পিয়ানোর সুর পর্ব-০৫

0
357

পিয়ানোর সুর
#৫মপর্ব

তাড়াহুড়ো করে বিমান টিকিট তারপর জব এপ্লিকেশন করে দুই সপ্তাহের ছুটি আর শেষে টিনার সাথে তুমুল ঝগড়া। পরের সপ্তাহেই উড়াল দিলাম বাংলাদেশ নামক গল্পে শোনা শ্যামলিমা দেশটির উদ্দেশ্যে। হিথরো (Heathrow Airport) বিমানবন্দরে মায়ের সাথে বাবার বাল্যবন্ধুও এসেছিলেন আমায় সী অফ করতে। মাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে মন চাইছিল খুব। উনি শোনালেন ইসলাম ধর্মীয় বিধিনিষেধের লম্বা বাণী। ইমিগ্রেশন পার হওয়ার আগমুহূর্তে একধরণের শূন্যতা নিয়ে টিনাকে কল দিলাম। রিসিভ করলো না।

বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে রিসিভ করলেন বাবার ঐ বাল্যবন্ধুর বড় বোনের হাজব্যান্ড। বাবাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে জানাইনি। কিন্তু কে জানতো আমি নিজেই সারপ্রাইজড হবো।

কেমন এক পৌরাণিক গা ছম ছম করা পুরাতন বাড়ী ঘর দিয়ে ঠাসা এক ঘিঞ্জি এরিয়ার ভেতরে এসে আমাকে নিয়ে আন্টিদের পাজেরো জীপ ঢুকলো। এত সঙ্কীর্ণ রোডে এতবড় জীপ নিয়ে ঢোকার কথা আমি হলে দুঃস্বপ্নেও ভাবতাম না। বাইসাইকেল নিয়েই ঢোকার সাহস হত না। বাইচান্স হতও যদি, খানাখন্দের ভেতর টুপ করে পড়ে ডুবে যাওয়ার ভয়ে মরে যেতাম।
বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখছিলাম, জীপটা কেমন সাপের মত এঁকেবেঁকে অনায়াসে ড্রাইভ করে এসে থামলো বহু বছরের পুরানো তিনতলার এক বাড়ীর সামনে। ভেতরে সেদিন আয়োজন চলছিল একটি ছোটখাটো পার্টির। প্রতিবছরই নাকি হয়। সেবারও হচ্ছিলো। আঙ্কলের (বাবার বন্ধু) বড়বোনের ফ্যামিলি এখানে আগেই এসে উপস্থিত। ওনার বড় বোনের হাজব্যান্ড যখন আমায় নিয়ে অসুখে শয্যাশায়ী বাবার বেডরুমে এলেন, বাবার কালো কালো বিশাল সমুদ্রের মত বড় বুদ্ধিদীপ্ত দু’চোখ চিনে নিল আমায়। দু’হাত প্রশস্ত করে দিয়ে তিনটি শব্দের প্রবল শক্তিশালী একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন,

— আমার ছেলে সৌরভ!

ধীর পায়ে হেঁটে বাবার বেডের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। উনি হাতের আঙুলে ওনার বুক লক্ষ্য করে ইশারা করলেন ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। বাবা ধরা গলায় করুণ সুর তুলে গাইলেন,

— হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থডে মাই সান.. হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! বুকে আয় না বেটা বাবার বুক শুকিয়ে গেল তো!

হাহাকার মিশ্রিত স্নেহের পরশ মাখানো আহ্বানে হাত পা অসাড় হয়ে এল আমার। আজন্মের অভিমান ভুলে ছোট্ট শিশুর মত বাবার বুকে ফোঁপাতে ফোপাঁতে নেতিয়ে পড়লাম। বাবাকে দেখার এক্সসাইটমেন্টে ভুলেই গিয়েছিলাম আজ ৭ই জুলাই আমার ত্রিশতম জন্মদিন। অসুস্থ হয়েও বাবার দু’হাত যেন ইস্পাতের মত শক্তিশালী। আমাকে শক্তভাবে বুকের সাথে চেপে ধরে বলেছিলেন,

— মা শা আল্লাহ কত বড় হয়ে গিয়েছে আমার ছেলেটা! মায়ের মতই গায়ের ঘ্রাণ। মায়ের মতই সুন্দর হয়েছিস তুই। একদম ব্রিটিশ রাজপুত্র!

কাঁদতে কাঁদতেই প্রতিবাদী হয়ে বললাম,
— মোটেই না। আমি আমার বাবার মত শক্তিশালী হয়েছি। বাবার মতই হ্যান্ডসাম। মা দুর্বল। বয়স হয়েছে মায়ের। তুমি এখনো এংরি ইয়াংম্যান।

— ওরে তোর মায়ের সবে ফিফটি টু হলো। আমিতো সিক্সটি পেরিয়েছি সেই কবেই।

— সিক্সটি টু চলছে তোমার। দেখে টোয়েন্টি সেভেন লাগছে। আমার চেয়েও তিন বছরের ছোট তুমি। বেডে শুয়ে আছো কেন? ওঠো শীঘ্রই।

আমার বাবা ভেজা চোখে হাসতে হাসতে সেই যে দু’বছর আগে আমার হাত ধরে শোয়া থেকে উঠে বসেছিলেন এরপর দাঁড়াতে দেড় সপ্তাহের বেশি সময় নেননি। এর ঠিক এক মাসের মাথায় রমনাপার্কে বাবা ছেলে সকাল বিকেল দৌড়ের পাল্লা দিয়ে বেড়াই। এই দুই বছরে সেই দৌড়ের বিন্দুমাত্র হেরফের হয়নি। আসলে আমার জন্যই বাবা অসুস্থ হয়েছিলেন। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি পরে প্রথমবারের মত ফোনে আমার কন্ঠ শুনে বাবা নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলেন। শুরু করেছিলেন অনিয়ম। নাওয়া-খাওয়া ভুলতে বসেছিলেন। অনিয়মিত জীবন যাপন বাবাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কেউ না জানুক আমি ঠিকই জানি, বাবার এই নতুন জীবনের পেছনে আমার মায়ের অবদান অনস্বীকার্য।

বাবাকে ছেড়ে আমার আর ফেরা হয়নি ইংল্যান্ডে। বাবা আমায় ধীরে ধীরে পুরাণ ঢাকার বাসিন্দা করে তুললেন। উর্দু ও কুট্টি ভাষায় এক আধটু চালিয়ে নেয়ার মত কথা বলতে পারি। তবে বাবার ইচ্ছে শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলি যেন। ক’দিন হলো জবের জন্য বিভিন্ন কোম্পানিতে এপ্লিকেশন মেইল করছি। টিনাকে এদেশে নিয়ে এসে বিয়ে করবো প্ল্যান করছিলাম। বাবা তিনতলার পুরোটাই আমার আর টিনার জন্য ভেঙে নতুন করে গড়ার কাজে হাত দেবেন এমন একটা সময়ে খবর এল টিনার ওয়েডিং সেরেমনির। একজন উঠতি হলিউড অভিনেতার খুবই শর্ট টাইমে প্রেমে পড়েছে টিনা। অতঃপর বিয়ে।

সবকিছু শেষ হয়ে গেল। প্রচন্ড বিধ্বস্ত অবস্থায় পিয়ানো নিয়ে বসেছিলাম। এটা বাবার পিয়ানো। বাবার কাছথেকে শেখা পিয়ানোয় সুর তোলা। দুই বছরের নিয়মিত প্রাক্টিস। খুব একটা খারাপ বাজাই না। টিনার ওয়েডিং রিসিপশনের দিন কেমন ওলট-পালট বাজালাম। তা শুনেই মিথি নামের মেয়েটি কী জানি বুঝে নিল। ওর এই আগ বাড়িয়ে বুঝে নেয়া শান্ত স্বভাবের আমিকে অশান্ত করে ছাড়লো।
বৃষ্টি মুখর সেই রাতের অন্ধকারে মেয়েটিকে ঠিক করে চেনা যায়নি। তবে কয়েক বার বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় তার চেহারার ঠিকরে ওঠা বিষন্ন রূপ আমায় থমকে দিয়েছিল। মিথির চোখে জল দেখেছি মনে হল। যদিও মুখটি বৃষ্টির পানিতে ভেজা ছিল। তবু মন বলল ওতে অশ্রু মেশানো। বুঝিনি ওভাবে কেন ছুটে পালালো। কথার মাঝখানে এভাবে চলে যাওয়া ইংলিশ কালচারে ভীষণ অভদ্রতা। সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। মিথির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। এরপরেও কী এক অমোঘ টানে ওর সাথে কথা বলার জন্য সে রাতে আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। ভেতর থেকে বারান্দায় চোখ রেখেছিলাম। মধ্যরাতে ওর আগমন আমার মনে প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। আবারও অভদ্রের মত কথার মাঝখানে জবাব না দিয়েই চলে গেল। পরদিন বাবাকে সব খুলে বললাম। বাবা হাসলেন আর বললেন,

— বাঙালী ললনার খপ্পরে পড়ো না সৌরভ। ওরা দুর্বোধ্য। তোমার ঐ ইংলিশ কালচারের নর্মস ভুলেও আশা কোরো না। বাঙালী মেয়েরা খুব লাজুক এবং অহংকারী।

— বাট ড্যাড অহংকার বাজে জিনিষ না?

— হ্যাঁ অবশ্যই বাজে। কিন্তু বাঙালী মেয়েদের বেলায় এ অহংকার সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিয়ের আগে পুরুষের স্পর্শ না পাওয়া মেয়েগুলো অনেক বেশিই লাজুক এবং আপন সম্ভ্রম নিয়ে বেশ অহংকারী হয় ওরা। মিথি সম্ভবত ধর্মীয় রক্ষণশীলতায় বেড়ে ওঠা মেয়ে। যে কারণে লজ্জা ওর ভূষণ। তুমি যত সহজে কথা বলবে ততটা গ্রহণ করার ক্ষমতা মিথির না থাকার সম্ভবনা বেশি।

— ওহ তাই বলো!
— সৌরভ?
— ইয়েস ড্যাড!
— তোমার ভালো লাগে মিথিকে?
— জানি না ড্যাড। কথা বলতে ইচ্ছে করে।

— অপেক্ষা করো। মিথির কথা বলতে ইচ্ছে হলে সে খুঁজবে তোমায়, যেমন করে তুমি খোঁজো।

— কতক্ষণ অপেক্ষা করবো ড্যাড? আইমীন, টাইম বলো। মিথি কখন কথা বলতে খুঁজবে আমায়?

বাবা মৃদু হেসে টিজ করলেন,
— আহা আমার অশান্ত ছেলেটা!

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে