অপ্রিয় প্রিয়জন পর্ব-০৮

0
323

#অপ্রিয়_প্রিয়জন
#Fiza siddique
#পর্ব-8

মেঘ খুব ভালো করেই জানে বৃষ্টির এখন মন খারাপ, আর এই অবস্থায় বাড়িতে যাবেনা। তাড়াতাড়ি ড্রাইভ করে চলে যায় সেই নদীর পাড়ে। সেখানে পৌঁছে মুখে হাসি ফুটে ওঠে মেঘের। কারন তার ধারনা ঠিক ছিল, নদীর পাড়ে মন খারাপ করে এক দৃষ্টিতে শূন্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বৃষ্টি।

বৃষ্টি! কারোর ডাকে চমকে তাকায় বৃষ্টি। তবে এই ডাকটা চিনতে খুব একটা অসুবিধে হয়না বৃষ্টির। এটাই সেই মানুষটা যে গত তিনটে বছর ধরে তাকে সামলে এসেছে। হারিয়ে যাওয়া বৃষ্টিকে আবার নতুন করে ফিরিয়ে এনেছে। নিঃস্বার্থভাবে পাশে থেকেছে সবসময়। যখনই বৃষ্টির কাউকে প্রয়োজন হয়েছে ঢাল হয়ে থেকেছে সবসময়। এই মানুষটার ভীষণ অবদান তার জীবনে। এই মানুষটার কাছে যে সে শুধু বন্ধু নয় সেটাও সে বেশ আন্দাজ করতে পেরেছে। তবে কখনও মুখে বলেনি মেঘ নিজের ভালবাসার কথা, হয়তো বলতে চেয়েও বলতে পারেনি।

বৃষ্টি আজ আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। অনেক ভেবেছি এই বিষয়টা নিয়ে, বারবার মনে হয়েছে যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে আমি মেনে নিতে পারবোনা। তার থেকে এভাবেই ভালো আছি। কিন্তু আমি আর পারছিনা। সত্যি এই দোটানায় বাঁচা অনেক কঠিন।

জানো কলেজের চকলেট বয় ছিলাম আমি। এমন কোনো মেয়ে ছিলোনা যার থেকে প্রেমের প্রস্তাব পাইনি আমি। কিন্তু কখনো কারোর উপর একবারও ঘুরে তাকাতেও ইচ্ছে হয়নি। তবে এই নয় যে আমি তাদের অসম্মান করতাম, বরং ভালো ভাবে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিতাম। বিদেশেও অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে কিন্তু কখনো করোর প্রতি একটুও দুর্বলতা তৈরি হয়নি। প্রথম যেদিন এই হসপিটালে এসেছিলাম এক বইপোকা মেয়েকে দেখে চোখ আটকে গেছিলো আমার। যেখানে বাকি সবাই আমাকে অ্যাপায়নে ব্যাস্ত, নিজেকে সুন্দরী প্রমাণে ব্যাস্ত, সেখানে একটা সাদামাটা কুর্তি আর জিন্স সাথে গলায় একটা স্কার্ফ ঝোলানো একটা মেয়ের প্রতি ভীষণ মুগ্ধ হই। হ্যা তবে সেটা ভালোবাসা ছিলোনা, ছিলো এক আকাশ সমান মুগ্ধতা, ভালোলাগা। তারপর তার প্রতিটা কাজেই ভীষণ মুগ্ধ হতাম। যখন কিছু বিষয় বুঝতে না পেরে মেয়েটা মুখে পেন নিয়ে চিন্তা করত, সেই কলমের প্রতিও হিংসা হতো আমার। ভীষন ছুঁয়ে দেওয়ার ইচ্ছে করতো মেয়েটাকে। নিজের এক বুক সমান ভালোবাসা উজাড় করে দিতে ইচ্ছে করতো। মনে হতো ঠিক এই বুকের মাঝখানটায় লুকিয়ে রাখি তাকে। যাতে আর কেউ না দেখতে পারে।

নিজের ইচ্ছে গুলো চাইলেও প্রকাশ করতে পারতাম আমি তার সামনে। তাই আসতে আসতে তার বন্ধু হতে শুরু করলাম। তাকে জানার পর, চেনার পর আরও একবার তার প্রেমে পড়লাম। এমন ভাবে হাজারও বার প্রেমে পড়েছি তার। একটা মেয়ের প্রতি এতটা পাগল হবো কখনো ভাবিনি, কখনও ভাবিনি কাউকে পাগলের মতো ভালোবাসবো আমি। নিজের অনুভূতিগুলো সামলাতে ব্যার্থ আমি বারবার ছুটে গেছি তার কাছে অচেনা সেজে। কখনও অন্ধকারে তো কখনও ছলনায় আলোতে তাকে দুচোখ ভরে দেখেছি, আর সে আমাকে আরও পাগল করে দিয়েছে। যতটা দূরে থাকতে চেয়েছি, নিজের অনুভূতিগুলোকে লুকাতে চেয়েছি ততবারই সে আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়েছে, আরো নিবিড়ভাবে ভালোবাসতে বাধ্য করেছে। ভীষণ ভালোবাসি আমি তোমাকে বৃষ্টি। জানিনা তোমার উত্তর কি হবে তবে শুধু একটাই অনুরোধ কখনও আমার থেকে দূরে চলে যেওনা, তাহলে বেচেঁ থেকেও করে যাবো আমি। জীবন্ত লাশ শব্দ টার সাথে আমাকে পরিচিত হতে হবে তখন।

এতক্ষন মন দিয়ে মেঘের অনুভূতি মিশ্রিত কথাগুলো শুনছিল বৃষ্টি। কখন যে নিজের অজান্তেই দুচোখ দিয়ে অশ্রুকণা বয়ে গেছে নিজেও খেয়াল করেনি। কিছুক্ষন দুজনই সামনের শান্ত, শীতল নদীর পানির দিকে তাকিয়ে থাকলো। দুজনের মনে চলছে আলাদা রকম ঝর। বাইরে থেকে পরিবেশটা যতটাই শান্ত লাগছে ভেতরে ততটাই অশান্ত ঝড় বইছে।

জানেন মেঘ ফারহান আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা। আমার জীবনটা জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছিল। আম্মু আব্বুকে যে কতগুলো দিন আমার জন্য কাঁদতে দেখেছি সেটা আমত নিজেরও অজানা। আপনি না থাকলে হয়তো আমি কখনো আমার স্বাভাবিক জিবনে ফিরে আসতে পারতাম না। আমি ভুলতে চাই ওই মানুষটাকে। জানি কখনই সম্পূর্ণ ভোলা সম্ভব হবেনা, তবুও আমি তাকে ভোলার চেষ্টা করতে চাই। ভুলতে চাই ওই #অপ্রিয়_প্রিয়জন মানুষটাকে। পারবেন আমাকে আমার অতীতের সাথে মেনে নিতে? পারবেন সহ্য করতে আমার মনে ওই #অপ্রিয়_প্রিয়জন এর বসবাস?

বৃষ্টির মুখটা নিজের দুই হাতের আজলায় নিয়ে মেঘ বলে, যদি বলি পারবো। যদি বলি তোমার সবটুকু নিয়ে আমি তোমাকে ভালোবাসবো, মেনে নেবে আমায়? তোমার হাতে হাত রেখে হাঁটার সুযোগ দেবে? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি একদিন তোমার সবটা জুড়ে শুধু আমিই থাকবো। এই অতিতের ব্যাথাগুলোর জন্য আমার আকাশ সমান ভালোবাসা ব্যাথানাশক হবে। একটু একটু করে তোমার জীবন থেকে অতীতের পাতাগুলো ঝাপসা করে দেবো আমি। কথা দিলাম।

বেশ কিছুসময় দুজনে সেখানে কাটিয়ে গড়িয়ে উঠে বসে বাড়ী যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আজ মেঘ ঠিক করে এসেছিলো যেভাবে হোক বৃষ্টিকে সবটা জানাবে, তবে ভাবেনি যে বৃষ্টির উত্তর এমন হবে। আজ ভীষণ খুশী মেঘ, বৃষ্টি হয়তো ওকে ভালবাসি বলেনি তবে ওকে ভালোবাসতে যে বাধা দেয়নি এটাই মেঘের জন্য অনেক বড়ো পাওয়া। এদিকে বৃষ্টির মনও আগের থেকে অনেকটা ভালো হয়ে গেছে, মেঘের সঙ্গ ওর সব মন খারাপকে গায়েব করে দিতে পারে। জাদু জানে এই ছেলেটা। এসব ভাবনার মাঝে হটাত করে গাড়ি থামায় বৃষ্টি সামনে তাকিয়ে দেখে ওর পৌঁছে গেছে, তাই মেঘকে বিদায় জানিয়ে নেমে যায়।

বৃষ্টি এক মিনিট! বলেই ব্যাক সিট থেকে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে বৃষ্টির হতে দেয়। আর বলে, যেদিন প্রথম আপুর জন্য শপিং করার বাহানায় তোমাকে নিয়ে গেছিলাম, সেদিনই এটা পছন্দ করে কিনেছিলাম তোমার জন্য। ভেবেছিলাম যেদিন নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবো সেদিন এটা দেবো তোমাকে। কাল যদি এটা পরো তাহলে ভালো লাগবে আমার। মেঘের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে একটু হেসে নেমে যায় বৃষ্টি। যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা গেলো বৃষ্টিকে মেঘ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকলো, তারপর বেরিয়ে পড়লো নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

ফ্রেশ হয়ে ডিনার করে ঘুমাতে যাওয়ার সময় বৃষ্টির চোখ পড়ে সেই শপিং ব্যাগের দিকে। সেটা খুলে দেখে একটা সবুজ রঙের হালকা শাড়ি, সাথে একজোড়া কানের দুল, একজোড়া পায়েল। সবগুলো জিনিসই ভীষণ পছন্দ হয় বৃষ্টির।

রোজকার মত আজও মেঘ অপেক্ষা করছে বৃষ্টির আসার। তবে আজ যেনো সময় শেষ হতে চাইছেনা। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে আর বৃষ্টির আসার অপেক্ষা করছে। হটাত সামনের দিকে তাকিয়ে মেঘের মুখ আপনাআপনি হা হয়ে যায়। বৃষ্টি তার দেওয়া শাড়ি, কানের দুল, সাথে পায়েলও পড়েছে, চোখে হালকা করে কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক আর কোমর সমান চুলগুলো খোপা করা। কোনোরকমে নিজেকে সংযত করে নিচের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে, “মায়াবিনী উহু আমার সর্বনাশীনি”

হটাত রাস্তায় আইস ক্রীম দেখে বৃষ্টি গাড়ি থামাতে বলে। তারপর এক দৌড়ে চলে যায় রাস্তা পার হয়ে ওপাশের আইসক্রিম বিক্রেতার কাছে। দূর থেকে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলা দেখে আর একদফা প্রেমে পড়ে মেঘ। এই মেয়েটার সবকিছুতেই মুগ্ধ হয় সে। কি দারুন ভাবে বাতাসে মুখের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়ছে সাথে এক সবুজপরী হাত নেড়ে নেড়ে কিছু একটা বলছে, গরমের জন্য মুখে জমে থাকা ঘামে সূর্যের আলো পড়ায় তা চিকচিক করছে। আনমনেই হাসে নিজের এমন চিন্তাধারায়।

পাশ থেকে একটা বাচ্চা মেয়েকে কিছু লাল গোলাপ নিয়ে যেতে দেখে কাঁচ নামিয়ে ডাকে মেয়েটাকে। এই পিচ্চি নাম কি তোমার?

আমার নাম জান্নাতুল

কোথায় থাকো?

হেই সামনের বস্তিতে থাকি ভাইজান। ফুল নিবেন? ভাবীরে দিবেন হেই ফুল। অনেক খুশি হবে।

তাই নাকি? ভাবি খুশি হবে বলছো?

হ ভাইজান। অনেক খুশী হবো।

আচ্ছা তোমার কাছে কত টাকার ফুল আছে?

মোট 200 টাকার ভাইজান।

এই নাও 1000 টাকা রাখো তুমি, আর আমাকে সবগুলো ফুল দিয়ে দাও। আর দুআ করো তোমার ভাবি যেনো অনেক খুশি হয়ে যায় এগুলো দেখে।

ভাইজান আপনি খারান। আমি আমনেরে বাকি টাকা ভাঙতি এনে দিচ্ছি।

আরে নাহ নাহ পুরোটাই রাখো তুমি। মনে করো তোমার বড়ো ভাই তোমাকে দিয়েছে। কি রাখবেনা বড় ভাইয়ের টাকাটা।

আমনে অনেক ভালো ভাইজান, বলেই চলে যায় বাচ্চাটা।

বাচ্চাটা চলে যাওয়ার পর ফুলগুলো হতে নিয়ে দেখতে দেখতে মেঘের চোখ যায় বৃষ্টির দিকে। আপনমনে একহাতে একটা আইস্ক্রিম খাচ্ছে আর অন্য হাতে আর একটা ধরে রেখেছে। ওটা যে মেঘের জন্যই আনছে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নিজের ভাবনার মাঝে হটাত চোখ পড়ে মেঘের অপরপাশ থেকে আসা ট্রাকের দিকে, গাড়িটা খুব জোরেই আসছে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে