অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-০১

0
937

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-১

ছোট ভাবী আমার গালে পাফ বোলাতে বোলাতে বলল, “সুন্দর করে সাজিয়েছি না বলো তো?”
“হুম।”
“কী হুম? ভালো করে দেখো।”

আমি দেখলাম। সামান্য ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে বলে এত সাজানোর কী আছে বুঝি না। বলতে ইচ্ছে হলো, এত সাজালে তারা আমাকে কখনোই পছন্দ করবে না। তারচেয়ে এমনিতেই যাই।

কিন্তু বললাম না। আমার এখন বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। মাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছি। এতদিনের জীবনটা ছেড়ে হুট করে নতুন সংসারে জড়ানোর মতো মানসিক প্রস্তুতি একদমই নেই। তবে কিছু বলতেও পারছি না। আমি অত ভালো ছাত্রী নই যে পড়াশোনার দোহাই দিয়ে বিয়েতে মানা করে দেব। আসলে আমার বিয়েতে মানা করারও কোনো সুনির্দিষ্ট কারন নেই। কে জানে হয়তো বিয়ের কথা উঠলে মেয়েরা প্রথম প্রথম মেনে নেবে না এই প্রথা অনুযায়ী মন মানছে না!

ভাবী চলে গেলে একা বসে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখলাম। অতিরিক্ত মেকাপে চেহারা ফরসা মানুষের চেয়েও ফরসা লাগছে। অথচ হাত শ্যামলা। বিয়ের যা খুশি হোক, নিজের ইমেজ নষ্ট করার মানে হয় না। আমি বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললাম। একটু ক্রিম আর চোখে কাজল লাগিয়ে নিলাম।

আমাকে নিতে এসে ছোট ভাবী মুখ কালো করে ফেললেন। তবে বললেন না কিছু। বড় ভাবী আর আপাকে বললেন, “আপনারা নিয়ে যান ওকে। আমি রান্না সামলাই।”

বসার ঘরে নিয়ে গেলেন আমার বড় ভাবী আর আপা। মেহমানদের কে যেন ডেকে পাশে বসালো আমায়। শুনেছি তারা আমাদের চেয়ে বড়লোক। বনেদী ঘর। আঁড়চোখে যতটুকু দেখা যায় তাতে পোশাকের জাঁকজমক চোখে পড়ার মতোই। অনেকে অনেক প্রশ্ন করলেন। আমি গুছিয়ে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করলাম। ভেবেছিলাম হয়তো হেঁটে দেখাতে বলবে, চুল খুলে দেখাতে বলবে। কিন্তু তেমন কিছু হলো না। বড় আপাকে দেখতে এসে অনেকেই এমনটা বলতো। যাই হোক, বেঁচে গেলাম।

একসময় কে যেন বলল, মেয়ে আর ছেলেকে আলাদা কথা বলতে দেয়া হোক।

আমাদের বাড়ির সামনে আর পেছনে দু’দিকেই বাগান। পেছনে ছোট একটা পুকুর আছে। বাঁধানো ঘাট। পুকুরের পাশে অনেক ধরনের গোলাপ আর বড় বড় দুটো কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সে আমাকে সেদিকেই নিয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে প্রথম প্রশ্নটা করল, “আপনার কোন রঙের গোলাপ পছন্দ?”

আমার কথা আসছে না। ভীষণ জড়তা কাজ করছে। ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছে। একজন লোক যার সাথে বিয়ে হলেও হতে পারে তার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলা যায়? আমি ছোটবেলা থেকে বেশ লাজুক ধরনের। ছেলেদের সাথে কখনোই তেমন মিশিনি। সারাজীবন গার্লস স্কুল, গার্লস কলেজে পড়েছি, এখনো অনার্স পড়ি সেই মহিলা কলেজে। এদিকে সে তাকিয়েই আছে আমার দিকে উত্তরের আশায়। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে আন্দাজেই বলে দিলাম, “লাল রঙের।”

তখনো তার মুখটা ভালো করে দেখিনি। লজ্জা লাগছে তাকাতে। তবে কণ্ঠস্বর ভারি সুন্দর! ভরাট, সুরেলা গলা। মূলত কণ্ঠ শুনেই মুখটা ভালো করে দেখতে ইচ্ছে করলো। সে বলল, “আমার কিন্তু লাল গোলাপ পছন্দ নয়। হালকা গোলাপী…না…মিষ্টি…ঠিক মিষ্টিও না আরেকটু গাঢ়…এই ধরুন আপনার গায়ের রঙের মতো….কিন্তু সেটা আপনাদের বাগানে নেই।”

আমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেলাম। মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম অন্যদিকে। কেমন কথা এটা! নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে গায়ের রঙটা দেখার চেষ্টা করলাম। আমি শ্যামবর্ণ, না তারচেয়ে একটু উজ্জ্বল হয়তোবা…এমন রঙের গোলাপ হয় নাকি?

সে একটু কাছে এসে বলল, “কী ভাবছেন?”

আমি চমকে তাকালাম তার দিকে। সেও আমার দিকেই চেয়ে আছে। পূর্ণ দৃষ্টিতে এবার ভালো করে দেখলাম তাকে। মুখটা ঠিক গোল নয়, লম্বাও নয়, চোখদুটো গোলাপের পাপড়ির মতো যেন, নাকটা উঁচু, ঘন চুল কপালের ওপর ছড়িয়ে আছে। আদুরে দেখতে একদম।

বসন্তের বিকেলবেলা পাখির কলকাকলি, প্রজাপতির ওড়াওড়ি, কৃষ্ণচূড়ার ঝড়ে পড়া পাপড়ি, আর ফুলের মিষ্টি সুবাসের মাঝে যেন অনেক অনেকটা সময় নিয়ে শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হলো।

ঘোর কাটলো একসময়। দু’জনেই হঠাৎ খানিকটা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম। সেই আগে আবার কথা বলল। সব যেন ছন্নছাড়া বেখেয়ালী কথাবার্তা। আমার আগের জড়তাটা আস্তে আস্তে কেটে গেল৷

কথা শুনে মনে হলো সে একটু উদাসীন কবি কবি ধরনের। জিজ্ঞেস করলাম, “কবিতা লেখেন?”
সে হেসে উত্তর দিল, “ইচ্ছে করে লিখতে। শব্দেরা জমাট বাঁধে। তবে লেখা হয়ে ওঠে না।”
“কেন?”
সে হাসলো। বলল না কিছু।

ভেতর থেকে ডাক পড়ল। মেহমানেরা যাওয়ার পায়তারা করছে। সে যাওয়ার আগে বলল, “জানেন আমার একটা ইচ্ছে আছে। সেটা পূরন হয়ে গেলেই কবিতা লিখতে পারব।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কী ইচ্ছে?”

সে ভাবুক হয়ে প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে আকাশপানে চেয়ে বলল, একটা দ্বীপে বাড়ি বানাবো। চারপাশে গভীর নীল সাগর, আর দ্বীপের মাঝখানে পাহাড়। সাথে থাকবে প্রেয়সী..সারাজীবন না থাকতে পারলেও অন্তত কিছুটা দিন সেখানটাতে একান্তই আমাদের হবে৷ কিছুটা দিন না হলে কিছুটা মুহূর্ত…!”

আমি গলা খাঁকারি দিয়ে তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলাম। “তারপর?”

সে হেসে বলল, “তারপর কবিতা লিখতে পারব।”

এই বলে সে চলে গেল। তবে যাওয়ার আগে রেখে গেল একরাশ মুগ্ধতা। চারপাশে আমি রজনীগন্ধার সুবাস পেতে লাগলাম। সারা ঘরে, বাগানে, নিজের শরীরে সবখানে মোহনীয় আঠালো একটা সুবাস। নয়তো নেশার ঘোর…

ঘোর কাটতে সময় তেমন লাগলো না। দু’দিন পর জানতে পারলাম ছেলেপক্ষের আমাকে পছন্দ হয়নি। তারা আরেকটু ফর্সা, আরেকটু ওয়েল এডুকেটেড মেয়ে চাইছে। ছোট চোখের, শ্যামলা আর বাংলায় ন্যাশনালে অনার্স করা মেয়ে পছন্দ না হবারই কথা।

আমার জীবনটা বড়ই সরল সোজাভাবে কেটেছে। ছোটবেলা থেকে বড় ধরণের কোনো ধাক্কা খাইনি। তাই বিয়ের পাত্রী হিসেবে রিজেক্ট হওয়ার ব্যাপারটা আমার মানতে বেশ কষ্ট হলো। আমি জানতাম আমি অতটা সুন্দরী বা যোগ্যতাসম্পন্না নই, তবুও কেউ কখনো সেটা আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বলে দেয়নি। এরা যেন সেটাই করল। বুকের চিনচিনে ব্যথা কি শুধু প্রত্যাখ্যান হওয়ার জন্য? নাকি ওদের থেকে প্রত্যাখ্যান হওয়ার কারনে? তার অমন আন্তরিক কথাবার্তায় কি একটু বেশিই প্রত্যাশা করে ফেলেছিলাম?

যেই আমি বিয়েতে রাজি ছিলাম না সেই বিয়ে ভাঙায় হঠাৎ যেন মনে হলো পুরো জীবনটা বৃথাই গেলো..সারারাত লুকিয়ে কাঁদলাম। কিসের কষ্ট নিজেও নিজের কাছে পরিষ্কার না।

পরদিন পহেলা বৈশাখ। সবার কতো আনন্দ! গত দু’দিনে যেন হাজারখানেক স্বপ্নজাল বুনে ফেলেছিলাম। ভেবেছিলাম বাণিজ্যমেলা থেকে কেনা সাদা রঙের শাড়িটা পরব পহেলা বৈশাখে। কোনোভাবে তার সাথে দেখা করব। তার সাদা পছন্দ! বলেছিলো সেদিন…. সব শেষ। নিজেকে জঞ্জাল মনে হচ্ছে। সুন্দর কেন নই…ভালো ছাত্রী কেন নই…?

বিকেলে সবাই হৈ হৈ করে ঘুরতে গেল। আমি জ্বরের কথা বলে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম হয়তো। উঠে দেখলাম ফোন বাজছে। অচেনা নম্বর। ধরতে ইচ্ছে করল না। ফোনটা কেটে যেতেই দেখলাম এটা নিয়ে সেই নম্বর থেকে মোট ৫১ বার ফোন করা হয়েছে! ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হবার জোগাড় আমার। ধরেই নিয়েছি বাড়ির সবাই মেলায় গেছে, সেখানে কিছু অঘটন হয়েছে। আবার ফোন এলো তক্ষুনি। সাথে সাথে ধরলাম।

আমার অস্থির কণ্ঠ শুনে ওপাশের মানুষটা একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “কোনো সমস্যা?”
মুহূর্তেই যেন শরীরটা অবশ হয়ে এল! সেই কণ্ঠ! বাতাসে ফিরে এলো রজনীগন্ধার সুবাস। বললাম, “না। আপনি হঠাৎ?”
“চিনেছেন তাহলে?”
“জি।”
“কেমন আছেন?”
“এইতো..আপনি?”
“ভালো নেই।”
“কেন?”
“মা প্রতিদিন মেয়ে দেখে দেখে পাগল বানিয়ে দিলো। মনে হচ্ছে দিনে দু’বার করে বাজার করতে যাচ্ছি। ঘন্টাখানেক দেখাদেখি করে পছন্দ হচ্ছে না বা দামে মিলছে না বলে চলে আসছি।”

আমার হৃদয়ে তরল একটা বিষন্ন স্রোত বয়ে গেল। সে বুঝি সব মেয়ে দেখতে গিয়েই তাদের সাথে অমন করে কথা বলে! বললাম, “মেয়ে দেখার ব্যাপারটা এমনই।”
“তবুও কেমন বিচ্ছিরি।”
“আপনার পছন্দ হয় না কাউকে?”
“বুঝতে পারি না ঠিক।”
“ওহ!”
“জানেন, সেদিন এক মেয়ে দেখলাম। সবই ভালো, শুধু তাদের বাড়ির সিঁড়ি সুন্দর না বলে মায়ের পছন্দ হলো না। এটা কোনো কথা?”
বলার ধরনে হেসে ফেললাম।
সে বলতে থাকলো, “কোনো মেয়ের নাক পছন্দ নয়, কেউ হাইটে কম, কেউ কথা বলে না তো কেউ উশৃংখল! এত এত বেছে হয় নাকি? কেউ কি পারফেক্ট হয়?”
“আপনি নিজেই কাউকে খুঁজে নিন, যাকে পারফেক্ট মনে হবে।”
সে একটু চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ, তাই করব। আপনার খবর বলুন।”
“আমার আর খবর কী! নতুন কিছু নেই।”
“তাই বুঝি? আজ কোথাও ঘুরতে যাবেন না?”
“নাহ!”
“কেন?”
“ইচ্ছে নেই।”
“আমিও কোথাও ঘুরিনি৷ আমার সাথে বের হবেন?”
একটু ইতস্তত করে বললাম, “আসলে আমার একটু জ্বর এসেছে। বাসার সবাই গেছে মেলায়। আমি রয়ে গেছি।”
“সে কী! ডাক্তার দেখাননি?”
“অতটা সিরিয়াস কিছু নয়।”
“আমি যাব একবার?”
“না না আপনি কেন আসবেন শুধু শুধু?”
“খুব সমস্যা হবে বুঝি?”
“তা নয়।”
“তাহলে আসছি। না করবেন না প্লিজ।”
“আচ্ছা।”

কেউ আসতে চাইলে তাকে মানা করে দেয়া যায় না। আমিও পারলাম না। কিন্তু যার সাথে বিয়ের কথা হওয়ার পর ভেঙে গেছে, তার এখানে এভাবে আসাটা কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। তাও যখন আমি বাড়িতে একা। চিন্তায় আমার মাথার দুই পাশ ব্যথা করতে শুরু করল। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পুরানো প্রিন্টের জামা পরনে। চুলে তেল চুপচুপ করছে। নিজেকে একটু পরিপাটি করে নেয়া প্রয়োজন। আর সে এলে খেতেও দিতে হবে। কী খাবার ঘরে আছে কে জানে!

ফোন রাখার পর মনে হলো নম্বর কোথায় পেল আমার? আর ফোনই বা করল কেন? আবার ফোন করে জিজ্ঞেস করব? না থাক। সে তো আসবেই। তখন জানা যাবে।
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে