Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 423



ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৮

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৮
প্রায় এক ঘন্টা হতে চলল। মা, মেয়ে আর ছেলে দ্বার রুদ্ধ করেছে। সোহান খন্দকার একবার উপরে ওঠছেন। আরেকবার নিচে নামছেন৷ বসার ঘরে সোফার এক কোণে মাথা নিচু করে বসে নামী। তার পাশেই নিধি বসে৷ ক্ষণে ক্ষণে নামী যে ঘেমে ওঠছে টের পেল নিধি৷ তাই দূরে চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সৌধকে বলল,

‘ সৌধ ফ্যানের পাওয়ার বাড়িয়ে দে। ‘

গম্ভীর মুখে এক পলক তাকাল সৌধ। দেখতে পেল নামী প্রচণ্ড হাসফাস করছে। ত্বরিত সে ফ্যানের পাওয়ার বাড়াল৷ ঠিক সে সময়ই সোহান এসে উপস্থিত হলো নামীর সামনে। নামীর বুক ধক করে ওঠল৷ নিধি খেয়াল করল মেয়েটার শরীর কাঁপছে। ঢোক গিলছে ঘনঘন। সে ত্বরান্বিত হয়ে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে। কিয়ৎক্ষণ পরই আবার চলে এলো। নিয়ে এলো, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি। যা নামীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘ পানিটা খেয়ে নাও নামী। ‘

অসহায় চোখে তাকাল নামী। নিধি ইশারায় গ্লাস নিতে বললে রুদ্ধশ্বাস ছাড়ল৷ সোহান খন্দকার ততক্ষণে নামীর পাশেই বসেছে। একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে তার চোখেমুখেও। নামী পানি খেয়ে বুকের ভেতর চলা তীব্র ভয়, উত্তেজনাকে দমানোর চেষ্টা করল৷ নিধি সোহানকে বলল,

‘ আংকেল আপনার জন্য পানি আনব? ‘

পেছন থেকে কপট রাগ দেখিয়ে সৌধ বলল,

‘ প্রশ্ন না করে নিয়ে আয়। ‘

নিধি চটজলদি গিয়ে গ্লাসে পানি ভরে ফিরে এলো। কিন্তু সোহান খন্দকার পানি খেলেন না৷ বুক ভর্তি তৃষ্ণাকে গুরুত্ব দিলেন না তিনি। পাশে বসা বাচ্চা মেয়েটির মনের অবস্থা টের পেয়ে দুঃখে জর্জরিত হয়ে গেলেন। তবুও যা করেছেন তা নিয়ে আফসোস করলেন না৷ বরং তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন,

‘ ঘাতপ্রতিঘাত জীবনেরই অংশ মা। সুসময়ের পর যেমন দুঃসময় আসে৷ তেমন দুঃসময়ের পরও সুসময় আসে। ‘

আচমকা অশ্রুতে দু’চোখ ভরে ওঠল নামীর। সোহান খন্দকার এতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। বললেন,

‘ একি মা ও চোখে পানি কেন? তুমি কী ভয় পাচ্ছ? ভয় কেন? বাবা আছে তো পাশে কোনো ভয় নেই। ‘

নিচের দিক মাথা করে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল নামী। সোহান খন্দকার তার মাথায় আস্থাশীল হাত রেখে বললেন,

‘ যে ঝড় এসেছে, সে ঝড় থেমে যাবে নামী। যদি থামতে খুব বেশি সময় নেয়, তুমি ভেঙে পড়ো না। মনে রেখো, তোমার উদ্দেশ্য আমার ছেলের বউ হয়ে সংসার করা নয়৷ তোমার উদ্দেশ্য তোমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করা। তোমার বাবা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তার পর এ পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান আমার কাছে। পরপারে নিলুর আত্মাও নিশ্চিন্ত আছে। কারণ তোমার পাশে আজ তার অতি প্রিয় মানুষটা আছে। যে তোমাকে বটগাছের ছায়ার মতো দুনিয়ার সমস্ত ঝড় থেকে রক্ষা করবে। ‘

ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল নামী৷ সোহান খন্দকার আচমকা ওর একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘ আমাকে কথা দাও মা যত যাই হয়ে যাক। এই বাবাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। ‘

সহসা এমন কথায় হতভম্ব হয়ে গেল নামী। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল সে। সোহান খন্দকার পুনরায় তাগাদা দিয়ে বললেন,

‘ কথা দাও মা। ‘

নামী এক মুহুর্ত ভাবল, বাবা চলে গেলে এ শহরে তার আপন বলতে কেউ থাকবে না। সে এ শহরেই থাকতে চায়৷ পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়৷ পূরণ করতে চায় মা এবং তার স্বপ্ন। সুহাসের সাথে তার বিয়ে হয়েছে। যত যাই হয়ে যাক এখন আর ফিরে তাকানো সম্ভব না। এখন শুধু তাকে সম্মুখে অগ্রসর হতে হবে। পেছনে তাকালেই সব শেষ!

‘ নামী মা? ‘

চমকে ওঠল নামী। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকাল সোহানের দিকে। এরপর মাথা নাড়িয়ে বলল,

‘ কথা দিলাম আংকেল। আপনাকে ছেড়ে যাব না। আমার জীবনে আপনিই এখন বড়ো শুভাকাঙ্ক্ষী। এই সত্যিটাও
ভুলব না। ‘
.
.
মানুষ হিসেবে ডক্টর উদয়িনী প্রচণ্ড স্বার্থপর। নিজের চৌকশ বুদ্ধি দ্বারা আজ সে সফল নারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এই মহিলা নিজের স্বার্থ হাসিলে নিজেকেও আঘাত করতে দ্বিধান্বিত হয় না। সন্তানদের চোখে বরাবরই সে একজন আদর্শ নারী। এ সুযোগটাই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি খাঁটিয়ে কাজে লাগাল। অতীত জীবনের সত্যিটা সুহাসের সামনে আসার আগেই মিথ্যা দিয়ে ঢেকে ফেলল তা। জীবনের শুরুতে যার কাছে হার মানেনি শেষে তার কাছে হার মানার প্রশ্নই ওঠে না৷ তাই নিলু আর সোহানের মাঝখানে সে কীভাবে ঢুকেছিল। সেই ঘটনা চেপে গিয়ে তার বিয়ের পর নিলু কীভাবে তার সংসারে ঢুকতে চেয়েছিল। সেই মিথ্যা রচনা বিবৃতি করে শুনাল ছেলেমেয়েকে। সেসব শুনে ছেলেমেয়েরা ঘৃণায় চোখমুখ শক্ত করে বসে রইল। উদয়িনী চোখের পানি ছেড়ে সুহাসকে মনে করিয়ে দিল, তার মা কখনো স্বামীর ভালোবাসা পায়নি। অনেক বড়ো একটি শূন্যতা নিয়ে সংসার করছে সে। এ সংসারে নিলু ঢুকতে পারেনি বলে শেষ পর্যন্ত নিলুর মেয়ে ঢুকে পড়ল! কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না উদয়িনী। মায়ের কষ্টে সুহাস তীব্র অপরাধবোধে ভুগতে থাকল। উদয়িনী ছেলের অপরাধবোধ দ্বিগুণ করতে বলল,

‘ তুই আমার একমাত্র ছেলে সুহাস। কত স্বপ্ন আমার তোকে নিয়ে। পড়াশোনা শেষ করবি। নিজের পায়ে দাঁড়াবি। আমি নিজের পছন্দ অনুযায়ী এ বাড়িতে পুত্রবধূ আনব। আমার সে সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল সুহাস। না স্বামীকে মনের মতো করে পেলাম। আর না সন্তানকে। ‘

উদয়িনী কান্নার বেগ বাড়ল। মায়ের কথা শুনে সিমরান তীব্র মন খারাপ করে ভাইকে বলল,

‘ তোমার বিয়ে নিয়ে আমারো কত প্ল্যান ছিল ভাইয়া। সেসব প্ল্যান তো দূরে থাক। কী মেয়েকে বিয়ে করলে তুমি? ও কি আমাদের সাথে যায় বলো। আমাদের কথা বাদ। তোমার সাথে যায়? আমার এত সুন্দর ভাইয়ের বউ কিনা অমন কালো! ‘

নাক ছিটকাল সিমরান৷ সুহাসের মাথাটাও বিগড়ে গেল। শতহোক অল্পবয়সী ছেলে। ভার বুদ্ধি তখনো হয়নি তার৷ সে নিজেও এখন বিশ্বাস করতে পারল না। ঐ মেয়েটাকে সে বিয়ে করেছে। ঐ মেয়েটা তার বউ! দু’হাতে মাথা চেপে ধরল সুহাস। তীব্র ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে বলল,

‘ মানি না এই বিয়ে আমি। মানি না। যার কারণে আমার মায়ের কষ্ট হবে তাকে আমি মানি না। আই ওয়ান্ট টু ডিভোর্স নাও। ‘

এক নিমিষে কান্না থেমে গেল উদয়িনীর। ছেলেকে কাছে টেনে সারা মুখে চুমু খেল সে। বলল,

‘ আমি জানতাম আমার সুহাস তার বাবার মতো হয়নি। ‘

মায়ের খুশি৷ বোনের সমর্থন দেখে সুহাস হনহনিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। দরজা খুলল শব্দ করে।
তৎক্ষণাৎ বুলেটের গতিতে তার মস্তিষ্কে আঘাত হানল বাবার বলা সেই কথাটি৷ সে যদি নামীকে বিয়ে না করে তাহলে বাবা মাকে ডিভোর্স দেবে! সহসা পা দু’টো থমকে দাঁড়াল তার। বিছানায় আঁধশোয়া হয়ে বসে থাকা মায়ের দিকে তাকাল বিস্ময় ভরে। হাত, পা কাঁপতে থাকল অবিরত। সিমরান পাশে এসে বলল,

‘ কী হলো ভাইয়া? ‘

সুহাস থমথমে কণ্ঠে বলল,

‘ বাবা বলেছিল, আমি নামীকে বিয়ে না করলে মাকে ডিভোর্স দেবে। এখন আমি যদি নামীকে ডিভোর্স দিই বাবা মায়ের সম্পর্কে বিচ্ছেদ আসবে না তো? ‘

‘ অবশ্যই আসবে। ‘

প্রায় হুংকার দিয়ে কথাটা বললেন সোহান খন্দকার। বড়ো বড়ো পা ফেলে ছেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সুহাস, সিমরান দু’জনই হতবাক কণ্ঠে ডাকল,

‘ বাবাহ! ‘

সোহান খন্দকার ছেলেমেয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ঘৃণা ভরে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,

‘ উদয়িনী আজ যদি সুহাস নামীকে ডিভোর্স দেয়। তাহলে তোমাকেও তো আমার ডিভোর্স দেয়া উচিত। তাই না? ‘

ভয়ে শিউরে ওঠল উদয়িনী। মায়ের সে ভয় দেখে তীব্র ক্রোধে ফেটে পড়ল সুহাস। তড়াক করে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,

‘ খবরদার, আমার মায়ের সঙ্গে এমন আচরণ করবে না। ‘

ছেলের স্পর্ধা দেখে সোহান খন্দকার মনে মনে আহত হলেন। কিন্তু সে অনুভূতি কাউকে বুঝতে না দিয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,

‘ বাহ উদয়িনী বাহ। কী শিক্ষা দিয়েছ ছেলেকে। যে ছেলের হাত বাবাকে মারার জন্য কষকষ করে! ‘

কাঁপতে থাকা হাত দুটো সামলে নিল সুহাস৷ কিন্তু ক্রোধে ভেসে ওঠা কপালের নীল রগ আড়াল করতে পারল না। স্বামীর ওপর এতক্ষণ ক্রোধ হলেও এবারে ভয় জমল বুকে। সত্যি সত্যিই সোহান তাকে ডিভোর্স দেবে! না না এভাবে সে হারতে পারে না। উদয়িনী ফুঁপিয়ে উঠলো। বলল,

‘ এ বয়সে এসেও নিজের সংসার বাঁচাতে যুদ্ধ করতে হবে আমাকে? ‘

ত্বরিত মাকে গিয়ে ধরল সুহাস। ক্রোধান্বিত স্বরে বলল,

‘ না মা আর তুমি যুদ্ধ করবে না। দরকার নেই আর এ সংসার আঁকড়ে থাকার৷ বাবা যদি চায় তোমাকে ডিভোর্স দিতে তুমি দেবে। আমি, সিমরান তোমার পাশে আছি। ‘

সিমরান চমকে ওঠল। বিস্ময় কণ্ঠে বলল,

‘ কী বলছ ভাইয়া! পাগল হয়ে গেছ তুমি। ঐ মেয়ের জন্য কেন আমরা আলাদা হবো। এতই সহজ। বাইরের একটা মেয়ের জন্য আমাদের সংসার ভাঙা, এতই সহজ? ‘

সোহান খন্দকার ধমকে ওঠল সিমরানকে,

‘ সিমরান নিজের রুমে যাও। অসুস্থ তুমি। বড়োদের মাঝখানে থাকতে হবে না। বিশ্রাম নাও। ‘

‘ আমার অসুস্থতার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না আব্বু৷ তুমি যদি আমাদের কথা এতই ভাবতে আজ এই পরিস্থিতি দাঁড়াত না। ‘

ছেলেমেয়েদের স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন সোহান। এ কোন শিক্ষায় মানুষ হয়েছে সুহাস, সিমরান৷ এ তো তার শিক্ষা নয়। এদিকে, সুহাস মাকে বোঝাতে লাগল, ডিভোর্স হলে হোক আর যেন সে ভয় না পায়। তার মতো স্বাবলম্বী নারীকে একটা সংসারের জন্য এভাবে ভয় মানায় না। ছেলের কথা বুঝলেও উদয়িনীর পক্ষে এ সংসার ছাড়া সম্ভব না৷ কারণ এ সংসার যতটা না তার ভালোবাসার তার চেয়েও বেশি জেদ আর প্রতিশোধের। এ কথা তো আর ছেলেকে বলা যায় না। তাই সে শান্ত হয়ে স্বামীকে বলল,

‘ সুহাস কোনোদিন ঐ মেয়েকে মন থেকে মানতে পারবে না। ‘

‘ আমি আজো তোমাকে মন থেকে মেনে নেইনি উদয়িনী।’

অকপটে জবাবে অপমানে মুখ থমথম করতে লাগল উদয়িনীর। সুহাস মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকাল বাবার দিকে। উদয়িনী বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল,

‘ নিলুর মেয়েকে আত্মসম্মানহীন মনে হচ্ছে না। ‘

তাচ্ছিল্য হেসে সোহান বলল,

‘ তাহলে মানছ, তোমার আত্মসম্মান নেই? ‘

চোয়াল শক্ত করে হুংকার দিল সুহাস,

‘ বাবা! ‘

সোহান খন্দকার তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করল,

‘ এক থাপ্পড়ে বেয়াদবি শুধরে দেব। স্টুপিড। ‘

হকচকিয়ে গেল উদয়িনী। বাবা, ছেলের সম্পর্কের বিপর্যয়তা দেখে ছেলেকে চোখের ইশারায় থামতে বলল৷ এরপর স্বামীকে বলল,

‘ সুহাস কোনোদিন ওকে বউ হিসেবে মেনে নেবে না। তোমার কি মনে হয় ঐ মেয়ে এসব সহ্য করে এখানে পড়ে থাকবে? ‘

‘ ওকে এসব সহ্য করার জন্য আনিনি আমি। ‘,

‘ তাহলে কেন এনেছ? ‘

‘নিলুর স্বপ্ন পূরণ করতে। অনেক বড়ো ডাক্তার তৈরি করতে। ‘

‘ তাহলে এই বিয়ে কেন? প্রতিশোধ নিলে?’

‘ ওটা তোমার স্বভাব, আমার না। ‘

এক মুহুর্ত শক্ত হয়ে বসে রইল উদয়িনী। পরোক্ষণেই বলল,

‘ সুহাসকে ওর বউ হিসেবে কোনোদিন মানব না আমি। ‘

সুহাস বলল,

‘ আমি এই বিয়েটাই মানছি না। ওকে মানা তো দূরে থাক। আমার কাছে আমার মায়ের আগে কেউ না৷’

ছেলের দিকে তাকালেন না সোহান। স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললেন,

‘ কাউকে মানতে হবে না। কিন্তু নামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে সুহাস ওকে ডিভোর্সও দিতে পারবে না। আর হ্যাঁ এ বাড়িতে নামী আমার মেয়ে হয়েই থাকবে। এটাই আমার শেষ কথা। ‘
.
.
উপরে হয়ে যাওয়া সমস্ত কথাই শুনতে পেল নামী। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। সে রাতে আর সুহাসের মুখোমুখি হয়নি সে৷ সারারাত ঘরের এক কোণে নিথর শরীরে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে শুধু। মেনে নিয়েছে আকস্মিক ঝড় আর কঠিন বাস্তবতাকে। ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝড়ে যাওয়া কলি হিসেবে জীবন শুরু হলো তার। আসার সময় কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, কাপড়চোপড় আর ব্যক্তিগত ডায়ারি এনেছিল। শেষ রাতে ডায়ারি বের করে মধ্য পাতায় লিখল,

‘ ফুল হয়ে ফোটার আগেই ঝরে যাওয়া কলি আমি। ‘

এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধির পাশে শুয়ে পড়ল। এ বাড়িতে আজ তার প্রথম রাত। নিয়ম অনুযায়ী আজ তার আর সুহাসের বাসর রাত। যে রাত নিয়ে সুহাস অনেক বেশি উত্তেজিত ছিল। তার পাশে এখন নিধি নয় সুহাস থাকার কথা ছিল। জগত এত নিষ্ঠুর কেন? যার যেখানে থাকার কথা সে কেন সেখানে থাকে না? সহসা সামাজিক রীতিতে হওয়া বিয়ের রাতের কথা স্মরণ হলো নামীর। বেপরোয়া সুহাসের বেসামাল অনুভূতির সংস্পর্শে যাওয়ার মুহুর্তটুকু মনে পড়তেই ডুকরে ওঠল৷ দু’হাতে মুখ চেপে ধরল মুহুর্তেই। নিধি আপু জেগে ওঠার ভয়ে। নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ল। নিভৃতে ঝড়াল অশ্রুজল।
_________________
পাঁচ মাস পর,

এমবিবিএস প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট’সদের আজ প্রথম ক্লাস। ছাত্র-ছাত্রীরা রঙ বেরঙের পোশাক সাদা অ্যাপ্রোনে আড়াল করে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হচ্ছে। দশটা পনেরোর দিকে চুইংগাম চিবুতে চিবুতে বাইক নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলো সুহাস। নির্দিষ্ট স্থানে বাইক রেখে আসার পথে দেখল সিনিয়র কয়েকজন ভাই জুনিয়রদের রেগ দিচ্ছে। বাঁকা হেসে তর্জনীতে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে সে গিয়ে মাঠের একপাশে বসার স্থানে বসল। কল করল সৌধকে। কখন আসবে শুনে নিয়ে একা একাই সময় কাটাতে লাগল। এমন সময় তার সহপাঠীরা এসে ঘিরে ধরল তাকে। বলল,

‘ দোস্ত প্রথম বর্ষের মেয়েরা আজ আসছে। চল কয়েকটাকে ধরে রেগ দেই। ‘

সুহাস আগ্রহ দেখাল না। তখন হুট করেই সেখানে আজিজ এলো। সুহাসের কানে কানে কী যেন একটা বলল। এরপরই তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সুহাস৷ বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল,

‘রেগ দিবি বললি না? ‘

সকলে হইহই করে ওঠল। সুহাস দুর্বোধ্য হেসে মাথা দুলিয়ে বলল,

‘ তবে দেরি কেন চল। ‘

এরপর আজিজকে ইশারায় কিছু বলতেই আজিজ বলল,

‘ ডান। ‘

কলেজ প্রাঙ্গনে প্রথম দিন নামীর৷ বন্ধু-বান্ধব এখনো হয়নি৷ ফেসবুকে কলেজের যে গ্রুপটা আছে সেখানে ফারাহ নামের এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সে বলেছে সাড়ে দশটায় গেটে থাকতে। তার জন্যই অপেক্ষা করছে নামী৷ এমন সময় তিনজন ছেলে এসে তার সামনে দাঁড়াল। বলল,

‘ প্রথম বর্ষ? ‘

নামী উত্তর দিল,

‘ জি। ‘

‘ আমরা সেকেন্ড ইয়ার তোমার সিনিয়র। ‘

নামী থতমত খেয়ে গেল। বুক ধুকপুক করে ওঠল তার। ঢোক চিপে মৃদু হাসার চেষ্টা করল সে। কিন্তু বড়ো ভাইদের কথা শুনে ধুকপুকানি বেড়ে বুক শুকিয়ে মরুভূমিতে রূপান্তরিত হলো।

‘ আমরা আজ জুনিয়রদের রেগ দিচ্ছি। তোমাকেও দিব। ‘

সিনিয়ররা বলল। সে মুহুর্তেই উপস্থিত হলো আজিজ। বলল,

‘ ভয় নেই। বিষয়টা আর সবার মতো ইজিলি নাও। আর সম্মানের সাথে বড়ো ভাইদের কথা মতো কাজ করো। ‘

আজিজকে দেখে কিঞ্চিৎ স্বস্তি পেল নামী। কারণ আজিজ তার চেনা৷ সৌধ ভাই, নিধি আপুর সঙ্গে আজিজও সেদিন তাদের বাড়ি গিয়েছিল। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। এদিকে সবাই বলল,

‘ আমাদের কলেজের মোস্ট হ্যান্ডসাম একজন ছেলেকে তোমায় প্রপোজ করতে হবে। ‘

তাদের ব্যাচের মোস্ট হ্যান্ডসাম ছেলে বলতে সৌধর নামটাই আগে আসে। যেহেতু সৌধ ক্যাম্পাসে উপস্থিত নেই সেহেতু সবার মাথায় এখন সুহাসের নাম এলো। আজিজ তির্যক হাসল। বুদ্ধিটা আসলে তারই। কারণ সে বন্ধু সুহাসের একনিষ্ঠ ভক্ত। সুহাস নামীর সম্পর্ক এখন ঠিক সাপে নেওলের মতো। জানে সে। তাই একটি থ্রিল দৃশ্য তৈরি করার পরিকল্পনা মাত্র। নামী প্রথমে এটাকে সাধারণ রেগ হিসেবেই নিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখল সুহাসকে প্রপোজ করতে হবে৷ তখন রাগে মাথা দপদপিয়ে ওঠল। বুঝে ফেলল, তাকে হেনস্তা করার জন্য এটা সুহাসেরই প্ল্যান। যেখানে সুহাসকে এখন সে সহ্যই করতে পারে না৷ সেখানে কিনা প্রপোজ করতে হবে!

জিন্স প্যান্টের সাথে কালো কামিজ পরনে নামীর৷ তার ওপর সাদা অ্যাপ্রোন। মাথার চুলগুলো পেছনে বেশ উঁচুতে ঝুটি করে রাখা। কপাল ছেয়ে আছে ছোটো ছোটো চুল দ্বারা। চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কাঁধে মাঝারি আকৃতির কালো ব্যাগ। আর হাতে সাদা রঙের আইফোন। শ্যামলাটে মুখটায় বিরক্তি ফুটিয়ে ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে৷ যা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে দেখতে থাকল সুহাস। সে একটু দূরেই দু-হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে সটান৷ নামী এসে সামনে দাঁড়াতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। অন্য সময় হলে তার দাম্ভিকতাকে বুড়ো আঙুল দেখাত নামী৷ কিন্তু এ মুহুর্তে তা সম্ভব হলো না। ওদিকে বড়ো ভাইরা চ্যাঁচাচ্ছে। উপায় না পেয়ে নামী হাঁটু গেড়ে বসল। আজিজের দেয়া কলমটা এগিয়ে ধরল সুহাসের দিকে। এরপর চোখমুখ খিঁচে বলে দিল,

‘ মিস্টার সুহাস খন্দকার, আই লাভ ইউ। ‘

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল সুহাস। দাপটের সঙ্গে পরিহিত কালো শার্টের বোতাম গুলো খুলতে শুরু করল। একে একে সবকটা বোতাম খোলার পর ভেতরের সাদা টিশার্ট বেরিয়ে এলো। শার্টের দু’দিকে ধরে দুহাতে টান দিল সুহাস। টিশার্টে ঢাকা লম্বা দেহের বুকের পাটা দৃশ্যমান করে মাথা নিচু করল। নামীর মুখোমুখি হয়ে দৃষ্টিজোড়া কঠিন করে আচমকা তীব্র চিৎকারে বলল,

‘ আই হেইট ইউ! আই জাস্ট হেইট ইউ নামী রহমান!’

তীব্র ক্ষোভ মিশ্রিত সে চিৎকারে সুহাসের বন্ধুরা স্তব্ধ হয়ে গেল! স্তব্ধ হয়ে গেল আশপাশে থাকা জুনিয়র এবং সিনিয়র ভাই, বোনরাও!

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৭

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৭

ভোরবেলা উদয়িনীর কল পেলেন সোহান খন্দকার। সিমরানের জ্বর হয়েছে। আরো একদিন কক্সবাজারে কাটানোর কথা থাকলেও মেয়ের ভয়াবহ জ্বর হওয়াতে ফিরে আসছে উদয়িনী৷ ভোর ছ’টায় রওনা দিয়েছে তারা। এখন বাজে ছ’টা পয়তাল্লিশ। স্ত্রীর ফোনকল পেয়ে সোহান খন্দকার ঘামতে শুরু করলেন। মেয়ের জ্বর নিয়ে সে দুশ্চিন্তা করছেন না। স্ত্রী এমবিবিএস ডক্টর। ছেলে মেডিকেল স্টুডেন্ট। সে দু’টো ক্লিনিকের মালিক। তাই সামান্য জ্বর নিয়ে চিন্তা করার মানুষ সে নয়। তার চিন্তা হচ্ছে নামীকে নিয়ে। সুহাস আর নামীর আইনগত ভাবে বিয়ে হয়নি৷ অবিলম্বে ছেলেমেয়ে দু’টো রেজিস্ট্রি করাতে হবে৷ উদয়িনী সাংঘাতিক দাম্ভিক একজন মহিলা। আইনিভাবে ছেলেমেয়ে দুটোর হাত এক না করলে উদয়িনী এই সম্পর্ক কখনোই মেনে নিবে না। যখন জানতে পারবে, নামী নিলুর মেয়ে। তখনকার পরিস্থিতি কী ঘটবে ভাবতেই শিউরে ওঠলেন। বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠল সোহানের। এক নিমিষেই যেন দিশেহারা হয়ে ওঠলেন মানুষটা। ভেবেছিলেন সুহাস, নামীকে নিয়ে আজ ধীরেসুস্থে এ বাড়ি থেকে বিদায় নেবেন। এরপর কোর্টে গিয়ে ছেলেমেয়ে দু’টোর রেজিস্ট্রি করিয়ে তারপর বাড়ি ফিরবেন। কিন্তু উদয়িনীর ফোন তার সমস্ত পরিকল্পনা উলোটপালোট করে দিল। ত্বরিত নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে সুহাসকে ডাকতে লাগলেন তিনি৷

‘ সুহাস, এই সুহাস। ‘

বাবার অস্থির চিত্তের ডাকগুলো শুনে বেঘোরে ঘুমানো সুহাস ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল। চোখদুটো ডলে বলল,

‘ কী হয়েছে বাবা! ‘

‘ সিমরানের জ্বর হয়েছে। তোর মা কক্সবাজার থেকে ছ’টায় রওনা দিয়েছে। দ্রুত ব্যাগ গুছা আমরা এক্ষুনি ফিরে যাব। ‘

স্তম্ভিত মুখে ওঠে ঠাঁই বসে রইল সুহাস। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠল তার। গা কাঁপুনি দিয়েও ওঠল। মেরুদণ্ড বেয়ে নিঃসৃত হলো স্বেদজল। শুষ্ক ওষ্ঠজোড়া জিভ দ্বারা ভিজিয়ে নিল ত্বরিত। থমথমে কণ্ঠে বলল,

‘ নামীর কী হবে বাবা? ‘

ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘর ছাড়তে উদ্যত হয়েও থেমে গেল সোহান খন্দকার। নামীর জন্য ছেলের মুখে দুশ্চিতার ছাপ দেখে প্রচণ্ড খুশি হলেন তিনি। কিন্তু সেই খুশিটাকে আড়ালে রেখে বললেন,

‘ কী হবে আবার? ছেলের বউকে সঙ্গে করেই তো ফিরব। তুই তৈরি হয়ে নে। আমি আখতারুজ্জামান আর নামীকে বলে আসি দ্রুত তৈরি হতে। দশটার মধ্যে কোর্টে পৌঁছাতে হবে আমাদের। এগারোটার মধ্যে তোদের রেজিস্ট্রি করাব। আর শোন, সৌধকে কল করে দ্রুত চলে আসতে বল। ‘
.
.
সৌধ বেশ নিয়মনিষ্ঠ ছেলে। ছোটোবেলা থেকেই দারুণ মেধাবী। পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি বিষয়ে কঠিন নিয়ম মেনে চলাই তার বৈশিষ্ট৷ সর্বদিকে বিশেষ নজর রাখা ছেলেটি নিজ স্বাস্থ্যের প্রতিও বেশ যত্নশীল। আঠারো বছর বয়স থেকেই নিয়মিত ব্যায়াম করে সে। ইউটিউব ঘেঁটে, বড়ো ভাইদের সহায়তা নিয়ে আলাদা করে ব্যায়ামের সমস্ত সরঞ্জাম কিনেছে সে৷ বেলা করে ঘুমানোর অভ্যাসটা ছেড়েছে তখন থেকেই৷ তিন বছরের পরিশ্রম বৃথা যায়নি৷ বাইশ বছরের আকর্ষণীয় শরীরটাই সে প্রমাণ। তার অন্যান্য বন্ধুদের শরীরে কচি ভাবটা দূর হয়নি এখনো। অথচ একই বয়সী হয়েও তার সুঠাম বলিষ্ঠ দেহখানায় প্রাপ্তবয়স্কের সিলমোহর।

প্রাত্যহিক দিনের ন্যায় আজো ভোরের চমৎকার আলো গায়ে মাখাচ্ছে সৌধ। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে প্রশান্তি ভরে। এমন সময় টের পেল পেছনে কেউ একজন আছে।গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। কিয়ৎকাল পেরোতেই অধর কোণে হাসি ফুটল। দু-হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়াল সোজা হয়ে। চোখ বুজে নিল প্রলম্বিত শ্বাস। বলল,

‘ এত দ্রুত ঘুম ভাঙল যে? ‘

প্রশ্নের উত্তরে কোনো সাড়া পেল না। অথচ পেছনের মানুষটি এসে ঠিক পাশে দাঁড়িয়েছে। মৃদু হাসল সৌধ। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে পুনরায় বলল,

‘ এখনো রাগ কমেনি? ‘

এবারেও কোনো সাড়া পেল না। সৌধ আবারো হাসল। বলল,

‘ চল হেঁটে আসি, ভোরের নির্মল বাতাসে হাঁটলে শরীর মন উভয়ই সতেজ হয়ে যায়। ‘

কথাটা বলেই চোখ খুলে পাশে তাকাল সে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠল। ফোলা ফোলা চোখদুটোর বাদামি রঙের মণি দুটো হৃৎস্পন্দন থামিয়ে দিল এক নিমিষে। নিজের বেগতিক অবস্থা টের পেয়ে ত্বরিত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সৌধ। মনে মনে বলল,

‘ সর্বনাশী একটা! ‘

আর কয়েক সেকেণ্ড ও মুখে তাকিয়ে থাকলে সত্যিই সর্বনাশ ঘটে যেত। সর্বনাশটা ঘটাত সে নিজেই। হৃদয়াকৃতির ও মুখশ্রী এ মুহুর্তে এতটা আদুরে লাগছে। সৌধর ইচ্ছে করছে দু’হাতে গাল চেপে ধরে সাড়া মুখে চুমু খেতে। এত্ত আদর করতে মন চায় কেন নিধিকে? বুকের ভেতর এত এত আদর জমা হয়ে একদিন তো আদুরে পাহাড় তৈরি হয়ে যাবে। তখন এই পাহাড়সম আদর সহ্য করতে পারবে তো মেয়েটা?

সৌধ ভাবনায় বিভোর। বন্ধুত্বের মধ্যে রাগারাগি বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয় না নিধি। গতকালকের রাগ গতকালই ফেলে দিয়েছে সে। তাই ওসব মনে না রেখে বর্তমান নিয়েই কথা বলল সে,

‘ না দেখেই বুঝে ফেললি আমি এসেছি? কী করে বুঝলি বলত! ‘

নিধির কণ্ঠে বিস্ময়। ওর বিস্ময়সূচক প্রশ্ন শুনে আচমকা মুখ ফস্কে সৌধ বলে ফেলল,

‘ তুই হলি আগুনপোকা বুঝলি? কখনো মাথার ভেতর কিলবিল করিস, কখনো বুকের ভেতর। তুই আশপাশে থাকলেই আমি পুড়তে থাকি, জ্বলে যাই। আর আমি যখনি জ্বলতে শুরু করি তখনি বুঝে যাই আশপাশে আগুনপোকা আছে, মানে তুই আছিস। ‘

অবাস্তব কথাগুলো শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলল নিধি৷ কী সব বলল সৌধ বোধগম্য হলো না। তবে সে আশপাশে থাকলে সৌধ জ্বলে যায়! এ কথা অহমিকায় লাগল খুব। অগ্নি দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

‘ কাল থেকে তোর ভাবসাব, কথাবার্তা দেখছি সৌধ।’

হকচকিয়ে গেল সৌধ। চোখ ফিরিয়ে দেখল নিধির ক্রোধান্বিত মুখশ্রী। দমে গেল নিমিষেই। কী যেন হয়েছে তার। ইদানীং নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কয়েকদিন নিধিকে দেখতে না পেরেই এই অবস্থা হয়েছে তার। অনুভূতিগুলো যেন এখন আর কোনো বাঁধাই মানতে চায় না৷ তাদের মাঝেকার বন্ধুত্বের যে দেয়ালটি আছে তা এক নিমিষে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে। সহসা সে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিল সৌধ। মস্তিষ্ক জুড়ে একটি প্রশ্ন আসতেই, কে বড়ো ভালোবাসা না বন্ধুত্ব? আজ যদি নিধিকে সে নিজের মনের কথাগুলো বলে দেয়। ভুল বুঝে নিধি দূরে সরে যাবে না তো? নষ্ট করে দেবে না তো বন্ধুত্বের সম্পর্কটিকে? সহসা সৌধর মনে পড়ে গেল নিধির বলা সেই কথাটি,

‘ সেম এজ রিলেশন গুলো খুব বিরক্তিকর। সেম এজ সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে, সংসার করা আর বিষ হজম করা একই কথা! ‘

চমকে ওঠল সৌধ৷ রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। আশ্চর্য হয়ে নিধিও ছুটে এলো তার পিছু পিছু। বলল,

‘ দেখ সৌধ, বাড়িতে ডেকে এনে এভাবে অপমান করবি না। আমি কিন্তু এক্ষুনি চলে যাব। ‘

‘ অপমান কোথায় করলাম? তুই ভুল বুঝছিস। ‘

‘ হ্যাঁ আমি তোকে শুধু ভুলই বুঝি। তুই কী বললি ওটা তখন। আমি আগুনপোকা? ‘

‘ মজা করেছি। ‘

হাঁটতে হাঁটতে একদম স্বাভাবিক স্বরে কথাটা বলল সৌধ। নিধি ওর সঙ্গে পা মিলিয়ে হেঁটে অবাক হয়ে বলল,

‘ আচ্ছা মেনে নিলাম। তাহলে তুই আমার উপস্থিতি টের পেলি কীভাবে? এর আগেও কিন্তু বিষয়টা খেয়াল করেছি। কাহিনীটা কী বল তো? ‘

আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল সৌধ। নিধির মুখে স্বাভাবিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কপট স্বরে বলল,

‘ দুনিয়াতে কিছু মানুষ থাকে এক্সট্রর্ডনারি। আমি সেই কিছুদের মধ্যেই একজন। ‘

প্রথমে বিস্মিত হলেও পরোক্ষণেই ভেঙচি কাটল নিধি। বলল,

‘ বেহুদা ভাব মারবি না। তুই…’

বাকি কথা আর বলতে পারল না। সৌধর ফোন বেজে ওঠায়। সৌধ ট্রাউজারের পকেট থেকে ফোন বের করেই দেখল সুহাস কল করেছে। এত সকালে সুহাসের কল! কেন?
.
.
বেলা এগারোটায় সুহাস নামীর রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হলো। সামাজিক, আইনি দু’ভাবেই নামী এখন মিসেস সুহাসিনী খন্দকার। এই খুশিতে সৌধ আর নিধি গিয়ে পোড়াবাড়ির নামকরা তিন কেজি চমচম নিয়ে এলো। উকিলকে এক কেজির প্যাকেট দিয়ে বাকি দুই কেজি সহ সকলেই বেরিয়ে এলো কোর্ট থেকে। উদ্দেশ্য সৌধদের বাড়ি যাওয়া। কোর্ট চত্ত্বর থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠে বসল সৌধ। নিধি সুহাস নামীকে নিয়ে একসঙ্গে এগুচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে সোহান খন্দকার ডাকলেন,

‘ সুহাস, নামী মা এদিকে এসো। ‘

ওরা তিনজনই থেমে গেল। নিধি টের পেল নব দম্পতির সঙ্গে একান্তে কথা বলবেন আংকেল। তাই মৃদু হেসে নামীকে বলল,

‘ আমি গিয়ে গাড়িতে বসছি। তোমরা এসো। ‘

নিধি চলে গেল। সোহান ছেলেকে কোর্ট চত্ত্বরের ডানপাশে নিয়ে গেলেন একান্তে কিছু কথা বলতে। আর আখতারুজ্জামান মেয়েকে নিয়ে গেলেন বাম পাশে। অল্প সময়ে অনেক বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। ভবিষ্যত উপরওয়ালার হাতে। তবুও নিজেদের চেষ্টায়ও ত্রুটি রাখা উচিৎ নয়৷ কর্মফল বলেও একটি কথা দুনিয়াতে জীবিত থাকে।

সোহান খন্দকার সুহাসকে বললেন,

‘ সুহাস, এ মুহুর্তে আমি তোকে বেশি কিছু বলতে পারব না বাবা। কিন্তু আমার বিশ্বাস তোরা দু’জন খুব শিঘ্রই সত্যিটা জানতে পারবি। আজ থেকে নামীর সব দায়িত্ব তোর আর আমার। অনেক বছর আগে আমাকে দিয়ে যে পাপ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আজ থেকে সেই পাপের বোঝা কমতে শুরু করবে। এরজন্য সম্পূর্ণ অবদান তোর বাবা। এক বাবার মাধ্যমে হয়েছিলাম পাপি। আজ আরেক বাবার মাধ্যমেই পাপ থেকে মুক্ত হলাম। যাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। আজ বহু বছর পর তার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদকে আগলে রাখার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই পড়ল। নিয়তির খেলায় শেষ হাসি আমি হাসতে পারলাম। ‘

এক মুহুর্ত চুপ করে সুহাসের কাঁধে হাত রেখে পুনরায় সোহান বললেন,

‘ মহান আল্লাহ তায়ালা যা করেন তার পিছনে বান্দার কোনো না কোনো মঙ্গল লুকিয়ে থাকে। আজ বুঝতে পারছি সেদিন ঐ ঘটনা না ঘটলে আজকের মঙ্গলটি হতো না। নামী আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুহাস অনেক। ‘

এদিকে আখতারুজ্জামান মেয়েকে বললেন,

‘ নামী মা, এক সময় এই পৃথিবীতে নিলু সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস আর ভরসা করত সোহানকে। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতা, কঠিন পরিস্থিতি ওদের সম্পর্কে দেয়াল তুলে দিয়েছিল৷ সে দেয়ালেই নিলু আমার স্ত্রী হয়। হয়ে ওঠে ভালোবাসার মানুষও। ওর প্রকাশ্য সুখ আর গোপন যন্ত্রণা খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। আমি জানি রাগ, অভিমান শেষে সোহানের প্রতি ওর ভালোবাসার গভীরতা। সব সময় মনে রাখবি মা, বাবা যা করেছে তোর ভালোর জন্য করেছে। বাবা যা করেছে পরপারে থাকা মা এতে সবচেয়ে বেশি খুশি৷ কারণ তার চোখের মণিকে আমি তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটির হাতেই তুলে দিলাম আজ। ‘

নামী জানত তার মায়ের একজন প্রাক্তন ছিল। কিন্তু আজ একদম পরিষ্কার হয়ে গেল সেই প্রাক্তনই সোহান আংকেল। অর্থাৎ তার শশুরই তার মায়ের প্রাক্তন! সহসা চমকাল নামী। তাই যদি হয় সোহান আংকেলের সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক হলো কীভাবে? সে তো জানত তারা কলেজ বন্ধু। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল, তার বাবা ছিল তার মায়ের সিনিয়র ভাই। অর্থাৎ বাবা, মা, সোহান আংকেল একই কলেজের স্টুডেন্টস ছিল? কিন্তু মায়ের বাবার সঙ্গে বিয়ে কীভাবে হলো? সোহান আংকেল মাকে ঠকিয়েছিল বলে? উহুম এমন কোনো কথাত শুনেনি। তাহলে কী? কঠিন পরিস্থিতির জন্য সব হয়েছে?

অসংখ্য প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে রয় নামী এবং সুহাস। তারা উভয়ই বুঝতে পারে বাবা, মায়ের জটিল অতীত রয়েছে। সেই জটিল অতীত স্পষ্ট ভাবে জানতে উদগ্রীবও হয়। দু’জনকেই স্বান্তনা দেয়া হয় এই বলে, ‘ একদিন সব জানতে পারবে। এখন তোমরা ছোটো। আরো বড়ো হও তারপর এসব বড়ো বড়ো জটিল বিষয় গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। ‘
_______________________

আচম্বিতে গাড়ির ব্রেক কষলো সৌধ। সুহাস চোখ বুজে অতীতে ডুবে। রেজিষ্ট্রি করার পর বাবার বলা সেই কথাগুলো। সৌধর গাড়ির পেছনে বসা লাল শাড়ি পরিহিতা নামী, সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সে। সাত বছর পর সেসব আজো একদম স্পষ্ট দেখতে পেল সুহাস। বাড়ি যেতে যেতে কতশত কল্পনা করছিল। মনে মনে কঠিন পণ করেছিল, যে ঠোঁট নাড়িয়ে নামী তাকে কবুল বলে স্বামী হিসেবে স্বীকার করেছে সেই ঠোঁটে আজ চুমু খাবেই খাবে। যে হাতে রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করেছে সে হাতেও করবে গাঢ় চুম্বন।

‘ সুহাস, এই সুহাস। ‘

সৌধের ডাকে চমকে ওঠল সুহাস। ভীতিগ্রস্ত হয়ে চোখ খুলে তাকাল আশপাশে। সৌধ পুনরায় বলে ওঠল,

‘ কোন জগতে তুই? আমরা পৌঁছে গেছি। এই যে দেখ তাকিয়ে। এই হসপিটালেই নামী জয়েন করেছে। ঘটনা বুঝলাম না। আমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়ে ও সুইজারল্যান্ড কেন এলো? ‘

বুকের ভেতর কী যেন একটা কামড়ে ধরল সুহাসের। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ির ডোর খুলে বেরিয়ে পড়ল সে। সৌধও ত্বরিত গাড়ি থেকে নেমে গাড়ি লক করল।নামীকে খুঁজে পেতে হলে নিজেদের একটি গাড়ির বিশেষ প্রয়োজন। এ মুহুর্তে গাড়ি কেনা সম্ভব না। তাই এখানে আসার পর পরিচিত এক বড়ো ভাইয়ের গাড়ি নিয়েই বেরিয়েছে ওরা। দুই বন্ধু হসপিটালের গেট পর্যন্ত গিয়ে গেটম্যান হ্যালো করে ইংরেজিতে বলল, ডক্টর নামী রহমান কি আজ এসেছেন? গেটম্যান ইংরেজিতেই জবাব দিলেন,
‘ ম্যাম সপ্তাহে দু’দিন আসে। রবিবার আর মঙ্গলবার।’

আজ বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ ডক্টর নামী রহমান এখানে আসবে রবিবার। সৌধ সময়টা জেনে নিল। কিন্তু সুহাস অধৈর্য হয়ে বলল,

‘ ও থাকে কোথায়? ‘

মুহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘উনি থাকেন কোথায়? উনার ঠিকানা দেয়া যাবে? ‘

গেটম্যান কোনোমতেই ঠিকানা দিল না।বরং বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। সৌধ সুহাসকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়িতে ওঠাল। বলল,

‘ কুল ম্যান, এত হাইপার হচ্ছিস কেন। ষোল মাস ধৈর্য ধরতে পারলি আর কটাদিন পারবি না? ‘

সহসা দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরল সুহাস। মুহুর্তেই আবার সিটে গা এলিয়ে দিল। চোখ বুজে শ্বাস নিল ঘনঘন। সৌধ চুপসে গেল। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হলো রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। জেনেভা লেকের কাছাকাছি এক বিলাসবহুল রিসোর্টে ওঠেছে তারা। যাত্রাপথে সুহাস আবারো অতীতে ডুব দিল। স্বচ্ছ পানির মতো অতীত। নিষ্ঠুর অতীত। বিষাক্ত অতীত৷ যেখানে সুখ জিনিসটা ছিল খুব খুব সীমিত। আর এই সীমিত সুখের রেশ ধরেই আজ সে ছুটে এসেছে ভিন দেশের ভিন শহরে। প্রিয়তমার খোঁজে। যার কাছে রয়েছে তার ছোট্ট এক অংশও। নিষ্ঠুর অতীতের নিষ্ঠুর প্রিয়তমা সেই অংশের আগমনী বার্তাও দেয়নি তাকে। বুকটা হুহু করে ওঠল সুহাসের। চোখ বুজে হৃদয়ের চোখে দেখতে লাগল অতীত জীবনটাকে…
_______________________

‘ ও কে, কে ও? নিলু! ওকে নিলুর মতো দেখতে। ওকে নিলুর মতো দেখতে কেন! কাকে সুহাসের বউ করে এনেছ তুমি সোহান। কে ও? ‘

উদয়িনীর কাঁপা কণ্ঠ শুনে সোহান বললেন,

‘ উদয়িনী, শান্ত হও। ও নিলুর মেয়ে, নামী। ‘

মুহুর্তেই দপ করে সোফায় বসে পড়ল উদয়িনী। তীব্র চিৎকারে বলল,

‘ আমার এত বড়ো সর্বনাশ তুমি কীভাবে করলে সোহান! আমার ছেলের জীবনটা তুমি এভাবে কেন ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিলে? ‘

তীব্র ক্রোধে উদয়িনীর চেহেরাই বদলে গেল। কাঁপতে লাগল থরথর করে। নিধি, সৌধ ভয়ে চুপসে গেল। উদয়িনীর আন্টির এই রূপ দেখে হতভম্ব তারা৷ খানিকপূর্বে ঘরে শুইয়ে আসা হয়েছে সিমরানকে। মায়ের চিৎকার শুনে জ্বর মাথায় ছুটে এলো সে। বলল,

‘ আম্মু, কী হয়েছে তোমার? ‘

নিধি গিয়ে ধরল সিমরানকে। বলল,

‘ সিমরান কিছু হয়নি৷ তুমি আমার সাথে ঘরে চলো।’

জেদি সিমরান সে কথা শুনল না। নিধির থেকে হাত ছাড়িয়ে ছুটে এসে মায়ের কাছে বসল। উদয়িনী মেয়েকে জাপ্টে ধরে ডুকরে ওঠল,

‘ তোর বাবা প্রতিশোধ নিল রে সিমরান। ঐ মেয়েকে নাকি সুহাস বিয়ে করেছে! জানিস ও কে? নিলুর মেয়ে! ‘

নামীর দিকে তর্জনী তুলে কথাটা বলল উদয়িনী। ভয়ে দেহ কেঁপে ওঠল নামীর। থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। সিমরান বিস্মিত হয়ে তাকাল শ্যামলা বর্ণের নামীর দিকে। যাকে কিয়ৎ মুহুর্ত আগে ভাইয়ের বান্ধবী ভেবেছিল সে আর তার মা। উদয়িনী হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আবার বলল,

‘ যেই নিলুর জন্য আমি কোনোদিন স্বামীর ভালোবাসা পাইনি। সেই নিলুর মেয়েকে বিয়ে করেছে আমার ছেলে! ‘

কথাটা বলেই শরীর ছেড়ে দিল উদয়িনী। সিমরান শক্ত করে মাকে ধরে চিৎকার করে ওঠল,

‘ আম্মু! ‘

স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সুহাসের স্তব্ধতা কেটে গেল এক নিমিষে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে মায়ের কাছে ছুটে এলো সে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল,

‘ মা, ও মা প্লিজ শান্ত হও মা। ‘

চলবে…
ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৬

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬

‘ সুহাসিনী, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রোকজ্জ্বল এই ক্ষণে কাজল রঙে আবৃত তোমার মায়াবিষ্ট আঁখি যুগলেই কি হলো আমার মরণ? ‘ __সুহাস

নামীর ব্যক্তিগত ডায়ারিতে স্থান পেল তাকে উদ্দেশ্য করে বলা সুহাসের প্রথম নৈসর্গিক বাক্যটি। একবার, দুবার, বার বার অসংখ্যবার বিড়বিড়িয়ে বাক্যটি আওড়াল নামী। নিজের ঘরে নাজুক মুখে বসে মুচকি মুচকি হাসছে সে। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে দুপুরের খাবার পর্বের সমাপ্তি ঘটেছে। সুহাস গেছে তার বন্ধুদের নিয়ে বাড়ির সামনে হাঁটাহাঁটি করতে। এ সুযোগেই সে একরাশ অনুভূতি বুকে চেপে ছুটে এসেছে নিজের ঘরে। ডায়ারিতে লিপিবদ্ধ করে রাখল, শব্দের বুননে তৈরি হওয়া ঐন্দ্রজালিক সে বাক্যটি। যা তার হৃদয় কুহরে আটকে গেছে জন্মান্তরের জন্য।

মিনিট পাঁচেক পরই দরজায় টোকা পড়ল। শুনতে পেল নিধি আপুর ডাক,

‘ নামী আসব? ‘

বিছানার পাশের টেবিলে ডায়ারি রাখল নামী। ধাতস্থ হয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ জি আপু আসুন। ‘

প্রথমে নিধি ঢুকল। এরপর প্রাচী। নামী ওদের বসতে বললে বিছানায় বসল ওরা। বলল,

‘ তোমাদের এদিকে দুইশ এক গম্বুজ মসজিদ হচ্ছে তো। ঝটপট রেডি হয়ে নাও। আমরা এখন ওখানে যাব। ‘

প্রাচী বলল,

‘ আর কী রেডি হবে? রেডিই তো। ‘

নামী ঈষৎ হেসে বলল,

‘ আমি যাব? ‘

‘ আমরা যাচ্ছি আর তুমি যাবে না! উফ নামী এটা কোনো প্রশ্ন? জলদি তৈরি হও। ‘

নামী বেশ ইতস্তত বোধ করতে লাগল। প্রাচী নিধিকে ইশারায় কিছু বলতেই নিধি আশ্চর্য মুখে বলল,

‘ তুমি এত সংকোচ করছ কেন? কোনো সমস্যা? ‘

নামী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমতা আমতা করে বলল,

‘ বাবা আর আংকেলকে বলতে হবে তো। আমি গিয়ে বলে আসি?’

নিধি বিস্মিত হলো। নামী বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই হাত টেনে ধরল সে৷ বলল,

‘ বাব্বাহ! সত্যিই খুব লক্ষী মন্ত মেয়ে গো তুমি। শোনো দুই আংকেলই অনুমতি দিয়েছেন। তাছাড়া সোহান আংকেল তোমার শশুর হলেও সে অন্যধারার মানুষ। ধীরেধীরে তুমি নিজেই টের পাবে। সে কখনোই তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে ট্রিট করবে না।’

লজ্জা পেল নামী। আর কিছু বলতে পারল না। তৈরি হওয়ার মধ্যে শুধু চুল আঁচড়ে ঠোঁটে ব্রাউন ন্যুড কালার লিপস্টিক লাগাল। এরপর হ্যান্ডপার্স আর ফোন তুলে বলল,

‘ আমি তৈরি আপু। ‘

নিধি সঙ্গে সঙ্গে সৌধকে কল করল। সৌধ রিসিভ করলে বলল,

‘ কী ভাই, হেলথ্ মিনিস্টার, আপনার চল্লিশ মিনিট হাঁটা হয়নি? ‘

আবারো ভাই! সৌধর মাথা দপদপ করে ওঠল। ইচ্ছে করল নিধির ঠোঁটজোড়ায় ইনজেকশন পুশ করে সারাজীবন অবশ করে রাখতে। যেন আজ এই মুহুর্ত পর থেকে ঐ মুখে আর তাকে ভাই শুনতে না হয়। সমবয়সী, বন্ধু হয়েই জীবনটা তেজপাতা হয়ে যাচ্ছে। না পারছে মনের অনুভূতি জানাতে আর না পারছে সহ্য করতে। এর মধ্যে এ ভাই, ও ভাই করে বুকের ভেতর রক্ত ক্ষরণ ঘটিয়ে দিচ্ছে। ক্রোধের বশে
শক্ত কিছু কথা বলতে গিয়েও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলল সৌধ। চোখ বন্ধ করে দু’বার ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘ আরো পনেরো মিনিট। ‘

অমন গম্ভীর কণ্ঠ শুনে নিধি হকচকিয়ে গেল। মনে মনে বলল, এই সৌধটার আজ হয়েছেটা কী? মুখে বলল,

‘ নামী রেডি, আমরা বেরুচ্ছি। তোরা সামনেই আছিস তো? ‘

‘ হুম। ‘

বলেই ফোন কেটে দিল সৌধ। নিধি ভ্রু কুঁচকে প্রাচীকে বলল,

‘ এই প্রাচী, সৌধর কী হয়েছে রে? ‘

প্রাচী অবাক হয়ে বলল,

‘ কী আবার হবে ওর? ‘

‘ জানি না। মনে হচ্ছে মেজাজ দেখিয়ে কথা বলছে। ‘

‘ মনে হচ্ছে কিন্তু সত্যি না৷ ওসব ছাড় তো, চল এবার। ‘

প্রাচী নিধির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ওদের পেছন পেছন চলল নামীও।
.
.
সৌধর গাড়িতে ড্রাইভার সিট সহ মাত্র পাঁচজন যাওয়া যাবে। অথচ মানুষ সাতজন। তাই গাড়ি রেখে অটো করে আট কি.মি দূরে অবস্থিত মসজিদ দেখতে গেল ওরা। ভেতর সিটে সুহাস, নামী পাশাপাশি আর নামীর পাশে প্রাচী। মধ্যসিটে সৌধ আর নিধি। অটোওয়ালার এক পাশে আজিজ। অন্য পাশে আইয়াজ। বেশ গল্প স্বল্প করতে করতেই পৌঁছাল ওরা। মসজিদের সামনে এসেই মাথায় কাপড় তুলল নামী। তাকে দেখে নিধি আর প্রাচীও মাথায় কাপড় তুলল। এরপর সকলে মিলে ভেতরে চলে গেল। মসজিদের ভেতরে গিয়ে বিশ মিনিট সময় কাটিয়েছে ওরা৷ এরপর নিচে নেমে ডান পাশের দোকান গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ফুচকার দোকান দেখেই নিধি চট করে সৌধর হাত চেপে ধরল। উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘ দোস্ত ফুচকা খাব। ‘

নিধির ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে সৌধ শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ এগুলো ভালো হবে না। অস্বাস্থ্যকর লাগছে। ‘

হাত ছেড়ে মেজাজ খারাপ করা স্বরে নিধি বলল,

‘ ধূর, তুই ভাই একটা নিরামিষ। ‘

সৌধকে কথাটা বলেই সুহাসকে বলল,

‘ এ সুহাস চল তো ফুচকা খাই। ‘

সুহাস নামীর দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,

‘ ফুচকা খাবে? ‘

নাজুক মুখে মাথা নাড়াল নামী। প্রাচী নিধির পেটে মৃদু গুঁতো দিয়ে বলল,

‘ দেখেছিস কাণ্ড! কে বলবে একদিন আগেও এরা দু’জন দু’জনের সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল? ‘

মাথা দুলিয়ে হাসল নিধি। এরপর প্রায় দৌড়েই চলে গেল ফুচকার দোকানে। নামীকে নিয়ে সুহাসও এগুলো। গম্ভীর মুখে ধীরপায়ে চলতে থাকা সৌধকে তাড়া দিয়ে সুহাস বলল,

‘ জোরে হাঁট। ‘

সৌধ হাঁটার গতি আরো কমিয়ে দিলে সুহাস পুনরায় ডাকল দু’বার। সৌধ ইশারায় বলল,

‘ এখানেই আছি। তোরা খেয়ে আয়। ‘

পকেটে দু-হাত গুঁজে মৃদু পায়ে ঘুরে ঘুরে দোকান দেখতে লাগল সৌধ। দেখতে পেল, আজিজ আর আইয়াজ তসবিহ, টুপিওয়ালা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করছে ওরা। বাঁকা হেসে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই চোখ পড়ল কয়েক হাত দূরে নিল রঙের বোরখা আর সাদা হিজাব পরা দু’টো মেয়ের দিকে। মেয়ে দু’টো তার দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে যেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনাও করছে। প্রথমে খেয়াল দিলেও পরোক্ষণেই এড়িয়ে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করল সে। মিনিট দুয়েক পর শুনতে পেল অল্প বয়সী মেয়েলি ডাক,

‘ ভাইয়া একটু শুনেন. ‘

ভ্রু কুঁচকে থেমে গেল সৌধ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল সেই বাচ্চা মেয়ে দু’টো। বাচ্চা সরল দু’টি মুখ দেখে কুঁচকানো ভ্রুদ্বয় ঠিক হয়ে গেল৷ মৃদু হেসে বলল,

‘ ইয়েস? ‘

মেয়ে দু’টোর মধ্যে ফরসা করে মেয়েটা চঞ্চলিত কণ্ঠে বলল,

‘ আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? ‘

সৌধ অবাক হলো। তৎক্ষনাৎ পাশের শ্যামলা মেয়েটা বলল,

‘ আসলে ভাইয়া আপনাকে না ঠিক হিরোদের মতো দেখতে। ‘

ফরসা মেয়েটা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘ না না হিরো নয় আমাদের প্রিয় সিংগার আরমান মল্লিকের মতো দেখতে। প্লিজ ভাইয়া একটা ছবি তুলতে দেন। বান্ধবীদের দেখাব। আমরা সবাই আরমান মল্লিকের ডাই হার্ট ফ্যান। আপনাকে দেখে তো আমরা খুব অবাক হয়ে গিয়েছি। কয়েক মিনিট লেগেছে ঘোর কাটতে। মনে হচ্ছে আপনারা জমজ ভাই। ইস, আপনার ফিটনেসও মারাত্মক। আচ্ছা ভাইয়া আপনি কি হিরোদের মতো জিম করেন? ‘

সৌধ খেয়াল করল মেয়েগুলো তার হাতের ফুলে ফেঁপে থাকা পেশির দিকে তাকাচ্ছে আর কথা গুলো বলছে। ঠিক কী উত্তর দেবে বা কী বলবে বুঝে ওঠতে পারল না সে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল শুধু। তাকে আরমান মল্লিকের মতো দেখতে? এ প্রথম এমন কথা শুনল। খুশি হওয়া উচিৎ না বিরক্ত হওয়া উচিৎ মেয়ে দু’টোর প্রতি? প্রচণ্ড বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল যেন। না খুশি হলো না বিরক্ত। অদ্ভুত অনুভূতি হলো তার৷ বাচ্চা মেয়ে দু’টোর অনুরোধে কয়েকটা ছবি তুলতেও দিল। এরপর বিদায় নিতে উদ্যত হলেই ফরসা করে মেয়েটা বলল,

‘ ভাইয়া আপনার ফেসবুক আইডি টা জানতে পারি? ‘

এ পর্যায়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল সৌধ। আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে চলে এলো আজিজ আর আইয়াজের কাছে। দেখল, ওরা দু’জন এক হাজার পুঁতির দুটো তসবিহ কিনে নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা করছে। সৌধ গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘ কী ব্যাপার তসবিহ কার জন্য? ‘

আজিজ দাঁত ক্যালিয়ে হাসল। বলল,

‘ নিউ ম্যারিড কাপলদের জন্য। ‘

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সৌধ। বলল,

‘ মানে! ‘

আজিজ বলল,

‘ একটু পরই বুঝবি। ‘

নামী ওরা ফুচকা খেয়ে বেরিয়ে আসতেই আজিজ গিয়ে সামনে দাঁড়াল। দু’টো তসবিহ দু’জনের হাতে ধরিয়ে বলল,

‘ হ্যাপি ম্যারিড লাইফ দোস্ত, হ্যাপি ম্যারিড লাইফ ভাবি। ‘

নামী সুহাস সহ প্রত্যেকেই ভীষণ অবাক হলো। এ প্রথম এমন কিছুর সম্মুখীন হলো তারা। আজিজ বলল,

‘ আজ থেকে প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর তসবিহ পড়বে দু’জনে। কী জপবে বলো তো? ‘

এবারে সুহাস টের পেল আজিজের দুষ্টুমি। কিন্তু নামী খুব সিরিয়াস হয়ে তাকিয়ে রইল। আজিজ তার দিকে তাকিয়েই বলল,

‘ প্রতিদিন এক হাজার বার সুহাস, সুহাস, জপ করবে। ‘

এরপর সুহাসের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আর তুই নামী, নামী। দেখবি তরতর করে মহব্বত বাড়বে। ‘

তীব্র লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল নামী। আরক্ত হলো তার কপোলদ্বয়। সুহাস চোখ রাঙিয়ে তসবিহ ফেরত দিতে নিলে নামী বাঁধ সেধে নরম স্বরে বলল,

‘ থাক না। উপহারের জিনিস ফেরত দিতে নেই। ‘

সকলে বিস্ময় চোখে তাকাল। সৌধ বাঁকা হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল ওদের থেকে। বুঝল, নামী মেয়েটা অসাধারণ। আংকেলের পছন্দটা মারাত্মক। কিন্তু সুহাসকে নিয়েই চিন্তা হচ্ছে। সুহাস ঠিক থাকবে তো? ঘন ঘন গার্লফ্রেন্ড বদলানো ছেলেটা এক নামীতে আটকাবে তো?

বাকিরা নিজেদের মধ্যে দুষ্টুমি আর সুহাস নামীকে ক্ষেপাতে ব্যস্ত। ঘোরাঘুরি শেষ করে চলে যাবার সময় সকলে আগে আগে হাঁটছিল। আর সুহাস নামী পিছু পিছু। ভীড় ঠেলে বেরুতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল ওদের। পরিস্থিতি বুঝে আচমকা সুহাস নামীর হাত ধরল। আগলে নিয়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। নামী স্তব্ধ মুখে তাকিয়ে সুহাসের পানে। শরীর জুড়ে শিরশির অনুভূতিতে সিক্ত তার। হৃৎ স্পন্দনের গতিও বাড়ছে অস্বাভাবিক ভাবে৷ বন্ধুরা অটোতে বসে দেখল নববিবাহিত বন্ধুর মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটি। সকলে এক সুরে বলেও ওঠল,

‘ মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ। ‘

গোধূলিলগ্ন। আকাশের অবস্থা সুবিধার না। নামীদের বাড়ি থেকে বিদায় নিল, পাঁচ বন্ধু। নামী জোরাজুরি করছিল, একদিন থেকে যেতে৷ নামীর বাবা, মাও বেশ জোর করল থাকতে। সকলেই বাড়ির বাহানা দিয়ে বিদায় নিল। তবে নামীকে কথা দিয়েছে সে সুহাসদের বাড়িতে যাওয়ার পর অবশ্যই তার সঙ্গে তারা দেখা করবে। তাছাড়া নামী যদি তাদের কলেজেই ভর্তি হতে পারে৷ তাহলে তো হয়েই গেল। এ ব্যাপারটা অবশ্যই সৌধ মাথায় রাখল। গ্রাম থেকে বেরোতে বেরোতে মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। বৃষ্টি হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেল ওরা। ড্রাইভ করতে করতে সৌধ বলল,

‘ সবাই আমার বাড়িতে থেকে যা। ‘

আইয়াজ বলল,

‘ না রে। ক’টাদিন ছুটি পেয়েছি। আজ না ফিরলে আম্মা কষ্ট পাবে। ‘

প্রাচী বলল,

‘ আমি আর নিধি থেকে যাচ্ছি এটাত কনফার্ম। ‘

আজিজ বলল,

‘ মেয়ে দুইডারেই নিয়ে যা। আমাদের নিয়ে এত চিন্তা কী। ‘

হঠাৎ নিধি বলল,

‘ আমি বুঝলাম না, তোর বাসায় ক্যান যেতে হবে? আমাদের বাসায় গেলে সমস্যা টা কী? ‘

বিরক্ত সূচক শব্দ করে সৌধ বলল,

‘ তুই বুঝিস টা কী আমাকে বলবি? বাসাটা কি তোর বাবার? ছুটি শেষ হয়নি, রাত করে হঠাৎ বাসায় যাবি। আর বাড়িওয়ালার অসংখ্য প্রশ্ন, সন্দেহের সম্মুখীন হবি৷ এ খেয়াল আছে? ‘

সহসা দমে গেল নিধি। সত্যিই তো!
মেডিকেল কলেজের পেছনে এক রুমের একটি বাসা ভাড়া করে থাকে নিধি, প্রাচী। অন্যের বাড়িতে ভাড়া থাকতে হলে খুব বেশি স্বাধীনতায় থাকা যায় না। তাদের ছুটি কতদিন বাড়িওয়ালা জানে। তাই এ সময় বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলে সত্যিই বিপদ বাড়বে। তাই সৌধর কথাই মেনে নিল। ছুটি শেষ হতে তিন দিন বাকি। সৌধর বাসায় দু’রাত থাকতেই হবে৷ ব্যাগপত্র গুছিয়ে যখন এসেছে। নিজ বাড়িতে দু’দিনের জন্য ফিরে যাওয়া অসম্ভব। তাছাড়া সৌধর বাড়িতে যাওয়া আসা হয়ই। আন্টি, আংকেল, স্মৃতি আপু সবাই খুব বন্ধুত্বপূর্ণ। সৌধের পরিবারটা সবচেয়ে আলাদা৷ সবচেয়ে ভালোবাসা পূর্ণ। যেখানে গেলে হাঁপ ছেড়ে শ্বাস নেয়া যায়। শান্তির আরেক নামই যেন সৌধর বাড়ি, সৌধর পরিবার। দুটো বছরে এইটুকু উপলব্ধি করেছে নিধি। অমন অমায়িক মানুষ, অমায়িক পরিবার আর দুটো দেখেনি সে।

আজিজ আইয়াজকে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির কাছাকাছি চলে এলো সৌধ। গ্যারাজে গাড়ি রেখে নেমে পড়ল তিনজনই৷ গাড়িতে একটি মাত্র ছাতা। প্রাচীর ঠাণ্ডার সমস্যা আছে। তাই নিধি প্রাচীকেই ছাতা দিল বলল,

‘ তুই আর ব্যাগ দুটো যেন না ভেজে। ‘

প্রাচী তার এবং নিধির ব্যাগ নিয়ে ছাতা মাথায় ত্বরিত সৌধদের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। ইচ্ছে করেই এমনটা করল সে। যেন সৌধ, নিধি বৃষ্টি মুখর রাতটায় একান্ত কিছু সময় কাটাতে পারে। এতে নিধির কী হবে জানে না৷ তবে সারাদিনে সৌধর বিগড়ানো মেজাজ অনেকটাই ঠিক হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ ভালোই লাগে নিধির। বৃষ্টি হয়েছে আর সে ভেজেনি এমন ঘটনা খুব কমই ঘটেছে। এমনও সময় গেছে যখন সে মাঝরাতে ছাদে গিয়ে বৃষ্টি বিলাস করেছে। আজ এমনিতেও গিয়ে গোসল করা লাগবে। গ্রীষ্মের গরমে একদিন গোসল না করে থাকা অসম্ভব! তাই ভিজতে কোনো অসুবিধা হলো না। বেশ উৎসাহ নিয়ে ভিজতে এবং হাঁটতে শুরু করল সে। তার পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়ে এলো সৌধও। নিধি প্রফুল্ল চিত্তে বলল,

‘ জোশ লাগছেরে ভাইই। আজকের দিন, রাত সবটাই অসাধারণ। ‘

সহসা বা হাত মাথার পেছনে দিয়ে নিজের চুল নিজেই টেনে ধরল সৌধ। মনে মনে বলল,

‘ কন্ট্রোল সৌধ কন্ট্রোল। ‘

এগুতে এগুতে আরো অনেক বকবক করল নিধি। সেসবে খেয়াল না দিয়ে মনে ক্রোধ চেপে মুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে একসঙ্গে শুধু এগিয়েই চলল সৌধ। আর নিজেকে রাখল কঠিন নিয়ন্ত্রণে। ল্যামপোস্টের আলোয় নিধির পরিহিত গাউন ভিজে একাকার হওয়ার দৃশ্য দেখল সে। গাউন সহ চুরিদারের দু’হাতে চেপে ধরে এগুচ্ছে নিধি। চুলগুলো খোঁপা করায় পৃষ্ঠদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান। সাদা রঙের গাউনটা ভিজে দেহের সঙ্গে লেপ্টে রয়েছে। কালো রঙা অন্তর্বার স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। মুহুর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সৌধ। নিচের দিকে মাথা নুইয়ে এগিয়ে এলো। তৎক্ষনাৎ নিধি ডাকল,

‘ আরেহ ভাই এত স্লো ক্যান তাড়াতাড়ি হাঁট। ‘

সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল সৌধ। চোখ দু’টো খিঁচিয়ে নিচু কন্ঠ অথচ চিবানো সুরে বলল,

‘ যদি কোনোদিন সুযোগ পাইরে নিধি, আস্ত গিলেই খাব তোকে! ‘

নিধি প্রায় লাফাতে লাফাতে বাড়ির সামনে চলে এলো। বৈদ্যুতিক ঝকঝকে আলোতে সৌধদের লোহার গেঁট আকড়ে থাকা বৃষ্টি ভেজা কাগুজি ফুলগুলো দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে গেল সে। বলল,

‘ এই সৌধ, এগুলো সাইজ করে কাটাস না কেন? ‘

সৌধ উত্তর দিল না। নিঃশব্দে পিছু পিছু গেট পেরিয়ে গেট লাগিয়ে তালাবদ্ধ করে দিল। বাড়ির মেইন দরজাও খোলা৷ নিধি ত্বরিত গতিতে যেতে উদ্যত হলেই সৌধ পিছু ডাকল,

‘ নিধি ওয়েট। ‘

নিধি দাঁড়িয়ে পড়ল। কপাল থেকে থুতনি অবধি পানিগুলো ঝেড়ে কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘ কী হলো? ‘

সৌধ দ্রুত সামনে এসে বলল,

‘ চুলগুলো ছেড়ে দে। ‘

‘ মানে চুল ছাড়ব কেন! ‘

এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে সৌধ বলল,

‘ যা বলেছি তাই কর। বাসায় কাজিনরা আছে। যদি বসার ঘরে থাকে সমস্যা হবে। ‘

‘ মানে কী সমস্যা হবে। ‘

‘ তোর সমস্যা হবে। ‘

‘ মানে কী বলছিস তুই বুঝছি না। ‘

সহসা রেগে গেল সৌধ। ধমকে বলল,

‘ তুই বুঝিসটা কী? বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে জামা লেপ্টে গেছে। জামার ভেতরকার বাচ্চা জামাটাও দেখা যাচ্ছে। ‘

মুহুর্তেই শক্ত হয়ে গেল নিধি। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল সৌধর মুখের দিকে। অবিশ্বাস্য ঐ দৃষ্টি দেখে সৌধ মেজাজ ঠাণ্ডা করে শান্ত গলায় বলল,

‘ কুল, বি পজেটিভ নিধি। একদম ভুল বুঝবি না। ‘

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৫

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫
গাঢ় গোলাপি রঙের ঘাগরার সঙ্গে গাঢ় নীল লেডিস শার্ট পরিহিত নামী। শার্টের দুই হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। গলায় ঝুলানো গোলাপি রঙের জর্জেট ওড়না। মুখশ্রীতে কোনো প্রসাধনী নেই। ঘন-কালো দিঘল রেশম চুলগুলো পেছন দিকে বেশ উঁচু করে বাঁধা। ছোট্ট কপালটা ছোটো-ছোটো চুলে ঢাকা। মুখে লেগে আছে স্নিগ্ধতা মেশানো মৃদু হাসি। হাতে হলুদ রঙের একটি কফির মগ। সুহাসের অনুমতি পেয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে এগিয়ে এলো নামী। বিস্ময়কর ভালো লাগার আবেশে ডুবে গেল সুহাস। নামী কফির মগ এগিয়ে দিতেই সে শ্যামলাটে মুখটায় প্রগাঢ় চাউনি ছুঁড়ে দিল। সন্তর্পণে হাত বাড়িয়ে মগটা নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,

‘ বসো। ‘

নামী লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে পাশে বসল। কফির মগে কয়েক পল তাকিয়ে থেকে সুহাস প্রশ্ন করল,

‘ তুমি বানিয়েছ? ‘

মৃদুস্বরে জবাব দিল নামী,

‘ হ্যাঁ। ‘

ধূসর রঞ্জিত চোখজোড়ায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে মাথা দুলিয়ে চুমুক দিল কফির মগে। নামী সরাসরি না তাকালেও আড় চোখে তাকিয়ে দেখল চুমুক দেয়ার দৃশ্যটি। অতি যত্নে মগে ঠোঁট ছোঁয়ানো দৃশ্যটি দেখতেই দেহ শিরশির করে ওঠল তার। মনে পড়ে গেল গতরাতে পুরুষালি ঐ গোলাপি ঠোঁটজোড়ার খুব কাছে ছিল সে। কিঞ্চিৎ দূরত্বই ছিল দু’জোড়া ঠোঁটের মিলন ঘটাতে! ধুকপুক করে ওঠল বুক। আড় দৃষ্টিতে তাকালেও খুব নিঁখুত ভাবে তাকিয়ে নামী। গতকাল খেয়াল না করলেও আজ খেয়াল করল, ছেলে হিসেবে সুহাসের ঠোঁটজোড়া বেশিই গোলাপি। অথচ মেয়ে হয়েই তার ঠোঁট অতো গোলাপি নয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ফরসা ত্বকের মানব, মানবিদের ঠোঁট বেশির ভাগ গোলাপিই হয়। শ্যামলা ত্বকের মেয়েদের অমন আকর্ষণীয় ঠোঁট খুব কম হয়। নামী খেয়াল করল, সুহাসের নিচের ঠোঁট উপরের ঠোঁটের তুলনায় মোটা। আর নিচের ঠোঁটের এক কোণায় স্পষ্ট একটি কালো তিল। যা দেখে চোখ দু’টো ধাঁধিয়ে ওঠল। একজন পুরুষও এমন আশ্চর্য সুন্দর হয়? তার ভাবি অযথাই বদনাম করছিল। সুহাস যথেষ্ট সুদর্শন এক যুবক। শুধু তাই নয় সে অন্যান্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই যেমন তার চোখ দু’টো আর পাঁচজন ছেলের মতো নয়। তার চোখ আলাদা। ধূসর বর্ণের ঐ চোখ দু’টোর গভীরতা কিঞ্চিৎ হলেও টের পেয়েছে সে৷ আর সুহাসের নাকটাকে লোকে হয়তো বোঁচা বলবে৷ কিন্তু তার কাছে বোঁচা লাগছে না বরং অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ফরসা, লম্বাটে দেহের হ্যাংলা, পাতলা সুহাসের যখন আরেকটু বয়স হবে। স্বাস্থ্য ভালো হবে৷ দেহে বলিষ্ঠতা আসবে। তখন লম্বাটে মুখে এই নাকটাই গুরুগম্ভীরতা আনবে। এ পর্যন্ত ভেবেই বক্ষঃস্থলে ধুকপুকানির মাত্রা বেড়ে গেল নামীর। সুহাস যেন টের না পায় তাই সে দম আঁটকে ঠাঁই বসে রইল। আচমকা সুহাস বলে ওঠল,

‘ আমার একার জন্যই এনেছ? মানুষ দু’জন অথচ কফি একটা! ‘

সুহাসের মুখে কপট বিস্ময়। নামী অবাক চোখে তাকিয়ে। আমতা আমতা করে বলল,

‘ সমস্যা নেই। আপনিই খান, আপনার জন্য করেছি।’

‘ কফি পছন্দ করো না? ‘

প্রশ্নটি করেই নামীর সর্বাঙ্গে সুক্ষ্ম দৃষ্টি বুলাল সুহাস। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছুঁয়ে যাচ্ছে তার। নামীর বেশভূষা যথেষ্ট মার্জিত। গায়ের রঙ চাপা হলেও মারাত্মক স্মার্ট। বুঝে ফেলল সুহাস। মনে মনে আনন্দিত হলো খুব। একদিক বাদ রেখে বাকি সবদিক দিয়ে মেয়েটা অসাধারণ। সুহাস মনে মনে এসবই ভাবতে থাকল। নামী তার প্রশ্নের জবাবে বলল,

‘ আমি মারাত্মক কফি লাভার। ‘

সুহাস বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,

‘ তাই? তাহলে তো একা একা এটা খাওয়া ঠিক হবে না। চলো শেয়ার করে খাই। ইউ নো হোয়াট? উই আর হাজব্যন্ড ওয়াইফ। সো শেয়ার করতেই পারি। ‘

সুহাস কফির মগ এগিয়ে ধরল। নামী হতভম্ব হয়ে তাকাল। ইতস্ততভাবে বলল,

‘ না, না। আপনিই খান আমি খাব না। ‘

ভ্রু কুঁচকে ফেলল সুহাস। বলল,

‘ কী ব্যাপার নামীদামি? দাম দেখাচ্ছ? ‘

‘ ছিঃ ছিঃ কী বলছেন। দাম কেন দেখাব। ‘

আঁতকানো কণ্ঠে বলল নামী৷ সুহাস কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ তাহলে সমস্যা কী? ‘

এ কথা বলেই বিস্ময় কণ্ঠে পুনরায় বলল,

‘ অ্যাঁই তুমি কি ভাবছ আমি দাঁত ব্রাশ করিনি? মুখে গন্ধ বেরোচ্ছে? গন্ধ মুখের এঁটো খেতে তাই এত্ত অনীহা। বাব্বাহ তুমি সত্যিই নামীদামি লোক। শোনো নামীদামি, একদম নতুন ঝকঝকে পরিষ্কার ব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না ওয়েট প্রুফ দিচ্ছি। ‘

ত্বরিত নামীর মুখের কাছে মুখ নিয়ে এলো সুহাস। হা করে শ্বাস ছাড়ল নামীর মুখের ওপর৷ পরোক্ষণেই আবার সামনের পাটির দাঁত গুলো বের করেও দেখাল। আকস্মিক কাণ্ডে হকচকিয়ে গেল নামী। আচমকা সুহাসের মুখের উষ্ণ শ্বাস নিজের মুখে পড়তেই চোখ দু’টো খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিল। শরীর জুড়ে দিয়ে ওঠল তীব্র ঝংকার। অবচেতন মন কেঁদে ফেলল এই ভেবে,
‘ এই ছেলেটা এত পাগল কেন? ‘
.
.
সৌধের গাড়ি মুক্তাগাছা ছাড়াবে। এমন সময় সৌধের ফোনে কল এলো, সোহান খন্দকারের। সৌধ মিটিমিটি হেসে গাড়ির ব্রেক কষলো। রিসিভ করল সোহান আংকেলের কল। নিধি সহ সকলেই তাদের কথোপকথন শুনল। সেসব শুনে বাকিরা অবাক না হলেও নিধি হলো। বাকিদের চোখে বিস্ময় না ফুটলেও নিধির দুচোখ বিস্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে গেল। সৌধ কথা শেষ করে ফোন পকেটে রাখতেই সহসা নিধি চিল্লিয়ে ওঠল,

‘ এসবের মানে কী সৌধ? ‘

সৌধকে প্রশ্নটি করেই পাশে বসা প্রাচীর দিকে তাকাল। রেগেমেগে বলল,

‘ প্রাচী! এসব কী? আংকেল তো এখন দাওয়াত দিল। আর আংকেল তো জানেও না আমরা যাচ্ছি। ‘

নিধির চিৎকারে সৌধ বিরক্ত হলো। প্রাচীকে ইশারায় বলল, পুরো বিষয়টা বোঝাতে। প্রাচী মাথা নাড়াল, ‘ বোঝাচ্ছি ‘ নিশ্চিন্ত মনে ড্রাইভ শুরু করল সৌধ। প্রাচী বলল,

‘ আসলে রাতে সুহাস জানিয়েছে সকালে আংকেল আমাদের দাওয়াত করবে। আমরা যেন চলে যাই। ‘

‘ দাওয়াত না পাওয়ার আগেই আমরা বেরিয়েছি কেন? ‘

‘ দেখ আংকেল এখন দাওয়াত দিল। আমরা যদি ভোরেই না বের হতাম তাহলে তুই দাওয়াতটা মিস করতি। কারণ এ সময় ময়মনসিংহ গিয়ে তোকে নিয়ে আসতে আসতে বিকাল হয়ে যেত। আমরা তো জানিই আংকেল আমাদের দাওয়াত করবে। তাই আগেভাগে তোকে নিয়ে এলাম। মাঝরাস্তায় দাওয়াতও পেয়ে গেলাম। ‘

সহসা হাত তালি দিয়ে ওঠল নিধি। এরপর চোখ কটমট করে তাকাল সৌধর দিকে। দাঁত চিবিয়ে বলল,

‘ বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই ওর। ‘

স্টিয়ারিং ঘোরানোর পাশাপাশি আয়নাতে নিধির রক্তিম মুখটা দেখে নিল সৌধ। আপনমনে হাসল কিঞ্চিৎ। রেগে গেলে নিধিকে কী ভয়ানক সুন্দরই না লাগে!

‘ ঐ শ য় তান হাসছিস তুই। ছিঃ ছিঃ কোন মাত্রার ছ্যাঁচড়া তোরা? দাওয়াত না দিতেই চৌদ্দ গুষ্টি সহ বেরিয়ে পড়ছিস। ‘

বিরক্ত স্বরে আইয়াজ বলল,

‘ আহ, চিল্লাচ্ছিস কেন? আমরা তো জানি দাওয়াত পাবো। আর পেয়েও গেছি। ‘

প্রাচী দাঁত ক্যালিয়ে হাসল। সৌধ বাঁকা হেসে আপনমনে ড্রাইভ করতে লাগল। নিধি হতাশ হয়ে গা এলিয়ে দিল সিটে। উপর দিকে চোখ তুলে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,

‘ আল্লাহ তুমি বিচার করো। ‘

প্রাচী বলল,

‘ এমন করছিস কেন। দাওয়াত দেয়ার আগে রওনা দিয়েছি। পৌঁছাব তো দাওয়াত দেয়ার পরই। ‘

‘ আংকেল যদি বলে এত দ্রুত তোমরা এলে কী ভাবে? সবাই একসাথেই বা কী করে? ‘

‘ সৌধ ম্যানেজ করবে সব তুই প্যারা নিস না। ‘

‘ হ্যাঁ দুনিয়ার যত কু’কর্ম সব তো ঐ করে। আর কুবুদ্ধি দিয়ে সব সামলায়। ‘

সৌধ খোঁচা দিয়ে বলল,

‘ অহেতুক চিল্লাতে মাথা না লাগলেও এসব করতে মাথা লাগে মাথা। ‘

এ কথায় ভয়ানক ক্ষেপে গেল নিধি। চিৎকার করে বলল৷

‘ এই তুই গাড়ি থামা। যাব না আমি। ‘

সৌধ পাত্তা দিল না। বরং গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল তিনগুণ। ‘
.
.
দুপুর সাড়ে বারোটায় সুহাসের বন্ধুরা নামীদের বাড়িতে পৌঁছাল। সুহাস আর সোহান খন্দকারের সঙ্গে আলাপ শেষে নামীকে ডেকে পাঠানো হলো। সুহাসের সঙ্গে এক মগে কফি খেতে বাঁধ্য হয়েছিল নামী। এরপর থেকেই তীব্র লজ্জায় গাল দু’টো রঙিন হয়ে ওঠছে তার৷ প্রথম আলাপে বিরক্ত লাগা মানুষটার প্রতি যে সীমাহীন ভালোলাগা তৈরি হচ্ছে টের পেল সে। এই ভালোলাগা ভালোবাসায় রূপ নিতে আর কতক্ষণ? না জানি দমকা হাওয়ার মতো কখন ছুঁয়ে দেয় এ হৃদয়।

বসার ঘরে বন্ধুদের সঙ্গে সুহাস বসে। সুহাসের এক পাশে সৌধ অন্য পাশে নিধি। প্রাচী, আইয়াজ, আজিজ ওরাও কাছাকাছিই বসে। সকলেই সুহাসের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। কারণ সৌধ যখন সুহাসকে জিজ্ঞেস করল,

‘ কী বন্ধু, বিয়ে করে কেমন ফিলিংস হচ্ছে? ‘

সুহাস সঙ্গে সঙ্গে বলল,

‘ কেমন যেন সবকিছু ভাল্লাগছে দোস্ত। ‘

নিধি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ কেমন ভাল্লাগছে সেটা বল? ‘

‘ কবুল বলার পর থেকেই ওকে আমার বউ বউ লাগছে। ‘

‘ আরে গাধার হাড্ডি। ও তো তোর বউই। ‘

‘ আসলে আমি বোঝাতে পারছি না। ‘

সৌধ বলল,

‘ বোঝাতে হবে না। শুধু বল বিয়ে করতে তো রাজি ছিলি না। রাজি না থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করে কেমন লাগছে? ‘

‘ ভালো লাগছে দোস্ত। ওকে শুধু আদর করতে মন চাচ্ছে। ও অনেক লক্ষ্ণী। ‘

স্তব্ধ মুখে বসে স্থির চোখে তাকিয়ে বলা সুহাসের এহেন কথা শুনে সকলেই নিচু কণ্ঠে একসুরে বলে ওঠল,

‘ এই ও টা কে দোস্ত? ‘

সুহাস ঘোরের মাঝেই বলে দিল,

‘ তোদের ভাবি। ‘

বন্ধুরা এবার একসঙ্গেই সুর তুলল,

‘ ওওও!!! ভাবি!!! ‘

সৌধ খোঁচাও দিল সুহাসের পেটে। তৎক্ষনাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল সুহাস। সকলে মিলে এবার তাকে ক্ষেপাতে উদ্যত হতেই সহসা উপস্থিতি ঘটল নামীর। ট্রে তে ছয়টা সরবত ভর্তি গ্লাস নিয়ে এসে সালাম দিল নামী। ওরা সকলেই বিস্ময় হয়ে তাকাল নামীর দিকে। কালো রঙের সোনালি পাড়ের শাড়ি পরিহিত শ্যামবর্ণা মেয়েটিকে দেখে কেউ অপছন্দ করতে পারল না। বরং সকলেই মুগ্ধ হলো তার গোলগাল মুখশ্রীর মিষ্টি হাসিতে। টি টেবিলের ওপর ট্রে রাখল নামী৷ সৌধরা সালাম ফিরিয়েছে। নিধি ওঠে এসে নামীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ আমি নিধি, সুহাসের বান্ধবী। ‘

প্রাচী সহ বাকিরাও পরিচয় দিল৷ নামী সৌজন্যতা মিশিয়ে তাকাল, হাসল। নিধি টেনে নিয়ে সুহাসের পাশে বসিয়ে দিল তাকে। প্রাচী ড্যাবড্যাব করে বেশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

‘ সুহাসের মায়াদেবী। ‘

আইয়াজ বলল,

‘ উহুম সুহাসের সুহাসিনী। ‘

নিধি হেসে ফেলল। বলল,

‘ সুহাসের চিরকালের সঙ্গী। ‘

সৌধ নিধির দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘ সেটা আমরা সবাই জানি। উপমা দিতে না পারলে চুপচাপ থাক। ‘

চোখ রাঙাল নিধি। নামী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে। ওরা সরবত নিল। সুহাস নিজেরটা নিতে গিয়ে নামীর দিকে তাকাল। নিচু কণ্ঠে বলল,

‘ নিজের জন্য আনোনি কেন? ‘

সুহাসের নিচু কণ্ঠ বাকিরা না শুনলেও সৌধ শুনল। মিটিমিটি হাসতে থাকল সে। নামী ইতস্তত করে বলল,

‘ আমি খাব না আপনারাই খান। ‘

সুহাস নড়েচড়ে একই কণ্ঠে বলল,

‘ আমিও খাব না। ‘

‘ কিরে সুহাস এখনি ফিসফাস করিস! ‘

হঠাৎ আজিজের কথা সকলের নজর সুহাস নামীর দিকে পড়ল। নামীর শ্বাসরোধ করে বসে৷ সুহাস মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসল। কিছু জবাব দেবে এমন সময় দুম করে কারেন্ট চলে গেল। থেমে গেল অনবরত ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখা। জৈষ্ঠ্যমাসের গরম। যেন কয়েক সেকেণ্ডেই গা জ্বলে ওঠল। নামী সহসা ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘ আমাদের এদিকে এ সময় কারেন্ট খুব ডিস্টার্ব করে। আপনারা বারান্দায় এসে বসুন। প্রাকৃতিক হাওয়া পাবেন। ‘

নামীর মিষ্টি কণ্ঠের সুন্দর সমাধান পেয়ে সকলে গিয়ে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসল। চুপিসারে সৌধ সুহাসকে বলল,

‘ শাড়ি পরেছে। একান্তে কিছু প্রশংসা করিস। ‘

‘ কী প্রশংসা করব? হ’ট লাগছে? ‘

সৌধ বাঁকা হেসে বলল,

‘ এখনি এসব বলবি কেন গাধা। আগে ইমপ্রেস কর৷ একে অপরের প্রতি মুগ্ধতা বাড়া। ‘

সৌধর কথা শুনে নামীর দিকে তাকাল সুহাস৷ নামী নিধির সঙ্গে কথা বলে ওঠে যাচ্ছিল। সৌধ পুনরায় বলল,

‘ চলে যাচ্ছে ডাক দে। একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশংসা কর। ‘

‘ কেমন টাইপ সেটা বল ফাস্ট। ‘

‘ অ্যাঁই শালা, ওটাও কি আমি বলে দিব? বউ কি আমার? বিয়ে কি আমি করছি। ‘

সুহাস ভ্রু কুঁচকে তাকাল। সৌধ ত্বরিত বলল,

‘ ওকে নিয়ে দূরে দাঁড়াবি। কথাবার্তা বলবি। এরপর
মনোযোগ দিয়ে ওর দিকে তাকাবি। মন দিয়ে আগাগোড়া দেখার পর মন থেকে যা আসবে তাই বলে দিবি। যদি অনুভূতি আসে তবেই বলবি। অনুভূতি না আসলে বলার দরকার নেই। যা ট্রাই কর গিয়ে। ‘

সৌধর পরামর্শ নিয়ে নামীকে ডাকল সুহাস। সবার সামনে ডাকাতে লজ্জা বাড়ল নামীর। তবুও এগিয়ে এলো। ভরদুপুরে বাইরে কড়া রোদ। তাই বিশাল বারান্দার ওপাশে গিয়ে দাঁড়াল সুহাস। কয়েক মুহুর্ত পরই নামী এসে পাশে দাঁড়াল। সৌধর কথানুযায়ী সুহাস মনোযোগ দিয়ে তাকাল নামীর দিকে। অতি সাধারণ ভাবেই দাঁড়িয়ে নামী। শ্যামলা মুখের টানা টানা মায়াবি চোখ দু’টোতে শুধু গাঢ় করে কাজলের প্রলেপ লাগানো। কাজল কালো ঐ আঁখি যুগলেই হারাতে বাধ্য হলো সুহাস। বুঝে ওঠতে পারল না এত অল্প সময়ে তার বক্ষঃস্থলে সুক্ষ্ম টান পড়ে কেন? অরিনের জন্যও তো কখনো এমন অনুভূতি হয়নি।
নামীর মুখে কী আছে এমন? এই চোখ দু’টোতে কী জাদু আছে? এমন লাগছে কেন? কেন হচ্ছে এমন অনুভূতিতে সিক্ত? কোন দৈববলে এত অল্প সময়ে এই গভীর অনুভূতির সৃষ্টি ? নামী তাকিয়ে আছে সুহাসের দিকে। সুহাস কী তাকে জরুরি কিছু বলতে ডাকল? কী ভাবছে এত? কী বলবে? খুব দরকারি কিছু কী? নামীর বুকের ভেতর অজানা ভয়ে কাঁপতে শুরু করল। সরল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনিমেষে। যেই দৃষ্টিতে ভয়ানক ভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ল সুহাস৷
আচম্বিতে তার বুকের গহীন বন থেকে বেরিয়ে এলো এক নৈসর্গিক বাক্য,
‘ সুহাসিনী, দ্বিপ্রহরের রৌদ্রোকজ্জ্বল এই ক্ষণে কাজল রঙে আবৃত তোমার মায়াবিষ্ট আঁখি যুগলেই কি হলো আমার মরণ? ‘

চলবে…
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৪

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪

ঘড়ির কাটা সকাল সাতটা পনেরো ছুঁয়েছে৷ এরই মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া এসে পৌঁছাল সৌধরা। সৌধ ড্রাইভ করার ফাঁকে ফ্রন্ট মিররে দেখে নিল, বান্ধবী প্রাচী ঘুমাচ্ছে। পাশে বসে বই পড়ছে চৌকশ স্টুডেন্ট আইয়াজ। সৌধর মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। আইয়াজের উদ্দেশ্যে বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ এই শালা মনে হয় টয়লেটে বসে বসেও পড়ে! ‘

একরাশ বিরক্তি এসে ভর করল ওর চোখে মুখে৷ পাশের সিটে বসে থাকা বন্ধু আজিজ হেডফোন কানে গুঁজে গান শুনছে। তার দিকে তাকিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলল,

‘ আজিজ, প্রাচীকে ডাক দে। ফুলবাড়ীয়ায় ঢুকেছি আমরা। ‘

গাড়ির স্পিড কমে এসেছে। আজিজ সৌধর কথা অল্প শুনে হেডফোন গলায় নামাল। জিজ্ঞেস করল,

‘ কী বললি? ‘

‘ ফুলবাড়ীয়া ঢুকেছি। নিধির বাড়ি কোথায় আমি জানি না। জানলেও তো লাভ নেই৷ সে তো আর তার বাড়িতে আমাদের পা মারাতে দেবে না। তার বাড়ি স্বর্গ কিনা? আর আমরা তো নরকের কীট! ‘

সৌধের কণ্ঠে যেন ক্ষোভ উপচে পড়ল। আজিজ বোকা ভাবে হেসে দিয়ে বলল,

‘ অযথা রাগছিস। ওর পরিবার অন্যরকম। জানিসই তো। তোর, আমার পরিবারে যেটা স্বাভাবিক ওর পরিবারে সেটা প্রচণ্ড অস্বাভাবিক। আমার দেখা সকল মধ্যবিত্ত পরিবারই এমনরে। ‘

‘ ধূরর বাদ দে। নিধিই বেশি ভয় পায়। যাকগে এখন প্রাচীকে ডাক। ‘

আজিজ আইয়াজকে বলল,

‘ কীরে ডাক্তার নানা, এবার তো বইটা বন্ধ কর। আমরা পৌঁছে গেছি। ‘

নাকের ডগায় আসা মোটা কালো ফ্রেমের চশমাটা উপরে তুলল আইয়াজ। এরপর গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ পৌঁছে গেছি! ‘

বিস্ময় প্রকাশের সঙ্গে পাশে বেঘোরে ঘুমানো প্রাচীকে ডাকতে শুরু করল সে৷ ধনবাড়ি ছাড়ার পর থেকেই ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। আইয়াজের মৃদু স্বরের ডাকে আড়মোড়া ভেঙে ওঠে বসল প্রাচী৷ হাই তুলতে তুলতে বলল,

‘ এত দ্রুত এসে গেছি! ‘

আজিজ বলল,

‘ দ্রুত কই তুই ঘুমুচ্ছিলি বলে সময়টা কম মনে হচ্ছে।’

সহসা প্রাচী বলে ওঠল,

‘ কাছাকাছিই এসে গেছি। আরেকটু সামনেই নিধির বাড়ি। ‘

সৌধ আচমকা ব্রেক কষলো। প্রাচী তার এলেমেলো চুলগুলো হাত খোপা করে নিয়ে পুনরায় বলল,

‘ এখানে থামলি কেন? এখানে না, আরেকটু সামনে গিয়ে থামা। সামনেই দেখবি ছোটো একটা বাজার, কয়েকটা চা স্টলও আছে। ওখানেই বসবি তোরা। ‘

সৌধ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে। আইয়াজ বই বন্ধ করে ব্যাগে ঢুকাল। আজিজ বলল,

‘ তুই একা চিনবি? ‘

‘ কেন চিনব না কেন? এর আগে দুবার এসেছি না? ‘

সৌধ গাড়ি স্টার্ট করে প্রাচীকে বলল,

‘ রেডি হয়েছে কিনা শোন। ‘

মাথা দুলিয়ে হাই তুলতে তুলতে নিধিকে কল করল প্রাচী৷ বেশ রাত করে ঘুমিয়েছিল সে। কে জানত রাত সাড়ে তিনটায় সৌধ ফোন করে সুহাসের বিয়ের দাওয়াত দেবে! সুহাসটার সঙ্গে কীভাবে কী ঘটে গেল। এই নিয়ে বিস্ময়, আতঙ্ক জেগেছে সকলের মনে৷ সেই বিস্ময়, আতঙ্ক মেটাতেই এভাবে ছুটছে ওরা৷ আজিজ হোস্টেলেই ছিল। আইয়াজের বাড়ি ঢাকার মোহাম্মদ পুরে। সেখান থেকেই ছুটে এসেছে সে৷ সৌধ, সুহাস টাঙ্গাইল শহরে স্থানীয়। জন্মদিনে বড়ো ভাইয়ের গিফট করা প্রিয় গাড়িটা নিয়ে ভোর রাতেই বেরিয়ে পরেছে সৌধ। প্রথমে বাসস্ট্যান্ড থেকে আইয়াজ, আজিজকে তুলেছে। এরপর ধনবাড়ি গিয়ে তুলেছে প্রাচীকে। তার বাবা, মায়ের অনুমতি ফোন কলেই নিয়েছে সৌধ। প্রাচীর বাবা প্রবাসী। পরমব্রত পালকে কল করেছিল সে। সৌধকে বেশ ভালো করেই চেনেন পরমব্রত পাল। দু’টো উপজেলার বর্তমান এমপি সুজা চৌধুরীকে কে না চেনে? সুজা চৌধুরীর ছোটো ছেলে সৌধ। এ খবর কে না জানে? এছাড়া সৌধর বন্ধু মহল সম্পর্কেও সকলে অবগত। সুহাস, সৌধের দাপটেই প্রাচী, নিধি সহ তাদের বাকি সব বন্ধুরা শহরে এবং কলেজ ক্যাম্পাসে নিশ্চিতভাবে চলাফেরা করতে পারে। সবদিক বিবেচনায় পরমব্রত পাল অমত করেননি। মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বন্ধুদের সঙ্গে। আলাদা ধর্মানুসারী প্রাচী খুবই মিশুক প্রকৃতির একটি মেয়ে। দু’বছরের বন্ধুত্বে কোনোদিন এক মুহুর্তের জন্যও কারো মনে হয়নি সে আলাদা ধর্মের। বরং অন্যদের তুলনায় তাকেই সবচেয়ে আপন মনে হয়েছে। যে কোনো কঠিন পরিস্থিতি মুহুর্তেই সহজ হয়ে যায় এই মেয়েটার জন্য। বন্ধুদের মাঝে ভয়াবহ ঝামেলা লেগে গেলে এই মেয়েটা ঠাণ্ডা মাথায় ঝামেলা মেটায়। সকলের পাশে রয় বিনা সংকোচে। ইদের সময় প্রতিটি বন্ধু, বান্ধবীকে উপহার দেয় সে। এছাড়া প্রতি ইদে প্রিয় বন্ধু সুহাস, সৌধদের বাড়িতে বেড়াতেও আসে। ওদের সকলের সুখ, দুঃখের বান্ধবী প্রাচী। যার জীবনে কোনো সমস্যা নেই আছে শুধুই সমাধান। এই যেমন, গত এক বছর যাবৎ সৌধ গোপনে গোপনে নিধির প্রতি তীব্র প্রণয়ে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রণয় একতরফা। তার সে গোপন অনুভূতি সুহাসের পর জানে শুধুই প্রাচী।

ছুটি পড়ে যাওয়ায় নিধিকে গুটি কয়েকদিন দেখতে পায়নি সৌধ। ফলশ্রুতিতে তার বুকের ভেতর অস্থিরতারা থইথই করছে৷ সেই অস্থিরতা কমাতেই আজ এভাবে ছুটে আসা। সুহাসের বিয়ের খবর শুনে নিধি নিশ্চয়ই চুপ থাকবে না৷ ছুটি কাটানোর কথা ভুলে গিয়ে অবশ্যই তাদের সঙ্গে সুহাসের বউ দেখতে আগ্রহী হয়ে পড়বে। আর সেই আগ্রহের সুযোগটাই সৌধ নিয়ে নিল। সে একা নিধিকে আনতে গেলে নিধি আসত না৷ তার পরিবার বেশ কঠিন কিনা। তাই বুদ্ধি করে ঘনিষ্ঠদের মধ্যে আইয়াজ, আজিজকে ধরে এনেছে। এতেও মেয়েটা জটিলতা বাড়াল। বলল,

‘ দেখ সৌধ, আমার বাবা খুব শক্ত ধাঁচের মানুষ। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের মেলামেশা একদম পছন্দ করেন না৷ তবুও আমার ছেলে বন্ধু আছে জানেন। কিন্তু সেই বন্ধু বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসা সে সহজভাবে দেখবেন না৷ জানিস তো, আমি কত যুদ্ধ করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। এখনো বার বার পরিবার থেকে বাঁধা পাই৷ বিয়ে নিয়েও অশান্তি চলে৷ এর ওপর তুই বা তোরা যদি বাড়ি আসিস। যতই সুহাসের বিয়ের দাওয়াতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসিস না কেন৷ এটা নিয়ে দশকথা হবে। আমার চাচারাও খুব কঠিন মানুষ। বাবাকে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দেবে। এমনও হতে পারে একটা পাত্র ধরে বিয়েও দিয়ে দেবে। ‘

নিধির এত এত সমস্যা নিয়ে বিরক্তিতে গা গুলাচ্ছিল সৌধর৷ কিন্তু যখন শেষ কথাটা বলল, বুকের মধ্যস্থে আঘাত পেল খুব। আর কিছু বলতে পারল না সে৷ তারপর অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, একটু কষ্ট হলে হোক প্রাচীকে নিয়ে যাবে তারা। নিধির বাড়িতেও শুধু প্রাচী যাবে। ওর পরিবারকে ম্যানেজ করে বাড়ি থেকে বের করে আনবে। এরপর বাকিটা খুব সহজেই সামলে নেয়া যাবে।

তিন বন্ধুর পঁচিশ মিনিট অপেক্ষার অবসান ঘটল। প্রাচী আর নিধিকে দেখেই আইয়াজ গিয়ে গাড়িতে বসল৷ আজিজ তখন থেকে সৌধকে খোঁচাচ্ছিল,

‘ দোস্ত একটা খাই? দোস্ত একটা ব্যস একটাই। ‘

সৌধ জানে আড়ালে আজিজ সিগারেট খায়। শুধু তাদের সামনেই সাধু সাজার চেষ্টা করে অনুমতি চায়। সৌধ এসব একদম পছন্দ করে না। করার কোথাও নয়। আগামী প্রজন্মদের নাগরিকদের সুস্থতা তো তাদেরই নিশ্চিত করতে হবে৷ ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষরা অসুস্থ হয়ে তাদের সাহায্য নিতে আসবে। দেখা গেল তাদের দ্বারাই অসুস্থ ব্যক্তিদের জ্ঞান প্রদান করা হবে। ‘ ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD) এমফাইসিমা ও ক্রনিক ব্রংকাইটিস সহ, ক্যান্সার বিশেষত ফুসফুসের ক্যান্সার, প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার, ল্যারিংস ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার এর ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। ‘ এরকম এক গাদা জ্ঞান দিয়ে রোগির জন্য ধূমপান হারাম করে দেয়া হবে। সেখানে তারাই যদি এসব করে রোগিরা তাদের জ্ঞান গ্রহণ করবে? যদিও রোগিরা জানবে না তারা সিগারেট খায় কিনা। তবুও বিবেক বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে৷ যা থেকে নিজেরা নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারবে না তা থেকে অন্যকে নিয়ন্ত্রণ থাকার পরামর্শ দেয়া তো অন্যায় হবে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সৌধ। প্রাচী আর নিধিকে আসতে দেখে চোখ কটমট করে আজিজের দিকে তাকাল। বলল,

‘ অনুমতি চাস ক্যান ব্যাটা। কন্ট্রোল না করতে পারলে দূরে গিয়ে চুষে আয় যাহ। মরে গেলেও অনুমতি পাবি না। ‘

কথাটা বলেই গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল সে। আজিজ নিরীহ লোকের মতো ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে গাড়িতে ওঠে বসল। মনে মনে ভাবল, কন্ট্রোল করতে পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। সে তো আর নেশাখোর নয়। শখের বশে মাঝেমধ্যে খায় এই আর কি৷ ভেবেই সৌধের গম্ভীর মুখটায় তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ তোর মেজাজ একটু বেশিই খিঁচে আছে আজ। ‘

সৌধ নির্বিকার ভঙ্গিতে এক পলক তাকাল। আজিজ জানালা দিয়ে মাথা বের করে নিধি, প্রাচীর উদ্দেশ্যে বলল,

‘ বইনেরা একটু স্পিডে হাঁটেন। ‘

নিধি চড়া গলায় বলল,

‘ ভাইয়েরা ধৈর্য বাড়িয়ে অভ্যাস করুন৷ সারাজীবন বউদের জন্য তো এভাবেই অপেক্ষা করতে হবে। শপিংয়ে বেরোলে, শশুর বাড়ি গেলে বা অন্য কোথায় বেড়াতে গেলে। ‘

আজিজ মৃদু হেসে মাথা ভেতরে ঢুকাল। ততক্ষণে নিধি, প্রাচী এসে পড়েছে। নিধি এসেই গাড়ির জানালা দিয়ে হাত ঢুকাল। আইয়াজের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

‘ কীরে ভাই, তোর সিলেবাস শেষ? ‘

আইয়াজ ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,

‘ নারে আরেকটু বাকি৷ তোর কী অবস্থা? ‘

‘ আমারো সেমরে দোস্ত। ‘

আজিজ ফিসফিস করে সৌধকে বলল,

‘ হয়ে গেল। এই দুইটা একসাথে হলেই হইছে। জ্বালাই ফালায় একদম। খালি পড়া পড়া আর পড়া৷ এদের জীবনে আর কিছু নাই। ‘

সৌধর গম্ভীর মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে গেল। তাদের বন্ধু মহলে সবচেয়ে পড়ুয়া স্টুডেন্ট আইয়াজ আর নিধি৷ দু’টোর সম্পর্কও বন্ধুর চেয়ে ভাইবোন বেশি। ওদের একে অপরের প্রতি আলাদা দরদ আছে। নিধি আইয়াজকে নিজের ভাইয়ের মতোই ভালোবাসে। আইয়াজও বোনের চেয়ে কম দেখে না নিধিকে। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল সৌধ। আপাতত তার মেজাজ ভালো নেই। সেটা নিধিকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য খেঁকিয়ে বলে ওঠল,

‘ এখানে আমরা পড়াশোনা নিয়ে ডিসকাস করতে আসছি? ‘

প্রাচী ত্বরিত গাড়ির ভেতরে ঢুকল। নিধি হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে এগিয়ে গেল সামনে। ড্রাইভিং সিটে বসা সৌধের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পাপড়ি ঝাপটাল কতক্ষণ। এরপর মাথা একটু নিচু করে বলল,

‘ কীইরে ভাইই, ষাঁড়ের মতো খেঁকাচ্ছিস কেন? ও মা মুখটা এত গম্ভীর কেন? কী রাগি লুক নিয়ে বসে আছিসরে সৌধ! ‘

সৌধ ভেবেছিল নিধির দিকে আপাতত তাকাবে না। আর না বলবে কথা৷ কিন্তু নিধির বলা টানা সুরে কীইরে ভাইই শুনে কানটাই গরম হয়ে গেল। শক্ত চোখে তাকাল শক্ত কিছু কথা বলতে। নিধি ওর ফর্সা মুখের অল্প দাঁড়ির শক্ত চোয়াল দেখে নিমিষে দমে গেল। ঈষৎ হেসে বলল,

‘ সরি সরি, তোর বোধহয় মেজাজ ঠিক নেই। বসছি আমি। পরে কথা বলব। ‘

সৌধর আর শক্ত কথা বলা হলো না। ফর্সা দেহের হার্ট আকৃতির মুখ, বাদামী বর্ণের এক জোড়া চোখ, মাঝারি আকৃতি বিশিষ্ট সুন্দর নাক আর হালকা গোলাপি রাঙা ফোলা ঠোঁটজোড়া দেখেই তার সমস্ত রাগ পানি হয়ে মাটির সাথে মিশে গেল। বুকজুড়ে বয়ে গেল প্রশান্তিদায়ক হাওয়া। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল সে। নিধি ধীরস্থির ভাবে গাড়িতে ওঠতে উদ্যত হয়েছে। আচমকা তার গাড়িটির দিকে খেয়াল হলো। বিস্ময় ভরে পুনরায় চলে এলো সৌধর কাছাকাছি। বলল,

‘ কীইরে সৌধ, নতুন গাড়ি নাকি? ‘

মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়াতে মৃদু হাসল সৌধ। পলকহীন তাকিয়ে বলল,

‘ বড়ো ভাইয়ের গিফট। বলেছিলাম তোকে। ‘

হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে নিধি বলল,

‘ ওওও ঐটা। বাহ কি সুন্দর রে। টয়োটা প্রিমিও? ‘

গাড়ির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল নিধি। সৌধ বলল,

‘ হ্যাঁ। গাড়িতে ওঠ দেরি হয়ে যাচ্ছে। ‘

নিধির সবচেয়ে ভালো লাগছিল গাড়ির রঙটা৷ নেভি ব্লু কালার টয়োটা প্রিমিও গাড়ি! আহা সৌধর আর সৌধর পরিবারের কাছে গাড়ি যেন দুধভাতের মতোই। ভাবতে ভাবতে ওঠে বসল সে। বলল,

‘ ড্রাইভার সাহেব, গাড়ি স্টার্ট করতে পারেন। ‘

নিধির এহেন কথায় সকলে হো হো করে হেসে ওঠল। ফ্রন্ট মিররে নিধির হাসিটুকুও সন্তর্পণে দেখে নিল সৌধ। এরপর আপন মনে ড্রাইভ করতে লাগল সে। গাড়িতে পুরোদমে হইচই লেগে গেছে। যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে বন্ধুরা৷ সুহাসকে অবশ্য মিস করছিল ওরা। তখন প্রাচী বলল,

‘ আরে আমরা তো ওর কাছেই যাচ্ছি। বাছাধন যে সিঙ্গেল থেকে মিঙ্গেল হয়ে গেল রে। ‘

নিধি এ কথায় সৌধর দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। বলল,

‘ শুনলাম আমাদের ড্রাইভার সাহেব নাকি সুহাসের প্রক্সি দিতে চেয়েছিল! ‘

হকচকিয়ে গেল সৌধ। চোখ কটমট করে তাকাল আইয়াজের দিকে। আইয়াজ চোরা চোখে এক পলক সৌধকে দেখে নিয়ে বইয়ের পাতায় মন দিল। সৌধ দাপুটে স্বরে বলল,

‘ তোকে ঐ গ্রুপে রাখিনি। ওটা আমাদের ব্যক্তিগত গ্রুপ। ওখানের কথা কোন লজ্জায় শুনিস তুই? ‘

ক্ষেপে গেল নিধি৷ বলল,

‘ ঐ ঐ আমি মোটেই শুনতে যাইনি। আইয়াজ যেচেই বলেছে। ভাগ্যিস বলেছে নয়তো জানতেই পারতাম না। তোর বিয়ের প্রতি এত ঝোঁক। স্মৃতি আপুকে বলতে হবে বিষয়টা। ‘

স্মৃতি সৌধের বড়ো বোন। যার সঙ্গে নিধির সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ। প্রায়ই ম্যাসেন্জারে কথা হয় দু’জনের। এ পর্যন্ত দু’বার দেখা হয়েছে। সৌধই নিয়ে এসেছিল ক্যাম্পাসে। বন্ধুরা শুনেছিল বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধ স্মরণে রেখেই সুজা আংকেল দ্বিতীয় সন্তানের নাম স্মৃতি আর ছোটো সন্তানের নাম সৌধ রেখেছেন৷ যাইহোক, স্মৃতি আপুর কাছে নালিশ জানাবে নিধি৷ শুনতেই প্রাচী ঠোঁট টিপে হাসল। এদিকে সৌধের গরম গরম চোখ দেখে নিধি বলল,

‘ আরে ড্রাইভার সাহেব ড্রাইভিংয়ে মন দিন। পেছনের সুন্দরীদের দিকে নজর পরে দিয়েন। ‘

সৌধ ফ্রন্ট মিররে তাকিয়ে নিধিকে উত্তর দিল,

‘ গাড়ির মালিককে মালিক বলতে শেখ। ড্রাইভার কীরে? বেয়াদব মেয়ে। ‘

নিধি ভেঙচিয়ে বলল,

‘ তোর দশ বিশটা গাড়ি হয়ে গেলেও তুই আমার কাছে মালিক হতে পারবি না। ড্রাইভারই থেকে যাবি।’

বাঁকা হাসল সৌধ। বিড়বিড় করে বলল,

‘ ব্যক্তিগত ড্রাইভার বানালে অসুবিধা নেই। ‘

পেছন থেকে চ্যাঁচিয়ে ওঠল নিধি,

‘ এ ভাইই, গালি দিলি নাকি? ‘

সৌধর মেজাজ আবারো খারাপ হলো। এই মেয়ে ওঠতে বসতে ভাই ভাই চিল্লায় কেন? আল্লাহ মালুম!
.
.
আলিয়া খাতুন নামীকে শাড়ি পরতে বললেন৷ অন্য কেউ বললে নামী শাড়ি পরত৷ সৎ মাকে সে একদমই পছন্দ করে না। তাকে দেখলেই মনে হয় এই মহিলাটি তার মায়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে। তাই শাড়ি পরতে বলায় জেদ করেই পড়ল না। সেলোয়ার-কামিজ পরেই ঘুরাফেরা করতে লাগল৷ একটু পরেই চাচি এসে খবর দিল, সুহাসের কিছু বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করা হয়েছে। তারা এখন রাস্তায়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।

সুহাস ঘুম থেকে ওঠল সকাল দশটায়। দাদি এসে নামীকে বলল তার জন্য কফি বানাতে। আর নিজে গিয়েই দিয়ে আসতে৷ এ কথা শুনে নামীর শ্যামলাটে মুখটা আরক্ত হয়ে ওঠল৷ শ্বাস-প্রশ্বাস পরিণত হলো ঘন থেকেও ঘনত্বে৷ মনে পড়ে গেল গতরাতের সেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থাটুকুর কথা। ছেলেটা কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। উহুম অস্বাভাবিক নয়। প্রতিটি স্বামীরই বোধহয় প্রথমবার স্ত্রীকে কাছে পেলে এমন অবস্থা হয়৷ ভাগ্যিস আচমকা সুহাসের ফোনটা বেজে ওঠেছিল। যতই তিন কবুল পড়ে বিয়ে হোক৷ এত অল্প সময়ে অমন কাছাকাছি আসাটা তার জন্য স্বস্তি দায়ক নয়। সুহাস ছেলে মানুষ। শহুরে ছেলে৷ অনেক বেশি স্মার্ট। সে হয়তো অল্পতে অনেকটাই মিশে যেতে পারে৷ কিন্তু তার তো সময় লাগবে৷ হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী৷ কফি বানাতে বানাতে বার বার মনে পড়ল রাতের দুর্ধর্ষ মুহুর্তটুকুই।

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে সুহাস৷ সৌধরা কোন পর্যন্ত জানতে ফোন করেছিল মাত্রই। ওদের খবর নিয়ে এবার হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকল। অরিনের অহরহ ম্যাসেজ এসেছে। মেজাজ খিঁচে গেল মুহুর্তেই।
গতরাতে নামী এসেছিল তার কাছে৷ দু’জন মিলে একান্তে কাটিয়েছে কিছু সময়৷ গল্প করেছে পড়াশোনা নিয়ে। এরপর রোমান্টিক মুহুর্ত তৈরি করেছিল৷ স্বামী হিসেবে মেয়েটার থেকে অনুমতিও নিয়েছিল। বলেছিল,

‘ নামী, আমরা একে অপরের পূর্ব পরিচিত নই। পরিচয় হবার আগেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলাম। এবার আমাদের জানাশোনা ধীরেধীরে হবে। তোমার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। আমি সিওর, আমার প্রতিও তুমি খুব একটা আগ্রহী নও। এর ওপর তখনকার ঘটনায় কিছুটা নেগেটিভ ভাবনাও এসেছে। এসব তো দূর করা প্রয়োজন। তাছাড়া বিয়ের প্রথম রাতে বউকে কিছু না কিছু দিতে হয়। আমি সঙ্গে তেমন কিছুই আনিনি৷ আপাতত প্রথম ভালোবাসার কিছু স্পর্শ ছাড়া কিছুই দিতে পারব না। আমি তোমাকে হলফ করে বলতে পারি, আমি তোমাকে যা দিতে চাই৷ তুমি যদি স্বামী হিসেবে মান্য করে তা গ্রহণ করো। এ জীবনে তোমার পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার হবে এটা। ‘

নামী বুঝেছিল তার কথার মানে। তাই বলেছিল,

‘ এতে তো ভালোবাসা থাকবে না। ‘

সে বলেছিল,

‘ অনুভূতি থাকবে। ভালোবাসার সূচনাটা এখান থেকেই হবে। সাইন্সের স্টুডেন্ট তো? মনের স্পর্শ যেমন দেহ পর্যন্ত নিয়ে যায়, দেহের স্পর্শও মন অবধি পৌঁছায় জানো? ‘

নামী উত্তর করেনি। লজ্জায় মস্তক নত করেছে শুধু।

এরপর সব ঠিকঠাকই ছিল। অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছিল দু’জন! একে-অপরের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছিল মুখে। নামীর শ্যামলা মুখটাও তীব্র লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠেছিল। শ্যামলাটে গোলাকৃতি মুখটার লাল আভা সুহাসকে আচমকাই মাতাল করে তুলেছিল৷ সে নামীর চোখা নাকটায় নিজের নাক ছোঁয়াতেই তীব্র আড়ষ্টতা নিয়ে ঘন পাপড়ি বিশিষ্ট চোখজোড়া বন্ধ করে নেয় নামী। তিরতির করে কাঁপতে থাকে ওর পাতলা মসৃণ ওষ্ঠজোড়া দেখে সুহাসের ভীষণ মায়া হয়৷ ফিসফিসানো কণ্ঠে শুধায়,

‘ সত্যিই তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল না? ‘

নামী আড়ষ্টতা নিয়ে মাথা দুদিকে নাড়ায়৷ আচম্বিতে বুকজুড়ে সুখের ঢেউ খেলে সুহাসের। দু’হাতে নামীর নরম কপোলদ্বয় আবদ্ধ করে নেয়। নিজের গোলাপি রঙা পুরু ঠোঁটজোড়া এগোয় অধর চুম্বনের জন্য৷ ঠোঁটের খুব কাছে সুহাসের উষ্ণ নিঃশ্বাস পেতেই নামীর কাঁপাকাঁপি বেড়ে যায়। দু-হাতে বিছানায় চাদর খামচে ধরে সে৷ সুহাস টের পায়৷ অবিশ্বাস্য সুরে প্রশ্ন করে,

‘ সিরিয়াসলি আমিই প্রথম এভাবে স্পর্শ করছি তোমায়? ‘

নামী মাথা দুলায়৷ সুহাস খেয়াল করে নামীর বদ্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। যা দেখে হতবাক হয়ে পড়ে সে। নামীর স্বচ্ছতা, পবিত্রতা মুগ্ধ করে দেয় ওকে। তীব্র সম্মানবোধ জাগ্রত হয়। গর্বে বুক ভরে ওঠে। মুখটা কিঞ্চিৎ উঁচুতে নিয়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় ছোট্ট ললাটে। সহসা চোখ খুলে নামী। অদ্ভুত ভালোলাগায় সুহাসের মুখাবয়ে চেয়ে রয়। সে চাউনি দেখে সুহাস নরম স্বরে বলে,

‘ অভিজ্ঞতা নেই তো, লিপ কিস করব? ‘

নামী চোখ নামিয়ে নেয়। নিঃশ্বাস ফেলে ভারিক্কি। সুহাস মৃদু হাসে। ভাবে দু’জোড়া ঠোঁট খুব কয়েক সেকেণ্ডের জন্য একবারি এক করবে। প্রথম স্পর্শে শিহরণ জাগাবে নামীর দেহ, মনে। এরপর দু’চোখ ভরে বউটির লজ্জা দেখবে। সাক্ষী হবে উত্তাল নিঃশ্বাসের। সুহাসের মনে হলো এটিই যেন স্বর্গীয় সুখ। যে সুখের খোঁজ এতদিন পায়নি সে। আজ পেয়ে উপলব্ধি করছে এতদিন সে নরককেই স্বর্গ ভেবে বসেছিল। সবকিছু তুচ্ছ করে এক নামীতে মত্ত হতে চাইল সে। চোখ খিঁচে শক্ত হাতে নামী যখন তার শার্ট খামচে ধরল। সে যখন দুইজোড়া ঠোঁটের একত্রিত করণে উন্মত্ত হতে উদ্যত হলো। সারা ঘর জুড়ে হলো দুইজোড়া হৃদয়ের উত্তাল নিঃশ্বাসের ছড়াছড়ি। ঠিক সে মুহুর্তেই বিকট শব্দে বেজে ওঠল সুহাসের ফোন। স্ক্রিনে অরিন নামটা দেখেই আঁতকে ওঠল সে। আচমকা চোখ খুলে শুষ্ক মুখে তাকানো নামীকে দেখে ঢোক গিলল৷ ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ আমার বন্ধু কল করেছে। কথা বলে আসি? ‘

নামী মাথা কাৎ করতেই সে বাইরে চলে যায়। কথা শেষে এসে দেখে নামী নেই। রাত তখন বারোটা ছুঁয়েছে বলে সেও অবসন্ন মনে শুয়ে পড়ে। সবটা পরিষ্কার মনে পড়তে থাকে সুহাসের আর বাড়তে থাকে রাগ। এক পর্যায়ে রাগটা এতই বেড়ে যায় যে, অরিনের কোনো ম্যাসেজেরই উত্তর না দিয়ে সোজা ব্লক করে দেয়। এরপর নিঃশ্বাস ছাড়ে স্বস্তি ভরে।

সহসা দরজায় টোকা পড়লে ভাবুক সুহাস চমকে ওঠে।

‘ আসব? ‘

আচমকা ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সুহাস। নামীকে দেখে চওড়া হাসি টানল ঠোঁটে। ত্বরিত কণ্ঠে বলল,

‘ ইয়েস কাম। ‘

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০৩

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩

বন্ধুদ্বয়ের সাথে কথোপকথনের সমাপ্তি ঘটেছে অনেকক্ষণ। নামীদের বাড়ির দোতলার বারান্দায় চনমনে চিত্তে বসে আছে সুহাস। ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নাম্বার জ্বলজ্বল করছে। সে অশান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। দু’বার কল করল মাকে। দু’বারই ফোন বন্ধ শোনাল। এরপর কিয়ৎকাল ভেবে কল করল ছোটো বোন সিমরানকে। তার ফোনও বন্ধ বলছে। মা আর বোন কক্সবাজার বেড়াতে গেছে। হয়তো নেটওয়ার্ক সমস্যা তাই কল ঢুকছে না। বুঝল সুহাস। তবুও একটু পর পর চেষ্টা করে গেল। একবার না একবার নিশ্চয়ই ঢুকবে। এদিকে কক্সবাজার সমুদ্র পাড়ে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে সিমরান। মাকে ছবি তুলে দিতে দিতে অস্থির সে। এবার নিজের হেয়ার স্টাইল ঠিক করে পরিপাটি হয়ে নিল। নেকি কণ্ঠে মাকে বলল,

‘ আম্মু, এবার ফটাফট আমাকে ছবি তুলে দাও তো। তুমি অনেক তুলেছ এবার আমার পালা। সূর্যাস্তের সময় কিন্তু ঐ ছবিটা ওঠব৷ একদম ব্রোর স্টাইলে। ওকে গিয়ে দেখাতে হবে না? ‘

শেষ বাক্যটি বেশ অহমিকার সঙ্গে বলল সে।উদয়িনী মুচকি হেসে বলল,

‘ ওকে বেবি। ‘

সিমরান মায়ের হাতে ফোন দিতে উদ্যত হলো। উদয়িনী বলল,

‘ ওয়েট বাবু, হাতা গুটিয়ে নিই। ‘

উদয়িনী তার পরিহিত শার্টের হাতা গোটাতে শুরু করল। মায়ের পরনে নীল রঙা লেডিস শার্ট, শুভ্র রঙা প্যান্ট। সঙ্গে মিলিয়ে শুভ্র রঙা স্কার্ফ গলায় প্যাঁচানো। সাতচল্লিশ বছর বয়সী আধুনিকা ডক্টর মায়ের বেশভূষা দেখে বরাবরের মতোই মুগ্ধ হলো সিমরান। মা মেয়ে আজ একই বেশে বেরিয়েছে। এটা তাদের পূর্ব পরিকল্পনাই ছিল। দুজনের বেশভূষা এক হলেও পার্থক্য রয়েছে চুলের কালারে। সিমরানের চুল ঈষৎ রক্তিম৷ যদিও এটা কৃত্রিম কালার। আর উদয়িনীর চুলগুলো স্বাভাবিকের ন্যায় কালোই। সিমরান মনে মনে ভাবল, মাকেও চুল কালার করে দিতে হবে। উচিৎ ছিল বেড়াতে আসার আগেই এটা করা। তখন খেয়াল করা হয়নি। এখন হয়েছে। তাই বাড়ি ফিরেই মাকে নিয়ে পার্লার ছুটবে সে৷ মনে মনে ভাবনাটি ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হঠাৎ চমকে ওঠল ফোনের রিংটোনে। তার ব্রো অর্থাৎ সুহাস ফোন করেছে। ভ্রু কুঁচকে কল কেটে দিল সে। বোঝাল সে এবং মা মহা ব্যস্ত। মনে মনে ভেঙচিও কাটল৷ এদিকে বারকয়েক ফোন বন্ধ শোনার পর যাও একবার কল ঢুকেছে। সে কলটাও কেটে দিল সিমরান? মেজাজ খারাপ হলো সুহাসের। ত্বরিত ম্যাসেজ করল,

‘ পিচ্চি, আমি কি তোর সৎ ভাই? নাকি তোরা মা, মেয়ে মিলে আমাকে তেজ্য করে দিয়েছিস। ফোন ধর বেয়াদব! ‘

প্রথম বাক্যগুলো পড়ে পৈশাচিক আনন্দ পেলেও শেষে ধমক খেয়ে চটে গেল সিমরান। এতক্ষণ নেটওয়ার্ক সমস্যার জন্য ফোন বন্ধ শোনাচ্ছিল। এবারে ভাইয়ের ওপর চটে গিয়ে এরোপ্লেইন মোড করে রাখল ফোন। সুহাস মা, বোন কাউকেই আর ফোনে পেল না। অবসন্ন বদনে কেবল স্বরণ করল বোনের এহেন আচরণের রহস্য।

সিমরানের এসএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সুহাস তার বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজার আর সেন্ট মার্টিনে গিয়ে ঘুরে এসেছে। এই নিয়ে সিমরানের সে কী মন খারাপ হয়েছিল। ভাইয়ের সঙ্গে দু’দিন কথা পর্যন্ত বলেনি। সে কষ্ট করে দিন রাত জেগে পড়াশোনা করছে। আর তার ভাই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। এটা কী কোনো আদর্শ ভাইয়ের লক্ষণ হতে পারে? কখনোই না৷ অথচ সে সব সময় সবার কাছে বলে বেড়ায় তার ভাই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ভাই। বোনের সেই রাগ, অভিমান সুহাস একা ভাঙাতে সক্ষম হয়নি৷ বান্ধবী নিধির সাহায্য নিতে হয়েছে। সে ভীষণ বুদ্ধিমতী মেয়ে। তার উপস্থিত বুদ্ধি বেশ দক্ষ। তাই তার পরামর্শ নিয়েই শুক্রবার করে তিন বন্ধু বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল। সৌধর বাইকে নিধি, সুহাসের বাইকে সিমরান আর আইয়াজ একাই। তাদের পিছন পিছন গিয়েছিল যমুনা সেতু বেড়াতে। যেহেতু তাদের শহর থেকে যমুনা সেতুর দূরত্ব খুব বেশি নয়। সেহেতু বোনের অভিমান ভাঙাতে এ স্থানই বেছে নিয়েছিল৷ দইয়ের স্বাদ ঘোলে মেটানো যাকে বলে। কিন্তু বোন সিমরানকে এত সহজে বাগে আনা যায়নি। শুধু অভিমানটাই ভেঙেছিল। শতহোক ভাই তার অভিমান ভাঙাতে বন্ধুদের সাহায্য নিয়েছে। এরপরও কি অভিমান করে থাকা যায়? বন্ধুদের সামনে ভাইয়ের প্রেস্টিজ রক্ষা করেছে সে৷ কিন্তু চার বন্ধুকে সিমরান ছ্যাঁকা দিয়েছিল যমুনা থেকে ঘুরে আসার পর। বাড়ি ফিরেই দাঁত ক্যালিয়ে মাকে বলেছিল, পরীক্ষার পর ছুটিতে তাকে নিয়ে কক্সবাজার ঘুরতে যেতে হবে। শর্ত একটাই ভাইয়াকে নেয়া যাবে না। সিমরানের এই কাণ্ড যখন সুহাস ক্যাম্পাসে এসে বন্ধুদের বলেছিল, একেকজনের পেটে খিল ধরে গিয়েছিল হাসতে হাসতে৷ সৌধ, আইয়াজ তো গড়াগড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা। বেচারি নিধি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সুহাসকে বলেছিল,

‘ বন্ধু কপাল গুণে বোন পাইছিস। এই মেয়ে যার বউ হবে সে তো গেল! ‘

সেই যে সিমরান মায়ের কাছে বায়না ধরল। সে বায়না পূরণ করতেই মেয়েকে নিয়ে উদয়িনী চলে এলো কক্সবাজারে। শর্ত পূরণ করতে ছেলেকেও সঙ্গে নেয়নি৷ মা তাদের ভাই, বোনের ছোটো থেকে বড়ো সব চাওয়াই পূর্ণ করে। সব বায়নাকেই দেয় বিশেষ গুরুত্ব। ছেলেমেয়ে দুটো সব সময় মায়ের থেকে অতিরিক্ত যত্ন পায়। সুহাস বাবার চোখে ভালোবাসার থেকে দায়িত্ব বেশি দেখলেও মায়ের চোখে দেখেছে শুধুই ভালোবাসা আর যত্ন৷ তাই তো মায়ের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আর মায়া কাজ করে৷

বোন আর মা চলে গেল বেড়াতে। বোনকে চটাতে চায়নি সুহাসও। তাই ছুটির দিনে মায়ের পিছু না নিয়ে বাবার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। আর এসেই পড়ে গেছে গ্যাঁড়াকলে। অবশ্য মনস্থির করেছে সে। মেনে নিয়েছে বাবার শর্তকে। বিয়ে করবে নামীকে। স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করছে, অল্প বয়স। দায়িত্ব নেয়া এখন সম্ভব না। বাবাও তার ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দেবে না৷ শুধু মেয়েটার সামাজিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। মন থেকেই সে স্বীকৃতি দেবে সে। কারণ ঐ মেয়েটা আজ থেকে তার শারীরিক খোরাক মেটাবে। বিয়ে যখন করছে এমনি এমনি তো আর সাজিয়ে রাখবে না৷ শারীরিক সম্পর্ক তো অবশ্যই করবে। যৌবনটাকে হালাল রূপে উপভোগ করার সুযোগটা লুফে নেবে৷ বুকের মধ্যিখানে খুশির ঢেউ খেলে গেল সুহাসের। উত্তেজনায় শরীরের লোমকূপ গুলোও সজাগ হলো৷ কখন রাত হবে? এসব অনুভূতির ভীড়ে তার মাথায় আরো কিছু ভাবনা এলো। তাদের মধ্যে মনের কোনো সম্পর্ক নেই। কী আর করার সে না হয় ধীরেধীরেই তৈরি হবে৷

লোকে বলে মনের সম্পর্ক ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক অর্থহীন। মন না ছুঁয়ে শরীর ছোঁয়া অনুচিত। কিন্তু সে জানে দুটো বিষয়ই পরিস্থিতি কেন্দ্রিক। শহরের আনাচে কানাচে বহু নর নারী সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা মানুষকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করে। তারা কি আদেও মন স্পর্শের জন্য অপেক্ষা করে শরীর স্পর্শ থেকে নিজেদের বিরত রাখে? নাকি খুব অল্প সময়েই মনে পৌঁছাতে পারে? পারে না। কেউ যদি সাত দিন বা এক মাসের পরিচয়ে বলে মন স্পর্শ করেছে তাহলে সেটা ডাহা মিথ্যা। তারা আসলে শরীরটাকেই আগে স্পর্শ করে৷ এরপর একসঙ্গে বসবাসকালে ধীরেধীরে তাদের মনের মিলন ঘটে। সুহাস নামীর ক্ষেত্রেও না হয় সেটিই হবে। আচম্বিতে কেঁপে ওঠল সুহাস। যদি বাবা, মায়ের মতো হয় তখন? পরোক্ষণেই ভাবল, নাহ সে তার বাবার মতো হবে না৷ কারণ তার মায়ের কষ্টটা সে খুব কাছ থেকে দেখেছে। এ পৃথিবীতে যে ছেলে খুব কাছ থেকে মায়ের যন্ত্রণাগুলো দেখতে পায়। সে ছেলে কখনো স্বেচ্ছায় তার স্ত্রীকে কষ্ট দিতে পারে না।

মা বোনকে না জানিয়ে বিয়ে করবে সুহাস। কিন্তু অবিবাহিত অবস্থায় মায়ের সঙ্গে শেষ সময় কাটাতে পারল না। এই নিয়ে আফসোস হচ্ছে। শেষ কথাটুকুও হলো না৷ দেখা তো দূরেই থাকুক। বোনের হিংসেমি আর নেটওয়ার্ক সমস্যাই এর জন্য দায়ী।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুহাস। আচমকা চোখ চলে গেল উঠান পেরিয়ে টিন সেট বিল্ডিং ঘরটায়৷ জানালার পাশে গুটিকয়েক মহিলা মানুষ দেখা যাচ্ছে। সুহাস স্পষ্ট বুঝতে পারল উনারা তাকে চুপিচুপি দেখছে। কিন্তু কেন? চুপিচুপি দেখছে কেন? সামনে এসে দেখুক না। পরিচয় হয়ে কিছুক্ষণ বসে আলাপও করুক৷ একা একা বসে থেকে বেশ বিরক্ত লাগছে। বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল সে। তার দুরন্ত মন উৎসুক হয়ে এগিয়ে এলো। বারান্দার রেলিং ধরে উঁকি দিয়ে তাকাল ও ঘরের জানালার দিকে। ও ঘরে উঁকিঝুঁকি করা মেয়ে গুলো হুড়মুড়িয়ে আড়ালে চলে গেল। যারপরনাই অবাক হলো সুহাস। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ কী ব্যাপার এরা কি আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে নাকি! ‘

নামীর দুই চাচাত ভাইয়ের বউ, আর চাচি আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখছিল সুদর্শন যুবক সুহাসকে। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট! দেখতেও আহামরি সুন্দর! মা মরা শ্যামলা বরণের নামীর ভাগ্যটা ওদের কাছে বেশ বিস্ময়কর লাগছে। নামীর ভাবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সুহাসকে দেখে মন্তব্য করে বসল,

‘ দেখতে সুন্দর। ধবধবা ফর্সা, লম্বাও মাশাআল্লাহ। সব ঠিকঠাক আছে। কিন্তু একটু ক্যাচড়া লাগতেছে। পুরুষ মানুষ মোটাসোটা না হলে কেমন দেখায়। জোয়ানকি ভাব আসে নাই। একেবারে হ্যাংলা পাতলা মনে হয় সুপারি গাছ। জোরছে বাতাস এলেই হেলে পড়বে। জামাই হিসেবে মানাচ্ছে না। ‘

নামীর চাচি বিরক্ত হয়ে বললেন,

‘ এত খুঁত ধইরো না বউ। অল্প বয়স। আমার রাজিবের থেকেও বয়সে ছোটো। একুশ, বাইশ বছরের পোলাপান তো এমনই থাকে। মেয়ে মানুষ তরতরিয়ে ডাঙর হলেও ওরা কি আর তরতরিয়ে ডাঙর হয়। হয় না তো। ‘

‘ কিন্তু আম্মা এই ছেলের চোখ দু’টো দেখছেন? বিড়াল চোখা। অমন ছোটো ছোটো ঘোলাটে সাদা মনির চোখ দেখেই তো আমার ভয় লাগে৷ তাছাড়া মুখে চাকমা চাকমা ভাব আছে। ‘

বড়ো ছেলের বউয়ের কথা শুনে নামীর চাচি বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছালেন। পাশে চুপচাপ বসে থাকা নামীর দিকে চেয়ে বললেন,

‘ নামীর ভয় না করলেই হইছে। তুমি চুপ থাকো। অতো কথা বইল না। ‘

নামী লজ্জা পেয়ে মুখ নত করল। সুহাসকে সে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেনি। ভাবি যেসব ত্রুটি ধরছে সেসব নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা নেই। বাবার কাছে শুনেছে, সুহাসের নানি চাকমা সম্প্রদায়ের ছিলেন। খাগড়াছড়ি বেড়াতে গিয়ে নানা প্রেমে পড়েন। একমাসের ব্যবধানে প্রেম করে নানিকে নিয়ে পালিয়ে আসেন তিনি। ফলশ্রুতিতে জিনগত কারণে সুহাসের মা মায়ের গড়ন পেয়েছে। আর সুহাসও পেয়েছে তার মায়ের গড়ন। হাঁপ নিঃশ্বাস ছাড়ল নামী। মনে পড়ল সুহাসের সঙ্গে একান্তে আলাপের সময়টুকু। এরপর যখন ক্রোধান্বিত হয়ে সে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। সোহান আংকেল তাকে নিয়ে আলাদা কথা বলতে চলে গেল বাড়ির সামনের রাস্তায়৷ সেখানেই সুহাস সম্পর্কে অনেকটা জানিয়েছে আংকেল। একটা মেয়ে উনিশ, বিশ বয়সে যতটা পরিণত হয়, একটা ছেলে ঠিক ততটা পরিণত হয় না৷ তাদের মানসিকতা পরিপক্ব হতে বেশ সময় নেয়। সুহাস অপরিপক্ব মস্তিষ্কের ছেলে। প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের। এ সম্পর্কে জানিয়েছে আংকেল সঙ্গে এটিও বলেছে,

‘ মামনি, এই যে বিয়েটা হচ্ছে। এটা কিন্তু তোমার সংসার জীবনে পা রাখার জন্য না। বরং এই দেশে নিশ্চিত ভাবে থেকে তোমার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য এই বিয়ে হচ্ছে। ‘

নামী সরল চোখে তাকিয়ে রয়। বিয়েটা তো ছেলেখেলা নয় এটা সারাজীবনের ব্যাপার। একটি স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে আরেকটি স্বপ্নের মৃত্যু ঘটাবে? তার জীবনে কী প্রেম, ভালোবাসা, সংসার নামক জিনিস গুলো থাকবে না? মনের প্রশ্ন সহসা মুখেও বলে দেয় নামী। সোহান খন্দকার হো হো করে হেসে ফেলেন। বলেন,

‘ তোমরা এখন বিয়ে করবে। তোমাদের সম্পর্ক হঠাৎ করেই তৈরি হবে না। সময় লাগবে। আমি চাই দু’জনই সম্পূর্ণ স্টাডিতে মনোনিবেশ করবে। সংসার চ্যাপ্টারটা ফিউচারের জন্য জমিয়ে রাখো। তবে হ্যাঁ পড়াশোনা ম্যানেজ করে যদি দু’জন মিলে প্রেম করতে চাও সেটা করতে পারবে। শান্তি কী জানো? তোমাদের প্রেম হবে বাঁধা মুক্ত সম্পূর্ণ হালাল। ‘

‘ কিন্তু আপনার ছেলে আমাকে মানবে তো? ‘

‘ তুমি মানতে পারবে? ‘

‘ মানতে পারব বলেই বিয়েতে মত দিয়েছি। ‘

‘ আমি সুহাসকে চিনি। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকো। ‘

নামীকে নিশ্চয়তা দিলেও সোহান খন্দকার চিন্তিত ছিলেন। ডানপিটে ছেলেকে নিয়ে নয় বরং স্ত্রীকে নিয়ে। তবে তারও জেদ নামীকে সে পুত্রবধূ করবেই।
সারাজীবন সকলের জেদের স্বীকার হওয়া সে এবার নিজের জেদে অটুট। তাছাড়া তার সহজসরল, দুরন্তমনার ছেলেকে সেই অতিশ মেজিস্ট্রেটের ছোটো মেয়ে অরিনের হাত থেকেও রক্ষা করা জরুরি। মেয়েটা তো উচ্ছন্নে গেছেই তার ছেলেকে উচ্ছন্নে পাঠাতেও ওঠে পড়ে লেগেছে!

হবু শশুরের সঙ্গে কথা বলার পর নামীর চিন্তা কমলেও সুহাসের সঙ্গে হওয়া ঐ অল্প কথোপকথন মাথা থেকে যাচ্ছে না। অতিরিক্ত চঞ্চল আর ঠোঁটকাটা ছেলেটার সঙ্গে তার মতো মেয়ের মিলবে কীভাবে কে জানে। সবদিক থেকেই তারা দু’জন যেন বিপরীত মেরু।

সন্ধ্যার পর মৌলভি ডেকে সতেরো, বিশজনকে সাক্ষি রেখে তিন কবুল বলার পদ্ধতি অবলম্বন করে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হলো সুহাস, নামী। সুহাস একদমই প্রস্তুতি ছাড়া এখানে এসেছে। কোনো কাগজপত্র সঙ্গে আনেনি৷ ফলে আইনিভাবে বিয়েটা স্থগিত থাকল। সোহান খন্দকার বন্ধু আখতারুজ্জামানকে কথা দিলেন, সময় করে রেজিস্ট্রি করিয়ে দেবে। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সকলে মিষ্টি মুখ করছিল। নামীর দাদি পিরিচে করে চারটা মিষ্টি আর একটি চামচ হাতে দিলেন সুহাসের। বললেন,

‘ নাত জামাই বউরে মিষ্টি খিলাই দেও। ‘

বউ! শরীর জুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল যেন। কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে একবার দাদি আর একবার নামীর দিকে তাকাল সুহাস। হালকা মেকআপে আবৃত শ্যামলা মুখটা বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। ফিনফিনে দেহে ফিরোজা রঙের জামদানী জড়ানো মেয়েটি তার বউ! বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ল সুহাসের। অবনত মুখশ্রীতে বসা নামীর দিকে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে। যা দেখে ঘরে থাকা প্রতিটি সদস্যের মুখে লেপ্টে রইল মিটমিটে হাসি। দাদি রসানো রসানো কিছু বুলি আওড়ে মিষ্টি দিল। সুহাস নামীকে মিষ্টি খাইয়ে দিলে নামীও দিল। ভীড়ের মাঝে একটু ফাঁক পেয়ে মোবাইল বের করল সুহাস। ম্যাসেন্জারে ঢুকে ম্যাসেজ গ্রুপে লিখল,

‘ বন্ধুরা, আমি এখন ইসলামি নীতি অনুযায়ী বিবাহিত। বউ পাশে নিয়ে বসে আছি। আর শশুর বাড়ির লোকেরা আমাকে চোখ দিয়ে ধ র্ষ ণ করে দিচ্ছে! ‘

আইয়াজ, সৌধ বিস্ময়ে হতবাক। সত্যি সত্যি বিয়ে করে নিল সুহাস? এভাবে এতিম করে দিল তাদের? দু’জন মিলে এক নাগাড়ে কান্নার ইমুজি দিল। এদিকে নামীর দাদি এসে নামীর হাত আর সুহাসের হাত এক করে দিয়ে বলল,

‘ এই যে হাত ধরাই দিলাম। এ জীবনে আর ছাড়বা না। ‘

সুহাসের ডানহাতের মুঠোয় নামীর মৃদু কম্পিত হাতটা জুড়ে দিল দাদি। চমকাল সুহাস। উষ্ণ নরম হাতটা ছুঁয়ে অদ্ভুত প্রশান্তি খেলে গেল বুকটায়। বা হাতে টাইপ করে দ্রুত বন্ধুদের জানাল বিষয়টা,

‘ ঐ নামীর হাত ধরে আছি। ওর দাদিই ধরিয়ে দিল! ‘

দুই বন্ধু বিস্ময়ে অভিনন্দন জানাতে লাগল। সৌধ বলল,

‘ কেমন ফিল করছিস? ‘

‘ অদ্ভুত উষ্ণতা পাচ্ছি। শুধু হাতে না পুরো শরীরে। ‘

‘ এটাই তো ম্যাজিক বন্ধু। ‘

ওদের মাঝে ফোঁড়ন কেটে আইয়াজ বলল,

‘ দোস্ত হাতটা কি অনেক বেশি নরম নাকি অল্প? ‘

সৌধ তৎক্ষনাৎ আইয়াজকে রিপ্লাই দিল,

‘ শা’লা মেনা, শা’লা লু চ্চা ওর বউয়ের হাত কতখানি নরম তা জেনে তুই কী করবি? ‘

আইয়াজ বলল,

‘ ভাই আমরা আমরাই তো। বন্ধুর বউ আমাদেরও…’

সুহাস রাগি ইমুজি দিল আইয়াজকে। তা দেখে আইয়াজ বলল,

‘ ওরে বাবা সৌধ দেখ দেখ অবস্থাটা কী! ‘

সৌধ বলল,

‘ ঠিকই আছে। তুই শা’লা ধুরন্ধর। তুই কি ওর বাসর সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা চাইবি নাকি? ‘

আইয়াজ অবাক হয়ে বলল,

‘ কেন চাইব না? সুহাস কি আমাদের পর লোক? আমাদের মধ্যে আগে ও বিয়ে করছে। আমাদের একটু শেখাবে, পড়াবে না?’

‘ কেন শেখাতে হবে কেন? তুই কি আমাদের কলেজের কলঙ্ক? ‘

‘ আরে ইয়ার, ওসব বিদ্যা বাদ। প্র্যাক্টিকেলি তো আর অভিজ্ঞতা নাই। ‘

ওদের কথোপকথন দেখল সুহাস। মুচকি মুচকি হাসল সে৷ বলল না কিছুই। এদের এমন ঝগড়া হরহামেশাই লেগে থাকে। সৌধ বরাবরই দেখতে শুনতে নম্র, ভদ্র, আর জনসম্মুখে মি.পারফেক্ট খ্যাত আইয়াজকে খোঁচাতে ভালোবাসে।

আইয়াজের প্রশ্নটা মাথায় রইল সুহাসের। নামীর হাত নরম কিন্তু কতখানি নরম তা পরোখ করতে হাতটা কিঞ্চিৎ জোরালো ভাবে ধরল। আলতো চাপ দিল। তুলোর মতো নরম সে হাত অনুভব করে সুহাসের কী যে ভালো লাগল! এদিকে সুহাসের এহেন কাণ্ডে নামীর অবস্থা তো শেষ। অল্প শিহরণ, তীব্র লজ্জা, সীমাহীন বিস্ময়ে টলমল লাগল তার। আশপাশে তাকাল সলজ্জে। সবাই তাদের দেখছে। যদি কেউ হাতের দিকে খেয়াল করে? আঁতকে ওঠল নামী। চাপাস্বরে বলল,

‘ কী করছেন কী? সবাই দেখবে। ‘

সুহাস আচমকা সশব্দে বলে ওঠল,

‘ সো হোয়াট? তুমি তো আমার প্রেমিকা নও বউ! ‘

আচমকা ঘরজুড়ে হাসির রোল পড়ল। নামী থমথমে বদনে কয়েক পল সুহাসের পানে তাকিয়ে মস্তক নত করল। সুহাস তার হাতটা আরো জোরাল ভাবে ধরে ফিসফিস করে বলল,

‘ মনে হয় কথা ছাড়িনি লাফিং গ্যাস ছেড়েছি। ‘

এ কথা বলে পুনরায় বেশ অহমিকার সঙ্গে বলল,

‘ অবশ্য মেডিকেলে পড়া স্টুডেন্ট’সদের মধ্যে এমন বহুত এক্সট্রা ট্যালেন্ট থাকে। তুমি তো সামনে এক্সাম দেবে রাইট? একদিকে মেডিকেল স্টুডেন্ট অপরদিকে আমার বউ। দু’টো মিলেমিশে এক্সট্রা ট্যালেন্ট’স প্রো ম্যাক্স হয়ে যাবে৷ ‘

নামীর মাথা ব্যথা ধরে গেল। আশপাশে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,

‘ একটু চুপ থাকুন প্লিজ। শশুর বাড়ি এসে নতুন বরদের এত কথা বলতে হয় না৷ লোকে নির্লজ্জ ভাবে। ‘

‘ কিন্তু আমিত নির্লজ্জ নই। স্পষ্টভাষী। ‘

নামী করুণ চোখে তাকাল। সুহাস মিটিমিটি হাসছে। ফ্যালফ্যাল করে দেখছে নামীর করুণ মুখশ্রী। কিন্তু সুহাসের এই মিটিমিটি হাসি কিছুক্ষণ পরই বন্ধ হয়ে গেল। যখন শুনল৷ আজ তাদের বাসর হবে না৷ হঠাৎ বিয়ে হলেও যে হঠাৎ বাসর হয় না। তা হারে হারে টের পেতে লাগল সে। নামীকে নিয়ে তার চাচি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এরপর একে একে সবাই তাকে রেখে চলে গেল। তার জন্য বিছানা গোছানোর দায়িত্ব নামীর ভাবির কাঁধে পড়েছে। সে এসে সুহাসকে বলে গেল, কয়েক মিনিট পর যেন পাশের ঘরে চলে যায়। মেজাজ বেশ খারাপ হয়ে গেল সুহাসের। ফাঁকা ঘরে কপাল কুঁচকে বসে কল করল সৌধকে। সৌধ সব শুনে বলল,

‘ বলিস কী মাম্মা এইভাবে ছ্যাঁকা! ‘

সুহাস রাগে গজগজ করে বলল,

‘ এটা কোন ধরনের আচরণ বল তো? আর ঐ নামীদামিও কী অদ্ভুত! বর রেখে বাড়ির লোকের কথায় নাচতে নাচতে চলে গেল। ‘

‘ আরেব্বাস নাচ দেখিয়েছে নাকি? ‘

‘ আরে বা’ল না। কথার কথা। ‘

সৌধ মুখ চেপে হাসল। বন্ধুর চরম বিপদে কী পরামর্শ দেয়া যায় কয়েক পল ভেবে নিয়ে বলল,

‘ বাসর করতে না দিক। অন্তত একান্তে কিছু সময় তো কাটাতে দেবে। একটু মনের কথা বলবি, হাত ধরবি। বেশি কিছু ইচ্ছে থাকলে কয়েকটা কিসও করবি। আপাতত এইটুকুর সুযোগ তো দেয়া উচিত ছিল রে দোস্ত। ‘

অনুভূতির জোয়ারে ভাঁটা পড়া বুকটায় তরতরিয়ে ঢেউ খেলে গেল। অনুরাগের স্বরে বলল,

‘ এই বাড়ির সবকটা লোক ডিজঅনেস্ট দোস্ত। আর সবচেয়ে বড়ো হিটলার তো আমার বাবা। নিজের মনে তো রঙঢঙ নেই। শা’লার আমার রঙেও জল ঢেলে দিল। ক্যান ব্যাটা বিয়ে করাতে পারলি বাসরের ব্যবস্থা ক্যান করলি না। একেকটা মীর জাফরের দল। ‘

দারুণ চটে গেছে সুহাস বুঝতে পেরে সৌধ বলল,

‘ কুল সুহাস কুল। মাথা ঠাণ্ডা রাখ। ‘

একটু ভেবে বলল,

‘ ও বাড়িতে তোর শালিকা টালিকা বা নামীর ভাবি, দাদি টাইপ কেউ নাই? থাকলে তাদের সাথে আমাকে কথা বলিয়ে দে।’

‘ কেন কী বলবি তুই? ‘

সৌধ দুষ্টুমি ভরে বাঁকা হাসল। বলল,

‘ অন্তত একটা হাগ আর কয়েক মিনিট চুমুর ব্যবস্থা করে দিব। ‘

‘ সিরিয়াস পারবি? ‘

‘ইয়েস বস। ‘

‘ দোস্ত এর বিনিময়ে যা চাইবি সব পাবি। ‘

‘ নিধিরে চারদিন ধরে দেখি না। ছুটি শেষ হতে আরো ছয়দিন। এর আগে ওরে দেখার সুযোগ করে দিবি। ‘

সুহাস এক মুহুর্ত চুপ থেকে বলল,

‘ আগে আমার কাজটা করে দে। কাল বাবাকে বলে তোদের সবাইকে নামীদের বাড়িতে দাওয়াতের ব্যবস্থা করে দিব। শুনেছি এদিকে নাকি দুইশ এক গম্বুজ মসজিদ তৈরি হচ্ছে। কাজ প্রায় শেষের দিকে। সবাই মিলে ওদিকটাও ঘুরে আসব। ‘

‘ ওকে ডান। যা এবার, যা বললাম তাই কর। ‘

সুহাস আর দেরি করল না। পাশের ঘরের দরজার কাছে গিয়ে নামীর ভাবিকে ডাকল,

‘ ভাবি আমার বন্ধু আপনার সাথে কথা বলতে চায়। ‘

ভাবি ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এলো। হাত বাড়িয়ে ফোন নিল। সুহাসের দিকে তাকিয়ে রইল সন্দিহান মুখে। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে আশপাশে তাকাতে লাগল সুহাস। সৌধ ভাবির সঙ্গে কথা বলে পুরো বিষয়টা ভাবিকে বোঝাল৷ সুহাস খেয়াল করল, ভাবি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে। হাসছে মুচকি মুচকি। কিঞ্চিৎ লজ্জা পেয়ে মাথা চুলকাল সুহাস। ইশারায় বলল,

‘ হেল্প করবেন তো? ‘

ভাবি তাকে কিছুই বলল না৷ ফোনের ওপাশে থাকা সৌধকে বলল,

‘ বুঝেছি আর বোঝাতে হবে না। আজকালকার ছেলেদের ধৈর্য্য তো নেই’ই। সাথে লজ্জার ল ‘ও নেই! ‘

কথাটা বলেই ফোন ফিরিয়ে দিল ভাবি। সুহাস তাজ্জব বদনে ফোন নিল। ভাবি চাপাস্বরে বলল,

‘ সুযোগ বুঝে পাঠাব। কিন্তু বেশি কিছু যেন না হয়। বড়োদের সামনে তাহলে আমি বা নামী কেউই মুখ দেখাতে পারব না। এটা তোমাদের শহর না। এটা গ্রাম। শুনলাম নামীকে নিয়ে ক’দিন পর তোমাদের ওখানে চলে যাবে? নিজের বাড়িতে নিজের বউয়ের সঙ্গে যা খুশি তাই করো। এ বাড়িতে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ মাফিক চলবে। ‘

চলবে…

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০২

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২

প্রচণ্ড সুশীল প্রকৃতির মেয়ে নামী। আর পাঁচটা মেয়ে রূপ, সৌন্দর্যের দিক দিয়ে তাকে পেছনে ফেলতে পারলেও গুণের দিকে পারবে না। এই মেয়েটি দারুণ মেধাবিনী। শুধু পুঁথিগত বিদ্যাতেই সে সীমাবদ্ধ নেই। বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও সাহিত্যের প্রতি রয়েছে নিবিড় ঝোঁক। পড়াশোনার ফাঁকে ঠিক সমরেশ, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, শরৎচন্দ্র ইত্যাদি বহু লেখকের বই পড়ে নেয়। এসএসসির পর থেকে বাবার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে করে নিয়েছে নিজের একচ্ছত্র অধিকার। এ পর্যন্ত শ’খানেক বই পড়া হয়েছে তার৷ সে চায় তার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হোক। তার বাবা ব্যবসায়ী আর মা ছিলেন গৃহিনী। দু’বছর হলো মা মারা গেছে। মায়ের স্বপ্ন ছিল, সে একদিন অনেক বড়ো ডাক্তার হবে৷ সেই স্বপ্নকে বুকে লালন করেই গতবছর এইচএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস অর্জন করেছে। কিন্তু আফসোস, মা এ খবর জানতে পারল না। আজ পৃথিবীতে নিলু বেঁচে নেই। কিন্তু নিলুর স্বপ্ন বেঁচে আছে। একমাত্র মেয়ে নামীর মাধ্যমেই সে স্বপ্ন গুলো পূর্ণতা পাবে৷ মায়ের স্বপ্ন পূরণে একাগ্রচিত্তে লড়ে যাচ্ছে মেয়ে নামী। গত বছর পারিবারিক সমস্যায় মেডিকেলে পরীক্ষা দিতে পারেনি৷ তাই এ বছরের জন্য পাকাপোক্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু বিজনেসের প্রয়োজনে বাবা আখতারুজ্জামানকে দেশের বাইরে যেতে হচ্ছে। সৎ মা আলিয়া খাতুন আর তাকে সহ নিয়ে যাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাবা। নামী জানে এছাড়াও তাদের বিশেষ একটি পরিকল্পনা রয়েছে। বাবা আর সৎ মা মিলে বেবি প্লানিং করছে। আমেরিকায় গিয়ে বেবি কনসিভ করবে আলিয়া। ফলশ্রুতিতে ঐ দেশের নাগরিকত্বও মিলে যাবে। নামী জানে বাবার বহুদিনের স্বপ্ন এটা। মা বেঁচে থাকলে হয়তো মেনে নেয়া সহজ হতো। যেখানে মন থেকে সৎ মাকেই মেনে নিতে পারেনি। সেখানে সৎ ভাইবোনকে কীভাবে মেনে নেবে? নতুন অতিথির আগমন ঘটার পর বাবা যদি তাকে আর ভালো না বাসে? সৎ মা এখন যে ভালো মানুষি দেখায় তখন যদি সবটা বদলে যায়। এত আশঙ্কা মনে নিয়ে আমেরিকায় যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
গতবছর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল নামী। সময়ের ব্যবধানে মনকে শক্ত করে নিয়ে, কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এখন। কিন্তু এ বছর মেডিকেল পরীক্ষায় না বসে ভিন দেশে চলে যেতে হবে! এটা মেনে নিতে পারল না সে। কিছুতেই রাজি হলো না আমেরিকায় যেতে। সদ্য যৌবনে পা দেয়া মেয়েকে দেশে একা ছেড়ে যেতে রাজি নন আখতারুজ্জামান। নিজের পরিবারকে ভরসা করতে পারছে না সে। তাই নিজের চরম বিপদের দিনে প্রিয় বন্ধু সোহানের শরণাপন্ন হয়েছে। আখতারুজ্জামানের মেইল পেয়েই ছেলেকে নিয়ে চলে এসেছে সোহান খন্দকার। সকল দিক বিবেচনা করে, অতীতে ঘটে যাওয়া সেই হৃদয়বিদারক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে নামীকে ছেলের বউ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একালে না হয় মাথা উঁচু করে নিলুর সামনে দাঁড়াতে পারেনি। পরকালে যেন দাঁড়াতে পারে। সেই আশায় নিলুর চোখের মণিকে সযত্নে নিজের ঘরে নিয়ে যাবার পণ করেছে। করেছে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছায়ার মতো পাশে থাকার অঙ্গীকার। পুত্রবধূ নয় নামী তার আরেক মেয়ে হয়েই থাকবে। হ্যাঁ মেয়ে। নামী নিলুর অংশ। যে মেয়েটার বাবা হওয়ার কথা ছিল সেই মেয়েটার শশুর হতে হবে তাকে। এই যদি হয় নিয়তি হোক। এ দফায় নিয়তিকে সুপ্রসন্ন মনে মেনে নেবে।

নামী বা সুহাস কেউই জানে না তাদের বাবা, মায়ের অতীত কী ছিল? তারা শুধু জানে ওরা খুব ভালো বন্ধু। নামীর বাবা, মা আর সোহান ছিল কলেজ ফ্রেন্ড। অতীতে তারা ছিল বন্ধু। বর্তমানে হতে যাচ্ছে বেয়াই, বেয়ান। এইটুকু কেবল জানা ওদের৷ অথচ কত কথা অজানা!

সুহাস প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের। ঠিক নামীর বিপরীত চরিত্র এই ছেলে। মিল শুধু এক দিকেই এই দু চরিত্রই দারুণ মেধাবী। মা ডাক্তার, বাবা দু’টো বেসরকারি চিকিৎসালয়ের মালিক। ফলশ্রুতিতে বেশ দম্ভ নিয়েই চলাফেরা করে। কলেজ প্রাঙ্গন থেকে শুরু করে পরিচিত শহর, বাড়ি। সকল স্থানেই সে এবং তার পুরো গ্যাং রাজ করে বেড়ায়। তাদের গ্যাং এর নাম, “বিগ বস”
বিগ বসের হেড সদস্য তিন বন্ধু। সুহাস খন্দকার, সৌধ চৌধুরী আর আইয়াজ হোসেন। তিনজনই বনেদি পরিবারের সন্তান। সুহাস, সৌধ স্কুল বন্ধু হলেও আইয়াজের সঙ্গে পরিচয় মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে। তবুও অপরিচিত কেউ বুঝতে পারবে না আইয়াজের সঙ্গে তাদের পরিচয় মাত্র দু’বছরের।

ছুটি কাটাতে এসে কীভাবে ফেঁসে গেছে সেই বিবৃতি লিখে ম্যাসেন্জার গ্রুপে সেন্ট করল সুহাস৷ সৌধ, আইয়াজ দু’জনই সিন করল। তৎক্ষনাৎ সৌধ রিপ্লাই করল,

‘ এ্যা মাম্মা বলিস কী! তোর বিয়ে! ? ‘

রিপ্লাইয়ের সাথে গোটা দশেক চোখ টিপ ইমুজি দিল সৌধ৷ আইয়াজেরও উৎসুক বার্তা এলো,

‘ বলিস কী দোস্ত। এই বয়সে বিয়ে! আংকেল যা মানুষ যদি করতেই হয়? মেয়ে দেখতে কেমন রে? কীসে পড়ে? ‘

সুহাস ভয়েসে উত্তর দিল। সৌধ গোটা দশেক দাঁত ক্যালানো ইমুজি দিয়ে বলল,

‘ এ্যা মাম্মা আমরা কি আসব? বাসর সাজাতে হবে তো। ‘

আইয়াজ হাহা রিয়াক্ট দিল। সুহাস রাগি ইমুজি দিয়ে বলল,

‘ মজা নেস তোরা? বা’লছা’ল বাদ দিয়ে পরামর্শ দে।’

আইয়াজ বলল,

‘ বিয়েতে পুরোপুরি অমত তোর? ‘

সৌধ বলল,

‘ মেয়ে দেখতে কেমন? ভালো হলে হাতছাড়া কেন করবি? ‘

সুহাস সৌধের ম্যাসেজের রিপ্লাইয়ে বলল,

‘ মেয়ের ফিজিক্যাল স্ট্রাকচার এগ্রিঅ্যাবল কিন্তু… ‘

‘ কিন্তু কী? এমন সুযোগ আমি পেলে তো লুফে নিতাম। তুই কেন নিবি না? অরিনের জন্য! দোস্ত, তুই কি অরিনের প্রতি সিরিয়াস? ‘

‘ উমহ সেটা বড়ো ব্যাপার নয়। ‘

‘ তাহলে কী? আকিব স্যার কী বলেছে মনে নেই? আমাদের যে বয়স চলছে, এ বয়সে বিয়ে করার মধ্যে আলাদা একটা জোশ আছে। কী যে মজা… টাটকা টাটকা ফিলিংস। ‘

সুহাস নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার দুরন্ত মস্তিষ্কে সৌধের কথায় অভিলাষ জন্মাল। সৌধ কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় বলল,

‘ শোন, তুই যদি বিয়েটা করতে না চাস আংকেলকে বল আমি করব বিয়ে। আব্বা, আম্মা রাজি না থাকলেও করব। ঠিকানা দে আসতেছি! ‘

বিস্মিত হলো সুহাস৷ মেয়ে না দেখেই সৌধ এতটা আগ্রহী? ভ্রু কুঁচকে গেল তার৷ ইগোতেও লাগল খুব। নামীকে তার জন্য বাছাই করা হয়েছে। সে যদি বিয়ে নাও করে সৌধ কেন করতে চাইবে? বুকের ভেতর বিশ্রী একটা অনুভূতি হলো৷ বলল,

‘ গায়ের কালার ডাল মেয়েকে তুই বিয়ে করবি?’

সৌধ হাহাহা ইমুজি দিয়ে বলল,

‘ দোস্ত এইটা কোনো ব্যাপারই না। নাইট ক্রিম কিন্না দিব। দরকার পড়লে বিদেশি প্রডাক্ট আইনা দিব। ‘

ওদের কথোপকথন দেখে আচমকা আইয়াজ ভেঙচি ইমুজি দিয়ে বলল,

‘ বিদেশি প্রডাক্ট আইনা দিলেই বিদেশি চিজ পাবা নাকি? ‘

সৌধ বলল,

‘ ওরে মেনি বিড়াল! কইছে টা কী! শা’লা মেনকা। ‘

এ পর্যন্ত ম্যাসেজ দেখেই সুহাস আর কিছু বলল না। সৌধ সুহাসের থেকে কোনো বার্তা না পেয়ে বলল,

‘ দোস্ত আমরা এখানেই থেমে যাই। বাই এনি চান্স ঐ মেয়েটা তোর বউ হয়ে গেলে এসবের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। তবে হ্যাঁ, তুই যদি বিয়েটা করতে না চাস। আংকেল আর মেয়েটির জন্য আমি রেডি৷ ‘

আইয়াজ বলল,

‘ সুহাস, একটা ছবি দে তো মেয়েটির। সাদা, কালো বিবেচনা না করে ভাবি হিসেবে চলে কিনা দেখি। ‘

সৌধ বলল,

‘ হ্যাঁ হ্যাঁ ছবি দে। ‘

কথোপকথনের এ পর্যায়ে সুহাস চমকে ওঠল। নামীর ছবি তার কাছে নেই! কী অবস্থা। সন্ধ্যার পর যাকে বিয়ে করতে হবে। তার একটা ছবিও নিজের কাছে নেই! ভেবেই ভীষণ মেজাজ খারাপ হলো৷ এটা কী জীবন? না না এটা কী কোনো বিয়ের পর্যায়ে চলে? বিচলিত ভঙ্গিতে আশপাশে তাকাল সুহাস। নামীদের বারান্দায় বসে ফোন টিপছিল সে। দুপুরের খাবার আয়োজন চলছে বোধহয়। পোলাওয়ের ঘ্রাণ ভেসে আসছে৷ নামী কোথায় রান্নাঘরে? নাকি অন্য কোথাও? সে কাউকে দিয়ে নামীকে ডেকে আনবে? ডাকলেই কি মেয়েটা আসবে? আসবে না কেন? তখন ওভাবে বেরিয়ে যাওয়ার পর সোহান খন্দকার কতভাবে তাকে শাসিয়েছে হিসেব আছে? এই শাসানোর বিনিময়ে হলেও নামীর এখন তার কাছে আসা উচিৎ। উচিৎ মানে আসতেই হবে। আচমকা ওঠে দাঁড়াল সে। আশপাশে তাকিয়ে খুঁজতে লাগল নামীকে। ঠিক সে মুহুর্তেই মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে বালতি হাতে উঠানে নেমে এলো নামী। উঠানে টাঙানো রশির সামনে এসে বালতি মাটিতে রাখল। এরপর নিচু হয়ে চিপটানো ভেজা কাপড়গুলো ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে রশিতে মেলে দিতে লাগল৷ সুহাসের মাথায় তখনি দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসল। ভাবল,
‘ যেচে গিয়ে ছবি চাওয়ার মানেই হয় না। এতে নাগিনীর ভাব বেড়ে যাবে। আর আমার ভেল্যু কমে যাবে। ভাববে আমি ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড। এরচেয়ে বরং আড়াল থেকে ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নেই। সেও জানল না আমারো দর বেড়ে থাকল। ‘

ভাবামাত্রই ক্রুর হেসে কয়েকটা ছবি তুলে ফেলল। প্রতিটি ছবিই ছিল অপ্রস্তুত। তার মধ্যে কয়েকটা ছবি দেখে সুহাসের মাথাই খারাপ হয়ে গেল। নামী যখন চিপ্টানো কাপড় ঝাঁকি দিতে দুহাতে কাপড় ধরে উপর দিক তুলেছিল সে মুহুর্তের তিনটা ছবি তোলা হয়ে গেছে। যে তিনটা ছবিতে ওর বুকের ওপর থেকে ওড়না সরে গিয়েছিল। ম্যাসেন্জারে সমানতালে সৌধ আর আইয়াজের ম্যাসেজ আসছে। আর সুহাস ফোনের স্ক্রিনে নামীর দেহ মধ্যস্থে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সৌধ ইনবক্সে ম্যাসেজ দিল,

‘ কীরে কই গেলি। পিক দিলি না? ‘

সুহাসের ধ্যান ভাঙল। মস্তিষ্ক এলোমেলো লাগছে তার। নামীকে তার চৌম্বক মনে হচ্ছে আর নিজেকে মনে হচ্ছে ধাতব বস্তু৷ অন্য মনস্ক হয়ে ম্যাসেন্জার গ্রুপে ঢুকল সে৷ সৌধ, আইয়াজ কী ম্যাসেজ দিয়েছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল ,

‘ চুম্বকের ধর্মই তো ধাতুকে আকর্ষণ করা তাই না? ‘

সৌধ আর আইয়াজ এ বার্তা দেখে ভেবাচেকা খেয়ে গেল৷ বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ছাত্র। একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের মুখে অতীব সাধারণ এই প্রশ্ন পেয়ে দু’জনেরই চোখ উল্টে গেল। ইমুজি পাঠিয়ে সেই উল্টো চোখানুভূতি সুহাসকে দেখিয়েও দিল তারা।

চলবে…

[ কপি করা নিষেধ ]

ত্রিধারে তরঙ্গলীলা পর্ব-০১

0

#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_১

বাচ্চাটি গোল গোল চোখে তাকিয়ে ছিল৷ দীর্ঘসময় তাকিয়ে থাকার পর তুলতুলে নরম দেহটি যেন ছটফটিয়ে ওঠল৷ সুহাস খেয়াল করছিল মিষ্টি মুখের মায়াবি বাচ্চাটি তাকে দেখছে। হঠাৎ শুনতে পেল আধো আধো কণ্ঠে বাচ্চাটি তাকে ডাকল,

‘ পাপাহ, পাপপাহ! ‘

সুহাস চমকাল। শিরশিরে অনুভূতি হলো দেহ জুড়ে৷ স্নায়ুতে চঞ্চলতা বাড়ল। নিজের দু’পাশে তাকিয়ে
সুক্ষ্মভাবে পরোখ করল কাকে ডাকছে। এদিকটায় তো সে ছাড়া কেউ নেই! বাচ্চাটি যার কোলে সে একজন বলিষ্ঠ পুরুষ। ধারণা করেছিল সেই পুরুষটিই বাচ্চার বাবা। তাহলে বাচ্চাটা তার দিকে তাকিয়ে কেন, পাপা ডাকছে? গলা শুঁকিয়ে গেল সুহাসের৷ খেয়াল করল তার বুক কাঁপছে। বাচ্চাটি তৃতীয়বার উচ্চারণ করল, পাপাহ! সুহাসের শারীরিক সমস্ত শক্তি যেন হরণ করে নিল সেই ডাক। দিশেহারা হয়ে আশপাশে তাকাল সে। দূরে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ফটোশুট করছে সৌধ। সে ভীত কণ্ঠে সৌধকে ডাকল। ক্যামেরা গলায় দাঁত ক্যালিয়ে এগিয়ে এলো সৌধ। সুহাস তার কাঁধে হাত রেখে কাঁপা কণ্ঠে বলল,

‘ দোস্ত, নামীর প্রেগ্ন্যাসি রিপোর্ট অনুযায়ী আমাদের বেবির বয়স এখন কত? ‘

‘ হঠাৎ এই প্রশ্ন? ‘

প্রশ্ন করল সৌধ। ভ্রু কুঁচকে সুহাসের মুখোমুখি দাঁড়াল সে। এতে বাচ্চাটি সুহাসের চোখের আড়াল হলো। সুহাস অস্থির কণ্ঠে বলল,

‘ সরে দাঁড়া। ও আমাকে পাপা ডাকছে। সামনে থেকে সরে দাঁড়া। ও আমাকে পাপা ডাকছে। ‘

সুহাসের আকুল কণ্ঠে বিস্মিত হলো সৌধ। তড়াক করে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, একজন বলিষ্ঠ যুবক ফুটফুটে এক বাচ্চাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠল। কিছু সময়ের ব্যবধানে গাড়িটা চলেও গেল। তৎক্ষনাৎ সুহাস উন্মাদের মতো বলতে লাগল,

‘ সৌধ, বাচ্চাটা চলে গেল! ও আমাকে পাপা ডেকেছে দোস্ত। প্লিজ ওদের আটকা। ‘

বলতে বলতেই এক ছুট দিল৷ পেছন পেছন সৌধও ছুটল। সুহাসকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরে বলল,

‘ সুহাস পাগলামি করিস না। কার না কার বাচ্চা। তোকে কেন পাপা বলবে? কোথাও ভুল হচ্ছে দোস্ত।’

সুহাস তীব্র ক্রোধ নিয়ে সৌধর কলার চেপে ধরল। ক্রোধে ফেটে পড়ে বলল,

‘ একটা বাচ্চা আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর পাপা ডাকল। একবার না, দুইবার না পরপর তিনবার। আর তুই বলছিস আমার ভুল হচ্ছে? ‘

‘ তা নয়তো কী? ওটা তোর আর নামীর সন্তান? জীবন এতই সহজ? এটা কী নাটক, সিনেমা আশ্চর্য!’

কপট রাগ দেখিয়ে সৌধ এ কথা বলতেই দপ করে নিভে গেল সুহাস। বলল,

‘ হতে পারে না? ‘

থমথমে সে প্রশ্নে সৌধ ওর কাঁধ চেপে বলল,

‘ দোস্ত, আমরা নামীকে খুঁজে বের করব। তুই প্লিজ ধৈর্য্য ধর। ‘

‘ আমাদের সন্তান ঐ বয়সীই তো সৌধ? ‘

একমুহূর্ত চুপ রইল সৌধ। বোধহয় মনে মনে হিসেব কষল। এরপর উত্তর দিল,

‘ আট বা ন’মাস তো হবেই। ‘

‘ এ বয়সে বাচ্চারা মা, বাবা ডাকে না? ‘

সুহাসের অসহায় মুখটা দেখে খুব মায়া হলো সৌধর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা ঝাঁকাল সে। অস্ফুট হাসি ফুটল সুহাসের অধর কোণে। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ শিশুরা বাবা, মা চিনতে ভুল করে না। ‘

সৌধ ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘ আমাদের ভাতিজা বাবাকে দেখেইনি। চিনবে কী করে? ‘

সুহাস চটে গেল। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ এর জন্য দায়ী নামী। ওকে আমি ছাড়ব না সৌধ। একবার শুধু ওকে পাই। ছাড়ব না কিছুতেই। ‘

সৌধ বাঁকা হাসল। বন্ধুর বুকে চাপড় দিয়ে বলল,

‘ ছাড়িস না। ‘

কথাটা বলেই লেকের পাশ ধরে হাঁটতে লাগল সৌধ। সুহাসকে ইশারায় বলল এগুতে। সুহাস পিছন ফিরে একবার তাকাল। ঝকঝকে পরিষ্কার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল করুণ চোখে। এরপরই শুনতে পেল সৌধের ডাক।

‘ সুহাস, কাম অন। ‘

বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠল। ভয়ানক সেই শূন্যতা সুহাসের বুকের ভেতরটা যেন ক্ষতবিক্ষত করে দিতে লাগল। গত ষোলমাস ধরে সে এই শূন্যতাকে লালন করছে। যে শূন্যতা ক্ষণিক পূর্বের ঘটনায় আরো প্রকট হলো। তার ভেতরের পিতৃসত্তা তীক্ষ্ণ ভাবে জেগে ওঠেছে ‘পাপাহ’ শব্দের তিন ডাকে। বাচ্চাটা কেন তাকে পাপাহ ডাকল কেন?

সুদূর বাংলাদেশ থেকে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে এসেছে সুহাস৷ বন্ধু সৌধকে নিয়ে৷ তাদের এখানে আসার আজ দ্বিতীয় দিন। দ্বিতীয় দিনেই এমন একটি ঘটনার সম্মুখীন হয়ে সুহাস যেন আরো উন্মাদ হয়ে গেল। যাদের খোঁজে এ শহরে পা রেখেছে তাদের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠল দ্বিগুণ। তার মন বার বার বলছে বাচ্চাটা তাকে এমনি এমনি পাপাহ ডাকেনি। সৌধ বুঝাল,

‘ সুহাস এ বয়সে বাচ্চারা যে বুলি প্রথম শেখে। সবাইকে তা বলেই ডাকে৷ ঐ বাচ্চাটা হয়তো ঐ একটা ডাকই শিখেছে। তাই তোকে পাপা ডেকেছে। ‘

সুহাস অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,

‘ আমাকেই কেন? এ সময়ে কেন আমাকে ওটা বলে ডাকল। ‘

‘ আরে শালা, ঐ বেবিটা কি জেনে বসে আছে তুই কোন সময়, কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস। বা’ল আমার, ভাল্লাগে না। এই যে দিওয়ানা হইছ না। এইটা এখন না হয়ে তখন হলে কাজে দিত। ‘

সুহাস যেন নিভে গেল। বিড়বিড় করে বলল,

‘ একবার শুধু ওকে পাই, একটাবার শুধু পাই। ‘

সৌধ তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘ পেলে কী করবি? আই লাভ ইউ বলার নাম করে আই হেইট ইউ বলবি। চুমু দেবার নাম করে কামড়ে দিবি। আদর করার নাম করে মেরে অজ্ঞান বানিয়ে ফেলবি। জানা আছে না আমার? শুধু কি আমার পুরো গ্যাং জানে তোর কাণ্ড। আহারে বেচারি… ওর কোনো দোষই আমি দিতে পারি না। ‘

এ পর্যন্ত বলেই সুহাসের দিকে চোখ পড়ল সৌধর৷ একদম শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে। ধূসর রঙা ঐ চোখ দুটোর শান্তভাব পিল চমকে দিল তার। পরোক্ষণেই বাংলাদেশে হওয়া বন্ধুর করুণ দশার কথা স্মরণে এলো। দমে গেল সে। ভরসার সহিত হাত রাখল বন্ধু সুহাসের কাঁধে। বলল,

‘ বন্ধু নামীকে তো খুঁজে পাবই। তোকে শুধু কথা দিতে হবে যেভাবেই হোক ওকে কনভিন্স করবি৷ ওকে কনভিন্স করে দেশে নেয়ার দায়িত্ব তোর। বউ তোর, বাচ্চা তোর দায়িত্বও তোর। আমি আর কোনো ঘটকালি করতে পারব না। নয়তো শেষে বাঁশটা আমারি যাবে। ‘

সুহাস মুখ ফিরিয়ে উদাস নয়নে বসে রইল। বিশাল রেস্তোরাঁর কাঁচের দেয়াল ভেদ করে তার দৃষ্টি পড়ল জেনেভা শহুরের রাস্তায়। সুইজারল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল শহর জেনেভা। এ শহরেই থাকে নামী। শুনতে অবাক লাগলেও সুহাসের হৃদয়ে তীরাঘাত করা রমণীর নাম নামী। ডক্টর. নামী রহমান। উহুম সুহাসের ভাষায় নামীদামী ডক্টর। নামী যে কারো নাম হতে পারে সুহাস ভাবতেও পারেনি৷ তাই তো প্রথম সাক্ষাতে নাম শুনেই বলেছিল,

‘ কী নামীদামি? আমাকে পছন্দ হয়েছে তো? ‘

এই শহরের কোথায় থাকে নামী জানে না সে। শুধু জানে এ শহরেই আছে সে। যাকে খুঁজে পেতে খুব বেশি কাঠখড় পোহাতে হবে না বোধহয়। কারণ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে নিধির ম্যাসেজ এসেছে। নামী জেনেভা শহরের একটি প্রাইভেট হসপিটালে কর্মরত রয়েছে। শুধু তাই নয় সেই হসপিটালের মালিকের সঙ্গেই অ্যামেরিকা থেকে জেনেভায় এসেছে। সুহাসের চোখ মুখ কুঁচকে গেল। নামীর সঙ্গে ঐ লোকটার পরিচয় কীভাবে? কীভাবেই বা তার সঙ্গে এতদূর আসার দুঃসাহস দেখাল? তীব্র ক্রোধ জেগে ওঠল অচেনা লোকটার ওপর। বিড়বিড় করে বলল,

‘ শা’লা তোদের খোঁজ পেলে তোকে আগে ক্যালাব। ‘

পরোক্ষণেই কাচুমাচু মুখে বলল,

‘ এই না আমি এখন ভদ্র ছেলে। ওসব করা যাবে না। তাহলে নামীদামী পটবে না। ‘

সৌধর ডাকে হুঁশ ফিরল তার।

‘ সুহাস এই সুহাস, কোথায় হারালি। ধূর বা’ল আমার। ‘

‘ ছিঃ সৌধ ভাই। এসব বলে না। ‘

সুহাস আচমকা কথাটি বলেই হো হো করে হেসে ওঠল। হেসে ফেলল সৌধ নিজেও। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠল দুই বন্ধু। উদ্দেশ্য নিধির পাঠানো ঠিকানায় যাওয়া। যেখানে গেলেই তারা পৌঁছাতে পারবে ডক্টর.নামী রহমান অবধি৷ সুহাসের বুক ধকধক করছে। তীব্র উত্তেজনায় বসে থাকতে পারছে না। হাসফাস করছে কেমন। সৌধ তার নাজেহাল অবস্থা দেখে জানালার কাঁচ নামিয়ে দিল। আচমকা জেনেভা শহরের ঝকঝকে বাতাস ছুঁয়ে দিল ওকে। চোখ বুঁজে লম্বা একটি শ্বাস নিল সুহাস। বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ অপরিচিত দেশ, অপরিচিত শহর। অথচ এ শহরের বাতাসে প্রিয়তমার গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। কী আশ্চর্য! কী ভয়ানক কাণ্ড! আহ নামীদামি, তুমি বড়োই আশ্চর্যজনক মহিলা! ‘

সহসা হৃদয় গভীরে উষ্ণ অনুভূতি ছুঁয়ে যেতেই সুহাস ডুব দিল অতীতে। মন, মস্তিষ্ক জুড়ে হানা দিল সেই নামীদামি রমণীটি। পাঁচটা বছরের অপ্রিয় প্রিয় মুখ দীর্ঘ সাত বছরের বিস্তর অতীত।
_______________________
‘ কী বলছ বাবা! আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে? ‘

বাবার আবদারে বিস্মিত হলো সুহাস। মাত্র ২১ বছর বয়স তার। মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবার সঙ্গে তার এক আত্মীয়ার বাড়িতে এসেছে। এসেই জানতে পারে সেই আত্মীয়া বাবার কলেজ বান্ধবী। যিনি মারা গেছেন আজ দু’বছর। তার একমাত্র মেয়ে নামীকেই বিয়ে করতে বলছেন বাবা। সুহাস কিছুতেই রাজি হলো না। একে তো সে স্টুডেন্ট মানুষ। আবার সুন্দরী গার্লফ্রেন্ডও আছে। এদিকে নামী নামের মেয়েটা দেখতে অসুন্দরীই বলা যায়! দূর থেকে দু’বার দেখেছে। চোখে ধরেনি একটুও। নাক ছিটকাল সুহাস। ঐ মেয়েটা তার সঙ্গে বড্ড বেমানান। কিন্তু সোহান খন্দকার। অর্থাৎ সুহাসের বাবার জেদ নামীকেই সে পুত্রবধূ করবে। বাবার জেদের কাছে সুহাসের জেদ তুচ্ছ হয়ে গেল। সোহান সাহেব ছেলেকে হুমকি দিলেন,

‘ তুমি যদি নামীকে বিয়ে না করো। আমি তোমার মাকে ডিভোর্স দিব! ‘

সুহাস কেঁপে ওঠল। মাকে সে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সে শুনেছে, বাবার সঙ্গে তার মায়ের বিয়েটা হয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। মা রাজি থাকলেও বাবা রাজি ছিলেন না। দাদা আর নানা মিলে জোর করে বাবা মায়ের বিয়ে দিয়েছেন।
ফলে এত বছর সংসার হলেও একে অপরের মাঝে বনিবনা হয়ে ওঠেনি। বাবার প্রতি মায়ের ভালোবাসা থাকলেও মায়ের প্রতি বাবার একবিন্দু ভালোবাসা জন্মায়নি৷ এই যে সংসার। এই যে তারা দু’টো ভাইবোন। কেবল দায়িত্ব থেকেই তাদের পৃথিবীতে এনেছেন সোহান খন্দকার। যা একদিন ঝগড়ার সময় মুখ ফস্কে ছেলে, মেয়ের সামনেই বলে ফেলেছেন সোহান। এছাড়া সুহাস তার মা অর্থাৎ ডক্টর. উদয়িনীর মুখে শুনেছিল, বোন সিনু পেটে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাবা মা’র সঙ্গে এক বিছানায় রাত কাটায়নি। কথাটা অবশ্য সরাসরি শোনেনি। শুনেছিল আড়াল থেকে। এসব থেকেই তারা দুই ভাই, বোন বুঝে নিয়েছে বাবা, মায়ের সম্পর্কের জটিলতা। ছোটোবেলা অনেক চেষ্টা করত বাবা, মায়ের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি করার। বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে সেই উদ্যম হারিয়ে ফেলে ওরা। কারণ, এখন ওরা বুঝে গেছে সংসার ছাড়া ভালোবাসা পূর্ণতা না পেলেও ভালোবাসা ছাড়া সংসার পূর্ণ হয়৷ তার বাবা মা করেছে পূর্ণ। এ শহরে এমন শতশত সংসার আছে। যা ভালোবাসাহীন। তবুও স্বামী, সন্তান দিয়ে পরিপূর্ণ। তার মায়ের সংসারটা ঠিক সেরকমই একটি সংসার। যেই মহিলা ভালোবাসাহীন একটি সংসার আঁকড়ে এতগুলো বছর বেঁচে আছে। যেই মহিলা পঁচিশ বছর ধরে এক তরফা ভাবে স্বামীকে ভালোবেসে সংসার করছে। সেই মহিলাকে কত সহজে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলতে পারল সোহান খন্দকার। কী নিষ্ঠুর মানুষটা৷ কী নিষ্ঠুর বাবা! সুহাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বাবার দিকে তাকাল করুণ চোখে। বাবা নিজ সিদ্ধান্তে অটুট। সুহাস সহসা বলল,

‘ মায়ের মতো মানুষ বলে পার পেয়ে যাচ্ছ বাবা। অন্য কেউ থাকলে তোমার কপালে দুঃখ ছিল। ‘

বাবা হাসলেন। তাচ্ছিল্য ভরে। বললেন,

‘ তুমি আমাদের সন্তান সুহাস। উদয়িনী আমার মস্ত বড়ো ক্ষতি করলেও আমি তার মস্ত বড়ো ক্ষতিটা করতে পারলাম না। কারণ সে তোমার মা, আমার স্ত্রী। তার সম্মান রক্ষা করাটা আমার দায়িত্ব। সোহান খন্দকার জীবৎকালে নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করেনি। কৃপণতাও দেখায়নি। ‘

মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে তৎক্ষনাৎ সুহাসের মনে একটি কথা চলে এলো৷ মুখ ফস্কে বলেও দিল,

‘ তুমি মায়ের সব নিড পূরণ করছ না বাবা! ‘

স্তব্ধ হয়ে গেলেন সোহান সাহেব। এক মুহুর্ত নিশ্চুপ থেকে ভাবলেন, তার ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়েছে। তাছাড়া স্ত্রীর স্বভাব তিনি জানেন। পেশায় ডাক্তার হওয়াতে সাধারণদের কাছে যা লজ্জাজনক। তার কাছে তা খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তাই সুহাসের এহেন মন্তব্যে বিচলিত হলেন না। বরং প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,

‘ মানসিক ভাবে তৈরি হও৷ আজ রাতেই তোমার বিয়ে। ‘

কথাটা বলেই সুহাসের হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিলেন তিনি। সুহাস পরিস্থিতি বুঝে হাসফাস শুরু করল৷ কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক তালগোল পাকিয়ে গেল তার৷ শেষে বাবাকে বলল,

‘ আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে চাই। ‘

‘ নো প্রবলেম মাই সন। তবে মনে রেখো নামীর সঙ্গে আজ তোমার বিয়ে না হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার মাকে আমি ডিভোর্স দিব। পঁচিশ বছর আগে যা করতে পারিনি। আজ তাই করব। বিকজ, আজ আমার জীবনে কোনো পিছুটান নেই। ‘
***
লম্বা ফিনফিনে দেহশ্রীতে সুক্ষ্ম দৃষ্টি বুলাল সুহাস৷ নামী তীব্র অস্বস্তি নিয়ে রুমের একপাশে দাঁড়িয়ে। বিছানায় দু-হাত ভর করে বসা সুদর্শন পুরুষটির গাঢ় চাহনির কবলে পড়ে হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হয়ে গেছে তার। সুহাস খেয়াল করল, মেয়েটি ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। আচমকা তার দৃষ্টি নামল তার বুকের মধ্যস্থে। অধর কোণে ফুটল দুর্বোধ্য হাসি। গায়ের রঙ চাপা হলেও মেয়েটির দেহশ্রী নিখুঁত। এতক্ষণ তার মধ্যে বিয়ের প্রতি অনিহা কাজ করলেও নামীকে আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পর অনিহা কেটে গেল। যতই তার গার্লফ্রেন্ড সুন্দরী হোক না কেন দৈহিক গঠন এই মেয়েটির মতো নজরকাড়া নয়। বিষয়টা মাথায় আসতেই সুহাস ভাবল, বিয়ে করতেই হবে৷ না করে উপায়ও নেই৷ বর্তমানে গায়ের রঙ চাপা কোনো সমস্যাই না৷ এটা ম্যানেজ করে নেবে। শুধু অরিনকে ম্যানেজ করাই কঠিন হবে। সাত মাসের রিলেশনে কত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটিয়েছে দু’জন। সে ভুলতে পারলেও অরিনের বেশ কষ্ট হবে। ঢোক গিলল সুহাস৷ খেয়াল করল নামী একটু পর পর তাকাচ্ছে তার দিকে। তাই মুচকি হেসে বলল,

‘ কী নামীদামি আমাকে পছন্দ হয়েছে তো? ‘

নামী লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল। এতে সুহাস মজা পেল খুব৷ দুই পা দুলাতে দুলাতে রসাল সুরে বলল,

‘ ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? পাশে এসে বসো। ‘

নামী এক চুলও নড়ল না। তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। সুহাস টের পেল মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। মনে মনে ভেঙচি কাটল তাই৷ এরপর ইচ্ছে করে দিল এক ধমক,

‘ অ্যাঁই নামীদামি, এত দাম দেখাচ্ছ কেন? এদিকে এসো, বসো পাশে। নইলে কিন্তু বিয়ে করব না। ‘

চমকে তাকাল নামী। কিঞ্চিৎ ভীত হয়ে ঢোক গিলল। মৃদু পায়ে এগিয়ে এসে বসল পাশে। সুহাস অবাক হয়ে তাকাল। ড্যাবড্যাবিয়ে নামীর ভাবগতিক বোঝার চেষ্টা করল। বলল,

‘ বাব্বাহ বিয়ের প্রতি এত ইন্টারেস্ট? তো নামীদামি ঝেড়ে কাশো তো। ‘

অবুঝ চোখে তাকাল নামী। সুহাস অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল,

‘ ওলে অবুঝলে। ‘

এ কথা বলেই ভ্রু নাচাল। মুখ নিচু করে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,

‘ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ক’বার ডেটে গেছ বেবি? ‘

চমকে ওঠল নামী। তড়াক করে ওঠে দাঁড়াল সে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে সুহাসের দিকে তাকাল একবার। তারপর রুম ত্যাগ করতে উদ্যত হলো। টের পেয়ে হাত চেপে ধরল সুহাস৷ লাফিয়ে ওঠে বলল,

‘ অ্যাঁই নামীদামি, একদম রুম থেকে বেরোবে না। ‘

নামী মুখ ফিরিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। হাত ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টাও করল। সুহাস বলল,

‘ ও মা গো! এত দেখি সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে। এই তুমি নাগিন টাগিন নও তো? ভেজা বেজি থেকে অগ্নিঝড়া সাপ! কী সাংঘাতিক!’

‘ হাত ছাড়ুন। ‘

শক্ত কণ্ঠের মেয়েলি বাক্যে চমকাল সুহাস৷ বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘ তার মানে বোবা নয়। ‘

নামী অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। সুহাস হাত ছেড়ে বলল,

‘ ওকে ফাইন ছাড়লাম। কিন্তু রুম থেকে যেও না। আজ রাতে তোমার আমার বিয়ে৷ জরুরি কথা আছে বসো পাশে। ‘

এ দফায় কিঞ্চিৎ শান্ত হলো নামী। কিন্তু বসল না৷ সুহাস আর বসতেও বলল না। নিজে বসে প্রশ্ন করল,

‘ বয়ফ্রেন্ড আছে? ‘

কাঠকাঠ গলায় নামী জবাব দিল,

‘ না। ‘

‘ থাকবে কী করে? ছেলেদের রুচি এখনো এত নিচে নামেনি। আর যাইহোক, সাক্ষাৎ নাগিনীর ধারেকাছে কেউ আসতে চাইবে না। ‘

তীব্র মেজাজ খারাপ হয়ে গেল নামীর। আর এক মুহুর্ত এই ছেলের সামনে দাঁড়ালে নিশ্চিত ঠাটিয়ে থাপ্পড় বসাবে। দু বছরের সিনিয়র বলে এমন কাণ্ড সে ঘটাতে চাইল না। এরচেয়ে ভালো এখান থেকে বিদায় হওয়া। উচ্চ পদধ্বনিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। সুহাস হকচকিয়ে গেল। ক্ষীণ স্বরে বলে ওঠল,

‘ ফায়ার স্ন্যাক! ‘

পরোক্ষণেই লাফিয়ে ওঠল৷ বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ অসম্ভব! জলজ্যান্ত সাপকে বিয়ে করা অসম্ভব। ছিঃ বাবা, তোমার রুচি দেখে বমি পেয়ে গেল! আমার অপরূপা মাকে তুমি চয়েজ করো না। অথচ এই ফায়ার স্ন্যাক তোমারি চয়েজ ছিঃ!’

চলবে।

প্রনয় পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব–৩৩

কোলাহল পূর্ন রাস্তা।আশেপাশে গাড়ির ছড়াছড়ি। জ্যামে ভর্তি পথ,কখনও সিগন্যাল।সাথে রোদের প্রকোপ।কোনো কিছুই আজ মন ছুঁতে পারছেনা রুদ্রর।এক বিন্দু বিরক্তি নেই মুখে।সে উদাস,অন্যমনস্ক। যেন ভিন্ন কোনো গ্রহে তার বাস এখন।দুনিয়ার মাটিতে শুধু পরে আছে দেহটা।সামনে রেহান মৃদূমন্দ গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে।মুখ ভার রেহানের।মন ও খারাপ।রুদ্র আজীবনের মতো দেশ ছাড়ছে।রুদ্র হোক রাগী,মেজাজি কিন্তু কতটা উদার,দয়ালু সে জানে।আজ অব্দি বিপদে পরেছে আর রুদ্র সাহায্য করেনি এমন সময় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।কত বছর ধরে রুদ্রর অধীনে কাজ করছে।মনে মনে সে রুদ্রর অন্ধভক্ত বলা যায়।অথচ আজ রুদ্র যখন চলে যাচ্ছে একবার মুখ ফুটে বলতেও পারছেনা স্যার যাবেন না।রেহান বারবার ভিউ মিরর দিয়ে রুদ্রকে দেখছে।অনেকক্ষন পর রুদ্র শান্ত কন্ঠে বলল ‘ কিছু বলতে চাও রেহান?
রেহান নড়েচড়ে ওঠে।স্টিয়ারিং এ রাখা হাত দুটো কেমন কেঁপে এলো।রুদ্র একী প্রশ্ন আবার করল।সাথে বলল,
“কিছু বলার থাকলে বলে দাও।পরে আর দেখা হবেনা।
রেহানের যেন কান্না পেলো।মেয়ে মানুষ হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদেই দিত।ধরাধরা গলায় বলল
‘ স্যার,বলছিলাম কী,যদি না যেতেন!
রুদ্র হাসলো।হাসির সাথে বের হলো দীর্ঘশ্বাস। রেহান উত্তর পেলো এতেই।রুদ্রকে আজ থামানোর ক্ষমতা তার নেই।রুদ্র যাবেই।ছাড়বেই মাতৃভূমি।

রুদ্র জানলা গলিয়ে বাইরে তাকালো।প্রকৃতি আজ হাস্যজ্জ্বল।সোনারোদ হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।রুদ্র শুধালো
‘ কীসের এত আনন্দ তোমাদের?আমার বিরহে কেন কাঁদছোনা তোমরা?
জবাবে ওরা আরো হাসে।হেসে কুটিকুটি হয়।রুদ্রর বিষন্নতা বাড়লো।সেলফোন বের করে শেফালির মেসেজটি বার করলো।বাংলায় লেখা ‘সেঁজুতি রাফসানের গায়ে হলুদ শেষ।এখন বিয়ের তোরজোর চলছে।কালকের বদলে বিয়ে হবে আজকেই।এইতো আধঘন্টা পর।
মেসেজটি এসেছে আরো ঘন্টাখানেক আগে।তারমানে এতক্ষনে সেঁজুতির বিয়ে শেষ। ও এখন অন্য কারো বউ?এটা ভেবেই রুদ্র চিৎকার করে কেঁদেছে।বাড়ি ভরা সার্ভেন্ট,অভ্র, কাউকে মানেনি।কারোর তোয়াক্কা করেনি।ভাঙচূর করেছে। অভ্র ধরেবেঁধে রাখতে হিমসিম খাচ্ছিলো বড্ড।রুদ্র মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসে পরে তারপর। হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়।কতক্ষন নিশব্দে কাঁদে।এরপর হুট করেই উঠে দাঁড়ায়।সার্ভেন্ট কে বলা হয় ব্যাগ গুছিয়ে দিতে।আজ এই মুহুর্তে দেশ ত্যাগ করবে।সাথে ত্যাগ হবে সেঁজুতির মায়া।অভ্রর শত অনুরোধ ফিকে হয় সেখানে।রুদ্র শোনেনা।বেরিয়ে পরে রেহান কে সাথে নিয়ে।অভ্র বহুবার সেঁজুতিকে ফোন করলো,চিন্তায় তার মাথা দুভাগ হয়ে যাচ্ছে।এত কিছু শুনেও মেয়েটা মত বদলালো না? এ কেমন পাষন্ড নারী?তবে ওর কান্নাগুলো ছিলো মিথ্যে?সেঁজুতির ফোন বন্ধ পেয়ে অভ্রর যেন আরো রাগ বাড়লো।বিড়বিড় করে সেঁজুতি কে গালি দিতে মন চাইলো।কিন্তু বড়ভাইয়ের প্রেয়সী বলেই বিবেকে বাঁধলো হয়ত!
____

রুদ্রর চোখ ভিজে উঠছে। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছলো কবার।লাভই হচ্ছেনা। আবার ভিজে যাচ্ছে।রেহান বারবার চোরা চোখে,মুখ কালো করে রুদ্রর কান্না দেখছে।রুদ্র বিরক্ত হলো নিজের ওপর। একটা মেয়ের জন্যে এত কীসের কান্না?কীসের শোক?বিরক্তিটা ঝাড়লো রেহানের ওপর। কঁড়া কন্ঠে বলল ‘ গ্লাস ঘোরাও।
সঙ্গে সঙ্গে রেহান ভিউ মিরর ঘুরিয়ে দিলো।এখন আর রুদ্রকে দেখা যাচ্ছেনা।রুদ্র ঠোঁট কামড়ে ধরে রাস্তা দেখছে।কান্না আটকাচ্ছে হয়ত।
এ জীবনে আর সেঁজুতিকে পাওয়া হলোনা। কথাটি যতবার মাথায় আসছে ততবার ভেতরের রক্তক্ষরন কয়েক গুনে বাড়ছে।কেন ভালোবাসতে গেলো?একপাক্ষিক ভালোবাসায় এত কষ্ট!এর থেকে তো আগের জীবনই ভালো ছিলো।ঝঞ্জাট মুক্ত,নির্ভেজাল।অন্তত ক্ষত বিক্ষত হৃদপিন্ড টা কে বয়ে বেড়াতে হয়নি।কাউকে না পাওয়ার দুঃখ সেখানে ছিলোনা।না ছিলো ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়ার ভয়।
সেঁজুতি সব আশা,ভরসা মিথ্যে প্রমান করলো।বউ হয়ে গেলো আরেকজনের।রুদ্র অস্পষ্ট শব্দে বিড়বিড় করলো “স্বার্থপর মেয়ে!

‘ এসিটা বন্ধ করো রেহান।
রেহান তাই করলো।রুদ্র গ্লাস খুলে দিলো গাড়ির।সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো।হঠাৎ কী মনে করে সিগারেটের উড়ে যাওয়া ছাই গুলোর দিক মনোযোগ দিয়ে চেয়ে থাকলো।ভালোবাসাটা কী এই সিগারেটের মতন নয়?যার শুরু আগুন দিয়ে হলেও শেষ হবে ছাই দিয়ে?
রুদ্রর ধ্যান ভাঙলো গাড়ি ব্রেক কষায়।রেহান ঘাড় ফিরিয়ে বলল
‘স্যার এসে গেছি…
রুদ্র মাথা দোলায়।সিগারেট ফেলে দিয়ে নেমে দাড়ালো।রক্তিম চোখদুটো লোকাতে সানগ্লাস পরলো।রেহান ও বের হলো।গাড়ির ডিকি খুলতে যাবে তখন রুদ্র এসে কাঁধে হাত রাখলো ওর।রেহান অবাক চোখে তাকালো।রুদ্র নম্র কন্ঠে বলল
” অনেক বকাঝকা করেছি তোমায় রেহান।পারলে ভুলে যেও সেসব।পরিবারের সাথে নিজেরও খেয়াল রেখ।আর আমার ভাইটারও।

রেহান এবার কেঁদেই ফেলল।রুদ্র ক্ষীন হেসে রেহান কে বুকে জড়ায়।রেহানের চোখ যেন তাতে বেরিয়ে আসে।রুদ্র সরে এলো। বলল ‘ যাও। লাগেজ নামিয়ে আনো।
রেহান মাথা নাড়ে।চোখ মুছে ডিকি খুলতে এগোয়।

‘ভাই?
অভ্রর গলা শুনে রুদ্র চমকে পেছনে তাকালো।ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘সেই এলিই?
অভ্র এগিয়ে এলো।বোজা কন্ঠে বলল,
‘যেওনা ভাই,,,প্লিজ

রুদ্র মেকি শক্ত কন্ঠে বলল,
‘আর লাভ নেই অভ্র।সিদ্ধান্ত নেয়া শেষ আমার।

‘ঐ একটা মেয়ের জন্যে সব ছেড়েছুড়ে যাবে ভাই?
রুদ্র উদাস হাসে,
‘ ঐ মেয়েটাই যে আমার কী ছিলো রে অভ্র। আজ বুঝছি।

‘ আমার কথা ভাবছোনা?তোমাকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো?আমি তোমার নিজের ভাই হলে পারতে এমন করতে?

রুদ্র বোবা বনে গেলো সেকেন্ডের জন্যে।ফিচেল কন্ঠে বলল
‘ এভাবে বলতে পারলি?তুই আমার পর?
অভ্র কথা বলেনা।বিদ্যুৎ বেগে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে।
‘ যেওনা ভাই যেওনা।
রুদ্র স্ফীত হাসলো,অভ্রর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
‘আমি কি একেবারে যাচ্ছি নাকি রে বোঁকা!কয়েক বছর পর আবার ফিরবো।তোর বিয়ে দিতে হবেনা?? ভাসুর হবো তারপর তোর বাচ্চাদের জেঠু হবো… অনেক কাজ বাকি এখনও।
অভ্র হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো,রুদ্র বিরক্ত হওয়ার ভান করে বলল,

‘ছাড় অভ্র।মেয়েদের মতো কাঁদবিনা।আর বাচ্চাদের মতোন বায়না তো একদম ধরবিনা।
অভ্র সরে এলো।কপট রাগ দেখিয়ে বলল ‘ তার মানে তুমি যাবেই?

রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো। ‘ ফ্লাইটের সময় হয়ে এসছে অভ্র।
অভ্রর পাশ কাটিয়ে রুদ্র চলে যায়।অভ্র রাগে দুঃখে গাড়িতে লাথি মারলো।এই সব কিছুর মূলে ওই মেয়ে।অকৃতজ্ঞ কোথাকারে!

_____
এয়ারপোর্টের চেকিং গেটের সামনে দাঁড়ালো রুদ্র।রেহানের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকালো। অভ্রকে দেখা যাচ্ছে।মন মরা হয়ে চেয়ে আছে ছেলেটা।একিরকম মন মরা রেহান ও।রুদ্র দুজনকেই একবার একবার করে দেখে নেয়।হাত নেড়ে বিদায় জানায়।চারপাশে ক্লান্ত দৃষ্টি ফেলে কাউকে মিথ্যে মিথ্যে খোঁজে,মনে মনে বলে,
“ভালো থাকবেন সেঁজুতি।নিজের নতুন জীবনে সুখী হবেন।আর আমি জ্বালাবোনা আপনাকে।এই শেষ!

অনেক কষ্টে ফেরত আসা অশ্রুটুকুন সংযত করলো রুদ্র। কাঁচের গেট ঠেলে ঢুকবে এর আগেই পেছন থেকে হাত টেনে ধরলো কেউ একজন।রুদ্র এবার সত্যিই বিরক্ত হলো।ফিরে না তাকিয়ে বলল
“এবার আর নিতে পারছিনা অভ্র।ছাড়। আমি যাবোই।
” যেতে দিলে তো যাবেন।
কাঙ্ক্ষিত কন্ঠস্বর শুনে স্তব্ধ রুদ্র।বিদ্যুৎ বেগে ঘাড় ঘোরালো।সেঁজুতি মুখ ফুলিয়ে চেয়ে আছে।রুদ্র অবিশ্বাসের কন্ঠে বলল,
‘আপনি?

সেঁজুতি নাক মুখ ফুলিয়ে বলল ‘আমাকে এভাবে একা রেখে চলে যাচ্ছেন?এত সাহস কোথ থেকে পেলেন আপনি?
রুদ্র যেন এখনও নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছেনা।এটা কী সেঁজুতি?
‘ আপনি কী সত্যি সত্যি এসেছেন?
‘ না।আমার ভূত এসেছে।

তর্ক করার বহরে রুদ্র বুঝলো এটা সত্যিই সেঁজুতি। কিন্তু খুশির বদলে অভিমান মাথা চাঁড়া দিলো।অন্যদিক চেয়ে বলল,
‘ কেন এসেছেন?আপনি না এখন অন্যের বিয়ে করা বউ?
সেঁজুতি দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ও তাই?তাহলে আপনি ধরেই নিয়েছেন আমি অন্যের হয়ে গেছি?তবে আর কি!ফিরে যাচ্ছি আমি।

সেঁজুতি চলে যাওয়ার ভান করতেই রুদ্র তড়িঘড়ি করে হাত টেনে ধরলো। সেঁজুতি পেছন ফিরলোনা।মিটিমিটি হাসছে।রুদ্র অনুরোধ করলো,

“যাবেন না সেঁজুতি!

“তবে যে বললেন আমি অন্যের।

‘তাহলে আপনি কার?
সেঁজুতি ঘুরে তাকায়।রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলে,
“জানেন না?
রুদ্র নিষ্পলক চেয়ে মাথা নাঁড়ে দুদিকে ‘ সে জানেনা।
সেঁজুতি চোখ নামিয়ে মুচকি হেসে বলল ‘ আপনার।
রুদ্র যেন ঘোরে ছিলো।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল ‘হু?আর,আর আপনার বিয়ে?
‘ ভেঙে দিয়েছি।

রুদ্র উদ্বিগ্ন হয়ে বলল ‘ শেফালী যে বলল আপনার___
সেঁজুতি মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল ‘ শেফালীকে আপনি কী করে চিনলেন?
সেঁজুতি ভ্রু নাঁচায়।সব জেনেও না বোঝার ভান করছে ও।রুদ্র জ্বিভ কাটলো।মুখ ফসকে বলে ফেলেছে নামটা।আমতা-আমতা করলো কিছুক্ষন।সেঁজুতি বলল
‘ থাক! আর বানিয়ে বলার দরকার নেই।আমি সব জানি।
রুদ্র ভঁড়কে বলল ‘ কী জানেন?

‘ সেসব আপনার না জানলেও চলবে।আমি বিয়ে ভেঙে দিয়েছি।আর শেফালীর ফোন থেকে ওসব আমিই পাঠিয়েছি।বুঝেছেন?

রুদ্র বোঁকা বোঁকা চাউনীতে মাথা দোলালো।তেমনি অবুঝের মত জিজ্ঞেস করলো’ বিয়ে ভেঙেছেন কেন?
সেঁজুতি এবার মহাবিরক্ত।সব কি মুখ ফুঁটে বলতে হবে?মাথামোটা লোকটা বুঝতে পারছেনা?রুদ্র একী প্রশ্ন আবার করলো।
‘কেন ভাঙবে আবার?আপনার জন্যে ভেঙেছে।

রুদ্র চোখ বড় করে বলল,
“আমার জন্যে? কিন্তু আমিতো কিছু করিনি।

” বললেই হলো করেন নি?এই যে আমার মন চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছেন এটা অপরাধ নয়?

রুদ্র বিমুঢ়।
‘মমানে? বিস্ময়ে গলা কেঁপে এলো রুদ্রর।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
মানে জানেন না??
রুদ্র এবারেও মাথা নেড়ে। সে জানেনা।

সেঁজুতি দপায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়।রুদ্রর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“ভালোবাসি।
রুদ্রর গোটা দেহে অদ্ভূত শিহরন হলো।শরীরের রক্তপ্রবাহ থেমে গেলো যেন।ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ করে উঠলো হৃদপিণ্ড টা।ওর বিস্মিত চাউনীতে সেঁজুতি গভীর দৃষ্টি রেখে বলল
“ভালোবাসি।
রুদ্র মূর্তির মত ঠোঁট নেড়ে বলল,
” আবার বলুন..

“ভালোবাসি।

“আরেকবার..
” ভালোবাসি।

‘আরেকবার।
‘ আর পারবনা।
রুদ্র তখনও হা করে তাকিয়ে।ঠিক শুনলো তো?সেঁজুতি ভালোবাসে?সত্যিই বাসে?সেঁজুতি ওড়নার মাথা আঙুলে প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল,

‘হা করে কি দেখছেন? জড়িয়ে ধরবেন না?
রুদ্র যেন হুশে ফেরে।নিশ্চিত হতে শুধায়,
‘ সত্যিই জড়িয়ে ধরবো.??

‘মিথ্যে মিথ্যে জড়িয়ে ধরা যায়?
রুদ্র ঘাড় চুল্কে বলল,
‘না মানে,ইয়ে…..
সেঁজুতি হেসে বলল,
‘রুদ্র রওশন চৌধুরী ও কিনা তোঁতলাচ্ছে?

রুদ্র আর সময় নষ্ট করলোনা।সঙ্গে সঙ্গে সেঁজুতি কে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।এত শক্ত করে ধরলো যে সেঁজুতির শ্বাস আটকে আসার জোগাড়। অথচ টু শব্দ করলোনা।সে ব্যাস্ত রুদ্রর গায়ের ঘ্রানে মিশতে।বুকটা প্রশান্ত হলে রুদ্র নিজেই মৃদূ হাত ঢিলে করলো।আওড়ালো
‘ আমিও ভালোবাসি সেঁজুতি। অনেক বেশি ভালোবাসি।
সেঁজুতি মুখ লোকালো ওর প্রসস্থ বুকে।এত শান্তি কেন এখানে?

সমানে মুখের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে সিটি বাজাচ্ছে অভ্র।আনন্দ বাঁধ মানছেনা।পাশেই হেসে দাঁড়িয়ে আছে রেহান, আবির, এরিকা।ওদের দেখে সেঁজুতি সরে আসতে চাইলেও বাঁধা দিলো রুদ্র।
‘ অলরেডি সবাই দেখে নিয়েছে, সো এখন আর লজ্জ্বা পেয়ে লাভ নেই।

সবার আগে এগিয়ে এলো অভ্র। আমুদে কন্ঠে বলল,
“বাহ ভাই বাহ।কি সুন্দর মানিয়েছে তোমাদের।বলেছিলাম না ভাই?ভালোবাসায় বিশ্বাস রাখতে।দেখলে তো অবশেষে সফল হলে?

রুদ্র ভাব নিয়ে বলল
” দিন দিন ভাইয়ের মতোই ট্যালেন্টেড হচ্ছিস। ভেরী ওয়েল।
অভ্র গাল ফোলালো,
‘ওমনি ক্রেডিট নিয়ে নিলে?

সেঁজুতি আর আবিরের চোখাচোখি হতেই আবির চোখ নামিয়ে ফেলল লজ্জ্বায়।ঐদিনের পর সেঁজুতির সামনেও পরেনি।সেঁজুতি আবিরের হাবভাবে হেসে ফেলল,
“আরে আবির , এতো লজ্জ্বা পাচ্ছো কেন? তোমার জন্যেই না আমি বুঝতে পেরেছি আমি স্যার কে ভালোবাসি।তুমি যা করেছো আমাদের জন্যই তো..
আবির খুশি খুশি কন্ঠে বলল
‘তাহলে তুমি রেগে নেই?

‘প্রথমে ছিলাম,,,কিন্তু এখন নেই।
আবির বুকে হাত দিয়ে বলল,
‘যাক বাবা!একটা বড় পাথর নামিয়ে দিলে আমার বুক থেকে।আমিতো ভেবেছিলাম দেখা হলেই ঠাস ঠাস চড় লাগাবে।

সেঁজুতি লজ্জ্বা পেলো।প্রসঙ্গ এড়াতে বলল
‘ওসব বাদ দাও । তোমার ওয়াইফ কিন্তু ভারী মিষ্টি।আলাপ করাবেনা?

-‘ওহ হ্যা হ্যা।সেঁজুতি ও হচ্ছে আমার মিসেস।আর এরিকা ও কে সেটা নিশ্চয়ই তোমাকে বলতে হবেনা।

-এরিকা হেসে ইংরেজিতে বলল ‘ একদম না।আমি চিনি ওনাকে।উনিইতো রুদ্র ভাইয়ের প্রান ভোঁমড়া।

সেঁজুতি নুইয়ে পরলো লজ্জ্বায়।
অভ্র তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে।রুদ্রর ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। সারা মুখ জুড়ে বিচরন করছে প্রশান্তি।সুখ তারার মত জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো।তার ভাই আজ খুশি। বড্ড খুশি।আর এই খুশিটাই তো দেখতে চেয়েছিলো ও।সত্যিই হয়তো নিজের ভালোবাসাকে আপন করে পাওয়ার মত সুখ,আনন্দ অত্র পৃথিবীর বুকে আর কোনও কিছুতে নেই।

অভ্র দুষ্টুমি করে বলল,
‘ভাই?তোমার না ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছে?যাবেনা?
রুদ্র চোখ পাঁকিয়ে তাকাতেই হেসে ফেলল সবাই।রুদ্র ও হাসলো।মাথা চুল্কে বলল,
‘এই দেশ আর ছাড়বনা।

‘ হ্যা এখন তো দেবদাসের পারবতি হাজির।দেশ ছেড়ে লাভ কী?

‘- তুই আর মানুষ হলিনা অভ্র।
অভ্র একটা লম্বা শ্বাস নিলো।দুহাত ওপরে তুলে বলল,
‘ যাক! সব ভালোয় ভালোয় মিটলো, এবার একটা জম্পেস খাওয়া দাওয়া দরকার।ভাই,আজ আমাদের বাড়িতে একটা পার্টি রাখলে কেমন হয়?
সবাই এক যোগে তাল মেলালো অভ্রর কথায়।
‘ চলো তাহলে? আবির, চলুন সবাই মিলে জোগাড় যন্ত করে ফেলি?
‘ হ্যা হ্যা চলুন…
রুদ্র মিনমিন করে বলল ‘ ইয়ে,তোরা যা অভ্র।আমি আসছি…
অভ্র মিটিমিটি হেসে বলল ‘ সেঁজুতি কে তবে নিয়ে যাই?
রুদ্র ভ্রু কোঁচকাতেই অভ্র ব্যাস্ত কন্ঠে বলল ‘ না বাবা আমার অত সাহস নেই।তোমরাই থাকো…

_____
সেঁজুতির আঙুলের ভাঁজে রুদ্রর এক হাতের আঙুল।অন্য হাত দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
আজ আর বাইরে তাকিয়ে নয়।রুদ্র কে একভাবে,একমনে দেখছে সেঁজুতি। হঠাৎ রুদ্র বলে ওঠে,
“এভাবে তাকিয়ে থাকলে গাড়ি চালাতে যে বড্ড মুশকিলে পরতে হবে ম্যাডাম…

‘হোক।আমি তাকিয়েই থাকবো।
রুদ্র তাকালো,ডান ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
‘ কি দেখছেন তাকিয়ে??

‘ আপনার হেয়ার স্টাইল দেখছি।

রুদ্র শব্দ করে হেসে ফেলল।হাসি থামিয়ে বলল,
“আমার কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই গেলো।বিয়ে ভাঙলেন কেনো?
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
” আবার? বারবার কি ভালোবাসি এটা শুনতে ইচ্ছে করছে?
রুদ্র গাঢ় স্বরে বলল,
” এটা শোনার জন্যে তো কম ছটফট করিনি।শোনালে মন্দ হয়না।

‘বলব।সারাজীবন বলতেই তো আপনার হাত ধরেছি।
সেঁজুতি রুদ্রর হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল।
রুদ্র মুগ্ধ হাসলো,
” বিয়েটা ভাঙলেন কি করে?এটা বলতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?

‘ না তা নেই।আসলে আমি রাফসান কে বলে দিয়েছি সব সত্যি।

‘ কোন সত্যি?

‘আপনাকে নিয়ে আমার জীবনের সব থেকে বড় আর প্রথম সত্যিটা।

‘ব্যাস? এতেই কাজ হয়ে গেলো?
সেঁজুতি থেমে থেমে বলল,
-‘আমি সেভাবে বলিনি।একটু রং ছড়িয়ে বলেছি সাথে। বলেছি যে আপনার সাথে আমার গত দু বছর ধরে প্রেম চলছে আর আমাদের ফিজিক্যাল ও হয়েছে। আমি জানি কোনও ছেলেই এটা শুনলে বিয়েতে রাজি হবেনা।আমাকে আলাদা করে কিছুই করতে হয়নি।রাফসান নিজেই বিয়ে ভেঙে দিলো এতে।

রুদ্র অবাক হয়ে বলল,
‘যতটা বোঁকা ভাবতাম ততটা নন।

‘ আমি কিন্তু অতটাও চালাক নই।আবিরকেও তো সত্যিটা জানিয়েছি।ওতো কি সুন্দর ভাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো!খুব অবাক হয়েছিলাম।ভেবেছিলাম হয়তো সব ছেলে এক নয়।অবশ্য পরেই না বুঝলাম সব নাটক।আপনার ইশারাতেই চলছিলো ব্যাটা।

রুদ্র সন্দেহী চোখে তাকালো,

“আবিরকে পছন্দ ছিলো অনেক??

‘কখনওই না।আমার শুধু এই রাগী,মেজাজি লোকটাকেই পছন্দ।

রুদ্র মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ তাহলে এতদিন এলেনা কেন?জানো কত কষ্ট পাচ্ছিলাম?
‘ আপনি একাই বুঝি পেয়েছেন?আমি পাইনি?
‘পেয়েছো?
‘ একশবার।
” একটা বিষয় খেয়াল করলে?
‘কী?
‘আমি কিন্তু তোমায় তুমি বললাম।

সেঁজুতি মুচকি হেসে বলল,
‘ তাতে কী হয়েছে?আপনার মুখে তুমিই সুন্দর।

‘তাই?তাহলে তোমার বলা উচিত না?
‘ সময় লাগবে।

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
‘ হু।
‘ এখন আর ভয় করছেনা?এখন আর মনে হচ্ছেনা আমাকে ভরসা করা ভুল?

সেঁজুতি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘একদম না।আপনাকে খারাপ জেনেই মন দিয়েছিলাম।দেরিতে হলেও আমার সব ভুল ধারনা ভেঙে গিয়েছে। আপনার প্রতি আমার মনে যা খারাপ ভাবনা ছিলো সব মুছে গেছে।আমি জানি, ভালোবেসে আমার হাত আঁকড়ে ধরার মত আপনার মত আর কেউ নেই।
রুদ্র শুভ্র হাসলো।সেঁজুতি মায়া মায়া চোখে চেয়ে বলল,

‘অনেক কষ্ট দিয়েছি তাইনা?
রুদ্র সেঁজুতির হাতের উল্টোপঠে চুমু খেলো।সেঁজুতি কেঁপে ওঠে ঈষৎ। রুদ্র শীতল কন্ঠে বলল,
‘সব কষ্টের থেকে আজকের সুখের পরিমান টা যে অনেক বেশি।তাই সব গোল্লায় যাক। অবশেষে ভালো তো বেসেছো এতেই চলবে।
এই এক মিনিট এক মিনিট, তুমি কি করে জানলে যে আবির আমার কথায় কাজ করছিলো??

‘ সে আমি যেভাবেই জেনে থাকি।
সেটাতো বড় কথা নয়।বড় কথা এটাই যে আজ থেকে ‘আমি আপনার আর শুধু আপনারই।

কথাটা শুনেই গাড়িতে ব্রেক কষলো রুদ্র।সেঁজুতি বুঝতে না পেরে বলল

‘ কি হলো?
রুদ্র গভীর চোখে চাইলো,
‘বলেছিলাম না?এই কথাটা একদিন তুমিই বলবে?
সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল,
“শুধু আজ নয়,এই কথাটা আজ থেকে সারাজীবন বলব আমি।

রুদ্রর চোখে মুখে খেলে গেলো একরাশ মুগ্ধতা। কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে নেমে এলো। ঘুরে গিয়ে সেঁজুতির পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল
“নামো।
রুদ্রর আচরন কিছুই বুঝছেনা সেঁজুতি। তবুও রুদ্রর কথাতে নামলো।মাটিতে পা ছোঁয়ানোর আগেই হুট করে রুদ্র কোলে তুলে নেয়।সেঁজুতি হকচকায় প্রচন্ড।ভয়ে পেয়ে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরলো।পরমুহূর্তে লজ্জ্বায় আড়ষ্ট হয়ে বলল,
‘ ককি করছেন?

রুদ্র হাসলো।ওকে কোলে নিয়েই সামনে এগোলো।খোলা মাঠ,চারপাশে গাছ।ছোট ছোট বেঞ্চ।অল্প হেটে রুদ্র সেঁজুতি কে নামালো।তখনি ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।হঠাৎ বৃষ্টির আক্রমনে সেঁজুতি হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করার ব্যার্থ চেষ্টা করলো।সেঁজুতির দিকে চেয়ে চেয়েই রুদ্র পেছনে এগোচ্ছে।সাদা শার্ট ভিজে দৃশ্যমান চওড়া দেহ।সেঁজুতি বুঝলো রুদ্র ভিজতে চাচ্ছে।তাই আর কথা বললনা।রুদ্র হঠাৎ দুহাত দুদিকে মেলে দিলো।নিরেট কন্ঠে বলল,

“””””আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
মনের আদ্যোপান্ত
তুমি আমার দুরন্ত মনের “”””””
একটু খানি প্রশান্ত
“”””””””তুমি আমার বেঁচে থাকার প্রেরনায়
মোহময়ী আশা
তুমিই আমার এ জীবনে…..”””””””
“””””প্রথম আর শেষ ভালোবাসা””””””

‘ ভালোবাসি সেঁজুতি। অকারনে ভালোবাসি।অজান্তেই ভালোবাসি।সারাজীবন বাসব।এক বিন্দু কমতি হবেনা এই ভালোবাসার।

সেঁজুতির চোখ ছলছল করে ওঠে।বৃষ্টির ঝাপটায় আলাদা ভাবে বোঝা যায়না তাদের।ছুটে গিয়ে রুদ্রর বুকে ঝাপিয়ে পরলো সেঁজুতি।

‘ ভালোবাসবেন তো এভাবে?

সেজুতির ভেজা চুল সরিয়ে কপালে এক গভীর চুঁমু আঁকলো রুদ্র।হাতের বাঁধন শক্ত করে বলল,
“মরার আগ পর্যন্ত বাসব।
দুজনের দেহ ভিজে চুপচুপে।অথচ ভ্রুক্ষেপহীন দুজনেই।বুকের সাথে সেঁজুতি কে মিশিয়ে ফেলছে রুদ্র।চাইলে ঢুকিয়ে রাখতো ভেতরে।
এই তো শুরু হলো তাদের #প্রনয়ের গল্প।এই বাতাস,সবুজ ঘাস,খোলা মাঠ আর বৃষ্টির প্রত্যেকটা ফোঁটাই না হয় তার সাক্ষী হয়ে থাকুক?

সমাপ্ত

(শেষ পর্বে সবার থেকে এমন কি সাইলেন্ট মেম্বার দের থেকেও মন্তব্য আশা করছি।))কাল থেকে সিজন ৩ কন্টিনিউ করব।

প্রনয় পর্ব-৩২

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব–৩২

“”””তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহুর্তের মধ্যে ফিরে এসে,
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়।
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে
যেখানেই রাখি এ হৃদয়।
(জীবনান্দ দাশ…….)

পৃথিবীতে দুটো জিনিস সব থেকে কষ্টের।
এক, ” যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে কিন্তু বলেনা।
দ্বিতীয়, যখন তোমার ভালোবাসার মানুষ তোমাকে ভালোবাসেনা,আর সেটা মুখের ওপরে সরাসরি বলে দেয়।
রুদ্রর ক্ষেত্রে হয়তো দুটিই ঘটলো।কিংবা একটি?রুদ্র বিভ্রান্ত। সেঁজুতি মুখের ওপর বহুবার বলেছে ভালোনাবাসার কথা।প্রতিটি শব্দে তার ঘৃনা ঝরেছে।অথচ চোখ?ওই চোখ দুটো দেখে আদৌ মনে হয়নি সেঁজুতি ঘৃনা করে।উলটে ওই দৃষ্টিতে ভালোবাসা অনুভব করেছে ।অপার ভালোবাসা।

রুদ্র জানলার কাঁচ গলিয়ে আকাশ দেখছে।তারা বিহীন মেঘলা আকাশ।সন্ধ্যায় এক দফা বৃষ্টি হয়েছে।মেঘ এখনও ডাকছে।বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।ওরাও বুঝি বুঝে ফেলল,রুদ্রর মনের অবস্থান?ওরা কী বিদ্র‍্যুপ করছে?হাসছে আমায় নিয়ে?ধিক্কার করে বলছে,
হাহ!রুদ্র রওশন চৌধুরী কিনা অবশেষে একটা মেয়ের ভালোবাসা না পেয়ে দেবদাস হতে চললো? সেঁজুতি কে পেলিনা?এত ভালোবেসেও না?আজকের রাত ফুরালে কাল তোর প্রেয়সীর গায়ে হলুদ।যদি কাল ও সেঁজুতি না ফেরে?তাহলে কী করবি তুই?দেবদাসের মতো কৃষ্ণচূড়া তলায় আহুতি দিবি?
রুদ্র ঢোক গিলল।উত্তর দিলো, চলে যাব আমি।পালিয়ে যাব। এত দূরে পালাব, যেখানে সেজুতির স্মৃতি তাড়া করে বেড়াবেনা।একদম না।কিন্তু মন মানছেনা।ইদানীং ও এতো বেহায়া হচ্ছে কেন?এই যে, সেঁজুতি যখন বারান্দায় এসে দাঁড়াতো,রুদ্র লুকিয়ে দেখতো।একটা দিন তার এদিক-ওদিক হয়নি।আবির যখনই সেঁজুতির সাথে কথা বলতো,রুদ্রকে গোপনে ভিডিও কলে রেখে দিত।সেঁজুতি বুঝতোনা।মন মরা হয়ে কথা বলাটা রুদ্রর চোখ এড়াতোনা।খুব করে চাইতো,সেঁজুতি একবার বলুক,”আবির!আমি রুদ্রকে ভালোবাসি।কিন্তু প্রত্যেকবার রুদ্র হতাশ হয়।সেঁজুতি বলেনি।চুপ মেরে যেত।

কি করনীয় এখন?ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেবে সব? নাকি জোর করে তুলে আনবে?কিন্তু কি লাভ এতে? আদৌ কোনও দিন সেজুতি ভালোবাসবে তাকে?বাসবে না।বরং ঘৃনার পাহাড় আরো উঁচু হবে।একটুখানি সুখের আশায় আজীবন অবহেলা আর ঘৃনা কে বরন করে নিতে পারবেনা রুদ্র।সেঁজুতির সুন্দর দুটি চোখে শুধু ভালোবাসা দেখতে চায় সে।শুধু ভালোবাসা।

কিন্তু সেই দিন, সেই ক্ষন কী আদৌ আসবে?ধরা দেবে এত সুখ?দেবেনা।সেঁজুতি যদি অন্যকারোর সঙ্গে সুখী হতে চায়।হোক না হয়।ভালোবাসলেই তাকে পেতে হবে,এমন তো কোনো কথা নেই।
রুদ্র চোখ বুজলো।সঙ্গে সঙ্গে দু ফোঁটা অশ্রু গড়ালো কার্নিশ বেয়ে।গাল অব্দি চলল তাদের বিচরন।রুদ্র থাই গ্লাস টেনে জানলা আটকে দেয়।এসে কাউচের ওপর বসে।ছিপি খুলে মদের বোতলে মুখ ডোবায়।বুকের জ্বালা কমছেনা। একটুও না।রুদ্র শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছলো।ভাঙা গলায় বিড়বিড় করলো,
— হয়তো আমার কপালে আপনি লেখা নেই সেঁজুতি।প্রথম বার ভালোবেসেই আমি ব্যার্থ।ঠিকই করেছেন আপনি,আমার মতো একগুঁয়ে জেদি,রাগী, চরিত্রহীন লোককে ভালোবাসা যায়না। একদম না।কিন্তু বিশ্বাস করুন,এই দেহে অসংখ্য নারীর নখের দাগ পরলেও মনে দাগ কেটেছেন শুধুমাত্র আপনি। আপনার পর এই শরীর টা কেউ স্পর্শ করেনি।কাউকে করতেও দেবনা আমি।এখনও আপনার স্পর্শ আমার কাছে জীবন্ত।আপনিই হতেন আমার জীবনের শেষ নারী সেঁজুতি। অাপনিই হতেন।

রুদ্রর কান্নায় শব্দ নেই।অথচ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি গাল ভিজে চুপচুপে।
নিঃশব্দে কাঁদছে।বুক ফেঁটে চিৎকার গুলো বের হতে চাইলেও পারছেনা।রুদ্র প্রশ্রয় দিচ্ছেনা।অন্য কেউ কেন শুনবে তার হাহাকার?কেন বুঝবে,রুদ্র রওশন চৌধুরী ও কাঁদে।তার ও কষ্ট হয়!কাউকে বুঝতে দেবেনা। এ কষ্ট যে একার, শুধুমাত্র তার একারই।

অভ্রর চোখে পানি।চিকচিক করছে কোটর।বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে প্রিয় ভাইয়ের যন্ত্রনায়।দরজার আড়ালে থেকে এতক্ষন সব দেখেছে,শুনেছে।
তার ভাই কাঁদছে? সেঁজুতি কে না পেলে সারাজীবন কাঁদবে।কষ্ট পাবে।কাউকে বলবেনা।গুমরে গুমরে মরবে।না না এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবেনা।
হাতে আর সময় নেই,যা করার এখনই করতে হবে। এক্ষুনি।

___
সেঁজুতি ফ্লোরে বসে আছে।পিঠ দেয়ালে ঠ্যাকানো।হাটুতে মুখ গুঁজে খানিক পরপর কেঁপে উঠছে শরীর।মেয়েটা কাঁদছে।আজ অর্ধমাস,কেঁদেই পার হচ্ছে প্রতিটি ঘন্টা।দুঃখ,শোক যেন পিছন ছাড়ছেনা।আমির আর হোসাইন এক রকম জোর করে সেঁজুতি কে রাফসানের সাথে দেখা করতে পাঠিয়েছে।ছেলেটির ব্যাপারে হোসাইনের বলা প্রত্যেকটা বিশেষন- ই সঠিক।একে বিয়ে করলে নিঃসন্দেহে সুখী হবে।অথচ,এই সুখ সে চায়না।চায়না অন্য কারো সাথে সুখি দাম্পত্য। যাকে চায়,কেন তাকে পেলোনা?কেন তার মধ্যেই পৃথিবীর সব থেকে খারাপ গুনটি দিলেন সৃষ্টি কর্তা!কেন দিলেন?
রুদ্রর প্রথম ভালোবাসি বলার মুহুর্ত, রুদ্রর নেশালো চোখ দুটি যতবার চোখে ভাসছে দুভাগ হচ্ছে হৃদপিণ্ড। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে রুদ্রকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরতে।চিৎকার করে বলতে ‘আমিও আপনাকে ভালোবাসি।
কিন্তু না।সব ইচ্ছে পূরন হবার নয়।রুদ্র তার অধরা ভালোবাসা।চাইলেও ছুঁতে পারবেনা,সারাটাজীবন পস্তানোর ভয়ে।
হঠাৎ মুঠোফোন বাজলো।সেঁজুতির আগের ফোন ভেঙে গেছে।হোসাইন নিজে থেকেই দুদিন আগে এনে দিলো এটা।সিমটা আগেরই।ফোনের শব্দেও সেঁজুতি মুখ তুললনা।কয়েকবার বেজে বেজে কেটে গেলো।সেঁজুতি না ধরলেও ওপাশের ব্যাক্তির কোনো বিশ্রাম নেই।লাগাতার ফোন করছে সে।অবশেষে বিরক্ত হয়ে ভেজা, ফোলা মুখ তুলল সেঁজুতি। উঠে এসে বিছানার ওপর থেকে ফোন তুলে দেখলো অচেনা নম্বর।কে ফোন করেছে?কেন করছে এসব ভাবলোনা সেঁজুতি। রিসিভ করলো।মুহুর্তেই ভেসে এলো একটা পুরুষালি উদ্বীগ্ন স্বর,

” হ্যালো।মিস সেজুতি?
সেঁজুতি গলা ঝেড়ে বলল
” জ্বি।কে বলছেন?

“আমি অভ্র চৌধুরী।
সেঁজুতি অবাক হলো
“আপনি হঠাৎ?

” বলবো।বলতেই তো ফোন করলাম।তা আপনার মূল্যবান সময়ের কিছুটা পাওয়া যাবে কি?
অভ্রর কন্ঠে ঝাঁঝ, বিদ্রুপ,বিরক্তি। সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল
“এভাবে কেনো বলছেন?

” তাও ঠিক।আপনার প্রতি এর থেকেও রুড হওয়া দরকার আমার।
সেঁজুতি অভ্রর এমন আচরনের আগামাথা খুঁজে পেলোনা,
” কি করেছি আমি?
অভ্র তেঁজ নিয়ে বলল,
“আপনি কি করেছেন সেটা আমার থেকে আপনিই ভালো জানেন।একবার এসে দেখুন, কি হারে ড্রিংক করছে ভাই।পাগলের মতো কাঁদছে। খুশি হচ্ছেন তো?

সেঁজুতি চুপ মেরে যায়।বুকের ভেতর উত্থাল-পাথাল শুরু হয়।লোকটা কাঁদছে?আমার জন্যে?কেন কাঁদবে?কই ছিলেন এতদিন?একটা বার তো আমার খোঁজ নিলেন না!বোজা কন্ঠে বলল,
“নিষেধ করুন ওনাকে।
অভ্র যেন আরো চেঁতে গেল,
” বাহ!আমি নিষেধ করলেই শুনবে বলে মনে হয় আপনার?
সেঁজুতি নিশ্চুপ।অভ্রর কন্ঠ হঠাৎই নরম হয়ে আসে,
” একটা কথা রাখবেন আমার?

“বলুন।

” কাল সকালে একবার দেখা করবেন আমার সাথে? প্লিজ!

” কেনো?
অভ্র বলল,
” আসবেন কিনা সেটাই শুনতে চাইছি।শুধু কিছু কথা বলব।
সেঁজুতি উদাস কন্ঠে বলল,
” কিন্তু কাল যে আমার….

অভ্র হাসলো।ফোনের ওপাশে হাসির আড়ালের তাচ্ছিল্য টা দেখলোনা সেঁজুতি।
” গায়ে হলুদ তাইতো? সেতো বিকেলে। অনেক সময়। আমি আপনার বেশি সময় নেবোনা,
কাল একবার আসুন প্লিজ।

“কোথায় আসতে হবে আমাকে?

“জানিয়ে দেবো।
____
জিগাতলা।সকাল সকাল কম ভিড়।এখনও লোক সমাগম জমেনি।রাস্তার এক পাড়ে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে অভ্র।অনেকক্ষন হলো এসেছে।কিন্তু যার জন্যে অপেক্ষা,তার দেখা নেই।অভ্র চিন্তিত।সেজুতি আসবে তো? আজ কিছু কথা বলা যে খুব দরকার।অভ্র হাত ঘড়ি দেখলো।এখানের কাজ শেষ করে অফিস যেতে হবে।ভাই দুদিন অফিসের ধারকাছে ঘিষছেনা।বলতে গেলে মনের জোরটা নেই।অভ্রই সামলাচ্ছে সব।

অভ্র আশেপাশে তাকালো। হঠাৎ দূর থেকে সেঁজুতিকে আসতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটলো।সেঁজুতির রিক্সা এসে থামলো ঠিক অভ্রর সামনে। ভাড়া মিটিয়ে ফিরতেই অভ্র বলল,

“এলেন তাহলে? কিন্তু একটু দেরী।
সেঁজুতি বলল,
” বাবাকে ম্যানেজ করতে সময় লাগলো।গায়ে হলুদের দিন মেয়ে বাইরে যাচ্ছে বোঝেনিই তো।

সেঁজুতির গলাটা কেমন ভাঙা ভাঙা শোনালো।মেয়েটা কী কেঁদেছে?অভ্র বলল,
“চলুন বসে কথা বলি।

দুজন মিলে কাছাকাছি একটা কফিশপে ঢুকলো।সেঁজুতি কে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও বসলো ওর মুখোমুখি।

” বলুন। কেনো ডেকেছেন?

“বলছি।তার আগে আপনি বলুন যে আমার পুরো কথাই শুনবেন আপনি?
সেঁজুতি মাথা দোলায়।এসে থেকে একবার ও অভ্রর চোখের দিক চায়নি।চাইলে হয়ত চাপা ক্ষোভ খুঁজে পেতো।যে দৃষ্টি আরো অপরাধি বানাতো ওকে।

অভ্র ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“মিস সেজুতি!রুদ্র রওশন চৌধুরী আপনার বস,যাকে রাগী, বদমেজাজী,ইগোয়িস্টিক, আর চরিত্রহীন বলেই জানেন আপনি। তাইনা?

সেঁজুতি তাকিয়েছিল।তাইনা কথাটায় আবার নামিয়ে ফেলল চোখ।অভ্র বলল,
“কিন্তু আদৌ কি মানুষ টা এরকম?? আচ্ছা, কোনও মানুষ কি পৃথিবীতে খারাপ হয়ে জন্ম নেয়?নাকী
পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে এভাবে তৈরী করে?
আপনি জানেন, ভাই তার মাকে সহ্য করতে পারেনা! এক কথায় যাকে বলে ঘৃনা করে। অনেক বেশিই ঘৃনা।
সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল,
“কেনো?
অভ্র নিঁচের দিক তাকালো।ঠান্ডা গলায় ওল্টাতে শুরু করলো রুদ্রর একেকটি অতীতের পাতা,

“ভাই তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার।কোটি কোটি টাকার মালিক তারা।কিন্তু আংকেল,মানে ভাইয়ের বাবা উনি ছিলেন পরিশ্রমে বিশ্বাসী। বাপের টাকায় আরাম আয়েশ করায় ওনার বাধতো।নিজে কিছু করতে চাইতেন।সম্পূর্ন নিজ চেষ্টায়।যেটা ওনার স্ত্রীর ছিলো সব চেয়ে অপছন্দের।যার বাবার এত টাকা পয়সা তার কেন চাকরি করতে হবে?আঙ্কেলের এরকম সিদ্ধান্তে দাদু-দিদুন কখনও আপত্তি করেননি।ছেলে যাতে ভালো থাকবে থাকুক। আঙ্কেল সরকারি চাকরি পেলেন।ফ্যামিলি বিজনেসের প্রতি ওনার ছিলো তীব্র বিতৃষ্ণা। এ নিয়েই আন্টির চাপা ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে।ভাইয়ের বয়স তখন পাঁচ কি ছয়?তখনও দিন ভালো কাটছে।একটা সময় আঙ্কেলের বদলি হলো ঢাকায়।উনি স্ত্রী সন্তান সহ ঢাকায় চলে এলেন।তারপর থেকে শুরু হলো আলাদা সংসার।এর আগে দাদুর ছত্রছায়ায় আন্টির সমস্ত বিলাসিতা পূর্ন হওয়ায় উনি অত প্রতিক্রিয়া করেননি।কিন্তু নতুন সংসারে আসার পর যেটা কালবৈশাখির রুপ নেয়। ভাই নাকী ভীষণ দুরন্ত ছিলেন।আগেতো দিদাই সামলাতো,এবার পুরোপুরি মায়ের কাঁধে পরলো ওকে সামলানোর দায়ভার।রুপচর্চা,নিত্য শপিং, স্বামী সন্তানের প্রতি উদাস চলাফেরা তখন ফুরিয়ে আসতে ধরলো।আঙ্কেল চাকরির টাকায় সংসার ভালোই চালাতেন।কিন্তু আন্টির মনঃপুত হতোনা।ওনার চাহিদা সম্পন্ন করায় আঙ্কেল ত্রুটি না রাখলেও সফল হতে পারেননি।ধীরে ধীরে তাদের মনমালিন্য শুরু হলো।আন্টির চাহিদা কমার বদলে দিন দিন যেন বাড়ছে। এ নিয়ে সংসারে সব সময় অ/শা/ন্তি,ঝ/গ/ড়া ,ক/ল/হ লেগেই থাকতো।আংকেল এর ওপর রাগ, আন্টি মেটাতেন ভাইয়ের ওপর। পাঁচ বছরের ছেলেটাকে মার/ধর করতেন একটুতেই।কখনও বা না খাইয়েও রাখতেন।কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মা তার সন্তানের সাথে এরকম করতে পারে, আমার জানা নেই।ঢাকায় আঙ্কেলের এক ধনী বন্ধু ছিলেন।আশরাফ।আঙ্কেলের সাথে বাসায় আসা যাওয়া ছিল ওনার।আঙ্কেলের সরলতা,বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আন্টি আর ওনার মধ্যে একটা সম্পর্কের শুরু হয়।আই মিন প/র/কীয়া। সংসারে যেটুকু শান্তি বেচে ছিলো তাও নিঃশেষ।ভাইয়ের জন্যে তাদের অবাধ বিচরনে বাঁধা পরতো।কারন ভাই আঙ্কেল কে বলে দিতো।আধো বুলিতে যতটুকু পারতো আর কী!এতে আন্টির ধরা পরার ভয়,রাগ দুটোই বাড়ে। ভদ্রলোক এলেই ভাইকে আগে সরাতেন উনি।অন্য ঘরে আটকে রাখতেন। তারপর মজে যেতেন পাপের দুনিয়ায়। এসব আঙ্কেল তখনও জানতেন কীনা আমি জানিনা।ভাইয়ের বলা কথা উনি কখনও সিরিয়াসলি নেননি হয়ত।দিন এভাবেই যাচ্ছিলো।কিন্তু একদিন,আঙ্কেলের শরীর খারাপ করলে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরেন।আন্টিতো আর জানতেননা।তাই সতর্ক হননি।ঐদিন আঙ্কেলের কাছে হাতে নাতে ধরা পরেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী।নিজের বন্ধুর সাথে স্ত্রীকে একই বিছানায় দেখে আঙ্কেল যেন উন্মাদে পরিনত হলেন।কাউকে সাফাই গাওয়ার কোনো সুযোগই দিলেন না।প্রথমেই ছু/ড়ি চালালেন বিবাহিত স্ত্রীর গ/লা/য়।আশরাফ তখন পালাতে চান,ভয়ে মাফ ও চান কিন্তু আঙ্কেল শোনেননি।রাগে,দুঃখে, শোকে পাথর সে কয়েকবার ওনার মাথা দেয়ালের সাথে ঠুকে দেন।ওনার প্রানবায়ু শেষ হয় সেখানে।আঙ্কেল নিজ হাতে তার স্ত্রীর কুকর্মের শাস্তি দেন।
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সেঁজুতি স্তব্ধ,বিমুঢ়। এই কথাগুলো তো রুদ্র গল্পের ছলে বলেছিলো সিলেটে।ওই যেদিন মদ খেলো!অথচ এটা রুদ্রর নিজেরই জীবনের গল্প?এত কষ্ট মানুষ টার?সেঁজুতি কেঁদে ফেলল।কাঁদতে কাঁদতেই শুধালো ‘ তারপর?

অভ্র শান্ত চোখে সেঁজুতির কান্নামাখা মুখটা দেখলো কিয়ৎক্ষন।বলল,
“তারপর আংকেল নিজেই পুলিশ কে খবর দিলেন।দাদু দিদাকেও আসতে বললেন।ভাইয়েরতো একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার।পুলিশ এলো বাসায়।দাদু দিদাও।সব শুনে মাথায় আকশ ভেঙে পরলো তাদের।ভাই মায়ের লা/শ দেখে থরথর করে কাঁপছিলো।পুলিশ যখন আঙ্কেল কে নিয়ে যাবেন,ভাই চিৎকার করে কেঁদেছে।একটা সময় জ্ঞান হারালো।

এদিকে
আংকেল কে কাস্টাডিতে নেয়া হলো।আঙ্কেল সবটা স্বীকার করলেন।জানালেন, তিনিই খু/ন করেছেন ওই দুজন কে।তার জামিন চাইনা।দাদু খুব চেষ্টা করলেন আঙ্কেল কে ছাড়ানোর।কিন্তু প্রকৃতির মতো আঙ্কেল ও বিরোধিতা করলেন।তার বাঁচার ইচ্ছে শেষ। একেতো খু/নের আসামি।তাও আবার দু দুটো।আশরাফ নামিদামি ব্যাবসায়ী। তার স্ত্রী স্বজন সবাই একজোট হয়ে নামলেন হত্যাকারীর বিচারের জন্যে। সব প্রমান আংকেলের বিপক্ষে।
জামিন আর পাওয়া হয়নি।আঙ্কেল ও চাননি।আদালত ফাসির ঘোষণা দিলো।তারপর থেকেই ভাই চুপ হয়ে যায়।কারো সাথে মেশেনা,কথা বলেনা।ওর ঘরই হয় ওর দুনিয়া।মনে মনে মায়ের প্রতি আকাশ সম ঘৃনার জন্ম নেয়।ভালোবাসা,বিশ্বাস এসবের ওপর থেকে আস্থা নড়ে যায়।মেয়ে মানুষ মানেই অর্থলোভী।টাকা পেলে এরা যা কিছু করবে এমন ভাবনা পোষন করে বড় হতে থাকে।দাদুর হঠাৎ মৃত্যুতে ব্যাবসা কাঁধে নিলো।নিজের পরিশ্রম বুদ্ধিদীপ্ততা দিয়ে ক্ষনিকের ঝুলে পরা ব্যাবসা তঁড়াক করে দাঁড় করালো।ভাইয়ের লঞ্জ করা কাপড় দেশ বিদেশে সুনাম কুঁড়ালো।কিন্তু ভাইয়ের ধারনা বদলালো না।যে মায়ের জন্যে তার বাবা,তাদের সংসার টা ভেঙে গেলো সেই মেয়ে জাতীর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা কমলোনা।হোটেলে একের পর এক মেয়ের সাথে রাত্রীযাপন হলো। প্রমান করলো মেয়ে মানেই অর্থসন্ধানী।স্বার্থপর।কথাটা পুরো সত্যি নয়।কারন হাতের পাঁচ আঙুল পাঁচ রকম।কিন্তু ফেলেও দেয়া যায়না।কারন হোটেলে আসা মেয়ে গুলো তার জ্বলন্ত প্রমান।ওরা স্বেচ্ছায় আসে।টাকা পাওয়ার লোভে।
মায়ের প্রতি ঘৃনা আর বাবার করুন পরিনতিই ভাইকে আজ এমন করেছে।বিশ বছর বয়স থেকেই শুরু এই নারী সঙ্গ।কিন্তু কখনও কোনও মেয়েকে অসন্মান বা জবরদস্তি করে নয়। লোভের বশবর্তী আর ভাইয়ের নৈকট্য পাওয়ার আশায় কিছু মেয়ে এমনিই আসতো।তবে রাত ছাড়া মেয়েদেরকে কখনওই নিজের ধারে কাছেও ঘিষতে দেয়নি ভাই।

সেঁজুতি হা করে শুনছে।অভ্র বিরতি নিলো একটু।তারপর ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
কিন্তু বিশ্বাস করুন,ভাইয়ের জীবনে যেদিন আপনি এসেছেন? সেদিন থেকে হোটেলে আর একটি মেয়েও আসেনি।ইনফ্যাক্ট ভাই তো হোটেলের সামনে বড় করে সাইনবোর্ড লাগিয়েছে নারী প্রবেশ নিষেধ।
অভ্র মৃদূ হাসলো কথাটা বলে।

ভাইয়ের মনে শুধু আপনিই আছেন সেজুতি। শুধু আপনি। আপনি জানেন? ভাইকে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি।কিন্তু কাল দেখেছি।প্রথম বার।কাঁদছিলো ভাই, শুধুমাত্র আপনার জন্য। ভাইয়ের মন স্পর্শ করেছেন আপনি।যার গভীরতা এতোই বেশি যে ভাই এখন পুরো পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও আপনাকে চায়। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই কিছু খারাপ গুন থাকে সেজুতি।কারোর টা হয়তো খুব বেশিই খারাপ হয়!কিন্তু তাই বলে তাকে শুধরানোর সুযোগ টুকু দেবেন না? ভাইতো যথাসম্ভব নিজেকে পাল্টেছে। তাও আপনার জন্যে।আপনি বললে নিজেকে পুরোপুরি পাল্টাতে দুবার ভাববেনা।আর কি চাই আপনার?

আপনি জানেন?ভাইকে বলা হয়েছিলো আপনাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে।অথচ ভাই তা চায়না।চায়না জোর করে আপনাকে পেতে। আপনি ভালোবেসে ধরা দেবেন এটাই ভাইয়ের ইচ্ছে।

সেঁজুতি ডুকরে কেঁদে উঠলো। টেবিলের ওপর হাত রেখে মুখ গুঁজে হুহু করে কাঁদলো কিছু সময়। অভ্র সময় দিলো সেঁজুতি কে।হাল্কা হোক মেয়েটা।অনেকক্ষন পার হলে অভ্র নিজেই বলল,
“আপনি কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করেননি।
সেঁজুতি মাথা তুলল।ভেজা কন্ঠে শুধালো ‘ কী?

অভ্র মুচকি হাসলো,
” আমি ভাইকে ভাই বললেও ওর বাবা মাকে আঙ্কেল- আন্টি বলেছি।
সেঁজুতির ভ্রু কুঁচকে আসে।সত্যিইতো!এটা খেয়াল করেনি এতক্ষন।সেঁজুতির জিজ্ঞাসু চেহারায় অভ্র ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

” এর কারন,আমি ভাইয়ের নিজের কেউ নই।ভাই আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলেন।

সেঁজুতি চমকে তাকায়।অভ্র বলল,
‘আমি আমার বাবা মাকে কখনও দেখিনি।জানিওনা তারা কারা।রাস্তায় ভিক্ষা করতাম।পড়নে ছেড়া কাপড়, গায়ে পায়ে ময়লা( উদাস হেসে)।ভাই নিজেও তখন ছোট।আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় ভাই।
একদিন স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রুটি খাচ্ছি।দূর থেকে দেখলাম একটা ছেলে স্কুলে ঢুকতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলো।পিচের রাস্তা,হাত পা ছিলেও গেছিলো।আমি ছুটে গিয়ে হাত বাড়াই।ছেলেটি কতক্ষন আমাকে দেখে আমার ময়লা হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়।আমি তার হাতে পায়ের ময়লা ঝেড়ে দেই।পড়নের জামা টা খুলে ছিড়তে থাকি।ছেড়া টুকরো গুলো দিয়ে কে/টে যাওয়া জায়গা বেধে দিই।ছেলেটি ছিলো ভাই।ভাই সেদিন অবাক চোখে আমাকে দেখছিলো।মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো আমার নাম কী?কোথায় থাকি?
যখন জানলো আমি এতিম, ভাই বিনা সঙ্কোচে আমাকে সাথে নিয়ে চলল।বলল, “আজ থেকে তুই আমার ছোট ভাই।সেই থেকে আমার পরিচয় বদলালো।এতিম ছেলেটাকে ভাই নিজের পরিচয় দিলো।সাথে আমার নামে আলাদা ব্যাবসা,গার্মেন্টস এসব তো রয়েইছে।এতক্ষন আপনাকে যা যা বললাম ভাইয়ের পরিবার নিয়ে? এগুলো ভাইয়ের দিদার থেকে শোনা আমার।

সেঁজুতি ফিঁচেল কন্ঠে বলল ‘ উনি এত উদার?
অভ্র হাসলো,বলল,
আবির বিবাহিত হওয়া স্বত্তেও বিয়েতে রাজি হয়,সেটা কিন্তু ভাইয়ের কথায়।
সেঁজুতি বিস্মিত।অভ্র আবার বলল,
‘ ভাই আসলে দেখতে চাচ্ছিলো আপনি সত্যিই বিয়ে করেন কীনা!ও এখনও বুক বেঁধে আছে এই আশায়,আপনি ফিরবেন।ওহ হ্যা আরেকটা কথা, আবির আপনাকে বলেছিলেন,এগ্রিমেন্টের টাকা দিয়েছেন উনি।এটাও কিন্তু মিথ্যে।
সেঁজুতির দুচোখ ভার হয়ে আসছে,
‘ কিন্তু এসব করে কী পেলেন?

‘ ওই যে বললাম,ভাই তার ভালোবাসার পরীক্ষা নিচ্ছিলো।আপনাকে যেদিন আংটি পরাতে যায় আবিরের পরিবার।আংটি হারিয়ে যায়।মনে আছে নিশ্চয়ই?
সেঁজুতি মাথা দোলায়।অভ্র হেসে বলল ‘ আবির সরিয়েছিলো।তাও ভাইয়ের পরিকল্পনা মাফিক।ভাই চায়নি অন্য কেউ আপনার আঙুলে আংটি পরাক।আপনি অন্যকারো বউ হবেন তাতো আরোই না।অথচ দেখুন, আবিরের সাথে আপনার বিয়ে না হলেও অন্য কারো সাথে কিন্তু ঠিকই হচ্ছে।

সেঁজুতি মাথা নিচু করে ফেলল।অভ্র বলল,
ভাই আপনাকে অনেক আগে থেকে ভালোবাসে সেঁজুতি। দিন তারিখ আমার ঠিক জানা নেই।সেই ভালোবাসা অনুভব করতেই ও চাকরির অজুহাতে আপনাকে নিজের আশপাশে রেখে দেয়।এগ্রিমেন্ট ও একটা ছুঁতো ছিলো।যাতে আপনি চাইলেও দূরে যেতে না পারেন।ভাই কিন্তু জানতো আপনি ওকে দেখতে পারেন না।কেন পারেন না সেটা আমি জানিনা।তারপরেও ভাই আপনাকে ভালোবেসেছে নিঃস্বার্থ ভাবে।যেভাবে পেরেছে সাহায্য করেছে আপনার অগোচরে।

আপনাদের কাজের মেয়েটি?উম,শেফালী?ও কিন্তু ভাইয়ের কথাতেই আপনাদের বাসায় কাজ নিতে যায়।আপনার থেকে বেতন নেয়া একটি অভিনয়ের অংশ।পাছে আপনি বুঝে ফেলেন!আপনি প্রতিদিন অফিসে দেরি করতেন।ভাইয়ের এতটুকু দেরিও সহ্য হতোনা।আপনাকে ছাড়া প্রত্যেকটা সেকেন্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগতো।একদিন খোঁজ নিয়ে জানলো আপনি পুরো বাসার দায়িত্ব পালন করে তারপর অফিসে আসেন।তাই ভাই শেফালীকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়।এতে অবশ্য এক ঢিলে ওর দুই পাখি বধ হলো।এক আপনি ঠিক সময় অফিসে এলেন,আপনার কষ্ট কমলো আর দ্বিতীয় টা না হয় না বলাই থাকুক।
সেঁজুতি মূর্তির মত বসে আছে।চোখে পলক অব্দি পরছেনা।রুদ্র এতভাবে সাহায্য করেছে?এত ঋন তার রুদ্রর প্রতি?কী দিয়ে শোধ করবে এই ঋন?ভালোবাসা কী যথেষ্ট হবে?

অভ্র সেঁজুতির হাতের ওপর হাত রাখলো।আকুতি নিয়ে বলল,
“সেঁজুতি! আপনাকে ছাড়া আমার ভাই বাঁচবে কিন্তু ভালো থাকবেনা। ম/রার মত বাঁচার কি স্বার্থকতা?
আচ্ছা, আপনিই বলুন,” যে আপনার জন্যে তার খারাপ অভ্যাস গুলো কে পরিত্যাগ করতে পারে,যার প্রত্যেকটা ভাবনাই শুরু হয় আপনার ভালো থাকা না থাকা দিয়ে তার ভালোবাসায় সন্দেহ থাকে কখনও?
এই ভাবে আমার ভাইকে শেষ করে দেবেন না।প্লিজ!,আমি অনুরোধ করছি।ভাইকে ভালোবাসলে কোনও দিনও ঠকবেন না আপনি।একবার বিশ্বাস করেই দেখুন।প্লিজ!
সেঁজুতি নিঃশব্দে কাঁদছে।অভ্র হাত সরিয়ে বলল ‘ আমার ধারনা মিথ্যে হবেনা।আপনার চোখ,আপনার এই কান্না বলে দিচ্ছে আপনিও ভাইকে ভালোবাসেন।তাহলে কেন করছেন বিয়েটা?এখনও সময় আছে ভেঙে দিন।ফিরে যান ভাইয়ের কাছে।আপ__
অভ্র পুরোটা শেষ করতে পারলোনা।এর আগেই সেঁজুতি মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।কফিশপের অনেকে এতক্ষন দেখছিলো তাদের।সেঁজুতির বেরিয়ে যাওয়ায় অভ্রর নিরস মুখ দেখেই শুরু হলো তাদের কানাঘুষা। অভ্রর তাতে মন নেই।সে ভাবছে সেঁজুতির যেতে যেতে বলা কথাগুলো ‘ আমি পারবনা,আমি পারবনা।
অভ্র বরাবরই নরম মনের মানুষ। চোখ জ্বলে উঠলো তার।এক দু ফোঁটা অশ্রু গড়ালোও।সেকী তবে পারলোনা,ভাইয়ের ভালোবাসা পাইয়ে দিতে?

চলবে?