একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-৪+৫

0
633

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৪
#Saji_Afroz

বাসায় এসে আবারও আজরা কে ফোন দেয় মানতাশা। আজরা না চাইতেও ফোন রিসিভ করলো। মানতাশা বলল, তখন আমার কথা শেষ হয়নি তো।
-তুই যে কীসব বলিস না মানতাশা! ইনতিসারের মনে এমন কিছু নেই। জানিস? আজ সে আমায় ফোন করেছে। বাইরে যাওয়ার কথা বলেছে।
-ওহ! কবে বেরুচ্ছিস?
-হ্যাঁ?
-বললাম কবে বের হচ্ছিস?

আমতাআমতা করে আজরা বলল-
ওর আবার কাজ পড়ে গেছে।
-সবই বাহানা।
-মোটেও এমনটা না! আমিই ফোন রিসিভ করিনি। তাই কাজের শিডিউল দিয়ে ফেলেছে।
-আমি তোকে এখন ইনতিসারের কথা বলতে ফোন করিনি।
-তবে?
-নাবীহার মনের অবস্থা জানাতে করেছি।
-ওর মনের অবস্থা তুই বুঝেছিস কীভাবে?
-তোর টা কী বুঝছি না? এই যে তুই এখন ইনতিসার কে নিয়ে ভাবছিস।
-আর নাবীহা?
-সেও ইনতিসার কে নিয়ে ভাবছে।

এইবার চিন্তার ভাজ পড়ে আজরার কপালে। সে ব্যস্ত হয়ে বলল, খুলে বল তো সব?
-আমি শিওর, আজ ইনতিসার কে সরাসরি দেখে ওর বড্ড আফসোস হচ্ছে। কথার মাধ্যমে সেটা তো কিঞ্চিৎ প্রকাশও করে ফেলেছে।
-কিন্তু ও তো সাজির কে পছন্দ করে।
-তখন ইনতিসার কে দেখেনি তাইনা! দেখার পর ওর চোখেমুখে যে আফসোস টা আমি দেখেছি না! তোর সাথে বিয়ে ঠিক না হলে নিশ্চয় ও ইনতিসারের কে হ্যাঁ বলে দিতো।
-এমনটা মনে হয়েছে তোর?
-হু। আমার মনে হয় এই ব্যাপারে তুই বরং ইনতিসারের সাথে কথা বল।
-কী বলব?
-যে ও সত্যি তোকে পছন্দ করে কী না নাবীহা কে। বিয়ের আগেই সবটা পরিষ্কার হয়ে নে।

এই বলে বিদায় জানিয়ে ফোন রাখে মানতাশা। সে জানে, আজরা সহজ সরল একটা মেয়ে। এসব কথা নিমিষেই বিশ্বাস করে ফেলেছে। আর এখন সে যদি ইনতিসারের সাথে এসব নিয়ে কথা বলে, নিশ্চয় বিষয়টা পছন্দ করবে না ইনতিসার। হতে পারে নাবীহা তার বান্ধবী জেনে নিজ থেকে বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে সে!
নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেই করলো মানতাশা। আজরা ও ইনতিসারের বিয়েটা ভেঙে গেছে, এটা শোনার অপেক্ষায় আছে সে।
.
.
মন খারাপের মাঝেই সারাটা দিন পার হয় আজরার। কানে সারাক্ষণ মানতাশার বলা কথাগুলো বাজছে। মনটা বড্ড অশান্ত হয়ে আছে।
মানতাশার কথামতো ইনতিসার কে ফোন করতে চাইলেও করলো না আজরা।
সে সিদ্ধান্ত নিলো, নাবীহার বাসায় যাবে। তাকে সবটা বলবে। নাবীহা কী চায় সেটা জানবে। সত্যিই যদি ইনতিসার কে নাবীহার পছন্দ হয়, তবে সে এই বিয়েটা করবে না।

এই ভেবে নাবীহার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় আজরা।

যা গরম পড়ছে! এই বিকেলেও গরমের উত্তাপ রয়েছে দেখে বিরক্ত হয় আজরা। খেটে-খাওয়া মানুষ যে কীভাবে এই গরমে কষ্ট করে! এসব ভেবে উদাসীন হয়ে উঠলো আজরা। নেহাতই সে নরম মনের মানুষ। তাই তো মানতাশার বলা কথাগুলো এতটা ভাবাচ্ছে তাকে!
.
.
আলমারি গোছাচ্ছেন আসমা আক্তার। তার পছন্দের গোলাপি রঙের কাতান শাড়িটা হাতে নিতেই মানতাশার কথা মনে হলো। এই শাড়িটা তাকে বেশ মানাবে। এই বাড়িতে আসলে তাকে শাড়িটি দেবেন।
মনে মনে এসব ভাবলেন তিনি।
ঠিক তখনি এলিজা আসে মা এর রুমে। মা এর হাতে শাড়িটি দেখে বলল, তোমার এই শাড়িটা অনেক সুন্দর।
-তাই না? কত বছর আগের শাড়ি কিন্তু ডিজাইন দেখেছিস? তখনই অনেক দাম দিয়ে নিয়ে দিয়েছিলেন তোর বাবা এইটা।
-আমার কলেজে প্রোগ্রাম আছে। ভাবছি এটা পরব।

আসমা আক্তার একটু থেমে বললেন, অন্য একটা পরিস। এটা না।

এলিজা ভ্রু কুচকে বলল-
কেন?
-কারণ এটা আমি মানতাশা কে দেব ঠিক করেছি।
-বউ হয়ে আসেনি এখনো। এখন থেকেই এত আদর!
-হ্যাঁ। আমার বউ মার জন্যে সব ঠিক করে রাখছি। ক’টা দিনের ব্যাপার আর!
-কিন্তু তোমার বউ মা যে এই পুরাতন শাড়ি পেয়ে খুশি হবে তুমি জানো?
-তাকে কী আমি পুরাতন শাড়িই শুধু দেব না কি? এটা আমার স্মৃতি হিসেবে দেব। ওকে বেশ মানাবে এটি।

এলিজা কে নিশ্চুপ দেখে আসমা আক্তার বললেন-
রাগ করলি?
-নাহ। ভাবছি।
-কী?
-মানতাশা আপু যথেষ্ট সুন্দর এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উনাকে আমার কেমন যেন ভালো লাগেনি।
-কেন? আমার তো বেশ লেগেছে।
-পোশাক দেখেছ তার?
-জানতো না আমরা যাব। বিয়ের পর ওসব ঠিক হয়ে যাবে।
-আচরণও কেমন যেন! তুমি চেইন পরিয়ে দিলে অথচ মুখে হাসি ছিল না তার। মনে হয়েছে আরও বড়ো কিছু আশা করেছিল!
-ধুর! হুট করে সব ঘটে গিয়েছে। তাই হয়তো নার্ভাস ছিল।
-কী জানি! আমার যা মনে হয়েছে বললাম।
.
আড়াল থেকে এসব শুনে এজাজ। এলিজার কথা একেবারেও ফেলে দেওয়া যায় না। আসলেই মানতাশার মুখে হাসি সে দেখেনি। বরং দেখেছে তার বিরক্তি ভাব! নার্ভাস আর বিরক্ত দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। মানতাশা নার্ভাস হওয়ার মেয়ে নয়।
এজাজ ভাবতো, পরিবারের সাথে সাক্ষাত করালে মানতাশা খুশি হবে। প্রত্যেক সম্পর্কে একটা মেয়ের তো এটাই চাওয়া থাকে! সেই জায়গায় এজাজের মা তাকে সাদরে গ্রহণ করে চেইনও পরিয়ে এসেছে। তবুও কেন মানতাশা খুশি হতে পারলো না!

এজাজ নিজের রুমে ফিরে আসে। ফোন দেয় মানতাশা কে। সে রিসিভ করলে এজাজ বলল, সারাদিন আর কোনো খবর নিলে না?
-কী খবর নেব?
-আজ মা আর এলিজা দেখা করলো তোমার সাথে। তাদের সাথে পরিচিত হয়ে কেমন লাগলো জানাবে না?
-জানতে চেয়েছ তুমি?

কথা না বাড়িয়ে এজাজ বলল, আচ্ছা বলো এখন।
-ভালোই। আচ্ছা শোনো, চেইনটা কী গোল্ড এর না কী গোল্ড প্লেটের?
-তোমার কী মনে হয়? মা তার পুত্রবধূর জন্য সিটি গোল্ড এর চেইন যত্ন করে রেখেছেন?
-সিটি গোল্ড কই বললাম! চকচক করছে দেখেই গোল্ড প্লেট বলেছি।
-গোল্ড এর সেটা।
-ও আচ্ছা।
-পছন্দ হয়েছে তোমার?
-চেইন তো চেইনই! পছন্দ হওয়ার আর কী আছে। হার হলে নাহয় ডিজাইন দেখে বলতাম।
-সেসবও হবে। বিয়ে টা তো ঠিক হতে দাও। তারপর দেখো কী কী হয়। আমার বউ কে আমি সেভাবে আনব না?

কী হবে! ছাই! আজরার ওই নেকলেসের মতো নেকলেস দিতে এজাজের সারাজীবন লেগে যাবে।
মনে মনে এসব ভেবে হতাশ হতে লাগলো মানতাশা।
.
.
.
নাবীহার বাসায় আসতেই চমকায় আজরা।
ড্রয়িংরুমটা সাজানো। ঘরের সবাই বেশ পরিপাটি হয়ে রয়েছে। সাথে রয়েছে সাজিরের পরিবার। এখানে কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে।
নায়লা খাতুন তাকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, আরে আজরা যে!

তাকে সালাম জানিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে আজরা। আজরা কে উপস্থিত কম বেশি সকলেই চেনে। অনেকদিন বন্ধুত্ব কী না তার নাবীহার সাথে!
নায়লা খাতুন বললেন, তুমি আসবে নাবীহা তো বলেনি।
-আমি আসলে বলে আসিনি। আমি কী অসময়ে চলে আসলাম?

নাবীহা তার ছোটো বোন নাফিসা কে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আজরা কে দেখে অবাক হয়ে বলল সে, আজরা তুই!
-আমি আসলে এমনেই এসেছিলাম।
-বেশ করেছিস। আজ নাফিসার জন্মদিন।
-ও আচ্ছা! আমি তো জানতামই না। শুভ জন্মদিন নাফিসা।

নাফিসা তাকে ধন্যবাদ জানালে আজরা বলল, আমি জানলে কখনোই খালি হাতে আসতাম না। তবে তোমার উপহার অবশ্যই পাবে তুমি।

নাবীহা বলল, কী যে বলিস না! আমাদেরও কোনো প্লান ছিল না। হঠাৎ ফুফু কেক নিয়ে চলে আসে। তারাই হুট করে সব আয়োজন করলো। নাহয় আমিও কী তোদের বাদ দিয়ে কোনো আয়োজন করি?

সাজির এসে বলল, বান্ধবীর সাথে কথা পরে। আগে আমার হবু শ্যালিকার কেক কাটা হোক?

মিষ্টি করে হেসে নাবীহা বলল, নিশ্চয়।

সবাই মিলে কেক কাটার পর্ব শেষ করলো। সাজির ও নাবীহা একইসাথে কেক খাইয়ে দেয় নাফিসা কে। এরপর তারা একে অপরকে কেক খাইয়ে দিলো।
তাদের একত্রে বেশ মানিয়েছে।
তাছাড়া দুই পরিবারের মিল মহব্বত দেখে বেশ ভালো লাগলো আজরার।

খানিকবাদে নাবীহা আজরা কে তার রুমে নিয়ে যেতে চায়। সাজির ইশারায় তাকে যেতে বারণ করে। নাবীহা বলল, এখন তোমার সময় শেষ। আমার বান্ধবী এসেছে না!

এই বলে আজরা কে নিয়ে রুমে চলে আসে সে। নাবীহা বলল, বল আর কী অবস্থা তোর? শপিং শুরু করলি তো?

এসব দেখে আজরা তার সিদ্ধান্ত বদলায়। সাজিরের সাথে হাসিখুশিতে আছে নাবীহা। মানতাশা না বুঝেই কথাগুলো বলেছে। মানতাশার কথার উপরে ভিত্তি করে নাবীহা বা ইনতিসার কে কোনো প্রশ্ন করা ঠিক হবে না।
নাবীহা সাজির কে নিয়ে ভালো আছে। ইনতিসারও তার সাথে পথ চলতে চায়। তবে আর পুরাতন কথা নিয়ে ভেবে কী হবে?

মাথা থেকে সবটা ঝেড়ে আজরা বলল, খুব তাড়াতাড়ি শুরু করব। তোর খবর বল?
-সাজির তো বিয়ে করতেই চায়। কিন্তু আমি চাইছি যেহেতু সে নতুন জব পেয়েছে একটু সময় নিক। এরমধ্যে আমিও জব খুঁজে নিই।
দু’জনে নিজের পা এ দাঁড়াই। এরপর চুটিয়ে সংসার করব।

কত সুন্দর পরিকল্পনাও করে রেখেছে নাবীহা। অথচ সে কী না নাবীহার কাছে বিব্রতকর প্রশ্ন করতে এসেছিল! ভাবতেই নিজের উপরে রাগ হলো আজরার।
.
.
.
সন্ধ্যায় টেবিলে বসে নাস্তা করছে মানতাশা। তার গলার দিকে চোখ যেতেই মরিয়ম বেগম বললেন, এই চেইন কই পেলি তুই?

মা এর কথা শুনে চমকে উঠলো সে। ভুলবশত চেইনটা খুলে রাখা হয়নি।
সে আমতাআমতা করে বলল, গোল্ড প্লেটের এটা। কিনেছি আজ। সুন্দর না?

মরিয়ম বেগম নুডলস খেতে খেতে বললেন, আমি ভাবলাম কেউ দিয়েছে। এমন কেউ থাকলে বলতে পারিস। তোর বাবার সাথে কথা বলব। বিয়ের বয়স তো হলোই।

এজাজের কথা বললে নিঃসন্দেহে তার পরিবার মেনে নেবে, এতে শতভাগ নিশ্চিত মানতাশা। কারণ তার ভালো সিদ্ধান্ত কে সবসময় গুরুত্ব দেয় পরিবার।
এজাজ শিক্ষিত ছেলে। এটা শুনেই যে তারা গুরুত্ব দেবেন জানে সে। চাকরির জন্য সময়ও দেবেন। কিন্তু সে এখনই এজাজের সম্পর্কে কিছু বলতে চায় না। কারণ মানতাশার ইদানীং মনে হচ্ছে, এজাজ নয় বরং ইনতিসারের মতো কেউ তার যোগ্য। এমন কারো জন্যে অপেক্ষা করতে ক্ষতি কী!
.
.
.
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলো আজরা। সিদ্ধান্ত নিলো, বিয়েটা করবে সে। অতীত নিয়ে পড়ে থাকা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। ইনতিসারের সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চায় সে। এটা অস্বীকার করা যায় না, এখন থেকেই ইনতিসারের প্রতি আলাদা টান অনুভব করছে সে। তার সাথেই সংসার জীবনে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক আজরা।
এই ভেবে চোখ জোড়া বন্ধ করলো সে। ঘুম পাচ্ছে তার ভীষণ। শান্তির ঘুম….
.
চলবে

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫
#Saji_Afroz

বিছানাভর্তি আজরার বিয়ের শপিং। পাশেই বসে রয়েছে মানতাশা। তাকে শপিং দেখাতে ব্যস্ত আজরা।

গোলাপি রঙের নেটের শাড়িটা হাতে নিয়ে মানতাশা বলল, এটা ভারী সুন্দর তো।
-তাই না? ও নিজে আমাকে পছন্দ করে নিয়ে দিলো এটা।
-দাম কত?
-একুশ হাজার টাকা।

টাকার পরিমাণ শুনে চোখ জোড়া বড়ো হয়ে গেল মানতাশার। বিয়ের লেহেঙ্গাটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, বিয়ের টা কত?
-এক লাখ পনেরো হাজার।

এক লাখ টাকায় বিয়ের কনের পুরো শপিং হতে দেখেছে মানতাশা। শুধু বিয়ের জামাতে এক লাখ পার হলো শুনে কথা বলার ভাষাই যেন হারিয়ে ফেললো সে।

আজরা বলল, আরও দাম দিয়ে নেওয়ার জন্যে জোরাজোরি করছিলেন আমার হবু শাশুড়ী। আমিই না করলাম। একদিনই পরব এটা। এত দাম দিয়ে নেওয়ার কী প্রয়োজন?

তার কথা শুনে মানতাশা বলল, তবুও তো লাখের ঘর পার করলি।
-উনি মানছিলেন না তাই।

এভাবে প্রতিটি জিনিসের দাম শুনে মানতাশা বিস্ময় এর শেষ পর্যায়ে চলে যায়।
ইনতিসার বড়ো ব্যবসায়ী শুনেছে। কিন্তু এত টাকার মালিক এটা সে জানতো না।

মানতাশার জন্য নাস্তা আনতে রুমের বাইরে যায় আজরা।
কিছু একটা ভেবে নাবীহা কে ভিডিও কল দিয়ে বসে মানতাশা। তাকে এসব দেখাতে থাকে সে। নাবীহা এসব দেখে বলল, আজরার হবু শাশুড়ীর চয়েজ দেখছি বেশ ভালো।
-তাই না?
-হু।
-আজরা নিজে আমাকে ফোন করে এসব দেখতে আসতে বলল। তোকে করেনি?

নাবীহা কে ফোন করেনি আজরা। কারণটা সে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু এতে কিছু মনে করেনি সে। নাবীহা হেসে বলল, আমি ব্যস্ত সে জানে। বললেও যেতে পারি না। তাই বলেনি।
-বললে যেন এসবে নজর দিবি তুই! অথচ এসব তোর হওয়ার কথা ছিল।

মানতাশার এসব কথায় বিরক্ত হয় নাবীহা। তাই সে কথা না বাড়িয়ে কাজের অজুহাত দেখিয়ে ফোনটা রেখে দিলো।

আজরা এসে নুডলস এর বাটিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কার সাথে কথা বলছিলি?
-নাবীহা ফোন করেছিল। আমি এখানে আছি, তোর বিয়ের শপিং দেখছি শুনেই ফোনটা কেটে দিলো। মনে হয় বিষয়টা পছন্দ করলো না।
-নাবীহা এমন মেয়েই নয়। তাছাড়া তোকেও তো ডাকিনি আমি। শপিং এর কথা শুনে নিজ থেকেই এসেছিস। সেও জানে শপিং করতে গিয়েছিলাম আমি।
-কী জানি বাপু! ওর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছে জেলাস।

মানতাশার কথার পিঠে কোনো কথা না বলে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলো আজরা। মানতাশা নুডলস খেতে খেতে বলল, আমি আরেকটা বিষয় নিয়েও এক্সাইটেড।
-কী?
-ইনতিসার আর নাবীহা মুখোমুখি হলে কী হবে? ইনতিসার নিশ্চয় অনেক বেশি আফসোস করবে। নাবীহা তো অলরেডি করছেই। আমার মনে হয় তুই মাঝখানে দেয়াল হয়ে রইবি।

বিষয়টা গুরুত্ব না দিয়ে হেসে ফেললো আজরা।
সে কথা ঘুরিয়ে বলল, বিয়েতে এজাজ ভাই কে বলি?
-মাথা খারাপ! আমার পরিবার আসবে। দেখে ফেললে?
-এজাজ ভাই কে বলতে পারলে আমারও ভালো লাগতো।
-কোনো প্রয়োজন নেই।

হঠাৎ বিয়ের ব্যাগের দিকে চোখ পড়ে মানতাশার। তা হাতে নিয়ে বলল, ব্যাগটা তো অনেক সুন্দর! পুরাটাই স্টোনের কাজ।
-অনেক ভারীও।
-এটা কত নিয়েছে?
– পঁচিশ হাজার।

মানতাশা ভ্রু কুচকে বলল, শুধু এসবেই মনে হয় পাঁচ-ছয় লাখ খরচ গেছে?
-আরও বেশি।

আচমকা মানতাশা উঠে এসে আজরার কপালে নিজের কপাল ঘষে বলল, ভাগ্যবতী রে! তোর থেকে একটু ভাগ্য নিয়ে নিই আমি।

এই সময় রুমে আসলেন আজিজা বানু। এই দৃশ্য দেখে তিনি প্রায় চ্যাঁচিয়ে বললেন, আরেহ করছ টা কী?

উত্তরে মানতাশা বলল, মারছি না ওকে! জাস্ট কপালে কপাল লাগালাম।
-এমনটা করতে নেই।
-কেন? সত্যি সত্যি ভাগ্য নিয়ে ফেলব না কি?

এই বলে হেসে উঠলো দুই বান্ধবী। তিনি রাগান্বিত হলেও কিছু বললেন না। এই মেয়ের সাথে কথাতে তিনি পারবেন না জানেন। তাই চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
তাকে এভাবে রাগান্বিত অবস্থায় দেখে দাঁড় করালেন আজহার শেখ।
তিনি বললেন, রাগান্বিত মনে হচ্ছে?

ঘটনা খুলে বলতেই হেসে ফেললেন আজহার শেখ। আজিজা বানু বললেন, এমন করলে সত্যিই না কি একজনের ভাগ্য অন্য জন নিয়ে যায়।
-এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছুই না।
-যাই বলো, মেয়েটা কে একদমই সহ্য হয় না আমার।
-একটু চঞ্চল সে। কিন্তু খারাপ না। ওসব নিয়ে মাথাটা খারাপ করো না তো।

স্বামী তাকে শান্তনা দিলেও শান্ত হলো না তার মন। মানতাশার প্রতি চরম বিরক্ত তিনি। নাবীহা আর আজরার বান্ধবী এই মেয়ে কীভাবে হলো হিসাব মেলাতে পারেন না তিনি।
.
.
.
আগামীকাল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান আজরার। হুট করে ইনতিসার আজ তাকে ডাকলো। কারণ জিজ্ঞাসা করলে কিছুই বলে না সে।
শপিং ছাড়া আর দেখা বা কথা হয়নি ইনতিসারের সাথে তার। আজ এভাবে হুট করে ডেকেছে বলে ভাবনায় পড়ে যায় সে। নানারকম চিন্তা এসে ভর এসে আজরার মনে।
ইনতিসার কী বিয়েটা নিয়ে কিছু বলতে চায়? করতে চায় না সে এই বিয়েটা?
এসব ভেবে ঘাবড়ে যায় আজরা।
তবুও সাহস করে ইনতিসারের দেখা করতে তার দেওয়া ঠিকানায় গেল সে।
.
.
.
রেস্টুরেন্টে আজরার অপেক্ষায় বসে আছে ইনতিসার। অনেক ভেবে সে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেটা সবার জন্যই ভালো হবে।
আজরার মতো মেয়েকে সে ঠকাতে পারে না।
তার সম্পর্কে যতটুক সে বুঝেছে, খুবই ভালো একটা মেয়ে আজরা। তার মা তো সারাক্ষণ আজরার গুণাগুণ সম্পর্কে বলতে থাকেন। তাকে পেতে চলে পরিবারের সবাই অনেক খুশি। তবে ইনতিসার নিজেই কেন অখুশি হবে? সেও সব মাথা থেকে ঝেড়ে নতুন এক সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চায়। ভালো লাগার মতোই মেয়ে আজরা। তবে কেন যা হওয়ার নয় তা ভেবে নিজের মনকে অশান্ত করতে হবে?
হ্যাঁ, ইনতিসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একটি সুন্দর মন নিয়ে আজরার সাথে নতুন জীবনে প্রবেশ করার জন্য। যে জীবনে থাকবে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, সম্মান, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা।
আজরা কে সে তার প্রাপ্য ভালোবাসাটা দিতে প্রস্তুত। আর প্রস্তুত নিজের ভালোবাসা আদায় করতে।
এসব ভাবতে ভাবতেই আজরার দেখা পায় ইনতিসার।

ধীরপায়ে সে এগিয়ে এসে কোমল স্বরে বলল, আসসালামু আলাইকুম। খুব বেশি দেরী করে ফেললাম?

ইনতিসার দাঁড়িয়ে বলল, নাহ নাহ! বসুন প্লিজ।

ইনতিসার চেয়ার টেনে দিতেই আজরা বসলো। ইনতিসার তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, আসতে অসুবিধে হয়নি তো?
-নাহ।

ইনতিসার খেয়াল করলো, আজরা একেবারেই চুপসে আছে। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। নাকের উপর মুক্তোর দানার ন্যায় কয়েক ফোটা ঘাম জমেছে। কপালেও জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
ইনতিসার তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নার্ভাস কেন মনে হচ্ছে আপনাকে?

টিস্যু হাতে নিয়ে আলতো করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে আজরা জবাব দিলো-
হুট করে ডাকলেন তো আপনি।
-আসলে সব এত হুটহাট হলো! আপনার সাথে আলাদা সময়ই কাটাতে পারলাম না। মা বলেন বিয়ের আগে এভাবে সময় কাটানো টাও না কি স্পেশাল, যা বিয়ের পরে অনুভব করা যাবে না।

একথা শুনে চোখ তুলে ইনতিসারের দিকে তাকালো আজরা।
তার মানে অহেতুক দুঃশ্চিন্তা করছিল সে! ইনতিসার আলাদা সময় কাটানোর জন্য তাকে ডেকেছে। আর সে কী না সারা রাস্তা কীসব ভেবে ভেবে এসেছে!

ইনতিসার বলল, বলুন কী খাবেন?
-কফি।
-জাস্ট?
-জি।
-তা বললে তো চলবে না। ওকে, আমি আপনাকে আমার ফেবারিট খাবারটা খাওয়াই। চলবে?
-জি।

বরাবরই এমন নরম স্বভাবের মেয়ে পছন্দ ইনতিসারের। ভালোই হলো আজ এখানে এসেছে সে। আজরার সাথে সময় কাটিয়ে মনে হচ্ছে, সঠিক সিদ্ধান্ত টায় নিতে চলেছে ইনতিসার।

খাবার আসলে দু’জনে খেতে খেতে গল্প জুড়ে দেয়।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠে আজরার। মানতাশার ফোন এসেছে। যদিও সে এখন কোনো ফোন রিসিভ করে তাদের মুহুর্তটা নষ্ট করতে ইচ্ছুক ছিল না, কিন্তু বান্ধবীর ফোন দেখে রিসিভ না করেও পারলো না সে।
সাথে ইনতিসারও বলল, কার ফোন?
-বান্ধবীর।
– সমস্যা নেই। রিসিভ করুন!

আজরা ফোন রিসিভ করতেই মানতাশা বলল, বাসায় আছিস?
-নাহ। আমি বাইরে আছি।
-কোথায়?
-বারকোড এ আছি।
-এই সময়ে ওখানে কী করিস!

আজরা কিছু বলতে যাবে তখনি মানতাশা বলল, ওহহো! সাথে ইনতিসার আছে না কি?

মৃদু হেসে আজরা বলল, হু!
-দেখা সাক্ষাতও চলে তাহলে?
-আজই প্রথম। হুট করে ডাকলো। তুই কেন ফোন দিয়েছিস বল?
-আমি আর নাবীহা শপিং কমপ্লেক্স এ এসেছিলাম। তোর বিয়েতে পরার জন্য দু’জনে ম্যাচিং করে শপিং করলাম। ভাবলাম তোর বাসায় গিয়ে সেসব দেখাই। এখন তো তুই বাসায় নেই। তবে কোনো সমস্যা নেই। আমরা বারকোডেই আসব। দুলাভাই থেকে একাই খাবি না কি তুই?

মানতাশা একা হলে কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু সাথে নাবীহা আছে শুনে চিন্তার ভাজ পড়ে তার কপালে। বিয়ের আগেই ইনতিসারের মুখোমুখি নাবীহা হোক সে চায়নি। এতে করে নাবীহার কোনো সমস্যা না হলেও ইনতিসার বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে পারে। এমনটা সে চায় না। ইনতিসারের সামনে মানতাশা কে কী বলবে খুঁজে পায় না সে। মেয়েটারও বিষয়টা বোঝার দরকার ছিল!

আজরা বলল, আমি বেরুবো। তোরা বরং বাসায়ই আয়৷ ওখানে দেখা হবে।

একথা শুনে ইনতিসার বুঝলো, আজরার বান্ধবী এখানে আসতে চায়ছে। তাই সে হেসে বলল, আসতে বলুন। আমার কোনো সমস্যা নেই। বরং ভালোই লাগবে আমার।

ওপাশ থেকে একথা শুনে মানতাশা বলল, ভাইয়া দেখছি বেশ মিশুক! ওকে তাহলে আমরা বেরুচ্ছি। দেখা হচ্ছে।

এই বলে ফোনের লাইন কেটে দেয় মানতাশা।
আজরার হাসিখুশি মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তা দেখে ইনতিসার ভাবলো, হয়তো হুট করে বান্ধবী আসছে বলে ইনতিসার কিছু মনে করছে ভাবছে। তাই সে বিষয়টা সহজ করতে বলল, আপনার বান্ধবী আছে ভালোই হলো। শ্যালিকার অভাব পূরণ হবে আমার। ক’জন বান্ধবী আছে?
– দু’জন।
-ভালোই হলো দেখা হবে। দু’জনেই সাথে আছে না কি?
-জি।

ভালো হবে না কী অন্যকিছু তা তো একটু পরেই বোঝা যাবে। কেন যে মানতাশার ফোন রিসিভ করতে গিয়েছিল সে!

সাজিরের সাথে ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় আজরা ও মানতাশার কথোপকথন শোনেনি নাবীহা।
সে কথা শেষ করে মানতাশার পাশে আসে। মানতাশা তাকে তাড়া দিয়ে বলল, চল যাওয়া যাক।
-আজরা কে জানিয়েছিস আমরা যাচ্ছি?
-হু। তবে ও বাসায় নেই। কাছেই রেস্টুরেন্টে আছে একটা। ওখানে যেতে বলল।
-ওখানে রাতে কী করছে?
-এতসব আমি কী জানি! সময় নষ্ট না করে চল তো।

এই বলে রিকশা ঠিক করতে থাকে মানতাশা। নাবীহা কে নিয়ে সেখানে যাওয়ার পর ইনতিসারের মুখের অবস্থা কী হবে এটা দেখার অপেক্ষায় আছে সে। বরাবরই চেয়েছিল, বিয়ের আগে একটাবার নাবীহা ও ইনতিসারের মুখোমুখি হোক আজরার সামনে। আজ যে এই দিনটি চলে আসবে ভাবতেই পারেনি সে। সুযোগটা হারাতে চায় না মানতাশা। তাই সে অতিদ্রুত রিকশা ঠিক করার কাজে মনোনিবেশ করলো।
.
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে