অপূর্ব সমাপ্তি পর্ব-২৯+৩০

0
498

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ২৯

পার হলো আরও দুই বছর। দুই বছরে অনেকটা বদলেছি আমি। একটু একটু করে। এই যেমন এখন চোখে মাঝারি পাওয়ারের একটা মোটা ফ্রেমের চশমা পরি, চুলগুলো আগের মতো বড় নেই, যত্ন করার ইচ্ছে হয় না বলে ছোট করে কেটে রাখি। বাইরে বের হলে শাড়ি পরি, মেয়েলিপনা আবেগ ছেড়ে কথা বলি একদম সোজাভাবে। অনেক সময় নিজেরই মনে হয়, যন্ত্র হয়ে গেছি। তবে এখন কলেজের ম্যাম হিসেবে বেশ সমীহ করে সবাই।

বয়স এবার উনত্রিশ হলো। একটা মেয়ে হিসেবে খুব বেশিও না আবার কমও না। বিধবা হিসেবে হয়তো একটু কমই? নাকি আগের দিনে এরচেয়েও অনেক ছোট মেয়েরা বিধবা হয়ে যেত? তাদের তবুও বাচ্চা থাকতো। আমার কিচ্ছু নেই। ব্যাস, শুধু নিজের মতো বেঁচে থাকা। সাতটা বছর সে আমার জীবনের সাথে লেপ্টে ছিল। আমায় কুসুম ফোটা একটা নাজুক ফুল থেকে পরিণত মানুষ করে দিয়ে গেছে।

তার মৃত্যুর ছয় মাস পর এক রাতে আমি হঠাৎ করেই যেন সবকিছু মেনে নিয়েছি। তার আগে প্রচুর কান্নাকাটি করতাম। পাগলের মতো লাগতো। ইচ্ছে করতো ছাদে গিয়ে এক লাফ দিয়ে জীবনের সব ঝামেলা শেষ করে ফেলি। আমার এমনিতেও কোনো পিছুটান নেই। কিন্তু কেন যেন পারতাম না। প্রেম, ভালোবাসা, ত্যাগ, স্মৃতি সবকিছু যন্ত্রণার জলে মিশে আমার হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠতো! সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখলাম সে একটা ব্রিজের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। পাশে আমি। সামনে যতদূর চোখ যায় পানি। ওপরে চাঁদটা চকচকে আলো দিচ্ছে। সে বলল, “তোমাকে ভালো রাখার জন্যই আমি সব করলাম। তুমি ভালো নেই কেন?”

আমি ছুটে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম। সে আটকে দিল। বলল, “কাছে এসো না। আমাকে ছোঁয়া যাবে না।”

“কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে চাই!”

“আমার সাথে থাকার অনেক কষ্ট। তুমি নিতে পারবে না।”

“পারব।”

“পারবে না। কথা দাও, ভালো থাকবে?”

আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “আমাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে।”

সে মৃদু হাসলো। চাঁদের আলোতে আমি স্পষ্ট দেখলাম তার অপরূপ মুখটি। সে বলল, “আমার শেষ ইচ্ছে, তুমি ভালো থাকবে? প্লিজ কথা দাও?”

আমি কথা দিলাম। সে আমার দিকে তাকালো না। উল্টো ঘুরে হেঁটে চলে গেল। আমি দৌড়ে পিছু নিলাম। তাকে ধরতে পারলাম না। কোথায় হারিয়ে গেল সে!

যখন জেগে উঠলাম তখনও হাঁপাচ্ছি। উঠে জানালার পাশে চলে গেলাম। সেই চাঁদটাই তো! চাঁদের আলোতে কদমগাছটা থেকে ভুতুড়ে পেঁচারা ডাকতে শুরু করল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, “আমি আর কাঁদব না। ভালো থাকব। তারপর থেকে চাইলেও সেভাবে কাঁদতে পারি না৷ নিজেরও অবাক লাগে, সে কি সত্যি স্বপ্নে এসেছিলো? নাকি সব আমার কল্পনা? হয়তো আমার নিজের সত্তাই চাচ্ছে না আর খারাপ থাকতে। এবার একটু শান্তি মিলুক নাহয়!

অনেকে অবশ্য পেছনে সেজন্য অনেক কথাও বলে, বরটা মরে গেল, তবুও শোকতাপ নেই আমার। কেমন দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি! আমার সেসব শুনলে কেন যেন অনেক মজা লাগে। এরাও হয়তো অনেক অসুখী। অন্যকে ভালো থাকতে দেখলে ভালো লাগে না।

সে মারা যাওয়ার কিছুদিন পর আমার শ্বশুর আমার স্বামীর অংশের সম্পত্তি আমার নামে করে দিল। আমি নিতে চাইনি, জোর করে দিয়ে গেল। আমি অনেকবার বললাম, ” আমার দরকার নেই, অর্না, অনুভবকে সমানভাবে ভাগ করে দিন, উনি রাজি হলেন না।

আমি অবশ্য পরে এই অজস্র সম্পত্তির একটা ব্যবস্থা করে ফেললাম। বেশ কিছু টাকা দিয়ে মেয়েদের জন্য একটা ঋণদান সংস্থা খুলে ফেললাম। তারা এখান থেকে প্রয়োজনে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিনা সুদে ঋণ নিতে পারবে।

কিছু টাকা মানসিক হাসপাতালে দান করলাম। আর বাকিটা দিয়ে বাড়ির পাশে একটা স্কুল খুলে ফেললাম। স্কুলটা গরীব বাচ্চদের জন্য। যারা টাকার অভাবে পড়তে পারে না। ভালো বেতনে কিছু শিক্ষকও রেখে দিলাম। স্কুলের টাকার একটা অংশ ব্যাংকে জমা থাকলো, যেখান থেকে শিক্ষকদের বেতনের টাকাটা উঠে আসে। এসব করতে সাহায্য করল ইভা। অনেক বুঝদার এই মেয়েকে পাশে পেয়ে আমার অর্ধেক কষ্টই কমে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর অদৃশ্য আরও দশটা হাত আছে, যেগুলো দিয়ে সব সামলায়। এমনই তো হওয়া উচিত একটা মেয়ের। আমার মতো কম গুণ নিয়ে জন্ম হলে জীবনটা কষ্টেই কাটে!

.
আমি এখন প্রচুর লেখালেখি করি। আমার একক বই বের হচ্ছে গত দুই বইমেলায়। অনেকেই আমায় চেনে। প্রতি বৃহস্পতিবার সাহিত্য সংঘের আসর বসে আমাদের পাশের এলাকায়। অনেক জ্ঞানীগুণী কবি সাহিত্যিকরা আসেন। আবার অনেক নতুন লেখকরাও যোগ দেয় তাতে। আড্ডা হয়, আবৃত্তি হয়, প্রতিযোগিতা হয়, সমালোচনা হয়। বেশ লাগে এই সময়টা! সব ভুলে অন্য জগতে চলে যাই।

সেখান থেকেই আবিষ্কার করেছি আমি ভালো আবৃত্তি করতে পারি। ছোটবেলায় স্কুল কলেজে সংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করতাম, অনার্সে ওঠার পর আর চর্চা হয়নি। তবুও আবৃত্তি সুন্দর হয়। মনপ্রাণ ঢেলে একেকটা কবিতা পড়ি। কবিতা আবৃত্তির সময় সবসময় আমার মনে হয় সামনে এখানকার কেউ নেই, শুধু আমি আছি, আর সামনে শ্রোতা সে। আমি প্রাণ দিয়ে জোর গলায় কবিতা শোনাচ্ছি, সে হাততালি দিয়ে বলছে, “বাহ, কি সুন্দর আবৃত্তি করো গো তুমি!”

সে শুধু এখানেই না, অনেক সময় আমার আশেপাশে চলে আসে। যেমন ভালো রান্না করলে, সে উদয় হয়ে চেখে দেখে বলবে, “ফার্স্টক্লাস!”। ভালো গল্প লিখলে পড়ে বলবে, ” চমৎকার হয়েছে।” কখনো সুন্দর করে সাজলে এসে দাঁত বের করে হেসে বলবে, “ভালোবাসি।”

কেউ না জানলেও আমি জানি, সে আছে৷ আমার খুব কাছেই সে এখনো বাস করে। তার দাদীর সেই আংটিটা এখনো আমার হাতে পরি। কখনো খুলিনি৷ এটার ইতিহাস সে বলেছিলো। আমার দাদী শ্বাশুড়ি আমার শ্বাশুড়িকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। তবে বড় নাতি ছিল তার চোখের মণি। তিনি এই আংটিটা খুব শখ করে মৃত্যুর আগে বড় নাতবউ এর জন্য বানিয়েছিলেন। কিন্তু তখন দিয়ে দিলে যদি আমার শ্বাশুড়ি পরে ফেলে, তাই তাকে কখনো এটা দেখাননি। চুপি চুপি নাতিকে দিয়ে বলেছিলেন, আংটিটা তার বউকে পরিয়ে দিতে, তবে মাকে যেন না দেখায়।

আংটির ওপর ছোট্ট দুটো অক্ষর খোদাই করা- এ.এস। ডিজাইনের ভিড়ে চোখে পড়ে না। আমি অনেক পরে সেটা দেখেছি৷ এ.এস তার ভালো নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। তবে আমার কাছে এটার মানে অপূর্ব-সমাপ্তি!

.
সন্ধ্যাবেলা আমার কাজ হলো এক মগভর্তি চা নিয়ে পড়তে বসা। লেকচার তৈরি করা, তারপর সময় ধরে কিছু পড়াশোনা করা, শেষে লেখালেখি। পুরো চা টা গরম থেকে ঠান্ডা বরফ হয়ে যায়, তখনও একটু একটু করে চুমুক দিয়ে যাই।

পড়ছি আমি, এমন সময় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। ধরতেই একটা ছেলেকন্ঠ সালাম দিলো। আমি উত্তর দিলাম৷ ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছেন?”

“ভালো। আপনি কে বলছেন?”

“আমি অপূর্ব।”

নামটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য হৃৎপিণ্ড থেমে গেল! পরক্ষণেই আবার সামলে নিলাম। এ নামে অনেক মানুষই আছে পৃথিবীতে। জিজ্ঞেস করলাম, “আমাকে কেন ফোন করেছেন?”

“ধন্যবাদ দিতে।”

“কিসের জন্য?”

“আজ এত সুন্দর করে আমার কবিতা আবৃত্তি করলেন, তখনই দিতাম, কিন্তু এখন রাত এত দ্রুত হয়ে যায়, সবাই কেমন হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল, আপনাকে আর পেলামই না!”

“কিন্তু আমি অপূর্ব নামের কারো কবিতা আবৃত্তি করিনি।”

“কার কবিতা পড়লেন তাহলে?”

“সেটা মনে নেই, তবে নামটা অপূর্ব ছিল না।”

“শিওর?”

“হ্যাঁ!”

ওপাশের ছেলেটা হো হো করে হেসে বলল, “ঠিক ধরেছেন। ওখানে নাম ছিল শাহরিয়ার কবির।”

“হ্যাঁ এটাই!”

“ওটা আমার ভালো নাম।”

“ওহ।”

“জানেন, আমার কবিতা এত সুন্দর করে কেউ কখনো আবৃত্তি করেনি। আমি জাস্ট মুগ্ধ হয়ে গেছি।”

“আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?”

“সাহিত্য সংঘের রেজিস্টারে সবার নাম্বারই থাকে ম্যাডাম।”

“ওহ হ্যাঁ।”

“আপনাকে এখন ফোন করার আরেকটা কারন অবশ্য আছে।”

“কী?”

“মা বিরিয়ানি রান্না করছে। ঘ্রাণে টিকতে পারছি না। অথচ রান্না শেষ হয়নি। তাই অন্যদিকে মন ঘোরতে আপনাকে কল করা৷”

“ও আচ্ছা!”

“আপনার বিরিয়ানি পছন্দ না বুঝি?”

“অনেক পছন্দ।”

“আমারও। একেবারে পাগল পাগল লাগে নাম শুনলে।”

আমি হেসে ফেললাম। ছেলেটা বলল, “আপনাকে প্রথম দেখে খুব চেনা লাগছিলো। কোথায় যে দেখেছি মনেই পড়ছিলো না। পরে একদিন মনে পড়ল। গতবছর কোলকাতায় গিয়ে মার্কেটে একটা মেনিকুইন খুব চমৎকার লেগেছিলো। আমি ছবি তুলে রেখেছিলাম। আপনার চেহারা অনেকটা সেরকম।”

“কি আজব!”

“আজবই তো বটে! আরও মজার কথা শুনবেন? সেবার বাবার সাথে বাজারে গেছি….”

ছেলেটা কথা বলতেই থাকলো, কোথা থেকে কোথায় গেল নিজেও বোধহয় জানে না। আমারও এমন আজগুবি, সহজ সরল কথাগুলো শুনতে খুব মজা লাগতে লাগলো। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো কথা বলতে বলতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দশটা বাজে। প্রায় দেড় ঘন্টা কথা বলেছি। আমি বললাম, “রাখছি। কত্তো কথা বলে ফেললাম! আপনার বিরিয়ানি হয়নি?”

“হয়ে গেছে। তবে আপনার সাথে কথা বলতে বিরিয়ানির চেয়ে মজা লাগছে।”

“আপনি তো ভারি অসভ্য!”

“উচিত কথা বললে অসভ্য হই কী করে? আপনার সাথে কিন্তু দেখা হচ্ছে পরের সপ্তাহে…”

“ঠিক আছে।”

“ভালো থাকবেন।”

“আপনিও।”

ফোন রাখার পর মনটা ফুরফুরে লাগতে লাগলো। খুশবুর কাছে চলে গেলাম। ওর সাথে দুষ্টুমি করলাম কিছুক্ষণ। ওকে জ্বালাতন করলে চোখমুখ লাল করে ফেলে। কি যে সুন্দর লাগে! ইভা রান্নাঘরে কাজ করছিলো। ঘরে এসে আমাদের হাসতে দেখে বলল, “আজ এত খুশি কেন তুমি?”

“কোথায় খুশি?”

ও মুখ টিপে হাসলো। আমাকে কথা বলতে দেখে উল্টোপাল্টা কিছু ভাবছে নাকি!

ও বলল, “খেতে চলো। বিরিয়ানি রান্না করেছি।”

“তুমিও বিরিয়ানি রেঁধেছ?”

“অন্য কে রাঁধলো?”

“না কেউ না, চলো।”
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব- ৩০

পরের বৃহস্পতিবার যথারীতি সাহিত্য সংঘে উপস্থিত হলাম। সেই ছেলেটার কথা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। মাঝে দুদিন মনে পড়েছে, তবে আজ একেবারে মাথায় ছিল না। কলেজ শেষে সরাসরি ওখানে চলে গেলাম। কলেজে মিটিং ছিল বলে দেরি হয়ে গেল। এখন শীতকাল হলেও তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ঘেমে গেছি।

আমি ঢোকার একটু পরেই একজন ঘোষণা দিল যে সে আইসক্রিম খাওয়াবে সবাইকে। কিন্তু সবাই রাজি হলো না শীতে আইসক্রিম খেতে। কেউ কেউ রাজি হলো। তাকে বলা হলো অন্যকিছু খাওয়ানোর কথা, কিন্তু সে আইসক্রিমই খাওয়াবে, যে যে খাবে, হাত তোলে যেন। আমার গরম লাগছিলো। খেতে ইচ্ছেও করছিলো। কয়েকজনের সাথে আমিও হাত তুললাম। আইসক্রিমটা খেয়ে প্রাণ জুড়ালো।

মাঝখানে অপূর্বর নাম্বার থেকে মেসেজ এলো, “সভা শেষ হলে যেন দাঁড়াবেন।”

আমি দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পর সেই আইসক্রিম খাওয়ানো ছেলেটা এসে পরিচয় দিলো, “আমি অপূর্ব।”

আমি ভালো করে ছেলেটার দিকে তাকালাম। আগেও দেখেছি, তবে খেয়াল করিনি। শ্যামলা গায়ের রঙ, একমাথা ঝাঁকড়া চুল, চোখগুলো বড় বড়। সাদা ধবধবে দাঁত বের করে হাসছে। হাইট সম্ভবত পাঁচ ফিট আট বা সর্বোচ্চ নয়, মাঝারি স্বাস্থ্য। পরনে কালো জ্যাকেট যার সামনের চেইন পুরোটা খোলা, ভেতরে সাদা টিশার্ট, সাথে জিন্স, পায়ে নীল-সাদা কেডস। তাকে দেখেই আমার প্রথমে যে কথাটা মনে হলো সেটা হলো- “বাচ্চা একটা ছেলে!”

আমাকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করতে দেখে সে বলল, “কোনো সমস্যা?”

“নাহ। কেমন আছেন?”

“ভালো।”

“ধন্যবাদ আপনাকে।”

“কেন?”

“আইসক্রিম খাওয়ানোর জন্য!”

“ওটা স্পেশালি আপনার জন্যই ছিল।”

“হুম সে আপনাকে দেখেই বুঝেছি।”

অপূর্ব হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “চলুন হাঁটি। আপনাকে বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেই।”

এখান থেকে আমাদের বাড়ি হেঁটেই যাওয়া যায়। তবুও একা বলে রিকশা করে যাতায়াত করি। হাঁটার প্রস্তাবে খুশিই হলাম। টুকটাক কথাবার্তা হলো। অপূর্বর কথা শুনে জানতে পারলাম, সে সত্যি সত্যি বয়সে আমার চেয়ে ছোট। মাস্টার্স পাশ করেছে সবে। ভালো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে বের হওয়ায় চাকরি হয়ে গেছে দ্রুত। বৃহস্পতি, শুক্র তার ছুটি থাকে। বাড়িতে মা বাবা আছে, ভাইবোন নেই। শখ হচ্ছে কবিতা লেখা আর ঘুরে বেড়ানো।

নিজের বৃত্তান্ত বলে আমাকে বলল, “আপনার সম্পর্কে বলুন কিছু…”

আমি মৃদু হেসে বললাম, “আমার কিছু বলার নেই। আমার জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি।”

অপূর্ব অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বলল, ” কী বলছেন আপনি? আপনার কথা কতো শুনেছি মৃন্ময় কাকার কাছে! আর আপনি বলছেন কিছু হয়নি? ভেরী ব্যাড! নিজের এচিভমেন্ট অপরকে ফলাও করে জানানো যেমন ভালো না, তেমন লুকিয়ে রাখাও ভালো না।”

আমি এদিকে অবাক। “মৃন্ময় স্যারকে আপনি চেনেন?”

“হ্যাঁ, আমার বাবার বন্ধু। উনি সবসময়ই আপনার গল্প করেন। আগে তো চিনতাম না আপনাকে, সাহিত্য সংঘে যোগ দেয়ার পর বুঝলাম, আপনিই তিনি।”

“কী কী বলেছেন স্যার আমার সম্পর্কে?”

“শুধু প্রশংসা! আর কিছু না।”

“ও আচ্ছা। স্যার আমাকে খুব পছন্দ করেন। অন্যদের সামনে একটু বাড়িয়েই বলেন।”

“মোটেই না। আমি আগে ভাবতাম এটা, কিন্তু আপনাকে দেখার পর থেকে মনে হয়, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে।”

আমি হেসে বললাম, “পৃথিবীর সব মেয়ে দেখা হয়ে গেছে?”

“না, তবে মেয়ে মহলে আমার খুন সুনাম আছে। ভালো খাতির করতে পারি। অনেক মেয়ের সাথে মিশেছি। তবে আপনার মতো কাউকে কখনো দেখিনি।”

আমি পা দিয়ে রাস্তা থেকে একটা ইটের টুকরো লাথি দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার মতো কারো হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে নই, সবচেয়ে অভাগী মেয়ে।”

ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। একটু ভেবে বলল, “কষ্ট সবসময় স্থায়ী হয় না। আপনার কষ্টও দূর হবে। আপনি সুখী হবেন।”

“সুখী হওয়ার দিন শেষ।”

“আহা! এতটুকু মেয়ে বলে দিন শেষ!”

কথার ঢঙে আমার ইচ্ছে হলো কান মলে দেই। চেহারাও অমন। দুষ্টু দুষ্টু। বললাম, “এই ছেলে যাও তো বাড়ি যাও, আমি একা যেতে পারব।”

সে হেসে বলল, “যাব তো! রাস্তাঘাট যা খারাপ! সুন্দরী মেয়েমানুষের একা চলাচল রিস্কি!”

“আমি মোটেও সুন্দরী নই।”

“আমার সাথে এসব বলে লাভ নেই। এটা হচ্ছে মেয়েদের টেকনিক। তারা জানে এভাবে বললো ছেলেরা প্রশংসা করে।”

আমি এবার রাগী চোখে তাকালাম। সে হেসে বলল, “ওইযে আপনার বাড়ি চলে এসেছে।”

“আপনি আমার বাড়ি চেনেন?”

“আবার তুমি থেকে আপনি কেন?”

“তখন ভুলে তুমি বলেছি। আগে বলুন আমার বাড়ি চেনেন কী করে?”

“একদিন এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, আপনাকে বের হতে দেখেছি।”

আমার অপূর্বর কথা বিশ্বাস হলো না। তবে কিছু বললাম না। একবার ভেতরে যেতে বললাম। সে রাজি হলো না। যাওয়ার আগে আস্তে করে বলে গেল, “আপনি কেন নিজেকে অসুন্দর ভাবেন বলুন তো? আপনি অনেক সুন্দর। সৌন্দর্যটা শরীর, মন, ব্যক্তিত্ব সব মিলিয়ে বিচার করা উচিত।”

.
সেদিনের পর থেকে অপূর্ব আমাকে প্রায় প্রতিদিন ফোন করে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন লাগে না। সে এত মজা করে কথা বলে যে শুনতেই ইচ্ছে করে। ইতিমধ্যে আমরা ভালো বন্ধুও হয়ে গেছি। অপূর্বর সাথে কথা বলার সময়টুকু মনে হয় আবার সেই আগের দিনগুলোতে ফিরে গেছি। সেই প্রাণবন্ত মনটা বেঁচে উঠেছে। অপূর্ব আমার বর্তমানের কথা কিছু তোলে না। আমার ধারণা সে সব জানে। আমিও তাই আগ বাড়িয়ে কিছু বলি না।

এমনও হয়, অপূর্ব ফোন না করলে আমিই করি। কথা না বললে ভালো লাগে না। সে কবিতা লেখে, আমি তার কবিতা তাকে পড়ে শোনাই। আমরা একে অপরকে তুমি করে বলতে শুরু করেছি।

যে সময় এই বন্ধুত্বটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে চলে গেছে, ঠিক সে সময়ে একদিন অপূর্ব আমাকে প্রপোজ করে বসল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ বলল, “তোমাকে আমার ভালো লাগে সমাপ্তি।”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তার কণ্ঠ অন্য সময়ের মতো হালকা না, বরং ভারী আর গভীর। আমি হালকাভাবে নেয়ার ভান করে বললাম, “আমাকে সবারই ভালো লাগে। তুমিই তো বলো, আমি ভালো মেয়ে।”

অপূর্ব খানিকটা অধৈর্য হয়ে বলল, “উহু, সেই ভালো লাগা না। অন্যরকম ভালো লাগা। ভালোবাসার মতো ভালো লাগা।”

আমি অপূর্বর ফোন কেটে দিলাম। ভালোবাসা শব্দটা অন্য কারো মুখ থেকে শুনতে আমি রাজি নই।

অপূর্বকে আমি ইগনোর করতে শুরু করলাম। কয়েক সপ্তাহ সাহিত্য সংঘে গেলাম না। ওর সাথে কথা বলে অভ্যাস হয়ে গেছিলো। নিজেরই খারাপ লাগা শুরু হলো। তবে পাত্তা দিলাম না।

একদিন ইভা আমার ঘরে এসে বলল, “একটা কোঁকড়াচুলো ছেলে প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোমার ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। খেয়াল করো না?”

আমি সত্যি খেয়াল করিনি। জানালার কাছে গিয়ে দেখি আসলেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটি আর কেউ নয়, স্বয়ং অপূর্ব।

এবার খুব রাগ হলো। সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলাম। অপূর্বর সামনে গিয়ে কোনো ভূমিকা ছাড়াই সজোরে একটা চড় মারলাম গালে। ছেলেটা হতভম্ব হয়ে গেল। চোখে চাপা বিষ্ময় আর বেদনা মিলেমিশে আছে। বললাম, “আর কোনোদিন আমার সামনে আসবে না। খুব খারাপ হয়ে যাবে তাহলে।”

বলে আর দেরি করলাম না। সোজা ভেতরে চলে এলাম। তবে আমার নিজেরই তারপর থেকে খারাপ লাগা শুরু হলো। ছেলেটাকে বুঝিয়ে বললেই হতো। এভাবে অপমান না করলেও চলতো। তাকে ফোন করব করব করেও করলাম না শেষ পর্যন্ত। প্রশ্রয় পেলে আবার যদি সেসব বলে?

.
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। প্রথম বছর এই দিনটা আমি কেঁদেই ভাসিয়েছিলাম৷ সারাদিন শেষে ফোলা চোখ নিয়ে ঘুমিয়ে গেছিলাম। পরদিন আবার কেঁদেছি তার আত্মার মাগফিরাতের জন্য কিচ্ছু করিনি বলে।

পরের বছর অবশ্য সেটা শুধরে নিয়েছি। সেবার অনেকগুলো পথশিশুকে খাইয়েছি পেট ভরে। আর বলেছি দোয়া করতে। তারা খেয়েদেয়ে হাত তুলে দোয়া করেছে আমার স্বামীর জন্য। এ দৃশ্য যে কি শান্তির! না, তারা কোনো দোয়া, কালাম কিছুই জানে না। তবুও আমি বুঝি, তাদের দোয়াটুকু ঠিক জায়গামতো পৌঁছে গেছে সাথে সাথেই।

এই বছরও ব্যতিক্রম হলো না। দিনটা কাটলো ব্যস্ততায়। দুপুরের পরপর ইচ্ছে হলো একাকী সময় কাটাতে। আমি বাসে চড়ে রওনা দিলাম। যেদিকে বাস যায়, যাব। কীভাবে কীভাবে যেন চলে গেলাম আশুলিয়ার দিকে। তুরাগ নদীর পাড়ে বিরুলিয়া ব্রীজের ওপর দাঁড়িয়ে মনে হলো এটা সেই স্বপ্নে দেখা ব্রীজটা!

সন্ধ্যে নামলো চোখের সামনে। ক্লান্ত সূর্যটা ডুবে গেল। গোধুলীর রঙে রাঙা হলো আকাশ। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগছে চোখেমুখে। হঠাৎ মনে হলো সে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। মৃদু শব্দে বলছে, “এখনো ভালো নেই তুমি। খুঁজে নাও নিজের সুখ। যতটুকু আনন্দ তোমার কাছে নিজে থেকে ধরা দেবে, ততটুকু লুটে নাও!”

ব্যাস, তারপর গায়েব।

অনেক সময় নিয়ে ভাবলাম কথাটা। একসময় মনে হলো, এটা সে বলেনি, আমার অবচেতন মন আমায় বলেছে। অপূর্বকে দেখে আমার নতুন করে সুখ খোঁজার যে ইচ্ছেটা তৈরি হয়েছে, সেটা আমার মস্তিষ্ক কাল্পনিক তার মুখ থেকে শুনিয়ে বৈধতা পেতে চাইছে!
(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে