বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৪৪+৪৫

0
1701

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪৪.

আদ্রিয়ান চলে গেছে প্রায় বারো ঘন্টা হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও আদ্রিয়ান একবারও ফোন করেনি অনিমাকে। শেষে অনিমাই করেছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু আদ্রিয়ান রিসিভ করেনি। এই নিয়ে খুব চিন্তিত অনিমা। ডিনারের সময় মানিক আবরারকে বলেছেও এই কথা। উনি ওকে এটা বলে আশ্বস্ত করেছে যে, আদ্রিয়ান বলেছিল ওর আজ স্টেজ শো আছে, সেসব নিয়েই ব্যস্ত আছে হয়তো। ফ্রি হলে নিশ্চয়ই ফোন করবে। ও আগেও এরকম করেছে অনেকবার। রিমা অবরারও তাই বললেন। ওনাদের এসব কথা শুনে অনিমার চিন্তা কিছুটা কমলেও মনের মধ্যে খচখচ করছে। রিক শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। এতো শক্ত করে স্পুন চেপে ধরে আছে যেন হাতের মধ্যে ঢুকে যাবে। সকলের সামনে আছে তাই দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মাত্র কয়েকঘন্টা যোগাযোগ হয়নি তাতেই আদ্রিয়ানের জন্যে এতো চিন্তা? কয়েকমাসেই এতো ভালোবাসা? অথচ ওর সাথে একটা বছর থাকার পরেও বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছুই ভাবতে পারেনি অনিমা ওকে। এটাকে কী বলে? আদ্রিয়ানের সার্থকতা? রিকের ব্যর্থতা? না-কি নিয়তি? কিন্তু ওর কী দোষ ছিল? যাকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছিল তাকে প্রতিনিয়ত অন্যের হয়ে যেতে দেখতে হচ্ছে। সেই মেয়েটা অন্যকারো জন্যে চিন্তা করছে, ছটফট করছে। প্লেটে স্পুন ঘষতে ঘষতে সেসবই ভাবছিল রিক। সেবেলাও ওর ঠিকভাবে খাওয়া হয়নি ওর। অনিমা আদ্রিয়ানকে ফোন করেই যাচ্ছে কিন্তু এখন ফোন বন্ধ বলছে। অনিমার এবার আরও বেশি টেনশন হচ্ছে। রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ এখন জানে ও কোথায় আছে। এটাও জানে যে আদ্রিয়ান ওর বর। আর কাছের মানুষকে হাতিয়ার করে যুদ্ধ লড়া ওনাদের মূল যুদ্ধনীতি। আদ্রিয়ানের সাথে খারাপ কিছু করবেনা তো ওনারা? অনিমা এসব নানারকম চিন্তায় বিভোর থেকে শেষ রাতের দিকে শেষের পাতা এক করল।

____________

সকালবেলায় অনিমা মুখ ভার করে সোফায় বসে আছে। ওর মধ্যে অস্হিরতা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মানিক আবরার রেডি হয়ে নিচে এসে অনিমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে হেসে বলল,

” মামনী?”

অনিমা মলিন মুখ নিয়ে ওনার দিকে তাকাল। ধীর কন্ঠে বলল,

” জি বাবা।”

মানিক আবরার অনিমার পাশে বসে বলল,

” আদ্রিয়ানের জন্যে চিন্তা হচ্ছে? ও তো বাচ্চা নয়, তাইনা? আর খুব বেশি ব্যস্ত থাকলে এরকমম করে ও। দেখবে দুপুরের মধ্যেই ওর ফোন চলে আসবে। আর না আসলেতো আমরা আছিই, তাইনা?”

রিমা আবরার কিচেন থেকে বেড়িয়ে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন,

” সেটাইতো বোঝাচ্ছি ওকে। সকালে ঠিককরে খায়ও নি। দেখ কেমন মুখ করে আছে।”

মানিক আবরার উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” আচ্ছা, তোমরা থাকো। আমাকে আবার একটু অফিস থেকে ঘুরে আসতে হবে।”

রিমা আবরার সম্মতি জানালেন। কিছুক্ষণ পর জাবিনও নিচে নেমে এলো। ও এসে অনিমার সাথে টুকিটুকি কথা বলে ওকে নরমাল করার চেষ্টা করছে। ঘন্টখানেক পর মিসেস রিমা রেডি হয়ে নিচে নেমে বলল,

” অনি, জাবিন আমি একটু আমার বান্ধবীর বাড়িতে যাচ্ছি। চলে আসব দুপুরের আগে। তোরা থাক। রিক ওপরে ঘুমাচ্ছে। দেখিস ওর কিছু লাগবে কি-না।”

অনিমা আর জাবিন দুজনেই মাথা নাড়ল। মিসেস রিমা বেড়িয়ে যাওয়ার পর অনিমা আর জাবিন দুজনেই সোফায় বসে বই পড়ছিল। কিন্তু অনিমার মনোযোগ বইয়ের চেয়ে বেশি ফোনের দিকে। আদ্রিয়ান ফোন করে যদি? কিন্তু আদ্রিয়ান ফোনই করছেনা। জাবিন ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল,

” আরে, এতো চিন্তা করছ কেন? ঠিক ফোন করবে দেখ। শোননা ভাবি, আমার না একটা ক্লাস আছে এখন। রুমে যেতে হবে। তুমি আমার সাথে রুমে আসবে না-কি এখানেই থাকবে?”

অনিমা বলল,

” না, না তুমি ক্লাস কর। আমি বরং এই ফাঁকে আদ্রিয়ানের ওয়াসরুমে গিয়ে শাওয়ারটা সেড়ে নেই।”

জাবিন মাথা নাড়ল। জাবিন আর অনিমা বই-টই নিয়ে একসাথেই ওপরে গেল। জাবিন ওর রুমে গেল আর অনিমা আদ্রিয়ানের রুমে গেল শাওয়ার নিতে।

প্রায় এক ঘন্টার মত শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়ে এসে অনিমা আয়নার দিকেই যাচ্ছিল চুল মুছতে। কিন্তু বিছানায় চোখ পরতেই দেখল রিক বসে আছে। ওর চোখেমুখে ভয়ংকর রাগ। অনিমা হঠাৎ ওকে এখানে দেখে ঘাবড়ে গেল। রিক কীকরে ঢুকল? ও কী তবে দরজা আটকায় নি? সেদিনের মত আবার কিছু করবে না-তো রিক? কথাটা মনে হতেই ও দ্রুত দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতে নিলেই রিক এসে ওর হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে নিল। অনিমা টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় বসে পরল। ও কোনরকমে উঠে দাঁড়াল আবার। রিক ক্রোধিত দৃষ্টিতে দেখছে অনিমাকে। এতোদিন আদ্রিয়ানের জন্যেই অনিমার কাছে আসতে পারত না। কোন না কোনভাবে ঠিক আদ্রিয়ান চলে আসত সেই মুহূর্তেই। কিন্তু আজ সুযোগ যখন পেয়েছে তখন ওকে সবটা জানতেই হবে। অনিমাকে ওর সব কথার উত্তর দিতে হবে। ওকে জবাব দিতে হবে এরকম কেন করল ও? রিককে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অনিমা কম্পিত কন্ঠে বলল,

” দেখুন, আমার কাছে আসবেন না আপনি। কেন এসছেন এখানে? আর কী চান আমার কাছ থেকে? কেন এভাবে অশান্তি সৃষ্টি করছেন আমার জীবনে?”

রিকের রাগ অনিমার এরকম কথায় আরও বেড়ে গেল। রিক অনিমার হাত চেপে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,

” আমি অশান্তি সৃষ্টি করছি? আমি? আর তুমি যেটা করেছো সেটা কী হ্যাঁ? বারবার এমনভাবে কথা বলছ যাতে আমি তোমাকে ঠকিয়েছি! আমি তোমাকে ছেড়েছি। আমি সব অন্যায় করেছি। নিজের দোষ ঢাকতে আমার ওপর দোষ চাপাচ্ছো?”

অনিমা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,

” আমি কিছুই করিনি। যেতে দিন আমায়।”

রিক আরও শক্ত করে হাত চেপে ধরে বলল,

” যেতে তো দেবোনা। আজ আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর তুমি যাবে। এই দোটানা, সংশয়, অনিশ্চয়তা আমি জাস্ট নিতে পারছি না। ইউ হ্যাভ টু এক্সপ্লেইন মি।”

অনিমা কান্নামাখা গলায় বলল,

” রিক, আমি আপনার ভাইয়ের বউ! সম্পর্কে আপনার ভাবি। এরকম করতে পারেন না আপনি আমার সাথে।”

রিক ঝাড়ি মেরে বলল,

” হ্যাঁ জানি! আর সেইজন্যেই তোমার কাছে শুধুমাত্র উত্তরটুকু চাইছি আমি। য‍দি তুমি আদ্রিয়ানের বউ না হতে তাহলে এতক্ষণে আমি তোমাকে__ কী যেন বলছিলে? তুমি কিছুই করোনি। সত্যিই কিছু করোনি? তোমার জন্যে এতোটা করার পরেও অকারণেই আমার সাথে বাজে ব্যবহার করোনি? আমার সাথে বিয়ে ঠিক থাকার পরেও আমার অনুপস্থিতিতে তুমি ঐ বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসোনি? তারপর মাত্র কয়েকমাসের পরিচয়ে আমার ভাইকে পটিয়ে নিয়ে তাকে বিয়ে করে ফেললে। আর আজ বলছ যে আমি তুমি কিছুই করোনি। আমি তোমার শান্তি নষ্ট করছি?”

অনিমার এবার রাগে সমস্ত গা জ্বলে যাচ্ছে। একের পর এক মিথ্যা অভিযোগ করে যাচ্ছে রিক ওর নামে। অথচ নিজে সাধু সাজছে। অনিমা রিককে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ করছেন! আপনি আমার শান্তি নষ্ট করছেন। আজ আপনি আমার দিকে আঙুল তুলছেন? হ্যাঁ এটা সত্যি আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তারজন্যে আমি আপনার কাছে সেদিনও কৃতজ্ঞ ছিলাম আর আজও আছি। সেইজন্যই আপনার প্রতি কোনরকম অনুভূতি না থাকার সত্ত্বেও অাপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। শুধুমাত্র আপনার ঋণ শোধ করার জন্যে।”

রিক অবাক দৃষ্টিতে তাকাল অনিমার দিকে। শুধুমাত্র ঋণ শোধ করার জন্যে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিল? অনিমা চোখ মুছে বলল,

” হ্যাঁ এটা ঠিক একপর্যায়ে আপনাকে নিজের সবথেকে ভালো বন্ধু মনে হতো আমার। তবে এটাও ভাবতাম যে আপনি আমাকে বিয়ে কেন করতে চান। কিন্তু আপনি? আপনি কী করছিলেন? নিজের বাবা আর মামার কুকীর্তি যাতে আমি বাইরে কাউকে না জানাতে পারি তাই বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আমায়। নিজের বউ নয়, বন্দি দাসী বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন আমাকে।”

রিক বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল অনিমার দিকে।এসব কী বলছে অনিমা? কীসের কুকীর্তি? অনিমা একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,

” অবাক হচ্ছেন? আমি কীকরে জানলাম? আপনার বাবা আর মামা নিজেই বলেছিল আমাকে সবটা। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি ওদেরক‍ে বিশ্বাস করিনি। আমি জানতাম ওরা নিজের স্বার্থে নিজের কাছের মানুষকেও ফাঁসাতে পারে। তাই পাত্তাই দেইনি ওদের কথায়। কিন্তু আমার বিশ্বাস আপনি সেদিনই হারিয়েছেন যেদিন এটা জানতে পেরেছি যে আপনারই ইনসট্রাকশনে রোজ আমাকে ইনজেকশন দেওয়া হতো। আমি জানিসা সেটা কীসের ইনজেকশন ছিল। আমার শরীরে সেটা কতটা ড্যামেজ করেছে। আর ভবিষ্যতে এর কারণে আমার কী ক্ষতি হতে পারে। জানেন তো আপনারা।”

রিক হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,

” অনি আমি..”

” এখন প্লিজ এটা বলবেন না যে আপনি ইনজেকশন দিতে বলেননি। কারণ সেটা আপনি নিজে স্বীকার করেছেন। ওরা যখন আমায় বলেছিল আমি মানিনি। আমি ভাবতেই পারিনি আপনি আমার সাথে এতো খারাপ কিছু করতে পারেন। কিন্তু মনে আছে আমি নিজে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে? যে আপনি সুমি আপুকে আমায় কোন ইনজেকশন পুশ করতে বলেছেন কি-না? আপনি সেদিন নিজে স্বীকার করেছিলেন যে হ্যাঁ আপনি বলেছেন এটা করতে।”

রিক একপ্রকার পাথরের মতই দাঁড়িয়ে আছে। ওর সব কথা যেন গলায় আটকে গেছে। অনিমার একেকটা কথা ওকে জমিয়ে দিচ্ছে। অনিমার নাক টেনে বলল,

” সেদিনের পর থেকে এমনিতেই আপনাকে সহ্য হতোনা আমার। আপনি যে রক্তের ধারাটাই পেয়েছেন সেটা বুঝে গেছিলাম। আর ঐসময় আমার সবকিছুই অসহ্য লাগত। আপনাকে একদমই সহ্য হতোনা আমার। আর তখনই আপনি আপনার আসল রং দেখিয়েছিলেন আমার ওপর। তাইনা? একেকটা দিন আমার কেমন কাটতো তখন জানেন আপনি? আর বারবার বলছেন যে আমি আপনার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসছি? সত্যি যদি পালাতে পারতাম ঐ নরক থেকে, খুব ভালো হতো। কিন্তু আমি পালাই নি! কীকরে পালাবো? আমাকে তো আপনি জেলের আসামীর মত বন্দি করে রাখতেন। কিন্তু সেদিন আপনার বাবা আমাকে একদল পাচারকারীর হাতে তুলে দিয়েছিল। আর সেটাতো আপনার জানাই। কারণ সেই দলের এরেঞ্জমেন্ট তো অাপনিই করেছিলেন। সবকিছু যাতে ঠিকঠাক হয় সেই ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন অাপনি। যদিও এই কথাটাই আছে যেটা আপনার মুখ থেকে শুনিনি আমি। কিন্তু বাকি সব সত্যি হলে এটাও নিশ্চয়ই সত্যি?”

রিক এখনও ওভাবেই তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। অনিমা বিছানায় বসে পরল। তারপর ভাঙা কন্ঠে বলল,

” আমার কোন অনুরোধ, কোন আকুতি সেদিন আপনার বাবার মন গলাতে পারেনি। আমি ওনার পায়ে পর্যন্ত পরেছিলাম। বলেছিলাম আমি অনেক দূরে চলে যাবো তবুও যাতে আমার এতোবড় ক্ষতি না করে। কিন্তু উনি শোনেন নি। জোর করে ওদের হাতে তুলে দিয়েছিল আমায়। সেটাতো আল্লাহর রহমত ছিল যে যেদিন আমায় হ্যান্ডওভার করা হচ্ছিল সেদিন আদ্রিয়ান চলে এসছিল ওখানে। না হলে আজ হয় আমি কবরে থাকতাম নয়তো কোন পতিতাপল্লীতে অন্যে__”

রিক সাথে সাথেই থমকে বলে উঠল,

” চুপ! একদম চুপ!”

বলে রিক দুহাতে নিজের চুল উল্টে ধরে দুকদম পিছিয়ে গেল। অনিমার কথাগুলো ওর মস্তিষ্কে ভনভন করে ঘুরছে। কী বলল এসব মেয়েটা? রিক ওর মামা আর বাবার ব্যাপারে যথেষ্ট দুর্বল। ওনাদের ব্যাপারে খারাপ কিছু ভাবতে চায়না। এটা ঠিক। কিন্তু এমনিতে ও যথেষ্ট বুদ্ধিমানও। তাই পুরো ব্যাপারটা মেলাতে ওর বেশি সময় লাগল না। অনিমা প্রচন্ড জোরে জোরে শব্দ করে কাঁদছে। রিক ওকে সামলাবে সেই মানসিক পরিস্থিতি ওর নেই। এখন ওকে কে সামলাবে? ওর হৃদপিণ্ড থেমে যেতে চাইছে। শ্বাস আটকে আসতে চাইছে। এখন ওর আদ্রিয়ানকে দরকার। খুব দরকার! কিন্তু সে-ও তো নেই। অনিমাকে নিজের হয়ে সাফাই দেওয়ার মত মানসিক অবস্থা ওর নেই তাই কিছু না বলে ধীরপায়ে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। অনিমা কান্না করতে করতে বিছানায় শুয়ে পরল। মাথাটা হঠাৎ আবার ব্যাথা করছে। ও তো ঐসব দিনগুলো ভুলতে চায়। কেন পারছেনা? বারবার কেন এগুলোই ওর সামনে আসে।

____________

দুপুরে রিমা আবরার এসে অনিমাকে ডেকে নিচে আনলেন। অনিমা একপ্রকার বাধ্য হয়েই নিচে এল। একেতো আদ্রিয়ানের খবর নেই, তারওপর রিকের সাথে ওসব নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছে।কান্নাকাটি করাতে চোখমুখ শুকনো লাগছে।নিচে এসে দেখে রিক আর জাবিনও আছে। রিকের সাথে চোখাচোখি হতেই ও চোখ সরিয়ে নিল। রিকের চোখমুখও লালচে হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেঁদেছে। মিসেস রিমা বলল,

” দেখেছ মুখচোখের কী অবস্থা হয়েছে? এবার আসুক ঐ ছেলে। আচ্ছা করে ধোলাই দেব। আমার মেয়েটাকে এভাবে কাঁদায়?”

অনিমা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। মিসেস রিমাকে জড়িয়ে ধরে সত্যিই কেঁদে ফেলল। জাবিন অবাক হয়ে বলল,

” আরে ভাবি, কেঁদোনা প্লিজ। ভাইয়ার খবর পেয়ে যাবো ঠিক। কিচ্ছু হবেনা।”

” বোকা মেয়ে, আমার ছেলে আমি চিনি ওকে। দেখ গিয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে। কান্নাকাটি থামা।”

বলে মিসেস রিমা অনিমাকে নিয়ে সোফায় বসলেন। অনিমা নাক টেনে কেঁদেই যাচ্ছে। রিক সোফায় বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে অনিমাকে। দেখছে ওর নীলপরী ওর ভাইয়ের জন্যে কতটা উদ্বিগ্ন হতে পারে। কতটা ভালোবাসলে এটা সম্ভব। জাবিন টিভি অন করে বলল,

” দেখি টিভিতে কিছু বলে কি-না। ভাইয়ার তো কাল শো ছিল।”

নিউস চ্যানেলে দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই টিভিতে খবর এলো যে, ‘শো করতে আসেন নি বিখ্যাত রকস্টার আদ্রিয়ান অাবরার জুহায়ের। ক্ষুদ্ধ দর্শকরা, স্টেজে ভাঙচুর! বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন ওরগানাইজাররা।’

#চলবে…

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪৫.

অনিমা খবরে এরকম কথা শুনে থমকে গেল। আদ্রিয়ান স্টেজেই যায় নি? ওর তো এরকম কোন রেকর্ড নেই। অনিমা যতদূর জানে আজ অবধি কোন শো-তে আদ্রিয়ান দেরী করে অবধি যায়নি। তবে কী ওর ধারণাই সত্যি? আদ্রিয়ানের কোন বিপদ হয়েছে? আদ্রিয়ানের বিপদ হতে পারে কথাটা কল্পনা করেই অনিমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। মিসেস রিমাও এবার ভয় পেয়ে গেছেন। যে কাজের জন্যে ছেলেটা নিজের বউকে ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে চলে গেল। সেখানেই যায়নি? এটা কীকরে হয়? জাবিন আর রিক দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। অনিমা যে কিছু বলবে সেই অবস্থাতে ও নেই। ওর চোখ ছলছল করে উঠছে, নিচের ঠোঁট কাঁপছে, স্বাভাবিকের চেয়েও অনেকটা ভারী লাগছে ওর কন্ঠ। বাকিরাও শকড তাই অনিমার দিকে কারও নজর নেই। এমন সময় মানিক আবরার হন্তদন্ত পায়ে ভেতরে এসে ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,

” তোমরা খবর চালিয়েছো? শুনলাম আদ্রিয়ান না-কি কালকে শো করতে যায়নি।”

মিসেস উঠে রিমা উঠে দাঁড়িয়ে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললেন,

” সেটাইতো দেখলাম। ও তো এমন করেনা। কোথায় গেল ছেলেটা? তুমি একটু ফোন করে দেখোনা?”

মানিক আবরার আদ্রিয়ানকে ফোন করতে করতে বলল,

” আমি আসতে আসতে অনেকবার ট্রায় করেছি ফোন বন্ধ বলছে। এই দেখ, এখনও বন্ধ বলছে।”

জাবিন উঠে দাঁড়িয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,

” বাবা, অভ্রকে একটা ফোন করে দেখ না?”

আদ্রিয়ানের ফোন বন্ধ বলে অনিমা অভ্রকে ফোন করেছিল কিন্তু ধরেনি ও। কিন্তু অনিমা সেই কথাটুকু বলবে সেই শক্তি নেই ওর মধ্যে। ও হতভম্ব হয়ে বসে আছে। মানিক আবরার দ্রুতই অভ্রকে ফোন করল কিন্তু ধরল না। হঠাৎ আদিব আর আশিসের কথা মনে পরতেই উনি দ্রুত আদিবকে ফোন করল। আদিব ফোন রিসিভ করে মানিক আবরার কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,

” আঙ্কেল টেনশন করবেন না একদম। আমরা খোঁজ করছি আদ্রিয়ানের। হয়তো কোন ইম্পর্টেন্ট কাজে আটকে গেছে। ঠিক খোঁজ পেয়ে যাবো।”

মানিক আবরার অবাক হয়ে একটু জোরে বলল,

” খোঁজ করবে মানে? তোমরা জানোনা আদ্রিয়ান কোথায় আছে? বাড়িতে সার্ভেন্টদের ফোন করেছিলে?”

অনিমা উঠে দাঁড়িয়ে গেল মানিক আবরারের কথা শুনে। এখন শরীরও কাঁপছে ওর। রিক উঠে ওকে ধরতে গেলে অনিমা হাত দিয়ে বাঁধা দিয়ে আটকে দিল। আদিব একটু ইতস্তত করল। এরপর নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ আঙ্কেল, কিন্তু ও বাড়িতে যায়ই নি আর।তবুও! আঙ্কেল আপনি চাপ নেবেন না। আমরা দেখছি। কিচ্ছু হবেনা আদ্রিয়ানের। চলে আসবে ও। আপনি আন্টি আর অনিমাকে সামলান প্লিজ। অনিমার মাথায় বেশি প্রেশার দেওয়া যাবে না। প্লিজ!”

মানিক আবরার দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে হাত দিয়ে নাকের নিচের ঘাম মুছে নিলো। তারপর নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল,

” হ্যাঁ! সেটাই। ও তো আর বাচ্চা না বল? চল আসবে, চলে আসবে।”

আদিব সাথেসাথেই বলল,

” হ-হ্যাঁ অবভিয়াসলি। নিশ্চয়ই চলে আসবে। আ- আমি এখন রাখছি হ্যাঁ?”

” হ্যাঁ। রাখো, রাখো।”

ফোনটা রাখার সাথেসাথেই মিসেস রিমা কাঁদোকাঁদো গলায় বললেন,

” ওরাও জানেনা? কোথায় গেল ছেলেটা?”

” চিন্তা করোনা। কোথায় আর যাবে? দেখো গিয়ে কোথায় কোন কাজে চলে গেছে। কিচ্ছু হবেনা। চিন্তা করোনা।”

মানিক আবরারের গলা কেঁপে কেঁপে উঠছে।মুখে যতই বলুক চলে আসবে, আদ্রিয়ানের কিছু হয়নি। চিন্তা ওনারও হচ্ছে। এটা ঠিক যে আদ্রিয়ান প্রায় এরকম না বলে গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু ওও নিজের কাজকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তারপর শো অরগানাইজারদের এতবড় ক্ষতি হল ও না আসাতে। আর যাই হোক আদ্রিয়ান শুধুমাত্র নিজের স্বার্থে অন্যের এতবড় ক্ষতি করবেনা। এটুকূ ওরা সবাই চেনে আদ্রিয়ানকে। এইজন্যই সবার ভয়ের মাত্রাটা বেশি। আর এরকম মুহূর্তে খারাপ চিন্তাগুলোই সবার আগে মাথায় আসে। অনিমা পরে যেতে নিলে রিক আর জাবিন দুজনেই একসঙ্গে ধরে ফেলল ওকে। অনিমা ভীষণরকম কাঁপছে আর কাঁদছে। ওরা দুজন মিলে দ্রুত অনিমাকে বসিয়ে দিল সোফায়। রিক দ্রুত চলে গেল পানি আনতে। জাবিন ওকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। মিসেস রিমাও বসে পরলেন সিঙ্গেল সোফায়। কেঁদে দিয়ে মানিক আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল,

” দেখোনা আরেকটু খোঁজ করে।”

মানিক আবরার উত্তর না দিয়ে ফোন করায় ব্যস্ত হয়ে পরলেন। অনিমা যে ঠিককরে কাঁদবে সেই অবস্থাটুকুও ওর নেই। জাবিনকে জাপটে ধরে বসে আছে। মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে আছে ও। এরমধ্যেই রিক পানি নিয়ে চলে এলো। ও অনিমার সামনে হাটু গেড়ে বসল। রিক জাবিনের থেকে অনিমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,

” মাত্র একটাদিনই হয়েছে ও হারিয়ে গেছে। ও বাচ্চা নয়। এখনই এতো চিন্তা করার কিচ্ছু হয়নি। চলে আসবে ও।”

অনিমা আদ্রিয়ানের ভাবনায় এতোটাই বিভোর যে ও ওর সামনে ওর বন্ধু রিককেই দেখতে পাচ্ছে। সেই রিককে দেখছেনা যাকে ও সহ্য করতে পারেনা। নাক নাক টেনে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

” ওনার ফোন কেন লাগছেনা?”

” অনেকসময় অনেক জায়গায় নেটওয়ার্ক প্রবলেম থাকে। চিন্তা করোনা।”

বলে রিক অনিমাকে পানি খাইয়ে দিল। ওর নিজেরও প্রচন্ড চিন্তা হচ্ছে। নানারকম খারাপ চিন্তায় ভেতরে ভেতরে কম্পন ওরও ধরছে। কিন্তু এখানে উপস্থিত সবাই ভেঙে পরেছে। এখন বাকি সবার মত ওও যদি ভেঙ্গে পরে তাহলে ব্যাপারটা সামলাতে পারবেনা। রিক চোখের ইশারায় জাবিনকে বলল অনিমাকে সামলাতে। জাবিন আবারও অনিমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল। রিক মিসেস রিমাকেও অনেকক্ষণ বোঝালো যে এতো চিন্তার কিছুই নেই, আদ্রিয়ান চলে আসবে। কিন্তু মায়ের মন কী মানে? প্রচন্ড রকম ছটফট করছেন উনি আর মাঝেমাঝে কেঁদে উঠছেন। এরকম একটা অস্বস্তিকর পরিবেশের মধ্যে দিয়েই তিন ঘন্টা কেটে গেল। বিকেল হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যাও হয়ে যাবে। রিক সারা ড্রয়িংরুমে পায়চারী করে করে ফোন করছে একেক জায়গায়। ওর জানাশোনা এমন কোন জায়গা বাদ নেই যেখানে ও ফোন করেনি। কিন্তু কেউ আদ্রিয়ানের কোনরকম খোঁজ জানেনা। মানিক আবরারও তাই করছেন। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ নেই আদ্রিয়ানের।রিক এতক্ষণ নিজেকে সামলে রাখলেও এবার ওরও ঘাম বেড়োচ্ছে। এভাবে জলজ্যান্ত একটা ছেলে কোথায় যাবে? এরমধ্যে কবির শেখ তিনবার কল দিয়েছিল রিক কে। ওনার নম্বর দেখেই ওর কালকের অনিমার বলা কথাগুলো মনে পরল। কিন্তু এখন আদ্রিয়ানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই রিক একবার রিসিভ করে কথা বলেছিল। বাকি দু-বার রিসিভই করেনি। অনিমা একদম শান্ত হয়ে জাবিনের গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। এখন কাঁদছেনা তবে দৃষ্টি স্হির, জাবিনও নিঃশব্দে মাঝে মাঝে চোখের জল ফেলছে। মিসেস রিমার আগের মতই থেকে থেকে কেঁদে উঠছেন। হঠাৎ করেই মানিক আবরারের ফোন বেজে উঠল। সবাই চমকে তাকাল। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে একটা ভালো খবর শোনার আশায়। মিসেস রিমা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ভাঙা গলায় বলল,

” ফোন লাউডে দাও।”

মানিক আবরার খুশি হয়ে ফোনটা তুলে লাউডে দিলেও, কথা বলার পর সব খুশি মিলিয়ে গেল। ফোনটা অভ্র করেছে। অভ্র এটাই জানালো যে ও জানেনা আদ্রিয়ান কোথায় আছে। গতকাল মাঝরাস্তাতেই অভ্রকে নামিয়ে দিয়ে একটা কাজে পাঠিয়েছিল। সেখান থেকে ও আজ ফিরল। তাই ও কিছুই জানেনা। অভ্রও ব্যাপারটা নিয়ে খুব বেশিই চিন্তায় আছে। এবার আর মাথা ঠিক রাখা সম্ভব হলোনা কারো। অনিমা জাবিনকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলল,

” আমি ওখানে যাবো।”

রিক এগিয়ে এসে বলল,

” কিন্তু তোমার শরীরের অবস্থা এখন..”

অনিমা চিৎকার করে বলল,

” আমি কোন কিন্তু শুনতে চাইনা! আমি যাবো ওখানে। তোমরা যদি আমাকে না নিয়ে যাও আমি একাই বেড়িয়ে যাবো।”

রিক অনিমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে বলল,

” ওকে ফাইন। আমরা সবাই যাবো ওখানে চল।”

মানিক আবরার আর মিসেস রিমাও যাবেন। নিজেদের ছেলের একটা খোঁজ না পাওয়া অবধি শান্তিতে এখানে পারবেন না ওনারা। তাই সকলেই কোনরকম প্রস্তুতি নিয়ে বেড়িয়ে পরলেন।

রাত সাড়ে দশটা বাজে। সোফায় আদিব, আশিস আর অভ্র আছে। পাশের সিঙ্গেল সোফায় তীব্র। অনিমাকে নিয়ে আরেকটা সোফায় জাবিন বসে আছে। পুলিশকেও ইনফর্ম করা হয়েছে। আজ রাতের মধ্যে না ফিরলে কাল থেকে কাজ শুরু করবে। সবার মুখই অন্ধকার। অরুমিতা আর স্নেহা এসছিল কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই যেতে হয়েছে। নাহিদ দেশে নেই। ওর যোগাযোগও করেনি কেউ। এখন সেই মনের অবস্থাও নেই কারো। মিসেস রিমাকে ঔষধ খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানিক আবরারও রুমেই আছেন। দুজনেই ভেঙ্গে পরেছেন। একমাত্র ছেলে ওনাদের। অনেক যত্নে বড় করেছেন। কখনও কোনকাজে বাঁধা দেয়নি। দুজনেরই চোখের মণি ও। আজ যদি ছেলেটার কিছু হয়ে যায় ওনারা বাঁচবেন না। আদিব বলল,

” অভ্র তোমাকে কিচ্ছু বলেনি? কোথাও যাওয়ার কথা, বা কিছু করবে। নাথিং?”

অভ্র হতাশ গলায় বলল,

” না ভাইয়া। স্যার কিচ্ছু বলেনি আমাকে। বললে আমি এতক্ষণ চুপ থাকি?”

সবাই বেশ হতাশ হল। খবরে কিছুক্ষণ চোখ রেখে এবিষয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করে বেশ অনেকরাতে ওরা চলে গেল। অনিমাকে নিয়ে জাবিন ওপরে চলে গেছে। অনেক কষ্টে দুই লোকমা ভাত খাওয়াতে পেরেছে ওকে। রিক ওপরে যেতে নিচ্ছিল তখনই ওর মামা ফোন করল। রিক একটু বিরক্তি নিয়েই ফোনটা রিসিভ করল। ওপাশ থেকে কবির শেখ অতিরিক্ত চিন্তিত সুরে বললেন,

” আদ্রিয়ানের খোঁজ পেয়েছ বাবাই?”

“রিক একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

” পেলেতো জানাতামই মামা।”

” এভাবে কথা বলছ কেন?”

” মামা, এখন মাথা ঠিক নেই। এদিকে পরিস্থিতি ভালো নেই পরে কথা বলব। রাখছি।”

কথাটা বলে রিক ফোন রেখে ওপরে চলে গেল। হঠাৎ করেই প্রাণপ্রিয় মামার ওপর একটা বিতৃষ্ণা জেগে গেছে ওর।

গভীর রাত! হয়তো ঘন্টাখানেক পরেই ভোররাত শুরু হবে। ছাদে রাখা বড় দোলনাটার ওপর পা গুটিয়ে বসে আছে অনিমা। আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাতে আছে। হালকা বাতাসে ওর অগোছালো খোলা চুল হালকা দুলছে। এই দোলানায় বসে আদ্রিয়ান আর ওর বিয়ের প্রথম রাতের কথা ভাবছে। আদ্রিয়ানের ওকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকা। সেসসব ভয়ংকর প্রেমময় বাক্য। যা শুনে অনিমা বরাবরই শিওরে উঠত।

‘এই মুহূর্তে আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? তোমার ঐ তুলতুলে নরম গাল দুটোতে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে। কিন্তু তোমার ভাগ্য অনেক ভালো আজ আমি সেটা করব না। কারণ প্রথমত আজ এমনিতেই তোমার ওপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে। আর দ্বিতীয়ত আজ আমাদের বিয়ের প্রথম রাত। সুতরাং আজ কোন মারামারি না শুধু প্রেম হবে।’

আদ্রিয়ানের বলা কথাটা মনে পরতে হালকা হেসে ফেলল অনিমা। আদ্রিয়ান কোথায় আছে কীভাবে আছে ও কিছুই জানেনা। কোথায় আছে আদ্রিয়ান? ওর কী একবারও মনে পরছেনা ওর মায়াবিনীর কথা? একটুও দেখতে ইচ্ছে করছেনা? বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল। চোখ দিয়ে অবাধ্য অশ্রুগুলো ঝড়ে পরল। ঐসময় ছাদে রিক এল। ওর ধারণাই ঠিক এই মেয়ে ঘুমায় নি। রিক ধীরপায়ে গিয়ে অনিমার কাছে দাঁড়ালো। দোলনায় বসতে গিয়েও বসল না। কিছু একটা ভেবে রেলিং এর ওপর বসল। অনিমা স্হির চাহনী দিল রিকের ওপর। তারপর নিজের চোখ মুছে ফেলল। রিক কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” কিচ্ছু হবেনা আদ্রিয়ানের। ও বলেছে তো চলে আসবে। আর আমি ওকে চিনি। হি নেভার ব্রেকস হিজ প্রমিস। আই থিংক তুমিও সেটা জানো।”

অনিমা শুধু তাকিয়ে রইল রিকের দিকে। রিক একটু হেসে চোখের ইশারায় বোঝাল হ্যাঁ ও সত্যি বলছে। অনিমা মাথা নিচু করে ফেলল। রিক নেমে এসে ওর হাত ধরে বলল,

” এখন নিচে চল। রুমে গিয়ে চুপচাপ ঘুমাবে এখন। আদ্রিয়ান যদি এসে দেখে তুমি অসুস্থ। তোমাকে কিছু বলবেনা ঠিকই, কিন্তু আমাদের হাল বেহাল করে দেবে। বলবে ইডিয়টের দল! আমার বউটাকে দুদিনের জন্যে রেখে গেলাম একটু খেয়ালও রাখতে পারিস নি?”

অনিমা কোন পতিক্রিয়া করল না। শুধু তাকিয়ে রইল রিকের দিকে। রিক অনিমার উত্তরের অপেক্ষা না ধরে ওকে নিচে নিয়ে গেল। অনিমা চুপচাপ রিকের সাথেই গেল। কোনকিছু বলার বা করার ইচ্ছা ওর এখন নেই। রিক প্রেসক্রিপশন দেখে অনিমাকে একপ্রকার জোর করেই ঔষধ খাইয়ে দিয়ে অনিমাকে। এরপর ওকে শুইয়ে দিয়ে ওর পাশেই বসে রইল। অনিমা ক্লান্ত থেকে দ্রুতই ঘুমিয়ে পরল। অনিমাকে ঘুমিয়ে পরতে দেখে রিক উঠে দাঁড়াল। অনিমার মাথায় হাত রেখে বলল,

” প্রেমিক হিসেবে আমি বরাবরই ব্যর্থ। না তোমাকে বুঝতে পেরেছি। না নিজেকে তোমায় বোঝাতে পেরেছি। কিন্তু একজন বন্ধু হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ হতে দেব না। অন্তত আমার জন্যে আর তোমার জীবনে কোন অশান্তি আসবে না।”

তারপর দেওয়ালে বড় করে টানানো আদ্রিয়ানের ছবিটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভালোকরে খেয়াল করে দেখল সারারুমে অনিমার অনেক ছবি টানানো। আদ্রিয়ান আর অনিমার একসাথেও অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি আছে। দেখলেই যেন মনে হয় মেড ফর ইচ আদার। ছবিগুলি দেখে মুচকি হাসল। এরপর দরজা ভিরিয়ে দিয়ে চলে গেল রুম থেকে।

____________

সকাল এগারোটা বাজে। চেঁচামেচির আওয়াজে অনিমা ভ্রু কুচকে অনেক কষ্টে তাকাল। ঘুমে চোখ ভেঙ্গে আসছে। কাল রিক ঔষধের সাথে ঘুমের ঔষধও দিয়েছিল। অনেকরাত করে দেওয়াতে এখন অনেকটাই বেলা হয়ে যাওয়ার পরেও ঘুম ভাঙতে চাইছেনা। কিন্তু এতো আওয়াজ শুনে আর শুয়ে থাকতে পারলোনা। মাথা চেপে ধরে আস্তে আস্তে উঠে বসল। ঘাড় ব্যাথা করছে। ধীরে ধীরে আওয়াজ বেড়েই চলেছে। অনিমা নিচে নেমে এসে দেখে ড্রয়িংরুমে মানুষের ভীড় জমে আছে। মিসেস রিমা কাঁদছেন চিৎকার করে কাঁদছেন, জাবিন ওনাকে সামলাতে সামলাতে নিজেও কাঁদছে। লিমা চৌধুরীও জড়িয়ে ধরে রেখেছে ওনাকে। মানিক আবরার বুকে হাত দিয়ে সোফায় বসে আছেন। রিক, আদিব, আশিস, অভ্র, তীব্র, রাইমা, অরুমিতা, স্নেহা সবাই হতাশ আর গম্ভীর মুখে পরিবেশ সামল দিতে ব্যস্ত। রঞ্জিত চৌধুরী, কবির শেখও আছেন। সদর দরজায় সাংবাদিকরা হৈ চৈ করছে। গার্ডরা আটকে রেখেছে ওনাদের। কয়েকজন সাংবাদিক ভেতরে ঢুকে পরেছে। অনিমা বুঝে উঠতে পারছেনা এখানে কী হয়েছে। এরকম অবস্থা কেন? আদ্রিয়ানের কথা মাথায় আসতেই ওর বুক ছ্যাত করে উঠল। অনিমা হতভম্ব হয়েই নিচে নেমে এল। তখনই ক্যামেরার সামনে একজন সাংবাদিক দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন,

” বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু বিখ্যাত রকস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের। শোকে ডুবে গেছে পুরো পরিবার। শিল্পীর অকাল মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত।”

কথাটা শোনা মাত্র অনিমার ভেতরে যেন বজ্রপাত হল। ও পিছিয়ে যেতেই সবার দৃষ্টি পরল ওর দিকে। অনিমা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুধু। ওকে দেখেই ভেতরে থাকা সাংবাদিকগুলো ছুটে এলো ওর দিকে। এরপর প্রশ্ন শুরু করে দিল। ‘ আপনাদের তো সদ্য বিয়ে হয়েছে। আপনি কী জানেন হঠাৎ উনি কেন ইউএস যাচ্ছিলেন?’ ‘গত পরশু উনি শো করতেও আসেননি, তখন উনি কোথায় ছিলেন সেটা বলতে পারবেন?’ অনিমা কিছুই বলছে না শুধু তাকিয়ে আছে সবার দিকে। কেউকে এদের বাঁধা দেবে সেই অবস্থা কারোর নেই। কী হল? কেন হল? কীকরে হল ও জানেনা। অনিমার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে। ‘বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু বিখ্যাত রকস্টার আদ্রিয়ান আবরার জুহায়েরের।’ আদ্রিয়ান বলেছিল, যেদিন ও থাকবেনা সেদিনই অনিমা ওর মূল্য বুঝতে পারবে। এর আগে না। তবে কী আদ্রিয়ানের সেই অভিমানমিশ্রিত কথা এইজন্যই ছিল? এসব ভেবেই শরীর অবস হয়ে আসছে ওর। দাঁড়িয়ে থাকা হয়তো আর সম্ভব হবেনা। শ্বাস আটকে আসছে। বুকের মধ্যে সব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। মনে হচ্ছে কেউ শ্বাসনালী কেটে দিয়েছে। ওর আদ্রিয়ান আর নেই! আদ্রিয়ান মুখ থেকে ‘জানপাখি’ ডাকটা ও আর শুনতে পাবেনা? কেউ আর ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলবেনা, ‘ভালোবাসি’? ব্যস এইটুকুই যথেষ্ট অনিমার অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়ার জন্যে। সম্পূর্ণ বিলীন।

#চলবে…

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪৫. (বর্ধিতাংশ)

আদ্রিয়ানের মৃত্যুর খবর শুনে অনিমা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেছে। নিজের ভালোবাসার মানুষটির মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার চেয়ে হয়তো মৃত্যু অনেক বেশি শ্রেয়। অনিমার পতিক্রিয়া করার ক্ষমতা নেই এখন। ওর দৃষ্টি স্হির, মন স্তব্ধ, কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু ভীষণ জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে চলেছে।
পুরো বাড়িতেই ভয়ংকর শোকের পরিবেশ। ভোর থেকেই আবার আদ্রিয়ানকে খোঁজার চেষ্টা চলছিল। আর তখনই সামনে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য। বাংলাদেশ টু ইউএস যাওয়ার প্লেন ক্রাশ হয়েছিল। ঐ দুর্ঘটনায় পাইলট, ক্রু, এবং যাত্রীসহ প্লেনের সবাই মারা গেছে। তাই কে কে মারা গেছে সেটা জানতে ঐ প্লেনে কে কে ছিল সেটার খোঁজ নিতে গিয়েই জানা গেছে এই ভয়ংকর সত্যি। ঐ প্লেনে আদ্রিয়ানও ছিল এমনটাই জানা গেছে খোঁজ করে। দেশের একজন তরুণ শিল্পীর এরকম অকাল মৃত্যু! স্বাভাবিকভাবেই সারা দেশে কয়েকঘন্টার মধ্যেই তোলপাড় হয়ে গেছে। খবরটা শুনেই আদ্রিয়ানের গোটা পরিবারের এখন এই অবস্থা। পুলিশ এসে যখন সবটা বলল ওরা কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি। পুরো দুই ঘন্টা লেগেছে ওনাদের সবটা বিশ্বাস করাতে। পুলিশ কোনরকম প্রমাণ ছাড়াই কারো মৃত্যু সংবাদ নিয়ে বাড়িতে আসবে না। তারা কাগজপত্র নিয়েই এসছে। আর সেগুলো বলছে যে আদ্রিয়ান ঐ প্লেনেই ছিলো। সুতরাং এটা বলা ভুল হবেনা যে আদ্রিয়ান মৃত। আদিব, আশিস আর বিশেষ করে অভ্র মিলে এমন কোন যুক্তি বাকি রাখেনি যেটা দিয়ে বলা যায় আদ্রিয়ান বেঁচে আছে। কিন্তু কোন যুক্তিই কাছে আসেনি। রিক তো কোনমতেই কিছুই মানবে না। পুলিশকে পর্যন্ত শাসিয়েছে। এটাও বলেছে যে যদি খবরটা ঠিক না হয় সবগুলোর চাকরি শেষ করে দেবে। ও বারবার কাজগুলো চেক করেছে। এয়ারলাইনসের ওখানে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু সব শেষে যা জানা যাচ্ছে তাতে এটাই প্রমাণ হচ্ছে আদ্রিয়ান ইজ নো মোর! এরপর মানিক আবরার শুধু আহত কন্ঠে একটাই প্রশ্ন করেছিল, ‘আমার ছেলের বডিটা পাবোতো অফিসার?’ কিন্তু সেরকম কোন নিশ্চিয়তাও পুলিশ দিতে পারেনি।

