বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৪২+৪৩

0
1601

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪২.

আদ্রিয়ানের দৃষ্টি বেশ শান্ত। ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিছু শুনেছে কি-না। অনিমা অনেকটা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান কিছু শোনেনিতো? ভুল ভাবেনিতো কিছু? ও তো বলতেই চেয়েছিল সব আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ানই কিছু শুনতে চায়নি। উল্টে রেগে গেছিল। কী করতো ও? এদিকে রিক ভয় না পেলেও আদ্রিয়ানের উপস্থিতিতে অস্বস্তিতে পরেছে। ও চায়না আদ্রিয়ানকে কষ্ট দিতে। আবার অনিকেও ওর সাথে সহ্য করতে পারছেনা। প্রচন্ড টানাপোড়েনের মধ্যে অাছে। ইতস্তত করে একবার অনিমা আরেকবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

” কী হল? দুজনেই মিউট হয়ে গেলি কেন?”

রিক মুখে জোরপূর্বক একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,

” আসলে অনিমা জাবিনের রুমে শুতে যাচ্ছিল, আমিও আমার রুমে যাচ্ছিলাম। এখানে দেখা হল দুজনের তাই একটু কথা বলছিলাম।”

কথাটা শুনে আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকাল। অনিমা চোখ নামিয়ে নিল। আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কথা বলা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই? আর এখন রাতও হয়েছে অনেক। অনি আমার রুমে এসো একটু।”

কথাটা বলে অনিমার হাত ধরে রিকের দিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

” গুড নাইট।”

রিক মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,

” গুড নাইট।”

আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে অনিমার হাত ধরে ওর রুমে নিয়ে গেল। রিক শুধু শক্ত চোখে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আদ্রিয়ান অনিমাকে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে, এরপর গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। অনিমা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দরজা লাগাচ্ছে কেন? আর ওকেই বা কেন আনল? দরজা লাগিয়ে আদ্রিয়ান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল অনিমার দিকে। অনিমা বেশ ভয় পাচ্ছে। একটু আগের ঘটনাটা নিয়ে আদ্রিয়ান ওকে কিছু বলবে না তো। আদ্রিয়ান দৃষ্টি দেখে অনিমা মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রিয়ান যত এগিয়ে আসছে অনিমা তত শক্ত করে বিছানার চাদর খামচে ধরছে। ওর খুব ভয় লাগছে যে আদ্রিয়ান কী না কী করে বসে। এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই। কিন্তু অনিমাকে অবাক করে দিয়ে আদ্রিয়ান ঝট করে অনিমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল। অনিমা হকচকিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থেকে বলল,

” এটা কী হল?”

আদ্রিয়ান মাথা ঘুরিয়ে অনিমার দিকে ঘুরে বলল,

” কিছু হয়নি তবে হবে, ঘুম। একটা সাউন্ড স্লিপ চাই জানপাখি। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।”

” আপনি এইজন্য আমাকে নিয়ে এসছেন?”

” হ্যাঁ, তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুম ভালো হবে। আর কথা বলোনা, এবার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও প্লিজ!”

অনিমা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

” কিন্তু জাবিন রুমের দরজা খুলে আমার জন্যে ওয়েট করছে তো!”

আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ রেখ বলল,

“আমি ঘুমিয়ে পরলে তুমি জাবিনের রুমে চলে যেও।”

” আচ্ছা নাহিদ ভাইয়া কোথায়? এখানে তো এলোনা?”

” ও একটু কাজে আটকে আছে। এদিকে আসতে পারবেনা।”

অনিমা আর কিছু না বলে আদ্রিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। আদ্রিয়ানও ভদ্র ছেলের মত চোখ বন্ধ করে রইল। আজ আর কোন দুষ্টুমি করল না। অনিমার রিকের বলা কথাগুলো মনে পরছে শুধু। রিক কী বলল তখন? রিক ওকে ভালোবাসে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব এটা? সব এরকম এলোমেলো লাগছে কেন? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আদ্রিয়ানের মুখের দিকে চোখ পরল ওর। চোখ বন্ধ করে রাখা অবস্থায় বেশ ইনোসেন্ট লাগছে আদ্রিয়ানকে। অনিমা বেশ অনেকক্ষণ আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল।

____________

রঞ্জিত চৌধুরী নিজের ক্যাবিনে বসে সামনে রাখা গ্লোবটা ঘোরাচ্ছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে কিছু একটা। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে কবির শেখ ঢুকতে ঢুকতে বলল,

” কী ব্যাপার! আজ এতো সকাল সকাল তলফ করলেন যে? কোন দরকার ছিল?”

কথাটা বলে চেয়ার টেনে বসলেন উনি। রঞ্জিত চৌধুরী গ্লোব থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ! রিক মানিকের বাড়িতে গেছে জানো তো?”

” হ্যাঁ শুনেছি!”

” তোমার কী মনে হয়? কী করবে ও?”

” কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ছেলেটা যদি আদ্রিয়ান না হয়ে অন্যকেউ হতো। তাহলে রিককে আমি আমার মত চালাতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটাই যে ওটা আদ্রিয়ান। তাই আমি এবিষয়ে ওকে বেশি উস্কাতে গেলে আমায় সন্দেহ করত। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হতো না। তাই আমি ওকে যেটুকু যা উস্কেছি কাজ হলে তাতেই হবে। আর যদি কাজ না হয় তাহলে এবিষয়ে আমাদের আর কিছু করার নেই।”

রঞ্জিত চৌধুরী হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

” এতো ঝামেলা আর ভালো লাগছেনা। একেতো এই ঝামেলা, তারওপর অনেক খোঁজ লাগিয়েও এখনও বুঝে উঠতে পারছিনা আমাদের অজান্তেই এভাবে আমাদের সব প্লান ভেস্তে কে দিচ্ছে?”

” হ্যাঁ! অনিমাকে যখন পাচার করা হচ্ছিল সেই মুহূর্তেই গ্যাংটা ধরা পরা, তখনই পুলিশ চলে আসা, ঐ বুড়ি মাদারের এভাবে ভ্যানিস হয়ে যাওয়া, আর এর আগে যেসব বাঁশ দিয়েছে সেসব বাদই দিলাম। আচ্ছা! অনিমা আদ্রিয়ানের কাছে আছে। আদ্রিয়ানই বিয়ে করল ওকে। কোনভাবে আদ্রিয়ান এসব করছে না তো?”

রঞ্জিত চৌধুরী তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিয়ে বললেন,

” আরে দূর! আর মানুষ পেলেনা? দু-বেলা গিটার নিয়ে টুংটাং করে বেড়ায়। গান গেয়ে একটু নাম ডাক করেছে। ওর দ্বারা এতো জটিল কাজ সম্ভব না-কি? আর তাছাড়াও এদেরতো অনেক ব্যস্ততা থাকে এতো জটিল কাজে যুক্ত হওয়ার সময় কোথায়? এটা কী সিনেমা না-কি?”

কবির শেখ দুই হাত একত্রিত করে তারওপর থুতনি রেখে বলল,

” সবকিছু এতো হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়। যে গিটারে টুংটাং করতে পারে সে বন্দুকের ট্রিগারও টানতে পারে। আর ওতো কেবল রকস্টার। বাস্তবেও আরও বড় বড় প্রফেশনে থাকা মানুষও এসবে যুক্ত থাকে। শুধু সাধারণ চোখে পরেনা। টাকার জোরে নিজেদের আড়ালে রাখে। পৃথিবী এতোটাও সহজ নয়। সেটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে?”

” হ্যাঁ ভুলকিছু বলোনি। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? অনিমা যদি আদ্রিয়ানকে আমাদের ব্যাপারে বলে দেয় তখন?”

” চিন্তা করোনা। বলবেনা। কারণ ও নিজেও নিশ্চিতভাবে কিছুই জানেনা। যেটুকু জানে অনুমান মাত্র। আর যেটুকু নিশ্চিতভাবে জানে সেটুকুতে আমাদের বড় কয়েকটা মাথা ফেঁসে গেলেও আমরা ফাঁসব না। তাই আপাতত বাবাই যা করছে করতে দাও। এখন এটা জানা বেশি জরুরি যে হঠাৎ আমাদের পেছনে লাগলোটা কে? বা কারা? আর কেন?”

____________

বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে করা ফুলের বাগানটা বেশ সুন্দর লাগে দেখতে। বিভিন্ন রকমের ফুল ফুটে বাগান জুড়ে। বোঝাই যায় খুব সুন্দরভাবে পরিচর্যা করা হয় এই বাগানের। এই আবরার মেনশনের মানুষগুলো সবাই যে কত শৌখিন তার পরিচয় এই বাড়ির প্রতিটা গাছ, মাটি, প্রতিটা ইট বহন করে চলেছে। আজ জাবিন নিজেই গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। ও বাড়িতে থাকলে মাঝেমাঝেই এটা করে। ওর খুব ভালোলাগে বাগানের যত্ন নিতে। কেমন একটা ‘আমার বাগান’ ‘আমার বাগান’ ফিল আসে। এই নিয়ে আদ্রিয়ানকের সাথে ছোটবেলায় ঝগড়াও করত অনেক। আদ্রিয়ান বলত বাগানটা ওর, আর জাবিন বলত ওর। শুরু হয়ে যেত দুই ভাই-বোনের ঝগড়া। সে কী ঝগড়া! গাছে পানি দিতে দিতে এসব ভেবে আনমনেই হাসল জাবিন। হঠাৎ ওর চোখ পরল অভ্রর দিকে। অভ্র হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে এদিকেই আসছে। ও একটু গলা ঝেড়ে চুল-টুল সেট করে গাছে পানি দেওয়ায় মন দিল। ওর মনে হল অভ্র হয়ত ‘গুড মর্নিং’ বা কিছু একটা বলবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অভ্র পাশ কাটিয়ে চলে গেল। জাবিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কোন ব্যবহার হল? প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর। না, ব্যাপারটা আর সহ্য করা জায়না। ও এবার চেচিয়ে বলল,

” ও হ্যালো?”

হয়তো গান স্লো বাজছিল তাই অভ্র শুনতে পেল। পেছন ঘুরে তাকিয়ে হেডফোন নামিয়ে নিয়ে বলল,

” কিছু বলবে?”

জাবিন রেগে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” নিজেকে কী মনে করেন অাপনি? প্রেসিডেন্ট টাইপ কিছু? এতো ভাব কীসের হ্যাঁ?”

অভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,

” সরি?”

” সরি মাই ফুট! সবসময় আশেপাশ দিয়ে গেলে এমন ভাব করেন যেন চেনেনই না। এতো মুড কীসের? নিজেকে খুব স্পেশাল কিছু ভাবেন? একটু কথা বললে কী হয়?”

জাবিনের এসব কথায় বোকা বনে গেল অভ্র। বোকার মতই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” আমি কিছুই বুঝলাম না।”

জাবিনের মাথায় এবার আগুন জ্বলছে। ও পানির পাইপটা সোজা অভ্রর দিকে দিয়ে ওকে পুরো ভিজিয়ে দিল। তারপর পাইপটা ছুড়ে ফেলে বলল,

” বুঝবেনও না, ডাফার।”

বলে হনহনে পায়ে চলে গেল। অভ্র অবাক হয়ে একবার নিজের ভেজা শরীরের দিকে একবার জাবিনের যাওয়ার দিকে তাকাল। কী হলো কিছুই বুঝলোনা। গোটা ব্যাপারটাই ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল ওর।

___________

আবরার মেনশনে ওরা এসছে দুদিন হয়ে গেল। এরমধ্যে অনিমা আর আদ্রিয়ানের কাছেও যেতে পারেনি। আসলে সারাদিনই ব্যস্ত থাকে। মিসেস রিমার সাথে পুরোটা সময়ই রান্নাঘরে থাকে, আবার কখনও মানিক আবরারের সাথে গল্প করে, জাবিনের সাথে আড্ডা দেওয়া। বাকি সময়টা পারিবারিক আড্ডা। তবে রিকের কাজ থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে ও। যদিও রিক আবার একবার ওরকম ব্যবহার করেছিল ওর সাথে কিন্তু অনিমা চলে এসছে নিজেকে সামলে। এতকিছুর মধ্যে আর আদ্রিয়ান পাচ্ছেনা ওকে। বেশ মেজাজ খারাপ হয়ে আছে ওর এইজন্য। সবার সামনে অনিমাকে ডাকতেও পারেনা। কিন্তু অনিমাও সবসময় কারো না কারো সাথেই আছে। তাই অনিমার ওপরও বেশ রাগ হচ্ছে ওর।

রাতে খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর পর বাকি কাজ সেড়ে অনিমা শোয়ার জন্যে জাবিনের রুমের দরজার কাছেই এসছে সবে। হঠাৎ কেউ ওকে কোলে তুলে নিল। অনিমা হকচকিয়ে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলে উঠল,

” একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবেনা। অনেক জ্বালিয়েছ এবার চুপচাপ থাকো।”

বলে ওকে কোলে নিয়েই হাটা শুরু করল। অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের। আজব তো! ও আবার কী করল? এভাবে রেগে আছে কেন? এই লোকটাকে মাঝেমাঝে ও মজা করে পাগল বলে। কিন্তু ওর এখন মনে হচ্ছে সত্যিই এই লোকের মাথার কয়েকটা ছেড়া। নইলে হুটহাট এমন অদ্ভুত আচরণ করে কেউ?

#চলবে….

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪৩.

আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে করে নিয়ে এসে সোজা বিছানায় বসিয়ে দিল। অনিমা বোকার মত তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। হুট করে এতো রাতে এভাবে তুলে নিয়ে আসার মানে কী? আদ্রিয়ান অনিমার দিকে ঝুকে একটু শক্ত কন্ঠে বলল,

” একদম নরবেনা। ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকো!”

অনিমাও ভদ্র মেয়ের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। কারণ দেখেই মনে হচ্ছে এই ছেলে রেগে আছে। পাগল খেপানোটা ঠিক হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রাগল কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই অনিমা তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার ওর দিকেই আসছে। অনিমা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আর বোঝার চেষ্টা করছে যে কী হচ্ছে। আদ্রিয়ন অনিমা পাশে বসে খাটের দিকে হেলান দিয়ে তাকাল অনিমার দিকে। অনিমা এখনও আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ও ঠিক কী করতে চাইছে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে। কিছু একটা করেছে ও কিন্তু সেটা কী? আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই ওর হাত ধরে একটানে নিজের বুকের ওপর এনে ফেলল। অনিমা চোখ বড়বড় করে করে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। ওর দুই হাত আদ্রিয়ানের বুকের ওপর। এরকম আচমকা আক্রমণ আশা করেনি ও। ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সরে আসতে চাইলে আদ্রিয়ান ওর কোমর চেপে ধরে ওকে কাছে টেনে আনল। আদ্রিয়ানের চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অনিমা শুকনো একটা ঢোক গিলল। আদ্রিয়ান অনিমার চোখে চোখ রেখে শক্ত কন্ঠে বলল,

” দূরে যাচ্ছো কেন? আমি কাছে থাকলে ভালোলাগেনা? দুনিয়াতে সবার জন্যে তোমার সময় আছে। তোমার বন্ধুদের জন্যে আছে, আমার বাবা-মায়ের জন্যে আছে, আমার বোনে ইভেন অভ্রর জন্যেও তোমার কাছে সময় আছে। শুধু আমার জন্যে নেই। মানে, আমার দিকে তাকানোর সময়টাও তোমার নেই। আর এদিকে তোমার একটু কাছে থাকার জন্যে আমি ছটফট করি আর তুমি শুধু দূরে বাহানা খুঁজে বেড়াও।”

অনিমা মুখ কাচুমাচু করে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল,

” আমার কী দোষ। বাড়িতে সবাই আছে। সবার সাথে কথা বলতে হয়। এরপর মামনীকে রান্নায় হেল্প করা, বাবাকে চা দেওয়া, জাবি…”

অনিমাকে থামিয়ে দিয়ে আদ্রিয়ান ঝাঝালো কন্ঠে বলল,

” হ্যাঁ সেটাইতো বললাম। সবাই তোমার কাছে ইম্পর্টেন্ট শুধু আমি বাদে। আমার প্রতি তোমার কোন রেসপন্সিব্লিটি নেই, কোন হোপও নেই। বিয়েটাও তো আমি তোমাকে একপ্রকার জোর করেই করেছিলাম রাইট? সো এটাই এসপেক্টেড।”

বলে অনিমাকে একপ্রকার ঠেলেই নিজের থেকে সরিয়ে দিল। অনিমা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। অসহায় গলায় বলল,

” আপনি সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এভাবে কথা বলছেন কেন?”

আদ্রিয়ান তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিয়ে বলল,

” সামান্য? হ্যাঁ তোমার কাছেতো আমার সবকিছুই সামান্য। এখন কাছে আছি। সবসময় তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করছি। তাই সবই সামান্য মনে হচ্ছে। হাত বাড়ালেই তো পেয়ে যাচ্ছো আমাকে। যেদিন তোমার সাথে থাকবনা, হারিয়ে যাব সেদিন বুঝতে পারবে।”

অনিমা চমকে উঠল আদ্রিয়ানের কথা শুনে। অবাক কন্ঠে বলল,

” কী বলছেন অাপনি এসব?'”

আদ্রিয়ান হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

” তোমার তাতে আর কী যায় আসে বল? সবাই আছে তো! এদের সাথে থেকে ভুলেই যাবে আদ্রিয়ান নামক কেউ তোমার জীবনে ছিল।”

কথাটা বলে আদ্রিয়ান হেটে ব্যালকনিতে চলে গেল। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে মাঝারি গতিতে। বাজ পরছে না আজ। অনিমা ঠায় বসে আছে ওখানে। আদ্রিয়ান যে ওর ওপর অভিমান করেছে বেশ বুঝতে পারছে। ওতো বুঝতে পারেনি আদ্রিয়ান এতোটা কষ্ট পাবে। ওকে একটু বুঝিয়ে বললেও তো হতো। এভাবে কথা বলে কেউ? অাদ্রিয়ান রেলিং ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির ঝাপটায় হালকা ভিজে যাচ্ছে ও। কিন্তু তাতে ওর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। কিছুক্ষণ পর অনিমা এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল আদ্রিয়ানকে। প্রথমবার আদ্রিয়ান ছাড়াতে চাইলে অনিমা আরও শক্ত করে ধরে রাখল। আদ্রিয়ান কোন রিঅ্যাক্ট করল না। অনিমা আস্যে করে বলল,

” সরি।”

আদ্রিয়ান তবুও কিছু বললনা। একটুপর আদ্রিয়ান খেয়াল করল যে অনিমা কাঁদছে। সেটা দেখে আদ্রিয়ান চমকে উঠল। দ্রুত অনিমাকে ছাড়িয়ে ঘুরে তাকাল অনিমার দিকে। অনিমা মাথা নিচু করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আদ্রিয়ান অনিমার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে ধরে বলল,

” এভাবে কাঁদছো কেন?”

অনিমা নাক টানতে টানতে ভাঙা গলায় বলল,

” আপনি কীকরে বললেন যে আমি আপনাকে ভুলে যাবো? এতোটা স্বার্থপর ভাবেন আমাকে?”

আদ্রিয়ান সযত্নে অনিমার চোখের জল মুছে দিয়ে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল,

” সত্যিই ভুলবেনা?”

” আপনি এসব থাকব না, হারিয়ে যাবো এসব কথা বলবেন না। আমার ভালোলাগে না।”

” আচ্ছা বাবা বলবনা। কান্না করোনা প্লিজ।”

অনিমা কিচ্ছু না বলে আদ্রিয়ানের বুকের সাথে একদম মিশে রইল। আদ্রিয়ানও আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অনিমাকে। বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির ঝাপটায় দুজনেই অনেকটা ভিজে গেছে। বেশ অনেকটা সমো এভাবেই কেটে গেল। আদ্রিয়ান বলল,

” কাল আমায় ফিরতে হবে। কিছু ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে। স্টেজ শো আর রেকর্ডিং ও আছে। সো আই হ্যাভ টু গো!”

অনিমা অবাক হয়ে আদ্রিয়ানকে ছেড়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” কালকেই?”

” হুম।”

” আর আমি?”

আদ্রিয়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,

” বাবা-মা তোমাকে এখন ছাড়বেনা। আমি পরে তোমাকে নিয়ে যাবো।”

” হুম।”

বলে অনিমা মাথা নিচু করে ফেলল। অনিমার যে মন খারাপ হয়ে গেছে সেটা আদ্রিয়ান বুঝতে পারছে। তাই কোমর ধরে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

” আরে কয়েকটা দিন তো। এখানে তো সবাই আছে। সারাদিন এমনিই কেটে যাবে। রাতেতো আমি আছিই ফোন করার জন্যে।”

অনিমা মাথায় তুলে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার নাক টেনে দিয়ে বলল,

” এবার মিষ্টি হাসিটা একটু দেখাও। মনটা শান্ত করি! আমার কিউট বউটার সুইট হাসি না দেখলে আমার দিনই কাটেনা।”

অনিমা একটু হেসে মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রিয়ান অনিমার কপালে চুমু দিয়ে বলল?

” দ্যাটস লাইক মাই লেডি।”

অনিমা বেশ লজ্জা পেল। মাথা তুলে তাকাচ্ছেনা আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান অনিমার অনিমার কানের কাছে মুখ এনে বলল,

” এভাবে লজ্জা পেওনা লজ্জাবতী। নিজেকে সামলে রাখতে ভীষণ অসুবিধা হয়।”

অনিমা হেসে দিয়ে আদ্রিয়ানের বুকে একটা কিল মেরে টিশার্ট খামচে ধরে আদ্রিয়ানের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলল। আদ্রিয়ানও নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল অনিমাকে যেন আজ ছেড়ে দিলে আর কখনও ধরতে পারবেনা।

______________

সকালবেলা অনিমা সবার জন্যে কফি করে একে একে সবাইকে দিচ্ছে। আদ্রিয়ান এখনো নামেনি। সবাইকে কফি দিয়ে আদ্রিয়ান ডাকতে যাবে। অনিমা দেখল রিক সদর দরজার দিকে দাঁড়িয়ে আছে। অনিমার একদমই ইচ্ছে করছেনা রিকের কাছে গিয়ে এখন ওকে কফি দিতে। কিন্তু আপাতত ওকেই দিতে হবে কিছু করার নেই। ও রিকের কাছে গিয়ে বলল,

” আপনার কফি।”

রিক কফিটা হাতে নিয়ে বলল,

” একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

অনিমা ভ্রু কুচকে ফেলে বলল,

” কী কথা?”

” আদ্রিয়ান আর তোমার মধ্যে কী সব ঠিক আছে?”

” ঠিক না থাকার তো কিছু নেই?”

রিক ইতস্তত করে বলল,

” না মানে, তোমরা এখনও একরুমে থাকোনা তাই___”

অনিমা রাগী কন্ঠে বলে উঠল,

” সেটা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার। আপনাকে এ বিষয় কোনরকম এক্সপ্লিনেশন দিতে আমি বাধ্য নই। আপনার সেই অধিকারও নেই।”

রিক স্হির দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” একসময় তুমি আমাকে নিজের বেস্টফ্রেন্ড বলতে। আর আজ বলছ অধিকার নেই?”

অনিমা আহত গলায় বলল,

” আমার সেই সম্বোধনের মর্যাদা আপনি রাখতে পারেননি মিস্টার চৌধুরী। যারা আগাগোড়া সবটাই মিথ্যে দিয়ে ভরা। সে আর যাই হোক বন্ধু হতে পারেনা।”

কথাটা বলে অনিমা আর দাঁড়াল না ওখানে। রিক অনিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গরম কফি মগটার ওপর দিয়ে নিজের হাত চেপে ধরল। রাগ, অভিমান, কষ্টের মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে ওর মধ্যে। কী হয়েছিল, কী হচ্ছে, কিছুই জানেনা ও। হ্যাঁ ও অনিমার সাথে মিসবিহেভ করেছে কিছুদিন। কিন্তু সেটাতো পরে। অনিমার হঠাৎ বদল ও মানতে পারেনি তাই। কিন্তু অনিমা এমন একটা ভাবে কথা বলছে যাতে করে মনে হচ্ছে বিশাল কোন পাপ করে ফেলেছে। এগুলো কী অনিমার কোন নাটক ওকে ইগনোর করার জন্যে। না-কি এমন কিছু আছে যা ও জানেনা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আদ্রিয়ান নিচে নেমে এলো। একবার ফ্রেশট্রেশ হয়েই নিচে এসছে। অনিমা কফি নিয়ে গেছিল ওপরে। ওপর থেকে কফি খেয়েই এসছে। এখন একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে সবাই। ব্রেকফাস্ট টেবিলে মানিক আবরার বললেন,

” আদ্রিয়ান কখন বেড় হচ্ছো তুমি?”

আদ্রিয়ান খাবার চিবুতে চিবুতে বলল,

” এগারোটার নাগাদ বেড় হয়ে যাবো বাবা।”

আদ্রিয়ানের যাওয়ার কথা শুনে অনিমার মন আবার খারাপ হয়ে গেল। মিসেস রিমা মুখ গোমড়া করে বলল,

” কদিন হল এলি? এখনই আবার যেতে হবে। কী এতো কাজ সত্যিই বুঝিনা। অনি কিন্তু এখানেই থাকছে আপাতত। ছুটি শেষ হওয়ার আগে নেওয়ার কথা ভুলেও ভাববি না।”

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,

” জানি আমি সেটা। তোমাদের আদরের ব‍ৌমাকে সেজন্যই রেখে যাচ্ছি।”

জাবিন আড়চোখে একবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

” তো তুই কী একাই যাবি?”

আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

” আমি আর অভ্র যাবো। আমি গেলে ওও আর থাকবে কেন?”

জাবিন আর কিছু বলল না খাওয়ায় মনোযোগ দিল। অভ্র জাবিনের দিকে কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে থেকে নিজেও খেতে লাগল। রিক কিছুই বলছেনা চুপচাপ খাচ্ছে শুধু।

আদ্রিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে আর অনিমা গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। শেষে টিশার্টের ওপর দিকে জ্যাকেটটা পরিয়ে দিল অনিমা আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ান অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অনিমা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান নরম কন্ঠে বলল,

” জানপাখি।”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে ছলছলে চোখে তাকাল। আদ্রিয়ান ওর দুই বাহুতে হাত রেখে বলল,

” যাওয়ার সময় একদম কাঁদবে না। চলে আসব তো। আর এখানেতো তুমি একা নও! সবাই আছে তোমার সাথে।”

অনিমা অসহায়ভাবে কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,

” তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন তো?”

আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

” আরে পাগলি জাস্ট তিন থেকে চারদিনের কাজ। তাছাড়াও আসতেতো হবেই। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব হুম? মৃত্যুছাড়া আমাদের আলাদা করার ক্ষমতা কারোর নেই।”

অনিমা সাথেসাথেই জড়িয়ে ধরল আদ্রিয়ানকে। নিঃশব্দে চোখে জল ফেলছে ও। ইচ্ছে করছে লোকটাকে ধরে বেঁধে রেখে দিতে। আদ্রিয়ানও আলতো হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু দিল।

নিচে গিয়ে সবার কাজ থেকে বিদায় নিল আদ্রিয়ান। রিকের কাছে গিয়ে বলল,

” থাক, আসছি আমি।”

রিক মুচকি হেসে বলল,

” তাড়াতাড়ি চলে আসিস।”

আদ্রিয়ান যাওয়ার সময় অনিমার ইচ্ছে করছিল আরেকবার আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু সবার সামনে আর সম্ভব হয়নি। শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে ছিল ওর যাওয়ার দিকে। আর বুক চিড়ে বেড়িয়ে এসছিল দীর্ঘশ্বাস।

#চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি।হ্যাপি রিডিং। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে