দু মুঠো বিকেল পর্ব-৫৭+৫৮+৫৯

0
1939

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_৫৭
Writer-Afnan Lara
.
রিমঝিম হসপিটালের বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে,তার চোখ একবার যাচ্ছে সামনে বসে থাকা স্পর্শর দিকে আবার মাঝে মাঝে এদিক ওদিকেও যাচ্ছে
আর স্পর্শর চোখ রিমের হাতের দিকে,যেটাতে ব্যান্ডেজ করা
রিম ঢোক গিলে একটু নড়েচড়ে বসছে বারবার,স্পর্শ হাতের ঘড়িতে কটা বাজে সেটা দেখলো তারপর রিমকে হুট করে টেনে বেড থেকে নামিয়ে হাঁটা ধরলো
রিম কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না,শুধু এটা বুঝেছে যে স্পর্শ খুব রেগে আছে
.
স্পর্শ রিমকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলো,মা বাবা আর রিহাব জিজ্ঞেস করছে বারবার যে তারা দুজন এত রাতে কোথায় গিয়েছিলো আর রিমের হাতে ব্যান্ডেজই বা কেন
মা তো হট্টগল শুরু করে দিয়েছেন রিমের গলার সোনার চেইনটা মিসিং দেখে
স্পর্শ রিমের হাত ছেড়ে দিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে গেছে
রিম সবাইকে ঘটনাটা বলে নিজেও রুমে ফিরে আসলো,স্পর্শ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে
রিম আস্তে করে কাছে এসে বললো”সসসসসসসরি,আমি সত্যিটা জানার জন্য আর আশিক ভাইয়াকে দেখার জন্য গিয়েছিলাম ওখানে,ব্যস এই টুকুই,,পথে হাইজ্যাকার এ্যাটাক করলো
প্রথমে চেইন দিতে চাচ্ছিলাম না বলে এমনটা করে ফেললো
আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম যে কত রাত হয়ে গেছে,আমি একা
.
স্পর্শ চুপচাপ জানালার গ্রিল ছুঁয়ে তার রুমের দিকে তাকিয়ে আছে
রিম স্পর্শর ঝুলানো হাতটা ধরে বললো”কথা বলবেন না?”
.
স্পর্শ হাত ছাড়িয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো চুপচাপ
রিমের কান্না আসছে ওর এমন রাগ দেখে
সে নিজেও বিছানায় এসে বসলো কিন্তু তার ঘুম আসলো না,কারণ প্রিয় মানুষটা যে তার উপর রেগে আছে
ব্যাপারটা খুব কষ্টের,,
আসলে দোষটা আমারই,,আমি দাপট দেখিয়ে এত রাত করে বের হয়ে এত বড় বিপদ ডেকে আনলাম
কিন্তু আমার যে কিছুই করার ছিল না,উনি তো আমাকে সত্যিটা বলতেই চাচ্ছিলেন না
.
কি হলো কথা বলবেন না?
.
……?
.
রিমের আর কিছু করার নাই,মুখ আরেকদিকে ঘুরিয়ে সেও শুয়ে পড়েছে এখন

ভোর হয়ে গেছে,,,রিম খুব সযত্নে স্পর্শর বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুুমাচ্ছে,ব্যান্ডেজ করা হাতটা ওর গায়ে লাগিয়ে
স্পর্শ জেগে গেছে আরও আগে,,নড়লে রিম জেগে যাবে বলে নড়ছে না সে
কাল রাতে রাগ দেখানোটা জরুরি ছিলো,,চড় মারাও উচিত ছিল এমন বেকুবি কাজের জন্য,কিন্তু সে নিজেই আগে থেকে হাতে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে বসেছিল বলে আর আঘাত দিলাম না,
,ও বুঝে না ওর এরকম কাজের জন্য আমার সাথে সাথে নিজেও বিপদে পড়বে,আর পড়েছেও
মা যখন শুনবে তার দেওয়া সোনার চেইনটা খোয়া গেছে,সব মাথায় তুলবে,নতুন ঝামেলা হতে চলেছে এখন
এই মেয়েটা কবে যে বুঝবে,সেদিন আমি থাকবো কিনা সেটাও তো জানি না
.
রিম এবার জেগে গেছে,কারণ চারপাশ থেকে আজান শুনা যাচ্ছিল
রিম উঠে বসে চোখ ডলে সবার আগে বললো”সরি”
.
স্পর্শ তাও কথা বললো না ওর সাথে,,পাঞ্জাবি টেনেটুনে সে গেলো ফ্রেশ হতে
রিমের রাগ হলো খুব,ঘুম থেকে উঠার পরেও রাগ দেখাচ্ছে,এত দেমাগ??
রিম বিছানা থেকে নেমে হনহনিয়ে স্পর্শর সাথে সাথে ওয়াসরুমের দিকে ছুটলো
স্পর্শ দরজা লাগানের আগেই সেও ঢুকে গিয়ে বললো”বের হবো না আমি,আগে থেকে বলে দিচ্ছি”
.
রিমঝিম আমার মেজাজ এমনিতেও গরম হয়ে আছে,আর বাড়াবা না
.
রিম কোমড়ে হাত দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো”কেন???কি করবেন কি আপনি?”
.
মার খাবা?খুব শখ?
.
রিম ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো”মারবেন?মারেন,তাও রাগ দেখাবেন না,আমার ভালো লাগছে না একটুও”
.
স্পর্শ রিমকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো”আর কখনও আমাকে না বলে এভাবে বেরিয়ে যাবা না,কাল যদি তোমার আরও খারাপ কিছু হয়ে যেতো তখন আমি কি করতাম?”
.
সরি,,আর কখনও এমনটা হবে না
.
আই এম সরি টু,এখন যাও রেস্ট নাও,,আর শুনো
.
কি?
.
মা গলার চেইনটার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে আমি নিয়েছি,কেন নিয়েছি সেটাও বলতে হবে না,,শুধু বলবা আমি নিয়েছি,ঠিক আছে?
.
মিথ্যা কেন বলবো?
.
সত্যি বললে মা তোমার উপর অনেক অনেক রেগে যাবে,সেটা ভাল?আমি নিয়েছি শুনলে মা রাগ করবে না
.
ওকে
.
রিম চলে গেলো,,স্পর্শ মনে করার চেষ্টা করছে চেইনটার ডিজাইন কেমন ছিল,বাবার থেকে টাকা নিয়ে সেম একটা চেইন বানিয়ে নিতে হবে,,যাতে মা পরে চাইলে সাথে সাথে দিয়ে দিতে পারি

রিম আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে,স্পর্শ ফোন নিয়ে ছাদে এসে জাকির চাচার দলের একটা লোককে বেশ কয়েকবার কল করার পর সে রিসিভ করলো
স্পর্শ ওকে জানালো সে জাকির চাচার সাথে সামনা সামনি কথা বলতে চায়
.
লোকটা শুরুতেই বলে দিল সম্ভব নাহ
.
স্পর্শ ধমকিয়ে বললো”সে সিরিয়াসলি দেখা করতে চায়,জরুরি কিছু কথা আছে”
.
লোকটা আর কোনো কথা না বলেই লাইন কেটে দিয়েছে
স্পর্শর মেজাজ গরম হচ্ছে অনেক
সামান্য দেখা করতেও এত ভেজাল লাগে,একবার হাতের কাছে পাই মেরে এরকম দাম বের করিয়ে দেবো
.
রিমঝিম ঘুম থেকে উঠে স্পর্শকে না দেখে আবারও চিন্তায় পড়ে গেলো,,,হুরমুরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো সে
রুম থেকে বের হতে না হতেই রিম দেখলো স্পর্শ বাসায় ঢুকছে
রিম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চেয়ে রইলো ওর দিকে
স্পর্শ রিমকে দেখতে পেয়ে বললো”আজ আমাদের বাসায় ফিরে যাব আমরা,,আমার আবার অফিস শুরু করতে হবে,অনেক ঝামেলা”
.
হুম,,আচ্ছা
.
আবারও চিন্তা করছো?
.
নাহ,আসুন তো এদিকে
.
রিম স্পর্শর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো রুমে,ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে নিচু হয়ে বসলো,তারপর স্পর্শর হাতদুটো ধরে বললো”ঐ জাকির চাচার সাথে যা ভেজাল করার করে ফেলেছেন,আর করতে হবে না,আমি চাই না আর কোনো বিপদ আসুক,আমি যদি জানতে পারি আপনি আবারও ঐ বিপদের মুখোমুখি হতে চেয়েছেন তাহলে আমি আগের রিম হয়ে যাবো যে আপনাকে ঘৃনা করতো”
.
স্পর্শ হাসলো,যেন রিমের কথাটা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে চলে গেছে
.
রিম ভ্রু কুঁচকে বললো”কথা কানে যায়নি?”
.
হুম,গেছে, এবার উঠুন, কয়টা বাজে খবর আছে??আমি তো যাচ্ছি রেডি হতে,,অফিস যাওয়ার আগে তোমাদের বাসায় বাজার করে দিয়ে যেতে হবে,সেটার কাজ সেরে তারপর যাব
নিজের খেয়াল রাখবে,,এমনিতেও তুমি এখন দূর্বল অনেক
.
কিসের অনেক,আমি একদম ফিট
.
তা তো দেখতেই পারছি,সরো এখন,আর বাহিরে কি করছো?শুয়ে থাকো চুপচাপ
.
হাতের সামান্য ব্যাথা দেখে এমনটা করছেন?
.
আমার মনে হয়েছিলো হাতে ব্যাথা আমি পেয়েছি,তার উপর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে,কি পরিমান টেনসন হয়েছিল আমার

সকাল দশটার সময়ে রিম স্পর্শদের বাসায় ঢুকে চোরের মতন এদিক ওদিক ঘুরাফিরা করছে,রোকসানা বেগমের নজরে এখনও তার গলার চেইনটার উধাও হওয়ার বিষয়টা পড়েনি
রিম স্পর্শের রুমে এসে এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে,,রোকসানা বেগমকে সে স্পর্শর চেয়েও বেশি ভয় পায়
কোনো মতে এখন উনার চোখকে ফাঁকি দিয়ে গাপটি মেরে সে এখানে বসে আছে
রোকসানা বেগম হঠাৎ দুপুর বারোটার দিকে রিমকে একটা ডাক দিলেন
এতক্ষণ সিরিয়াল দেখছিলেন
রিমের কলিজা কাঁপছে অনবরত,,পা টিপে টিপে সে রুমের দিকে গেলো,,রোকসানা বেগম বললেন”আজ বিকালে কিছু মেহমান আসবে ওকে দেখতে ও যেন সেজেগুজে থাকে,রিম মাথা নাড়ালো
রোকসানা বেগম টিভির থেকে চোখ সরিয়ে রিমের দিকে এক নজর তাকালেন তারপর বললেন”নীল রঙের শাড়ী পরিও”
কথা শেষ করতে যেতেই তার চোখ গেলো রিমের খালি গলার দিকে
রিম ঢোক গিলে ফেলেছে এমন চাহনি দেখে
.
একি!!তোমার গলা খালি কেন?
.
ইয়ে মানে আসলে
.
কি মানে মানে করছো??চেইন খুলেছো কেন?
.
রিম ভয়ের চোটে স্পর্শর শিখিয়ে দেওয়া মিথ্যা কথাটাও বলতে পারছে না,রীতিমত কাঁপছে ভয়ে
রোকসানা বেগম উঠে এসে বললেন”কি হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
.
রিম রোকসানা বেগমকে রেগে থাকতে থেকে ফরফর করে সত্যি কথাটাই বলে দিলো
যে কাল হাইজ্যাকার ধরে নিয়ে গেছে
.
রোকসানা বেগম এক চিৎকার করলেন,ওপাশ থেকে আসমা আর আঁখি দৌড়ে আসলো উনার চিৎকার শুনে
উনি মাথায় হাত দিয়ে বললেন”কি অলক্ষী ঘরে ঢুকালাম,আমার এত স্বাদের চেইন কিনা চোরকে দিয়ে দিলো,আমার নিজের হাতে গড়া এই সংসার এই মেয়ে তো মনে হয় দুদিনেই শেষ করে দিবে”
.
মা আমি আসলে…
.
চুপ,একদম চুপ,আবার মুখে মুখে কথা,তোমার সাহস হলো কি করে রাত করে বের হওয়ার,নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার
অবশ্য কাকে কি বলছি,তোমার তো এমন রাত বিরাতে বাসা থেকে পালানোর স্বভাব আছে পুরোনো,তুমি তো এসবে পটু
সবসময় ধরা খাও না,,, খেলে তো সেদিন যেদিন আমার দেওয়া চেইনটা গলায় ছিল তোমার
হাত কাইটা নিয়ে যায় নাই??
.
রিম চোখের পানি মুচছে বারবার,,তার মা বাবা এমনকি রিহাবও কখনও এমন করে কথা বলেনি ওর সাথে,খুব খারাপ লাগছে ওর
এখন মনে হচ্ছে মিথ্যাে বললেই হয়ত সে বেঁচে যেতো
এত কথা আর শুনতে হতো না
রোকসানা বেগম রেগে ফোন হাতে নিয়ে স্পর্শর বাবাকে ফোন করছেন জানানোর জন্য
রিম কাঁদতে কাঁদতে রুমে ফিরে এসেছে
আঁখি ওর কাঁধে হাত রেখে বললো”মায়ের কথায় কষ্ট না পেতে,মা এমন করেই কথা বলে”

বিকালের দিকে স্পর্শ বাড়ি ফিরলো,রিম ঘন্টাখানেক আগেই দুপুরের খাবার খেয়ে এখন ঘুমাচ্ছে,স্পর্শ অফিসের ব্যাগ টাকে টেবিলের উপর রেখে ফ্রেশ হয়ে আসলো,তারপর আস্তে করে রিমের কাছে এসে ওর কপালে চুমু দিয়ে চলে গেলো লাঞ্চ করতে,দুপুরে খাওয়া হয়নি তার
টেবিলে সব রাখা আছে
খাবার মুখে দিতেই ওর মনে আসলো রিমের চোখে পানি দেখেছিল,নাকি মনের ভুল,??ঘুমিয়ে আবার মানুষ কাঁদবে কেন
খাওয়া শেষ করে স্পর্শ ও রিমের পাশে এসে শুয়ে পড়লো,,এতদূর জার্নি করা টাফ ব্যাপার
রিমকে জড়িয়ে ধরলো ক্লান্তি কমানোর জন্য,তখনই সে খেয়াল করলো রিমের হাতে ব্যান্ডেজ নেই
অবাক হলো সে পরে ভাবলো হয়ত বিরক্ত লাগছিল বলে খুলে ফেলেছে
এবার ওর নজর গেলো ফ্লোরের দিকে
ফ্লোরে যত্রতত্র হয়ে পড়ে আছে রক্তমাখা ব্যান্ডেজটা
পাশেই ডাস্টবিন, তাহলে সেখানে না ফেলে এভাবে ফ্লোরে ফেলে রেখেছে কেন মেয়েটা?
কিছু একটা তো হয়েছে,কিন্তু কি হয়েছে?
রিম??রিম??উঠো
.
রিম নড়েচড়ে কম্বলের ভেতরে চলে গেলো ভালোমতন,শীতের বিকেলটায় উষ্ণতায় পরিপূর্ণ থাকে বলে এসময়ে উঠতে মন চায় না তেমন
রিমের ও তাই,,বরং পাশে স্বামীকে পেয়ে সে তাকেও জড়িয়ে ধরলো ভালোমতন,,এবার আরও ভালো ঘুম হবে
স্পর্শ ও তার বউকে আগলে রাখলো,,মাঝে মাঝে অনেক বাচ্চামো করে মেয়েটা
স্পর্শ রিমের কপালের উপরের চুলগুলো হাত দিয়ে বুলাতে বুলাতে চোখটা বন্ধ করলো,,যখন চোখ খুললো তখন সে রিমকে পাশে পেলো না
দরজা খোলা,মনে হয় চলে গেছে
আর শুয়ে থেকে কাজ নেই,দেখি একটু টিভি দেখি,,আজকের খবর দেখবো,সাথে গরম গরম চা আর পাকোড়া,রিম নিশ্চয় এখন পাকোড়া বানাবে
ভাবতে ভাবতে স্পর্শ সোফায় এসে বসলো,রোকসানা বেগম তার রুম থেকে বেরিয়ে স্পর্শকে দেখে গালটা আরও বেশি ফুলালেন,চুপচাপ ডাইনিং থেকে পানি নিয়ে খেয়ে পুনরায় নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি
রিম পাকোড়ার বাটি স্পর্শর সামনে রেখে চলে যেতে নিতেই স্পর্শ রিমের শাড়ীর আঁচল ধরে টান দিলো
চলবে♥

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_৫৮
Writer-Afnan Lara
.
মন খারাপ কেন?
.
রিম মুচকি হেসে বললো”কোথায়??এই তো বেশ কাজ করছি”
.
তাহলে পাশে বসো
.
মাকে পাকোড়া দিয়ে আসি তারপর?
.
ঠিক আছে
.
রিমঝিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মায়ের রুমে গিয়ে পাকোড়া দিয়ে আসলো,আঁখিকে ডেকে তারপর স্পর্শর পাশে এসে বসে বললো”অফিস কেমন কাটলো?”
.
ভালোই,তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছো?
.
না তো
.
কাল সকাল সকাল আমরা একটা জায়গাতে যাবো
.
কোথায়??
.
সারপ্রাইজ
.
আগে বললে ভালো হয়
.
ক্লু দিচ্ছি,,আমরা হানিমুনে যাচ্ছি
.
রিম সব রাগ ভুলে গিয়ে এক গাল হাসি ফুটালো মুখে,এক দৌড়ে সে রুমে চলে গেছে,স্পর্শ রিমের এমন হাসিখুশি রুপটাই চেয়েছিলো যেটা এতক্ষণ ছিলো না
এখনও হানিমুনের টিকেট বুক করা হয়নি,আগে রিমের মন ঠিক করা জরুরি ছিল বলে আগেই জানিয়ে দিলো
পকেট থেকে ফোন বের করে এখন টিকেট কাটলো সে
.
রোকসানা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে বললেন”আসমা চা আসতে এত দেরি কেন?”
.
চা হয়ে আসছে আপা,এই তো দিচ্ছি
.
রোকসানা বেগম স্পর্শর দিকে একটিবার তাকালেন এরপর ওর রুমের দিকে তাকালেন,সেখানে রিম হাসি মুখে ব্যাগে জামাকাপড় সব পুরতেছে
রোকসানা বেগম ব্রু কুঁচকে বললেন”কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
.
অফিসের কাজ তিনদিন অফ থাকবে কারণ ওখানে বিল্ডিং পেইন্টিং এর কাজ হচ্ছে,,তাই এ সুযোগে রিমকে নিয়ে ঘুরতে যাবো
.
রোকসানা বেগম চোখ বড় করে বললেন”আমার এত শখের সোনার চেইনটা কি করে খোয়ালো তাতে কি তোর কিছুই যায় আসলো না?”
.
স্পর্শ টিভির থেকে চোখটা সরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো,তার আর বুঝতে বাকি নেই যে রিম মাকে সত্যিটাই বলেছে,আর মা তাকে সাত পাঁচ কিছু একটা বলেছে আর সেজন্যই তখন থেকে ওর মন খারাপ ছিলো,এবার সবটা ক্লিয়ার
.
কিরে?
.
না কিছুই যায় আসলো না,রিমের বেশি ক্ষতি হয়নি এটাতেই আমি খুশি,ওমন চেইন আরও হাজারটা পাওয়া যাবে
.
ওটা আমি শখ করে বানিয়েছিলাম,সেম টা পাওয়া যাবে না
.
যদি আমি এনে দিই??
.
তুই কেন দিবি,যে হারিয়েছে তার বাপরে বল এনে দিতে,টাকা কি গাছে ধরে?
.
রিম পর্দার আড়ালে থেকে সবটা শুনছে
.
স্পর্শ মুচকি হেসে বললো”আমি দেওয়া আর রিমের বাবা দেওয়া একি ব্যাপার,তুমি চেইনটা পেলেই হলো তো??
আর চেইনটা তো তুমি রিমকে দিয়ে দিয়েছিলে তাহলে এখন কেন তোমার চেইনটা চাই?”
.
দিয়ে দি নাই,ওটা বংশগত, রিম তার পুত্রবধূকে দিতো,কিন্তু সেটা আর হলো কই
.
নিয়ম তৈরি হয় আবার পরে ভঙ্গ ও হয়,আবার নতুন নিয়ম হয়
এখন নাহয় নিয়মটা ভাঙ্গলো,সেম টু সেম চেইনটা কয়েকদিন পর থেকে রিমের গলায় দেখতে পাবে তুমি,আর ভবিষ্যতে আমার ছেলের বউকে সেই চেইনটাই রিম পরিয়ে দেবে
.
কথাটা বলে স্পর্শ উঠে চলে গেলো
.
রিম চোরের মতন এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে,রোকসানা বেগম রাগ হলেন আবার খুশিও হলেন,চেইন আরেকটা আসছে তা ভেবে,রিমকে যেটা দিয়েছিল সেটা পুরান ছিল,সেম যদি এনে দেয় তবে আমার বাবা কেনো আপত্তি নাই
আমার কথা হলো আমার যা চাই তা আমাকে দিয়ে দিলেই হবে,এবার তোমরা যেখানে খুশি সেখানে যাও,যা খুশি তা করো,আমার কি
.
স্পর্শ রিমকে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে মনে লজ্জাবোধ করলো,কারণ যেখানে ওর দোষ ছিল না,চেইন হারালো সাথে সে নিজেও চোট পেলো তার পরেও তাকে এতকিছু সইতে হচ্ছে
.
রিম মাথা নিচু করে বারান্দার দিকে চলে গেলো,আর কতক্ষণ এভাবে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকবে সে??
তার একটুও রাগ হচ্ছে না,বরং খারাপ লাগছে এই ভেবে যে তার কারণে এত দামি একটা চেইন খোয়া গেলো
মা যা বলেছেন তা ঠিক,তিনি তার জায়গায় একদম ঠিক
দোষটা সম্পূর্ন আমার,আমি কেন কাল রাত করে বের হতে গেলাম,কেন!!?
.
রিম চোখ বন্ধ করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে,স্পর্শ ওর কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে রেখে বললো”মায়ের কথা কখনও ওভাবে নিবা না,দেখবে সব ভালো লাগছে”
.
হু
.
আমার মা,তোমার ও তো মা তাই না?
.
হুমমম
.
অনেক অনেক জায়গায় ঘোরাবো,দেখবা মন ভালে হয়ে গেছে
.
রিম পিছন ফিরে মুচকি হেসে বললো”ঘুরার কথা শুনেই খুশি লাগছে,অনেকদিন হলো দূরে কোথাও ঘুরতে যাই না আমি”
.
আফসোস বারতি ছুটি নিতে পারলাম না,তিনদিনেই সব ঘুরাফিরা শেষ করতে হবে
.
চলবে
.
চলবে??
.
রিম নাথা নাড়াতে যেতেই ওর চোখ গেলো তারই বারান্দার দিকে,সেখানে তামিম নিচে গোল হয়ে বসে এমন ভাব ধরে আছে যেন ওর দুনিয়ায় কেউ নাই,একেবারে নিস্ব
ফকিরের আল্ট্রা প্রো ম্যাক্স মনে হচ্ছে ওকে দেখে
রিমের এমন ওদিকে চাওয়া দেখে স্পর্শ ও তাকালো
.
দেখে মনে হচ্ছে তামিম বেশ বড় সড় ছ্যাকা খেয়েছে,গাল ভিজে একাকার,অনেক কেঁদেছে বুঝা যাচ্ছে,কিন্তু ওর এমন অবস্থার কারণ কি
.
রিম একটু এগিয়ে গিয়ে ডাক দিলো ওকে
তামিম যে কোন দুনিয়ায় আছে,তার কোনোদিকে কোনো খবর নেই
স্পর্শ একটু জোরে ডাক দিলো ওকে
এরপর ভেতর থেকে মা এসে দেখলেন তামিম এমন করে বসে আছে আর রিম স্পর্শ মিলে ওকে ডাকছে ক্রমাগত
মা মুচকি হাসলেন,আবার তামিমের কথা ভেবে মুখটা একটু ছোট করে বললেন”তামিমের কাঁটা আলা গাছটা আবারও উধাও”
.
কথাটা শুনে স্পর্শ আর রিম ফিক করে হেসে দিলো,কিন্তু তামিমের এমন হাল দেখে হাসি কোনোমতে থামিয়ে তারা অবাক হয়ে বললো”কখন??কে চুরি করলো”
.
তামিম ওদের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো”আপু এনে দাও আমার গাছটাকে,আমি জানি রিনতি নিয়েছে”
.
স্পর্শ মুখে হাত দিয়ে হাসলো আবারও,তারপর হাসি থামিয়ে বললো”শালাবাবু আর কেঁদো না,আমি খুঁজে দেবো,এরকম হতদরিদ্রের মতন বসে থাকা তোমাকে মানায় না একদমই,আমরা তো ভেবেছিলাম আরও বড় কিছু হয়েছে,এটা তো জাস্ট একটা গাছ”
.
এটা আমার বেস্টফ্রেন্ড,আমাকে অলওয়েজ কাঁটা দিয়ে হেল্প করে রিনতিকে এ্যাটাক করতে,আর তুমি বলছো কিছু না??
.
আচ্ছা খুঁজে দেবো,কান্নাকাটি বন্ধ করো এখন
.
তামিম উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত চোখে চেয়ে বললো”যদি আমি গাছটা খুঁজে পাই তাহলে সব কাঁটা রিনতির গায়ে ফোটাবো আমি”
.
রিম স্পর্শকে বিষয়টা দেখতে বলে চলে গেলো নিজের কাজে
রুমে এসে নিজের দুটো সেলোয়ার কামিজ আর একটা শাড়ী নিলো সে,যেখানে যাবে সেখানে পরবে এগুলো,সাথে স্পর্শর ও প্যাকিং করে নিলো
.
রোকসানা বেগম রান্নাঘরে এসে ঠুসঠাস করে পাকোড়া আর আছে কিনা তাই খুঁজছেন
এত ভালো পাকোড়া বানিয়েছে রিম,মন চায় আরও খেতে
.
রিম ব্যাগ গুছিয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো রোকসানা বেগম একবার এক পাতিলের ঢাকনা খুলে দেখছেন ভিতরে কি আছে
রিম এগিয়ে গিয়ে বললো”কিছু লাগবে মা?”
.
না
.
রোকসানা বেগম মুখ বাঁকিয়ে চলে যেতে নিতেই আবারও থেমে গিয়ে বললেন”পাকোড়া আর নাই?”
.
ছয় পিস আছে,বাবার জন্য রেখেছিলাম,আপনি খান ওগুলা,,আমি নাহয় বাবা আসলে আবার বানিয়ে দিব
.
রোকসানা বেগম সাথে সাথে বললেন”কোথায় পাকোড়া গুলা”
.
রিম তাকের উপর থেকে হটপটটা নিয়ে উনার হাতে দিলো
উনি তো মহাখুশি,হটপটটা নিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে,সিরিয়াল দেখবেন আর খাবেন
রিমঝিম খুব খুশি হলো তার বানানো পাকোড়া উনার এত পছন্দ হয়েছে দেখে,এটাই সে চেয়েছিলো

স্পর্শ রিনতিদের বাসার সামনে এসে দরজা ধাক্কানো শুরু করেছে
পিছনেই তামিম একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,এজ লাইক দারোগা
রিনতির আম্মু এসে দরজা খুলে বললেন”কি ব্যাপার??”
.
স্পর্শ নরমালি জিজ্ঞেস করলো রিনতি কোথায়
.
উনি বললেন রিনতি ঘুমাচ্ছে
.
স্পর্শ এবার বললো”আমাকে কি আপনি রিনতির রুমটা দেখতে দেবেন?ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,আর দরকার হলে আপনিও পাশে থাকতে পারবেন”
.
কি কারনে জানতে পারি?
.
রিনতি তামিমের ক্যাকটাস গাছটা বারবার নিয়ে নিজের কাছে রাখে
.
নিয়ে রাখে না,,ও চুরি করে,সবসময় আমার গাছটা চুরি করে ও
.
রিনতির আম্মু মুখটা বাংলার পাঁচ করে বললেন”আমি তো এই ব্যাপারে জানতাম না,আচ্ছা আসুন,ভিতরে আসুন”
.
স্পর্শ আর তামিম হনহনিয়ে ভিতরে চলে গেলো,রিনতি কোলবালিশ ধরে মরার মতন ঘুমাচ্ছে,স্পর্শ আর তামিম মিলে ওর রুমটা ভালমতন তদারকি করলো কিন্তু গাছটা পেলো না
স্পর্শ মন খারাপ করে রিনতির আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললো”সরি,মনে হয় রিনতি নেয়নি,ভুল হয়েছে”
.
তামিম ফ্লোরে বসে খাটের নিচে চেক করে বললো”ঐ তো আমার গাছ”
.
স্পর্শ সাথে সাথে নিচে বসে তাকিয়ে দেখলো তামিমের গাছটা
কি সাংগাতিক মেয়েরে বাবা!এখানেও কেউ গাছ লুকায়??
.
তামিম গাছটা নিচ থেকে তুলে গাল ফুলিয়ে বললো”ওরে তো পরে দেখে নিব,এখন চলো আমরা যাই,ও ঘুমাক”
.
তামিম তার গাছ নিয়ে চলে গেলো,স্পর্শ ভাবছে এরকম ডেঞ্জারাস পোলাপান আজকালকারই হয়,বাবারে বাবা,একটার থেকে একটা

রিমঝিম কালকের রুম সাজানো থেকে একটা গাঁদা ফুলের মালা নিয়ে এসেছে তার রুম থেকে
ফুলের মালাটা বেশ বড়,স্পর্শ আসার আগেই সে মালাটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে গলার মালা আর মাথার একটা ক্রাউন বানিয়ে নিলো,স্পর্শ রিমকে ফুলের গয়নায় দেখতে অনেক ভালোবাসে,রিম সেটা ভালোমতন জানে,তাই সে এখন এটা করছে
.
স্পর্শ তামিমের কাজ সেরে আশিককে গিয়ে দেখে আসলো একবার,তারপর বাসায় ফিরলো
.
রুমটা অন্ধকারাচ্ছন্ন,,কি ব্যাপার?রিম কোথায়?
.
স্পর্শ রুমের লাইট জ্বালাতে গিয়েও পারলো না,একটা হাত ওর হাতটা আটকে ফেললো,নরম হাতের ছোঁয়া পেতেই স্পর্শ বুঝে গেলো এটা রিম
.
রিম ফিসফিস করে বললো”অন্ধকারে রিমকে খুঁজেন তো দেখি”

কথাটা বলে রিম পিছিয়ে আঁধারে হারিয়ে গেলো
স্পর্শ দরজা লাগিয়ে পা বাড়িয়ে সামনে এগোচ্ছে,রিমের গায়ের কাঁচা ফুলের গন্ধ তাকে জানান দিচ্ছে রিম ঠিক কোথায়
.
রিম??নিজের গায়ের ঐ ফুলগুলো সরাতে পারতে তাহলে হয়তবা কম দেরি হতো তোমায় খুঁজতে
.
রিম জিভে কামড় দিলো,,
ইস রে,যাতে খুঁজে না পায় তা ভেবে হাতের চুড়িগুলো খুলে রেখেছিলাম তাও কাজ হলো না
.
রিম জলদি করে গলার থেকে ফুলের মালাটা খুলতে যাওয়ার আগেই স্পর্শ ওকে ধরে ফেললো
.
খুলতে হবে না,এখনও তো ফুলে কেমন লাগছে তাই দেখা হলো না আমার
.
রিম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়
স্পর্শ হাত বাড়িয়ে ওর গলার মালাটাকে ছুঁয়ে ঘুরাচ্ছে
রিম চোখটা শক্ত করে বন্ধ রাখলো
হাত মুঠো করে রাখলো
তার খুব লজ্জা লাগছে,লজ্জায়য় মরে যাচ্ছে সে
অথচ স্পর্শ ওকে ছোঁয়নি,জাস্ট ফুলগুলো ধরেছে
স্পর্শ নিচু হয়ে ফুলের মালাটা একটু সরিয়ে রিমের গলায় চুমু দিলো
রিম একটু নড়েচড়ে দাঁড়াতেই স্পর্শ ওর কোমড়টা ধরে আটকে ফেললে ওকে
.
এখনও ভয়?
.
উহু
.
তাহলে?
.
জানি নাহ,, লাইট জ্বালাই?
.
নাহ থাক
.
কথাটা বলে স্পর্শ রিমকে তুলে ফেললো,,ওকে বিছানায় নামিয়ে দিয়ে ওর দিকে এগোতে যেতেই রিম ওকে থামিয়ে বললো”তামিম!!”
.
তামিম??কই?
.
আমার রুমে
.
স্পর্শ পিছনে চেয়ে দেখলো তামিম রিমঝিমের রুমে বিছানা পেতেছে
সে এখন,একটা খেলনা নিয়ে বিছানায় বসে খেলছে,মাঝে মাঝে হাতে থাকা দূরবীন দিয়ে একবার একদিকে তাক করছে,জানালার দিকে যদি একবার দূরবীনটা তাক করে তাহলে নদীর এ কূল ও যাবে ও কূল ও যাবে,সেই জানালায় ও পর্দা টাঙানো না আর এই জানালায় ও না
.
বাচ্চা শালা পাওয়ার অপকারিতা!!!
.
রিম হাসতে হাসতে শেষ
চলবে♥

দু মুঠো বিকেল⛅♥
#পর্ব_৫৯
Writer-Afnan Lara
.
পরেরদিন আমরা দুজন লাভ বার্ডস গিয়েছিলাম কক্সবাজার,,কি সুন্দর জায়গা,ভাবতেই আমার খুব ভালো লেগে উঠছিলো,,
পুরো জার্নিতে আমি স্পর্শর বাম হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম,মনে মনে কত আনন্দ ছিলো আমার,আবার মাঝে মাঝে ঘুমাতাম ও,,,বাসে উঠলেই ঘুম পায় আমার
স্পর্শ বেশ আগলে রেখেছিলো আমায়
বাস থেকে যখন নামি তখন সন্ধ্যাবেলা ছিলো,আমরা দুপুরেই রওনা হয়েছিলাম,আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো
চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে তবে বাস যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখানে যথেষ্ট আলো ছিলো
আমি আমার হাতের সাইড ব্যাগটা ধরে ভেতরে ফোন আছে কিনা সেটা চেক করে পাশে তাকাতে তাকাতে বললাম”এবার আমরা তো হোটেলে যাব তাই না?”
কথা শেষ করে দেখি আমার পাশের মানুষটা নেই,ভাবলাম বাস থেকে নামেনি
আমি বাসে উঠলাম, পুরো বাস খালি,আমাকে খালি বাসে উঠতে দেখে ড্রাইভার বললো”বাস যাবে না”
আমি নেমে আসলাম,এদিক ওদিক চারিদিকে স্পর্শকে খুঁজলাম,কিন্তু পেলাম না
দুচোখ ভারী হয়ে আসছিলো আমার,কারন সময়টা এমনই ছিলো
হাতে দুটাকাও ছিল না আমার,সাইডব্যাগে শুধু ফোন আর টিসু
ফোন নিয়ে তাকে ২০/৩০বারের মতন ফোন করলাম আমি,ফোন বারবার সুইচড অফ বলছে
মানুষটা গেলো কোথায়,আমি কি করবো কোথায় যাব এই মূহুর্তে?
নিজেকে শক্ত করে একটা দোকানে গিয়ে বসলাম,রিহাব ভাইয়াকে ফোন করে সবটা জানালাম,ভাইয়া আমাকে কাঁদতে মানা করে বললেন আশেপাশের কোনো বিকাশের দোকানে গিয়ে বসতে,, টাকা পাঠাবেন আমার জন্য,আমি যেন বাসায় ফিরে আসি
আমি রাজি হলাম না কারন আমার স্পর্শ তো এখানে,আমি তাকে এখানে দেখেছিলাম,মূহুর্তে সে তো দূরে কোথাও যেতে পারে না,সে আসবে!
.
কিন্তু না,ভাইয়ার কথার অবাধ্য হয়েছি ঠিক তবে ভাইয়াই ঠিক ছিলো,স্পর্শ রাত দশটা অবদি ও আসেনি,কাঁদতে কাঁদতে আমি চোখে মুখে ঝাপসা দেখছি এখন
রিহাব ভাইয়া জানালাে তিনি আমাকে আনতে রওনা হয়েছেন
আমি যে স্পর্শকে ছাড়া যাবো না,বাস থামার আগেও তো স্পর্শ আমার পাশে ছিলো,তাহলে সে কোথায় এখন??রাত গভীর হচ্ছে,আমি যে দোকানে এতক্ষণ ছিলাম তারা দোকান বন্ধ করে চলে গেছে
আমি এখন ফাঁকা রোডে গায়ের বেগুনি শালটা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছি,আশেপাশে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর এসে গেছি
স্পর্শকে বহুবার ডেকেছি,কিন্তু সে সাড়া দেয়নি
দম বন্ধ লাগছে আমার,কিছুই করতে পারছি না
এত সহজে জীবনটা বদলে যেতে পারে তা আমি আমাকে দিয়েই টের পেলাম
ভাইয়া আসতে আসতে রাত বারোটার উপর বাজলো
আমি শুকনো মাটিতে বসে আছি মূর্তির মতন
আর কোনো উপায় নেই,সবচেয়ে কাছের মানুষটা আমার থেকে হারিয়ে গেছে,আর আমি নির্বাক হয়ে বসে আছি
ভাইয়া এসেই আমাকে মাটি থেকে তুলে দাঁড় করালেন,সবটা জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু আমি আবেগপূর্ণ হয়ে গেছি
কথাই বলতে পারছি না কান্নার জন্য
ভাইয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না,হাত ধরে নিয়ে গেলেন পুলিশ স্টেশনে
উনারা রিপোর্ট লিখলেন,আমি তাদের বললাম আমি তার হাত ধরে বাস থেকে নেমে হাত ছেড়ে বাম পাশে তাকিয়ে ব্যাগ চেক করে আবার যেইনা ডান পাশে তাকালাম আর তাকে দেখিনি
ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাস স্টেশনে আসলেন,ঢাকায় ফিরে যাবেন,আমি তার পা ধরে বললাম আমি যাব না,আমি স্পর্শকে না নিয়ে কোথাও যাব না
স্পর্শ আমাকে বলেছিলো সে সবসময় আমার পাশে থাকবে,তার অনুপস্থিতি যেন আমি বিশ্বাস না করি
ভাইয়া ধমক দিয়ে আমাকে জোর করে ঢাকায় নিয়ে আসলেন
বাড়ি ফিরার সাথে সাথে হাজার হাজার অপমান জনিত কথা আমায় শুনতে হলো,আর সেটা বললেন সয়ং রোকসানা বেগম,আমার শাশুড়ি
তার মতে আমি অলক্ষী,আমার জন্যই স্পর্শর বিপদ হয়েছে,তিনি রিপন থেকে সব শুনেছেন
রোকসানা বেগমের একটা কথাও গায়ে লাগছে না আমার
আমার পুরো দেহ জুড়ে শিহরন,স্পর্শকে সন্ধ্যা থেকে না দেখতে পাওয়ার কষ্ট আমাকে শেষ করে দিচ্ছে
ভাইয়া আমাকে ঐ বাসায় একটা মিনিট ও থাকতে দিলেন না,নিজের বাসায় নিয়ে আসলেন
বসে বসে স্পর্শকে ফোন করে যাচ্ছি,বারবার সুইচড অফ বলছে কেন ওরা??
চোখের পানি মুছতে গিয়ে স্পর্শর রুমটার দিকে চোখ গেলো আমার
আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি কাল এসময়টায় সে আমাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছিলো,গায়ে এখনও সেই ভালোবাসার দাগ লেগে আছে,অথচ সেই মানুষটা নেই
আমার কিছু চাই না এখন,আমার শুধু স্পর্শকে চাই
তামিম খাবারের প্লেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে,আমি আমার ভাইকে কখনও ধমক দিই নাই,অথচ আজ দিলাম,বকলাম ওকে
বললাম চলে যেতে,মনে সুখ নেই আমার,সেই আমি খাবার মুখে তুলবো??
.
দেখতে দেখতে একটা মাস হয়ে গেছে,আর আমি আজও পাগলের মতন কাঁদছি,আমার কান্নার কোনো ফল পাচ্ছি না,আজকেও স্পর্শর নাম্বার অফ বলে
পুলিশ এখনও খুঁজছে তাকে
ভাইয়া চুপচাপ রুমে এসে একটা রিপোর্ট টেবিলের উপর রেখে বললেন”আর এটা বাকি ছিল”
.
আমি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কাঁপা কাঁপা হাতে রিপোর্ট টা নিলাম টেবিলের উপর থেকে
“পজিটিভ”
আমি স্পর্শর সন্তানের মা হতে যাচ্ছি
রোকসানা বেগমের বাসার দরজা আমার জন্য চিরকালের মতন বন্ধ,স্পর্শর বাবা অনেক করে আমাকে নিতে চেয়েছেন কিন্তু রোকসানা বেগমের জন্য পারেননি
তিনি আমাকে আজও দোষী মানেন,হয়ত আমি সত্যি দোষী
যে কিনা বিয়ের তিনদিনের মাথায় স্বামী হারিয়েছে সে তো অলক্ষীই বটে
না সকালে খাচ্ছি,না দুপুরে
রাতে এক মুঠো ভাত তাও মা নিজ হাতে খাইয়ে দেয়,আমাকে নয় আমার পেটের বাচ্চাটার খাতিরে
যখন থেকে জানতে পেরেছি আমার মধ্যে আরেকটা জীবন আছে,একটিবারের জন্যও আমি খুশি হইনি,,
পেটে হাত বুলিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করিনি
আমার সামনে পিছনে ডানে বামে শুধু স্পর্শর ছবি
যে লোকটা আমার ছবির বিরাট বড় একটা পোস্টার তার ফ্ল্যাটের রুমে টাঙিয়ে ছিলো আজ আমি তারই শত শত ছবি দিয়ে আমার রুম সাজিয়েছি
যে লোকটা আমাকে দেখার জন্য সবসময় তার রুমের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতো আর এখন আমি আমার রুমের জানালায় দাঁড়িয়ে তারই রুমটা দেখি
একটিবার তার পোশাকেও হাত বুলানের অধিকার আমার নেই,মা আমাকে ছুঁতে দেননি,ওগুলোতে তো তার গায়ের গন্ধ পাওয়া যাবে তাই না?চেয়েও আমি সেই গন্ধ নিতে পারিনা আজ
কি এক জাহান্নামে আমায় রেখে সে চলে গেলো
.
ইদানিং খাওয়া নিয়ে অনিয়ম করে করে অসুস্থ হয়ে গেছি বেশ
এতই অসুস্থ যে এখন বিছানা থেকে নামতে পারছি না আর
গায়ে অনেক জ্বর আর বমি তো লেগেই আছে
মা কাঁদতেন অনেক,এখন আর কাঁদেন না
কিন্তু আমি প্রতিদিন কাঁদি,এই শোক যে ভোলার মতন না
হয়ত ভুলতাম যদি না পেটে স্পর্শর দেওয়া এই উপহার আসত
পুলিশ কোনো খবর দিতে পারছে না,আশিক ভাইয়া মারা গেছেন,এত এত লড়াই করেও জিততে পারেননি মৃত্যুর সাথে
তমার বিয়ে হয়ে গেছে আরেকটা ছেলের সাথে
সেও কেঁদেছিলো,কয়েক মাস পর ঠিক হয়ে গেছে,তবে সে বিয়ের দিন আশিকের কথা মনে করে অনেক কেঁদেছে
আর আমি মাথা ঠুকরে কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে আমার স্পর্শর সাথে না জানি কি হয়েছে
এখন ছয় মাস হলো,পেট একটু বড় হয়েছে,আমি তাকাই না কখনও,মা বলেছে বড় হয়েছে
আমি শুধু চেয়ে থাকি স্পর্শর ছবিগুলোর দিকে,সে যেন আমার পাশেই আছে
এই দিনটা আসবে সে জানত,সে সিউর ছিলো আর তাই আমাকে বিয়ের পরেরদিন বলেছিল হারিয়ে যাওয়ার কথাটা
যাকে তিনটা বছর ধরে ঘৃনা করেছি,শেষ সময়ে এসে যখন তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি তখন সে আমায় ছেড়ে চলে গেলো
যে সময়ে একটা নারী তার স্বামীকে পাশে চায় সেই সময়টায় আমি তাকে একটিবার ছোঁয়ার কিংবা দেখার ও সুযোগ পাচ্ছি না
আচ্ছা!!আমি মরে কেন যাই না??কি দরকার এ জীবনের??
জ্বর ভালো হচ্ছে না,হসপিটালে এসে বেডে রুগী হিসেবে ভর্তি হয়ে শুয়ে আছি এখন
বুকে উনার একটা ছবি জড়িয়ে ধরে উপরের ছাদের দিকে চেয়ে আছি আমি
পাশেই ডাক্তার সালমা চৌধুরী মাকে বলছেন এরকমটা করলে বাচ্চার সাথে সাথে আমার ও অনেক ক্ষতি হবে
মা সাথে সাথে বললেন”আপনি তো জানেন ও কেন এমন হয়ে গেলো,অন্তত বাচ্চাটার কথা ভাবুক সে,সেটাও ভাবে না,কোনদিন তিনবেলা খাবার খেয়েছে সে বলতে পারবে না,একবেলা খাওয়াতেই যত ঝামেলা করতে হয়
রুচি আছে কিন্তু মন নাই,এমনটা আর কতদিন চলবে?”
.
ডাক্তার বলে দিলেন জোর করে খাওয়াতে,হাই পাওয়ারের মোটা মোটা ঔষুধ দিলেন কতগুলো,আমার জন্য না,বাবাুর জন্য,আমি খেলে তার লাভ হবে
ছবিটা বুকে থাকছে না,পড়ে যাচ্ছে,পেট ফুলে আছে যে তাই
এতটা মাস পর আমি খেয়াল করলাম আমার পেট বড়,তাও না দেখার ভান করে ছবিটাকে আকড়ে পড়ে থাকলাম
রিহাব ভাইয়া আর আঁখি আপু দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছেন
আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলি না,ভাইয়া কেন আমাকে সেদিন নিয়ে আসলেন?আমি উনাকে ছাড়া আসতে চাইনি তাও!

দেখতে দেখতে নয়টা মাস ও হয়ে গেছে,এই মাসের চার তারিখে নাকি বাবু দুনিয়ায় আসবে আমার পেট থেকে বেরিয়ে,অথচ আমার না আছে কষ্ট না আছে খুশি,,
আমি ব্যাগে পানির বোতল আর আপেল একটা ঢুকিয়েছি,,কালো বোরকাটাও পরে নিয়েছি
হ্যাঁ আজ আমি বাসা থেকে পালাবো,আমার স্পর্শর কাছে যাব আমি
সেদিন রাতে আমি কুশন দিয়ে পেট বানিয়ে রাত বিরাতে বের হয়েছিলাম,আর আজ সত্যি সত্যি আমার পেটটা বড়,আর কুশনের প্রয়োজন নেই
সবাই যখন ঘুমে তখন আমি একা একা বেরিয়ে পড়েছি
কক্সবাজার যাব বলে
মরে যাওয়া অবদি স্পর্শকে খুঁজবো আমি,পুলিশের উপর ভরসা করে এতটা মাস আমি বসেছিলাম,কোনো লাভ হলো না,নিজেই নিজের মানুষটাকে খুঁজে বের করবো আমি
হাঁটতে অনেক অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার,যা বলার মতন না
মনে হচ্ছে পেটে ইট বেঁধে রেখেছি,দম ও বন্ধ হয়ে আসছে,মুখ দিয়ে শ্বাসনিশ্বাস নিচ্ছি ক্রমশ
পানি খেয়ে খেয়ে বোতলটা খালি করে ফেলেছি,সেদিকে খবর নেই,বাস ধরতে হবে এটাই এখন উদ্দেশ্য
বাস ও পেয়ে গেছি তবে পনে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিলো
বাসের জানালার পাশের সিটটায় বসে একটু হাসলাম,,আজ এতটা মাস পর আমি হাসলাম,তাকে খুঁজতে যাচ্ছি তাই ভেবে
আরও আগে আসা উচিত ছিলো আমার,,এই ডিসিশান নিতে এত দেরি করে ফেললাম
আমার পাশেই একজন ভদ্র মহিলা বসলেন,বারবার জিজ্ঞেস করছেন কই মাস,কারণ আমার অবস্থা খারাপের দিকে
এসময়ে জার্নি করা একদম ঠিক না,আর আমি সেটা করছি,মাথা ঘুরছে,কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি!!!
.
উনাকে বললাম ৬মাস,উনি একটুও বিশ্বাস করলেন না,বারবার বললেন দেখে মনে হয় এক দুদিন পর ডেলিভারি
.
আমি আর কথা বললাম না উনার সাথে
ঘুম আসছে চোখ জুড়ে,কিন্তু নাহ,ঘুমানো যাবে না,বাস থামার সাথে সাথে আমি উনাকে খুঁজতে বের হবো
কক্সবাজারের কোনো কোণা বাদ রাখবো না,তাকে ছাড়া আর একটা দিন ও আমি বাঁচবো না,ভুলতে পারার কথা মাথায় ও আনতে পারি না আমি
বাস থেকে নামলাম সবেমাত্র,আশেপাশের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে সব আমার দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসছে
আমি নিজেই দূর্বল আর সেই আমি কিনা এই বিরাট জায়গায় স্পর্শকে খু্ঁজতে এসেছি তাও এতটা মাস পর
এখানেই তো তাকে হারিয়েছিলাম
ফাঁকা রোডটা দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি সে বলেছিল সে সবসময় আমার আশেপাশে থাকবে,তাহলে সে এখন কোথায়?
খালি পায়ে হাঁটছি কারণ পা এসময়ে গরম থাকে,এই এক অস্বস্তি, জুতা পরলেই মনে হয় পায়ের নিচে জলন্ত কয়লা
জুতা এক হাতে আর আরেক হাতে ব্যাগ,এপাশ ওপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছি
আজও একই কথা,ভাগ্য যেদিকে নিবে আমায় আমি সেদিকেই যাব,পেলেও তো সেই মানুষটাকে ফিরে পেতে পারি
কিছু অন্ধকার, আবার কিছু ল্যাম্পপোস্টের আলো
শরীর খারাপ হতে হতে চরম পর্যায় এসে গেছে,আমি মনে হয় পাগল হয়ে গেলাম
তাই তো যেটার কোনো শেষ নেই সেই শেষের সীমানা খুঁজছি
যাকে এতদিন পাইনি তাকে এখন হেঁটে হেঁটে পেয়ে যাব??
চলবে♥

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে