আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি পর্ব-১৭

0
732

#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৭

রায়া বিছানাতেই বসে ছিল। ইরিনা বেগম আর এশা দৌঁড়ে রুমে চলে আসে। ইরিনা বেগমকে পিছনে ফেলে রেখেই এশা এসে রায়াকে জড়িয়ে ধরে।
এশা মিষ্টি হেসে বলে,” আমি ফুপি হব! আমি তো ভাবতেই পারছি না যে, আজকের সকালটা এত ভালো হবে!”

এশা রায়াকে ছেড়ে দিয়ে বলে,” তোমরা কথা বলো আমি বরং তোমাদের বাড়িতে খবর দিয়ে আসি। আজকের এত খুশির খবরে রাইয়ান ভাইয়া নিশ্চয়ই আর রাগ করে থাকতে পারবে না।”

ইরিনা বেগম এশাকে বলেন,” হ্যাঁ যা,খবরটা দিয়ে আয়। সবাইকে নিয়ে চলে আসবি। ”

এশা রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ইহান রুমে আসে। ইরিনা বেগম রায়ার দুই গালে হাত রেখে কপালে একটা চুমু খান। পাশে বসে রায়ার দুই হাত ধরে বলেন,” আমি ক’দিন হলো ভাবছিলাম তোকে বলব যে, অনেকটা সময় তো নিলি এবার একটা নতুন অতিথি নিয়ে আয়। জানিস তো একটস ছোট্টো প্রাণ পারে সব সমস্যার সমাধান করতে। যা আমরা বড় মানুষগুলো পারি না। এই যে দেখ, রাইয়ান কারো সাথে কথা বলে না এতগুলো মাস এখন যদি শোনে যে সে মামা হবে তাহলে কি আর রাগ করে থাকতে পারবে? পারবে না কিন্তু। এখন থেকে ধীরে ধীরে রাগটা মোমের মত গলে যাবে।”

পাশে থেকে ইহান বলে ওঠে,” ছোটো থেকে আমি কিছু না করেও কেমন দোষী ওর কাছে!”
” সব ঠিক হয়ে যাবে। তোরা দুজন সমবয়সী তাই এমন।”

তিনজনের অনেকক্ষণ ধরেই কথাবার্তা চলতে থাকে। এত খুশির মাঝেও রায়ার মনটা কেমন করছে। মনে মনে ভাবছে রাইয়ান কি আসলেই ঠিক হবে? মেনে নেবে সবকিছু!
______

রাবেয়া বেগম এবং শামসুজ্জামান সাহেব এশার মুখে খুশির সংবাদ শুনতেই তাড়াহুড়ো করে রায়ার কাছে চলে যায়। এশা গিয়ে রাইয়ানের রুমের দরজায় নক করে। রাইয়ান তখনও ঘুমে। বারবার দরজায় নক করার শব্দে রাইয়ানের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম জড়ানো চোখ ডলতে ডলতে দরজার খুলে দেখে এশা দাঁড়িয়ে। মেয়েটার মুখে হাসি লেগে আছে।

রাইয়ান বিরক্তস্বরে বলে ওঠে,” কী চাই এখানে? সকাল সকাল সূর্য না উঠতেই ডাকছিস কেন?”
” খুশির খবর আছে ভাইয়া। সেই খবরই তো দিতে এলাম।”
” পরে দেওয়া যাচ্ছিল না?”
” খুশির খবর গরম গরম দিতে হয় আর দুঃখের খবর রয়েসয়ে পরিস্থিতি বুঝে জানাতে হয়।”
” কী খবর? বলে এখান থেকে চলে যা, ঘুমোতে দে আমায়।”
” খবর জানতে হলে আমাদের বাড়ি যেতে হবে আপনাকে।”
” এশা, তুই ভালো করেই জানিস আমি তোদের বাড়ি যাই না।”
” কিন্তু আজ তো যেতেই হবে।”
” কেন? কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বলে এখান থেকে বিদায় হ’ যা।”

এশা রাইয়ানের বাহু ধরে টেনে রুমের বাহিরে নিয়ে আসতে আসতে বলে,” আজ কোন কথা শুনব না, চলুন না প্লিজ।”
” হাত ছাড় এশা। আমি তোর ভাই ইহান নই।”
” রাইয়ান ভাই তো!”
” ছাড় এশা।”

এশা রাইয়ানের হাত ছেড়ে বলে,” যাবেন না আপনি? আপনার আব্বু-আম্মু কিন্তু আমাদের বাসায় চলে গেছে।”
” হয়েছে টা কী?”
” বুঝতে পারছেন না?”
” কী বুঝব?”
” আপনি মামা হতে চলেছেন আর আমি ফুপি হতে চলেছি। ”

রাইয়ান এশার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,” ওহ আচ্ছা।”

এশা ভ্রু কুচকে বলে ওঠে,” শুধু ওহ আচ্ছা?”
” তো কী মেয়েদের মতো খুশিতে লাফাবো নাকি?”
” প্রয়োজনে সেটাও করতে পারেন৷ মামা হবেন আর লাফাবেন না এটা কেমন কথা!”
” যা বাড়ি যা এখন।”
” ইশ ফোনটা আনলে ভালো হতো৷ আপনি লাফাতেন আর আমি ছবি তুলে রাখতাম। ভবিষ্যতে বাচ্চাকে দেখানো যেত।”
” গেলি তুই?”
” আপনাকে যেতে বলেছে। আপনি না গেলে আমিও যাচ্ছি না।”
” থাক তুই এখানে দাঁড়িয়ে৷”
” আপনি কি আবার রেডি হয়ে আসবেন? রেডি হতে হবে না লুঙ্গি পরেই আসেন।”
” এশা, যা তুই এখান থেকে।”
” রায়া আপু আপনাকে যেতে বলেছে। আমরা সবাই আপনার অপেক্ষায় থাকব। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।”

এশা আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে নিজেদের বাড়িতে চলে আসে। সবাই রুমে একসাথেই ছিল। এশাকে একা ফিরতে দেখে রায়ার একটু মন খারাপ হয়ে যায়।

ইরিনা বেগম এশাকে জিজ্ঞেস করেন,” এশা, রাইয়ান আসলো না?”

এশা মুখটা মলিন করে বলে,” আসবে না হয়তো।”

রায়া উৎসুক চোখে ইহানের দিকে তাকায়। ইহান ইশারায় রায়াকে বোঝায় সব ঠিক হয়ে যাবে। এত খুশির দিনেও রায়ার মনের একটা কোণে খারাপ লাগা থেকেই যাচ্ছে। এরকম একটা দিনে সবাই কাছে থাকলেও তার একমাত্র ভাই তার থেকে দূরে।
______

রায়ার মন খারাপের চিহ্ন স্পষ্ট সারাদিন দেখেছে ইহান। দুপুরবেলা কাজের জন্য যেখানে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে কল দিয়েছিল সময় পিছানো যায় কি না সেটা জানতে। সেখান থেকে জানিয়েছে ইহান আগামী মাসে যে ট্রেইনিংয়ে জয়েন করতে চেয়েছিল সেটা এই সপ্তাহে জয়েন করতে পারলে দেড় মাসের মধ্যে কাজ সম্পর্কে সব জানা কমপ্লিট হয়ে যাবে এমন কী সে ওখান থেকেই কাজ পেয়ে যাবে।
রায়াকে এই অবস্থায় রেখে যেতে মন টানছে না ইহানের। তার এই কাজের জন্য সংসার চলবে না এমন কিছু নয়৷ এক্সট্রা সুযোগ পেয়েছিল সে নিজের কম্পানিটা দাঁড় করানোর। শুরুর দিকেও খুব একটা খারাপ চলছে না।
ইহান সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেই সে দুই রাকাত নামাজ পড়ে নেয় যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কোন সহায়তা পেতে পারে। রায়া ইরিনা বেগমের রুমে বসে গল্প করছিল। ইহান নামাজ আদায় করে জায়নামাজে বসে বসে ভাবছে কী করবে! রায়ার পাশে থাকবে নাকি ক্যারিয়ারের চিন্তা করবে সে!

বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। বাহিরে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুতেই মন টানছে না তার। প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায় একটা মেয়ের সব থেকে বেশি প্রয়োজন তার স্বামীকে। আর এই সময়টায়ই সে যদি দূরে থাকে তাহলে সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না বলে ভাবতে থাকে ইহান। সফলতা দেরিতেই আসুক আগে নিজের মানুষকে ভালো রাখবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় ইহান। অতঃপর এই খুশির দিনে সে রায়ার চোখে পানি দেখবে না বলে ঠিক করে ইহান।

জায়নামাজ থেকে উঠে সেটা ভাজ করে রাখার সময় ইরিনা বেগম রুমে প্রবেশ করেন। ইহানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ” তুই কি বাহিরে যাচ্ছিস?”

মায়ের গলা শুনে ইহান পিছনে ফিরে তাকায়। মাথার টুপিটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলে,” এখন কি যাওয়া উচিৎ হবে মা? এখন তো চলছেই, ভালোই চলছে। গেলে ভালো হতো তবে না গেলেও কোন ক্ষতি হবে না। রায়ার এমন অবস্থায় ওকে ছেড়ে থাকা বোধ হয় উচিৎ হবে না।”
” আমিও সেটাই ভাবছিলাম। না গেলেও যদি চলে তাহলে থেকে যা। জীবনে অনেক সফলতা আসবে ইন শা আল্লাহ। মেয়েটার এই অবস্থায় আসলেই তোর দূরে থাকা ঠিক হবে না কারণ আমরা মা, শাশুড়ি যতই থাকি না কেন স্বামী হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আপন মানুষ।”

ইরিনা বেগম থেমে আবার বলে,” মেয়েটা এই ভালো একটা দিনেও কেমন মনমরা হয়ে আছে। রাইয়ানও আসলো না আবার তুইও চলে যাচ্ছিস ভেবে আরও বেশি মন খারাপ করে আছে।”
” আমি যাব না আম্মি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমার পরিবার আগে তারপর সবকিছু। আর তাছাড়া আমাদের যা কিছু আছে তোমার নাতি-নাতনিও খেয়ে যেতে পারবে তাই না? আমার এত চাপ নেই। ”

ইহানের কথায় হেসে ফেলে ইরিনা বেগম। ইহানও মাথা চুলকে মুচকি হাসতে থাকে। ইরিনা বেগম ইহানের অবস্থা দেখে ভাবেন এই ছেলেটাই বছর খানেক আগে কতটা গম্ভীর ছিল আর এখন রায়ার সাথে থাকতে থাকতে সেও রায়ার মতোই মিশুকে হয়ে গেছে।

ইরিনা বেগম হাসি থামিয়ে বলেন,” চল আমার রুমে। মেয়েটা মন খারাপ করে বসে আছে। এখনই গিয়ে বলবি যে তুই কোথাও যাচ্ছিস না, তুই এখানেই থাকবি। আর তুই নিজেও তো রাইয়ানের সাথে কথা বললেও তো পারিস বাবা। রাইয়ানটাও কেমন হয়ে গেছে।”
” আচ্ছা আম্মি, কথা বলে নেব আমি। এখন চলো যাই।”

দুজন রুম থেকে বের হবে এমন সময় রায়ার চিৎকার শুনতে পায়। রায়ার চিৎকার শুনে ইহানের মুখের হাসি যেন উবে যায়। কপালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। রায়ার কী হলো? এত জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো কেন? ইহান দৌঁড়ে মায়ের রুমের দিকে চলে যায়৷ ইরিনা বেগমও আর দেরি না করে ইহানের পিছে পিছে ছুটে যায়।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে