পিয়ানোর সুর পর্ব-০৬

0
367

পিয়ানোর সুর
#৬ষ্ঠপর্ব

প্রতিদিনই ভোরে বাবার সাথে রমনা পার্কে মর্নিং ওয়াক করতে চলে আসি। দুইদিনের টানা বৃষ্টিতে আমাদের বাসার সামনে সরু রাস্তাটা হাটু সমান পানিতে ডুবে গিয়েছে। পুরান ঢাকার অধিকাংশ রাস্তার একই হাল দেখছি দুই বছরের অভিজ্ঞতায়। একটু বৃষ্টি হলেই ড্রেনে ব্লকেজ সৃষ্টি হয়ে সম্পূর্ণ পানি রাস্তায় উঠে আসে। রাস্তায় পানি উঠলে বাবা ভোরে হাটতে বের হন না। একবারে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বের হন।

আমার আবার একটা অভ্যস্ততায় পেয়ে বসলে সহজে কুইট করতে পারি না। বাবা জানেন সেটা। একটা রিক্সা ফিক্সড করে দিয়েছেন ভোরে আমায় নিয়ে রমনা পার্কে আনা নেয়া করার জন্য। বাসার গ্যারাজে পানি উঠে যাওয়ায় গাড়ী বাবার অফিসের গ্যারাজে রাখা হয়েছে। বাবা রিক্সা নিয়ে অনেকটা পথ এসে পরে উবার নিয়ে অফিসে যান। সন্ধ্যায় অবশ্য নিজের গাড়ীতে করেই ফেরেন যতদূর পানি ভেঙে আসা যায় আসেন তারপর ড্রাইভার রিক্সা ঠিক করে দেন।

আজ মেজাজ খারাপ নিয়ে মর্নিং ওয়াকে এসেছি। রিক্সাওয়ালা মামা আসার সময় বুঝেছেন মেজাজ ভালো না। উনি জিজ্ঞেস না করে আন্দাজে বলে দিলেন, “বাবার ওপর যেন রাগ না করি। বাবা নাকি সাদা মনের মানুষ।”
তখনই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। বাবার নামে প্রশংসা খুব বেশি শুনি। যতবার শুনি আমি গর্বিত অনুভব করি।
কিন্তু এখন আবার মনে পড়ে গেল। পার্কে বেশিক্ষণ হাঁটতে, দৌড়াতে ভালো লাগছে না। বৃষ্টির কারণে ঘাসগুলো ভেজা। বসার মত কন্ডিশনে নেই। একটা গাছের গুড়ির ওপর বসার সাথে সাথে পিচ্চি একটা ছেলে চায়ের ফ্ল্যাক্স নিয়ে হাজির। চিনি তাকে। বাবা প্রায়ই ওর থেকে চা কিনে পান করে। আমি কখনো ট্রাই করিনি। তবু সে বাবাকে না দেখলে আমাকে জোর করে। যেন একবার ওর চা টেস্ট করে দেখি। আমি ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যাই। এমুহূর্তে সেটা এড়ানো সম্ভব নয়। পায়ের কাছে এসে বসেছে ছেলেটা। খাবো কিনা জিজ্ঞেস না করেই ওয়ান টাইম কাপে ফ্ল্যাক্স থেকে গরম গরম চা ঢেলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। প্রাণবন্ত একটা হাসি দিয়ে বলল,

— নেন খান, ফ্রি দিলাম পয়সা দিতে হইবো না।

হাসিমুখে চায়ের কাপ নেয়ার আগেই ওকে একশত টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম,

— এটা রাখো। চায়ের দাম পাঁচ টাকা বাকিটায় চকোলেট কিনে খেও।

পিচ্চিটা ভীষণ স্নিগ্ধ উচ্ছল একটা হাসি দিয়ে বলল,

— আফনে আমার মন ভালা কইরা দিলেন। আফনার মন খারাফ ক্যান কন শুনি?

মনের কথা অবুঝ বালককে বলতে দ্বিধা হলো না। বললাম,

— ভুল করে বাবার কোম্পানিতে জব এপ্লিকেশন দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউতে ভালোমতো পাশও করেছি। কিন্তু কী জানো, জয়েনিং লেটারে বাবার সিগ্নেচার দেখার আগপর্যন্ত জানিইনি কোম্পানির বস আমার বাবা। ওনার কোম্পানির মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ একটা পোস্টে আমার জব হয়েছে।

— আরে স্যার এইডা তো খুশীর কথা। বাবার কোম্পানিতে চাকরি কেন বস হইয়া বইয়া পড়েন। আমি হইলে সিদা বস বস ডাবল বসের ভাব নিয়া বইয়া পড়তাম।

— ডাবল বস মানে বুঝলাম না। কোন পজিশন সেটা?

— বাবায় বস হইলে পোলায় ডাবল বস হয় এই সিম্পল ম্যাথ বুঝলেন না স্যার কন কী!

— ওহ তাই বলো! নাহ পরিচিত সার্কেলে জব চাইনি। আর উনি তো আমার বাবা। এ নিয়ে বাবার সাথে ঝগড়া করে মন মেজাজ ভালো না। তোমার নাম কী?

— সৌরভ। আফনের?
— আরে আমার নামও তো সৌরভ!

— আল্লাহ কেমনে মিল্ল্যা গেল গা! নামে মিল থাকলে মিতা কয়। আফনে আমার মিতা স্যার।

— কে বললো?
— নাইট স্কুলের মাস্টার কইছে। নামে নামে মিল্ল্যা গেলে মিতা কয় তারে।

— তুমি স্কুলে পড়ো?

— হ পড়ি। ক্লাস সিক্সে থন এইবার সেভেনে উডুম। দিনে চা বেচি রাইতে স্কুলে যাই।

— ভেরি গুড সৌরভ। তুমি অনেক পরিশ্রমী ছেলে। একদিন অনেক বড় হবে।

— কত আর বড় হমু স্যার। যতই বড় হই আফনার মতন তো হমু না। আফনের লগে নামে মিল হইলে কী হইবো কপালে কপালে ফারাক আছে স্যার। আফনের বাবায় চাকরি দিছে আর আমার বাবায় গাঞ্জা খাইতে খাইতে মইরাই গেছে। বাবায় যদ্দিন আছে বাবার কথা হুইনেন স্যার। নাখোশ হইয়েন না। বাপ বাপই। আমারে জিগান, আমার বাবায় গাঞ্জা খাইতো তও বাবার কথায় উঠছি আর বইছি। কত সাহস ছিল। খেলতাম দৌড়াইতাম কেউ কিসসু কওয়ার সাহস পাইতো না। বাবায় মরলো লাথি ঝাঁটার জিন্দেগী শুরু হইলো। মাইনষে সুন্দর একটা নাম দিছে “টোকাই”। ফাঁক পাইলে ভাঙ্গারি বেচি হেইর লেইগ্যা এই নাম। হাজার কইলেও কেউ সৌরভ কইয়া ডাকে না। নামের লগে নাকি কামের মিল নাই। মুখ ভেঙ্গায়। আইজা আসি স্যার কাইল আবার কথা কমুনে। আল্লাহ হাফেজ।

মনটা এবার খুবই ভেঙে গেল। বাচ্চাটা ওর সীমাহীন কষ্টের কথা হাসি হাসি মুখে বলে গেল আমার হাসি নিভিয়ে দিয়ে। বাবাকে ভীষণ মিস করছি। দ্রুত বাসার দিকে রওনা হলাম।

রিক্সা আমাদের গলির ভেতর ঢোকার পর দূর থেকে দেখছি বাবা আমাদের বাসার সামনে এই পচা পানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার সাথে একটি মেয়ে হাসি হাসি মুখে কথা বলছে। মেয়েটির মুখ দূর থেকে ক্লিয়ারলি বোঝা গেল না। কাছে যেতেই দুজনেরই হাসির আওয়াজ কানে ভেসে এল। মেয়েটি আমার দিকে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে।
দীর্ঘাঙ্গি, ঢেউয়ের মত বাঁকানো শারীরিক আদল। মেঘের মত ছাই ছাই কালচে সিল্কি চুলগুলো মাথার উঁচুতে ঝুঁটি করে বাঁধা বলে ঠিক আইডিয়া করা গেল না কতখানি লম্বা। গ্রীবার পেছনে কাঁধের উন্মুক্ত অংশ দেখেই বোঝা যায় রূপালী আভা ছড়ানো গায়ের রঙ। বয়স অনুমান করা গেল না ফেইস দেখা যাচ্ছে না বলে। তবে কানে ভেসে আসা ওর হাসির আওয়াজ সুইট সিক্সটিনথ গার্লের মত লাগছে।

রিক্সাওয়ালা মামা আমাদের বাসার সামনে ঠিক মেয়েটির গা ঘেঁষে রিক্সা থামালেন। এতক্ষণে বাবা আমার দিকে তাকালো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বাবা বললেন,

— মিথি দেখো দেখো এতটা সময় ধরে যার গল্প শুনছিলে এই দেখো সে চলে এসেছে। সালমান আশরাফি মৃধা সৌরভ। আমার ছেলে।

আমি রিক্সা থেকে নামতে ভুলে গেলাম। মিথি আমার দিকে ফিরতে ফিরতে ফিরলো না বাবার মুখে আমার নাম শুনে সেও আমারই মত রিএক্ট করলো। স্থির হয়ে গেল।

কতগুলো দিন হয় মেয়েটির ছায়াটুকুর খবর পাইনি। রাতের পর রাত বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে ওকে একনজর দেখার প্রহর গুনেছি। নিষ্ঠুর অভদ্র মেয়েটি ঈদ উইশটুকু পর্যন্ত করতে আসেনি। আজ এইমুহূর্তে, এই সাত সকালে ড্রেনের পানিতে আনন্দে পা ডুবিয়ে সেই মেয়ে আমার বাবার সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে তাও টপিক আমি.. আশ্চর্য!

অদেখা মেয়েটির বুক বিদীর্ণ করা সেই মোহনীয় কন্ঠ কথা বলে উঠলো। বাবাকে তড়িঘড়ি করে বললো,

— কাকু আরেকদিন পরিচিত হবো দেরি হয়ে যাচ্ছে নানু বকা দেবে।

বাবাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পানিতে ঝুপঝাপ পা ফেলার তরঙ্গের ঢেউ তুলে মিথি দৌড়ে ওর নানাবাড়ীর গেটের ভেতর ঢুকে গেল। ঢুকেই ভেতর থেকে গেট লক করে দিল। ব্যস ঐ পর্যন্তই। বাড়ীর একদম ভেতরে গেল না। তখনো রিক্সা ছেড়ে নড়তে পারিনি আমি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি ওরই দিকে।
লোহার গেটের ভেতরটা বাইরে থেকে অন্ধকার লাগছে। কিন্তু মিথির পরনের সাদা রঙের পোশাক ওর উপস্থিতি জানিয়ে দিল। নিশ্চয়ই সে আমাকে দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। স্বার্থপর মেয়ে নিজেকে আড়াল করে উঁকি দিচ্ছে আমায় দেখতে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।

যেই পচা পানিতে দুঃস্বপ্নেও নামার চিন্তা করি না সেই পানিতেই জাম্প দিয়ে নামলাম। বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, একইসাথে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। মিথি বৃষ্টি ভালোবাসে মনে হতেই ইচ্ছে করে বাবাকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছি। দাঁড়িয়েছি ঠিক ঠিক মিথির দিকে পিছন ফিরে। বুঝুক মজা এবার।

ওদের গেটের বেশ কাছেই দাঁড়িয়ে আছি। ক্লিয়ারলি শুনতে পেলাম মিথি আফসোসের সুরে নিজ মনেই ফিসফিস করছে,

— ইশশ একটুও কী দেখতে পাবো না! সৌর প্লীজ একটু ঘুরুন, এদিকে তাকান!

শান্তির এক নহর বয়ে গেল মন জুড়ে। বাবা বেশিক্ষণ ভিজতে দিলেন না। হাত ধরে টেনে নিয়ে বাসায় ঢুকলেন।

ঘন্টাখানেক পর শাওয়ার, ব্রেকফাস্ট সেরে কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। তাকাবো না করে করেও মিথিদের বারান্দার দিকে ইনডাইরেক্টলি তাকাতে গিয়ে হাত থেকে গরম কফির মগ বারান্দার ফ্লোরে পড়ে গেল। কাঁচের ভাঙা টুকরো আর গরম কফি ছিটকে পড়লো পায়ের ওপর। সেদিকে সেন্স কাজ করছে না আমার। নজর সামনের বারান্দায়।

লাইট ভায়োলেট কালারের ট্রান্সপারেন্ট একটা শাড়ী পরিহিতা মেয়ে তার সদ্য শাওয়ার করা ভেজা চুল টাওয়াল দিয়ে মুছছে আমার দিকে পেছন ফিরে। তার টপসের পিঠ ও কাঁধের ডিজাইন ডীপ স্কয়ার শেপের কাট। সকালের স্নিগ্ধ আলোয় ওর নিরাভরণ পিঠের রূপালী চিকচিকে অংশ রক্তে বান ডাকে। অনাবৃত কোমড়। শাড়ী আঁচল পুরোপুরি কাঁধে নেই। অনেকটাই হাতের ওপর খসে পড়া। পিঠ ছড়ানো চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ঝাড়ছে। এ শরীরের বাঁক আমার চেনা। একটু আগেই তো দেখলাম।

কখন যে মেয়েটা ঘুরেছে তাও খেয়াল করিনি। কল্পনার চোখে বাবার সাথে গল্পেরত মেয়েটিকে দেখছিলাম। সম্বিৎ ফিরলো মিথির উৎকন্ঠা মিশ্রিত আওয়াজে। সে বলছে,

— সৌরভ সরুন, সরে দাড়ান আপনার পা পুড়ে যাচ্ছে।

হুঁশ এবারও দেরি করে হলো। যখন তাকালাম দেখি মিথি টাওয়াল দিয়ে মুখ আড়াল করে নিয়েছে। অভিমানের ধরা গলায় বললাম,

— পুড়ে যাক। কী এসে যায়। আপনি মুখ ঢেকে না রেখে রুমে চলে যান। নাহ এখানেই থাকুন। আমিই বরং যাই।

পা বাড়ালাম নিজের রুমের দিকে। মিথি উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলল,

— ফার্স্টএইড এপ্লাই করুন এক্ষুণি, নইলে ফোস্কা পড়ে যাবে।

মনের মধ্যে বেশ যন্ত্রণা নিয়ে বললাম,
— দেখতে না পাওয়ার কষ্ট বোঝেন মিথি? এত উদ্বিগ্নতা কেন? কে আমি?

নিভে যাওয়া কন্ঠে মিথি রূঢ জবাব দিল,
— কেউ না। কিছু বুঝি না আমি। কোনো কষ্ট নেই আমার।

— কতগুলো দিন হয় দেখি না। ওপাশের যন্ত্রণা আমি কিন্তু বুঝি মিথি। আপনার মত রুড নই।

— প্লীজ সৌরভ পা ক্লিন করে মেডিসিন লাগিয়ে নিন।
— না। আপনি এসে লাগিয়ে দিন।
— অসম্ভব!

— ভুলে যান তবে কী বলেছি বা কী হয়েছে। যেমন আছে তেমন থাকুক। মাত্রই বললেন, কেউ নন। স্ট্রেঞ্জার্স হয়েই থাকুন। আমিও থাকবো। যেমন আগে ছিলাম। বাই মিথি।

ওকে ওভাবে রেখে রুমে এসে বারান্দার দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলাম। আর যাবো না বারান্দায়। পাথুরে মেয়ে একটা। লাগবে না তোমাকে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে