Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 424



প্রনয় পর্ব-৩০+৩১

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব–৩০
মেয়ের সামনে অসহায় মুখ করে বসে আছেন আমির।হাত কঁচলাচ্ছেন সমানে।সেঁজুতি রেগে একাকার।আর সেজুতির রাগ মানেই মুখে কিছু বলবেনা।সারাটাদিন না খেয়ে চুপচাপ বসে থাকবে ঘরে।আমিরের চিন্তায় মাথা ফেঁটে যাওয়ার জোগাড়।
কে জানালো সেঁজুতিকে বিয়ের ব্যাপারে?তারা দুই বন্ধু ভেবেছিলেন ধীরে সুস্থে জানাবেন।ইশ! সব ঘেটে গেলো এখন!আমির মুখ কাচুমাচু করে বললেন,

“আমি আজকেই জানাতাম তোকে।

চোখ উঠিয়ে বাবাকে একবার দেখলো সেঁজুতি। আবারো মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আমির ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,
” আচ্ছা, এখানে আমার কি দোষ?তোর হোসাইন আঙ্কেল ই তো বললেন তোকে পরে জানাতে।আমি তো তাই___
সেঁজুতি মাঝপথে আটকে দিলো,
-“তাই তুমিও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেনা। বাহ! হোসাইন আংকেল আমার বাবা নাকি তুমি আমার বাবা?তুমি আমার থেকে কি করে লুকাতে পারলে ব্যাপারটা?
আমির বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললেন,
” সময় নিচ্ছিলাম,বিশ্বাস কর!
এখন এসব ছাড় না। অনেকক্ষন না খেয়ে আছিস,খাবার নিয়ে আসি?

” তোমাকে কষ্ট করতে হবেনা।আমি পারবো।এখন থেকে আমি নিজের কাজ নিজে করে নেবো।এমনিতেও আমাকে তাড়ানোর চিন্তা করছো তো, অহেতুক আর মায়া বাড়িয়ে লাভ কী?
সেঁজুতি রান্নাঘরে ঢুকে গেলো।আমির মাথা নেড়ে বিড়বিড় করলেন,
‘এই মেয়েটা এক্কে বারে ওর দাদির মত হয়েছে। কথা শোনাবে কিন্তু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।

মায়ের কথা মনে পরতেই মুখ টা কালো হয়ে এলো আমিরের।বাইশ বছর ও বাড়ির দোরগোঁড়ায় পা রাখেনি। কত কিছুই তো বদলে গেলো।শেষ বার বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও অভিমানে চাপা পরে গিয়েছে তার ছটফটে মন।প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যারা মুখ তুলেও দেখলোনা,এখনও কি তাকে তারা মনে রাখবে? পৃথিবীতে ভালোবেসে বিয়ে করা এতোই অপরাধের বুঝি?? যা আপন মানুষকেও দূরে ঠেলে দেয়?
সেঁজুতি ভাতের প্লেট এনে সোফার ওপর বসলো।আমির নিজে থেকেই এগিয়ে গেলেন।আদুরে কন্ঠে বললেন ‘ আমি খাইয়ে দেই?
সেঁজুতি মুখ ফোলালো ঠিকই তবে মানা করলোনা।বাবার দিকে প্লেট এগিয়ে দিলো।আমির হাসলেন।হাত ধুয়ে তরকারিতে ভাত মেখে মেয়ের মুখে দিলেন।সেঁজুতি চুপচাপ খাচ্ছে।আমির ভাবলেন সেঁজুতির মন ভালো হয়েছে হয়ত।সতর্ক কন্ঠে শুধালেন,
“বিয়েতে তোর কোনও আপত্তি নেইতো?
সেঁজুতির খাওয়া থেমে গেলো তাৎক্ষণিক।খাবার গলায় বাঁধলো যেন।চোখের সামনে অকারনেই রুদ্রর মুখটা ভেসে উঠলো।আমির একি কথা আবার জিজ্ঞেস করায় ধ্যান ভাঙলো সেঁজুতির।নিভু কন্ঠে বলল,

“আবিরের সাথে বিয়ের ব্যাপারটা আমার ভালো লাগছেনা বাবা।আমি ওকে কখনও এভাবে ভাবিনি।,বন্ধুত্ব টাই ঠিক আছে,সেখানে সম্পর্কের এমন পরিনতি দেয়ার কি দরকার বলো?

‘বন্ধু তো কি হয়েছে? বন্ধুকে কি বিয়ে করা যায়না? একজন ভালো বন্ধুই সব থেকে ভালো লাইফ পার্টনার হতে পারে।
সেঁজুতি আর কথা খুঁজে পাচ্ছেনা।রুদ্রর নামটা উগড়ে বের হতে চাইলো খুব।কিন্তু বলার মতোন ভরসা পেলোনা।মিহি আপত্তি জানালো,
‘ ভেবে জানাব বাবা।

‘আচ্ছা বেশ! তুই বরং আবিরের সাথে এ নিয়ে একবার আলাদা ভাবে কথা বল।

‘ আবির কি রাজি এই বিয়েতে?

‘ হোসাইন তো তাই জানালো।বাকিটা তুই জেনে নিস না হয়?
সেঁজুতি খেয়াল করলো,বিয়ের কথা বলতে গেলেই আমিরের মুখ চকচক করে উঠছে।বোঝাই যাচ্ছে সে কত খুশি!সেঁজুতি বোজা কন্ঠে বলল
“ঠিক আছে।
___
বিকেল চারটায় আসার কথা আবিরের। অথচ এখন চারটা বিশ।আবিরের ছায়াও পরেনি এখনও।
অনেকক্ষন যাবত বসে আছে সেঁজুতি।আবিরই আসতে বলেছে এখানে।বিয়ের ব্যাপারে আবিরের সাথে সেঁজুতিরও সামনা সামনি কথা বলা দরকার।সেঁজুতির কেমন শ্বাস আটকে আসছে।যতবার ভাবছে আবিরকে বিয়ে করতে হবে,ততবারই কোথাও কান্না পাচ্ছে খুব।রুদ্রর কথা মনে পড়ছে বারবার।সেঁজুতি হাতঘড়ি দেখলো।অপেক্ষা করতে করতে সে বিরক্ত।আচ্ছা,রুদ্রও তো এমন অপেক্ষা করতো সিলেটে।উনিও কী এমন বিরক্ত হতেন?সেঁজুতি উদাস চোখে জানলা গলে বাইরে তাকায়।তখনি আবির এসে
ধড়ফড় করে চেয়ারে বসলো।সেঁজুতি খানিক চমকায়।আবির ঘেমে জুবুথুবু। কপাল বেয়ে টপটপ করে পরছে ঘাম।বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে অর্ধেক পানি খেয়ে ফেলল।সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,

“কি হয়েছে? এভাবে হাপাচ্ছো কেনো?
আবির হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল,
‘আরে তোমার ওই বস আছেনা?উনি আমাকে ধাওয়া করেছিলেন?
সেঁজুতি আঁতকে উঠলো,
— কিহ? কেনো?

‘ কোনও ভাবে খবর পেয়েছেন হয়তো আমরা দেখা করছি। আর তাই আমাকে এখানে আসতে বাঁধা দিচ্ছিলেন।
সেঁজুতির যেন বিশ্বাসই হচ্ছেনা।সন্দেহী চোখে চেয়ে থাকতে দেখে আবির হেসে বলল,
” আরে সিরিয়াস হচ্ছো কেনো? মজা করছিলাম।
সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।অন্যদিক চেয়ে বলল,
“এসব ব্যাপারে মজা করা ঠিক নয়।

‘আচ্ছা বাবা স্যরি!এখন এসব ছাড়ো। আমি কি ওসবে ভয় পাই নাকি।আপাতত তুমি এটা ভাবো যে..
আমাদের বিয়ে হচ্ছে সেঁজুতি। তুমি ভাবতে পারবেনা হাউ মাচ আ’ম এক্সাইটেড!
কিছুক্ষন চুপ থাকলো সেঁজুতি। তার মানে সত্যিই আবির রাজী। সেঁজুতি নিচের দিক চেয়ে মিহি কন্ঠে বলল ‘ আমি এই বিয়ে করতে চাইনা আবির।

আবির যেন বিস্মিত,
‘কেনো??

সেঁজুতি উপযুক্ত কোনো কারন খুঁজে পেলোনা।আবির নিজেই বলল,
‘ কাউকে ভালোবাসো?
সেঁজুতির বুকটা কেঁপে উঠলো।সিলেটে রুদ্রর খিলখিল করে হাসির দৃশ্য, ওদের কাছাকাছি যাওয়ার দৃশ্য গুলো স্বচ্ছ জলের মতো ভাসতে থাকলো চোখের সামনে।

” কি হলো?কাউকে ভালোবাসো?
সেঁজুতি সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতো নঁড়ে ওঠে।আবিরের প্রশ্নে একটা নামই মাথায় আসছে’ রুদ্র! রুদ্র!রুদ্র!আবির পুনরায় ডাকলো,

“সেঁজুতি? এই সেঁজুতি? কোথায় হারিয়ে গেলে?

‘হু?হ্যা বলো..
” কাউকে ভালোবাসো কীনা এখনও বললেনা।

আবিরের মুখে মিটিমিটি হাসি।খুব করে চাইছে সেঁজুতি কাঙ্ক্ষিত নামটি বলুক।অথচ সেঁজুতি টু শব্দ করলোনা।তার দৃষ্টির মত তার মন ও উদাসীন।আবির নিজেই বলল,

‘ বুঝেছি।কেউ নেই তাইতো?তাহলে সমস্যা কোথায়? বিয়ের পর না হয় আমাকেই ভালোবাসবে।খুব সুখে রাখবো তোমাকে।
আবির সেঁজুতির হাতের ওপর হাত ছোঁয়ায়।সেঁজুতি তড়িৎ গতিতে হাত সরিয়ে নিয়ে কোলের ওপর রাখলো।আবিরের হাসি পেলো ভীষণ।
মেকি সিরিয়াস কন্ঠে বলল,
‘দেখো সেঁজুতি!আমাদের বিয়েটা নিয়ে তোমার আমার আগ্রহের থেকেও আমাদের পরিবারের আগ্রহ অনেক বেশি।তাদের স্বপ্ন তারা তাদের ছেলেমেয়েদের একসাথে দেখতে চায়।এতে ভুল তো কিছু নেই।হ্যা তোমার যদি একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো তবে না হয় মেনে নিতাম,কিন্তু যেখানে পাকাপোক্ত কোনও কারনই দেখাতে পারছোনা, সেখানে বিয়ে তে না করার কোনও মানে হয়?প্লিজ! সেঁজুতি,যেদিন থেকে জেনেছি তোমাকে ঘরের বউ করে আনবে বাবা-মা,সেদিন থেকেই আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি তোমাকে নিয়ে।তাই আর অমত কোরোনা।প্লিজ!

সেঁজুতি তখনও চুপ করে থাকলো।কন্ঠ বুজে আসছে কথা বলতে।কোনো রকমে মাথা দুলিয় নিরব সম্মতি বোঝায়।মুখে বলল ‘এবার তবে উঠি?

” হ্যা নিশ্চয়ই, তবে আর একটা কথা…

সেঁজুতি তাকালো,আবির বলল,
“তোমাকে আর রুদ্রর অফিসে কাজ করার দরকার নেই।
আবিরের কন্ঠে অধিকারবোধ।সেঁজুতি চাপা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এক কথা বারবার কেনো বলছো আবির?সব তো বলেছিলাম তোমাকে।
আবির নিশ্চিন্ত কন্ঠে বলল,
” এগ্রিমেন্টের কথা তো? জানি।আর তাই আমি জরিমানার পাঁচ কোটি টাকা ওনার অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি।
সেঁজুতি বিস্ফোরক দৃষ্টিতে তাকালো,

“কিহ? আমাকে না জানিয়েই?
“জানালে টাকা তুমি নিতেনা আর তাই এরকম করলাম। এসব নিয়ে ভেবোনা এখন।
দুদিন পরে অর্ধাঙ্গিনি হবে আমার।সেটা নিয়েই ভাবো।ওই রুদ্রর মুখ আর দেখতে হবেনা তোমাকে।

সেঁজুতির হৃদয় থমকে যায় কয়েক মুহুর্তের জন্যে।আবিরের মুখে অর্ধাঙ্গিনী শব্দটি পৃথিবীর সব থেকে কুৎসিত মনে হলো।সাথে অজানা কষ্টে হাহুতাশ করে উঠলো বুক।রুদ্রর থেকে ছাড়া পেলো সে?কিন্তু খুশি হতে পারছেনা কেন?হাসি ফুঁটছেনা কেন মুখে?কেন কান্না পাচ্ছে? এতোদিন যার থেকে নিস্তার পেতে চাইলো, আজ এতো সহজে পেয়ে গিয়েও ভেতরটা অস্থির অস্থির লাগছে কেন?যেন অমূল্য কিছু হারিয়ে যাচ্ছে।আর সে মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। আর কোনও দিন দেখতে পাবেনা সেই রাগী বদমেজাজী রুদ্র রওশন কে?রুদ্রর ঝারি না খেলে যে তার সকালই শুরু হয়না।
সেঁজুতির ভাবনা কাটলো আবিরের কথায়
” চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
” আমি যেতে পারব আবির।অন্তত এ ‘কটা দিন নিজের মত চলতে দাও।
আবির আর বাঁধা দিলোনা।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা পায়ে বেরিয়ে এলো।রিক্সা ডেকে উঠে হুড টেনে দিলো।সেই প্রথম দিনের মতো মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো অাজ।কিন্তু শব্দ হলোনা।ওড়নার প্রান্ত মুখে গুঁজে কাঁদলো পুরোটা রাস্তা।পথে কোনো কালো গাড়ি দেখলেই রুদ্রর কথা মনে পড়ছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি কাঁচ গলে বেরিয়ে আসবে রুদ্রর শান্ত মুখ।রাগি কন্ঠে বলবে ‘ এটা কান্নার জায়গা নয় সেঁজুতি! বাসায় গিয়ে কাঁদুন।তখন কান্না আরো বেড়ে আসে সেঁজুতির।
বাড়িতে ঢুকে বাবার সঙ্গে দেখা করলোনা সেজুঁতি।আমির তখন নিজের ঘরে থাকায় মেয়ের ফেরা টের পাননি।দরজা সেঁজুতি চাবি দিয়ে খুলেছে।রুমে ঢুকেই সেঁজুতি সিটকিনি টেনে দিলো।ওয়াশরুমে গিয়ে পানির সব গুলো ট্যাব খুলে রেখে বসে পরলো ভেজা মেঝেতে।হাউমাউ করে কাঁদলো। রুদ্রর কথা যত মাথায় আসছে তত দ্বিগুন হচ্ছে কান্না।সেঁজুতি চিৎকার করে বলল

‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি রুদ্র।ভালোবাসি আপনাকে।পারলাম না,নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রন করতে।পারলাম না তাদের আটকাতে।সেই আপনাকে ভালোবেসেই ফেলল ওরা।কিন্তু, আমি চাইলেও যেতে পারছিনা আপনার কাছে।চাইলেও বলতে পারছিনা মনের কথা।আপনি একটা চরিত্রহীন।যার প্রত্যেকটা রাত কাটে ভিন্ন ভিন্ন মেয়ে নিয়ে, কোন ভরসায় তার কাছে যাব আমি?কোন ভরসায় তাকে জীবন সঙ্গী বানাব?আমি না খেয়ে থাকব,গাছতলায় ঘর বাঁধব,তবুও একজন চরিত্রহীন লোককে কাছে টানবনা।কিছুতেই না।

____
টি টেবিলের ওপর কাঁচের এস্ট্রে। একটু একটু করে হাতের সিগারেট এর পুড়ে যাওয়া অংশ ফেলছে রুদ্র।ছাদের দিক মাথা তুলে ধোয়া ছাড়ছে।কী আয়েশী ভঙ্গি তার!যেন এই মুহুর্তে এমন সুখকর কাজ দ্বিতীয়ও টি নেই।
রুদ্রর বাম দিকে চিন্তিত মুখ করে বসে আছে এরিকা।কিন্তু রুদ্র ভ্রুক্ষেপহীন। এরিকা নিজেকে অনেকক্ষন সংযত রাখলো।শেষে আর না পেরে বলেই ফেলল ‘আপনার কি মনে হয় এতে কাজ হবে??

রুদ্র নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,
“হবে বলেই করছি। রুদ্র রওশন কখনও অকাজ করেনা।

“কিন্তু হিতে বিপরীত হলে?

রুদ্র ঘাড় কাঁত করে তাকালো,
“আপনার ভালোবাসার ওপর আপনার বিশ্বাস নেই এরিকা?
“থাকবেনা কেনো?
এরিকার দৃঢ় কন্ঠ।রুদ্র সামনে ফিরে বলল,
“তবে এমন প্রশ্ন করার যে কোনও মানেই হয়না।আমাকেও তো দেখতে হবে আমার ভালোবাসার জল কত দূর অব্ধি গড়ায়!
ছাড়ুন ওসব।আমার আতিথেয়তা কেমন লাগছে বলুন।
এরিকা হাসলো,
‘খুব ভালো।

____

দু সপ্তাহ কেটে গেলো।এই মাসের শেষ দিকে আবির-সেঁজুতির বিয়ে। মাঝখানে আংটি পরাতে আসেন আবিরের মা মনোরমা।সাথে আবির- হোসাইন ও আসেন।সেঁজুতি নিরস মুখে শাড়ি পরে তাদের পাশে বসলো।একটা বার মুখ তুলে দেখলোনা সামনে হাসি হাসি মুখ করে বসা আবিরকে।আমির হোসাইন কতবার যে একে অন্যের দিকে চেয়ে তৃপ্তির হাসি দিলেন তার হিসেব ছিলোনা।দুজন ভীষণ খুশি।বন্ধুত্ব এবার আরো জোড়ালো হবে।কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো আংটি পরাতে গিয়ে।বাক্স খালি।হীরের আংটিটা হঠাৎই গায়েব দেখে মনোরমা যেন আঁতকে উঠলেন।চিল্লিয়ে বললেন ‘ একী আংটি কই?বাক্স তো খালি।
সবার তখন চোখ বেরিয়ে আসে।মাথায় বাঁজ পরলো প্রত্যেকের।এ আবার কী অলুক্ষনে কথা! আংটি পরাতে এসে আংটিই পাচ্ছেনা?ঠিক হলো আবার একটা আংটি কিনে আনা হবে।এক্ষুনি।কিন্তু বাঁধ সাধলো আবির।আমতা-আমতা করে বলল ” একবার যখন আংটি হারিয়েছে তার মানে বাঁধা পরেছে আম্মু।আংটি বদল বাদ দাও।একবারে বিয়ের দিন পড়িও না হয়?
মনোরমা খুঁতখুঁত করলেন।কিন্তু নিরব সেঁজুতি আগ্রহ দেখালো এবার।জানালো সেও একমত।এমনিতেই আংটি পরা থেকে নিজেকে কীভাবে বাঁচানো যায় সেই কথাই ঘুরছিলো মাথায়।সুযোগ পেয়ে লুফে নিলো। ছেলে মেয়ের দুজনেরই যখন একি মত তখন আর কেউ গাইগুই করলেন না।মেনে নিলেন।তবে মনোরমা গলার চেইনটা খুলে পরিয়ে দিলেন সেঁজুতি কে।মন ভরে দোয়া করলেন দুই স্বামী- স্ত্রী।শেফালি রাতে কাজে এলেও ঐদিন সকাল সকাল চলে এলো।আমির বলেছিলেন,সাথে অন্য একটা কারন।বাটন ফোন চেপে চেপে একটু পরপর রুদ্রকে সব খবরাখবর দিচ্ছে সে।এমনকি কাল রাতে রান্না করার সময় সেঁজুতির কান্নার শব্দ শুনেছে তাও জানালো।তার কাজইতো এটা।সেঁজুতি মাস শেষে বেতন দিলেও রুদ্রর থেকে বাড়তি টাকা পায় শেফালি।তাও সেঁজুতির সব খুঁটিনাটি খবর রুদ্রকে পাঠিয়ে।এই বাড়ির ঠিকানা দিয়ে সেদিন তো রুদ্রই তাকে পাঠালো।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে আবিররা চলে যায়।আমির মেয়ে জামাইয়ের জন্যে আংটি গড়েছিলেন,কিন্তু ওই কথায় আর পড়াননি।সেঁজুতিও চুপচাপ উঠে রুমে ঢোকে।দরজা আটকেই সাথে সাথে টেনে পড়নের কাপড় খুলে ফেলে।ডুকরে ডুকরে কাঁদে বিছানায় শুয়ে।শেফালী কান সজাগ করে শুনছিলো সে শব্দ।যখন নিশ্চিত হলো সেঁজুতি কাঁদছে তখন চট করে একটা বানান ভুলে ভরা মেসেজ পাঠালো রুদ্রর ফোনে।সেঁজুতি বিছানার চাদর খামছে কাঁদছিলো।রুদ্রকে একটাবার দেখার তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে কাঠ।কিন্তু রুদ্র তার বিশ্বাসের অযোগ্য বলেই সংবরন করছে নিজেকে।এমন নয় যে রুদ্র লা পাতা।মাঝখানে একদিন গভীর রাতে রুদ্র কল করে সেঁজুতি কে।রুদ্রর কল দেখেই সেঁজুতি ধড়ফড় করে রিসিভ করলো।রুদ্র তখন শীতল কন্ঠে বলল
‘একবার ভালোবাসুন না,সেঁজুতি!

জবাবে সেঁজুতি লাইন কেটে দেয়।ফোনটাকে দেয়ালের ওপর ছুড়ে মারে।ভেঙে টুকরো হয় সেটি।তারপর আর চাইলেও রুদ্র যোগাযোগ করতে পারেনি।আজ পুরো দশ দিন এক সেকেন্ডের জন্যেও রুদ্রর গলা শোনেনি সেঁজুতি। সেঁজুতিদের সব খরচ এক প্রকার জোর করে আবির চালাচ্ছে।অবশ্য আবির নয়,পেছনে মূলহোতা রুদ্র।সেঁজুতি সেসব জানেনা।
অযৌক্তিক অভিমানে তার বুক ভার হয়ে আছে।রুদ্র কেন যোগাযোগ করছেনা?ফোন ভেঙেছে বলে কী যোগাযোগ করা যায়না?উনি আমাকে আদৌ ভালোবাসেন তো?ভালোনা বাসলে আমার মত সাধারন একটা মেয়ের পেছনে কেন এতো সময় নষ্ট করলেন?কম অপমান তো করিনি ওনাকে।মুখে যা এসেছে তাই বলেছি।যে লোক কখনও কারো থেকে দু কথা হজম করতোনা সে আমার সব অপমান মুখ বুজে মানতেন।হাসতেন।তাহলে এখন কেন গায়েব হয়ে গেলেন উনি?একটা বার নিজেকে শুধরে ফিরতে পারেন না?এসে বলতে পারেন না,সেঁজুতি,তুমিই হবে আমার জীবনের শেষ নারী!যদি নাই বলবেন তবে কেন আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলেন রুদ্র?এই বিয়ে কী করে করব আমি? কী করে?সেঁজুতি আবার কান্নায় ভেঙে পরলো।এবার আর শব্দ এলোনা বাইরে।
_____
বিয়ের বাকী মাত্র দুই দিন।সেঁজুতি মরা শরীর টা টেনেটুনে হাটছে। কথা বলছে,হাসছে সবার সাথে।
বিছানার ওপর বিছিয়ে রাখা বিয়ের বাজার।আজই আবিরদের ড্রাইভার দিয়ে গেলেন।বিয়ের জন্যে কনভেনশন হল ও ভাড়া করা শেষ। সেঁজুতিদের আত্মীয় স্বজন নেই।যা লোক সব আবিরদের। এক ধ্যানে বিয়ের শাড়ি,গয়নার দিক চেয়ে আছে সেঁজুতি। হাটুতে থুতনী রাখা।রক্তশূন্য চেহারা।তখন রুমে কারো পায়ের শব্দ পেলো।সেঁজুতি বিদ্যুৎ বেগে চোখ মুছে পেছনে তাকালো।আমির হোসাইন দুজনে একসাথে দরজায় দাঁড়িয়ে।সেঁজুতি মেকি হেসে বলল ‘ আরে তোমরা?এসোনা।
হোসাইন- আমির ভেতরে এলেন।সেঁজুতি বলল,

” কেমন আছো আংকেল?

আজ আর হোসাইন হাসলো না।চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ তীব্র।পাশেই নিশ্চুপ আমির।হোসাইন কোনো রকম জিজ্ঞেস করলো,
” তুই কেমন আছিস?

” ভালো। তোমাদের কিছু হয়েছে?এরকম দেখাচ্ছে কেনো?

“কিছু হয়নি।
হবেওনা। যদি তুই আমাদের কথা রাখিস।

সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
“কি কথা?
হোসাইন ইতস্তত করলেন,
” কিভাবে যে তোকে কথা টা বলি?

” সিরিয়াস কিছু হয়েছে নাকি?বলোনা?
বাবা তুমি বলোতো কি হয়েছে?

আমির আর্তনাদ করে বললেন ‘ আমি? না না আমি জানিনা,হোসাইন জানে।
হোসাইন রেগেমেগে তাকালেন,
” আমি জানি? আমাকে ফাসিয়ে দিচ্ছিস তাইনা?? বল তুই-ই বল,আমি পারবোনা বাবা।

সেঁজুতি অধৈর্য,
” উফফ কি হয়েছে বলবে তো??
আমির বললেন,
” আসলে হয়েছে কি…

” কি?
হোসাইন মিনমিন করে বললেন,
“আসলে সেঁজুতি তোর সাথে আবিরের বিয়েটা আমি দিতে পারবোনা মা।

চলবে।

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব–৩১

সেঁজুতি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।মাত্রই কর্নকুহর হলো আবিরের সাথে বিয়েটা হচ্ছেনা।হতভম্ভ হয়ে একবার বাবাকে দেখছে তো আরেক বার হোসাইনকে। দুজনেই মাথা নিঁচু করে রেখেছেন।বিয়ের সিদ্ধান্ত টা যে তাদের যূগল পাঁকামোর ফল তাতো এড়াবার জো নেই।
“তোমরা প্লিজ আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বলবে সবটা? কোনও সমস্যা হয়েছে কি?

জবাবে চুপ থাকলো আমির।মেয়ের রাগ কে ভীষণ ভয়।হোসাইনের ওপর দ্বায় দিয়ে চুপ থাকাই শ্রেয় এই মুহুর্তে। ওপর নিচ হালকা মাথা দোলালেন হোসাইন।

সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছে?
” আবির বিয়ে করতে পারবেনা।ও বিবাহিত।
সেঁজুতি চমকে ওঠে।চোখ পিটপিট করে বলল,
“কী বলছো?

“হ্যা। এক বছর আগে সিঙ্গাপুরের এক মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে।আর কালই মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।মেয়েটা প্রেগন্যান্ট।

সেঁজুতি কিছুই বুঝলোনা,
“এক বছর আগে বিয়ে করেছে? তবে ও বিয়েতে রাজী কেনো হয়েছিলো?

” সেসব বলছেনা।জিজ্ঞেস করলে বলেছে তোকেই বলবে।জানিস, মেয়েটা অন্যান্য বিদেশী মেয়েদের মতো নয়।বেশ ভদ্র,আর আবিরের জন্য মুসলিম হয়েছে।এরপরেও কি করে না মেনে নিয়ে থাকতে পারি বল??

হোসাইনের চোখেমুখে অসহায়ত্ব। সেঁজুতির রাগ হচ্ছে আবিরের ওপর।বিয়ে করবেনা আগে বলতে পারলোনা?শুধু শুধু এত কষ্ট পেলো সে।আবার খুশিও লাগছে বিয়ে হবেনা ভেবে।এটাইতো চাইছিল ও।কিন্তু ভেতরের খুশিটা ধরা দিলোনা কাউকে।মেকি দুঃখি ভাব নিয়ে বলল,

“বিয়ে যখন করেছে মেয়েটা তোমার বাড়ির বউ।মেনে না নিয়ে যাবে কোথায়?আর সব থেকে বড় কথা, ভালোবাসে ওরা দুজন দুজন কে।

“কিন্তু আমি তো চেয়েছিলাম তুই আমার পুত্র বধু হবি। হোসাইন মন খারাপ করে বললেন।
সেঁজুতি বিড়বিড় করলো ‘ খুব বাঁচা বেচেছি। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করা যে কী কঠিন! তুমি জানবেনা আঙ্কেল।মুখে বলল,
“আল্লাহ হয়তো চাননি,,ওনার মর্জিই তো সব।
আমির পাশ থেকে বললেন,
” হ্যারে মা, তোর রাগ হচ্ছেনা আমাদের ওপর?

সেঁজুতি সোজাসাপটা বলল,
— না।তোমাদের ওপর হচ্ছেনা।তবে আবিরের ওপর মারাত্মক রাগ লাগছে।এক বছর আগেই বিয়ে করে এত নাটক করলো কেন?আর আগেই বা এসব জানালো না কেনো?

হোসাইনও মেজাজ নিয়ে বললেন,
‘হতচ্ছাড়াটাকে তো মারতেও পারিনি নতুন বউয়ের সামনে।তবে আমি ওর সাথে কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি।ঠিকই তো, বিয়ে করেছিস তো বাসায় জানাবিনা?,তোর সাথে ওর বিয়ে নিয়ে আমরা আগাতাম তাহলে? সমস্ত আত্মীয় স্বজনরা জেনে গিয়েছেন।আমাদের সন্মান থাকলো কই?

“বাদ দাও।যা হবার হয়েছে।

“আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলবি?

” বলো!
হোসাইন আশাবাদী কন্ঠে বললেন,
“তুই তো আমাকে তোর বাবার মতোই ভাবিস তাইনা?
সেঁজুতি হেসে ফেলল,

“বাবার মতো ভাবিইনা।বরং ভালো ও বাসি।
হোসাইন মুগ্ধ হাসলেন।আমিরের দিক তাকালেন।আমির ও হাসছেন খুশিতে।হোসাইন সেঁজুতির দিক ফিরলেন,ওর হাত দুটো মুঠোয় নিয়ে বললেন,
“আমার একটা অনুরোধ রাখবি?

” এভাবে বলার কী আছে আঙ্কেল?বলোনা কি বলবে!
হোসাইন খানিক সময় নিয়ে বললেন,
“ওই তারিখেই তোর বিয়েটা দিতে চাই আমরা।

সেঁজুতি চকিতে তাকালো। স্তব্ধ সে।হোসাইনের মুঠো থেকে হাত দুটো বিদ্যুৎ বেগে বার করে আনলো।অস্পষ্ট আওয়াজে বলল
“কি!
হোসাইন আশা ছাড়লেন না।জ্বিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,

“আমার কলিগ মিস্টার মেহরাব।যিনি তোর বাবার ট্রিটমেন্ট করিয়েছিলেন? ওনার ছেলে রাফসানকে আমি ছোট বেলা থেকে চিনি।প্রতিষ্ঠিত, দেখতে ভালো,ভদ্র।তোকে সব দিক থেকে সুখে রাখবে।

সেঁজুতি বাকরুদ্ধ।একবার বাবার দিক তাকালো।আমির আশা নিয়ে চেয়ে আছেন।অপেক্ষা করছেন মেয়ের উত্তরের।সেঁজুতি ক্ষীন স্বরে বলল,

” কি বলছো এসব আংকেল?চেনা নেই জানা নেই৷ কে না কে?

হোসাইন ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,
” চেনা নেই তো চিনে নিবি।বিশ্বাস রাখ মা,রাফসান খারাপ ছেলে নয়।ও সত্যিই ভালো।খারাপ হলে কী আমি তোর সাথে ওর বিয়ে ঠিক করতাম?
আমি নিজে কথা বলেছি ওর সাথে।

সেঁজুতি গলায় দলা পাঁকানো কান্না কোনো রকম রোধ করে বলল ‘
” এটা হয়না।

“কেনো হয়না রে মা?আমারও ইচ্ছে আর তোর বাবারও!
সেঁজুতি বাবার দিক চেয়ে বলল ‘ তুমিও তাই চাও?
আমির নরম কন্ঠে বললেন
” এছাড়া এখন আর উপায় নেই রে সেঁজুতি। তোর আঙ্কেল কার্ড বিলিয়েছেন।ওর সন্মান জড়িয়ে এখানে।তাছাড়া ওর ওপর আমার আস্থা রয়েছে।ও নিশ্চয়ই তোর যোগ্য কাউকে বেছে আনবে।

সেঁজুতির খুব বলতে মন চাইলো,’ আর আমার ইচ্ছে?তার কোনো দাম নেই?যাকে জীবনে কোন দিন দেখিনি তাকে বিয়ে করব?আর যাকে ভালোবাসি ভুলে যাব তাকে?কী করে পারব?
কিন্তু বলা হলোনা।জ্বিভ অসাড় হয়ে এলো ।রুদ্র ঠিক থাকলে হয়ত বিয়ের বিষয় এতদূর গড়াতোইনা।প্রথম দিনই বাবাকে জানাতো, সে অন্য কাউকে মন দিয়ে বসেছে।

আমির মেয়েকে নিরুত্তর দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
” তোকেতো আমি কতবার জিজ্ঞেস করেছি,কাউকে পছন্দ কীনা।তুই কোনো উত্তর দিলিনা।তাহলে বিয়ে তুই আমার ইচ্ছেতেই করতে চাচ্ছিস,আমি এরকমই ধরে নিয়েছি।তবে আপত্তি কোথায়?যদি তোর জীবনে অন্য কেউ থাকতো আমি কখনওই এমন সিদ্ধান্ত তোর ওপর চাপাতাম না। নেই যখন,কেন অমত করছিস মা?কত লোক জেনে গিয়েছে কাল বাদেই তোর বিয়ে।সেখানে বিয়েটা না হলে যে আমাদের দুজনার সন্মানই শেষ।
সবই এখন তোর হাতে।

সেঁজুতি পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলো।ফর্সা চেহারা কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।জ্বিভ ঠেলে বের হতে চাইছে রুদ্রর নাম।কিন্তু পারছেনা।ওই যে,ভরসার খাতা শূন্য।আবেগের বশে জীবনে এমন কাউকে জায়গা দেবেনা যার মধ্যে চরিত্রের ছিটেফোঁটাও নেই।
আমির হোসাইন একে অন্যকে দেখছেন।মেয়ে কী রাজি হবে?হোসাইন নম্র কন্ঠে শুধালেন,
” কিরে মা! কিছুতো বল।তুই কী রাজি?

সেঁজুতির উত্তর এলো সময় নিয়ে।কোনও রকম বলল,
” যা খুশি করো।
সেঁজুতি আর দাঁড়ালোনা।কাউকে কিছু বলার সূযোগ ও দিলোনা।দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ছাদের উদ্দেশ্যে।

একটু পরপর পায়ের ওপরে ওঠানো পা টা নাড়াচ্ছে রুদ্র।নীঁচের ঠোঁট চেপে ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে।একীরকম চিন্তিত উপস্থিত প্রত্যেকে। আবির শুধালো,
“এই রাফসানের চ্যাপ্টার টা মাঝখানে কিভাবে এলো বলুন তো!
রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয়

” নো আইডিয়া।

“কি করবেন এখন?আপনার কথা মতো সবই তো করলাম।আর প্ল্যান অনুযায়ী সব পার্ফেক্টলি এগোচ্ছিলোও।মাঝখানে বাবা সব ঘেটে দিলো একেবারে।
কথাটা বলে একটু দম নিলো আবির।বেশ উতলা সে।রুদ্র তার এত বড় উপকার করলো আর সে কীনা কিছুই করতে পারছেনা ওর জন্যে?

“আচ্ছা মি:রুদ্র এক কাজ করলে হয়না?
রুদ্র সরু চোখে তাকালো, আবির উদ্বগ নিয়ে বলল,
আবির গমগমে কন্ঠে বলল,
” আমরা যদি রাফসান ব্যাটাকে হুমকি -ধামকি দেই?সিলেটে আমাকে যেমন মারতে লোক পাঠিয়েছেন ওরকম।লোক দিয়ে ওকেও যদি মারি?বিয়েটা না করতে বলি?ব্যাটা নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে পালাবে?কি কেমন আইডিয়া দিলাম বলুন?

“ভেরী ব্যাড আইডিয়া মিঃআবির।

হঠাৎ পাশ থেকে বলে উঠলো অভ্র।দুহাতে দুটো কফির মগ। মাত্রই এসে দাঁড়িয়েছে।একটা মগ আবিরের দিকে বাড়িয়ে বলল,

“কফি চলবে?

“নো থ্যাংকস!
“কষ্ট করে এনেছি যখন নিয়েই নিন।
আবির রুদ্রকে দেখিয়ে বলল,
‘ ওনাকে দিন।

“ভাই এই সময় কফি খায়না।এটা আপনার জন্যেই এনেছিলাম আমি,নিন।

আবির নিলো।ছোট একটা চুমুক দিয়ে অভ্রর দিকে তাকালো।হেসে বলল,

” বাহ! ভালো বানিয়েছেন।
অভ্র পাশে বসতে বসতে জবাব দেয়,
-“থ্যাংক ইউ!তবে আমি বানাইনি,সার্ভেন্ট বানিয়েছে,,আমি নিয়ে এসেছি মাত্র।

আবির হেসে উঠলো স্বশব্দে।পরক্ষনে রুদ্রর চিন্তিত মুখ দেখে হাসি থামিয়ে ফেলল।অভ্রকে শুধালো,

“,আমার আইডিয়া টা খারাপ কেনো? বললেন না যে…
অভ্র কপালের পাশ চুলকে বলল,
” খারাপ এই জন্যে, রাফসান কে আপনি হুমকি দিয়ে বিয়ে করতে আটকাবেন।দুনিয়াতে আরো অনেক ছেলে আছে আবির,কতোজন কে আর ধরে রাখতে পারবেন আপনি?

আবির মাথা নেড়ে সহমত পোষণ করলো। ঠিক কথা।
“তাহলে আমাদের কি করা উচিত এখন?

‘ আপাতত কিছুই করবোনা।সব টাই সেঁজুতির ওপর ছেড়ে দেবো।
এ পর্যায়ে রুদ্র মুখ খুলল,ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘পরিষ্কার করে বল।
রুদ্রর আগ্রহে অভ্র উৎসাহ পেলো।মুখে রাখা কফিটুকু গিলে বলল,

” লিসেন ভাই!তুমি হয়তো সেঁজুতির জন্যে ঠিক করা প্রত্যেক টা ছেলেকে সরিয়ে বিয়ে আটকাতে পারবে।সে ক্ষমতা তোমার রয়েছে।অথবা চাইলে সেঁজুতিকে তুলে এনে জোর করে হলেও ওকে নিজের করতে পারবে। কিন্তু এতে কি সেঁজুতির ভালোবাসা পাবে তুমি?? পাবেনা।বরং ওনার থেকে তোমার দুরুত্ব আরো বাড়বে

রুদ্রর মুখে ঘন কালো আঁধার নামলো।অভ্রর প্রত্যেকটা কথাই ঠিক।মৃদূ কন্ঠে বলল,
‘ তাহলে কি করতে বলছিস?
রুদ্রর গলাটা অভ্রর কাছে কেমন অসহায় শোনালো।ভালোবাসলে মানুষ এতটা অসহায় হয় বুঝি?অভ্র উঠে এসে রুদ্রর কাঁধে হাত রাখলো।

‘ ওনাকে সময় দাও ভাই।আবিরের ধারনা সত্যি হলে সেঁজুতি তোমাকে ভালোবাসে।আর ভালোবাসলে উনি নিশ্চয়ই সব ছেড়েছুড়ে ফিরবেন।
কি মিস্টার আবির, ঠিক বলছি তো?

আবির মাথা দোলালো,
— হ্যা। একদম,সত্যি বলছি। এ কদিনে সেঁজুতিকে দেখলে বুঝতে পারতেন।যতবার আমার সাথে বেরিয়েছে,রাস্তায় কাউকে দুর থেকে দেখলেও ভাবতো ওটা আপনি।ইনফ্যাক্ট আমাকে ডাকতে গিয়ে স্যার ডেকে ফেলতো।কতো টা কষ্টে যে
হাসি চাপিয়ে রাখতাম তখন।

রুদ্র সূক্ষ্ণ হাসলো।শান্তি পেলেও স্বস্তি মিললোনা।আবিরের ধারনা যদি ভুল হয়?সেঁজুতি যদি না ফেরে?কিন্তু শেফালি যে বলেছে সেঁজুতি কাঁদছিলো?কেন কাঁদছিলো মেয়েটা?আমার জন্যে?নাকী বাবাকে ছেড়ে যাবে সেজন্যে?রুদ্রর চিন্তার ধ্যান কাটে অভ্রর কথায়,
” ইয়েস! এই জন্যেই বলেছি সেঁজুতির ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দিতে।দেখা যাক না উনি কি করেন?

আবির সন্দেহী কন্ঠে বলল,
” কিন্তু দেখতে গিয়ে যদি বিয়ে টা হয়ে যায়?

‘ হবেনা।শেষ সময়েও যদি দেখি অপেক্ষার ফল শূন্য। তবে আপনার পদ্ধতিই কাজে লাগাবো না হয়।
অভ্রর কন্ঠ দৃঢ়,আবির উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,

-” আরে এতো সময় আপনি পাচ্ছেন কই?কাল বাদে পরশুই বিয়ে।

‘ ব্যাপার না।সময় মতো সব সেট করে ফেলব।
কি ভাই ভালোবাসায় ভরসা আছে না তোমার?

রুদ্র উঠে দাঁড়ায়।চুল গুলো পেছনের দিক ঠেলে গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,

” আমি দেখতে চাই সেঁজুতি ঠিক কি করেন?উনি চাইলে বিয়ে করে নেবেন।আমি জোড় করে ওনাকে পেতে চাইনা।ভালোবেসে পেতে চাই।অবশ্য আমার ভালোবাসার মানুষ গুলো আমার থেকে সব সময়ই দূরে চলে যায়।এটাতো নতুন নয়।অন্যান্যবারের মতোন এবারো হজম করে নেবো না হয়!বিগড়ে যাওয়া রুদ্রটাই আবার ফেরত আসবে।ক্ষতি কি?

শেষ কথাগুলোয় রুদ্রর গলা ভেঙে এলো।অভ্র আবির দুজনেই মুখ কালো করে দেখলো রুদ্রর চলে যাওয়া।দুজনেরই খারাপ লাগছে।অভ্রর কষ্ট হচ্ছে।ভাইয়ের জন্যে কী কিছুই করতে পারবেনা ও?মনে মনে দৃঢ় সংকল্প নিলো,

‘ তোমার ভালোবাসাকে ব্যার্থ হতে আমি দেবনা ভাই।একবার যে অন্ধকার,নারীসঙ্গ থেকে তুমি বেরিয়েছ কিছুতেই ও পথে ফিরতে দেবনা।সেঁজুতি তোমাকে অনেক বদলেছে।তোমার গম্ভীরতা ঠেলে ভেতর থেকে প্রানচ্ছ্বল তুমিটাকে টেনে বের করেছে।কী করে আবার আগের মতো হতে দেই তোমাকে?জীবনে প্রথম বার কাউকে ভালোবেসেছো তুমি।ব্যার্থ হবেনা।আমি যেটুকু বুঝছি তাতে সেঁজুতি তোমাকে ভুল ভাবছে।আর ওনার সেই ভুল টাই ভাঙাতে হবে আমাকে।আমার জন্যে অনেক করেছো ভাই ,,আর তোমার জন্যে যদি এইটুকু করতে না পারলাম,তবে কেমন ভাই মেনেছি তোমাকে আমি?

চলবে।

প্রনয় পর্ব-২৮+২৯

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৮

আবির হতবাক।কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে।অবিশ্বাস তার চোখেমুখে। রুদ্র হাসছে।বরাবরের সূক্ষ্ণ হাসিটা।আর সেই হাসি গোল চোখে দেখছে আবির।
মাত্রই শুনলো,রুদ্র সেঁজুতিকে ভালোবাসে।শুধু ভালোইবাসে না, ভালোবেসে রীতিমতো হাবুডুবু খাচ্ছেন।রুদ্র মজা পাচ্ছে আবিরের মুখ দেখে।ছেলেটা এবার ভালোয় ভালোয় সেঁজুতির পেছন ছাড়লে হয়।মশা মেরে হাত নষ্ট করতে কার-ই বা ভালো লাগে?আবিরের মুখ অর্ধখানেক ফাঁকা হয়ে আছে।রুদ্র টেবিলের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বলল,

“মি:আবির!আপনার সাথে আমার ভাই অভ্রর বেশ সাদৃশ্য আছে। জানেন কী?

আবির দুদিকে মাথা নাঁড়লো।সে জানেনা।রুদ্র কৌতুক কন্ঠে বলল,
“অভ্র আর আপনি দুজনেই আন-এক্সপেক্টেড কিছু শুনলে মুখ হা করে থাকেন।এই যে,এখন আপনি যেমন রয়েছেন।

আবির সম্বিৎ ফিরে পেলো।নঁড়েচড়ে গলা ঝাঁড়লো,
চেহারায় একটু সিরিয়াস ভাব নিয়ে এলো।নিশ্চিত হতে শুধালো,
” আপনি সত্যিই সেঁজুতিকে ভালোবাসেন?

“মিথ্যে মিথ্যে ভালোবাসা যায় নাকি??

“না ঠিক তা নয়। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি যে আপনার আর সেঁজুতির স্টাটাস তো এক নয়।কোথায় আপনি অার কোথায় সেঁজুতি!আপনি এত বড় একজন বিজনেসম্যান, আর সেঁজুতি সেখানে সামান্য মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে।তাহলে ব্যাপারটা কি করে? মানে ঠিক বুঝতে পারছিনা আমি।

“এটাই তো ভালোবাসা মি: আবির।কখন কার প্রতি কার অনুভূতি জন্মাবে সেটা আগে থেকে না বলা যায়, আর না নিয়ন্ত্রণ করা যায়।আমার ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে।সেঁজুতি আর আমার মধ্যে অর্থের তফাৎ আমি কোনো দিনও আসতে দেবোনা।আমাদের মন এক হবে।বাকী সব আলাদা হোক।চূলোয় যাক আই ডোন্ট কেয়ার!
এনি ওয়ে,সব টাই আপনাকে বলেছি আমি।বলার প্রয়োজন যদিও ছিলোনা তাও বলেছি।
কেনো জানেন?

“কেনো?

” কারন,আপনার সাথে কথা বলে আজ মনে হলো আপনি একজন ভদ্র মানুষ।তারওপরে সেঁজুতির ছোট বেলার বন্ধু।আপনার সাথে দ্বিতীয় বার অশোভনীয় কিছু করতে আমার মন স্বায় দিচ্ছেনা।

আবির ভ্রু কুঁচকে বলল ‘ দ্বিতীয় বার মানে?
রুদ্র চেহারায় সেই গম্ভীর ভাবটা নিয়ে এলো আবার। স্পষ্ট ভাষায় বলল
‘ সিলেটে ছিনতাইকারীর বেশে যারা আপনার ওপর আক্রমন করে?ওরা আমার লোক,আমিই পাঠিয়েছিলাম ওদের।

আবিরের কাশি উঠে গেলো কথাটায়।রুদ্র পানির গ্লাস এগিয়ে দিতেই ত্রস্ত হাতে নিলো।ভয়ে ভয়ে চেয়ে থেকে ঢকঢক করে খেলো পানিটুকু।অস্পষ্ট কন্ঠে বলল
” আপনি!
রুদ্রর নিরুদ্বেগ জবাব
‘ হ্যা আমি।আপনি সেঁজুতির আশেপাশে বেশি ঘেষাঘেষি করতেন,যেটা আমার পছন্দ হয়নি।তাই আপনাকে একটা ছোট্ট শিক্ষা দিতে চাইলাম।দিয়েও দিলাম।আপনিও বোঁকা।ছিনতাইকারী আপনার ওপর হামলা করবে অথচ ফোন,ওয়ালেট এসব কিছুই নেবেনা?শুধু আপনাকে কটা বারি দিয়ে রেখে যাবে?ফানি না?

আবির বড় বড় চোখে ঘনঘন পাতা ফেলল।কি ডেঞ্জারাস লোক!এরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে অকপটে স্বীকার করছে?এর কী প্রসাশনের ভয়ও নেই?
রুদ্র যেন শুনতে পেলো।দৃঢ় কন্ঠে বলল,
‘ রুদ্র রওশন চৌধুরী কাউকে ভয় পায়না।একমাত্র সৃষ্টি কর্তা ছাড়া।
আবিরের চোখ পারলে লাফিয়ে আসে বাইরে।ইনি কী মনের কথাও শুনতে পায়?
রুদ্র শান্ত অথচ কঁড়া কন্ঠে বলল,

“আপনি ভদ্রলোক।আমিও ভদ্রলোক।তাই ভদ্রভাবেই ব্যাপারটা মেটাতে চাইছি।জেনেই নিলেন আমি সেঁজুতিকে ভালোবাসি।আর রুদ্র রওশনের ভালোবাসা তার রাগের থেকেও মারাত্মক। এবার আর আপনি আমাদের মাঝখানে আসবেন না আশা করি। আর সব শুনেও যদি আসতে চান, তো আমার অন্য রুপটাও দেখাতে বাধ্য হব আবির।আই সোয়্যার,এবার আর আপনার হাত পায়ের ওপর দিয়েই যাবেনা শুধু।

কি সুন্দর হুমকি!কি অবলীলায় দিলো রুদ্র।আবিরের ভয় পাওয়া উচিত।অথচ সে মুচকি হাসলো।রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো এতে।আবির লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

” আপনার কোথাও একটু ভুল হচ্ছে মিস্টার চৌধুরী।

রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
“ভুল?আপনি যাই বলুন না কেনো আবির,এটুকু বোঝার বুদ্ধি আমার রয়েছে।সেঁজুতির প্রতি আপনার দরদ,আপনার অনুভূতি কতটা তীব্র আমি জানি।
আবির এবার হেসেই ফেলল শব্দ করে।রুদ্রর চোয়াল শক্ত হলো।সে কী জোক্স বলল?এভাবে হেসে কী প্রমান করছে ছেলেটা? আবির হাসি থামিয়ে বলল

” একটা কথা আপনি ঠিক বললেন,সেঁজুতির প্রতি আমার দরদ, আমার অনুভূতি এসব অনেক প্রবল।এই প্রবল অনুভূতি দিয়ে যদি আপনি ভালোবাসা বোঝান, তবে বলবো আপনি অবশ্যই ভুল করছেন।কারন সেঁজুতি আমার বন্ধু,ইনফ্যাক্ট খুব ভালো বন্ধু। আমার বয়স যখন আট বছর,চার বছরের ফুটফুটে সেঁজুতি কে আমি কোলে নেই।প্রথম বারেই ও আমাকে খামঁচে দেয় জানেন?আমি তাতে রাগিনি।উলটে হেসে ফেলি।সেঁজুতির হয়ত তাতে আমাকে ভালো লাগে।ও-ও হাসলো।আর এরপর থেকে আমার পিছুই ছাড়লোনা।মাকে নকল করে আমাকে নাম ধরে ডাকতো।আবির টা উচ্চারন করতো “আবিল “বলে।আমার ভীষণ হাসি পেতো ওই ডাকে।সবাই বলতেন ভাইয়া ডাকো,ও তোমার বড়।কিন্তু ও কী কথা শুনবে?শোনেনি।নাম ধরেই ডাকে।যেটা এখন অব্দি ওর অভ্যেস।যেদিন আমি দেশ ছাড়ি?এয়ারপোর্টে আঙ্কেল নিয়ে যান ওকে,ও আমার গলা জড়িয়ে কাঁদে। কিছুতেই আমাকে ছাড়বেনা।সেদিন ওর প্রতি আরো বেশি মায়া অনুভব করি।সিঙ্গাপুর গিয়ে প্রথম প্রথম খাপ খাওয়াতে পারিনি।বাড়ির কথা,সেঁজুতির কথা ভীষণ মনে পড়তো। তাই বাবা যোগাযোগ কমিয়ে দেন।আমার শক্ত হওয়ার খাতিরে।আমিও আস্তে আস্তে পড়াশুনা,হৈ হুল্লোড়ে ব্যাস্ত হয়ে পরি।ভুলে যাই সব।সেঁজুতি কেও।তেমন সেঁজুতিও ভুলে যায় আমাকে।বারো বছর পর আবার দেখা হয় সিলেটে।আমি ওকে চিনে ফেললেও ও পারেনি।আমি ওর সাথে মজা করার জন্যেই ওমন কাছেকাছে ঘিষতাম।কৌশলে জানতেও চেয়েছিলাম,ও আমাকে আসলেই চিনলো কীনা! কিন্তু ওর কাছে যাওয়াটা আপনার চক্ষুশূল হবে তা কিন্তু আমার জানা ছিলোনা।সেঁজুতি কে আমি শুধুই বন্ধুর চোখে দেখি।সারাজীবন দেখব।আর একজন বন্ধু তার বন্ধুর ভালো চায় বলেই আমি আজ এখানে ওর হয়ে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছিলাম।এখানে দ্বিতীয় কোনো কারন নেই মিস্টার চৌধুরী।

আবির থামতেই রুদ্র সন্দেহী কন্ঠে বলল,
“আপনি যে সত্যি বলছেন তার কি মানে?কেনই বা আমি বিশ্বাস করব আপনাকে?

‘বিশ্বাস করা না করা আপনার ওপর। সেখানে আমার হস্তক্ষেপ কোনো কাজে আসবেনা।আপনি আপনার জায়গায় একদম সঠিক।কারন,আমরা যাকে ভালোবাসি তার আশেপাশে অন্য কারো সামান্য বিচরন আমরা মেনে নিতে পারিনা।হিংসে হয় সেই লোকের প্রতি। যেমন আপনার হয়েছিলো,আমার ওপর। তবে এটাই সত্যি,বন্ধুত্বের বাইরে আমি সেঁজুতিকে আলাদা ভাবে কখনও দেখিনি।আর এর থেকেও একটা বড় সত্যি হলো,
“আ’ম অলরেডি ম্যারিড।
রুদ্র চমকে বলল ”What!

” ইয়েস!এক বছর হতে চললো আমি বিয়ে করেছি।

রুদ্র অবাক কন্ঠে বলল,
“কিন্তু আমিতো ইনফরমেশন পেয়েছিলাম__
আবির মাঝপথে আটকে দিলো,

“এটা সবাই জানেনা।এর ভেতরের গল্প টা আমি আপনাকে বলছি…
আবির নিঃশ্বাস ফেলল,
“বাবা বরাবর ভালো ছাত্র ছিলেন।ওনার কাছে পড়াশোনার অনেক মূল্য।আমিও যৎসামান্য ভালো স্টুডেন্ট ছিলাম।তাই বাবার ইচ্ছেতে সিঙ্গাপুর পড়তে যাওয়া ঠিক হলো।একটা সময় সেখান কার ভার্সিটি পড়াকালীন আলাপ হয় এরিকার সঙ্গে।আমার ওয়াইফ।ও অন্যান্য বিদেশিদের মতো নয়।একদম আলাদা।উগ্রতা ছিলোনা।উলটে মায়াবি,কেয়ারিং আর ভীষণ মার্জিত বলেই অজান্তেই ওকে মন দিয়ে ফেলি।ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রোপোজ করলে ও বলল ভেবে দেখবে।দেড় মাস পর হ্যা জানালো।আমার খুশির অন্ত ছিলোনা সেদিন।কিন্তু ভয় পেতাম,দুজন আলাদা ধর্ম,বাবা কী মানবে?ওনাকে আমি জমের মতো ভয় পেয়ে আসছি সেই ছোট বেলা থেকে।ভাবলাম একবার বিয়ে হলে নিশ্চয়ই আর অমত করার সুযোগ থাকবেনা।বাধ্য হবে মানতে।সেই চিন্তা করেই আমি এরিকাকে বিয়ের কথা বলি।ওর তো কোনো ভয় ছিলোনা।ও এক কথায়ই স্বায় দিলো। কিন্তু এখনও বাড়িতে কিছুই জানাতে পারিনি আমি।

” কেন?

“আসলে বাবা মা দুজনকে নিয়েই ভয়। মা একজন ইমামের মেয়ে ছিলেন। উনি নিজেও পর্দা করেন।মন-মানসিকতা কেমন হবে বুঝতেই পারছেন?বিদেশী মেয়ে মানেই উগ্রো,বেয়াদব,ছোটো ছোট জামাকাপড়, পার্টি,নাইটক্লাব এ দেশের কালচারের সাথে মিলবেনা এসব ভাবনা তো রয়েইছে।আর তার সাথে ও দ্বি-জাতি। মানে খ্রিস্টান। মা শুনলে কি রিয়্যাক্ট করবে না করবে সেসব ভেবেই এখনও চুপ আছি।বিয়ে তো করে নিলাম কিন্তু নিজ গৃহে এরিকাকে দায়িত্বের সহিত নিয়ে আসতে পারছিনা।

রুদ্র বলল,
“কিন্তু জানাতে তো আপনাকে হবেই,।আজ না হোক কাল।আফটার অল সি ইজ ইওওর ওয়াইফ নাও।

আবিরের মুখে অন্ধকার,
“সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।ওদিকে এরিকাও দেশে আসার জন্যে প্রেশার ক্রিয়েট করছে।কোনও রকমে বুঝিয়ে শুনিয়ে এসেছি যে আগে সবটা ম্যানেজ করে নেব, তারপর ওকে নিয়ে আসবো।কিন্ত এসে থেকে এক কদম ও আগাতে পারছিনা।আমি যে কেন এত ভীতু!

‘ ধৈর্য রাখুন।এভ্রিথিং উইল বি ফাইন!

আবির মাথা নাঁড়লো।ওর সমস্যার কথা শুনে খারাপ লেগেছে রুদ্রর।কিন্তু ভেতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ও বেরিয়েছে।বুকের ওপর থেকে নেমে গেছে একটা বড় পাথর।এতদিন যাকে গলার কাঁটা ভেবে এলো,সে আসলে কাঁটার ধারেকাছেও না।শুধু শুধু আবির কে নিয়ে তার এতো চিন্তা হচ্ছিলো।ধুর!

আবির চিন্তিত মুখে মাথা নীচু করে বসে আছে।রুদ্র ওর হাতের ওপর হাত রাখলো।নম্র কন্ঠে বলল,
” চিন্তা করবেন না।যে কোনো হেল্প লাগলে আমাকে জানাবেন।
_____
অফিসে ঢুকতে না ঢুকতেই রুদ্রর কেবিনে ডাক পরলো সেঁজুতির।অবাক হলো।অন্তত একটু বসে জিরোতে দে!এমনিতেই আজ প্রচন্ড গরম।সকাল বেলা এত্ত জ্যাম! গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার প্রায়।ঠিক দশটায় ঢুকতে পারেনি,দশটা পাঁচ বাজে এখন।এই জন্যেই কী ডাকছে?পাঁচ মিনিটের বিলম্বে ঝারি দেবেন বলে?কাঁধ ব্যাগ টা ডেস্কের টেবিলে রেখে পা বাড়ালো সেঁজুতি ।তীব্র অনিহা মনে।তাও কিছু করার নেই।কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই রুদ্র রিমোর্ট দিয়ে দরজা খুলে দেয়।অর্থ,সে নিরবে অনুমতি জানালো।সেঁজুতি ঢুকলো ভেতরে।

‘ডেকেছেন স্যার?
রুদ্র সরু চোখে তাকালো,
“মাত্রই এলেন?
“জ্বি।

রুদ্র পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো,
“খেয়ে নিন।
” লাগবেনা।

রুদ্র তপ্ত চোখে তাকালো।সাথে সাথে টেবিল থেকে গ্লাস ওঠালো সেঁজুতি। আসলে তেষ্টা পেয়েছিল।রুদ্র দিয়েছে বলেই খেতে চায়নি।কিন্তু এই লোকের চাউনি?মারাত্মক।তার ওপর এটা অফিস।সিনক্রিয়েট হোক চায়না সেঁজুতি। পানি খেয়ে ভেজা ঠোঁট হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুছে বলল,
“এবার বলুন।
পুরোটা সময় রুদ্র চেয়েছিলো।সেঁজুতির প্রশ্নে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,”কি বলবো?

” ডেকেছেন কেনো?
“ও হ্যা, আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো।

রুদ্র উঠে এলো।সেঁজুতির কাঁপা-কাঁপি শুরু হলো ওমনি।এই লোক চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ানো মানে ভয়ানক কিছু ।কখন কি বলবে, কি করবে, কেউ জানেনা।রুদ্র সেঁজুতির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।সেঁজুতি এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে মেঝেতে। রুদ্র পা দুটো ফাঁক করে পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো।পরমুহূর্তে ঝুঁকে গিয়ে ফু দিলো সেঁজুতির মুখে।সেঁজুতি থমকে গেলো।কপালের চুল গুলো উড়ে উঠলো ক্ষনবায়ুতে।সেঁজুতি বাকরুদ্ধ তখন।ঢোক গিলে বলতে নিলো ‘ আপ…

রুদ্র থামিয়ে দিলো।ফিসফিস করে বলল ‘ কিছু বলার দরকার নেই।আমি জানি আমি চরিত্রহীন।অসভ্য।
সেঁজুতি চোখ মুখ কুঁচকে চেয়ে থাকলো।রাগ করতে চাইছে খুব।কিন্তু কোনওভাবেই রাগ টা বের হচ্ছেনা।কেন?
রুদ্র সোজা হলো।আগের মতোই গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপনার নামের মানে আমি বার করে ফেলেছি।সেঁজুতি। মানে, সন্ধ্যা প্রদীপ।আই মিন অন্ধকার দূর করতে যে আলো প্রথম জ্বালানো হয়।
এই জন্যেই তো বলি, এতো মেয়ে থাকতেও এই রুদ্র রওশন কেনো আপনার প্রতি হোচট খেলো?
একটা টান তো আছেই তাইনা?আপনি আসার আগে আমার জীবন টা তো ঠিক সন্ধ্যা বেলায় ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের মতই ছিলো।আর তার প্রদীপ হিসেবে আপনি এলেন।কি সুন্দর আলো জ্বেলে দিলেন আমার জীবনের।

রুদ্রর বৃত্তান্তে সেঁজুতি চোখ পিটপিট করলো,
” কোথা থেকে কি মানে বার করলো এই লোক?
মুখে বলল,
এই জন্যে ডাকলেন?
‘হ্যা।
সেঁজুতি বলল,
বলা শেষ? তাহলে আমি আসছি।আর আপনি আমাকে একটু কম কম কেবিনে ডাকবেন।অফিসের লোকজন আমাদের নিয়ে কানাঘুষা করে। সেটা আপনি না শুনলেও আমার কানে আসে।

রুদ্রর নিরুদ্বেগ জবাব
‘তো?
সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল,
‘তো মানে?? আরে এভাবে লোকে কথা ছড়াক আমি চাইনা।

‘কথা ছড়াবে কেনো?ওদের মধ্যে আমাদের বিয়ে, আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ইন্টারেস্ট আছে তাই ওরা বলাবলি করে। দ্যাটস ইট।

সেঁজুতি হতভম্ব হয়ে বলল,
” বিয়ে?? কিসের বিয়ে? আর কিসেরই বা সম্পর্ক?

রুদ্র মিটিমিটি হাসলো।সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকায়।
‘ হাসছেন কেন?ইদানীং প্রায়ই দেখছি এরকম মিটমিট করে হাসেন।সমস্যা কী আপনার?

‘ আমার কী সমস্যা?কোনো সমস্যা নেই।আর হ্যা,শুনুন,আপনি অফিস আওয়ারের আট ঘন্টার মধ্যে পাঁচ ঘন্টাই আমার কেবিনে থাকেন।আসতে হয় আপনাকে।আমিই ডাকি।সবাই এটা নিয়ে কানাঘুষা করছেনা। অফিসের সবাইকে বলা হয়েছে যে খুব তাড়াতাড়িই আমাদের বিয়ে,সেই নিয়েই এদের মাতামাতি।

সেঁজুতি আশ্চর্কিত,
“কি বলছেন কি এসব?আমাকে না জানিয়ে, আমার থেকে অনুমতি না নিয়ে আপনি ওদের এসব বলতে পারেন না!
রুদ্রর নিরুৎসাহিত জবাব,
“কেনো পারবোনা? ভালোবাসার সময় তো পারমিশন লাগেনি।ভালো তো আপনাকে না জানিয়েই বেসেছি।

সেঁজুতি রাগে, শোকে কাঁদোকাঁদো হয়ে এলো,
“আপনার সাথে কথা বাড়ানোই ভুল।আপনি আগেই ভালো ছিলেন।কথা কম বলতেন,মুড নিয়ে থাকতেন,অন্তত এতো বাজে বাজে যুক্তি গুলো শোনা থেকে বেঁচে যেতাম আমি।

রুদ্র শান্ত কন্ঠে বলল
“এখনও পারবেন,যদি আপনি চান।
আমার ভালোবাসা গ্রহন করে।
সেঁজুতি দুকান চেপে ধরলো,
” উফফ! আবার শুরু।
______

সেঁজুতি পড়ছে।এই মাসের আঠাশ তারিখ সেমিস্টার ফাইনাল শুরু।তখন দরজার সামনে এলেন আমির।
‘আসবো রে মা??
সেঁজুতি ঘাড় ফেরালো,বাবাকে দেখে হেসে বলল,
‘বাবা? এসোনা।তোমার আবার অনুমতি নিতে হয় বাবা?
আমির হাসলেন।হুইলচেয়ার চালিয়ে মেয়ের রুমে ঢুকলেন।সেঁজুতি বইটা বন্ধ করে বলল,

‘এখনও ঘুমোয়নি যে!

“অনেকক্ষন এ পাশ ও পাশ করলাম।ঘুমই আসছেনা।ওষুধের ডোজ টা বোধহয় বাড়াতে হবে। ভাবলাম তোর সাথে একটু গল্প করে আসি।
পড়ছিলি নাকি রে?

“ওই একটু দেখছিলাম নেড়েচেড়ে।পরীক্ষার আর অল্প কদিন বাকী।

আমির চুপ করে গেলেন।মেঝেতে অগোছালো দৃষ্টি ফেলে ভাবছিলেন কিছু।সেঁজুতি লক্ষ্য করে বলল ‘ কিছু বলবে বাবা?

‘হ্যা?না।আসলে….
‘ কী ব্যাপার? আমার সাথে কথা বলতেও আজকাল এত ভাবছো তুমি?

আমির সময় নিয়ে বললেন ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করবো??
‘অবশ্যই।একটা কেন,দশটা করো।
আমির হেসে বললেন,
‘আবির কে ভালোই লাগে বল?বেশ ভদ্র একটা ছেলে।কথা বার্তাও খুব সুন্দর।এতো বছর বাইরে থেকেও ভদ্রতা ভোলেনি।এসেই একেবারে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছে জানিস?

‘বাহ! ভালো তো।ওতো এমনিতেও ছোট বেলা থেকে বেশ ঠান্ডা মেজাজের।এই জন্যেই না ওকে আমার এতো ভালো লাগে।

আমিরের হাসি প্রসস্থ হলো।নিশ্চিন্তের শ্বাস নিলেন।
যাক!উত্তর পেয়েছেন।আবির কে তাহলে সেঁজুতির ও পছন্দ। আজই হোসাইন প্রস্তাব রাখলেন সেঁজুতি কে ছেলের বউ করতে চান উনি।আমির এক কথাতেই রাজী হন।প্রান প্রিয় বন্ধু,তার এত ভালো, আদর্শবান ছেলে।সেঁজুতি কে হোসাইন কত ভালোবাসে তাতো আর অজানা নয়।অমত করবেনই বা কেন?মেয়েটা নিজেদের মধ্যেই থাকলো।
কিন্তু তার আগে ছেলেমেয়েদের মতামত তো জরুরি।হোসাইন বললেন সে আবিরের মত নেবে।আর আমিরকে দায়িত্ব দিলেন সেঁজুতির মতামত নিতে।আমির সেই থেকেই উশখুশ করছিলেন কথাটা কীভাবে তুলবেন?বাবা হয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারবেননা বিধায় এভাবে ঘুরিয়ে কথা গুলো তুললেন।আশানুরূপ ফল ও পেলেন।এবার আবিরের কথা জানার পালা।আমির যখন গভীর ভাবনায় সেঁজুতি জিজ্ঞেস করলো,

“হঠাৎ আবিরের কথা বলছো বাবা!

” হ্যা?না এমনিই।আমি বরং যাই এখন।বেশি রাত জাগিস না হ্যা? ঘুমিয়ে পড়িস।
সেঁজুতি ঘাড় কাঁত করলো,
“আচ্ছা।
___
পরেরদিন রুদ্র মাত্র অফিসে ঢুকেছে।সেঁজুতি তখনও আসেনি।রুদ্র কেবিনে বসতে না বসতেই বশির জানালেন আবির এসছে দেখা করতে।রুদ্রর একটু অবাক লাগলো। আজ আর অপেক্ষা করায়নি।সমস্যা যখন মিটে গেলো,তখন আর এসব করে কী লাভ?যত্র আবিরকে ডাকতে পাঠালো রুদ্র।আবির আসলো হন্তদন্ত পায়ে।বেচারার চেহারার অবস্থায়ও টলমলে।রাতে ঘুমোয় নি নাকী?রুদ্র আমুদে কন্ঠে বলল,

কি ব্যাপার আবির সাহেব? আজ আবার কাকে আটকালাম আমি?
আবির চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“আমি একটা বিপদে পরে এসেছি আপনার কাছে।একমাত্র আপনিই পারবেন আমাকে সাহায্য করতে।
রুদ্র সিরিয়াস হলো,
“কি হয়েছে?

চলবে।

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব–২৯

হারফি রেস্টুরেন্ট। কোনার দিকের একটা টেবিলে একে একে বসে আছে রুদ্র, আবির আর অন্য পাশে এরিকা।এইতো কিছুক্ষন আগেই বাংলাদেশে পৌঁছোলো মেয়েটা।মেয়েটাকে দেখে আসলেই বিদেশিনী লাগছেনা।পড়নে ভদ্র পোশাক।ব্লু জিন্স সাথে হাটু অব্দি কূর্তি।পিঠে ছড়ানো সোনালী চুল।একটু আধটু বাংলা বলতে পারে।কিন্তু বুঝতে পারে পুরোটাই।রুদ্র ব্লাক কফির মগে চুমুক দিলো,শান্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
” এখন আপনি কি করতে চাইছেন আবির?

আবিরকে কেমন এলোমেলো দেখালো।চিন্তিত ছেলেটা!বলল,
“আমি জানিনা। আমার মাথায় কিছুই আসছেনা।,বিশ্বাস করুন, কাল রাতে বাবার মুখে বিয়ের কথা শুনলাম,মন চাইছিলো সত্যিটা বলে দেই।কিন্তু পারিনি।কেমন একটা সঙ্কোচ হচ্ছিলো।মডার্ন কান্ট্রিতে লাইফ স্পেন্ড করে এসেও মাইন্ড টাকে চেঞ্জ করতে পারছিনা।

রুদ্র হাসলো।এই হাসিতে স্পষ্ট ধিক্কার।বলল,
“কি অদ্ভূত তাইনা!এখন আপনার মাথায় পুরো পৃথিবীর চিন্তা ঘুরছে।এর একটা চিন্তাও যদি এরিকাকে ভালোবাসার আগে,বা বিয়ে করার আগে করতেন তাহলে হয়তো এইদিন দেখতে হতোনা।

আবিরের মুখ কালো হয়ে আসে।এরিকা মাথা নিঁচু করে কাটাকাটা ইংরেজিতে বলল,
“আমিই দ্বায়ী এসবের জন্যে।আমার জন্যে যত ভোগান্তি।
রুদ্র বলল,
“না। আমি আপনাকে বলিনি।এখানে আপনার কোনও দোষ নেই।

আবির নিজের চিন্তা ঝেড়ে এরিকাকে সান্ত্বনা দিলো,হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
“এরিকা প্লিজ।তুমি এভাবে ভাবছো কেন?এত ভেবোনা।আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব।

এরিকা মাথা তুলল।অভিমানী কন্ঠে বলল,
‘এটা তুমি গত এক বছর ধরে বলে আসছো আবির।,তুমিতো আমাকে ঠিক করে তোমার সমস্যা গুলোও বলছোনা।

রুদ্র মাথা নেঁড়ে বলল,

“ও আই সি!মিস্টার আবির, আপনি তাহলে এখনও ওনাকে আসল কথা গুলোই জানান নি?

আবির মাথা নামিয়ে ছোট করে বলল,
‘না।

” না জানালে সমস্যার সমাধান হবে আপনার?

আবির অসহায় চোখে তাকালো,
– কি করবো? আপনিই বলুন।
এরিকার দিকে একবার তাকালো রুদ্র।মেয়েটি কাঁদছে।ফর্সা গাল ভিজে একাকার।রুদ্র যেন বুঝে নিলো এরিকার মনের অবস্থান।মনে হচ্ছে এরিকার থেকে আশানুরূপ উত্তর পাওয়া যাবে।রুদ্র ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল,

” মিসেস এরিকা!আপনি তো আবিরকে ভালোবাসেন তাইনা?

এরিকা মাথা দোলায়।রুদ্র আবার বলল,
‘সারাজীবন আপনি আবিরের সাথেই থাকতে চান তো?
এরিকা ভ্রু কোঁচকায়, “ইউ হ্যাভ এনি ডাউট মিস্টার চাউডোরি?
রুদ্র হাসলো।তার পদবীটা হয়ত একটু বেশিই কঠিন।প্রায় সব বিদেশী ক্লায়েন্ট গুলোই এমন বিকৃত করে ডাকে।
-” না।আমার কোনো সন্দেহ নেই।তবে কিছু প্রশ্ন আছে।করতে পারি?
‘বলুন।

রুদ্র সোজাসাপটা বলল,
“আমি শুনেছি আপনি খ্রিস্টান। আপনি কি জানেন একজন মুসলিম হয়ে বিধর্মী কাউকে ঘরের বউ হিসেবে মেনে নেয়া ঠিক কতোটা কঠিন কাজ?
এরিকা প্রশ্ন নিয়ে তাকালো।রুদ্র নিজেই বলল,

‘ আমি বলতে চাইছি আপনি যদি আবিরকে পেতে চান তবে সবার আগে আপনাকে মুসলিম হতে হবে। অন্যথায় আবিরের পরিবার আপনাকে মেনে নেবেন না।
এরিকা স্তব্ধ হয়ে আবিরের দিকে তাকালো।অবিশ্বাসের কন্ঠে শুধালো,
“ইজ ইট ট্রু আবির?

অপরাধীর মত মাথা নাড়লো আবির।এরিকা কিছু সময়ের জন্যে থম মেরে যায়।সময় নিয়ে বলে,
” এটাই তাহলে তোমার মূল সমস্যা ছিলো? তাইতো?

আবির নিশ্চুপ।রুদ্র বলল,
” মিসেস এরিকা, এই মুহুর্তে আবির কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন।ওর হয় আপনাকে বেছে নিতে হবে না হয় ওর পরিবারকে।কিন্তু আমার ধারনা আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে কোনও বাবা মা আপনার কারণে তাদের একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ফেলুক?

এরিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আবির হাসফাস করলো ওর কান্নায়।কিছু বলতে নিলে রুদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল ‘ ওনাকে বলতে দিন আবির।
এরিকার জবাবে এলো অনেকক্ষন পর।কাঁদতে কাঁদতে বলল ‘ আমি চাইনা।

রুদ্র বলল ‘এখন সবটাই আপনার মর্জি এরিকা।আপনি যা চাইবেন তাই হবে।

এরিকা ভেজা কন্ঠে বলল
“আমি একটি চার্চে বড় হয়েছি।আমার নিজের বলতে আবির ছাড়া কেউ নেই।পরিবার বলতে আমার কাছে ওই চার্চটাই। তাই একটা পরিবার থেকে আলাদা হওয়ার দুঃখ আমি বুঝি।আমি আবিরকে পেতে সব করব।সব।

আবির,রুদ্র একিসাথে প্রশান্ত হাসলো।আবির এরিকাকে জড়িয়ে ধরলো একহাতে।এরিকা মুখ লোকালো আবিরের বুকে।প্রথমে দুটো কিল-ঘুষিও মেরেছে অভিমানে।কেন এই কথাগুলো আগে বলেনি ছেলেটা?আবির কৃতজ্ঞ চোখে রুদ্রর দিকে তাকালো।ইশারায় বোঝালো ‘ থ্যাংক্স।রুদ্র মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ায়।ওদের দুজনকে একা ছাড়া উচিত। হাটতে হাটতে মানস্পটে সেঁজুতির মুখটা ভেসে ওঠে। মেয়েটা যে কবে তাকে বুঝবে?বুঝলে এভাবেই ভালোবাসবে কী?সেও কী বলবে,’ রুদ্র,আমি আপনার জন্যে সব করতে পারব?
__
ধানমন্ডি লেক।পাড়েই সিমেন্ট বাঁধানো ছোট ছোট বেঞ্চ।রুদ্র এই প্রথম এখানে এলো।কাজ,ব্যাস্ততা,ইচ্ছে কোনটাই অনুকূলে ছিলোনা।ঘুরতে যাওয়ার সময় কই?রুদ্র পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে।হাতে সিগারেটের আধপোঁড়া অংশ।চোখ লেকের সবুজ পানিতে অবিচল।
চারপাশ জুড়ে কপোত কপোতির ভীর।রুদ্র একবার ব্রিজের ওপারের মেন রাস্তার দিকে তাকালো।সেঁজুতির আসার কথা।দশমিনিট পার হলো অথচ এলোনা।এই মেয়েটা কি কোনো দিন শুধরাবে না?মেয়ে মানুষ মানেই দেরি।রুদ্র মনে মনে হাসছে।সেঁজুতি কে বলেছে
আর্জেন্ট মিটিং। এসে যখন বুঝবে মিটিং আসলে অজুহাত,নির্ঘাত রুদ্রকে ঠেলে পানিতে ফেলে দেব।হ্যা দেবেই।যা রাগ!

সেতুর পারে রিক্সা থামালো সেঁজুতি। ভাড়া মিটিয়ে
এপাশ ওপাশ দেখলো।এতো লোকের ভীড়ে রুদ্র কে খুঁজে পাওয়া কী সম্ভব?ব্যার্থ হয়ে রুদ্রর নাম্বারে ডায়াল করতে যাবে এর আগেই রুদ্র কল দিলো।
“স্যার! কোথায় আপনি?

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
‘সেতু পার হয়ে হাতের বাম দিকে এলেই পাবেন।
রুদ্র লাইন কেটে দিয়েছে।সেঁজুতি হাটা ধরলো।আজ রবিবার।অফিস বন্ধ।হঠাৎ এভাবে মিটিং পরার কারন সে জানেনা।তাও এরকম একটা লেকের পারে?অদ্ভূত না?

রুদ্র বসে বসে পা নাড়ছে।আশেপাশের যূগল দের প্রেম দেখে নিজেরও প্রেম প্রেম পাচ্ছে।গুনগুন করে গান গাইতে মন চাইছে।কিন্তু না! আজ প্রেমিক ভাব টা লুকোতে হবে।সেঁজুতি এসে পরবে এখনি।প্রেমিক ভাব আগেই দেখালে সিরিয়াস কথাগুলো বলা হবেনা।মেয়েটা এমনিতেই চেঁতে থাকে তার ওপর।তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো,যেদিন সেঁজুতি তাকে ভালোবাসবে,তাদের প্রথম ডেট এই পার্কেই হবে।আহামরি কিছু নেই।অথচ মনোমুগ্ধকর জায়গা। সেঁজুতি কে এখানে ডাকার কারন,কিছু কথা সামনাসামনি বলা।অফিসে কী সব বলা যায় নাকী?

রুদ্র নিঁচের দিক চেয়ে ভাবছিলো।হঠাৎ সেখানে এক জোড়া স্লিপার পরা পা দেখে বুঝলো কাঙখিত মানুষটি এসেছে।রুদ্র চোখ তুলে দেখলো।

হলুদ সালোয়ার কামিজ পড়নে সেঁজুতির।কাঁধে ব্যাগ।চুল গুলো বেনি করে এক পাশে এনে রাখা।মুখে কোনো প্রসাধনী নেই।বিকেলের রোদ টা যেমন স্নিগ্ধ, নরম- লালচে,সেঁজুতিকে ঠিক তেমন মনে হলো রুদ্রর।মেয়েটার সবকটা রুপ তার বুকে ঢেউ তুলতে যথেস্ট।সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে রেখেছে।রুদ্র নিজের পাশ ইশারা করে বলল ” বসুন।সেঁজুতি বসলোনা।উলটে প্রশ্ন ছুড়লো,
“এখানে মিটিং?কার সাথে?কাউকেই তো দেখছিনা।

রুদ্রর নিরুদ্বেগ উত্তর,
” মিথ্যে বলেছি।লেকের পাড়ে আদৌ মিটিং হয় নাকি?
সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল,
‘ মানেটা কি এসবের?মিথ্যে বলে আমাকে এনেছেন?কেন?
রুদ্র উঠে দাঁড়ালো।পকেটে হাত গুঁজে বলল,
“মানে এটাই যে আপনি বড্ড বোঁকা! বললাম মিটিং আর চলে এলেন?এসব জায়গায় অফিসের মিটিং হয়? অবশ্য হয়,তবে কিসের মিটিং সেটা চারপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন….
রুদ্রর কথায় কৌতুক।সেঁজুতির মেজাজ খারাপ লাগছে।
” আপনি আমার সাথে মজা করছেন?
‘করছি।আপনার সাথে মজা করা বারন,এরকম লেখা কোথাও পড়িনি আমি।

সেঁজুতি মেকি শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ তা আমাকে ডাকার কারন?

“আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
সেঁজুতি ভ্রু নাঁচালো,
“কি এমন কথা? যার জন্যে এখানে ডাকতে হবে? অফিসে বলা যেতোনা?
রুদ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘না। যেতোনা বলেই এখানে অাসা।আর অবশ্যই দরকার ছাড়া আমি আপনাকে ডাকবনা।

রুদ্রর গম্ভীর কন্ঠ শুনে সিরিয়াস কিছু হয়েছে মনে হলো সেঁজুতির। ভ্রুয়ের ভাঁজ টানটান করে বলল ‘বলুন।
রুদ্র জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,

“আবিরের সাথে আপনার বিয়ের কথা চলছে।আপনি জানেন?
সেঁজুতি চমকে উঠলো।কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে থাকলো।পরক্ষনে রুদ্রকে ধরা না দিতে স্বাভাবিক করলো চেহারা।
“হ্যা জানি।

রুদ্র নিশব্দে হাসলো।সেঁজুতি যে জানতোনা সে ওর মুখ দেখেই বুঝেছে।ডান ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
” তাই?আপনি জানেন?
সেঁজুতি কেন যেন রুদ্র চোখে চোখ মেলাতে পারলোনা।অন্যদিক ফিরে বলল,
“যেহেতু আমার বিয়ের কথা চলছে, আমি জানবো সেটাই তো স্বাভাবিক।

“এ নিয়ে আপনার কিছু বলার নেই?
” কি বলার থাকবে?
“আপনি কি এই বিয়েতে রাজি?
সেঁজুতি কাটকাট জবাব দিলো,
” রাজি না হওয়ার ও তো কিছু নেই। আবির সব দিক থেকেই ভালো ছেলে।আই মিন সব দিক থেকে..

শেষের কথাটা রুদ্রর দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে বলল সেঁজুতি। মানে বুঝে মাথা নিচু করে মুচকি হাসলো রুদ্র।সব দিকের সাথে সাথে চরিত্রের দিক থেকেও আবির পার্ফেক্ট। এটাই বোঝালো মেয়েটা।
পরক্ষনে উদাস হলো রুদ্রর চেহারা।আবির রাজি হবেনা,কিন্তু সেঁজুতি? ওতো রাজি।ওতো জানেওনা আবির বিবাহিত।আজ আবির না হোক,কাল অন্য কোনো ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করলে?সেঁজুতি তখনও রাজি হবে?হবে নাই বা কেন!তার জীবনে কোনো পিছুটান আছে? নেই।রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো।সেঁজুতির ভেতরটা অজান্তেই মোচড় দিলো এমন চাউনিতে।রুদ্র আকুতি নিয়ে বলল
” আমাকে ভালোবাসা যায়না সেঁজুতি?
সেঁজুতি দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।রুদ্রর চোখে তাকানো যায়না আজকাল।ঢোক গিলে মুখ শক্ত করে জবাব দেয়,
” না।
রুদ্রর বুক হুহু করে কেঁদে ওঠে।
“শুধু এই একটা অন্যায়ের জন্যে?
আমিতো ওসব কবেই__রুদ্রর কথা সম্পূর্ন করতে দিলোনা সেঁজুতি।বলল
” আপনি শুধু চরিত্রহীনই নন। তার পাশাপাশি আপনি একটা খুনিও।

রুদ্রর কন্ঠ রোধ হয়ে এলো। কার কথা বলছে সেঁজুতি? ও এসব জানলোই বা কী করে!অস্পষ্ট আওয়াজে বলল, ” মানে?

সেঁজুতি তাচ্ছিল্য হাসলো ‘ অভিনয়ে আপনি অনেক কাঁচা রুদ্র।এই যে আপনার মুখের চিন্তার ছাপ টা? আমি এখান থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
বুঝেও না বোঝার ভান করছেন আপনি। নেহাল উদ্দীন এর মার্ডার কে করিয়েছে মি:রুদ্র রওশন চৌধুরী? অস্বীকার করতে পারবেন?আপনি মারেন নি ওনাকে?

রুদ্র অবিনত,
‘মেরেছি।
সেঁজুতি বিস্মিত না হয়ে পারলোনা।
“এটা বলতে আপনার একটুও বাঁধলো না?

রুদ্র মুখের ওপর বলল ‘ না।
সেঁজুতি ক্ষেপে গেলো।
‘বাঁধবে কি করে,আপনি তো একটা নির্লজ্জ্ব!
শব্দ করে হেসে উঠলো রুদ্র।হাসতে হাসতেই বলল,

” অনেস্টলি একটা কথা বলি?সেদিন যদি নেহালের হাতে আপনার রেপ হতো, আজ এই নির্লজ্জ কথাটা আপনি শুনতেন। সমাজের কাছে।
সেঁজুতি মাথা নামিয়ে নিলো।রুদ্র দৃঢ় কন্ঠে বলল

“নেহাল কে আমি মেরেছি।আর এটা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। কারণ ও আপনার দিকে হাত বাড়িয়েছে।আপনাকে অসন্মান করেতে চেয়েছে। আর তাই ওর প্রাপ্য শাস্তি একমাত্র মৃত্যু
। যা আমি নিজ হাতে দিয়েছি।

সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল,
” সে ও যাই করুক,মানুষ খুন করা পাপ।

রুদ্র দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল
“ও আচ্ছা?আর কাউকে ধর্ষন করতে চাওয়া বুঝি পূন্যের কাজ ? ধর্ষিতা হলে আজ এই কথা গুলো বলতে পারতেন?পারতেন না।তখন নিজেই ওর শাস্তির জন্যে থানার দোরগোড়ায় মাথা ঠুকে বেড়াতেন।

সেঁজুতি নিরুত্ত্যর।রুদ্রর একটা কথাও মিথ্যে নয়।নেহাল মরে যাওয়ায় ভেতর ভেতর একটা শান্তি পেয়েছে সেদিন।হত্যাকারীর প্রতি খুশিও ছিলো।তাহলে যখন জানলো সেই খুনি রুদ্র স্বয়ং,কেন এত খারাপ লাগছে?রুদ্রতো কেউ নয় তার!নাকী সেই বুঝতে পারছেনা,রুদ্র কতটা জুড়ে গেছে।সেঁজুতির ঘোর কাটলো রুদ্রর কথায়,

” আপনি কিভাবে জানলেন এসব?
“থানার ওসি মিঃ মাহবুল আলম,
যিনি আমার স্টেটমেন্ট নিয়েছিলেন,উনি বলেছেন।

রুদ্র অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল
” ও গড,তাই নাকী?কিন্তু তাহলে তো এতক্ষন আমার জেলে থাকার কথা ছিলো!আমি বাইরে কী করে?

রুদ্রর ইয়ার্কিতে সেঁজুতির মেজাজ আবার বিগড়ে আসে।চেঁতে বলল,
“বোকা সাজছেন? আমি জানি আপনি কত ধুরন্দর লোক!আপনার বিরুদ্ধে কোনো প্রমান আপনি রাখেননি। তাই এখনও বাইরের খোলা হাওয়া খেতে পারছেন।

রুদ্র অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
” লাইক সিরিয়াসলি? আপনার এটা মনে হয়? ভেরী ফানি।
আমি এখনও বাইরের হাওয়া খাচ্ছি কারণ আমার পকেটে টাকা আছে।ওরা যদি সব ইনফরমেশন পেয়েও যায় তবুও আমাকে গ্রেফতার করতে আসবেনা।বর্তমান আঈন ব্যাবস্থা কতটুকু জানেন আপনি? টাকার কাছে আজকাল সব কিছুই নত। শুধু মাত্র ভালোবাসাটাই পাচ্ছিনা।
শেষ কথাটায় রুদ্রর গলা বুজে এলো।উত্তরে সেঁজুতি মুখের ওপর বলল,

“আর পাবেন ও না।
রুদ্র গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
“একবার ভালোবেসেই দেখুন না আমাকে।কোনও দিন ঠকবেন না।কথা দিচ্ছি।

সেঁজুতির ইচ্ছে হলো রুদ্রকে বিশ্বাস করতে।পরমুহূর্তে সেই হোটেল,অত মেয়ে,আর রুদ্রর নারীসঙ্গের কথা মনে পড়তেই কঠিন কন্ঠে বলল,
“আপনার কথা দেয়ার প্রয়োজন নেই।বিয়েতে আসবেন।অবশ্য দাওয়াত করে যাব।

রুদ্র হতাশ হলো আরেকবার।ঠিক কী করলে সেঁজুতি মানবে?কেউ যদি বলে দিতো! তাই করতো ও।রুদ্র ভেজা কন্ঠে পিছু ডাকলো সেঁজুতির।সেঁজুতি দাঁড়িয়ে যায়,ফিরে চায়না।রুদ্র বলল ‘ ভালোবাসি।
সেঁজুতির পা কেঁপে ওঠে।এগোতে চায়না।টেনে,হিচড়ে শাসিয়ে নিয়ে চলল ওদের।
রুদ্র নিষ্পলক চোখে দেখলো যতক্ষন সেঁজুতি রিক্সা নিয়ে অদৃশ্য না হলো ততক্ষন।

রিক্সা চলছে।ব্যাস্ত রাস্তা।ফুরফুরে হাওয়াগুলো আজ মন ছুঁতে পারছেনা সেঁজুতির।ঘন মেঘ জমেছে মুখে।কেন যেন কান্না পাচ্ছে।পেছন ফিরে কারো মলিন মুখটা দেখার ইচ্ছে জাগলেও সাহসে কূলোলোনা।অজান্তেই সেঁজুতির চোখ ভিজে উঠলো। রুদ্রর কালো মুখ,অসহায় কন্ঠ কানে বাজছে যতবার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। সেঁজুতি নিজেই অবাক হচ্ছে এতে।কেন এমন হচ্ছে? সে কী তবে রুদ্রকে ভালোবেসে ফেলল?সারাক্ষন রুদ্রর ভালোবাসি বলাটা তার হৃদয় ছুঁতে পারলো?সেঁজুতি বড্ড অভিমানি কন্ঠে বিড়বিড় করলো,
“আবিরের সাথে আমার বিয়ে?এটা তুমি ঠিক করলেনা বাবা!ঠিক করলেনা।

রুদ্র বেঞ্চের ওপর বসে পরলো আবার।হঠাৎই বাঁকা হাসি ফুটলো ওষ্ঠে।
“কোথায় আর যাবেন সেঁজুতি? টার্ন ব্যাক তো আমার কাছেই নিতে হবে। আবিরের সাথে বিয়েটা যে আপনার হচ্ছেনা,তার ফুল সেট আপ আমি করেই এসেছি। এবার শুধু দেখার অপেক্ষা আপনি ঠিক কতদূর এগোতে পারেন!অভিনেত্রী আপনি বড্ড খারাপ।আমার মতোন।

চলবে,

প্রনয় পর্ব-২৭

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৭

সেঁজুতি রেগেমেগে আগুন।বিরক্তিতে তেঁতো, মুখ থেকে গলবিল সব।কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখছে রুদ্রকে।রুদ্রর সে খবর নেই।সে ব্যাস্ত।অনেক ব্যাস্ত।এতই ব্যাস্ত যে দুনিয়ার ব্যাস্ততম পুরুষ হিসেবে এই মুহুর্তে নিঃসন্দেহে তাকে আখ্যা দেয়া যাবে।সেঁজুতি এখন রুদ্রর কেবিনে।রুদ্রর মুখোমুখি রাখা উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসিয়ে রাখা হয়েছে তাকে।আজ অফিস আসার পরপরই তার ডাক পরলো।আর সেই যে ঢুকলো,বের হওয়ার নাম নেই।রুদ্র এক সেকেন্ডের জন্যেও ছাড়লোনা।সেঁজুতির সামনে মেলে রাখা একটি হলুদ ফাইল।হাতে পেন্সিল।গত এক ঘন্টা যাবত এটাকে দেখে টেখে ফুলস্টপ গুলোও মুখস্থ হয়ে গেছে।সেঁজুতি আগের কয়েকবারের মতো এবারেও রুদ্রর দিকে ফাইলটা ঠেলে দিলো,
‘ চেকিং শেষ স্যার!
রুদ্র ফোন ঘাটছে।রীতিমতো আয়েশ করে হেলান দিয়ে চেয়ারে।স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলল,
‘আবার চেক করুন।
সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বলল ,
‘স্যার এই নিয়ে সাত বার চেক করেছি।

সেঁজুতি যতটা উদগ্রীব,রুদ্র ঠিক ততটাই শান্ত,
‘প্রয়োজনে আট বার করলেন।এনি প্রব্লেম?

“না।
দাঁতে দাঁত চেপে আবারও ফাইলের দিক চোখ রাখলো সেঁজুতি। ঠিক জানে এসব রুদ্রর শয়তানি।এক ঢিলে দুই পাখি মারার ধান্দা।তাকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখাও হলো,আবার কাজের ছুঁতোয় বিরক্তও করা যাবে।
রুদ্রর সামনে এভাবে বসে থাকায় যতোটা অস্বস্তি হচ্ছে, এই নিয়ে রুদ্র ঠিক ততটাই মজা পাচ্ছে।
তাও কিচ্ছু করার নেই। বসের অর্ডার। মানতে হবেই।
হঠাৎ মুঠোফোন বাজলো সেঁজুতির।টেবিলের ওপর রাখা ছিলো ফোন।সেঁজুতি গলা উঁচিয়ে দেখলো
আবিরের নাম স্ক্রিনে ভাসছে।
রিসিভ করতে ধরবে রুদ্র খপ করে হাত চেপে ধরলো।কঠিন কন্ঠে বলল,
” কাজের সময় ফোনে কথা বলা এলাউড না। জানেন না?
রুদ্র হাত সরিয়ে নিলো।সেঁজুতি আর রিসিভ করলোনা।ফাইলে চোখ রেখেই বিড়বিড় করলো,

” কাজ না ছাই।আবিরের নাম দেখেই এরকম ব্যাবহার করলেন।সেটা আমি ভালোই জানি।

রুদ্র সেসব শোনেনি।সে ব্যাস্ত চোরা পথে সেঁজুতির ছবি তুলতে।এই যে সেঁজুতি কেমন মুখ বেঁকাচ্ছে,বিড়বিড় করছে,গালিও দিচ্ছে হয়তো! কখনও আড়চোখে তাকাচ্ছে, সব রুদ্র ক্যামেরাবন্দী করেছে।মেয়েটার এরকম অনেক ছবি আছে তার ফোনে। সিলেটে যেদিন সেঁজুতি মন দিয়ে ঝর্না দেখছিলো?সেদিনও লুকিয়ে ছবি তুলেছে ওর।বোঁকা মেয়েটি টেরই পায়নি।হা হা। রুদ্র মনে মনে হাসলো।আবার মুঠোফোন বাজলো।সেঁজুতি এবার বিরক্ত হলো আবিরের ওপর। ধরছেনা যখন, সে নিশ্চয়ই ব্যাস্ত।আবির এটা বুঝে নিতে পারেনা?ফোনের দিক চাইতেই দেখলো তার নয়,রুদ্রর ফোন বাজছে।সেঁজুতি ছোট্ট শ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে নেয়।রুদ্র ফোন রিসিভ করলো।

“ইয়েস মিস ওয়ালিহা…হোয়্যাট এবাউট ইউ?
মেয়ের নাম শুনে সেঁজুতি চোরা চোখে চাইলো।রুদ্র হেসে হেসে বলছে,
” শিওর।আ’ম কামিং। যাস্ট গিভ মি ফিফটিন মিনিটস।
লাইন কেটে সেঁজুতির দিক তাকাতেই সেঁজুতি তৎপর চোখ সরায়।রুদ্র বুঝতে পেরে ক্ষীন হাসলো।বলল,

” মিস সেঁজুতি।আপনি আপনার ডেস্কে যান।
আমাকে বেরোতে হবে।আর আজকে হাফ টাইম সো নিউ প্রজেক্টের ফাইল টা চেক করে রেখে তারপর যাবেন। ক্লিয়ার?
সেঁজুতি এক পাশে ঘাঁড় নাঁড়লো।
রুদ্র কেবিনের দরজা অব্ধি গিয়ে আবারো ফিরে তাকায়। সেঁজুতি ফাইলের পৃষ্ঠা গোছাচ্ছে।রুদ্র বরফ কন্ঠে ডাকলো

“সেঁজুতি?
সেঁজুতি ভেবেছিলো রুদ্র বেরিয়ে গেছে।ডাক শুনে চমকে তাকালো ‘ হ্যা স্যার?
রুদ্র কিয়ৎক্ষন চেয়ে থেকে বলল,
” ভালোবাসি।
সেঁজুতির মুখ হা হয়ে এলো।রুদ্র অপেক্ষা করলোনা উত্তরের।গোটা গোটা পা ফেলে বের হলো।সেদিকে হাবলার মতো চেয়ে থাকলো সেঁজুতি।
_____

রিক্সার সাথে রোমাঞ্চকর একটা ব্যাপার আছে।সেঁজুতির সব থেকে পছন্দ রিক্সাচড়া। কেমন চারপাশের ঠান্ডা বাতাস চোখ মুখে ছঁুয়ে যায়।চুল ওড়ে।মুক্ত শ্বাস নেয়া যায়।প্রত্যেকদিনের মতো আজও অফিস শেষে রিক্সা করে বাসায় ফিরছে সেঁজুতি। ধানমন্ডি ০৮ এর কাছাকাছি আসতেই চোখ পরলো রাস্তার পারে।রুদ্রর আভিজাত্যপূর্ণ সেই কালো গাড়িটি। মাত্রই এসে থেমেছে একটা রেস্টুরেন্টের গেটের কাছে। গাড়িটি দেখে একটুও চিনতে অসুবিধা হলোনা সেঁঁজুতির।আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকলো সেদিকে। গাড়ির দরজা খুলে রুদ্র আগে নামলো। অপর পাশ থেকে নামলো ধবধবে সাদা একটি মেয়ে।মাথা ভর্তি সোনালী চুল।হাটু পর্যন্ত টপ্স পড়নে।সেঁজুতির চোখ কপাল ছুঁলো।
” সেই দুপুরে এসেছে আর এখন রেস্টুরেন্টে? মানে এতোক্ষন মেয়ে নিয়ে ঘুরে ফিরে তারপর গিলতে এসছে?এই মামা দাঁড়ান তো…
রিক্সা থামাতেই সেঁজুতি নেমে গেলো।রুদ্রর পিছু পিছু হাটা ধরলো রেস্টুরেন্টের দিকে।
রেস্টুরেন্টের ভেতরে রুদ্ররা ঢুকেছে ততক্ষনে।বাইরে টা দেখা যায় এরকম এক জায়গার দুটো চেয়ার টেনে বসেছে দুজন।ওয়েটারকে ডেকে রুদ্র খাবার অর্ডার করলো।হেসে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো সে কী খাবে?সেঁজুতি নিজেকে আর দমাতে পারলোনা।গটগট করে গিয়ে ঠিক ওদের মাঝখানে দাঁড়ালো।সেঁজুতি কে দেখতেই রুদ্র ভঁড়কালো।

” আপনি এখানে??
সেঁজুতি স্পষ্ট বলল,
“দেখতে এলাম আপনার কীর্তিকলাপ।

রুদ্র বুঝলোনা,
” মানে?
সেঁজুতি দাঁত পিষে বলল,
“মানে সারাক্ষন ভালোবাসি ভালোবাসি বলেন না? এটাই তার নমুনা? যেই আমাকে পেলেন না ওমনি বিদেশীনি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?অবশ্য এটাই আশা করা যায় আপনার থেকে। আর এই জন্যেই আপনাকে আমার সহ্য হয়না।

রুদ্র হেসে ফেলল।ঝকঝকে দাঁত গুলো উন্মুক্ত হলো। সেঁজুতি খেই হারালো। লোকটা এত সুন্দর করে হাসে কেন?রুদ্র টেনে টেনে বলল,
” ঠিক বলেছেন,মেয়ে নিয়ে ঘুরছি। অভ্যেস কি আর এতো রাতারাতি চেঞ্জ হয় বলুন?

সেঁজুতির ক্ষনিকের মুগ্ধতা লেজ তুলে পালালো এই কথায়।অবাক কন্ঠে বলল,

-্আপনার লজ্জ্বা লাগছেনা?
-রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
“আমার তো লাগছেনা।কেনো? আপনার লাগছে বুঝি?

‘আপনাকে কিছু বলা মানেও অনেক কম হয়ে যাবে।

“তাহলে বরং চুপ থাকুন।
দুজনের কথার মাঝে ভ্যাবলার মতো চেয়ে থাকলো মেয়েটি।বাংলা ভাষা বোধগম্য হচ্ছেনা।কৌতুহলী কন্ঠে রুদ্রকে শুধালো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?? হোয়াট ডিড সি সে??
রুদ্র কিছু বলার আগেই মুখ খুলল সেজুতি।মুখ ঝামটা মেরে বলল,
“কোন চুলো থেকে এসেছেন?বাংলা বোঝেন না?
মেয়েটি বুঝলোনা।কপালে ভাঁজ নিয়ে চেয়ে থাকলো,
সেঁজুতি কটমট করে বলল,
“আবার তাকিয়ে আছে?তাকিয়ে আছেন কেনো হ্যা? কি দেখছেন? ইসশ কি জামা কাপড়ের ছিড়ি! বাড়ি থেকে কি টাকা পয়সা কম দেয়…? কাপড় একটু বাড়িয়ে কিনতে পারেন না?

রুদ্র চোখ সরু করে সেঁজুতির কথা শুনছে।হাসিও পাচ্ছে।মেয়েটা কী আসলে বোঁকা?না।বোঁকাদের ও বোঁকামির লিমিট আছে।মেয়েটি নির্বোধ!

‘সেজুতি!উনি আমেরিকান।সো বাংলা বুঝবেন না,আপনি ইংলিশে বলুন।
সেঁজুতি মনে মনে আওড়ালো,
” ইংলিশে বললে বুঝে যাবে আমি ঝগড়ুটে,আর তাই বাংলা তেই সুযোগ টা কাজে লাগাচ্ছি।
এটার মজা আপনি কি বুঝবেন?

সেঁজুতিকে চুপ দেখে রুদ্র শান্তি পেলো বোধ হয়।দুদিকে মাথা নেড়ে নিঃশ্বাস ফেলল।ওয়ালিহাকে কাটাকাটা ইংলিশে বলল,
“ওয়ালিহা! ও আমার হবু বউ।সেঁজুতি।
ওয়ালিহা হেসে তার ফর্সা হাত বাড়ায়,
“ও হাই! নাইস টু মিট ইউ।

সেঁজুতিও হেসে হাত মেলায়।পরক্ষনে রুদ্রর দিকে চোখ পাঁকিয়ে তাকায়।
” সেই আবার আমাকে ফিয়ন্সি বলে পরিচয় করালেন?আমিতো বারন করেছিলাম।
রুদ্র মুখের ওপর বলল ‘ আমি আপনার বাধ্য নই।
সেঁজুতি অন্যদিক ফিরে মুখ বাঁকালো।রুদ্র বলল,

” সেজুতি উনি হলেন ওয়ালিহা গোমস।আমাদের নিউ প্রজেক্ট এ আমার পার্টনার।এতোক্ষন প্রজেক্ট দেখিয়ে এনেছি ওনাকে,ঘুরে বেড়াইনি।আশা করি বুঝেছেন?

সেঁজুতি নিচের দিক চেয়ে জ্বিভ কাটলো।বিজনেস পার্টনার?আর সে কিনা না জেনেই এতো গুলো কথা শুনিয়ে দিলো?ছি!
সেঁজুতির কাঁচুমাচু চেহারা দেখে রুদ্র হাসলো,সেঁজুতি চোখ ছোট করে বলল, ,
” হাসছেন কেনো?
” অনেস্টলি একটা কথা বলবেন?
“কি কথা?
রুদ্র এতক্ষনে উঠে দাঁড়ায়।সেঁজুতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
” আর ইউ জেলাস??
রুদ্রর গরম নিঃশ্বাসে সেঁজুতির কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়।তুঁতলে বলে,
“মমা..ননে??

রুদ্র সোজা হলো,
‘মিস ওয়ালিহা কে দেখে রিক্সা থেকে নেমে এলেন।এতোগুলো কথা শোনালেন।এমনি এমনি?
সেঁজুতি মেকি ভাব নিয়ে বলল,
” তো আর কি কারণ থাকবে?

“কি জানি!
“আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে আমি এখন আসি।

রুদ্র থামিয়ে দিলো ‘ না থাক।কষ্ট করে যখন এসেইছেন, তখন থেকে যান।
আমার ফিয়ন্সি হিসেবে না হলেও পি -এ হিসেবে আপনাকে কাজে লাগতে পারে।
না বলতে ইচ্ছে হয়নি সেঁজুতির।এক কথাতেই স্বায় দিলো।একটা চেয়ার টেনে বসলো।রুদ্রর মিটিমিটি হাসি এবার যেন গাঢ় হয়।মনে মনে বলে,

‘আমি খুব ভালো করেই বুঝেছি’ এই ব্যাপারে আপনি না বলবেন না।ওয়ালিহার পরিচয় সত্যি না মিথ্যে সেটা যাচাই করতেই থেকে গেলেন তাইতো?
কোনও ব্যাপার নয়। এতে তো আমারই ভালো
।,আবিরের প্রতি নিজের জেলাসনেস থেকে যদি আমি মনের কথা জানাতে পারি তবে এই বিদেশীনির প্রতি আপনিও একটু আকটু জেলাস হলেন না হয়।ক্ষতির তো কিছু নেই।
____
বাসার নিচে গাড়ি ব্রেক করার শব্দ।দোতলার জানলা দিয়ে উঁকি দিলো আবির।সেঁজুতির জন্যেই অপেক্ষা করছিলো সে।দেখলো সেঁজুতি গাড়ি থেকে নেমেছে।গাড়িটা রুদ্রর।ওইতো ড্রাইভিং সিটেই বসে আছে সে।আবির সরে এলো সেখান থেকে।সেঁজুতি ঘরের ভেতর ঢুকতেই দেখলো আবির সোফায় বসে টেলিভিশন দেখছে।রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে।নিশ্চয়ই আমির সেখানে।এখন বাজে সাতটা।শেফালী আসবে নটার দিকে।সেঁজুতি আবিরকে দেখে হেসে বলল,
‘আরে,তুমি কখন এলে?
“এইতো কিছুক্ষন। অফিস কেমন কাটলো আজ?

সেঁজুতি পাশে বসতে বসতে বলল’রোজ যেমন কাটে আর কি।
আবির টেলিভিশন বন্ধ করে দিলো,
-“তোমার বস তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে গেলো দেখলাম।
” হ্যা।
“রিজাইন দাওনি?তুমি না বলেছিলে আজ রিজাইন দেবে?
সেঁজুতি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘ দেইনি।আসলে আমি চাকরিটা ছাড়তে চাইছিনা।
আবির নড়েচড়ে বসলো,
“ছাড়তে চাইছো না?কেন?
সেঁজুতি ছোট করে বলল
“এমনি।
আবির রেগে গেল,
” মিথ্যে বললে। চাকরী টা নিয়ে তোমার মধ্যে ইন্টারেস্ট থাকলে শুরুতেই তুমি আমাকে নিষেধ করে দিতে। রিজাইন দেয়ার কথা ভাবতে না।
এর মধ্যে নিশ্চয়ই অন্য কোনও গল্প আছে।

সেজুতিকে নিরুত্ত্যর দেখে সন্দেহ আরো বাড়লো। ঝুঁকে এসে সেজুতির দুহাত নিজের দুহাতে নিয়ে বলল,
“ছোট বেলা থেকে আমরা দুজন দুজনের খুব ভালো বন্ধু সেঁজুতি। আমার সব সমস্যা যেমন আমি তোমায় জানাতাম তেমনি তুমিও জানাতে আমায়।তাহলে আজ কি হলো? আজ এতো সঙ্কোচ কেনো করছো? প্লিজ সব সত্যিটা বলো আমায়??

সেঁজুতির মুখ কালো হয়ে এলো।সময় নিয়ে বলল,
” বেশ! বলছি
সেঁজুতি আরেকটু সময় নিলো বলতে ‘আবির!আসলে আমি চাইলেও চাকরী টা ছাড়তে পারবোনা।
আবির ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেনো??
“আমার ওখানে একটা এগ্রিমেন্ট করা আছে।
” কিসের এগ্রিমেন্ট??

সেঁজুতি একবার রান্নাঘরের দিকে তাকালো।আমির আসছেন কীনা!পরমুহূর্তে আবিরের দিকে চেয়ে রুদ্রর সাথে রাত কাটানো,পার্টিতে রুদ্রর ভালোবাসি বলা এই দুটো কথা লুকিয়ে বাকী সবটা বুঝিয়ে বলল। আবিরের ফর্সা মুখ তখন টকটকে লাল রাগে।
‘ উনি এভাবে ফাঁসিয়েছেন তোমাকে??

সেঁজুতি নিশ্চুপ।এই বিষয়ে উত্তর দিতে কেনো জানিনা ইচ্ছে করছেনা এখন।
“এর উত্তর আমি নিজেই নিয়ে নেবো ওনার থেকে।
নিজে নিজে ভেবে নিলো আবির।
কাল তাকে রুদ্রর অফিসে যেতে হবে।এই ব্যাপারে বোঝাপড়া করা দরকার।
_____
রুদ্র বাড়ি ফিরলো খুশিমনে।ওয়ালিহার প্রতি সেঁজুতির জেলাস মুখটা যতবার মনে পড়ছে ততবারই পেট ফেঁটে হাসি আসছে।গম্ভীর থাকার চেষ্টা করেও পারছেনা।রুদ্রর মন বলছে,এ জনমে তার গম্ভীরতা অার ফিরবেনা হয়ত।রাগী রুদ্র ডায়নোসরের মত পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হচ্ছেনাতো?রুদ্রর রুমে যাওয়ার আগে অভ্রর রুম পরে।দরজা খোলা।দেখলো অভ্র দুগালে হাত দিয়ে বাবু হয়ে বসে আছে বিছানায়।কোলের মধ্যে একটা বালিশ ও আছে।রুদ্র আর নিজের রুমে যায়না।অভ্রর রুমে ঢুকে খুকখুক করে কাশলো ওর মনোযোগ পেতে।হঠাৎ শব্দে চমকে ওঠে অভ্র।রুদ্রকে দেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।রুদ্র ভ্রু কোঁচকায়,
‘কি হয়েছে? মুড অফ??
অভ্র তাকালোনা।তবে জোরে জোরে মাথা দোলালো।হ্যা মুড অফ।রুদ্র আর্তনাদের ভান করে বলল,
‘আরে আস্তে আস্তে। এতো জোরে মাথা ঝাক্কাচ্ছিস! যেকোন মুহূর্তে খুলে পরে গেলে?

অভ্র অবাক চোখে তাকালো।ভাই মজা করছে?এতো বিরল ঘটনা।পরক্ষনে কিছু একটা ভেবে আবার মুখ কালো করে বলল,
‘পরে যাক! আমার আর বাচার ইচ্ছে নেই।
“ছ্যাকা ট্যাকা খেয়েছিস নাকি?
অভ্র কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
” ধুর ভাই!কি যা তা বলছো?আমিতো তোমার কথা বলছি,অবশ্য এটা তো এক ধরনের ছ্যাকাই।

রুদ্র এসে অভ্রর পাশে বসলো,
“আমি আবার কি করলাম??
অভ্র ঘুরে বসলো রুদ্রর দিকে,অভিমানি কন্ঠে বলল,
“কি করোনি তাই বলো?ভাই , তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসো,,প্রোপোজ পর্যন্ত করলে অথচ তুমি নিজে থেকে কিচ্ছুটি জানালে না আমাকে?,এটা কি ঠিক করেছো?

রুদ্র ঘাঁড় চুলকে বলল,
” ইয়ে..তোকে জানাতাম আমি।কিন্তু তুই জানলি কোত্থ থেকে?
অভ্র ঠোঁট উলটে বলল,
“পার্টি হাউসের একজন স্টাফ বলেছে।
আর আমি নিজেও সিসি টিভি ফুটেজ চেক করেছি।
রুদ্র ভ্রু উঁচালো,
‘ হঠাৎ গোয়েন্দা গিরি করলি?

‘তো করবোনা?? সেদিন পার্টিতে যা পাগলামো করছিলে হুশে থাকলে বুঝতে।সবাই তো ভয় পেয়ে শেষ। আচ্ছা ছাড়ো,তা ভাই বলোনা,প্রেম কদ্দুর এগোলো?রাজী হলো??

রুদ্র ছোট করে বলল ‘না।
অভ্র ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বলল
‘কি বলছো ভাই?তোমাকে রিজেক্ট করেছে??
” বারবার।
অভ্র ক্ষেপে গেলো,
‘কি?মেয়েটার এত সাহস আমার ভাইকে রিজেক্ট করছে? নাহ এটা অামি মেনে নেবনা। এই মেয়েটা যে কি ভাবে নিজেকে?

রুদ্র হাসলো।টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস নিয়ে পানি খেলো।টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,
“ওর এসব ভাবনার জন্যেই ও আলাদা।আর এই জন্যেই আমি ওকে ভালোবাসি।নাহলে জীবনে সুন্দর মেয়েতো কম দেখিনি।ওর পেছনেই কেন পরলাম জানিস?
অভ্র দুদিকে মাথা নাঁড়ে।সে জানেনা।
রুদ্র টিস্যুটা দুমড়ে মুচড়ে রুমের কোনায় রাখা ময়লার ঝুড়িতে ফেলল।গলার টাই ঢিলে করতে করতে এগিয়ে এলো জানলার কাছে।থাই গ্লাস টা সরিয়ে দিতেই হুহু করে ভেতরে ঢুকলো ঠান্ডা বাতাস।রুদ্র চোখ বুজে নেয়।ভেসে ওঠে সেঁজুতিকে ভালো লাগার প্রথম দিনটা।সেই যে বাচ্চা মেয়েটিকে পরম আদরে খাইয়ে দিচ্ছিলো?সেই মুহুর্তটি মনে করে হাসলো রুদ্র।
” সেঁজুতিকে প্রথম দেখে আমি প্রেমে পড়িনি।এমন কি ভালো করে ওর মুখটাও দেখিনি।আবার দেখেওছি বলা যায়।জলে টইটম্বুর দুটো ডাগর ডাগর চোখ।তাতেই ভালো লেগেছিলো তাও ক্ষনিকের ওই রাতের জন্যে।প্রশ্ন করিস না কোন রাতের?উত্তর দিতে পারবনা আমি।পরেরবার সেঁজুতি কে দেখি হাসপাতালে। দেখেই চিনেছি।কিন্তু ফিরে তাকাইনি দ্বিতীয়বার।আমার কাছে উনি তখন নিম্নমানের।নোংরা।কিন্তু এরপরের দেখায় উনি বিনা অনুমতিতে ঢুকে পরলেন আমার চিন্তায়।আমার ভাবনায়।বারবার ভাবছিলাম ওনাকে।বারবার।কিছুতেই মিলছেনা হিসেব।যেমন ভেবেছি আদৌ উনি সেরকম কীনা সেই প্রশ্নে ছটফটাচ্ছিলাম।কেন?তা আমি জানিনা।কীসের এত আকর্ষন অনুভব করেছি তাও জানিনা।বিরক্ত হচ্ছিলাম নিজের ওপর। প্রচন্ড বিরক্ত।রুদ্র কীনা এক মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় মশগুল?এও সম্ভব?এরপর ওনাকে দেখলাম রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায়।আমাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজে আহত হন যেদিন।সেদিন ওনার জন্যে প্রথম আমার হার্ট বিট করলো,অন্যভাবে।ওনার মাথাটা যখন আমার কোলে রাখলাম আমার পা দুটো অজান্তেই কেঁপে ওঠে।নির্নিমেষ ওনার অচেতন মুখের ওপর চেয়ে থাকতে ভালো লাগে।হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারি এর আগেও আমাকে রক্ত দিয়েছে এই মেয়ে।বুঝলাম,আমরা বারবার যে মেয়েটিকে টাকা দিচ্ছিলাম,আর মেয়েটিও ফেরত দিচ্ছে,রীতিমতো শাসাচ্ছে সে এই মেয়ে।অামার হিসেব তখন আরো গোলমেলে। সেঁজুতির সাথে প্রথম সাক্ষাৎ এর বিষয় টা আর এই বিষয়টা আকাশ পাতাল তফাত।
অথচ তখন তার টাকার খুব দরকার ছিলো কিন্তু।তাও উনি ফেরত দিয়েছেন কারো দান উনি হাত পেতে নেবেন না বলে।ওনার এই আত্মসন্মানবোধই ছিলো ওনার প্রতি আমার দূর্বল হওয়ার প্রথম কারন।দ্বিতীয় টা হলো কারো জন্যে ওনার প্রবল মায়া।যেদিন ওনাকে বাড়িতে ছাড়তে গিয়েছিলাম, রাস্তায় একটা কুকুর ছানা গাড়ির নিচে পরতে যাচ্ছিলো। সেটা নিয়ে মেয়ের কি ভয়?? তারপরে বাবার প্রতি ওনার অগাধ ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে।আর যাই হোক, আমিও যে আমার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতাম।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুদ্র।
“ওনার বাবা যেদিন অসুস্থ হন সেদিন ওনার চোখে পানি দেখে আমার হৃদয় কেঁপেছিলো জানিস?
তারওপরে কোনও মেয়েকে আশেপাশে দেখলেই মনে হতো এটা সেঁজুতি, পাগল পাগল লাগতো তখন,হোটেলে মেয়ে আসা নিষিদ্ধ করে দিয়েছি অনেক আগে থেকে অথচ আমার মনে ওনার বিচরন বন্ধ করতে পারিনি।তবে বুঝে উঠিনি এটা কী আকর্ষন?নাকী ভালোবাসা?
ঠিক করে নিলাম, ওনাকে নিজের আশেপাশেই রাখব।যদি আমার মনে হয় ওনাকে আমার প্রয়োজন,ভালোবাসি ওনাকে তবেই উনি আমার।ওনাকে মিথ্যে বলে চাকরি দিয়েছি।শুধু এই কারনে নয়,জানতাম উনি এমনি দিলে নেবেন না।তখন ওনাদের অর্থ প্রয়োজন, তাও মেয়েটা আত্মসন্মান দেখাবে।তাই অত বানিয়ে বলা।কন্ট্রাকে সাইন করানো।জানতাম আমাকে দেখলে উনি কিছুতেই চাকরী করতে চাইবেন না।চাকরি কেন?কোনো প্রকার সাহায্যই নেবেন না।তাই এর আগেও ওরকম উদ্ভট সেজে তোদের সামনে যাই।উনি চিনতেই পারেন নি আমাকে।
রুদ্র হাসলো
“প্রথম দিন আমাকে অফিসে দেখে কী তেঁজ টাই না দেখালেন।ভাগ্যিশ বুদ্ধি করে এগ্রিমেন্ট পেপারে সাইন করিয়েছিলাম।পাখি আর পালাতে পারেনি।তারপর শুরু করি ওনাকে বিরক্ত করা।গাদা গাদা কাজ দিয়ে ওনার ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছি।এই বদমেজাজী রুদ্র কে কতোটা সহ্য করতে পারবে সেটা দেখার আশায়।কিন্তু যত কাজ ই দিতাম বিরক্ত হতোনা জানিস।হ্যা অসহায় চোখে তাকাতো।তবে সেসব দায়িত্ব নিয়ে শেষও করতো।

দিনের পর দিন ওনাকে চোখের সামনে দেখা,ওনার হাসি,কান্না,জেদ,রাগ ভ্রু কোঁচকানো সবেতে আমার হৃদয় ধুকপুক করতো।ঘুমোতে গেলে স্বচ্ছ হয়ে চোখে ভাসতো।এরকম করতে করতে কখন যে আমার প্রয়োজন টা ভালোবাসায় পরিনত হলো। বুঝতেই পারিনি।আস্তে আস্তে ওনার মাঝেই মিশিয়ে ফেললাম নিজেকে।ওনার প্রত্যেক টা কাজ প্রত্যেকটা কথা আমার ভালোবাসা বাড়িয়ে দিচ্ছে আরো।অথচ দ্যাখ,আমি যে ভুল কাউকে বেছে নেইনি তার প্রমান উনি আরো একবার দিলেন আমায়।আমাকে প্রত্যাখান করে।রুদ্র রওওশনের লুক,টাকা এসবে কত মেয়ে পাগল।অথচ আমি যার জন্যে পাগল সে ফিরেও দেখছেনা আমায়।কতটা নির্লোভ আমার সেঁজুতি। রুদ্র আবার বিড়বিড় করলো ‘ আমার সেঁজুতি। অভ্র!ওনাকে ছাড়া চলবেনারে আমার। কিছুতেই না।
কথা শেষ করে রুদ্র নিঃশ্বাস ফেলল।পেছন ফিরে অভ্রর দিকে তাকালো।অভ্র ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।হা হয়ে আছে মুখ।বিস্ময়ের শেষ প্রান্তে তার অবস্থান।

‘মুখটা বন্ধ কর।মশা ঢুকবে।
অভ্র নড়ে উঠলো।পরমুহূর্তে উত্তেজিত হয়ে এক লাফ দিয়ে নামলো বিছানা থেকে।মাথায় হাত দিয়ে বলল,

‘আই কান্ট বিলিভ ভাই।আই যাস্ট কান্ট বিলিভ।তুমি কিনা অবশেষে ভালোবাসলে? এবার আমার সব প্রশ্নের উত্তর মিললো।হোটেলে মেয়ে আসা কেনো বন্ধ করেছো,এই বার বুঝলাম।তবে এই ব্যাপারে আমি অন্তত খুশি।মেয়েটা তোমার লাইফে এসে ভালো কিছু করেছে।

রুদ্র অভ্রর চুল গুলো এলোমেলো করে দিলো হাত দিয়ে।বলল ‘ বলেছিলাম না? আমার রহস্যের সমাধান হলে তোর টাও হবে? আমার রহস্যটাই ছিলো আমি সেঁজুতি কে ভালোবাসি কীনা! আর তার জবাব তো আমি পেয়েছি।
অভ্র চোখ পিটপিট করে বলল ‘ কিন্তু আমি একটা প্রশ্নের উত্তর পাইনি ভাই।
‘ আবার কী?
‘ সেঁজুতি তোমাকে দেখলে চাকরি করতেন না বললে,আবার হাসপাতালে তার আগে তুমি মুখ ঢেকে গেলে? তার মানে উনি তোমাকে আগে থেকে চিনতেন? কিন্তু কীভাবে?

রুদ্র বাম চোখ টিপে বলল

“এটা টপ সিক্রেট।
অভ্র ঠোঁট ওল্টালো,
— দিস ইজ নট ফেয়ার ভাই। বলোনা,,

অভ্রর কথায় কান দিলোনা রুদ্র।কাবার্ডের ওপর থেকে গিটার নামালো।অভ্রর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম।ভাই কী গান গাইবে?এই গিটার কবে কিনলো ভাই? এখানে কী করে এলো?
অভ্রর সব উত্তর মিলল,যখন রুদ্র কাউচের ওপর বসে গান ধরলো
‘ আমি ভাবি,যদি আবার, ছুঁতে পারতাম তোমাকে।
সত্যি বা স্বপ্নই হোক,এ দুরুত্ব শেষ হয়ে যেত যে…
‘ভালো লাগা,ভালোবাসার তফাত কী যে হয় জানতাম না।
তবে কী হায়,সব দোষ টা আমার।দেরী করেছি, বুঝতে তবু ভয়, ভয় পেওনা আমি আছি, তোমারই কাছে।রাখব যে জড়িয়ে, তো..মা..কে!

_____

রুদ্রর কেবিনে বসে আছে আবির। এসেছে প্রায় দুই ঘন্টা।অথচ মাত্রই ঢুকলো এখানে।রুদ্র ব্যাস্ততার অজুহাত দিয়ে বসিয়ে রেখেছিল ওকে।আবিরের সামনেই রুদ্র স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে।এই ছেলেটাকে দেখলেই তার রাগ ওঠে।এত রাগ যা দিয়ে দুনিয়া উলটে দেয়া যাবে।আজ একেবারে অফিসে এসে হানা দেয়ার কারন রুদ্রর অজানা।অফিস বলে কিছু বলতেও পারছেনা।নাহলে ওইদিন সেঁজুতির কোমড় ধরে নাঁচার মজা সুদে আসলে মেটাত।রুদ্র অনিহা নিয়ে বলল,
“তো বলুন কি আপনার জরুরি কথা?
আবির গলা ঝেড়ে বলল,
‘বলবো,বলতেই তো এসেছি।

“একটু তাড়াতাড়ি। আমার সময় এর দাম আছে নিশ্চয়ই?

আবির মৃদূ তেঁজ নিয়ে বলল,
“আপনার সময় নষ্ট করতে আমি আসিওনি।
আচ্ছা আমাকে একটা কথার উত্তর দিন তো,,এসবের মানে কি?

আবিরের কন্ঠস্বর সিরিয়াস।রুদ্রর মেজাজ বিগড়েছে।ছেলেটা তার চার বছরের ছোট হবে। অথচ কী অবলিলায় কৈফিয়ত চাইছে।রুদ্র চিরচেনা গম্ভীরতায় ফিরে এলো যেন।বলল
-প্রথমেই বলে রাখি রুদ্র রওশন কে জবাব দিহি করতে আসবেন না।কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে আমি পছন্দ করিনা।

” কৈফিয়ত চাইছিনা,জানতে চাইছি। আপনি এভাবে সেঁজুতিকে এখানে আটকে রেখেছেন কেনো?

রুদ্র ভ্রু নাঁচালো,
” আটকে রেখেছি? লাইক সিরিয়াসলি? তা ঠিক কিভাবে আটকে রেখেছি আমি?

আবিরও একি ভাবে ভ্রু নাঁচায়,
” ভনীতা করছেন?? এমন ভাব করছেন যেনো কিছুই বুঝতে পারছেন না।না জানিয়ে ভুল বুঝিয়ে আপনি কৌশলে সেজুথিকে দিয়ে কন্ট্রাকে সাইন করিয়ে নিয়েছেন।চাইলেও এখন তিন বছরের আগে ও চাকরী ছাড়তে পারবেনা। অসহায়ত্বের সুযোগ নিলেন তাইনা??আপনি ভালো করেই জানেন যে পাঁচ কোটি কেনো পঞ্চাশ লাখ দেয়ার মত ক্ষমতাও সেজুতির নেই।আর তাই এভাবে ফাসালেন ওকে।,এটাকে আটকে রাখা নয় তো আর কি?

রুদ্র প্রসস্থ হাসলো,বলল,
” না এটা কে আটকে রাখা বলেনা।এটাকে বলা হয় ভালোবাসার বন্ধনে নিজের প্রেয়সী
কে বেঁধে রাখার প্রয়াস।
আবির বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন ছোড়ে,
— ভালোবাসা??

চলবে….

প্রনয় পর্ব-২৬

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৬

সময় দুপুর বারোটা।সেঁজুতি বসে আছে ডেস্কে।টেবিলের ওপর পেপার ওয়েটের নীচে রাখা রেজিগনেশন লেটার। একটু পরপর ঘড়ি দেখছে সেঁজুতি।অফিসের দেয়ালে টাঙানো মস্ত ঘড়ির কাটা যেন নড়ছেনা আজ।নড়লেও তার মনঃপুত হচ্ছেনা। অফিস শুরু হয়েছে দু ঘন্টা আগে, অথচ রুদ্র আসেনি এখনও। ব্যাপারটা সেজুতিকে বড্ড ভাবাচ্ছে। যে লোক পারলে সূর্য ওঠার আগেই অফিসে এসে বসে থাকে তার আজ এত দেরী? ঠিক দশটায় রুদ্র অফিসে হাজির হয়।এই এক মাসে একটু উনিশ-বিশ দেখেনি সেঁজুতি। সেই পাংকচুয়্যাল লোকের আজ কী হলো?
ধৈর্য রাখতে পারলোনা সেঁজুতি। এই নিয়ে পঞ্চম বারের মতো রুদ্রর কেবিনে উঁকি দিলো।পরেরবার দিলো মেন গেটে।হতাশ হলো এবারও। এখনও আসেনি।অদ্ভূত তো!বস ই যদি না আসে তবে রেজিগনেশন লেটার বানিয়ে লাভ হলো কি?সেঁজুতি মন মরা হয়ে ডেস্কের দিকে ফিরে যাচ্ছিলো,তখন পেছন থেকে ডেকে ওঠে পিওন- বশীর।

“ম্যাডাম! আপনার কি কিছু দরকার?
সেঁজুতি মৃদূ হেসে মাথা নাঁড়ালো।কিছু দরকার নয়।বলল,
” আসলে দেখছিলাম স্যার এসেছেন কিনা!

“বস তো আজ আসবেন না ম্যাডাম।

সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
” আসবেনা? কেনো?
বশির দুই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
“সেকি, আপনি জানেন না?

” না তো।কি হয়েছে বশির ভাই?

” কি বলছেন ম্যাডাম?অফিসের সবাই জানে আর আপনি জানেন না?

সেঁজুতি এবার অধৈর্য কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে বলবেন তো!
বশির এক পা এগিয়ে এসে,ফিসফিস করে বললেন,
” কাল রাতে বস মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন।আর জানেন ই তো যা হয় আর কি?

এটুকু শুনতেই সেঁজুতির চেহারার রং পালটে যায়।
“ততাতারপর?
সেঁজুতি গলা কাঁপলো।বশির দুঃখী কন্ঠে বললেন,
“তারপর আর কি, গাড়ি নিয়ে সোজা খাঁদে।আমার তো শুনেই ভীষণ কষ্ট লেগেছে স্যারের জন্যে।

সেঁজুতি আর্তনাদ করে বলল,
” কি? কি বলছেন কি আপনি?

সেঁজুতির উদগ্রীবতায় আগ্রহ পেলেন বশির।বললেন,
” তবে আর বলছি কি ম্যাডাম!আমরাও তো বেশ ঘাঁবড়ে গিয়েছিলাম খবর টা শুনে।স্যার তো আর এমনি এমনি ড্রিংক করেন না।যখন ওনার মন খারাপ হয় তখন ই করেন।,কাল ও হয়তো তেমন কিছু হয়েছিলো আর তাই এখন এই অবস্থা,সত্যিই নিয়তি কি নিষ্ঠুর!
বশির দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সেঁজুতির মুখটা রক্তশূন্য দেখাচ্ছে।

” উনি ঠিক আছেন তো বশীর ভাই? বলুন না….

” এ যাত্রায় প্রানে বেঁচেছেন ঠিকই তবে পা দিয়ে আর দাঁড়াতে পারবেন কিনা সন্দেহ।

সেঁজুতি আঁতকে উঠলো,
‘কী বলছেন? উনি কোথায় এখন??

” সিটি হাসপাতালে। নাহলে ওনার বাসায়। আমি জানিনা ঠিক করে।তবে আর যাই বলুন ম্যাডাম এতে আমাদের তো লাভের লাভ কিছুই হলোনা। বস এক্সিডেন্ট করলো তাতে অন্তত কদিন অফিস টা বন্ধ রাখতে পারতো অথচ দেখুন আজ কেও কাজ করতে হচ্ছে।
বশিরের চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।সেঁজুতি অবাক না হয়ে পারলোনা।

” কি বলছেন এসব বশির ভাই?,একটা মানুষের এই অবস্থা আর আপনি এ গুলো ভাবছেন?ছি! ছি! কারো প্রানের থেকে আপনার কাছে ছুটি কাটানো টা বড় হয়ে গেলো?স্যারের এমন অবস্থায় আপনার খারাপ লাগছেনা?
বশিরের সোজাসাপটা উত্তর,

“খারাপ লেগে আর কি হবে?উনি সব সময় যা ধমকে ধামকে রাখেন আমাদের, তাতে ওনার কিছু হলে তো আমাদের ই ভালো।উনি আর অফিসে আসতে পারবেন না।আমরা সবাই অভ্র স্যারের আন্ডারে কাজ করবো। উনি আর যাই হোক ওমন রগচটা নন। আর এতে তো আপনারও ভালো ম্যাডাম,এতো কাজ কেউ করাবেনা আপনাকে দিয়ে।

সেঁজুতি ধমকে উঠলো,
” চুপ করুন।কি দিয়ে তৈরি আপনি? ছি!
বশির সাফাই গাইতে নিচ্ছিলেন,কিন্তু অতটা শোনার সময়, ইচ্ছে,কোনোটাই নেই সেঁজুতির।দুশ্চিন্তা -ভয় তার গলা চেঁপে ধরেছে।ভেতর থেকে একটাই প্রশ্ন আসছে ‘উনি ঠিক আছেন তো?
___
রিক্সার গতি পছন্দ হচ্ছেনা সেঁজুতির।হুইলচেয়ার চলছে যেন।এত আস্তে রিক্সা চলে?সেঁজুতি আগের মতোই তাড়া দিয়ে বলল,

“ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালান না।

রিক্সায় ওঠা থেকে শুরু করে বারবার একী কথা বলছে সেঁজুতি। রিক্সাচালক বিরক্ত হলেন এবার। প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন,

“আফা এতো তাড়া দিলে হইবো? বারবার খালি এক কথা কইতাছেন।আমি কি প্লেন চালাইতাছি?দুই পা দিয়া আর কত জোড়ে চালামু কন?

সেঁজুতি বুঝলো সে একটু বেশিই করে ফেলল।চিন্তায় অবস্থা খারাপ হলে যা হয়।নরম কন্ঠে বলল,
–স্যরি ভাই!আসলে আমার অনেক তাড়া আছে।

“তাড়া আছে তো রিক্সায় ক্যান উঠছেন আফা ?ট্যাক্সি কইরা যান।

‘এটা তো খারাপ বলেননি।থামান থামান, আর যেতে হবেনা।সাইড করে দাঁড় করান।

রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে রাস্তার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালো সেজুতি। উদ্দেশ্য ট্যাক্সি নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া। আর যাই হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে যে পৌঁছাতেই হবে।
___

হাসপাতালে ঢুকে সেঁজুতি সোজা রিসেপশনে গেলো।বোজা কন্ঠে বলল,
“- এক্সিকিউজ মি! আমাকে প্লিজ একটু বলবেন মি: রুদ্র রওশন চৌধুরী কত নম্বর কেবিনে আছেন?
“ম্যাম একটু ওয়েট করুন,,আমি চেক করে জানাচ্ছি আপনাকে।

‘হ্যা একটু তাড়াতাড়ি প্লিজ।

মেয়েটি মনিটর থেকে চোখ তুলে বলল,

— ম্যাম কি নাম বললেন?

“রুদ্র রওশন চৌধুরী।

“স্যরি ম্যাম! এই নামে কেউ এডমিট হয়নি এখানে..

সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল,
” কি বলছেন,,এটা সিটি হসপিটাল তো?

-“জ্বি।

‘প্লিজ একটু ভালো করে দেখে বলুন।

‘আমি ভালো করে দেখেই বলেছি ম্যাম!এ নামে কেউ এখানে এডমিট হয়নি।
সেঁজুতি আহত হলো।এত দৌড় ঝাপ করে এসে শুনলো রুদ্র নেই এখানে?তবে কোথায় উনি?ওনার কী খুব ক্ষতি হয়েছে?ভালো আছেন তো?সেঁজুতির হঠাৎ মাথায় এলো বশিরের একটা কথা।
“এক সেকেন্ড!বশির ভাইতো বললেন স্যার বাড়িতেও থাকতে পারে।এখানে যেহেতু নেই তবে নিশ্চয়ই বাড়িতে ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন উনি?
আমি বরং একবার ওনার বাড়িতে যাই।
সেঁজুতি হন্তদন্ত পায়ে ছুট লাগালো।রুদ্রর বাড়ি যেতে হবে এখন।বাড়ির ঠিকানা জানেনা।কখনও যায়ওনি।ট্যাক্সিতে উঠে ব্যাগ থেকে আইডি কার্ড বার করলো।অফিসের দ্বিতীয় দিন পেয়েছিলো এটা।কার্ডের পেছনে রুদ্রর সেল ফোন নম্বর দেয়া থাকে।সাথে ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে অভ্রর ও।সেঁজুতি ব্যাস্ত হাতে অভ্রর নম্বরে ডায়াল করলো।অভ্র ধরলোনা।অনেকবার কল দিলেও না।এরপর গুগলে সার্চ করতেই পেয়ে গেলো।সেঁজুতির ঠোঁটে বিজয়ের হাসি ফুটলো এইটুকুতেই। যেন বিশ্ব জয় করেছে মাত্র।
____

রুদ্রর বাড়িটা দেখে সেঁজুতির দুই ঠোঁট আলাদা হয়ে এলো।এত্ত বড় বাড়ি!এতক্ষন যেই চিন্তা টা হচ্ছিলো,উদ্বীগ্নতা ছিলো সব যেন বাড়ির সামনে এসে আরো জেঁকে বসলো কাঁধে। নার্ভাসনেসে হাত পা কঁাপছে।খুব করে প্রার্থনা করছে রুদ্র সুস্থ থাকুক।ভালো থাকুক।সেঁজুতি ত্রস্ত পায়ে গেটের কাছে আসতেই দারোয়ানের নজর পরলো।বসে ছিলেন উনি।উঠে এসেই গেট খুলে দিলেন।
“আসুন ম্যাডাম। আসুন আসুন।

দারোয়ানের খাতির দেখে অবাক লাগলো সেজুতির।
এর আগে এ বাসার ত্রিসীমানায় ও তো সে আসেনি। যেখানে অচেনা ব্যাক্তি হিসেবে দারোয়ানের তাকে এক গাদা প্রশ্ন করা দরকার, সেখানে এমন যত্ন করে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে?

যাক।যা খুশি হোক।এই মুহুর্তে তার এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। আপাতত মাথায় রুদ্র কে নিয়ে যত ভাবনা। কি অবস্থা লোকটার জানার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠছে মন।সেঁজুতি নম্র কন্ঠে শুধালো,

” স্যার আছেন..??

“স্যার তো নেই ম্যাডাম।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
” নেই মানে? কোথায় গিয়েছেন?

” অফিসে।
সেঁজুতির চোখ কপালে উঠলো,
— অফিসে??না না আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে
উনি অফিস কি করে যেতে পারেন?ওনার তো কাল রাতে এক্সিডেন্ট হয়েছে। তাইনা?

দারোয়ান লোকটিও পালটা ভ্রু কোঁচকান
— কি বলছেন ম্যাডাম?স্যার এই কিছুক্ষন আগেই একেবারে তরতাজা অবস্থায় আমার সামনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।আর আপনি বলছেন এক্সিডেন্ট হয়েছে।তাও কাল রাতে?

” হয়নি?
” না ম্যাডাম।স্যার তো যাওয়ার আগে বলে গেলেন আপনার কথা।তাই জন্যেই না আপনাকে আমি গেট খুলে দিলাম।
আমার কথা বিশ্বাস না হলে অফিসে গিয়ে দেখতে পারেন।

সেঁজুতির রাগে মাথার চুল ছিড়তে মন চাইলো।এক্সিডেন্ট হয়নি?রুদ্র অফিসে শুনে তার ভালো লেগেছে।কিন্তু পরমুহূর্তে এরকম একটা বিষয় নিয়ে মিথ্যে বলাতে রাগ গিয়ে পরলো বশিরের ওপর। যদি এক্সিডেন্ট নাই হয়ে থাকে তবে বশীর ভাই আমাকে মিথ্যে কেনো বললেন?আর রুদ্রই বা কী করে জানলেন যে আমি আসব এখানে?
এর উত্তর তো অফিসে গেলেই পাবো।
_____

রুদ্রর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে সেঁজুতি।দরজায় নক করতেই উত্তর এলো,

” আসুন।

ভেতরে ঢুকলো সেঁজুতি। রুদ্র দিব্যি সুস্থভাবে বসে আছে চেয়ারে।আঙুলের ভাঁজে কলম নাঁড়িয়ে নাঁড়িয়ে ফাইল চেক করছে।রুদ্রকে দেখে গতকালের কথা মনে পড়লো।রুদ্রর অকপটে ভালোবাসি বলাটা।মুহুর্তেই অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে এলো শরীর। রুদ্রকে ভালো না বাসা সত্ত্বেও ওকে ঠিকঠাক দেখে প্রান ফিরে পাওয়ার মতোন অনুভূতি হলো ।পরক্ষনে রাগ টাও মাথা চাঁড়া দিলো বশিরের ওপর। অনেকক্ষনেও সেঁজুতির কোনও সাড়া না পেয়ে রুদ্র নিজেই বলল,

“এসে থেকে দাঁড়িয়ে আছেন!
আমাকে দেখছেন?? তো বলুন কেমন লাগছে আমাকে?
রুদ্রর কথায় কৌতুক।
ফাইল রেখে চেয়ারে হেলান দিলো। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।সেঁজুতি উত্তর দেয়না।রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
” কি হলো?? চুপ যে? ওহ আচ্ছা আচ্ছা!কথায় আছে মৌনতা সম্মতির লক্ষন।তার মানে আমি যেটা বললাম সেটাই ঠিক, আপনি আমাকেই দেখছিলেন?

সেঁজুতি মুখ খুলল এবার,শান্ত ভাবে বলল
” না।আমি আপনাকে কেমন লাগছে সেটা দেখতে আসিনি।এসেছি আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর নিতে।

“মানে? আমি কি নোট বুক নাকি? যে সব প্রশ্নের উত্তর থাকবে?

“বাজে কথা রাখুন।আমার কথা শুনুন, কথাটা জরুরি।
রুদ্র টেবিলের ওপর ঝুঁকে এলো ‘তাই?আচ্ছা বলুন।

সেঁজুতি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“বশির ভাই আমাকে বলেছেন,আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে,আপনি সিটি হসপিটালে ভর্তি।
অথচ সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম আপনি কেনো আপনার নামের কেউ- ই সেখানে নেই।তারপর আমি আপনার বাড়িতেও গিয়েছি। আপনার বাসায় গিয়ে দারোয়ানের থেকে শুনলাম আপনি নাকি অফিসে এসেছেন।এখন যে মানুষ টা পা দিয়ে দাড়াতে পারবেনা শুনলাম , সে কি করে অফিসে এলো? আর আমাকে এমন জঘন্য মিথ্যা কেনো বলা হলো? আপনিই বা কী করে জানলেন আমি আজই আপনার বাড়িতে যাব?

রুদ্র প্রশ্ন গুলো এড়িয়ে গেলো।পালটা প্রশ্ন করলো, “আমার এক্সিডেন্ট? কই?নাতো।

“সেটাতো আমিই দেখতে পাচ্ছি। আপনি একদম সুস্থ।তাহলে আমাকে মিথ্যে কেন বলেছেন উনি?

-” আমি সুস্থ আছি দেখে খুব খারাপ লাগছে আপনার? কথাটা সত্যি হলে বুঝি খুশি হতেন?

সেঁজুতি শক্ত কন্ঠে বলল “সেটা আপনার জানার দরকার নেই।বশীর ভাই কে ডাকুন…

“কেনো?

“কেনো মানে?ওনাকে জিজ্ঞেস করবেন না উনি এরকম একটা ফালতু মজা আমার সাথে কেনো করলেন?

রুদ্রর নিরুদ্বেগ ভাবমূর্তি,
“তার প্রয়োজন নেই।

সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল ‘ কেন?
রুদ্র হাসলো।সূক্ষ্ণ হাসি।বলল
‘ আপনি অনেক বোঁকা।এতটুকু বিষয় বুঝতে পারছেন না?আমার অফিসে আমারই ব্যাপারে কেউ বানোয়াট,মিথ্যে কিছু বললে সেটা কী আমার কানে আসবেনা?বশিরের এত সাহস?
সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বলল,
” সেই জন্যেই তো বলছি ডাকুন ওনাকে।এরকম মজা করার কী মানে?

“মিস সেঁজুতি, এতোটা সাহস বশীরের নিজে থেকে আসবে বলে মনে হয় আপনার ?? নিশ্চয়ই এখানে আমার হাত আছে।কথাগুলো বশীর আপনাকে এমনি এমনি বলেনি,
আমার অর্ডারে বলেছে।

রুদ্র ভাবলেশহীন। যেন অতি সাধারন একটি বাক্য বলল।সেজুতির চোখ ভারী হয়ে এলো বিস্ময়ে।ফিচেল কন্ঠে বলল, ” কী?
তার মানে এসবের পেছনে আপনি? মানে কি এগুলোর?
শেষ কথাটা চিৎকার করে বলল সেঁজুতি। রুদ্র কানে আঙুল গুঁজে বলল
” এতো চেচাচ্ছেন কেনো?ধীরে কথা বলুন না।,আপনার জন্যে যদি আমার কানের পর্দা ফেটে যায়, তখন?
সেঁজুতি আঙুল উঁচিয়ে বলল,
“একদম নাটক করবেন না আমার সাথে।বলুন কেনো করলেন এরকম?
রুদ্র চোখ পিটপিট করে বলল
‘কেনো আবার?ঐ যে! আপনার মতোই অামারও প্রশ্নের উত্তর জানা বাকী।

সেঁজুতি ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল,
‘কিসের প্রশ্ন? কিসের উত্তর?

রুদ্র নিরেট কন্ঠে বলে,
” কাল আপনার বলা কথা গুলো সত্যি ছিলো নাকি মিথ্যে সেটা জানতে হবেনা?দেখুন,
গত কাল আপনাকে আমি নিজের মনের কথা জানিয়েছি।আর তার বিনিময়ে আপনার থেকে অপমানিত ও হয়েছি।কিন্তু আমার কেন জানিনা মনে হয়েছিলো ওগুলো আপনার মনের কথা ছিলোনা।কারণ আর যাই হোক কাউকে প্রত্যাক্ষান করতে গেলে কারো চোখে পানি থাকেনা। আর তাই সত্যিটা যাচাই করতেই আজকের এই নাটক।
কিন্তু কি বলুন তো? ধরা আপনি পরে গেছেন,সামান্য এক্সিডেন্টের কথা শুনে আপনার এতো ব্যাকুলতা এটাই প্রমান করে যে আপনিও আমাকে ভালোবাসেন।

আশ্চর্যকিত সেঁজুতি। এইসব নিয়ে কেউ মজা করে?
“আমার অবাক লাগছে আপনার চিন্তাধারা দেখে।
রুদ্র তুষ্ট কন্ঠে বলল,
-“থ্যাংক ইউ।
-সেঁজুতি আগুন চোখে তাকালো,

“চুপ করুন। আমার ভাবনার থেকেও খারাপ আপনি।শুধু খারাপ ই নন,রীতিমতো একটা অমানুষ।
কি বললেন যেন,আমি আপনাকে ভালোবাসি?? এটা মনে হয় আপনার? তাহলে তো বলবো আপনার ধারণা সম্পূর্ন ভুল। কারণ আপনাকে ভালোবাসি বলেই আমি এতো ছোটাছুটি করিনি।
আপনি ভুললেও আমি ভুলিনি যে আমরা বন্ধু হয়েছিলাম।সেদিন বন্ধুত্ব চাওয়া টা আপনার কথার কথা হলেও আমি মন থেকে আপনাকে বন্ধু বলে মেনে নিয়েছিলাম।আর তাছাড়াও একজন মানুষ আরেকজন মানুষের বিপদে উদগ্রীব হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই এইসব চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।আর যাই হোক আপনার মতো চরিত্রহীন লোককে আমি অন্তত ভালোবাসবোনা।

এত এত খারাপ কথায়ও রুদ্রর হেলদোল এলোনা।উলটে মুচকি মুচকি হাসলো।সেঁজুতির গায়ে জ্বালা ধরে গেলো হাসি দেখে।আর এক মুহুর্ত দাড়ালোনা। বেরিয়ে গেলো কেবিন ছেড়ে।রুদ্র চেয়ার দুপাশে দুলিয়ে বলল

” বাসবেন বাসবেন।ভালো আপনি আমাকে ঠিকই বাসবেন।তবে কেনো জানিনা আপনার প্রত্যেক টা কাজে আপনার প্রতি আমার মুগ্ধতা বেড়েই যাচ্ছে।এই যে এতোগুলো কথা বলে গেলেন,এতে কিন্তু ভালোবাসা কমলোনা আমার। উল্টে বাড়লো।
কি আর করার?? আনফরচুনেটলি রুদ্র রওশন প্রেমে যখন পরেই গেছে,তখন আপনাকেও তার প্রেমে পরতে বাধ্য করবে সে।আর সেটা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
___
কিছুক্ষন বাদে আবারো কেবিনে এলো সেজুতি।,একেবারে নক ছাড়া।হাতে তার পূর্বপ্রস্তুত সেই রেজিগনেশন লেটার । সেজুতি কিছু বলবে এর আগে ফাইলের দিকে চোখ রেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলো রুদ্র।

” দিন।

রুদ্রর হাত বাড়ানোর মানে বুঝতে পেরেই কাগজ টা পেছনে লুকিয়ে ফেললো সেজুতি।

” কি দেবো?

“রিজাইন দিতে এসেছেন তো? দিন।

“হ্যা দেবোই তো।এতো কিছুর পরে এখানে কাজ করবো ভাবলেন কি করে?

রুদ্র তাকালো,ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,
তা কোথায় কাজ করবেন? আবিরের অফিসে?

” সেটা আপনার ভাবতে হবেনা।দরকার পরলে কোত্থাও কাজ করবোনা। তাও অন্তত এখানে আর নয়।
রুদ্র ছোট করে বলল
“ওহ, তা ডান হাতে পেপার্স এনেছেন অন্য হাত খালি কেন?

সেঁজুতি বুঝলোনা,
“মানে?

“মানে হিসেব মতো ওইহাতে পাঁচ কোটি টাকা থাকার কথা।অন্তত ডিল তো তাই বলে।

রুদ্রর কথার ইঙ্গিত বুঝলো সেঁজুতি। মুহুর্তেই মুখটা কালো হয়ে এলো।সেতো এখানে কনট্রাকটেড।গতকাল থেকে
এতো কিছুর চাপে ব্যাপারটা বেমালুম ভুলে বসেছে।বেরিয়েই গেছিলো মাথা থেকে। তাহলে এখন উপায়?? চাকরি ছাড়তে হলে তো তাকে জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু সেটাতো অসম্ভব। অতগুলো টাকা!
তাহলে কি এখানেই থেকে যেতে হবে?কিন্তু সেটাওতো সম্ভব নয়। এখনও তিন মাস হয়নি চাকরীর আর সেখানে তিন বছর? সেঁজুতির ধ্যান ভাঙলো রুদ্রর আওয়াজে,

” কি ভাবছেন?ভুলে গিয়েছিলেন তাইতো?কোনও ব্যাপার নয়,আমি মনে করিয়ে দিলাম।
এবার থেকে যতোবার রিজাইন দিতে আসবেন নাহয় ততবারই মনে করিয়ে দেবো।

সেঁজুতি নিশ্চুপ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো রুদ্র।সেজুতির মুখোমুখি দাড়িয়ে বলল

‘কি বলুন তো মিস সেঁজুতি! আপনি আসলে ভয় পাচ্ছেন।আপনি ভাবছেন , এখানে থাকতে থাকতে মানে আট ঘন্টা আমার চোখের সামনে থাকলে আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলবেন।
আর তাই আপনি পালাতে চাইছেন।

সেঁজুতি মৃদূ তেঁতে বলল,
“ভুল ধারণা আপনার।আপনার চোখের সামনে ৮ ঘন্টা কেন ২৪ ঘন্টা থাকলেও আপনাকে ভালো আমি বাসবোনা।নিজের ওপর এতটুকু বিশ্বাস আমার আছে।
রুদ্র ঘাঁড় কাঁত করে বলল
“তাহলে রিজাইন কেনো দিচ্ছেন?বিশ্বাসে মরিচা ধরেছে?

‘ রিজাইন দিচ্ছিনা আমি।
রুদ্র হাসলো,
” সে আপনি চাইলেও রিজাইন দিতে পারবেন না।পাঁচ কোটি টাকা তো আর হেটে হেটে আসবেনা আপনার কাছে।
পরমুহূর্তে ভাবার নাটক করে বলল,
“ওয়েট ওয়েট!! আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম যে এখন আপনার পাশে আবির আছে।ওনার থেকেই নিতে পারবেন তো। পাঁচ কোটি কেনো আপনি চাইলে উনি আপনাকে পুরো পঁচিশ কোটি দিয়ে দিবেন আমার যা ধারণা। শত হলেও উনি আপনার বন্ধু।অন্য কেউ দিলে সেটা দয়া,বন্ধু দিলে অন্যকিছু, তাও যদি বন্ধু হয় আবির।
শেষ কথাগুলো দাঁত চিবিয়ে বলল রুদ্র।সেঁজুতি হিঁসহিঁস করে উঠলো।কঠিন কিছু বলতেও পারলোনা।রাগ ঝাড়তে রেজিগনেশন লেটার টা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললো সেজুতি।সাধ্য থাকলে রুদ্র কেও এমন টুকরো টুকরো করতো।

” উহু !! আর যাই ভাবুন না কেনো অন্তত এটা ভাব্বেন না।আমার মত এমন সুঠামদেহী লোক এর এই অবস্থা করা আপনার সাধ্য নয়।

রুদ্রর কথায় থতমত খেলো সেঁজুতি।মনের কথা উনি কী করে বুঝলেন?তুঁতলে বলল

-“আ..আআমি ককি তাই বলেছি?

রুদ্র গভীর দৃষ্টিতে তাকালো,
“আমাকে সব কথা বলে দিতে হয়না।আপনার বেলায় তো আরো না।
সেঁজুতির গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো রুদ্রর হিম কন্ঠে।ঢোক গিলল। রুদ্র হঠাৎই সিরিয়াস হয়ে বলল,
এবার কাজে যান।আপনি আমার ফিয়ন্সি বলে কাজ কম দেয়া যাবে তবে একেবারে কাজ থেকে ছাড় দিতে পারবোনা।
সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল,

-‘ফিয়ন্সি?? আমি?? আপনার??
রুদ্রর নিরুদ্বেগ জবাব
“এনি ডাউট?? দুদিন বাদে যদি আমাদের বিয়ে হয় তবে এখন তো আপনি আমার ফিয়ন্সিই হলেন তাইনা?
সেঁজুতি ফুঁসে উঠলো,
‘ ফালতু কথা রাখুন।জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছেন?কোনও ব্যাপার নয়, দেখতে থাকুন।স্বপ্ন আপনার স্বপ্নই থেকে যাবে।
রুদ্র দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“সেটা তো সময়ই বলবে হবু মিসেস রুদ্র রওশন চৌধুরী। স্বপ্ন জেগে দেখি বা ঘুমিয়ে,আপনি আমার আর আমার ই।এটা একদিন আপনি নিজেই বলবেন।

চলবে।

প্রনয় পর্ব-২৫

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৫
ভালোবাসা একটি মানবীয় অনূভুতি।একটি আত্মকেন্দ্রিক অভিজ্ঞতা। হাজার রকম ভালোবাসার মধ্যে পুরুষ আর নারীর মধ্যকার ভালোবাসা….. জগত সংসারে #প্রনয় বলে সন্মোধিত। যার আক্ষরিক অর্থ প্রেম। ধীরে হোক বা দ্রুত, প্রেম কারো জীবনে বলে কয়ে আসেনা।
প্রেম হয় দেখা ও চোখের ভালো লাগা থেকে,রাগ থেকে প্রেম হয়, প্রেম হয় অপমান থেকে। এমনকি লজ্জ্বা থেকেও বর্ষিত হয় প্রেমের বারিধারা। প্রেম লুকিয়ে আছে মানব সম্প্রদায়ের প্রতিটি ক্রোমোসমে,প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
সুযোগ পেলেই সে জেগে ওঠে।উঠবেই।
( হুমায়ুন আহমেদ)

ভালোবাসা মানে ভালোবাসার মানুষ টার জন্যে নিজের সমস্ত ইগো কে বিসর্জন দিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পন করা। জয়ের কাছে স্বীকার করা পরাজয়।
ঠিক তেমনভাবে আজ পরাজিত রুদ্র।ভালোবেসে হার মেনেছে সেঁজুতির কাছে। অবশেষে নিজেকে সংযত করতে না পেরে মনের কথা মুখ অব্ধি এনেছে। সেজুতির চোখের দিক চেয়ে জানান দিয়েছে নিজের অভিব্যক্তি।

দুজনার মধ্যে এক ইঞ্চির দুরুত্ব।কারো মুখে কথা নেই।সেজুতি বিষ্মিত চোখে রুদ্র কে দেখছে।,তার বাহুদ্বয় এখনও রুদ্রর হাতে বন্দী।রুদ্র ধূসর দৃষ্টিতে একভাবে তাকিয়ে অাছে সেজুতির দিকে।তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে সেঁজুতির কপালে, সেঁজুতির চোখের পাতায়।এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছেনা কয়েক সেকেন্ড আগে রুদ্রর উচ্চারিত তিনটে শব্দ। অনিশ্চিত কাঁপা কন্ঠে শুধালো ‘কি বললেন??
সেঁজুতির বাহু চেপে আর একটু শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো রুদ্র। ঠান্ডাস্বরে থেমে থেমে বলল ‘ আই… লাভ… ইউ। এত সাবলীল তার আওয়াজ, যেন পৃথিবীতে এই মুহুর্তে এর থেকে সহজ সুন্দর বানী আর দ্বিতীয় টি নেই।

‘ আমি আপনাকে ভালোবাসি সেঁজুতি। জানিনা কবে থেকে।তবে বাসি,ভীষণ ভালোবাসি।

রুদ্রর হাত ঢিলে হলো।ধ্যান সরে যাওয়ায় হয়ত।সুযোগটা লুফে নিলো সেঁজুতি। ধাক্কা মেরে রুদ্রকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দিলো।আচমকা এতো প্রবল ধাক্কায় রুদ্র কয়েক পা পিছিয়ে গেলো।অবাক চোখে তাকালো সেঁজুতির দিকে।হঠাৎই হু -হা করে হেসে উঠলো সেঁজুতি। যে হাসিতে স্পষ্ট, বিদ্রুপ,তাচ্ছিল্য, ধিক্কার।রুদ্র চমকালো সেঁজুতির ব্যাবহারে।
সেঁজুতি হাসছে।অথচ কোটর ভর্তি টলমলে অশ্রু।

“নিজেকে কি ভাবেন মি: রুদ্র রওশন চৌধুরী?? হোয়াট ডু ইউ থিংক টু ইওরসেল্ফ?টাকা আছে বলে যখন যার সাথে যেমন ইচ্ছে তেমন ব্যাবহার করবেন আপনি?আমার সাথে এমন নিম্ন মানের মজা করার সাহস কোথ থেকে এলো আপনার?বেতন ভুক্ত কর্মচারী বলে আপনার সব অসন্মান সহ্য করে যাবো এমন টা কিন্তু নয়।

রুদ্র এগিয়ে আসতে নিলে সেঁজুতি হাত উঁচু করে বলল ‘ দূর থেকে কথা বলুন।আমি কানে শুনতে পাই।
সেঁজুতির কঠিন স্বর।কঠিন মুখ।রুদ্র দাঁড়িয়ে যায়।মোলায়েম কন্ঠে বলে,
‘সেজুতি আমি আপনার সাথে মজা করছিনা।আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি।

সেঁজুতি আবার হাসলো।ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ভালোবাসেন?? ইয়া আল্লাহ! মি: রুদ্র রওশন কিনা ভালোবাসে আমার মত মেয়েকে? আদৌ এটা বিশ্বাস যোগ্য?আর তাছাড়া ভালোবাসি তো বললেন, ভালোবাসার মর্ম বোঝেন আপনি? বোঝেন এর গভীরতা?ইচ্ছে হলেই ভালোবাসি বলে দেয়া যায়না।
ভালোবাসা কে শুধু বয়ফ্রেন্ড- গার্লফ্রেন্ড এর মধ্যকার সম্পর্ক মনে করবেন না।খুব তুচ্ছ কারনে কাউকে ভালো লাগলেও ভালোবাসা এতো সহজ নয়। ভালোবাসা এমন এক বস্তু যাকে ভালোবাসলে পুরো পৃথিবীর বিপক্ষে গিয়ে হলেও শক্ত করে তার হাত ধরে রাখা যায়।যাকে ভালোবাসলে সব ছেড়েছুড়ে তাকে নিয়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাওয়া যায়। যার কাছে থাকা মানে আমি সব চেয়ে নিরাপদ।,যাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়,যার প্রতি নির্ভর হয়ে পথ চলা যায়।আচ্ছা আপনিই বলুন না, আদৌ কি আপনি এসবের যোগ্য?যে ছেলে জামাকাপড় এর মতো বেড পার্টনার চেঞ্জ করে তাকে আর যাই হোক বিশ্বাস করা যায়না।
যার মধ্যে চরিত্রের ছিটেফোঁটাও নেই তাকে নির্ভর করে পথ চলা তো দূর,কয়েক সেকেন্ড তার সামনে দাড়িয়ে থাকতেও ভয় লাগবে। আর সেখানে ভালোবাসার তো কোনও প্রশ্নই আসেনা।
(একটু থেমে)
আপনি চাইলেই টাকা দিয়ে অনেক কিছু পেতে পারবেন।সে ক্ষমতা আপনার আছে।কিন্তু ভালোবাসা পাওয়ার মতো গুন বা যোগ্যতা আপনার মধ্যে নেই। তাই অহেতুক নিজেকে প্রহসন এর স্বীকার নাই বা বানালেন।আপনার মতো মানুষ এমন পবিত্র শব্দ উচ্চারন করলে এর অপমান বৈ কিছুই হবেনা।পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে আপনার সাথে রাত কাটিয়েছিলাম বলে কোনও সস্তা পন্যের সাথে আমার তুলনা করাটা ভুল হবে আপনার।প্রয়োজন হলে কুমারী থেকে যাবো তাও কোনও দুশ্চরিত্রবান লোককে নিজের জীবনে জায়গা দেবোনা।

রুদ্র স্তব্ধ।সেঁজুতির মনের মধ্যে তাহলে এত্ত নোংরা ধারনা তাকে নিয়ে?এতদিনের ভালো ব্যাবহার নিছক অভিনয়? সেঁজুতি তাকে ঘৃনা করে?হ্যা করেইতো।নাহলে এভাবে বলতোনা নিশ্চয়ই। সেঁজুতি রুদ্রর পাথর বনে যাওয়া মুখের দিকে তাকালোনা।একবারওনা।সোজা বেরিয়ে গেলো পার্টি হাউস ছেড়ে।
স্থির হয়ে সেখানে দাড়িয়ে থাকলো রুদ্র।এতোটা অপমান আজ অব্ধি তাকে কেউ করেনি । এই মুহুর্তে পুরো পৃথিবী জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। ভালোবেসে কি অন্যায় করে ফেলল তাহলে? নিজেকে অনেক বার অনেক রকমভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রেখেছিলো।যাতে আর যাইহোক নিজের মনের কথা গুলো মুখ অব্ধি চলে না আসে।অথচ রাগের বশে আজ সত্যিটা বলে ফেলল।কিন্তু তার পরিবর্তে কি পেলো? উপহাস!ধিক্কার!এখন তো নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃনা হচ্ছে।কিন্তু,
একটা কথা এই মেয়ে সত্যি বলেছে, এখন না হোক, কয়েক মাস আগে অব্ধি রোজ রাতে নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গি পাল্টেছে সে। তাই বলে কি নিজেকে শুধরে কাউকে ভালোবাসা যায়না?? যায় তো। এই যে রুদ্র বাসলো।তবে কেনো মেয়েটি ফিরিয়ে দিলো তাকে?রুদ্র পুলের সবুজ পানিতে চোখ রাখলো।দুপা এগিয়ে এসে পুলের কিনারায় দাঁড়ালে পানিতে ভেসে ওঠে তার স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। রুদ্র নিজের প্রতিবিম্বকেই প্রশ্ন করলো,
— আমি কি সত্যিই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই?
রুদ্রর চোখ জ্বলছে।
চোখের কোনে চিকচিক করছে অশ্রুকনা। কত বছর পর সে কাঁদছে?ঠিক মনে করতে পারলোনা।পানিটুকু আঙুলের ডগায় এনে চোখের সামনে ধরলো ।
একটা মেয়ের জন্যে আজ তার চোখে পানি?? তাও তার থেকে প্রত্যাখান হওয়ার কারণে? সত্যিই নিজেকে বড্ড বেশীই প্রহসনের স্বীকার বানালো।
____
বিছানার ওপর মাথা চেপে ধরে বসে আছে সেজুতি। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।,রাগে দুঃখে পুরোটা পথ কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। যার ফল এই ব্যাথা। রুদ্রর আচরন গুলো যতবারই মনে পড়ছে, ততবারই রাগে শরীর গিজগিজ করছে।
শেষ মেষ এরকম একটা বিষয় নিয়ে মজা?আদৌ কি এই লোক ভালোবাসার কিছু বোঝে? বোঝেনা। এরা শুধু জানে মেয়েদের বিছানায় নিতে। ভালোবাসাতো তাদের কাছে এরই একটা অংশ।কিন্তু তার সাথেই কেনো? সে নিজেও তো রুদ্রর শয্যাসঙ্গী ছিলো একরাতের।তারপর নাকী রুদ্র আর কোনও মেয়ের দিকে ফিরে তাকায়না? তাহলে কেনো ভালোবাসার কথা বললো তাকে? কে জানে!হয়তো চাকরী দেবার মতো এটাও নতুন কোনও ফাঁদ।
রুমের মধ্যে কারো পায়ের শব্দ পেলো সেঁজুতি।চোখ তুলে দেখলোআবির এসেছে।সেঁজুতির খারাপ লাগলো।
ইশ! এই ছেলেটা তার সাথে পার্টিতে গিয়েছিলো, আর সে কিনা ওকে রেখেই চলে এলো?আসার আগে বলে পর্যন্ত আসলোনা?আবিরের মুখে চিন্তার ছাপ।উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“সেজুতি!কি হয়েছে? পার্টি ছেড়ে ওভাবে চলে এলে??

“এমনি শরীর টা ভালো লাগছেনা। মাথা ব্যাথা হচ্ছিলো।

” কমেছে এখন?

‘একটু।
আবির সেঁজুতির পাশে এসে বসলো।প্রশ্ন করলো,
“কিন্তু তোমার বস তোমাকে ওভাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কেনো?জানো আমি যখন ওদিক টায় যেতে নিচ্ছিলাম মি:রুদ্রর ভাই আব কি যেনো নাম?,ওহ হ্যা মিঃ অভ্র, উনি আমাকে আটকে দেন।
তাই বাধ্য হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হলো আমাকে।
সেঁজুতি নীঁচু কন্ঠে বলল

‘স্যরি আবির!আসলে আমি তোমাকে রেখেই চলে এলাম।

” এটা এমন কোনও ব্যাপার নয়।শরীর খারাপ লেগেছে সো এসে ভালো করেছো।আমি তোমাকে খুঁজেছি অবশ্য,পরে আংকেল কে ফোন করেই জানতে পারলাম তুমি বাসায় চলে এসেছো।
কিন্তু কি জানো? তোমার বসের রাগ দেখে আজ আমি সত্যিই আশ্চর্যকিত হয়ে গেছি।বাবারে। কি তেজ লোকটার!

সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো । উৎসুক কন্ঠে বলল,

— কেনো?? কি হয়েছে? কি করেছেন উনি?

সেঁজুতির প্রশ্নে আবির আগ্রহ পেলো, বলল,
‘কি করেননি তাই বলো??প্রথমে তো তোমাকে ওভাবে টেনে নিয়ে গেলেন।তার কিছুক্ষন পর এসেই সবার সামনে পার্টির সমস্ত জিনিস পত্র ভাংচুর করতে শুরু করলেন।ওনার ভাই অভ্র আরও কজন মিলেও ধরে রাখতে পারছিলেন না কিছুতেই। আর কি চেঁচাচ্ছিলেন! ওমন ক্ষিপ্ত লোকের আন্ডারে কিভাবে কাজ করো তুমি?

সেঁজুতি মনে মনে বলল,
— আমার ওপরের রাগ তাহলে এভাবে মিটিয়েছে?
মুখে বলল ‘ কি আর করার?সবই ভাগ্য।
আবির দুদিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘ না। এটা বললে চলবেনা।তোমার ওখানে চাকরি করার দরকার নেই।তুমি বরং ছেড়ে দাও ওটা।আরে বাবা আমি আর ড্যাড তো রয়েছি। তোমাদের দুজন এর খেয়াল রাখতে আমরাই যথেস্ট সেজুতি।

সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে বলল,
আবির সেটা আমি জানি।কিন্তু আমি আত্মনির্ভরশীল হতে চাই।নিজে কিছু করতে চাই,অনেক তো সাহায্য নিয়েছি তোমাদের। এবার না হয় আমার মতো করে বাবাকে দেখি?

আবির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— বেশ! তা করো, কিন্তু ওই রুদ্র রওশনের আন্ডারে নয়।,যদি একান্ত চাকরী করতেই হয় তবে আমার অফিসে করো না হয়।

— কিন্তু….

“আর কোনও কিন্ত শুনবো না আমি সেঁজুতি। আমার এই কথাটা অন্তত শুনতে হবে তোমাকে।
কালই জব ছাড়ছো তুমি,ওকে?
সেঁজুতি মনে মনে বলল,

‘কাল ওই জব টা আমি এমনিতেও ছাড়বো। আর যাই হোক এতো কিছুর পরে ওই লোকের আন্ডারে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

চলবে…..

প্রনয় পর্ব-২৪

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২৪

সিলেট জার্নি সমাপ্ত।রুদ্রর কাজ শেষ।তাও আরো একদিন আগেই।সেঁজুতি সিলেটে প্রথম আসায় লাস্ট মিটিং সময় নিয়ে ঠিক করেছিলো রুদ্র।কিন্তু আর থাকা যাবেনা।অভ্র অফিস সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।প্রত্যেকবারই খায়।কিন্তু তখন রুদ্র এক দুইদিনের মাথায় ফিরে আসে।এবার চারদিন কাটালো।কারনটা সেঁজুতি। উদ্দেশ্য ওর সাথে আরেকটু বেশি সময় কাটানো।গতকাল ফিরেছে ওরা।রাস্তায় সেঁজুতির অল্পস্বল্প মন খারাপ ছিলো।ঢাকার কোলাহল,যানজট ,কাজের ব্যাস্ততা,দুশ্চিন্তা সব ভুলে সিলেটের সবুজ প্রকৃতিতে মিশে গিয়েছিলো কদিনে।স্নিগ্ধ পরিবেশটায় একরকম মুদে ছিলো।সেঁজুতি মনে মনে খুব করে চাইলো ‘ কোনো একদিন বাবাকে নিয়েও আসবে।অনেকদিন কাটাবে।সিলেটের সব কাজ ভালোয় ভালোয় করেছে সেজুতি।প্রত্যেক টা প্রেজেন্টেশন ই তার সফল হয়েছে।রুদ্রর একটা ডিল ও হাতছাড়া হয়নি।রুদ্র বলেছে এই ক্রেডিট সেঁজুতির।অথচ সেঁজুতি তো জানে,পুরো কৃতিত্বই রুদ্রর।অমন গুছিয়ে লিখে না দিলে সে কী পারতো এত সুন্দর গুছিয়ে উপস্থাপন করতে?কখনও না।
সেঁজুতি ডেস্কে বসেছিলো।কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ থাকলেও মন ছিলো সিলেটের প্রত্যেকটি ঘটনায়।রুদ্রর বন্ধুত্ব করতে চাওয়ার কথাগুলো স্পষ্ট মাথায় গেঁথে আছে।বারবার মনেও পড়ছে।রুদ্র অফিসে এসেছে ঘন্টাখানেক।এর মধ্যে একবারও ডাকেনি দেখে সেঁজুতি একটু অবাকই হয়েছে।মনে মনে ভয়ও পাচ্ছে।রুদ্র আবার পালটি খেলো নাতো?বন্ধুত্ব করার পেছনের উদ্দেশ্য কী সেঁজুতির মনের কথা জানা ছিলো?হ্যা হতেই পারে।সেঁজুতি মনে মনে বলল ” আমিতো প্রথমে বলতে চাইনি।উনি কী সেজন্যে আমাকে ইমোশোনাল ব্লাকমেইল করলেন?সেঁজুতির এবার নিজের প্রতিই রাগ হলো।এত বোঁকা কেন সে?রুদ্রর চালাকী টেরই পেলোনা।সেঁজুতি যখন গভীর ভাবনায় তলিয়ে তখন বশীর এসে হাঁক পারলেন।রুদ্র ডাকছে।
সেঁজুতি ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” যাচ্ছি।
___

“আসবো স্যার?

” yes!
অনুমতি পেয়ে ভেতরে এলো সেঁজুতি।কেবিনে রুদ্র একা নয়,অভ্রও আছে।রুদ্রর উল্টোপাশের চেয়ারটায় বসে আছে হাসি হাসি মুখে।এই এক মাসে অভ্রকে দেখলেও সেঁজুতি একটা কথাও বলেনি। অভ্রর প্রতিও তার সমান রাগ।ওইতো ভুলভাল বলে সেঁজুতিকে এগ্রিমেন্টে সই করিয়েছিলো। অভ্র ও কখনও সেঁজুতির সাথে কথা বলতে আসেনি।সে নিজের মতো থাকতো।সেঁজুতি যে চটে আছে তার ওপর, আদৌ সেই খবর সে জানেনা।তাই ওকে দেখতেই হেসে বলল

— হেই মিস সেজুতি!হোয়াটস আপ?
সেঁজুতি সৌজন্যবোধ জানে।তাই রাগ চেপে রেখে ভদ্রভাবে বলল,
” নাথিং স্পেশাল স্যার।

“আপনার পারফমেন্স কিন্তু খুব ভালো ছিলো।একেবারে সবগুলো ডিল-ই কনফার্ম।ভাই বলেছে আমাকে।

অভ্রর গলাটা আরেকটু উৎফুল্ল শোনালো।জবাবে হাসলো সেজুতি।একেবারেই অল্প হাসি।যাকে বলে না চাইতেও জোর করে হাসা।
অভ্র আবার বলল,
“আর আপনার এই সাক্সেস এর জন্যে ভাই কাল সন্ধ্যায় বিশাল বড় পার্টি থ্রো করছে।

পার্টির কথা শুনে সেঁজুতি অবাক হয়।গোল চোখেই রুদ্রর দিকে তাকালো।রুদ্র ভাবলেশহীন। একভাবে নিচের দিক তাকিয়ে ল্যাবটব এ কাজ করছে।যেন কত ব্যাস্ততা মহাশয়ের।সেঁজুতি আবার অভ্রর দিকে ফিরলো।

“পার্টি? আমার জন্যে?

‘ ইয়েস। অফিসের যেকোন বড় বড় ডিল বিদেশী ক্লায়েন্টদের সাথে কনফার্ম হলে ভাই পার্টি থ্রো করে।এটাতো হয়েই আসছে।তবে এবারের পার্টির মধ্যমনি কিন্তু আপনি।

সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো।এত বড় অফিসের পার্টি,তার মধ্যবিন্দু আবার সে? কী শুনছে এসব?সেঁজুতির বুক ধুক ধুক করছে চিন্তায়।অত গুলো মানুষ দেখে পার্টিতে হার্টফেল না করলে হচ্ছে।সেঁজুতি আবার রুদ্রকে দেখলো।লোকটা দিন দুনিয়া ভুলে ল্যাবটবে ডুবে আছে।সেঁজুতি আসার পর থেকে যে কতবার তাকিয়েছে তা বোধহয় দেখতেও পায়নি।এমন ভাব, যেনো এখানে কেউ নেই।সেঁজুতি মনে মনে বিরক্তই হয়।সেতো রুদ্রকে বন্ধুই ভেবেছে।তাহলে রুদ্র বস বস বিভেব করছে কেন?অফিস বলে?এটাই হবে।হওয়াই উচিত।অফিসে শুধু কাজের সম্পর্ক। এর বাইরের টা বাইরে।সেঁজুতি গলা ঝেড়ে নিভু কন্ঠে বলল,

— স্যার! আমাকে কি জন্যে ডেকেছেন যদি বলতেন।

এতক্ষনে চোখ ওঠালো রুদ্র।কী শান্ত চাউনি! সেকেন্ডের কম সময়ে আবার ফিরলো স্ক্রিনের দিকে।বলল,

‘ আগামীকাল সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ -এ রেডিসন ব্লুতে পার্টি থ্রো করেছি।চলে আসবেন।এক মিনিট ও এদিক ওদিক যেন না হয়।
সেঁজুতি ছোট করে বলল ‘ ওকে স্যার।

‘শাড়ি পরে আসবেন। পার্টির থিম শাড়ি।আসুন এখন
।সেঁজুতি মাথা নেঁড়ে বিদায় নিলো।ওমনি অভ্র অধৈর্য কন্ঠে বলল,

‘সিরিয়াসলি ভাই? কাল পার্টির থিম শাড়ি?

রুদ্র উত্তর দিলোনা।সূক্ষ্ম হাসলো।অভ্রর জিজ্ঞাসু চেহারার দিকে চেয়ে বলল ‘ সেটাতো পার্টিতে গেলেই বুঝবি।
____
আজকে প্রচন্ড গরম। সাথে রাস্তার বিরাট জ্যাম। পাশেই দাঁড়িয়েছে এক্টা এম্বুলেন্স। জ্যামে পরতেই ওটা তীব্র শব্দে সাইরেন বাজালো।ব্যাস! সেঁজুতির মাথার দফারফা। মাইগ্রেনের ব্যাথা দপদপানি শুরু করলো মুহুর্তেই।বাসায় পৌঁছোতে পৌঁছোতে সাড়ে দশটা বাজলো।ক্লান্ত পায়ে সিড়ি বেয়ে উঠে বাসার কলিংবেল বাজালো।দরজা খুলল মিনিট খানেকের মাথায়।সেঁজুতি তখন নিঁচু হয়ে জুতো খুলছে।ওপাশের ব্যাক্তিটিকে দুপায়ে দাঁড়ানো দেখে তৎপর মাথা উঁচালো। সঙ্গে সঙ্গে ৪৪০ ভোল্টেজের ঝটকা খেলো একটা।একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে। ঠোঁটে প্রসস্থ হাসি।সেঁজুতি তাকাতেই এক ভ্রু উঁচু করে বলল ‘ কী? অবাক হলেন?

অবাক হয়েছে মানে!এরকম অবাক সে আজকাল প্রায়ই হচ্ছে।রুদ্রর সাথে থাকতে থাকতে।একদিন অবাক হতে হতেই প্রানটা ঠুস করে বেরিয়ে না যায়!সেঁজুতির চোখে বিস্ময়। ভ্রু কুঁচকে বলল
— আপনি? এখানে?কী করে?
ওপাশের যুবকটি বলে,
‘আগেতো ভেতরে আসুন, তারপর বলছি না হয়।
সেঁজুতি ঘরের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলল,

‘আপনি কি করে এখানে এলেন? মানে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
এর মধ্যে শেফালী এসে সেঁজুতির হাতে ঠান্ডা এক গ্লাস পানি ধরিয়ে দিয়ে গেলো।

” কি হলো বলুন?

‘ যুবক টি মুচকি হাসলো
‘ বলব বাবা বলব।আপাতত পানি খান।

সেঁজুতি ক্লান্ত ছিলো এমনিতেই।ঢকঢক করে পানি খেলো।যুবকটির দিকে তাকাতেই মিষ্টি হেসে বলল,

— বসে কথা বলি?

সেঁজুতি বিরক্ত হলো এবার।এত রাগঢাকের কী আছে এখানে?যা বলতে ছেলেটির এত গড়িমসি? সেঁজুতি সোফায় বসলো।ছেলেটি বসলো সেঁজুতির মুখোমুখি সোফায়।তখন বসার ঘরে হাজির হলেন আমির।আমিরকে দেখতেই ছেলেটি বলল,

“আপনার প্রশ্নের উত্তর না হয় আংকেলই দিক।
আমির সেঁজুতির দিকে ফিরতেই সেঁজুতি ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল,
— ওনাকে তুমি চেনো বাবা??

‘চিনবনা কেন?ওকে না চিনে পারা যায়?অবশ্য অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।ছোট ছোট চেহারায় এখন দাঁড়ি গজিয়েছে।আমি অবশ্য প্রথমে চিনতে পারিনি,পরিচয় দেয়ার পরেই না চিনলাম।

সেঁজুতির ভ্রু কুঞ্চন আরো গাঢ় হয়,
‘ মানে? কি এমন পরিচয়?

‘তুইও চিনতে পারিস নি?আরে ও আবির।আমাদের আবির।তোর হোসাইন আংকেলের ছেলে।
সেঁজুতি চমকে তাকালো আবিরের দিকে।আবির মিটিমিটি হাসছে।

‘মানে আপনিই সেই আবির?
” ইয়েস।
” এইজন্যেইতো বলি এত মিল চেহারায় হয় কী করে!আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিনা।তাহলে সিলেটে থাকা কালীন বলোনি কেনো?? কেনো লুকিয়েছিলে?আর তুমি তো সিঙ্গাপুর ছিলে।সিলেট গেলে কী করে?

‘মাত্র এই কটা প্রশ্ন সেঁজুতি? আমিতো ভেবেছি তুমি প্রশ্নের জাহাজ বানিয়ে ফেলবে।
আমির হাসলেন।বললেন ‘ তোরা কথা বল।আমি আসছি একটু। আমিরের যাওয়ার থেকে চোখ ফিরিয়ে আবির সেঁজুতিকে দেখলো।মলিন কন্ঠে বলল

‘ এসেছিলাম তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে।অথচ আঙ্কেল কে এইভাবে দেখে আমি নিজেই সারপ্রাইজড।বাবাও আমাকে কিছু জানাননি।
সেঁজুতির ঠোঁটের হাসিটুকুও মুছে গেলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ সবই ভাগ্য।

আবির বুঝলো সেঁজুতির মন খারাপ হচ্ছে।তাই উচ্ছ্বল কন্ঠে বলল,
‘ জানো সেঁজুতি!সিলেটে প্রথম দিন তোমাকে দেখে আমি কিন্তু ভীষণ অবাক হয়েছি।তোমাকে চেনা চেনা লাগছিলো আমার।পরে তোমার বসের মুখে নাম শুনতেই শিওর হলাম যে তুমিই সেই আমির আংকেলের মেয়ে সেঁজুতি।তারপর থেকে ইচ্ছে করে করে তোমার সামনে যেতাম কথা বলার ছুঁতোয়।দেখছিলাম তুমি চিনতে পারো নাকী।ভাবলাম চিনতে পারোনি যখন তখন না হয় নাই বলি।একবারে ঢাকা ফিরে চমকে দেয়া যাবে।আর বলে দিলেতো তোমার অবাক মুখটা দেখতেই পেতাম না।তবে যাই বলো,তুমি কিন্তু আমাকে ছ্যাচড়া মনে করেছিলে।ভাবছিলে তোমাকে লাইন মারছি। হা হা।
আবির শব্দ করে হাসাতে সেঁজুতি লজ্জ্বা পেলো।সেতো সত্যিই আবিরকে গায়ে পরা ভেবেছে। তবে এতদূর নয়।
প্রসঙ্গ এড়াতে বলল ‘সিঙ্গাপুর থেকে আগে ঢাকায় না ফিরে সিলেট কেন?
আবির বলল ‘ সে কথা সময় হলেই তোমাকে জানাব।এখন নয়।

সেঁজুতি ঘাড় কাঁত করলো।অল্প সময়েই খোশগল্পে মজে উঠলো দুজন।আমির,হোসাইন গলায় গলায় বন্ধু।একে অন্যের বাসায় লাগামহীন আসা যাওয়া ছিলো।সেই সূত্রে আবির আর সেঁজুতির ও বন্ধুত্ব হয়।আবিরের যখন বারো বছর তখন দেশের বাইরে পড়তে পাঠায় হোসাইন।সেঁজুতির বয়স তখন নয়।আবিরের যাওয়ার পুরোটা সময় সেঁজুতি কাঁদছিলো।আবির তার একটামাত্র বন্ধু।হোক চার বছরের বড়।নাম ধরে ডাকতো বলে, আবির কোনো দিন রাগ করেনি।হেসেছে।এখনও হাসে। ভীষণ শুভ্র ওর হাসি।দেখে মনে হবে কোনো পাপ নেই হাসিতে।আবির দেশ ছাড়ার পর ওদের আর কোনও যোগাযোগ হয়নি।কথা ছিলো গ্রাজুয়েশন শেষ করে ফিরবে আবির।কিন্তু সে অজান্তেই ফিরতে চায়নি।থাকতে চেয়েছে ওখানে।তাই হোসাইনও আর জোর করেননি।
অনেকক্ষন গল্প করার পর আবির বলল,

” সেঁজুতি! তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও।অফিস থেকে এসেছো টায়ার্ড নিশ্চয়ই।

“তা একটু বলা যায়।

‘আঙ্কেল বললেন তোমার অফিস আট টায় শেষ হয়। তবে আজ দেরী করলে যে?কাজের অনেক প্রেশার?

‘আরে না।ঢাকার রাস্তায় জ্যামের কথা তো জানোই।লম্বা জ্যামে পরেছিলাম।অবশ্য অফিসেও কাজ অনেক। কাল আবার একটা পার্টি রয়েছে। সেখান কার ডেকোরেশন নিয়েও টুকটাক কথা বললেন বস।

— পার্টি? কী উপলক্ষে?

‘ সিলেটে আমার কাজে বস ইম্প্রেস হয়েছেন।তাই উনি এই পার্টির আয়োজন করেছেন।

“দারুন তো!তার মানে কাল পার্টির মধ্যমনি তুমি?তবে তো আমিও যেতে পারব,কি বলো?

“অবশ্যই। কেনো নয়।
সেঁজুতির হঠাৎ মাথায় এলো আবিরের আহত হওয়ার কথা।
‘ আচ্ছা আবির,শুনলাম তোমাকে নাকী ছিনতাইকারী ধরেছিলো?
আবির মুখ কালো করে বলল,
‘ হু।আর বোলোনা, এরকম অভিজ্ঞতা তাও বেড়াতে গিয়ে হবে কে জানতো?
আমিতো গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম।হঠাৎ কোত্থেকে একটা পাথর এসে গাড়ির কাঁচে পরলো।কাঁচ ভেঙে ক্ষান্ত হয়নি,ফাঁকা দিয়ে এসে পাথর টা পরলো সোজা আমার কাঁধে। অকষাৎ, সামলাতে পারিনি বলে গাড়ি লেগে যায় একটা গাছের সাথে।এরপর কয়েকজন মুখোশ পরা লোক এসে আমাকে টেনে নামালো গাড়ি থেকে। দুহাতে পায়ে কয়েকটা বারি মারতেই আমি জ্ঞান হারাই।তারপর কিছু মনে ছিলোনা।জ্ঞান ফিরলে দেখলাম একটা তালপাতা ছাউনীর দোকানের বেঞ্চীতে শুয়ে আছি।স্থানীয়রা তুলে এনেছেন।এরপর ওনাদের মাধ্যমে হোটেলে ফিরলাম।তবে হোটেলের চিকিৎসা ব্যাবস্থা বেশ ভালো।দুদিনেই ফিট হয়ে গিয়েছি দেখছোনা?মজার কথা কী জানো?ছিনতাই করতে এসে আমার ফোন, ওয়ালেট কিছুই নেয়নি ওরা।বোধ হয় নেয়ার আগেই লোকজন চলে আসে।
বাই দ্যা ওয়ে,তুমি কী করে জানলে?তোমার সাথেতো আমার তারপর আর দেখাই হয়নি।
আবিরের কপালে ভাঁজ।সেঁজুতি বলল
‘ সেটাও অনেক কথা।তুমি বোসো, আমি চট করে ফ্রেশ হই।এসে বলব।
‘ আচ্ছা।
____

তখন সন্ধ্যে।রেডিসন ব্লুয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে লোক সমাগম।এখানেই পার্টি থ্রো করেছে রুদ্র।বড় বড় অতিথিদের ভীর।অথচ সেই কখন থেকে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। একটু পরপর চোখ বোলাচ্ছে হাতঘড়িতে।কত গেস্ট আসছে,অথচ যার অপেক্ষায়, সে কই?
ঠিক সন্ধ্যা ৭ঃ২০। গেটের সামনে সাদা রংয়ের একটি গাড়ি এসে থামলো।রুদ্র তাকালোনা।যার জন্যে দাঁড়িয়ে, সেতো আর গাড়িতে আসবেনা।অভ্র পাশ থেকে বলল ‘ এইতো,সেঁজুতি চলে এলো।
রুদ্র তখন চোখ ওঠালো।সেঁজুতিকে দেখে ধুকপুকানিটা কয়েকশ গুন বাড়লো।জুড়িয়ে এলো দুচোখ। হাফ সিল্কের একটা কালো শাড়ি পরেছে সেঁজুতি। চুল গুলো ছড়িয়ে আছে পুরো পিঠ।ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক।দু হাত ভর্তি রেশমি চুড়ি।আর কপালে ছোট্ট একটা কালো টিপ।ব্যাস! এতেই যেন রুদ্রর আত্মহুতি দেয়ার মত অবস্থা।শাড়িতে মেয়েটাকে সুন্দর লাগবে ভেবেছিলো,কিন্তু এত সুন্দর লাগবে জানতোনা।তাও এত সামান্য সাজে।সেঁজুতি কে শাড়িতে দেখার লোভ অনেকদিনের।ভাগ্যিশ মিথ্যে বলল। নাহলে কবে দেখতো এরুপে কে জানে?
সেঁজুতি রুদ্র আর অভ্রকে দেখতেই এগিয়ে আসে।হেসে বলল ‘গুড ইভিনিং স্যার!
রুদ্রর ধ্যান ভাঙলো। অন্যদিক ফিরে বলল ‘ হু।অভ্র উত্তর দিলো ‘ গুড ইভিনিং।আপনি একদম ঠিক সময়ে এলেন।সেঁজুতি মৃদূ হাসলো।অভ্রতো আর জানেনা তার দেরী করার গল্প।রুদ্রর
এতক্ষনে নজর পরলো গাড়ির দিকে।জিজ্ঞেস করলো,
— কার গাড়ি এটা?
তখনি আবির বের হয়।পড়নে ব্লু স্যুট। ভূত দেখার মতো চমকালো রুদ্র।এই লোক এখানে কি করে।প্রশ্নটা করেই ফেলল।

‘মিঃ আবির এখানে? তাও আপনার সাথে? হাউ?

সেঁজুতি হা করতেই পাশ থেকে আবির বলে ওঠে,
‘হাই মিঃ রুদ্র রওশন।আমাকে দেখে চমকে গিয়েছেন নিশ্চয়ই??
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলল
‘ কে আপনি?
সেঁজুতি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।একি অবস্থা আবিরেরও।দুজন দুজনের দিক তাকিয়ে আবার রুদ্রর দিকে তাকায়।সেঁজুতি মনে মনে বলল,
‘একটু আগেই তো আবিরের নাম বললেন উনি।এর মধ্যেই ভুলে গেলেন?আজিব তো!এ আবার হয় নাকী!

আবির নিজেকে সামলে নেয়।হেসে বলে,
‘আমি? আমি আবির রহমান।সেজুতির বাবার বন্ধু, ড:হোসাইনের ছেলে। সিলেটে আপনার সাথে দেখা হয়েছিলো।মনে পড়ছে?

রুদ্রর ভালো মুড টা যাস্ট বিগড়ে গেছে।এই ছেলেটা শেষে কীনা সেঁজুতির বাবার বন্ধু?দুনিয়ায় আর কেউ রইলোনা?গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” হতে পারে।আসলে অনেকের সাথেই তো রাস্তা ঘাটে চলতে ফিরতে দেখা হয়।কিন্তু যাদেরকে মনে রাখা প্রয়োজন আমি তাদের বাইরে বাকি সবাইকে ভুলে যাই।
রুদ্রর কথায় স্পষ্ট অপমান। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পরলো আবির।সেঁজুতি রুদ্রর কথায়
হোচট না খেয়ে পারছেনা।আবিরের সাথে এক দফা ঝগড়া অব্দি করা লোক এখন বলছে তাকে মনে নেই?আশ্চর্য না?আবির নিজের অস্বস্তিটা ফের ঢেকে ফেললো হাসিতে।বলল,

” গেস্ট দের কি বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখেন আপনি?? নাকি ভেতরেও আসতে দেবেন?

‘ ইয়াহ শিওর।আসুন।

আবির আর সেঁজুতি ভেতরে ঢুকলো।রুদ্র সেদিকে কটমটে দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে গলার টাই ঢিলে করলো।এত গরম লাগছে কেন? মনে হচ্ছে শরীর থেকে আগুন বের হচ্ছে।কীসের আগুন এটা?হিংসের নাতো!অভ্র এতক্ষন ছিলো নিরব দর্শক।সেঁজুতিরা আঁড়াল হতেই কৌতুহলি কন্ঠে বলল ‘ ইনি কে ভাই?
রুদ্র মুখ কালো করে তাকালো।এই মুহুর্তে তার কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।আবির নামের ছেলেটাকে এত টা হাল্কা ভাবে নিয়ে এখন আবার পস্তাতে না হয়। সেই বা কী করে জানবে যে ঘুরেফিরে এই হবে সেঁজুতির আত্মীয়!উফ!কেমন চিপকে আছে সেজুতির সাথে।অভ্র উত্তর না পেয়ে বুঝলো ভাইয়ের মুড অফ।তাই বলল ‘ সবাইতো এসে গেছে ভাই।পার্টি শুরু করি?

রুদ্র মাথা নাঁড়ে।দুজনে ভেতরে আসে। অভ্র চলে যায় সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে।আর রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে এক কোনায়।একা একা।চোখ,মন দুটোই সেঁজুতি আর আবিরের ওপর।
অভ্র মাইকে এনাউন্স করতে শুরু করলো।সংক্ষেপে সেজুতির প্রসংশা আর তাদের কোম্পনির বর্ননা দিলো।রুদ্রর বুদ্ধি আর স্কিলের দৌড়ে কোম্পানি কতটুকু এসেছে এই অল্প সময়ে, সেটাই ছিলো মূলবিষয়।সাথে আজকের পার্টি থ্রো করার
কারনটাও বলল ।একটা সময় স্টেজের মেইন পয়েন্টে অভ্র সেঁজুতি কে ডাকে।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা কদমে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে ঘন তালির বর্ষন হয়।সবাই সমস্বরে কংগ্রাচুলেশন জানায়।সেঁজুতির ভালো লাগায় কান্না পেয়ে গেলো।নিঁচের ওষ্ঠ চেপে রেখে সংবরন করলো নিজেকে।এত্ত খুশি কখনও হয়নি তার।পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো করলেও নয়।একটু পর অভ্র রুদ্র কেও ডাকলো।থমথমে মুখ নিয়ে হাজির হলো রুদ্র। পকেটে দুহাত গুঁজে সেজুতির পাশে দাঁড়ালো।সেঁজুতি রুদ্রকে দেখলো ক’বার।সাদা শার্টের ওপর কালো কোর্ট পরেছে রুদ্র।চুল গুলো পরিপাটি করে স্পাইক করা।সেঁজুতি মনে মনে বলল ‘ ছেলেদের একটু কম সুন্দর হওয়া উচিত মিস্টার বস।তোহা আপনার ওপর এমনি এমনি ক্রাশ খায়নি।এখনই না বুঝতে পারছি আমি।

অতিথিদের করোতালি একটু পর পর বাজছে।অভ্রর একেকটি উদ্বুদ্ধ মূলক কথা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে।বাদ পরছেনা আবিরও।রুদ্রর মুখে হাসি নেই।ব্যাপার টা অন্যদের কাছে স্বাভাবিক।,কিন্তু সেঁজুতি এ নিয়ে চিন্তিত।কারন তার সামনেই রুদ্র হোহো করে হেসেছে।
তাহলে আজ কি হলো?যখন পার্টিতে এলো তখনও কী সুন্দর হাসিমুখে চেয়ে ছিলো।চাঁদপানা বদনে এমন আমাবস্যা কেন?

স্টেজে একটি বড় কেক আনা হলো।সেঁজুতির এক হাত ধরে কেক কাটলো রুদ্র।একটা কথাও বললনা।কেক কাটা শেষ হলে অভ্র এক টুকরো রুদ্রকে খাওয়াতে নিলে সে হাত সরিয়ে দিলো। বলল ‘ আমার সুগার আছে।তুই খেয়ে নে।তারপরই গটগট করে হেটে চলে গেলো সেখান থেকে।সেঁজুতির মন খারাপ লাগলো।সে এক টুকরো কেক হাতে তুলেছিলো রুদ্রকে খাওয়াবে বলে।যেখানে অভ্রর টাই খেলোনা,তার হাতে খাবে নাকী?

অভ্র সেঁজুতি কে খাওয়ালো।সাথে অফিসের আরো বেশ কজন কর্মকর্তাকে।এক সময় মাইক্রোফোনে ডান্স অফার করলো অভ্র। সবাই তখন মেতে উঠলো উত্তেজনা,আনন্দে।

সেঁজুতি এদিক ওদিক তাকিয়ে রুদ্র কে খুঁজছে। এই লোকের যে কি হয় কে জানে!এদিকে শাড়ি পরেই তার অবস্থা কাহিল।সচারাচর পরেনা বলে অভ্যেস নেই।বারবার জুতোয় বাঁধছে।পার্টিতে এসে তো তার বিষম খাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।
পার্টির থিম নাকী শাড়ি।অথচ এখানে সে একাই শাড়ি পরে এসছে।বাকি সবাই ওয়েস্টার্ন পরেছে নিজেদের মতো করে।তাহলে রুদ্র তাকে মিথ্যে কেনো বলল? নাকী পরে আবার থিম চেঞ্জ হলো।সে জানেনা।হতেই পারে।

ইতোমধ্যেই সবাই নিজেদের কাপল নিয়ে ডান্স শুরু করে দিয়েছে।উজ্জ্বল আলোটা নিভিয়ে সবুজ রঙের একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে এখন।সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে অরিজিৎ সিংয়ের সফট গান।হঠাৎ পাশ থেকে কেউ বলে ওঠে,

“কি হয়েছে সেঁজুতি?
সেঁজুতি ঈষৎ কেঁপে উঠলো আবিরের ডাকে।রুদ্রকে খুঁজতে গিয়ে আবিরের কথা বেমালুম ভুলে গেছিলো।আস্তে করে বলল

‘কই কিছু নাতো!তুমি এখানে কেন?যাও ডান্স করো…
” ডান্স? কীভাবে করব?তুমিতো এখানে।চলো চলো,

‘ এই না না আবির,আমি এসব পারিনা।তুমি যাওনা।আমাদের অফিসে কিন্তু অনেক সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে।
সেঁজুতি দুষ্টু হাসলো।আবির হেসে বলল ‘ থাকুক।আমার দরকার নেই ভাই।আপাতত তুমি এলেই হবে।চলোতো…

সেঁজুতি কে টেনেটুনে নিয়ে চলল আবির।
দূর থেকে এতক্ষন সবটা দেখেছে রুদ্র। রাগে ব্রক্ষ্মতালু চলছে তার।হিঁসহিসঁ করছে।

সেজুতির এক হাত নিজের বুকের ওপর, আর নিজের হাতটা সেঁজুতির কোমড়ে রাখলো আবির।গা দুলে দুলে সবার সাথে তাল মিলিয়ে নাঁচতে শুরু করলো।সেঁজুতির অস্বস্তি হচ্ছিলো।আবির বিদেশে মানুষ।তাই এগুলো ওর কাছে ডালভাত।কিন্তু সেতো অভ্যস্ত নয়।কেমন কেমন লাগছে। আবিরের খারাপ লাগবে ভেবে মুখে কিছু বলতেও পারছেনা।

হাত ইশারা করে একজন সার্ভেন্ট বয়কে ডাকলো রুদ্র। ছেলেটির হাতে ওয়াইন ভর্তি ট্রে।রুদ্র প্রথম গ্লাসে চুমুক দিলো সেঁজুতির দিকে চেয়ে থেকে।সেঁজুতির কাছে আবিরকে যাস্ট সাপের মতো মনে হচ্ছে তার।যেন পেঁচিয়ে ধরেছে মেয়েটাকে।সাপটাকে এক্ষুনি গিয়ে গলা টেপে মেরে ফেলতে মন চাইছে রুদ্রর।একে একে সাত আটটাা গ্লাস ই ফাঁকা করলো রুদ্র আবিরকে হিংস্র চোখে দেখে দেখে।কিন্তু এতেও লাভ হচ্ছেনা।
রাগ তার কমছেনা।রুদ্র সেঁজুতির দিকে হেলেদুলে এগোলো।গিয়ে দাঁড়ালো একদম আবির আর সেঁজুতির মাঝখানে। রুদ্রকে দেখে আবিরের বুক থেকে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সেজুতি।কিন্তু আবির সেঁজুতির কোমড় ছাড়লোনা।রুদ্রর রক্ত বর্ন চোখ সেদিকেই তাকিয়ে।আবির বুঝতে পেরে হাত সরালো।বলল
‘এনি প্রব্লেম মিঃ রওশন?
উত্তর দিলোনা রুদ্র।যে হাত সেঁজুতি আবিরের বুকে রেখেছিলো চেপে ধরলো সেটা।সেঁজুতির চোখ উঠলো কপালে।আবিরও বিস্মিত।রুদ্র কারো অভিব্যক্তি পাত্তা না দিয়ে টানতে টানতে সেঁজুতি কে নিয়ে হাটা ধরলো সুইমিং পুলের দিকে।

এতো জোরে টানছে রুদ্র, সেঁজুতি তাল মেলাতে পারছেনা। তার ওপরে শাড়ি।হুমড়ি খেয়ে পরতে নিচ্ছে কয়েকবার।রুদ্র রেগে আছে সেঁজুতি টের পেয়েছে আগেই।কিন্তু কেন?আর তাকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছেই বা কোথায়?

গন্তব্যে এসেই সেজুথির হাত ছেড়ে দিলো রুদ্র।নাকের পাটা ক্রমশ ফুলছে।রাগে ফোস ফোস করছে। শক্ত চোয়াল,লাল চোখ দেখে সেঁজুতি ঘাঁবড়াল।সে কী কোনো ভুল করলো?ভীত কন্ঠে শুধালো,

‘কিছু হয়েছে স্যা…
পুরোটা শেষ করার আগেই সেঁজুতির দুইবাহু চেপে ধরলো রুদ্র।মিশিয়ে ফেলল ওকে নিজের বুকের সাথে।চমকে ব্যাথা ভুলে গেলো সেজুথি।রুদ্র ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,

“আবিরের সাথে সময় কাটাতে আপনার অনেক বেশি ভালো লাগে তাইনা সেজুতি?কেমন বুকে হাত দিয়ে নাঁচছিলেন।ও আপনার কোমড় কেন ধরেছে?হুয়াই?ওর স্পর্শে মজা পাচ্ছিলেন?না পেলে কেন কিছু বললেন না?নাকী পরপুরুষের স্পর্শ খুব ইঞ্জয় করেন আপনি?

সেঁজুতি এতক্ষন শান্ত ছিলো।কিন্তু রুদ্রর নোংরা নোংরা কথায় রেগেমেগে আগুন সে।ঝাঁড়া মেরে রুদ্রর হাত সরাতে চেষ্টা করলো। লাভ হলোনা। রুদ্রর গায়ে যেন অসুরে শক্তি।অগত্যা রুদ্রর সাথে মিশে রইলো ওইভাবে। সেঁজুতি নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করায় রুদ্রর রাগ দ্বিগুন বাড়লো।আগের থেকেও চেঁতে বলল ‘ আমি ধরলেই আপনি নিজেকে সরাতে চান।কই, এতক্ষন আবির ও তো ধরেছিলো।একবারও তো এরকম ছাড়াতে দেখলাম না আপনাকে!কী সম্পর্ক আপনাদের?হ্যা?বলুন?

সেঁজুতি স্তম্ভিত।রুদ্রর মুখ থেকে পাওয়া উৎক গন্ধে বুঝলো রুদ্র আবার মদ খেয়েছে।সেঁজুতির মেজাজ চটে গেলো যেন।বারবার মাতলামি করতে তাকেই পায়? বন্ধু হিসেবেও রুদ্রর মদ খাওয়া তার পছন্দ হলোনা।সেঁজুতি কে নিরুত্তর কিছুতেই মানতে পারলোনা রুদ্র।যদি আবিরের সাথে কিছু না ই হবে তবে বলছেনা কেন?সেঁজুতিকে ঝাঁকালো রুদ্র,দাঁত পিষে বলল ‘ কি হলো বলুন? কি চলছে আপনাদের মধ্যে?আবিরের সাথে এতো ঘষাঘষী কিসের আপনার?? কিসের এতো ঢলাঢলি, বলুন আমায়?

সেঁজুতি ফুঁসে উঠলো এবার,
— ভদ্র ভাবে কথা বলুন।মুখে যা আসছে তাই বলতে পারেন না আপনি।

রুদ্র চিৎকার করে বলল
-“পারি অবশ্যই পারি। আপনার ব্যাপারে তো সব পারি।আপনি আর আবিরের সাথে মিশবেন না। ওর ধারে কাছেও আমি আপনাকে দেখতে চাইনা ব্যাস।

সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল,
–মানে? আমি কার সাথে মিশব,কার সাথে মিশব না,সেটা কি আপনি বলে দেবেন?বন্ধু হয়েছি বলে আপনার হুকুমে আমার লাইফ চলবে?আর তাছাড়া,কিসের এতো অধিকার বোধ আপনার!আমি যার সাথে ইচ্ছে নাঁঁচবো,যার সাথে ইচ্ছে মিশবো।যাকে ইচ্ছে ধরব।কেনো আপনি নিষেধ করবেন আমায়?,কেনো?

‘ বিকজ আই লাভ ইউ ড্যামেট!আই লাভ ইউ….!!

চলবে?

প্রনয় পর্ব-২৩

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব-২৩

বিকেলের নরম আলো চারপাশে।সামনের নদীটায় কপোত কপোতির ভীর।নৌকা ভ্রমনে কী উচ্ছ্বাস তাদের!পরিবারের সাথে এসেছে অনেকে।ছোট ছোট বাচ্চাও রয়েছে কতকের।পার্কটির চারপাশে ঘিরে বাউন্ডারির মতো সৌন্দর্য বর্ধক গাছ লাগানো।তাতে ফুটেছে নাম না জানা বাহারি ফুল।মনোরম এই পার্কটির সৌন্দর্যে এতক্ষন মুদে ছিলো সেঁজুতি। অথচ সব ভালো লাগা তার বিদেয় নিলো রুদ্রর কথা শুনতেই।
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে।রুদ্রর নিরুদ্বেগ ভাবমূর্তি নিখুঁত চোখে অবলোকন করছে।
কী এমন কথা জানতে চাইবেন?আওয়াজ শুনে তো মনে হয়নি হালকা পাতলা কিছু।ভয়টা সেখানেই সেঁজুতির।রুদ্রকে এ ক’দিনে বেশ চিনেছে।কারনবিহীন একটা কাজ করেনা এ লোক।ব্যাবসায় যতটুকু দেখলো,” যেখানে লাভ নেই সেখানে রুদ্র নেই।যেখানে লোকসান সেখানে তো তার ছাঁয়াও খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
মনের মধ্যে হাজার প্রশ্নের ঝুড়ি সাজালো সেঁজুতি। কিন্তু সেসব করা হলোনা রুদ্রর থম ধরে থাকা চেহারা দেখে।

— ককি জা..জাননতে চচান?? অজান্তেই গলা কাঁপলো সেঁজুতির।
রুদ্র তেমনি শান্ত কন্ঠে বলল
‘এতো তোঁতলানোর কিছু হয়নি।শুধু শুধু ভয় পাবেন না।
সেঁজুতি মেকি ভাব দেখিয়ে বলল,
‘ আমি ভয় পাচ্ছিন।আপনি কি জানতে চান?

‘ আপনি দেখছি বলার জন্যে বড্ড অধৈর্য!

এবার বিরক্ত হলো সেঁজুতি। সত্যিই সে অধৈর্য। কিন্তু তাতো আর ওনাকে জানানো যাবেনা।চুপ করে অন্যদিকে তাকালো। এমন লোকের সাথে কথা না বাড়ানোই ভালো,সুযোগ পেলেই খোঁচা মারে।

“সেদিন রাতে আমার হোটেলে কেনো এসেছিলেন?

সেঁজুতি তখন অন্যদিক ফিরে।ভুলে গেলো রুদ্রর কথা।চারপাশ যখন নিরিবিলিতে ক্ষনিকের মত রুপ নিলো,ঠিক তখনই একটা প্রশ্নবজ্র ফেলল রুদ্র।সেঁজুতি বিস্মিত,স্তব্ধ হলো কথাটুকু কানে যেতেই।রুদ্র উদ্বেগহীন।সেঁজুতি প্রচন্ড চমকালো।প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ফিরতেই রুদ্র বলল,

” বলুন!

সেঁজুতি নিশ্চুপ।তার উত্তর নেই।সে বিমুঢ় হয়ে চেয়ে আছে।চোখে পলক অব্দি ফেলছেনা।নিশ্চল দৃষ্টিতে খেলছে সহস্র প্রশ্ন,লক্ষ্য কৌতুহল।কেন জানতে চাইছেন উনি এসব?কেন তাঁজা করছেন ঐ পুরোনো নোংরা ঘা!
নিরুত্তর সেঁজুতি কে দেখে ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র।সেঁজুতি অাপোসে কিছুই বলবেনা সে জানতো।রুদ্র নিজেই বলল,

‘দেখুন সেঁজুতি!অলরেডি,ড:হোসাইনের থেকে আমার অনেকটা জেনে নেয়া শেষ।আপনি যেদিন আমার হোটেলে এসেছিলেন তার একদিন পরেই আপনার বাবার অপারেশন হয়।তার কস্টিং ও প্রায় ছয় লাখের মতোন।আমি কি তবে ধরে নেবো, যে এইজন্যেই আপনি….

“তার মানে আমার পেছনে আমারই ব্যাপারে তদন্ত চালিয়েছেন আপনি?
সেঁজুতির কঠিন স্বর।শক্ত মুখ।রুদ্র সূক্ষ্ণ হাসলো।সেই অফিসের প্রথম দিনের সেঁজুতিই যেন বসে আছে আজ।তর্কে তর্কে বিদ্ধ হবে,তবুও হারবেনা।রাগি রুদ্র নিজেকে আজ বড্ড শীতল রাখছে।কেন যেন এই মেয়ের কাছে এলে তার রাগের বদলে অন্য কিছু বের হয়।একদম আলাদা কিছু।রুদ্র একিভাবে জবাব দেয়,
“ঠিক তদন্ত নয়।অনেক টা গোলক ধাঁধায় আটকে ছিলাম আমি।কী?কেন?কীভাবে?কী করে?এসব প্রশ্নের যাতাকলে অনবরত পিষে যাচ্ছিলাম।যাস্ট সেখানে থেকেই নিজেকে মুক্ত করার ক্ষুদ্র প্রয়াস বলতে পারেন।ওসব ছাড়ুন,যেটা জানতে চাইছি তার উত্তর পাইনি এখনও।
সেঁজুতির চোখের কোটর ভরে উঠলো।অথচ গড়ালো না।কাট গলায় বলল,
” আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার ব্যাক্তিগত রাখতেই পছন্দ করি আমি। আপনাকে আমি কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

সেঁজুতি এতটা কঠোরভাবে বলতে চায়নি।কিন্তু এই বিষয়ে রুদ্রকে প্রশ্রয় দিতেও মন স্বায় দেয়নি।যে জিনিসটা সে খুব গোপনে শুধুমাত্র নিজের মধ্যে রেখেছে, কেন অন্যকে বলবে সেসব? কে রুদ্র?শুধুই অফিসের মালিক।তার বস।আদৌ এসব শেয়ার করার মতোন সম্পর্ক তাদের নয়।কখনও হবেওনা।তাহলে কেন অন্যের কাছে ছোট হবে সে?সেঁজুতি উঠে দাঁড়ায়।এগোতে গেলেই পেছন থেকে এক হাত টেনে ধরলো রুদ্র।সেঁজুতি ফের চমকায়।ঘাঁড় ঘুরিয়ে রুদ্রকে কিছু বলার পূর্বেই
টান মেরে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো রুদ্র।হাত ছাড়লোনা।সেঁজুতি হাত মোঁচড়াতে মোঁচড়াতে বলল,

“ছাড়ুন বলছি…
রুদ্রর স্থির জবাব,
‘ উত্তর না পাওয়া অব্ধি ছাড়ছিনা।
সেঁজুতি চেঁতে বলল,
‘আপনার প্রশ্নের কোনও উত্তর ই দেবোনা আমি।এতো কিছু জানতে পেরেছেন তো বাকিটাও নিজের মতো করে জেনে নিন।আমাকে বিব্রত করে কি লাভ হচ্ছে আপনার?

রুদ্র বাঁকা হাসলো। এমন হাসি অনেকদিন পর দেখলো সেঁজুতি। সেই প্রথম দিনের মতো ক্রুর হাসি এটা।যাতে মিশে থাকে চূড়ান্ত অহংবোধ।রুদ্র বলল

‘আমি চেষ্টা করলে সব টাই পানির মতো স্বচ্ছ করে জেনে নিতে পারতাম।কিন্তু আমি পুরোটা আপনার থেকে শুনতে চাইছি।ইটস কোয়াইট ইম্পরট্যান্ট ফর মি।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
“কিসের ইম্পরট্যান্ট?
রুদ্র সামনে তাকালো,
” সেটার উত্তর না হয় পরে দেই?আর হাত এতো মোঁচড়ামুঁচড়ি করবেন না।ছাড়াতে তো পারবেন ই না,উলটে ব্যাথা পাচ্ছেন। মচকেও যেতে পারে।তাই শান্ত হয়ে বসুন।আর যেটা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিন।

সেঁজুতি ক্ষুব্ধ হলো এবার।
‘আর কতবার একী কথা বলব আপনাকে?আমি কী করেছি,কী করব সেসব জানারই বা আপনি কে?আপনি কী বুঝতে চাইছেন না!এ নিয়ে আমি কথা বাড়াতে চাইনা আপনার সাথে?আপনি আমার বস।এর বাইরে আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।নিজের পার্সোনাল লাইফ নিয়ে কথা বলার মতো তো নয়ই।

রুদ্র খেই হারালো মেজাজের।হাতের বাঁধন শক্ত করলো।সেঁজুতি ব্যাথায় চোখ বুজে ফেলতেই রুদ্র ঢিলে করলো আবার।আরেকদিক ফিরে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে শান্ত করলো নিজেকে।সময় দিলো।বুঝতে পারলো,
এভাবে জিজ্ঞেস করলে কাজ হবেনা।শুধু শুধু কথা খরচা হবে, কিন্তু উত্তর পাওয়া যাবেনা।
মুঠোয় রাখা সেজুতির হাত ছেড়ে দিলো রুদ্র।সেঁজুতি বুকের কাছে গুটিয়ে আনলো সেটা।লাল হয়ে গিয়েছে যেখানে ধরেছিলো।সেঁজুতি মাথা নামিয়ে নেয়।একমনে পাথরের মেঝেটা দেখতে থাকে। ভীষণ কান্না পাচ্ছে।চোখ জ্বলছে।না হাত ব্যাথায় নয়।বুকের ব্যাথায়।চোখের সামনে ভাসছে সেদিন রাতের গল্প।নিজের সতীত্ব বিলিয়ে দেয়ার দৃশ্য।গায়ে কাঁটা দিচ্ছে রুদ্রর হিংস্র স্পর্শের অনুভূতিতে।লজ্জ্বা-ঘৃনায় নেতিয়ে, অবশ হয়ে আসছে গোটা দেহ।কীভাবে যে নিজেকে সংবরন করছে সেই জানে শুধু।রুদ্র উঠে দাঁড়ায় হঠাৎ।টের পেয়ে মুখ তুললো সেঁজুতি।সেঁজুতিকে অবাক করে দিয়ে হাটু মুঁড়ে ওর সামনে বসলো রুদ্র।সেঁজুতি ব্যাস্ত কন্ঠে বলল

“কি করছেন??
কথাটায় কান দিলোনা রুদ্র।সেজুতিকে আরো একধাপ বিস্মিত করতে ওর এক হাত নিজের মূঠোয় নিলো।এতোই কোমল ভাবে ধরলো যেন কিয়ৎ পরিমান ও ব্যাথা না লাগে।লাল হওয়া জায়গাটায় আঙুল বুলিয়ে সেঁজুতির চোখের দিকে তাকালো।হালকা ঢোক গিলে স্পষ্ট বলল ‘ আই এ্যাম স্যরি।
সেঁজুতি বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে থাকলো।গত রাতে রুদ্র নেশার ঘোরে স্যরি বলেছিলো।আজ একদম সজ্ঞানে বলছে?রুদ্র রওশন চৌধুরী কীনা তার একজন সামান্য এসিস্ট্যান্ট কে স্যরি বলছে? সেঁজুতির ভেতর থেকে একটা কথাই বার হয় ” এ অসম্ভব,অবিশ্বাস্য।
কিন্তু সে আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য।সুগভীর ভাবনার সুতোতে টান পরে রুদ্রর আওয়াজে।রুদ্র ভীষণ কোমল কন্ঠে বলল,

“আমি জানি আপনি অবাক হচ্ছেন। আমাকে এভাবে দেখে।সব সময় আপনাকে বকাঝকা করা,মেজাজ দেখানো, ইগোয়িস্টিক, বদ রাগী, রুদ্রর ব্যাবহার যে এরকম হতে পারে সেটা সত্যিই আশ্চর্যের!আমিও মানছি।কিন্তু কি জানেন? আমি নিজেও কিন্তু আপনার মতোই রক্ত মাংস দিয়ে তৈরী একজন মানুষ। আমার মধ্যেও খারাপ লাগা, ভালো লাগা, দুঃখ পাওয়া, এসব অনুভূতি রয়েছে।অথচ সবাই যেভাবে খুব সহজে প্রকাশ করতে পারে,আমি সেভাবে পারিনা।এটা আমার ব্যার্থতা,দূর্বলতা আপনি যা ভাববেন সেটাই।
(একটু থেমে)
আপনি আমার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট,আর আমি আপনার বস।আমাদের মধ্যে এই একটাই সম্পর্ক।যেটা একটু আগে আপনি বললেন।সেই সম্পর্কের ভিত্তিতে আমি আপনার থেকে আপনার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে পারিনা এটা সত্যি। উত্তর পাবোনা এটাও স্বাভাবিক।
কিন্তু আমি যদি বলি, যে এই মুহুর্ত থেকে আমি আপনার আর আপনি আমার খুব ভালো বন্ধু হবো? তাহলে সেটা কি খুব একটা ভুল হবে??
আমার দাদু বলতেন,বন্ধুত্বের সম্পর্ক পৃথীবিতে সব চেয়ে মিষ্টি সম্পর্কের মধ্যে একটি।
কিন্তু আমার কোনও বন্ধু ছিলোনা।ছোট বেলা থেকেই ছিলোনা।এখনও নেই।কেউ করতে চায়নি তা নয়।আসলে আমিই চাইনি আমার জীবনের তিক্ততা কমিয়ে কোনও মিষ্টি সম্পর্কে নিজেকে জড়াতে।তাই হয়তো কখনও প্রেম ও হয়নি।
কিন্তু আজ চাইছি।চাইছি আমার একজন বন্ধু হোক।যার কাছে আমি নিজেকে তুলে ধরব, যে তাকে তুলে ধরবে আমার কাছে।কোনো পর্দা থাকবেনা সেখানে।আপনি বলেছিলেন না? আমার জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে টাকা দিয়ে আপনাকে ছোট করতে চেয়েছি আমি?সেই ভুল শুধরে নিয়ে যদি আপনার বন্ধুত্ব চাই, দেবেন?বলুন না সেঁজুতি, দেবেন?হবেন এই বদমেজাজি রুদ্রর বন্ধু?

সেঁজুতি কিংকর্তব্যবিমুঢ়! নিষ্পলক তার দৃষ্টি। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে।হা করে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে থাকলো।মুগ্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার দুই চোখ।রুদ্রর বলা প্রত্যেকটি কথা মধুর বানীর মতো লেগেছে।এইতো,এখনও বেজে যাচ্ছে কানে। এতো সুন্দর করে কেউ বন্ধুত্ব করতে চায়?তাও এমন একগুয়ে একটা লোক?
আদৌ কি সে সঠিক শুনলো?নাকি কানদুটো খারাপ হয়ে গেলো?

রুদ্র মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
” হবেন না আমার বন্ধু?

ঠোঁট দুটো প্রসস্থ করে হাসলো সেঁজুতি। ওপর নিচে আলতো করে মাথা ঝাঁকালো। চোখ বুজে স্বায় বোঝালো। হ্যা হবে।হবে সে রুদ্রর বন্ধু।
রুদ্র প্রশান্ত হাসলো।মুঠোয় রাখা সেঁজুতির নরম হাতের দিকে একবার চাইলো।বলল,

“বন্ধুত্বের জোরেই নাহয় আমাকে বলুন।যেটা আপনি কাউকে বলেননি বা বলতে পারছেন না,এমন কি আপনার বাবাকেও নয়।

সেঁজুতি অবাক কন্ঠে বলল,
” আপনি এটাও জানেন?
“জানি।

” কীভাবে?এ কথাতো হোসাইন আঙ্কেল ও জানেননা।
রুদ্র মৃদূ হাসলো,
” আন্দাজ করেছি।আপনাকে যতদূর চিনলাম তাতে খুব কঠিন হয়নি। আমার কথা ছাড়ুন,এবার বলুন তো কি ঘটেছিলো?
এতক্ষন রুদ্রর এমন সহজ-সাবলীল আলাপে সেঁজুতি নিজেও সহজ হলো।
বন্ধু যখন হয়েইছে তখন বলাই যায়।অর্ধেকের বেশিই তো জানেন উনি।সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।শুধুই দীর্ঘশ্বাস ছিলোনা এটা।ছিলো ভেতরে লুকোনো অনেক ব্যাথা প্রকাশের প্রস্তুতি।
সেঁজুতি রুদ্রর দিকে তাকায়নি।চোখ কোলে রাখা অন্যহাতের দিকে রেখে ভাঙা গলায় বলতে শুরু করলো,
” সেদিন আমি ভার্সিটি থেকে মাত্র ফিরেছি।দরজায় তালা লাগানো নেই দেখে বুঝলাম “বাসায় বাবা ফিরেছেন।দরজাও খোলা,ভেজানো ছিলো শুধু।ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম বসার ঘরে অনেক লোক।সবাই আমাদের বিল্ডিংয়ের ভাড়াটিয়া।রুমের মধ্যে ঢুকতেই আমার মাথা ঘুরে এলো বাবাকে অচেতন অবস্থায় দেখে।বাবা বিছানায় শুয়ে ছিলেন।আর পাশে অনেকে দাঁড়ানো। অনেক কে চিনি অনেককে না।বাবা একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করতেন।কাজেরমধ্যে হুট করে অসুস্থ হন ।বুকেহাত চেপে বসে পরেন ।কয়েক জন ধরাধরি করে হাসপাতালে নেয়।আর তারপর বাড়িতে আনেন।রিপোর্ট দেবে কদিন পর।এরকমটাই আমাকে বলেছিলেন বাবার এক সহকর্মী ।আমি প্রচন্ড ঘাঁবড়ে গেলে সবাই আমাকে আস্বস্ত করলেন।এটা সিরিয়াস কিছু নয় বোঝালেন ওনারা।আমি মেনে নিলাম।
সেদিনের মতো বাবা সুস্থ হলেন।রাতে ঠিকঠাক খাবার খেলেন।ঘুমোতে যাওয়ার আগে আমরা গল্প করলাম নিত্যদিনের মতো।কিন্তু সেসব ক্ষনিকের আনন্দ।পরেরদিন সকালে আমি বাবা দুজনেই তৈরি। আমার উদ্দেশ্য ভার্সিটি। বাবার অফিস।বাবা আগে বের হতে যান।কিন্তু দরজা অব্দি যাওয়ার আগেই আাবার বুকে হাত চেপে নিচে বসে পরেন।
আমি তখন ক্লাশের বই ব্যাগে ভরছি।বাবার চিৎকার শুনে দৌড়ে যাই।আঁতকে উঠলাম বাবাকে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকতে দেখে।আমার চিৎকারে গোটা বাড়ির ভাড়াটিয়ারা হাজির।বারবার বাবার চোখে মুখে পানি ছিটানোতেও লাভ হচ্ছিলোনা।,ভাবলাম সিভিয়ার কিছু হলো কিনা!হোসাইন আংকেল তখন দেশের বাইরে। ওনার থেকে যে একটু সাহায্য পাবো তার ও উপায় নেই।বাড়ির কজন বাবাকে হাসপাতাল অব্ধি নিয়ে গেলেন।
কিন্তু তাতে অনেক দেরি হয়ে যায়।ততক্ষনে বাবার এট্যাক ব্রেন অব্ধি এফেক্ট ফেলে।ডাক্তার মেহরাব জানালেন ইমিডিয়েট অপারেশনের ব্যাবস্থা করতে হবে।যত সময় যাবে তত বাবার বাঁচার আশা কমবে। বাবা আর বাঁচবেন না।অলরেডি তার ডান পা প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।এরপর পুরো বডি ধরে যাওয়ার আসঙ্কা রয়েছে।আমি এক কথায় বলি “আপনারা ব্যাবস্থা করুন। কিন্তু অপারেশনের এমাউন্ট শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।দুচোখে নেমে এলো অন্ধকার।এতো টাকা তাও একদিনে? কিভাবে জোগার করবো আমি? আমার মাথায় কিচ্ছু আসছিলোনা।মাথায় হাত দিয়ে কতক্ষন বাবার কেবিনের সামনে বসেছিলাম জানিনা।হুশ ফিরতেই ছুটে বাসায় যাই।
মায়ের রেখে যাওয়া ছোট খাটো স্বর্নের চেন,কানের দুল, বাবার তুলে রাখা বাসা ভাড়ার টাকা, আমার জমানো টাকা সব মিলিয়ে এক লাখের মতো হলো।কিন্তু এটাতো ওই টাকার ধারে কাছেও ছিলোনা।
টিউশনি দুটো থেকে যা বেতন পেয়েছি তার সিংহভাগ বাবাকে ভর্তি করতেই চলে যায়।আমি বাবাকে নিয়ে রিস্ক নেইনি।ওই এরিয়ার ভালো হাসপাতালেই বাবাকে নিয়েছিলাম।ভর্তি ফি, কেবিন ফি কোনোটাই কম ছিলোনা। হুট করে মাথায় এলো বাবার ব্যাংক থেকে লোন নেবো। সেখানে গিয়েও হতাশ হই। ম্যানেজারের থেকে জানতে পারি কিছুদিন আগেই বাবা এখানে জয়েন হওয়ায় ওনারা নতুন এম্পলোয়িকে এতোগুলো টাকা কোনও ভাবেই ঋন দেবেন না।

রুদ্র মাঝপথে প্রশ্ন ছোড়ে,
“নতুন এম্পলোয়ি ছিলেন??

“হ্যা। আগে যেখানে কাজ করতেন তার থেকে এখানে বেতন ভালো। তাই বাবা অাগের চাকরিটা ছেড়ে দেন।

‘ তারপর?

সেঁজুতি নাক টেনে বলল
‘বাবাকে ছাড়া আমার আর কেউ নেই।বাবার কিছু হয়ে গেলে আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেতাম।হয়তো মরেই যেতাম।,আমার জন্মের এক মাস পরেই আমার মা মারা যান।তার চেহারাও আমি দেখিনি।আমার অবহেলা হবে ভেবে, বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি।সব সময় বুকে আগলে রেখেছেন।,আর সেই বাবা মৃত্যূর মুখে এটা আমি কিভাবে মেনে নিই?আপনিই বলুন!
সেঁজুতি ডুঁকরে কাঁদলো।রুদ্র শান্ত কন্ঠে বলল ‘ তারপর?

‘কিন্তু আমার তখন চোরাবালিতে ডুবে মরার অবস্থা।এতোগুলো টাকা কে দেবে আমায়?হোসাইন আংকেলের সাথেও কোনও ভাবেই যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। কাউকে চিনতাম ও না।যার থেকে একটু সাহায্য পাব।বন্ধুদের মধ্যে এক তোহা ছিলো।কিন্তু মেয়েটা নিজেই অন্যের বাড়িতে দত্তক কন্যা।সেখানে আমি কী করে ওকে বলি?
সব দিক থেকে শূন্য পেয়ে আমি যখন ক্লান্ত, তখন হুট করেই তোহার বলা একটা কথা মাথায় আসে।আপনি ওর ক্রাশ।মেয়েটার ভীষণ পছন্দ আপনাকে।আপনার ব্যাপারে এমন কোন নিউজ বের হবে তার তোহা জানবেনা কোনো দিন হয়নি এরকম।ওর ফোনের গুগলেও আপনার নাম সার্চ লিস্টের প্রথমে থাকে।সারাদিন আপনার সমন্ধে বলে বলে কান পঁচিয়ে দিতো আমার।কথায় কথায়
একদিন বললো আপনার কাছে যাওয়া মেয়েদের ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড এ পাঁচ লাখ করে দেয়া হয়।আমি ওইদিন বিশ্বাস করিনি।এত টাকা কার হয়? ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে পঁাচ লাখ দেবে!আলাদিনের চেরাগ আছে নাকী?হেসে উড়িয়ে দেই এসব বলে।কিন্তু বাবার অসুস্থতায় আমার সেদিন সব বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো।মনে হলো বাবাকে বাঁচানোর এই একটাই রাস্তা।আর কোনও কিছু ভাবিনি।আর -আর -সি হোটেলের এড্রেস জোগার করে বেরিয়ে পরি।
ওখানে গিয়েও আমি আশাহত।মিস সুভা জানালেন টাকার ব্যাপার আপনার মন মর্জি মোতাবেক।আপনার মুডের ওপরে নির্ভর করে ওটা।যাকে আপনার মনে ধরবে শুধুমাত্র তাকেই খুশি হয়ে পাঁচ লাখ দিয়ে থাকেন।কিন্তু যাকে ভালো লাগেনা তাকে কোনো রকম কিছু।আমার অবস্থা তখন অভাগির সাগর শুকানোর মতো।কিন্তু আশা আমি ছাড়িনি।উপায় ও নেই যে।মেহরাব আঙ্কেল কে বলে একদিনের সময় চেয়েছি।উনিও বলেছেন ওই রাতটা বাবাকে দেখে রাখবেন।নিজ দায়িত্বে। উনি ভালো মানুষ ছিলেন।
কিন্তু মিস সুভা আমাকে কিছুতেই নেবেন না।অন্য মেয়ে নিয়েছেন উনি।আজ রাতে সেই যাবে।কিন্তু আমারও যে আজ রাতটাই হাতে আছে।আমি ওনার পা চেপে ধরি।ভেঙে পরি কান্নায়।উনি খুব অবাক হন।আমার চোখের পানি দেখে দয়া হয়েছিলো ওনার।ঠিক করা মেয়েটিকে বাদ দিয়ে ওই রাতে আপনার রুমে পাঠাতে আমাকে সিলেক্ট করলেন।আমি শুধু একটা কলের পুতুলে পরিনত হই তখন।মনে মনে প্রার্থনা করি একটা ম্যাজিক হোক,সতিত্ব বিলানো ছাড়াই টাকা টা ম্যানেজ হোক।ওদিকে চিন্তায়ও ছিলাম।আপনি কী আমাকে পছন্দ করবেন? আমি পাবোতো পাঁচ লাখ টাকা?অনেক অপেক্ষা শেষে আপনি এলেন।তারপর সকালে যখন টেবিলে রাখা চেক টায় পাঁচ লাখ টাকা লেখা পাই আমার আনন্দের সীমা ছিলোনা।রাতের সব দুঃখ কষ্ট এক নিমিষে ভুলে যাই আমি।ছুটে যাই হাসপাতালে। বাবার অপারেশন হয়।বাবা বেঁচে ফেরেন।চোখ খুলে আমাকে অস্পষ্ট আওয়াজে যখন ডাকেন ‘ সেঁজুতি, আম্মা, বলেন আমার সমস্ত যন্ত্রনার মলম ছিলো সেই ডাক।আমার আর কোনো দুঃখ ছিলোনা।কোনো দুঃখ না।বাবা সুস্থ হতেই বারবার জিজ্ঞেস করতেন,এত টাকা কোথায় পেলাম।আমিও মিথ্যে উত্তর দেই,লোন নিয়েছি তোহার থেকে। বাবা মেনে নেন।আজ অব্দি এই সত্যিটা কেউ জানেনা।বাবা জানলে হয়তো ঘৃনায় আমার মুখ দেখবেন না।অনেক বড় আঘাত পাবেন।আত্মহত্যাও করতে পারেন।এসব ভেবেই প্রতিনিয়ত গুমরে মরছি আমি।এই কষ্টটা শুধুমাত্র নিজের মধ্যে রেখেছি।বিশ্বাস করুন আমি চাইনি ওইরাতে ওরকম রাস্তা বেছে নিতে।কিন্তু বাবার মুখ চেয়ে আর থাকতে পারিনি।টাকার কাছে বিলিয়েছি নিজেকে।আমার উপায় ছিলোনা।সত্যিই ছিলোনা।

সেঁজুতি দুহাতে মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে ওঠে।কথাগুলো বলতে অনেক সময় লেগেছে।বারবার থেমে থেমে বলেছে।কখনও লম্বা করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলেছে।পুরোটা সময় রুদ্র ধৈর্য ধরে বসেছিলো।একিভাবে।হাটুমুড়ে।অবশেষে সব কৌতুহলের অবসান হলো।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না শুনলেই ভালো হতো।এত কেন ভারী লাগছে বুকটা?যেন কয়েকশ মন ওজনের পাথর রেখেছে কেউ।
একটা মেয়ে কতোটা অসহায় হলে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেয়!তার চারদিক ঘিরে এতো এতো প্রপার্টির ছড়াছড়ির জন্যে আদৌ টাকা কোনও বড় ব্যাপার মনে হয়নি কোনও দিন।অথচ যে টাকা মেয়েদের সাথে এক রাত কাটাতে খরচ করে আসছে সেই টাকার জন্যে কোনো সন্তান হাহাকার করে।বাবার জীবন বাঁচাতে কোনো মেয়ে তার সতীত্ব বিলিয়ে দেয়?
এই বুঝি টাকার মূল্য,,??

সেজুতি তখনও কাঁদছে।ফোঁপাচ্ছে।মেয়েটা দুঃখ পাচ্ছে ওইসব মনে করে।কিন্তু এই কথাগুলো রুদ্রর জানা যে খুব দরকার ছিলো।রুদ্র ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে সেঁজুতির দুহাত মুখ থেকে সরালো।সেঁজুতির চোখমুখ টকটকে লাল তখন।এই মুখটা দেখলেই স্পন্দন বেড়ে যায় রুদ্রর বুকের।উফ! মহা ঝামেলা তো।
রুদ্র ন্যানো সেকেন্ডে নিজেকে সামলায়।সেজুতির দুচোখের কার্নিশ বেয়ে গড়ানো পানি টুকু নিজের দু আঙুল দিয়ে মুছে দেয়।বরফ কন্ঠে বলে,
” কেঁদে নিন সেঁজুতি।এটাই যেন আপনার জীবনের শেষ কান্না হয়।এরপর সব টা হোক সুখ আর শান্তির!

সেঁজুতি নিশব্দে কাঁদছিলো।রুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে হঠাৎই উৎফুল্ল কন্ঠে বলল ” চলুন,আপনাকে আপনার প্রিয় হাওয়াই মিঠাই খাওয়াব।

সেঁজুতির কান্না থেমে গেলো তাৎক্ষণিক। হা করে বলল,
‘ এখানে হাওয়াই মিঠাই কোথায় পাব?
রুদ্র অনিশ্চিত,
‘ পাওয়া যাবেনা?
‘ আমি তো জানিনা।
‘না গেলে না। অনলাইনে অর্ডার করব।
সেঁজুতি চোখ বড় করে বলল
” আপনি অনলাইনে হাওয়াই মিঠাই অর্ডার করবেন?
” হ্যা।কেন? করা যায়না?
সেঁজুতি ফিক করে হেসে ফেলল। চোখে তখনও জল।এই সময়ে মেয়েটাকে কী সুন্দর লাগছে ওকী জানে?রুদ্র সেঁজুতির হাসি দেখেই বুঝলো সে বোঁকা বোঁকা কথা বলেছে।ঘাঁড় চুলকে বলল,

‘ ঠিক আছে চলুন।সন্ধ্যা হচ্ছে। ফিরতে হবে।
সেঁজুতি মাথা দোলায়।রুদ্র আজ আর সামনে হাটে না।সেঁজুতির সাথে ধীরে সুস্থে পা মেলায়।পার্ক থেকে বের হতেই চোখে পরে ফুচকার ছোট খাটো দোকান।রুদ্র দাঁড়িয়ে পরলে সেঁজুতিও দাঁড়ালো।কৌতুহলে শুধালো ” কী হয়েছে?

‘ মেয়েদের নাকী ফুচকা অনেক পছন্দ!খাবেন ?
‘ আমার তো পানিপুরী বেশি পছন্দ।ফুসকা নয়।
রুদ্র মুখ বিকৃত করে চেষ্টা করলো নামটা বলতে।এ নাম সে জন্মে শোনেনি।রুদ্রর চেহারা দেখেই সেঁজুতির প্রচন্ড হাসি পেলো।হেসেও ফেলল শব্দ করে।রুদ্র মনে মনে স্বস্তি পেলো।যাক! মেয়েটার মন ভালো হলো।
তারপর পুরো বিশ মিনিট খোঁজ করে পানি পুরির দেখা মেলে।রুদ্রতো চেনেনা।সেঁজুতিই পেলো।রুদ্র দেখেই জিজ্ঞেস করলো ‘ এটাতো ফুসকার মতই দেখতে।নাম আলাদা কেন?
সেঁজুতি বলল ‘ সেটা মুখে দিলে বুঝবেন।
রুদ্র মেনে নিলো।তবে সে খাবেনা।এসব রাস্তার খাবার খেলে আজ আর সুস্থ থাকতে হবেনা।কয়বার ওয়াশরুমে আউট-ইন করতে হবে গুনেও মনে রাখা যাবেনা।সেঁজুতি একাই খেলো।পুরো তিন প্লেট।রুদ্রকে অনেকবার বললেও খায়নি।শুধু মন দিয়ে সেঁজুতির পানিপুরি মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে ফেলার সময় টা দেখেছে।

ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজলো ওদের।সেঁজুতির কয়েক রুম পরে আবিরের রুম।রুদ্র আগে আগে হেটে এসেছে
সেঁজুতি রুমে ঢুকতে গিয়ে হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে যায়।জেনারেটর চালু হবে সেকেন্ড খানেকের মধ্যে।তবে সেঁজুতি তো সেঁজুতিই। ওইটুকু সময়েই একজনের সাথে ধাক্কা লাগলো।দুইজন দুইদিকে ছিটকে পরলো।তখনি জেনারেটর চালু হলো।সেঁজুতি ভয়ে চিৎকার করে দিয়েছিলো।অন্যজনের হাতে কিছু একটা ছিলো যা পরতেই বিকট শব্দ হয়।রুদ্র সেঁজুতির চিৎকার শুনেই রুমে থেকে মাথা বের করে তাকায়।জেনারেটরের আলোতে দেখলো সেঁজুতি উঠছে মেঝে থেকে।ধাক্কা লাগা ব্যাক্তিটি একজন সার্ভেন্ট।হাতে শুকনো খাবারের ট্রে আর ওষুধ ছিলো। সেগুলোই পরেছে ফ্লোরে।রুদ্রর রাগ হলো, ‘ এই মেয়ে এত্ত ধাক্কা খায়।ধাক্কা খেলেই মেঝেতে চিৎ হয়ে পরে।একে জাদুঘরে রাখা উচিত না?

সার্ভেন্ট লোকটি সেঁজুতি কে স্যরি বলল।সেঁজুতির সেদিকে মন নেই।তার মুখ কালো খাবার পরে যাওয়ায়।এ জন্যে লোকটা আবার বঁকা খাবেনাতো?দোষ তো তারই।ওমন হুটোপুটি করে আসার কী দরকার ছিলো?
সার্ভেন্ট লোকটি যেতে নিলে সেঁজুতি ডাকলো।রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। সেঁজুতি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে সার্ভেন্ট লোকটির হাতে দিয়ে নম্র কন্ঠে বলল ‘ আমি ভীষণ দুঃখিত।আপনাকে দেখতে পাইনি।
লোকটি অবাক হয়েছে।।ইতস্তত করে বললেন “থ্যাংক ইউ ম্যাম।তবে এটার দরকার নেই।
‘ কেন?আরে রাখুন না।যাদের খাবার নষ্ট হলো তারাতো…
লোকটি মাঝপথে বলে ওঠে,
‘ ম্যাম আমি বুঝতে পেরেছি।আপনি ভীষণ ভালো মনের মানুষ। তবে এটার প্রয়োজন নেই।কারন আবির স্যারও অনেক ভালো মানুষ। উনি কিছু বলবেন না।

সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো।রুদ্র এত সময় চুপ ছিলো।আবিরের নাম শুনে দেহ পুরো বার করে বাইরে এলো দরজার।এতক্ষনে ওকে দেখতে পেলো সেঁজুতি।একবার রুদ্রকে দেখে সার্ভেন্টকে জিজ্ঞেস করে,
” এত ওষুধ? ওনার?কি হয়েছে ওনার?

‘ আমি ঠিক জানিনা ম্যাম।উনি সকালে আহত হয়ে ফিরেছেন।যতটুকু শুনলাম ওনাকে ছিনতাইকারী ধরেছিলো।গাড়ির গ্লাস ফেটেছে আর ওনাকেও আঘাত করেছে হাতে পায়ে।এইটুকুই।
আমি এখন আসি ম্যাম?

‘ জ্বি?আচ্ছা আসুন।
লোকটি চলে যেতেই সেঁজুতি রুদ্রর দিকে ফিরলো।রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। সেঁজুতি চিন্তিত কন্ঠে বলল,
‘ আবির অসুস্থ।ওনাকে দেখতে যাওয়া উচিত না?

রুদ্র কঁড়া কন্ঠে বলল, ‘ কেন? আপনার কাজ নেই?এখানে আপনাকে আমি অফিসের কাজে এনেছি।অন্য কোথাও মন না দিয়ে কাজে ফোকাস করুন।কাল ফিরব আমরা।সব রেডি করুন যান।

‘ আমার তো সব রেডি স্যার।ব্যাগ গুছিয়েছি আমি।সকালেই।
রুদ্র সময় নিয়ে বলল,
‘ আমার টা গুছিয়ে দিয়ে যান তাহলে । উম, ফ্রেশ হয়ে আসুন আগে।

সেঁজুতি মাথা দুলিয়ে রুমে ঢুকলো।রুদ্র ও ধড়াম করে দরজা লাগালো।মুখে মিটিমিটি হাসি।
‘ বলেছিলাম না মিস্টার আবির?
আমার জিনিসে সামান্য হস্তক্ষেপ ও বন্ধ!হাত পা ভেঙে কেমন লাগছে এখন?
চলবে,

প্রনয় পর্ব-২২

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথি
পর্ব–২২

রুদ্র ঘুমিয়েছে অনেক ক্ষন।রাত গড়িয়ে প্রায় ভোর হওয়ার জোগাড়।রুদ্রর মাথাটা এখনও ওইভাবে সেঁজুতির কোলে রাখা।সেঁজুতি উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে থাই জানলার কাঁচ গলিয়ে অদূরে
।অন্ধকারে আকাশটাও পরিষ্কার নয়। রুদ্রর মাথায় একিভাবে হাত বোলাচ্ছে সেঁজুতি। এমন নয় যে রুদ্র জোর করেছে।সেতো গভীর নিদ্রায়।সেঁজুতি অজান্তে,নিজের ইচ্ছেয় করছে। মনের মধ্যে কেমন অস্থির লাগছে।
গল্পের শেষ টুকু আর শোনা হলোনা।যত টুকু শুনেছে তাতেই তার চোখ গুলো ভিজে উঠছে। ফুঁপিয়ে কান্নাও করেছে কিয়ৎক্ষন।
গল্প বলার সময় রুদ্রর গলা ধরে আসছিলো।যেনো সেই রাজপূত্রের সহিত তার কোনো সংযোগ রয়েছে।কষ্ট ওই রাজার ছেলের নয়,হচ্ছে তার।
আচ্ছা,রাজপূত্রের কী হলো তারপর? কী হলো তার বাবার?সে কেন ফিরে এলোনা? রাজপুত্র কীভাবে নিজেকে সামলালো?ওইটুকু ছোট বাচ্চা কীভাবে বড় হলো?কে-ই বা ছিলো ওই রাজপূত্রের আড়ালের সত্যি মানুষটি?সেসব জানতে ভীষণ ইচ্ছে করছে সেঁজুতির।রাজপূত্রের জীবনের শেষ টা জানার আগেই রুদ্র ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো।
এমন নিষ্পাপ মুখ করে ঘুমোচ্ছে রুদ্র, সেজুথির আর জাগাতে ইচ্ছে হলোনা।সুযোগ পেলে কখনও জেনে নেবে না হয়!
কিন্তু কিভাবে জানবে?আজ না হয় ড্রিংক করেছে বলে নিজের মধ্যে ছিলেননা।এতোটা বাচ্চামো করছিলেন।কিন্তু হুশে আসলে এর মতো বদ মেজাজী,ইগোয়িস্টিক আর দুটো খুজে পাওয়া মুশকিল।সেঁজুতি বোঁকার মতো চাইলো রুদ্র আরেকবার এমন করুক , আর গল্পের শেষ টুকু বলে দিক।পরক্ষনেই,নিজের মাথায় চাটি মারলো।রুদ্র আজ যা করলো,প্রথমে তো ভয়ে প্রান বেরিয়ে গেছিলো তার।সেঁজুতির মনে পড়লো রুদ্রর বুকের ওপর পরে যাওয়ার কথাটা।মুহুর্তেই শিরদাঁড়া বেয়ে এক ঠান্ডা শীতল স্রোত গড়ালো।
____
জানলার পর্দা ভেদ করে সকালের মিষ্টি রোদ হুটোপুটি খেলো রুমের ভেতর। হাল্কা বাতাসে রুদ্রর ধূসর চোখে আছড়ে পরলো সূর্যের রশ্নি।রুদ্র চোখ কুঁচকে নিলো।কিঞ্চিৎ নঁড়েচড়ে উঠে বসলো।মাথা ভার লাগছে।ঝিমঝিম করছে। হঠাৎ
রুমটা খেয়াল পরতেই ঘুম ছুটে পালালো রুদ্রর। বিষ্ময়ে মুখ হা হয়ে এলো।

“এটা,এটাতো সেঁজুতির রুম,আমি এখানে কি করছি? আমি কী এখানেই ঘুমিয়েছি?উনি কোথায়?

রুদ্রর মনে পড়লো কালকে রাতের কথা।সেঁজুতিকে উল্টোপাল্টা বলার পর অনেকবার স্যরি বলতে এসেছিলো।অথচ ইগোর কারনে দরজা অব্দি এসে ফিরে গিয়েছে।নিজের প্রতি ক্ষোভে,রাগে -শোকে প্রচুর পরিমান মদ্যপান করেছে তারপর। কিন্তু এরপরে কী হলো তাতো মনে নেই।না মনে পড়ছেওনা।রুদ্রর হাসফাস লাগছে এখন।মদ খেয়ে সেঁজুতির সাথে খারাপ কিছু করেনি তো?সেঁজুতি তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে নাকী?রুদ্রর কলিজা ছলাৎ করে উঠলো ভয়ে।এই প্রথম, এই প্রথম, ভয় লাগলো তার।কাউকে পাওয়ার আগেই হারানোর ভয়ে গোটা শরীর অবশ হলো।
হঠাৎ ঘাঁড় ঘোরাতেই রক্তশূন্য চেহারাটা চকচকে হয়ে এলো রুদ্রর। নিথর দেহে যেন প্রান সঞ্চয় পেলো। সোফার ওপর গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সেজুতি।
এসির ঠান্ডা হাওয়ায় শীতে অল্প অল্প কেঁপে উঠছে।
বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুদ্র।
নিশ্চল চোখে সেঁজুতির ঘুমন্ত মুখ দেখলো।
বিছানা ছেড়ে নেমে ব্লাঙ্কেট নিয়ে সোফার কাছে এলো।গায়ে জড়িয়ে দিতেই নঁড়ে উঠলো সেঁজুতি।শীতের মধ্যে ব্লাঙ্কেটের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে নিজের সাথে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো সেটা।রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকলো। অপেক্ষা করলো সেঁজুতির ঘুম গাঢ় হওয়ার।অল্প সময় পর
হাটু ভাঁজ করে ফ্লোরে বসলো। ঘুমে জুবুথুবু সেঁজুতির পাশে। নিষ্পলক চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলো সামনে এলোমেলো চুলের ফর্সা মেয়েটিকে।কালকের মতোই অপরুপ লাগছে সেঁজুতিকে।কিন্তু কাল ধরা পরার ভয়ে দেখতে পারেনি ঠিক করে।সেই তৃষ্ণা এখন মেটাবে রুদ্র।সেঁজুতিকে দুচোখ ভরে দেখার অমোঘ তৃষ্ণা!

সেঁজুতি দুচোখ হালকা ফাঁকা রেখে ঘুমায়।মেয়েটা কী তাকে দেখছে?ঘুমের ভান করে নেইতো?
না, না,দেখলে এতক্ষনে ছিটকে দশ হাত দূরে সরে যেত।রেগেমেগে আগুন হয়ে বলতো ‘ চরিত্রহীন, অসভ্য!

রুদ্র ঠোট বেঁকিয়ে হাসলো।সেঁজুতির গালি গুলো ইদানীং শুনলে রাগ হয়না।কেন হয়না?তারতো রাগ করা উচিত! ভয়ানক রাগে লাল হওয়া উচিত।যে রাগে তার গোটা অফিস,ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন সিটিয়ে থাকে।
রুদ্র ঝুঁকে এলো সেঁজুতির মুখের ওপর। সেঁজুতির শুকনো ঠোঁট দুটোও কেমন টানছে।যেন সুপ্ত আহব্বান দিচ্ছে তার সাথে মিশে যেতে।রুদ্র চোখ বুজে ঢোক গিললো।নিজেকে সামলালো।সেঁজুতির ওই উষ্ণ ঠোঁটের আস্বাদন সেদিন নেবে,যেদিন সেঁজুতি চাইবে।আদৌ কী আসবে ঐদিন?অতো সুন্দর মুহুর্ত বেঁচে থাকতে দেখবেতো রুদ্র?

রুদ্র ছোট্ট করে ফু দিলো সেজুথির কপালে। সাথে সাথেই ঈষৎ উড়ে উঠলো কপালের ছোট ছোট চুল।রুদ্রর ওদের প্রতি ভীষণ হিংসে হয়।ওরা সেঁজুতি কে ছুঁতে পারে দিনরাত।সেঁজুতি কিচ্ছু বলেনা।কেন সে চুল হলোনা?তাহলে প্রত্যেক সেকেন্ড সে ঝাপটে পরতো সেঁজুতির চোখে,ঠোঁটে,গোলাপি দু গালের ওপর। ইশ! মিস হয়ে গেলো।
রুদ্র অতি সন্তর্পনে নিজের অধরের ছোট্ট একটা পরশ এঁকে দিলো সেজুতির কপালের ঠিক মাঝখানে।হৃদপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে তার।এ নতুন নয়।সেঁজুতি আশেপাশে থাকলেই তো এমন হয় আজকাল।সে শুধু খুব কষ্ট করে সামলায় সেসব।বোঁকা মেয়েটা বুঝতেও পারেনা।

রোদের আলোতে সেজুতির কোঁচকানো ভ্রু দেখে উঠে গিয়ে জানলার পর্দা ভালো করে টেনে দিলো রুদ্র।আরেকবার সেঁজুতি কে দেখে রুম ছেড়ে দ্রুত পায়ে বের হলো।
____
ফোনের রিংটনের শব্দে বিরক্ত হচ্ছে সেঁজুতি।এমন গগন বিদারী চিৎকার সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা।তার এতো সাধের ঘুম নষ্ট করতে যথেস্ট এই চিৎকার।সেজুতি হাঁতড়ে হাঁতড়ে ফোন খুজছে।ঘুমের মধ্যেই বালিশের নিঁচ, নিজের দুপাশ, হাঁতড়াচ্ছে।হাত এগোতে এগোতে, এগোচ্ছে নিজেও।
আর ওমনি ধপাস করে সোফা থেকে মেঝেতে পরলো।ভয়ে, চমকে লাফিয়ে উঠলো সেঁজুতি। ব্যাথায় মুখ বিকৃত করে বলল,

” উফ বাবা! ,কি কুক্ষনে যে সিলেট এসেছি?এসে থেকে খালি পরেই যাচ্ছি আমি।রাতে যে সোফায় শুয়েছি মনেই ছিলোনা ।

সেঁজুতির চোখ দুটো হঠাৎ বড় হয়ে এলো।রুদ্রর কথা মনে পড়েছে।ফ্লোরে বসে থেকেই তড়িৎ গতিতে বিছানার দিক তাকালো।
বিছানা ফাঁকা।রুদ্র কোথাও নেই।

‘ উনি চলে গিয়েছেন?
সেঁজুতির গায়ের ব্লাঙ্কেটের দিক চোখ পরলো।এটাতো গতকাল রুদ্রর গায়ে ছিলো। ওর গায়ে কী করে এলো? উনি দিয়ে গিয়েছেন?

সেঁজুতির ফোন বাজলো আবার।তড়িঘড়ি করে উঠে ছুটে গেলো সে।ফোন হাতে নিতেই ছোট্ট করে অ্যাটাক হলো সেঁজুতির।চোখ উঠলো কপালে।রুদ্রর ফোন।সেঁজুতি মাথায় হাত দিয়ে বলল,

৩২ টা মিসড কল??ইয়া আল্লাহ!তাও আবার ওনার?
ফোনের ওপরে ছোট্ট করে লেখা সময়টায় চোখ যেতেই আবারও একদফা বিস্মিত সেঁজুতি।
বেলা ১২ টা অব্ধি ঘুমিয়েছে?
তার ইতিহাসে এই প্রথম।

কাল সারারাত একটুও ঘুমোয়নি। কেনো ঘুমায়নি নিজেও জানেনা।ওই ভাবেই রুদ্রর মাথা কোলে নিয়ে বসে ছিলো।অথচ সেটা কিন্তু না করলেও হতো।
শেষ রাতে আর ঘুমের কাছে টিকতে না পেরে রুদ্রকে শুইয়ে দিলো বিছানায়।নিজে গিয়ে শুলো সোফায়।কিন্তু তাই বলে এতো বেলা হয়ে যাবে বোঝেনি।আজ তো তার সেকেন্ড প্রেজেন্টেশন। তাও ছিলো সকাল দশটায়।এখন বাজে বারোটা।কী হবে এখন?সেঁজুতির বুক কাঁপছে। ডিল হাত ছাড়া হলে রুদ্র তাকে আস্তো রাখবেনা।
হাতের মুঠোতেই ফোন কেঁপে উঠলো আবার।
ধড়ফড় করে রিসিভ করলো সেঁজুতি। ওপাশ থেকে ভেসে এলো রুদ্রর কঠিন স্বর।

‘কটা বাজে মিস সেঁজুতি? আপনি কি এখানে ঘুমোতে এসছেন?? ১২ টা বেজে গিয়েছে অথচ আপনার দেখা নেই।চাকরী করার ইচ্ছে নেই? তাহলে বলুন তার ব্যাবস্থা করছি আমি।

সেঁজুতি ভয়ে ভয়ে বলল ‘ স্যরি স্যার!আমার জন্যে অনেক বড় ক্ষতি হলো আপনার। আমি একদম জেনেবুঝে করিনি।

সেঁজুতির কন্ঠ কাঁদোকাঁদো। রুদ্র বলল,
‘ ফাইল সমেত পাঁচ মিনিটের মাথায় ,
আপনাকে নিচে দেখতে চাই আমি।যাস্ট ইন ফাইভ মিনিটস ওকে?

সেজুতিকে কিছু বলার সুযোগ দিলোনা রুদ্র। নিজের মত এক দমে কথা বলে লাইন কাটলো। সেঁজুতি পিটপিট করলো চোখ।প্রেজেন্টেশন এর সময় নেই,তাহলে এখন ফাইল নিয়ে কেন যাবে?
আর কতোগুলো কথা শোনালো!আরে ইচ্ছে করে এতো ঘুমিয়েছি নাকি? আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে নিজে তো হাত পা ছড়িয়ে আরামসে ঘুমিয়েছেন।ওনার জন্যে আমার ঘুম হলোনা আর এখন উনিই আমাকে কথা শোনাচ্ছেন?এই জন্যেই বলে উপকারিকে বাঘে খায়।
___

ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় নিচে নামলো সেঁজুতি।এক সেকেন্ড এদিক ওদিক হয়নি।গাড়ি ঘেঁষে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র।সেঁজুতিকে প্রথমে দেখে অবাক হয়েছে।এত পাংকচ্যুয়াল কবে হলো মেয়েটা?সেঁজুতি কাছে আসতেই রুদ্রর মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে এলো। হাতে ফাইল নিয়ে হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এসে রুদ্রর সামনে দাড়িয়েছে সেঁজুতি। অনেক টা ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো মুখ করে সেজুতির পা থেকে মাথা অব্ধি দেখে নিলো রুদ্র।সেঁজুতি শ্বাস টেনে বলল,

‘পাঁচ মিনিটে এসে গিয়েছি স্যার।কোথায় যাবেন
চলুন।
রুদ্রর জবাব এলোনা।সে চেয়েই আছে।সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো। এভাবে কী দেখছেন উনি? রুদ্র গলা ঝেড়ে অন্যদিকে তাকালো।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“মিস সেজুতি!আপনি জামা উলটো পরেছেন….

সেঁজুতির চোয়াল ঝুলে পরলো,
‘এ্যা?
রুদ্র এবার ওর দিক তাকিয়ে বলল,
‘এ্যা নয় হ্যা,,
পড়নের জামার দিকে তাকাতেই লজ্জ্বায় কুঁকড়ে গেলো সেঁজুতি।নিচু মুখ কিছুতেই উঁচু করতে পারলোনা।,সত্যিই জামা উলটো পরেছে।ইশ! এভাবেও বেইজ্জতি লেখা ছিলো কপালে?তাও ওই লোকের সামনে।ছি!

” ঠিক করে পরে আসুন যান।
রুদ্র ভাবলেশহীন। এতে যেন লজ্জ্বা আরো দশগুন বাড়লো সেঁজুতির। একদম মিইয়ে গেলো।
কোনও রকম মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বোঝালো।ঘুরে হোটেলের দিকে পা বাড়াতেই রুদ্র ডেকে বলল,

” কাকের বাসা গুলোও আঁচরে আসবেন।,রুমে নিশ্চয়ই চিরুনির অভাব পরেনি।

সেজুতির এবার অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। এক দৌড়ে ঢুকে গেলো ভেতরে।লজ্জ্বা পেয়েই প্রথমবার কেউ শহীদ হবে দুনিয়ায়।আর সেই কেউটা হবে স্বয়ং সে-ই। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্যে দ্বায়ী করবে কাকে? রুদ্রকে?
সেজুতি যাওয়া মাত্রই হেসে উঠলো রুদ্র। দ্বিতীয় বারের মতো প্রবল হাসিতে মাতলো তার ওষ্ঠ।
হাসি থামছেইনা।পাঁচ মিনিটে রেডি হতে গিয়ে কতোটা নাকানী চোবানী খেলো মেয়েটা।
____
রুদ্রদের সেকেন্ড প্রেজেন্টেশনের সময় ছিলো সকাল দশটা।কিন্তু সেঁজুতি ঘুমোচ্ছিলো দেখে রুদ্র সময়টা চেয়েছে দুপুরে।রুদ্র যেহেতু সফল ব্যাবসায়ী,ভালো নাম ডাক রয়েছে, প্রতিটি প্রোডাক্ট তার চাহিদাসম্পন্ন হয় তাই বিদেশী ক্লায়েন্টরা বিনাবাক্যে মঞ্জুর করলেন।সময় নির্ধারিত হলো দুপুরে।সাড়ে বারোটায়।বারোটা বাজলেও যখন সেঁজুতি উঠছেনা তখন আর উপায় পেলোনা রুদ্র।কয়েকবার দরজা ধাক্কিয়ে,ফোন করেও মেয়েটার সাড়া নেই।শেষে যখন কল রিসিভ হলো তখন ইচ্ছে করেই কাট গলায় কথা বলল।নাহলে তৎক্ষনাৎ সেঁজুতি সিরিয়াস হতোনা।মেয়েদের তৈরি হতে এমনিতেও দেরি হয়।তাই জন্যেই ওভাবে কথা শুনিয়েছে।এবারেও সেঁজুতি ভালো ভাবে প্রেজেন্ট করেছে প্রোডাক্টের সমস্ত ডিটেইলস।বরাবরের মতো আজকেও ডিল এগিয়েছে।সেখান থেকে বেরিয়ে লাঞ্চ করেছে দুজন।এরপর তো হোটেলে ফেরার কথা!অথচ রুদ্র কোথায় একটা নিয়ে এলো সেঁজুতিকে।পার্কের মতোন।জায়গাটা ভীষণ সুন্দর,নিরিবিলি।একদম নদী ঘেঁষে। সেখানেই একটা বেঞ্চের ওপর রুদ্র তাকে বসতে বলল।নিজেও বসলো সচেতন দুরুত্বে।
সেঁজুতি ভাবলো রুদ্র হয়ত আজকেও তাকে ঘুরতে এনেছে।ওইদিনের মতোন।
রুদ্র চুপচাপ বসে ফোন ঘাটছে।তার মনে ঠিক কি চলছে সেই জানে।এদিকে সেঁজুতি বসে থাকতে থাকতে অধৈর্য। উঠে আশপাশটা ঘুরতে চেয়েছিলো,রুদ্র বারন করেছে।বলেছে চুপচাপ বসে থাকুন।অনেকক্ষন পর সেঁজুতি আবার রুদ্রর দিকে ফিরলো,নরম কন্ঠে বলল,

— স্যার।অনেকক্ষন তো হলো,এবার উঠি,,,?
রুদ্রর জবাব,
‘না
‘তাহলে একটু সামনেটা দেখে আসি?
রুদ্র একিভাবে বলল ‘ না।
সেঁজুতি অসহায় কন্ঠে বলল ‘ বসে থাকব এভাবে?
রুদ্র ঘাঁড় বেঁকে তাকালো। ফোন পকেটে ভরে পায়ের ওপর তোলা পা টা হালকা নেঁড়ে সামনের দিকে ফিরলো।শান্ত স্বরে বলল,

‘আপনার থেকে আমার কিছু জানার আছে সেঁজুতি।আমি,আশা করব,শুধু মাত্র সত্যি টাই বলবেন আপনি।

চলবে,

প্রনয় পর্ব-২০+২১

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-২০
সেঁজুতি রুদ্রর ওপর বিরক্ত।ক্রুদ্ধ,ক্ষুব্ধ।এতদিনের বিশেষন গুলোর সহিত আরো একটা বিশেষন যোগ করলো সেঁজুতি। “মুখোশধারী ভদ্রলোক”।মাঝে মাঝে এত ভালো ব্যাবহার করে মনে হয় সত্যিই ভালো উনি।সেকেন্ড যেতে না যেতেই আবার আসল ফর্মে ফিরে আসেন।সেই মেজাজ,সেই রাগ,সেই অহংকার।সেঁজুতি নিজে নিজেই আওড়ালো ‘ অসহ্য! অসহ্য! অসহ্য লোক একটা।কতবার বলল ব্যাথা পেয়েছে, হাটতে কষ্ট হবে।অথচ উনি একটু মায়াও দেখালেন না।এরকম দামী হোটেলে কত রকম ব্যাবস্থা থাকে, উনি চাইলে ঠিক পারতেন কোনো একটা ব্যাবস্থা করে দিতে।তা করবেন কেন? ওনার তো সব সময় মাথায় হাবিজাবি ঘোরে।কীভাবে মেয়ে নিয়ে থাকা যায় এসবে বেশি পটু।ঘুরেফিরে কোলে নেয়ার কথাতো ঠিকই বললেন।লুচু কোথাকার! সেঁজুতির হঠাৎ চা বাগানের কথাটা মনে পড়লো।সাথে সাথে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে পরে।ওরকম নির্লজ্জ্বের মতো সে চেয়ে ছিলো রুদ্রকে দেখে ভাবতেই কেমন কেমন লাগছে।ছি! ভাগ্যিশ সঠিক সময়ে হর্ন বাজালেন ড্রাইভার।না হলে কি হতো?কিন্তু এখানে রুদ্রর দোষ পুরোপুরি নেই।দোষ তারই।সে কেন ওরকম হুশ হারিয়ে বেক্কলের মত দাঁড়িয়ে ছিলো? তাই জন্যেই না এত বড় একটা ব্যাপার চুপচাপ সয়ে গেলো।এ নিয়ে কথা তোলাতো দূর।সে যে এ নিয়ে প্রচন্ড অস্বস্তিতে আছে রুদ্রকে বুঝতে অব্দি দিচ্ছেনা।সেঁজুতি রুমে এসে বিছনায়ায় বসলো।রুদ্র আজকে তাকে চড় অব্দি মারলো।শেষে কীনা বসের হাতে চড়? এখানেও তার দোষ। আজ পুরো দিনটা দোষে দোষে দোষাময়।সেঁজুতি পিঠে হাত দিয়ে মুখ বিকৃত করলো ব্যাথায়।কোমরের কাছ থেকে উরু অব্দি ব্যাথা করছে ভীষণ।সেঁজুতির অসহায় লাগছে এখন।বিকেল তিনটায় আবার মিটিং রয়েছে।কী ভাবে কী করবে? আবার সেই সব রাগ গিয়ে অজ্ঞাত ছেলেটির ওপর জড়ো হলো।পাশাপাশি রুদ্রকেও একটু ভাগ দিলো। তখন দরজায় নক করলো কেউ।একটি মেয়েলী স্বর ভেসে এলো ‘ ম্যাডাম মে আই কাম ইন?
সেঁজুতি উত্তর পাঠালো ‘ আসুন।
হোটেলের নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরা একটি মেয়ে রুমে ঢুকলো।মিষ্টি হেসে বলল ‘ হ্যালো ম্যাম আমি জেনিথ।
সেঁজুতিও হাসলো উত্তরে। মেয়েটির হাত ভর্তি ওষুধ পত্র।টেবিলের ওপর রেখে বলল
‘ ম্যাম আপনি তখন পরে ব্যাথা পেয়েছেন, তাই স্যার পাঠালেন। আপনার ব্যাথার জায়গায় ওষুধ লাগাতে।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো ‘ রুদ্র স্যার?
‘ জী?
সেঁজুতির রাগ চট করে উবে গেলো।প্রচন্ড ভালো লাগলো।মেয়েটি বলল ‘ আমি লাগিয়ে দেব ম্যাডাম? যদি একটু কো অপারেশন করেন?
সেঁজুতি বিনাদ্বিধায় মাথা নাঁড়লো।উরুর দিকে সে পারবে।পিঠের টা মেয়েটাই লাগাক।
মেয়েটি মলম লাগিয়ে কিছুক্ষন ম্যাসাজ করে দেয়।ট্রেতে খাবার এনে ওষুধ খেয়ে নিতে বলে বেরিয়ে যায় রুম ছেড়ে।সেঁজুতি করলোও তাই তাই। তার মন ভালো হয়ে গিয়েছে।রুদ্র আরো একটা ভালো কাজ করেছে মিটিং ক্যান্সেল করে সকাল দশটায় দিয়েছে।সেঁজুতি আবার একী কথা আওড়ালো
‘ যতটা খারাপ ভাবি ততটা একদমই নয়।

______
“Ek pal ka jeena,phir to hain jaana
Tohfa kya leeke jaiyen, dil yehn batana
Khali haath ayee the hum
Khali haath jayeenge….
Bass peyar ke do mitheey bol jhilmilayenge
Toh hass kyun ki duniya ko hain hasana
Aee mere dil tu gaye jaa
Ae aye aoe aye aaa….”

সেঁজুতি মনের সুখে গান গাইছে।এত সুখের গান বেসুরো লাগছে বড্ড।তাতে কী? তার মন ভালো,গান তো সে গাইবেই।রুদ্র দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে সেঁজুতির গান থামার।হাসিও পাচ্ছে ।কিন্তু সে পণ করেছে আর যেখানে সেখানে হাসবেনা।তার গাম্ভীর্য একটু একটু বিলুপ্ত হচ্ছে এই মেয়ের সঙ্গ দোষে।এরকম হলে অফিসের শ’য়ে শ’ য়ে লোককে টাইট দেয়া দুষ্কর হবে।মোটেও এরকম হু হা হাসি তার জন্যে উপযুক্ত নয়।ওদিকে সেঁজুতির থামার নাম নেই।সে গাইছে তো গাইছে।এমন বেসুরো গানে রুদ্র শেষ মেষ ধৈর্য হারালো।দরজা ভেজানো ছিলো। রুদ্র দরজা ঠেলে দিতেই হা করে খুলে গেলো।সেঁজুতি ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বার করছিলো।আপাতত তিন কী চারদিন তারা এখানে।সব ব্যাগ থেকে নামিয়ে নামিয়ে আলমারিতে রাখছে। সাথে গান তো আছেই।রুদ্রকে কীভাবে খেয়াল করবে তাহলে? এই যে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে পকেটে হাত ঢুকিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে সেঁজুতির নজর তখনও পরেনি।রুদ্র অবশেষে মুখ খুলল,

” শুধু কি নেঁচে গেয়েই যাবেন?অফিসের কাজ ও করুন একটু?
রুদ্রর আওয়াজ পেতেই চট করে গান থেমে যায়।সেঁজুতি লজ্জ্বায় চোখ খিঁচে নিয়ে জ্বিভ কাটলো।পেছন ঘুরে তাকায়না।রুদ্র তার গলায় এমন বাজে গান শুনলো? মান সন্মান যা ছিলো সব শেষ।সমাপ্ত।রুদ্র বুঝলো সেঁজুতি লজ্জ্বা পেয়েছে।জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। ইদানীং মেয়েটা কী ভাবছে তাকে নিয়ে সে বুঝতে পারে।কখনও পারেনা।যেমন সকালের ওই বিষয়টা? তখন একটুও বোঝেনি সেঁজুতি এত দ্রুত স্বাভাবিক হতে পারবে।রুদ্র গলা ঝেঁড়ে বলল ‘ আমি কিন্তু দরজায় নক করেছি।আপনি শোনেননি।

সেঁজুতি কপাল কুঁচকে তাকালো।উনি একথা কেন বললেন? আমিতো কিছু বলিইনি।
রুদ্র দু কদম এগিয়ে এলো।একটা ফাইল এগিয়ে বলল,
“,এটা রাখুন।
” এটা কি?
“কালকের প্রেজেন্টেশন এর কপি।আমি সব লিখে দিয়েছি আপনি দেখে ভালো করে শিখে যাবেন।

” কিন্তু, আমি তো প্রেজেন্টেশন এর কপি বানিয়েই রেখেছি।

রুদ্রর সোজাসাপ্টা উত্তর,

” আপনার ওপর কোনও ভরসা নেই আমার,দেখা যাবে পুরোটাই ঘেটে দিয়েছেন
।তাই কোনও রিস্ক না নিয়ে নিজেই তৈরী করে দিলাম।

সেঁজুতির এতক্ষনের ভালো মুড টা যাস্ট ধুঁয়ে গেলো এক্ষুনি।চোখ ছোট করে বলল,
— আপনার মাথায় কি সব সময় আমাকে অপমান করার চিন্তাই থাকে?

রুদ্রর নিরুদ্বেগ জবাব,
‘আমার মাথায় যে ঠিক কি ঘুরছে সেটা সময় হলে আপনাকে জানাব। আপাতত এটা পুরোপুরি শিখে রাখুন।কাল কে সব টা পার্ফেক্ট চাই আমার।

সেঁজুতি মনে মনে সহস্র ভেঙচি কাটলো। যা তা বলল।বকাবকি করলো।রুদ্র দরজা অব্দি গিয়ে ফিরে তাকালো।ঠান্ডা কন্ঠে বলল,

“আর হ্যা, গান গাইতে হলে স্লো ভয়েজে গাবেন।আপনার পাশের রুম টাই আমার।এন্ড আই নিড রেস্ট। এমন কাকের আওয়াজে নিজের ঘুম নষ্ট করতে চাইনা আমি।

রুদ্র চলে গেলো।সেঁজুতি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষন।কথাটা শুনে মুখ হা করে ফেলেছিলো একদম।কিছু বলতেও পারলোনা রুদ্র চলে যাওয়ায়।দুঃখে, কষ্টে কাতর হয়ে ফাইল টাকে বিছানার ওপর ছুড়ে মারলো।ফোসফোস করে বলল,

“কি বলে গেলেন উনি?? কি বলে গেলেন টা কি?? আমি কাক? আমাকে কাক বললো?আমার আওয়াজ কাকের আওয়াজ?

সেঁজুতি এবার রুদ্রকে শোনানোর মিথ্যে চেষ্টায় দরজার দিকে মুখ বাড়িয়ে বলল,
‘আমি তো তাও ওই কাকের আওয়াজে গান গাইতে পারি।আপনি তো খালি অর্ডার করা ছাড়া কিছুই পারেন না।আমাকে ডিজগাস্টিং বলেন না?নিজেই সব চেয়ে বড় মাপের ডিজগাস্টিং। কে বলেছিলো পাশাপাশি রুম নিতে?এতো দূরে এসেও একটু শান্তি মতো থাকতে পারবনা জানলে ছাদের চিলেকোঠায় রুম নিতে বলতাম আমি।

অনেকক্ষন নিজের মতো বকবক করে ক্ষান্ত হলো সেঁজুতি। আড়মোড়া ভেঙে বলল,

‘বড্ড ক্লান্ত লাগছে!একটা জবরদস্ত ঘুম দরকার।এত্তো জার্নি,,তার ওপর আবার একটা চড় ও খেলাম!গালের চামড়া বোধ হয় ছিলে গিয়েছে আমার।কারো মারে এত ব্যাথা? সেঁজুতি গালে হাত ডলতে ডলতে ভাবল।
______
সেঁজুতি এক ঘুমে রাত পার করেছে।রাতে রুদ্র এতবার কল দিয়েছে,দরজায় নক করেছে খাওয়ার জন্যে বেচারী ঘুমের মধ্যে কিছুই টের পায়নি।সকালে ফোন দেখে চক্ষু চড়কগাছ। ফ্রেস না হয়েই দৌড়ে রুদ্রর রুমে যেতে গেলো।রুদ্র ও মাত্র বেরিয়েছে। আর ওমনি রুদ্রর সাথে ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পরলো।রুদ্র ধরাতে বেঁচে গেলো যদিও।সেঁজুতির ওই খেয়াল নেই। সে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল ‘ স্যার আপনি কল দিয়েছিলেন? আমি একদম শুনতে পাইনি।স্যরি স্যার!

রুদ্র তখন অন্য কোথাও।নিজের মধ্যে নেই।সেঁজুতির ঘুমুঘুমু চেহারা,আর এলোমেলো চুল তলোয়ারের মতো খন্ড বিখন্ড করে দিচ্ছে তাকে।ঘুম থেকে উঠলে এত মায়াবী লাগে কাউকে?সেঁজুতি উত্তরের আশায় ড্যাবড্যাব করে চেয়ে ছিলো।ইদানিং রুদ্র চুপ মেরে যায় হঠাৎ। সেঁজুতির একদম ভালো লাগেনা।ঝড় আসার আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত থাকে তার কাছেও রুদ্রর চুপ থাকা ওরকম লাগে।ভেতরে ভয় লাগে।যতই লোকটাকে তার অপছন্দ হোক, সে ভয় পায়।ওনার একটা ধমকে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।জন্মের পর থেকে যদি কারো ধমক শোনে তাহলে সেটা রুদ্রর।শুধুকী ধমক? এখন তো এই লিস্টে একটা থাপ্পড় ও যোগ হয়েছে।রুদ্র কিচ্ছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছে।তাও অনেকক্ষন।সেঁজুতি যখন ঠোঁট কামড়ে ভাবছিলো সে আর দাঁড়াতে পারেনি।এই মেয়ে তার দূর্বলতা।আর সেই দূর্বলতা সে পায়ে ঠেলে অস্বীকার করতে যত চায় তত যেন সাপের মত গলা পেঁচিয়ে ধরে।সেঁজুতির যখন খেয়াল পরলো রুদ্র চলে গেছে।সে বোঁকার মত দাঁড়িয়ে থাকলো তাও।রুদ্র রুমে ঢুকে রীতিমতো দরজা লাগিয়ে দিয়েছে মুখের ওপর।সেঁজুতি মুখ কালো করে রুমে ফিরে আসে।ভাবলো,হয়ত ফোন না ধরায় রুদ্র রেগে আছে।তাই এখন তার চটপট রেডি হতে হবে।কারন আজকের মিটিংয়ে দেরি করলেই রুদ্র তাকে সিলেটের পাহাড় থেকে নিঁচে ফেলে দেবে।ড্যাম শিওর।

দশটায় মিটিং। তাদের রওনা দেয়ার কথা নটায়।নটা বাজার আগেই নিজেকে একেবারে গুছিয়ে নিচে নামলো।সেঁজুতি।তার বসের টাইম সেন্স ভীষণ ভালো।এক কথায় পাংকচ্যুয়াল বয়।আর সেখানে তার পি এ হয়ে সে কীনা আস্ত একটা লেট লতীভ?ছি!

‘হ্যালো মিস সেঁজুতি।
সেঁজুতি পেছন ফিরলো।কালকের ধাক্কা খাওয়া সেই ছেলেটি।হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

“আপনি?

” জ্বি। আমিও এখানেই উঠেছি।

“ও।
“কালকের জন্যে কী এখনও রেগে আছেন??

সেঁজুতি ফাইলটা বুকের সাথে চেপে দাঁড়ালো।ভ্রু গুটিয়ে বলল,
“যদি ইচ্ছাকৃত ধাক্কা দিয়ে থাকেন তাহলে রেগে আছি।
ছেলেটি মুচকি হাসলো।সেঁজুতির হাসিটা পরিচিত লাগলো। এমনিতেও ছেলেটির চেহারায় কাউকে মনে পড়ছে।
সেঁজুতি কে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে ছেলেটির হাসি আরো বাড়লো।হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমি আবির…

সেঁজুতি কেমন চমকে বলল ‘ আবির?

ছেলেটি ভ্রু কোঁচকালো ‘ নাম শুনে অবাক হলেন যে?অনেক খারাপ নাম বুঝি?

সেঁজুতি হেসে ফেলল – না আসলে তা নয়। এই নাম টা আমার খুব পরিচিত একজনের।আপনার সাথে ওর চেহারাটাও মিলছে তাই…

” ভাবছেন সেই আমি কীনা?
” না। আপনি সে হওয়ার চান্স নেই।কারন সে আপাতত বিদেশ বিভূঁইয়ে।

ছেলেটি ছোট করে বলল,
‘ ওহ।পরপর প্রশ্ন করলো,
“আচ্ছা কাল কের লোকটা কে ছিলো?আপনার হাজবেন্ড তো মনে হলোনা।আপনি করে বলছিলেন দুজন দুজন কে।

” উনি আমার বস।আমি তার এসিস্ট্যান্ট।

‘ ওহ আই সি।অফিস্যিয়্যাল কাজে আসা?
‘ জ্বী।
“আমিও তাই।
‘আচ্ছা।

রুদ্র তখন লিফট থেকে বেরিয়েছে।গ্রাউন্ড ফ্লোরে এসে সেঁজুতি কে দেখলো।পাশেই গতকালকের ছেলেটি।দুজনের এত হাসিহাসি আলাপে রুদ্র থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। সেঁজুতি রুদ্রকে খেয়াল করেনি।আবির ও না।রুদ্রর যেন মেজাজ আরো বিগড়ালো এতে।গল্পে এত মজেছে যে আমাকে দেখছেইনা?রুদ্র দাঁত চেপে বিড়বিড় করলো,
“এক ধাক্কায় হাসি উপচে পরছে তাইনা?

গটগটিয়ে হেটে বাইরে বেরিয়ে এলো রুদ্র।
সেঁজুতি বারবার ঘড়ি দেখছে।নটা দশ বাজে অথচ উনি আসছেন না কেন?আবির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছে।সৌজন্যতায় সেঁজুতি চলে যেতেও পারছেনা।হঠাৎ
একজন স্টাফ এসে বললেন,
“ম্যাম আপনাকে স্যার ডাকছেন।
সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন উনি।সেঁজুতি ভাবলো রুদ্র রুমে ডেকেছে।বলল
” আচ্ছা যাচ্ছি।

সেঁজুতি লিফটের দিকে যেতে উনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,
-“ম্যাম রুমে নয়।স্যার তো বাইরে।গাড়িতে।

সেঁজুতির চোখ আকাশ ছুঁলো ‘ কী? কখন গেলেন?

‘এইতো দশ মিনিট হবে।
সেঁজুতি মাথায় হাত দিলো
” ইয়া মাবূদ।
ওভাবেই ছুট লাগালো সেঁজুতি। তাড়াহুড়োয় আবিরের থেকে বিদেয় ও নেয়নি।সেঁজুতির দৌড়ে যাওয়া দেখে হাসলো আবির।

রুদ্র গাড়িতে বসে ফুঁসছে রাগে।এত হাসি কীসের?অচেনা অজানা ছেলের সঙ্গে দাঁতের দোকান খুলে বসেছেন উনি।কই, আমার সাথে কথা বলতে এলে তো এর ছিটেফোঁটাও থাকেনা।কাজের কথা ছাড়া একটা কথাও বলেন না আমার সাথে।ওই ছেলে কী আমার চেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম? বেশী সুদর্শন?
রুদ্র ভিউ মিররে নিজেকে দেখলো।তাকে একটুও সুন্দর লাগছেনা মনে হচ্ছে।ছোট বেলা থেকে চেহারা নিয়ে শুনতে শুনতে কান পাঁকানো লোকটার আজ প্রথম বার নিজেকে অসুন্দর মনে হলো।সে যদি ড্যাশিং হতো,হ্যান্ডসাম হতো সেঁজুতি নিশ্চয়ই তাকাতো।তাইনা?
তখনি হন্তদন্ত পায়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে বসে পরলো সেজুতি।হাপাতে হাপাতে বলল,
” স্যার আপনি কখন এলেন?আমিতো….

“আপনি তো ব্যস্ত ছিলেন তাইনা,,তাহলে কিভাবে দেখবেন?
রুদ্র ওকে থামিয়ে দাঁত চিবিয়ে বলল।

সেঁজুতি চোখ পিটপিট করে বলল,” না স্যার। ব্যস্ত কই ছিলাম?আমিতো গ্রাউন্ড ফ্লোরে দাঁড়িয়ে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।
রুদ্র ভ্রু বাঁকালো ‘ তাই? শুধুই অপেক্ষা করছিলেন?

সেঁজুতি মাথা দুলিয়ে বলল ‘ হ্যা। তখন ওই কালকের ছেলেটি মানে আবি…

‘ চুপ করুন।

রুদ্র ধমক দিতেই সেঁজুতি চুপ মেরে গেলো।সেঁজুতি ভাবছে কল না ধরায় রুদ্র এখনও রেগে আছে। নীঁচু কন্ঠে বলল
‘ স্যরি স্যার! আমি সত্যিই আপনার কল শুনতে পাইনি।আপনি এভাবে রেগে থাকলে আমার প্রেজেন্টেশন খুব খারাপ হবে।
সেঁজুতি অতী নরম সুরে বলাতে রুদ্রর রাগ পরে গেলো।একটু আকটু খুশিও হলো।সে রাগ করলে সেঁজুতির প্রেজেন্টেশন খারাপ হবে? কথাটা নিজের মতো সাজিয়ে ফুরফুরে মনে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
_____
চার ঘন্টা পর অফিস থেকে বের হলো রুদ্র সেজুতি। সেজুথির মন ভালো।ভালো মানে অনেক ভালো।এই প্রথম বার সে প্রেজেন্টেশন দিলো আর তাতেই ডিল ফাইনাল হয়েছে।সবাই বেশ প্রশংসাও করেছে।সেঁজুতি একবার চোখ তুলে রুদ্রকে দেখলো।যা কিছু ক্রেডিট সব ই তো ওনার।
ওতো কিছুই করেনি।উনি লিখে দিয়েছেন বলেই শিখতে পারলো।এখন তার মনে হচ্ছে রুদ্র কপি নিজে থেকে করে দেয়ায় তার জন্যে ভালো হলো।,নাহলে সে যা লিখেছিলো প্রেজেন্টেশন দেবে বলে, ইয়া আল্লাহ! ওসব শুনলে আজ চাকরিই থাকতোনা।ডিল তো বহুদূরের ব্যাপার।রুদ্রর কপির সাথে তার কপির কোনো মিলই নেই।আকাশ পাতাল তফাৎ। হওয়ারই কথা।এই পদে চাকরি পেতে গ্রাজুয়েশন লাগে। আর সেখানে সে মাত্র সেকেন্ড সেমিস্টার। তাও পার করেনি।কত কিছুই ভালমতো জানেনা।তাও পরশুরাতে গুগল ঘেয়েঘুটে,নিজের মতো করে কোনো রকমে সাজিয়েছিলো।ভাগ্যিশ ওসব বলতে হয়নি।আল্লাহ বাঁচিয়েছেন।রুদ্র চুপচাপ। তার হেলদোল পৃথীবিতে নেই।সেঁজুতি জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু হয়েছে স্যার?
রুদ্র ছোট করে বলল ‘ না।

“আমার পার্ফমেন্স ভালো হয়নি?

— হয়েছে।
সেঁজুতি খুশি হয়ে বলল,
— আচ্ছা। তবে সব টাই আপনার জন্যে।আপনি কপি করে না দিলে…
রুদ্র দাঁড়িয়ে পরলো।ভ্রু কুঁচকে বলল,
” আমার একার কেন হবে?এটার ক্রেডিট পাশাপাশি আপনারও।লিখে দিলেই হলোনা।প্রেজেন্ট করতে পারাটাই বড় ব্যাপার।তাছাড়া আপনার উচ্চারন, বলার ভঙি ভালো ছিলো বলেই ওনারা ব্যাপারটা গুছিয়ে বুঝেছেন।

সেঁজুতি মিষ্টি করে হাসলো।রুদ্র সময় নিলো একটু।পরক্ষনেই চোখ সরু করে বলল,

— ছেলেটির সাথে কি বলছিলেন?

” কোন ছেলে স্যার?

“সকালে হোটেলের সেই ছেলেটা?

-“ওহ ওই উনি?তেমন কিছুনা, যাস্ট নাম ধাম জিজ্ঞেস করছিলেন।

” আর আপনিও বললেন?

“হ্যা…

“কেনো?

“নাম জিজ্ঞেস করলে বলতে হয়না?

“না হয়না।এটা ডিপেন্ড করে কে জিজ্ঞেস করছে তার ওপর? আমি জিজ্ঞেস করলে বলবেন।বাট ওই ছেলে গুলোর মত কেউ জিজ্ঞেস করলে নয়।
রুদ্র হনহনিয়ে হাটা ধরলো।সেঁজুতি কিছুই বোঝেনি।সব মাথার ওপর দিয়ে গিয়েছে।রুদ্র যেতে যেতে বলল

” চলুন।ইটস লাঞ্চ টাইম।
_____
রেস্টুরেন্টে বসে আরেক ঝামেলায় পরলো সেজুতি।,সব গুলো কন্টিনেন্টাল খাবার আইটেম অর্ডার করেছে রুদ্র।ইন্ডিয়ান ফিস কারী,ইন্ডিয়ান চাপলী কাবাবের সাথে গ্রীল্ড স্যামন উইথ গ্রীন পি ম্যাশ এন্ড স্ট্রবেরী কম্পোট।সেঁজুতি হাত কঁচলাচ্ছে বসে বসে।রুদ্র আরামসে খাচ্ছে।সেঁজুতি উশখুশ করছে।খিদে লেগেছে অথচ খেতে পারছেনা।
প্রথমত দুপুরে ভাত ছাড়া তার চলেনা।তাও একটু এডযাস্ট করা যেতো যদি অন্য খাবার হত।
মাটন তো সেজুথি খায় না,গা গুলোয়।সাথে স্ট্রবেরীর ঘ্রানেও একি অবস্থা। তাহলে কি করে খাবে সে?
তাই হাত গুটিয়ে বসে থেকে চুপচাপ রুদ্রর খাওয়া দেখছে।রুদ্র প্লেটে চামচ নাড়তে নাড়তে বলল,

— খাচ্ছেন না যে!

সেঁজুতি মাথা নিচু করে বলল “এমনি।
রুদ্র খাওয়া থামিয়ে তাকালো।
-” ভাত খাবেন?
-চোখ গুলো চকচক করে উঠলো সেজুতির।রুদ্র আবার জিজ্ঞেস করলো,
” ভাত খাবেন বা অন্য কিছু??

সেঁজুতি মাথা নেড়ে বলল ‘ ভাত।
“এটা এতক্ষনে বললেই পারতেন।এমনিতে তো প্রচুর বকবক করেন।তাহলে কাজের কথা বলার সময় এই অবস্থা হয় কেন?বসুন,আমি অর্ডার করছি।
রুদ্র অন্যদিকে তাকাতেই সেঁজুতি মুখ ব্যাঁকালো।

” খাওয়াবে ঠিকই কিন্তু কথা শোনাতে ছাড়বেনা।

সেঁজুতির এতক্ষন ধরে একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো।রুদ্র চুপ করে খাচ্ছিলো বলে প্রশ্ন করেনি।রুদ্র যখন কথা বলল মাত্র, তাই সুযোগ বুঝে বলল,
“আচ্ছা, এখানে এসে সবাই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলো খায়।তাহলে আপনি এসব কেনো খাচ্ছেন.??

রুদ্রর নিরুৎসাহিত উত্তর,
“আই এ্যাম নট ইন্টারেস্টেড ইন ট্রেডিশনাল ফুড।

সেঁজুতি বিড়বিড় করে বলল,
” হ্যা হ্যা। কোনও কিছুতেই এর ইন্টারেস্ট নেই। শুধু মেয়ে ছাড়া।
সেঁজুতির সামনে এনে রাখা হলো এক প্লেট গরম ধোয়া ওঠা ভাত।মুরগীর মাংস,ইলিশ মাছ,চিংড়ি ভর্তা আর সালাদ।সেঁজুতির জ্বিভে পানি এসে গেলো খাবার দেখে।এক প্রকার ঝাপ দিলো প্লেটের ভেতর।
খাওয়া শেষে সিলেটের ঐতিহ্য অনুসারে পান দেয়া হলো ওদের।রুদ্র খেলোনা।সেঁজুতি অভিভূতের মতো পান চাঁবাচ্ছিলো।সাথে পানের বোটায় চুন লাগিয়ে একটু করে খাচ্ছে।ঠোঁট জ্বিভ, সব লাল টুকুটুকে।রুদ্রর বেশ ভালো লাগছে দেখতে।সেঁজুতি পিক ফেলতেই রুদ্রর ভালো লাগা শেষ। উলটে গা শিরশির করলো। ‘ ইয়াক! বলে মুখ ঘোরালো আরেকদিক।সেঁজুতি বোকা বনে গেলো।পানের পিক দেখে কেউ এমন করে?

দুপুরে খাওয়ার পাঠ চুকলো।গাড়িতে বসার আগে সেঁজুতি বলল,
“আমি একটু আসছি।বাবাকে একটা ফোন করবো…
রুদ্র কিছু বললনা।সেঁজুতি কথা শেষ করে এসে গাড়িতে বসলো।রুদ্র তখন থমথমে গলায় বলল,
“আপনি আপনার বাবাকে খুব ভালোবাসেন তাইনা?
সেঁজুতি প্রথমে অবাক হলো হঠাৎ এমন প্রশ্নে।পরে হেসে বলল,

“ভীষন! শুধু আমি কেন? পৃথিবীর সব সন্তান তার বাবা মাকে ভালোবাসে।তাইনা?

তাইনা বলে সেঁজুতি রুদ্রর দিক তাকালো।রুদ্র মাথা নিচু করে আছে।ভেতরটা কাঁদছে খুব,
” ভালোবাসার আগেই যে সব তছনছ হয়ে গেলো।
” কি ভাবছেন?

রুদ্র সামনে ফিরে বলল
“কিছুনা।
“এখন আমরা কোথায় যাবো.??
“আপাতত হোটেলে।
_____
সারা রাস্তায় রুদ্র চুপ ছিলো।সেঁজুতি কে তোহা ফোন করে জানিয়েছে পরীক্ষার রুটিন বেরিয়েছে।সেঁজুতি জানালো সিলেট থেকে ফিরেই ভার্সিটি যাবে ও।চাকরীর কথা বলে, নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে স্যারদের থেকে একটু সহযোগিতা পেয়েছে সেঁজুতি। ক্লাস মিস করার ফলে পরীক্ষায় বসতে না দেয়ার ব্যাপারে ওনারা ছাড় দিয়েছেন।সেঁজুতি ভালো ছাত্রী।সাথে বাবার অবস্থা জেনেই ওনার এই বিশেষ সুযোগ টুকু দিয়েছেন ওকে।তোহার সাথে কথা বলতে বলতেই হোটেলে এসে পৌছালো ওরা।রুদ্রর মন তখন বিষন্ন।গাড়ি থেকে নেমে হাটা ধরলো সেজুতি।রুদ্র গাড়ি নিয়ে এগোলো পার্কিং লটে।সেঁজুতি ভেতরে ঢুকতে যেতেই সামনে এসে দাড়ালো আবির।হেসে বলল,
“এসে গেছেন??

আবির হঠাৎ সামনে আসায় সেঁজুতি চমকেছে।বিদ্যুৎ বেগে নিজেকে সামলে মৃদূ হাসলো,
” আপনি কি আজ আর ওপরে যাননি? তখনও গ্রাউন্ড ফ্লোরে এখনও তাই।

আবির স্পষ্ট বলল,
“আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

সেঁজুতি ভ্রু বাঁকালো,মুখের হাসিটা নেই।
” আমার জন্যে?
আবির থেমে থেমে বলল,
” আসলে এখানে একা এসেছি তো!সময় টা বোরিং যাচ্ছে,আপনার সাথে পরিচয় হলো ভাবলাম আপনার সাথেই গল্প করে কাটাবো।
আপনার কোনও অসুবিধে নেইতো?
সেজুথি কিছু বলার আগেই পাশ থেকে রুদ্র বলে ওঠে ‘ অবশ্যই আছে।

রুদ্র সেঁজুতির পাশে এসে আবির বরাবর দাঁড়ালো।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” এখানে উনি কাজ করতে এসেছেন।কারো সাথে খোশগল্প করতে নয়।

আবির নাক ফোলালো।মেজাজ দেখিয়ে বলল,
“কথাটা তো আমি আপনাকে বলিনি। তবে আপনি কেনো ওনার হয়ে কথা বলছেন?

‘কারন আমি ওনার,বস…
বস কথাটা রুদ্র সময় নিয়ে বলল।আবির কাট গলায় বলে,
“হ্যা, বস তো কাজের সময় ওনাকে পেলেই হলো।আপনার কাজ পার্ফেক্ট হওয়াটাই দরকার আপনার। তারপর উনি কার সাথে মিশবেন বা কথা বলবেন,,সেটা কি আপনি দেখতে আসবেন নাকি?

রুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে।
“আমি কি করবো না করবো তার হিসেব আপনি নেবেন না নিশ্চয়ই?আর কাল -ই তো ওনাকে দেখলেন এর মধ্যেই গল্প করার জন্যে ডাকছেন?,বেশ এডভান্স দেখছি আপনি!

‘ আমি আমার সার্টিফিকেট আপনার থেকে নেবোনা।অফিসের বস বসের মতোই বিহেভ করুন।
রুদ্র ভ্রু নাঁচালো।হাত মুঠো হলো।
‘তো এখন আপনি আমাকে বিহেভিয়ার শেখাচ্ছেন?
আবির মুখের ওপর বলল
“হ্যা শেখাচ্ছি…

সেঁজুতি এতক্ষন ভ্যাবলাকান্তের মত দাঁড়িয়ে ছিলো।বলদ বনে গেছিলো কিছু সময়ের জন্যে।দুজনের তর্ক যখন মাত্রা ছাড়াচ্ছে তখনি চেঁচিয়ে, বিরক্তি নিয়ে বলল,

” চুপ করুন, চুপ করুন।কি করছেন আপনারা?ঝগড়া করছেন বাচ্চাদের মতো?এখানে কী বিতর্ক প্রতিযোগিতা হচ্ছে?
সেঁজুতি এরপর আবিরের উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে বলল,
“মি:আবির!আমি আসলে গল্প, আড্ডা এসবে অভ্যস্ত নই।আর এখানে সত্যিই আমি কাজের জন্যে এসেছি। সো এটাই এখন আমার একমাত্র মোটিভেশন।আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।

রুদ্রর দিকে একবার তাকালো সেজুতি।সে সানগ্লাশ পরে ঠিক কোন দিকে তাকিয়ে তা ঠাওড় করতে পারলোনা।আর কথা না বাড়িয়ে লিফটে উঠে গেলো।
সেঁজুতি আঁড়াল হতেই রুদ্রর ঠোঁটে সূক্ষ্ণ হাসি ফুটলো।বিদ্রুপ করে বলল,
“দেখলেন তো মি:আবির? পি এ কিন্তু শেষ মেষ তার বসের মানে আমার কথার বাইরে যায়নি।
আর হ্যা আপনি কি যেনো বললেন বসকে বসের মতো বিহেভ করতে,,,??
আমি তো সেজুতির নামে মাত্র বস,,,ভেতরে তো অন্য কিছু।

আবিরের মুখটা চুপসে ছিলো এত সময়। রুদ্রর শেষ কথায় কপাল কুঁচকে বলল,
“অন্য কিছু মানে?
রুদ্র চোখের চশমা একটু ঠেলে দিয়ে গমগমে কন্ঠে বলল,
” সেটা আপনাকে বলার প্রয়োজন বোধ করছিনা।

রুদ্র চলে যেতেই দু আঙুলে নিজের কপাল ঘষতে শুরু করলো আবির।
“এই বস কে তার ঠিক লাগছেনা,,,,,ভেতরে অন্য কিছু দিয়ে কি বোঝালো এই লোকটা??
কি থাকতে পারে এদের মধ্যে??
#প্রনয়?? সেজুতি আর রুদ্রর #প্রনয়…??
________
ফোনের রিংটোনের শব্দে তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো সেঁজুতি। ফোন তুলতে যাওয়ার আগেই লাইন কেটে গেলো।রুদ্রর কল।সেঁজুতি ব্যাক করার আগে আবার দরজায় নক করার শব্দ।সেঁজুতি উপায়ন্তর না পেয়ে দরজা খুলতে এগোলো।রুদ্র পকেটে হাত দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো।পড়নে চেক শার্ট আর ব্লাক ডেনিম প্যান্ট।দরজা খোলার আওয়াজে তাকাতেই সদ্যস্নাত সেজুতিকে দেখে গলা শুকিয়ে এলো।এরকম প্রত্যেকবারই হচ্ছে।অফিসেও তার এমনহয়েছে।এই মেয়েকি তাকে মারার প্ল্যান করছে ইদানীং। রুদ্র ঢোক গিলে মুখ ফিরিয়ে বলল,
“ফোন রেখে কই ছিলেন??

“শাওয়ার নিচ্ছিলাম স্যার।

“রেডি হয়ে নিচে আসুন,ফাস্ট।

আর এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে প্রস্থান নিলো রুদ্র। ঠোঁট উলটে কিছু না বুঝতে পারার ভঙ্গিমা করলো সেঁজুতি। আরতো কোনো মিটিং নেই।কাজ ও নেই এখন।সন্ধ্যে হয়ে এসছে।উনি আমাকে নিয়ে কোথায় যাবেন তাহলে?

চলবে….

#প্রনয়
এর ২১ পর্ব রেস্ট্রিকটেড। ডিলিট করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ওটাত আবার নতুন করে লেখা সম্ভব নয় তাই আমি ছোট্ট করে বর্ননা করে দিচ্ছি,যাতে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হয়।

”রুদ্র সেঁজুতির প্রতি অনুভূতি নিয়ে চিন্তিত অনেক।সে চায়না তার কোনো কিছু অনুভব হোক মেয়েটির প্রতি।কিন্তু অবাধ্য অনুভূতিরা না শোনায় রগচটা রুদ্র নিজের প্রতিই বিরক্ত হয়।রেগে যায়।সেঁজুতিকে ঘুরতে নিয়েও মাঝপথে ফিরে আসে তাই।এমনকি সারা দিনেও সেঁজুতির সামনে যায়নি।হোটেলের রুমবন্দি বসে ছিল।সেঁজুতিতো আর ওসব জানেনা।তার চিন্তা হতে থাকলো।রুদ্রর কিছু একটা হয়েছে ভেবে সিদ্ধান্ত নিল একবার রুমে গিয়ে দেখবে।চিন্তামতো রুদ্রর রুমে এসে দেখলো রুদ্র নেই।তখনি রুদ্র ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হলো।উদাম গা, তোয়ালে পেঁচানো শুধু।সেঁজুতি লজ্জ্বা পেয়ে মুখ ঘোরাতেই রেগে থাকা রুদ্র আরো রেগে গেল।মুখে যা এলো তাই শোনালো সেঁজুতিকে।সেঁজুতি কষ্ট পেয়ে নিশ্চুপভাবে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। রুদ্রর তারপর থেকে খুব অনুতাপ বাড়ে।সে নিজের প্রতি ক্ষুব্ধতায় মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে। রাতে সেঁজুতির রুমে আসে।
মাতাল রুদ্র সেঁজুতির কোলে শুয়ে বায়না ধরে মাথায় হাত বোলাতে।সাথে সে গল্পও বলবে।সেঁজুতি রুদ্রর সাথে না পেরে রাজি হয়।রুদ্র রাজকুমারের আকারে তার ছেলেবেলার গল্প বলে।
তার মায়ের অবৈধ সম্পর্ক থাকে তার বাবার বন্ধুর সঙ্গে। এক সময় তার বাবা জেনে যায় আর নিজ হাতে দুজনকে খু’ন করে।আর রুদ্র বড় হয় তার দাদা -দাদুর কাছে।কিন্তু রাজকুমারের ছলে বলায় সেঁজুতি বুঝতে পারেনা যে এটা রুদ্রর নিজেরই গল্প।না জেনেই সে কেঁদে ফেলে।
রুদ্রর মাথা কোলে নিয়ে ওভাবেই বসে থাকে।আর রুদ্র ঘুমিয়ে যায় ও ঘরে।
এই হলো ২১ পর্বের কাহিনী 😇

প্রনয় পর্ব-১৯

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব-১৯

“রুদ্র চড় মেরেছে,রুদ্র চড় মেরেছে”সেই তখন থেকে কানের পাশে ভনভন করে ঘুরছে কথাটা।
গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে রুদ্রর দিকে চেয়ে আছে সেঁজুতি।শক্ত হাতের শক্ত চড়ে এত ব্যাথা?ছোট বেলা থেকে বাবার আদূরে মেয়ে বলে আমির ঘুনাক্ষরেও মেয়ের গায়ে হাত তোলেননি।সেঁজুতিও জানেনা মার কাকে বলে!বিশ বছর বয়সে এসে একটা পুরুষের হাতে চঁড় খেয়ে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম।পাথরে পরিনত হয়েছে যেন।মূর্তির মতো রুদ্রর শক্ত চোয়াল দেখছে সে।রুদ্রতো এমনিই রেগে ছিলো।সেঁজুতি নিরুত্তর দেখে রাগ যেন বেশি চাপলো মাথায়।মুহুর্তেই দুহাতে সেঁজুতির কাঁধ ঝাকিয়ে বলল,
‘এই মেয়ে কোনও সেন্স নেই তোমার?এরকম একটা অচেনা জায়গায় এত সাহস নিয়ে এত দূর চলে এলে? তাও এই ফালতু প্রজাপতি ধরতে?আর ইউ লস্ট ইওর মাইন্ড?হ্যাভ ইউ এনি আইডিয়া আমি তোমায় কতক্ষন ধরে খুঁজে যাচ্ছি?কত চিন্তা হচ্ছিলো,ভয় পেয়েছি আমি জানো? জানো তুমি?
কোনো মূল্য নেই আমার কথার?তোমাকে নঁড়তে বারন করেছিলাম তো ওখান থেকে।করেছিলাম না বারন?? আন্সার মি ড্যামেট!
রুদ্র চিৎকার করতেই সেঁজুতি থরথর করে কেঁপে উঠলো।রুদ্র রাগে হিঁসহিঁস করছে।চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে।অধিক ক্রোধে প্রথম বার সেঁজুতি কে তুমি করে বলেছে।কিন্তু সেসবে কী খেয়াল আছে মেয়েটার?সেঁজুতি কিয়ৎক্ষন হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থেকেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো।থতমত খেলো রুদ্র।বোঁকা বনে গেলো কিছু সময়ের জন্যে।এতক্ষন রাগের মাথায় কি করেছে টনক নড়লো এবার।মনে মনে আওড়ালো
শীট!শীট! শেষে কিনা চঁড় মেরে বসলাম!
সেঁজুতি বাচ্চাদের মতো কাঁদছে।ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে।রুদ্র অসহায় চোখে তাকালো।ভীষণ আফসোস হচ্ছে এখন।এসেছে নাহয় একটু দূরে।এত্ত রিয়্যাক্ট করার কি ছিলো? মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখলেই পারতি রুদ্র।ইশ! কি বাচ্চার মত কাঁদছে,নিশ্চয়ই অনেক ব্যাথা পেয়েছে।
সেঁজুতি হেঁচকি তুলে ফেলল।কাঁদতে কঁাদতে চোখ ডলে বলল ‘ আমমি জীবনে কখনও মার খাইনি।
রুদ্রর আফসোস আরও বাড়লো,মোলায়েম কন্ঠে বলল,
প্লিজ কাদবেন না!আমি ইচ্ছে করে মারিনি।আসলে তখন আপনাকে না দেখতে পেয়ে..আমি আসলে,,, ইয়ে…ওই….

সেজুতির কান্না থামার নাম নেই।এমন কান্নায় রুদ্রর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।সব সময় গুছিয়ে কথা বলা লোকটাও হিমশীম খাচ্ছে সান্ত্বনা দিতে।নির্জন চা বাগানে সেঁজুতির কান্নার শব্দ বাড়ি খাচ্ছে এদিক ওদিক।রুদ্র অনেকক্ষন সেঁজুতির কান্না দেখলো।এই মেয়ে আর থামবে না বোধ হয়।রুদ্রর এবার বিরক্ত লাগলো।একটা চড়ে এত কাঁদতে হয়? আর সে কিনা কদিন আগেই সেঁজুতির নিজেকে সামলানোর ক্ষমতায় অভিভূত হলো?রুদ্রর ভেতরের সত্ত্বাটা চেঁচিয়ে বলল,

‘ উফফ রুদ্র!ঝোকের বশে একটা নন স্টপ এফ -এম চালু করে দিলি তুই।কি করে থামাই এখন?
রুদ্র আগের থেকেও নরম কন্ঠে বলল,
‘শুনুন প্লিজ! সেঁজুতি? আমার কথাটা শুনুন।
প্রথম দিকে শান্তস্বরে বলল। সেঁজুতি থামছেনা।রুদ্র এমনিতেই বদরাগী।আবার খেই হারালো মেজাজের।
‘ যাস্ট স্টপ ইট ড্যামেট,,থামতে বলেছিতো আপনাকে…
রুদ্রর একটা ধমকই যথেষ্ট।কেঁপে উঠে চুপ করে গেল সেঁজুতি। রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই আবারও আগের মত ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। হাল ছেড়ে দিলো রুদ্র।
‘ কাঁদুক উনি।যত ইচ্ছে কাঁদুক।
রুদ্র এক হাত ভাঁজ করে আরেক হাতে থুতনী ঘষে সেঁজুতির দিকে মন দিলো।খেয়াল পরলো সেঁজুতির কানে একটা বুনো ফুল গুঁজে রাখা।কান্নায় নাকের ডগা টা লাল হয়ে উঠেছে।চোখের পাপড়ি গুলো ভিজে চুপচুপে।ঠোঁট ভেঙে, চোখ বুজে হেচকি তুলে কাঁদছে।এর আগেও বহুবার সেজুতিকে কাঁদতে দেখেছে রুদ্র।তবে সে কান্নায় বড্ড ম্যাচুরিটি ছিলো।যার ছিটেফোটাও আজ নেই।
সেঁজুতির বাচ্চা বাচ্চা ভঙিমায় প্রচন্ড হাসি পেলো রুদ্র।আজ আর আটকাতে পারলোনা।পেট ফেঁটে বেরিয়ে এলো।হু- হা করে হেসে ফেলল রুদ্র।আচমকা হাসিতে সেঁজুতির কান্না থেমে গেলো।বিস্ময় ছেয়ে এলো চোখ জোড়ায়। এক মাসের মধ্যে এই প্রথম রুদ্রকে এভাবে হাসতে দেখে আশ্চর্যকিত হয়ে তাকিয়ে রইলো।আপনা আপনি তার ঠোঁটেও হাসি ফুটলো।অভিভূতের মতো দেখছে রুদ্রর ঝলমলে হাসি।ভেতর থেকে প্রশ্ন এলো ‘ পুরুষ মানুষের হাসিও এত সুন্দর হয়?
কি সুন্দর করে হাসে লোকটা।অথচ সব সময় এমন গোমড়া মুখে থাকে কেনো?সেঁজুতি মুখ ফস্কে বেরিয়ে এলো
‘ হাসলে আপনাকে ভীষণ সুন্দর লাগে।
চট করে রুদ্রর হাসি থেমে গেলো।সেঁজুতি অপ্রস্তুত হয়ে পরলো। রুদ্র তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতেই চোখ সরিয়ে এলোমেলো ভবে তাকালো এদিক ওদিক।রুদ্র দুহাতের আজোলে সেজুতির মুখ তুলল।সেঁজুতি চমকালো খুব।রুদ্র সেসবে তোয়াক্কা না করে নিজের মতো সেঁজুতির চোখের কাঁনিশে জমে থাকা পানি টুকু মুছে দিলো।ঠান্ডা স্পর্শে সেঁজুতির শরীর শিরশির করছে।রুদ্র অত্যাধিক বরফ কন্ঠে বলল
‘এভাবে কাঁদলে আপনাকেও বেশ লাগে।

সেঁজুতি হা করে চেয়ে আছে। কোন রুদ্র রওশনের সাথে পরিচিত হচ্ছে সে?রুদ্র একভাবে সেঁজুতির স্নিগ্ধ মুখটা দেখছে।সেঁজুতিও যেন বাদামী দৃষ্টির স্বীকার হলো আজ।সম্মোহনের মতো তাকিয়ে আছে সেও।ধাবমান বাতাসে সেঁজুতির কপালের ছোট চুল উড়ছে।পলক হীন চোখের মায়ায় আটকে অবাধ্য ইচ্ছে মাথা তুলল। রুদ্র সেঁজুতির দিকে ঝুঁকে এলো কিঞ্চিৎ।সেঁজুতি এক চুল ও নঁড়লোনা।যেন এই মুহুর্তে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া এক জড় সে।রুদ্র সেঁজুতির ঠোঁটের কাছে ঠোঁট আনলো।সেঁজুতির ঠোঁট দুটো ঠকঠক করে কাঁপাতে ঘি ঢাললো রুদ্রর অনুভূতির আগুনে।দুজনের ঠোঁটে অর্ধইঞ্চি ফাঁক।ছুঁইছুঁই হতে যাবে হঠাৎ গাড়ির হর্নের শব্দ এসে পৌঁছায়। ধ্যান ভাঙলো দুজনের।হুশ ফিরতেই দুজন দুদিকে ছিটকে গেলো।সেঁজুতি লজ্জ্বা,ঘৃনায় আড়ষ্ট।রুদ্ররও একি অবস্থা।একে অন্যের দিকে তাকাতেও পারছেনা।আরেকটু হলে কী হতে যাচ্ছিলো ভেবেই সেঁজুতির শ্বাস আটকে এলো।ছি! ছি! শেষে কীনা এসব?সেঁজুতি কপাল চাঁপড়ালো মনে মনে।রুদ্রর ফোন বাজলো তখন।রুদ্র রিসিভ করে আসছি বলল শুধু।এরপর মুখের কাছে হাত এনে খুকখুক করে কাশলো।উদ্দেশ্য সেঁজুতির মনোযোগ। উশখুশে কন্ঠে বলল

‘গাড়ি এসে গেছে হয়তো।যেতে হবে আমাদের।
সেঁজুতির উত্তর জানতে রুদ্র তাকালো।সেঁজুতি শুধু মাথা দোলালো।টু শব্দ করলোনা।রুদ্র হাঁটা ধরলে সে বরাবরের মতোন পেছন পেছন এগোয়।

গাড়ি চলছে অনেকক্ষন।অস্বস্তিতে গাট হয়ে আছে দুজনেই।রুদ্রর মনে হঠাৎ ভয় জেঁকে বসলো।তখনকার ব্যাবহারের জন্যে সেঁজুতি কী রেগে গেলো? ক্ষেপে আছে? ভুল বুঝছে তাকে? রুদ্র একটা ছোট্ট পরীক্ষা নিতে চাইলো সেঁজুতির।সামনে ড্রাইভার। পেছনে রুদ্র আর পাশেই জড়োসড়ো হয়ে বসে সেঁজুতি। রুদ্র নিরবতা ভেঙে বলল

‘একটা প্রজাপতি দেখে এত দূর আসার কারন?
সেঁজুতি বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালো।পরমুহূর্তে চোখ রাখলো কোলের ওপর রাখা হাতে।নীঁচু কন্ঠে বলল,

‘আসলে, তখন ওখানে একটা সাপ দেখে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় লাগছিলো।আপনিও ফোনে কথা বলছিলেন,তাই আপনাকে না ডেকে নিজের মত একটু হাটছিলাম।কখন যে এতো টা দূরে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।আর প্রজাপতির পিছু নেয়া আমার ছোট বেলার অভ্যেস।ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে ঢাকা পরেছিলো বলতে পারেন।কাজের চাপেও এসবের তেমন সুযোগ হয়না।হঠাৎ প্রজাপতি টা উড়তে দেখে এত ভালোলাগলো যে ছেলেমানুষী যেন আবার ফিরে এলো।কিছু না ভেবেই ওর সাথে পা মেলালাম।

সেঁজুতি মৃদূ হাসলো।রুদ্র ভেতরে ভেতরে শান্তি অনুভব করলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো সে।যাক! সেঁজুতি তবে রেগে নেই।পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সেঁজুতি জিজ্ঞেস করলো,
‘এটা সিলেটের কোন জায়গা?

‘জাফলং।
সেঁজুতি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
— জাফলং?? ওয়াও!এটার সম্পর্কে আমি বইতে পড়েছিলাম।সিলেটের প্রকৃতি কন্যা বলা হয় এ জায়গা কে তাইনা?সত্যিই এমনি এমনি দেয়নি এমন নাম।ভীষণ সুন্দরও। আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো সিলেটে আসার,কিন্ত হয়ে ওঠেনি।আজ আপনার জন্যেই আমার ইচ্ছে টা পূরন হলো।

জবাবে কিছুই বললোনা রুদ্র।সেজুতির থেকে চোখ সরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো।
দেশে বিদেশে কত জায়গায়ই না ঘুরেছে। অথচ সামান্যতম প্রতিক্রিয়া আসেনি নিজের মধ্যে।
আর এই মেয়েটা,দেশের এতো ছোট একটা জায়গায় আসা নিয়েও কতটা আনন্দিত!

—-
পাঁচ তারকা বিশিষ্ট একটি হোটেলের সামনে এসে গাড়ি থামানো হলো। দুপাশের দরজা খুলে নেমে এলো রুদ্র -সেজুতি ।
সেজুতিকে রেখেই হোটেলের ভেতর ঢুকে গেলো রুদ্র।সেঁজুতি একটু ক্ষুন্নই হলো এতে।ড্রাইভার তখন লাগেজ নামাতে ব্যাস্ত।সেঁজুতি আমিরকে ফোন সিয়ে জানালো ওরা পৌঁছেছে।রুদ্র গিয়ে রিসিপশনে দাঁড়িয়েছে।

” রুম রেডি??
ছেলেটি সৌজন্য হেসে বলল,
‘ ইয়েস স্যার!সব কিছু আগে থেকেই ঠিকঠাক করে রেখেছি। আপনার কথা অনুযায়ী পাশাপাশিই দুটো রুম দিয়েছি। আর সব থেকে বেস্ট দুটোই।
রুদ্র তুষ্ট কন্ঠে বলল,

‘ গুড।চাবি দিন,,
___
সেঁজুতি ওপরের ছাদ থেকে নিচের মেঝে অব্দি দেখতে দেখতে হাটছে।বাইরের থেকে ভেতরটা আরো বড়।এমন নয় সে ফাইভ স্টারে প্রথম এলো।এর আগে গিয়েছিলো, রুদ্রর আর-আর-সিতে।ওটাওতো ফাইভ স্টারই ছিলো।কিন্তু সেদিন অত কিছু দেখার মত মন -মানসিকতা কোনোটাই রপ্ত ছিলোনা ।আজ তাই এই হোটেলটি খুঁটিয়ে খাঁটিয়ে দেখছে সে। সেঁজুতি যখন এদিক ওদিক দেখছে ঠিক তখনি কারো সাথে ধাক্কা লাগলো।সেঁজুতি পরে যেতে নিলে সামনের আগন্তুক ফিল্মের হিরোর মত ওর কোমড় ধরে আটকাতে চাইলো।কিন্তু ধরার আগেই কোত্থেকে হাওয়ার বেগে উদয় হলো রুদ্র। ছেলেটির হাত খপ করে ধরে ফেলে আটকালো।সেঁজুতি কে কেন ছোঁবে এই ছেলে?আর ব্যাস! ধপাস করে মেঝেতে পরলো সেঁজুতি। আর্তনাদ করে উঠলো ব্যাথায়,

” ও বাবা! কে ফেললো আমায়?হাড়গোড় বোধ হয় সব ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছে।

রুদ্র গম্ভীর হয়ে দেখছে সেঁজুতিকে।একটু যদি হাসি থাকে মুখে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির হাত তখনও মুঠোয়।ছেলেটি একবার ওকে দেখছে একবার সেঁজুতি কে।রুদ্র তাকালো।ছেলেটির হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের এক হাত পকেটে গুঁজলো।
ছেলেটি ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘কি ব্যাপার? আপনি আমাকে আটকালেন কেনো?আমি ধরলে উনি তো পরতেন না।

রুদ্রর কাটকাট জবাব,
‘ ওনার পরে যাওয়া নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবেনা। সেজন্যে আমি আছি,আপনি নিজের কাজ করুন

আশেপাশে তাকালো রুদ্র।স্টাফ যারা আছে তারা যথেস্ট স্বাভাবিক।আর সেটাও এখানে সে উপস্থিত তাই। অন্য সময় হলে সেজুতিকে নিয়ে এতক্ষনে হয়তো হাসির রোল পরে যেতো।

সেজুতি গাল ফোলালো।টাইলসের মেঝেতে পরে ভীষণ ব্যাথা লেগেছে পিঠে।সব রাগ গিয়ে পরলো অজ্ঞাত ছেলেটির ওপর। সে না হয় একটু অন্যমনস্ক ছিলো।কিন্তু ইনি? ইনি চোখ কোথায় রেখেছিলেন?

সেঁজুতি কোমড় চেঁপে উঠে দাঁড়ালো।কাঁধব্যাগ টা আগের মত কাঁধে ছড়িয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো।সে এখনও ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ওর দিকে।যেন কিছু একটা মেলাচ্ছে।সেঁজুতি মৃদূ মেজাজ নিয়ে বলল,

‘ এই যে আপনি চোখে দেখতে পান না?? মেয়ে দেখেছেন আর ধাক্কা মেরে দিলেন?

ছেলেটি অবাক হয়ে বলল,
“কি বলছেন এসব?আমি তো দেখিইনি।ইচ্ছে করে ধাক্কা মারার মত অভদ্র আমি নই।

সেঁজুতি সন্দেহী কন্ঠে বলল,

সত্যি বললেন নাকি মিথ্যে?

‘সত্যি বিশ্বাস করুন।

রুদ্র পাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘লিসেন মিস সেজুতি।, আপনি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারেন না।,উনি না হয় দেখেন নি,,,
কিন্তু আপনার চোখ কোথায় ছিলো?

সেঁজুতি চুপসে গিয়ে বলল,
‘ইয়ে আমি তো,হোটেল টা দেখছিলাম।
রুদ্র বিরক্তি দেখিয়ে বলল,
‘ চলুন।
সেঁজুতি মুখ কালো করে বলল,
“বলছিলাম কি,একটা ট্রেচার নিয়ে আসা যায়না?যা জোড়ে পরেছি। ভীষণ ব্যাথা করছে।

রুদ্র ভ্রু নাঁচালো,
‘ হোটেলে স্ট্রেচার?
সেঁজুতি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
” কিছু একটা আনুন না।আমি হাটবোনা পায়েও ব্যাথা পেয়েছি।
কিঞ্চিৎ এগিয়ে এলো রুদ্র।সেঁজুতির কানের কাছে মুখ নিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,

‘ভালোয় ভালোয় চলুন।নাহলে হসপিটালের সেদিনের সেই ব্যাবস্থা নেবো আমি।
ইঙ্গিত বুঝতে এক সেকেন্ড ও লাগেনি সেজুতির।দুদিকে মাথা নেঁড়ে ভাবলো,
‘ আর যাই হোক,এর কোলে ওঠা যাবেনা।

রুদ্র বুকের সাথে দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।সেঁজুতি তাকাতেই ডান ভ্রু উঁচালো।ঠোঁট উলটে হাটা ধরলো সেঁজুতি। পা ব্যাথায় টনটন করে উঠলেও থামলোনা।রুদ্র পেছন পেছন ঠোঁট বাকিয়ে এগোলো।বিড়বিড় করে বলল,
— পানিশমেন্ট ইজ পানিশমেন্ট।
ছেলেদের সাথে ধাক্কা খাওয়ার মজা বুঝুন এবার।

চলবে….