অবিবাহিত বউ পর্ব-০৯

0
342

#অবিবাহিত_বউ
#পর্বঃ৯
#লেখিকা_লক্ষী_দেব

তোহা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়েই তারেকুলের সম্মুখীন হলো। বুকের ভেতরের তোলপাড় বেড়ে গেল। তারেকুলের চোখ-মুখ শক্ত দেখাচ্ছে। তোহা আশে পাশে তাকাল। সুমনকে দেখা যায় কি-না। কিন্তু না। সুমন এখানে নেই। তাহলে কি সুমন আব্বুকে সব বলে দিয়ে চলে গেছে? তাছাড়া আব্বুই বা এখানে এলো কি করে? আব্বু তো চলে গিয়েছিল। তোহা প্রশ্ন গুলো নিজের মনে থামা চাপা দিয়ে করুণ স্ব’রে ডাকল,
“আব্বু..।

তারেকুল তোহার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাল। মুখ ভ’ঙ্গি শক্ত রেখেই গম্ভীর গলায় বলল,
“ছেলেটা কে?

তোহার আর কিছু বোঝার বাকি রইল না। তার মানে সুমন সব বলে দিয়েছে। তোহার বুকটা কেঁপে উঠছে। আব্বুও কি তাকে সুমনের মতোই ভুল বুঝবে? তোহা সব বিস্তারিত বলতে মুখ খুলল,
“আব্বু সুমন যা…!

তারেকুল তোহার কথাটা সম্পূর্ণ হতে দিল না। কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছুটা ধ’মক দিয়ে বলল,
“তোমার থেকে কোনো কথা আমি শুনতে চাইনি। ছেলেটা কে জানতে চেয়েছি।

তোহার চোখ দুটো ছলছল করে উঠল। আব্বু তাকে ধ’মক দিয়ে কথা বলল। এমনটা আগে কখনো হয়েছিল? উহু। তোহার মনে পড়ছে না। তারেকুল কখনো তাকে ধ’মক দিয়ে কথা বলে না। সবসময় স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। ভুল করলে ভুলটা ধরিয়ে দিয়ে দ্বিতীয়বার একই ভুল করতে মানা করেন।

তবে আজকের তারেকুলের মাঝে এসব কোনো কিছুর লক্ষন দেখা যাচ্ছে না। এ যেন অন্য এক তারেকুল। তোহাকে নি’শ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারেকুল আবারো গম্ভীর গলায় বলল,
“তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি তো।

তোহা শুকনো ঢোক গিলল। রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তোহার সাথে সাথে তারেকুল ও গেল। তোহা দরজা থেকেই ওদের বরাবর চার নম্বর টেবিলে নাহিদকে দেখতে পেল। নাহিদের মুখোমুখি রিয়া বসে আছে। তোহা আঙুল উঠিয়ে নাহিদের দিকে তাক করে বলল,
“ওই যে ওই ছেলেটা।

তারেকুল কিছুক্ষণ তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল। তোহা তারেকুলের পিছু পিছু গেল। তারেকুলের হাব-ভাব তোহা বুঝতে পারছে না। এতদিনের চেনা আব্বু আজ বড় অচেনা ঢেকছে।

তারেকুল গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল। তোহা ধীর পায়ে গাড়ির পাশে এসে দাঁড়াল। গাড়িতে উঠার কোনো প্রয়াস তার মাঝে দেখা গেল না। কিছুক্ষণ এভাবেই চলে গেল। তারেকুল এবার বলে উঠল,
“কি হলো? গাড়িতে উঠছো না কেন? নাকি ওই ছেলেটা গিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে?

তারেকুলের তী’ক্ষ্ণ কথার তীর তোহাকে এফোড়ওফোড় করে দিল। তোহার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল। হুট করেই আব্বুর প্রতি বড্ড অভিমান জমল। আব্বু কেন তার কথা না শুনে আরেকজনের কথা বিশ্বাস করল? সে কি আব্বুর কাছে এতোটাই অবহেলার পাত্রী হয়ে গেল?

তোহা ভীষণ অভিমান নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। তারেকুল গাড়ি ছাড়ল। তোহার চোখে পানি চিকচিক করে উঠল। এক্ষুনি যেন গাল বেয়ে টপ টপ করে পানি ঝড়ে পড়বে। কিন্তু তা হলো না। তোহা নিজেকে সামলে নিল। আব্বুর-ই বা দোষ কোথায়? সে তো না জেনেই রাগ করে আছে। কিন্তু একবার অন্তত তোহার কথাটা শোনার উচিত ছিল।

তোহা নিশ্চুপ হয়ে সারা রাস্তা পাড় করল। বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই তোহা গাড়ি থেকে নেমে গেল। বাসার ভিতরে যাওয়ার পর তারেকুল বলে উঠল,
“আমার মান-সম্মান এভাবে ধূলোয় মিশানোর জন্য তোমাকে এতো বড় করেছিলাম?

তোহা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আব্বু তাকে এটা বলল? তোহার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। শব্দ গুলো যেন বিদ্রোহ শুরু করেছে। তারেকুল আবারো গম্ভীর গলায় বলল,
“তোমাকে বারবার জিঙ্গেস করেছিলাম তোমার পছন্দের কেউ আছে কি-না। তুমি আমাকে বললে আমি কি তোমাকে মেরে ফেলতাম? তোমার কোন ইচ্ছেটা আমি অপূর্ন রেখেছি? আজকে যাওয়ার সময় ও তো জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার পছন্দের কেউ আছে কি-না। জিঙ্গেস করিনি?

তোহা তারেকুলের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তারেকুলের ভুলটা ধরিয়ে দিতে বলল,
“আব্বু তুমি আমায় ভুল বুঝ…..

তারেকুল তোহাকে ধ’মক দিয়ে বলল,
“তোমাকে যেই প্রশ্ন জিঙ্গেস করেছি সেই প্রশ্নের উত্তর দাও। আমি অন্য কিছু শুনতে চাচ্ছি না।

তোহা মাথা নিচু করে ফেলল। নিচু স্বরে সরাসরি জবাব দিল,
“হুম। জিঙ্গেস করেছিলে।

“তাহলে আমাকে বললে না কেন? কেন আমাকে সুমনের মুখ থেকে শুনতে হলো। ওইটুকু ছেলের কাছে আমার সম্মান’হানি করিয়ে খুব ভালো লাগছে না?

তোহা মাথা নিচু করে রইল। কোনো জবাব দিল না। নি’শ্চুপে দাঁড়িয়ে রইল। তারেকুল তোহাকে এতগুলো কথা শুনিয়ে চলে গেলেন নিজের রুমে। তারেকুল যেতেই তোহার আম্মু এসে দাঁড়াল। উ’দ্বিগ্ন হয়ে শুধাল,
“কি হয়েছে তোহা? তোর আব্বু তোর সাথে এমন ব্যবহার করল কেন?

তোহা কোনো জবাব দিল না। ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমের দিকে চলে গেল। পেছন থেকে তোহার আম্মু অবুঝ চোখে চেয়ে রইল। কি হয়েছে আজকে? তোহা কোনো জবাব দিল না কেন?
________
রাতের বেলা তোহা বি’ষন্ন মনে রুমে শুয়ে ছিল। তখনই তার ফোনটা বেজে উঠল। তোহা এতটা তাড়াহুড়ো করল না। সে জানে ফোনটা কে করেছে। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। তারপর আবারো আগের ন্যায় বেজে উঠল। তোহা রয়ে সয়ে কলটা রিসিভ করল। তখনই ওপাশ থেকে উ’দ্বিগ্ন কন্ঠে অরিন বলে উঠল,
“তোহা তোর বিয়ের কি হলো?

তোহা মনমরা ক’ন্ঠে জবাব দিল,
“বিয়ে ভে’স্তে গেছে।

তোহার জবাবে অরিন খুশি হয়ে গেল। কিন্তু তোহার মনমরা ক’ন্ঠ শুনে তার ভ্রঁ কুঁচকে এলো। তোহাকে পরিহাস করে বলল,
“বিয়ে ভে’স্তে গেছে বলে কি মনমরা হয়ে অনশন শুরু করছিস নাকি?

অরিনের পরিহাস বুঝতে পেরে ও তোহা নির্বি’কার রইল। স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিল,
“না। কিন্তু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আব্বু, সুমন আমাকে ভুল বুঝেছে।

তোহার কথার অর্থ অরিন বুঝতে পারল না। অবুঝ কন্ঠে শুধাল,
“কিসের ভুল বোঝাবুঝি? কীভাবে হলো?

অরিন প্রশ্নটা করার সাথে সাথে তোহার মুখের সামনে নাহিদদের চেহারাটা ভেসে উঠলো। তোহার নাহিদের উপর রাগটা চওড়া হলো। এক আকাশ সমান বির’ক্তি নিয়ে বলল,
“সবটা হয়েছে ওই নাহিদের জন্য।

নাহিদের কথা বলায় অরিন অবাক হলো। অবাক কন্ঠে শুধাল,
“নাহিদ ভাইয়ার জন্য? নাহিদ ভাইয়া তোদের মাঝখানে এলো কোথা থেকে? কি করেছে নাহিদ ভাইয়া?

তোহা অরিনকে রেস্টুরেন্টে ঘটে যাওয়া সবটা ঘটনা বলল। সবটা শুনে অরিন বি’স্মিত হলো। সাথে খুশিও হলো। তোহাকে বলল,
“যাই বলিস, নাহিদ ভাইয়া ছিল বলেই আজকে বিয়েটা ভে’ঙ্গে গেছে। নাহলে তোর বিয়েটা হয়েই যেত। তখন তোর ও আমাকে একা করে স্বামীর বাড়ি চলে যাওয়া লাগতো।

অরিনের কথায় তোহা বি’রক্ত হলো। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
“তুই এখনো নাহিদের পক্ষ নিয়ে কথা বলছিস। কেন? আমি কি বিয়েটা ভা’ঙ্গে দিতে পারতাম না? আব্বুকে বললে কি আব্বু আমার কথা শুনতো না? মাঝ খান থেকে ওই নাহিদ এসে আমার আর আব্বুর মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিল।

অরিন তোহার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলল,
“আঙ্কেল তোকে খুব বকেছে না?

তোহা নি’ষ্প্রাণ ক’ন্ঠে জবাব দিল,
“হুম।

“আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। আমি এখন রাখি কেমন?

তোহা জবাব দিল না। অরিন কল কেটে দিল। তোহা আগের মতো শুয়ে রইল। তারেকুলের চেহারাটা তোহার মুখের সামনে ভেসে উঠল। আব্বু তাকে এভাবে ভুল বুঝতে পারল? তারপর নাহিদের চেহারাটা ভেসে উঠল। ওদের বাবা মেয়ের ভুল বুঝাবুঝির মূলে রয়েছে নাহিদ। হ্যাঁ। নাহিদই তো সবটা করল।
___________

ভার্সিটিতে পা রেখেই তোহা এদিক ওদিক তাকাল। আজ মন’স্থির করে নিয়েছে নাহিদের সাথে দেখা হলে কথা বলা তো দূরের কথা নাহিদের মুখ দর্শন করার ইচ্ছে ও তোহার নেই। আশে পাশে তাকিয়ে দেখল নাহিদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তোহা স্ব’স্তির শ্বাস ফেলে অরিনকে বলল,
“নাহিদকে আসতে দেখলে আমাকে বলবি।

অরিন মাথা নাড়ল। শীতল স্বরে মুখে বলল,
“আচ্ছা।

তোহার গতকালের ঘৃ’নিত দৃষ্টি নাহিদকে শান্তি দিচ্ছে না। বারংবার হৃদয়টা ক্ষ’ত-বি’ক্ষত করে তুলছে। নাহিদ তোহার রাগ, বি’রক্ত মাখা চাহনি দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু ঘৃ’না? উহু সে তো তোহার ঘৃ’না ভরা দৃষ্টিতে দেখতে চায়নি। কিন্তু তাকে তোহার ঘৃ’না ভরা দৃষ্টির সম্মুখীন হতে হয়েছে। তাকে কী তোহা ঘৃ’না করে?

কেন্টিন থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে আসতেই তোহাকে মাঠের মাঝখান দিয়ে যেতে দেখল নাহিদ। মনটা আবারো তোহাকে বলতে উদগ্রীব হয়ে আছে। নাহিদ দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে লাগলো।

অরিন নাহিদকে আসতে দেখেই তোহাকে বলল,
“তোহা নাহিদ ভাইয়া এইদিকে আসছে।

অরিনের কথা শুনে তোহা অরিনের হাতটা ধরল। যতটা দ্রুত হাঁটা যায় ততটা দ্রুত হাঁটতে লাগলো। নাহিদ তাড়াতাড়ি হেঁটেও তোহাকে ধরতে পারল না। নাহিদ আসার আগেই তোহা ক্লাসে চলে গেছে। এখন কিছু করার নেই। কেবল ছুটি দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে