বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব-৪৬+৪৭

0
1539

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪৬.

মানুষের জীবনে হঠাৎ এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় যার জন্যে মানুষ আগে থেকে প্রস্তুত থাকেনা। নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকেও তখন আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করেনা। নিজের ওপরই জন্ম নেয় চরম অবিশ্বাস। সেটা নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষের চলে যাওয়া হোক বা নিজের কোন কাছের মানুষের একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ফিরে আসা হোক। মর্গের ভেতরে ঢুকে ওর চোখ সামনে পরতেই হাসান কোতয়ালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে অনিমা। প্রায় পাঁচ বছর আগেই যার মৃত্যু হয়েছে সেই মানুষটাকে নিজের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যে কেউ চরমভাবে অবাক হবে। আর সেটা যদি হয় নিজের বাবা, তাহলে মনের অবস্থা কীরকম হয় সেটা কল্পনা করাটাও দুঃসাধ্য। অনিমাও তখন এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি। নিজের চোখের সামনে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখার পর আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হয়নি ওর পক্ষে। চোখ ঝাপসা হওয়ার সাথেসাথেই শরীরটাও ছেড়ে দিল। অনিমা পরে যেতে নিলেই সাথে সাথে একজোড়া হাত ওকে ধরে ফেলল। অনিমা পুরোপুরি নিজের জ্ঞানে নেই। কিন্তু অতি পরিচিত সেই স্মেল পেয়ে অনিমা কেঁপে উঠল। ও চোখ তুলে সামনে তাকালে ওর চোখ স্হির হয়ে গেল। আদ্রিয়ান ওকে পরম যত্নে দুইহাতে আগলে রেখেছে। ওর আদ্রিয়ান বেঁচে আছে? কিচ্ছু হয়নি তাঁর। সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিয়ান ওর সামনে। অনিমার কাছে এখন সবটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কেমন যেন সব ঘোরের মত। যা দেখতে পাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছেনা। কিছুক্ষণ আগে নিজের বাবাকে দেখতে পেল আর এখন ও নিজের স্বামীর বুকে আছে। অথচ দুজনেই পৃথিবীর চোখে মৃত। এটা তাহলে ভ্রম ছাড়া আর কী? ভ্রম হোক আর যাই হোক মানুষটাকে দেখতে তো পারছে। ও এই ভ্রমের মধ্যেই থাকতে চায়। সারাজীবন, অনন্তকাল। অনিমা আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকাল। ওর মনে হচ্ছে কতযুগ পরে দেখতে পেলো মানুষটাকে। চোখভর্তি জল নিয়ে আস্তে করে আদ্রিয়ানের গালে হাত রাখল। সাথেসাথেই সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে গেল ওর। এমন মনে হচ্ছে যেন এই মানুষটাকে ছুঁতে পেরে ওর জীবন ধন্য হয়ে গেল। এ স্পর্শ নয় যেন অমৃত। আদ্রিয়ানের দৃষ্টিও অসহায়। ও শুধু নিজের মায়াবিনীর এরকম বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখছে। আদ্রিয়ানে অনিমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

” জানপাখি।”

অনিমা দ্বিতীয়বার কেঁপে উঠল। ‘জানপাখি’ শব্দটা যেন কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ও ফুপিয়ে কেঁদে উঠল সাথেসাথেই ঝাপিয়ে পরল আদ্রিয়ানের বুকে। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল। এখন আর আদ্রিয়ানকে ছাড়া যাবেনা। একদমই না। যদি আবার হারিয়ে যায়? আদ্রিয়ান অপরাধী দৃষ্টিতে অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে। তারপর বলল,

” এই বোকা মেয়ে! এভাবে কাঁদছো কেন? দেখো, এইতো আমি। একদম ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার। তাকিয়ে দেখ। একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি। নিজের কী অবস্থা করেছ দেখেছ? এরকম করে কেউ? ”

কথাগুলো বলতে বলতে অনিমার এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিল আদ্রিয়ান। অনিমার সেদিকে কোন খেয়াল নেই ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আদ্রিয়ানকে আর জোরে জোরে কেঁদে চলেছে। উপস্থিত সকলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পরেছে। ভালোবাসাময় এরকম দৃশ্য যেন দেখে চোখ সার্থক করছেন ওনারা। রিক শুধু তাকিয়ে আছে অনিমার দিকে। ওর চোখ টলটল করছে কিন্তু ঠোঁটে মুচকি হাসি। আজ আদ্রিয়ান ফিরে না এলে অনিমা শেষ হয়ে যেত, যেটা রিক সহ্য করতে পারতো না। অন্তত এই তিনদিনে ও ভালোভাবে বুঝে গেছে যে আদ্রিয়ান ছাড়া অনিমা নিঃস্ব, একেবারেই নিঃস্ব। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

” জানপাখি, ওদিকে দেখ?”

অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মাথা রেখেই আদ্রিয়ানের ইশারা করা দিকে আস্তে আস্তে তাকাল। তাকিয়ে দেখে হাসান কোতয়াল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। উনি এতক্ষণ প্রাণভরে নিজের মেয়েকে দেখছিলেন। ওনারা ছুটে বেড়ানো সেই চৌদ্দ বছরের মেয়েটা আজ কত ম্যাচিউর হয়ে গেছে। একটা ছেলেকে কতটা ভালোবাসতে পেরেছে। কতটা ভালোবাসল কারো জন্যে এরকম আহাজারি করা যায়। অনিমার এতক্ষণ মস্তিষ্কে ধাক্কা লাগল যে হ্যাঁ এখানে এসে প্রথমে ওর বাবাকেই দেখেছিল। কিন্তু সবটাই আবছা মনে হচ্ছিল সবটাই ভ্রম মনে হচ্ছিলো ওর কাছে। কিন্তু এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ও অবাক চোখে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান চোখের ইশারায় বোঝাল ও যা দেখছে সেটা সত্যি। সত্যিই ওর বাবা ওর কাছে ফিরে এসছে। হাসান কোতয়াল অনিমার দিকে এগিয়ে এলেন। অনিমার কাছে এসে ছলছলে নয়নে তাকিয়ে রইলেন নিজের মেয়ের দিকে। অনিমা আদ্রিয়ানকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসান কোতয়ালের দিকে সিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অসহায় কন্ঠে ডেকে উঠল,

”আব্বু।”

হাসান কোতয়াল এক মুহূর্ত দেরী না করে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলেন নিজের মেয়েকে। অনিমা নিজের বাবাকে পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। যখন নিজের বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিল তখন ওর কী অবস্থা হয়েছিল শুধু ও-ই জানে। ভাবতেও পারেনি আবার কোনদিন মানুষটার বুকে মাথা রেখে ও কাঁদতে পারবে। ও এখন কিচ্ছু বলতে চায়না। কিচ্ছূ জিজ্ঞেস করতে চায়না। ও ওর বাবাকে ফিরে পেয়েছে ওর এতেই চলবে। হাসান কোতয়ালও কাঁদছেন। কতদিন পর নিজের মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এই দিনটার জন্যে কতদিন যাবত অপেক্ষা করে ছিলেন। আজ ওনার বেঁচে থাকা স্বার্থক হল।

___________

আদ্রিয়ানের বাড়ির ড্রয়িংরুমে ছোটখাটো ভীর হয়েছে। অনিমা গুটিয়ে হাসান কোতয়ালের বুকের সাথে মিশে বসে আছে সোফায়। অনেক বড় একটা বিষাদের মুহূর্ত পার করল এই পরিবার। বাড়ির ছেলেটাতো অলমোস্ট সবার চোখে মরেই গেছিল। তবে আদ্রিয়ানকে কেউ এখনো কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। ও কোথায় ছিল?.এরকম কেন করল? হাসান কোতয়ালই বা এতক্ষণ ওর কাছে কীকরে এলো? এই সব প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খেলেও আপাতত আদ্রিয়ান ফিরে এসছে এটাই তাদের কাছে অনেক। এগুলো জানার জন্যে সময় পরে আছে। যেখানে আদ্রিয়ানকে ওনারা মৃতই ভেবে ফেলেছিল সেখানে যে ও ফিরে এসছে এটাই কম কী? সাংবাদিক‍দের কানেও খবর পৌঁছে গেছে আসার পথে ঝেকে ধরেছিল। কিন্তু পুলিশ সরিয়ে দিয়েছে। আদ্রিয়ানের বাড়িতেও এলাও করা হয়নি কাউকে। তবে এসবের মধ্যে নতুন তথ্য পাওয়া গেল। সেটা হচ্ছে মানিক আবরার আর হাসান কোতয়াল ভার্সিটি লাইফের খুব ভালো বন্ধু। কিন্তু ভার্সিটির শেষে কোনকারণে ওনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবে ওনার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন মানিক আবরার। আজ বন্ধুকে জীবিত দেখে উনিও খুশি। দুই বন্ধুর আবেগ মিশ্রিত মিলনও হল এই বাড়িতে আজ। মিসেস রিমা এখনও আদ্রিয়ানকে জাপটে ধরে আছে। ছাড়ার নামই নিচ্ছেনা। আদ্রিয়ান অসহায় কন্ঠে বলল,

” মা। এবার কান্না থামাও আর আমায় ছাড়ো। পুলিশ স্টেশনে তোমার বর জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে, আমার এই ভাই আর বন্ধুনামক গাধাগুলো একসাথে যেভাবে ধরেছিল। প্লেন ক্রাশে না মরলেও আরেকটু হলে এদের চাপে পরে দম বন্ধ হয়ে শিওর মরতাম। বাড়িতে আসার পর তোমার ছিচকাঁদুনে মেয়ে কেঁদেছে। আর তোমার বউমার কথাতো ছেড়েই দাও। এখন তুমিতো ছাড়ো। বেঁচে আছি আমি।”

মিসেস রিমা ছেড়ে ধমক দিয়ে বলল,

” এবার কিন্তু ঠাটিয়ে একটা মারব বলে দিচ্ছি। এভাবে জ্বালিয়ে কী মজা পাস তুই?”

এবার আদিব, আশিস সবাই মিলে ওকে ঝাড়া শুরু করল। আদ্রিয়ান অসহায় বালকের মত সবার ঝাড়ি শুনে যাচ্ছে। রিক বলল,

” সত্যি বলছি ভাই! এই তিনদিন এখানে কী গেছে তুমি ভাবতেও পারবেনা।”

আদ্রিয়ান ধমকে বলে উঠল,

” চুপ কর গাধা। তোকে ওকে নিয়ে মর্গে আসতে কে বলেছিল? ওখানে ওয়েট করা যেতোনা? আরেকটু হলেই তো আমার বউটা হার্ট ফেইল করত।”

রিক মুখ কাচুমাচু করে বলল,

” তখন অতকিছু মাথায় ছিলোনা।”

মানিক আবরার বললেন,

” তা ঐ হতচ্ছাড়া নাহিদ কই।”

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে বলল,

” হতচ্ছাড়া বিকেলে আসবে।”

” অভ্র কোথায়?”

” রাগ করে ফ্লাটে চলে গেছে। চিন্তা করোনা বিকেলের মধ্যেই সুরসুর করে চলে আসবে।”

জাবিন এবার একটু বিরক্তি নিয়ে বলল,

” কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী খুলে বলবি আমাদের? কী হয়েছিল যে এমন করলি? আর আঙ্কেল তোর কাছে কীকরে এল? আর এতোদিনই বা কোথায় ছিল।”

আদ্রিয়ান কিছু বলার আগেই মিসেস রিমা বললেন,

” এখন না। পরে সব শুনবো। এখন যা রুম গিয়ে রেস্ট কর। অনিকে নিয়ে যা। তিনদিন যাবত ঠিককরে কিছু খাচ্ছেনা। তাকিয়ে দেখ এখনো ঠিক নেই ও।”

সবাই তাকিয়ে দেখল আসলেই অনিমা এখনো স্বাভাবিক নয়। একদম চুপচাপ লেপ্টে আছে হাসান কোতয়ালের বুকে। বোঝাই যাচ্ছে এখনো ও ঘোরের মধ্যে আছে। হাসান কোতয়াল মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,

” মামণী? চুপ করে আছো কেন এভাবে?”

অনিমা কিছু না বলে আরও গুটিয়ে গেল হাসান কোতয়ালের বুকে। আদ্রিয়ান উঠে এসে অনিমার সামনে বসে বলল,

” মিস্ট… মানে আঙ্কেল এখানেই আছেন। কোথাও যাবেনা। এখন রুমে এসো। ইউ নিড রেস্ট।”

অনিমা না বোধক মাথা নাড়ল। হাসান কোতয়াল অনিমাকে আশ্বস্ত করে বললেন,

” আমি এখানেই আছি মা তুমি যাও।”

” সত্যিই যাবেনা তো? প্রমিস কর?”

হাসান কোতয়াল মেয়ের বাচ্চামো দেখে হেসে দিয়ে বললেন,

” প্রমিস। এতকষ্ট করে এসছি তোমাকে ছেড়ে যেতে না-কি? এখন রুমে যাও।”

বাবার অনুমতি পেয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল ওনাকে। ওনার দিকে স্হির চোখে তাকাতেই উনি আবারও আশ্বস্ত করলেন উনি এখানেই আছেন। মানিক আবরার হাসান কোতয়ালকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” তুইও চল খেয়ে রেস্ট করবি। পরে সব কথা হবে।”

আদ্রিয়ান অনিমাকে কোলে তুলে নিয়ে ওর রুমে চলে গেল। অনিমা আদ্রিয়ানে গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশে রইল। আদ্রিয়ান হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দন উপলব্ধি করছে ও। আদ্রিয়ান আরো ভালোভাবে মিশিয়ে নিল অনিমাকে নিজের সাথে। পরম শান্তিতে আস্তে আস্তে চোখ বন্ধ করে নিল অনিমা। এর চেয়ে সুখের অনুভূতি হতেই পারেনা। এভাবেই যেন অনন্ত কাল পার করে দিতে পারবে ও। এই বুকে মাথা রাখতে পারলে ওর আর কিচ্ছু চাইনা। কিচ্ছুনা।

#চলবে…

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪৭.

কপালে কারো ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে অনিমা পিটপিটিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করল। নাকে আসছে অতি পরিচিত সেই মিষ্টি গন্ধ। চোখ না খুলেই অনিমা অনায়াসে বুঝতে পারল ও আদ্রিয়ানের বুকে আছে। দুই বাহু দিয়ে নিজের বুকে আবদ্ধ করে রেখেছে আদ্রিয়ান ওকে। বিছানার সাথে হেলান দিয়ে ওকে বুকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। অনিমার জন্যে এর চেয়ে আরাম আর তৃপ্তির জায়গা আর কিছু হতেই পারেনা। তাই চোখ না খুলে আদ্রিয়ানকে আরেকটু জোরে জড়িয়ে ধরে। আদ্রিয়ান অনিমাকে নড়তে দেখে চোখ খুলে তাকায়। ওর চোখ লেগে এসছিল। ও বুঝতে পারল অনিমা জেগে গেছে। আর জাগার পর অনিমার এমন কান্ড দেখে হেসে ফেলল। তারপর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

” জানপাখি?”

অনিমা কিছু বলল না চোখ বন্ধ করে আদ্রিয়ানের টিশার্ট খামচে ধরল। আদ্রিয়ান অনিমার গালের ওপর থেকে চুল সরাতে সরাতে বলল,

” তাকাও!’

অনিমা না বোধক মাথা নাড়ল। ওর এখনও মনে হচ্ছে যদি সব স্বপ্ন হয়? চোখ খুললেই যদি দেখে সবটাই স্বপ্ন ছিল, আদ্রিয়ান বা ওর আব্বু কেউ-ই ফিরে আসেনি, তাহলে? না, তারচেয়ে ও এইরকম স্বপ্নেই ভালো আছে। এভাবেই থাকতে চায় ও সারাজীবন। অনিমার মনের কথাটা যেন আদ্রিয়ান বুঝে ফেলল। ও কোমল স্বরে বলল,

” এসব কিছুই স্বপ্ন নয় অনি। তোমার বাবাও ফিরে এসছে, আর আমিও। আমরা দুজনেই আছি। চোখ খুলে দেখ।”

অনিমা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকাল এবার। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর চোখ দিয়ে পানি পরতেই আদ্রিয়ান সাথেসাথেই ওর চোখদুটো মুছে দিয়ে বলল,

” কেঁদোনা প্লিজ। তুমি জানো আমার এই একটা জিনিস সহ্য হয়না। কাঁদছো কেন এভাবে? আমি চলে এসছিতো। আর দেখ তোমার বাবাও ফিরে এসছেন। আজকেও যদি এভাবে কাঁদতে থাকো তাহলে হয়?”

অনিমা নাক টেনে টেনে বলল,

” আপনি খুব খারাপ একটা মানুষ। এভাবে না বলে কেউ উধাও হয়ে যায়? জানেন আমার কত কষ্ট হচ্ছিল? আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, হাত-পা আবস হয়ে যাচ্ছিল, আমি শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, আমি মরে যাচ্ছিলাম আদ্রি..”

কথাটা শেষ করার আগেই আদ্রিয়ান অনিমার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বল,

” হুশ! একদম মরার কথা বলবেনা জানপাখি। তোমার কিছু হলে আমি কী-করে থাকব বলো? আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে তো শুধু তোমারই বসবাস। তুমি চলে গেলে আমার মধ্যে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আর আমাকে এভাবে অস্তিত্বহীন করে দেওয়ার অধিকার তোমার নেই, একদম নেই।”

এরপর আলতো করে অনিমার কপালে চুমু দিল। অনিমা আদ্রিয়ানের বুকে মাথা দিয়ে বসে আছে। আদ্রিয়ান বলল,

” তোমাকে কোলে করে ওপরে নিয়ে আসতে আসতে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পরলে। এটা কোন কথা হল? কিছু খাওয়াও হয়নি তোমার এখনো। দেখ তোমার খাবার এনে রেখে দিয়েছি। উঠুন ম্যাডাম, খেতে হবে।”

অনিমা ভাঙা গলায় বলল,

” আব্বু কোথায়?”

” খাওয়া-দাওয়া করে নিজের রুমে রেস্ট করছে। সন্ধ্যায় সবাই মিলে একসাথে গল্প করব। চল ওঠ, খাবে।”

অনিমা উঠে বসল। আদ্রিয়ান গিয়ে ওয়াসরুম থেকে নিজের হাত ধুয়ে এলো। বেড়িয়ে এসে দেখে অনিমা খাটে আসাম করে বসে আছে। আদ্রিয়ান মুচকি হেসে খাবারের প্লেট নিয়ে এসে অনিমার সামনে বসল। এরপর ওর দিকে এক লোকমা এগিয়ে দিতে অনিমা জিজ্ঞেস করল,

” আপনি খেয়েছেন?”

” তোমাকে প্রথম লোকমা দিয়ে এরপর আমি খাবো। দ্রুত হা কর।”

অনিমা আদ্রিয়ানের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হা করল। আদ্রিয়ান ওকে খাইয়ে এরপর নিজেও খাবার মুখে দিল। কয়েকমাস আগেও অনিমার মনে হতো ওর মতো খারাপ ভাগ্য পৃথিবীতে কম মেয়েরই আছে। না হলে এতো বড় পৃথিবীতে ও এতো অসহায় কেন? কিন্তু এখন বুঝতে পারে যে ও কতটা ভালো ভাগ্য নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছে। এমন স্বামীভাগ্য কজনের হয়। অনিমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আদ্রিয়ান ভ্রু নাচিয়ে অতি প্রেমময় ভঙ্গিতে বলল,

” এম আই লুকিং টু মাচ হ্যান্ডসাম, জানপাখি?”

অনিমা সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিল। আদ্রিয়ানের বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠল ওর। ঠোঁটে কোণে ফুটে উঠল হালকা হাসি। আদ্রিয়ানও আর কিছুই না বলে অনিমাকে খাওয়ানোতে মনোযোগ দিল। তখনই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রিক বলল,

” আসতে পারি?”

আদ্রিয়ান তাকিয়ে রিককে দেখে মুচকি হাসল। তারপর বলল,

” জিজ্ঞেস করার কী আছে? চলে আয়?”

রিক ভেতরে এসে সোজা আদ্রিয়ানের মাথায় একটা চাটা মারল। আদ্রিয়ান মাথা হাত দিয়ে ঘষে বলল,

” মারছিস কেন?”

” নাহ, মারবো কেন? আপনাকে তো ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা উচিত ছিল আমার। অতি মহৎ কাজ করে ফিরেছেন কি-না।”

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে আবার অনিমাকে খাওয়াতে শুরু করল। অনিমা একপলক রিকের দিকে তাকিয়ে আর তাকায় নি। রিক টুল টেনে বসে বলল,

” ইডিয়ট একটা। এই মেয়েটার অবস্থা দেখেছিস একয়েকদিনে কী হয়েছে? কাঁদতে কাঁদতে চোখের সব পানি এই তিনদিনেই শেষ করে ফেলেছে। এবার ভবিষ্যতে যখন তোদের ধুমধাম করে আঙ্কেল বিয়ে দেবে। তখন বিদায়ের সময় কাঁদবে কীকরে?”

আদ্রিয়ান ফিক করে হেসে দিল। অনিমা মুখ ফুলিয়ে তাকাল রিকের দিকে। রিক ওর হয়ে কথা বলছে না-কি ওকেসহ পঁচাচ্ছে বুঝতে পারছেনা। রিক ধমকের সুরে বলল,

” ঐ একদম হাসবি না। নিজের বউকে কাঁদিয়ে এখন হাসছে। ইরেস্পন্সিবল একটা।”

আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

” আরে ভাই, তুই ছিলিতো। আমি জানি তুই আর যাই হোক বন্ধু হিসেবে বেস্ট। আর এরকম মুহূর্তে একজন বন্ধুই সবচেয়ে বেশি সামলাতে পারে।”

অনিমা আর রিক দুজনেই অবাক দৃষ্টিতে তাকাল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ানেল কোন ভাবান্তর নেই। ওর মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ও অতি স্বাভাবিক একটা কথা বলেছে। রিক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল,

” মানে?”

আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

” তোর নীলপরী কেমন আছে?”

অনিমা হালকা কেঁপে উঠল। আদ্রিয়ান নীলপরী সম্পর্কে জানে? এটাও কী জানে যে নীলপরী কে? না-কি শুধু নামটাই জানে? রিক অবাক হলেও একটু হাসার চেষ্টা করে অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল,

” ভালো আছে। ইনফ্যাক্ট খুব ভালো আছে।”

তারপর সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিল। এরপর ব্যস্ত কন্ঠে বলল,

” অ-আমি রুমে যাচ্ছি। তোরা রেস্ট করে সন্ধ্যায় নিচে চলে আসিস। সবাই আসছে।”

আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

” তুইও গিয়ে রেস্ট করে নে, তোর ওপর দিয়েও অনেক ধকল গেছে।”

রিক দ্রুতপদে বেড়িয়ে গেল রুম থেকে। যেন এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই কিছু একটা ধরা পরে যাবে। অাদ্রিয়ান ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে আবার অনিমাকে খাওয়ানো শুরু করল। অনিমাও মাথা নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছে। কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখালোনা। তবে আদ্রিয়ানের শেষের কথাগুলো ভাবাচ্ছে ওকে।

___________

আবরার মেনশনে ড্রয়িংরুমে কোলাহলপৃর্ণ খুশির আমেজ। যেন তিনদিনের ঘনকালো মেঘ পেরিয়ে উজ্জ্বল রোদের আলো দেখা দিয়েছে। সকলেই চা পাকোড়া খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন। আদিব, আশিস, অভ্র, নাহিদ। এদিকে অরুমিতা, তীব্র আর স্নেহা সবাই এসছে। নাহিদকে মানিক আবরার আচ্ছামত কানমোলা দিয়েছে কারণ ও সবটাই জানতো যে আদ্রিয়ান কোথায় আছে। কিন্তু বলেনি। সোফাতে হাসান কোতয়ালের এক হাত জড়িয়ে ধরে বসে আছে অনিমা। এতোবছর পর বাবাকে ফিরে পেয়ে ছাড়তেই চায়না ও আজ আর। আদ্রিয়ান ওপর সাইডে সোফার হ্যান্ডেলে বসে আছে, রিক ঠিক ওর বিপরীত হ্যান্ডেলে বসেছে, বসার জায়গাটায় স্নিগ্ধা বসে আছে। অনেকক্ষণ আড্ডার পর মানিক আবরার বললেন,

” তো এবার খুলে বলতো কী হয়েছিল?”

মিসেস রিমাও বললেন,

” হ্যাঁ এভাবে হুট করে উধাও হয়ে গেলি। হাসান ভাইকেও নিয়ে এলি। কী হয়েছিল?”

অনিমা সহ সবাই কৌতহলী চোখে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের দিকে। হাসান কোতয়াল মৃদু হাসছেন। আদ্রিয়ান কয়েকসেকেন্ড চুপ থেকে তারপর বলল,

” আমি আর নাহিদ ভার্সিটি লাইফে একবার রাজশাহী গিয়েছিলাম মনে আছে? তো ওখানে রাতে আমি আর নাহিদ বাইকে করে ঘুরছিলাম। কিন্তু আনফরচুনেটলি__ এক্চুয়ালি ফরচুনেটলি বলা যায়, ব্যালেন্স হারিয়ে আমাদের বাইকটা পাশের সরু এবং প্রায় পানিশূণ্য খাদে পরে যায়। আমাদের তেমন বিশেষ ইঞ্জুরি হয়নি ঠিকই। কিন্তু একটা মানুষকে ওখানে অজ্ঞান অবস্থায় পাই আমরা। লোকটার বেশ ভয়ংকররকম ইঞ্জুরি ছিল। আর উনি আঙ্কেলই ছিলেন।”

সবাই বেশ অবাক হয়। অনিমা ওর বাবাকে আরেকটু শক্ত করে আকড়ে ধরে। আদ্রিয়ান বলল,

” আমরা ওনাকে নাহিদের বাবার হসপিটালে নিয়ে গেছিলাম। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে পরেরদিন নিউস পেপারে ওনারাই মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। পেপারের ছবি দেখেই সেটা বুঝেছি। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল ওনার জীবিত থাকার খবরটা ঐ মুহুর্তে বাইরে যাওয়া ঠিক হবেনা। তাই আমরা ওনাকে লুকিয়ে ফেলেছিলাম, সবার আড়াল করে রেখেছি। আর উনি এতোদিন ইউ এস এ তে নাহিদর বাড়িতে ছিলেন। অনিকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে আমি ওনাকে নিয়ে আসতেই ইউএস যাচ্ছিলাম কিন্তু এয়ারপোর্ট যাওয়ার পর জানতে পারি এই নাহিদ গাধা ওনাকে নিয়ে ওলরেডি চলে এসছে। এখন চট্টগ্রাম আছে। তাই আমি সেখানেই গেছিলাম ওদের আনতে।”

সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। সবার সবকিছুই এলোমেলো লাগছে, কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। আদিব ভ্রু কুচকে বলল,

” এতোকিছু হয়ে গেল আর আমরাই জানিনা? কিন্তু তাহলে এই পাঁচবছরে আঙ্কেল ফিরে আসলেন না কেন? আর তুই কীকরে জানলি যে ইনিই অনির বাবা? আর চট্টগ্রাম গিয়ে কাউকে কিছুই না বলে তিনদিন পরে ছিলি কেন? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা সব গুলিয়ে যাচ্ছে।”

আদ্রিয়ান আর হাসান কোতয়াল একে ওপরের দিকে তাকাল। ওনাদের ঠোঁটে এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। আর কিছু বলার আগেই রঞ্জিত চৌধুরী আর কবির শেখ এসে প্রবেশ করলেন ভেতরে। ওনাদের পেছনে মিসেস লিমাও এসছেন। কবির শেখ দ্রুত পদে এসে আদ্রিয়ানকে জড়িয়ে ধরলেন। আদ্রিয়ানও হেসে দিয়ে নিজের মামার পিঠে হাত রাখল। কবির শেখ ওকে ছেড়ে বলল,

” এটা ঠিক আদ্রি? এভাবে হুট করে গায়েব হয়ে যায় কেউ? এদিকে কী অবস্থা হতে পারে বোঝনা তুমি?”

আদ্রিয়ান ঘাড় বাঁকা করে কাপ ধরে বলল,

” সরি মামা। আসলে আমি প্লেনে উঠিনি সেই দুঃখে যে প্লেনটা ক্রাশ করে বসবে সেটা বুঝিনি।”

মিসেস লিমা রাগী কন্ঠে বললেন,

“সেই কিউট করে সরি বললেই সব গলে যায়।এইছেলে কোনদিনও শোধরালো না।”

আদ্রিয়ান হাসল। রঞ্জিত চৌধুরী বললেন,

” তবুও তোমার জানানো উচিত ছিল।”

” হ্যাঁ আই এগ্রি। তাইতো সরি বলছি। বাই দা ওয়ে মামা। আমার বউকে তো চেনই এতোদিনে। এখন আমার শশুরমশাইয়ের সাথে আলাপ করে নেও।”

এরপর আদ্রিয়ান হাসান কোতয়ালকে দেখিয়ে করে বলল,

” অনিমার বাবা, হাসান কোতয়াল। পেশায় জার্নালিস্ট।”

হাসান কোতয়ালকে দেখে কবির শেখ আর রঞ্জিত চৌধুরী দুজনেই জমে গেলেন। যেন চোখের সামনে ভুত দেখছেন। ঘাম বেড়িয়ে গেছে ওনাদের। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। মন একটাই প্রশ্ন করছে, এটা কীকরে সম্ভব?

#চলবে…

[ রি-চেইক করা হয়নি। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে