Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 426



প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৫১ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৫১ [সমাপ্তি পর্ব]

ইয়ামিন দর্শিনীর দিকে এগিয়ে যায়। দর্শিনী নিজেকে রক্ষা করতে একধাপ পিছিয়ে যায়। একসময় ইয়ামিন তাকে স্বশব্দে দুটো থাপ্পড় দেয়। দর্শিনীর গাল যেন জ্বলে যাচ্ছিল। তাছাড়া থাপ্পড়ের বেগে দর্শিনী নিচে পড়ে যেতে নেয়। তবে নিজেকে পেটের ভরে উবুর হয়ে পড়ে যাওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। ইব্রাহিম খলিল নিজের কার্য হাসিল করতে প্রিয়মা বেগমকে বিশ্রী গালি দিয়ে বলেন,

‘মেয়েকে বাঁচাতে চাইলে স্ট‍্যাম্প পেপারে সই কর। নাহলে তোর চোখের সামনেই তাকে সুন্দর মৃত্যু উপহার দেবো। ভালো চাইলে চুপচাপ স্ট‍্যাম্প পেপারে সই করে দে।’

দর্শিনী ইব্রাহিম খলিলের কথায় আঁতকে উঠে। প্রিয়মা বেগম অসহায় হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। এতোক্ষণ ধরে তিনি দলিলে সই করেনি। কিন্তু তারা দর্শিনীকে প্রিয়মা বেগমের দূর্বলতা বানিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে ডেকে এনেছেন। তিনি সই না করলে দর্শিনীর বিপদ। ইব্রাহিম যেই সম্পত্তির জন‍্য এতো নিচে নেমেছে। সেখানে সবার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া সম্পত্তির পরিমাণ অধিক। তাছাড়া নিজের ভাইয়ের ছেলেরা, অন‍্য চাচাতো ভাই, বোন সবার অধিকার রয়েছে সেখানে। বর্তমানে সবকিছু এখন প্রিয়মা বেগমের নামে। তবে একসময় তাকে সবার অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রিয়মা বেগমের বাবা বেঁচে থাকতে সন্দেহ করেছিলেন। ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটতে পারে! এজন‍্যই তিনি অনির্দিষ্ট সময়ের জন‍্য সম্পত্তির মালিকানা মেয়ের নামে করে গেছেন। যেখানে সবার অধিকার আছে। সেখানে প্রিয়মা বেগম একজনকে সবটা কীভাবে দিবেন? এটা হয়না! তাছাড়া তিনি কখনো এমন কুৎসিত চিন্তাভাবনা ভেতরে আনেনি। দর্শিনীকে বাঁচাতে সবার অধিকার নষ্ট করার মতো বিশাল অন‍্যায় কাজটা করতে যাচ্ছেন তিনি। তবে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবে। প্রিয়মা বেগমকে রাজি করাতে শুরু থেকেই উনার উপর অত‍্যাচার করছিলো ইব্রাহিম খলিল। কিন্তু যখন দেখলেন কোনো ভাবেই রাজি হচ্ছে না। তখন দর্শিনীকে মারার হুমকি দেয় ইব্রাহিম। তিনি কার্যসিদ্ধিতে দর্শিনীকে টোপ হিসাবে ব‍্যবহার করেছেন। তবে সম্পূর্ণ প্ল‍্যান ছিল ছেলে ইয়ামিন আয়ভির!

ইব্রাহিম বেশি সময় নিলেন না। স্ট‍্যাম্প পেপার গুলো প্রিয়মা বেগমের হাতে দিলেন। প্রিয়মা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন। ইয়ামিন দর্শিনীকে গান পয়েন্টে রেখেছে। যেন বাবার ইশারা পাওয়া মাত্রই দর্শিনীকে চিরদিনের জন‍্য মুক্তি দিতে কার্পণ্য করবে না। দর্শিনী সাহস করে বলে,

‘ওরা যেটা চাইছে সেটা মারাত্মক অন‍্যায়। মা, তুমি ওদেরকে সমর্থন করো না।’

দর্শিনীর কথা শুনে ইব্রাহিম খলিল এসে স্বশব্দে থাপ্পড় বসালেন। দর্শিনীর কোমল ঠোঁটের কোণে আঘাতে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। ইব্রাহিম দর্শিনীর পেছনের চুলগুলো শক্ত করে টেনে দাঁত পিষে বলে,

‘জীবন্ত কবর দিয়ে দিবো বুঝেছিস? আর একটা শব্দ উচ্চারণ করবি তো মৃ’ত্যু যন্ত্রণা কেমন ভালো মতো উপলব্ধি করতে পারবি।’

প্রিয়মা বেগম রেগে গেলেন। যত যাই হোক মেয়ের উপর আঘাত তিনি সহ‍্য করবেন না। তিনি ইব্রাহিম খলিলকে বললেন,

‘আমি সই করে দেবো। আমার মেয়েকে ছেড়ে দে।’

ইব্রাহিম খলিল ক্রুর হাসলেন। প্রিয়মা বেগম তাকে সর্বদা আপনি বলে ডাকতো। কিন্তু এখন তুই সম্বোধন করছে। এতে রাগ হলেও প্রকাশ করলেন না। কারণ তুই ডাক শোনার মতো কাজ করছেন তিনি। দলিলে সই হোক আগে! তারপর দুই আপদকে শিক্ষা দিবেন ঠিক করলেন। ইয়ামিন এখনো দর্শিনীকে গান পয়েন্টে রেখেছে। প্রিয়মা বেগম মেয়েকে বাঁচাতে সই করে দিলেন। সই করা শেষে ইব্রাহিম খলিল আর ইয়ামিন উচ্চশব্দে হাসলেন। তাদের লক্ষ‍্য সফল হয়েছে। হঠাৎই ইয়ামিন পৈশাচিক একটা কাজ করতে এগিয়ে আসলো। সে দর্শিনীর পেটে লাথি মারতে উদ্ধত হতেই প্রিয়মা বেগম মেয়েকে সামনে থেকে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন। দর্শিনীর কোন ক্ষতি হয়নি! কিন্তু ইয়ামিনের লাথিটা প্রিয়মা বেগমের উপর তীর্যক ভাবে পড়েছে। উনি পীঠে তীব্র ব‍্যথা পেয়েছেন। দর্শিনী মাকে জড়িয়ে কান্না করে দেয়। সে ইব্রাহিম খলিলকে অনুরোধ করে তাদেরকে টর্চার না করতে।

অফিসের কাজের ফাঁকে আবিদের দর্শিনীর কথা মনে পড়ে। আজকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল তার। হঠাৎ করেই প্রচন্ড অস্থিরতা অনুভব করে আবিদ। দর্শিনীকে মনে পড়ছে। সে তৎক্ষণাৎ ব্লেজার হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ে। ফোনটা চেক করার কথা মাথাতেই ছিল না আবিদের। সে বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে হঠাৎ করেই ফোনে দর্শিনীর নাম্বার থেকে অসংখ্য ফোনকলস, ম‍্যাসেজ দেখতে পায়! ফোন স্ক্রিনে এতোগুলো মিসড কল দেখে আবিদের হাত কেঁপে উঠে। দর্শিনীর কোনো বিপদ হয়নি তো? তৎক্ষণাৎ আবিদ ম‍্যাসেজটি অপেন করে। আবিদ ম‍্যাসেজটি মন দিয়ে শুনলো। ইব্রাহিম খলিল, ইয়ামিন আয়ভি, সেদিনের ছেলেগুলো! এখন সবকিছু তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। তীব্র রাগে আবিদের হাতের রগগুলো ফুলে উঠেছে। এইমুহূর্তে যদি ইব্রাহিমের শিরশ্ছেদ করতে পারতো অনেক হালকা অনুভব করতো নিজেকে। আবিদ তৎক্ষণাৎ স্বশব্দে গাড়ি ঘুরিয়ে মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

দর্শিনীর পেটে ব‍্যথা হঠাৎই বেড়ে যায়। সে আর্তনাদ করে উঠে। প্রিয়মা বেগম বুঝলেন মেয়ের লেবার পেইন উঠেছে। তিনি ব‍্যস্ত হয়ে পড়লেন দর্শিনীকে নিয়ে। তাকে এখুনি দর্শিনীকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত কিন্তু কীভাবে নেবেন? তিনি ইব্রাহিম খলিলের কাছে হাত জোড় করে বললেন,

‘আমার মেয়েটাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন! আমার মেয়েটাকে বাঁচতে দিন। আমি আপনাকে সবকিছু দিয়ে দিয়েছি যা কিছু আপনার প্রয়োজন ছিল। আমার মেয়েটাকে বাঁচান দয়া করে।’

ইব্রাহিম খলিল ক্রুর হাসলেন। যদিও দর্শিনীকে মারার কোনো ইচ্ছে তার ছিলোনা। আজ যদি দর্শিনী ইয়ামিনের সহধর্মিনী হতো তাহলে ঠিকই বাঁচিয়ে রাখতেন। এখন যদি তিনি বাঁচিয়ে রাখতে চায় তাহলে ইয়ামিন সেটা হতে দিবেনা। তিনি প্রিয়মা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন,

‘আমার হাতে কিছুই নেই। আমি দয়া করে বাঁচাতে চাইলে ইয়ামিন সেটা হতে দিবেনা। আমার ছেলেটার রাগ বেশি। হসপিটালে নেওয়ার কোনো চান্স নাই! বসে থেকে মেয়ের মৃত্যুর সময় গুণতে থাক।’

দর্শিনী ইব্রাহিম খলিলের কাছে অনুরোধ করে বলে,

‘প্লীজ আপনি আমাকে নয়, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচতে দিন। ও আমার স্বামীর প্রাণ! দয়া করে আমার বাঁচ্চাটাকে ছেড়ে দিন।’

দর্শিনীকে এভাবে মিনতি করে কাঁদতে দেখে ইব্রাহিম খলিল কিছুটা নরম হয়ে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কী করবে? ইয়ামিন চোখ গরম করে বলে,

‘আজকে তুই আর তোর বাচ্চা দুজনেই মরবি।’

ইয়ামিন দর্শিনীর পেট বরাবর শুট করতে যাবে তখনই প্রিয়মা বেগম তাকে দূরে সরিয়ে সামনাসামনি দাঁড়ায়। ইয়ামিন রাগের বশে সত্যি সত্যি ফায়ার করে দেয়। গুলিটা সোজা প্রিয়মা বেগমের বুকে গিয়ে লাগে। এতো জোরে গুলির শব্দ পেয়ে আবিদ ভয় পেয়ে যায়। ভাবতে থাকে দর্শিনী ঠিক আছে তো? সে গেট পেরিয়ে দৌঁড়াতে থাকে! দর্শিনী ফুলো পেট নিয়ে ব‍্যথায় উঠে দাঁড়াতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে মা বলে আর্তনাদ করে উঠল। প্রিয়মা বেগমের চোখে অশ্রুধারা। তিনি শব্দ করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন। ইয়ামিন এবার দর্শিনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সে ইয়ামিনকে হিংস্র রূপে দেখে চমকে উঠে। দর্শিনী কান্নাভেজা চোখে বারবার অনুরোধ করে তার বাচ্চাকে ছেড়ে দিতে। ইয়ামিন শুনছে না! হঠাৎ-ই বুট পরিহিত পা-দিয়ে দর্শিনীর পেটে আঘাত করতে যায়। দর্শিনী আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করে। তার পেটে আঘাত পাওয়ার আগেই আবিদ চলে এসেছে। আবিদ দ্রুত ইয়ামিনের ডান-পা ধরে ফেলে। তৎক্ষণাৎ সর্বশক্তি দিয়ে মুচড়ে দেয় ইয়ামিন গগনবিহারী চিৎকার করে উঠে। ইবলিশটা তার দর্শিনীকে মারতে উদ্ধত হয়েছিল। আবিদ তাকে এতো সহজে ছাড় দিবেনা। ইব্রাহিম সবটা হতবিহবল হয়ে দেখতে থাকে। তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে আবিদ স্বজোরে ইয়ামিনের পা–দুটো উল্টে ফ্লোরে আঁছাড় দেয়! মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায় ইয়ামিন। তৎক্ষণাৎ ফিনকি দিয়ে নাক মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ফ্লোরে শব্দ করে পড়ায় হাতের গানটা অদূরে প্রিয়মা বেগমের কাছে ছিঁটকে যায়। প্রিয়মা বেগম তখন বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। ছেলের এমন অবস্থা দেখে ইব্রাহিম রাগের বসে নিজের হাতের গান দিয়ে আবিদকে পেছন থেকে শুট করে দেয়। আবিদ বুঝতে পারেনি এমন কিছু হবে। তৎক্ষণাৎ স্বশব্দে একটা গুলি আবিদের পীঠ বরাবর এসে বিঁধে। আবিদ ছিঁটকে পড়া হতে নিজেকে সামলে নেয়। প্রথমে মায়ের এখন স্বামীর এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে দর্শিনী কাঁদতে থাকে। পেটের তীব্র ব্যথার চেয়ে দর্শিনীর কাছে এই দৃশ্যগুলো বেশি পীড়াদায়ক ছিল।

প্রিয়মা বেগম নিজেকে শক্ত করে গানটা তুলে নেন। তিনি ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে পরপর তিনটা গুলি ছুঁড়েন। ইয়ামিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিচেই পড়ে থাকে। ফ্লোর ভেসে যায় রক্তে। ইব্রাহিম খলিল ইযামিন বলে চিৎকার করে উঠেন। পরক্ষণেই ইব্রাহিম প্রিয়মা বেগমের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। প্রিয়মা বেগম বুঝে যান তার হাতে বেশি সময় নেই। ইব্রাহিম বেঁচে থাকলে তার মেয়ে, জামাইকে মেরে দিবে। তৎক্ষনাৎ তিনি ইব্রাহিমকে টার্গেট করে হৃদপিণ্ড বরাবর সব গুলি ছুঁড়ে মারেন। বন্দুকে উপস্থিত শেষের গুলিটা হৃদপিণ্ড ভেদ করে গেলে ইব্রাহিম সেখানেই লুটিয়ে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করে। ইব্রাহিমের বাকি সহযোগী গুলো ভয়ে পেয়ে পালিয়ে যায়। ইয়ামিনও বাবার মতো সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেছে। প্রিয়মা বেগম বন্দুকটা ফেলে মেয়ের কাছে যেতে চান। কিন্তু পারেন না! তিনি সেভাবেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন। আবিদ পীঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাহায্যের জন‍্য ফোনটা বের করে। কিন্তু আফসোস ফোনে চার্জ না থাকায় কিছুক্ষণ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শিনীর ফোনটা অদূরে খণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে। ইয়ামিনই ফোনটা ছুঁড়ে ফেলেছিল। এজন্যই আসার সময় আবিদ দর্শিনীকে ফোনে পায়নি। আবিদ কী করবে ভেবে পায়নি। পীঠে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। তার কী করা উচিত? কাকে বাঁচাবে? নিজে কতক্ষণ স্টেবল থাকতে পারবে? আবিদ বুঝতে পারছেনা। প্রিয়মা বেগম শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করার আগে অনেক কষ্টে বলেন,

‘বাবা! আমার হাতে সময় নেই। তুমি আমার মেয়েকে বাঁচাও। ওর লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে। এখন অ‍্যাম্বুলেন্সে ফোন দিলে তাদের অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে। বেবি নরমালে হওয়া সম্ভব। তুমি চাইলে অতি সাবধানে নরমাল ডেলিভারী করতে পারবে। এতোক্ষণ ধরে আমার মেয়েটা পেইন সহ‍্য করছে। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো। আমি জানি তুমি পারবে।’

কথাগুলো বলেই প্রিয়মা বেগম চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকেন। গুণে গুণে চারটা গুলি লেগেছে! চাইলেও বাঁচা সম্ভব না। অনেক দেরী হয়ে গেছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আশরাফ সাহেব এবং দুই মেয়ের চেহারা স্বরণ করে নিলেন। ভাগ‍্যের কী নিদারুণ পরিহাস মৃত্যুর পূর্বে ভালোবাসার মানুষটিকে তিনি দেখে যেতে পারবেন না। তার আগেই হয়তো মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বেন।

আবিদ কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে থাকে কী করবে! এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আবিদের মাথাকাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে প্রথমে অ‍্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করল। তারপর প্রিয়মা বেগমের কথা অনুযায়ী পীঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই বিছানার চাদর দিয়ে মোটামুটি চর্তুরভূজের মতো করে দর্শিনীকে ঘিরে দিলো। পরপর দুইমিনিটের মধ্যে গরম পানি, পরিস্কার একটা কাপড় নিয়ে চর্তুরভূজ আকৃতির ঘিরে দেওয়া জায়গাই প্রবেশ করে দর্শিনীকে বলে,

‘জান ইউ হ‍্যাভ টু ডু ইট! আমার সঙ্গে চেষ্টা করো। হাতে সময় নেই!’

দর্শিনী তখন চিৎকার করে বলে,

‘আবিদ আমার প্রচন্ড ব‍্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের একটা হাড় অবশিষ্ট নেই সব ভেঙ্গে গেছে! আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লীজ আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন।’

‘দর্শিনী সময় নেই আমাদের হাতে! অ‍্যাম্বুলেন্সে ফোন করেছি জানিনা কখন আসবে! ফ্রী আছে কী না সেটাও জানিনা! শুধু বলল আমরা দেখছি। আমার তোমাকে নিয়ে ড্রাইভ করার মতো শক্তি আপাতত নেই। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। পীঠে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে! ব‍্যথা করছে ক্ষতস্থান! যেকোনো সময় আমি জ্ঞান হারাতে পারি। এখন তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। অন্তত আমার মেয়ের কথা ভেবে চেষ্টা করে দেখ বউ!’

দর্শিনী ব‍্যথায় আর্তনাদ করে কাঁদছে। ইতিমধ্যে শরীর ঘেমে গোসল করে ফেলেছে। আবিদ দ্রুত তার চুলগুলো রাবার ব‍্যান্ড দিয়ে বেঁধে দেয়। পরক্ষণেই পেট হতে শাড়িটা সরিয়ে দেয়। তারপর ভীতিকর অবস্থায় দুইপা থেকে শাড়ি কিছুটা উপরে তুলে। দর্শিনী আবিদের হাত খামচে চিৎকার করে বলে,

‘আবিদ আমি মরে যাবো। এখানে নয়, এখানে নয় প্লীজ আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন!’

‘দর্শিনী আমার কথা শোনো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকো! আমি বলছি তুমি পারবে। এর চেয়ে দ্বিগুণ ব‍্যথা সহ‍্য করতে হয় সিজার সেকশনে! তুমি তো জানোই হসপিটালে সিজার বলতে পেট কেটে বাচ্চাকে বের করা হয়। সেই ব‍্যথাটা সারাজীবন স্থায়ী হয়। পুস্পিতা ভাবীকে নিশ্চয়ই দেখেছো তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিজারের ব‍্যথায় কষ্ট পেয়ে আসছেন। আমার দর্শিনী তো ব্রেইভ। একটু কষ্ট সহ্য করো। আমি জানি আমার তেজস্বিনী পারবে।’

দর্শিনী আবিদের কথায় জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বাচ্চাটা পেটের ভেতরে নড়ছে। এজন্যই ব‍্যথাটা তীব্র অনুভূত হচ্ছে। দর্শিনী চেষ্টা করে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। ঠিক মতো পারছে না! শুধু চিৎকার করছে। আবিদ এবার ঘাবড়ে যায়। তার পীঠেও মারাত্মক ব‍্যথা হচ্ছে! কিন্তু দর্শিনীর প্রসব যন্ত্রণার কাছে এটা হয়তো কিছুই না। আবিদ উপায় না পেয়ে গরম পানিতে হাত ডুবিয়ে হাতটা জীবাণু মুক্ত করে নেয়। তারপর পরিস্কার শাড়ির আঁচলটা গরম পানিতে ভিজিয়ে দর্শিনীর পেট হালকা করে মুছে দেয়। পরবর্তীতে পেটের উপর থেকে নিচে দিকে ধীরে ধীরে মৃদু চাপ দিতে থাকে। আবিদ দর্শিনীকে কাঁদতে দেখে সাহস করে নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করতে বলে। আবিদের কথায় দর্শিনী উপর উপর জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। এবং পেটে মৃদু চাপ দেয়। কিয়ৎক্ষণ বাদে দর্শিনী গগনবিদারী আর্তচিৎকার করে উঠে। তার শরীরের নীল রগগুলো যেন মুহূর্তেই ফুলে উঠল। দেড়ঘন্টা লেবার পেইন সহ‍্য করে দর্শিনী নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে ফুটফুটে সুন্দর এক রাজকন‍্যার জন্ম দেয়! কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই আবিদের মাধ্যমে!

আবিদের মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই কান্না করে দেয়। তার কান্না শোনার আগেই প্রিয়মা বেগম শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেছেন। দর্শিনী এখন অচেতন হওয়ার মতো অবস্থায়। নিজের মাকে হারিয়ে, প্রসবের মতো হাড়ভাঙ্গা ব‍্যথা সহ‍্য করে নিজের নাড়ি ছেঁড়া মেয়েকে দেখার পর তার চোখেমুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠে। পরপরই মাকে মনে করে বিষণ্ন হয়ে পড়ে দর্শনী। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ে।

আবিদ মেয়েকে স্বযত্নে কোলে তুলে নেয়। বাবা হয়ে সর্বপ্রথম নিজের সন্তানকে কোলে তুলে অন‍্যরকম ভালোলাগা অনুভব করল আবিদ। আবিদের মেয়ে দেখতে তার মতোই। কিন্তু ত্বক পেয়েছে মায়ের মতো ধবধবে তুষার শুভ্রকায়! ঠোঁট যেন রক্তকণিকার ন্যায় টকটকে লাল। আবিদ মাশাআল্লাহ বলে তার কানের কাছে মৃদু স্বরে আজান দেয়। মেয়েকে পরিস্কার শুভ্র কাপড়ে মুড়িয়ে দর্শিনীর পাশে রাখে। পরবর্তী ধাপে আবিদ দর্শিনীর গর্ভফুলকে আলাদা করে দেয়। তৎক্ষণাৎ বাহিরে পুলিশের গাড়ি এবং অ‍্যাম্বুলেন্স দুটোর শব্দই শোনা যাচ্ছে। আবিদ আগেই ল‍্যান্ডলাইন থেকে হসপিটাল, পুলিশস্টেশনে ফোন দিয়ে রেখেছিল। তারপরই বাবা-মাকে জানিয়েছে! তারা হয়তো কিছুক্ষণের মধ‍্যেই স্বপরিবারে এখানে পৌঁছে যাবে।

আবিদ নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে দর্শিনীর শরীরের কাপড় ঠিক করে দেয়। অ‍্যাম্বুলেন্স থেকে নার্স, ওয়ার্ডবয় বের হয়ে দর্শিনীকে স্টেচারে তুলে নেয়। সদ্যজন্মানো মেয়েকে কোলে নিয়েই আবিদ পুলিশ অফিসারকে সংক্ষেপে সবকিছু খুলে বলে। তারা ইব্রাহিম, ইয়ামিনের লাশকে পোস্ট মোর্টামের জন‍্য নিয়ে যায়। আবিদ এখানে ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রিয়মা বেগমের পোস্ট মোর্টাম আঁটকে দেয়। দর্শিনী চায়না তার মায়ের লাশের পোস্ট মোর্টাম হোক। ঘন্টা খানেক আগেই আবিদের পীঠে গুলি লেগেছিল! অথচ আবিদ কেমন স্বাভাবিক। তার শরীরে বিষক্রিয় ব‍্যথাটা পুরো ছড়িয়ে পড়েছে। আবিদ কোন রকম সহ‍্য করেছিল। তবে তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা। আবিদের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। যেকোনো সময় যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। অ‍্যাম্বুলেন্সের লোকগুলো আবিদের ইশারার জন‍্যই অপেক্ষা করছে। আবিদ বললে তারা রওনা দেবে। পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই আশরাফ সাহেব এবং চৌধুরী বাড়ির সবাই মুহতাসিম ভিলায় উপস্থিত হয়েছে। আশরাফ সাহেব মৃত সহধর্মিনীকে দেখে ধ্বপ করে নিচে বসে পড়েন। উনার চোখে পানি। প্রিয়মা বেগম নেই! বিষয়টি তিনি মানতে পারছেন না। আবিদ সবাইকে ঘটনাটা বলে অ‍্যাম্বুলেন্সের দিকে যেতে থাকে। সবাই যেনো পাথর বনে গেছে সবটা শুনে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মুহতাসিম ভিলার সবাই শোকাহত–মর্মাহত হয়ে পড়েছেন। অন‍্যদিকে অনুসা বেগম আবিদ, দর্শিনী এবং তাদের মেয়ে সহিসালামত ছিল বলে বারবার স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল।

পথিমধ‍্যেই আবিদ মেয়েকে কোলে নিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে নেয়! কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। তার সদ‍্য জন্মানো মেয়েটিকে সুরক্ষা দিতে আবিদ দর্শিনীর কোলে রেখে দেয়। পরক্ষণেই দূর্বলতার জন‍্য অচেতন হয়ে যায় আবিদ। পরবর্তীতে ওয়ার্ডবয়, নার্সরা তাকে স্ট্রেচারে করে দর্শিনীর পাশে তুলে নেয়! অ‍্যাম্বুলেন্স হসপিটালের উদ্দেশ্যে তার নিজস্ব গতিতে করুণ শব্দে চলতে শুরু করে। শুধু পেছনে ফেলে যায় চিরচেনা কয়েকজনকে!

_______________

পরিশেষে,

আবিদের মেয়ে রূপকথা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সুস্থ স্বাভাবিকই ছিল! কিন্তু দর্শিনী নিজের জন্মদাত্রী মাকে হারিয়ে বিষণ্ন হয়ে গেছিল। মায়ের মৃত‍্যুদিনেই তো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মেয়ের জন্ম হয়েছে। তাই দর্শিনী বারবার নিজের মেয়ের মাঝে মাকে খুঁজতে থাকে। দর্শিনী সুস্থ ছিল! কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। তবে আবিদের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন হয়েছে। গুলিবিদ্ধ ইন্জুরি নিয়ে আবিদ যেভাবে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছিল। এখানেই মূলত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আবিদের ইন্জুরি সিরিয়াস। ক্ষতস্থানে বিষক্রিয়ার মাধ‍্যমে ইনফেকশন হয়ে গেছে। সার্জারি না করলে সেই জায়গাতে ক‍্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা একশত পার্সেন্ট! ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া মাত্রই আবিদকে সরকারি প্রাইভেট প্লেনে করে মাদ্রাজ পাঠানো হয়েছে। মাদ্রাজে সার্জারী এক্সপার্টদের মাধ্যমে ট্রিটমেন্ট করানোর জন‍্য। আবিদ যখন সবাইকে বিদায় জানিয়ে মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দর্শিনী তখন মেয়েকে নিয়ে ডক্টরের অবজার্বেশনে ছিল। আবিদের সুযোগ হয়নি মেয়েকে দ্বিতীয়বার দেখার, কোলে নেওয়ার। দর্শিনী তখন অচেতন ছিল। আবিদের বহিরে যাওয়ার ব্যপারে কিছুই জানেনা। তাই আবিদ যাওয়ার আগে তার জন‍্য একটা চিঠি লিখে যায়। সেই চিঠিতে আবিদ সবটা বুঝিয়ে বলে দর্শিনীকে। এমনকি শেষের লাইনে মেয়ের নাম আদ্রিজা চৌধুরী রূপকথা রাখতে বলে। মাদ্রাজে দুইমাস অতিবাহিত হওয়ার পরে আবিদ দ্রুত সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসবে। এটা জেনেই দর্শিনী, রূপকথা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দর্শিনী নিজের মেয়ের নাম কাউকে রাখতে দেয়নি। আবিদ যেভাবে বলেছে সবকিছু মেনে চলেছে! আবিদের অপেক্ষায় দিন পার করছে। চৌধুরী বাড়িতে সবাই রূপকথাকে আবিদের দেওয়া নামেই ডাকে। দর্শিনী তাদেরকে অন‍্যনামে ডাকতে নিষেধ করেছে। তবে ভাগ‍্য বুঝি সুপ্রসন্ন ছিল। তাই তো আবিদ সর্বপ্রথম নিজের মেয়েকে কোলে নিতে পেরেছিল। ফলস্বরূপ সবাই রূপকথাকে কোলে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নাহলে আবিদ কোলে না নিলে দর্শিনী হয়তো আবিদের আগে কাউকে কোলে নেওয়ার পারমিশন দিতো না।

_____________

প্রিয়মা বেগমের মৃত‍্যুর পরে আশরাফ সাহেব একদম ভেঙ্গে পড়েন। কিছুদিন আগেই স্বেচ্ছায় কলেজ থেকে রিটায়ার্ড করেছেন তিনি। সহধর্মিনীর ইচ্ছে অনুযায়ী আশরাফ সাহেব উইল অনুযায়ী সম্পত্তি প্রিয়মা বেগমের ওয়ারিশদের নামে দিয়ে দেন। এমন কী প্রিয়মা বেগমের লাশকে দূরবর্তী গোরস্থানে দাফন না করে মুহতাসিম ভিলার গার্ডেন সাইডে নির্জন একটা জায়গাই দাফন করেন। প্রজ্জ্বলিনী, প্রিয়দর্শিনী দুইবোন মাকে প্রচন্ড মিস করে। মাকে ছাড়া মুহতাসিম ভিলাতে তারা বেশিক্ষণ থাকতে চায়না। বিশেষ করে দর্শিনী। এই বাড়িতে প্রিয়মা বেগমের অজস্র স্মৃতি রয়েছে। দর্শিনী এখানে আসলেই মাকে প্রচন্ড মিস করে। মা বেঁচে থাকতে দর্শিনী নিয়ম করে আসার জন‍্য ছটফট করতো। অথচ এখন মাঝেমাঝে অসুস্থ দাদাকে দেখতে যায়। কিন্তু আগের মতো থাকা হয়না সেদিনই ফিরে আসে। আশরাফ সাহেব একাকী থাকতে শিখেছেন। তিনি এখনো আফসোস করেন মৃত্যুবেলায় সহধর্মিনীকে দেখতে পাননি বলে। শবনম চৌধুরীর কষ্টটা তিনি বুঝতে পারেন! উনার কষ্টের পরিমাণটা সুদে–আশুলে আশরাফ সাহেবের কাছে ফিরে এসেছে। যদিও সবকিছু পরিস্থিতি ছিল। শবনম চৌধুরী প্রিয়মা বেগমের মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছেন। তিনি আবিদের মেয়েকে দেখতে বাংলাদেশে ব‍্যাক করেছিলেন। সেইসময় আশরাফ সাহেবের সঙ্গে তার কথা হয়। প্রিয়মা বেগমকে খু’ন করা হয়েছে শুনে তিনি ব‍্যথিত ছিলেন। কথার ফাঁকেই আশরাফ সাহেব অতীতে তাদের মধ‍্যে যাকিছু ঘটেছিল। সবটা শবনম চৌধুরীকে খোলাশা করে বলেন। এই কথাগুলো কখনো বলার সুযোগ হয়নি আশরাফ সাহেবের। সবটা বলার পরে তিনি শবনম চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। উনার ধারণা শবনম চৌধুরীর সঙ্গে যাকিছু হয়েছে। সেটার প্রভাবেই জীবনে এমন সিচুয়েশন এসেছে। তিনি শবনম চৌধুরীর কাছে প্রিয়মার হয়েও ক্ষমা চাইলেন। অন‍্যদিকে শবনম চৌধুরী এতোবছর পরে অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য কথা জানতে পেরে হতবিহ্বল হন। তিনি এতোদিন যাবত আশরাফ সাহেবকে ভুল বুঝে গেছেন। অতঃপর সত‍্যিটা জানতে পেরে উনার চোখে অগোচরে পানি চলে আসলো। যাওয়ার আগে শবনম চৌধুরী আশরাফ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে যান,

‘সত‍্যি আমার কোন অভিযোগ ছিলনা! আফসোস ছিল প্রিয়মার জায়গাই হয়তো আমার থাকার কথা ছিল। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম আশরাফ। আমি তোমার প্রতি রাগ করেছি, অভিমান করেছি। কিন্তু কখনো তোমাদের খারাপ চাইনি। বিদায়!’

শবনম চৌধুরীকে সবটা জানিয়ে কিছুটা অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পান আশরাফ সাহেব। অবশেষে দুই প্রাক্তনের সুন্দর একটা বিদায় মুহূর্ত তৈরি হয়! যাদের ব‍্যপারে কেউ কখনো জানতে পারেনি। আর না তারা কাউকে জানাতে চেয়েছেন। তারা দুজনেই ভালোবাসার মানুষকে স্বরণ করে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুজনের মনে আজ কোনো আফসোস, অভিযোগ কিছু অবশিষ্ট নেই। আশরাফ সাহেব খুশি কারণ তিনি শেষমুহূর্তে প্রিয়মা বেগমকে ভালোবাসতে পেরেছেন বলে। অন‍্যদিকে শবনম চৌধুরী খুশি কারণ ভালোবাসার মানুষটি তাকে কখনো ধোঁকা দেয়নি বলে। সেদিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে দুইজনের বিচ্ছেদ হয়েছিল। তবে আশরাফ সাহেব তাকে সত্যিই ভালোবেসে ছিলেন। এই কথাটুকু যথেষ্ট ছিল শবনম চৌধুরীর বেঁচে থাকার জন‍্য। তাদের গন্তব্য এখন আলাদা। দেরিতে, কিন্তু সত্যিটা জানতে পেরে শবনম চৌধুুরীর আর কোনো অভিযোগ নেই। তিনি সত্যিটাকে আগলে রেখে বাকিটা জীবন আরামসে কাটিয়ে দিতে পারবেন।

________________

চৌধুরী বাড়িটা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। শুধুমাত্র আবিদ ফিরবে বলেই শাহরিয়ার চৌধুরীর এতোকিছু আয়োজন। ইতিমধ্যে বাড়িতে মেহমান উপস্থিত হয়েছেন। তাদের মধ‍্যে প্রজ্জ্বলিনী, উজান, তাদের একমাত্র ছেলে প্রহরও উপস্থিত। তাছাড়া আজকের অনুষ্ঠানে একটা বিশেষ কারণে নিহাল উপস্থিত আছে। সবাই মূলত আবিদকে দেখতে এসেছে। কিন্তু নিহালের আরো একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। আজকে নিহাল শাহরিয়ার চৌধুরীর কাছে আদিবাকে চেয়ে নিবে। নিহাল যথেষ্ট কনফিডেন্ট শাহরিয়ার চৌধুরী তাকে মেয়ে জামাই হিসাবে গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ডা. নিহাল রায়হান আদিবার জন‍্য যোগ‍্যতম ব‍্যক্তি! রাজি না হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আজকের অনুষ্ঠানে সবার মাঝে আশরাফ মুহতাসিম অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি দর্শিনীর দাদুকে রেখে আসতে পারেনি। কারণ মুহতাসিম ভিলায় এখন আশরাফ সাহেব এবং আহমেদ মুহতাসিম একাই থাকেন। তবে প্রিয়মা বেগমের মৃত্যুর পরে আশরাফ সাহেব তেমন কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করেনি।

চৌধুরী বাড়ির সামনে আবিদের হেলিকপ্টার ল‍্যান্ড করেছে মাত্রই। সবাই আগ্রহের সঙ্গে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আবিদকে এক ঝলক দেখবে বলে! অন‍্যসবার মতো দর্শিনী অধির আগ্রহে আবিদের জন‍্য অপেক্ষা করছে। বাকি সবাই নিচে উপস্থিত ছিল। কিন্তু দর্শিনী মেয়েকে নিয়ে নিজের রুমেই আছে। অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে আবিদ বাড়িতে উপস্থিত হয়। সে কিছুক্ষণ সবার সঙ্গে দেখা করে নিজের রুমে চলে আসে। দীর্ঘদিন পরে বউ বাচ্চাকে দেখতে পাবে বলে আবিদের যেনো সামান্য দেরীটুকু সহ‍্য হলোনা। তৎক্ষণাৎ সে দর্শিনীকে দেখতে পায়। মসৃণ কালো খয়েরী সংমিশ্রণে শাড়ি পরিহিত— অপরূপ সুদর্শিনী রমণীটি! উদাসীন ভঙ্গিতে রাজকীয় বিছানায় ঘুমন্ত রাজকন‍্যাটির সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করছে। রাজকন‍্যাটির বাবার কথা বলছে কী? তার মসৃণ চুলগুলো যেন অবাধ‍্য! বারবার মুখের সামনে চলে আসছে। দর্শিনী রমণীটি সন্তপর্ণে অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে নেয়। কী অপরূপ সেই দৃশ্য! ফোনে তখন লো–ভলিউমে একটা গান ভেসে আসছে। যেটা আবিদের কন্ঠেই প্রিয়দর্শিনীর জন‍্য ছিল!

স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপরী‚
হাসি তার জোছনা মায়াবী!
হরণী চোখে তার‚ মোহিনী যে দৃষ্টি!
দুচোখে আমার ভাসে‚ তারই ছবি
আমার প্রিয়-দর্শিনী!

আবিদ দর্শিনীকে গভীর ভাবে দেখতে থাকে। মুহূর্তেই তার কন্ঠস্বর যেন অবরোধ হয়ে আসলো। সহসা আবিদ দর্শিনীকে ক্ষীণ স্বরে ডাকে,

‘প্রিয়দর্শিনী……!’

দর্শিনী আবিদের কন্ঠস্বর শুনে চমকে সামনে তাকায়। এতোদিন পর আবিদকে স্বশরীরে সুস্থভাবে দেখে দর্শিনী ইমোশনাল হয়ে যায়। হঠাৎই আবিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে দেয়! আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় আবিদ কিছুটা পিছিয়ে যায়। পরক্ষণেই পরম আনন্দে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরে। শুধু জড়িয়ে ধরে থামেনি! দর্শিনীর শরীরের মিষ্টি সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আবিদ তার গলাই মুখ গুঁজে! পরপরই কপালে, গালে, ঠোঁটে অজস্র চুমু খায়। তারা দুজনে যেনো মুহুর্তেই দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ ভুলে গিয়ে সমস্ত দূরত্ব ঘুঁচিয়ে নেয়। কিয়ৎক্ষণ বাদে আবিদ দর্শিনীকে ছেড়ে মেয়ের কাছে যায়। মেয়ে তার ঘুমোচ্ছে। কী স্নিগ্ধ রূপ! রূপকথার বয়স দুইমাস চলছে। আবিদ ছোট্ট প্রাণটিকে খুব সন্তপর্ণে তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয়। মেয়ের তুষার শুভ্র নরম গালে চুমু খায় আবিদ! বাবার কমল পরশে রূপকথা নড়েচড়ে উঠে। আবিদ সেটা লক্ষ্য করে অশ্রুসিক্ত চোখে দর্শিনীর দিকে চেয়ে সামান্য হাসল। এ যেনো প্রাপ্তির আনন্দ অশ্রু!

#সমাপ্ত

প্রিয়দর্শিনী পর্ব-৫০

0

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৫০

সময় যেন থেমে নেই। দর্শিনীর নয় মাস রানিং চলছে। প্রসবকালীন ভয়াবহ সময়টা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। দর্শিনীর পেট আগের চেয়ে অনেক উঁচু হয়েছে। ডাক্তার বলেছে তার শারীরিক কন্ডিশন নরমাল। তাই বাচ্চা নরমালে হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি! সবটা আবিদের জন‍্য সম্ভব হয়েছে। আবিদের অতিরিক্ত যত্ন–ভালোবাসার জন‍্য! প্রেগন‍্যান্সির শেষমুহূর্তে আবিদ দর্শিনীর জন‍্য বেশ টেনশনে রয়েছে। এমন কী আবিদ সরাসরি অফিসে উপস্থিত হয়নি। কারণ বশত বলা যায় হঠাৎ করেই যদি দর্শিনীর লেবার পেইন উঠে তাহলে করণীয় হিসাবে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে ভেবেই। ফলশ্রুতিতে আবিদ ভার্চুয়ালে কানেক্টেড থেকে যাবতীয় কাজকর্ম–অফিস সামলাতে ব‍্যস্ত।

চৌধুরী বাড়িতে দর্শিনীর প্রেগন‍্যান্সির শুরু থেকেই অনুসা বেগম, পুস্পিতা তার ভালো মতো খেয়াল রাখে। তাছাড়া পুস্পিতা সবসময় দর্শিনীকে নিজের বোনের মতো সাহায্য করে। যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে আগেই সর্তক করে। করণীয় সবকিছু স্পষ্টত ব্যাখ‍্যা করে। দর্শিনী পুস্পিতাকে বলে ভাগ্য করে শ্বশুরবাড়িতে দ্বিতীয় মা-বোন পেয়েছে। পুস্পিতা দর্শিনীর কথা শুনে মিষ্টি করে হাসে। তার ছেলেটা মাকে হাসতে দেখে কিছু একটা বুঝে হাসতে থাকে। ছোট্ট সমুদ্র, আরহান এবং পুস্পিতার একমাত্র ছেলে। বয়স সবে আট মাস চলছে। আট মাসেই সমুদ্রকে এক্সট্রা অর্ডিনারি দ্রুত বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের মতো মনে হয়। ছোট্ট সমুদ্র দেখতে সুদর্শন বটে। তুষার শুভ্র, ফর্সা ত্বক তার! দর্শিনী মাঝে মাঝেই সমুদ্রকে দেখে বিস্ময় বোধ করে। কারণ সমুদ্র যেনো তারই মেইল ভার্সন! দর্শিনী ছোটবেলায় সমুদ্রের মতো তুষার শুভ্র ফর্সা ছিল। কাজিনরা সবাই তাকে কোলে নেওয়ার জন‍্য উদগ্রীব থাকতো। কিন্তু ছোট্ট দর্শিনী বাবার কোল ছাড়া কারো কোলে যেতে পছন্দ করতো না। দর্শিনী পুরোনো কথা মনে করে হাসল কিছুক্ষণ। হঠাৎ-ই আবিদ রুমে এসে হন্তদন্ত হয়ে তৈরি হতে থাকে। এইমুহূর্তে হয়তো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাবে! পুস্পিতা তখন সমুদ্রকে নিয়ে চলে যায়। দর্শিনী তখন বিছানায় শুয়েছিল। সে আবিদকে তাড়াহুড়ো করতে দেখে জিগ্যেস করে,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে! দুপুরের আগেই চলে আসবো। কোনো সমস্যা হলে ফোন করবে। নাহলে মাকে জানাবে! মনে থাকবে?’

‘আচ্ছা! আপনি সাবধানে থাকবেন।’

আবিদ দর্শিনীর কপালে দীর্ঘ চুমু খেয়ে বেড়িয়ে যায়। কাল রাত থেকে দর্শিনীর পেটে মৃদু ব‍্যথা হচ্ছে। অবশ্য শেষের কয়েকদিন ধরেই এমন ব‍্যথা। দর্শিনী বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবেই নেয়। মৃদু ব‍্যথা হওয়ার কারণ বেবির নড়াচড়া! দর্শিনী বিগত দুই-তিন মাস ধরে বেবির নড়াচড়া অনুভব করতে পারে। যখনি বেবি নড়াচড়া করে উঠে! আবিদ তখন দর্শিনীর পেটে কান পেতে বেবিকে অনুভব করে। মাঝেমাঝে বেবির লাথিকে অনুভব করে আবিদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতো। নিজের ঔরসজাত সন্তান বলে কথা! আবিদ প্রায়ই দর্শিনীর পেটে মুখ গুঁজে মেয়ের সঙ্গে নানান গল্পে মেতে থাকতো। ইমোশনাল হয়ে দর্শিনীকে অজস্র চুমু দিতো। আবিদ সর্বদা বলে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে আমার জন‍্য সবসময় আলহামদুলিল্লাহ্! তাইতো আল্লাহ্ খুশি হয়ে তাদেরকে কন‍্যাসন্তান দান করেছেন। হ‍্যাঁ, আবিদ দর্শিনীর মেয়ে হবে! দুইমাস আগে সবাই খবরটা জানতে পেরেছে। চৌধুরী বংশে শবনম চৌধুরী এবং আদিবার পরে আবার কন‍্যাসন্তান আসছে। খবরটা শুনে সবাই খুশি ছিল। বিশেষ করে আবিদ! পেটে মৃদু ব্যথার জন্য দর্শিনী সকাল থেকে শুয়ে ছিল। তলপেটের ব‍্যথাটা কেমন যেন অন‍্যদিনের থেকে বেশি অনুভব হচ্ছে। দর্শিনী বিষয়টিকে স্বাভাবিক দিনের মতো আমলে নিলো। সে প্রসব ব‍্যথা সম্পর্কে ভেবেই দেখেনি।

সকাল দশটায় প্রজ্জ্বলিনীর সঙ্গে কথা বলে দর্শিনী ঘুমানোর প্রচেষ্টা করে। কারণ খাওয়া, ঘুমানো, শুয়ে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই তার। একটু আগে পুস্পিতা ফলমূল কেটে দিয়ে গেছে। দর্শিনী বমি করার ভয়ে সকালে অল্প খেয়েছে। আজকে শরীরটা ভালো লাগছে না। দর্শিনী খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বাবাকে ফোন দেয়। কিন্তু বাবার নাম্বার সুইচঅফ বলছে। সে ভাবল মাকে ফোন দিবে। হঠাৎ করেই দর্শিনীর ফোনে মুহতাসিম ভিলার ল‍্যান্ডলাইন থেকে ফোন আসে। দর্শিনী রিসিভ করতেই মায়ের কান্নাকাটি শুনতে পেলো। মাকে কাঁদতে দেখে দর্শিনী ভয় পেয়ে যায়! ভাবলো বাসার কারো বিপদ হয়নি তো? ভয়ে তার কন্ঠস্বর আড়ষ্ট হয়ে গেছে! তৎক্ষনাৎ দর্শিনী ব‍্যস্ত হয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

‘হ‍্যালো মা! তুমি ঠিক আছো? এভাবে কান্না করছো কেনো? দাদু ঠিক আছে তো? নাকি বাবার শরীর খারাপ? বাবাকে ফোন দিলাম কিন্তু সুইচঅফ বলছে!’

অপরপাশে প্রিয়মা বেগমের কান্নার স্বর আরো বেড়ে যায়। দর্শিনী বিছানা ছেড়ে কষ্ট করে উঠে পড়ে। পরক্ষণেই মাকে কান্না থামিয়ে সবটা খুলে বলতে বলে। প্রিয়মা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

‘যাই হয়ে যাক, প্রিয় তুই এখানে আসবি না!’

উক্ত কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অপরপাশে স্বশব্দে থাপ্পড়ের আওয়াজ পায় দর্শিনী। ভীতিকর অবস্থায় প্রিয়মা বেগম চিৎকার করে ছিঁটকে পড়েন। ফোনটা কেটে যায়। দর্শিনী আবার ফোন দেয়! কিন্তু না আর রিসিভ হচ্ছে না। টেনশনে বেশ কয়েকবার আবিদকে ফোন দিয়ে বসে। আবিদ ফোন ধরছে না। কি করবে বুঝতে না পেরে দর্শিনী বিছানায় বসল। একটুপর ল‍্যান্ডলাইন নম্বর থেকে আবার ফোন আসল! দর্শিনী রিসিভ করতেই একজন বিশ্রীভাবে হেসে বলল,

‘মাকে বাঁচাতে চাইলে মুহতাসিম ভিলায় চলে আয়। খবরদার কাউকে কিছু জানালে তোর মাকে মেরে ফেলব। শোন চালাকি করার চেষ্টা করিসনা। নাহলে ফলাফল ভালো হবেনা। এই মুহূর্তে কাউকে না জানিয়ে একা চলে আয়।’

লোকটি হুমকি দিয়েই ফোন বন্ধ করে দেয়। দর্শিনীর ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। লোকটি তাকে ঘটনাটা কাউকে জানাতে নিষেধ করল। কিন্তু কে সেই লোক? তার মাকে আঁটকে কী চাইছে? এমন হাজারটা প্রশ্নকে সাইডে রেখে দর্শিনী পার্সে কিছু টাকা আর ফোনটা নিয়ে মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে যায়। তাকে চুপিচুপি বেড়িয়ে আসতে হলো। বাড়ির কেউ দেখলে তাকে যেতে দিতো না। সবটা জানাজানি হয়ে যেতো। পরবর্তীতে হয়তো তার মায়ের ক্ষতি করে দিতো। তাই কাউকে জানায়নি সে। দর্শিনী রাস্তায় দাঁড়িয়ে ব‍্যস্ত হয়ে ট‍্যাক্সি খুঁজে চলেছে। পুরোপুরি নয় মাস বিশ দিনের ফুলো পেটকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। তবুও সে দাঁড়িয়ে রইল! কিছুক্ষণ পরে একটা ট‍্যাক্সি তার সামনে এসে দাঁড়াল। লোকটি প্রেগন‍্যান্ট মেয়েটিকে সাহায্য করতেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দর্শিনী তাকে দ্রুত মুহতাসিম ভিলার দিকে যেতে বলে। রাস্তায় অনেক জ‍্যাম ছিল। বিশ মিনিট পরে ড‍্রাইভার তাকে সহিসালামত পৌঁছে দিলো। দর্শিনী ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে মুহতাসিম ভিলার দিকে যেতে থাকলো।

এতো ভারী পেট নিয়ে টেনশন, দৌঁড়াদৌঁড়ি সহ‍্য হচ্ছে না দর্শিনীর। পেট, পীঠ, কোমড় ব‍্যথায় জর্জরিত। দর্শিনী গেটে ঢুকতে কোনো দাড়োয়ানকে দেখতে পেলো না। কেমন যেন নিঃশব্দ অবস্থা। ভয়ের চোটে দর্শিনীর ঘাম ছুটে গেছে। শাড়িটাকে ভালো করে জড়িয়ে শরীর, পেট ঢেকে আল্লাহর নাম নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে দর্শিনী! আশরাফ সাহেব বাসায় উপস্থিত ছিলেন না। হয়তো কলেজে গেছেন। তাছাড়া আহমেদ মুহতাসিম বিছানাগত। তিনি নিজের রুমেই থাকেন। আবার কাজের মেয়েটি সবসময় থাকেনা। বাড়িতে শুধু প্রিয়মা বেগম একা থাকেন। মায়ের ব‍্যপারে বেশ দুশ্চিন্তা হচ্ছে দর্শিনীর। বাড়িতে ঢুকতেই লিভিং রুমে প্রিয়মা বেগমের বিধ্বস্ত, ভীতিকর অবস্থা নজরে পড়ল। মেঝেতে লুটিয়ে বসে আছেন তিনি। মুখে, ঠোঁটে রক্তের শুকনো দাগ। মাথায় বন্দুক তাঁক করে রেখেছে তারই দূরসম্পর্কের মামা। প্রিয়মা বেগমের চাচাতো ভাই ইব্রাহিম খলিল এবং তার ছেলে ইয়ামিন আয়ভি। তারা সুযোগ বুঝে বাড়িতে কয়েকজন গুন্ডা-মাস্তান নিয়ে এসেছে। যদিও দর্শিনী কারণটা জানেনা। মায়ের ভীতিকর অবস্থা দেখে সে আত্মচিৎকার করে এগিয়ে যায়। প্রিয়মা বেগম এইমুহূর্তে দর্শিনীকে দেখে আঁতকে উঠেছেন। এভাবে ভরা পেট নিয়ে দর্শিনীর এখানে আসা ঠিক হয়নি। মেয়েটাকে ওরা হয়তো আজকে মেরে ফেলবে। অতিরিক্ত টেনশনে প্রিয়মা বেগম যেনো মূর্ছা যাচ্ছেন। তিনি দর্শিনীকে এগিয়ে আসতে দেখে বলেন,

‘কেনো এসেছিস মা? নিষেধ করেছিলাম যে! এভাবে কাউকে না জানিয়ে বিপদের সম্মুখে স্বয়ং হাজির হওয়া উচিত হয়নি। তুই এখুনি পালিয়ে যা। এই মুহূর্তে আবিদের কাছে চলে যা।’

দর্শিনী কাঁদতে কাঁদতে বলে,

‘মা তোমার এই অবস্থা কেনো? কী হয়েছে সবটা বলো আমাকে!’

দর্শিনী হাউমাউ করে কেঁদে ইব্রাহিমের উদ্দেশ্যে বলে,

‘আপনারা আমার মার সঙ্গে এমন কেনো করছেন, মামা?’

ইব্রাহিম খলিল বিশ্রী ভাবে হেসে ওঠেন। একটু আগে যেই গান দিয়ে প্রিয়মা বেগমকে গান পয়েন্টে রেখেছিল। এবার সেটা দর্শিনীর দিকে তাঁক করেন। দর্শিনী ভয় পেয়ে যায়! চোখের সামনে বন্দুক দেখে সে ঘাবড়ে গেছে। প্রিয়মা বেগম দর্শিনীর জন্য আঁকুতি করেন।

ইয়ামিন এবং ইব্রাহিম খলিল দুজনেই সমান তালে হাসছে। দর্শিনীদের করুণ অবস্থায় তাদের পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে। তাদের হাসি দেখে ভেতরে ভেতরে দর্শিনীর শরীর জ্বলে উঠল। ইব্রাহিম খলিল হাসছে ঠিকই! কিন্তু ইয়ামিন বেশি খুশি হতে পারেনি। ইয়ামিনের শরীরে তো রাগ উপচে পড়ছে। দর্শিনীকে অন‍্যের বাচ্চা বহন করতে দেখে রাগ অতিশয় বাড়ছে কিন্তু কমছে না। সে প্রিয়দর্শিনীকে পছন্দ করতো। একসময় বিয়ে করতে চেয়েছিল। একবছর আগে বিয়ের প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল। কিন্তু প্রিয়মা বেগম সেটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন উনার নিজের বংশ খুব একটা সুবিধার নয়। বংশগত উনার বাপ-দাদারা গুন্ডা, মাস্তান ছিলেন! তাছাড়া চাচাতো ভাই, তাদের ছেলেদের অনেক স্ক্যান্ড্রেল আছে। স্পষ্টত বললে মেয়েলী স্ক‍্যান্ড্রেল! তাই তিনি দর্শিনীকে সর্বদা তাদের নজর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। মেয়ের অনিন্দ্য সৌন্দর্য্য সর্বদা ঢেকে রাখতে চাইতেন। তিনি দর্শিনীকে দাদুবাড়ি কিংবা নানাবাড়ি যেতে দিতে চাইতেন না। আগে বাবা বেঁচে থাকতে তিনি ভয় পাননি। কিন্তু আহমেদ মুহতাসিমের অসুস্থতার পরে আবার নিজের বাবার মৃত্যুতে অনেকটা দমে যান প্রিয়মা বেগম। আজ উনার বাবা বেঁচে থাকলে ইব্রাহিম হয়তো সাহস পেতোনা। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নেন দর্শিনীর সুরক্ষার জন‍্য দ্রুত বিয়ে দিবেন। এতো সাবধানতার পর ইব্রাহিম খলিলের ছেলে ইয়ামিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। নিঃসংকোচে দ্বিতীয়বার সেটা নাকচ করে দেন প্রিয়মা বেগম। অতঃপর ইব্রাহিম খলিলের ভেতরে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়। অবশ‍্য আগে থেকেই সম্পত্তি বিষায়ক ক্ষোভ ছিলো। সবশেষে আরোএকটি যোগ হলো! প্রিয়মা বেগম বাবার দুইমাত্র সন্তান ছিলেন। উনার সহোদর নিজের ভাই ছিল। কিন্তু চাচাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে অনেক আগে মারা গেছে। পরবর্তীতে প্রমাণ ছাড়া দর্শিনীর নানু কিছু করতে পারেনি। তবে কৌশলে তাদের প্রাপ্যটুকু বাদে সমস্ত সম্পত্তি মালিক মেয়েকে লিখে উইল করেন। প্রিয়মা বেগম এসব কিছুই চাইতেন না। তাই বাবা বেঁচে থাকাকালীন সবটা দেখেছেন। কিন্তু দখল করেনি কখনো। তাদের প্রয়োজনই পড়েনি। চাচার মৃত্যুর পরে— অর্থ সম্পদের পরিমাণ খুবই সামান‍্য পেয়ে ইব্রাহিম ক্রুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে তিনি সবকিছু মেনে নেন। নিজের স্বার্থে ছেলের জন‍্য স্বাভাবিক ভাবে দর্শিনীকে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বারবার প্রত‍্যাখান পেয়ে একটু বেশিই ক্রুদ্ধ ছিলেন। তিনি ছেলেকে ভরসা দেন দর্শিনীকে তুলে নিয়ে আসবেন তার জন‍্য। দরকার হলে জোর করে ইয়ামিনের সঙ্গে বিয়ে দিবেন। এতে মেয়ে জামাই হিসাবে ইয়ামিন সম্পত্তি, দর্শিনী দুটোরই মালিকানা পেয়ে যেতো।

অতঃপর তাদের প্ল‍্যানকে ধূলিসাৎ করতে অগোচরে আশরাফ সাহেব দর্শিনীর জন‍্য পাত্র দেখতে শুরু করেন। পরবর্তীতে দর্শিনীর জীবনে ঢাল স্বরূপ আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরীর আগমন ঘটে। দর্শিনীর বিয়ে হবার পরেও ইয়ামিন তাকে পেতে চাইতো। তাই জন্য সবসময় আবিদের খোঁজখবর রাখতো। লোক লাগিয়ে তাকে ফলো করতো। অগোচরে আক্রমণ করতো। সেদিনের সেই ছেলেগুলো ইব্রাহিমের কথাতে আবিদকে হামলা করেছিল। ইব্রাহিমের প্ল‍্যান অনুযায়ী তারা আবিদকে মেরে দর্শিনীকে উঠিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু আবিদের জন্য পারেনি। ইব্রাহিম আবিদের উপর অনেকবার অ‍্যাটাক করিয়েছে। কিন্তু বিশেষ কোনো লাভ হয়নি। তারা আবিদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। প্রতিবারই ইব্রাহিম খলিল এবং তার ছেলে ইয়ামিন ব‍্যর্থ হয়েছে।

দর্শিনী অন‍্যে কারো বাচ্চার মা হবে। এজন্যই তাকে বিয়ে করার স্বপ্নটা ইয়ামিনের কোনদিন পূরণ হবে না। প্রচন্ড রাগে ইয়ামিনের এইমুহূর্তে দর্শিনীকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে। দর্শিনী যেহেতু তার নয়! অন‍্য কারো থাকলে সে মানতে পারবে না। নিজেদের প্ল্যানের কথা ইয়ামিন স্বহাস‍্যে বলে পৈশাচিক হাসতে থাকে। তাদের কথা শুনে দর্শিনী ভয় পেয়ে যায়। অগোচরে বুদ্ধি করে নিজের ফোনে সমস্ত কথোপকথন রেকর্ড করে নেয়। পরবর্তীতে কৌশলে আবিদকে ফোন করে কিন্তু আবিদ রিসিভ করেনা। দর্শিনী আবিদকে সবটা কীভাবে জানাবে বুঝতে পারেনা! তার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে। নিজের বিপদকে তোয়াক্কা না করে, বেবিকে কীভাবে বাঁচাবে সেই উপায় খুঁজে চলেছে দর্শিনী। সময় বিলম্ব না করে আবিদকে ম‍্যাসেজের মাধ্যমে রেকর্ডিং পাঠিয়ে দেয় দর্শিনী। আবিদ হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কাজে আঁটকে গেছে। তাই ফোন রিসিভ করছেনা। এখানো পর্যন্ত টেক্সট সিন করেনি। দর্শিনী মনে মনে প্রার্থনা করছে— আবিদ যেনো দ্রুত স্ক্রিনের ম‍্যাসেজটা লক্ষ‍্য করে! ম্যাসেজটি দেখলে সে দ্রুত কিছু করতে পারবে। যেভাবেই হোক তাদেরকে বাঁচাতে ছুটে আসবে। তার নিজের অংশকে রক্ষা করবে।

#চলবে

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২৭
#আয়েশা_আক্তার

আজ লাবণ্যর চেকআপ ডেইট। নাস্তার পর্ব শেষ করেই লাবণ্য আর মেহেদী বেরিয়ে পরে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ইরফানের ক্যাবিনের সামনের করিডোর দিয়ে যাচ্ছিলো তারা। হঠাৎ করে লাবণ্য’র মনে হলো, ক্যাবিনের ভেতরে পরিচিত কন্ঠস্বর। মনের ভুল ভেবে ক্যাবিনের দরজার সামনে দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে সে৷ কিন্তু একই কন্ঠ আবার শুনে কৌতুহল বশত ক্যাবিনের ভেতরে উঁকি দেয় লাবণ্য। উকি দিয়ে যা দেখলো। তা দেখতে পাবে ভাবতেও পারেনি লাবণ্য। সে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে ভেতরে। লাবণ্য’র দাঁড়িয়ে যাওয়া অনুসরণ করে মেহেদী জিজ্ঞেস করে,

-কি হলো?

লাবণ্য মেহেদীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাত উঠিয়ে ইশারা করে সামনে। তারপর অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

-সাদাফ।

লাবণ্য’র কথা শুনে মেহেদী ভেতরে তাকায়। সেই সাথে ভেতরের মানুষ গুলোও দৃষ্টি পাত করে ওদের দিকে। দরজার দু’পাশের সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। কতদিন পর দেখা!

এশা ছুটে এসে লাবণ্য’কে জড়িয়ে ধরতে গেলে লাবণ্য বাঁধা দিয়ে পেটের দিকে ইশারা করে। এশা এতোক্ষণ খেয়াল না করলেও এখন বলে,

-আপু তুমি প্রেগন্যান্ট? জানো আমরা লন্ডনে এসেই তোমাকে খুঁজেছি। রাস্তায় বের হলেই আমি আশপাশে তোমায় খুঁজি। হঠাৎ যদি দেখা হতো।

লাবণ্য কিছু বলতে যাবে তখনই ডক্টর নাঈম এসে হাজির হয়। মেহেদীকে এখানে দেখে নাঈম জিজ্ঞেস করে,

-কি ব্যাপার তুই এখানে? কই আমাকে বলিসনি তো?

– আরে, তোর ভাবিকে গাইনী ডক্টর টিনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম। তোকে বলা হয়নি কারণ ভেবেছিলাম তোর সাথে তো দেখা হবেই। কিন্তু তোর সাথে দেখা হওয়ার পূর্বেই তোর ভাবীর বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তাই আর তোর ক্যাবিনে যাওয়া হয়নি।

নাঈম এবার লাবণ্য’র দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

-কেমন আছেন ভাবি?

-অনেক ভালো, আপনি?

-শরীরের কি অবস্থা? আর এরা সবাই আপনার বন্ধু?

-না, ওইযো তালগাছটা আমার বন্ধু। তার পাশের জন আমার ছোটবোন, তালগাছের ওয়াইফ।

-বাহ, কাকতালীয় ভাবে দেখা হয়ে গেলো সবার! (নাঈম)

তারপর সবাই একসাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। ডক্টর নাঈম মেহেদীর বন্ধু। নাঈম ইরফানের শরীরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চলে যায়। তার ঠিক দুইদিন পরে হাসপিটাল থেকে রিলিজ পায় ইরফান। সাদাফ এশার বিয়েতে কেউ থাকতে পারে নি৷ তাই আজকে সাদাফের ফ্ল্যাটে সবার৷ দাওয়াত। ইরফান- তানহা, লাবণ্য -মেহেদী, সাদাফ -এশা তিন জোড়া কাপল একসাথে আড্ডায় মেতেছে। সেই সাথে খাওয়া দাওয়া, গান তো আছেই। কেমন একটা পিকনিক পিকনিক ভাব এসেছে সবার মধ্যে। এটা মানতে হবে বন্ধুদের সংস্পর্শে থাকলে সবাই বাচ্চাদের মতো আচরণ করতে শুরু করে হোক সে বড় কিংবা ছোট। তখন বয়সের পার্থক্য কোনো মেটার নয়। বন্ধু মানেই, ভালোবাসা, ভরসা আর বিশ্বাসের জায়গা। যেখানে কোনো ফর্মালিটির স্থান নেই।
__________________________

ঢাকার অদূরে ছোট্ট একটা শহরে দুই রোমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে মোহনা আর হৃদয়। হৃদয় একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করছে। হৃদয় মোহনার দুটো দুই বছর বয়সী টুইন বেবিও আছে। তাদের নাম, হৃধ এবং হৃধি। হৃধি হয়েছে হৃদয়ের মতো আর হৃধ হয়েছে মোহনার মতো। এরজন্যই হয়তো বলা হয়, ছেলেরা মায়ের মতো হয়। আর মেয়েরা বাবার মতো হয়। হৃধ শান্ত স্বভাবের তাই তারজন্য কোনো কষ্ট করতে হয় না মোহনার শুধু খাওয়ার সময় খাওয়া আর ঘুমের সময় ঘুম পাড়ালেই সব ঠিক। কিন্তু হৃধি সুযোগ পেলেই তোলপাড় শুরু করে। কখনো ওয়াশরুমের কল ছেড়ে পানিতে ভিজে, কখনো বা দরজা খোলা থাকলে সিঁড়িতে চলে যায়, আবার কখনো সুযোগ পেলেই জিনিসপত্র ভেঙে একাকার করে ফেলে। এই যেমন এখন গ্লাস দিয়ে ঢিল ছুঁড়ে টিভির গ্লাস ভেঙে ফেললো। মুহুর্তে টিভি কালো হয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। কাঁচের গ্লাস এবং টিভির গ্লাসের ঝনঝন শব্দ শুনে মোহনা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে। টিভিতে কার্টুন দেখছিলো হৃধ হঠাৎ করে টিভি অফ হয়ে যাওয়ায় কান্না শুরু করে সে। একবার টিভি দিকে তাকাচ্ছে আর একবার বোনের দিকে তাকাচ্ছে সে। টিভি ভেঙে খুশি হলেও ভাইয়ের কান্না দেখে মন খারাপ হয়ে যায় হৃধির। সে ভেবেছে ঢিল ছুঁড়ে নতুন একটা খেলার আবিষ্কার করবে এবং তার ভাই খুশি হয়ে সে খেলায় যোগ দিবে। কিন্তু উল্টো হৃধ কেঁদে ফেলায় হৃধি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মোহনা এসে টিভির অবস্থা দেখে ছুটে আসে। তারপর ছেলে এবং মেয়ে দু’জনের শরীর পরীক্ষা করে দেখে কোথায় ব্যথা পেয়েছে কি না। কারো গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন না পেয়ে মোহনা শান্ত হয়৷ ওদেরকে খেলনা দিয়ে বারান্দায় দিয়ে এসে সাবধানে গ্লাসের টুকরো গুলো উঠিয়ে পরিষ্কার করে নেয় মোহনা।

সন্ধ্যা হতেই হৃদয় অফিস থেকে ফিরে আসে। ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই আগে ছেলে এবং মেয়েকে আদর করে দেয়। মোহনা শরবত নিয়ে এসে হৃদয়ের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

-কতদিন বলেছি, বাইরে থেকে এসেই বাচ্চাদের সাথে মিশবি না। ওরা অসুস্থ হয়ে যাবে, কত রকমের জীবাণু নিয়ে আসিস বাইরে থেকে তুই।

– আমার বাচ্চাদের আমি আদর করলে তোর হিংসা হয় মোহ? তুই বললে আমি তোকেও আদর করতে রাজি আছি।

মোহনা লজ্জা পায়। মনে মনে বলে, এই ছেলেটা আর ভালো হবে না। বাচ্চাদেরকে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে হৃদয় শরবতটা একটানে খেয়ে নেয়। তারপর মোহনার কানের কাছে মুখ এনে বলে,

-লজ্জা পেলে তোলে একদম লাল টুকটুকে আপেলের মতো লাগে। আর তুই তো জানিস আপেল আমার কতটা প্রিয়।

মোহনা কিছু বলতে যাবে তার আগেই হৃধি হৃদয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

-বাবা, তুমি তি আমাল আম্মুতে কিসি দিত্তো? আমাতেও দাও।

হৃদয় চোখ বড় বড় করে মেয়ের দিকে তাকায়। সে তো জাস্ট মোহনার সাথে কথা বলছিলো। আর তার মেয়ে এটা কি বললো! হৃদয়ের অবস্থা দেখে মোহনা হেসে ফেলে বলে,

-যেমন বাপ তার তেমন মেয়ে। মুখে কোনো কথা আঁটকায় না।

-ওই বাবা আমালেও কিসি তাও। (হৃধি)

মোহনা হৃদয়কে ইশারায় ওয়াশরুমে যেতে বলে। মেয়ের পাশে বসে বলে,

-বাবা ফ্রেশ হয়ে কিসি দিবে সোনা। বাবার সাথে জার্ম আছে, আর জার্ম তোমাকে অ্যাটাক করলে তো তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে আর খেলতে পারবে না।

মোহনার কথা শুনে হৃধি মাথা নাড়ায়।
______________________
রাতে খাওয়ার পর্ব শেষ করে হৃদয় ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে টিভি অন করতে গিয়ে দেখে টিভির অবস্থা নাজেহাল। ডেকে উঠে মোহনাকে৷ মোহনা বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে এদিকেই আসছিলো। হৃদয়ের ডাক শুনেই বুঝতে পারে যে কেন ডেকেছে হৃদয়? মোহনা এসে দাঁড়াতেই হৃদয় প্রশ্ন করে,

-টিভির এই অবস্থা কেন?

-হৃধি…

-সারাদিনে দুটো বাচ্চাও সামলাতে পারিস না? (মোহনা কথা শেষ করার আগেই হৃদয় ধমকে সুরে বলে উঠে।)

হৃদয়ের কথা শুনে মোহনার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। সেখানে এক মুহুর্তও না দাঁড়িয়ে বারান্দায় চলে আসে। তার কিছুক্ষণ পর হৃদয় তাদের শোয়ার ঘরে এসে দেখে বিছানায় শুধু হৃধ আর হৃধি। মোহনা নেই। তাই সে বারান্দার দিকে অগ্রসর হয়। মোহনা আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয় ধীর গতিতে এগিয়ে যায় মোহনার কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে মোহনার খোঁপা করা চুলগুলো মুক্ত করে দেয়। সেকেন্ডে কালো কেশরাশি মোহনার পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। মোহনা এখনো আগের মতোই নির্বিকার। একটুও নড়ছে না। হৃদয় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মোহনার চুলে নাক ডুবিয়ে দেয়। ফিসফিস করে বলে,

-সরি, মোহ পাখি। তুই তো জানিস টিভিটা মাত্র গতমাসেই কিনেছি। আবার নতুন একটা টিভি কিনতে গেলে কতগুলো টাকা দরকার!

প্রতিত্তোরে মোহনা কিছু বলে না। হৃদয় মোহনার চুল থেকে মুখ সরিয়ে কাঁধে থুতনি রাখে। আবারো বলে উঠে,

– সরি তো, আর কতক্ষণ অভিমান করে থাকবি?

-আমি অভিমান করিনি। মোহদের অভিমান করতে নেই। তুই ঠিকই বলেছিস আমি বাচ্চা সামলাতে পারি না। কিন্তু তুই নিজেও জানিস হৃধি তোর মতো রগচটা কারো কথা শুনে না।

-আমি রগচটা?

-হ্যাঁ, তুই রগচটা দেখেই মেয়েটাও তোর মতো হয়েছে। হৃধকে দেখ একদম আমার মতো শান্ত।

-আচ্ছা পরেরবার থেকে বেবিদেরকে বলে দিবো আমার মতো হইস না বাপ। তোর মায়ের মতো হইস।

-পরেরবার মানে?

-আমি তো চাই আমাদের আরো দুটো টুইন বেবি হোক।

মোহনা হৃদয়ের বুকে আঘাতের চেষ্টা করে বলে উঠে, – ফাজিল।

-মোহ, তুই কিন্তু আমায় এখনো বন্ধুর নজরে দেখছিস। এটা কি ঠিক বল?

-মানে?

-আমাদের বিয়ে হয়েছে তিন বছর হয়ে গেছে। আর তুই এখনো আমায় বন্ধুর নজরেই দেখিস। এবার তো একটু জামাই জামাই নজরে দেখ।

-কিভাবে জামাই জামাই নজরে দেখতে হয়?

-এখন থেকে আমায় তুমি তুমি করে বলবি। তাহলেই হবে।

-আচ্ছা, তুই বুঝি আমায় বউ বউ নজরে দেখিস?

-অবশ্যই, সেই প্রথম দেখাতেই তো তোকে আমি বউ বউ নজরে দেখা শুরু করেছি।

-তাহলে তুই আমায় তুই করে বলিস কেন? নিজে আগে বন্ধু থেকে জামাই হ। তারপর আমায় বলবি।

– ধুর, থাক তোকে বউ হতে হবে না। তুই হলি আমার প্রেয়সী। প্রেম প্রেয়সী। যাকে দেখলেই আমার প্রেম প্রেম পায়।

সমাপ্ত

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-২৬

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২৬
#আয়েশা_আক্তার

মেহেদী কোলের উপর ল্যাপটপ বসিয়ে সেই কখন থেকে কাজ করছে। লাবণ্য কাপড় ভাজ করছে আর আড়চোখে মেহেদীর দিকে তাকাচ্ছে। লাবণ্য’র মাথায় চট করেই একটা প্ল্যান আসে। সে কাপড় রেখেই পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় মেহেদীর দিকে। লাবণ্য দেখতে চায় মেহেদীর পাশে তার দাঁড়ানোতে তার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। সে এসে দাঁড়াতেই মেহেদী বলে উঠে,

-বসো।

-উহু, তুমি কাজ করো।

এটা বলে লাবণ্য চলে যেতে নিলেই মেহেদী একহাতে লাবণ্যর হাত ধরে আটকায়। তারপর ডান হাতে ল্যাপটপে কিছু একটা করে কয়েক সেকেন্ড পর ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়। তারপর লাবণ্যকে তার পাশে বসিয়ে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতেই লাবণ্য বলে উঠে,

-কাজ শেষ না করেই রেখে দিলে কেন?

-বউয়ের থেকে কাজ বড় নয়। কাজ অনেক আছে, করাও যাবে কিন্তু একটা মাত্র বউকে কাছে পেলেই আমার আদর আদর পায়।

কথাগুলো গত তিন বছরে মেহেদীর মুখে লাবণ্য শতবার হবে শুনেছে। তারপরও যতবার শুনে ততবারই খিলখিলিয়ে হেসে ফেলে লাবণ্য। অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

-অসভ্য।

-হায়! এটা নতুন নয় বউ পাখি তোমার সাথে এ্যাংগেইজম্যান্ট হওয়ার পর থেকেই আমি অসভ্য হতে শুরু করেছি। তবে বিয়ের পর পুরোপুরি হয়ে গিয়েছি।

-ছি! তারমানে আমি তোমায় অসভ্য বানিয়ে ফেলেছি? আশ্চর্য!

-তুমি অসভ্য বানাওনি। সুন্দরী বউদের কাছে সব পুরুষ হাজারবার অসভ্য হতে রাজি।

-হয়েছে এখন ছাড়ো আমার কাজ আছে।

-তোমাকে বলেছি না এ অবস্থায় কোনো কাজ করতে হবে না? দেখি তো আমার হামিংবার্ড কেমন আছে?

এ কথা বলেই মেহেদী লাবণ্যকে বালিশে হেলান দিয়ে বসিয়ে দেয়। তারপর লাবণ্যর পেটের উপর আলতো স্পর্শ করে বলে উঠে,

-এইযে আমার হামিংবার্ড ঘুমাচ্ছিস? দেখছিস তোর মা আমায় অসভ্য বলছে, তুই পৃথিবীতে এসে তোর মাকে বকে দিবি ওকে?

লাবণ্য আবারো হেসে উঠে। মেহেদী লাবণ্যকে বসতে বলে বিছানা থেকে নেমে বাকি কাপড় গুলো ভাঁজ করে ওয়ারড্রবে রেখে দেয়। আর লাবণ্য দেখতে থাকে তার একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষটি কে। সে মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে। আল্লাহ তায়ালা তার ভাগ্যে এতো ভালো একজন মানুষকে দিয়েছেন সেই জন্য। প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই মেহেদী লাবণ্যর দিকে দিগুণ খেয়াল রাখা শুরু করেছে। আগে যে রাখতো না তেমন নয়, তবে গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে কোনো কাজেই করতে দেয় না মেহেদী লাবণ্যকে। রান্নার মহিলা এসে রান্না করে দিয়ে যায় আর বাদ বাকি কাজ মেহেদীই বেশির ভাগ সময় করার চেষ্টা করে। মেহেদী কাপড় ভাজ করে রেখে ঘড়িতে চেয়ে দেখে রাত এগারোটা বেজে গেছে। তাই সে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। খাবার গরম করে একটা প্লেটে করে আবারো ঘরে ফিরে আসে মেহেদী। তারপর ভাত মেখে লাবণ্যর মুখের সামনে ধরতেই লাবণ্য তৃপ্তি সহকারে খেতে শুরু করে। খাওয়াতে খাওয়াতে মেহেদী লাবণ্যর পেটের দিকে চেয়ে কৌতুক করে বলতে শুরু করে,

-হেই পুঁচকে দেখছিস তো বাবা কত রোমান্টিক? তুইও শিখে রাখ ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। রোমান্টিক বাপের আনরোমান্টিক পোলা হোক এটা আমি চাই না। বুঝছিস?

-যদি মেয়ে হয়?

– মেয়ে হলেও সমস্যা নেই। মেয়ে তার বরের কাছে আবদার করবে, ভাত খাইয়ে দাও নয়তো খাবো না। আমার বেশির ভাগ সময় মাকে ভাত খাইয়ে দিতে। এবার তুমি আমায় খাইয়ে দাও।

লাবণ্য এসব শুনে হো হো করে হেসে ফেলে। লাবণ্যর প্রেগ্ন্যান্সির সাত মাস চলছে। এই সাত মাসে এমন রংঢং মেহেদী আরো অনেক বার করেছে। তবুও লাবণ্যর কাছে মেহেদীর সবকিছুই নতুন লাগে। মনে হয়, এইতো সেদিন এ্যাংগেইজম্যান্ট হলো, তারপর কিছু মাস পরই বিয়ে। কিন্তু অলরেডি তাদের বিয়ের তিন বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। আসলে ভালোবাসলে সবকিছুই নতুন লাগে। ভালোবাসা কখনো পুড়নো হয় না।
________________________

অপারেশন শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই সাদাফ এশা চলে যায়। তার ঘন্টা খানেক পরই ইরফানের জ্ঞান ফিরে। হ্যাঁ তানহার হাসবেন্ডের নাম ইরফান। বিজনেসের সুত্র ধরেই ইরফান লন্ডনে এসেছে। ভালো মানুষদের যেমন শত্রুর অভাব নেই তেমনই ইরফানের ও। তাই ইরফানের চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখেই চলাচল করে। কিন্তু আজ একটা ইমার্জেন্সি এবং জরুরী কাজে গিয়েছিলো ইরফান। সেখান থেকে ফেরার সময়ই কেউ দূর থেকে ইরফানের উপর গুলি ছুড়ে। গাড়িটাও রাস্তায় খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আর এই সুযোগ টা-ই কাজে লাগালো ইরফানের শত্রু’রা।

তানহা ইরফানের জন্য হাসপাতালের ক্যানটিন থেকে স্যুপ নিয়ে এসে খাইয়ে দিয়েছে। তারপর ঔষধ গুলো খাইয়ে দেয়। এরপর তানহা ইরফানের সামনে বসতেই ইরফান তানহার মুখ পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। একহাতে তানহাকে কাছে আনার চেষ্টা করে বলে,

-কেঁদে কেঁদে কি অবস্থা করেছো নিজের?

তানহা কিছু বললো না। তার গাল বেয়ে আরো কিছুটা তরল পানি গড়িয়ে বললো। ইরফান নরম কন্ঠে বলে উঠলো,

-আবার কাঁদছো? কেঁদো না প্লিজ।

-আজ থেকে গার্ড সাথে নিয়ে যাবে। তা নয়তো বিজনেস ফিজনেস করতে হবে না। বাংলাদেশে ফিরে চলো।

-বাংলাদেশেও শত্রু আছে। তাই পালিয়ে যাওয়ার মানে হয় না। আমি লড়াই করতে জানি। এবার একটু অসতর্ক থাকায় ওরা সুযোগ পেয়েছে। তুমি চিন্তা করো না।

তানহা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাদাফ এশা হাজির হলো। তাই আর তানহা কিছু বললো না। সাদাফ এসে ইরফানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো,

-কি অবস্থা এখন আপনার?

-এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আপনাদের জন্যই এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম।

-উহু, জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।

-তা ঠিক তবে আমার আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। যেখানে দেশের মাটিতেই এক জনের বিপদে অপরজন পাশ কেটে চলে যায় সেখানে আপনারা আল্লাহর দেওয়া উপহার স্বরূপ এসেছেন।

– যাদের মধ্যে মানবতা আছে তারা অপরের বিপদে কিছুতেই নির্বিকার থাকতে পারে না। এসব কথা বাদ, তানহা এশা কেমন লাগছে তোমাদের এতো দিন পর দেখা হয়ে? আল্লাহ চেয়েছিলো তোমাদের দেখা হোক তাই হয়তো এভাবে আমাদের সবার এক হওয়া হয়েছে।

-আমি তো ভীষণ খুশি। জানো তানহা আমি তোমায় কত খুঁজেছি? (এশা)

-আমার বাবা মারা যাওয়ার পর বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়ে যায়। বাবাকে হারিয়ে আমি একদম ভেঙে পড়েছিলাম। তখন ইরফানকে মেনে নিতেও পারিনি। আর না কারো সাথে যোগাযোগ করতেও পারিনি। হয়তো চেষ্টাও করিনি। কারণ আমি অনেকটা ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। সুই সাই ড করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ইরফান ধীরে ধীরে আমায় ডিপ্রেশন থেকে বের করে এনেছে। তারপর আমিও ওকে ভালোবেসে ফেলি, স্বামী হিসেবে মেনে নেই। আর এটা মানতেই হবে আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করে। তোর কি অবস্থা সেটা বল? (তানহা)

-আমিও সাদাফের অসুস্থতায় অনেক ভেঙে পড়েছিলাম। একটা বছর…. (এশা)

-উফ, এতো দিন পর দেখা হলো কই হাসিখুশি কথা বলবে, আনন্দ করবে তা নয় দু’জন মিলে মন খারাপের গল্প শুরু করেছে। (এশার কথা কেড়ে নিয়ে সাদাফ বলে উঠে।)

-হাহাহা, রকস্টার’রা সবসময় জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসে। (ইরফান)

-অবশ্যই, আপনি বললে আমি গান গাইতে শুরু করতে পারি। (সাদাফ)

চলবে..

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-২৪+২৫

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২৪
#আয়েশা_আক্তার

মেয়েরা মনের দিক থেকে ভীষণ নরম প্রকৃতির হয়ে থাকে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা একটু দূর্বল প্রকৃতির হয় সেটা আমরা সবাই জানি। তবে কিছু কিছু মেয়ে হয় ভিন্ন প্রকৃতির। তারা সাহস ও মনোবলের দিক দিয়ে ছেলেদেরকেও ছাড়িয়ে যায়। এই যেমন একটা মাস ধরে দিন-রাত হাসপাতালে এসে সাদাফের কেবিনের সামনে বসে থাকছে সে।

সেদিন এক্সিডেন্টে সাদাফ অনেক বেশি আঘাত পায়। মাথায় আঘাতটা এতো বেশিই পেয়েছে যে সাদাফ কোমায় চলে গেছে। এক মাসেও সাদাফ সুস্থ হয়নি। পঁচিশ দিন হাসপাতালে থাকার পর ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে সাদাফের বাবা-মা সাদাফকে নিজের বাসায় নিয়ে আসে। এশা সুস্থ হওয়ার পর থেকেই দিনরাত সাদাফের পাশে বসে থাকে। ওদের এ্যাংগেজম্যান্ট হয়ে যাওয়ায় বাইরের কেউ কিছু বলতেও পারে না। ধবধবে ফর্সা এশার চোখের নিচে কালি পড়েছে, শরীরে পড়ছে অযত্নের ছাপ। ভালোবাসার মানুষটিকে এভাবে দিনরাত ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতে দেখে মোটেও ভালো লাগে না এশার।

এশা সাদাফের ঘরেই জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ে আল্লাহর নিকট কান্না করে সাদাফের সুস্থতা কামনা করে। নামাজ শেষ করে চোখ মুছে নেয় এশা। জায়নামাজ উঠিয়ে ভাজ করে রাখার সময় হাতে থাকা অনামিকা আঙ্গুলে সাদাফের পড়ানো এ্যাংগেইজম্যান্ট রিং এর দিকে চোখ যেতেই এশার চোখে দু’মাস আগের স্মৃতি’রা এসে ভির জমায়।

সেদিন ছিলো শুক্রবার,
এশা লাল রঙের একটা কাতান শাড়ী গায়ে জড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো সাদাফদের আসার। সাদাফ ও লাল খয়েরী রঙের পাঞ্জাবিতে রাঙিয়ে জুম্মার নামাজ শেষ করেই পৌঁছে যায় এশাদের বাসায়। এশা এবং সাদাফের পরিবারের উপস্থিতিতেই তাদের দু’জনের এ্যাংগেইজম্যান্ট হয়ে যায়। সাদাফ এশা একে অপরের হাতে রিং পড়িয়ে দেয়। দু’জনেই ঠোঁটে লেগেছিলো প্রাপ্তির হাসি। রিং পড়ানোর পরই খাওয়া দাওয়ার পর্ব শুরু হয়। খাওয়া শেষে সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে আড্ডার আসর জনায়। সাদাফ এশার দু’জনের বাবা পূর্ব পরিচিত বন্ধু হওয়ায় তাদের গল্প যেন শেষই হতে চায় না। সাদাফ সবার আড়ালে এশাকে ছাঁদে যেতে ইশারা করে। কিন্তু এশা মুখটা খানিক বাঁকা করে ইশারায় বলে, “সবাই কি ভাববে? ”

বিষয়টা ইয়াশা লক্ষ্য করে। তারপর সে গিয়ে তার মায়ের পাশে বসে বলে,

-মা, তোমরা গল্প করো। আমি আপু আর সাদাফ ভাইয়াকে নিয়ে একটু ছাঁদ থেকে ঘুরে আসি।

-আচ্ছা যা।

এবার আর এশা না করতে পারে নি। রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ি ভেঙে এগিয়ে যায় ছাঁদের দিকে। সাদাফ আর ইয়াশা এশার পিছু পিছু যাচ্ছে। এশা ছাঁদের রেলিং ধরে আকাশ পানে মুখে করে চেয়ে আছে। গোধূলি বেলার আকাশ এশার ভীষণ প্রিয়। কি সুন্দর রক্তিম আকাশ!

সাদাফ আর ইয়াশা ছাঁদের চিলেকোঠার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ইয়াশা কেশে গলার পরিষ্কার করার চেষ্টা করে বলে উঠে,

-ভাইয়া, আমি যে আপু আর আপনাকে ছাঁদে আসার সুযোগ করে দিলাম। তারজন্য যদি…

-যা চাইবে তাই দিবো৷ আমার একটা মাত্র শালিকা বলে কথা!

ইয়াশা কথা শেষ করার আগেই সাদাফ বলে উঠে। ইয়াশা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,

-বেশি কিছু না শুধু আইসক্রিম খাওয়ালেই হবে। খবরদার আপুকে বলবেন না। আপু জানলে আম্মুকে বলে দিবে। আর আম্মুর কানমলা যেই ব্যথা।

-হাহাহা, তোমার আপু জানবে না। পেয়ে যাবে আইসক্রিম।

-ওকে, তাহলে আপনারা কথা বলুন। আমি যাচ্ছি।

সাদাফ হেসে মাথা দোলাতেই ইয়াশা ছুটে চলে যায়। সাদাফ এশার শরীরের সাথে ঘেষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

-কি দেখছো?

-আকাশ।

-আকাশ, বুঝি অনেক সুন্দর?

-ভীষণ।

-আর আমি?

– আপনি মানুষ, আমার মানুষ। পৃথিবীর সবচাইতে দামি মানুষ।

তারপরের কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে না। সাদাফ নিরবতা ভেঙে এশাকে তার সামনে দাঁড়াতে বলে। এশা বাধ্য মেয়ের মতো এসে সাদাফের সামনে দাঁড়ায়। সাদাফ এশার আঁচলটা মাথায় দিয়ে বলে,

-এবার একদম লাল টুকটুকে বউয়ের মতো লাগছে।

এশা লজ্জা পেয়ে দু’হাতে মুখ ঢাকে।

কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে এশার ধ্যান ভাঙে। চকিতে পেছনে তাকিয়ে দেখে, সাদাফের মা এশে দাঁড়িয়েছে। এশা কিছু বলার চেষ্টা করার পূর্বেই তিনি বলে উঠে,

-এভাবে নিজেকে অসুস্থ কেন করে তুলছো মা? আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে তোমার এমন বিধস্ত অবস্থা দেখলে কষ্ট পাবে তো। তুমি বাসায় গিয়ে নিজের যত্ন নাও, পড়াশোনায় মন দাও।

-সাদাফ যতদিন সুস্থ হবে না, ততদিন আমি কোথাও যাবো না। ও সুস্থ হয়ে আমায় খুঁজে না পেলে বড্ড রাগ করবে।

সাদাফের মা আর কিছু বলতে পারে নি। তিনি চোখের জল মুছতে মুছতে ছেলের দিকে একবার তাকিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।

এশা আবার সাদাফের ডান হাতটা ধরে সাদাফের বিছানার পাশে বসে। তার চোখ বেয়ে গরম অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সাদাফের হাতটা শক্ত করে ধরে এশা বলতে শুরু করে,

-এটা কথা ছিলো না সাদাফ। তুমি এভাবে আমায় করে শুয়ে থাকতে পারো না। আমাদের একসাথে অনেকটা পথ চলার কথা ছিলো। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে সাদাফ। এই সাদাফ, এই, দেখো তোমার এশা কাঁদছে। প্লিজ উঠো। প্লিজ….
_________________

কিছুদিন পর,
আজ সাদফকে চিকিৎসার জন্য কানাডা নিয়ে যাওয়া হবে। যদিও সবাই এশাকে যেতে নিষেধ করেছিলো কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। কারণ হিসেবে এশার মন্তব্য সে না গেলে সাদাফ এশাকে ফাঁকি দিবে। আর কখনো এশার কাছে ফিরবে তার শ্যাম পুরুষ। এটা সে কিছুতেই হতে দিবে না। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এশা সাদাফের সঙ্গে বাঁচতে চায়। তারজন্য এশার পাসপোর্টও তৈরি করা হয়। এশা নিজের বাড়িতে এসে বিভিন্ন জিনিস পত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। ইয়াশা চেয়ে এশার দিকে। তার আপুটা কেমন বদলে গেলো! ইয়াশার ইচ্ছে করছে কিছুক্ষণ এশাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে। কিন্তু ভয়ে এগুচ্ছে না। কারণ এশার মন মানসিকতা ভালো না। এ অবস্থায় যদি সে ইয়াশার এমন আবদারে অখুশি হয়!

এশা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে তার আদরের ছোট বোন তার আশেপাশে সেই কখন থেকে ঘুরঘুর করছে। এশা বুঝতে পারে ইয়াশা কিছু বলতে চাইছে কিন্তু ভয়ে বলছে না। তাই নিজেই ছোট বোনের নাম ধরে কাছে ডাকে।

-ইশু?

আপুুর মুখে নিজের নাম শুনে ইয়াশার চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠে। সে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে জবাব দেয়,

-হ্যাঁ, আপু।

-এদিকে আয়তো।

ইয়াশা গিয়ে এশার উপর বসলে এশা জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

-কিছু হয়নি তো আপু। আমার আবার কি হবে?

-তুই সত্যি করে বল কি হয়েছে?

-কিছু হয়নি আপু।

-তাহলে তোর চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?

এবার আর ইয়াশা থাকতে পারে না। হুহু করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়,

-তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছে আপু। আমার সুন্দরী, কিউটিপাই এমন অবস্থা আমার সহ্য হচ্ছে না আর।

-ধুর, পাগলী। কান্না থামা বলছি। ইশু, তোর ভাইয়ার জন্য দোয়া করবি। তোর ভাইয়া যেন আগের মতো আমার সাথে কানাডা থেকে ফিরে আসে।

-আচ্ছা আপু, একটা কথা বলবো?

-বল।

-তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি।

এশা কিছু না বলে ইয়াশাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।

চলবে…

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২৫
#আয়েশা_আক্তার

তিন বছর পর,
সাদাফ এশার বিয়ের আজ দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। তাই তারা ঠিক করেছে আজ সারাদিন লন্ডনের অলিগলি ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সাদাফ এখন দেশের সাথে সাথে বিদেশেরও একজন নামকরা রকস্টার। তার গান আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ তিন বছর আগে অনেক ডাক্তারই বলেছে, সাদাফ আর বাঁচবে না। ডাক্তারদের মুখে এমন কথা শুনেও ভেঙে পড়েনি সাদাফের বাবা-মা এবং প্রাণভোমরা এশা। এশার অক্লান্ত পরিশ্রমই সাদাফকে সুস্থ হতে সহায়তা করেছে। যদিও সাদাফ পুরো একটা বছর মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত মৃত্যুও এশার ভালোবাসার কাছে হার মেনে সাদাফকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

সাদাফ এসব মনে মনে ভেবে ঠোঁটে হাসি ফোটায়। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে এশার মতো একজন প্রেম_প্রেয়সী সাদাফকে উপহার দেওয়ার জন্য। সাদাফ পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পরই দুই পরিবারের উপস্থিতিতে এশা এবং সাদাফের বিয়ে হয়। বিয়েতে অমিত এবং প্রীতম উপস্থিত থাকলেও হৃদয়-মোহনা, লাবণ্য উপস্থিত হতে পারে নি। তবে বিয়ের পুরোটা সময় তারা অমিত এবং প্রীতমের ফোনে ভিডিও কলে সাদাফ এশার এক হওয়াকে দেখেছে।

সাদাফ ড্রাইভিং করছে আর এশা বাইরে চেয়ে রাতের লন্ডন দেখছে। হঠাৎ করেই বিকট এক শব্দে চারপাশ স্তব্ধ হয়ে যায়। সাদাফ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থামিয়ে আশেপাশে দেখার চেষ্টা করে এক্সাক্টলি কি হয়েছে? সামনে কিছুটা যেতেই দেখতে পায় তার বয়সী একজন সুদর্শন যুবক বুকে হাত দিয়ে নিচে শুয়ে ছটফট করছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে স্পষ্ট বোঝা যায় ছেলেটির বুক থেকে গলগল করে র ক্ত বের হচ্ছে। এতোক্ষণে রাস্তায় পড়ে থাকা যুবকটির কাছে আরো পথচারী ছুটে এসেছে। কিন্তু কেউ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সাদাফ সবাইকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে যার বাংলা অর্থ ,

– আপনারা কেউ উনাকে চিনেন?

কেউ কোনো সাড়াশব্দ করলো না। সাদাফ বুঝতে পারে কেউ চিনে না। তাই বাধ্য হয়ে নিজেই কয়েকজনের সাহায্য নিয়ে ধরে গাড়ির পেছনের সিটে শুয়ে দেয়। তারপর সাদাফ ড্রাইভিং সীটে বসে এশাকে ইশারায় বলে সামনের পাশের সীটে বসতে। এশা উঠে বসতেই সাদাফ শাঁ শাঁ গতিতে এগিয়ে যায় কোনো এক হসপিটালের সন্ধানে।
_______________________

The Royal London Hospital,

ইমারজেন্সিতে একজন পেশেন্টকে ভর্তি করানো হয়েছে।শ্বাস-প্রশ্বাস খুবই ধীর গতিতে চলছে।বয়সটা আনুমানিক ৩০-৩১ হবে।গুলি লেগেছে বুকে একটি,হাতে একটি। বাচঁবে নাকি বলা যাচ্ছে না। রক্তক্ষরণ খুব বেশি হয়ে গিয়েছে।অপারেশন করাটারিস্কি। ইমারজেন্সিতে ডক্টররা মিটিং এ বসেছে।তারা দ্রুত ৪ জনের একটি টিম তৈরি করে। যাদের মধ্যে থাকবে এই টিমের সব চাইতে কনিষ্ঠ এবং দক্ষ সার্জন ডক্টর নাজিব আহমেদ নাঈম । বয়স ২৮ এর কাছাকাছি। অপারেশন শুরু হবার আগে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলো। নাঈম সবুজ রঙের এপ্রোন,মাস্ক,ক্যাপ আর হাতে গ্লাভস পড়ে তৈরি হয়ে যায় ওটিতে যাওয়ার জন্য। ঠিক তখনই নীল রঙের স্কার্ট, আর শার্ট পরিহিত অল্প বয়সী শ্বেত বর্নের এক রমনী তার সামনে এসে আহাজারি করছে,কাদঁছে। মেয়েটির চোখ কান্নামিশ্রিত।শোকের ছায়া মুখমন্ডল জুরে। মেয়েটির কপালের একাংশ জুড়ে ছুপ ছুপ লালাভ রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো। মেয়েটি এইবার ফোলা ফোলা চোখ আর ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে ভাঙা গলায় বললো,

-প্লিজ সেইভ মাই হাসবেন্ড ডক্টর। সেইভ মাই লাভ। ইট টোটাল্লি ডিপেন্ডস অন ইউ। আই উইল ওয়েট ফর হিম পেশিয়েন্টলি।

নাঈম কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে দেখলো এক মৃত্যুপথযাত্রীর প্রেয়সীকে। সে তাকে আশ্বস্ত করলো যে সে চেষ্টা করবে বাকিটা সৃষ্টিকর্তার হাতে। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা নির্দিষ্ট আয়ু দিয়ে পাঠায় যা কেউ চাইলেও বদলাতে পারে না। কিন্তু এই শরীরের আগেই অনেকের আত্মার মৃত্যু ঘটে যায়। নাঈমের বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। অপারেশন শুরু হলো। কিন্তু বাইরে পেশেন্ট এর বিবাহিতা স্ত্রী হাউমাউ করে কাদঁছে। কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে।

পাশে পাতানো বেঞ্চে বসে আছে সাদাফ এশা৷ মেয়েটিকে তাদের বড্ড চেনা চেনা মনে হচ্ছে। এতোক্ষণে তারা বুঝে গিয়েছে আগন্তুক ছেলেটির ফোন থেকে ❝বউ পাখি❞ দিয়ে সেইভ করা নম্বরটি এই মেয়েটিরই ছিলো। সাদাফ ছেলেটিকে হাসপাতালে ভর্তি করেই তার আত্নীয়দের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। ছেলেটির ফোনে সর্ব প্রথম এই নম্বরটি পাওয়ায় সাদাফ এই নম্বরেই ডায়াল করে। সাদাফের হসপিটালের এড্রেস বলতে দেরি হয়েছে মেয়েটির ছুটে আসতে দেরি হয়নি। মেয়েটির হাউমাউ করে কান্না দেখে সাদাফ এশার দিকে তাকায়৷ এশার চোখ ছলছল করে উঠছে। এশা কাঁপা গলায় বলে,

-এবার ভাবো একটা বছর আমি কতটা যন্ত্রণা সহ্য করেছি? কতটা ছটফট করেছি?

সাদাফ কোনো কথা না বলে এশার হাতটা শক্ত করে ধরে। এশা সাদাফের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে যায় ক্রন্দনরত মেয়েটির দিকে। মেয়েটির সামনে বসতেই এশা অবাক হয়ে যায়। তার কারণ মেয়েটি আর কেউ না। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী তানহা। এশার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। সাদাফের অসুস্থতায় একটা বছর এশা কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারেনি। তারপর সাদাফ সুস্থ হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করে ও তানহার সাথে আর যোগাযোগ হয়ে উঠে নি এশার। এশা কাঁপা হাতে তানহার শরীর স্পর্শ করে। তানহা সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। কান্না থামিয়ে পলকহীন চেয়ে থাকে। নিরবতা ভেঙে এশা তানহার নাম ধরে বলে উঠে,

-তানতা!

তানহা এশাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে আবারো। এশার মুখে তানহার নাম শুনে সাদাফ এগিয়ে আসে তাদের দিকে। এশা তানহাকে ধরে নিয়ে পাশের বেঞ্চে বসায়। এতো বছর পর বন্ধুর সাথে দেখা হয়েও খুশি হতে পারছে না তানহা। কারণ তার ভালোবাসার মানুষটি অসুস্থ। তবে বিদেশের মাটিতে এমন বিপদে বন্ধুকে পাশে পেয়ে ভেতরে ভেতরে শক্তি পাচ্ছে তানহা।
___________________

অপারেশন শেষ হলো দীর্ঘ ৪ ঘন্টা পর। দরজা খুলে করিডোরে আসতেই দেখলো মেয়েটি বেঞ্চে মাথা এলিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে চোখে এক সমুদ্র উৎকণ্ঠা নিয়ে। সেই সাথে তাকিয়ে আছে আরো দুজন মানব- মানবী। ক্রন্দনরত মেয়েটি যেন অস্থির চিত্তে দৌঁড়ে এলো। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে থাকলো। নাঈম চেয়ে রইলো শূণ্য দৃষ্টিত আর অধরে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে জবাব দিলো,

– ইউর ওয়েট ইজ ওভার।হি ইস টোটাল্লি ফাইন।অপারেশন ইস সাকসেসফুল।ইউ ক্যান মিট হিম হুয়েন হি রিগেইনস হিজ সেন্স।নাউ হি ইজ ইন অভজারভেশন।
(আপনার অপেক্ষার অবসান ঘটেছে।সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।আপনি তার জ্ঞান ফিরলেই দেখা করতে পারবেন।এখন তিনি আমাদের অবজারভেশনে আছেন)

তানহার খরস্রোতা বুকটা যেন প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো। সেই সাথে সাদাফ এশার ঠোঁটে ফুটে উঠলো কিঞ্চিত হাসি। তানহার অধর রংধনুর ন্যায় হাসিতে ভরে উঠলো। মন ভরে দোয়া করলো। আর স্নিগ্ধ কন্ঠে বললো,

-ইউ গেভ মাই লাই লাইফ ব্যাক টুডে।ইফ ইউ নিড সামথিং ফ্রম মি জাস্ট রিমেমবার মি ওয়ান্স।
(যদি কখনো আমার প্রয়োজন পড়ে যে কোন দরকারে আমাকে একবার স্মরণ করবেন। আপনি আজ আমার জীবন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।)

চলবে…..

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-২৩

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২৩
#আয়েশা_আক্তার

ঢাকা শহরে আজ সবচেয়ে বড় কনসার্ট হতে চলেছে। এখানে প্রধান অতিথি হয়ে আসছে প্রবাসী বাঙালি নামকরা বিজনেস ম্যান। সাদাফের গান আজ তার মন ছুঁয়ে গেলেই সাদাফকে তিনি কানাডায় কনসার্টে গান গাওয়ার অফার করবে। সাদাফ এ পর্যন্ত তিনটি গান গেয়ে শেষ করলো। প্রবাসী অতিথি’র অনুরোধে সাদাফ এবার চতুর্থ গানটি শুরু করলো এবং এটিই সাদাফের আজকের গাওয়া বাংলা গান। বিদেশে অনেক বছর ধরে থিয়েটার নিয়ে কাজ করছে বলে নিজের দেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে ভুলে যাননি তিনি। তাই তো আজ সাদাফকে নিজের দেশের গান গাইতে বললেন তিনি।

❝ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।
তোমার হাওয়ায় করেছি যে দান।
আমার আপন হারা প্রান, আমার বাধন ছেড়া প্রান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান…❞

সাদাফ গান শুরু করতেই আবারো চারপাশে হাত তালি এবং হইহই ধ্বনি উচ্চারিত হলো। জনগন সাদাফের গান বেশ পছন্দ করছে। সেটা তাদের প্রতিক্রিয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামনে দর্শকদের ভীরে পিংক কালারের জামদানী শাড়ি পরিহিতা নারীটির দিকে সাদাফের চোখ যেতেই তার ওষ্ঠ যুগল হাসিতে প্রসারিত হয়। হাসি ফোটে উঠে দর্শকদের ভীরে বসে থাকা নারীটি’র ঠোঁটেও। একে অপরের চোখে চোখ রেখে কথা বলে চলেছে। সাদাফ হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠেই গেয়ে চলেছে,

❝পূর্নিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনী গন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়।
পূর্ণিমা সন্ধ্যায়, তোমার রজনী গন্ধায়
রূপসাগরের পাড়ের পানে উদাসী মন ধায়।
তোমার প্রজাতির পাখা,
আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখে রঙিন স্বপ্ন মাখা।
তোমার প্রজাতির পাখা,
আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখে রঙিন স্বপ্ন মাখা।
তোমার চাঁদের আলোয়….
মেলায় আমার দুঃখ সুখের সকল অবসান।❞

এশা সাদাফের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে ভাবছে, লোকটা এতোটা নিখুঁত ভাবে কি করে গায়। কই আগে তো আমার কারো গান শুনতে এতো ভালো লাগতো না। তাহলে এই লোকটার গান কেন আমায় এতোটা মুগ্ধ করে? সবই এই ভালোবাসা নামক অনুভূতির যাদু! আমরা যাকে ভালোবাসি তার স্বভাব থেকে শুরু করে তাকে কেন্দ্র করে রয়েছে এমন প্রতিটি ক্ষেত্রকেই আমরা ভালোবাসতে শুরু করি। তাই এমনটা হচ্ছে আমার। তবে যাই বলুন, আপনি কিন্তু দারুণ গান, আমার শ্যাম পুরুষ।

চারপাশে জনগনের চি ৎ কা রে এশার ধ্যান ভাঙে। সবাই সাদাফ সাদাফ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস কাঁপাচ্ছে। সাদাফ স্টেজ থেকে নেমে এশেই এশার পাশে চেয়ারে বসে। এশার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-অমন ভাবে চেয়ে কি দেখছিলে?

-কই?

এশা নির্লিপ্ত ভাবে তাকাতেই সাদাফ এশার নিকট আরো কিছুটা এগিয়ে যায়। বলে উঠে,

-এভাবে তাকিও না, খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে!

-ইশ! অসভ্য।

-বিশ্বাস করো, স্টেজে আমি যখন গাইছিলাম তখন তুমি আমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলে, ওভাবে আমি তোমার দিকে তাকালে তোমারও অসভ্য হতে ইচ্ছে করবেে।

-আমি তোমার মতো অসভ্য নই। আর তুমি ও আমার দিকে চেয়েছিলে আমি দেখেছি।

সাদাফ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই একজন লোক এসে মাইক হাতে নিয়ে প্রতিযোগীতায় বিজয়ী’র নাম ঘোষণা করে। সবাই উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে আছে। সাদাফ এশাও তার ব্যাতিক্রম নয়। বিজয়ীর তালিকায় প্রথম নামটি এনাউন্সমেন্ট হতেই সবার আগে এশা জোরে জোরে হাত তালি বাজাতে শুরু করে। তার সাথে সবাই জোরে জোরে কর তালিতে চারপাশ মুখরিত করে তুলে। সাথে কিছু জনগণ সাদাফের নাম নিয়ে উচ্চ ধ্বনি করতে থাকে। সাদাফকে ম্যাডেল পড়িয়ে দেয় প্রবাসী অতিথি। সেই সাথে সাদাফের নিক অফার রাখে কানাডার কনসার্টে যেনো সাদাফ অবশ্যই গাইতে যায়। সাদাফও হেসে জবাব দেয়, সে অবশ্যই কানাডার কর্নসার্টে অংশ নিবে।
______________________

অনুষ্ঠান শেষে সবাই যে যার গন্তব্য স্থলে রওয়ানা দিয়েছে। সাদাফ আর এশাও ছুটে চলেছে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে। তাদের সাথে আছে সাদাফের বাবার ড্রাইভার রমিজ আলি। রমিজ আলি সামনে বসে গাড়ি চালাচ্ছে। পেছনে সাদাফ এশা বসে আছে। এশা মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে আছে। যেটা সাদাফের একদমই ভালো লাগছে না। সাদাফ এশার কাঁধে হাত রাখে। এশা ঘুরে সাদাফের দিকে চেয়ে ঠোঁটে হাসি ফুটায়। সাদাফ এশাকে একটানে নিজের কাছে এনে জিজ্ঞেস করে,

– কি হয়েছে?

-কিছু না।

-মন খারাপ?

-না, ভয় করছে।

-কিসের ভয়?

-যদি তোমায় হারিয়ে ফেলি। আমার ভাগ্যে যদি এতো সুখ না থাকে সেই ভয়৷ আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।

-নেগেটিভ কথা কেন ভাবছো পাগলী? বেঁচে থাকতে কেউ তোমায় আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। আল্লাহ ব্যাতিত কারো শক্তি নেই তোমার থেকে আমায় কেড়ে নেওয়ার মতো।

ড্রাইভার তখন পেছনে ফিরে যুগল প্রেমিক- প্রেমীকার দিকে চেয়ে প্রশান্তির হাসি হাসে। সামনে তাকাতেই বিকট এক শব্দে চারপাশ থমকে যায়। হ্যাঁ, সাদাফদের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়।ড্রাইভার যখন সাদাফ এশার কথা শুনে পেছনে তাকায় তখনই তার অগোচরে বড়সড় এক ট্রাক এগিয়ে আসে তাদের দিকে। সামনে তাকাতেই চোখের পলকে তাদের ছোট্র গাড়ির উপর দিয়ে চলে যায় ট্রাকটি। নিমিষেই রমিজ আলির পা দুটো গুঁড়ো হয়ে যায়। ব্যথায় আর্তনাদ করার সময় টুকুও পায়নি সে। তার আগেই প্রাণ পাখি দেহ থেকে বেরিয়ে উড়ে যায়।

একে অপরকে জড়িয়ে থাকা সাদাফ- এশা ছিটকে পড়ে দু’জন দু’দিকে। গাড়ির কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঢুকে যায় সাদাফ এশার শরীর ভেদ করে। দু’জনেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে প্রচন্ড ব্যথা পায়। রক্ত ক্ষরণ হতে শুরু করে তাদের শরীর দিয়ে।

স্থানীয় লোকজন ট্রাকটাকে ধরার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তারা এগিয়ে এসে সাদাফ এশাকে নিয়ে নিকটস্থ হসপিটালে এডমিট করায়। যদিও এই সমস্ত ঝামেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে চলতে চায়। তবে রকস্টার সাদাফকে অনেকেই চেনে। তার গান অনেকেই পছন্দ করে। তাই সাদাফের আইডি কার্ড দেখে নিমিষেই জনগণ সাদাফকে চিনে ফেলে। আর ডাক্তাররাও চেনে। তাই দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে এবং সাদাফের ফোন থেকে তার বাবা-মা এর ফোন নম্বর কালেক্ট করে তারা বাসায় জানিয়ে দেয়। এশার বাবা-মা কেউ জানানো হয়।

চলবে….

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-২২

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২২
#আয়েশা_আক্তার

এক সপ্তাহ পর,
আজ লাবণ্য আর মেহেদী চলে যাবে লন্ডনে। বন্ধুরা সব এসে এয়ারপোর্টে ভির জমিয়েছে। সবার চোখেই আজ অশ্রু চিকচিক করছে। করবে নাই বা কেন? লাবণ্য যেমন মিষ্টি দেখতে। তেমন মিশুকে তার স্বভাব। বন্ধুরাই যেন তার প্রাণ। বিশেষ করে মোহনা এবং লাবণ্য এক আত্মার দুটি প্রাণ। তাইতো মোহনার আজ এতো বেশি কষ্ট হচ্ছে। মোহনা আর লাবণ্য একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সেই কখন থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। মাইকে সুন্দর এক নারী কন্ঠ কিছু একটা এনাউন্স করতে মোহনা লাবণ্যকে ছেড়ে দাঁড়ায়। হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,

-বিদেশে গিয়ে আমায় ভুলে যাবি না তো লাবু?

-কখনোই না। তুই আমার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে ভালো মেয়ে! আর ভালো মেয়েদের কি ভুলে যাওয়া যায়?

মোহনা কথা বলতে পারে না। সমানে হেঁচকি তুলেই যাচ্ছে। লাবণ্য হৃদয়ের সামনে গিয়ে বলে,

-মোহকে কখনো কষ্ট দিস না হৃদয়। মেয়েটা ছোট থেকেই অনেক কষ্ট সহ্য করে বড় হয়েছে। তুই ওকে সুখে রাখিস।

হৃদয়ের চোখেও পানি টলমল করছে। সে মোহনার হাত ধরে বলে,

-তোর কথা অবশ্যই রাখবো। তুই ভালো থাকিস ভাইয়ার সাথে। দোয়া রইলো, পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সুখের অধিকারীনী মেয়েটা যেনো তুই হোস।

হৃদয় আর কথা বলতে পারলো না। দু’হাতে চোখ মুছে সরে দাঁড়ায়। একটু দূরে মেহেদী ছয়জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত বন্ধু দলটির দিকে চেয়ে আছে। তার চোখ জোড়াও ছলছল করে উঠছে বারংবার। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ এক সম্পর্কের স্বাক্ষী হয়েছে আজ মেহেদী। মনে বলতে থাকে, “সবার জীবনেই যেন এমন এক বন্ধু দল থাকে।” তাহলে আর কেউ বন্ধু হীনতায় ভুগবে না।

লাবণ্য ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় সাদাফের দিকে। সাদাফ নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে অন্যদের মতো কাঁদতে পারে না। তবে কেন যেনো আজ চোখ দুটো বড্ড জ্বলছে। লাবণ্য ফুপিয়ে বলে উঠলো,

-নিচের দিকেই চেয়ে থাকবি? আমায় বিদায় দিবি না?

কথাটুকু বলেই লাবণ্য হুহু করে কেঁদে উঠে আবার। সাদাফ কান্নারত লাবণ্যর দিকে চেয়ে বলে উঠে,

-ভালো থাকিস লন্ডনে। আর একদম আমাদের ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবি না। শোন, আমাদের মধ্যে থেকে কারো সামান্য অসুস্থ হলেও কিন্তু আমি তোর ডাক্তার জামাইকে লন্ডন থেকে তুলে আনবো৷ দুলাভাই ডাক্তার থাকতে আমরা কেন অন্য ডাক্তারের পেছনে ছুঁটবো?

সাদাফের কথা শুনে কান্নার মাঝেও সবাই হেসে ফেলে। ও মূলত শেষবার বন্ধুদের একসঙ্গে হাসির মুহুর্তটা ক্যাপচার করতেই কথাগুলো এভাবে বলেছে। সবাই হেসে উঠতেই, সাদাফ প্রীতমের হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে মেহেদীর হাতে দিয়ে বললো,

-এইযে দুলাভাই, আমাদের বন্ধুদের একসঙ্গে হাসি কান্নার মুহুর্তটা ক্যাপচার করে দিন তো।

মেহেদী হাসি মুখে ক্যামেরাটা নিয়ে ওদের সবার কিছু ছবি ক্যামেরা বন্দী করে দিলো। আবারো মাইকে সুন্দর নারী কন্ঠের ধ্বনি উচ্চারিত হয়। সাথে সাথে একদল বন্ধুদের বুকে ব্যথাও তীব্রতর হয়। সাদাফ মেহেদীর হাত থেকে ক্যামেরা নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরে মেহেদীকে। জড়িয়ে ধরে মেহেদীও। সাদাফ কাঁপা কন্ঠে বলে,

-আমার বন্ধুকে ভালো রাখবেন ভাইয়া। ও ভীষণ ভালো মেয়ে।

-ইনশাআল্লাহ, তোমরাও ভালো থেকো। আর তোমার বন্ধুকে সুখী করার দায়িত্ব আমার। আমি সেটা যথাযথ ভাবে পালন করার চেষ্টা করবো।

বন্ধুদের পালা শেষ করে, মেহেদী’র পরিবার এবং লাবণ্য’র পরিবার থেকে আবারো বিদায় নিয়ে মেহেদী এবং লাবণ্য পা বাড়ায় বিমানের দিকে। পা বাড়ায় বন্ধু দলের প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ গৃহের দিকে।
________________________

সাদাফ ছাঁদে বসে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। বার কয়েক এশাকে কল করে না পেয়ে আকাশ দেখায় মন দিয়েছে সে। মুঠোফোনটা বেজে উঠতেই আকাশ দেখায় ব্যাঘাত ঘটে সাদাফের। ফোন স্ক্রিনে প্রেয়সী নামটা জ্বলজ্বল করতেই ঠোঁটে হাসি ফোটে সাদাফের৷ সে কল কেটে কল ব্যাক করে। মনে মনে খুশি হলেও এমন ভাবে কথা বলে যেন এশা বুঝতে পারে সাদাফ অভিমান করেছে। এশা ফিসফিসিয়ে বলে জিজ্ঞেস করে,

-অভিমান নাকি রাগ?

-জানি না।

-শুনো।

-বলো।

-ভালোবাসি।

সাদাফ হেসে ফেলে। হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে বলে উঠে,

-আমিও ভালোবাসি।

-হ্যাঁ, তবে আমি বেশি।

-কখনোই না, আমি তোমাকে বেশি ভালোবাসি।

-না, আমি।

-আমি।

-হ্যাঁ তুমিই, এবার বলো সবসময় এভাবেই ভালোবাসবে তো?

সাদাফ হেসে বলে উঠে, -মোটেও না।

এশার খানিক মন খারাপ হয়। সে কন্ঠ অন্য রকম করে জিজ্ঞেস করে, -কেন?

সাদাফ ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়, – কারণ আমি তখন আরো বেশি বেশি ভালোবাসবো তাই।

এশা খিলখিলিয়ে হেসে বলে, – তুমি একটা পাগল।

-হুম, তোমার জন্য।

এশা কিছু বলে না খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। সাদাফ এশার হাসিটা মুগ্ধ হয়ে শুনে জিজ্ঞেস করে,

-এতো সুন্দর করে হাসতে নেই প্রেমে পড়তে মন চায়।

-মন চায়?

-হ্যাঁ।

– তারমানে তুমি এখনো প্রেমে পড়োনি?

-প্রথম দেখাতেই পড়েছি। এ পর্যন্ত কতবার হিসেব নেই। তবে এতো প্রেমে পড়া ভালো না।

-কেন?

– বিয়ের পর বেশি বেশি প্রেম করবো তাই।

– তাহলে বিয়ে করছো না কেন?

-চলো আজই বিয়ে করে ফেলি?

-আজ!

-হুম, আজ।

-কিভাবে?

-বাবা-মা কে গিয়ে বলবো, আমি এখনই এশা’কে বিয়ে করতে চাই। বউকে ছাড়া আর ভালো লাগছে না।

– লজ্জা নাই তোমার?

-একটুও না।

-পাগল।
___________________

দীর্ঘ ৯ ঘন্টা জার্নির পর লাবণ্য আর মেহেদী লন্ডনের মাটিতে পা রাখে। এয়ারপোর্টে ঝামেলা মিটিয়ে বের হতেই তারা দেখতে পায়, কালো রঙের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাদের জন্য। মেহেদী আর লাবণ্য পেছনের পাশাপাশি সীটে উঠে বসতেই ড্রাইভার হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,

-অনেক দিন পর আসলেন স্যার। কেমন আছেন? আর ম্যাডাম কিন্তু অসম্ভব সুন্দর।

লন্ডনে এসেও কেউ বাংলায় কথা বলছে শুনে লাবণ্য অবাক হয়ে যায়। মেহেদী হেসে জবাব দেয়,

-মুরাদ চাচা, কতবার বলেছি আমাকে স্যার বলবেন না। আর ওকেও ম্যাডাম বলার কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা দু’জনেই আপনার ছেলেমেয়ের মতো। আপনি কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?

-আলহামদুলিল্লাহ, তয় আপনাগো দু’জনকে দেখে আরো ভালো হয়ে গেলাম।

-ড্রাইভার কথা শেষ করে গাড়ি চালাতে শুরু করে। লাবণ্য ফিসফিস করে মেহেদীকে জিজ্ঞেস করে,

-উনি বাংলা কিভাবে জানে?

-এই গাড়ীটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে দিয়েছে। আর মুরাদ চাচাকেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার ড্রাইভার হিসেবেউ নিয়োগ দিয়েছে। মুরাদ চাচা অনেক ভালো মানুষ। উনিও আমাদের বাংলাদেশেরই। তাই উনার সাথে আমার ভালো একটা সম্পর্ক আছে।

-অহ, আচ্ছা।

বলেই লাবণ্য বাইরের দিকে আগাতে যায়। ঠিক তখনই মেহেদী বাম হাতে লাবণ্য’র কোমড় আঁকড়ে ধরে। লাবণ্য’র চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ইশারা করে বলে ড্রাইভার আঙ্কেল দেখে ফেলবে। মেহেদী এক টানে লাবণ্যকে একদম নিজের কাছে নিয়ে এসে বলে,

-মুরাদ চাচা গাড়ি চালানোতে ব্যস্ত। বিয়ের এক সপ্তাহ শেষ হয়ে গেলো আমি ঠিকঠাক ভাবে বউয়ের কাছেই যেতে পারলাম না।

-মানে? রাতে কার সাথে ঘুমিয়েছো?

-শুধু রাতেই তো একসাথে ঘুমিয়েছি। দিনের বেলা তো তোমাকে খুঁজে ও পাওয়া যায় না। এখন এই আন্টি, তখন ওই আন্টি, একটু পরে প্রতিবেশী। আর তোমার বন্ধুদের কথা নাই বললাম। শত হোক তারা আমার বউয়ের বন্ধু বলে কথা। তাদের জন্য একটু ছাড় দেওয়াই যায়। কিন্তু প্রতিবেশী গুলো একের পর এক বউয়ের সাথে এমন ভাবে চিপকে ছিলো যে আমার বউটাকে সারাদিনে দেখার সৌভাগ্যও হয়নি এ কয়দিনে।

লাবণ্য হেসে ফেলে বলে,

-বাচ্চাদের মতো হিংসে করছো তুমি।

-একমাত্র তোমার জন্যই আমি হিংসুটে। তবে এখন থেকে সবসময় তোমাকে আমার সামনে বসিয়ে রাখবো।

-আর হসপিটাল?

-যতক্ষণ বাসায় থাকবো ততক্ষণ সুপার গ্লু দিয়ে আমার সাথে আটকে রাখবো তোমায়।

মেহেদীর কথা শুনে লাবণ্য হুহু করে হেসে উঠে। ড্রাইভার মুরাদ নবদম্পতির হাসিতে নিজের মনেও সুখ অনুভব করে।

চলবে….

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-২০+২১

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২০
#আয়েশা_আক্তার

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই হৃদয় মোহনা বেরিয়ে যায় গ্রাম থেকে। শাঁ শাঁ গতিতে হৃদয়ের বাইক ছুটছে। সেই সাথে মোহনার ছোঁয়া হৃদয়ের মনে এক অদ্ভুত ঝর তুলছে। মোহনা কাল যতটা অস্বস্তি নিয়ে হৃদয়ের সাথে এসেছিলো আজ ততটা অস্বস্তিতে নেই। বরং আজ হৃদয় বলার আগেই সে হৃদয় কোমড় জড়িয়ে ধরে বসেছে। আজকে মোহনার কাছে হৃদয়ের সঙ্গ যেন দিগুণ পরিমাণে ভালো লাগছে। হৃদয় একটা কাজী অফিসের সামনে গিয়ে বাইক থামায়। মোহনা সামনে চেয়ে লাবণ্যকে দেখে অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তার মুখ অটোম্যাটিকেলি হা হয়ে যায়। মোহনাকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লাবণ্য এগিয়ে আসে। মোহনার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস?

মোহনা কোনো জবাব না দিয়ে লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরে লাবণ্যও। কিছুক্ষণ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাটায়। তারপর মোহনা আশেপাশে তাকিয়ে বলে,

-এটা কোথায়?

-আমরা সবাই এখানে কেন এসেছি?

এশা এগিয়ে এসে হেসে বলে উঠে, -এটা কাজী অফিস মোহপু।

– কাজী অফিসে কেন এসেছি? লাবণ্যর বিয়ে তো আজ বাড়িতেই হবে। তাহলে? কিরে লাবু, তুই কি ভাইয়াকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করার প্ল্যান করেছিস? (মোহনা বিস্ময় নিয়ে কথা গুলো বলে উঠে)

মোহনার কথা শুনে সবাই হুহা করে হেসে উঠে। এমনকি লাবণ্য নিজেও হেসে ফেলে। হৃদয় মোহনাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-তুই এতোটা বোকা কবে থেকে হলি মোহ?

-ওমা আমি আবার কি করলাম?

-লাবণ্য কেন কাজী অফিসে এসে বিয়ে করতে যাবে? বিয়েটা আমাদের। কারণ কালকে হুজুররা আমাদের বিয়ে পড়িয়েছেন ঠিকই। তবে আমাদের বিয়ে হয়েছে তার কোন প্রমাণ আমরা কাউকে দেখাতে পারবো না। তাই এখানে আবার বিয়ে করে কাবিননামা সাথে নিয়ে যাবো।

নিজের বিয়ের কথা শুনে লাবণ্য চুপ হয়ে যায়। সাদাফ তাড়া দিয়ে বলে,

-এবার চল, কাজী সাহেব অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে তোদের জন্য। আর লাবণ্যকেও তো বাসায় সবাই খুঁজাখুঁজি শুরু করবে।

সাদাফের কথামতো সবাই কাজী অফিসের ভেতরে চলে যায়। কাবিননামায় স্বাক্ষর করার সময় মোহনার মনে হলো তার হাত ভীষণ কাঁপছে। মোহনা সবার দিকে এক নজর তাকায়। লাবণ্য মোহনাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

-কি হয়েছে?

মোহনা ডানে বামে মাথা নাড়ায়। তারপর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মনে মনে আল্লাহর নাম নিয়ে সাইন করে দেয়। সাইন করে হৃদয়ও। কাজী অফিস থেকে বের হয়ে সবাই লাবণ্যদের বাসায় চলে যায়। বাসায় পৌঁছাতেই বিউটি পার্লার থেকে আসা মেয়েরা ঘিরে ধরে লাবণ্যকে। ভাগ্যিস লাবণ্য আগেই গোসল সেরে নিয়েছিলো। লাবণ্যর রুমে গিয়ে কালকের পড়া শাড়ি খুলে অন্য একটা জামা পড়ে নেয় মোহনা। জীবনের প্রথম এতোটা সময় মোহনা শাড়ি পড়েছিলো। হঠাৎ করেই মোহনার মনে পড়ে যায় বন্ধুত্ব শুরু হওয়ার বছরে লাবণ্য প্রায়ই বলতো তারা একই দিনে বিয়ে করবে। কাকতালীয় ভাবে লাবণ্য’র আগেই মোহনার বিয়েটা হয়ে গেলো। তা-ও একই দিনে। লাবণ্যকে সাজাচ্ছে পার্লার থেকে আসা একটা মেয়ে। লাবণ্য পিটপিট করে চোখ খুলে মোহনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেয়েটাকে থামতে বলে। মেয়েটা সাজানো বন্ধ করে থামতেই লাবণ্য বলে উঠে,

-ওই মোহ, গোসল করে আয়। আমাকে সাজানো শেষ হলেই তুই বসে পড়বি। বুঝছিস?

-আমি সেজে কি করবো? তোর বিয়ে তুই সাজ।

– তোর ও তো আজই বিয়ে হলো। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয় বলছি। আর এদিকে একটু শোন তো।

মোহনা লাবণ্যর দিকে এগিয়ে গিয়ে একদম সামনে এসে দাঁড়ায়। লাবণ্য মোহনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-আমার বন্ধুটার বুঝি তার বউকে বধু সাজে দেখতে ইচ্ছে করে না? আমার বন্ধু কি বলছি হৃদয় তো তোরও বন্ধু। বধু সেজে আজ বন্ধু প্লাস তোর স্বামী মহোদয়কে জিজ্ঞেস করবি, ওহে প্রাণেশ্বর বলো তো আমায় কেমন লাগছে।

-ধেত, তুই না…

মোহনা লজ্জা পেয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে চলে যায়। লাবণ্য হেসে ফেলে।
_____________________
লাবণ্য’র সাজ শেষ হওয়ার পরই লাবণ্য পার্লার থেকে আসা মেয়েটাকে মোহনাকে সাজাতে বলে দেয়। কিন্তু লাবণ্য কিছুতেই সাজবে না। অনেক জোর করার পর শুধু শাড়ি পড়তে রাজী হয়। লাবণ্য মোহনাকে একটা লাল রঙের জামদানী শাড়ি ধরিয়ে দিয়ে বলে,

-এটা হৃদয় তোকে গিফট দিয়েছে। আর তুই আজ এটাই পড়বি।

-আমাকে গিফট দিয়েছে? এটা না তুই সেদিন শপিং করতে গিয়ে কিনে আনলি?

-হ্যাঁ, সেদিন এটা হৃদয়ই পছন্দ করেছে তোর জন্য। আর এই শাড়ির দামও হৃদয় দিয়েছে। আমাকে বলেছে আমি যেনো পড়ে তোকে দিয়ে দিই। ছেলেটা সেই প্রথম দিন থেকেই তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে মোহ। আর তুই নিজেও ওকে ভালোবেসেও ইগনোর করে গেছিস। সৃষ্টি কর্তা হৃদয়ের জন্যই তোকে সৃষ্টি করেছে। তাই তো তোরা এতোকিছুর পরও এক হয়ে গেলি।

মোহনার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। লাবণ্যকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই লাবণ্যর ফোন বেজে ওঠে। লাবণ্য মোহনাকে শাড়ি পড়তে ইশারা করে বারান্দায় চলে যায়।

মেহেদী ভিডিও কল করেছে। লাবণ্য কল রিসিভ করতেই মেহেদী যেনো একটা হার্টবিট মিস করে ফেলে। সে অপলক চেয়ে থাকে বধু সাজে ফোন স্ক্রিনে ভেসে উঠা মুখশ্রী’র দিকে। মেহেদীর তাকানো দেখে লাবণ্য হেসে ফেলে।হেসে জিজ্ঞেস করে,

-কি দেখো?

-প্রেয়সীকে।

-আগে কখনো দেখোনি?

-দেখেছি তো তবে আজ একদম রাঙা বউ লাগছে।

লাবণ্য লজ্জা পেয়ে ফোন স্ক্রিন থেকে চোখ সরায়। তার গালে একছটা লজ্জার লাল আভা এসে ছুঁয়ে দেয়। মেহেদী লজ্জাবতী লাবণ্যকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেহেদী ছোট বোন ক্যামেরার সামনে চলে আসে। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

-ভাবি, তোমাকে এত্তো বেশি সুন্দর লাগছে কি বলবো? আমার ভাবি সবচেয়ে কিউট ভাবি।

লাবণ্য সামনে তাকিয়ে মারিয়াকে দেখে হেসে জবাব দেয়,

-তুমি আমার থেকেও অনেক অনেক বেশি কিউট। যার ননদিনী এতো কিউট তার ভাবি তো একটু কিউট হবেই বলো?

-উহু, তুমি বেশি কিউট। দেখছো না ভাইয়া তোমার থেকে চোখই ফেরাতে পারছে না। আমরা তোমাদের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি। কিন্তু ভাইয়া তোমাকে না দেখে থাকতেই পারছে না। তাইতো গাড়িতে বসে ভিডিও কল করেছে। ঠিক না ভাইয়া?

মেহেদী বোনের মাথায় হালকা চপড় দিয়ে বলে, খালি পাকা পাকা কথা? সর তো। আমার বউকে দেখতে দে।

মারিয়া মেহেদীর কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হয়। লাবণ্য লজ্জা পায়। সে মেহেদীকে বলে,

-ওকে বকছো কেন? আর গাড়িতে বসে এসব কি? ফোন রাখো।

-রাখতে বলছো? ওকে আমি এসে তারপর শাস্তি দিবো।

বলেই কল কাটে মেহেদী। লাবণ্য বারান্দা থেকে রুমে এসে দেখে মোহনা শাড়ি পড়ে তৈ হয়ে নিয়েছে। সে মোহনার কাছে এসে বলে,

-আজ হৃদয় শেষ মোহ। তোকে যা সুন্দর লাগছে। আমারই তো চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

-আর মেহেদী ভাইয়ার অবস্থা কি হবে? তোকে বুঝি কম সুন্দর লাগছে?

পার্লার থেকে আসা মেয়েটা হেসে ফেলে বলে,

-আপনাদের দুজনকেই সুন্দর লাগছে ম্যাম।

কথাটা বলেই মেয়েটি রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লাবণ্য আর মোহনা হেসে ফেলে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। লাবণ্য বলে উঠে,

-তোর মনে আছে? আমি এক সময় বলতাম আমরা দু’জন একসাথে বিয়ে করবো। দেখছিস আজ একসাথেই আমাদের দুজনের বিয়ে হলো।

ঠিক তখনই দুজনেই শুনতে পেলো, বাইরে কারা যেন ❝ বর এসেছে, বর এসেছে ধ্বনি তুলেছে।

চলবে…

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_২১
#আয়েশা_আক্তার

লাবণ্য আর মেহেদী’র বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এবার বিদায়ের পালা। লাবণ্য এক এক করে সবাইকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়। বাবা-মা ভাইকে ছেড়ে চলে যেতে লাবণ্য’র বুকে তীরের ফলার মতো আঘাত অনুভব হচ্ছে। সবশেষে লাবণ্য বন্ধুদের সামনে এলো। মোহনার সামনে এসেই জড়িয়ে ধরে লাবণ্য। কেঁদে উঠে হু হু করে। কাঁদে মোহনাও। ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে উঠে,

-সাবধানে থাকিস মোহ। হৃদয়ের বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিস প্লিজ। আর কোনো সমস্যা হলে হৃদয়কে জানাবি। একদম হ্যাজিটেশন করবি না।

লাবণ্য সাদাফদের দিকে চেয়ে বলে, -ভালো থাকিস তোরা। মোহ’র খেয়াল রাখিস। এশাকে সুখে রাখিস সাদাফ।

তারপর কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে।
_________________

লাবণ্য চলে যেতেই মোহনাকে নিয়ে হৃদয় নিজের বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়। মোহনার বুক ধুকপুক করছে ভয়ে। হৃদয়ের বাবা-মা কি আদৌও মেনে নেবে মোহনাকে? এমন হাজারো ভাবনা বারবার মোহনার মাথায় উঁকি দিচ্ছে। ভয় হচ্ছে হৃদয়েরও। কিন্তু হৃদয় নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। সাদাফ এশাকে বাড়িতে দিয়ে এসে নিজেও হৃদয়ের সাথে যাচ্ছে। প্রীতম আর অমিতও যেতে চেয়েছিলো কিন্তু সাদাফ ওদেরকে চলে যেতে বলায় তারা চলে যায়।

ডোর বেলের শব্দ শুনে রাজীব হোসাইন এসে দরজা খুলে দেয়। রাজীব হোসাইন কয়েকবার হৃদয়ের বন্ধুদের দেখেছে। তাই তিনি সহজেই মোহনা এবং সাদফকে চিনতে পারলেন। সাদাফ এবং মোহনা সালাম দিলে তিনি হাসি মুখে সালামের জবাব দিয়ে ভেতরে আসতে বলেন। ভেতরে প্রবেশ করে মোহনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদাফ এবং হৃদয় রাজীব আহমেদের সামনের সোফায় বসে। রাজীব আহমেদ মোহনার দিকে চেয়ে হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-কি ব্যাপার মা? তুমিও বসো।

ড্রয়িং রুমে একাধিক মানুষের কথার শব্দ শুনে বেরিয়ে আসেন রাহেলা বেগম। রাহেলা বেগমকে দেখতে পেয়ে সালাম দেয় মোহনা৷ রাহেলা বেগম সালামের জবাব নিয়ে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে,

-তোমরা কখন এলে?

-এইতো কিছুক্ষণ হলো। (সাদাফ)

-রাহেলা সবার জন্য চা নাস্তার ব্যবস্থা করো। কতগুলো দিন পর বাচ্চাগুলো এসেছে! (রাজীব)

রাহেলা বেগম স্বামীর কথা মান্য করা স্বরূপ রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে যাবে ঠিক তখনই হৃদয় বাঁধা দিয়ে বলে উঠে,

-দাঁড়াও মা।

ছেলের কথা শুনে রাহেলা জিজ্ঞেসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁড়ায়। ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তাকায় রাজীব আহমেদ ও। মোহনার শরীর যেনো কাঁপতে শুরু করেছে। সে নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আল্লাহকে ডেকে চলেছে। হৃদয় নিজের ওষ্ঠ যোগল ভিজিয়ে বড় করে নিশ্বাস নেয়। তারপর বলতে শুরু করে,

– আমার আর মোহ’র বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

রাজীব আহমেদ এবং রাহেলা বেগম যেনো নিজ কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। অটোমেটিকেলি তাদের চোখ জোড়া বড় হয়ে যায় খানিকটা। রাহেলা বেগম অস্ফুটে উচ্চারণ করে,

-মানে? কি বলছিস তুই হৃদয়?

-হ্যাঁ, মা আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

-বিয়ে যদি করতেই চাও তাহলে আমাদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি কেন তুমি? এটা তুমি ঠিক করো নি হৃদয়। (রাজীব)

বাবার কথার জবাবে কিছু বলতে যাবে তখন সাদাফ চোখে ইশারা করে চুপ হয়ে যেতে। তাই হৃদয় আর কিছু বলে না। সাদাফ বলে উঠে,

-আসলে আঙ্কেল বিয়েটা ওদের হাতে ছিলো না। এক্সিডেন্টলি ওদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।

-এক্সিডেন্টলি মানে? (রাজীব)

সাদাফ মোহনাদের গ্রামে হয়ে যাওয়া ঘটনা খুলে বলে সবাইকে। সবটা শোনার পরও রাহেলা বেগমের মন গললো না। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার অনেক ইচ্ছে ছিলো। স্বামী রাজীব হোসাইন একজন সরকারি কলেজের প্রফেসর। স্বামীর ঘরে এসে সংসার সামলাতে সামলাতেই তার জীবন শেষ প্রায়। তার ইচ্ছে টিভি সিরিয়ালে যেমন বড়লোক বাড়ির কর্তৃ থাকে তেমন তিনিও একদিন হবেন। তারও একদিন গোটা কয়েক কাজের লোক থাকবে। সে পায়ের উপর পা তুলে খাবেন, টিভি দেখবেন এবং সময়মতো ঘুমাবেন। স্বল্প বেতনের সরকারি চাকরি করা স্বামী তাকে কাজের লোক রেখে দিতে পারে নি৷ উল্টো, শশুর -শাশুড়ী, ননদের পড়াশোনা বিয়ে সব তার স্বানীর টাকাতেই হয়েছে বলে সংসারে টানাপোড়েন না থাকলেও কাজের লোক রাখার মতো টাকা তাদের ছিলো না। তিনি চেয়েছিলেন, ছেলে ভালো চাকরি করবে তারপর একটা চাকরি করা মেয়েকেই ছেলের বউ করবে। ছেলে – ছেলের বউ দু’হাতে ইনকাম করে এনে তার কাছে দিবে আর তিনি ইচ্ছে মতো খরচ করবে, কাজের লোক রাখবে। সব শখ আহ্লাদ পূরণ করবে। কিন্তু এসবের কিছুই হতে দিলো না হৃদয়। তিনি মনে মনে রাগে ফুঁসছে। তবে স্বামীর প্রতিক্রিয়া দেখার আশায় চুপ করে আছে।

মোহনার শান্ত স্বভাবের জন্য রাজীব আহমেদের মোহনাকে ভালো লাগে। পানিতে ডুবে মা রা যাওয়ার হৃদয়ের বোন হৃদিতাও ছিলো এমন শান্ত স্বভাবের। তাছাড়া রাজীব আহমেদের কাছে মনে হয় মোহনা এবং হৃদিতার চেহারার মধ্যেও বেশ কিছু মিল আছে। এর আগে যতবার তিনি মোহনাকে দেখেছে ততবার মনে হয়েছে এটাই যেন তার হৃদিতা। তাই আজ মোহনার সাথে ছেলের সম্পর্কের কথা শুনে প্রথমে একটু খারাপ লাগলেও বিস্তারিত শোনার পর মনে হচ্ছে, সৃষ্টি কর্তাই হয়তো তার হৃদিতাকে মেহনার স্বরূপ ফিরিয়ে দিয়েছে। সে কিছুক্ষণ বসে চিন্তা ভাবনা করে জবাব দিলেন,

-বিয়ে যেহেতু হয়ে গিয়েছে তখন তো আর কিছু করার নেই। হৃদয়ের মা, তুমি সবাইকে বলে দাও আমরা আবার ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে হৃদয় মোহনার বিয়ে দিবো। আমি বরং বাজারে যাই। মিষ্টি নিয়ে আসি। ছেলের বিয়ে বলে কথা সবাইকে তো মিষ্টি মুখ করাতে হবে।

এতোক্ষণে যেন মোহনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। মনে মনে, আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। রাজীব সাহেবের সাথে হৃদয়ের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় সাদাফও।

স্বামীর এমন খুশি হওয়া দেখে রাহেলা বেগমের মন খারাপ আরো দিগুণ বেড়ে যায়। রাজীব হোসাইন বেরিয়ে যেতেই তিনি হৃদয়ের সামনে গিয়ে বলে উঠে,

-দুপুরে খেয়ে এসেছেন নাকি টেবিলে খাবার দিবো?

মায়ের এমন কথা শুনে হৃদয় চমকে তাকায়। দেখতে পায় তার মায়ের মুখে ছড়িয়ে আছে হিংস্র মনোভাব। হৃদয় কোমল সুরে বলে,

-এভাবে কথা বলছো কেন মা?

-আমায় মা বলে ডাকবেন না। আমি আপনার মা নই। মা হলে বিয়ে করার আগে একবার মায়ের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ অন্তত করতেন।

রাহেলা বেগমের অভিমান বুঝতে পেরে হৃদয় মা’কে জড়িয়ে ধরে।

-অভিমান করো না মা। সবটা তো শুনলেই। আর মোহনার সাথে আমার বিয়ে না হলে ওকে অনেক অপমানের স্বীকার হতে হতো মা। আমি সেটা কিভাবে হতে দেই বলো? আমি মোহকে ভালোবাসি।

চলবে…

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_১৮
#আয়েশা_আক্তার

সাদাফ এশা এক প্রকার দৌড়ে ছাঁদ থেকে নিচে আসে। ওরা নিচে আসতে আসতে প্রীতম, অমিত, হৃদয়ও সেখানে এসে হাজির হয়েছে। সবাই মোহনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য মোহনাকে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্রমাগত। কিন্তু মোহনা কেঁদেই চলেছে। লাবণ্য এবার মোহনাকে রেখে সাদাফের দিকে এগিয়ে আসে। তারপর বলতে শুরু করে,

-মোহ’র বোন কল করেছিলো ওর মা নাকি অনেক অসুস্থ। তোরা কেউ মোহ’কে নিয়ে যেতে পারবি?

-আমরা সবাই যাবো তার আগে ওকে কান্না থামাতে বল।(হৃদয়)

-তোদের কাউকে যেতে হবে না। তোরা আনন্দ কর। আমি একাই যেতে পারবো। (মোহনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো।)

-বললেই হলো একা যেতে পারবি? তোরা এখানে থাক। আমি বরং মোহ’কে নিয়ে ওর গ্রামে যাই। যদি বেশি গুরুতর অবস্থা হয় তাহলে তো আন্টিকে শহরে নিয়ে আসতে হবে।

কথাগুলো বলে সাদাফ এশার দিকে তাকায়। এশার হাত ধরে বলে,

-সাবধানে থেকো, আর অনুষ্ঠান শেষে হৃদয়কে নিয়ে বাসায় চলে যেও। খবরদার একা যাবে না।

-তারচেয়ে ভালো তুই বরং এদিকটায় থাক। আমিই না-হয় মোহ’কে গ্রামে নিয়ে যাই? (হৃদয়)

-হ্যাঁ, এটাই ভালো হবে। সাদাফ তুই এখানেই থাক। এতো বড় করে আয়োজন করা না হলে আমিই চলে যেতাম মোহ’র সাথে। কিন্তু এখন সবদিক তো সামাল দিতে হবে বল? হৃদয় আর দেরি করিস না। এখনই বেরিয়ে পর সন্ধ্যা ফুরিয়ে যাচ্ছে।

লাবণ্য’র কথা মতো হৃদয় মোহনাকে নিয়ে বেরোয় গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ভয়ে মোহনার শরীর কাঁপছে তার মায়ের কোনো বিপদ হলো না তো?

মোহনা হৃদয়ের বাইকে বসেছে। কিন্তু ও যেভাবে বসেছে হৃদয় নিশ্চিত মোহনা পড়ে যাবে। তাই হঠাৎ করেই ব্র্যাক করে বাইকে থামিয়ে দেয় হৃদয়। মোহনা জিজ্ঞেসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই হৃদয় বলে উঠে,

-এমনিতেই পাটকাঠির মতো শুকনা শরীর তার উপর এভাবে বসলে তো তোকে বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।

হৃদয়ের কথা বোধগম্য হয়না মোহনার। সে ভ্যাবলার মতো চেয়ে রয় শুধু। হৃদয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,

-এবার ধরে বসবি, নয়তো পড়ে যাবি। আর তুই পড়ে গেলে কিন্তু আর কেউ তোকে বিয়ে করবে না। হাত পা ভেঙে ঘরে বসে থাকতে হবে।

-দিবো এক চড়, পড়ে যাবো কেন তুই আছিস না?

-আমি তো আছিই। এক কাজ কর সারা জীবনের জন্য আমায় তোর নামে লিখে নে, প্রমিজ কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। প্রয়োজনে কোলে করে রাখবো যেন পড়ে না যাস।

-কি বিরবির করছিস?উঠ, এবার ধরেই বসবো।

-হ্যাঁ, ছাড়বি না একদম।

-আচ্ছা।

হৃদয় বাইক স্টার্ট দিলে মোহনা হৃদয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বসে। হৃদয় মনে মনে খুশি হয়। মোহনাও ভালো লাগা অনুভব করে।
_____________________

গ্রামে,
মোহনার জন্য একটা ভালো সমন্ধ পেয়েছে মোহনার মা মনোয়ারা বেগম। ছেলে বিদেশে থাকে, এক টাকাও যৌতুক দিতে হবে না। সাথে মোহনার ছোট বোন মিথিলাকেও পড়াশোনা করাবে তারা। আর পড়াশোনা শেষে তারাই ভালো ঘর দেখে মিথিলার বিয়ে দিয়ে দিবে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? তাইতো মনোয়ারা নিজের অসুস্থতার নাম করে মেয়েকে ডেকে পাঠালো। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে। গ্রামে রাত আটটা মানেই অনেক কিছু। ঘড়ির কাটা আটটার ঘরে যেতেই ছেলের এক আত্নীয় বলে উঠে,

-এখনো তো মাইয়ার আসার নাম নাই। মাইয়া আইবো তো?শহরের মাইয়াগো আমার দুই চোখে সহ্য হয় না। তুমি যে কি দেইখা এমন শহরে পড়ালেখা করা মাইয়ার লগে মিরাজের বিয়া ঠিক করলা ভাবি আমি তো তাই বুঝি না।

-আমি না, তোর ভাইয়ের কি হইছে কেডা জানে? এ মাইয়ারেই সে ছেলের বউ করবো। আমার কোনো কথা তো শুনে না। আমার পোলার মতে পোলা সারা গ্রাম খুঁইজা পাওন যাইবো? আমার এমন সোনার টুকরা পোলার লাইগা তোর ভাই এমন হাভাতে মাইয়া যে কেন পছন্দ করলো সেই জানে।

মনোয়ারা বেগমকে দেখতেই তারা নিজেদের মধ্যে কথা থামিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায় তার দিকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-আপনের মাইয়া আইবো তো?

-আইবো না কেন আপা? আমার মাইয়া আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চইলা আইবো। দেখবেন ভাইজান কাজি নিয়া আসার আগে আমাগো মোহনা আইসা হাজির।

-আচ্ছা আপা একটা কথা কই?

-হুম কন? অনুমতি লওয়ার কিছু নাই।

-শহরের মাইয়ারা তো ভালা না আপা। পড়াশোনার নাম কইরা পোলাগো লগে মাখামাখি কইরা বেড়ায়। শহরে কেন দিলেন মাইয়ারে যাইতে?

এমন প্রশ্ন শুনে অস্বস্তিতে পরে মনোয়ারা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে উঠে,

-আমার মাইয়া এমন না। আমার মাইয়ার একটা ছেলে বন্ধু পর্যন্ত নাই। মাইয়া দেখলেই বুঝবার পারবেন আমার মাইয়া কেমন? মাইয়ার বাপের স্বপ্ন ছিলো ঢাকায় পড়াশোনা করাইবো৷ সে নাই বইলা তার ইচ্ছে দাম আমার মাইয়া ভুলে নাই। বাপের স্বপ্ন পূরণের জন্যই শহরে পড়াশোনা করতে গেছে।

-ঢং, মাইয়া মানুষের আবার স্বপ্ন?

-কেন আন্টি, মেয়ে মানুষের স্বপ্ন থাকতে নেই? তারা মেয়ে বলে মানুষ নয়?

মোহনার কথার জবাব খুজে না পেয়ে মহিলা দুজন চুপ হয়ে যায়। মোহনার পাশে হৃদয় দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে আসতে গিয়ে মোহনা শাড়ি চেঞ্জ করতে পারে নি। মোহনাদের বাসায় উপস্থিত সবাই মোহনার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মোহনা বুঝতে পারছে না তার মায়ের অসুস্থতায় এতো মানুষ কই থেকে এলে? তাদের তো এতো আত্নীয় নেই। মোহনা কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তার মাকে জিজ্ঞেস করে,

-তুমি না অসুস্থ? তাহলে উনারা কারা? আর তুমিই বা দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে তো?

-তার আগে ক তোর পাশের পোলাডা কেডা?

মোহনা হৃদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে জবাব দেয়,

-ও আমার বন্ধু হৃদয়।

সঙ্গে সঙ্গে মহিলা দু’জন বলে উঠে,

-এ সবাই চলো, কইছি না শহরের মাইয়ারা কহনো ভালো হয় না? এই দেখছো তার নমুনা? শহরে পড়ালেখার নাম কইরা পোলাগো লগে মাখামাখি করুনের স্বভাব।

তারপর মহিলাদের একজন এসে মনোয়ারা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-এতোক্ষণ তো ভালোই চাপা ছাড় ছিলেন। আপনের মাইয়া নাকি অন্য মাইয়াগো মতো না? এখন দেখলেন তো সাইজ্জা গুইজ্জা পোলা লইয়া ঘুইরা বেড়ায়।

কথাগুলো বলে আর এক মুহুর্তও দাড়ায় না মহিলাটি। বড় বড় কদম ফেলে দরজার বাইরে বেরিয়ে যায়। বাকি মানুষজনও তার সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। এসবকিছু আগামাথাই মোহনা বুঝে উঠতে পারছে না। সে মায়ের নিকট আবারো জানতে চায়,

-মা, উনারা এসব কি বলে গেলো? আর উনারা কারা মা? আমি কিছু বুঝতেছি না।

মনোয়ারা বেগম রাগ সংবরণ করতে না পেরে মোহনার গালে জোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। মোহনা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে হৃদয় হাত ধরে আগলায়। সে মনোয়ারার সামনে এসে বলে,

-আপনি ওকে মারছেন কেন আন্টি?

-সেই জবাব আমি তোমারে দিমু না। আর এই তোর পড়াশোনা? এমনে সাইজ্জা এই পোলার লগে কই গেছিলি?

-মা, আমি লাবণ্যর বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিলাম। তুমি অসুস্থ শুনে চেঞ্জ করার সময় পাইনি।

-আমারে ভুলভাল বুঝাইবি না মোহন? সত্যি কইরা ক তোর এই পোলার লগে কি সম্পর্ক?

মোহনার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মায়ের মান সম্মানের কথা ভেবে মোহনা হৃদয়কে ভালোবাসা সত্ত্বেও একদিন মুখ ফোটে বলেনি কিছু। অথচ আজ মা তার সাথে এমন করছে?

মনোয়ারা আবারো বলে উঠে,

-আমার আগেই বোঝার উচিৎ ছিলো।তোরে শহরে যাইতে দেওয়াই আমার সবচেয়ে বড় ভুল।

চলবে…

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_১৯
#আয়েশা_আক্তার

মোহনা হৃদয়কে অনেক বার চলে যেতে বলার পরও সে অনড়। হৃদয়ের মন বলছে, আজ মোহনাকে তার মা আরো মা র বে ন। তাই সে আজ কিছুতেই গ্রাম ছেড়ে যাবে না। এদিকে গ্রামে মোহনাদের প্রতিবেশী’রা এক এক করে এসে কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। মোহনা নিরবে চোখের জ্বল ফেলছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো? বাবা থাকলে আজ মোহনাকে এতো এতো অপবাদ সইতে হতো? কখনোই না। জানে মোহনা, তার বাবা তাকে সব বিপদ হতে আগলে রাখতো। গ্রামের মানুষদের মধ্যে একজন বয়স্ক মহিলা এসে বললো,

-কি গো মোহনের মা, তোমার মাইয়ারে নিয়া কত গর্ব তোমার! মাইয়া শহরে পড়ালেখা করে। এহন পড়ালেখার নামে এগুলান কি হুনি? ছি! ছি! ছি! গ্রামে আর মুখ দেখানো যাইবো না। এই মাইয়ারে বিয়া করবো কেডা? জীবনেও কেউ বিয়া করবো না।

হৃদয় এতোক্ষণ চুপ করে থাকলেও। এবার আর নিজেকে চুপ রাখতে পারলো না। সে উঠে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর এতোক্ষণ মোহনাকে নিয়ে বাজে কথা বলা মানুষদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

-চুপ করুন আপনারা? আমি আর মোহ খুব ভালো বন্ধু। এটা কেন মানতে চাইছেন না আপনারা? তখন থেকে মিথ্যা এ্যালিগেশন দিয়েই যাচ্ছেন! আর কি বলছেন? মোহ’র কখনো বিয়ে হবে না। কেন হবে না? কি করেছে ও? খবরদার আমার বন্ধুকে আর একটা বাজে কথা বললে আমি কিন্তু ছেড়ে কথা বলবো না।

বেশির ভাগ মানুষই হৃদয়ের কথা শুনে চুপ হয়ে যায়। কিন্তু কয়েকজন এখনো মোহনাকে অপদস্ত করতে পিছুপা হয়নি। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠে,

-বন্ধু, পোলা আর মাইয়া কিসের বন্ধু? পোলারা পোলাগো লগে চলবো তারা কেন মাইয়াগোরে বন্ধু বানাইবো? পোলাগো কথা কি কমু? সব তো মনো আর ওর মাইয়ারই দোষ। পোলাগো এমন একটু ছুঁকছুঁক স্বভাব থাকেই। কিন্তু মাইয়া মানুষের তো উচিৎ নিজেরে সামলাইয়া রাখা।

-চাচি, আমি এমন কোনো অন্যায় করিনি যার জন্য আপনারা আমাকে এভাবে অপমান করতে পারেন। (মোহনা)

– মাইয়ার দেমাগ দেহো এহনো কমে নাই।

এটা শুনে হৃদয়ের হাত মুষ্টি বদ্ধ হয়। রাগে চোখ দুটো রক্ত বর্ণ ধারণ করে। সে গর্জে উঠে বলে,

-মোহ’কে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে আমি ভুলে যাবো আপনি একজন গুরুজন।

এবার পেছন থেকে মোহনার মা এসে বললো,

-খুব তো দরদ দেহাইতাছো, তোমাগো মতো শহরের পোলাগো আমার চেনা আছে। তোমরা মাইয়া নিয়ে ফু র্তি কইরা ছুঁইড়া ফালায় দাও। সাহস থাকলে এখন মোহনকে বিয়ে করে নিজের বাসায় লইয়া যাও।

হৃদয় চুপ হয়ে মোহনার দিকে তাকায়। মোহনা তার মায়ের দিকে চোখ বড় বড় করে চেয়ে আছে। মনোয়ারা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে উঠে,

-এখন চুপ মাইরা গেলা কেন? জানি তো পারবা না।

হৃদয় এবার চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয়। সে মোহনার দিকে একবার তাকিয়ে মনোয়ারা বেগমের দিকে দৃষ্টিপাত করে জবাব দেয়,

-পারবো।

উপস্থিত সবাই বলতে শুরু করে, হ হ এই পোলার লগেই আমাগো মোহনার বিয়া হইবো। এই পোলার লাইগা যেহেতু বিয়া ভাঙছে তহন এই পোলাই বিয়া করবো।

-হ্যাঁ, আমিই বিয়ে করবো। আর আজ এখনই করবো।আপনারা বিয়ের ব্যবস্থা করুন।

-এসব কি বলছিস তুই? এভাবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিবি না হৃদয়। আমরা খুব ভালো বন্ধু এটাই ঠিক আছে। আমি তোর বোঝা হতে চাই না হৃদয়। এমনকি কারো জীবনেই বোঝা হয়ে থাকতে চাই না আমি।

-কে বললো, আমার কাছে তুই বোঝা হয়ে থাকবি?

-আমি জানি তুই আমার উপর করুনা করে আর গ্রামের মানুষের অপমান থেকে আমাকে রক্ষা করতেই বিয়েটা করছিস।

-আর আমি যদি বলি, আমি তোকে ভালোবাসি।

-কিহ?

-সত্যি, মোহ আমি তোকে সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই ভালোবেসে এসেছি। কিন্তু তুই যদি আমায় ফিরিয়ে দিস, আমার সাথে বন্ধুত্ব নষ্ট করিস। সেই ভয়ে বলতে পারিনি।

মোহনার চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তবে এ কান্নায় কষ্ট নেই আছে কিছু প্রাপ্তি। মোহনার দু’জন প্রতিবেশী গিয়ে পাশের মসজিদ থেকে একজন হুজুর নিয়ে আসে বিয়ে পড়ানোর জন্য। কলমা পড়ে গ্রামের সবার সামনে বিয়ে হয়ে যায় ওদের। হৃদয় সাদাফকে মেসেজ করে সবটা জানায়৷ সাদাফ ভরসা দিয়ে বলে, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তুই চিন্তা করিস না আমরা সবাই মিলে তোর বাসায় গিয়ে আঙ্কেল আন্টিকে ম্যানেজ করবো।

সেদিন রাতে বাধ্য হয়ে মোহনাদের বাড়িতেই থাকতে হয় হৃদয়কে। মোহনাদের দুটো ঘর। এক ঘরে তার বাবা-মা ও অন্য ঘরে মোহনা এবং মিথিলা থাকতো। মোহনার বাবা মারা যাবার পর থেকে একটা ঘর প্রায় সময় বন্ধই থাকতো৷ আজ সে ঘরটা সুন্দর করে পরিষ্কার করেছে মিথিলা। হৃদয়কে বড় বোনের স্বামী হিসেবে বেশ পছন্দ হয়েছে তার। মিথিলা ঘর গুছিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে মায়ের সাথে গিয়ে শুয়ে পড়ে। মিথিলা জানালা ধরে বাইরে দূর আকাশের দিকে মুখ করে আছে অনেকক্ষণ হলো। হৃদয় চেয়ে আছে মোহনার দিকে। হৃদয় ভাবতে থাকে,

“সৃষ্টি কর্তা চেয়েছেন বলেই আজ মোহনার সাথে তার বিয়ে হলো। সে প্রতি মোনাজাতে আল্লাহর কাছে মোহনাকে চেয়ে এসেছে। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেই মোহনাকে উপহার স্বরূপ দিয়েছে। ”

মোহনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

-তুই ঘুমিয়ে পর, আমি নিচে বিছানা করে শুয়ে পড়ছি।

-না তোর ঠান্ডা লেগে যাবে মোহ। তুই উপরে শুয়ে পর আমার মেঝেতে থাকতে সমস্যা নেই।

-দিবো এক চড়, যা বলছি তা কর।

হৃদয় উপরের দিকে দু’হাত তুলে বলে, -আল্লাহ! জল্লাদ একটা বউ দিছো। প্রথম রাতেই জামাইকে মারতে চায়।

মোহনা একটু লজ্জা পেলো হৃদয়ের মুখে বউ সম্বোধন শুনে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে চাইলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলার চেষ্টা করলো,

-তুই আগে আমার বন্ধু পরে অন্য কিছু।

-অন্য কিছু কি?

হৃদয়ের চোখে মুখে রহস্যের হাসি। মোহনা বুঝতে পেরে লজ্জায় আবারও জানালা ধরে বাইরে তাকায়। হৃদয় মোহনার একদম কাছে গিয়ে ঘেঁষে দাঁড়ায়। ফিসফিসিয়ে বলে উঠে,

-এতো লজ্জা পেতে হবে না। তোর যত দিন ইচ্ছে সময় নে। তবে এটাও জানি, তোর মনে একটু হলেও আমার জন্য ফিলিংস আছে। আর তুই কিছুতেই আমায় মেঝেতে ঘুমোতে দিবি না। সেইম আমিও তোকে সেটা করতে দিবো না। এক কাজ কর দু’জন একসাথেই শুয়ে পড়ি। কেমন?

মোহনা পাশ ফিরে বড় বড় চোখ করে তাকায়। বলে উঠে,

-মানে?

-এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? আমি অতোটাও খারাপ ছেলে নই। যে বউয়ের মনে আমার জন্য প্রেম জাগার আগেই বাসর করতে চাইবো। আগে তো আমার প্রেয়সীর মনে আমার জন্য প্রেম জাগুক। তারপর ই না হয় প্রেম প্রেয়সীকে প্রেমের বর্ষণে ডুবাবো। ভয় নেই কোল বালিস টা মাঝখানে রেখে শুয়ে পর।

কথাগুলো বলেই হৃদয় গিয়ে একপাশে শুয়ে পড়ে। মাঝখানে কোল বালিশ রেখে শুয়ে পড়ে মোহনাও। ক্লান্ত লাগছে শরীর ভীষণ। সারা দিনের এতে ধকলে আর কত সহ্য করবে ছোট্ট দেহ?

চলবে….

প্রেম প্রেয়সী পর্ব-১৭

0

#প্রেম_প্রেয়সী
#পর্ব_১৭
#আয়েশা_আক্তার

মোহনাদের গ্রামের প্রবেশ পথেয় গাড়ি থামাতে বলে লাবণ্য। কারণ গ্রামের মানুষ এতোগুলো ছেলেমেয়েদের সাথে মোহনাকে দেখলে বাজে কথা বলতে পারে তাই। সবাইকে গাড়িতে থাকতে বলে লাবণ্য মোহনার সাথে মোহনাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে এশা জানায় সেও যেতে চায় ওদের সাথে। তাই তিনজনই যায় মোহনাদের বাসায়। বাকিরা গাড়ি থেকে নেমে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সাদাফ দূরে ধান গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। হৃদয় উদাসমনে দূরে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ায় পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে একটা ছবির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রয়। ছবিটা বছর কয়েক আগে। বন্ধরা সবাই মিলে ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছিলো। তখন কিছু একটা দেখাতে লাবণ্য এবং মোহনা হৃদয়কে ডাকছিলো। কিন্তু হৃদয় আড্ডায় এতোটাই মগ্ন যে শুনতেই পেলো না। তখন মোহনা এসে হৃদয়ের কান টেনে ধরে। আর লাবণ্য সেই মুহুর্তটা ক্যামেরা বন্দী করে ফেলে। বন্ধুদের সাথে এমন হাজারো রঙিন মুহুর্ত ক্যামেরা বন্দী করা হয়েছে। কিন্তু হৃদয়ের কেন যেন এই ছবিটাই বেশি ভালো লাগে। সে এ পর্যন্ত কত হাজার বার ছবিটা মুগ্ধ হয়ে দেখেছে তার হিসেব নেই।

হৃদয়কে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রীতম এসে হইহই করে বলে উঠলো,

-এইযে লাভ গুরু, এতোই যখন ভালোবাসিস বলে দিলেই তো পারিস?

-আমি কোনো লাভ গুরু টুরু নই। আজাইরা প্যাঁচাল পারবি না।

– হাহ! তুমি লাভ গুরু না! তুমি হইলা মোহের প্রেমে দিওয়ানা। হাহাহা।

প্রীতম এবং অমিত একসাথে হেসে উঠে। সাদাফ ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

-তোরা চুপ কর তো। মোহ’র জীবন অন্য পাঁচটা মেয়েদের মতো না। তাই হৃদয় মোহকে কিছু বলতে পারে না। তোরা সেটা কেন বুঝিস না? সবসময় মজা নেওয়া বাদ দিয়ে ওর দিকটা ভাব। বেচারা চারটা বছর ধরে নিরবে মোহ’কে ভালোবেসে যাচ্ছে।

প্রীতম এবং অমিত সাদাফের ধমকে চুপ হয়ে যায়। হৃদয় কিছু বলে না। মুঠোফোনটা পকেটে রেখে আকাশ পানে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সাদাফ হৃদয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে,

-হৃদয়, অনেক তো অপেক্ষা করলি। এবার বরং তুই মোহ’কে নিজের মনের কথা বলে দে।

-ও যদি আমায় না করে দেয়? যদি বন্ধুত্ব নষ্ট করে কিভাবে সহ্য করবো আমি সাদাফ?

-আমি তোর মনের অবস্থা বুঝতে পারছি হৃদয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন একা একা কষ্ট পাবি? এটলিস্ট বলেই দেখ, মোহ’র প্রতিক্রিয়া কি হয়?

তখনই হৃদয় দেখলো দূর থেকে মোহ’রা চলে আসছে।

-আচ্ছা বলবো, এখন চুপ ওরা আসছে।

সবাই একটু নড়েচড়ে বসে। হৃদয় আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে মোহ’র মা কি বলেছে সেটা শোনার জন্য। লাবণ্য মন খারাপের ভান করে বলে,

-সবাইকে আমার একটা কথা বলার আছে।

-হ্যাঁ, বল? কি বলল? আন্টি অনুমতি দিয়েছে?

অমিত একনাগাড়ে প্রশ্ন গুলো করে। হৃদয়ের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। লাবণ্য একটু নাটক করে মন খারাপের ভান করে থাকলো। তারপর সবার মন খারাপ হচ্ছে বুঝতে পেরে হুহু করে হেসে বলে উঠে,

-আন্টি অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।

বলেই লাবণ্য খুশিতে বাচ্চাদের মতো মোহনাকে জড়িয়ে ধরে। সেই সাথে সবাই হইহই করে উঠে। হৃদয়ের মুখেও ফোটে উঠে এক চিলতে হাসি।
_______________________

এক সপ্তাহ পর,
শপিং করা, ঘুরাঘুরি, আড্ডাতেই যেন কেটে গেলো একটা সপ্তাহ। এইযে এখন যার গায়ে হলুদে সব বন্ধুরা মজা -আনন্দে মেতে উঠেছে। কালকে দুপুরের পর থেকে তাদের মধ্যে লাবণ্য আর আগের মতো থাকবে না। বিয়ের পর প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বদল হয়। তখন তার জীবন সঙ্গীর পছন্দ অনুযায়ীই মানুষ জীবন যাপন করে অনেকটা।যদিও মেহেদী সেরকম নয়। সে লাবণ্য’র বন্ধুদের খুব ভালো করেই চেনে। কিন্তু তাতে কি? বদল তো অবশ্যই হবে। বিয়ের মাস খানেক পরই তো লাবণ্য মেহেদীর সাথে উড়াল দিবে লন্ডনে। বাকি পড়াশোনা সেখানেই শেষ করবে লাবণ্য।

এশা আর মোহনা কলা পাতা রঙের শাড়ি পড়েছে। দু’জনেই চুলগুলো খোঁপা করে তাতে বেলি ফুলের গাজরা জড়িয়েছে। চোখে গাঢ়ো কাজল, হাতে শাড়ির সাথে ম্যাচিং চুড়ি, গলায় নেকলেস, কানে ঝুমকো। দু’জনকেই বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। লাবণ্যও সেইম কালারের শাড়িই পড়েছে। তবে ওদের দুজনের থেকে লাবণ্য’র সাজটা আরো একটু গর্জিয়াছ। যতই হোক বউ বলে কথা। লাবণ্য, এশা, মোহনা একসাথে বসে কয়েকটা সেলফি তুলছিলো ঠিক তখনই এশার ফোনে টেক্সট আসে। এশা মেসেজ সীন করে দেখতে পায়,

“আমার বন্ধুদের পেয়ে তো আমাকে ভুলেই গেলে বউ পাখি। আমার কিন্তু অনেক অনেক অভিমান জমা হচ্ছে তোমার উপর। এখনই যদি ছাঁদে না আসো তবে কিন্তু এর হিসেব পরে তোমায় চুকাতে হবে। ”

মোহনা এবং লাবণ্য এশার পাশে থাকায় সবটাই ওদের চোখে পড়ে। এশার মুখে লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে যায়। লাবণ্য এশাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলে,

-ওলে ওলে বাচ্চাটা আর লজ্জা পেতে হবে না। আমার বন্ধুটা অপেক্ষা করছে যাও এখনই ছাঁদে যাও।

এশা ইতস্তত করে থেকে যেতে চায়। কিন্তু লাবণ্য ঠেলে ঘর থেকে বের করে দেয় এশাকে। এশা ধীর পায়ে ছাঁদের দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ি ভেঙে ছাঁদে গিয়ে পৌঁছাতেই এক পশলা ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় এশাকে। সাদাফের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই সাদাফ এশার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। তারপর পকেট থেকে একটা লাল টকটকে গোলাপ বের করে এশার খোঁপায় গুঁজে দেয়। তারপর মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ এশার দিকে চেয়ে থাকে। এশা লজ্জা পায়। চাঁদের আলোতে লজ্জাবতী এশাকে দেখে সাদাফের মনে উথাল-পাতাল ঢেউ বয়ে যায়। নিষিদ্ধ কাজ করে ফেলতে ইচ্ছে করে। সাদাফ নিজেকে সামলে এশাকে জড়িয়ে ধরে। এশার শরীরে এক সুন্দর শিহরণ বয়ে যায়। এশা সাদাফের বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,

-তুমি অনেক অসভ্য হয়ে যাচ্ছো দিন দিন।

-তাই?

এশা সাদাফের বুকে নাক ঘষে বল, -হুম।

-অসভ্য কিভাবে হলাম?

-তখন, আপুদের সামনে অমন একটা মেসেজ কেন দিলে? আপু’রা কি ভাবলো? আমার অনেক লজ্জা লাগছিলো।

-ওরে, আমার লজ্জাবতীরে। আজ সারাদিন তোমাকে দেখিনি। সেই সকালে একবার দেখেছি। আজকের চাঁদটা অনেক সুন্দর। চাঁদের আলোয় বউকে দেখার ইচ্ছে হলো বলেই তো ডাকলাম।

-ওভাবে মেসেজ না দিয়ে, ছাঁদে আসো লিখেও মেসেজ দেওয়া যেতো।

-আচ্ছা, বুঝলাম।

-কি বুঝলে?

-আমার বউ একটা আনরোমান্টিক।

তখনই সাদাফের ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে দেখে লাবণ্য কল করেছে। রিসিভ করতেই লাবণ্যের গলা ভেসে আসে,

-কই তোরা? তাড়াতাড়ি নিচে আয়। মোহ’কে গ্রামে যেতে হবে।

-কেন? কি হয়েছে? এখনো তো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি। গ্রামে কেন যেতে হবে?

-নিচে আয়, তারপর সব বলছি। মোহ’র মা কল দিয়েছে মাত্র।

চলবে….