আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি পর্ব-১২

0
869

#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১২

” আপনি আমার সাথে, কাছাকাছি না থাকলে আমার ভীষণ খারাপ লাগবে, চারপাশটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগবে।”

ইহান আর রায়া বিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ইহান জানায় এখন সে রায়াকে ওখানে রেখে চলে আসবে, এখানে একটা জরুরি কাজ আছে। ইহানের কথা শুনে রায়া উক্ত কথাটি বলে মুখ ফুলিয়ে ড্রেসিংটেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে থাকে।

ইহান শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে রায়ার পাশেই বিছানায় বসে বলে, ” আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওখানে ফিরব। আমি নিজেও তো সবার সাথেই সময় কাটাতে চাচ্ছিলাম কিন্তু কী করব বল! কাজ তো করতেই হবে। এই বয়সে পরিশ্রম করতেই হবে শেষ বয়সে ভালোভাবে দিন কাটাতে। আর আমার যদি কিছু হয়ে যায়, তোর জন্য তো রেখে যেতে হবে কিছু তাই না!”
” একদম বাজে কথা বলবেন না। সবসময় এরকম আজেবাজে কথা আপনার মুখে এসেই থাকে তাই না? সময় সুযোগ বুঝে বের করে দেন। ”

রায়া কথাগুলো বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যাগটা ইহানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ” এখানে বসে বসে আর আজেবাজে কথা শুনতে চাইছি না। চলুন, আমাকে রেখে আসুন।”

ইহান এগিয়ে গিয়ে রায়াকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। রায়া বারবার ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ইহান রায়ার কাধে থুতনি রেখে বলে, ” আমি ছাড়া তোর জীবনে আর কেউ না আসুক কোনদিন।”
” আসবে না। আমি যার সাথে এখন ভালো আছি, তার সাথেই থাকতে চাই৷ ”
” আমাকে ভালোবাসিস?”

রায়া একটু ভেবে জবাব দেয়, ” হয়তো কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভালোবাসি।”
” কিঞ্চিৎ পরিমাণই ভালোবাসিস তবে সেটা আমাকেই বাসিস।”
” এখন কি আমরা বের হব?”
” একটু জড়িয়ে ধরে নিই আগে৷”

রায়া মুচকি হেসে ইহানের দিকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরে। ইহানও দেরি না করে রায়াকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।
______

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। সূর্য পশ্চিমে মাথা ডুবিয়েছে। রায়া খয়েরী শাড়িতে নিজেকে আবৃত করেছে। রাস্তার পাশেই ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইহানের জন্য অপেক্ষা করছিল সে। বাড়ির মেইন গেইটের বাহিরে এসে রায়ার মা ডাক দিলে রায়া সেদিকে এগিয়ে আসে।

রায়া শাড়ি ঠিক করতে করতে বলে, ” কী হয়েছে আম্মু?”
” তোর আব্বু একা বসে আছে, গিয়ে কথা বল যা।”
” আমি একা যাব না। আব্বুর সামনাসামনি হতে এখন কেমন একটা লাগে। ”
” এখন গিয়ে কথা বল, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
” পরে কথা বলব। আব্বুও তো পারে একটু কথা বলতে।”

হঠাৎ বাইকের হর্ণ বাজতেই রায়া পিছনে তাকিয়ে দেখে ইহান চলে এসেছে। ইহান বাইক এক সাইডে রেখে এসে মা-মেয়ের পাশে দাঁড়ায়। একটা ছোট শপিংব্যাগ রায়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ” কী হয়েছে? এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ”

রায়ার মা ইহানকে বলে, ” দেখ বাবা, তোর কাকা এখনো মেয়ের সাথে কথা বলতে না পেরে ছটফট করে কিন্তু কথা বলতে পারে না৷ আমি রায়াকে বলছি যে তোর আব্বু আর তোর উপর রেগে নেই, যা কথা বল কিন্তু সে মেয়ে যাচ্ছেই না।”

ইহান চকিতে বলে ওঠে, ” আমি নিয়ে যাচ্ছি, সমস্যা নেই। ”

রায়া বলে ওঠে, ” না, আব্বুর সামনে যেতে আমার ভয় লাগে।”
” কই আগে তো ভয় পাস নি! এখন কেন ভয় লাগবে? চল আমি নিয়ে যাচ্ছি। কাকার সাথে আমারও কথা হয়নি।”
” আমার ভয় লাগছে। এই অনুষ্ঠান বাড়িতে যদি অন্যরকম কিছু হয়ে যায়?”
” কিচ্ছু হবে না, চল তুই আমার সাথে।”
” আমার ভয় লাগছে, প্লিজ।”

ইহান রায়ার কথা না শুনে রায়াকে হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়।
চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান খাটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবছিলেন। হঠাৎ রুমে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ধীরে ধীরে চোখ খোলেন তিনি। চোখ খুলে মেয়ে-জামাইকে একসাথে দেখে সোজা হয়ে বসেন তিনি।

রায়াকে দেখেই হাত বাড়িয়ে তিনি মেয়েকে ডেকে বলেন, ” আয় মা, আমার কাছে আয়।”

বাবার এমন স্বাভাবিক আচরণে ভীষণ অবাক হয় রায়া। মানুষটা এতগুলো দিন পর এত স্বাভাবিক হয়ে কীভাবে কথা বলতে পারে! আদৌ সম্ভব এটা!
রায়া মুখে কিছু না বলে বাবার কাছে গিয়ে চুপ করে বসে। শামসুজ্জামান ইহানকে ইশারায় চেয়ারে বসতে বলেন। ইহান চেয়ার টেনে শামসুজ্জামানের পাশেই বসে।

শামসুজ্জামান মেয়ের কাধে হাত রেখে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, ” এতদিনে আমার কথা মনে পড়লো আমার মায়ের?”

রায়া তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে ওঠে। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আ’ম স্যরি আব্বু। আমি জানি, আমি অনেক বড় অপ*রাধ করে ফেলেছি। আমি তো ছোট তোমার কাছে, আমি তো ভুল করতেই পারি না তাই আব্বু? আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ। ”

শামসুজ্জামান মেয়ের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলতে থাকেন, ” আমি তোর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম রে মা। প্রতিদিন রুমে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম এই বুঝি আমার মেয়ে দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলবে- আব্বু যা হওয়ার হয়ে গেছে সব ভুলে যাও তো৷ আমি তোমাকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না।”
” তোমাকে ভীষণ ভয় লাগছিল আব্বু।”

ইহান বাবা আর মেয়েকে একা কিছুটা সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বাবা-মেয়ের মিলন যেন চোখের শান্তি বয়ে আনে। ইহান রুম থেকে বের হতেই রায়ার মা এক প্রকার দৌঁড়ে এসে ইহানকে জিজ্ঞেস করেন, ” বাবা- মেয়ের মিল হলো?”
” হ্যাঁ মিল হয়ে গেছে। দুজনের একটু ব্যক্তিগত সময় দরকার। আমি তাদের দুজনের মধ্যে কখনো ছিলাম না আর থাকতেও চাই না।”
” যাক আলহামদুলিল্লাহ৷ এখন আর একজন ঠিক হলেই সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। ”

ইহান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ” আর কে?”
” রাইয়ান। ”
” ওকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না কাকি৷ রায়া ঠিক মানে সব ঠিক৷ সে তো তার ভুল বুঝতেই পেরেছে।”
” সব ভালো থাকলেই ভালো রে বাবা। ওহ, কোথাও যাচ্ছিলি?”
” দেখি সবাই কী করছে।”
” সবাই ছাদে আছে। ”
” সাজানো হয়ে গেছে সবকিছু?”
” হ্যাঁ, যা ছাদে চলে যা। সবাই ওখানেই আছে।”
” আচ্ছা। ”

ইহান সোজা ছাদের উদ্দেশ্যে সিঁড়ি বেয়ে চলে যায়। বেশ জমজালো আয়োজন করা হয়েছে। আজকের মধ্যমনি মাহমুদ সাদা পাঞ্জাবি, পাজামা আর একটা গামছা নিয়ে বসে আছে। সামনে ডালায় ডালায় বিভিন্ন জিনিস সাজানো আছে। সামনে, ডানে, বামে সবাই চেয়ার নিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ দল হয়ে গান সিলেক্ট করতে ব্যস্ত। কে কোন গানে নাচবে সেটার বাছাইপর্ব চলছে। ইহান সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নেয়৷ মাকে খুঁজে পেতেই মায়ের পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসে৷ মায়ের সাথে কথাবার্তা শুরু করে দেয়।

প্রায় বিশ মিনিট পর রায়া তার বাবা-মাকে নিয়ে ছাদে আসে। বাবা-মাকে এক পাশে বসিয়ে দিয়ে ইহানের কাছে এসে দাঁড়ায়। ইহান রায়াকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কী? সব ঠিকঠাক হলো?”
” হ্যাঁ হয়েছে। আপনি পাঞ্জাবি-পাজামা পরবেন না? সবাই পরেছে, আপনিও পরবেন৷ আসুন আমার সাথে।”
” এখন আর পরব না৷ অনুষ্ঠান তো শুরুই হয়ে গেছে। শার্ট-ই থাকুক, সমস্যা নেই তো।”
” না, আপনি পাঞ্জাবিই পরবেন। আমি নিয়ে এসেছি কেন তাহলে?”

ইরিনা বেগম পাশে থেকে ইহানকে বলে ওঠেন, ” মাত্র আনন্দ করার বয়স তোদের৷ মেয়েটা তোর জন্য পাঞ্জাবি নিয়ে এসেছে, যা পরে আয়। ”

মায়ের কথায় ইহান চেয়ার ছেড়ে উঠে রায়ার সাথে সাথে যেতে শুরু করে। ভীড় ছেড়ে সিঁড়িতে এসেই বলে ওঠে, ” বউরা কি সারাজীবন এভাবেই প্যারা দিতে থাকে?”
” হ্যাঁ, বউরা এভাবেই প্যারা দেয়৷ বউয়ের কথা মেনে না নিলে বরের জীবন তছনছ ও হয়ে যায়। তাই বলছি কথা না বাড়িয়ে চলুন তাড়াতাড়ি। ”
” জি, চলুন ম্যাম।”

ইহান রায়ার পিছন পিছন একটা রুমের সামনে চলে যায়৷ রায়া দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই পাশের দেয়াল থেকে স্যুইচ টিপতেই লাইট অন হয়ে যায়। রায়া সোজা গিয়ে একটা আলমারি থেকে নিজের ব্যাগটা বের করে। ইহান ততক্ষণে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। রায়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়৷

রায়া ব্যাগ থেকে ইহানের পাঞ্জাবি-পাজামা বের করে ইহানের হাতে দিয়ে বলে, ” যান, ওয়াশরুমে গিয়ে চেঞ্জ করে আসুন ”
” আগে বউকে জড়িয়ে ধরি একটু৷ সেই কখন এসেছি, একটাবারের জন্যও বউকে জড়িয়ে ধরতে পারি নি৷ ”
” আগে চেঞ্জ করে আসুন তারপরে জড়িয়ে ধরবেন।”
” ওহ তোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি আমি।”
” কী?”

ইহান পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। হাতে বাধতেই বলে, ” আচ্ছা আগে চেঞ্জ করে আসি তারপর দিচ্ছি ”
” না, আগে দিয়ে যান। কী এনেছেন আমার জন্য?”
” এখন কেন? আমি জড়িয়ে ধরতে চাইলাম তখন তো খুব বললি চেঞ্জ করে এসে তারপর। তাহলে এখন কেন আমি আগে দেব?”

রায়া অসহায় চোখে ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইহান ভ্রু গুটিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে রায়ার হাত থেকে নিজের জন্য আনা পাঞ্জাবি-পাজামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। রায়া সেখানেই দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে, কী এনেছে ইহান তার জন্য?

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে