Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 425



প্রনয় পর্ব-১৭+১৮

0

প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৭
হোসাইন তব্দা খেয়ে তাকিয়ে আছেন।পুরু ঠোঁট দুটো নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে আছে অনেকক্ষন হলো।সেঁজুতি কে সেই ছোট্ট বেলা থেকে চেনে।দুর্দান্ত ছিলো পড়াশুনায়।একেতো বন্ধুর মেয়ে, সাথে সেঁজুতির এই পড়াশুনায় মনোযোগী ভাবের জন্যেই তিনি অতি মাত্রায় স্নেহ করতেন মেয়েটাকে।নিজে থেকেই খেলনা থেকে শুরু করে সেঁজুতি কে টুকিটাকি যা পারতেন কিনে দিতেন ভালোবেসে।মেয়েটির সিক্সথসেন্স ও ভালো।হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো মেয়ে কোনো কালেই ছিলোনা।হোসাইনের বিচারে সেজুতি নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমতি। সেই ঠান্ডা মস্তিষ্কের মেয়েটি প্রেমে পরলো কীনা রুদ্র রওশন এর মতো বদমেজাজি, অহংকারী লোকের? যে প্রত্যেকটা কথা দাঁড়িপাল্লায় মেপে বলে।নিঃশ্বাস ও ফেলে হিসেব করে? চেহারার সৌন্দর্য আর টাকায় ভোলার মতো মেয়েতো সেঁজুতি নয়।সে প্রচুর আত্মসন্মানী।হোসাইনের মস্তিষ্ক তখন ভাবতে ব্যাস্ত।তার বিস্ময় ভাব কাটেনি।কথাটা কী বিশ্বাস যোগ্য? নাকী নয়? এ নিয়েই ভাবছে।আবার সেদিক থেকে দেখতে গেলে রুদ্রর এমন নিরদ্বেগ স্বীকারোক্তিতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই।
‘ মুখ টা বন্ধ করুন ডাঃ হোসাইন। এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই।
রুদ্রর শান্ত স্বরে হোসাইন সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতোন নঁড়ে ওঠেন।সন্দেহী কন্ঠে বললেন,
‘আপনি সেজুথির বয়ফ্রেন্ড?ইয়ে- মানে এটা কি করে সম্ভব??
রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো ” এখানে অসম্ভবের ঠিক কী দেখলেন?
হোসাইন ইত্তস্তত করে বললেন,
— না মানে ,আমি যতদূর সেঁজুতি কে চিনি ওর এসব প্রেম ট্রেমে আগ্রহ দেখিনি কখনও। বই, বাবা, দায়িত্ব এসব নিয়েই ব্যাস্ত ছিলো সব সময়।ও আবার এগুলোকে কবে থেকে…মানে আমিতো কিছুই জানতে পারলাম না।
রুদ্র বিস্ময়ের ভান করে বলল ‘
‘কি অদ্ভূত!প্রেম করলে কি আপনাকে জানিয়ে করবে?

হোসাইন লজ্জ্বা পেলেন রুদ্রর সোজা সোজা কথায়।রুদ্র ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল,
‘ ডঃ হোসাইন!ওসব কথা ছাড়ুন।আমি যে কাজে এসেছি আগে সেটা সাড়ি বরং?
‘ জী।নিশ্চয়ই!

রুদ্র ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে টেবিলের ওপর দুহাত রাখলো।একটার ভাঁজে আরেকটার আঙুল।প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ আচ্ছা ড: হোসাইন,যেদিন সেঁজুতি আমাকে ব্লাড ডোনেট করেছিলো,সেদিন উনি ঠিক কি কাজে হসপিটালে এসেছিলেন?

হোসাইন পালটা কপাল কুঁচকে বললেন,
‘ কেনো আবার?আমির,মানে ওর বাবার অপারেশনের জন্যে।কিন্তু আপনি যদি ওর কাছের কেউ হন তাহলে এসব তো আপনার জানার কথা।আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছেন মিস্টার চৌধুরী?

রুদ্র মেজাজ হারালো।পরমুহূর্তে নিজেকে সামলালো।রাগ দেখালে চলবেনা। কিছুই জানা যাবেনা।ঠান্ডা রাখতে হবে নিজেকে।মৃদূ হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ করছি তার কারন আছে অবশ্যই। আমাদের সম্পর্ক তো মাত্র কদিনের। এতো তাড়াতাড়ি কি দুজন দুজনের কাছে সব কিছু শেয়ার করা যায় বলুন?তাছাড়া সেজুতিকে তো আপনি ছোট থেকেই চেনেন।নিজের দূর্বলতার কথা সে কাউকে বুঝতে দেয়না।আপনিই ওর বাবার পরে আরেকজন কাছের মানুষ।তাই আমি এসেছি আপনার থেকে জানতে। বুঝলেন এবার??

হোসাইন মাথা নাঁড়লেন।সত্যিই বিষয় টা পরিষ্কার হলো।এতক্ষন তাহলে মিছিমিছি সন্দেহ করছিলেন।হোসাইন অল্প সময়ে বিস্তর হিসেব কষলেন।সেঁজুতি রুদ্রকে দুবার যেঁচে প্রানে বাঁচিয়েছে।শেষ বার সেঁজুতিদের বাসায় রুদ্রকে দেখেছেন।আমিরের থেকেও শুনলেন রুদ্রর অফিসে সেঁজুতির ভালো পোস্টে চাকরী পাওয়ার কথা।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালেন হোসাইন।দুজনের মধ্যে তাহলে মাখোমাখো সম্পর্ক। সেজন্যেই সেঁজুতি ইজ্যিল্যি চাকরী পেলো।রুদ্রই দিয়েছে।নাহলে গ্রাজুয়েশন ছাড়া একটা মেয়ে কী করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরীর সুযোগ পায়? তাও মালিকের ব্যাক্তিগত সহকারী হিসেবে? এটাতো চোখ বন্ধ করে যে কেউ বলতে পারবে।সেই শুধু বুঝতে পারেনি।আসলে এরকম তো পেঁচিয়ে ভাবেইনি বিষয় টা।হোসাইনের চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালো রুদ্র।পরবর্তী প্রশ্ন ছুড়লো সে,

‘ ওনার বাবার অপারেশনের ডেট কবে ছিলো?
হোসাইন একটু ভেবে উত্তর দিলেন,
‘ উমম..গত মাসের ২৬ তারিখে মেইবি।কারন আমি এখানে ২৭ তারিখ সকালে এসেছিলাম।
রুদ্র মনে মনে ভাবলো,
‘আর উনি আমার হোটেলে এসেছিলেন ২৫ তারিখ রাতে।
তৃতীয় প্রশ্ন করলো রুদ্র,
‘আচ্ছা ওনার বাবার ঠিক কি হয়েছিলো?
হোসাইন দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলেন,
‘মেজর এট্যাক। বাচার চান্স খুব কম ছিলো।আর এ ধরনের এট্যাকে পেশেন্টের শরীরের যেকোনো অংশ প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে।যেমন আমিরের ডান পা অবশ হয়,আর লাস্ট মোমেন্ট এ সেটা কেটে আলাদা করতে হয় নাহলে পুরো বডি ধরে যাওয়ার চান্স ছিলো।
” oh I see! তো ওনার অপারেশনের জন্যে নিশ্চয়ই অনেক টাকার প্রয়োজন পরেছে?

” তাতো লেগেছেই।এক দু লাখ হলেও হয়ত কথা ছিলো।পুরো ছয় লক্ষ টাকা জোগাড় করতে হয়েছে মেয়েটাকে। কীভাবে কী করেছে জানতেও পারিনি।আমারও এমন দূর্ভাগ্য! প্রিয় বন্ধুর বিপদে দেশের বাইরে ছিলাম আমি।থাকলে হয়ত কিছু সাহায্যে লাগতাম।কিন্তু তা আর হলো কই? মেয়েটাকে অহেতুক এর -ওর কাছ থেকে ঋন করে বাবার চিকিৎসা করাতে হলো।আর সেই ঋন চোঁকাতেই তো গাঁধার খাঁটুনি খাঁটছে।ওইটুকু মেয়ে,বয়সই বা কত বলুন।মুখ দেখলেই মায়া হয় ভীষণ।কোনো কিছু দরকার পরলে আমাকে বলেওনা।এত সংকোচ মেয়েটার।কারো থেকে হাত পেতে কিছু নিতেই ওর রাজ্যের অস্বস্তি।আমির ও এমন ছিলো।পুরো বাবার কার্বন কপি মেয়েটা।
হোসাইন থামলেন।রুদ্র চুপচাপ শুনছে।ভাবুক তার দৃষ্টি।সব উত্তর সে পেয়েছে।এতদিন শুধু আন্দাজের ভিত্তিতে এগিয়েছে।আজ যেন কাঁচের মতোন স্বচ্ছ হলো।হোসাইন নরম কন্ঠে বললেন
‘ আমার আপনার কাছে একটা অনুরোধ থাকবে মিস্টার চৌধুরী।
রুদ্র তাকালে হোসাইন টেবিলে রাখা রুদ্রর হাত মূঠোতে নিলেন।বললেন ‘ মা মরা মেয়ে।বাবাকেই যতটুকু কাছে পেয়েছে।ভীষণ সংগ্রামী জীবন ওর।ভালো রাখবেন ওকে।

রুদ্র উত্তর দিলোনা অনেকক্ষন।সময় নিয়ে ছোট্ট করে বলল ‘ ওকে।
হোসাইন নিশ্চিন্তে হাসলেন।রুদ্র বলল,
“আরেক টা কথা!আমার এখানে আসার ব্যাপার টা সেজুথির কান অব্ধি যেনো না পৌছায় সে দায়িত্ব আপনার।আর আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটাও ওর বাবাকে জানানোর দরকার নেই।সময় হলে আমিই জানাবো।কথাটা যদি রাখতেন উপকৃত হতাম ড:।

হোসাইন আস্বস্ত করে বললেন ” নিশ্চয়ই!
” thanks!
রুদ্র বেরিয়ে গেলো।হোসাইন নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন।ডুব দিলেন গভীর ভাবনায়।
____

ব্যাস্ত রাস্তায় ড্রাইভ করছে রুদ্র।ঠোঁট যুগলে বিজয়ের হাসি ঝোলানো।যা বোঝার ছিলো বুঝলো অবশেষে। হোক তাতে কাঁড়ি কাঁড়ি মিথ্যে বলার প্রয়োজন।অজানা তো আর কিছুই রইলোনা।
‘ আপনার আর আমার মাঝে আর কোনো পর্দা নেই সেঁজুতি। আপনাকে পুরোটাই আমি চিনে ফেললাম।এবার আমাকে আপনার চেনা উচিত।
রুদ্র সিগারেট ধরালো।গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ধোয়া ছাড়লো বাইরে।তখনি রাস্তার ওইপাশে চোখ যায়।চেনা সেই মুখ দেখতেই রুদ্রর গাড়ির গতি কমে।সিগারেট এস্ট্রে তে ফেলে ইউটার্ন নিয়ে এগোয় সেদিকে।
একটা চকলেট কালারের থ্রিপিস পরেছে সেঁজুতি। কাঁধে ব্যাগ।মাথায় জর্জেটের ওড়না দিয়ে ঘোমটা টানা।সামনের চুল গুলো অল্প বাতাসে দুলছে।পাশেই স্ক্র‍্যাচ হাতে দাঁড়িয়ে আমির।দুজনেই উৎসুখ চোখে কিছু খুঁজছে।অপেক্ষা করছে।
সেঁজুতি বিরক্তি নিয়ে বলল ‘ আজ বোধ হয় সবকটা সি এন জি ওয়ালা নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে বাবা।এভাবে রোদের মধ্যে কতক্ষন দাঁড়ানো যায় বলোতো? তোমারও তো কষ্ট হচ্ছে।
আমির ও একিরকম বিরক্ত।তাও মেয়েকে শান্ত করতে বললেন ‘ এসে যাবে রে মা। আরেকটু দেখি।একটা না একটা তো পাবোই।

তক্ষুনি ওদের সামনে রুদ্র গাড়ি ব্রেক করলো।সেঁজুতি দেখেই চিনে ফেলল এটা কার গাড়ি।সেঁজুতি কে ঠিক প্রমান করে একটু পর রুদ্রর মুখটা দৃশ্যমান হলো গাড়ির জানলা দিয়ে।রুদ্র কে দেখে আমির ও চিনলেন।সেঁজুতি কৌতুহল নিয়ে শুধালো ‘ স্যার?আপনি এখানে?

রুদ্র গাড়ি থেকে নামেনি।বসে থেকেই উত্তর দিলো, ‘একচ্যয়েলি আমি এখান থেকেই যাচ্ছিলাম।তা কোথাও যাচ্ছিলেন আপনি?

সেঁজুতি সহজ কন্ঠে বলল ‘হ্যা।কিন্তু যেতে আর পারিনি।সেই কতক্ষন ধরে দাড়িয়েই আছি।একটা রিক্সা, সি এন জি কিচ্ছু পাচ্ছিনা।
রুদ্র জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘এক কাজ করুন।গাড়িতে উঠে বসুন,আমি পৌঁছে দিচ্ছি…

সেঁজুতির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো।রুদ্র নিজে থেকে পৌঁছে দেবে বলছে? ঠিক শুনলো?আমিরও একিরকম বিস্মিত।রুদ্রর সেদিনের ব্যাবহারের সঙ্গে আজকে মিল পেলেন না।ভাবলেন,
— এই ছেলেটা সেদিন কি ভাব টাই না দেখিয়েছিল।হঠাৎ এত পরিবর্তন?

সেঁজুতি ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
‘না না আপনাকে যেতে হবেনা।শুধু শুধু আমাদের জন্যে আপনি কেনো কষ্ট করবেন?
রুদ্রর কাটকাট জবাব,
‘ আমার কষ্টের কথা আমাকে ভাবতে দিন। আমি জানি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে আপনার বেশ মজা লাগছে।কিন্তু আপনার বাবার?? ওনার তো কষ্ট হচ্ছে।নিজেকে ছেড়ে ওনার কথা টা ভাবুন।সব সময় আপনার জেদ দেখানো জরুরি?
যেটা বলছি করুন,উঠে বসুন গাড়িতে।

সেঁজুতি চোখ নামিয়ে নেয়।একবার বাবার দিকে তাকায়।আমির ও মেয়ের দিকে চেয়ে।মেয়ে যা বলবে সে করবেন।তবে রুদ্র ওনার কথা ভাবায়,ভালো লেগেছে আমিরের। সেঁজুতি ভাবলো
‘আর যাই হোক কথা তো আর ভুল বলেননি উনি। সত্যিই বাবার এতো রোদের মধ্যে এভাবে স্ক্র‍্যাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ওনার কথাটাই বরং শুনি।
বাবাকে গাড়ির পেছনের সিটে বসালো সেজুতি।নিজে বসতে নিতেই রুদ্রর সেদিনের বলা কথা মনে পড়লো।আজও যদি ইগোতে লাগে লোকটার? লাগে কী ? লাগবেই।নিশব্দে এসে রুদ্রর পাশের সিটে বসলো সেঁজুতি।

রুদ্র ড্রাইভ করতে করতে বলল ‘ কোথায় যাবেন?
‘ কল্যানপুরে।ওখানে একটা শিশুপার্ক আছে।সেখানেই, আপনি চলতে থাকুন,আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
‘ শিশুপার্ক?

সেঁজুতি মিহি কন্ঠে বলল” আসলে, ছোট বেলা থেকে বাবার প্রত্যেকটা ছুটির দিনে আমরা দুজন সেখানে ঘুরতে যেতাম।পার্কটা আমার এত্ত পছন্দ ছিলো যে বড় হওয়ার পরেও যেতাম।বাবার হাত ধরে ঘুরলে নিজেকে সেই ছোট্টোটিই মনে হয়।গত কয়েক মাস যাবত বাবা ঘরবন্দী। আমিও ব্যাস্ত।আগের মতো কিছুই নেই আর।তাই আমি আর বাবা ওখানেই যাচ্ছি। বলতে পারেন শৈশব বিলাস করতে!

সেঁজুতির এত্তগুলো কথার পিঠে আমির উদাস রইলেন।পুরোনো অনেক দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে এলো। একবার কাটা পায়ের দিকে তাকালেন।মুহুর্তেই ভিঁজে উঠলো চোখ দুটো। মেয়ের চোখে পরার আগেই মুছে নিলেন তাড়াহুড়ো করে।রুদ্র উত্তরে ছোট করে বলল ‘ ওহ”
পুরো রাস্তায় আর কেউ কথা বলেনি।মাঝে মাঝে শুধু আমিরের দু একটা শুকনো কাশির শব্দ ছিলো।
গন্তব্যে এসে পৌছাতেই আগে নামলো সেঁজুতি।এরপর বাবাকে নামালো।জানলার কাছে ঝুঁকে কৃতজ্ঞ হেসে বলল ‘ অনেক ধন্যবাদ স্যার।

সেঁজুতি আমির কে নিয়ে এগোতে নিলো।হঠাৎ পেছন থেকে রুদ্র ডাকলো। ‘ মিস সেঁজুতি?

সেঁজুতি ফিরে তাকালো ‘ জ্বি!
রুদ্র স্টিয়ারিংএ হাত ঘষে বরফ কন্ঠে বলল,
“আপনি দেখছি একদম ই ম্যানার্স জানেন না।ঘুরতে যাচ্ছেন অথচ আমাকে একবার ও সাথে যেতে বললেন না?
রুদ্রর কথায় জ্বিভ কাটলো সেজুতি।আসলেই তো।উনিতো ঠিক বললেন। ইশ! এটা একদম বাজে দেখালো না? উনি না চাইতেই উপকার করলেন আর ও কিনা একটা ধন্যবাদ দিয়েই চলে যাচ্ছিলো!কিন্তু ওরই বা কী দোষ?এমন নাক উঁচু লোক কী এরকম একটা সস্তা জায়গায় যেতে চাইবেন?যে লোক তাকে পদে পদে হেনস্তা করেন সে কী চাইবেন ওদের সাথে ঘুরতে? এসব ভেবেই তো বলেনি। এ পর্যায়ে আমির মুখ খুললেন। হেসে বললেন ‘ আপনিও আসুন মিস্টার চৌধুরী। সেঁজুতিও তাল মেলালো।সাথে স্যরিও বলল।রুদ্র ভ্রু নাঁচিয়ে জবাব দিলো
“আমি বলার পরে সাধছেন?
সেঁজুতি নিচু কন্ঠে বলল,
— আসলে বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তো তাই আর!প্লিজ কিছু মনে করবেন না।আপনি আমাদের সাথে আসলে আমরা খুশিই হবো।

রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে এলো।সানগ্লাশ টা চোখে পরে পকেটে হাত গুঁজে হাটা ধরলো। সেঁজুতি তিনটে টিকিট কাটলো কাউন্টার থেকে।গেট পেরিয়ে ভেতরের দিকে এগোচ্ছে ওরা।মধ্যিখানে আমির।দুপাশে সেঁজুতি আর রুদ্র।রুদ্র চারপাশ টা দেখছিলো।সে এখানে প্রথম এলো।অথচ সেজুতির মনোযোগ রুদ্রর দিকে।ওকে দেখতে দেখতেই ভাবছিলো”
লোকটার হাবভাব বড্ড অদ্ভুত।মাঝে মাঝে এতোটা অহংকারী মনে হয় বলার বাইরে।অথচ আজ?? আজ একটুও মনে হচ্ছেনা।নিজে থেকে আমাদের লিফট দিলেন।আবার এখন আমাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাটছেন।এত রহস্যময় কেন উনি?

আমির কে ধরে গাছের ছায়ায় আচ্ছাদিত একটি বেঞ্চীতে বসালো সেজুতি।রুদ্রর মনোনিবেশ অন্য কোথাও।পরিবার সহ আসা বাচ্চাগুলোকে এক ধ্যানে দেখছে সে।বাচ্চাগুলোর নিষ্পাপ ছোট ছোট চোখ গুলোয় খুশি উপচে পরছে।বাবা মায়ের সাথে পার্কে আসার আনন্দ যেন ধরছেনা ছোট্ট মনে।রুদ্র আনমনেই অল্প হাসলো।বুকটা ভীষণ ব্যাথায় কাতরে উঠলো।এই ব্যাথা কমবে না। সারাজীবনেও না।সব থেকেও তার একটা জিনিস নেই।নেইতো নেই,এমন অমূল্য জিনিসটাই নেই যেটা কোটি টাকা দিলেও পাওয়া অসম্ভব।রুদ্র সানগ্লাশ ভেদ করে দূর আকাশে চোখ রাখলো ‘ ওপারে কেমন আছে তার পরিবার?

সেঁজুতি দের পাশেই চঁড়কি ঘুরছে।কয়েকটি বাচ্চা খিলখিল করে হাসছে।অনেকে আবার ভয়ে মাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।থামানোর জন্যে চিৎকার করছে। আমির সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন।আদুরে কন্ঠে বললেন ‘ আজকে চঁড়কিতে উঠবিনা আম্মা?

সেঁজুতি নীচের দিক চেয়ে বলল ‘ না।
‘ কেনো? চঁড়বিনা কেনো? আগে তো ওঠার জন্যে বায়না ধরতিস খুব।
সেঁজুতির ভেতরটা কেঁদে উঠলো ‘ আজ তো তুমি পাশে বসতে পারবেনা বাবা।ভয় পেলে কাকে শক্ত করে ধরব বলো?
মুখে বলল
— আজ ভালো লাগছেনা বাবা।
আমির চুপ করে গেলেন।মেয়ের না উঠতে যাওয়ার কারন বুঝলেন হয়ত।একটা পা নেই তাই চঁড়কি তে ওঠাও তার সম্ভব নয়। সে না হয় আর কখনও পারবেনা মেয়েকে চঁড়কিতে চঁড়ার সময় হাত আঁকড়ে বসতে।কিন্তু যেদিন তার মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরার লোক আসবে, সেদিনই উঠবে না হয়।
রুদ্র মুখ খুলল এতক্ষন পর।আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো,
‘ চঁড়কী কী?
সেঁজুতির হাসি পেলো রুদ্রর বাচ্চা বাচ্চা প্রশ্নে।ঠোঁট টিপে হাসলোও।আঙুল উঁচু করে দেখালো,
‘ওই যে ওটা।অনেকে নাগরদোলাও বলে।আমি অবশ্য চঁড়কীই বলি।
জিনিসটা দেখতেই রুদ্রর মাথা ঘুরে এলো।বিড়বিড় করে বলল ‘ এটা এরকম ঘুরছে কেন?দেখেইতো মাথায় চক্কর কাটছে।আর এই মেয়ে কীনা এরকম অদ্ভূত জিনিসে ওঠার বায়না ধরতো?
রুদ্র একবার মনে মনে ভাবলো সেঁজুতি কে নিয়ে উঠবে ওটাতে।কিন্তু সেঁজুতি কী রাজি হবে? আর সেও কী সামলাতে পারবে? ওটা অত উঁচু! সেতো এমনিতেই লো প্রেশারের রোগী।চিৎ কাৎ হয়ে পরবে নাতো?অনেক ভেবে রুদ্র ঠিক করলো সেঁজুতি কে জিজ্ঞেস করবে উঠবে কীনা! পরমুহূর্তে ভাবলো,” না থাক! যদি মুখের ওপর না বলে? তার ইগোতে লাগবে।রুদ্রর ভাবনার মাঝেই সেঁজুতি চেঁচিয়ে উঠলো,
‘হাওয়াই মিঠাই। বাবা দেখো…
আমির, রুদ্র দুজনেই ফিরলো সেদিকে।বাচ্চা একটি ছেলের কাঁধে বিশাল বড় লাঠি।তার মাথায় ফুলের মতো সাদা,গোলাপী রংয়ের কী একটা বাঁধা! রুদ্র বুঝতে পারলোনা ওটা কী।অনেকক্ষন দেখেও পলিথিনের ভেতরে আটকানোর জিনিসটার রহস্য উদঘাটন সম্ভব হলোনা।
ওদিকে হাওয়াই মিঠাই দেখে ছুটে গেলো সেজুতি।রুদ্রর প্রচন্ড কৌতুহল হলো।সেঁজুতির উৎসাহ দেখেই মূলত।সেঁজুতি সাদা রঙের দুটো মিঠাই নিলো হাতে।রুদ্র পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘এটা কী?লাঠির মতোন।মাথায় আবার কেমন প্যাকেট মোড়ানো?
রুদ্রর প্রশ্নটা সেঁজুতির বোঁকা বোঁকা মনে হলো।তখন হাসি আটকে রাখলেও এখন হেসে ফেলল শব্দ করে।
‘আপনি এটা চেনেন না?? কোন গ্রহে থাকেন?
রুদ্র চোখ পাঁকাতেই সেঁজুতি চুপ হয়ে যায়।পরমুহূর্তে আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে।রুদ্রর মুখটা ছোট হয়ে এলো।লজ্জ্বা পেয়েছে বোধ হয়।
‘কিছু জিজ্ঞেস করলে কাউকে নিয়ে এভাবে হাসা উচিত?
সেঁজুতি কোনো রকমে হাসি থামালো।হাসতে হাসতে চোখে জল এসেছে। বলল,
‘স্যরি! স্যরি!আসলে আপনি এমন ভাবে বললেন যে না হেসে পারিনি।আচ্ছা আমি বলছি, এটার নাম হাওয়াই মিঠাই।আমার ভীষণ ভালো লাগে।
‘ এটা আবার কেমন নাম?
‘ এটার বিশেষত্ব কি জানেন?
‘ কী?
‘ এটা এত্তগুলো হাতে নেবেন।অথচ মুখে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া হয়ে যায়। ট্রাই করে দেখবেন??দাঁড়ান…
রুদ্রর কথাটা বিশ্বাস হলোনা।এরকম আবার হয় নাকী? সেঁজুতি একটা হাওয়াই মিঠাই ওর হাতে দিলো।খাবেনা খাবেনা ভেবেও নাক মুখ কুঁচকে মুখে দিলো রুদ্র।তাৎক্ষণিক মুখের ভঙিমা পালটে গেলো।বিগলিত কন্ঠ বলল,
‘ বেশ ইন্টারেস্টিং তো!
‘ তবে আর বলছি কি? এটা এত ইন্টারেস্টিং বলেই না আমার এত্ত পছন্দ।
আচ্ছা কত হলো তোমার?( ছেলেটির দিকে তাকিয়ে)
রুদ্র পাশ থেকে বলল,
” আমি দিচ্ছি।কত এসছে?
ছেলেটি বলল
‘তিনটা নিয়া মোট ৩০ টাকা।
রুদ্র চোখ পিটপিট করলো।মানিব্যাগ চেক করে দেখলো আস্ত টাকার নোট।সেঁজুতি হেসে বলল,
‘ থাক। আপনার আর দিয়ে কাজ নেই।আপনার পকেটে ৩০ টাকা নেই আমি জানি।অবশ্য থাকার ও কথা না।আপনার মতো লোক কী আর পকেটে খুচরো নিয়ে ঘোরে ??
রুদ্র কপট রাগ দেখিয়ে বলল
‘ বেশি কথা বলেন আপনি।
‘সেটা আমিও জানি।নতুন কিছু নয়।সরুন, আমি দিয়ে দিচ্ছি…
রুদ্র তীব্র আপত্তি জানালো,
আপনার টাকায় আমি কেনো খেতে যাবো?আমিই দেব।
মানিব্যাগ থেকে ৫০০ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিলো রুদ্র।ছেলেটা মাথা দুলিয়ে জানালো,
‘ ভাঙতি নেই।
রুদ্র বলল
— পুরোটাই রেখে দাও।
ছেলেটির মুখ চকচক করে উঠলো।অন্যদিকে সেঁজুতি বিমুঢ় হয়ে চেয়ে আছে।কটমট করছে চোয়াল
‘ আচ্ছা শয়তান লোক তো!আমার টাকায় কিনবো বলে ৩০ টাকার জায়গায় ৫০০ টাকা দিয়ে দিলো?আর আমি কিনা এই একটু আগে ভাবলাম লোক টা ভালো হয়ে গিয়েছে? অসম্ভব! এই লোক জন্মেও শুধরাবে না।উহু!
____
ঘোরাঘুরি শেষ হলো সন্ধেবেলা। রুদ্র এই সময়টায় অনেক কিছু দেখেছে।সেঁজুতি কে প্রশ্ন করতে করতে নেতিয়ে ফেলেছে প্রায়।এটা কী! ওটা কী! এটা এরকম মেন? ওরকম কেন? আর সেঁজুতিও খুশি মনে আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিয়েছে। একটুও বিরক্ত হয়নি।সেঁজুতি দের বাসায় পৌঁছে দিয়ে মাত্রই ফিরল রুদ্র।সেঁজুতি আমির দুজনেই বাসায় ঢোকার জন্যে বলেছিলো কিন্তু সে শোনেনি।ক্লান্তি তার চুলের ডগায়।আজকাল অজানা কারনে ঘুম হচ্ছেনা।আগে রাতে মেয়ে নিয়ে মেতে থাকতো।এখন একা বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোলেও ঘুম আসেনা।মাথার মধ্যে সেঁজুতি ঘোরে।ওর হাসি,কান্নামাখা মুখ,রাগে ফুলে ওঠা নাকের ডগা সব কেমন চক্রাকারে চোখের সামনে ঘোরে।রুদ্র তখন চোখ খিঁচে বালিশ চেপে ধরে মুখের ওপর।
তাই এখন তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।রুমে এসেই বিছানার ওপর সটাং হয়ে শুয়ে পরলো রুদ্র। চেহারাটা টসটসে স্ট্রবেরি হয়ে আছে। রোদের মধ্যে এতো কিভাবে ঘোরে মানুষ?অভ্র তখন রুমে ঢুকলো।রুদ্রকে ক্লান্ত পায়ে ফিরতে দেখেই পেছন পেছন এসেছে।এসেই দেখলো রুদ্র বিছানায় দুহাত মেলে চিৎপটাং। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল
“ভাই কি হয়েছে? শরীর খারাপ??
“একটু ক্লান্ত লাগছে,,

” ভাই রেহান তো সেই কবেই ফিরেছে।তুমি ওকে নিয়ে যাচ্ছোনা কেনো?নিজে নিজে ড্রাইভ করছো। একটা কিছু হলে?হলে মানে কী? একবার তো হতেই যাচ্ছিলো।ভাগ্যিশ সেবার বেঁচে গেলে।তোমারতো ড্রাইভ করার অভ্যেস নেই।এইজন্যেই ক্লান্ত হয়ে পরছো।

রুদ্র সব কথা চোখ বুজেই শুনলো।তার কানে সেঁজুতির খিলখিল হাসিটা বারি খাচ্ছে যেন।আচ্ছে মেয়েটাকে কখন বেশী সুন্দর লাগে? হাসলে? নাকী কাঁদলে? নাকী জেদ দেখালে? না। রাগলে বোধ হয়।রুদ্র কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারলোনা।মন দিলো অভ্রর কথায়।বলল” আমার আর ড্রাইভার প্রয়োজন পরবে না অভ্র।

অভ্র জিজ্ঞাসু চেহারায় তাকিয়ে আছে ।রুদ্র চোখ খুলে মাথার পেছনে এক হাত রেখে শুলো।দেয়ালে লাগানো এসিটার দিকে চেয়ে বলল ‘ ইদানীং ড্রাইভ করতে ভালো লাগে।ড্রাইভার থাকলে নিজেকে যন্ত্র যন্ত্র মনে হয়।আর একা থাকলে?সেরকম লাগেনা।

অভ্র বিহ্ববল হয়ে শুনছে।বিশ্বাস হচ্ছেনা এসব রুদ্র বলল।”ভাইতো ড্রাইভার ছাড়া এক পাও বাইরে রাখতোনা আগে। হঠাৎ এত পরিবর্তন? বিড়বিড়িয়ে বলল,
“কি যে হলো তোমার কে জানে!ইদানিং বড্ড মিস্টেরিয়াস লাগে তোমাকে।যার সবটা শুধু রহস্য আর রহস্য,।রুদ্রর কানে পুরো কথাটাই গেলো।
জবাবে মৃদূ হাসলো। বলল,
‘আগে আমার রহস্য ভেদ হোক,তারপর না নয় তোর টার ও একটা ব্যাবস্থা করবো আমি।
রুদ্র চট করে উঠে টাওয়াল নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো।অভ্র বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে থাকলো।অবশ্যই বোকাঁ বোঁকা চাউনীতে।
___
ঘড়ির কাঁটায় যখন দশটা,রুদ্র অফিসে ঢুকলো তখন।এক সেকেন্ড ও দেরী হয়না এতে।এসেছিলো তিক্ত মেজাজে।মধ্য রাস্তায় কতগুলো হিজরার খপ্পরে পরেছিলো আজ।রেহান সাথে ছিলো ।এমনিতে একা হলেও, অফিস আসার সময় ড্রাইভার নিয়ে আসতে ভোলেনা রুদ্র। হিজরা গুলো টাকা চাইতে এসেছে ভালো কথা,রুদ্র এক কথায় দিয়েছে। ওদের চাহিদার থেকেও বেশি দিয়েছে।কিন্তু ওরা যাওয়ার সময় রুদ্রর চেহারা নিয়ে এমন প্রশংসা করলো রুদ্র রীতিমতো রেহানের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পরলো।অপ্রকাশিত লজ্জ্বা ও পেলো।একিরকম লজ্জ্বা রেহান ও পেয়েছে। প্রসংশার বহর যে এমনও হয় রুদ্র আজই প্রথম জানলো। আর সেই থেকেই তার মেজাজ খারাপ।কিন্তু ওই খারাপ মেজাজ ভাল হলো মুহুর্তেই।অফিসে ঢুকতেই তার এতদিনের ইচ্ছে পূরন হলো।আজ সেঁজুতি আগেই হাজির।সবার সঙ্গে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা।সুন্দর করে সমস্বরে বলেছে “শুভ সকাল।রুদ্রর খুব ভালো লাগল।কিন্তু এটাতো প্রকাশের সময় নয়।গটগট করে হেটে গেলো কেবিনে। সেঁজুতি যেন অপেক্ষাতেই ছিলো রুদ্রর ডাক আসার।এই এক মাসে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ইদানীং রুদ্রর সাথে কথাবার্তাও সহজ হচ্ছে।প্রথম দিনের মতো হিংস্র আলাপ বিলুপ্ত প্রায়।তবে মনে মনে রুদ্রকে দেখতে পারেনা সেঁজুতি। সেটা সে প্রকাশ ও করেনা।চেষ্টা করে ভদ্র ভাবে থাকতে।আর যাই হোক,এটাতো সত্যি,তিন বছরের জন্যে এখানেই শিকড় আটকে পরলো তার।
বশীর এসে হাঁক পারলেন।রুদ্র ডাকছে।সেঁজুতি উঠে গেলো।নক করে কেবিনে ঢুকলো।রুদ্র তখন জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে।সেঁজুতি আসার আরো চারমিনিট পর কথা শেষ হয়।সেঁজুতি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। রুদ্র পেছন ঘুরলো ফোনের লাইন কাটতে কাটতে।ওমনি গলা শুকিয়ে এলো তার।সেঁজুতির পিঠ সমান খোলা চুল গুলো থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পরছে।পড়নে সাদা থ্রিপিস।তাতে সুতার হাল্কা কারুকাজ।মুখে কোনো প্রসাধনী নেই।শুধু চিকন ঠোঁটে চিকচিক করছে লিপবাম।রুদ্রর মাথায় একটাই কথা এলো,”সদ্যস্নাত পদ্ম’

‘ ডেকেছেন স্যার?
সেঁজুতি প্রশ্ন ছুড়লো।অতি দ্রুত রুদ্র সামলালো নিজেকে।কোনো ভাবেই অন্য কারো সামনে নিজের দূর্বলতা তুলে ধরেনা সে।সেঁজুতির সামনে তো আরোই না।চেয়ারে এসে বসে ধীরু হাতে পানির গ্লাশ তুলে পানি খেলো।টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘ কফি দিন।

সেঁজুতি ভুলেই বসেছিলো কথাটা।গত পরশু আগ বাড়িয়ে এই দায়িত্ব নিয়েছিলো সে।চুপচাপ কফি মেকারের দিকে এগোতে ধরলে রুদ্র হঠাৎ গম্ভীর আওয়াজ তোলে।বলে ওঠে..
‘ এটা অফিস। আর কতবার আপনাকে মনে করাতে হবে মিস সেঁজুতি?
সেঁজুতি বুঝলোনা।তবে প্রশ্ন ও করলোনা।চেয়ে থাকলো জিজ্ঞাসু চোখে।রুদ্র নিজেই বলল ‘ আপনি খোলা চুলে এসেছেন কেন? তাও এরকম ভেজা চুল নিয়ে?

সেঁজুতি চোখ নিঁচে নামিয়ে নিলো।আজ অফিসে আগে এসেছে সে।কিছুতেই জ্যামের কবলে পরবেনা,বড় মুখ করে বলেছে দেরিও করবেনা। সে জন্যেই এত পায়তারা করে আসা।সকাল সকাল গোসল করে আজই প্রথম এলো।এতদিন তো সময় ই পেতোনা।অত রাতে গিয়ে করতে হতো।প্রায়সই ঠান্ডাও লাগতো। আগে আগে আসবে ভেবে তাড়াহুড়ো করে চুল শুকায়নি।ভেবেছিলো যেতে যেতে বাতাসে শুকাবে।তাও হয়নি।চুল থেকে পানি পরছিলো বলে বাঁধেওনি।ভাবেনি রুদ্র খেয়াল করবে।লোকটাতো সব সময় কাজে ডুবে থাকে।ইশ! ব্যাপারটা কি বিচ্ছিরি দেখালো! বস কীনা চুল বাঁধতে বলছে? এইদিন দেখার আগে অল্প করে মরে যাওয়া দরকার।রুদ্রর অফিসের রুলস রেগুলেশনের মধ্যে পরিপাটি করে আসাও একটা। সেঁজুতি দেরি না করে চুল গুলো হাত খোপা করে ফেলল।আস্তে করে বলল ‘ স্যরি স্যার।এরকম আর হবেনা।

রুদ্র কিছু বলেনি।চেহারা গম্ভীর রেখেই কাজে মন দিয়েছে।সেঁজুতিও নরম হাতে কফি বানাচ্ছিলো।রুদ্র আঁড়চোখে দেখে নেয় কয়েকবার।নিজে নিজে আঁওড়ায়
‘ মেয়েটা কি জানে, ওকে খোলা চুলে কেমন বাজে দেখতে লাগে?এমন বাজে রুপেও যে কারো ঘুম উড়ে যাওয়ার জোগাড়!
চলবে,

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৮

বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। অল্প অল্প মেঘ ও ডাকছে।সেঁজুতি বৃষ্টিতে ভেঁজেনি।অফিস থেকে বেরিয়ে ডিরেক্ট সি এন জি তে উঠেছে। কিন্তু মন ভীষণ খারাপ।যতটা খারাপ হলে নিজের চুল খামচে ছিড়তে মন চায়,ততটাই খারাপ।এর কারণও ঘুরেফিরে সেই রুদ্র।আজকের গোটা দিনটাকে অপয়া বলে ঘোষণা করেছে সেঁজুতি। সকালবেলা চুল নিয়ে রুদ্রর ঝাড়ি শুনলো।এরপর রুদ্র বলেছিলো এসির পাওয়ার বাড়াতে।সেঁজুতি বেখেয়ালে কোথায় চেপেছে কে জানে! এসিটাই বন্ধ হয়ে গেছিলো।সেঁজুতির তখন রুদ্রর ধমকের ভয়ে প্রান যায় আর আসে।এমন ভুল কেন করলো কিছুতেই বুঝলোনা।সেতো এসি চালাতে জানে।হয়ত নিজেদের বাসায় নেই কিন্তু তবুও জানে।অথচ, রুদ্র ধমকাতে চেয়েও ধমকায়নি।কি মনে করে ধমকায়নি সে-ই জানে।চুপচাপ সার্ভিসিংয়ের লোক এনে ঠিক করিয়েছে।সেঁজুতির মুখটা তখন দেখার মতো ছিলো।চোর চুরি করেছে, ধরাও পরেছে, অথচ বাড়ির লোক না পিটিয়ে চোখের সামনে রেখে বলছে’ দাঁড়িয়ে থাকো।এভাবেই।তারপর সবাই শান্ত,ঠান্ডা। কিছু বলছেওনা , করছেওনা।ওই পরিস্থিতিতে চোর বাবাজির যেমন অবস্থা হবে,সেঁজুতির ও ঠিক তাই হলো।রুদ্রর ধমক শুনে অভ্যস্ত সে কিছুতেই শান্ত রুদ্রকে মেনে নিতে পারলোনা।
তারপর যখন ডেস্কে এলো মন একটু ঝরঝরা হচ্ছিলো আস্তে আস্তে।সারাদিনে রুদ্র আর ডাকেনি কেবিনে।অফিস ছুটির এক ঘন্টা আগে আবার ডাকলো।সেঁজুতি গেছিলো ভালো মনে,ঠিকঠাক মেজাজে।অথচ এরপরের রুদ্রর কথা শুনতেই মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে এলো তার।কথাই বন্ধ হয়ে গেছিলো অল্প সময়ের জন্যে।রুদ্র মুখের সামনে হাত না নাঁড়লে তো, সম্বিৎই ফিরতো না।
রুদ্র তার নতুন প্রজেক্ট রেখেছে সিলেটে।কয়েকটা কনফারেন্স, মিটিং প্রেজেন্টেশন এখন খুব দরকার।বড় মাপের ডিল সাইন হবে।অতি দ্রুত সেখানে যেতে হবে তাকে।সব সময় রুদ্র আর তার এসিস্ট্যান্ট যায়।আর তখন গোটা অফিসের দায়িত্ব অভ্রর কাঁধে।এবারেও এর হেরফের হবেনা। কিন্তু এসিস্ট্যান্ট যেহেতু মেয়ে, তাই রুদ্র হেজিট্যেট করছিলো।সেঁজুতিকে বলতেও কেমন সঙ্কোচ হচ্ছিলো।অন্য মেয়ে হলে এক কথা,কিন্তু সেঁজুতির সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ তো অত সুমধুর নয়।মেয়েটা রাজী হবেতো? এসব ভেবে ভেবেই অফিসের পুরো দশ ঘন্টা রুদ্র হাসফাস করেছে।কিন্তু কিছু করার ও নেই।অগত্যা কোনো উপায়ন্তর না পেয়েই সেঁজুতি কে সিলেট যাওয়ার কথা জানালো রুদ্র।সেঁজুতি একটা প্রত্যুত্তর ও করেনি।এক পাশে ঘাঁড় হেলে স্বায় দিয়েছে।তার মতে,সে না বললেই কী লোকটা শুনবে? অফিসের কাজ,যেতে তো হবেই।কিন্তু এভাবে রুদ্রর সাথে একা যাওয়াটাও মেনে নিতে পারছেনা।কেমন খচখচ করছে।সেঁজুতির মুখের অন্ধকার রুদ্রর চোখ এড়ালোনা।কিন্তু সে ধরা দেয়নি।সেঁজুতি যেতে রাজী, এটাই অনেক। এই সুযোগে আরেকটু কাছাকাছি থাকা হবে।রুদ্র মনে মনে খুশিই হলো যেন।

বাড়ি ফেরা থেকেই সেঁজুতি মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে।আমির প্রথমে ভয় পেয়েছেন।পরে তার মাথায় এলো এটা সেঁজুতির স্বভাব।একটু কিছু নিয়ে মন খারাপ, বা দুঃখ পেলেই সে স্ট্যাচুতে পরিনত হয়।দুনিয়ার সবাই বুঝতে পারবে মেয়েটির মন ভালো না থাকার খবর। আমির কয়েকবার সেঁজুতি কে ফ্রেশ হতে বললেন।সেঁজুতি নঁড়লোনা।শেফালী এসে চা দিলো।সেঁজুতি খেলোনা।সে থম ধরে আছে।আমির বুঝলেন ব্যাপারটা অত সিরিয়াস কিছু নয়।সিরিয়াস কিছু ঘটলে তার মেয়ে একদম স্বাভাবিক থাকবে।কেউ বুঝতেই পারবেনা ভেতরে কি চলছে?বাড়িতে নাওয়া খাওয়া বাদে আমিরের তিনটি কাজ, পত্রিকা পড়া,টিভি দেখা আর মাঝেমধ্যে সেঁজুতির পছন্দের নাস্তা বানানো।আমির এখনও পত্রিকাই পড়ছিলেন।ঘরবন্দী থাকতে থাকতে দিনের একটা পত্রিকাই দশ বার পড়ে সে।সময় কাটে।ভালোও লাগে।একটা দাঁড়ি কমাও বাদ পরেনা পড়া থেকে।আমির পত্রিকার কাগজটাকে ভাঁজ করে টি টেবিলের নিঁচের তাকে রাখলেন।মেয়ের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সেই কখন থেকে সেঁজুতি একভাবে বসে আছে।যেন বিয়ের গয়না চুরি করেছে কেউ।আমির আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না।প্রশ্ন করেই ফেললেন,
‘ আমার আম্মা!এসে থেকেই মুখ টা ওমন করে রেখেছেন কেন?
সেঁজুতি উত্তর না দিয়ে বাবার দিক ফিরলো।মাথা থেকে হাত নামিয়ে বাবু হয়ে বসলো।পরমুহূর্তে আবার মাথায় হাত দিলো।আমির অধৈর্য কন্ঠে বললেন,’ আহহা! এসবের কোনো মানে হয়? কিছু বলছিস না।ফ্রেশ হচ্ছিস না।চা টাও তো ঠান্ডা হয়ে গেলো।
সেঁজুতি একবার শরবত রুপী চায়ের দিকে তাকালো।আমির হাক পারলেন শেফালীকে।সে তখন রান্নায় ব্যাস্ত।বললেন চা টা আবার একটু গরম করে দিতে।
শেফালী যেতে যেতে বলল ‘ আফার মনে হয় জামাই মরছে।আমির শেফালী কে ছোট্ট করে ধমক দিলেন।এরপর একই প্রশ্ন আবার করলেন।সাথে একটু মিথ্যে মেজাজ নিয়ে বললেন ‘ সেঁজুতি! বাবা কিন্তু এবার রেগে যাচ্ছি।কি হয়েছে বলবি?

সেঁজুতি হা হুতাশ করতে করতে বলল
‘ আমি শেষ বাবা! আমি শেষ!
আমির আর্তনাদ করে বললেন ‘এসব আবার কী কথা?

সেঁজুতি দুঃখী দুঃখী মুখে বাবার দিকে তাকালো। আমির উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন
‘কি হয়েছে?
সেঁজুতি এতক্ষনে বলার জন্যে মুখ খুলল,
“কি হয়নি তাই বলো!অফিসের কাজে আমাকে এখন সিলেট যেতে হবে। তাও ওই বদমেজাজী,বদমাশ, বিভৎস, বেপরোয়া লোকটার সাথে।ভাবতে পারছো?? ওইরকম একটা লোকের সাথে আমি একা কাজে যাবো?ব্যাপার টা অনেকটা বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘের সামনেই ঘুমানোর মতনা?
কখনও কোন কাজে ভুল হলেই আমাকে খপাৎ করে গিলে ফেলবে।

আমির হেসে ফেললেন,
‘এই জন্যে তুই এতো চিন্তায় ছিলি এতক্ষন?
সেঁজুতি দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল
‘ তুমি হাসছো? এটা চিন্তার বিষয় নয়??

আমির দুইদিকে মাথা নেঁড়ে বললেন “একদম ই নয়।আরে বাবা অফিসের কাজে বাইরে যাবি এটা আর এমন কি?উল্টে তোর জন্যেই ভালো।নতুন নতুন এক্সপেরিয়েন্স হবে,অনেক কিছু শিখবি,তাছাড়া সিলেট তো কখনও যাসনি একবারে দেখেও আসলি!আর কাজ ঠিক ভাবে করলে কার সাধ্য আছে ভুল ধরার.
(একটু থেমে)তাছাড়া, সেদিন রুদ্র রওশন কে দেখে আমার অনেক অবাক লেগেছে।আমাদের বাড়ি এসে শাসিয়ে যাওয়া সেই লোকের সাথে সেদিনের ওনার কোনও মিল পাইনি।ওইদিন পার্কে ওনাকে আমার একটুও মনে হয়নি আদৌ এই লোকটা এতো টা অহংকারী।কি সুন্দর মিশলেন আমাদের সঙ্গে!ঘুরলেন,কথা বললেন।অহংকারী হলে কেউ অফিসের কর্মচারীর সঙ্গে এভাবে মেশে বলতো?
আমার মনে হয় ওনাকে আমরা যেমন টা ভাবি উনি আসলে তেমন নন।আর বাইরে থেকে একটা মানুষকে দেখলে কি আর বোঝা যায়?বুঝতে হলে তাকে অনেক কাছ থেকে দেখতে হয়। তার পাশে থেকে তাকে চিনতে হয়।তার সাথে মিশে তার ভেতর টা জানতে হয়।তবেই না বোঝা যাবে মানুষ টা কেমন?
সেঁজুতি মন দিয়ে শুনছিলো।মানস্পটে ভাসছিলো রুদ্রর সেদিনের উচ্ছ্বল মুখটা।বোঁকা বোঁকা প্রশ্ন গুলি।আর উত্তর পেয়ে কেমন বাচ্চা বাচ্চা চাউনি।সত্যিই লোকটাকে তার খারাপ লাগেনি ঐদিন।বরং অন্য রকম লেগেছে।একদম আলাদা।কিন্তু সেই লাগা দিয়ে কাজ হবে? কাজের বেলায় রুদ্র ভীষণ স্ট্রিক্ট। কোনো ছাড় দেবেনা।
আমির মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন,
তুই এতো ভাবিস না,আর ভয়ও পাসনা।দেখবি, যা হবে ভালোই হবে।

“কিন্তু সমস্যা তো আরও একটা আছে বাবা।
‘ আবার কী?
সেঁজুতি মায়া মায়া চোখে চেয়ে বলল,
“আমি গেলে তুমি একা কিভাবে কি করবে?
আমির এবারেও হাসলেন,
‘আরেহ পাগলী মেয়ে!শেফালী আছেনা?ওতো সব কাজ ই এগিয়ে দিয়ে যাবে।

” কিন্তু রাতে?

আমির কপাল চাঁপড়ে বললেন,
— উফফ! এই মেয়েটা কে নিয়ে আমি আর পারিনা।একটা পা গিয়েছে বলে কি তোর বাবার সব ক্ষমতাই চলে গিয়েছে নাকি?অন্য পা দিয়ে এগোতে তো পারি নাকি? তাছাড়া তুইতো আমার জন্যে স্ক্র‍্যাচ এনেছিস।আমার একা একা বিছানা থেকে নামতে কোনো অসুবিধাই হয়না এখন।তুই নিশ্চিন্তে যা তো…
আর এখনি আমাকে অভ্যেস করতে হবেনা? তোর বিয়ে হয়ে যখন শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি তখন তো আমাকে একাই…
সেঁজুতি বাবার হাটু আঁকড়ে ধরলো তৎক্ষনাৎ। মাথা গুঁজে বলল ‘ আমি কখনও বিয়েই করবনা।
আমির মৃদু হাসলেন।কিছু বললেন না।মেয়েকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেই বুক ভারী হয়ে আসে।কেন যে দুনিয়ার এই নিয়ম!
___

সেঁজুতি চটপট তৈরি হচ্ছে।রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলো।হাত পায়ে লোশন মাখছে এখন।ভেবেছিলো তাকে বাসে করে যেতে হবে।একা একাই।এরকম হলেই হয়ত বেঁচে যেত।কিন্তু হঠাৎ রুদ্র রাত বারোটার দিকে কল দিলো।প্রথমে তো সেঁজুতি বিশ্বাসই করতে পারেনি। যবে থেকে অফিস জয়েন করলো,রুদ্র কল দিলো এই প্রথম। সেঁজুতি দেরী করেনি।ফটাফট রিসিভ করেছে।রুদ্র তখন কড়া হুকুম জারি করে বলেছে ‘ সেঁজুতি কে তার সাথে গাড়িতে যেতে হবে।ওমনি সেঁজুতির মুখ চুপসে যায়।রুদ্র গাড়ির কাঁচ একদম খুলতে দেয়না।সেঁজুতির আদবকায়দাহীন চুল তার মুখের ওপর পরে নাকী! দ্বিতীয়ত সে এসির বাতাস ছাড়া চলতে পারেনা।তৃতীয়ত, এসিতে সেঁজুতির দম আটকে আসে।রুদ্রর সামনে নঁড়াচড়া করতে গেলেও হিসেব করতে হয়।সে নিশ্চয়ই রুদ্রর সামনে কানে হেডফোন গুঁজে গান শুনতে পারবেনা?বসের সাথে বেয়াদবি করা হবেতো! সিলেট তো আর বাড়ির কাছে নয়। অতটা রাস্তা কী তাহলে রোবটের মতোন বসে যাবে? ঘুমোতেও পারবেনা।বাই এনি চান্স যদি রুদ্রর কাঁধে মাথা পরে যায়? ভাবতেই সেঁজুতির গা ঠান্ডা হয়ে আসছে।একেতো লজ্জ্বায় দুইয়ে ভয়ে।রুদ্র যদি রাগে তাকে ছুড়ে মারে গাড়ি থেকে? কী হবে?সেঁজুতির অকূল ভাবনার ইতি ঘটলো কানের মিধ্যে উৎকট হর্নের শব্দে।নিশ্চয়ই রুদ্র এসেছে।সেঁজুতি তড়িঘড়ি করে ব্যাগ নিয়ে বাবার ঘরের দিক ছুটলো।

বাসার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু সেজুতি আসার নাম নেই। গাড়ির হর্ন আরো জোরে বাজালো রুদ্র।বিড়বিড় করলো,
“এই মেয়েটা আর শুধরালো না।সব কিছুতে লেট আর লেট! লেটুস পাতা একটা।
তখনি সেঁজুতি দৌড়ে আসতে আসতে বলল,
‘আরে আসছি আসছি, হর্ন বাজিয়ে মাথা খারাপ করে দিলো।
গাড়ির কাছে এসে থামলো সেঁজুতি।কাঁচ নামালো রুদ্র।সেঁজুতি মুখ দেখেই বুঝলো রুদ্র চঁটেছে বেজায়। হাপাতে হাপাতে বলল ‘ স্যরি স্যার।
রুদ্রর জবাব ‘ গাড়িতে উঠুন।
-‘ও হ্যা হ্যা।
সেঁজুতি উঠে বসতেই রুদ্র কিছু বলার জন্যে হা করলো।সেঁজুতি ধড়ফড় করে বলল,
‘ আপনি একদম আমাকে বকবেন না। আমি কিন্তু মাত্র ৪ মিনিট দেরি করেছি।

রুদ্র দাঁত চিবিয়ে বলল’ লিসেন?
( একটু থেমে)
না।আপনাকে কিছু বলে মুখে ব্যাথা বানিয়ে লাভ নেই।আপনি শুধরাবার পাত্রী নন।
রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিতেই সেঁজুতি জানলার দিক ফিরে মুখ ব্যাঁকালো।মনে মনে আওড়ালো ‘ নিজে যেন শুধরে উলটে দিয়েছে।

___
সেঁজুতির এখন সত্যিই মাথা ঘুরছে।একেতো সকালে খায়নি।দুইয়ে বন্ধ গাড়ি।এর ষোলকলা পূর্ন হচ্ছে যখন বাইরের দিকে তাকাচ্ছে।অন্যান্য দিনে গাছগুলোর ছোটাছুটি তার ভীষণ ভালো লাগে।অথচ এখন কেমন গা গোলাচ্ছে।বমি আসবে নাকী?ইয়া আল্লাহ! এই লোকের গাড়ি যদি বমি করে ভাসায়,তবেতো বিপদ।মহাবিপদ। লোকটা তাকে ভৎস করে দেবে। রুদ্র হঠাৎ বলে ওঠে,
‘ পেছনের সিটে খাবার আছে। খেয়ে নিন।
সেঁজুতি তড়িৎ গতিতে তাকালো।তখনও বোঝেনি রুদ্র কী বলল মাত্র।রুদ্র ড্রাইভ করছে মনোযোগ দিয়ে।সেঁজুতি বোঁকার মত চেয়ে আছে দেখে আবার বলল একী কথা।সাথে একটু ঝাঁঝ নিয়ে বলল ‘ কানেও কম শুনছেন। বাহ! আর কি কি গুন আছে আপনার?

সেঁজুতির উত্তর দেয়ার সময় নেই। তার খিদে পেয়েছে।তাও অতিমাত্রায়। চটপট পেছনের সিট থেকে পাউরুটি আর জেলি নিয়ে খেতে শুরু করলো।রুদ্র গাড়িতে ওঠার আগে কিনে ছিলো এসব।সাথে জুস,কলা, আরও অনেক শুকনো খাবারও আছে।মাঝ রাস্তায় তো অতবার গাড়ি থামানো যাবেনা।বিকেল তিনটায় মিটিং আছে।গিয়ে বিশ্রাম ও নিতে হবে।হাল্কা ক্ষুধা লাগলে খাওয়া যাবে। রুদ্র
কিয়ৎ হাসলো।ঠিক বুঝেছে সেঁজুতি খায়নি। সাথে অবাক ও হচ্ছে ‘ মেয়েদের মুখ দেখে মন বোঝার ক্ষমতা কবে হলো তার?
সেঁজুতি খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো ‘ আপনি খাবেন না?
রুদ্র ছোট করে বলল ‘ না।
সেঁজুতি আবার বলল
‘একটা কথা বলবো?
‘ হু।
সেঁজুতি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল’ এসি টা বন্ধ করে দিন না।আমি একিটু জানলাটা খুলি?
রুদ্র মুখের ওপর বলল ‘ না।
‘ প্লিইইইইইজ!
‘ No
‘আর কক্ষনও লেট করবোনা।প্রমিস!
রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
‘ আপনার মনে হয়,আপনি লেট করে এসেছেন বলে আমি না করছি?
সেঁজুতি অসহায় কন্ঠে শুধালো,
‘তাহলে?
রুদ্র ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলল ‘ জানলা খুললেই আপনার চুল আমার মুখে এসে পরে।আমার যে তখন কী হয়,আপনি কীভাবে বুঝবেন!কোনো রিস্ক আমি নেবনা।

‘ কি ভাবছেন? খুলব জানলা?
‘ না বললাম তো!
সেঁজুতি ঠোঁট উলটে বলল ‘ এমন করছেন কেন? আমিতো বললাম আর দেরী হবেনা।কক্ষনও না।

রুদ্র বিদ্রুপ করে বলল ‘ আপনার মাথায় বেশ বুদ্ধি।টের পাচ্ছি আমি।
সেঁজুতি সন্দিহান কন্ঠে বলল
‘ প্রশংসা করলেন?
‘ এবারতো আরো ক্লিয়ার হলো।বুদ্ধির নমুনা।

সেঁজুতি নাক মুখ ফোলালো।লোকটা তার বুদ্ধি নিয়ে কথা তুলে অপমান করলো?এর একটা জবাব দেয়া উচিত না? ঝগড়ার কঠোর প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
‘শুনুন আপ…
রুদ্র থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ আপাতত কিছু শুনতে চাইছিনা।আপনার যদি কিছু বলতেই হয় তবে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে বলবেন।

সেঁজুতির মুখটা এবার থমথমে হয়ে এলো।চোখ কপালে তুলে বলল,
“আবার অপমান? আপনার গাড়িতে উঠেছি বলে আমাকে কথা শোনালেন? এই ছিলো আপনার মনে?আমিতো বলেইছিলাম আমি বাসে চলে যাবো,কেনো এলেন আপনার এই গাড়ি নিয়ে? আমি কী যেঁচে উঠেছি? এর আগেও একবার গাড়ি নিয়ে খোঁটা দিয়েছেন।গাড়িকে কী মনে করেন? পঙ্খিরাজ ঘোড়া?
সেঁজুতি মুখ কুঁচকে বলল ‘ এটা একটা গাড়ি হলো?কি কালো?? দেখলেই মনে হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে অন্ধকার রাজ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছি।এমন গাড়িতে চড়ার থেকে পায়ে হাটাও ভালো।এক্ষুনি নষ্ট হয়ে যাক এটা।আমাকে খোঁটা দেয়া না?দেখবেন গরীবের অভিশাপ ফল….
পুরোটা শেষ করার আগেই গাড়িটা ঢুলতে ঢুলতে অফ হয়ে গেলো।সেঁজুতির কথা বন্ধ হয়ে গেলো সাথে সাথে।রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে লাভ হচ্ছেনা।সেঁজুতি মিনমিনিয়ে বলল,
‘ কী হলো এটার??আমিতো এমনি এমনি বলেছি,ওকী সিরিয়াসলি নিয়ে নিলো?সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গেলোনাতো?

সেঁজুতি চোখ বড় করে রুদ্রর দিকে তাকালো ওর উত্তরের আশায়।রুদ্র চুপচাপ দরজা খুলে বের হলো।এতটা পথ এই প্রথম ড্রাইভ করছে।সাথে এত গরম।তাও জার্নি টা খারাপ লাগছিলোনা।বরং মনে হচ্ছিলো জীবনের সব থেকে সুন্দর জার্নি এটা।অথচ এখন গাড়িটাই খারাপ হয়ে গেলো? পথ তো আর বেশি নেইও।অলমোস্ট সিলেটে তারা।এতক্ষন সেঁজুতির বকবকে বিরক্ত না হলেও এখন মেজাজ প্রচন্ড তেঁতে আছে।ফোন করে রেহান কে ঝাঁড়লো কিছুক্ষন।কেন সে গাড়ি চেক করে দিলোনা? তাতেও রাগ মিটলোনা যখন,গাড়ির সাইডে সজোরে একটা লাথি মারলো।সেঁজুতিও বেরিয়েছে ততক্ষনে।রুদ্রকে গাড়িতে লাথি মারতে দেখে চুপসে গিয়ে বলল,
‘বেচারা গাড়িতে লাথি মেরে কি লাভ!
রুদ্র চোখ পাঁকাতেই সেঁজুতি নিঁচু কন্ঠে বলল,

— এ..এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো,আমি কি করেছি?
অন্যদিকে মুখ ঘোরালো রুদ্র।সেঁজুতি চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“গাড়িতো খারাপ হয়ে গেলো। এবার কি করবো আমরা?
রুদ্র হঠাৎই চেঁতে বলল,
— নাঁচতে ইচ্ছে করলে নাঁচুন,বাট ডোন্ট ডিস্টার্ভ মি।
সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল
— আমি আবার আপনাকে কখন ডিস্টার্ভ করলাম?
‘আপনার এই বকবকানি গুলোই আমার বিরক্তির মূল কারন।
‘ওকে নিন চুপ করলাম।
ঠোটে আঙুল দিয়ে অন্যদিকে তাকালো সেঁজুতি। মুখটা হা হয়ে এলো একটু দূরে চোখ যেতেই।ঠোঁট গোল করে বলল,
‘ওয়াও!কি সুন্দর!

রুদ্র সেঁজুতির চোখ অনুসরন করে চাইলো। সাড়ি সাড়ি সবুজ চা বাগান, আর পাহাড় ছাড়া তার চোখে কিছুই পরলোনা।এই মেয়ে এত খুশি হলো কীসে?সেজুতির চেহারায় একরাশ উচ্ছ্বাস।দৃষ্টিতে মুগ্ধতা।আর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি।
এতক্ষনের জমে থাকা বিরক্তিটা নির্নিমেষ কেটে গেল রুদ্রর।সঙ্কুচিত ভ্রু জোড়া সোজা হলো। ভ্রু নাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘সিলেটে প্রথম বার?
‘ হু
‘চলুন..
‘ কোথায়?
‘ এলেই বুঝবেন।
রুদ্র লম্বা পা ফেলে এগোলো।কথা না বাড়িয়ে পিছু নিলো সেঁজুতি।
___
দুপাশে চা বাগান।মাঝখানে সরু রাস্তা।অনেকটা ক্ষেতের আঈলের মতো আঁকাবাঁকা, উঁচু নিঁচু।সেই রাস্তা ধরে রুদ্রর পাশে পাশে হাটছে সেজুতি।উৎসুক চোখে এদিকে ওদিক তাকাচ্ছে।মন দিয়ে অবলোকন করছে সিলেটের অন্যতম প্রধান সৌন্দর্য।

রুদ্রর এসবে আগ্রহ কোথায়?সে মহাব্যাস্ত ফোনের নেটওয়ার্ক পেতে।অনবরত কারো নাম্বার ডায়াল করছে।কিন্তু এক দাগ নেটওয়ার্ক যদি উঁকি দিতো ফোনে।
সেঁজুতি যখন সবটা মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করছে তখনি বাগানের পাশ ঘেষে একটা সাপ বের হলো।মূলত চা বাগানের ভেতর থেকেই বেরিয়েছে।সেঁজুতি দেখতেই আকাশে উঠে এলো চোখ।গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার ছুড়লো,

“সাপ, সাপ, স্যার সাপ
গলার সব টুকু জোড় কাজে লাগিয়েছে সেঁজুতি। শুধু কী তাই? উত্তেজনায় পাশে হাটতে থাকা রুদ্রর এক বাহু শক্ত করে চেপেও ধরলো।রুদ্রর কানে তালা ঝুলে গিয়েছে সেঁজুতির চিৎকারে।উদগ্রীব হয়ে বলল
‘ কোথায় সাপ?কোথায়?
সেঁজুতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল
‘নেই।
চলে গিয়েছে,ওদিকে।
রুদ্র চিন্তিত কন্ঠে শুধালো, ‘ আপনি ঠিক আছেন?
সেঁজুতি হাসলো। নাকী হাসার চেষ্টা করলো? নিজেকে ভীতু প্রমান করার হাত থেকে রক্ষা করতে বলল,
— আরে সাপ টা তো আমার কাছেই আসেনি।ওদিকে থেকে ওদিকে গিয়েছে( আঙুল দিয়ে দেখালো)হয়তো ভয় পেয়েছে।

রুদ্র স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ আসল ভয়টা কে পেয়েছে, সেটা চিৎকার শুনেই বুঝতে পেরেছি।
সেঁজুতি মুখটা ছোট করে ফেলল।
রুদ্রর হঠাৎ খেয়াল পরলো নিজের হাতের দিকে।যেটা সেঁজুতি আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এখনও। রুদ্র একবার সেঁজুতির দিকে তাকালো,একবার ওর ধরে রাখা হাতের দিকে। সেঁজুতির ভ্রুক্ষেপ নেই ওদিকে।ভয়ে ভয়ে বাগানের চারপাশে তাকাচ্ছে। এক কথায় সাপ খুজছে সে।রুদ্র আস্তে করে সেঁজুতির হাতটা সরিয়ে দিলো।হঠাৎ ঘটায় চমকে তাকালো সেঁজুতি। পরমুহূর্তে পুরো বিষয়টা মাথায় ঢুকলো তার।এতক্ষন ওনার হাত জড়িয়ে রেখেছিলাম আমি?ছি! কি ভাবলেন উনি? সেঁজুতি লজ্জ্বায় মাথা যে নিচু করলো, তুললোইনা আর।
সেজুতি লজ্জ্বাটা বুঝলো রুদ্র। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে গলা খাঁকারি দিয়ে কেশে নিলো।সেঁজুতির দিকে তাকাচ্ছেনা।সেঁজুতিও তাকিয়ে নেই।রুদ্র সহজ কন্ঠে বলল,
‘আমি একটা কল করে আসছি,এখানে নেটওয়ার্ক এমারজেন্সি হয়ে আছে।আপনি এখানেই দাড়ান।আর হ্যা বেশি নঁড়াচড়া করবেন না।সাপ কিন্তু একটা নেই এখানে, থাকলে অনেক গুলোই আছে।
শেষ কথাটা সেঁজুতি কে ভয় দিতে বলল।সেঁজুতি ভয় পেলোও।চোখ গোল করে ভয়ে ভয়ে বলল,

‘ সস্যতি?
রুদ্র মুখটা গম্ভীর রেখে হাটা ধরলো।উলটোপথে চলতেই মিটিমিটি হাসলো।
___
” স্যার আপনি লোকেশন পাঠান।আমি এক্ষুনি আপনাদের পিক করতে গাড়ি পাঠাচ্ছি।
‘হু।আপনার গাড়ি যেন বিশ মিনিটের মধ্যে আসে।
‘ জ্বী স্যার।একদম লেট হবেনা।
‘ রাখছি।
লাইন কেটে লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে রুদ্র আগের জায়গায় এসে দাঁড়ালো।
সেঁজুতি কোথায়? এদিক ওদিক তাকালো রুদ্র।আশেপাশে দেখা যাচ্ছেনাতো।গেলেন কোথায়?
একটু সামনে এগিয়ে নাম ধরে ডাকলো রুদ্র।সাঁড়া এলোনা।রুদ্র অনেকবার ডাকলো।গলার সব টুকু জোর দিয়ে।সাড়া নেই।এবার টেনশন হচ্ছে রুদ্রর।অচেনা জায়গা কোথায় গেলো এই মেয়ে?
রীতিমতো ঘাম ছুটলো।বুকের মধ্যে ধুকপুক শব্দ হচ্ছে।ভয়ে ঢিপঢিপ করছে।কিছু হারিয়ে ফেলল সে।অনেক দামী কিছু।এমন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পরছে গোটা প্রসস্থ দেহ।

‘সেজুতি! সেঁজুতি? কোথায় আপনি?? এট লিস্ট সাড়া তো দিন….
জোরে ডাকাডাকি করেও লাভ হচ্ছেনা।প্রকৃতি নিশ্চুপ হয়ে আছে।মাঝে মাঝে কটা বুনো পাখির ডাক ছাড়া কোনো শব্দ নেই। রুদ্রর গলা শুকিয়ে এলো।ছুটতে ছুটতে অনেকটা পথ এসেছে।রুদ্র হাপিয়ে গেলো।থেমে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে চারপাশে তাকালো,
‘কোথায় গেলেন আপনি?কেনো আপনাকে একা রেখে গেলাম!এখন যদি আপনার কোনও ক্ষতি হয় আমি যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।
আচ্ছা আপনি ইচ্ছে করে লুকিয়ে নেইতো? লুকোচুরি খেলছেন আমার সাথে?খুব খারাপ হয়ে যাবে তাহলে।খুব খারাপ,,
নিজের সাথে বিড়বিড় করলো রুদ্র।মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। এক হাত কোমড়ে রেখে অন্য হাত দিয়ে মাথার চুল খাঁমচাতে শুরু করলো চিন্তায়।
কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে আঁওড়ালো,
‘প্লিজ আসুন,,,প্লিজ,প্লি….
বলতে বলতে হাতের ডান দিকে তাকালো রুদ্র। একটু দূরে গাছের আঁড়াল থেকে হলুদ রংয়ের কিছু উড়তে দেখে চোখ আটকালো।হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে ছূট লাগালো রুদ্র।যা ভেবেছিলো ঠিক তাই।
নীল রঙয়ের একটা প্রজাপতি বসেছে গাছের ডালে।সেঁজুতি পা টিপে টিপে এগোচ্ছে ধরার জন্যে।
রাগে চোখ লাল হয়ে এলো রুদ্রর।
‘এই মেয়েটা তার মাথা খারাপ করে দিয়ে এখানে প্রজাপতি ধরছে?এতটা বাচ্চামো একটা ম্যাচিউরড মেয়ের থেকে রুদ্র আশা করেনি।এত দিনকার সেঁজুতির সঙ্গে যেন এর আকাশ পাতাল তফাৎ। কত বড় সাহস এই মেয়ের!কোনও ধারনা আছে ঠিক কতোটা ইরেসপন্সেবলের মতো কাজ করেছে?
দাঁতে দাঁত খিচিয়ে এগিয়ে গিয়েই সেজুতির এক হাত ধরে নিজের দিকে ফেরালো রুদ্র। সেঁজুতি কেঁপে উঠলো হঠাৎ কেউ এভাবে ধরায়।এবার তাকে পৃথিবীর সব থেকে বড় চমক উপহার দিয়ে রুদ্র ঠাস করে একটা চঁড় বসালো গালে।সেঁজুতির চোখ ঘোলা হয়ে এলো।মাথা চক্কর দিলো।গাল ঝিমঝিম করে উঠলো।কান গরম হয়ে এলো। পা দুটো টলছে।এক্ষুনি পরে যাবে।মরে যাবে হয়ত,
তারপর নিউজ বের হবে ‘ চঁড় খেয়ে এক অবলা তরুনীর মৃত্যু!

চলবে…..

প্রনয় পর্ব-১৬

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৬
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নতুন ভোরের সূচনা।সাথে সব মন খারাপের অবসান।সেঁজুতি সারারাত ছটফট করেছে উত্তেজনায়।এক ফোঁটা যদি ঘুম আসে।নেহালের মরদেহ দেখে রাতে খেতেও পারেনি।বমি করেছে কয়েকবার।এত নৃসংশ ভাবে একটা মানুষকে আরেকটা মানুষ কীভাবে মারে কে জানে? অজ্ঞাত খুনিকে পুলিশ খুঁজছে।কঠোর সাজা হবে তার।কিন্তু সেঁজুতি খুনির ওপর প্রসন্ন।জঘন্য লোকটির জঘন্য মৃত্যুতে মনে মনে ও শান্তিই পেয়েছে।প্রথম কয়েক দফায় তো বিশ্বাসই হয়নি এটা উনিই কীনা।চেহারার যাচ্ছে তাই অবস্থা।পুলিশ আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে বলেই নাম ধাম তুলে দিয়েছিলো শিরোনামে।দেখেই ভয়ে থরথর করে কেঁপে ওঠে সেঁজুতি। পছন্দের সেমাই আর খাওয়া হয়নি।মাথায় তখন নেহাল ঘুরছিলো।দুপুরের ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা মনে করে শরীর অবশ হয়ে আসছিলো।অথচ বাবাকে কিচ্ছু বুঝতে দেয়নি।নিজেকে সামলানোর দারুন ক্ষমতা তার।চুপচাপ উঠে নিজের রুমের দিক যায়।বাথরুমে গিয়েই বমি করে ভাসায়।তারপর টানটান হয়ে লেপ্টে থাকে বিছানায়।আমির কতবার খেতে ডাকলেন তাও উঠে যায়নি।রুম থেকেই আওয়াজ পাঠালো ‘খাবনা ‘বলে।চোখের সামনে একটা লোককে সুস্থ দেখে এসে, রাতেই তার বিভৎস মরদেহ দেখাটা সেঁজুতির স্নায়ু তৎক্ষনাৎ নিতে পারেনি।ফলে শরীর আরো নেতিয়ে গেছিলো।তবুও প্রশান্তি লাগছিলো খুব।সারাটা দিন চিন্তায় তার মাথা ঠিক ছিলোনা।কাজে অনেক ভুল করেছে।রুদ্র বলেছে এক, সে করেছে আরেক।জোর পূর্বক মাথা ঠান্ডা আর মুখ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় হয়ত ত্রুটি ছিলোনা,কিন্তু মন তখনও অশান্ত,অবিচল।কিছুতেই ঘটনা গুলো মেনে উঠতে পারেনি। নেহাল প্রতাপশালী ব্যাবসায়ী।নিশ্চয়ই অনেক ক্ষমতা।সে যা করে এলো নেহাল তো এমনি এমনি ছেড়ে দেবেনা।রাস্তাঘাট থেকে তুলে নিয়ে যাবে কী? নাহয় এসিড মেরে মুখ ঝলসে দেবে।অথবা গাড়ি চাপা দিয়ে মারবে।এসব ভেবেই ভয়ে আঁটশাট হয়েছিলো সেঁজুতি। ফলে কাজেও মন ছিলোনা।ভুল হয়েছে অনেক।কিন্তু, যে রুদ্র তাকে কথা শোনানোর সুযোগ খোঁজে সে কাল ছিলো নির্লিপ্ত।যেন বকাঝকা কাকে বলে জানেই না।সেঁজুতির একটা ভুলেও তাকে কিচ্ছু বলেনি।শুধু ঠান্ডা নজরে দেখে গেছে,শান্ত ভাবে ঠিক কর‍তে বলেছে।সেঁজুতির মনে তখন কালবৈশাখি। তাই রুদ্রর অদ্ভূত আচরন গুলো খেয়াল করেনি।রুদ্র প্রায় এক ঘন্টা অফিসে থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। সারাদিনে আর আসেনি।আজতো আসবে, আজ আবার লোকটার মুখোমুখি হবে।কাল কে রুদ্রর বলা কথাগুলো মনে পড়লেও সেঁজুতির রাগ তরতর করে বাড়ছে।সেঁজুতি চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ডুবে ছিলো ভাবনায়।ফোনের টোন বাজতেই ঘোর কাটলো তার।বিছানা থেকে ফোন তুলে দেখলো তোহার মেসেজ।সামনের মাসের শুরুতে সেমিস্টার ফাইনাল।তারই ছোট্ট বার্তা।সেঁজুতি মৃদূ হাসলো।মেয়েটা না চাইতেই সব তাকে টাইমলি মনে করিয়ে দেয়।সেঁজুতির রেজাল্ট যাতে কোনো ভাবেই খারাপ না আসে তোহা তাতে ভীষণ তৎপর। সেঁজুতি দম ফেলল। তার ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা বড় নগন্য।অথচ সেই নগন্য সংখ্যাটাই তাকে প্রান উজাড় করে ভালোবাসে।যেমন বাবা,তেমন হোসাইন আঙ্কেল,তার স্ত্রী,আর তোহাও।এদের ভালবাসায় তার সব মন খারাপ কর্পূরের মতো উবে যায়।সেঁজুতি কাঁধ ব্যাগ গুছিয়ে বের হলো।আজ সে আরো একটা কাজ করেছে।স্প্রে বোতলের মধ্যে মরিচের গুড়ো গুলে নিয়েছে।কালকের মতো যদি কিছু হয়? মেয়ে মানুষ! বিপদ আপদের বালাই নেই।বুদ্ধি করে না চললে কেউ বাঁচাতে আসবেনা।কেউনা।সেঁজুতি বাড়ির সামিনের রাস্তা ধরে হাঁটছে।মাথায় তখন ও নেহালের কথা ঘুরছে।লাশের চেহারা ভেসে উঠছে চোখে।
কিন্তু লোকটাকে মারলো কে?মেরে আবার মুখ থেতলে দিয়েছে।বলাই যায় বেশ কষ্ট দিয়ে মেরেছে।হাত কেটে দিয়েছে একটা।সারা শরীরে ক্ষত।সেঁজুতির আবার গা গুলোলো।ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে খেলো।মোড়ের মাথায় এসে রিক্সা ডেকে উঠলো।অফিসের কাজের চাপে থাকলেই হয়ত মাথা থেকে বের হবে এসব।

রিক্সার মিনমিনে গতিতে সেঁজুতির ঘুম পাচ্ছিলো খুব।বাইরে ফুরফুরে হাওয়া যেন ষোল কলা পূর্ন করলো তার।একেতো রাতে ঘুম হয়নি।সকাল বেলা উঠে রান্নাবান্না,সব মিলিয়ে এখন দুচোখে রাজ্যের ঘুম ভর করেছে।চোখের পাতা খুলে রাখাই দ্বায়।অফিসের ক্যান্টিন থেকে এক কাপ স্ট্রং কফি খেতে হবে।কিন্তু সে অব্দি যেতে পারলে হয়।ঘুমে ঢুলে বোধ হয় এখানেই পরবে।চোখে দেখছেও অন্ধকার।সেঁজুতি কোনও মতে রিক্সা থেকে নেমে অফিসের দিক হাঁটা ধরলো। আর ওমনি ধাক্কা।অকষাৎ ধাক্কা খেয়ে পরতে পরতে বাঁচলো।সামনের শক্ত জিনিস টাকে দেখতে তাকালো।চোখের সামনে স্পষ্ট তখন রুদ্রর গম্ভীর মুখটা।সেঁজুতির আর কফির প্রয়োজন পরেনি।রুদ্রকে দেখতেই ঘুম শেষ। ভর করলো এক ঝাঁক রাগ।পাশ কাটিয়ে চলে যাবে ভাবলো।এর আগেই রুদ্র গমগমে কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ চোখ কী আকাশে রেখে হাটেন?নাকি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিলেন।বস কে তো বস মনেই করেন না।তার কেবিনে নক না করে ঢোকেন,মুখে ফাইল ছুড়ে মারেন।এবার কী ধাক্কা দিয়ে ফেলার ইচ্ছে হলো?
মুখ টা কালো হয়ে এলো সেজুতির।সেতো দেখতেই পায়নি।দেখলে কী ধাক্কা খেতো? কখনওই না।উলটে রুদ্রর থেকে একশ হাত দূরে দূরে থাকতো।
সেঁজুতির চুপ থাকা রুদ্রর হজম হয়নি।
” কিছু বলছি…
‘ শুনতে পেয়েছি।
কথাটা বলে সেঁজুতি রুদ্রর দিকে তাকালো।ঘুমুঘুমু চোখ দুটো তীরের বেগে রুদ্রর বুকে বিঁধলো বোধ হয়।তৎক্ষনাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিলো সে।শুকনো ঢোক গিলল।রুদ্রর মুখ ঘোরানোটা অদ্ভূত লাগলো সেঁজুতির।ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে তৈরী হয়েছিলো।মুখে কিছু লেগে আছে ভেবে হাত বোলালো একবার।রুদ্র অন্যদিক চেয়ে থেকেই বলল
” আপনি শুনতে পেলে উত্তর দিলেন না কেন?আমার কথার পিঠে চুপ থাকার মত সাহস কোথায় পেলেন?

সেঁজুতি যেন আকাশ থেকে পরলো।এমন কথা বাপের জন্মে শোনেনি ।কারো কথার পিঠে চুপ থাকা একটি অপরাধ? রুদ্র না বললে তো জানতেই পারতোনা।জবাবে বলল,
‘ আমি আপনার সাথে সকাল সকাল কথা বলে মুড খারাপ করতে চাইছিনা।
রুদ্র তড়িৎ বেগে তাকালো,
‘হোয়াট?? হোয়াট ডিড ইউ সে….?
সেঁজুতি থতমত খেয়ে বলল ‘ ককিছুনা।কিছুনা।
সেঁজুতি আবার চুপ করে যায়।রুদ্র সামনে দাড়িয়ে থাকায় সে যেতেও পারছেনা।আবার রুদ্রকে সরতে বলতেও পারছেনা।রুদ্র চাইছে সেঁজুতি কথা বলুক।কাল মেয়েটার ওমন চুপসে যাওয়া তার একদম ভালো লাগেনি।অথচ সেজুতি যেন তালা এঁটেছে মুখে।কিছুক্ষন পর সেঁজুতি বলল ‘ আমি কী যেতে পারি স্যার?
রুদ্র সানগ্লাস ভেদ করে সেঁজুতির অধৈর্য মুখভঙ্গি দেখছে।কথাটা কতটা রয়েসয়ে বলেছে মেয়েটা, সে জানে।মন থেকে মেয়েটি তাকে আদৌ এত সন্মান করে নাকী! রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলে,
— আপনাকে ভেতরে যেতে হবেনা।
সেঁজুতি ঘাঁবড়ে গেলো।ভেতরে যেতে মানা করছেন কেন? চাকরি টা কী নেই?।রুদ্র কী কালকের জন্যে তাকে বার করে দিলো?বার করে দিলে সে অত গুলো টাকা কোথা থেকে দেবে? তার চৌদ্দ গোষ্ঠী হাটে বেঁচলেও পাঁচ কোটি পাওয়া যাবেনা।
কাঁপা কন্ঠে শুধালো ‘ ককেনো?
রুদ্র হঠাৎই ক্ষ্যাপাটে ষাড়ের মতো আচরন করলো,মেজাজ নিয়ে বলল,
— আপনি এতো প্রশ্ন কেনো করেন?বলেছিনা বসের মুখের ওপরে প্রশ্ন করবেন না? আপনি আসলেই অভদ্র।
সেঁজুতির মুখটা থমথমে হয়ে এলো অপমানে।জীবনে প্রথম কেউ তাকে অভদ্র বলল।
রুদ্র আবার বলল,
‘রুদ্র রওশন চৌধুরী জবাব নিতেই পছন্দ করে, দিতে নয়।এনি ওয়ে, গাড়িতে উঠুন।যান।

সেঁজুতি ঠোঁট কাঁমড়ালো।গাড়িতে উঠবে কেন? রুদ্র ধমকে বলল ‘ Go!
সেঁজুতি কেঁপে উঠে ধড়ফড় করে গাড়ি তে গিয়ে বসলো।কিন্তু পেছনে।রুদ্র ড্রাইভিং সিটে বসলো এসে।গাড়ির লুকিং গ্লাসের দিকে চেয়ে বলল
“পেছনে বসেছেন কেনো?? আমি ড্রাইভ করবো আর আপনি গাড়ির পেছনে বসবেন?কেনো? আমি কি আপনার ড্রাইভার?
সেঁজুতি মুখ কোঁচকালো।মনে মনে আওড়ালো,
— আজব তো!ভাবলাম পি- এ বসের পাশে বসলে ওনার সন্মানে লাগবে তাই তো পেছনে বসেছি।এই লোকটা এতোটা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কিভাবে ভাবতে পারে,, আল্লাহই জানে।
‘ সামনে আসুন।
সেঁজুতি সামনে এসে বসলো চুপচাপ।
রুদ্র সিট বেল্ট বেঁধে দেয়ার জন্যে এগোলে থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমি পারবো,,সেদিন দেখে নিয়েছি।
‘ ওকে।
রুদ্র সোজা হয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।ততক্ষনেও সেঁজুতির বেল্ট বাঁধা হয়নি বলে পেছনে হেলে পরলো একদম।নঁড়বড়ে হাতে অনেক সময় নিয়ে বাঁধলো শেষে। রুদ্র পুরোটাই খেয়াল করলো।বললনা কিছু।গাড়ির কাঁচ তুলতে গেলে সেঁজুতি মিনমিনিয়ে বলল ‘ একটু খোলা থাকুক না! আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
রুদ্র উত্তরে নিশ্চুপ।নিরবতা সম্মতির লক্ষন হিসেবে ধরে নিলো সেঁজুতি।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো হাইওয়ের ওপর দিয়ে গাড়ি চলার সময়। খোলা জায়গা পেতেই বাতাসের ঝাপটায় সেঁজুতির চুল উড়াউড়ির পাল্লা দিলো।আর সব পরছে তো পরছে,রুদ্রর মুখের ওপর। রুদ্র কয়েকবার সরিয়ে দিলো। কাজই হচ্ছেনা।ওদিকে সেঁজুতি ও বারবার হাত দিয়ে চেপে ধরছে।রুদ্র শেষ মেষ বিরক্ত হয়ে বলল ‘ চুল সামলাতে না পারলে কেটে ফেলুন।এভাবে মুখের ওপর এসে পরছে কেন?ডিসকাস্টিং!
সেঁজুতি উপায় না পেয়ে গাড়ির জানলা আটকে দিলো। রুদ্রও এসি অন করলো।পুরো রাস্তা মুখ অন্ধকার করে রাখলো সেঁজুতি।একটু না হয় মুখের ওপর পরেইছে তাতে এমন করার কী হলো? এই চুল বড় করতে তার কত সময় লেগেছে লোকটা জানে? নির্দ্বিধায় বলল কেটে ফেলতে।নিজের টা কাটলেই পারে!এরপর গাড়ি এসে একটি বিশাল বাড়ির আঙিনায় থামলো।সেঁজুতি কে নামতে বলে রুদ্র নিজে নেমে গেলো আগে আগে।সেঁজুতি নেমে সামনে তাকাতেই মুখ হা হয়ে এলো।এতো লোকজন বাড়ির সামনে?বিড়বিড় কিরে বলল ‘ কার বাড়ি এটা?
রুদ্র তখন সেঁজুতির পাশে এসে দাঁড়ানোয় শুনতে পেলা।নিরুদ্বেগ কন্ঠে বলল ‘ নেহাল উদ্দিনের বাড়ি।
সেঁজুতি হতবাক।ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এই লোকের বাসায় আমাকে কেনো এনেছেন?
‘ কাজ আছে।
‘ আপনার আছে তো আপনি আসতেন। আমি কেনো আসবো..?
রুদ্র রেগে গেলো,
‘ মুখে মুখে তর্ক করবেন না।মিস্টার নেহাল আমার অনেক কাজের একজন লোক ছিলেন।ওনার আকষ্মিক এমন মৃত্যু তে আমাদের সবার ই খারাপ লেগেছে।তাই আমাকে আসতে হতো, আর আপনি যেহেতু আমার পি -এ তাই অবশ্যই আপনিও আসবেন তাইনয় কি?
সেঁজুতি চুপ মেরে যায়।বলার কিছু নেইও।রুদ্রর যুক্তিতো একদম ঠিক।রুদ্র লম্বা পা ফেলে সামনে এগোতেই সেঁজুতি ও পিছু নিলো ওর।বাড়ির ভেতর যৎসামান্য ফাঁকা নেই।লোকজনে গিজগিজ করছে।মৃত লোকের বাড়ি বলেই এমন, সেঁজুতি এতক্ষনে বুঝেছে সেটা।কিন্তু অবাক না হয়ে পারছেনা।একটা লোকের চোখেও যদি পানির দেখা মেলে।পেটের মধ্যে কৌতুহল রাখতে না পেরে রুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,

” আচ্ছা কেউ কাঁদছেনা কেনো?? মৃত লোকের বাড়িতে তো কান্নার রোল পরে যায় আর এখানে সবাই কী স্বাভাবিক!
জবাবে রুদ্র উদ্বেগহীন কন্ঠে বলল,
” কে কাঁদবে?? কেউ থাকলে তো!নেহালের সাতকূলে কেউ নেই।
‘ তাহলে এরা কারা?ওনার স্ত্রী সন্তান ও নেই? এত বয়সের একটা লোক বিয়ে করেন নি?
সেঁজুতির আগ্রহে রুদ্র চোখ ছোট করে তাকায়।পরমুহূর্তে সামনে তাকিয়ে বলে ,
” এরা ওনার ব্যাবসায়ীক লোকজন।ওনার বাবা মা নেই।স্ত্রী আর এক মেয়ে ছিলো। নেহালের চারিত্রিক দোষের জন্যে ওনার স্ত্রী ওনাকে ডিভোর্স দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বিদেশ চলে গিয়েছেন।
” উনি আর বিয়ে করেননি?
” না।
‘ কেন?
রুদ্র কপাল কুঁচকে বলল ‘ আমি কী করে জানব?

সেঁজুতি নিজের মতো ভেবে নিলো ‘ লোকটার চরিত্র ভালোনা।মেয়ে নিয়ে পরে থাকলে কী আর বিয়ের দরকার হয়? তবে ওনার স্ত্রী একটা ভালো কাজ করেছেন ওনাকে ডিভোর্স করে। দুশ্চরিত্র লোকের সাথে সারাজীবন কাটানোর থেকে একা থাকাও ভালো। শেষ কথাটা বিড়বিড় করলো সেঁজুতি। কিন্তু রুদ্রর কানে ঠিক পৌঁছোলো।শীতল চোখে সেঁজুতি কে দেখলো সে। ভেতর থেকে কোথাও প্রশ্ন উঠলো ‘ আমিও কী দুশ্চরিত্র?

সেঁজুতি চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়িটা পর্যবেক্ষন করছে।পুলিশ এসেছে বাড়িতে।এছাড়া বাকিরা ফরমাল পোশাক আশাকের লোকজন।রুদ্র দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ফোনে।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ভরাট কন্ঠে ডাকলো,
” এক্সকিউজ মি ম্যাম!

সেঁজুতি ফিরে তাকালো।পুলিশের এক লোক দাঁড়িয়ে। আস্তে করে বলল,
‘ জ্বি? আমাকে বলছেন?
‘ জ্বি।আমি উত্তরা থানার ও-সি মাহবুল আলম।নেহালের ব্যাপারে আপনার একটা স্টেটমেন্ট দরকার আমাদের।
সেঁজুতি বুঝলোনা,
” আমার স্টেটমেন্ট? কিসের জন্যে?
‘ নেহালের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করার জন্যে ম্যাডাম।গতকাল ওনার অফিসে উনি আপনার সন্মান হানি করতে চেয়েছিলেন শুনলাম।

সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বলল ‘ সেটা আপনি কি করে জানলেন?
লোকটি জবাব দেয়, ‘ আপনার বস মিস্টার রুদ্র রওশন চৌধুরী আমাদের জানিয়েছেন।
বিস্ময় নিয়ে একবার দূরে ফোনালাপে ব্যাস্ত রুদ্রকে দেখে নেয় সেঁজুতি। আবার লোকটির দিকে ফিরে বলে,
“কিন্তু একজন মৃত লোকের বিরুদ্ধে কেস ফাইল করে কি লাভ?? ওনাকে তো আর জীবিত করে শাস্তি দিতে পারবেন না তাইনা?

এ পর্যায়ে লোকটি মুচকি হাসলেন। বললেন,
‘ তা হয়তো পারবোনা ম্যাডাম,কিন্তু ওনার সমস্ত বাজে কাজ গুলোর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে এবং তা সরকারের কাছে প্রমান করে ওনার সমস্ত প্রপার্টি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ এসেছে ওপর মহল থেকে।

সেঁজুতি চোখ গোলগোল করে বলল,
‘উনি কি আরও কোনও খারাপ কাজে যুক্ত ছিলেন ?
এই মুহুর্তে যেন সেঁজুতির প্রশ্নের উত্তর করাই লোকটির গুরুত্বপূর্ণ কাজ।রুদ্রর এসিস্ট্যান্ট বলেই এত সমীহ করছেন উনি।আর সেঁজুতিও পাল্লা দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ছে।
“জ্বি, ফ্যাশন ডিজাইনিং এর বিজনেস ছাড়াও ওনার অন্যান্য অনেক কালো টাকার বিজনেস ছিলো।অবৈধ ভাবে হীরে আনা নেয়া করা বিদেশ থেকে,নারীপাচার এসবেও যুক্ত ছিলেন। আর সেসবের হদিস আমরা রুদ্র স্যারের থেকেই পেয়েছি।
আর এখানে যেহেতু ইনকাম ট্যাক্সের লোকজন ও এসেছেন তো ওনার সব কাজ কর্মের হিসাব নিকাশ পাওয়া যাবে খুব তাড়াতাড়ি।
রুদ্রর কথা শুনে মাথা ঘুরছে সেঁজুতির।চোখের সামনে লাল নীল আলো দেখছে।কি হলো ব্যাপার টা?এই লোকটা কাল নেহাল উদ্দিনের সাপোর্ট টেনে কথা বললেন।কাল কি একটু আগেও তো বললেন নেহালের মৃত্যু তে শোক পেয়েছেন।একেবারে শোকে নাকী শোকাহত উনি! তাহলে এত সৎ বুদ্ধির উদয় কি করে হলো? কোন দিকে উঠলো সূর্য? নাকী, ওনাকে যতটা খারাপ ভেবেছি উনি ততটা খারাপ নন।হোক ভালো তাতে আমার কী? হুহ!

‘ ম্যাম?
সেঁজুতির সম্বিৎ ফিরলো।একটু হেসে বেলল ‘ আমি স্টেটমেন্ট দিতে রাজি।কি করতে হবে বলুন।
____
সেঁজুতি রুদ্রকে খুঁজছে তখন থেকে।একটু আগেই না এখানে ছিলেন উনি? গেলেন কোথায় এর মধ্যে? ওনার এমন রহস্যময় চালচলনের মানে আমার মাথায় কিছুই ঢুকছেনা।নিজেই নেহাল উদ্দিনকে কাজের লোক বলে নিজেই তার গোপন তথ্য পুলিশকে দিয়ে দিলো?সেঁজুতির একবার মনে হলো রুদ্রও কী এসবে যুক্ত? পরমুহূর্তে নিজের মাথায় চাটি মারলো নিজেই।রুদ্র যুক্ত থাকলে কী যেচে পুলিশকে এসব জানাতেন? উনিও তো ফাঁসবেন তাহলে। নেহাল লোকটা কাল বলেছিলেন রুদ্রকে ৭ বছর ধরে চেনে।রুদ্রর খুটিনাটি সব জানেন। তাহলে রুদ্রও ওনার সব জানবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
” কিছু খুজছেন??
হঠাৎ কথায় চমকালো সেঁজুতি। রুদ্রকে দেখেই ধড়ফড়িয়ে বলল,
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো!
রুদ্র উৎকন্ঠাহীন
“আমি জানি আপনি কি বলবেন(একটু থেমে) আপনি এটাই ভাবছেন, যে আমি এসব কেনো করছি?যেখানে নেহাল উদ্দিন কে আমার এতো কাজে লাগতো?
সেঁজুতি জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালো।যার অর্থ হ্যা।রদ্র ঝুঁকে এলো কিঞ্চিৎ। হাল্কা গলায় বলল ‘ শুনবেন?
সেঁজুতির অদ্ভূত অনুভূতি হলো। ঢোক গিলে মাথা নাড়লো আবারও। রুদ্র সেঁজুতির চোখের দিক সেকেন্ড খানিক চেয়ে থেকে সোজা হলো।মুখ ঘুরিয়ে বলল’ আপনাকে কোনও উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই,সো আপনি কিছু জানতেও পারছেন না।
(ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) লেট হয়ে যাচ্ছে। চলুন, এখানের কাজ শেষ।

বলেই রুদ্র হাটা ধরলো।সেঁজুতি কিছু সময়ের জন্যে বোঁকা বনে গেলো।হুশ ফিরতেই ছুট লাগালো রুদ্রর পেছনে।
“আরে এসব এর কি মানে আরে শুনুন তো..
গাড়িতে বসে গিয়েছে রুদ্র।সেজুতিও হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো।হাঁপিয়ে গিয়েছে এটুকু দৌড়ে। হাত নাড়িয়ে বলল ,
“আচ্ছা বেশ! আপনাকে সব টা বলতে হবেনা।যাস্ট এইটুকু বলুন যে স্টেটমেন্ট নেয়ার জন্যে ওনার বাড়িতে কেনো?? থানায় গেলেই তো হতো…

রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল’ তাহলে তো পুরোটাই বলতে হবে।
সেঁজুতি অনুরোধ করলো এবার,
— প্লিজ বলুন না, আর কক্ষনও কোনও প্রশ্ন করবোনা আপনাকে।
রুদ্র ভ্রু নাঁচালো,
” শিওরিটি দিচ্ছেন?
“হ্যা
” বেশ,
রুদ্র ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“আপনাকে এখানে নিয়ে আসার দুটো কারণ ছিলো।no 1-আমি চাইনি আমার অফিসের পিএ থানায় যাক।থানা ব্যাপারটা আমি ইগনোর করে চলি।আপনি যেহেতু আমার সাথে যুক্ত(সেঁজুতি তাকাতেই)আই মিন আমার অফিসের সাথে তাই আপনাকে এটা থেকে দূরে রাখা আমার উচিত।কারন এখানে আমার কোম্পানির রেপ্যুটেশন জড়িয়ে।And no 2-কাল আপনি যেভাবে কাঁদছিলেন,তাই আমার মনে হলো মরার পরেও বেচারার এমন অবস্থা দেখলে কিছুটা হয়তো শান্তি পাবেন।দ্যাটস ইট….

রুদ্রর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে সেজুতি।এই কি সেই লোকটা যে কাল তাকে ওসব কথা শোনোলো।সেঁজুতি নিজেকেই শুধালো,
“আমার মনের শান্তি নিয়ে ভাবছেন উনি?পরমুহূর্তে চিন্তা ঝেড়ে রুদ্রর দিক তাকালো,
” আচ্ছা,,আপনার কি মনে হয় , ওনাকে কে মারতে পারে??আর তাও এভাবে?
রুদ্রর সেই নিরুদ্বেগ উত্তর, ‘সেটা কী আমার জানার কথা?আমার জানার কোনও দরকার আছে বলেও মনে হয়না।আর না প্র‍য়োজন আছে আপনার।
হতে পারে নেহাল কারো কোনও দামী জিনিসের দিকে হাত বাড়িয়েছিলো তাই এভাবে মরলো।বেচারা!
সেঁজুতি ফোসফোস করে বলল’কাল আমার কাছে যদি একটা ছুরি থাকতো না?আমি নিজেই ওর পেটে ঢুকিয়ে দিতাম।
হাসলো রুদ্র।সেজুথির আঁড়ালেই।বলল
‘ কাল আপনার কিছু কথার উত্তর দেয়া বাকি রয়ে গিয়েছে।
সেঁজুতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলো।রুদ্র ওর দিক দেখলোনা।সে সামনে তাকিয়ে। ওভাবেই নিরেট কন্ঠে বলল,

“আমি জানি আপনি আমাকে খারাপ ভাবেন।সত্যিই আমি খারাপ।সাথে এটাও সত্যি আমি মেয়েদের সহ্য করতে না পারলেও অসন্মান করিনি কখনও।অন্য কেউ অসন্মান করুক সেটাও মেনে নেইনি।নেহাল উদ্দিন কাজ টা যখন করেইছেন তখন একটা পানিশমেন্ট ওনার পাওনা ছিলো। কিন্তু তার আগেই বেচারার মার্ডার হয়ে গেলো।তাই ভাবলাম অন্তত পুলিশ ফোর্স কে একটু সাহায্য করি!আর এজন্যেই সব ইনফরমেশন কালেক্ট করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি।এবার বাকিটা ওরাই বুঝে নিক।রুদ্র একটু থামলো।দম নিলো বোধ হয়,পরের টুকু
শক্ত কন্ঠে বলল,
“আর হ্যা! আপনি নেহাল উদ্দিনের সাথে আমাকে মেলাতে আসবেন না।কারণ আমি কাউকে জোর করে নয় বরং নিজ ইচ্ছায় যারা এসেছে তাদের সাথেই ওয়ান নাইট স্ট্যান্ডে যাই।যেমন একদিন আপনি এসেছিলেন হোটেলে।

এতক্ষন উৎসুক হয়ে রুদ্রর সব কথা শুনছিলো সেঁজুতি।শেষের কথাটা কানে যেতেই মুখে আমাবস্যা নামলো।পুরোনো ক্ষত-তেই কেন বারবার খোঁচা মারে এই লোকটা?তাৎক্ষণিক জানলার দিক মুখ ঘোরালো সেঁজুতি।দৃষ্টি জোড়া উদাস হলো।বুকের ভেতর শুরু হলো অসহ্য ব্যাথা।
ব্যাপারটা ঠিকই আঁচ করতে পারলো রুদ্র।তবুও সে নিশ্চুপ।মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলো ‘ আমি তো জেনেই ছাড়বো মিস সেজুতি।কেনো আপনার মত একটা মেয়ে আমার হোটেলে এসেছিলো সেদিন?
জেনেই ছাড়বো আমি।যেটা আমি ভাবছি সেটাই যদি সত্যি হয় তবে সামনে আপনার সাথে যে অনেক কিছু ঘটবে।যা আপনি কল্পনাও করেননা।

চলবে

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১৬( বাকী অংশ)
কিছুদিন পার হলো।নেহালের হত্যাকারীকে খুঁজে পেতে পুলিশের তৎপরতা তেমন একটা দেখা যায়নি।এত বড় ব্যাবসায়ী হলেও কেস চালানোর মতো কেউ ছিলোনা।অন্যদিকে পুলিশও তদন্ত করে কোনো ক্লু পায়নি।তাই আপাতত ফাইল বন্ধ না করলেও মুখে মুখে ওঠা গুঞ্জন থেমেছে।ধামাচাপা পরেছে এক কথায়।
সেঁজুতিও কাজের চাপে নেহালের বিষয় টা ভাবেনা।ভাবার ফুরসত কই? সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে পুরো বাসার কাজ একা হাতে সামলায়।আবার অফিস গিয়ে এক গাঁদা কাজ রুদ্রর।মেয়েটাকে ছুটিয়ে প্রান নেবে হয়তো।অনেক সময় বাড়ি সামলে অফিস পৌঁছোতে দেরীও হয় সেঁজুতির।বৃষ্টি হলেতো কথাই নেই।একটা রিক্সা যদি পায় তখন।দেরী করা নিয়ে রুদ্র অনেকবার ওয়ার্নিং দিয়েছে। তবে হালকা পাতলা।রুদ্র অফিসে আসার পর মহারানী আসেন। এটাই তার অপরাধ।রুদ্রর প্রবল ইচ্ছে,যখন সে অফিসে ঢুকবে বাকীদের সঙ্গে সঙ্গে সেঁজুতিও দাঁড়াবে।মিষ্টি করে মিহি কন্ঠে বলবে ‘ গুড মর্নিং স্যার! কিন্তু সেই ইচ্ছে ইচ্ছেই রয়ে যাচ্ছে।সেঁজুতির দেখা মেলে সাড়ে দশটার দিকে।কিন্তু এতে ওরতো দোষ নেই।এত ধকল সামলে কেই বা পারবে টাইম মেইনটেইন করতে? কিন্তু এ কথা রুদ্রকে বোঝাবে কে? সে ফুলে অাছে রীতিমতো। সেঁজুতি কে কঁড়া কিছু শোনানোর জন্যে ওকে কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছে অাজ।সেঁজুতি মাত্রই এসেছে।চেয়ারে বসবে তার আগেই পিওন এসে হাক পারলো।দীর্ঘশ্বাস ফেলল সেঁজুতি। বিড়বিড় করলো ‘ জীবন বড় বেদনার।

সেঁজুতি মাথা নিঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অন্ধকার।এই মুহুর্তে সে রুদ্রর সামনে দাঁড়িয়ে। রুদ্রর কেবিনে।অন্যদিকে পকেটে হাত গুজে সেঁজুতির দিকে চেয়ে আছে রুদ্র।চোখে মুখে সহস্র বিরক্তি।কার ওপর সেটা অনিশ্চিত রুদ্র।সেঁজুতি কে কঠিন কিছু শোনাতে গেলে তার জ্বিভ আজকাল স্বায় দেয়না।কেমন বেঈমানি করে।রুদ্র তিতিবিরক্ত এতে।তাও, যৎসম্ভব গম্ভীর স্বরে বলল,

“মিস সেজুতি অফিস টাইম কখন শুরু হয়?
সেঁজুতি জানে তাকে এসব প্রশ্ন কেন করছে রুদ্র।আজও দেরি করেছে সে।আস্তে করে বলল ‘ দশটায় স্যার।
‘ আপনি এসেছেন কখন?
সেঁজুতি চোরের মত মুখ করে বলল ‘ ইয়ে..সাড়ে দশটায় মেইবি।
রুদ্র দাঁত চেপে মৃদূ স্বরে বলল ‘ নট মেইবি।সাড়ে দশটায়ই এসেছেন আপনি। গত চারদিন যাবত ঠিক আধঘন্টা দেরী করছেন।হুয়াই?

সেঁজুতি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলো।তার যে বাড়িতে এক গাঁদা কাজ সেড়ে আসতে হয় এসব কী আর বলা যায় কাউকে?রুদ্র নিজেই বলল,
‘ আচ্ছা বলুন,বস আগে এসে পি- এর জন্যে অপেক্ষা করে নাকি পি- এ বসের জন্যে অপেক্ষা করে?
সেঁজুতি একইরকম নিঁচু স্বরে বলল,
— পি-এ বসের জন্যে অপেক্ষা করে।

‘ তাহলে কার আগে আসা উচিত?পি -এর নাকী বসের??
সেঁজুতি মুখ ফস্কে বলল
— বসের।ইয়ে না পি-এর,,
রুদ্র ভ্রু নাঁচালো,
— কিন্তু দেরী কে করছে?
সেঁজুতি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল
‘পি-এ…

“এই পি-এ টা কে??
” আমি..
” তাহলে দেরী কার হচ্ছে?
এ পর্যায়ে নিঁচের ঠোঁট ওপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরলো সেঁজুতি। তার যে দেরী হয়েছে এটা তাকে দিয়েই স্বীকার করাচ্ছে লোকটা! কি ধুরন্ধর!আগের থেকেও আস্তে করে বলল,

‘ আমার,,
রুদ্র তুষ্ট হওয়ার ভান করে বলল ‘ বাহ! একদম ঠিক বললেন।
সেঁজুতি চোখ ওঠালো।অল্প হেসে বলল ‘ ধন্যবাদ”
রুদ্র তাকাতেই হাসি থামিয়ে চট করে মাথা নিচু করে রইলো আবার।রুদ্রর বিরক্তি বোধ হয় বাড়লো।শক্ত কন্ঠে বলল,
” রোজ রোজ আপনি যদি এভাবে দেরী করে আসতে থাকেন তবে আপনাকে আমি ছাটাই করতে বাধ্য হব।আর তখন তিন বছর আগে চাকরী ছাড়ার জন্যে জরিমানার টাকা জমা করতে হবে আপনাকে।সব টাই জানেন তো?
সেঁজুতি মাথা নাঁড়লো।সে জানে।
‘ কাল থেকে দেরী করবেন আর?
সেঁজুতি এবারেও মাথা নাঁড়লো।সে দেরী করবেনা।
রুদ্র টেবিল থেকে কফির মগ নিতে নিতে বলল ‘ নাও লিভ!কফির মগে চুমুক দিয়েই থু দিয়ে সেটা ফেলে দিলো রুদ্র।মুখ কুঁচকে বিস্বাদ নিয়ে বলল,

” ইয়াক! কি বানিয়েছে এটা?ডিজগাস্টিং,
হাজার বার বলেছি এতো টা মিষ্টি না দিতে!এক্ষুনি এই পিওনটাকে বার করে দেব অফিস থেকে।
সেঁজুতি চলেই যাচ্ছিলো।রুদ্রর কথায় দাঁড়িয়ে পরলো।পিওনের প্রতি তার নরম মনে মায়া হলো বেশ।মনে মনে ভাবলো,
“বশীরভাই কফি ভালো বানাতে পারেননা,নিশ্চয়ই।একটু পরেই হয়তো ওনাকে ডেকে আচ্ছা মতো ঝাড়বেন এই লোক।কাজ থেকে ছাড়িয়েও দেবেন।বেচারার কি হবে তখন?অবশ্য সারাদিনই তো লোকটা কে এই কফিটুকুই খেতে দেখি।বেশ কয়েকবার খান। সেটাও যদি ভালো না হয় তবে মাথা গরম তো হবেই।ওনারও দোষ নেই।সেঁজুতি কে ঠাঁয় দাঁড়ানো দেখে রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো,
” কি ব্যাপার?? আপনি এখনও যান নি যে?কাজ করার ইচ্ছে নেই?
সেঁজুতি রুদ্রর দিকে দু-কদম এগিয়ে এলো।হাঁত কঁচলাতে কঁচলাতে বলল,
‘বলছিলাম কি…..
রুদ্রর ভ্রু কুঞ্চন আরো গাঢ় হয়।সেঁজুতি অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে বলল ‘
” স..স্যার! আপনার কফি বানানোর ভার টা যদি আমি নেই?মমানে আমি অনেক ভালো কফি বানাতে পারি তো, তাই।
সেঁজুতি হাসার চেষ্টা করলো একটু।কিন্তু হাসিটা ভালো করে ফোঁটার আগেই মিলিয়ে গেলো রুদ্রর কথায়।
রুদ্র সন্দেহী কন্ঠে বলল ‘ আপনি বানাবেন? স্ট্রেঞ্জ!কাজের কথা শুনলেই তো আপনার মুখ আমাবস্যার মতো কালো হয়ে যায়।
সেঁজুতি চোখ ছোট করে ফেলল।মনে মনে বলল,
‘ব্যাস শুরু হয়ে গেলো এই লোকের খোঁচা মেরে কথা বলা।মেকি হেসে বলল,
“আমি পারবো…
রুদ্র চেয়ারে গিয়ে বসলো,শ্বাস ফেলে বলল,
‘ বেশ!যেচে কাজ নিতে চাইছেন নিন।তবে কাল থেকে নয়।এক্ষুনি এক মগ কফি বানিয়ে দিন আমাকে।

সেঁজুতি অনুরোধ করে বলল,
‘ বশীর ভাইকে কাজ থেকে বরখাস্ত করবেন না। প্লিজ স্যার!
রুদ্রর সোজাসাপ্টা জবাব,
‘ দ্যাটস ডিপেন্ড টু ইওর পার্ফমেন্স।আপনি যদি কফিটা ভালো বানাতে পারেন তবে আর করবনা।

সেঁজুতির মুখে বিস্তর হাসি ফুঁটলো ‘ আমি এক্ষুনি আসছি স্যার।পাঁচ মিনিট সময় দিন।
সেঁজুতি কেবিন থেকে বের হয়।সেদিক তাকিয়ে হাসলো রুদ্র।কফির খালি মগটা টেবিলের ওপর রাখলো।
‘ বারবার আপনাকে বোঁকা বানাতে এত কেন মজা লাগছে বলুনতো সেজুতি?শুধু কফি বানানো কেনো আস্তে আস্তে রুদ্র রওশনের প্রত্যেক টা কাজই আপনাকে করতে হবে।আপনি চান বা না চান।ও হ্যা টাইমলি আপনাকে অফিসে কিভাবে টেনে আনতে হয় সেটা এই রুদ্র রওশন খুব ভালোভাবে বুঝে ফেলেছে।
____
সেঁজুতি বাসায় ফিরেছে দশ মিনিটের মতো।এই কম সময়ে একশর বেশি ঝটকা খেলো সে।
ঘরের সব কাজ শেষ,নতুন করে রান্নাও করে রাখা।সেঁজুতি কাপড় ভিজিয়ে রেখে গেছিলো,ভেবেছিলো এসে ধুঁয়ে দেবে।অথচ সেগুলোও সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ। সেঁজুতি তখন অবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
‘ এসব কে করলো বাবা?
আমির টিভি দেখতে দেখতে জবাব দিলেন ‘ শেফালী।
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
‘ শেফালী?শেফালী টা আবার কে
‘ আমি আফা…
আওয়াজ শুনে ঘাঁড় ঘোরালো সেঁজুতি। ২৪-২৫ বয়সী একটি মেয়ে।পড়নে সুতির পুরোনো শাড়ি।মুখে পান।পায়ের কাছেই রাখা এক বালতি ময়লা পানি আর ন্যাকড়া।সে মাত্রই আমিরের ঘরের বারান্দা মুছে এলো।সেঁজুতি এতক্ষন দেখতে পায়নি এজন্যে।মেয়েটির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো সেজুথি।
আপনি কে?মেয়েটির উত্তর,
‘ ওইতো শেফালী।
‘ হ্যা বুঝেছি।কিন্তু আপনি কে?
মেয়েটি বিরক্ত হলো যেন,
‘কি কন আফা?কইলামত আমি শেফালী!
সেঁজুতিও পালটা বিরক্ত,
— উফফ!
আচ্ছা বুঝেছি, এখানে কেনো এসেছেন?
শেফালীর উদ্বেগহীন জবাব,
“কাম করতে আইছি।আর কিল্লাই আইতে যামু?
“কিন্তু আমিতো আপনাকে কাজে রাখিনি। আপনাকে কখনও দেখেছি বলেও মনে পড়ছেনা।
শেফালী পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো,
‘রাহেন নাই তো কি অইছে।না রাখলে কি কাম করোন যায়না?এহন থেইক্কা আমনেগো সব কাম আমি কইরা দিমু।আফনারে আর কষ্ট কইরা ঘর বাইর সামলান লাগতো না।তয় মাসে মাসে কিন্তু আমারে দেড়ডা হাজার ট্যাকা দেওন লাগবো।একদাম আফা।

সেঁজুতি হতবুদ্ধি ভাবে শেফালীর সব কথা শুনলো।মাথায় এখনও কিছুই ঢুকছেনা।বলল
‘কিন্তু আপনি কি করে আমাদের বাড়ির খোঁজ পেলেন?
শেফালী এবারেও হাসলো।
‘কি যে কন আফা!আমরা হইলাম গরীব মানুষ, সারাদিন কাম খুইজতে থাহি।ওই এক ভাবেই পাইছি আপনাগো বাসা।তারপর খালুজানের কাছে আইসা জিগাইতেই হেয় কইলো সত্যিই আমনেগো কামের লোক দরকার একজন।
সেঁজুতি দ্বিধায় পরলো।এমন অচেনা একজন মানুষকে কাজে রাখা ঠিক হবে? তাও এমন হুটহাট! বাবার যা অবস্থা!যদি খারাপ হয়?সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে বলল,
‘কিন্তু…..

আমির এতক্ষন টিভিতে ডুবে থাকলেও সব কথা শুনেছেন।সেঁজুতির কিন্তু শুনতেই কপট ধমকে বললেন,
‘ এত কী ভাবিস তুই?কোনো কিন্তু নয়।ওকে কাজে রাখবি তুই।সারাদিন এতো খাঁটুনি খাটছিস,এগুলো আমি দেখতে পারছিনা,তাই আজ থেকে ওই তোর সব কাজ এগিয়ে দিয়ে যাবে।

‘ কিন্তু বাবা তুমিতো বুয়ার হাতের রান্না খেতে পারোনা।

আমির দৃঢ় কন্ঠে বললেন ‘পারিনা,কিন্তু পারবো।আমার মেয়ের জন্যে এইটুকু অভ্যেস করতে পারবোনা আমি?
সেঁজুতি অসহায় চোখে তাকালো,
‘তবুও…
পাশ থেকে শেফালী কথা কেঁড়ে নিয়ে বলল,
‘ আর ভাইবা লাভ নাই আফা।খালুজান যহন কইছে তহন আমার চাকরী পাক্কা।এই আমি এইহানে বইলাম।
শেফালী হাত পা গুছিয়ে ফ্লোরে বসে পরলো।সেঁজুতি হেসে ফেলল তাতে। ‘ আচ্ছা ঠিক আছে রাখলাম।উঠুন এখন।
” হাছা কইলেন?? ঠিক আছে,তয় উটতাছি।
‘ কোথায় বাসা আপনার ?
‘বলখেলার মাঠ টার পিছন দিক দিয়া যে বস্তিখান, ওইহানে।
‘ ওহ! কাল থেকে প্রতিদিন সকাল ৮ টায় চলে আসবেন।
শেফালী ঘাঁড় কাত করলো ‘আইচ্ছা।
অনেক রাইত হইছে ওহন আমি যাই। কাইল সক্কাল বেলা আমুনে।দেড়ি করলে জামাই টা আবার মন খারাপ করবো! হেতি আমারে অনেক ভালোবাসে তো।বাবার সামনে শেফালীর বেঁফাস কথায় লজ্জ্বা পেলো সেজুতি।
” মাথার তার তো দেখি ছেড়া।তবুও ভালো,
অন্তত কাউকে তো পাওয়া গেলো।অন্য কেউ কাজ গুলো সেড়ে রাখলে আর অফিস যেতে দেরী হবেনা আমার। ওই বদমাশ লোকের ঝাড়ি ও খেতে হবেনা।এবার আপনিও দেখবেন মিঃ বস,আমি কতটা পাংকচুয়াল!হুহ!
_____
ওটি সেড়ে মাত্রই চেম্বারে বসেছে হোসাইন।গরমে অবস্থা যাচ্ছেতাই।অসময়ের বৃষ্টিতে আদৌ কোনো লাভ হচ্ছেনা। একটু যদি ঠান্ডা লাগে! হোসাইন এসির পাওয়ার বাড়ালো।সাদা এপ্রোন চেয়ারের হাতলে রেখে বোতল খুলে পানি খেল।তখনি একজন এসে জানালেন ‘ স্যার রুদ্র রওশন চৌধুরী আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন।
হোসাইন অবাক হলেন।রুদ্র এই সময়ে তার চেম্বারে ঠিক কী কারনে আসবে বুঝে উঠলেন না।সেদিনের পর লোকটাকে আর দেখেন ও নি।খবর দিতে আসা লোকটিকে বললেন ‘ পাঠিয়ে দাও।
দু মিনিটের মাথায় রুদ্র নক করলো দরজায়।দরজা খোলাই ছিলো।রুদ্র শুধু টোকা দিয়ে হোসাইনের মনোযোগ নিলো। রুদ্রকে দেখতেই হোসাইন বিরাট হাসি ঝোলালেন মুখে।লোকটা ভীষণ হাসিখুশি হিসেবেই পরিচিত।’ মিস্টার চৌধুরী যে! আসুন আসুন।,প্লিজ বসুন…
রুদ্র বসলো।
‘থ্যাংক ইউ!
‘ কি খাবেন বলুন? চা? কফি? নাকি ঠান্ডা।
‘ নাথিং!
রুদ্র সোজাসুজি মূল বিষয় তুলল ‘ আমি এখানে আপনার থেকে কিছু জানতে এসেছি।বলতে পারেন ইনফরমেশন চাইতে এসছি।
হোসাইন বুঝলেন না,
‘ আমার কাছে ইনফরমেশন ? কি ব্যাপারে?

রুদ্রর অকপট জবাব, ‘ সেঁজুতির ব্যাপারে।
হোসাইন যেন হোচট খেলেন, ‘ সেঁজুতির ব্যাপারে?
‘ হু।
হোসাইন নড়েচড়ে বসলেন।শান্ত অথচ কঠিন স্বরে বললেন ‘ স্যরি! এভাবে আমি সেজুতির অপরিচিত কাউকে ওর ব্যাপারে তথ্য দিতে পারবনা।

রুদ্র ভ্রু বাঁকালো,
অপরিচিত?? আমি যে সেজুতির অপরিচিত সেটা আপনাকে কে বললো?আপনি হয়তো জানেন না আমি ওর কে?
হোসাইনের হাসি পেলো।সেঁজুতির ব্যাপারে এমন কোনো কথা আছে নাকী সে জানেনা? দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল
“তাই? তা কে আপনি ??
রুদ্র স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘আমি ওর বয়ফ্রেন্ড।বাংলায় যাকে বলে প্রেমিক। আর কিছুদিন বাদেই যেটা দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে হাজবেন্ড হয়ে যাবে।

চলবে…

প্রনয় পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রনয়
# নুসরাত সুলতানা সেজুতি 🍁
পর্ব- ১৪

বাড়িতে ঢুকেই কাঁধ ব্যাগটা দূরে ছুড়ে ফেলে, বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরলো সেজুতি।ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে।শরীর আর কাজ করছেনা যেন।
প্রথম দিনেই এতো এতো কাজ! বাপরে বাপ!এত কাজ তো কোনো পুরোনো এমপ্লয়িকেও দেয়া হয়না।সব যে রুদ্রর ইচ্ছাকৃত সেঁজুতি হাড়েহাড়ে বুঝেছে।পুরো দশটা ঘন্টায় তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়লো লোকটা। চৌদ্দবার কেবিনে ডেকেছে,একবার এই ফাইল চেক করো তো আরেকবার অন্য ফাইল নিয়ে এসো।একবার ওই ডেস্কে এর কাছে যাও তো আরেকবার অন্য ডেস্কে আরেকজনের কাছে যাও।ছুটতে ছুটতে আজ অবস্থা দফারফা। পা গুলোর অবস্থাও করুন।এমনিতেই খুব বেশিক্ষন দাঁড়ানো বা ছোটাছুটি তার ধাতে নেই।ক্লাশ টেনে থাকতেই বাঁতের ব্যাথা শুরু হয়।তারপর থেকেই ছোটাছুটি বন্ধ।যাকে বলে একপ্রকার নিষিদ্ধ।সেঁজুতি বালিশে মুখ গুজে বিড়বিড় করলো ” বদের হাড্ডি, অসভ্য,বদমাশ।
তখনি রুমে ঢুকলেন আমির।মেয়ের ছুড়ে ফেলা কাঁধব্যাগ মাটি থেকে তুলে টেবিলের ওপর রাখলেন।মেয়ের দিকে নরম চোখে তাকালেন তারপর ।সেঁজুতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে।আমির প্রশ্ন ছুড়লেন,
” অফিসের প্রথম দিন বোধ হয় খুব খাটুনী গেলো আম্মা?
বাবার স্বর শুনে ফিরে তাকালো সেঁজুতি। উঠে বসতে বসতে বলল ‘ ওই আরকি বাবা! খেয়েছো তুমি?
” না।একসাথে খাবো বলে তোর জন্যে বসে ছিলাম।
সেঁজুতি দেয়াল ঘড়িতে চোখ বোলালো,উৎকন্ঠা নিয়ে বলল
‘সেকি!দশটা বাজে এখনও খাওনি?
সেঁজুতি ব্যাস্ত ভঙ্গিতে নামতে নামতে বলল,
‘আমি এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুমি গিয়ে টেবিলে বসো

” সব হবে।এত তাড়াহুড়ো করিস নাতো।ধীরে সুস্থে যা।
” আচ্ছা।
সেঁজুতি যেতে নিলে আমির পিছু ডেকে বললেন,
” বসের সাথে দেখা হলো? তা কেমন উনি? ভালো নাকী রাগী খুব?
এতক্ষন মেজাজ যেটুকু ভালো ছিলো এবার সেটুকুও উবে গেলো সেঁজুতির।লোকটার কথা মনে করলেও তার রাগে জ্বলে ওঠে শরীর।সেঁজুতি কিড়মিড়িয়ে বলল
— ওই বদ টার কথা আর বলোনা তো বাবা,,
আমিরের চোখ কপালে উঠে এলো মেয়ের সম্বোধন শুনে,
— সেকিরে!বদ? প্রথম দিনেই বসের নামে এমন নিন্দে করছিস?কি করেছেন কি উনি? খুব খাটিয়েছে?

— খাটিয়েছে কী?কি করেন নি তাই বলো,আমাকে দিয়ে এই এত্তগুলো কাজ করিয়েছে( হাত দিয়ে দেখিয়ে)
আমির মৃদূ হেসে বললেন,
— বেতন কি আর এমনি এমনি দেবে রে?কাজ তো করাবেই।

— তাই বলে এত্ত?সব ওই রুদ্র রওশনের ইচ্ছাকৃত, আমি জানি।তুমি জানোনা।
আমির ভ্রু কোঁচকালেন,
— কি নাম বললি?
সেঁজুতি ছাড়া ছাড়া কন্ঠে বলল,
— রুদ্র রওশন চৌধুরী।

“রুদ্র রওশন মানে, ওই বিজনেসম্যান রুদ্র রওশন?

— হু।
আমির মনে করার ভঙ্গিতে বললেন,
— দাড়া দাড়া,এই লোকটা তো,এই লোকটা তো সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন।
রীতিমতো তোকে শাসিয়ে গেলেন ওইদিন।

সেঁজুতি সতর্ক চোখে তাকালো।রুদ্রকে আমির চিনবে স্বাভাবিক। কিন্তু রুদ্রর বাড়িতে আসার ব্যাপারটা তো তার জানার কথা নয়।উনিতো পরিচয় লুকিয়ে এসেছেন।সেঁজুতি কৌতুহলী হয়ে বলল,
— আমাকে শাসিয়ে গিয়েছিলো? কবে?

— সেদিন তুই ছিলিনা।ওই যে তুই হাসপাতালে হোসাইনের কাছে ছিলি,তোকে একটা লোক পৌঁছে দিতে এসেছিলেন??

সেঁজুতি জোরে দুবার মাথা ঝাঁকালো ‘ হু হু

-ওইদিন সকাল বেলা এসেছিলেন।
সেঁজুতি চট করে এসে বিছানায় বাবু হয়ে বসলো।আগ্রহ নিয়ে বলল ‘ পুরোটা বলোতো বাবা।কেন এসেছিলেন উনি?
আমির একটা দমফেলে একে একে পুরো ঘটনাটাই খুলে বলল।সব শুনে ক্ষুব্ধ সেজুতি।রাগ না হয়ে পারলোনা।লোকটা বাড়িতে এসে শাসিয়ে গিয়েছেন।তাও আমার বাবাকে?? কি ভাবেন টা কি নিজেকে?শর্ট টেম্পারড লোক একটা।কোন কুক্ষনে যে ওনার বিপদে সাহায্য করতে গেলাম!
______
মিঃ নেহাল উদ্দিন এর সাথে কাল মিটিং ফিক্সড করবি।দুপুর ১২টা থেকে একেবারে দুটো অব্ধি।
অভ্র অবাক কন্ঠে বলল,
— টানা দু ঘন্টা?? উনি কি রাজী হবেন ভাই??
— টাকার জোরে হবে।
হাতে একটা কালো ব্রিফকেস নিয়ে অভ্রর সামনে রাখলো রুদ্র।ভেতর টা দেখতেই অভ্রর চোখ কোটর ছেড়ে বার হয় যেন।এতগুলো টাকা?রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল
‘ এটা ওনাকে দিবি।
অভ্র জিজ্ঞাসু মুখ চোখে কিছুক্ষন চেয়ে থাকলো।পরে মাথা নেঁড়ে বলল,
— ওকে ভাই।
বরাবরের মতো রুদ্রকে সে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারেনি।দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্রিফকেস সমেত নিজের রুমে এলো।জানলা গলিয়ে আকাশের দিক চেয়ে ভাবলো,
‘ আর খুব বেশি দেরি নেই।এবার মেন্টাল এসাইলোমে আমার জন্যে একটা সিট বুকিং দিতেই হবে।ভাইয়ের থ্রিলিং ক্যারেক্টরের মানে বুঝতে গেলে আমার আধপাগল হওয়া ছাড়া রাস্তা দেখছিনা।এতো গুলো টাকা দিয়ে একটা লোককে মিটিং এ ব্যস্ত রাখার কারন কী?

করুদ্র কফি মগ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।ঠান্ডা বাতাস আর কফির গরম ধোঁয়ায় মিশ্র অনূভুতি হচ্ছে। নেহালের সাথে মিটিং টা জরুরী।বিদেশী কোম্পানির সাথে অনেক গুলো ডিল ঝুলে আছে।নেহাল উদ্দিনের সই একান্ত প্রয়োজন। ব্যাবসার শুরুর দিকে এই লোকটা পার্টনারশিপে ছিলো।অল্প সময়েই রুদ্র হিসেবে পাকাপোক্ত হলো।তারপর আলাদা করলো কোম্পানি।আর রুদ্রর কোম্পানি এখন নেহাল কেও ছাড়িয়েছে।কিন্তু তাও,বিদেশে তাদের একচ্ছত্র কোম্পানির কথাই সবাই জানে।কারন,নেহাল মাঝবয়েসী, অভিজ্ঞ লোক।রুদ্রর মতো অল্পবয়সী দুদিন মাঠে নামা লোকের সাথে এত বড় বড় ডিল ফাইনাল করতে তাদের ভাবতে হয়।যদিও পরে, পার্ফমেন্সে প্রত্যেকে স্যাটিসফাইড হয়।তাও শুরুর দিকে ঝামেলা করতে মন চায়না রুদ্রর।এখনও কিছু ক্ষেত্রে নেহালের সাইন দরকার পরে।আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহারই করে লোকটি।প্রচন্ড ধূর্ত বলে হিউজ টাকা দাবী করে।কখনও মিটিং রাখতে গড়িমসি করে।রুদ্র অনেকবার অনেক টাকা অফার করেছিলো, কোম্পানি আলাদা হওয়ার একটা প্রমান হিসেবে নেহাল কে সই করতে বলে।নেহাল ইনিয়েবিনিয়ে এড়িয়েছে।রুদ্র ইচ্ছে করলেই করতে পারতো অনেক কিছু।কিন্তু মাঝেমাঝে তার ও আলসেমি লাগে।সব সময় সবাইকে ভয়ে তৎপর রাখতে ভালো লাগে?নেহাল চায়না রুদ্রর কোম্পানি তাকে আরও ছাড়াক।অথচ রুদ্রর ভয়ে মুখ ফুঁটে বলেনা।রুদ্র হাসলো।কফির মগে চুমুক দিলো।ভাগ্যিস আন্ডারওয়ার্ল্ডে একটা গুপ্ত যোগাযোগ আছে তার।যার দরুন ক্ষমতার সব ব্যাবহারই করে থাকে।আর এই ভয়েই অনেকে তার কোনো ক্ষতি করতে চেয়েও পারেনা।নেহাল অনেক ব্যাস্ততা দেখাবে কাল, রুদ্র জানে।তার পাঠানো কর্মচারীকেও ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করাবে কাজের ছুঁতোয়।কিন্তু তাও না বলতে পারবেনা।আর এই কাজের জন্যে এখন একমাত্র সেঁজুতির নামটাই মাথায় এলো রুদ্রর।মেয়েটির ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়া যাবে এবার!

===
পরেরদিন🍁
সেঁজুতি আজ তিক্ত মেজাজ নিয়ে অফিসে ঢুকেছে।রুদ্রর অফিসে কাজ করতে হচ্ছে ভাবলেই তার গা গুলোয়।নারী সঙ্গে ডুবে থাকা একটি লোকের এসিস্ট্যান্ট সে মনে পড়লেই রাগ আসে।আর সেই রাগ কয়েকশ গুন বৃদ্ধি পেলো ডেস্কে গিয়ে।রীতিমতো চোখ কপালে উঠে এলো।
পুরো ডেস্ক এর টেবিল টা ফাইল দিয়ে ভর্তি।এক ইঞ্চি জায়গা যদি থাকে! হাত রাখাও দ্বায়।চেয়ারে বসার দরকার না পরলে হয়তো চেয়ারেও ফাইল রাখতো।সেঁজুতির মাথা ঘুরে এলো।খেয়াল করতেই দেখলো ফাইলের ওপর ছোট্ট একটা কাগজ লাগানো।এককথায় চিরকুট। সেঁজুতি হাতে নিয়ে পড়লো,
“এক ঘন্টার মধ্যে সব ফাইল জমা চাই।
এবার সেঁজুতির অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়’ এত্তো গুলো? মাত্র এক ঘন্টায়?
সেঁজুতি মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসলো।
— কাল কম ছিলো কিন্তু আজ??এতো কম সময়ে এতো গুলো সলভ কি করে করবো?? হায় আল্লাহ!! কোন দিক থেকে শুরু করবো, কোনটা শেষ করব কিছুইতো বুঝতে পারছিনা।

” হ্যালো মিস…
সেঁজুতি যখন মন দিয়ে ফাইল ঘাটছে।পাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষালী স্বর।সেঁজুতি ঘাঁড় বাঁকা করে ফিরলো।লম্বাচওড়া একটি ছেলে।মুখে হাসি লেপ্টে রেখেছে যেন।সেঁজুতি একে কশ্মিন কালেও দেখেছে বলে মনে পড়ছেনা।অফিসেরই কেউ হয়তো।সৌজন্যে হেসে বলল,
‘ জ্বি বলুন?

লোকটা ভ্রু নাঁচালো’ অফিসে নতুন??
‘জ্বি।
“আমি রুপক,,আপনার সামনের ডেস্ক টা আমার ডেস্ক।
‘ওহ আচ্ছা।আমি নুসরাত সুলতানা।
রুপকের বাড়ানো হাতে হাত মেলালোনা সেঁজুতি।সে ভীষণ ব্যাস্ত। রুপকের অস্বস্তি লাগলো।হাত গুটিয়ে এনে মেকি হেসে বলল,
‘ সুন্দর নাম।
সেজুতি বেশ ভালো বুঝলো রুপক ছেলেটি তার সাথে ভাব জমাতে এসেছে।অন্য সময় হলে এক কথা।কিন্তু এখন একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেক কিছু।দুচার লাইন কথা বলতে গেলেও সময় নষ্ট হবে।
যা আগামী এক ঘন্টাতে একদম ই করা যাবেনা।
কিন্তু রুপক দাঁড়িয়েই আছে।উশখুশ করছে। কিছু বলবে বলবে ভাব।সেঁজুতি আবার তাকালো।মিষ্টি করে হেসে বলল
‘বলছিলাম যে বস আমাকে একটা কাজ দিয়েছেন। উইল ইউ প্লিজ এক্সিকিউজ মি?
একেবারে মুখের ওপর বলে দিলো? রুপকের চেহারায় ঘনিয়ে এলো অন্ধকার।সে বেশ অপমানিত বোধ করেছে।পেছন ফিরে একবার রুদ্রর কেবিন টাকে দেখলো।এরপর আবার সেঁজুতির দিক ফিরে মুখে হাসি টেনে বলল,
‘ নিশ্চয়ই!আপনি কাজ করুন।পরে কথা হবে।
রুপক চলে যেতেই সেঁজুতি মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল।তারপর ডুব দিলো ফাইলের কঠিন কঠিন ইংরেজিতে।
_____
রুদ্র চোখ সরিয়ে ল্যাবটবে রাখলো।ফিচেল হাসি তার ওষ্ঠে।মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা ব্যাপার তো নিশ্চয়ই আছে।মুখের ওপর কথা বলার কি দারুন ক্ষমতা!সেঁজুতিকে কাজের তীব্র চাপে রেখে একই সাথে বিরক্ত করার এক দুষ্টু বুদ্ধি ভর করেছিলো মাথায় ।অফিসের ড্যাশিং বয় হিসেবে আখ্যায়িত
রুপককে সেঁজুতির কাছে পাঠালো তাই।ছেলেটির সাথে খোশগল্প করতে করতে , কাজে ব্যাঘাত ঘটবে সাথে সময় মতো ফাইল জমাও হবেনা। এমনই ভেবেছিলো রুদ্র।আর সেই সুযোগে সেঁজুতি কে আবার কিছু কঁড়া কথা শোনাবে।তেঁজী মেয়েটার চুপসে যাওয়া চেহারাটা উপভোগ করবে মন ভরে।
অথচ তার কিছুই হলোনা। সেজুতি মুখের ওপর এমন ভাবে কথা টা বললো যে বেচারা রুপক থতমত খেলো।সন্মানের ভয়ে আর দাঁড়াতেই পারেনি।

কিন্তু কতক্ষন?
রুদ্র দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো এক ঘন্টা হতে আর কয়েক মিনিট বাকি।বাঁকা হাসলো,
দেখা যাক।কত দূর কি করতে পারেন উনি।
এক ঘন্টা পার হয়েছে অনেকক্ষন।সেঁজুতি ফাইলের মধ্যে নাকানিচুবানি খাচ্ছে তখনও।খানিক পর সব গুছিয়ে লম্বা শ্বাস ফেলল সেঁজুতি। এসির মধ্যেও চিন্তায় তার ঘাম ছোটার জোগাড়। রুদ্রর কেবিনের দরজায় নক করতেই ভেতরে আসতে বলল সে।সেঁজুতি ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা এসে ফাইল গুলো রুদ্রর টেবিলের ওপর রাখলো।নিঁচের দিক চেয়েই বলল ‘ চেকিং শেষ স্যার।
রুদ্র সরু চোখে দেখছে মেয়েটাকে।পিঠ সমান চুল গুলো ঝুঁটি করে বাঁধা।ক্রিম কালারে থ্রি পিস পড়নে।হাতে একটা কালো বেল্টের ঘড়ি,কানে কালকের দুল জোড়াই,আর ঠোঁটে লিপবাম।রুদ্র পরক্ষনেই নঁড়ে উঠলো।এই মেয়েটা সামনে এলে তাকে এত খুঁটিয়ে দেখে কেন? কী আছে এর মধ্যে?কিছু নেই।রুদ্র স্বাভাবিক হলো। কিয়ৎ সময়েও তার সাড়া না পেয়ে মুখ তুলল সেঁজুতি। স্পষ্ট কাটাকাটা অক্ষরে বলল ‘ স্যার!সব গুলো চেক করেছি আমি।
রুদ্র এবার দেয়াল ঘড়িতে চোখ ইশারা করে বলল,
— বাট ইউ আর টুয়েন্টি মিনিটস লেট।আমি এক ঘন্টা বলেছিলাম।

সেঁজুতির মেজাজ এমনিই খারাপ।রুদ্রকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে মন চাইছে তার।এত গুলো ফাইল যে সে এক ঘন্টা বিশ মিনিটে সলভ করলো সেটা দেখলোনা।সময় টাই বড়? ভদ্র ভাবে বলল
‘অনেক গুলো ফাইল তো তাই একটু সময় লেগে গেলো।

রুদ্র কঁড়া কন্ঠে বলল,
— এটা আপনার স্কুল নয় মিস সেজুতি।যে সর্দি জ্বরের অজুহাত দিয়ে আপনার হোম ওয়ার্ক না করার শাস্তি থেকে বেঁচে যাবেন।ইটস আ অফিস।এখানে প্রত্যেক টা কাজ টাইমলি হতে হবে মানে টাইমলি।গট ইট??

সেঁজুতি বাধ্যমেয়ের মতো মাথা ঝাঁকালো।মানে সে বুঝেছে।রুদ্র অবাক না হয়ে পারলোনা।সাথে ভালোও লাগলো। যে মেয়ে কাল এই কেবিনেই চাকরী করবেনা বলে চিৎকার চেঁচামেচি করলো সেই মেয়েই আজ কতটা নির্লিপ্ত,কতটা শান্ত।নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা সত্যিই অসাধারন।
‘ গুড।
রুদ্রর কথা শেষ হতেই সেজুতি যাওয়ার জন্যে পা বাড়ালো।পারলোনা।আটকে গেলো রুদ্রর গম্ভীর আওয়াজে,
‘আপনাকে যেতে বলেছি আমি??
সেঁজুতি ঘাঁড় ফেরালো।ভ্রু কুঁচকে বলল ‘ তো কী করব?
রুদ্র ক্ষেপে গেলো যেন,
‘ বসের মুখের ওপরে প্রশ্ন করছেন?ভদ্রতা বলতে কিছুই জানেন না?
সেঁজুতি দাত কপাটি পিষে ধরলো।কটমট করছে তার চোয়াল। বিপাকে ফেলে এখন কথা শোনাচ্ছেন তাইনা মিঃ বস?? কোনও ব্যাপার নয়,,কর্মচারী যখন,তখন সহ্য তো করবই।
আস্তে করে বলল ‘স্যরি!
রুদ্র তুষ্ট হেসে বলল,
— ভেরী গুড।একদিনেই ম্যানার্স শিখে গিয়েছেন দেখছি।এনি ওয়ে আপনাকে এখন এক জায়গায় যেতে হবে।
সেঁজুতি সহজ ভাবেই শুধালো,
‘ কোথায় যাব?
রুদ্র ল্যাবটবে চোখ দিলো।ব্যাস্ততা দেখালো হয়ত।জবাব দিলো ঠান্ডা স্বরে,
‘ উত্তরাতে!মিঃ নেহাল উদ্দিন এর অফিসে,ঠিকানা ম্যানেজারের থেকে নিয়ে যাবেন।
‘ ওখানে গিয়ে আমার কাজ?
রুদ্র চোখা চোখে চাইলো।দৃষ্টি বুঝে চোখ নামালো সেঁজুতি। মিনমিন করে বলল,
‘ স্যরি!
রুদ্র ঠোঁট বাঁকালো,অথচ গলা শক্ত করে বলল,
‘আগামী দু দিন আমাদের বোর্ড মিটিং রয়েছে। আপনাকে সেজন্যে ওনার শিডিউল নিয়ে আসতে হবে এবং সেটা দুপুর একটার মধ্যে।আর হ্যা শিডিউল নিয়ে তবেই আসা চাই।আপনি নিশ্চয়ই বুঝেছেন আমি কী বললাম?
সেঁজুতি ছোট করে বলল ‘ হু।
রুদ্রর দৃঢ় জবাব,
‘হু নয়। বলুন ‘ওকে স্যার।
সেঁজুতি দাঁত চিবিয়ে বলল
‘ ওকে স্যার।
”now go!
______
যানজট পেরিয়ে আসতে আসতে বারোটা বেজে গিয়েছে প্রায়।সহ্য শক্তি যেটুকু ছিলো সেটুকুও অবশিষ্ট রইলোনা এখানে আসার পর।রিসেপশনে গিয়ে জানলো নেহাল উদ্দিন ব্যাস্ত।এক্ষুনি দেখা হবেনা।অপেক্ষা করতে হবে।আগামী এক ঘন্টায়ও সে ব্যাস্ততা শেষ হলোনা।ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে থাকতে সেঁজুতির হাতে পায়ে ঝিম ধরে গেলো।কতক্ষন পায়চারি করলো,কতক্ষন বসলো এভাবেই পার করলো সময় টুকু।আরেকবার,
রিসেপশনে গিয়ে দাড়ালো সেজুথি,,
— এক্সকিউজ মি!ওনার মিটিং আর কতক্ষন??
লোকটি এবার অধৈর্য হলো,ভ্রুয়ে দৃশ্যমান হলো দু তিনটে সূক্ষ্ম ভাঁজ।
— ম্যাম বললাম তো আপনি ওয়েট করুন,মিটিং শেষ হলেই আপনাকে ডাকবো আমি।
সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— ওকে।সেঁজুতি তিতিবিরক্ত।
সেই একই কথা মিটিং এ আছেন,মিটিং এ আছেন।এদিকে যে প্রায় ১ টা বাজতে চললো তার কি হবে? উফফ কি কুক্ষনে যে এই জব টা করতে এসেছিলো সে আল্লাহই জানে।দেরী করলে লোকটা আবার কথা শোনাবে। ব্যাগ থেকে ফোন বার করে বাবার নাম্বার এ ডায়াল করতে যাচ্ছিলো সেঁজুতি।কল ঢুকলোনা।এর আগেই ফোনের স্ক্রিনে অচেনা নম্বর জ্বলে উঠলো।চাপ লেগে রিসিভ ও হলো সঙ্গে সঙ্গে।
‘ আসসালামু আলাইকুম! কে?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো সময় নিয়ে।গুমোট স্বরে কেউ বলল,
— কোথায় আপনি?আওয়াজ শুনেই
কান থেকে ফোন নামিয়ে স্ক্রিনে একবার চোখ বোলালো সেঁজুতি।ফোন আবার কানে ধরতেই কেউ ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল,
‘শুনতে পাচ্ছেন না?

‘ স্যার,আমি নেহাল উদ্দিনের অফিসেই আছি। আসলে উনি…
রুদ্র থামিয়ে দিয়ে বলল,
‘আসল নকল রাখুন।১টা বেজে পাঁচ মিনিট অথচ আপনার ছায়াও অফিসে পরেনি।আদৌ কাজ টা করতে পেরেছেন তো?
সেঁজুতি যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
‘স্যার উনি মিটিং রুমে রয়েছেন।আমাকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে।ওনার মিটিং শেষ না হওয়া অব্দি ঢুকতে দেবেনা।মিটিং শেষ হলেই আমি…
” আমি কোনো এক্সকিউজ চাইনি।

সেঁজুতি অন্যদিক তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলল।দাঁত চেপে বিড়বিড় করলো।লোকটাকে তার একদম সহ্য হয়না।রুদ্র কিছু একটা ভেবে বলল,
‘ বেশ ঠিক আছে, আপনাকে সময় দিলাম।শত হলেও আপনি আমার পি..এ, এইটুকু দয়া আপনাকে করাই যায়,,বাট আই ওয়ান্ট হিজ শিডিউল।এ্যাট এনি কস্ট।ওকে?
রুদ্র ফট করে লাইন কাটলো।
সেজুতির ইচ্ছে হলো ফোন টা কে আছাড় মারতে।
অসহ্য!দয়া করছেন আমাকে?? কে চেয়েছে ওনার দয়া?বারবার এসব বলে আমাকে ছোট করার কি আপ্রান চেষ্টা ওনার!এতো বড় একজন বিজনেস ম্যান এভাবে হাত ধুঁয়ে আমার পেছনে কেনো পরলো ?আর এই নেহাল উদ্দিন না বেহাল উদ্দিন?? ওনার মিটিং কি আজকেই পরতে হলো।ইচ্ছে করছে এক ঘুষিতে দুটোর নাক ই ফাটিয়ে দেই।
সেঁজুতির অপেক্ষার অবসান ঘটলো আরো কিছুক্ষন পর। মিটিং শেষ হলো।রিসেপশনিস্ট থেকে এলো কাঙ্ক্ষিত ডাক।সেঁজুতি তিরিক্ষ মেজাজ শীতল হলো মুহুর্তেই।নেহাল উদ্দিনের এসিস্ট্যান্ট এসে নিয়ে গেলেন সেঁজুতি কে।কেবিন দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন উনি।সেঁজুতি আলতো হাতে নক করলো।
— মে আই কাম ইন স্যার?

— ইয়েস,,
সেঁজুতি ভেতরে ঢুকলো।কাঁধে ব্যাগ।অন্য হাতে ফাইল।সামনে তাকিয়ে চেয়ারে বসা নেহাল উদ্দিন কে দেখলো একবার।একটু হেসে সালাম দিলে নেহাল ও হেসে জবাব দেয় সালামের।
একবার পা থেকে মাথা অব্ধি পর্যবেক্ষন করে নেয় সেঁজুতির।এইতো, এই চাউনীই ভয় পায় সেঁজুতি। এতক্ষন ধরে রাখা কনফিডেন্স গুলিয়ে গেলো মুহুর্তেই।এক ঝাঁক ভয়,অস্বস্তি বাসা বাঁধলো মনে।নেহাল সেঁজুতি কে বসতে বললেন।সেঁজুতি বসলো।নেহাল কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে।মনে হলো,মাপঝোঁক করছে শরীরের।সেঁজুতি দু চারবার করে ওড়না টানছে। লোকটা চোখ দিয়ে গিলছে তাকে।পেট ভরছে তো ওনার?

চলবে….

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব — ১৫

নেহালের কেবিন রুদ্রর মতো নয়।রুদ্রর মতো ফুটবলের মাঠ নিয়ে বসেনি উনি।ঠিক যত টুকু জায়গা দরকার ততটুকুই ব্যাবহার করেছেন কেবিন হিসেবে।সেঁজুতি চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলো।বিশেষ কিছু চোখে লাগলোনা।এখান থেকে বাইরেটাও দেখা যায়না।সেঁজুতি নেহালের দিকে তাকালো।তিনি এখনও ওর দিকে চেয়ে।কেমন অদ্ভূত দৃষ্টি। টেবিলের মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে সেজুথি আর অপর পাশে নেহাল।নেহাল টুকিটাকি কথা বলছেম।মুখের থেকে লোকটার চোখ চলছে বেশি। শরীরের দিকে তাকাচ্ছেন বারবার।ব্যাপার টা যতবার ই সেজুথি বুঝতে পারছে তত বার ই নঁড়েচড়ে গাট হয়ে বসছে।

— স্যার! তবে কি আপনি মিটিং ফিক্সড করতে রাজি আছেন?
সেঁজুতি মৃদূ কন্ঠে শুধালো।নেহাল বললেন,

‘আপনার বস এতো ঘনঘন মিটিং কেনো চাচ্ছেন? আমার নিজেরও কিছু কাজ থাকে তাইনা?হূটহাট বললেই তো হয়না।
সেঁজুতি রুদ্র অার নেহালের ব্যাপারে আগামাথা কিছুই জানেনা।এ প্রেক্ষিতে তার উত্তর কী হওয়া উচিত জানেনা সেটাও।চুপ থাকবে নাকী উত্তর দেবে এই নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগলো।নেহাল জিজ্ঞেস করলেন,

— হ্যালো মিস,,কিছু ভাবছেন??
সেঁজুতি মাথা নেঁড়ে বলল,
— জ্বি? না।
নেহাল চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন,
“মিটিং ফিক্সড করতে আমার কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু শিডিউল আমি এক্ষুনি দিতে পারছিনা।কোথায় কোন মিটিং আছে চেক করতে হবে। আমি না হয়, শিডিউল আপনাদের অফিসে আমার এসিস্ট্যান্ট কে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো।

সেঁজুতি ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
— না,না স্যার,আপনার কষ্ট করে পাঠাতে হবেনা।আমরা ব্যাবস্থা করেই রেখেছি।
সেঁজুতি ফাইল থেকে কাগজ বের করে নেহালের সামনে রাখলো।
” এই দেখুন স্যার,এই পেপার্স এ সমস্ত কিছু উল্লেখ করাই আছে। আপনি শুধু পুরো টা পড়ে সাইন করে দেবেন।তাহলেই হবে।
নেহালের মেজাজ বিগড়ালো।ভাবলো এই সুযোগে রুদ্রকে আরেকটু ঘোরাবে।চতুর লোকটা একটা ফাঁক ও রাখেনা মাছি পালানোর।মেকি হেসে বলল,
— ওহ আই সি,,,

খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাগজের সব লেখা পড়লো নেহাল।তুষ্ট কন্ঠে বলল,
বাহ! টাইম মেইনটেইন তো বেশ ভালোই করেছেন।এরকম টাইমিং এ আমার কোনও আপত্তি থাকবেনা,। আমি সাইন করে দিচ্ছি…

‘ধন্যবাদ স্যার,

— পেন?

সেঁজুতি কলম এগিয়ে দেয়।নেহাল যেন সুযোগ সন্ধানী । কলম নেয়ার অজুহাতে নিজের হাত দিয়ে সেজুথির হাতে স্পর্শ করলো।ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মেজাজ খারাপ হলেও সেজুথি কোনও প্রতিক্রিয়া দেখালোনা।বা দেখাতে পারলোনা।

— নিন।

— ধন্যবাদ স্যার,এবার তবে আমি উঠি।
সেঁজুতি সন্তর্পনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।এতক্ষন লোকটার সামনে দম আটকে বসে ছিলো যেন।পৃথিবীর সব পুরুষই কী এমন?নারীদের শরীরেই তাদের আকর্ষন।সেঁজুতি উঠে দাড়াতেই ডেকে উঠলো নেহাল,

– শুনুন। আপনার পুরো নাম?

‘নুসরাত সুলতানা স্যার।

‘ ওকে মিস নুসরাত,
চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো নেহাল।নেহাল কে এগোতে দেখে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইলো সেজুতি। নেহাল ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। দাঁত বার করে হাসলো।সেঁজুতি এলোমেলো দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাচ্ছে।কেন যেন গলা শুকিয়ে আসছে।অজানা আসঙ্কায় আড়ষ্ট শরীর। নেহাল সেঁজুতির পা থেকে মাথা অব্দি চোখ দিয়ে মাপলো।সেঁজুতিকে স্তব্ধ করতে দু আঙুল দিয়ে গালে স্লাইড করে বলল
“ইউ আর সো বিউটিফুল লেডি!
প্রসংশা শুনলে খুশি হওয়া উচিত।অথচ নেহালের বলার ভঙ্গিতে খুশির বদলে ফুঁসে উঠলো সেঁজুতি। তার ওপর লোকটা গায়ে হাত দিলো।সেঁজুতি একরকম ঝাঁড়া মেরে গাল থেকে নেহালের হাত টা সরিয়ে দিলো।শান্ত অথচ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
“আপনি আমার বসের সহকর্মী।বয়সেও আমার বাবার মতোই।তাই আপনার ভদ্রতা বজায় রাখা দরকার স্যার।

সেঁজুতি ভাবলো ব্যাপারটা এখানেই মিটে যাবে।নেহাল হয়তো অতোটাও অভদ্র হবেন না।নেহাল কে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে ধরলো।কিন্তু নেহাল তাকে ভুল প্রমান করলো নিমিষেই। খপাৎ করে হাত চেপে ধরলো নেহাল।সেঁজুতি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।নেহাল ভ্রু কুঁচকে বলল

” দেমাগ দেখাচ্ছো? তা ভালো।সুন্দরী মেয়েদের একটুআকটু দেমাগ না থাকলে ঠিক জমেনা।দেমাগী মেয়েদের বশ করতেও আমার খুব আনন্দ লাগে। কিন্তু এত্ত দেমাগ আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই।সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিসের আবার কীসের এত অহংকার!
সেঁজুতির মাথায় যেন বাঁজ পরলো।সেকেন্ড হ্যান্ড দিয়ে কী বোঝালো লোকটা? নেহাল কুটিল হেসে বলল,
” রুদ্র রওশনের বয়স যখন ২২, তখন থেকেই ওকে চিনি আমি।ওর সব খুঁটিনাটি জানি।রাতে ওর নারী সঙ্গের কথা বিজনেস এরিয়ার কে না জানে?আর তুমিতো সেখানে ওর পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।সব পার্সোনাল কাজেই রুদ্রর তোমাকে দরকার তাইনা?প্লিজ এখন এটা বলোনা যে ওর সাথে বিছানায় যাওনি এখনও।রুদ্রর আশেপাশে যেসব মেয়েরা ঘুরঘুর করে সবাই ওর সাথে বেড শেয়ার করার জন্যে উঠেপরে লাগে।আর সেখানে তুমিতো এত্ত সুন্দরী। তোমাকে কি আর রুদ্র রওশন ছেড়ে দিয়েছে? শুধু শুধু নাটক করছো। আমার কথা মন দিয়ে শোনো,একবার ভেবে দেখো,ওই রুদ্র রওশনের থেকে বেডের টাকা বাড়িয়ে দেবো তোমাকে ,আর সাথে আমার পার্ফমেন্স ও ভালো হবে।চিন্তা নেই।

সেঁজুতি নিজেকে আর সংযত করতে পারলোনা।নেহাল থামতেই ঠাস করে এক চড় বসালো গালে।নেহাল হকচকালো প্রথমে।শরীরের সমস্ত রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠলো তাৎক্ষণিক।গালে হাত বোলালো নিজের।হাটুর বয়সী মেয়ের থাপ্পড় খেলো সে? নেহাল যেন বিশ্বাসই করতে পারলোনা। ক্রোধে জ্বলে উঠলো চোখ দুটো।আগের থেকেও শক্ত করে চেপে ধরলো সেঁজুতির হাত।দাঁত পিষে বলল

— দুই টাকার মেয়ে!এতবড় সাহস তুই নেহাল উদ্দিন এর গায়ে হাত তুলিস?আজ তো তোকে এখানেই….

সেঁজুতির কপালে সূক্ষ্ণ ঘাম।ভেতরটা ঢিপঢিপ করছে।নেহাল এগিয়ে আসতেই পেছাতে শুরু করলো।কাঁপা গলায় বলল
” এ…এগোবেন না…দে…দেখুন আ..আমি কিন্তু চিৎকার করবো..লোক জড়ো করবো…
নেহাল তাচ্ছিল্য হাসলো,পৈশাচিক আনন্দে হৈ হৈ করে বলল,
” চেঁচা না,চেঁচা। যত পারিস চেঁচা। রেপ হবি আর না চেঁচালে হয়?আমিওতো মজা পাবোনা।এটা আমার অফিস। এখানে সবাই আমার গোলাম,তোর চিৎকার শুনলেও কেউ কিচ্ছু করতে আসবেনা।অবশ্য শুনবেই বা কিভাবে রুম টাই তো সাউন্ডপ্রুফ।হা হা হা।
নেহাল অট্টহাসিতে ফেঁটে পরলো। সেঁজুতির চোয়াল ঝুলে পরলো ওর কথা শুনে।পেছাতে পেছাতে দেয়ালেও পিঠ ঠেকে এলো।নেহাল তড়িৎ গতিতে সেঁজুতির গাল চেপে ধরলো এক হাতে।অন্য হাতে সেঁজুতির এক হাত শক্ত ভাবে বন্দি।নেহাল ঠোঁট এগিয়ে আনতেই চট করে ওর সারা মুখে পারফিউম স্প্রে করে দিলো সেজুতি।আচমকা হামলায় নেহাল ভঁড়কালো।স্প্রে চোখে নাকে ঢুকে গিয়েছে। জ্বলে যাচ্ছে সব।সেঁজুতি মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো নেহালের।হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চিৎকার করে উঠলো।
সেঁজুতি বিজয়ের হাসি হাসলো।উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
— এখানে চিৎকার করে কোনও লাভ নেই বেহাল মশাই।সাউন্ড প্রুফ রুম বানানোর মজা বোঝ এবার।
কথাটা বলেই জোরে নিজের পা দিয়ে একটা লাথি বসালো নেহালের পায়ের আঙুলের ওপর।বেচারা একেতো চোখ ডলছিলো।পায়ের ব্যাথায় চিৎকার করে ওঠে আবারো। দৌড়ে টেবিলের কাছে আসে পানির গ্লাস হাতরাতে।বিড়বিড় করে বলল ‘ মা** তোকে মজা দেখাচ্ছি দাঁড়া।

সেঁজুতিকে আর পেলেতো?সেই কখন সে সুযোগ বুঝেই পগারপার।
_______
সি এন জি তে সারাটা রাস্তা কেঁদেছে সেঁজুতি। কাঁদতে কঁদতে হেচকি উঠেছে।বুদ্ধি করে না বাঁচলে আজ তার কী হতো? নেহাল নিশ্চয়ই তাকে ছিড়েখুঁড়ে খেতো।হয় মেরে ফেলে লাশ গুম করতো আর নাহলে ছেড়ে দিতো আশ মিটিয়ে।ওভাবে বাঁচলেও বা কী! ওটাতো মরার মতোই।জীবন্ত লাশ এক কথায়।সেঁজুতির সব রাগ ক্ষোভ গিয়ে পরলো রুদ্রর ওপর। অফিসে ঢুকে সোজা সে রুদ্রর কেবিনের দিকে ছূটলো।রুদ্র তখন গভীর মনোযোগে কাজ করছে। সেঁজুতির আসা টা লক্ষ্য করেনি। সেঁজুতি কোনও কিছুতে তোয়াক্কা করলোনা।রুদ্র অফিসের মালিক রীতিমতো ভুলে বসলো কথাটা।নক না করেই গটগটিয়ে রুদ্রর কেবিনে ঢুকলো।
তীব্র ক্রোধে হাতের ফাইলটাকে ছুড়ে মারলো রুদ্রর মুখের ওপর। অতর্কিত হামলায় রুদ্র হতভম্ব হয়ে সামনে তাকালো।সেঁজুতি শূন্য অভিব্যাক্তি তে চেয়ে আছে।চোখ মুখ ফুলে ফেঁপে একাকার।রুদ্রর সেসবে খেয়াল নেই।একটু আগের ঘটনাটাই ঘুরেফিরে মাথায় ঢুকলো তার।
রাগে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো, চিৎকার করে বলল,
— হোয়াট দ্যা হেল,,,ইজ দিস?? তোমার সাহস কি করে হয় আমার গায়ে ফাইল ছুড়ে মারার?
রুদ্রর চিৎকারে ঈষৎ কেঁপে ওঠে সেঁজুতি।
অথচ ঘাবড়ায়না।রুদ্রর মতোই পালটা চিৎকার ছুড়ে বলল

— এসব কি হচ্ছে সেটাতো আপনি আমাকে বলবেন। ইচ্ছে করে আমাকে এতো টা অসন্মান করিয়েছেন আপনি তাইনা?আপনার শিখিয়ে দেয়া কাজ ই করেছে ওই নেহাল তাইতো?
সেঁজুতির গলা বুজে এলো।
চোখদুটো আবার ভিজলো টলটলে পানিতে।রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো।মেয়েটা কাঁদছে কেন? নরম স্বরে বলল,

— মানে?
সেঁজুতি চেয়ারে বসে পরলো।টেবিলে দুহাত রেখে মাথা গুজে হুহু করে কেঁদে উঠলো।রুদ্র চমকালো।উঠে এসে সেঁজুতির পাশে দাঁড়ালো।উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
— কি হয়েছে মিস সেজুতি? আপনি কাঁদছেন কেন?আমাকে বলুন….
সেঁজুতির কান্না থামলোনা।পিঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে।রুদ্র একবার ছুঁতে গিয়েও হাত গুটিয়ে আনলো।মোলায়েম কন্ঠে বলল

— কি হলো,, আমাকে বলুন…কাঁদছেন কেনো আপনি??
সেঁজুতি চোখ তুলল।নাকের ডগা টা টকটকে লাল।ভেজা চোখের পাঁপড়ি।আর কেঁপে ওঠা ঠোঁট দুটোতে রুদ্র কিয়ৎ সময় গুলিয়ে যায়।তাল কাটে সেঁজুতির কথায়। নাক টেনে টেনে কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনাটাই রুদ্রকে বলল সেঁজুতি।
রুদ্র যেন বাকরুদ্ধ,বিস্মিত। নেহাল লোকটা খারাপ সে জানে কিন্তু এত দূর এগোবে সেটা ভাবেনি।ভাবলে সেঁজুতি কে কখনওই পাঠাতোনা।ক্ষুব্ধ রুদ্রর হাত মুঠো হয়ে এলো তাৎক্ষনিক।কপালের নীলাভ রগ দৃশ্যমান হলো। জ্বলন্ত চোখে আগুন দাউদাউ করছে যেন।
সেঁজুতি তখনও কাঁদছে।ফর্সা গালে অশ্রু কনা শিশিরের মতো লাগছে।রুদ্র জোরে একটা নিঃশ্বাস নিলো।ঘুরে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে বরফ কন্ঠে বলল

— মিস সেজুথি,এটা অফিস, আপনার কান্নার জায়গা নয়।
সেঁজুতির চেহারা রক্তশূন্য হয়ে এলো।অবাক চোখে তাকাতেই রুদ্র না চেয়েই বলল
‘এভাবে তাকানোর কিছু নেই।এসব আজকাল অহরহ ঘটছে।এগুলো ভুলে গিয়ে নিজের কাজে মন দিন।বড় বড় বিজনেসম্যান দের চরিত্রে এরকম একটু আকটু দোষ থাকে।
রুদ্র ল্যাবটবে কাজের ব্যাস্ততা দেখালো।

— হ্যা যেমন আপনার আছে।তাইনা…?
সেঁজুতি উত্তেজিত হয়ে পরলো রাগে।রুদ্রর প্রতি যেটুকু আস্থা অবশিষ্ট রইলো ধামাচাপা পরলো সেটুকুও।দাঁত চেপে কথা গুলো বলে উঠে দাড়ালো সেজুতি।পরমুহূর্তেই রাগে ফুঁসে বলল,
“ভেবেছিলাম আপনি যেমন ই হোন না কেনো একটা মেয়ের সন্মান হানি করতে চাওয়ার বিচার টা অন্তত করবেন।কিন্তু আমি ভুল ছিলাম,,আপনারা সব এক।সব।সেঁজুতি হনহন করে কেবিন ছেড়ে বের হয়। রুদ্রর মাঝে হেলদোল দেখা গেলোনা।ভাব এমন সেঁজুতির কথা কানেই ঢোকেনি তার।সে ব্যাস্ত।মহাব্যাস্ত।
___
সেঁজুতি অফিস থেকে ফিরেছে অনেকক্ষন।সারাটা অফিস মন মরা হয়ে থাকলেও বাড়ি এসেই মন ভালো হয়েছে মোটামুটি। আমির তিন রঙের সেমাই রেঁধেছে সেঁজুতির জন্যে।যেটা দেখতেই মুখে হাসি ফুটেছে। ছোট থেকেই এই সেমাই টা তার ভীষণ প্রিয়।কত গুলো রং একসাথে দেখা যায়।রঙিন সেমাই বেশ আনন্দ নিয়ে খেতো সে।আজ ও তাই।সব মন খারাপ ঝেরে ফেলে সেঁজুতি ফ্রেশ হলো।এক বাটিতে বাবার জন্যে আরেকটায় নিজের জন্যে সেমাই বেড়ে বাবার পাশে এসে বসলো ।আমির তখন টিভিতে চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন।সেঁজুতি এক চামচ সেমাই মুখে তুলতে তুলতে টিভির দিকে তাকালো।হঠাৎ একটা চ্যানেলে চোখ আটকালো তার।তড়িঘড়ি করে বলল
‘বাবা দাঁড়াও দাঁড়াও,,আগের চ্যানেল টাতে দাও
তো,,
সেজুথির কথায় চ্যানেল পালটে আগের চ্যানেল ধরলো আমির।

-ব্রেকিং নিউজ……

“””””””””উত্তরার বিজনেসম্যান নেহাল উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধার….”””””””””””””””””””
সেঁজুতির খাবার গলায় আটকে এলো।চোখ যেন কোটর ছেড়ে লাফিয়ে আসে।এটাতো সেই নেহাল উদ্দিন।

চলবে…

প্রনয় পর্ব-১২+১৩

0

# প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব – ১২

কাঁচের দরজাটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলো সেঁজুতি।এমনিই নার্ভাস সে।সাথে এসির ঠান্ডার মাত্রায় গুটিয়ে আসছে আরো।সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা শরীর, আর চোখ তুলে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো।অভ্রও একিভাবে চেয়ে আছে।মুখ দেখে মনে হলো সেও অবাক হয়েছে।
সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বলল,
মিঃ অভ্র?? আপনি?
অভ্র বসা থেকে সটান উঠে দাঁড়ালো ‘ সেঁজুতি যে! আপনিই কী সেই ক্যান্ডিডেট?

সেঁজুতি এক পাশে মাথা নাঁড়লে অভ্র হাসলো। দম নিলো,
‘ এক মিনিট’
সময় টুকু চেয়ে টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেলো অভ্র।পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বসলো।সেঁজুতি কে বলল” বসুন।

সেঁজুতি এগিয়ে এলো বসার জন্যে।কৌতুহল তার মুখ চোখে।অভ্রকে এখানে আশা করেনি একদমই।অভ্রর অবস্থাও তাই।সেও সেঁজুতি কে আশা করেনি।গতকাল থেকে রুদ্রর হাবভাব ভালো লাগছিলোনা।যেখানে শত শত গ্রাজুয়েট লোক লাইনে থাকে ‘আর -আর -সিতে একটা চাকরী পেতে,সেখানে অফিসের বস নিজে যেচে একজন কে চাকরী দিচ্ছে।এমনকি এপ্যোয়েন্টমেন্ট লেটার অব্দি নিজে বানিয়েছে।অফিসের নেম প্লেট পাল্টেছে।ম্যানেজার কে পাঠিয়ে ভুঁড়ি ভুঁড়ি মিথ্যে বলিয়েছে।অভ্র তখনও জানতোনা যার জন্যে এসব, সে আদৌ ছেলে নাকী মেয়ে।রুদ্র তার সামনেই ম্যানেজার কে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছিলো।তখনও সে বোঝেনি মেয়েটি আসলে সেঁজুতি হবে।কিন্তু সেঁজুতির জন্যে ভাইয়ের এত কর্মকাণ্ডের মানে কি? শুধুই কী ঋন শোধ? অভ্র যখন গভীর ভাবনায়, সেঁজুতি বলল,
— তার মানে এটা আপনাদের অফিস?আমি কিন্তু জানতাম না আপনি এখানে থাকবেন।
‘ আমিওনা।
সেঁজুতি এতক্ষনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো,
‘যাক! ব্যাপার টা তাহলে আপনার ইচ্ছাকৃত নয়।

“একদম ই নয়,,
সেঁজুতি মৃদূ হাসলো ‘ তাহলে ঠিক আছে। ইচ্ছেকৃত হলে হয়তো কাজটা করা হতোনা আমার।
অভ্র পালটা হেসে বলল ‘ জ্বি জানি। একদিনে আপনাকে এত টুকু বুঝেছি।কারো দানপত্র নেয়াতে আপনার খুবই এলার্জি।বলেছিলেন আপনি!
অভ্র মনে মনে ভাবলো,’ হয়ত এইজন্যেই ভাই এত কাহিনী করলো আপনাকে চাকরী টা পাইয়ে দিতে।ভাইয়ের বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারছিনা।মেয়েটা টাকা নেয়নি দেখে এইভাবে তার ঋন শোধ করার উপায়টা কিন্তু দারুন!

সেঁজুতি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,
‘তো এখন কি আমি সিলেক্টেড?
অভ্র দৃঢ় কন্ঠে বলল
‘অবশ্যই…
‘ ইন্টারভিউ?
‘ আমাদের ম্যানেজার আপনাকে বলেনি কিছু?
‘ বলেছিলো।মার্কের ওপর ডিপেন্ড করে চাকরীটা পাচ্ছি কিন্তু এখানে এসে ভার্সিটির কাউকে দেখলাম না যে! আর মার্ক ভালো হলেই গ্রাফিক্স বা ডিজাইনিং ভালো পারব তাও কিন্তু নয়।

অভ্র প্রসন্ন হেসে বলল ‘ সেঁজুতি! আপনি নিঃসন্দেহে একজন বুদ্ধিমতি মেয়ে।আপনার যাচাই করার ধরন টা কিন্তু ভালো।আসলে ব্যাপারটা হলো আমরা এক ডিপার্টমেন্ট থেকে যে কোনো একজন কে বাছাই করি।আপনাদের ডিপার্টমেন্টে মোট চারজন করে করা হয়।এরপর তন্মধ্যে লটারি করা হলো।আর লাকিলি আপনার নাম উঠলো।বুঝতে পারলেন?
ভেতরে ভেতরে হাফ ছাড়লো অভ্র।এত গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারায় বাহবা দিলো নিজেকে।
‘ ওহ! তাই ভাবি কাউকেই এখানে পেলাম না।
অভ্র চট করে বলল
‘ আপনি একটু পরেই আরো একটা প্রশ্ন করে বসবেন আমি জানি।তাই আগেভাগে উত্তর দিচ্ছি শুনুন, আপনাদের লটারি করার দায়িত্ব কিন্তু আমার ছিলোনা,তাই আমি জানতে পারিনি যে সিলেক্ট হলেন তার পরিচয় কী! বা তিনিই আপনি।
সেঁজুতি হেসে ফেলল।হাতের ফাইল ঠেলে দিয়ে বলল ‘ এখানে আমার সব ডকুমেন্টস আছে।ওখানে যা যা লেখা ছিলো এনেছি সব।

অভ্র নাটকীয় ভাবে সেগুলো নিলো বিনাবাক্য ব্যায়ে।সেঁজুতি একটু ইতস্তত করে বলল
‘ আমার কী কাজ এখানে? মানে কী পদ?
অভ্রর সহজ উত্তর,
‘ পি এ… আই মিন পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।
‘ আপনার?
‘আমার ভাইয়ের…
সেঁজুতি চোখ বড় করে বলল,
‘ ওই যে উনি? যিনি চেহারা ঢেকে রাখেন সব সময়?
‘ জ্বি।অত্র অফিসের মালিক উনিই।আমিতো সামান্য ভার বহন করছি।
সেঁজুতি অন্যমনস্ক হয়ে বলল ‘ কী কাকতালীয় ব্যাপার। গত পরশুই উনি আমার চাকরীর কথা জানতে চাইলেন।আর আজ ওনার কোম্পানি তেই চাকরী পেয়ে গেলাম আমি?
,
একেই বলে ভাগ্য!
অভ্র দাঁত বের করে হেসে নীল রংয়ের একটি ফাইল এগিয়ে দিলো।
‘ আপনার জয়েনিং কিন্তু কাল থেকে।আপাতত এটাতে একটা সই করে দিন।

সেঁজুতি ফাইল খুলে পড়তে গেলে অভ্র তটস্থ হয়ে বলল’ তেমন কিছুই না।আসলে এতে লেখা আছে যে আগামী তিন মাসে আপনি যদি একদিন ও অফিসে অনুপস্থিত থাকেন তবে আর এই চাকরী টা আপনার থাকবেনা।এখনও তিন মাস সময় লাগবে আপনার স্থায়ী হতে।অন্যান্য অফিসেও যে রুলস হয় আরকী।আর দ্বিতীয় শর্তটা হলো আপনি যে এখানে এসে জয়েন করেছেন সেই ব্যাপারে একটা ছোট্ট দস্তখত।আপনার তো আবার শিরায় শিরায় সন্দেহ।চাইলে পড়ে দেখতে পারেন।

সেঁজুতি একটু লজ্জ্বা পেয়ে বলল
‘কোথায় সাইন করতে হবে বলে দিন আমি করে দিচ্ছি।
‘একদম নীচে।
না পড়েই পেপার্স গুলোতে একে একে সাইন করে দিলো সেজুথি।কাজ শেষে যথারীতি ফাইল টা আবার এগিয়ে দিলো অভ্রর দিকে।হ্যান্ড ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে বলল’ এবার তাহলে আসি।
‘এক সেকেন্ড!

সেঁজুতি থামলো।অভ্র একটা মোটা টাকার বান্ডিল টেবিলের ওপর রেখে বলল, এটা আপনার এডভান্স।
সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো,
— এডভান্স??
অভ্র স্পষ্ট কন্ঠে বলল,
‘ এই চাকরীটার ক্ষেত্রে এই নিয়ম টা চলে এসছে।যেহেতু প্রত্যেকে স্টুডেন্ট হয় ভাই -ই সেজন্যে নিয়ম টা বানিয়েছিলো।
সেঁজুতি আর ভাবলোনা।এত বড় কোম্পানিকে সন্দেহ করার কী আছে?প্রসন্ন হেসে টাকা গুলো ব্যাগে ভরলো।কিন্তু মন বড় নাছোড়বান্দা। হাটতে হাটতে ভাবছিলো,
‘ জয়েন হওয়ার আগেই স্যালারি দিয়ে দেয়া? এটা ঠিক কেমন অফিস? তবে টাকা পেয়ে মন্দ হয়নি।এটা এই মুহুর্তে ভীষণ দরকার ছিলো।অন্তত বাসা ভাঁড়ার ব্যাপার টা তো চুঁকে যাবে।
___
আমি ও এটা বুঝতে পারছিনা যে সব কিছু এতটা কাকতালীয় কিভাবে হয়?চাকরীর বাজারে সামান্য একটা চাকরীর জন্যে যেখানে মারামারি লেগে যায় সেখানে পায়ে হেটে এত ভালো একটা অফার এসে গেলো তোর কাছে?তাও আবার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট এর পোস্টে? মানে এত বড় পদ? তাও ওই সেই চেনা লোকের।কি হচ্ছে কিছুইতো বুঝতে পারছিনা।
সেঁজুতি বাবার পায়ের কাছে বাবু হয়ে বসেছিলো।গালে হাত দিয়ে বলল ‘আমিও নাহ.

আমির কিছুক্ষন ভেবে বললেন, ‘তোর ওখানে কাজ করার দরকার নেই,যেতে হবেনা তোকে।
সেঁজুতি তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে ওঠে,
— এটা আবার কি কথা? টাকা নিয়ে এলাম।মার্ক শীট থেকে শুরু করে সব ডকুমেন্টস জমা দিয়ে এলাম।আর এখন বলছো যাবোনা? পরমুহূর্তে বসে পরলো আবার। নরম স্বরে বলল’ এত ভেবোনা তো।যা হবে ভালোই হবে।এখন একটা জব এমনিতেই দরকার ছিলো।তাতে তো ভালোই হলো যে ওনারা আমার পরিচিত ছিলেন।তাছাড়া আমি নিজে গেলাম অফিসে, কত্ত বড় অফিস না দেখলে বুঝবেনা।শয়ে শয়ে লোক কাজ করছিলো।এত কিছুতো আর মিথ্যে হবেনা বলো!
,,
দ্যাখ যেটা ভালো মনে করিস৷

সেঁজুতি আবার উঠে দাঁড়ায়।
” খন্দকারের টাকা টা দিয়ে আসি।ব্যাটার মুখে টাকা গুলো ছুড়ে মারব আজ।

আমির চোখ পাঁকালেন ‘ এই না,কোনও বেয়াদবী করবেনা তুমি।
,,
আচ্ছা বাবা আচ্ছা।
______
রুদ্রর মুখে বিস্তর হাসি।চিকিমিক রোদ খেলছে মুখ জুড়ে।নিঁচের ঠোঁট চেপে রেখে ফাইল থেকে পেপার্স গুলো বের করে উল্টে পালটে দেখছিলো এতক্ষন।সব শেষে বাঁকা হেসে ভাবলো, মেয়েটা নিজেকে যতটা চালাক ভাবে অতটা নয়।বরং অনেক বেশি বোঁকা।আর কতটা বোকা হলে একটা এডুকেটেড মেয়ে না পড়েই পেপার্স এ সাইন করে দেয়?এভাবেতো জমিজমাও লিখে নেবে কেউ।অবশ্য এটাকী মেয়েটির বোঁকামী নাকী তার চতুরতা? সে এমন কোনো ক্লুই ছাড়েনি যাতে সেঁজুতির সন্দেহ হতো।

রুদ্র হাত মেলে দিলো কাউচের ওপর। ওপর দিক তাকিয়ে ভাবলো
‘মিস সেজুথি! আপনি জানেন ও না আপনি ঠিক কোন জালে আটকে পরেছেন।স্বয়ং রুদ্র রওশনের বোনা জাল। এখান থেকে বের হওয়া আপনার সাধ্যের বাইরে।আসল খেলা তো কাল জমবে।যখন আপনি আর আমি মুখোমুখি হবো।
,
রুদ্রর সামনেই বিছানার ওপর বসে আছে অভ্র।
পেপার্স গুলো দেখে দেখে রুদ্রর এমন হাসির কোনও মানেই খুজে পাচ্ছেনা সে।
,,
এই ভাইয়ের যে কি হলো কে জানে।প্রথমেত হোটেলে মেয়ে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে।মেয়েদের ধারেকাছে আর ঘিষবেনা ভাবলাম।অথচ এখন কিনা আরেকটা মেয়েকে নিয়েই এত কান্ড করছে?একেবারে নিজের পি এর পোস্টে চাকরী দিয়ে দিলো? ভাইতো নিজেই মেয়ে এসিস্ট্যান্ট রাখতে চাইতোনা।সব সময় ছেলেদের রাখতো।হঠাৎ কি এমন চৈতন্য হলো ভাইয়ের? যে একেবারে এতদিনের নিয়ম জারি জুরি সব ভেঙে দিলো?অভ্রর ভাবতেই অবাক লাগছে যে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া একটা মেয়ে কিনা এতো বড় অফিসের বসের পি এ হবে?ভাইয়ের আগের এসিস্ট্যান্ট ছেলেটাই তো ঠিক ছিলো।স্মার্ট, ভদ্র,গুছিয়ে কথা বলতো।যদিও ভাই তাকে অন্য কোম্পানি তে চাকরীর ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।তারপরেও একটা কিন্তুতে এসে সব থেমে যাচ্ছে অভ্রর।সেঁজুতি ভাইয়ের পি এ কী করে হবে? হাউ ক্যান ইট বি!কিভাবে হ্যান্ডেল করবে সব? কোনো অভিজ্ঞতা নেই কিচ্ছুনা।কম্পিউটার ঠিকঠাক চালাতে পারে কীনা কে জানে!এমন চাকরী পাওয়ার জন্যে কত শিক্ষিত লোক ও কপাল চাপড়াচ্ছে।আর সেখানে মিস সেজুথির কোনও রিয়্যাকশন ই ছিলোনা।উনি হয়তো বুঝতেই পারেন নি উনি ঠিক কি পাচ্ছেন?তবে তার থেকেও এখন তার ভাইয়ের ব্যাপার টা জানা জরুরি।ভাইয়ের জায়গায় অন্য কেউ হলে তো এতক্ষনে এটা ধরে নিতাম যে মেয়েটার প্রেমে পড়েই এসব করছে।,কিন্তু ভাই আর প্রেম?ব্যাপারটা উত্তর -দক্ষিন।
তবে এর মধ্যে ঠিক কি কারন থাকতে পারে?
— আমাকে নিয়ে এত না ভেবে নিজের কাজে যা অভ্র।
অভ্র ভূত দেখার মতোন তাকালো।এতক্ষন আকাশ পাতাল ভাবনায় ছেদ পরায় পিলে চমকালো তার।সেতো মনে মনে ভাবছিলো,রুদ্র বুঝলো কি করে? কি অদ্ভূত! রুদ্র তার মুখ দেখে মনের কথা বুঝে যায়।এরকম গুন যদি তার ও থাকতো তবে এখন এত হাসফাস করতে হতোনা।সব উত্তর জেনে নিত।তারপর নাকে সরষে তেল দিয়ে ঘুমাতো।
অনেকটা চুরি করতে এসে ধরা পরে যাওয়ার মত মুখ করে নিশব্দে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো অভ্র।
ওহ গড! ( ওপর এর দিকে তাকিয়ে) কেনো এতটা গাঁধা বানালে আমাকে তুমি?ভাইয়ের মত একটু বুদ্ধি দিলেও তো পারতে!সব থেকে বেশি কষ্ট তো তখন হয় যখন ভাইয়ের আশেপাশে এতো এতো মেয়ে দেখেও নিজের বেলায় একটা গার্লফ্রেন্ড পাচ্ছিনা…..ভাবা যায়!
_______
দরজা খুলে সেঁজুতি কে দেখতেই আঁতকে উঠলো খন্দকার।ধড়ফড় করে ফাঁটা নাক, কাটা ঠোঁটে হাত বোলালো।ব্যাথা এখনও আছে।বরং বেশিই আছে।বড় বড় চোখ করে বলল ‘ ততুমি?
সেঁজুতি কোনো কথা না বলে টাকা এগিয়ে দিলো।
খন্দকার একবার সেদিকে তাকিয়ে বলল ‘ কী এটা?
সেঁজুতি মুখ কুঁচকে বলল ‘ আপনার ভাঁড়া।নিন ধরুন।পুরো দুমাসের আছে কীনা দেখে নিন।

খন্দকার আর্তনাদ করে বলল ‘ না।আমি নেবনা।
সেঁজুতি ভঁড়কালো।কপাল গুছিয়ে বলল ‘ নেবেন না? কেন?
খন্দকার তোঁতলালো ‘ এমমনি এএওমনি! তুমি যাও যাও।আজ থেকে বাসা ভাঁড়া দিতে হবনা তোমাদের।

সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল ‘ আপনার মাথা ঠিক আছে? সেদিন এতো অপমান করে এলেন। আর আজ বলছেন বাড়ি ভাড়া নেবেন না?
খন্দকার অত্যধিক নরম কন্ঠে বললেন,
‘না মা বললাম তো।তোমাদের ভাড়া দিতে হবেনা,তুমি টাকা টা নিয়ে যাও।আজ থেকে বাসা টা তোমাদের জন্যে ফ্রি।

‘ ফ্রি কেন? আপনি ফ্রি দিলেও কী আমরা ফ্রিতে থাকব নাকী?
খন্দকার থতমত খেয়ে বললেন ‘ আসলে ফ্রি বলতে বোঝালাম,নিয়ম ফ্রি।মানে এক তারিখ টাকা দিতে হবে এরকম কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম মানতে হবেনা।যখন তোমাদের সুবিধে তখন টাকা দেবে।

সেঁজুতি চেঁতে গেল এবার।
,
আজব লোক তো আপনি!,সেকেন্ডে সেকেন্ডে রং বদলাচ্ছেন।না সেকেন্ডে নয়, একদিন পর পর রং বদলাচ্ছেন।কিন্তু এমন করলে তো হবেনা কাকা।টাকা আপনাকে নিতেই হবে,বাড়ি বয়ে এসে টাকা দিচ্ছি এমনি এমনি নাকি? সেদিনের কথা ভুলে যাইনি আমি।কি কুৎসিত কথা শুনিয়েছিলেন আপনি আমাকে।

খন্দকার হা- হুতাশ করে উঠলেন।
,
দোহাই তোমার!,টাকা টা নিয়ে যাও,দরকার হলে এসো তোমার পায়ে ধরি আমি।
সেঁজুতি ছিটকে দুহাত পিছিয়ে গেলো। হতভম্ব হয়ে বলল
‘ এ কী! কি করছেন?

খন্দকার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“সেদিনের সব কথা আমি ফিরিয়ে নিলাম।আজ থেকে ওই ফ্ল্যাট শুধুই তোমাদের।আমি কেউনা৷, কেউনা,,তাও আমাকে টাকা দিতে এসোনা।হাত জোর করছি।

সেঁজুতির চোয়াল ঝুলে এলো খন্দকারের অদ্ভূত আচরনে।
‘এ আবার কেমন বাড়িওয়ালা রে বাবা?ভাঁড়া নেবেনা বলে পায়ে অব্দি ধরতে এলো?
— এত ভাবতে হবেনা মা,,টাকা নিয়ে যাও,,আমাকে বাঁচাও.. তোমার পায়ে ধরি আমি। পায়ে হাত দিতে দিতে)

— আরে আরে কি করছেন ছি! ছি। আপনি গুরুজন।বারবার পায়ে হাত কেনো দিচ্ছেন?
,,
তাহলে বলো টাকা তুমি দিচ্ছোনা??
,,
ঠিক আছে দিচ্ছিনা।তবে হ্যা আবার যদি অপমান করতে যান, তখন কিন্তু….
খন্দকার তড়িঘড়ি সোজা হলেন,
‘না না আমার ঘাঁড়ে কটা মাথা যে আমি তোমাদের অপমান করবো?
নাক মুখ কুঁচকে চলে এলো সেজুথি,,
‘এই লোক নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে,।সুস্থ হলে আবার টাকা চাইতে আসবে।টাকা টা বরং রেখে দেবে।এলেই বের করে দেয়া যাবে।
,,
সেজুথি যাওয়া মাত্রই ঘরের দরজা ধঁড়াম করে বন্ধ করলেন খন্দকার।ভাগ্যিশ বাড়ি ফাঁকা।নাহলে ব্যাপারটা ম্যানেজ করতে হিমসিম খেতো।খন্দকার দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিলো দুবার।
বাপরে! প্রানের মায়া বড় মায়া।আগে তো বাঁচি।এই টাকা নিলে তার ঘাঁড় টা থাকতো তবে ঘাঁড়ের ওপর এর মাথা টা আর থাকতো নাহ।সেদিনের সেই ঘুষি, থাপ্পড় এখনও জীবন্ত মনে হয়।আর তারপর? তারপর যখন ছাদে চোখ মেলে রক্তচক্ষু দুটো দেখলো,আত্মা শুকিয়ে এসছিলো তার।লোকটা কি ভয়ানক ভাবে শাসিয়েছিলো।লাইটার দিয়ে চুলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখালো।আর শেষে?ছুড়ি দিয়ে ঠোঁটের পাশে টান মারলো।কথাগুলো ভেবেই ঠান্ডা হয়ে এলো খন্দকারের হাত পা।চোখ খিচে ঠোঁটে হাত রাখলো ‘ কি ব্যাথা! উফ!

চলবে….

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব-১৩
অফিসের আজ প্রথম দিন।দিনটি সেঁজুতির পরীক্ষার দিনের মতোই লাগছে।মানসিক প্রস্তুতি,মাথা ভর্তি টেনশন সবটা ঠিক একইরকম।দশটায় অফিস।সেঁজুতি সকাল সকাল উঠে বাড়ির সব কাজ সেড়েছে।বাবাকে সাথে নিয়ে নাস্তাও খেয়েছে।বাবাকে ওষুধ খাইয়ে তৈরী হয়ে এসে বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো সেঁজুতি। দোয়া দুরুদ পাঠ করে দুরুদুরু বুক নিয়ে পা বাড়ালো গন্তব্যে।আজ তার জীবনের একটি স্বপ্ন পূরন হতে যাচ্ছে।ছোট থেকেই নিজেকে ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেখার ইচ্ছে সেঁজুতির।পড়ছিলোও সেই লাইনে।এত দ্রুত যে একটা ভালো চাকরি পাবে সে ভাবতেই পারেনি।শুধুমাত্র তোহাকে জানিয়েছে চাকরীর বিষয়ে।তবে কিভাবে সিলেক্ট হয়েছে সেটুকু বলতে চেয়েও বলেনি।ম্যানেজার লোকটি মানা করেছিলেন তাই।রিক্সায় বসে সেঁজুতি লম্বা করে শ্বাস নিলো।উচ্ছ্বল,মুগ্ধ শ্বাস।মন ভীষণ ভালো আজ।
চুল গুলো বেনি করে এক পাশে রাখা।সামনের চুল গুলো কালো ক্লিপ দিয়ে আটকানো।কানে এক জোড়া পাথরের দুল। পড়নে সবুজ থ্রি পিস, কাঁধে ব্যাগ।এই তার সাজগোজ।
অফিসের সামনে নেমে,ভাঁড়া চুকিয়ে ভেতরে ঢুকলো সেঁজুতি। যত এগোচ্ছে বুক তত কাঁপছে চিন্তায়।সে পারবেতো তার দায়িত্ব ঠিকঠাক সামলাতে?ঢুকতেই ম্যানেজারকে দেখতে পেলো।ওকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি।আজ ও একইরকম সাজপোশাক।আশরাফুল হেসে জিজ্ঞেস করলেন ” ভালো আছেন ম্যাডাম?
মধ্যবয়সী লোক।ম্যাডাম ডাকাতে অস্বস্তি লাগলো সেঁজুতির।কাজের দিক থেকে হয়ত সে ওপরের পদে তাই লোকটা ডেকেছে।কিন্তু তারতো অভ্যেসের খাতা শূন্য।ইতস্তত করে বলল ‘ জ্বি।আপনি?
‘ বেশ ভালো আছি।আসুন আপনাকে আপনার ডেস্ক দেখিয়ে দেই।
সেঁজুতির ভালোই হলো।একা একা কোন দিকে যেত সে নিয়েই চিন্তা করছিলো এতক্ষন।উনি আসাতে বেঁচে গেলো অল্পস্বল্প। লোকটি কিছু সময় কুশল বিনিময় করে চলে গেলেন।সেঁজুতি চোখ বুজে দুবার ঘন শ্বাস ফেলল।এভাবে ভয়,কাঁপা-কাঁপি এসবের সময় নেই তার।অনেক দায়িত্ব এখন। অনেক।কনফিডেন্স বাড়াতে হবে ।একটা ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও যেন বস ভুল ধরতে না পারেন সে ব্যাপারে তটস্থ থাকতে হবে সবসময়। সেঁজুতি এদিক ওদিক তাকালো।অভ্রকে খুঁজলো হয়ত।একমাত্র ওই পরিচিত বলতে গেলে।এভাবে বসে থাকবে নাকী কোনো কাজ করবে সে জানেনা।বলাও হয়নি।যেঁচে কী একবার যাবে অভ্রর কেবিনে? ভালো দেখাবে সেটা?
____
রোলিং চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে রুদ্র।আয়েশী ভঙ্গি তার।একটু পরপর চেয়ার সমেত দুপাশে দোল খাচ্ছে।চোখ দুটো তীক্ষ্ণতা নিয়ে সামনে নিবদ্ধ।তার কেবিনের পুরোটাই কাঁচ দিয়ে তৈরী।বাইরের সব কিছু স্বচ্ছ ভাবে দেখা যায়।অথচ বাইরের কেউ তার টিকিটাও দেখেনা এই কাঁচ গলিয়ে।এমন ভাবেই সে নিজের স্পেস টা তৈরি করেছিলো।কেবিনে বসেই পুরো ডেস্ক দেখা যায়।এই কথা সবাই জানে।তাই রুদ্র অফিসে থাকাকালীন কেউ গল্প করার সাহস করেনা।যন্ত্রের মতো কাজ করে।ঈগলের মতো চোখ দিয়ে রুদ্র সব খবর তার নখদর্পনে রাখে সে ব্যাপারে সবাই জ্ঞাত।জানেনা শুধু সেঁজুতি। জানলে কী বুঝতো,ঠিক এই সময় রুদ্র মন দিয়ে দেখছে তাকে।নিঁখুত ভাবে তার প্রত্যেকটা মুখভঙ্গি পরোখ করছে।মূলত, রুদ্রর এসিস্ট্যান্টের জন্যে অফিসে আলাদা কেবিন থাকে।কিন্তু রুদ্র ইচ্ছে করেই সেঁজুতির ডেস্ক টা তার কেবিনের একদম সামনে দিয়েছে।কেন দিয়েছে? সেটা শুধুমাত্র রহস্য ময় এই লোকটাই জানে।
রুদ্র অনেকক্ষন পর সোজা হয়ে বসলো।চোখ দুটো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নীচের দিক তাকালো।একটু পর আবার সেঁজুতির দিকে।সেঁজুতি আঙুলের ফাঁকে কলম নাড়াচ্ছে।

রুদ্র বাঁকা হাসলো একটু,
“এবার তাহলে এই লুকোচুরি খেলার অবসান ঘটানো যাক?আর ইউ রেডি মিস সে….জু…..তি?”
______
সেঁজুতি বোর হচ্ছিলো ভীষণ। কাউকে চেনেনা, পরিচয় নেই।কী করবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো যখন,তখনি পিওন পদের লোকটি ফিনফিনে কন্ঠে বলে ওঠে,
“ম্যাডাম! আপনাকে বস ডাকছে…
সেঁজুতি লোকটিকে চেনে।কাল একে দেখেছিলো ফাইল এদিক থেকে ওদিক আনা নেয়া করতে।আবার যখন সে অভ্রর কেবিনে ছিলো তখন ইনিই চা, আর দুটো স্যান্ডউইচ দিয়ে গেছিলেন।
হাল্কা ঘাঁড় নেড়ে বলল ‘ যাচ্ছি।
রুদ্রর কেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো সেঁজুতি। গায়ের ওড়না ঠিকঠাক করতে দেখে রুদ্রর হাসি পেলো।মেয়েটি যদি জানতো সে আসা থেকেই রুদ্র তাকে দেখছিলো তখন কী করবে? সেঁজুতি যেই হাত উঁচিয়ে নক করবে দরজায়, তখনি দরজা রিমোর্টের বাটন টিপে খুলে দিলো রুদ্র। সেঁজুতি প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। খানিকটা ভঁড়কায়ও।সেকেন্ড খানিক গবেষণা করে আঁওড়ালো ‘ এটা মনে হয় রিমোর্ট কন্ট্রোল দরজা।
তখনি রুদ্র ভেতর থেকে কঠিন কন্ঠে বলে ওঠে,
‘ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হলে বাইরে যান।সেঁজুতি নঁড়বড়ে খুঁটির মতোন কেঁপে উঠলো।মৃদূ মৃদূ কন্ঠে বলল
-আসব স্যার?
ওপাশ থেকে উত্তর এলো ‘ ইয়েস!
সেঁজুতি দরজা টানবে কি টানবে না ভাবলো।এমনি এমনি খুলেছে যেভাবে সেভাবেই কী লেগে যাবে আবার? দরজা হা করে খুলে রেখে গেলে যদি বস রেগে যান?দু সেকেন্ড ভেবে দরজা টানলো।নরম পায়ে এসে রুদ্রর টেবিলের কোনায় দাঁড়ালো।কেবিন থেকে একাবার বাইরের দিকে তাকাতেই ঠোঁট দুটো আলাদা হয়ে এলো।এখান থেকে সব দেখা যাচ্ছে? তার মানে তারা যা করবে লোকটা সব দেখবে? কী এক ঝামেলা! সেঁজুতি চোখ সরিয়ে এনে মেঝের দিক রাখলো।বস নামক
লোকটিকে সে চেনে।দুবার দেখা হলো।কথাও হয়েছে।তাও কেমন স্বস্তিবোধ হচ্ছেনা। অজানা আশঙ্কায় বুক ধড়ফড় করছে।উনি কি জানেন আমার কথা? নাকী অভ্রর মতোন অবাক হবেন আমায় দেখে।সেঁজুতি চোখ তুলে তাকায়।রুদ্র চেয়ার নিয়ে উল্টো হয়ে ঘুরে আছে।লোকটাকে চিনলেও মুখ দেখেনি।নাম অব্দি জানেনা।সেঁজুতির মনে পড়লো লোকটির সেদিন তাকে কোলে তোলার মুহুর্তটা।সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি কয়েকশ গুন বাড়লো।ওইদিন গাড়িতে সে লোকটির সাথে একদফা ঝগড়া ও করেছিলো। আজ সেই কীনা এখন তার বস।বারবার উঠতে বসতে স্যার সম্বোধন করতে হবে।সত্যিই পৃথিবী গোল!
সেঁজুতি যখন ভাবনায় মশগুল।রুদ্র তখন ভরাট কন্ঠে বলে,
“তো মিস সেঁজুতি, অফিস কেমন লাগছে আপনার?
সেঁজুতি বুঝলো রুদ্র তার কথা জানে।নাহলে নাম কীভাবে বললেন? ছোট করে উত্তর দিলো,
— গুড স্যার।
— অফিসের সবাইকে?
— গুড স্যার।
— আর আপনার বস কে?
তাৎক্ষণিক চেয়ার ঘুরিয়ে সামনে ফিরলো রুদ্র।
‘গুড স্যা…….. সেঁজুতি এতক্ষন নিচের দিক চেয়ে ছিলো।রুদ্র ঘুরেছে বুঝতে পেরে চোখ ওঠাতেই কথাটুকু গলায় আটকে পরলো।
সেজুথির মুখের অবস্থা দেখার মতোন মনে হলো রুদ্রর।সূচালো হাসিটা আরও দ্বিগুন বাড়লো যেন।মেয়েটার এই এক্সপ্রেশন টা দেখার জন্যেই তো কাল রাত থেকে তর সইছিলোনা তার।ভাবছিলো কখন সকাল হবে আর সেঁজুতির এই মিশ্র চাউনীটা দেখবে।যেখানে থাকবে, ভয়, বিস্ময় , অস্বস্তি,কৌতুহল, আর লাভার মত ক্রোধ।আর এত কিছু একসাথে মন ভরে উপভোগ করবে রুদ্র।এই যে দেখো..কি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটা।,এতো টা সারপ্রাইজড হয়তো ও এ জীবনে হয়নি…
সেজুতির মুখ থেকে কোনও কথা বেরোচ্ছেনা।জ্বিভ যেন অসাড় হয়ে পরলো।গোটা শরীরটা পরিনত হয়েছে ফ্রিজে।নড়তেও পারছেনা যেন।এই লোকটা! এই লোকটা তো রুদ্র রওশন চৌধুরী। সে এখানে কেন? কী করে এলো?অনেকক্ষন পরেও যখন সেঁজুতির কোনো শব্দ নেই রুদ্র তখন নিজেই ধৈর্য হারালো। কৌতুক কন্ঠে বলল
“বললেন না তো,বস কে কেমন লাগল?
সেঁজুতি যেন নিজেতে ফিরলো।থেমে থেমে বেগ নিয়ে বলল,
” আপনি! আপনি তো রুদ্র রওশন চৌধুরী? আপনি এখানে কেন?
রুদ্র নিরেট কন্ঠে বলে,
— ইয়েস,আমিই রুদ্র রওশন চৌধুরী। আজ থেকে আপনি যার P. A আই মিন ব্যাক্তিগত সহকারী!
সেঁজুতি মাথা চেপে ধরে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল মেঝেতে।পরমুহূর্তে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল,
— এটা….এটা কি করে স..সম্ভব?আমার বস তো মিঃঅভ্র চৌধুরীর ভাই ছিলেন তাইনা?
রুদ্র একিরকম বাঁকা হাসলো
“আমিইতো অভ্র চৌধুরীর একমাত্র ভাই।
সেঁজুতির গাঢ় বিস্ময় এবার মাত্রা ছাড়ালো।আঙুল উঁচিয়ে মনে করার ভঙ্গি করে বলল
‘তার মানে ওই লোকটা…ওই মাস্ক পরা লোকটা… আপনি ছিলেন?
‘ yeah!
সেঁজুতি অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো।
“এই সব কিছু আপনি জেনেবুঝে করেছেন?
এইজন্যেই আপনি ওভাবে মুখ ঢেকে গিয়েছিলেন আমার সামনে?
রুদ্র মাথা নেঁড়ে বলল
-ঠিক ধরেছেন।
” এইসব আপনার প্রিপ্ল্যান্ড?? চাকরী দেয়ার ব্যাপারটা? সেটা মিথ্যে?
রুদ্রর দৃঢ় জবাব, ” অভিয়েস্লি..

সেঁজুতি কতক্ষন শূন্য মস্তিষ্ক নিয়ে চেয়ে থাকলো।পরক্ষনেই তীব্র ক্রোধ এসে বাসা বাঁধলো শরীরে।টেবিলের ওপর দুহাত থাঁপড়ে ঝুঁকে বলল,
“এটা কিছুতেই হতে পারেনা।আপনারা আমাকে এভাবে ঠকাতে পারেন না।আমি এই চাকরী করবোনা।এই মুহুর্তে আমি রিজাইন দেবো।যাস্ট নাও।
রুদ্র জানতো এমন হবে।অবাক হলোনা।কিন্তু সেঁজুতি কে উষ্কাতে ভীষণ ইচ্ছে জাগলো মনে। সহজ কন্ঠে বলল,
কেনো? চাকরির প্রথম দিনেই রিজাইন কেন দেবেন?
সেঁজুতি দাঁত চেপে বলল ‘ দ্যাটস মাই চয়েস।
রুদ্রর ভারি মজা লাগছে।কাউকে ক্ষিপ্ত হতে দেখতে এত আনন্দ? এত?অবুঝের ভান করে বলল
‘ আশ্চর্য! এতো বড় কোম্পানি তে জব পেতে কত মানুষ আহাজারি করছে আপনি জানেন?আর সেখানে আপনি পেয়েও ছেড়ে দিতে চাইছেন??হোয়াই?
সেঁজুতি রুষ্ট চোখে চাইলো।
‘হ্যা চাইছি।আর তার একমাত্র কারন আপনি নিজে।
আপনাকে দেখলেই আমার সেই রাতের…

রুদ্র বুঝেও চোখ ছোট ছোট করে শুধালো,
‘সেই রাতের কী?
সেঁজুতি শান্ত করলো নিজেকে।কাকে রাগ দেখাবে সে? রুদ্র তার কেউ নয়।বিপদে পরে একবার শরীর মিশেছিলো লোকটির সাথে ব্যাস ওইটুকুই।গত একটা সপ্তাহ ধরে যে রাতের জঘন্য স্মৃতি থেকে পালাতে চেয়েছে,ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছে,ঘন্টার পর ঘন্টা শাওয়ারের নিঁচে দাঁড়িয়ে গা ভিজিয়েছে শুধুমাত্র অযাচিত স্পর্শ গুলো ধুঁয়ে ফেলতে। স্বয়ং সেই লোকের অফিসের কাজ করা কী আদৌ সম্ভব? তাও তারই সহকারী হয়ে? কোনো মেয়ে পারবে সেটা?
সেঁজুতি ঢোক গিলে ঠান্ডা ভাবে বলল,
‘ কিছুনা।এতো কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।আমি আসছি।

‘এক সেকেন্ড!
রুদ্রর কথায় সেঁজুতি দাঁড়ালো।ঘুরে তাকালোনা।স্তম্ভের মতো শক্ত করে মাটিতে লাগিয়ে রাখলো পা দুটো।ভীষণ ভাবে টলছে এগুলো।দাঁড়ানোর শক্তি যেন নেই।ভাগ্য কী নির্মম প্রতারণা করলো শেষে।

এতক্ষনে চেয়ার ছেড়ে উঠলো রুদ্র।সেঁজুতির সামনে এসে পা দুটো কিঞ্চিৎ ফাঁকা রেখে পকেটে দু হাত গুজে দাঁড়ালো।ঘাঁড় কাঁত করে বলল
— আপনি ঠিক ই বলেছেন। সব টাই আমার তৈরী পরিকল্পনা।সব টা।এই যে আপনাকে এখানে চাকরী দেয়া,তার জন্যে ম্যানেজার কে দিয়ে আপনাকে মিথ্যা বলানো, এসব কিছু আগে থেকে সাজানো ছিলো।আর এতটাই নীট এন্ড ক্লিন ভাবে রুদ্র সাজিয়েছে যে তার ফাঁকফোকড় খুঁজে পাওয়া আপনার মতো মেয়ের জন্যে দুঃসাধ্যই নয়,অসম্ভব ও বটে!
সেঁজুতি স্তব্ধ।কী অকপটে নিজের অন্যায় স্বীকার করছে এই লোক!
রুদ্র দুই ভ্রু উঁচালো,
— অবাক হচ্ছেন?এখনি অবাক হবেন না মিস সেঁজুতি। আপনার জন্যে যে এখনও অনেক চমক বাকী।
(একটু থেমে)
আমাকে চেনেন তো?? ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট রুদ্র রওশন চৌধুরী।দেশে বিদেশে যাকে নাম্বার ওয়ান বিজনেসম্যান দের মধ্যে একজন হিসেবে এক ডাকে চিনে যায় সবাই।আমার থেকে সব সময় সবাই হাত পেতে নিয়েছে। আর আমিও দুহাত ভরে দিয়েছি।
সেই রুদ্র রওশন কিনা আপনার মত সামান্য একটা মেয়ের দান নিয়ে বেঁচে থাকবে?? ইটস কোয়াইট ইম্পসিবল মিস সেজুতি।আপনাকে টাকা দিতে চেয়েছিলাম আমি।এবং সেটা দুবার,কিন্তু না। আপনি রাখেন নি।নিজের তথাকথিত আত্মসন্মান দেখিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন।যেটা আমার ইগো তে লেগেছে(দাঁত চিবিয়ে)
আপনি চাইছিলেন আপনি আমাকে বাঁচিয়ে আমার কাছে সারাটাজীবন ম..হা..ন হয়ে থাকবেন।কিন্তু সেটা তো আমি হতে দিতে পারিনা।আমি বুঝে গিয়েছিলাম টাকা আপনি নেবেন না।অন্য কিছু ভাবতে হবে।আপনি অনেকটা ভাঙবেন তবু মচকাবেন না টাইপের।তাই এত্তকিছু করতে হলো।আর এই ভাবেই আপনাকে আমি আমার কাছে নত করে রাখলাম।প্রতিনিয়ত এখন আমার অর্ডারে চলতে হবে আপনাকে,আপনার যে কিচ্ছু করার নেই মিস নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি…..

সেঁজুতি থম মেরে শুনছিলো।কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছে।কি মারাত্মক জঘন্য চিন্তাভাবনা লোকটির।বিস্মিত না হয়ে পারলোনা সে।মানুষকে সাহায্য করার সংগা টা এত বিশ্রী ভাবে ভাবেন উনি? ছি!সেঁজুতি হাসলো,সবাই আসলে সব কিছুর মূল্য দিতে জানেনা।এই লোকের ও হয়েছে তাই।রুদ্রর দিকে তাকালো।রুদ্র ছোট চোখের গভীর দৃষ্টিতে তারই দিক চেয়ে।সেঁজুতি এক পাশে ঠোঁট বাঁকালো,
-কে বললো কিছু করার নেই?আপনি হয়তো আমার কথা শুনতে পাননি। আমি এক্ষুনি রিজাইন দেবো বলেছি।এবার শুনেছেন?আপনার আন্ডারে চাকরী আমি করছিনা।
রুদ্র চোখ সরু করলো
— আমার আন্ডারে কাজ করতে কত মেয়ে লাইন ধরে আছে ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?

‘মেয়েঘটিত ব্যাপার টাতে আপনি অনেক অভিজ্ঞ যে।হয়তো তাই!তাছাড়া আপনার মত লোকের জন্যে লাইন কি আর কোনও ভদ্র ঘরের মেয়েরা ধরবে??
কিংবা কোনও সভ্য মেয়ে আসবে আপনার কাছে?আপনি ও যেমন ওরাও ঠিক তেমন।
সেঁজুতির কথায় স্পষ্ট বিদ্রুপ।রুদ্রর ভয়ে যেখানে অফিসের সকলে তটস্থ,সেখানে সটান দাঁড়িয়ে এই মেয়ে পাল্লা দিয়ে তর্কে লিপ্ত।রুদ্র ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,

আপনি ভুলে যাচ্ছেন মিস সেঁজুতি, এটা আমার অফিস।আপনার বাড়ি নয়।আর আপনি আমার অফিসের সামান্য একজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। তাই
এখানে আপনার গলার জোর টা ছোট থাকাই শ্রেয়
(ছোট শ্বাস ফেলে)
এনি ওয়ে!কি যেনো বলছিলেন? আমার জন্যে কোনও ভদ্র ঘরের মেয়েরা লাইন ধরবেনা,কিংবা কোনও সভ্য মেয়ে আমার কাছে আসবেনা ব্লা ব্লা ব্লা?হু?
রুদ্র ঝুঁকে এসে ডান ভ্রু নাঁচালো।পরমুহূর্তে ফেঁটে পরলো অট্টহাসি তে।যে হাসিতে তাচ্ছিল্য পরিষ্কার।সেঁজুতির যেন গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে রুদ্রর অযৌক্তিক হাসি দেখে।
রুদ্র হাসি থামিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“তবে তো সেই সব অসভ্য মেয়েদের কাতারে আপনিও পরলেন। আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন সেই রাতে…. আমার হোটেল রুমে….আপনি আর আমি..
মনে পড়ছে? কতটা কাছাকাছি ছিলাম আমরা?

সেঁজুতি তাৎক্ষণিক চেঁচিয়ে বলল, ‘ চুপ করুন।চুপ করুন আপনি!
আমি ভুলে যেতে চাই,,মনে করতে চাইনা,,চাইনা মনে করতে…..
সেঁজুতি হাসফাস করলো কতক্ষন।যেন শ্বাস কষ্টে ভুগছে।রুদ্র শান্ত নজরে পরোখ করছে ওর অভিব্যাক্তি।সেঁজুতি সময় নিয়ে ঠান্ডা হলো। ভেজা চোখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কেনো করছেন আপনি এরকম?আমি তো বললাম আমি আপনার আন্ডারে কাজ করবোনা।তাও কেন এত কথা শোনাচ্ছেন?মানে কি এসবের?আমি যেতে চাচ্ছি আমাকে যেতে দিন!

রুদ্র ভ্রুক্ষেপ হীন।বলল, ” সব সময় যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায়? এটা রুদ্রর জায়গা।তার রাজত্ব।এখানে নিজ ইচ্ছায় প্রবেশ হয়তো করা যায়।কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া বের হওয়া যে অসম্ভব।

সেঁজুতি কিছুই বুঝে ওঠেনি।চোখেমুখে তীব্র জিজ্ঞাসা দেখে রুদ্র বলল ‘ আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আছে।ওয়েট…
রুদ্র টেবিলের ড্রয়ার টেনে খুলে সেই নীল রংয়ের ফাইলটা সেঁজুতির দিক ইশারা করে টেবিলের ওপর একরকম ছুড়ে মারলো।মোটা কন্ঠে বলল
‘ পড়ুন এটা।
আগে থেকে দেখে রাখায় চিনতে অসুবিধে হয়নি সেজুতির।এই ফাইলেই সে দস্তখত দিয়েছে কাল।
সেঁজুতি কে ভ্রু কুঁচকে ফাইলের দিক চেয়ে থাকতে দেখে রুদ্র বলল,
— কাল তো না পড়েই সাইন করেছিলেন,আজই কে বরং পড়ে দেখুন।আ বিগ সারপ্রাইজ এ্যাওয়েটস ফর ইউ।
রুদ্রর প্রতিটি কথা রহস্যময়।সব রহস্যের সমাধান কী এই ফাইলে? তাড়াহুড়ো করে ফাইল হাতে নিলো সেঁজুতি। পড়তে পড়তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এলো।রক্তশূন্য যাকে বলে।হাত দুটো কেঁপে উঠলো যেন।ফাইলটা ঝুপ করে পরলো পায়ের কাছে।সেঁজুতির চোখের কোটর ভরে উঠেছে।ঠান্ডা অশ্রুতে গাল দুটো ভিজে চুপচুপে হয়েছে।তবুও এক চুল নড়লোনা সে।
এতটা প্রতারনা?এতটা!
রুদ্র সেঁজুতির হয়ে মিথ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।ভেতরে ভেতরে ভারী মজা পাচ্ছে হয়তো।সেঁজুতি যে সহজে পোষ মানবেনা সে জানত।তাইতো এত জল ঘোলা করতে হয়েছে।একটু না হয় কষ্টই পাক!
রুদ্র গ্লাস ভর্তি পানি সেঁজুতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-খেয়ে নিন।আই থিংক ধাক্কা টা সামলে উঠতে পারবেন।
রাগ, ক্রোধ ছুটছে সেঁজুতির সমগ্র শিরায়।তার ওপর রুদ্রর এমন উপহাস করে বলা কথা আগুনে ঘি ঢালার মতোন।সেঁজুতি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল,
‘ আপনি অত্যন্ত নোংরা, বিদঘুটে মস্তিষ্কের একটা লোক।এত দিন জানতাম,আপনার চরিত্র টাই জঘন্য। এখন দেখছি মন টা তার থেকেও কুচকুচে কালো আপনার। কি সুন্দর ভাবে আমাকে ঠকালেন?আপনি একা কেন, আপনার ভাই অভ্রই বা কম কিসে? উনি নিজেই আমাকে মিথ্যে বলে এখানে সাইন করিয়েছিলো,আর আমিও বোকার….

রুদ্র আটকে দিয়ে বলল,
“আপনিও বোকার মত সাইন করে দিলেন।সত্যিই পড়ে দেখা উচিত ছিলো আপনার।এত মেধাবী স্টুডেন্ট আপনি আর এই ভুল টা আপনার দ্বারা মেনে নেয়া যায়না।আফসোস লাগছে আমার।সত্যি বলছি।এখন যা হবার বা যা করার করা হয়ে গিয়েছে।দেখে নিলেন তো সবটা?আশা করি বুঝতেও পেরেছেন।
আগামী তিন বছরের আগে আপনি এই চাকরী ছাড়তে পারছেন না।এর আগে যদি আপনি রিজাইন দিতেই চান,তবে আমার কোনও অসুবিধে নেই,ডিল অনুযায়ী জরিমানার পাঁচ কোটি টাকা জমা করলেই আপনিও খুশি আমিও খুশি।

সেজুতি নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রাখলো।লোকটা তাকে বিপদে ফেলে কি আনন্দটাই না পাচ্ছে।টেবিলের ওপর দুহাত রেখে
সেজুথির দিকে ঝুকে এলো রুদ্র,বরফ কন্ঠে বলল,
—তো মিস,বেশ ভালোভাবেই ফেসে গিয়েছেন আপনি।বেরোনোর কোনো পথ ই যে খোলা নেই আর।আমি খোলা রাখিওনি।তাই রিজাইন দেয়ার চিন্তা ঝেরে ফেলে কাজে মন দিন.…
নাউ…গেট ব্যাক টু ইওর ওয়ার্ক।
রুদ্র সোজা হয়ে দাঁড়ালো। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো সেঁজুতি। পারলে এই দৃষ্টি দিয়েই ঝলসে দিতো লোকটাকে।
ডেস্কে এসে ধপ করে বসে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো চিন্তায়।
,
মিঃঅভ্র আমার বিশ্বাসের এই দাম দিলেন ? বাবা ঠিকই বলেন দুষ্টু লোকের মিষ্টি কথা!
এখন এই লোকটার সাথে কি করে কাজ করবো আমি?যতবারই একে দেখবো আমার চোখের সামনে সেই অভিশপ্ত রাত টাই তো ভেসে উঠবে।এত বড় একটা শাস্তি আমাকে কেন দিলে আল্লাহ?

বাম হাতে পেপারওয়েট টেবিলের ওপর রেখে ঘোরাচ্ছে রুদ্র।ঘুরে ঘুরে থেমে যায়, রুদ্র একিভাবে ঘুরিয়ে দেয় আবার।শান্ত চাউনী তখনও কেবিনের মুখোমুখি সেজুথির ডেস্কের ওপর।সেজুতির অসহায় মুখটাও বেশ সুন্দর মনে হলো!

চলবে…..

প্রনয় পর্ব-১০+১১

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব-১০

বিছানা ছেড়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো সেজুথী।ঘুম ভাঙলো দেরী করে।ফজরের নামাজ ও পড়া হয়নি।হবেইতো, রাতে গায়ের ব্যাথায় ঘুমই হয়নি।এক কাত ফিরলেও টনটনিয়ে উঠেছে শরীরটা।রেললাইনের মতো সোজা হয়ে কী আর ঘুমানো যায়?অন্যদিন ছাদে হাটাহাটি করে সকালে।আজই এমন হলো।রাতে পেইন কিলার নিয়েছিলো।ব্যাথা অনেকটা কমেছে আগের থেকে।রাতে খাওয়ার সময় আমির চেপে ধরলেন ওষুধ খাওয়ার জন্যে।প্রেসক্রিপশন যে অভ্রর কাছে রয়ে গিয়েছে সেটা তখন মনে পড়লো সেঁজুতির।মিনমিনিয়ে বাবাকে বলতেই আমির ধমকে ধামকে রাখলেন না।শরীরের ব্যাপার। সেখানে এত কেয়ারলেস হলে চলে? সেঁজুতি আশ্চর্য হলো,বাবা নিজেই ওষুধ খেতে চাননা।অনেক বলে কয়ে খাওয়াতে হয়।অথচ তার বেলা? সেঁজুতি বিছানা ছেড়ে উঠলো।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢুকলো বাথরুমে।সকালের নাস্তাটা যদি বানাতে পারে তবেতো ভালোই।এইটুকু ব্যাথায় হাটতে না পেরে তার এক আকাশ সমান মন খারাপ ছিলো।
তাহলে বাবার না জানি কত মন খারাপ হয়।সেতো আর কোনও দিন…
ভাবতেই বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।ভাগ্য ভালো কাল রান্না টা পাশের ফ্ল্যাটের পরিচিতা ভাড়াটিয়া করে দিয়েছিলেন। নাহলে দুই বাপ বেটিকে না খেয়েই থাকতে হত।ব্রাশের মাথায় পেস্ট লাগাতে লাগাতে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে গেলো সেজুতি।
“সামনে কত খরচ,বাবার ওষুধ,নিজের পড়াশুনা,খাবার।টুকিটাকি খরচা। সামান্য দুটো টিউশনীর বেতন থেকে কিভাবে সম্ভব?এমনিতেও কাল এক্সিডেন্ট এ তার হাতের প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো ওখানেই পরে গিয়েছে হয়ত।আবার নতুন করে ওগুলো কেনা।
দুশ্চিন্তায় সে মরেই যাবে।এই প্রথম সংসারের ভার পরলো কাঁধে।এতদিন তো বাবাই সামলেছেন।সেতো মাথাও ঘামায়নি।এখন তো বাবা আর ওই অবস্থায় নেই।সব তাকেই করতে হবে।সে-ই বাবার ভরসা।কিন্তু কীভাবে কি করবে? ভাগ্যিস সময় কাটাতে টিউশন দুটো করাচ্ছিলো।একটু হলেও লাভ হচ্ছে।হোসাইন আংকেল এর থেকেই বা কত নেবে?এ অব্ধি বাবার সব ওষুধ এর খরচা সেই দিয়েছে।নিতে না চাইলেও দিলেন।হাসপাতালের বিরাট অঙ্কের বিল টাও মিটিয়েছেন।লজ্জ্বায় সেঁজুতির অবস্থা তখন করুন হয়েছিলো।যদিও হোসাইন কে সে নিজের বাবার মত ভাবে।কিন্তু কোথাও একটা দ্বিধা কাজ করে যে! এই দ্বিধার নামই বোধ হয় আত্মসন্মান।

রুদ্রর মাথা ব্যাথা কমেছে।তার একটা হাকেই দুজন সার্ভেন্টস এসে তন্নতন্ন করে বাম খুঁজেছে রুমে।কিন্তু এরাও পায়নি।তারাতো হাত ও দেয়না ওখানে।আর রুদ্রর রুম থেকে জিনিস নেয়ার সাহস ও নেই কারো।তাও আবার একটা মাথা ব্যাথার মলম? অনেক খুঁজে শেষে বাম পাওয়া গেলো অভ্রর বিছানার ওপর। কাল সেও রাত করে ঘুমিয়েছে।মাথা ব্যাথা করছিলো বলে রুদ্রর রুম থেকে বাম নিয়ে গেছিলো।রুদ্র তখন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।ভাবছিলো বসে বসে, তার এত টাকা পয়সা! অথচ পুরো বাসায় কীনা একটা বামের এত সংকট?যে এভাবে টানাটানি পরে গেল!

প্রেস্ক্রিপশন হাতে নিয়ে থম ধরে বসে আছে রুদ্র।কাল আগ বাড়িয়ে অভ্রকে প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে রাখতে সেই বলেছিলো।মেয়েটির ওষুধ পত্র যা লাগবে নিজেই বুঝেশুনে কিনে দেবে ভেবে।কিন্তু দিতেই ভুলে গেলো একদম।রাতে নিশ্চয়ই মেয়েটি ওষুধ খেতে পারেনি।রুদ্রর খারাপ লাগলো এতে।
ভেবেছিলো মেয়েটির ত্রিসীমানায় আর যাবেনা।কেমন হিপনোটাইজ করে রাখে তাকে।হ্যালুসিনেশনে তার গলা অব্দি ডুবেছিলো। কিন্তু এখন এটা পাঠাবে কাকে দিয়ে? ড্রাইভার কে দিয়ে পাঠানো যাবেনা।অভ্রকেও দেয়া যাবেনা।একটা মেয়ে নিয়ে তার এত বাড়াবাড়ি সবার চোখে বিঁধবে।কাল কের ব্যাপার নিয়ে এমনিতেই অভ্র কী কী ভাবছে কে জানে! তখন অত ভেবে দেখেনি, অথচ এখন কেমন অদ্ভূত লাগছে।আচ্ছা অদ্ভূত লাগারই বা কী আছে? রাতে মেয়ে নিয়ে হোটেলে থেকে দিনের বেলায় যে বুক ফুলিয়ে হাটে সে একটা মেয়েকে কোলে নেয়ায় এত সংকোচ করছে কেন?
পরমুহূর্তেই ভাবলো,না। কীসের সাথে কী মেলাচ্ছি?দুটো এক নাকি! সম্পূর্ন আলাদা।মেয়েরা আমার হোটেলে আসে।আর ওখানেতো আমি নিজে আগ বাড়িয়ে গেলাম।রুদ্র অনেকক্ষন ভাবলো।পরে নিজেই অবাক হলো।এত ভাবাভাবি বিজনেসের ব্যাপারেও করতে হয়না।এই সামান্য ইস্যু টাকে সেকী একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছেনা?দিচ্ছেইতো।
শেষে এসে ঠিক করলো সে নিজেই যাবে।প্রেস্ক্রিপশন টা দিয়েই চলে আসবে।একবার তাকাবেও না সেঁজুতির দিকে। নাহলে সারা টা দিন ওই মেয়ে পরোক্ষভাবে ঘুরঘুর করবে তার পেছনে।

______
সেঁজুতি বেশ কষ্ট করে নাস্তা বানিয়েছে।আমির তখনও ঘুমে।মধ্য রাত অব্দি মেয়ের মাথার কাছে বসেছিলেন তিনি।চুলে বিলি কেটেছেন।সেঁজুতি কতবার যেতে বললেও শোনেননি।মেয়েটার সারা গায়ে ব্যাথা।যদি কিছু দরকার হয়! বাবার এত ভালোবাসা দেখে সেঁজুতির সব কষ্ট,ব্যাথা দুশ্চিন্তা উবে যায় কর্পূরের মতোন।যা করেছে তার জন্যেও হীনমন্যতা আসেনা।আসবে কেন? সেতো বাবার জন্যে করেছে সব।এতে যদি নিজের সব শেষ হয়, হবে।তাও বাবাতো পাশে রইলো।
সেঁজুতি নাস্তা বেড়ে ভাবলো বাবাকে ডাকবে।এর মধ্যেই ডোরবেল বাজার শব্দ।দরজা খুলে বাড়িওয়ালাকে দেখতেই মুখ অন্ধকার হয়ে এলো সেঁজুতির।সকাল সকাল বাড়িওয়ালা হাজির। যেখানে ভাড়া দিতে হয় ১ তারিখ সেখানে আজ মাসের ২১ তারিখ।আবার গত মাসের টাও বাকী।এত কিছুর মধ্যে ভাঁড়ার কথা বেমালুম ভুলে গেছিলো।টিউশনির চার হাজার টাকা দিয়ে বাজার করেছিলো কাল,সাথে টুকিটাকি কিছু জিনিস।সেগুলোতো রাস্তায়ই পরে রইলো।বাবার জমানো এক টাকাও নেই ঘরে।এখন কী করবে? কি দিয়ে দেবে ভাড়া!

— কেমন আছো সেঁজুতি?

— জ্বি ভালো,ভেতরে আসুন। দু পা বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকলেন খন্দকার।মুখে আমাবস্যা নেমেছে যেন।ভাঁড়া দেরি করে কেউ দেয়না তাকে।এ ব্যাপারে খুব স্ট্রিক্ট তিনি।মাসের ভাঁড়া মাসে নেয়াই তার কাজ।কোনো ছাড় নেই। তাতে তুমি মরো, বাঁচো যাই করো ভাঁড়া টাইম টু টাইম চাই খন্দকারের।ই এম আই নিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন।ভাগে পেয়েছেন মাত্র চারটি ফ্লোর।কাজ বাজ ও করেননা।এই টাকায় সংসার চলে।তার ওপর এ বাড়ির সব চেয়ে সুন্দর ফ্ল্যাটটি নিয়েই এই বাবা মেয়ে থাকে।ভাড়াও বেশি এটির।ঠিকমতো ভাঁড়া না দিয়ে উপায় আছে? ভাঁড়া দেয়ার কথা সেই এক তারিখ।কতবার এসে ঘুরে গেছেন।মস্ত বড় তালা ঝুলছিলো দরজায়।শুনেছেন আমির হাসপাতালে। তাই আর কিছু বলেননি।কিন্তু উনিশ দিন সময় তো দিয়েছেন।তার জন্যে এটা এক বছরের সমান।আজ এসেছেন হয় ভাঁড়া নেবেন।না হয় যা মুখে আসবে বলবেন।

রুদ্র সিড়ি বেয়ে উঠছিলো।সেঁজুতি দের দরজা অব্দি আসতেই হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে থেমে গেলো ওখানেই।দরজা ভেজানো।ভেতরে চিল্লিয়ে কথা বলছে কেউ।কোনো পুরুষালী স্বর।রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকলো। লোকটি বলছে,

‘ দেখো, এই ব্যাপারে আমি কোনো ছাড় দিতে পারবনা জানোইতো।তাও তোমার বাবা অসুস্থ বলে গত মাসে আমি কিছুই বলিনি।কিন্তু এর বেশী সময় দিতে পারবনা।আমার যে মাসের ভাঁড়া মাসে চাই সেটা কী নতুন জানো তুমি? আর তোমার সাথে এত কথাই বা আমি বলছি কেন? বাড়ি ভাড়া তো তুমি নাওনি নিয়েছেন তোমার বাবা।কই উনি? ডাকোতো।

সেঁজুতি বারবার রুমের দিক তাকাচ্ছে।খন্দকার এত চেঁচাচ্ছেন বাবার ঘুম না ভাঙলে হয়।এসব শুনলে বাবা খুব কষ্ট পাবে।নিজেকে দোষ দেবে।

-আমিতো বললাম শুধু এ মাস টা সময় দিন।আগামী মাসের টাকা সহ একসাথে দিয়ে দেব।

– না না না,ওটি হচ্ছেনা।আমি বাবা এই টাকা দিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকি।ভাড়ার ব্যাপারে আমার কাছে কোনও আহ্লাদ নেই।

– আচ্ছা আপনার ভাড়া আমরা দেইনি বা দিতে পারিনি এরকম কোনও দিন হয়েছে?শুধু তো দু মাসের ভাড়াই।

‘ দু মাস গড়িয়ে চার মাস করা ভাড়াটিয়াদের কাজ, সেকী আর আমি জানিনা।অত কথা বলে লাভ নেই।আমার ভাঁড়া চাই।এক্ষুনি।দিতে না পারলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেয় হও।
‘ আশ্চর্য লোক তো আপনি। বললাম তো দিয়ে দেব তাও এরকম করছেন কেন?বাবা অসুস্থ আপনি জানেন না? লজ্জ্বাও করেনা একটা অসুস্থ মানুষের বাসায় এসে এভাবে চেঁচামেচি করতে! আপনার মতো এমন ছোটলোক আমি জন্মে দেখিনি।টাকা থাকলেই কী সবাই মানুষ হয়?
খন্দকার ফুঁসে উঠে বললেন
‘ এই মেয়ে এই, মুখ সামলে কথা বলো বলে দিচ্ছি।আমি ছোটলোক? ছোটলোকি কাকে বলে দেখাইনি এখনও। যখন পুলিশ ডেকে এনে ঘাড় ধরে বার করব তখন বুঝবে আসল ছোটলোকি কেমন হয়।তোমার বাবা অসুস্থ বলেই আগের মাসে আমি কিছু বলিনি।কিন্তু আরতো ছাড় দেবনা।ভাঁড়া আমার চাই।এই আমি বসলাম,ভাঁড়া না নিয়ে কোথাও যাবনা।
সেঁজুতি হতাশ শ্বাস ফেলল।এখন এত গুলো টাকা কোথায় পাবে সে।বাবা গত মাসের ভাড়া রেখেছিলেন।কিন্তু সেসব টাকা তার হাসপাতালের ভর্তিতে লেগে গিয়েছে।এখন সারা বাড়ি খুঁজলেও টাকা পাওয়া যাবেনা।
সেঁজুতির মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা খন্দকারের পছন্দ হয়নি।
‘ কী ব্যাপার? স্ট্যাচু হয়ে আছো কেন? আমি তোমাকে দেখতে আসিনি।এসেছি ভাড়া নিতে।বেহায়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যাও টাকা নিয়ে এসো।
সেঁজুতি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো।নরম কন্ঠে বলল
‘ আঙ্কেল এত গুলো টাকা এখন আমি কোথায় পাব বলুন? একটু বোঝার চেষ্ট….
‘ কোথায় পাবে আমি কি জানি? দরকার হলে নিজেকে বেঁচে টাকা এনে দাও।মেয়ে মানুষ খোদ্দেরের অভাব হবে নাকী!
দরজার বাইরে রুদ্রর হাত মুঠো হয়ে এলো তাৎক্ষণিক। খন্দকারের মুখে চরম এক ঘুষি বসিয়ে রক্ত বের করতে ইচ্ছে জাগলো।এক পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো,সেঁজুতি ক্ষিপ্ত বাঘীনির মত চেঁচিয়ে ওঠাতে

‘ মুখ সামলে কথা বলবেন। টাকা পান বলে যা আসছে তাই বলছেন? এক্ষুনি বের হন এখান থেকে।আর আপনার টাকাতো?পরশুদিন,আগামী পরশুর মধ্যে আপনার টাকা গিয়ে আপনার মুখে ছুড়ে মেরে আসব।
খন্দকার তীব্র অপমানে ফেঁটে পরলেন,
‘ আমার বাড়ি থেকে আমাকেই বের করে দিচ্ছো? ঠিক আছে! এই অপমান খন্দকার ভুলবেনা।পরশুদিন তো? দেখা যাক।পরশুদিন টাকা না পেলে দুই বাপ বেটিকে ল্যাংটো করে ঝুলিয়ে পেটাব।

সেঁজুতি চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।খন্ধকার হিঁসহিঁস করতে করতে বেরিয়ে গেলেন।দরজা টা ধড়াম করে ফেলে গেলেন যাওয়ার সময়। সেঁজুতির টনক নড়লো যেন ।বাবা শোনেনি তো কিছু?

দরজার বাইরে আসতেই কেউ একজন খপ করে পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো খন্দকারের।আচমকা আক্রমনে খন্দকারের রুহ কেঁপে উঠলো।ভালো করে তাকানোর আগেই শক্ত হাতের ঘুষি পরলো নাকে।গলগলিয়ে রক্ত বের হলো সাথে সাথে।খন্দকার ভঁড়কে গেলেন।নাকের ব্যাথায় চোখ ঝাপ্সা হয়ে আসতে না আসতেই কানের পাশে টের পেলেন আরেক শক্ত থাবা।মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো।কানে যেন খসে পরলো মেঝেতে।চিৎকার করার ও সুযোগ পেলেন না।লুটিয়ে পরলেন মাটিতে। রুদ্র তার ছিপছিপে দেহ টাকে কাঁধে তুলে ছাদের দিকে রওনা দিলো।একবার চোখ বোলালো চারদিকে।কেউ কী দেখেছে?

আমিরের বুকে ব্যাথা করছে ভীষণ। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।হাত পা অবশ হয়ে আসছে।মস্তিষ্ক শূন্য শূন্য লাগছে।কলিংবেলের শব্দেই ঘুম ভেঙেছিলো।বিছানা থেকে একা একা উঠে হুইল চেয়ারের নাগাল পায়নি বলে বের হতে পারেনি।তবে উঠে বসেছিলো।বসার ঘরের সব কথা কানে এসেছে এতক্ষন।লজ্ব্বায় মাটিতে মিশে যেতে মন চাইছে। তার জন্যে,শুধুমাত্র তার জন্যে আজ মেয়েটাকে এত এত নোংরা কথা শুনতে হল? ছি! বাবা হয়ে কিচ্ছু করতে পারলেন না। এত গুলো বছর সে সন্মানের সহিত মাথা উঁচু করে বেঁচে ছিলেন তা এক নিমিষেই গুড়িয়ে গেলো।আমির বুক চেপে ধরলেন।মরে যাবেন মনে হলো।ভয়ে আটশাট হয়ে এলো শরীরটা।মরে গেলে মেয়েটার কী হবে?
সেঁজুতি রুমে ঢুকতেই বাবাকে বুকে হাত চেপে বসে থাকতে দেখলো।ধড়ফড় করে এগিয়ে এলো,
— কি হয়েছে বাবা? বুকে ব্যাথা করছে?
আমির জোরে জোরে শ্বাস নিলেন কবার।ঢুলে পরলেন মেয়ের হাতে।
রুদ্র সিড়ি বেয়ে নামছিলো।ভাগ্যিশ আজ কালো শার্ট পরেছে।নাহলে রক্তের দাগ গুলো স্পষ্ট বোঝা যেত।সেঁজুতির প্রকান্ড চিৎকারে পা দুটো থেমে গেলো তার।কী হলো?তড়িৎ গতিতে ঘরের দিকে দৌড় মারলো সে।এই মেয়ের ঘাড় থেকে দেখছি বিপদ নামছেইনা।

দরজা লক করা ছিলোনা।খন্দকার বেরিয়ে গেলেও দরজা লাগানো হয়নি সেঁজুতির।সে তড়িঘড়ি করে বাবার রুমে এসেছিলো।রুদ্রর এতে সুবিধেই হয়েছে।একদম ঘরে ঢুকে পরেছে সে।সেঁজুতি কাঁদছে। আমিরকে ঝাঁকাচ্ছে।ও বাবা ও বাবা বলে হাউমাউ করছে।রুদ্র যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝলো তখন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সেখানে।
‘ কি হয়েছে ওনার?
সেঁজুতি রুদ্রর দিকে তাকালোনা।তাকানোর সময় কই? কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিলো,
দে.. দেখুন না বাবা ক…কথা বলছেনা,,দেখুন না…

রুদ্র ব্যাস্ত কন্ঠে বলল
‘কাদবেন না আমি দেখছি।
বাবার অসুস্থতায় রুদ্রকে খেয়াল করেনি সেঁজুতি। লোকটা আজকে আবার কেন এলো সে জানেওনা।কিংবা খেয়াল করলেও কোনো প্রশ্ন করার মন মানসিকতা হয়নি।আমির লম্বালম্বি শুয়ে আছে বিছানায়।মাথার কাছে বসে সমানে ফোঁপাচ্ছে সেজুতি।হোসাইন ও এসেছেন। একটু আগেই তারা হাসপাতাল থেকে ফিরলেন আমির কে সাথে নিয়ে।নতুন নতুন অপারেশন। ওপরে এরকম একটা ধাক্কা।তাই ব্যাথা হচ্ছিলো বুকে।আবার চিন্তায় প্রেশার ও ফল করেছিলো বলে জ্ঞান হারায়।খুব সিরিয়াস কোনও ইস্যু নয় বলে ডাক্তার মেহরাব শুধু চেক- আপ আর টেস্ট করে ছেড়ে দিলেন।সাথে ঘুমের ইঞ্জেকশন। বাসায় আনা নেওয়া সব রুদ্র করেছে।আমিরের ভারী শরীরটা নিয়ে সেইতো সিড়ি বেয়ে নেমেছে উঠেছে।সেঁজুতি তো শুধু পিছু পিছু ছুটেছে তার।কেঁদেছে ফ্যাচফ্যাচ করে।গায়ের ব্যাথা তখন তাকে কাবু করতে পারেনি।বাবার কাছে তার যন্ত্রনা কিছুইনা।তবে রুদ্রর আজ প্রথম মনে হলো তার এত বছরের জিমে যাওয়া স্বার্থক।

সেঁজুতি সেই তখন থেকে কাঁদছে।শব্দ না হলেও নাক টানছে।রুদ্রর ভালো লাগছেনা এত কান্না।ডাক্তার তো বলেছেন ভয়ের কিছু নেই।তাও এত কাঁদছে কেন মেয়েটা।
রুদ্রর মনের কথা বলে দিলেন হোসাইন,
—সেজুতি! শুনলে তো সিরিয়াস কিছু নয়।তাহলে কেনো কাদছো তুমি?

সেঁজুতি বোধ হয় একটু থামলো।চোখ মুছে পাশ ফিরতেই নজরে এলো রুদ্রকে।আজ ও সেই সাজ তার।সেঁজুতি মুখ না দেখলেও সাজ দেখেই বুঝলো এটা অভ্রর ভাই।অবাক হয়ে বলল,

— আপনি কখন এলেন??
রুদ্র ছোট করে বলল,
— অনেকক্ষন।

— কিন্তু আমিতো এতক্ষন আপনাকে দেখিনি।

—আপনি বেহুশ ছিলেন তাই খেয়াল করেননি।।
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
— আমি বেহুশ ছিলাম?

— আপনার বাবার এই অবস্থায় হুশে ছিলেন না সেটাই বোঝালাম।
পাশ থেকে হোসাইন বললেন,
‘তুই দেখিস নি?কি বলছিস? ওই না তোর বাবাকে হাসপাতালে নিলো।আবার নিয়েও এলো? সাথে সাথেই তো ছিলিস এতক্ষন।
সেঁজুতি ছোট করে বলল,
‘ খেয়াল করিনি।দেখেছিলাম।ভেবেছি পাশের ফ্ল্যাটের কেউ।উনি হবেন মাথায় আসেনি।

হোসাইন আবার বললেন,
‘ তা হঠাৎ এত অসুস্থ হলো কেন আমির? এত চিন্তা করছিলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি রে?
জবাবে দুদিকে মাথা নাড়লো সেজুথি।কিছু হয়নি।সব টা জানাতে গেলে আংকেল বাড়ি ভাড়া দিতে চাইবেন।বাবার জন্যে যেটা আরও অপমানের।এর আগের সাহায্য নিতেও বাবার অনেক আপত্তি ছিলো।তাও অনেক জোড়াজুড়ি তে নেওয়া।সেতো তার বাবার মতোই হয়েছে।এই ব্যাপার টা জানানো যাবেনা কিছুতেই।টাকা তাকেই ম্যানেজ করতে হবে।

উত্তর পেয়ে হোসাইন কিছু বললেন না।তবে রুদ্র বিস্মিত। মিথ্যে কেন বলল? হয়েছেতো অনেক কিছুই।এবার আর মুখ ফুঁটে সত্যি বলা সমিচীন মনে করলোনা সে।হোসাইন হাত ঘড়ি দেখে বললেন

–; ঠিক আছে,ওষুধ গুলো ঠিকঠাক ভাবে খাওয়াস।আমার ওটি আছে।যেতে হবে।
— আচ্ছা।
হোসাইন ঘর ছেড়ে বের হতেই রুদ্র আর টিকতে পারলোনা।ধৈর্য হীন কন্ঠে বলল
‘আপনি এতো মিথ্যে কেনো বলেন??

সেঁজুতি অবাক চোখে তাকালো
‘কি মিথ্যে বললাম?

— কাল আপনার এক্সিডেন্ট এর ব্যাপার টা তো আপনার বাবাকে বলেন নি।আর আজ ওনাকে আপনাদের বাড়ি ভাড়ার ব্যাপার টাও লুকিয়ে গেছেন।ইফ আ’ম নট রং, বাড়িওয়ালার এমন অপমানের জন্যেই আপনার বাবা এত টা অসুস্থ হয়ে পরেছেন।তাহলে সেটা ওনাকে জানালেন না কেনো?

সেঁজুতি ভ্রু উঁচালো,
— বাড়ি ভাড়ার ব্যাপার টা আপনি কি করে জানেন?

রুদ্র বলল ” শুনেছি।
এরপর পকেট হাতড়ে প্রেস্ক্রিপশন বের করলো,’ ভুল করে রয়ে গেছিলো।দিতে এসেছিলাম।

সেঁজুতি ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে আমিরের মাথায় হাত বোলালো।বিছানা ছেড়ে উঠে বলল ‘ চলুন।
রুদ্র কে নিয়ে বসার ঘরে এলো। ‘ আপনি বসুন।আমি আসছি।রুদ্র বসলোনা,
সেঁজুতি যেতে নিলে বলে ওঠে,

— উত্তর টা পেলাম নাহ।
সেঁজুতি ফ্লাস্ক থেকে চা ঢালতে ঢালতে জবাব দিলো
– ওসব আপনি বুঝবেন না।
এক কাপ চা আর পিরিচে পাউরুটি ডিম দিয়ে ভাজা,আর এক গ্লাশ পানি । ট্রেতে গুছিয়ে রুদ্রর সামনে এনে রাখলো সেঁজুতি। এসব সকালে নিজেদের জন্যে বানিয়েছিল কিন্তু খাওয়া আর হয়নি।ফ্লাস্কে চা আর হটপটে রুটি রাখায় এখনও বেশ গরম আছে বলে সুবিধে হলো।সেঁজুতি সোজা হতেই রুদ্র চট করে বলল ‘ আমি চা খাইনা।
সেঁজুতি মাথা নুইয়ে বলল ‘ কফি করে দিচ্ছি।
রুদ্র বাঁধা দিলো’ দরকার নেই।সময় কম।আমি খেয়েই বেরিয়েছি।

সেঁজুতি চুপ করে রইলো।ঘরে আগে কফি আনা ছিলো বলে দিতে চেয়েছিলো।কিন্তু লোকটা যখন খাবেনা তখন আর কী করার।রুদ্র থেমে থেমে বলল
‘ আপনি না কাল বললেন, ডক্টর হোসাইন আপনার ভরসার জায়গা? তাহলে তার কাছ থেকে লুকোনোর কি আছে?

সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।লোকটার কৌতুহল একটু বেশিই।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বেঁচে থেকে বাবার অসহায় চাউনী সহ্য করা অনেক কঠিন। মরে গেলে তো আর সেটা দেখবনা তখন।
আর হোসাইন আংকেল আমাদের জন্যে অনেক করেছেন , কত আর হাত পাতবো বলুন তো?বাবার সন্মানের কথা ভেবেই বলিনি।

রুদ্র চোখা চোখে চেয়ে বলল
— আপনি কি করেন?

—অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি।
‘ চাকরী?
সেঁজুতি মলিন হাসলো
‘ গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেও কত মানুষ চাকরী পাচ্ছেনা। সেখানে আমিতো! তবে কয়েকটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি অভিজ্ঞতা নেই! হয়নি।

রুদ্র ব্যাস্ততা দেখাল, ” আমি আসি এখন।আপনার বাবার খেয়াল রাখবেন।
‘ হু।
‘ আপনারও
সেঁজুতি তাকাতেই রুদ্রর রন্ধ্রে রন্ধে অস্বস্তি ছুটে গেলো।কথাটা তার মুখ ফসকে বেরিয়েছে। বলতে চায়নি একদম।মেয়েটি কি ভাবলো? হ্যাংলা?
তার অস্বস্তি কাটলো সেঁজুতির কথায়।
‘ সাবধানে যাবেন।রাস্তা পার হতে এত তাড়াহুড়ো করবেন না যেন।

রুদ্রর প্রচন্ড ভালো লাগলো কথাগুলো।একটু হাসলো কি গম্ভীর লোকটা? কি জানি,মাস্কের কারনে বোঝা গেলোনা তো!

চলবে….

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
পর্ব-১১

আর-আর-সি ইন্ডাস্ট্রিজ।বিশাল জায়গা নিয়ে অফিসটি।দশতলা ভবনের।ভেতরে ঢুকলে এসির হিমহিম ঠান্ডা,কাঁচ বেস্টিত দেয়াল, চকচকে ঝকঝকে সব কিছু চোখে লাগতে বাধ্য।রুদ্রর মেইন অফিস এটি।এখানেই সব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং,কনফারেন্স, ইম্পোর্ট -এক্সপোর্টের যাবতীয় কাজ সাড়ে সে।অন্যান্য গার্মেন্টস, রেস্টুরেন্ট গুলোতে ঢু মারলেও দিনের সব থেকে বেশি সময় কাটায় এখানেই। অফিসের সব থেকে আকর্ষনীয় জায়গাটি হচ্ছে রুদ্রর কেবিন।এত বড় জায়গা নিয়ে বানানো, দেখে বসার ঘর ভেবে বসবে যে কেউ।তার সাথে কেবিনে বিশাল বড় এক জানলা।যদিও সব সময় বন্ধই থাকে।তাও থাই গ্লাস ভেদ করে দূরের গাছগুলো দেখতে ভালো লাগে রুদ্রর।আশেপাশে আর উচু বিল্ডিং না থাকায় খুব সহজেই দেখা যায় সেসব।অভ্র মাত্রই রুদ্রর কেবিনের দরজায় নক করলো।রুদ্রর কেবিনের সব থেকে বিশেষ একটি দিক হচ্ছে তার দরজাটি রিমোর্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।ইচ্ছে করলে বসে বসেই লক করে দেয়,যখন মনে হয় একা থাকা প্রয়োজন। আবার ইচ্ছে হলে বসে বসেই খুলে দেয়।রুদ্রর ও বেশ লাগে বিষয় টা।অভ্র মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলো,
—ভাই ডেকেছিলে?
‘ভেতরে আয়।
অভ্র আসতেই রুদ্র বসতে ইশারা করলো।অভ্র বরাবরই বাধ্য ভাই।বসতে সময় নিলোনা।তবে চিন্তিত সে।রুদ্র তাকে গল্প করতে ডাকেনা।খাবার খেতেও না।একমাত্র কাজ ছাড়া কেবিনে সবার ঢোকা নিষেধ।তাতে সে ভাই হলেও বা কী!
‘ কিছু হয়েছে ভাই?
রুদ্রর জবাব এলো সময় নিয়ে।অভ্রর দিকে একটা কাগজ মতো কিছু এগিয়ে দিয়ে বলল, ” পড় এটা।
অভ্র হাতে নিয়ে রুদ্রর দিক চেয়ে থাকলো বোঁকার মতন।রুদ্র ছোট্ট শ্বাস ফেলল
,আমাকে পরে দেখিস।আগে পড়।

অভ্র মনে মনে জিভ কেটে কাগজে চোখ দিলো।পুরোটা পড়লো এক নিঃশ্বাসে।
‘এটাতো…
‘ এপ্যোয়্যেন্টমেন্ট লেটার।

অভ্র জিজ্ঞাসু মুখচোখ নিয়ে বলল,
— হ্যা।কিন্তু কার ভাই?আর দেখো,এখানে আমাদের অফিসের নাম টাও ভুল এসছে। RRC ইন্ডাস্ট্রিজ এর জায়গায় শুধু চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রিজ লেখা এসছে।
রুদ্র চেয়ারে হেলান দিলো।আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল
ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
— কার জন্যে সেটা না হয় পরে জানবি।এখানে যা আছে সব আমি দিয়েছি। কোনও ভুল নেই।তোকে বলছি কারন তোর কিছু কাজ আছে।
অভ্র প্রশ্ন করলনা।তাকিয়ে রইলো।রুদ্র বলল,
‘ আজকেই অফিসের নেম প্লেট চেঞ্জ করবি।

অভ্র এবারেও নিশ্চুপ।সে প্রশ্ন করতে চেয়েও করছেনা।ভাই নিজে থেকেই বলুক।একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুক উত্তরের।ভাইতো প্রশ্ন করা পছন্দই করেনা।
রুদ্র অভ্রকে এপোয়েন্টমেন্ট লেটার ইশারা করে বলল
‘ ওখানে অফিসের মালিকের নাম নেই।লক্ষ্য করেছিস?

অভ্র তড়িৎ বেগে চোখ বোলালো।’ আসলেই তো।
রুদ্র কপট রাগ নিয়ে বলল
,
তোকে পড়তে দিয়েছি কেন? এত কেয়ারলেস হলে চলবে অভ্র? একটা কাগজের কিছু পড়া মানে দাঁড়ি,কমা সব কিছুতে চোখ বোলানো।
অভ্র চোরের মত নামিয়ে নিলো মাথাটাকে।রুদ্র এবার শান্ত কন্ঠে বলল,
,
যা যা বলছি মন দিয়ে শোন।কান দিয়ে নয় শুধু,মন দিয়ে… ওকে?
অভ্র মাথা কাত করলো,
‘আমি একটা ঠিকানা দেব। ম্যানেজার কে দিয়ে এটা পাঠাবি সেখানে।আমি যা যা বলতে বলবো ঠিক তাই তাই যেনো বলা হয়।একটা ওয়ার্ড না বেশি আর না একটা ওয়ার্ড কম।
‘ ওকে ভাই।
,
যা এখন।এটা নিয়ে যা।
অভ্র বেরিয়ে যেতেই রুদ্র ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল।পরমুহূর্তে রহস্য হাসলো।চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইলো অদূরে।
,
আমি কারো ঋন রাখিনা মিস সেঁজুতি ……
___________
বাবা আর একটা কথাও নয়।তুমি যাবেনা ব্যাস!
সেঁজুতি কঁড়াভাবে বলে, সোফার ওপর ধুপ করে বসলো।পেছন পেছন হাজির হলেন আমির।মেয়েকে মানাতে বললেন,
‘আরে বাবা এতে কি এমন হয়েছে?এখন আমাদের যা অবস্থা তাতে তো বাসা টা ছাড়াতেই হবে তাইনা! দু মাসের ভাড়া আমাদের ঘাঁড়ে রে মা।একটু তো বোঝ!
সেঁজুতি বিস্ময় নিয়ে বলল,
— বাসা ছাড়বো মানে?ছোট্টবেলা থেকে এ বাসায় বড় হয়েছি আমি। এ বাসায় আমাদের কত স্মৃতি,বাসা কেনো ছাড়বো?
আমির মোলায়েম কন্ঠে বললেন
‘ এটাকী আমাদের বাড়ি রে মা? এটাতো ভাড়া বাড়ি।একদিন না একদিন ছাড়তে হবেনা?

‘ সে তখন দেখা যাবে বাবা।বাসা ছাড়লেও মাথা উঁচু করে ছাড়ব।এভাবে টাকা দিতে পারছিনা বলে অপমানের ভয়ে নয়।

আমির হতাশ শ্বাস ফেললেন,
সেঁজুতি এ বাসায় থাকতে হলে টাকা লাগবে।মাসে এত গুলো টাকা ভাঁড়া।কীভাবে সামলি সেটা তো ভাব।

সেঁজুতি অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
একটা না একটা ব্যাবস্থা ঠিক হবে।

আমির অধৈর্য হয়ে পরলেন।মেয়েটা ঠিক তার মায়ের মতোন জেদি।একটা কথা যদি সহজে বোঝে।
‘ কি করে করবি তুই ব্যবস্থা?অপারেশনের জন্যে লোনের টাকাগুলোই তো এখনও শোধ হয়নি। এতো এতো টাকার ভার একা কিভাবে সামলাবি তুই?
সেঁজুতি ও বাবার সমান রাগ দেখিয়ে বলল
— তাই বলে তুমি জামাকাপড় ফেরি করবে??

আমির ক্ষীন হাসলেন মেয়ের রাগে।আদুরে কন্ঠে বললেন,
তাতে কি হয়েছে আম্মা?পৃথিবীতে কোনও কাজ ই ছোট নয়।
সেঁজুতি মুখ ঘুরিয়ে বলল
হোক।তাও তুমি কোত্থাও যাবেনা
।না মানে না।আমি ছেলে হলে কী আমার ওপর ভরসা করতেনা? তাহলে এখন কেনো করতে পারছোনা।আমি মেয়ে বলে??

আমির বিরক্ত হলেন ” আমি কখন বললাম?
,
বলোনিতো?তাহলে অামার কথা শুনবে।আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাইছিনা।তুমি কোত্থাও যাবেনা।তোমাকে কোনও কাজ করতে হবেনা ব্যস।

সেঁজুতির অবিচল জেদ।অবশেষে হার মানলেন আমির।দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সেঁজুতি আঁড়চোখে একবার বাবাকে দেখে রান্নাঘরে গেলো।এই সময় চা খাওয়ার অভ্যেস তাদের।খেয়ে পড়তে বসবে।শরীর খারাপ থাকায় ভার্সিটি যাওয়া হলোনা।হাতে এক হাজার টাকা আছে। আপাতত দু একদিনের বাজার হয়ে যাবে এতে।কিন্তু খন্দকারকে যে বলল বাড়ি ভাঁড়া পরশুর মধ্যে দেবে কী করবে তার?
এদিকে সকালে তাদের বাড়িতে বিরাট এক কান্ড ঘটেছে।খন্দকার কোথা থেকে নাক মুখ ফাঁটিয়েছেন।কানেও কম কম শুনছেন নাকী।সেঁজুতিদের পাশের ফ্ল্যাটে এক জোড়া দম্পতি থাকেন।তারা অবশ্য এক রুমে থেকে, বাকী রুম ব্যাচেলর ছেলেদের ভাঁড়া দিয়েছেন।স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরীজীবি।আটটা বাজলেই অফিসে চলে যায়।ফেরেও একসাথে।প্রেমের বিয়ে। দুজনেই একই অফিসে।ব্যাচেলর ছেলে গুলোতো সারাদিন থাকেনা বাসায়। গতকাল উনিই রান্না করে দিয়েছিলেন।আজকেও দেখতে এসেছিলেন বাবা মেয়েকে।ওনার মুখেই খন্দকারের কথা কানে যায় সেঁজুতির।লোকটা নাকি সিড়ি থেকে পরে গেছিলেন।সবাই দেখতে গেলেও সেঁজুতি যাইনি।উলটে মনে মনে খুশিই হলো,
” সকালে তাকে আজেবাজে কথা শোনানোর ফল এগুলো।এতদিন ভাঁড়া ঠিকঠাক দিয়েছে। লোকটার গলায় তখন মধু ঝড়তো।যেই দুটো মাস দিতে পারলোনা ওমনি প্রত্যেকটা কথায় যেন বিষ পরে।
______
আমির চুপ করে বসে আছেন।মেঝের টাইলস গুলোর সুন্দর নকশা দেখছেন মনোযোগ দিয়ে।
ভাগ্য তাকে কি দিন দেখালো!এত বড় ঘরের সন্তান হয়েও ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে ঘর ছেড়েছিলো একদিন।প্রিয় মানুষ টির নাম ছিলো মুনারা।তিনি ভালোবেসে ডাকতেন মুনা বলে।ছোট্ট একটা ভাড়া বাসায় নিজেদের সংসার সাজিয়েছিলো দুজনে।তখন তার মাস্টার্স শেষ।প্রথম প্রথম দুজনেই বেশ কষ্ট করেছেন।পরে যখন তার ব্যাংকের কাজ টা হলো,তখন আর পেছনে তাকাতে হয়নি।স্বচ্ছলতার ছোয়ায় এত বড় বাসায় এসে উঠলো।ভালোই যাচ্ছিলো দিন।তারপর ঘর আলো করে এলো সেজুথি।কি ফুটফুটে সুন্দর পুতুলের মতোন হয়েছিলো মেয়েটা।মুনা প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পরেন তারপরপরই।
আর এক মাস পরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন।এরপর মেয়েকে নিজের মত মানুষ করেছেন আমির।একা হাতে ছোট্ট শিশুটাকে মায়ের মত আগলেছেন,আবার অফিসের কাজও করেছেন।আয়া রেখেছিলেন যদিও।কিন্তু সেঁজুতি ছোট থেকেই বড্ড ন্যাওটা ছিলো তার। স্ত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়েও দু বাড়ির কেউই আসেনি মুনারা বা তাদের দেখতে।তাই রাগ আর অভিমানে তিনিও সেজুথিকে জানাননি ওর দাদু বাড়ি বা নানু বাড়ি সম্পর্কে।ভেবেছিলেন মেয়েটার বিয়ে দিলে তার একার জীবন কোনো মতে চলে যাবে।দ্বিতীয় বিয়ের কথা মাথায়ও আনেননি।কোনও দিন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলো, তার পুতুলের মতো মেয়েটিকে সংসারের জোয়াল টানতে হবে? গত কদিনেই মেয়েটার শরীর ভেঙে গিয়েছে।রাতেতো ঠিকঠাক ঘুমায়ওনা। নিজের এমন করুন অবস্থা হবে আর বসে বসে মেয়ের কষ্টের টাকায় তাকে খেতে হবে ভাবেনি আমির।এতো ছোট বয়সে মেয়ে টা মা হারালো,আর এখন এই বয়সে পুরো সংসার খরচের দায়িত্ব কাঁধে।কি করবে কে জানে!এখন তো আল্লাহই তাদের একমাত্র ভরসা।
____
সেঁজুতি মাত্রই চা বানিয়ে বাবার হাতে দিয়েছে। তখন কলিংবেল বাজলো।
‘এখন আবার কে এলো?
‘ বাড়িওয়ালা নাকী? বলেছিলাম তো টাকা কাল দেব।এখন এলো কেন?
‘ দরজা খুলে দে।খবরদার খারাপ ব্যাবহার করবিনা।
সেঁজুতি বাবার আঁড়ালে মুখ বাঁকালো।খারাপ ব্যাবহার উনি করবেন,আমি ছেড়ে দেব নাকী?
চায়ের কাপ টা শব্দ করে রাখলো টি-টেবিলে। দরজা খুলতেই দেখল একজন অপরিচিত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। সেঁজুতি লোকটির পা থেকে মাথা অব্দি দেখলো।একেবারে স্যুটেড বুট্যেড যাকে বলে।
ভেতরের রুম থেকে জিজ্ঞেস করলো আমির ‘ কে এলো?
‘ দেখছি বাবা।

সেঁজুতি লোকটির দিকে তাকালো।মিষ্টি করে বলল,
-জ্বি, বলুন! কাকে চান?
‘ এটাকী মিস্টার আমির উদ্দিন এর বাসা?
‘ হ্যা।
‘ ওনার মেয়ে মিস নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি আছেন?
‘ জ্বি আমিই সেঁজুতি। আপনি কে?
, আমি চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম। আপনার জন্যে একটি চাকরির অফার এনেছি।এই যে আপনার এপ্যোয়েন্টমেন্ট লেটার।
সেঁজুতি অবাক হলো।লোকটি ফাইল থেকে দুপাতার কাগজটি বের করে এগিয়ে দিলেন। সেঁজুতি পড়ার আগেই বলল
‘কিন্তু আমিতো আপনাদের অফিসে চাকরীর জন্যে এপ্লাই করিনি।
লোকটি সামান্য হেসে বললেন,
— জ্বি ম্যাডাম।আপনি এপ্লাই করেননি।তবে এটা আমাদের পক্ষ থেকে সেইসব ব্রাইট স্টুডেন্ট দের জন্যে একটি গোল্ডেন চান্স,নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার।একেক বছর একেক ভার্সিটির স্টুডেন্ট দের চান্স দেয়া হয় যাদের পাশিং মার্ক্স ভালো।এ বছর আপনাদের ভার্সিটি থেকে আপনাকে সহ আরও কয়েকজন কে দেয়া হচ্ছে।আমরা আপনাদের ভার্সিটিতে খোজ নিয়ে তবেই এসেছি।নাহলে এড্রেস কোথায় পেলাম বলুন! লাস্ট ইয়ার এক্সামে আপনার রেজাল্ট ভালো ছিলো তাই জন্যেই আপনি এই চান্স টা পাচ্ছেন,,,…
খুশিতে ঝলমল করে উঠলো সেঁজুতির চেহারা।অপ্রত্যাশিত চাকরি পেয়ে বিশ্বাসই হচ্ছেনা যেন।
দুচোখে সুখ আর কৃতজ্ঞবোধ উপচে আসছে।
‘ ভেতরে আসুন আপনি।
আশরাফুল বললেন,
‘ নো ম্যাম। আমার তাড়া আছে।তবে একটা কথা।এই নিউজটি আপাতত লিক করবেন না।
সেঁজুতি সন্দেহী চোখে তাকালো

‘কেনো? এই যে আপনারা বললেন আপানারা খোজ নিয়েই এসছেন আমার ভার্সিটি থেকে।
,
হ্যা কিন্তু সেটা টেকনিক্যালি জেনে নিয়েছি।এইরকম কোনও ব্যাপার জানাজানি হওয়া টা আমাদের অফিসের আউট অফ রুলস।তাছাড়া এটা,,আমাদের ইকোনোমিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে
তাই আপনাকে বলছিলাম যে…
সেঁজুতি ছোট করে বলল ‘ বুঝেছি।
,
ধন্যবাদ,,,তবে আপনি কালই অফিসে আসুন।আর এখানে সমস্ত ডিটেইলস আর এড্রেস দেয়াই আছে।

‘আচ্ছা।
লোকটি চলে যেতেই সেঁজুতি দরজা আটকালো।
“কে ছিলো?
“একটা চাকরীর এপোয়েন্টমেন্ট লেটার এসছে বাবা।তাও আবার এপ্লাই ছাড়াই।
‘এপ্লাই ছাড়া আবার চাকরী?
সেঁজুতি খুশি খুশি কন্ঠে বলল
‘তাইতো। এটা নাকি ভার্সিটির ভালো ছাত্রছাত্রিদের চান্স দেয়া হয়ে থাকে ওনাদের অফিস থেকে। আর সেটা প্রতি বছর,এ বছর আমি আর কজন পাচ্ছি।

আমির শ্বাস ফেলে বললেন,
ওহহ!” যাক ভালোই হলো,,,আল্লাহ একটা উপায় করে দিয়েছেন।
সেঁজুতি কে এবার চিন্তিত দেখালো।
‘কিন্তু কাল ই যেতে বলেছে,বাড়িওয়ালা তো কাল ই আসবে।কীভাবে কি করব?
‘ ওনা কে নাহয় বুঝিয়ে বলবো।তুই ভাবিস না।চাকরী হয়েছে শুনলে নিশ্চয়ই ছাড় দেবেন।সামনের মাসে তো দিয়েই দিচ্ছি তাইনা।
,
হু
সেঁজুতি হাতের কাগজটি উলটে পালটে দেখলো।খটকা নিয়ে ভাবলো,
চাকরীর লেটার অথচ বসের নাম নেই?
____
অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলো সেজুতি।ঠিকানা অনুযায়ী রিক্সা থেকে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়লো চৌধুরী ইন্ডাস্ট্রির সামনে।সামনে তাকাতেই মুখটা হা হয়ে এলো
‘বাপরে কত্ত বড় অফিস,,এতো বড় অফিসে আমি কাজ করব? এত ভাগ্য আমার?
সেঁজুতি চারপাশ দেখলো।কত্ত গাড়ি এখানে।বিভিন্ন রংয়ের।আরেকটু খেয়াল করলে হয়ত সেই লোকটির কালো গাড়িটাও দেখতে পেতো।বেশ নার্ভাস হয়ে ভেতরে নরম পায়ে প্রবেশ করলো।
অফিসের ভেতর ঢুকে তার অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়।এটাত ফুটখেলার মাঠ! এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সেজুতি। সব কিছু কতটা গোছানো, পরিপাটি।এক চুল পরিমান যেখানে কোনও অসৌজন্যতা নেই।কেন যেন এখানে নিজেকে বড্ড বেমানান লাগছে তার।কিন্তু তাকে ঠিক কোথায় যেতে হবে কিছুই তো জানেনা।চোখে পরলো রিসেপশন।কিছু না ভেবে সেখানে গেলো।
‘এক্সিকিউজ মি!
পাতলা গড়নের একটি মেয়ে।চুল গুলো ওপরে ঝুটি করে বাঁধা।পড়নে লেডিস কোর্ট। মন দিয়ে কাজ করছিলো কম্পিউটারে। সেঁজুতি ডাকতেই চোখ না তুলেই বলল,
ইয়েস ??
‘আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে।ওই..
পুরো কথা বলার আগেই রিসেপশনিস্ট মেয়েটার টেলিফোন বাজলো।মেয়েটি ব্যাস্ত কন্ঠে বলল,
‘এক মিনিট অপেক্ষা করুন,,
টেলিফোনের রিসিভারটি কানে তুললো মেয়েটি।ওপাশ থেকে কী বলল শোনা গেলোনা।মেয়েটি তৎপর কন্ঠে বলছে,

‘ইয়েস স্যার,,
‘ ওকে স্যার ওকে ,আমি পাঠাচ্ছি…
এতক্ষনে মেয়েটি হাসলো।মোলায়েম সুরে বলল,
,
ম্যাম আপনাকে এখানে জবের জন্যে ডাকা হয়েছে রাইট??
সেঁজুতি মাথা নাড়তেই বলল,
,
ওকে আপনাকে তাহলে অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের রুমে যেতে হবে।
,
রুম টা কোথায় একটু বলবেন?
মেয়েটি হাতের ইশারায় একটা দিক দেখাতেই সেঁজুতি হাটা ধরলো।প্রত্যেকটা কদমে বুক ধুকপুক করছে সাথে ভীরছে আকাশ কুসুম ভাবনা।
এই ম্যানেজিং ডিরেক্টর ই কি তার বস? বস কি অনেক রাগী হবে?বয়ষ্ক হবে? কিংবা তামিল ভিলেন দের মত মোটা বড় বড় গোফ থাকবে?
অনেক কৌতুহল নিয়ে দরজার সামনে এসে দাড়ালো সেজুথি।একবার নক করতেই ভেতর থেকে উত্তর এলো..

কাম ইন….

চলবে…

প্রনয় পর্ব-৮+৯

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব-০৮+০৯
” অভ্র”
এক তরঙ্গমিশ্রিত ঠান্ডা গলার স্বর।এমন গম্ভীর আওয়াজ কবিতা আবৃত্তির জন্যে একদম পার্ফেক্ট।এমনটাই মনে হলো সেঁজুতির।অভ্রর সাথে সাথে সেও তাকালো দরজার দিকে।গোলগোল চোখ দুটো বেরিয়ে আসার উপক্রম অভ্রর।দরজায় দাঁড়ানো লোকটাকে আপাদমস্তক দেখলো সেঁজুতি। অফ হোয়াইট রংয়ের শার্টের ওপর কালো জ্যাকেট।কালো ডেনিম প্যান্ট।এক জোড়া চকচকে দামী বুট।সাথে সিলভার রংয়ের দামী ঘড়ি কব্জিতে।পা থেকে শুরু করে মাথা অব্দি আভিজাত্য আর আভিজাত্য।কিন্তু অতি আশ্চর্য,হাসপাতালের ভেতরে লোকটি সানগ্লাশ পরে ঢুকেছে।যার গ্লাশ দুটো নাক অব্দি এসে ঠেকলো।চোখ তো খুঁজে পাওয়াই বাহুল্য।মাথায় একটা কালো ক্যাপ।মুখে আবার মাস্ক।লোকটার চেহারার এত টুকুন অংশ যদি দেখা যায়।
সেঁজুতি অনেকক্ষন দেখলো।তবুও অভ্রর এমন অবাক চাউনীর কারন তলিয়ে পেলোনা।অন্যদিকে অভ্র ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে।
এটা কি তার ভাই?ডেকেছেতো ভাইয়ের মতই।কিন্তু এইটুকু সময়ে এমন উদ্ভট সেজে এলো কোত্থেকে? মুখে মাস্ক,মাথায় ক্যাপ আবার চোখে টায়ারের মতো গোল গোল গ্লাশ দুটোই বা পরেছে কেন? চেনার কী কোনো উপায় রেখেছে?বহু কষ্টে চিনলো হয়তো।সেঁজুতির দিক ফিরে দেখলো সেঁজুতি কেমন কেমন চোখে তাকিয়ে আছে।অভ্র দাঁত কেলিয়ে হাসলো।সে যে এক মুহুর্তের জন্যে বোকা বনে গিয়েছে, তাও তার নিজের ভাইকে না চিনতে পেরে সেটা এই মেয়েকে কিছুতেই বুঝতে দেবেনা।
আচ্ছা, ভাই বোঝেনিতো? তার তো আবার অনেক বুদ্ধি। যাকে বলে শিরায় শিরায়।অভ্র চট করে রুদ্রর দিকে চোখ ঘোরালো। রুদ্র কারো চাউনীর তোয়াক্কা করে? সে তার মতো শক্ত পায়ে কেবিনের ভেতর ঢুকলো।অভ্র তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। সে এখনও শিওর হয়নি এটা ভাই কীনা।রুদ্র এসে ঠিক তার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো।নিচু আওয়াজে বলল
” ড:হোসাইন কে ডেকে আন।

রুদ্র যতটুকু পারলো শব্দ এবং কথা কম খরচ করতে,তাই করলো।পাছে সেঁজুতি চিনে ফেলে যদি।তাহলে লাভের লাভ কিছুই হবেনা।অভ্র এবার নিশ্চিত এটা তার ভাই।রুদ্র উত্তর না পেয়ে আবার তাকাতেই সে চটপট বেরিয়ে গেলো।বেশিদূর যেতে হয়নি।এর আগেই কেবিনে ঢুকলো হোসাইন।ডাক্তার মানুষ,পেশেন্ট এর ভীড়ে তাকে খুঁজে পাওয়াই দুঃসাধ্য।তাও বন্ধুর মেয়েকে নিজের মেয়ের থেকে কোনও অংশে কম ভালোবাসেন না তিনি।সুজোগ পেলেই একবার করে চলে আসছেন।
সেঁজুতি এতক্ষন দুই ভাইয়ের দিকেই চেয়ে ছিলো।লোকটার হাটাচলা, দাঁড়ানো অন্য রকম।অভ্র তার ভাই,অথচ কি সাদামাটা। সে মনে মনে ভাবলো,
‘অনেকেই হাসপাতালের গন্ধ টা সহ্য করতে পারেনা।তাই হয়তো মুখে মাস্ক বেধেছে।কিন্তু চোখে সানগ্লাস?? হাস্পাতালের ভেতরে কেউ সানগ্লাস পরে ঘোরে বুঝি?
রুদ্র বেশ আস্তে আস্তে কথা বলছে।সাথে চেষ্টা করছে কন্ঠে গম্ভীরতা না টানার।সে রাতে মাত্র দুটো কথা বলেছিলো সে মেয়েটির সাথে।যদি মনে রেখে দেয়? তাই এত সাবধানতা। কিন্তু রুদ্র কথা বলবে আর তাতে গাম্ভীর্য থাকবেনা সেকী হয়?তার ওপর সেঁজুতি অদ্ভূত ভাবে দেখছে তাকে।সেঁজুতি তার উদ্ভট সাজের জন্যে চেয়ে আছে রুদ্র সেটা বোঝেনি।সে ভাবছে চিনে ফেলল কী?
হোসাইনের সাথে কথা শেষ। এখন বাড়ি ফেরার পালা।রুদ্র সেঁজুতির দিকে তাকালো।সেঁজুতি বুঝলোনা।এত কিছু দিয়ে মুখ ঢাকলে কেই বা বোঝে?রুদ্র ছোট করে বলল ‘চলুন’
সেঁজুতি নিঃশব্দে বেড থেকে নামার উদ্যোগ নিলো।পা দুটো ফ্লোরে ঠেকাতেই কামড়ে ধরলো বোধ হয়।প্রচন্ড ব্যাথায় টানটান হয়ে এলো।সেঁজুতি দাঁড়াতে পারলোনা।পারার কথাও নয়।পরে যেতে নিতেই খপ করে ধরে ফেলল রুদ্র।যা পেয়েছে তাই ধরেছে।আর জায়গাটা যে সেঁজুতির সরু কোমড় বুঝতে সময় লাগেনি তার।
‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?
চমকে তাকালো সেঁজুতি। এইতো,ঠিক
এইরকম গম্ভীরসুরের একটা প্রশ্ন ঠিক আগেও শুনেছে সে।হ্যা অবিকল একরকম।কিন্তু কোথায় শুনলো?রুদ্র আঁচ করতে পারলো সেঁজুতির চাউনি।এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে ধীর স্বরে বলল,
‘আপনার কি হাটতে সমস্যা হচ্ছে?
রুদ্র তখনও ধরে আছে কোমড়।মেয়েদের স্পর্শ করা তার কাছে নতুন কী? কিন্তু সমস্যা হলো সেঁজুতির। সে কিছুতেই পরপুরুষের অযাচিত স্পর্শ চায়না।মোচড়ামুচড়ি করে রুদ্রর হাত সরিয়ে দিয়ে বেডের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়ালো।হ্যা বোধক মাথা নাড়লো নিচের দিক চেয়ে।হাটতে সমস্যা হচ্ছে তার।সমস্যা কী? সে হাটতে পারবে কীনা সেটাই সন্দেহ এখন।পা দুটো ফুলে ফেপে একাকার বোধ হয়।পা উলটে পরেছিলো তখন।ভাগ্যিশ পা দুটো গাড়ির নিচে পরেনি।
হোসাইন এক পা এগিয়ে এসে বলল
,
— ওহ হ্যা,মি: র..
নাম ধরে ডাকার আগেই হোসাইন কে থামিয়ে দিলো রুদ্র।তৎপর কন্ঠে শুধালো
‘ওনার কি পায়ে কিছু হয়েছে?
‘জ্বি আমি সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম আপনাকে।ওর পায়ের হাড়ে ব্যাথা। দু এক দিন লাগবে সাড়তে।সেটা ওকে আমি বলেও দিয়েছি।এখন তো হেটে যেতেই পারবেনা।আমি বরং ওর জন্যে একটা হুইল চেয়ারের ব্যাবস্থা করি।
হোসাইন যেতে নিলে রুদ্র আটকে দিলো।
‘দরকার নেই।আই উইল ম্যানেজ।

অভ্র নিরব দর্শক।তার এখানে বলার কিছু নেই এখন।মুখস্ত বিদ্যায় সে ভালো হলেও চটপট কিছু বলার মতো জ্ঞান নেই। তার ওপর যেখানে স্বয়ং রুদ্র, সেখানে সে বলবেই বা কী? ওদিকে সেঁজুতি ও ভ্রু কুঁচকে আছে।সে হাটতে পারবেনা।লোকটা হুইলচেয়ার আনতেও মানা করছে।উড়ে উড়ে যাবে তাহলে? হোসাইন বললেন,
‘কিভাবে ম্যানেজ করবেন মিস্টার চ…
হোসাইন শেষ করতে পারেনি।রুদ্র ফট করে সেঁজুতিকে কোলে তুলে ফেলল।উপস্থিত সবাই ভড়কে গেলো।চক্ষু চড়কগাছ তাদের।অভ্রর তো মনে হলো তার ঠোঁট দুটো দু প্রান্তে চলে গেলো। এরা আর এক হবেনা। কোনও দিন না।
সেঁজুতির মাথায় গোটা আকাশটা ভেঙে পরার অবস্থা।এই লোক তাকে কোলে নিয়েছে কেন? কি সর্বনাশ! অচেনা অজানা লোকের কোলে চড়ে সে বাসায় যাবে।ছি ছি!অভ্র ভাবছে,
“ভাই তো রাত ছাড়া কোনও মেয়ের ধারে কাছেই ঘেঁষে না।তবে আজ একেবারে সবার সামনে একটা মেয়েকে কোলে তুলে নিলো?অভ্র চোখ কচলে আবার তাকালো।
এদিকে সেঁজুতি লজ্জ্বায় নুইয়ে পরেছে হোসাইনের সামনে।লোকটা তো বাবার বন্ধু।একজন পরপুরুষ তাকে কোলে নিয়েছেন উনি কি ভাববেন।হোসাইন টু শব্দ করলেন না।প্রত্যেক কে একবার করে দেখে কেবিন ছেড়ে বের হলেন তিনি।এত কিছুতে হেলদোল নেই শুধুমাত্র ওই একজনের। কাউকে পাত্তা সে কোনো দিন দিয়েছে ? আজ কী এমন স্পেশাল দিন।যে আজ দেবে?এদিকে সেঁজুতি রীতিমতো হাত পা ছোটাছুটি শুরু করলো।হূট করে কোলে তোলায় রুদ্রর শার্ট যাও একটু খামছে ধরেছিলো ছেড়ে দিলো তাও।রেগেমেগে বলল,
এসব কী অসভ্যতা? আপনি আমাকে ছোঁয়ার আগে আমার অনুমতি নিয়েছেন? আপনাকে কে বলেছে কোলে তুলতে? নামান, নামান বলছি।
রুদ্রর তাতে কান নেই।সে হাটা শুরু করতেই সেঁজুতি দ্বিগুন হাড়ে মোচড়ানো শুরু করলো।
‘ আপনি কথা শুনছেন না কেন? আপনাকে নামাতে বললাম তো আমি।আশ্চর্য মানুষ তো আপনি,আপনার কি লজ্জ…

‘ লিসেন! আপনি যত ইচ্ছে চেঁচাতে পারেন।আপনার কথায় আমি আপনাকে নামাবো ভাবলে ইউ আর রং। তবে এভাবে লাফাতে থাকলে মেঝেতে ফেলে দেব সেটুকু নিশ্চিত।আপনার তো হাতে পায়ে ব্যাথা।নতুনকরে নিশ্চয়ই পরে ব্যাথা পেতে চাননা?ভালো এটাই,একদম চুপ করে থাকুন।
রুদ্রর ক্ষুব্ধ কন্ঠে চুপসে গেলো সেঁজুতি। ভয় পেলো কী?এমনিতেই সারা গায়ে ব্যাথা।পায়ে তো আরও বেশি ব্যাথা।এমন অবস্থায় যদি সত্যিই নিচে ফেলে দেয় তবে এক সপ্তাহেও আর সোজা হয়ে দাঁড়ানো যাবেনা।কোলে যখন নিয়েইছে স্পর্শ টুকুতো আর ফেরত দেয়া যাবেনা।তার থেকে থাক বরং।
অভ্রর দায়িত্ব ছিলো বিল মেটানো।কাজ সেড়ে সে রুদ্রদের পিছু পিছু এলো।তার মনে হচ্ছে, টিকিট ছাড়াই সিনেমা দেখছে সে।যার হিরো রুদ্র, আর হিরোইন এই মেয়েটি।পাশাপাশি কিন্তু মানিয়েছে।একদম পার্ফেক্ট যাকে বলে।নিজের ভাবনায় ঠোঁট টিপে হাসলো অভ্র।ভাই জানলে তাকে উলটো করে ঝুলিয়ে পেটাতো নির্ঘাত।

রুদ্র সেঁজুতি কে গাড়িতে বসিয়েছে।নিজেও এসে বসেছে পাশে।সেঁজুতির দিকে চেয়ে বলল
‘সিট বেল্ট বাধুন।

সেঁজুতি এতক্ষন অন্যমনস্ক ছিলো।প্রথম দিকে তার খেয়াল না পরলেও আস্তে আস্তে লোকটার গায়ের গন্ধ ভীষণ চেনা লাগছিলো তার।আগেও পেয়েছে।একজনের সাথে মিলেছে খুব।কিন্তু কোথায় সে! আর কোথায় এই লোক।মেজাজী,কিন্তু ভালো লোক ইনি।কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেও হেল্প তো করছে তার।কিন্তু ওই লোকটা! না না ওই মানুষ টাকে নিয়ে ভাবা যাবেনা।তাহলেই সারা শরীরে সূচ ফোটার মতো যন্ত্রনা হয়।ঘিনঘিন করে।নিজেকে ঘেন্না লাগে।সেঁজুতির সাড়া না পেয়ে রুদ্র একি কথা আবার আওড়ালো।সেঁজুতি নড়ে উঠলো যেন।সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বলল, ‘ হ্যা? জ্বি বাধছি।
কিন্তু, বেল্ট নেড়ে চেড়ে হতাশ হলো সেজুতি।সে সিট বেল্ট বাধতে জানেনা।জানবেই বা কী করে? প্রাইভেটে চড়েছে কোনো দিন?সব সময় বাস,রিক্সা নাহলে সি এন জি।এদিকে সঙ্কোচে কথাটা লোকটাকে বলতেও পারবেনা সে।
কিন্তু রুদ্র ঠিক বুঝেছে।সেঁজুতির বেল্ট নেড়েচেড়ে দেখাতেই মাথায় ঢুকেছে কথাটা।অবাক না হয়ে পারলোনা।
‘ এখন কার মেয়ে কিনা গাড়ির সিট বেল্ট বাধতে জানেনা।
এগিয়ে এসে সেঁজুতির হাত থেকে নিয়ে নিজেই বেল্ট বাধলো।সেঁজুতি প্রথমে কাচুমাচু করলেও পরমুহূর্তে স্বাভাবিক হয়েছে।সবাই সব কিছু পারবে এমন কোনো কথা আছে নাকী?এই বলে নিজেকে সান্ত্বনাও দিয়েছে মনে মনে।রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিলে শা করে ছুটে চলল সেটি।
গাড়ির মধ্যে একটু শব্দও নেই।সেঁজুতি মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে আছে।চিন্তায় অবস্থা খারাপ তার।বাবা কি করছে জানেনা।সে বেরিয়েছে সেই সকালে।এখন বিকেল।দুপুরে খেয়েছেই বা কী? কথাতো ছিলো বাজার নিয়ে গিয়ে তারপর রাধবে। পথে এত কাহিনি ঘটবে কে জানতো!
সেজুথির দিকে একবার তাকিয়ে আবারও সামনের দিকে ফিরে তাকালো রুদ্র।এত সময়ের চড়া নীরবতা ভঙ্গ করে বলল,
,
কি লাভ এসব করে??
সেঁজুতি প্রশ্ন নিয়ে চোখ ঘোরালো রুদ্রর দিক।সে সামনে তাকিয়ে ড্রাইভ করছে তখনও।
‘ বুঝলাম না ঠিক।
,
আই মিন,,এভাবে নিজের লাইফ রিস্ক নিয়ে কাউকে বাচিয়ে কি লাভ হয় আপনার? পুরোটাই তো ক্ষতি।আজ তো আপনার খারাপ কিছুও হতে পারতো তাইনা?
রুদ্র তাকাতেই সেঁজুতি মুচকি হাসলো।রুদ্রর স্টিয়ারিং এ রাখা হাতটা কেঁপে উঠলো ঈষৎ।মনের তীব্র বিরোধিতা জানিয়ে বলল’ এ হাসি বড্ড বিশ্রী। সেঁজুতি তার রিনরিনে কন্ঠে বলল,
লাভ লোকসান বিবেচনা করলে কাউকে সাহায্য করা যায়না।সবসময় নিজেকে উহ্য মনে করেই পদক্ষেপ নিতে হয়।একটা মানুষ তার পরিবারের একমাত্র সাহারা হতে পারে।হতে পারে তার কাঁধে অনেক দায়িত্ব। আপনজন গুলো তার দিকে চেয়েই বেঁচে।কিংবা তার জীবনের মূল্য কারো কাছে অনেক বেশি।সেই মানুষ টা যদি আমার ওসিলায় একটা নতুন জীবন পায় আমি তাতে ধন্য। আর তাতে যদি আমার কিছু হয় এতেও আমার কোনো আক্ষেপ থাকবেনা।

রুদ্র অবাক হয়ে শুনলো।চেহারা ঢেকে থাকায় সেই বিস্ময় সেঁজুতির দৃষ্টি গোচর হয়নি।রুদ্র বলল
,
আর আপনার পরিবার?তাদের কি হবে?

সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ‘ আসলে যার আয়ু যতটুকু সে ততটুকুই বাঁচবে।আমার আপনার হাতে কি কিছু আছে?সব সৃষ্টি কর্তার হাতে যখন উনিই ঠিক ব্যাবস্থা করতেন।তাছাড়া আমার ভরসার একটা জায়গা আছে।সেটা হলো হোসাইন আঙ্কেল।উনি আর বাবা আপন ভাইয়ের মত।আমার কিছু হলে বাবাকে উনি দেখে রাখবেন।হয়ত সেই ভরসাতেই আমি এসব করার সাহস পাই।আমার তো বাবা ছাড়া কেউ নেই।কিন্তু আপনার নিশ্চয়ই একটা গোটা পরিবার আছে? বাবা মা…
এটুকু শুনতেই রুদ্র ধমকে বলল,
“চুপ করুন।আমি চাইছিনা আপনি আর কথা বাড়ান।
সেঁজুতি তাজ্জব বনে গেলো।একটা অপরিচিত মানুষকে এভাবে ধমকায় কেউ?মাথায় ছীট আছে নির্ঘাত।নাহলে নিজেই তো জানতে চাইছিলো।
হুট করে চেতে গেলো কেন? হুহ! বয়েই গেছে আমার ওনার সাথে কথা বাড়াতে।
রুদ্রর মুখ শক্ত হয়ে এলো।স্পিড বাড়ালো রাগে।মনে মনে আর্তনাদ করে বলল,
“কেউ নেই আমার।কেউ নেই।

‘এই গাড়ি থামান,, গাড়ি থামান।
হঠাৎ সেজুতির চিৎকারে ভাবনা থেকে ছিটকে পরলো রুদ্র।নিজেকে কোনও মতে সামলে তাড়াহুড়ো করে ব্রেক কষলো গাড়িতে।
‘কি হয়েছে?? এমন চেঁচালেন কেন?
,
আরে চেঁচাবো নাতো কি করবো আর একটু হলেই ও মারা পরতো

সেজুথির আঙুল বরাবর সামনে তাকালো রুদ্র।রাস্তার পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলো একটা ছোট্ট কুকুরছানা।রুদ্রর গাড়ির এত স্পিড দেখে ভয়ে দৌড় লাগিয়েছিলো।সেঁজুতি তো ভেবেই নিয়েছে বেচারা শেষ। রুদ্র ঠিক সময় ব্রেক না কষলে হতোও তাই।কিন্তু এটা রুদ্রর কাছে আহামরি লাগেনি।একটা সামান্য কুকুরছানাই তো।এমন ভাবে চেচালেন যেন উনিই চাকার তলে পরেছেন।মেজাজ তো আগেই তেঁতে ছিলো এবার বাকী ষোল কলাও পূর্ন হলো তাতে।
পাশ থেকে সেঁজুতি বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিলো।তুষ্ট কন্ঠে বলল,
‘যাক! বাবা আপনি সময় মতো ব্রেক করলেন নাহলে কি যে হতো,,বাচ্চাটা মারা গেলে ওর মা তো খুব কষ্ট পেতো।কুকুর তো কি হয়েছে মা তো মা -ই বলুন…
রুদ্র চোয়াল শক্ত করে তাকালো।কটমট করে বলল,
‘আপনাকে চুপ করতে বলেছিলাম না আমি?? আর একটা কথা বললে এবার গাড়ি থেকে ফেলে দেবো।
অপমানে মুখটা থমথমে হয়ে এলো সেজুতির।গাড়ি থেকে ফেলে দেবে?ক্ষেপে বলল,
— এই আমি কি আপনার গাড়িতে যেচে উঠেছি নাকি?? আপনিই তো নাঁচতে নাঁচতে আমায় গাড়িতে এনে বসালেন।এখন আবার গাড়ি নিয়ে খোঁটা দিলেন?যাবোনা আমি আপনার গাড়িতে।এক্ষুনি নেমে যাবো আমি,
খুলুন এটা,,,খুলছেনা তো।দরজা টেনে খোলার অনেক চেষ্টা চালিয়েও লাভ যখন হলোনা তখন রুদ্রর দিকে তাকালো সেঁজুতি। সে মন দিয়ে ড্রাইভ করছে।পৃথিবীতে এটাই একমাত্র তার কাজ এখন।
সেঁজুতি ফোসফোস করে বলল ‘ কি করেছেন আপনি? দরজা খুললনা কেন?
রুদ্রর নিরুদ্বেগ উত্তর
‘লক করে দিয়েছি। সুতরাং আপনি আর বেরোতে পারছেন না যতক্ষন না আমি চাইছি।তাই এখন চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া আপনার কাছে আর কোনও অপশন নেই।

চলবে….

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী 🍁

পর্ব-৯
ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হুইল চেয়ার চালাচ্ছেন আমির।দুই বারান্দায় পরপর উঁকি ঝুঁকি মারছেন।এই বুঝি মেয়েটা এলো।কখনও ঘড়ির দিকে তো কখনো খোলা সদর দরজার দিকে তাকাচ্ছেন।,ছয় ঘন্টা গড়িয়ে সাতে পরলো সেঁজুতি ফেরার নাম নেই।হোসাইনের সাথে দেখা করতে গিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু এত সময় কি করছে ও? গেলো তো বাজারে।এসে তো রান্না করবে।বিকেলে পড়াতে যাবে।সেসব রেখে হাসপাতালে কি করছে?ওর বাবা বাসায় একা এতটা সময়, মেয়েটা জানে।আমিরের মন মানছেনা।তার মেয়ে নির্ঘাত বিপদে পরেছে।হাসপাতাল শুনলেই মনের মধ্যে কু ডাকে।তার ও হয়েছে তাই।মেয়েটা আমার এত কান্ডজ্ঞানহীন নয়।এ নিশ্চয়ই বিপদের লক্ষন। মেয়ের চিন্তায় নাওয়া খাওয়া সব তোল্লায় উঠেছে তার।আমির আবার ছুটলো ঘরের দিকে।হোসাইন কে ফোন করতে হবে।
গত দুবার লাইন পায়নি।ব্যাস্ত ব্যাস্ত ব্যাস্ত।এইতো এবারও লাইন ব্যস্ত।আমির চিন্তায় জুবুথুবু একদম।এই একটি মাত্র মেয়েই তার সব।পরিবার পরিজন তো কবেই পর হয়েছে।প্রিয় মানুষ টাও নেই দুনিয়ায়।এই মেয়ের কিছু হলে সে বাঁচবে?আমির হতাশ হলোনা,আরো একবার হোসাইনের নম্বরে কল দিলো।যাক লাইন পেয়েছে এবার।
,
হোসাইন মাত্রই পেশেন্ট দেখে ফ্রি হলেন।আমিরের এত্ত গুলো কল দেখে তার বুঝতে বাকি নেই। সেঁজুতি তো বের হলোই কিছুক্ষন।এখন সে কী বলবে? এই বাবা মেয়ের অতিরিক্ত ভালোবাসা তার ভালো লাগে,কিন্তু মাঝে মাঝে বিপদেও পরতে হয় তাকেই।এই যেমন এখন পরলো। হোসাইন ফোন রিসিভ করতেই আমির ছটফটে পাখির মতো বললেন,
“হ্যালো হোসাইন,,সেজুথি কোথায় রে? ওকি এখনও তোর কাছে?
হোসাইন গলাটা পরিষ্কার করে জবাব দিলো,
— ওতো অনেক ক্ষন আগেই বেরিয়ে গেলো,,পৌছায় নি?
— বেরিয়েছে? কই না এখনও আসেনিতো।
— চিন্তা করিস না এতো। এসে যাবে।ওতো আর বাচ্চা সেজুতি নেই তাইনা।
— হু।আচ্ছা, ঠিক আছে। রাখছি।

হোসাইন চিন্তা করতে মানা করলেন।কিন্তু বাবার মন কী আর মানে?আমির আগের মতোই শান্ত হয়ে ডুব দিলেন চিন্তায়।চোখের কোনা চিকচিক করে উঠল। নিজেকে আজ অসহায় লাগছে।এতটা অসহায় মনে হচ্ছে কপাল চাপড়ে কাঁদি।আজ পঙ্গু নাহলে এভাবে হাত গুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে হতোনা।মেয়েটার ও এত খাটুনির প্রয়োজন পরতোনা তখন।পা হীন জীবন অনেক টা মরার মতই মনে হচ্ছে এখন।এরকম বাবার বেঁচে থেকে লাভ কী? যে নিজের মেয়ের বিপদে একটু সাহায্য করতে পারলোনা।বিষন্ন মন নিয়ে আমির থম মেরেই বসে রইলো ঘরে।
______
বাবা নিশ্চয়ই এতক্ষন না খেয়ে আছে!থাকবেই তো আমাকে ছাড়া কখনও খেয়েছে?ইশ!বাবার ওষুধ সব মিস হয়ে গেল।
গাড়ি ব্রেক কষলো ভীষণ জোরে।সেঁজুতি সামনে ঝুকে পরলো কিছুটা। বিরক্তি নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালো। আর জবাবে রুদ্র বলল,
,
নামা উচিত,এসে গেছি।
সেঁজুতি বাইরে তাকালো।গাড়ি তাদের বাসার সামনেই।লোকটাকে কী বাড়ির ঠিকানা বলেছিলো সে? কই মনে তো পড়ছেনা।তাহলে কি করে চিনলেন? হয়ত হোসাইন আঙ্কেল বলেছেন।
কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বের হতে নিলেই খপ করে ওর হাতের কনুই টেনে আটকালো রুদ্র।সেঁজুতি হকচকিয়ে তাকালো।
— গাড়ির দরজা তো খুললেন,একা একা হেটে যেতে পারবেন তো,?
সেঁজুতির মন টা খারাপ হলো মুহুর্তেই।আসলেই তো, পায়ের ব্যাথার কথা টা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু যেতে হলে এই লোকটার কোলে আবার উঠতে হবে। না। ওঠা যাবেনা।না মানে না।
— পারবো…
রুদ্র সন্দেহী কন্ঠে বলল,
— পারবেন??
— হ্যা,,
— ওকে।তাহলে নামুন।
রুদ্র তড়িৎ গতিতে বেরিয়ে গেলো। ঘুরে এসে সেজুথির পাশের দরজা খুলে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো আরেকদিক।
,
ভাব দেখলে বাঁচিনা।
মনে মনে রুদ্রর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে পা কোনও রকম বাইরে নামালো সেঁজুতি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে এক আকাশ চমকে দিয়ে কোলে ওঠালো রুদ্র।সেঁজুতি ভঁড়কালো বটে।সাথে রাগ ও হলো।কোলে উঠবেনা উঠবেনা করেও উঠতে হলো শেষ মেষ!
,
বলেছিলাম তো হাটতে পারবো,,
রুদ্র বাঁকা হাসে,বিদ্রুপের হাসি।
‘আমি জানি কার দৌড় কতটা!
— লোকটা কি আমাকে অপমান করলো( মনে মনে)
সিড়িতে রুদ্রর গটগট বুটের শব্দ শেষ হলো সেঁজুতি দের ফ্ল্যাটের সামনে এসে।দরজা হা করে খোলা।রুদ্রর এতে সুবিধেই হয়েছে।সেঁজুতি কে কোলে নিয়ে একদম ভেতরে ঢুকলো সে।সেঁজুতি এতক্ষন উশখুশ করছিলো। ভয়,লজ্জ্বায় সিটিয়ে আসছিলো।এরকম একটা পুরুষ মানুষের কোলে তাকে দেখলে বাবা কি ভাবতে পারে সেই চিন্তায় শুকিয়ে চাচ্ছিলো গলাটা।সিড়িতে অনেকবার ভেবেছিলো লোকটাকে নামিয়ে দিতে বলবে।কিন্তু নিজেও বা উঠবে কিকরে? সেই ভেবেই বলেনি আর।অথচ বসার ঘরে বাবাকে না দেখে এতক্ষনের আটকে রাখা দম ফেলল সেঁজুতি। রুদ্র তাকে সোফায় বসিয়েছে।নিজে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই বলল, “আপনার বাবাকে ডাকুন।

রুদ্র না বললেও সেঁজুতি ডাকতো।বাবাকে দেখার জন্য তার মন আঁকুপাঁকু করছে।রুদ্রর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ডাকলো,
‘ বাবা! ও বাবা…
সেঁজুতির এতক্ষনের কন্ঠস্বরের সাথে এই ডাকের কোনো মিল পেলোনা রুদ্র।এত টা আদুরে আহ্লাদী গলা এমন ধেড়ে মেয়ের হয় বুঝি?অথচ হাসপাতালে কি ঝাঁঝ ছিলো গলায়।কি যেন বলছিলো? আজব মানুষ আপনি! তাইতো, রুদ্রতো একটা আজব মানুষই।নাহলে অফিসের গাদা গাদা কাজ ফেলে কেউ একটা মেয়ের সাথে আসে? তাকে বাসায় দিয়ে যেতে?

ওদিকে সেঁজুতির ডাক শুনেই উদ্ভ্রান্তের মতোন ছুটে এলেন আমির।সেঁজুতির ফোনে কল করতে করতে হাপিয়ে উঠছিলো সে।সেতো আর জানেনা,মেয়েটা ফোন সাইলেন্ট করে বালিশের নিচে রেখে গিয়েছে।
আমিরের সবার আগে চোখ গেলো লম্বাচওড়া রুদ্রর দিকে।চিনতে পারলোনা।ভ্রু কুঁচকে পরক্ষনে মেয়ের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন একেবারে।
মেয়ের মাথায় ইয়া বড় ব্যান্ডেজ।গালেও ব্যান্ডেজ।আমিরের মাথা ঘুরে এলো।বুক কাঁপলো।ঠিক ধরেছিলো মেয়ের একটা বিপদ হয়েছে।নাহলে তার মেয়ে কীনা এমন করবে? এ তাকে মেরেধরেও কেউ বিশ্বাস করাতে পারবেনা।
,
একী! তোর মাথায় ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে তোর? ঠিক আছিস? আমি ঠিক জানতাম তোর কিছু একটা হয়েছে। দেখলিতো এত ছটফট করিস সারাদিন।উফ বলেছিলাম সাবধানে থাকতে।
আমির ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললেন।রুদ্র এক ধ্যানে চেয়ে থাকলো ওনার দিকে।তার ভেতরটা পুড়ছে খুব।কিছু একটার অভাব বোধ হচ্ছে ভীষণ। কিসের? বাবার এমন আদরের?

সেঁজুতি ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বলল,
“বাবা কিচ্ছু হয়নি আমার।একটা ইটের সাথে হোঁচট খেয়ে পরে গেছিলাম।আর তাতেই অল্প কেটে গিয়েছে।সেজন্যেই না আঙ্কেলের কাছে গেলাম। উনি ব্যান্ডেজ করে দিলেন।ব্যাথার ওষুধ ও দিয়েছেন।বলেছেন এত্ত চিন্তার কিচ্ছু নেই।তুমি না বলো তোমার ওষুধ খেতে ভালো লাগেনা? এবার থেকে বাপ মেয়ে মিলে একসাথে ওষুধ খাব কেমন?

আমির ঠান্ডা হলেন বোধ হয়।সাদা গজের ওপর থেকে ভেতরের ক্ষতটা ঠিক ধরতে পারেননি।সেখানে হাত বোলালেন।নরম কন্ঠে বললেন,
” অনেক ব্যাথা পেয়েছিলি?

সেঁজুতি বাবার হাতটা মুঠোয় নিয়ে বলল,
‘ কি যে বলোনা।এইটুকু চোটে কেউ ব্যাথা পায়? আমিতো ব্যান্ডেজ করাতেই চাইনি।তুমিতো আঙ্কেল কে চেনো। ধরে বেঁধে ঠিক করিয়ে ছাড়লেন।শুধু ওই যে হোচট খেলাম,তাই পায়ে ব্যাথা করছে খানিকটা। একটা পেইন কিলার নিলে তড়াক করে লাফাবো আবার।দেখো।

,
এই আপনি মিথ্যে কেনো বলছেন?? কেনো লুকোচ্ছেন সবটা?সত্যিটা বলুন।
সেঁজুতির দিকে এতক্ষন নাক মুখ কুঁচকে চেয়েছিলো রুদ্র।কি গুছিয়ে মিথ্যে বলে মেয়েটা।শেষ অব্দি আর নিতে পারলোনা।
সেঁজুতির চোখ কপালে উঠে গিয়েছে।আমির ঘাঁড় ঘুরিয়ে পেছনে রুদ্রর দিকে তাকালো।তখন একে নিয়ে মাথা ঘামায়নি মেয়ের চিন্তায়।এতক্ষনে খেয়াল পরতেই ভ্রু কুঁচকে বলল
আপনি? আর কীসের সত্যির কথা বলছেন?
বাবার পেছন থেকে সেঁজুতি ক্রমাগত হাত জোর করছে রুদ্রকে।চুপ হতে ইশারা করছে। আরো যত রকম অনুরোধ করা যায় সব করা শেষ তার। অথচ লোকটার মন গললো কী?সেতো চেহারা দেখার ও উপায় ছাড়েনি।

সেঁজুতির অনুরোধ রাখার প্রয়োজন অনুভব করলোনা রুদ্র।কিছু ক্ষন থেমে বলল,
“আমি কে সেটা না হয় পরে জানলেন।আগে আসল ব্যাপার টা আপনার শোনা উচিত,,আপনার মেয়ে আপনাকে মিথ্যে বলছে…
আমির মেয়ের দিকে তাকাতেই সেঁজুতি মূর্তি বনে গেল।এতক্ষন যে হাত মুখ ছুড়ে রুদ্রকে অনুনয় বিনুনয় করলো তাতে কাজ হয়নি।
আমির তাকিয়ে চোখ ছোট করলেন।
— উনি মজা করছেন বাবা।
সেঁজুতি হাসার চেষ্টা করলো।
‘আপনি কেনো বাবার সাথে এমন মজা করছেন বলুন তো?চুপ করে থাকুন না।
শেষ টুকুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল রুদ্রর দিক চেয়ে।

রুদ্র অবিশ্বাসের সুরে বলল,
মজা করছি?আপনার তাই মনে হচ্ছে?
!
— না আমি করছি।হয়েছে,?
আমির এবার ধৈর্য চ্যুত হলেন।
— কি শুরু করলি?আমাকে একটু সব টা পরিষ্কার করে বলবি?

সেঁজুতি তাড়াহুড়ো করে বলল,
— না বাবা।পরিষ্কার ভাবে আর কিছু বলার নেই।তোমাকে আমি বলে দিয়েছি। আর কিচ্ছু তোমার শুনতে হবেনা।আর উনি কে সেটা জিজ্ঞেস করছিলে না?উনি আমার পরিচিত।না। ঠিক অপরিচিতের মতন পরিচিত।আমাকে এগিয়ে দিতে এসেছেন।

আমির বুঝতে না পেরে বললেন,
— অপরিচিতের মতন পরিচিত?সেটা আবার কী রে?
সেঁজুতি হাত নেড়ে নেড়ে বলল,
— আমি বোঝাতে চাইছি হোসাইন আঙ্কেলের পরিচিত তাই আমার ও পরিচিত।বুঝেছো?
.
রুদ্র এলোমেলো দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।এই মেয়েটা সত্যি কথা টা বলবে না বলে কত্তগুলো মিথ্যে বলল।যাস্ট আউট অফ থিংকিং।এমন ভাব করছেন যেন ওনার বাবা টের পাবেন না।একই বাসায় থেকে কেউ লুকিয়ে রাখতে পারে এসব?বোকা নির্বোধ মেয়ে একটা।
আমির রুদ্রকে বললেন,
এই দেখুন আপনি সেই তখন থেকে দাড়িয়ে আছেন। বসুন না।আমি দেখি একটু চায়ের ব্যাবস্থা করি।

আমির যেতে নিলে সেঁজুতি থামালো।” তোমাকে যেতে হবেনা।আমি যাচ্ছি।
রুদ্রর হাসি পেল।যে মেয়ে বাসায় এলো অন্যের কোলে চড়ে।সে কীনা এখন চা বানাবে।
আমির বললেন’ না না তুই না বললি পায়ে ব্যাথা, তুই বসে থাক।ওটুকু আমি পারব।

বাবা মেয়ের চা বানানোর প্রস্তুতিতে জল ঢাললো রুদ্র।হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল ” আপনাদের কাউকেই কিছু করতে হবেনা।
আমার আর্জেন্ট মিটিং রয়েছে।আমাকে যেতে হবে এক্ষুনি।
‘ সেকি বাবা! একবারে খালি মুখে যাবেন?একটু বসুন।
রুদ্রর কপালে ভাঁজ পরলো।
এমন ভাবে কথা বলছে যেনো শ্বশুর বাড়ি এসছি।
অথচ ধীর স্থির গলায় বলল
আমার খাওয়ার সময় নেইম
আই হ্যাভ টু গো।চলি…
কাউকে আর কিছু বলতে দিলোনা।যেতে যেতে একবার সেঁজুতি কে দেখলো।বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো তারপর । সেদিক তাকিয়ে সেঁজুতি বিরবির করলো” লোকটা কী অদ্ভূত!
_________
বিছানার ওপর হাত পা মেলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে অভ্র।তার সারপ্রাইজ হওয়ার ধকল টা এখনও কাটেনি।এক্ষুনি আ্যাটাক ফ্যাটাক করে ফেলতে পারে।কিছুক্ষন আগে হাসপাতালের ওই ঘটনায় সেতো বোবা বনে গেছিলো।তাও নিজেকে সামলে হেলেদুলে পৌঁছে ছিলো বাসায়।হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসবে তখনি মিস সুভা কল করলেন।অভ্র তখনও বোঝেনি সে কী শুনতে চলেছে।এরপর যা শুনলো তাতে খাবার আটকে গলায় লাফাচ্ছিলো তার।ঝুলছিলো পেটে যাওয়ার আগের জায়গাটুকুতে।
রুদ্র নাকী বলেছে আর কোনো মেয়েই আসবেনা হোটেলে।এখন থেকে হোটেলে তার নারীসঙ্গ সমাপ্ত। সাথে একটা সাইনবোর্ড ও টানাতে বলল যেখানে লেখা থাকবে ‘
“”নো এন্ট্রান্স অফ গার্লস “”
মানে মেয়ে মানুষের ঢোকা বন্ধ! আসলেই কি তাই? অভ্র ভেবে পেলোনা।এ যে অবিশ্বাস্য।অবিশ্বাস্য।অবিশ্বাস্য।অভ্র বেশ কবার একি কথা আওড়ালো।ভাইয়ের বয়স যখন ২০ বছর তখন থেকেই তার এই নারী সঙ্গ।মানে কি দাঁড়ায়? বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বাসর সেড়েছে ছেলেটা।আর এখন চলছে ২৯। টানা নয়টা বছর নারীদেহের ঘ্রান নিয়ে যার রাত কাটে সে কীনা দুদিনের মাথায় সেসব ছেড়ে দেবে? কী এমন ঘটলো।হুট করে কি হলো যে একেবারে সব বন্ধ,কাল রাতেও একটা মেয়েকে পাঠাতে বলল
একটু পর তাকে বার করেও দিলো।সত্যিই রুদ্রকে জ্বীনে ধরলো নাতো! ব্যাস এটুকু ভেবেই অভ্র চিৎপটাং হয়ে পরলো বিছানায়।খাওয়ার দফারফা তার।আপাতত শক খেয়ে খেয়ে দিন কাটাবে।রুদ্র দেবে সে খাবে।
অভ্রর হঠাৎ খারাপ লাগতে শুরু করলো।না রুদ্রর জন্যে নয়।ওই মেয়ে গুলোর জন্যে।অনেক মেয়ে টাকার লোভে এলেও কেউ কেউ ভাইয়ের ওপর ক্রাশ খেয়েও আসে।কী হবে ওদের?
অভ্র এত ভাড় সইতে পারলোনা।তার মাথাটা অধিক ছোট। এত কিছু একসাথে আঁটে? এর থেকে ভালো সে নিজে গিয়ে রুদ্রকে শুধাবে।দু চারটে ধমক খেলেও খাবে।কিন্তু জেনেই ছাড়বে আজ।
অভ্র সোজা গিয়ে রুদ্রর রুমে উঁকি দিলো।দরজা ভেজানো ছিলো।মাথাটা তার মধ্যে থেকে ঢুকিয়েই রুমের দিক তাক করলো অভ্র।রুদ্রর দেখা মিলল কাউচের ওপর। সামনে মদের বোতল আর গ্লাস।ঢালছে আর খাচ্ছে।ঢকঢক শব্দ হচ্ছে।অভ্র মাথা চুল্কালো।
,
ভাইয়ের আবার কি হলো?? ভাইয়ের তো মন খারাপ না থাকলে ড্রিংক করেনা।ভাইয়ের কী এখন মন খারাপ? আমি কি যাব ভেতরে? যদি মাথা গরম হয়?তুলে আছাড় দেবেনাতো?
দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে “ভাই বলে ডাকলো অভ্র।এক ডাকেই রুদ্র তাকালো।কি টকটকে লাল চোখ দুটো।কেঁদেছে নাকী?অভ্রর মস্তিষ্ক বিচলিত হলো মুহুর্তেই।ভয় টয় ঝেড়ে, দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে এলো।

,
কি হয়েছে ভাই??
রুদ্র হাতের গ্লাশ টা শব্দ করে রাখলো। অদ্ভূত কন্ঠে বলল ‘ বুঝতে পারছিনা।খালি মনে হচ্ছ আমি ঠিক নেই।আমি ভালো নেই।আর মনে হচ্ছে ও তার ওষুধ।ওকে ছুঁয়েছি,ধরেছি।সেসব মনে করে করে ভেতর ভেতর আরো ভেঙে যাচ্ছি আমি।এরকম তো কখনোই হয়নি অভ্র।ওর বেলায় কেন হচ্ছে?কেমন অদ্ভূত টান একটা। বুঝে উঠিনা আমি।

আগামাথা কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা অভ্র।মাথামুণ্ডু ছাড়া কথা, রুদ্র বলেনা।বলেছে যখন নিশ্চয়ই এর একটা মানে আছে।কিন্তু এমন শক্ত মানে টা তার নিরেট মাথায় ঢুকবে বলে মনে হয়না।রুদ্র লাগাতার মদ খেয়েছে এতক্ষন।গলা জ্বলে যাচ্ছে এখন।গলার টাই ঢিলে করে সোফায় মাথা এলালো সে।অভ্র অনেকক্ষন ভাবলো।মন দিয়ে ভেবে দেখলো।না তাও কিছু খুঁজে পেলোনা যখন, তখন রুদ্রর দিকে তাকালো।জামাকাপড় ও পাল্টায়নি।
রুদ্রকে উঠিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো অভ্র।মদের বোতলের ছিপি আটকে রেখে দিলো রুমের মিনি ফ্রিজে।এটো গ্লাস টা ফেলল ডাস্টবিনে।রুদ্রর বুক সমান কাথা টেনে যেতে যেতেই মৃদূ স্বরে ডাকলো রুদ্র।
‘অভ্র! ভাই আমার..

রুদ্রর নেশার্ত কন্ঠে এত সুন্দর ডাক শুনে অভ্রর মন প্রান জুড়িয়ে এলো।রুদ্র তাকে কতটা ভালোবাসে সে জানে।কিন্তু কিছু মানুষের ওপর টা ঝিনুকের খোলসের মতন শক্ত হয়।তারা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনা।রুদ্র হচ্ছে অনুরুপ।অভ্র ধীর পায়ে গিয়ে রুদ্রর মাথার কাছে বসলো।রুদ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিছু লাগবে ভাই?

রুদ্র নড়েচড়ে উঠে থেমে গেলো।অভ্র ভাবলো ঘুমিয়েছে।নিঃশ্বাস ফেলতে না ফেলতেই রুদ্র ঘুমু ঘুমু আওয়াজে বলল
-আপনি আর আমার সামনে আসতে পারবেন না।সব রাস্তা আমি বন্ধ করে দিলাম।আপনাকে আমি আর ছোঁবোনা। কিছুতেই না।আপনাকে ছুঁলে কেমন ধুক করে ওঠে বুকটা।আজব আজব লাগে।আপনি চাইলেও আমার কাছে আর আসতে পারবেন না।বিছনার ওপর বসে থাকবেন না।সব বন্ধ করে দিয়েছি আজ।সব।মিস সেঁজ…
এটুকু বলেই রুদ্র চুপ মেরে গেলো।ভেসে এলো ভারী নিঃশ্বাস।
কিছুক্ষন বোকার মত তাকিয়ে থেকে মাথা চুল্কালো অভ্র।ভাই ঘুমিয়ে পরেছে।কি যে বলে গিয়েছে মাথা ফুটো করে চলে গেল একদম।কিন্তু এই আপনি টা কে?
_____
রুদ্রর ঘুম ভাঙলো বেলা করে।উঠে বসলো শোয়া থেকে।মাথা এরকম ঝিম ঝিম করছে কেন?ভ্রু দুটো ব্যাথা ব্যাথা করছে।কাল রাতে প্রচন্ড মদ খাওয়ার ফলাফল। রুদ্র উঠে প্রথমেই এগোলো বাম আনতে।ব্যাথা না কমলে আজ কোনো কাজই করতে পারবেনা।দুদিনে অনেক কাজ জমেছে তার।কতগুলো ফাইল যে ঘেটেঘুটে দেখা বাকী।টেবিলের ড্রয়ার টানলো রুদ্র।বাম পেলোনা।এখানেই তো থাকে।সার্ভেন্টস তো হাত দেয়না এখানে।গেলো কোথায়?রুদ্র খুজলো খানিকক্ষন। তার খোজা মানেই পুরো ঘরে টর্নেডো আসা। অল্প একটু খুজেই হাপিয়ে গিয়ে চিল্লিয়ে সার্ভেন্টস ডাকলো। হঠাৎই চোখ আটকালো টেবিলের ওপর রাখা কাগজের মত কিছুতে।রুদ্র বামের চিন্তা বাদ দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলো সেটা।

— শীট! শীট! এটা তো মিস সেজুথির প্রেস্ক্রিপশন ছিলো,,আমি দিতে একদম ভুলে গিয়েছি।

চলবে….

প্রনয় পর্ব-৬+৭

0

# প্রনয়
# নুসরাত সুলতানা সেজুতি
# পর্ব- ৬+৭

সেজুতিদের বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা এসে গাড়িতে বসেছে রুদ্র।এলাকাটা বেশ নিরিবিলি।বিল্ডিং টার সামনে গাছ লাগানো অনেক।এত গরমে এরকম বৃক্ষ ছায়া শান্তিদায়ক হলেও রুদ্রর সে শান্তি উপভোগ করার সময় নেই।আর না আছে আগ্রহ।সে জানলা আটকে এসি অন করলো।গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবলো,
— মেয়েটার বাবার পা নেই.. কোনও কাজ করতে পারেনা,তার মানে মেয়েটাই কিছু না কিছু করছে।
ব্যাপারটা ভাবতে গেলে এটাই বোঝা যায় যে,,, “দে নিডস মানি।অথচ আমার পাঠানো টাকা গুলো ফেরত দিলো।সেটা একবার নয় বরং দু,, দু বারর।কেন?কী কারন? সো কল্ড সেল্ফ রেস্পেক্ট? হাহা..
রুদ্র নিজেই হাসলো।তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘আজকাল কার মেয়েদের আবার সেল্ফ রেস্পেক্ট। এরা টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে?আর তার উদাহরণতো আমার হোটেলে আসা প্রত্যেকটা মেয়ে।পুরোনো দিনের জমিদাররা নাকী মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত।এক রাত রেখে ফেরত দিতো আবার।অনেক মেয়ে সন্মান হারিয়ে আত্মহত্যাও করতো।এরকম মেয়েদের মাথা নুইয়ে সন্মান করা যায়।অথচ এখনকার মেয়েগুলোকে দেখো।তাদের কী তুলে আনি আমি?না।উলটে তারাই এসে ভীড় জমায় আমার সাথে থাকার জন্যে।এক রাত থেকে পাঁচ লাখ টাকা কামানোর মত সুজোগ কোনও মেয়েই হাতছাড়া করতে চায়নাযে!লোভী একেকটা।
আচ্ছা কোনও ভাবে কি এই সেঁজুতি মেয়েটার টাকার পরিমান কম হয়ে গিয়েছে।অভ্র কত টাকা দিয়েছে সেটাতো জানা হয়নি। যদি কম হয় তবে… বাড়িয়ে দেব।ডাবল দেব আমি,কিন্তু কোনও মেয়ের দান নিয়ে রুদ্র রওশন বাঁঁচবেনা।
পরমুহূর্তে মাথায় একটা কথা আসতেই রুদ্র তুষ্ট হাসলো,
ও ওয়াও, মিস সেজুথিকে নিয়ে ভাবতে গিয়ে হোটেলের সেই মেয়েটার কথা আমার একবারও মনে পড়েনি ব্যাপার টা খুব একটা খারাপ হয়নি।,এমনিতেই সেই মেয়েটা আমার মাথা চিবিয়ে খাচ্ছিলো। পরের বার পাই,,বারবার আমার সামনে আসা একেবারে ঘুচিয়ে দেবো।রুদ্রকে জ্বলন্ত অগ্নীশিখা।তাকে ধরতে এলে যে নিজেকেই পুড়তে হবে।
হূট করে মাঝরাস্তায় গাড়ি থেমে গেলো রুদ্রর।বার বার স্টার্ট করলেও লাভ হচ্ছেনা।রুদ্র বিরক্ত হয়ে নেমে এলো।গাড়ির সামনের ডিকি খুলেও বুঝে উঠলোনা কিছু।অনেকক্ষন খুটিয়ে খাটিয়ে দেখে বুঝলো ইঞ্জিনের দুরাবস্থা।

— আজকেই ড্রাইভার ছাড়া বেরিয়েছি আর আজকেই এই অবস্থা.. ডিজগাস্টিং!
রুদ্র গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো।অভ্রর নাম্বারে দুবার ডায়াল করার পরে ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করলো সে…
— কোথায় থাকিস তুই,,কতবার কল করতে হয়??
— স্যরি ভাই,,শাওয়ার নিচ্ছিলাম..
,
শোন আমার নিয়ে আসা গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে.
আমি তোর ফোনে লোকেশন পাঠাচ্ছি,ইমিডিয়েট কাউকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দে…
,
ওকে ভাই…. আমি পাঠাচ্ছি।

দশ মিনিট হলো গাড়ি আসার নাম নেই।অবশ্য আসার কথাও নয়।রুদ্রর বাড়ি থেকে সেঁজুতির বাসা অনেকটা দূরে।কিন্তু কড়া রোদে রুদ্রর পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্কর।ওদিকে গাড়ির এসিও বন্ধ।ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠছে রোদের তাপে।মেজাজের অবস্থাও দফারফা। এভাবে কারো জন্যে কখনো অপেক্ষা করেছে নাকী? অনেককে করিয়েছে।রুদ্র আবার মুবারক কে কল দিলো।এবারেও তার একই কথা, ‘স্যার আসছি আমি,আর কিছুক্ষন লাগবে.

রুদ্র রেগেমেগে ফোন কাটলো।আরো খানিকক্ষণ পরে মুবারক কল দিলো তাকে।রুদ্র কিড়মিড়িয়ে বলল,
— কোথায় তুমি ড্যামেট…এভাবে কতক্ষন এই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি??

— স স্যার আ.. আ সলে গাড়ি জ্যামে আটকে গিয়েছে.. আমি রাস্তার উল্টো পাশেই আছি,,কিন্তু জ্যামের কারনে গাড়ি ঘুরিয়ে আনতে পারছিনা।
রুদ্র পেছনে তাকালো।ওইতো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তার।আসলেই বিশাল জ্যাম।অথচ এই রাস্তায় চলছে।ঢাকা শহরের কী একটা অবস্থা।রুদ্র শ্বাস ফেলে বলল
— ঠিক আছে তুমি ওখানেই গাড়ি সাইড করো,,আমি আসছি।
ফোনের লাইন কেটে রাস্তা পার হওয়ার জন্যে এগোলো রুদ্র।সচরাচর নিজের গাড়িতে যাতায়াত করার কারনে এই অভ্যাস নেই বললেই চলে।শেষ কবে রাস্তা হেটে পার হয়েছে মনে নেই।
তাই খুব একটা সুবিধে করে উঠছেনা।রাস্তার গাড়িগুলো কি স্পিডে ছোটে এই প্রথম আন্দাজ করলো রুদ্র।জান হাতে নিয়ে পার হতে হয় দেখছি। যার একটা ধমকে তটস্থ থাকে গোটা ধানমন্ডি সে কীনা রাস্তা পার হতে রীতিমতো হিমশীম খাচ্ছে?
____
আরে,,এই যে গাড়ি আসছে তো সরে যান,,এই যে শুনতে পাচ্ছেন।
পেছন থেকে অনবরত চেচিয়ে যাচ্ছে সেজুতি।হাতে তার বাজারের ব্যাগ।পুঁইশাকের লতানো ডগা টা বেরিয়ে আছে সেখান থেকে।
ফেরার পথে কাউকে এমন ঝুকিপূর্ণ ভাবে রাস্তা পার হতে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।হুট করে লোকটার অন্য দিক থেকে গাড়ি আসতে দেখেই চেচিয়ে যাচ্ছে তখন থেকে।কিন্তু এই লোকের কান নেই।চেঁচিয়ে গলা ভাঙলেও শুনছেনা।এত গাড়ির শব্দে,, সেজুথির বলা কথাগুলো কান অবধি পৌছাচ্ছেনা রুদ্রর।সেতো রাস্তা পার হতে গিয়ে হাবুডুবু খাওয়ার মতো দশা।রুদ্রর হঠাৎ চোখ পরলো তার দিকে একটি গাড়ি খুব হাইস্পিডে এগিয়ে আসছে।
কিন্তু সরে যাওয়ার আর উপায় নেই।অনেকটা দেরী।তবে কী এখানেই মৃ/ত্যু? রুদ্র রওশন চৌধুরী রাস্তা পার হতে গিয়ে ম/রবে! নিউজ আসবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন রুদ্র রওশন চৌধুরী। সত্যিই মৃ/ত্যূ এভাবে আসবে জানা ছিলো কী?রুদ্র প্রস্তুতি নিলো ম/রা/র।গাড়ি কাছাকাছি আসতেই হুট করে কারো ধাক্কায় রাস্তার পাশে পরলো ছিটকে।পিচের সাথে কপাল ঠুকে গেলো।
টনটন করে উঠলো জায়গাটা।ছিলে গিয়েছে।কপাল চেপে ধরে সামনে তাকালো রুদ্র।কে ধাক্কা দিলো তাকে?সে কী বেঁচে গেলো তবে?তার থেকে খানিকটা দূরে র/ক্তা/ক্ত অবস্থায় পরে আছে একটি মেয়ে।পাশেই সব্জির ব্যাগটা লুটোপুটি খাচ্ছে।ধাক্কা দেয়া গাড়িটাও নিয়ন্ত্রন হারিয়ে কারেন্টের খাম্বার সাথে বাড়ি লেগেছে।তার কী অবস্থা রুদ্র জানেনা।মেয়েটি তাকে বাঁচিয়েছে সেটুকুনিই শুধু ঢুকেছে মাথায়।রুদ্র উদ্ভ্রান্তের মত সেদিকে ছুটে গেলো।ঝাপসা চোখে কাউকে নিজের দিকে ছুটে আসতে দেখলেও স্পষ্ট ভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো সেজুতির।মনে মনে শুধু প্রার্থনা করলো সে যেন বেঁচে থাকে।নাহলে বাবার কী হবে?

রুদ্র কাছে এসে হাটু মুড়ে বসে সেঁজুতি কে নিজের দিকে ফেরালো।মুহুর্তেই শিরদাঁড়া ঠান্ডা হয়ে এলো তার।আশেপাশে লোকজনের ভীড়। গাড়িগুলো যেতে না পেরে বিশাল জ্যাম বেধেছে এপাশেও।
‘আরে এটা?? এটাতো সেই হোটেলের মেয়েটা…..
ওহ শীট আমাকে বাচাতে গিয়ে নিজেই গাড়ির নিচে পরে গিয়েছে।
মুবারক কোনও মতে গাড়ি নিয়ে আসতে পেরেছে।রুদ্রর গাড়ির নিচে পরতে পরতে বেঁচে যাওয়ার দৃশ্য দেখেই সে গাড়ি নিয়ে এক প্রকার উড়ে এলো।
— স্যার আপনি ঠিক আছেন তো?

রুদ্র উত্তর দিলোনা।সেজুতির গাল গলা হাত সব কেটেছে।সেখান থেকেই রক্ত পরছে অনর্গল। অচেতন সেজুতিকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে উঠলো রুদ্র।,সেজুথির মাথা নিজের কোলে রেখে মুবারক কে বলল,
‘এখানেই যে হাসপাতাল টা আছে সেখানে চলো…
গাড়ি অনেক দ্রুত ড্রাইভ করছে মুবারক,,
আর রুদ্র এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সেজুথির দিকে।সেঁজুতির চোখের পাতা মৃদূ কাঁপছে।মাথার এক পাশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে র/ক্ত পরছে।তবে যতটা পরার কথা ততটা নয়।মেয়েটির গায়ে বোধ হয় র/ক্ত কম। কেমন ফ্যাকাশে হাত পা।মেয়েটা আজ তাকে বাচালো।নাহলে এখানে এই অবস্থায় এতক্ষনে তার থাকতে হতো।রুদ্র চোখ বুজে সিটের সাথে মাথা এলালো।মনে মনে চাইলো মেয়েটি বেঁচে যাক।তার ঋন না থাকুক।এত বড় ঋনের বোঝা সে বইতে পারবেনা।গাড়ি ব্রেক করায় ধ্যান ভাঙলো রুদ্রর
আবারও সেজুথিকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকলো।এত বড় বিজনেস ম্যান কে এ অবস্থায় দেখে সেদিকে এগিয়ে এলো হাসপাতালের কজন।ওনাদের চোখে কৌতুহল। মেয়েটি কে? রুদ্রর কোলেই বা কেন?এত প্রশ্ন তাদের।রুদ্র চোখ মুখ দেখেই বুঝে নিলো।বিরক্ত হলো।র
— এক্সিডেন্ট কেস,,ইমিডিয়েট স্ট্রেচার নিয়ে আসুন..যান।
তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে তারা।
‘যেন চাক্ষুশ সিনেমার দৃশ্য। রুদ্র এবার জোরে চেঁচিয়ে বলল,
— আরে এখনও দাঁড়িয়ে আছেন,, যাস্ট গো।
— যাচ্ছি স্যার যাচ্ছি

বাইরে চেঁচামেচির শব্দ।হাসপাতালে এমন ষাড়ের মতো কে চেঁচায়?কান্ডজ্ঞান নেই নাকী!চেম্বার ছেড়ে উঠে এলো হোসাইন।পথিমধ্যে একজন নার্সকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
কি হয়েছে নার্স..এত চিৎকার কিসের?
মেয়েটি তাড়ায় ছিলো।তাড়াহুড়ো কন্ঠেই বলল,
— স্যার বিজনেস ম্যান রুদ্র রওশনের কোনও রিলেটিভ এর এক্সিডেন্ট হয়েছে.. সে জন্যেই
উনি.. হাইপার হয়ে চিৎকার করছেন।

রুদ্রর নাম শুনে চিনতে সময় লাগেনি তার।গতবার এর অপারেশন হোসাইন করেছিলো।তার ওপর এত বিখ্যাত একজন ব্যাবসায়ী। না চিনে উপায় কী।
— পেসেন্ট কোথায়??
— পেশেন্ট করিডোরে,, স্ট্রেচার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
হোসাইন রেগে বলল,
— আরে এখনো হচ্ছে মানে কি?যান তাড়া দিন..আর এক্সিডেন্ট কেস এর ট্রিটমেন্ট এ ভারপ্রাপ্ত কে আছেন?

— ড: রাতুল স্যার..
— ঠিক আছে ওনাকে খবর দিন..
নার্স মাথা নেড়ে চলে যেতেই করিডোরের বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো হোসাইন।
রুদ্রর কোলে সেজুথি কে চোখে পরতেই দৌড়ে এলো সে।বিচলিত হয়ে প্রশ্ন ছুড়লো একের পর এক।রুদ্রর সেসবে কান নেই।সে তাকিয়ে আছে দূরের স্ট্রেচারের দিক।ইতিমধ্যেই স্ট্রেচার নিয়ে হাজির হয়ে গেছেন ওয়ার্ড বয়।
রুদ্র তড়িঘড়ি করে কোল থেকে নামিয়ে সেখানে শুয়িয়ে দিলো সেজুথি কে।
মুহুর্তে তাকে নিয়ে আই সিইউ তে ঢূকলো।
ডাঃ হোসাইন এর মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।সেও হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো স্ট্রেচারের পিছু পিছু।
রুদ্র একবার ভাবলো হাসপাতালে তো নিয়ে এসেছি এবার বরং চলে যাই।পরক্ষনেই আবার তার মানবিকতা তাকে বাধা দেয়ায় সেখানে রাখা চেয়ারে বসে পরলো।এসেছে যখন একবারে জেনেই যাবে মেয়েটি কেমন আছে?আধ ঘন্টা পর ড: রাতুল সহ, ড: হোসাইন কে বের হতে দেখে উঠে দাড়ালো রুদ্র,
— ইজ সি ওকে ড:??
— ইয়াহ,,এখন সুস্থ…. মাথায় চোট পেয়েছিলো কিন্তু
আল্লাহর রহমতে সেটা খারাপ ভাবে হয়নি.. যার কারনে সিভিয়ার কিছু হওয়া থেকে বেচে গিয়েছেন উনি… ( ড: রাতুল)এমনিতে হাতে পায়ে চোট আছে।পিচের রাস্তায় পরেছেন তো তাই কে/টে/কুটে গিয়েছে।তবে তাতে চিন্তার কিছু নেই।পেন কিলার নিলে ঠিক হয়ে যাবে কদিনে।
ভেতর থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো রুদ্রর..
“যাক মেয়েটা বেচে গেছে।
ডা: রাতুল চলে গেলো।আপাতত তার কাজ শেষ। কিন্তু হোসাইন গেলেন না।সে এক ভাবে তাকিয়ে থাকলেন রুদ্রর দিকে।রুদ্রর হাসফাস বুঝে উঠলেন না তিনি।
— মিঃ রওশন ?? ওকে আপনি কোথায় পেলেন??
আর ওর এই অবস্থাই বা কি করে হয়েছিলো?
রুদ্র ভ্রু ক্রুটি করে বলল,
— ওনাকে আপনি চেনেন?
— হ্যা আমার বন্ধুর মেয়ে…
রুদ্র ছোট করে বলল,
— ওহ।
আসলে আমাকে বাচাতে গিয়ে নিজেই গাড়ির নিচে পরে গিয়েছিলো।
হোসাইন মাথায় হাত দিয়ে বলল,
— ও মাই গুডনেস!কত টা রিস্ক নিয়ে ফেলেছিলো মেয়েটা।আমিতো ভাবতেই পারছিনা।
এই মেয়েটার এই একটাই সমস্যা।কখনও নিজের কথা ভাব্বেনা।সব সময় অন্যের ব্যাপারে ভাবছে।
এই যে দেখুন আপনাকে চেনেনা,জানেনা অথচ এই নিয়ে দুবার আপনাকে বাচালো মেয়েটা।
রুদ্র সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতন তাকালো।

— দুবার?

চলবে….

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী
#পর্ব-০৭
রুদ্রর জানার ইচ্ছে দেখে হোসাইন যেন আগ্রহ পেলেন অনেকটা।আগের থেকেও উদ্বেজনা নিয়ে বললেন,
‘হ্যা সেই যে আপনার গুলি লেগেছিলো?ব্লাড দরকার হয়েছিলো? তখন তো ওই আপনাকে ব্লাড ডোনেট করলো।কি আর বলব বলুন,আপনার ভাই তো নিতেই নারাজ।হাসপাতালের ব্লাড ব্ল্যাংক গুলোও বেশ দূরে বিধায় সেঁজুতিই আপনার ভাইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করালো।ভাবতে পারছেন? চেনেনা জানেনা অথচ আপনাকে রক্ত দেয়ার জন্যে যেচে এগিয়ে এলো মেয়েটা।আজ আবার বাঁচালো।সত্যিই! এখন কার দিনে মানুষের অভাব নেই,কিন্তু এরকম ভালো মানুষের সত্যিই বড় অভাব।
রুদ্র এতক্ষন বিহ্বল হয়ে শুনছিলো।তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে বোধ হয়।অস্পষ্ট আওয়াজে বলল,
,ইনিই সেই মেয়ে?
হোসাইন ঠিক শুনতে পেলেন না।তবে ঠোঁট নাড়ানো দেখে বুঝলেন রুদ্র কিছু বলল।নিশ্চিত হতে বলল,
,
,কিছু বললেন মিস্টার রওশন?
রুদ্র চমকালো।
,হ্যা? না।
রুদ্র থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক পছন্দ হলোনা হোসাইনের।এরকম কথা শুনে কেউ এমন নির্বাক, থাকে কি করে? সে হলেতো কৃতজ্ঞতায় লুটিয়ে পরতো।
‘ ওকে মিস্টার রওশন,আমি তাহলে আসি এখন।বিশ মিনিটের মাথায় সেঁজুতির জ্ঞান ফিরে আসার কথা।আপনি চাইলে দেখা করে নেবেন।
রুদ্র ভদ্রের মত মাথা ঝাকালো।হোসাইন ঢুকে পরলেন চেম্বারে।রুদ্র তখনও স্তম্ভের মতোন দাঁড়িয়ে।তার মাথায় এখনও কিছুই ঢুকছেনা।ঘুরেফিরে সব গোলক ধাঁধার সমাধান এই মেয়েতেই হলো?এই সেই হোটেলের মেয়ে যে কীনা টাকার বিনিময়ে তার সাথে রাত কাটালো।আবার এই মেয়েই তাকে রক্ত দেয়ার দৌলতে পাঠানো টাকা ফেরত পাঠালো।কেন? ব্যাপারটা কেমন রহস্যময় উপন্যাসের মতোন হয়ে গেলো না?রুদ্রর একটু খারাপ ও লাগছে এখন
‘এই মেয়েটাই তাকে দু বার সেফ করলো,অথচ মেয়েটাকে নিয়ে কি নিম্ন মানের চিন্তাভাবনাই না ছিলো তার!অবশ্য! তার এতে কি দোষ,মেয়েটা যা করেছে তাতে তার জায়গায় থাকলে যে কেউ এসব ই ভাববে।রুদ্র পায়চারি করলো খানিকক্ষন।এই একটা মেয়ে গত দুদিন যাবত তাকে পাগল করে দিচ্ছে কেউ কী জানে?সব হিসেব মিলিয়েও একটা জায়গায় আটকে যাচ্ছে রুদ্র,
যে মেয়ে বারবার হাতে টাকা পেয়েও নিচ্ছেনা,,সে মেয়ে কেনো টাকার বিনিময়ে আমার সাথে হোটেলে থাকতে গিয়েছিলো?কি এমন দরকারে!
নাহ কিচ্ছু আসছেনা মাথায়,,বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে মাথাটা।তার মন বলছে কিছু একটা ব্যাপার আছে…কিন্তু কি?তার কী জানা উচিত? না কেন?এটা সম্পূর্ন সেই মেয়ের ব্যাপার। সে কেন মাথা ঘামাবে?কিন্তু মাথা না ঘামিয়েও যে শান্তি পাবেনা।হ্যা তার জানা উচিত।সব টা জানা উচিত।নিজের শান্তির জন্যে হলেও।কিন্তু কিভাবে জানবে?মেয়েটাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই কি মেয়েটা তাকে বলবে?কখনওইনা।উল্টে মেয়েটি যদি তার ভাবনার মতো অন্যরকম হয় তবে তাকে দেখে অস্বস্তি বোধ করবে।তাহলে এখন সে করবে টা কি?
_____
হাসপাতালে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে অভ্র।মুবারকের থেকে জেনেছে এক্সিডেন্টের ব্যাপারে।পুরোটা না শুনেই ছুট লাগিয়েছে ছেলেটা।প্রান প্রিয় ভাই তার।সে কীনা গাড়ির তলায় পরতে যাচ্ছিলো?অভ্র দুঃখে শোকে শেষ প্রায়।কি দরকার ছিলো রুদ্রর একা বের হওয়ার,তাও ড্রাইভার ছাড়া।মনে মনে রুদ্রকে কড়া শাসন করতে মন চাইলেও সে সাহস তার এখনও হয়নি।
হাসপাতালে এসেই করিডোরে এসেছে অভ্র।পথে অবশ্য একজন কে জিজ্ঞেস করেছিলো রুদ্রর কথা।সেই দেখিয়ে দিয়েছে রুদ্র কোথায়।
রুদ্র চেয়ারে বসে আছে।ভাবছে কিছু।হাটুর ওপর ঝুঁকে হাত ঠেকিয়েছে থুতনীতে।আশেপাশে খেয়াল নেই তার।পরনের আকাশী রংয়ের শার্টে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ এখনও। অভ্র ঘাঁবড়ালো।এমন রক্ত কোত্থেকে এলো?দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে অভ্র।কাঁধের ওপর হাত ছুইয়ে আস্তে করে ডাকে,
ভাই??
স্পর্শ পেয়ে ধ্যান ভাঙলো রুদ্রর।ঘাঁড় ফেরাতেই অভ্রকে দেখে অবাক কন্ঠে বলল,

— একি! তুই এখানে?
অভ্র রুদ্রর পাশের চেয়ারে বসলো।বলল,
— মুবারকের থেকে জানতে পারলাম তোমার এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো।তুমি হাসপাতালে,,তাই আর থাকতে পারিনি,,চলে এসেছি,,তুমি ঠিক আছো ভাই??

— হুম..
অভ্র খেয়াল করলো রুদ্র গভীর চিন্তায়।এখন কী আর কিছু বলা ঠিক হবে?অভ্র চুপ করলেও রুদ্র বলে ওঠে,
‘ ঠিক থাকতাম না হয়ত,যদি না মেয়েটি আমাকে বাঁচাতো।
অভ্র অবশ্য এটুকু শুনেছিলো মুবারকের কাছে।তাই আর অবাক হয়নি।তবে বুঝলো এত রক্ত নিশ্চয়ই মেয়েটির।ছোট করে শুধালো,
এখন তার কি অবস্থা??

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলো।
‘ভালো।জানিস এই মেয়েটা কে??
‘কে??
‘ সেই মেয়েটি।যে তোর পা ভাঙার হুমকি দিয়েছে।

অভ্র তঁড়াক করে লাফিয়ে উঠলো।গোল গোল চোখে চেয়ে বলল,
কি? ওই ঝগড়ুটে মেয়েটি?মানে আগের বারও যে তোমাকে…
রুদ্রর মুখের গম্ভীর ভাবখানা দূর হলো।অভ্রের চোখমুখ দেখে কেমন হাসি পেলো তার।কি নাম দিলো মেয়েটির? ঝগড়ুটে? মেয়েটি কি আসলেই তাই?অভ্রর আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো রুদ্রর।অভ্র কেমন টেনে টেনে বলল
‘ও গড।মেয়েটা তো বলতে গেলে তোমার জন্য এঞ্জেল হয়ে গেলো ভাই।নাহলে তুমিও বারবার বিপদে পরছো আর ওই বাঁচাচ্ছে তোমায়।হ্যা রক্ত দেয়ার ব্যাপারটা নাহয় একটু স্বাভাবিক। কারন অনেকেই স্বেচ্ছায় রক্ত দান টান করে।কিন্তু আজকের বিষয় টা অনেক গভীর।কেউ এমন রিস্ক নিয়ে গাড়ি ভর্তি রাস্তায় কাউকে বাঁচাতে যাবেনা।মরার ভয় সবার থাকে।
অভ্র বিরতি নিতেই রুদ্র মাথা দুলিয়ে হাসলো।বিদ্রুপের হাসি। ছেলেটা কী বলল,
‘ এঞ্জেল?? হাহ,,রুদ্রর আবার এঞ্জেল।পৃথিবীতে সব থেকে মজার কৌতুক হয়ত এই কথাটাই।
,
মেয়েটার সাথে দেখা করেছো ভাই??
রুদ্র এবার সিরিয়াস মুখ করলো।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। এতক্ষন বসে বসে অনেক কিছু ভেবেছে।প্ল্যানিং ফুল কমপ্লিট।তার অনুমান সত্যি হলে এভাবে মেয়েটার সামনাসামনি যাওয়া ঠিক হবেনা।ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কাজ করায় অবশ্য রুদ্রর জুড়ি মেলা ভাড়।
রুদ্র পকেটে দুহাত ঢুকিয়ে বলল
‘তুই গিয়ে দেখা করে আয়।
অভ্র দুই ভ্রু ওপরে তুলে বলল
‘ আমি? আমি গিয়ে কি বলব ভাই?
ছেলেটার কথাটা একটু বোকা বোকা শোনালোনা?লম্বায় বাড়লেও বুদ্ধি হয়েছে কী?রুদ্র চোখ ছোট করে বলল,
‘ যে মেয়ে তোর ভাইকে বাঁচালো তাকে দেখতে যাওয়া তোর দায়িত্ব নয়?
অভ্র মাথা নাড়লো।হ্যা দায়িত্ব তো।রুদ্র আবার বলল
‘ বলবি ও যাকে আজ বাঁচালো তুই তার ভাই।বোঝা গেলো?
অভ্র এবারেও মাথা দোলায়।রুদ্র যেতে নিয়ে আবার ফিরে তাকালো।বলল,
‘শোন,মেয়েটার সামনে আমার নাম বলবিনা।ভুলেওনা।
ঠান্ডা ভাবে বললেও অভ্রর মনে হলো রুদ্রর হুমকি দিলো তাকে।যদিও রুদ্রর ভালো কথাও এমন।শুনলেই মনে হয় ধমকাচ্ছে।

— কিন্তু তুমি?
,
আমি আসছি…
_______
বেডের ওপর আধশোয়া হয়ে আছে সেজুতি।মাথায় ব্যান্ডেজ করা।পা গুলোও ভীষণ ব্যাথা করছে।সমস্ত গা ভারী ভারী লাগছে।ম্যাজম্যাজ করছে। ডাক্তার বলেছে পায়ে তেমন কিছু হয়নি।শুধু পেশিতে টান পড়ায় ব্যাথা হচ্ছে।দুই একদিন বাদেই ঠিক হয়ে যাবে।আজ তার টিউশনি দুটোর বেতন নিতে গিয়েছিলো। সেগুলো থেকে বাজার নিয়ে ফেরার পথেই এত কিছু ঘটে গেলো।বাবা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছেন?? ভীষণ চিন্তাও করছেন।হোসাইন আঙ্কেল কি বাবাকে জানিয়েছে কিছু?আল্লাহ যেন না জানায়।জানালেই বাবা ছটফট করবেন।নিজেকে দোষারোপ করবেন।না না প্লিজ আঙ্কেল! কোথায় যে গেলেন উনি?আমি কী এখন বাড়ি যেতে পারব জানা দরকার? কিন্তু একা যাবই বা কি করে! পায়ে তো খুব ব্যাথা।মাটি ছুঁতে পারব কীনা সন্দেহ।আঙ্কেল সেই যে এলেন আর দেখা নেই।ডাক্তার মানুষ ভীষণ ব্যাস্ত।কিন্তু আমিও এভাবে বসে থাকব কতক্ষন।আমার তো সিভিয়ার কিছু হয়নি যে দু তিন দিন হাস্পাতালে থাকা প্রয়োজন। আঙ্কেল এলে একবার জেনে নিতাম,সেই লোকটা কেমন আছে? উনিই কী আমায় হাসপাতালে এনেছিলেন? হবে বোধ হয়।নাহলে হোসাইন আঙ্কেলের তো জানার কথা নয় রাস্তায় কি ঘটেছে।উনিতো খুব রেগেছিলেন।ধমক ও দিয়েছেন আমাকে।কিন্তু আমি কি করব?কারো বিপদ দেখলে সাহায্য না করে থাকা যায় নাকী? আমিতো পারিইনা।শরীরের মধ্যে কেমন নিশপিশ করে আমার।অবশ্য এত কিছুর মধ্যে একটা জিনিস ভেবে শান্তি পাচ্ছি যে লোকটার কিছু হয়নি।বাঁচাতে পেরেছি তাকে।কিন্তু ওমন দাঁমড়া লোক রাস্তা পার হতে পারেনা? কেমন বাচ্চাদের মতো করছিলো।কে ছিলেন লোকটা?আঙ্কেল তো কিছু বললেন না এ ব্যাপারে। শুধু ভবিষ্যতে এমন ঝুঁকি না নেই যাতে তার জন্যে হম্বিতম্বি করে গেলেন।
,
আসতে পারি?হ্যালো মিস শুনতে পাচ্ছেন? আসব কী ভেতরে?
সেঁজুতির টনক নড়লো এতক্ষনে।কেবিনের দরজায় চেনা পরিচিত লোকটিকে দেখে বিস্মিত হলো।
আরে! আপনি?? এখানে?আসুন।
অভ্র ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
‘কি করবো বলুন,,ঘুরেফিরে আপনার সাথেই দেখা হয়ে যাচ্ছে।তা এত কি ভাবছিলেন বলুন তো,আমি সেই কখন থেকে ডাকছিলাম।
সেঁজুতি লজ্জ্বা পেলো।সে জান প্রান দিয়ে ভাবছিলো বলে কোনও কিছুই কর্নকুহর হয়নি।ইশ! লোকটা কি ভাবলেন।
সেঁজুতির মুখ দেখে হাসলো অভ্র।বলল
,আমি কিছু মনে করিনি।

সেঁজুতি মুচকি হেসে বলল ‘ধন্যবাদ।তবে আপনি..
অভ্র কথা কেড়ে নিয়ে বলল
— আমি এখানে কেনো তাই ভাবছেন তো..
—জ্বি
অভ্র টুল টেনে বসলো।বলল,
,
না না।ভাববেন না যে আবারও টাকা দিয়ে আপনাকে অপমান করতে এসেছি।আমার পা ভাঙার ভয় আমার আছে।
সেঁজুতি হেসে ফেলল শব্দ করে।
‘আসলে ঐদিন এত রাগ হয়েছিলো তাই বলে ফেলেছি।কিছু মনে করবেন না।টাকা পয়সার ব্যাপারে আমার একটু এলার্জি আছে।
‘ আমি কিছু মনে করিনি।
কথাটা মুখে বললেও অভ্র মনে মনে বলল,
‘ করেছি অনেক কিছু মনে করেছি।আপনি আমার পা ভাঙবেন আর আমি কিছু মনে করবনা এত উদার আমি নই।

সেঁজুতি প্রশ্ন করলো,
কিন্তু আপনি এখানে কেন বললেন না।

অভ্র লম্বা শ্বাস ফেলে বলল
আসতে তো হতোই।না এসে উপায় আছে বলুন? কারন আজকেও আপনি যে লোকটাকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাচিয়েছিলেন,তিনি আমার ভাই।

সেঁজুতি হা করে বলল
‘উনি আপনার ভাই ছিলেন? মানে সেই লোকটা?
,
জ্বি আমার সেই ভাই… যাকে আগের বারেও আপনিই বাচিয়েছেন।

সেঁজুতি এবার চোখ নামিয়ে বলল
,.বারবার এভাবে বাঁচানো কথাটা উল্লেখ করবেন না।বাচানোর একমাত্র মালিক আল্লাহ।আমি ওসিলাহ মাত্র।বাঁচা মরা সব ওনার হাতে।
এই প্রথম সেঁজুতির কথায় মুগ্ধ হলো অভ্র।না মেয়েটি ভালোই।
তখনি কেবিনে ঢুকলেন হোসাইন।অভ্রকে দেখে হেসে বললেন
— আরে মিঃ চৌধুরী যে…আপনি কখন এলেন?

অভ্র উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো হোসাইনের সাথে।চমৎকার হেসে বলল,
‘ আমার ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে যার এক্সিডেন্ট। তাকে দেখতে আমি আসবনা?
,নিশ্চয়ই। হোসাইন এবার সেঁজুতির দিক ফিরলেন।বেশ গুছিয়ে বললেন,
‘আমির কে আমি ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি তুমি আমার কাছে আছো।এটুকু শুনতেই সেঁজুতি চোখ কপালে তুলল।হোসাইন বুঝতে পেরে বলল,
‘ ভয় পাওয়ার কিছু নেই।এক্সিডেন্টের কথা জানাইনি।শুধু শুধু
চিন্তা করবে।তাই বলেছি দেখা করতে এসেছো।

সেঁজুতি নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলল।হেসে বলল,
— এটুকুতেই হবে আংকেল,,অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
হোসাইন মুখটা গোমড়া করে বললেন,’ সাহায্য টা রোজ রোজ পাবেনা।সেটাও মনে রেখো।
সেঁজুতি মুখটাকে চোরের মতো করে নামিয়ে ফেলল।হোসাইন ছোট্ট শ্বাস ফেলে হাতের কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল
— তোর প্রেস্ক্রিপশন। ডাঃ রাতুলের থেকে নিয়ে এলাম,,সব ওষুধ সময় মতো খাবি।

সেঁজুতি হাত বাড়ানোর আগেই অভ্র হোসাইনের হাত থেকেনিয়ে নিলো। দুজন তাকাতেই বলল,
,আপনি তো অসুস্থ।আপাতত আমি রাখছি।এটুকুর জন্যে নিশ্চয়ই পা ভাঙবেন না?

সেঁজুতি হোসাইনের দিকে তাকালো।সে কিছুই বোঝেনি।কথা বেশিদূর গড়াতে পারে ভেবে আস্তে করে বলল’ আচ্ছা রাখুন।
‘ ওনার তবে রিলিজ তাইনা,,
‘জ্বি।
হোসাইন এসে সেঁজুতির মাথায় হাত বোলালো।
‘মাথা ব্যাথা করছে?
সেঁজুতি দুপাশে মাথা নাড়লো।
‘তুই একটু অপেক্ষা কর,আমি কজন পেশেন্ট দেখে তোকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
পাশ থেকে অভ্র হৈহৈ করে বলল,
না না আপনার যেতে হবেনা।আমি ওনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘সেকি আপনি কেনো যাবেন?

‘প্লিজ! এটা তে না করবেন না।প্লিজ!তাছাড়া ড: হোসাইন আপনাকে দিয়ে আসার সময় টুকুতে অনেক পেশেন্ট কেই দেখতে পারবেন তাইনা?? কত লোক সিরিয়াল ধরে আছে,,তাদের কষ্ট টাও কমে যাবে। অভ্র খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে তার ট্রিক্স কাজে লাগবে।সেঁজুতি নিশ্চয়ই এটা শুনে রাজি হবে।

সেঁজুতি খানিক ভেবে বলল
‘ঠিক আছে।

অভ্র মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল।সে ঠিক তাই তাই বলল,যা রুদ্র শিখিয়ে পড়িয়ে গিয়েছে।ঠিকমতো বলতে পেরেছেতো? ভাই আবার ঝাড়ি না মারলে হয়।
‘আমি একটু আসছি বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে কল দিলো।
,
হ্যা বল।
,ভাই এবার কী করব? পৌঁছে দেবো?
“না তোকে যেতে হবেনা।
‘ তাহলে কে যাবে?
,সময় হলে দেখবি।

,কিন্তু তুমি কোথায়?

‘আসছি….
রুদ্র লাইন কেটে দিয়েছে।অভ্র আবারও কেবিনে ঢুকলো।সেঁজুতি এবার পা ঝুলিয়ে বসেছে বিছানায়।
অভ্রকে দেখতেই বলল
‘এবার তাহলে যাই আমরা?আমার বাবা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে…
অভ্র কি বলবে খুঁজে পেলোনা।চট করে মিথ্যে সে বলতেও পারেনা।আমতা-আমতা করে বলল,
— আসলে হয়েছে কি, আমি যেতে পারবনা।প্লিজ কিছু মনে করবেন না।ভাই বললো ওই আপনাকে পৌঁছে দেবে…

‘উনি আবার শুধু শুধু কেনো যাবেন?,ইনফ্যাক্ট আপনার ও যাওয়ার প্রয়োজন ছিলোনা।
আমি কিন্তু ম্যানেজ করে নিতে পারতাম..!

— হ্যা সে হয়তো আপনি পারতেন ম্যানেজ করতে।কিন্তু আপনাকে পৌছে দিতে যাওয়াতে আমরা যে একটু হলেও শান্তি পাবো সেটা কি হাতছাড়া করা যায় বলুন…?আপনি যাস্ট দু মিনিট বসুন,ভাই এক্ষুনি এসে পরবে..

সেঁজুতির আর কিছু করার নেই।হোসাইন অলরেডি বেরিয়ে গেছেন ওটির উদ্দেশ্যে।ছোট করে বলল, ‘ঠিক আছে।
সময় যেতে না যেতেই রুদ্র এসে কেবিনের সামনে দাঁড়ালো।প্রথমেই চোখ পরলো সেঁজুতির দিকে।কপালে ব্যান্ডেজ।গালে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ।পড়নে নীল রঙের থ্রি পিস।মেয়েটিকে কি সুন্দর লাগছে?রুদ্র নিজের কাছেই প্রশ্ন করলো।কিন্তু উত্তর এলোনা অনেকক্ষনেও।
পরমুহূর্তে নিজের চিন্তায় নিজেই মুখ থুঁবড়ে পরলো সে।মেয়েটিকে সুন্দর লাগলেই বা! তার কি?

চলবে..

প্রনয় পর্ব-৪+৫

0

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুথী 🍁
পর্ব- ৪+৫

বাবা নাস্তা দিয়েছি খেতে এসো…

আমির পত্রিকা পড়ছিলেন।সেঁজুতির কথায় চিল্লিয়ে বললেন,
‘আসছি আসছি,এই নিউজ টা পড়েই আসছি।

সেঁজুতিও পাল্টা চিল্লিয়ে বলল,
— নটা বেজে গিয়েছে বাবা,আমাকে ক্লাসে যেতে হবে,,তাড়াতাড়ি এসো।

আমির ব্যাস্ত কন্ঠে বললেন,
— ওহ হ্যা হ্যা,,আসছি।
পাশেই নিউজ পেপার টা ভাজ করে রেখে দিলো আমির।টেবিলের কাছে আসতেই
হঠাৎ ডোরবেল বাজলো।আমির মেয়ের দিক তাকালেন।
‘কে এলো এখন?হোসাইন মনে হয়।

সেঁজুতি চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো দরজা খুলতে।ওপাশে কালো পোশাক পরিহিত দুজন অচেনা লোক।পরিপাটি, ফরমাল পোশাক আশাক।সাথে বড় বড় গোফ দুজনের।একজনের হাতে মস্ত বড় ব্যাগ। সেঁজুতি লোক দুটোর আপাদমস্তক দেখলো।
তন্মধ্যে একজন বললেন,
— এটা কি মিস সেজুথির বাসা?

— জি,কিন্তু আপনারা?

— অভ্র স্যার আমাদের পাঠিয়েছেন,,আপনাকে এই টাকা গুলো দেয়ার জন্যে…
হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বললেন একজন।

সেঁজুতি চিনলোনা।একটু ভাবলো।বলল
— অভ্র টা আবার কে?আর আমাকেই বা টাকা কেনো দিতে যাবে?যেহেতু আমার নাম টা ঠিক বলেছেন সেহেতু আপনারা ভুল বাসায়ও আসেননি।,তবে এটা ঠিক কিসের টাকা?

অন্য লোকটি ব্যাস্ত ভঙিয়ে বললেন,
‘ম্যাম টাকা টা ধরুন,স্যার বলে দিয়েছেন একবার ওনার দেয়া টাকা আপনি রিজেক্ট করেছেন এবার আমরা যেন এই টাকা আপনাকে দিয়ে তবেই ফিরি…

এবার সেজুথির বোধগম্য হলো এরা ঠিক কার কথা বলছে, আর এটা ঠিক কিসের টাকা!
তাও সন্দেহ কাটাতে জিজ্ঞেস করলো,
‘কদিন আগে যার ভাই হাসপাতালে ছিলেন সেই কি আপনাদের স্যার?

লোক দুটি সমস্বরে বললেন’জ্বী!
সেঁজুতি মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘ ওওও এবার বুঝেছি।আমার রক্তের দাম দেয়া হচ্ছে তাইনা?আপনার স্যার এর তো দেখছি খুব সাহস! আমি যেখানে ওনার মুখের ওপর বলে এলাম আমি টাকা নিচ্ছিনা।সেখানে আবার উনি আমার বাড়ি অব্ধি আপনাদের পাঠিয়ে দিলো…?
অদ্ভুত তো!শুনুন, আপনার স্যার কে বলে দেবেন,,ফের যদি আমার বাড়ির আঙিনায় উনি বা ওনার কোনও পাঠানো লোক কে দেখতে পাই আমি,তবে ঠ্যাং ভেঙে একেবারে হাতে ধরিয়ে দেবো…
বুঝেছেন?
ধমক খেয়ে বোকা বনে গেলেন দুজন। হতভম্ব হয়ে মাথা দুলিয়ে বললেন,
— জ্বি জ্বি বুঝতে পেরেছি..

সেঁজুতি তুষ্ট হাসলো,
ভেরী গুড,,তো দাঁড়িয়ে কেনো আছেন?নাস্তা বেড়েছি খাবেন??

লোক দুটো চোখ কপালে তুলে বললেন,
— জ্বি?? না.. না…
— তবে আর কি,আসুন।
দিরুক্তি না করে লোক দুটোর মুখের ওপর ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দিলো সেঁজুতি।
___
প্রায় অনেক দিন পর ভার্সিটিতে এলো সেঁজুতি। ভার্সিটিতে ঢুকতেই সেঁজুতির ওপর এক প্রকার হামলে পরলো তোহা।মেয়েটা এতিম।দেখতে মারাত্মক।তবে খ্রিস্টান।এতিমখানায় মানুষ হওয়ার পর খুব ছোটবেলায় এক খ্রিস্টান পরিবার দত্তক নিয়েছে ওকে। সেখানেই মেয়ের আদরে মানুষ। সেঁজুতির একমাত্র বন্ধুই তোহা। তোহা দৌড়ে এসে হন্তদন্ত, উত্তেজিত হয়ে বলল,

— সেজুথি! কোথায় ছিলি তুই,,চারদিন ধরে না ফোন করিস আর না ধরিস… ভার্সিটিও আসিস নি।

সেঁজুতি পা ঝুলিয়ে বসলো বাদাম গাছের নিচে পাতানো বেঞ্চে।পাশে তোহাও বসলো।
— বাবার শরীর একটু বেশিই খারাপ ছিলো তো, তাই ব্যাস্ত ছিলাম বাবাকে নিয়ে।তোর কী খবর? পড়াশোনা চলছে ঠিকঠাক?

– তা চলছে।কিন্তু কেমন আছেন আংকেল এখন?তুই আমাকে একবার জানালিওনা!
—আরে তেমন কিছু হলেতো বলতাম পাগলী।এখন ভালো আছে।

— আচ্ছা এই নে
ব্যাগ থেকে কিছু নোটস বের করে সেঁজুতির ব্যাগের ওপর রাখলো তোহা।বলল,
এগুলো গত চার দিনে যা ক্লাস হয়েছে তার নোটস
তার আগের ক্লাস তো করেছিলি তাই ওগুলো নোট করিনি…
সেঁজুতি বিস্মিত কন্ঠে বলল,

— আমিতো এখনও তোর কাছে চাই-
ইনি..
আর তুই বুঝে গেলি?
তোহা হেসে বলল,
— না বোঝার কি আছে,?,বেস্ট ফ্রেন্ড কি এমনি এমনি হয়েছি নাকি!আর তাছাড়া এত ভালো স্টুডেন্ট তুই,সামান্য কারনে রেজাল্ট খারাপ হবে এটা আমি হতে দেবো?
খুশিতে কেঁদে ফেলল সেঁজুতি। নিঃশব্দে।ভ্যা ভ্যা করে কাঁদা তার জন্যে নয়।
আনন্দে তোহা কে জড়িয়ে ধরলো এক হাতে।মেয়েটা বড্ড ভালো কেন?
______

ভার্সিটি বাসা থেকে বেশ কাছেই।হেটে হেটেই যাতায়াত করে সেজুথি।এতে ভাড়ার টাকাও বেঁচে যায় তার। আজও হেটে আসছিলো ফুটপাত ধরে।রাস্তার এক পাশে ময়লার স্তুপ করে রাখা।গন্ধ নাকে আসতেই সেঁজুতি ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। হঠাৎ চোখ পরলো সেদিক টায়।বাচ্চা একটা মেয়ে।পড়নে ময়লা ছেড়ে জামাকাপড়,মাথার চুল এলোমেলো,কোকড়ানো।
একটা কুকুর পলিথিনে মোড়ানো কিছু খাবার চেটে খাচ্ছিলো।,বাচ্চা মেয়েটা দৌড়ে গিয়েই কুকুর টাকে তাড়ালো।এরপর পলিথিন টা হাতে উঠিয়ে অর্ধ খাওয়া এক পিস পরোটা পেলো। একটু ছিড়ে মুখে দিতে যাবে ওমনি ওর হাত খপ করে ধরে আটকালো সেজুতি।মেয়েটি বোকা বোকা চাউনিতে তাকালো। সেঁজুতি মেয়েটির হাত ঝাকিয়ে ফেলে দিলো খাবারটুকু।মেয়েটি প্রচন্ড কষ্ট পেলো বোধ হয়। সেঁজুতি অধৈর্য হয়ে বলল,

একি করছো বাবু?? এটাতে কুকুর টা মুখ দিয়েছে.. এটা কেনো খাচ্ছো তুমি?

মেয়েটি মুখ কালো করে বলল
আমার খুউব খিদা লাগছে। কাইল রাত থেইকা কিচ্ছু খাইনাই।
সেঁজুতি অবাক হয়ে বলল
— এই টুকু বাচ্চা,, কাল রাত থেকে না খেয়ে আছো?তোমার বাবা মা কোথায়?

— বাপজান নাই।মায় কইছে হেয় নতুন মা নিয়া চইলা গেছে।
সেজুথি বুঝতে পারলো যে তার বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে।কষ্ট লাগলো তার।
‘আর তোমার মা??

মেয়েটি এবার উঠে দাঁড়ালো।হাফ প্যান্টে হাত মুছে বলল,
‘মায়ের অনেক জ্বর!দুইদিন ধইরা কামে যাইতে পারেনাই।ঘরে যা ছিলো সব শ্যাষ, তাই আর কিচ্ছু খাইতে পারিনাই।
সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল,
— আচ্ছা বুঝেছি।এগুলো খেতে হবেনা।আমি তোমাকে খাবার কিনে দিচ্ছি দাড়াও..
বাচ্চা মেয়েটার হাত ধরে পাশের একটা ভাতের হোটেলে নিয়ে গেলো সেঁজুতি। হোটেলের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিলো।দুপুরের সময়। অনেক লোক,ভাত খেতে বসেছে। সেঁজুতি আর ভেতরে গেলোনা। বাইরে থেকে ভাত আর মুরগীর মাংস কিনে মেয়েটাকে নিয়ে আবারো আগের জায়গায় ফেরত এলো। রাস্তার পাশে সিমেন্টের বাধানো ছোট ছোট বেঞ্চ।সেঁজুতি একটা বেঞ্চে মেয়েটাকে বসিয়ে নিজেও বসলো পাশে।হোটেল থেকে খাবারের সাথে একটা প্লেট ও এনেছে সে।
প্যাকেট থেকে খাবার গুলো বের করে প্লেটে ঢেলে বাচ্চা মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল,
— নাও খাও।
মেয়েটি সময় নিলোনা।চোখ মুখ চকচক করছে খুশিতে।খাবার পেয়েই অনেক তাড়াহুরো করে খেতে থাকলো।
কিন্তু সমস্ত খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলছিলো অল্পতেই।বাচ্চা মানুষ, তার ওপর ক্ষুধার্ত। গুছিয়ে খাবেই বা কী করে?
“তুমিতো ঠিক ভাবে খেতেই পারছোনা। আমাকে দাও,আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি…

মেয়েটি মাথা নেড়ে সেঁজুতির হাতে প্লেট দিলো।কোলের ওপর থেকে কাধব্যাগ নামিয়ে পাশে রাখলো সেঁজুতি। ভাত মেখে লোকমা তুলে সযত্নে মেয়েটির সামনে ধরতেই একপ্রকার লুফে নিলো মেয়েটি।

রাস্তায় মস্ত বড় জ্যাম।সিগন্যালে আটকা পরেছে সব গাড়ি।তার মধ্যে রুদ্রর কালো গাড়িটাও আছে।গাড়ির ভেতর বসেই এতক্ষন একভাবে সেঁজুতির কর্মকান্ড দেখছিলো রুদ্র।গত এক ঘন্টা ধরে তার গাড়ি জ্যামে আটক।
বিরক্ত হয়ে গাড়ির জানালা খুলে রাস্তার পরিস্থিতি দেখতে তাকিয়েছিলো।
হুট করেই তার চোখ পড়ে রাস্তার ডান পাশে সেজুথির দিকে।এবার কিন্তু একবার দেখাতেই সে চিনে ফেলেছে মেয়েটিকে।ভাবতে হয়নি।
কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে খাবার কিনে দেয়া থেকে শুরু করে খাইয়ে দেয়া দেখে রীতিমতো হা হয়ে গিয়েছে রুদ্র।এমন জীর্ন শীর্ন ময়লা পোশাক পড়া একটা বস্তির বাচ্চা মেয়ে!আজকাল কার কোনও মেয়েতো ধারেকাছেই ঘেষতে দেবেনা একে।
সেখানে এই মেয়েটা ওকে খাইয়েও দিচ্ছে..?.
অদ্ভূত না বিষয় টা?
রুদ্রর সুক্ষ্ণ বুদ্ধি মাথা চাড়া দিচ্ছে।বলছে এই মেয়েটা হয়তো সেরকম নয় যেরকম সে ভাবছে।যা দেখলো এতক্ষন নির্দ্বিধায় একে ভালো মানুষের কাতারে ফেলা যায়।তবে ওইদিন রাতে তার সাথে থাকলো কেন?এর মধ্যে কোনও গল্প আছে…??
পরমুহূর্তেই ভাবলো,
থাকলেই বা…
তার কি এসে যায়…?
তখুনি
জ্যাম ছুটে গেলো।সেজুথির দিকে একপলক তাকিয়ে গাড়ির জানালার কাঁচ টা তুলে দিলো রুদ্র।
আর তার গাড়ি ছুটে চললো নিজ গন্তব্যে…
_____
ভাই??

— হুম
ফাইল চেক করতে করতে ছোট করে জবাব দিলো রুদ্র।তার জবাব বরাবরই এত টুকুন।

অভ্র দরজায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে বলল
‘কিছু বলার ছিলো তোমাকে?

— বল…

অভ্র দেখলো রুদ্র তাকাচ্ছেনা।রুদ্রর আগ্রহ পেতে একটু জোরে বলল,
‘ভাই সেই মেয়েটার ব্যাপারে।

— কোন মেয়ে??
রুদ্রর ভাবলেশহীনতায় অভ্র অবাক না হয়ে পারেনি।একদিনে ভুলে গেলো?অবশ্য হবেইতো।যার চারপাশে সব সময় মেয়ে মানুষের আনাগোনা সে কী আলাদা করে একটা মেয়েকে মনে রাখতে পারে নাকী?
— ওই মেয়েটা,, যে তোমাকে ব্লাড ডোনেট করলো।
রুদ্র ফাইলের কাগজ ওল্টাতে ওল্টাতে বলল,
— হুম, তো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিস??
অভ্র এবার মহা ঝামেলায় পরেছে তাতো আর ভাই জানেনা।মেয়েটা যে তার ইজ্জত খেয়ে ফেলল একদম। নিজের মুখে কী করে বলবে সে? মিনমিন করে বলল,
— শোনোনা ভাই,,হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট থেকে মেয়েটার এড্রেস নিয়ে আমাদের দুজন লোক কে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম।গতবার চেক নেয়নি ভেবে এবার ক্যাশ পাঠিয়েছিলাম একেবারে।

রুদ্র এবার তাকালো।
— তো??
অভ্র রুদ্রর তাকানো দেখেই ঘাবড়ালো আরো।আস্তে করে বলল,
— মেয়েটা টাকা রাখেনি ভাই,,

রুদ্রর কপালে ভাঁজ।সে অবাক হয়েছে।
রুদ্রর এমন চাউনী বুঝতে পেরে অভ্র এগিয়ে এলো কয়েক পা।উদগ্রীব হয়ে বলল

‘– হ্যা ভাই টাকা তো রাখেইনি উলটে আমাকে হুমকি দিয়েছে।

রুদ্র বুঝলোনা,
— মানে?
অভ্র থেমে থেমে বলল
— মানে, মেয়েটা বলেছে,,এরপর ওনার বাড়ির আঙিনায় যদি আমি বা আমার কোনও লোক টাকা নিয়ে হাজির হয়,তবে…

— তবে?
— তবে ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবে..
মুখ কাচুমাচু করল অভ্র।

রুদ্র চমকালো।ক্ষেপেও গেলো।ঝরঝরে ইংলিশে বলল,
‘ হোয়াট? আর ইউ কিডিং উইথ মি?
অভ্র ঘন ঘন মাথা নাড়লো দুদিকে।তার কী অত সাহস আছে নাকী? রুদ্রর সাথে মজা করবে। ছিঃ ছিঃ এ স্বপ্নে ভাবাও অন্যায়।
— নো নো ভাই,,সত্যি বলছি।মেয়েটা তাই বলেছে।এমনকি ওনাদের মুখের ওপর দরজা লাগিয়ে দিয়েছে নাকী।কি মারাত্মক মেয়ে!

রাগে চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো রুদ্রর।উঠে দাঁড়ালো তাৎক্ষণিক। ফাইলটা পরে গেলো ফ্লোরে।রুদ্রর সে খেয়াল নেই।হাত দুটো মুঠো বন্দি করে দাঁত চিবিয়ে বলল,
‘হাউ ডেয়ার সি?? রুদ্র রওশন চৌধুরির দেয়া টাকা বারবার রিজেক্ট করছে ওই মেয়ে?
কি নাম মেয়েটার??
‘ পুরো নাম বলব? নাকী ডাক নাম?
রুদ্র তাকাতেই অভ্র চট করে বলল ‘সে..সেজুতি।
রুদ্র বেরিয়ে যেতে যেতে বলল
‘বাসার এড্রেস টা আমাকে টেক্সট কর।

চলবে….

( নাইস,নেক্সট বাদ দিয়ে গঠন মূলক মন্তব্য করুন)

#প্রনয়
#নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব- ৫

শাঁ শাঁ করে বাতাস বইছে। প্রকোপে হন্নের মতো উড়ছে জানলার সোনালী রংয়ের পর্দা। রুদ্রর মন,মস্তিষ্ক বড্ড অশান্ত,অবিচল।অস্থিরতায় এক ফোঁটা শান্তি নেই যেন।কেমন অন্যরকম অশান্তি এটা।এরকম কেন হচ্ছে?ফাঁকা ফাকঁা লাগছে কেন এত? রুদ্র খেয়াল করেছে রাস্তায় সেজুতিকে দেখার পর থেকেই এই অবস্থা।কিচ্ছু ভালো লাগছেনা।এখানে অন্য কোনো মেয়ে হলেও কী এরকম হতো?একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে আপনজন দের মতো সাহায্য করায় তার ভীষণ ভালো লেগেছে এটা ঠিক।কাজ টা যেই করতো না কেন এরকমই ভালো লাগতো।কিন্তু এই অদ্ভূত অদ্ভূত লাগার কারন কী?মেয়েটিকে সে চেনে বলে?খুব কাছ থেকে দেখেছে বলে?মেয়েটিকে প্রথম দেখায় খারাপ বলে আখ্যায়িত করার জন্যে? নাহলে কী?কেন মনে হচ্ছে মেয়েটি খারাপ নয়!অন্য রকম।আলাদা।পুরোটাই আলাদা।
শান্তি পাচ্ছেনা রুদ্র।তার বার বার মনে হচ্ছে সেজুথী এখানে আসা বাকি মেয়েগুলোর মত নয়
তবে?? তবে ঠিক কি কারনে একটা মেয়ে নিজ ইচ্ছায় এখানে আসবে?? হোয়াই??এখানেতো ভালো মেয়েরা আসেনা।কাউকে তুলেও আনা হয়না।সব আসে টাকার লোভে,আর রুদ্রকে ছোঁয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায়।সেঁজুতি কেন তাহলে?

— হোয়াট এভার,, আমি কেনো এসব নিয়ে ভাবছি..?
না আর ভাববোনা এসব থার্ড ক্লাস টাইপ মেয়ে নিয়ে।

মুখে ভাববেনা বললেও মন কী শোনে? সে অত্যন্ত বেহায়া কীনা!একই কথা বারবার তার মাথায় ঘুরেফিরে আসছে।
রুদ্র সটান শুয়ে পরলো।দুহাত মেলে দিয়ে জোরে শ্বাস নিলো।চোখ বন্ধ করলো।কাত হয়ে শুলো।নাহ! কোনো ফল সে পাচ্ছেনা।সেঁজুতির সেই স্নিগ্ধ মুখ খানা উঁকি দিচ্ছে চোখে।মেয়েটিকে খাওয়ানোর সময় এত নিষ্পাপ লাগছিলো কেন তাকে? সেকী আসলেই এত নিষ্পাপ?
রুদ্র তড়াক করে উঠে বসলো।মেজাজ তেঁতে গেছে।
— ও গড, এসব কি হচ্ছে আমার সাথে?কেনো হচ্ছে কেনো?
জোরে চিল্লালো রুদ্র।টেবিলে রাখা ফুলদানি টাকে চোখে পরলো।পেলোও হাতের কাছে।রাগের মাথায় সেটাকে উঠিয়ে ছুড়ে মারলো দূড়ে।
কিছু একটা ভাঙার শব্দে দৌড়ে রুদ্রর রুমে এলো অভ্র।উদ্বিগ্ন তার চেহারা।দরজা অব্দি এসে ভেতরে রুদ্রকে দেখে দাঁড়িয়ে পরলো ওখানেই।
রুদ্র বিছানার ওপর বসে আছে।হাত মুঠো বন্দী করে ডোরা সাপের মতো হিঁসহিস করছে যেন।সেকী রাগ নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে?
অভ্রর কী এখন কথা বলা উচিত?আচ্ছা ভাঙলো কী?অভ্র রুমের ভেতর উঁকিঝুঁকি দিয়ে ভাঙা ফুলদানি দেখে শিওর হলো রুদ্রর মাথা গরম।ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো,
— ভা.. ভাই কি হয়েছে তোমার..
রুদ্রর উত্তর এলো সময় নিয়ে,
— অভ্র,,মিস সুভাকে কল কর,,,আধ ঘন্টার মধ্যে আমি হোটেল পৌছাচ্ছি,,,কাউকে পাঠিয়ে দিতে বলবি…
অভ্র যেন অবাক হলো,ইতস্তত করে বলল,
— কিন্তু ভাই,,এখন তো বিকেল।তুমিতো রাত ছাড়া সেখানে যাওনা।

রুদ্রর রাগ এমনিতেই সপ্তম আকাশ ছোঁয়া।অভ্রর কথা যেন ঘি ঢাললো। লাল চোখে তাকালো,
—ডু হোয়াট আই সে ড্যামেট…
রুদ্রর ধমকে কেপে উঠলো অভ্র।ভয়ে আটশাট হয়ে পরলো একদম।না, রুদ্রকে এর বেশি ঘাটানো বিপদজনক তার জন্যে।মারবেনা কিন্তু একটা বাজখাই ধমকে সে মরবে নির্ঘাত।
— ও…. ওকে ভাই,,
সুভার নাম্বারে ডায়াল করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো অভ্র।সুভা আর আর সি হোটেলের ম্যানেজার। রুদ্রর কোন রাতের সঙ্গী কোন মেয়ে হবে সেসব গোপনে সেই ঠিক করে।
জোরে জোরে গাড়ি ড্রাইভ করছে রুদ্র।রেহান কে ও নাইনি।ঠিক কি কারনে তার এত চটেছে মেজাজ সে নিজেই বুঝতে পারছেনা।
তবে কি অজানা কোনও প্রশ্নের উত্তরের কারনে???হয়তো.. হয়তো না।এত দ্রুত গাড়ি চালানোর কারনে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা পার হলো মাত্র বিশ মিনিটে।গাড়ি এসে থামলো সেই একী হোটেল RRC এর সামনে।নির্ধারিত ৪০৪ নাম্বার রুমের লক খুলে ভেতরে ঢুকলো সে।
আজকেও বিছানার ওপর একটি মেয়ে সেজেগুজে বসে আছে।রুমের লাইট জ্বলছে।রুদ্র পরপর দুবার জোড়ালো শ্বাস নিলো।তাকালো মেয়েটির দিকে।একটু বাদে মেয়েটি মাথা তুলতেই ৪৪০ ভোল্টেজের শক খেলো রুদ্র।চমকে উঠলো যেন।
নিজে নিজে আওড়ালো,
— একি এটা তো সেই মেয়েটা।যার জন্যে এইটুকু সময়ে এই হাল।
রুদ্র রেগে বলল,
— হেই ইউ?? আবার এখানে কেনো এসছো ? কে এত সাহস দিয়েছে তোমাকে??
মেয়েটি ভয় পেলো।কেঁপে কেঁপে বলল,
— আ.. আমাকে তো সুভা ম্যাম ডেকেছে.. আজকের জন্যে।
রুদ্র ভালোভাবে তাকালো।খেয়াল করলো এবার।
‘কই এটাতো সেই মেয়ে নয়,এটাতো অন্য মেয়ে.. তবে যে একটু আগে সে দেখলো।কি ছিলো সেসব??

— আ..আমি কি তবে চলে যাবো স্যার??
রুদ্র নিজেকে সামলে জবাব দেয় ‘না’
দরজায় লক টেনে এগিয়ে আসে রুদ্র।হঠাৎ চোখে পরলো সেদিন রাতের দৃশ্য।ঐ মেয়েটা ঠিক এইভাবে বসে ছিলোনা? হ্যা এখানেই বসেছিলো।কেমন গুটিশুটি মেরেছিলো।কিন্তু কেন?এই মেয়েটিতো কী সহজ ভাবে বসে।সেই মেয়েটির কি হয়েছিলো তাহলে?
পরমুহূর্তে মাথাটাকে জোরে ঝাকালো রুদ্র।অসম্ভব! এই যন্ত্রনা সহ্য হচ্ছেনা তার।মেয়েটাকে এক দুবার দেখে এরকম ব্যাবহারের কোনো মানে আছে? মেয়েটা চুলোয় যাক,মরুক।তাতে তার কী এসে যায়?
রুদ্র বিছনার ওপর বসলো।মেয়েটির চোখের দিকে তাকাতেই সেঁজুতির জলে ভেজা চোখ দুটো খুঁজে পেলো যেন।আচ্ছা সেরাতে মেয়েটি কাঁদছিলো কেন?
উফ! আচ্ছা জ্বালাতো!
পরপরই তার চোখে ভেসে উঠলো সেজুথির বাচ্চা মেয়েটাকে খাইয়ে দেয়ার সময় ঠোঁটের হাসিটুকুন।
— উফফ কি হচ্ছে টা কি আমার সাথে??
মাথা চেপে ধরলো রুদ্র।

— কি…কি হয়েছে স্যার??
মেয়েটার কথায় চোখ তুলে তাকালো রুদ্র।একী আবার ওই মেয়ে? একদম তার সামনে বসে আছে? তাকে এত জ্বালিয়েও হচ্ছেনা।
— আবার?? আবার তুমি?? কি চাইছো হ্যা,,কি চাইছো.?? এখনও দাঁড়িয়ে আছো??বের হও,,আই সে গেট আউট ফ্রম হেয়ার।
রুদ্র গলার সব টুকু জোর দিয়ে চেঁচালো।মেয়েটির আত্মা শুকিয়ে গেলো ভয়ে।মনে মনে রুদ্রকে পাগল উপাধি দিয়ে রুম ছেড়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো সে।
রুদ্র এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেলো।বিড়বিড় করলো,
— কি চায় ওই মেয়ে?
________
অভ্র গালে হাত দিয়ে বসে আছে।বাম হাতে পেপার ওয়েট ঘোরাচ্ছে মন দিয়ে।এমন সময় সুভার কল দেখে ভ্রু কোঁচকালো। কানে ধরতেই সুভা ফটফটে কন্ঠে বলল,
হ.. হ্যালো স্যার,,,স্যার।
— ইয়েস মিস সুভা,বলুন..( অভ্র)
সুভ্রা হা-হুতাশ করে বলল,
— ইয়ে মানে স্যার,,বস তো মেয়ে টাকে রুম থেকে বের করে দিয়েছেন।
অভ্র বুঝলোনা,
‘বের করে দিয়েছে মানে
‘ জ্বি স্যার মেয়েটিতো তাই বলল।স্যার নাকী খুব রাগারাগি ক
রেছে।ধমকেছে।এত জোরে কখনও ধমক খায়নি বলে মেয়েটি সেই থেকে নাকেচোখে জল দিয়ে কাদছে।
‘ নিশ্চয়ই মেয়েটি কিছু করেছে।নাহলে শুধশুধু ভাই বের করে দেবে কেন?ভাইতো নিজেই গেলো।
‘ স্যার আমিও তাই ভেবেছিলাম।কিন্তু স্টাফ রা অনেকে স্যারের চিৎকার চেঁচামেচি শুনেছে।আর সব থেকে বড় কথা মেয়েটি কিছু করলে স্যার আমাকে বলতেন।হুশিয়ার করতেন যেন এরকম না হয়।তাতো করলেন না।
অভ্র বিভ্রান্তিতে পরলো।রুদ্রর হয়েছেটা কী?
— ভাই কি বেড়িয়ে গেছে ওখান থেকে??

— জি। কিছুক্ষন আগেই বের হলো।
অভ্র ছোট করে বলল, ‘ ওহ ওকে।
সুভা তাৎক্ষণিক ধৈর্য হারা হয়ে বলল,
‘ স্যার আসল কথাতো বলিনি।
‘ কি কথা?
সুভা উদ্বেগ নিয়ে বলল,’ স্যার যাওয়ার সময় কড়া করে বলে দিয়েছেন,উনি না বলা অব্ধি আর কোনও মেয়ে যেন এখানে না আসে।
অভ্র বিষম খেলো যেন।কেশে উঠলো একেবারে।হতচকিত কন্ঠে বলল,
— হ্যা?অসম্ভব!কি যা তা বলছেন। মিস সুভা আই থিংক আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
সুভা প্রচন্ড কনফিডেন্স নিয়ে বলল,
— না স্যার সত্যি বলছি।
অভ্রর মাথা ঘুরছে।
— ঠিক আছে আমি দেখছি..
‘ওকে স্যার।
লাইন কেটে ফোনের দিক তাকিয়ে থাকলো অভ্র।
ভাইয়ের হয়েছে টা কি?নিজেই তো মেয়ে পাঠাতে বললো,নিজেই আবার বের করে দিলো।
এখন আবার এসব কী শুনলাম? অভ্র দুহাতে তুলে বলল ইয়া খোদা! আমার ভাইয়ের ওপর যেন জীন ভূতের আছর না পরে।

পরেরদিন…..
সকাল আনুমানিক এগারোটা।সেঁজুতি বাজারে গিয়েছে অনেকক্ষন।আমির বাসার পেছনের বারান্দায় বসে ছিলেন।সেখানে অনেক গুলো ফুল গাছের টব।দু একটা সব্জিও আছে।সে কিনে এনেছিলো,আর যত্ন করে লাগিয়েছিলো সেঁজুতি। হঠাৎ ডোরবেল বাজলো।সেঁজুতি এলো বোধ হয়।হুইল চেয়ার চালিয়ে সদর দরজার দিক এগোলো আমির।দরজার নিচের দিকের সিটকিনি খুলে দিতেই হা হয়ে মেলে গেলো সেটি।ওপাশে
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন যুবকিটে চিনতে পারলেন না তিনি।তবে চেনা চেনা লাগছে অনেক।কোথাও যেন দেখেছে।খুব বেশি না ভেবে বলল,
‘আপনি?? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না,,
রুদ্র ফুল্যি এটিটিউডের সাথে জবাব দেয়।
— রুদ্র,,রুদ্র রওশন চৌধুরী..
নাম শুনেই চিনে নিলেন আমির।এই লোক কে তো কয়েবার টিভিতে দেখেছে।পত্রিকায় ও পড়েছে এর সম্পর্কে। নামি ব্যাবসায়ী।অঢেল টাকাপয়সার মালিক।এত কম বয়সী ছেলের এত সাফল্যের কথাইতো প্রতিনিয়ত নিউজ হয়।
এত বড় বিজনেস ম্যান তার বাসায় ঠিক কি জন্যে আসবে?? ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না আমির।তবুও এসেছেন যখন সেতো অতিথি।আমির খানিক পাশ ঘেষে গেলেন।রুদ্রকে বললেন
— ভেতরে আসুন…রুদ্র ভেতরে ঢুলো।চারপাশে একবার চোখ বোলালো। মধ্যবিত্তের বাসা ঠিক যেমন হয় এটা ঠিক তেমনই। কোথাও কোনো বাড়তি কিছু নেই।যা দরকারী ঠিক তাই।দেয়ালে কতগুলো হ্যান্ড ক্রাফটের কাজ টাঙানো অবশ্য।

— বসুন না…
রুদ্রর চশমার গ্লাস ভেদ করে আমিরের দিকে তাকালো।গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ আমি এখানে বসতে আসিনি.. আব,,কি যেনো নাম?সিথি…উম না সেজুতি?হ্যা সেঁজুতি। আপনার কে হয়??
আমির বিচলিত কন্ঠে বলল,

— আ.. আমার মেয়ে,,কেনো বলুন তো?কিছু হয়েছে?
— ডাকুন ওনাকে।আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর চাই।

— ওতো এখন বাসায় নেই,,,
আপনি আমাকে বলতে পারেন..

রুদ্র চোখ ছোট করে বলল,
— বললাম না,,প্রশ্নের উত্তর ওনাকে দিতে হবে। কোথায় গিয়েছেন উনি?
— কিছু জিনিস আনতে গিয়েছে।আসলে আমার এই অবস্থা,তাই বাজার থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সব টাই মেয়েটাকে সামলাতে হয়।আপনি বসুন না,ও চলে আসবে…
রুদ্র তীব্র অহংকারে ফেটে পরে বলল,
— অপেক্ষা করতে আমি পছন্দ করিনা।আপনি বরং ওনাকে একটা কথা বলে দেবেন।

— কি কথা??
রুদ্র এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল
— এটাই যে,, তৃতীয় বার যদি রুদ্র রওশন এর পাঠানো তওফা ফেরত দেয়া হয় তার ফলাফল খুব একটা ভালো হবেনা ওনার জন্যে।
আর এক মুহুর্ত দাড়ালোনা রুদ্র।গটগট করে হেটে বাসা ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।আমির নাক মুখ কুঁচকে চেয়ে রইলো সেদিকে।

— হাটুর বয়সী ছেলের কি এটিটিউড!পয়সাওয়ালা হলে যা হয় আর কি….ভদ্রতা বলতে কিচ্ছু নেই।
কিন্তু এমন উগ্র লোকের সাথে আমার মেয়ের কি দরকার?? আর কোন তওফার কথাই বা বলছিলেন উনি???

চলবে…

প্রনয় পর্ব-২+৩

0

#প্রনয়
# নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্ব-২+৩
ভ্যাপসা গরম।বাইরে তেজী সূর্য থাকলেও এখানে প্রচন্ড অন্ধকার।হাত খুঁজে পাওয়াও মুশকিল।মাথার ওপর জ্বলছে হলদে লাইট।হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে পরে আছে আলতাফ।চারপাশে কালো পোশাকের বন্দুকধারী লোক সব।এদের দেখতেই ভয়ে জড়োসড়ো সে।এত কাহীনি করে পালিয়েও বাঁচা গেলোনা।রুদ্রর লম্বা হাতের সামনে নিজেকে এখন চুনোপুঁটি বলতেও দ্বিধা হচ্ছে।ঠিক লোকটা খুঁজে নিলো তাকে।ধরেও ফেলল।আর শেষ মেষে এখন সে জান হাতে নিয়ে বসে আছে এখানে।যে কোনো সময় রুদ্র আসবে আর দ্যা এন্ড করে দেবে তার।
আলতাফের ভাবনার মধ্যেই কতক পায়ের আওয়াজ ভেসে এলো কানে।রুদ্রকে দেখতেই ভয়ে কলিজা হাতে চলে এলো তার।লোকটা আজ তাকে মেরেই ফেলবে।পেছনে অভ্র আছে।রুদ্র এসেই ঠিক তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসলো।তাকালো।আলতাফের দিকে। এইতো, এই দৃষ্টি দেখলেই আলতাফের পানি শুকিয়ে আসে দেহের।রক্তশূন্যতায় মাথা ঝিমঝিম করে।কি কুক্ষনে যে রুদ্রর বিরোধিতা করতে গিয়েছিলো বুঝে পেলোনা। রুদ্র তাকিয়েই থাকলো।ছোট ছোট চোখ দুটো ধারালো অস্ত্র যেন।হুট করে এক টান দিয়ে আলতাফের মুখে লাগানো স্কচটেপ টা টেনে খুলল।ঠোঁটের চামড়া যেন ছিড়ে নিলো মনে হলো আলতাফের।তবে কথা বলার সুযোগ পেয়েই হাসফাস করে উঠলো সে। আর্তনাদ করে বলল,
‘ স্যার আমার ভুল হয়ে গিয়েছে আমাকে ক্ষমা করে দিন।আর জীবনে এই ভুল করবনা আমি।
রুদ্র যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলো।আলতাফ শেষ করতেই হেসে উঠলো সে।আলতাফের ভয় গাঢ় হলো আরো।শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো।রুদ্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ ভুল? আচ্ছা? ওকে ফাইন,আজকে তোমাকে ক্ষমা করলাম।তারপর আলতাফ? তারপর তুমি আবার আমার গোপন খবর কালেক্ট করে রওনাফ কে দিয়ে আসবে তাইতো?
আলতাফ শুকনো জ্বিভ নেড়ে উত্তর দিতে পারলোনা।চোখ দিয়ে আকুতি ঝরালো।দুদিকে মাথা নাড়লো ঘনঘন।এই কাজ ভুলেও সে আর করবেনা।বহু কষ্টে আওড়ালো,
‘ সেকেন্ড চান্স স্যার…

‘ রুদ্রের ডিকশোনারীতে সেকেন্ড চান্স বলে কিছু নেই।

ঠান্ডা স্বরে বলল রুদ্র।যে স্বরে হিম হয়ে এলো প্রত্যেকের গা।রুদ্র হাত পাতলো। মুহুর্তেই হাতের তালুতে কেউ একজন হাজির করলো কালো গান।যেটা দেখতেই আলতাফের চোখ উঠে এলো আকাশে।হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে বার হলো যেন।রুদ্র সময় নিলোনা।একেবারে শ্যুট করলো আলতাফের বুক বরাবর। আলতাফ উল্টে পরলো মেঝেতে।গলা কা/টা মুরগীর মতো ছটফট করলো খানিক ক্ষন।এরপর ঝিমিয়ে পরলো।রুদ্র হাতের রিভলবার আলতাফের ব/ডির পাশে ছুড়ে ফেলল।গ্লাভস দুটো খুলে অভ্রর দিকে তাকালো।কপাল জুড়ে ঘামে জুবুথুবু ছেলেটা।রুদ্র বডি দেখিয়ে ইশারা করলো,

‘ এটার যেন কোনও চিহ্ন না থাকে।

– ওকে ভাই,,ওর টিকিটাও কেউ খুজে পাবেনা।

– গুড..
– কথা শেষ করে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো রুদ্র।হঠাৎই একটি গুলির শব্দ। কান ঝাঝিয়ে উঠলো অভ্রর।ওদিকে প্রচন্ড পিঠ ব্যাথায় কাত/রে উঠলো রুদ্র।ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই পেছনে ফিরে তাকালো রুদ্র।উপস্থিত সকলে হতচকিত, হতভম্ব তখন।বুঝে ওঠার আগেই পরপর আরো দুইটা গু/লি ছুড়লো আলতাফ।রুদ্র কুকড়ে উঠে পিছিয়ে গেলো দুপা।চেপে ধরলো বুক।আলতাফ কুটিল হেসে বলল,

-কি ভেবেছিস আমাকে মা/রবি?আমিতো মর/বো জানি,কিন্তু তার আগে তোকে মেরে যাব।তোকে তো শেষ করাই লক্ষ্য ছিলো আমাদের।কিন্তু সেটা economically,,, এবার ফিজিক্যালিও করে দিলাম আমি।
-ব্যাপার টা এতোটাই দ্রত ঘটে গেছে যে অভ্র সহসবাই বেশ ভড়কে গিয়েছিলো।
হুশ আসতেই কালো পোশাকের একজন গিয়ে মাথা বরাবর লা/থি বসালো আলতাফের।ব্যাথায় আর্তনাদ করে হাত থেকে রিভলবার ফেলে মাথা চেপে ধরলো..আলতাফ।লোকটা আরো কয়েকটা লাথি মারলো একিজায়গায়।সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত প্রত্যেকে আলতাফ কে গু/লি করতেই শার্ট ছিড়ে ঝা/ঝ/ড়া হলো তার বুক।এদিকে বুকে হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো রুদ্র।ভাই বলে এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ছুটে গেলো অভ্র।

– রেহান গাড়ি বের করো ফাস্ট।

গাড়িতে রুদ্রর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে অভ্র।গায়ের জামা র/ক্তে মাখামাখি তার।পাগলের মতো কতক্ষন হাত ডলছ্ব রুদ্রর কতক্ষন হাত বোলাচ্ছে মাথায়।যত দ্রুত সম্ভব ড্রাইভ করছে রেহান।বয়স কম লোকটার।প্রথমে তার বাবা ড্রাইভার ছিলেন রুদ্রদের।এখন সে।কিন্তু এরকম অবস্থায় আজ প্রথম পরলো। রুদ্র কে কখনও রক্তারক্তিতে সরাসরি অংশ নিতে দেখেনি সে।হ্যা আন্ডারওয়ার্ল্ড-এ রুদ্রর আনাগোনা আছে।কিন্তু সেটাত প্রত্যক্ষ ভাবে নয়।

‘স্যার,,এই মুহুর্তে ভালো ক্লিনিকে নিতে গেলে স্যার কে বাচানো যাবেনা,,কাছের কোনও হাসপাতালে নেই?

রেহানের কথায় অভ্র আরো ভয় পেলো।
– যেটা ভালো হয় করো,কিন্ত তাড়াতাড়ি করো প্লিজ,,ভাইয়ের সেন্স চলে যাচ্ছে…

______
স্ট্রেচারে করে দুজন নার্স রুদ্র কে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে নিয়ে গেলো।অভ্র পায়চারী করত্ব শুরু করলো সমানে।চিন্তায় রুহু কাঁপছে তার।তার মাথার ওপর এই একজনই আছে।যাকে বলে বটবৃক্ষ। এই ভাই-ই তার সব,,ভাইয়ের কিছু হলে সে যে একদম একা।

টানা এক ঘন্টা পর ওটি থেকে ডা: হোসাইন বের হয়।লম্বায় ছয় ফুট লোকটা।দেহের গড়ন প্রসস্থ বেশ।চেহারার আদলে একটা শ্রদ্ধা ভাজন ভাব আছে।ওনাকে দেখতেই এগিয়ে এলো অভ্র,,

‘ভাইয়ের কি অবস্থা ডক্টর,,?
দৈণন্দিন এমন হাজার পেশেন্ট আসে দোরগোড়ায়। এতে অভ্যস্ত হোসাইন।তবুও অভ্রের ব্যাকুলতা দেখে উনিও বেশ চিন্তিত কন্ঠে বললেন,
– অনেক টা ব্লি/ডিং হয়ে গিয়েছে,, এমার্জেন্সী ব্লা/ড লাগবে…

– তো অপেক্ষা করছেন কেনো?

– দেখুন ও -নেগেটিভ একটি রেয়ার ব্লা/ড গ্রুপ,,সচরাচর পাওয়া যায়না,,আর আমাদের এখানেও সংগ্রহ করা নেই এখন।প্রতিনিয়ত এমন অনেক পেশেন্ট আসে যাদের ব্লাড দিতে হয়।সব সময় হাসপাতাল মজুদ রাখতে সক্ষম হয়না।
অভ্র জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো,
– বুঝেছি,,আমি ব্লাড ব্যাং/ক থেকে আনানোর ব্যাবস্থা করছি

‘ তাড়াতাড়ি করবেন।অবস্থা ভালো না।

‘শুনুন।
পাশ থেকে মেয়েলী আওয়াজে যেতে যেতে ফিরে তাকালো অভ্র।হোসাইন ও তাকালো একিভাবে।অভ্র বলল,
‘ আমাকে বলছেন?

– আমি একটু আগে আপনাদের সব কথা শুনেছি।আসলে
আমারও সেইম ব্লা/ড গ্রুপ,আমি র/ক্ত দিতে চাই।.

– পেশেন্ট কে তুমি চেনো?

হোসাইন অতি আগ্রহে করে ফেলল প্রশ্নটা।সেঁজুতি সহজ কন্ঠে বলল
– আব,না…কিন্তু তোমাদের কথায় বুঝলাম ব্যাপার টা অনেক সিরিয়াস,,,ইমিডিয়েট র/ক্ত প্রয়োজন।

অভ্রর বিষয়টা ভালো লাগেনি।সে তিরিক্ষ মেজাজে বলল,
– আপনাকে র/ক্ত দিতে হবেনা,আমি র/ক্ত নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করছি,,আমার একটা ফোন কলেই এখানে ব্লা/ড ব্যাংক বসে যাবে।

সেঁজুতি ভ্রু কোঁচকালো। কিন্তু শান্ত কন্ঠে বলল,
– দেখুন আমি জানি,,আপনাদের টাকা আছে তাই এইগুলো হতেই পারে।কিন্তু এই হস্পিটালের ব্লা/ড ব্যাংক গুলো অনেকটা দূরে।,ব্লা/ড নিয়ে আসতে আসতে ঘন্টা খানেকতো লেগেই যাবে,
এতক্ষনে যদি পেশেন্ট এর ভালো মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়?তখন আপনার বসানো ব্লা/ড ব্যাংক কোনও কাজেই লাগবেনা আপনার,তাই বলছিলাম ব্যাপারটা ভেবে দেখুন,,
হোসাইন বললেন,

– মি, অভ্র.. মেয়েটা ঠিকই বলছে,পেশেন্ট এর তিনটি গুলি লেগেছে এবং একই জায়গায়,,বুঝতে পারছেন সিচ্যুয়েশন কতটা ক্রিটিকাল? হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই,
অভ্র সময় নিলো।ভাবলো।দুজন মানুষ চেয়ে আছে তার দিকে।ওদিকে রুদ্রর অবস্থাও ভালো না।তাই বলল,
– আচ্ছা বেশ,,প্লিজ যা করার তাড়াতাড়ি করবেন,,
ভাইয়ের যেনো কিছু না হয়

– আমি আমার বেস্ট টা দিয়ে ট্রাই করবো,,সেজুতি মা আমার সাথে এসো।

ওনারা যেতেই অভ্র পায়চারী শুরু করলো আবার।
মেয়েটার থেকে র/ক্ত নেয়া কি ঠিক হলো?
কোনও মেয়ের র/ক্ত ভাইয়ের শরীরে,এটা শুনলে ভাই যদি রেগে যায়??কিন্তু করারতো কিছুই ছিলোনা।
ভাই নাহয় দুটো ধমক দেবে।
ভাইকে বাচাতে এটুকু সহ্য করে নিতে পারবো আমি,,

– হয়ে গেছে,
– হাতের স্ট্রিপ খুলতে খুলতে বললেন হোসাইন।

সেঁজুতি আস্তে করে উঠে বসলো।
– ঠিক আছে তবে আমি আসছি।
– যেতে নিতে আবার ফিরে এলো। মনে করার ভঙিতে বলল,
ওহ হ্যা,,বাবার সামনে ভুলেও বলতে যেওনা,,খুব বকবে..
হোসাইন মাথায় হাত বোলালো ওর,
– আচ্ছা বেশ বলবোনা,,

– আচ্ছা..
সেঁজুতি চলে গেলো।হোসাইন দম ফেলল বড় করে।
‘মেয়েটা বড্ড বেশি ভালো,,আমির তুই বড্ড ভাগ্যবান এমন হীরের টুকরো মেয়ে পেয়েছিস।

সেঁজুতি বের হতেই হাতে থাকা চেক টা ওর দিকে এগিয়ে দিলো অভ্র।’নিন
সেঁজুতি কপাল কুঁচকে বলল
– কি এটা?

– এখানে দু লাখের এমাউন্ট দেয়া আছে,কম হলে বলবেন,,বাড়িয়ে দেয়া হবে।
শত হলেও আপনি আমার ভাইকে বাচিয়েছেন।

সেঁজুতির এতক্ষনের ভালো মেজাজ তেঁতে গেলো মুহুর্তেই।
– আমি কি আপনার কাছে র/ক্ত বেচেছি?
অভ্র হাত গোটালো।বলল।
– না তা কেন হবে?আমি তো তা বলিনি।

সেঁজুতি কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।
– তবে কি এটা বোঝাতে চাইছেন আপনারা অনেক বড়লোক?আপনাদের অনেক টাকা? শুনুন,
আমি আপনার ভাইকে টাকার বিনিময়ে বাচাইনি।বাঁচিয়েছি নিজের বিবেক থেকে। এই এটা,দেখিয়ে আপনি আমাকে অপমান বৈ কিছুই করলেন না।আর সত্যি বলতে আপনাদের বড়লোক দের এমন স্বভাবের জন্যেই বিপদ এর সময়ে আপনারা কাউকে পাশে পান না। প্রত্যেক টা মানুষেরই আত্বসন্মান আছে জেনে রাখবেন।টাকা দিয়ে সব সময় সেটাকে পরিমাপ করতে কেন যান? এছাড়া আপনাদের আর কাজ নেই নাকী?যত্তসব!

.সেঁজুতি মুখ ঝামটা মেরে চলে গেলো।অভ্র এতক্ষন হা করে তাকিয়ে ছিলো ওর দিকে।
সেজুথির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে অভ্র বিড়বিড় করে বলে উঠলো..

– বাপরে,,মেয়ে তো নয়,,একেবারে ঝাল মরিচ
_____

প্রায় তিন দিন লেগে গেছে রুদ্রর,,পুরোপুরি সুস্থ হতে।বুকের ব্যান্ডেজ ও খোলা হয়েছে।কদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে এখন।অভ্র একটা মস্ত বড় ফুলের বুকে নিয়ে ঢুকলো কেবিনে।হাসি হাসি মুখ করে বলল,

– ভাই এখন কেমন আছো?
রুদ্র ছোট করে বলল,
– ঠিক আছি

– যাক।জানো কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।
কত ব্লিডিং হয়ে ছিলো তোমার।ডক্টর তো আমাকে রীতিমতো ঘাবড়ে দিয়েছিলেন।
ব্লা/ড ব্যাংক গুলোও এখানে অনেক দূরে দূরে,,টাইমলি যে হাতের কাছে পাওয়া যাবে সেরকম কোনও সুযোগ ই নেই জানো?এটার কোনো মানে হয় বলো?
ভাগ্যিস ওই মেয়েটা সময় মতো র/ক্ত দিয়েছিলো নাহল
রুদ্র মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল

– কোন মেয়ে?

হুশ আসতেই জ্বিভ কাটলো অভ্র,
‘এইরে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই কেনো সন্ধ্যা হয়,ভাইয়ের সামনেই বেফাস কথা বলে দিলো…এবার কি হবে???

রুদ্র গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
– কিছু জিজ্ঞেস করেছি অভ্র,,
অভ্র উশখুশ করলো খানিকক্ষন।ধমক শোনার জন্যে প্রস্তুতি নিলো।আমতাআমতা করে বলল,
– একটা মেয়ে র/ক্ত দিয়েছে ভাই,আমি চিনিনা তাকে,, ঢোক গিলে)আ,আমি নিতে চাইনি..কিন্তু তোমার যা অবস্থা ছিলো এছাড়া কোনও ওয়ে ছিলোনা,,

রুদ্র শান্ত ভাবে প্রশ্ন ছুড়লো,
– ,,কত এমাউন্ট দাবি করলো?

রুদ্রর কথায় অভ্র শতাধিক আগ্রহ পেলো। উদ্বেগ নিয়ে বলল,
– একটা টাকাও নেয়নি ভাই,,উল্টে আমি টাকা দিতে যাওয়ায় আমাকে কত গুলো কথা শুনিয়ে দিয়েছে…

রুদ্র অবাক চোখে তাকালো।পরমুহূর্তেই কিছু একটা ভেবে বলল,
‘ওকে ফাইন,, মেয়েটার এড্রেস কালেক্ট কর।আর টাকা পাঠিয়ে দে।ইউ নো না?রুদ্র রওশন চৌধুরী কারো ঋন রাখেনা…

– ওকে ভাই,,আমি পাঠিয়ে দেবো…

– হুম চল।
– .রায়জাদা কোম্পানির সাথে ডিল টা আজকেই ফাইনাল করতে হবে..
অভ্র চোখ দুটো বড় বড় করে বলল,
– সেকি? এই অবস্থায়?? আমি বলিকি আজ ছেড়ে দাও…
– রুদ্র ঠান্ডা স্বরে বলল,
– বিজনেসে আমি কখনও আপোস করিনি..অভ্র।.আর না করবো..

অভ্র বুঝলো তার বলে লাভ নেই।রুদ্র কী কথা শোন্র লোক?মাথা নেড়ে বলল
– ঠিক আছে।

করিডোরের কাছে এসে অভ্র দাঁড়ালো।রুদ্রর দিক ফিরে বলল,

– ভাই,তুমি একটু দাড়াও,,আমি বিল আর বাকী ফর্মালিটিস গুলো সেড়ে আসছি…
রুদ্রর ছোট উত্তর,
– হুম…
অভ্র রিসপশনের দিক হেটে গেলো হেলেদুলে।
রুদ্র করিডোরে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।,চারপাশে কত লোকজন , কেউ কাদছে,কেউ মূর্তির মতো বসে আছে নিরবে।আচ্ছা, এরা তো কোনও না কোনও রোগীর ফ্যামিলি।তীব্র অপেক্ষায় তাদের কাছের মানুষ, আপনজন কবে সুস্থ হবে তার। আজ যদি সে মরে যেত এভাবে কেউ কি কাঁদতো?
কি অদ্ভূত.. তার মত হয়তো একেবারে একা কেউ নেই…সে মরে গেলে দুফোটা চোখের জল ফেলার ও কেউ নেই।এরকম শাস্তিও হয়?টাকার কুমির লোকটা নিতান্তই একা।

ভাবার একফাকে রুদ্রর চোখ পড়লো কিছুটা দূরে। সাদা ড্রেস পরিহিতা একটি মেয়ে।মেয়েটিকে খুব সম্ভবত একজন ডাক্তার প্রেস্ক্রিপশন দেখিয়ে কিছু একটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন।মেয়েটিও মাথা নেড়ে নেড়ে বুঝে নিচ্ছে।
ব্যাপার টা আহামরি কিছু নয় হয়ত।.
কিন্তু তবুও রুদ্র কিছুক্ষন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে।তার মনে হচ্ছে মেয়েটিকে সে কোথাও একটা দেখেছে।
– এটা তো সেই মেয়ে যে লাস্ট নাইট আমার বেড পার্টনার ছিলো…..

চলবে…

# প্রনয়
নুসরাত সুলতানা সেজুতি
পর্ব – ৩

কথাটা মনে পড়া মাত্রই মুখ ঘুরিয়ে নিলো রুদ্র।অদ্ভূত ঘৃনা লাগলো তার।এসব মেয়েদের প্রতি তার ইন্টারেস্ট ওই রাত অব্দিই।এরি মাঝে হাজির হলো অভ্র।

— ভাই হয়ে গেছে চলো

— হুম..

সেঁজুতি কেবিনে ঢুকলো।বেডের ওপর একজন পৌঢ় বসে আছেন।সেঁজুতি ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন,
কিরে মা কোথায় গিয়েছিলি?

— ডাক্তারের থেকে সব ওষুধ বুঝে নিলাম বাবা,,আজকে তোমার রিলিজ হয়ে যাচ্ছে কিনা..

আমির দম ছেড়ে বলল
— যাক,, এবার অন্তত বাড়ি ফিরতে পারবো,,এতদিন এই চার দেয়ালে দম আটকে আসছিলো একেবারে
তখনি কেবিনে ঢুকলেন হোসাইন।আমিরের কথা কানে যেতেই বললেন,
— কেনো রে শালা,, এখানে আদর যত্ন কম পড়ে গেছিলো নাকি?

আমির বিস্ময়ে হতবাক হলো যেন।
— হোসাইন!তুই এখানে?কখন এলি?
হোসাইন আমিরের পায়ের কাছে বসলেন,
— কাল রাতেই এলাম,,সিভিয়ার কেস ছিলো একটা,, আর এসেই একটার পর একটা সামলাচ্ছি,,তবে তুই যে এত টা অসুস্থ সেটা কিন্তু জেনেছি এখানেই এসেই…

— সেজুথি বলেছে?

— হ্যা ওর থেকেই না শুনলাম,,যাক আল্লাহ বাচিয়েছেন,এরকম মেজর এট্যাক হলে রোগীর বাচার চান্স কিন্তু খুবই কম থাকে।
আমির মলিন হাসলো,

— ওই আর কি,,একটা পা খুয়িয়েছি,এখন তো বেচেও মরার মত থাকতে হবে.. এই যা..

সেঁজুতি ওষুধ পত্র গোছগাছ করছিলো এতক্ষন।কথাটা শুনতেই কপট রাগ নিয়ে বলল,
— বাবা? তুমি আবার এসব বলছো?

আমির হাসলো।
— আচ্ছা বাবা,,আর বলবোনা,,

— মনে থাকলেই হলো।
আচ্ছা, আমার কিন্তু সব গুছিয়ে নেয়া শেষ, বিল ও পেইড হয়ে গেছে,,এবার আমরা যেতে পারি..
ডক্টর আংকেল তুমিও চলো।

হোসাইন ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল,
— নারে মা,,সে সুযোগ কি আর আছে,,এখন আবার পেশেন্ট দেখতে হবে।
তবে আমির.. ডাক্তার মেহরাবের সাথে আমার কথা হয়েছে তোকে কিন্তু ফুল বেড রেস্টে থাকতে হবে,,ওকে??

— সে আর বলতে,এই যে আমার মা আছে না( সেজুথির দিকে তাকিয়ে),,খুব শাসন এ রাখে আমাকে..

— ঠিক আছে, তবে আমি এখন উঠি.. পরে গিয়ে দেখে আসবো তোকে।
সেজুথী মামুনি.. বাবার সাথে সাথে নিজের ও খেয়াল রাখবে কেমন ( মাথায় হাত বুলিয়ে)

— আচ্ছা..
সেঁজুতি হাল্কা হেসে মাথা এলালো।
_____

রুদ্র রওশন ইন্ডাস্ট্রিজ এর ভেতর থেকে বের হলো অভ্র আর রুদ্র।প্রখর রোদে গা পুড়ে যাওয়ার জোগাড়।অভ্র রুদ্রর দিক চেয়ে হাফ ছেড়ে বলল,

যাক বাবা এট লাস্ট ডিল টা ফাইনাল হলো,,কত দিন ধরে ঝুলে ছিলো আল্লাহ।

— তোর ওপরে দায়িত্ব দিলে এটাই নরমাল
অভ্র মুখ হা করে বলল,
— আমি? আমি আবার কি করলাম?তাছাড়া নতুন চাল কি ভাতে বাড়ে নাকি . এই জন্যেই না।আমিতো এখনও তোমার থেকে শিখছি..

অভ্রর বকবক রুদ্র শুনলোনা কীনা কে জানে! বলল,
‘রেহান কে গাড়ি গেটের সামনে নিয়ে আসতে বল..

মিনিট পাচেকের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলো রেহান।ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে ব্যাক সিটের দরজা খুললো সে।
— উঠুন স্যার..

-গাড়িতে উঠতে গিয়ে রুদ্র হঠাৎ লক্ষ্য করলো রেহান কে স্বাভাবিক লাগছেনা।দুশ্চিন্তায় মুখটা ছোট হয়ে আছে।রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো,

— তোমার কিছু হয়েছে রেহান?

রেহানের মন আরো খারাপ হলো এতে।এবার নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে রইলো।

‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি তোমাকে?

রেহান মুখ ভার রেখেই বলল,
‘আসলে স্যার,,আমার মা আর আমার মেয়ে দুজনারই জন্ডিস হয়েঁছে.. বাবাও বেচে নেই,আর বাড়িতে পুরুষ মানুষ আমিই একা,,এই মুহুর্তে আমার ওখানে থাকা টা খুব দরকার,,যদি আমাকে কদিনের ছুটি দিতেন।
রেহান অসহায় মুখ করে তাকালো।
মা অসুস্থ কথা টা শুনে রুদ্রর চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলেও মেয়ের কথা শুনে পরক্ষনেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,

— কদিনের ছুটি লাগবে তোমার?

— দিন চারেকের স্যার..

— হুম…………….অভ্র?

পাশ থেকে অভ্র জবাব দেয়,
হ্যা ভাই,,

—ওকে এ মাসের এডভান্স সহ এক সপ্তাহের ছুটি দিয়ে দে

আর হ্যা,( রেহানের দিকে তাকিয়ে)
তোমাকে তোমার মায়ের জন্যে ছুটি দিচ্ছিনা আমি,,
দিচ্ছি তোমার মেয়ের জন্যে,গট ইট??

রুদ্রর উদারতায় রেহানের চোখে পানি এসে গেছিলো।এইতো এক মাস আগেই ঈদের ছুটি ছিলো তার।আজ তাই আবার ছুটি চাইতে ভীষণ অস্বস্তি আর ভয় লাগছিলো।কিন্তু রুদ্র এত সহজে ছুটি দিলো সাথে না চাইতে টাকাও।লোকটা আসলেই নারকেলের মতো।ওপর টা শক্ত ভেতরটা তুলতুলে হয়ত।কী জানি! দেখা হয়নি কখনও।

গাড়িতে উঠে বোসলো রুদ্র,আর তার পাশে অভ্র।
অভ্র খেয়াল করলো রুদ্র গাড়ির জানালা দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে।মুখে রা নেই।এই মুহুর্তে রুদ্রর মনে কি চলছে অভ্র হয়তো আচ করতে পারলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবলো

— ভাই যে তার মা কে কেন এত ঘৃনা করে কে জানে!

রাতের বেলা,
রুমে বসে পড়ছিলো সেজুতি।পড়ায় নাক মুখ ডুবে আছে তার।এতদিন অনেক পড়া মিস হয়ে গিয়েছে। আর সামনেই ফাইনাল।কি করবে! কোন দিক যাবে।পাশ হবে কীনা আল্লাহ জানেন।

কিছু সময় পর,হাতে করে এক গ্লাস গরম দুধ এনে টেবিলের ওপরে রাখলো আমির।বড় আহ্লাদী স্বরে বললেন,
‘দুধ টা খেয়ে নাও তো মা.

সেঁজুতি যেন আঁতকে উঠলো বাবাকে দেখে।
— সেকি? তুমি এ অবস্থায় কেনো নিয়ে আসতে গেলে.. আমাকে ডাকলেই পারতে বাবা।

আমির হাসলেন,
— আমি ঠিক আছি রে মা,
সেঁজুতি রেগে গেলো।
— বাবা! ডক্টর আংকেল কি বললেন শোনোনি,এখন ফুল বেড রেস্ট।আর তুমি কীনা এভাবে হাটাহাটি করছো? পা ব্যাথা করবেনা?

আমির বিছানার ওপর বসতে বসতে বললেন,
— ডাক্তার রা ওরকম বলে।সারাদিন শুয়ে থাকা যায় নাকি…তাছাড়া আমি এক দম সুস্থ..এখন।পায়ে একটুও ব্যাথা নাই।

— আচ্ছা মেনে নিলাম তুমি সুস্থ,কিন্তু এই গ্লাস টা নিয়ে আসতে তোমার কত কষ্ট হয়েছে আমি জানিনা?

— আমার একটুও কষ্ট হয়নি,,পা গিয়েছে তো কি হয়েছে.. হাত দিয়ে কাজ করতে তো অসুবিধে নেই তাইনা,,আর তুই ওত ভাবিস না তো.. নে খেয়ে নে।।

পরমুহূর্তেই আমির অসহায় কন্ঠে বললেন,
‘হ্যারে মা? আমার জন্যে তোর পড়াশুনায় অনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছে তাইনারে?

সেঁজুতি উদ্বেগ নিয়ে বাবার পায়ের কাছে বসে বলল,
— না বাবা,,এরকম কেন হবে?
আমির মেয়ের মাথায় হাত বোলালেন,
— এই যে দিন রাত হাসপাতালে ছিলিস,,পড়তে পারিস নি,ঠিক মতো ক্লাসে যেতে পারিস নি..

সেঁজুতি হাসলো,
— বাবা! এটা আর এমন কি,,ক্লাসের নোটস আমি তোহার থেকে নিয়ে নেবো,,আর পড়াগুলো আগেই এগিয়ে রেখেছিলাম তো,,তাই অসুবিধে হবেনা..

— ঠিক আছে,,,নে পড়,,আমি বরং তোর পাশে বসি..

সেঁজুতি অবাক চোখে তাকালো,
— সেকি আমিতো রাত জাগবো,,তোমাকে ঘুমোতে হবে বাবা।

— সারাটা দিনই ঘুমিয়েছি,,এখন আর পারছিনা,,তুই পড় আমি বসে থাকি..তোর কিছু লাগলে আমি দেবো,,একদম আমাকে মানা করবিনা..

বাবার দিকে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো সেজুথি..চোখের কোনা গুলো চিকচিক করে উঠছে তার,,
বাবা তাকে কত ভালোবাসে,এমন বাবাকে কি হারিয়ে যেতে দাওয়া যায় নাকি? উহু…উলটে নিজের সর্বস্ব দিয়ে হলেও নিজের কাছে রেখে দিতে হয়…
….আর সেটাই তো করেছে সে।
__<<< ভাই আসবো? -- আয়.. অনুমতি পেয়ে অভ্র দরজা ছেড়ে ভেতরে এলো।রুদ্র আধশোয়া হয়ে ছিলো বিছানায়। --- ভাই বলছিলাম যে,,মিস সুভা আমাকে কল করেছিলো,একটা মেয়ে এসেছে। তোমার তো আজ শরীর টা ঠিক নেই,, আজ কে কি থাকবে? রুদ্র ঘাড়ে হাত বোলালো।সদ্যশান্ত কন্ঠে বলল, -- অভ্র... অভ্যাস বদলানো যায়,কিন্তু কু অভ্যাস কখনই নয়,, কথাটা শুনেছিস?আই থিংক এর বেশি কিছু বোঝাতে হবে না তোকে.. অভ্র মিটিমিটি হাসলো। -- ওকে ভাই বুঝে গিয়েছি,,মেয়েটাকে পাঠাতে বলছি আমি.. চলবে....

প্রনয় পর্ব-০১

0

#প্রনয়
লেখনীতে:নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
পর্বঃএক

নিশুতি রাত।গোটা গোটা অক্ষরে ‘আর আর সি ‘লেখা।যার পুরো অর্থ রুদ্র রওশন চৌধুরী।ঝা চকচকে একটা আবাসিক হোটেল এটি।ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেল গুলির মধ্যে অন্যতম।মিনিট খানেকের মধ্যেই একটি কালো রংয়ের বিলাসবহুল গাড়ি এসে দাঁড়ালো সেখানে।মুহুর্তেই হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন গার্ড হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে যায় সেদিকে।একজন গাড়ির দরজা খুলে দেয় নতজানুভাবে।সেকেন্ডের কম সময়ে গাড়ি থেকে এক জোড়া বুট পরিহিত পা এসে মাটিতে ঠেকে।ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হয় লোকটির পুরো শরীর। চোখে কালো সানগ্লাস,ছাই রঙা শার্টের সাথে কালো রঙের কোর্ট,চকচকে ঘড়ি বাঁধা বা হাতের কব্জিতে।গৌড় বর্নের সুদর্শন এ পুরুষটি ডানে বামে না তাকিয়েই হনহনিয়ে হেটে যায় হোটেলের ভেতরে।
চোখের কালো চশমা খানা খনিক বাদে তর্জনী দিয়ে ঠেলছেন তিনি।রাত্রিবেলা বুঝি কেউ কালো চশমা পরে? এ প্রশ্ন অনেকেরই।তবু করার সাহস নেই।কাকেই বা করবেন?ইনি কি পাত্তা দেবেন তাদের? হাটার এ্যাটিটিউড টাই যে বলে দিচ্ছে উত্তর। যেতে যেতে প্রত্যেক কর্মচারীর প্রদত্ত সন্মান তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি তার মধ্যে।এ যে এখন রোজকার ডাল ভাতের মতোন।টাকা যার,দুনিয়ায় সন্মান তার হতে বাধ্য বলেই মানে সে।

অত্র হোটেলের মালিক সে।এরকম আরো গুটিকয়েক হোটেল,রেস্টুরেন্ট,গার্মেন্টস তার অধীনস্থ বলে টাকার উঁচু পাহাড়ে বসবাস তার।ভদ্রতা আর চরিত্রের ঘাটতি সেখানে থাকলেও তিল পরিমান অহংকারের ঘাটতি মিলবেনা।
বয়স ২৯ এর কোঠায় ছুঁইছুঁই এখন।ব্যাক্তিত্বে অকল্পনীয় কঠোরতার প্রভাব।মায়া মমতাও নেই বোধ হয়।ঠোঁটের হাসি টাও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের মতো।অত্যাধিক মেজাজের দরুন ধারেকাছে খুব কম লোকের আনাগোনা ।তাতে কী? সেতো দিব্যি আছে,তার মতোন।

রুদ্র সোজা গিয়ে ঢুকলো ৪০৪ নম্বর রুমে।ধানমন্ডির এই হোটেলটি তার অধিক প্রিয় বলে নিজের সব থেকে পার্সোনাল কাজটি এখানেই সাড়া হয়।রুদ্র ভেতরে ঢুকে দরজার লক লাগালো। পুরো রুম অন্ধকারে ডুবে আছে।থাই কাঁচ ভেদ করে আলো এলেও অতি সমিহ করে উঠছেনা।রুদ্র সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো প্রথমে।চোখ রাখলো বিছানার ওপর।মাঝ বরাবর গুটিসুটি মেরে বসে আছে একটি মেয়ে।পড়নে পাতলা ফিনফিনে জর্জেটের শাড়ি।স্লিভ লেস ব্লাউজ।কানে ভারী দুটো ঝুমকো।মুখ ভর্তি মেক-আপ আর রং চটা লিপস্টিক।লাইট জ্বলতে সে যেন গুটিয়ে গেলো আরো।রুদ্রর চোখ এড়িয়ে শরীরের উন্মুক্ত অংশ একটু ঢাকতে চাইলো কী?কি জানি! রুদ্রর দেখার অতো সময় নেই।গায়ের কোর্ট,হাতের ঘড়ি আর সানগ্লাশ খুলে টেবিলের ওপর রাখলো।তীক্ষ্ণ চোখে খানিকক্ষন দেখলো মেয়েটিকে।এক রাতের জন্যে এতটা স্বাজার কি আছে?সেতো ওই স্বাজ ফিরেও দেখবেনা।
মেয়েটির দৃষ্টি মেঝে বরাবর। ভুলেও সে তাকাচ্ছেনা।মেলাচ্ছেনা চোখ।রুদ্র এগিয়ে আসে।মেয়েটা নিজেকে গুটিয়ে নিলো কিঞ্চিৎ। রুদ্র বিছানার ওপর বসলো।বাদামী রংয়ের চোখ দুটো দিয়ে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষন করলো সামান্য।মেক আপের দৌলতে গায়ের আসল রং বোঝা মুশকিল।তবে আজকের রাতের জন্যে চলনসই।
মেয়েটির হাতের ওপর হাত রাখতেই শক খাওয়ার মতো ঝাঁকুনি দিলো মেয়েটার শরীর।যেন এ স্পর্শ বড্ড অনাকাঙ্ক্ষিত।
রুদ্র মাথা ঘামালোনা।ঠোঁট দুটো এগোতেই মেয়েটি পিছিয়ে নিলো মাথাটা।রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো,মোটা কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো…
‘ হোয়্যাট হ্যাপেন্ড?
মেয়েটি ঢোক গিললো।কৃত্রিম আলোতে রুদ্র স্পষ্ট দেখলো মেয়েটির চোখের পানি।মেয়েটা কী কাঁদছে?কেন? তাকে তো জোর করে আনা হয়নি এখানে।এসেছে স্বেচ্ছায়।তবে?রুদ্র তাকিয়ে থাকলো।মেজাজ তার খারাপ হচ্ছে বৈকি।মেয়েটি জবাব দেয়ার নামই নিচ্ছেনা।এবার সে ধমকে একী প্রশ্ন আওড়ালো।তাৎক্ষণিক ওপাশ থেকে কাপাকাপা গলায় উত্তর এলো
‘দদুঃখিত!আ..পপনি কন্টিনিঊ করুন।

রুদ্র আর মাথা ঘামায়না।নিঃশব্দে বেড সুইচ টিপে লাইট নেভায়।লিপ্ত হয় তার দৈনন্দিন কর্মে।
রুদ্রের কাছে যাওয়ার পরিমান বেড়ে যায়।ঘনিষ্ঠতার মাত্রা যতটা অতিক্রম হয় মেয়েটির চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির পরিমান বেড়ে যায় তত।
কিন্তু রাতের অন্ধকারে সেটা আর চোখে পরেনা কারো।রাত গভীর হয় আরো।মেয়েটির মনে হতে থাকে সামনের লোকটি মানুষ কীনা! এতটা হিংস্রতা কোনো পুরুষের স্পর্শে থাকে বুঝি?অতি কষ্টে চাপানো কান্না বের হয় তাৎক্ষণিক।ফোঁপানোর শব্দে বিরক্ত হয় রুদ্র।ক্ষনিকের জন্যে থেমে রুঢ় শব্দে বলে,
‘ ব্যাথা পেলেও আই হ্যাভ নাথিং টু ডু।এখানে আসার আগে ভেবে নিতে হয়।

তখন সকাল দশটা।কড়া রোদ যেন একটু তাড়াতাড়িই হাত পা মেলেছে আজ।ফোনের রিংটোন এর শব্দে ঘুম ভাঙে রুদ্রর।
হাতড়ে টেবিল থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করতে ভেসে আসে উদ্বীগ্ন স্বর।রুদ্র কানে তোলেনা।উল্টে থমথমে গলায় বলে,
‘অভ্র, ডোন্ট ইউ নো দ্যাট, আই ডোন্ট লাইক ডিস্টার্বেন্স ইন টাইম অফ স্লিপিং..?

রুদ্রর ছোট ভাই অভ্র।কাজ সূত্রে তার সহকারীও বলা যায়।যতটা ভালোবাসে তার থেকে অধিক ভয় পায় সে রুদ্রকে।রুদ্রর আওয়াজে অভ্র মিনমিনে কন্ঠে বলল
“স্যরি ভাই! আমি একদম বিরক্ত করতে চাইনি। আসলে একটা আর্জেন্ট নিউজ তোমাকে দেয়ার ছিলো।

– কি নিউজ?

মুহুর্তেই ধৈর্য হীন হয়ে আসে অভ্র।
– ভাই মিঃ আলতাফ কে পাওয়া গেছে।বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছিলো।আমাদের লোক ওকে পেট্রোল পাম্পে আটকে রেখেছে…
রুদ্রর ঘুম ছুটে যায়।উঠে বসে জলদি।তুষ্ট কন্ঠে বলে,
– গুড।আমি আসছি
ফোনের লাইন কেটে পুরো রুমে চোখ বোলালো রুদ্র.রুম ফাকা।টেবিলের ওপরে রাখা চেক টাও নেই,
তার মানে মেয়েটি চলে গেছে।
রুদ্র আর দেরী করেনা।নগ্ন দেহ টেনে ঢুকলো ওয়াশরুমে। দেয়ালে এক হাত ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রুদ্র।মাথার ওপরে ঝরঝরিয়ে ছেড়ে রাখা শাওয়ার।গা ভেজাচ্ছে রুদ্র। বুজে আছে চোখ।ফর্সা পেট,পিঠ, বুক নখের আচড়ে হিজিবিজি।পানি পরতেই জ্বলছে।রুদ্র ভ্রুক্ষেপ।এটাও তার কাছে রোজকার ব্যাপার
তবে নখের আচড় গুলো ভিন্ন ভিন্ন মেয়েদের হয়,তফাৎ এইটুকুই।

এদিকে,,

হোটেল গেইটের সামনে থেকে রিক্সা ডেকে উঠে পড়লো সেজুতি। চোখ জ্বলছে।বুকটা পুড়ছে বেশ।হাহাকার লাগছে সব কিছু।অস্থিরতা যেন গলা টিপে মারছে তাকে।রিক্সাওয়ালাকে কোন মতে হূড টেনে দিতে বলল।হুড ওঠাতেই মুখ ঢেকে হুহু করে কেঁদে উঠলো সেঁজুতি।
এতক্ষন কান্না গুলো গলার ভেতর দলা পাকাচ্ছিলো।দিচ্ছিলো মৃত্যু সমান যন্ত্রনা।

‘শেষ! আজ তার সব শেষ! নিজ হাতে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে এলো সে।একটা মেয়ের সবথেকে দামী জিনিস স্ব-ইচ্ছায় এভাবে হারালো।সেঁজুতির গা ঘিনঘিন করছে।ওড়না দিয়ে গাল থেকে শুরু করে যতটুকু পারছে ডলছে সে।এই স্পর্শ চাইনা তার।মনে পড়লেই বারবার মরতে ইচ্ছে হচ্ছে।ঘৃনায় নিজেকেই তিরষ্কার করতে মন চাইছে।
কান্নায় হেচকি উঠে গেলো একেবার।
শব্দ পেয়ে রিক্সাচালক এবার রিক্সা থামালো।ঘাড় ঘুরিয়ে বলে উঠলো..
‘আপা কোনও সমস্যা?

নিজেকে কোনও ভাবে সামলে নিলো সেজুতি। ক্রন্দনরত কন্ঠ লুকিয়ে বললো…
‘নাহ আপনি চলুন,,
রিক্সাচালক বুঝে নিলেন তাও।ফোলা চেহারাটা কি লোকানো যায়?বললেন,
– কোথায় যাবেন কইলেন না তো?
সেঁজুতি একটু সময় নিলো।বলল,
– আর একটু সামনে গিয়ে বামের মোড়ে যে হাসপাতাল টা আছে ওখানে।

– আইচ্ছা
রিক্সা আবার চলতে শুরু করলো।সেই সাথে নিজ গতিতে চলতে থাকলো দু প্রান্তের দুটো মানুষের জীবন।

চলবে।