিয়ে বললেন,আবার মিথ্যা কথা।

মেকাপ না করলে গাল কি এমনিতেই লাল হয়ে থাকে?
বোকা পেয়েছো আমাদের?

নিধি উত্তর দিলো জ্বী স্যার।

তখন স্যার রেগেমেগে বললেন,
এখন যদি তোমার মুখ ধোয়ার পর দেখি লাল রঙ আর নেই।
তাহলে এই মুহূর্তে আমি তোমাকে ক্লাস থেকে বের করে দিবো।
তুমি রাজি আছো?

নিধি আস্তে করে উত্তর দিলো,জ্বী স্যার।

এবার ক্লাসের সবাই আমরা অবাক হলাম।
কারণ নিশ্চিত এই মেয়ে মেকাপ করে গাল লাল করে আসে আমাদের ধারণা।

ভাইয়া তখন বল্লো,
তারপর?
তারপর কি হলো?

আমি বললাম,নিধি তারপর আমার কাছ থেকে পানির বোতল নিয়ে বাইরে গিয়ে মুখ ধুলো স্যারের সামনে।

কিন্তু এ কি দেখছি,
ওর গাল যেমন ছিলো তেমনই আছে।

পরে ও বল্লো,
স্যার আমি আমার আম্মুর মত হয়েছি,
একটু রোদে,তাপে,গরমে কিংবা ক্লান্ত হয়ে গেলে আমার আম্মুর মত আমারো গাল লাল হয়ে যায়।

আগে আম্মুকে সবাই বলতো,মেকাপ করে থাকো নাকি সব সময়?

এখন অনেকে আমাকেও বলে।

এই কথা শুনে স্যার হেসে নিজে সরি বলে নিধিকে সিটে গিয়ে বসতে বলেন।
আর বলেন,ভালোই হয়েছে তোমার আর টাকা খরচ করে মেকাপ কিনতে হবেনা।

ভাইয়া আমার কথা শুনে হা হা করে হাসতে থাকে আর বলে,এত দিন আমিও ভাবতাম,এই মেয়ে প্রতিদিন স্কুলে মেকাপ করে যায়।

ভাইয়ার কথা শুনে আমার হাসি আরো বেড়ে গেলো।

তারপর ভাইয়া আমাকে চুপ করিয়ে আমার হাসি থামিয়ে বল্লো,

নিধিকে ভাবী বলে ডাকতে পারবি আর কয়েক বছর পর?
আমার ওকে ভালো লাগে।

আমি উত্তর দিলাম,পারবোনা কেন,১০০ বার পারবো।আমারো ওকে খুব ভালো লাগে।খুব মিশুক।সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে।

ভাইয়া আমাকে বলে এখন থেকে তাহলে তোর হবু ভাবীর খেয়াল রাখবি।

সেদিন আমি বুঝতে পেরেছিলাম,ভাইয়া তোকে পছন্দ করে।

আর আমি সেদিন থেকে তোকে চোখে চোখে রাখি।
কিন্তু কখনো বুঝতে দেইনা তোকে,আমি যে দুর্জয় ভাইয়ার বোন।

_আচ্ছা বুঝলাম,এখন বল টিশার্ট টা..

_আরে বলতে তো দে,

তারপর কেটে গেলো অনেক গুলো দিন,

আমরা উপরের ক্লাসে উঠলাম।
ভাইয়া তোকে তার মনের কথা জানায়নি কারণ সে ভেবেছিলো তুই আরেকটু বড় হলে ভাইয়া তোকে জানাবে তার মনের অনুভূতি।

কিন্তু ভাইয়া তোকে প্রতিদিন দূর থেকে দেখতো।

আমি বাসায় এলে ভাইয়া আমাকে সব বলতো আর আমার কাছ থেকে তোর খবর নিতো।

_ক্লাস টেনে উঠার পর তোর ভাইয়া আমার সামনাসামনি ঘুরঘুর শুরু করে।
আগে দেখিনি।
এখন দেখি মাঝেমধ্যেই।

কিছু দিন আগে তো আমাকে ডিরেক্ট বলেছে,তার সাথে চা খেতে যাবো নাকি।

আর আমি না করায় আমার সাথে কি রকম শুরু করেছে।

_কি রকম শুরু করেছে মানে?

_এই যে রক্তে ভেজা টিশার্ট,আরো কত কি।

__আর কিছুনারে,শুধু রক্তে ভেজা টিশার্ট ই।

কিছু দিন আগে ভাইয়া এক্সিডেন্ট করে।
আর রক্তে তার টিশার্ট যেন ভিজে যায়,এমন অবস্থা।

ভাইয়া তোকে দেখতে যাচ্ছিলো।
আর তখনই এক্সিডেন্ট হয়।

ভাইয়া দেখে তুই তোর ব্যাগ টা দোকানের বেঞ্চে রেখে একটু দূরে গিয়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছিস বান্ধবীদের নিয়ে।

আর তখনই ভাইয়া টিশার্ট টা তোর ব্যাগে রেখে দেয়।

আর তুই যেখানে ছিলি ওখানেই তো মেডিকেল।তাই ওই ভাবেই চলে যায়।
ব্যান্ডেজ করে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে এই ভেবে।
আর সব চেয়ে বড় কথা, তোর যেন রক্ত ভেজা টিশার্ট টা দেখে মায়া লাগে ভাইয়ার জন্য,তাই আরো রেখে যায় তোর ব্যাগে।

ভেবেছে,আমাকে বলবে তোর ব্যাগ থেকে টিশার্ট টা নিতে আর তখনই তোকে বলতে ভাইয়ার এক্সিডেন্ট হয়েছে।

কিন্তু তার আগেই তো তুই ক্লাসে হাঙ্গামা শুরু করে দিলি।

_এইটুকুই আমার ভাইয়ের কাহিনী।এ ছাড়া আর বাড়তি কিছুই নেই।
এটাকে আর কোন ভাবে না ছড়ালে খুশি হবো।

তিথীর কথা গুলো সত্যি মনে হচ্ছে।
এত বড় মিথ্যে কাহিনী ও বলবেনা।

কিন্তু এর পরের ঘটনা গুলো তাহলে কে ঘটালো?

কে এমন ভাবে আমাদের ঘুম হারাম করছে।
আমি ভাবতে লাগলাম এসব।

এরপর কয়েক দিন কেটে যায়।

আমরা সবাই শান্তিতে ঘুমাই এ কয় দিন।
ভেবেছি আর করবেনা এমন জ্বালাতন ওই ছেলে।

কিন্তু হঠাৎ আবার একদিন রাতে টিনের মধ্যে বারির আওয়াজ।

এবার আম্মু আবার কে রে কে রে বলা শুরু করলো।

এবার আমি আম্মুকে ফিসফিস করে বলি,
তুমি এখানে এই ছেলের সাথে কথা বলতে থাকো।
আমি শুধু ওই রুমের জানালা টা একটু খুলেই টর্চ লাইটের আলো দিয়ে দেখবো কে ওই ছেলে।
যদি কোন সমস্যা করে ওই ছেলে,তুমি চিৎকার দিও।
আমিও চিৎকার দিবো,তাহলেই সবাই চলে আসবে।
কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।
প্রতিদিন এমন প্যারা সহ্য করার চেয়ে একবারে সব শেষ হোক।

আম্মু আমাকে না করা সত্ত্বেও আমি ঠিকই অন্য রুমের জানালা খুলে টর্চ লাইটের আলো জ্বালাই ওই ছেলের দিকে।

কিন্তু আলোটা যার মুখের উপর গিয়ে পড়ে,সে আর কেউনা সে আম্মুর ফেভারিট আবির ভাইয়া।

আমি জোরে চিল্লায় বলি,আবির ভাইয়া আপনি?

আর আবির ভাইয়া চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বলে,
নিধি বিশ্বাস কর আমি না।

এই দেখ,আমাকে বাড়ি দিয়ে ফেলে চলে গেলো ও…

চলবে..