সাংবাদিকরা অনিমার দিকে নিজেদের প্রশ্নবান ছুড়েই যাচ্ছে। কেউ যে ওকে এসে সামলাবে সেই অবস্থাতেই নেই কেউ। সবাই ভেঙ্গে পরেছে। মিস্টার এন্ড মিসেস অাবরারের তো উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। নিজের একমাত্র ছেলেকে হারানোর চেয়ে বড় যন্ত্রণা বাবা-মার আর কিছুতেই হতে পারেনা। জাবিন নিজেই ভেঙ্গে পরেছে। মিসেস লিমা নিজের বোনকে সামলাতে ব্যস্ত। আদিব, আশিস, তীব্র, অভ্র ওরা ফোন সামলাবে, মিডিয়া সামলাবে না-কি নিজেদের? কী ছেড়ে কী সামলাবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ শুধু তামাশা দেখছে। তবে চেহারায় দুঃখী ভাবটা রেখেছেন লোকেদের এটা বোঝাতে যে ওনারাও শোকাহত। অরুমিতা, রাইমা, স্নেহা ওরা চেষ্টা করেও মিডিয়ার জন্যে অনিমার কাছে আসতে পারছেনা।
রিক এগিয়ে এসে সাংবাদিকদের একপ্রকার ঠেলে সরিয়ে অনিমার কাছে গেল। ওকে দুইহাতে ভালোভাবে ধরে রেখে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য বলল,

” দেখুন, এইমুহূর্তে আমাদের অবস্থাটা আপনাদের বোঝা উচিত। আমরা সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আর দুর্ঘটনাটা এই মেয়েটার হাজবেন্ডের সাথে ঘটেছে। তাই আপনাদের মুখরোচক কোন সংবাদ দেওয়ার মত অবস্থা ওর নেই। প্লিজ এক্সকিউস আস।”

বলে ও অনিমাকে ধরে ওখান থেকে নিয়ে এলো।সাংবাদিকরা আপাতত বেড়িয়ে গেল। পুলিশ অফিসার আদিবকে পরে থানায় যোগাযোগ করতে বলে চলে গেলেন। অনিমার এবার হুশ ফিরল। ও রিকের দিকে শান্ত চাহনি দিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল,

” ও-ওরা কী বলছে এ-এসব? আমার আদ্রিয়ান কোথায়?”

রিক অসহায় চোখে তাকাল অনিমার দিকে। কী বলবে? কীভাবে বলবে? কীকরে একজন স্ত্রীকে বলা যায় যে তোমার স্বামী আর এই পৃথিবীতে নেই। সেটাই বুঝতে পারছেনা রিক। এইজন্যই কেউ অনিমাকে ঘুম থেকে তুলতে যাওয়ায় সাহস পায়নি। আর অনিমাও ঘুমের ঔষধের প্রভাবে কিছুই টের পায়নি। ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

” নীলপরী, তুমি বস আগে। আমি…”

রিক আর কিছু বলার আগেই অনিমা রিকের কলার ধরে চেচিয়ে বলে উঠল,

” আমি জিজ্ঞেস করছি কোথায় আমার আদ্রিয়ান?

অনিমার চিৎকারে সবাই তাকাল এদিকে। রিক তাকিয়ে রইল অনিমার মুখের দিকে। এলোমেলো চুল, চোখ আর নাক লাল হয়ে গেছে, ঠোঁট কাঁপছে মেয়েটার। ও এতক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখলেও অনিমার এমন বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে রিকের চোখ টলমল করে উঠল। ও কেঁপে ওঠা কন্ঠে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা। অনিমা রিককে ধাক্কা মেরে ছেড়ে দিয়ে আবার চিৎকার করে বলল,

” ওনারা এসব কী বলল? কোথায় আদ্রিয়ান? বল কোথাও ও? সবাই এভাবে চুপ করে কেন আছো?”

অরুমিতা ওরা এসে অনিমাকে ধরতে গেলে অনিমা দ্রুতই ছাড়িয়ে নিল। তারপর বলল,

” এই তোরাতো বলবি আমাকে তাইনা? আদ্রিয়ান কোথায়? বল না। আদ্রিয়ান কোথায়?”

অরুমিতা, স্নেহা ওরা তিনজনেই কেঁদে ফেলল। কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা। অনিমা ওদের কাছেও উত্তর না পেয়ে মানিক আবরার আর মিসেস রিমার দিকে তাকিয়ে ওনাদের ওরকম অবস্থা দেখে বলল,

” তোমরা কাঁদছো কেন? বাবা, মামনী বলোনা আদ্রিয়ান কোথায় আছে? ওতো বলেছিল চলে আসবে এভাবে কাঁদার কী আছে হ্যাঁ?”

অনিমার এরকম করুণ আহাজারি শুনে মিসেস রিমা আরও জোরে কেঁদে উঠলেন। মানিক আবরার চোখ বন্ধ করে নিলেন। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল ওনার। অনিমা খুব জোরে চিৎকার করে বলল,

” তোমরা কেউ কেন বলছোনা আদ্রিয়ান কোথায় আছে? প্লিজ বলো ওরা যা বলছে সব মিথ্যে। আদ্রিয়ান কোথাও যায়নি। আমি হাত জোর করছি। আমার আদ্রিয়ানকে এনে দাও, প্লিজ।”

কথাটা বলে অনিমা জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করল। রিক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমার কাছে যাওয়ার শক্তি নেই ওর মধ্যে। চোখে টলমল করা জলটুকু গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল শুধু। এরমধ্যে স্নিগ্ধাও চলে এলো। ওর মেডিকেলে এক্সাম ছিল তাই আসতে দেরী হল। কিন্তু এসে অনিমার এমন অবস্থা দেখে ও মানসিকভাবে আহত হল। ও ব্যাগ ফেলে দ্রুত এগিয়ে এসে অনিমাকে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল,

” চুপ! শান্ত হ। কিচ্ছু হয়নি।”

অনিমা স্নিগ্ধাকে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে হাফিয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

” স্নিগ্ধু দেখনা ওরা বলছেই না আদ্রিয়ান কোথায় আছে। ও বলেছিল ও চলে আসবে, ও আসছেনা কেন? ওরা কীসব আজেবাজে কথা বলছে। আমার আদ্রিয়ানের কিছু হয়নি। বোঝানা ওদের!”

বলে অনিমা কান্না করতে করতে বসে পরল। স্নিগ্ধাও বসে পরে অনিমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” এরকম পাগলামো করেনা সোনা। চুপ।”

অনিমার কান্নার মাত্রা বেড়েই চলেছে। পুরো ড্রয়িংরুম জুড়ে ওর চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। উপস্থিত কারো পক্ষেই এই দৃশ্য দেখে ঠিক থাকা সম্ভব না। রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ শুধু একেওপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। হঠাৎ কিছু একটা ভেবে অনিমা রক্তবর্ণ চোখে তাকাল রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখের দিকে। এরপর ঠান্ডা গলায় বলল,

” আদ্রিয়ান কোথাও যায়নি। ওরা কিছু করেছে আমার আদ্রিয়ানের সাথে। ওরাই করেছে। আর এখানে এসে সাধু সাজছে।”

স্নিগ্ধাকে ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে উঠে গিয়ে কবির শেখের কলার চেপে ধরে দাঁড় করাল অনিমা। কবির শেখ থতমত খেয়ে গেছেন। অনিমা তাঁর গলা টিপে ধরে চেচিয়ে বলে উঠল,

” আর কত? আর কত মানুষের জীবন নিয়ে খেলবেন আপনারা? কোথায় রেখেছেন আদ্রিয়ানকে আপনারা। বলুন নয়তো আমি খুন করে ফেলব আপনাকে। বলুন? কোথায় আছে?”

অনিমার হঠাৎ এমন ব্যবহারে সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। সবাই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনেক কষ্ট করে ওকে ছাড়াল। কবির শেখের কাশি উঠে গেছে। রঞ্জিত চৌধুরী ওনাকে ধরে বসিয়ে পানি খাওয়ালেন। রিক অনিমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে কারণ অনিমা বারবার তেড়ে যাচ্ছে ওনাদের দিকে। অনিমা আস্তে আস্তে নেতিয়ে পরল মাথা ব্যথা করছে ওর ভীষণ। ওর শরীর আর দিতে পারলোনা, জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী হাফ ছেড়ে বাঁচলেন।

____________

দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যাও হয়ে যাবে। রঞ্জিত চৌধুরী চলে গেছেন কাজের বাহানা দিয়ে। কবির শেখ এই মাত্র বেড় হলেন। রাতে একবার আসবে বলেছে। মনে যাই থাক বাইরে দিয়ে তো সবার কাছে মামাই। তাই সেভাবেই চলতে হবে। আদিব, অভ্র গেছে পুলিশ স্টেশন। আশিস আর তীব্রও সাথে গেছে। সন্ধ্যার পর অরুমিতা আর স্নেহাকেও চলে যেতে হল। কাল অাবার আসবে ওরা। জাবিন আর রাইমা মিস্টার অার মিসেস আবরারের ঘরে আছে। ওনাদের সামলাচ্ছে। আর অনিমার রুমে রিক আর স্নিগ্ধা বসে আছে।অনিমার জ্ঞান ফেরার পর অার একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। রাতে অনেক কষ্ট করে রিক আর স্নিগ্ধা মিলে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। এরপর ঔষধ খাইয়ে দিয়ে ওকে ঘুমাতে বললে অনিমা অসহায় দৃষ্টিতে রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আমার আদ্রিয়ানকে এনে দাও না। ওর তো এখানে শো করার কথা ছিল ও কেন ইউ এস যাবে বল? পুলিশগুলো সব বানোয়াট কথা বলছে। ওসব মিথ্যা। আমাকে আদ্রিয়ানের কাছে নিয়ে যাও প্লিজ। আমি ওর কাছে যাবো?”

রিক করুন চোখে তাকাল অনিমার দিকে। আজ আবার অনিমা ওকে তুমি সম্বোধন করল। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে। ও আর ওখানে বসতে পারল না। হনহনে পায়ে ব্যালকনিতে চলে গেল। স্নিগ্ধা অনিমাকে শুইয়ে দিয়ে রিকের পেছনে গেল। গিয়েছে দেখে রিক আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর চোখে জল। স্নিগ্ধা ওর কাঁধে হাত রাখতেই রিক বলল,

” আদ্রিয়ান কী সত্যিই ফিরতে পারেনা? বিশ্বাস কর আমি আমার নীলপরীকে এভাবে দেখতে পারবনা। ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরকম হলে ওকে বাঁচানো যাবেনা।”

স্নিগ্ধা কিছু বলল না। কী বলবে? আপাতত বলার মত আর কিছুই বাকি নেই।

অনিমা শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। আদ্রিয়ানের কথাগুলো কানে বাজছে ওর, ‘ আমার দিকে তাকানোর সময়টাও তোমার নেই। আর এদিকে তোমার একটু কাছে থাকার জন্যে আমি ছটফট করি আর তুমি শুধু দূরে থাকার বাহানা খুঁজে বেড়াও।’ ‘ হাত বাড়ালেই তো পেয়ে যাচ্ছো আমাকে। যেদিন তোমার সাথে থাকবনা, হারিয়ে যাব সেদিন বুঝতে পারবে।’ ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব হুম? মৃত্যুছাড়া আমাদের আলাদা করার ক্ষমতা কারোর নেই।’ অনিমা ডুকরে কেঁদে উঠল। ওর চিৎকার করে কেঁদে বলতে ইচ্ছে করছে। ফিরে আসুন না আদ্রিয়ান। আপনার জানপাখি কাঁদছে। আপনি শুনতে পাচ্ছেন না? প্লিজ ফিরে আসুন।

আরও একটা বিষাক্ত রাত পার হয়ে সকাল হল।সরারাতে কেউই নিজেদের চোখের পাতা এক করতে পারেনি। অনিমা কারো সাথে কথা বলেনি। শুধু রোবটের মত একটা কথাই বলেছে মাঝেমাঝে যে, ওর আদ্রিয়ান কোথাও যায়নি। যেতে পারেনা। সকালবেলায় পুলিশ স্টেশনে ডাক পরেছে ওদের। সেটা শুনে সবার আগে অনিমা ছুটে বেড়িয়ে এসছে। ও যাবেই। সবাই জানে ওকে আজ আটকানো যাবেনা তাই চেষ্টাও করেনি। পুলিশ স্টেশনে ভোরবেলাতেই রিক, আদিব, অভ্র, আশিস, তীব্র আবার চলে গেছে। অনিমারা সাড়ে দশটায় গেল ওখানে। গিয়ে দেখে রিক, আদিব, অভ্র ওরা সবাই মুখ ভয়ংকর গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা যাওয়ার পর পুলিশ জানালো যে ঐ প্লেনে আদ্রিয়ান ওঠেইনি। হ্যাঁ টিকিট কেটেছিল, এয়ারপোর্টেও নাকি এসছিল, সব ফরমালিটি করেছিল এই অবধি সত্যি। কিন্তু লাস্ট মুমেন্টে কিছু একটা হয়েছিল যার ফলে ওকে ফিরে আসতে হয়েছে। গভীরভাবে ভেতরকার তথ্য নিয়ে এটাই জানা গেছে। সকলের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অনিমা বলল,

” দেখেছ? আমি তোমাদের বলেছিলাম! উনি যাননি কোথাও। আমার আদ্রিয়ানের কিছুই হয়নি। হতেই পারেনা।

মানিক আবরার বলল,

“তারমানে আদ্রিয়ান সেফ আছে। তাইতো?”

অফিসার গম্ভীর স্বরে বললেন,

” উনি প্লেনে উঠতে পারেননি তার কারণ আছে।”

এবার অনিমা আটকে যাওয়া কন্ঠে বলল,

” ক-কী কারণ?”

কথাটা বলতেই রিক অনিমার হাত ধরল। অনিমা অবাক হয়ে তাকাল রিকের দিকে। রিক গম্ভীর মুখে তাকাল শুধু কিছু বলতে পারল না। অনিমার হাত ধরে নিয়ে গেল। পুলিশ আর বাকিরা সবাই সাথে আসছে। অনিমা রিকের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আর হাটছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে ওর পা থেমে গেল। মর্গে কেন নিয়ে এলো রিক ওকে? এখানে ওদের কী কাজ? অনিমাকে থেমে যেতে দেখে রিক আবারও টেনে ধরে ওকে নিয়ে হাটা দিল। মর্গের ভেতরে গিয়ে রিকের ইশারা মত তাকিয়ে অনিমা যা দেখল তাতে ওর দুনিয়া ওলটপালট হয়ে গেল। ও শক্ত হয়ে জমে গেল মুহূর্তেই। এটা অসম্ভব। হতেই পারেনা। এতদিন ওর মনে হচ্ছিল ও ঘোরে আছে কিন্তু এখন ওর বিশ্বাস নিশ্চয়ই কোন স্বপ্ন দেখছে। এটা বাস্তব হতেই পারেনা। ওর চোখ যা দেখছে তা সম্ভব না। কক্ষণো না। ও খেয়াল করল ও নিশ্বাস নিতে পারছেনা, চোখে ঝাপসা দেখছে সবকিছু, মাথা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। ও গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। অনেক গভীর।

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে